Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 421



ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৫৯+৬০+৬১

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৯|
হসপিটাল কোয়াটার৷ নিজের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে বসে আছে ডক্টর. অর্পণ শিকদার। অবসর সময় গুলো বই পড়ে কাটায় সে৷ বাবা হওয়ার পর থেকে বই পড়ার সময় হয়ে ওঠে না তেমন৷ অবসর পেলেই ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ ছেলে এবং ছেলের মা। কেউই বাসায় নেই। বেড়াতে গিয়েছে। সেও কর্মহীন। তাই বই নিয়ে বসেছে। তার মা অপরূপা শিকদার। এক কাপ দুধ চা নিয়ে ছেলের কাছে এলেন৷ পাশে বসে চা হাতে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

‘ বউ মা কখন আসবে? ‘

এক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে অপর হাতে চোখের চশমা খুলল অর্পণ। কোলের ওপর রাখা বইয়ের ওপর চশমা রেখে মৃদু হেসে বলল,

‘ অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে৷ একটু দেরি হবে বোধহয়। ‘

অপরূপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলের দিকে থম মেরে তাকিয়ে থেকে ওঠে গেলেন নির্লিপ্ত ভাবে। এ জীবন ভালো লাগে না তার৷ বেঁচে থাকতে ছেলের সুখ দেখে যেতে পারবে কিনা জানে না। সন্তান হয়ে গেল। তবু ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলো না। বিয়ে করল, সন্তান হলো। অথচ সংসার হয়ে ওঠল না। সংসারটা যেন ভাসমান পানা। ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে যতটা সংশয় তার চেয়েও অধিক সংশয় এখন নাতিকে নিয়ে৷ অর্পণ চুপচাপ চা পান করছে। তার মা নিজের ঘরে গিয়ে সব সময়ের মতো দুঃশ্চিন্তা করছে তার পরিবার নিয়ে। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠল৷ মৃদু চমকে ওঠে দাঁড়াল অর্পণ। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই নিধির ফ্যাকাশে মুখের দেখা মিলল। ঘুমন্ত অনিরূপকে জড়িয়ে ধরে বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ। সহসা হাত বাড়াল সে। বিনাবাক্যে অনিরূপকে কোলে তুলে দিল নিধি। অর্পণ ছেলেকে বুকে আগলে নিয়ে সরে দাঁড়াল। নিধি নিশ্চুপ ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে চলে গেল নিজের ঘরে৷ বরাবরই মুখে আঁধার নামিয়ে থাকে নিধি। কালেভদ্রে যদিও হাসি দেখা যায়। তা শুধু অনিরূপের সঙ্গেই। আজ বন্ধুদের সাথে দেখা করে এলো। সেখানে নিশ্চয়ই সৌধ ছিল। নিশ্চয়ই তাকে দেখে মনের মধ্যে থাকা অপরাধবোধ গাঢ় হয়েছে? মনে মনে ধারণা করে ছেলেকে নিয়ে বেডরুমে গেল অর্পণ। দেখতে পেল বিছানার একপাশে মলিন মুখে বসে নিধি। সে ঘরে যেতেই ত্বরিত ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছল৷ এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনিরূপের বিছানা গুছাতে। বিছানা গুছানো শেষ হলে অর্পণ শুইয়ে দিল অনিকে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠে অনিরূপ। তাকে সামলাতে বাইরের পোশাকেই শুয়ে পড়ে নিধি। ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে ফের ঘুমের দেশে ফিরে যায় অনি৷ অর্পণ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় ড্রয়িংরুমে। আধঘন্টা পর যখন নিজের ঘরে ফিরে দেখতে পায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নিধি। যে কান্না তাকে দেখে থেমে যায়। ধাতস্থ হয়ে ওঠে নিজের কাপড়, তোয়ালে নিয়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্পণ। ছেলের পাশে গিয়ে বসে। হাত বাড়িয়ে নিষ্পাপ বাচ্চাটার মাথায় আলতো করে স্পর্শ করে। বিরবিরিয়ে বলে,

‘ তোর বাবা, মায়ের সংসারটা আর হলো না অনি৷ তোর মুখ চেয়ে আমি কিছুই করতে পারছি না৷ জোর করে সংসার নামক মায়াজালে আর আঁটকে থাকতে ইচ্ছে করে না। ‘
.
.
মাগরিবের আজান দিয়েছে। প্রকৃতির আবছা আলোয় সৌধর গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষা করছে সে। অভিমানী তরুণীর অপেক্ষা। গাড়ি পর্যন্ত কাজিনরা এগিয়ে দিল সিমরানকে। হবু দুলাভাইয়ের সঙ্গে আলাপও করে গেল। গাড়ির দরজা খুলে বসে ছিল সৌধ। সিমরান ওঠে এসে বসল তার পাশে৷ দরজা লক করে সম্মুখে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ বসে রইল। সৌধ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। এরপর লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে ড্রাইভারকে বলল,

‘ চলুন। ‘

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলে নড়েচড়ে বসল সিমরান। তার পরনে হালকা গোলাপি রঙের ঢিলেঢালা জর্জেটের সেলোয়ার-কামিজ। বাদামি বর্ণ চুলগুলো পেছন দিকে উঁচু করে তুলে ঝুঁটি বাঁধা। মুখে কোনো প্রসাধনী মাখেনি। আর না ঠোঁটে ছুঁইয়েছে লিপস্টিক।
দু’কাধে ওড়নার দুই কোণা তুলে বুক ঢেকে রেখেছে। খুব সাধারণ, শালীন বেশ। সবই ঠিকঠাক। ঠিক নেই শুধু সিমরানের মুখ। এত ব্যস্ততার ভীড়ে সময় দিচ্ছে এই হাঁড়ির মতো মুখ দেখার জন্য? ভ্রু কুঁচকে রইল সৌধ। গাড়ি চলছে। সিমরান তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। এসি চলছে। তাই কাঁচ নামানো নেই। সৌধ জিজ্ঞেস করল,

‘ কোথায় যাবি? ‘

সিমরান সব সময় যেখান থেকে কেনাকাটা করে সেখানের নাম বলতেই ড্রাইভার সেদিকে গাড়ি ঘুরালো। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই সৌধ পুনরায় প্রশ্ন করল,

‘ আমি আজ তোকে বকিনি। একটা সাধারণ বিষয়, সাধারণ একটা কথা। এরজন্য এভাবে মুখ ভাড় করে রাখলে বিষয়টা আমার জন্য বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তুই বাইরের কোনো মানুষ না। খুব তাড়াতাড়ি আমার ব্যক্তিগত মানুষ হতে যাচ্ছিস। তোর সঙ্গে আমার সব ধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে। প্রয়োজনে বকতে পারি৷ চার, পাঁচটা ধমক দিতে পারি। প্রয়োজনে মানুষ সবকিছুই করে। আর আমি মানুষটা অপ্রয়োজনে থুথুও ফেলি না। তখন যদি রাগ দেখিয়েও থাকি, চোখ রাঙিয়েও থাকি। সেটা প্রয়োজনীয় ছিল। এরজন্য মুখ ভাড় করে কী বোঝাতে চাইছিস? কী চাচ্ছিস? আমি সরি হই এটা চাচ্ছিস? যদি এটা তোর উদ্দেশ্য হয় তাহলে এক্ষুনি তুই আমার প্রতি সরি হবি। কারণ, আমি ভুল করিনি। অযথা, অন্যায় ভাবেও কিছু বলিনি। ‘

অভিমান হয়েছিল। এখনো ছিল৷ কিন্তু সৌধ ভাইয়ের কথাগুলো শুনে ধুকপুক করে ওঠল বুক। সে কি সত্যি সৌধ ভাই দুঃখীত হোক চাচ্ছিল? একদমই না৷ কিন্তু তার খুব অভিমান হয়েছিল। এখনো হচ্ছে। তাই বলল,

‘ তুমি সরি হও চাইনি আমি। ‘

‘ তাহলে কী চাচ্ছিস? ‘

‘ কিছু না৷ একটু মন খারাপ হয়েছিল। ‘

‘ কেন? ‘

মনে মনে সিমরান বলল,

‘ বলব না৷ বললে তুমি আমায় ভুল বুঝবে। নিধি আপুর প্রতি তোমার চোখে অদ্ভুত মায়া আমায় তীব্র কষ্ট দিচ্ছিল৷ ‘

মুখে বলল,

‘ তখনকার প্রশ্নের উত্তর পাইনি বলে। ‘

‘ কেন দেইনি? ‘

দৃঢ় কণ্ঠ সৌধর৷ সিমরান ঢোক গিলে বলল,

‘ বেডরুমে ছিলাম না তাই। ‘

অকস্মাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সৌধ। সিরিয়াসলি? পরোক্ষণেই আবার ভাবল, হ্যাঁ সিরিয়াসলি। সুহাসের বোন বলে কথা। হালকা কেশে ওঠল সৌধ। গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘ তোর প্রশ্নটা কী ছিল? ‘

সহসা সৌধর পানে তাকাল সিমরান। মৃদু আলোয় সৌধর ভারিক্কি চোয়াল, সুগভীর দৃষ্টিদ্বয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ তুমি এখনো নিধি আপুকে ভালোবাসো? ‘

‘ যদি না বলি মিথ্যা হবে। যদি হ্যাঁ বলি তুই কষ্ট পাবি। আমি তোকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। ‘

বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল সিমরানের। সৌধ ভাই বলল, তাকে কষ্ট দিতে চায় না। তাই উত্তরটা বুঝতে পেরেও সুপ্ত ক্লেশপূর্ণ অনুভূতিটুকু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সচেতন ভাবে। যেন পাশের মানুষটা টের না পায় ভালোবাসার মানুষটি অন্য কাউকে এখনো ভালোবাসে কিনা প্রশ্নটি করেই নিঃশ্বাস আঁটকে ছিল সে। এত সচেতন হয়েও লাভ হলো না। সৌধ স্পষ্ট শুনতে পেল সেই নিঃশ্বাসের শব্দ। তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি যে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি প্রখর। তা বোধহয় পাশের রমণীটি জানে না৷ ভেবেই মনে মনে হাসল কিঞ্চিৎ।

শপিংমলের সামনে গাড়ি থেমেছে। সৌধ ড্রাইভারকে নেমে দাঁড়াতে বলে। ড্রাইভার নেমে গেলে সিমরানও দরজা খুলতে উদ্যত হয়। সৌধ বাঁধা দেয়। তার পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতের বাঁধা পেয়ে চমকে যায় সিমরান। হকচকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। সৌধ একপেশে হেসে তার ফরসা নরম হাতটা টেনে কাছে নেয়। বা’হাতের অনামিকায় পরিয়ে দেয়া রিংটাতে দৃষ্টি স্থির রেখে শীতল কণ্ঠে বলে,

‘ হবু স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা মেনে নেয়া যন্ত্রণার৷ এটুকু যন্ত্রণা তোর প্রাপ্য ছিল সিনু। জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিস। একটু তো পুড়তেই হবে। ‘

এ পর্যন্ত বলেই নিজের দু’টো উষ্ণ হাতে সিমরানের বা’হাত জড়িয়ে রাখল। একটুখানি গা ঘেঁষেও বসল। সিমরান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা নিয়ে বসে। সৌধ ওর নরম হাতটা নিজের হাত দ্বারা জড়িয়ে। গভীর দৃষ্টিতে সেখানেই তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে লাগল,

‘ একটি সত্যি কথা শুনবি? ‘

‘ হু? ‘

‘ আমি আমার প্রথম প্রেম হারিয়ে যে যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। সেই যন্ত্রণা ক্ষীণ হয়ে এসেছে তোর যন্ত্রণা অনুভব করে। এই যে প্রতিনিয়ত কষ্ট পাচ্ছিস, একটু একটু করে পুড়ছিস। এরজন্য ভিতর থেকে আমি খুব সরি হচ্ছি তোর প্রতি। ‘

একটুখানি চমকাল সিমরান। দু-চোখে ভর করল কিঞ্চিৎ বিস্ময়। সৌধ একটু থেমে পুনরায় বলল,

‘ সিনু, ভালোবাসা অন্যরকম এক অনুভূতি। এই অনুভূতি সহজে কারো প্রতি আসে না। আর যদি সহজে এসে যায়। তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না৷ যদি সম্ভব হয় তাহলে ওটা ভালোবাসা না ক্ষনিকের মোহ। নিধি আমার মোহ ছিল না। ওকে আমি খুব সহজেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। একদম হুট করে। সবচেয়ে বড়ো কথা ভালোবাসার ঊর্ধ্বে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। অনেক ঘনিষ্ঠ মুহুর্তও ছিল আমাদের! রাগ করি, যাই বলি ওকে ভুলা ওকে ভালো না বাসা আমার পক্ষে সম্ভব না। তার মানে এই না আমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব না। ‘

এ পর্যায়ে সিমরানের চোখের দিকে তাকাল সৌধ। ধীরে ধীরে মেয়েটার চোখ ঝাপসা হয়ে এলে ত্বরিত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ধরে রাখা হাতটা আরো গভীর করে ধরল। একটু শক্তভাবে। এরপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ আমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব এই বিশ্বাস টা কবে থেকে হয়েছে জানিস? যেদিন ছোটো কাকুর বাংলোতো তোকে প্রত্যাখ্যান করে এলাম, সেদিন থেকে। তোর চোখ দু’টোতে তাকিয়ে যখন আমার বুক কেঁপে ওঠল। আমি বুঝে গেলাম, তুই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসিস। তুই ব্যতীত আর কেউ আমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে না। যুক্তি, তর্কের বাইরে গিয়ে বলছি, একটা মানুষ যদি ভেতর থেকে অনুভব করতে পারে অপর মানুষটি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ তাকে এতবেশি ভালোবাসতে পারবে না। তাহলে নিঃসন্দেহে ওই মানুষটাই তার যোগ্য। বিকজ, সবাই এটা অনুভব করাতে পারে না। সে ছাড়া কেউ তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারবে না। এই অনুভূতি যাকে ঘিরে তৈরি হয়৷ মানুষের উচিত তাকে আঁকড়ে ধরা। হারাতে না দেয়া। ‘

সিমরানের ধরে রাখা হাত দু’টো থেকে একটা হাত সরিয়ে নিল সৌধ। এরপর সে হাত নিজের বুকের বা’পাশে চেপে ধরে সিমরানের ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

‘ ট্রাস্ট মি. নিধির চোখে আমি সেই ভালোবাসা দেখিনি। এত বছর ওর সঙ্গে মিশেও আমি অনুভব করিনি ওর মতো কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। বরং ও সব সময় আমার প্রতি নির্লিপ্ত ছিল। কখনো কখনো মনে হতো গোপনে ভালোবাসে। বিয়ে করলেই পুরোপুরি প্রকাশ করবে। কখনো মনে হতো স্রেফ বন্ধুত্বটুকুই। আজ আমার জীবনে নিধির অস্তিত্ব ধোঁয়ার মতো। দীর্ঘসময় আগুন জ্বলার পর আগুন নেভালে যে ধোঁয়া ওঠে সেই ধোঁয়ার মতো। তুই সেই পানি যা আমার হৃদয়ে নিধি নামক আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছে। বাকি রয়েছে ধোঁয়া। এই ধোঁয়াটুকু যতদিন থাকবে। তোর কষ্ট ঠিক ততদিনই। এরপর হয়তো আর কষ্ট পাওয়ার সুযোগ পাবি না৷ সিনু, আমার তোকে চাই। তোর ভালোবাসা চাই আমার। বিনিময়ে আজন্ম সুখ দেব। অভিযোগ করার সুযোগ দিব না। আমি জানি না দ্বিতীয় বার হাঁকডাক করে বলতে পারব কিনা আমি ভালোবাসি। শুধু জানি আমি ভালোবাসতে পারব। কারণ প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ সব রহস্যই ভেদ করেছি আমি। ‘

দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল সিমরানের। কয়েক ফোঁটা অশ্রু পড়ল সৌধর হাতের পিঠে। অশ্রু স্পর্শে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হলো সৌধর। গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সিমরানে অশ্রুসিক্ত রক্তিম মুখশ্রীতে। ওভাবে কত সময় কাটল তা বেহিসেবী। ঘোর কাটল ফোনের রিংটোনে। সৌধর ফোন বাজছে। নাক টেনে মুখ ঘুরিয়ে রইল সিমরান৷ সৌধকে বিচলিত দেখাল না৷ যেন ফোনের আওয়াজ সে শুনতেই পায়নি৷ এমন ভঙ্গিতে বলল,

‘ এদিকে ঘোর। ‘

সিমরান মুখ ফেরায়। সৌধ একহাতে ওর গাল বেয়ে পড়া অশ্রু মুছে পকেট থেকে টিস্যু বের করে দেয়। এরপর ধরে রাখা হাতটা একটু উঁচু করে ধরে প্রশ্ন করে

‘ এখনো ব্যথা আছে? ‘

সিমরান দু’দিকে মাথা নেড়ে না বোঝাল। দুপুরে যেখানটায় ব্যথা পেয়েছিল ওখানটায় বার বার আঙুল বুলাচ্ছে সৌধ। আকস্মিক উষ্ণ স্পর্শ পেতেই সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাতেই সৌধ মাথা তুলে। হাত ছেড়ে দিয়ে বাঁকা হেসে ভারিক্কি গলায় বলে,

‘ এনি প্রবলেম? ‘

ঢোক গিলে সিমরান৷ লজ্জায় আরক্ত মুখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়৷ বুকের গহীনে দ্রিমদ্রিম শব্দে তরঙ্গ বইতে শুরু করে। মনে মনে বলে,

‘ তুমি একজন পারফেক্ট হার্ট সার্জন সৌধ ভাই। আমার বুকের ব্যথা সারতে তোমার থেকে পাওয়া এই মেডিসিন টুকুই যথেষ্ট। ‘

আবেগে টইটম্বুর হয়ে রইল সিমরান। নিঃশ্বাস ফেলল ঘনঘন৷ সমস্তই অনুভব করল সৌধ। অদ্ভুত অনুভূতি হলো বুকজুড়ে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ সজাগ হলো আচমকা। কান বেয়ে গেল এক উষ্ণ নরম হাওয়া। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিজোড়ার হাসি কত সুন্দর হয় কেউ কি জানে? সৌধ জানে। এই তো সিমরানের অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টো কী সুন্দর হাসছে৷ তার বুকের ভেতর চেপে থাকা বিশাল পাথরটাও সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যাকে পায়নি তার জন্য যাকে পেয়েছে তাকে কষ্ট পেতে দেয়া অসম্ভব তার পক্ষে। পুরোপুরি অসম্ভব।

লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারছে না সিমরান। সৌধ বলল,

‘ আর কতক্ষণ লজ্জা পাবি? ‘

নিমেষে চোখ তুলে তাকাল মেয়েটা। সৌধ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘ আর কতক্ষণ? ‘

লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে সিমরান বলল,

‘ তুমি বাইরে যাও। আমি পাঁচ মিনিট পর বেরুবো। ‘

‘ আরো পাঁচ মিনিট লজ্জা পাবি? ‘

ইশ! মুখ ঘুরিয়ে নিল সিমরান। সৌধ মিটিমিটি হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল সে। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলল,

‘ কী হলো এটা? একটু কষ্টের বিনিময়ে যদি এতটুকু সুখ পাওয়া যায়। আমি কষ্টগুলোকে হাসিমুখে বরণ করে নিব। ‘
.
.
নিধির হাবভাব ভালো ঠেকছে না। সন্দেহ করল অর্পণ। মন দেয়া-নেয়া না হলেও দাম্পত্য জীবনের বহুদিন একসাথে কাটানোর ফলে একটু, আধটু বুঝতে পারে নিধিকে৷ খেতে বসে নিধি বার বার তার দিকে তাকিয়েছে। ঘরে আসার পর টের পেল কিছু একটা বলতে এসেও বারবার থেমে যাচ্ছে অনির মা। অনিরূপকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে নিধি। অর্পণ ডিভানে বসতে বসতে ভাবল, ছেলে ঘুমাক তারপর কথা বলবে। জিজ্ঞেস করবে সে কিছু বলতে চায় কিনা।

আইয়াজের কথাগুলো বারবার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাসায় ফেরার পর থেকে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করছে নিধি। তবু অর্পণের সাথে একটি শব্দও বিনিময় করতে পারেনি৷ অদ্ভুত জড়তা কাজ করে। সে প্রচণ্ড ইগোয়েস্টিক একজন নারী। জীবনের এ পর্যায়ে এসে খুব করে অনুভব করল তা। এতদিন সৌধর জন্য নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করত। সেই অশান্তি, সেই যন্ত্রণায় শান্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়তে পারত না৷ আজ আইয়াজের পরামর্শে অর্পণের সাথে সব ঠিক করে নেয়ার চেষ্টায় শ্বাস নিতে পারছে না। কীভাবে শুরু করবে? কী বলবে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না একদম। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে নিজের পারিপার্শ্বিক সবকিছুর প্রতি। অভিযোগ তুলতে ইচ্ছে করছে গোটা পৃথিবীর দিকে। কী দোষ তার? কী অপরাধ তার? তার কি শান্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়ার অধিকার নেই? তার কি অধিকার নেই সুখী জীবনযাপন করার? ভালোবাসা নামক সুখটা কি সে আঁকড়ে ধরতে পারে না? নিমেষে বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল যেন। অনিরূপ ঘুমিয়েছে বুঝতে পেরে বালিশের পাশে থাকা ফোনটা নিয়ে ছুটে গেল বাথরুমে। অকস্মাৎ নিধির এহেন কাণ্ড দেখে অর্পণ ওঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল বাথরুমের সামনে। আড়ি পাতার স্বভাব নেই তার। আজ স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে আড়ি পাতল শুনতে পেল নিধির কথা…।

সৌধর সঙ্গে ডিনার করে বাড়ি ফিরেছে সিমরান৷ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়েছে মাত্র। মামাত বোন তার সাথে ঘুমাতে চেয়েছিল। কারো সঙ্গে বেড শেয়ার করতে পারে না সে। ঘুম হয় না। সামনে অনুষ্ঠান। ঠিকঠাক ঘুম না হলে সমস্যা হবে। তাই বুঝিয়ে বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার ঘুমাবে সে৷
ঘুমানোর পূর্বে বা’হাত উঁচু করে যেখানটায় সৌধ চুমু খেয়েছে ঠিক সেখানটায় পরপর নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল। অনুভব করল বুকের ভেতর শিরশির করছে। অচেনা সুখে হৃদয় টালমাটাল। এমন মুহুর্তে আকস্মিক ফোনটা বেজে ওঠল। চমকে গিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখতে পেল, নিধিপু৷ নিমেষে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অস্বীকার করার জোর নেই। নিধি আপুকে হিংসে হয় তার। কারণ ওই মানুষটাই সৌধ ভাইয়ের প্রথম প্রেম। সৌধ ভাই এখনো মাথা উঁচু করে বলতে পারে নিধিকে ভালোবাসি। অথচ তোকে ভালোবাসি সিনু এটা বলতে পারে না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান৷ হঠাৎ নিধি আপু কল করছে কেন তাকে? কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে ওঠে বসে ফোন রিসিভ করল।

‘ নিধি আপু! হঠাৎ? ‘

‘ কী করছিস? ‘

শুয়ে আছি বলতে পারত সিমরান৷ কিন্তু তার আগে কী করেছে সেটা জানানোর ইচ্ছে হলো খুব৷ কেন হলো? জানে না। তবে এটা না বললে তার কোথাও কোনোকিছু কম পড়বে অনুভূতি থেকে বলল,

‘ শপিংয়ে গিয়েছিলাম সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে। একসঙ্গে ডিনার করে মাত্র ফিরেছি। ঘুমাব ভাবছিলাম। তুমি কী করছ আপু? ‘

মুখটা দৃঢ় হয়ে গেল নিধির। নিজেকে বড্ড ছোটো অনুভব করল। কারণ সে টের পেয়ে গেছে সিমরান তাকে জানাতে চাইছে সে সৌধর সঙ্গে টাইম স্পেন্ট করেছে। বোঝাতে চাইছে সৌধ এখন শুধুই তার। তাচ্ছিল্য ভরে হাসল সে। কথা না বাড়িয়ে যে উদ্দেশ্যে ফোন করেছে সেদিকে মন দিল। রয়েসয়ে বলল,

‘ তুই সৌধকে বিয়ে করিস না সিনু। ‘

বুক ধড়াস করে ওঠল সিমরানের। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,

‘ কেন! কী বলছ নিধি আপু? তুমি এ কথা কেন বলছ! তুমিই তো সেদিন অনুরোধ করেছিলে আমি যেন সৌধ ভাইকে না ছাড়ি তাহলে? তুমি কি সৌধকে ভাইয়ের লাইফে ফিরতে চাও? ‘

কণ্ঠ কাঁপছিল সিমরানের। বাঁকা হেসে নিধি বলল,

‘ আমার খুব পরিচিত একজন সৌধকে ভালোবাসে। ওকে না পেলে মেয়েটা ভয়ংকর কিছু করে ফেলবে। তুই যদি সরে দাঁড়াস মেয়েটার লাইফ বেঁচে যায়। ‘

মাথা ঘুরে গেল সিমরানের। থমকানো স্বরে বলল,

‘ কে মেয়েটা? ‘

‘ ধরে নে আমার আপন কেউ। ‘

চমকে ওঠল সিমরান। কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রইল। চোখ দু’টো বন্ধ করে অনুভব করল কেবল সৌধকে। আর তার বলা সেই কথা, সেই স্পর্শ। নিজের বা’হাত মুখের সামনে নিল। ঠোঁট বাড়িয়ে আবারো চুমু খেল সেখানটায় যেখানে সৌধ তার পুরুষালি ঠোঁটের উষ্ণ পরশ এঁকেছে আজ। এরপর গলায় মৃদু ক্রোধ মিশিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলল,

‘ তুমি খুব স্বার্থপর নিধিপু। নিজের সুখের জন্য তুমি সবাইকে কষ্ট দিতে পারো সবাইকে। বিলিভ মি তুমি যদি বলতে তুমি সৌধ ভাইয়ের জীবনে ফিরে আসবে। আমি যদি দেখতাম সৌধভাই সবকিছু ভুলে তোমাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী। তাহলে সব স্বার্থ ত্যাগ করে, আমার আবেগ, ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে ঠিক কোনো নাটকীয় চরিত্রের মতোই বিয়েটা ভেঙে দিতাম। কিন্তু না তুমি নিজের সুখের জন্য সৌধ ভাইকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছ আজ এসেছ আমাকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে৷ আ’ ম সরি নিধিপু। সৌধ ভাইকে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে দান করার মতো শক্তি আমার নেই। আম্মু ঠিক বলত জানো? আমি অতিরিক্ত সরল বলে সবাই এই সরলতার সুযোগ নেয়। আজ তুমি প্রমাণ করে দিলে আপু। তোমাকে আমি দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মানুষ ভেবেছিলাম। সৌধ ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষ নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ হবে না৷ আজ বুঝতে পারলাম, তুমি সৌধ ভাইয়ের জীবনের বিগ মিস্টেক! ইয়েসস, ইউ আর অ্যা বিগ মিস্টেক ইন সৌধ ভাই’স লাইফ! ‘

নিজের বক্তব্য শেষ করে তীব্র ক্রোধ আর চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন কেটে দিল। সিমরান ফোন কেটে দিয়েছে বুঝতে পেরে চোখ দু’টি সন্তর্পণে বুজে ফেলল নিধি৷ ফিরে গেল সে দিনটায়। যেদিন দুর্বল হৃদয়ের অধিকারিনী সিমরান নিজের ভালোবাসার কথা ভুলে গিয়ে তার দুপা ধরে অনুরোধ করেছিল। সৌধর ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়ে। সময়ের স্রোতে আজ সব বদলে গেছে। ওই মেয়েটা এখন নিজেরটা বুঝে নিতে শিখেছে। সিনু বুঝে গেছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কারো সাথেই আপোষ করতে নেই। নিধির চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বিরবির করে বলল,

‘ আমি সৌধর লাইফে মিস্টেক হয়েই থাকতে চাই। আজ যে কথা তুই বলেছিস ভবিষ্যতে একই কথা সৌধর মুখে শুনতে চাই। যদি না শুনি তাহলে তুই হেরে যাবি সিনু। ‘
.
.
বাথরুমের দরজা খুলতেই অর্পণের মুখোমুখি হলো নিধি৷ স্তব্ধ মুখে তাকিয়ে অর্পণ। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

‘ তোমার কোন আপনজন সৌধকে ভালোবাসে? ‘

‘ আড়ি পাতছিলেন? ‘

রাগান্বিত কণ্ঠ নিধির৷ আজ অর্পণের ধৈর্য্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেল। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ পাতছিলাম। বলো কোন আপনজন সৌধকে ভালোবাসে? আপনজনটা তোমার হৃদয় না তো? ‘

সহসা কেঁপে ওঠল নিধি। দৃষ্টি জোড়া ঝাপসা হয়ে গেল তার। ধরা গলায় বলল,

‘ আপনি আমাকে অপমান করছেন। ‘

‘ না করছি না। সত্যিটা বলছি। এভাবে আর নয় নিধি। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স! ‘

‘ হোয়াট! ‘

‘ ইয়েস। ‘

‘ অনির কী হবে? ‘

‘ সেই চিন্তা তোমার থাকলে আজ তুমি এখানে এভাবে থাকতে না৷ ‘

ক্রোধে ফুঁসছে অর্পণ। নিধির সামনে এক মুহুর্ত দাঁড়াতে চাইল না সে। সরে যেতে উদ্যত হলো। মাথা ঘুরতে শুরু করল নিধির। কী করবে? কী বলবে কিচ্ছু ভেবে না পেয়ে আচমকা অর্পণের হাত টেনে ধরে বলল,

‘ প্লিজ আপনি মাথা ঠান্ডা করুন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিন। ‘

ফুঁসে ওঠা আগুন নিভে গেল আচমকা। নিধির থেকে এই অনুনয় নতুন তার জন্য। তাই নিভল। চুপচাপ গিয়ে ডিভানে বসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,

‘ বলো কী বলার আছে? ‘

নিধি দাঁড়িয়ে ছিল। অর্পণ এ কথা বলায় গিয়ে পাশে বসল। যা অর্পণকে অনেক বেশিই অবাক করে। নিধি হঠাৎ মাথা নিচু করে কান্নারত কণ্ঠে বলল,

‘ আমি মিথ্যা বলেছি সিনুকে। ‘

‘ কেন? ‘

‘ যাচাই করে নিলাম সৌধর জন্য ও কতটুকু যোগ্য। কারণ একদিন ও অনায়াসে সৌধর থেকে সরে যেতে চেয়েছিল। ‘

‘ তোমার লাভ? ‘

‘ সৌধ আমার বন্ধু। মিথ্যা বলব না৷ অতীতে অনুভব না করলেও এখন করি, ও আমার জীবনে বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু ছিল। তাই ওর জীবনে সত্যি কারের ভালোবাসা আসুক। তাকে নিয়ে ও সুখী হোক। এটুকুই চাই এখন। ‘

‘ পরীক্ষা করছিলে সৌধর হবু ওয়াইফকে? ‘

বুদ্ধিমান অর্পণ। তাই বুঝে নিল সবটাই। নিধি মাথা তুলে ঘুরে তাকাল। অর্পণ তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে তার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ আমি সুখ চাই অর্পণ। আমি শান্তি চাই। আমি ডিভোর্স চাই না। সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাই আপনার কাছে। ‘

চোখ দিয়ে নোনাপানির ধারা নামল নিধির। অর্পণ চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করল। মনটা তার বিধ্বস্ত। সুখ কী জিনিস ভুলেই গেছে। শান্তি! সেটা কী? ডিভোর্স? রাগের মাথায় উচ্চারণ করেছে। তাই বলে কি দিতে পারবে? বহুদিনের পছন্দের মানুষ ছিল নিধি। ভাগ্যক্রমে বউ হিসেবে পেয়ে ভালোবাসতে শুরু করেছিল গভীরভাবে। সেই ভালোবাসায় ভাঁটা পড়ল মেয়েটার থেকে দিনের পর দিন অপমান আর অসম্মান পেয়ে। আজো তার হৃদয়ে কোথাও না কোথাও নিধির গভীর অস্তিত্ব রয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা তারা স্বামী, স্ত্রী। তাদের ফুটফুটে একটি সন্তান রয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্পণ। নম্র স্বরে বলল,

‘ সরি। রাগের মাথার ডিভোর্সের কথা বলেছি। মন থেকে না। ‘

অবাক হয়ে তাকাল নিধি। নিজের প্রতি ঘৃণা হলো তার। এই মানুষটা কত বিনয়ী। সৎচরিত্রের অধিকারী। অথচ এর সাথে সে দিনের পর দিন অন্যায় করে যাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো নিধি। অর্পণ ওঠে দাঁড়ালে সেও আচমকা ওঠে দাঁড়াল। বার বার স্মরণ করতে লাগল আইয়াজের বলা কথাগুলো। তারও মন বলছে সব ইগো দূরে সরিয়ে, সবকিছু ভুলে গিয়ে যে মানুষটার সঙ্গে সে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেই সব সমস্যার সমাধান। সব যন্ত্রণার অবসান।

প্রচণ্ড জড়তা, মানসিক টানাপোড়েন পেরিয়ে আচমকা অর্পণের সামনে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিধি। ভুলে গেল সে একজন ডক্টর, কারো মা। আটাশ বছর বয়সী এক নারী। একদম বাচ্চাদের মতো করে স্বামীর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কান্নারত কণ্ঠে কী বলল কিচ্ছু বুঝল না অর্পণ। শুধু থেকে থেকে সরি শব্দটি শুনতে পেল। এরপর? এরপর আর কী? অর্পণ কী পারে নিজেকে ধরে রাখতে? দীর্ঘদিন গুমোট হয়ে থাকা অনুভূতিগুলো সম্পূর্ণ উগরে বেরুলো। স্ত্রীকে জড়িয়ে নিল বুকের মধ্যিখানে। এভাবে কতক্ষণ সময় পেরুলো তাদের জানা নেই।

নিধির কান্না কমে এলে অর্পণ দু’হাতের তালুতে ওর গোলাকৃতি মুখটা আলতো করে চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে বলল,

‘ অনির আব্বু অনির আম্মুকে ভীষণ ভালোবাসে। আফসোস অনির আম্মুর সে ভালোবাসা চোখে পড়ে না। ফেলে আসা ভালোবাসায় বিভোর হয়ে সামনের ভালোবাসা দেখতে বড্ড অনীহা তার। ‘

অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল নিধি। ধীরেধীরে আবারো জড়িয়ে ধরল অর্পণকে। বুকে মাথা রেখে বিরবির করে বলল,

‘ আমায় ভালোবাসুন অনির আব্বু৷ প্রমিজ করছি আর অনীহা দেখাব না। শুধু ভালোবাসুন আমায়। প্লিজ আমি মরে যাব, ভালোবাসার অভাবে মরে যাব আমি৷ ভালোবাসুন আমায়। ‘

নিধি কথাগুলো বলতে বলতে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অর্পণকে। অর্পণ অনুভব করল তার বুকের ভেতর যেন ঢুকে যাবে নিধি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। নিধির সম্পূর্ণ অনুভূতি টের পাচ্ছে অর্পণ। তাই কিছু সময় শান্ত করার চেষ্টা করল ওকে। এরপর ভালোবাসার কাঙালিনীকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে পা বাড়াল বিছানার দিকে। নিধির চোখ দু’টো বন্ধ। পুরো মুখশ্রীতে অশ্রুজল লেপ্টে আঠালো হয়ে আছে। সন্তর্পণে স্ত্রীকে শুইয়ে দিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। এরপর ঘরের ডানপাশে গিয়ে দোলনায় সযত্নে শুইয়ে দিল অনিকে ৷ দু’পাশে দু’টো কোল বালিশ রাখল আপাতত বাবা, মায়ের প্রক্সি হিসেবে। এরপর রুমের বাতি নিভিয়ে সে চলে গেল বউয়ের কাছে। দীর্ঘদিন এক ঘরে এক বিছানায় থেকেও কাছাকাছি আসা হয়নি। আজ অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েও অর্পণ সৎ ব্যবহার করল না। নিধির মন বিধ্বস্ত। দেহের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাদের। হয়নি কেবল মনের। তাই বুকে আগলে নিয়ে কপালে চুমু খেল। একে একে আদুরে স্পর্শে ভরিয়ে তুলল পুরো মুখশ্রীতে। এরবেশি এগুলো না। নিধি না চাইলে এরবেশি আগাবেও না। সময় গড়াল বেশ। হঠাৎ নিধির সম্পূর্ণ দেহশ্রী আগলে নিয়ে ওর কানের কাছে মুখ রাখল অর্পণ। মৃদুস্বরে বলল,

‘ পৃথিবীতে সব মানুষ এক নয়। এক নয় সব মানুষের ভালোবাসার নিয়মও। সৌধ তোমাকে কীভাবে ভালোবেসেছে জানি না৷ জানতেও চাই না। আমি সৌধ নই৷ আমি অর্পণ। আমি আলাদা। আমি তোমার স্বামী৷ তোমার সন্তানের বাবা৷ আমি যেমন আলাদা একজন মানুষ তেমনি আমার ভালোবাসাও আলাদা। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিধি। তুমি যদি আমার ভালোবাসা অনুভব করতে না পারো তাহলে শুধু একটা কথা মনে রেখো, সৌধ তোমার জন্য হারাম। আমি হালাল। আমাদের এই পবিত্র সম্পর্কের ঊর্ধ্বে কোনোকিছুই হতে পারে না৷ শুনতে খারাপ লাগলেও বলছি তোমাদের বন্ধুত্বও আমাদের সম্পর্কে ঠুনকো। নিধি, ফোকাস করো আমার স্পর্শে, আমার কথায়। দেখো শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ নেই আর কিচ্ছু নেই। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬০|
আজ সৌধ, সিমরানের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। সকাল থেকে তোড়জোড় চলছে৷ দু পরিবারে আলাদা আলাদা আয়োজন। চৌধুরী বাড়ি থেকে সৌধর কিছু কাজিন এসেছে খন্দকার বাড়িতে৷ তারা সিমরানের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের ফটোশুট, ভিডিয়োশুট করতে ব্যস্ত। পছন্দের মানুষটাকে বর হিসেবে পেতে চলেছে সিমরান। চারপাশে সুখ, সুখ সুবাস৷ কত মানুষ, কত আনন্দ ঘিরে রয়েছে তাকে৷ আব্বু, ভাইয়া, বন্ধু, বান্ধব এছাড়াও পরিচিত, অপরিচিত অনেক আত্মীয়-স্বজন বাড়ি জুড়ে। তার আশপাশে সর্বক্ষণ মানুষের ভীড়। এত সুখ, আনন্দ, মানুষের ভীড়ে একটিমাত্র শূন্যতা মনকে বিষাদে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এত আয়োজন, সীমাহীন সুখ প্রাপ্তি, ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেয়ার পথে জন্মদাত্রীকে ভীষণ মিস করছে মেয়েটা। যখনই সুযোগ পাচ্ছে বারবার টলমল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আব্বু, আর ভাইয়ার দিকে। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। বেঁচে থাকাকালীন মাকে খুব বেশি কাছে পাওয়া হয়নি৷ জীবনের বিশেষ সময় গুলোতেও খুব কম পাওয়া হয়েছে মানুষটাকে। তবু মা আছে। এই মনোবলটাই সামনের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে৷ আগে কখনো পৃথিবীটাকে নিঃসঙ্গ লাগেনি। প্রতিষ্ঠিত মা এবং মায়ের সন্তানদের জীবনে প্রচুর সেক্রিফাইস করতে হয়৷ যার নিদারুণ উদাহরণ উদয়িনী আর সুহাস, সিমরান। শত ব্যস্ততায়ও বেলা শেষে একটিবার ফোন করে মেয়ের খোঁজ নিত উদয়িনী। আজ কতগুলো দিন হয়ে এলো। দূরান্ত থেকে কেউ ফোন করে খুঁজ নেয় না৷ বুকের ভেতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে সিমরানের৷ আম্মুর পাশাপাশি নামীকেও ভীষণ মনে পড়ছে। আজ ভাবি হিসেবে নামী তার পাশে থাকতে পারত! তীব্র অভিমান হয় নামীর প্রতি। প্রচণ্ড স্বার্থপর মনে হয় ভাইয়ের বউটাকে। তাদের খারাপ সময়, ভালো সময় কোনোটাতেই নামী থাকল না। পৃথিবীতে সব মানুষ একরকম হয় না৷ তার ভাইটা না হয় একটু বেখেয়ালি। তাই বলে ভয়াবহ কোনো অপরাধী নয়৷ সুহাস কেমন ছেলে প্রত্যেকেই জানে৷ নামীও নিশ্চয়ই এতবছরে কম চেনেনি নিজের স্বামীকে। দু’জনের মাঝে মনোমালিন্য হয়েছে। হতেই পারে। তাই বলে এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আলাদা দেশে পাড়ি জমাতে হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান৷ মনে মনে পণ করল, ভাবি হিসেবে, বড়ো বোন এবং বন্ধু হিসেবে হৃদয়ের যে স্থানে নামী ছিল। আজকের পর সে স্থান শূন্য করে দেবে। আম্মু নেই, ভাবি থেকেও নেই৷ তার জীবনে বাবা, ভাইয়া আর স্বামী সৌধ চৌধুরী ছাড়া আর কোনো আপনজন নেই। ভাবতে ভাবতে অজান্তেই
দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ে। চারপাশে মিউজিক, গানের সুর, হৈচৈয়ে মুখরিত। বিয়ের পরিপূর্ণ আমেজ। দুপুর হওয়ার পূর্বেই কাঁচা হলুদ বাঁটা নিয়ে প্রাচী আর ফারাহ সিমরানের কাছে এলো। ড্রয়িং রুমের একপাশে ছোট্ট স্টেজ ডেকোরেট করা হয়েছে। স্টেজের মধ্যমণি গাঢ় হলুদ রঙের সারারা ড্রেস পরিহিত সিমরান৷ ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে হালকা জুয়েলারি পরেছে। ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক, চোখে কাজল, মাথায় টিকলি সবমিলিয়ে একদম চোখ ধাঁধিয়ে ওঠা সৌন্দর্য ফুটে ওঠেছে সর্বাঙ্গে। প্রাচী, ফারাহ ঝটপট সিমরানের সাথে কিছু ফটোশুট করে নিল। এরপর শুরু করল গায়ে হলুদ লাগানো।

সৌধর বিয়েতে বরপক্ষ হিসেবে থাকার কথা ছিল সুহাসের। প্রাচী, ফারাহ এদেরও বরপক্ষ হবার কথা৷ ভাগ্যচক্রে এখন সবাই কনে পক্ষ। কারণ কনে সুহাসের ছোটো বোন৷ সুহাস বোন রেখে বন্ধুর তরফে চলে যেতে পারে না। ছোটোবোনের বিয়ে। কাঁধে তার বিরাট দায়িত্ব। মা নেই, বউ নেই৷ বাবাকে পাশে নিয়ে তাকে যেন সিমরানের মা, ভাবির সব দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় তাকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে প্রাচী, ফারাহ। আইয়াজ, আজিজ বাকি বন্ধুরা বর পক্ষ হিসেবে উপস্থিত আছে চৌধুরী বাড়িতে।

কনের মনে বিষাদ, চোখ দ্বয়ে মেঘ৷ ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি ঝড়ছে। ছবি তুলতে গিয়ে খেয়াল করল, শান। একদিকে সে ফটো তুলছে অপরদিকে সুযোগ বুঝে সেসব সৌধকেও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাচ্ছে।

গায়ে হলুদ নিয়ে সৌধর কোনো মাথা ব্যথা নেই। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী যতটুকু করলেই নয় ততটুকু করছে। দাদুনির বকবক বেড়েছে খুব৷ কারো থেকে সে খবর পেয়েছে সিনু সকালবেলা পার্লার থেকে সেজে এসেছে। এই নিয়ে যত অভিযোগ তার। নতুন বউ বিয়ের আগে কোনো কাজ করতে পারবে না। এটা তাদের বাড়ির নিয়ম। যদিও সিমরান কাজে অপটু। এমনিতেও সে কাজ পারে না। তার নিষেধ ছিল, বাইরে টাইরে যাওয়া নিয়ে। তাহলে সে কেন গেল? গজগজ করছে দাদুনি। শাশুড়িকে থামাতে পারে না তানজিম চৌধুরী। সৌধ মহাবিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে দৃঢ় চোখে তাকায়। তানজিম চৌধুরী চোখের ইশারায় ছেলেকে শান্ত থাকতে বলে নিজের কাজ সেরে কাছে আসে। আড়ালে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,

‘ সিনুকে কল করে বলে দে আমরা পার্লারের লোক পাঠাব। মেহেদির সাজ, বিয়ে, বউভাতের সাজ সব বাড়িতেই সাজাবে। বাইরে যেতে হবে না। ‘

দাদুনির ওপর বিরক্ত হলেও আম্মার বলা কথায় সমর্থন দিল সৌধ। নিজের রুমে গিয়ে ফোন করল সিমরানকে। ইতিমধ্যেই ছোটো ভাই শানের পাঠানো ছবি গুলো দেখেছে সে। তাই প্রস্তুতি নিল হালকাপাতলা শাসন করার। বিয়ের আগের দিন বউ শাসন৷ এতদিন বন্ধুর বোন হিসেবে শাসন করেছে এখন করবে বউ হিসেবে। ভেবেই মনে মনে মুচকি হাসল। সবাই মিলে হলুদ লাগাচ্ছিল সিমরানকে। এমন সময় সৌধর কল। ফোন রিসিভ করে কাঁপা গলায় হ্যালো বলল সিমরান। দৃঢ় কণ্ঠে মৃদু ধমক মিশিয়ে সৌধ বলল,

‘ খুব বাজে দেখতে লাগছে সিনু। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ধরে বেঁধে বিয়ে ঠিক করেছে তোর বাপ, ভাই। চোখ ভর্তি নোনাজলে প্রকাশ পাচ্ছে, পছন্দের হিরো নয় অপছন্দের ভিলেনের বউ হতে যাচ্ছিস তুই। ‘

তীব্র বিষাদ অনুভূতিতে এক টুকরো প্রশান্তি ছিল সৌধর ফোন কল। আর মৃদু ধমকে, শাসনের সুরে ছিল সুখ সুখ অনুভূতি। সমস্ত যন্ত্রণা এক নিমেষে ভুলে গেল মেয়েটা। চোখের পানি মুছে, নাক টানতে টানতে বলল,

‘ সরি। ‘

‘ বিরহিণীর মা সেজে বসে থাকার দরকার নেই। রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমা। যদি প্রণয়ী হতে পারিস তবে যাওয়ার দরকার নেই। আমি প্রণয়ী সিনু চাই বিরহিণী না। ‘

এ পর্যন্ত বলে থামল সৌধ৷ একটু ভাবুক হয়ে পরোক্ষণেই বলল,

‘ আর পার্লারে যাওয়ার দরকার নেই। আমি লোক পাঠিয়ে দিব৷ বাড়ি গিয়ে সাজিয়ে দেবে। ‘

সিমরানকে কিছু বলার সুযোগ দিল না সৌধ৷ ফোন রেখে বেরিয়ে গেল রুম থেকে৷ নিচে তার জন্য হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। বন্ধুরা মিলে ফটোশুটে ব্যস্ত। দাদুনি গলা ছেড়ে ডাকছে তাকে। এত আয়োজন, এত নিয়মকানুন ভালো লাগছে না তার৷ বেশি অসহ্য লাগছে দাদুনির হাঁকডাক। স্বস্তি ভরে রুমে বসতেই পারছে না৷ বিয়ে করছে নাকি সদ্য জন্ম নিচ্ছে বুঝা মুশকিল। বাড়ির সব ক’টা যেন চোখে হারায়৷ সবচেয়ে বেশি চোখে হারাচ্ছে দাদুনি৷ এ মুহুর্তে দাদুভাইয়ের অভাব বোধ করছে সে। দাদুভাই থাকলে নিশ্চয়ই দাদুনিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত।

সৌধর ইচ্ছে ছিল সাদাসিধে ভাবে বিয়ে করবে। কিন্তু পারিবারিক ধারাবাহিকতা আর সিমরানের স্বপ্ন দু’টোয় বাঁধা পড়ে সবকিছু মেনে নিতে হচ্ছে। সিমরানের স্বপ্ন বিরাট আয়োজন করে বিয়ে করবে। ধুমধাম করে যাবে শশুর ঘরে। প্রতিটি অনুষ্ঠানই হবে ধুমধাম করে৷ কোনোকিছুতে কমতি থাকা যাবে না। বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা স্বপ্ন থাকে। সিমরানের স্বপ্ন আর চৌধুরী বাড়ির ধারাবাহিকতা মিলে যাওয়াতে সৌধ হাসিমুখে মেনে নিয়েছে সব। কিন্তু নিজেকে নিয়ে টানাহেঁচড়া পছন্দ হচ্ছে না৷ জাস্ট তিন কবুল পড়ে বিয়েটা সম্পন্ন হোক। এরপর বউভাত ব্যস। পরবর্তীতে আর কারো নিয়মে বাঁধা পড়া যাবে না। কারো নিয়মে বাঁধা পড়া মানেই নিজের স্বস্তির বারোটা বাজানো। রুদ্ধশ্বাস ফেলল সৌধ। দাদুনির বাড়াবাড়ি দেখে আন্দাজ করল, সিনুকে বড্ড জ্বালাবে মানুষটা৷ মনে মনে কিঞ্চিৎ হেসে বলল, ‘ প্রিয় দাদুভাই এর বেগম তুমি যদি অগ্নিশিখা হও তোমার প্রিয় নাতির বেগম তবে বরফ টুকরো। লাভ নেই ডিয়ার লোকসান আছে প্রচুর। ‘
.
.
মেহেদি অনুষ্ঠান। সবাই তৈরি হয়ে যার যার মতো করে স্টেজে উপস্থিত হচ্ছে। সিমরান তৈরি। নিচে যায়নি এখনো৷ কারণ ফারাহ তার লাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছে৷ সে বলে বলে দিচ্ছে কোনটা নিয়ে যাবে কোনটা রেখে যাবে। মেয়েটা শাড়ি পরতে পারে না। ও বাড়িতে শাড়ি পরা নিয়ে চাপ নেই। তাই সেলোয়ার-কামিজ ওঠাল শুধু। সেলোয়ার-কামিজ পরার অভ্যাসও কম সিমরানের৷ শশুর বাড়িতে গিয়ে পরতে হবেই। ফারাহ কম দিন দেখছে না ওকে। তাই সব গুছিয়ে বলল,

‘ টিশার্ট আর প্লাজো ওঠাই? ‘

চমকাল সিমরান। বলল,

‘ ও বাড়িতে তো এসব পড়া যাবে না আপু। ‘

নাকের ডগায় এসে পড়া চশমা ঠেকে ঠিকঠাক করে ফারাহ বলল,

‘ বাড়িতে পড়বে না তো। বেডরুমে পরবে। যখন শুধু তুমি আর তোমার বর থাকবে। আর কেউ থাকবে না। বর ছাড়া আর কেউ দেখবে না। ‘

সহসা লজ্জা পেল সিমরান। রক্তিম হয়ে ওঠা গালদুটো আড়াল করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

‘ থাক দরকার নেই। ‘

ফারাহ মানলো না কথাটি। দু’টো টিশার্ট আর প্লাজো ওঠিয়ে দিয়ে বলল,

‘ দুটো ওঠিয়ে দিলাম৷ প্রয়োজন হলে পরো। পরবর্তীতে না হয় নাইট ড্রেস কিনে নেবে। ‘

কিছু বলল না সিমরান৷ উশখুশ চিত্তে ভাবতে শুরু করল, কাল তার আর সৌধ ভাইয়ের বিয়ে। রাতে বাসর! হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠল অকস্মাৎ। তাদের কি কাল বাসর জাতীয় কিছু হবে? কী জানি!বাসরটাসর না হলেও তারা তো একসঙ্গে এক বিছানাতে ঘুমাবে। শরীরের লোমকূপ সজাগ হলো সিমরানের। দুরুদুরু বুকে ভাবতে লাগল, কাল থেকে তার জীবনটাই বদলে যাবে। সে ডক্টর. সৌধ চৌধুরীর বউ হবে৷ একসঙ্গে এক ঘরে, এক বিছানাতে ঘুমাবে। সৌধ ভাই কি একটুও আদর করবে না তাকে? কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসা দিতে লোকটা কি অনেক বেশি সময় নেবে? তার কী ধৈর্য্য হবে? সে কী পারবে ধীরে ধীরে মানুষটার হৃদয়ের সমস্তটা জুড়ে আধিপত্য করতে? একটু ভয় সীমাহীন লজ্জা, টালমাটাল হৃদয় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করল সিমরান।

সবাই মেহেদি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেছে। ফারাহ এখনো তৈরি হতে পারেনি৷ সিমরানকে নিচে পাঠিয়ে সে চলে গেল নামীর আলাদা ঘরটায়৷ এ ঘরে সে আর প্রাচীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সব জিনিসপত্রও এখানে রাখা। পোশাক বদলে ঝটপট তৈরি হয়ে নিল ফারাহ৷ অনেকদিন পর শাড়ি পরেছে সে৷ ভাবল নিচে গিয়ে আইয়াজকে ভিডিয়ো কল করবে একবার। ভীষণ মিস করছে আইয়াজকে। কনে পক্ষ হয়ে নিজের বরের থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। আইয়াজ বলেছে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সিনুর সাথে তাকে আর প্রাচীকেও ও বাড়িতে নিয়ে যাবে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগপত্র একপাশে রেখে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ খেয়াল করল, নামীর ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ার একটু খোলা। তাই এগিয়ে এসে ড্রয়ারে ধাক্কা দিতে উদ্যত হয়৷ হঠাৎ হালকার ওপর ঝাপসা দৃষ্টি পড়ে নীল রঙের কভারের ওপর মা এবং শিশুর ছবির মতো কিছু দেখে। অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে ড্রয়ার খুলে সে। দেখতে পায় রিপোর্ট পেপার। বুক ধক করে ওঠে তার। এটা কার রিপোর্ট? দেখে তো মনে হচ্ছে প্র্যাগ্নেসির। ভেতরে দেখা প্রয়োজন। সহসা বুক কাঁপতে শুরু করল ফারাহর৷ ভেতরে চোখ বুলাতেই আঁতকে ওঠল! স্পষ্ট দেখতে পেল নামীর প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট। দু’মাসের প্র্যাগ্নেসির সময় করা হয়েছে টেস্ট গুলো। অর্থাৎ আরো তিন মাস আগেকার রিপোর্ট এটা৷ নামী তাহলে বর্তমানে পাঁচ মাসের প্র্যাগনেন্ট! সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল ফারাহর৷ বিস্ময়, উত্তেজনা, খুশি, ভয় সবমিলিয়ে যাচ্ছেতাই হয়ে গেল যেন। মনে পড়ে গেল, সে আর আইয়াজ দীর্ঘদিন যাবৎ বেবি নেয়ার ট্রাই করছে। দু’জনের কারোরি সমস্যা নেই। তবু আল্লাহ তায়ালা মুখ তুলে তাকাচ্ছে না৷ আর এদিকে তার প্রিয় বান্ধবী মা হতে চলেছে। আইয়াজের প্রিয় বন্ধু বাবা হচ্ছে। অথচ তারা কেউ জানেই না৷ এত বড়ো সুসংবাদ কীভাবে চেপে গেল নামী? নামী মা হচ্ছে… খুশিতে পাগলপ্রায় হয়ে গেল ফারাহ। পরোক্ষণেই আবার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করল। নামী কেন রাগ করে চলে গেল? কেন তাদের কাউকেই খুশির খবরটা জানালো না। সুহাস ভাই! সে তো বাবা হতে যাচ্ছে। তীব্র উত্তেজনায় কাঁপছে ফারাহ। মেহেদী অনুষ্ঠানের কথা ভুলে গেল সে। এক হাতে রিপোর্ট গুলো ধরে অন্যহাতে ফোন নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কল করল আইয়াজকে। আইয়াজ ফোন রিসিভ করতেই হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আয়াজ, নামী প্র্যাগনেন্ট! আমি ওর ঘর থেকে প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট পেয়েছি। মেয়েটা কী বোকামি করল বলো তো? এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল। আমার নামী, আমার বান্ধবী মা হতে চলেছে আমি এত দেরিতে জানলাম। হায় আল্লাহ, সুহাস ভাই জানলে কী খুশি হবে!’

আকস্মিক ফারাহর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আইয়াজ৷ রয়েসয়ে বলল,

‘ ফারাহ কান্না থামাও। শান্ত হয়ে বলো কী পেয়েছ তুমি৷ কী বলছ এসব? ‘

শান্ত হতে সময় নিল ফারাহ। কিন্তু নিজের খুশি, উত্তেজনা চেপে রাখতে পারল না৷ সবটা বুঝিয়ে বলল আইয়াজকে৷ সঙ্গে সঙ্গে আইয়াজ সমস্ত কথা জানালো সৌধকে। সৌধ সবটা শুনেই ফারাহকে বলল রিপোর্ট গুলোর ছবি পাঠাতে। ফারাহ ছবি পাঠালে তৎক্ষণাৎ সৌধ কল করল তাকে। রিসিভ করতেই বলল,

‘ ফারাহ বিষয়টা প্লিজ কষ্ট করে চেপে রাখো। আর এ মুহুর্তে কাউকে জানতে দিও না৷ পারলে রিপোর্ট গুলো তোমার কাছে লুকিয়ে রাখো। সুহাস কেমন জানোই তো? আপাতত বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। তারপর আমরা সুহাসকে জানাব৷ ‘

ফারাহকে বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল সৌধ। তার বিচক্ষণ মাথায় প্রশ্ন জাগল, এদেশে শেষ সময় নিধির সাথে কাটিয়েছে নামী। নিধি কি জানত সুহাস বাবা হতে চলেছে? বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। নিধি তার বিয়েতে আসবে কিনা জানা নেই। কিন্তু নামীর ব্যাপারে নিধির সঙ্গে তার যোগাযোগ করতেই হবে৷ সুহাস জানে নামী তার বাবার কাছে রয়েছে। জানে না শুধু নামী নয় নামীর গর্ভে তার সন্তানও রয়েছে। যখন জানবে তখন ঠিক কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে আর ভাবতে পারছে না সৌধ। যা ক্ষ্যাপাটে সুহাস৷ বান্ধবী, পরের বউ এক বাচ্চার মা বলে ছেড়ে দেবে না৷ যে তার বউকেই ছাড় দেয় না সে বান্ধবীকে ছাড় দেবে আশা করা বোকামি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। সুহাসের জায়গায় সে কখনো যাবে না৷ তবু একবার নিখুঁত ভাবে ভাবার চেষ্টা করল, তার স্ত্রী গর্ভবতী।
অথচ তার স্ত্রী সেসব তাকে না জানিয়ে ভীনদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কেমন অনুভূতি হবে? আর ভাবতে পারল না সৌধ। আচমকা সিনুর মুখটা ভেসে ওঠল চোখের সামনে। অনুভব করল, বউয়ের ভাবনা মাথায় এলেই এখন সিনুর মুখ দেখতে পায় সে। কী আশ্চর্য গতিবিধি। মানব হৃদয়ের এ কেমন লীলা? বুকের ভেতর মৃদু স্পন্দন হচ্ছে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠেছে মৃদু হাসি। পাশে আাইয়াজ। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ সে হঠাৎ নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ কতশত বছর আগে আমাদের আলাদা দু’টো জীবন এক হওয়ার পরোয়ানা জারি হয়েছে রে? এত অল্প সময়ে ডিরেক্ট বউ হয়ে চোখের পাতায়, মনের কোণায় ধরা দিচ্ছে? ‘

চলবে..
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬১|
.
.
ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় নিধির৷ ক্ষণকাল ব্যয় করে মস্তিষ্ক সজাগ করে। পাশে তাকিয়ে দেখে অর্পণ ঘুমিয়ে৷ বুকের মাঝে অনিরূপকে আগলে নিয়ে। নিষ্পাপ শিশুটি বাবার বক্ষদেশে কী নির্ভার, প্রশান্তিময় ঘুম ঘুমাচ্ছে৷ দৃষ্টিজোড়ায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। স্মিত হেসে মুগ্ধ দৃষ্টিদ্বয় ফিরিয়ে নেয় নিধি৷ ত্বরিত খোলা চুলে হাত চালায়। দৃঢ় করে খোঁপা বাঁধে। বিছানা ছাড়তে উদ্যত হলে আচমকা থেমে যায়। সেলফোন খুঁজে সময় দেখে৷ লক ছাড়িয়ে ঢুকে ফেসবুক অ্যাপে। নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে চোখ আঁটকে গভীর রাতে সৌধর আইডি থেকে পোস্ট করা একটি ভিডিয়োতে। সৌধর রুম৷ ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে ওর কাজিন মহল আর বন্ধুরা৷ সকলের মাঝখানে গিটার হাতে সৌধ৷ পাশে কফির মগ হাতে আইয়াজ বসে। সৌধর মুখে হাসি নেই৷ চোয়াল দ্বয় দৃঢ়, চোখ দু’টো এক মনে গিটারে স্থির। দেখে কেউ বলবে না রাত পেরুলে তার শুভবিবাহ। পুরু ঠোঁটজোড়া নড়ছে বিরতিহীন। কী তীক্ষ্ণ সুর, কী গভীর ছন্দ!

কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না..
কবিতা,
এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা।

দেখবে আমাদের ভালবাসা,
হয়ে গেছে কখন যেন
পদ্ম পাতার জল, পদ্ম পাতার জল।

কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না
কবিতা,
এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা।

বেদনা সিক্ত অশান্ত এই মন
খুঁজে ফেরে মেটায় প্রয়োজন,
যতদূর জানে এ ব্যাকুল হৃদয়
নীল বিষের পেয়ালা মনের বাঁধন।

দেখবে আমাদের ভালবাসা,
হয়ে গেছে কখন যেন
পদ্ম.. পাতার জল,
পদ্ম.. পাতার জল।

কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না…।
.
.
ভিডিয়োর সমাপ্তিতে সকলের হাততালি। সৌধর অধরে বাঁকা হাসি৷ নিমেষে নিধির বুক ধক করে ওঠে। থম মেরে বসে রয় দীর্ঘক্ষণ৷ পরোক্ষণেই হৃৎস্পন্দন কেঁপে ওঠে। আজ যে সৌধ, সিনুর বিয়ে! সে সহ তার পুরো পরিবার আমন্ত্রিত। এই আমন্ত্রণ এসেছে চৌধুরী বাড়ি থেকে৷ সুহাসের তরফ থেকেও এসেছে। সৌধ বা সিনু দু’জনের কারো থেকেই আলাদা ভাবে আমন্ত্রণ বাক্য পায়নি। এক টুকরো দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে। বেলাশেষে সৌধর প্রতি যাই অনুভব করুক না কেন৷ আজ তার কোনো মূল্য নেই৷ কিন্তু বেলা ওঠতে যে অনুভূতি নিয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসেছে তাদের জীবনে? সেই বন্ধুত্ব। সেটাও কি ঠুনকো হয়ে গেছে? নিঃশ্বাসে অস্থিরতা বাড়ে নিধির। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে মনে মনে বলে, তার প্রতি সৌধর অনুভূতি মিথ্যে ছিল না৷ যতই নিজেকে সামলে নিক। গুছাতে উদ্যত হোক। পুরোনো স্মৃতি, অতীতে পাওয়া আঘাত কোনোটাই মুছে যায়নি৷ ভুলে যায়নি সৌধ। আর এই যে আজ সে বেলাশেষে নিজের অনুভূতিকে পুরোপুরি জেনে গেল৷ সেটাও মিথ্যা না৷ সব চন্দ্র, সূর্যের মতোই সত্য আর দৃশ্যমান। সৌধ তার জীবনে বেস্ট ফ্রেন্ডের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। যা সময় থাকতে সে বুঝতে পারেনি। অনেক সময় হয়তো বুঝেও অবহেলা করেছে। সবশেষে সে সবার কাছে অপরাধী। নিজের কাছেও। সময় থাকতে নিজের অনুভূতিকে গুরুত্ব না দেওয়া, সময় চলে গেলে আপনাআপনিই অনুভূতিদের টের পাওয়া অপরাধই বটে। এই দায় আসলে নিজেরই। অন্য কারো নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি। ঘুরে তাকায় স্বামী, পুত্রের দিকে। ভাবে, ভালোই হয়েছে। সৌধ বা সিনু তাকে আমন্ত্রণ করেনি। ওদের বিয়েতে তার উপস্থিতি কারো জন্যই স্বস্তিকর হবে না। সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে পড়বে অর্পণ, সে, সৌধ আর সিনু। কী দরকার এক সঙ্গে দুই দম্পতিকে অস্বস্তিতে ফেলার? ঠোঁটের কোণে হাসি থাকলেও চোখের কার্ণিশে জল গড়াল। টের পেয়ে আঁতকে ওঠল নিধি৷ গতরাতে অর্পণের বলা কথাগুলো স্মরণ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনল। দু’টো চোখ উপর দিকে নিয়ে শ্বাস আঁটকে মনে মনে আওড়াল,

‘ এ পৃথিবীতে অগণিত নারী অনুভূতির দাবানলে জ্বলে। একদিন সব ঠিক হবে। সবাই সবার মানুষটাকে নিয়ে সুখী হবে৷ সে বা সৌধ কেউই এর ব্যতীক্রম নয়৷ তবু দিনশেষে সৌধর হৃদয়ে নিধি নামক নারী নৈরাশ্য হয়ে ধরা দেবে। আর তার হৃদয়ে সৌধ কেবলই আফসোস। ‘

ঘোরের ভেতরে থাকা মনো ভাবনা গুলোর সমাপ্তি টানল নিধি৷ চোখ বুঁজে ঘনঘন কয়েকবার নিঃশ্বাস ছেড়ে অর্পণের গায়ে হাত রাখল৷ ডাকল বারকয়েক। স্বামীর ঘুম ভাঙলে সে বলল,

‘ আজো অফ ডে। চলুন না কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসি। ‘

ঘুম ছুটিয়ে ওঠে বসে অর্পণ। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘ আজ না তোমার বন্ধুর বিয়ে? ‘

‘ আপনি যাবেন? ‘

সহসা চুপ মেরে যায় অর্পণ। সেদিন একটা ভুলকে কেন্দ্র করে ওরা যা ঘটিয়েছে। এরজন্য উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারত সবাইকে। শুধুমাত্র না জেনে বুঝার ভুল, নিধির খুব ভালো বন্ধু আর সৌধ সুজা এমপির ছেলে
বলে ক্ষমা করে দিয়েছে। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল অর্পণ।
কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটিয়ে বলল,

‘ সরি, আমার কাজ আছে। ‘

মুখ ফুলিয়ে নিধি বলল,

‘ আপনার সঙ্গে ঘুরতে যাব বলে বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ের দাওয়াত ইগনোর করছি। আর আপনি আমাকে কাজ দেখাচ্ছেন? ‘

ছোটো ছোটো করে তাকায় অর্পণ। পাশ থেকে চশমা তুলে দেয় নিধি। বলে,

‘ চশমাটা পড়ুন৷ এরপর দেখুন। ‘

‘ ভেবে বলছ? বিয়েতে যাবে না ‘

‘ একদম। ‘

বুকের ওপর থেকে যেন বিশাল পাথর সরে গেল অর্পণের। সে বোঝে নিধিকে। কেন যেন অনায়াসেই এই মেয়েটার মন বুঝে। চোখের ভাষাগুলো পড়তে পারে। একজন স্বামীর জন্য এই সত্যিটা খুবই নির্মম। তার স্ত্রী অন্য এক পুরুষের গভীর প্রণয়কে ভুলবশত উপেক্ষা করার দহনে জ্বলছে। তার প্রতি এক সময় নিধির মুগ্ধতা ছিল৷ যা ভালোবাসায় রূপ নেবার পূর্বেই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। গতরাতে নতুন করে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। নিধি প্রাণপণে চাইছে নিজেকে সুস্থির করার৷ তাকে আপন করে নেয়ার। স্বামী হিসেবে সম্মানের সঙ্গে সাপোর্ট দেবে সে৷ দৃঢ় বিশ্বাস উপরওয়ালা নিরাশ করবে না৷ সে তার ধৈর্য্য, সম্মান, কর্তব্যবোধ আর ভালোবাসা দিয়ে নিধিকে জয় করে নেবে। এতদিন নিধি তাকে সুযোগ দেয়নি৷ এবার যখন দিচ্ছে পূর্ণ সৎ ব্যবহার করবে৷ দু’দিক থেকেই যখন আঁকড়ে ধরার পায়তারা চলে কার সাধ্য ছিন্ন করার?
.
.
আজ আদরের বোনটার বিয়ে৷ সারা বাড়ি ফুল আর ঝিলিক বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। রাত হলেই বিয়ে বাড়ির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ফুটে ওঠবে৷ এলাহি আয়োজন, বিয়ে বাড়ির উৎফুল্লতা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এতসবের ভীড়ে সকাল থেকে বুক ভার সুহাসের। কারো দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আর না কেউ তার মুখের দিকে তাকাতে পারছে। সোহান খন্দকারের অবস্থাও কাতর৷ মানুষটা সকাল থেকে কিছু মুখে তুলেনি৷ আজ ভীষণ মনে পড়ছে উদয়িনীকে। শত তিক্ততার ভীড়ে উদয়িনী তার হৃদয়ের কতটুকু দখল করে ছিল। সময়ের স্রোতে তা দৃঢ়ভাবে অনুভব করছে। আজ যদি উদয়িনী বেঁচে থাকত তাহলে বোধহয় এতটা নিঃসঙ্গ লাগত না৷ ছেলের বিয়েতে যত সুখ মেয়ের বিয়েতে ততই শোক৷ বুকে কম্পন ধরে সোহানের৷ মেয়েটা চলে গেলে তার পুরো বাড়িটাই শূন্য। এমতাবস্থায় পুত্রবধূ, প্রিয় নিলুর মেয়েকে স্মরণ হয়৷ আফসোসে ডুবে যায়। নামীকে তো সে মেয়ের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি৷ তবে কেন আজ তার বাবা সত্তার অসহায়ত্বে নামী কাঁধে হাত রাখল না? তবে কী সে ভুল করেছে সুহাসের সাথে নামীর জীবন গেঁথে দিয়ে? তীব্র অসহায় বোধে ভুগে সোহান খন্দকার। বুকের পাঁজরে ব্যথায় বিষিয়ে ওঠে। কলিজাটা ভীষণ ছটফট করছে। যেন আর কিছু সময় এরপরই তার শরীর ভেদ করে কলিজা ছিঁড়ে নেয়া হবে৷ মেয়ের বিয়েতে প্রতিটি বাবার হৃদয়ে হওয়া রক্তক্ষরণ কেউ কি দেখতে পায়? শুনতে পায় কি কেউ মেয়ে বিদায়ে বুকের ভেতর চলা বাবাদের আর্তনাদ গুলো?

আব্বু আর ভাইয়ার অবস্থা দেখে সিমরানের চোখের পানি বাঁধ মানে না৷ বিয়ে নিয়ে এতদিন যে চঞ্চল অনুভূতিটা ছিল৷ প্রিয়জনকে নিজের করে পাওয়ার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবই যেন থমকে যায়। অন্তঃকোণে বাবার বিষণ্ণ মুখ, ভাইয়ের আঁধারে নিমজ্জিত চোখ তার সমস্ত সত্তা নাড়িয়ে দেয়৷ আম্মুকে মনে পড়ে খুব৷ বুকের ভেতর বিশাল একটা জায়গা জুড়ে কেবল শূন্য শূন্য লাগে। বিয়ে শব্দটা সহজ হলেও এর ভাবার্থ কত কঠিন৷ বিয়ে শব্দে দুটো অক্ষর থাকলেও, বিয়ে দুই নর নারীর মধ্যে সংঘটিত হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা। বিয়ে শুধু ছেলে, মেয়ের মাঝেই সম্পর্ক স্থাপন করে না৷ দু’টো পরিবারকেও এক সুতোয় গেঁথে দেয়। ঘরের দেয়ালে টাঙানো পারিবারিক ছবির দিকে তাকায় সিমরান৷ জ্বলজ্বল করছে মায়ের মুখটা। কী সুন্দর হাসি! মায়ের ডানপাশে মায়ের আদলের লম্বাটে ভাই সুহাস৷ বাম পাশে গম্ভীর মুখে বাবা দাঁড়িয়ে। তার বুকের অতিনিকটে মিষ্টি হাসিতে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজে। নিঃশ্বাস আঁটকে যায় মেয়েটার। এই ছবিটা আর কখনো জীবন্ত হবে না। আম্মু কখনো ফিরে আসবে না। আজ তার বিশেষ দিনেও না। তৃষ্ণা পায় তার। বীভৎস তৃষ্ণা। মায়ের বুকে একবারটি মাথা রেখে রুদ্ধশ্বাস ছাড়তে আকুল হয় হৃদয়। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে বলে,

‘ আজ আমার বিয়ে। আব্বু, ভাইয়ার মতো আম্মু পাশে থাকলে বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগত না। সেই ছোট্ট থেকে নিজের কোনো বিশেষ দিনেই ওই মানুষটাকে পাশে পেলাম না৷ আজো না। ‘

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সিমরান৷ একদিকে সাজানো হয়। অন্যদিকে কেঁদে গাল ভাসায়। ইতিমধ্যেই সে মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজ রাতে, বাসরঘরে একান্ত মুহুর্তে সেই সিদ্ধান্তটি জানাবে সৌধকে। নিজের জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা গুলোই এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে বাধ্য করল।

সাজ প্রায় কমপ্লিট। বাকি রয়ে গেছে শুধু চুল। চুল বাঁধা শেষ হলেই লেহেঙ্গা পরবে। আকাশি নীল রঙের গর্জিয়াস, ব্রাইডাল ল্যাহেঙ্গা। এই রঙটা সৌধর ভীষণ পছন্দের। পছন্দ সিমরানেরও। সবচেয়ে বড়ো কথা সিমরান চেয়েছিল তার বিয়ের সবকিছু ডিফারেন্ট টাচে থাকবে। আর সৌধ তার পুরো ব্যক্তিত্বেই ডিফারেন্ট টাচ রাখে৷ তাই বিয়ের সাজে, পোশাকে দু’জনের পছন্দ খাপে খাপ মিলে গেল।

চুল বাঁধা শেষে লেহেঙ্গা আর জুয়েলারি পরার পূর্বে মেয়ের ঘরে সোহান খন্দকারের আগমন ঘটে। পেছন পেছন আসে সুহাস। পার্লার থেকে আসা মেয়েদের নিয়ে বাইরে চলে যায় প্রাচী৷ ফারাহ আর সিমরানের মামি আসে গরম গরম খাবার নিয়ে৷ তারা খাবার গুছিয়ে চলে গেলে সুহাস দরজা আঁটকে দেয়৷ সৌধদের আসার সময় হয়ে এসেছে। বরপক্ষ আসার পূর্বে তারা বাবা, ছেলে সিমরানের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চায়৷ একসঙ্গে খাবার খেতে বসল ওরা৷ তিনজনের কারো পেটেই দানাপানি নেই। সুহাসের নানুমনিই তাই বুদ্ধি করে মেয়ের জামাই আর নাতিকে সিমরানের ঘরে পাঠালো। নিজের হাতে তুলে খাবে না সিমরান৷ বাবা, আর ভাইয়ের হাতেই খাবে। সোহান খন্দকার ঝাপসা দৃষ্টিতে হাসিমুখে মেয়ের মুখে খাবার তুলতে উদ্যত হলে হঠাৎ সিমরান বাঁধা দেয়। ছলছল চোখে মৃদু হেসে বলে,

‘ ওয়েট আব্বু। আম্মুকে নিয়ে আসি। আমার কোনো বিশেষ দিনেই আম্মু পাশে থাকেনি৷ ছুটি নেই, কাজের ব্যস্ততা এই সেই৷ আজ যখন কাজ নেই, ছুটি আছে৷ তখনও আম্মু নেই৷ এসব কেমন নিষ্ঠুরতা বলো তো? ‘

কথাগুলো বলতে বলতে ওঠে দাঁড়ায় সিমরান। বিছানার পাশের টেবিলে মায়ের একটি সিঙ্গেল ছবি রয়েছে। দু’দিন আগেই রেখেছে৷ সেটা নিয়ে এসে কোলে রেখে আব্বু আর ভাইয়ের দিকে তাকায়। কান্নারত মিষ্টি হেসে বলে,

‘ আমাদের পরিবার কমপ্লিট। ‘

কথাটা বলেই হা করে। সোহান খন্দকার চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেয়। সুহাস ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকায়। টলমল দৃষ্টিতে একবার বোন আরেকবার মায়ের ছবি দেখে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে বলে,

‘ না বোন। আমাদের পরিবার কমপ্লিট সেদিন হবে যেদিন আমার পাশে নামী বসবে। ‘
.
.
বরপক্ষের এগারোটা গাড়ি, তেত্রিশটা বাইক তৈরি। তৈরি চৌধুরী বাড়ির সদস্যরাও। শোনা যাচ্ছে বরও তৈরি। শুধু রাজকীয় পাগড়ি আর নাগরা জুতো পরা বাকি। যা আইয়াজ, আজিজ এসে ঝটপট পরিয়ে দিল৷ আয়নার সামনে স্তম্ভিত মুখে দাঁড়িয়ে সৌধ। এ প্রথম নিজেকে ট্রাডিশনাল লুকে দেখতে পাচ্ছে সে। পরনে অফ হোয়াইট কালার শেরওয়ানি, মাথায় আকাশি নীল রঙের কারুকাজখচিত, শুভ্র পালকশোভিত পাগড়ি, পায়ে আকাশি নীল রঙা নকশা করা নাগরা জুতা। দাঁড়িমোচ ছেঁটেছে বিধায় মুখবায়বেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঠেকছে। সব মিলিয়ে নিজেকে পুরোনো দিনের কোনো এক রাজ্যের যুবরাজ মনে হচ্ছে। যেন আজ তার অভিষেক। মৃদু হাসল সৌধ। ঘুরে দাঁড়িয়ে বুক টান টান করে শ্বাস নিল দীর্ঘ৷ আইয়াজকে বলল,

‘ তোরা যেতে থাক আমি আসছি। ‘

সঙ্গে সঙ্গে আইয়াজ বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। সবাই বেরিয়ে গেলে একটু স্বস্তি পেল সৌধ। ত্বরিত পা বাড়িয়ে দরজা আঁটকে দিল৷ এরপর ধীর পায়ে গিয়ে বসল বিছানায়। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজল সন্তর্পণে। আবেগ স্মরণ করল নিধিকে। বিবেক স্মরণ করল সিমরানকে। জীবনে চলার পথে আবেগ ক্ষতিকর হলেও বিবেক ক্ষতিকর হয় না৷ বিশেষ দিন, বিশেষ মুহুর্ত আচমকা সৌধর ভেতরের সত্তায় কম্পন সৃষ্টি হলো। এই দিনটা নিয়ে একদিন সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নের নারীটি ছিল নিধি৷ স্বপ্নের দিন সত্যি হতে যাচ্ছে। কেবল দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে নারীটি৷ চোখ খুলল সৌধ। বিরবির করে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল,

‘ প্রথম জীবনের শোক দ্বিতীয় জীবনের সুখে বিলীন হোক। আজ থেকে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু। আমার জীবনে সিনু দ্বিতীয় নারী হয়ে নয় শেষ নারী হয়ে থাকুক। আমার সবটুকু আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ওকে ঘিরে তৈরি হোক। যে আমাকে অনুভব করিয়েছে সে ছাড়া কেউ আমাকে ভালো রাখতে পারবে না। তার প্রতি আমার অন্তহীন ভালোবাসা জন্মাক। হে প্রভু, ভাঙা হৃদয় গড়িয়ে নেয়ার যুদ্ধে আমি বা সিনু কেউ যেন না হারি। ‘

|চলবে|

®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৫৭+৫৮

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৭|
মনের ভেতর অদ্ভুত অশান্তি চলছে। কাউকে ভালো লাগছে না। কোনোকিছুতে মন বসছে না। ঘরের দরজা বন্ধ করে বিবশ মুখে বসে রইল সিমরান। একটু আগে তার কাছে সুহাস এসেছিল। ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশ্ন করেছে,

‘ সৌধ ফোন করেছিল? ‘

সে জবাব দেয়,

‘ হ্যাঁ। ‘

‘ কী বলল? ‘

‘ সন্ধ্যায় বেরুবে। এখন বন্ধুদের নিয়ে ক্লাবে আড্ডা দেবে। তুমিও তো যাচ্ছ? ‘

চটে যায় সুহাস। আইয়াজ ফোন করে ইনভাইট করেছে তাকে। সব শুনেই বোনের কাছে এসেছে। বোন সবটা জানে শুনে তেড়ে এসে বলল,

‘ তুই মেনে নিলি? ‘

‘ না নেয়ার কী আছে? বিয়ে করছে বলে সবকিছু জলাঞ্জলিতে তো দেবে না। আমি অমোন দজ্জাল বউ হতে পারব না৷ বরকে প্রাইভেসি দিব৷ ‘

সুহাস ফুঁসতে শুরু করে। যেখানে সৌধ আজ সিনুকে নিয়ে বেরুবে বলেছে। সেখানে প্ল্যান ক্যানসেল হয় কী করে? সৌধ কোন সাহসে তার বোনের সঙ্গে বেরুবার কথা ভঙ্গ করে? বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে? আচমকা সুহাসের মনে নিধি বিঁধতে শুরু করল৷ সৌধ কি নিধির জন্য তার বোনকে অবমূল্যায়ন করছে? সিনুর চেয়ে নিধিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে? একবার ভাবল সে যাবে না৷ আবার মত পাল্টালো। তাকে যেতে হবে। সৌধ এখন শুধু তার বন্ধু না। বোন জামাইও হতে যাচ্ছে। আর নিধি সৌধর দুর্বলতা। ওখানে না যাওয়াটাই নির্বুদ্ধিতা। বরং গিয়ে বুঝতে হবে আসল পরিস্থিতি আর সৌধর মনোভাব। সিমরানের জন্য সৌধ কতটুকু যোগ্য, মঙ্গলকর দু’চোখে প্রমাণ সমেত নিশ্চিত হতে হবে। বোনের স্বার্থে কারো সঙ্গে আপোষ করতে রাজি নয় সুহাস৷ সে হোক সৌধ, বা নিধি৷ আগে বোন পরে বন্ধুত্ব। প্রচণ্ড ক্ষেপেছে সুহাস। এমনিতেই মনে শান্তি নেই। এর ওপর বোনের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার পথে৷ ভাইয়ের ক্রোধে জর্জরিত মুখটা দেখে সিমরান শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,

‘ তুমি রাগ করছ কেন? ব্যাচেলের জীবনের শেষ আড্ডা তার। আমি কেন বাঁধা দিব? তাছাড়া বলেছে তো সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে বেরুবে। অহেতুক রাগ করো না ব্রো। যাও গিয়ে ঝটপট রেডি হয়ে বের হও। কতদিন পর সব বন্ধুরা একসঙ্গে হচ্ছো। স্পেশালি নিধি আপু আসছে। কতদিন পর তোমাদের সেই পুরোনো বন্ধুমহল এক হতে যাচ্ছে…। ‘

সিমরানের কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। চোখে, মুখে খুশির ঝলক। যা সুহাসের বুকের ভেতরও শিহরণ জাগালো। সব ক্রোধ ছাপিয়ে নম্র হলো মন। সত্যিই তো! কতদিন পর তারা সব বন্ধুরা এক হচ্ছে। আড্ডা হবে, মজা, মস্তি। গল্পের আসর, গানের আসর একদম জমে ক্ষীর। সে শুধু শুধু রাগ করছে। বোনের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকে সৌধকে ভুল বুঝছে সে। সৌধ কঠিন ব্যক্তিত্বের পুরুষ। চরিত্রে এক বিন্দু ত্রুটি ধরাও মুশকিল। নিধির প্রতি অতীতে আসক্ত ছিল ঠিক৷ বর্তমানে দুর্বলও। তাই বলে তার বোনকে ঠকাবে না৷ কারো প্রতি অন্যায় করতে পারে না সৌধ। সেখানে মানুষটা যদি হয় সিনু, তার বোন। ক’দিন বাদে সৌধর বউ হবে যে মেয়েটা। তাকে ঠকানোর সাধ্য সৌধর হবে না৷ ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরোক্ষণেই একটু চমকাল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

‘ নিধি আসবে কে বলল তোকে? ‘

সিমরান প্রশান্তিময় হেসে উত্তর দেয়,

‘ কে আবার সৌধ ভাই। ‘

চোখ দু’টো কপালে ওঠে গেল সুহাসের। মনে মনে বলল,

‘ ও বাবা এতদূর? শা’লা দেখি পাক্কা খেলোয়াড়, আমার মতো কাঁচা না। ‘

নিমেষে বোনের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হলো। কী সব ভাবছে। সৌধ এখন শুধু তার বন্ধু না। ছোটো বোনের হবু বরও। রয়েসয়ে মন্তব্য করতে হবে। ভেবেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বোনকে মৃদু হাসি বিনিময় করে বেরিয়ে গেল। ভাই বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সিমরানের অশান্তি শুরু…

সে অশান্তি দূর করতে ফোন করে বান্ধবী লুনাকে। তার স্বস্তির মানুষ। নিজের মনের অস্থিরতা জানালে
লুনা পরামর্শ দেয়, ঝটপট লেকের পাড়ে চলে যেতে। সে আর বাকি বন্ধুরা সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। মামাত ভাই, বোনরা এসেছে। বাবার দিকের আত্মীয়তেও ভরপুর। এত মানুষের মাঝে কারো সঙ্গেই স্বস্তি অনুভব করে না সিমরান৷ তাই বান্ধবীকে সায় দিয়ে ত্বরিত পোশাক পাল্টে নিল৷ এরপর বেরিয়ে পড়ল বাবার অনুমতি নিয়ে। বিয়ের কনে একা একা বেরুচ্ছে বলে নানুমনি গজগজ করল। তাকে সামলে নিল সোহান খন্দকার।
.
.
তিন রাস্তার মোড়। পশ্চিম পাশে দোতলা বিল্ডিং। নিচে দোকান উপরে দু’টো ফ্ল্যাটের পাশে একটি ঘর৷
হলঘরের মতো। যার সামনে সাইনবোর্ডে লেখা- “বিগবস ক্লাব” পুরো বিল্ডিংটাই সুজা চৌধুরীর। ক্লাবের অংশ বাদে বাকি অংশ ভাড়া দেয়া। সৌধর বন্ধুরা আগেই উপস্থিত হয়েছে। তারা নিজেদের মতো করে আড্ডা দিচ্ছে। সৌধ এলো তারা উপস্থিত হওয়ার ঘন্টাখানিক পর। এক গাড়িতে চার বন্ধু এলো। সৌধ, আইয়াজ, আজিজ আর প্রাচী। ওরা উপস্থিত হতেই সকলে মিলে স্বাগতম জানালো, কুর্নিশ করতে করতে একবাক্যে বলল,

‘ সৌধ ভাইয়ের আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম। ‘

সৌধ বাঁকা হাসিতে ভেতরে প্রবেশ করল। কাঁধ থেকে গিটার খুলে সামনে এগিয়ে ধরতেই একজন সেটা নিয়ে নিল। প্রাচী চোখ, মুখ কুঁচকে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

‘ কী সমস্যা। সৌধ কি একাই আসছে? ওরে একাই স্বাগত জানাবি? আমরা কি এলিয়েন নাকি! ‘

সকলে হো হো করে হেসে ওঠল। সৌধকে যেভাবে স্বাগত জানালো একই ভাবে এবার প্রাচীকে জানিয়ে বলল,

‘ প্রাচী আফার আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম। ‘

‘ হইছে, হইছে। সেধে সেধে আর সম্মান নিতে চাই না।’

চোখে চশমা ঠেলতে ঠেলতে আইয়াজ গিয়ে বসল চেয়ারে। এদিকে আজিজ সবাইকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখে বলল,

‘ কীরে শা’লা, কীরে ভাতিজারা খবর ভালো? ‘

বলতে বলতেই একটু দূরে স্টেজ সিস্টেম ইট সিমেন্টের উঁচু জায়গাটায় ওঠে দাঁড়াল। এরপর বক্তৃতার ভঙ্গিতে দু-হাত তুলে বিজ্ঞের মতো বলতে লাগল,

‘ হে বন্ধুগণ, আপনারা শান্ত হন। আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। কারণ খুব তাড়াতাড়ি আমাদের জাতির ডক্টর, জাতির চৌধুরী সাহেব এবং জাতির ভাই সৌধ ভাইয়ের বলিদান সেলিব্রেশন করতে। ‘

‘ বলিদান! ‘

হকচকিয়ে গিয়ে আইয়াজ কথাটা বলতেই দাঁত ক্যালিয়ে হাসল আজিজ। আইয়াজকে ইশারা করে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে পুনরায় বলতে লাগল,

‘ এই তো বলি প্রাপ্ত বন্ধু আমার! এই তো তাহারা একই পথের পথিক হতে যাচ্ছে। ‘

কান্না আসে না। তবু জোর করে কান্নার ঢঙ করে আজিজ৷ আইয়াজ হতভম্ব মুখে বসে। আজো কী পরিমাণ নাটকবাজ রয়ে গেছে আজিজ! প্রাচী হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে বসে পড়েছে৷ সৌধ এদের হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই অবাক হলো না। ওদেরকে ওদের মতো ছেড়ে দিয়ে আইয়াজকে ইশারা করে কাছে ডাকল। জিজ্ঞেস করল,

‘ খাবারের ব্যবস্থা করেছিস? ‘

‘ সুহাস করবে। বাসমতী চালের খাসির কাচ্চি, স্প্রাইট, স্পিড ক্যান। এখন চা, কফি পাচ্ছি শুধু। ‘

‘ কোথায় ও? ‘

‘ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে বলল। ‘
.
.
ক্লাবের সামনে বাইক থামতেই নিধির ডাক শুনতে পেল সুহাস,

‘ এই সুহাস, এই। ‘

আচমকা পিছনে ঘুরতেই বাচ্চা কোলে নিধিকে দেখতে পেল সে। নিমেষে বুকের ভেতর জমে থাকা সব রাগ, অস্বস্তি দূর হয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসির রেখা ফুটল সুহাসের। ত্বরিত বাইক থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে অনিরূপকে কোলে তুলে নিল। নিধি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বলল,

‘ কেমন আছিস? ‘

‘ এইতো আছি.. তোর কী খবর? ‘

অনিরূপের সঙ্গে খেলা করতে করতে জিজ্ঞেস করল সুহাস৷ নিধি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ আজ আমি ভীষণ ভালো আছিরে দোস্ত। কতদিন পর তোদের একসঙ্গে পাচ্ছি। আই এম সো হ্যাপি। ওরা সব কোথায়? এসে গেছে? ‘

‘ হ্যাঁ আমি আর তুইই লেট। ‘

অনিরূপের বুকে নাক ঘষল সুহাস। খিলখিল করে হেসে ওঠল ছেলেটা৷ সুহাস আশ্চর্য কণ্ঠে বলল,

‘ কিইরে দোস্ত! ও তো তোর মতো খলখল করে হাসে। ‘

নিধি হা হয়ে গেল৷ সুহাসের গাল টেনে দিয়ে বলল,

‘ আমি খলখল করে হাসি? ‘

সুহাস দুষ্টুমি ভরে উত্তর দিল,

‘ ঘোড়া ছুটলে চারপাশে যে ধ্বনি বাজে তুই ঠিক অমন হাসিস বিলিভ না হলে সৌধকে জিজ্ঞেস করে দেখিস। ‘

অনেকদিন পর দেখা। অনুভূতি জেগে ওঠেছে পুরোনো দিনের মতোই৷ তাই তো কথার ছলে পুরোনো স্বভাবে মুখ ফস্কে সৌধর নাম বলে ফেলল সুহাস৷ সহসা দু’জনের মুখই চুপসে গেল। চারপাশ যেন সুনসান নীরবতায় আচ্ছন্ন। সুহাস আর খেলা করছে না। যত্ন নিয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে অনিরূপকে। অনিরূপ ওর চুল নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত। নিধি স্মিত হাসল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

‘ চল ভেতরে যাই। ‘

সায় দিল সুহাস৷ ওরা দু’জন যখন ক্লাবের দরজার সামনে উপস্থিত হলো শুনতে পেল, সবাই মিলে সৌধকে জেরা করছে, তাদের হবু ভাবি কোথায়? সুহাসের সঙ্গে আসবে নাকি? সৌধ গম্ভীর গলায় বিরক্ত হয়ে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে,

‘ ওর আসার কথা ছিল না। অহেতুক গ্যান্জাম করিস না তো। ‘

কতদিন? বহুদিন? হ্যাঁ বহুদিনই বটে। বহু এবং বহুদিন পর সৌধর দেখা পেল নিধি৷ বুকের ভেতরটা আবেগে টইটম্বুর। এক সময় কত ভালো বন্ধু ছিল দু’জন। কত ভালো সময় কাটিয়েছে তারা৷ যেখানেই সৌধ সেখানেই নিধি৷ সৌধর চারধারে এক নিধির অস্তিত্ব। চোখ দু’টো টলমল হয়ে ওঠল ওর৷ কেউ দেখার আগেই তা অস্পষ্ট করে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল৷ সকলের প্রশ্নে বিরক্ত হলো কিঞ্চিৎ। এরা কি নিজেদের বোধবুদ্ধি গিলে খেয়েছে? বিগবস ক্লাবে সিনু কেন আসবে? এটা সৌধর বন্ধুহলের ক্লাব। আজ তারা বন্ধুরা মিলে মিট করতে এসেছে। বন্ধুদের মাঝখানে কেন সিনু আসবে? বউ আর বন্ধু দু’টো দু জায়গাতেই মানানসই৷ এক জায়গাতে না। বউ কখনো বন্ধু হতে পারে না৷

সুহাস, নিধিকে দেখে খুশিতে চিৎকার করে ওঠল প্রাচী, ‘ ওহ নিধি। ‘ বলেই একছুটে এসে নিধিকে জড়িয়ে ধরল সে৷ এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না নিধি। কেঁদে ফেলল আচমকা। ওদের দু’জনের জড়িয়ে ধরা দেখে স্টেজ থেকে লাফিয়ে ছুটে এলো আজিজ। দু হাত এগিয়ে ধরে ঢঙ করে বলল,

‘ ওহ নিধি আয় বুকে আয়। ‘

আজিজের কথা শুনে লাফিয়ে সরে গেল নিধি প্রাচী দু’জনই। আজিজ নিধির দিকে যেতে যেতে বাঁক নিল। সুহাসের দিকে৷ নিধির ছেলে অনিরূপকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল। আফসোসের স্বরে বলল,

‘ আয় ভাই তুইই বুকে আয়। তোর মা তো আসবে না তুইই আয়। ফা টা কপাল আমার। ‘

বান্ধবীর ছেলেকে ভাই! এই আজিজ পারেও বটে৷
সকলের মাঝে হাসির রোল পড়ল৷ এক সৌধ ছাড়া। সে নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছে৷ এদিকে আজিজের শক্ত বুকে শক্ত চাপ খেয়ে অনিরূপ উচ্চ গলায় কান্না করে দিল। তার কান্না শুনতেই নিধির বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে ওঠল যেন। তড়াক করে এসে আজিজকে বকতে বকতে ছেলেকে কোলে তুলে নিল।

‘ কীরে তুই! এখনো শুধরালি না। বাচ্চাদের সাথে কেউ এমন করে। সব জায়গায় মজা নেস। ভয় পেয়েছে ছেলেটা। ‘

ছেলেকে পরম মমতায় বুকে আগলে নিল নিধি৷ এরপর উপস্থিত সকলের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে নির্দ্বিধায় চলে গেল সৌধর সামনে৷ সৌধ যে চেয়ারটায় বসে আছে তার পাশের চেয়ারে বসে নিজেকে সুস্থির করল। এরপর তাকাল সৌধর পানে। সহসা বুকের ভেতর ধক করে ওঠল। সৌধ তাকায়নি তার দিকে। সে এসেছে অথচ সৌধর মাঝে বিন্দু পরিমাণ উৎসাহও নেই। এই যে পাশে বসল এতেও ভ্রুক্ষেপহীন। আহত হলো নিধি। গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ কেমন আছিস? ‘

উত্তর দিতে সময় নিল না সৌধ। কৃপণতাও করল না। সহজ গলায় বলল,

‘ ভালো। তুই? ‘

একটুক্ষণ চুপ রইল নিধি। অপেক্ষা করল সৌধর তাকানোর। তাকাল না সৌধ। নিরাশ হলো সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ আছি, ভালোই। ‘

কথাটা বলে খেয়াল করল সৌধর ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি৷ নিধির হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল এ হাসিতে। পুরোনো দিন গুলো আর ফিরে আসবে না৷ তাই বলে এতখানি পার্থক্য মানতে কষ্ট হলো। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে৷ কী করবে কী বলবে বুঝতে না পেরে অনিরূপের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ অনিরূপকে দেখবি না? আমার ছেলে। বাচ্চাদের সঙ্গে রেগে থাকতে নেই। ‘

নিধি যখন এ কথাটা বলল সৌধর বুকের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধল, অনিরূপ অর্পণ শিকদার আর নিধির সন্তান। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিল সৌধ। নিধির দিকে তাকাল না একবারো। তবে নিষ্পাপ শিশুটার দিকে তাকাল। অনিরূপের ফর্সা গুলুমুলু মুখ, মায়ের মতো বাদামি রঙের নিষ্পাপ চাহনি হৃদয় শীতল করে দিল তার। স্মিত হাসল সে। সহসা ডান হাত বাড়িয়ে অনিরূপের ডান হাত স্পর্শ করে বলল,

‘ হেই লিটল স্টার, উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস? ‘

সৌধ, নিধিকে আশ্চর্য করে দিয়ে অনিরূপ মুগ্ধ করা এক হাসি দিল। দু-হাত বাড়িয়ে প্রায় লাফিয়ে চলে গেল সৌধর কোলে। সৌধ আগলে ধরল অনিকে। দু’হাতে উঁচিয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,

‘ ওকে ফাইন পাক্কা দোস্ত হয়ে গেলাম আমরা। ‘

এবারে নিধির দিকেও তাকাল সৌধ। বহুদিন না দেখা মুখটায় তাকিয়ে হাসল অমায়িক ভঙ্গিতে। যে হাসিতে নিধি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ সৌধ দৃষ্টি সরিয়ে নিল নিধির হালকা লালচে চোখ দু’টো থেকে। তার মনে হলো ভেতরে ভেতরে কাঁদছে নিধি৷ কেন কাঁদছে? উত্তর জানতে চায় না। নিধি অপলকভাবে সৌধর কোলে অনিরূপকে দেখছে৷ সৌধ ওর সঙ্গে অল্প অল্প কথা বলছে, হাসাতে চেষ্টা করছে। অনিরূপ বার বার সৌধর নাকে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে লাগলে সৌধ মুখ সরাতে সরাতে নিধিকে বলল,

‘ ভালো ইয়ার্কি মারে তোর ছেলে। ঠিক তোর মতো। বন্ধু পাতাতে না পাতাতেই ইয়ার্কি শুরু করে দিয়েছে।’

একটু দূরেই প্রাচী। সবই শুনছিল৷ হঠাৎ কাছে এসে বলল,

‘ বাব্বাহ বন্ধু পাতিয়ে ফেললি? ‘

‘ এটাই ব্যাটার। ‘

দৃঢ় স্বর সৌধর৷ প্রাচী টের পেয়ে কথা বাড়াল না৷ দূর থেকে ওদের তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করল সুহাস৷ সৌধ নিধির সঙ্গে বিরবির করছে৷ কী বলছে ওরা? কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এলো সে। তক্ষুনি আজিজ গিটারে টুংটাং বাজাতে লাগল। কী বিশ্রী শুনালো! সুহাস রেগে গিয়ে বলল,

‘ ছাগল দিয়ে হাল চাষ হয় না। দে এদিকে দে। ‘

প্রাচী হঠাৎ চ্যাঁচিয়ে ওঠল,

‘ এই সৌধ, এই সুহাস গান ধর তো একটা। ‘

বাকি বন্ধুরা প্রতিবাদ করল।

‘ এই না এভাবে না। এক এক করে গাইতে হবে। তার আগে সবাই শান্ত হয়ে বোস। ‘

ওরা সবাই শান্ত হয়ে বসল। নিচ থেকে সবার জন্য চা নিয়ে এলো কয়েকজন। ওরা সবাই মিলে চা খেতে খেতে আড্ডা দিল। নিধির ছেলের বয়স সাড়ে সাত মাস। আড্ডার কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ছেলেটা ক্ষুন ক্ষুন করে কাঁদতে লাগল। নিধি টের পেল, খিদে পেয়েছে। বার বার মায়ের কোলে আসতে বাহানা খুঁজল। নিধি কোলে নিলে বুকের দিকে মুখ ঘষতে শুরু করল অনিরূপ। সকলে আড্ডায় ব্যস্ত৷ আড্ডার ফাঁকে সৌধর চোখ চলে যায় নিধির অস্বস্তি ভরা মুখে। বুঝতে পারে সমস্যা। তাই প্রাচীকে ইশারা করে নিধিকে নিয়ে ওপাশে চলে যেতে। ছোটো বাচ্চা নিয়ে মায়েদের এই সমস্যা। ওরা পরিস্থিতি বুঝে না৷ খিদে পেয়েছে ওদের খাবার চাই। এতে মা যতই বিব্রত হোক ওরা সেসব কেয়ার করে না৷ করবে কী? ওরা তো বুঝতেই পারে না৷ ভেবেই আচমকা মুচকি হাসল সৌধ।
.
সকলে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার পাশাপাশি ফোন টিপছিল সৌধ৷ ফেসবুক স্ক্রলিং করতে গিয়ে হঠাৎ দৃষ্টি থমকাল সিমরানের আইডিতে লুনার একটি লাইভ ট্যাগ দেখে। ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে৷ লাইভ শো করল। দেখতে পেল লুনা সহ আরো গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে। লেকের ধারে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সেখানে সিমরানও আছে৷ লুনা সিগারেট খাচ্ছে আর লাইভে তার ফ্যান, ফলোয়ারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। নিমেষে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার৷ লুনা মেয়েটাকে একদম পছন্দ নয় তার। এর আগে একবার ওর সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছে সিমরানকে। বেস্ট ফ্রেন্ড বলে মেলামেশা বন্ধ করতে পারেনি৷ তাই বলে রাস্তাঘাটে, বাইরে মেয়েটা এভাবে সিগারেট খাবে? এ কেমন অসামাজিকতা! অসভ্য, বর্বর একটা মেয়ে! ক্রোধে দেহ শক্ত মূর্তি হয়ে গেলো সৌধ৷ এতদিন সিমরান শুধু ওর বন্ধুর বোন ছিল৷ এখন হবু বউ৷ সুজা চৌধুরীর হবু পুত্রবধূ। একটু হিসেব করে চলা উচিত ছিল৷ মেজাজ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সুহাসকে ডাকল। সুহাস কাছে আসতেই ফোন এগিয়ে ধরে বলল,

‘ লুনার সাথে ওকে মিশতে না করিস না কেন তুই? ‘

চমকে ওঠল সুহাস। বিস্ময়ে বড়ো বড়ো চোখ করে একবার ফোন আর একবার সৌধর দিকে তাকাল। ঢোক গিলতে গিলতে ভাবল, সিনু তো বাড়ি ছিল। কখন বের হলো? যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সৌধ কেমন ছেলে, কোন বাড়ির ছেলে, সৌধর কী অপছন্দ, তাদের বাড়ির চোখে কী অপরাধ। সমস্তটাই অবগত সুহাস৷ এদিকে বোন যে ভুল করেছে সেটা মনে মনে স্বীকার করলেও সৌধর সামনে স্বীকার করতে নারাজ৷ তাই দোষ সৌধকেই দিল৷ ঠিক বাচ্চাদের মতো করে বলল,

‘ সিনু তো বাড়িতে ছিল৷ কখন বের হলো? সব দোষ তোর। তুই আজ এ সময় ওকে নিয়ে বেরুতে চেয়েছিলি। যদি কথা রাখতি ও কি লুনার কাছে যেত? ‘

বিগড়ানো মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল সৌধর৷ এই সুহাস কোনোদিন ঠিক হবে না৷ ভুল তারই হয়েছে। সুহাসের থেকে সমাধান পাবে না সে৷ অহেতুক কথা বাড়ল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। বাকি বন্ধুদের দিকে তাকাল একবার। ওরা ফিসফাস করছে। শুনতে পেল, তার হবু বউকে দেখার আগ্রহ অনেকের। কেউ কেউ আশায় ছিল আজ হবু বউকে নিয়েই আসবে। পরিচয় করাবে তাদের সঙ্গে। হঠাৎ করেই সৌধর মনে কী চাপল কে জানে? কল করল সিমরানকে। যেহেতু লুনার লাইভ চলছে সেহেতু দেখতেই পেল সিমরান কী করে।

আচমকা সৌধর কল পেয়ে কেঁপে ওঠে সিমরান। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লুনার থেকে দূরে সরে যায়৷ কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই সৌধ তিরিক্ষি মেজাজে বলে,

‘ কোথায় আছিস? ‘

ঢোক গিলে সিমরান। আমতা আমতা করে সত্যিটাই বলে সে কোথায় আছে। সত্যি বলাতে একটু ঠান্ডা হয় সৌধ। আদেশ করে,

‘ পনেরো মিনিটের মধ্যে ক্লাবের সামনে আসবি। এসে কল করবি আমাকে, অপেক্ষায় থাকলাম। ‘

আর একটা কথাও বলল না সৌধ। যা বলার সামনাসামনি বলবে। যতই বেস্ট ফ্রেন্ড হোক। মেয়েটা বিশৃঙ্খল লাইফ লিড করে৷ লুনাকে হয় ওই লাইফ ত্যাগ করতে হবে৷ নয়তো সিমরানের সাথে বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। মনে মনে কঠিন পণ করল সৌধ।

অনিরূপকে খাইয়ে শান্ত করে ফিররে এলো নিধি। বসল সৌধর পাশের সিটে৷ পুরোনো অভ্যাস তার। বরাবর সৌধর পাশের সিটটা তার জন্যই বরাদ্দ ছিল৷ সে অনুযায়ী বিনা দ্বিধায় আজো বসে পড়ে। যা সুহাসের কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে খুব৷ আবার বন্ধুত্বের জায়গা থেকে মেনে নিচ্ছে। সৌধকে ঠিক বুঝতে পারছে না সুহাস৷ কেমন শান্ত, শীতল আচরণ দিচ্ছে। শক্ত ধাঁচের মানুষ নিয়ে এই হলো সমস্যা। ভেতরে ভাঙছে না মচকাচ্ছে বোঝা মুশকিল।

গানের আসর জমে ওঠেছে৷ সৌধকে হাজার জোরাজোরি করেও গান গাওয়ানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত নিধি অনুরোধ করল। সৌধ ভেবেছিল গাইবে না৷ নিশ্চিত ছিল সুর আসবে না৷ নিধি অনুরোধ করতে করতে হঠাৎ যখন তার বাহু চেপে ধরল৷ একদম বিনা সংকোচে। চমকে ওঠল সৌধ। অনুভব করল নিধির এই স্পর্শ যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। মেনে নিতে পারছে না এই স্পর্শকে। অথচ একদিন এই স্পর্শের জন্য অভুক্তের ন্যায় অপেক্ষা করেছে সে। অবাক দৃষ্টিতে তাকায় সৌধ। সুক্ষ্মতার সাথে খেয়াল করে নিধির হালকা লাল চোখ দু’টোকে। যে চোখের ভাষা সে কোনোদিনও বুঝে ওঠতে পারেনি৷ সেই চোখের ভাষা আজ তাকে বিস্মিত করছে। কাঁদছে মেয়েটা৷ ওর মন কাঁদছে। কেন কাঁদছে? কেন কাঁদবে? প্রশ্ন গুলো তীব্র জেদ তুলে দেয় মনে। আলগোছে তীব্র অবজ্ঞায় সরিয়ে দেয় নিধির ধরে রাখা হাতটি। এরপর ওঠে গিয়ে সম্মুখে সুহাসের পাশে বসে। গিটার তুলে নিয়ে সুহাসকেও বলে আজিজের হাতের গিটারটা নিতে। সুহাস গিটার নিতেই সে কোন গান গাইবে বলে৷ এরপর দু বন্ধু গিটার বাজায়। গান গায় শুধু সৌধ একা।

—- পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে
Satellite আর cable এর হাতে
Drawing room-এ রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি
আ-হা-হা-হা, আ হা, আ-হা-হা-হা
আ হা, আ-হা-হা ——

মাথা নত সৌধর। দৃষ্টিজোড়া আবদ্ধ। একমনে গিটারে আঙুল চালাচ্ছে। মৃদু মৃদু মাথা নাড়াচ্ছে আর গাইছে। পাশে বসে সুহাস। ওর গিটারের ধ্বনি একটু বিধ্বংসী। সৌধর ধ্বনিতে যত আবেগ সুহাসের ধ্বনিতে ততই ক্রুদ্ধতা।

—- ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে
ঘুচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি
আ-হা-হা-হা, আ হা, আ-হা-হা-হা
আ হা, আ-হা-হা-হা —–

নিধির বুকের ভেতরটা অশান্ত হয়ে ওঠেছিল। যা গাঢ় হলো সৌধর গলায় পরের লিরিক শুনে,

—- ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে
ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে —–

সহসা বুকে কম্পন সৃষ্টি হলো নিধির৷ চোখ দু’টো টলমল। তারদিকে সৌধর কোনো খেয়াল নেই৷ ওর সমস্ত খেয়াল আজ নিজের দিকে। হাতে থাকা গিটারের সুরে।

—- সারি সারি মুখ আসে আর যায়
নেশাতুর চোখ TV পর্দায়
পোকামাকড়ের আগুনের সাথে সন্ধি
আ-হা-হা-হা, আ হা, আ-হা-হা-হা
আ হা, আ-হা-হা-হা–

পাশাপাশি বসে একসাথে দেখা
একসাথে নয়, আসলে যে একা
তোমার-আমার ভাড়াটের নয়া ফন্দি
আ-হা-হা-হা, আ হা, আ-হা-হা-হা
আ হা, আ-হা-হা-হা

ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে
ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে….

কেউ নিশ্চুপ। কেউ হতবিহ্বল। কেউ তীব্র ক্লেশে বিভোর। কেউ বা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গান শুনছে৷ এমনই ক্ষণে আচমকা সৌধর ফোন বেজে ওঠল। আঙুলে চলন থামে সৌধর৷ কণ্ঠে সুর বন্ধ হয়। আলগোছে পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করতেই সিমরান ভীত কণ্ঠে বলে,

‘ সৌধ ভাই, এসেছি আমি। ‘

সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দেয় সৌধ। প্রাচীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ প্রাচী ক্লাবের সামনে সিনু দাঁড়িয়ে আছে৷ নিয়ে আয় ওকে। ‘

সুহাস চমকে ওঠল। সকল বন্ধুরা প্রথমে বিস্মিত হয়। এতবড়ো চমক রেখেছিল সৌধ! ‘ হুররেএ ‘ ওরা খুশিতে হৈচৈ শুরু করে। নিধি ছেলে কোলে হতভম্ব মুখে বসে। সৌধ কি ইচ্ছে করে সিনুকে ডেকে আনল? তীব্র অসন্তুষ্টির ছাপ নিধির মুখে। বন্ধুমহলে সিমরানকে সে মেনে নিতে পারল না৷ সিমরান সুহাসের ছোটো বোন৷ আজ বাদে কাল সৌধর বউ হবে, হয়ে যায়নি তো আর। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল নিধি৷ অবিশ্বাস্য চাউনিতে তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। অনুভব করল তার বুকের ভেতর ভয়াবহ কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। ইচ্ছে করে এক্ষুনি ছুটে পালিয়ে যেতে৷ সময় থাকতে যে অনুভূতি তাকে ছুঁতে পারেনি। অসময়ে সে অনুভূতি কেন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল।
যা সৌধর মুখোমুখি হতে আরো প্রগাঢ়তায় রূপ নিচ্ছে। তবে কি বন্ধুত্বের দিকে তাকিয়ে এখানে আসা ভুল হলো? বিধ্বংসী এক ঝড়ের পূর্বাভাস নিধির বক্ষগহ্বর জুড়ে…।

| চলবে |
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৮|
বন্ধু মহলের আড্ডা কিছুক্ষণ স্থগিত। সকলে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে। খোলা দরজার সামনে কখন সৌধর হবু বউ এসে দাঁড়াবে। সেই প্রতীক্ষায় রয়েছে প্রত্যেকে। নিধির ভেতর অদ্ভুত অস্বস্তি চলছে। সে চাচ্ছে না এই অস্বস্তিতে ভুগতে। যথাসম্ভব নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে। তবু মনটা নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইছে না৷ নিধির অস্বস্তি সর্বপ্রথম ধরা পড়ে আইয়াজের চোখে৷ এরপর থেকেই আইয়াজ খেয়াল রাখতে শুরু করে নিধির দিকে। সবার মতো সৌধও বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। সুহাস খেয়াল করে বলল,

‘ প্রাচীকে না পাঠিয়ে তুই যেতে পারতিস। আমাকেও বলতে পারতিস৷ বোন আমার, আমিই নিয়ে আসতাম। ‘

সৌধ মহাবিরক্তি নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘ বোন ভক্তি খুব দেখাতে পারিস তাই না? তোর বোন এখন শুধু তোর বোন নেই। আমার হবু বউও৷ সো, আমি তাকে কীভাবে ট্রিট করব সেটা তোর থেকে শিখতে হবে না৷ শোন সুহাস, সাবধান করে দিচ্ছি আমার আর সিনুর মধ্যে ঢুকার চেষ্টা করবি না। বন্ধু আমার তুই, সেই সম্পর্কটায় চিড় যেন না ধরে। আর সিনুর বড়ো ভাই। সম্মানের জায়গাটা ঠিক রাখিস৷ আমি জানি তুই সম্পর্কের মূল্য কম বুঝিস। তার মানে এই না আমি সিনুর সঙ্গে কী করব, কীভাবে করব এসবে তুই ইন্টারফেয়ার করবি! ‘

বিস্ময়ে হতবুদ্ধি সুহাস। সে সম্পর্কের মূল্য কম বুঝে? শেষ পর্যন্ত তার ভাঙা হৃদয়ে আঘাত করল সৌধ! আর কী বলল? সিনুর সাথে কী করবে, কীভাবে করবে ওর ব্যাপার। সে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সিনু তার বোন একদম নিজের বোন৷ আদরের ছোটো বোন। তা কি সৌধ ভুলে গেছে। ক্রোধে গজগজ করতে করতে সুহাস বলল,

‘ ও তোর বউ হওয়ার আগে আমার বোন। আমি অবশ্যই ওর ব্যাপারে নাক গালাব৷ ‘

সৌধর চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল। মনে মনে বলল, ‘ বুঝেছি তোর নাকের ডগা বেশি উঁচু হয়েছে। ওয়েট নিচু করে দিচ্ছি। ‘ এরপর আশপাশে তাকিয়ে দেখল সবার মনোযোগ কোনদিকে। তার দিকে নেই৷ তাই দুর্বোধ্য হেসে সুহাসের দিকে ঝুঁকে বসে ফিসফিস করে বলল,

‘ তাহলে তো মুশকিল হয়ে গেল সুহাস। আমার বউকে আমি ওপেন ফ্রেমে লাভ বাইট দিতে পারব না। তার নির্লজ্জ, বেহায়া ভাইয়ের চোখে পড়ে গেলে আমার কলার ধরে ইন্টারফেয়ার করতে আসবে! ডিপজলের ফরমে চলে গিয়ে বলবে, মাথা নষ্ট, তুই কোন সাহসে আমার বোনকে অমন গাঢ় চুমু খেলি? ‘

সহসা চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল সুহাসের। কেশে ওঠল খুক খুক করে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সৌধকে আপাদমস্তক দেখে ঢোক গিলল। জীবনে প্রথমবার বোধহয় লজ্জা পেল ছেলেটা। স্তম্ভিত মুখ তার কিংকর্তব্য বিমূঢ়। সৌধ খেয়াল করল সুহাস লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে দারুণ মজা পেল সে। সুহাসকে জব্দ করার জম্পেশ অস্ত্র তাহলে এটাই।

ইচ্ছে করে সৌধ তাকে জব্দ করল টের পেল সুহাস। আচম্বিত ওঠে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সুহাসের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসতে লাগল সৌধ। হাসির ফাঁকে যেই ডানদিক, সম্মুখে দৃষ্টি গেল অমনি হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে গেল হাসিটা৷ বন্ধুর সঙ্গে দুষ্টুমির ছলে যে কথাটা বলেছে মনের মাঝে তা টিপটিপ বৃষ্টির মতো ঝড়তে লাগল। একদিকে নিধির অদ্ভুত দৃষ্টি অপরদিকে মনের মাঝে টিপটিপ বৃষ্টি। বৃষ্টির উৎসর্গ তার হবু বউ সিমরান। মৃদু কেশে ওঠল সৌধ। নিধির দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পা বাড়াল বাইরের দিকে। প্রাচী এখনো ভেতরে আসছে না যে? কোনো সমস্যা হলো না তো? ভাবতে ভাবতে দরজা পর্যন্ত যেতেই প্রাচী আর সিমরানের মুখোমুখি হলো।

সিমরানের মুখশ্রীতে আঁধার নেমেছে। যা দেখে সৌধর ভ্রু কুঁচকে গেল। প্রাচী কপালে ভাঁজ ফেলে চাপা গলায় বলল,

‘ সুহাস বকেছে সিনুকে। তুই নাকি কিসের লাইভ দেখেছিস ও কোন সিগারেট খোর বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিচ্ছিল! তাই সুহাসও বকল আর বলল তুইও নাকি ঝাড়বি। ‘

আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল সৌধ। সুহাসের মাথা কি একেবারেই খারাপ হয়ে গেল? সে কখন বলেছে, সিনুকে বকবে? তাও এই ভরা জলসায়? দাঁতে দাঁত চেপে ধরল সৌধ। সিমরানের দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ চোখে। বলল,

‘ আমি সুহাসের মতো মাইন্ডলেস না। বউ ডেকে এনে বন্ধুদের সামনে ঝাড়ার পিণ্ড নিয়ে জন্মায়নি আমি। ‘

অকস্মাৎ চমকে নত দৃষ্টি উঁচু করল সিমরান। সৌধর ভারিক্কি মুখাবয়ব, গভীর, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়ায় দৃষ্টি মিলতেই সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল৷ নিমেষে দৃষ্টি সরিয়ে নিল, ভয় শূন্য হৃদয়ে। শরীরের প্রতিটি ইন্দ্রিয় যেন জানিয়ে দিল ‘ এ দৃষ্টি ভয়ের নয় সিনু, এ দৃষ্টি প্রথম প্রহরের প্রণয়াবেগের। ‘ এমনিতেই রোদ মাথায় এসেছে। ফর্সা ত্বকে রোদ পড়ে লালচে হয়েছিল৷ তার ওপর সৌধর মুখে হবু বউ থেকে সোজা বউ শুনে বুকের ভেতর ঢেউ খেলে গেল। বুক ভর্তি পানিতে যেন ছলাৎ ছলাৎ তরঙ্গ বইছে। কান দু’টোয় ছুঁয়ে দিচ্ছে উষ্ণ বাতাস। চারপাশে এত মানুষ। অথচ সিমরানের সেদিকে হুঁশ নেই। সে বিগলিত চিত্তে লজ্জা মাখা মুখশ্রীতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। সৌধ কখন প্রাচীকে ইশারা করে তাকে ভেতরে নিয়ে বসাতে বলেছে খেয়ালই করল না। যখন হুঁশ ফিরল নিজেকে আবিষ্কার করল পরিচিত, অপরিচিত বহু চোখের সম্মুখে। নেই শুধু সৌধ আর সুহাস।

সৌধর বন্ধুরা খুবই বিনয়ের স্বরে কথা বলছে সিমরানের সাথে। যারা চেনে তারাও আজ যেন নতুন করে আলাপে মেতেছে। ভাবি, ভাবি ডাকে পুরো ঘরটা মুখরিত। সিমরান লজ্জায় টইটম্বুর। এত সম্মান, এত প্রাধান্য। কার জন্য? ডক্টর সৌধ চৌধুরীর জন্যই তো। এতকিছুর ভীড়ে সিমরান ভুলেই গিয়েছিল, এখানে ছেলে সমেত নিধি উপস্থিত আছে৷ সবার সঙ্গে আলাপচারিতা, আজিজের দুষ্টুমি উপভোগ করতে করতে হঠাৎ নিধির দিকে দৃষ্টি পড়ল। নিধি তাকিয়েই ছিল তার দিকে। তাই চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসল নিধি। সিমরানের এত্ত অপরাধবোধ হলো। মনে মনে ইশ বলেই ওঠে গিয়ে নিধির পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছো নিধি আপু? তোমার ছেলে! ওয়াও কী কিউট। ‘

অনিরূপের গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিল সিমরান। নিধি বলল,

‘ ভালো আছি। তুই? ‘

সে জানে সিমরান খুব ভালো আছে৷ ভালো থাকারই কথা৷ তবু আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে জিজ্ঞেস করল। সিমরান অমায়িক একটা হাসি দিয়ে বলল,

‘ ভালো আছি। বাবুকে কোলে নিই? ‘

অনিরূপকে এগিয়ে দিল নিধি। সিমরান ওকে কোলে নিয়ে গুলুমুলু গালে চুমু খেল সযত্নে। নিধি অপলকভাবে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা৷ কী স্নিগ্ধ, কী প্রশান্তিমাখা হাসি। কী দারুণ সুখী একটা মেয়ে। যেন পৃথিবীর সমস্ত প্রাপ্তি তার হাতের মুঠোয়।

সত্যিই কি তাই? স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ কি আদতেও পৃথিবীতে আছে? সিমরান কি স্বয়ংসম্পূর্ণ? একদমই না। তবু তাকে সবচেয়ে সুখী সরূপ দেখছে নিধি। নিজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটা প্রাপ্তি গোটা সিমরানকেই বদলে দিয়েছে। বড্ড লোভ জাগে, ঈর্ষা হয়। তৎক্ষনাৎ নিজেকে দমিয়ে নেয়। মস্তিষ্কে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সেদিনের সেই দৃশ্যটা। যেদিন, সিমরান তার পায়ে ধরে সৌধর ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়েছিল। অনুরোধ করেছিল সৌধকে ফিরিয়ে না দিতে৷ সিমরানের কোনো দোষ নেই। সৌধর কোনো দোষ নেই৷ তাহলে সে কেন লোভী হয়ে ওঠছে? কেন ঈর্ষা হচ্ছে তার? না এখানে আর এক মুহুর্ত থাকা যাবে না৷ নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে চলে যাওয়ার ভয়ে কুঁকড়ে গেল নিধি। দোষী তো সে নিজেও না। সবটাই ভাগ্যের দোষ। ভাগ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া এখন আর উপায় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সিমরান অনিরূপকে রূপ নামে ডেকে ডেকে আদর করছে। নিধি নিতে চাইলে সিমরান দিল না। এমতাবস্থায় সৌধ আর সুহাস এলো। দুপুরের খাবার আয়োজন হয়ে গেছে। একটু পরই খাবার পাঠিয়ে দেবে। সৌধ এসে দেখল নিধির পাশে বসে সিমরান৷ অনিরূপকে আদর করছে। সে গিয়ে সিমরানের মুখোমুখি চেয়ারটায় বসল। তাকিয়ে রইল সিমরান আর অনিরূপের দিকে। অনিরূপ ভীষণ মিশুক বাচ্চা। যে কোল পাতে তার কোলেই চলে যায়৷ আর কী সুন্দর মিশে যায়। সিমরানের সাথে খেলা করতে করতে একবার ওর চুল মুঠো ধরছে, আরেকবার ওড়না টেনে মুখে দিচ্ছে। সমস্তই খেয়াল করছিল সৌধ। এক পর্যায়ে অনিরূপ সিমরানের চুল এমন করে টেনে ধরল ব্যথায় চোখ কুঁচকে ফেলল মেয়েটা।

দেখামাত্র সৌধ তড়াক করে ওঠে এসে রয়েসয়ে অনিরূপের হাত থেকে সিমরানের চুল ছাড়িয়ে দিতে লাগল। বন্ধুরা সবাই তা দেখে হৈহৈ করে ওঠলে সুহাস ধমক দিল। ধমক দিয়ে সে নিজেও অনিরূপের হাত থেকে বোনের চুল ছাড়াতে সাহায্য করল। সৌধ বলল,

‘ আস্তে জোরে টানিস না। তাহলে চুলে আঁচ লেগে রূপের হাত কেটে যাবে। কচি হাত তো…। ‘

নিধি খেয়াল করল সিমরান, সৌধ দু’জনই অনিরূপকে শুধু রূপ বলে ডাকল। সিমরান কেন শুধু রূপ বলল জানে না৷ তবে সৌধর বলায় ব্যাখ্যা বের করল, অনি নামটা তার আর অর্পণের সঙ্গে মিলিয়ে। তাই হয়তো সৌধ ওই নামে ডাকল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি। ওঠে এসে অনিরূপকে কোলে নিয়ে বলল,

‘ সরি সরি। ওর জন্য সিনুর কষ্ট হলো। ‘

সৌধ ভ্রু কুঁচকে ফেলে বলল,

‘ সরি বলার কী আছে? ও কি বুঝতে পারে নাকি আশ্চর্য! ‘

মুখ ঘুরিয়ে নিল সৌধ। দেখল সিনু হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। সৌধ গম্ভীর গলায় বলল,

‘ ওড়না ঠিক কর। পারলে মাথায় দে। ‘

সিমরানকে কথাটা বলেই সরে গেল সৌধ৷ পরিস্থিতি গুমোট। দম বন্ধ লাগছে নিধির। তাই সুহাসকে বলল,

‘ সুহাস বাবুকে নিয়ে আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না রে। আমি বিদায় নিই। ‘

সুহাস বলল,

‘ বাবুর তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কী মাম্মা সমস্যা হচ্ছে? ‘

অনিরূপ ফোকলা দাঁতে হাসল। সুহাস বলল,

‘ দেখ ও খুব এনজয় করছে। দে আমার কোলে দে তুই ওদের সঙ্গে আড্ডা দে, চিল কর। ‘

বলেই খপ করে কোল থেকে অনিরূপকে নিয়ে পুরো ঘরময় ঘুরতে লাগল। একে একে সব বন্ধুরাই অনিরূপকে কোলে নিল। এমন ভাবে বাচ্চাটাকে মাতিয়ে রাখল যে মা এবং খিদে দু’টোর কথাই ভুলে গেল অনিরূপ।
.
.
খাবার দিয়ে গেলে ওরা সবাই মিলে খেতে বসল। খেতে খেতে গল্পও চলছিল ওদের। সৌধর পাশেই সিমরান বসেছে। নিধি আর প্রাচী ওদের সম্মুখীন হয়ে বসা। বাকি বন্ধুরাও আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খাচ্ছে। খেতে খেতে সৌধ আর সিমরানকে খেয়াল করছিল নিধি। এক বলিষ্ঠ সুদর্শন যুবকের পাশে ফিনফিনে দেহের অপরূপা যুবতী৷ দেখতে মন্দ লাগছে না৷ সৌধ যেমন সুদর্শন সিমরানও রূপ, লাবন্যে চোখ ধাঁধানো। পাশাপাশি দু’জনকে মেইড ফর ইচ আদারই লাগছে। হঠাৎ নিধির মনে পড়ল সৌধ সব সময় তাকে বলত, ‘ তুই সিম্পল মেয়ে নিধি৷ তোর এই সাধারণত্বই আমার ভালো লাগে। ‘ সে কথা মনে হতেই সিমরানকে সুক্ষ্ম চোখে দেখল। সিমরান তার মতো সাধারণ নয়৷ গর্জিয়াস মেয়ে।
সৌধর পছন্দ সাধারণ। তাহলে সিমরানকে কেন পছন্দ হলো? যে যেমন পছন্দ করে তার বিপরীত কাউকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পায়। কথাটির সত্যতা মিলল যেন। পরনে লেডিস জিন্সের সাথে হলুদ কামিজ পড়েছে সিমরান। মাথায় হলুদ রঙের জর্জেট ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেয়া৷ নতুন বউয়ের মতোই লাগছে দেখতে। বিয়ের ফুল ফুটেছে বোধহয়। মনে মনে হাসল নিধি। শুনতে পেল আজিজ সিমরানকে ডাকছে,

‘ ভাবি ও ভাবি। ‘

সিমরান ডান দিকে তাকাল। লজ্জা লাগছে তার। সৌধ নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ তাকাস না ফাইজলামি করছে। প্রয়োজনীয় কথা বলবে না। ‘

সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ঘুরিয়ে খাওয়ায় মন দিল সে। আজিজ থেমে রইল না৷ বলল,

‘ ও ভাবি আমাদের সৌধ কিন্তু মাছের কা টা বাছতে পারে না। আপনি কিন্তু বিয়ের পর এ দিকটা খেয়াল রাখবেন। যত্ন করে মাছের কা টা বেছে বেছে খাওয়াবেন। ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। সে শুনেছিল সৌধ ভাই খুব একটা মাছ খায় না৷ যেগুলোতে কা টা বেশি সেগুলো তো একদমই খায় না। তানজিম আন্টি ছোটো থেকেই ছেলেকে জোর করে মাছ খাওয়ায়। এখনো মাছ বেছে দেয় ছেলেকে। সে নিজেও তো এসবে কাঁচা। মুখ ভার হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, বাড়ি গিয়ে মাছ নিয়ে বসবে৷ মাছ বাছা শিখতে হবে তাকে। এতদিন সেও মাছ এড়িয়ে চলেছে। যখন খেয়েছে আম্মু বা ভাবি বেছে দিলে খেয়েছে। এখন আর ওভাবে চলবে না। নিজেকে পাকা করতে হবে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে সৌধর দিকে তাকাল সিমরান। বলল,

‘ এটা তো প্রয়োজনীয় কথাই। ‘

সৌধ কিছু বলল না৷ মনে মনে হাসল৷ আজিজ আবার ডাকল,

‘ ভাবি ও ভাবি। ‘

সিমরান একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা নত করল। আজিজ বলল,

‘ সৌধর খেয়াল রাখিয়েন হ্যাঁ? ‘

সিমরান জবাব দিল না৷ প্রাচী ব কা দিয়ে ওঠল,

‘ কী শুরু করেছিস ফা জিল? ‘

আজিজ পাত্তা না দিয়ে ফের ভাবি ভাবি করলে সৌধ গরম চোখে তাকাল। আজিজ সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হয়ে ঘুরে বসল। সৌধর খাওয়া শেষ। ওঠবে এমন সময় খেয়াল করল সিমরানের বা হাতের পিঠে লম্বা লাল দাগ। সদ্যই আঁচ লেগেছে বুঝতে পারল। ভ্রু জোড়া কুঁচকে হাতটা ধরে ওপরের দিকে ওঠিয়ে বলল,

‘ কীভাবে লাগল? ‘

চমকে ওঠল সিমরান। আমতাআমতা করে বলল,

‘ রিকশা থেকে নামতে গিয়ে। ‘

সৌধ কা টা স্থানে বুড়ো আঙুল বুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ রাস্তায় দেখেশুনে চলাফেরা করতে হয়। ‘

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল সৌধ। নিধি সবটাই খেয়াল করছিল। শেষ দৃশ্যে বুকের ভেতরটা ভার হয়ে ওঠল পুরোনো স্মৃতি মনে করে। চোখ দু’টো শত চেষ্টায়ও আর স্বচ্ছ রাখতে পারল না৷ ঝাপসা হয়ে ওঠল আপনাআপনি। সৌধ কতটা কেয়ারিং ছেলে সে জানে। সিমরানের প্রতি ওর ভালোবাসা কতটুকু তৈরি হয়েছে জানে না৷ কিন্তু আজ যে সব দৃশ্যের সম্মুখীন হলো, এতে স্পষ্ট বুঝতে পারল, সৌধ আর তার অভাবে ভুগছে না৷ সে অযথাই কষ্ট পাচ্ছে, অহেতুক নিজেকে অপরাধী করে বেঁচে আছে। বুকটা কেঁপে ওঠল তক্ষুনি। অহেতুক? অযথা? সে চোখ থাকতেও অন্ধ, বোধ থাকতেও নির্বোধ হয়ে অপরাধ করেনি? এই যে বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। এই যে আফসোস নামক ঝড় বইছে এগুলোর দায় কার? তারই তো? গলা দিয়ে আর খাবার নামল না নিধির। অজান্তেই দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল। নিমেষে তা আবার মুছেও নিল। অঘটন অবশ্য ঘটে গেল একটা৷ আইয়াজ দূর থেকে তার কান্না দেখে ফেলল!
.
.
খাওয়াদাওয়া শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে ওঠেছে৷ পাশাপাশি বসে আছে সৌধ, সিমরান৷ ওদেরকে ঘিরেই সকল আনুষ্ঠানিকতা। নিজেকে খুব নিকৃষ্ট লাগছে নিধির। এতগুলো দিন ধরে নিজেকে বহুভাবে গুছিয়ে নিয়েছিল। আজ চোখের সামনে সৌধর পাশে সিমরানকে দেখে। দু’চোখ ভরে সিমরানের সুখ দেখে তার হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তীব্র। অথচ সে কষ্ট পেতে চায় না৷ সে মন, প্রাণ ভরে সৌধ, সিনুর সুখ প্রার্থনা করে। নিজের মনের এই টানাপোড়েন থামাতে না পেরে শেষে মিথ্যার আশ্রয় নিল সে৷ হঠাৎ করেই বলল,

‘ অর্পণ ম্যাসেজ করেছে রে। ওর নাকি শরীর খারাপ। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। ‘

আকস্মিক কথায় সকলে থমকে গেল৷ নিধি চলে যাবে এত তাড়াতাড়ি? সৌধ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল একবার৷ নিধির চোখ, মুখ দেখে মাথা নত করল। বিরবিরিয়ে বলল,

‘ লায়ার। ‘

পাশে বসা সিমরান স্পষ্ট শুনল শব্দটি। বিস্মিত চোখে তাকাল সৌধর পানে৷ সৌধ খেয়াল করল সিনু তাকিয়েছে তার দিকে। তাই ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ ও মিথ্যা বলছে। ‘

সিমরানের বুকের ভেতর চিড়িক দিয়ে ওঠল। সে যে ভালোবাসে। তাই তো দেখতে পারে ভালোবাসার যন্ত্রণা। থমথমে গলায় সিমরান বলল,

‘ তুমি চাও নিধি আপু না যাক? ‘

সৌধ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

‘ থাকলেই কি না থাকলেই কী? ‘

‘ তুমি এখনো নিধি আপুকে ভালোবাসো? ‘

সহসা চোখ দু’টো দৃঢ় হয়ে ওঠল সৌধর। শক্ত, নিচু গলায় বলল,

‘ এখন এসব প্রশ্ন করার সময়? আমি তোর সাথে বেড রুমে আছি? ‘

‘ সরি। ‘

অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল সিমরান। এদিকে নিধি সকলের থেকে বিদায় নিয়ে সৌধ আর সিমরানের সামনে এলো। মুখে মিথ্যে হাসির রেখা ফুটালেও মন থেকে বলল,

‘ সৌধ, সিনু তোদের জন্য শুভকামনা। অনেক ভালো থাক তোরা৷ ‘

এরপর সিমরানের মুখোমুখি হয়ে সিমরানকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল৷ কানে কানে বলল,

‘ সৌধকে ভালো রাখিস। সুখী হোস তোরা। ‘

আর এক মুহুর্ত দেরি করল না নিধি৷ সুহাসের থেকে অনিরূপকে কোলে তুলে নিল৷ সবাই ওকে নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেও রিকশা না পাওয়া পর্যন্ত পাশে থেকে গেল শুধু আইয়াজ।
.
.
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে এসে পড়েছে নিধি, আইয়াজ৷ নিধির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আইয়াজের। তাই সেই বলল, কিছুক্ষণ হাঁটতে। একটু অপেক্ষা করে বাসায় যেতে৷ এ মুহুর্তে একাকী কারো সঙ্গ প্রয়োজন ছিল নিধির৷ যে তাকে বুঝবে, সম্পূর্ণ মনোযোগ তাকে দিয়ে সময় দেবে। আইয়াজ বলল,

‘ অর্পণ স্যারের টেক্সট করার বিষয়টা মিথ্যা। বুঝেছিলাম আমি। ‘

বাঁকা হেসে নিধি বলল,

‘ এত বুঝিস ক্যান তুই? ‘

ঠোঁট কামড়ে আলতো হাসল আইয়াজ৷ অকস্মাৎ বলল,

‘ তুই এখন ফিল করছিস সৌধকে ভালোবাসিস রাইট? ‘

থমকে দাঁড়াল নিধি। অনিরূপকে কোলে নিতে ইশারা করল৷ আইয়াজ অনিরূপকে কোলে নিলে সে বসে পড়ল ডান পাশের বটগাছের শিকড়ের ওপর। বুকের ভেতর থেকে উপচে আসা কান্না গুলো গিলে ফেলে বলল,

‘ আমি মরে যাচ্ছি আয়াজ, আমি মরে যাচ্ছি। ‘

হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে আইয়াজ গিয়ে নিধির পাশে বসল। ধীরস্থির গলায় বলল,

‘ শান্ত হো নিধি। আমার কথা শোন। ‘

‘ এখানটায় ভীষণ জ্বলছে আয়াজ।
মরে যাচ্ছি আমি। দেখ নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ‘

বুকের বা’পাশে হাত রেখে নিধি ছটফট করছিল। আইয়াজ বলল,

‘ কিচ্ছু হচ্ছে না, কিছুই হবে না৷ জাস্ট শান্ত কর নিজেকে। আমার কথা শোন। ‘

ওড়নার কোণা মুখে চেপে হুহু করে কেঁদে ফেলল নিধি৷ বলল,

‘ আমি সৌধর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি রে। আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আমার সাথে। আমি সৌধকে ঠকাইনি। আমি আসলে ঠকিয়েছি আমাকে।’

‘ আমরা সবাই সেটা জানি৷ সৌধ নিজেও জানে। ‘

চমকে গেল নিধি। বিস্মিত হয়ে বলল,

‘ সৌধ জানে! ‘

‘ এসব এখন বাদ দে। আমি তোকে কিছু কথা বলতে চাই। কথাগুলো যদি শুনতে চাস কান্না থামিয়ে চোখের পানি মোছ। ‘

বাচ্চাদের মতো অসহায় ভঙ্গিতে আইয়াজের কথা মেনে নিল নিধি। আইয়াজ খুব আহত হলো নিধির এই রূপ দেখে। কী সুন্দর প্রাণোচ্ছল, শক্তিশালী মেয়েটা কীভাবে মনের দ্বন্দ্বে অসহায় হয়ে পড়ল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল আইয়াজ,

‘ “Sometimes you don’t know what you’ve got until it’s gone!” মাঝে মাঝে তুমি জানো না যে তুমি কি পেয়েছো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা হারিয়ে যায়!’

‘ আমার সাথে এটাই হয়েছে। ‘

দৃঢ় স্বর নিধির৷ আইয়াজ স্মিত হেসে বলল,

‘ হয়নি তবে হতে পারে। যদি তুই তোর ভুল অনুভূতি থেকে সরে না দাঁড়াস। ‘

‘ মানে? ‘

‘ যা চলে গেছে, যা পাসনি তা নিয়ে আমি বলতে চাই না। আমি বলব, যা পেয়েছিস তাই নিয়ে। সৌধকে তুই পাসনি৷ সো ওই চ্যাপ্টার ক্লোজ। তুই কাকে পেয়েছিস বল? অর্পণ স্যার আর অনিরূপ। তুই ওদের মূল্যটা বুঝছিস না। অন্ধ হয়ে আছিস সেই মানুষটাকে ঘিরে। যে আজ বাদে কাল অন্য একজনের হয়ে যাবে। ‘

থামল আইয়াজ। নিধি স্তম্ভিত। আইয়াজ ফের বলল,

‘ আমি অত্যন্ত লজ্জিত সেই দিনটার জন্য। শুধু আমি না আমরা তিন বন্ধুই লজ্জিত। যেদিন না জেনে না শুনে স্যারের ওপর হাত তুলেছিলাম। এরজন্য একদিন তাকে সরি বলে দিব। অজানা ভুল ছিল ওটা। নিধি, আসল ভুল তোর ছিল। তুই আমাদের জানাসনি তোর বিয়ের কথা৷ যেভাবেই বিয়ে হোক। হয়েছে তো? আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড। সৌধকে জানাতে অসুবিধা ছিল আমাকে বা সুহাসকে জানাতে পারতিস৷ যাক সে কথা। জানাসনি, প্রচণ্ড গোলমাল হয়েছে ফলসরূপ। কিন্তু এরপর থেকে যা সব হচ্ছে। তার জন্য আমরা মোটেও তোর ওপর সন্তুষ্ট নই। যে সৌধ ভেঙে পড়েছিল তোর বিয়ের কথা শুনে। যে সৌধ অর্পণ স্যারকে খু ন করার হুমকি দিয়েছে সেই সৌধও তোর ওপর অসন্তুষ্ট। কেন জানিস? তুই ওকে বাছাই না করে অর্পণ স্যারকে করেছিস এ জন্য না। হ্যাঁ এজন্য ও দুঃখ পেয়েছে। তীব্র যন্ত্রণায় ভুগেছে। যার রেশ আজো রয়ে গেছে। কিন্তু ও অসন্তুষ্ট এ জন্য যে অনেকগুলো বছর ধরে ও যাকে ভালোবেসে আসল। তাকে ও ভুল চিনেছে। তুই সব সময় তোর সিদ্ধান্তে অটুট থেকেছিস। সবসময় ন্যায়, অন্যায়, সঠিক, ভুল বিবেচনা করে চলেছিস। সেই তুই কীভাবে অর্পণ স্যারের প্রতি অন্যায় করিস। তা আমরা কেউই মেনে নিতে পারি না৷ আমরা সবাই তোর ভালো চাই। তুই নিজের মনকে স্থির কর নিধি। আজ যা পেয়েছিস তা ধরে রাখ৷ এক জীবনে একই ভুল দু’বার করিস না। তাহলে তোর প্রতি যতটুকু সম্মান আছে তা আর থাকবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা এখনো আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আগের স্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব৷ কিন্তু তুই যদি তোর বৈবাহিক জীবনে সুখী না হোস৷ তবু তোরই ভুলে। তাহলে সৌধ তোকে ছাড়বে না। না বন্ধুত্ব রাখবে আর না তোকে। ‘

‘ কী করবে ও? মেরে ফেলবে আমাকে? ‘

‘ মরেই তো আছিস। দেহ টুকুর বিদায় দেবে। ‘

মুখাবয়ব শক্ত হয়ে ওঠল নিধির। আইয়াজ ওর মাথায় একহাত রেখে বলল,

‘ শান্তি, শান্তি। ‘

সহসা নরম হলো মেয়েটা। ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আমি খুব খারাপ আয়াজ। আমি খুব খারাপ। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি মন থেকে চাই ওরা ভালো থাকুক। প্রার্থনা করি, ওদের দেখে আমার মনের যন্ত্রণা না বাড়ুক। ‘

‘ তুই খুব ভালো মেয়ে নিধি। আমরা সবাই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আমাদের দ্বারা ভুল হবেই৷ সেই ভুল শুধরে নিতে হবে শুধরানোর সুযোগ না থাকলে দ্বিতীয় বার যেন একই ভুল না হয় সচেতন থাকতে হবে। ‘

নিশ্চুপ নিধি। আইয়াজ বলল,

‘ বাসায় যা। গিয়ে অর্পণ স্যারের সঙ্গে কথা বল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখ মানুষটাকে। উনি তোর সন্তানের বাবা। যার সন্তান তোকে মা ডাকে তার বুকে একবার মাথা রাখ। দেখবি পৃথিবীতে তোর মতো সুখী মেয়ে আর একটিও নেই। ‘

আইয়াজের কথা শুনে শরীরে কাঁ টা দিয়ে ওঠল। বুকে কম্পন ধরল খুব৷ আইয়াজ জিজ্ঞেস করল,

‘ স্যার তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে? ‘

নিধি মাথা নাড়ল। না করে না। আইয়াজ বলল,

‘ তোরা একসঙ্গে ঘুমাস? ‘

‘ হু। ‘

‘ লাস্ট কবে চুমু খেয়েছিস তোরা? ‘

একটু চমকাল নিধি৷ মনে করতে পারল না। ভাবল, অনিরূপ পেটে আসার আগে লাস্ট ঘনিষ্ঠ হবার সময়ই বোধহয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আইয়াজ বলল,

‘ লাস্ট কবে ইন্টিমেট হয়েছিস? ‘

‘ অনিরূপ পেটে আসার আগে। ‘

‘ হোয়াট! কী সমস্যা, স্যার কি ইন্টারেস্টেড না? ‘

‘ উনার সঙ্গে আমি খুব খারাপ বিহেইভ করিরে। কী করব বল? ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে মানসিক রোগি হয়ে গেছি। উনি আমার সাথে কথা বললেই মেজাজ গরম হয়। শরীরে টাচ করলেই মাথায় আগুন ধরে যায়। ‘

ধমক দিল আইয়াজ। নিধি বলল,

‘ এত সিরিয়াস হয়ে কথা বলিস না । অচেনা লাগে। ‘

‘ তুই অচেনা হয়ে গেছিস নিধি। এটা তুই না৷ এই জীবন তোকে মানায় না। ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শোন, আজ গিয়ে তুই স্যারের সঙ্গে সময় কাটাবি। নাহ শোন এক্ষুনি বাসায় যাবি স্যার সামনে আসা মাত্র জড়িয়ে ধরবি শক্ত করে৷ যা হারিয়েছিস তা নিয়ে আফসোস না করে যা পেয়েছিস তা আঁকড়ে ধর দোস্ত প্লিজ। অর্পণ স্যার তোর শত্রু নয় এ পৃথিবীতে এখন সেই তোর সবচেয়ে আপন মানুষ। অনিরূপের বাবা অর্পণ স্যার, তোর স্বামী। ‘
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৫৪+৫৫+৫৬

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৪|
গোধূলি বিকেল৷ দু’কাপ চা বানালো ফারাহ৷ সুহাসের ঘরের বেলকনিতে আইয়াজ, সুহাস বসে আছে নিশ্চুপ। চায়ের কাপ দু’টো নিয়ে সেখানেই উপস্থিত হলো সে৷ ভীষণ মাথা ধরেছে সুহাসের৷ আইয়াজের মুখটা এখনো হতভম্ব। চোখের পলকে কতকিছু ঘটে গেল৷ সে নীরব দর্শক হয়েও দোষের ভাগিদার। কেবলমাত্র বন্ধু সৌধর চোখে৷ ফারাহ চা নিয়ে এসেছে দেখে মৃদু হেসে চা নিল৷ সুহাসকে নিতে ইশারা করলে সুহাস চিন্তিত মুখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ সিনু কী করছে? কিছু বলেছে ও? ‘

ফারাহ চা এগিয়ে দিল। সুহাস কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল ধীরস্থির ভাবে। ফারাহ বসল আইয়াজের পাশে। বিনয়ের সুরে বলল,

‘ পোশাক পাল্টে, সাজ ধুয়ে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়েছে। ঘুমিয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় ওর একটু সময় দরকার। যা কিছু ঘটে গেল এর জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না ঠিকই৷ কিন্তু সিনু এতে একটুও অখুশি হয়নি। কারণ ওর চোখেমুখে গতকাল থেকে যে বেদনার সুর ভাসছিল সেটা এখন আর নেই। ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস৷ আইয়াজকে বলল,

‘ সৌধকে ফোন কর তো। ‘

আইয়াজ চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

‘ সরি দোস্ত। আমি ফোন করতে পারব না। তুই কর। ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল সুহাস। চাপা ক্রোধ প্রকাশে বলল,

‘ আমি করব মানে? ও আমার কথা শুনবে? কোনো কোশ্চেন করলে আনসার দেবে? রাগ দেখাবে, জেদ দেখাবে। আর কিছু বড়োলোকি গালি ছুঁড়বে। ‘

‘ তোর কি মনে হয় আমি সৌধর গুরু? ফোন দিলেই ভক্তির সাথে রিসিভ করবে। কোনো প্রশ্ন করলে গড়গড় করে উত্তর দেবে? ‘

আইয়াজও চটে গেল৷ ওদের দু’জনকে থামালো ফারাহ৷ আইয়াজের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ উফফ চুপ করবে? নিজেদের মধ্যে ঝামেলা পাকাচ্ছ কেন? ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করো সব। ‘

এরপর সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ সুহাস ভাইয়া, আমার মনে হয় সৌধ ভাই হুটহাট ডিসিশন নেয়ার মানুষ নন। উনি যখন সিনুকে বিয়ে করার কথা জানিয়েছে। নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই জানিয়েছে। সুজা আংকেল যখন ইনভলভ আমাদের চিন্তা করার কী দরকার? তাছাড়া যেখানে সিনু সৌধ ভাইয়াকে ভালোবাসে। সৌধ ভাইয়াও রাজি হয়েছে। বেশ জোরালো ভাবেই৷ সেখানে এত দুঃশ্চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। এবার যা করার দু বাড়ির সিনিয়র পার্সনরাই করুক।’

ফারাহর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে সুহাস। ফারাহ কথার সমাপ্তি দিতেই সে বলল,

‘ ও আমার বোনকে ভালোবাসতে পারবে? ‘

ফারাহ বলল,

‘ কেন পারবে না? সিনু অবশ্যই সৌধ ভাইয়ার ভালোবাসা ডিজার্ভ করে। ‘

‘ আমি মেনে নিতে পারছি না। সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। চোখের সামনে ওসব দেখে বোনের স্বামী হিসেবে… ‘

আইয়াজ বিস্মিত গলায় বলল,

‘ ওসব মানে কোন সব দেখেছিস? কী বলছিস তুই? ‘

চমকাল সুহাস। আমতা আমতা করে বলল,

‘ তুই গভীরে নিয়ে গেলি কথাটা৷ আমি সিম্পল ভাবে বলেছি। ‘

আসক্তিহীন কথাটা বলেই ফের তীব্র উত্তেজনা নিয়ে বলল,

‘ সৌধ আর সিনু! ব্যাপারটা কেমন লাগছে না? আমার ছোটো বোনের স্বামী হবে সৌধ৷ আমার শরীর খারাপ করছে ভাবতেই। ‘

আচমকা আইয়াজ দু-হাত বাড়িয়ে সুহাসের দুগাল ধরল। এদিক, ওদিক ঘুরিয়ে ভাবুক কণ্ঠে বলল,

‘ কীরে দোস্ত তুই কি আরো একটা ছ্যাঁকা খেতে চলেছিস? ‘

‘ মানে? ‘

চাপা হাসল আইয়াজ৷ ফারাহ টের পেয়ে মুখ লুকিয়ে হাসল৷ আইয়াজ বলল,

‘ ভাবি সাহেবা ভ্যানিশ হওয়ায় বড়ো মাপের ছ্যাঁকার পাশাপাশি বন্ধুর বউ তোর বোন হবে এটা কি কম ছ্যাঁকা নাকি?’

‘ আইয়াজ! ‘

চোখ রাঙালো সুহাস৷ আইয়াজ কিঞ্চিৎ দূরে সরে গিয়ে হাসতে থাকল। সুহাস রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

‘ মজা নেস? ফারাহ তুমি জানো তোমার সাথে প্রেম হবার আগে আইয়াজ কী করেছে? ‘

‘ কী করেছে? ‘

তীব্র উৎসুকভাব ফারাহর। সুহাস যেন তারই সুযোগ নিল৷ আইয়াজের বিরুদ্ধে নারী ক্যালেঙ্কারির বিস্তর এক বর্ণনা দিল সে৷ ফারাহ চুপচাপ শুনল। এরপর শীতল দৃষ্টিতে তাকালো আইয়াজের দিকে। দু’জোড়া চশমা এক হতেই আইয়াজ থমথমে গলায় বলল,

‘ আমি জানি তুমি বিশ্বাস করোনি ওর কথা। ‘

ফারাহ দৃঢ় গলায় বলল,

‘ তুমি ভুল জানো। আমি সুহাস ভাইকেই বিশ্বাস করেছি। ‘

নিমেষে আইয়াজের মুখটা চুপসে গেল। সুহাস এবার হো হো করে হাসতে লাগল। ফারাহ গোপনে গোপনে হাসলেও গম্ভীর হয়ে রইল প্রকাশ্যে। যা আইজারের বুকের ভেতর বাজনা বাজালো দ্রিমদ্রিম! সে শান্তশিষ্ট, ঝকঝকে হৃদয়ের অধিকারী। কোনো মানে হয় বউয়ের কাছে এভাবে ফাঁসিয়ে দেয়ার? ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। সুহাসের দিকে তাকিয়ে রইল নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে। সুহাস ওর দৃষ্টি খেয়াল করে দাঁত ক্যালিয়ে বলল,

‘ কী মাম্মা তাকাই থাকো ক্যান টাকা পাও নাকি? ‘

আইয়াজ বিরবির করে বলল,

‘ হিটলার কোথাকার! পারবি শুধু আমার সাথে। বউ আর বোন যে বাঁশ দিতেছে ওটা ঠেকাতে পারবি না। ‘
.
.
সন্ধ্যার পর। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল সিমরানের৷ ঘুম ভাঙতেই সে আশ্চর্য ভঙ্গিতে ওঠে বসল। অবিশ্বাস্য মনে বলল, ‘ আমি কখন ঘুমিয়েছি? ‘ দেহ সচল হওয়ার পাশাপাশি মস্তিষ্কও সচল হয়ে ওঠল। মনে পড়ে গেল দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। সৌধ ভাই! নামটা স্মরণ হতেই শিউরে ওঠল দেহ। ত্বরিত বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিঁটাল৷ এরপর বেরিয়েই সর্ব প্রথম ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিজের বন্ধ ফোন বের করে চার্জে ঢুকাল। সন্ধ্যা হয়েছে। সোহান খন্দকার ফারাহকে পাঠিয়েছে সিমরানকে ডাকতে। ফারাহ দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পেল সিমরান ওঠেছে। তাই মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। বলল,

‘ আংকেল ডাকছে তোমায়। ‘

মৃদুভাবে চমকে ওঠল সিমরান। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল পলকহীন। অনুভব করল, খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে৷ নিমেষে মুখটা করুণ হয়ে গেল। অনুভব করল কতকাল সে কিছু খায় না। ঠিক যেমন বিছানায় শোয়ার আগে অনুভব হচ্ছিল কতকাল সে ঘুমায় না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। অদ্ভুত গলায় ফারাহকে বলল,

‘ মানুষ একটা কিছু পাওয়ার জন্য কত স্ট্রাগল করেও পায় না৷ হতাশ হয়ে যেই স্ট্রাগল করা বাদ দেয় তখনি সফল হয়। এটা কেমন নিয়ম ফারাহ আপু? ‘

‘ কেমন নিয়ম তা জানি না। শুধু জানি ভালোবাসার স্ট্রাগলে তুমি জিতেছ মেয়ে। সৌধ ভাই তোমার মতো হীরের টুকরো চিনতে ভুল করেনি। ‘

সহসা লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠল সিমরান। সে লজ্জাটুকু আবার নিমেষে হারিয়ে গেল মুখশ্রী থেকে। নরম গলায় বলল,

‘ মোটেই হীরের টুকরো না আপু। আমি নিধি আপুর মতো গুণী মেয়ে নই। সৌধ ভাইয়ের ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য আমার হবে কিনা জানি না৷ কিন্তু এই যে হঠাৎ চমকটা পেলাম। এটার পেছনের কারণ জানা না পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। ‘

‘ আচ্ছা বুঝলাম চলো এবার আংকেল অপেক্ষায় আছে। ‘

নিচে নেমে আসার পর দেখতে পেল সোফায় বসে আছে বাবা, ভাই আর আইয়াজ ভাই। সিমরান বুঝতে পারল তারা কী নিয়ে কথা বলবে। তাই ফারাহকে জিজ্ঞেস করল,

‘ সেলিনা আপা এসেছে? ‘

ফারাহ হ্যাঁ বলতেই বলল,

‘ আমার খুব খিদে পেয়েছে আপু। সেলিনা আপাকে খাবার দিয়ে যেতে বলো এখানেই বসে খাই৷ খেতে খেতে কথা বলি আব্বুর সাথে। ‘

সেলিনা আপাকে বলল না ফারাহ। এমন একটি পরিস্থিতিতে নামীকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। নামী নেই। সে দু’দিনের অতিথি হয়ে এসেছে। তাতে কী? তার দ্বারা যতটুকু সম্ভব হচ্ছে ততটুকুই করবে। ভেবেই নিজেই খাবার বেড়ে আনল। ভাইয়ের পাশে সোফায় দু পা ওঠিয়ে হাঁটু মুড়িয়ে বসল সিমরান৷ কোলের ওপর কুশল রেখে তার ওপর ভাতের প্লেট রেখে খেতে আরম্ভ করল। দৃশ্যটা সোহান খন্দকারের এত ভালো লাগল। মায়াও হলো ভীষণ। কতদিন পর মেয়েটা তার আগ্রহের সাথে খেতে বসছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল সে৷ এরপর বলল,

‘ মামনি, তোমার আন্টি কল করেছিল। সুজা ভাইয়ের ওয়াইফ। তোমার ফোন নাকি বন্ধ? কথা বলতে চান উনি। খেয়ে কল দিও। ‘

মাথা কাত করল সিমরান। সুহাস ভেবেচিন্তে কথা বলে না। আর না তার কথাগুলো গুছাল হয়। তাই সে ফটাফট প্রশ্ন করল,

‘ তুই এখনো সৌধকে বিয়ে করতে চাস? ভেবে উত্তর দিবি। ‘

সুহাস বোনকে ভীষণ আদর করে। অন্যান্য ভাই বোনের মতো তারা সব সময় তুই তুকারি করে না। বেশিরভাগ তুমি করেই বলে। কেবল রেগে বা সিরিয়াস মুহুর্তে তুই বলে। অর্থাৎ সুসাহ এখন হয় রেগে আছে নয়তো সিরিয়াস আছে৷ টের পেল সিমরান। সোহান খন্দকার বলল,

‘ আহ হা এ আবার কেমন প্রশ্ন সুহাস। উত্তরটা কি তুমি জানো না? ‘

সিমরান ভাইয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে খেতে খেতেই বাবার দিকে তাকাল। শান্ত দৃষ্টি। সোহান খন্দকারও মেয়ের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল আবার। সিমরান বলল,

‘ আমার উত্তর না হবে না। পারিবারিক ভাবে তোমরা কথা আগাও। আমি সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে বাকি কথা পার্সনালি বলে নিব। ‘

বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুহাস৷ তার বোনকে বড়ো বড়ো লাগছে৷ এই যে কথাগুলো বলল, মনে হলো কত জ্ঞানী একটা মেয়ে। অথচ বোন তার ছোটো। কত ছোটো? অনার্স তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। বয়স বাইশ চলছে। সে এমন উত্তর দিতেই পারে। কিন্তু সুহাস মেনে নিতে হিমশিম খেলো। পরোক্ষণেই ভাবল, বোন আসলে বড়ো হচ্ছে। ধীরেধীরে আরো হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম যা তাকে মেনে নিতে হবে৷ কিন্তু সৌধকে কীভাবে মানবে? ও বন্ধু হিসেবেই ঠিক। বোন জামাই হিসেবে কি ঠিক? সৌধ ভীষণ রাগি। ওর চলন বলন আর সিমরানের চলনবলনে পার্থক্য অনেক। সহজ কথায় দু’জন ঠিক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মনের গভীর ভাবনা গুলো প্রকাশ করল সুহাস বলল,

‘ সৌধর সঙ্গে তুই মানিয়ে নিতে পারবি না সিনু। ও আর তুই সম্পূর্ণ আলাদা। তোদের ভাবনা, চিন্তা, চলাফেরা সব আলাদা। ও অনেক ম্যাচিওরড। তুই ওর পর্যায়ে ম্যাচিওর না। ভয়টা আমার এখানেই। তোদের দু’জনের মিলবে না। নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হবে। ‘

সুহাসের এহেন বক্তব্যে প্রথম বিরোধীতা করল সোহান খন্দকার,

‘ ও কী পারবে না পারবে তা তুমি কী করে বলে দিতে পারো? ‘

‘ ও আমার বোন। আর সৌধ আমার বন্ধু। আমি দু’জন সম্পর্কেই জানি বাবা। ‘

‘ আমি তোমার সম্পর্কেও জানি। সিনু অন্তত তোমার মতো গর্দভ নয়। ‘

সহসা চুপ হয়ে গেল সুহাস। তখন আইয়াজ ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ আমি যদি বলি ওরা মুদ্রার এমপি ওপিঠ বলেই ওদের কম্বিনেশন দারুণ হবে। যা নিধির সাথে হয়ে ওঠত না। ‘

সুহাস হঠাৎ রেগে গেল। সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। বহু বছর একটা মেয়ের প্রতি দুর্বলতা ছিল সিনু। আজ তোর এসব গায়ে লাগছে না৷ বিয়ের যে লাগবে না তার গ্যারান্টি কী? আমি তোকে কোনোভাবেই কষ্টে দেখতে পারব না৷ তোর হাজব্যন্ড তোকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে এটা দেখে শান্তি পেতে চাই আমি। ‘

সিমরান চুপচাপ রইল কিছুক্ষণ। তাকাল বাবার দিকে। সোহান খন্দকার ভরসার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তবু কথাগুলো বলতে লজ্জা পেল সে। না বলে উপায়ও নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ তোমার বন্ধু যখন চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসে তোমার বোনের এনগেজমেন্ট বরবাদ করেছে। তখন বিয়ের পর তোমার বোনকে ভালোবাসতেও পারবে৷ আর বললে নিধি আপুর কথা? আমি নিধি আপুর বিষয়ে জানার বহু আগে থেকে সৌধ ভাইকে ভালোবাসি। আমার পছন্দ, আমার ভালোবাসা, আমার সিদ্ধান্ত ঠুনকো নয়। এটার প্রমাণ এতদিন না পেলেও আজ পেয়েছি। যদি এক্সিডেন্টলি, আমি আমার হাজব্যন্ডের ভালোবাসা না পাই তাহলেও কখনো কষ্ট পাবো না। সারাজীবন তো আমি এটা নিয়েই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আমাকে আজ জীবিত মৃত হওয়া থেকে উদ্ধার করেছে সে। ‘

একদমে কথাগুলো বলে নিঃশ্বাস ছাড়ল সিমরান। সোহান খন্দকার মেয়ের কথা শুনে আপ্লুত চোখে তাকিয়ে রইল। সুহাস বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। আইয়াজ মনে মনে বলল,

‘ পারফেক্ট। সৌধ তো এমন কাউকেই ডিজার্ভ করে। কে বলেছে সৌধ সিনুকে ভালোবাসতে পারবে না? আমি কাগজে লিখে দিতে পারি একদিন সৌধ সিনুকে এতটাই ভালোবেসে ফেলবে যে ও নিজের প্রতিই নিজে অবাক হয়ে থাকবে! ‘

সিমরানের খাওয়া শেষ হলো ইতিমধ্যেই। সোহান খন্দকার সুহাসকে বলল,

‘ আগামী বাইশ সেপ্টেম্বর সৌধর জন্মদিন। দু’দিন ছুটিও আছে শুনলাম। হুট করে এসেছে তাই চলে যেতে হবে ওকে। একুশ তারিখ আসবে আবার। বাইশ তারিখ ওদের এনগেজমেন্ট হবে। এর পরের মাসে বিয়ে। আমাদের সিদ্ধান্ত এটাই। তোমার কিছু বলার আছে? ‘

‘ আমার বলার থাকলেই শুনছে কে? ‘

কপট রাগ দেখিয়ে সুহাস এ কথা বলতেই বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুতে ধুতে সিমরান বলল,

‘ সুহাস খন্দকারের অনুমতি না পেলে বিয়েই করব না৷ ‘

সুহাস অদ্ভুত ভাবে ভেঙচি কাটল বোনকে। বলল,

‘ আর ভালোবাসা দেখাতে হবে না। বোন খুশি থাকলেই সুহাস খুশি। ‘

ঠোঁট টিপে হাসল সিমরান৷ সুহাস বোনের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আইয়াজকে বলল,

‘ তোর বন্ধুকে বলে দিস, আমার বোনকে খুশি রাখতে হবে, সুখী করতে হবে। এর হেরফের হলে দেখে নিব আমি। ‘

আইয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ সে কী! সৌধ আমার একার বন্ধু? ‘

ফারাহ খোঁচা দিল আইয়াজকে। ফিসফিস করে বলল,

‘ আহ বলুক না। তুমি তর্ক দিও না। ‘

সোহান খন্দকার প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ কথা তাহলে ঠিকঠাক। সৌধ কাল চলে যাবে। বাকি কথা সেরে ফেলি সুজা ভাইয়ের সাথে। কী বলো সুহাস? ‘

নিচু কণ্ঠে সুহাস উত্তর দিল,

‘ ওকে। ‘
.
.
ন’টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে মাত্র ওঠল সৌধ। ফোন বাজছে তার৷ স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল, ‘সিনু’। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ওঠে ফোন কেটে দিল সে। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে গেল বাথরুমে। হাতমুখ ধুয়ে খিদে খিদে টের পেল। রুম ছেড়ে বেরুতেই দেখল তার কাজিনরা নিচে মিটিং করছে। কিসের মিটিং হতে পারে বুঝেই বিরক্ত হলো। যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই মতোন অবস্থা। দূর সম্পর্কের দু’জন কাকাত ভাই। আর ফুপাত ভাই, বোন রয়েছে সেখানে। ছোট্ট তাহানীও আছে। সে ধীর পায়ে নিচে নামতেই সবার কণ্ঠ নিচু হলো। মুখে লেপ্টে রইল মৃদু মৃদু হাসি। দূর সম্পর্কের কাকাত দুই ভাইয়ের নাম, শেখ সাদি ছোটো করে সবাই সাদি নামে ডাকে। আরেকজনের নাম, সালমান। ফুপাত ভাই শান আর ফুপাত বোন উর্মিও রয়েছে। সবাই বয়সে ছোটো। সাদি অনার্স ফোর্থ ইয়ার। সালমান ফার্স্ট ইয়ার। শানও ফোর্থ ইয়ার শুধু উর্মি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। সামনে সৌধ ভাইয়ের এনগেজমেন্ট এরপর বিয়ে৷ সেই নিয়েই তাদের উত্তেজনা এবং পরিকল্পনা চলছিল। যা সৌধ আসাতে ক্ষ্যান্ত দিল। সৌধ তার আম্মাকে ডাকল,

‘ আম্মা খেতে দিন৷ খিদে পেয়েছে। ‘

তাহানী ছুটে গেল বড়ো মায়ের কাছে। এরপর আম্মা এসে ছেলেকে খেতে দিল৷ খাওয়া শেষে সৌধ ভাই, বোনদের সাথে বসল কিছুক্ষণ। সবার পড়াশোনা কেমন চলছে? সাদি আর সালমান রাজনীতিতে যুক্ত৷ মূলত এজন্যই এ বাড়িতে তাদের আনাগোনা বেশি। চাচা এমপি কিনা…। তাই তাদের থেকে রাজনীতির খবরাখবরও নিল। এরপর আম্মাকে বলল, কাজের মেয়েকে দিয়ে তার ঘরে এক মগ কফি পাঠাতে৷ কাল ভোরে চলে যেতে হবে তাকে। তাই যতটুকু পারা যায় বিশ্রামে থাকবে এখন। নিজের ঘরে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কাজের মেয়েটা কফি দিয়ে গেলে কফির মগ হাতে চলে গেল বেলকনিতে। পকেটে ফোন ছিল। ফোন বের করে কফি খেতে খেতে কল করল সিমরানের ফোনে। রিসিভ হতে সময় নিল না। শুনতে পেল মিহি কণ্ঠের রমণীর চার শব্দের বাক্যটি,

‘ তুমি ব্যস্ত সৌধ ভাই? ‘

তখন ফোন কেটে দিয়েছে বলেই শুরুতে এমন প্রশ্ন। সৌধ সে উত্তর না দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

‘ ফোন অন না করলেও সমস্যা ছিল না। ফোন বন্ধ করাতে আমার বিন্দু পরিমাণও সমস্যা হয়নি। ‘

নিমেষে বুকের ভেতর মৃদু এক চাপ অনুভব করল সিমরান। সৌধ ভাই ফোন করেছিল তাকে?কতবার করেছিল? ইশ! মনটা খচখচ করে ওঠে। বলে,

‘ রাতে হঠাৎ ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর মন এত খারাপ ছিল যে চার্জ দেয়ার আগ্রহ পাইনি। সরি আমি। ‘

কফির মগে চুমুক দিল সৌধ। এরপর উত্তর দিল,

‘ ফোনের চার্জ কখনো হঠাৎ শেষ হয় না। আস্তেধীরেই হয়। যাক সে কথা, কী জন্য ফোন করেছিস সেটা বল। ‘

ঠোঁট কামড়াল সিমরান৷ একটু ভাবুক হলো যেন। এরপর বলল,

‘ তুমি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে? ‘

‘ জানি না। ‘

হতভম্ব হয়ে গেল মেয়েটা। এ আবার কেমন উত্তর? কেন জানো না আর জিজ্ঞেস করল না। যদি বেয়াদবি ধরে নেয়? তাই বলল,

‘ আচ্ছা। মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ‘

‘ অভিনয় আমি জানি না। মনে না এলে কিছু করা সম্ভব হয় না আমাকে দিয়ে। ‘

আচমকা চোখ দু’টোয় ঝলমলে হাসি খেলা করল সিমরানের। নরম গলায় ফের প্রশ্ন করল,

‘ আমাকে তো ভালোবাসো না তাই না? ‘

‘ না। ‘

‘ পছন্দ করো? ‘

‘ হু। ‘

‘ পারিবারিক বিয়ে তো পছন্দতেই হয় তাই না? ‘

‘ হ্যাঁ। ‘

এ পর্যায়ে সিমরান একটু রয়েসয়ে প্রশ্ন করল। এগুলোকে অবশ্য প্রশ্ন বলা যায় না৷ পরীক্ষা বলা চলে। সেই সঙ্গে নিজের ব্যাপারে সবটাই প্রকাশ করা বলে। কারণ সে নিধি আপুর মতো পারফেক্ট গার্ল না। সৌধ যেমন সঙ্গিনী চাইত সে তেমনও না। দু’টো মানুষ একসঙ্গে থাকতে হলে নিজেদের পছন্দ, অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই বলল,

‘ তোমার বউ হলে তার মাঝে কী কী গুণ থাকতে হবে বলবে? ‘

‘ কেন? ‘

‘ আসলে আমি তো অনেক কিছুই বুঝি না, পারি না। শুধু এটুকু বুঝে গেছি শুধু ভালোবাসতে পারলেই কারো বউ হয়ে ওঠা সম্ভব না৷ ‘

‘ তোর বেলায় আমার বউ হওয়া সম্ভব। ভালোবাসাটাই যথেষ্ট। ‘

সহসা বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল সিমরানের। বুকে ধুকপুকানি নিয়ে বলল,

‘ আমি এতটাই গুণহীন যে মেয়ে হয়েও শাড়ি পরা শিখিনি। ‘

‘ দরকার নেই তো। খুব দরকার পড়লে আমি শিখে নিব। ‘

বিস্ময়ে টালমাটাল সিমরান। নিঃশ্বাস আঁটকে ফের বলল,

‘ রান্নাবান্না পারি না আমি। ‘

‘ পৃথিবীর সব পুরুষকে রাঁধতে জানা মেয়ে বিয়ে করতে হবে। এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ‘

‘ ঠিকঠাক কোনো কাজই পারি না। ‘

‘ আমার বউ কাজ না পারলেও চলবে। আমাকে ভালোবাসাই তার একমাত্র কাজ। ‘

‘ জামাকাপড়ও পরিষ্কার করতে পারি না। ‘

‘ ঘর ভর্তি মেইড এনে দিব। তবু এসব ভেল্যুলেস টপিক নিয়ে মাথা ঘামাস না। রাখছি। ‘

চমকে ওঠল সিমরান৷ ত্বরিত শুধাল,

‘ তোমার কোনো প্রশ্ন নেই? ‘

‘ কেন থাকবে? তোর সম্পর্কে কী জানি না আমি? ‘

মিইয়ে গেল সিমরান। নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা রাখি। ‘

বলেই ফোন কটে দিয়ে মনে মনে বলল,

‘ আমি সব শিখে নিব সৌধ ভাই। শাড়ি পরা, রান্নাবান্না সব। বিনিময়ে সারাজীবন তোমার বুকে ঠাঁই চাই৷ আমি ভালোবাসি তোমাকে, ভীষণ ভালোবাসি। যতখানি ভালোবাসলে তোমাকে হারানোর বেদনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ততখানি ভালোবাসি। ‘
.
.
সিমরান ফোন রাখার পর। সৌধ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে ম্যাসেন্জারে ঢুকতেই দেখতে পেল তার এক বন্ধু কিছু ম্যাসেজ এবং ফটো পাঠিয়েছে। বন্ধুটির এয়ার লাইনে নতুন জব হয়েছে। ছবিতে দেখতে পেল, নিধি আর নামীকে। নিধির কোলে তার ছোট্ট ছেলে। কয়েকটা ছবি দিয়ে বন্ধু লিখেছে,

‘ নিধি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না? দেখা হয়েছিল একবার তোদের সাথে। তাই দ্বিতীয় দেখায় চিনে ফেলেছি। বিয়ে হয়ে গেছে ওর। বেবিটা কী কিউটরে। ‘

সৌধর কপালে ভাঁজ পড়ল তৎক্ষনাৎ। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাসেজ দিল,

‘ ওদের কোথায় পেলি? ‘

‘ নিধির পাশের মেয়েটার নাম নামী৷ নিধির ফ্রেন্ড বলল। আমেরিকার পারি দিল গতকাল। ওকেই বিদায় দিতে এসেছিল। পিএইচডি করতে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ফ্লাইটে ওঠার আগে রেষ্টুরেন্টে বসেছিল কিছুক্ষণ। সেখানেই দেখা। ‘

উত্তর পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সৌধ। নামী চলে গেছে দেশ ছেড়ে? সুহাসকে ছেড়ে? এতবড়ো ঘটনা কীভাবে ঘটাল মেয়েটা? সত্যি মেয়েটার দম আছে। কিন্তু কাজটা কতটুকু সঠিক হলো বুঝতে পারল না সৌধ। আর নিধি? মেজাজ বিগড়ে গেল নিমেষে। নিধি তাকে না জানাক অন্তত সুহাস, আইয়াজকে জানাতে পারত ব্যাপারটা। বিতৃষ্ণায় বুকটা ভার হয়ে ওঠল। ভাবল সুহাসকে ফোন করে বিষয়টা জানাবে। পরোক্ষণেই মত ঘুরালো। সে দেখতে চায় নিধি নিজে থেকে সুহাসকে জানায় কিনা। নামী তো চলেই গেছে। সুহাস জানতই যাবে। আলাদা করে এখনি জানানোর দরকার নেই। আপাতত অপেক্ষা নিধির মধ্যে বন্ধুত্ব কতটুকু বেঁচে আছে৷ সেটা দেখার। আবার ভাবল,
নামী কি নিধিকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে গেছে? তাহলে তো হয়েই গেল। নীতিবাদী নিধি মরে গেলেও মুখ খুলবে না। পারলে চোখ দু’টোও বুজে থাকবে। বন্ধুত্ব রসাতলে যাক। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। প্রকৃতি চন্দ্রিমায় ভরা। হাসছে যেন প্রকৃতি৷ এত হাসছে কেন চাঁদের মেয়ে চন্দ্রিমা? মুহুর্তেই সিমরানের কথা মনে পড়ল ওর। সিমরানের মুখটি এই চন্দ্রিমার মতোই স্নিগ্ধ, আদুরে৷ আজ বুঝি চন্দ্রিমার মতোই হাসছে সে? হাসবে না? মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে পাওয়ার সম্ভাবনায় এভাবেই তো হাসে৷ সে হাসি হয় স্নিগ্ধ, নরম রাতের আকাশে চন্দ্রিমার মতোই নিগূঢ় আদুরে।

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৫|
মোবাইল হাতে বসে আছে সিমরান৷ চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে সময়ের দিকে৷ আর মাত্র একঘন্টা। সৌধ ভাইয়ের ঊনত্রিশতম জন্মদিন। বুক ধুকপুক করছে। প্রতি বছরই এমন সময় পাড় করে সে৷ হৃৎপিণ্ডের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়। জন্মদিনের ছোট্ট একটা উইশ। বিনিময়ে সৌধর থেকে ছোট্ট একটি থ্যাংকস পায়। এতেই যেন এক জীবনের সকল সার্থকতা পেয়ে যায় মেয়েটা৷ অতীতে পেড়িয়ে আসা বছর গুলোর চেয়ে এ বছরের ধুকপুকানি সম্পূর্ণ আলাদা। এত বছর সৌধ জানত না সে তাকে ভালোবাসে৷ তার জন্য ওর হৃদয়ে প্রণয়ানুভূতি আছে৷ আজ জানে। হয়তো বুঝতেও পারবে এত বছর কেন বাইশ সেপ্টেম্বর এলে রাত বারোটার সময় অন্য সবার মতো সিমরানও তাকে উইশ করে। মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একবার বিছানায় শুয়ে থাকছে। আরেকবার ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগদান উপলক্ষে সিমরানের বেস্ট ফ্রেন্ড লুনা এসেছে। মা বেঁচে নেই। ভাবি থেকেও নেই। সে বার ফারাহ ছিল। আজ ফারাহও নেই। তাই বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। দিনের আলো ফুটতেই তার দুই মামা আসবে। আর চৌধুরী বাড়ির লোকজন আসবে৷ সৌধ ভাই, সুজা আংকেল, অর্থাৎ পুরুষ সদস্যরা আসবে দেরিতে। শুনেছে পারিবারিক কয়েকজন আত্মীয়, স্বজন উপস্থিত থাকবে। বন্ধু, বান্ধব কেউ এ মুহুর্তে ফ্রি নেই। ঘনিষ্ঠ যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছে, বিয়েতে আসবে। সৌধও আর জোরাজোরি করেনি৷ সবাই এখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। একটা সময় পর ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন দু ক্ষেত্রেই ব্যাপক ব্যস্ততা বেড়ে যায়। যা মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে আমাদের চলতে হয়।

লুনা খ্রিস্টান ধর্মের মেয়ে। সিমরানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে। যার সঙ্গে নিজের সুখ, দুঃখ অনায়াসে ভাগাভাগি করতে পারে সিমরান। মানুষ সব ক্ষেত্রে নিজের সুবিধাজনক একটি স্থান খুঁজে বেড়ায়। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে লুনাই হতে পেরেছে সিমরানের কমফোর্ট জোন। এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট৷ বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল লুনা৷ সময় দেখতেই লাফিয়ে ওঠে বলল,

‘ সিনু সিনু, ঊনষাট ঊনষাট। ‘

সিমরান ম্যাসেজ লিখে রেখেছে। শুধু পাঠানোর অপেক্ষা। তাই লুনাকে শান্ত করতে বেলকনি থেকে ঘরে এসে বলল,

‘ জাস্ট সেন্ট করব। ‘

হলিউড মুভি দেখছিল সৌধ। ঘড়ির কাঁটা কখন বারোটায় এসে ঠেকেছে খেয়াল করেনি৷ যখন খেয়াল করল একটু চমকাল৷ পরোক্ষণেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। আজ বাইশ সেপ্টেম্বর। সময় রাত বারোটা। তার জন্মদিন। জীবন থেকে একটা বছর হারিয়ে গেল। উহুম শুধু বছর নয়। এর সঙ্গে হারিয়েছে অনেক কিছু। চেনা এক মুখ অচেনা হয়েছে। চেনা আরো এক মুখ আরো চেনা হয়ে ওঠছে। সবই সময়ের ব্যবধান৷ ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে আলতো হাসির রেখা ফুটল সৌধর৷ সে হাসিতে অল্প ব্যথা, অল্প সুখের সংমিশ্রণ ছিল। আজ দিনের আলো ফুটে দুপুর গড়ালে বাগদান অনুষ্ঠান। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মুভি দেখায় বিরতি টেনে প্রস্তুতি নিল ঘুমানোর। গা এলিয়ে দিল নরম বিছানায়। অভ্যেস অনুযায়ী একবার মেবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াতেই দেখতে পেল, ফেসবুক নোটিফিকেশন, ম্যাসেন্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রাম মিলে হাজার খানেক ফ্যান, ফলোয়ারের উইশেষ ভীড় জমাচ্ছে। কিন্তু সৌধ সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে পরপর দু’জনের ম্যাসেজে মন দিল। প্রথম ম্যাসেজটা নিধির। ছোট্ট করে লিখেছে,
‘ হ্যাপি বার্থডে সৌধ। গড ব্লেস ইউ। ‘

দ্বিতীয় ম্যাসেজ সিমরানের। সে ইংরেজিতে গুছিয়ে লিখেছে,

‘ Happy Birthday Soudh Bhai. Only one prayer to the creator that I can make you happy and make you smile. ‘

যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ” শুভ জন্মদিন সৌধ ভাই। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি আমি যেন তোমায় সুখী করতে পারি এবং তোমার হাসি মুখের কারণ হতে পারি। ”

প্রতি বছর সিমরান জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় তাকে। সেখানে শুধু লেখা থাকে ‘ হ্যাপি বার্থডে সৌধ ভাই ‘ সে উত্তরে ধন্যবাদ জানিয়ে দেয় সৌধ। এ বছরের শুভেচ্ছায় আলাদা কিছু রয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক হিসেবে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার৷ এই আলাদা কিছুর বিনিময়ে শুঁকনো ধন্যবাদ দিতে আগ্রহ বোধ করল না। তাই লিখল,

‘ ঘুমিয়ে পড়। ‘

সিমরানকে ম্যাসেজটা দিয়েই নিধির কনভার্সেশনে
ঢুকল। শুভেচ্ছার প্রতিত্তোরে লিখল,

‘ আজ আমার আর সিনুর এনগেজমেন্ট। তুই না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিস। শেষ পর্যন্ত আমি এনগেজমেন্টের কথা না জানিয়ে পারলাম না। লুকোচুরি খেলাটা আমি ঠিক পারি না। ‘

ম্যাসেজটি দেয়ার ছ’মিনিট পর নিধির রিপ্লাই এলো,

‘ শুনেছিলাম…। তবে সিয়র ছিলাম না। আমার ওপর জেদ করে সিনুর জীবন নষ্ট করছিস না তো? বিয়েটাকে নিজের জেদে রূপান্তর করিস না। ‘

শুয়ে ছিল সৌধ। ম্যাসেজটি দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না৷ ওঠে বসল। ত্বরিত আঙুল চালিয়ে লিখে পাঠালো,

‘ সিনু আমার জেদ না। ‘

‘ ভালোবাসা? ‘

বাঁকা হেসে সৌধ লিখল,

‘ না। তবে আমার হৃদয়ের তৃতীয় নারী সিনু। আম্মা, আপার পর যার চোখে আমার জন্য স্বার্থহীন, নিখুঁত ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি আমি। ‘

লাইক ইমোজি দিল নিধি। বহু বছরের বন্ধুত্ব থেকে পুরোপুরি নিধিকে না চিনলেও এটুকু বুঝল তার কথাকে অবজ্ঞা করল নিধি। করাটা বোধহয় স্বাভাবিক। তাই বর্তমানে সিনুর প্রতি তার প্রকৃত অনুভূতিটুকু বোঝাতে সেই সঙ্গে নিধির প্রতিও তার এ মুহুর্তের অনুভূতি জানাতে লিখল,

‘ ঘুরিয়ে, প্যাঁচিয়ে কথা বলি না আমি। তুই সেই নারী যাকে ইহকালে পাওয়ার যুদ্ধে হেরে গেছি। সিনু সেই নারী যে পরকালে আমাকে পাওয়ার যুদ্ধে জিতে গেছে। সিনু আমার বউ হবে৷ সিদ্ধান্তটি আমি দেরিতে নিলেও সৃষ্টিকর্তা অনেক আগেই লিখে রেখেছেন। স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখী হো। তোর বিয়ের কার্ড পাইনি তো কী হয়েছে? আমারটা ঠিক সময় পৌঁছে যাবে। আল্লাহ হাফেজ। ‘

ম্যাসেজটি দিয়েই মৃদুভাবে ফোনটি বিছানার একপাশে ছুঁড়ে ফেলল৷ অনুভব করল বুকের বা’পাশে সেরে ওঠা ঘা’তে জ্বলছে। এ জ্বালায় আর কতদিন জ্বলতে হবে? নিধি নামক আগুনপোকার হাত থেকে কবে রেহাই পাবে? বিধ্বস্ত হৃদয়ের উত্তপ্ত, ভারিক্কি নিঃশ্বাসে ঘরময় ছন্দ তুলল। যে ছন্দে তাল হারিয়ে দু’ চোখের পাতা এক করল সৌধ৷ নিভৃতে ডান চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়ল। অতীত পিছু ছাড়ে না। সৌধর এই অতীত কখনোই পিছু ছাড়বে না৷ সে নিজেও পারবে না পুরোপুরি ছাড়তে। এজন্যই বোধহয় বলা হয় বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রণয়ানুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে নেই। পরিণয় না পেলে জ্বলতে হয় পুরো জনম ভরে৷ সময়ের স্রোতে অগ্নি জ্বালা ফিকে হয় অবশ্য কিন্তু পুরোপুরি নিঃশেষিত হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই সুপ্ত কিছু ব্যথা থাকে। থাকে ব্যর্থতা। না পাওয়ার গ্লানিতে ভুগে আজন্মকাল। পৃথিবীতে সব মানুষ এক রকম হয় না৷ কেউ প্রথমবার ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার ওঠে দাঁড়ায়। ভুলে যায় প্রথমবার না পাওয়ার বেদনাটুকু। আবার কেউ ওঠে দাঁড়ালেও ভুলতে পারে না। জীবনে দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসা সম্ভব হলেও প্রথম জনের থেকে পাওয়া আঘাত ভুলা সম্ভব হয় না৷ দীর্ঘদিন একটি আশা নিয়ে বেঁচে থাকার পর ব্যর্থ হলে কি ভুলা যায়? নিধি আজ অন্য কারো বউ। কাল সে অন্য কারো বর হবে। তাই বলে কি পুরোনো দিন গুলো মুছে যাবে? মুছবে না বলেই নতুন করে বাঁচার লড়াই করতে হয়৷
.
.
বাড়ি ভর্তি মানুষ। জাঁকজমক আমেজে পরিপূর্ণ। বাড়ির প্রতিটি কোণায় মৃদু সুখ লেপ্টে আছে৷ প্রতিটি সদস্যের মুখে ঝলমল করছে খুশিরা৷ রান্নার জন্য বাবুর্চি আনা হয়েছে। তাদের তদারকি করছে সুহাসের দুই মামা৷ সোহান খন্দকার সুজা চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। সৌধর বাড়ি থেকে কাজিন ঊর্মি আর তাহানী এসেছে। সিমরান তৈরি হচ্ছে। ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখল সুহাস। প্রত্যেকের খবরাখবর নিল। এরপর নিজের ঘরে পা বাড়াতেই হঠাৎ পা দু’টো থমকে গেল একটি ঘরের সামনে৷ যে ঘরটায় এক সময় নামী থাকত। হ্যাঁ এ বাড়িতে এই ঘরটা নামীর ব্যক্তিগত৷ সেদিন সন্ধ্যার পর তাদের মাঝে তুমুল ঝগড়া হলে সে বেরিয়ে যায়। যখন ফিরে আসে নামীকে আর নিজের ঘরে পায় না। এরপর খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখতে পায় নামী এই ঘরে শুয়ে আছে। যা দেখে নিজের ঘরে ফিরে আসে। অনুভব করে নামীর মতো তারও একা থাকা প্রয়োজন। সেই যে একা থাকতে চেয়েছিল তা ক্ষণিকের জন্য। যা নামী দীর্ঘ করে পরেরদিন সকালে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। আকস্মিক বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রণা অনুভব করে সুহাস৷ নিজের ঘরে না গিয়ে নামীর ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রয়৷ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর শরীরটা অবশ হয়ে আসতে শুরু করে। ইচ্ছে করে নামীর একান্ত ব্যক্তিগত বিছানায় গা এলিয়ে আরামদায়ক একটি ঘুম দিতে। চমকে ওঠে নিমেষে। ইচ্ছেটা এ মুহুর্তে অবাঞ্ছিত। একটু পর সৌধরা আসবে৷ সিমরান সৌধ দু’জনের জীবনেরই বিশেষ একটি দিন আজ। বোন আজ কত খুশি। চোখ, মুখে কী প্রসন্নতা! এত দীপ্তি, এত খুশিতে আঁধার নামাতে চায় না সে৷ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে ফিরে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ দৃষ্টি আটকালো একটু দূরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ওয়ারড্রবের দিকে। ভ্রু কুঁচকে গেল নিমেষে। কী ব্যাপার ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ার হালকা ফাঁক কেন? এ ঘরে তো কেউ আসে না৷ তাহলে কী নামীই এভাবে রেখে গিয়েছে? বড্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে বেরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই? মুখটা বিষণ্ন হয়ে ওঠল। ধীরপায়ে এগুলো ওয়ারড্রবের দিকে। যেই নিচু হতে যাবে অমনি সেলিনা আপা ডাক দিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ তাড়া নিয়ে বলল,

‘ সুহাস ভাই, মেহমানরা এসে পড়েছে। আপনারে খুঁজতেছে, তাড়াতাড়ি আসুন। ‘
.
.
চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা বসে আছে৷ তাদের আপ্যায়ন করছে সুহাসের দুই মামা, সুহাস আর সোহান খন্দকার। এরই মধ্যে সৌধর বড়ো ভাইয়ের ছেলে সুর কান্না শুরু করল। সৌধর বড়ো ভাই সৌরভ এখন দেশে নেই। তার স্ত্রী ঝুমায়না আর তাদের একমাত্র ছেলে সুরকে দেশে রেখে বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে গেছে সে। সুরের জন্ম কানাডায়। তার মাতুলালয়ে। ঝুমায়না জন্মসূত্রে কানাডিয়ান৷ বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশি। বাংলাদেশের গরমের সঙ্গে অভ্যস্ত না তারা৷ দু, একমাসের জন্য শশুর বাড়িতে বেড়াতে আসে তবু বেছে বেছে শীতকালে। এবার গরমে আসা হয়েছে একমাত্র দেবরের বিয়ে উপলক্ষে। তীব্র গরমে ঝুমায়নার সমস্যা হলেও মানিয়ে নিচ্ছিল৷ কিন্তু ছেলের কান্নায় আর সম্ভব হলো না। সৌধও ভাতিজা আর ভাবির অসুবিধা বুঝতে পেরে সুহাসকে বলল, তার ভাবিকে উপরে নিয়ে যেতে৷ উপরে তিনটে ঘরে এসি আছে৷ এর মধ্যে সুহাস বা সিমরান যে কারো ঘরে নিয়ে বসাতে বলল। সুহাস মাথা নেড়ে ঝুমায়না ভাবিকে নিয়ে উপরে যেতে উদ্যত হতেই সকলের দৃষ্টি আঁটকে গেল সিমরানের দিকে। সিঁড়ি পেরিয়ে কি এক হুরপরী আসছে? যাকে দেখে উপস্থিত সকলের চোখ ধাঁধিয়ে ওঠল? কাজিন ব্রাদার্সরা শুরু করে দিল ফটোগ্রাফি। হঠাৎ সকলকে থমকে যেতে দেখে সৌধও তাকাল সিঁড়ির দিকে। লাইট অরেঞ্জ কালার গর্জিয়াস গাউন পরিহিত একটি বারবি ডল যেন সিমরান। আজ তাকে দেখে বাংলাদশি তরুণী মনে হচ্ছে না। ঝুমায়না দেখতেও মারাত্মক সুন্দরী। চেহেরায় বাঙালিয়ানা নেই। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা। চুল গুলো বাদামি বর্ণ। ঝুমায়নার মুখে শোনা যায়, এক বলিউড প্রডিউসার নায়িকা হওয়ার জন্য অফার করেছিল তাকে। সৌরভের সঙ্গে সম্পর্কে না জড়ালে সে ওই জীবনটাই বেছে নিত বোধহয়। সেই ঝুমায়নার সৌন্দর্যও যেন সিমরানের পাশে ক্ষীণ হয়ে গেল আজ। একপাশে বান্ধবী লুনা আরেক পাশে ছয় বছরের তাহানী৷ মাঝখানে সিমরাম৷ গাউনের দু’পাশে ধরে এক এক করে সিঁড়ি পেরুচ্ছে। মাথায় ফ্লোরাল হেডপিস। পেছন দিয়ে লাইট অরেঞ্জ কালার লম্বা দোপাট্টা একদম পা ছুঁই ছুঁই। মুখে প্রসাধনী ব্যবহার করেছে ঠিক৷ কিন্তু সেগুলোর এত সুন্দর ফিনিশিং টেনেছে যে একদমই ন্যাচারাল লাগছে। লুনা যেন মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজিয়েছে বান্ধবীকে। এছাড়া মনের মানুষের জন্য সাজতে পারলে ভেতরে যে উৎফুল্লতা থাকে। তাও যেন সিমরানের চোখে মুখে উপচে পড়ছে। যা তার সৌন্দর্যকে গগনচুম্বী তুলে দিয়েছে। ঝুমায়না উপরে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে অপলকভাবে তাকিয়ে রইল। সিমরান নিচে নেমে এসে সকলকে সালাম দিতেই হুঁশ ফিরল তার। আশপাশে তাকিয়ে খেয়াল করল নিজের দিকে কেউ তাকিয়ে আছে কিনা। না নেই। সবার নজর এখন সিমরানের প্রতি। যা তার ভেতরে ঈর্ষার আবির্ভাব ঘটাল। তিন বছরের ছেলেটাকে কোলের বা পাশ থেকে ডান পাশে নিয়ে সুহাসকে বলল,

‘ আমার ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ উপরে নিয়ে চলুন৷ এসি ছাড়া এক মিনিট থাকা ওর জন্য যন্ত্রণার। আপনাদের ড্রয়িংরুমে এসি নেই কেন বুঝতে পারছি না! ‘

ঈষৎ বিস্ময় ঝুমায়নার কণ্ঠে। সুহাস সহজ বুদ্ধির ছেলে। সে না টিটকারি বুঝল আর না ঈর্ষা বুঝল। সে মৃদু হেসে সহজ গলায় উত্তর দিল,

‘ আপনাদের বাড়ির মতো যৌথ পরিবার নয় আমাদের। আমরা বাড়িতেই থাকি না। কালেভদ্রে আসা হয়। সিনু ওর রুমেই সর্বক্ষণ কাটায়। তাই প্রয়োজন পড়েনি। যখন প্রয়োজন মনে হবে অবশ্যই ড্রয়িংরুমে এসি লাগাব। ‘

কথা গুলো বলতে বলতে ঝুমায়নাকে নিয়ে উপরে চলে গেল। তানজিম চৌধুরী সিমরানকে নিজের পাশে বসালেন৷ সৌধর দাদুনি তীব্র অসন্তুষ্টির চোখে তাকিয়ে। সে শিক্ষিত নারী হলেও খাঁটি বাঙালি। পারিবারিক নিয়ম রীতিও মান্য করে খুব। তাই শাড়ির পরিবর্তে এসব গোলগাল চমকওয়ালা পোশাকে সিমরানকে দেখে পছন্দ করলেন না। তবু আনুষ্ঠানিকতার জন্য চুপ থাকলেন। সুজা চৌধুরী স্ত্রীকে ইশারা করলেন পারিবারিক ধারা বজায় রেখে বাগদান সেরে ফেলতে। তানজিম চৌধুরী মুচকি হেসে নিজের হ্যান্ড পার্স থেকে একটি গোল্ডের নেকলেস বের করে পরিয়ে দিলেন সিমরানকে। এরপর দাদুনিকে ইশারা করা হলো। দাদুনি হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,

‘ নাকে তো ফোঁড়া নাই৷ নাকফুল পরাব কী করে? ‘

সহসা দাদুনির কথায় সকলের মাথায় ছোটোখাটো বিস্মরণ ঘটল। দাদুনি যে কঠিন মানুষ। ঝুমায়নার মতো মেয়েকে বিয়ের দেড় বছর পর নাক ফোঁড়া করিয়ে ছেড়েছে৷ সেখানে সিমরান! ঢোক গিলল সকলেই। শান্ত রইল কেবল সুজা চৌধুরী আর সৌধ। সোহান খন্দকার এগিয়ে এসে বললেন,

‘ চাচি আমি খেয়াল করিনি বিষয়টা৷ বুঝেনই তো মা নেই। বউ মাও পড়াশোনার জন্য দূরে থাকে। সবমিলিয়ে ভুল হয়ে গেছে। ‘

সিমরান ভীত চোখে বাবার দিকে তাকাল। তার এই ট্রাডিশন একদম পছন্দ নয়। বিয়ে করে দু’হাতে চুড়ি পরে ঘুরো, নাকফুল দিয়ে ঘুরো। তবু শখ করে চুড়ি পরা যায়৷ কিন্তু নাক সুঁই দিয়ে ফুটো করে সেখানে গহনা অসম্ভব। কান ফুটো কবে কখন করিয়েছে। মনে নেই। নাক সে ফুটো করবে না । গা শিউরে ওঠল ভয়ে। এদিকে দাদুনি তীব্র রোষানলে ফেটে পড়ছে। এমনিতেই সিমরানকে পছন্দ না তার। এর ওপর এসেই দু দু’টো ভুল চোখে পড়েছে৷ মুখে আঁধার নামিয়ে বসে রইল দাদুনি৷ তানজিম চৌধুরী ছেলের দিকে তাকাল৷

শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত সৌধ। পাঞ্জাবির ওপর লাইট অরেঞ্জ কালার কটি৷ গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি। দৃঢ় চোয়ালে লেপে আছে৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য ছেঁটেছে দাঁড়ি গুলো। সিমরানের বান্ধবী লুনা সুক্ষ্ম নজরে দেখছে সৌধকে। বান্ধবীর হবু বরের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণ করল তিনটে জিনিস। এক হিরোদের মতো ফুটনেস৷ দুই স্বচ্ছ গভীর একজোড়া দৃষ্টি। আর তিন হলো ওষ্ঠজোড়ার উপরে চৌকা নাকের নিচে কিঞ্চিৎ রাজকীয় স্টাইলে রাখা মোচ। এর আগে বহুবার দূর থেকে দেখেছে। ছবিতেও দেখেছে। কিন্তু আজ এত কাছ থেকে দেখে মনে মনে বলল,
‘ বান্ধবী এত্ত হট একটা জামাই পাইতেছিস!জিতছস জান জিতছস! ‘

দাদুনির কথায় সৌধ বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু সিমরান নাক ফুটো করেনি বিষয়েটা সে জানত না৷ কেউই বোধহয় খেয়াল করেনি। নাই করতে পারে৷ বিষয়টা এত জরুরি নয়৷ ভেবেই সিমরানের দিকে তাকাল। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাবার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ছেলের ঠান্ডা চোখের ভাষা বুঝতে পেরে গজগজ করতে থাকা মায়ের দিকে তাকালেন সুজা চৌধুরী। শীতল গলায় বললেন,

‘ আম্মা নাক তো ফুটা নাই। তাহলে বাকি কাজ সেরে ফেলা যাক। ‘

দাদুনি মানতে নারাজ হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুজা চৌধুরী মাকে চোখের ভাষায় নিয়ন্ত্রণ করে ফেললেন। এরপর মুচকি হেসে মধুর স্বরে বললেন,

‘ সৌধ আংটি পরিয়ে ফেলুক। অনুমতি দিন আম্মা। ‘

দাদুনি গম্ভীর হয়ে তাকালেন সৌধর দিকে। সৌধ একপেশে হেসে ভ্রু উঁচালে বললেন,

‘ আচ্ছা পরাও। ‘

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তানজিম চৌধুরী। সৌধর কাজিন সাদি, সালমান দু’জনই ভিডিয়ো আর ফটোশুটে ব্যস্ত। শান ব্যস্ত লুনার সাথে লাইন মারার চেষ্টায়। ঊর্মি সৌধর বড়ো আপু স্মৃতিকে ভিডিয়ো কল করেছে। আদরের ভাই, প্রিয় সিনুর বাগদানে উপস্থিত থাকতে না পেরে মন খারাপ তার। হাজব্যন্ডের ছুটি না হওয়াতে আসতে পারেনি। দেশের বাইরে থাকলে যে কোনো সময় আসা সম্ভব হয় না৷ তাকে ছাড়া এনগেজমেন্ট হলেও বিয়েটা হবে সে আসার পরই। তাই ভাইয়ের এনগেজমেন্ট ভিডিও কলেই উপভোগ করল সে।

পাশাপাশি বসে সৌধ, সিমরান। সৌধ যখন আলতো হাতে সিমরানের বা’হাত ধরে ডায়মন্ডের আংটি পরাচ্ছিল৷ সে সময় আপনাআপনিই সুহাসের চোখ দু’টো মুগ্ধতায় ভরে ওঠে। তার মনে হতে থাকে এত সুন্দর দৃশ্য এ পৃথিবীতে আর দু’টি দেখেনি। আর সৌধ যখন সিমরানকে স্পর্শ করল। আংটি পরাল অনুভব করল সিমরানের হাত কাঁপছে। এতে একটু বিস্মিত হয় সে। তাকায় সিমরানের মুখশ্রীতে। দেখতে পায়, কমলার কোষের মতো ঠোঁট দু’টি তিরতির করে কাঁপছে। নিমেষে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,

‘ ভয় পাচ্ছিস? ‘

ওই স্বর সিমরান ব্যতীত কেউ শুনতে পায় না। মুখে কিছু উত্তর দিতে পারে না সিমরান। আবেগান্বিত হয়ে পড়েছে। মাথা দিয়ে না বুঝাতে গিয়েও কেঁদে ফেলে৷ তানজিম চৌধুরী কাঁধ চেপে ধরে ওর। আদরে, আহ্লাদে ভরিয়ে তুলে। সুহাস এসে সম্মুখে বসে। আদুরে কণ্ঠে বলে,

‘ কাঁদছিস কেন? একটুও কাঁদবি না৷ চুপ। ‘

ভাই কাছে আসাতে কান্না গুলো বাঁধ ভাঙে। মনে পড়ে আম্মুকে। কী অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয় হৃদয়। বোঝাতে পারবে না কাউকেই। শুধু অনুভব করে এত সুখেও কিছু একটা নেই। মা ছাড়া যে প্রতিটি সন্তানই অসম্পূর্ণ। সৌধর খারাপ লাগে। এত মানুষের ভীড়ে স্বান্তনা দেয়ার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। তবু কান্না থামাতে শান্ত চোখে তাকায়। শীতল গলায় শুধায়,

‘ কাঁদতেই থাকবি, আমাকে রিং পরাবি না ? ‘

আচমকা চুপ হয়ে যায় সিমরান। হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায় সৌধর পানে। সৌধ নিজের বা’হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘ জলদি বাগদান সম্পন্ন কর সিনু। খিদে পেয়েছে আমার। খেতে দিবি না? ‘

চলবে..
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৬|
সময় গড়াল ঢালু রাস্তায় নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ার মতো৷ বিয়ের ছুটিতে বাড়ি এসেছে সৌধ। একমাসের জন্য স্মৃতি আপু আর দুলাভাইও এসেছে৷ বড়ো ভাই সৌরভ এসেছে এক সপ্তাহ আগে। চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে মানেই বিরাট ব্যাপার। একমাস আগে থেকেই তোরজোড় শুরু হয়৷ স্মৃতিসৌধ নামক আলিশান বাড়িটা আত্মীয়স্বজনে ভরে ওঠে।

বিয়ের কেনাকাটা বাকি নেই খুব একটা। সৌধর ছুটি পেতে দেরি হয়েছে। তাই স্মৃতি আপু আর দুলাভাই মিলে সিমরানকে নিয়ে শপিং করেছে। আজ সৌধ এসেছে। তাই স্মৃতি আপু সৌধকে আদেশ করল, আগামীকাল সিমরানকে নিয়ে বেরুতে। বাকি যা কেনাকাটা আছে দু’জন মিলে সেরে নিতে বলল। স্মৃতি আপুর খুব আদরের সিমরান। সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। জানত স্মৃতি আপু। বড়ো বোন হিসেবে সব সময় সাপোর্ট করত ভাইকে৷ কিন্তু নিধির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যখন জানতে পারল সিমরান সৌধকে ভালোবাসে। তখন থেকে মনে প্রাণে সিমরানকে ভাই বউ হিসেবে চাইত৷ আজ সে চাওয়া পূরণ হতে যাচ্ছে। সিনুর কাছে শুনেছে সৌধর সঙ্গে খুব একটা কথা হয় না। এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। তবু প্রয়োজন ব্যতীত তাদের মধ্যে ফোনালাপ হয়নি। সৌধকে ভালোবাসার পাশাপাশি ভীষণ শ্রদ্ধা করে সিমরান। ভয়ও পায়। সবমিলিয়ে নিজে থেকেও ফোন করেনি৷ এই যে দূরত্ব, একে অপরের মধ্যকার জড়তা। এসব তো কাটাতে হবে? এর জন্য অবশ্যই তাদের একে অপরকে সময় দিতে হবে। বোঝাপড়া, ভাব বিনিময়, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, গভীর প্রণয়ানুভূতি সব কিছুর মিশ্রণেই তো স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্ক পূর্ণতা পাবে। বিয়ের আর মাত্র চারদিন বাকি। তবে কেন এত দূরত্ব? স্মৃতি আপু একদম মানতে পারল না। সিমরানকে কল করে জানিয়ে দিল, আগামীকাল সৌধর সঙ্গে বেরুতে হবে৷ স্মৃতি আপুর কথা শুনে সন্ধ্যাবেলা সৌধকে কল করল সিমরান। সৌধ তখন গিটার নিয়ে বসেছে মাত্র। ফোন বেজে ওঠতেই রিসিভ করে বলল,

‘ ভালো আছিস? ‘

‘ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ‘

‘ এই তো..। ‘

‘ কাল বেরুচ্ছি আমরা? ‘

‘ হু। ‘

একটুক্ষণ চুপ রইল সিমরান৷ বুকের ভেতর অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ কী করছ? ‘

‘ নাথিং। গিটার নাড়াচাড়া করছিলাম। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

ফোন কেটে দিল সিমরান। সৌধ আলতো হেসে ভাবল, সম্পর্কটা আগের মতো থাকলে সিনু এখন গান শোনার আবদার করত। আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে মেয়েটা। সেই সঙ্গে অনেক বেশি জড়তা কাজ করছে ওর মধ্যে। সারাক্ষণ ভয়ে থাকে। মেপে মেপে কথা বলে। না জানি কী বলে আর ভুল হয়ে যায়। ওই মেয়েটা এত যত্ন নিয়ে ভালোবাসতে জানে? অনেক বেশিই আশ্চর্য হয় সৌধ। বিরবির করে বলে,

‘ নারীর ছলনা পুরুষকে নরকে ধাবিত করে। আর
ভালোবাসা স্বর্গে ভাসায়। ‘

নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছে সুহাস৷ মনের বিষণ্নতা দেহে উপচে পড়ছে তার। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়। ক’দিন পর বোনের বিয়ে। কোথায় সে হাসি মুখে সকল দায়দায়িত্ব পালন করবে। বোনকে শশুর বাড়িতে পাঠাবে। তা না। সারাক্ষণ বিষণ্ন চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে সে জানতে পেরেছে নামী আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। জানিয়েছে তার শশুর। শশুরের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছে, তাদের মধ্যেকার ঝামেলার কথা বাবাকে জানায়নি নামী। কারণ, বাবা তাকে প্রশ্ন করেছিল,

‘ তোমারও বেড়াতে আসার কথা ছিল বাবা। নামী বলল কাজ পড়ে গেছে। কবে নাগাদ আসতে পারবে জানিও। ‘

সুহাস হাসিমুখে উত্তর দিয়েছে,

‘ সময় সুযোগ করে জানাব। ‘

খুব ইচ্ছে করছিল নামীর সঙ্গে একবার কথা বলতে। মুখ ফুটে বলতে পারেনি৷ নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। এ জীবনে কতশত ভুল করল সে। যখন ভুলগুলো করে তখন একবারের জন্যও অনুভব করে না, ভুল হচ্ছে। ভুলের প্রতুত্তরে মাশুল দিতে গিয়েই টের পায় মস্তবড়ো ভুল হয়ে গেছে। ভুলটা কি এতই বেশি ছিল যে এভাবে ছেড়ে চলে যাবে নামী? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। সিমরাম এলো সে সময়। ভাইয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলল,

‘ ভাবিপুকে মিস করছ? ‘

কপাল থেকে হাত সরিয়ে বোনের দিকে সরল চোখে তাকাল সুহাস। স্মিত হেসে ওঠে বসতে বসতে বলল,

‘ সিনু, বিয়ে নিয়ে, দাম্পত্য জীবন নিয়ে ভালো কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমার। খুব ভয় হচ্ছে তোকে নিয়ে। এতকিছুর পর তোর কোনো প্রকার কষ্ট দেখলে আমি সহ্য করতে পারব না। শোন, কক্ষনো কোনোকিছু লুকাবি না আমাকে। যে কোনো সমস্যায় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবি। সৌধ আমার বন্ধু তাতে কী? তোর চেয়ে বেশি প্রাধান্য আমি সৌধকে দিব না।’

সিমরানের চোখ দু’টো টলমল হয়ে ওঠল। আস্তে করে মাথা রাখল ভাইয়ের কাঁধে। একহাত নরম করে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমাকে নিয়ে টেনশন করো না তো। সৌধ ভাইয়ের সঙ্গে মাত্রই কথা হলো। কাল আমাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বের হবে।’

‘ সৌধ কল করেছিল! ‘

একটু মিথ্যার আশ্রয় নিল সিমরান। কারণ এতে তার ভাইয়া খুশি হবে। বলল,

‘ হ্যাঁ। বলল কাল বেরুবে আমার সঙ্গে। ‘

বিষণ্ন, হতাশাগ্রস্ত মুখে এক মুঠো রোদ পড়ল যেন। সিমরান প্রসঙ্গ বদলে বলল,

‘ ভাবিপুকে মিস করছি খুব। ভাবিপুও কতকিছু মিস করে গেল বলো? এক কাজ করো ভাইয়া, বিয়ের কাজ মিটে গেলে তুমি ভাবিপুর কাছে যাও। ‘

শ্বাস আঁটকে এলো সুহাসের। বলল,

‘ আমি গেলে নামী খুশি মনে স্বাগত জানাবে না। আর না ফিরে আসবে। ও যে কাজে গেছে তা শেষ করুক। যদি না ফেরে তখন দেখা যাবে। একটা সম্পর্ক তো এভাবে চলে না তাই না? শুরু থেকেই ছিন্নভিন্ন সম্পর্ক আমাদের। ও পিএইচডি শেষ করুক। এরপর সরাসরি প্রশ্ন করব, আমার সাথে থাকতে চাও কি না? ‘

মাথা তুলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সিমরান। বলল,

‘ যদি না করে? ‘

‘ ডিভোর্স করে দিব! ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। ভাই রেগে গেছে টের পেয়ে বলল,

‘ কুল ব্রো। রাগের মাথায় এসব বলছ। ঠান্ডা হয়ে কথা বলো। ভাবিপু তোমার সাথে থাকতে না চাইলে ডিভোর্স করে দেয়া অনুচিত হবে। সে রাগের মাথায় এমন সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তাই বলে তুমিও রাগ করে মেনে নিবে? তোমরা তো দু’জন দু’জনকে ভালোবাসো! ‘

‘ ভালোবাসাটাই আজ পর্যন্ত বুঝে ওঠতে পারলাম না সিনু। ‘

নিজের প্রতি তীব্র তাচ্ছিল্য ভরে কথাটা বলল সুহাস৷ সিমরানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার ভাই এত কষ্ট পাচ্ছে। তীব্র অসুখে দিন কাটাচ্ছে। আর সে সুখের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানব জীবনের এ কেমন চক্র?
.
.
সৌধর ছোটো থেকে বড়ো বেলা যত বন্ধু, বান্ধবী আছে৷ সকলকেই বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড পাঠানো হয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বান্ধবরা দু-তিন আগেই এসে পড়েছে৷ নিধির ঠিকানায়ও বিয়ের কার্ড পাঠানো হয়েছে। সবার ধারণা সে আসবে না। সৌধর আরেক বন্ধু আজিজ। সে আজ সাতসকালে এসে উপস্থিত হলো৷ এসেই হৈচৈ লাগালো। প্রাচী, আইয়াজ, আর আজিজ মিলে সিদ্ধান্ত নিল, আজ পুরোনো বন্ধুরা মিলে তাদের ক্লাব অর্থাৎ বিগবস ক্লাবে মিট করবে। আজকে সৌধর পরিকল্পনা অন্যকিছু। সিমরানকে নিয়ে বেরুবে সে। সেই পরিকল্পনা বরবাদ হলো আজিজের কলকলানিতে। সে জোঁকের মতো সবাইকে চেপে ধরল৷ কেনাকাটা কালও করা যাবে। বা সন্ধ্যায়। কিন্তু সব বন্ধুদের সন্ধ্যার পর ভাগে নাও পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে নিধি! সে তো আর বাচ্চা নিয়ে সন্ধ্যার পর বের হবে না। হাজব্যান্ডকেই বা কী জবাবদিহি করবে? সৌধ জানে না বিয়েতে নিধি আসবে কিনা। তবে আজ প্রাচীরা মিলে বিগবস ক্লাবে আসতে বলল আসার সম্ভাবনা নিরানব্বই পার্সেন্ট। তাই ভাবুক হয়ে পড়ল সৌধ। ভাবনায় বিভোর সৌধকে দেখে আজিজ বলল,

‘ কী দোস্ত, হবু ভাবিকে ম্যানেজ দিতে পারবি না? নাম্বারটা দে আমি পরিয়ে ফেলি। তাছাড়া সুহাস থাকতে চিন্তা কী? সুহাসকে কল কর। ‘

সৌধ বিরক্ত হলো। কঠিন দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল। কল দিল সিমরানকে। বুকের ভেতর অস্বস্তি হচ্ছে তার। দোটানা অনুভূতি হচ্ছে। এক মন বলছে বন্ধুদের সময় দিতে। আরেক মন প্রশ্ন তুলছে, সিনুর প্রতি অন্যায় হবে না? অবহেলা হয়ে যাবে না? সে দোটানা কাটাতেই সিমরান কল ধরলে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,

‘ আজ যদি বেরুতে না পারি? ‘

ফোনের ওপাশে চঞ্চলিত হৃদয়টা দপ করে স্থির হয়ে গেল। আশাহত স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ কোনো কাজ পড়ে গেছে? তাহলে কাল যাই… ‘

‘ হ্যাঁ, কাজ পড়ে গেছে। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

সিমরান সহজে মেনে নিল। যা সৌধর ভেতরে আরো বেশি জটলা পাকালো। নিজের প্রতি নিজেই অসন্তুষ্ট হলো কিছুটা। সিনু কি মন খারাপ করল? কাজ আছে শুনে মেনে নিল ঠিক। কিন্তু কী কাজ জানতে পারলে কষ্ট পাবে? ভাববে কি বন্ধু নয় আসলে নিধিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি আমি? আচমকা বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠল। এই মুচড়টা কেন ওঠল? সিনুর চেয়ে নিধির গুরুত্ব বেশি হোক। সৌধর ভেতরে থাকা মন এটা চায় না বলেই কী? তার ভেতরের হৃদযন্ত্র এই নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে পারল না বলেই কী তীক্ষ্ণ মুচড় অনুভব করল বুকে?

সিমরান ফোন রেখে দিতে উদ্যত হয়েছে। অমনি ত্বরিত কণ্ঠে ডাক দিল সৌধ,

‘ সিনু? ‘

চমকে ওঠল সিমরান। হাতটা কেঁপে ওঠল একটু। শুঁকনো গলায় বলল,

‘ হুহ, কিছু বলবে? ‘

ঢোক গিলল সৌধ। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আজিজ, প্রাচী, আইয়াজের দিকে একবার দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বুক চিরে বেরিয়ে এলো, রুদ্ধশ্বাস। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে স্থির রাখল সম্মুখের দেয়ালে। শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ আজিজ, প্রাচী ওরা চাইছিল আমরা পুরোনো বন্ধুরা মিলে ক্লাবে আড্ডা দিই আজ। আরো তিনদিন বাকি আছে। আগামীকাল আমরা বেরুই কী বল? আজ ওদের সময় দিই? ‘

সহসা মৃদু হাসিতে মুখ ভরে ওঠল সিমরানের। বুকের ভেতরটা যেন প্রশান্ত নদীতে রূপান্তরিত হলো। একদম মাখনের মতো নরম হয়ে গেল মন। বলল,

‘ আচ্ছা। নো প্রবলেম। আমি একটুও মন খারাপ করিনি। কাল তো যাচ্ছিই। কাল আমরা একসঙ্গে কেনাকাটা করে বাইরে খেয়ে বাড়ি ফিরব ঠিক আছে? ‘

উল্লসিত কণ্ঠ সিমরানের। সৌধ সায় দিয়ে আবার ডাকল,

‘ সিনু? ‘

‘ বলো। ‘

‘ নিধি আসতে পারে। ‘

এক নিমেষে নিভে গেল সিমরান। কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ নিধি আপু আসবে? ‘

‘ সম্ভবত। ‘

বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠল মেয়েটার। একহাতে বুকের বা’পাশে চেপে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ আচ্ছা। ‘

সৌধ নিশ্চুপ। সিমরান কিয়ৎক্ষণ নীরবতায় থেকে বলল,

‘ থ্যাংকিউ। ‘

এ পর্যায়ে একপেশে হাসল সৌধ। বলল,

‘ রাখছি। ‘

ফোন কেটে যেতেই বুকের মধ্যিখানে ফোনটা চেপে ধরে বসে রইল সিমরান। অস্বীকার করবে না। সে চায় না নিধি আপু সৌধ ভাইয়ের আশপাশে থাকুক। এই যে আজ দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতেও ঘোর আপত্তি রয়েছে তার৷ কিন্তু সৌধ ভাই নিধি আপুকে কেন্দ্র করে যে প্রাধান্যটা দিল তাকে। এতে নিজের মাঝে একদম চৌধুরী সাহেবের বউ বউ অনুভূতি টের পেল। অনুভব করল অদৃশ্য এক অধিকার বোধ। যা স্ত্রী হিসেবে প্রতিটি মেয়ের থাকে। তারও তৈরি হচ্ছে! তিন কবুল পড়েনি। তবু মনে মনে সম্পর্কের যে সমীকরণ তৈরি হয়েছে। এতেই ভবিষ্যতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে মন খারাপ অন্যদিকে নিজেকে সুখী অনুভব করল সিমরান। মনে মনে পণ করল, আজ সারাদিন যখন খুশি তখন সৌধ ভাইকে কল করবে। নিধি আপু পাশে থাকুক, কাছে থাকুক। তার কল রিসিভ করতে হবে ডক্টর সৌধ চৌধুরীকে। যতক্ষণ না সে ফোন ছাড়বে ততক্ষণ ফোন ধরে থাকতে হবে। যদি এর হেরফের হয় সে চুপ করে থাকবে না। সরাসরি চলে যাবে ক্লাবে। নিধি আপু আর সৌধ ভাই যদি পাশাপাশি বসে থাকে। সে গিয়ে মাঝখানে বসবে। মাঝখানে জায়গা না হলে একদম সৌধ ভাইয়ের কোলে ওঠে বসে থাকবে।

আবোলতাবোল ভাবনা গুলো ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওঠল মেয়েটা। আকস্মিক অনুভব করল বুকের গভীরে কোথাও একটু যন্ত্রণা হচ্ছে। যাকে পাত্তা দিতে চাইল না সে। বিরবির করে মনকে বুঝাল বলল,

‘ ওরা শুধু বন্ধু হিসেবেই মিট করছে ব্যস। কিছুই হবে না৷ কোনো ভয় নেই। যেখানে সৌধ ভাই নিজে ফোন করে কিছুটা অনুনয় সুরেই কথা বলে জানালো সবটা। সেখানে এত চিন্তা করার কিছু হয়নি। নিধি আপু ম্যারেড, বিউটিফুল একটি বেবি আছে। আর সৌধ ভাই তার সঙ্গে কমিটেড। ‘

সব অস্বস্তি দূরে ঠেলে স্বস্তি ভরে শ্বাস নিল সিমরান।
তার অবস্থা মানসিক টানাপোড়নে রূপ নিয়েছিল৷ আকস্মিক ফের কল এলো সৌধর। সিমরান অবচেতনেই রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সৌধর বিচলিত কণ্ঠস্বর,

‘ আমরা সন্ধ্যার পর বের হচ্ছি সিনু। আজ যখন কথা ছিল আজই বের হবো। এই গরমে দিনের চেয়ে সন্ধ্যাবেলাটাই বেস্ট হবে। ছ’টা ত্রিশে বাড়ির সামনে থাকব। রাখছি এখন।’

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৫১+৫২+৫৩

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫১|
সংসার জীবন সম্পর্কে ধারণা কম সিমরানের। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার তিক্ত সম্পর্কে ধারণা বেশ৷ ছোটো থেকে বাবা মায়ের মধ্যে তিক্ততা দেখে বড়ো হয়েছে। ঝগড়া, বিবাধ করে কতকাল বাবা, মা একে অপরের মুখ দেখেনি হিসেব ছাড়া। তবে শেষদিকে এসবের অবসান ঘটেছিল। আফসোস একটাই সময়টা ছিল খুবই অল্প। দুঃখের দিনগুলো এত বেশি। সুখের দিন এত অল্প কেন? উত্তর জানা নেই মেয়েটার৷ তবে এবার মনে মনে তীব্র আতঙ্কিত হলো। বাবা, মায়ের অতীত জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তো? ভাই, ভাবির জীবনে!

নামী কোথায় গিয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। সুহাসও নাছোড়বান্দা। উত্তরের জন্য পিছু পিছু বেডরুমে গেছে। নিচ থেকে স্পষ্ট তর্ক শুনতে পেল সিমরান৷ ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। আর ভালো লাগে না এসব। কবে সমাপ্তি ঘটবে এই অশান্তির? কবে একটু হাঁপ ছেড়ে নিঃশ্বাস নেবে সে।
ইদানীং বাবাকেও কেমন বিষণ্ণ লাগে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও ভালো নেই। সারাজীবন ভালো না বেসে যে নারীর সঙ্গে সংসার করল। যে নারী তাকে দু’টো সন্তানের বাবা হওয়ার সুখ দিল। সেই নারী বিয়োগে এটুকু বিষণ্নতা স্বাভাবিকই। সিমরান অনুভব করল তাদের বাড়ি থেকে সুখ বিলীন হয়ে গেছে। আর মন থেকে ওঠে গেছে শান্তি৷ তারা এখন বিরাজ করছে সুখহীন অশান্তির রাজ্যে। এ রাজ্য থেকে কবে মুক্তি পাবে সে? দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। চারপাশে দেখতে পায় শুধু ঘন অন্ধকার। একটু প্রশান্তির শ্বাস, কিঞ্চিৎ আলোর দেখা এ জন্মে পাবে তো? নিভৃতে ওর গাল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ে৷ সে অশ্রুকণা সন্তর্পণে মুছে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে হ্যান্ড পার্স আর সেলফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বুকভরে শ্বাস নিতে৷ এই দমবন্ধকর বাড়িটায় আর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না। তবু কিছুক্ষণের জন্য রেহাই পাওয়ার প্রত্যাশায় ছুটে বেরিয়ে যায়।
.
অনেকক্ষণ ধরে তর্ক করেও নামী মুখ ফুটে বলল না। কোথায় গিয়েছিল? সুহাসের ক্রোধ এবার গগনচুম্বী। নামী বুঝতে পারল তবু নিজের ক্রোধটুকু দমাতে পারল না। আপাতত সুহাসের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না৷ মাথাটা দপদপ করছে। নতুন একটি সেলোয়ার-কামিজ বের করে তোয়ালে নিয়ে বাথরুম ঢুকে পড়ল সে। সুহাস অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল সবই। নামী গোসল করে ভেজা চুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বেরুতেই ফের সে প্রশ্ন করল,

‘ কোথায় ছিলে সারাদিন? কোথায় গিয়েছিলে? ‘

বিরক্ত হলো নামী। এই ঘ্যানঘ্যান আর ভালো লাগছে না। খিদে পেয়েছে খুব। শরীরটা দুর্বল লাগছে। তাই কিছুই বলল না। চুপচাপ গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল। চুলগুলো ভালো করে মুছে নিয়ে মুখে ক্রিম লাগালো। সুহাস উত্তর না পেয়ে মুখের লাগাম হারালো এবার। বলল,

‘ কার সঙ্গে ফূর্তি করে এলি! যে বলতে লজ্জা করছে?’

নিমেষে চটে গেল নামী। তড়াক করে ওঠে এসে তর্জনী উঁচিয়ে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,

‘ মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ ডক্টর. সুহাস খন্দকার। আমার ক্যারেক্টার তোমার মতো জঘন্য নয়। ‘

‘ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কার সঙ্গে ডেটে গিয়েছিলে সেটা বলো। ‘

সুহাস ইচ্ছে করে ঘাঁটতে শুরু করল। যাতে রাগান্বিত হয়ে সত্যিটা বলে দেয় নামী। সে নিজেও জানে নামী কেমন চরিত্রের মেয়ে৷ তবু খোঁচাখুঁচির স্বভাব তার। সুহাসের মনোভাব পুরোপুরি বুঝতে পারেনি নামী৷ সকালের ঘটনাটি নিয়ে তীব্র ক্রোধে জর্জরিত ছিল সে। তাছাড়া ইদানীং ঘনঘন মেজাজ হারাচ্ছে তার। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে ত্বরিতবেগে। সবচেয়ে বড়ো কথা এই সুহাসকে তার অসহ্য লাগছে। তাই ওর বলা কথাটি মারাত্মক ভাবে আঘাত করল মাথায়। ফলশ্রুতিতে চিৎকার করে বলল,

‘ কী বললে তুমি? সবাইকে নিজের মতো চরিত্রহীন ভাবো? তোমার মতো ল’ম্পট চরিত্রের অধিকারী আমি না সুহাস খন্দকার! ‘

আকস্মিক নামীর মুখে এমন কথা শুনে সুহাসের ক্রোধও নিয়ন্ত্রণ হারালো। মস্তিষ্ক বিগড়ে গেল নিমেষে। চোখ, মুখ খিঁচিয়ে বলল,

‘ আমি চরিত্রহীন! ল’ম্পট! তুমি যদি এতই সৎ চরিত্রের অধিকারী হও। সাহস করে বলতে পারছ না কেন কোথায় গিয়েছিলে? আমি ল’ম্পট? আমি? তাহলে… তাহলে ইউ আর অ্যা বেড কিড! শুনতে পেয়েছ? ইউ আর এ বেড কিড! এজন্যই ঠিক এজন্যই স্বামীর মুখোমুখি হয়ে বলতে পারছ না সারাদিন কোথায় কার সাথে কাটিয়ে এলে। ‘

সহসা থরথর করে কেঁপে ওঠল নামী। ক্রোধে চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। শেষ পর্যন্ত বাবা, মা পর্যায়ে চলে গেল সুহাস? সে খারাপ মানুষের সন্তান? আচম্বিতে মায়ের সরল মুখটা ভেসে ওঠল চোখের পাতায়৷ মুহুর্তেই আত্মাটা হুহু করে কেঁদে ওঠল মেয়েটার। আচমকা তেড়ে এসে সুহাসের কলার চেপে ধরে বলল,

‘ আমার মৃত মাকেও ছাড়লে না তুমি! আমার মা খারাপ নয় সুহাস। আমার মা মাটির মতো মানুষ ছিল। যার সঙ্গে জোচ্চুরি করেছিল তোমার মা৷ বিশ্বাস না হলে তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। তাহলেই বুঝতে পারবে আমার মা কী ছিল? আর তুমি যে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারোনি বলে আমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছ সে মা কী ছিল। ‘

নামী কথার সমাপ্তি দিতে পারল না। নিজের মাকে জোচ্চর বলাতে সুহাসের মাঝে ভর করল পশু রূপি পৌরুষ। সহসা নামীর দু’গাল প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

‘ কী বললি! আমার মা জোচ্চর, আমার মা জোচ্চর?’

বলতে বলতে নামীর গাল চেপে ধরা অবস্থাতেই এগুতে লাগল। আর নামী পিছুতে পিছুতে একদম দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে গেল৷ পুরুষালি শক্ত চাপে গাল দু’টো ব্যথায় টন টন করে ওঠল তার। অনুভব করল তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সর্বাঙ্গ অবশ। আচমকা স্মরণ হলো, আজ দুপুরের কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের কথা। যে সময় প্রথম জানতে পারল সে মা হচ্ছে। তার গর্ভে বেড়ে ওঠছে তার আর সুহাসের ছোট্ট একটি অংশ। দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল মেয়েটার। সুহাসের ক্রোধ মিশ্রিত রক্তিম চোখে তাকিয়ে মাথা দু’দিকে নাড়াল। অর্থাৎ, সুহাসের মা জোচ্চর ছিল না। একজন মৃত মানুষকে এভাবে বলতে চায়নি নামী। ক্রোধের বশে কীভাবে বলে ফেলল জানে না। সুহাস বলেছে বলে তারও বলতে হবে? তাহলে দুজনের মধ্যে তফাৎটা কোথায় থাকল? আচমকা নিজের একটা হাত তলপেটে চলে গেল নামীর। ওখানটায় কেমন কাঁপছে। বাবা, মায়ের ঝগড়াতে ভয় পাচ্ছে কি তার ছোট্ট সোনামুনিটা? বাবা মাকে কষ্ট দিচ্ছে বলে তারও কি কষ্ট হচ্ছে খুব?
নামীর ক্রন্দনরত অসহায় মুখশ্রী দেখে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিল সুহাস৷ রাগে হিসহিসিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আর নামী ওখানেই বসে পড়ল। অঝড় কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা। চিৎকার করে কাঁদল। তার কান্নার শব্দ সিঁড়ি পেরুতে পেরুতেও শুনল সুহাস।
.
.
দেড়মাস পর:

সেদিনের পর যে সকালটা এসেছিল। সে সকালে আর নামীর দেখা পায়নি কেউ। শুধু সেদিন নয় আজ সাতচল্লিশ দিন হয়ে এলো নামীর দেখা নেই। আর না আছে কারো সঙ্গে যোগাযোগ। সেদিন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কী ঘটেছে কেউ জানে না। কিন্তু যত দিন এগুতে লাগল সুহাস যেন নিভে যেতে শুরু করল। মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত নামীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল সে। প্রথমে সবগুলো নাম্বার বন্ধ পেল। তার বাবা, আর বোন বহু আগে থেকেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ধারণা সুহাসের সাথে রাগ করে সবার সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করেছে নামী। কিন্তু সুহাসের মনে কু ডাকছে। সে জানে নামী আমেরিকা যাবে। কতদিনের জন্য সেটা জানে না। সে আর নামী গেলে বিশ, পঁচিশ দিনের জন্য যেত৷ যেহেতু সে যাচ্ছে না। তার সঙ্গে নামীর সম্পর্কের ফাটল ধরেছে। সেহেতু নামী একাই যাবে। কিন্তু গিয়ে যদি আর না আসে? এই ভয়েই নামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে ছেলেটা। ফোনে না পেয়ে নামী যেখানে থাকে সেখানে যায়৷ জানতে পারে পিএইচডি করার জন্য দেশের বাইরে যাবে নামী। কিন্তু কবে, কখন আর বর্তমানে নামী কোথায় আছে এসব কিচ্ছু জানতে পারেনি। কেউই সঠিক বলতে পারেনি।

নামীর ওখান থেকে ফিরে এসে সৌধর সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। আর কাউকে কিছু না বললেও সৌধকে খুলে বলে সবটা। সব শুনে প্রচুর গালাগাল করে সৌধ৷ হু’মকি দেয়,

‘ সামনে পেলে তোকে মে’রে তক্তা বানিয়ে দেব শা’লা। ‘

সুহাস বিষণ্ন চিত্তে জবাব দেয়,

‘ তক্তা এমনিতেই হয়ে গেছি দোস্ত। প্লিজ নামীকে খুঁজে দে। ‘

‘ তোর মতো লিজেন্ড আমি দু’টো দেখিনি। আর কতবার বউ হারাবি তুই? ‘

সুহাস ধরা গলায় বলে,

‘ আমি ভুল করেছি সৌধ৷ আমি আর পারছি না এভাবে থাকতে। আমার নামীকে চাই, আমার নামীদামিকে চাই সৌধ। ‘

‘ এক মিনিট, ফারাহর সঙ্গে কথা বলেছিস? ‘

সহসা চমকে ওঠল সুহাস৷ কোনোকিছু না বলেই ফোন কেটে দিয়ে সেই মুহুর্তেই কল করল ফারাহকে। ফারাহ রিসিভ করেই উত্তেজিত গলায় বলল,

‘ আরে সুহাস ভাইয়া, কেমন আছেন? ভাবছিলাম আপনাকে কল করব। এই নামীটার কী হয়েছে বলুন তো? ফোন অফ, ফেসবুক আইডি বন্ধ করে রেখেছে। হোয়াটসঅ্যাপেও এক্টিভ নেই। ‘

নিমেষে নিঃশ্বাস আঁটকে গেল সুহাসের। দু-চোখ বেয়ে না চাইতেও জল গড়িয়ে পড়ল৷ ফোন কেটে দিল আচমকা। ফের কল করল সৌধকে। সৌধ শুনতে পেল নাক টানার শব্দ। হকচকিয়ে বলল,

‘ কী রে ভাই! বউ হারিয়ে হাত, পা ছড়িয়ে কাঁদছিস নাকি? ‘

ধরা গলায় সুহাস বলল,

‘ ফারাহ কিচ্ছু জানে না৷ ও নিজেও নামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ‘

এ পর্যায়ে সৌধও চিন্তিত হলো। সে ডিউটিতে আছে বলে তাড়া নিয়ে বলল,

‘ দোস্ত আমি ডিউটিতে। ডিউটি শেষ করে ফোন দিই। তুই কোনো চিন্তা করিস না। নামী যেখানেই আছে ভালো আছে৷ ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। নিজেকে ভালো রাখার মন্ত্র খুব ভালো করেই জানে। নামী ভালো আছে এটুকুতেই তুই শান্ত থাক। রাগ, অভিমান করে বউ হারালে বউ খুঁজে পাওয়া যায় নো টেনশন। ‘
.
.
পরিবার নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে সোহান খন্দকার। গোপনে সে খবর পেয়েছে নামী আমেরিকায় যাওয়ার তোরজোর শুরু করেছে। ভিসা রেডি। নামীর ওপর অভিমান হলো মানুষটার৷ মেয়েটাকে এত ভালোবাসে। আর সে সুহাসের সাথে অভিমান করে তার সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিল! নিজের বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নামী৷ তাদের মাধ্যমেই জানতে পেরেছে, খুব তাড়াতাড়িই সে আমেরিকায় পারি জমাবে। তাই নামীর বাবা বন্ধু আখতারুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করেছে সোহান। নামী যাচ্ছে অসুবিধা নেই তার। নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক মেয়েটা। অনেক সময় দূরত্বও কাছে আসতে সাহায্য করে। যদি সৃষ্টিকর্তা সুহাস, নামীর সংসার চায়। তাহলে ওরা আবার এক হবে। সে আর জোরজুলুম করবে না। অনেক হয়েছে আর না৷ ছেলেমেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। তার শাসন বারণ আর মানে না। তাই যদি মানত সে এত বোঝানোর পরও, নিষেধাজ্ঞা করার পরও নামী বাড়ি ছাড়া হতো না৷ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখত না। বয়স হয়েছে সোহানের। দুনিয়ার ঝুটঝামেলা আর ভালো লাগে না। সেই কবে নিলু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। এরপর একদিন শুনতে পারল দুনিয়া থেকেও বিদায় নিয়েছে মানুষটা। হারিয়ে গেল উদয়িনীও। এত তাড়াতাড়ি কেন তারা চলে গেল? এই গোটা পৃথিবীতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশ্ব লাগে সোহানের। দুনিয়ার মোহ, মায়া ত্যাগ করতে ইচ্ছে করে। পারে না শুধু মেয়েটার জন্য।

সোহান খন্দকারের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু এসব শুনে তাকে পরামর্শ দিল আল্লাহর দরবারে যেতে। তাহলেই তার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। হৃদয়ে প্রশান্তি আসবে৷ জীবনে টাকা, পয়সা অনেক রোজগার করেছে। এবার পরকাল নিয়ে চিন্তা করতে পরামর্শ দিল। বন্ধুর কথাটি মনে ধরল সোহানের। সায় দিল সে। তখন বন্ধু বলল, ‘ ছেলেকে তো বিয়ে করিয়েছ। এবার মেয়ের ব্যবস্থা করো। তারপর চলো দু’জন একসাথেই হজ্জে চলে যাই। আমার সবগুলো বিয়ে করানো শেষ। ছোটো মেয়ে ইন্টারে পড়ে। তবু বিয়ে দিয়ে দিছি। শশুর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে আমার ঘরেই থাকবে। ‘

বন্ধুর এহেন কথা শুনে সহসা নড়ে ওঠে সোহান খন্দকার। সিমরানের বিয়ে! এটা নিয়ে তো আর ভাবা হয়নি। অথচ ভাবা উচিত ছিল তার। চোখের সামনে মেয়েটা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে৷ একাকীত্বে ভুগে টের পায় সে। অনার্স শেষ হতে আর দেড়, দু’বছর। এবার বাবা হিসেবে ওর জীবন গুছিয়ে দেয়া উচিত। তার আদরের মেয়েটা এমন বিষণ্নতায় ভুগছে। ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। আর সে একবারো ভাবেনি তার জন্য উপযুক্ত সঙ্গী বাছাই করার? মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বন্ধুকে বলল,

‘ আমার একটামাত্র মেয়ে জাবের। কোনদিকেই কোনো কিছুর কমতি নেই। সুপাত্রের খোঁজ পেলে জানিও। ‘

ঠিক এর পনেরো দিনের মাথায় বন্ধু জাবের আলী ফোন করল সোহান খন্দকারকে। জানালো,

‘ তোর মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র পেয়েছিরে সোহান। ছেলে এডভোকেট। ‘

পাত্রের বিবৃতি দিতেই পছন্দ করে ফেলল সোহান। বলল আগামীকালই ছেলেকে দেখতে যাবে সে। তার যদি সবকিছু মিলিয়ে পছন্দ হয়। তবেই মেয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। কথানুযায়ী ছেলেকে দেখে এসে সিমরানের সঙ্গে আলোচনায় বসে সোহান খন্দকার। বাবার মুখে বিয়ের কথা শুনে মুখে আঁধার নেমে আসে সিমরানের। ছেলের বিবৃতি শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ জীবনে কি আর কাউকে হৃদয়ে স্থান দিতে পারবে? অসহায় বোধ করে খুব। সোহান খন্দকার টের পায় মেয়ের অনুভূতি। তাই বোঝায়,

‘ মা আমরা যা চাই সব সময় কি তা পাই? পাই না। জীবন অনেক কঠিন রে মা। সৃষ্টিকর্তা আমাদের যা দেয় তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যা দেয় না তা নিয়ে আফসোস করতে হয় না। মনে রাখতে হয়, যা কিছু পেলাম তাতে নিশ্চয়ই মঙ্গল আছে। যা পেলাম না তা আমার জন্য মঙ্গলদায়ক না। ‘

মন কাঁদছে সিমরানের। কিন্তু বাবাকে বুঝতে দিল না। সে জানে তার বাবা ভালো নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভোগে খুব। কিয়ৎক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল সে। সোহান খন্দকার চাতক পাখির ন্যায় মেয়ের অনুমতির অপেক্ষা করতে লাগল। সিমরানের গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়াল৷ তীব্র কষ্টে কেঁপে কেঁপে ওঠল বুক। ভেতরটা হাহাকার করে বলল, ‘ সৌধ ভাই, আমি অন্য কারো বউ হয়ে যাব! আমার জন্য অন্য কাউকে বাছাই করেছে আব্বু। জাস্ট অনুমতি দিলেই অন্য কেউ এসে আমাতে অধিকারত্ব পাবে! ‘

আচমকা হুহু করে কেঁদে ফেলল সিমরান। সোহান খন্দকার চমকে ওঠল৷ কাছে টেনে নিল মেয়েকে। বাবার বুকে মুখ লুকিয়েও কাঁদল খুব৷ মেয়ের কান্না দেখে সোহান খন্দকারের চোখ বেয়েও জল গড়াল। মনে মনে ভাবল,

‘ তোর যন্ত্রণা আমি বুঝি রে মা। কিন্তু কী করব বল? আমরা যে নিরূপায়। যার হাতে দিব সেই তো তোকে নিতে চায় না৷ বাবা হয়ে কী করে এমন কারো হাতে তোকে তুলে দেই। যে তোকে গ্রহণ করতে অনাগ্রহী। নিজ জীবন দিয়ে যা উপলব্ধি করেছি তা অন্য কাউকে করাতে চাই না। আর না তোর জীবনটা তোর মায়ের মতো হোক এটা চাই। ‘

মুখে বলল,

‘ জোর নেই মা। তুই না চাইলে আমি আর কথা আগাব না। ‘

সহসা মাথা তুলল সিমরান। কান্না থেমে গেছে তার। তবু চোখ দু’টি অশ্রুসিক্ত। ওষ্ঠদ্বয় ভেজা। নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করে বলল,

‘ আমার না চাওয়ার কোনো কারণ নেই আব্বু। তুমি কথা আগাও। কোনো সমস্যা নেই আমার। এই পৃথিবীতে সবাই তার ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে, এর কোনো মানে নেই।’

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫২|
আগামীকাল শুক্রবার। সিমরানের এনগেজমেন্ট। অ্যাডভোকেড অণুজ সরকারের সঙ্গে। লোকটার গায়ের বর্ণ শ্যাম হলেও আকর্ষণীয় চেহেরা। ভীষণ সুদর্শন। সুহাস নিজে গিয়ে দেখা করেছে ছেলেটির সঙ্গে। প্রথম দেখা এবং আলাপচারিতায় চোখ, মন দুটোই কেড়েছে অণুজ। এক দুইদিনের পরিচয়ে মানুষ চেনা ভার৷ পারিবারিক বিয়ে অবশ্য অল্প পরিচয়েই হয়৷ তাছাড়া এনগেজমেন্ট হওয়ার পর বেশকিছু দিন সময় পাওয়া যাবে জানা শোনার। নিজের মনের সকল বিষণ্নতা দূরে ঠেলে আপাতত বোনকে সময় দিচ্ছে সুহাস৷ পাশাপাশি নামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা থেমে নেই। বাড়িতে বাবা, ছেলে আর বোন। তারা দু’টি ছেলে কি আর অতকিছু বোঝে? আত্মীয়, স্বজন সব দূরে দূরে থাকে। নানুমনি বৃদ্ধা। শারীরিক অবস্থা সুবিধার নয়। তাই তাকে এখন আর টানাহেঁচড়া করতে চাইল না। বিয়ে ঠিক হোক। একেবারে বিয়ের সময়ই সবাই আসবেনি৷ আবার ভাবল কালকের মতো দিনে সিমরানের পাশে একজন মেয়ে থাকা জরুরি। নামীকে মনে পড়ল খুব। মেয়েটা বড্ড পাষাণ। এমন পাষাণীকে কোন দুঃখে বিয়ে করল সে? পরোক্ষণেই মনে পড়ল, কোন দুঃখে আবার? বাবার হু’মকি নামক দুঃখে! অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল আইয়াজ, আর ফারাহকে খবর দিবে। ওরা দু’জন ছুটি কাটাতে বাড়ি আছে কিছুদিন। এ মুহুর্তে ওরা ছাড়া বড়ো কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই তার। ভেবেই বন্ধুকে ফোন করে নিজের অবস্থা জানায়। সব শুনে আইয়াজ, ফারাহ আর দেরি করেনি চলে এসেছে। সন্ধ্যা মাথায় করে এলো দু’জন৷ এসেই জানতে পারল, বন্ধুদের মধ্যে তাদেরই জানিয়েছে শুধু। সৌধর পরিবার বা সৌধকে জানায়নি। সিমরানের দুর্বলতা আছে ওদের প্রতি৷ তাই সুহাসই জানাতে নিষেধ করেছে বাবাকে। ছেলের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে সোহান খন্দকার। কারণ সেও জানে এতে সিমরানের মঙ্গল হবে। মেয়েটার মন ভীষণ নরম। ও বাড়ির সদস্যরা সামনে থাকলে নিজেকে যেটুকু শক্ত করেছিল সেটুকু ভেঙে পড়বে নিষ্ঠুরভাবে। একবার বাগদানটা হয়ে যায়। অণুজের সঙ্গে আলাপ হোক। ভালোলাগার জায়গা তৈরি হোক। এরপর না হয় বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানাবে চৌধুরী বাড়ির সবাইকে। ড্রয়িংরুমে বসে সবাই অণুজ সরকারের ফটো দেখছে। প্রথম দর্শনেই সবার পছন্দ হয়ে যায়। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে সকলে। সিমরানের এসব ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি করছে সবাই। যেন বাচ্চা মেয়ে সে। মার্কেটে গিয়ে একটা ড্রেস পছন্দ করেছিল। সেটা কিনে না দিয়ে অন্যটা কিনে দিয়েছে। এখন সেটা পরার আগে বাড়িয়ে বাড়িয়ে প্রশংসা করে তার মন ভুলানোর চেষ্টা করছে। গোপনে তাচ্ছিল্য ভরে হাসল সে। ওঠে চলে গেল উপরে৷ আকস্মিক বোন ওঠে যাওয়ায় মুখে আঁধার নেমে এলো সুহাসের। আইয়াজ খেয়াল করে ফারাহকে ইশারায় সিমরানের কাছে যেতে বলল৷ ফারাহ মাথা দুলিয়ে ওঠে পা বাড়াল উপরের দিকে।

অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলছে ফারাহ৷ সিমরান হু, হা তে উত্তর দিচ্ছে। মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের যন্ত্রণা বোঝা সহজ। তাই তো ফারাহ বুঝে ফেলল সিমরানের বুকের ভেতর বিষাদ সিন্ধু তৈরি হয়েছে। যে সিন্ধুতে বইছে তীব্র তরঙ্গ। এমনই এক তরঙ্গে সে ভুগেছে বহুদিন। যা থেকে তাকে মুক্ত করেছে আইয়াজ নাম শুদ্ধ প্রেমিক পুরুষটি৷ বিষাদ সিন্ধুতে অঢেল প্রেম দিয়েছে। যে প্রেম সকল বিষণ্নতাকে গ্রাস করে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত ডুবিয়ে রাখছে প্রগাঢ় প্রেম তরঙ্গে। মুহুর্তেই মনে মনে প্রার্থনা করল ফারাহ, সিমরানের জীবনেও এমন একজন পুরুষ আসুক। যে তার মনের সব বিষণ্নতা শুষে নিয়ে অঢেল প্রেমে ভরিয়ে তুলবে, ডুবিয়ে রাখবে। যা পেয়ে সিমরানের এই পৃথিবীটা নরক না স্বর্গ মনে হবে। নিজের জীবনের সুখগুলোকে মনে হবে স্বর্গীয় সুখ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারাহ। সিমরানকে বলল,

‘ শুনলাম শপিং করেছ? দেখি কাল কী পরবে? শাড়ি, ল্যাহেঙ্গা না গাউন। ‘

নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল সিমরান। সে শপিং করেছে? ওহ হ্যাঁ করল তো গতকাল। ভাই ছিল সাথে। নিজে থেকে কিচ্ছু পছন্দ করেনি। সব সুহাসের পছন্দে কিনেছে। যেখানে সঙ্গীটাই নিজের পছন্দের হবে না। সেখানে এসব সাজ সজ্জার জিনিস নিজের পছন্দের হয়ে কী হবে? রুদ্ধশ্বাস ফেলল সিমরান। মৃদু হেসে যা যা কেনাকাটা করেছে সবই দেখাল। ফারাহ বেশ প্রশংসা করল প্রতিটি জিনিসের। সিমরানের মনে হলো আজ সবাই সবকিছুতে বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করছে। যা দৃষ্টিকটুর পাশাপাশি কর্ণকটুও ঠেকল। ফারাহর সঙ্গে সময় গুলো কেটে গেল তাড়াতাড়িই। রাতে খাবার খাওয়ার সময় হয়ে এলো। সুহাস ডাকতে এলো ওদের। খেতে ইচ্ছে করছে না সিমরানের। চারদিকে বিষাদে ছেয়ে গেছে। তীব্র অবসাদে ভুগছে মনটা। তবু খেতে যেতে হলো। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না ওর৷ পানি দিয়ে গিলে গিলে খেল। ওর অবস্থা দেখে আইয়াজের দিকে করুণ চোখে তাকাল ফারাহ। চোখের সামনে এসব দেখে সহ্য হয়? আইয়াজ চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল ওকে। বোনের অবস্থা খেয়াল করল সুহাসও৷ এই পরিস্থিতিতে আসলে কী করা উচিত, কী বলা উচিত বোধগম্য হলো না। শুধু গোপনে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। মনের কোথাও একটা যেন সৌধর প্রতি ওর ক্রোধ জন্মেছিল। যা সিমরানকে এই অবস্থায় দেখে জেগে ওঠল৷ প্রিয় বন্ধু সৌধকে এখন অপাত্র মনে হলো তার। আর বোনের তীব্র ভালোবাসাকে মনে হলো ঘি। অপাত্রে ঘি ঢালতে গেলে এভাবেই কষ্ট পেতে হয়৷ আফসোস হলো ভীষণ। আদরের বোন তার। ভুল মানুষকে ভালোবেসে এভাবে পস্তাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল, কালকের পর থেকে যেন ধীরেধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। নতুন মানুষে নতুন উদ্যমে যেন বাঁচতে শেখে সিমরান।
.
.
আজকের দিনটা যেন চোখের পলকে মিলিয়ে গেল। রাত যত বাড়তে লাগল ততই অদৃশ্য এক ভয় জাপ্টে ধরল সিমরানকে। কাল তার এনগেজমেন্ট হবে। সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একজন মানুষ। যাকে নিয়ে কখনো কল্পনা করেনি সে। এমন একজন মানুষ তাকে দেখবে। গভীরভাবে দেখবে। আংটি পরানোর সময় তার হাতও স্পর্শ করবে। সহসা গায়ে কাঁ টা দিয়ে ওঠল সিমরানের। বুকের ভেতর ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে শুরু করল৷ কীভাবে মেনে নেবে সে? পারবে তো নিজেকে শক্ত রেখে সব সয়ে নিতে? প্রচণ্ড হাসফাস চিত্তে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে মেয়েটা। ঘুম চোখে ধরা দিচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে খুব৷ একসময় বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে ওঠল। একবার মৃদু আর্তনাদে ডাকল, ‘ আম্মু… কেন চলে গেলে এভাবে? আমি যে আর পারছি না নিজেকে সামলাতে। ‘ আরেকবার ডাকল,’ সৌধ ভাই! কাল থেকে আমি অন্যকারো হয়ে যাব। আফসোস কেউ আমার হবে না। আমি মানিয়ে নিতে পারব ঐ লোকটাকে কিন্তু মনে নিতে পারব না। ‘

রাত একটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ একটা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সৌধ। মারাত্মক একটা ঘুম পেয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার চাপ বেশি যাবে। তাই ঘুমানোর তোরজোর শুরু করল। বিছানায় গা এলিয়ে ফোনে এলার্ম দিতে গিয়ে খেয়াল করল, হোয়াটসঅ্যাপে বেশকিছু ম্যাসেজ এসেছে। একটা প্রাচীর। লিখেছে, “কেমন আছিস দোস্ত। ” আর গুলো এলাকার ছোটো ভাই আর বন্ধুর। হঠাৎ নোটিফিকেশন এলো দেখতে পেল সিমরানের ফেসবুক আইডি থেকে জাস্ট একটার দিকে একটি পোস্ট করা হয়েছে। এই মেয়ে রাত জাগাতে পটু৷ খেয়াল করেছে সে। অনেকদিন ভেবেছে কিছু বলবে, ঝাড়িটাড়ি দেবে। পরমুহূর্তে আর দেয়নি৷ কিন্তু রাতদুপুরে পোস্ট! এটা যেন বাড়াবাড়ি ঠেকল। তা কী পোস্ট করেছে দেখি। ভেবেই নোটিফিকেশনে ক্লিক করল। ভেসে ওঠল ইংরেজিতে লেখা কয়েক লাইন। ইংরেজির স্টুডেন্ট। পোস্ট ইংরেজিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে বিরবিরিয়ে পুরো লেখাটা পড়ল সৌধ।

“Why do people get lost? Tears flow in the eyes when a loved one dies. If you lose your life, why does the fire burn in the chest? A dreamer’s dream of a man will never come true The end of the dreamer’s dream. ”

ইংরেজিতে পোস্টটি পড়ে নিমেষে চোখ বুজে ফেলল সৌধ। সিমরানের ইংরেজি পোস্টটির বাংলা হলো-
“মানুষ কেন হারিয়ে যায়? ভালোবাসার মানুষ মরে হারালে চোখে অশ্রু ঝড়ে। জীবন্ত হারালে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে কেন? স্বপ্নচারিণীর স্বপ্ন পুরুষ কখনো সত্যি হবে না৷ স্বপ্নচারিণীর স্বপ্নের সমাপ্তি। ”

বাংলা অর্থ বুঝতেই বুক ধক করে ওঠে সৌধর। ঘুম ছুটে যায় নিমেষে। মুখ হয়ে ওঠে গম্ভীর। অধর কামড়ে বিচলিত চিত্তে হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে সিমরানের নাম্বারে ম্যাসেজ পাঠায়,

‘ ঘটনা কী বলত সিনু, তোর কি ইংরেজি সাহিত্যিক হতে ইচ্ছে করেছে? ওহ হ্যাঁ তুই তো ইংরেজি সাহিত্য নিয়েই পড়ছিস। তা মাইকেল মধুসূদনের জীবন কাহিনি জানিস? ‘

ম্যাসেজটা দিল। সিন হলো। অথচ উত্তর নেই। শুয়ে থাকা ভারিক্কি দেহটি আচমকা ওঠে বসল। সিনু তার ম্যাসেজ সিন করল আর রিপ্লাই দিল না? আশ্চর্য! চোখ, মুখ কুঁচকে গেল সৌধর৷ ত্বরিত আঙুল চালিয়ে ফের টেক্সট দিল,

‘ ঘুমোসনি কেন এখনো? ‘

আবারো সিন হলো। সৌধ ত্বরিত লিখল,

‘ রিপ্লাই কর। ‘

সৌধর ম্যাসেজ পেয়ে ধাতস্থ হতে সময় লাগল সিমরানের। মধ্যরাতে সৌধ ভাইয়ের ম্যাসেজ অপ্রত্যাশিত ছিল। আবারো কান্না পেয়ে গেল মেয়েটার। কাঁদতে কাঁদতে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। মন, মস্তিষ্ক সবটাই বিধ্বস্ত। শেষে ‘রিপ্লাই কর’ ম্যাসেজটি দেখে চমকে ওঠল। এটা ধমক ছিল। বুঝতে পারল সে। তাই তীব্র অভিমান বুকে চেপে উত্তর দিল,

‘ আজ দুপুরে আমার এনগেজমেন্ট সৌধ ভাই। সেই খুশিতে ঘুমাতে পারছি না। কেমন আছো তুমি? ‘

সিমরানের ফোনে চার্জ শেষের পথে ছিল। সারাদিন এত দুঃশ্চিন্তা, মানসিক অশান্তিতে ভুগেছে যে ফোন চার্জ দিতেও খেয়াল নেই। সবকিছু থেকে এমনি ভাবে মন ওঠে গেছে তার। তাই এটুকু রিপ্লাই দেয়ার পর পরই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। আচমকা ফোন বন্ধ হওয়াতে একটুও বিচলিত হয় না সিমরান। বিরবির করে আফসোসের সুরে বলল,

‘ এই ফোনটাও চায় না তোমার সাথে আমার কথা হোক। ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। সহসা তীব্র ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ফোনটা নিয়ে চার্জ দেয়ার পরিবর্তে বন্ধ অবস্থাতেই ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রাখল। কিচ্ছু দরকার নেই তার, কিচ্ছু না। বিছানায় ফিরে এলো আবার। ধপাস করে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে হুহু করে কাঁদতে লাগল। সারারাত কেঁদেকেটেই শেষ করে দিল৷ ঘুমালো না একটুও। সকালের দিকে একটু চোখ লেগেছিল বটে। কিন্তু তা কি আর দেহ, মনের ক্লান্তি দূর করতে পারে?
.
.
আজ সিমরানের সব দায়িত্ব ফারাহর ওপর পড়েছে। ফারাহ অনেক বুঝিয়ে সকালে একটু খাইয়ে দিয়েছিল৷ এরপর আর খাওয়াতে পারেনি৷ এখন সময় হয়ে এসেছে। অনেক বলে বলে গোসলে পাঠাল মেয়েটাকে৷ ততক্ষণে সে সবকিছু গুছিয়ে রাখল। সিমরান বেরিয়ে আসতেই একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ফারাহ৷ এতক্ষণ কী ভয়ংকর লাগছিল মেয়েটা। মুখের বর্ণ পুরোপুরি লাল ছিল। চোখ দু’টো এখনো ফোলা। সারারাত কী পরিমাণ কান্নাকাটি করেছে। তার প্রমাণ ফুলো ফুলো চোখেই দেখতে পাচ্ছে ফারাহ। চুলগুলো মুছে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে পুরোপুরি শুঁকিয়ে ফেলল সিমরান। ফারাহ ওকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসতে বললেই একবার শান্ত চোখে তাকাল। পরোক্ষণেই স্মিত হেসে এগিয়ে এসে বসল চুপচাপ। ফারাহ মৃদু হেসে কাঁধে হাত রাখল। বলল,

‘ আগে চুল বাঁধি তারপর মুখ সাজাই কী বলো? শেষে ল্যাহেঙ্গা পরো। এতে গরম কম লাগবে। এসির পাওয়ার কি আরেকটু কমাব? ‘

‘ না ঠিক আছে। তোমার যেমন খুশি তেমনি সাজাও নো প্রবলেম। ‘

নির্লিপ্ত স্বর সিমরানেও। ফারাহ মৃদু হেসে একে একে সাজাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বিষণ্ন মুখের সিমরান হয়ে ওঠল বিষাদ রাজ্যের রাজকুমারী। যার সব আছে সব। নেই মুখে হাসি। চোখে আনন্দের ঝিলিক। সাজ সম্পন্ন হওয়ার পর পুরোপুরি তৈরি হয়ে নিল সিমরান। ফারাহ যেন ওর দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারল না। অবাক গলায় বলল,

‘ কী কিউট লাগছে! তুমি কিন্তু মারাত্মক সুন্দরী সিনু। ‘

একপেশে হাসল সিমরান। মনে মনে বলল,

‘ এই সৌন্দর্যও এক সময় আমার অহংকার ছিল। কিন্তু আজ মূল্যহীন! ‘

মৃদু পায় ড্রেসিং টেবিলের খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল সে। আয়নায় দেখতে পেল আপাদমস্তক সুসজ্জিত নিজেকে। তার শুভ্র ত্বকে লাইট পিঙ্ক কালার ল্যাহেঙ্গাটি দারুণ মানিয়েছে। ল্যাহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে ব্রাইডাল জুয়েলারি গুলোও ভীষণ সুন্দর। গলায় একটি নেকলেস পরেছে হীরের। যা ইন্ডিয়া থেকে তার বাবা এনেছিল তার জন্য। আলতো স্পর্শ করল নেকলেসটায়। মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসল। তার বাবা, ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতে হয়। এরপর তাকাল নিজের পানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ফারাহ আপুর দিকে। আপু এত সুন্দর সাজাতে পারে জানা ছিল না৷ সে বরাবরই ব্রাইডাল সাজতে পছন্দ করে। যদিও সৌধর পছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ইদানীং ব্রাইডাল সাজত না। তবে আজ নিজেকে সম্পূর্ণ ব্রাইডার লুকে দেখে পছন্দ হলো ঠিক৷ কিন্তু মনের ভিতর দানা বেঁধে রইল একটাই। এই সাজ কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য নয়। মুহুর্তেই বুকের ভেতরটা ডুকরে ওঠল। কান্না উপচে এলো গলা পর্যন্ত। সেই মুহুর্তেই দরজায় টোকা পড়ল সুহাসের।

‘ এই ফারাহ, অণুজরা এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি দরজা খোল। ‘

সহসা বাক্যে শিউরে ওঠল সিমরান। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল তার৷ নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে তীব্র কষ্ট অনুভব করল। চারিদিকে ঝকঝকে আলো তবু যেন কী গভীর অন্ধকারে ডুবতে শুরু করল সে। তবে কী সবাই মিলে এক আঁধার থেকে অন্য আঁধারে নিক্ষেপ করছে তাকে?

পাশাপাশি বসে অণুজ, সিমরান। সিমরানের মস্তক নত৷ বড়োরা কথা বলছে। আংটি বদল হয়ে গেলেই একসঙ্গে খেতে বসবে সবাই। বর্তমান যুগের স্মার্ট কোনো মেয়ে এত লাজুক হয় নাকি? অণুজের ভারিক্কি জ্ঞানে প্রশ্নটি বার বার উঁকি দিতে লাগল৷ এর আগে দু’বার কথা হয়েছে সিমরানের সাথে। তখনও টের পেয়েছিল সিমরান বেশ লজ্জা পাচ্ছে। তার সঙ্গে কথা বলতে জড়তা কাজ করে মেয়েটার৷ সে যা প্রশ্ন করত তাই উত্তর দিত। নিজে থেকে একটি প্রশ্ন করত না৷ আজ সামনাসামনি দেখা হলো। কিন্তু কথা বলল সে একাই৷ সিমরান মুখে হু, হা উত্তর দিয়েছে। আর মাথা নাড়িয়ে। এর বাইরে একটি কথাও বলেনি। ভেতরে ভেতরে এটা নিয়ে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি অনুভব করছিল অণুজ৷ তার মা বিষয়টা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল,

‘ কোনো সমস্যা? ‘

অণুজ মাথা নাড়াল। কোনো সমস্যা নেই। দু’পক্ষের আলাপচারিতা শেষ হলো। অণুজ অনুমতি পেল সিমরানকে আংটি পরিয়ে দেয়ার জন্য। ফারাহ এসে বসল সিমরানের অপর পাশে। মেয়েটার বুক কম্পন হচ্ছিল বহুক্ষণ ধরেই৷ সে কম্পন এবার শরীরে শুরু হয়েছে। দূর থেকে খেয়াল করেই চলে এসেছে ফারাহ। অণুজ খুব সুন্দর একটি হীরের আংটি বৃদ্ধা এবং তর্জনী আঙুল দিয়ে ধরে সিমরানের সামনে নিয়ে এলো। এ সময় আইয়াজ বলল,

‘ অণুজ ভাই দাঁড়িয়ে পড়ুন। সিনু ওঠে দাঁড়া। ‘

আইয়াজের হাতে ক্যামেরা। অণুজের চোখ দু’টোয় দীপ্তি ফুটে ওঠল। ওঠে দাঁড়াল সে। ফারাহ ফিসফিস করে ওঠতে বলল সিমরানকে। সিমরান ওঠল না৷ তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না। যেন এ জগতে সে নেই। ঢোক গিলল ফারাহ। কী হচ্ছে এসব? সিমরান কেন বুঝতে পারছে না? এটা কোনো সিনেমার অংশ নয় এটা বাস্তব জীবন। আজ এ মুহুর্তে একটু ভুলচুক হয়ে গেলে দু’পক্ষকেই বিব্রত হতে হবে। পড়তে হবে তীব্র লজ্জায়। সবশেষে অসম্মানিত হতে হবে আংকেল আর সুহাস ভাইকে।
অনেক বলে ধাক্কাধাক্কি করে অবশেষে ওঠানো হলো সিমরানকে। যা খেয়াল করে অণুজের মুখে আঁধার নেমে এলো। তবে কী এই বাগদানে সিমরানের মত নেই? যা হচ্ছে পারিবারিক চাপে পড়ে? শ্বাস রোধ হয়ে এলো অণুজের। বিয়ে ব্যাপারটা তার কাছে খুব ইম্পর্ট্যান্ট। তার বউ হতে এলে আলাদা উৎসাহ নিয়ে হতে হবে। তার প্রতি তীব্র আগ্রহী থাকতে হবে মেয়েকে। এসব না হলে, না থাকলে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না৷ সে কোনো ফেলনা পুরুষ নয়। সিমরান নিঃসন্দেহে সুন্দরী নারী। ছবিতে প্রথম দেখেই আকৃষ্ট হয়েছে সে। বাস্তবে দেখে সেই আগ্রহ গাঢ় হয়েছে।
কিন্তু সিমরান? সে তো তার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। আকর্ষণ দূরে থাক একবিন্দু আগ্রহীও নয়। জীবনের কাঙ্ক্ষিত একটি মুহুর্তে এসে অণুজ যেন ভেঙে পড়ল৷ মা, বাবা, ভাইরা তাকে উৎসাহ দিচ্ছে আংটি পরাতে। নিমেষে ভাবনা ফুরালো। মন বলল, সে যা ভাবছে এমন কিছু নয়। তাই হলে এত সুন্দর করে সেজে তৈরি হয়ে সামনে আসত না সিমরান। আজকালকার মেয়েরা এত বোকা নয়। বুকটা হালকা হলো এবার৷ মৃদু হেসে বা’হাতে সিমরানের বা’হাতটায় প্রগাঢ়ভাবে স্পর্শ করল। অনুভব করল একটুখানি কেঁপে ওঠেছে সিমরান। যা অবিরত চলতেই থাকল।

কাঙ্ক্ষিত সেই মুহুর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আগমন ঘটল সৌধর। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সুহাসদের উন্মুক্ত সদর দরোজা পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল সে! প্রথমে সামনে পড়ল আইয়াজ। যে ক্যামেরা তাঁক করে আছে অণুজ আর সিমরানের দিকে। সৌধ অবিশ্বাস্য, থমকানো দৃষ্টিতে একবার আইয়াজ আরেকবার সিমরানের দিকে তাকাল৷ এরপর আচমকা আইয়াজের থেকে থাবা মে রে ক্যামেরা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। বিধ্বস্ত মুখ, উষ্কখুষ্ক চুল কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পরনে ইস্ত্রি বিহীন কালো শার্ট। দু’হাতের হাতাই গোটানো। বুকের কাছটায় দু’টো বোতাম খোলা। ফর্সা বুকে কালো লোম গুলো উঁকি দিচ্ছে স্পষ্ট। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করে দেখা গেল ওর পরনে প্যান্ট নয় ট্রাউজার! সৌধ চট্টগ্রামে ছিল। গতকাল সকালেও কথা হয়েছে আইয়াজের সাথে। তাহলে আচমকা সৌধর আগমন কী করে? তাও কিনা এই রূপে। যে রূপে সৌধর বেডরুম ব্যতীত নিজের বাড়ির ড্রয়িং রুমেও দেখেনি কখনো। সেই রূপে দেখে আইয়াজ, ওপাশে থাকা সুহাস, ফারাহ, সোহান খন্দকার প্রত্যেকেই হতভম্ব। উপস্থিত প্রত্যেকে ধাতস্থ হতে সময় নিল। সৌধ হঠাৎ এসে এমন বিশৃঙ্খলা করছে কেন? ও তো এমন ছেলে নয়। নিমেষে সবার কর্ণকুহরে পৌঁছাল আইয়াজের কলার ধরে বলা সৌধর গমগমে কণ্ঠস্বর,

‘ ভেবেছিলাম সুহাসই আমার চরম শত্রু হয়ে গেছে। এখন দেখছি তুইও! ‘

বলেই কলার ছেড়ে দিল। হাত ঝাড়া দিয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখল সকলের স্তম্ভিত মুখ৷ কেবল একজনই নির্লিপ্ত। আচমকা চোখ বুজে নিজের মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করল সৌধ৷ নিমেষে আবার চোখ খুলল। সোহান খন্দকার ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। কিছু বলতে উদ্যত হতেই সে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ আমি খুব দুঃখীত আংকেল। নিরুপায় আমি। ‘

থেমে গেল সোহান খন্দকার। সৌধ চোখ ফিরিয়ে নিল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অণুজ, সিমরানের দিকে। নিমেষে পথে বাঁধা হয়ে সুহাস দাঁড়াল। অনুরোধের সুরে বলল,

‘ কী করছিস এসব? ওদিকে যাচ্ছিস কেন? ‘

‘ তোর সাথে তো আমার কথাই চলে না। পথ ছাড়।’

ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল সৌধ। সুহাস আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ নাটক করবি না। ‘

সৌধ ওর বুক সই করে ধাক্কা দিয়ে বলল ‘ওটা তোর স্বভাব। আমার না। ‘

ধাক্কা খেয়ে কিঞ্চিৎ দূরে সরে গেল সুহাস। চোখের পলকে সিমরানের মুখোমুখি হলো সৌধ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল একবার৷ এরপর নিজের বলিষ্ঠ ডানহাতটা তুলে সিমরানের স্নিগ্ধ, মসৃণ গাল দু’টো আলতো চেপে ধরল। ব্যথা যেন না পায় এভাবেই ধরল। অদ্ভুত করে হাসল কিঞ্চিৎ। সে হাসিতে এক টুকরো ব্যথা মিশে ছিল কী? জানা নেই। অদ্ভুত সে হাসি হেসে সিমরানের মুখশ্রীতে গাঢ় চোখে তাকাল। দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘তোর কি পার্বতী হওয়ার শখ হয়েছে সিনু? ‘

সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল। অণুজ বাকহারা। আর তার পরিবার স্তম্ভিত মুখে সোহান খন্দকারের পানে তাকিয়ে। সিমরান নিষ্পলকে সৌধকে দেখছে। সত্যি সৌধ ভাই এসেছে? এটুকু বিশ্বাস করতেই সময় লাগল বেশ। এরপর হুট করেই বুকটা মুচড়ে ওঠল। পার্বতী কে? সে কেন পার্বতী হতে যাবে!

এদিকে সৌধ উত্তর না পেয়ে একটুও বিচলিত হলো না৷ সে ঘাড় বাঁকিয়ে সিমরানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির পানে তাকাল। দেখল সিমরানের বা’হাত ছেলেটির বাঁহাতে ধরা। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল এ দৃশ্য দেখে। বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেল যেন দৃশ্যটি। ভেবেই সিমরানের দিকে একবার নিজের রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই দৃষ্টিটাকে শীতল করে ফের তাকাল অণুজের পানে। অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিমায় হাত বাড়িয়ে সিমরানের হাত থেকে অণুজের হাতটা সন্তর্পণে ছাড়িয়ে নিল। এরপর অণুজের ডানহাতের দিকে নিজের ডানহাত এগিয়ে ধরে জোরপূর্বক হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল,

‘ হ্যালো আমি সৌধ চৌধুরী। সন অফ এমপি সুজা চৌধুরী। ‘

অণুজ বাকশূন্য। সৌধর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে হাত ছেড়ে দিয়েছে। পুনরায় তাকিয়েছে সিমরানের বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে। ওর বিস্মিত মুখ তার মনকে চনমনে করে তুলল। মুখ বলল,

‘ তুই কি চাস দেবদাস হতে গিয়ে ফিরে এসে আমি আবার দেবদাস হয়ে যাই? ‘

একটু থামল। উপস্থিত সকলের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল,

‘ যদি না চাস চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়াবি। ভয় নেই। লজ্জিত হবারও কারণ নেই। আর না আছে কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত হবার। লাইফে অনেক সিনেমা দেখেছিস৷ মনে কর আজ এ বাড়িতে তোর আমার জীবন্ত একটি সিনেমা হচ্ছে। যা ইতিহাসের পাতায় যুগের পর যুগ লিখিত ভাবে বেঁচে থাকবে। কাম অন সিনু। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫৩|
চোখের পলকে ভবিতব্য বদলে গেল৷ মনের বাইরে চলা পরিকল্পনা গুলো হেরে গেল মনের ভিতরে চলা পরিকল্পনার কাছে। যারা মনের বাইরে পরিকল্পনা করেছিল তারা জানে না, ভেতরের পরিকল্পনাকারীর চিন্তাশক্তির প্রখরতা। জানে না তার বিচার বিশ্লেষণ আর পাঁচ জন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। খুবই শান্ত একটি পরিবেশ চোখের পলকে অশান্ত হয়ে ওঠেছিল। সারাজীবন শৃঙ্খলা মেনে চলা ছেলেটি বহু বছরের ভালোবাসা হারিয়ে উশৃংখল হয়ে ওঠেছিল প্রথম। এরপর দীর্ঘ একটি সময় কেটে যায়। নিজেকে পুরোপুরি ধাতস্থ করে ফেলার আগেই দ্বিতীয়বার এলোমেলো হয়ে যায় মানুষটা। ফলাফল দু’টো পরিবারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সেই পরিস্থিতিও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাথে সামলে নেয়। একজন চৌকস রাজনীতিবিদ। সৌধর শ্রদ্ধেয় পিতা সুজা চৌধুরী।

গতরাতে সিমরানের শেষ ম্যাসেজটা পড়েই স্তব্ধ হয়ে যায় সৌধ। তার আড়ালে এতকিছু হয়ে গেল। অথচ সুহাস একটিবারও তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না? বন্ধুত্বের জায়গা থেকে তীব্র অভিমান হয়৷ পরোক্ষণেই হিসেব করে মেলায় সুহাসেরও তার প্রতি চাপা অভিমান আছে৷ সেই অভিমান কী নিয়ে? টের পেতেই শিউরে ওঠে৷ মানুষের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই থাকে। যাদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নেই। তারা জীবনের ভিন্ন এক স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়৷ সৌধ বঞ্চিত হয়নি৷ সে পেয়েছে জীবনের ভিন্ন স্বাদ৷ সে দেখেছে প্রকৃতির অদলবদল। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তো এই অদলবদল ঘটায়। গভীর রাতে ফাঁকা ঘরটায় দেহজুড়ে হঠাৎই অদ্ভুত রকমের অশান্তি শুরু হয় সৌধর। এতকাল যে চিন্তা, চেতনা বুকের গভীরে লুকায়িত ছিল। ক্রমশ তার উন্মোচন ঘটতে থাকে৷ নিজেকে স্থির রেখে আর বিছানায় বসে থাকতে পারে না৷ সেদিনের দেখা সিমরানের অসহায় মুখশ্রী, অশ্রুতে টলমল দৃষ্টিজোড়া মনে পড়ে আচমকা। কতগুলো মাস ধরে এই আচমকা মনে পড়ার রোগে হয়েছে তার৷ সে প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবক। ভগ্ন হৃদয়ের অধিকারী। যে হৃদয় কেউ নির্মম ভাবে ভেঙে দেয়। সে হৃদয়ে কি আবারো নড়াচড়া করে? সে তো ভেবেছিল এইতো শেষ। ওখানেই জীবনের সমাপ্তি। রঙহীন এক বেরঙিন জীবন৷ কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এ কী লীলা? কেঁপে ওঠে সৌধ। নিধিকে যেমন আকস্মিক ভালোবেসেছিল, হারিয়েছিলও আকস্মিক। নিধি তখন সম্পূর্ণরূপে অন্যকারো। জীবনের এ পর্যায়ে এসে সে অনুভব করে সৃষ্টিকর্তা চায়নি তাদের মিলন হোক। তাই তো পুরোপুরি অন্যকারো হয়েই তার দৃষ্টি খুলল। আর সিমরান? যে কিনা নিজের অনুভূতি উজার করে দিয়ে তাকে ভাবাতে বাধ্য করল। হ্যাঁ ভেবেছে সৌধ। সিমরানকে নিয়ে ভেবেছে সে। যে ভাবনাতে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই৷ আছে শুধু অন্যরকম শান্ত, স্নিগ্ধ এক অনুভূতি। দু’টো নারী। দু’জনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেহ আলাদা, দেখতে আলাদা। হৃদয়? সেটিও ভিন্ন৷ সে দেখেছে নিধির হৃদয়ের পাষাণত্ব। দেখেছে সিমরানের হৃদয়ের অসহায়ত্ব৷ আজ জীবনের এমন একটি পর্যায়ে এসে কোনটা তাকে বেশি টানছে? নিখুঁত ভাবনা ভেবে নেয়।

নিধি, সিমরান এদের একজনকে বদ্ধ উন্মাদের মতো প্রেম নিবেদন করেছিল সৌধ। কিন্তু মানুষটি নির্বিকার ছিল। আর একজন যাকে নিয়ে কখনো ভুল ক্রমেও স্বপ্ন দেখেনি৷ সে তাকে শুদ্ধরূপে ভালোবেসে সঙ্গী হয়ে জীবনে আসার আবেদন দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান পেয়ে ফিরেও গেছে।
যে হারায় সেই তো জানে হারানোর বেদনা। যার হৃদয় ভাঙে সেই তো জানে হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা। যার ভাঙে না সে কি জানে? সিমরানের অনুভূতি প্রগাঢ় ভাবে অনুভব করে সৌধ৷ ভালোবাসায় ভুল থাকে না। ভুল থাকে ভুল মানুষকে ভালোবাসাতে। তার জীবনে ভুল মানুষ এসেছিল। ভুলের মাশুল আজো দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কারো জীবনে ভুল হতে চায় না। এক নিষ্পাপ হৃদয়ে ফুল হয়ে ফুটতে চায়৷ মানুষটি যদি হয় সিমরান তবে তো একদমই ভুল হওয়া উচিত নয়। তাই বলে সেদিন সিমরানকে প্রত্যাখ্যান করে কি সে ভুল করেছিল? একদমই নয়। সেদিন সে ভুল করেনি। আজো করবে না। কিন্তু আজ যদি সিমরানের এনগেজমেন্ট না ফেরায়৷ নিজের ভেতর জন্ম নেয়া সুপ্ত অনুভূতিদের স্বীকার না করে তবে ভুল হয়ে যাবে। মস্ত বড়ো ভুল। যে ভুলটা নিধির জীবনে হয়েছে। সে ভুল সে করতে চায় না। কারণ সে নিধি নয়। মানুষের জীবন কি অদ্ভুত তাই না? সময় কি চমৎকার ভাবেই মানুষের গতিবিধি বদলে দেয়৷ বদলে দেয় মনের ভেতরে চলা অনুভূতিদেরও সমীকরণ। নিজের ভাবনাচিন্তা গুলোর সমাপ্তি দিয়েই সিমরানকে ফোন করে সৌধ। ফোন বন্ধ পায়৷ যা তার ভেতরের অনুভূতিকে গাঢ় করে। বুকের ভেতরে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বারবার ফোন করেও যখন ফোন খোলা পায় না। তখন কল করে সুহাসকে। ফোন রিসিভ হয় না। নিমেষে ভয় জাপ্টে ধরে। তবে কি দ্বিতীয়বারের মতো সে হেরে যাবে? হার শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছে নিধি। দ্বিতীয় কোনো নারী আর তাকে এ শব্দের সঙ্গে পরিচয় না করাক। ভেবেই টালমাটাল হৃদয়টুকু নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। শুধু একটি মোবাইল ফোন আর ওয়ালেট ছাড়া কিছুই সঙ্গে নেয় না৷ তীব্র দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পুরো জার্নির সমাপ্তি ঘটায়। ভরদুপুর তখন। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই তার স্মরণ হয় একবার বাবাকে কল করা উচিত। মুহুর্তেই বাবাকে কল করে। রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে বলে,

‘ আপনি কোথায় আব্বা? ‘

ছেলের কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠেন সুজা চৌধুরী। আবার কী হলো ছেলেটার? উদ্বিগ্ন চিত্তে শুধায়,

‘ আমি একটি মিটিংয়ে আছি। লাঞ্চ করছ? ‘

‘ আমি মাত্র টাংগাইলে নামলাম। সুহাসদের বাড়ি যাচ্ছি। আজ সিনুর এনগেজমেন্ট। যে করেই হোক আটকাতে হবে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ও কাউকে বিয়ে করতে পারবে না আব্বা। ‘

হতভম্ব হয়ে যায় সুজা চৌধুরী। নির্লপ্ত কণ্ঠে বলে,

‘ যেইখানে তুমি ওদের প্রত্যাখ্যান করছ। সেইখানে এমন মনোবাসনা নিয়ে যাবা না। ‘

‘ আমি সিনুকে বিয়ে করব আব্বা। আপনি কথা বলুন আংকেলের সাথে। আমি পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। ‘

‘ তুমি ভেবেচিন্তে বলছ সৌধ? তোমার এই সিদ্ধান্ত কতটুকু শক্ত?’

তীব্র আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ সৌধর,

‘ যতটুকু শক্ত থাকলে আমাকে আর কেউ ভাঙতে পারবে না। ‘
.
.
প্রধান দপ্তরে নোটিশ দেয়ায় সৌধর কাজ সহজ হয়ে গেল। যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন শান্ত। প্রকট এক ঝড় বয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতি যেমন শান্ত, শীতলতায় রূপ নেয়। সোহান খন্দকারের বাড়ি এবং উপস্থিত সদস্যরা তেমনি শান্ত আর শীতল হয়ে আছে। সৌধ, অণুজ পাশাপাশি বসে আছে। অণুজের বাবাকে সোহান খন্দকার কি বোঝাবে? এমপি সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘ বিশ মিনিট কথার সমাপ্তি দিয়ে সেই বোঝাচ্ছে সোহান খন্দকারকে,

‘ দেখুন আজকাল এমন হয়েই থাকে। ছেলেমেয়েরা তাদের পছন্দ মুখ ফুটে বলতে পারে না। ভাগ্যিস এমপি সাহেবের ছেলে সাহস করে ছুটে এসেছিল৷ নয়তো কতবড়ো বিপদ ঘটে যেত। আপনার মেয়েকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম। বুক ফাটছে তবু মুখ ফুটে কিছু বলছে না৷ ‘

সৌধ মেকি হাসল উনার কথা শুনে। কারণ ভদ্রলোক মুখে যতই মধু মিশিয়ে কথা বলুক। ভিতরে ভিতরে ঠিকই এমপি সাহেবের চৌদ্দ গুষ্টি তুলে গালি দেয়া শেষ৷ দেয়ারই কথা। বড়োসড় ছ্যাঁকা খেয়েছে কিনা…। সৌধর এসবে যায় আসে না। সে আপাতত নিজেকে নিয়েই ভাবতে চায়। নিজের সুখ, শান্তিকেই প্রাধান্য দিতে চায়। ভাবতে ভাবতেই দোতলা সিমরানের ঘরের দিকে একবার তাকাল। এতকিছুর ভীড়ে সিমরান কখন চলে গেছে খেয়াল করেছে সে৷ কিন্তু যে খুশিটা ওর মুখে দেখার প্রত্যাশা ছিল তা দেখেনি। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। তাকাল সুহাসের দিকে। গম্ভীর মুখে আইয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ দৃঢ় দৃষ্টিতে দুই বন্ধুকে পরোখ করল সে। সুহাসকে উদ্দেশ্য করে বিরবির করে বলল,
‘ মীর জাফর কোথাকার! বাঙালির সম্পদ ইংরেজের হাতে তুলে দিচ্ছিল। ‘
.
.
দুপুরের খাবার খেয়ে অণুজ সহ অণুজের পরিবার বিদায় নিল৷ খুবই আন্তরিকতার সাথে। তারা বিদায় নেয়ার পরই সোহান খন্দকার পুরোপুরি হাঁপ ছাড়লেন৷ একজন বাবার কাছে মেয়ের সুখের চেয়ে বড়ো কোনো প্রাপ্তি থাকতে পারে না৷ তাই তো সৌধর আকস্মিক আগমনে প্রথমে হকচকালেও এখন তার বুকে প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে। কারণ মেয়েটাকে যে আর বুকে পাথর চেপে কিছু মেনে নিতে হবে না৷

অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে। তিন বন্ধুর কেউই কারো সাথে কথা বলেনি। অতিথি বিদায় নিলে সুহাসই প্রথম মুখ খুলল। তেড়ে এসে সৌধর বুক বরাবর মৃদু ঘু ষি দিয়ে বলল,

‘ মাতলামি করবি না সৌধ। যা করেছিস খুব খারাপ করেছিস। ‘

সুহাসের রাগান্বিত মুখে তাকিয়ে ফিচেল হাসল সৌধ। খুব যত্নসহকারেই এড়িয়ে গেল বন্ধুকে। সম্মুখীন হলো, হবু শশুর মশাইয়ের। দৃঢ় গলায় বলল,

‘ আসছি আংকেল। আব্বার সাথে তো কথা হয়েছেই৷ বাকি কথাও সেরে নেবেন পারিবারিক ভাবে। আমি ভীষণ টায়ার্ড। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে হবে। ‘

সোহান খন্দকার এতদিন এই ছেলেকে দেখে শুধু অবাকই হয়েছে। কিন্তু আজ ঝড়ের মতো উড়ে এসে কী শান্ত ভঙ্গিমায় সমস্তটা সামলে নিয়ে বিদায় নিল। চোখের সামনে এমন অমায়িক ঘটনা এবং ঘটনার কেন্দ্রে থাকা মানুষটিকে দেখে মুগ্ধ হলো। তার অনুমতি নিয়ে সুহাস, আইয়াজকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে গেল সৌধ। না বন্ধু আর না সিমরান। আপাতত কারো সাথেই কথা বলার প্রয়োজন মনে করল না।

ক্লান্ত দেহে বাড়িতে পৌঁছাল সৌধ। ড্রয়িংরুমে গিজগিজে মানুষ দেখতে পেল। অমনি তার মস্তিষ্ক সজাগ হলো। তার বিয়ের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে আব্বা। প্রথম সে চোখে পড়ল তার আম্মার। তানজিম চৌধুরী ছেলেকে দেখেই খুশিতে গদগদ হয়ে এগিয়ে এলেন। সৌধর ঘর্মাক্ত কপালে চুমু খেতে একটুও দ্বিধা করলেন না। সন্তর্পণে স্নেহময় একটি চুমু খেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। সৌধও মায়ের আলিঙ্গন উপভোগ করে শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘ মাথা ধরেছে আম্মা। জাস্ট ঘরে যাব, শাওয়ার নিব। এরপর লম্বা ঘুম। ‘

ছেলের অবস্থা বুঝতে পারলেন তানজিম চৌধুরী। সৌধ উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে শুধু দাদুনিকে সালাম দিয়ে শুধাল কেমন আছেন? দাদুনি অদ্ভুত সুরে উত্তর দিল। সৌধ সেসবে খেয়াল না দিয়ে নিজের অবস্থা জানিয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই শুনতে পেল দাদুনির বলা কিছু কথা,

‘ সুহাসের বোনকে আমার পছন্দ না জানোই বউ মা। তোমরা যদি ওরেই বউ করবা ঠিক করে থাকো। সৌধ যদি নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়। তাহলে ওই মেয়েকে শিখায়, পড়ায় নিয়ো। অতো ফটর ফটর কথা বলা যাবে না৷ চলনবলনেও পরিবর্তন আনতে হবে। ধেই ধেই করে পুরা বাড়ি নাচাও যাবে না। ‘

সিঁড়ির দু ধাপ উঠতেই রেলিং ধরে থেমে গেল সৌধ। ঘাড় বাঁকিয়ে, ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ সুহাসের বোন বোবা না দাদুনি৷ আর তোমার প্রাণপ্রিয় নাতি কোনো বোবা বা খোঁড়া মেয়েকে বউ করে আনছে না। অল্প বয়সী মেয়ে যখন তখন মুখও চলবে, পা দু’টোও দৌড়াবে। তোমার বয়সী হলে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। নো প্রবলেম। ‘

আকস্মিক কথায় দাদুনির চোখ কপালে ওঠে গেল! সৌধ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেল নিজের ঘরে।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৮|
মিসেস উদয়িনী ইজ নো মোড়! ডক্টর উদয়িনী আর নেই৷ দু’টো সন্তান আজ মাতৃহারা। সোহান খন্দকার বিপত্নীক হলেন৷ দুনিয়াতে নতুন প্রাণের আগমনে চারপাশ ঝলমলে হয়ে ওঠে৷ আপনজনেরা ছড়িয়ে দেয় উল্লাস। আনন্দে উদ্ভাসিত হয় সকলের মুখ।
আর পুরোনো প্রাণ বিদায় নিলে চারপাশ মলিনতায় ছেয়ে যায়। আপনজনেরা হয় শোকাবহে স্তব্ধ। মুখাবয়বে ফুটে ওঠে বিষণ্ণতা। মানুষের জীবন যেন প্রদীপের আলো। যতদিন বাঁচে ততদিন কাছের মানুষদের আলোকিত করে রাখে। যখন মৃত্যু ঘটে জ্বলন্ত প্রদীপটা ধুপ করেই নিভে যায়। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি মানুষ।

সকালবেলা ডিউটির জন্য তৈরি হচ্ছিল সৌধ। আচমকা বাড়ি থেকে কল আসে। খবর পায়, সুহাসের মা উদয়িনী আন্টি আর নেই৷ নিমেষে মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়। পা দু’টো হয় অবশ। বুকের ভেতর তীরের ফলার মতো এসে বিঁধে সিমরানের মলিনত্বে ঘেরা শুভ্র মুখশ্রী। ঝাপসা সেই অক্ষিযুগল স্মরণ হতেই শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্থিরতা বাড়ে। ফোন রেখে থমকানো দৃষ্টিতে স্ক্রিনে আঙুল চালায়। সুহাস! সুহাস, নামী জানে? কোথায় ওরা? ভেবেই ত্বরিত সুহাসের ফোনে কল দেয়। ওপাশ থেকে নামী রিসিভ করে। কান্নারত গলায় বলে,

‘ সৌধ ভাই, আমরা রওনা হয়েছি। কখন পৌঁছাব জানি না৷ আপনি এখন কোথায়? ‘

‘ আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছি নামী। তুমি জাস্ট সুহাসকে সামলে নিয়ে এসো। আয়াজ! আয়াজ, ফারাহ আছে তো? ‘

‘ হ্যাঁ, ওরা আছে৷ ‘

বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নামী। সৌধ ফোন রেখে নিজের কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ল। ওরা পৌঁছাল সন্ধ্যাবেলা। সুহাসদের বাড়িটা নিরিবিলি হলেও আলাদা প্রাণ ছিল৷ আজ যেন জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটা প্রাণশূন্য। যে বাড়িতে এতদিন মানুষের দেখা মেলাই কঠিন ছিল। আজ সে বাড়িতে গিজগিজে মানুষ। সদর দরজা অব্দি পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হলো সুহাস, নামীকে। আইয়াজ ভীড় ঢেলে আগে যাচ্ছিল। সুহাস, নামী এসেছে দেখেই জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দু’দিকে ভাগ হয়ে গেল। সুহাসের পা দু’টো নড়ছে না। শরীর টলছে। নামী শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। এগুচ্ছে একটু একটু করে। সুহাস শোকে স্তব্ধ। তার ধূসর দৃষ্টিজোড়া আজ ভয়াবহ রক্তিম। নিথর দেহে মাকে দেখলেই বোধহয় রক্ত বেরুবে ওই দৃষ্টিদ্বয় বেয়ে। নামীর গলা শুঁকিয়ে কষ্ঠে রূপান্তরিত। বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত। মা হারার যন্ত্রণা জানে সে। তাই সুহাস আর সিমরানের মনের অবস্থা টের পেল। বুকের ভেতর ধকধক করছে৷ কীভাবে সামলাবে সুহাসকে? সিমরানকেই বা কী বলে সান্ত্বনা দেবে আজ? সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো ভাষাই যে জানা নেই তার কাছে।

সুহাস সদর দরজায় পা রাখতেই হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটল। তাদের সাজানো, গোছানো বিশাল বড়ো ড্রয়িং রুমের সব আসবাবপত্র একপাশে রাখা। ফ্লোরের মধ্যিখানে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে মাকে। তার পায়ের কাছে হাত, পা ছেড়ে বসে আছে সোহান খন্দকার। তার পাশে সুহাসের দুই মামা। মাথার কাছটায় বিধ্বস্ত রূপে সিমরানকে দেখতে পেল। চোখের জল শুঁকিয়ে আবারো গাল দুটো ভিজে ওঠেছে মেয়েটার৷ সারাদিনে কতবার জ্ঞান হারিয়েছে হিসেব নেই। এলোমেলো ভেজা চুল দেখে বোঝা গেল মাথায় পানি ঢালা হয়েছে বেশ কয়েকবার। চিৎকার করে কান্নাকাটি আর মাকে ডাকাডাকির ফলে গলা ভেঙে গেছে। এখন আর শব্দ করে কাঁদতে পারছে না মেয়েটা। আশপাশে পরিচিত, অপরিচিত অনেক আত্মীয়কে দেখতে পেল সুহাস৷ সিমরানের পাশে একজন সুদর্শনীয় বৃদ্ধা বসে আছেন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে বোঝা যাবে, তার চোখ দু’টি কাঁদছে না। কেঁপে কেঁপে ঠোঁটজোড়া নড়ছে শুধু। দোয়া পড়ছে। বুঝল সুহাস। কারণ বৃদ্ধাটি তার নানুমনি। যার চোখ না কাঁদলেও মনটা হুহু করে কাঁদছে। সন্তানের মরা মুখ কোন মায়ের সহ্য হয়? শেষ বয়সে এসে সন্তানের মৃত্যু দেখা একজন বৃদ্ধার জন্য নির্মমই বটে। নিশ্চল দেহে স্তব্ধ চোখে সমস্তই অবলোকন করল সুহাস। এরপর বা’পাশে ঘাড় ঘুরাল। শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল স্ত্রী নামীর দিকে। নামীর বুক ধক করে ওঠল। সুহাস সন্তর্পণে নামীর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। টলানো শরীরে এগিয়ে গেল মায়ের প্রাণহীন দেহের কাছে। ভাই এসেছে! আচমকা ভাঙা গলায় ভাইয়া ডেকে এক চিৎকার দিল সিমরান। যে চিৎকার সুহাসের হৃদয় নাড়িয়ে দিল। পুরুষ মানুষ। তবু নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দুই ভাইবোনের গগনবিদারী সে চিৎকারে পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠল। কেঁপে ওঠল সোহান খন্দকারের স্বামী সত্তা, পিতৃ সত্ত। পাশ থেকে সুহাসের মামা কান্না করতে করতে বলল,

‘ দুলাভাই ওদের কাছে যান। ছেলেমেয়ে দু’টোকে ভরসা দিন। ‘

নামী ছুটে এসে ততক্ষণে সুহাসকে ধরেছে। সিমরান ভাইয়ের বুকে সমানতালে কিল বসাতে বসাতে বিলাপ করছে,

‘ আম্মুকে ফিরিয়ে দাও ভাইয়া, ফিরিয়ে দাও আমার আম্মুকে। তুমি তো ডাক্তার ফিরিয়ে দাও আমার আম্মুকে প্লিজ। এমন কোনো ইনজেকশন দাও যাতে আম্মু জেগে ওঠে। ‘

‘ মা আর ফিরবে না সিনু। মা আর ফিরবে না। ‘

রেগে গেল সিমরান। চিৎকার করে বলল,

‘ কেমন ডাক্তার তুমি? নিজের মাকে বাঁচাতে পারবে না? ‘

বলেই ফোপাঁতে শুরু করল। সোহান এসে ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরল। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই সুহাস বাবার আলিঙ্গন ছেড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। দু’হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে নাক টেনে বলল,

‘ ও মা, আমি এসেছি৷ তোমার সুহাস। ‘

নামী এসে সুহাসের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠল। সুহাস সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। বাবার বুকে মাথা রেখে কতক্ষণ নিশ্চুপ রইল সিমরান৷ সহসা তার দুই মামি এসে বলল,

‘ দুলাভাই আপাকে গোসল করাতে হবে। সময় বেশি নেই। ‘

এশার নামাজের পর জানাজা পড়ানো হবে। কবর হবে, সোহানদের গ্রামের বাড়ির গোরস্তানে। মামির কথা শুনে তড়াক করে বাবার বুক থেকে মাথা তুলল সিমরান। হাঁটু ভর দিয়ে চলে গেল মায়ের মাথার কাছে। মাথায় কাঁপা কাঁপা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু কণ্ঠে ডাকল,

‘ আম্মু, আম্মু ও আম্মু। ‘

সুহাসও ডাকল,

‘ মা ও মা, মা। ‘

সোহান খন্দকার ওদের কাছে আসতে নিলে নানুমনি বাঁধা দিলেন। বললেন,

‘ কিছুক্ষণ চোখ ভরে দেখুক ওরা। মন ভরে মাকে ডাকুক। বাঁধা দিও না বাবা। আর তো দেখতে পারবে না। আর তো ডাকতে পারবে না। ‘

বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে ওঠলেন বৃদ্ধা। মায়া দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মৃত মেয়ে আর তার জীবন্ত দুই নাতি নাতনিকে। এরপর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ আমাকে ঘরে দিয়ে আয় কেউ। নামাজে বসব আমি। ‘
.
.
সুহাসের বন্ধু, বান্ধব সকলেই উপস্থিত। উপস্থিত সৌধদের বাড়ির সদস্যরাও। সৌধ এখন পর্যন্ত ভেতরে আসেনি৷ সে বাড়ির সামনেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকলেই বন্ধুর করুণ দশা দেখতে হবে। দেখতে হবে বিধ্বস্ত রূপী সিমরানকেও। কেন যেন সাহস পেল না ভেতরে ঢুকবার। অপেক্ষা করতে লাগল শুধু। সুহাসদের গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। গাড়ি সব রেডি। উদয়িনী আন্টির দেহ বিদায় পর্ব শেষেই বেরুবে। উদয়িনীকে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। সিমরান, সুহাস নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের মা যেন হাসছে৷ সিমরান অভিমানে ভেঙে পড়ল। থমথমে কণ্ঠে সুহাসকে বলল,

‘ দেখো ভাইয়া, আম্মু হাসছে। ‘

এটুকু বলতেই গলা জড়িয়ে এলো। নিজেকে সামলে নিল মুহুর্তেই সময় বেশি নেই। ভেবেই ভেতরটা কাঁপতে লাগল। নিঃশ্বাস রোধ। মায়ের মুখে নিষ্পলক তাকিয়ে হঠাৎ সিমরান বলল,

‘ আম্মু, অ্যাঁই আম্মু। এত অল্প সময় ছিল তোমার আমার জন্য? ‘

একটু থামল। পরোক্ষণেই হাঁপানো সুরে বলল,

‘ কেমন ঘুম ঘুমালে আম্মু? এত ডাকলাম তবু ওঠলে না? ‘

সুহাস মায়ের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে। সিমরান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলল,

‘ তোমার ছেলে কেমন ডাক্তার হলো যে মায়ের ঘুম ভাঙাতে পারছে না? লাখ লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে ডাক্তার করলে এত তাড়াতাড়ি আমাদের মা হারা করার জন্য? ‘

নামী এসে মাথায় হাত রাখল সিমরানের। সিমরান নামীকে দেখে ছোটো ছোটো করে তাকাল। বলল,

‘ এই যে আরেক ডাক্তারনি। তোমরা আমার আম্মুর ঘুম ভাঙাতে পারছ না কেন? কোনো মেডিসিন কি নেই ঘুম ভাঙানোর? ‘

নামী কেঁদে ফেলল আবার। সিমরানকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ চিরনিদ্রা ভাঙানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো ডাক্তারেরই নেই সিনু। ‘
.
.
রাত প্রায় এগারোটা। সুহাসকে নিয়ে বন্ধুরা বাড়ি ফিরে এলো। সোহান খন্দকার আজ আর ফিরবেন না৷ সৌধ, আইয়াজ, প্রাচী সহ অনেক বন্ধুরাই আছে। সুহাসের পাশে রয়েছে তারা। নেই শুধু নিধি। তার গর্ভাবস্থার শেষ ধাপ। নয়তো ঠিকই আসত। জানে সবাই। সৌধদের বাড়ি থেকে খাবার এসেছে। সৌধ আইয়াজ মিলে নামীকে দিয়ে সুহাসের রুমে খাবার আনালো। নামী খাইয়ে দিতে চাইল৷ সুহাস খেলো না৷ সৌধ জোর করল৷ বোঝাল তাকে এখন শক্ত থাকতে হবে। বাবা, বোন সবাইকে সামলাতে হবে। বোনের প্রসঙ্গ আসামাত্র সম্বিৎ ফিরল সুহাসের। থমকানো গলায় বলল,

‘ সিনু! সিনু কোথায়? সারাদিন কিছু খায়নি ও। আমার বোনটাও মরে যাবে। ‘

নামী কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘ তানজিম আন্টি আছে সিনুর কাছে। নানুমনিও আছে। আন্টি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে ওকে৷ তুমি প্লিজ খেয়ে নাও। ‘

শান্ত হলো সুহাস। ভাতের থালা ঠেলে দূরে সরিয়ে বলল,

‘ একদিন না খেলে কিছু হবে না। জাস্ট এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাব। ‘

তৎক্ষনাৎ নিচে গিয়ে ঠান্ডা পানি আনল নামী। অনেক জোরাজোরি করেও খাওয়াতে পারল না সুহাসকে৷ যত সময় বাড়ল ছেলেটা ততই ভেঙে পড়ল। মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বেরুলো,

‘ ওই অন্ধকারে কীভাবে মাকে মাটিচাপা দিয়ে এলাম আমি! ‘

সুহাসের অবস্থা দেখে দুঃশ্চিতায় পড়ে গেল সৌধ। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। মানসিক অবস্থাও বিধ্বস্ত। একটু ঘুমাতে পারলে কাজ হতো৷ কিন্তু আজ কি ঘুম আসবে ওর? অনেক ভেবে নামীকে ইশারায় বাইরে যেতে বলল। এরপর দু’জন পরামর্শ করে ঘুমের ইনজেকশন আনিয়ে সুহাসকে বুঝতে না দিয়ে কৌশলে পুশ করে দিল। সুহাস টের পেল যখন তখন সৌধর হাত চেপে ধরল। সৌধ স্মিত হেসে বলল,

‘ তোর ঘুম প্রয়োজন। ‘

এরপর সুহাসের দায়িত্ব নামীকে দিয়ে বন্ধুরা ওদের বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তখন নিচে যেতেই প্রাচী বলল,

‘ সুহাসের মামিরা খেতে ডাকছে চল খেয়ে নিই। ‘

এমন সময় পাঁচ বছরের তাহানী নিচে নেমে এলো। গুটিগুটি পায়ে সৌধর কাছে এসে বলল,

‘ সিনুপু খাচ্ছেই না। বড়ো মা আমাকে জোর করে খাওয়াতে পারে। সিনুপুকে পারেই না। ছোটো ভাইয়া? আমার আম্মুও তো আল্লাহ তায়ালার কাছে চলে গেছে। আমিত অভিমান করে না খেয়ে থাকি না৷ সিনুপুকে কতবার বললাম। কেয়ারই করল না। আজ তাহানী বেবিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ‘

হাত নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে ওঠল তাহানী৷ সৌধ ভ্রু কুঁচকে মনোযোগ দিয়ে শুনল কথা গুলো। এরপর আচমকা প্রাচীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তোরা খেয়ে নে। আমি সিনুর কাছে যাচ্ছি। ‘

কথাটা বলেই দেরি করল না সৌধ। তাহানীকে কোলে তুলে উপরে চলে গেল। উদয়িনী আন্টির রুমে।কারণ সিমরান ওখানেই আছে। নানুমনিকে মাত্রই সুহাসের বড়ো মামি এসে নিয়ে গেল। ঘরে এখন তানজিম চৌধুরী আর সিমরান। সুজা এমপির পত্নী সিমরানের কাছে রয়েছে। এতেই সকলে বেশ নিশ্চিন্ত। আর কাউকে প্রয়োজন নেই সিমরানের জন্য৷ সকলে এটা ভাবলেও সৌধর মন বলল সিমরানের পাশে তাকে ভীষণ প্রয়োজন। সৌধ ঘরে এলো। দেখল, ভাতের থালা হাতে মন খারাপ করে বসে আছে তার আম্মা। আর সিমরান বিষণ্ন মুখে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে দেয়ালের দিকে। তাহানীকে কোল থেকে সযত্নে নামাল সৌধ। মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ আম্মা, খাচ্ছে না সিনু? ‘

‘ না বাবা। এত বুঝাচ্ছি। কেমন থম ধরে আছে। এভাবে তো সমস্যা হবে। সুহাস খেয়েছে? ‘

‘ না। এক গ্লাস পানি খেয়েছে শুধু। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে এলাম। ‘

হতাশা ভরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন তানজিম। সৌধ এগিয়ে এলো। আচমকা বলল,

‘ যদি কিছু মনে না করেন আমি সিনুর সঙ্গে একা কথা বলতে চাই। ‘

সহসা ছেলের কথায় চমকে ওঠল তানজিম। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। এরপর ধাতস্থ হয়ে নেমে দাঁড়াল। সৌধ মায়ের হাত থেকে ভাতের থালা নিজ হাতে নিয়ে বলল,

‘ আমি চেষ্টা করি? ‘

শোকের মাঝেও এক টুকরো সুখ ফুটে ওঠল তানজিম চৌধুরীর চোখে। ত্বরিত ছেলেকে অনুমতি দিয়ে তাহানীকে নিয়ে চলে গেল সে। দরজা খোলাই রাখল। আম্মা বেরিয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিমরানের পাশে বসল সৌধ৷ খেয়াল করল সিনুর মনে কোনো ভাবান্তর নেই। একই ভাবে বসে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হাত পরিষ্কারই ছিল। তাই ডাল আর আলুভাজি দিয়ে ভাত মেখে সিমরানের মুখের সামনে ধরল। শীতল গলায় বলল,

‘ না খেয়ে থাকলে আন্টি ফিরে আসবে না সিনু৷ হা কর। আন্টি চলে গেছে। তার জায়গা কেউ পূরণ করতে পারবে না জানি। কিন্তু আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আমি তোর পাশে আছি সিনু। ‘

শেষ বাক্যে কী যেন মিশে ছিল। যা সহসা বুকে কম্পম সৃষ্টি করল সিমরানের। অদৃশ্য একটি ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে বিস্মিত চোখে সৌধর পানে তাকাল সে৷ দৃঢ় চোয়াল বিশিষ্ট সুগভীর চোখ দু’টোয় মলিনত্বের ছাপ স্পষ্ট। তবু অদ্ভুত এক শীতলতা খুঁজে পেল। যা প্রগাঢ় হলো তার মুখের সামনে ধরে রাখা পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতটি দেখে৷ নিমেষে ভেতর থেকে কান্না উপচে এলো সিমরানের। কিন্তু কাঁদল না সে। হতভম্ব মুখে একবার সৌধর হাত আরেকবার চোখে তাকাতে লাগল শুধু৷ সৌধ একই সুরে পুনরায় বলল,

‘ ছোটো থেকেই নিজহাতে খেতে ভালোবাসি৷ কারো হাতে খাই না৷ কাউকে খাইয়েও দিই না। আজ তোকে দিচ্ছি, নে হা কর। ‘

ভাগ্যের কী লীলা! ভারিক্কি ব্যক্তিত্বের সৌধ চৌধুরী। নিধিতে ভয়ংকর মাত্রায় আসক্ত ছিল মানুষটা। কী নির্মমভাবেই না প্রত্যাখ্যান করেছে সেদিন সিমরানকে৷ আজ সেই সৌধ কিনা সিমরানের দুর্দিনে এভাবে পাশে থাকছে৷ অবিশ্বাস্য দৃশ্যে সিমরানের চিত্ত বিচলিত হলো কিঞ্চিৎ। মনের অস্থিরতা মুখে প্রকাশ করল না। সৌধ তৃতীয়বারের মতো তাকে খাবার মুখে নিতে বলল,

‘ সিনু হা কর। ‘

সৌধের কণ্ঠে দৃঢ়তা স্পষ্ট। সিমরান লম্বা একটি শ্বাস টানল। পলকহীন দৃষ্টিতে পলক ফেলল বারকয়েক। এরপর নির্লিপ্ত ভাবে সৌধর হাতটা দূরে ঠেলে দিল। ভাতের থালা নিজহাতে কোলের ওপর তুলে নিয়ে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দু’টি দিয়ে ফের তাকাল সৌধর পানে। কণ্ঠ ভাঙা ভাঙা৷ তবু বলল,

‘ আমি কি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছি সৌধ ভাই?’

আকস্মিক কথায় সৌধর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। কেন জানি স্বাভাবিক লাগছে না সিমরানকে। সে কিছু বলতে উদ্যত হবে তক্ষুনি আবারো সিমরান বলল,

‘ আমি তোমার ভালোবাসা চেয়েছিলাম সত্যি। কিন্তু দয়া চাইনি একটুও। আমি জানি এমন সময় সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন। কিন্তু তোমার থেকে এটা নিতে আমার কষ্ট বাড়বে।

‘ সিনু! ‘

সৌধর কণ্ঠে বিস্ময়। সিমরান থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আমি নিজ হাতেই খাব। তুমি আমার কথা ভেবে এটুকু সহায়তা করতে এসেছ। এজন্য থ্যাংকিউ। ‘

গলায় কান্না আঁটকে কথাটা বলেই নিজহাতে ভাত তুলে মুখে দিল। না চিবিয়ে গিলে ফেলল নিমেষে। বলল,

‘ আমি বিজনেসম্যান সোহান খন্দকারের মেয়ে। ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে আমি। ডক্টর সুহাসের বোন আমি। আর ডক্টর নামীর ননদ। আমার জন্য এদের ভালোবাসা আর সাপোর্টই যথেষ্ট। তোমার ভালোবাসা পাইনি৷ দায়টুকুরও প্রয়োজন নেই। এই দেখো একাই খেতে পারি। যাদের মা নেই তাদের তো একা একাই খেতে হয়। ‘

বলেই আবারো একনাগাড়ে ভাত তুলে মুখে দিতে লাগল। না ঠিকভাবে ডাল, আলুভাজির সঙ্গে মাখালো আর না চিবালো। সৌধ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,

‘ সিনু আস্তে, আস্তে গলায় আঁটকে যাবে। ‘

শুনল না সিমরান। ওর অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সৌধ। আজকের মতো একটি দিনে হয়তো ধমক দেয়া ঠিক হবে না। তবু কঠিন চোখে তাকাল।
ওর ভালোর জন্যই দৃঢ় কিন্তু নিচু গলায় ধমকও দিয়ে ফেলল। যে ধমকে কেঁপে ওঠল সিমরান। এতক্ষণ যা গিলেছিল সব বেরিয়ে এলো সহসা। সে মুখে হাত চেপে ধরলেও লাভ হলো না। হাতের দু’পাশ দিয়ে সব বেরিয়ে বিছানা নষ্ট হলো। চোখের সামনে এমন অবস্থা দেখে সৌধ উঁচু গলায় তার আম্মাকে ডাকতে লাগল। পাশাপাশি পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলো সিমরানের কাছে। মুখের কাছে গ্লাস ধরে কঠিন গলায় রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,

‘ পানি খা। ‘

পানি খেল সিমরান। সৌধর শরীরটা রাগে তখনো কাঁপছে। সিমরান শান্ত হয়ে এলে রাগটুকু আর প্রকাশ করল না। শুধু বলল,

‘ মেয়েদের জেদ থাকা ভালো, তেজও ঠিক আছে। কিন্তু ভুল স্থানে, ভুল মানুষে, ভুল বুঝে জেদ, তেজ কোনোটাই ভালো না। ‘

এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেল। চোখ বুজে একটুক্ষণ কী যেন ভেবে চোখ মেলল আবার। সাদা পোশাকে, বিষণ্ন মুখশ্রীর সিমরানের দিকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে, ডক্টর সুহাসের বোন তাই তো? ‘

কথা আঁটকে এলো তবু সিমরান জবাব দিল,

‘ বিশ্বাস হয় না? ‘

তীক্ষ্ণ রাগ ঝড়ে পড়ল যেন। সৌধ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,

‘ ডক্টর নামীর ননদ?’

দু-চোখে এবার অশ্রু ঝড়ে পড়ল সিমরানের। সৌধ দৃষ্টি সরিয়ে নিল মুহুর্তেই বলল,

‘ নিজেকে একা সামলে প্রমাণ করে দে তোর কাউকে প্রয়োজন নেই। পারবি? ‘

চোখের পানির মাত্রা বাড়ল। নিঃশ্বাসে বাড়ল অস্থিরতা। তবু চোখ বুজে ঠোঁট কামড়ে কান্নারত গলায় দৃঢ় শব্দে সিমরান বলল,

‘ পারব। ‘

সহসা একপেশে হাসল সৌধ। অতি সন্তর্পণে ওঠে দু’হাত পকেটে গুঁজে দিয়ে কয়েক কদম হেঁটে গেল দরজার দিকে। নিমেষে ঘাড় বাঁকিয়ে ফিরে তাকাল একবার। নিচু কণ্ঠে সিমরান শুনতে পাবে এমন করে বলল,

‘ বেস্ট উইশেষ। ‘

তানজিম চৌধুরী এলেন সেই মুহুর্তে। বললেন,

‘ খেয়েছে? ‘

সৌধ রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে মৃদু স্বরে আম্মাকে বলে গেল,

‘ খাবে। খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি থাকুন ওর কাছে। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৯|
লোকমুখে একটি কথা প্রায়শই শুনত সুহাস৷ আজ মরলে কাল দু’দিন। নিঃসন্দেহে কথিত সেই বাক্যটি চিরন্তন সত্য। উদয়িনী নেই আজ একমাস দশদিন। এত গুলো দিন চলে গেল। মা নেই। বাড়ি ফিরে বোনের রুগ্ন দেহ আর শুষ্ক মুখ দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল সুহাসের। দু’দিনের ছুটি। তাই ছুটে চলে এসেছে মায়ের স্বপ্নের বাড়িতে। আফসোস মা নেই। দীর্ঘশ্বাস মা আর কোনোদিন আসবে না৷ গম্ভীর রূপে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এ বাড়িময় আর বিচরণ করবে না। সে এসেছে বাবা আর বোনের কাছে। বোনটা যে তার চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে। সুহাস আসার আধাঘন্টা পরেই নামীর উপস্থিতি ঘটল। ড্রয়িং রুমে ঢুকে সুহাসকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল নামী।

মা মারা যাওয়ার পর থেকে বেশ পরিবর্তন এসেছে সুহাসের মাঝে। এই পরিবর্তনে দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা হচ্ছে নামীর সঙ্গে তার দূরত্ব। যত সময় গড়াচ্ছে দূরত্ব বাড়ছে বৈ কমছে না৷ নামী ঠিকই তার খেয়াল রাখার চেষ্টা কারে৷ কাজের সূত্রে দূরে থাকলেও নিয়ম করে খোঁজ নেয়৷ ফোন করে রোজই৷ কিন্তু সুহাস ফোন ধরতে চায় না। বার বার ফোন করার পর এক প্রকার বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে। কথা বলে প্রচণ্ড উদাসীনতা নিয়ে। যা টের পায় নামী। খারাপ লাগে ওর। কষ্টও হয়। তবু ধৈর্য্য ধরে থাকে। সদ্য মা হারিয়েছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই আশায় অপেক্ষা করে। পুরোনো সুহাসকে ফিরে পাবার৷ এই যে আজ সে বাড়িতে আসবে। গতকাল বলেছিল সুহাসকে। জিজ্ঞেস করেছিল, সুহাস আসবে কিনা। উত্তর দেয়নি সুহাস। নিরুত্তর ছিল। সুহাস আসবে না। নামীর আসারও বাধ্যবাধকতা নেই। তবু এসেছে। শশুর আর ননদের সঙ্গে সময় কাটাতে। ফাঁকা বাড়িতে সিমরান সারাদিন একাই থাকে। ভাবি হিসেবে তার কিছু দায়িত্ব, কর্তব্য আছে। তাই এসেছে। তাছাড়া এই সংসারের ভাড় এখন তার ওপরই। যতই চাকরি করুক, ব্যস্ত থাকুক৷ দিনশেষে সংসার নামক জীবনটাকেও আগলে রাখতে হবে। নামীকে দেখে সিমরান অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশি হলো। সুহাস দেখেও না দেখার ভাণ ধরে বসে রইল৷ নামী এগিয়ে এসে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ গতকাল জিজ্ঞেস করেছিলাম আসবে কিনা। কেন বলোনি? ‘

বোনের সঙ্গে বসে ফোনে কী যেন দেখছিল সুহাস। সেলিনা আপা দু কাপ কফি দিয়ে গেল। নামীকে দেখে খুশি হলো সেলিনা আপাও। বলল,

‘ ভাবি আসছেন! কেমন আছেন? ‘

‘ ভালো। তুমি ভালো আছো? এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো। ‘

বলতে বলতে সুহাসের পাশে গিয়ে বসল নামী। চুল গুলো ঠিক করতে করতে সিমরানের দিকে তাকাল। সিমরান মৃদু হেসে বলল,

‘ কেমন আছো ভাবিপু? ‘

সিমরানের মুখ পানে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল নামী।
মেয়েটা এখন তাকে নামীপু না বলে ভাবিপু ডাকে।
***
ছুটি শেষ। তাই উদয়িনী মারা যাওয়ার সাতদিনের মাথায় সুহাস, নামী দু’জনকেই চলে যেতে হলো। যাওয়ার সময় নামীকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে সিমরান। বলে,

‘ আমার আম্মু খারাপ মানুষ নয় নামীপু৷ জানো আম্মু চেয়েছিল পুরোনো সব তিক্ততা ভুলে তোমাকে আপন করে নিতে। অনেক ধুমধাম করে এ বাড়িতে তোমাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। আমি আর আম্মু মিলে কত প্ল্যান করেছিলাম। ভেবেছিলাম যেদিন এ বাড়িতে আবার আসবে সেদিন থেকে তোমাকে ভাবিপু বলে ডাকব। তুমি তো আমার ভাইয়ের বউ। আমরা সবাই তোমাকে মেনে নিয়েছি। সবাই ভালোবাসি তোমাকে। ‘
***
সিমরানের প্রশ্নে নামী উত্তর দিল,

‘ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? মুখটা শুঁকিয়ে গেছে। ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করো না নিশ্চিত? বাবা কোথায়? ‘

সিমরান হাসল কিঞ্চিৎ। অনেকদিন পর ভাই, ভাবিকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছে তার। সিমরানের সাথে কথা বলার ফাঁকে সুহাসের দিকে তাকাল নামী। মৃদুস্বরে বলল,

‘ কিছু বলেছি তোমায়। ‘

সুহাসের মাঝে ভাবান্তর হলো না। সিমরান সুহাসের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ কী ব্যাপার ব্রো? ভাবিপুর সাথে অভিমান করেছ নাকি? ‘

উত্তর দিল না সুহাস। নামীর মেজাজ খারাপ হলো। রাগান্বিত হয়ে সুহাসের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,

‘ সুহাস কিছু বলেছি তোমায়। ‘

নিমেষে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। সিমরান, নামী দু’জনই চমকে ওঠল ওই দৃষ্টি দেখে। ভয়াবহ ক্রোধে জর্জরিত সুহাস৷ সে আর এক মুহুর্ত ওখানে বসল না। ফোনটা নিয়ে তড়াক করে ওঠে উপরে চলে গেল৷ নামী হতভম্ব হয়ে ঠাঁই বসে। সিমরান ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বলল,

‘ কী হয়েছে ভাইয়ার? ‘

নামীর চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অজান্তেই বেরুলো। নিমেষে তা আবার তর্জনী দিয়ে মুছে মৃদু হেসে বলল,

‘ মা চলে যাওয়ার পর থেকে একটা দিনও আমরা এক বিছানায় ঘুমাইনি সিনু। আর না একসঙ্গে বসে ভালো মন্দ দু’টো কথা বলেছি। আমি চেষ্টা করেছি কাছে যাওয়ার কথা বলার। ও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ফোন দিলে ফোন রিসিভ করে না। বার বার দেয়ার পর যদিও বা একবার রিসিভ করে যা বলি তার উত্তর দিয়েই কেটে দেয়। আমার ওখানে যেতে বললে যায় না৷ আজ বাড়ি আসবে কিনা কতবার জিজ্ঞেস করলাম বলল না। অথচ এসেই ওকে দেখলাম। জানালে কী হতো? একসঙ্গে আসতে পারতাম না বলো? ‘

উদয়িনী বেঁচে থাকাকালীন নামী কখনো তাকে মা বলেনি। এই প্রথম আজই বলল। সিমরাম খুশি হলো এতে। কিন্তু সুহাসের ব্যাপারে বলা কথা গুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার ভাই এমন করছে! এত রাগ কেন ভাবিপুর প্রতি? কীসের এত্ত অভিমান? গা শিউরে ওঠল আচমকা। জিজ্ঞেস করল,

‘ কারণ? ‘

নামী বলল,

‘ প্রথমে ভেবেছিলাম সদ্য মা হারিয়েছে তাই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সুহাস আমাকে ভুল বুঝছে। ‘

‘ কেন? ‘

‘ মা চেয়েছিলেন ধুমধাম করে আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে। আমি সময় নিচ্ছিলাম। এত বেশি নিলাম যে উনি আর পৃথিবীতেই রইলেন না। ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। নিঃশ্বাস আঁটকে এলো সিমরানের। সত্যি বলতে এ বিষয়টা নিয়ে তারও আফসোস আছে। মায়ের শেষ ইচ্ছে এটাই ছিল। যা পূরণ হয়নি। ভাবিপু সময় নিয়েছে এটা কি দোষ হতে পারে? সে তো জানত না মা এক্ষুনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে৷ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে সিমরান বলল,

‘ তুমি মন খারাপ করো না ভাবিপু৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। না হলে আমি, আব্বু মিলে বুঝাব ভাইকে। ‘

স্মিত হাসল নামী৷ সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বলল,

‘ ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি। রাতে কী খাবে বলো। ‘

সিমরান মৃদু হেসে কী খাবে জানালো। নামীও ত্বরিত পা বাড়াল উপরে। গোসল করে বাইরের পোশাক বদলে তারপর নিচে আসবে৷ নিজহাতে রান্না করবে শশুর, স্বামী আর ননদের জন্য।
.
.
অনেকদিন পর বাড়িটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। একসঙ্গে খেতে বসে এটাই ভাবল সোহান খন্দকার। ছেলে, ছেলে বউ আসাতে ভীষণ খুশি সে। নামী আজ একা হাতে তাদের জন্য রান্না করেছে। সব সুহাস, সিমরানের পছন্দের খাবার৷ এসব খাবার পছন্দ সোহান খন্দকারেরও। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক গল্প করছিল সোহান। গল্পের ফাঁকে খেয়াল করল, সুহাস খাচ্ছে না৷ আঙুল দ্বারা নাড়াচাড়া করছে শুধু৷ তাই শুধাল,

‘ সুহাস খাচ্ছিস না কেন? খাবার ভালো হয়নি? ‘

নামীও খেয়াল করেছিল। সুহাস খাচ্ছে না৷ কিছু বলার সাহস করে ওঠতে পারছিল না। বাবা বলায় ভরসা পেল। কিছু না ভেবেই বলে ফেলল,

‘ আমার ওপর রাগ থাকতেই পারে। খাবারের ওপর তো নেই। ভণিতা না করে খেয়ে নাও সুহাস। ‘

নামী কথাটা বলেছে মাত্র। অমনি ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ওঠে দাঁড়িয়েছে সুহাস। তার কাণ্ড দেখে কয়েক পল হতবাক ছিল সোহান খন্দকার। সুহাস যখন খাবার ঠেলে চলে যেতে উদ্যত হলো তখন চমকাল সে৷ আকস্মিক সুহাসের হাত টেনে ধরে মৃদু ধমক দিল,

‘ এটা কী ধরনের আচরণ সুহাস! বসো, বসো বলছি। খাবার ফেলে এভাবে যাবে না৷ ‘

বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারল না সুহাস। নামীর দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একবার। এরপর চুপচাপ বসে খেতে শুরু করল৷ বাবা, মা যে জীবনের কতবড়ো সম্পদ। মা চলে যাবার পর থেকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মায়ের অভাব বাবা পূরণ করতে পারে না। কিন্তু সোহান খন্দকার নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছে ছেলেমেয়েদের আগলে রাখতে। যতই সুহাস প্রতিষ্ঠিত হোক। বিবাহিত হোক। দিনশেষে তারও মাথার ওপর ছায়ার প্রয়োজন পড়ে। যা সোহান খন্দকার দিচ্ছে পরিপূর্ণ ভাবে। তাই তো এখন বাবার প্রতি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে ছেলেমেয়ে দু’টো। খাওয়া শেষে সুহাস চলে গেলে সোহান খন্দকার নামীকে জিজ্ঞেস করল,

‘ সুহাস তোমার ওপর রেগে আছে মা? ‘

নামী জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। গ্লাসে পানি ভরতে ভরতে বলল,

‘ তেমন কিছু না বাবা৷ জানেনই তো আপনার ছেলে কেমন রগচটা। অল্পতেই রেগে যায়। ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না। ‘

সোহান খন্দকারের পৃথিবী বলতেই সুহাস, নামী আর সিমরান৷ তিনজনকে নিয়ে ভাবে মানুষটা। চিন্তা করে খুব৷ নামী বুঝে সবটা। তাই তাকে চিন্তায় ফেলতে চায় না বলে সবটা চেপে গেল। মিথ্যে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলল নিজের যন্ত্রণা গুলো।
.
.
সিমরানের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে নিজেদের ঘরে ফিরল নামী। তার আর সুহাসের ঘর। সুহাস অবশ্য এখন ঘরে নেই৷ বাইরে গেছে হয়তো। ভেবেই লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদু পায়ে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সময় নিয়ে চুল গুলো আঁচড়ে বিনুনি গাঁথল। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিয়ৎক্ষণ। হৃদয় পুলকিত হলো৷ আগের চেয়ে মুখে গ্ল্যামার বেড়েছে তার। শুধুই কি মুখে? দু পা পিছিয়ে গিয়ে আপাদমস্তক দেখল নিজেকে। শারীরিক গঠন আগের চেয়েও আকর্ষণীয় লাগছে। বডিশেপটাও মারাত্মক আকর্ষণীয়। আপনমনে নিজেকে নিয়ে এসব ভেবেই তীব্র লজ্জায় আরক্ত হলো মুখশ্রী। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরণ জেগে ওঠল হঠাৎ। পুলকিত চিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার পানে তাকাল একবার। সুহাস কখন আসবে? সুহাসের অপেক্ষায় বিছানায় গিয়ে বসে রইল। সহসা কেঁপে ওঠল হোয়াটসঅ্যাপের ম্যাসেজ টোনে৷ ত্বরিত ফোনটা হাতে নিতেই দেখল, ফারাহ ম্যাসেজ করেছে।

‘ কেমন আছিস দোস্ত? জানিস গতকাল নিধি আপুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল আয়াজ। আপুর ছেলেটা দেখতে মাশাআল্লাহ। কী কিউটরে! দাঁড়া তোকে ছবি পাঠাচ্ছি। ‘

হেসে ফেলল নামী। নিধি আপুর ছেলে! উদিয়িনীর মৃত্যুর ছয়দিন পর নিধির ডেলিভারি হয়। ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় সে। সে সময় তাদের মানসিক অবস্থা এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যে তারা কেউ দেখতে যেতে পারেনি৷ স্বাগতম জানাতে পারেনি বাচ্চাটাকে।
পরে অবশ্য সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী আপু গিয়েছিল। কিন্তু সে যেতে পারেনি। তাই তরান্বিত হয়ে রিপ্লাই করল,

‘ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? ‘

ফারাহ উত্তর দিয়ে গোটা দশেক ছবি পাঠাল। নামী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল প্রতিটা ছবি। চোখ দু’টো তার প্রশান্তিতে ভরে ওঠল যেন৷ ত্বরিত লিখল,

‘ হাউ কিউট! মাশাআল্লাহ। নিধি আপুর মতোই হয়েছে রে। নাম কী বাবুর?’

‘ অনিরূপ শিকদার। অর্পণ স্যারের অ আর নিধি আপুর নি নিয়ে ছোট্ট করে সবাই নাকি অনি ডাকে। জানিস, বাবুটাকে দেখে এসে আয়াজ সারারাত ঘুমাতে পারেনি। এত্ত বাবু পাগল ছেলেটা। ভুলতেই পারছিল না অনিকে। তাছাড়া নিজের বান্ধবীর মেয়ে তো। ওদের বন্ধু মহলের ফার্স্ট বেবি। টানটা একটু বেশিই৷ আর জানিস কী করেছে? সে আবদার করেছে। তারও অনির মতো কাউকে চাই। বাবা হতে চায় সে। ‘

ম্যাসেজটা দিয়েই লজ্জা পাওয়ার ইমোজি দিল ফারাহ। নামী শিউরে ওঠল সহসা৷ ফারাহকে বলল,

‘ আয়াজ ভাইয়ের আবদার পূরণ কর ফারাহ। মা হওয়ার বয়স হয়েছেই আমাদের। এবার মা ডাক শোনা উচিত। ‘

ফারাহকে ম্যাসেজটা দিয়েই মন খারাপ হয়ে গেল নামীর। তার বয়স কত হলো? ছাব্বিশ চলছে। এবার তো একটা বেবি নিতে পারে৷ মুহুর্তেই চমকে ওঠল সে। গত মাসে পিরিয়ড মিস গেছে তার। এ কথা বেমালুম ভুলে গেছিল। আচমকা মনে পড়ায় হাত, পা কাঁপতে শুরু করল অনবরত। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগল। আকস্মিক শাশুড়ির মৃত্যু, কর্ম জীবনে ব্যস্ততা, সুহাসের দূরত্ব সব মিলিয়ে সে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে হেলাফেলা করেছে!

সুহাস কোথায়? চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল নামীর। তর আর সইল না যেন। মন বলল এক্ষুণি টেস্ট করতে। কিন্তু কিন্তু…কীভাবে? সুহাসকে ফোন দিয়ে বলবে, প্র্যাগ্নেসি কীট নিয়ে আসতে? না থাক। আগে নিজে একা একা পরীক্ষা করবে। রেজাল্ট পজেটিভ হলে তারপর জানাবে সুহাসকে। একদম চমকে দেবে। স্ত্রীর থেকে পাওয়া একজন পুরুষের জীবনের বেস্ট গিফট তো এটাই৷

নামী যখন এসব ভাবনায় মশগুল। তখন ঘরে ফিরল সুহাস। নামীকে দেখেই কপাল কুঁচকে ফেলল। নামী সুহাস এসেছে দেখেই বিগলিত চিত্তে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল। সুহাস তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেলকনিতে চলে গেল। কিয়ৎক্ষণ পর নামীর নাকে এলো সিগারেটের গন্ধ। সুহাস সিগারেট খাচ্ছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো! ক্রোধে জর্জরিত হলো মন। এতটা অধঃপতন! মেনে নিতে পারল না৷ সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না নামী। তাই আচমকা কড়া গন্ধে নাক চেপে ধরে কেশে ওঠল।কাশতে কাশতে এক পর্যায় পেটে মোচড় খেয়ে গা গুলিয়ে ওঠল তার। ছুটে চলে গেল বাথরুমে। বেলকনিতে দাঁড়িয়েই সুহাস শুনতে পেল, নামীর কাশির শব্দ। গলগল করে বমি করছে এটাও টের পেল৷ নিমেষে বিরক্ত হয়ে সিগারেট ফেলে দিল বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একদম নিচে। এদিকে বমি করে মাথা ধরে গেল নামীর। চোখ, মুখে পানি দিয়ে রুমে এসে বিছানায় বসতে বসতে হাঁপিয়ে ওঠা স্বরে ডাকল সুহাসকে,

‘ সুহাস, এই সুহাস এদিকে এসো না…। ‘

সুহাস শুনল তবু এগিয়ে এলো না। এবার কান্না করে দিল নামী। ক্রন্দনরত কণ্ঠে ফের ডাকলে বিরক্ত মুখে সুহাস এলো। তাকে দেখে শান্ত হলো নামী। বলল,

‘ আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে সুহাস। ‘

সুহাস ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ বমি হলো তাই৷ শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। ‘

‘ তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে বলে! ‘

আর জবাব দিল না সুহাস৷ চুপচাপ বাতি নিভিয়ে বিছানার অপর পাশে শুয়ে পড়ল। নামীর এত্ত খারাপ লাগল যে আর একটিও কথাও বলতে পারল না। সেও নিশ্চুপ শুয়ে রইল এক কোণে৷ অন্ধকার ঘরে নিশ্চুপ তারা দু’জন। দু’জনার মাঝে দূরত্ব একহাত সমান৷ হঠাৎ নামীর কেমন ভয় ভয় লাগল। এর আগে কখনো এত ভয় করেনি৷ আজ ভয় পাচ্ছে কেন? অজান্তেই নিজের একটা হাত পেটে রাখল। বুলাতে বুলাতে বলল, কোনো ভয় নেই। এরপর জড়োসড়ো হয়ে সুহাসের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে রইল।

সুহাস অনুভব করল নামীর স্পর্শ। কিন্তু ফিরে তাকাল না। ঠিক যেন রোবট সে। এভাবে শুয়ে রইল। বুকের ভেতর চলল তীব্র অশান্তি। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা এভাবে তিনঘন্টা অতিক্রম হলো। নামীর শরীর দুর্বল ছিল। তাই সে ঘুমিয়ে গেছে৷ কিন্তু সুহাসের ঘুম হলো না। সে ফোন হাতে নিয়ে সৌধকে ফোন করল। সৌধ ফোন ধরল না। আর কাকে ফোন করবে? এ সময় কে জেগে আছে তাকে সঙ্গ দিতে? রাত গভীর। পাশে স্ত্রী। তবু তীব্র একাকীত্বে ভুগতে লাগল সুহাস। যে একাকীত্বের সুযোগ পেয়ে শয়তান তার মস্তিষ্ক বিগড়ে দিল। পুরোনো নাম্বার ঘেঁটে ঘেঁটে সে ফোন করল তার পুরোনো গার্লফ্রেন্ডদের মধ্যে ইসমা নামের একটি মেয়েকে। আশ্চর্য হলো দুবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হওয়ায়। এরপর কথা বলতে বলতে আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন যখন ইসমার সাথে কথা বলে নিজের মাঝে ভালো লাগা অনুভব করতে শুরু করল। এতক্ষণ যে অশান্তিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল, সে অশান্তি এক নিমেষে দূর হয়ে গেছে বুঝতে পেরেই ইসমার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করল। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা এভাবে ভোর পর্যন্ত কথা বলল ওরা।

ফজরের আজান দিতেই নামীর ঘুম ছুটে গেল। সে শুনতে পেল মৃদু স্বরে সুহাস কথা বলছে কারো সাথে। কী বিনয়ের সুর৷ সে সুর শুনতে শুনতে আকস্মিক মস্তিষ্ক সচল হলো তার। তড়াক করে ওঠে বসেই শুধাল,

‘ কার সঙ্গে কথা বলছ সুহাস! ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৫০|
এক সময়ের প্লেবয় খ্যাত সুহাস এখন বিবাহিত। এ সম্পর্কে সবাই অবগত। রোমিও সুহাস এখন আর আগের মতো নেই৷ বিয়ের পর বদল ঘটেছে বিস্তর।
আকস্মিক বদলে যাওয়া এই ছেলেটি যখন বহু বছর পর ইসমাকে ফোন করে। প্রচণ্ড অবাক হয় ইসমা। বিস্ময়াপন্ন হয়ে ফোন রিসিভ করে। এরপর ভালো, মন্দ কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। ইসমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। স্বামী বিরাট বড়ো বিজনেস ম্যান। নিজের প্রাক্তন সুহাসকে এ কথা জানাতে ভুলে না সে৷ এক সময় সুহাসের প্রতি ভীষণ দুর্বল ছিল ইসমা৷ সে জানত সুহাস তাকে প্রকৃত ভালোবাসে না৷ তবু ক্ষণিকের একটি সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল তারা। অগণিত প্রেমিকার ভীড়ে সেও ছিল একজন৷ চেষ্টা করেছিল সুহাসের হৃদয়ে পৌঁছাতে। কিন্তু পারেনি৷ সুহাস সম্পর্কে সিরিয়াস ছিল না কখনোই৷ কাপড় বদলানোর মতো গার্লফ্রেন্ড বদলানো স্বভাব যার তার কি আর সাধারণ ঘরের ইসমাতে মন আঁটকায়? এরপর আচমকাই একদিন জানতে পারে সুহাস বিয়ে করেছে। তার সাথে ব্রেকআপ বিহীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল বহু আগেই। সুহাসের বিয়ের খবর শুনে সেদিন প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল সে। রাত জেগে কেঁদেছিল খুব৷ সবচেয়ে অবাক হয়েছিল যখন সুহাসের বউকে দেখল। বিশ্বাস করতে পারছিল না গায়ের রঙ চাপা এমন একটি মেয়ে সুহাসের বউ৷ এত সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েদের সঙ্গে টাইমপাস করে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করল শ্যামবতী নামীকে! পুরুষ মানুষের মন বোঝা খুব কঠিন৷ আর সুহাসের মন তো জিলিপির প্যাঁচকেউ হার মানায়৷ সেদিনের কষ্টকে স্মরণ করে প্রাক্তন প্রেমিককে কৌশলে অনেক কথাই বলে ইসমা৷ তার হবু বর দেখতে কেমন, বাড়ি কেমন, কয়টা গাড়ি আছে সবই বিবৃতি করে শোনায়। বোঝানোর চেষ্টা করে সুহাসের চেয়ে বহুগুণে গুণান্বিত কেউ তার জীবনে আসতে চলেছে। সুহাসও কম নয়। সে এখন কোথায় কী করছে, তার ওয়াইফ কী করছে সবটাই জানায়। নিজের বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্য বলে না৷ নামীর সঙ্গে সে যে রাগ করে আছে, তীব্র অভিমানে জর্জরিত হয়ে আছে সেটিও লুকায়। সে শুধু তার দাম্পত্য জীবনের ভালো ভালো কথাগুলো বিবৃতি করতে থাকে। নামী তাকে কত ভালোবাসে, কেয়ার করে সবই বলে। সুখের গল্প শেষে দুঃখের গল্পও করে। হঠাৎ করে মা চলে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি৷ রাতে ঘুম আসে না। ঘুমালেই দুঃস্বপ্ন দেখে। এই রাতবিরেতে বন্ধুদের ফোন করে পেল না। তার স্ত্রীও অসুস্থ। তাই হঠাৎ ইসমাকে মনে পড়ল বলেই কল দেয়া। ইসমা শুনে হাসে। তারা আবারো তাদের গল্প জমে ওঠে। এভাবে রাত পেরিয়ে যায়। নামীর ঘুম ভাঙে। চকিতে ওঠেই প্রশ্ন করে সুহাসকে কার সাথে কথা বলছে? সুহাস উত্তর দেয় না৷ ইসমার সঙ্গে কথার সমাপ্তি টানে৷ ফোন কেটে বিছানা ছাড়তেই হঠাৎ নামী তার হাত টেনে ধরে। তীব্র ক্রোধে জর্জরিত হয়ে শুধায়,

‘ কতদিন ধরে চলছে এসব? ‘

‘ বলতে বাধ্য নই। ‘

নামী বরাবরের শান্তশিষ্ট। খুব সহজে রাগে না৷ আজ এই মুহুর্তে তার কী হলো কে জানে? নিজের ক্রোধটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না একদমই। আচম্বিতে ওঠে গিয়ে সুহাসের কলার চেপে ধরল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,

‘ কার সঙ্গে কথা বলছিলি? কতদিন ধরে চলছে এসব? বলতে বাধ্য নই মানে আলবাত বাধ্য।’

নামীর আচরণে যারপরনাই অবাক হলো সুহাস। সহসা নামীর হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে বাতি জ্বালালো সে। এরপর বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো নামীর অগ্নিদৃষ্টি আর ক্রোধে জর্জরিত মুখশ্রীর পানে। নিমেষে বুক কেঁপে ওঠল। ইতিপূর্বে নামীকে এই রূপে দেখেনি সে। আর ওর মুখে তুই তুকারি! সে তো দুঃস্বপ্ন। সুহাস হতভম্ব মুখে তাকিয়ে। নামী বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল। যেন কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। হাঁপানি রোগিদের মতো শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। সুহাস হতবাক হয়ে তাকিয়ে। রাগ, অভিমানের ঊর্ধ্বে বুকের খুব গভীরে নামীর জন্য খারাপ লাগা অনুভব করল। দেখতে পেল কিয়ৎক্ষণ পূর্বে অগ্নিমূর্তি ধারন করা মেয়েটা
ধীরেধীরে শান্ত হয়ে গেল। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসল বিছানার একপাশে। মুখটা বিধ্বস্ত লাগছে ওর৷ এরপর সুহাসকে অবাক করে দিয়ে দু-হাত মুখে চেপে ডুকরে ওঠল নামী৷ সুহাসের ইচ্ছে করল ছুটে কাছে যেতে। কাঁধে হাত রাখতে। মাথায় হাত বুলাতে৷ বুকের ভেতর আগলে নিয়ে সান্ত্বনা দিতেও ইচ্ছে করল৷ ইচ্ছে করল বলতে,

‘ কাঁদছ কেন নামীদামি? এই তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবি না৷ কতদিন ধরে না, জাস্ট আজকেই ফোন করেছি৷ বন্ধু হিসেবেই কথা বলছিলাম এর বাইরে কিচ্ছু না। তোমার সুহাস তোমারি আছে। ডোন্ট ক্রাই নামী, ডোন্ট ক্রাই। ‘

ইচ্ছে গুলোকে দমিয়ে নিল সুহাস। বুকের ভেতর যে পাথর চাপা আছে। সে পাথর যে পর্যন্ত সরে না যাচ্ছে। নামীর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারবে না সে৷ রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সুহাস৷ মাথাটা ঘুরছে তার। নিজের খারাপ লাগাকে বুঝতে দিল না নামীকে। শার্টের কলার ঠিকঠাক করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মুহুর্তেই। নামী টের পেল সুহাস বেরিয়ে গেছে। যার ফলে তার কান্নার মাত্রা বাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে মাথা চক্কর দিল। ক্ষণে ক্ষণে গা গুলিয়েও ওঠল৷ শেষ পর্যন্ত বাথরুমে গিয়ে বমি করে শান্ত হলো সে।
.
.
সূর্যদয় দেখতে ভীষণ ভালোবাসে সৌধ। ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি গায়ে মাখাতে পছন্দ করে বেশ। আজ হসপিটালে যেতে হবে না। তাই জগিংয়ে বেরুলো। প্রকৃতি প্রেমী মানুষ সে। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চটজলদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঝকঝকে সাদা রঙের রানিং সুজ, গাঢ় নীল রাঙা শর্টস আর সাদা রঙের টিশার্ট পরিহিত সৌধ। এখানকার স্থানীয় কিছু যুবক রয়েছে। যারা বয়সে তার ছোটো৷ কিন্তু রাজনীতির সাথে সংযুক্ত। সেই সুবাদেই সৌধর সঙ্গে তাদের বেশ খাতির। সৌধ যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়৷ তবু বাবা, ভাইয়ের উছিলাতে সব জায়গাতেই রাজ করে বেড়ায়৷ আয়েশ করে কাটিয়ে দেয়৷ চট্রগ্রাম শহরেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ সাতসকালে জগিংয়ে বের হলেও নয়, দশজন ছেলেপুলে সঙ্গ দিতে চলে আসে৷ সৌধ বুঝতে পারে এসবের পেছনে তার বাবা, ভাইয়ের সুকৌশল দায়ী। তবু চুপ রয়। উপভোগ করে বেশ।

যে বাসায় ভাড়া থাকে সৌধ। সে বাসার মালিকের কনিষ্ঠ কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। নাম আভিরা খান। এবার বাড়ি এসে প্রথমেই তার নজর পড়েছে ডক্টর সৌধ চৌধুরীর ওপর। প্রথম দেখা হয় বাড়ির গেটের সামনে। প্রথম কথোপকথনে জেনে নেয় সৌধর ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে সৌধর ব্যক্তিত্ব। রূপ, লাবণ্যের কমতি নেই আভিরার। প্রথম দর্শনে যে কোনো পুরুষই কপোকাত হতে বাধ্য। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা। চোখ দু’টি কাজল কালো নয় তবে আকর্ষণীয়। চোখের বর্ণ ধূসর। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত। স্বাস্থ্য মোটামুটি। সব মিলিয়ে শহরের সেরা দশজন সুন্দরীদের মধ্যে একজন হওয়ার মতোন। সেই আভিরার দিকে সৌধ একবার ছেড়ে দু’বার তাকায়নি। খেয়াল করে আভিরা। অত্যন্ত সুকৌশলে দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে সৌধ কেমন স্বল্প আলাপ করল তার সঙ্গে। যা তার যুবতী চিত্তকে অশান্ত করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে রাতের ঘুম। বাড়ি এসে বেলা করে ঘুমোনোর অভ্যাস বদলেছে। শুধুমাত্র সৌধ চৌধুরীকে এক পলক দেখার লোভে। কথা বলার তৃষ্ণায়। রোজ সৌধ যখন জগিংয়ে বেরোয় এই সময়টাতে আভিরাও বেরোয়৷ তার প্রিয় বিড়ালছানাকে কোলে নিয়ে পিছু নেয় সৌধর। দু’দিন খেয়াল করেছে সৌধ। তৃতীয় দিন খেয়াল হতেই মেজাজ বিগড়ে গেল। এসব ছ্যাঁচড়া ব্যক্তিত্বের মেয়ে তার একদম পছন্দ নয়। তারা একটি পার্কে ছিল। আভিরাকে দেখেই পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো সৌধ। অমনি পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল,

‘ ডক্টর সৌধ চৌধুরী… ‘

সহসা থেমে গেল সৌধ। সে থেমেছে বলে আভিরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে এগিয়ে এলো। বিড়াল ছানাকে বুকে চেপে ধরে বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা নিয়ে সৌধর মুখোমুখি দাঁড়াল। আচমকা তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল সৌধর বলিষ্ঠ বুকে। নিমেষেই ঠোঁট দু’টি কেঁপে ওঠল। এই ছেলেটা তার বয়ফ্রেন্ড হলে সে তো সারাদিন ওই বুকেই একশখানা কিস করে দিবে। ঢোক গিলল আভিরা। উত্তেজনায় বুক কাঁপছে তার। ধীরেধীরে দৃষ্টি উঁচু করল। তাকাল সৌধর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আবৃত দৃঢ় চোয়ালের পানে। মনে মনে বলল, ‘ মাইন্ড ব্লোয়িং! ‘ তার বেশরম মনটা আকুপাকু করে ওঠল। শেষ দৃশ্যে যেন মরে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনো পুরুষ মানুষের ঠোঁটও বুঝি এত আকর্ষণীয় হয়? সবকিছুতে অদ্ভুত সৌন্দর্য আর দৃঢ়তা। এই ছেলেটা এতকাল কোথায় ছিল? কেন আগে দেখা পায়নি এর? আফসোস হলো ভীষণ। এই এত এত দেখার ভীড়ে একবারো সৌধর চোখের দিকে তাকাল না আভিরা৷ যদি একবারো তাকাতো। তাহলে সৌধ চৌধুরীর কঠোর দৃষ্টির কবলে পরে মোহময় হৃদয়টা তার শতসহস্র বার ফাঁসিতে ঝুলতে চাইত। তার মতো সুন্দরী মেয়েকে কোনো যুবক মুগ্ধ দৃষ্টির বাইরেও অন্য কোনো দৃষ্টিতে দেখতে পারে তাও কিনা ক্রোধান্বিত, দৃঢ় দৃষ্টিতে। এ যে অকল্পনীয়!

আভিরার ওপর চরম বিরক্ত সৌধ। শুধু তাই নয় আভিরার আচরণে ভয়াবহ ক্রোধও চেপেছে মাথায়। সেই ক্রোধ প্রকাশিত হলো আভিরা যখন তাকে বলল,

‘ আজ এখনি চলে যাচ্ছেন কেন সৌধ? আসুন না ওদিকে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। ‘

প্রতুত্তরে চিবিয়ে চিবিয়ে সৌধ বলল,

‘ আপনি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছেন। অথচ নূনতম ভদ্রতা নেই আপনার মাঝে! না হলেও আমি আপনার ছ’বছরের সিনিয়র। সো, ইউ শুড হ্যাভ কলড মি ব্রাদার। ‘

অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল আভিরার। বুকের ভেতর ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে ওঠল সৌধর বলা প্রতিটি বাক্য শুনে। সৌধ নিজের বক্তব্য দিয়ে এক মুহুর্তও সময় নষ্ট করেনি। চলে এসেছে। এদিকে আভিরা অপমান সহ্য করতে না পেরে বুকে আগলে রাখা বিড়ালটাকে অবচেতনে এত্ত জোরে চেপে ধরল যে। দম আঁটকে ছটফটিয়ে ওঠল বিড়ালছানা। মিউউউ শব্দে কেঁদে ওঠতেই আচমকা হাত দু’টো আগলা করে দিল আভিরা। বিড়ালছানা মাটিতে পড়ে জোরে জোরে মিউ মিউ করতে লাগল।
.
.
সকালবেলা বেরিয়েছে নামী। কোথায় গেছে কাউকে বলে যায়নি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অথচ বাড়ি ফেরার নাম নেই। সিমরান, সুহাস দু’জনই প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তা করছে৷ ঘনঘন ফোন দিচ্ছে। ধরছে না নামী। ওরা দুই ভাই যখন চিন্তায় অস্থির। চারিদিকে যখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে। তখন বাড়ি ফিরল মেয়েটা। তার চোখ, মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। ড্রয়িংরুমে পা দিতেই সুহাস যেন খাবলে ধরল তাকে। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

‘ কোথায় ছিলে সারাদিন? ‘

নামীও ক্রোধানলে ফেটে পড়ল। কিন্তু সেটা মনে মনে। মুখটা একদম শান্ত। চোখ দু’টোও সুস্থির। সহসা মৃদু হাসল সে। সুহাসের ধূসর বর্ণীয় চোখ দু’টোয় দৃঢ় চোখে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,

‘ বলতে বাধ্য নই। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৫|
সৌধ ভেবেছিল উদয়িনী আন্টির সাথে দেখা করবে। শেষ পর্যন্ত দেখা করা হলো না৷ আইয়াজের সাথে কথা হয়েছে ভোরবেলা। সে পরামর্শ দিল, উদয়িনী আন্টি নয় শুধু সিমরানের সঙ্গেই একান্তে কথা বলতে। এই বিয়েতে সুহাস রাজি নয়। রাজি নয় উদয়িনী আন্টিও। সুহাসের বিয়ে যেমন সোহান আংকেল নিজের সিদ্ধান্তে দিয়েছে। তেমনটা সিমরানের বেলায়ও করতে চাচ্ছে। সুহাসের সঙ্গে সৌধর সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ফাটল ধরেছে। সুহাসের তরফ থেকেই এই ফাটল। ওর মাঝে ছেলেমানুষী আছে। আইয়াজ, সৌধ দু’জনই অবগত এ ব্যাপারে। সৌধ যদি এখন বাড়ি বয়ে গিয়ে উদয়িনী আন্টিকে জানায় সে এই বিয়েতে রাজি নয়। বিয়েটা যেভাবেই হোক আটকান। তবে সুহাস ভুল বুঝতে পারে৷ সিমরান ওর একমাত্র বোন৷ সে কোনো ফেলনা বস্তু নয়। মা ছেলের অহংবোধ প্রগাঢ়। সেখানে অযথা আঘাত করার প্রয়োজন নেই৷ সিমরানের মাঝে ছেলেমানুষী থাকলেও সুহাসের থেকে ওর বুঝ শক্তি আলাদা। তাছাড়া সৌধকে ছোটোবেলা থেকেই খুব মানে মেয়েটা৷ সেটা যে কারণেই হোক না কেন। তাই একমাত্র সিমরানের সাথে কথা বলাই সমীচীন হবে৷ সিমরান, সৌধর সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে পরিবারে। তাদের সিদ্ধান্ত বিপরীতে মোড় নিচ্ছে বলেই এত জটিলতা। যদি সিদ্ধান্ত এক হয় তবে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে না৷ আর না তাদের এত বছরের পারিবারিক বন্ধুত্ব, সুহাস সৌধর ঘনিষ্ঠতায় দেয়াল ওঠবে৷

আইয়াজের সাথে কথা শেষ করল সৌধ। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে কল করল সিমরানকে। এ সময় সিমরান ঘুমে থাকে৷ জানে সৌধ। তাই একবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হয়নি বলে বিচলিত হলো না৷ কিয়ৎক্ষণ পর আবার কল করল। রিসিভ হলো ফোনটা। কর্ণকুহরে পৌঁছাল মিহি কণ্ঠের বিস্ময়কর দু’টি শব্দ,

‘ সৌধ ভাই! ‘

বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল সৌধ৷ বা’হাতে কানে ধরা থাকা ফোন ডানহাতে নিয়ে কানে ধরল৷ এরপর বা হাতটা সযত্নে ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল রুম জুড়ে। ফোনের ওপাশে থাকা তরুণী শূন্য মস্তিষ্কে, ছটফটে হৃদয়ে অপেক্ষা করছে। টের পেল সৌধ। তাই অপেক্ষা দীর্ঘ হতে না দিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ ন’টার দিকে গলির মোড়ে দাঁড়াব আমি৷ কারো সঙ্গে কিছু শেয়ার করবি না৷ জাস্ট তৈরি হয়ে চলে আসবি৷ দু’তিনঘন্টা সময় নিব। ওকে? ‘

কথাগুলোতে অনুরোধ ছিল না স্পষ্ট। তবে কি আদেশ ছিল? উহুম এ মুহুর্তে এসব ভেবে সময় নষ্ট করতে চায় না সিমরান। তাই ত্বরিত হকচকানো মিহি কণ্ঠে বলল,

‘ ওকে, ওকে আমি আসব। ‘

সিমরান বাক্যের সমাপ্তি দিতেই ফোন কেটে দিল সৌধ। ভাবতে লাগল কোথায় মিট করবে? আর পাঁচ জনের মতো সে কাউকে একাকী রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে বসতে পারে না৷ পরিস্থিতি যা তাতে বাড়িতে নিয়ে আসাও সম্ভব না৷ তাহলে যাবে টা কোথায়? অনেক ভেবেচিন্তে ছোটো কাকার বাংলোতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল৷ ত্বরিত কল করল ছোটো কাকাকে। যদিও তাকে না জানিয়েও যেতে পারত৷ তবু সে তার ব্যক্তিত্বে স্বচ্ছতা ধরে রাখতেই কল করে অনুমতি চাইল। ছোটো কাকা বলল,

‘ তুই তুইই রয়ে গেলি সৌধ। সময় কাটাতে কাকার বাংলোতে যাবি এরজন্য অনুমতির কী প্রয়োজন? সাত্তার কাকার কাছে চাবি আছে। চাইলে ভাবির থেকেও চাবি নিতে পারিস। ‘

সাত্তার কাকাকে চেনে সৌধ। বাংলো দেখাশোনার দায়িত্বে আছে সে৷ ওখানেই রাস্তার ধারে চায়ের দোকান। ছোট্ট চায়ের দোকান আর বাংলো দেখাশোনা। এই করেই বৃদ্ধ বয়সে পেট চালায় লোকটা৷ ফোন রেখে সকালের নাস্তা সেরে নিল সৌধ। মায়ের থেকে চাবি নিল না। সাত্তার কাকাকেই ভরসা করল৷ মায়ের থেকে চাবি নেয়া মানে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। সে এবং তার মা কেউই মিথ্যা সহ্য করতে পারে না৷ সত্যি বলাও সম্ভব না। তাই মিথ্যা যেন বলতে না হয় সে ব্যাপারে সচেতন রইল।
.
.
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে৷ যাদের ব্যক্তিত্ব এতটাই দৃঢ়, শীতলতায় আচ্ছন্ন যে তাদের সামনে খুব হিসেব করে কথা বলতে হয়৷ বেহিসেবে একটু বেচাল হয়ে গেলেই পড়তে হয় তীব্র লজ্জা আর অস্বস্তিতে। সিমরানের জীবনে সৌধ এমনই একজন। যার সামনে দাঁড়াতে হলেও দশবার ভাবতে হয় তাকে৷ পরনের কাপড় ঠিক আছে তো? সাজসজ্জায় বাড়াবাড়ি রকমের কিছু নেই তো? জামার রঙটা সৌধ ভাইয়ের পছন্দ হবে? কথা বলার সময় সৌজন্য ধরে রাখতে পেরেছে? উগ্র হয়ে যায়নি তো কোনো বাক্য? সে কি সৌধ ভাইয়ের কাছে সুশীলা হতে পারবে? এরকম অজস্র দুঃশ্চিন্তা জাপ্টে ধরে সিমরানকে। তার অনুভূতি সেই সব মেয়েরাই বুঝতে পারবে। যারা কিশোরী বয়স থেকে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নিজের প্রতি আকর্ষিত করতে স্ট্রাগল করে যাচ্ছে। অথচ কিশোরী বয়স পেরিয়ে যুবতীর কোঠায় পৌঁছে গিয়েও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হচ্ছে না।

একরাশ দুঃশ্চিন্তায় বুঁদ হয়ে দুরুদুরু বুকে গলির মোড়ে এলো সিমরান। মুহুর্তেই ডানপাশের রাস্তা থেকে সৌধর গাড়ি এসে থামল তার সামনে। গাড়ির দরজা খুলে দিতেই কোনোদিক না তাকিয়ে ঝটপট ওঠে পড়ল সে। এরপর দরজা লক করে পাশে তাকাতেই দেখতে পেল নেভি ব্লু রঙের টি-শার্ট পরনে সৌধ। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বসে আছে। দৃষ্টি সামনে অবিচল ছিল। সে তাকিয়েছে টের পেতেই তার দিকে ফিরে তাকাল। নিরাসক্ত, সচ্ছ সুন্দর দৃষ্টি। সিমরান তাকিয়েই রইল। সৌধ বুঝতে পারল না মনে মনে হাসছে সে। কারণ কাকতালীয় ভাবে তাদের দু’জনের পোশাকের রঙ মিলে গেছে। প্রায় ঘন্টা লাগিয়ে ড্রেস বাছাই করার কষ্ট দূর হলো সিমরানের। এই ড্রেসটা নামী কিনে দিয়েছিল তাকে৷ এখন পর্যন্ত পরা হয়নি। আজই প্রথম। নেভি ব্লু কালার কটন কাপড়ের গাউন৷ জমিনে সোনালি সুতোর কাজ বিধায় তার সাথে মিলিয়ে সোনালি রঙের ওড়না নিয়েছে। গোপনে একটি শান্তির নিঃশ্বাস বেরুলেও মনটা শান্তি পেল না। কারণ তার অবচেতন মন ঠিক টের পেয়েছে সৌধ ভাই কেন আলাদা করে তাকে ডাকল। প্রত্যাখ্যান নিশ্চিত জেনেও এসেছে সে৷ নামী সব সময় বলে, সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা সবচেয়ে উত্তম। সেই কথাটায় তীব্র বিশ্বাস রেখেই আসা। তার ভবিতব্যে যদি সৌধ না থাকে। কীভাবে সামলাবে নিজেকে জানে না৷ এতদিন যেভাবে কেটেছে এভাবে কাটলে কতদিন বাঁচবে তাও জানে না।

ভাবনার অতল গহ্বরে সিমরান। সৌধ গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। বেশি দূরের পথ নয়। সতেরো মিনিটেই পৌঁছাল। জায়গাটা চেনা সিমরানের। বন্ধু, বান্ধব নিয়ে ঘুরতে এসেছে বহুবার। কিছু দূরেই রেললাইন। ওখানে করা কতশত ছবি, ভিডিয়ো আছে তার। চেনা জায়গাতেও অচেনা জায়গার দেখা পেল সে। এদিকটা কেমন সুনসান। ভূতুড়ে ভূতুড়েও। ঢোক গিলল সে। সৌধ গাড়ি থামিয়েছে। এখানে পার্কিং করার মতো ব্যবস্থা নেই৷ তাদের পেছনে দু’টো বাইক আসছিল। সৌধ ফোন করল প্রথম বাইকে থাকা একজনকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই বলল,

‘ রাসেল আশপাশেই থাকিস। গাড়ি এখানে রেখে গেলাম। ‘

‘ ওকে ভাই। ‘

ফোন কেটে সিমরানকে নামতে ইশারা করল সৌধ। মুখে মাস্ক পড়ে নিজেও নেমে পড়ল। দু’মিনিটের মতো হাঁটতে হলো ওদের৷ উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম তিন মোড়ের রাস্তা৷ পশ্চিমের রাস্তা শুরু হতেই একটি ছোট্ট চা স্টল। চা স্টলে বসা বৃদ্ধ লোকটির সামনে গিয়ে সৌধ সালাম দিল। বলল,

‘ ভালো আছেন সাত্তার চাচা? ‘

সাত্তার চাচা সেই বৃদ্ধ যার দাদু শব্দটির সঙ্গে পরিচয় নেই। সবাই তাকে এক নামে চেনে৷ সে নামটি হলো সাত্তার চাচা। কচি থেকে তাগড়া যুবক সবাই তাকে সাত্তার চাচা বলে। এই যেমন সৌধর ছোটো কাকা সুলল চৌধুরী তাকে সাত্তার চাচা ডাকে। সৌধও সাত্তার চাচা ডাকে৷ কুশলাদি বিনিময় করে বাংলোর চাবি নিল সৌধ। এরপর তাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু বাংলোর সামনে চলে এলো সিমরান। প্রথম দর্শনে সিমরান হকচকিয়ে গেল। তার শহরে এত সুন্দর একটি বাংলো আছে শুনেনি তো কখনো। আশ্চর্যান্বিত মুখে চারপাশে তাকিয়ে রইল সে। বাংলো সইসই চিকন পাকা রাস্তাটা ধরে হাঁটছিল ওরা। সৌধ নির্লিপ্ত। সিমরান বিহ্বল দৃষ্টিতে চারপাশ তাকিয়ে দেখছে আর এগুচ্ছে। দু’পাশে হরেকরকমের ফুল গাছ। রঙবেরঙের সে ফুল গুলো থেকে সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। একপাশে ছোট্ট একটি পুকুর। খেয়াল করল সেখানে লাল, সাদা শাপলা ফুটেছে। বুকের ভেতরটা ভালো লাগায় শিরশির করে ওঠল ওর। সৌধ অনেকটা এগিয়ে গেছে। বাংলোর বারান্দা পেরিয়ে প্রধান দরজার তালা খুলল। ভেতর থেকে দু’টো বেতের চেয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো তক্ষুনি। সিমরানের মুগ্ধতায় ভরা মুখে তাকিয়ে বলল,

‘ পুকুর পাড়ে আয়। এদিকটা ঠান্ডা। ‘

হুঁশ ফিরল সিমরানের। ত্বরিত তাকাল সৌধর দিকে। দু-হাতে দু’টো চেয়ার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন পুরুষটি। এই তো আর কিছু সময়। মানুষটা প্রত্যাখ্যান করবে তাকে। বুকের ভেতর এই মুহুর্তে যে পুলকিত অনুভূতি আছে সবটা শুষে নেবে একটি বাক্যে,

‘ আমার পক্ষে তোকে বিয়ে করা সম্ভব না সিনু। ‘

বিদ্যুতের ঝটকা লাগার মতো কেঁপে ওঠল সিমরান। লম্বা করে নিঃশ্বাস টেনে তা ছেড়ে দিল আবার। পা বাড়াল ডান পাশে। সৌধর পাশে গিয়ে বসতেই সৌধ বলল,

‘ প্রথম এনিভার্সারিতে ছোটো কাকিকে এই বাংলোটা গিফট করেছিল কাকা। প্র্যাগ্নেসির তিনমাস চলছিল। দাদুনি বাড়ির বাইরে তাও আবার এমন একটা জায়গায় নতুন বাংলো বাড়িতে থাকার পারমিশন দেয়নি। প্ল্যান ছিল প্রথম সন্তানকে নিয়ে দ্বিতীয় বছর প্রথম এখানে থাকবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মানুষের পরিকল্পনাকে অসফল করে নিজ শক্তির দৃঢ়তা দেখিয়ে দিলেন। ‘

কথার সমাপ্তি টেনে অদ্ভুত রকমের হাসল সৌধ। সিমরান বলল,

‘ খুব সুন্দর বাংলো। ছোটো আংকেল ভীষণ রুচিশীল। ‘

সৌধ তাকাল একবার। সিমরান খেয়াল করে পুকুরের দিকে তাকাল। সৌধ স্মিত হেসে বলল,

‘ আমি জানতাম তুই’ই অনেক রুচিশীল। জানাটা ভুল কেন হলো? ‘

আচমকা চোখ ফেরাল সিমরান। সৌধর দৃষ্টি তখন পুকুরে ফুটা ছোট্ট সাদা শাপলাতে স্থির। বলল,

‘ আমার পক্ষে তোকে বিয়ে করা সম্ভব না সিনু৷ আই এম রেইলি সরি। ‘

সিমরানের সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল। নিমেষেই সামলে নিল আবার। বলল,

‘ বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। পাত্রী আমি হলে সমস্যা কোথায়? ‘

ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল সৌধ। এমন ভারিক্কি কথা সিমরানের থেকে আশা করেনি সে। সেদিনের একরত্তি মেয়ে সিমরান। কবে এত বড়ো হয়ে গেল! নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে সৌধ কিছু কথা বলল ও’কে। যাতে তার অনুভূতি বুঝতে পারে সিমরান। আর একটা মেয়ে কখনোই অন্য মেয়ের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত ছিল এমন ছেলেকে স্বামী রূপে চাইবে না৷ জানে সে।

কথা গুলোতে তীব্র আফসোস ছিল,

‘ কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথমদিন। বড়ো ভাইরা ফার্স্ট ইয়ারদের রেগ দিচ্ছিল। রেগিং আমার তখন থেকেই অপছন্দ। তাই বন্ধুদের নিয়ে কিছুটা দূরে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম মেরুন রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরা একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে। লম্বা, ফর্সা অতি সাধারণ পোশাকের মেয়েটিকে সাধারণ ভাবেই দেখছিলাম। বড়ো ভাইরা ডাকল ওকে। রেগ দিল। মেয়েটা তেজীয়ান। বড়ো ভাইদের আদেশ মানবে না। ভাইরাও কম তেজীয়ান নয়৷ হট্টগোল বেঁধে যাচ্ছে প্রায়। এমন সময় আমি ওখানে উপস্থিত হলাম। জানতে পারলাম আমাদেরই ব্যাচমেট। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালাম একবার। গোলগাল মুখ। ঠোঁট দু’টো লাভ শেপ। মৃদু হেসে ভাইদের জিজ্ঞেস করলাম, কী করতে বলেছেন? ওরা প্রথমে বিব্রত হচ্ছিল। বড়ো হলেও আমার স্থান তাদের কাছে আরো বড়োতে। ভয়ও পাচ্ছিল কিঞ্চিৎ। আমি আশ্বাস দিলাম। তারা আমাকে বলল বড়ো ভাইদের মধ্যে দেখতে কালো, মোটা আর চোখের মণি সাদা ভাইয়ার চোখের দিকে পলকহীন এক মিনিট তাকিয়ে থাকতে হবে। মেয়েটা নাছোড়বান্দা। কিছুতেই তাকাবে না। আমি ওর সামনে গেলাম। চোখে চোখ রাখতেই আমার বুকে টান পড়ল। কী আশ্চর্য দু’টো চোখ। পিঙ্গলবর্ণের ঐ চোখ দু’টি দেখেই আমি ভাইদের দিকে তাকালাম। বললাম, ‘ আছলাম ভাইয়ের জায়গায় আমি থাকলে সমস্যা আছে? ‘ ওরা এক সুরে না করল। সমস্যা নেই। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ ফার্স্ট ইয়ার? ‘
‘ হ্যাঁ।’
‘নাম?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘ জান্নাতুল ফেরদৌসী নিধি। ‘
আমি ওর চোখে, ওর নাকে, ঠোঁটে, থুতনীতে সমস্ত জায়গায় আমার চোখ বিচরণ করতে করতে বললাম, ‘কলেজ সম্পর্কে ধারণা নেই তোমার? শোনো বড়ো ভাই রেগ দিচ্ছে। এটা মেনে নিতে তুমি বাধ্য৷ আছলাম ভাইয়ের চোখে তাকাতে অসুবিধা থাকলে আমার চোখে তাকাও। যত দেরি করবে তোমারি সময় নষ্ট হবে। ‘

নিধি এবার আমার দিকে ভালোভাবে তাকাল। আমি চোখে ইশারা করে বুঝালাম আমরা সেম ব্যাচ। উই আর ফ্রেন্ডস। সো অসুবিধা কী? বুদ্ধিমতী মেয়ে। মেনে নিল। পাক্কা এক মিনিট পলকহীন তাকিয়ে রইল আমার চোখে। আর আমি তাকিয়ে রইলাম ওর ব্রাউন কালার হৃদয়ে টান পড়া চোখ দু’টিতে। এরপরই পরিচয় আর বন্ধুত্ব হলো আমাদের। সময় প্রবাহিত হলো ঠিকই। কিন্তু ওই যে এক মিনিটের দৃষ্টি বিনিময়। আমি ওর চোখে খুঁজে পেলাম আমার প্রথম যৌবনে সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া গোলাপকে। শুরুটা ওখান থেকেই হলো। ভীষণ জেদি আমি। এক কথার মানুষ যেমন, তেমনি এক অনুভূতিতে অটুট৷ কলেজ জীবনের পাঁচটা বছর কাটিয়ে দিলাম। একতরফা ভালোবেসে আর অপেক্ষা করে। এরপর যখন সেই নিখুঁত, গভীর ভালোবাসা থেকে আঘাত পেলাম। তখন আমার মনে কী ভয়ানক জেদ চেপে ওঠল কল্পনাতীত। এই আঘাত কোনোদিন সেরে ওঠবে না। আর না প্রথম অনুভূতির তিক্ততা আমার হৃদয় থেকে মুছে যাবে। আমি নিধিকে ভালোবাসতাম, প্রচণ্ড পরিমাণে ভালোবাসতাম। ঐ ভালোবাসা এ জন্মে কারো প্রতি আসা সম্ভব না। আর যদি ভুলক্রমেও আসে তাহলে প্রথমবারের ভুলটা দ্বিতীয়বার করব না। ‘

থামল সৌধ। অনুভব করল সিমরান অস্বস্তিতে ভুগছে। কিন্তু তাকাল না একবারো। পুনরায় বলল,

‘ আমার ভুল কি ছিল জানিস? নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা। ভালোবাসায় অন্ধত্ব বোকামি। আমি ওকে সেক্রিফাইস করেছিলাম। ভালোবাসায় ততক্ষণ সেক্রিফাইস করতে নেই যতক্ষণ না অপর মানুষটা পূর্ণাঙ্গ রূপে নিজের হয়। আমার ভুলটা ঠিক এখানেই। আমার দম ছিল। নিধিকে নিজের করার দম ছিল আমার। আমি ওকে মুক্ত পাখির মতো চেয়েছিলাম বলে সেই দমটা নিভিয়ে রেখেছিলাম। ‘

ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ৷ জড়োসড়ো হয়ে গেল সিমরান৷ বুকের ভেতর জ্বলছে। ভীষণ জ্বলছে তার। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস গুলো স্বাভাবিক করে নিয়ে সৌধ বলল,

‘ একজন মানুষকে দূর থেকে যেমন দেখায় সে পুরোপুরি তেমন হয় না। আমাকে তুই ততটুকুই চিনিস যতটুকু তোর সামনে প্রকাশ করেছি। এ পৃথিবীর কোনো মানুষই কারো কাছে নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করে না৷ আমিও করি না। সুহাস আমাকে যেভাবে, যে রূপে চিনে তুই চিনিস না। তুই যেভাবে যে রূপে জানিস অন্য কেউ সেভাবে জানে না। আমি আমার আম্মার কাছে যে রূপ দেখাই সেটা কিন্তু অন্য কেউ দেখে না। প্রত্যেকটা মানুষ ভেদে আমি আলাদা। আমি তোর কাছেও আলাদা। এই আলাদাটুকু নিয়েই থাকতে চাই। ‘

সিমরান কিছু বলতে উদ্যত হলো। সৌধ বলতে দিল না৷ নিজেই বলল,

‘ আমি তোকে বিয়ে করতে চাই না। শুধু তোকে নয় এ মুহুর্তে আমার পক্ষে কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। আর তোকে কোনো মুহুর্তেই সম্ভব না কারণ, আমি হয়তো দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারব না। সিনু, তোর জীবনটা উদয়িনী আন্টির মতো হোক। এটা আমরা কেউ চাই না৷ সোহান আংকেল ভীষণ ভালো মানুষ। আমি তার মতো ভালো নই, উদার নই। আমাকে বিয়ে করলে উদয়িনী আন্টির থেকেও অধিক যন্ত্রণা পাবি তুই৷ ‘

এত এত কথার ভীড়ে সৌধ খেয়াল করল না সিমরানের চোখ বেয়ে অনর্গল জল গড়াচ্ছে। সে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ তুই কী চাস মায়ের মতো ভালোবাসাহীন সংসার করতে? সারাজীবন ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাতে। সামনে থাকা উজ্জ্বল ভবিষ্যতটাকে দূরে ঠেলে নরকে ঝাঁপিয়ে পড়তে? ‘

‘ তুমি নরক নও। আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমার কাছে স্বর্গ তুমি। ‘

আচমকা চোখ বুজে ফেলল সৌধ। দু-হাত মুঠোবন্দি করে পরোক্ষণেই দৃষ্টি খুলল। সিমরান কাঁদছে। সে আঁচ করেছিল এমন কিছুই হবে। তাই না তাকিয়েই দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ আমি শপিংমলের কোনো জামা নই সিনু৷ কান্নাকাটি করে আমাকে পাওয়া যাবে না। ‘

সহসা কান্না থেমে গেল সিমরানের। অদ্ভুত এক খারাপ লাগা এসে ভর করল বুকের ভেতর। সৌধ ভাই এভাবে বলতে পারল তাকে? ভালোবাসে বলে সে তো আর ছ্যাঁচড়া মেয়ে মানুষ হয়ে যায়নি। অসহায় বোধ করল খুব৷ নিরুপায় লাগল নিজেকে। সৃষ্টিকর্তা কেন এই মানুষটাকে ঘিরে তার হৃদয়ে এত ভালোবাসার জন্ম দিল? যদি নাই পাবে তবে এতখানি ভালোবাসায় কেন মন ডুবাল? অসহায় চোখে তাকাল সৌধর পানে। শক্ত চোয়ালে সৌধ সটানভাবে বসে। সিমরান তাকিয়েছে। অশ্রুসিক্ত তার দৃষ্টিদ্বয়। টের পেয়ে ঢোক গিলল। এক নিঃশ্বাসে বলল,

‘ আমি তোকে ভালোবাসি না। তুই যে চোখে আমাকে দেখিস আমি ভুলক্রমেও কখনো সে চোখে দেখিনি৷ তোর আত্মসম্মান কি এতটাই ঠুনকো? যে ছেলে তোকে ভালোবাসে না, নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াতে চায় না৷ যে ছেলে তার পরিবারের কাছে তোকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আজ তোর সামনে বসেও প্রত্যাখ্যান করছে। তাকে বিয়ে করবি? বউ হবি তার? ‘

দম বন্ধ হয়ে এলো সিমরানের। আচমকা দু’হাতে কান দু’টো চেপে ধরে বলল,

‘ চুপ করো প্লিজ। ‘

সৌধ চুপ করল না। একের পর এক বলতেই থাকল,

‘ তুই জেনে-বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিবি? ‘

সহসা মৃদু চিৎকার দিল সিমরান। অসহনীয় গলায় বলল,

‘ কথা শেষ করো সৌধ ভাই। ‘

সিমরান উত্তেজিত হচ্ছে। আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলতে ফের সৌধ বলল,

‘ বাড়ি ফিরে যা৷ আম্মাকে ফোন দিয়ে বল এই বিয়েতে তুই রাজি না৷ এতদিন ভুল করেছিস। আজ মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে না করে দিলি। সোহান আংকেল আমাদের বাড়ি যাওয়ার আগে আম্মাকে ফোন দে৷ ‘

বাক্য গুলো কী নিষ্ঠুর! পাশের মানুষটা কত বড়ো মাপের পাষাণ। ভেবেই সহসা ওঠে দাঁড়াল সিমরান। অমনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভয়ংকর ভাবে কেঁপে ওঠল৷ সে কাঁপুনি আর থামল না৷ অতিরিক্ত যন্ত্রণা, উত্তেজনা মিলিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সৌধ বিচলিত হলো এ দৃশ্য দেখে। ত্বরিত সিমরানের হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল পাশে। দৃঢ় গলায় বলল,

‘ শান্ত হো। মাথা ঠান্ডা কর। জাস্ট কন্ট্রোল সিনু। ‘

ধরে রাখা হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে নিল সিমরান। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,

‘ তুমি শান্ত হতে পেরেছিলে? তুমি কন্ট্রোল করতে পেরেছিলে নিজেকে? পারোনি তো। আমাকে কেন বলছ তাহলে। যে যন্ত্রণায় নিজে ভুগছ সেই একই যন্ত্রণায় আমাকে ভোগাতে তুমিই বাধ্য করলে। ‘

সত্যি বাক্য। সৌধ নিভে গেল৷ হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ওর মাথায়। বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ আমি নিরুপায় সিনু। তোর ভালোর জন্যই বলছি। আমি তোকে বিয়ে করতে পারব না। আমি ভুলতে পারব না আমার প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদ যন্ত্রণাকে। ‘

আবারো তাচ্ছিল্য ভরে সৌধর হাত ছাড়িয়ে দিল সিমরান। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আমিও পারব না। তুমি যেমন নিধিপুর স্বার্থপরতা মনে রেখেছ। আমিও তোমার প্রত্যাখ্যান মনে রাখব।’

কথাটা বলেই হুহু করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। সৌধ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল৷ কেটে গেল কয়েক পল। এরপর আচমকাই থেমে গেল সিমরান৷ ধাতস্থ হয়ে নিজের চোখের পানি গুলো মুছে ওঠে দাঁড়াল। ওঠে দাঁড়াল সৌধ নিজেও। বলল,

‘ চল, বাড়ি ফিরবি। ‘

তিনটে শব্দ বলেই পা বাড়াল সৌধ। শরীর টলছে সিমরানের। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে এগুচ্ছিল। আর ভাবছিল সৌধর বলা প্রতিটি কথা। হঠাৎ স্মরণ হলো, কলেজে নিধি আপুর চোখ দেখেই প্রেমে পড়েছিল সৌধ। মন মানল না সিমরানের। প্রত্যাখ্যান পেয়েও তার ভেতরের অনুভূতি হাহাকার করে ওঠল। হৃদয় গহিন থেকে জাগ্রত হলো একটিই কথা। যে চোখে প্রেম, ভালোবাসা ছিল না সে চোখ দেখে সৌধ ভাই প্রেমে পড়ল। ভালোবেসে ফেলল বিশুদ্ধভাবে। তবে যে চোখে তার জন্য অগাধ প্রেম আছে, প্রগাঢ় ভালোবাসা আছে। আছে তাকে পাওয়ার একরাশ তৃষ্ণা। সে চোখে তাকালে কি পাথর মনে ফুল ফুটবে না? গলবে না বিরহে ভরা বরফ টুকরো?

‘ সৌধ ভাই।’

কান্না মিশ্রিত ভাঙা কণ্ঠস্বর শুনতেই পা দু’টো থমকে গেল সৌধর৷ পেছন ঘুরে দাঁড়াতেই সিমরানকে সম্মুখে আবিষ্কার করল। বলল,
‘ বল? ‘

‘ তুমি যাকে ভালোবাসো তার চোখে তাকিয়েছিলে তো। ‘

‘ বহুবার। ‘

অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল সৌধ। সিমরান বলল,
‘একটা অনুরোধ করব? ‘
‘হু?’
‘ সেই কিশোরী বয়স থেকে যে তোমাকে ভালোবাসে তার চোখের দিকে একবার তাকাবে? গভীর ভাবে। ‘

ঢোক গিলল সৌধ। সিমরানের ফর্সা মুখশ্রী কান্নার ফলে লালচে বর্ণে পরিণত হয়েছে। নাকের ডগাও রক্তিম। মেয়েটার ভেতর জেদ আছে। তেজও আছে। জানত সে। শুধু জানত না এই মুহুর্তে দেখা অসহায়ত্ব টুকুকে। এর পেছনে দায়ী সে নিজে। ভাবতেই তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব বিব্রত হলো। সুহাস যদি জানতে পারে আজকের ঘটনাটি। তাকে ক্ষমা করতে পারবে তো? শ্বাস রোধ হয়ে এলো। ভাবনায় বিভোর হয়েই সিমরানের চোখে চোখ রাখল সে। অশ্রুতে বড়ো বড়ো ঘন পাপড়ি গুলো জড়োসড়ো হয়ে আছে। জলপূর্ণ দৃষ্টি। ঝাপসা সে দৃষ্টিতে তীব্র অভিমান। প্রগাঢ় ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যান পেয়ে তীব্র অভিমানী দু’টো চোখ। ভিজে ওঠছে ক্ষণে ক্ষণে। নিঃশ্বাস আঁটকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে সৌধ। নির্নিমেষে সে চোখে তাকিয়ে শুধু একটা কোথাই ভাবছে, কার জন্য আঘাত দিলাম তোকে? নিধির জন্য, নিজের জন্য নাকি তোরই জন্য।

‘ সৌধ ভাই? ‘

‘ হু? ‘

‘ তুমি কেন নিধি আপুকে এতখানি ভালোবাসলে? আমায় কেন একটুও ভালোবাসলে না। আমাকে যদি অল্পখানিও ভালোবাসতে তোমাকে এত দুঃখ পেতে হতো না, আমিও এতখানি দুঃখ পেতাম না। ‘

সৌধ নিশ্চুপ। সিমরানের দুই গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ল। ভাঙা কণ্ঠে ফের বলল,

‘ আমাকে ভালোবাসলে কী খুব ক্ষতি হতো? ‘

এতক্ষণ অনেক কথা বললেও এ মুহুর্তে উত্তর খুঁজে পেল না সৌধ। রক্তিমা, অসহায় মুখশ্রীর সিক্ত দৃষ্টিজোড়ায় তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। ভাবতে লাগল দ্বন্দ্বময় অজস্র ভাবনা৷ অনুভব করল তার বুক কাঁপছে। কেন কাঁপছে?

আচম্বিতে সম্মুখের নারী শরীর, অসহায় মুখ আর জলপূর্ণ চোখ দুটি মিলিয়ে গেল৷ সিমরান চোখের পানি মুছতে মুছতে এক ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে গেল৷ সৌধ স্তব্ধ মুখে অবশ দেহে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এদিকে তীব্র অভিমান বুকে চেপে, ভগ্ন হৃদয়ে অটোতে ওঠে বসল সিমরান। সৌধ ভেবেছিল সে গাড়িতে গিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণ পর এসে যখন দেখল সিমরান গাড়িতে নেই৷ আশপাশে তাকিয়েও খুঁজে পেল না। তখন সাত্তার চাচার কাছে ছুটে গেল। জিজ্ঞেস করলে সাত্তার চাচা বলল,

‘ মেয়া তো অটোত কইরা চইলা গেল। ‘

চমকে ওঠল সৌধ। দেরি না করে তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। সিমরান যে অটোতে ওঠেছে সেটা ধরতে সময় লাগল না তার। শুধু নিশ্চিত হয়ে নিল সিমরান ঠিক আছে৷ এরপর বাড়ি পর্যন্ত অটোর পিছু পিছু এলো সৌধ। সিমরান নেমে বাড়িতে ঢুকছে দেখে নিয়ে অতঃপর সে রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল। গাড়ি ঘুরালো নিজের বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরে প্রথম যে কথাটি শুনল তা বলল তার দাদুনি। কারণ সে সিমরানকে একদমই পছন্দ করে না। আর সৌধ তার অতি পছন্দের নাতি৷ তাই তাদের বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন কঠিন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ওই মেয়েকে বাড়ির বউ করো না। কেউ তার নিষেধ মানছিল না। আজ সিমরান নিজেই ফোন করে বিয়েতে অমত পোষণ করেছে। তাই দাদুনি বেজায় খুশি। বেশ খোশমেজাজে সে এসে সৌধকে জানালো,

‘ শুনছ দাদুভাই ঐ দস্যি মেয়ে বিয়েতে না করে দিছে। আল্লাহ কতবড়ো বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিল তোমারে। অমন দস্যি মেয়ের স্বামীর হওয়ার চেয়ে চিরকুমার থাকা ঢেড় ভালো। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৬|
অন্ধকার আছে বলেই আলোর মর্ম বোঝা যায়৷ প্রকৃতির নিয়মেই রাত্রির আগমন ঘটে। তাই বলে কি মানবকূল বিচলিত হয়? নাহ, তারা অপেক্ষা করে প্রভাতের। তারা জানে সন্ধ্যায় যে সূর্য অস্ত যায়। সময়ের চাকা ঘুরে সে সূর্য উদিতও হবে। মানুষের জীবনে সুসময়, দুঃসময়, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ঠিক সূর্যাস্ত আর সর্যদয়ের মতোন। আজ দুঃখ পেয়েছ? অপেক্ষা করো কাল সুখী হবে। প্রাপ্তির খাতা আজ শূন্যতায় ভুগছে? সবুর করো কাল পরিপূর্ণতায় রূপ নেবে। মানুষের জীবনের এই ধারাবাহিকতা চলছে, চলবে৷

কেটে গেছে কয়েকটি সপ্তাহ। এরই মধ্যে বেশকিছু হসপিটালে এপ্লাই করে রেখেছে কার্ডিওলজিস্ট সৌধ চৌধুরী। পরিবার, বন্ধু কাউকে না জানিয়েই। নিজের হার্টের অবস্থা যখন বিধ্বস্ত তখন সে কী করে অন্যের হার্টের চিকিৎসা দেবে? এমন প্রশ্নবাক্যকে পুঁজি করেই সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে কাটিয়েছে এতদিন। এবার কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। হৃদয় থেকে অনুভব করছে তার ভালো থাকা উচিত। ক্যারিয়ারে ফোকাস করা উচিত। সর্বোপরি তাকে যারা ভালোবাসে তাদের কষ্ট দেয়া অনুচিত। যে ভালো থাকতে ছেড়ে গেছে সে ভালো থাকুক। সে ক্ষত টুকু নিয়েই না হয় ঘুরে দাঁড়াক।

তানজিম চৌধুরী খবর পেয়েছে ছোটো পুত্রধন আর নেশা করছে না। দিনে একটা, দু’টো সিগারেটেই সীমাবদ্ধ থাকছে। মাতৃহৃদয় এখন অনেকটাই শান্ত। কিন্তু সৌধ আচমকা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়াতে চিন্তায় পড়েছিল। সে চিন্তা দূর হলো শাশুড়ির কথায়। সৌধর দাদুনি আশায়রা বলেছেন,

‘ বড়ো বউ তুমি খেয়াল করছ কিনা জানি না।সুহাসের বোন বিয়েতে না করার পর থিকাই দাদু ভাই স্বাভাবিক হইতেছে। তোমরা তো জোর কইরা চাপাই দিতে চাইছিলা৷ এখন বুঝলা তো তোমার ছেলের আসল ভালো কোথায় ছিল? ‘

শাশুড়ির কথা শুনে আশ্বস্ত হয় তানজিম। যদি এটাই সত্যি হয় বেশ তো। ছেলেটা ভালো থাকুক এটাই মূখ্য বিষয়। একজন মায়ের এর বেশি কিছু চাওয়ার থাকে না। সিমরান বিয়েতে না করেছিল বলে অভিমান হয়েছিল তার৷ কিন্তু ছেলেকে ভালো থাকতে দেখে সব অভিমান কেটে গেল। মনে মনে ভাবল, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সিমরানকে।

নতুন একটি সূর্যের আবির্ভাব। ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি গায়ে মাখিয়ে শরীরচর্চা করল সৌধ। এরপর ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে নিচে এলো। রুমে গিয়ে গোসলের প্রস্তুতি নিতেই সেলফোন বেজে ওঠল৷ আইয়াজের ম্যাসেজ করেছে,
” ওয়েল ডান দোস্ত। আমরা খুব খুশি। পুরোনো সৌধকে খুব মিস করছিলাম। ”

ম্যাসেজটা দেখে বাঁকা হাসে সৌধ। শরীরচর্চা করার সময় ছোট্ট একটি ভিডিও করে পোস্ট করেছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেটা দেখেই আইয়াজ ম্যাসেজটি করেছে। সে পাল্টা ম্যাসেজ করল,

‘ ভাবছি বিগ বস ক্লাব থেকে ট্যুর দিব একটা। তুই আর সুহাস তো ব্যস্ত। বাকি সদস্যদের নিয়ে যাই কী বলিস? ‘

‘ সিয়র, নো প্রবলেম। আমাদের ঝিমিয়ে পড়া গ্যাংটাকে তুইই পারবি সচল করতে। ‘

সৌধ আর কোনো রিপ্লাই দিল না। লম্বা শাওয়ার নেবে এবার। পরের সিদ্ধান্ত অনেকদিন পর পরিবারের সঙ্গে বসে সকালের নাস্তা করবে। কয়েকদিন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে ক্লাব থেকে দীর্ঘ ট্যুরে যাবে। দৃঢ় বিশ্বাস এরই মধ্যে পছন্দ সই কোনো না কোনো হসপিটালে জয়েন করতে পারবে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সিদ্ধান্তও নিল। নিজের পরিকল্পনার কথা কাউকেই জানালো না। যারা একবার ব্যর্থ হয় তারা কখনো জীবনের আর কোনো সু পরিকল্পনা কাউকে জানাতে পারে না। আসলে পূর্বের জোশটা আর থাকে না। সবকিছু ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। আর অপেক্ষা করে সময়ের। নিজের ওঠে দাঁড়ানো, সফলতা মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে দেখিয়ে দেয়ার।
.
.
ভোরবেলা। কাজের মেয়েটার সঙ্গে মিলে নাস্তা বানাচ্ছে উদয়িনী। শরীরটা ভালো নেই। মেয়েকে নিজ হাতে কিছু বানিয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে বলেই রান্না ঘরে আসা৷ বয়সের সাথে সাথে মানুষের মানসিক অনেক পরিবর্তন ঘটে। উদয়িনীর মাঝে যেন সেই পরিবর্তন লক্ষনীয়। কিছুদিন আগেই
রিটায়ার করেছে সে কিন্তু অফিশিয়ালি বিদায় হয়নি। সামনে মাসে বিদায় পর্ব। এরই মাঝে চলে এসেছে বাড়িতে। বাড়ি ফেরার পর যখন প্রথম সিমরানকে দর্শন করল। আত্মা কেঁপে ওঠেছে তার। অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি পড়েছে টপ টপ৷ কী অবস্থা তার মেয়েটার? সিমরান নিঃসন্দেহে একজন সুন্দরী তরুণী। কিন্তু উদয়িনী তার মাঝে কোনো সৌন্দর্য্য খুঁজে পায়নি। যে বয়সে মেয়েদের লাবণ্য বৃদ্ধি পায়। সে বয়সে সিমরানের লাবণ্য ম্রিয়মাণ। চৈত্রের খরা মানুষের দেহে, মুখশ্রীতে এভাবে দৃশ্যমান হয়? উদয়িনী মেয়ের মাঝে ঠিক যেন চৈত্র মাসের খরা দেখতে পেল। স্বাস্থ্যের অবনতি যে মেয়ের ওজন দুমাস আগে ছিল পঞ্চাশ কেজি। বর্তমানে তার ওজন কিনা ঊনচল্লিশ! রূপ লাবণ্যের অবনতি এতটাই যে এই মেয়েটার গায়ের বর্ণ দুধে আলতা ছিল এখন দেখে কেউ বিশ্বাসই করবে না৷ পড়াশোনার অবস্থাও করুণ৷ সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট খারাপ এসেছে৷ সবমিলিয়ে মেয়ের শোক
জেঁকে ধরল উদয়িনীকে। ছেলেকে ফোন করে কান্নাকাটি করল। সুহাস মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সিমরানের খেয়াল রাখতে বলে ফোন রেখে দিল৷ সে এখন ভীষণ ব্যস্ত৷ উদয়িনী মেয়েকে নিয়ে তীব্র দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করে। জোর করে ভালোবাসা পাওয়ার লড়াইয়ে যদি সে হেরে না যেত। সংসার জীবনে যদি অসুখী না হতো। স্বামীর চোখে যদি এতটা নীচ না হতো তবে মেয়ের জন্য সৌধকে যেভাবেই হোক নিয়ে আসত৷ নিজের জীবনকে বাজি রাখা যায় কিন্তু সন্তানের জীবন বাজি রাখা অসম্ভব। আজকাল সুনিশ্চিত ভবিষ্যতও দূর্ভাগ্য বয়ে আনে। সেখানে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে দূর্ভাগ্য তো নিশ্চিত হবেই।

সিমরান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এদিকে ফোন রিংটোন বাজতে বাজতে থেমে গেল। একবার, দু’বার এমন করে চারবার ফোন এলো আর থামল। পাঁচবারে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তার। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে অচেনা নাম্বার দেখে রিসিভ করে কানে ধরল। চোখ দু’টো বন্ধ, ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে৷ ঘুম কাতুরে কণ্ঠস্বরে বলল,
‘ কে বলছেন? ‘

ওপাশটা নীরব রইল কিয়ৎক্ষণ। এরপর সহসা ভেসে এলো একটি আদুরে, মিষ্টি কণ্ঠ,
‘ সিনুপি হাউ আর ইউ? ‘

ঝড়ের গতিতে ঘুম ছুটে গেল সিমরানের। ত্বরিত ওঠে বসল সে। বাম কান থেকে ডান কানে ধরল ফোনটা। হকচকানো কণ্ঠে বলল,

‘ তাহানী! আই এম ফাইন বনু। তুমি কেমন আছো? হাউ আর ইউ কিউটি? ‘

আদুরে স্বরে তাহানী উত্তর দিল,
‘ আই এম ভেরী ওয়েল সিনুপু। ‘

সহসা খিলখিল করে হেসে ওঠল সিমরান৷ নিজের এলোমেলো চুলগুলো এক হাতে গুছিয়ে নিয়ে বলল,

‘ তাহানী বুড়িটা আমাকে মিস করছে বুঝি? ‘

ওপাশ নীরব। একটুক্ষণ পর মিষ্টি সুরটা ভেসে এলো আবার,

‘ ইয়েস, আই ডু। ‘

হাসির মাঝেও কান্না এসে গেল সিমরানের। ঐ বাড়ির প্রতিটা মানুষের প্রতি যে অগাধ মায়া জন্মেছে বুকে। তা কাটাবে কীভাবে? এতগুলো দিনে বুক যে তার শুকিয়ে ওঠেছে। কী নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার সে। গলায় আঁটকে থাকা কান্নাগুলো সযত্নে গিলে ফেলল সিমরান। এরপর জিজ্ঞেস করল,

‘ চলে এসো বেবি। আমরা একসঙ্গে খেলব, খাব, ঘুমুবো। আসবে? ‘

ওপাশে উৎসাহিত স্বর,

‘ ইয়েস, ইয়েস। ‘

‘ তবে দেরি কেন? পাপার অনুমতি নিয়ে চলে এসো।’

সৌধর ছোটো চাচার মেয়ে তাহানীর সঙ্গে কথা শেষ হলো। ফোন কাটতেই সিমরানের মনে পড়ল, নাম্বারটা কার জিজ্ঞেস করা হয়নি৷ তাহানী একা একা তার নাম্বার খুঁজে ফোন দিতে পারবে না৷ কেউ তাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু কে? তানজিম আন্টি? নাহ সে তো রেগে আছে তবে ছোটো আংকেল? নাম্বারটা কী নামে সেভ করবে বুঝতে পারছিল না সে। অনেক ভেবেচিন্তে তাহানী নামেই সেভ করল। এরপর সারাদিন অপেক্ষা করল। তাহানীর জন্য। তাহানী এলো না। আর না এলো সেই নাম্বার থেকে ফোন। ভাবল, তাহানী বাচ্চা মানুষ। হয়তো তার বায়নায় কেউ বাধ্য হয়ে ফোন করেছিল৷ শিশু মস্তিষ্ক তারপরই ভুলে গেছে তাকে। সে আর বায়না করেনি। আর না কেউ মিটিয়েছে তার বায়না৷ এ পর্যায়ে তাহানীকে হিংসে হলো খুব। ভাবল, ছোটোরা কত সহজেই সব ভুলে যায়। তবে বড়োরা কেন ভুলতে পারে না? তবে কি বড়ো হওয়া অভিশাপ! বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সিমরানের৷ নিজের দুঃখ গুলো শেয়ার করার মতো একটা মানুষও নেই তার। নামী ইন্টার্ন ডক্টর হিসেবে জয়েন করেছে। থাকে গাজীপুর। এখন আর তাকে সময়ে, অসময়ে কাছে পাওয়া যায় না। আপন মনেই হাসল সিমরান। ফোন করল বান্ধবী লুনাকে। বলল,

‘ ন’টায় বেরুতে পারবি? শহর ঘুরব। ‘

লুনা বলল,
‘ সাতসকালে কে শহর ঘুরে? শহর ঘুরতে হয় রাতের বেলা। ‘

‘ আমার কাছে সাতসকাল বলে কিছু নেই৷ প্রতিটা সময়ই রাত। ‘

‘ দোস্ত সিগারেট খাবি? ‘

‘ কতবার না করেছি? ‘

‘ আরে ইয়ার ছ্যাঁকা খেলে সিগারেট খাওয়া বৈধ হয়ে যায়। ‘

‘ বাজে বকিস না তো। ফুল ফ্যামিলি ডাক্তার আমার। আমি সিগারেট খেলে মানাবে না৷ একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না জান। প্লিজ, প্লিজ। ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান। ধমকে বলল,

‘ ফ্রেশ হবো। সময় মতো কলাবাগান দাঁড়াবি। ‘
.
.
বহুদিন পর গিটারিস্ট সৌধর আগমন ঘটেছে। ছাদে একাকী বসে গিটারে টুংটাং ধ্বনি তুলছে সে৷ রাতের সময় তখন কত জানা নেই। চারপাশে নীরবতায় আচ্ছন্ন। নিস্তব্ধ রজনী। আকাশে তাঁরার মেলা। মধ্যিখানে হাস্যজ্জ্বল চাঁদের বুড়ি। ছাদের একপাশে বসে সৌধ। আকাশে চাঁদের বুড়ির পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। তার শান্ত হৃদয় আর শীতল দৃষ্টিতে হাতছানি দিল বিস্ময়কর কেউ। দু-চোখের তারায় ভেসে ওঠল কৃষ্ণবর্ণীয় একজোড়া ঝাপসা দৃষ্টি। নিমেষে দু’হাতের আঙুল গুলোয় চঞ্চলতা বৃদ্ধি পেল। ছাদ থেকে নিচ পর্যন্ত শুনতে পাওয়া গেল গিটারের সুর। মনে হলো এই সুরকে আজ থামানো সম্ভব না। তবু থেমে গেল৷ সৌধ চৌধুরীকে থামিয়ে দেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা যার সেই থামালো। ফোনের শব্দ পেয়ে বা’হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে অচেনা নাম্বার দেখল সৌধ। ত্বরিত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর। যা তার মস্তিষ্ক বিগড়ে দিতে কৃপণতা করল না। ওপাশের মানবী বলল,

‘ কেমন আছিস সৌধ? ‘

আচমকা বিদ্যুৎ চলে গেলে যেমন ঘর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সৌধ আপাদমস্তক তেমনি নিভে গেল৷ ক্রমশ চোয়াল দ্বয় কঠিন হয়ে এলো তার। এক পর্যায়ে তীব্র ক্রোধে হাত, পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। ওপাশের মানবী সৌধর থেকে উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলল,

‘ জানি ভালো নেই। বিশ্বাস কর তোকে কষ্ট দিয়ে আমি নিজেও ভালো নেই। সৌধ, ইদানীং আমার শরীরটা ভালো যায় না রে। ডেলিভারির টাইম যত ঘনিয়ে আসছে ততই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি। আমি জানি একজন ডক্টর হিসেবে এমন কথা অতি লজ্জার। তবু কেন এত ভয় পাচ্ছি নিজেও জানি না। আমি একটা আবদার করব সৌধ রাখবি? প্লিজ, একটা দিন জাস্ট একটা দিন সময় দে আমাকে। দেখা কর। আমি সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী সবাইকে কল করেছিলাম রে। কেউ রাজি হয়নি। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। সবার এই ব্যস্ততা থেকে আমার জন্য একটা দিনও সময় নেই। ‘

তীব্র আফসোস ঝড়ে পড়ল নিধির কণ্ঠে। সৌধ এবার অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ তোর স্বামী কোথায়? ‘

‘ জানি না। তার সাথে আমার জোনো যোগাযোগ নেই। ‘

‘ থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব। ফাইজলামি করিস? সময় চাস আমার কাছে সময়? এই সময়টা তোর বরের কাছে চা ইডিয়ট! ‘

‘ সৌধ…’

‘ শাট আপ! কী করে ভাবলি তোকে আমি সময় দিব? সিরিয়াসলি! তোর মনে হয় পরের বউয়ের জন্য আমার সময় আছে? ডক্টর অর্পণ শিকদারের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতে চাস আমাকে? শ্যাম অন ইউ নিধি, জাস্ট শ্যাম অন ইউ। ‘

আর এক মুহুর্তও নিধির কথা তো দূরে থাক। শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজও সহ্য করতে পারল না সৌধ। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে গিটার রেখে ওঠে দাঁড়াল সে৷ বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বিরবির করে বলল,

‘ ওই অর্পণকে বিয়ে করার সাথে সাথে তোর বোধবুদ্ধি সব গিলে খেয়েছিস নিধি। বড্ড সাহস বেড়েছে এখন তাই নারে? এই সাহসটা অন্য একজন পুরুষকে জীবনে জড়িয়ে তার সন্তান গর্ভে ধারণ করার আগে দেখানো উচিত ছিল৷ শোন নিধি সম্পূর্ণ হুঁশে থেকে আজ তোকে বলছি, সৌধ চৌধুরী তোর জন্য উন্মাদ ছিল সত্যি, কিন্তু ভুলবশতও চরিত্রহীন হতে পারবে না। আমি তোকে ভুলতে চাই না এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য আমি তোকে ছাড়া ভালো থাকতে চাই। ইয়েস, আই ওয়ান্ট টু বি ব্যাটার উইথআউট ইউ! ‘

শেষ বাক্যটি প্রচণ্ড চিৎকার করে বলল সৌধ। যা বার বার বাতাসের বেগে প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কাছেই ফিরে এলো।

প্রকৃতির নিয়ম এটাই। সময় বহমান। আর মানুষ পরিবর্তনশীল। দুঃখকে আলিঙ্গন করে সুখের পথে পা বাড়ানোই মানুষের ধর্ম। আমি, আপনি বা সৌধ কেউই এই ধর্মের ঊর্ধ্বে নয়।

চলবে..
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৭|
প্রকৃতির যৌবন মাস চলছে। আকাশ, বাতাস, মাঠ, মাটি সর্বস্তরই নিজের যৌবন দ্বারা সুবাসিত করে রেখেছে শরৎরানি৷ আকর্ষিত মানব চিত্ত। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুভ্র আলোকরশ্মি আর স্নিগ্ধ আবহাওয়া। প্রকৃতির এই রূপকে ভীষণ ভালোবাসে নামী৷ তার সেই ভালোবাসায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল সুহাস৷ জানালো, পরশু তারা রাঙামাটি বেড়াতে যাবে। শুধু তারাই নয় আইয়াজ, ফারাহও যাচ্ছে। সরকারি ছুটি পড়েছে। এই সুযোগে ঘুরে আসবে তারা৷ কথানুযায়ী ব্যাগপত্র গুছিয়ে ঢাকা চলে এলো নামী। সুহাসের কোয়াটারে। এসেই জানতে পারল আইয়াজ, ফারাহও এসেছে। অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীকে কাছে পেয়ে বিগলিত চিত্তে ফারাহকে জড়িয়ে ধরল নামী। সুহাস এ দৃশ্য দেখে ঢঙ করে আইয়াজকে জাপ্টে ধরল। নামী খেয়াল করে সঙ্গে সঙ্গে ফারাহকে ছেড়ে সুহাসের দিকে তেড়ে গেল। সুহাস অমনি বন্ধু আর বন্ধুর বউয়ের সামনে জড়িয়ে ধরল নামীকে। লজ্জায় মূর্ছা গেল নামী। সুহাসের বুলে কিল বসিয়ে বলল,
‘ নির্লজ্জ। ‘

সুহাস দুষ্টুমি ভরে হাসল। ওর ছোট্ট ললাটে গভীর ওষ্ঠ স্পর্শ দিয়ে বলল,
‘ ইয়েস সম্পূর্ণ লজ্জা বর্জিত স্বামী তোমার। ‘

ওদের কাহিনি দেখে আর সুহাসের কথা শুনে ফারাহর মুখটা লজ্জায় লাল টমেটো হয়ে গেছে৷ খেয়াল করে চোখের চশমা ঠিক করতে করতে গলা খাঁকারি দিল আইয়াজ। অমনি সুহাস ছেড়ে দিল নামীকে। বলল,
‘ ধূরর দুইজোড়া তাকালে সমস্যা ছিল না। এ তো দেখি চার জোড়া তাকিয়ে আছে। ‘

ফারাহ স্তব্ধ। এই সুহাস ভাই আর বদলালো না। একই রয়ে গেল৷ খুব লজ্জায় ফেলে দেয় সবাইকে। আইয়াজ বলল,
‘ তোরও একজোড়া চোখের প্রয়োজন। চশমাকে চোখ বলছিস। নামী এক কাজ করো তো সুহাসকে চোখের ডাক্তার দেখাও। ‘

বেশ লম্বা সময় ওদের খুনসুটি চলল। যার অবসান ঘটল আইয়াজের ফোনে সৌধর ফোনকল এলে। আইয়াজ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সৌধ বলল,
‘ এই বদমাশ! স্টেশনে থাকতে বলেছিলাম তোকে। ‘

‘ দোস্ত বিলিভ মি থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফারাহ অসুস্থ ফিল করছিল বলে চলে আসছি। ‘

‘ বউ ছাড়া দেড় মিনিট চলতে পারিস না সেটা বল। থাকার ইচ্ছে থাকলে বউ রেখেও আসতে পারতি। ‘

আইয়াজ প্রচণ্ড নার্ভাস ফিল করতে লাগল। খেয়াল করে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল সুহাস৷ কতগুলো মাস হয়ে গেল। সৌধর সঙ্গে নিজে থেকে যোগাযোগ করে না সে। সৌধও ব্যস্ত খুব। নিজের স্বপ্ন পূরণে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছে। দেড়মাস হলো চট্রগ্রাম মেডিকেলে হার্ট সার্জন হিসেবে জয়েন করেছে সৌধ। এর মাঝে কথা হয়েছে বার দুয়েক। তবু সে ফোন করেনি৷ সৌধ নিজেই ফোন করেছে৷ নিজের হালচাল জানিয়ে জেনে নিয়েছে তার হালচাল। বহুদিন পর বোধহয় স্বেচ্ছায় সৌধর সঙ্গে কথা বলল সুহাস। আইয়াজের থেকে ফোন নিয়েই সে বলল,

‘ পৌঁছে গেছিস? ‘

সৌধ একটু অবাকই হলো। পরোক্ষণেই ভাবল, পৃথিবীর কোনো শক্তি কি তাদের বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে? ভেবেই আলতো হেসে বলল,

‘ এইতো পৌঁছালাম। আগামীকালের টিকেট কেটেই আসছি। ‘

‘ আগামীকালই ফিরে যাবি? ‘

‘ ফিরব না কী করব? তোদের ব্যাগপত্রে ওঠিয়ে আমাকে সাজেক নিয়ে যাওয়ার ধান্ধা করছিস নাকি। শোন সুহাস, আমি ব্যাচেলর হতে পারি। কিন্তু কাবাব মে হাড্ডি না। ‘

দু বন্ধুর কথোপকথন চলল বেশকিছুক্ষণ। এরপর ফোন রেখে দিল সৌধ। সুহাস আইয়াজকে ফোন ফেরত দেয়ার সময় বলল,

‘ ওর ডেলিভারির ডেট কবে? ‘

আইয়াজ ধাতস্থ হয়ে উত্তর দিল,

‘ সামনে সপ্তাহ। রবিবার। ‘

‘ আমরা ঘুরে এসে নবজাতক সহ দেখা করব। কিন্তু সৌধ কি তখন আসতে পারবে? ‘

‘ মেবি না তবু কথা বলে দেখিস। নিধির ইচ্ছেটুকু জানাস। ‘

নিধি চায় ডেলিভারির আগে একবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ব্যস্ততা কাটিয়ে নিজেদের জন্য সময় বের করেছে আইয়াহ, সুহাস। যদি নিধির সঙ্গে সম্পর্কটা আগের মতো থাকত। তাহলে নিজেদের জন্য বাছাই করা সময় অনায়াসে দিয়ে দিত। কিন্তু পরিস্থিতিটা আজ এমন যে নিধিকে সময় দিতে গেলে ওদের বন্ধুদের তীব্র অস্বস্তি জড়িয়ে ধরে। সবচেয়ে বড়ো কথা যে স্থানে সৌধর থাকার কথা ছিল। সে স্থানে অর্পণ স্যারকে মেনে নিতে পারে না ওরা। শুনেছে অর্পণ স্যারের সঙ্গে ঝামেলা ঠিক হয়েছে নিধির৷ হবে নাই বা কেন? ক’দিন পর নতুন অতিথি আসবে। এসেই যদি বাবা, মা’কে সেপারেশনে দেখে ভালো লাগবে ওর? শিশুটা তো নিষ্পাপ। যা কিছু হচ্ছে এর জন্য ও তো কোনোভাবেই দায়ী নয়৷ নিধি, অর্পণ দু’জনই পূর্ণ বয়স্ক এবং শিক্ষিত। স্পেশালি দু’জনই ডাক্তারি প্রফেশনে আছে৷ তাই একটি শিশুর ভালো, মন্দ তারা দু’জনই খুব ভালো বুঝবে৷ পাশাপাশি নিজেদের ভুল গুলোও টের পাবে। দূরে গিয়ে ভুলবোঝাবুঝি বাড়ানোর চেয়ে। কাছে থেকে ভুল শুধরে নেয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
.
.
নামী আর ফারাহ মিলে রান্নাঘরে। আর তিন বন্ধু ড্রয়িং রুমে কফি আড্ডা দিচ্ছে। কখনো ওরা পুরোনো দিনে ফিরে গেল। কখনো বা ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করল। হঠাৎ আইয়াজ বলল,

‘ সামনে সপ্তাহে নিধির ডেলিভারি। ও তো আমাদের খুব পুরোনো বন্ধু। আমাদের কি উচিত না ওর সঙ্গে একটিবার দেখা করা। নতুন অতিথিকে ওয়েলকাম করা? ‘

ওরা তিন বন্ধু ভীষণ ঘনিষ্ঠ। যখন একাকী একসঙ্গে সময় কাটায় তখন বাঙালি আর পাঁচ জন ছেলে বন্ধুদের মতোই মিশে যায়। একে অপরের সঙ্গে মারপিট করে, গালাগালি করে। সবচেয়ে বেশি গালি দেয় সুহাস। সৌধ দু একটা সহজ গালি দিয়ে ফেলে। আইয়াজ এমনিতে ভোলাভালা সভ্য হলে কী হবে। কলিজা পঁচানো গালি সেও জানে। প্রয়োজন পড়লে সে গুলো ব্যবহার করে প্রয়োজন ব্যতীত ব্যবহারিত হয় না৷ এ মুহুর্তে আইয়াজের বলা কথাগুলো আশা করেনি সৌধ। মানুষ কি তার জীবনের দূর্ঘটনা গুলো বার বার স্মরণ করতে চায়? দেখতে চায় ফেলে আসা দুঃস্বপ্ন? নিধি সৌধরও বন্ধু। তবু বন্ধুত্বের বাইরে গিয়ে নিধির প্রতি যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তা যে আজ ক্ষতবিক্ষত। সে ক্ষত আজ সেরে ওঠলেই দাগ ঠিকই রয়ে গেছে। সে দাগকে দু-চোখে দেখার আগ্রহ পায় না সৌধ। তাই আওয়াজের বলা আকস্মিক কথাটায় মস্তিষ্ক বিগড়ে গেল তার। বেমালুম ভুলে গেল সে কোথায় আছে। মুখ ফস্কে বলে ফেলল,

‘ ধূরর বা*ল! এসবের জন্য ডেকে এনেছিস? ‘

‘ ছিঃ সৌধ ভাই! এসব বলে না। আপনিও এসব স্ল্যাং ইউজ করেন? ‘

থতমত খেয়ে গেল সৌধ। চমকে গিয়ে তাকাল নামীর দিকে। নিমেষে মুখ কঠিন হয়ে ওঠল ওর। নামী ভয় পেল একটু৷ সৌধ মুখ ফিরিয়ে নিল। সুহাস নামীর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

‘ কী চাই? ‘

‘ কফির মগ গুলো নিতে এসেছিলাম। ‘

‘ নিয়ে যাও। ফ্রেন্ড সার্কেল কথা বললে এসব হয়েই থাকে। তুমি কান দুটো বন্ধ করে কাজ করো। ‘

নামী আপাতত কিছু বলল না। সৌধ সম্পর্কে তার ধারণা অন্যরকম৷ তাই আকস্মিক ছোট্ট একটি গালি শুনে ভড়কে গিয়েছিল৷ খেয়াল করল সৌধও অস্বস্তি বোধ করছে৷ তার বোধহয় এভাবে প্রশ্ন করা উচিত হয়নি৷ সৌধ সবার কাছে যেমনি হোক৷ বন্ধুদের সঙ্গে নিশ্চয়ই বন্ধুসুলভই থাকে? ধূর বোকামি করে ফেলল। নামী কফির মগ নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেলে মুখ খুলল সৌধ।

‘ বন্ধুর জন্য বড্ড বেশি দরদ উতলাচ্ছে তোদের। যা তোরা গিয়ে দেখা করে আয়। বেবিকে ওয়েলকাম কর। আমার পক্ষে পসিবল না। কারণ হিসেবে আপাতত উত্তর একটাই। ঐ বেবিটা আমার না। অথচ ও আমার হতে পারত! ‘

পরিবেশ গুমোট হয়ে গেল৷ নীরবতায় কাটল দীর্ঘক্ষণ। সুহাস, আইয়াজ নিধি বিষয়ে আর কথা এগুলো না। অন্য গল্পে চলে গেল সুহাস৷ চিন্তান্বিত গলায় বলল,

‘ ডিসেম্বরে নামী ইউ এস এ যেতে চায়। আমাদের দুজনেরই পাসপোর্ট আছে৷ ভিসার জন্য জোরাজোরি করছে। এদিকে মা বলেছে ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক ভাবে নামীকে ঘরে তুলবে৷ দুজনের দুরকম সিদ্ধান্তের মাঝখানে পড়ে গেছি আমি। ‘

আইয়াজ কোনো মন্তব্য করল না। বিবাহিত জীবন সহজ নয়৷ পারিবারিক বহু জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়৷ জানে সে। তাই নিশ্চুপ রইল। সৌধ পিঠ এলিয়ে বসেছিল৷ সুহাসের কথায় সোজা হলো। ভাবুক গলায় বলল,

‘ আন্টির কথা শুনে নামীর মতামত কী? ‘

‘ নামী জেদ করছে অত্যাধিক। এতদিন অপেক্ষা করানোর পর আরো সময় মা নেবে? মা যে খুশি মনে আমাদের জন্য আয়োজন করতে চাচ্ছে এটাই তো অনেক৷ নামী বুঝে না ব্যাপার গুলো। ‘

সৌধর বিশ্বাস হলো না। নামী এমন করতে পারে। তাই বলল,

‘ তুই বোঝাসনি? ‘

‘ ওর বাবা জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আসবে। ও চায় অনুষ্ঠানে ওর পরিবারও উপস্থিত থাকুক। ‘

‘ চাওয়াটা অন্যায় নয়। এতবড়ো আয়োজন যখন হচ্ছে নামী বাবা উপস্থিত থাকুক। বেচারির মা নেই। বাবা থাকলে শান্তি পাবে। ‘

‘ কিন্তু মা…’

‘ তুই বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। এ বছর তাহলে দু’বার হানিমুন হচ্ছে তোদের। এবার বেবি প্লানিং করে ফেল সুহাস। ‘

মজার ছলে সৌধ কথাটা বলতেই আইয়াজ সুহাসের কাঁধ চেপে ধরল। বলল,

‘ সিরিয়াসলি দোস্ত। নিধির একটা ছেলে হোক আর সামনে বছর তোর আর নামীর মেয়ে আসুক। তারপর তোরা বেয়ান, বেয়ানি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলবি। ‘

ঝোঁকের বশে। গল্পে মজে ফের নিধির কথা ওঠল। সৌধ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকাল আইয়াজের পানে। আইয়াজ থতমত খেয়ে বলল,

‘ সরি। ‘

সৌধ থমকানো গলায় বলল,

‘ সরি আমার বলা উচিত। আমার কারণে এত বছরের গভীর বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে। হাজার চাইলেও তোরা নিধিকে ভুলতে পারবি না। আসলে ভোলা যায়ও না। বন্ধু তো! ‘

গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। ভুলতে কি সে পারছে? পারছে না। সবকিছুর পরও কোথায় যেন একটা টান রয়ে গেছে। আচমকা নীরব হয়ে গেল সৌধ। চারপাশে অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠল তার। অন্তঃকোণ বলে ওঠল,

‘ সামনে সপ্তাহে নতুন একটি প্রাণের আগমন ঘটবে। নিধির সন্তান সে। নিধি মা হচ্ছে… অথচ সে বাবা হতে পারল না। ‘

নিমেষে বুক ভার হয়ে গেল। আফসোস মিশ্রিত এক টুকরো নিঃশ্বাস বের হলো নাসিকা বেয়ে। বুকের গহীনে অসহ্য এক পীড়া শুরু হতেই ঝড়ের বেগে ভারিক্কি বুকটায় বর্ষণ নামল। একদম বিনা বজ্রপাতে। এ বর্ষণ আকাশ চিঁড়ে নয় এ বর্ষণের আগমন ঘটল কারো একজোড়া চোখ চিঁড়ে। কী আশ্চর্য! আজো ওই হরিণী চোখ দু’টির নোনাজল ভিজিয়ে তুলে তার বক্ষগহ্বরে খরায় আক্রান্ত মৃত্তিকাকে।

সৌধর শান্ত রূপ বন্ধুদের অশান্ত করে তুলল। সুহাস কাঁধ ধাক্কা দিয়ে বলল,

‘ কী ভাবছিস? ‘

চমকে ওঠল সৌধ। অধর কামড়ে ভাবুক কণ্ঠে বলল,

‘ ভাবছি না, বোঝার চেষ্টা করছি। ‘

‘ কী? ‘

‘ পুরোপুরি বোঝার পর বলব। ‘

জীবনে কখনো কখনো এমন একটি সময় আসে। যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের বুঝতে পারি না, চিনতে পারি না৷ চেনা আমিটা যখন অচেনা হয়ে যাই। তখন চারপাশের সবকিছু অস্বস্তিকর মনে হয়। যে অস্বস্তি কখনো আমাদের অস্থির করে তুলে৷ কখনো বা জড়িয়ে ফেলে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায়।

সৌধর কথা শুনে সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ওদিকে নামীর গলা শুনতে পাওয়া গেল,

‘ সুহাস, তোমরা কি এখনি ডিনার করবে? নাকি লেট হবে। ‘

‘ লেট হবে। ‘

গলা উঁচিয়ে বলল সুহাস৷ ফিরতি কথায় নামী শুধাল,

‘ তোমরা আজ একসাথে থাকবে তো। রুম গুছিয়ে দেব? ‘

‘ দাও। ‘

বহুদিন পর আজ তিন বন্ধু একসঙ্গে রাত কাটাবে৷ বহুদিন পর দুই বান্ধবীও একসঙ্গে ঘুমাবে। আজ ওরা প্রত্যেকেই ভীষণ উল্লসিত।
.
.
ওজন মাপার মেশিন এখন সিমরানের ঘরেই রাখা হয়েছে। অবসর নেয়ার পর থেকে বেশ মন দিয়ে সংসার সামলাচ্ছে উদয়িনী৷ সেই সঙ্গে ছেলেমেয়ের কাছে ধরাও পড়েছে। রোজ গাদাগাদা ওষুধ সেবন করে উদয়িনী। তার ডক্টর ছেলে একদিন ধরে ফেলল মায়ের দেহে ডায়াবেটিস আছে। প্রেশার সব সময় হাই। আজ থেকে ছয় বছর আগেও একদম সুস্থ, সবল ছিল মা। অথচ আজ দেহে নানারকম রোগ ভর করেছে। কঠোর নিয়মে চলতে হয় উদয়িনীকে। সে নিয়ম মানার পাশাপাশি সিমরানের যত্নে ত্রুটি রাখে না। সারাজীবনের সব যত্ন যেন একবারে ঢেলে দিচ্ছে মেয়েটাকে। তিনবেলার এক বেলাও নিজহাতে ভাত খেতে হয় না সিমরানকে। যেন দিন দিন তার বয়স বাড়ছে না কমছে। অন্তত মায়ের আদর, ভালোবাসা দেখে তো সিমরানের তাই মনে হয়৷ মাঝে মাঝে ভাবে ভাগ্যিস মা তার প্রতি কেয়ারিং হয়েছে। নয়তো সৌধ ভাইকে না পাওয়ার যন্ত্রণা একদিন নিঃশেষ করে দিত তাকে।

রাতের খাবার তৈরি। মেয়েকে ডাকতে এসে ভ্রু কুঁচকাল উদয়িনী। সন্ধ্যা থেকে ফোন ঘাঁটছে মেয়েটা৷ এখনো সেই তালেই আছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সে। এগিয়ে এসে শাসনের সুরে বলল,

‘ আম্মুজান? এখনো ফোনে কী? অতিরিক্ত ফোন দেখলে স্বাস্থ্যটা আবার খারাপ করবে। চোখের নিচে আবার ডার্ক সার্কেল দেখা দেবে। রাখো ফোন। নিচে চলো খেয়েদেয়ে পড়তে বসবে। ‘

মায়ের মিষ্টি বকা খেয়ে হাসল সিরমান। ফোন রেখে ওঠতে ওঠতে বলল,

‘ কিচ্ছু হবে না আম্মু। তুমি আছো তো আমার পাশে। তুমি পাশে থাকলে আমার কিচ্ছু হবে না। ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে আমি। কোন অসুখের সাধ্য আমাকে গ্রাস করে? ‘

হিহি করে হেসে ফেলল সিমরান। মেয়েকে টেনে নিয়ে ওয়েট মেশিনে দাঁড় করাল উদয়িনী। উপরের ঠোঁট দ্বারা নিচের ঠোঁট চেপে ধরে ওজন দেখল। এরপর মৃদু হেসে বলল,

‘ বাহ নাইস! আটচল্লিশ হয়ে গেছ। ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। বলল,

‘ আল্লাহ! আর বাড়ানো যাবে না বুঝছ আম্মু। লোকে মটু বলবে। ‘

‘ ধূর পাগলী। পাঁচ ফুট তিন উচ্চতার মেয়েদের আটচল্লিশ কোনো ওজনই না। আরো বাড়াতে হবে। চলো খেয়ে নিবে। খাওয়ায় বড্ড অনিয়ম করো। আমার অনুপস্থিতিতে এসব করে করেই চেহেরার বাজে হাল করেছিলে। এখন আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখলে প্রাউড ফিল হয় না? ‘

হাসল সিমরান। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে উদয়িনী বলল,

‘ খাবারদাবার আর ঘুম এই দু’টো জিনিস ঠিকঠাক রাখবে। কোনোকিছু নিয়েই দুঃশ্চিতা করবে না। তাহলে মন, শরীর দু’টোই ফিট৷ আর সব সময় মনে রাখবে দুঃশ্চিন্তা তোমার জীবনে একবিন্দু সফলতাও এনে দিতে পারবে না। দুঃশ্চিন্তা মানুষকে গ্রাস করে নেয়।’

খাবার টেবিলে সব গুছানোই ছিল। উদয়িনী খুব যত্ন করে খাইয়ে দিল মেয়েকে। সিমরান নিজের ফোন ঘরে রেখে এসেছে। তাই মায়ের ফোন থেকেই বাবাকে কল করল। বাবা রিসিভ করতেই সে আহ্লাদী স্বরে বলল,

‘ মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো আব্বু? ‘

মেয়ের মুখ দেখেই মুখে হাসি ফুটল সোহানের৷ বলল,
‘ কী বাবা? ‘

‘ মনে হয় এতদিন আমি বড়ো ছিলাম। আর এখন শিশু বয়স পাড় করছি। ‘

কথাটা বলেই ক্যামেরা মায়ের দিকে তাক করল। উদয়িনীর মুখ দেখে হাসি প্রশস্ত হলো সোহানের। বলল,

‘ সেলিনা আসেনি আজ? ‘

‘ এসেছিল। সন্ধ্যায় চলে গেছে। ‘

মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে উত্তর দিল উদয়িনী। সোহান খন্দকার বলল,

‘ তোমায় ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘

সহসা চমকাল উদয়িনী। সোহান বলেছে তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এর মানে সুক্ষ্ম নজরে সোহান খেয়াল করেছে তাকে। আচমকা চোখ ঝাপসা হয়ে এলো উদয়িনীর৷ স্বামী আর মেয়ের চোখে ধরা পড়ার ভয়ে দৃষ্টি নত করে ভাত তরকারি মাখাতে শুরু করল। সিমরান ক্যামেরা নিজের দিকে ঘুরিয়ে উৎসুক হয়ে বলল,

‘ কবে আসবে আব্বু? মিস ইউ… ‘

‘ এইতো মা পরশু ফিরছি। ‘
.
.
ঠিক তিনদিন পর। আজ সেলিনা আপা আসেনি। গতকাল থেকে তার ছেলের ভীষণ জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে যাবে। উদয়িনী বলেছে ব্লাড টেস্ট করে রিপোর্ট এনে দেখাতে। গতরাতে উদয়িনী সিমরানকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। সকালে কী খাবে সে? হঠাৎ করেই সরষে ইলিশ খেতে চেয়েছে সিমরান। কারণ তার মামা গতকাল অনেক বড়ো একটি ইলিশ মাছ পাঠিয়েছে। আবদার শুনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উদয়িনী বলে,

‘ এটা কখনো করিনি। ইউটিউব দেখে শিখে নিব। খারাপ লাগলে নাক কুঁচকাবে না। ‘

সত্যি বলতে উদয়িনী এতকাল সেভাবে কোনো রান্নাই পারত না। অবসর নেয়ার পর সেলিনার কাছে আর ইউটিউব ঘেঁটে শিখেছে অনেকটাই। সরষে ইলিশ এখন পর্যন্ত রাঁধেনি সে। সিমরানের আবদার শুনে সকাল সকাল ওঠে ইউটিউব দেখে রাঁধবে সিদ্ধান্ত নেয়। রাতে একবার রেসিপিটা দেখেছে৷ সকালে আর একবার দেখলেই হয়ে যাবে।

নতুন আরো একটি সকাল। বেলা তখন ন’টা পঁচিশ। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সিমরানের। ঘড়িতে সময় দেখে চমকে ওঠে সে।’ কী ব্যাপার! আম্মু আজ এখনো ডাকতে এলো না। ‘ নাক ফুলিয়ে বসে রয় মেয়েটা। পরোক্ষণেই খুশিতে চিত্ত চঞ্চল হয়। নিশ্চয়ই আম্মু সরষে ইলিশ ট্রাই করতে গিয়ে তাকে ডাকতে আসতে পারেনি। আজ সেলিনা আপাও নেই। ইশ আম্মুর ওপর চাপ হয়ে গেল৷ ভেবেই দেরি না করে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখে ঘরটা ফাঁকা। চুলা জ্বলছে না। তবে কি রান্না শেষ? আম্মু উপরে। ঠোঁট ফুলালো সে। গুটিগুটি পায়ে নাক বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। প্রতিটি কড়াই, পাতিলের ঢাকনা উঁচিয়ে উঁচিয়ে খুঁজল সরষে ইলিশের ঘ্রাণ৷ নিমেষে নিরাশ হলো সে। অভিমানে বুক ভার। তবে কি আম্মু রান্না করেনি? তাহলে সে এখন খাবে কী? তার যে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উপরে ওঠে এলো সিমরান। মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে স্বাভাবিক শক্তিতে দরজা ধাক্কা দিতেই বুঝল ভেতর থেকে দরজা আটকানো। প্রথমে বিস্মিত হলো। এরপর রাগান্বিত হয়ে দরজায় মৃদু থাপ্পড় দিয়ে ডাকল,

‘ আম্মু, আম্মু দরজা খোল। ‘

ভেতর থেকে সাড়াশব্দ পেল না। আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল যেন। মুহুর্তেই ভাবনায় এলো, আম্মু কি ওয়াশরুমে গেছে? ধূরর। হতাশ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে দু’টো চকোলেট ছিল। তার থেকে একটি নিয়ে খেতে খেতে ফের মাকে ডাকতে এলো। ফের দরজায় ঠকঠক করতে করতে বলল,

‘ অ্যাঁই আম্মু, কী করছ তুমি দরজা খুলছ না কেন? খিদে পেয়েছে আমার। ‘

মেজাজ ক্রমশ খারাপ হতে লাগল এবার। আকস্মিক খেয়াল করল জানালা খোলা। দেরি না করে ছুটে এলো জানালার কাছে৷ চকোলেট চিবুচ্ছে সে৷ পাশাপাশি জানালা গলিয়ে ভেতরে তাকাতেই আশ্চর্য হয়ে গেল। সে কী! আম্মু যে এখনো ঘুমুচ্ছে। এবার গলার স্বর উঁচু হলো সিমরানের। ডাকতে লাগল অবিরত। এক পর্যায়ে তার আম্মু আম্মু ডাক আচমকা থেমে গেল। কেউ যেন সহসা বুকের ভেতর বিশাল এক পাথর চেপে ধরল । শ্বাসরোধ হয়ে এলো নিমিষে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে ওঠল। ঠোঁট দু’টিও একসঙ্গে চেপে রইল না। কাঁপতে শুরু করল তিরতিরিয়ে৷ সর্বাঙ্গ অবশ হতে গিয়েও এক ঝটকায় স্বাভাবিক করে নিল নিজেকে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘ তোমার কি শরীর খারাপ আম্মু? ও আম্মু, দরজা খোলো। দরজা না খুললে তোমার কাছে যাব কীভাবে? কী হয়েছে তোমার, জ্বর হয়েছে? ‘

আশপাশে অদ্ভুত ভাবে তাকাল সিমরান। মাথাটা ঘুরছে। ধীরেধীরে পা এগুলো। নিজের ঘরে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন তুলল। কল করল আব্বুকে। ফোন রিসিভ হতেই ঢোক গিলে শান্ত গলায় বলল,

‘ আম্মু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি আব্বু। মনে হয় শরীর খারাপ। জানো আম্মু কী করেছে? দরজা ভেতর থেকে লক করে ঘুমিয়েছে। এত ডাকছি তবু ওঠছে না। এখন আমি কী করে ভেতরে যাব? ‘

কথাগুলো বলতে বলতে সিমরান অনুভব করল ওর কণ্ঠনালী দিয়ে আর কথা বেরুচ্ছে না৷ ওপাশে কী আব্বু কিছু বলল? সে তো শুনতে পেল না। যখন হুঁশ এলো দেখল ফোন কেটে গেছে। সিমরান শান্ত ভঙ্গিতে আবার মায়ের ঘরের সামনে চলে গেল। দরজা ঠকঠক শব্দে মুখরিত করল বারকয়েক। ডাকল,

‘ আম্মু, গলা শুঁকিয়ে যাচ্ছে ডাকতে ডাকতে। তুমি কি দরজা খুলবে নাকি রাগারাগি করব আমি? অনেকদিন আমার ভাঙচুর দেখো না তাই না। আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি আম্মু। ‘

এবারেও কণ্ঠনালী রোধ হয়ে এলো। ঘামতে শুরু করল সিমরান৷ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল শীতল স্রোত। একটুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কল করল ভাই সুহাসকে। সুহাস রিসিভ করতেই সিমরান শান্ত কণ্ঠে থেমে থেমে বলল,

‘ অ্যাঁই ভাই, আম্মু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি জানো? এত ডাকছি ওঠছেই না৷ দরজা লক করে ঘুমিয়েছে। আমি ভেতরেও যেতে পারছি না। ‘

‘ সাড়ে দশটা বাজে আর মা ঘুম থেকে ওঠেনি? সিনু বাবাকে কল কর। মায়ের শরীর খারাপ হয়তো। আমি মাকে কল করছি। ‘

সুহাস কেটে দিল৷ কিয়ৎক্ষণ পরই উদয়িনীর শিয়রে থাকা ফোনটা বাজতে লাগল অনবরত। সিমরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল বার বার ফোনটা বেজে কেটে যাচ্ছে। অথচ তার আম্মু ওঠছে না। আম্মুর ঘুম তো এত প্রগাঢ় নয়। সে ঘুমালে তার রুমে কেউ হাঁটাহাঁটি করলেও জেগে ওঠে। আজ তাহলে এত ঘুমাচ্ছে কেন? ঘুমের ওষুধ খেয়েছে কী? আচমকা হাতে থাকা ফোনটির রিং বাজতেই কেঁপে ওঠল সিমরান। স্ক্রিনে বাবা নামটা জ্বলজ্বল করছে।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪২|

সৌধর মা তানজিম চৌধুরী। সিমরানকে খুব ছোটো থেকে বড়ো হতে দেখেছে। সেদিনের সেই এক রত্তি মিষ্টি মেয়ে সিমরান। চোখের পলকে কতবড় হয়ে গেল৷ সচক্ষে দেখল, বাবা, মা, ভাইয়ের কাছে একরোখা, জেদি তকমা পাওয়া মেয়েটি আদর, ভালোবাসা, যত্ন পেলে কেমন মোমের মতো গলে যায়৷ মিলিয়ে যায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। তানজিম চৌধুরী দু’টো পুত্র আর একটি কন্যা সন্তানের জননী। উচ্চ শিক্ষিত হলেও ভীষণ সংসারী। স্বামী, সন্তান আর বিরাট সংসারেই সুখ খুঁজে পায় সে। সেই সুখের রাজ্যে রাজ করতে করতে সুখের উৎসর্গ সম্পর্কেও খুব জ্ঞান আহরণ করে। তার নিখুঁত দৃষ্টিতে পরিবারের সকল সদস্যই এক একটা বইয়ের মতো। দীর্ঘদিন সংসার করে, তাদের যত্নআত্তি নিয়ে , দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করার মাঝে এই বই গুলোর অনেক পৃষ্ঠাই পড়া হয়ে গেছে। তার চতুর দৃষ্টিজ্ঞান শুধু পরিবারেই সীমাবদ্ধ নয়৷ তার পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যার মধ্যে সিমরানও একজন। যে মেয়েটা ছোটোবেলা থেকে বাবা, মায়ের সঙ্গে অদৃশ্য দেয়াল দেখে বড়ো হয়েছে। শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনের যাত্রাটি যার আর পাঁচ জন সাধারণ মেয়ের মতো ছিল না। বড্ড ভালোবাসার কাঙালি মেয়েটা৷ যেখানেই ভালোবাসা পায়, একাকীত্ব কাটানোর সঙ্গী পায় সেখানেই ছুটে যায় দ্বিধাহীন। তাই তো কিশোরী বয়সের দীর্ঘ সময় গুলো কেটেছে বন্ধু, বান্ধবীদের সঙ্গে অবাধে চলাফেরা করে। যৌবনে পা রাখার পর পারিপার্শ্বিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের সান্নিধ্যে এসে অবশ্য সেই চলার পথ থেমেছে। বাঁক নিয়েছে মার্জিত, সুন্দর পথে। তাই তো সব দেখা, সব জানা, আপাদমস্তক বুঝে নেয়া, চিনে নেয়া মেয়েটিকে নিজের অতিপ্রিয় ছোটো পুত্রের জন্যে মনে মনে বাছাই করেছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তানজিম চৌধুরী। বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকা সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ কে বলল তুমি পাত্রী হিসেবে খারাপ? কার এতবড়ো স্পর্ধা মা! ‘

সিমরানের কান্নার বেগ বাড়ল। তানজিম চৌধুরী আশপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে সিমরানকে বুকে আগলেই নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে নিজের পাশে সিমরানকেও বসালেন। এরপর দু’হাতে আদর করে গাল মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালেন,

‘ কী হয়েছে সিনু মা? আমাকে খুলে বলো। না বললে তো বুঝতেছি না। ‘

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলল মেয়েটা৷ শান্ত হতে সময় নিল অনেকক্ষণ। তানজিম চৌধুরী তার জহরি দৃষ্টি দ্বারা তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। সিমরান শান্ত হলো কিছুটা। এরপর থেমে থেমে গা কাঁপিয়ে ফের একই প্রশ্ন বাক্য ছুড়ল,

‘ আমি কি পাত্রী হিসেবে খুব খারাপ? ‘

কাঁদতে কাঁদতে ফর্সা মুখটা লাল বর্ণে পরিণত হয়েছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। বিধ্বস্ত লাগছে মেয়েটাকে। তানজিম চৌধুরীর মাতৃ হৃদয় নড়ে ওঠল। হাত বাড়িয়ে দু-চোখ উপচে পড়া অশ্রুকণা গুলো মুছতে মুছতে বলল,

‘ ছিঃ ছিঃ মা এসব কী প্রশ্ন! পাত্রী হিসেবে খারাপ কেন হবা? এত সুন্দর ফুলের মতো মেয়ে তুমি। কত লক্ষ্মীমন্ত! আজকাল এমন পাত্রী পাওয়াই তো দুরাশা। কত ভালো পরিবার তোমার। কোনোদিকে এক চুল কমতি নেই। এসব প্রশ্ন কে মাথায় ঢুকিয়েছে? তোমাকে না বলছি আজেবাজে বন্ধু, বান্ধবের সাথে মিশবা না। ‘

ওড়নার কোণা দিয়ে চোখের পানি মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান। ভাঙা কণ্ঠে বলল,

‘ এখন আর মিশি না তো। ‘

বারকয়েক পলক ফেলল তানজিম। এরপর সিমরানের কাছাকাছি বসে ক্ষীণ কণ্ঠে শুধাল,

‘ কী নিয়ে কষ্ট পাচ্ছ মা? আমার কাছে শেয়ার করো। আমি তো বলেছি আমি তোমার দ্বিতীয় মা। উদয়িনী ভাবি তো সব সময় কাছে থাকে না। তাই যখন ইচ্ছে হবে এই মায়ের কাছে আসবা, মনের কথা শেয়ার করবা। সময় কাটাবা৷ ‘

বিগলিত হলো সিমরান। মাথা নিচু করে নিঃশ্বাস আঁটকে বলল,

‘ আমার মতো পাত্রী পাওয়া যদি দুরাশাই হয়। তোমার ছেলের জন্য তবে অন্য মেয়ে কেন দেখছ? ‘

দু-চোখ বেয়ে আবারো অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। তানজিম চৌধুরী স্তম্ভিত! স্বাভাবিক হতে সময় নিল। সিমরান নত মস্তক একটুখানি তুলে দেখল আন্টিকে। আন্টির স্তম্ভিত মুখশ্রী দেখে হৃৎপিণ্ড ছটফটিয়ে ওঠল তার৷ চোখ দুটো টলমল হলো আবার৷ কিন্তু অশ্রুজল গড়াল না। গলায় আঁটকে থাকা কান্না গুলো গিলে নিল ভয়ে। কাঁপা কাঁপা স্বরে পুনরায় বলল,

‘ আমি তোমার ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসি আন্টি। তুমি প্লিজ আমাকে বেহায়া ভেবো না। বিশ্বাস করো আমি নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি। আমাকে বোঝার মতো কেউ নেই আন্টি কেউ নেই। এই কঠিন পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য একমাত্র তুমি ছাড়া কাউকেই খুঁজে পাইনি আমি। ‘

বাক্যের সমাপ্তি দিয়ে দু-হাত বাড়াল সিমরান। তানজিম চৌধুরীর দুগাল আলতো ছুঁয়ে ঘাড় ডানদিকে কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে, অসহায় কণ্ঠে বলল,

‘ ক্লাস নাইন থেকে সৌধ ভাইকে ভালোবাসি আমি। সাহস করে কখনো বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম বলব একদিন। এরপর জানলাম সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে৷ সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে জানার পর আমার হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেই কষ্ট আমি আজো ভুলতে পারিনা। এখনো কষ্ট হয় খুব। ‘

একটু থামল মেয়েটা। এরপর আচমকা করুণ স্বরে বলল,

‘ নিধি আপুর জন্য সৌধ ভাইয়ের যে যন্ত্রণা সেই যন্ত্রণা সৌধ ভাইয়ের জন্য আমাকে পেতে দিও না আন্টি৷ ম রে যাব! বিশ্বাস করো ম রে যাব! আমি সৌধ ভাইয়ের মতো স্ট্রং না। সহ্য করতে পারব না আন্টি। সৌধ ভাইয়ের জীবনে অন্য কোনো মেয়ে, অন্য একটা মেয়ে সৌধ ভাইয়ের বউ!’

কথাগুলো বলতে বলতে শ্বাস আঁটকে এলো সিমরানের। দু’হাতে আগলে ধরা আন্টির গাল দুটো আলগোছে ছেড়ে একহাত নিজের বুকে চেপে ধরল। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বলল,

‘ তোমার ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসি আন্টি। এই দেখো এখানটায় কত কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছি না৷ দম বন্ধ হয়ে আসছে। এসব শুধুমাত্র তোমার ছেলেকে পাগলের মতো ভালোবাসি বলেই তো হচ্ছে।
ভালোবাসা কি প্রমাণ করা যায় আন্টি? তুমি এখানটায় হাত রেখে দেখো কত্ত ছটফট করছে। ট্রাস্ট মি, আমার এই ছটফটানিটুকু বুঝলে তুমি প্রমাণ চাইবে না ঠিক বিশ্বাস করবে। ‘

সহসা তানজিম চৌধুরী হাত বাড়ালেন। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেপে ধরলেন সিমরানের বুকের বা’পাশে। এবারে সিমরানের চোখের অশ্রু ঝড়ল। আঁটকে রাখা কান্না বাঁধন হারালো ফের। ভাঙা স্বরে বলল,

‘ যেদিন জানতে পারি তোমার ছেলের ভালোবাসার মানুষ অন্য কেউ। সেদিনের পর থেকে ঠিক এমনই যন্ত্রণা নিয়ে রাত কাটে, দিন হয়৷ তুমি বিশ্বাস করছো তো আমাকে? ‘

‘ চুপ! আর কিছু বলতে হবে না বিশ্বাস করেছি আমি। ‘

আকস্মিক কথাটা বলেই সিমরানকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তানজিম। নিভৃতে দু-চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়াল তার। সন্তর্পণে চোখ বুজে লম্বা একটি শ্বাস নিলেন তিনি। মনে মনে বললেন,

‘ আমার সৌধর জন্য সিনুকেই চাই। এই ভালোবাসা থেকে সৌধ মুখ ফেরাতে পারবে না৷ এই নিষ্পাপ ভালোবাসা বৃথা যাবে না৷ মা হয়ে আমি ছেলের জন্য সঠিক মানুষ চিনতে ভুল করিনি৷ একদম করিনি। কিন্তু উদয়িনী ভাবি! ‘

চমকে ওঠলেন তানজিম। সৌধর বিয়ের কথাবার্তা চলছে বেশ কয়েকমাস ধরেই। সর্বপ্রথম কথা ওঠেছিল সিমরানকে নিয়ে। কিন্তু সেই কথাবার্তা থেমে গিয়েছে। কারণ উদয়িনী চায়নি সৌধর সঙ্গে সিমরানের জুটি মিলুক। এই নিয়ে উদয়িনীর প্রতি কারো রাগ নেই। বিষয়টাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে৷ কোন মা চাইবে জেনে-বুঝে মেয়েকে মাঝ সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলতে? যেখানে অন্য একটা মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করবে না স্থির করেছে সৌধ। সেখানে এসব জেনেশুনে উদয়িনীর মতো দাম্ভিক মহিলা নিজের মেয়েকে বিয়ে দেবে? উদয়িনী প্রস্তাব নাকোচ করার পর থেকে অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করে সুজা চৌধুরী। ভালো পরিবারের এডুকেটেড মেয়ে দেখেছে। সাধারণ পরিবারের সুন্দরী মেয়েও বাদ রাখেনি। মনের মতো কাউকেই পাচ্ছে না। যাও দু একটা পাচ্ছে ভয়ে এগুচ্ছে না৷ সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়ে কি সৌধর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে? যেই মানসিক সমর্থনটা প্রয়োজন তা দিতে পারবে তো? সবচেয়ে বড়ো কথা আজকালকার যুগে কোন মেয়ে এমন সম্পর্কে এগুবে? ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে ছন্নছাড়া জীবন বেছে নেয়া ছেলের হাত ধরার সাহস কি সব মেয়ের হয়? হয়তো একদম সাধারণ পরিবারের মেয়ে বিয়েতে রাজি হবে। বিপুল সম্পদ, ক্ষমতা, সুদর্শন পুরুষ, চমৎকার ভবিষ্যত পাওয়ার লোভে। কিন্তু দিনশেষে কি সৌধকে ভালো রাখতে পারবে? হয়ে ওঠতে পারবে মনের মতো জীবন সঙ্গী? হয়তো পারবে, নয়তো না। এই নিয়ে প্রচণ্ড শঙ্কিত তানজিম চৌধুরী। তার বিশ্বাস ছিল সিমরানের বিষয়টা পুরোপুরি ভিন্ন। আজকে সৌধর প্রতি সিমরানের ভালোবাসার স্বীকারোক্তি পেয়ে সেই বিশ্বাসের জায়গাটা মজবুত হলো। সিমরানকে আলাদা করে সৌধর ব্যাপারে না কিছু জানানোর আছে আর না কিছু বোঝানোর। সৌধরও ঠিক তাই। সবচেয়ে বড়ো কথা আলাদা পরিবারের আলাদা মেয়ের সঙ্গে সৌধ মানিয়ে নিত কিনা, সৌধ তাকে গ্রহণ করতে পারত কিনা এই নিয়ে বিরাট সংশয় ছিল৷ কিন্তু সিমরানের বেলাতে এই সংশয় নেই৷ কারণ সিমরানের প্রতি সৌধ যথেষ্ট সংবেদনশীল। সেটা ভালোবাসা নামক অনুভূতি থেকে না হলেও বন্ধুর বোন হিসেবে। সিমরানকে সৌধ অপছন্দ করে না৷ বরং মেয়েটার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল পূর্ব থেকেই। বন্ধুর বোনের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা, যত্নশীলতাই কি পারে না আগামী দিনে তাদের মধ্যে আদর্শ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে। যে ভালোবাসা সিমরানের বুকে লালিত আছে সেই ভালোবাসা কি সৌধর ভগ্ন হৃদয় জোড়া লাগিয়ে পূর্বের থেকেও শতগুণ মজবুত করে দিতে পারে না? অবশ্যই পারে। উদ্দেশ্য যদি সৎ এবং পবিত্র হয় মানবকূলের পক্ষে সবই সম্ভব। আর যে নারীর হৃদয়ে ভালোবাসা নামক বীজ রোপিত আছে সে নারীর পক্ষে সে বীজ থেকে বৃক্ষ তৈরি অস্বাভাবিক কিছু না৷

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তানজিম চৌধুরী। ধীরেসুস্থে সিমরানকে সামলে নিয়ে বললেন,

‘ দেখি মাথা তুলো। আমার কথা শোনো মন দিয়ে। এতক্ষণ আমি শুনেছি, এখন তুমি শোনো। শোনার পর যত পারো কাঁদো। এই আজকেই শেষ। এরপর তোমার জন্য আমার বাড়ি কান্না হারাম। ‘

মাথা তুলল সিমরান। ভয় হচ্ছে ভীষণ। এখন পর্যন্ত আন্টির রিয়াকশন পায়নি কোনো। তাই এবার নিজেকে তৈরি করল কঠোর প্রতিক্রিয়া সহ্য করার জন্য। কিন্তু তানজিম চৌধুরী যা বললেন তা শুনে গায়ে কাঁ টা দিয়ে ওঠল তার।

‘ সৌধর জন্য অনেক আগে থেকেই তোমাকে পছন্দ আমার। আমরা যেদিন থেকে সৌধর জন্য পাত্রী খুঁজছি। সৌধর বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করছি। সেদিন তোমার কথাই আগে মাথায় এসেছে। তোমার আংকেলকেও জানিয়েছিলাম বিষয়টা। তোমার আংকেল তোমার বাবা,মাকে প্রস্তাব দিয়েছিল। তোমার বাবা রাজিও ছিলেন কিন্তু বাঁধা এলো তোমার মায়ের থেকে। সে শঙ্কিত তোমার ভবিষ্যত নিয়ে। আসলে সে তার জায়গায় সঠিক। আজ যদি তার জায়গায় আমি আর তোমার জায়গায় স্মৃতি থাকত আমিও বাঁধা দিতাম। ‘

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটুক্ষণ থামল। এরপর আবার বলতে শুরু করল,

‘ তার রাজি না হওয়াতেই আমরা অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করি৷ কিন্তু ঐ যে নিয়তির লেখা বলেও কিছু থাকে তাই তো যোগ্য পাত্রী খুঁজে পাইনি। আজ তুমি যা বললা এটা যদি আগে জানতাম অন্য কোথাও মন দেওয়ার কথা ভাবতাম না। যেখানে তুমি সৌধকে ভালোবাসো সেখানে আর অন্য কোথাও মন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস চৌধুরী বাড়ির ছোটো পুত্রবধূ তুমি ছাড়া কেউ হবে না৷ কারো সাহস নেই এ বাড়ির ছোটো ছেলের বউ হবার। কারণ কেউ তোমার মতো করে সৌধকে ভালোবাসতে পারবে না। সবটা জেনে-বুঝে কেউ এমন কঠিন আবদার করতেও পারবে না৷ এই ক্ষমতা, এই সাহস এক সিমরান খন্দকারেরই আছে। ‘

‘ আমি নিজেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি আন্টি কিন্তু পারিনি৷ অনেক বুঝিয়েছি মনকে, সৌধ ভাই আমাকে ভালোবাসে না। তবু মানাতে পারিনি। বুকটা হুহু করে আমার। মন বুঝ দেয় একদিন বাসবে। কোনোকিছুর বিনিময়ে আমি আমার প্রথম প্রেমকে হারাতে চাই না। আমি সেদিন ওই এক মুহুর্তের জন্যই সৌধ ভাইকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলাম। নিধি আপুর কাছে কারণ সৌধ ভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে। এরপর আর কারো কাছে কোনোকিছুর বিনিময়ে ত্যাগ স্বীকার করতে পারব না। ট্রাস্ট মি আন্টি, সৌধ ভাইকে ছাড়া অন্য কারো প্রতি আমার রুচি আসে না। তুমি প্লিজ ক্ষমা করো আমাকে। আমি জানি তুমি সৌধ ভাইয়ের মা। তোমাকে এভাবে বলা নির্লজ্জতা হচ্ছে। কিন্তু কী করব বলো? ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে নিঃশেষ হওয়ার চেয়ে নির্লজ্জ হওয়া ঢেড় ভালো। ‘

তানজিম চৌধুরীর চিত্ত বিগলিত হলো। হাসল কিঞ্চিৎ। আদর পেল খুব। মেয়েটা জেদি, একরোখা ছাপিয়ে ভীষণ মিষ্টি আর প্রচণ্ড সৎ। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করল ওর সাহসীকতা। ক’টা মেয়ে পারে এভাবে ছেলের মা’কে এসে বলতে, ‘ তোমার ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসি আন্টি? ‘ সৌধর মতো শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষের জীবনে এমন সাহসী নারীই তো প্রয়োজন। যে মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে ভীরু হয় না, কুণ্ঠা বোধ করে না। সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তানজিম। দৃঢ় গলায় বললেন,

‘ আমি আজই তোমার আংকেলের সাথে কথা বলব। তার মত নিয়ে কথা বলব সৌধর সঙ্গে। কিন্তু মা তোমার মা আর ভাইকে নিয়েই চিন্তা। ‘

‘ আম্মু, ভাইয়াকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার আন্টি। ‘

তীব্র আত্মবিশ্বাসী স্বর শুনে হাসলেন তানজিম। সে জানেন উদয়িনী সহজে মানবে না। না মানলেও এখন আর কিছু করার নেই৷ যেখানে সিমরান রাজি, তারা রাজি। সেখানে বিয়েতে বড়ো কোনো বাঁধা নেই বললেই চলে। একটুখানি চিন্তিত হলেন অবশ্য ছেলেকে নিয়ে। পরোক্ষণেই মাতৃহৃদয় বলল, তার ছেলেটা অমানুষ বা অজ্ঞ নয়। ক্ষণিকের যন্ত্রণা তাকে হয়তো ছন্দহীন করে তুলেছে। এটাকে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া থেকে আটকাতে সিমরানকে প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। মেয়েটাকে সে নিজ হাতে গড়ে তুলবে। একদম সৌধর জন্য যোগ্য নারী হিসেবে তৈরি করবে। যাকে দেখে একদিন সৌধ স্বীকার করতে বাধ্য হবে নিধি নয় সিমরানই তার যোগ্য নারী৷ যোগ্য ভালোবাসার মানুষ।
“প্রথমা হয় যদি ভুল দোষ কি দ্বিতীয়ায়?
প্রথমায় ভুল ফুল হয়ে ফুটুক দ্বিতীয়ায়। যে’জন যায় তার বিরহে মন না মরুক। যে’জন আসে তার প্রণয়ে মন ভরুক। দ্বিতীয়বারো প্রেম হয়, পরিপূর্ণতা পায় ভালোবাসা। শর্ত কেবল একটাই, মানুষটা সঠিক হতে হবে। ”
.
.
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৩|
সেদিন কথোপকথন শেষ করে গভীর ভাবনায় পড়ে তানজিম চৌধুরী। এরপর বেশ তাড়াহুড়ো করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সিমরানকে৷ কারণ সে সময় সৌধ, সুহাস ছাড়াও ওদের আরো বন্ধু, বান্ধবী বাড়িতে উপস্থিত ছিল। সিমরান চলে যায়। কেউই টের পায় না, জানতে পারে না সেদিন সিমরানের চৌধুরী বাড়িতে আসার খবর৷ এরপর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন তানজিম চৌধুরী। স্বামীর অনুমতি নিয়েই দু’দিন পর ডেকে পাঠান ছেলে সৌধ আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুহাসকে। তারা দু’জন প্রস্তুত ছিল। সুহাসের পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, সৌধর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন আন্টি। সুহাস খুশিই হলো। দু’দিন আগেই তারা বন্ধুরা মিলে নিধিকে দেখতে গিয়েছিল। প্রাচী বুঝিয়েছে মেয়েটাকে। সারাজীবন বাস্তবতা আঁকড়ে ধরা মেয়েটা জীবনের এমন পর্যায়ে এসে আবেগে যেন গা না ভাসায়৷ হুশিয়ারি দিয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়েছে একটুখানি মিথ্যার আশ্রয়৷ সৌধ এনগেজড। খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে করবে সৌধ চৌধুরী। সৌধকে নিয়ে বলা এহেন কথা বিশ্বাস করতে পারেনি নিধি৷ তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা টের পায় কিছু একটা গড়বড় আছে। সে যে টের পেয়েছে সেটি বুঝতে দেয় না কাউকেই৷ বন্ধুরা তার সঙ্গে দেখা করে, স্বান্তনা দিয়ে, জ্ঞান মূলক বাণী আওড়ে ফিরে আসে। সেও ফিরে যায় স্বামী অর্পণের সঙ্গে তার বাসায়। নিধিকে বলা সেই মিথ্যাকে সত্যি প্রমাণ করতে বন্ধুরা উদগ্রীব। তীব্র অনীহা সৌধর। সুহাস যতটা উৎসাহিত হয়ে তানজিম আন্টির সঙ্গে দেখা করতে এলো। সৌধ মায়ের কাছে এলো ততটাই নিরুৎসাহিত ভাবে।
.
.
অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বস্ত কথাগুলো শুনে দু’টো মস্তিষ্কে যেন বিস্ফোরণ ঘটল! সৌধ, সুহাস হতভম্ব মুখে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল কয়েক পল। এরপর বিমূঢ় মুখে তাকাল তানজিম চৌধুরীর পানে। এই মানুষটা কখনো নড়বড়ে কথা শোনা পছন্দ করেন না৷ সেখানে নিজে নড়বড়ে কথা বলা তো অসম্ভব। সম্পূর্ণভাবে সঠিক তথ্য বিহীন আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া মানুষ নন মা। জানে সৌধ৷ মনে প্রাণে বিশ্বাসও করে। কিন্তু আজকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু বিশ্বাস নয় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্টবোধ করছে। সিমরান! সিমরান তাকে ভালোবাসে? সেই ক্লাস নাইন থেকে ভালোবাসে সিমরান তাকে? অথচ সে টের পেল না আশ্চর্য! নাকি ওভাবে কখনো খেয়াল করেনি বলেই বুঝতে পারেনি। এসব কথা, প্রশ্নের মাঝেই আচমকা মনে পড়ল সেদিন সিমরানের বলা সেই কথাটি। সে যখন বলল, গোপন প্রেমিক আছে কিনা। সিমরান তখন সত্যি, মিথ্যার প্রশ্ন তুলল৷ তখন সে বলেছিল,

‘ আমি মিথ্যা সহ্য করতে পারি না। ‘

আর সিমরান উত্তর দিয়েছিল,

‘ তুমি সত্যিটাও সহ্য করতে পারবে না৷’

তবে কি সত্যি এটাই ছিল!

সৌধর মতো একই অবস্থা সুহাসেরও হলো। কিন্তু পরোক্ষণেই মাথায় আসল সেদিন সিমরানের দেয়া প্রতিক্রিয়াটি৷ শুধু সেদিন নয় গত কয়েকমাস ধরে সিমরানের সমস্ত আচরণ এক এক করে স্মরণ হতেই কেঁপে ওঠল অকস্মাৎ। থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল সৌধর পানে। সৌধ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

‘ আই কান্ট বিলিভ দিস। ‘

সুহাসেরও বিস্মিত স্বর,

‘ মি ঠু। ‘

ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে তানজিম চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জানালেন পূর্বে করা তাদের পরিকল্পনার কথাটিও। এক পৃথিবীতে একই সঙ্গে এতবার বজ্রপাত হয়েছে কি কখনো? যতবার সৌধ আর সুহাসের মাথায় হলো? আর নিতে পারল না সুহাস। অতিআদুরে বোন তার। যাকে কোনোদিন একটা ধমক পর্যন্ত ঠিকভাবে দিতে পারেনি। তার উদ্দেশ্য এবার কড়া শাসনের সুর আওড়াল। সৌধ কেমন মানুষ খুব ভালো করেই জানে সে। বন্ধু সম্পর্কে ধারণাও কম নেই তার। তাই তাকে স্বান্তনার স্বরে বলল,

‘ আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব আর সিমরানকে কড়া শাসন করব৷ এখন বুঝতে পারছি ওর কতটা শাসনের অভাব। কতবড়ো ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। আজ সপাটে কয়েকটা থা প্পড় মেরে বুঝিয়ে দিব। ‘

ক্রোধে জর্জরিত সুহাস। বিচলিত সৌধ। সে জানে রাগের বশে সুহাস এভাবে বললেও এতখানি করতে পারবে না। কিন্তু সেই জানার বাইরে গিয়ে যদি ঝোঁকের বশে করে ফেলে মারাত্মক বিপদ ঘটে যাবে৷ সিমরানকে তো কম দিন দেখছে না। সেই ছোট্ট সময় থেকে চেনে মেয়েটাকে। তাই সাবধানি বাক্য ছুঁড়ল,

‘ সুহাস মাথা ঠান্ডা কর। যা বলেছিস বলেছিস এসব করতে যাস না। বিপদ ঘটবে। ‘

বন্ধুকে কথাটা বলেই শান্ত মুখে শীতল দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। তানজিম চৌধুরী অত্যন্ত গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন। সুহাসকে দেখছেন জহরি চোখে। সৌধ তার দিকে তাকিয়েছে টের পেতেই দৃঢ় কণ্ঠে সুহাসকে প্রশ্ন করল,

‘ সুহাস, তোমার কি আমার ছেলে সৌধকে অযোগ্য মনে হয়? ‘

চমকে তাকাল সুহাস। বিব্রত কণ্ঠে বলল,

‘ এ কী বলছ আন্টি! সৌধ আমার কতটা ঘনিষ্ঠ, বন্ধু কম ভাই বেশি। অযোগ্য কেন মনে হবে? ‘

‘ তাহলে সিনু মাকে কেন শাসন করবে? কেন তার গায়ে হাত তুলবে? তার দোষটা কোথায়? ‘

দৃঢ় কাঁধ দু’টো নুইয়ে পড়ল সুহাসের। হতাশ কণ্ঠে বলল,

‘ জেনে বুঝে বোন আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইছে আন্টি। ভাই হয়ে আমি আটকাব না? ‘

চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল তানজিম চৌধুরীর। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,

‘ আমার ছেলে আর এই পরিবার দু’টোই তোমার কাছে আগুন? ‘

আকস্মিক জিভ কামড়াল সুহাস। বলল,

‘ না, না এই পরিবার না। কিন্তু সৌধকে আমি যতটা চিনি ততটা এই পরিবারের কেউ চেনে না। আমার বোন সম্পর্কেও তো জানি আমি। বোন আমার উপর থেকে যেমনি দেখো ভেতরে ভেতরে খুব নরম, ঠান্ডা পানি একদম। সেখানে সৌধ! রাগ করো না আন্টি। সৌধ সত্যি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। ও নিধি ছাড়া আর কোনো মেয়ের জন্য মোমের চেয়েও নরম, বরফের চেয়েও ঠান্ডা হতে পারবে না। আমি সৌধকে খুব কাছ থেকে জানি৷ এমন জানা তোমরা কেউ জানো না। সিনু অবুঝ। বিশ্বাস করো, ও খুব অবুঝ আর আবেগি মেয়ে। ভালোবাসার কাঙাল। খুব বোকাও। নয়তো চোখের সামনে এতসব দেখে ও কেন তোমার কাছে আসবে। এভাবে আবদার করবে? আমার মনে হয় একা একা থাকতে থাকতে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ‘

সুহাসের কথা শুনে হাসল তানজিম চৌধুরী। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ শুধু সিনু নয় তার ভাইটাও খুব বোকা আর ভীতু। ‘

‘ হ্যাঁ আমি ভীতু আন্টি। আমার বোন অসুখী যেন না হয় সেই ভয়ে থাকি আমি। সারাজীবন দু ভাই বোন ভালোবাসার কাঙাল হয়ে বড়ো হলাম। বাবা, মায়ের দূরত্ব, বিবাদ দেখলাম। সেই একই অবস্থা বোনের জীবনে হোক চাই না। ‘

থামল সুহাস। শ্বাস নিল বড়ো বড়ো করে। তানজিম চৌধুরী একটু ভাবুক হলেন। তাকালেন সৌধর দিকে। সৌধ নিশ্চুপ। যেন ভাবছে গভীর কোনো ভাবনা। সে বললেন,

‘ সৌধ, সুহাসের বক্তব্য শুনলাম। আমার আর তোমার বাবার ইচ্ছে, আদেশ যাই বলো আমরা সিনুকে তোমার বউ করে আনতে চাই। সোহান ভাইয়েরও মত আছে। তোমার মত জানতে চাই। ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল সৌধ। সে চিন্তিত সিমরানকে নিয়ে। কিন্তু সিদ্ধান্ত সেটা আবার কী? নতুন করে কী সিদ্ধান্ত দেবে সে। যা দেয়ার তা তো আগেই দিয়েছে।

‘ আমার সিদ্ধান্ত পূর্বে যা ছিল এখনো তাই আছে আম্মা। ‘

সহসা রেগে গেলেন তানজিম। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বললেন,

‘ তুমি সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে? ‘

চোখ তুলে তাকাল সৌধ বিনয়ের সঙ্গে হাসল মৃদু। বলল,

‘ ইয়েস। এভাবেই কাটিয়ে দেব। ‘

‘ বিয়ে তোমাকে করতে হবে সৌধ। ‘

তীব্র জেদি কণ্ঠ তানজিম চৌধুরীর। মায়ের এমন জেদি রূপ এই প্রথম দেখল সৌধ। কড়া দৃষ্টি বরাবর নিজের দৃষ্টি রাখতে পারল না আর। মস্তক নত করল৷ ফেলল গভীর এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস। পাশ থেকে সুহাস বলল,

‘ এভাবে জীবন কাটানো যায় না সৌধ। সব সময় তো তুই নীতি বাক্য বলিস। আমাদের ভালো, মন্দ পরামর্শ দিস। আজ আমি দিচ্ছি, শোন উপরে একজন আছেন। যার নিয়মেই পৃথিবী চলে, মানুষ চলে। একটি গাছের একটি পাতাও তার আদেশ ছাড়া নড়ে না। সেখানে তুই আমি কিন্তু তুচ্ছ। বিয়ে কিন্তু আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় একটি অধ্যায়। আমি চাই নিজের জন্য যোগ্য পাত্রী নির্বাচন করে বিয়ে কর তুই। ‘

‘ জ্ঞান দিস না এসব তোর থেকে ভালো আমি জানি আমি বুঝি। আম্মা সামনে না থাকলে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতাম আরো। ‘

মৃদু ধমকে কথাগুলো বলল সৌধ। তানজিম চৌধুরী ছেলের আচরণ দেখে স্তব্ধ হয়ে রইলেন৷ বিমূঢ় স্বরে বললেন,

‘ বিয়ে তোমাকে করতেই হবে সৌধ৷ এরজন্য যদি আমার প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় দিব। ‘

সহসা হুমকিতে বুক কেঁপে ওঠল সৌধর। বিস্মিত গলায় বলল,

‘ আম্মা! ‘

সুহাসও ভয় পেয়ে গেল। তীব্র দুঃশ্চিতায় শরীর দুর্বল অনুভূত হলো তার। এমন সময় চোখ, মুখ শক্ত করে হঠাৎ সৌধ বলল,

‘ ওকে ফাইন, বিয়ে করা যদি তোমরা বাধ্যতামূলকই করো করব। কিন্তু সিনুকে না আম্মা। ও আমাদের সবার খুব স্নেহের, আদরের। জেনে-বুঝে ওর জীবন আমি নষ্ট করতে পারব না। আমি চাই না ও অসুখী হোক। স্বামীর ভালোবাসার অভাব নিয়ে জীবন কাটাক৷ ‘

একই চাওয়া সুহাসেরও। একই মতও সুহাসের। তানজিম চৌধুরী কড়া গলায় বললেন,

‘ তুমি চাও না সিনু অসুখী হোক। আর আমরা কেউ চাই না পরের বাড়ির পরের মেয়ে অসুখী হোক। নারী হয়ে আমি আরেক নারীর চরম সর্বনাশ করতে পারব না সৌধ। তাই তোমার জন্য সিনু ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আনাও সম্ভব না। ‘

রাগান্বিত হলো সৌধ। সিমরান যদি তার প্রতি দুর্বল হয়েও পড়ে তার মা কেন দুর্বল হচ্ছে সিমরানের প্রতি? সে কি বুঝতে পারছে না এই দুর্বলতা সিমরানের জন্য ক্ষতিকারক! আর এক মুহুর্ত মায়ের সামনে বসে থাকার ধৈর্য্য হলো না সৌধর। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে প্রস্থান করল। এটুকু না করলে শ্রদ্ধেয় আম্মার সঙ্গে চরম বেয়াদবি করে ফেলত! বিয়ে করতে সম্মত হয়েছে শুধু মায়ের হুমকি শুনে নয় ওদিকে তার বন্ধুরা নিধিকে বলে এসেছে তার বিয়ে ঠিক। বন্ধুদেরকে মিথ্যাবাদি প্রমাণ করতে চায় না সে। আর না চায় ওই বেইমানটার সংসার ভাঙুক। প্রতারকটা দুশ্চরিত্রা রূপে সর্বমহলে পরিচিতি পাক। সবশেষে সে নিজেও সহ্য করতে পারবে না নিধির ওই ঘৃণিত চেহেরা। যে গুণে মানুষটাকে ভালোবেসে এত এত বিরহ বুকে পুষল সেই গুণ গুলোর সবটুকু এভাবে মিথ্যা, ধোঁয়াশায় পরিণত হতে পারে না৷ একদমই না।

সৌধর মায়ের কথায় তীব্র অসন্তুষ্ট সুহাসও। তাই বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না আর৷ কিন্তু তানজিম বললেন,

‘ সুহাস তুমি নিজেও কিন্তু প্রথমে নামীকে মেনে নিতে পারোনি। নামী তোমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একটা মেয়ে ছিল। এরপরও সৃষ্টিকর্তার রহমতে পবিত্র সম্পর্কের জোরে তোমাদের মধ্যে অপরিমেয় ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। যেখানে তোমাদের অসম্ভব সম্পর্ক সম্ভবে পরিণত হয়েছে। সেখানে সিনু আর সৌধর সম্পর্ক কিন্তু সম্ভব। সিনু সৌধকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর সৌধ সিনুর প্রতি সংবেদনশীল। প্রচণ্ড স্নেহ করে সিনুকে। সবচেয়ে বড়ো কথা অন্য একটা মেয়েকে সৌধর বউ করে আনলে তার প্রতি সৌধ অবিচার করতে দুবার ভাববে না৷ কিন্তু সিনুর প্রতি অবিচার করার আগে ওর বিবেক নড়ে ওঠবে। ‘

‘ ভুল বললে আন্টি। সৌধ কিন্তু সুহাস নয়। প্রথম দিকে নামীর প্রতি যে অন্যায়টা আমি করেছি সেটা সৌধ করবে না। তোমার ছেলেকে তুমিই চিনতে পারোনি আন্টি! ‘

থেমে গেল তানজিম। সত্যিই তো। তার সৌধ কক্ষণো কারো প্রতি অবিচার করতে পারবে না। সেভাবে ছেলেকে গড়েই তুলেনি সে৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এই অস্ত্রটিই তো কাজে লাগবে তার। সবাইকে এটাই বোঝাতে হবে। তবেই না সবাই রাজি হবে সিনু আর সৌধর শুভ বিবাহের জন্য। তাই পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল,

‘ সুহাস তোমার কথা হয়তো ঠিক৷ কিন্তু বাবা যাকে বিয়ে করবে তার প্রতি বিবেকবান হয়ে লাভ কি যদি মন থেকে ভালোবাসতেই না পারে? ‘

‘ তুমি কী বলতে চাচ্ছ সৌধ সিনুকে ভালোবাসতে পারবে? ‘

‘ পারবে? ‘

‘ কীভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছ আন্টি? ‘

‘ আমি তো মা সুহাস। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি একজন নারী। নারী ভালোবেসে সব জয় করতে পারে। সিনু যদি সৌধকে এতটা ভালো না বাসত তাহলে এতখানি জোর করতাম না বাবা। যে ভালোবাসা আমি দেখেছি যে হৃদয় নাড়ানো কথা শুনেছি এরপর সিনুকে কষ্ট দেয়া সম্ভব না৷ এই মুহুর্তে সৌধ সিনুর ভালো ছাড়া আমি আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। ‘

এত বুঝিয়েও লাভ কিছু হলো না। সুহাস একদম নিরুত্তর হয়ে ওঠে পড়ল৷ বিদায় নিল একরাশ হতাশা ভরে। এরপর বাড়ি গিয়ে সর্ব প্রথম বোঝাপড়া করল সিমরানের সাথে। দু ভাই বোনের প্রথমে তর্ক, বিতর্ক হলো। এক পর্যায়ে তীব্র ক্রোধে আচমকা সুহাস থা প্পড় মেরে বসল সিমরানের গালে। সহ্য করতে না পেরে চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে নিজের ঘরে দৌড়ে চলে গেল সিমরান। দরজা আঁটকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা। নিচ থেকে বোনের এমন করুণ দশা দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারল না সুহাস৷ ত্বরিত টেলিফোনের কাছে গিয়ে কল করল মা, বাবাকে৷ জানালো কী কঠিন পরিস্থিতিতে আছে তারা ভাইবোন। বাবা জানালো সে এক্ষুনি আসছে। মা আগামীকাল আসবে। এরপর সুহাস অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবল কী করা যায়। সিমরানকে কীভাবে বোঝানো যায়। কিন্তু কোনো সুরাহা মিলল না। নিজের এই কঠিন পরিস্থিতিতে নামীর সঙ্গে হওয়া সব রাগ, অভিমান ভুলে গিয়ে ছুটে গেল নামীর ফ্লাটে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কাক ভেজা হয়ে হঠাৎ সুহাসের আগমন। চোখ দু’টো রক্তিম, মুখ ভাড়। ভয় জেঁকে ধরল নামীকে। কী হয়েছে সুহাসের? এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন? ফারাহ আজকের জন্য পাশের রুমে চলে গেল। তারা দু’জন এখন বিরাট একটি ফ্লাট ভাড়া করে থাকে। আগে সুহাস আসত৷ রাগারাগি হওয়ার পর আসে না আর৷ আইয়াজ আসে মাঝে মাঝেই৷ এছাড়া পুরো ফ্লাটে তারা দুই বান্ধবীই রাজত্ব করে বেড়ায়। মাঝেসাঝে সিমরান এসেও থাকে অবশ্য। আজ হঠাৎ সুহাস আসাতে ফারাহ চলে গেল অন্য রুমে। বদ্ধ ঘরে সুহাস হাত, পা ছেড়ে ফ্লোরে ভেজা কাপড়ে বসে রইল। নামী ঠান্ডা গলায় বেশকিছু ক্ষণ সময় বলল,

‘ সুহাস কাপড় বদলে আসো ঘর ভিজে যাচ্ছে। ‘

সে কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না ছেলেটা। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু। প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল নামী৷ কাল পরীক্ষা আজ হঠাৎ সুহাস এলো। তাও এই বিধ্বস্ত অবস্থায়। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে এলো। মোবাইল নিয়ে দ্রুত চলে গেল বেলকনিতে। ফোন করল সিমরানকে। চারবার রিং হলো অথচ ফোন রিসিভ হলো না। টেনশনের মাত্রা দ্বিগুণ হলো এবার৷ কাকে ফোন করা যায় ভাবতে ভাবতে ফোন করল সেলিনা আপাকে। সুহাসদের বাসার কাজের মহিলা। সেলিনা আপা ফোন রিসিভ করেই ভয় জড়ানো কণ্ঠে এক এক করে সবটা খুলে বলল নামীকে। সব শুনে শিউরে ওঠল নামী। বুকে সৃষ্টি হলো কম্পন। তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিল সে। রাখার আগে সাবধান করে বলল,
‘ সিনুর খেয়াল রেখো। দরজা বন্ধ তাতে কী? জানালা তো খোলা, সব সময় খেয়াল রাখবে। কোনো বিপদ ঘটতে নিলেই ফোন করবে বাবা, মাকে। ‘

সেলিনা আপার সাথে কথা শেষ করেই সোহান খন্দকারকে কল করল। জানতে পারল সে বাসার পথে। এবার কিছুটা নিশ্চন্ত হয়ে ফোন কেটে দিল। রুমে গিয়ে ফোন রেখে নিজের ছোট্ট কাভার্ড থেকে ভাঁজ করে রাখা সুহাসের গরম কাপড় বের করল।
চটজলদি তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে এলো সুহাসের কাছে। যত্ন নিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে বলল,

‘ ঠান্ডা লেগে যাবে সুহাস৷ কাপড় চেঞ্জ করো। ‘

যেন কিছুই শুনেনি এমন একটা ভাব। আগের চেয়েও দ্বিগুণ জেদ ধরে, শরীরটা দৃঢ় করে বসে রইল। নামী ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখটায় তাকাল একবার। মাথা মুছা শেষ। তাই বিছানার এক পাশে তোয়ালে রেখে। কাছাকাছি সম্মুখীন হয়ে বসে সুহাসের শার্টের বোতাম খুলতে লাগল এক এক করে। মনে মনে ভেঙচি দিয়ে বলল,

‘ যত তেজ আমার কাছেই। ‘

মুখে বলল,

‘ আরে বাবা শরীর শক্ত করে রাখলে শার্টটা খুলব কী করে? ‘

পরোক্ষণেই মনে মনে গজগজ করতে করতে বলল,

‘ এতদিন মুখে কথার খই ফুটিয়ে জ্বালিয়েছে। এখন এসেছে গম্ভীর, বোবা বনে গিয়ে জ্বালাতে। ‘

বেশ বেগ পেতে হলো শার্টটা খুলতে। ভেজা শার্ট ফ্লোরের একপাশে রেখে শরীর মুছে দিল। সুহাসের কোনো ভাবান্তর নেই৷ প্যান্টটাও ভেজা। বড্ড মুসিবতে পড়ল নামী। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

‘ প্যান্টটাও কি আমাকে খুলতে হবে? ‘

এ পর্যায়ে নড়চড় করল সুহাস। অন্য সময় হলে কতশত অসভ্য কথা বলে ফেলত এ মুহুর্তে। লজ্জা দিত সভ্য বউটাকে। কিন্তু আজ কিছুই বলল না। চুপচাপ ওঠে বের করে আনা পোশাক গুলো নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। এতেই বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠল নামীর। ভীষণ মায়াও হলো। ভালোবাসার মানুষটির একটুখানি কষ্টও যে সহ্য হয় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মনস্থির করল, আজ আর সিনু, সৌধ ভাই নিয়ে কোনো প্রকার কথা বলবে না। প্রশ্ন করবে না। কিছু বোঝাবেও না। রাগ অভিমান চলছে তাদের। কত্তদিন পর এলো মানুষটা। আজ একসঙ্গে সময় কাটাবে। মন ভালো করার চেষ্টা করবে। সুহাস যদি কিছু বলতেও চায় সে শুনবে না। বলবে,
‘ সব কথা আগামীকাল শুনব৷ আজ শুধু তোমার, আমার কথা চলবে। আজকের এই বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যা, দীর্ঘ রাতটা শুধু তোমার আর আমার জন্য। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪৪|
গভীর রাত। ধরণিতল বৃষ্টিতে ভিজে চুপ চুপ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সুহাস ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। তার এক হাত নামীর কাঁধ আঁকড়ে, এক পা কোমরে তোলা। বউকে ঠিক কোলবালিশের ন্যায় আঁকড়ে ঘুমোচ্ছে সে৷ ক্ষণে ক্ষণে মুখের ভারিক্কি, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নামীর ঘাড়ে এবং কানে। সুহাস গভীর ঘুমে থাকলেও নামীর ঘুম গভীরতায় পৌঁছায়নি। তাই তো রাত বাড়ার সাথে সাথে সুহাসের দেহের প্রগাঢ় উষ্ণতা অনুভব করতে পারল সে৷ এক পর্যায়ে শঙ্কিত চিত্তে দৃষ্টি মেলে তাকাল। বলিষ্ঠ দেহে জড়ানো তার দেহখানি রয়েসয়ে সরিয়ে ওঠে বসল। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের কপাল। নিমেষে চোখ দু’টি বড়ো বড়ো হয়ে গেল৷ ভীত স্বরে বলল,

‘ হায় আল্লাহ, এত্ত জ্বর! ‘

বারকয়েক ঢোক গিলল সে। ত্বরিত সুহাসের ডান গালে হাত রেখে ডাকল,

‘ এই সুহাস, তোমার তো খুব জ্বর। এই সুহাস শুনছ?’

কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিল নামী। দু’টো বেজে একান্ন মিনিট৷ বুক ধুকপুক করে ওঠল৷ এগারোটায় পরীক্ষা৷ এদিকে সুহাসের ভয়াবহ জ্বর। আর বসে থাকতে পারল না৷ ছুটে গিয়ে মেডিসিন বক্স আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। সুহাসের ঘুম ছুটোতে পরিশ্রম হলো খুব। জ্বরে কাতর সুহাস বেঘোরেই মেজাজ দেখাল কিঞ্চিৎ। কত্ত বড়ো সাহস নামীদামির। তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়! মেজাজ টুকুতে
রাগ করল না নামী। সব সময় স্বামীর মেজাজকে তোয়াক্কা করতে নেই। মন খারাপ হতে নেই। কিছু পুরুষ মানুষ থাকেই আজন্মের বেআক্কল। এরা নিজের ভালো বুঝে না। বউ ভালো করতে এলেও দেমাক দেখায়। আবার ভালো করতে না এলে তকমা দিয়ে দেয় অযত্নশীল বউ। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা নেই ইত্যাদি, টিত্যাদি। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল নামী৷ বুঝিয়ে, অনুরোধ করে জোর পূর্বক জ্বর সেরে ওঠার প্রাথমিক ট্যাবলেট গুলো খাইয়ে দিল। এরপর নরম কাপড় ভিজিয়ে জলপট্টি দিল তিনটা পর্যন্ত। সুহাস ঘুমে কাঁদা। বেচারির আর ঘুম হবে না। তাই ওঠে গিয়ে টেবিল থেকে বই নিয়ে এলো৷ জলপট্টি দেয়ার পাশাপাশি পড়ে নিলো কিছু ইম্পর্ট্যান্ট টপিক।

সুহাসের জ্বর কমল চারটার দিক। এতক্ষণ পাঁচ মিনিট পর পরই কপালে, গলায় হাত দিয়ে অপেক্ষা করছিল কখন জ্বর কমবে? যদি না কমে আজকের পরীক্ষাটা তার মাটি। যতই হোক মানুষটাকে তো ভালোবাসে। এভাবে জ্বরে রেখে পরীক্ষার হলে মন টিকবে? একটুও টিকবে না৷ তাই জ্বর কমাতে খুশি হলো। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ফারাহকে টেক্সট করল একটি,

‘ সুহাসের খুব জ্বর ওঠেছিল। ঘুমাতে পারিনি ঠিকভাবে৷ এখন ঘুমাব। ন’টার আগে ওঠা সম্ভব না।
আমাদের রান্না তরকারিতে ঝাল বেশি৷ সুহাস ঝাল খেতে পারে না একদম। ওর জন্য ঝাল কম দিয়ে মাছ ভাজা করিস শুধু, এতেই হবে৷ পরীক্ষা আমাদের বুঝবে ও। তুই আবার টেনশন করিস না৷ ইলিশ মাছ প্রিয় ওর ভাজি খেতে পছন্দ করে, ক’টা পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে দিস। ‘

পরীক্ষা বলে নিজেদের রান্না করে রেখেছিল ওরা। সকালে শুধু গরম গরম ভাত করতে হতো। সুহাস আসাতে অল্প কাজ বাড়ল। যা ফারাহকে করতে বলে সুহাসের পাশে শুয়ে পড়ল নামী। চেষ্টা করল ঘুমুতে। আশ্চর্য! ঘুম এলো না৷ এপাশ-ওপাশ করতে করতে ওঠে বসল। হাত বাড়িয়ে সুহাসের গা স্পর্শ করে আবার দেখল জ্বর আছে কিনা। অনুভব করল জ্বর ছেড়ে ঘাম বেরুচ্ছে শরীর থেকে৷ তাই ত্বরিত টি-শার্ট খুলতে চেষ্টা করল। এতেই ঘুম ছেড়ে গেল সুহাসের। বৈদ্যুতিক তীক্ষ্ণ আলোয় নামীর শ্যামলাটে স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে থমকালো একটু৷ কয়েক পল নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে আচমকা দুষ্টু হাসি ফুটে ওঠল ঠোঁটে। নামী ওর টি-শার্ট উঁচিয়ে ধরেছিল মাত্র। সেই ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরে হেঁচকা টান মারল। সহসা মুখ থুবড়ে পড়ল বুকে। সুহাস সাপের মতো প্যাঁচিয়ে ধরল বুকের মাঝে। ভীষণ গভীর করে। এরপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ আমাকে অচেতনে পেয়ে এতবেশি ডেস্পারেট হয়ে গেলে? সচেতনে কেন হও না ডার্লিং? পারবে না বলে? ‘

নিমেষে মুখ হা হয়ে গেল নামীর। রেগেমেগে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

‘ এইতো গর্তের ইদুর গর্ত থেকে মাথা তুলেছে। সারারাত যে জ্বরে কাতরাচ্ছিলে সেই খেয়াল আছে? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে যে সেবা করলাম জানো? জ্বর ছেড়ে ঘেমে একাকার দেখে জাস্ট টি-শার্ট খুলার ট্রাই করছিলাম। অমনি শুরু হয়ে গেল অসভ্যতামি? ‘

কথার বলার ফাঁকে সুহাসের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করল নামী৷ কিন্তু সুহাস তাকে মুক্তি দিল না। তার রাগান্বিত চোখ, মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলল। কতদিন, কতদিন পর এই পাগল আর পাগলামো আক্রমণ করল নামীকে? হিসেব করতেই বুকটা হুহু করে ওঠল। সহসা সেও জড়িয়ে ধরল সুহাসকে। বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল বাচ্চাদের মতো। বলল,

‘ খুব মিস করেছি সুহাস, খুব। ‘

আলতো হেসে মাথায় হাত বুলালো সুহাস। মুখ তুলে কপালে চুমু এঁটে মৃদুস্বরে বলল,

‘ বাতি নিভিয়ে এসো। ‘

গলার স্বরে পরিচিত আহ্বান। নামী লজ্জা পেল। বিস্ময়ে বলল,

‘ না, একদম না। পরীক্ষা আছে আমার, ওঠতে হবে।’

আড়চোখে ঘড়িতে সময় দেখে নিল সুহাস। জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই নামীর কোমরের পাশে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরল। ভারিক্কি, উষ্ণ কণ্ঠে বলল,

‘ ছ’ঘনটা সময়ের মধ্যে বরকে একঘন্টা দিতে পারবে না? কেমন বউ তুমি? ‘

‘ সব সময় বাড়াবাড়ি তাই না? ‘

‘ মেয়েরা তো বাড়াবাড়ি রোমান্স করা ছেলেদেরই পছন্দ করে। ‘

‘ হ্যাঁ সেই। তুমি তো মেয়েদের নিয়ে পিএইচডি করেছ। ‘

‘ মেয়েদের নিয়ে না করলেও নামীদামিকে নিয়ে করেছি৷ একদম আপাদমস্তক। পা থেকে মাথার চুলের প্রতিটি গোড়া পর্যন্ত। প্রুফ চাই? ‘

শেষে প্রশ্নবোধক দু শব্দের বাক্যটি বলেই নামীর দিকে দুর্বোধ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাস। অমনি তার
বুকের বা’পাশে আচমকা কিল বসাল নামী। নিচু গলায় বলল,

‘ অসভ্য, খুব খারাপ তুমি। ‘

সুহাস টোপ করে অসভ্য বলা মুখটায় চুমু খেল। এরপর চট করে ওঠে গিয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে ফিরে এলো৷ নামী ঢোক গিলে ত্বরিত স্বরে বলল,

‘ সারারাত জ্বরে কাতরাচ্ছিলে সুহাস। অসুস্থতা কাটেনি পুরোপুরি। ‘

সুহাস হেঁচকা টানে ফের বুকে জড়াল ওকে। কানের লতিতে আলতো কামড় দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ এইতো এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাব আমি। ‘

‘ সুহাস… ‘

তর্জনী দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে সুহাস বলল,

‘ আদর করার সময় বাঁধা দেওয়ার অভ্যেস ছাড়ো৷ জানোই তো বাঁধা দিলে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠি আমি৷ নাকি ইচ্ছে করেই এমন করো। আমার বেপরোয়া ভালোবাসা পাওয়ার নেশায় পড়েছ নাকি?’

চুপসে গেল নামী। লজ্জায় যাচ্ছেতাই হয়ে গেল যেন।
বুকে ধুকপুক শুরু হলো। সুহাস যেন আজ খুব বেশিই বেপরোয়া। দূরত্বই বুঝি পেছনের কারণ? দেহ শিরশির করল। তিরতির করে কেঁপে ওঠল ঠোঁটদ্বয়৷ সুহাস টের পেল৷ আদুরে স্পর্শে কাছে টেনে নিল গভীরভাবে। লজ্জা ভয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নামী। সুহাস হাসল৷ বেগ পেতে হলো বক্ষঃতলে নামীর দেহশ্রী বিছাতে। ধীরেধীরে একচ্ছত্র ভারিক্কি নিঃশ্বাসে দু’টো শরীর এলোমেলো হয়ে গেল। সময়ের প্রবাহে একজন সুখকর স্পর্শে বুঁদ হলো। আর অপরজন সুখদায়ক অশ্রুতে।
.
.
পরীক্ষা শেষ করে বেরুতেই সুহাসের মুখোমুখি হলো নামী৷ সুহাস তার হাতটা ধরে রিকশা নিল একটা৷ বলল,

‘ চলো। লেকের পাড়ে বসব কিছুক্ষণ। ‘

নামী মৃদু হেসে ওঠে বসল। সে জানে সুহাস এবার সিমরানকে নিয়ে আলোচনা করবে৷ সকালে খেতে বসে কথা তুলেছিল একবার৷ সে বলেছে পরীক্ষা শেষ করে ফ্রি মুডে সব শুনবে। আট মিনিটের পথে সুহাসের ফোন বাজছিল অনবরত। বারবার কেটে দিচ্ছল সুহাস৷ নামী জিজ্ঞেস করল,

‘ কে ফোন করেছে? ‘

‘ সৌধ। ‘

‘ ধরছ না কেন? ‘

‘ ইচ্ছে করছে না তাই। ‘

ক্রোধের সঙ্গে অভিমান স্পষ্ট। এই ক্রোধ, এই অভিমানের পেছনের কারণ খুঁজে পেল না নামী৷ এত ভালো বন্ধু ওরা৷ ওদের বন্ধুত্ব ভাই, ভাই সম্পর্ককেও হার মানায়। তাহলে এই অভিমান, ক্রোধের উপসর্গ কী?
.
পাশাপাশি লেকের ধারে চুপচাপ বসে আছে দু’জন। নামী আশপাশে তাকিয়ে দেখছে একজোড়া কিশোর, কিশোরীকে। তারা একে অপরের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মুচকি হাসল সে। তাকাল সুহাসের পানে৷ সুহাস তার দিকেই স্থির নেত্রে তাকিয়ে। সে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ সিনু সৌধকে ভালোবাসে। ‘

সুহাস অপেক্ষায় ছিল নামীর চোখে বিস্ময় দেখতে। মুখে বিস্ময় ভরা কিছু বুলিও শুনতে চেয়েছিল৷ কিন্তু এমনটা হলো না৷ নামী নির্লিপ্ত স্বরে বলল,

‘ এরজন্য এত রাগ কেন সুহাস? একটা মেয়ে কি একটা ছেলেকে ভালোবাসতে পারে না? ‘

‘ পারে৷ কিন্তু মেয়েটা আমার বোন হলে পারে না। ছেলেটা সৌধ হলে ভালোবাসা অন্যায়। ‘

তাচ্ছিল্য ভরে হাসল নামী। বলল,

‘ ভালোবাসা কখনো অন্যায় হতে পারে না। সিনুর ভালোবাসায় আমি কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। ‘

‘ সবকিছু জেনেও এভাবে বলতে পারছ? ‘

‘ কেন পারব না? ‘

‘ সৌধ নিধিকে ভালোবাসত। নিধির প্রতি ওর অনুভূতির প্রগাঢ়তা তুমি জানতে। ‘

‘ আমি সিনুর ভালোবাসার প্রগাঢ়তাও জানি। ‘

‘ হোয়াট! ‘

বিস্ফোরিত কণ্ঠ সুহাসের। সহসা ওর হাত চেপে ধরল নামী৷ বলল,

‘ ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনো। আমি সবটা আগে থেকেই জানি। বলতে পারিনি কারণ সৌধ ভাই নিধিকে ভালোবাসত। তাছাড়া যখন জানতে পারি তখন তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে দূরত্ব ছিল। আর যখন থেকে সম্পর্ক ভালো হয়েছে। বলতে চেয়েছি ব্যাপারটা, কোনো না কোনোভাবে বাঁধা পেয়েছি। মানসিক দ্বন্দ্বের কবলে পড়েছি৷ তাই বলা হয়নি। ‘

সুহাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল। দৃঢ় স্বরে বলল,

‘ সব জেনেও সিনুকে বাঁধা দাওনি কেন? ‘

‘ তোমার বোন নাবালিকা নয় সুহাস। আর না সে আমার বাধ্যগত। ‘

‘ ও তোমাকে মানে। ‘

‘ এক্ষেত্রে ও কাউকে মানে না। ‘

নিভে গেল সুহাস। কিয়ৎক্ষণ থম মেরে থেকে বলল,

‘ আমার কী করা উচিত? ‘

নামী এবার ওর কাঁধ স্পর্শ করল। বলল,

‘ আমরা সবাই মিলে কি পারি না সৌধ ভাই আর সিনুকে এক করতে? ট্রাস্ট মি, এণ্ড ট্রাস্ট হার। ও খুব ভালোবাসে সৌধ ভাইকে৷ আমি ওর ভালোবাসাকে সম্মান করি৷ খুব কাছ থেকে দেখেছি, অনুভব করেছি সিনুর গভীর ভালোবাসাকে। এতদিন পুরোপুরি সমর্থন করতে পারিনি নিধি আপুর জন্য। কিন্তু নিধি আপু যখন সৌধ ভাইকে ভালোই বাসে না৷ নিজের জীবনে অন্য একজনকে বেছে নিয়েছে তখন সৌধ ভাইয়ের পাশে যোগ্য হিসেবে সিনুকেই পাচ্ছি আমি।’

‘ অসম্ভব। ‘

‘ কেন অসম্ভব সুহাস? সিনুর জন্য কি তুমি এমন একজনকেই চাইতে না? ‘

‘ চাইতাম কিন্তু তার হৃদয়ে সিনুর প্রতি গভীর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে চাইতাম৷ সৌধ দ্বিতীয় কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না নামী। আমি আমার বোনকে খুব ভালোবাসি। আমি ওকে স্বামীর ভালোবাসা বিহীন সংসারী দেখতে চাই না। আমি আমার মাকে যে জায়গায় দেখেছি সে জায়গায় সিনুকে দেখতে চাই না। ‘

‘ দেখবে না। ‘

তীব্র আত্মবিশ্বাসী স্বর নামীর। সুহাস ভ্রু কুঁচকে ফেলল।

‘ তুমি কী করে নিশ্চিত হচ্ছো?’

কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল নামী। মনে মনে ভাবল বলাটা ঠিক হবে না। সুহাসের মা অন্যের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিল বলেই সে সংসার জীবনে সুখী হতে পারেনি। কিন্তু সিমরান তা নয়৷ সে কারো ভালোবাসা কেড়ে নিচ্ছে না। বরং নিজের ভালোবাসাকেই মনে, প্রাণে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটির ভগ্ন হৃদয় নিজের ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করতে চাচ্ছে। উদ্দেশ্য সৎ থাকলে জীবনে সুখী হওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু এসব সুহাসকে বলতে পারল না। মায়ের বিরুদ্ধে সন্তানকে বলে লাভ নেই। বলা উচিতও নয়৷ তাই শুধু বলল,

‘ সিনুর ভালোবাসায় আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে৷ আস্থা আছে সৌধ ভাইয়ের বিচক্ষণতায়ও। তার দ্বারা ভুল একবারি হয়েছে। ভুল মানুষকে বাছাই করে। দ্বিতীয়বার হবে না আশা করি৷ এবার নিজের জীবনে সঠিক মানুষকে চিনে ঠিক বাছাই করে নিবে। ‘

তাচ্ছিল্যতার হাসি হাসল সুহাস। নামীর কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ ও এক কথার মানুষ নামী। ও যখন বলেছে সিনুকে বিয়ে করবে না এর মানে করবেই না। গতকাল আন্টি বুঝিয়েছে। লাভ হয়নি। ‘

নামী সুক্ষ্ম চোখে তাকাল। রয়েসয়ে বলল,

‘ আমি যদি ভুল না করি সুহাস তুমি সৌধ ভাইয়ের ওপর কিছুটা রেগে আছো। সৌধ ভাই তোমার বোনকে রিজেক্ট করেছে এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মনকে বুঝ দিচ্ছ এত বছরের পরিচিত সৌধর অনুভূতি গুলোকে সম্মান করে। শতহোক সিনু তোমার বোন। নিঃসন্দেহে সৌধ ভাই তার উপযুক্ত। এভাবে রিজেক্ট হলে খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু কী জানো সৌধ ভাই এখন যা বলছে, যা করছে এগুলো একটাও সে তার স্বীয় সত্তা থেকে বলছে, করছে না৷ সে এখন একজন ভঙ্গুর মানুষ। নিজের আবেগ, অনুভূতি ভেঙেচুরে নিঃস্ব প্রায়। এমতাবস্থায় তার কোনো কথা বা সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়া অনুচিত। ‘

নামীর বিচক্ষণতা মুগ্ধ হওয়ার মতোই। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়ে রাগান্বিত হলো সুহাস। বলল,

‘ ভুল তুমি। সৌধ নিধিকে ভালোবেসে ছ্যাঁকা খেয়েছে। আমি কোনো ছ্যাঁকা খাওয়া মানুষের কাছে আমার নিষ্পাপ বোনকে দিতে রাজি নই। রাগ আমার সিনুর প্রতি। পৃথিবীতে এত এত ছেলে থাকতে ও কেন সৌধর মতো ব্যাকুবকে বেছে নিল? ‘

মুখে এ কথা বলে মনে মনে ভাবতে লাগল নামীর শেষ কথাগুলো নিয়ে। এদিকে তার কথা শুনে আচমকা হেসে ফেলল নামী৷ সে হাসিতে সুহাসের ক্রোধ গাঢ় হলো। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে ওঠে নামী বলল,

‘ উহুম বোনের প্রতি রাগ না অভিমান তোমার। ইশ বোন তার ভালোবাসার মানুষকে পাবে না৷ আজ বন্ধুকে যে অবস্থায় দেখছ কাল বোনকে সে অবস্থায় দেখার ভয়ে আছো খুব৷ ‘

এটুকু বলেই সুহাসের কাঁধে মাথা রাখল। বলল,

‘ শোনো সুহাস। বউ আমি তোমার। তোমাকে তোমার থেকেও বেশি আমি চিনি, বুঝি। ‘

এক নির্মল ভালো লাগায় সহসা বুক শীতল হয়ে ওঠল সুহাসের। বলল,

‘ সৌধ সিনুকে জীবনসঙ্গী রূপে চায় না নামী। কী করব এখন আমি? সিনুকে কীভাবে সামলাব। ও যে শেষ হয়ে যাবে৷ কী দরকার ছিল সৌধকে ভালোবাসার? আমরা সবাই মিলে ওর জন্য একজন বেস্ট পার্সন এনে দিতে পারব না বলো? ‘

‘ এত টেনশন করছ কেন তুমি? উপরে যিনি আছেন তার পরিকল্পনার চেয়ে বেস্ট কিছু হতে পারে?’

‘ তুমি সিনুকে বুঝাও৷ তুমিই পারবে ওকে বুঝাতে। সৌধ ওর জন্য ঠিক নয়, একদম ঠিক নয়। ‘

নামী পাত্তা দিল না সে কথায়। মনে মনে বলল,

‘ আগে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় দেখি। তারপর না বোঝানোর পালা। ‘

মুখে বলল,

‘ সৌধ ভাইয়ের বাবা, মা কী বলেন দেখো৷ এরপর তোমার বাবা, মায়ের সিদ্ধান্ত দেখো৷ বড়োদের সিদ্ধান্ত জানার পর আমরা সিনুকে বুঝাব৷ তার আগে নিজেকে শান্ত করো। সিনুর গায়ে হাত তুলেছ না? ভুল করেছ। কারো অনুভূতিকে আঘাত করতে নেই। তুমি কাল ওর গায়ে আঘাত করোনি৷ করেছ অনুভূতিকে। বাবা, মায়ের থেকে ও তোমাকে বেশি ভরসা করে৷ সেই তুমিই যদি এমন করো ও কোথায় যাবে? কার কাছে আশ্রয় নিবে?
.
.
গুটিগুটি পায়ে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। লক্ষ ভ্রষ্ট সৌধ৷ বন্ধুরা যে যার মতো ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে। অথচ সে নিরাসক্ত, লক্ষ হীন জীবন কাটাচ্ছে। মাত্র দুই কি তিন মাসের ব্যবধান। অর্পণ স্যার বাবা হবে। একেবারে সফল পুরুষ। নিধি মা হবে। ক্যারিয়ার গুছানো। স্বামী, সন্তান নিয়ে এবার সুখের সংসার৷ সুহাস, আইয়াজ সবাই সবার পথে এগিয়ে চলেছে। থেমে আছে শুধু সৌধ। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব অবশ্য পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কি করছে। এগিয়ে চলার বিন্দু উৎসাহ, ইচ্ছে কোনোটাই পাচ্ছে না সৌধ। সে আপতত বিয়ার খেতে খেতে ল্যাপটপে মুভি দেখছে। ভারতীয় মুভি। দিন গুলো অবশ কাটে তার। রাতগুলো কাটে তীব্র বিষাদে। মনকে একটু হালকা রাখার জন্যই রোজ সিগারেট, বিয়ার আর মুভিতে ডুবে থাকে। ‘একজন এমপির যোগ্য পুত্র কি একেই বলে?’ ভেড়ানো দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে করতে প্রশ্নটি করলেন সুজা চৌধুরী। এতক্ষণ জানালা দিয়ে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করে আর চুপ থাকতে পারেনি মানুষটা। সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি পরনে। চিবুক ভরা মেহেদি রাঙা দাঁড়ি। দৃষ্টি জোড়া চৌকস। তুখোড় রাজনীতিবিদ। বাবা সামনে দাঁড়িয়ে। কোলের ওপর থাকা ল্যাপটপটা কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত সহকারে বা’পাশে রাখল সৌধ৷ বা’হাতে থাকা বিয়ারের বোতল অত্যন্ত কৌশলে বিছানার ওপাশে ফেলে দিল৷ বিপত্তি ঘটল ফ্লোরে পড়ে তা অদ্ভুত শব্দ করল বলে৷ সুজা চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সৌধ মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বাবাকে বসার জায়গা করে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ বসুন আব্বা। ‘

দৃঢ় চোয়ালে, ভারিক্কি কদম ফেলে ছেলের কাছাকাছি এলো সুজা চৌধুরী। অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বসল একপাশে। ততক্ষণে সৌধ পাশ থেকে টি-শার্ট পরে নিজের আকর্ষণীয় বলিষ্ঠ, উদাম শরীরটা ঢেকে নিয়েছে।

‘ এত খেটেখুটে ডাক্তারি পাশ করলা রাতে ঘরে বসে বিয়ার পান করার জন্য? এটাত বুঝিনাই আব্বা। ‘

সৌধর বুকটা ভার হয়ে ওঠল৷ করুণ চোখে তাকিয়ে রইল শ্রদ্ধেয় আব্বার পানে। সুজা চৌধুরী ছেলের দৃষ্টি দেখে গম্ভীরতা কমিয়ে নিলেন। বললেন,

‘ আগামীকাল সোহান আসতেছে। তোমার আর সিনুর বিয়ে উপলক্ষে কথা বলব আমরা। তোমার আপত্তি আছে জানি৷ কিছু কিছু সময় সন্তানদের আপত্তি থাকলেও বাবা, মাকে বিরোধিতা করতে হয়। আমাদের এখন সেই সময়টা আসছে। ‘

এ পর্যন্ত বলেই ছেলের দিকে তাকালেন। সৌধ যেন নিঃশ্বাস আঁটকে রয়েছে। টের পেয়ে বললেন,

‘ নিঃশ্বাস ছাড়ো। আর কত আঁটকে রাখবা? আমার ছেলে এত দুর্বল প্রকৃতির জানা ছিল না। সবল হও। সুজা চৌধুরীর ছেলেদের এভাবে মানায় না। ‘

‘ আব্বা…।’

‘ এ বিষয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। তুমি এত বড়োও হয়ে যাও নাই যে নিজের সব ভালো বুঝবা। নিজের সব সিদ্ধান্ত নিবা। যেদিন আমার মতো আব্বা হবা সেদিন নিজের সব সিদ্ধান্ত নিয়ো। আর শুনলাম কোনো হসপিটালে জয়েন দিতেছ না। আর দিয়ে কাজ নাই। যেখানে পড়াশোনা করছ ঐখানেই লেকচারার হিসেবে ঢুইকা যাও। নাকি বাইরে টাইরে যাবা? ‘

সৌধ নিশ্চুপ। অত্যন্ত সচেতনতার সাথে ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কখনো বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে, গলা উঁচিয়ে কথা বলেনি। আজ বড্ড ইচ্ছে করছে বলতে। ইচ্ছে করছে ভয়ানক বেয়াদব রূপে উপস্থাপন করতে নিজেকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্ত বদলালো। বাবা, মায়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ হবে না। হয় তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে নয়তো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে হবে। দু’টো কাজই তার জন্য অত্যন্ত কঠিন এবং অসম্ভব ব্যাপার। তাই ভাবল, আগামীকাল সে উদয়িনী আন্টির সাথে দেখা করবে। এরপর কথা বলবে সিনুর সঙ্গে। এই দু’জনই পারে তাকে সাহায্য করতে। নিজের জীবনে এত বড়ো বিপর্যয়ের পেছনে যার হাত রয়েছে তাকে একবার স্মরণ করল সৌধ। মনে মনে বলল,
‘ তোকে আসলে ক্ষমা করা যায় না নিধি। বেইমান একটা। তোর জন্য সারাজীবন যুদ্ধ করে গেলাম আমি৷ এতদিন মনের সঙ্গে করেছি। এখন পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে করব। ‘

সুজা চৌধুরী চলে গেলেন। আগামীকাল শুধু সোহান খন্দকারই আসবে। উদয়িনী বা সুহাস আসবে না৷ সৌধ জানে এই দু’জনের কেউই রাজি নয় সিনু আর তার বিয়েতে৷

সৌধ চোখ বুজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার ভাবনায় এখন সিমরান এসে ভর করেছে। কখনো ভাবেনি সিমরানের সঙ্গে তার সম্পর্কের সমীকরণ এভাবে বদলে যাবে। কিঞ্চিৎ আফসোস হলো। বিরবির করে বলল,
‘ তুই অনেক ভালো মেয়ে সিনু। এতবড়ো ভুল কী করে, করে ফেললি তুই? আমার চেয়ে অনেক ব্যাটার কাউকে ডিজার্ভ করিস তুই। প্রে ফর ইউ, আমার প্রতি তোর সব অনুভূতি মুছে যাক। ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। সিমরান সুহাসের বোন৷ মেয়েটাকে ছোটো থেকে দেখছে সে। ব্যক্তিত্বে চঞ্চলতা আছে,প্রচণ্ড রাগ, জেদও আছে। ম্যাচিওরিটি নেই। ও ঠিক নিধির বিপরীত স্বভাবের। ভেবেই অস্থিরতা অনুভব করল। ফের ভাবল, বিপরীত হওয়াটাই ভালো। সিনু আর যাইহোক নিধির মতো স্বার্থপর, বেইমান না৷ অনেস্ট একটা মেয়ে৷ এ পর্যায়ে সৌধর কাছে নিধির চেয়ে সিমরানের ব্যক্তিত্ব অনেক উঁচুতে ওঠে গেল।

সব ছাপিয়ে সিমরানের মাঝে নরম একটা মনও আছে। ওই মনটুকুতে আঘাত করতে চায় না সৌধ। কাল সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পর হয়তো ক্ষণিকের জন্য আঘাত পাবে৷ কিন্তু বেঁচে যাবে চিরজীবনের জন্য। সৌধ নামক অগ্নিকুণ্ডতে জেনেশুনে ও পুড়বে না। পুড়তে চাইলেও সৌধ পুড়তে দিবে না। কিছু জিনিস থাকে খুব নরম আদরের। সিমরান তার জীবনে এমনই একজন। যাকে কষ্ট দিতে চায় না, কাঁদাতে চায় না বলেই জীবনে জড়াবে না৷ কারণ এ জীবনে দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসা তার পক্ষে সম্ভব না। ভালোবাসা বিহীন, অনুভূতি ছাড়া সিমরানকে নিজের বউ করার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য কোনো ছেলে হয়তো পারত৷ কিন্তু সৌধ পারবে না। সে সবার ব্যক্তিত্বের ঊর্ধ্বে জীবন যাপন করে৷ সবাই যা পারে সে তা পারে না। আর সবাই যা পারে না তাই সে করে দেখাতে পছন্দ করে।

সৌধ জীবনে বিয়ের সম্পর্কে জড়াব কিনা তার ইয়ত্তা নেই। যদিও বা জড়ায় তা কারো চাপে পড়ে নয়৷ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় জড়াবে৷ পরিস্থিতি যেমনি হোক নিজ সিদ্ধান্তে সে অটল। হোক তা বাবা, মায়ের সামনে বিরোধীতা করে বা আড়ালে, চতুরতা খাঁটিয়ে।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৯|
গত কয়েকদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। দিন নেই রাত নেই প্রকৃতি মুখরিত হয়ে আছে শ্রাবণ ধারায়। সুহাস, আইয়াজ গতকাল ঢাকায় ফিরেছে। ছুটি শেষ ওদের। ফারাহ আপাতত নামীর সঙ্গে নামীর বাসাতে থাকছে। একমাসের মধ্যে আইয়াজ তার পরিবারকে মানিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফারাহকে ঘরে তুলবে। আজ আইয়াজ আর সৌধর নাইট ডিউটি। তাই ওরা দু’জন হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। ফাঁকা বাসায় আয়েশ করতে করতে সুহাস কল করল নামীকে। নামী ব্যস্ত থাকায় ফোন রিসিভ করল ফারাহ। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,

‘ ভাইয়া নামী শাওয়ার নিচ্ছে। ‘

সুহাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। জিজ্ঞেস করল,

‘ রাত বাজে ন’টা। এখন শাওয়ার নিচ্ছে মানে? জ্বর, ঠান্ডা লাগানোর মতলব করছে নাকি তোমার বান্ধবী? ‘

ফারাহ বিব্রত হলো। বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে গেল সুহাস। বলল,

‘ নামী এলে ব্যাক করতে বলো। ‘

ফোন কেটে দৃঢ়চিত্তে প্রচণ্ড ঝগড়ার সিদ্ধান্ত নিল সুহাস। কয়েকদিন ভালোবাসায় বুঁদ থেকে ঝগড়ার সময় হয়ে ওঠেনি। আজ বাসা ফাঁকা, বিশেষ করে সৌধ নেই। আরামসে, জবরদস্ত ভাবে ঝগড়া করা যাবে। মনটা শিহরিত হয়ে ওঠল সুহাসের। অনেকদিন পর তার সুহাসিনীকে আজ কঠিন রাগিনী রূপে দর্শন করবে। ঝগড়ার শুরুটা কী নিয়ে করবে? বিছানায় আয়েশ করে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে ভাবল, প্রথমে সন্দেহি হওয়ার ভাণ করে এত রাতে শাওয়ার নেয়ার রহস্য জানতে চাইবে। ব্যস দপ করে জ্বলে ওঠবে নামীদামি!
.
.
হসপিটালে ঢুকতে না ঢুকতেই নিধির সম্মুখীন হলো সৌধ। কয়েক হাত দূরে একজন সিনিয়র ডক্টরের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে নিধি৷ সৌধ আর আইয়াজকে দেখে একটুখানি হাসল। সৌধ এক পলক দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে শ্বাসরোধ করে ত্বরিত স্থান ত্যাগ করল। তার পিছু পিছু ছুটল আইয়াজও৷ নিধি হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরল সম্মুখে থাকা ডক্টরের ডাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি। কথা শেষে চলে গেল নিজের কাজে। একজন মহিলার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। তার ডি এন সি করানো হচ্ছে। পাশের কেবিন থেকে গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসছে। যে চিৎকার গুলো শুনে নিধির শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সে একজন প্যাশেন্টকে ইনজেকশন পুশ করতে গিয়ে হাতে কাঁপন ধরিয়ে ফেলল। পাশ থেকে সিনিয়র ডক্টর ধমকে ওঠল তাকে। ধমক খেয়ে নিজের কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সিনিয়র ডক্টর বুঝতে পারলেন তার অস্বাভাবিকতা৷ তাই বললেন,

‘ তোমাকে কিছুটা ডিপ্রেশড লাগছে। এভাবে রুগি দেখবে কী করে? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। ‘

‘ জি স্যার। ‘

ক্ষীণ কণ্ঠে এটুকু বলেই ত্বরিত বেরিয়ে এলো নিধি। আশপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজল যেন। না পেয়ে কল করল আইয়াজের ফোনে। এত বছরের বন্ধুত্ব তাদের। এই প্রথম এতখানি অবহেলা, এড়িয়ে চলা। মেনে নিতে তীব্র কষ্ট হচ্ছে। সৌধর ব্যাপারটা না হয় আলাদা। আইয়াজও কথা বলল না? মনের ভিতর এসবই চলছিল তার৷ ফলে অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিল৷ এরওপর কারো হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। যা তার হৃদয়ও ব্যথিত করল। সব মিলিয়ে অবস্থা করুণ। আইয়াজ ফোন না ধরাতে সেই করুণতা বৃদ্ধি পেল। হাসফাস চিত্তে এদিকওদিক ঘুরতে লাগল সে। তক্ষুনি ফোন এলো অর্পণ স্যারের। ফোন রিসিভ করতেই ভালো, মন্দ জিজ্ঞেস না করে সরাসরি অর্পণ স্যার প্রশ্ন করল,

‘ মা’কে ফোন দিয়েছিলে? ‘

আঁতকে ওঠল নিধি। বলল,

‘ সরি আমার খেয়াল ছিল না। ডিউটিতে আছি কাল সকালে দিব। ‘

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল অর্পণের। চটে যাওয়া মেজাজি কণ্ঠেই বলল,

‘ ইট’স নট রাইট নিধি। আমার মায়ের একমাত্র ছেলের বউ তুমি৷ তোমার থেকে উনি অনেকবেশি আশা করে৷ তিনদিন হয়ে গেল মাকে একটা ফোনকল করার সময় তুমি পাওনি। এখন ডিউটির অজুহাত দিচ্ছ? সারাদিন কী করলে বাসায়? নাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছ সারাদিন! এক মিনিট, সৌধদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার? ‘

একনাগাড়ে এতগুলো কথা শুনে মাথা ধরে গেল নিধির। বিষণ্ন মনটা বিষিয়ে ওঠল খুব৷ তবু স্বামী হিসেবে সম্মান পূর্বক শেষ কথাটির জবাব দিল,

‘ হ্যা হয়েছিল। ‘

সেদিন বিয়ে বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভুলতে পারেনি অর্পণ স্যার। বন্ধুত্বের পাশাপাশি সৌধ নিধিকে ভালোবাসে আর নিধি স্রেফ বন্ধুই ভাবে। এ কথা নিধিই জানিয়েছে তাকে৷ সৌধর হয়ে ক্ষমা চেয়েছে অনেকবার৷ কান্নাকাটি করেছে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে। নিধির কোনো দোষ পায়নি অর্পণ স্যার৷ আর না সৌধকে দোষারোপ করতে পেরেছিল। সেদিন তিন বন্ধু খোলা চোখে যা দেখেছে তারই প্রতিবাদ করেছে। তারা তো আর জানত না তার আর নিধির ভেতরকার সম্পর্কটির কথা। তাই ওইদিনের ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ দূর্ঘটনা হিসেবেই নিয়েছে। তবু কিঞ্চিৎ অপমানের রেশ থেকে গেছে সুপ্তভাবে। খুবই ভদ্র শ্রেণীর মানুষ হওয়ার সুবাদে এ নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি৷ সবচেয়ে বড়ো কথা বউয়ের বন্ধু ওরা৷ বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় খুঁজে পায়নি৷ কিন্তু নিজের বউকে অন্য কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখছে বা দেখবে এটা তার অহমিকায় আঘাত করে৷ তাই নিধিকে বোঝায়, সৌধর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে৷ যদিও নিধি কিছু বলেনি৷ তবু অর্পণ বুঝে নিয়েছিল তার কথা মেনে চলবে নিধি৷ কতটুকু মেনে চলল সেই সত্যতা যাচাই করতে প্রশ্ন করল,

‘ কথা হয়েছে? ‘

হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিধি উত্তর দিল,

‘ না। ‘

স্বস্তি পেল অর্পণ। বলল,

‘ সাবধানে থেকো। সমস্যা হলে জানিও আমাকে। ‘

‘ কী সমস্যা হবে? ‘

‘ প্রশ্ন করছ, বুঝতে পারছ না? সৌধ মোটেই সুবিধার ছেলে নয়। ‘

কপাল কুঁচকে গেল নিধির৷ শত হোক প্রিয় বন্ধু বলে কথা। তাই মন প্রতিবাদ করে ওঠল। শক্ত কণ্ঠে শুধাল,

‘ সুবিধার নয় বলতে কী বোঝাতে চাইলেন স্যার? সেদিন যা ঘটেছে তা ধরে আপনি সৌধকে বিচার করবেন না। সৌধ আর যাই হোক ক্যারেক্টারলেস নয়। সেদিন ও জানত না আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ। আমি ম্যারেড৷ কিন্তু আজ জানে…। ‘

‘ বন্ধুর জন্য স্বামীর সঙ্গে এমন শক্ত আচরণ! আমি একবারো বলিনি সৌধ চরিত্রহীন৷ ওকে আমিও জানি কিছুটা তবু ও তোমাকে ভালোবাসত। তোমার জন্য প্রচণ্ড ডেস্পারেট সৌধ। স্বামী হিসেবে এটুকু সচেতন করতেই পারি আমি। ‘

বিরক্ত হলো নিধি। থমথমে গলায় বলল,

‘ আপনার কথার টোন তেমনই ছিল। ‘

‘ ওকে ফাইন, হার মানলাম বউ। ঘুমাব আমি বুঝেছ?’

ছোটো করে উত্তর দিল নিধি,

‘ হু। ‘

অর্পণ স্যার বলল,

‘ শোনো, কষ্ট করে হলেও মাকে ফোন দিও একটা। জাস্ট তিন মিনিট সময় দিও। মা খুশি হবে, আমারো ভালো লাগবে৷ বিয়ে মানে শুধু বিয়েই নয় নিধি, বিয়ে মানে অনেকটা দায়বদ্ধতা। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ‘

‘ হু, রাখছি৷ গুড নাইট। ‘

চট করে কল কেটে দিল নিধি। হঠাৎই অর্পণ স্যারকে অসহ্য লাগছে তার। অথচ দু’দিন আগে অবধি তার কথায় মুগ্ধ হতো। তাকে দেখে বিমোহিত হতো চোখজোড়া। হৃদয় কোণে শিহরণ জাগত৷ কী প্রগাঢ় অনুভূতিতে সিক্ত ছিল মন। হঠাৎ করে এমন বিরক্তি ঠেকছে কেন? চারপাশ জুড়ে এত অসহ্য অসহ্য অনুভূতি কেন হঠাৎ? দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিধি৷ ভাবল মন ভালো নেই, বন্ধুরা এড়িয়ে চলছে৷ ওদিকে একই বাসায়, একই রুমে থেকেও প্রাচীকে আগের ন্যায় অনুভব করতে পারছে না৷ মেয়েটা কথা বলছে, মিশছে, হাসছে তবু যেন এক আকাশসম দূরত্ব। চোখে যেন এক সমুদ্র রাগ, অভিমান, ক্ষোভ। বাসায় প্রাচী হসপিটালে সৌধর পাশাপাশি আইয়াজের এড়িয়ে চলা সব মিলিয়ে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যা তার সমস্ত ভালোলাগা শুষে নিয়েছে। ফলে অর্পণ স্যারকেও এখন ভালো লাগছে না৷ কী অদ্ভুত মন তার। বিয়ে, স্বামী এসব কী আর ছেলেখেলা? গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অবস্থায় সহসা
মনে পড়ল আইয়াজকে কল করার কথা৷ ছেলেটা কল ধরল না। ব্যাকও করল না। তবে কী ওরা চাইছে না ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে! বুকের ভেতর গভীর এক চাপ অনুভব করল নিধি৷ অশান্ত হৃদয়ে পা বাড়াল আইয়াজের কেবিনের উদ্দেশ্যে। কেবিনে গিয়ে জানতে পারল আইয়াজ ইমারজেন্সিতে গেছে৷ ওর কোন আত্মীয় যেন এক্সিডেন্ট করেছে। কী আর করার হতাশ চিত্তে ফিরতে উদ্যত হলো নিধি। এমন সময় পাশের রেবিন থেকে সাদা অ্যাপ্রোন পরনে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো সৌধ বেরিয়ে এলো। আকস্মিক তাকে দেখে একটুখানি চমকালেও মুহুর্তেই সামলে নিল নিজেকে। এরপর সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই ত্বরিত ডাকল নিধি,

‘ সৌধ প্লিজ দাঁড়া। ‘

হাঁটা পা থেমে গেল সৌধর সম্মুখে দৃষ্টি অটল রেখে দু’পা পিছিয়ে এলো। কিন্তু ডানপাশ ঘুরে দাঁড়াল না। কান দু’টো সজাগ রাখল শুধু৷ নিধি ওর ভাবগতিক বুঝে ঢোক গিলল৷ ভয় ভয় কণ্ঠে বলল,

‘ তোরা এভাবে এড়িয়ে চলিস না আমাকে। মানছি আমার ভুল হয়েছে তোদের না জানিয়ে…।’

বাকিটুকু শোনার আর ধৈর্য্য রইল না সৌধর। শক্ত মুখে দৃঢ় চিত্তে প্রস্থান করল ত্বরিত। নিধি থমকে গেল। অসহায় চোখে নিষ্পলক দেখল রুদ্ধশ্বাসে সৌধর চলে যাওয়া৷ নিধির চোখের আড়ালে যাওয়া মাত্রই নিয়ন্ত্রণ হারাল সৌধ। সবার দৃষ্টির অগোচরে শক্ত মুঠো করে দেয়ালে ঘুষি দিল গোটা দশেক। এরপর বাথরুমে ঢুকে একবার নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরল। আরেকবার বুকের যে পাশটায় অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে সে পাশে খামচে ধরল। মনে মনে হাজারবার আর্তনাদ করে ওঠল,

‘ তুই আমাকে ডাকিস না রে, তুই আমার সামনে আসিস না রে বেইমান। ‘
.
.
ওদের ইন্টার্নির শেষ সময়গুলো ছিল খুবই দুর্বিষহ। সৌধ চাইত না নিধির সঙ্গে দেখা হোক৷ কিন্তু হয়ে যেত বারংবার। নিধি চাইত সুহাস, আইয়াজ, সৌধ, প্রাচী সবার সঙ্গে আগের মতো মন খুলে কথা বলতে। সময় কাটাতে চাইত বন্ধুদের সঙ্গে। কষ্ট পেত ওদের এড়িয়ে যাওয়া দেখে। দম বন্ধ লাগত, তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠত আগের সময় গুলো স্মরণ করে৷ স্মৃতির পাতায় সৌধর যত্নশীল আচরণ, সুহাসের দুষ্টুমি, আইয়াজের শীতল দুষ্ট স্বভাব, প্রাচীর বোনবোধ মিস করত খুব৷ কখনো কখনো তার শক্ত হৃদয় নরম হতো, কান্নাও করত। ইন্টার্নির শেষ দিন ফেরার পথে তো মেয়েটা সর্বসম্মুখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না সবাই সহ্য করলেও সহ্য করল না সৌধ। সে প্রচণ্ড রাগান্বিত হলো প্রাচীর ওপর, সুহাস আর আইয়াজের ওপরও। নিধি তাকে ঠকিয়েছে, তার সঙ্গে বেইমানি করেছে শাস্তি কেন সবাই মিলে দেবে? প্রাচীকে ধমকাল খুব। সুহাস, আইয়াজকেও ধমকে বলল,

‘ আমি একাই তোদের বন্ধু? ও বন্ধু নয়? কথা বলছিস না কেন ওর সঙ্গে? শেষদিন অন্তত তোরা একসঙ্গে কিছু সময় কাটাতে পারিস। আমার কোনো প্রবলেম হবে না। ‘

সৌধর কথায় সকলে স্তম্ভিত। কাঁদল নিধি একাই৷ ওর কান্নায় সৌধর ক্রোধ বাড়ল মারাত্মকভাবে। পকেট থেকে টিস্যু ছুঁড়ে দিয়ে বলল,

‘ তোকে কাঁদলে মানায় না। যারা মানুষকে কাঁদায় তারা কাঁদলে হাস্যকর লাগে, অসহ্য ঠেকে। কান্না থামা, চোখের পানি মোছ। নয়তো থা প ড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব৷ তখন তোর অর্পণ তার মনের দর্পণে আর ঠাঁই দিবে না৷ ‘

সৌধর এহেন কথায় সকল মূঢ় হয়ে গেল। আর নিধি আবেগান্বিত হয়ে আকস্মিক সৌধকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল ওর জীবনে। সৌধ তো অপমান করে গা ঝাড়া দিয়ে ছুঁড়ে ফেললই৷ এদিকে অর্পণ স্যারের পরিচিত এক নার্স দৃশ্যটি দেখে দূর থেকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল মুহুর্তেই। বউয়ের প্রতি গোপন সন্দেহ ছিল অর্পণের। সে সন্দেহের জের ধরেই পরিচিত নার্সটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত৷ নিধির খেয়াল রাখতে বলত। সে খেয়ালটা কূটনীতিতে পরিণত হয়ে গেল হঠাৎ। আগে পড়ে না ভেবে নার্স মহিলাটির পাঠানো ছবির রেশ ধরেই অর্পণ, নিধির দাম্পত্য জীবনে অশান্তির সূচনা ঘটল…! এটা কী প্রকৃতির অভিশাপ নাকি করুণ নিয়তি?

তিনমাস পর,

বন্ধুমহল এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আইয়াজ, ফারাহ সুখে সংসার করছে। সোহান খন্দকারও উদয়িনীর সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে। নামীকে ঘরে তুলতে আপত্তি নেই উদয়িনীর। বেশ বড়ো করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেও প্রস্তুত সে। কিন্তু শশুর ঘরে ফিরে যেতে ঘোর আপত্তি নামীর৷ সে জানালো, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নড়চড় নেই। এই নিয়ে সুহাসের সঙ্গে তুমুল বাকবিতন্ডা হলো। সুহাসও জানিয়ে দিল, তার সঙ্গে না দেখা করবে আর না কথা বলবে। তার মা এতবড়ো মুখ করে সব আয়োজন করতে চাইল। আর সে দম্ভ দেখিয়ে না করে দিল? বেশ ভালো কথা। নামী যেমন ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে শশুর ঘরে পা মাড়াবে না। সেও তেমন নামীর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎ, ফোনকল, টেক্সট সমস্ত কিছু থেকে বিরত থাকবে। জেদ শুধু নামীর একারই নয় তারও আছে৷ সিদ্ধান্ত শুধু নামী না সেও নিতে পারে। সুতরাং সুহাস, নামী এখন পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন!
.
.
বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। বিয়ে নিয়ে সৌধর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে এক কথায় অনড়,

‘ আমি বিয়ে করব না৷ বিয়ে বিহীন বেঁচে থাকা অন্যায় হলে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দাও। ‘

ছেলের এহেন কথা শুনে মা তানজিম চৌধুরীর প্রেশার বাড়ে। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী রয় তিনদিন। একদিকে বিরহ বেদনা অন্যদিকে বিয়ের চাপ, মায়ের অসুস্থতা। সবমিলিয়ে সৌধ যেন আরো ছন্নছাড়া হয়ে ওঠে৷ সিগারেটের পাশাপাশি অ্যালকোহলের প্রতিও ঝুঁকে পড়ে সে। সুজা চৌধুরীর কানে সমস্ত কথাই যায়। যেখানে সুহাস, আইয়াজ সহ সৌধর বাকি বন্ধুরা ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত। সেখানে সৌধর বেহাল দশা ভাবিয়ে তুলল তাকে। বন্ধু সোহান তাকে পরামর্শ দিল সৌধ যতই আপত্তি করুক, পাগলামি করুন বিয়ের বন্দোবস্ত করতে। তার বেপরোয়া, উদ্ধতস্বভাবের ছেলেটা যদি বিয়ের পর নামীর সংস্পর্শে এসে এতটা বদলাতে পারে৷ সৌধও নিশ্চয়ই পারবে। পুরুষ যতই কঠিন, শক্তিশালী হোক না কেন, যতই তাদের রক্ত উষ্ণ থাকুক নির্দিষ্ট একজন নারী যে কিনা তার অর্ধাঙ্গিনী তার সংস্পর্শে এলে ঠিক নরম, দুর্বল এবং শীতল হতে বাধ্য। বন্ধুর ইতিবাচক পরামর্শে সুজা চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেয় এবার ছেলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে।

এদিকে অর্পণ স্যারের সঙ্গে নিধি এখন হসপিটাল কোয়ার্টারেই থাকে। তারা এখনো ডাক্তারি লাইসেন্স পায়নি। লাইসেন্স পাওয়ার আগ পর্যন্ত চর্চার ওপরে থাকবে৷ সপ্তাহে দু’দিন একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে বসে নিধি৷ একই শহরে থাকা সত্ত্বেও সৌধর সঙ্গে দেখা হয় না। এখন আর দেখা করার ইচ্ছেও হয় না। সৌধ তাকে সহ্য করতে পারে না। বন্ধুরা তার সঙ্গ পছন্দ করে না। তাই দূরত্ব বুকে পুষেই সংসার করে যাচ্ছে অর্পণ স্যারের সঙ্গে। সেদিনের সেই ঘটনার জন্য কম ভুগতে হয়নি৷ স্বামীর থেকে অপমান, অবহেলা, লাঞ্ছনা পেয়েও মাথা নত করে থেকেছে। একজন কঠিন ব্যক্তিত্বের নারীর ব্যক্তিত্ব কত সহজে একজন পুরুষ হরণ করে নিতে পারে নিজ জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। সে একজন প্রতিবাদী, প্রতিষ্ঠিত নারী হয়েও স্বামীর কাছে অতি নগন্য রূপে ধরা দিয়েছে। কেন দিয়েছে? এর সঠিক উত্তর নিজেকেও ঠিকঠাক দিতে পারবে না নিধি৷ আবার হয়তো দিতে পারবে কিন্তু দেবে না। কারণ তাকে ভালো থাকতে হবে। অর্পণ স্যারকে নিয়েই সুখে থাকতে হবে তাকে। যদি না পারে তবে অভিনয় করতে হবে সুখে থাকার৷ জগতে নারীর জন্য এ যে চির ধারিত অভিনয়। প্রতিষ্ঠিত সুন্দরী নারী হোক বা অসুন্দরী অশিক্ষিত, অবহেলিত গৃহিণী নারী৷ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবনে নায়িকা না হলেও সুনিপুণ অভিনেত্রী। নিধির অভিনয় করে যেতে হবে৷ ক্লান্ত হলেও থামা যাবে না৷ কারণ যে সর্গীয় প্রেম অবহেলা, অনাদরে ফেলে ক্ষণিকের মোহে ডুবে অর্পণ স্যারকে বেছে নিয়েছে। সে প্রেমের সামনে নিজের অসুখ প্রকাশ করা যাবে না। নিজের অসুখী জীবন চিত্র সমাজ, বন্ধু, বান্ধবের সম্মুখে প্রকাশ হওয়ার ভয়েই অভিনয় করে যেতে হবে তাকে। দিনশেষে আফসোস রয়ে যাবে একটাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েও পাওয়া হলো না। নিজের ভুল অনুভূতির জন্য। নিধি আজ খুব করে অনুভব করে নিজের অনুভূতি দ্বারাই ভীষণ ভাবে প্রতারিত সে৷ সৌধর সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে কিনা জানে না৷ তবে নিজের সঙ্গে অনেক বড়ো একটি প্রতারণা করেছে। বিয়ের প্রথম দিকে নিধির মনে হতো অর্পণ স্যার তাকে ভীষণ ভালোবাসে। যে ভালোবাসার গভীরতা সৌধর ভালোবাসার চেয়ে হাজার গুণ বেশি৷ কিন্তু একসঙ্গে থাকতে থাকতে সে অনুভব করল, এরচেয়েও গভীরভাবে সৌধ তাকে ভালোবেসেছিল। যা তখন বুঝতে না পারলেও এখন হারে হারে টের পাচ্ছে। এরপর যখন সৌধকে জড়িয়ে ধরা ছবি নিয়ে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হলো। তখন নিখুঁতভাবে অনুভব করল সে অর্পণ স্যারকে ভালোবাসে না৷ অর্পণ স্যারের প্রতি তার অনুভূতিটা আসলে মোহ মাত্র। বুকের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটল তখনি৷ যখন অর্পণ স্যারের কথায় তার মাথায় আসতে শুরু হলো এখানে সৌধ থাকলে কী বলত? নিশ্চয়ই এভাবে বলত, ওভাবে রিয়াক্ট করত। অর্পণ স্যার গভীর রাতে তার শরীর ছুঁয়ে কষ্ট দিলে আকস্মিক তার হৃদয় নড়ে ওঠত। মন বলত, এখানে সৌধ থাকলে নিশ্চয়ই এতটা হার্ডলি স্পর্শ করত না। মনে পড়ে যেত সৌধর করা সেই প্রথম চুম্বন মুহুর্তটুকু। কী আবেগপ্রবণ, কত ভালোবাসাময় ছিল সৌধর প্রতিটা কথায়, প্রতিটা স্পর্শে। এসব মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠত নিধি৷ গভীর রাতে দু’টো শরীর আদিম খেলা মত্ত। যার একটি মন ভালোবাসার অভাবে ডুকরে ওঠত। আকস্মিক নিধির কান্না শুনে অর্পণ স্যার বিরক্তি সুরে বলত,

‘ কী আশ্চর্য ফার্স্ট নাইটেও তো এভাবে কাঁদোনি! ‘

বলেই দূরে সরে যেত৷ এরপর সারারাত নির্ঘুম, ক্রন্দনরত নিধি ছটফট করতে করতে দীর্ঘ রাত পারি দিত৷ তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে অসহ্য হয়ে নিধি ভেবেছিল ডিভোর্স দেবে৷ বিয়ের এক বছর না যেতেই ডিভোর্স! এ নিয়েও গুমড়ে মরছিল মেয়েটা। তক্ষুনি মা বুদ্ধি দিল বাচ্চা নিতে৷ এতে তাদের সম্পর্ক মজবুত হবে। হুঁশে নয় বেহুঁশেই বাচ্চা নিয়ে নিল নিধি৷ সত্যি বলতে যে ভালোবাসা ভুলবশত দূরে ঠেলে এসেছে ঐ ভালোবাসা অর্পণ স্যারের কাছে পাওয়ার লোভ জন্মাল। কারণ এই মানুষটা তার স্বামী। সবশেষে তাদের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি পবিত্র সম্পর্ক আছে৷ যেটাতে প্রতিটি মেয়েই ভীষণ রকমের দুর্বল। দুর্বল নিধিও। সত্যি সত্যি অশান্তি কাটল ওদের৷ নতুন প্রাণের আগমনী বার্তায় প্রথম দিকের অর্পণকেই ফিরে পেল নিধি৷ বুকের ভেতর কিছুটা ক্ষ ত থেকে গেল অবশ্য। নিধি এখন তিনমাসের গর্ভবতী। তার গর্ভে একটু একটু করে বেড়ে ওঠছে অর্পণ স্যারের অংশ। সেই অংশকে নিয়ে আজ বেরিয়েছে একটু ফুচকা খেতে৷ অর্পণ ব্যস্ত থাকায় একা একাই বেরিয়েছে। টুকটাক জিনিস কিনে ফুচকা খায়। খাওয়া শেষে অনুভব করে তার গা গুলাচ্ছে৷ তাই ত্বরিত সামনে থেকে পাঁচ মিশালি আচার কিনে রিকশা ডাকতে উদ্যত হয়৷ কিয়ৎক্ষণ অতিক্রান্ত হতেই মাথা চক্কর দেয় তার অমনি ভয়ে
জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে৷ যখন জ্ঞান ফেরে সম্মুখে স্তব্ধ মুখে, রক্তিম দৃষ্টিতে পলকহীন বসে থাকা সৌধকে দেখতে পায়! ভয়ে শিউরে ওঠে নিধি। ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসতেই দেখতে পায় তার দু’পাশে নামী আর ফারাহ বসে। নামী নিধিকে ধরে কিছু বলতে উদ্যত হতেই থমকানো কণ্ঠে সৌধ আদেশ করল,

‘ নামী, ফারাহ তোমরা দু’জন একটু বাইরে যাও। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা।

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪০|
বছর পেরোয়নি একটাও৷ তবু যেন বহু বছরের তৃষ্ণা। ঠিক এমন করেই তাকিয়ে আছে সৌধ। যে তাকানোতে বাইরে থেকে প্রকাশ পাচ্ছে তীব্র ক্রোধ, অভিমান। অথচ ভেতরে আকুলতায় ভরা। ব্যাকুলতায় গাঁথা। পুরুষালি দেহের ভিতর থাকা ছোট্ট হৃদযন্ত্রটা ছটফট করছে ভীষণ। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি দু’টো নির্মল হতে চাইছে ক্ষণে ক্ষণে। কী ভীষণ যুদ্ধ করে নিজের গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে ছেলেটা৷ কী ভয়ানক জেদ খাঁটিয়ে আঁটকে রেখেছে অনুভূতিদের। বাচিঁয়ে রেখেছে তীব্র রাগ, কঠিন জেদ। নিধির শরীরটা ভীষণ দুর্বল। মুখের ফর্সা ত্বক ফ্যাকাশেতে পরিণত হয়েছে। তার দুর্বল দেহের ভিতরে থাকা ছোট্ট হৃদয়খানি হঠাৎ অদ্ভূত অশান্তি চাপল। মলিন দৃষ্টিজোড়া ছলছল করে ওঠল। সে কোথায়, কীভাবে এলো, কেন এলো সব প্রশ্ন উহ্য রেখে সৌধর রাশভারি রক্তিম মুখটায় তাকিয়ে সহসা বলে ওঠল,

‘ এ কী অবস্থা তোর! কতদিন ধরে শেভ করিস না? বদ্ধ উন্মাদ লাগছে, ঠিক পাড়ার বখাটেদের মতো। ‘

সৌধর জীবন এখন ছন্নছাড়া। সারাজীবন ডিসিপ্লিন মেনে চলা ছেলেটা এখন উশৃংখল জীবন কাটাচ্ছে। যা তার চেহেরাতেও ফুটে ওঠেছে৷ নিয়ম মেনে না খাওয়াদাওয়া করে আর না শরীরের যত্ন নেয়। তাই তো মাথার এলোমেলো উষ্কখুষ্ক চুল, না কামানো ঘন দাঁড়ি, মোছ দেখে নিধি বিস্মিত। তার বিস্ময় কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল সৌধ। পা দু’টো লম্বা করে এক হাঁটুর ওপর হাত রেখে অন্য হাত ছেড়ে বসা ছিল সে। নিধির ছলছল দৃষ্টি আর মলিন মুখের প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে ফেলল৷ দু-হাত চট করে বুকে বেঁধে পা নাচাতে নাচাতে আকস্মিক চোখ বুজল৷ ভাবল কিছু একটা৷ এরপর চট করে চোখ খুলল। নিধি কিছুটা চমকে গিয়ে ঢোক গিলল। সৌধ খেয়াল করল আগের চেয়ে ঢেড় বেশি নিষ্পাপ আর সুন্দরী লাগছে নিধিকে। এলোমেলো চুল, মলিন মুখ, ভীত দৃষ্টি, শুষ্ক ঠোঁট। সর্বত্র জুড়েই আশ্চর্য রকমের সৌন্দর্যে ভরপুর। এই যে চোখের নিচের পাতলা ত্বক কাজল বিহীল কালচে বর্ণে পরিপূর্ণ। এতেও মারাত্মক সুদর্শনীয় লাগছে। ভাবতে ভাবতেই নিধির বুক বরাবর দৃষ্টি আটকাল। সহসা সৌধর চোখ নিচে নামতেই গলা শুঁকিয়ে গেল নিধির৷ ত্বরিত ওড়না ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খেয়াল করল সৌধ৷ তাচ্ছিল্য ভরে হাসল কিঞ্চিৎ। দৃষ্টি সরাল না৷ একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে পা নাচাতে নাচাতে ভাবল, ‘ওখানে থাকা মনটা সুন্দর তো?’

মুহুর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। চোখ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করল সম্মুখের নারীর প্রতি মুগ্ধতা, বুকের ভেতর হওয়া অসহনীয় ব্যথাকে মাটিচাপা দেয়ার চেষ্টা করল। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল নিধিকে ঘিরে সমস্ত অতীত৷ এত এত চেষ্টা কী সফল হলো? একদমই নয়। তবু পুরুষ তো? শক্তিশালী মনের অধিকারী কিনা… তাই ভাণ করল সব ঝেড়ে, মুছে পরিষ্কার করার৷ শেষ অব্দি অবশ্য পুরোপুরি পারল না। ঠিক যেমন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া আয়নাকে সারিয়ে তোলা যায় না৷ সৌধ নিজেও পারল না। দাগ ফুটে ওঠলই।

‘ তুই প্র্যাগনেন্ট? ‘

সহজ, স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন করতে অস্বাভাবিক ঠেকল সৌধর৷ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল। আচমকা সৌধর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেল নিধি। পড়ল তীব্র লজ্জা, অস্বস্তি আর ভয়ে। ঢোক গিলল সতর্ক হয়ে। উত্তর না পেয়ে একপেশে হাসল সৌধ। যাতে প্রকাশ পেল শুধুই তাচ্ছিল্য। নিধি জড়োসড়ো হয়ে গেল কেমন৷ মুখটা ছোটো হয়ে গেল খুব৷ সৌধ নিজে থেকেই ফের বলল,

‘ তোর শরীর দুর্বল। এমন অবস্থায় একা একা বেরিয়েছিস কেন জিজ্ঞেস করব না। তোর মহান স্বামী তোকে একা ছেড়েছে কেন তাও জিজ্ঞেস করব না। শুধু জিজ্ঞেস করব, তোর ক’মাস চলছে? বেবির টেককেয়ার করছিস না কেন? বেবিটা তো উড়ে আসেনি। তোদের ভালোবাসার মিলনেই এসেছে। ‘

শেষ বাক্যটি বলতেই নিঃশ্বাস আঁটকে গেল সৌধর। থেমে গেল ছেলেটা৷ দৃষ্টি নত হলো কিঞ্চিৎ। চোয়ালদ্বয় শক্ত হলো, নাকের দু’পাশে ফুলে ওঠল। বেঁধে রাখা হাত দু’টো ছেড়ে গেল আপনাআপনি। বসে থাকা নিধি বিচলিত হলো এহেন দৃশ্য দেখে। নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে গিয়ে ত্বরিত বেড থেকে নেমে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে সৌধর কাঁধ স্পর্শ করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,

‘ সৌধ কী হলো, ঠিক আছিস? পাগলামি করিস না ভাই প্লিজ। ‘

স্বভাবসুলভ অতীতের ন্যায় ফের ভাই শব্দটি বলতেই সৌধর ঘোর কাটল৷ সম্বিৎ ফিরতেই সহসা মাথা তুলে রক্তিম দৃষ্টিতে তাকাল। নিধি আঁতকে পিছু হাঁটতে নিতেই শক্ত হাতের নিধির ডান হাত চেপে ধরল। শরীর দুর্বল থাকায় সৌধর বলিষ্ঠ হাতের কঠিন চাপে ব্যথায় হাত টনটন করে ওঠল নিধির। কাঁপা স্বরে বলল,

‘ ব্যথা পাচ্ছি। ‘

ফুঁসে ওঠা সাপটা যেন মিইয়ে গেল হঠাৎ। শক্ত খোলস পাল্টে নির্মল হয়ে গেল মুহুর্তেই। ধীরেধীরে হাতের বাঁধন আলগা করে দু-হাতে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল নিধির। মাথাটা ঠিক তলপেটের কাছে ছুঁইয়ে শ্বাসরোধ করে কম্পিত গলায় বলল,

‘ ও কেন আমার হলো না? ‘

কী আকুল ব্যথা প্রশ্নটিতে! সহসা ডুকরে ওঠল নিধি। ওর কান্নার শব্দে চমকে ওঠল সৌধ। পাগলপ্রায় হয়ে নিধিকে ছেড়ে তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে নিতে আশপাশে তাকাল উন্মাদের মতো। এরপর তড়িঘড়ি করে কেবিন ছাড়তে উদ্যত হতেই ছুটে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল নিধি। পা দুটো অবশ হয়ে গেল সৌধর৷ কান জুড়ে বিস্ফোরণ ঘটাল নিধির হাউমাউ করে কান্নার শব্দ। সৌধ শক্ত মূর্তির ন্যায় ঠাঁই দাঁড়িয়েই রইল। বুকের ভেতর বয়ে গেল কালবৈশাখী ঝড়। মিনিট দেড়েক পর কান্না থেমে গেল নিধির। আচমকা সৌধকে ছেড়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। শরীর দুলছিল তাই গিয়ে বসল বেডে। সৌধ আর ফিরে তাকাল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই বলল,

‘ তোর আড়াই মাস চলছে। এটাও গোপন রেখেছিলি। আমি গোপনীয়তা পছন্দ করি না৷ বিয়ে যখন করছিস বাচ্চা হবেই। কিন্তু মনে রাখিস, তুই আমার হসনি বলে তোর প্রতি ঘৃণা জন্মেছে। ও আমার হয়নি বলে সেই ঘৃণাটা অটুট থাকবে। ‘

অশ্রুসিক্ত নয়নে চমকে তাকাল নিধি। সৌধ যেন টের পেল সেই তাকানো। ম্লান হেসে দুহাত পকেটে গুঁজে বুক টানটান করে বলল,

‘ নিধি শোন, ভুলবশতও আর কখনো আমাকে ভাই বলবি না। ‘

ক্রন্দনরত কণ্ঠে নিধি বলল,

‘ আমি তো তোর হইনি, তাহলে এখন কী সমস্যা? ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ৷ হতাশার সুরে বলল,

‘ বউ হোসনি সয়ে গেছে কিন্তু তোর বাচ্চার মামা হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য হবে না৷ ‘

বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠল নিধির। সৌধ কিয়ৎক্ষণ থেমে পুনরায় বলল,

‘ সাবধান করে গেলাম মাথায় রাখিস। আর তোর স্বামীকে বলিস, সপ্তাহে একদিন অন্তত বউকে দেয়ার জন্য। লাইফে টাকাই সবকিছু নয়। বউ, বাচ্চার থেকে বড়ো কিছু হতে পারে না। ‘

প্রস্থান করল সৌধ। ওড়নার আঁচল মুখে চেপে ফুঁপাতে লাগল নিধি। কয়েক পল পরেই নামী আর ফারাহর সঙ্গে একজন নার্স ঢুকল কেবিনে। তিনজন সচক্ষে দেখতে পেল ওড়নার আঁচল মুখে চেপে কাঁদছে নিধি। ওদের দেখে আকস্মিক সে কান্না থেমে গেল। নার্স বললেন,

‘ ম্যাম, স্যার এসে আপনাকে নিয়ে যাবে৷ কিছুক্ষণ এখানেই রেস্ট নিতে বলেছে। ‘

নিধি দেখল নার্স মহিলাটি তাদের দুই বাসা পরে থাকে। একমাস আগে কথা হয়েছিল একবার। যেদিন জানতে পারে সে গর্ভবতী। অর্পণ স্যার সেদিন সবার বাসায় মিষ্টি পাঠিয়েছিল তাদের মধ্যে এই নার্স আপাও ছিল। তবে কি এনার মাধ্যমেই সৌধ জানতে পেরেছে সে প্র্যাগনেন্ট? নামী, ফারাহর সঙ্গে কথা হলো কিছুক্ষণ। জানতে পারল, কেনাকাটা করে ফুচকা খেতে গিয়ে রাস্তার পাশে ভীড় দেখে কৌতূহল নিয়ে নামী, ফারাহ এগিয়ে আসে৷ ভীড়ের ভেতর তাকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে প্রচণ্ড তাড়াহুড়োয় তাকে নিয়ে হসপিটাল চলে আসে। সুহাস বর্তমানে ঢাকাতে। আওয়াজ গেছে চট্রগ্রাম। আশপাশে পরিচিত হেল্পফুল একমাত্র সৌধই রয়েছে। নিধির বিপদ! তারা বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে না? কোনোকিছু না ভেবেই সৌধকে কল করে নামী। ব্যস, সবকিছু ভুলে দিকবিদিকশুন্য হয়েই সৌধ উপস্থিত হয়। কিন্তু তাকে ফোন করা, তার উপস্থিতি যে একদম উচিত হয়নি এটা নামী সে সময় না বুঝলেও এবার বুঝতে পারছে। বিপদে মাথা কাজ করে না। আর এতে করেই ঘটে যায় আরেক বিপদ৷ অর্পণ স্যার এলো ঘন্টাখানিক পর। নামী, ফারাহকে দেখে সৌজন্য আচরণ প্রকাশ করল। তার অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হলো নামী। স্যারকে দূর থেকেই দেখেছে সে। ক্লাস পেয়েছিল খুব কমদিন। কাছ থেকে স্যার, স্টুডেন্ট সম্পর্কেই বাইরে আজই প্রথম আলাপ। মানুষটাকে বেশ ভালো লাগল তার। নিধি আপু সৌধ ভাইকে ভালোবাসেনি, বাসতে পারেনি। কিন্তু সে ভীষণ রুচিশীল আবারো টের পেল। কারণ অর্পণ স্যারের মতো মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছাই করা দারুণ রুচিরই বহিঃপ্রকাশ। ভালোবাসায় আবেগ থাকে কিন্তু নিয়তি নয়। নিধি আপু হয়তো ভালোবাসাতেও আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি৷ আর সৌধ ভাই? তাকে কেবলই বন্ধু রূপে চেয়ে এসেছে। আজও চায়। প্রমাণ সরূপ কিছুক্ষণ আগের হাউমাউ করে কান্নাটিকেই ধরে নিল। অনুভব করল ঝোঁকের মাথায় সৌধকে ডাকা অন্যায় হয়ে গেছে। এদের সম্পর্ক এখন কোনদিকে বোঝা উচিত ছিল তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। অর্পণ স্যার তাদের খুব অনুরোধ করল বাসায় যেতে৷ কিন্তু তারা গেল না৷ বিদায় নিল স্যার আর নিধি আপুর থেকে। বিদায় নিয়ে হসপিটাল গেটের সামনে আসতেই দেখতে পেল সৌধর গাড়ি৷ অর্থাৎ এখনো সৌধ ফিরে যায়নি? দুরুদুরু বুকে এগিয়ে এলো নামী পাশাপাশি হাঁটল ফারাহ৷ গাড়ির কাছাকাছি আসতেই জানালা দিয়ে সৌধ মাথা বের করল। বলল,

‘ তোমাদের জন্য ওয়েট করছিলাম। ‘
.
.
কেটে গেল আরো তিনমাস। একদিন মাঝরাতে হঠাৎ সৌধর ফোনে নিধির কল এলো। ঘুমহীন সৌধ। সিগারেটের ধোঁয়ায় বুঁদ। হঠাৎ নিধির কল পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিন্তু রিসিভ করল না। পরের বউ মাঝরাতে তাকে কল করবে কেন? পরের বউয়ের কল ধরতে বয়েই গেছে তার। মনে মনে এসব ভেবে অনবরত বাজতে থাকা ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল সৌধ। নিমেষে স্ক্রিন ফেটে বন্ধ হয়ে গেল ফোনটা। এরপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে সে। বেলা বারোটায় ঘুম ভাঙলে জানতে পারল সুহাস, আইয়াজ আর প্রাচী এসেছে!

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৪১|
কোনোমতে শরীরে টি-শার্ট জড়িয়ে নিচে নেমে এলো সৌধ৷ দেখতে পেল সুহাস, আইয়াজ আর প্রাচীর আতঙ্কিত মুখ। সুহাস ঢাকাতে ছিল, গতকাল সকালেই কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। তাই আকস্মিক সুহাসের আগমন সন্দেহ তৈরি করল মনে। আইয়াজ আর ফারাহর গত মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। আইয়াজের বিয়েতে প্রাচী উপস্থিত থাকতে পারেনি৷ সুহাস, নামী আর সে উপস্থিত ছিল। বর্তমানে আইয়াজ ঢাকাতে থাকে আর ফারাহ এখানেই নামীর সঙ্গে থাকে। পরীক্ষা চলছে তাদের। হুট করে আইয়াজও তার বাড়িতে! আর প্রাচী? সে তো অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দু’দিন আগেই কথা হলো। বলেছিল যাওয়ার আগে সময়, সুযোগ বুঝে দেখা করবে সবার সঙ্গে। কিন্তু আজ হঠাৎ এভাবে? চোখে, মুখে তীব্র দুঃশ্চিতার ছাপ নিয়ে কেন?

ভ্রুদ্বয় কুঁচকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে এগিয়ে এলো সৌধ। যখন ওদের একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়াল আচম্বিতে মস্তিষ্ক স্মরণ করিয়ে দিল গতরাতে নিধির ফোনকল পাওয়ার কথা। যে কারণে ক্রোধের বসে ফোন ভেঙে ফেলেছে সে! নিমেষে থমকে দাঁড়াল সৌধ। ক্ষীণ কণ্ঠে ‘ ওহ শীট ‘ বলেই চোখ দু’টো বুজে ফেলল। ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে চেপে ধরল কপালের একপাশ। বা’হাতে ধরল কোমরের এক পাশে। শ্বাস আঁটকে গেল হঠাৎ। চোয়াল দ্বয় দৃঢ় হয়ে কপালের নীল রগ ফুটে ওঠল। সম্মুখে বসা প্রতিটি ব্যক্তিই সৌধর এহেন অবস্থা দেখে ঢোক গিলল। চাওয়াচাওয়ি করল একে অপরের দিকে। এরপর সুহাস ওঠে এসে সৌধর কাঁধ স্পর্শ করে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ রিলাক্স দোস্ত। এদিকে আয় কথা আছে, বোস এখানে। ‘

নড়ে ওঠল সৌধ। গভীর একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মৃদু পায়ে এগুলো সোফার দিকে। বসল প্রাচীর পাশে। ভণিতা বিহীন ত্বরিত রাশভারি গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ কী হয়েছে? ‘

গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রাচী৷ আইয়াজের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকাল একবার। আইয়াজ আশ্বাস দিলে বলল,

‘ চল তোর রুমে যাই। ‘

প্রশ্নের উত্তরে প্রাচীর এহেন বাক্য পেয়ে দৃঢ় চোখে তাকাল সৌধ। তক্ষুনি কফির মগ নিয়ে এগিয়ে এলো কাজের মেয়েটা। সৌধর মা তানজিম চৌধুরীই ছেলের বন্ধুদের জন্য কফি বানিয়ে পাঠিয়েছেন। সৌধ কফি গুলো উপরে তার ঘরে নিয়ে যেতে বলে ওঠে দাঁড়াল। বন্ধুদের ইশারা করে বলল সঙ্গে যেতে।

সৌধর রুমে গিয়ে সকলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন৷ সুহাস ঝটপট রুমের দরজা লক করে দিলে সকলে নিজেদের জায়গা দখল করে নিল। সুহাস আর আইয়াজ বসল বিছানায়। প্রাচী বসল ডিভানে সৌধর ঠিক ডান পাশে। সৌধর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়েছে আগেই। নিশ্চয়ই জটিল কিছু ঘটেছে। প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে গেল মুখটা। হাত, পা হিম ধরে শক্ত হয়ে গেল। বা হাতে ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করল একটা। আশপাশে তাকিয়ে লাইটার খুঁজতেই সুহাস বালিশের কাছ থেকে লাইটার নিয়ে ছুঁড়ে মারল। মুহুর্তেই কেস ধরে ফেলল সৌধ। আইয়াজ বলল,

‘ প্রফাশনালি সিগারেটখোর হয়ে গেলি? ‘

ঠোঁট কামড়াল সৌধ। তীব্র দুঃশ্চিতা ঘিরে ধরল ওকে। আইয়াজের কথিত বাক্যে তাই গম্ভীর কণ্ঠেই জবাব দিল,

‘ শুধু সিগারেট না অ্যালকোহলও পান করি। ‘

সুহাস দু-হাত, পা ছেড়ে শুয়ে পড়ল। বেচারা টেনশন নিতে পারে না৷ জানে সৌধ। এই যে আচমকা শুয়ে পড়ল। এটা যে অতিরিক্ত চিন্তার ফল বুঝতে পারল। তাই প্রাচীর দিকে তাকাল সূক্ষ্ম নজড়ে। বলল,

‘ কী হয়েছে? ‘

বলতে বলতেই সিগারেট ধরাল। প্রাচী ঘনঘন ঢোক গিলল। কাঁধ সমান চুলগুলো ত্বরিত প্যাঁচিয়ে কাঁটা লাগিয়ে নিল। এরপর দম ছেড়ে বলল,

‘ যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ কথা শেষ না করব রিয়াক্ট করবি না৷ ওভার রিয়াক্ট তো একদমই নয়। ‘

‘ প্রশ্ন করা যাবে? উত্তর দিতে পারব? ‘

সৌধর দৃঢ়, গম্ভীর কণ্ঠে প্রাচী ম্লান হেসে মাথা নাড়াল। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ফের সৌধ বলল,

‘ সহ্য করতে পারবি? ‘

প্রাচী তাকাল সৌধর হাতের দিকে৷ সিগারেট ধরাল সৌধ। সিগারেটের উদ্ভট গন্ধ সে সহ্য করতে পারে। অন্যান্য মেয়েদের মতো সিগারেটের গন্ধে এলার্জি নেই তার। মাঝেমধ্যে দু’একটা খাওয়ার অভ্যাসও আছে। যা তার বন্ধুমহলের মধ্যে শুধু সুহাসই জানে। তাই মৃদু হেসে বলল,

‘ নো প্রবলেম দোস্ত। ‘

সুহাস বলল,

‘ কফি গুলো ঠান্ডা হয়ে গেল৷ কেউ খাবি না? ‘

প্রাচী বলল,

‘ তোরা খা৷ কথা শেষে ঠান্ডা কফি এক চুমুকে খেয়ে নিব আমি। ‘

সৌধ সম্মতি দিয়ে একবার কফির মগে চুমুক দিল তো আরেকবার সিগারেট ফুঁকল। বন্ধুর কাণ্ড দেখে তাজ্জব বনে গিয়েও গেল না প্রাচী। কারণ এই মুহুর্তে তাকে এমন কিছু সত্যি আর জটিল বিষয়ে কথা বলতে হবে যে অন্য কোনো বিষয়, বস্তু নিয়ে ভাবার, আগ্রহ প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র ফাঁক পাবে না।

‘ দোস্ত আংকেল, আন্টি আমাদের শুক্রবার ইনভাইট করেছিল। আমাদের প্ল্যান ছিল আমরা আগামীকাল তোদের বাড়ি আসব। সারপ্রাইজ দিব তোকে। ‘

‘ সারপ্রাইজটা একদিন আগে পেলাম যে? ‘

পায়ের ওপর পা তুলে বা’দিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্নটি করল সৌধ। প্রাচী সচেতন হয়ে ঢোক গিলে পুনরায় বলল,

‘ আমি গতকাল নামীদের বাসায় ওঠেছি। ভেবেছিলাম একদিন থেকে আগামীকাল তোদের এখানে আসব। আংকেল, আন্টি চায় তুই বিয়ে কর। সংসারি হো। কিন্তু তুই কিছুতেই এটা মানতে পারছিস না৷ তুই তোর সুস্থ জীবন মেনে নিতে চাইছিস না আর আংকেল, আন্টি পারছে না তোর অসুস্থ জীবন মেনে নিতে৷ তাই অসহায়ের মতো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তারা। তারা যেমন তাদের সন্তানের জীবন নিয়ে আতঙ্কিত। আমরাও আমাদের বন্ধুর জীবন নিয়ে আতঙ্কিত। ‘

থামল প্রাচী। সহসা উচ্চশব্দে হেসে ওঠল সৌধ। তার হাসিতে শুয়ে থাকা সুহাস ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। আইয়াজের হৃৎপিণ্ড ছটফটিয়ে ওঠল। গলা শুঁকিয়ে গেল প্রাচীর৷ চৈত্রের খরার মতো গলা ঢোক চিপে ভিজিয়ে নিল নিমেষে। সিগারেটের শেষ অংশটুকু ফ্লোরে ফেলে হাত দিয়ে ধোঁয়া সরাতে সরাতে হাসতে হাসতেই সৌধ বলল,

‘ আমি তাহলে সবার জীবনে আতঙ্ক হয়ে পড়েছি! ‘

কণ্ঠে উপচে পড়ছে বিস্ময়। প্রাচী হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ স্পর্শ করল। বলল,

‘ দোস্ত আমার কথা শেষ হয়নি। ‘

মাথা দুলালো সৌধ। গা এলিয়ে বসে পায়ের ওপর তোলা পা নাচাতে নাচাতে বলল,

‘ ওকে, শেষ কর। ‘

প্রাচী এবার ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে বলতে শুরু করল,

‘ নিধি অসুস্থ! গতকাল রাতে হসপিটালে এডমিট করিয়েছে ওকে। আগামীকাল আসার কথা থাকলেও আজ আমরা এসেছি নিধির জন্য। ‘

‘ স্ট্রেঞ্জ! ‘

সহসা শব্দটি বলেই সোজা হয়ে দেহ টানটান করে বসল সৌধ। প্রাচী খেয়াল করল, সৌধর চোয়াল দ্বয় কঠিন থেকে কঠিনতর। চোখ দু’টোর বর্ণও পরিবর্তন হচ্ছে। পুরু ঠোঁটজোড়া নড়ল তক্ষুনি। ভেসে এলো গমগমে কণ্ঠস্বর,

‘ বউ তো আমার নয়। ওর বাচ্চার বাবাও আমি না। তাহলে অসুস্থতার খবর নিয়ে আমার এখানে এসেছিস কেন? তোদের তো ওর স্বামীকে খোঁজা উচিত। হসপিটালে ওকে দেখতে যাওয়া উচিত। ‘

কথাগুলো স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেও সৌধর ভেতরে ভেতরে চলছিল নিদারুণ উত্তেজনা। যা উপস্থিত সকলেই টের পেল। মৌন রইল সম্মুখের দুই বন্ধু। পাশের বন্ধুটি হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ যাব তার আগে তোর সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া আছে৷ ‘

আশ্চর্যান্বিত হয়ে ডানপাশে ঘাড় ঘোরাল সৌধ। তাচ্ছিল্য মিশ্রিত ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘ আমার সাথে বোঝাপড়া! ‘

মাথা নাড়াল প্রাচী৷ সৌধ প্রায় নিঃশ্বাস আঁটকে মৃদু কাঁধ উঁচিয়ে ফের বলল,

‘ ওকে ফাইন। ‘

‘ তুই কেন বিয়ে করছিস না সৌধ। প্লিজ তুই রাজি হো দোস্ত৷ তোর এই একটা সিদ্ধান্তের ওপর শুধু তোর ভালো নয় আরো তিনটে জীবনের ভালো নির্ভর করছে। ‘

‘ মানে! ‘

‘ হ্যাঁ দোস্ত। তুই যতদিন একা থাকবি ততদিন নিধি ওর সংসারে মন দিতে পারবে না৷ নিধি সংসারে মন না দিলে অর্পণ স্যার ভালো থাকবে না। নিধি, অর্পণ স্যার আর অনাগত বাচ্চা তিনজনের ভবিষ্যত পরোক্ষভাবে তোর ওপরই নির্ভর করছে। ‘

‘ মানে! ‘

‘ হ্যাঁ সৌধ। তুই তোর জীবন গুছিয়ে নিলে নিধি আর অপরাধভোগে ভুগবে না৷ আর না ওর বুঝে যাওয়া অনুভূতি গুলো গুরুত্ব পাবে। তোর জীবন অন্যকারো সাথে না বাঁধলে নিধির তার নীতিজ্ঞান ভুলে যাবে। ‘

‘ ভণিতা বাদ প্রাচী। পরিষ্কারভাবে বল। ‘

রুদ্ধ কণ্ঠ সৌধর। প্রাচী বলতে শুরু করল,

‘ নিধি ঠিক নেই দোস্ত, একদম ঠিক নেই। আমাদের সেই চেনা, আদর্শ বান্ধবীটি বদলে গেছে রে। ও অর্পণ স্যারের সঙ্গে সুখে নেই। বিয়ের পর থেকেই ওর মনে অসুখ বিরাজ করছে৷ সেই অসুখটা সৃষ্টি হয়েছে তোকে নিয়ে৷ বিয়ের আগে ও যা অনুভব করতে পারেনি বিয়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত তা অনুভব করে গুমরে ম রছে। আফসোস, হতাশায় জর্জরিত হয়ে মানসিক খেই হারিয়ে ফেলছে দিনকে দিন। ভয় হয় সৌধ। এই খেই হারানোর ওর চরিত্রে না দাগ লাগায়!’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল প্রাচী। সৌধ স্তব্ধ নয়নে সম্মুখে বসা আইয়াজ আর সুহাসের পানে তাকিয়ে রইল৷ কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই হঠাৎ হাসল ঠোঁট বাকিয়ে৷ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বেলকনিতে যেতে যেতে বলল,

‘ এই সুহাস, এই আয়াজ প্রাচীর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। পাগলটাকে সামলা তোরা। ‘

আইয়াজ, সুহাস হতভম্ব। প্রাচী দমে রইল না৷ ত্বরিত বেগে ওঠে পিছু নিল সৌধর। গিয়ে দাঁড়াল পাশে। সৌধ খোলা বেলকনির রেলিঙেয়ে দু-হাত রেখে পিছমুখী হয়ে দাঁড়ানো। প্রাচীও গিয়ে পাশে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ নিধি প্র্যাগনেন্ট হওয়ার পর থেকে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বাড়ে দোস্ত৷ সব রাগ, অভিমান, অন্যায়, অভিযোগ শেষে আমরা তো বেস্ট ফ্রেন্ড বল? আমি পারিনি পুরোপুরি যোগাযোগ অফ করতে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় একটা মেয়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট। আমি বুঝতে পারছিলাম নিধি ভালো নেই। ডিপ্রেশনে ভুগছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ওর ঘনঘন মুড সুইং হচ্ছে। এ সময় মেয়েদের এমন হয়েই থাকে৷ কিন্তু ধীরেধীরে বুঝতে পারি দাম্পত্য জীবনে ও অসুখী৷ কিন্তু কেন? এই অসুখের কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সব অভিমান ভুলে পুরোনো দিনের মতো করেই ওর সঙ্গে মিশতে শুরু করি। জানার চেষ্টা করি অর্পণ স্যারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে। আর তখনি কিছু আশ্চর্যজনক বিষয় টের পাই। জানিস বিষয়টা কী? ‘

সৌধ তাকাল না প্রাচীর দিকে। আর না মুখ ফুটে উত্তর দিল ‘কী’ শুধু গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। যে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল প্রাচী। ঈষৎ হেসে বলল,

‘ এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। যেই অজ্ঞতার জন্যই সারাজীবন চরম খেসারত দিতে হয়। এই অজ্ঞতা কিন্তু কোনো বোকা শ্রেণির মানুষদের আক্রমণ করে না৷ এই অজ্ঞতার শিকার হয় নিধিদের মতো জ্ঞান, বুদ্ধি সম্পন্ন আদর্শ রমণীরা। এরা সারাজীবন আদর্শ মেনে জীবনযাপন করতে করতে অনুভূতিদের মূল্যায়ন দিতে ভুলে যায়। এদের সবাইকে নিয়ে চিন্তা হয়, সবকিছু নিয়ে চিন্তা হয়। কেবল নিজের বিশেষ অনুভূতিটুকুন ছাড়া। দেখ না নিধি পরিবারের চিন্তা করল, পড়াশোনার চিন্তা করল, প্রিয় বন্ধুর প্রেমের প্রপোজাল রিজেক্ট করল পরিবার, পড়াশোনার কথা চিন্তা করে। দিনশেষে পরিবারের সম্মান, প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে প্রচণ্ড পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করেও ফেলল। কিন্তু একবারো কি অনুভূতির মূল্যায়ন করেছে? নাহ করেনি! ‘

শক্ত পাথরের ন্যায় দাঁড়ানো সৌধ। প্রাচী এক পলক তাকিয়ে দেখল ওকে। এরপর দম ছেড়ে ফের বলতে শুরু করল,

‘ তুই ওর প্রতি কতটা সিরিয়াস ছিলিস আগে বুঝলেও খুব একটা অনুভব করতে পারেনি। কিন্তু সেদিন তোর অবস্থা দেখার পর থেকে মনে মনে অপরাধবোধে ভুগছিল। তাছাড়া সেদিনের পর থেকে আমরা সবাই ওকে দোষারোপ করেছি, ওর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছি। যা ওর মনে বিরূপতা সৃষ্টি করে৷ নতুন জীবন থেকে মন ওঠা শুরু সেখান থেকেই। সারাক্ষণ মানসিক চাপ নিয়ে সংসারে মন বসত না। অর্পণ স্যার ভালো কথা বললেও ওর খারাপ লাগত। নিধির মুখেই শুনেছি ও তোকে মিস করে, তোর কেয়ার করা গুলোকে, তোর ভালোবাসাকে মিস করে। অর্পণ স্যারের মাঝে সারাক্ষণ তোকে খুঁজে বেড়ায়। একজন মানুষ কি আরেকজনের প্রক্সি দিতে পারে? বিশেষ করে ব্যক্তিগত মানুষের প্রক্সি? পারে না তো। অর্পণ স্যার আদর্শবান পুরুষ। তাকে দেখে ভালো লাগে, তার আচরণ মুগ্ধ করে। স্বীকার করে নিধি৷ কিন্তু একসঙ্গে থাকতে গিয়ে ও অনুভব করে তার ভালোবাসা ওর হৃদয় ছুঁয়ে দেয় না। কারণ বহু আগেই ওর হৃদয়ে অন্যকারো ভালোবাসা ছুঁয়েছে। এক হৃদয়ে কি দুই পুরুষের ভালোবাসা স্থান পায়? সঠিক সময়ে সঠিক অনুভূতি বুঝতে না পারার খেসারত দিচ্ছে বেচারি। ‘

‘ শাট আপ, জাস্ট শাট আপ! ‘

সহসা ধমকে ওঠল সৌধ৷ সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠল প্রাচীর। ভিতর থেকে ছুটে এলো সুহাস, আইয়াজ। প্রাচী ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে সুহাস এসে ওর কাঁধ চেপে ধরল। বারকয়েক ঢোক গিলে প্রাচী বলল,

‘ ঠিক আছি আমি। ওকে শান্ত কর। ‘

সৌধ অগ্নি চক্ষুতে তাকিয়ে। আইয়াজ ওকে শান্ত করতে উদ্যত হলেই চোখ, মুখ খিঁচিয়ে বলল,

‘ প্রাচীকে চুপ থাকতে বল আয়াজ। আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলব৷ ‘

আয়াজ নিশ্চুপ। সুহাস তেজ দেখিয়ে বলল,

‘ কন্ট্রোল হারিয়ে ভেসে যা তুই তবু প্রাচী চুপ করবে না৷ সবটা শুনবি বুঝবি তারপর রিয়াক্ট করবি সৌধ। নিজের আসল সত্তা এভাবে বিসর্জন দিস না তুই। ‘

কিঞ্চিৎ দমল সৌধ। প্রাচী স্বাভাবিক হতে সময় নিল একটু৷ এরপর ত্বরিত কণ্ঠে বলল,

‘ বেশকিছু দিন আগে অর্পণ স্যার আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। নিধির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আমি তাই অনেক কিছুই শেয়ার করেছে। অনুরোধ করেছে নিধিকে বাস্তবতা বোঝাতে৷ কী আশ্চর্য তাই নারে? আমাদের মধ্যেকার সবচেয়ে বাস্তববাদী মেয়েটাকে এখন আমাকে বাস্তবতা বোঝাতে অনুরোধ করে তার স্বামী। ‘

একটুক্ষণ থামল প্রাচী। সময় নিয়ে বলল,

‘ লোকটা সত্যিই অসহায় হয়ে পড়েছে রে। আর তার মধ্যে আমি নিধির প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি বিরক্তিও দেখেছি। এই বিরক্তি তার প্রতি নিধির অনীহার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। বেচারা ভীষণ চিন্তিত ভবিষ্যত নিয়ে। বাচ্চাটাকে নিয়ে আতঙ্কে আছে ভীষণ। শুনেছি বাচ্চা নেয়ার তাড়া ছিল নিধিরই। আমার মনে হয় ও ভয় পাচ্ছিল নিজের আসল সত্তা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার। ও আসলে মন থেকে চায়নি ওর তোর প্রতি প্রগাঢ় অনুভূতি আছে সেটা ওর স্বামী বা বন্ধু – বান্ধব টের পেয়ে যাক। স্বাভাবিক, যা আগে প্রকাশ করেনি তা এখন করে তো বদনাম ছড়ানোর মানে হয় না৷ বাচ্চা পৃথিবীতে আসার সময় ঘনিয়ে আসছে আর ওর রাগের মাত্রা বাড়ছে৷ গতকাল রাতেও দু’জন ঝগড়া করেছে৷ নিধি নাকি ডিভোর্স চেয়েছে স্যারের কাছে। স্যার ডিভোর্স দেবে না। এ কথা সরাসরি না বলে রাগের মাথায় বলেছে ডিভোর্স দিয়ে কার কাছে যাবে সৌধর কাছে? নিধি নাকি জোর গলায় বলেছে, হ্যাঁ। স্যারের সামনেই নাকি তোকে ফোনও করেছিল। স্যার বলল তুই নাকি রিসিভ করিসনি৷ এরপরই অতিরিক্ত রাগান্বিত হয়ে সেন্সলেস হয়ে যায় ও। শারীরিক অবস্থা ভালো না ওর। অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিতে পারেনি বলেই এই অবস্থা। ফজরের আজানের সময় স্যার ফোন করে এসব জানিয়েছে আমাকে। ‘

প্রাচীর কথা শেষ হতেই হঠাৎ সুহাস অধৈর্য গলায় বলল,

‘ এই শোন প্রাচী তোদের মেয়েদের বড্ড প্যাঁচানোর স্বভাব। আর প্যাঁচিয়ে বলা লাগবে না৷ এবার আমি সরাসরি বলছি সৌধকে। ওর যা বর্তমান অবস্থা তোর কথা বোঝবার শক্তি নেই। ‘

এ কথা বলেই সৌধর দিকে তাকাল সুহাস। বলল,

‘ আমাদের দ্য গ্রেট নিধি জ্ঞানী আপা পরিবারের সম্মান, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে তার ক্রাশকে বিয়ে করেছে। বেচারি বুঝতে পারেনি বিয়ের পর তার ক্রাশিং ফিলিং বাঁশিংয়ে পরিণত হবে। এর ওপর আবার মনে মনে চুরি করে তোকেও ভালোবেসেছিল। চুন্নি মহিলা সেটা প্রকাশ করেনি৷ করবে কীভাবে গোবেট কিনা? জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধাশক্তি সব মেডিক্যাল পড়া আর পরের উপকারে খরচ করে নিজের জন্য এঁটোটুকুও রাখতে পারেনি। এখন জামাই চুমু দিলে ভালোবাসার ফিল আসে না। পান্তা ভাত লবণ ছাড়া খেলে যেমন লাগে তেমন লাগে৷ এখন লবণ নামক সৌধকে মনে পড়ে। ভেবেছিল বাচ্চা আনলে লবণের অভাব পূরণ হবে। কিন্তু ফলাফল শূন্য হওয়াতে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যার ফলাফল জামাইয়ের সাথে এই ঝামেলা আর হসপিটালে ভর্তি। ‘

থামল সুহাস। আইয়াজ প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। রেগে বলল,

‘ এই তোর প্যাঁচ ছাড়া কথা? সিরিয়াস মোমেন্টেও তোর এমন করা লাগবে? কী করে সহ্য করে নামী তোকে? ‘

সুহাস কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ ধমকে ওঠল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,

‘ যা বলছিস এসব সত্যি হলে আমি নিধিকে খু ন করে ফেলব। ‘

তীব্র জেদি স্বর সৌধর। প্রাচী আতঙ্কিত হয়ে বলল,

‘ না তুই এসব করবি না। ‘

চিৎকার করে ওঠল সৌধ।

‘ এছাড়া আর কী করণীয় থাকতে পারে আমার? ওই বেইমানটা আমার সাথে বেইমানি করেনি শুধু ও নিজের সঙ্গেও বেইমানি করেছে। ‘

কথাটা বলেই সহসা শরীর ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল সৌধ। সুহাস ত্বরিত ধরল ওকে। সৌধ হতাশার সুরে বলল,

‘ আমি আর নিতে পারছি না। জাস্ট নিতে পারছি না। খু ন চেপে গেছে আমার৷ হয় কাউকে খু ন করব নয়তো নিজেই খু ন হবো। এছাড়া আমার আত্মায় শান্তি মিলবে না। ‘

সুহাস, আইয়াজ, প্রাচীর একসঙ্গে বলল,

‘ না সৌধ৷ এভাবে আবেগে গা ভাসালে চলবে না। তোকে এবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে হবে। ‘

‘ সম্ভব না। ‘

প্রাচী বলল,

‘ কেন সম্ভব না? তুই যদি নিজের জীবন গুছিয়ে নিস নিধি বুঝবে ওর জন্য তোর জীবন থেমে নেই। ও দিকশূন্য হয়ে গেছে সৌধ। ওকে হুঁশে আনতে হবে তোকে। একমাত্র তুইই পারিস। আ’ম সিয়র তুই বিয়ে করে নিলে ও ছোট্ট একটা আঘাত পাবে। সেই আঘাতই ওকে ওর আসল জীবনটাকে মেনে নিতে বাধ্য করবে। ‘

‘ ওর জন্য অন্য একটা মেয়ের জীবন কেন নষ্ট করব প্রাচী? আমি তো নিধির মতো স্বার্থপর নই। আমি ওর মতো অজ্ঞ বা প্রতারকও নেই। ‘

‘ নষ্ট কেন করবি? বিয়ে করবি, বউকে ভালোবেসে সংসার সাজাবি। সুখে থাকবি। ‘

আইয়াজের কথা শুনে হোহো করে হাসল সৌধ। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,

‘ এ জীবনে কী এটা সম্ভব আর? ‘

প্রাচী বলল,

‘ এই পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তুই আমাদের কথা শোন সৌধ। আমরা আজ নিধির সঙ্গে দেখা করে বলব, তোর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। সামনে মাসে বিয়ে। ‘
.
.
পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল সিমরান। গলার স্বর উঁচিয়ে এক নাগাড়ে ডাকল,

‘ আন্টি, আন্টি, কোথায় তুমি? ‘

ভেতর থেকে ছুটে এলেন তানজিম চৌধুরী। দেখলেন হাঁপাচ্ছে সিমরান। চোখ মুখের অবস্থা বিধ্বস্ত! ত্বরিত পায়ের গতি বাড়িয়ে সিমরানের মুখোমুখি হলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে গাল স্পর্শ করে বললেন,

‘ কী হয়েছে সিনু মা? এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন! কোথায় থেকে আসলে তুমি? ‘

মুহুর্তেই থমকে গেল সিমরান। আশপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল তার ভাই আর ভাইয়ের বন্ধুদের। স্মরণ করল ঘন্টা খানেক আগের ঘটনা –
***
ঘুম থেকে ওঠে ব্রাশ হাতে নেয়া মাত্রই সিমরান জানতে পারে সুহাস তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। গতকাল বেশ রাত করে ঢাকা থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরেছে। সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে যাচ্ছে? মেজাজ খারাপ হলো মেয়েটার। ছুটন্ত পায়ে নিচে এসে ভাইয়ের পথ রোধ করল। কোমরে দু-হাত রেখে রাগান্বিত স্বরে শুধাল,

‘ আমার সাথে দেখা না করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? নামীপুর কাছে নিশ্চয়ই নয়? ‘

চিন্তান্বিত মুখেই কিঞ্চিৎ হাসল সুহাস। হাত বাড়িয়ে বোনের এক গাল ছুঁয়ে বলল,

‘ সরি’রে। দেখা করার সময় পাইনি। নামীর ওখানে যাই না জানিসই তো। আমি সৌধদের বাড়ি যাচ্ছি। আয়াজ, প্রাচীও আসছে। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সিমরানের। কোমর থেকে হাত নামিয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াল। সৌধর নাম নেয়াতে বিচলিত হলো কিঞ্চিৎ। আবার কিছু হলো না তো? প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তা নিয়ে মনের প্রশ্ন মুখে তুলল,

‘ কিছু হয়েছে? সৌধ ভাই আবার পাগলামি করছে? ‘

সময় কম তবু বোনকে প্রশ্নের উত্তর দিল,

‘ সৌধর কিছু হয়নি। হয়েছে নিধির। ‘

আকস্মিক কথায় বুক ধক করে ওঠল সিমরানের। আঁতকানো কণ্ঠে বলল,

‘ কী হয়েছে নিধিপুর! ‘

সুহাস পা বাড়াল সদর দরজার দিকে। সিমরান পাশে হাঁটতে হাঁটতে আকুতির সুরে বলল,

‘ ব্রো প্লিজ বলে যাও আমাকে, নয়তো টেনশন হবে খুব। ‘

গাড়ির দিকে এগুতে এগুতে ত্বরিত স্বরে সুহাস বলল,

‘ আর বলিস না আমাদের প্ল্যান ছিল শুক্রবার সবাই মিলে সৌধদের বাড়িতে যাব। আংকেল, আন্টি গোপনে ইনভাইট করেছে। সৌধর বাড়ি থেকে মেয়ে দেখছে ওর বিয়ের জন্য৷ কিন্তু ফা জিলটা এই নিয়ে অশান্তি করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। থামাথামির আর নাম নেই৷ গত সপ্তাহে ভাঙচুর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল, ফিরেছে মাঝরাতে নেশাগ্রস্থ হয়ে। ভাব একবার আংকেলের সম্মানটা কোথায় নিয়ে ঠেকিয়েছে ও? এজন্যই আংকেল আমাকে অনুরোধ করেছিল একদিন যেন সময় দেই। আন্টি ফোন করে অনুরোধ করে আয়াজ, প্রাচীকেও সঙ্গে নিতে। অনেকদিন পর সবাইকে একসাথে পেলে সৌধর মন হালকা হবে। পাশাপাশি সৌধকে আমরা বোঝাতে পারব, গুড সাজেশন দিতে পারব। কারো জন্য কারো লাইফ থেমে থাকে না তো বল? ‘

কথার সমাপ্তি দিয়ে গাড়িতে ওঠে বসে সুহাস। ডোর লাগাতে নিলে সহসা সিমরান বাইরে থেকে টেনে ধরে৷ সুহাস খেয়াল করে সিমরান থরথর করে কাঁপছে। সাধারণত প্রচণ্ড ক্রোধে আর ভয়ে শরীর কাঁপে সিমরানের। এ মুহুর্তে ভয় পাওয়ারই বা কী হলো, রাগেরই বা কী হলো? বোধগম্য হলো না সুহাসের। শুধু হাত বাড়িয়ে বোনের গাল ছুঁয়ে বলল,

‘ ঠিক আছিস তুই? ‘

‘ না নেই! ‘

তীব্র রোষানলে ফেটে পড়ল সিমরান। সুহাস ভয় পেয়ে গেল। আশ্চর্য মুখে তাকিয়ে বলল,

‘ এমন করছিস কেন? ‘

নিমেষে নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেল সিমরান। চোখ বুজে কিয়ৎক্ষণ বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ খুলল। থমথমে কণ্ঠে বলল,

‘ তোমরা সৌধ ভাইকে বিয়েতে রাজি করাতে যাচ্ছ?’

‘ হ্যাঁ। কিন্তু আরেক বিপদ ঘটে গেছে। ‘

হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে সিমরান জিজ্ঞেস করল,

‘ নিধিপুর কী হয়েছে? ‘

‘ অর্পণ স্যারের সাথে ওর বনিবনা নেই তেমন। শুনলাম দোষ নিধিরই। স্যার যথেষ্ট ভদ্র আর ভালো মানুষ। ওই মানাতে পারছে না৷ এদিকে প্র্যাগ্নেসিরও সাড়ে পাঁচ মাস চলছে। গতকাল মাঝরাতে নাকি তুমুল ঝগড়া করেছে জামাই, বউ মিলে। এক পর্যায়ে নিধি সেন্স লেস হয়ে যায়। প্রাচী গতকাল নামীদের বাসায় ওঠেছে। কথা ছিল আজ আমাদের বাড়ি আসবে, কাল সবাই মিলে সৌধদের বাড়ি যাব৷ কিন্তু নিধি হসপিটালে ভর্তি। তাই আজই যেতে হবে। ‘

‘ কেন যেতে হবে? ‘

সিমরানের মাথা ঘুরছে। একদিকে সৌধ ভাইয়ের বিয়ের তোড়জোড়। অন্যদিকে নিধি আপুর অসুস্থতায় সবাই মিলে সৌধ ভাইয়ের কাছে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বুকের ভেতর তিতকুটে অনুভূতি হলো ওর। সুহাস বলল,

‘ বাকি কথা পরে বলব বোন। এখন যেতে হবে। ‘

আর অপেক্ষা করল না সুহাস। ডোর লক করে গাড়ি স্টার্ট করল। সিমরান নিশ্চল দেহে, শূন্য মস্তিষ্কে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক পল। এরপর আচমকা সম্বিৎ ফিরতেই ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। তাকে এক্ষুনি তৈরি হতে হবে। যেতে হবে চৌধুরী বাড়িতে।
***
সবটা স্মরণ হতেই দু-চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়ল সিমরানের। তানজিম চৌধুরী হকচকিয়ে গেলেন৷ হঠাৎ কী হলো মেয়েটার? এভাবে কোথায় থেকে ছুটে এলো? এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেন? কাঁদছেই বা কেন? বাবা, মায়ের সাথে আবার মান, অভিমান হয়নি তো? সুহাস তো কিছু বলল না এ ব্যাপারে। চিন্তিত মুখে সিমরানের চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন তিনি। বললেন,

‘ আমার সিনু আম্মাটার কী হয়েছে শুনি? ‘

কথাটা বলতেই আচমকা তানজিম চৌধুরীকে জাপ্টে ধরল সিমরান। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আমি কি পাত্রী হিসেবে খুব খারাপ আন্টি? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৩৭+৩৮

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৭|
মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে ফোন কেটে দিল সুহাস। তার রাগের মাত্রা দেখে নামীর বুকে ধুকপুক শুরু হলো। এতক্ষণ সুহাস কথা বলছিল আর সে পাশে বসে সমস্ত কথা শোনার এবং বোঝার চেষ্টা করছিল। যতটুকু বুঝল সিমরানকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। এটা নিয়েই অশান্তি করেছে সিমরান। অশান্তির মাত্রা কতখানি টের পেল নামী। কারণ আর কেউ না জানলেও সে জানে। মেয়েটা একগুঁয়ে স্বভাবের। সৌধ ভাইয়ের প্রতি মেয়েটা গভীর প্রণয়ে আসক্ত। সৌধর জীবনে যে ঝড় এসেছে এই ঝড় থামাতে সিমরানের এক বুক ভালোবাসাই যথেষ্ট। যদি সৌধ সুযোগ দেয়। এতদিন ভয় পেলেও এখন নামী মন প্রাণ দিয়ে চায় সৌধের সঙ্গে সিমরানের জুটি মিলুক। এজন্য সুহাসের সাহায্য দরকার। সাহায্যের আগে সুহাসকে জানানো দরকার সিমরান সেই কিশোরী বয়স থেকে এক সৌধতে মত্ত। ভীষণ ভালোবাসে মেয়েটা। যে ভালোবাসা সমুদ্রের অতল গহ্বরের চেয়েও গভীর। নিধি আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। নিয়তি বা পরিস্থিতি যে কারণেই হোক সৌধর জীবনে সিমরানের আগমনের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছে নিধি আপু। আর কোনো বাঁধা নেই, দোটানা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। সুহাসের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ মাথা ঠান্ডা করো সুহাস। ‘

নামী ভেবেছিল এবার সিমরানের সত্যিটা জানাবে৷ কিন্তু তার আগেই সুহাসের রোষানলের শিকার হলো।

‘ শাটআপ! ‘

ধমকে ওঠল সুহাস। নামী কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,

‘ আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? আমি কী করেছি? ‘

আকস্মিক সমস্ত ক্রোধ নামীর ওপর ঝেড়ে ফেলল সুহাস। প্রচণ্ড জোরে দেওয়া ধমকটি নামীর দেহ ছাড়িয়ে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলল। ফলে আপনাআপনিই জল গড়াল চোখ বেয়ে। সুহাসের সেদিকে হুঁশ নেই। তার একমাত্র আদরের বোন। তার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়েছে। বাবা, মা সিমরানের বিয়ের কথা ভাবছে। অথচ সে জানে না। মেয়েটা বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত কিনা, ওর কাউকে পছন্দ কিনা এসবও জেনে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল সুহাস। তীব্র ক্রোধে নাক, কান রক্তিম বর্ণ ধারণ করল তার। ধমক খেয়ে স্তব্ধ নামী কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সুহাসের অবস্থা দেখে পিঠে হাত বুলালো। নিচু আর নরম গলায় শুধাল,
‘ সুহাস, প্লিজ শান্ত হও। ‘

দু’হাতে কপাল থেকে চিবুক অবধি জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিয়ে লম্বা শ্বাস নিল সুহাস৷ বলল,

‘ বাড়িতে প্রচুর অশান্তি হয়েছে। ভাঙচুর করেছে সিনু। আমাদের আজই ফিরতে হবে নামী। ‘

চমকে ওঠল নামী। আজই ফিরতে হবে? তারা তো হানিমুনে এসেছে। এভাবে ভেঙেচুরে হানিমুন বরবাদ করে চলে যাওয়ার মতো সত্যিই কি কিছু ঘটেছে? তাছাড়া আজ তো আইয়াজ ভাই আর ফারাহর বিয়ে হবার কথা। সুহাস কি ভুলে গেছে এসব? গোপনে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নামী বলল,

‘ কিন্তু আজ তো আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে। কীভাবে ফিরে যাব আমরা? ‘

তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সুহাস। ওরা বসেছিল বীচের কাছাকাছি একটা রেষ্টুরেন্টে। লোক সমাগম কম তবু দু’একজন ছিল। রাগ ওঠলে সুহাসের মাথার ঠিক থাকে না৷ তাই মায়ের রাগ নামীর ওপর খাঁটিয়ে দিল,

‘ তোমার যেতে সমস্যা থাকলে আমি একাই যাব। বোনটা তো আমার। দায়দায়িত্ব, দরদ সবটাও আমার। তুমি বুঝবে কী করে আমার অনুভূতি? ‘

‘ সুহাস, কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ! ‘

রেষ্টুরেন্টের কাছাকাছিই ছিল সৌধ। আইয়াজ, ফারাহর ছবি তুলে দিচ্ছিল সে। হঠাৎ সুহাসের চড়া গলা শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসে। সুহাসকে রাগান্বিত দেখে আর নামীর সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখে এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে ধমক দেয়,

‘ কী ব্যাপার তোর! ওকে ধমকাচ্ছিস কেন? লোকজন দেখছে সুহাস রাগ কন্ট্রোল কর। শান্ত হয়ে বসে বল সমস্যা কী? ‘

সহসা ওঠে দাঁড়াল নামী। কান্না প্রায় মুখ করে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে একছুটে রিসোর্টে চলে গেল। পিছন থেকে ফারাহ ডাকল কয়েকবার। নামী শুনল না। দূর থেকে দেখা গেল চোখের পানি মুছতে মুছতে ত্বরিত বেগে হেঁটে চলে যাচ্ছে মেয়েটা।
.
.
বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বেশ মন দিয়ে শুনল সৌধ। প্রচণ্ড অবাক হলো সে। উদয়িনী আন্টি এত তাড়াতাড়ি সিনুর বিয়ের কথা ভাবার মতো মানুষ নন৷ তাহলে হঠাৎ এই ভুত কে চাপালো তার মাথায়? আর সামান্য একটি বিষয় নিয়ে সিনুই বা এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাল কেন? বিয়ে না করলে না করবে। তাই বলে ভাঙচুর করে নিজে আহত হবে? এই মেয়েটা যে সত্যি ভাইয়ের ফটোকপি এতে একবিন্দু সন্দেহও নেই। বিস্মিত মুখে সুহাসের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিল সৌধ। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল সুহাসের কথায়,

‘ দোস্ত আমাকে এক্ষুণি ফিরতে হবে৷ এদিকটা তুই ম্যানেজ করে নিস প্লিজ। ‘

হাসফাস চিত্তে ওঠে দাঁড়াল সুহাস। মুহুর্তেই তার হাত টেনে বসিয়ে দিল সৌধ। কঠিন মুখে বলল,

‘ তুই কোত্থাও যাবি না। যাব আমি। ‘

‘ হোয়াট! ‘

‘ ইয়েস ব্রো। হানিমুনে এসেছ হানিমুন করো ওদিকটা আমি সামলে নিব। ‘

‘ আমার বোন হসপিটালে ভর্তি সৌধ! ‘

চ্যাঁচিয়ে ওঠল সুহাস৷ সৌধ নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর কাঁধে হাত রেখে শীতল কণ্ঠে জবাব দিল,

‘ আমার বোনটা রিসোর্টে গিয়ে চোখের জল ফেলছে সুহাস। ‘

উদ্যমি চিত্ত আকস্মিক নিরুদ্যম হয়ে গেল। চঞ্চল দৃষ্টি হলো অঞ্চল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। বলল,

‘ নামী বুঝদার সৌধ। ওকে আমি ম্যানেজ করে নিব।’

‘ তুই বুঝদার নোস সুহাস৷ তাই অবুঝতা করছিস। ওদিকের খবর নিয়েছি আমি৷ সিনুকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। পায়ে লেগেছে, ব্যান্ডেস করে দিয়েছে দ্যাটস ইট। বাকি যা সমস্যা দেখে নিব আমি। মাত্র ক’টা দিন ছুটি৷ তুই নামীকে সময় দে দোস্ত। ভালোবাসা পেয়ে যাওয়া মানেই ইট’স ওকে নয়। ভালোবাসা পাওয়া মানে যত্নের সঙ্গে তা রক্ষা করা। অবহেলা, অনাদরে ভালোবাসা হারাতে নেই সুহাস৷ যা পেয়েছিস তা আগলে রাখতে শেখ। ‘

‘ কিন্তু সিনু…’

‘ ব্যাপারটাকে তুই একটু বেশিই জটিল করছিস। ‘

‘ ওর কারো সাথে রিলেশনশিপ আছে সৌধ। ‘

‘ না নেই। ‘

‘ হয়তো আছে আমরা জানি না। নয়তো এমন কিছু কেন ঘটাবে? ‘

‘ তোর বোন সম্পর্কে তোর চেয়েও আমি জানি। কার সাথে মিশছে, কখন কোথায় আড্ডা দিচ্ছে সব আপডেটই পাই। এমনভাবে পাই মনে হয় বোনটা তোর না আমার। ‘

এক চিলতে বাঁকা হাসির দেখা মিলল সৌধর অধর কোণে৷ সুহাস পুনঃপুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ কী করব আমি এখন আমি? ‘

‘ তুই বউয়ের সঙ্গে এনজয় করবি। আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে দিবি। আমি এক্ষুনি রওনা দেব। ‘

কৃতজ্ঞতায় বুক ভার হলো সুহাসের। সৌধর বুকে মৃদু কিল বসিয়ে ওঠে দাঁড়াল। দাঁড়াল সৌধও। এরপর আচমকা সুহাস তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,

‘ তুই শুধু বন্ধু না সৌধ তুই আমার ভাই। ‘

ওদের কথোপকথন শেষে আইয়াজকে ফোন করল সৌধ। বলল,

‘ আমি ব্যাক করছি দোস্ত। ইমিডিয়েটলি ব্যাক করতে হচ্ছে আমাকে। সরি ভাই, তোর বিশেষ দিনটায় পাশে থাকতে পারলাম না। ‘

আকস্মিক সৌধর সিদ্ধান্তটি সুহাসের মনে দানা বেঁধে থাকলেও আইয়াজ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ ভোরবেলা প্রাচীর দেয়া বার্তাটি দেখেছে সে৷ আর সেই থেকেই হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছিল তার। তাই হঠাৎ সৌধকে ব্যাক করতে হবে জেনে মন খারাপের পাশাপাশি একটু খুশিও হলো। উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নয়তো সৌধ থেকে গেলে কোনোভাবে যদি নিধি আর অর্পণ স্যারের মুখোমুখি হয়ে যায়। সেই বীভৎস মুহুর্তটুকু নিয়ে আর ভাবতে চাইল না আইয়াজ। বলল,

‘ সাবধানে যাস। ‘

সৌধ বাঁকা হাসল। যেন টের পেল আইয়াজের মনোভাবনা। বেইমানদের সহ্য করা গেলেও বেইমান তৈরির মেশিনদের সহ্য করা যায় না৷ সৌধর কাছে অর্পণ স্যার বেইমান তৈরির মিশনের মতো৷ যার মুখ দর্শন করতে ভয় হয় তার৷ না জানি তার দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায় মেশিনটা। খু ন হয়ে যায় অর্পণ স্যার! না জানি বিধবা রূপে ধরা দেয় তার আগুনপোকা নিধি!
.
.
|চলবে…|

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৭| (বর্ধিত অংশ)

গভীর নিস্তব্ধ রজনী। স্পষ্ট সমুদ্রের গর্জন শুনা যাচ্ছে। চারদিক থেকে শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে কয়েকটা মানব শরীর। পাতলা ফিনফিনে শাড়ি পরিহিত রমণী হিম বাতাসে থেকে থেকে শিউরে ওঠছে। শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ছে তার৷ পাশে দাঁড়িয়ে আছে রমণীটির অর্ধাঙ্গ। বউয়ের
নাজুক অবস্থা দেখে লম্বাটে দেহখানা গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল,

‘ এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে কমপ্লিট। তারপর রুমে চলে যাব। ‘

সুহাসের নরম স্বরে বিগলিত হলো নামী। চোখের ইশারায় বোঝাল,

‘টেনশন করো না। আমি ঠিক আছি। ‘

মন মানল না সুহাসের। নামীর হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিল। গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চুপ। নামীও জড়োসড়ো হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ওদের সঙ্গে আরো কয়েকজন সদ্য পরিচয় হওয়া মানব, মানবি রয়েছে। যারা আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে উপলক্ষে সাহায্য করতে এসেছে৷ এরা সৌধর পরিচিত। মধ্যরাতে কাজী সাহেবও উপস্থিত। মোটা অংকের টাকা দিয়ে ঠিক করা হয়েছে তাকে। আজকের সব আয়োজন সৌধরই পরিকল্পনা। বলা যায় বন্ধু আইয়াজের বিয়ের উপহার এটি৷ এমন স্মরণীয় একটি উপহার কেবল সৌধর মাথা থেকেই আসা সম্ভব। সমুদ্রের কাছাকাছি বালুচরের ওপর গোলাকৃতির একটি টেবিল ঘিরে তিনটে চেয়ার রাখা। যার দু’টিতে বসে আছে আইয়াজ, ফারাহ। আর একটিতে কাজী সাহেব৷ বিয়ে পড়ানো শুরু করতেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করল ফারাহ। কাজী সাহেব ভ্রু কুঁচকে একবার আইয়াজের দিকে তাকাল তো আরেকবার সুহাসের দিকে। বলল,

‘ জবরদস্তি করে বিয়ে পড়ানো ঠিক না। বিয়ে কবুল হয় না৷ ‘

সুহাসের কপালে ভাঁজ পড়ল। আইয়াজ আহত চোখে একবার কাজী আর একবার ফারাহর ভীত মুখের দিকে তাকাল৷ নতুন বরের করুণ দশা দেখে সুহাস মিটিমিটি হাসল। নামীকে ইশারায় বলল ফারাহর কাছে যেতে। সঙ্গে সঙ্গেই নামী ফারাহর পাশে এসে ওর কাঁধ স্পর্শ করল। অভয় দিয়ে কাজী সাহেবকে বলল,

‘ আসলে ও নার্ভাস ফিল করছে। ‘

কথাটা বলেই ফারাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ বি স্ট্রং ফারাহ। আজ তোর জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। তোদের পাঁচ বছরের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে আজ দোস্ত, ভাবতে পারছিস? ‘

কেঁপে ওঠল ফারাহ। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে তাকাল আইয়াজের পানে। মৃদুমন্দ বাতাসে মৃদু আলোয় প্রিয়জনের আকুল দৃষ্টি দেখে বুক ধুকপুক করে ওঠল৷ নিমেষে দৃষ্টি সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নামী কাজীকে ইশারা করল বিয়ে পড়াতে। পাঁচ বছরের ভালোবাসা! ঢোক গিলল কাজী সাহেব। ভালোবাসাবাসির বিয়ে তাহলে… মধ্যরাতে অদ্ভুত বিয়ের আয়োজন দেখে সন্দেহ হচ্ছিল তার। ভেবেছিল মেয়েটাকে জোর করে তুলে আনা হয়েছে। সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলে নিশ্চিন্ত মনে বিয়ে পড়ানো শুরু করল। বিয়েটা সুসম্পন্ন হতেই দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে ওঠল ফারাহ। উপস্থিত সকলে হতভম্ব। নামী তৎক্ষনাৎ পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল। আসলে ওর অনুভূতি একমাত্র নামীই বুঝতে পারল। আইয়াজও বুঝল কিছুটা তবে পুরোপুরি নয়। সে শুধু আহত চোখে, নির্বাক মুখে বসে রইল চুপচাপ। অনেকটা সময় নিয়ে ফারাহ শান্ত হলে আকস্মিক সবাই মিলে আতশবাজি ফোটাতে শুরু করল। নামী সুহাস সহ সকলেই একসুরে বলে ওঠল,

‘ মাঝরাতে সমুদ্রপাড়ে একজোড়া লাভ বার্ডের বিয়ে সম্পন্ন হলো। হাউ রোমান্টিক! ‘

আর পাঁচটা স্বাভাবিক, সাধারণ বিয়ের মতো বিয়ে নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, অনন্য দৃশ্যপটে বিয়ে হলো আইয়াজ, ফারাহর৷ পূর্ণতা পেল দু’টো আকুল হৃদয়। যে প্রণয়ে সার্বক্ষণিক ভয় জেঁকে ছিল সে প্রণয় পরিণয় পেল। মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যপট তৈরি করল কক্সবাজার সমুদ্র পাড়ে। বিয়েটা যেমন আর পাঁচটা স্বাভাবিক, সাধারণ নয় বাসরটাও অসাধারণ ভাবে করল ওরা৷ বদ্ধ, নিস্তব্ধ ঘরে বিছানায় শরীর বিছিয়ে শরীর ছুঁয়ে নয় এই নব দম্পতির বাসর হলো সমুদ্র পাড়ে। বালুচর আর শীতল জলে পা ডুবিয়ে। একে অপরের হাতে হাত রেখে। কাঁধে মাথা ফেলে। সূর্যোদয়ের একটুক্ষণ পূর্বে দু’জনার আকুল হৃদয়ের টানে কিয়ৎক্ষণের জন্য দু’টো ঠোঁট অবশ্য এক হলো। সিক্ত হলো গভীর প্রণয় স্পর্শে…!
.
.
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৮|
আজ সকালে সূর্যের দেখা মেলেনি। থেকে থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে৷ প্রকৃতি অবসাদগ্রস্ত। সেই অবসাদ গ্রাস করে নিয়েছে সিমরানকেও। দু’পায়ে এখনো ব্যান্ডেজ মেয়েটার। কান্নাকাটি করে ফর্সা মুখ লালচে বর্ণে পরিণত হয়েছে। চোখ দু’টোও ফুলে আছে ভীষণ। সময় সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ মেয়ের ঘুম ভেঙেছে, উদয়িনী টের পেয়েছে ব্লুটুথ স্পিকারে গান শুনে। বাইরে থেকে অল্পস্বল্প শোনা যাচ্ছে সিমরানের ঘরে গান বাজছে। হিন্দি গান। যে গানে মিশে আছে বিরহ বেদনা। যে অনলে নিজে দগ্ধ হচ্ছে সে অনলে মেয়েকে দগ্ধীভূত হতে দেখতে চায় না বলেই বিয়ের তোরজোর শুরু করেছিল উদয়িনী। তবু যেন শেষ রক্ষা হলো না৷ ভালো করতে গিয়ে মন্দতে পরিণত হলো সব৷ বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে উদয়িনীর। মেয়ের জন্য নিজ হাতে সকালের নাস্তা তৈরি করতে নিচে নামে। এমন সময় আবির্ভাব ঘটে সৌধ চৌধুরীর। যা রীতিমতো বিস্মিত করে তুলে তাকে। সৌধ স্বভাবসুলভ সালাম দিয়ে মৃদু হাসল। উদয়িনী নিজের বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ তোমরা তো কক্সবাজার ছিলে! সাতসকালে কী করে এলে? ‘

‘ আমি গতকাল রাতেই ফিরেছি আন্টি৷ এদিকের খবর শুনে সুহাস টেনশন করছিল খুব। তাই বললাম আমি গিয়ে অবস্থা দেখি। সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করি৷ তোরা আস্তে ধীরেই আয়। ‘

সন্তুষ্ট হলো না উদয়িনী। যেখানে সুহাসের আসার কথা সেখানে শুধু সৌধ আসাতে মন কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তার ছেলের বউ প্রীতি এতটাই যে যে আদরের বোনের অসুস্থতার কথা জেনেও আসল না৷ দায় এড়াতে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিল। অন্য সময় হলে সৌধর উপস্থিতি তাকে খুশি করত কিন্তু আজ করল না। কারণ মনে মনে সৌধকে নিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখত তা আর এখন দেখে না। তবু পারিবারিক বন্ধুত্ব, ছেলের বন্ধু হিসেবে সৌজন্যতা দেখাল। সৌধকে বসতে দিয়ে নিজেও পাশে বসল। বাড়ির পরিস্থিতি জানালো, মা হয়ে সে মেয়ের মন পড়তে পারছে না৷ মেয়েটাও তাকে বন্ধু ভেবে নিজের যন্ত্রণা ভাগাভাগি করতে চাইছে না৷ বাবার সাথে যেটুকু সখ্যতা ছিল সেটুকুও এখন আর নেই। শুধুমাত্র না জানিয়ে তার জন্য পাত্রপক্ষ নিয়ে আসার ভুলে। সৌধ সমস্ত কথা শুনল৷ এরপর বুঝেশুনে প্রশ্ন করল,

‘ আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না আন্টি। সিনু সবেমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। অন্তত পক্ষে অনার্স কমপ্লিট করার পর তোমরা বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারতে। এত দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছ যে শুধু সিনু নয়, আমরা সবাই স্তব্ধ! ‘

এত দ্রুত সিমরানের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে দু’টো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো, উদয়িনীর চতুর বুদ্ধিমত্তা বলে, খুব শিঘ্রই চৌধুরী বাড়ি থেকে সিমরানের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসবে৷ কারণ সৌধর মা তানজিম চৌধুরী সিমরানকে খুবই পছন্দ করে। এছাড়া খবর পেয়েছে সুজা চৌধুরী ভাবছেন ছোটো ছেলের বিয়ের ব্যাপারে৷ ব্যস্ততা কাটিয়ে পারিবারিক ভাবে বসবেনও তারা৷ এই পারিবারিক আলোচনায় সোহান খন্দকারও থাকবেন৷ সোহান কেমন মানুষ জানে উদয়িনী। তাই সেই অঘটন ঘটার আগেই স্বামীকে নিজের কিছু দুর্বলতা দিয়ে ঘায়েল করেছে। রাজি করিয়েছে সিমরানের জন্য ভালো পাত্র দেখতে৷ সব ঠিকঠাক চলছিল। মাঝে বেঁকে গেল সিমরান। কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা বুঝতে পারছে না৷ এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি সিমরান। শতবার প্রশ্ন করা শেষ। অথচ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে মেয়েটা৷ না প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে আর বা ভালো, মন্দ কিছু বলছে। সে যেন নির্বাক বনে গিয়েছে। আর এর জন্য দায়ী তারা বাবা, মা দু’জন। সবচেয়ে বেশি দায়ী সে নিজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল উদয়িনী। সৌধর কথার বিপরীতে বলল,

‘ তুমি তো জানো বাবা তোমার আংকেলের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না৷ আত্মীয়, পাড়াপ্রতিবেশি সবার মাঝে আমাদের নিয়ে চর্চা হয়৷ ইদানীং তোমার আংকেলের সাথে সম্পর্কটির একটুআধটু উন্নতি হয়েছে। তাই ভেবেছিলাম ছেলেটা তো নিজেরটা বুঝে নিতে শিখেছে। মেয়েটা এখন যুবতী। খুব সরল মনের৷ আমরা দু’জন তো ওকে সময় দিতে পারি না৷ সারাক্ষণ একা একা থাকে। যদি বিয়ে দিয়ে একটা সঙ্গী জুটিয়ে দিই মন্দ হবে না৷ সিনু কেমন জানোই তো। ওর জন্য ভালো হবে। সবদিক দিয়ে ও স্যাটিসফাইড হবে এমন পাত্রই দেখছিলাম। ‘

সৌধ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে। উদয়িনীর কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ কপালে ভাঁজ পড়ল। নাকের এক পাশে তর্জনী দিয়ে চুলকে নিল আয়েশি ভঙ্গিতে। উদয়িনী আন্টির কথাতে গড়মিল স্পষ্ট। সে যে গড়মিল পেয়েছে বুঝতে দিল না। সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলল,

‘ সিনুর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল আন্টি। বিয়ে জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। হুট করে বিয়ের বিষয়টা সামনে আসাতে ওর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ‘

‘ বুঝতে পারছি। কিন্তু ওর রিয়াকশন ওভার ছিল। এতটাও কাম্য ছিল না। আমরা বিয়ে দিয়ে দিইনি। জাস্ট দেখতে এসেছে মাত্র। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সৌধর। ভাবুক কণ্ঠে বলল,

‘ তোমার কী মনে হচ্ছে ও কারো সঙ্গে সম্পর্কে আছে, কমিটেড? ‘

‘ সন্দেহ হচ্ছে, ভুলও হতে পারে। আসলে বাবা এ সময় সুহাসকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। সিনু আমার আর তোমার আংকেলের থেকেও সুহাসকে বেশি ভরসা করে। কিন্তু সুহাসের বোধহয় আমাদের জন্য সময় হবে না। ‘

শেষ বাক্যে ছেলের প্রতি কিছু অভিমান মিশে ছিল৷ সৌধ লক্ষ করল, ইদানীং উদয়িনী আন্টির অভিমান বেড়েছে। মানুষ যখন ধীরেধীরে বড়ো হয় তখন অভিমানও বাড়তে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট সময় তা স্থির রয়। আবার যখন বয়স বাড়ে, বৃদ্ধ হতে শুরু করে তখন অভিমানেরাও বৃদ্ধ হয়। উদয়িনী আন্টির অভিমান কি সেসবেরই ইঙ্গিত? কত আর বয়স হয়েছে তার? এ বয়সী নারীরা তো বৃদ্ধা তকমা পায় না। মনের ভাবনা মনেই রইল। মুখ ফুটে কিছু বলল না সৌধ। কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎ বলল,

‘ আমি কি সিনুর সঙ্গে কথা বলব একবার? ‘

চিন্তান্বিত মুখে উদয়িনী বলল,

‘ বলবে? দেখো গিয়ে। যতটুকু জানি তোমাকে খুব মানে ও। আমাদের তো কিছু বলে না। যদি তোমাকে বলে। ‘

উদয়িনীর কণ্ঠে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখার মতো ভরসা মিশে ছিল৷ সৌধ দু’কাঁধ মৃদু নাড়িয়ে ত্বরিত ওঠে দাঁড়াল। ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে পা বাড়াল উপরের দিকে। বলে গেল,

‘ অকে, আই সি। ‘

উদয়িনী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ত্বরান্বিত হয়ে সকালের নাস্তা তৈরি করতে লাগল৷ পাশাপাশি আফসোস হলো, সৌধ কেন নিধির প্রতি আসক্ত হলো? ছেলেটা যদি নিধির প্রতি দুর্বল না থাকত। তাহলে আজ এসব কিছুই ঘটত না৷ সে কখনোই সিমরানের জন্য অন্যত্র পাত্র দেখত না। এমন সময় হঠাৎ মন বলল, সিমরান যদি কারো সাথে সম্পর্কে থেকে থাকে। তাহলে পারিবারিক ভাবে সৌধর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আগাতে গেলেও তো একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো!
.
.
জানালার থাই গ্লাসে ভীড় জমিয়েছে অগণিত বৃষ্টিফোঁটা। সেদিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে সিমরান। স্পিকারে তখন গান বাজছে,
” এ হামনাভা, মুঝে আপনা বানা লে…
ছুখি পারি দিল কি ইছ জামি-কো ভিগা দে ।
হুমম… হু এ্যাকেলা, জারা হাথ বারহা দে…”

গানের লিরিক এ পর্যন্ত যেতেই দরজায় টোকা পড়ল। ভেসে এলো পুরুষালি মোটা, সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর,

‘ ক্যান আই কাম সিনু? ‘

থমকানো দৃষ্টি দুটো এক নিমিষে বারকয়েক পলক ফেলল। বিরস বদনে ভর করল বিস্ময়। পীড়িত চিত্তে চঞ্চল হলো। নিঃশ্বাস, প্রশ্বাসে বাড়ল অস্থিরতা। ম্রিয়মাণ বুকটায় অশান্তির ঢেউ ওঠল। ধুকপুক শব্দে মুখরিত হলো বক্ষগহ্বর। কার কণ্ঠ পেল? দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে? অস্থির হয়ে গান বন্ধ করে দিল। বদ্ধ উন্মাদের মতো এপাশ, ওপাশ তাকিয়ে ওড়না গলায় ঝুলালো। সৌধ ফের দরজায় টোকা দিল৷ সিমরান কান সজাগ করে শুনল সেই টোকা। সৌধ ফের বলল,

‘ কীরে আসব? ‘

আচমকা দৃষ্টিজোড়া টলমল হয়ে ওঠল৷ বুকের ভেতর থেকে উপচে এলো কান্না। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে শ্বাস রোধ করে ঠাঁই বসে রইল। প্রচণ্ড কষ্ট হলো কণ্ঠস্বর বের করতে। তবু উচ্চারণ করল,

‘ এসো। ‘

এসো বলেও শান্ত থাকতে পারল না। অস্থির, উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইল দরজার পানে। মুহুর্তেই দেখা মিলল, কালো রঙের টিশার্ট আর ধূসর রঙা প্যান্ট পরিহিত তাগড়া যুবকটির। যে ধীরেসুস্থে এগিয়ে এলো। আশপাশে তাকিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে থাকা কাঠের চেয়ার টেনে বসল তার পাশে। সিমরান আবেগে বিগলিত হলো। আন্দোলিত হলো তার ছোট্ট হৃদয়। বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইল মন৷ অবাধ্য ইচ্ছেরা বুকে তরঙ্গ বইয়ে দিল, একটিবার, শুধু একটিবার সৌধভাইকে জড়িয়ে ধরার জন্য। ঐ হৃষ্টপুষ্ট পুরুষালি বুকটায় ঝাঁপিয়ে পড়ার তৃষ্ণা জাগল খুব৷ হাউমাউ করে কান্না করতে ইচ্ছে করল। অভিযোগ জানাতে ব্যাকুল হলো মন।

‘ সৌধ ভাই জানো আব্বু, আম্মু আমার জন্য পাত্র দেখছে। আমাকে কয়েকজন অপরিচিত লোক এসে দেখে গেছে৷ আমি তো তোমাকে ভালোবাসি সৌধভাই। আমি তো তোমার বউ হতে চাই। ওরা কেন এমন করল কেন ওরা মন বিষিয়ে দিল আমার৷ আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই আমার ভাগিদার হতে দিব না৷ তুমি ছাড়া আর কাউকেই এই হৃদয়ে স্থান দিতে পারব না। ‘

ইশ অতিআবেগ মিশ্রিত, ছেলেমানুষি বাক্যগুলো মনে মনেই রয়ে গেল৷ তা আর বলার সাহস করে ওঠল না৷ আর না ওই বুকে মুখ গুঁজে নিজের কষ্টগুলো কমাতে পারল। কেবল অসহায়িনীর ন্যায় মুখ করে বসে রইল চুপচাপ। কী বিষাদগ্রস্ত ওই মুখ। ছোট্ট, সুন্দর মুখখানিতে কী গভীর মলিনতা! দু-চোখে এহেন দৃশ্য দেখে বড্ড খারাপ লাগল সৌধর৷ মনে মনে বলল ‘ সিনুর অবস্থা তো খুব খারাপ। আমাদের সন্দেহটাই ঠিক নাকি! ‘ মনে মনে এসব বলেকয়ে প্রকাশ্যে আচমকা বলে ফেলল,

‘ কীরে পিচ্চি সত্যি করে বল তো কার জন্য এই বিধ্বস্ততা? ‘

সহসা সচেতন হয়ে গেল সিমরান৷ বারকয়েক ঢোক গিলে স্বাভাবিক হয়ে নিয়ে বলল,

‘ মিথ্যা করে বলছি কারো জন্য না। ‘

‘ আমি মিথ্যা সহ্য করতে পারি না। ‘

‘ তুমি সত্যিটাও সহ্য করতে পারবে না। ‘

‘ পাকনি হয়ে গেছিস! পুতুলের মতো সুন্দর গালটায় আমার পাথুরে হাতের পাঁচ আঙুল বসার আগে সত্যি বল পাকনি। ‘

ম্লান হাসল সিমরান। বলল,

‘ তোমরা চলে এসেছ? ‘

‘ আমরা না আমি একা। ‘

‘ কেন? ‘

‘ তোর জন্য। ‘

বুকে গহিনে তীক্ষ্ণ ব্যথা লাগল বুঝি। হতভম্ব মুখে সরাসরি তাকাল সিমরান। সৌধ স্বাভাবিক ভণিতায় বলল,

‘ আমি না এলে তোর পাগলা ভাই বউ, হানিমুন সব কক্সবাজার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছিল। ওদিক যেন না ভাসে তাই আমি চলে এলাম এদিক সামলাতে। এদিক ঠিক থাকলেই ওদিক রক্ষা। ‘

কথা শেষ করে মৃদু হাসল সৌধ। সিমরান অপলকে তাকিয়ে দেখল, একটা ছেলের কথার ভঙ্গিমা কত সুন্দর হতে পারে। কী সুন্দর তার দিকে না তাকিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিজোড়া নাড়িয়ে, পেশিবহুল হাত এপেশওপেশ করে, ঠোঁটদ্বয়ে অমায়িক মৃদু হাসি বজায় রেখে কথা বলছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটি যেন এই মানুষটা। যার সর্বত্রেই চোখ ধাধানো সৌন্দর্য বিরাজ করে৷ এছাড়া সব পরিস্থিতি সামলানোরও ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে এই মানুষটার৷ ভাবতেই নিমেষে চমকে গেল। সত্যি কী তাই? সবার জীবনের কঠিন পরিস্থিতি সহজ, স্বাভাবিক করতে পারলেও মানুষটা কি পারে নিজের জীবনে আসা কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে? সেদিনের সেই দৃশ্য, সেই পরিস্থিতি এখনো ভুলতে পারেনি সিমরান। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো তার। শুনতে পেল পুনরায় সৌধর করা প্রশ্নবিদ্ধ বাক্যটি,

‘ সমস্যা কী বলত? প্রকাশ্যে তো বয়ফ্রেন্ড নেই, গোপনে আছে? ‘

অকপটে সিমরান জবাব দিল,

‘ না নেই। ‘

‘ তাহলে এখন বিয়ে করতে চাইছিস না? ‘

শ্বাসরোধ করে উত্তর দিল,

‘ না চাইছি না। ‘

‘ ওকে ফাইন করবি না৷ তাই বলে হাত, পা কে টে, ঘরকুনো, গুমরামুখো হয়ে বসে থাকতে হবে? আর কী গান শুনছিলি এসব গান শোনার বয়স এখন? ‘

সিমরানের বিষণ্নতা কেটে গেল অনেক। চোখজুড়ে ভর করল একরাশ মুগ্ধতা। সকাল সকাল স্বপ্ন দেখছে না তো? অপ্রত্যাশিতভাবে সৌধকে পেয়ে হৃদয় জুড়ে শিহরণ জেগে ওঠল। পলকহীন তাকিয়েই রইল মানুষটার দিকে। মুগ্ধতার রেশ কণ্ঠে মিশিয়েই বলল,

‘ তুমি কেমন আছো সৌধভাই? ‘

সহসা এহেন প্রশ্নে সৌধ একটু থমকাল। নতমস্তকে ঠোঁট কামড়ে একটুখানি ভাবার চেষ্টা করল, সে কেমন আছে? তৎক্ষনাৎ আচম্বিতে একটি মুখ ভেসে ওঠল দু-চোখের পাতায়। নাক জুড়ে চেনা শরীরী ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল সেই রমণীর। বুক আর মস্তিষ্ক জুড়ে কিলবিলিয়ে ওঠল একটি নাম, নিধি! কী আশ্চর্য! সে ভালো আছে কিনা ভাবতে গেলেও বেইমান নিধির মুখ ভেসে ওঠে। ওই মুখ, ওর ঘ্রাণ, ওই নাম সবই তীক্ষ্ণ ভাবে মনে করিয়ে দেয় সে ভালো নেই৷ কেন ভালো নেই? নিধি নামক প্রতারকের জন্য হাহ…।

সিমরান আকুল চোখে তাকিয়ে৷ সৌধ প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,

‘ শোন বিয়ে করবি না ইট’স ওকে। নো প্রবলেম, তোর বিয়ে হবে না৷ কেন হবে না, কীভাবে হবে না এসব আমার ওপর ছেড়ে দে৷ কিন্তু শর্ত আছে যা তোকে পালন করতে হবে। ‘

‘ কী শর্ত? ‘

সিমরানের কণ্ঠে বিস্ময়। সৌধ বাঁকা হাসল। যে হাসিতে ফের ফাঁসল সিমরান। তরুণিমাকে নিজের বাঁকা হাসিতে পুরোদস্তুর ফাঁসিয়ে তরুণ বলল,

‘ মন খারাপ করে থাকা যাবে না। সব সময় হাসি, খুশি থাকতে হবে৷ নিজের যত্ন নিতে হবে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করতে হবে। মন দিয়ে পড়তে হবে। আর যে কোনো সমস্যায় পড়লে তৎক্ষনাৎ আমাকে বা সুহাসকে জানাতে হবে। আর হ্যাঁ আন্টি, আংকেল না বুঝে ভুল করে ফেলেছে এটা নিয়ে সমস্ত রাগ, অভিমান ভুলে যেতে হবে৷ ক্লিয়ার? ‘

সৌধর কথার সমাপ্তি ঘটতেই সিমরান বাধ্য মেয়ের মতো মাথা কাত করল। সৌধ মাথা দুলিয়ে হেসে বলল,

‘ তুই আসলেই গুড গার্ল। সুহাস, আন্টি শুধু শুধু তোকে নিয়ে টেনশন করে। পায়ের অবস্থা কেমন হাঁটতে পারিস? ‘

প্রথম বাক্যদ্বয়ে ঠোঁট ফুলাচ্ছিল সিমরান। মা আর ভাই তার ইমেজ কতখানি নষ্ট করতে পারে জানে সে। কিন্তু শেষ বাক্যে সিরিয়াস হলো। বলল,

‘ ট্রাই করিনি। ‘

‘ আজ থেকে করবি। ওঠছি আমি, সাবধানে থাকিস।’

সৌধ ওঠতে উদ্যত হলে সিমরান ত্বরিত ডাকল,

‘ সৌধভাই? ‘

‘ হু? ‘

‘ আর একটু বসবে? ‘

ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে করা আবেদনটি ফেলল না সৌধ। মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই৷ নিজের জীবনে চলা সমস্যা গুলোর সমাধান তার কাছে নেই। কিন্তু অন্যের জীবনের সমস্যা গুলো কী অনায়াসেই সমাধান করতে পারে৷ এই যেমন সিমরানকে দেখে তার স্বাভাবিক লাগছে না। মেয়েটি ভয়াবহ বিষণ্নতায় ভুগছে। বর্তমানে ডিপ্রেশন শব্দটির ভয়াবহতা সম্পর্কে কারোরি অজানা নয়। আর সিমরান যে ধরনের মেয়ে। এই মেয়ে তীব্র বিষণ্ণতায় যা কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসল সৌধ। বলল,

‘ তোর যদি এখানে ভালো না লাগে আমাদের বাড়ি চলে যা। ওখানে আম্মা, তাহানীর সঙ্গে সময় কাটাবি ভালো লাগবে। ‘

‘ তোমার ছুটি কতদিন? ‘

‘ ছুটি আরো কয়েকটা দিন আছে। বাট আমি আগামীকালই চলে যাব। ‘

মুখটা কাচুমাচু হয়ে গেল সিমরানের। সৌধ খেয়াল করে বলল,

‘ আর কিছু বলবি? ‘

চট করে তাকাল সিমরান। অসহায় মুখ করে আবদার করল,

‘ একটা গান শুনাবে প্লিইজজ? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৩৫+৩৬

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৫|
সুগন্ধা পয়েন্টে তিনটে কাপল রুম ভাড়া করেছে সৌধ। যার দু’টিতে কাপল থাকলেও একটিতে সে একা থাকবে৷ বিষয়টা মজার নাকি আফসোসের? আফসোসের হওয়ার কথা থাকলেও মনের ওপর জোর প্রয়োগ করে মজার হিসেবেই নিল। বিলাসবহুল হোটেল রুমে বিরহ যন্ত্রণা বুকে পুষে কাটিয়ে দিল শেষরাত। সূর্যোদয়ের সময় গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিচের উদ্দেশ্যে। কেউ বিরহে নিদ্রাহীন কাটায় তো কেউ তীব্র অনুরাগে। নামী আর সুহাসের জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় রাত ছিল আজ। আজকাল সুহাসের ভালোবাসায় খুব যত্ন মিশে থাকে। সময়ের সাথে সাথে একটা মানুষ কতটা বদলায় সুহাস তার চাক্ষুষ প্রমাণ। এই দুষ্টু ছেলেটাকে নামী এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বলা যায় তার পুরো পৃথিবীটাই এখন একমাত্র বর সুহাসকে ঘিরে। প্রথম হানিমুনের প্রথম ঘনিষ্ঠতার পর সুহাস যখন কানে কানে ফিসফিস করে বলল,

‘ মিসেস সুহাসিনী, সমুদ্রপাড়ে একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখা কি বাকিই থাকবে? ‘

নামী নাজুক মুখে মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। বলিষ্ঠ বুকটায় মাথা রেখে গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ে। বলে,

‘ নো মিস্টার সুহাস, একে একে একসঙ্গে সব স্বপ্নই পূর্ণ করব। ‘

এরপরই বেরিয়ে পড়ে দু’জন। পথিমধ্যে সুহাস, নামীর সাথে দেখা হয়ে গেল সৌধর। সুহাস উৎফুল্লতার সঙ্গে বলল,

‘ আরে দোস্ত ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিস! ‘

‘ তো আর কী করব? আমার তো বউ নেই যে তাকে নিয়ে বেরুবো। ‘

আকস্মিক কথায় থতমত খেয়ে গেল সুহাস। সৌধর মনের অবস্থা কী? কতখানি যন্ত্রণা বুকে পুষে ছেলেটা তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সবই বুঝতে পারল৷ এ মুহুর্তে উচিত ছিল সিঙ্গেল ভাবে সৌধকে সময় দেয়া। কিন্তু সৌধর জেদেই কাপল হয়ে আসতে বাধ্য হলো। সুহাসের থমকে যাওয়া দেখে সৌধ হো হো করে হেসে ওঠে বলল,

‘ কী রে মুখ চুপসে গেল কেন তোর? দ্রুত পা চালা কাপল পিক তুলে দিব। ‘

দুই বন্ধুর কথোপকথন চলছিল এদিকে নামী প্রচণ্ড লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে রইল৷ কারণ, সে বুঝতে পারেনি সৌধর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। সাতসকালে তারা জামাই, বউ গোসল করে বেরিয়েছে। লজ্জা অবশ্য এটা নিয়ে পাচ্ছে না। লজ্জা পাচ্ছে তার ইয়া লম্বা, ঘন চুল গুলো ভেজা দৃশ্যমান বলে। লজ্জায় নিঃশ্বাস আঁটকে গলার ওড়না মাথায় তুলল চটপট। নামী লজ্জা পাচ্ছে টের পেয়ে সুহাস ওর গা ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,

‘ লজ্জা পাচ্ছ কেন? বন্ধু আমার ইজি থাকো। ‘

সৌধ খেয়াল করল সুহাস, নামী দু’জনেরই চুল ভেজা৷ ভোরবেলা সদ্য স্নান করে আসা কপোত-কপোতী। ভেবেই গোপনে হাসল সে। নামীর ভেজা চুল চুইয়ে পানি ঝড়ছে। ফলে কামিজের পেছনের অংশ ভিজে গেছে অনেকটা। ওড়না দিয়ে অর্ধেক চুল ঢাকা পড়লেও বাকিটা উন্মুক্ত। ত্বরিত
দৃষ্টি সরিয়ে নিল সৌধ। বন্ধুর বউ হলেও নামীকে সে নিজের বোনের চোখে দেখে। তাই ও লজ্জা পেয়েছে বুঝতে পেরে সুহাসকে বলল,

‘ তোরা যা আমি এদিকটার কিছু দৃশ্য বন্দি করে আসছি। ‘

একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখে কিছু সময় সমুদ্রপাড়ে কাটিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ সুহাসের নজর পড়ল একটি বাচ্চা মেয়ের দিকে। যে তার বাবা, মায়ের হাত ধরে বালুচরে হাঁটছে। প্রকৃতির শান্ত, স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মাখাচ্ছে। সকালবেলায় মিষ্টি রোদে এই মিষ্টি দৃশ্যটি দেখে আচমকা সুহাসের মন বিগলিত হলো। পাশে থাকা স্নিগ্ধ মুখের রমণীকে আকস্মিক ডাকল,

‘ নামী। ‘

ত্বরিত সে ডাকে তাকাল নামী। উত্তর করল,

‘ বলো? ‘

সুহাস চোখে ইশারা করে মিষ্টি পরিবারটিকে দেখাল। চোখেমুখে দীপ্তি ফুটিয়ে বলল,

‘ লেটস প্ল্যান অ্যা বেবি? ‘

হৃদয়ে যেন বিদ্যুৎ স্পর্শ করল নামীর! আকস্মিক কথাটির ধাক্কা সামলাতে না পেরে সুহাসের হাত ছেড়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে রইল সুহাসের পানে। সুহাস মিটিমিটি হাসতে হাসতে হাত দু’টো তার থ্রি কোয়াটার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল,

‘ কী সুইট না?’

নামী পুনরায় তাকাল। সত্যি সুইট। কিন্তু সুহাস কী বলল এটা? ভেবে বলল নাকি ঝোঁকের মাথায়? সে যাইহোক কথাটা তার হৃদয়ে লেগেছে। অদ্ভুত অনুভূতিতে গা শিউরে ওঠছে৷ কেমন যেন কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেটা আপনাআপনিই প্রকাশ হয়ে গেল। তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। কেন এমন হলো? কী ছিল সুহাসের কথাটিতে? অমন একটি কথা বলে সুহাসেরও মাথায় হাত। কী এমন অপরাধ হয়ে গেল হঠাৎ। যে নামী কাঁদছে? মুখটা পাংশু বর্ণে পরিণত হলো সুহাসের। দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে নামীর হাত চেপে ধরে বলল,

‘ সরি জান। মজা করছিলাম। আমরা নিজেরাই তো বেবি। আমাদের আবার কীসের বেবি প্ল্যান? ‘

এ কথায় আরো বেশি কান্না পেল নামীর। দু-চোখ উপচে পানি গড়াল অবিরত। সুহাস হতভম্ব মুখে তাকিয়ে নামীর হাত টেনে ধরে বলল,

‘ চলো ফিরে যাই। বকাঝকা, কান্নাকাটি সব রুমের ভেতর করবে। প্লিজ এখানে রিয়াক্ট করো না। এই সৌধটা কই চলে গেল। ‘

কথার ফাঁকে আশপাশে নজর বুলাল সে। দেখতে পেল একটু দূরেই সৌধ দাঁড়িয়ে। গলা ছেড়ে ডাকল তাই,

‘ এই সৌধ চল ফিরে যাই। আয়াজের খবরটা নিতে হবে তো… ‘

হোটেলে ফেরার পর নিজেদের রুমে ঢুকে সুহাসকে কিছু বলতে দিল না নামী৷ তার পূর্বেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে। বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদল কিছুক্ষণ৷ সুহাসের এত্ত মায়া লাগল যে কী করবে কী বলবে কিছুই ঠাওর করতে পারল না। ওর মনোভাব বুঝে নামী নিজেই মাথা তুলল। দু-হাত বাড়িয়ে সুহাসের সহজসরল মুখটায় আলতো করে চেপে ধরে ভাঙা কণ্ঠে বলল,

‘ আমাদের তো সংসার করা হয়নি সুহাস। কবে সংসার হবে আমাদের? ‘

এবারে মাথা খুলল সুহাসের। কান্নার কারণ তবে এটাই? কিয়ৎক্ষণ ভেবেচিন্তে নামীর হাত দু’টো চেপে ধরে ডান হাতের তালুতে চুমু খেল। এরপর হাত বাড়িয়ে নামীর চোখের অশ্রু কণাগুলো মুছতে মুছতে বলল,

‘ সিম্পল একটি বিষয় নিয়ে কেউ এভাবে কাঁদে পাগলী! ‘

সুহাসের হাতের কব্জি ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠল নামী। সুহাস আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘ প্লিজ নামী! ডোন্ট ক্রাই, আমরা সংসার করব। জাস্ট আর কয়েক মাস। আমার ইন্টার্নি শেষ হোক। তোমারো ফাইনাল ইয়ারটা কমপ্লিট হতে থাকুক। তুমি তো খেয়াল করেছ মা’কে। সে কতটা শান্ত, শীতল হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে এখন সব স্বাভাবিক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস খুব শিঘ্রই মা আমাদেরও মেনে নিবে। পুত্রবধূর অধিকার দিয়ে ঘরে তুলবে তোমাকে।’

সুহাসের কথাগুলো সত্যি না মিথ্যা জানে না নামী৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এতটুকু স্বান্তনা বাণীর খুব প্রয়োজন ছিল তার খুব।
.
.
দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে দরজা খুলল আইয়াজ৷ দেখতে পেল সৌধ দাঁড়িয়ে। মলিন হাসল সে। সরে গিয়ে বিমর্ষ কণ্ঠে বলল,

‘ আয়। ‘

রুমের ভেতর উঁকি দিয়ে সৌধ দেখল ফারাহ এখনো গভীর ঘুমে। বুঝল, ঘুমের ওষুধের রেশ এখনো কাটেনি। আইয়াজের চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে ঘুমায়নি। চোখের পাপড়ি দেখে পুরোপুরি বুঝে গেল, এই ছেলে কান্নাকাটি করেছে। ধীরপায়ে হেঁটে রুমের ভেতর প্রবেশ করল সৌধ। ভাবল, কান্নাকাটি করাটা কি স্বাভাবিক নয়? তার মতো শক্ত মনের পুরুষ যদি ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে মানতে না পেরে চোখে অশ্রু ঝড়ায় আইয়াজের মতো নরম মনের পুরুষ প্রেমিকার ধ র্ষিত হওয়ার গল্প শুনে কাঁদবে না? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ডিভানে বসতে বসতে বলল,

‘ পোশাকটাও পাল্টাসনি! আমি বসছি যা ফ্রেশ হয়ে নে৷ একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব। সুহাস, নামী ওয়েট করছে। ফ্রেশ হয়ে এসে ফারাহকে ডাকবি। ‘

সৌধর কথায় নিঃশ্বাস চঞ্চল হলো আইয়াজের। স্থির অচঞ্চল ছেলেটা আজ বড্ড অস্থির আর চঞ্চল হয়ে ওঠেছে। ফারাহকে এক সেকেণ্ডও চোখের আড়াল করতে নারাজ মন। কিন্তু এ মুহুর্ত সৌধ এসেছে। তাই ওর ওপর ভরসা করে ওয়াশরুম ঢুকল। ঢোকার পূর্বে অবশ্য বলে গেল,

‘ যদি ওঠে আমাকে ডাকবি। ‘

সৌধ বাঁকা হেসে বলল,

‘ এত টেনশন নিচ্ছিস কেন? যে ঘুম দিয়েছে না ডাকলে পাঁচ, দশমিনিটে ওঠার সম্ভাবনা নেই। চিল ম্যান। ‘

আইয়াজ ওয়াশরুম ঢোকার পর সৌধ নিজের ফোন ঘাটাঘাটি করছিল হঠাৎ ডিভানের এক কোণে আইয়াজের ফোনের স্ক্রিনে নজর পড়ল। প্রাচীর ম্যাসেজ এসেছে? ফোনটা যে অবহেলায় পড়ে আছে বুঝতে পেরে হাত বাড়িয়ে ফোন কাছে এনে লক ছাড়াল। সুহাস, আইয়াজের দু’জনেরই লক তার জানা। তাই অসুবিধা হলো না৷ আর এটাই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়াল। কারণ প্রাচী জানে না তারা কক্সবাজার এসেছে। প্রাচী কেন বন্ধুদের মধ্যে কেউই জানে না। প্রাচী লিখেছে,

‘ দোস্ত জানিস ডক্টর নাকি অর্পণ স্যারের হাওয়া বদল করতে বলেছে৷ শরীর ফিট হলেও মন নাকি ফিট না৷ তাই নিধি আর অর্পণ স্যার আগামীকাল বেড়াতে যাচ্ছে। শা লা আমাদের বন্ধুর মন ভেঙে নিজের মন ফুরফুরা করতে কক্সবাজার যাচ্ছে। আমার শরীর একবারে জ্বলে গেছে এসব শুনে। নিধিটার ওপর রাগ হয় আবার মায়াও হয়৷ শা লার পরিবারের চাপে মেয়েদের কত কীই করা লাগে উফফ। ‘

প্রাচীর প্রথম ম্যাসেজের পর সেকেণ্ড ম্যাসেজ ছিল,

‘ সৌধর কী অবস্থা দোস্ত? আম্মা অসুস্থ বলে আমি আর থাকতেও পারলাম না। তোরা ওকে দেখে রাখিস ভাই। আর শোন নিধি আর অর্পণ স্যারের ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও সৌধকে বলিস না৷’

তৃতীয় ম্যাসেজ,

‘ কীরে ছ্যামড়া রিপ্লাই করস না ক্যান? সৌধকে নিয়ে ব্যস্ত কি তোরা… শোন শোন আরেকটা কথা, সুহাসকেও ব্যাপারটা বলিস না। ওর তো আবার পেটে কথা থাকে না। মুখ ফস্কে বলে দিলেই বিপদ। ‘

ম্যাসেজ গুলো দেখা শেষে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল সৌধ৷ হাতের শক্ত মুঠোয় আইয়াজের ফোনটা নিয়ে ভয়াবহ এক আছাড় দিতে নিয়েও হঠাৎ থমকে গেল। নিজের কপাল দোষে অন্যের যন্ত্র কেন নষ্ট করবে কেন? হতাশ ভঙ্গিতে ফোন কিঞ্চিৎ দূরে ছুঁড়ে মেরে শরীর এলিয়ে দিল ডিভানে। মুখ হা করে শ্বাস নিল ঘনঘন। যেভাবেই হোক এই যন্ত্রণা থেকে বেরুতে হবে তার। যেভাবেই হোক ওই বেইমানটার মুখোমুখি হওয়ার আগে কক্সবাজার ত্যাগ করতে হবে। তার মাথায় যে খু ন চেপেছে এই খু নের শিকার অর্পণ স্যার হোক চায় না সে। কারণ সবশেষে নিধি বিধবা তকমা পাবে এটাও তার সহ্য হবে না। আনমনেই বাঁকা হাসল সৌধ৷ নিজের অশান্ত বুকে হাত বুলাতে বুলাতে বিরবির করে বলল,

‘ ভালোবাসা এক রহস্যময় অনুভূতি। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৬|
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ডিভান ফাঁকা দেখল আইয়াজ। নিমেষে ভ্রূদ্বয় কুঁচকে বিছানায় তাকাল। ফারাহর অবস্থা একই৷ মেয়েটা এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কুঁচকে যাওয়া ভ্রূদ্বয় ধীরেধীরে স্বাভাবিক করে নিল সে। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি প্রয়োজনে সৌধ বেরিয়ে গেছে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল পোশাক বের করতে। লাগেজ খুলে ধূসর রঙা একটি টি-শার্ট বের করে উদাম শরীরটা ঢেকে ফেলল চটপট। এরপর চোখে চশমা পড়ে বিছানায় এসে ফারাহর পাশে বসল। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল ওর ডান গালটায়। কিয়ৎক্ষণ উষ্ণ, নরম গালে নিজের হিম ধরানো হাতটা রেখে তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল সেইসব দিনগুলোকে স্মরণ করে। যেদিন গুলোতে ফারাহ সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে তাদের সম্পর্কে দূরত্ব বাড়ানোর। কতবার বিচ্ছেদ হয়েছে তাদের৷ কতবার ফারাহর মুখে শুনেছে,
‘ আয়াজ বিলিভ মি, আমি তোমার যোগ্য নই। ‘

মাঝেমধ্যে সে যখন রেগে গিয়ে বলত,
‘ তাহলে কেন এসেছিলে আমার জীবনে? আমি যতই প্রেম নিবেদন করি কেন গ্রহণ করলে? তুমি গ্রহণ না করলে আমি এগুতাম না। আমি ওই ধরনের ছেলে নই। গ্রহণ যখন করেছ ফা ল তু কারণ দেখিয়ে বর্জন করতে দিব না সরি। ‘

নরম মনের অধিকারী ফারাহ। নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা একেবারেই কম। তাই তখনো ঠিকভাবে বোঝাতে পারেনি আর না আইয়াজের প্রশ্নের যোগ্য জবাব দিতে পেরেছে। সেই মুহুর্তে শুধু কান্না ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেনি৷ আইয়াজও পারেনি তার জীবনে আশা প্রথম নারীকে কোনো মূল্যে হারাতে দিতে। বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আইয়াজের। গালে রাখা হাতটা আপনাআপনিই ফারাহর মাথায় চলে গেল। ধীরেধীরে পরমাদরে সে হাতে মাথা বুলাতেও শুরু করল। এভাবে কেটে গেল অনেকটা সময়। আইয়াজের ফোন বেজে ওঠল হঠাৎ। সুহাস কল করেছে,
‘ কীরে ভাই সেই যে ঢুকেছিস আর বেরুবি না? কাহিনি কী বল তো? বিয়ের আগেই হানিমুনের ওপর দিয়ে হানিমুন করে ফেললি না তো! ‘

বিমর্ষ মুখটায় কিঞ্চিৎ দীপ্তি ফুটল আইয়াজের৷ চোখে ভেসে ওঠল খানিকটা লজ্জা। মনে ভর করল এক চিলতে দুষ্টুমি। বন্ধুর টিপ্পনীতে ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল,

‘ ওটাত তুই করেছিস। আমি তোর মতো এত ফাস্টলি এগুতে পারি না দোস্ত। আমাকে স্লোলিই এগুতে হবে। ‘

হো হো করে হেসে ওঠল সুহাস। বলল,

‘ চাপাখানা আছে। ঢাকাইয়া পোলা তো চাপা দিয়েই বাজিমাত। ‘

মৃদু হাসল আইয়াজ বলল,

‘ ফারাহ তো ওঠছে না। কী করি বল তো? ‘

‘ ডাকছিস? ‘

‘ না, ভাবছি ডাকব। ‘

‘ না ডাকলে ওঠব ক্যামনে মাম্মা। তাড়াতাড়ি ডাক আর ঝটপট চলে আয় বুফে যাব। ‘

‘ মিনিট দশেক পর নামীকে পাঠিয়ে দিস। ‘

‘ ওকে, প্যাড়া নাই। ‘

ফোন রেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল আইয়াজ। ফারাহর ঘুম ভাঙার পর ঠিক কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে? ভাবতেই বুক ধুকপুক করে ওঠল। একই সঙ্গে কয়েকটা ধাক্কা খাবে মেয়েটা৷ নিশ্চয়ই সুখ, দুঃখ মিলেমিশে কান্না করবে খুব? নিজেকে সেই পরিস্থিতির জন্য তৈরি করে নিল আইয়াজ। ফারাহকে সামলে নেয়ার পুরো শক্তি অর্জন করে বুক টানটান করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর ডাকতে শুরু করল। যেইডাকে মিলেমিশে রইল, একচ্ছত্র আদর, প্রগাঢ় ভালোবাসা আর সীমাহীন সম্মান।

আধোঘুমে ফারাহ শুনতে পেল অতিপরিচিত এক মানুষের হৃদয়ে গাঁথা কণ্ঠস্বর। এত দরদ মেখে একজনই ডাকে। আইয়াজ! সাতসকালে আইয়াজ কীভাবে ডাকবে তাকে? নিশ্চিত ভ্রম। ভাবতেই হঠাৎ বুক ধক করে ওঠল। আচমকা দু-চোখ খুলে বড়ো বড়ো করে তাকাল সম্মুখের মানুষটার দিকে। মস্তিষ্কে হঠাৎ চাপ অনুভব করল গতকালকের কথা স্মরণ হতেই৷ সুহাস ভাই, সৌধ ভাই এসেছিল তাদের বাসায়। তার আর আইয়াজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সে তার আপার সঙ্গে কথা বলে কান্না করল এরপরই শুনতে পেল সুহাস ভাইরা চলে গেছে। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল তার৷ কী ভয়ানক এক যন্ত্রণায় বুক ভার হয়েছিল সারাদিন। মনের অসুখে সবকিছু বিষাদ লাগছিল। আইয়াজের সাথে শেষবারের মতো কথা বলতে ইচ্ছে করছিল খুব৷ কিন্তু কথা বলতে গেলেই ছেলেটা মাকড়সার জালের মতো প্যাঁচিয়ে ধরবে। বশ মানিয়ে ফেলবে এক মুহুর্তে। সেই ভয়ে বন্ধ ফোনটা আর খুলেওনি। সন্ধ্যাবেলায়ই আপার জোরাজোরিতে নাকে, মুখে ভাত ঢুকিয়ে শুয়ে পড়েছে। ভেবেছিল ঘুম হবে না৷ কিন্তু নাহ, ভাবনাটা ভুল। গভীর ঘুম হয়েছে। তাই তো প্রিয় মানুষটাকে স্বপ্নে দেখেছে, তার ডাক শুনেছে৷ এই তো চোখ খোলার পরও মানুষটার ভালোবাসাময় স্নিগ্ধ মুখটা দেখতে পাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে একটুখানি ছুঁয়ে দেবে কি? না না তাহলেই ভ্রম কেটে যাবে। স্বপ্ন ভেঙে যাবে।

‘ ফারাহ? অ্যাঁই ফারাহ, ঘুম ভেঙেছে? ‘

ইশ ছেলেটা এত মধুর সুরে ডাকে কেন তাকে? চোখ দু’টো টলমল হয়ে গেল। নিঃশব্দে, মৃদু হেসে চোখ বুজে নিল সন্তর্পণে। আইয়াজের কপালে ভাঁজ পড়ল। প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ত্বরিত কল করল সুহাসের ফোনে। রিসিভ হতেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,

‘ দোস্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোতে কোনো সমস্যা হলো না তো? ওর মন, শরীর দু’টোই তো খুব নরম৷ বেড এফেক্ট পড়ল না তো? ‘

আইয়াজের কথা শুনে সুহাসের কপালে ভাঁজ পড়ল৷ বলল,

‘ কেন বলত? ‘

সুহাসকে উত্তরটা দিতে পারল না আইয়াজ। কারণ তার কথা শুনে ইতিমধ্যেই শোয়া থেকে তড়াক করে ওঠে বসেছে ফারাহ। দু’হাতে চোখ ডলে বিস্ময়াপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আইয়াজের পানে। ভেবেছিল ঘুমের ঘোরে ভ্রম কিন্তু সুহাসকে বলা কথাটা শুনতেই ভ্রম না, স্বপ্ন না টের পায় ফারাহ। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চোখ খুলে ফোন কানে চেপে আইয়াজকে দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে। আইয়াজও চমকায়। ফারাহর ঘুম ভেঙেছে বুঝতে পেরে ফোন কেটে দেয়। মুখে ঈষৎ হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলে,

‘ গুড মর্নিং। ‘

মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে ফারাহ। ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে রয় কিয়ৎক্ষণ। এরপরই বৈদ্যুতিক স্পর্শ পাওয়ার মতো করে কেঁপে ওঠে। আইয়াজের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিলাসবহুল কক্ষে দৃষ্টি বুলায়। এরপর তাকায় বিছানার দিকে। মুহুর্তেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। কাচুমাচু হয়ে বলে,

‘ আমি কোথায়? তুমি কীভাবে আমার সামনে? ‘

বুকে শিহরণ জাগে আইয়াজের। ফারাহ ঘুমকাতুরে মুখটায় তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,

‘ আমরা কক্সবাজারে। ‘

‘ কীহহ! ‘

ফারাহর চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। আইয়াজের হাসি চওড়া হয়। বলে,

‘ গতরাতে তোমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ‘

স্তম্ভিত হয়ে যায় ফারাহর মুখ। আইয়াজ হাত বাড়িয়ে ওর গালে স্পর্শ করে। বলে,

‘ তোমার আপা সাহায্য করেছে আমাদের। ‘

তিন বন্ধু আপার সাহায্যে কীভাবে তাকে অপহরণ করল সেই গল্প শুনে ফারাহর মাথা ভনভন করতে লাগল। আপা সাহায্য করেছে মানে? গলা শুকিয়ে গেল তার। ভয় ভয় স্বরে বলল,

‘ আপা কেন সাহায্য করল? ‘

‘ আজ রাতে আমরা বিয়ে করব তাই। ‘

বুক কেঁপে ওঠল ফারাহর। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠল মুহুর্তেই। শরীরও কাঁপতে লাগল। আইয়াজ খেয়াল করে ওকে কাছে টেনে নিল৷ বুকে টেনে বলল,

‘ আমরা বিয়ে করব ফারাহ। ‘

এক ঝটকায় আইয়াজের বুক থেকে সরে গেল ফারাহ। দু’চোখে উপচে পড়ল বাঁধ ভাঙা অশ্রুজল। বলল,

‘ এটা সম্ভব নয় আয়াজ। আমি তোমাকে ঠকাতে পারব না। ‘

আইয়াজ কাছে চলে এলো। দু-হাত বাড়িয়ে ওর অশ্রুসিক্ত দুগাল স্পর্শ করে নরম কণ্ঠে বলল,

‘ বিয়েটা না করলে অবশ্যই ঠকাবে। ‘

আচমকা আইয়াজকে জড়িয়ে ধরল ফারাহ। কান্নারত গলায় বলল,

‘ তুমি বুঝতে পারছ না আয়াজ, তুমি বুঝতে পারছ না। আমি তোমাকে ঠকাতে চাই না। বিশ্বাস করো। ‘

একটু থেমে পুনরায় হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,

‘ আমি ভুল করে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার মতো শুদ্ধ পুরুষের ভালোবাসা গ্রহণ করেছি ভুল করে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার মতো অশুদ্ধ নারী তোমার যোগ্য না। ‘

ফারাহর কাঁধ চেপে সোজা করল আইয়াজ৷ চোয়ালদ্বয় শক্ত করলেও তার দৃষ্টি ঝাপসা। বলল,

‘ তুমি অশুদ্ধ না ফারাহ। ‘

লজ্জায় মূর্ছা গেল ফারাহ। আইয়াজ এখন শক্ত গলায় তার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসে যা বলছে তা সে ভাঙতে চায় না৷ কিন্তু না ভাঙলে যদি তাকে জীবনে জড়ায়? আর পরবর্তীতে আফসোস করে? ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকাল ফারাহ। কাঁপা স্বরে বলল,

‘ আমি একজন ধ…’

সহসা মুখ চেপে ধরল আইয়াজ। চোখ বন্ধ করে, শ্বাস রুদ্ধ করে বলল,

‘ চুপ! আমি সবটা জানি। গতকাল ফারজানা আপা সমস্ত কিছু জানিয়েছে সৌধকে। আর সৌধ জানিয়েছে আমাকে। দ্বিতীয়বার আর ও সম্পর্কে জানতে চাই না আমি। একেবারেই না। ‘

‘ আইয়াজ! ‘

অবিশ্বাস্য কণ্ঠ ফারাহর! আইয়াজ চোখ খুলল। সহসা তার দুগাল বেয়ে পড়ল দু’ফোটা অশ্রু। ফারাহ হুমড়ি খেয়ে ওর বুকে পড়ল। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করল,

‘ কী বলছ তুমি আইয়াজ! ‘

ফের বাঁধ ভাঙা কান্না। ফারাহ কোনোদিনও আইয়াজের চোখে তার জন্য ঘৃণা দেখতে পারবে না। তাই ভয় কাঁপতে থাকল। প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়েও রইল আইয়াজকে। আইয়াজ বুঝতে পারল তার যন্ত্রণা। এতগুলো বছর দেখছে মেয়েটাকে। মনের কথা বুঝতে পারবে না? তাই মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘ তোমাকে আমার আগে কে স্পর্শ করেছে এটা ইম্পর্ট্যান্ট নয় ফারাহ। ইম্পর্ট্যান্ট আমার পর কেউ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। ‘

ফারাহ ফুপাচ্ছে। বুক ফাটছে আইয়াজেরও। তবু মুখে বলল,

‘ কে নোংরা ভাবে তোমার শরীর ছঁয়েছিল এসবে আমার আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ তোমার ভালোবাসার প্রতি। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু এটাই ইম্পর্ট্যান্ট আমার কাছে। আমি চাই তোমার কাছেও জাস্ট এটুকুর ইম্পর্ট্যান্টস থাকুক ব্যস। ‘

পুরুষ জাতি কী? পুরুষ জাতি কেমন এর আর কোনো ব্যাখ্যা জানতে চায় না ফারাহ। আজ এইক্ষণে আইয়াজ, তার ভালোবাসার মানুষটির যেই রূপের সম্মুখীন হলো। এরপর আর এক মুহুর্ত এ পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস নিতে না পারলেও তার আফসোস থাকবে না। এতদিন সে জানত তার প্রেমিক পুরুষটি খুব ভালো, মনের, ভদ্র, সভ্য, প্রচণ্ড মেধাবী আর স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী৷ কিন্তু আজ স্বচক্ষে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করল তার প্রিয়তম মানুষ হিসেবে কতটা শ্রেষ্ঠ। প্রেমিকার ধ র্ষিতা হওয়ার অতীত জানার পর তাকে বউ করতে বুকে দম লাগে। আইয়াজের সেই দমটা আছে৷ এই দমটুকু নিয়েই ফারাহ কাটাতে চায় তার বাকি জীবন।
.
.
ভরদুপুরে মেকআপ বক্সের সেট ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছুঁড়ে মে রে আয়নাটা ভেঙে ফেলল সিমরান৷ ক্রোধে ফুঁসছে সে। শুধুমাত্র আয়না ভেঙেই ক্ষ্যান্ত হলো না৷ তীব্র জেদে ভাঙা কাঁচের টুকরো গুলোর ওপর দিয়ে হাঁটল দু’পা। ছুটতে ছুটতে দরজার সামনে এসেছে উদয়িনী৷ মেয়ের অমন অবস্থা দেখে করুণ আর্তনাদ করে ওঠেছে সে৷ সিমরানও দু’পায়ে কাঁচ ঢুকে ভয়াবহ রক্তপাত দেখে জ্ঞান হারিয়েছে মুহুর্তে। উদয়িনী চিৎকার দেয়ার পর পরই ছুটে এসেছে। প্রথমে মেয়ের রাগান্বিত হয়ে উপরে ওঠা এরপর স্ত্রীর আর্তনাদ। বুক কেঁপে ওঠে সোহান খন্দকারের। অতিথি বিদায় শেষে ড্রয়িংরুমে এসেছিল মাত্র। আর অপেক্ষা না দৌড়ে সেও উপরে চলে এলো৷ কাজের বুয়া সেলিনা আপাও ছুটে এলো। মেয়ের দু’পা থেকে কাঁচ তুলে মেয়েকে জাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে উদয়িনী। ভুলে গেছে নিজের ডাক্তারি সত্তা। সোহান খন্দকার হাত মুঠ করে ঝাঁকি দিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলল,

‘ ওহ শীট! মস্ত বড়ো ভুল হয়ে গেল উদয়িনী। আমাদের ওর সঙ্গে আলোচনা না করে পাত্রপক্ষকে আসতে বলা উচিত হয়নি৷ ‘

বলতে বলতে মেয়েকে ত্বরিত কোলে তুলে ছুট লাগালেন৷ উদয়িনীও তার পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। সেলিনা আপা আরো জোরে দৌড় দিয়ে ড্রাইভারকে ডাকতে লাগল আর বলতে লাগল,

‘ আমজাদ ভাই তাড়াতাড়ি আহেন, হাসপাতালে যাওয়া লাগব। সিনু আপার পা কাটছে, অজ্ঞান হইছে! ‘

গাড়িতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বিধ্বস্ত স্ত্রীর মুখে তাকাল সোহান। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

‘ সিনু কারো সাথে রিলেশনশিপে আছে?’

উদয়িনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ গলায় বলল,

‘ আই ডোন্ট নো। ‘

ধমকে ওঠল সোহান,
‘ সুহাসকে কল করো। আমার মেয়ের প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব নেই তোমার। মা হয়ে মেয়ের মনের কথা জানো না। কেমন মা তুমি? ‘

কেঁপে ওঠল উদয়িনী। মেয়ের চিন্তায় মানুষটা যাই বলুক কষ্ট পাবে না সে। তাছাড়া সিনুকে এখনি বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত তার একার নয়। সোহানেরও। কথাবার্তা এগুতো সুহাস আসার পরই। আজকে শুধু প্রাথমিক ভাবে সিমরানকে দেখাতে চেয়েছিল। মেয়েটা অতিথিদের সামনে ধৈর্য্য ধরে থাকলেও অতিথিরা চলে যাওয়ার পর এমন ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেবে কল্পনার বাইরে ছিল। বা হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে ডান হাতের সাহায্যে ছেলেকে কল করল উদয়িনী। কী বিপদ ঘটেছে সেসব না বলে শুধু জিজ্ঞেস করল,

‘ বাবা সিনু কি কোনো ছেলেকে পছন্দ করে? কারো সাথে সম্পর্কে আছে সিনু মার? ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
রিচেক দিইনি৷ ভুল ত্রুটির জন্য দুঃখীত।