Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 422



ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩২|
প্রিয় মানুষের মৃত্যু শোকও একসময় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব৷ কিন্তু চোখের সামনে তাকে অন্যকারো হয়ে যাওয়ার শোক কাটানো অসম্ভব। এই শোক এতটাই
দৃঢ় যে আজন্মকাল থেকে যায়। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ হারালে হৃদয় ব্যথিত হয় ঠিকি কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষ হারালে তা হয় দুর্বিষহ যন্ত্রণার। কেটে গেছে তিন রাত তিন দিন। স্বাভাবিক হতে পারেনি সৌধ। তীব্র আঘাতে হুঁশ হারিয়ে অর্পণ স্যারকে যে আঘাত করেছিল তারা তিন বন্ধু, সে আঘাত সেরে গেছে অনেকটাই। সময়ের স্রোতে একদিন পুরোপুরিই সেরে যাবে। কিন্তু হুঁশে থেকে নিধি যে আঘাত সৌধকে করেছে এ আঘাত কি কোনোদিন সেরে ওঠবে? কিছুটা মলিন হলেও সেরে ওঠবে না কোনোদিন। রাতগুলো কাটছে নির্ঘুম। সৌধকে সামলানো মুশকিল খুব। পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে একেবারেই অপারগ। সুজা চৌধুরীর ভরসা ছোটো ভাই অর্থাৎ সৌধর ছোটো চাচা৷ যাকে খুব মানে সৌধ। বলা যায় তার প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড ছোটো চাচা সুলল চৌধুরীই। ভাতিজার কঠিন সময়টা অনুভব করতে পারছে সুলল। তারা উভয়ই প্রিয়তমা হারানোর শোক পেয়েছে। পার্থক্য এটুকুই সে প্রিয়তমার মৃত্যু শোক পেয়েছিল আর সৌধ প্রিয়তমা অন্য কারো হয়ে যাওয়ার শোক পেয়েছে। নিজের ব্যথার চেয়েও ভাতিজার ব্যথা তীব্র। দিনশেষে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বস্তি পেলেও সৌধ পাবে না। তাদের সবাইকে বেশ কঠিন সময় পার করতে হবে এবার। সামলাতে হবে সৌধকে। সুহাস আর আইয়াজ নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায়নি। গতকাল নামী আর সিমরান চলে গেছে। যদিও তার ইচ্ছে ছিল না। সুহাস, নামী আর উদয়িনী তিনজনের চাপেই মেয়েটা যেতে বাধ্য হয়েছে। নামী গেছে তার বাসায় আর সিমরান মায়ের সঙ্গে নিজ বাড়িতে। উদয়িনী এতটা জোর করত না মেয়েকে৷ কিন্তু তার মেজাজ চটে গেছে সৌধ নিধিকে ভালোবাসত শুনে। যার কাছে নিজের মেয়েকে দিতে চেয়েছিল। যাকে মেয়ে জামাই করতে তীব্র আগ্রহী ছিল। সে অন্য মেয়ের প্রতি আসক্ত! মেনে নিতে পারেনি উদয়িনী। যদিও সৌধর জীবনে এখন নিধি আর আসবে না, নিশ্চিত। তবু সৌধর মনের ঘরে অন্য নারীর বাস ছিল এখনো আছে। তাই তো এভাবে ভেঙে পড়েছে ছেলেটা৷ ঠিক এখানেই ঘোর আপত্তি জানিয়েছে উদয়িনীর মন৷ নিজ জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকেই নিজের বিশেষ মনোবাঞ্ছা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সৌধর মায়ের মনের ভাবনা জানে উদয়িনী।
যা সব ঘটে গেল এরপর কী হতে পারে চৌধুরী পরিবার কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দ্বারা ঠিক টের পাচ্ছে। তাই ভয় পেয়েই যতদ্রুত সম্ভব মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। কারণ যে ভুলটা সে করেছে একই ভুল তার মেয়েকে করতে দেবে না। যদিও তার বিশ্বাস সিমরান নিজেও আগ্রহী হবে না এসবে। অন্য নারীর প্রতি আসক্ত পুরুষের প্রতি লোভ করে জীবন, যৌবন সবটা ধ্বংস করে দিয়েছে উদয়িনী। একই ভুল আর মেয়ের জীবনে করতে চায় না। অন্য নারীর প্রতি আসক্ত ছেলেকে নিজের মেয়ের জন্য মরে গেলেও বাছাই করবে না৷ এতদিন পছন্দ করত, মনে মনে আশা রেখেছিল কারণ এতদিন জানত না সৌধ নিধির প্রতি ভয়ানক ভাবে দুর্বল।
.
.
গত তিন রাতের মতো চতুর্থ রাতটাও নির্ঘুম। সৌধর সঙ্গে জেগে আছে আইয়াজ আর সুহাসও। সৌধ তার বিছানার মাঝ বরাবর সটান হয়ে শুয়ে। একধ্যানে তাকিয়ে আছে চরকির মতো ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে ছেলেটা। জীবনটাও তো ঠিক চরকির মতোই। আজ তুমি যাকে যতটা দেবে কাল সে তোমাকে ততটাই ফেরত দেবে। আকস্মিক চোখ বুজে ফেলল সৌধ। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,

‘ আমি তাকে একবিন্দু কষ্টও ফেরত দিতে চাই না৷ শুধু চাই ও সুখী হোক, সুখে থাকুক। কারণ আমি ওকে ক্ষমা করতে চাইনা। ও যতদিন সুখে থাকবে আমি ঠিক ততদিনই ওকে ক্ষমা করতে পারব না৷ ওর সুখটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকুক। আমি যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি ওর সুখের গল্প শুনে। আমি যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় একটিবার বলতে পারি নিধি, আমি তোকে ক্ষমা করিনি। ‘

রাত গভীর হয়নি৷ সবে দশটা বাজে। আইয়াজ আর সুহাস কমেডি মুভি দেখার প্ল্যান করছে। যাতে সৌধর বুক একটু হালকা হয়৷ তাদের এই প্রচেষ্টা বুঝতে পারে সৌধ। তাচ্ছিল্য ভরে একটুখানি হাসে। ওর ব্যথা কি আর ওরা বুঝে? যে পুরুষের বুকের ভেতরে বাস করা নারী প্রতি রাতে অন্য পুরুষের বুকে ঘুমায় সে পুরুষ জানে জীবন কত নৃশংস, নিয়তি কত্ত বড়ো বেইমান, নারী কি ভয়াবহ ছলনাময়ী!

সহসা ওঠে বসল সৌধ। বিড়বিড় করে বলল কিছু কথা৷ সুহাস, আইয়াজ কান সজাগ করে শুনে নিল সবটাই,

‘ও যদি ক্লাস নাইন বা ইন্টার পড়ুয়া মেয়ে হতো।তাহলে নিজের মনকে বুঝ দিতে পারতাম। মনের দিকে যদি দুর্বল প্রকৃতির মেয়ে হতো তবু মেনে নিতাম। যদি আল্লাহ প্রদত্ত কোনো অসুখ করে ও মারা যেত তবু মনটাকে স্বান্তনা দিতাম। ছাব্বিশ বছর বয়সী একটি মেয়ে। খুব শিঘ্রই পরিপূর্ণ ডক্টর পেশায় নিয়োজিত হবে। সে কী করে পারল এমন একটি ঘটনা ঘটাতে? কী করে পারল! ‘

শেষে চিৎকার করে ওঠল সৌধ। সুহাস এসে ধরল ওকে৷ আইয়াজ ভীত স্বরে বলল,

‘ ছোটো কাকুকে ডাকব? ‘

সৌধ তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। বদ্ধ উন্মাদের মতো সুহাসের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে গেল ঘরের বাইরে। পেছন পেছন সুহাস আর আইয়াজও ছুটে গেল। সুহাস ভেবেছিল, সৌধ বাড়ির বাইরে চলে যাবে৷ কিন্তু না সে তার মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে ডাকতে শুরু করল,

‘ আম্মা, আম্মা দরজা খোলো, আম্মা। ‘

সৌধর কণ্ঠে বড্ড তাড়াহুড়ো। যা থেকেই টের পাওয়া যায় মানুষটার বুকের ভেতর কতখানি অশান্তি বিরাজ করছে। সুহাস, আইয়াজ চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে সৌধর পেছনে দাঁড়িয়ে। ওদের শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে বন্ধুর করুণ দশা দেখে। তানজিম চৌধুরী আধোঘুমে ছিলেন৷ ছেলের এক ডাকেই ধড়ফড়িয়ে ওঠেছেন তিনি৷ এরপর দ্রুত পায়ে এসে দরজা খুলেই ভীত স্বরে বললেন,

‘ কী হইছে আব্বা? ‘

সৌধ কিছুটা শান্ত হলো। ধীরপায়ে ঘরে ঢুকে অসহায় ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকাল। বলল,

‘ আমি কি খুব বেশি বড়ো হয়ে গেছি আম্মা? ‘

চোখ ছলছল করছিল তানজিমের। হঠাৎ অশ্রু ছেড়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে সৌধর গাল স্পর্শ করলেন। বললেন,

‘ এই কথা বলো কেন আব্বা? মায়ের কাছে সন্তান কোনদিন বড়ো হয়? ‘

সৌধর মুখে দেখা দিল একটুখানি হাসির আভাস। পেছন থেকে সুহাস, আইয়াজ এগিয়ে এসে বলল,

‘ সৌধ রুমে চল। আংকেলের ঘুম ভেঙে যাবে। ‘

‘ ভাঙবে না, আব্বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। ‘

বন্ধুকে উত্তর দিয়েই মা’কে নিঃসংকোচে বলল,

‘ আমি যদি আজ তোমাদের সাথে ঘুমাই অন্যায় হবে আম্মা? ‘

আকস্মিক ছেলেকে জাপ্টে ধরলেন তানজিম চৌধুরী। সন্তানের ব্যথা মায়ের চেয়ে কে বেশি বুঝে? যে ছেলেটা ক্লাস সিক্সে ওঠার পরই বাবা, মায়ের সাথে ঘুমাতে লজ্জা পেত। যার ব্যক্তিত্বে আঘাত করত বাবা, মায়ের মাঝখানে ঘুমাতে। আজ সে নিজে থেকেই বাবা, মায়ের কাছে থাকতে চাচ্ছে।

মায়ের সম্মতি পেয়ে পেছনে তাকাল সৌধ। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুহাস, আইয়াজকে বলল,

‘ তোরা কি হাসবি? ‘

সুহাস তৎক্ষনাৎ মাথা দু’দিকে নাড়াল। না না একদম হাসবে না। আইয়াজ স্তব্ধ মুখে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,

‘ না, না হাসব কেন? তোর আম্মা তোর আব্বা একশবার ঘুমাবি তাদের সাথে। আমরা হাসার কে, হু আর উই? ‘

আইয়াজের প্রতিক্রিয়া দেখে সৌধর চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল। আইয়াজ মুহুর্তেই মাথা ঝাঁকানো থামিয়ে বোকা বোকা হাসতে লাগল। সৌধ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ গো এ্যাঁ। ‘

ওরা চলে গেল। তানজিম চৌধুরী ছেলের জন্য বালিশ বের করে বিশাল বিছানার মাঝ বরাবর রাখল। গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল সৌধ। তানজিম চৌধুরী ছেলের পাশে শুয়ে বললেন,

‘ সকালবেলা তোর আব্বা দেখে অনেক খুশি হবে। ‘

ঈষৎ হাসল সৌধ। চোখজোড়া বন্ধ করে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর হাত বাড়িয়ে মায়ের একটা হাত টেনে নিজের মাথায় রেখে বলল,

‘ হাত সরাবা না। ‘

বুক ভেঙে কান্না এলো তানজিম চৌধুরীর। সারারাত সে আর ঘুমাতে পারল না। সৌধও যে ঘুমায়নি টের পেল ওর চোখের কার্ণিশ ঘেষে পড়া একফোঁটা অশ্রু কণা দেখে। যা তার বুকের ভেতরটা তীরের ফলার মতো আঘাত করল। কখনো সে সৌধর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল কখনো বা বুকে। মা মাথায় হাত বুলানোর পাশাপাশি বুকেও হাত বুলাচ্ছে। কিঞ্চিৎ আরাম পেল সৌধ। একসময় চোখ বোজা অবস্থাতেই বুকে রাখা মায়ের হাতের ওপর দৃঢ়ভাবে নিজের হাতের তালু রেখে চাপ দিয়ে বলল,

‘ এখানে ব্যথা করছে বুঝতে পারলে কী করে আম্মা?’

‘ মায়েরা সব বুঝতে পারে। ‘

উত্তর দিয়েই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠল তানজিম চৌধুরী। কাঁদল সৌধও। তার কান্না শব্দহীন। অথচ ব্যথা কী ভীষণ গভীর!
.
.
কেটে গেছে চার রাত৷ পঞ্চম রাতটাও নির্ঘুম। সুহাস ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। এভাবে কাটতে থাকলে সৌধকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। নাওয়া, খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে ছেলেটা কী একটা ঘোরে আছে, কীভাবে বের করবে এখান থেকে মাথা কাজ করছে না৷ হঠাৎ আইয়াজ বলল,

‘ দোস্ত আর মাত্র তিনদিন ছুটি আছে৷ চল সৌধকে নিয়ে দু’দিনের জন্য কক্সবাজার চলে যাই। খোলা আকাশের নিচে, সমুদ্র পাড়ে নির্ঘুম কাটালে আর যাইহোক বদ্ধ ঘরের মতো যন্ত্রণা হবে না। ‘

আইয়াজের কথাটা মনে ধরল সুহাসের। সুজা আংকেলকে কল করে অনুমতি নিয়ে সৌধকে জানাল তারা আগামীকাল কক্সবাজার যাবে। এ কথা শুনে হঠাৎ সৌধ বলল,

‘ বারে যাবি? ‘

সুহাস চোখ, মুখ কুঁচকে বলল,

‘ হোয়াট! ‘

গতকাল থেকেই সিগারেট চাচ্ছিল সৌধ। প্রথমে দিতে না চাইলেও আজ সকালে এনে দিয়েছে। তাকে সঙ্গ দিয়ে নিজেরাও এক, দুইটা খেয়েছে। ভেবেছিল সিগারেট অবধিই সীমাবদ্ধ থাকবে সৌধ। কিন্তু এখন তো ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি মাত্রায় চলে যাচ্ছে। যদিও সৌধর জন্য এটা ব্যাপার না। সৌধর বড়ো ভাইয়ের বন্ধুর নিজস্ব বার আছে। তবু তাদের তো একটা ইমেজ আছে। প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল সুহাস, আইয়াজ। এখন যা অবস্থা তাতে সৌধর মতের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা৷ কিন্তু সে তো বিবাহিত। নামী যে ধরনের মেয়ে যদি একবার ভুলক্রমেও এসব কানে যায় রক্ষা থাকবে না। এমনিতেই ক’দিন ধরে মেয়েটাকে সময় দিতে পারছে না৷ না দেখা না ঠিকভাবে কথা। এরওপর যদি শুনে বন্ধু নিয়ে বারে গেছে সে। নিশ্চিত গলা কা টবে। নয়তো বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেবে। এই মেয়ের নীতি, রাগ, জেদ সম্পর্কে এতদিনে খুব ভালো করেই জানা হয়ে গেছে। এদিকে আইয়াজও অসহায় বদনে দাঁড়িয়ে। ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে বন্ধুর মুখের দিকে৷ বন্ধুর বিরহে আজ যদি তারা দু’জন বারে যায় তাদের বিরহ আসন্ন নিশ্চিত!

সৌধ বারে যাবি প্রশ্নটা করেই ঝটপট তৈরি হয়ে নিয়েছে। এরপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বেলকনিতে যেতে যেতে আদেশ করে গেছে, তৈরি হতে। বুক ধুকপুক নিয়ে তৈরি হয়ে নিল সুহাস, আইয়াজ। আত্মাটা হাতের মুঠোয় নিয়েই বেরিয়েছে বারের উদ্দেশ্যে।

নেশায় অভ্যস্ত না সৌধ বা সুহাস, আইয়াজ। আজই প্রথম বারে এসেছে তারা৷ চারপাশে চাকচিক্যময় লাইটিং। পরিচিত অনেক ভাই, বন্ধুরাও রয়েছে। ওদের তিনজনকে দেখে তারা ভূত দেখার মতোই তাকিয়ে আছে৷ বিগ বস ক্লাবের তিন পার্টনার বারে এসেছে! বিষয়টা হজম হচ্ছিল না অনেকেরই৷ এরই মধ্যে সুন্দরী ডান্সারের রঙ্গলীলা শুরু হয়ে গেল। সৌধর অবশ্য এসবে হুঁশ নেই। সে জীবনে প্রথমবারের মতো রেড ওয়াইন গলায় ঢালল। চোখ, মুখ কুঁচকে মাথা নিচু করে ফেলল মুহুর্তেই। সুহাস, আইয়াজ ঢোক গিলে বলল,

‘ খুব বাজে নারে? ফেলে দে ইস কী দুর্গন্ধ! ওয়াক থু..’

কিয়ৎক্ষণ পর মাথা তুলল সৌধ। মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,

‘ এই দুর্গন্ধই তো চাই। যাতে ভেতরে থাকা আগুনপোকাটা এই গন্ধে পালিয়ে যায়। ‘

কথাটা বলেই একের পর এক গ্লাস শেষ করতে লাগল সৌধ। সুহাস ওর হাত টেনে ধরে আকুতি স্বরে বলল,

‘ দোস্ত আর না। ‘

সৌধ চোখ গরম করে তাকাল। সুহাস ফের বলল,

‘ দোস্ত চল বাড়ি যাই৷ নামী কল করছে। যদি টের পায় আমরা কোথায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। ‘

এ পর্যায়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল সৌধ। ধরে রাখা রেড ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলে রেখে সুহাসের দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ ভাবে। বলল,

‘ নামীকে কল কর। ‘

চমকে ওঠল সুহাস৷ বলল,

‘ ভাই গর্দান যাবে আমার। ‘

‘ কিচ্ছু হবে না। ফোন করে বলবি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে আমরা হানিমুন যাব। ‘

‘ হোয়াট!’

চিৎকার দিয়ে ওঠল সুহাস৷ আইয়াজ হতভম্ব। সৌধ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,

‘ বলদ! কক্সবাজার যেতে চাইলি তখন, তাই বলছি হয়ে যাক হানিমুন। তুই আর নামী। আইয়াজ আর ফারাহ। আর তোদের চারজনের সাথে আমি। তাহলে কী হলো আমরা না?’

হঠাৎ কাশতে শুরু করল সুহাস। একটুক্ষণ কেশে নিয়ে বলল,

‘ তাই বল। ‘

পরোক্ষণেই আবার চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ আইয়াজ ফারাহ কী করে যাবে? ওদের তো বিয়েই হয়নি। ‘

‘হবে, আগামীকাল। ‘

সৌধর কথা শুনে চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো ওদের। আইয়াজ ধরা গলায় বলল,

‘ ও মনে হয় পাগল হয়ে গেছে রে। আমার ইমোশন নিয়ে মজা নিচ্ছে। ‘

‘ ধূরর শা লা ওর নেশা হয়ে গেছে। ‘

সুহাস কথাটা বলেই ঢুলতে থাকা সৌধকে জাপ্টে ধরল। বলল,

‘ দোস্ত তোর নেশা হয়ে গেছে, বাড়ি চল। ‘

‘ নেশা হলেও তাল ঠিক আছে। ‘

সুহাসের কানে কানে বলল সৌধ। সুহাস বলল,

‘ ওঠ বাড়ি যাব। ‘

সৌধ হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেল। সামনে যে মেয়েটি ডান্স করছে তার দিকে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আঙুল তুলে সুহাসকে দেখিয়ে বলল,

‘ সুহাস দেখ ওই মেয়েটা বার ডান্সার সবাই ওকে ঘৃণার চোখে দেখে। তুই আর আইয়াজও দেখছিস।
কিন্তু আমি দেখছি না। কেন জানিস, ও নর্তকী হলেও বেইমান না। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৩|
ঘুম পাগলী মেয়েটা হঠাৎ ঘুম বিমুখ হয়ে পড়েছে৷ রাত যত বাড়ে বুকের বা’পাশের চিনচিনে ব্যথাটুকু ততই তীব্র হয়৷ বক্ষঃস্থল জুড়ে আশ্চর্যজনক এক অশান্তি বইতে থাকে সর্বক্ষণ। যে অশান্তি তাকে না ঘুমোতে দেয় আর না প্রত্যাহিক জীবনের কোনো কাজে মন বসাতে দেয়। মন কেবল ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে ওঠে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটি আফসোসে। কিশোরী বয়স থেকে যে মানুষটিতে সে মত্ত ওই মানুষটি গত পাঁচ বছর যাবৎ মত্ত ছিল অন্য নারীতে। বুকটা হাহাকার করে ওঠে একটি কথাই ভেবে সে ওই মানুষটির প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্পর্শ হতে পারল না৷ প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার গভীরতা সে খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারে৷ কারণ ওই মানুষটির প্রতি তার যে প্রেম, ভালোবাসার অনুভূতি সবটাই প্রথম। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ওঠে বসে সিমরান৷ বিছানা থেকে ধীরেসুস্থে নেমে দাঁড়ায়। ঠিকঠাক ঘুম না হওয়াতে শরীরটা কেমন নুইয়ে পড়ছে৷ মাথা ঝিমঝিম করে খুব। হঠাৎ হৃদয় গভীরে একটি কথা ছলকে ওঠে সিমরানের। কোথায় যেন সে পড়েছিল, কারো প্রথম প্রেম হওয়াটা গর্বের না হলেও শেষ প্রেম হওয়া গর্বের। এছাড়া সেদিন রাতে নিধি আপুও তাকে কত কী বোঝাল। সৌধ ভাইয়ের আগে তো সেই জানতে পেরেছিল নিধি আপু বিবাহিত। তার হাজব্যান্ড ডক্টর অর্পণ শিকদার। নিধি তাকে তার বিয়ের সব কাহিনি বলেছিল সেদিন। জানিয়েছিল সৌধর অনেক কথাও। অনুরোধ করেছিল,

‘ সিনু, তুই আমাকে কথা দে কোনো পরিস্থিতিতেই সৌধর থেকে মুখ ফিরাবি না৷ ও এখন আবেগে ভাসছে ঠিক৷ কিন্তু যেদিন বাস্তবতা বুঝবে আর তোর ভালোবাসার গভীরতা টের পাবে সেদিন ঠিক তোকে আপন করে নেবে। ‘

সিমরান ভয় পায় সে কথা শুনে। বিষয়টা অসম্ভব লাগে। নিধি তার দু গালে হাত রেখে তখন বলে,

‘ শোন, আমরা যদি মোনাজাতে চেয়েও কাউকে না পাই তাহলে বুঝতে হবে আমাদেরও কেউ মোনাজাতে চাচ্ছে। যার প্রার্থনা আরো বেশি গভীর আর বেশি জোরালো। দেখ না সৌধ আমাকে কত চাইল পেল কি? পেল না। কেন পেল না এর সঠিক উত্তরটাই আমি খুঁজছিলাম। আজ পেয়েও গেলাম। কারণ সৌধ আমাকে যেভাবে চায় তার চেয়েও বেশি গভীরভাবে তুই সৌধকে চাস। আই বিলিভ দ্যাট অবুঝ বয়সের প্রেমে বেশি গভীরতা থাকে। তুই যে বয়স থেকে সৌধকে ভালোবাসিস ও বয়সে ভালোবাসা ছাড়া, মুগ্ধতা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নেই। ‘

নিধি আপুর সে কথা শুনে চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায় সিমরান। অবাক কণ্ঠে বলে,

‘ সৌধ ভাই যে তোমাকে ভালোবাসে এটায় কী স্বার্থ আপু? ‘

জোর পূর্বক হাসে নিধি। উত্তর দেয়,

‘ বোকা মেয়ে ওর ভালোবাসায় স্বার্থ আছে বলছিনা৷ কিন্তু তোর ভালোবাসায়ও স্বার্থ নেই। ‘

সিমরান থমকানো কণ্ঠে বলল,

‘ সৌধ ভাই কেন পেল না তোমাকে? ‘

স্মিত হেসে নিধি জবাব দিল,

‘ তুই পাবি বলে। যার জন্য যেটা মঙ্গলদায়ক সৃষ্টিকর্তা তাকে সেটাই দেয় রে সিনু বুড়ি। ‘
.
.
বেলা করে ঘুমানো মেয়েটা যে ইদানীং সাতসকালে ওঠে পড়ে খেয়াল করেছে উদয়িনী। আজও ভোরবেলা ওঠে সিমরান৷ হাসফাস চিত্তে পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উল্টায়৷ দু’টো কফি করে এনে দরজার সামনে উপস্থিত হয় উদয়িনী৷ মিষ্টি হেসে এগুতে এগুতে বলে,

‘ আম্মুজান আজো জলদি ওঠেছে দেখি। ‘

ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় সিমরান৷ ঈষৎ হেসে মুখ ফিরিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। ইদানীং আম্মুকে ভীষণ শান্ত আর স্নিগ্ধ লাগে সিমরানের কাছে। অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়েছে তার আম্মুর৷ আব্বুর মাঝেও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি হচ্ছে তার আব্বু, আম্মুকে এখন একসঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায়, গল্প করতে দেখা যায় এবং রাতে তারা এক ঘরে একই বিছানাতে ঘুমায়। ঠিক আগের মতোন স্বাভাবিক। ভালোবাসা না থাকলেও তাদের মধ্যে যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল সেটি যেন ফিরে এসেছে আবার। সিমরানের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ঠিক বুঝতে পারে এটি সম্ভব হয়েছে আম্মুর কারণেই। একটা মেয়ে চাইলে আসলে সবই সম্ভব। বিশেষ করে একজন সভ্য পুরুষকে সঠিক পথে আনা কঠিন কিছু নয়৷ একটু সম্মান, যত্ন, ভালোবাসা এবং সততা পেলে পুরুষ মানুষ বশ মানতে বাধ্য। সোহান খন্দকার ভীষণ ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। আগ বাড়িয়ে গরম হওয়ার ব্যাপারটা তার ব্যক্তিত্বে নেই। তার মধ্যেকার বিশেষ গুণটি হলো, সে মানুষকে ক্ষমা করতে পারে। বিশেষ করে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া, নিজের ভুল বুঝতে পারা মানুষ গুলোকে সে পছন্দ করে। এরা প্রকৃত অর্থেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য৷ জীবন থেকে যা কিছু হারিয়ে গেছে তা হয়তো ফিরে পাওয়া সম্ভব না৷ কিন্তু যা কিছু রয়ে গেছে তা ধরে রাখা সম্ভব। সোহান খন্দকার হয়তো এ কারণেই ঘরে মন দিয়েছে। তার মন নরম করেছে উদয়িনীর মাঝেকার আমূল-পরিবর্তন। নানারকম ভাবনা, কল্পনা, জল্পনা করে গোপনে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ে সিমরান। উদয়িনী তার পাশে চেয়ার টেনে বসে কফি এগিয়ে দেয়। বলে,

‘ শরীর তো ভীষণ দুর্বল। ঠিকঠাক খাবার না খেলে, ঘুম না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। ‘

মেয়ের শরীরের দিকে তাকিয়ে, চোখ লক্ষ্য করে কথাগুলো বলল উদয়িনী। সিমরান ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে কফির মগ হাতে নিল। এক চুমুক দিয়ে বলল,

‘ কিছু হবে না। আব্বু ওঠেছে? ‘

‘ হ্যাঁ, তুমি অন্য প্রসঙ্গ টেনো না। কী নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছ সেটা শেয়ার করো। ‘

আকস্মিক স্তব্ধ হয়ে গেল সিমরান৷ তার ব্যস্ত আম্মু মেয়ের দিকে খেয়াল করেছে তাহলে? একটুখানি হাসে সিমরান। বলে,

‘ ছুটিত শেষ। যাচ্ছ না কেন? ‘

‘ ছুটি বাড়িয়েছি। ‘

‘ কেন? ‘

‘ ভালো লাগে না আর। হাঁপিয়ে ওঠেছি খুব৷ ভাবছি রিটায়ার্ড করে নিব। ‘

‘ সে কী! আর তো ক’টা বছর সময়ের আগে রিটায়ার নিতে পারবে? ‘

‘ উপযুক্ত কারণ দেখালে পারব। ‘

‘ কী দেখাবে? ‘

‘ আমি অসুস্থ। ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। বলল,

‘ মিথ্যা বলবে? ‘

‘ জীবনে প্রচুর মিথ্যা বলেছি। এবার সত্যি বলেই নিব। ‘

মন খারাপ হয়ে গেল সিমরানের। বলল,

‘ সামান্য অসুখে রিটায়ার নেয়া যায়? ‘

সিমরান জানে বয়সের কারণে বেশকিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে উদয়িনীর। তাই বলল কথাটা। উদয়িনী মৃদু হেসে বলল,

‘ যায়। ‘

মেয়ের সাথে কথোপকথনের এ পর্যায়ে সুহাসের কল পেল উদয়িনী। রিসিভ করতেই জানতে পারল, আজ তারা তিন বন্ধু কক্সবাজার যাচ্ছে। সঙ্গে নামীও যাবে। আইয়াজের যে মেয়েটার সাথে রিলেশন চলছে সে মেয়েটার সাথে আজই বিয়ে করার পরিকল্পনা করছে আইয়াজ৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী সব হলে আইয়াজের বউও যাবে৷ এ পর্যন্ত কথা বলেই ফোন কেটে দিল সুহাস। গোপনে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল উদয়িনী। ছেলের সাথে তার দূরত্ব দূরত্বই রয়ে গেল৷ আর কমল না। যতটুকু সম্পর্ক ততটুকু বোধহয় দায়ে পড়ে। প্রয়োজন ব্যাতীত কথা বলে না ছেলেটা। মায়ের প্রতি ছেলের ভালোবাসা কতটুকু ক্ষীণ হয়েছে চার বছরে ভাবলেই বুক কাঁপে উদয়িনীর। সিমরান বেশকিছু ক্ষণ উশখুশ করে হঠাৎ বলল,

‘ ভাইয়া কক্সবাজার যাবে? সৌধ ভাইও? ‘

উদয়িনী মাথা নাড়াল৷ সিমরান হঠাৎ আকুল স্বরে বলে ওঠল,

‘ আমিও যাব আম্মু। ‘

উদয়িনী ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,

‘ কী সব বলো? ভাই ভাবি আর তার বন্ধুরা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে তুমি কী করবে? ‘

মন খারাপ হয়ে গেল সিমরানের। সব আকুলতা নিভিয়ে কফির মগে চুমুক দিল। বুঝতে পারল সত্যি ঝোঁকের বশে আম্মুর কাছে এমন একটি আবদার করা উচিত হয়নি।
.
.
সকাল হতে না হতেই নজরুল মিঞার বাসায় সুজা এমপির ছোটো ছেলের আগমন। নজরুল মিঞা সম্পর্কে ফারাহর দুলাভাই। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। লোকটাকে প্রথম দেখাতে পছন্দ হয়নি সৌধর। চোখ দু’টো দেখে মনে হচ্ছে কঠিন কামাসক্ত মানুষ। এই মনে হওয়া নিয়ে একটুও বিব্রত নয় সৌধ। পুরুষ হয়ে নারীর চোখের ভাষা বুঝতে সে অক্ষম হলেও পুরুষের চোখের ভাষা বুঝতে অক্ষম নয়। সৌধর সঙ্গে তার ছোটো চাচা আর সুহাস এসেছে। তারা এসেছে আইয়াজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। নজরুল মিঞার শুধু চোখ দু’টিই সন্দেহ জনক নয়। তার ব্যবহারেও প্রকাশ পাচ্ছে অতিভক্তি। যা চোরের লক্ষণ। সে যাইহোক এসবে যায়-আসে না সৌধ বা সুহাসের৷ তারা মূল কথা বলল। প্রথমে নজরুল মিঞা বুঝতে পারছিলেন না এত বড়ো ঘরের লোক তার বাসায় কেন? কিছুটা ভয় আর কৌতূহল থেকে সম্মান দেয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত কথাও বলে ফেলেছে। পাঁচ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী আর শালিকাকে খাঁটিয়ে আপ্যায়নও করেছে। কিন্তু তাদের আসার কারণ জানতে পেরে হঠাৎ দমে গেলেন যেন৷ আমতা আমতা করে বললেন,

‘ ফারাহকে চেনেন আপনারা? ওর কারণেই আসছেন? ‘

সৌধ মাথা নাড়ায়। ওর চাচা সুলল চৌধুরী বলে,

‘ আমরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি৷ আপনাদের অনুমতি পেলে আজই বিয়ে পড়ানো হবে। পরে ধীরেসুস্থে মেয়ে ওঠিয়ে দেবেন। ‘

ফারাহর বর্তমান গার্জেন বলতেই নজরুল মিঞা আর তার স্ত্রী। সবাই এ সম্পর্কে জানে। এতিম মেয়েটা বোন আর দুলাভাইয়ের দায়িত্বে আছে। ভালো পাত্র পেলে খুশি মনে বিয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নজরুল মিঞা খুশি হলেন না। স্বস্তিও পেলেন না৷ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকলেন। তার এহেন আচরণের মাথা মুণ্ডু খুঁজে পেল না কেউই। আগের মতো আর ধৈর্য নেই সৌধর৷ বর্তমানে তার মাথা খারাপই বলা যায়। তাই নজরুল মিঞার ইনিনো বিনানো, আমতা আমতা ভাবে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। আকস্মিক চোয়াল শক্ত করে, কঠিন চোখে তাকাল নজরুল মিঞার দিকে৷ নজরুল মিঞা হকচকিয়ে গেলেন। এমপির ছেলে সৌধ। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এরা ক্ষেপে গেলে তার চাকরি যেতে সময় লাগবে না। এ শহরে থাকাও স্বস্তি দায়ক হবে না৷ জীবনেরও গ্যারান্টি থাকবে না৷ রাজনীতির সাথে জড়িত মানুষ গুলো কতখানি ভয়ংকর হয় জানে সে৷ তাই ঢোক গিলল। সৌধ তার ভয় পাওয়া বুঝতে পেরে ভয়কে দ্বিগুণ করতে বলল,

‘ ফারাহর বাবা,মা নেই৷ অর্থাৎ এ পৃথিবীতে ওর কোনো অরিজিনাল গার্জেনই নেই। তাই আমরা ফারাহর অনুমতির পর বড়োজোর আপনার স্ত্রীর অনুমতি নিতে পারি৷ এরপরও আপনাকে বলছি জাস্ট ভদ্রতার খাতিরে৷ এবার আপনিও ভদ্রতার পরিচয় দিন। নয়তো আমরা অভদ্রতার পরিচয় দেব।’

সুহাস তখন সৌধর গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করল,

‘ দোস্ত দুলাভাইকে সুবিধার লাগছে না৷ নিশ্চিত ভেজাল আছে। ‘

‘ ভেজাল আছে তা তো প্রথম পলকেই টের পেয়েছি। জাস্ট ওয়েট, বেশি বুঝলে দুলাভাইয়ের পশ্চাৎদেশে ব্যান্ড বাজিয়ে আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে দিব। ‘

সুহাস মাথা দুলাল একটু। বুঝতে পারল তার প্রিয় বন্ধুটি নিজের ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে বন্ধুদের নিয়েও চিন্তায় আছে। সে যে আঘাত পেয়েছে এ আঘাতের সম্মুখীন যেন তার আর কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ না হয় সেই প্রচেষ্টা করছে। সত্যি এই ছেলেটার মনে যেমন খাঁটি প্রেম রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে বন্ধুত্ব। এমন একজন মানুষকে সৃষ্টিকর্তা এভাবে নিঃস্ব করে দিতে পারে না৷ যদি করে দেয় তাহলে এর চারগুণ নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে?

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৪| [ এলার্ট- এই পর্বটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত। ]

ইতঃপূর্বে ফারাহর যত বিয়ে এসেছে সব ফিরিয়ে দিয়েছে নজরুল মিঞা। কিন্তু এবার সরাসরি ফিরিয়ে দিতে অক্ষম। কারণ এবার তার সামনে চৌধুরী বাড়ির দুই ছেলে উপস্থিত। যার মধ্যে একজন অর্থাৎ সুলল চৌধুরী তুখোড় রাজনীতিবিদ। তাই নানারকম জটিলতা দেখাতে শুরু করলেন। বিয়ে দেবে না এ কথা না করলেন না৷ সময় চাইলেন, এ মুহুর্তে কেন বিয়ে দিতে পারবেন না তার পিছনে নানাধরণের যুক্তি দাঁড় করালেন। ফারাহর বড়ো বোন ফারজানা দূর থেকে সৌধদের খেয়াল করল, আর স্বামীর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল, তাকেই কিছু একটা করতে হবে। তার পাশে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ফারাহ দাঁড়িয়ে ছিল। ফারাহকে টেনে ভিতর ঘরে নিয়ে গিয়ে সে শুধাল,
‘ তুই বিয়েটা করতে চাস? ‘

সহসা হুহু করে কেঁদে ফেলল ফারাহ। বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমি আয়াজকে খুব ভালোবাসি আপা। আর ভালোবাসি বলেই বিয়েটা করতে চাই না। ও খুব ভালো আপা, ভেরি অনেস্ট। কিন্তু আমি ভালো নই, অনেস্ট নই। আমি কলঙ্কিত! ‘

শেষ শব্দটা চোখ, মুখ খিঁচে বলল ফারাহ। বোনের যন্ত্রণার গল্প জানে ফারজানা। একই যন্ত্রণায় সেও ভুগছে বহুদিন৷ বুক যেন ফেটে গেল তার। এতিমদের জন্য দুনিয়া কত কঠিন তারা দু’বোন হারে হারে টের পাচ্ছে। তাই তো সেদিন নিজের মেয়ের মুখ চেয়ে সুইসাইড করতে পারেনি ফারজানা। সদ্য জন্ম দেওয়া শিশু সন্তানটির মুখ চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নরপশু স্বামীর ঘর করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। একজন মা সন্তানের সুখে নরক জীবন কাটাতেও দ্বিধা করে না। ফারজানা সেই মা যে নিজের দুশ্চরিত্র স্বামীর সংসার করছে শুধুমাত্র সন্তানের মুখ চেয়ে। আজ থেকে ঠিক সাড়ে চার বছর আগের ঘটনা,

ফারজানার সিজার হয়েছে দু’দিন। দু’রাত বোনের কাছে হসপিটালে কাটিয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে ফারাহ৷ আরো দু’দিন থাকতে হবে। তাই দুলাভাই তাকে বাসায় গিয়ে কয়েকঘন্টা কাটিয়ে আসতে বলে। এর মধ্যে ঘুম আর গোসলটাও সারতে বলে। ফারজানার শাশুড়ি দুপুরে খাবারদাবার নিয়ে আসবেন। তাই রান্না না করলেও চলবে। বোন এবং দুলাভাইয়ের কথানুযায়ী ফারাহ রাজি হয়। আর দুলাভাইয়ের সঙ্গে চলে যায় বাসায়৷ শরীর অতিরিক্ত দুর্বল থাকায় গোসল সেরে বিছানায় গা মেলে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। ছোটোবেলা থেকেই সে ভীষণ ঘুমকাতুরে। একবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে সে ঘুম ভাঙানো খুব কঠিন। ঠিক এই সুযোগটাই নেয় তার দুলাভাই। নজরুল মিঞা নিজেও জানতেন না নিজের শালিকার সঙ্গে এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন ৷ গোসল করে ছাদে কাপড় মেলে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরছিলেন তিনি৷ আকস্মিক দৃষ্টি পড়ে জানালা ভেদ করে শালিকার দিকে। দুধে আলতা গায়ের বরণ ফারাহর। অল্প বয়সী হৃষ্টপুষ্ট, আকর্ষণীয় শরীর তার। ওড়না বিহিন হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। নিঃশ্বাসের সাথে ওঠানামা করছে বক্ষঃস্থল। কামিজের গলা বড়ো হওয়াতে আকর্ষণীয়, নরম বক্ষ বিভাজন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যা নজরুল মিঞার ভেতর সম্ভোগের ইচ্ছে জাগায়৷ ফারাহ এর সাথে তার সম্পর্ক ভুলিয়ে দেয় ভেতরের কাম সত্তা। মুহুর্তেই হয়ে ওঠে লোভাতুর জন্তু। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা ফারাহ যেন কাঁচা নরম মাংসের দলা, আর সে ক্ষ্যাপাটে কুকুর। এভাবে হামলে পড়ে। দেহ থেকে একে একে সব বস্ত্র হরণ করে তবু ঘুম ভাঙে না মেয়েটার। সম্পূর্ণ ন গ্ন দেহশ্রী যখন পুরুষালি শরীর দ্বারা আবৃত করে ফেলে, নরম ঠোঁটে পুরুষালী ঠোঁটের দৃঢ় স্পর্শ পড়ে, বক্ষস্থলের নরম মাংসপিণ্ডে পড়ে শক্ত হাতের গভীর চাপ তখনি আচমকা দৃষ্টি বড়ো করে তাকায় ফারাহ। নিঃশ্বাস ছাড়ার ফাঁক টুকু পায় না মেয়েটা৷ দৃষ্টি বড়ো করে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় এতকাল বড়ো ভাইয়ের চোখে দেখে আসা, সম্মান দেয়া দুলাভাইয়ের কামাসক্ত মুখাবয়বে। নিজের বস্ত্রহীন দেহে তাকিয়ে লজ্জায়, ঘৃণায় ছটফটিয়ে ওঠে। কণ্ঠনালী থেকে সুর আসে না৷ মস্তিষ্ক অসাড়। নজরুল মিঞার বিকৃত স্পর্শে শরীরে অসহ্য পীড়া শুরু হয়। সেই স্পর্শ চূড়ান্ত মুহুর্তে পৌঁছে গেলে গগনবিদারী চিৎকার দেয় ফারাহ। নজরুল মিঞা যেন সেই চিৎকারে আরো বেশি উন্মাদ হয়ে ওঠে৷ পুরুষালি শরীরটার সঙ্গে পেরে ওঠে না ফারাহ৷ বড়ো বোনের স্বামীর কাছে নিজের কুমারীত্ব হারাতে বাধ্য হয়। আপার কাছে শুনেছিল তার দুলাভাই এর একটা কঠিন রোগ আছে৷ সেই রোগটা কী কোনোদিনও ফারাহকে বলেনি। চোখের সামনে শুধু আপার কষ্ট দেখেছে ফারাহ। তার সুন্দরী আপা বিয়ের পর কেমন অসুন্দরী হয়ে ওঠল। তার মতোই স্বাস্থ্য ছিল আপার৷ বিয়ের পর সে স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটল। ফারাহ ভেবেছিল প্রিয়তম স্বামীর অসুস্থতার জন্য আপা খুব চিন্তা করে। সে চিন্তার ফলেই নিজের প্রতি অযত্ন। কিন্তু আজ বুঝতে পারল তার দুলাভাইয়ের সমস্যাটা ঠিক কী? সে যে যৌ ন বিকারগ্রস্ত! এটা টের পায় তখন যখন দুলাভাইয়ের শরীরী চাহিদা মিটে গেলে আকস্মিক তার পা ধরে ক্ষমা চায়। আর বোঝাতে শুরু করে সে ইচ্ছে করে এই পাপ করেনি৷ তার ভেতরের কামসত্তা বাধ্য করেছে এটা করতে। যদিও মানসিক, শারীরিক কোনোভাবেই ফারাহ সক্ষম ছিল না এসব শোনার। তবু শুনতে হয়েছিল। দুলাভাই ক্ষমা চেয়ে, কান্নাকাটি করে বিদায় নেয়ার পর রক্তাক্ত চাদর গায়ে চেপে বিধ্বংসী কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যা করবে। এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই। বাবা,মা মারা যাওয়ার পর বোনের বিয়ে দেয় চাচারা এরপর বোনের আশ্রয়ে চলে আসে সে। আত্মীয়-স্বজনরা এখন আর তেমন যোগাযোগ রাখে না৷ তার জীবনের শেষ ভরসা ছিল বোন, দুলাভাই৷ সেই ভরসার মানুষটার মাধ্যমে আজ সে ধ র্ষিত! নিজের ওপর ঘৃণায় মূর্ছা ধরে ফারাহ৷ ফ্যানে ওড়না বেঁধে গলায় ধরবে ঠিক এমন সময়ই মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। আপা কল করেছে! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। কল রিসিভ করেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। আপা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জানতে চায় কী হয়েছে? ফারাহ বলতে পারে না৷ শেষে আপা স্বান্তনা দেয়,

‘ কোথায় আমার মেয়ের কান্না থামাবি তা না করে নিজেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিস? কখন আসবি তোরা? বাবু কাঁদছে শুনতে পাচ্ছিস? ‘

ফারাহর কান্নার বেগ বাড়ে। সে না হয় মরে গিয়ে নিজের কলঙ্ক মুছবে কিন্তু তার আপার কী হবে? চরিত্রহীন স্বামীর সঙ্গে ঘর করবে কী করে তার আপা? আর বাবু সেও তো চরিত্রহীন বাবা পেল। দিশেহারা হয়ে ওঠে ফারাহ৷ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে নিমিষেই। নতুন সিদ্ধান্ত নেয়, দুলাভাইয়ের মুখোশ টেনেহিঁচড়ে বোনের সামনে তুলে ধরবে। হসপিটালে কিছু বলতে না পারলেও বাসায় আসার পর বোনকে সবটা জানায় ফারাহ। সব জেনে ফারজানা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়৷ তার স্বামী প র্ণগ্রাফিতে আসক্ত। এ কথা জানতে পারে বিয়ের কয়েকমাস পরেই। অতিরিক্ত প র্ণ দেখার ফলে মন, মস্তিষ্ক দু’টোই বিকৃত হয়ে গেছে। মানসিক ভাবে অসুস্থও হয়ে পড়েছে৷ একজন স্বাভাবিক পুরুষের আচরণ আর একজন যৌ ন বিকারগ্রস্তের আচরণে পার্থক্য থাকে অনেক। যা স্ত্রী হিসেবে অনুভব করেছে ফারজানা। কিন্তু এসব তো আর লোকের কাছে বলা যায় না। এগুলোর সমাধান নিজেদেরই খুঁজতে হয়। নজরুল মিঞা ফারজানার কথায় পাত্তা দেয় না। নিজের বিকৃত, বিধ্বস্ত আচরণে প্রতিরাতে যখন ফারজানা অসুস্থ হয়ে পড়ত, কখনো কখনো জ্ঞান হারাত তখন কিছুটা অনুতপ্ত হতো। সকাল হলেই সেসব ভুলে যেত আর বলত, সে একদম সুস্থ। আসল সমস্যা ফারজানারই। স্বামীকে খুশি করার মুরোদ নেই। অথচ বর্তমান সময়ে অনেক পুরুষের মাঝেই এই সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা রঙিন জগতের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে বাস্তবতাতে৷ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়৷ হবে কী করে? চোখে যে লেগে আছে রঙিন পর্দা। সে পর্দা ভেদ করে প্রাকৃতিক, সত্যতে বিশ্বাস করতে পারছে না৷

ফারজানা অল্প শিক্ষিত নারী৷ মা, বাবার মৃত্যুর পর সে পড়াশোনা করতে পারেনি। চাচারাও বিয়ে দিয়ে দিল। সংসার আর ছোটোবোনের চিন্তায় পড়াশোনা থেকে একেবারেই মন ওঠে যায়৷ স্বামী, সন্তানকে ঘিরে স্বাচ্ছন্দ্যে কাটানোটাই একমাত্র লক্ষ্য তার। সেই লক্ষ্যের মাঝে আকস্মিক ধাক্কা পায়। কী করবে? কোথায় যাবে কূলকিনারা মিলে না। শালিকা আর বউয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে নজরুল মিঞা পা ধরে ক্ষমা চায় ফারজানা আর ফারাহর কাছে৷ যে ঘৃণ্য অপরাধ করেছে সে, তার ক্ষমা কি আদেও হয়? জানা নেই ওদের৷ কিন্তু এ পৃথিবীতে ওদের মতো অসহায় এ মুহুর্তে কেউ নেই। মান, সম্মান, লজ্জা চারিদিক থেকে চেপে ধরে। ফারজানার সন্তানও একদম শিশু৷ সব মিলিয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীকে ক্ষমা করার নাটক করে ফারজানা। আর ফারাহ সে ঘরকুনো হয়ে কাটাতে লাগে এক একটা দিন। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর নামীর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এরপর পরিচয় হয় আইয়াজের সঙ্গে। প্রেম ভালোবাসায় জড়ানো তো দূরে থাক কোনোদিন বিয়েও করবে না। এমন সিদ্ধান্ত নেয়া মেয়েটি আইয়াজের গভীর প্রণয়ে ফেঁসে যায়৷ অবচেতনে হওয়া সে প্রেম থেকে চেতনায় ফিরে বহুবার বেরুতে চেষ্টা করে ফারাহ৷ কিন্তু সে যত দূরে সরতে চায় আইয়াজ যেন ততোই গভীরে তলিয়ে নেয়৷ এভাবেই কেটে যায় কয়েকটা বছর। ফারজানা আপা দ্বিতীয় বার গর্ভবতী হওয়ার পর একদিন দুলাভাই তাদের দু’বোনের কাছে প্রস্তাব রাখে সে ফারাহকে বিয়ে করবে। তাদের ধর্মে চার বিয়ে ফরজ। সেখানে দুই বিয়ে কোনো ব্যাপার না। এমনই মন্তব্য করে দুলাভাই৷ ফারজানা, ফারাহ কেউ রাজি হয় না। দুলাভাই তখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে, সেদিন যা ঘটেছে অনিচ্ছাতে, ঘোরের মাথায়৷ এমন ঘটনার পর ফারাহকে আর কেউ বিয়ে করবে না। এছাড়া নিজের পাপের জন্য সেও অনুতপ্ত। তাই ফারাহকে বিয়ে করে আল্লাহ পাকের কাছে পাপ মুক্ত হবে। তার এই সিদ্ধান্তের পর দু’বোন খুবই আতঙ্কিত। এই আতঙ্কের মাঝেই আইয়াজের হয়ে সৌধরা এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। যা ফারজানার কাছে আল্লাহ তায়ালার আশীর্বাদ। কিন্তু ফারাহ কেন এত ভয় পাচ্ছে? সত্যিটা আইয়াজকে কখনো না জানালেই তো হলো।

ফারাহর পিঠে হাত বুলিয়ে ফারজানা বলল,

‘ তুই কি ভয় পাচ্ছিস? তোর সঙ্গে যে দূর্ঘটনাটি ঘটেছিল তা আইয়াজ জেনে যাবে বলে? ‘

কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়াল ফারাহ। বলল,

‘ ভয় পাচ্ছি না। আমি ওকে খুব ভালোবাসি আপা। তাই চাইছি না আমার মতো মেয়ে ওর জীবনসঙ্গী হোক। ‘

থরথর করে কাঁপতে লাগল ফারাহ। ফারজানা বোনের মুখ তুলে চোখের পানি মুছে দিল। নিজের কান্না আঁটকে বলল,

‘ তুই খুব ভালো মেয়ে বোন। যা ঘটেছে সব আমাদের কপালের দোষ। ‘

একটু থেমে আবার বলল,

‘ শোন এই দুনিয়ায় তো কত মেয়ে স্বেচ্ছায় নিজের সতীত্ব হারায়। একসময় সেই অবৈধ সম্পর্ক ভুলে দিব্যি অন্য পুরুষের ঘর করে৷ তুই তো তাদের মতো না বোন। তুই পরিস্থিতির স্বীকার। আমার কথা শোন, তুই রাজি হয়ে যা। আমি এক্ষুণি গিয়ে ওদের জানাব তুই আমি রাজি৷ তোর দুলাভাইকে আজ আর তোয়াক্কা করব না। ‘

আপার কথা শুনে ভয়ে শিউরে ওঠল ফারাহ। জাপ্টে ধরে বলল,

‘ ও আপা, আমিত আয়াজকে ভালোবাসি। আমি কি করে পারব ওকে ঠকাতে? ওর জায়গায় অন্য পুরুষ হলে বিয়ের ক্ষেত্রে এতখানি বাঁধত না৷ বিয়ের পর আয়াজ যদি বুঝতে পারে বা কোনোদিন সত্যিটা জানতে পারে আমি ওর চোখের দিকে তাকাব কী করে? ‘

‘ তাহলে সবটা আইয়াজকে জানা তুই। যদি সত্যি ও তোকে ভালোবেসে থাকে, যদি সত্যি সৎ হয়, মনের দিকে শুদ্ধ হয় বুঝবে তোকে। সম্মান করবে তোর ভালোবাসাকে। ‘

‘ আমি পারব না আপা, পারব না৷ আয়াজ এসব জানার আগে মৃত্যু হোক আমার, মৃত্যু। ‘

ফারজানা হতাশ ভঙ্গিতে সরে গেল৷ বুঝতে পারল এভাবে হবে না৷ ফারাহও ঘরের এক কোণে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠল৷ কেন সে আইয়াজকে জীবনে জড়াল কেন? কেন হার মানল ওর ভালোবাসার কাছে? প্রেমিকা হিসেবে সামনে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু স্ত্রী হয়ে কি কোনোদিন ও চোখে চোখ রাখতে পারবে? আইয়াজের মতো শুদ্ধ পুরুষ কি পারবে ওর কলঙ্কিত নারীকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে মেনে নিতে?
.
.
ক্রন্দনরত ফারাহকে ঘরে রেখে বাইরে আসে ফারজানা। স্বামীর ভাবগতি আর বোনের অনুভূতি বুঝে দারুণ এক সিদ্ধান্ত নেয়। উপস্থিত হয় ড্রয়িংরুমে। নজরুল মিঞার কথায় বিরক্তে চোখমুখ কুঁচকে আছে সৌধ। মেজাজ ভীষণ তপ্ত হয়ে ওঠেছে। তার একহাত শক্ত করে চেপে ধরেছে সুহাস৷ বলা যায় না, কখন হাত চালিয়ে দেয় সৌধ। এমন মুহুর্তে হঠাৎ সৌধর দৃষ্টি পড়ে গর্ভবতী ফারজানার দিকে৷ ইশারায় কিছু একটা বলছে ফারজানা। এমন সময় নজরুল মিঞার দৃষ্টি পড়তেই স্তব্ধ হয়ে গেল ফারজানা। তৎক্ষনাৎ সৌধ ওঠে দাঁড়াল। মুহুর্তেই সকলের হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে ওঠল৷ সৌধ বলল,

‘ আমার একটু ওয়াশরুম যাওয়া দরকার। ‘

নজরুল মিঞা ওঠে দাঁড়াতে নিলে সৌধ সুহাসকে ইশারা করল কিছু। সঙ্গে সঙ্গে সুহাস নজরুল মিঞার হাত চেপে ধরে বলল,

‘ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সৌধকে আপা ওয়াশরুম দেখিয়ে দিক। আপনি কাকুর সাথে আলাপের সমাপ্তি টানেন। ‘

সুললও ভীষণ চৌকস। তাই সৌধর হাবভাব টের পেয়ে নজরুল মিঞাকে কথার প্যাঁচে ফেলতে শুরু করল। সৌধও ত্বরিত চলে গেল ফারজানার কাছে। বলল,

‘ চলুন আপা ওয়াশরুম দেখিয়ে দেবেন। ‘
.
.
রাত আটটায় তিনজন তাগড়া যুবক অপহরণ করল ঘুমন্ত এক সুন্দরী যুবতীকে! সহায়তা করল যুবতীর বড়ো বোন নিজেই!

পরিকল্পনাটি করা হয় আজ সকালেই। সৌধদের ফ্লাইট রাত সাড়ে দশটায়। সে অনুযায়ী যে করেই হোক ফারাহকে আজ তাদের চাই’ই চাই। তাদের এই চাওয়া পূর্ণ করল, ফারজানা আপা। সৌধর সঙ্গে পরিকল্পনা করে সন্ধ্যা বেলায় স্বামী আর বোনকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ায়। ওরা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেই কল করে সৌধকে। সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রো নিয়ে বাসার সামনে হাজির হয় সৌধ, সুহাস, আইয়াজ। সৌধ ড্রাইভিং সিটে বসে অপেক্ষা করে৷ নামী পেছনে বসা। সুহাস আর আইয়াজ যায় বাসার ভেতরে। ফারজানা আপার সহায়তায় আইয়াজ তার প্রেয়সীকে পাঁজা কোল করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে৷ পেছন পেছন ফারাহর লাগেজ হাতে বেরোয় সুহাস। তাড়াহুড়োয় ফারজানা আপার থেকে বিদায় নেয়া হয় না। গাড়িতে ওঠার পর আইয়াজ জালানার বাইরে উঁকি দিয়ে ইশারা বিদায় নেয় আর তার ওপর ভরসা রাখতে বলে। ফারজানা আপার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। এক টুকরো আশার আলো খুঁজে পায় স্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে থাকা বিশ্বস্ত দু’টি চোখ দেখে।

এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পুরো সময়টাই ফারাহ আইয়াজের বুকে ঘুমিয়েছে। সেই যে ছেলেটাকে কোলে তুলেছে একটুর জন্যও নামায়নি। সুহাস বার বার বলেছে সিটে শুইয়ে দিতে। প্রচুর জায়গা আছে। তবু শুনেনি। ফারাহর ঘুম সকালের আগে ভাঙবে কিনা সন্দেহ। এমনিতেই ভীষণ ঘুমকাতুরে। এ-র ওপর ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, কক্সবাজার পৌঁছানোর পরও ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা নেই। মেয়েটা ঘুমাক। তারা নির্ঝঞ্ঝাটে পৌঁছে যাক কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে।

বিয়ের পর নামীকে নিয়ে এই প্রথম দূরে কোথাও যাচ্ছে সুহাস৷ প্রথম হানিমুন। একদিকে বন্ধুর বিয়ে অন্যদিকে প্রথম হানিমুন। সব মিলিয়ে সুহাসের মনটা বেশ ফুরফুরে। ড্রাইভিং সিটে সৌধ। মাঝখানে সে আর নামী। আইয়াজ ফারাহ পেছনে। অনুভূতি বেশ প্রগাঢ়। সেই অনুভূতির রেশ ধরে নামীর গালে টোপ করে চুমু এঁটে দিল সুহাস। মুহুর্তেই চোখ বড়ো বড়ো করে নামী তাকাল সামনের দিকে। সৌধর মন এদিকে নেই৷ সে ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত। দেখেই ত্বরিত পিছনে তাকাল আইয়াজের দৃষ্টি ফারাহতে স্থির৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে এবার নিজের বরের দিকে তাকাল। বকা দেয়ার আগ মুহুর্তে হঠাৎ পুরো গাড়ি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল! এমন কাণ্ড কে ঘটাতে পারে বুঝতে বাকি রইল না কারোরি৷ নিজের মতো লাইট অফ করে নামীর কোমর পেঁচিয়ে ধরল সুহাস। একটানে একদম নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো৷ আঁতকে ওঠল নামী। সুহাস ঘনিষ্ঠ হতে হতে ফিসফিসিয়ে কানে কানে বলল,

‘ হানিমুন জার্নি একটু হর্নি না হলে চলে জান? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
❤️

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-২৯+৩০+৩১

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৯|
কন্যা বিদায়ের পর নিজ ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল সুজা চৌধুরী। এমন সময় বাড়ির কাজের লোকদের হট্টগোল শুনতে পেল। তানজিম চৌধুরী স্বামীর মাথা টেপা স্থগিত রেখে মাথায় কাপড় তুলে বেরিয়ে এলেন। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বললেন,

‘ এই তোরা চুপ করবি? কর্তা বিশ্রাম নিচ্ছে। ‘

চৌধুরী গিন্নির উক্ত কথায় একজন প্রায় কেঁদে দিয়ে বলল,

‘ খালা গো সৌধ ভাই আর হের বন্ধুরা মিলা কারে জানি কু পাইতে গেল গো! ‘

আকস্মিক কথায় মুখে ডানহাত চেপে ধরল তানজিম চৌধুরী। আতঙ্কিত গলায় বললেন,

‘ এসব কী কথাবার্তা! ‘

ত্বরিত গতিতে নিচে নেমে এলেন তানজিম চৌধুরী। হাঁকডাক করে ডাকতে লাগলেন দেবর আর বড়ো ছেলে সুনীলকে। অন্যান্য ঘর থেকে ছেলে, মেয়েরা ছুটে এলো। বেরিয়ে এলো নামী, ফারাহ, প্রাচী আর সিমরানও। তারা ভারি পোশাক পরিবর্তন করতে ঘরে গিয়েছিল। এরই মাঝে বাইরে থেকে সৌধর বন্ধু আজিজ দৌড়ে এলো। চিৎকার করে বলল,

‘ সুজা আংকেল কোথায়? সুজা আংকেল? প্লিজ আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন। ভয়ানক কিছু ঘটে যাবে। অর্পণ স্যারকে মেরেই ফেলবে ওরা! ‘

বাড়ির হট্টগোল কানে পৌঁছেছে সুজা চৌধুরী আর ছোটো চাচা সুলল চৌধুরীর। সুজা চৌধুরী বেরুতে দেরি করলেও সুলল আর সুনীল দেরি করল না৷ মেয়ে তাহানীকে ঘুম পাড়াচ্ছিল সুলল। হট্টগোলে মেয়েটা আর ঘুমাতে পারল না৷ তাই মেয়েকে কোলে নিয়েই নিচে নেমে এলো। সকলের আতঙ্কিত মুখ আর কথা শুনে তাহানীকে বোনের মেয়ের কোলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঘটনা কী? আর সৌধরা কোথায়। নামী, প্রাচী, ফারাহ কিছুই বুঝতে পারছিল না৷ কিন্তু সিমরান সমানে ঢোক গিলছে৷ সে বুঝতে পারছে ঠিক কী ঘটতে পারে। গতরাতে নিধি আপুর ব্যাপারে সবটা জেনেছে সে। সেই সবই সৌধ ভাই জেনে যায়নি তো? যদি জেনে যায় তবে এখন থেকেই শুরু হবে তাদের সবার জীবনে কঠিন পরীক্ষা। যে পরীক্ষার জন্যই নিধি সাহস জুগিয়েছে তাকে। কথা দিয়েছে পরীক্ষায় সফল না হওয়া পর্যন্ত সে সব সময় পাশে থাকবে। মুহুর্তেই হাত, পা কাঁপতে শুরু করল সিমরানের৷ একটা কথা তার মাথায় ঢুকছে না। নিধি আপু বলেছিল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই নিজের ব্যাপারে সব জানাবে বন্ধুদের। তবে কেন আজ এমন অসময়ে জানালো? সবটা জেনেই কি সৌধ ভাই অর্পণ স্যারকে খু ন করতে চাইছে? সিনেমার মতো নিধি আপুকে পেতে সৌধ ভাই কি খু নও করতে পারে!
.
.
বোন বিদায়ের পর পর নিধিকে খুঁজতে থাকে সৌধ৷ ঠিক সে সময়ই আইয়াজ জানায় অর্পণ স্যার জোর পূর্বক নিধিকে টেনে তাদের স্টোর রুমে নিয়ে গেছে। নিধি স্বেচ্ছায় অর্পণ স্যারের হাত ধরতে পারে। এমন কথা ভাবতেই পারে না আইয়াজ। খোলা চোখে যা দেখেছে আর যা বুঝেছে তাই বন্ধুকে গড়গড় করে বলেছে এতেই মাথা বিগড়ে গেছে সৌধর৷ এত্ত বড়ো সাহস অর্পণ স্যারের? তার বাড়ি এসে তারই ভালোবাসার মানুষকে জোরজবরদস্তি! মুহুর্তেই ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো তিন বন্ধু ছুটে আসে। দীর্ঘদিন যাবৎ যে মেয়েটাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। নিজের সর্বস্ব জুড়ে রয়েছে যে মেয়েটা। যাকে বউ করে ঘরে তোলার জন্য বুকের ভেতর তোলপাড়। যার একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা। তাকে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে দেখে মাথায় রক্ত ছলকে ওঠে। টগবগিয়ে ফুটতে থাকে শরীরের রক্ত কণিকা। নিধি শুধু সুহাস, আইয়াজের বান্ধুবিই নয়। প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু সৌধের মনের মানুষ। তাদেরও মাথা ঠিক নেই নিধি আর অর্পণ স্যারের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের দৃশ্য দেখে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ওরা৷ কিছু মুহুর্তের জন্য হয়ে ওঠে মানুষ থেকে অমানুষ। প্রথমে তিনজন এলোপাতাড়ি মা রধর করে অর্পণ স্যারকে। নিধি বাঁধা দিতে গেলে আইয়াজ শক্ত হাতে ওকে টেনে ধরে ঘরের বাইরে নিতে চায়৷ ধস্তাধস্তি হয় দুজনের মধ্যে। সৌধ বুঝতে পারে অর্পণ স্যারকে রক্ষা করতে আহাজারি করছে নিধি৷ শুনতে পায় বারবার বলা ওর কিছু কথা,

‘ সৌধ প্লিজ উনাকে ছেড়ে দে। উনি কোনো জুলুম করেনি আমাকে। যা হচ্ছিল আমার ইচ্ছেতে হচ্ছিল, প্লিজ সৌধ। আমার কথা শোন তোরা পায়ে ধরি ভাই আমার কথাটা শোন। ‘

নিধির থেকে এমন একটি বাক্য শোনার পর সৌধ আর ঠিক থাকে না৷ থাকতে পারে না৷ অর্পণ স্যার ওকে ছুঁয়েছে। সে ছোঁয়াটা ওর ইচ্ছের ছিল! যেখানে গতরাতে ওকে ছুঁয়ে থা প্পড় খেয়েছে সেখানে অর্পণ স্যারের ছোঁয়াতে ওর সম্মতি? আরো বীভৎস হয়ে ওঠে সে। এতক্ষণ স্বাভাবিক মারধর থাকলেও এরপরের গুলো হয় অমানুষিক। অর্পণ স্যার নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে যথেষ্ট। কিন্তু পারেনি৷ দু’জন বলিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে একজন পেরে ওঠা অসম্ভব। চোখে, মুখে অগণিত লা ত্থি পড়ায় চশমার কাঁচ ভেঙে চোখের মণিতে ঢুকে যায়। নাক মুখে রক্ত ছলকে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মাথায় একটি মোটা কাঠের আঘাত সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারায় অর্পণ স্যার। নিধির হাতটা শক্ত করে ধরে আছে আইয়াজ৷ বেচারি গলা ফাটিয়ে আহাজারি করছে। শেষ পর্যন্ত না পেরে আইয়াজের হাতে কামড় বসিয়ে ছাড়া পায়। ছুটে এসে অর্পণ স্যারকে জড়িয়ে ধরে৷ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। মুহুর্তেই তার বাহুতে থাবা দিয়ে নিজের বুকে তুলে আনে সৌধ। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে নিধিকে জড়িয়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘ ডোন্ট ক্রাই নিধি, এই জা নো য়া রটা তোকে ছুঁয়ে ছিল না? জন্মের মতো তোকে ছোঁয়ার স্বাদ মিটিয়ে দিয়েছি। ‘

আকস্মিক কান্না থেমে যায় নিধির। বিধ্বস্ত মুখে তাকায় সৌধর ভয়ানক রক্তিম চোখে। এরপর আচমকাই কষিয়ে এক থা প্পড় বসায় গালে। দু’হাতে কলার চেপে ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে,

‘ কেন করলি এটা কেন করলি? বললাম তো যা হচ্ছিল দু’জনের আগ্রহতেই হচ্ছিল। তোকে আমি ছাড়ব না সৌধ। তোকে আমি ছাড়ব না। ‘

কথাগুলো বলেই হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে এক ছুটে অর্পণ স্যারের কাছে চলে যায়৷ হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে স্যারকে। সুহাস স্তব্ধ মুখে পাশেই দাঁড়িয়ে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ সুহাস, অর্পণ স্যার মরে যাবে। উনাকে হসপিটাল নিতে হবে৷ প্লিজ আমাকে হেল্প কর। সৌধর বন্ধু হয়ে মা রতে সাহায্য করেছিস। আমার বন্ধু হয়ে মানুষটাকে বাঁচাতে সাহায্য কর প্লিজ। ‘

নিধির কথাগুলো বিষাক্ত ঠেকে সৌধর। পুনরায় উদ্ভ্রান্তের মতো নিধিকে ধরতে এলেই ওখানে উপস্থিত হয় তার ছোটো চাচা আর বড়ো ভাই। নিধি তাদের দেখে আরো ভেঙে পড়ে৷ ছুটে এসে সুলল চৌধুরীর দু’পা আঁকড়ে ধরে বলে,

‘ কাকু প্লিজ আমার হাজব্যান্ডকে বাঁচান! ওরা মেরে ফেলল উনাকে৷ প্লিজ হেল্প করুন, হসপিটাল নিয়ে চলুন উনাকে। প্লিইইজ কাকু। ‘

সুলল চৌধুরীর মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায় নিজের ভাতিজার কাণ্ড দেখে। সে জানত অর্পণ শিকদার সৌধদের কলেজের টিচার। নিধি সৌধর বান্ধবী। এখন শুনছে অর্পণ শিকদারের স্ত্রী নিধি। এখন এসব ভাবার সময় নয়। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। কঠিন চোখে তাকায় সৌধর দিকে। অসহায় একটা মেয়ের আর্তনাদ বুকে লাগে সৌধর ভাই সুনীলের৷ সেই সাথে রক্তাক্ত দেহে পড়ে থাকা অর্পণকে দেখে প্রচণ্ড রেগে যায়। ছুটে এসে ভাইকে মারতে উদ্যত হয়৷ তাকে আটকায় সুহাস। তাদের পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত। যে কাণ্ড ঘটিয়েছে তার ছোটো ভাই৷ এটা যদি বাইরের কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়, বিরোধী দলের সদস্যরা জানতে পারে অতিথিকে এভাবে আহত করা হয়েছে। মারাত্মক ক্ষেপে ওঠবে তারা, ক্ষেপিয়ে তুলবে জনগণকেও। দিশেহারা প্রায় হয়ে ড্রাইভারকে কল করে বাড়ির পেছন গেটে আসতে বলে সুনীল।
সুহাস, আইয়াজ, সৌধ তিনজনই বিস্ফোরিত নিধির বক্তব্যে। সৌধ ভয়াবহ লাল চোখে তাকিয়ে আছে। যে চোখে বিস্ময়, অবিশ্বাস সমস্তই ভর করেছে। এমতাবস্থায় নিধিকে ধরে ওঠায় ছোটো চাচা। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেয়। ততক্ষণে গাড়ি এসে পড়ে। সুনীল আর সুলল মিলে অর্পণ স্যারকে গাড়িতে তুলে। সঙ্গে বদ্ধ উন্মাদের মতো ছুটে যায় নিধিও৷ কিন্তু গাড়িতে ওঠতে পারে না৷ তার পূর্বেই শক্ত থাবা দিয়ে নিধিকে আঁটকে দেয় সৌধ৷ বড়ো ভাই সুনীল চোখ গরম করে বলে,

‘ সৌধ ওকে ছাড়। ‘

সৌধ শক্ত মুখে জবাব দেয়,

‘ মরে গেলেও না। ‘

নিধি করুণ স্বরে বলে,

‘ তোর দু’টি পায়ে ধরি সৌধ। আমাকে যেতে দে, ছেড়ে দে আমায়। ‘

‘ না ছাড়ব, না যেতে দেব। ‘

তীব্র জেদি স্বর। এরপরই হেঁচকা টানে নিধিকে একদম নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে। নিধি সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ছাড় পেতে। সুলল চৌধুরী ধমকায়। তবু ছাড়ে না সৌধ। আজ যেন স্বয়ং উপরওয়ালা ছাড়া কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তাকে৷ কাউকে পরোয়া করবে না সে। ধৈর্য্যের সব বাঁধ ভেঙে গেছে তার। এদিকে অর্পণ স্যারের মুখ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। জ্ঞান হারা তখনো। বাধ্য হয়ে সুনীল বলল,

‘ কাকা আমাদের যাওয়া উচিত। সৌধর সঙ্গে কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে। ‘

সুলল চৌধুরী সায় দিল বড়ো ভাতিজাকে। এরপর নিধিকে বলল,

‘ মা নিধি, আমরা যাই। তুমি চিন্তা করো না অর্পণ শিকদারের চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি হবে না। ‘

হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল নিধি। সৌধর থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে হতাশ ভঙ্গিতে তাকাল সুললের দিকে। অসহায় ভাবে মাথা কাত করে সম্মতি দিল। গাড়ি স্টার্ট হলো। তক্ষুনি চোখের পলকে চলেও গেল গাড়িটা। এরপরই বাঘের মতো গর্জন দিয়ে সৌধ বলল,

‘ অর্পণ তোর হাজব্যান্ড? ‘

নিধির কান্না থেমে গেল আচমকা। শক্ত মুখে জবাব দিল,

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, উনি আমার স্বামী। ‘

সহসা নিধির গলা চেপে ধরল সৌধ। সুহাস, আইয়াজ দু’জনি ছুটে এসে সৌধকে থামানোর চেষ্টা করল। নিধি চোখ উল্টে দিলে ছেড়ে দিল সৌধ৷ এরপর টানতে টানতে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। পাশাপাশি বন্ধুদের হুংকার দিয়ে বলল,

‘ কাজী ডাক তোরা। আগে বিয়ে পরে বোঝাপড়া। ‘

নিধিকে টেনে হিঁচড়ে সদর দরজার সামনে যেতেই মুখোমুখি হলো শ্রদ্ধেয় পিতা সুজা চৌধুরীর। ছোটো ভাই আর বড়ো ছেলের ওপর দায়িত্ব দিয়ে সে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ির একটা মেয়ে বউ বা অতিথিবৃন্দ। কাউকেই যেতে দেয়নি ওদিকে। কিন্তু এবার সর্ব সম্মুখে সৌধই এলো। তার চেহেরা দেখে পরিষ্কার সে স্বাভাবিক অবস্থাতে নেই। সৌধর অস্বাভাবিকতা নিশ্চিত হলো তখন যখন একঘর লোকের সামনে শক্ত হাতে বান্ধুবির কব্জি ধরে বাবার মুখোমুখি হয়ে বলল,

‘ আব্বা ও নিধি, চিনেন তো? আমি ওকে ভালোবাসি আজ পাঁচ বছর৷ স্মৃতি আপুর বিয়ে মিটে গেলেই জানাতে চেয়েছিলাম। বিয়ে মিটে গেছে জানিয়ে দিলাম৷ সুহাস কাজী ডাকতে গেছে। আজ এক্ষুনি ওকে বিয়ে করব আমি। ‘

সুজা চৌধুরী স্তম্ভিত হয়ে সৌধর পেছনে তাকালেন। সুহাস থমথমে মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। সৌধর মা তানজিম চৌধুরী পেছন থেকে কান্নারত গলায় বলল,

‘ সুহাস তো তোর পেছনে। ‘

সহসা ক্রোধান্বিত ভঙ্গিতে পেছনে তাকাল সৌধ। চোয়ালদ্বয় কঠিন করে বলল,

‘ তোকে না বললাম কাজী ডাকতে? ‘

সুহাস বোঝানোর ভঙ্গিতে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ বিশ্রী একটা গালি দিল ওকে। সুজা চৌধুরী ধমকে ওঠল। সে ধমক শুনে বাড়ির সদস্যরা ভয়ে সরে পড়ল সবাই। রইল শুধু দাদুনি, সৌধর ফুপু আর মা তানজিম চৌধুরী। নিধি মাথা নিচু করে কাঁদছে। সুজা চৌধুরী সুক্ষ্ম চোখে তাকালেন ওর দিকে। দেখলেন তার ছেলের হাত থেকে ছাড় পেতে মেয়েটার তীব্র চেষ্টা৷ কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে থেকে সুজা চৌধুরী ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘ ভিতরে আসো ওকে নিয়ে। ‘

সৌধ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল নিধির দিকে। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে৷ কী বিশ্রী এই কান্না। বুকটা বিতৃষ্ণ লাগল সৌধর। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ কান্না থামা। ‘

নিধি চোখ, মুখ শক্ত করে হাত মোচড়াতে লাগল। সৌধর বিধ্বস্ত মুখে ঈষৎ হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। বাম দিক, ডান দিক ঘাড় বাঁকিয়ে প্রগাঢ় চোখ নিক্ষেপ করল নিধির পানে। ফিসফিসে কণ্ঠে বলল,

‘ ভালোবাসা দিয়ে আমাকে চেনাতে চেয়েছিলাম চিনলি না। এবার আমার রাগ, জেদ, ক্ষমতা দিয়ে চেনাব। ‘

বুকের ভেতর চিড়িক দিয়ে ওঠল নিধির। দু’চোখ উপচে আবারো অশ্রু গড়াতে শুরু করল। তা দেখে সৌধ আঁতকানো কণ্ঠে বলল,

‘ এই আবার কাঁদছিস, ভয় পাচ্ছিস তুই? বোকা মেয়ে, সবকিছুর পর আমি তোকে ভালোবাসিরে। জাস্ট বউ হয়ে যা, সাত খু ন মাফ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ আগে যা সব বলেছিস এসব জাস্ট ভুলে যাব। বিলিভ মি, সব ব্যথা ভুলে ভালোবাসব আমরণ, জাস্ট আমার বউ হয়ে যা পাগলি। ‘

শেষ বাক্যগুলো ছিল তীব্র আবেগ মেশানো। যা বলার সময় গলা কাঁপছিল সৌধর৷ কাঁপছিল বুকের গহীনে থাকা হৃদযন্ত্রটাও। আর নিধি? সে ছিল নির্বিকার। সৌধকে কেবল অমানুষ, ডক্টর রূপে কষাই ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। বিষাক্ত ঠেকছে ওর স্পর্শ, কণ্ঠ, মুখাবয়ব সবটা।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩০|
বিয়ে বাড়ির আমেজ এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কাছের অতিথিবৃন্দের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত আছে। তাই সুজা চৌধুরীর ব্যক্তিগত মিটিং রুমে নেয়া হলো সৌধ, নিধিকে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সৌধর মা আর দাদুনিকে রাখা হয়েছে৷ বন্ধুদের মধ্যে রাখা হলো শুধু সুহাস, আইয়াজকে। ছোটোবেলা থেকেই সৌধ ভীষণ শান্ত প্রকৃতির হলেও জেদটা মারাত্মক।
ব্যক্তিভেদে প্রচণ্ড গম্ভীরও এই ছেলে। মেজাজের ব্যাপারটা কালেভদ্রে দেখা যায়। কিন্তু এমন উশৃংখল মেজাজের দেখা মিলল এবারি প্রথম। সুজা চৌধুরী স্তম্ভিত মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে। ছোটো ছেলের এ কোন রূপের সঙ্গে পরিচয় ঘটল তার? সে জানত বড়ো ছেলেটা তার স্বভাবের হয়েছে। ছোটোটা পেয়েছে মায়ের স্বভাব। মাথায় রক্ত ওঠা, খু ন চাপা ক্রোধ তো স্ত্রী তানজিমের নয়। এই ক্রোধ তো তারই অংশ। ঘোর কাটল সুজা চৌধুরীর। তার পাশের চেয়ারে দৃষ্টি মেঝেতে স্থির রেখে সৌধ বসা। সম্মুখের চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে কাঁদছে নিধি৷ তার ডান পাশে তানজিম চৌধুরী, বামপাশে দাদুনি। সুহাস আর আইয়াজ একপাশে উদ্বিগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে। সকলের দিকে একবার শীতল দৃষ্টিপাত করে মুখ খুললেন সুজা চৌধুরী। টেবিলে দু’হাতের কনুই ভর দিয়ে নিধিকে উদ্দেশ্য করে দৃঢ়স্বরে বললেন,

‘নিধি মা, তুমি আমার ছেলের সাথে কমিটেড ছিলা?’

তৎক্ষনাৎ দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে হুহু করে কেঁদে ওঠল নিধি। দু-হাত মুখ চেপে একাধারে কেঁদেই গেল সে। নিজেকে বড্ড এলোমেলো লাগছিল সৌধর। মাথাটা ঘুরাচ্ছে। মস্তিষ্কে চাপ পড়ছে খুব। বুকের ভেতর একটা অংশ জুড়ে অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করছে। কোনোভাবে হিসেব মেলাতে পারছে না সে৷ তার এই এলোমেলো অবস্থায় বাবার প্রশ্নে নিধির উত্তর বিস্ফোরণ ঘটাল। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে উদ্যত হলো নিধির দিকে তেড়ে আসতে। সুজা চৌধুরী বুদ্ধিমান মানুষ। তুখোড় রাজনীতিবিদ। এক মাথায় ঘরে, বাইরে রাজনীতি করে বেড়ায়। তার তীক্ষ্ণ জ্ঞানে ছেলের প্রতিক্রিয়া আর নিধির প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ অমিল লক্ষ্য করলেন। তাই ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহসা হাত টেনে ধরে গরম চোখে তাকালেন। বাবার তোপের মুখে পড়ে কিঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রণ হলো সৌধ। ধীরগতিতে বসল আগের ন্যায়। সুজা চৌধুরী ফের ক্রন্দনরত নিধির পানে তাকালেন। বললেন,

‘ দেখো মা আমার বিশ্বাস সৌধকে আমি যতটুকু চিনি তার চেয়ে বেশি তুমি, সুহাস, আইয়াজ চিনো। আমার ছেলের প্রতি কিছুটা বিশ্বাস রাখাকে তুমি অন্যায় ভাবে দেখো না। ‘

কথাটা বলে শেষ করতেই হঠাৎ তার চোখ পড়ল সুহাসের দিকে। সুহাস যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। অনুমতির অভাবে সাহস পাচ্ছে না। তাই অনুমতি, সাহস দু’টোই দিলেন তিনি বললেন,

‘ সুহাস এদিকে আসো। ‘

সঙ্গে সঙ্গে সুহাস এগিয়ে এলো। সুজা আংকেল বলল,

‘ বসো তোমার কিছু বলার থাকলে বলো। আমি শুনতে চাই। ‘

সুহাস যেন এই সুযোগটারি অপেক্ষায় ছিল। তাই চেয়ারে না বসে চট করে নিধির সম্মুখে মেঝেতে বসে পড়ল৷ এরপর তাকাল সুজা আংকেলের দিকে। বলল,

‘ আমি নিধির সাথে কথা বলতে চাই আংকেল। আমার মনে হয় এতে করে সবাই সবার উত্তর পাবে। কী সত্যি, কী মিথ্যা সেটাও জানা হবে। ‘

‘ বেশ কথা বলো। ‘

কিয়ৎক্ষণ নীরবতা চলল। সুহাসও তৈরি হয়ে নিল নিধির সঙ্গে বোঝাপড়া করার। নিধি দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। যে কথাগুলো ঠান্ডা মাথায়, ঠান্ডা পরিস্থিতিতে বন্ধুদের বলতে চেয়েছিল। আজ এই বিধ্বস্ত মুহুর্তে সে কথাগুলো বলতে বাধ্য হলো সে। তার পূর্বে অবশ্য সুহাসের ক্রোধ মিশ্রিত কিছু কথার উত্তর দিয়ে নিল। সুহাস বলল,

‘ তুই জানতি না সৌধ তোকে ভালোবাসে?’

নিধি মাথা নাড়াল। সুহাস আবারো প্রশ্ন করল,

‘ তুই ওকে সময় দিসনি? ‘

এবারেও মাথা নাড়াল নিধি। চোয়াল শক্ত করে রক্ত বর্ণ চোখে তাকিয়ে সুহাস বলল,

‘ স্মৃতি আপুর বিয়ের পর পরিবারকে জানিয়ে তোর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার কথা ছিল না? ‘

সুহাসের প্রতিটা প্রশ্নে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল নিধি। এতে সুহাসের ক্রোধ প্রগাঢ় হলো। বলল,

‘ তাহলে এই বেইমানিটা কীভাবে করতে পারলি? সৌধকে তুই ভালোবাসা, সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দিসনি মানলাম। কিন্তু গত তিন বছরে তোদের চালচলন, হাবভাবে কিছু সুপ্ত অনুভূতি ছিল। যা খোলা চোখে দেখা না গেলেও আমি এবং আমরা দেখতে পেয়েছি। তুই কেন সৌধর অনুভূতি নিয়ে খেললি? অর্পণ স্যারের প্রতি তুই ক্রাশড ছিলি। তাই বলে তাকে ভালোবাসিস বা তার সাথে সম্পর্কে আছিস এমন কিছু না দেখেছি আর না শুনেছি আর না তুই বলেছিস। কেন করলি এমন বল? যদি অর্পণ স্যারকেই ভালোবাসিস গত তিন বছরে কেন আমাদের বা সৌধকে জানাসনি। সৌধর অনুভূতিতে কেন নীরব ছিলি, কেন এভাবে ধোঁকা দিলি? খুব কষ্ট হচ্ছে নিধি খুব। তোকে বেইমান ভাবতে, তোর এই নতুন রূপ দেখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবশেষে সৌধর অনুভূতি নিয়ে এভাবে খেলাধুলা জাস্ট মেনে নিতে পারছি না। ‘

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল সুহাস। ওপাশ থেকে আইয়াজ বলল,

‘ মুখ খোল নিধি। নয়তো আজ এখানেই আমাদের বন্ধুত্ব শেষ। ‘

আকস্মিক কেঁপে ওঠল নিধি। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে ত্বরিত স্বরে বলল,

‘ সব বলব আমি। বলতে চেয়েছিলামি। কিন্তু সেই সুযোগটা পাইনি। ভেবেছিলাম স্মৃতি আপুর বিয়ের ঝামেলা কে টে গেলে বলব। আমি চাইনি আমার জন্য সৌধর আনন্দ মাটি হয়ে যাক। ‘

সুহাস স্তব্ধ মুখে বলল,

‘ একটা কথা বল, অর্পণ স্যারের সঙ্গে তোর প্রেম কত দিনের? ‘

ঢোক গিলল নিধি। মাথা নিচু করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ আমাদের মধ্যে কখনো প্রেম ছিলই না। উনার প্রতি আমার সফট কর্ণার ছিল তবু তিন বছর আগে। ‘

‘ এখন? ‘

‘ আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী! ‘

ঠান্ডা কণ্ঠ নিধির । বাবার পাশে বসা সৌধ অস্থির হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুজা চৌধুরী তার মুখে হাত চেপে ধরল। দৃঢ়স্বরে বলল,

‘ আব্বা শান্ত হও। আমার ওপর ভরসা রাখো। বলতে দেও ওরে, আগে শুনি সব। ‘

সৌধ শান্ত হতে পারল না। তবু বাবার কথায় কান সজাগ করে বসে রইল ঠাঁই। নিধির কথা শুনে সুহাসের কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না সে৷ কিন্তু নিধি নিজে থেকেই বলতে শুরু করল সবটা –

***
সৌধকে আমি বন্ধুর চোখে দেখেছি মাত্র দু’বছর। এরপরই ওর দৃষ্টিতে বন্ধু ছাড়া আলাদা কিছু টের পাই। এর সত্যতা মিলে যায় সেদিন যেদিন নিজ মুখে ও স্বীকার করে ও আমাকে ভালোবাসে। যা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম তা সত্যি হয়ে যাওয়াতে একদিকে খুশি আরেকদিকে দুঃখ হচ্ছিল। সৌধ নিঃসন্দেহে চমৎকার একজন মানুষ। প্রতিটা মেয়েই ওর মতো ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওর মতো ছেলের ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষায় থাকে। তাছাড়া চৌধুরী বাড়ির মতো পরিবার আমি খুব কমই দেখেছি। সব মিলিয়ে সৌধর ভালোবাসা পাওয়াটা আমার জন্য সৌভাগ্য ছিল৷ এর আগে ওদের মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের বলতাম৷ এরপর থেকে মনে মনে সব সময় নিজেকে সৌভাগ্যবতী ভাবতাম। কিন্তু কোনোদিন ওকে নিজের করে পাবো বা আমি ওর বউ হতে পারব বিশ্বাস হতো না৷ এর কারণ আমার পারিবারিক সমস্যা। সেই সমস্যা গুলোই তিনবছর আগে খোলাখুলি বলি ওকে। সবটা শুনে ও আমাকে এত সুন্দর করে বোঝায়, ভরসা দেয় আমি জাস্ট বিমোহিত হয়ে যাই। আশার আলো খুঁজে পাই ওকে পাওয়ার। সেদিন থেকে বন্ধুত্বের বাইরেও ওর প্রতি একটা দুর্বল জায়গা সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু সেটাকে আজ আমি ভালোবাসা বলতে পারছি না, তখনো পারিনি৷ যেহেতু আমরা বন্ধু ছিলাম সেহেতু ভালোবাসাবাসির ব্যাপারটা আসলে সেভাবে আসেনি। সৌধর দিক থেকে এলেও আমার দিকে আসেনি। চেষ্টা করিনি তা না চেষ্টা করেছি কিন্তু সেই অনুভূতি আসেনি। তবে নিজেকে তৈরি করছিলাম ওর জন্য৷ কারণ আমি সিয়র ছিলাম একদিন সৌধকেই বিয়ে করতে হবে আমাকে। কারণ ওর ভয়ংকর রকমের ভালোবাসার কাছে হারতে বাধ্য আমি। সব ঠিকঠাকই ছিল। অর্পণ স্যারের প্রতি আমি ক্রাশড ছিলাম ঠিকি। কিন্তু গত তিন বছরে সেসব মুছে গিয়েছিল। আমরা আমাদের মতো পড়াশোনা করেছি৷ বন্ধুদের সময় দিয়েছি, আড্ডা জমিয়েছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছি। তখন বুঝতে পারিনি, খেয়াল হয়নি আমাদের চেয়েও বড়ো পরিকল্পনাকারী একজন আছেন। সৃষ্টিকর্তার লিখন খণ্ডানোর সাধ্য আমাদের মতো নগন্য মানুষদের নেই। সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময়। যেইদিন হঠাৎ মামার অসুস্থতার খবর পেয়ে ময়মনসিংহে ছুটতে হয়েছিল। আমার মামার একপাশ প্যারালাইজড হয়ে যায় সেদিন। কারণ, মামার একমাত্র মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। মান, সম্মানের ভয়ে মামার ওই অবস্থা হয়নি। মামার ওই অবস্থা হয়েছিল প্রিয় বন্ধুকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারল না বলে। মামার বন্ধু মারা গেছে দেড় বছর আগে৷ মামির থেকে জানতে পারি, মামা তার বন্ধুকে কথা দিয়েছিল তার একমাত্র মেয়েকে বন্ধুর বড়ো ছেলের কাছে বিয়ে দেবে। কোনো এক কারণবশত মামা তার বন্ধুর কাছে ঋণী ছিল। যা আমি জানি না৷ আমি ওখানে পৌঁছে যখন এসব শুনলাম তার ঘন্টা খানিক পরই অর্পণ স্যারের দেখা পাই। আমার মতো সেও মামাকে দেখতে হসপিটালে এসেছে। প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম সেদিন কারণ কোইন্সিডেন্সলি অর্পণ স্যারই ছিলেন আমার মামাত বোনের হবু বর৷ আমি যেমন স্যারকে দেখে বিস্মিত ছিলাম স্যারও ছিলেন। সেদিন স্যারকে দেখেই মামা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ হাত জোর করে বার বার ক্ষমা চায়। সবাই খুব আতঙ্কে ছিল প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার যন্ত্রণায় মামার আরো ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে না তো? অর্পণ স্যার একজন ডক্টর, আমিও ইন্টার্ন ডাক্টার। সে মুহুর্তে মামার মানসিক, শারীরিক উভয় অবস্থাই আমরা টের পাচ্ছিলাম। অর্পণ স্যার মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো। তাই মামাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, যা ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে এসব নিয়ে তার সমস্যা নেই। উপরওয়ালা নিশ্চয়ই তার ভাগ্যে ব্যাটার কিছু রেখেছেন৷ কিন্তু মামা এসব কানে তুলেনি৷ ভেঙে পরছিল খুব। মা, মামি সবার অবস্থাই দিশেহারা। একদিকে বোন নিখোঁজ অন্যদিকে মামার এই অবস্থা মাথা কাজ করছিল না আমার। এরপর অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। আমরা সবাই হসপিটালেই ছিলাম। হঠাৎ অর্পণ স্যার মামার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চায়। তারা কথা বলার পর আমাকে আর আম্মুকে ডাকা হয়। মামা জানায় মামার শেষ একটা ইচ্ছে আছে তা হলো, অর্পণ স্যারের সঙ্গে আমার বিয়ে। স্যার নাকি বলেছেন, সে আমাকে বহুদিন ধরেই পছন্দ করে। মেয়ে আর ভাগ্নি আলাদা কী? এক মেয়ে দিতে পারেনি তো কী হয়েছে আরেক মেয়ে আছে তো? মামার চোখে আমি ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পাই। দেখতে পাই তার প্রতিশ্রুতি ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা ক্ষীণ হতেও। আম্মুরও আপত্তি দেখলাম না। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমিও আপত্তি করতে পারলাম না। সেদিন রাতে বিয়ের আগে স্যারের সঙ্গে যখন আলাদা কথা বলতে দেয়া হয়, স্যার বলেন, তার আমাকে অপছন্দ নয়। কিন্তু মামাকে যেভাবে কনভিন্স করেছে তা পুরোপুরি সত্যি নয়। মামার গ্লানিবোধ কাটাতেই একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে জানাতে পারি। ওই মুহুর্তে আমি আপত্তি করতে পারিনি। আমি জানতাম সৌধ আমাকে ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে ছেলেটা আমাকে। কিন্তু ওর ভালোবাসা আমাকে ওই সময়ে একটুও ছুঁতে পারেনি। নিজেদের স্বার্থে ঠিক অর্পণ স্যারকে বিয়ে করে নিয়েছি। মামার প্রতি ঋণী ছিলাম আমি আর আম্মুও। টাকা পয়সার ঋণ শোধ করা গেলেও ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না। কিন্তু মামার ভালোবাসার ঋণ আমি শোধ করেছিলাম তাকে আত্মগ্লানি থেকে রক্ষা করে। এত সব ঝড় মোকাবিলা করার পর আরো একটা ঝড়ের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলাম। অনুভব করছিলাম আমার জীবনে খুব সহজ কিছু ঘটে যায়নি, সামনেও সহজ কিছু ঘটবে না। সৌধ আমার বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। ওর প্রতি আমি দুর্বল ছিলাম। ও ছিল আমার প্রতি ভয়ানক দুর্বল। তাই সেভাবেই সবটা সামলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই যে এতকিছুর সম্মুখীন হতে হবে বুঝতে পারিনি। সবকিছুর পরও সৌধকে আমি খুব ভালো বন্ধু ভাবি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভেবেও যাব। সৌধ ভাবুক আর না ভাবুক৷ তবু ভালোবাসা বিহীন ওর জীবনে জড়াব না। ওর প্রতি আমার উইকনেস থাকলেও ভালোবাসা ছিল না এটার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ আমি অর্পণ স্যারের বউ। আমার শেষ কথা এটাই, আমাকে যদি বন্ধু ব্যাতীত সৌধর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করা হয় এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত স্টেপ আমি নিব৷ আজ যা হয়েছে তার জন্য হয়তো ওকে ক্ষমা করতে পারব কিন্তু এরপর কোনোভাবেই ক্ষমা সম্ভব না। সবকিছুর পর আমি নিজের কাছে স্বচ্ছ এটাই আমার সাহস এটাই আমার শক্তি।
***

নিধির চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছে। তার বলা প্রতিটি বক্তব্য বাকরূদ্ধ হয়ে শুনল উপস্থিত সকল ব্যক্তি। সবার শরীর বরফের মতো শীতল আর শক্ত। শুধু সৌধ ব্যাতীত৷ সে একধ্যানে নিধির দিকে তাকিয়ে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। হাত, পা ছড়িয়ে রক্তশূণ্য মুখে তাকিয়ে আছে কেবল নিধির পানেই। নিধি এক পলক তাকিয়ে দেখল সৌধকে। ত্বরিত চোখ সরিয়ে মুখ নিচু করে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টাও করল। সৌধকে সে ভালোবাসতে পেরেছিল কিনা জানে না৷ কিন্তু সবার সামনে ভালোবাসি না বলাটা খুব জরুরি ছিল বলেই বলা। অন্যের বউ হয়ে এটুকু তো তাকে বলতেই হতো। সবকিছুর পর বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক যন্ত্রণা হচ্ছে। যতক্ষণ সৌধর সামনে থাকবে ততক্ষণ এই যন্ত্রণা উপশম হবে না। বুঝতে পারল নিখুঁত ভাবেই।এদিকে অর্পণ স্যারকে নিয়েও দুঃশ্চিন্তায় বুক ভার৷ যা কিছু লুকোনো ছিল সব প্রকাশ করে দিয়েছে। সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে সে স্বেচ্ছায় কিছু লুকোয়নি। পরিস্থিতি তাকে তৎক্ষনাৎ সবাইকে জানাতে দেয়নি। আর কিছু বলার নেই তার। নেই আর কিছু জানানোরও। এখন বিদায় নেয়ার পালা। চলে যাওয়া উচিত তার। নিজের স্বামীর মরণাপন্ন অবস্থায় পাশে থাকা উচিত। এতকিছুর পরও যদি সৌধ তাকে জোর করে জবরদস্তি করে আটকাতে চায় তাহলে আর বন্ধুত্বের খাতিরে চুপ থাকবে না। ভেবেচিন্তে সুহাসের বাকরূদ্ধ মুখটায় তাকাল নিধি। কান্নারত মুখে ঈষৎ হাসল। এরপর তাকাল সুজা চৌধুরীর চিন্তান্বিত মুখপানে। অসহায় ভঙ্গিতে কান্নারত কণ্ঠে বলল,

‘ আংকেল, আমার হাজব্যান্ডের অবস্থা খুব খারাপ। আমি তার কাছে যেতে চাই। ‘

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩১|
ভালোবাসা ভালো কিন্তু ভালোবাসায় অন্ধত্ব বোকামি। সৌধর মতো শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষটাও দিনশেষে হেরে গেল। সত্যিই কি হারল? খাঁটি প্রণয়ে কি হার শব্দটি জড়ায় কখনো? নাকি এই হারটাই একদিন বিস্ময়কর জয়ে পরিণত হবে? সৌধ কি সত্যি হেরে যাওয়ার মতো ছেলে? দিনশেষে আসলে হারল কে? যে গভীর প্রণয় আহ্বান করল সে নাকি যে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করল সে? বনেদি পরিবারের ছেলে সৌধ। রূপ, গুণ, বংশপরিচয়, আত্মমর্যাদা সবকিছুতে শতভাগ এগুনো ছেলেটা নিঃস্বার্থ ভাবে কেবল নিধি নামক এক সাধারণ পরিবারের মেয়েকেই ভালোবেসেছিল। আর পাঁচটা ছেলের মতো অহরহ নারী লোভ ছিল না তার। এক নারীতেই আসক্ত ছিল পাঁচটা বছর। সেই নারীটার শত প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েও আশায় বেঁচেছিল। এক নারীকে বুকে পুষেই স্বপ্ন দেখেছিল। আজকের পর সব আশা, সব স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে। পুরুষের গভীর প্রেম যে নারীর হৃদয় ছুঁতে পারেনা। সে নারীর জীবনে প্রেম কি কেবলই মরীচিকা নয়?

বলিষ্ঠ লম্বা হাত, পা গুলো ছড়ানো সৌধর৷ গোল গোল রক্তিম চোখ দু’টো নিষ্পলক তাকিয়ে নিধির বিধ্বস্ত, অশ্রুসিক্ত মুখটায়৷ সকলের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ নীরবতা চলল। সুজা চৌধুরী বুড়ো আঙুল দ্বারা নিজের বাম ভ্রু চুলকাচ্ছে। গভীর চিন্তা করা কালীন ভ্রু চুলকায় তিনি৷ তানজিম চৌধুরী ছেলের পানে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সৌধর ভেতরে কী ঝড় বইছে টের পাচ্ছেন তিনি। একসঙ্গে এত ধাক্কা সামলে ওঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। তার ছেলে নিধিকে পছন্দ করে জানতেন না তিনি। আজ যখন জানতে পারলেন তখন আর কিছু করার রইল। আর যাইহোক কারো বউকে তো আর ছেলের জন্য নিয়ে আসতে পারবেন না তারা। যেখানে মেয়েটাও স্পষ্ট বলছে সে সৌধর সঙ্গে বন্ধু ব্যাতীত আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না। সৌধর বুক ফাটা আর্তনাদ মা হয়ে যেন শুনতে পেলেন তিনি। স্বামীর দিকে তাকালেন করুণ চোখে৷ সুজা চৌধুরীও স্ত্রীর পানে তাকালেন একবার। এরপর তাকালেন পাশে বসা ভঙ্গুর ছেলেটার দিকে। মেয়ে হলে নিশ্চয়ই তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদত? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ছেলের কাঁধে হাত রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,

‘ আব্বা, আজ পর্যন্ত আমার দ্বারা কোনো অন্যায় হয়নাই। তুমি চাইলে আজ একটা অন্যায় আমি করতে পারি৷ কিন্তু কথা দিতে হবো তুমি এতে সুখ পাবা। ‘

সুজা চৌধুরীর কথা শুনে সৌধ বাদে উপস্থিত সবাই কেঁপে ওঠল। থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিধিও। সে আঁচ করতে পারল কী ভয়ানক একটি কথা সুজা আংকেল বলেছেন। ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠল সে। হাত, পা কাঁপতে শুরু করল মৃদুভাবে। সৌধর দৃষ্টিজোড়া তখনো তার দিকে অনড়। বাবার কথায় নিধির হাত, পায়ের কাঁপন, মুখে ভীতিগ্রস্ত ভাব। স্পষ্টই দেখতে পেল। সহসা চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল সৌধ। তানজিম চৌধুরী দেখলেন দু’গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়াল। মুহুর্তেই আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠলেন তিনি৷ সুহাস, আইয়াজ আচমকা সৌধর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল বিস্ময়কর দৃশ্যটি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সুহাস। ছুটে গিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল। ছুটে এলো আইয়াজও। কাঁধে হাত রেখে তীব্র ক্রোধে তাকাল নিধির পানে। নিধি জড়োসড়ো হয়ে ঠাঁই বসে। সৌধ যেভাবে ছিল ওভাবেই রইল৷ না বন্ধুদের ধরল আর না চোখ তুলে তাকাল। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ দৃঢ়স্বর ভেসে এলো সৌধর,

‘ ছাড় আমাকে। ‘

সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল সুহাস। সরে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ ঘাড় বাঁকিয়ে বাবার পানে তাকাল। বাবার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ আপনাকে কোনো অন্যায় করতে দিব না আমি। ‘

সুজা চৌধুরী প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। আকস্মিক ছেলের কথা শুনে রুদ্ধশ্বাস ছাড়লেন। যা বোঝার বুঝে গেছেন৷ তাই স্ত্রী তানজিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ ড্রাইভারকে ফোন দেও। নিধিকে হসপিটালে পৌঁছে দিতে বলো। ‘

স্ত্রীকে কথাটা বলেই ফের ছেলের দিকে তাকালেন। সৌধ চুপচাপ আগের জায়গায় বসে পড়ল। আগের ন্যায় তাকিয়ে রইল নিধির পানে। পরিস্থিতি বুঝেশুনে ওঠে দাঁড়াল নিধি। কিন্তু আর একবারো সৌধর দিকে তাকানোর সাহস পেল না। সুজা চৌধুরী নিধিকে বললেন,

‘ যা কিছু হইছে এরজন্য আমার ছেলেকে যদি ক্ষমা করতে পারো করো নয়তো অনুমতি দিলাম ওর বিরুদ্ধে যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার আইনিভাবে নেও। ‘

সুজা চৌধুরী চৌকশ চরিত্রের মানুষ। সে ঠিক জানে নিধি কোনো পদক্ষেপই নেবে না। আর নিলেও তা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। তবু নিজের দাম্ভিকতা দেখিয়ে কথাটা বললেন। এরপরই ওখান থেকে প্রস্থান করলেন তিনি৷ সঙ্গে করে নিজের মাকেও নিয়ে গেলেন। ছেলেকে সামলাতে রেখে গেলেন স্ত্রী আর ছেলের বন্ধুদের। স্বামী প্রস্থান করতেই মুখ খুললেন তানজিম চৌধুরী। বললেন,

‘ আজকালকার মেয়ে মানুষ হয়ে তুমি কী কাজ করলা বুঝলাম না। আমার ছেলে কোন দিক দিয়ে কম? তোমরা না লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াইতেছ? শুনছি তোমার নাকি মুখের ওপর উচিত কথা বলার স্বভাব আছে? বাপের বিরুদ্ধে যাইয়া ডাক্তারি পড়ছ? এমন মেয়ে হইয়া পরিবার চাপ দিল আর বিয়ে করে নিলা! মেয়েতো আমারো আছে। ‘

তানজিম চৌধুরীর কথায় স্পষ্ট রাগ। নিধি অবাক হলো না। সৌধর মা হিসেবে এটুকু স্বাভাবিক তাই ঈষৎ হেসে বলল,

‘ যার পরিস্থিতি সেই বুঝে। তাছাড়া আমিত বলেছি ওর প্রতি আমার উইকনেস ছিল কিন্তু ভালোবাসা না। ‘

তানজিম চৌধুরী মুখ ঝামটা দিলেন। সুহাস এসে নিধির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

‘আই কান্ট বিলিভ তুই এভাবে বিয়ে করতে পারিস।’

নিধির মাথা ধরে গেল। কোনোরকমে সোজা হয়ে সুহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তর দিল,

‘ মি ঠু সুহাস। ‘

চোখ, মুখ শক্ত হয়ে ওঠল সুহাসের। নিধি আর কথা বাড়াতে চাইল না। তার এবার যাওয়া উচিত। অর্পণ স্যার কেমন আছে জানা উচিত। বিনা দোষে, নিরপরাধ হয়ে মানুষটা যা কিছুর মুখোমুখি হলো। সবটার জন্য একমাত্র সে দায়ী। আকস্মিক পেছনে তাকাল নিধি৷ রোবটের মতো তাকিয়ে থাকা সৌধর দিকে কয়েক পল চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল৷ চোয়াল শক্ত করে লম্বা একটি শ্বাস নিয়ে পা বাড়াল দরজার দিকে। সৌধর ঘোর কাটল ঠিক তক্ষুনি। বসা থেকে তড়াক করে ওঠে এলো সে। বন্ধু, মাকে অতিক্রম করে নিধির সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। চমকে ওঠল নিধি। ঢোল গিলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌধর পাগলপ্রায় মুখটায়। তানজিম চৌধুরী ত্বরিত এসে ছেলেকে ধরতে চাইল তার আগেই হাত ওঠিয়ে মাকে নিষেধাজ্ঞা দিল সৌধ। বলল,

‘ আমি ঠিক আছি আম্মা। তুমি অস্থিরতা কমাও। ‘

চুপসে গেলেন তানজিম চৌধুরী। সুহাস, আইয়াজ দু’জনই এগিয়ে এলো। নিধি সুহাসের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। যেন সে খুবই অসহনীয় এখন। সৌধ বুঝতে পারল, নিধির বুকে এখন কেবলই অর্পণ স্যারকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। তার হৃদয় যে চুরমার হয়ে যাচ্ছে এতে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই বেইমানটার। আকস্মিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠল সে। উন্মাদ গ্রস্ত কণ্ঠে বলল,

‘ তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছিস? ‘

দৃষ্টি নত করে মাথা নাড়াল নিধি। সৌধ বলল,

‘ আমার দিকে তাকিয়ে বল। ‘

নিধি তাকাল না৷ কয়েক পল অপেক্ষা করে ফের সৌধ বলল,

‘ তুই অন্যকারো বউ? ‘

নিধি হ্যাঁ বোধকে মাথা নাড়াল। হঠাৎ মায়ের দিকে তাকাল সৌধ। বলল,

‘ আম্মা একটু সরে দাঁড়াও ব্যক্তিগত কোশ্চেন করব। ‘

তানজিম চৌধুরী একবার নিধির দিকে তাকিয়ে সরে গেলেন কিছুটা। বুকের ভেতর অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে তার। সৌধকে স্বাভাবিক ঠেকছে না। ছেলেটা নিজের মধ্যে নেই। মা সরে যেতেই নিধির খুব কাছাকাছি হয়ে দাঁড়াল সৌধ। একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে শুধাল,

‘ বাসর করেছিস? ‘

আঁতকে ওঠল নিধি। হতভম্ব হয়ে একবার সৌধ আর একবার পাশে সুহাস, আইয়াজের দিকে তাকাল। তীব্র অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওকে। তাদের বিয়ের অনেক গুলো দিন কেটে গেছে। স্বামী হিসেবে যখন অর্পণ স্যারকে গ্রহণ করেছে। তখন সব ধরনের অধিকারও দিয়েছে। ব্যক্তিগত এই প্রশ্নটিতে বিব্রত হলো খুব। ঢোক গিলল ঘনঘন৷ সৌধ যেন মরিয়া হয়ে ওঠল জানার জন্য। সহসা চিৎকার করে বলল,

‘ কী হলো বল সে ক্স করেছিস তোর অর্পণ স্যারের সাথে? ‘

কাঁধ ঝাকিয়ে কেঁপে ওঠল নিধি। চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে স্বীকার করল। হয়েছে বাসর। মুহুর্তেই বীভৎস এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল সৌধ। সুহাসকে বলল,

‘ বিশ্বাসঘাতক, বেইমানটাকে চোখের সামনে থেকে নিয়ে যা। আর এক মুহুর্তও যদি ও আমার সামনে থাকে প্রাণ নিয়ে বেরুতে পারবে না। ‘

কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সৌধ। দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। নিধিও আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে চলে গেল। তার পেছনে গেল সুহাস। কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সৌধর কাছে তানজিম চৌধুরী এলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ মায়ের হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ দৌড় দিল। সিঁড়ি বেয়ে, ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজার বাইরে চলে গেল ছেলেটা। তানজিম চৌধুরী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের পেছনে ছুটলেন। ছুটল আইয়াজও। ভেতর ঘর থেকে নামী, সিমরান সহ সবাই বেরিয়ে এলো। সদর দরজার বাইরে বেরুতেই দেখতে পেল নিধি গাড়িতে ওঠতে নিচ্ছিল এমন সময় সৌধ গাড়ির ডোর টেনে ধরল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে নিতে বলল,

‘ আল্লাহর কসম তোকে আমি ক্ষমা করব না। ‘

নিধি স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে। সুহাস সৌধকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আইয়াজ পিছন থেকে টেনে ধরেছে। তবু সৌধ টলছে না। নিধি ফের গাড়িতে ওঠতে নিলে সৌধ ওর আঁচল টেনে ধরল। বলল,

‘ তুই আমার গভীর ভালোবাসা দেখেছিস, ঘৃণা দেখিসনি। ‘

এ পর্যায়ে হুহু করে কেঁদে ফেলল নিধি। বলল,

‘ সৌধ আমাকে ক্ষমা কর তুই। ‘

নিধির কান্নায় আরো ক্ষেপে গেল সৌধ। বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বলল,

‘ আমার ভালোবাসায় অন্যকারো অধিকার। আমার অধিকারে অন্যকারো আধিপত্য। কসমরে, মরে গেলেও ক্ষমা পাবি না। তোর মতো ছলনাময়ীর জায়গা এই বুকেও আর হবে না। ‘

কথাগুলো বলে সরে আসতে নিয়েও আসল না। নিধির একদম পেছন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গা থমথমে কণ্ঠে বলল,

‘ তোর স্বামীকে যেন আমার ত্রিসীমানায়ও কখনো না দেখি। যদি ভুলেও কোনোদিন দেখিরে…জীবন বাজি রেখে বলছি, ও আর প্রাণ নিয়ে তোর কাছে ফিরবে না! যে অধিকারে ও তোর কাছে যায় আজন্মের মতো শেষ করে দিব সেই অধিকার। যে পরিচয়ে আজ তুই আমাকে খু ন করে গেলি চিরতরে খু ন হয়ে যাবে সেই পরিচয়! ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
রিচেক দিইনি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-২৬+২৭+২৮

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৬|

জগিংয়ে বেরিয়েছিল সৌধ৷ বাড়ি ফেরার সময় আকস্মিক তার কাঙ্ক্ষিত রমণীর দেখা মিলে। নিধি এসেছে! সাতসকালে প্রাণপ্রেয়সীর মুখ দর্শন। এক নিমিষে বক্ষঃস্থল চনমনে হয়ে ওঠল। চোখ, মুখে ছড়িয়ে পড়ল ভোরের স্নিগ্ধ জ্যোতি। ঝিমিয়ে পড়া হৃদয়টুকু সহসা তরঙ্গিত হলো। সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। ছোট্ট একটি লাগেজ হাতে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিধি। কানে ফোন ধরা৷ কারো সঙ্গে কথা বলছে সে৷ সৌধ ত্বরিত গতিতে এগিয়ে এলো। পলকহীন তাকিয়ে রইল ভোরের শান্ত নদীর মতো মুখটায়। সৌধর উপস্থিতি টের পেয়ে সংক্ষিপ্তে কথা শেষ করে ফোন কেটে দিল নিধি৷ দীপ্তি চোখে তাকাল সৌধর পানে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না৷ বুকটা ধড়াস করে ওঠল প্রেমময় পুরুষটার চাউনি দেখে৷ ও চোখের গভীরতা বরাবরের মতোই বুকে গিয়ে বিঁধল। প্রথম কথা বলল সৌধ নিজেই। অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ কী ব্যাপার সাতসকালে কোথায় থেকে এলি তুই? ফুলবাড়িয়া থেকে এত্ত সকালে আসা তো সম্ভব না। তাহলে এলি কীভাবে ? ‘

থতমত খেল নিধি। কিয়ৎক্ষণ বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে থাকার পর আকস্মিক চোখ পাকিয়ে, ধমকানো সুরে বলল,

‘ সাতসকালে এসে কী অপরাধ হয়ে গেল? কেমন আছি জিজ্ঞেস করলি না। বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দিলি না৷ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বসলি। ওকে ফাইন ব্রো, চলে যাচ্ছি আমি। দুপুর না হওয়া পর্যন্ত আসছি না। ‘

শক্ত হাতে লাগেজ ধরে, রাগে গজগজ করতে করতে দু’পা এগুলো নিধি৷ তৎক্ষনাৎ চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে খপ করে তার হাতটা চেপে ধরল সৌধ। এত চাওয়া, এত অপেক্ষার পর যে মানুষটা তার দ্বারে উপস্থিত হয়েছে তাকে এত সহজেই ফিরে যেতে দেবে? সব সময়ের মতোই নিধি আজো তার কথার উল্টো মানে বের করল। এই মেয়েটা একবিন্দুও বোঝে না তাকে। আর না কখনো চেষ্টা করে এক চুল পরিমাণ বোঝার। হতাশা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে৷
আহত হলো হৃদয়, ব্যথিত হলো দৃষ্টি। কিন্তু মুখে স্বভাব সুলভ দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল,

‘ ফটাফট কাজ করা বন্ধ কর৷ এতদূর থেকে এসেছিস নিশ্চয়ই শরীর ক্লান্ত? তাই মেজাজটাও দ্রুত খারাপ হয়ে গেছে৷ চল রেস্ট নিবি৷ ‘

নিধি কীভাবে এলো? ভোররাতে রওনা দিয়েছিল কিনা। এসব প্রশ্ন মাথায় এলেও মুখে আর করল না৷ বেচারি জার্নি করে ভালো মুডে নেই একদম৷ বুঝতে পেরে ভেতরে নিয়ে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠল৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিধি। সৌধর দৃঢ় চোয়াল বিশিষ্ট মুখটায় তাকিয়ে ভেঙচি কে টে বলল,

‘ যাব না ভেতরে। নিব না রেস্ট। তুই আমাকে ইনভাইট করে এনে অপমান করেছিস হুহ। ‘

তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সৌধ। অধর কামড়ে কিছু একটা ভেবেই ধরে রাখা নরম হাতটায় শক্তি প্রয়োগ করল৷ এরপর হেঁচকা টানে নিয়ে এলো একদম নিজের কাছে। টাল সামলাতে না পেরে সৌধর বুকে নাক ঠেকল নিধির। সৌধর পরনে ব্লু কালার জগিংয়ের পোশাক। আর নিধির পরনে গ্রে কালার সেলোয়ার-কামিজ। দোতলার বেলকনিতে আইয়াজ আর সৌধর কয়েকজন বন্ধু দাঁড়িয়ে। দূর থেকে তারা অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছি সৌধ, নিধিকে। আকস্মিক এমন একটি দৃশ্য হতেই আজিজ একছুটে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে এলো। তুলে ফেলল ফটাফট গোটা দশেক ছবি। এদিকে সৌধর হাতের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড় পেতে ছটফট করে ওঠল নিধি৷ চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ভীত কণ্ঠে বলল,

‘ সৌধ ছাড়। কেউ দেখে ফেলবে। আমি কিন্তু চ্যাঁচাব, আন্টি, আংকেলকে ডাকব। ‘

সৌধর বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হলো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে একপেশে হাসল কেবল। বুকটা তার শীতলতায় ভরে ওঠেছে৷ এই মোহিত মুখ দর্শন করে। শরীর জুড়ে পাচ্ছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। ইচ্ছে করছে, নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। ওর আদুরে নরম ঠোঁটজোড়ায় উষ্ণ চুমুতে ভরিয়ে তুলতে। কিন্তু জায়গাটা বড্ড বেমানান। রোমান্সের জন্য এই স্থান উপযুক্ত নয়৷ গেটের ওপাশে দারোয়ান চাচাও বসে। সুতরাং, এক বুক আফসোস নিয়ে ছাড়তে হবে তার আগুন পোকাকে। সহ্য করতে হবে মন এবং মস্তিষ্কের তীব্র কিলবিলানো আর জ্বলুনি।

নিধি চ্যাঁচিয়েই যাচ্ছে,

‘ কী ছাড়বি না? ওকে দাদুনিকে ডাকতে হবে নিশ্চয়ই? ‘

সৌধর দাদুনির ব্যাপারে খুব ভালো করেই অবগত সবাই। অবগত নিধিও। তাই ভয় পাওয়াতে কথাটা বলল নিধি। এ পর্যায়ে নিজের মর্জিতেই ছাড়ল সৌধ৷ কিন্তু নিধি ভাবল, দাদুনিকে ডাকতে চাওয়ায় কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তাই হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,

‘ আচ্ছা তাহলে এই ট্রিকস ফলো করতে হবে৷ ‘
.
.
নিধির আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়তেই সকলে এসে ভীড় জমালো ড্রয়িং রুমে। শুধু সুহাস, নামী, সিমরান আর স্মৃতি আপু ছাড়া। তানজিম চৌধুরী নিধির সঙ্গে কথা বলছেন। তারা দু’জন সোফায় বসে। মায়ের পাশে সৌধ দাঁড়িয়ে। পকেটে একহাত গুঁজে দিয়ে অধর কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তাকিয়ে আছে প্রেয়সীর লাজুক মুখে৷ চোখের সামনে দু’জন প্রিয় নারী বসে৷ একে অপরের সঙ্গে গল্পে মশগুল তারা। পাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখতে সুন্দর লাগছে বেশ।
বাকি সদস্যরাও কেউ বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে আইয়াজ এগিয়ে এলো। সৌধর কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ কী বন্ধু চোখের পলক ফেলবা না নাকি? ‘

সৌধ একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ না ফেললে দোষ কী তাতে? ‘

‘ নাহ কোনো দোষ নাই। ‘

‘ নজর দিস না। আগামীকাল ফারাহও আসবে। আমি নিজে গিয়ে ওর দুলা ভাইকে ইনভাইট করে আসছি। ‘

সহসা হৃদয় গভীরে কেঁপে ওঠল আইয়াজের৷ কাল ফারাহ আসবে? গুণে গুণে একশ একুশ দিন পর দেখা পাবে সে হৃদয় হরণকারী প্রিয়াকে? আকস্মিক একটা ঘোরের মধ্যে বিচরণ করতে থাকল আইয়াজ। সেলফোন বের করে সময় দেখে ভাবতে লাগল ঠিক কত ঘন্টা, কত মিনিট পর ফারাহর সঙ্গে তার দেখা হতে পারে। কাজের মেয়ে নিধির জন্য কয়েক প্রকারের হালকা নাস্তা নিয়ে এলো। নিধি নিষেধ করে বলল,

‘ এ বাবা আমি এত খাবার কী করে খাব? খেয়ে এসেছি আমি। প্লিইজ আন্টি আমি কিছু খাব না। ‘

তানজিম চৌধুরী সে কথা শুনল না। টি টেবিল টেনে সামনে এনে সবগুলো খাবার সাজিয়ে রাখল। সৌধ মায়ের পাশে বসতে বসতে বলল,

‘ অল্প অল্প করে সবগুলোই মুখে দিতে হবে। ‘

তানজিম চৌধুরী মাথা নাড়ালেন। ছোট্ট তাহানী ছুটে এলো দাদুনির রুম থেকে। পেছন পেছন দাদুনি নিজেও এলো। তাহানী এসে নিধির সামনে দাঁড়িয়ে চিকন কণ্ঠে বলল,

‘ বান্ধবী এসেছ বান্ধবী? ‘

ছোট্ট তাহানীর স্পষ্ট কথায় সকলেই চমকাল, ভড়কাল। আচমকা হেসেও ফেলল। নিধি এর আগেও অসংখ্য বার ভিডিয়ো কলে তাহানীকে দেখেছে। সাক্ষাতে দেখেছে মাত্র দু’বার। তাহানীর সঙ্গে তার খুব ভাব আগে থেকেই। তাই হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিল পিচ্চিটাকে। দুই গালে চুমু দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বলল,

‘ হ্যাঁ গো তোমার বান্ধুবি এসেছে। ‘

খিলখিল করে হেসে ওঠল তাহানী৷ নিধিকে তার ভীষণ পছন্দ। তাই গলা জড়িয়ে ধরে সৌধর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ছোটো ভাইয়া তোমার বান্ধবী আমারো বান্ধবী। ‘

উপস্থিত সবাইও হেসে ওঠল। দাদুনি এলো সে সময়ই৷ নিধি খেয়াল করে তাহানীকে একপাশে বসিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সালাম দিল নম্র স্বরে। দাদুনি বিগলিত হলো এতে৷ এই মেয়েটার শিষ্টাচার দেখে আগে থেকেই মুগ্ধ সে। আজ আবারো মুগ্ধ হলো। তানজিম চৌধুরী ওঠে শাশুড়িকে বসার জায়গা করে দিল। নিধি দাদুনির সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে নাস্তা সেরে নিল৷ পুরোটা সময় জুড়েই সৌধ পাশে ছিল। তাকিয়ে ছিল নির্নিমেষ চোখে৷ যা খেয়াল করে হাসফাস লাগছিল নিধির৷ তাই গল্পের ফাঁকে হঠাৎ বলল,

‘ এই সৌধ, জগিংয়ের পোশাক পাল্টাবি না? সেই কখন থেকে বসেই আছিস। ‘

বন্ধু, আর কাজিনরা আশপাশেই ঘুরাঘুরি করছিল। তন্মধ্যে আজিজ হঠাৎ দাঁত ক্যালিয়ে এগিয়ে এলো। বন্ধুদের মধ্যে সবাই এখন জানে সৌধ নিধির প্রতি ভয়ংকর রকমের দিওয়ানা৷ তাই টিপ্পনী কে টে বলল,

‘ সৌধ তো মুডে আছে এখন। পোশাক আর পাল্টাবে কী? ‘

দাদুনি চোখের চশমা ঠিক করতে করতে আজিজের দিকে সুক্ষ্ম চোখে তাকাল। খেয়াল করে কিঞ্চিৎ ভয় পেল আজিজ। তাই ধড়ফড় করা বুক নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল আইয়াজদের কাছে। দাদুনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে তাকাল সৌধের দিকে। বলল,

‘ দাদুভাই যাও পোশাক বদলাও। ‘

এরপর নিধির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তুমিও যাও বিশ্রাম নেও কিছু সময়। ‘

দাদুনি ওঠে চলে গেল। কাজের মেয়ে রুবি এসে নিধির লাগেজ নিতে উদ্যত হলো। কিন্তু সৌধ বাঁধ সেধে বলল,

‘ আমিই নিতে পারব। তুই অন্য কাজ কর। আপা ওঠেছে? আপাকে ঘুম থেকে তোল গিয়ে যা। ‘

এ বাড়ির সদস্যদের সংখ্যার থেকে কাজের লোকের সংখ্যা বেশি। তাই তারা থাকতে সৌধই লাগেজ নেবে। বিষয়টা বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য। তবু সেই বিষয়টিই ঘটতে দেখল সৌধর কাজিন মহল আর বাড়ির কাজের মেয়ে, মহিলারা। সেই সঙ্গে বুঝতে পারল সৌধর জীবনে নিধি নামক সুন্দরী রমণীটির স্পেশালিটিও।

সৌধর সঙ্গে একা উপরে যেতে ভয় করছে নিধির৷ দুরুদুরু বুকে এক একটা সিঁড়ি অতিক্রম করছে সে৷ এই ছেলেটার মাঝে এখন কোনো রাখঢাক নেই। আর না আছে একবিন্দু সংযম। ঢাকা থেকে আসার পর যে ভাবে এড়িয়ে চলেছে এতে করে আরো ভয়ংকর লাগামহীন হয়ে ওঠেছে। তা প্রতিক্ষণেই টের পাচ্ছে সে৷ একা পেলে নির্ঘাত ভুলভাল কিছু করে বসবে৷ ইতিপূর্বের ঘটনা গুলো তো সে আর ভুলে যায়নি। মনে মনে একাধারে বিপদের দোয়া পড়তে শুরু করল নিধি৷ বিপদটা খুব দ্রুত কেটেও গেল যখন দোতলায় ওঠতেই সুহাসের চিন্তান্বিত মুখাবয়বের সম্মুখীন হলো।

আধঘন্টা যাবৎ সিমরানের পাশে বসেছিল সে আর নামী। বোনটা তার কান্না করতে করতে চোখ, মুখ লাল করে ফেলেছে। কোনোভাবেই কান্না বন্ধ করা যাচ্ছে না৷ কী কারণে এভাবে কাঁদছে, কী নিয়ে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে, কোনোটারি উত্তর দেয়নি। শুধু বলছে বাড়ি চলে যাবে। সুহাস, নামী দু’জনই এত করে বোঝাল কাল বাবা, মা আসবে। আজ শুধু শুধু বাড়ি গিয়ে কী করবে? তাছাড়া বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড় ফেলে হঠাৎ বাড়িই বা কেন যাবে? কত কী জিজ্ঞেস করল, কতভাবে বোঝাল। কিন্তু মেয়েটা এক জেদে অটুট। শেষে নামীকে দিয়ে স্মৃতি আপুকে ডেকে তুলল। ঘুম থেকে ওঠে স্মৃতি আপু সিমরানের অবস্থা দেখে স্তম্ভিত। তার মস্তিষ্ক পুরোটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শেষে বাধ্য হয়ে সুহাস সৌধকে খুঁজতে শুরু করে।

সুহাসের চিন্তান্বিত মুখ দেখে সৌধ, নিধি দু’জনই প্রশ্ন করে,

‘ তোর মুখ এমন কেন সুহাস এনিথিং রং? ‘

ত্বরিত কপালের ঘাম মুছে চিন্তান্বিত মুখেই সুহাস বলল,

‘ পুরোটাই রং। ‘

আঁতকে ওঠল নিধি। বলল,

‘ কী হয়েছে! ‘

সৌধর ভ্রূদ্বয় কুঁচকে গেছে। সুহাস অসহায় ভঙ্গিতে বলল,

‘ সিনু খুব কান্নাকাটি করছে। বাড়ি চলে যাবে বলছে। কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে কী হলো? ‘

এমন কথা শুনে সৌধর ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকাল। সিমরান চলে যেতে চাচ্ছে? এটা কী করে সম্ভব! ভেবেই প্রশ্ন করল,

‘ আপা কই? ওঠেছে? ‘

‘ স্মৃতি আপুও কিছু বুঝতে পারছে নারে। ‘

এদিকে সুহাসের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে নিধি বলল,

‘ কিহ, সিমরান চলে যেতে চাচ্ছে? হাউ পসিবল ভাইই…! ‘

সুহাস নীরব৷ বোনকে নিয়ে সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেছে সে। আসলে আকস্মিক সিমরানের এত কান্না। চোখ ভর্তি এত পানি মেনে নিতে পারছে না সুহাস। তার মন বলছে, ‘ সিরিয়াস কোনো আঘাত পেয়েছে সিমরান। ‘ সিমরান তার আদরের বোন, কলিজার টুকরা। তার চোখে অশ্রুজল, কান্না কি সহ্য হয়?

সৌধ বলল,

‘ ঘাবড়াস না আমরা দেখছি, চল ও কোন রুমে? ‘

নিধিও বলল,

‘ টেনশন নিস না। আমি দেখছি বিষয়টা৷ চল ওর কাছে যাই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখি। ‘

চোখের পানি মুছতে মুছতে ক্লান্ত হয়ে গেছে স্মৃতি আপু। তবু কান্না থামছে না সিমরানের। পৃথিবীর কঠিনতম ভার হচ্ছে কথার ভার৷ যা বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না৷ সিমরানের মতো অতিআদুরে, নরম মনের মেয়ের পক্ষে তো একেবারেই সম্ভব না। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ রক্তিম হয়ে ওঠেছে মেয়েটার৷ নাকের ডগা পর্যন্ত লালচে হয়ে গেছে। বেচারি কী কঠিন দুঃখ পেয়েছে কেউ জানে না৷ শুধু জানে ওকে সামলাতে না পারলে উদয়িনী আন্টির ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হবে। বিছানার একপাশে নামী আরেক পাশে স্মৃতি আপু৷ মাঝখানে ক্রন্দনরত সিমরান। একটু পর পর স্মৃতি আপু টিস্যু দিচ্ছে নামী সেটা দিয়ে সিমরানের চোখের জল মুছছে৷ এমনই সময় সেখানে উপস্থিত হলো সুহাস, সৌধ আর নিধি৷ আচমকা সৌধর মুখোমুখি হয়ে সিমরানের কষ্টের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে ওঠল। দু-হাতে মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে ওঠল সে। সৌধ বাদে উপস্থিত সবাই এহেন অবস্থা দেখে হতভম্ব, বাকরুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সুহাস অসহায় চিত্তে তাকাল সৌধর পানে৷ সৌধ ইশারায় শান্ত হতে বলল। ফিসফিস করে বলল,

‘ টেনশন ফ্রি থাক, আমি আছি, নিধি আছে। আমরা সবাই আছি পিচ্চিটাকে সামলে নিতে খুব কঠিন হবে না। শুধু জানতে হবে এই কান্নার সূত্রপাত কোথায়? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৭|
মানুষের অল্প ব্যথা তীব্র হয় আপনজনের সান্নিধ্য পেলে। সিমরানেরও ঠিক তাই হলো। প্রথমে ভাই সুহাস পরে সৌধ। দু’জন পুরুষই তার ভীষণ আপন। সুহাস আপন এতে কোনো প্রশ্ন আসে না, সন্দেহও থাকে না৷ আর সৌধ তার মনের মানুষ। বাবা, ভাইয়ের পর যে পুরুষকে সে সবচেয়ে কাছের ভাবে৷ আপন দৃষ্টিতে দেখে। যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে ব্যাকুল রয় দিবানিশি। সেই মানুষটার সামনেও মনের যন্ত্রণা প্রগাঢ় হলো। কান্নার বেগ বাড়তে থাকল ত্বরিত বেগে৷ সৌধ সন্দিহান মুখে চেয়ার টেনে বসল সিমরানের সম্মুখে। তার এক পাশে সুহাস আরেক পাশে নিধি। নিধিকে দেখে ওঠে এলো স্মৃতি আপু৷ ভীতিকর কণ্ঠে নিধির কাঁধ চেপে ধরে বলল,

‘ তুমি এসেছ! দেখো না সিনুটা কেমন করছে৷ কিচ্ছু বুঝতে পারছি না৷ রাতে তো সব ঠিকঠাকই ছিল। ‘

নিধি চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে মুখে ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ আমি দেখছি আপু। ‘

এরপরই সিমরানের পাশে গিয়ে বসল। মাথায় হাত রেখে বলল,

‘ আমার বনুটার কী হয়েছে? তার কথায় আমি এত্ত তাড়াতাড়ি চলে এলাম। দেখে খুশি না হয়ে কান্নাকাটি করে নিজেও অস্থির হচ্ছে, সবাইকেও অস্থির করে তুলছে কেন হুম? ‘

কিঞ্চিৎ শান্ত হলেও মুখ তুলল না সিমরান৷ সকলের মস্তিষ্কই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এক রাতের ব্যবধানে কী হলো মেয়েটার বুঝে ওঠতে পারছে না কেউই৷ প্রত্যেকের মধ্যে যখন প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি নামী তখন সংশয় চিত্তে তাকায়। একবার ক্রন্দনরত ননদের মুখ আরেকবার নিধির মুখ দেখে। দু’জন নারীকেই দেখতে থাকে নিষ্পলক৷ পাশাপাশি বোঝার চেষ্টা করে সিমরান কি সৌধ আর নিধির সম্পর্কে জেনে গেল! এজন্যই কী বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছে মেয়েটা? আকস্মিক বুক ধক করে ওঠে নামীর। তার ভীতিগ্রস্ত চোখজোড়া এবার সুহাসের চিন্তিত মুখে পড়ে। সৌধ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বোঝার চেষ্টা করছিল সিমরানের ভাবগতিক। এরপর গম্ভীর কণ্ঠে হঠাৎ শুধায় ,

‘ কী হয়েছে তোর? কে কী বলেছে? ‘

নিধির স্বান্তনায় একটু কান্না থেমেছিল। সৌধর গম্ভীর এবং সন্দিহান গলা শুনে পুরোপুরি থেমে গেল সিমরান। সকলের দৃষ্টি অনড় রইল তার কান্না মিশ্রিত লালচে মুখশ্রীতে। সৌধ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে।অপেক্ষা করছে উত্তর পাবার। টের পেল সিমরান৷ বুকের ভেতর অনুভব করল গভীর এক চাপ। তবু মুখ খুলল না। সৌধ ফের প্রশ্ন করল,

‘ বলবি না? ‘

কয়েক পল শ্বাসরোধ করে রাখার পর নিঃশ্বাস ছাড়ল সিমরান৷ মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বোঝাল ‘ না ‘ সে বলবে না। সৌধর কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তাগ্রস্ত সুহাস ঠোঁট কামড়ে বিচলিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে। সকলের হতভম্ব ভাব প্রগাঢ় হলো। হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। সৌধ একটু ধমকে কথা আদায় করতে চাইল। পরোক্ষণেই মত পাল্টাল। সিমরান ধমক খেয়ে কথা শোনার মানুষ নয়। বরং এতে করে জেদ বাড়বে, কান্না বাড়বে৷ তাই কণ্ঠ নরম করে প্রশ্ন করল,

‘ কেউ কিছু বলেছে? ‘

‘ আমি বাড়ি যাব। ‘

তীব্র জেদি স্বর সিমরানের। এতক্ষণ যাবৎ তাকে জোর করে আঁটকে রেখেছে নামী আর সুহাস। এবার বুঝি আর আটকানো সম্ভব হলো না। তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সে৷ চোখ বড়ো বড়ো করে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল নামী আর নিধিও। সৌধর চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল। মেয়েটাকে আজ নতুন চেনে না৷ তবে খুব কাছ থেকে দেখা আজই প্রথম। সুহাসের কাছে অবশ্য ওর রাগ, জেদ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিল বেশ। সুহাস এগিয়ে এসে সিমরানের মাথার মাঝখানে ডান হাতের তালু চেপে ধরল। বাবার কাছে শিখেছে এটা৷ সিমরান অতিরিক্ত রেগে গেলেই তার বাবা এভাবে মাথায় হাত রেখে শান্ত হতে বলে। সেও বলল,

‘ কুল সিনু। সিনক্রিয়েট করিস না তোর সমস্যা টা বল আমাকে। ‘

সিমরান বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে। অতিরিক্ত রাগ আর কান্নায় ফুঁসছে মেয়েটা। এমন পরিস্থিতিতে সহসা স্মৃতি আপু চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ এই সৌধ কাল ঘুমানোর আগে সিপনকে দিয়ে দাদুনি সিনুকে ডেকে পাঠিয়েছিল। ও ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোনোভাবে দাদুনি কিছু বলেনি তো? ‘

ফোঁস ফোঁস থেমে গেল সিমরানের। স্তব্ধ মুখে অনড় রইল সে৷ সবাই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল সিমরানের দিকে। সৌধ যেন বুঝে ফেলল অনেক কিছুই৷ বসা থেকে সাবলীল ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়াল সে। সিমরানের মুখোমুখি হয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ দাদুনি বকেছে? ‘

আবারো দু’ফোঁটা অশ্রু গড়াল সিমরানের চোখ বেয়ে। নিধি তাকাল সৌধর দিকে। ইশারায় বলল সবাইকে নিয়ে বাইরে যা। কথানুযায়ী সবাই বেরিয়ে গেলে শুধু সুহাস, সৌধ আর সিমরান রইল রুমে। সিমরান তীব্র অস্বস্তি নিয়ে সুহাসের দিকে কঠিন চোখে তাকাল। সুহাস করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ প্লিজ বোন রাগ করিস না৷ তুই চলে গেলে আন্টি, আংকেলের সামনে বিব্রত হবো। বাড়িতে মাও অশান্তি করবে খুব। বলবে, আমি শুধু বউয়েরই কেয়ার করি, বোনের কেয়ার একটুও করি না। ‘

‘ চুপ থাক। ‘

সৌধ থামিয়ে দিল সুহাসকে৷ পুনরায় চেয়ারে বসে সিমরানকে বলল বসতে। সিমরান বসল না। সুহাস জোর করে ওকে বসিয়ে নিজেও পাশে বসল। সৌধ বলল,

‘ আ’ম সিয়র দাদুনিই কিছু বলেছে কী বলেছে সবাইকে বলতে না পারলেও আমাদের দু’জনকে বলতে হবে। এরপর আমি নিজ দায়িত্বে তোকে বাড়ি দিয়ে আসব। আমি যখন দায়িত্ব সহকারে নিয়ে এসেছি। আমিই দিয়ে আসব। ‘

অনেক জোরাজুরির পর মুখ খুলল সিমরান৷ কাঁদতে কাঁদতে গতরাতে দাদুনির বলা সব কথা খুলে বলল। এরপর সুহাসের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপাতে শুরু করল একনাগাড়ে। সুহাস সৌধর দিকে থমথমে মুখে তাকাল। দাদুনির কথাগুলো ওরও গায়ে লেগেছে খুব। তার বোন এ বাড়ির মেহমান হয়ে এসেছে। দোষ থাকুক, ত্রুটু থাকুক মুখের ওপর এভাবে অপমান করতে পারে না দাদুনি। তাছাড়া তাদের জীবনের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হচ্ছে পরিবার। তারা পরিবার পায়নি৷ তাদের বাবা, মায়ের মধ্যে বনিবনা নেই৷ এগুলো নিয়ে তারা দু’ভাইবোন কথাটা হতাশায় ভোগে, কত দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ছোটোবেলা বড়ো হয়েছে। এসব কি দাদুনি জানে? তার বোনের বয়স একুশ বলেই সে আর পাঁচ জনের মতো পরিপক্ব মস্তিষ্কের হয়ে ওঠেনি৷ সে স্বাভাবিক পরিবার পায়নি৷ পায়নি বাবা, মায়ের পরিপূর্ণ যত্ন, ভালোবাসা। এগুলো কি দাদুনি কখনো বুঝবে? যা বুঝবে না যা অনুভব করতে পারবে না। তা নিয়ে এত বড়ো বড়ো কথা কীসের? এই পৃথিবীতে যার যার অবস্থান সে সেই বুঝে। এর আগেও সিমরানকে ন্যাকা, অভদ্র বলতে শুনেছে। তার বোন যেমনি থাকুক তার কাছে সেরা৷ প্রচণ্ড আদুরে৷ তাই বোনকে নিয়ে অন্যের কুরুচিপূর্ণ কথা মেনে নেয়া বা সহ্য করা সম্ভব না, তার পক্ষে। সুহাসের কান দু’টো লাল টকটক করছে। লালচে হয়ে ওঠেছে নাকের ডগাও৷ সুহাসকে খুব ভালো মতোন চেনে সৌধ। সবটা শুনে তারও মেজাজ খিঁচে গেছে। দাদুনিকে পরে বুঝে নেয়া যাবে। আপাতত সিমরানকে সামলাতে হবে। গতরাতের তিক্ত অনুভূতি ভুলিয়ে দিতে হবে। নয়তো সিমরান চলে যাবে। আর সিমরান চলে গেলে সুহাসকে আঁটকে রাখা কঠিন হবে। তাছাড়া বন্ধুর বোনের অসম্মান মানে বন্ধুর অসম্মান। আর বন্ধুর অসম্মান মানে তার অসম্মান।
.
.
সৌধ সেই পুরুষ যার সম্মোহনী শক্তিতে সিমরান সকল বশ মানতে রাজি। সিমরানকে করা দাদুনির অপমান ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সৌধ৷ খুব সুন্দর করে মেয়েটাকে বুঝিয়েছে সে। সেই সঙ্গে দাদুনির বলা কিছু কথা যেগুলো সত্যি শিক্ষনীয় ছিল সেগুলো চমৎকার বাচনভঙ্গি দিয়েও বুঝিয়েছে। বুঝতে পেরেছে সিমরান। মেনে চলছে সর্বাত্মক চেষ্টায়। স্মৃতি আপুর গায়ে হলুদ চলছে। বাড়ির সকল মেয়েরা স্মৃতি আপুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হলুদ রঙের শাড়ি পরিধান করেছে। শাড়ি পরেছে নামী নিজেও। ছোট্ট তাহানীও বাদ যায়নি। বাচ্চা শাড়ি কিনে দেয়া হয়েছে তাকে৷ সেটা পরে ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক দিয়ে স্মৃতি আপুর পাশে বসে আছে চুপচাপ। সবাই শাড়ি পরলেও নিধি আর সিমরান পরেনি৷ তারা দু’জন হলুদ আর সবুজ মিশেলে সারারা পরেছে। নিধি এসেছে থেকেই ছোঁকছোঁক করছিল সৌধ। ঠিক যেমন সুহাস সারাক্ষণ নামীর পিছনে ছোঁকছোঁক করতে থাকে। বিষয়টা আইয়াজ খেয়াল করে সৌধকে বলল,

‘ কীরে মনে হচ্ছে নিধি ইলিশ মাছ আর তুই বিড়াল এমন ভাবে ছোঁকছোঁক করছিস। ‘

সৌধ থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। পাল্টা উত্তর দিয়ে দেয়,

‘ কাল তোর বোয়াল মাছ আসতেছে মনে আছে? পিছন লাগবি না একদম। বরং সুযোগ করে দে। কাল তাহলে বোনাস পাবি। ‘

চোখ দু’টো চকচক করে ওঠে আইয়াজের৷ গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ যখন মিসড কল দিব ছাদে চলে যাবি। আমি নিধিকে পাঠাচ্ছি। ‘
.
.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ প্রায়৷ স্মৃতি আপু গোসলে যাবে। সিমরান অনেকক্ষণ ধরেই সৌধকে অনুসরণ করছিল। মনটা অত্যাধিক চঞ্চল হয়ে ওঠেছে তার৷ আজ মনের কথা না বললে মরণি হবে বোধহয়। যে মানুষটা তাকে এত সুন্দর করে ভালো, মন্দ বোঝায়, যে মানুষটা তার চোখের পানি শুষে নিতে নিগূঢ় চেষ্টা করে, যে মানুষটা তার চলে যাওয়া আঁটকে দেয় এক নিমেষে। সে মানুষটাকে মন কথন জানাতে আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। না পারে সর্ব সম্মুখে চিৎকার করে বলে দেয়,

‘ আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সৌধ ভাই। আমি তোমার বউ হতে চাই চৌধুরী সাহেব। ‘

মনটা খলখল করে ওঠে সিমরানের। সৌধকে অনুসরণ করতে করতে সিঁড়ির কাছে চলে আসে৷ এত রাতে সৌধ ভাই ছাদে যাচ্ছে কেন? মনের ভেতর প্রশ্ন উঁকি দেয়৷ ভাবে, ভালোই হলো, নিভৃতে মনের কথা বলতে পারবে৷ কিন্তু পিছু যেতে যেতে আকস্মিক থেমে যায় বৈদ্যুতিক আলোয় নিধিকে দেখে। সৌধ ছাদের দরজা একটু চাপিয়ে চলে যায় নিধির কাছে। সিমরানের বুকটা ধক করে ওঠে অজানা সন্দেহে। গলা শুঁকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে যায়৷ দরজার ফাঁকে একটু করে উঁকি দিয়ে দেখে, সৌধ গিয়ে নিধির পাশে দাঁড়াল। তাদের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা গেল না অস্পষ্ট। কিন্তু দেখতে পেল সবই শুনতে পেল অল্পস্বল্প। যা থেকেই পুরোপুরি বুঝে গেল তার মনের মানুষটির মনের মানুষ সে নয় অন্য কেউ!

আইয়াজের অনুরোধে এসেছিল নিধি। তারও ইচ্ছে ছিল সৌধর সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার। যেগুলো এখন না বললেই নয়৷ কারণ এ বাড়িতে আসার পর স্মৃতি আপু আড়ালে ডেকে বলেছে, স্মৃতি আপুর বিয়ের পরই সৌধ সুজা আংকেলকে মনের কথা জানাবে। এরপরই তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব যাবে চৌধুরী বাড়ি থেকে। তাই সৌধ ছাদে আসা মাত্র দেরি করল না নিধি। ভালো, মন্দ কথা দূরে থাক চট করে বলে ফেলল,

‘ সৌধ তুই আর আমি শুধু বন্ধু। আমরা সারাজীবন একে অপরের বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। তুই প্লিজ বিয়ের সিদ্ধান্ত বদলে ফেল। আংকেল, আন্টিকে কিচ্ছু বলবি না। স্মৃতি আপুকেও বলবি আমার প্রতি তোর উইকনেস কেটে গেছে। আমরা শুধুই বন্ধু। তোর তরফে যা ছিল নিছক আবেগ মাত্র। ‘

নিধির কথাগুলো অহেতুক ঠেকল সৌধর। এতদিন পর কাছাকাছি তারা। কোথায় ভালো, মন্দ দু’টি কথা বলবে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকবে দীর্ঘ সময়। কয়েকটা চুমুর বর্ষণ নামাবে তা না৷ আবারো সেই আবোলতাবোল বকা শুরু করেছে৷ বাঁকা হাসল সৌধ। আচমকা বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল নিধিকে। একহাতে কোমর পেঁচিয়ে অন্যহাতে নিধির মুখে পড়া সিলকি চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। বলল,

‘ বকবকানি থামাবি? কত মিস করেছি জানিস? ‘

প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে আকুল স্বরে কথাটা বলল সৌধ। নিধির বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠল৷ সৌধর বাঁধন থেকে ছাড় পেতে মরিয়া হয়ে ওঠল সে। কিন্তু সৌধ কি ছাড়ার বান্দা? সে আরো ঘনিষ্ঠ হলো। নিধির কপালে কপাল ঠেকিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ সব সময় ছটফট করিস কেন? এমন করলে ভালোবাসা দিব কীভাবে? ‘

‘ প্লিজ সৌধ এমন করিস না প্লিজ। আমার কথা শোন তোর সাথে আমার কথা আছে। খুব জরুরি। ‘

ত্বরিত স্বরে কথাগুলো বলতেই সৌধ ওর কপালে গাঢ় করে চুমু খেল। বলল,

‘ সব শুনব। তার আগে আমাকে শান্ত কর। দেখ বুকের ভেতর কেমন খাঁখাঁ করছে। আর কত জ্বালাবি এখানটায়? একটু তো ঠাণ্ডা কর। ‘

বুকে ইশারা করে কথাগুলো বলেই একহাত নিধির গালে রাখল। চোখ, মুখ খিঁচে রইল নিধি। শরীরের জোর প্রয়োগ করল ছাড়া পাওয়ার৷ কিন্তু সৌধ সেসব তোয়াক্কা করল না৷ সে তার প্রেয়সীকে আদর করতে ব্যস্ত৷ একনাগাড়ে কয়েকটা উত্তপ্ত চুমু পড়ল গাল জুড়ে। আকস্মিক চোখ খুলল নিধি৷ মুখটা শক্ত পাথর হয়ে গেছে তার। শরীর জুড়ে যেন দাউদাউ করে আগুন জলে ওঠেছে। সৌধ তার মতোই ব্যস্ত।

‘ খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব নিধি। তুই আর আমাকে দূর দূর করতে পারবি না দেখিস৷ খুব তাড়াতাড়ি এই সৌধর বুকে মুখ লুকোনোর ব্যবস্থা করব৷ খুব তাড়াতাড়ি তোকে সম্পূর্ণ আমার করে নেব আমি। ‘

ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে মাতাল কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে নিধির নাকে নাক ঠেকাল। এরপর উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল নিধির নরম অধরে। মুহুর্তে ক্রোধে ফুঁসে ওঠল নিধি। আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না নিজেকে। তার নরম হাতের শক্ত থাপ্পড় বসিয়ে দিল প্রিয় বন্ধু, সৌধর গালে। এতক্ষণ আড়ালে স্তব্ধ হয়ে থাকলেও শেষ দৃশ্য দেখে দু-হাত মুখে চেপে ডুকরে ওঠল সিমরান। আর সৌধ আকস্মিক নিধির রণমুর্তি দেখে বাক শক্তি খুইয়ে রইল কয়েক মিনিট। যখন তার ঘোর কাটল তখন হাতটা আপনাআপনি ডান গালে চলে গেল। জীবনে প্রথমবার কেউ তার গায়ে হাত তুলল! আর এই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটাল সে যাকে ভালোবাসে, তার হৃদয়ের নারী। চোয়াল দ্বয় দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো সৌধর। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকাল নিধির ক্রোধান্বিত মুখশ্রীতে। ধীরেধীরে তার চোখজোড়া রক্তিম বর্ণে পরিণত হতে থাকল।
আর নিধি ওড়নায় মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে প্রস্থান করল ছাদ থেকে। সিমরান একই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। নিধি কি ওকে দেখতে পেল?

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৮|
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম অনুভূতি জন্মায় ভুল মানুষকে কেন্দ্র করে। প্রেম কখনো ভুল হয় না, ভুল হয় না কাউকে ঘিরে হৃদয়ের তীব্র অনুভূতিতেও। ভুল হয় আসলে মানুষটা৷ তাই তো তীব্র আবেগ, দৃঢ় ভালোবাসাও ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়।

কাল বিয়ে। সবাই ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কনে আজ ভীষণ ব্যস্ত। সারাদিনের আনুষ্ঠানিকতায় মাথা ধরেছে৷ বিছানায় হাত, পা মেলে শুয়ে পড়েছে সে৷
তাকে ঘিরে আছে কাজিন মহল। দাদুনি চুলে বিলি কে টে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। শারীরিক দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, আশপাশ জুড়ে গিজগিজে মানুষ সিমরানের কথা বেমালুম ভুলিয়ে দিয়েছে স্মৃতি আপুকে। সৌধর মেয়ে বান্ধবীদের জন্য রুম গোছগাছ করা আছে। প্রাচী, আইয়াজ গেছে সুহাস, নামীর জন্য বরাদ্দ করা ঘরে৷ গল্প করছে তারা। সেই সঙ্গে অপেক্ষা করছে সৌধ নিধির ফিরে আসার৷ তারা দিব্যি জানে সৌধ, নিধি এখন নির্জন নিশীথে সময় কাটাচ্ছে। প্রাচী নিধির জন্য বরাদ্দ করা ঘরটা ফাঁকা ছিল। সিমরানেরও একটু ফাঁকা স্থানের দরকার ছিল। তাই ওই ঘরটায় ঢুকে পড়ল। বুকের বা’পাশটায় চিনচিন করছে তার। হাত, পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা। ঘরে ঢোকার পর তড়িঘড়ি করে দরজা আঁটকে দিল৷ অনুভব করল
নিঃশ্বাসটাও বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব৷ শ্বাসরুদ্ধকর এই অনুভূতি থেকে মুক্তির আশায় শরীর ছেড়ে দিল মেয়েটা। আচমকা বসে পড়ল ফ্লোরে। থেকে থেকে দেহ কেঁপে ওঠল৷ বুকের বা’পাশের ব্যথাটা গাঢ় হচ্ছে ক্রমাগত টের পেয়ে
একহাতে চেপে ধরল ওখানটায়। অন্যহাতের তালু চেপে ধরল মুখে। কিয়ৎক্ষণ শব্দহীন বসে থাকার পর আচমকাই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। সৌধ তার কিশোরী বয়সের আবেগ। যুবতী বয়সের তীব্র অনুভূতি। এত বছর ধরে চেনে মানুষটিকে। অথচ একবারো টের পায়নি তার ভেতরে অন্য নারীর বাস। সেই নারীটি আর কেউ নয়, তার ভাই এবং সৌধর বেস্ট ফ্রেন্ড নিধি আপু! কান্নার দমকে থরথর করে কাঁপতে থাকল সিমরান। এ দহন কীভাবে সহ্য করবে সে? ও দৃশ্য কীভাবে ভুলবে? কীভাবেই বা মেনে নেবে সৌধর জীবনে নিধি আপুকে?

বাথরুমে ঢুকে চোখে, মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিচ্ছিল নিধি৷ হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দ পায়। এরপরই কারো চাপা কান্নার আওয়াজ। বুক ধক করে ওঠে নিমিষেই! কে কাঁদছে এভাবে? এমন যন্ত্রণাময় কান্না কার? তীব্র কৌতূহল নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে নিধি৷ অমনি দু-চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায় তার। সিমরান কাঁদছে! মুহুর্তেই শক্ত হয়ে যায় নিধি। সৌধর সঙ্গে রাগারাগি করে যখন ছাদ থেকে নেমে এলো তখন আবছা আলোয় সিমরানকে দেখতে পেয়েছিল সে৷ কিন্তু অতিরিক্ত রাগান্বিত থাকায় থামেনি। ইচ্ছে করেনি সিমরানকে প্রশ্ন করতে, সে এখানে কেন? কোনোভাবে কি তাকে আর সৌধকে ফলো করছিল? না প্রশ্ন করেছে আর না বুঝতে দিয়েছে সে সিমরানকে দেখেছে। কিন্তু সিমরান যে তার আর সৌধর মধ্যেকার সমস্ত ঘটনা দেখেছে তা নিখুঁতভাবেই টের পেল এই মুহুর্তের এই দৃশ্য দেখে। তবে কি সিমরান কোনোভাবে সৌধর প্রতি উইক?
মাথাটা ঝিমঝিমিয়ে ওঠল নিধির। আকস্মিক চোখ দু’টো বন্ধ করে নিল। ভাবতে শুরু করল গভীর কিছু ভাবনা৷ নিধি চমৎকার বুদ্ধিমতী এবং জ্ঞানী নারী৷ তাই খুব বেশি ভাবতে হলো না। যা বোঝার বুঝে ফেলল এক নিমিষে। ঠোঁটদ্বয়ে হাসি ফুটল তার৷ শুধু বুকের খুব গভীরে সুক্ষ্ম এক ব্যথার আঁচ পেল। যাকে পাত্তা দিল না খুব একটা। বিড়বিড় করে বলে,

‘ আমি যা ভাবছি তাই যেন সত্যি হয় খোদা। ‘

কথাটা বলেই ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সিমরানের কাছে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে আদর মিশিয়ে ডাকল,

‘ সিনুমনি ? ‘

হাঁটু নাড়িয়ে কেঁপে ওঠল সিমরান। আকস্মিক ভীতিকর কিছু দেখেছে এমন ভঙ্গিমায় তাকিয়ে রইল পলকহীন। নিধি ঈষৎ হেসে ধীরে ধীরে ওর সামনে বসল। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ওর অশ্রুসিক্ত গাল। বলল,

‘ কী হয়েছে আমার বনুটার? এত কষ্ট পাচ্ছে কেন হুম? ‘

চোখ দু’টি করুণ করে তাকিয়ে সিমরান। নিধির ভীষণ মায়া হলো। দু’হাতে ওর গালের নোনাপানির ধারা মুছে দিতে দিতে বলল,

‘ আমাদের ওভাবে দেখে কষ্ট পাচ্ছিস? তুই জানতি না অনেক বছর ধরেই সৌধ আমার প্রতি উইক? ‘

সিমরানের বুকের ভেতর সুঁচ ফুটল যেন। সে জানত না, সত্যি জানত না। জানলে আজ এভাবে আঘাত পেত না৷ হাত, পা থরথর করে কেঁপে ওঠল ওর৷ নিধির সুক্ষ্ম নজর এড়াল না সিমরানের কাঁপাকাঁপি। নিধি ওর মাথায় হাত বুলালো। আদর করল কিছুক্ষণ পুনরায় বলল,

‘ সৌধকে ভালোবাসিস? ‘

চোখ দুটো বন্ধ করে হুহু করে কেঁদে ফেলল সিমরান৷ ওর কান্না দেখে নিধির চোখ দু’টোও টলমল করছে। সে আবারো প্রশ্ন করল,

‘ ভালোবাসিস ওকে? ‘

যে প্রশ্নের উত্তর অনায়াসে দিয়ে দিতে পারত সিমরান। সে প্রশ্নের উত্তর আজ একেবারেই দিতে পারল না। সৌধকে সে ভালোবাসে কিনা এই উত্তর দেয়ার আগে হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। চোখের পাতায় ফুটে ওঠল ছাদের সেই দৃশ্য। সৌধ ভাই নিধিকে ভালোবাসে। ব্যস, আর কী থাকে বলার? ঐ মানুষটার দৃঢ়তা সম্পর্কে কারোরি অজানা নয়৷ আজ যদি সে মরেও যায় সৌধর অনুভূতি, সিদ্ধান্ত কোনোটাকেই টলানো যাবে না। সে হয়তো আর পাঁচ জনের মতো ম্যাচিওর নয়৷ তাই বলে ভালোবাসার যে অনুভূতি বুকের ভেতর পুষে রেখেছে সে অনুভূতির প্রগাঢ়তা নিয়ে কোনো অবুঝতা নেই৷ সে সৌধকে ভালোবাসে বলেই জীবনে দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেনি৷ দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে কাছ ঘেঁষতে দেয়নি। সে যে অনুভূতিতে সৌধ ভাইকে ভালোবাসে। সৌধ ভাইও নিশ্চয়ই একই অনুভূতিকে নিধি আপুকে ভালোবাসে? বুকটা হুহু করে কাঁদতে লাগল তার। কান্না মিশ্রিত অসহায় চোখ দু’টি স্থির করল নিধির ভেজা মুখে। বুকে পাথর চাপল যেন নিধির মুখটা দেখে। মন বার বার ডুকরে ওঠল একটা কথাই বলে,

‘ তুমি কত ভাগ্যবতী নিধি আপু, তুমি কত ভাগ্যবতী!’

সহসা কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিধি প্রশ্ন করল,

‘ কীরে ভালোবাসিস সৌধকে? ‘

অসহায় ভঙ্গিতে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না বোঝাল সিমরান৷ নিধি বিশ্বাস করল না। তাই কড়া গলায় বলল,

‘ তাহলে কাঁদছিস কেন? ‘

ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে সিমরান বলল,

‘ তুমি সৌধ ভাইকে কেন মারলে নিধি আপু? ভাইয়া তো তোমাকে ভালোবাসে। ‘

বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় নিধি! সন্দিহান চিত্তে ভাবে সিমরান এজন্য কাঁদছে? তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল? তৎক্ষনাৎ ক্ষীণ কণ্ঠে শুধায়,

‘ এজন্য কাঁদছিস? পিছু নিয়েছিলি কেন আমাদের? ‘

‘ সৌধ ভাই ছাদে যাচ্ছে দেখে ভাবলাম ভাইয়া, নামী আপু, তোমরা সবাই আছ৷ গল্প, আড্ডা হবে এসব ভেবেই পিছু নিয়েছিলাম। ‘

হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল সিমরান৷ নিধি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা কেমন ডাহা মিথ্যা বলল তাকে। আর কত অবাক করবে সুহাসের আহ্লাদী বোনটা? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। বলল,

‘ শোন এই পৃথিবীতে ছিয়ানব্বই পার্সেন্ট মানুষের প্রথম প্রেম হয় ভুল মানুষের প্রতি। আর চার পার্সেন্ট হয় সঠিক মানুষের প্রতি। সৌধ হচ্ছে ছিয়ানব্বই পার্সেন্টের মধ্যে একজন৷ আর তুই হলি চার পার্সেন্টের মধ্যে একজন। ‘

নিধির কথার মর্মার্থ এই মুহুর্তে বোঝা সম্ভব না সিমরানের। সে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে রইল। নিধি বুঝল মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ডুকরে ম রছে। তাই আরো কাছাকাছি বসে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। পিঠে হাত বুলিয়ে নিচু গলায় বলল,

‘ সৌধকে ভালোবাসিস বোন? ‘

সিমরান চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিল,

‘ না আপু। সৌধ ভাই তোমাকে ভালোবাসে। ‘

‘ কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি না সিনু। ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। এমন একজন পুরুষের ভালোবাসা কোনো মেয়ে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? মুখে বলল,

‘ সৌধ ভাইকে ভলো না বেসে থাকতে পারবে না আপু৷ দেখে নিও। ‘

‘ আর সম্ভব নয়। ‘

সহসা ওঠে দাঁড়াল নিধি। বলল,

‘ যদি তুই সৌধকে ভালোবাসিস বিনা দ্বিধায় বলতে পারিস। আর যদি না বাসিস তাহলে আমার বোঝার ভুল, চোখের ভুল দুঃখিত। ‘

কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হয় নিধি। সিমরান ত্বরিত তার দু’পা আঁকড়ে ধরে। বলে,

‘ আমি সৌধ ভাইকে ভালোবাসি না আপু। তুমি প্লিইজ সৌধ ভাইকে ফিরিয়ে দিও না। ‘

হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলল সিমরান। নিধি হতভম্ভ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তার বুঝতে বাকি রইল না এই বাচ্চা মেয়েটা ভয়াবহ ভাবে সৌধতে আসক্ত। খাঁটি ভালোবাসার নিদারুণ উদাহরণ। সুহাসের ইমম্যাচিওর, রগচটা, জেদি, খামখেয়ালি বোনটা কবে এত বড়ো হয়ে গেল? কবেই বা বুকের ভেতর তার সৌধর জন্য এতখানি ভালোবাসার জন্ম দিল? আঁতকে ওঠল নিধি। একহাতে মুখ চেপে ধরে মনে মনে বলল,

‘ ছিঃ ছিঃ আমার সৌধ কেন হবে? আজ থেকে সৌধ তো শুধুই সিমরানের। ‘
.
.
গতরাতে সৌধ একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে আর নিধির কাছে ভালোবাসার আবেদন রাখবে না। আর না তার প্রণয় আহ্বানে সাড়া দিতে অনুরোধ করবে। অনেক হয়েছে ভদ্রভাবে, নরম সুরে ভালোবাসার ডাক। অনেক হয়েছে সোজা আঙুলে ঘি তোলার প্রচেষ্টা। এবার আঙুল বাঁকাবে। বাঁকাতেই হবে। সরাসরি নিধির পরিবারের সামনে দাঁড়াবে সে। হয় শান্তশিষ্ট ভাবে তার মনের মানুষকে চেয়ে নেবে নয়তো তীব্র অশান্ত রূপে ছিনিয়ে আনবে। সৌধর এই মনোবাসনাকে শুধু কঠিন সিদ্ধান্ত বললে ভুল হবে। এটা সৌধ চৌধুরীর এক কঠিন জেদও বলা যায়। যে জেদ নিধিকে তার বউ করেই ছাড়বে।
.
.
বিয়ে বাড়িতে সকল অতিথি উপস্থিত হয়েছে। বাকি শুধু সৌধর মেডিকেল কলেজের কয়েকজন টিচার্স। তার মধ্যে রয়েছে অর্পণ স্যারও। অর্পণ স্যারের অপেক্ষাতেই ছিল সকলে৷ স্যার এলে সৌধ, সুহাস, নিধি, নামী, আইয়াজ, ফারাহ এবং সিমরান। সকলে একসঙ্গেই খেতে বসল। গতরাতের পর থেকে সৌধ নিধির সঙ্গে কথা বলেনি। চোখ তুলে একবারটি যে তাকাবে তাও তাকায়নি৷ নিধি অবশ্য কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। ছেলেটা মারাত্মক জেদি। নিজের জেদে অটল রয় সব সময়। তাই কথা বলেনি। রাত থেকে সিমরানও বেশ স্বাভাবিক। নিধির পাশেই বসেছে সে। খাওয়ার ফাঁকে বারবার অর্পণ স্যারের দিকে তাকাচ্ছে সিমরান। অভিভূত হয়ে দেখছে শ্যামবর্ণীয় ত্বকের বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী অর্পণ স্যারকে। গতরাতে সে নিধির সঙ্গে শুয়ে ছিল। অনেক গল্প করেছে দু’জন। সে গল্পের বেশিরভাগ জুড়েই ছিল অর্পণ স্যার৷ সেই গল্পের সঙ্গে আজ সামনাসামনি দর্শনে পুরোপুরি মিলে গেল অর্পণ স্যার। সিমরানের মুগ্ধতাও বিস্তৃত হতে শুরু করল। মনে মনে বলল,

‘ইশ, কী সুন্দর! ‘

খাওয়াদাওয়া শেষে কনে বিদায়ের পালা চলে আসে। পরিবারের সকলের মুখে নামে মেঘের ঘনঘটা। স্মৃতি আপু তার বড়ো ভাই সুনীল চৌধুরী আর ছোটো ভাই সৌধকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। রক্তিম বর্ণ হয়ে আছে সৌধর চোখ দুটিও। বোন বিদায় এত্ত যন্ত্রণাদায়ক হয় বুঝতে পারেনি সে। কলিজাটা ছিঁ ড়ে যাচ্ছে যেন উফফ। সুজা চৌধুরী আর তানজিম চৌধুরী এলেন সেই মুহুর্তে। ছেলেমেয়ে জড়িয়ে ধরলেন দু’জনই। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী হলো পরিবার, পরিজন আর অতিথিবৃন্দরা।

একদিকে স্মৃতি আপুর বিদায় পর্ব চলছে। অন্যদিকে নিধির ফোনে সমানতালে কল করে যাচ্ছে অর্পণ স্যার। নিধি সবার থেকে কৌশলে নিজেকে আড়াল করে অর্পণ স্যারের বলা জায়গাটায় চলে এলো দ্রুত। সৌধদের বাড়ির পিছন সাইট এটা। যার একপাশে ছোট্ট একটি পুকুর আর একপাশে টিন দিয়ে নির্মিত একটি স্টোর রুম। খেয়েদেয়ে হাঁটাহাঁটি করতে করতে ঠান্ডা আবহাওয়া খুঁজে পায় বাড়ির পেছন দিকে। আর তখনি নজর পড়ে দরজা খোলা স্টোর রুমটায়। এদিকে একেবারেই নির্জন। মানুষ জন নেই। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল অর্পণ স্যারের। পারপেল কালার চাকচিক্যময় শাড়ি পরিহিত রমণীরত্নটি আসা মাত্রই হেঁচকা টানে নিয়ে চলে গেল ঘরের ভেতর। নিধি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই অর্পণ স্যার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট চেপে ধরল। ভারিক্কি কণ্ঠে বলল,

‘ কত মিস করছিলাম জানো? ‘

চোখ দু’টি বুজে এলো নিধির। ঠোঁটে লাজুক হাসি আর বুকে তার ধুকপুকানি। অর্পণ স্যার যেন বড্ড বেপরোয়া এখন। তার মুখ, হাত বড্ড লাগাম ছাড়া। প্রথমে সায় দিল নিধি। যখন বুঝল অপর মানুষটা হুঁশে নেই তখন বাঁধা দিয়ে বলল,

‘ কী করছেন কী? পাগল হলেন নাকি! আমরা কোথায় হুঁশ আছে? ‘

‘ পাগল তো সেদিনই করেছ ডার্লিং, হুঁশ তো সেদিনই হারিয়েছি আমি যেদিন তিন…’

আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না অর্পণ স্যার। তিন জোড়া হাত বাঘের মতো থাবা দিয়ে তার থেকে ছিনিয়ে নিল নিধিকে। সেই তিন জোড়া হাতের মালিক আর কেউ নয় , সৌধ, সুহাস আর আইয়াজ!

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা

|২৩|

ইদের ছুটি কাটাতে সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছে। গতরাত দেড়টার দিকে সুহাস এসেছে নামীর কাছে। এই নিয়ে প্রচণ্ড রাগারাগি করেছে নামী। দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে প্রায় দু’ঘন্টা। সিমরানের থেকে খবর পেয়েছে সুহাস বাড়ি এসেছে বিকেলের দিকে। এরপর দু’ঘন্টা সময় বোন এবং মাকে দিয়েছে। উদয়িনীর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে, মতের অমিলও অনেক। চাপা অভিমান আকাশছোঁয়া। তবু মায়ের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই। সুহাস এখন পুরোপুরি নামীতে মত্ত৷ বুঝতে পারে উদয়িনী। কিন্তু আগের মতো ঘাটে না আর৷ তার মনে তীব্র ভয় আছে৷ ছেলেমেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। বুঝ, শক্তি প্রখর হচ্ছে। প্ররোচিত করার চেষ্টা পূর্বে বহুবার করলেও এখন আর করে না৷ পাছে নিজের কুকর্ম প্রকাশ পেয়ে যায় এই ভয়ে। শতহোক পৃথিবীর কোনো মা নিজের প্রতি গর্ভজাত সন্তানের ঘৃণা দেখতে চায় না৷ চায় না উদয়িনীও। তাই বলে নামীকেও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি৷ কখনো পারবে কিনা তাও জানে না। নামী সম্পর্কিত কোনো কথাই সুহাসের কাছে জানতে চায় না সে। আর না সুহাস বউ সম্পর্কে মাকে কিছু জানায়৷ মাঝেমাঝে অবশ্য সিমরানকে টিটকিরি দিয়ে অনেক প্রশ্নই করে। সিমরানও কম নয়। তার মা যদি বুনো ওল হয় সে যেন বাঘা তেঁতুল। ঠিক এমনই করে জবাব দিয়ে দেয়। বাড়িতে সময় দিয়ে ক্লিনিকে গিয়ে বাবার সাথেও দেখা করে আসে সুহাস। এরপর বেরোয় বন্ধুদের সঙ্গে বাইক নিয়ে। সেখান থেকেই নামীর কাছে ফিরতে রাত বাজে দেড়টা। সুহাস আসবে বলে কয়েক পদের রান্না করেছিল নামী। সেগুলো আর কারোরি খাওয়া হয় না। ঝগড়া করতে করতে এক পর্যায়ে রেগে বাসা ছাড়তে উদ্যত হয় সুহাস। নামী তখন আর কিছুই বলতে পারে না। এই ছেলেটা তার অনুভূতিই বুঝে না৷ তীব্র অভিমান বুকে চেপে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে চুপচাপ। রাগি বউয়ের আকস্মিক নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ায় সুহাসও দমে যায়। বাসা ছাড়তে পারে না আর। রুমে গিয়ে বউয়ের মান ভাঙাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে৷ শেষ রাত কাটে বউয়ের মান ভাঙিয়ে, আদর দিয়ে, ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখে।

রাতটা নিদ্রাহীন কাটিয়ে সকালবেলা সুহাস গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। নামী আর ঘুমায়নি। শাওয়ার নিয়ে এসে ভেজা চুল আঁচড়ে চুপচাপ বসে আছে সুহাসের পাশে৷ তাকিয়ে দেখছে উবু হয়ে ঘুমানো বরটাকে।
গত কয়েক বছরে সবকিছুর পরিবর্তনের সঙ্গে সুহাসের শারীরিক পরিবর্তনও চোখে লাগার মতো। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের ফলে সে যে পেশিবহুল শরীরটা তৈরি করেছে। এর পিছনে একমাত্র অবদান নামীরই। সেদিনের সেই অপমান কতখানি মনে গেঁথেছিল তা আজ ওর শরীরের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। শুধু কি তাই? অসভ্য ছেলেটা ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেও টিপ্পনী কাটতে ছাড়ে না। নিজের পেশিবহুল উন্মুক্ত বক্ষঃতলে পিষতে পিষতে ফিসফিস করে শুধায়,

‘ তোমার সেই ফকফকা চেঙ্গিস খান এখন লোমশে আবৃত বলিষ্ঠ বুকের নিচে তোমাকে পিষতে পারে। এ মুহুর্তে তোমার অনুভূতি ঠিক কী জান? শর্টকাটে শেয়ার করো প্লিজ? ‘

নামী তখন তীব্র লজ্জায়, ঈষৎ রাগে ছটফটিয়ে ওঠে। নখ ডাবিয়ে দেয় সুহাসের পুরো পিঠজুড়ে। সুহাস চ্যাঁচিয়ে ওঠে৷ শক্ত করে চেপে ধরে আদুরে কামড় বসায় বউয়ের গ্রীবাদেশে। নিজেদের সেই একান্ত মুহুর্তের কথা স্মরণ করে লজ্জায় আরক্ত হয় নামী। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে সুহাসের পিঠে। বেচারার পিঠজুড়ে অসংখ্য নখের আঁচড়। মায়া হয় খুব৷ পরোক্ষণেই ভেঙচি কেটে বিড়বিড়ায়,

‘ বেশ হয়েছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। ‘
.
.
সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠেই তৈরি হয়ে নিল সিমরান। হ্যান্ড পার্স নিয়ে বের হবার পূর্বে মায়ের ঘরে উঁকি দিল। দেখল, মা কফি খাচ্ছে। তাকে দেখেই বলল,

‘ সাতসকালে কোথায় যাচ্ছ? ‘

সিমরান মৃদু হেসে কপটহীন স্বরে বলল,

‘ নামীপুর বাসায়। ব্রোও আছে ওখানে। ‘

সুহাস নামীর কাছে বুঝতে পেরেছিল উদয়িনী। এ নিয়ে আর কিছু বলার নেই তার। কিন্তু সকাল হতেই মেয়েও সেখানে ছুটছে? মুখটা কঠিন হয়ে এলো। কিছু বলতে উদ্যত হলে সিমরান প্রচণ্ড তাড়া নিয়ে বলল,

‘ আমি বেরুচ্ছি আম্মু, ফিরতে দেরি হবে টেনশন করো না। ‘

চলে গেল সিমরান৷ বিমূঢ় হয়ে বসে রইল উদয়িনী৷ ইদের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছে। পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটাবে বলে। অথচ তার পরিবার নেই। গত কয়েক বছর ধরেই ছেলেমেয়েদের সাথে তার দূরত্ব। নিজের অহংবোধে ডুবে গিয়ে এই দূরত্বকে এতকাল সে গুরুত্ব দেয়নি৷ এখন বয়স বাড়ছে। চাকরির মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব নতুন নয় পুরোনো। ছেলেমেয়েদের সাথে যে মনের সংযোগ ছিল তা ছিন্ন হতে হতে এবার সে নিজেকে সম্পূর্ণ একা অনুভব করতে শুরু করল। কেঁপে ওঠল বুক। মৃদু কম্পন অনুভব করল হাত, পায়েও৷ কফির মগ পাশের টেনিলে রেখে ফোন হাতে নিয়ে কল করল ছেলেকে। ঘুম ভেঙে গেল সুহাসের। ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পেল মায়ের কাঁপা স্বর,

‘ বাবা ওঠেছিস? ‘

ঘুম কাতুরে কণ্ঠে সুহাস জবাব দিল,

‘ না, এনি প্রবলেম? তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন?’

উদয়িনী ঠোঁট কামড়ে নিজের কষ্ট চেপে নিল। বলল,

‘ সিনু না খেয়েই বেরিয়ে গেল। বলল তোদের ওখানে যাবে। একসঙ্গে খেয়ে নিস। ‘

সুহাস চোখ ডলতে ডলতে ওঠে বসল। শত অভিমান থাকলেও মায়ের এই কণ্ঠ সুহাসের হৃদয়ে গিয়ে লাগল। সে নরম গলায় বলল,

‘ চিন্তা করো না। নামী খাইয়ে দিবে ওকে। নামীর হাতে খেতে পছন্দ করে সিনু। ‘

উদয়িনী চমকে গেল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ ওহ! ‘

‘ তোমার শরীর ঠিক আছে মা? ‘

বাঁকা হেসে উদয়িনী বলল,

‘ হ্যাঁ ঠিক আছে। তোর বাবার নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপে দিতে পারবি? ‘

পৃথিবীতে এরচেয়ে বিস্ময়কর কিছু হতে পারে কী? এক নারী তার সন্তানকে ফোন করে বলছে তার স্বামীর ফোন নাম্বার দিতে? বাবা নাম্বার পরিবর্তন করেছে আড়াই বছর আগে। সেই নাম্বার যে মা জানে না। সুহাস মাত্রই জানতে পারল৷ মায়ের শতদোষ থাকলেও বাবার প্রতি রাগ হলো এবার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ দিচ্ছি। তুমি কী করছ মা? ‘

‘ কফি খাচ্ছিলাম। তোর নানু আসবে দুপুরে। তার ঘরটা গুছাব। বাবার নাম্বারটা মনে করে দিয়ে দিস। রাখছি। ‘

ফোন কেটে গেল। সুহাস কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে বাবার নাম্বার সেন্ট করল মাকে। আজ মায়ের কণ্ঠ ভীষণ অন্যরকম লাগল। ঐ কণ্ঠে ক্রোধ ছিল না ছিল প্রচণ্ড অসহায়ত্ব। যা অনুভব করে সুহাস বাবাকে একটা টেক্সট করল,

‘ মা ভালো নেই বাবা। মা তোমায় ফোন করলে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলো প্লিজ। ‘

রাতে রান্না করা খাবার গুলো গরম করে রুমে এলো নামী। ননদ এলেই খাবে তারা। আপাতত ভেজা চুলগুলো শুকানো যাক। হেয়ার ড্রায়ারে লাইন দিয়ে বরের হাতে ধরিয়ে দিল সে। সুহাসের ঘোর কাটল শ্যাম্পুর কড়া ঘ্রাণে৷ চুল কী শুকাবে? বউকে জাপ্টে ধরে কোলে বসিয়ে চুলে নাক গুঁজে বসে রইল কিয়ৎক্ষণ। এরপর চুল শুকাতে শুকাতে গল্প করল বন্ধুদের নিয়ে। আইয়াজ আর ফারাহর সম্পর্ক কেমন চলছে? মাঝেমধ্যেই ফারাহকে জ্বিনে ধরে। তখন বেচারা আইয়াজের দশা হয় ঠিক দেবদাসের মতো৷ ছেলেটা বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। কিন্তু ফারাহই ভিড়াচ্ছে শুধু। মাঝে মাঝে ফারাহকে বেশ সন্দেহ হয়, রহস্যময় লাগে। সুহাসের মুখে এ কথা শুনে নামীও চিন্তিত হয়ে পড়ে। সুহাসের কথা বা ভাবনা ভুল নয়। তার নিজেরও ইদানীং ফারাহকে বেশ রহস্যময় মনে হয়৷ আইয়াজ ফারাহর গল্প শেষে সৌধ আর নিধিতে চলে গেল ওরা। সৌধ নিধির প্রতি ভীষণ পজেসিভ৷ এতগুলো বছর ধরে বিনা স্বার্থে ভালোবেসে যাচ্ছে মেয়েটাকে। অথচ তার তরফ থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। খুব কঠিন হৃদয়ের নারী নিধি। এতকিছু করেও টলানো যাচ্ছে না। সৌধ, নিধির কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেল নামী। সৌধ যেমন নিজের সবটুকু দিয়ে নিধিকে ভালোবাসে। ঠিক তেমনি সিমরান ভালোবাসে সৌধকে। এরা দু’জনই একতরফা ভাবে ভালো বেসে যাচ্ছে। নামী জানে সৌধ কোনোদিন সিমরানকে ভালোবাসবে না। তার ভালোবাসা সব একমাত্র নিধির জন্যই। সৌধ খুব একগুঁয়ে স্বভাবের। তার বিশ্বাস নিধিকে সে নিজের করেই ছাড়বে। তাছাড়া একটি ছেলের থেকে এমন ভয়ানক ভালোবাসা পেলে কোন মেয়েই বা মুখ ঘুরিয়ে থাকবে? থাকলেও কতদিন পারবে? সবটা বুঝে নামী৷ তাই সিমরানকে ইনিয়েবিনিয়ে অনেক সময়ই বোঝায়, সৌধ তাকে ভালোবাসে না৷ কিন্তু মেয়েটা নেতিবাচক কথাগুলোও ইতিবাচক নিয়ে নেয়৷ তার দৃঢ় বিশ্বাস সৌধকে সে নিজের করে পাবেই পাবে। এর কারণ বহু যুবকের প্রেম প্রত্যাখ্যান করে এক সৌধতে মগ্ন সে। তার এই প্রগাঢ় বিশ্বাস, ভালোবাসা কখনোই বৃথা যেতে পারে না। সিমরানের সেসব কথা শুনে চুপসে যায় নামী৷ কিছুই বলতে পারে না৷ আর না কখনো সুহাসের সাথে শেয়ার করে এসব। যে যাই বিশ্বাস করুক৷ সে একমাত্র ভাগ্যে বিশ্বাস করে। খুব ভালো করেই জানে মানুষ যাই পরিকল্পনা করুক না কেন সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী এক এবং অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা।

চুল শুকানো শেষে রাবার ব্যন্ড দিয়ে চুল বেঁধে সুহাসের দিকে ঘুরে বসল নামী। জিজ্ঞেস করল,

‘ সৌধ ভাই নিধি আপুর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে না কেন? ‘

‘ পাঠাবে স্মৃতি আপুর বিয়ের পরই। ‘

‘ তাদের বাড়ির সবাই জানে নিধি আপুর ব্যাপারে?’

‘ এখনো না। জানাবে শিঘ্রই। ওর পরিবারে এসব নিয়ে প্রবলেম নেই। সব প্রবলেম নিধির পরিবারেই। সুজা আংকেলকে জানানোর পর এসব সলভ হয়ে যাবে৷ ‘

নামী মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,

‘ এবার সিমরানকে সৌধ ভাই আর নিধি আপুর ব্যাপারে জানানো উচিত। ‘

পরোক্ষণেই ভাবল,

‘ উহুম, যখন বিষয়টা পারিবারিক ভাবে আগাবে তখনি জানাব৷ আমার কাজ শুধু পাশে থেকে মেয়েটাকে সামলানো। ‘

এরপর ভাবল, সৌধর প্রতি সিমরানের অনুভূতি বিষয়ে সুহাসকে জানাবে কিনা? প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে গেল সে। বলবে বলবে করেও শেষ পর্যন্ত আর বলল না। না জানি সুহাস কী প্রতিক্রিয়া দেবে। এই ভয়েই কিছু বলতে পারল না৷ সে তো জানে বোনের ব্যাপারে ছেলেটা কতখানি পজেসিভ!
.
.
এমপি সুজা চৌধুরীর বাড়ি আত্মীয়, স্বজনে ভরপুর। পুরো বাড়িটা সাজানো হচ্ছে ঠিক রাজমহলের মতো। এ যেন ঠিক এক রাজকন্যেরই বিয়ের আয়োজন। সৌধদের বাড়ির নাম স্মৃতিসৌধ। এই বাড়িটা সুজা চৌধুরীর খুব শখের বাড়ি৷ আজ বাদে কাল যে মেয়েটির বিয়ে। সেই মেয়েটিও এ বাড়ির খুব শখের। বাড়ি জুড়ে একদিকে সুখের বন্যা বইলেও অন্যদিকে চাপা কষ্টের জোয়ার আসছে। তবু জীবন চালনা করতে হবে জীবনের নিয়মেই। সকালের নাস্তা শেষে চৌধুরী গিন্নি ছোটো ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। সৌধর মা তানজিম চৌধুরী। মায়ের ঘরে এসে সৌধ দেখল, মা পান মুখে দিচ্ছেন৷ পাশে আপু আর ছোটো কাকার চার বছরের মেয়ে তাহানী। তাহানী নামটা রেখেছে তানজিম চৌধুরী। যাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু তাহানীকে অভিনন্দন জানিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে চৌধুরী বাড়িতে। তাহানী নামের অর্থ অভিনন্দন।
সৌধর একমাত্র কাকা সুলল চৌধুরী। স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি আর বিয়ে করেনি। বয়স গতমাসে একচল্লিশে পড়েছে। চার বছর ধরে পরিবারের সবাই খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে সুললকে বিয়ে করানোর জন্য৷ সে চেষ্টা বরাবরের মতোই বৃথা। তাহানীকে সৎ মা নামক শব্দটির সঙ্গে পরিচয় করাতে নারাজ সে। ঘোর আপত্তি। তার বুড়ো মা আর ভাবির দায়িত্বেই আছে ছোট্ট তাহানী। আর সে একাগ্রচিত্ত ঢাকা শহরে থাকা তাদের পারিবারিক বিজনেস সামলাচ্ছে৷ মায়ের ঘরে ঢুকে তাহানীকে কোলে তুলে নিল সৌধ। ছোটো ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে রইল তাহানী। সৌধ ওর ছোট্ট গালে চুমু খেয়ে মাকে বলল,

‘ আম্মা ডাকছিলে? ‘

তানজিম চৌধুরী পান চিবুতে চিবুতে বললেন,

‘ হু আব্বা ডাকছিলাম। সোহান ভাইয়ের বাড়ি যাও তাড়াতাড়ি। সিনু মারে নিয়া আসো গা। ‘

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে সৌধ বলল,

‘ তোমাকে কতদিন বলেছি পান খাবে না। আর তুমি এটা অভ্যাসে পরিণত করছ? ‘

তানজিম চৌধুরী হাসলেন। কাঁধে পড়ে থাকা আঁচলখানি মাথায় তুলে নিয়ে বললেন,

‘ এই একটুআধটু খাই। তুমি যাও সিনু মারে নিয়া আসো গা। সুহাস ব্যাটায় নাকি শশুর বাড়ি গেছে শুনলাম। মেয়ে মানুষ বৃষ্টি মাথায় কইরা একা একা না আসাই ভালো। ভাবিও নাকি আসছে৷ তার সাথে কথা বইলা তারপরে নিয়া আইসো। ‘

স্মৃতি আপু আড়চোখে ভাইকে দেখে নিল। গতরাতেই ভাইকে সে বলেছিল সিনুকে সাতসকালে নিয়ে আসতে। ভাইয়ের মেজাজ ভালো নেই। তাই রাজি হয়নি৷ সুহাসের পরিবারের সঙ্গে চৌধুরী পরিবারের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। সেই সুবাদে স্মৃতি আর সিমরানের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ আর মধুর। একদিন বাদেই মেহেদি অনুষ্ঠান। টুকটাক শপিং এখনো বাকি। সিমরানের পছন্দ জ্ঞান ভালো। প্রচণ্ড স্মার্ট আর মিশুক প্রকৃতির মেয়ে। স্মৃতির মতে বিয়ে বাড়ির আমেজ খুবই সাদামাটা। বিয়ে বিয়ে অনুভূতিটা ঠিক আসছে না। আসল কথা তার কাজিনদের সাথে বা অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে মতের অমিল, রুচির অমিল হচ্ছে। নিজের বাড়িতেও ভীষণ অস্বস্তিকর লাগছে। সৌধর বন্ধু, বান্ধবী সবাই আসবে ইদের পরদিন। তার বান্ধবীরাও ইদের পর আসবে। আগে কারো পক্ষে আসা সম্ভব হবে না৷
নামী আসবে আগামীকাল। সে সুহাসকে নিয়ে গেছে তার গ্রামের বাড়িতে। একদিন থেকে তারপর ফিরবে। এই বৃষ্টিমুখর পরিবেশে সিমরান একা একা আসুক চায় না স্মৃতি৷ তাছাড়া উদয়িনী আন্টিকে খুব ভয় পায় সে৷ তানজিম সবটা বুঝিয়ে ছেলেকে আদেশ করল সিমরানকে নিয়ে আসতে। মায়ের আদেশ অমান্য করার মতো ছেলে সৌধ নয়৷ পারিবারিক ভাবে তারা সকল ভাই, বোনই খুব কঠিন নিয়মে মানুষ হয়েছে। বেয়াদবের স্থান সুজা চৌধুরীর বাড়িতে নেই৷ তাই মায়ের আদেশ আদবের সঙ্গেই মান্য করল সৌধ৷ তাহানীকে স্মৃতি আপুর কোলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে৷ প্রথমে ভেবেছিল গাড়ি নিয়ে বের হবে৷ বৃষ্টি থেমেছে। আকাশটাও পরিষ্কার। সবটা দেখে নিয়ে বাইক নিয়েই বের হলো। স্মৃতি আপুও সিমরানকে টেক্সট করে বলে দিল,

‘ সিনু, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসিস৷ একদম বিয়ের পর বাড়ি ফিরবি৷ আব্বাকে দিয়ে আংকেলকে ফোন করিয়ে দিব নো প্রবলেম। আর আন্টিকে ভাই ম্যানেজ করে নেবে নো টেনশন। ‘

স্মৃতি আপুর ম্যাসেজ পেয়ে সিমরানকে আর পায় কে? ঝড়ের গতিতে সে তৈরি হয়ে নিল। সৌধ ভাই! তার স্বপ্নের পুরুষ আসছে তাকে নিতে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভাবল, বিয়ের আগেই ঘটা করে শশুর ঘরে ক’জন যেতে পারে হু হু? আহা! আকাশে বাতাসে আজ শুধু খুশির ঢেউ।

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৪|
বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক বৃষ্টি দেখছিল উদয়িনী। সোহানের নাম্বার নিয়েছে কিছুদিন আগে। অথচ ফোন বা টেক্সট কিছুই করা হয়নি। অপেক্ষার সমাপ্তি টানতে বাধ্য হলো সে। বুঝে ফেলল সোহান আজো আসবে না। তাই কল করল স্বামীর নাম্বারে। দু’বার রিং বাজতেই কল রিসিভ হলো। উদয়িনী সাবলীল কণ্ঠে শুধাল,

‘ কেমন আছো? ‘

সেদিন সুহাসের ম্যাসেজ পেয়ে বিরক্ত হয়েছিল সোহান। তবু ছেলের অনুরোধ ফেলে দিতে চায়নি৷ অপেক্ষা করছিল উদয়িনীর ফোনকলের। দিন পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। উদয়িনী কল করল না। সোহান খন্দকারও অপেক্ষা করা বন্ধ করে দিল। ব্যস্ত সময় কাটাতে লাগল একাগ্রচিত্তে। এরই মধ্যে আজ হঠাৎ করে অপ্রিয় স্ত্রীর ফোন পেয়ে একটুও অবাক হলো না। সহজ গলায় বলতে উদ্যত হলো,

‘ বলো কী বলবে? ‘

তার পূর্বেই উদয়িনীর বিস্ময় করা কণ্ঠের স্বাভাবিক প্রশ্ন শুনে বলল,

‘ সৃষ্টিকর্তা যে হালে রেখেছেন সে হালেই আছি। ‘

ব্যস থেমে গেল সোহান। উদয়িনীকে পাল্টা জিজ্ঞেস করল না সে কেমন আছে? একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের মন ওঠে গেলে সে ভালো আছে কিনা জানতে চাওয়া কি সত্যি সম্ভব? অন্যকারো দ্বারা সম্ভব হলেও সোহান খন্দকারের পক্ষে সম্ভব হলো না। উদয়িনী বোধহয় আশা করেছিল। তাই নিশ্চুপ ছিল কয়েক পল। অপরপ্রান্তেও নীরবতা অটুট থাকলে থমথমে কণ্ঠে বলল,

‘ বাড়ি আসবে কবে? ‘

সোহান খন্দকারের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল। বলল,

‘ তুমি কি এটা জিজ্ঞেস করতেই ফোন করেছ? ‘

‘ না। ‘

‘ যে কারণে ফোন করেছ সে কারণটাই বলো। ‘

‘ আমি জানি তুমি বিরক্ত হচ্ছো। ‘

‘ এরপরও কেন কল করেছ? ‘

গলা কেঁপে ওঠল উদয়িনীর। আকস্মিক কেঁদে ফেলল। ওপাশে চমকাল সোহান। উদয়িনীর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যে নারী এতকাল কখনো ভাঙেনি আজ সে এত অল্পতেই ভেঙে পড়বে? বিশ্বাস হলো না। শক্ত মুখে বসে রইল সোহান৷ কানে ধরে রইল ফোন। বোঝার চেষ্টা করল ভাবগতিক। উদয়িনী নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,

‘ সোহান, একটা দিন কি আমাকে দেয়া যায় না? তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন সোহান, ভীষণ। ‘

‘ আমি শান্তিতে থাকলে তোমার সহ্য হয় না? আর কতভাবে অশান্তিতে রাখবে? আর কী প্রয়োজন আমাকে? আমার জীবন, যৌবন সবটাই তো ধ্বংস করে দিয়েছ৷ আর কী ধ্বংস করার আছে? আমার ছেলেটার জীবন ধ্বংস করতেও ওঠে পড়ে লেগেছ। সফল হতে পারছ না বলে নতুন ছক কষছো? ‘

চ্যাঁচিয়ে কথাগুলো বলল সোহান৷ উদয়িনী কয়েক পল স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে রইল। পরোক্ষণেই স্তব্ধতা কাটলে বলল,

‘ আর কারো জীবন ধ্বংস হবে না সোহান। তুমি প্লিজ একটা দিন সময় দাও আমাকে। ‘

উদয়িনী হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়। সোহান ভেবেছিল বরাবরের মতোই তর্ক দেবে উদয়িনী। এরপর প্রচণ্ড কথা-কাটাকাটি করে ফোন রেখে দেবে। কিন্তু উদয়িনীর তরফ থেকে এমন একটি উত্তর পেল যে আর কোনো কঠিন কথা শোনাতে পারল না। শত হোক সে ভদ্রলোক। আর উদয়িনী তার স্ত্রী এবং তাদের দু’টো সন্তানের মা। তাই ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল,

‘ আমার পক্ষে সম্ভব না। ‘

‘ এটা যদি আমার শেষ চাওয়া হয় তবু না? ‘

চুপ হয়ে গেল সোহান। দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ ঠাট্টা করছ? ‘

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উদয়িনী। বলল,

‘ সে বয়সটা আর নেই সোহান। ‘

বাক্যটির সমাপ্তি ঘটিয়ে আকস্মিক কেশে ওঠল উদয়িনী। কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে ওঠল। ধীরপায়ে ঘরে এসে বিছানায় বসল আধশোয়া হয়ে। ওপাশে চুপচাপ সমস্তই শুনছে সোহান। কল কেটে দেয়নি বলে উদয়িনী একটু স্বস্তি পেয়ে বলল,

‘ কবে ফ্রি থাকবে? ‘

‘ কেন? ‘

‘ তুমি না আসতে পারলে আমি যাব। ‘

দমে গেল সোহান। উদয়িনী আসতে চাইলে নিষেধ করার উপায় নেই। কারণ তার সবকিছুই উদয়িনীর মাধ্যমে পাওয়া। এই যে ক্লিনিকটায় সে অবস্থান করছে এটা তার নিজের হলেও এর সূত্রপাত হয়েছে উদয়িনীর মাধ্যমেই। উদয়িনীর পারিবারিক সাপোর্ট না থাকলে আজ সে এভাবে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারত না। সবকিছু বিবেচনা করে সে বলল,

‘ দিনে সময় দিতে পারব না। সন্ধ্যায় বাড়ি আসছি। ‘

উদয়িনী হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। এক চিলতে হাসি ফুটল তার অধর কোণে। বলল,

‘ থ্যাংকস অ্যা লট সোহান। ‘

ফোনে কথা বলা শেষ হতেই কাজের মেয়ে সেলিনা এসে খবর দিল, সৌধ এসেছে। সিমরানকে নিয়ে যাবে তাদের বাড়ি৷ চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে লেগেছে। তারা সবাই আমন্ত্রিত। সুহাস, সিমরান কয়েকদিন আগে চৌধুরী বাড়ি যাবে। কথা হয়েই ছিল। আজ
সিমরানকে নিতে আসবে এটাও স্বাভাবিক। যেহেতু সৌধ নিতে এসেছে একবিন্দু আপত্তিও করল না উদয়িনী। তাছাড়া আজ সোহান আসবে। তাই সিমরান ও বাড়ি চলে গেলে সোহানের সঙ্গে একাকী দীর্ঘ সময় কাটানো যাবে। ভেবেই সেলিনাকে বলল,

‘ সিনুকে তৈরি হতে বলো। আমি নিচে যাচ্ছি। ‘

কথাটা বলেই গলায় ওড়না ঝুলিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেলিনাকে পিছু ডেকে আবার বলল,

‘ তাড়াতাড়ি এসে দু’কাপ কফি করে দাও। সৌধ কফি ছাড়া কিছু খাবে না। ‘

সেলিনা মাথা কাত করে সিমরানের ঘরে চলে গেল।
.
.
রেইনকোট আর হেলমেট খুলে টি টেবিলের ওপর রাখল সৌধ। নিঃশব্দে বসল সোফায়৷ উদয়িনী এলো এক মিনিটের মাথায়। সৌধ তার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষ করল। ততক্ষণে সেলিনা এসে কফি তৈরি ফেলেছে। উদয়িনী সৌধ দু’জনই কফি খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক গল্প করে সময় কাটাল। সবাই উদয়িনীর সামনে বেশ অস্বস্তি নিয়ে থাকলেও সৌধর মধ্যে অস্বস্তির ছিটেফোঁটাও নেই। উদয়িনী সবার অস্বস্তি টের পায়, টের পায় কেউ তাকে পছন্দ করে না৷ তার সামনে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। কিন্তু সৌধ আলাদা। সে উদয়িনীকে আলাদা চোখে দেখে না। সবার চোখে যা কঠিন, অস্বাভাবিক সৌধর চোখে যেন তাই সহজ আর স্বাভাবিক। মোটকথা উদয়িনীর কলহপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এড়িয়ে চলে সৌধ। ঠিক এই জিনিসটাই ভালো লাগে উদয়িনীর। ব্যক্তিগত ভাবে সৌধকে ভীষণ পছন্দ তার। তাদের পারিবারিক সম্পর্কটাও বেশ মধুর৷ যা থেকেই সুপ্ত একটি ইচ্ছে অনেক আগে থেকেও বুকের ভেতর দানা বেঁধেছে। আজ সোহান এলে এ বিষয়েও কথা বলতে হবে। সুজা চৌধুরী তাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে। সিমরানকেও চোখে হারায় ও পরিবারের লোকগুলো। আত্মীয়ে আত্মীয়ে পরম আত্মীয়ের ইঙ্গিতটা তানজিম ভাবিই প্রথম দিয়েছে তাকে। তখন এ বিষয়ে ভাবা না হলেও এবার ভাবতে হবে। হাতে সময় খুবই অল্প। আলাপচারিতার মাঝেই লাগেজ নিয়ে সিমরান নিচে নেমে এলো৷ বুক ধুকপুক করে ওঠল সৌধর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির দৃঢ় চোয়ালদ্বয় দেখে। সিমরানকে দেখে উদয়িনীর মুখে হাসি ফুটে ওঠল৷ মেয়েকে কাছে ডেকে কপালে চুমু খেল সে৷ এরপর সৌধ দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। ‘

সৌধ বিব্রতবোধ করল। সিমরান দীপ্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে৷ সৌধ মাথা নাড়াল। বলল,

‘ সিয়র আন্টি , বাড়িতে সবাই ওর খেয়াল রাখবে৷ টেনশন করো না। ‘

উদয়িনীকে কথাটা বলেই সিমরানের দিকে তাকাল। বলল,

‘ হেলমেট কই? ‘

হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে সেলিনা আপাকে ডেকে হেলমেট আনাল সিমরান৷ পরনে হলদু রঙের রেইনকোট আর মাথায় কালো হেলমেট পরে তৈরি সে৷ সৌধও রেইনকোট আর হেলমেট মাথায় দিয়ে বিদায় নিল উদয়িনীর থেকে৷

ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রমণীর বুকের ভেতর অনাসৃষ্টি চলছে। তার মনের পুরুষটি ভয়াবহ সুদর্শন। যার পেছনে বসে তার বলিষ্ঠ কাঁধ স্পর্শ করে বাইকের মৃদু গতিতে সে যাচ্ছে স্বপ্নের বাড়ি৷ স্বপ্ন পুরুষটির বাড়িই তার স্বপ্নের বাড়ি৷ একদিন যে বাড়ির ছোটো বউরানি হবে সে। আপন গতিতে বাইক নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে সৌধ। সিমরান সুহাসের ছোটো বোন৷ প্রচণ্ড আদরের সম্পদ। এই বাচ্চা মেয়েটা শুধু সুহাসেরই নয়৷ তাদের পরিবার, বন্ধু -বান্ধবী প্রত্যেকেরই ভীষণ আদরের৷ সৌধ নিজেও যথেষ্ট আদর করে সিমরানকে। মেয়েটা এখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তবু তাদের কাছে মনে সিমরান যেন ঠিক ঐ আট বছরের আঁটকে আছে। সৌধর পেছনে দু’পা দুদিকে দিয়ে বসে সিমরান৷ একহাত সৌধর কাঁধে, অন্যটি নিজের ভাজকৃত হাঁটুর উপরে রাখা। পাঁচ মিনিট অতিক্রম করতেই হঠাৎ সৌধ বলে ওঠল,

‘ ভালোভাবে ধরে বোস। স্টাইল দেখাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটবে। ‘

আকস্মিক কথায় ভড়কে গেল সিমরান। সে স্টাইল দেখাচ্ছে? কীভাবে, কখন? চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে সৌধকে ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকাল। এতক্ষণ তার মধ্যে ভীষণ জড়তা কাজ করছিল। সৌধ তাকে স্রেফ বন্ধুর বোন, ছোটো বোনের নজরে দেখলেও সে তো তা দেখে না। তাই তো একটুখানি স্পর্শ করতেই অদ্ভুত শিহরণে পাগলপ্রায় লাগছিল। সব অনুভূতি তুচ্ছ করে দৃঢ়ভাবে কাঁধ ধরল সিমরান। কিছুটা ঘেঁষেও বসল। ঠান্ডা প্রকৃতি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, পছন্দের পুরুষটার বাইকের পেছনে বসে তাকে ছুঁয়ে অল্প পথ ভ্রমণেই মনটা রোমান্টিক হয়ে ওঠল। আলগোছে চোখ বুঝে বিড়বিড় করে বলল,

‘ আই ফিল ইউ সৌধ ভাই , ডিপলি ফিল ইউ! ‘

‘ কিছু বললি? ‘

গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সৌধ। সিমরান চমকাল। ঈষৎ হেসে বলল,

‘ না কিছু বলিনি। ‘

এরপর হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,

‘ অনেক কিছু বলি আমি, অনেক কিছু অনুভব করি। তুমি কি শুনতে পাও? পাও না তো। তোমার মতো এটিটিউড বয় কি এসব শুনতে পাবে? ‘

মনে মনে কথাগুলো বলে সিদ্ধান্ত নিল অনেক হয়েছে আড়ালে আবডালে ভালোবাসা। অনেক হয়েছে অপেক্ষা। এবার সে সৌধকে মনের কথা জানাবে। এতদিন অপেক্ষা করছিল সৌধ নিজে থেকেই তাকে প্রেম নিবেদন করবে৷ একটা সময় সে ধারণা করেছিল তার মতো করেই সৌধও তাকে মনে মনে ভালোবাসে। সে ধারণা থেকেই এতগুলো বছর অপেক্ষা। কিন্তু সৌধ তেমন কিছু বলেনি। অথচ তার হাবভাব সিমরান ঠিক বুঝতে পেরেছিল সে তাকে ভালোবাসে। এই যেমন সিমরান টিকটক করত। সেগুলো আবার ফেসবুকেও ছাড়ত৷ এটা নিয়েই একদিন ফোন করে শাসাল,

‘ সিনু এরপর যদি ফেসবুকে তোর একটা টিকটক পাই বাসায় এসে ঠাটিয়ে এক থা প্প ড় লাগাব। সবগুলো টিকটক ডিলেট করবি। ‘

এরপর আরেকদিন সে তার ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে মহেরা ঘুরতে গিয়েছিল। এই নিয়েও শাসন করেছে। কোন কোন ছেলে ভালো না, কার ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে। এরপর থেকে আর তাদের সাথে মেশেনি সে। মোটকথা তার যেসব কর্মকাণ্ড সৌধর পছন্দ না সবই এড়িয়ে চলেছে। সৌধর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সিমরান কথা মান্য করত না৷ সে এতটাও বাধ্য মেয়ে নয়৷ কিন্তু সৌধ যখন এসব বলেছে ওর মনে হয়েছে সৌধ চায় না তার ব্যক্তিগত নারী অন্য কোনো ছেলের সাথে চলাফেরা করুক বা পাবলিকলি সহজলভ্য হয়ে যায়। নিজের পোশাকআশাকেও যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছে৷ আগের মতো শার্ট, প্যান্ট এখন খুব একটা পরে না। সৌধর পছন্দ অনুযায়ী ঢিলেঢালা পোশাকই পরার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে স্মৃতি আপুকে অনুসরণ করে খুব। এতকিছু করার পরও সৌধর থেকে ইতিবাচক কোনো বার্তা পায়নি৷ তাই এখন তার মনে হচ্ছে শক্ত ব্যক্তিত্বের ছেলেরা ভালোবাসার মানুষটার কাছে ভালোবাসার আবেদন নিয়েও ছ্যাবলামি করতে পারে না৷ সৌধ আলাদা ধরনের। এজন্যই সিমরান তাকে ভালোবাসে। থাকুক না মানুষটা তার আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে৷ নাইবা বলল নিজে থেকে ভালোবাসার কথা। তাদের ভালোবাসাটা না হয় ভিন্ন ধারার হবে৷ সেই না হয় আগে ভালোবাসা প্রদান করবে।

বাড়ির প্রায় কাছাকাছিই এসে পড়েছে। এমন সময় আকস্মিক বাইক থামাল সৌধ৷ চমকে ওঠল সিমরান। বাইক থামিয়ে সিমরানকে নামতে বলল সে। সিমরান অবাক হয়ে নেমে দাঁড়াল। নেমে দাঁড়াল সে নিজেও৷ এরপর আশপাশে তাকিয়ে দেখল হেলমেট খুলবে কিনা৷ ফাঁকা রাস্তা। একটা, দু’টো গাড়ি যাচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তে আর হেলমেট খুলল না। পাছে কে দেখে চিনে ফেলল। সুজা চৌধুরীর ছোটো পুত্র একটি মেয়ে নিয়ে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই তো আর জানে না সিমরান তার বন্ধুর বোন। পারিবারিক আত্মীয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। মন, মেজাজ তার খুব একটা ভালো নেই। কারণ নিধির মধ্যে ভয়াবহ ধরনের পরিবর্তন খেয়াল করেছে সে৷ আজকাল আর রাত দশটার পর ওকে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ দিনেও বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে। এই ব্যস্ততার কারণ কী বুঝে ওঠতে পারে না। বুঝতে পারে শুধু নিধি তাকে এড়িয়ে চলছে। কিছুদিন আগেও এই এড়িয়ে চলাটা ছিল না। বরং কিছুটা আশকারা ছিল। হঠাৎ সব কেমন যেন হয়ে গেল। দু’দিন হলো কথা হয় না। রাগারাগি করেছে সে নিজেই৷ কিন্তু নিধি আর রাগ ভাঙায়নি। বলা যায় সে হয়তো রাগ ভাঙানোর সময় করে ওঠতে পারেনি। রাগ, অভিমান, খারাপ লাগা সবকিছুর পরও মেয়েটাকে ভালোবাসে সৌধ। তাই আর নিজেকে আটকাতে পারল না। সাহায্য নিল সিমরানের। বলল,

‘ একটা হেল্প কর তো। ‘

বুক ধক করে ওঠল সিমরানের। উত্তেজনায় ঠোঁট কাঁপছিল তার। মন বলছিল সৌধ বুঝি কাঙ্ক্ষিত কিছু বলার জন্যই এভাবে মাঝরাস্তায় বাইক থামিয়েছে। কিন্তু না সে তো হেল্প চাইছে! কী হেল্প? মনের প্রশ্ন মুখেও বেরিয়ে এলো,

‘ কী হেল্প? ‘

‘ নিধিকে তোর ফোন থেকে একটা কল কর। আর জিজ্ঞেস কর কবে আসবে। ‘

সৌধর চিন্তান্বিত দু’টি চোখে তাকিয়ে ঘনঘন পলক ফেলল সিমরান৷ নিধি সৌধ ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। শুধু সৌধ না তার ভাই সুহাসেরও বেস্ট ফ্রেন্ড। তারা সবাই সবার প্রতি খুব পজেসিভ। ঠিক যেন গল্পটা বন্ধুত্বের নাটকের মতো ওদের বন্ধুত্বের বন্ডিং। সবই জানে সিমরান৷ সেই সাথে নিধির পারিবারিক সমস্যার কিছু কথা শুনেছে। স্মৃতি আপুর বিয়েতে সবাই আসবে। নিধি আসবে কিনা এ নিয়ে সকলের মধ্যে সংশয়৷ সংশয় সৌধর চোখে, মুখেও ফুটে ওঠেছে৷ ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসল সিমরান। বলল,

‘ আচ্ছা ফোন দিচ্ছি। তুমি টেনশন করো না। নিধিপু ঠিক আসবে। ‘

কথাটা বলেই কল করল নিধির ফোনে। সৌধ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখনো। একবার রিং হলে ধরল না৷ সৌধ অধৈর্য হয়ে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে গেলে রিসিভ হলো সিমরানের ফোন। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ঘুম কাতুরে এক পুরুষালি কণ্ঠস্বর,

‘ হ্যালো কে বলছেন? ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করেই ফোন কেটে দিল। ঢোক গিলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

‘ সৌধ ভাই, ছেলে মানুষ ফোন ধরেছে। ‘

ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো সৌধ। হাত বাড়াল ফোন চেয়ে। সিমরান ফোন এগিয়ে দিলে সে নিজেই কল করল। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো। শোনা গেল নিধির শান্ত গলা,

‘ হ্যালো সিমরান? ‘

সৌধ সঙ্গে সঙ্গে সিমরানের হাতে ফোন দিল। সিমরান ফোন কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই নিধি বলল,

‘ কেমন আছো? ‘

‘ এইতো ভালো আপু তুমি কেমন আছো? কে ফোন ধরেছিল? ‘

নিধি কথাটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,

‘ কিছু বলবি? ‘

‘ কবে আসবে তুমি? সবাই জানতে চাচ্ছে। ‘

সবাই বলতে কে ঠিক বুঝে নিল নিধি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুচকি হাসল। বলল,

‘ সৌধকে বল আমি ইদের পরেরদিনই যাব। এত ফোন দিতে হবে না৷ একবার যখন বলেছি যাব তো যাবই। ‘

ফোনে কথা শেষ করে সৌধকে সবটা বলতেই বাইক স্টার্ট দিল সৌধ। এরপর তারা পৌঁছাল নিজেদের গন্তব্যে। বাড়ির সদর দরজায় পা রাখতেই সৌধর মা তানজিম চৌধুরী এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল সিমরানকে। এরপর সিমরানের কোমল থুতনি ছুঁয়ে কপালে চুম্বন এঁটে বলল,

‘ আমার ছোটো আম্মা হাজির। এইবার আমার ঘরের খুশি কানায় কানায় পূর্ণ। ‘

স্মৃতি আপু চোখ ছোটো ছোটো করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল৷ বড়ো ভাবিকে তার মা, বাবা বড়ো আম্মা বলে ডাকে। সিমরানকে ছোটো আম্মা ডাকল কেন? তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে অন্য রকম গন্ধ পৌঁছাল। ঠিক সেই মুহুর্তে সৌধ এসে সিমরানের পাশে দাঁড়াল। এক মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল স্মৃতি। পরোক্ষণেই মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনার ইতি টানল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ ধূরর কী সব মাথায় আসছে। পাঁচ বছর যাবৎ সৌধ নিধিকে ভালোবাসে। আর আম্মা হয়তো এত ডিপলি চিন্তা করে কিছু বলেনি। আর যদি চিন্তা করে বলেও থাকে এটা কখনোই সম্ভব না। আমার ভাই যা জিনিস! ‘

মাথা ঝাঁকিয়ে দুঃশ্চিতা সরিয়ে দিয়ে সিমরানকে গিয়ে চেপে ধরল স্মৃতি । প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা যখন হাজির৷ এবার বাড়িতে বিয়ে বিয়ে অনুভূতি ঠেকায় কে?

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|২৫|
সিমরান বেড়ে ওঠেছে একক পরিবারে। যেদিন থেকে সৌধদের যৌথ পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে সেদিন থেকে এই পরিবারের প্রতি আলাদা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। এ পরিবারের মানুষ গুলোও তাকে খুব আপন করে নিয়েছে। নিজের পরিবার বলতে বাবা, মা, ভাইকেই দেখেছে সে। বাবা, মাকে পেয়েছে খুব কম সময়। পরিবার কী? পরিবার কেমন হয় জানত না। তেমন কোনো অনুভূতি ছিলই না পরিবার নিয়ে। চৌধুরী বাড়ির সঙ্গে তার বাবা, মায়ের বন্ধুত্ব সম্পর্কের সুবাদে এ বাড়ি আসা, যাওয়া শুরু হয়৷ তারপর থেকেই বুঝতে শুরু করে যৌথ পরিবারের মর্ম। একটি যৌথ পরিবারে শুধু হাসি, খুশি, আনন্দ, উল্লাস বা শুধু ভালোবাসাই থাকে না। থাকে দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ এবং নিয়মানুবর্তিতা। সিমরান খোলা চোখে এ পরিবারে শুধু অঢেল ভালোবাসা আর আনন্দ টুকুই দেখেছে। বাদবাকি বিষয়ে খুব একটা খেয়াল করা হয়নি। তার মাধ্যে প্রচণ্ড পরিমাণে ম্যাচিওরিটির অভাব। বাবা, মায়ের সান্নিধ্য পায়নি বলেই শিশুকাল থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। চাইতে দেরি কিন্তু পেতে দেরি হয়নি কখনো৷ বাবা, মায়ের অভাব বোধ অনুভব করলেও তারা দুই ভাই, বোন কখনো অভিযোগ করতে পারেনি। কেন করবে? ছোট্ট থেকেই তো শেখানো হয়েছে, বোঝানো হয়েছে , ‘ তোমরা যখন যা চাচ্ছ তাই পাচ্ছ। অন্যান্য পরিবারের বাচ্চারা তোমাদের মতো এত সুবিধা পাচ্ছে না। সবাই সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে না। একদিকে সেক্রিফাইস করলে অন্যদিকে পরিপূর্ণ ভাবে পাওয়া যায়। ‘ সেই শেখানো বুলি মস্তিষ্কে চেপেই বেড়ে ওঠা ওদের। অভিযোগ করার কারণ দাঁড় করাতে পারেনি কখনোই। সেই একক পরিবারের সন্তান হয়ে যৌথ পরিবারে মানিয়ে নেয়াও ভীষণ কঠিন৷ যতই ভালোলাগা থাকুক তবু কিছু জটিলতার সম্মুখীন তো হতেই হয়৷ হতেও হলো সিমরানের৷ গতকাল স্মৃতি আপুর মেহেদি অনুষ্ঠান ছিল। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সৌধর বাবা-মা দু’দিকের আত্মীয় আর বন্ধু, বান্ধব। নিধি বাদে সব বন্ধুরাই উপস্থিত ছিল। নিধি গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত এই তিনদিন থাকবে কথা দিয়েছে। তাই মেহেদি অনুষ্ঠানে না থাকায় রাগ করেনি সৌধ। চুপচাপই ছিল সে। বড়ো বোনের মেহদি অনুষ্ঠানে আনন্দ করেছে খুব। নাচ, গান, গল্পআড্ডা সবশেষে কাজিন আর বন্ধুদের জোরাজোরিতে একটু মেহেদি লাগানো হাতে৷ সব মিলিয়ে সময়টা তার দারুণ কেটেছে। তাকে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে সিমরান। কাজিনদের মধ্যে সবাই সৌধকে ভীষণ ভয় পায়৷ প্রচণ্ড সম্মান আর ভালোওবাসে। কিন্তু পাশাপাশি বসে তার হাত ধরে মেহেদি দিয়ে দেয়াতে সাহস সিমরান ছাড়া কারোরি বেশি ছিল না। প্রিয় মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে হাত রাঙিয়ে দেয়ার সুযোগটুকুও হাত ছাড়া করতে চায়নি সিমরান, লুফে নিয়েছে তৎক্ষনাৎ। সৌধর দাদি আশায়রা বেগম। খুবই চতুরা নারী। সেকালের মেট্রিক পাশ । শিক্ষিতা নারী। এ-র ওপর বড়ো ঘরের বউ। ভীষণ দাপুটে। বর্তমানে বয়স পয়ষট্টি ছুঁয়েছে। মাথায় কাঁচা চুলের দেখা মেলে না। দেহের চামড়া ঝুলে বার্ধক্যের চিহ্ন ফুটে ওঠেছে। চোখের পাওয়ারও কম। চশমা ছাড়া চোখে দেখে না৷ তবু তেজ কমেনি এক চুল পরিমাণও। এই পরিবারে তার চোখে চোখ রেখে, তার কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে পারো দু’জন ব্যক্তি। একজন তার বড়ো ছেলে সুজা চৌধুরী। আরেকজন ছোটো নাতি সৌধ চৌধুরী। আশায়রা বেগম ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করে না সিমরানকে। তার কাছে সিমরান আর সুহাস দু’জনকেই অতিরিক্ত চঞ্চল, আর ঔদ্ধত্য মনে হয়৷ যাদের মধ্যে সাধারণ জ্ঞান নেই। ভদ্রতা, সভ্যতার লেশমাত্র নেই। বড়োদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হয় এদেরকে পরিবার থেকে শিখানো হয়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা আশায়রা বেগম উদয়িনীকে অপছন্দ করেন। তার পরিবারের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না উদয়িনী এবং তার ছেলেমেয়েদের চলনবলন। সুজা কীভাবে এমন একটি পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল সৌধই বা কোন রুচিতে এদের সঙ্গে বন্ধু পাতালো বুঝে ওঠতে পারেন না তিনি। সিমরানের অতিরিক্ত হৈহৈ রৈরৈয়েও বিরক্ত তিনি। এই বিরক্তি ক্রোধে পরিণত হলো তার দুই মেয়ে অর্থাৎ সৌধর দুই ফুপু আর ফুপাত ভাই, বোনরা আসার পর৷ কারণ সৌধর ফুপাত ভাইদের মধ্যে দু’জনই তাগড়া যুবক। বাড়ি, ভর্তি আত্মীয়স্বজন, এদের মাঝে সিমরান বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে। কানামাছি, লুকোচুরি খেলে। পরনের ওড়না ঠিকভাবে রাখে না। রাতদুপুরে শুধু টিশার্ট আর প্লাজু পরে ঘুরে বেড়ায়। সব মিলিয়ে সিমরানকে তার নির্লজ্জ মনে হয়েছে। আর নির্লজ্জ নারীরা তার দুচোখের বিষ। গতকাল মেহেদি অনুষ্ঠানেও তার নাতনিদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে দেখেছে। শেষ পর্যন্ত সৌধকেও ছাড় দেয়নি। সর্ব সম্মুখে হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। তার চোখ জহুরি। সিমরানের চোখ দু’টোর ভাষাও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই অনুষ্ঠান শেষে সিমরানকে একা ডেকে পাঠায় সে। দাদুনিকে আর সবার মতো সিমরানও ভয় পায় ভীষণ। হঠাৎ ডেকে পাঠানোতে বুকের ভেতর ধুকপুকানি নিয়েই উপস্থিত হয়। ঘরে ঢুকেই চোখে, মুখে হাসি ফুটিয়ে শুধায়,

‘ দাদুনি আমাকে ডেকেছ? ‘

তিনটে শব্দে ভুল আরো একটা করে বসে সিমরান। দাদুনিকে এ বাড়ির বড়ো থেকে ছোটো সবাই আপনি সম্বোধন করে। বিষয়টা একদমই মনে থাকে না সিমরানের। মনে তখনো ছিল না৷ তাই তুমি করেই বলে ফেলে৷ এতে দাদুনির রাগ তীব্র হয়। সদ্যই চশমা খুলে পাশের টেবিলে রেখেছিল। তা পুনরায় চোখে তুলে৷ এরপর সুক্ষ্ম চোখে তাকায় সিমরানের পানে। সিমরানের পরনে কালো রঙের টিশার্ট আর ধূসর রঙের ঢোলা পাজামা৷ কাঁধের দু’পাশে চুল ছাড়া একদম বুক অবধি। তাই আলাদা করে আর ওড়না পরেনি৷ মধ্যরাত৷ অনুষ্ঠানে রাত জেগে সবাই যে যার ঘরে ঘুমুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই যেভাবে ছিল ওভাবেই ত্বরিত এসে পড়েছে। আপাদমস্তক সিমরানের দিকে নজর বুলিয়ে দাদুনি বলল,

‘ এ বাড়ির সবাই আমাকে আপনি সম্বোধন করে। বড়োদের সম্মান পূর্বক আপনি সম্বোধন করাই উচিত। যদি গদগদ সম্পর্ক হয় আর কেউ তুমিতে সায় দেয় তবেই তুমি করে বলা যায় নচেৎ তুমি বলা চরম বেয়াদবি। ‘

মুহুর্তেই মুখটা থমথমে হয়ে যায়। থমকানো কণ্ঠে সিমরান বলে,

‘ সরি দাদুনি, মনে ছিল না। ‘

দাদুনি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,

‘ এরপর থেকে মনে রাখবা। ‘

মাথা কাত করে সিমরান। দাদুনি কিয়ৎক্ষণ চুপ রয়৷ সিমরান দু-হাত সামনে বেঁধে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। দাদুনি এবার শোনাতে শুরু করে কয়েকটা কড়া কথা। কথাগুলো শিক্ষনীয় হলেও প্রকাশভঙ্গী খুবই কঠিন আর অপমান দায়ক ছিল। যেসবে একেবারেই অভ্যস্ত নয় সিমরান৷ প্রচণ্ড মিশুক প্রকৃতির মেয়ে সে। কারো সঙ্গে নিজেও কঠিন আচরণ করতে পারে না। আর না কারো কঠিন আচরণ সহ্য করতে পারে।

দাদুনি বলে,

‘ শুনো তোমার পারিবারিক শিক্ষার অভাব আছে আমরা সবাই জানি। যাদের বাবা, মায়ের মাঝে বনিবনা কম, যাদের বাবা মা সন্তানকে একা ছেড়ে দূরে থাকে তারা এমনই ঔদ্ধত্য হয়৷ কিন্তু সব পরিবার তো আর তোমার এই ঔদ্ধত্য মেনে নিবে না৷ তাছাড়া মেহমান হয়ে কোনো বাড়িতে এসে মেয়ে মানুষের ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলিও সব পরিবার সহ্য করবে না৷ বয়স তোমার কম হয় নাই। পুরুষ মানুষের থেকে দূরত্ব রেখে চলা উচিত। বাড়ি জুড়ে মেহমান ভর্তি। দামড়ি মেয়ে সকলের সামনে ছুটাছুটি করো লজ্জা করে না? তাহানী, আর ইনানের সাথে তোমার তাল মিলানি তো মানায় না। তোমাকে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়ার মানুষ নাই। তাই আমিই দিলাম, অতো ছটফটানি বাদ দিয়া দাওয়াত খাবার আসছ। খেয়েদেয়ে বিদায় হও। ‘

তাহানী এ বাড়ির ছোটো ছেলের মেয়ে। আর ইনান সৌধর বড়ো ভাইের ছেলে বয়স সাড়ে তিন বছর৷ এই বাচ্চা দু’টোর সঙ্গে সিমরানের সখ্যতা অনেক বেশিই।
চুপচাপ দাদুনির কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যেন চোখ গলে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মেয়েটার। দাদুনি সেটা খেয়াল করল না৷ সিমরান ত্বরিত বেগে দু’হাতে অশ্রু কণা মুছে নিল। দাদুনি আরো বলল,

‘ আর বিশেষ করে আমি নাতিদের থেকে দূরত্ব মেপে চলবা। পরনের কাপড় ঠিকঠাক রাখবা৷ তোমাদের বাড়ির মতো এই বাড়ি না৷ এখানে অনেক সদস্য আছে। তার ওপর অনুষ্ঠান বাড়ি৷ পুরুষ মানুষের আনাগোনাও কম নাই৷ তোমার লজ্জা, শরম কম এইটা পরের বাড়ি এসে বোঝানোর দরকার নাই৷ তোমার কারণে আমার বাড়ির সম্মান নষ্ট হউক এটা আমি চাই না। মনে রাখবা কথাগুলো। যাও এখন। ‘

মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করত পারল না সিমরান। গলা কাঁপতে লাগল। বহু কষ্টে মাথা কাত করে সম্মতি দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরুতে উদ্যত হলো। তৎক্ষনাৎ দাদুনি ফের পিছু ডেকে বলল,

‘ আর একটা কথা। কারো ঘরে ঢুকবার আগে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়। কেউ মনে হয় শিখায় নাই। আমি আজ শিখিয়ে দিলাম৷ এটাও মাথায় রাখবা। ‘

বুকের ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে যেন গলায় আঁটকে রইল। দরজার ওপারে যেতেই একছুটে উপরে চলে আসে সিমরান। স্মৃতি আপু ঘুমিয়ে কাঁদা। সে গিয়ে চুপচাপ স্মৃতি আপুর পাশে শুয়ে পড়ে৷ কিন্তু সারারাত কাটে নির্ঘুমে। সকাল হলেই সিদ্ধান্ত নেয় এ বাড়িতে আর এক মুহুর্ত নয়। দাদুনি তাকে পছন্দ করত না টের পেয়েছিল আগেই৷ কিন্তু গতরাতে যেভাবে ঘরে ডেকে অপমান করল এরপর আর এ বাড়িতে থাকা সম্ভব হলেও তার সামনে যাওয়া সম্ভব না। এ বাড়িতে থাকতে হলে তার সামনে যেতেই হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিল, বাড়ি চলে যাবে সে। ত্বরিত ব্যাগপত্র গুছিয়ে ভাইয়ের ফোনে কল দিল।
.
.
বেশ রাত করে ঘুমিয়েছে সুহাস, নামী। সৌধদের গেস্ট রুমে ঘুমিয়েছে তারা। তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে রাতে৷ যুদ্ধ আবার কবে হয় না তাদের? সেই শুরুর দিন থেকে চলছে যুদ্ধ। এরপর থেকে একটা না একটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে লেগেই থাকে। স্বামী-স্ত্রী থেকে শত্রু হলো। শত্রু থেকে আবার বন্ধু। এরপর তাদের সম্পর্ক মোড় নিল গাঢ় প্রণয়ে। তবু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল না। সৌধর দু’জন যুবক ফুপাত ভাইদের মধ্যে একজনের মাঝে ছ্যাবলামি দোষ রয়েছে। নাম, রোশান আহমেদ। ছোটো করে শান ডাকে সবাই। অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মামাত বোনের বিয়েতে এসেছে আর মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করবে না? তাই কখনো হয় নাকি? তাই কেন জানি এত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে নামীকেই খুঁজে পায় সে৷ গল্প জমানোর ফাঁকে অবশ্য জানতে পারে নামী সুহাসের বউ। তাতে তার কী? কে কার বউ এসবে তার কাজ নেই। বিয়ে বাড়িতে এসেছে, তার দরকার ফ্লার্ট করার তাই সেটা করাতেই মন দিয়েছে। নামী তখন মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিল ছোট্ট তাহানীর হাতে৷ তখনি শান এসে পাশে বসে। অনেকক্ষণ ইয়ার্কি, ঠাট্টা করার পর হাত পেতে বলে,

‘ ভাবিজান, দেবরের হাতে মেহেদি পরিয়ে দেন না? ‘

স্মার্ট মেয়ে নামী। সবকিছুরই প্রতিত্তোর দিতে পারে সে৷ তাই ঠাট্টার উত্তর ঠাট্টা দিয়েই দিচ্ছিল৷ কিন্তু তাহানীর মেহেদি পরা শেষ হতেই নামীকে সে বায়নার স্বরে বলল,

‘ শানুভাইয়ের হাতে মেহেদি দিয়ে দাও ভাবি। ‘

বাচ্চা মেয়েটার বায়না আর শানের ঠাট্টা,

‘ তোমার ভাবি শুধু তোমাকেই মেহেদি পরাতে পারে তাহানী সিস্টার৷ দেবরদের মেহেদি পরানোর কলিজা তার নেই। ‘

ব্যস কথাটা অহমিকায় লাগল খুব। মনে জেদ চেপে শানকে মেহেদি দিয়ে দিতেও শুরু করল। সুহাস, আইয়াজ আর আজিজকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে গিয়েছিল৷ হাঁটাহাঁটি শেষে অনুষ্ঠানে আসতেই দেখতে পেল, তার বউটি সৌধর ফুপাত ভাইয়ের হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই এই ছেলেটাকে পছন্দ না তার। কেমন যেন মেয়েদের গা ঘেঁষে থাকা স্বভাব। সে নিজেও অসংখ্য গার্লফ্রেন্ড লালন, পালন করা ছেলে৷ কিন্তু এই রোশান ছেলেটার সঙ্গে তার যেন বহুগুণ তফাৎ। একটি ছেলে আরেকটি ছেলের চোখের ভাষা, মনের ভাষা যেভাবে পড়তে পারে একটি মেয়ের পক্ষে তা কখনো সম্ভব হয় না৷ রোশানকে অপছন্দ করার পেছনে আরো একটি কারণ হলো, সৌধ। সৌধ নিজেও রোশানকে পছন্দ করে না। তাহলে নিশ্চয়ই এই ছেলেটার মধ্যে সমস্যা আছে? তাই কঠিন ক্রোধে ফেটে পড়ে সুহাস৷ বার বার ডেকে পাঠায় নামীকে। কিন্তু মেহেদি পরানো শেষ না হওয়া অবধি নামী তার কাছে আসে না৷ এরপর রাতের খাবার খেয়ে শোবার সময় হয়ে এলে নামী যখন গেস্ট রুমে আসে। পাগলা ঘোড়ার মতো আক্রমণ করে সে। দরজা লক করে আচমকা নামীর গাল দু’টো একহাতে চেপে ধরে বলে,

‘ এখন এলি কেন? থেকে যেতি ঐ শানের কাছে। ‘

গাল ব্যথায় অসহ্য হয়ে ওঠে নামী। এরওপর এমন বাঁকা কথা শুনে রাগও হয়। এক ঝটকানি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠে,

‘ পাগল হয়ে গেছ সুহাস? এটা কী ধরনের আচরণ!’

চ্যাঁচিয়ে ওঠে সুহাস নিজেও,

‘ একদম উপযুক্ত আচরণ। এখানে এসেছিস কেন? যা ঐ শানের ঘরে যা। যাকে এতক্ষণ আদর করে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছিলি। ‘

চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলে নামী৷ বলে,

‘ মুখ সামলে কথা বলো। ‘

‘ তুই সামলে চলবি না আর আমি সামলে বলব? ‘

‘ আশ্চর্য! কী করেছি আমি? তোমার মতো বউ থাকা সত্ত্বেও দশ, পাঁচটা জিএফ পুষেছি? ‘

‘ জিএফ পুষবি কেন তুই ওটা পুষব আমি৷ তুই পুষবি বিএফ। ‘

দুজনের মধ্যেই ভয়াবহ ঝগড়া লেগে যায়। সুহাসের চিৎকার, চ্যাঁচামেচি, অপমান, গায়ে হাত তুলতে আসা সবটায় তিক্ত হয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় নামী৷ সুহাস তখন পেছন থেকে জাপ্টে ধরে তাকে। বলে,

‘ কোথায় যাচ্ছিস শানের ঘরে? ‘

তীব্র ক্রোধে নামীও স্বীকার করে,

‘ হ্যাঁ শানের ঘরেই যাচ্ছি। তোমার মতো পুরুষের কাছে থাকার চেয়ে অন্য পুরুষের কাছে যাওয়া ঢের ভালো! ‘

এমন একটি কথা কি আর সহ্য হয়? এক হাতে নামীর মুখ চেপে ধরে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সুহাস বলে,

‘ এটা কী বললি তুই? ‘

আর কিছু বলে না নামী। বলতে পারে না। সুহাসের মতো রাগের বশে যাতা বলার স্বভাব নেই তার। তবু বলে ফেলেছে। তাই আর জোর খাটায় না সুহাসের থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য৷ কিন্তু সুহাসের কি আর রাগ কমে? সমস্ত রাগ, সমস্ত ঝড় উগ্রে দেয় নামীর শরীরের ওপর। অন্ধকার, বদ্ধ ঘরে ক্ষেপাটে সুহাসকে সামলানো খুব সহজ ছিল না। তবু সহজ করে নিয়েছে নামী। ভোর হলেই শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে শাওয়ার নিয়ে নেয় দ্রুত। এরপর ঘরে এসে ভেজা চুল শুকাতে নিলে সুহাস সাহায্য করতে চায়। নামী তার সাহায্য নিতে নারাজ। শরীর জর্জরিত তীব্র ব্যথায় আর মন তীব্র অভিমানে। তাই ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসে। পিছু পিছু এসে সুহাস পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে। নরম স্বরে বলে,

‘ সরি বউ। ‘

নামী চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ সুহাস ওর কানের নিচে কামড়ের দাগটায় আলতো চুমু খায়। রাতে রাগের বশে এমন অসংখ্য দাগ বসিয়েছে বউয়ের শরীরে। যা এখন স্পষ্ট দেখতে পেয়ে নিজেরি খারাপ লাগছে। নামী তার থেকে ছুটার জন্য ছটফট করে৷ সুহাস জোরপূর্বক গালে একটি চুমু দিয়ে বলে,

‘ শান ভালো ছেলে নয় নামী। আমি আগেই বলতে চেয়েছিলাম ওর থেকে সাবধানে থাকতে৷ তার আগেই ও তোমার সঙ্গে এসে ভাব জমিয়েছে আর তুমিও সায় দিয়েছ দেখে রাগটা সামলাতে পারিনি। ‘

‘ এখন আর কী চাই? রাগ কমেনি, ঝাঁঝ মেটেনি? আরো মেটাতে চাও। বিছানায় আসো তবে। এটুকুই তো জোর। ‘

নামীর গলা কাঁপছিল কথাগুলো বলার সময়৷ সুহাস জোরপূর্বক ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। দু’হাতে গাল দুটো আলতো করে ধরে কপালে চুমু খেল। বলল,

‘ সরি জান। জানোই তো আমি কেমন। তুমি তর্ক না দিয়ে শান্ত থাকলেই এতটা রিয়াক্ট হতো না। ‘

নামী চোখ ঘুরিয়ে নিল। তাচ্ছিল্য মুখে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে। সুহাস আদুরে স্বরে বলল,

‘ সরি বউ, তোমার বরটা কেমন পাগলাটে, তার রাগটাও কেমন পাগলাটে জানোই তো। ‘

‘ না জানি না৷ এখন জানছি তুমি কেমন রাক্ষস! ‘

মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে ওঠল সুহাস৷ জোরপূর্বক নামীর চুল শুকাতে সাহায্য করল। এরপর বিছানায় বসিয়ে নিজের রাগ মিশ্রিত ভালোবাসার চিহ্ন গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে আদুরে চুমু বসাল প্রতিটি স্থানে। নামীর মন তখনো গলল না। তাই বাঁধ্য হয়ে বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দু’কান ধরল সে। বলল,

‘ ক’বার ওঠবোস করলে রাগ কমবে? ‘

নামী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সুহাস মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল,

‘ বউয়ের রাগ ভাঙাতে এই সুহাস সব করতে পারে। ‘

ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল নামী। বলল,

‘ ওকে পঁয়ত্রিশবার ওঠবোস করো। ‘

ঠিক পঁয়ত্রিশ বারই ওঠবোস করল সুহাস। সেই সঙ্গে শানের থেকে কেন দূরত্ব বজায় রাখবে এবং সে ঠিক কী কী অপছন্দ করে সবটাই খুলে বলল। সবশেষে বলল,

‘ ভালোবাসি খুউব জান৷ তোমায় নিয়ে আমি ভয়ংকর পজেসিভ বউ। সবকিছুতে ছাড় পাবে শুধু আমি ব্যতীত অন্য পুরুষের সান্নিধ্যে থাকবে এ বিষয়টায় ছাড় পাবে না৷ এতে সুহাস তোমার কাছে খারাপ হোক, রাক্ষস হোক বা নরকের কীট হোক আই ডোন্ট কেয়ার। ‘

তাদের সে যুদ্ধের সমাপ্তি শেষেই সিমরানের কল আসে। কল রিসিভ করতেই শুনতে পায় সিমরানের হুহু করে কান্নার শব্দ। নিমেষেই বুক ধক করে ওঠে সুহাসের। নামী কাছেই ছিল কান্নার শব্দ শুনে সেও চিন্তিত হয় খুব৷ অন্তঃকোণে প্রশ্ন জাগে সাতসকালে মেয়েটার কী হলো হঠাৎ?

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
প্রিয় পাঠক, ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-২০+২১+২২

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২০
চোখের পলকেই অতিক্রান্ত হলো বিবাহিত ব্যাচেলর জীবনের কয়েকটা মাস। এই কয়েকমাসে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। নামী, সুহাসের সম্পর্ক মোড় নিয়েছে বন্ধুত্বে। প্রত্যহ কাজের পাশাপাশি নিয়ম করে তিনবেলা খুনশুটিও চলে তাদের। ওদের এই বন্ধুত্ব, খুনশুটির আড়ালে রয়েছে প্রগাঢ় ভালোবাসা। যা ওরা টের না পেলেও টের পায় আশপাশে থাকা প্রত্যেকে। সুহাস, নামী কেউই মুখে স্বীকার করেনি ওরা একজন অপরজনকে ভালোবাসে। অথচ অবলীলায় দু’জন স্বীকার করে তারা বন্ধু। তাদের ভেতরে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাদের সে কথায় বন্ধু মহল মুচকি হাসে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে গাঢ় বন্ধুত্ব থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। ওদের এই সম্পর্কটা বাকি বন্ধুদের কাছে বাচ্চা শিশুর মতোই অবুঝ। পৃথিবীতে কিছু মানুষ তো থাকেই যারা নিজের অনুভূতি সম্পর্কে নিজেরাই ভীষণ আনাড়ি হয়৷ এই দু’জনকে ঠিক ঐ মানুষদের তালিকাতেই রাখা যায়।

সোহান খন্দকার আর উদয়িনীর সম্পর্ক এখন শুধু কাগজে, কলমেই রয়েছে। নামী চলে যাওয়ার পর থেকে উদয়িনীর মুখোমুখি একবারই হয়েছিল সোহান খন্দকার। এরপর আর উদয়িনীর মুখোমুখি হয়নি। উদয়িনী ছুটিতে এলে সে চলে যায় ক্লিনিকে। ওখানে তার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায়ই সময় কাটায়। তবু স্ত্রীর সঙ্গে এক ঘরে থাকা তো দূরের কথা এক বাড়িতেও থাকে না৷ উদয়িনী চলে গেলে তখন বাড়িতে আসে। ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটায়৷ মায়ের শিক্ষায় বেঁকে যাওয়া দু’টো বাচ্চা যে এখন বাবার সান্নিধ্য পছন্দ করে বুঝতে পারে সে৷ তাই তো ভাগ্যের প্রতি শেষ ভরসা টুকু রেখেছে। নামীর সাথেও মাসে দু’বার দেখা করে। মেয়েটার কাছে সে অপরাধী। অথচ মেয়েটা তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় রাখেনি। যতবারই দেখা করতে গেছে ততবারই শ্রদ্ধাভরে কয়েকঘন্টা সময় কাটিয়েছে। নিজ হাতে রান্না করে যত্ন নিয়ে খাইয়েছে। ঠিক নিলুর স্বভাবের হয়েছে নামী৷ মানুষের প্রতি সম্মান, ভালোবাসা হয়েছে মায়ের মতোই দৃঢ়৷ ইদানীং সুহাসের আচরণ সোহান খন্দকারের মনে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। সুহাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঠিক নামীকে স্ত্রীর মর্যাদা দেবে। ঘরেও তুলবে৷ এটাও নিশ্চিত হয়েছে সুহাস নামীকে সম্মানের সাথে ঘরে আনতে চাইলে নামী তাকে ফিরিয়ে দেবে না৷ সে সুহাসের বন্ধু সৌধ, নিধির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে। ওদের দেয়া তথ্য মতে
এটুকু বুঝেছে তার ছেলে নামীর প্রতি ধীরেধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর নামী শুরু থেকেই দুর্বল তার আর সুহাসের সম্পর্কের প্রতি। ওদের দু’জনের এই দুর্বলতা যেদিন কঠিন ভালোবাসায় পরিণত হবে৷ সেদিন আর কারো সাধ্য থাকবে না ওদের আটকাতে। উদয়িনীর গড়ে তোলা দেয়াল যে ভাঙতে শুরু করেছে এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত।

নামী, সুহাসের বন্ধুত্বের সম্পর্কটি স্বাভাবিকই চলছে৷ স্বাভাবিক আইয়াজ, ফারাহ এর সম্পর্কও। তারা একটি স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্কে রয়েছে। ফারাহর কোনো পরিবার নেই। সে বোনের পরিবারে আগাছার মতো জীবনযাপন করছে৷ মেয়েটা চাপা স্বভাবের হওয়াতে তেমন কিছুই শেয়ার করে না৷ কিন্তু বুদ্ধিমান আইয়াজ বুঝতে পারে অনেক কিছুই। তাই সে সবসময় ফারাহকে ভরসা দেয়। কোনো প্রকার দুঃশ্চিন্তা না করতে৷ মাত্র কয়েকটা বছর। ইন্টার্নির সময়ই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে তার আপু আর দুলাভাইয়ের কাছে। পারিবারিক ভাবে খুব ধুমধাম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে তারা৷ আইয়াজের থেকে এই ভরসা পেয়ে ভারি বুকটা হালকা হয় ফারাহর। পরোক্ষণেই আবার সুক্ষ্ম আতঙ্ক জেঁকে বসে। এই আতঙ্কের পেছনে থাকা করুণ গল্পটা জানার পর আইয়াজ তাকে ভালোবাসবে তো? গ্রহণ করতে পারবে তো? সে যে কোনোকিছু গোপন রেখে আইয়াজের বউ হতে চায় না৷ পৃথিবীর সবার কাছে সেই নির্মম সত্যিটুকু গোপন রাখলেও আইয়াজের থেকে গোপন রাখার শক্তি ধীরেধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। তাদের ভালোবাসা যত গভীর হচ্ছে ভেতরের যন্ত্রণাটা ততই তীব্র হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতেই ফারাহ সিদ্ধান্ত নেয় আর এই সম্পর্ক এগোবে না৷ সে আইয়াজের যোগ্য না। আইয়াজ তার থেকে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত অনড় থাকতে দেয় না আইয়াজ। দু’দিন কথা না বললেই কেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না সে সবকিছু ঠিকঠাক করে, যতক্ষণ না স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবে, ততক্ষণ যেন পুরো দুনিয়াটাই অস্থির করে রাখে। এই পাগলটাকে কীভাবে ছাড়বে সে? কীভাবেই বা বলবে সেই ভয়ানক সত্যিটা? এসব নিয়েই প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তার মধ্যে জীবনযাপন করছে ফারাহ। সুযোগ পেলেই অদ্ভুত আচরণ করে। যেন আইয়াজ তাকে ভুল বুঝে দূরে চলে যায়। কিন্তু প্রতিবারই ছেলেটা তাকে ভালোবাসার বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে বশে এনে ফেলে। এই ছেলেটার ভালোবাসার সম্মোহনী শক্তি এতটাই প্রখর যে চোখে চোখ রাখলেই পৃথিবী ভুলে গিয়ে শুধু ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
***
নিধির তরফ থেকে এখন পর্যন্তও সাড়া পায়নি সৌধ৷ রোজ রোজ এই নিয়ে অভিযোগ করতে করতে সৌধ বিরক্ত হয়ে ওঠেছিল। অভিযোগ শুনতে শুনতেও বিরক্তি এসে গিয়েছিল নিধির। তাই একদিন ক্লাস শেষে পুকুর ঘাটে গিয়ে দাঁড়ায় নিধি৷ সৌধকে একা আসার আহ্বান জানায় সে। কথানুযায়ী সৌধ একাই আসে। সেদিন নিধি ঠাণ্ডা মাথায় শান্ত সুরে সৌধকে বোঝায়,

‘ সৌধ, তোদের মতো আমার জীবন নয়৷ নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য অনেক স্ট্রাগল করতে হচ্ছে আমায়৷ জন্মদাতার বিরুদ্ধে গিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি। মা আর মামার সাহায্যে পড়াশোনা করছি। এই সময়টা আমি অন্যকিছুতে ব্যয় করতে পারব নারে। আজ যদি তোর সাথে সম্পর্ক গড়ি কাল আমার বিবেক আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে৷ আমি কি এসব করতে এসেছি? আজকাল অনেক মেয়ে আছে যারা পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে দূরে গিয়ে প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এসব মেয়েদের নিয়ে সমাজে খুব চর্চাও হয়। আমি নিজেও একসময় চর্চা করেছি৷ বাবা, মা যখন এসব ইস্যু দেখিয়ে আমাকে দূরে পড়তে পাঠাতে অমত করছিল। আমি জোর গলায় বলেছি, আমি অমন নই। আমি অমনটা কখনোই করব না৷ সেই আমি যদি আজ তোর সাথে সম্পর্কে জড়াই আর এসব যদি বাবা, মা বা মামা জানতে পারে পরিস্থিতি কতটা বিগড়ে ওঠবে জানিস না। তাছাড়া তোকে আরো একটা কথা বলা হয়নি, সেম এজ রিলেশনে আমি বা আমার পরিবারের কেউ ভরসা করে না। কারণ আমার বড়ো বোন ডিভোর্সি। নিজে পছন্দ করে ক্লাসমেটকে বিয়ে করেছিল আপু। দু’বছরের মাথায় বোঝাপড়ার অভাবে সে সম্পর্কটা আর টিকাতে পারেনি। তুই বুঝতে পারছিস আমার কথা? ‘

সৌধ সমস্ত কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। এরপর অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বলেছিল,

‘ সব বুঝতে পারছি। ‘

নিধি ওর ভাবমূর্তি দেখে ব্যাকুল স্বরে বলল,

‘ আমি আমাদের বন্ধুত্বটুকু নষ্ট করতে চাই না সৌধ৷ চাই না তোর মতো বন্ধুকে হারাতে। ‘

নিধির সে কথা শুনে আচমকা ওর দুগালে আলতো করে দু-হাত রাখে সৌধ। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বলে,

‘ আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না। আমাকে তুই কখনোই হারাবি না নিধি। আজ আমি তোকে কথা দিচ্ছি, তোর বিবেক তোকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না৷ তোর পারিবারিক পরিস্থিতিও বিগড়াবে না। ঠিক এমন করেই তোকে আমার বউ করব৷ আর রইল সেম এজের বিষয়টা। এমন সময় তোকে বউ করব যে সময় এই ব্যাপারটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা থাকবে না। আজ আমি তুই মেডিকেল তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। আর মাত্র দু’টো বছর। এরপর আর এই পরিচয় থাকবে না। কার্ডিওলজিস্ট সৌধ চৌধুরী বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাবে গাইনোকলজিস্ট জান্নাতুল ফেরদৌস নিধির পরিবারে, ইনশাআল্লাহ। ‘

দৃঢ়চিত্তে বলা সৌধর সে কথা শুনে বিস্মিত হয় নিধি। রেগেমেগে বলে,

‘ তুই তোর জেদ অটল রাখবি? ‘

সৌধ স্মিত হেসে উত্তর দেয়,

‘ ভুল হলো ম্যাডাম, জেদ নয় ভালোবাসা অটল রাখব। ‘

‘ কিন্তু আমি তোর প্রতি ঐরকম ভালোবাসা ফিল করি না। ‘

অকপটে জবাব সৌধর,

‘ আপাতত ওসব ফিল করার প্রয়োজন নেই। মন দিয়ে পড়াশোনা কর, আর আমাকেও করতে দে। ‘

নিধির গাল টিপে কথাটা বলেই চোখ টিপল সৌধ। নিধি নাক ফুলাল এতে৷ তা দেখে পুনরায় বলল,

‘ যা বাসায় যা। ওরা দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। ‘

নিধি উঁকি দিয়ে দেখল কয়েকহাত দূরে আম গাছের পেছনে দশবারো জন ছেলে দাঁড়িয়ে। আইয়াজ, সুহাস নেই ওখানে৷ আজিজ সহ আরো অনেক পরিচিত মুখ। নিধির ভালো লাগে না ওদের। কিন্তু সৌধর আশপাশে সব সময় এসব ছেলেপুলে থাকেই। যতই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকুক। সেফটি নিয়ে চলতেই হয় ওকে।
***
আজ মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে নামীর। পড়ার টেবিলে দু’হাতের কনুই ভর করে হাতের তালুতে থুতনি রেখে বসে আছে সে৷ প্রাচী তিন মগ কফি বানিয়ে একটা নামীকে দিয়ে বলল,

‘ মুড অফ নাকি বনু? এটা খাও মন, মাথা সবই ফ্রেশ হয়ে যাবে। ‘

মৃদু হেসে কফির মগ হাতে নিল নামী। বলল,

‘ থ্যাংকিউ সো মাচ আপু, খুব প্রয়োজন ছিল এটার৷ কিন্তু আলসেমির জন্য করা হচ্ছিল না। ‘

‘ মেয়ে, ফর্মালিটি রাখো। ক্যাম্পাসে সিনিয়র হলেও এখানে ওসব মেইনটেইন করার প্রয়োজন নেই। আলসেমি লাগছিল মুখে বলতেই পারতে, এই প্রাচী যা এক মগ কফি বানাই আন। ‘

নামী হেসে ফেলল। বলল,

‘ তাই বলে নাম ধরে তুই, তুকারি করতে বলো না। এটা আমাকে দিয়ে হবে না। ‘

বিছানায় বসে পড়ছিল নিধি। হঠাৎ ঘড়ির টাইম দেখে প্রাচীকে ধমক দিল,

‘ কিরে কফি দিবি না ওখানেই দাঁড়াই থাকবি। ‘

‘ আসতেছি, আসতেছি। ‘

প্রাচী ছুটে গেল। নামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা দু’টো ভাঁজ করে চেয়ারে তুলে বসল। এরপর কফিতে চুমুক দিতে দিতে মোবাইল হাতে নিল। সুহাসের নাম্বার ডায়াল লিস্টে দেখে ভাবল কল করবে কিনা। আবার কি যেন ভেবে আর কল করল না। ইয়ারফোন খুঁজে বের করে কানে গুঁজল। ইউটিউবে ঢুকে রবীন্দ্র সংগীত বের করে শুনতে লাগল একের পর এক।

প্রাচী, নিধি বিছানায় পাশাপাশি বসে। নামীকে খেয়াল করে মিটিমিটি হাসছে দুজন। চুপিচুপি নিজেদের মধ্যে ম্যাসেজিং করে কথাও বলছে তারা। প্রাচী বলল,

‘ আর দেড়ঘন্টা দোস্ত। ‘

প্রাচীর ম্যাসেজের রিপ্লাই করল নিধি,

‘ সিনু আর সৌধ প্র্যাক্টিকেলে সুহাসকে বোঝাচ্ছে। আমি বলেছি ভিডিয়ো ক্লিপ পাঠাতে। ‘

কথাটা বলতে বলতেই হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভিডিয়ো পাঠাল আইয়াজ। যেখানে সৌধ সিমরানকে প্রপোজ করে সুহাসকে শেখাচ্ছে ঠিক কীভাবে নামীকে মনের কথা জানাবে৷ ধূসর রঙের টিশার্ট পরনে সৌধর। সিমরানের পরনে কালো রঙের টিশার্ট আর জিন্স প্যান্ট৷ গলায় একটি জর্জেট ওড়না ঝুলানো৷ ব্রাউন কালার থ্রি স্টেপ চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সৌধর মুখোমুখি। সৌধ ধীরেধীরে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই সিমরান চিল্লিয়ে ওঠল।

‘ না না এভাবে না। এটা এখন ওল্ড স্টাইল তুমি দাঁড়াও, দাঁড়িয়ে বলো। ‘

সৌধ দাঁড়াল। একহাত পকেটে ঢুকিয়ে অন্যহাত মুঠো করে সিমরানের দিকে এগিয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতো সে মুহুর্তে আবারো চ্যাঁচিয়ে ওঠল সিমরান,

‘ থামো থামো। আমাকে তোমার থেকে বেশিই শর্ট লাগছে। নামী আপু ব্রোর চেয়ে এত্ত শর্ট না৷ ওয়েট আমি হিল পড়ে আসছি। ‘

কথাটা বলেই সিমরান দৌড় দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সৌধ চোখ কটমট করে তাকাল সুহাসের দিকে। আর ভিডিয়ো করতে থাকা আইয়াজের দিকে। বলল,

‘ এত আয়োজন করার কী আছে বুঝতে পারছি না। মেয়েদের এই এক সমস্যা সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। ‘

সুহাস বলল,

‘ এই একদম সিনুর ওপর বিরক্ত হবি না। ও যে আমাদের হেল্প করতে রাজি হয়েছে এই তো অনেক। ‘

আইয়াজ বলল,

‘ অভিনয় নিখুঁত না হলে সুহাসের মতো আনাড়ি প্রেমিক শিখবে কীভাবে? সিনুর আয়োজন ঠিকই লাগছে আমার। মেয়েদের বুদ্ধি ছাড়া পুরুষ অচল আবারো প্রুফ হলো। ‘

সৌধ ঠোঁট কামড়াল। আইয়াজ যেদিন থেকে ফারাহর প্রেমে পড়েছে সেদিন থেকে মেয়েদের নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করে। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখন এসব ভাবার সময় নয়। তাই বলল,

‘ আমি বা সিনু কেউই প্রেমটেম করিনি। তবু আমরা এই শা’লাকে প্রেম শেখাচ্ছি। তোর তো বুড়িগঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে মরা উচিতরে। ‘

শেষ কথাটা সুহাসকে ভর্ৎসনা করে বলল সৌধ। সুহাস চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘ কথায় কথায় শা’লা বলবি না। তোর নিধি আমার বোন না যে আমি তোর শা’লা হবো। আর আমার বোনকে তোর মতো অশ্লীলের কাছে দিবও না। ‘

সৌধ তেড়ে এলো সুহাসের দিকে। বলল,

‘ এই শা’লা আমি অশ্লীল? তাহলে তুই কি তুই তো ইমরান হাসমির সিকোয়েন্স! ‘

দু’জনের মা’রামারি লাগল প্রায় মুহুর্তে হিল পড়ে ত্বরিত সামনে এসে দাঁড়াল সিমরান। দুই বন্ধু মুখে শরীর, মুখ উভয়তেই লাগাম টানল। সৌধ আর সময় নষ্ট না করে প্রপোজ করে দেখাল সিমরানকে,

‘ ইহজনম এবং পরজনম দু’জনমের জন্যই আমার হৃদয়কে মুঠো ভর্তি করে তোমার তরে সমর্পণ করলাম। ‘

সিমরান বিগলিত চিত্তে সৌধর মুঠো ভরা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বারকয়েক ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর নিজের হাত মুঠো করে বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বলল,

‘ গ্রহণ করলাম। ‘

পাশ থেকে আইয়াজ চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ ফাটাফাটি। ‘

ভিডিয়োর শেষ হতেই নিধি, প্রাচী দু’জনই চিল্লিয়ে ওঠল,

‘ দারুণ অভিনয়। ‘
***
ঠিক বারোটা সময় নামীর ফোনে একটি ম্যাসেজ এলো,

‘ হ্যাপি ফার্স্ট মিটিং নামীদামি। ‘

বই থেকে মুখ তুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল নামীর। এরপর আরো একটি ম্যাসেজ এসে হৃদয় নাড়িয়ে তুলল তার।

‘মিসেস সুহাসিনী… হ্যাপি ফার্স্ট ওয়েডিং এনিভার্সারি। ‘

দ্বিতীয় ম্যাসেজটা দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠল সে। অতিরিক্ত কম্পনের ফলে দু’হাতে ফোন ধরে রাখতেও হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্থায় এলো
তৃতীয় ম্যাসেজটি। যেটা দেখে দু’চোখ উপচে জল গড়াতে গড়াতে আকস্মিক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল নামী।

‘ টু ডে ইজ দ্য ডে টু কিস ইয়র ফরহ্যাড মাই বেগাম ‘

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২১

ঠিক বারোটা সময় নামীর ফোনে একটি ম্যাসেজ এলো,

‘ হ্যাপি ফার্স্ট মিটিং নামীদামি। ‘

বই থেকে মুখ তুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল নামীর। এরপর আরো একটি ম্যাসেজ এসে হৃদয় নাড়িয়ে তুলল তার।

‘ মিসেস সুহাসিনী… হ্যাপি ফার্স্ট ওয়েডিং এনিভার্সারি। ‘

দ্বিতীয় ম্যাসেজটা দেখে থরথর করে কেঁপে ওঠল সে। অতিরিক্ত কম্পনের ফলে দু’হাতে ফোন ধরে রাখতেও হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্থায় এলো
তৃতীয় ম্যাসেজটি। যেটা দেখে দু’চোখ উপচে জল গড়াতে গড়াতে আকস্মিক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

‘ টু ডে ইজ দ্য ডে টু কিস ইয়র ফরহ্যাড মাই বেগাম ‘

কান্নায় ডুবে গিয়ে চতুর্থ ম্যাসেজটি দেখতেই পেল না। নিধি, প্রাচী এক ছুটে এসে দু’পাশ থেকে নামীর দু’কাধ জাপ্টে ধরল। একসুরে বলল,

‘ হ্যাপি এনিভার্সারি বনু, হ্যাপি এনিভার্সারি। ‘

আকস্মিক হুঁশ ফিরল নামীর। এ কী করছে সে? কাঁদছে কেন? হঠাৎ এতটা ভেঙেই বা পড়ল কেন? সে তো এমন দুর্বল নয়। তবে কি ভালোবাসা নামক অনুভূতিটুকু তার মতো শক্ত ধাঁচের মেয়েকেও দুর্বল করে ফেলল? মুখ থমথমে হয়ে গেল তার। প্রাচী, নিধি দু’জন তাকে ছেড়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

‘ তোমার আর সুহাসের সম্পর্ক আজ এক বছরে পদার্পণ করল। ‘

ওদের সে কথায় কর্ণপাত করল না নামী। তার মনের গভীরে চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। এটা কী করে ফেলল সে? এবার যদি এ কথা সুহাসকে জানানো হয় খুব বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি হবে। ছেলেটা খুব খুঁচিয়ে কথা বলতে জানে। তাছাড়া সে ওর জন্য কেঁদে গা ভাসিয়েছে এ কথা জানলে অহংকারে মাটিতে পা’ই ফেলল না। দেখা গেল আকাশে ভাসতে ভাসতে তার মাথার ওপর থুথু নিক্ষেপ করতে শুরু করবে! রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল নামী। সুহাসের কাছে নিজের দুর্বলতা কক্ষনো প্রকাশ করবে না সে। কক্ষনো না। ত্বরিত সামলে নিল নিজেকে। নিধি টেবিলে রাখা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে নামীকে দেয়া সুহাসের চতুর্থ ম্যাসেজটি দেখতে পেল।

‘ আ’ম ওয়েটিং নামী। নিচে এসো। ‘

ম্যাসেজটা দেখে নিধি বলল,

‘ ঐ দেখো রোমিও হাজির। ‘

প্রাচী অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ এতদ্রুত? ‘

‘ আসবে না? ‘

হাসতে হাসতে প্রাচীকে এ প্রশ্ন করেই নামীকে বলল,

‘ বনু তাড়াতাড়ি ড্রেস চেঞ্জ করে নিচে যাও। সুহাস অপেক্ষা করছে। ‘

নামীর অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া সীমাহীন বিস্ময়ে ভরে ওঠল। ঢোক গিলল রয়েসয়ে। বলল,

‘ সুহাস এসেছে! ‘

প্রাচী নিশ্চিত হতে বেলকনির দরজা খুলে উঁকি দিল গ্রিলের ফাঁকে। অমনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সুহাসের বেশভূষা দেখে কপালে পড়ল সুক্ষ্ম ভাঁজ। কবে হবে এই ছেলেটার বুদ্ধি? এমন প্রশ্নে জর্জরিত হলো হৃদয়। তাদের সবচেয়ে লম্বা বন্ধু সুহাস। অথচ ওর বোধবুদ্ধি সব হাঁটুর নিচে। তার দিদা ঠিকই বলে লম্বা ছেলেদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুর নিচে। সুহাসই তার চাক্ষুুস প্রমাণ৷ বিবাহবার্ষিকীতে বউকে উইশ করতে এসেছে। তার গেটআপ থাকবে অন্যরকম। অথচ এ ছেলে কিনা টিশার্টের সাথে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে এসেছে! চোখমুখ কুঁচকে ফেলল প্রাচী। তক্ষুনি ফোন করল সুহাসকে। বলল,

‘ এই ছ্যাড়া, তুই থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ছস কেন? এইভাবে কেউ কোনো মেয়েকে প্রপোজ করতে আসে? ‘

‘ বইন যা গরম পড়ছে। ফুল প্যান্ট পড়ে বেরোনোর সাহস পাইনি। সৌধও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আসছে। ‘

‘ আরে গাধা ওর ব্যাপার আর তোর ব্যাপার এক হলো নাকি? আজ তোর ম্যারেজ ডে। বউকে উইশ এণ্ড প্রপোজ করতে আসছিস। ‘

‘ ধূরর, প্রবলেম নেই। আমি তো আর কোনো অচেনা মেয়ে বা গার্লফ্রেন্ডকে প্রপোজ করতে আসিনি। এসেছি বউকে প্রপোজ করতে। থ্রি কোয়ার্টার পড়ি, হাফ পড়ি বা কিছু নাই পড়ি তাতে কি আসে যায়। ‘

কথাগুলো বলেই দুষ্টুমি ভরে হাসল সুহাস৷ প্রাচী বিড়বিড় করে বলল,

‘ অসভ্য ছেলে ! ‘

‘ আমার সভ্য বউটাকে কুইকলি পাঠারে জান। ধৈর্যে কুলাচ্ছে না আর৷ ‘

প্রাচীর সংবিৎ ফিরল। পিছনে তাকিয়ে দেখল নিধির উৎসুক চোখ আর নামীর থমথমে মুখ। অমনি ফোন কেটে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠল,

‘ ঐ তো আমার দোস্তটা দাঁড়াই আছে। ‘

প্রাচীর কথা শুনে নামীর হৃৎস্পন্দন যেন লাফাতে শুরু করল। সুহাস এসেছে! আজ তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। শুধু ম্যাসেজ করে উইশ নয় সরাসরি দেখা করতেও চলে এসেছে। আবারো কান্না পেয়ে গেল তার। অসম্ভব সে কান্না কেন পেল? খুশিতে কী? এই খুশি কীসের আভাস? তার আর সুহাসের সম্পর্কের মোড় বদলে দেয়ার? নিধির কথায় ধ্যান ভাঙল নামীর।

‘ কোনো ভয় নেই, পুরো এলাকা ম্যানেজ করা আছে আজ। যতখুশি এই চত্তরে দু’জন সময় কাটাও। ‘

প্রাচী ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

‘ তুমি রাজি থাকলে আমরা কিন্তু আজ রুম বুকও করে ফেলতাম! ‘

মৃদু কম্পন খেলে গেল নামীর শরীরে। লজ্জায় মস্তক নত হলো কিঞ্চিৎ। নিধি পুনরায় চাপাস্বরে তাড়া দিল তাকে,

‘ কী হলো নামী, ছেলেটা অপেক্ষা করছে তো। ‘

ছেলেটা অপেক্ষা করছে তো। এই বাক্যটি যেন কর্ণে নয় একদম বুকে গিয়ে লাগল নামীর। অতীতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা, বর্তমানের স্রেফ বন্ধুত্ব সব তুচ্ছ করে কাপড় বদলে, গেটের চাবি নিয়ে ছুটে নিচে চলে গেল৷

গলির মোড়ে গাড়ির ভেতর শুয়ে আছে সৌধ। আজ সে ছোটো কাকার গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। তাদের বাড়িতে দু’টো গাড়িতে এসি রয়েছে এক বাবা দুই ছোটো কাকা। আজ ছোটো কাকার গাড়ি ফ্রি ছিল। তাই তারটা নিয়েই বন্ধুর বিয়ের প্রথম বছর পালন করতে এসেছে। প্রাচী জানাল নামী নিচে নেমেছে। অর্থাৎ সব ঠিকঠাক। এবার সে আরামসে ঘুম দেবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আজিজ। সে এলাকার কয়েকটা ছুটকো নেতাদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। সৌধ গলা উঁচিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল,

‘ এই আজিজ সুহাস গেছে? ‘

‘ হ’রে মাম্মা গেছে। ‘

‘ খেয়াল রাখিস। ‘

আজিজের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা বলল,

‘ ভাই আপনি চিন্তা না করে চিল করেন। আমরা আছি। ‘

সৌধ বাঁকা হাসল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ তোদের না থেকে উপায় আছে? পকেট ভরিয়েছি কি আর এমনি এমনি। ‘
***
গেট খুলে পুনরায় তালাবদ্ধ করল নামী। জড়ীভূত হয়ে দুরুদুরু বুকে তাকাল সুহাসের দিকে। ল্যামপোস্টের আলোয় লম্বাটে দেহটি দেখেই হৃৎস্পন্দন যেন থমকে গিয়েও আবার চঞ্চল হয়ে ওঠল। সুহাস ইশারা করল কাছে যেতে। নামী ধীরে ধীরে এগুতে লাগল। অদ্ভুত এক সম্মোহনে ডুবে রইল সে। নামীর অগ্রগতি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। ঠোঁট জুড়ে মুচকি মুচকি হাসি লেপ্টে দাঁড়াল রাস্তার মাঝখানে। দীর্ঘ কয়েকমাস যাবত ব্যায়ামের মাধ্যমে তৈরি দেহের বুক টান টান করে সে দণ্ডায়মান রইল। যেন নিজের স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখাতে ভীষণ মরিয়া সে। মরিয়া থাকবে না কেন? এসব যে শুধুই নামীর জন্য। তার প্রাক্তনরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বর্তমান লুক দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অরিন তো সেদিন কমেন্টেই বলল,

‘ বলেছিলাম আমি নিয়মিত জিমে যাও। নিজের প্রতি যত্নশীল হও। এবার আমার কথা ফলল তো? কীসে তোমার ভালো, কীসে তোমার মন্দ এই অরিন ছাড়া আর কে বুঝবে? ‘

কমেন্টটা সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করে দিয়েছে সে। এতদিন ম্যাসেন্জারে ব্লক থাকলেও সেদিন সরাসরি ফেসবুক থেকেই ব্লক করেছে। তার এই উন্নতি সব মেয়েদের নজড়ে পড়েছে শুধু নামী ছাড়া৷ এখন পর্যন্ত নামী কোনো প্রকার মন্তব্য করেনি। অথচ সে মুখিয়ে আছে এই মেয়েটার থেকে কিছু শোনার জন্য।

নামী এসে সামনে দাঁড়াতেই প্রকৃতির স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে দিল সুহাসকে। তার কপাল জুড়ে থাকা সিলকি চুলগুলো উড়তে লাগল সে বাতাসে। উড়ল নামীর পিঠ জুড়ে থাকা খোলা চুলও। আচমকা মাথা তুলে আকাশ পানে তাকাল সুহাস। ঘন মেঘে ঢাকা আকাশটায় না আছে চন্দ্র, না আছে নক্ষত্রের মেলা। আকাশের মুখ ভার বুঝতে পেরে দৃষ্টি নামাল। তাকাল নামীর স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে। নামী দু’বার পলক ফেলল। সুহাস দেখল ঘন পাপড়ি যুক্ত কাজল কালো চোখ দু’টির নমনীয়তা।ঢোক গিলে ত্বরিত কানের নিচে চুলকে নিয়ে বলল,

‘ তুমি এসেছ? ‘

বোকার মতো প্রশ্নটি করে আপনমনেই গালি দিল নিজেকে। কয়েক পল চোখ বন্ধ করে থেকে মনে করার চেষ্টা করল সৌধ, আইয়াজের শেখানো বুলি গুলো। এরপর চোখ খুলল। নামী একই ভঙ্গিতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তাকিয়ে আছে তার পানে। আবারো ঢোক গিলল সুহাস। আপাদমস্তক নামীকে দেখে নিয়ে উদ্যত হলো হাঁটু গেড়ে বসার। আচমকা প্রকৃতির শান্তরূপ অশান্ত হতে শুরু করল। বাতাসের বেগ বেড়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে প্রকৃতিতে। আবারো আকাশে চোখ তুলল সুহাস। বলল,

‘ বৃষ্টি আসবে নাকি! ‘

নামী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। সে নিঃশ্বাসের শব্দে সুহাস তাকাল ওর দিকে। বলল,

‘ শুভ বিবাহবার্ষিকী নামী। ‘

নামীর হাঁটুতে কিঞ্চিৎ কম্পন অনুভূত হলো। নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রেখে সে বলল,

‘ সেম টু ইউ সুহাস। ‘

ঈষৎ হেসে চারপাশে দৃষ্টি ঘোরাল সুহাস। পকেট হাতিয়ে কিছু একটা বের করে হাত মুঠো করে রাখল। নামী হঠাৎ চমকে ওঠল শরীরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ফোঁটা পড়ায়। বলল,

‘ বাসায় চলে যাও সুহাস বৃষ্টি পড়ছে! ‘

কথাটা বলেই পিছু ঘুরল সে। উদ্যত হলো ফিরে যেতে। সুহাস কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হলো এতে। পিছন থেকে হাত টেনে ধরল নামীর। বলল,

‘ এটাত হয় না নামীদামি। বৃষ্টি আসুক, সুনামি আসুক, ভূমিকম্প হয়ে পৃথিবী ধসে পড়ুক। তবু আমি যাব না। আর না তোমাকে যেতে দিব। ‘

নামী বিস্ময় ভরে তাকাতেই সুহাস হ্যাঁচকা টানে ওকে নিজের সম্মুখীন করে দাঁড় করাল। হাতে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করল নামী। বড্ড জোর খাঁটিয়ে ধরেছে ছেলেটা। বুঝেই চাপা গলায় বলল,

‘ এত জোরে ধরেছ কেন? ছাড়ো, যাব না আমি ছাড়ো। ‘

ছেড়ে দিল সুহাস। ততক্ষণে তুমুল বর্ষণ শুরু হয়েছে। গা ভিজে কাপড় লেপটে যাচ্ছে শরীরে। নামী হতভম্ব মুখে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। আর সুহাস রয়েসয়ে হাঁটু গেড়ে বসল তার সামনে। যদিও সৌধ, সিমরান এটি শেখায়নি তবু নিজ গরজে বসল। অবাক হওয়ার শীর্ষে পৌঁছে গেল নামী। দৃষ্টি কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সুহাস পলকহীন নামীর সিক্ত মুখের অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ শত চেষ্টা করেও ভালোবাসি বলতে পারিনি। চাইও না বলতে। লাইফে এত মেয়েদের ভালোবাসি শব্দটা বলেছি যে আসল জনকে বলতে এলেই দ্বিধায় পড়ে যাই। আই লাভ ইউ শব্দটাকে আমি হাঁট, বাজারের জিনিসের মতো সস্তা করে ফেলেছি। তাই হয়তো তোমার মতো মূল্যবান মানুষটাকে ওটা বলতে এত দ্বিধা কাজ করে আমার৷ ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসা যায়। আই লাভ ইউ শব্দটি ছাড়াও প্রিয়জনকে প্রপোজ করা যায়। নামীদামি,
ইহজনম এবং পরজনম দু’জনমের জন্যই আমার হৃদয়কে মুঠো ভর্তি করে তোমার তরে সমর্পণ করলাম। ‘

ডান হাত মুঠো বন্দি করে উঁচু করতেই চমকে গেল নামী। এ কোন সুহাসকে দেখছে সে? আজ কোন সুহাস তার সম্মুখে এসেছে? কী বলছে এসব সে? হৃদয়কে মুঠোভরে সমর্পণ এও সম্ভব! দু-চোখ জলে ভরে তা গাল বেয়ে পড়তে লাগল নামীর। মৃদু আলোয় নামীর মুখে সুহাস শুধু বৃষ্টির পানিই দেখতে পেল। বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানিও যে বেরুচ্ছে তা বুঝল তখন যখন নামী ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল,

‘ সেই স্বপ্ন দেখিয়ো না সুহাস, যে স্বপ্ন একদিন দুঃস্বপ্ন হয়ে ভেঙে যায়। ‘

সুহাস প্রতিবাদ করে বলল,

‘ ভাঙবে না নামী। ক্যান ইউ ট্রাস্ট মি। ‘

ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। প্রচণ্ড শীত লাগল নামীর। এই শীত শুধু দেহ নয় মনেও পৌঁছে গেল। সুহাস হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল নামীর এক পা। নামী আঁতকে ওঠে পিছু হাঁটতে নিতেই সুহাস টেনে ধরল। বোঝাল পা উঁচু করতে সে কোনো বাঁধা শুনবে না আজ। নামী থেমে গেল৷ অবাধ্য হতে ইচ্ছে করল না আর। আজ যেন তার বাধ্য হওয়ার দিন। সুহাসের বাধ্য বধূ রূপে ধরা দেয়ার দিন৷ সুহাস নিজের হাঁটুর ওপর নামীর পা তুলে ভেজা পাজামা একটু উপরে তুলল। এবারে ভয়ানক লজ্জা পেল নামী। কী করছে এসব সুহাস? বোধগম্য হলো না তার। সুহাস অতি যত্ন নিয়ে বা হাতে থাকা একটি রূপোর পায়েল পরিয়ে দিল পায়ে। বলল,

‘ গার্লফ্রেন্ডদের প্রপোজ করলেও বউকে প্রপোজের ব্যাপারে বড্ড আনাড়ি আমি৷ তাই কীভাবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ প্রাচী একটা গানের ভিডিয়ো পাঠাল। হিরো হিরোইনকে এভাবেই পায়েল পড়াচ্ছিল। তাই এভাবেই ট্রাই করলাম। ‘

কথাগুলো বলেই ওঠে দাঁড়াল সুহাস। বৃষ্টিতে ভেজা নামীর অধরকোণে তাকিয়ে পুনরায় বলল,

‘ স্বীকৃতি দেইনি বলে যে বিয়েটা আড়ালে পড়ে আছে। তা আমি প্রকাশ্যে আনতে চাই। কেন জানো? তোমার আশপাশে ওকে সহ্য করতে পারছি না। কেন পারছি না জানো? বিকজ ইউ আর মাই ওয়াইফ৷ মিসেস. সুহাসিনী। ‘

‘ ও ‘ শব্দটায় ভড়কে গেল নামী। কার কথা বলছে সুহাস? নামীর মুখো ভঙ্গি দেখে ফিচেল হাসল সুহাস। বলল,

‘ কুশলের থেকে দূরে থাকবে। ওকে জানিয়ে দেবে ইউ আর ম্যারেড, এণ্ড আ’ম ইউর হাজব্যন্ড। ‘

মুখ হা হয়ে গেল নামীর। কুশল তার ক্লাসমেট, ভালো বন্ধুও। গতমাসে হুট করেই প্রপোজ করে বসে ছেলেটা। বিষয়টা খুবই গোপনে ঘটেছে। তবু সুহাস জেনে গেছে সবটা। তীব্র অস্বস্তিতে পড়ে গেল নামী। বলল,

‘ আসলে ব্যাপারটা। ‘

‘ আসলে, নকলে শুনতে চাই না। যা বললাম মাথায় রাখবে। ‘

উত্তর দিল না নামী। সুহাস এ প্রসঙ্গে আর কথা বলল না। আপাতত নামীকে নিয়ে উথাল-পাতাল বৃষ্টিতে গা ভেজাতে ইচ্ছে করল। দুলতে ইচ্ছে করল প্রগাঢ় প্রণয় তরঙ্গে। যে ইচ্ছেটাকে উস্কে দিল আকস্মিক বজ্রপাত ঘটে ল্যামপোস্টের বাতি নিভে গিয়ে। নামী অন্ধকার ভয় না পেলেও বজ্রপাত ঘটে বাতি নিভে যাওয়ার ভীত হলো। আতঙ্কিত স্বরে ডাকল,

‘ সুহাস! ‘

তৎক্ষনাৎ মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জানিয়ে নামীর হাত চেপে ধরল সুহাস। কণ্ঠে গভীরতা মিশিয়ে বলল,

‘ এই তো। ‘

হৃৎস্পন্দন থেমে গেল নামীর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাথা ভনভন করতে লাগল। অন্ধকার, তুমুল বর্ষণে সুহাসের হাতের স্পর্শে যেন আরো গভীরতা মিশে রইল। টের পেল নামী। দুরুদুরু বুকে কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘ বাসায় যাব, ফিরে যাও তুমি। ‘

‘ যাব তো। ‘

সহসা ভেজা, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল নামীর মুখশ্রীতে। শিউরে ওঠে পিছুটান দেওয়ার চেষ্টা করল নামী৷ টের পেয়ে এক হাতে ওর কটিদেশ বেঁধে ফেলল সুহাস। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ভারিক্কি স্বরে বলল,

‘ ডোন্ট মুভ নামী। ‘

নামী শুনল না। শক্তি প্রয়োগ করল খুব। সুহাস অনড় হয়ে নামীর কপালে অধর স্পর্শ করে পুনরায় বলল,

‘ ডোন্ট মুভ জান। ‘

শরীর জুড়ে ঝংকার খেলে গেল নামীর। দু’হাতে সুহাসের বাঁধন আলগা করার চেষ্টা করে কাঁপা গলায় বলল,

‘ আমরা রাস্তায় আছি সুহাস। কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ। ‘

এ কথায় ক্ষেপে ওঠল সুহাস। হাতের বাঁধন দৃঢ় করে নামীর নাকে নাক ঠেকাল। ঠোঁটের কাছাকাছি ঠোঁট নিয়ে বলল,

‘ আর কত কন্ট্রোল করব? কন্ট্রোলে আছি বলেই বিয়ের এক বছর পরও তুমি স্টিল ভার্জিন। ‘

‘ কী আশ্চর্য পাগলামি করছ কেন? ‘

‘ চুপপ, জাস্ট দু’মিনিট। ‘

‘ মানে! ‘

‘ কিস অন দ্য লিপ। ‘

‘ সুহাস… ‘

‘ অনুমতি দেবে না? ভেবে বলো। আমি অতটা ভদ্র নই যে অনুমতি না দিলে খালি মুখে ফিরে যাব৷ জোর করেই কিস করে দিব৷ এমন ভাবে করে দিব দুদিন কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। ‘

‘ ছিঃ ‘

মুখ ঝামটা মেরে দিল নামী। সুহাস বলল,

‘ তার মানে তুমি অনুমতি দেবে না? ‘

নামী কড়া গলায় বলল,

‘ না। ‘

‘ অর্থাৎ কঠিন চুমু চাচ্ছ? গোটা এক বছর জমিয়ে রাখা বিধ্বস্ত চুমুর বর্ষণ? ‘

হৃৎস্পন্দন ধড়াস ধড়াস শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠল। নামী আর শক্তি প্রয়োগ করছে না। আর না সুহাসের থেকে ছোটার আকুতি জানাচ্ছে। সুহাস অনুভব করল নামীর শরীর শীতল আর নরম হয়ে এসেছে। নিঃশ্বাসে বেড়েছে গভীরতা। আর অনুমতির অপেক্ষা করল না সে। কিন্তু অনুমতি না দেয়াতে শাস্তি দিল ঠোঁটে ঠোঁটে উত্তপ্ত ঘর্ষণে। মৃত্তিকা ভিজল আকাশ চেড়া বর্ষণে। কোনো এক নারীর কোমল ঠোঁটজোড়া ভিজল কোনো এক পুরুষ ঠোঁটের উত্তপ্ত চুমু বর্ষণে। দু’জোড়া হৃদয়ও ভিজে ওঠল হৃদয় চেড়া বর্ষণে। আজ যেন উথাল-পাতাল বর্ষণে শান্ত আকাশ, উত্তপ্ত মাটি, তৃষ্ণার্ত হৃদয় সমস্তই ভিজিয়ে তোলার দিন৷

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা

|২২|

আজ সূর্যি মামার দেখা মেলেনি। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। জানালা ঘেঁষে উদাস মুখে বসে আছে নামী। ঐ আকাশের সকল মেঘ যেন তার মুখে ভর করেছে আজ৷ দেখতে দেখতে তাদের জীবনে কেটে গেছে তিন বছর। পড়াশোনা, বন্ধুত্ব, প্রেম, ঘুরাফেরা, মান অভিমান সবই ছিল বছর জুড়ে। কোনোটাতেই এক রত্তি কমতি ছিল না। এরই মধ্যে ইতি ঘটেছে সুহাস, সৌধদের ম্যাডিকেল পড়ারও। তারা এখন ঢাকা ম্যাডিকেলে ইন্টার্নি করছে। গতকাল ছিল নামী, সুহাসের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী। ঠিক রাত বারোটার সময় নামীর দ্বারে এসেছিল সুহাস। প্রিয়তমাকে বিয়ের চারবছর পূর্তির অভিনন্দন জানিয়েছে। গতকালের সেই সুখে পরিপূর্ণ স্মৃতি গুলো মনে পড়ছে বারবার। আগে সুহাস খুব একটা দায়িত্বশীল ছিল না৷ ইদানীং বেশ দায়িত্বশীল হয়েছে। শিখেছে প্রেমিক এবং স্বামী হিসেবে প্রেমিকা, বউকে বিশেষ যত্ন নিতে৷ ইন্টার্নি করে অল্পস্বল্প আয় করে সে৷ যা দিয়ে বউকে ছোটোখাটো উপহার দেয়। অবশ্য সবার কাছে ছোটোখাটো হলেও নামীর কাছে এগুলোই বিশাল ব্যাপার। অদ্ভুত সুখ আর সীমাহীন ভালোবাসার। সেদিনের দুরন্ত ছেলেটা যে একদিন তাকে ভালোবেসে এতটা উজার করে দেবে একবিন্দুও টের পায়নি৷ ভেবেছিল ওখানেই বোধহয় সব শেষ। ওখানেই সে একদম নিঃশেষ। এই পৃথিবীতে আসলে শেষ বলতে কিছু নেই৷ যেখানেই শেষ ঘটে, সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন সম্ভাবনার।

গতরাতে নামী, সুহাস দু’জন মিলে একসাথে খাবার খেয়েছে। নামীর হাতে খেতে ভীষণ ভালোবাসে সুহাস৷ নামীও সুযোগ হলেই নিজ হাতে যত্ন নিয়ে খাইয়ে দেয় তাকে। খুব ছোটোবেলা থেকেই নিজ হাতে খেতে শিখেছে সুহাস আর সিমরান৷ বাবা, মা দু’জনই ব্যস্ত মানুষ। তাদের ভাই, বোনকে দেখাশোনা করত কাজের লোকেরা। তাই মা তিন বছর বয়স থেকেই নিজহাতে খেতে শিখিয়েছে৷ বাসার কাজের লোকের হাতে ছেলেমেয়েরা খাবার খাবে এটা একদম পছন্দ করত না উদয়িনী৷ মায়ের সে শিক্ষায় মানুষ হয়ে কখনো কারো আদর, স্নেহভরা হাতে ভাত খাওয়া হয়নি। যখন থেকে নামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। যখন থেকে দু’জন দু’জনের পরিপূরক হতে শুরু করেছে তখন থেকেই দু’জন একসাথে খেতে বসলে নামীর হাতেই খাওয়া হয়। একদিন আবদার করেও বসে কখনো সুযোগ হলে সিমরানকেও যেন খাইয়ে দেয়। নামী বুঝতে পারে এটা শুধুই আবদার নয়৷ ভালোবাসা, যত্নের অভাবে নিমজ্জিত থাকা বোনটিকে একটু যত্ন আর ভালোবাসার অনুনয়। এরপর থেকে সিমরান যখনি আসে তাকেও নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। এতে করে শশুর, ননদ, স্বামী সবার সঙ্গে খুবই মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে মেয়েটার।

রাতে খাবারের পাট চুকিয়ে সুহাসের দেয়া শাড়ি পরে একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটায়। চার বছরে সুহাসের সঙ্গে অসংখ্য সময় কাটালেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে স্বাভাবিক দৈহিক মিলন ঘটে, তা কেবল একবারই ঘটেছিল৷ তাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীতে। সৌধদের বাড়িতে। সেদিন সৌধদের বাড়িতে কাজের লোক আর সৌধ ছাড়া কেউ ছিল না৷ তাই প্রিয় বন্ধু আর বোন নামীকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল সৌধ৷ সেই মিলনের পর থেকেই যেন সুহাসের মাঝেকার পরিবর্তন গুলো গাঢ় হতে থাকে৷ এক নামীর মাঝেই খুঁজে পায় সকল সুখ। এর আগে নামীর সঙ্গে মন দেয়া, নেয়া চললেও অভ্যেসের দোষে পুরোনো গার্লফ্রেন্ডদের সঙ্গেও সময় কাটিয়েছে বারকয়েক। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কম ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়নি৷ কিন্তু যেদিন থেকে পরিপূর্ণ ভাবে স্ত্রী রূপে নামীকে পেয়েছে। সেদিন থেকে পিছু ফিরে তাকায়নি একবারো। সেইরাত কখনো ভুলার নয়। যেই রাতে ভালোবেসে নিজের সবটা উজার করে দিয়েছে নামী। সে রাতের পর দ্বিতীয় রাত তাদের জীবনে এলো ঠিক এক বছর পর। শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর নিকট এসেছে সুহাস। দ্বিতীয়বারের মতো স্ত্রীর দেহ, মনে তুলেছে আদিম সে ঝড়। যে ঝড়ের তাণ্ডবে মেয়েটা শতসহস্র বার তার বুকে মরণাপন্ন হয়ে থাকে। মাত্র কয়েকঘন্টা কাছে পেয়ে যতটা সুখ পায় নামী তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণা পায় যখন মানুষটা দীর্ঘ সময়ের জন্য দূরে চলে যায়৷ এখনো পাচ্ছে সেই যন্ত্রণা। হৃদয় জুড়ে লেপে আছে সুহাস, শরীর জুড়ে এঁটে আছে সুহাস। অথচ সামনে নেই সুহাস। তার দেয়া প্রতিটা স্পর্শকে স্মরণ করে এখনো বুকে শিহরণ জাগছে। দেহ জুড়ে রয়েছে তার দেয়া আদুরে চিহ্নগুলোও। যা দেখে একই সঙ্গে সুখ, দুঃখ দু’টোই হয়। কবে তারা একসঙ্গে থাকতে পারবে। কবে থেকে তার প্রতিটা রাত কাটবে সুহাসের বুকে মুখ লুকিয়ে? কবে হবে তার সুখে ভরা একটি সংসার? বিষণ্ণ চোখ দু’টো এবারে ঝাপসা হয়ে ওঠে। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া বুজে ফেলে আচমকা। দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নামে গাল বেয়ে৷ তাকায় সহসা, কোলের উপরে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে। দু’টি শব্দের ম্যাসেজ লিখে সেন্ট করে প্রিয়তমকে,

‘ মিস ইউ। ‘

চোখের পানি মুছে পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে বসল নামী৷ নিধি, প্রাচী চলে যাবার পর এই নতুন বাসায় ওঠেছে সে। বাসাটা সুহাসই ভাড়া করে দিয়েছে। দু’টো বেডরুম, একটি ড্রয়িং, ডাইনিং এবং একটি কিচেনের ছোটোখাটো ফ্ল্যাট। এক রুমে নামী একাই থাকে৷ আরেক রুমে সুহাসের পরিচিত দু’জন ছোটোবোন। সিমরানের স্কুল ফ্রেন্ড এরা। কুমুদিনীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স করছে। দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট’স। ওরা দু’জন থাকে দু’জনের মতো আর নামী থাকে নামীর মতো৷ সুহাস মাঝেমাঝে এখানে আসে, সময় কাটায় এই যে রাতটা কাটিয়ে গেল৷ এতে করে ওদের বা বাসার মালিকের কোনো সমস্যা হয়নি৷ কারণ সবাই জানে সুহাস, নামী স্বামী-স্ত্রী। পড়াশোনার জন্যই আলাদা থাকতে হচ্ছে দু’জনকে। এছাড়া সিমরান প্রায় রোজই একবার করে আসার চেষ্টা করে৷ এই তিন বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তনে দূরত্ব কমেছে সিমরান আর নামীর মধ্যেও। ননদ, ভাবি নয়৷ তারা এখন একে অপরের শুভাকাঙ্ক্ষী। সিমরান নামীকে ভাবি নয় বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে মূল্যায়ন করে৷

সময়ের স্রোতে সবকিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পরিবর্তন ঘটেনি উদয়িনীর মাঝে। সে নিজের জেদে অটুট। যা বাড়িয়ে তুলেছে ছেলেমেয়ের সঙ্গে তার দূরত্ব। স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব নতুন নয় পুরোনো। শুধু কাগজে, কলমেই তারা স্বামী-স্ত্রী। সম্পর্ক কেবল দুটো সন্তানের বাবা, মা পর্যন্তই। সোহান খন্দকার এখন আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। বাড়িতে আসেন শুধু ছেলেমেয়েদের জন্য। মাসে একবার কিংবা কয়েকমাস পরপর৷ স্ত্রীর মুখদর্শন করে না বহুদিন। ভুলবশত একবার, দুবার হয়ে যায় তখন যখন ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক ঘরে না থাকলেও এক ছাদের নিচে থাকতে হয়। তবু উদয়িনীর হৃদয় নরম হয়নি। চূর্ণ হয়নি অহংকার। ভাঙেনি ভুল। এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যারা ভেঙে যাবে তবু মচকাবে না। উদয়িনী সেই মানুষদের মধ্যেই পড়ে। এ পৃথিবীতে সেই মানুষ গুলো খুব বোকা হয়৷ যারা বলে ভাঙব তবু মচকাব না। নিজেদের ভেঙে চুরমার করে দিতে যারা প্রস্তুত। তবু মচকাবে না একচুল৷ অথচ তারা কখনো ভেবে দেখে না। মচকানো জিনিস সারিয়ে তোলা যত সহজ ভাঙা জিনিস সারিয়ে তোলা ততই কঠিন। যা একবার ভেঙে যায় তা কখনো জোড়া লাগে না৷ সম্পর্কের সুতোয় টান পড়েছে বহুদিন। ছিঁড়ে যাওয়ার আগে উদয়িনী কি শুধরাবে? উত্তর দেবে একমাত্র সময়।
.
.
কোরবানির ইদের জন্য বেশকিছু দিন ছুটি পেয়েছে সৌধ। বড়ো আপু স্মৃতির বিয়ে ইদের তৃতীয় দিন। হাজব্যান্ড কানাডায় স্যাটেলড। বিয়ের পর বউকেও নিয়ে যাবে৷ সুজা এমপির একমাত্র মেয়ের বিয়ে। তোড়জোড় চলছে খুব। ধুমধাম করে মেহেদি অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত সবমিলিয়ে জমকালো আয়োজনের করা হচ্ছে। সৌধর সকল বন্ধু, বান্ধুবী, স্কুল, কলেজ মিলিয়ে সকল স্যার, ম্যামকেও আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছে। বাকি শুধু একজন সে হলো সৌধর হৃদয়েশ্বরী নিধি। ঢাকাতে সুহাস সে আর আইয়াজ একসঙ্গেই থাকে। নিধি, প্রাচী থাকে হোস্টেলে। গতকাল ভোরবেলা নিধির মামা অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থতার মাত্রা কতখানি জানা নেই। নিধি সেভাবে কিছু বলে যেতে পারেনি প্রাচীকে। তেমন কিছু না জানিয়েই ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে মেয়েটা। প্রাচীর কাছে দুপুরে এসব জানতে পেরে প্রচণ্ড রাগ করে সৌধ। ভোরবেলা মেয়েটা একা এতদূর চলে গেল! ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। প্রাচীর ডিউটি ছিল বলে সঙ্গে যেতে পারেনি। তাই বলে তৎক্ষনাৎ তাকে একবার ফোন দেবে না? এবারে প্রাচীর প্রতিও বিরক্ত সে৷ এরপর কেটে যায় একদিন। পরের দিন নিধির ডিউটি থাকা সত্ত্বেও সে ঢাকায় ফিরে আসেনি৷ ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। ওদিককার কী খবর কে জানে? কী পরিস্থিতিতে আছে মেয়েটা তাও অজানা।
একদিকে বোনের বিয়ে আসন্ন অন্যদিকে হুট করে নিধি উধাও।

পাক্কা তিনদিন যাবৎ উধাও নিধি৷ সৌধর অবস্থা করুণ। ইদের ছুটি পড়ে গেছে এরই মধ্যে। কিন্তু বাড়ি ফেরার উদ্যম নেই কারোরি। একদিকে নিধির চিন্তা অপরদিকে সৌধ। বিপন্ন অবস্থা বন্ধুদের৷ শেষমেশ ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করতে দেখা গেল সৌধকে। মুখাবয়ব বিধ্বস্ত। পুরুষ মানুষ কাঁদতে পারে না৷ সৌধর মতো কঠিন ব্যক্তিত্বের পুরুষরা তো একদমই না৷ কিন্তু মনের কান্না কি থামানো যায়? যায় না তো। থামাতে পারছে না সৌধ। তিনরাত নির্ঘুম কাটিয়ে চোখ, মুখ ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে৷ ওর রক্তিম চোখ দু’টোয় তাকালেই বুক ধক করে ওঠছে। কারো সাথে কথা বলে না। আর না কেউ সাহস দেখায় কথা বলার। খাবার বেলায় সুহাসের জোরাজুরিতে একটুআধটু খেয়ে ওঠে পড়ে৷ আর সারাবেলা কাটায় ঘনঘন পানি খেয়ে আর ফোন দেখে৷ ঘনঘন নিধির ফোনে কল করতেও দেখা যায়৷ কিন্তু ওপাশে রিং বাজে না। আর না কেউ রিসিভ করে সৌধর বুকের আগুন নেভায়। হঠাৎ ব্যাগপত্র গোছাতে দেখে সুহাস, আইয়াজ দু’জনই নিজেদের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। ওরা ভেবেছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরুবে সৌধ৷ কিন্তু ওদের ভুল প্রমাণ করে গম্ভীর গলায় সৌধ বলল,

‘ আমি ফুলবাড়িয়া যাব। তোরা যেতে চাইলে আসতে পারিস। নয়তো বাড়ি ফিরে যা। ‘

চমকে গেল সুহাস৷ চমকাল আইয়াজও। বেচারার ধৈর্যের সব বাঁধই ভেঙে গেছে বুঝতে পেরে সুহাস বলল,

‘ আমরা যাব তোর সাথে। ‘

আইয়াজ বাঁধ সেধে বলল,

‘ নিধির পরিবারে যদি সমস্যা হয়ে থাকে? ওর বাবা, কাকারা নাকি সাংঘাতিক মানুষ। হিতে বিপরীত হবে না তো? ‘

কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল সৌধ। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল নিমিষেই । আইয়াজ ঢোক গিলল। ঈষৎ হাসার চেষ্টা করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ তুই যেতে চাইলে যাবি বারণ নেই তো। কিন্তু গেলে কী সমস্যা হতে পারে স্মরণ করিয়ে দিলাম। সবশেষে আমরা তো আর নিধির ক্ষতি হবে এমন কিছু করতে পারি না। ‘

সৌধর মনের অস্বস্তি তীব্র হলো। সে ওখানে গেলে নিধির ক্ষতি হবে এটা বিশ্বাস হচ্ছে না৷ বারবার মন বলছে সে ওখানে না গেলেই ওর ক্ষতি হবে। তাই তো আর মন মানছে না। নিজেকে আর আঁটকেও রাখতে পারছে না। অদৃশ্য এক সুতো যেন টানছে খুব। যেতে হবে তাকে। শিঘ্রই যেতে হবে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি তিন বন্ধু। এমনই সময় সুহাসের ফোন বেজে ওঠল। স্ক্রিনে নিধির নাম্বার জ্বলজ্বল করছে। সুহাস চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ দোস্ত নিধির কল। ‘

মুহুর্তেই ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল সৌধ। বুকের পাটা হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে তার। হাত, পা কাঁপছে ভীষণ। সে কাঁপা হাতেই ফোন রিসিভ করল। অমনি শুনতে পেল আত্মায় প্রশান্তি দেয়া কণ্ঠস্বর,

‘ এই সুহাস কই তুই? ‘

‘ নিধি! ‘

থমকানো কণ্ঠ সৌধর। যা শুনে নিধির কণ্ঠও রোধ হয়ে এলো। সৌধ থমকানো স্বর এবার ব্যগ্রতায় রূপ নিল। অধৈর্য গলায় সে বলল,

‘ তুই কোথায়? কেমন আছিস নিধি? কী হয়েছিল তোর, ফোন বন্ধ ছিল কেন? ‘

‘ ভাইই, সব প্রশ্নের উত্তর দিব। আমি আর প্রাচী তোদের বাসার সামনে আছি। বাসায় থাকলে জলদি চলে আয়। ব্যাগপত্র গুছিয়ে একদম সিএনজি করে বেরিয়েছি। এটা নিয়েই বাড়ি ফিরে যাব। আসব একদম ছুটি কাটিয়ে। তার আগে দেখা করে যাই তোদের সঙ্গে। ‘

তিন বন্ধু বেরিয়ে এলো। নিধি প্রাচীও সিএনজির ভিতর থেকে বেরিয়েছে। সৌধ সামনে আসতেই নিধি বিস্মিত হয়ে গেল! বড়ো বড়ো চোখ করে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ এ কী অবস্থা তোর? চোখ মুখের এ কী হাল! মনে হয় তিনদিন না ঘুমিয়ে গাঞ্জা খাইছিস। ‘

সুহাস, আইয়াজ নিধির ওপর প্রথমে রাগান্বিত থাকলেও পরমুহূর্তে ওর কথাবার্তা শুনে হেসে ফেলল। নিধি কথা বলার ফাঁকে সৌধর কপালে একবার হাত রাখল। সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ জ্বর তো আসেনি। ও’কে এমন লাগছে কেন? তোদেরও তো চোখমুখ শুঁকনো। আরে ভাইই আমি মরে যাইনি যে তোদের অবস্থা এমন হবে। আমাদের ওখানে চারদিন যাবৎ বিদ্যুৎ ছিল না। ফোনে চার্জ ছিল না বলে বন্ধ দেখিয়েছে। তাছাড়া মামা এতটাই অসুস্থ ছিল যে ব্যস্ততায় আমি ফোন করারও সুযোগ পাইনি। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে সৌধর কপাল থেকে হাত সরিয়ে একটু সরে যাচ্ছিল নিধি৷ কিন্তু সরতে পারল না। সকলের সম্মুখে আকস্মিক নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সৌধ। বরফের মতো শীতল আর শক্ত হয়ে গেল নিধি। দু-চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল পাশে দাঁড়ানো সুহাস, আইয়াজের দিকে৷ ওরা ইশারা করে বোঝাল, ‘ প্লিজ নিধি রাগ করিস না। ওকে একটু সামলে ওঠতে দে। হুট করে তোর সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াতে ছেলেটা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ‘ ওদের ঠোঁট নাড়ানো, ইশারায় বলা কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হলো না নিধির৷ আকস্মিক বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভব করল সে। স্মিত হেসে নিজের কষ্ট গুলো আড়ালে রেখে সৌধর পিঠে হাত রাখল সন্তর্পণে। টের পেল সৌধর হৃৎস্পন্দনের ভয়াবহ গতি। যা আচমকা বুক কাঁপিয়ে দিল তার। চোখ বুজে এলো আপনাআপনি। দু-চোখের কার্ণিশ বেয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুজল। সৌধর ভারী নিঃশ্বাস, হৃৎস্পন্দ সমস্তই অনুভব করল নিধি৷ তার সর্ব দেহে, সর্ব মনে কাঁপন ধরিয়ে দিল সৌধর প্রগাঢ় অনুভূতি। নিজেকে দূর্ভাগিনী মনে করবে নাকি সৌভাগিনী? এক কঠিন দ্বিধায় দিশেহারা হলো মন৷

| চলবে |
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-১৭+১৮+১৯

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৭

লিভিং রুম থেকে গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসা সিমরান সে শব্দ শুনেই লাফিয়ে ওঠে বলল,

‘ ও মাই গড! সৌধ ভাই গিটার বাজাচ্ছে! ‘

নামী ওর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। আকস্মিক লাফিয়ে ওঠায় ভয় পেয়ে গেল সে। শুনেছিল সুহাস, সৌধ দুজনই দারুণ গিটার বাজাতে পারে। গানের গলাও অসাধারণ। তাই জিজ্ঞেস করল,

‘ কী করে বুঝলে সৌধ ভাইয়া? তোমার ভাইয়াও তো হতে পারে। ‘

সিমরান উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,

‘ উহুম কখনোই না। বিলিভ না হলে চলো দেখলেই বুঝবে আ’ম রাইট৷ এত্ত স্লোলি গিটার ব্রো বাজাতে পারে না। ব্রো মানেই ধুমধাড়াক্কা। ‘

বলতে বলতেই আয়নায় নিজেকে দেখে ত্বরিত নামীর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। বলল,

‘ থ্যাংকিউ সো মাচ নামীপু। এবার জলদি রেডি হয়ে নাও একসঙ্গে ওখানে যাব। ‘

বারকয়েক পলক ফেলে তৈরি হয়ে নিল নামী। এরপর সিমরান নিজেই তার হাত চেপে ধরে নিয়ে গেল লিভিং রুমে। নিধি, প্রাচী মিলে বেশ ভালোই বুঝিয়েছে সিমরানকে। শুধু তাদের বুঝানোতে অবশ্য এতটা গলেনি সিমরানের মন। কথার ছলে যখন শুনল নামীকে সৌধ নিজের বোনের চোখে দেখে৷ তাছাড়া এ বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। অথচ নামী এ বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও পার্টিতে অংশগ্রহণ করবে না৷ এটা একদমই ভালো দেখায় না। বিশেষ করে সৌধর চোখে। বনেদি পরিবারের ছেলে সৌধ। তাদের পরিবার সম্পর্কে নিধি, প্রাচীর থেকেও সুহাস, সিমরান বেশি অবগত। পারিবারিক ভাবে ঐ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক বেশি গাঢ়৷ চৌধুরী বাড়ির প্রায় সব অনুষ্ঠানে সোহান খন্দকার, সুহাস, সিমরান উপস্থিত থাকে৷ উদয়িনীও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করে৷ সময় সাপেক্ষে হয়ে ওঠে না৷ একটা যৌথ পরিবারের বন্ধন কেমন হয় তা সৌধর পরিবার দেখে শেখা উচিত। অমন পরিবারের ছেলে সৌধ৷ তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও অজানা নয় সিমরান। দেখা গেল নামীর অনুপস্থিতি দেখে তাদের দু’ভাইবোনের ওপর নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলো। যে ধারণা তার জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে৷ সিমরান কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। সমস্যা তার বাবা, মা আর নামীর মধ্যে। তার ভাইও জড়িয়ে। সে এসবে জড়িয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষের চোখে খারাপ হতে চায় না৷ তাই মায়ের আদেশ আর নামীর ওপর রাগ দূরে সরিয়ে নামীকে নিজের জন্মদিন পার্টিতে নিয়ে এলো। ওদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে নিধি, প্রাচী মিটিমিটি হাসছিল৷ সুহাস অবাক হয়ে আইয়াজকে বলল,

‘ কীরে কাহিনি কী? সিনু ওর সাথে! ‘

আইয়াজ নিধি, প্রাচীকে দেখিয়ে বলল,

‘ সব এদের জাদু। ‘

সিমরান, নামী চলে এলেই সৌধর হাত থেমে গেল। নামীকে দেখে একহাত দূরে বসা নিধির দিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে একটি হাসি উপহার দিল। নিধি মাথা দুলিয়ে, ভ্রু নাচিয়ে বুঝাল,

‘ এই নিধির পক্ষে সব সম্ভব। ‘

সৌধ আপ্লুত হয়ে ঠোঁটজোড়া চোকা করে চুমু দেখাল। নিধি বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে আকস্মিক সবার সামনেই মারতে শুরু করল সৌধকে। সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল ওদের দিকে৷ নামী আর সিমরানও দুই বন্ধুর খুনসুটি দেখে হাসল৷ সৌধ নিধিকে থামাতে ওর দু-হাতের কব্জি ধরে বলল,

‘ কী আশ্চর্য! হুটহাট আক্রমণ করছিস। শরীর ঠিক আছে তোর? ‘

সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী তিনজনই সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে। ওরা তিনজন স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিধি এমনি এমনি ক্ষেপেনি৷ সৌধ নাটক করছে এও স্পষ্ট। এই নাটক কেন করছে তাও বুঝল ওরা৷ দু’জন জুনিয়র সদস্য উপস্থিত বলেই সৌধ এই নাটকটা করতে বাধ্য হচ্ছে। মারতে মারতে হাত ব্যথা হয়ে গেলে থামল নিধি৷ ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল সোফায়। প্রাচী ব্যস্ত হলো সিমরানের কেকের ছবি তুলতে। নিধি হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে নামী সিমরানকে খেয়াল করে নামীকে বলল,

‘ খুব সুন্দর সাজিয়েছ তো সিনুকে। ‘

সিমরান খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কোমরের দু’পাশের গাউন ধরে এগিয়ে গেল ভাইয়ের সামনে। বলল,

‘ কেমন লাগছে আমাকে ব্রো বললে না তো! ‘

প্রশ্নটা সুহাসকে করলেও নামী বাদে সবাই এক সুরে বলল,

‘ সো প্রিটি আওয়ার বেবিডল। ‘

খুশিতে আত্মহারা হয়ে সকলের দিকে তাকাল সিমরান। সৌধ সহ সবাই ওঠে দাঁড়িয়েছে। সুহাস বোনের দু’কান চেপে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

‘ হ্যাপি বার্থডে মাই প্রিন্সেস সিস্টার। ‘

একে একে সবাই উইশ করল। নিধি সুহাসকে বলল,

‘ সিনুকে সব ড্রেস আর সব সাজেই মারাত্মক লাগে তাইনারে৷ ‘

সুহাস বেশ ভাব নিয়ে নামীর দিকে এক ঝলক তাকাল৷ এরপর বলল,

‘ বোনটা কার দেখতে হবে না? ‘

প্রাচী বলল,

‘ তোরা কি এভাবেই সময় শেষ করবি? কেকটা কাটবি কখন? সিনু তুই এদিকে আমার কাছে আয়। ‘

সিমরান সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে গেল। দেয়ালের একপাশ জুড়ে হালকা গোলাপি রঙের পর্দা টাঙানো। তার সামনে হালকা গোলাপি, নীল রঙের বাটারফ্লাই বেলুন দিয়ে বৃত্ত আকারে ডেকোরেট করা। বৃত্তের মধ্যবর্তী স্থানে লেখা ” হ্যাপি সেভেনটিন্স বার্থডে সিনু” সবটায় দৃষ্টি বুলিয়ে কেকের দিকে তাকাল সিমরান৷ তার একদম বাচ্চা বয়সের একটি ছবি বসানো কেক। কেকটাই দেখানো হয়নি তাকে। এখন দেখে ভাইয়ের দিকে বিস্মিত চোখে তাকাল। মৃদু হাসল সুহাস। বোনের খুশি দেখলেই অদ্ভুত শান্তি লাগে তার। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত খুশি ওর পায়ের কাছে সমর্পণ করতে। বার্থডে কেকের পুরো আইডিয়াই সৌধর। নিজ দায়িত্বে নিজ খরচে সবটা করেছে ও৷ তাই সৌধর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ তোর ভাই কেমন অকর্মণ্য জানিস তো? এসব সৌধর মাথা থেকে এসেছে ইভেন কেকটা সৌধর তরফ থেকেই তোর বার্থডে গিফ্ট। ‘

আচমকা সৌধর দিকে তাকাল সিমরান৷ সৌধ ওর তাকানো দেখে মুচকি হাসি উপহার দিল। বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠল মেয়েটার। উত্তেজনায় গা শিরশির করছে। এদিকে নিজেকে অকর্মণ্য বলে হঠাৎ নামীর দিকে চোখ পড়ে সুহাসের। দেখতে পায় নামী তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। অমনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এমনিতেই এই মেয়ের ওপর ভয়ানক রেগে আছে সে। সকালের ব্যাপারটা নিয়ে মারাত্মক রাগান্বিত। আর এই মেয়ে কিনা গা জ্বালানো হাসি দিচ্ছে! সে অকর্মণ্য এটা বোনকে জাস্ট ফর্মালিটি করে বলেছে। তাই বলে এভাবে হাসার কী আছে? ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাস ফেলল সুহাস৷ নামী ততক্ষণে সুহাসের ক্ষুব্ধ দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিধির সঙ্গে সিমরানের কাছে চলে গেছে। কেক কাটার আগে সৌধ সবাইকে সাবধান করে দিল কেউ যেন কেক ছোড়াছুড়ি না করে। কিন্তু সুহাস মনে মনে ছক কষে ফেলেছে নামীকে একটা শিক্ষা দেবে। কোন সাহসে সে পাশের বাড়ির মহিলার সঙ্গে মিষ্টি মুখে কথা বলেছে? কোন সাহসেই বা পাশের বাসার আন্টি এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে যায়? এটা ঠিক কোন ধরনের ইতিহাস? যে জামাইয়ের কাছে বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসে ছিঃ! পরোক্ষণেই আবার মত পাল্টাল। পাছে দেখা হলো নামীদামি তেজ দেখিয়ে পার্টি থেকেই চলে যাবে।

মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটল সিমরান৷ সর্বপ্রথম কেক খাইয়ে দিল সুহাসকে। এরপর সৌধকে খাইয়ে দিতে গেলে সৌধ নিজে না নিয়ে পাল্টা ওকেই খাইয়ে দিল। মৃদু হেসে নাজুক ভঙ্গিতে একে একে সবাইকে কেক খাইয়ে শুরু করল কিছু সেলফি তুলতে। সবার সাথে সেলফি নিয়ে নামীর সাথে নিতেও বাদ রাখল না। সব শেষে সেলফি নিতে গেল সৌধর কাছে। সৌধ দু’টো সেলফি নিয়ে হঠাৎ অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ সিনু, আমাদের ড্রেস তো ম্যাচিং হয়ে গেছে। ‘

সিমরান মুখ ফসকে বলে ফেলল,

‘ কাপল লাগছে না? ‘

সৌধ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ উহুম, যতই ম্যাচিং হোক বাচ্চাদের সাথে কাপল লাগে না। ‘

কথাটা বলেই কিছু একটা ভেবে আবার বলল,

‘নিধিরে ডাক তো বল আমি ডাকছি। ‘

মুখটা চুপসে গেল সিমরানের। বাচ্চা, বাচ্চা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। কবে সে বড়ো হবে? কবে অনার্সে পড়বে? কবেই বা সৌধ ভাইকে প্রপোজ করতে পারবে? বুকে অস্থিরতা শুরু হলো সিমরানের। নিধির কাছে গিয়ে বলল,

‘ আপু সৌধ ভাইয়া ডাকে। ‘

নিধি আইয়াজের সাথে কয়েকটা সেলফি নিয়ে সৌধর কাছে গেল। সৌধ ওর সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নিতে নিতে নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ চুলটা ছেড়ে দে। ‘

নিধি আড়চোখে তাকিয়ে ওর মতো করেই বলল,

‘ না রে গরম লাগে খুব। ‘

সৌধ এবার মুখটা আরেকটু নিচু করে বলল,

‘ তোর বাঁধা চুলে আমার আরো বেশি গরম লাগছে। ‘

সৌধর দৃষ্টি আর কণ্ঠ শুনে চাপা আর্তনাদ করে ওঠল নিধি,

‘ মানে! ‘

‘ ঘাড়ের এই তিলটা অসহ্য করে তুলছে আমায়। চুল না ছেড়ে ওটা আড়াল না করলে না জানি কখন জাপ্টে ধরে ফাঁকা ঘরে নিয়ে যাই আর চুমুতে চুমুতে অসহ্য করে তুলি তোকে! ‘

ঘাড়ে ঠিক যেখানটায় তিল সেখানে তর্জনী ছুঁয়ে কথাটা বলল সৌধ। কান গরম হয়ে চোখ দু’টি বড়ো হয়ে গেল নিধির। সর্বাঙ্গে কম্পন ধরে গেল নিমিষেই। অবিশ্বাস্য চোখে কয়েক পল তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। এরপর আচমকা মুখটা কঠিন করে বলল,

‘ আমাদের বন্ধুত্বের সমাপ্তি টানতে না চাইলে নিজেকে কন্ট্রোল কর সৌধ। ‘

সহসা সৌধর মুখো ভঙ্গি পাল্টে গেল। নিধি খেয়াল করল সৌধর চোয়াল জোড়া ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। ঢোক গিলে আশপাশে তাকাল সে। সবাই সেলফি নিতে ব্যস্ত। এরপর সৌধর দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,

‘ সৌধ… ‘

বাকিটুকু আর বলতে দিল না সৌধ। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো৷ অমনি খপ করে হাত চেপে ধরল নিধি৷ বলল,

‘ রাগছিস কেন? ‘

ভ্রু বাঁকিয়ে সৌধ বলল,

‘ রাগব কেন? তুই ভুল বা অন্যায় কিছু বলিসনি। ‘

নিধি অপরাধীর সুরে বলল,

‘ সৌধ প্লিজ, আমি জানি তুই ভয়ংকর রেগে গেছিস।’

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ। আশপাশে তাকিয়ে দেখল তাদের দিকে কারো নজর নেই। তাই চট করে নিধির হাত টেনে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে। এরপর দরজাটা সপাৎ শব্দে বন্ধ করে দিল।

নামী প্রাচীর সাথে ছবি তোলার ফাঁকে এ দৃশ্যটা দেখে গম্ভীর হয়ে গেল। তাকাল ভাইয়ের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকা সিমরানের দিকে৷ এরপর কে কে সিমরানের জন্য কী গিফ্ট এনেছে এসব দেখানো শুরু করল প্রাচী৷ সিমরান সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এমন সময় নামী বলল,

‘ আমার গিফ্ট তোলা রইল সিমরান। পেয়ে যাবে। ‘

সুহাস ফোড়ন কেটে বলল,

‘ আমার বোন বাসি জিনিস নেয় না। ‘

সুহাস ভেবেছিল নামী তার সঙ্গে এবার তর্ক দেবে৷ কিন্তু না সে তর্ক দিল না। হঠাৎই মনটা খুব খারাপ করে চুপ হয়ে গেল। সিমরান তাকে পছন্দ করে না। ভেবেছিল বার্থডে পার্টিতেও আসা হবে না৷ তাই গিফ্ট নিয়ে ভাবা হয়নি৷ অথচ আসা ঠিকি হলো, গিফ্ট দেয়া হলো না৷ এ নিয়ে আর কেউ ছাড় দিলেও সুহাস দিল না৷ আত্মসম্মানে আঘাত পড়ল খুব। তাই চুপ রইল সে। তার এই চুপ থাকাটাও সহ্য হলো সুহাসের। প্রথমে ইনিয়ে-বিনিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করল। লাভ হলো না বলে শেষে ভদ্র হয়ে এসে বসল নামীর পাশে। এতে শুধু নামীর সাথে হকচকিয়ে গেল উপস্থিত সবাই। সিমরান বলল,

‘ নামীপু তো আমাকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। এটাও তো একটা উপহার৷ ‘

প্রাচী ওর কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,

‘ বাহ দারুণ বললি তো। ‘

নামী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সিমরানের দিকে। সিমরান মুচকি হাসি দিল। সুহাস বলল,

‘ আমার বোনকে পটালে কী করে? ‘

চমকে তাকাল নামী। সুহাসের মুখটা এক পলক দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সিদ্ধান্ত নিল ওঠে যাবে৷ সুহাসের পাশে বসার রুচি নেই তার৷ কিন্তু তার আগেই সুহাস আবার বলে ওঠল,

‘ যেভাবে পাশের বাসার ব্যাংকারকে পটিয়েছ? মানতে হবে চয়েজটা! কালাচাঁদ তাতে কি ব্যাংকার তো। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল নামীর। এসব কী বলছে সুহাস? কে কালাচাঁদ, কেই বা ব্যাংকার? মনের প্রশ্ন মুখে করতেই সুহাস ঠোঁট কামড়াল। নামী কি এসব জানে না? কৌতূহলী চিত্তে বলল,

‘ আমাদের পাশের বাসার ইয়ামিনকে চেনো না? ব্যাংকে জব করে? ‘

বিরক্ত সূচক শব্দ করে নামী জবাব দিল,

‘ না। ‘
***
দরজার কপাটের সাথে একদম পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিধি। দু’হাত কপাটে রেখে মধ্যস্থে নিধিকে বন্দি করে রেখেছে সৌধ। লাগাতার প্রশ্ন করে যাচ্ছে,

‘ আমি রাগি তাতে তোর কী? বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি। অপরাধ হয়ে গেছে। শাস্তি সরূপ বন্ধুত্বের শেষ টানবি৷ আমি রাগলাম না মরলাম তোর কী যায় আসে হু? ‘

সৌধর মুখের ভারিক্কি নিঃশ্বাস গুলো মুখের ওপর পড়তেই চোখ বুজে মুখ ঘুরিয়ে রইল নিধি। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,

‘ ছাড় সৌধ। পাগলামি করিস না। ‘

‘ ধরে রাখিনি। ‘

‘ বেঁধে রেখেছিস। ‘

চ্যাঁচিয়ে বলল নিধি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সৌধর। সুহাসের মতো দরজায় চিপায় না পড়লে এই মেয়েও মুখ খুলবে না৷ তাই ঘাড় বাঁকিয়ে সুইচবোর্ডে নজর বুলাল। এরপর তাকাল নিধির সরল মুখটায়। বলল,

‘ সোজা কথায় স্বীকার করবি না যখন বাঁকা কাণ্ড করতেই হবে৷ ‘

বলতে বলতেই তড়াক করে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে বাতি নিভিয়ে পুনরায় নিধির সামনে চলে এলো। আকস্মিক রুম অন্ধকার হতে ভয়ে চিৎকার দিল নিধি৷ কিন্তু সে চিৎকার বাইরে গেল না৷ সৌধ ওর মুখ চেপে ধরল। নিধি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে শুরু করল। সৌধ ওকে শান্ত করতে দু’হাতে জড়িয়ে নিল বুকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

‘ আরে পাগলি মেয়ে ভয় কীসের আমি আছি৷ নে এবার ঝটপট বলত মনের ভেতরটা উগ্রে দে। ‘,

‘ প্লিজ সৌধ। ‘

‘ আই লাভ ইউ সৌধ বল। তারপর ছাড়ব। ‘

‘ বলব না৷ ‘

‘আমিও ছাড়ব না। ‘

কথাটা বলার পর নিধি খেয়াল করল সৌধ শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। ধীরেধীরে মুখ এগুচ্ছে ঘাড়ের দিকে। আচমকা সৌধর বুকে ধাক্কা মারল দুহাতে। বলল,

‘ আমাকে সময় দে দোস্ত প্লিজ প্লিজ প্লিজ। প্লিজ কিছু করিস না৷ মরে যাব, মরে যাব আমি। প্লিজ সৌধ আমাকে সময় দে। ‘

থেমে গেল সৌধ। ত্বরিত গিয়ে লাইট অন করে ছুটে এলো আবার৷ দু’হাতে আলতো করে নিধির গাল চেপে ধরে বলল,

‘ এই, এই কাঁদছিস কেন? কিছু করিনি আচ্ছা সরি সরি। আমারি ভুল সময় চাই তোর? ওকে ফাইন। আরে মেয়ে কাঁদবি না। একদম না। ‘

চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল সৌধ। নিধি ওর বুকে শক্ত দুটো কিল দিয়ে বলল,

‘ তুই খুব খারাপ সৌধ। ‘

আলতো হেসে সৌধ বলল,

‘ তোর জন্য আমি খারাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারি নিধি৷ আবার তোর জন্যই ভালোদের শীর্ষে থাকতে রাজি। ‘

অশ্রুসিক্ত নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে নিধি। মনে মনে বলল,

‘ অনেক ভাগ্য করে তোর মতো ছেলের ভালোবাসা পাওয়া যায় সৌধ। ‘

সৌধ কি শুনল কথাটা? অদ্ভুত ভাবে হাসল একটুখানি। এরপর ওর গলার ওড়না ঠিক করে দিল নিজ হাতে। চুলগুলোও ঠিক করে দিয়ে বলল,

‘ চল সবাই আমাদের খুঁজছে হয়তো। ‘
***
তিনদিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে উদয়িনী। এই তিনদিন নামীকে খুব সাবধানে থাকতে হবে৷ উদয়িনীর সামনে পড়া যাবে না একদম৷ এই মহিলা খুব সাংঘাতিক। অপমান করে কলিজা সিদ্ধ করে ফেলে। আর সে জবাব দিলেই সুহাস রেগেমেগে ভুত হয়ে ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেয়। কয়েকমাস হলো সুহাসের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। পায়ে পা লাগিয়ে এখন আর ঝগড়া করতে আসে না। মাঝেমধ্যেই ছাদে দেখা হয়ে গেলে টুকটাক স্বাভাবিক কথাবার্তা হয় এখন৷ নামীর কেন যেন ভালো লাগে এই সুহাসকে। ইচ্ছে করে ছেলেটাকে ভালোবেসে আরো বদলে দিতে৷ যে ছেলে কয়েকটা কড়া কথায় এতটুকু পরিবর্তন হতে পারে। সে ছেলেকে ভালোবাসা দিয়ে বুঝালে আরো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। শুনেছে অরিন বাদে আর কারো সাথেই কথা বলে না সুহাস। অরিনের সাথেও খুব অল্প কথাবার্তা হয় এখন। নামমাত্র গার্লফ্রেন্ড। দেখাসাক্ষাৎ একেবারে বন্ধই করে দিয়েছে। এসব আইয়াজ বলেছে ফারাহকে। আর ফারাহ বলেছে নামীকে। কলেজ থেকে এসে খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছিল নামী। ঘুম ভেঙে গেল দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে৷ দরজা খুলতেই দেখতে পেল উদয়িনী রণমুর্তি ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে দরজা খুলতেই দু’টো বস্ত্র ছুঁড়ে মারল মুখে। বস্ত্র দু’টির মধ্যে একটি নামীর ওড়না আরেকটি অন্তর্বাস। যা সুহাসের কাভার্ড গোছাতে গিয়ে পেয়েছে উদয়িনী। ছেলের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস আর ক্রোধটুকু প্রকাশ করতে পারেনি সে৷ কারণ সুহাস ক্লাসে গেছে। পাঁচটার পর বাসায় আসবে। সুহাসকে পড়ে বুঝে নেবে। আপাতত নিলুর মেয়েকে শায়েস্তা করবে সে।

নামীর শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই সুহাসের ঘরে এসব পেয়েছে মিসেস উদয়িনী? একদিকে লজ্জা অপরদিকে ভয়ে শরীরে ঘাম ছেড়ে দিল নামীর। আর উদয়িনী করে বসল ভয়াবহ এক ঘটনা। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে সম্পূর্ণ ছাই ফেলল নামীর ওপর৷ আকস্মিক নিজের হাতের পাঁচটা আঙুল বসিয়ে দিল নামীর শ্যামলাটে নরম গালে। শুধু তাই নয় একাধারে কুরুচিপূর্ণ বাক্যে নামীর সমস্ত সত্তাকে নাড়িয়ে তুলল। ঠোঁটের কোণা বেয়ে রক্ত ছলকে পড়ছে নামীর। দু’চোখ উপচে বেরোচ্ছে অশ্রুধারা। সেদিকে খেয়াল নেই উদয়িনীর। সে নামীর শরীরে আঘাত করার পাশাপাশি মনকেও আঘাতে আঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ব্যস্ত৷ বাবা, মায়ের আদুরে সন্তান নামীর আজ কী এটাই প্রাপ্য ছিল? এ বাড়িতে সে রয়েছে শুধুমাত্র সোহান খন্দকারের অনুরোধে। সে যেচে পড়ে থাকতে আসেনি৷ এমনও নয় তার ভরণপোষণের দায়িত্ব সোহান খন্দকারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে তার দুটো ব্যাংক একাউন্ট। একটাতে আমেরিকা থেকে প্রতি মাসে বাবা টাকা পাঠায়৷ আরেকটাতে তার নামে টাকা রয়েছে পয়ত্রিশ লক্ষ। একজন সফল ব্যবসায়ীর মেয়ে হয়ে এভাবে ডক্টর উদয়িনীর অপমান, খাওয়া পরার খোঁটা শুনবে? কী ভেবেছে উদয়িনী তার হাজব্যন্ডের অর্থে সে চলছে৷ পড়াশোনা করছে? পৃথিবী উলটেপালটে যাক। ধ্বংস হয়ে যাক এ পৃথিবী। তবু এই অপমান সহ্য করবে না সে। মিসেস উদয়িনীকে আজ যোগ্য কিছু জবাব দিয়ে বেরিয়ে যাবে এ বাড়ি থেকে। তার কাছে সম্পর্কের চেয়েও, সোহান খন্দকারের অনুরোধের চেয়েও নিজের আত্মসম্মানটা বড়ো!

চলবে..

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৮

ঠোঁটের কোণা বেয়ে পড়া রক্ত টুকু তর্জনীতে মুছে নিল নামী৷ মুছে নিল গাল বেয়ে পড়া অশ্রুটুকুও৷ এরপর নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ মিসেস উদয়িনী, অনেক বলেছেন আপনি। এবার আপনার শোনার পালা। ‘

চমকে গেল উদয়িনী। হতভম্ব মুখে তাকিয়ে রইল নামীর বিধ্বস্ত মুখপানে। বুক কেঁপে ওঠল বহু বছর পূর্বে দেখা সেই মুখটিকে মনে করে। সে মুখটা নিলুর। আজ নামী যেন নিলু রূপেই তার সামনে দাঁড়িয়ে। ঢোক গিলল সে। দৃষ্টিজোড়া তির্যক করে বলল,

‘ বেয়াদব মেয়ে নাম ধরে ডাকছিস আমার? ‘

‘ আপনি আমার খুব আদবের শাশুড়ি নন, অধিকারও দেননি যে শাশুড়ি মা বলে ডাকব। ‘

দাঁতে দাঁত পিষে কম্পিত গলায় বলল নামী। উদয়িনী স্তম্ভিত হয়ে গেল এই মেয়ের সাহস দেখে। তেড়ে আসল কষিয়ে আরো একটা থাপ্পড় লাগাতে। কিন্তু সফল হলো না। তার পূর্বেই নামী তার হাত ধরে ময়লা ঝাড়ার মতো করে ছুঁড়ে ফেলল। কিঞ্চিৎ ব্যথা পেয়ে মুখ হা হয়ে গেল উদয়িনীর। ডান বাহুতে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল৷ তার সে চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে সেলিনা আপা দৌড়ে এলেন। নামী আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। এই নিচু মহিলার আর একটি কথা শোনা তো দূরে থাক মুখ দর্শনও করার ইচ্ছে নেই তার। শুধু সঠিক কিছু জবাব দিয়ে চলে যাওয়ার অপেক্ষা। এ ঘরে তার জন্য ছোট্ট একটা বুকশেলফ এনেছিল সোহান খন্দকার। উপরের তাকে শেষ দিকে কয়েকটা ডায়ারি। তার মধ্যে সবুজ রঙের সবচেয়ে পুরোনো ডায়ারিটা নিয়ে ফের উদয়িনীর সম্মুখে দাঁড়াল নামী। উদয়িনী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নামী মুখে তাচ্ছিল্যতা মিশিয়ে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ এই ডায়ারিটা আপনার ছেলেকে পড়তে বলেছিলাম। সে আপনাকে এতটাই বিশ্বাস করে। উহুম অন্ধ বিশ্বাস করে যে এটা ছুঁয়েও দেখেনি। ‘

ভয়ানক ভাবে চমকে গেল উদয়িনী। ত্বরিত তাকাল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিনার দিকে৷ কড়া গলায় বলল,

‘ সেলিনা, তুই এখান থেকে যা। ‘

ভয়ে তৎক্ষনাৎ চলে গেল সেলিনা। উদয়িনী মানুষটাই এমন যার ভয়ে বাড়ির কাজের লোক থেকে পরিবারের সদস্য। সবাই তটস্থ থাকে। সেলিনা চলে যেতেই নামী আবারো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,

‘ এত ভয়! এটাই স্বাভাবিক। যারা অন্যায় করে ভয় তো তারাই পায়। ‘

‘ কী বলতে চাচ্ছিস তুই? ‘

চোখ, মুখ শক্ত হয়ে গেল নামীর। পৃথিবীতে বোধহয় এই মহিলাই প্রথম যে তার সঙ্গে কদর্য আচরণ করছে। তাই আর সময় নিল না সে। ডায়ারিটা দেখিয়ে বলতে শুরু করল,

‘ আমার কি মনে হয় জানেন? সুহাস ভয় পেত এটা পড়তে৷ যদি মায়ের বিরুদ্ধে কোনো চরম সত্যি জেনে যায়? পৃথিবীতে সবার বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু জন্মদাত্রী মায়ের বিশ্বাসঘাতকতা না। যখন এটা বুঝতে পারলাম তখন থেকে আর চেষ্টা করিনি সুহাসের ভুল ভাঙাতে। আংকেলকেও নিষেধ করে দিয়েছিলাম। ডক্টর উদয়িনীকে দয়া করেছিলাম যেন তার ছেলে তাকে ভুল বুঝে দূরে চলে না যায়। আপনি কি জানেন, আপনার ভেতরের অমানবিকতা পুরোপুরি আপনার দুই ছেলেমেয়ে ধারণ করেনি। ওদের ভেতরে নিষ্পাপ একটা মন আছে? ‘

শেষ বাক্য দুটো ফিসফিস করেই বলল নামী। তীব্র ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল উদয়িনী৷ ইচ্ছে হলো মেয়েটার গলা টিপে কণ্ঠনালী রোধ করতে৷ দু-হাত শক্ত মুঠ করে দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির ন্যায়। নামী থেমে রইল না। সে বলতে থাকল লুকিয়ে রাখা সেই অতীত৷ যে অতীত ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করে গেছে নামীর মা নিলু।

‘ উদয়িনী আর নিলুফা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল তাই না ডক্টর উদয়িনী? ‘

এ প্রশ্নে আতঙ্কিত হয়ে তাকাল উদয়িনী। নামী সব জানে সব৷ ঘামতে শুরু করল সে। ওড়নার কোণা ধরে মুছতে শুরু করল কপাল, মুখ আর গলা বেয়ে নিঃসৃত হওয়া স্বেদজল। নামী বলল,

‘ আম্মু আর আংকেলের সাত বছরের সম্পর্ক ছিল। আপনি ছিলেন আমার মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। আম্মু তার জীবনের সমস্ত ঘটনা আপনার সাথে শেয়ার করত৷ শেয়ার করেছিল আংকেলের কথাও। আপনাকে নিয়ে জাস্ট তিনবার দেখা করেছিল আংকেলের সাথে। প্রথম দেখাতেই আপনি চিনতে পারেন সোহান আংকেলকে। সোহান আংকেল আপনার বাবার বন্ধুর ছেলে। আপনার অহমিকায় আঘাত পড়ে সেদিনই। অত্যাধিক সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও আপনি নিখুঁত প্রেমিক আর ভালোবাসা পাননি। আর নিলু শ্যামলা চেহারার হয়েও সোহান খন্দকারের মতো সুদর্শন পুরুষের খাঁটি ভালোবাসা পাচ্ছে। ঠিক এখানটাতেই আঘাত পান আপনি। আপনার মনে হতে থাকে সোহান খন্দকার নিলুর জন্য পারফেক্ট নয়৷ উনি পারফেক্ট কেবল আপনার জন্যই। সেদিন থেকেই একের পর এক ষড়যন্ত্র শুরু করে দেন৷ আর আপনাকে সাহায্য করে আপনার বড়োলোক দাদুভাই, বাবা আর আপনার প্রয়াত শশুর, শাশুড়ি। তারা চাইতেন আপনার সঙ্গে আংকেলের বিয়ে হোক৷ এরপর আপনার বাবার সকল প্রোপার্টির মালিক হোক সোহান আংকেল। কারণ আম্মু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিল। মধ্যবিত্ত ছিল আংকেলের পরিবারও৷ তাই তারা আপনার মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েকে ঘরের বউ করার স্বপ্ন দেখেছিল। দু’জন মানুষের হৃদয় ভেঙে, স্বপ্ন ধ্বংস করে আপনারা সফল হয়েছেন৷ পূরণ করেছেন নিজেদের অন্যায় স্বপ্নকে। আম্মু যেদিন জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটিকে কেড়ে নিয়েছে তারই প্রিয় বান্ধবী। সেদিন একদিকে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা অপরদিকে বান্ধবীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষাক্ত ব্যথা সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সে যাত্রায় আম্মু বেঁচে যায়৷ সোহান আংকেল সব বাঁধা পেরিয়ে হসপিটালে ছুটে আসে। নানা, নানু, মামাদের সামনে পা ধরে ক্ষমা চায় আম্মুর। আমার আম্মু নির্বাক হয়ে শুধু দুচোখে অশ্রু ঝাড়িয়েছিল। সোহান আংকেল বুঝে গিয়েছিল তার নিলু তাকে ক্ষমা করলেও তার সঙ্গে কথা বলতে বা তার মুখ দেখতে আগ্রহী নয়। ভালোবাসার মানুষকে চাইলেও ঘৃণা করা যায় না। আম্মুও পারেনি ঘৃণা করতে৷ তাই ক্ষমার সঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করা পুরুষকে চিরমুক্তি দিয়ে দান করেছিল আপনাকে। আফসোস আপনার মনের কদর্যতার ভীড়ে সোহান আংকেল জায়গা পায়নি। একটা কথা চিরসত্য যা আম্মু স্পষ্ট করে লিখে গেছে, ঐ সময় পরিস্থিতি এমনই ছিল যে সোহান আংকেলকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না৷ তবে আংশিক দোষী সে ছিলই৷ আমার কী মনে হয় জানেন মিসেস উদয়িনী? ওই ঘটনা গুলো যদি আজকের এই সময়ে ঘটত সোহান খন্দকারকে আপনি পেতেন না৷ আংশিক দোষীও সে হতো না। আফসোস সময়টা তখন অন্যরকম ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই জানে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা কেমন হয় কী প্রকারের হয়? আংকেল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিল। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সেক্রিফাইস করতে করতে জীবন, যৌবন সব ধ্বংস হয়ে যায়। যার চাক্ষুষ প্রমাণ সোহান আংকেল! তিনি তার নিলুকে এতটাই ভালোবাসত যে শেষে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে তার বন্ধু মানে আমার বাবার হাতে তুলে দেয় আম্মুকে। আম্মুও প্রেমিকের বাছাই করা পাত্রকে সাদরে গ্রহণ করে সুখের সংসার পাতে। আপনি হেরে গিয়েছিলেন, আবারো হেরে গিয়েছিলেন নিলুর কাছে। কারণ সে স্বামীর পরিপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে সংসার করেছে। যা আপনি আজো পারেননি। ‘

দু’হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল উদয়িনী।

‘ তুই থাম, থাম তুই নিলুর বাচ্চা! ‘

ঘৃণাভরে তাকায় নামী। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ কতটা হিংসাত্মক হতে পারে উদয়িনীই তার প্রমাণ।
সে খেয়াল করল, উদয়িনীর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠেছে৷ কান থেকে হাত সরিয়ে বুকের বা’পাশে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তাই জিজ্ঞেস করল,

‘ কষ্ট হচ্ছে নিজের ব্যর্থতাকে স্মরণ করে? বয়স তো অনেক হলো তবু কেন বুঝতে পারছেন না, ষড়যন্ত্র করে আর যাইহোক জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় না। ‘

‘ শাটআপ! ‘

‘ সত্যিই মানতে হবে.. মনে জোর না থাকলেও মুখে বেশ জোর আপনার। আম্মু ঠিকই বলেছে আই মিন ঠিকই লিখেছে। ‘

মৃদু হাসল নামী। যে হাসি উদয়িনীকে আরো বেশি ক্ষিপ্ত করে তুলল। আর সহ্য করতে পারছিল না সে। নামীও বুঝল যতটুকু বলার ছিল বলা শেষ। এবার যেতে হবে। তাই বলল,

‘ মিসেস উদয়িনী? আজ আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আপনার যদি ক্ষমতা থাকে স্বামী আর পুত্রকে আমার থেকে আটকে রাখবেন৷ যদি না পারেন সেই দায় আমার নয়। আমি স্টিল নাও সুহাস খন্দকারের স্ত্রী। আমার স্বামী যদি সম্মানের সাথে আমাকে গ্রহণ করতে চায় পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই আমাকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দেয়ার৷ আর আমার স্বামী যদি আমাকে ত্যাগ করতে চায় পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই তার জীবনে আমাকে আটকে রাখার জাস্ট মাইন্ড ইট। ‘

এরপরই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায় নামী।
উদয়িনী নামীর মুখে অতীত শুনে কিছুক্ষণের জন্য অস্বাভাবিক হলেও পরোক্ষণেই সামলে ওঠে। আর মনে মনে বিজয়ের হাসি হাসে৷

দু’জন যুবক, যুবতী এক বাড়িতে রয়েছে। সম্পর্কে স্বামী – স্ত্রী৷ যতই ছেলের মনে বিষ ঢুকিয়ে দিক। পুরুষ মানুষ তো। আর নামী, সে তো নিলুর মতোই বশীকরণমন্ত্র জানে৷ নয়তো কীভাবে আকস্মিক তাদের জীবনে হানা দিল? স্বামী, সন্তানকে বশ করে কীভাবে প্রবেশ করল এ বাড়িতে? নিজের ভুলটা বুঝতে পারল উদয়িনী। একদমই উচিত হয়নি সুহাসকে এভাবে ছেড়ে রাখা। না জানি ঠিক কতটা গভীরতায় পৌঁছেছিল নামী আর সুহাসের সম্পর্ক। সে ভয়েই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে উদয়িনী। মুখে যা ইচ্ছে তাই বলেই ক্ষ্যান্ত হননি। গায়েও হাত তুলেছে৷ কিন্তু ভাবতেও পারেননি এর পরিণাম ঠিক কী দাঁড়াতে পারে। যে ভয়ে সে নামীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করল। আজকের পর থেকে সেটাই যে সত্যি হবে ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না। সে কেবল নামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা উপভোগ করলেন। বহু বছর আগের মতোই মনে মনে মিথ্যা স্বান্তনা পেলেন। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল সোহান খন্দকার নিলুকে ভালোবাসলেও বিয়ে করতে পারেনি। এই একটা জায়গায় আটকে ছিল সোহান।
আর সুহাস নামীকে ভালো না বাসলেও তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছে। আইনিভাবেও স্বীকৃত বউ নামী সুহাসের। যেখানে সম্পর্ক হালাল সেখানে মনের মিলন হতে কতক্ষণ? সৃষ্টিকর্তা হারাম সম্পর্কে রহমত দান না করলেও হালাল সম্পর্কে ঠিকই রহমত দান করেন৷
***
ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসের পেছনে চলে এলো চার বন্ধু আর দুই বান্ধবী। পরপর সিঁড়িতে বসল সবাই। আইয়াজের মুখ ভার। তার মনের বিষণ্ণতা চোখ, মুখ উপচে বেরুচ্ছে। সর্বপ্রথম খেয়াল করেছে নিধি। ক্লাস টাইমেই সে খেয়াল করে আজ আইয়াজ অন্যমনস্ক। ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্রের অমনোযোগী রূপ দেখে শুধু বন্ধুরাই নয়। বায়োকেমিস্ট্রি লেকচারারও ধমকেছে। হঠাৎ করে কী হলো আইয়াজের? সবাই বেশ চিন্তিত। সৌধ আজিজকে বলল,

‘ ও তো কিছু বলবে না। নিজের সমস্যা গুলো বরাবরই চেপে রাখে৷ তুই’ই ওর এ কয়েকদিনের গতিবিধি জানা৷ ‘

আজিজ আর আইয়াজ হোস্টেলে একই রুমে থাকে। তাই আজিজ গড়গড় করে বলতে শুরু করল,

‘ আর বলিস না মাম্মা, কয়টা মাস ধরে এই শা’লার জন্য ঘুমাইতে পারি না৷ এগারোটা পর্যন্ত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। তারপরই শুরু হয় ক্যালমা। এই ক্যালমা চলতে চলতে ফজরের আজানও দিয়া দেয়। তাও শা’লার ক্যালমা শেষ হয় না। ক্যালমা দেখাইতে দেখাইতে কাল রাত থেকে ভং ধরছে৷ ‘

আজিজের কথার ধরন দেখে সুহাস হেসে কুটিকুটি। প্রাচী সুহাসের মাথা গাট্টা মেরে বলল,

‘ সিরিয়াস মোমেন্টে হাসবি না সুহাস৷ ‘

সুহাস হাসি থামালে নিধি আজিজকে বলল,

‘ মন মেজাজ ভালো নাই আজিজ৷ ভণিতা না করে ভালোয় ভালোয় বল কাল রাতে কী হয়েছে? ‘

সৌধ নিধির কুঁচকানো কপালের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তোর সমস্যা কী? ঠিক কাকে মেজাজ দেখাচ্ছিস তুই? ‘

সৌধর কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না নিধি। আজিজের সামনে গিয়ে কড়া গলায় বলল,

‘ তুই বলবি? ‘

ঢোক গিলল আজিজ। বলল,

‘ আররে মাম্মি ডর দেখাস ক্যান।’

চোয়াল শক্ত করে কঠিন চোখে তাকাল নিধি। আজিজ ভড়কে গিয়ে বলল,

‘বলতাছি বলতাছি।’

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে থম মেরে বসে থাকা আইয়াজের দিকে তাকাল নিধি। আজিজ বলল,

‘ কাল রাত দুইটার সময় ফারাহ ফোন করে নাকি অনেক কান্নাকাটি করেছে৷ আর বলেছে সম্পর্কটা আর আগানো সম্ভব না। ‘

‘ হোয়াট! ‘

সৌধ, নিধি, প্রাচী, সুহাস চারজন একইসঙ্গে চ্যাঁচিয়ে ওঠল। সৌধ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,

‘ মামাবাড়ির আবদার নাকি! আইয়াজ এই মেয়ে তোর ইমোশন নিয়ে খেলল না তো? ‘

প্রাচী ক্রোধ মিশ্রিত গলায় বলল,

‘ ভোলাভালা পোলাপানের সাথে এটাই হয়। ধূরর বা’ল ইনোসেন্ট পোলাডার জীবনে একটা প্রেম আসল তাও নাকি এমন। ‘

বলতে বলতেই আইয়াজের পাশে গিয়ে বসল প্রাচী৷ চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ দোস্ত প্লিজ তুই ভেঙে পড়িস না। মাত্র কয়েক মাসেরই তো ব্যাপার। মুভ অন করে ফেল। ‘

প্রাচীর এহেন কথা আইয়াজ এমন ভাবে তাকাল যে উপস্থিত সকলেই ভয় পেয়ে গেল। সৌধ বুঝতে পারল আইয়াজের মনের অবস্থা তাই সবাইকে সরতে বলে ও গিয়ে বসল পাশে। বলল,

‘ কী কারণে ফারাহ এমনটা বলেছে? ‘

নিধি বলল,

‘ আমি কি একবার নামীর সাথে কথা বলব? ‘

তৎক্ষনাৎ সুহাস বলল,

‘ নামীদামির কারসাজি নয়তো? ‘

সৌধ ধমকে ওঠল। বলল,

‘ ফাইজলামি করবি না সুহাস৷ আমরা এখন সিরিয়াস আলোচনা করছি৷ ‘

এ কথা বলেই আইয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ কারণ বলেনি? ‘

আইয়াজ মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে বলল,

‘ অনেক কান্নাকাটি করছিল আর সম্পর্কের ইতি টানতে চাচ্ছিল। এ-র বেশি কিছুই বলেনি। ‘

‘ তুই কি বললি? ‘

‘কিছু না, ফোন কেটে দিয়েছি। ‘

নিধি বলল,

‘ শখ করে ব্রেকআপ করলে কাঁদবে কেন? ‘

আইয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ শখ করে করলে মেনে নিতাম। আমার মনে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। ‘

সৌধ নাক খিঁচাল ভালোবাসার ঊর্ধ্বে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না৷ তাই বলল,

‘ ব্রেকআপ চাইলেই ব্রেকআপ দিবি? মানানোর চেষ্টা কর৷ না মানলে তুলে এনে জাস্ট বিয়ে করাই দিব চিল ম্যান। ‘

সকলের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা। নিধি নড়েচড়ে ওঠল সৌধর কথা শুনে৷ উপস্থিত সকলেই জানে সৌধ মোটেই ফাঁকা আওয়াজ দেয়নি। এ জন্যই মুখটা চুপসে গেছে নিধির। যা দেখে ফিচেল হাসল সৌধ। বলল,

‘ চল ওঠ সবাই। আর আইয়াজ তুই আমার সঙ্গে চল আজ আমার সাথে থাকবি৷ ফারাহকে বুঝাবি না বুঝলে আমি বুঝাব। আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে৷ না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিব৷ আপাতত প্রথমটা ট্রাই করব আজ। ‘

আইয়াজকে কথাটা বলেই সুহাসকে বলল,

‘ আর তুই নামীর কাছ থেকে জানার চেষ্টা করবি। বেস্ট ফ্রেন্ড ওরা৷ হতে পারে পার্সোনাল কোনো প্রবলেম যা আইয়াজকে বলতে পারছে না কিন্তু নামীকে বলেছে।’
***
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফারাহকে কল করেছিল নামী৷ ফারাহর ফোন বন্ধ। কী করবে কোথায় যাবে মাথা কাজ করছিল না তার। অতিরিক্ত রাগ আর দুঃশ্চিন্তায় মাথা ঘুরছিল খুব। কোনো উপায় না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত নিজের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবে। তারপর বাড়ির লোকের সাথে আলোচনা করে হোস্টেলে ওঠবে। বড়ো মুখ করে উদয়িনীকে বলে এসেছে তার ছেলে কাছে এলে গ্রহণ করবে। কিন্তু অতো সৌভাগ্য যে তার নেই সে খুব ভালো করেই জানে। সুহাস হয়তো এখন তার সঙ্গে আগের মতো খারাপ আচরণ করে না৷ তাই বলে তাকে বউ বলে মানে এমনটাও নয়৷ জেদের বশে উদয়িনীকে আঘাত করতেই কথাটা বলেছিল সে। ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রিকশা নিল বাসটার্মিনালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে রিকশা থেকে পড়ে গেল মেয়েটা। মুহুর্তেই হুলস্থুল অবস্থা তৈরি হয়ে গেল রাস্তায়। জ্ঞানহারা মেয়েটাকে ধরাধরি করে নেয়া হলো সদর হাসপাতালে। নিধির এক বান্ধবী সে সময় ওই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিল। চলন্ত রিকশা থেকে সে নামীকে চিনতে পারে। আর তৎক্ষনাৎ নিধিকে কল করে জানায়,

‘ এই নিধি আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়র মেয়েটা আছে না? ঐ যে যার সাথে তোর বেশ ভালো সম্পর্ক। শ্যামলা করে মেয়েটা? সে তো সেন্স লেস হয়ে রাস্তায় পড়ে গেছে৷ সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল! ‘
.
সুহাস মাত্রই বাড়িতে এসেছে। উদয়িনী তখন নিজ রুমে কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিল। এই সুযোগে সেলিনা আপা সুহাসকে গড়গড় করে বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বলে দিল। যতটুকু সে জেনেছে শুনেছে ঠিক ততটুকুই। এরপর ওড়না মুখে চেপে কেঁদে দিয়ে বলল,

‘ আহারে গো মেয়াডারে ক্যামনে মারল। চাচির মনে আল্লাহ দয়ামায়া দেয়নাই গো ভাই। মেয়েডা এত কষ্ট অপমান সহ্য করবার না পাইয়া চইলা গেল। আল্লাহ জানে চাচা রাইতে আইসা কী তাণ্ডব বাজায়! আল্লাহ জানে মেয়াডা কই গেল? মা নাই, বাবা দেশে নাই আহারে গো! ‘

সেলিনার বলা কথাগুলো আর হায় হুতাশ শুনে সুহাসের সমস্ত পৃথিবীই যেন থমকে গেল। তার মা হঠাৎ কেন এমন করল? বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতায় দম বন্ধ হয়ে এলো তার। হুঁশে হোক আর বেহুঁশে নিজের রুম পর্যন্ত আর গেল না সে।ড্রয়িংরুমেই ব্যাগ ফেলে অ্যাপ্রোন ফেলে মোবাইল আর বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল। এদিকে প্রাচীকে নিয়ে নিধি সদর হাসপাতালের পথে পা বাড়িয়েছে। রিকশায় ওঠেই সৌধকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে,

‘ সুহাসকে নিয়ে ইমিডিয়েটলি সদর হাসপাতাল চলে আয় সৌধ। ‘

সৌধকে কথাটা বলেই ফোন কেটে কল করল নামীকে। এদিকে সুহাসও নামীর ফোনে লাগাতার কল করে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে নিধি, সুহাস একসঙ্গে ফোন দেয়া শুরু করল দু’জনই দু’দিকে থেকে নামীর ফোন ব্যস্ত পায়। সুহাসের ফোনে ঐ সময়ই একটি ম্যাসেজ আসে সৌধর,

‘ এই শা’লা তোর ফোন ব্যস্ত কেন? নিধি তোকে নিয়ে এক্ষুনি সদর হাসপাতালে যেতে বলল। আমি তোর বাড়ির কাছাকাছিই বের হ দ্রুত। ‘

সুহাসের বুকের ভেতর ধক করে ওঠল ম্যাসেজটা পেয়ে। হাসপাতালে কেন যেতে বলছে নিধি? নামীর কিছু হলো কী? ভীতিগ্রস্ত হয়ে চোখ, মুখ রক্তিম হয়ে ওঠল সুহাসের। বিড়বিড় করে বলল, ‘ না না নামী হাসপাতালে যাবে কী করে নিধি হয়তো অন্য কোনো দরকার বা অন্যকারো দরকারে যেতে বলেছে। ‘

অবিশ্বাস হলেও সত্যি সুহাসের এ মুহুর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। নামীদামির জন্য দুঃশ্চিন্তায় নিজেকে এত অসহায় লাগছে কেন? আকস্মিক এ কোন সঙ্কটে পড়ল সে?

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৯

সৌধর গাড়ি এসে থামল সদর হাসপাতালের সামনে। সুহাস ত্বরিত গাড়ি থেকে নেমে দৌড় লাগাল৷ সৌধ মুখে মাস্ক পরে অপেক্ষা করতে লাগল ওদের ফিরে আসার৷ সে নিজে আর নামল না৷ দেখা গেল কেউ চিনে ফেললে বাবা, ভাইকে জানিয়ে দেবে। আর তারা রাগারাগি করবে একা একা বের হওয়ায়।
সুজা এমপির অত্যাধিক সুদর্শন, ছোটো পুত্রকে এ শহরের কে না চেনে? বাবা, চাচা, ভাইরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সে এসবে জড়ায়নি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। এমপির ছেলে সৌধ চৌধুরী। বর্তমানে মেডিকেল দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। যেমন মেধাবী তেমন সুদর্শন। মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব জিমে এক্সারসাইজ করা ভিডিয়ো আপলোড দেয়। যেগুলোতে হিউজ পরিমাণ ভিউ পড়ে৷ কমেন্ট বক্সে জড়ো হয় অগণিত মেয়েদের ঘায়েল হওয়ার বার্তা। এত অল্প বয়সে সকলের নজড়ে এভাবে চলে আসবে সৌধ তার পরিবারের কেউ ধারণাও করতে পারেনি৷ মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞায় বড়ো ভাই, বাবা তাকে রাজনীতির পথেও আসতে দেয়নি৷ অথচ বড়ো ভাইয়ের চেয়েও তুমুল জনপ্রিয় সে। সৌধর ফ্যান ফলোয়ারদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক জানে সে সুজা চৌধুরীর ছেলে৷ এরপরও সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। তার বন্ধুর ঝুলি পূর্ণ হলেও শত্রুর ঝুলি শূন্য। কিন্তু পারিবারিক শত্রুর অভাব নেই। বাবার আদেশ আছে একা একা ঘুরাফেরা না করার। সেই আদেশ অমান্য করেই বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে৷ নিজ বুদ্ধিমত্তায় যতটুকু সম্ভব নিরাপদে থাকারও চেষ্টা করে।

নামীকে দেখে যারপরনাই অবাক হচ্ছে নিধি, প্রাচী। এই মেয়েটা কি পাথর দিয়ে গড়া? বাড়িতে কী ঘটেছে জানে না তারা৷ তবে বুঝে নিল, সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে বলেই ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। উপরে উপরে শক্ত থাকলেও ভিতরে ভিতরে তীব্র কষ্টে অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ অথচ এ মুহুর্তে চোখ দু’টো নির্বিকার। মুখে মলিন হাসি। হাত, পায়ে ছিলে যাওয়া ত্বকে মেডিসিন দিয়ে ওষুধ লিখে দেয়া হয়েছে৷ নামী সে সব বুঝে নিয়ে নিধি, প্রাচীর উদ্দেশ্যে বলল,

‘ আমার বিপদের কথা শুনে তোমরা এভাবে ছুটে আসবে ভাবতে পারিনি। ধন্যবাদ। ‘

এইটুকু বলেই ব্যাগপত্র নিয়ে বাসটার্মিনাল যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াল। যে মেয়েটা কিছুক্ষণ পূর্বে অজ্ঞান হয়ে পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। সে মেয়েটা এত দ্রুতই নিজেকে কীভাবে শক্ত করে নিল? ভাবতেই গা শিউরে ওঠল নিধির৷ সে ত্বরিত নামীর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে প্রাচীকে বলল,

‘ ওর জন্য ডাব কিনে নিয়ে আয়। আমরা ওপাশে বসার জায়গায় গিয়ে বসি৷ ‘

এরপর নামীকে বলল,

‘ এদিকে এসো বসো এখানে। ‘

নামী বসতে রাজি হলো না। সে মুহূর্তেই তীব্র দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ নিয়ে উপস্থিত হলো সুহাস। একটু চমকালেও নিজেকে সামলে নিল নামী। সুহাস কোনোদিকে না তাকিয়ে আচমকা ওর হাত চেপে ধরে বলল,

‘ কী হয়েছে তোমার? ‘

নামী চাপা আর্তনাদ করে ওঠল। নিধি চ্যাঁচিয়ে বলল,

‘ ওই ছাড়, রিকশা থেকে পড়ে ব্যথা পাইছে। ওখানেও জখম হইছে। ‘

সহসা হাত ছেড়ে দিল সুহাস। নামী শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের পাশ দিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ লোক হাঁটা পা থামিয়ে তাকিয়ে রইল ভ্রু কুঁচকে। নিধি খেয়াল করে মুখ ফিরিয়ে নিল। নামী ইতস্ততভাবে দাঁড়িয়ে। ওদের ভাবমূর্তি দেখে সুহাস পাশে থাকা ভদ্রলোককে দেখে মৃদু হাসল। ভদ্রলোকের মুখ কঠিন হলো এতে। সুহাস বুঝল লোকটা তাকে সন্দেহ করছে। তার চটপটে চেহেরা নিয়ে হয়েছে জ্বালা। সবাই দুষ্ট প্রকৃতিরই ভাবে। তাই বলল,

‘ কিছু বলবেন আংকেল? ‘

উত্তর দিল না ভদ্রলোক। তাকাল নামীর দিকে। তার চাহনি খেয়াল করে সুহাস চোখমুখ কুঁচকে বলল,

‘ ও আমার বউ। ‘

লোকটা চমকে ওঠল। চমকে ওঠল নামী আর নিধিও৷ সে চমকানো দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল সুহাস৷ নামীর বিস্মিত দৃষ্টি দেখে কানের নিচে চুলকাতে শুরু করল৷ ভদ্রলোক নামীর দিকে তাকাল জহরি চোখে। নামী খেয়াল করল লোকটা তার দিকে প্রশ্নসূচকে তাকিয়ে। তাই জোরপূর্বক হেসে বোঝাল সুহাসের কথাই ঠিক৷ সে তার বউ। এবারে লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থান ত্যাগ করল। সুহাস তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

‘ এদের জন্য শান্তি নেই। ব্যাটা হসপিটালে আসছিস নিজের রোগি থাকলে তাকে সামলা। অন্যের রোগির দিকে খেয়াল দিতে কে বলেছে? ‘

নিধি বিস্মিত দৃষ্টিতে সুহাসকে আপাদমস্তক দেখতে লাগল৷ নামী তার সকল বিস্ময় ঝেড়ে প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে নিধির থেকে লাগেজ নিয়ে বলল,

‘ আসছি আপু। ‘

সুহাস চমকে ওঠে খপ করে লাগেজ নিয়ে নিল হাত থেকে। অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ আসছি মানে! ‘

নামী জবাব দিল না। প্রাচী ডাব কিনে এনে নামীকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ এটা খেয়ে নাও শরীর ভালো লাগবে। ‘

নামী নিতে চাইল না। সে দম আটকে দাঁড়িয়ে রইল। সুহাসের সামনে থেকে যেতে পারলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আজ সুহাসের কর্মকাণ্ড দেখে বান্ধবীরা ভাবল, নিশ্চিত নেশা করেছে এই ছেলে। প্রাচীর হাত থেকে ডাব নিয়ে নামীর সামনে ধরল সুহাস। বলল,

‘ আমি ধরে রেখেছি৷ তুমি খাও। ‘

আকস্মিক দরদে মেজাজ খারাপ করল নামীর৷ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘ এসব আলগা দরদ দেখাতে আসবেন না। ‘

‘ এই নামীদামি একদম দাম দেখাবে না। যা বলছি তাই করো। ‘

ধমকে ওঠল সুহাস। নিধি বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বিস্ময়ে কেশে ওঠল প্রাচীও। নামী থমথমে মুখে চারপাশে তাকিয়ে দেখল কয়েকজন তাদের দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিধি ভীত স্বরে বলল,

‘ এই সুহাস আস্তে কথা বল। ছিঃ ছিঃ মানুষ তাকাই আছে। ‘

সুহাস আশপাশে একবার তাকিয়ে নামীকে বলল,

‘ খাও। ‘

নামী কথা বাড়াল না। তীব্র অনীহা নিয়ে ডাবের পানি শেষ করতে লাগল। পাশাপাশি ভদ্র কিছু গালিগালাজ করতে লাগল সুহাসকে। আর সুহাস থম মেরে তাকিয়ে দেখতে লাগল, তার হৃদয়ের কলহপ্রিয় নারীটির কোমল ঠোঁটজোড়ার মাঝ বরাবর থাকা হলদে রঙা পাইপটাকে। যা দৃষ্টিপাত করে মনে মনে আওড়াল,

‘ আজ এই পাইপটাকেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হচ্ছে!’

সৌধর গাড়ির সামনে এসে ছোটোখাটো সুনামি ঘটিয়ে ফেলল সুহাস, নামী দম্পতি৷ সুহাস কিছুতেই নামীকে গ্রামে যেতে দেবে না। আর নামী কিছুতেই সুহাসের মতো দুর্বল মনের পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করবে না। এই নিয়ে তাণ্ডব শুরু হলো। সুহাস বুঝতে পারল মুখ চললেও নামীর শরীর ভালো নেই। ওর চোখ দু’টোই বলে দিচ্ছে প্রচণ্ড দুর্বল সে৷ তাই শেষে চিৎকার করে বলল,

‘ তোমার জন্য ঐ ব্যাংকার আর ব্যাংকারের মায়ের কাছে ছোটো হয়েছি আমি। আর তুমি আমাকে ফেলে চলে যাবে! তা তো হবে না নামীদামি। ‘

মুখ বন্ধ হয়ে গেল নামীর। তার সঙ্গে নিধি, প্রাচীও ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নামী চাপা স্বরে বলল,

‘ এ কথার মানে কী?’

সৌধ এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করল। বলল,

‘ নামী লোকজন দেখছে। গাড়িতে বসে কথা বলো। এরপর সিদ্ধান্ত নাও। প্রয়োজনে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে। ‘

সৌধর ব্যবহার এতটাই অমায়িক যে নামী কখনোই তার কথা ফেলতে পারে না। আজো পারল না। ওঠে বসল গাড়িতে। নিধি বসল সামনে। বাকিরা পেছনে। নামী, সুহাসকে বসানো হলো পাশাপাশি। এরপর নামী বলল,

‘ আপনি কী চান সুহাস? ‘

‘ তুমি কোথাও যেতে পারবে না নামী। ‘

একগুঁয়ে স্বর সুহাসের। নামীও জিদি কণ্ঠে উত্তর দিল,

‘ আমি কোথায় যাব না যাব এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। ‘

‘ শাটআপ! ‘

ধমকে ওঠল সুহাস। নিধি কিছু বলতে নিলে সৌধ ওর হাত চেপে ধরে চোখের ইশারায় বলল,

‘ ওদের টা ওদের বুঝে নিতে দে। ‘

এদিকে প্রাচীও পার্স থেকে ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে নিউজফিড স্ক্রোল করতে শুরু করল। নামী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সুহাসও রক্তিম চোখে তাকিয়ে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলছে। যা দেখে চাপাস্বরে নামী বলল,

‘ অধিকার ফলাচ্ছেন? ‘

চোখে চোখ রেখে সুহাস বলল,

‘ ধরে নাও তাই। ‘

‘কিন্তু কেন অধিকার দেখাচ্ছেন? কী অর্থে? ‘

‘ অর্থ আবার কীসের? আমার অধিকার আমি ফলাই তোমার কী সমস্যা? ‘

ওপাশ থেকে সৌধ বলল,

‘ বলে দে ভালোবাসিস তাই অধিকার ফলাস। ‘

‘ অসম্ভব ওর মতো মেয়েকে আমি ভালোবাসি না। ‘

এ কথায় উত্তেজিত মনটা নিভে গেল নামীর। সৌধ তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘ তাহলে ঐ ব্যাংকারের মাকে কেন বললি নামী ম্যারেড আর তুই ওর হাজব্যন্ড। তোরা পড়াশোনা করছিস বলে এসব গোপন আছে। তাই উনারা যেন নামীকে নিয়ে তোর বাবা মায়ের কাছে প্রস্তাব না দেয়। ‘

বিস্ময়ে নামীর চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এসব কী শুনছে সে? সুহাস এসব বলেছে পাশের বাসার আন্টিকে! সৌধর প্রশ্নে সুহাস উত্তর দিল,

‘ যা সত্যি তাই বলেছি। ‘

‘ তাহলে সাহস করে ভালোবাসার কথাটাও বলে দে। ‘

নামীর হাত, পা কাঁপতে শুরু করেছে। সুহাসের দিকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে সে। সুহাস চোরা দৃষ্টিতে নামীর অবস্থা দেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ আমি কোনো নামীদামিকে ভালোবাসি না। ‘

এ কথা শুনে সৌধর মারতে ইচ্ছে করল ও’কে। আর নামীর ইচ্ছে হলো কষিয়ে দু’টো থাপ্পড় দিতে। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল নিজের গাল ইশারা করে বলল,

‘ দেখেছেন? ‘

সুহাস চুপ হয়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

‘ এরজন্য আমি দায়ী নই। এর শাস্তি আমি পেতে পারি না। ‘

বাঁকা হেসে নামী বলল,

‘ একজনের জন্য অপরজন শাস্তি পায় এটা আপনিই শিখিয়েছেন আমায়। ‘

‘ তার মানে বলছ তোমার মায়ের ভুলে তুমি শাস্তি পাচ্ছ? ‘

‘ নেভার, আমার মা কোনো ভুল করেনি। ভুল করেছে… ‘

‘ ব্যস, ‘

তাচ্ছিল্য হেসে নামী বলল,

‘ আমার মেরুদণ্ড আপনার মতো নিচু নয় সুহাস৷ আমাকে যেতে দিন। যদি স্বামীর অধিকার দেখাতে চান তাহলে নিজের মায়ের মুখোমুখি হয়ে আমাকে স্বীকার করুন। পারবেন? আপনি যদি এটা পারেন আমি ফিরে যাব আপনার সঙ্গে। ‘

নামীর এ কথায় সকলেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। নামী দুচোখ ভরে দেখতে লাগল এক অসহায়, ভঙ্গুর পুরুষকে। যেন ক্লাস ফোরের একটি বাচ্চা ছেলে ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করার দরুন মাথা নত করে বসে আছে। মায়া হলো খুব, তিন কবুল বলে গ্রহণ করা স্বামী নামক পুরুষটির অসহায়ত্ব যন্ত্রণা দিল তাকেও। ঠিক সে সময়ই সুহাসের মনের অবস্থা টের পেয়ে নিধি প্রস্তাব দিল,

‘ গ্রামে যাওয়ার কী দরকার নামী? তুমি আমাদের বাসায় ভাড়া ওঠতে পারো। চিন্তা নেই এমনি এমনি ওঠতে বলছি না। রুমমেট খুঁজছিলাম আমরা। তুমি ওঠলে বেশ ভালোই হবে৷ ‘

নিধির উপস্থিত বুদ্ধি বাহবা দেয়ার মতো। সৌধ অভিভূত হয়ে চেয়ে রইল। সুহাস তাকাল কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে। প্রাচী দুহাত জোড় করে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল নামী যেন রাজি হয়। আর নামী তাকিয়ে রইল সুহাসের ধূসর বর্ণের রক্তিম চোখজোড়ায়। ও চোখের ভাষা আজ বড্ড অপরিচিত তার। অপরিচিত এই ভাষা তার হৃদয় অস্থির করে তুলছে। মনে হচ্ছে এই দৃষ্টির মালিক তার আপন খুব খুব আপন। এই দৃষ্টির আকুলতা তার জন্য শুধুই তার জন্য। এই দৃষ্টির মালিক তার একান্তই তার। সকলে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তার সিদ্ধান্ত জানার জন্য। সে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করল অনেকক্ষণ। মা নেই। বাবা দেশের বাইরে। গ্রামে যারা আছে তারা তাকে কিছু পরামর্শ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না৷ মাঝখান থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে, তাকে শশুর ঘরের লোক মেনে নেয়নি, স্বামী গ্রহণ করেনি। কী দরকার এসব জলঘোলা করার। তার সমস্যা একান্ত তার সমস্যা হয়েই থাকুক না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। বলল,

‘ আমি রাজি। ‘
***
সুহাস বাড়ি ফিরছে বেশ রাত করে। মায়ের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিধিকে ম্যাসেজ করে বলল,

‘ নামীকে বলে দিস, মায়ের হয়ে আমি সরি খুব সরি।’

নিধি রিপ্লাই করল,

‘ বলতে পারব না৷ তোর দেয়া ম্যাসেজটা দেখিয়ে দিব। ‘

নিধির ম্যাসেজ দেখা শেষে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল সে। দেখতে পেল সিমরানের একটি বড়োসড় ম্যাসেজ,

‘ আব্বু, আম্মুর মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছে ব্রো। আব্বুর গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিল আম্মু আমি বাঁধা দেয়ায় থাপ্পড়টা আমার গালে পড়েছে। আমার আর এসব ভালো লাগে না। বাবা, মায়ের ঝগড়া দেখতে দেখতে আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমাকে তুমি হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করো প্লিজ ব্রো প্লিজ। আমি এ বাড়িতে আর থাকব না। আমি আমার বাবা, মায়ের থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাই। আমি ভুলতে পারছি না ব্রো আমার গালে আম্মুর পাঁচ আঙুলের দাগ। আমি সহ্য করতে পারছি না, একটুও সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ ব্রো তুমি আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচাও। এরা আমাদের বিষাক্ত বাবা, মা বিলিভ মি ব্রো এরা দুজনই আমাদের জন্য অভিশাপ! আমি খুব ডিপ্রেশড ব্রো খুব। আমি কিছু একটা করে ফেলব দেখো। কিছু একটা করে এই দু’জনকে কঠিন একটা শিক্ষা দিয়ে যাব। ‘

বোনের ম্যাসজটা পড়েই ক্রোধে মাথা দপদপিয়ে ওঠল৷ আচমকা মোবাইল ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে চিৎকার করে ওঠল। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এরপর ত্বরিত চলে গেল বোনের ঘরে। রুম অন্ধকার করে এক কোণে বসে ছিল সিমরান। ভাই গিয়ে লাইট অন করতেই ছুটে এসে ভাইকে জাপ্টে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আম্মু আমাকে মেরেছে ব্রো! আমি মেনে নিতে পারছি না। একদমই পারছি না। আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইট ব্রো, আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইট! ‘

বোনকে শক্ত করে বুকে চেপে রইল সুহাস। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ সিনু শান্ত হ প্লিজ। চুপ, চুপ কাঁদবি না, একদম না সিনু। ‘

কথাটা বলেই বোনের মুখ উঁচু করল। দুধে আলতা মসৃণ ত্বকে পাঁচ আঙুলের দাগ দেখে বুক কেঁপে ওঠল সুহাসের। মনে পড়ল নামীর গালেও একই দাগের কথা। শ্বাসরোধ হয়ে এলো তার। কাঁপা কণ্ঠে বলল,

‘ মা পাগল হয়ে গেছে সিনু। আমি আমার এই মাকে চিনতে পারছি না, একদম চিনতে পারছি না। ‘

সিমরানের কান্নার বেগ বাড়ল। সুহাস ওকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল,

‘ বাবা কোথায়? ‘

‘ জানি না। সেই যে রেগে বেড়িয়েছে… ‘

সুহাস সিদ্ধান্ত নিল আগে বোনের মন ভালো করবে। শান্ত করবে বোনকে এরপর বাবার সাথে দেখা করবে। কিন্তু মায়ের মুখোমুখি সে কিছুতেই হবে না। যে রূপে মাকে সে ভাবতে পারে না, মায়ের যে রূপ সে বিশ্বাস করে না। সেই রূপ স্বচক্ষে দেখতে সামনে যাবে না। তবে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে মাকে ঠিক বোঝাবে সে যা করেছে ভুল করেছে। যে কারণে নামীর ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছে আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি। ভুল বোঝাবুঝি থেকে এত বড়ো ঘটনা ঘটানো, নামীর গায়ে হাত তোলা, সিমরানের গায়ে অবধি হাত তোলা! একদম উচিত হয়নি, একদম না।

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-১৪+১৫+১৬

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৪

নিজের প্রতি খুবই অবাক হলো সুহাস৷ সে তো এটা বলতে চায়নি। খেলার শর্ত মেনে নামীকে আই লাভ ইউ’ই বলতে চাচ্ছিল৷ তাহলে কী করে আই হেইট ইউ বলে ফেলল! ভালোবাসি বলতে গিয়ে ঘৃণা করি বলে ফেলল কেন? এসব ভাবনার ভীড়ে নামীর ঝাপসা চোখ, গাল বেয়ে পড়া অশ্রু নজর এড়াল না। কেন জানি খুব খারাপ লাগল সুহাসের৷ দৃষ্টি নত করে নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়াল সে৷ নামীও নিজেকে চটজলদি স্বাভাবিক করে নিল। বাঁকা হেসে নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ এটা খুব ভালো গুণ সুহাস। আপনি মিথ্যেমিথ্যি কিছু বলতে পারেন না৷ ‘

কথাটা বলেই তাকাল সকলের দিকে। মিষ্টি হেসে গিয়ে বসল ফারাহর পাশে। বলল,

‘ সবাই এমন চুপ কেন খেলা কি শেষ? ‘

সুহাসের কাণ্ড দেখে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেছিল। নামীর কথায় হুঁশ ফিরল। ফারাহ নামীর দিকে মায়াভরা চাউনিতে তাকিয়ে। আইয়াজ নির্বিকার। সৌধ, নিধি সুহাসের দিকে ছুঁড়েছে অগ্নি দৃষ্টি। আইয়াজ তখন ওদের শান্ত করতে নিচু গলায় বলল,

‘ কিপ কুল ফ্রেন্ড’স। হাঁদারামটাকে ধরে বসা৷ এখনো সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়নি৷ প্রয়োজনে সারারাত আজ খেলাধুলা করব আমরা। ‘

নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নিল তিন বন্ধু। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি বলল,

‘ না না খেলা তো সবে শুরু। ‘

সুহাসের কানে তখন নামীর কথাটা বারেবারে বাজছিল,

‘ এটা খুব ভালো গুণ সুহাস। আপনি মিথ্যেমিথ্যি কিছু বলতে পারেন না। ‘

নামীর ও কথার প্রতিত্তোরে সে ভাবল, সত্যি কি তাই? সত্যিই কি সে মিথ্যা কিছু বলতে পারে না? নাকি তার সর্বস্ব জুড়েই মিথ্যার খোলসে আবৃত?

সৌধর শক্ত হাতের হেঁচকা টানে মেঝেতে বসে পড়ল সুহাস। চমকে ওঠে নিঃশ্বাস ছাড়ল শব্দ করে। বলল,

‘ তোরা খেল, আমার এসব বিরক্ত লাগছে। ‘

নিধি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ কেন সমস্যা কী তোর এত ভাব মারিস কেন সবসময়? ‘

আড়চোখে নামীর সরল চোখ দু’টোয় তাকাল সুহাস। এরপর আচমকাই বলে ফেলল,

‘ দেখছিস না এই মেয়েটা আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। ‘

সকলেই বিস্মিত হয়ে নামীর দিকে তাকাল। সে সুহাসকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে? এমন সিরিয়াস মুহুর্তে সুহাসের বলা এই কথাটি পরিস্থিতিই বদলে ফেলল। সুহাস এতেই ক্ষ্যান্ত রইল না। নামীর দিকে বক্র চাউনি নিক্ষেপ করে ধমকের সুরে বলল,

‘ আই নো আই এম হ্যান্ডসাম নামীদামি। তাই বলে সর্বক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার নজর লাগে। আর নজর লাগলে খুব গার্লফ্রেন্ডের ঘাটতি পড়ে আমার। শোনো মেয়ে, এই সুহাস সব লোকসান মেনে নিতে পারে, কিন্তু গার্লফ্রেন্ড লোকসান মানতে পারে না। ‘

আজগুবি কথা শুনে মুখ বিকৃত করে ফেলল নামী। বাকি সবাই হো হো হেসে ফেলল। ফারাহ হাসল ঠোঁট টিপে। সুহাস ভাই নামীকে কষ্ট দেয় এদিকে খারাপ হলেও অন্যদিকে মানুষটা বেশ মজার। মানুষের মাঝে ভালো গুণ, খারাপ গুণ উভয়ই বিদ্যমান থাকে৷ সুহাস যেমন তার খারাপ আচরণ দিয়ে পরিস্থিতি বিগড়ে দিতে পারে৷ তেমনি ভালো গুণ দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেও তুলতে পারে৷ সুহাসের কথার প্রেক্ষিতে নিধি বলল,

‘ ভাই তুই থাম। আর কিছু বলিস না৷ হাসির চোটে পেট ফেটে যাচ্ছে আমার। ‘

সৌধ বিরক্ত সূচক শব্দ করে বলল,

‘ হাসির চোটে মানুষের পেট ফাটে কীভাবে? সুহাসের মতো তোরও মাথা খারাপ হলো নাকি? ‘

‘ আরেহ ভাই… ‘

নিধি এ পর্যন্ত বলতেই সৌধ ধমকে ওঠল,

‘ চুপপ! ‘

আঁতকে ওঠে বড়ো বড়ো চোখে তাকাল নিধি। ডানহাতটা বুকে চেপে ঢোক গিলে বলল,

‘ কীরে ভাইই এভাবে ধমকাস ক্যান। ‘

অসহ্য হয়ে নিধির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল সৌধ। নিচু কণ্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘ কীরে বাল এই মেয়ের সমস্যা কী! ‘

সুহাস শুনতে পেয়ে মিটিমিটি হাসল। খেয়াল করে সৌধ চোখ রাঙাল। বলল,

‘ সুহাস, অহেতুক নামীর সাথে ঝগড়া করবি না। এমনিতেই খেলার নিয়ম ভেঙে মেজাজ গরম করে দিছিস। ‘

সুহাস ফিসফিস করে বলল,

‘ আমার জন্য মেজাজ বেশি বিগড়েছে নাকি ভবিষ্যত বউয়ের মুখে ভাই শুনে বেশি বিগড়েছে? ‘

ওদের ফিসফাসের মাঝে হঠাৎ নামী বলে ওঠল,

‘ ওয়েট ভাইয়া, আপনার বন্ধুকে জবাবটা দিয়ে দিই। কিছু সময় যোগ্য জবাব দিতে হয়। ‘

সৌধ চুপ মেরে তাকাল নামীর দিকে। নিধি, আইয়াজ, ফারাহ উৎসুক চাউনি নিক্ষেপ করল নামীর দিকে। সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নামী সেই কুঁচকানো মুখে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে লেপ্টে বলল,

‘ তো মিস্টার সুহাস, কী বলছিলেন? ‘

একটু ভাবার ভাণ করে পুনরায় বলল,

‘ আপনি হ্যান্ডসাম? ওহ রেইলি তাই মনে হয় আপনার? নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছেন? আমার মনে হচ্ছে দেখেননি। যদি দেখতেন আপনার এই পাটকাঠির মতো ফকফকা দেহটি আর যাইহোক সুদর্শন মনে হতো না। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে একবার তাকাল সৌধর দিকে। আরেকবার তাকাল আইয়াজের দিকে। এরপর শক্ত মুখে বলল,

‘ শুনুন মিস্টার ফকফকা চেঙ্গিস খান, হ্যান্ডসাম শব্দটির ডেফিনেশন আপনার এই দুই বন্ধুকে দেখে যখন বুঝেননি। তাহলে তাদের থেকে ভালো করে জেনে নেবেন৷ ডেফিনেশন না জানা অবধি আর মেডিকেল কলেজে পা রাখবেন না৷ তাহলে ঐ কলেজের আঙিনাও লজ্জা পেয়ে যাবে আপনাকে দেখে। ‘

উপস্থিত সকলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সুহাস যেন একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে গেল অকস্মাৎ আক্রমণে। পুরুষ মানুষ আর যাইহোক নিজের সঙ্গে অন্য পুরুষের তুলনা সহ্য করতে পারে না। তুলনা দেয়া মানুষটা যদি হয় নিজের বিয়ে করা বউ তাহলে তো কথাই নেই। সবচেয়ে বেশি আহত হলো নামী তার বন্ধুদের সুদর্শনতার তুলনা দিচ্ছে বলে। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে সৌধ আর আইয়াজের দিকে তাকাল সুহাস। বয়স হিসেবে শুধু উচ্চতাই বেড়েছে তার। স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি নেই। তার গায়ের রঙ ফরসা, উচ্চতা ছ’ফুট এক। তবুও সে সুদর্শন নয়৷ এদিকে সৌধ উচ্চতায় তার চেয়ে এক ইঞ্চি কম আইয়াজ কম তিন ইঞ্চি। গায়ের রঙে সৌধ তার থেকে পিছিয়ে না থাকলেও শ্যামবর্ণের আইয়াজ পিছিয়ে৷ তবু নামীর চোখে তারা সুদর্শন। কারণ তাদের নজরকাড়া শরীর আছে। পুরুষের ব্যায়ামপুষ্ট দেহ নারীর দুর্বলতা। সে জানত তবু কখনো এসবে আগ্রহ পায়নি। তবে আজ পেল। মনে তীব্র জেদ চাপল নামীদামিকে সে দেখিয়ে দেবে। এই পাতলা শরীরের জন্য সকলের সামনে এভাবে অপমান করল নামীদামি? এর জবাব সে একদিন দেবেই দেবে। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সুহাস। নামীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘ এর জবাব তুমি একদিন পাবে। ‘

নামী গা ঝাড়ার মতো করে কথাটা ঝেড়ে ফেলল। ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

‘ ওহ হ্যাঁ আরো একটা কথা। আপনার মুখের এই চাকমা গড়ন আর যাইহোক কোনো বাঙালি মেয়ের কাছে সুদর্শন মনে হবে না। ‘

প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল নামী। এবার শান্তি লাগছে খুব৷ বুকের ভেতর আনন্দেরা লুটোপুটি খাচ্ছে শান্তিতে। স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিতে মন চাচ্ছে, আজকের এই মুহুর্তটুকু। দ্য গ্রেট সুহাস ওরফে মিস্টার ফকফকা চেঙ্গিস খানের অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া মানসিক শান্তি ফিরে পাচ্ছে সে।

তীব্র ক্রোধে দপদপ করতে করতে সুহাস কিছু বলতে যাবে, তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিল নিধি। কড়াভাবে সকলকে ধমক দিয়ে বলল, খেলা শুরু করতে। এদিকে আইয়াজও তাদের আসল পরিকল্পনার কথা স্মরণ করিয়ে দিল৷ একবার নামীর পালা আসুক। খেলা শুরু হলো যথারীতি। ঘুরতে ঘুরতে বোতল থামল ফারাহর মুখ করে। সবাই হইহই করে ওঠল। নামী বলল,

‘ ফারাহ ঝটপট বলে ফেল তো এ যাবৎ কয়টা প্রেম করেছিস? ‘

নাকের ডগায় আসা চশমা ঠেলতে ঠেলতে আইয়াজের দিকে এক পলক তাকাল ফারাহ। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,

‘ একটাও না। ‘

সুহাস বিশ্বাস করল না। তাই বলল,

‘ পুরাই ঢপ। ‘

নিধি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ চুপ কর তুই। সবাই কি তোর মতো রোমিও হবে নাকি? ‘

আইয়াজের চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি৷ সৌধ বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে নিচুস্বরে তাকে বলল,

‘ বেস্ট অফ লাক দোস্ত একদম খাপে খাপ। ‘

ফারাহর পর আবার নিধির দিকে বোতল থামল। সুহাস হইহই করে বলল,

‘ দোস্ত তুই জানি কয়টা ছ্যাঁকা খাইছিস? ‘

নিধি খোশমেজাজে জবাব দিল,

‘ একটাই তো,ঐ যে ক্লাস সেভেনে। রোল এক হওয়ার অপরাধে ফেল্টুস বয়ফ্রেন্ড ব্রেকআপ করে দিল। শালা নিশ্চিত এখন ভ্যান চালিয়ে খায়। ‘

সৌধ ছোটো-ছোটো চোখে তাকিয়ে আছে৷ নিধির চোখে চোখ পড়তেই ফোঁস করে বলল,

‘ তোর কি সেই ভ্যানে চড়ে আমার সাথে প্রেম করার স্বাদ জাগছে? ‘

‘ মোটেই না আমি বরং চিন্তিত এই ভেবে যে, অর্পণ স্যার না পটলে সেকেণ্ড ছ্যাঁকা আসন্ন। ‘

চোখ কটমট করে তাকাল সৌধ। সবাই মিটিমিটি হাসতে হাসতে আবার খেলা শুরু করল। এবারে বোতল ঘুরতে ঘুরতে মুখটা গিয়ে থামল সৌধের দিকে। সুহাস কাউকেই কিছু বলতে দিল না। সে যেন প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বলল,

‘ সৌধ, আংকেলকে ফোন দে। দিয়ে বল, তুই একটা মেয়েকে ভালোবাসিস। ‘

সৌধ প্রচণ্ড সাহসী ছেলে হলেও বাবাকে খুব মান্য করে। তাই সুহাসের ধারণা ছিল সৌধ এ যাত্রায় হার মেনে নিবে। সামান্য গেমকে এতটা প্রাধান্য দেবে না।
কিন্তু সৌধ তো হার মানার পাত্র না৷ জীবনের ছোটোখাটো বিষয় থেকে বড়ো বড়ো বিষয়াদি। কোনোটাতেই এই ছেলে হারতে রাজি হয়নি। তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য জীবনের সব লড়াইয়ে জিততে হবে। জীবনের সব পরিস্থিতিতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে৷ এখনো হলো তাই। সে মুহুর্তেই বাবাকে ফোন করল। সালাম দিল লম্বা করে,

‘ আসসালামু আলাইকুম বাবা। ‘

‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম আব্বাজান। ঘুমাওনি এখনো? ‘

‘ না বাবা, জরুরি কথা বলতে ফোন করেছি। ‘

‘ জি? ‘

‘ আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। ‘

সকলে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে। নিধির চোখে একই সাথে বিস্ময় আর অবিশ্বাস। কারণ সৌধ ফোনে বাবাকে এ কথা বলার সময় তার দিকেই দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ঢোক গিলল সে৷ অনুভব করল বুক কাঁপছে তার। ফোনের ওপাশে ছেলের কথা শুনে এমপি সুজা চৌধুরী হো হো করে হাসলেন। বললেন,

‘ ডাক্তারি পাশ দিয়ে বিয়ে করবা নাকি পড়ার ফাঁকেই? যা বলবা তাই করব। শর্ত একটাই আমাকে ডাক্তারি লাইসেন্স এনে দিতে হবো। সবাই যেন এক ডাকে বলতে পারে এমপি সুজা চৌধুরীর তিন সন্তানই মানুষের মতো মানুষ হইছে। ‘

ছেলের থেকে বাবা কত ধাপ এগিয়ে টের পেল সুহাস৷ কারণ সে সৌধর খুব কাছাকাছি বসাতে সুজা আংকেলের কথা শুনতে পেল সব। সৌধ সুহাস সহ সকলের দিকে নজর বুলাল। এরপর দৃষ্টি গিয়ে স্থির করল নিধির ভীত মুখটায়। বলল,

‘ এ ব্যাপারে পরে কথা বলব বাবা। রাখছি। ‘

ফোন কেটে দিল সে। সকলের দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। নামী শুধু অবাক হয়ে দেখতে লাগল সৌধ ভাইকে। এখানে থাকা সবচেয়ে শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষ সৌধ। যেমন সাহস তেমনি ঠোঁটকাটা। মানুষের প্রতি তীব্র সম্মান বোধ যেমন আছে। তেমনি মানুষকে নিয়ে ভয়ডরের লেশমাত্র নেই। যে ছেলে বাবাকে অকপটে ভালোবাসার কথা জানাতে পারে সে ছেলের পক্ষে সব সম্ভব সব৷ নিধির দিকে তাকাল সে। তার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে। নিধি আপুর প্রতি সৌধর চোখে ভালোবাসার চিহ্ন দেখেছে সে৷ কিন্তু নিধি আপু? নিশ্চয়ই সেও বাসে। এমন শক্ত মেরুদণ্ডের পুরুষকে ভালো না বাসাটা মারাত্মক অন্যায়।

সকলের স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগল। আইয়াজ সৌধর বুকে চাপড় দিয়ে বাহবা দিল। সুহাসও বুঝে গেল এখানে সবচেয়ে অকর্মণ্য সে। কারণ এরপর আইয়াজের পালা এলে আইয়াজকে প্রিয় মানুষের উদ্দেশ্যে দু লাইন গান করতে বলা হলো। সে গান পারে না। বন্ধুদের মধ্যে সুহাস খুব ভালো গান পারে। সৌধও গানের পাশাপাশি খুব ভালো গিটারিস্টও। গান, বাজনা আইয়াজ অপটু। তবু প্রিয় মানুষের সামনে বলতে পারল না সে গান পারে না৷ চেষ্টা করল
ফারাহকে উদ্দেশ্য করে দু’লাইন গাওয়ার,

‘ তোমায় দেখলে মনে হয়
হাজার বছর তোমার সাথে
ছিল পরিচয় বুঝি
ছিল পরিচয়…’

আইয়াজের কণ্ঠে গান শুনে ফারাহ লজ্জা পেল। মোটা সুর তবু কাঁপা কাঁপা। বাকিরা হাততালি দিল। এরপর বোতল ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে থামল নামীর দিকে। ঠিক এই সুযোগটারই অপেক্ষায় ছিল সকলে। সুহাস নামীকে জব্দ করে নিজের মতো কিছু করতে বলতে উদ্যত হচ্ছিল। কিন্তু তাকে সবাই থামিয়ে দিয়ে নিধি বলল,

‘ খেলার সমাপ্তি তাহলে নামীকে দিয়েই হোক। ‘

এ কথা বলেই এক পলক সুহাসের দিকে তাকিয়ে নামীর দিকে তাকাল। বলল,

‘ নামী আজ সারারাত তুমি আর সুহাস এক ঘরে, এক বিছানায় কাটাবে। ‘

নিধি থামল। এবার আইয়াজ বলল,

‘ শুধু তাই নয়। সুহাসকে মাথা টিপে ঘুম পারাতে হবে। ‘

চমকে ওঠল নামী সুহাস দু’জনই। সুহাস খেয়াল করল চোখ, মুখ শক্ত করে নামী এই ডেয়ার নাকচ করতে উদ্যত হয়েছে। সুহাসও প্রথমে নাকচ করতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন বুঝল নামীদামিকে জব্দ করার সুবর্ণ সুযোগ এটাই তখন আর না করল না। বরং চোখ মুখে দ্যুতি ফুটিয়ে দুরন্ত হাসি হাসতে লাগল। নামী না করবে করবে ভাব এমন সময় সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘ জানিস আজ দুপুরে ছাদে গিয়েছিলাম। তারপর একজনের ইজ্জত হরণ করে নিয়ে এসেছি। ‘

কপাল কুঁচকে ফেলল নামী। সুহাস তার দিকে তাকিয়ে এসব কী বলছে? নামীকে বুঝিয়ে দিতে সুহাস পুনরায় বলল,

‘ কারো বোধহয় কোনো মূল্যবান জামাকাপড় হারানো গিয়াছে। ‘

মুহূর্তেই শক্ত হয়ে গেল নামী। বুকের ভেতর দপদপানি
শুরু হলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল সুহাসের দিকে। সুহাস বলল,

‘ ডেয়ার পূরণ না করলে এদের সবাইকে স্বাক্ষী রেখে মালিকের কাছে তার মূল্যবান সম্পদ ফেরত দিব। ‘

একদিকে ডেয়ার অপরদিকে সুহাসের হুমকি। সবদিক দিয়েই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। সবদিক বিবেচনায় বাধ্য হয়ে ডেয়ার পূরণ করতে রাজি হলো। সুহাস যদি পরপুরুষ হতো তাহলে হয়তো হার মেনে নিত৷ যেহেতু সে পরপুরুষ নয় সেহেতু হার মানার প্রশ্নই ওঠে না। সুহাস যখন বুঝল নামী ডেয়ার পূরণ করবে তখন মনে মনে তীব্র জিদ্দি হয়ে বলল,

‘ আজকের রাতটা তুমি কখনো ভুলতে পারবে না নামীদামি। ‘

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৫

সুহাস নামীকে একঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিল নিধি৷ এরপর প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে সৌধ, আইয়াজ আর ফারাহর সঙ্গে খুঁড়িয়ে নিচে চলে এলো। তাকে সাহায্য করল সৌধ। সুহাস, নামীর মধ্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। বদ্ধঘরে এবার দু’জন মা’রামারি করুক, কা’টাকা’টি করুক। বা প্রেম, ভালোবাসায় হাবুডুবু খাক। এটা সম্পূর্ণ ওদের ব্যাপার। তবু দু’জন কাছাকাছি থাকুক। অচেনা, অজানা দু’টো ছেলেমেয়ে। অল্প বয়সে বিয়ের মতো একটি সম্পর্কে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক। পরিবারের উচিত ছিল ওদের একে অপরকে বোঝাপড়ার সময় দেয়ার। তা না করে মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাঁধা নয় ছেলেমেয়ে দুটোর মনে এমন বিষ ঢেলেছে যে তারা একে অপরকে শত্রুর চোখে দেখে৷ বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ইমম্যাচিওর সুহাস। ফলে মা ভক্তি তাকে আরো বেশি ইমম্যাচিওর করে তুলেছে। তবে বন্ধুদের বিশ্বাস সুহাস যেটা দেখাচ্ছে এটা আসলে ও নয়৷ সে দুরন্ত মনের ছেলে হলেও অনেক দিন ধরে চেনে তারা। গড়মিল তো আছেই। সেই গড়মিলের সমাধান আজকের রাতেই মিলবে। নিজেদের পরিকল্পনায় সফল হলো ওরা। ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসল সকলে। নিধি বলল,

‘ ফারাহ কফি বানাতে পারো?’

ফারাহ মাথা নাড়াল সে পারে। নিধি বলল,

‘ আচ্ছা, আমাদের জন্য কফি করে নিয়ে এসো। আমিত সাহায্য করতে পারব না৷ তাই আইয়াজ তোমাকে সাহায্য করবে।

কথাটা বলেই তাকাল আইয়াজের দিকে। বলল,

‘ আমাদের সব বন্ধুর প্রতিই যত্নশীল হওয়া উচিত। ‘

আইয়াজ থতমত খেলেও খুশি হলো। প্রচণ্ড ভদ্র, সভ্য বন্ধুর এই খুশিটা দেখতে চেয়েছিল নিধি। পাশের সোফায় বসে থাকা ফারাহ প্রচণ্ড লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে দাঁড়াল। চলে গেল রান্নাঘরে পিছন পিছন গেল আইয়াজও৷

এদিকে সম্মুখে আয়েশি ভঙ্গিতে বসা সৌধ নিধির কথার পাল্টা জবাব দিল,

‘ হ্যাঁ আমাদের সব বন্ধুর প্রতিই যত্নশীল হওয়া উচিত। এই যে তুই একা একা এখানে বসে আছিস। আর আমি সঙ্গ দিচ্ছি। এটাও যত্ন৷ ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল নিধি। বন্ধুদের মধ্যে সবাই জানে একাকী ঘরে থাকতে পারে না সে৷ ভয় পেয়ে প্রচণ্ড খারাপ অবস্থা হয়। একবার জরুরি প্রয়োজনে প্রাচী বাড়ি গিয়েছিল। সে একা ছিল বাসায়। মাঝরাতে কারেন্ট চলে যাবার পর ভয়ে প্যানিক এট্যাক হয়েছিল। খুব কষ্টে ফোন চেপে শুধু কল করতে পেরেছিল সুহাসকে৷ এ শহরে তার আপন বলতে এরাই। নিজের সমস্যা গুলোর কথা পরিবারে জানাতে না পারলেই এই চার বন্ধুকে অবলীলায় জানাতে পারে। নিধির পরিবার কখনো চায়নি সে ডাক্তারি পড়াশোনা করুক৷ নিজ মেধায় মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার পরও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বাবা। চার কন্যার মধ্যে সে দ্বিতীয় জন। বড়ো বোন ডিভোর্সি। বাবা, চাচারা চেয়েছিল সে অনার্স ভর্তি হয়ে বিয়ে করে সংসারি হোক। শক্ত মনোবলের মেয়ে হয়ে বাবা, চাচাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি নিধি। মাকে বুঝিয়ে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে৷ মায়েরা আর যাইহোক মেয়ের স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না৷ নিধির মাও পারেনি। তাই স্বামীর সঙ্গে লড়াই করেছে। রাগ করে পড়াশোনার জন্য নিধির পিছনে একটা টাকাও খরচ করে না বাবা। নিধির মাও স্বামীর সহায়তা আশা করেনি। সে তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পত্তি ভাইয়ের নামে লিখে দিয়েছে। বিনিময়ে ভাই নিয়েছে নিধির পড়াশোনার দায়িত্ব। পারিবারিক এই জটিলতা গুলোর জন্যই নিধি নিজের জীবনের কোনো সমস্যার কথাই মাকে জানায় না৷ কপাল গুণে কিছু বন্ধু পেয়েছে। তারা জীবনে আসার পর জীবন যতটা কঠিন ভেবেছিল ততটা কঠিন মনে হয়নি আর। সেদিন মধ্যরাতেই উপস্থিত হয়েছিল সুহাস। সঙ্গে সৌধ আর স্মৃতি আপুকে নিয়ে। যতই বন্ধু হোক, যতই সৌধ এমপির ছেলে হোক৷ বাড়িওয়ালা মধ্যরাতে তাদের ঢুকতে দেবে না৷ তাছাড়া নিধিকে সামলাতে একজন মেয়ে লাগবেই। তাই বুদ্ধি করে বড়ো বোনকে নিয়ে এসেছিল সৌধ। স্মৃতি আপু সৌধর জীবনের প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই সে খুব সুন্দর ভাবেই সামলে নিয়েছিল সবটা। নিধির সঙ্গে স্মৃতি আপুর বন্ধুত্বের সূচনা সেখান থেকেই। সেদিনের পর থেকে সবাই জানে অতিরিক্ত ভয় পেলে প্যানিক এট্যাক হয় নিধির। ঠিক সেটা ভেবেই সৌধ মিটিমিটি হাসছিল তখন। কারণ সে জানে, জরুরি কথা বাহানা মাত্র৷ সেদিনের পর থেকে অন্ধকারেও এলার্জি নিধির। এই মেয়ে নাকি পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ডাক্তারি পড়ছে। বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হয় সৌধর।

কফি বানানো কী এমন কঠিন কাজ যে আইয়াজের সহায়তা নিতে হবে? তাই নরম সুরে ফারাহ বলল,

‘ আপনার কিছু করতে হবে না। আমি করতে পারব।’

কথাটা শুনে আইয়াজ একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর ফারাহ তাকাল তার দিকে। তাকানোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠল,

‘ কিছু করতে হবে না যখন তখন দাঁড়িয়ে না থেকে ওখানে গিয়ে বসুন। ‘

নড়েচড়ে ওঠল আইয়াজ। প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফারাহর দিকে। বলতে চাইল,

‘ তুমি কফি বানাও, আমি এখানেই থাকি। একসঙ্গে ওদের কাছে যাব৷ ‘

কিন্তু বলে ফেলল,

‘ তুমি কফি বানাও, আর আমি তোমাকে দেখি!’

কথাটা শুনতেই দেহ শিউরে ওঠল ফারাহর। সহসা দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাজে মন দিল সে। আইয়াজ হতভম্ব হয়ে গেল। এটা কী বলে ফেলল সে? হয়েছে টা কী তার? এমন উল্টাপাল্টা করলে ফারাহ তাকে কী মনে করবে? নিজেকে ধাতস্থ করে নিল আইয়াজ। বড়ো বড়ো করে দু’বার নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বদলাতে হবে৷ কিন্তু কী বলা যায়… ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল তারা ম্যাসেজে অনেক কথাই বলেছে। পড়াশোনা নিয়ে, নিজেদের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে। এর বাইরে কিছু বলা বা জানা হয়নি। তাই বলল,

‘ তোমার পরিবারে কে কে আছে? ‘

‘ আমি আপু, দুলাভাই, আর ভাগ্নি। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল আইয়াজের। বলল,

‘ বাবা, মায়ের সাথে থাকো না? ‘

মুখে মেঘ জমল ফারাহর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমার বাবা, মা নেই। আমি এতিম! ‘

আমি এতিম! বাক্যটিতে আহত হলো আইয়াজ। তার দুচোখে মেয়েটির জন্য অদ্ভুত মায়া জেগে ওঠল। বুকের ভেতর অনুভব করল চিনচিনে ব্যথা। অপরাধীর ন্যায় মস্তক নত করে বলল,

‘ আই এম সরি। ‘

নিজের ঝাপসা চোখ চশমার আড়ালে রেখেই মৃদু হাসল ফারাহ৷ বলল,

‘ সরি বলছেন কেন? আপনি কোনো ভুল করেননি। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর বাবা মারা যায় তিন বছর আগে। তাই বড়ো বোনের কাছেই থাকি আমি। ‘

নিজের দূর্ভাগ্যের কথা শুনে আইয়াজের মুখ ব্যথিত হলো বলে খারাপ লাগল ফারাহর। তাই নিজের কথার ইতি টেনে জিজ্ঞেস করল ,

‘ আপনার পরিবারে কে কে আছেন? ‘

আইয়াজ তাকাল ফারাহর মলিন মুখটায়। ঈষৎ হেসে বলল,

‘ মা, বাবা, বড়ো ভাই, ভাবি আর ছোটো বোন। ‘
***
প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে নামীর৷ বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়েছে ওরা। আজ এই ত্যাঁদড় ছেলে সুহাসের সাথে রাত কাটাতে হবে। বিছানার এক কোণে বসে হাসফাস করছে মেয়েটা৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নামীর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেল সুহাস। এরপর তাকাল নিজের দিকে। আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আর ভাবল, সে নিঃসন্দেহে সুদর্শন। গায়ের রঙ, হাইট দু’টোই ঠিকঠাক তবে কমতিটা কী? সৌধ অনেকবার তাকে বলেছিল তার সঙ্গে জিমে যেতে৷ নিয়মিত ব্যায়াম করতে। সে কথা শুনেনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সৌধর কথা শোনা উচিত ছিল৷ আগে শুনেনি তাতে কী হয়েছে? এবার থেকে শরীর চর্চা করবে সে। সুহাসের কেন জানি মনে হলো তার গার্লফ্রেন্ডদের তুলনায় নামী অনেক বেশি স্মার্ট। উন্নত মনের মেয়ে। অরিনকে সে সবচেয়ে স্মার্ট মনে করত। অথচ অরিনও কোনোদিন তাকে শরীর চর্চা করতে বলেনি। নিজের হ্যাংলা, পাতলা শরীরটা বিরক্ত লাগল সুহাসের। কল্পনায় আঁকল নিজের ব্যায়ামপুষ্ট শরীর। বাহ দারুণ, শরীর তাহলে ফিট করতেই হবে। ভেবেই আয়নায় তাকাল। নামীকে দেখে দিল দুর্ভেদ্য হাসি। বলল,

‘ কী নামীদামি? ভয় করছে? ‘

চকিতে তাকাল নামী। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,

‘ কেন ভয় পাব কেন? ‘

প্রশ্নটি করে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না সে। পা দুলাতে শুরু করল ক্রমাগত৷ সুহাস সেদিকে খেয়াল করে ঘুরে দাঁড়াল। কেন জানি মনে হলো অতিরিক্ত টেনশনে নামীর মুখটা চুপসে গেছে৷ আর এই যে পা দুলাচ্ছে এটাও অতিরিক্ত চিন্তার ফল। নামীর মুখে ভয়, দুঃশ্চিতার ছাপ দেখে তার মনে সুড়সুড়ি লাগল। চনমনে চিত্তে বলল,

‘ এই ফকফকা চেঙ্গিস খান এখন তোমার সব অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। তবুও ভয় লাগছে না? ‘

‘ তার মানে স্বীকার করলেন আপনি ফকফকা চেঙ্গিস খান? ‘

ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সুহাস বলল,

‘ তোমার ভাষ্যে। ‘

কথাটা বলেই ধীরপায়ে এগুতে লাগল সে। তার ভাবমূর্তি আর আগানো দেখে নামী আতঙ্কিত হলো। মনে মনে বিপদের দোয়া পড়ে আশপাশে তাকাল সচেতন চোখে৷ চিৎকার দিতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল৷ কী লাভ চিৎকার করে? সুহাস তার স্বামী। সম্পর্কে জটিলতা আছে ঠিক। কিন্তু সুহাস যদি তার ওপর অধিকার ফলায় সে কি সত্যি বাঁধা দিতে পারে? হ্যাঁ পারে কিন্তু সেটা সকলের চোখে অশোভন দেখাবে। কিন্তু নিজের চোখে না। তাই ধাতস্থ হয়ে কাঁপা গলায় বলল,

‘ সুহাস, আপনি আমার কথাটা শুনুন। ‘

সুহাস হাসল। হাসিটা কেন যেন বিকৃত দেখাল নামীর চোখে। সে ভীতিগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পা তুলে বসল। ততক্ষণে সুহাস কাছাকাছি এসে গেছে। নামীর শরীর কাঁপতে শুরু করল। পিছিয়ে গেল তড়াক করে। সুহাস হো হো করে হেসে ওঠল। বসল বিছানায়। বিদ্রুপ করে বলল,

‘ এ কী কাণ্ড! নামীদামি যে ভয় পাচ্ছে। ‘

ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে বড়ো বড়ো করে শ্বাস টানল নামী। সুহাস ভ্রু কুঁচকে অকস্মাৎ বলল,

‘ অ্যাজমা কি ছোঁয়াচে রোগ? ‘

সুহাস জানে হাঁপানি ছোঁয়াচে রোগ না৷ তবু নামীকে চটাতে বলল কথাটা৷ কিন্তু নামী অদ্ভুত চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ পড়াশোনা করে নিজের গরজে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছেন? নাকি বাবা, মা টাকার জোরে জোর পূর্বক ওখানে ভর্তি করিয়েছে? ‘

ক্ষেপে গেল সুহাস। চোখ, মুখ শক্ত করে বলল,

‘ মানে? আমার মেধা নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুলছ! ‘

ঢোক গিলল নামী। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল মুহুর্তেই। ভাবল কথার প্যাঁচে ফেলে সুহাসকে বাগে আনতে হবে৷ তাই বলল

‘ শুধু আপনার মেধা নিয়ে নয় মেরুদণ্ড নিয়েও আমি সন্দিহান। ‘

‘ হোয়াট! ‘

‘ হ্যাঁ। আপনি একটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষ। এজন্যই বাবার আদেশে বিয়ে করেছেন, মায়ের আদেশে বিয়ে অস্বীকার করেছেন৷ ‘

‘ নামী! ‘

‘ ধমকালেই সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না সুহাস। আর আপনি যাকে সহ্য করতে পারেন না, নির্লজ্জের মতো তার কাছাকাছি আসছেন কেন? বিবেকে বাঁধছে না? নিজেই ভাবুন তো এসব দেখে আপনাকে নিয়ে আমার ধারণা এছাড়া আর কী হবে? ‘

‘ এটা একটা গেম। শর্ত অনুযায়ী সারারাত মাথা টিপে দেবে আমার। ‘

চমকাল নামী। তার মানে সে যা ভাবছে অমন কিছু নয়? তাহলে সুহাস ওভাবে কেন বলল সব অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে? মনের প্রশ্ন মুখে বেরিয়ে এলো তার। সুহাস টের পেল কথাটা শুনে নামী ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই এমন করছে। তৎক্ষনাৎ আবার সুহাস পূর্বের রূপ ধারণ করল। আজ এই নামীদামিকে একটা শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে৷ ভাবনা অনুযায়ী হাত বাড়াল সে। নামী ছিটকে সরে গিয়ে চাপা ক্রোধে বলল,

‘ আমাকে স্পর্শ করবেন না আপনি। ‘

সুহাস শুনল না সে কথা। হেঁচকা টান দিয়ে নামীকে নিজের কাছাকাছি নিয়ে এলো। একহাতে নামীর বাহু অন্যহাতে নামীর কোমর চেপে ধরল শক্ত হাতে। মুখ খিঁচিয়ে রইল নামী৷ নিজেকে সুহাসের বাঁধন থেকে ছুটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। শাসাতে লাগল অসংখ্য বাক্য দ্বারা৷ কিন্তু সুহাস সেসবের ধার ধারল না৷ সন্তর্পণে নামীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাক ঘষতে শুরু করল। নামী দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করল অপ্রিয় স্বামীর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো। সুহাস তার নরম শরীর ছুঁয়ে বদ্ধ দৃষ্টিজোড়ায় তাকিয়ে মাতাল সুরে বলল,

‘ এই চেঙ্গিস খানের এটুকু শক্তির সঙ্গেই কুলোতে পারছ না নামীদামি? তাহলে আজ কী হবে ভাবো একবার। ‘

শাসাল বাক্যটি শুনে শরীর কাঁপতে শুরু করল নামীর। চোখের পাতা, ঠোঁটজোড়াও কেঁপে কেঁপে ওঠল। সুহাস খুব কাছ থেকে দেখল সেই কম্পন। যতটা বোঝাল ততটা করবে না সে। তবু তার এটুকু স্পর্শেই যে নামী ঘৃণায় মূর্ছা যাচ্ছে। এতেই আত্মতৃপ্তি মিলছে৷ বাঁকা হাসল সুহাস। একেবারে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রও সে নয়। কিছু একটা ঘটানো উচিত। ভেবেই চট করে নামীর গলা জুড়ে থাকা ওড়নাটা খুলে ফেলল। চোখের সামনে ভেসে ওঠল শ্যামলাটে নামীর লাস্যময়ী রূপ। মস্তিষ্কই এলোমেলো হয়ে গেল সুহাসের৷ নামী কাচুমাচু হয়ে নিজেকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করল। সুহাস বক্র হাসি ঝুলিয়েই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

‘ মেয়ে, তোমার রূপে আগুন না থাকলেও কথায় আগুন আছে। আজ এই নরম বিছানায় প্রমাণ করব
তোমার ঐ অগ্নিবাণ কথার ক্ষমতা বেশি নাকি
এই হ্যাংলা, পাতলা সুহাসের ক্ষমতা বেশি। ‘

সুহাসের এহেন কথায় থমকে গেল নামী৷ তার দুচোখ বেয়ে গড়াল নোনাপানির ধারা। সুহাসের কাঁধ ভিজে ওঠল। নামীর হঠাৎ চুপসে যাওয়া, নোনা পানির স্পর্শে চুপসে গেল সুহাস। বলল,

‘ আর ইউ ওকে? ‘

নামী রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল৷ রক্তবর্ণ চোখে তাকাল সুহাসের চোখে। কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের গালে। সুহাস অবাক হলো। হঠাৎ নামীর এই অদ্ভুত আচরণে হিমশিম খেয়ে গেল সে। কিছু বলতে উদ্যত হবে তৎক্ষনাৎই নামী ভাঙা কন্ঠে বলল,

‘ আমরা স্বামী-স্ত্রী সুহাস। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন। আমাকে স্পর্শ করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনার৷ কিন্তু কি জানেন? মন থেকে আমি আপনার স্পর্শ গুলো গ্রহণ করতে পারব না৷ আফসোস টা আমার এখানেই। মনের বিরুদ্ধে কোনো পুরুষকে শরীর দিয়ে দেওয়া খুব যন্ত্রণার। যে ছেলে আমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি, সে ছেলে আমার এই শরীরটাকে কত সহজে গ্রহণ করতে চাইছে। ‘

শেষ বাক্যে প্রচণ্ড তাচ্ছিল্যতা প্রকাশ পেল। সুহাসের মুখের আকৃতি বদলে গেল নিমেষে৷ বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠল তার। নামী ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে পুনরায় বলল,

‘ নারীকে ছোঁয়া সাধনার বিষয় সুহাস। নারীর শরীর ছুঁয়ে নারীকে ছুঁয়েছি ভাবা ঘোলকে দই ভেবে খাওয়া একই কথা৷ দইয়ের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে পুরুষরা নিজেদের শক্তিমান, ক্ষমতাবান মনে করে৷ কিন্তু তারা জানে না তাদের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা এখানেই। কারণ তারা নারীর হৃদয় ছুঁতে পারেনি। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সুহাসের। বলল,

‘ তার মানে তোমার শরীর ঘোল? আর হৃদয় দই? ‘

ম্লান হাসল নামী। আফসোস হলো সুহাসের অপরিপক্ক মানসিকতার কথা ভেবে৷ এই ছেলে কবে বড়ো হবে? কোনোদিন কি এই ছেলে বুঝবে ভালোবাসা কী? সম্পর্ক কী? নাকি সবটা বোঝার আগেই মিসেস উদয়িনী তাদের সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে দেবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। নিজেকে সুহাসের দুই হাতের বন্ধনে আবদ্ধ দেখে নিয়ে পুনরায় চোখ রাখল ধূসর রাঙা চোখ দুটোয়। বলল,

‘ শুনেন নির্বোধ পুরুষ, নারীর হৃদয় না ছুঁয়ে দেহ ছোঁয়া পুরুষকে ধর্ষক বলে। ‘

সহসা নামীকে নিজের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিল সুহাস। মুক্তি পেয়েও কোনো ভাবান্তর হলো না নামীর। বরং সে ভয়ানক এক কাণ্ড করে বসল। শরীর ছেড়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। শরীরে ওড়না না থাকায় ঘনঘন নিঃশ্বাসের সাথে গলা এবং উদরের মধ্যবর্তী আকর্ষক অংশটুকু উঠানামা করছে। সুহাস দৃষ্টি সংযত করল এবার। নামী সেসব খেয়াল করল না। তীব্র জেদি কণ্ঠে বলল,

‘ নিজেকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে মেলে দিলাম। আমাকে ভোগ করুন সুহাস। নাম মাত্র বিয়ের বদৌলতে আজকের রাতটার জন্য আমার শরীরটাকে দিয়ে দিলাম। বিনিময়ে একটা জিনিস চাই আপনার থেকে। ‘

থমকানো দৃষ্টিতে নামীর অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকাল সুহাস। ঈষৎ হেসে নামী বলল,

‘ ডিভোর্স চাই। ‘

বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল সুহাসের। হতভম্ব মুখে পলক ফেলতে ভুলে গেল সে৷ নামী পুনরায় বলল,

‘ ভয় নেই। আপনার মা, বাবার সংসার নষ্ট হবে না। ডিভোর্সটা গোপন থাকবে সাড়ে পাঁচ বছর বা ছ’বছর। পড়াশোনা শেষ করে দেশে চাকরি করার ইচ্ছে নেই আমার। ইন্টার্ন শেষে লাইসেন্স পেয়ে গেলেই আমেরিকায় চলে যাব। আর তখনি সবাই জানবে আমাদের ডিভোর্সের কথা। এরজন্য আপনাকে কোনোভাবেই দায়ী করা হবে না। সম্পূর্ণ দায় আমার ঘাড়ে নিব৷ এতে আশা করি আংকেল আপনার বা আপনার মায়ের ওপর অহেতুক রাগ ঝাড়বে না। আপনার হয়তো মনে হতে পরে এখুনি কেন ডিভোর্স চাইছি। কয়েক বছর পরে ডিভোর্স নিলেও তো চলবে। না সুহাস চলবে না। ডিভোর্স আমার এখুনি চাই৷ আপনার বউ হওয়ার পর থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরছি আমি। অপমানে, অসম্মানে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার আত্মসম্মানে আঘাত পড়ছে। যে ছেলে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি। যে জনসম্মুখে স্বীকার করে না আমাকে, গোপনে তার বউ হয়ে থাকাটা তীব্র যন্ত্রণার। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর অসম্মান থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করুন প্লিজ। ‘

সমাজের এক অমোঘ সত্য নারীরা শরীর বেঁচে সম্মান খোয়ায়। আজ আরো এক সত্যির সম্মুখীন হলো সুহাস। কেউ শরীর বেঁচে সম্মান খোয়ায়। কেউ বা সম্মানের বিনিময়ে শরীর বেঁচতে চায়। হ্যাঁ নামী এক রাত তার স্বামীর দৈহিক চাহিদা মিটিয়ে চিরদিনের জন্য নিজে সম্মানের সাথে বাঁচতে চাইছে৷ তীব্র ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠল সুহাসের৷ এতটা অধঃপতনও হয়নি তার। নামী কী করে পারল তাকে এতটা নীচ ভাবতে? সে তো শুধু ভয় দেখাচ্ছিল! জব্দ করছিল দেমাকি নামীদামিকে। তীব্র ক্রোধে দপদপিয়ে ওঠল মাথাটা। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। নিধি দরজা লক করে দিয়েছে। তাই বাথরুমে ঢুকে প্রচণ্ড শব্দ করে দরজা আটকে দিল। টিশার্ট খুলে আছড়ে ফেলল মেঝেতে। এরপর শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিচে দাঁড়িয়ে রইল। নামীর দৃষ্টি ছাদের দিকে। নিশ্চল দেহে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কর্ণে ঠিকই শুনতে পেল শাওয়ারের শব্দ!

চলবে..

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৬

সুহাস, নামী এক সঙ্গে এক রাত বদ্ধ ঘরে থাকা মানে ভয়াবহ সুনামি ঘটবেই ঘটবে। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল বন্ধুরা। কিন্তু সেই সুনামির পরিণাম যে সুহাসকে এভাবে বদলাতে শুরু করবে ভাবতে পারেনি ওরা। ভাবতে পারেনি স্বয়ং নামীও। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেদিনের পর সুহাস আর নামীর পেছনে লাগেনি৷ কখনো সামনে পড়লে অল্প সময় চোখাচোখি হয়েছে শুধু৷ নামী ঐ চোখে পূর্বের মতো ক্রোধ দেখতে পায়নি। পায়নি বিন্দুমাত্র দুরন্তপনাও। ও চোখের ভাষা ঠিক কী বুঝতেও পারেনি সে। বুঝতে চায়ও না৷ শুধু কৌতূহল জাগে একটি বিষয় নিয়ে। ডিভোর্সের ব্যাপারে সুহাস আগাচ্ছে না কেন? সে যেভাবে আশ্বাস দিয়েছে তাতে সুহাসেরই বেশি আগ্রহী থাকার কথা। তাহলে সুহাস নিশ্চুপ কেন? সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সেদিনের পর রোজ ফজর ওয়াক্তের পর সুহাসকে বাড়ির বাইরে যেতে দেখা যায়। জিমের পোশাক পড়ে সাইকেল নিয়ে চলে যায় সৌধদের বাড়িতে৷ তাদের বাড়ি থেকে সৌধদের বাড়ির দূরত্ব সাইকেল করে পঁচিশ মিনিট। এ বাড়িতে যে মহিলা কাজ করতে আসে তার সঙ্গে নামীর খুব ভালো সম্পর্ক। তার কাছেই শুনেছে সুহাস সৌধর ব্যক্তিগত শরীরচর্চা কেন্দ্রে যোগ দিয়েছে। এ কথা সেলিনা আপাকে বলেছে সিমরান৷ সে নাকি খুব ভাব নিয়ে বলেছে,

‘ সেলিনা আপা, খুব তাড়াতাড়ি আমার ব্রোও সৌধ ভাইয়ের মতো ড্যাশিং ম্যান হয়ে যাবে। এই একটা কমতিই ছিল আমার ভাইয়ের। কত বলেছি, ভাগ্যিস এতদিনে উইজডম হলো। ‘

সুহাস ড্যাশিং ম্যান হোক বা ফাঁসিং ম্যান, যায় আসে না নামীর। তার ফোকাস কেবল ক্যারিয়ারের দিকে।

সকালবেলা নাস্তা সেরে রেডি হয়ে নিল নামী। হলুদ রঙের ঘেরওয়ালা সূতি একটি গাউন পরে তার ওপর সাদা অ্যাপ্রোন পরে নিল ঝটপট। এরপর কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে বা’হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বেরিয়ে পড়ল। গেটের সামনে আসতেই পাশের বাসার ভদ্রমহিলা মিষ্টি হেসে এগিয়ে এলেন৷ যেন নামীর অপেক্ষাতেই ছিল সে। এর আগে পরিচয় হয়েছিল উনার সাথে তাই সৌজন্যতা দেখিয়ে সালাম দিল নামী। ভদ্রমহিলা সালাম ফিরিয়ে বলল,

‘ তোমার আংকেল, আন্টি কবে ফিরবে জানো? ‘

নামী অটো দাঁড় করিয়ে তাড়াহুড়োয় উত্তর দিল,

‘ আংকেল সাতদিন পর, আন্টির কথা জানি না। আমার সাথে কথা হয়নি তার সাথে। আসি আন্টি। ‘

ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে মাথা কাত করল। নামী চলে গেলে সে ভাবল, আপাতত সোহান খন্দকারের ছেলেমেয়ের সাথেই কথা বলে যাবে। ভাবা অনুযায়ী কলিং বেলে চাপ দিল বারকয়েক। ভিতর থেকে সেলিনা এসে গেট খুলে বলল,

‘ চাচা, চাচি বাসায় নাই। ‘

‘ উনার ছেলেমেয়েরা আছে? ‘

‘ সিনু আপা কলেজে। আর সুহাস ভাই মাত্রই জিম থিকা ফিরল। ‘

ভদ্র মহিলা হাসল। বলল,

‘ আমি সুহাসের সাথেই কথা বলব। ‘

সেলিনা সন্দেহের চোখে তাকিয়েই তাকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিল। এরপর দোতলায় গিয়ে ডেকে আনল সুহাসকে৷ সুহাস রেডি হচ্ছিল ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য৷ এরই মধ্যে পাশের বাসার মহিলা চলে আসায় ভীষণ অবাক হলো। হঠাৎ তার কাছে কী প্রয়োজন? সে তো এদেরকে ঠিকভাবে চিনেই না। আলাপও হয়নি কখনো। কৌতূহলী চিত্তে নিচে নেমে এলো সে। বসল ভদ্রমহিলার মুখোমুখি হয়ে। ভদ্রমহিলা এক গাল হেসে বলল,

‘ আমি তোমাদের প্রতিবেশী। আমার ছেলে ইয়ামিন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। খুব ব্রিলিয়ান্ট! দেখতে লম্বা, চওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। শুধু গায়ের রঙই কালো। প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে অফিসে যায়। দেখেছ বোধহয়। ‘

সুহাস তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। ভদ্রমহিলার বেশভূষায় বলে দিচ্ছে সে যথেষ্ট শিক্ষিত আর রুচিশীল। কিন্তু আচমকা এসে এসব কথাবার্তা বলায় বিব্রত হলো সে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,

‘ হ্যাঁ দেখেছি কয়েকবার। ‘

সুহাসের এ কথায় মহিলাটির জোশ বাড়ল। বলল,

‘ তোমার বাবা, মায়ের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি অনেকদিন৷ দু’জনই ব্যস্ত মানুষ বলে সুযোগ পাচ্ছি না। তুমি কি তোমার বাবা, মায়ের নাম্বারটা দিতে পারবে? ‘

সুহাস দেরি করল না। ইয়ামিন সাহেবের মাকে বাবা, মায়ের নাম্বার দিয়ে উদ্ধার হতে চাইল। কিন্তু ইয়ামিনের মা তাকে উদ্ধার হতে দিল না। সে নাম্বার নিয়ে হঠাৎ চাপা স্বরে বলল,

‘ একটু আগে বের হলো মেয়েটার নাম তো নামী রহমান? ‘

সুহাসের ভ্রু জোড়া কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিল,

‘ হুম। ‘

‘ তোমার মায়ের বান্ধবীর মেয়ে তো? ডাক্তারি পড়তেছে। তুমি যেখানে পড়ো ওখানেই তাই না? ‘

বাবার বন্ধুর মেয়ে নামী। এ মহিলা মায়ের বলছে কেন? তবে কি নামী বলেছে? নাকি বাবাই সবাইকে এটা বলে ম্যানেজ করেছে? আর ভাবতে পারল না সুহাস। একই তো হলো। তাই বলল,

‘ হ্যাঁ। ‘

মহিলাটি এবার আরো নিচু স্বরে বলল,

‘ মেয়েটা বেশ সুশীল আছে তাই না? কারো সাথে রিলেশনশিপেও নেই। জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিন। ‘

এবারে অস্বস্তি ঠেকল সুহাসের। এমন স্মার্ট একজন মহিলা ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছে তাকে বোধগম্য হলো না। শুধু অপেক্ষা করতে লাগল পরের কথা গুলো শোনার জন্য৷ তার মন বলছে আরো কিছু বলবে সে। হলোই তাই। মহিলাটি বলল,

‘ আমার ছেলেকে তো দেখেছ? ওর জন্য পাত্রী খুঁজছি। সমস্যা হচ্ছে ফরসা চামড়ার মেয়েরা ওকে পছন্দ করে না৷ গায়ের রঙ বেশি ডার্ক হওয়াতে ওর ছবি দেখে মেয়ে তো দূরে থাক মেয়ের পরিবারই প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়৷ এজন্য আমিও আর ফরসা মেয়ে খুঁজি না। আমার ছেলেও বলে দিয়েছে ফরসা মেয়ে না দেখে সুশীল মেয়ে খুঁজো গায়ের রঙ যাই হোক ওর সমস্যা নেই। ‘

আকস্মিক কপালের রগ দপদপিয়ে ওঠল সুহাসের। এই মহিলা কী বলতে চাচ্ছে? কী বোঝাতে চাচ্ছে তাকে? নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রেখে চোয়াল শক্ত করে সে বলল,

‘ আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন। ‘

‘ নামী মেয়েটাকে আমার ছেলের বউ হিসেবে খুব পছন্দ হয়েছে। মেধাবী মেয়ে। দেখতে শ্যামলা হলেও মুখের আদল মাশাআল্লাহ। আমার ছেলের উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় আর ওর পাঁচ ফুট পাঁচ। আমার ছেলের ওজন পচাত্তর আর নামীর ওজন তিপ্পান্ন। একদম পারফেক্ট ম্যাচ। শুনেছি ওর মা নেই সৎ মা আর বাবা আমেরিকায় থাকেন৷ ওর সব দায়িত্ব এখন তোমার বাবার। শুনো তোমার বাবার সাথে আমি কথা বলব। তুমিও উনাকে বলো আমার কোনো মেয়ে নেই৷ তিন ছেলের মধ্যে ইয়ামিনই বড়ো। ওর বউকে একদম নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবো আমি। ‘

কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে সুহাসের। আর সহ্য করতে পারছে না সে। নামীর সাথে তার সম্পর্কটা হয়তো স্বাভাবিক না। তাই বলে তাদের ডিভোর্স না হতেই অন্য একজন বিয়ের প্রস্তাব আনবে? আর নামী। সেই বা কোন লজ্জায় নিজের ব্যাপারে এত কিছু বলতে গেছে? তবে কি সে নতুন করে কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইছে? এজন্যই কি সেদিন ওভাবে ডিভোর্স চাইল? দু-হাত শক্ত মুঠ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল সুহাস। ইয়ামিন সাহেবের মা খেয়াল করলেন সুহাসের চোখ, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। কপাল চুইয়ে চোয়াল বেয়ে ঝড়ছে ঘাম। তাই বললেন,

‘ কী হয়েছে বাবা, গরম লাগছে? ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সুহাস। চাপা গলায় বলল,

‘ হ্যাঁ গরম লাগছে। আপনি বসুন আমি উপরে যাচ্ছি। ‘

‘ না, না বাবা আর বসব না৷ কথা তো সব বলেই দিলাম। বাকিটা তোমার বাবা, মায়ের সাথে বলব। ‘

চমকে ওঠল সুহাস। মহিলাটি বিদায় নিল। তার হৃদয় জুড়ে শুরু হলো প্রবল তরঙ্গ। বাবার সাথে কথা বললে কী হবে জানে না। কিন্তু মায়ের সাথে কথা বললে মা নির্ঘাত এর সুযোগ নেবে! মা চাইবে নামী তার জীবন থেকে পুরোপুরি চলে যাক। বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক চাপ অনুভব করল সুহাস৷ দুরুদুরু বুকে
ঢোক গিলল সে। মাথাটা জাস্ট ধরে গেল। সহ্য করতে না পেরে পকেট থেকে দ্রুত মোবাইল বের করে কল করল সৌধকে। আজ সিমরানের জন্মদিন। মা, বাবা নেই। তাই বন্ধুদের নিয়ে ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করেছে সে। তারা ভাই, বোন মা, বাবাকে খুব কম সময়ই পেয়েছে। সরকারি ছুটি ছাড়া মাকে তো পাওয়াই হয় না। জন্মদিনে সিমরান খুব মন খারাপ করে মা কাছে থাকে না বলে৷ এবার তো বাবাও কাছে নেই। তাই বন্ধুদের সঙ্গে প্ল্যান করেছে এবার অন্যভাবে সিমরানের জন্মদিন পালন করবে৷
সিমরান তার বন্ধুদের সাথে সারাদিন এনজয় করে রাতে ভাই আর ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে কেক কাটবে। সেই কেক এর দায়িত্ব দিয়েছে সৌধ আর আইয়াজের ওপর৷ ওরা কেকের সাথে মেয়ে বান্ধবী নিয়ে সিমরানের জন্য গিফট কিনতেও গেছে৷ সব কেনাকাটা শেষে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ক্লাসে যাবে। ক্লাস শেষ হবে বিকাল পাঁচটায়। সন্ধ্যার পর জন্মদিনের পার্টি। সব পরিকল্পনা মাফিকই আগাচ্ছিল। এর মধ্যে ইয়ামিনের মা এসে গণ্ডগোল করে দিল। সুহাসও প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বাসায় আসতে বলল সৌধদের।

আধা ঘন্টার মধ্যে সৌধ, আইয়াজ, নিধি, প্রাচী এসে উপস্থিত হলো৷ ড্রয়িংরুম সাজানোর দায়িত্ব নিল নিধি, প্রাচী আর আইয়াজ। সাথে সেলিনা আপাও৷ ওরা ওদের কাজে লেগে পড়ল ঝটপট। ক্লাস টাইম হওয়ার পূর্বে যতটা করা যায়। এদিকে সুহাস সৌধকে নিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে খুলে বলল সমস্ত ঘটনা। এরপর নামীর ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপা সুরে বলল,

‘ সব ঐ নামীদামির কারসাজি। ও ইচ্ছে করে এটা করেছে। ‘

বলতে বলতেই নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরল। সৌধ বেআক্কলের মতো তাকিয়ে। বলল,

‘ বুঝলাম না, এখানে নামীর দোষটা কী? ‘

সুহাস বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে ওঠল। সৌধও বাদ রইল না। তেড়ে এসে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলল ওকে। এরপর ওর পেটের ওপর বসে গলা চেপে ধরে বলল,

‘ শা’লা, ম্যাঁ ম্যাঁ করে বউকে স্বীকৃতি দিবা না। সেই বউ তোমার পা চেটে পড়ে থাকব আশা করো? ‘

দুই বন্ধুর বদ্ধ ঘরের কীর্তি কেউ দেখল না৷ ওরা একে অপরের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করতে থাকল৷ সৌধর ভাষ্যে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। এটাই সুহাসের প্রাপ্য ছিল। সুহাসের ভাষ্যে নামীদামি কেন এসবে আগ্রহ প্রকাশ করবে তারা এখনো স্বামী- স্ত্রী। কোন সাহসে ঐ মহিলাকে নিজের হাইট, ওয়েট সম্পর্কে অবগত করেছে। কী প্রয়োজন ছিল উনার সাথে মিষ্টি স্বরে আলাপ করার? তার বেলায় তো ঠিকি নিম পাতার রসের মতো তেঁতো স্বর বেরোয়। প্রচণ্ড ডেসপারেট হয়ে পড়ল সুহাস৷ ভাবগতিক স্বাভাবিক না, টের পেয়ে সৌধ প্রশ্ন করল,

‘ তুই নামীকে ভালোবাসিস? ‘

সুহাস তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল,

‘ জিন্দিগি তে না। ‘

সৌধর মেজাজ খারাপ হলো। এই ছেলে ভাঙবে তবু মচকাবে না৷ তাই সে ঠাণ্ডা মাথায় বলল,

‘ দেখ সুহাস ইগো টিগো দূরে রেখে ভালোই ভালোই সবটা বল। ‘

সহসা শান্ত হলো সুহাস। ধীরেসুস্থে গিয়ে বসল সৌধর পাশে। বলল,

‘ তুই নামীকে বলবি না কিছু। ‘

‘ ওকে বলব না। ‘

‘ সেই রাতের পর আমি ফিল করেছি ওর প্রতি আমার তীব্র ফিলিংস আছে। আর আজ সেই ফিলিংস একদম পরিষ্কার। ‘

হো হো করে হেসে ওঠল সৌধ। বলল,

‘ তবু বলবি না তুই ওকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছিস। ‘

মুখ নিচু করে সুহাস বলল,

‘ না বলব না৷ আমি কোনো নামীদামি কে ভালোবাসি না। ‘

মিটিমিটি হাসল সৌধ। তার বন্ধুর অতিরিক্ত ইগো এরওপর আবার মায়ের ন্যাওটা। সবটা বুঝে ভরসার স্পর্শ রাখল সুহাসের কাঁধে। বলল,

‘ কুল ম্যান। নামীকে ভালোবাসা লজ্জার বা অস্বস্তির না৷ ওর মতো কঠিন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়েকে ভালোবাসা গর্বের। ‘

হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। বলল,

‘ দরজার চিপায় পড়েছিরে দোস্ত। ‘

‘ আমি আছি চাপ নিস না। বের করে ফেলব। ‘

চমকে তাকাল সুহাস৷ সৌধ চোখ উপর নিচ করে বলল,

‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য রাখ, সবচেয়ে বড়ো কথা নিজের মনকে স্থির কর। কোনটা সঠিক কোনটা ভুল সুক্ষ্ম মনে বোঝার চেষ্টা কর। স্যালিউশন পাবি। না পেলে আমরা আছি৷ ‘

শেষ কথাটা বলেই চোখ টিপ দিল সৌধ৷ মাথার ওপর থেকে অনেক বড়ো একটি বোঝা নেমে গেল নিমেষে। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। বলল,

‘ পার্টিতে নামীদামিকে রাখার ব্যবস্থা করিস। ‘

ফিচেল হেসে সৌধ বলল,

‘ নিধির ওপর ছেড়ে দিছি। ও সিমরানকে বোঝাবে। সিমরান যেচে ইনভাইট করলে নামী প্রেজেন্ট থাকবে৷ সিমরান না বললে সিয়র দিতে পারছি না৷ ‘
***
জমকালো আয়োজনে ড্রয়িংরুম সজ্জিত করা হয়েছে। নামী জানত আজ সিমরানের জন্মদিন। সেলিনা আপার কাছে শুনল, সন্ধ্যায় পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। নিধি আপুও ম্যাসেজ করেছিল তাকে উপস্থিত থাকতে হবে৷ ম্যাসেজটা দেখে নামী বাঁকা হেসেছে। তার আত্মসম্মানকে এতটা ঠুনকো ভাবে কেন এরা? সিমরান তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। সে না হয় ছোটো মেয়ে। কিন্তু সুহাস তো এতটাও ছোটো নয়৷ সুহাসও তাকে বলেনি জন্মদিনের আয়োজনে উপস্থিত থাকতে। তাহলে সে কেন থাকবে? নিধি আপুর কথায়? অসম্ভব। নিধি আপু সুহাসের বান্ধবী। তার দেয়া দাওয়াতে সে তার ননদের জন্মদিনে উপস্থিত থাকবে? ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর আর অপমানের। তাই কলেজ থেকে এসে লম্বা ঘুম দিয়েছিল সে। ভেবেছিল রাতের আগে ওঠবে না। অথচ সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দিলেই আচমকা ঘুম ছুটে যায়৷
আজান শেষে আচমকা দরজার বাইরে সিমরানের গলা শুনে চমকেও ওঠে সে।

‘ নামী আপু, নামী আপু, আসব? ‘

এ প্রথম সিমরান তার সঙ্গে কথা বলছে৷ ভাবি হিসেবে মানতে পারেনি বলেই বোধহয় আপু বলছে। অস্বস্তি হলো না নামীর বরং মন থেকে না মেনে ভাবি ডাকলেই তীব্র অস্বস্তিতে ভুগত৷ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল,

‘ দরজা খোলা আছে, ভেতরে এসো। ‘

বলতে বলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল সিমরান। হাতে দু’টো শপিং ব্যাগ। সে এসেই চটপটে গলায় বলল,

‘ শোনো তোমার ওপর আমার যত রাগ ছিল সব একপাশে রেখে এসেছি। আশা করি তুমিও সব রাগ একপাশে রেখে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। ‘

কথাগুলো বলেই নামীর সামনে এসে বসল। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে হঠাৎ নামীর হাত দু’টো ধরে বলল,

‘ আমাকে একটু সিম্পল সাজে সাজিয়ে দাও তো। ‘

বিস্মিত হলো নামী৷ যতটুকু জানে সুহাসের বোন সিমরান প্রচণ্ড গর্জিয়াস একটা মেয়ে। চুলে করা ব্রাউন কালার, ভ্রু প্লাক করা, চেহারার চাকচিক্যেই সেটা বোঝা যায়। সে মেয়ে হঠাৎ সিম্পল সাজতে চাইছে। তাও আবার তার কাছে! সিমরান বুঝতে পারল আকস্মিক তার এত ভালো আচরণে অবাক হচ্ছে নামী। তাই তাকে স্বাভাবিক করতে বলল,

‘ শোনো আমি নিজের স্বার্থেই তোমার কাছে এসেছি এত সন্দেহ করার দরকার নেই। ‘

সতেরো বছর বয়সী মেয়েটার স্পষ্টভাষী স্বভাবে যারপরনাই বিস্মিত হলো নামী। সুহাসের বিপরীত এই মেয়ে টের পেল৷ সেই সঙ্গে মুগ্ধ হলো, ওর চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে। মুখের আদল মা ভাইয়ের মতো হলেও চোখ দু’টো তাদের মতো হয়নি৷ কাজল কালো টানা চোখ দুটোর জন্যই নিখুঁত রূপবতী তকমা দেয়া যাচ্ছে। যুবতী বয়সে না জানি কত রূপবতী লাগবে!
এই বাচ্চা মেয়েটার রূপে তারই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মেয়ে হয়েই যদি তার এ অবস্থা হয় ছেলেদের না জানি কি হাল! ঢোক গিলল নামী। বলল,

‘ তুমি তো খুব সুন্দর দেখতে! ‘

আকস্মাৎ কথায় ভড়কে গেল সিমরান। লজ্জা পেয়ে গেল খুব। নিচু গলায় বলল,

‘ থ্যাংকিউ। ‘

নামী বলল,

‘ ড্রেস কি এটাই থাকবে এভাবেই সাজাব? ‘

সিমরানের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। নিচু গলায় বলল,

‘ এখানে দুটো জর্জেট গাউন আছে। একটা চুজ করে দাও। নিধি আপু বা প্রাচী আপুকে হেল্প করতে বলতে পারতাম৷ কিন্তু খুব লজ্জা পাচ্ছি ওদের সামনে। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল নামীর। লজ্জা পাচ্ছে কেন? মেয়েটা কি অনেক লাজুক? কোথায় এতদিন তো এ কথা মনে হয়নি। সিমরান গাউন দু’টো বের করে দেখাল। দুটোই আকাশি রঙা। নামী অবাক কণ্ঠে বলল,

‘ ওমা, দুটোই আকাশি রঙের কেন? ‘

‘ আমার তো সব রঙেরই ড্রেস আছে। জন্মদিন উপলক্ষেও সব রঙের ড্রেস কিনেছি। তার মধ্যে এই দুটোর সঙ্গে আজ সৌধ ভাইয়ের পরা শার্টের মিল পেয়েছি! ‘

মুখ ফসকে কথাটা বলেই জিভ কামড়াল সিমরান। নামী হকচকিয়ে গেল। এই মেয়ে বলে কী? সিমরান তৎক্ষনাৎ নামীর হাত ধরে বলল,

‘ প্লিজ প্লিজ কিছু ভেবো না। আসলে আই এম ইন লাভ উইথ সৌধ ভাই ফর টু ইয়ার্স। সেই ক্লাস নাইন থেকে৷ এই সিক্রেটটা কিন্তু কেউ জানে না। আমি আরেকটু বড়ো হলেই আই মিন ইন্টারটা শেষ করলেই ওকে মনের কথা জানাব। এখন বললে ভাববে বাচ্চা বয়সের আবেগ। তুমি কিন্তু কাউকে বলো না৷ বললে খুব খারাপ হবে তোমার সঙ্গে। ‘

দম ছাড়ল সিমরান। নামী নির্বাক দৃষ্টিতে এক আনাড়ি মেয়ের প্রেমের পাগলামি প্রলাপ শুনছে। সিমরান তাড়া দিয়ে আবার বলল,

‘ সৌধ ভাই একদম সিম্পল সাজ লাইক করে। শুনেছি আমি, তাই আজকে তার পছন্দ অনুযায়ীই সাজব। এবার বুঝতে পেরেছ তো কেন তোমার কাছে এসেছি? নিধি, প্রাচী আপুকে তো এসব বলে কনভিন্স করতে পারতাম না৷ লজ্জা পেতাম, লাভ সিক্রেটটাও সবাই এখনি জেনে যেত। তাই তোমার কাছে আসা। ‘

আরো একবার দম নিয়ে পুনরায় বলল,

‘ আর শোনো আমাদের মধ্যে যে সমস্যা আছে এটার প্রভাব কিন্তু সাজে ফেলো না৷ তাহলে কিন্তু ব্রো’কে বলে তোমাকে খুব অপদস্ত করাব। একদম অনেস্ট ভাবে সাজিয়ে দেবে। দেখতে ভালো না লাগলে কিন্তু বাড়ি মাথায় তুলব, তোমার রুমের সব জিনিস ভাঙচুরও করব৷ রেগে গেলে আমি খুব ভয়ানক হয়ে যাই৷ কেউ সামলাতে পারে না। এবার বলো কোনটা পড়লে বেশি সুন্দর লাগবে। বলো বলো। ‘

সিমরানের পরিবর্তে অন্য কেউ হলে নামী দুটো কঠিন কথা বলে দিত। এমন উদ্ধতস্বভাব তার একদম পছন্দ না৷ কিন্তু সিমরান যখন কথা গুলো বলছিল একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল। রাগ তো হলোই না বরং খুব আদর পেল এই মেয়ের প্রতি। সেই সাথে আরো একটা জিনিস অনুভব করল। ওরা দুই ভাই বোনই খুব সরল মনের। ওদের ভেতরে রাগ, জেদ, অহংকার এসব ছাপিয়ে খুব সরল একটা মন আছে। শুধুমাত্র সঠিক গাইডলাইনের অভাবে এরা অনেকটা বেঁকে গেছে। যাবে নাই বা কেন? বাবা, মা ছেড়ে কাজের লোকের কাছে বড়ো হওয়া সন্তানরা আর কতোই সুশীল হবে? কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে আর যাইহোক সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করা যায় না।

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-১২+১৩

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১২

বিকেল পাঁচটা বেজে ঊনত্রিশ মিনিট৷ ফোনের রিংটোনে সহসা ঘুম ছুটে গেল সৌধর। স্ক্রিনে ‘ নিধি ‘ নামটুকু দেখেই বুক ধক করে ওঠল। সেদিন অল্প কথা-কাটাকাটি হওয়াতে নিধি তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর রাগ ভাঙানোর সুযোগ হয়নি আর। রাগ না ভাঙাতেই মেয়েটা কল করেছে! বিশ্বাস করতে পারছিল না। মুহুর্তেই শ্বাস-প্রশ্বাস চঞ্চল হয়ে ওঠল। সটান হয়ে বসে রিসিভ করল প্রিয়তমার ফোনকল,

‘ কিরে সৌধ কই তুই? কখন আসবি? ‘

ভ্যাবাচ্যাকা খেল সৌধ। তার কোথাও যাওয়ার কথা ছিল নাকি? কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল, আইয়াজের সাতটা ম্যাসেজ, দু’টো মিসড কল ভাসছে। একটা ম্যাসেজে লিখা,

‘ দোস্ত নিধিরে নিয়ে সুহাসের বাড়ি যাচ্ছি। জলদি চলে আয়। ‘

মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল সৌধ। ফোন কানে চেপে ধীরেসুস্থে ওঠে দাঁড়াল। রুমের লাইট অন করে শীতল কণ্ঠে বলল,

‘ ফোন রাখ, রেডি হবো৷ ‘

ওপাশ থেকে দু’জন মানুষকে ‘ হুররেএ ‘ বলতে শোনা গেল। সৌধ বাঁকা হেসে বিছানায় ছুঁড়ে রাখল ফোনটা। এরপর ত্বরিত ঢুকে পড়ল বাথরুমে। তাকে সুহাসদের বাড়ি যেতে হবে।

সৌধ আসার পর বাড়িটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠল৷ নিধি আইয়াজ মিলে এতক্ষণ যা যা পরিকল্পনা করেছিল সবটা জানাল সৌধকে। তারা বন্ধুরা মিলে অনেক সময় অনেক ভাবেই চেষ্টা করেছিল সুহাসকে বোঝাতে। নামী আর সুহাসের সম্পর্কের শুরুতেই তৈরি হওয়া দেয়ালটা ভাঙার চেষ্টা করেছিল প্রাণপনে। তাদের সে চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, সুহাস একদিকে মা ভক্ত অপরদিকে অসহ্য রকমের রগচটা। আর নামী প্রচণ্ড জেদি, তুখোড় আত্মমর্যাদাপূর্ণ মেয়ে। নিধি আইয়াজের পরিকল্পনা শুনে সৌধ সমর্থন করল। সৌধর সমর্থন পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে সুহাসকে ডাকল নিধি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিল সুহাস। নিধির ডাক শুনে ফোন কাটল। রুমে এসে দেখল সৌধ তার বিছানায় শুয়ে৷ আইয়াজ ডিভানে বসে ফোন টিপছে৷ নিধি তার হাত টেনে বিছানায় বসাল। বলল,

‘ সেলিনা আপার রান্না ভালো লাগে না৷ চল রাতে নিজেরা রান্না করি। ‘

সৌধ খোঁচা দিয়ে বলল,

‘ তুই রান্নায় পিএইচডি করলি কবে? ‘

আইয়াজ মুচকি হাসল। সুহাস ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

‘ ফুড পান্ডায় অর্ডার করে দিই? ‘

নিধি রান্নাবান্না খুব একটা পারে না। যতটুকু পারে নিজের জন্য চলে যায়। তাছাড়া বান্ধবী প্রাচীর জন্যই খুব ভালোভাবে রান্নাটা শেখা হচ্ছে না। মেয়েটা এত ভালো রাঁধে! ফাস্ট ইয়ারে রান্নার লোক এসে রেঁধে দিয়ে যেত। সেকেন্ড ইয়ারে প্রাচী আর সে মিলেই রান্না করে খায়। সুহাস জানে নিধিও রান্নায় পটু না না৷ তাই বাইরে থেকে খাবার আনার প্রস্তাব দিল। নিধি নাক কু্ঁচকে বলল,

‘ না না বাইরের খাবার খাব না৷ আমরা সবাই মিলে আজ পিকনিক করব। ‘

সুহাস চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ এ বইন আমি সৌধ রান্না পারি না৷ তুই আর আইয়াজ যতটুকু পারিস এতে পিকনিক হবে না। কেলেঙ্কারি ঘটাবার মতলব করিস না দোস্ত। ‘

চট করে সুহাসের পেটে গুঁতো দিল নিধি। বলল,

‘ আরে ব্যাটা, বলতে দে আমায়। ‘

নিধির মুখোভঙ্গি দেখে সৌধ মিটিমিটি হাসছে৷ এই মেয়েটা দারুণ বুদ্ধিমতী৷ সে জানে, পরিকল্পনা অনুযায়ী সুহাসকে ঠিক কনভিন্স করে ফেলবে। নিধির কথা শুনেই চিৎকার করে ওঠল সুহাস,

‘ অসম্ভব! নামীদামির কোনো সাহায্য নিব না আমি।’

সৌধ তড়াক করে ওঠে পড়ল। বলল,

‘ বা’ল আমার! কথা না শুনে না বুঝে খালি চিল্লাস। ‘

নিধি ভয় পেয়ে গেল৷ সৌধকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে সুহাসকে বলল,

‘ সুহাস, ছেলেদের এত হিংসেমি মানায় না। আন্টি তো এখানে নেই যে আজকে নামীকে নিয়ে আমরা পিকনিক করলে মহাবাংলাদেশ সমস্যা হয়ে যাবে। তাছাড়া আমরা এমনি এমনি ওকে পিকনিকে নিব না৷ মেয়েটা কী ভালো রান্না করে! ইস ঐ যে একবার ওর হাতের রান্না খেলাম স্বাদটা এখনো জিভে লেগে আছে। ‘

সুহাস চুপ মেরে গেল। মনে করল সেদিনের কথা। আহা বুকটায় শীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন। জিভে টনটন করে ওঠল নামীর হাতে রান্না করা খাবারগুলোর স্বাদ। তার ভেতরের গোপন লোভটা চড়াও হলো। মাঝে মাঝেই নামীর হাতে রান্না খেতে লোভ জাগে তার৷ কত কষ্টই না হয় সে লোভ সংবরণ করতে৷ তিনটা গার্লফ্রেন্ড বানিয়েছে। কপাল মন্দ একজনও রান্না করতে পারে না। তিন ললনার কথা মনে করে কপাল কুঁচকে গেল সুহাসের৷ নিধি ওর বাহুতে ধাক্কা দিল,

‘ কিরে কিছু তো বল? ‘

‘ আমি কী বলব? যেই না দেমাকি মেয়ে। দেখ গিয়ে হাতে পায়ে ধরেও রাজি করাতে পারিস কিনা। ‘

সুহাসের এহেন কথায় ফিচেল হাসল সৌধ৷ সুহাসের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,

‘ তার মানে তুই রাজি? ‘

সুহাস টুঁশব্দটিও করল না। মৌণতা সম্মতির লক্ষণ বুঝে নিয়ে নিধি চলে গেল নামীর কাছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস নামী কথা রাখবে। অবাধ্যতা করবে না। মেয়েটা খুবই সুশীল জানে সে।

সুহাসের কথাই ঠিক হলো৷ নামী রাজি হলো না৷ সুহাসের প্রতি অভাবনীয় তিক্ততা জন্মেছে নামীর৷ যেই তিক্ততা রাজি হতে দিল না তাকে৷ নিধি অনেক বুঝাল৷ বলল,

‘ নামী, তুমি সুহাসকে ইম্পর্টেন্টস দিচ্ছ কেন? তুমি ভাবো না আমরা তোমার অতিথি। ‘

নামী বিষণ্ণ চোখে তাকাল। ম্লান হেসে বলল,

‘ এটাত সত্যি নয়। ‘

‘ এটাই সত্যি নামী। আমরা তোমার কলেজের বড়ো ভাই, বড়ো আপু৷ তোমার কাছে এসেছি কীভাবে আপ্যায়ন করবে এবার তুমি বুঝবে। কী ফারাহ ঠিক তো? ‘

নামীর পাশে শান্ত মুখে বসা ফারাহ হ্যাঁ সূচকে মাথা নাড়াল৷ নামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ রোজ রোজ এত ঝগড়া ভালো লাগে না আপু৷ সুহাস আমাকে সহ্য করতে পারে না৷ দেখলেই যা-তা মন্তব্য করে। তাছাড়া আমারো ওর মুখ দেখতে মন চায় না৷ ভালো লাগে না ওর আশপাশে থাকতে৷ অপছন্দের মানুষটির ত্রিসীমানায় যেতেও পছন্দ করি না আমি৷ এ বাড়িতে রয়েছি শুধুমাত্র আংকেলের জন্য। ‘

‘ সবটা জানি বোন৷ একটা দিনই তো৷ মনে করো না আজ এ বাড়িতে সুহাস নেই। শুধু তুমি আর আমরা৷ তোমার কি মন চায় না একটা দিন আনন্দে কাটাতে? বন্ধুদের সঙ্গে কিছু সুন্দর মুহুর্ত কাটিয়ে বুকের ভেতরে জমানো কষ্টগুলো থেকে কিছুটা সময় দূরে থাকতে? ‘

নিধির কথা শুনে নামীর দু-চোখ টলমল করছিল। খেয়াল করে নামীকে জড়িয়ে ধরল নিধি৷ মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের চোখের ভাষা বোঝা খুব কঠিন কিছু নয় নামী। তুমি আমাকে আর সৌধ, আইয়াজকে বন্ধু ভাবতে পারো। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি৷ ‘

নিধির স্নেহময় সান্নিধ্যে গলে গেল নামী। কেঁদে ফেলল আচমকা। কতদিন এভাবে কেউ আদর করে না, ভরসা দেয় না৷ নেয় না মমতাভরে বুকে আগলে। নিধি টের পেল ওর অনুভূতি। তাই আরো গভীর করে বুকে জড়িয়ে নিল মেয়েটাকে। আদর করল নিগূঢ় ভাবে। অনুভব করল, মেয়েটা খুব ভালোবাসার কাঙাল। ইস, সুহাসটা কেন যে বেঁকে গেল। কেন যে আপন করে নিল না মেয়েটাকে। শুধুমাত্র মায়ের বশ্যতা মেনে নিয়ে একজন পুরুষ এতটা নির্দয় হতে পারে? ফুলের মতো মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারে এতটাই! বুক ভার হয়ে ওঠল নিধিরও। তার মনে হলো এরজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সুহাসের বয়স৷ মানসিক ভাবে পরিণত থাকলে নিশ্চয়ই সুহাস এমনটা করত না? বড্ড আফসোস হতে লাগল তার। মেয়েরা একুশ, বাইশ বছর বয়সে যতটা পরিণত হয় ততটা যদি ছেলেরা হতো!

রান্নাবান্নার তোড়জোড় শুরু হলো৷ সুহাস বিশ্বাসই করতে পারছে না নামী রাজি হয়েছে। নিধির দিকে ক্ষণে ক্ষণে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সে। নিধিও বেশ ভাব নিয়ে ভ্রু নাচাচ্ছে। ইশারায় বলছে,

‘ এই নিধির পক্ষে সব সম্ভব। ‘

রান্নায় নামীকে সহায়তা করছে নিধি, ফারাহ দু’জনই। ছেলেরা কিছু করবে না এ হয় নাকি? আশপাশে সুহাস নেই৷ সে দাম্ভ দেখিয়ে রুমের ভেতর বসে আছে৷ সৌধ আর আইয়াজ আশপাশেই আছে৷ ফারাহর সঙ্গে দৃষ্টিতে দৃষ্টিতে খেলা চলছিল আইয়াজের টের পেল নিধি৷ ঠোঁট টিপে হেসে হাঁক ছেড়ে ডাকল আইয়াজকে,

‘ এই আইয়াজ এদিকে আয় তো। আমরাই শুধু পরিশ্রম করব তোরা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবি তা তো হয় না। ‘

আইয়াজের সুবিধাই হলো৷ সে চঞ্চল চিত্তে ড্রয়িংরুম থেকে চলে এলো কিচেনে। নিধি ফারাহকে বলল,

‘ ফারাহ তুমি গাজর কাটো আর আইয়াজকে শসা কাটতে দাও। ‘

নিধির মুখে দুষ্টুমি উপচে পড়ছে। আইয়াজ বুঝতে পারল তার বান্ধবীটি বুঝে ফেলেছে তাদের ভদ্রবেশে ইটিসপিটিশ। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল সে। নাকের ডগা ফুলে ওঠল৷ সরলা ফারাহর দিকে তাকাল করুণ চোখে। নিধির দুষ্টুমি বুঝতে পারেনি ফারাহ৷ তাই সে একটি বাটিতে শসা আর ছুরি এগিয়ে দিল৷ আইয়াজ বা’হাতে চশমা ঠিক করতে করতে বাটি নিয়ে ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়াল। পাশ থেকে নিধি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,

‘ দোস্ত পানি খাবি? ‘

ঢোক গিলল আইয়াজ। ভীষণ নার্ভাস লাগছে তার৷ ফলে গলা শুকিয়েও গেছে৷ নিধি কি এটাও টের পেয়ে গেল? কয়েক পল পর আবারো শুনতে পেল নিধির ফিসফিস,

‘ দোস্ত বুক কাঁপছে? শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে কাউকে ডাকব? কাকে ডাকি বলত, ‘

একটু থেমে ভাবুক স্বরে বলল,

‘ এই ফারাহ বেশ নাদুসনুদুস। জড়িয়ে ধরলে বেশ আরাম পাবি৷ ওকে বলব? ‘

কেঁপে ওঠল আইয়াজ। নিধির মুখে এসব কী কথাবার্তা! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল সে৷ নিধি ঠোঁট টিপে হেসে গাল টেনে দিল তার। এরপর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বেশ উঁচু গলায় বলল,

‘ ডুবে ডুবে জল খেলে একটু অসভ্য তো হবোই বন্ধু।’

চমকে ওঠল ফারাহ। মাথা নুইয়ে গাজর কাটায় মন দিল সে। চুলোর আঁচ কমিয়ে ফারাহর দিকে তাকাল নামী। মুচকি হাসল বান্ধবীর লাজুক মুখখানি দেখে৷ নতুন নতুন প্রেমে পড়লে মেয়েরা কী ভয়ানক লজ্জাবতীই না হয়ে যায়! ছোট্ট নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ফারাহকে স্বাভাবিক করতে বলল,

‘ তোর তো গরুর মাংসে এলার্জি৷ তাই তোর জন্য মুরগির মাংস ভাজা করব। চলবে? ‘

মাথা দুলাল ফারাহ৷ চলবে তার। সৌধ রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে অনেকক্ষণ। আইয়াজের সঙ্গে নিধিকে ফিসফিস করতে দেখেই ঠাঁই রয়েছে সে৷ নিধি যখন বলল, ‘ ডুবে ডুবে জল খেলে একটু অসভ্য তো হবোই বন্ধু। ‘ শুনতে পেয়েছে সে৷ তা শুনেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেছে তার৷ এই মেয়ে সবার সব সমস্যা বুঝে৷ কে গোপনে কষ্ট পেল, কে কাকে গোপনে ভালোবাসলো, কে ডুবে ডুবে জল খেল সব জানে, সব বুঝে। শুধু তার বেলাতেই অবলা, অজ্ঞ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সৌধ৷ নিধি কাজের ফাঁকে তাকে দেখতে পেয়ে চ্যাঁচাল,

‘ কিরে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাতে হাতে কিছু তো করতে পারিস? আরেক নবাবজাদা কোথায়? ওকে কি কান ধরে নিয়ে আসতে হবে? ‘

সৌধ জবাব দিল না৷ নিজের মতো রান্নাঘরে ঢুকল। ফ্রিজ খুলে ফলমূল থেকে একটা কমলা নিল৷ এরপর কমলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে নিধির পাশে খুব কাছাকাছি দাঁড়াল। দৃষ্টি কমলার দিকে রেখে ভাবুক স্বরে বলল,

‘ আইয়াজ ডুবে ডুবে জল খায় সেটা বুঝিস, আর কেউ যে প্রকাশ্যে জল খাচ্ছে ওটা বুঝিস না? ‘

প্লেট গোছানোর পাশাপাশি আনমনে উত্তর দিল নিধি,

‘ যেটা প্রকাশিত ওটা আলাদা করে বোঝার কিছু নেই। ‘

বিস্মিত হলো সৌধ। বলল,

‘ তার মানে তুই বুঝেও না বোঝার ভান করিস? ‘

অকপটে জবাব নিধির,

‘ ধরে নে তাই। ‘

‘ কারণ? ‘

‘ দুটো। ‘

‘ কীহ? ‘

‘ আমরা সেম এজ এণ্ড আমরা খুব ভালো বন্ধু। ‘

স্তম্ভিত হয়ে গেল সৌধ৷ তার মানে নিধি অনেক আগেই টের পেয়েছে সে তার প্রতি আলাদা কিছু অনুভব করে? নিধির ক্ষেত্রে টের পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না বরং স্বাভাবিকই। নির্বাক হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সৌধ৷ সহসা মৃদু চিৎকারে তার জড়ীভূত ভাব কেটে গেল। চিৎকারটি নিধির৷ আইয়াজ শষা কেটে ছুরি পাশেই রেখেছিল। নিধির হাত লেগে সেটা নিচে পড়ে৷ নিধির পায়ের পাতায়৷ অল্প কেটে গিয়ে অনেক রক্ত ঝড়তে শুরু করেছে নিধির৷ সৌধ, নামী, আইয়াজ, ফারাহ সবাই আঁতকে ওঠল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিচে বসে পড়ল সৌধ৷ দু’হাতে নিধির পা চেপে ধরে চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ আইয়াজ, ফার্স্ট এইডস বক্স নিয়ে আয় জলদি। ‘

আকস্মিক ঘটনায় সকলেই হতভম্ব! কী থেকে কী হয়ে গেল! রক্ত পরিষ্কার করে নিজ হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিল সৌধ৷ নিধির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। ব্যথায় মুখের আকৃতিই পরিবর্তন হয়ে গেছে মেয়েটার৷ সৌধ চোয়াল শক্ত করে নিধির পাশে বসে আছে৷ সুহাস আইয়াজকে ধমকাতে লাগল,

‘ শালা, দেখে রাখবি না ছুরিটা? ‘

এরপরই অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল নামীর দিকে।

‘ দু, তিনটা আইটেম রান্না করতে একশজনের সহায়তা লাগে? ‘

আশ্চর্য হয়ে গেল নামী। পরোক্ষণেই দৃষ্টিতে কাঠিন্য ফুটিয়ে তাকাল সুহাসের দিকে৷ সুহাস চোখ সরিয়ে নিধির দিকে তাকাল। বলল,

‘ উপরে চল শুয়ে রেস্ট নিবি। ঘেমে গেছিস একদম। ‘

নিধি করুণ মুখে তাকাল। হাঁটবে কী করে সে? সুহাস বুঝতে পেরে অভয় দিল,

‘ আমাকে ধর। ‘

হাত বাড়াল সে। সৌধ বাঁধ সেধে বলল,

‘ আমি নিয়ে যাচ্ছি। ‘

এ কথা বলেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ কোনোকিছু পরোয়া না করেই চট করে কোলে তুলে নিল নিধিকে। নিধি হতবুদ্ধি হয়ে চাপা আর্তনাদ করে ওঠল,

‘ সৌধ কী করছিস তুই! আরেহ… ‘

নিধিকে নিয়ে সৌধ চলে গেল উপরে৷ পেছন পেছন গেল সুহাসও। আইয়াজ তাকাল মন খারাপ করে থাকা নামী আর ভয়ে বাকরুদ্ধ চোখে তাকানো ফারাহর দিকে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। বলল,

‘ নামী রান্নাটা শেষ করা দরকার। আমি সাহায্য করছি তোমাদের চলো। ‘
***
নিধিকে সুহাসের বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দিল সৌধ। সুহাস ব্যথা কমার মেডিসিন খুঁজে বের করে নিধিকে দিল। বেড সাইট টেবিল থেকে ওয়াটার বোতলও নিতে ইশারা করল। নাক টেনে ওষুধ খেল নিধি। আহাজারি করতে করতে বলল,

‘ এ কী হয়ে গেল সুহাস! আমি কাল ক্লাসে যাব কী করে? ‘

সুহাস বলল,

‘ আরে ইয়ার তুই চাপ কেন নিচ্ছিস। আমরা আছিত দোস্ত। তুই শান্ত হো এক কাজ কর কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাক৷ ‘

সৌধর অসহ্য ঠেকল। নিধির কান্না সহ্য হচ্ছে না তার। কতখানি কেটে গেছে ! রক্তপাতও হয়েছে অনেক। চোখের সামনে ওর ব্যথা, কান্না দেখে বুক কাঁপছে তার। অশ্রুসিক্ত মুখশ্রী দেখলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে। ইচ্ছে করছে যতটুকু নিধির কেটেছে ঠিক ততটুকু নিজেকেও আঘাত করতে। সুহাস তাকিয়ে আছে সৌধর শক্ত মুখটার দিকে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওর ভেতর এখন কী চলছে। ছেলেটা পাগলের মতো ভালোবাসে নিধিকে। নিধির এই অল্প আঘাতটাই সৌধর বুকে বিশাল হয়ে বিঁধছে জানে সে৷ তাই কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ ওর পাশে বসে থাক তুই আমি আশপাশেই আছি৷ ‘

দু’জনকে একা ছেড়ে দিল সুহাস। সৌধও ধীরপায়ে গিয়ে দরজা লক করে দিল। নিধি সবেই চোখটা বুজেছিল। দরজা লকের শব্দ শুনে রুমে শুধু সৌধকে দেখে তড়াক করে ওঠে বসল। সৌধ এ দৃশ্য দেখে ভ্রু কুঁচকে কাছে আসল ত্বরিত৷ মুখে বিরক্ত সূচক শব্দ করে বসল মুখোমুখি। বলল,

‘ এভাবে ওঠলি কেন? ‘

‘ দরজা আটকালি কেন! ‘

আতঙ্কিত স্বর নিধির৷ সৌধ থমথমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘ ভয় পাচ্ছিস কেন? মনে হয় আমি তোকে নিষিদ্ধ কিছু করার জন্য দরজা আটকেছি! বন্ধুর প্রতি এটুকু ভরসা নেই? ‘

মুখ ঘুরিয়ে নিধি বলল,

‘ থাকবে কী করে? বন্ধুত্বের ভেতরে যে নিষিদ্ধ অনুভূতি আনতে পারে সে নিষিদ্ধ কিছু করে ফেলবে না তার কী গ্যারান্টি? ‘

‘ দুটো ছেলেমেয়ে বন্ধু হতে পারলে ভালোবাসতে পারবে না কেন? ‘

সহসা মুখ ফেরাল নিধি৷ সৌধর ধারাল দৃষ্টিজোড়া হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল ওর। যে কম্পন চায় না ও৷ যেই কম্পন নিষিদ্ধ ওর জন্য৷ তাই বলল,

‘ এভাবে তাকাবি না সৌধ এভাবে তাকাবি না প্লিজ। ‘

দৃষ্টিজোড়া আরো তীক্ষ্ণ হলো সৌধর৷ নিধির কম্পিত কণ্ঠস্বর হৃদয়জুড়ে অন্যরকম দুলুনি দিল তার।নিঃশব্দে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল সে। একদম মুখোমুখি হয়ে ছাড়ল একরাশ উত্তপ্ত নিঃশ্বাস। নিধি সরে যেতে উদ্যত হতেই হাত বাড়িয়ে ওর গাল বেয়ে চলা অশ্রুটুকু মুছে দিল। চোখ বুজে নিল নিধি। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠল নিমিষে। এমন অস্থির লাগছে কেন ঠাওর করতে পারল না সে। এ প্রথম এত কাছাকাছি এসেছে সৌধ তাই কি এমন অনুভূতি হচ্ছে? কেন হবে? সৌধ তাকে নিয়ে আলাদা কিছু অনুভব করলেও সে তো অনুভব করেনি। তাহলে কেন এমন লাগছে? এ প্রথম কোনো পুরুষ এতটা কাছে এসেছে বলেই কী? হ্যাঁ তাই হবে৷ যতই তারা ভালো বন্ধু হোক না কেন। তারা তো বিপরীত লিঙ্গ। নিধি চোখ বুজে অনুভূতির হিসেব কষতে ব্যস্ত। এদিকে সৌধর বুকের ভেতর চলা অনুভূতির তরঙ্গোচ্ছ্বাসটুকু বাধ্য করল, নিধির সিক্ত কোমল গালটায় নিজের পুরো ঠোঁটে আদর মিশিয়ে উত্তপ্ত স্পর্শ ছোঁয়াতে। আকস্মিক সৌধর এহেন স্পর্শে সারা শরীরে বিদ্যুৎ চমকাল নিধির৷ মস্তিষ্ক চেতনাশক্তি হারাল। বড়ো বড়ো চোখ করে অবিশ্বাস্য চাউনি নিক্ষেপ করল সৌধর প্রগাঢ় দৃষ্টিতে৷ ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,

‘ এটা তুই কী করলি? ‘

আলগোছে সরে গেল সৌধ। মুচকি হেসে বলল,

‘ কিছু করিনি খেয়েছি, বুঝিসনি? আবার খাব? ‘

‘ মানে কী খাবি তুই? ‘

‘ অন্যকিছু নয়, চুমু। ‘

মুখ হা হয়ে গেল নিধির। সৌধ যে এমন কাণ্ড করবে এমন কথা কিছু বলবে ভাবনার বাইরে ছিল তার৷ এই ছেলের বন্ধুত্ব এত মসৃণ আর ভালোবাসা কী বেপরোয়া! কান দু’টো গরম হয়ে গেল বেচারির৷ নাকের ডগা রক্তবর্ণ হয়ে ওঠল নিমিষে। সহসা হো হো করে হেসে ওঠল সৌধ। বলল,

‘ এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমাদের প্রেম হয়নি তো ডিয়ার, লজ্জা পেতে হবে না৷ চুমুটা বন্ধু হিসেবেই খেয়েছি। প্রেমিক হিসেবে খেলে তো ঠোঁটে খেতাম গালে নয়। ‘

‘ বন্ধু হিসেবে চুমু খেয়েছিস? অসভ্য। ‘

কথাটা বলেই সৌধর কলার চেপে ধরল সে। সৌধ অমায়িক ভঙ্গিতে নিধির দুহাতের ওপর নিজের হাত রাখল। ঠোঁটে দুষ্টুমি ভরে হাসি ফুটিয়ে শুধাল,

‘ বান্ধবীকে চুমু খাওয়া কি দণ্ডনীয় অপরাধ? ‘

দাঁতে দাঁত চিবিয়ে নিধি বলল,

‘ নারে দোস্ত অপরাধ না, অধিকার। এ জন্যই তুই কাল প্রাচীকে চুমু খাবি। ইট ইজ ফাইনাল। ‘

‘ হোয়াট! ‘

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৩

রান্না শেষে ঘেমে-নেয়ে একাকার নামী। এমতাবস্থায় খেতে বসা সম্ভব না। তাই সকলকে বলল, খেয়ে নিতে। সে গোসল সেরে খাবে। সৌধ বাঁধ সেধে বলল,

‘ এতক্ষণ যাবৎ পরিশ্রম করলে। আর তোমায় ছাড়া আমরা খেয়ে নিব? এ তো হয় না বোন। ‘

সৌধর মুখে বোন শব্দটি শুনে আপ্লুত হলো নামী। সৌধ মৃদু হেসে বলল,

‘ নিধি নিচে আসতে পারবে না। আমরা বরং খাবার গুলো উপরে নিয়ে যাই৷ তুমি শাওয়ার নিয়ে উপরে চলে আসো কেমন? ‘

নম্র স্বরে সম্মতি দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল নামী।
আইয়াজ তখন সৌধর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ আরেব্বাস, একসময় সুহাসের প্রক্সি দিতে চাইলি। মানে বউ করতে চাইলি এখন আবার বোন করে ফেললি! তুই পারিসও দোস্ত। ‘

সৌধ চাপা স্বরে উত্তর দিল,

‘ ওটা জাস্ট ফান ছিল গাধা। বন্ধু বউকে স্বীকার করলে ভাবি করতাম। বউ স্বীকার করেনি তাই বোন করে ফেললাম। ‘

হাসল আইয়াজ। নাকের ডগায় চলে আসা চশমাটা ঠেলে দিয়ে বলল,

‘ বুঝলাম। ‘

সৌধ বাঁকা হেসে বলল,

‘ আরো একটা জিনিস বোঝার বাকি আছে। ‘

‘ কী? ‘

‘ নিধি আমার মনের কথা জেনে গেছে। সো লুকোচুরি খেলার সমাপ্তি। আজ থেকে যা হবে সব ওপেনলি। ‘

অবাক কণ্ঠে আইয়াজ জিজ্ঞেস করল,

‘ কী জেনে গেছে নিধি? ‘

‘ আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক একদিন হাজব্যন্ড ওয়াইফে পরিণত হবে, এটাই। ‘

বিস্মিত হলো আইয়াজ। অতিরিক্ত চমক পেলে তোতলাতে শুরু করে সে৷ তাই তুতলিয়েই বলল,

‘ হোয়াট! এর আগে কখনো বলিসনি তো? ‘

চোখ টিপল সৌধ বলল,

‘ সারপ্রাইজ। ‘
***
ফারাহ অপেক্ষা করছে নামীর জন্য। আইয়াজ আশপাশেই ঘুরঘুর করছে। একে অপরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। আইয়াজের বোকা চোখের প্রগাঢ়তায় হৃৎস্পন্দন ক্রমশই বেড়ে চলেছে মেয়েটার৷ শ্যামলা বর্ণের সরল মুখের স্বচ্ছ
চোখজোড়ার ভাষা পড়তে পারছে সে। ড্রয়িংরুমের শোভামণ্ডিত সোফায় বসে ফারাহ। হঠাৎ আইয়াজ এসে তার সম্মুখে বসল। জীবনে প্রথমবার নিজ হৃদয়ে কারো প্রতি প্রণয়ানুভূতি টের পেয়েছে আইয়াজ। পুস্তকের বাইরে দৃষ্টি থমকেছে নিগূঢ়ভাবে। এই অনুভূতি ভীষণ মোহনীয়, খুবই প্রগাঢ়। আকস্মিক আইয়াজ সম্মুখে এসে বসায় বেশ আড়ষ্টতা কাজ করল ফারাহর। লজ্জায় রঙিন হয়ে ওঠল তার গাল দুটো। লজ্জা পাচ্ছিল আইয়াজও। অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় সে আলাদা। কোনো দুরন্তপনা নেই তার মধ্যে। আর না আছে মেয়ে ঘটিত, প্রেম ঘটিত ব্যাপারে অভিজ্ঞতা। ফারাহ নামক এই মেয়েটার প্রতি হুট করেই এত বেশি অনুভূতি জেগে ওঠেছে যে যা অবিশ্বাস্য, যা কল্পনার অযোগ্য তাই করে বসছে৷ আইয়াজের কাণ্ড দোতলার বারান্দা থেকে দেখছিল, সৌধ, সুহাস। মিটমিটিয়ে হাসছিল ওরা৷ পাশাপাশি সুহাস ফোনে কয়েক সেকেণ্ডের ভিডিয়ো করেও নিল৷ আইয়াজ বন্ধুদের কাণ্ড সম্পর্কে অজ্ঞাত রইল৷ সে নিজের কাণ্ড করতে মগ্ন।
খুবই কোমল এবং মোহময় স্বরে সে ফারাহকে জিজ্ঞেস করল,

‘ তোমার কি বোরিং লাগছে? ‘

একপলক তাকাল ফারাহ। চোখের চশমা ঠিক করে দৃষ্টি নইয়ে ফেলল। মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বোঝাল বোরিং লাগছে না৷ এমন মুহুর্তে সুহাস, সৌধর উপস্থিতি ঘটল৷ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা সুহাসের। সৌধ হালকা কেশে ওঠার ঢং করে বলল,

‘ আটজোড়া চোখ তাহলে প্রেমে পড়েই গেল! ‘

বিস্মিত হওয়ার ভাণ ও কণ্ঠে। আইয়াজ আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়িয়ে গেল ফারাহ। আকস্মিক ওদের ওঠে পড়ায় সুহাস ঢং করে বলল,

‘ ও বাবা দেখেছিস কাণ্ড! ‘

সৌধ মাথা দুলিয়ে বলল,

‘ হু হু দেখলাম। খুব তাড়াতাড়ি সানাই বাজাতে হবে তাহলে। ‘

আইয়াজ বোকা চোখে একবার ফারাহর দিকে আরেকবার বন্ধুদের দিকে তাকাল। ফারাহ যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম। ওদের এমন অবস্থায় ওখানে উপস্থিতি ঘটল নামীর। সদ্য স্নান করে আসা সে রমণীকে দেখে চোখ আটকে গেল সকলেরই৷ হলুদ রঙের ঘাগরার সঙ্গের কালো রঙের টিশার্ট পরনে নামীর। গলায় হলুদ রঙা জর্জেট ওড়না ঝুলানো। ভেজা চুলগুলো পেছনে ছড়ানো। কানের পাশে ছোটো-ছোটো চুলগুলো থেকে এক দু’ফোঁটা জল গড়াচ্ছে। কী পবিত্র, কী স্নিগ্ধ ও মুখশ্রী! ঘন পাপড়িতে আবৃত কাজল কালো চোখ, লিপস্টিক বিহীন পাতলা মসৃণ ঠোঁটজোড়ায় যেন অদ্ভুত সৌন্দর্যে মণ্ডিত। শ্যামলা বর্ণের এই মেয়েটির মধ্যেও আছে ধারাল সৌন্দর্যের বসবাস। খুব কাছে থেকে, খুব নিগূঢ়ভাবে যে পুরুষ এ সৌন্দর্য অনুভব করতে পারবে। বিনা দ্বিধায় স্বীকার করতে বাধ্য, সে সৌভাগ্যবান পুরুষ। সকলের নির্নিমেষ দৃষ্টি হঠাৎই সুহাসের দিকে ঘুরে গেল৷ সুহাস অপলকে তাকিয়ে নামীর পানে। খেয়াল করে ইতস্তত বোধ করতে লাগল নামী। নিচু গলায় বলল,

‘ রাত হয়ে যাচ্ছে, চলুন খেয়ে নিই সকলে। ‘

সবাই ওর কথা শুনল। কিন্তু সুহাস শুনল কী? বোধহয় না। তাই তো নেই কোনো ভাবান্তর। আইয়াজ সুহাসের দিকে তাকিয়ে সৌধর কাছে এগিয়ে এলো। চাপা স্বরে বলল,

‘ দোস্ত সুহাসের চোখ দেখছিস? ‘

সৌধ ফিসফিস করে বলল,

‘ সব দেখছি আমি৷ প্ল্যানটার কথা মনে আছে? ‘

‘ হ্যাঁ দ্রুত খাওয়া শেষ করে এদের ব্যবস্থা করব, চল।’

সুহাসের রুমে মেঝেতে বসল সবাই। ফারাহ আর নামীই সকলকে খাবার পরিবেশন করে দিল৷ সুহাস বেশ অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছে। না চাইতেও বার বার তার দৃষ্টি নামীতে থমকাচ্ছে। গোসল শেষে এই মেয়েটাকে অভাবনীয় স্নিগ্ধ দেখায়। সে রোজই বিষয়টা খেয়াল করে। হয় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে না হয় ছাদে দেখা হয়ে গেলে৷ কিন্তু আজ ভেজা চুলে এতটা কাছ থেকে দেখে যেন অনেক বেশিই অপরূপা লাগছে। না চাইতেও বার বার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে সুহাসের। কত ললনাদের সঙ্গে ওঠাবসা তার। অথচ এই নামীতে যেন অন্যরকম ঘ্রাণ মেশানো। যা তাকে খুব করে টানে। ভাগ্যিস মাঝের দেয়ালটা ছিল! নয়তো তাণ্ডব ঘটে যেত মেয়েটার সঙ্গে, ভয়াবহ তাণ্ডব৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস৷ নামী খাওয়ার ফাঁকে সুহাসের দৃষ্টি খেয়াল করে মনে মনে বকল,

‘ তেদর ছেলে কোথাকার! ‘

সুহাসও খেয়াল করল নামী তার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে৷ নিশ্চয় মনে মনে বকছে তাকে? বুঝে নিয়ে সকলের সামনেই বলে ওঠল,

‘ প্যাঁচার মতো চোখে কী দেখছ? আফসোস হচ্ছে আমার মতো সুদর্শন ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেছে বলে? লোভ হচ্ছে আমার সান্নিধ্য পেতে? ‘

আচমকা সুহাসের এমন কথায় সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও নামী অপমান বোধ করল। খাওয়া থেমে গেল তার৷ মুখ কঠিন হয়ে গেল নিমিষেই। নিধি ধমক দিল সুহাসকে। বলল,

‘ সুহাস একদম বাজে কথা বলবি না৷ কখন থেকে দেখছি তুইই ওর দিকে অভুক্ত প্রানীর মতো চেয়ে আছিস৷ আর বলছিস উল্টোটা? ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল নামী। সে নিঃশ্বাসের শব্দ পেয়ে সুহাস বলল,

‘ দেখ কীভাবে শ্বাস ফেলে স্নেকি গার্ল কোথাকার। ‘

আর চুপ থাকতে পারল না নামী। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ মঙ্গুস বয়! এজন্যই বুঝি সহ্য করতে পারছেন না? ‘

হো হো করে হেসে ওঠল সৌধ। সুহাসকে বলল,

‘ দারুণ জব্দ। ‘

এমন সময় আইয়াজ বলল,

‘ আমার মনে হয় সুহাস বেজি না ও হলো সাপুড়ে। ‘

ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল সৌধ। সুহাসের কানে ফিসফিস করে বলল,

‘ আইয়াজ বোধ হয় ঠিকই বলছে দোস্ত। তোর মাঝে কোনো সাপুড়ে আত্মাই ভর করেছে। ‘

ওপাশ থেকে আইয়াজ নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা দোস্ত তোর কি সাপ নিয়ে খেলাধুলা করতে মন চাচ্ছে? শুনেছি সাপুড়েরা সাপ নিয়ে খেলাধুলা করতে না পারলেই উল্টাপাল্টা করে। ‘

ক্ষেপে গেল সুহাস। খাবার ছেড়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে নিধি ধমকে ওঠল সবাইকে। বলল,

‘ কী শুরু করলি তোরা? শান্তিতে খেতে দিবি না? সুহাস বোস, বোস বলছি। তুই যদি খাবার ছেড়ে ওঠে যাস আমিও খাবার ছেড়ে এক্ষুনি তোর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব। ‘

নিধির হুমকি শুনে সবাই ভয় পেল। শুরু করল যে যার মতো দ্রুত খেতে। খাওয়া শেষে ঠাণ্ডা পানীয় পান করল সবাই। এরপর নামী আর ফারাহ চলে যাবে বলে বিদায় নিতে চাইল। কিন্তু পারল না। নিধি আর আইয়াজ আটকাল৷ তারা এখন একটা গেম খেলবে। নামীর মনটা খিঁচে আছে তাই সে রাজি হলো না। সুহাসও দাপট দেখিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আইয়াজ অনুরোধ করল খুব। তার অনুরোধে ফারাহ নরম হলো। করুণ চোখে তাকাল নামীর দিকে। নামী তবুও রাজি হলো না। সে গটগট পায়ে রুম ছাড়তে উদ্যত হলো। দরজা পর্যন্ত যেতেই সৌধ পথ আটকাল। অমায়িক একটা হাসি দিয়ে বলল,

‘ কী ব্যাপার আমার বোন তো এতটা অবাধ্য নয়। ‘

মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল নামী। সৌধর মুখে এই নিয়ে দু’বার বোন শুনল সে। বুকের ভেতরটা বিগলিত হয়ে ওঠল। আমতা আমতা করে বলল,

‘ আসলে ভাইয়া…

বাকিটা বলতে পারল না। সৌধ বলল,

‘ আসলে, নকলে কিছুই নয়। আমরা যতক্ষণ না বলছি তুমি কোথাও যাচ্ছ না। ‘

নিশ্চুপ হয়ে গেল নামী। সৌধ ওর চোখে চোখ রেখে ভরসার সঙ্গে বলল,

‘ আদেশ নয় বন্ধু, ভাই হিসেবে ভালোবেসে সঙ্গ চাইছি। ‘

আর না করতে পারল না নামী। ওদিকে ফারাহ যে যেতে চাইছে না সেটাও টের পেল। অগত্যা ওদের সঙ্গে গেম খেলতে বসতে হলো। সৌধ গিয়ে টেনে নিয়ে এলো সুহাসকে। ওরা সবাই মেঝেতে গোল করে বসল। দু’লিটারের কোকাকলার খালি বোতল রাখল মাঝখানে। আইয়াজ খেলাটা বুঝিয়ে দিল সবাইকে,

‘ শোনো সবাই বোতলটা ঘুরানো হবে। যার দিকে মুখ করে থামবে তাকে আমরা যা বলব তাই করতে হবে।’

এরপরই খেলা শুরু হলো। নিধির দিকে বোতল থামতেই সৌধ বলল,

‘ চোখ বন্ধ করে যে কোনো একজন যুবককে কল্পনা করার চেষ্টা করবি। এরপর যার মুখটা বা যাকে দেখতে পারবি তার নামটা আমাদের বলবি। ‘

কথা অনুযায়ী চোখ বন্ধ করল নিধি। সবাই উৎসুক মুখে তার দিকে তাকিয়ে। বেশ কিছু সময় অতিক্রম হলো। কিন্তু চোখ খুলল না নিধি। যেন সে কিছু একটা অনুভব করছে। সৌধ বলল,

‘ কাকে দেখতে পাচ্ছিস? ‘

নিধি তখনকার বলা সৌধর কথা, স্পর্শ অনুভব করছিল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে ওঠছিল তার। এমন সময় সৌধর প্রশ্ন পেয়ে উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেল। এক ঢোক গিলে নিজেকে সচেতন করে নিয়ে বলল,

‘ অর্পণ স্যার! ‘

সৌধর মেজাজ খারাপ করল। কঠিন চোখে তাকাল সে। সুহাস ওর কাঁধে হাত রেখে ইশারা করল চুপ থাকতে। সৌধ দমে গেল। মনে মনে বলল,

‘ আচ্ছা খেলাটা শেষ হোক তারপর মনে করাচ্ছি তোকে। এখন আর কোনো রাখঢাক নেই আমার। ভুলে গেছিস তুই। ‘

এরপর আবার শুরু হলো বোতল ঘোরা৷ যা গিয়ে থামল সুহাসের দিকে। ঠিক এ মুহুর্তটুকুর অপেক্ষাতেই যেন ছিল সকলে। সবাই হইহই করে ওঠল। সুহাস বুঝে গেল এদের মাথায় কিছু চলছে। নিধি বলল,

‘ দোস্ত এটা কিন্তু খেলা। ‘

সুহাস ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ হ্যাঁ আমার মাথায় আছে। তোরা মাথায় রাখলেই শান্তি। ‘

আইয়াজ মিটিমিটি হাসল। সুহাস চটে গিয়ে বলল,

‘ বদের মতো হাসবি না। ‘

সৌধ সবাইকে চুপ থাকতে বলে সুহাসকে বলল,

‘ আচ্ছা কেউ হাসবে না। এবার আমরা যা বলব তাই কর। ‘

সুহাসের মুখ থমথমে। সৌধ বলল,

‘ নামীকে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করবি। বলবি, আই লাভ ইউ সো মাচ। ‘

‘ অসম্ভব। ‘

সৌধর কথায় নামীর প্রথমে রাগ হতে নিচ্ছিল। কিন্তু কলেজ ক্যাম্পাসে ঘটা প্রথম দিনের কথা মনে পড়তেই চুপ হয়ে গেল। আর অপেক্ষা করতে লাগল, সুহাসের মুখে আই লাভ ইউ শোনার। আর বুঝিয়ে দেয়ার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে প্রপোজ করার, আই লাভ ইউ বলার জ্বালাটা ঠিক কেমন।

সুহাস কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। নামী তাই তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

‘ ছেড়ে দিন ভাইয়া৷ আপনার উচিতই হয়নি এমন মেরুদণ্ডহীন প্লেয়ারকে নিয়ে খেলতে বসার। ‘

এহেন কথায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলো সুহাস। তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সে। ক্রোধে গজগজ করতে করতে বলল,

‘ ওকে ফাইন। এটা যেহেতু খেলা সেহেতু মিথ্যামিথ্যি আর গেম হিসেবে বলাই যায়। ‘

মুহুর্তেই চারপাশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠল। সুহাসের নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে নামীর সামনে বসে পড়ল, হাঁটু গেড়ে। মনে মনে একবার ভেবে নিল, আই লাভ ইউ বলেই সরে যাবে নামীদামির সামনে থেকে। এরপর তাকাল নামীর চোখের দিকে। নামী তখন ধূসর বর্ণের দাম্ভিক পুরুষটার দিকেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে। সুহাস ঐ চোখে অদ্ভুত চাউনি নিক্ষেপ করল। প্রস্তুত হলো প্রপোজ করতে,

‘ আই…

সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। নিধি আইয়াজের হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে৷ ফারাহ সরল চোখে তাকিয়ে আছে নামী, সুহাসের দিকে। সৌধ পকেট থেকে ফোন বের করে দৃশ্যটাকে ক্যামেরা বন্দী করতে ব্যস্ত। সুহাস একবার ‘ আই ‘ উচ্চারণ করে চুপ হয়ে গেছে। তাই নিধি তাকে তাড়া দিল,

‘ কী হলো এত লেট করছিস কেন? বল। ‘

সুহাস পুনরায় বলল,

‘ আই…’

বাকিটুকু যেন বেরই হচ্ছিল না। সৌধ বিরক্ত হয়ে গেল৷ আইয়াজ বলল,

‘ এমন ভাব করছিস মনে হয় জীবনে কোনো মেয়ে কে আই লাভ ইউ বলিস নি? এ শব্দটা যেন আজ নতুন জানসিছ, শিখছিস, আর বলতে চাচ্ছিস। ‘

সকলের থেকে সমানতালে উৎসাহ আর বিভিন্ন মন্তব্য পেতে পেতে একসময় সুহাস এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল,

‘ আই হেইট ইউ সো মাচ নামীদামি। ‘

তৎক্ষণাৎ আচমকা দু-চোখ গলে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নামীর গাল বেয়ে। সে সুহাসের চোখে দেখেছে সুহাস এ কথা বলতে চায়নি৷ সে সুহাসের মধ্যে আই লাভ ইউ বলার যে উদ্যম দেখেছে তা মিথ্যে নয়৷ মিথ্যা হতে পারে না। তবুও কেন? কেন? ঘৃণার ওজন এতটাই বেশি? যে মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটি আসতে গিয়ে ঘৃণাটাই বেরিয়ে আসে।

আপনি অপরাধী নন। অথচ কেউ আপনাকে দাঁড় করিয়েছে কাঠগড়ায়। নিক্ষেপ করছে অজস্র ঘৃণার ফলা৷ এরচেয়ে বড়ো তিক্ততা হয় না। এরচেয়ে যন্ত্রণাময় ঘটনা এ পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-১০+১১

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১০

ক্লাস শেষ হলো বিকেল পাঁচটায়। সৌধর হাবভাব ভালো ঠেকেনি নিধির৷ একদম স্যারের পিছু পিছু বেরিয়েছে সে৷ কিন্তু বিপদ ঘটল অর্পণ স্যারকে দেখে। আটাশ বছর বয়সী যুবক অর্পণ। তাকে এই মেডিকেল কলেজের হার্টথ্রবও বলা হয়। যার প্রতি অন্যান্যদের মতো নিধিও দারুণ মোহিত। বর্তমানে স্টুডেন্ট’সদের মধ্যেও একজন হার্টথ্রব রয়েছে। যার নাম সৌধ চৌধুরী। এমপি সুজা চৌধুরীর ছোটো ছেলে। কিন্তু নিধির চোখ সেখানে আটকায়নি। দমিত হয়নি হৃদয়। ধরা যায়, ছোঁয়া যায় এমন জিনিসে আমরা আকৃষ্ট কম হই৷ নিধির ক্ষেত্রে ঠিক এমনই ঘটেছে। তার নজরে অর্পণ স্যার গগন হলেও সৌধ কেবলই মৃত্তিকা। অর্পণ স্যারকে সব সময় কালো রঙের ফুল হাতা শার্ট আর নেভি ব্লু জিন্স প্যান্টে দেখা যায়৷ আজো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। লম্বাটে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ে ঐ কালো শার্টটাই যেন সবচেয়ে বেশি মানানসই। শার্টের ওপর সাদা অ্যাপ্রোন, চোখে চিকন সোনালি ফ্রেমের চশমা, গলায় ঝুলানো স্টেথোস্কোপ, বা’হাতের কব্জিতে ব্র্যান্ডের ঘড়ি। সবমিলিয়ে নজরকাড়া যুবকটিকে স্থির নয়নে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নিধি। ক্লাসের সামনে বারান্দা ধরে এগুচ্ছিল সে। অর্পণ স্যার কাছাকাছি আসতেই সম্মুখে দাঁড়িয়ে দুরুদুরু বুকে সালাম দিল,

‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। ‘

‘ নিধি? ওয়ালাইকুমুস সালাম। কী অবস্থা তোমার? ‘

প্রথম বর্ষের শেষের দিকে অর্পণ স্যার ক্লাস নিয়েছিল তাদের। পরিচয় হয়েছিল ক্লাসেই। স্যার তার নাম মনে রেখেছে! ভাবতেই উত্তেজনায় হাত, পা কাঁপতে শুরু করল৷ শ্বাসরোধ করে কোনোরকমে উত্তর দিল সে। অর্পণ স্যার মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। নিধি শুনতে পেল সুহাসরা সালাম দিচ্ছে অর্পণ স্যারকে। এরপরই শুনতে পেল আইয়াজের মৃদুস্বর,

‘ দোস্ত সৌধ কিন্তু ব্যাপক রেগে আছে। তোকে নাকি কোন ছেলেরা টিজ করেছে! জানাসনি কেন? ‘

সহসা রেগে গেল নিধি৷ বলল,

‘ কেন ওকে কেন জানাতে হবে? বন্ধু বলে আমার সব বিষয় ওকে জানাব? আমার কোনো প্রাইভেসি নেই?’

হকচকিয়ে গেল আইয়াজ। নিধির কথা, শুনতে পেয়ে সুহাসও হতভম্ব হয়ে গেল। সৌধর কমে এলো পায়ের গতি। দূরত্ব কম হওয়াতে ঐ গতিতেই নিধির পাশে এসে দাঁড়াল। গমগমে সুরে বলল,

‘ প্রাইভেসি? ‘

সৌধর স্থির বাঁকা চাহনিতে ভড়কে গেল নিধি। আমতাআমতা করে বলল,

‘ দোস্ত আমি কোনো ঝামেলা চাই না। প্লিজ। ‘

গায়ে চাপানো অ্যাপ্রোন খুলে বা হাতের বাহুতে রাখল সৌধ। ডানহাতের আঙুল চালালো চুলে। পুরু ঠোঁটজোড়া জিভ দ্বারা ভিজিয়ে নিল দ্রুত। বলল,

‘ তুই আমার ফ্রেন্ড। শুধু ফ্রেন্ড না ভেরি গুড ফ্রেন্ড। তুই এ শহরের মেয়ে না, আলাদা শহরের। এখানে তুই আছিস, বলা যায় আপন বলতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। তোর সুবিধা, অসুবিধা দেখার দায়িত্ব আমাদেরই। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার সুজা চৌধুরীর ছোটো ছেলের বান্ধবী তুই। এলাকার কয়েকটা বখাটে ছেলেপুলে তোকে উত্যক্ত করবে আর আমি জানব না? জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিব না? আর কী বললি প্রাইভেসি! এখানে তোর প্রাইভেসিটা ঠিক কী নিধি? ‘

ঢোক গিলল নিধি৷ অসহায় চোখে তাকাল সুহাস আর আইয়াজের দিকে। এরপর তাকাল সৌধর তীক্ষ্ণ চোখে। আমতাআমতা করতে লাগল সে। সৌধর শীতল অভিব্যক্তি বুকে কাঁপন ধরাল ক্রমাগত। হাসফাস চিত্তে বলল,

‘ চল যেতে যেতে কথা বলি। ‘

দু’কাঁধ উঁচু করে সৌধ ইশারায় বলল,

‘ চল। ‘

ক্যাম্পাসের পিছনে বিরাট বড়ো পুকুর। সে পুকুরের সিঁড়িতে এসে বসল নিধি। বসল সুহাস আর আইয়াজও। সৌধ অ্যাপ্রোনটা আইয়াজের হাতে দিয়ে নিধির থেকে দু-হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। দু-হাত রাখল কোমরে। বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস নিল। নিধি সুহাসের দিকে থমথমে মুখে তাকিয়ে। সুহাস ইশারায় শান্ত থাকতে বলল তাকে। আইয়াজ ফিসফিস করে বলল,

‘ ছেলে গুলো কী বলেছে সেটা বল। ‘

নিধিও ফিসফিস করে বলল,

‘ তার আগে বল তোরা এসব কী করে জানলি? ‘

‘ আমাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে এখনো তোর সন্দেহ আছে? ‘

‘ না ভাই, নেটওয়ার্কটা কী সেটা বল, কে বলেছে? ‘

‘ সৌধর দূর সম্পর্কের খালাত বোন ওখানেই ভাড়া থাকে। নার্সিংয়ে পড়ছে মেয়েটা। চিনবি মেবি। তোদের তিন বাসা পরেই থাকে। ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি৷ সৌধর দিকে তাকাল অসহায় ভঙ্গিতে। বলল,

‘ দোস্ত এখানে এসে বোস। ‘

সহসা তাকাল সৌধ। নিধি ঈষৎ হেসে বসতে ইশারা করল। সৌধ যেন ময়লা ঝারার ভঙ্গিতে কথাটা ঝেড়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল,

‘ ছেলেগুলো কী বলেছিল তোকে? ‘

‘ আর বলিস না তিনটাই জুনিয়র। ওদের মধ্যে হৃদয় নামে ছেলেটা প্রেমের প্রপোজাল দিয়েছে। আমি কীসে পড়ি আমার বয়স কত সেসব না জেনেই। জানিস ছেলেটা কীসে পড়ে? ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। ‘

বলতে বলতেই খিলখিল করে হেসে ওঠল নিধি৷ হাসল আইয়াজও৷ সুহাস ঠোঁট টিপে হেসে তাকাল সৌধর দিকে। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ বেচারা জেলাসনেসে লাল হয়ে যাচ্ছে। ‘

নিধির হাসি থামল সৌধর কটমট চাহনি আর গম্ভীর কণ্ঠে,

‘ তুই কী বললি? ‘

‘ কী আবার বলব, বলে দিলাম আমার বয়স আর কীসে পড়ি। ব্যস হৃদয়ের সঙ্গে আসা ছেলে গুলো হো হো করে হেসে ওঠল। ক্ষেপাতে শুরু করল হৃদয়কে। আর আমি চলে গেলাম বাসায়। ‘

সৌধ কিঞ্চিৎ শান্ত হলো। খালাত বোন মুনিয়া কথোপকথন শুনেনি। শুধু দেখেছে নিধির কাছে এসে কয়েকটা ছেলেকে হাসাহাসি করতে। তাহলে আসল ঘটনা এটাই। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। এরপর নিধির কাছাকাছি এসে ঝুঁকে বলল,

‘ এরপর থেকে কেউ এমন কিছু বলতে এলে বলবি তুই সুজা চৌধুরীর আত্মীয়। আর হ্যাঁ অবশ্যই আমাদের জানাবি। ‘

নিধি মাথা দুলাল। সৌধ সরে গিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করল পরিচিত এক ভাইকে। নিধি যে এলাকায় থাকে সে এলাকার নাম বলে ছেলেটার নাম জানালো। কিসে পড়ে তাও জানালো। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ বেশি না, দু’টো চটকানি দেবেন। ‘

নিধি চমকে ওঠল। চ্যাঁচিয়ে বলল,

‘ আরে সৌধ এসব করার কী দরকার, মেয়ে হয়ে জন্মেছি, দেখতে শুনতে ভালো প্রপোজাল তো আসবেই। আশ্চর্য লোক তুই ভাই! ‘

কথাটা বলেই সুহাস আর আইয়াজের দিকে তাকাল। সহসা বাহুতে শক্ত হাতের চাপ অনুভব করল সে। সঙ্গে বল পূর্বক টান। সৌধর শক্ত থাবায় ভড়কে গেল সে। চাপা আর্তনাদ করে বলল,

‘ আহ, কী করছিস কী! ব্যথা পাচ্ছি। ‘

‘ এরচেয়েও বেশি ব্যথা আমি পাচ্ছি… ‘

বসা নিধিকে একটানে দাঁড় করাল সৌধ। মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে কথাটা বলল সে। নিধি কাঁপা কণ্ঠে বলল,

‘ তুই এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিস কেন কী হয়েছে তোর? ‘

‘ অর্পণ স্যারের দিকে ওভাবে তাকাস কেন? ‘

সৌধর ক্রোধ বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে আজ। নিধির দৃষ্টিতে অন্য পুরুষের প্রতি মুগ্ধতা ক্ষিপ্ত করে তুলেছে তাকে। কিন্তু নিধি এই ক্ষিপ্ততা অগ্রাহ্য করে ব্যথাহত স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ কীভাবে তাকাই? ‘

সৌধর ভাবমূর্তিতে শুধু নিধি নয় সুহাস, আইয়াজও ভড়কে গেছে। আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। সুহাস এসে চেপে ধরল সৌধর কাঁধ। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,

‘ দোস্ত, নিধি ব্যথা পাচ্ছে। ‘

আইয়াজ উত্তেজিত হয়ে ধমকে ওঠল,

‘ সৌধ! ‘

আচমকা নিধির বাহু ছেড়ে দিল সৌধ। তার পেশিবহুল হাতের থাবা পেয়ে নিধির কোমল বাহুতে লাল দাগ বসে গেল। প্রায় কান্না করে দিল নিধি। ত্বরিত অ্যাপ্রোন খুলে বাহুতে বসা আঙুলের দাগ দেখে ক্রোধে ফেটে পড়ল সে৷ এক চিৎকার দিয়ে বলল,

‘ এটা তুই কী করলি সৌধ। ‘

সৌধ অধর কামড়ে থমকানো চোখে তাকিয়ে। নিধি ওর থেকে উত্তর না পেয়ে আইয়াজের দিকে তাকাল। ক্রোধ মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করে পুনরায় চিৎকার দিয়ে বলল,

‘ বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওর সমস্যা কী জিজ্ঞেস কর। বান্ধবীর সাথে বউয়ের মতো ট্রিট কেন করছে ও? ‘

আইয়াজ হতভম্ব মুখে তাকিয়ে। তার হতভম্বতা নিধির ক্রোধ তীক্ষ্ণ করে তুলল। এবার সুহাসের দিকে তাকাল সে। তৃতীয়বার চিৎকার দিয়ে বলল,

‘ ওকে বলে দিস ফারদার যদি এই আচরণ দেখি তাহলে আমাদের বন্ধুত্বের সমাপ্তি এখানেই। ‘

নিধির মুখে এমন কথা শুনে সৌধ হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ল। হাত কেঁপে ওঠল কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিতে৷ কিন্তু অমন অঘটন ঘটার পূর্বেই সুহাস সৌধকে জাপ্টে ধরল। আইয়াজকে জোর গলায় বলল,

‘ আইয়াজ নিধিরে পৌঁছে দিয়ে আয়। আমরা এখানেই অপেক্ষা করছি। ‘

শরীরে বাঁধা পেয়ে মুখে কিছু বলতে উদ্যত হবে সৌধ, তৎক্ষনাৎ নিচু কণ্ঠে সুহাস বলল,

‘ কন্ট্রোল সৌধ কন্ট্রোল। অলরেডি নিধি সন্দেহ করে ফেলছে। তোর এবার থামা উচিত। এতটা কন্ট্রোল হারাবি বুঝতে পারলে আগেই সাবধান করতাম। ‘
***
এক মাসের জন্য ইন্ডিয়া গেছেন সোহান খন্দকার। চাচাত ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য ছেলেমেয়েদের রেখে যেতেই হলো। বাড়িতে সুহাস, সিমরান আর নামী ছাড়া কেউ নেই। শুক্রবার, ছুটির দিন৷ বাড়ির কাজের মহিলার নাম সেলিনা। সুহাস, সিমরান তাকে সেলিনা আপা বলে ডাকে। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। শীতল আবহাওয়ায় সেলিনা আপার কাছে খিচুড়ির আবদার করল সিমরান। সকালের নাস্তা শেষ করেই আবদারটি করেছে সে। তাই সেলিনা আপা জানালো, দুপুরে খিচুড়ি আর গরু মাংস করবে।

কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে জানালা খুলেছে নামী। অমনি চোখ পড়েছে ওপাশের বেলকনিতে দাঁড়ানো সুহাসের দিকে। জানালা খোলার শব্দ পেয়ে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে সুহাস। নামী আপাদমস্তক সুহাসকে দেখে নিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ নির্লজ্জ কোথাকার! ‘

সুহাস স্পষ্ট ভাবে না শুনলেও বুঝে ফেলল নামী তাকে নির্লজ্জ বলেছে। আর কেন বলেছে টেরও পেল। তাই নিজের ধবধবে উদাম শরীরে তাকাল সে। পরনে শুধু থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। তাও উদরের কেন্দ্রস্থলের নিচে পরা। নিজেকে দেখে নিয়ে অধর কোণে বক্র হাসি ফুটিয়ে তুলল। নামীর পানে তাকাল দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে। এরপর ঠোঁট কুঞ্চিত করে শিষ বাজাতে শুরু করল। সুর তুলল একটি দুষ্টুমিভরা গানের। ‘ আমি নষ্ট মনে নষ্ট চোখে দেখি তোমাকে মন আমার কী চায় বুঝাই কেমনে ‘ সুহাস মনে মনে এ গানের সুর তুললেও নামী স্পষ্ট বুঝতে পারল না। তবে তার মন খুঁত খুঁত করতে লাগল। কেন যেন খুব পরিচিত মনে হলো সুরটা। সুহাস মুখো ভঙ্গি দেখে বুঝে ফেলল নামী গানটা বুঝেনি। না বুঝলে তো আসল মজাটাই হবে না। ভেবেই ত্বরিত পকেট থেকে ফোন বের করল সে। এরপর ইউটিউবে ঢুকে গানটা সার্চ করে বের করে প্লে করল। সুহাসের দুরন্ত চোখজোড়া স্থির রইল নামীতেই। মোবাইলে পান্থ কানাই আর মমতাজ গাওয়া সে গানটা বাজছে,
‘ আমি নষ্ট মনে নষ্ট চোখে দেখি তোমাকে মন আমার কী চায় বুঝাই কেমনে! ‘

গানটা শুনতেই নামী ধরে ফেলল সুহাসের সুর। সহসা কান দু’টো গরম হয়ে ওঠল তার। চোখের সামনে দাঁড়ানো সুহাসকে এখন মমতাজ মুভির হুমায়ূন ফরিদীর সেই চরিত্রকেই মনে পড়ল। কিন্তু মমতাজের চরিত্র কে? এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই খেয়াল করল সুহাস তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। যে চাহনির ভাষা সুবিধার নয়। তার মন বলল, ও চোখ নষ্ট, ও মন নষ্ট, এই ছেলে পুরোটাই নষ্ট! গা শিউরে ওঠা অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে ওঠল সে। সুহাসের দৃষ্টি অনুসরণ করে আচম্বিতে দৃষ্টি পড়ল নিজের দিকে। অমনি তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সুহাসের দৃষ্টি তার গলদেশ ও উদরের মধ্যবর্তী অংশে। বোঝা মাত্র এক চিৎকার দিয়ে বলে ওঠল,

‘ অসভ্য, নির্লজ্জ, লষ্ট মাইন্ডেড ছেলে কোথাকার! আই উইল কিল ইউ! ‘

আরো নানারকম বকাঝকা করে শব্দ করে জানালা
বন্ধ করে দিল। কাণ্ড দেখে হো হো করে হাসতে লাগল সুহাস। অনেকদিন পর মেয়েটাকে জব্দ করে মনটা চনমনে হয়ে ওঠল তার। কিয়ৎক্ষণ প্রাণভরে হেসে শান্ত হলো সে। এরপর আচমকাই গলা খাঁকারি দিয়ে টিপ্পনী কাটল ,

‘ ঢাকনা ছাড়া বিরিয়ানির পাতিল। অথচ গন্ধ ছড়াবে না, তাই কখনো হয়? ‘

দরজা লাগিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে নামী। তাই সুহাসের বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেল। একদিকে লজ্জা অন্যদিকে তীব্র ক্রোধ মিলেমিশে মুখটা থমথম হয়ে রইল তার৷ কিন্তু সুহাসকে কঠিন কিছু কথা না বলে শান্তি পেল না। চুপ থাকতেও পারল না৷ তাই গর্জন ছেড়ে বলল,

‘ আশপাশে যে হুলো বেড়াল ওঁত পেতে আছে বেমালুম ভুলে গেছিলাম। ‘

হুলো বেড়াল! নিজেকে হুলো বেড়াল মেনে নিতে কষ্ট হলো সুহাসের। বলার জন্য পাল্টা কিছু খুঁজে পেল না। মস্তিষ্ক কেমন নিশ্চল ঠেকল। আবার মনে ক্রোধও জাগল। রাগে গজগজ করতে করতে ঢুকল ম্যাসেণ্জারে। সৌধ লাইনে নেই, কিন্তু আইয়াজ আছে। তাই তাকে বলল,

‘ কী করি বল তো, এই নামী খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বাড়িতে টেকা যাচ্ছে না। ‘

আইয়াজ বলল,

‘ কেন কী করল আবার? ‘

‘ এই তো মাত্রই আমাকে হুলো বেড়াল বলল। ‘

‘ কেন তুই কি ছুঁকছুঁক করছিস দোস্ত? ‘

প্রশ্নটা করেই কয়েকটা চোখ টিপ ইমুজি পাঠালো আইয়াজ। সুহাস ফোঁস ফোঁস করতে করতে রাগি ইমুজি দিল তাকে। আইয়াজ সঙ্গে সঙ্গে বলল,

‘ আরে ইয়ার রাগিস কেন? ও তোরে হুলো বলছে তুই ওরে মেনি বলে দে শুধবাদ। ‘

সুহাসের মাথায় যেন বুদ্ধি খুলল। সে গলা বাড়িয়ে তৎক্ষনাৎ নামীকে বলল,

‘ নিজেকে যে বেড়ালী ভাবো জানতাম না তো! ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন বেড়ালী, তোমার মতো মেনির প্রতি আই হেভ নো ইন্টারেস্ট। ‘

চলবে…

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১১

নিজের ভেজা দুটো টিশার্ট ছাদে টাঙানো রশিতে মেলে দিল সুহাস। ভেজা চুলে হাত নেড়ে পানি ঝেড়ে গিয়ে দাঁড়াল ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে। সদ্য গোসল করা সুহাসকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। তার লোমহীন ধবধবে ফরসা বুকটাও আকর্ষণীয়। পাশের বাড়ির ছাদে চৌদ্দ, পনেরো বছর বয়সী এক কিশোরী। কাপড় নাড়ার পাশাপাশি লক্ষ্য করছিল সুহাসকে৷ দুরন্ত সুহাস টের পেতেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠল। শিষ বাজিয়ে চেষ্টা করল বাচ্চা মেয়েটির মনোযোগ দৃঢ় করার। কাপড় নাড়া শেষে সম্পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল মেয়েটি। সুহাস দুষ্টুমি ভরে হাসল। ডান চোখ টিপ দিল। লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল মেয়েটা। লাজুক হাসি এঁটে রইল ওর ওষ্ঠজোড়ায়। সুহাস ভেবেছিল বাচ্চা একটা মেয়ে৷ এক চোখ টিপ দিলেই ভয়ে দৌড়ে পালাবে৷ কিন্তু না, তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি ওড়নার কোণা কচলাতে শুরু করল। আর মাঝে মাঝে আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগল তাকে। ভড়কে গেল সুহাস। এ মেয়ে তো তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে। সে ফ্লার্ট করল আর মেয়েটা পটে গেল! নাহ পাশের বাড়ির অল্পবয়সী ললনাদের সঙ্গে ফ্লার্ট করা যাবে না। বলা যায় না কখন বাড়ি এসে বসে থাকে৷ এক কালনাগিনী নিয়েই তার জীবন ঝালাপালা। কালনাগিনীর দল আর ভারী করতে চায় না সে৷

সুহাসরা এই বাড়িটি নতুন করেছে। ডুপ্লেক্স এই বাড়িতে ওঠেছে মাসখানেক হলো। এর আগে এ শহরে তারা ভাড়া বাসায় থাকত। নিজস্ব এই বাড়িটা তার বাবা মায়ের খুব শখের। সারাজীবন যত রোজগার করেছে তার বেশির ভাগি ঢেলে দিয়েছে এই বাড়িতে৷ আশপাশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার বাবা মায়ের আলাপ থাকলেও তার নেই। তাই পাশের বাড়ির অল্পবয়সী মেয়েটার সাথে আজি প্রথম দেখা। গলা খাঁকারি দিল সুহাস। জিজ্ঞেস করল,

‘ এই তোমার নাম কী ? ‘

মেয়েটা চমকাল। মুখ তুলে একবার তাকিয়ে হাসল লাজুকতা ভরে। এরপর মাথা নুইয়ে বলল,

‘ অতসী তালুকদার। ‘

‘ কোন ক্লাসে পড়ো? ‘

‘ ক্লাস সেভেন। ‘

বিস্মিত হলো সুহাসের দৃষ্টি। পরোক্ষণেই কেশে ওঠল সে। মেয়েটার চোখে কিঞ্চিৎ ব্যাকুলতা। সুহাস নিজেকে স্বাভাবিক করল সময় নিয়ে। এরপর বলল,

‘ তোমার বড়ো বোন আছে? ‘

মাথা দুলালো অতসী। সুহাস এবার প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল। কুটিল হেসে বলল,

‘ তাহলে আমাকে দুলাভাই ডাকবে। আপুর নাম্বার মুখস্থ আছে? ‘

অতসীর মুখে মেঘ নেমে এলো। অমাবস্যার রাতের ন্যায় মুখ করে সে বলল,

‘ আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে। ‘

এরপর আর এক মুহুর্তও দাঁড়াল না অতসী। তীব্র অভিমান নিয়ে ছাদ থেকে চলে গেল সে। এই মেয়ে আবার অভিমান করতেও জানে? মানুষ তো অভিমান করে তার কাছের লোকজনের সাথে। সুহাস তো তার কাছের কেউ নয়৷ তবে কেন অভিমান করল? বর্তমানে অল্পবয়সী মেয়েদের পাকনামি আকাশ ছোঁয়া। এরা মুহুর্তের মধ্যে প্রেমে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যেই প্রেমে পড়ে যাওয়া পুরুষটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কেউ কেউ আবার সংসারও করে ফেলে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সুহাস৷ হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল তার। হাসি থামল তাদের গেট বরাবর দৃষ্টি যেতেই৷ তাদের গেটের সামনে ফারাহ দাঁড়িয়ে! নামীর বেস্ট ফ্রেন্ড ফারাহ। কী ব্যাপার? আকস্মিক গম্ভীর হয়ে গেল সুহাস। বোঝার চেষ্টা করল ঘটনা টা ঠিক কী?

এক মিনিট পর গেট খুলা হলো। নামীর হাসিমাখা মুখটা এক পলক দেখল মাত্র। ফারাহ ভেতরে ঢুকল। গেটে তালা লাগিয়ে ফারাহকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল নামী। ছাদে ওঠার সময় ওপাশ থেকে খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে এসেছিল তার। সেলিনা আপাও খিচুড়ি করছে সেই ঘ্রাণ খুব একটা পায়নি। নামীও আজ খিচুড়ি করছে। সেই খিচুড়ি খেতেই কি বান্ধবীকে বাড়ি ডেকে আনল? তাহলে সে কেন চুপ করে থাকবে? তারও উচিত বন্ধু-বান্ধব ডেকে আনা৷ তারপর আনন্দ উল্লাস করে খিচুড়ি ভোজন করা। বাবা বাড়ি নেই। ফেরার আশঙ্কাও নেই। এই তো সুযোগ নামীকে জ্বালানোর। আর দেরি করল না সুহাস৷ ঝটপট ম্যাসেজ করল সৌধকে। সৌধ তার প্রস্তাব নাকচ করে দিল। সে খেয়েদেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবে৷ পুরো সপ্তাহ রাত জেগে পড়াশোনা করে। শুক্রবার দুপুরের পর কয়েক ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস তার। তাই ঘুমের চেয়ে সুহাসের এই ফালতু প্রস্তাবকে বেশি গুরুত্ব দিল না ৷ নামীকে জ্বালানো ছাড়া আর কোনো লক্ষ্যই যেন সুহাসের নেই৷ নম্র, ভদ্র, শান্তশিষ্ট মেয়েটাকে অহেতুক অপমান, অসম্মান, বিরক্ত করাতে কখনোই পক্ষপাতিত্ব করেনি তারা৷কতগুলো মাস হয়ে গেল বোঝাচ্ছে সুহাসকে। মাতৃভক্তে এতটাই অন্ধ হয়ে গেছে ছেলেটা, যে নামীর ব্যাপারে ইতিবাচক পরামর্শ দিলে বন্ধুদেরও শত্রু ভেবে বসে থাকে। সৌধর থেকে পাত্তা না পেয়ে আইয়াজকে কল করল সুহাস৷ ব্যাপক পড়ুয়া ছাত্র আইয়াজও পাত্তা দিতে চাইল না। কায়দা করে সুহাস ফারাহ আসার কথা জানাল। আইয়াজ যে ফারাহ’র প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে টের পেয়েছে সে। ইদানীং ম্যাসেন্জারে ফারাহর সঙ্গে বেশ চ্যাটিং করে আইয়াজ। সব খবর আছে সুহাসের কাছে। তাই ফারাহ নামক টোপ ফেলল সে। মুহুর্তেই সে টোপ গিলেও নিল আইয়াজ৷ বলল,

‘ আসছি আমি। সাথে করে নিধিকেও নিয়ে আসছি। নিধির আসার খবরটা তুই শুধু সৌধকে বলে দে। ওর ঘুম উড়ার পাশাপাশি ফুড়ুৎ করে তোর বাসায় উপস্থিত হবে। ‘

আইয়াজের বুদ্ধি মানেই খাপে খাপ। আজ ওরা এলে রেখে দেবে। রাতেও যেতে দেবে না ৷ জম্পেশ আড্ডার পাশাপাশি নামীদামিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে। শান্তি ভরে শ্বাস নিল সুহাস। নিচে নামতে পা বাড়াল। তৎক্ষনাৎ মাথায় তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বালতি হাতে ছাদে প্রবেশ করল নামী। মুখোমুখি হলো সুহাসের। সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ছাদের মাঝ বরাবর। নামীর চলনবলন দেখলেই সুহাসের শরীর জ্বলতে শুরু করে। এই মেয়ে হাবভাব এমন দেখায় যেন সে এই দেশের মিনিস্টার। কাপড়ের পানি ঝেড়ে শুখা দিতে লাগল নামী। সুহাস নিচে গেল না৷ সে বিপরীত পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল নামীর দিকে। নামী ভেবেছিল সুহাস চলে গেছে। তাই জামার নিচে পরিধেয় ছোট্ট বস্ত্র শুখা দিতে উদ্যত হলো। সে মুহুর্তেই বেজে ওঠল সুহাসের ফোন৷ চমকে ওঠল নামী। ধাতস্থ হয়ে অধোবস্ত্রটি লুকিয়ে ফেলল। সুহাস ফোন রিসিভ করলেও নামীর থেকে নজর সরাল না। নামী কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর কামিজের নিচে আলগোছে অধোবস্ত্রটি রেখে কামিজ টান টান করে শুখা দিয়ে নিচে চলে গেল। নামী চলে যেতেই ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল সুহাস। ব্যাপারটা কী ঘটল? ফোনের ওপাশে প্রীতি বকবক করেই চলেছে। সুহাসের সেদিকে হুঁশ নেই৷ সে মগ্ন নামীতে। নামী কী লুকাল? অমন দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কেন? এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগল মাথায়। একসময় ফোন কেটে দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। কিঞ্চিৎ দ্বিধা ঠেকলেও দুরন্ত মস্তিষ্ক তাকে পাত্তা দিল না। চট করে জামা উঁচিয়ে দেখে ফেলল কাঙ্ক্ষিত বস্ত্রটি। নিমিষেই শরীর শিরশির করে ওঠল তার। হৃৎপিণ্ডে ধড়াস জনক একটি শব্দও হলো। কণ্ঠনালি শুঁকিয়ে নীরস হয়ে গেল। কেঁপে ওঠল জামা ধরে রাখা হাতটা। শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। নিজের প্রতি অভিযোগ আসল একবার। পরোক্ষণেই মনটা চনমনে হয়ে ওঠল। আশপাশে চোরা চোখে তাকিয়ে ছাদের দরজার দিকে সচেতন ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। এরপর ত্বরিত অধোবস্ত্রটি টান দিয়ে ভরে নিল হাতের মুঠোয়। ছাদের দরজা পর্যন্ত গিয়ে কী যেন ভেবে মুঠো ভরা বস্ত্রটি থ্রি কোয়াটার প্যান্টের পকেটে পুরে নিল। দৃষ্টিতে ঝলমল করল দুষ্টু হাসিরা। অধরে ফুটে ওঠল বক্র হাসি। ‘ আহ নামীদামি দারুণ জব্দ হবে তুমি। ‘ মনে মনে কথাটা বলেই বুকের ভেতর খেলে গেল পৈশাচিক আনন্দ।
***
বড়ো আপুকে খুব কষ্টে রাজি করেছে ফারাহ৷ যেন নামীর কাছে ক’দিন থাকতে দেয়৷ দু’জন মিলে একসঙ্গে পড়াশোনা করবে। নামী পড়াশোনায় কত ভালো সে গল্প শুনেছে ফারাহর বড়ো আপু। সে বরাবর ভালো স্টুডেন্ট’সদের সমীহ করে। তাই নামীর রিকুয়েস্ট ফেলতে পারেনি। তাছাড়া শুনেছে মেয়েটা একা থাকবে। তার বাবা গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেশের বাইরে গেছে। মা মরা মেয়ে বড্ড মায়া হয়েছে নামীর জন্য৷ সোহান খন্দকার নামীর শশুর এ কথা ফারাহ জানলেও ফারাহর বড়ো বোনকে জানানো হয়নি। তাছাড়া সুহাস, নামীর সম্পর্কের কথা কেউ জানে না৷ কেবল ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু – বান্ধব ছাড়া। তাই খুব একটা সমস্যা হয়নি আপুকে পটাতে৷ দুই বান্ধবী মিলে দুপুরবেলা আচাড় দিয়ে পাতলা খিচুড়ি খেল। এরপর পড়াশোনা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে পড়তে বসল যে যার মতো।

সময় গড়াল অনেকক্ষণ। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে চমকে ওঠল নামী। ছুটে চলে গেল ছাদে, কাপড় আনতে। ফারাহও বই বন্ধ করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল সুহাস ভাইদের বাড়িটা। সদর দরজা দিয়ে ঢুকছিল আইয়াজ। ফারাহ এক পাশ থেকে অপর পাশে যেতে নিতেই নিজ ওড়নায় নিজেরই পা লেগে পড়ে গেল। স্বাস্থ্য ভালো নাদুসনুদুস মেয়েটা পড়ে গিয়ে আঘাত পেল তীব্রভাবেই। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই অমন দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারল না আইয়াজ। ত্বরিত গিয়ে ধরল মেয়েটাকে। ভারিক্কি নরম শরীরটাকে ওঠে বসাতে বেশ বেগ পেতে হলো। দুই চোখ গলে পানি পড়ছে ফারাহ। তরতরা নাক, গোলাপি রাঙা ঠোঁটদ্বয় রক্তিম হয়ে ওঠেছে। আইয়াজের পেছনে নিধি ছিল। আতঙ্কিত হয়ে সেও ছুটে এসে ধরল ফারাহকে। দুই বন্ধু মিলে ওঠাল ওকে। ধীরেসুস্থে নিয়ে বসাল ড্রয়িং রুমের সোফায়৷ ওপর থেকে সুহাস নামী দু’জনেই ছুটে এলো। নামী ফারাহকে ধরে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,

‘ কী হয়েছে ফারাহ! ‘

আইয়াজ চশমা ঠিক করতে করতে সরে গেল। নিধি বলল ঘটনাটি। নামী বকে ওঠল ফারাহকে। বলল,

‘ চশমা ছাড়া বেরিয়েছিস কেন তুই? ইস, কোথায় কোথায় লেগেছে বল আমায়। ‘

সুহাস বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। ব্যঙ্গ করে বলল,

‘ আসছে ডাক্তারনি। ‘

নামী তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ফারাহকে বলল,

‘ দেখি ওঠতে পারবি? রুমে চল। ‘

নিধি বলল,

‘ আমি সাহায্য করছি। ‘

নামী, নিধি দু’জন মিলে ধরে ফারাহকে নামীর ঘরে নিয়ে গেল। আইয়াজ ব্যথাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের যাওয়ার পানে৷ সুহাস তা দৃষ্টিপাত করে নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ কীরে চক্কর কবে থেকে চলে? ‘

‘ কীসের চক্কর টুকটাক কথা হয় শুধু৷ আর কিছু নয়। ‘

‘ তাহলে ব্যথা কোথায় পাচ্ছিস চোখে না বুকে? ‘

‘ মানে কী বলছিস কী? ‘

দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করল আইয়াজ। সুহাস তার চতুর্দিকে ঘুরপাক দিতে দিতে দুষ্টু হেসে বলল,

‘ বুকের ব্যথা চোখে ফুটে বন্ধু, চোখে ফুটে। ‘

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৯

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৯
বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেনি। উদয়িনী পুরোপুরি তার স্বামীর প্রাক্তনের মেয়েকে ছেলের জীবন থেকে সরাতে পারেনি৷ কিন্তু ছেলেমেয়ে দু’টোর মাঝে তুলে দিয়েছে শক্তপোক্ত দেয়াল। যে দেয়ালের নাম ঘৃণা। সুহাস নামীকে ঘৃণা করে তার মায়ের জন্য। যে মেয়ের মা তার মায়ের জীবনের সব সুখ কেড়ে নিয়েছে সেই মায়ের মেয়েকে সে কেন সুখ দেবে? হিংসাত্মক প্রশ্নটি উদয়িনীর। যা ছেলে সুহাসের মস্তিষ্কে শক্ত লোহার ন্যায় গেঁথে দিয়েছে সে। আর নামী সুহাসকে ঘৃণা করে মেরুদণ্ডহীন পুরুষ বলে। যে ছেলে ভিত্তিহীন একটা ভাবনা থেকে বিয়ের মতো পবিত্র একটি বন্ধনকে অস্বীকার করে। মায়ের সন্তুষ্টির জন্য দেয় না বৈবাহিক স্বীকৃতি। শুধু তাই নয় যে ছেলে মায়ের আক্রমণাত্মক, হিংসাত্মক আচরণ গুলোকে বিনা সংকোচে মেনে নেয়, নিজের অনুভূতিদের দিয়ে দেয় বলিদান৷ মাকে তৃপ্ত করার জন্য নিরপরাধ একটি মেয়েকে অসম্মান, অপমান করতে দ্বিধা করে না। সে ছেলে আর যাই হোক তার যোগ্য হতে পারে না। প্রথম দিকে নামী সুহাসকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, তাদের বাবা, মায়ের অতীতের সঙ্গে সে কোনোভাবেই জড়িত নয়। কিন্তু সুহাস কিছুতেই বুঝতে চায় না৷ নামী যখন নিজের মায়ের পক্ষ নিয়ে সুহাসকে বলে, উদয়িনী যা অভিযোগ করছে সব মিথ্যা। তখন থেকে সুহাস আরো ক্ষেপে যায়। মায়ের বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে নারাজ সে। ব্যর্থ হয় নামী৷ জিতে যায় উদয়িনী। কিন্তু এই জেতা তার এবং তার স্বামীর মাঝেকার নড়বড়ে দেয়ালটা শক্তপোক্ত করে তুলে।একই বাড়ি হয়ে যায় দু’ভাগ। একভাগে সোহান খন্দকার আর নামী। আরেক ভাগে সুহাস, উদয়িনী আর সিমরান৷

প্রথম দিন কলেজ ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে বেশকিছু দিন বিষন্নতায় কাটিয়েছে নামী। নিজের বেলকনিতে বসে জানালার পাশে বসা বিষণ্ন নামীকে দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছে সুহাস৷ নামী জানত সুহাস তাকে ফলো করে। বিষণ্ণতার এ কয়েকটা দিন সেটা আরো বেড়ে গেছে। টের পেয়েছে নামী। সে পারত জানালা বন্ধ করে রাখতে। ফলো করতে না দিতে। তবুও কেন জানি এটা করতে ইচ্ছে করেনি। পুরো ফাঁকা বাড়িতে দম বন্ধ লাগে তার। জ্বালানোর জন্য হলেও সুহাস যে তাকে ফলো করে এটাকে সে ইতিবাচক ভাবেই নেয়। উদয়িনী থাকে ময়মনসিংহ। সোহান খন্দকার শুক্রবার ব্যাতীত বাকি দিন গুলোয় রাত এগারোটার আগে বাড়ি ফেরে না। ওদের ভাগে, সিমরান নিজের মতো থাকে। বাড়ির আশপাশে তাকে দেখা যায় না। একটা কাজের মহিলা এসে সকাল বিকাল সুহাসদের রান্না সহ বাকি কাজগুলো করে দিয়ে যায়। তাদের ভাগে সে সারাদিন একাই থাকে। রান্না পারে বলে আলাদা করে লোক রাখেনি। শুধু সাপ্তাহিক ধোপানি রেখেছে একজন।
.
.
সকাল সকাল তৈরি হয়ে সদর দরজা পর্যন্ত আসতেই সুহাসের সামনে পড়ে গেল নামী। এক পলক নামমাত্র স্বামীর মুখটা দেখেই চোখ সরিয়ে নিল সে। পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সময় শুনতে পেল,

‘ সকাল সকাল প্যাঁচী দেখলাম! হে খোদা যাত্রা শুভ করো। ‘

এমন কথা শুনে সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল নামী। ঘাড় ফিরিয়ে চোখ কটমট করে তাকাল। পরোক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে উচ্চবাচ্যে বলল,

‘ হে আল্লাহ, সকাল সকাল ফকফকা বাঁদর দেখলাম। যাত্রা শুভ করো। ‘

এটুকুতেই ক্ষ্যান্ত দিল না। সঙ্গে আরবি উচ্চারণ করে দোয়া পড়তে পড়তে স্থান ত্যাগ করল। মারাত্মক ভাবে মেজাজ বিগড়ে গেল সুহাসের। এই মেয়ের এত দেমাক আসে কোথায় থেকে? তাদের দয়ায় এ বাড়িতে থাকছে। আবার তাদেরই দেমাক দেখাচ্ছে। সব বাবার জন্য। তীব্র ক্রোধে গজগজ করতে করতে দরজায় তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেও। প্রত্যেকের কাছেই একটা করে চাবি থাকায় ফেরা নিয়ে কাউকেই কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না।

ফারাহ নামের মেয়েটির সঙ্গে নামীর বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ওঠেছে। সবসময় দু’জনকে একসঙ্গেই দেখা যায়। ক্যান্টিনে নামীর জন্য অপেক্ষায় ছিল ফারাহ। নামীর আসতে আর মিনিট দুয়েক লাগবে। এমন সময় ক্যান্টিনের দরজায় সুহাসকে দেখতে পেল সে। চোখের চশমাটা ঠিকঠাক করে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ আরে এটাত সেই ভাইয়া! রেগকে সত্যি ভেবে নামীকে হেইট বলা ভাইয়াই তো এটা। ‘

সুহাস তার ক্লাসমেট প্রীতিকে নিয়ে ক্যান্টিনে প্রবেশ করল। তৎক্ষনাৎ ফারাহ বই বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে সুহাসদের উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, আপু। ‘

দর্পযুক্ত ভঙ্গিতে তাকাল সুহাস। সালাম ফেরাল কিনা বোঝা গেল না৷ প্রীতি মেয়েটা মৃদু হাসল। ফারাহ মুখ নিচু করে হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে মোবাইল টিপতে শুরু করল। সালাম দিয়ে দিয়েছে। এবার আর বেয়াদপ ভেবে রেগ টেগ দিতে পারবে না। সুহাস খুব ভালো করেই জানে চশমাওয়ালি মেয়েটার সঙ্গে নামীর গদগদ ভাব। তাই তাকে ক্যান্টিনে বসা দেখেই সে তার তিন নাম্বার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এখানে চলে এলো। দৃঢ় বিশ্বাস কিছুক্ষণের মধ্যে নামীও আসবে। হলোও তাই কিয়ৎকাল অতিবাহিত হতেই নামীর উপস্থিতি ঘটল৷ নামী প্রথমে থতমত খেলেও ত্বরিত সামলে নিল নিজেকে। দৃঢ়চিত্তে গিয়ে বসল ফারাহর পাশে। এক কাপ কফি খেতে খেতে পড়াশোনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষ করল। এরপর বান্ধবীকে নিয়ে এমনভাবে ক্যান্টিন ত্যাগ করল যে সুহাসের অহমিকায় আঘাত পড়ল ভয়ানক আকারে। ক্রোধে কপালের রগ দপদপিয়ে ওঠল। প্রীতি তার হাতের ওপর হাত রেখে মৃদু হেসে বলল,

‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড সুহাস, আর ইউ ওকে?

ত্বরিত প্রীতির হাত সরিয়ে ওঠে দাঁড়াল সুহাস। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ আমার তাড়া আছে। যেতে হবে। ‘

প্রীতি অবাক হলো খুব। মুখটা থমথমে হয়ে গেল তার। নতুন নতুন রিলেশন। কোথায় সুহাস তার প্রতি আলাদা যত্নশীল থাকবে। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল প্রীতির৷ ভাবল,

‘এই সুহাসটা এমন কেন? ওর জায়গায় সৌধ থাকলে ব্যাপারটা কি অন্যরকম হতো? সৌধর মধ্যে আলাদা একটা ব্যাপার আছে। আপাদমস্তকই কামুকতায় ভরা। ওর গার্লফ্রেন্ড হতে পারলে বোধহয় জোশ হতো৷ কিন্তু সে তো প্রপোজাল রিজেক্ট করে দিয়েছে!’

একরাশ হতাশা নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল প্রীতি৷ সুহাসের ক্লাস দু’টায়। তবুও সে নামীদের ক্লাস টাইমে ক্যাম্পাসে আসে। জুনিয়র, সিনিয়র অনেক মেয়েদের সঙ্গেই আড্ডা দেয়। বর্তমানে তার তিনটে গার্লফ্রেন্ড। প্রীতি আর বাকি দু’জন বাইরের। তারা মেডিকেল স্টুডেন্ট নয়। আপাতত সুহাসের কলেজে মন টিকছে না। যে উদ্দেশ্যে আগেভাগে আসা সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তাই খিঁচানো মেজাজ নিয়ে চলে গেল সৌধদের বাসায়। সেখানে গিয়ে খিঁচানো মেজাজটা চড়া হলো। যখন শুনল গতকাল নিধিকে কয়েকটা ছেলে টিজ করেছে। অথচ এ ব্যাপারে নিধি তাদের কিচ্ছু জানায়নি। সৌধের মনের অবস্থা টের পেল সুহাস৷ আজ যে নিধির অবস্থা কী হবে ভেবেই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সৌধকে শান্ত করতে সুহাস বলল,

‘ তোর কিছু বলতে হবে না৷ ওকে যা বোঝাবার আমিই বুঝিয়ে দেব। ‘

সৌধ কাভার্ড থেকে টিশার্ট বের করে বিছানায় রাখল। সুহাসের দিকে তাকাল হিংস্র চোখে। সুহাস শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,

‘ কে কে ছিল জানতে পেরেছিস? ‘

আচমকা ভয়ানক গালি দিল সৌধ। যা শুধু অবিশ্বাস্যই নয় অভাবনীয়ও। সৌধর মুখে বা’ল শব্দটি ছাড়া কখনো অন্য কোনো গালি শুনেনি সুহাস৷ নিধির প্রতি মারাত্মক পজেসিভনেস থেকেই এ মুহুর্তে উত্যক্তকারীদের গালি দিয়ে ফেলেছে সে। কোনোরকমে বন্ধুকে শান্ত করে একসঙ্গে বের হলো দু’জনে। বেরিয়েই কল করল নিধিকে। নিধি রিসিভ করেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করল,

‘ দোস্ত একটা মহিলাও পাই না, যে অন্তত ওয়াশরুমটা পরিষ্কার করে দেবে। ঠাণ্ডা লেগেছে নিজেরও করতে ইচ্ছে করছে না। রুমমেটও নেই বাড়ি গেছে। দুদিন এভাবে ওয়াশরুম রাখতেও গা গুলাচ্ছে। ‘

সুহাস সেসব কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,

‘ এমনিতে এত বকবক করিস, গতকালের ঘটনা অন্যকারো থেকে শুনতে হলো কেন? ‘

সহসা জিভ কামড়ে ধরল নিধি। বলল,

‘ সরি রে, মেয়েদের এসব ফেস করতেই হয়। সামান্য বিষয় নিয়ে তোদের বিরক্ত করতে চাইনি। ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল সুহাস। বলল,

‘ বিরক্ত! ‘

স্পিকার অন থাকায় কথা শুনে সৌধর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সুহাস আড়চোখে তা দেখে নিয়ে নিধিকে বলল,

‘ ক্যাম্পাসে আয়। ‘

‘ একটু লেট হবে রে। ওয়াশরুম পরিষ্কার করে গোসল দিয়ে তারপর আসব। ‘

তৎক্ষনাৎ সৌধ সুহাসের থেকে ফোন নিয়ে নিল। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ আমি লোক পাঠাচ্ছি ওয়াশরুম পরিষ্কার করে দেবে। তোর না করলেও চলবে। ‘

সৌধর কণ্ঠ শুনেই চমকাল নিধি। ঢোক গিলে তোতলানো কণ্ঠে বলল,

‘ তুই! ‘

দাঁতে দাঁত চেপে সৌধ বলল,

‘ ক্যাম্পাসে আয়। ‘

নিমিষেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল নিধির মুখ। বলল,

‘ দেখ ভাই, আমি অতো ঝামেলা পছন্দ করি না। আর চাইও না তোরা কোনো ঝামেলা করিস। ‘

এবার আর সৌধকে আটকায় কে? ভাই শুনে নিভু নিভু আগুনটা যেন ফুঁসে ওঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘ তোর বাপকে বলিস পঞ্চম বার বেবি প্লানিং করতে। এবারে ছেলের মুখ দেখলেও দেখতে পারে। আর তুইও জন্মের মতো একটা ভাই পেতে পারিস। ‘

অমন ভয়ানক কথা শুনে আঁতকে ওঠল নিধি! অস্ফুটে বলল,

‘ ছিঃ সৌধ কী বলছিস! ‘

‘ পনেরো মিনিটের মধ্যে একজন মহিলা পাঠাব। কাজ শেষ হওয়ার পর বিশ মিনিটের মধ্যে ক্যাম্পাসের সামনে আসবি। নয়তো ফলাফল খুব খারাপ হবে। ‘

ফোন কেটে দিল সৌধ। তিরতিরিয়ে ঘামতে শুরু করল নিধি। ত্বরিত গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে ওয়াটার বোতল নিয়ে পানি খেয়ে নীরস গলাটা ভিজিয়ে নিল।

ক্লাসটাইম হয়ে গেল৷ অথচ নিধি এলো না। আইয়াজ তাড়া দিয়ে সৌধকে বলল,

‘ ক্লাসে চল। ক্লাস শেষে এই টপিকে আলোচনা করা যাবে। ‘

সৌধ ক্লাসের দিকে এগুতে শুরু করল। আইয়াজ৷ সুহাসও পায়ে পা মেলালো। সৌধ বলল,

‘ আর কোনো আলোচনা নয়। ছুটির পর এলাকাটায় ঢুকব। ওর সাথেই। ‘

সুহাস কিছু বলল না। জানে বলে লাভ নেই। আইয়াজ বলল,

‘ ঢোকার তো প্রয়োজন নেই। একটা ফোনই যথেষ্ট।’

‘ আলবাত প্রয়োজন আছে। ‘

দৃঢ়চিত্তে সৌধের এহেন বাক্য শুনে আইয়াজও আর কিছু বলল না। সৌধকে সে খুব ভালো করেই চেনে। যেখানে তাদের বেস্ট ফ্রেন্ড নিধি জড়িয়ে সেখানে ওর দ্বারা সহজ আপোস সম্ভবই নয়। নেতার ছেলে এটুকু রক্ত গরম অস্বাভাবিক কিছু না।

প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট’রা বেরুচ্ছে। ওদের দেখে সালাম দিয়ে দিয়েও যাচ্ছে। নামী আর ফারাহ বের হতেই আইয়াজ চাপা স্বরে বলল,

‘ ভাবি আসছে। ‘

সুহাস চোখ রাঙাল। সৌধ রাশভারি কণ্ঠে বলল,

‘ সিনক্রিয়েট করবি না। ‘

সুহাস হাওয়া উড়ানোর মতো করে বলল,

‘ ওর সাথে সিনক্রিয়েট করার জন্যও আমার ইন্টারেস্ট আসে না। ‘

হাঁটার গতি কমিয়ে দিল সৌধ। সুহাসের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ফিচেল হাসল। মৃদুস্বরে বলল,

‘ আই সি.. ‘

নামী আর ফারাহ ওদের একদম কাছাকাছি চলে এলে সৌধ, আইয়াজকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিল নামী। সৌধ দাঁড়িয়ে পড়ল। ঈষৎ হেসে দিল সালামের জবাব। দাঁড়াল নামী, ফারাহও। কিন্তু সুহাস দাঁড়াল না। সে তেজ দেখিয়ে হনহনিয়ে
ক্লাসে চলে গেল। সৌধ বলল,

‘ পড়াশোনা ঠিকঠাক তো? যে কোনো সমস্যা হলেই আমাকে জানাবে। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও তো আছে? ‘

‘ জি ভাইয়া কোনো সমস্যা নেই। ‘

‘ বাসায় ফিরছ? ‘

‘ জি ভাইয়া, আসি তাহলে। ‘

অত্যন্ত নমনীয় ভাবে কথা বলা শেষ করে দুই বান্ধবী চলে গেল। সৌধও এগিয়ে গেল ক্লাসের দিকে। কিন্তু আইয়াজ গেল না। সে তাকিয়ে রইল গাঢ় সবুজ রঙের গাউন, সাদা অ্যাপ্রোন, চোখে কালো ফ্রেমের গোল চশমা পরা, গৌরবর্ণীয় হৃষ্টপুষ্ট মুখ আর কোঁকড়া চুলের মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে। এক মুহুর্তে যেন তার দৃষ্টি থমকে গেল, থমকাল শ্বাসপ্রশ্বাসও। কিয়ৎকাল পর সম্বিৎ ফিরল আরেক সহপাঠীর ডাকে। চমকে ওঠে সে ত্বরিত ক্লাসে চলে গেল। সৌধর পাশে বসে চনমনে মনে জিজ্ঞেস করল,

‘ দোস্ত খেয়াল করেছিস, নামীর সাথেকার মেয়েটা আমার মতোই চশমা পড়ে? ‘

সুহাস ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ভাব নিয়ে বলল,

‘ কোনটার কথা বলছিস ঢোলের মতো মেয়েটার? ‘

সৌধ কিছু বলল না। বোঝার চেষ্টা করল কথাগুলো। আইয়াজ কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘ কীসের ঢোল স্বাস্থ্য ভালো মেয়েটার কথা বলছি। ‘

‘ ঐ তো মোটা মেয়েটা? ‘

আইয়াজ পুনরায় শুধরে দিয়ে বলল,

‘ আরে মোটা না মিডিয়াম স্বাস্থ্যের মেয়েটা। নামীর সাথে যেটা ছিল তুই বোধহয় খেয়াল করিসনি। ‘

সহসা সৌধ মিটিমিটি হেসে বলল,

‘ বই বাদ দিয়ে তুই হঠাৎ স্বাস্থ্য ভালো মেয়ে নিয়ে চর্চা করছিস কেন আইয়াজ? ‘

পেছন থেকে কান পেতেছিল আজিজ। হঠাৎ সে বলল,

‘ শা’লা যে লুই’চ্চা আগেই টের পাইছিলাম। এখন আরো ভালো কইরা পাইলাম। দেখছস সুহাস, শালায় যেনতেন গাইয়ের দিক নজর দেয় না। লাউ, পটল তার নজরে আটকায় নাই একবারে মিষ্টি কুমড়ায় আটকাই গেছে! ‘

হো হো করে হেসে ওঠল সুহাস। তৎক্ষনাৎ ঝড়ের গতিতে ক্লাসে ঢুকল নিধি। সৌধর মুখ শক্ত হয়ে ওঠল নিমিষেই। পাশের বেঞ্চে বসতে বসতে হাঁপানো সুরে নিধি বলল,

‘ এই স্যার আসছে স্যার আসছে চুপ কর সবাই। ‘

চলবে…