Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 420



ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭৮

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৮|
ডিসেম্বরের সূচনা৷ হিমশীতল পরিবেশ। ধরণিতলে সূর্যরশ্মি পড়েনি আজ৷ মনকেমন করা একটা সকাল। অলস দুপুর আর ম্রিয়মাণ বিকেল। রাতটা পিপাসিত। পিপাসিতা রমণীটি বসে আছে আয়নার সামনে। নিজের রূপ, ঐশ্বর্য দৃষ্টিপাত করে ভেঙচি কাটছে বারংবার। কারণ খুবই হৃদয়স্পর্শী। সুন্দরী তরুণিমার তরুণকুমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। চঞ্চলা মন, উষ্ণ, নরম দেহ হাপিত্যেশ করে। পরোক্ষণেই আবার শিশুভুলানোর মতো করে বলে,

‘ শরীরটুকুই দূরে। মন ঠিকি কাছে মিশে। ‘

প্রিয়তমের ভাবনায় মশগুল সিমরান। ব্যস্ত অশান্ত হৃদয়ে সান্ত্বনা দিতে। তৎক্ষনাৎ বেজে উঠে সেলফোন। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কল ভেবে ছুটে যায়। ফোন ধরতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে ‘ সুলল কাকু ‘ নামটা। একটুক্ষণ থেমে নিঃশ্বাস ছাড়ে শব্দ করে। এরপর ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়। সালাম ফিরিয়ে শান্ত, সুন্দর, সাবলীল কণ্ঠে সুলল কাকু শুধায়,

‘ কেমন আছো আম্মু? ‘

‘ আলহামদুলিল্লাহ, আপনারা কেমন আছেন কাকু? ‘

উৎফুল্ল কণ্ঠ সিমরানের। সুলল কাকু স্মিত হেসে বলে,

‘ এইতো ভালো। তোমার বোনটি যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কাল আসবে, উত্তেজনায় আজি তার ঘুম আসছে না। ভাবছি ওর স্কুল থেকে ফেরার পথে পিক করে নেব তোমায়। তৈরি থেকো কেমন? ‘

বুকের ভেতর শীতল শিহরণ বয়ে যায় সিমরানের। বারকয়েক পলক ঝাপটিয়ে মৃদু হেসে সম্মতি দেয়। ফোন রেখে দেয় সুলল কাকু। সিমরানের মনে পড়ে যায় লুনার কথা। বেচারি তার বিয়ের পর বেশকিছু মাস প্রচণ্ড বিরক্ত করেছে সুলল কাকুকে। তাহানীর সেকেণ্ড মাদার হওয়ার শখ হয়েছিল খুব৷ অচেনা একটি নাম্বার থেকে ডিস্টার্ব করাতে সুলল কাকু যখন খোঁজ লাগালো নাম্বারটি কার? মেয়েটি কে? লুনা সম্পর্কে জানার পর সর্বপ্রথম সিমরানের কাছেই এসেছিল। কী ভয় পেয়েছিল সিমরান। সে ভয় কাটিয়েছে সুলল কাকু নিজেই৷ খুবই অমায়িকভাবে প্রশ্ন করে শুনে নিয়েছে সবটা। এরপর একদিন লুনার সঙ্গে দেখা করে সুলল কাকু। সে দেখায় তাদের কী কথা হয়েছে জানা নেই। তবে সেদিনের পর থেকে লুনাকে আর দেখা যায়নি। অন্য বন্ধু, বান্ধবীদের থেকে শুনেছে, লুনার দিদা ভীষণ অসুস্থ। তাকে দেখতেই দেশের বাড়ি চলে গেছে। এরপর কতগুলো মাস পেরুলো। লুনার কোনো খোঁজ পায়নি কেউ। বাস্তব এবং ভার্চুয়াল। দু’টো জগত থেকেই লাপাত্তা মেয়েটি৷ ওর কোনো আত্নীয়, স্বজনকে চেনে না বান্ধবীরা৷ ওর মায়ের একটি ফোন নাম্বার ছিল৷ সেটাও বন্ধ। পড়াশোনাটাও যেন থেমে গেল মাঝপথে। কে জানে উদ্ভ্রান্ত, পাগলী মেয়েটা কেমন আছে? প্রিয় বান্ধবী লুনার কথা ভাবতে ভাবতে ত্বরিত ব্যাগপত্র গুছাতে মন দিল সিমরান। বাবার বাড়িতে বেশ অনেকদিন হলো এসেছে। নিত্যদিন বাবার সঙ্গে জমিয়েছে গল্প-আড্ডা। নিয়ম করে বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে। সময়, অসময়ে ব্যস্ত থেকেছে বরের সঙ্গে ফোনালাপেও। পাশাপাশি চালিয়েছে পড়াশোনা, ডায়ারি লেখা আর ইউটিউব ঘেঁটে টুকিটাকি রান্না শেখা। এতকিছুর ভীড়ে সময় গুলো কীভাবে ফুরিয়ে গেল টেরই পায়নি। শশুর বাড়ি ফেরার আনন্দ হওয়ার পাশাপাশি বাবাকে ছেড়ে যাবে বলে মন খারাপও হলো। মানুষটা যে ভীষণ একা। ভাইয়া, ভাবি আর সুহৃদ এলে বাবাকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা থাকবে না। তাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে ক্ষানিকটা মন খারাপ করেই হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল। বেশ আবেগি, আহ্লাদী হয়েই সৌধকে ম্যাসেজ করল,

‘ কবে আসবে তোমরা? কাল ও বাড়ি যাব। আব্বুকে ছেড়ে যেতে খুব মন খারাপ হচ্ছে। ভাইয়া, ভাবিপু, সুহৃদ থাকলে কি এই মন খারাপটা হতো? ‘
.
প্র্যাগ্নেসির সাড়ে পাঁচ মাস চলছে ফারাহর। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মনও বিষাদে ভুগে খুব৷ বাবা, মাকে ইদানীং ভীষণ মনে পড়ে। কাছে পেতে ইচ্ছে করে৷ মনে বলে, যদি একটিবার বাবা ভরসামাখা হাত মাথায় রাখত। মা যদি একবার তার স্নেহময় বুকে আগলে ধরত। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয় যখন আকস্মিক মনে পড়ে এ পৃথিবীতে তার বাবা, মা নেই৷ এতিম সে ৷ আছে কেবল বোনটাই। যার সঙ্গে বিয়ের পর তেমন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আগে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হতো। এখন সেটুকুও হয় না৷ আইয়াজকে বলেছিল, আপুকে একদিন ফোন করে তাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করতে। আইয়াজ সরাসরি না করেছে। ফারাহর অনুভূতি বুঝতে পারে আইয়াজ। তবু রাজি হয়নি। তার রাজি না হওয়ার পেছনের কারণটা জানে ফারাহ। তবু মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। ফোনে কথা হলেই আপুকে দেখতে ইচ্ছে করে। একবার কাঁধে মাথা রাখতে ইচ্ছে করে৷ নিজের জীবনের পরিবর্তন, প্রাপ্তি গুলো মন খুলে বলতে ইচ্ছে করে। তাই এখন ফোনও করে না। একটা বীভৎস ঘটনা, অতীত কত নির্মমভাবে দু’বোনের মাঝে দেয়াল তুলে দিল!

গর্ভাবস্থায় মেয়েরা সাধারণত মুটিয়ে যায়। ফারাহ আগে থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কিন্তু গর্ভবতী হওয়ার পর সে স্বাস্থ্য ক্রমশ নুয়ে পড়ছে। খেতে ভালোবাসা মেয়েটি এখন খেতে পারে না। আইয়াজ চেষ্টা করে যথাসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে বাপের বাড়ির যে সুবিধা পায় মেয়েরা। ফারাহ সেটা পাচ্ছে না৷ আইয়াজের মা দায়িত্ব পালন করে ঠিক। কিন্তু মায়েদের যে আন্তরিকতা সেটুকু ফারাহর প্রতি খুঁজে পাওয়া যায় না৷ ফলশ্রুতিতে আইয়াজই চেষ্টা করে সকলের অভাব নিজে একাই পূরণ করতে। ইদানীং টুকটাক রান্না শেখাও হচ্ছে। বউ মাঝেমাঝে ওটা, সেটা খাওয়ার বায়না করলে তৈরি করে খাওয়ায়। দিনে যেহেতু ব্যস্ত থাকে তাই মধ্যরাতটাই হয় ওর বউকে রেঁধে খাওয়ানোর যোগ্য সময়৷ এমনই ভাবে গতকাল রাতে ফারাহকে তেঁতুলের চাটনি করে খাইয়েছে। একটা ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও দিয়েছে। যেখানে সুহাস, সৌধ সহ তিন বন্ধু আর সিমরান, ফারাহও ছিল। তেঁতুল চাটনি দেখে সবাই প্রশংসা করেছে খুব৷ সিমরান প্রশংসার পাশাপাশি জানিয়েছে, সে এখন বেশ রান্নাবান্না শিখেছে। এখন জলপাইয়ের মরশুম। ইউটিউব ঘেঁটে শিঘ্রই জলপাই আচার বানাবে। আর এক বয়াম পাঠিয়ে দেবে ফারাহপুর ঠিকানায়। সিনুর ম্যাসেজ দেখে ফারাহ তো বেজায় খুশি। ভীষণ অপেক্ষায় জলপাই আচার খেতে সিনুপাকনির হাতে।
.
.
জেনেভা শহরে প্রায় একমাস হতে চলল সৌধ সুহাসের। অথচ নামীমন গলল না। হয়তো-বা গলেছে। কিন্তু টের পায়নি এখন অবধি ৷ নিয়ম করে ছেলেকে কাছে পায় সুহাস। বাবা, ছেলের মধ্যিখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না নামী। ছেলেকে নিয়ে মাঝেমাঝে লং ড্রাইভে বেরোয় বাবা। হয় নিত্যদিনের খেলার সাথীও। যেদিন নামীর হসপিটালে ডিউটি থাকে। সেদিন পুরোদিন সুহৃদের দেখভাল করে সুহাস৷ নিজের কাছে নিয়ে রাখে। বাবা আর চাচ্চু সৌধর সান্নিধ্যে দারুণ সময় কাটে সুহৃদের। উপভোগ করে ভীষণ। ভিডিয়ো কলে কথা বলে দাদুভাই আর ফুপির সাথে। খিলখিল করে হেসে, অস্পষ্ট সব কথা বলে মুগ্ধ করে রাখে সবাইকে। সময়গুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। নিভৃতে বোধহয় গলতে শুরু করেছিল নামীমনের বরফও। এমতাবস্থায় আকস্মিক একটি অঘটন ঘটে। বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে সুহৃদের দুরন্তপনাও বাড়ছিল। গতরাতে একটা ইংরেজি উপন্যাস পড়ায় ব্যস্ত ছিল নামী৷ সুহৃদ পাশেই খেলনা দিয়ে খেলছিল। হঠাৎ খেলা ছেড়ে বেডের পাশে টেবিলে রাখা পানি ভর্তি কাঁচের গ্লাস ধরতে গিয়ে ফেলে দেয়। নামী বইয়ে এতটাই মগ্ন ছিল যে শব্দটা শুনেও গুরুত্ব দেয়নি। আর সুহৃদ একটু চমকে বিছানা থেকে নেমে যায়। বয়স ন’মাস চলছে। শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে একা হাঁটতে পারে না। তাই এক কদম এগুতে গিয়ে কাঁচের টুকরো গুলোর উপরই মুখ থুবড়ে পড়ে! সঙ্গে সঙ্গে গালের একপাশে, হাতে আর পেটে কাঁচ ঢুকে যায়। নিমেষে শিশু বাচ্চাটির তরতাজা রক্তের স্রোত আর হৃদয় বিদারক কান্নায় মুখরিত হয় নীরব ঘর। এরপর সাড়া বাড়ি। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নামী। সন্তানের এহেন দৃশ্য দেখে ডাক্তারসত্তা নিভে গিয়ে মাতৃসত্তায় দিশেহারা হয়ে উঠে৷ পাগলপ্রায় হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে, দাঁতে দাঁত পিষে, শ্বাসরুদ্ধ করে সুহৃদের শরীর থেকে কাঁচের টুকরো গুলো বের করে। এরপর নরম কাপড়ে কেটে যাওয়া অংশগুলো বেঁধে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ছুটে যায় নিচে। বাড়িতে অ্যালেন ছিল। তাই তাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। গালে আর পেটে দু’টো সেলাই পড়ে বাচ্চাটার। হাতে ব্যান্ডেজ। সুহাস আর সৌধকে খবর জানালে তারা যেভাবে, যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই ছুটে আসে৷ এতটুকুন একটা বাচ্চা। ছোট্ট শরীর। ধকল ঠিক কতটা গেছে ভাবতেই শিউরে উঠে সুহাস৷ চোখমুখ লাল করে, বিধ্বস্ত হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেকে নিজের কাছে চাইলে জানানো হয়, সুহৃদকে দুগ্ধপানে ঘুমপাড়ানোর চেষ্টা করছে নামী।

মধ্যরাত। হসপিটাল কেবিনে ঘুমে বিভোর সুহৃদ। পাশে নামী। টলমল চোখে ছেলের ব্যান্ডেজ করা অংশে তাকিয়ে আছে। সুহাস এলো তখন৷ একটু চমকাল নামী৷ এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। দোষারোপ করতে ওস্তাদ সুহাস৷ এখন রাগ ঝাড়বে। দোষারোপ করবে। আক্রোশে ফেটে পড়ে অনেক কটুবাক্যই আওড়াবে৷ জানে নামী। মনটা তার ক্ষতবিক্ষত এখন। সুহাসের দোষারোপ, ক্রোধ সহ্য করার শক্তি নেই। আর না আছে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য। তাই কান্না বিগলিত কণ্ঠে বলল,

‘ প্লিজ, যত রাগ ঝাড়ার, যত দোষারোপ করার পরে করো। এ মুহুর্তে মনের দিক দিয়ে আমি ভীষণ আহত। ‘

বেডের একপাশে চুপচাপ বসল সুহাস। রক্তিম দৃষ্টিজোড়া ছেলের ব্যথাতুর মুখে স্থির। নামীর দিকে তাকাল না। শুধু প্রতিত্তোরে বলল,

‘ রাগ, দোষ? আমার সন্তানের কোনো বিপদেই তো আমি পাশে থাকতে পারিনি৷ ওর একটু একটু করে বেড়ে উঠা, এ পৃথিবীতে আগমন এর কোনো অনুভূতিই আমি পাইনি। না ওর পাশে থাকতে পেরেছি আর না ওর মায়ের৷ তাহলে আজ কোন অধিকারে দোষারোপ করব? কী স্পর্ধায় রাগ ঝাড়ব? ‘

ধরে আসা গলায় কথাগুলো বলতেই ডান চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ল। টলমল দৃষ্টিতে নামী দেখল তা৷ বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়ে গাল বেয়ে নোনাপানির ধারা নামল তারও৷ অনুভব করল একই রক্তক্ষরণ সুহাসেরও হচ্ছে। সে যেমন সুহৃদের মা সুহাসও বাবা। তার থেকে আজ যেন সুহাসের যন্ত্রণাটাই বেশি। অপারগতার যন্ত্রণা যে ভয়ানক হয় ভীষণ ভয়ানক।

চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭৭

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৭|
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসকে বলা হয় প্রেমের শহর। এ শহরে ল্যালা নামক এক প্রণয়ীর বাস। বয়স বত্রিশ। সুন্দরী, বোকা, স্মার্ট শ্বেতাঙ্গ রমণী সে। বাবা, মা কেউ বেঁচে নেই৷ দু’বার বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল। দূর্ভাগ্যবশত সম্পর্কগুলো টেকেনি। বর্তমানে সিঙ্গেল জীবনযাপন করছে৷ বাবা, মায়ের বিজনেস বড়ো ভাই আর বোন দেখে। সে তার ছন্নছাড়া জীবনটুকু নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত৷ নিজেকে একজন ইউটিউব ব্লগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ফ্যানফলোয়ার ছড়িয়ে গেছে লাখের ঘরে। এছাড়া গত এক বছর ধরে খুঁজে চলেছে ‘অ্যা ম্যান উইথ অ্যা বিউটিফুল হার্ট।’ প্রেমের শহরের মেয়ে সে। মনে প্রাণে লালন করে প্রেমানুভূতিকে। তাই একজন যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে চলেছে নিজের সবটুকু প্রণয় ঢেলে দেয়ার জন্য। সে ধারণা করে তার জন্য বিধাতা যাকে ফিক্সড করে রেখেছে এখন পর্যন্ত সেই সুপুরুষের সঙ্গে তার দেখাই হয়নি৷ ইতিপূর্বে যে দুজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল ওরা নেহাতই দু’টো এক্সিডেন্ট। আর এক্সিডেন্ট নয়৷ এবার সে বেশ সচেতন। প্রেম করলে রয়েসয়ে করবে। বিয়েতে জড়ালেও বুঝেশুনে জড়াবে৷ লোকে প্রথম প্রেম নিয়ে আগ্রাসি থাকলেও সে আগ্রাসি তার শেষ প্রেম নিয়ে।

হুটহাট সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যামো রয়েছে ল্যালার। দেড় মাস আগে মায়ের বান্ধবী যাকে সে লিটল মম বলে ডাকে। তার বাসা জেনেভাতে এসেছিল। তখনি পরিচয় হয় নামীর সঙ্গে। অ্যালেনের মা আর ল্যালার মা দু’জন খুব ভালো বন্ধু ছিলেন৷ মায়ের মৃত্যুর পর লিটল মমের কাছে মায়ের মতো শান্তি পায় ল্যালা। সেই সুবাদেই জেনেভায় এসে নামীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।
নামী ল্যালাকে লায়লা নামে ডাকে। ল্যালা যে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে লাইফ পার্টনার খুঁজে চলেছে। এ নিয়ে পরিবার, বন্ধু, বান্ধব তার সঙ্গে হাসি, ঠাট্টা করলেও নামী এসব করে না। বরং সে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে, ” আমার দৃঢ় বিশ্বাস লায়লা, তোমার মতো সুন্দর মনের মেয়ের জীবনে একজন পারফেক্ট ম্যান আসবে৷ আর তোমাদের প্রেম লায়লা, মজনুর থেকেও গভীর হবে। ” বাংলা ভাষা জানে না ল্যালা। তাই ওর সঙ্গে ইংরেজিতেই বাক্য বিনিময় করে নামী।

গতরাতে সৌধ, সুহাস ফিরে যাওয়ার পর কিছুতেই নামীর ঘুম আসছিল না। ঘুমুতে ঘুমুতে শেষ রাত৷ চোখটা যখন লেগে এসেছে মাত্র। তক্ষুনি ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ল্যালার নাম। কল রিসিভ করতেই ল্যালা জানায়, সে গতকাল জেনেভাতে এসেছে। এখন আসছে তাদের বাসায়। আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে। ল্যালার স্বভাব সম্পর্কে মোটামুটি জানে নামী৷ তাই হুট করে কোনোকিছু না জানিয়ে আসাতে অবাক হলো না। অ্যালেন বা তার মা বোধহয় জানেই না৷ ল্যালা আসছে। জানলে খুশিই হবে৷ শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছিল। তবু উঠল সে। গায়ে চাদর জড়িয়ে তাকাল সুহৃদের পানে। ছেলেটার ওঠার সময় হয়ে এসেছে।
উঠে যদি তাকে না পায় তবে কান্নাকাটি করবে৷
সুহৃদের সঙ্গে তার কিছু মিল, অমিল রয়েছে। সে মিষ্টি পছন্দ করে না৷ সুহৃদও মিষ্টি খায় না৷ আবার সে একা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে৷ কিন্তু সুহৃদ একা থাকতে মোটেই পছন্দ করে না৷ যতক্ষণ ঘুমায় ততক্ষণ একা থাকলেও ঘুম ভাঙার পর তার সঙ্গে একজন না একজন থাকা চাই। খুব বেশি কাঁদে না সুহৃদ। সব সময় মুখে হাসি লেপ্টেই থাকে৷ ঠিক বাবার মতো। কাঁদে শুধু ঘুম থেকে ওঠার পর আশপাশে পরিচিত কোনো মুখ না দেখলে। সুহাসও এরকম। ছোটো থেকেও বন্ধুবৎসল। একা থাকা, চুপচাপ থাকা ওর স্বভাবে নেই৷ মা, বাবা সবসময় কাছে না থাকলেও বোন আর বন্ধু, বান্ধব নিয়ে হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়ে ওঠেছে। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নামী৷ বেঘোরে ঘুমানো বাচ্চাটাকে আর তুলল না৷ নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি পেরুতে পেরুতেই শুনতে পেল কলিং বেল বাজছে। এত তাড়াতাড়ি এসে গেছে ল্যালা! মাত্রই তো কথা হলো। বলল, আধঘন্টা লাগবে। সে ভেবেছিল নিচে এসে এক মগ কফি খেতে খেতে অপেক্ষা করবে। ভ্রু যুগল কুঁচকেই সদর দরজার দিকে এগুলো সে।

হাড় কাঁপানো শীত। জেনেভা শহরের শীতার্ত ভোর৷ চারপাশ সাদা তুলোর মতো বরফে ঢেকে গেছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোর রাতে মনকে আর মানাতে পারেনি সুহাস৷ ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখল। বুকে জড়িয়ে আদর করল। কত হাসি, কত খেলার সঙ্গী হলো৷ অথচ ছেলের মা? তার সুহাসিনী। সে দেখা দিল না৷ না চোখের তৃষ্ণা আর না হৃদয়ের। কোনোটিই মিটল না। সুদূর বাংলাদেশ থেকে এ শহরে এসেও যদি মানুষটার দেখা না পায়৷ তবে মন, মস্তিষ্ক ঠিক থাকে? থাকে না৷ তাই তো উন্মাদগ্রস্ত হয়ে বউ আর ছেলের জন্য নিয়ে আসা দুটো লাগেজ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সে। সৌধকে ডেকে আর বিরক্ত করেনি। এমনিতেই সৌধ তার জন্য অনেক সেক্রিফাইস করেছে। এতকিছুর পর শান্তিতে একটু ঘুমাচ্ছে। এটা আর নষ্ট করতে মন সায় দেয়নি৷ তাই একা একাই চলে এসেছে অ্যালেনের বাড়িতে৷ বউ, বাচ্চার কাছে। ছোটো ছোটো বরফে গাড়িটা ঢেকে গেছে প্রায়। ডোর খুলে নেমে দাঁড়াতেই পরনে কালো রঙের হুডি ধবধবে সাদা বরফ বৃষ্টিতে মেখে যায়। ত্বরান্বিত হয়ে লাগেজ দু’টো বের করে৷ এরপর গাড়ি লক করে লাগেজ দু’টো হাতে নিয়ে ছুটে চলে যায় বাড়ির সামনে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে চাপতে থাকে কলিং বেল।

সদ্য ঘুম ভেঙে খোলা, এলোমেলো চুলে সদর দরজা খুলল নামী। দু’হাতে লাগেজ। লম্বাটে দেহে কালো হুডি পরা মানুষটা৷ লাগেজ সহ শরীর জুড়ে বরফে ছেয়ে গেছে৷ ফর্সা মুখটা তীব্র শীতে রক্তশূণ্য, ফ্যাকাসে৷ ধূসর বর্ণীয় দৃষ্টিজোড়া নীল, নীল ঠেকছে৷ নিমেষে বুকের গহীন বনে চিড়িক দিয়ে উঠল নামীর৷ সর্বাঙ্গে বেয়ে গেল এক গুচ্ছ হিম বাতাস। হৃৎস্পন্দনের গতি বুঝিয়ে দিল, সম্মুখের মানুষটার প্রতি তার ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। কোমল হৃদয়টিকে ঘিরে রাখা শক্ত খোলস ম্রিয়মাণ হলো। চোখ দু’টি ভরে উঠল নোনাপানিতে। স্তব্ধ চোখ, বাকরুদ্ধ মুখ আর নিশ্চল দেহে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল অভিমানী নারীটি৷

কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শনে হৃৎস্পন্দন থমকে গেছে সুহাসের। সেই চেনা মুখ, অভিমানে ঘেরা পলকহীন, ছলছল দৃষ্টিদ্বয়। ভোমর কালো চুল। আপাদমস্তক নামীতে দৃষ্টি বুলালো সুহাস। যে নামী তাকে ছেড়ে এসেছে সেই নামীর মাঝে আজ এই নামীর অনেক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ভীড়ে চোখ দু’টিই কেবল জানান দিল,
‘সুহাস তোর সুহাসিনী আজো তোকেই ভালোবাসে। ‘

আচমকা ধূসর মণিযুক্ত ছোটো ছোটো চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে উঠল। নিষ্পলক তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সুহাস। ওষ্ঠ কোণে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে, কান্নাহাসির দাবানলে চাপা উত্তেজনা নিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল ,

‘ সুহাসিনী, শীতার্ত ভোরে আজ এ অনাকাঙ্ক্ষিত দেখার সুখে যদি মরণও হয় তবে তাই সই। ‘

আকস্মিক কাঁপা ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে নরম কণ্ঠে বলা সে বাক্যটি শুনে নামীর মন আকাশে জমে থাকা মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল। যা দেখে ত্বরিত নিজের দু’হাতে থাকা লাগেজ দু’টো নিচে রেখে এগিয়ে এলো সুহাস৷ যেন এক্ষুনি বুকে টেনে উষ্ণ আলিঙ্গনে ভরিয়ে তুলবে প্রিয়তমাকে। সুহাসের সেই উদ্দেশ্যকে সফল হতে দিল না নামী। আর না এক মুহুর্ত ওর সম্মুখে দাঁড়াল। সুহাস তার কাছে যাওয়ার পূর্বেই সে এক ছুটে চলে গেল উপরে। নিজের ঘরে গিয়ে দেখতে পেল, সুহৃদ ওঠে পড়েছে৷ কান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছে মাত্র। নামী তাকে কাঁদতে সুযোগ দিল না৷ কারণ এখন সে কাঁদবে, খুব কাঁদবে। যে কান্না কাউকে দেখানো যায় না৷ যে দুর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ করা যায় না৷ যে অনুভূতি একান্তই তার, শুধুমাত্র নিজের।

দরজা বন্ধ করে ছুটে এসে ছেলেকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল নামী। ভেতরটা শেষ হয়ে গেল ভেঙেচুরে। ঠিক এ কারণেই সে এতগুলো দিন দূরে সরে আছে৷ দিনশেষে সেও তো নারী৷ তার ভেতরেও একটা নরম মন আছে। ওই মানুষটা যত ভুল করুক। অন্যায় করুক। বেলা শেষে যখন সামনে দাঁড়ায়। ইনোসেন্ট মুখটা নিয়ে ভালোবাসে, নরম সুরে কথা বলে গলে যায় সে৷ নিজেকে কেন যেন আর আটকাতেই পারে না। তাই তো সেদিনের পর আর মুখোমুখি হতে চায়নি৷ ওর করা ভুলের শাস্তি গুলো সামনে থেকে দিতে পারবে না বলেই দূরে চলে এসেছিল৷ ওর ভুলের শাস্তি দিয়েছে। বুঝতে পেরেছে নিজের ভুলটাও। তবু যে প্রগাঢ় অভিমান হৃদয়ে জমেছে তা থেকে বেরুতে পারছে না৷ অনেকটা সময় সুহৃদকে বুকে জড়িয়ে কাঁদল৷ একদম মন খুলে কাঁদল। যখন নিজেকে একটু হালকা অনুভব করল সম্বিৎ ফিরল তক্ষুনি। অকস্মাৎ খেয়াল হলো, সুহাস এসেছে। সুহৃদের বাবা এসেছে। শীতে কেমন কাঁপছিল। রক্তশূন্য হয়েছিল চোখ, মুখ। সে কি এতটাই নিষ্ঠুর? মানুষটার অমন অবস্থা দেখেও অবজ্ঞা করে চলে এলো। অতিরিক্ত শীতে অসুস্থ হয়ে পড়ে সুহাস৷ কোল্ড এলার্জি আছে! ভাবতেই বুকটা কেঁপে ওঠল। ত্বরিত সুহৃদকে ফ্রেশ করিয়ে ভাবল নিচে যাবে৷ মুখোমুখি যখন হয়েই গেছে। আর লুকোচুরি করে কী হবে?
.
.
এক টুকরো শীতল স্থিরতা এসেছে সুহাসের মনে। এক ঝলক নামীকে দেখতে পেরেই মন হয়ে গেছে শান্ত, সুস্থির। এই যে নামী অবজ্ঞা করে চলে গেল। এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না সুহাস। গতকাল নামীর সাথে হওয়া কথোপকথনের সবটাই সৌধর মুখে শুনেছে সে। এরপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দাঁতে দাঁত পিষে, বুকে তীব্র যন্ত্রণা পুষেই অপেক্ষা করবে। তার সুহাসিনীর অভিমান ভেঙে পড়ার অপেক্ষা। দৃঢ় বিশ্বাস। তার সুহৃদের মা ঠিক ক্ষমা করবে তাকে। কিছু দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়, কিছু দূরত্ব মানুষকে শুধরাতে সাহায্য করে। আবার কিছু দূরত্ব শুষে নেয় আমাদের মনের সকল ভুল, পাপ, বিষপূর্ণ অনুভূতি।

ড্রয়িংরুমের সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে সুহাস৷ গায়ে পরা নরম বরফ টুকরো গুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে মাত্রই বসেছে। শীত লাগছে ভীষণ। মিস করছে অতীতের বহু শীতার্ত রাত। যে রাত গুলোয় নামীর নরম দেহের উষ্ণ আলিঙ্গনে কাটিয়েছে সে। কখনো কখনো অতীতের স্মৃতি যেমন সুমধুর হয় তেমনি আবার তিক্ততারও হয়৷ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল সুহাস। সে পারত নামীর পেছনে ছুটে যেতে। জোর করে মেয়েটাকে কাছে টেনে বুকে জড়াতে। নিজের এই জোরটাকে খুব কষ্টে দমিয়ে রেখেছে। যে মেয়ে এতগুলো মাস একা কাটাল তাকে ছাড়া। তাকে আজো একাই ছেড়ে দিল। শুধু একবার নিজে থেকে কাছে আসুক। ধরা দিক একটিবার৷ এরপর আর কক্ষনো একলা ছাড়বে না। কক্ষনো না।

দু’হাতের তালু ঘষে ঘষে দু’গালে ছোঁয়াচ্ছিল সুহাস। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছিল আর ছাড়ছিল৷ কী করবে না করবে বুঝতে পারছে না৷ এ বাড়িতে আর কাউকেই দেখছে না৷ ঘুম থেকে উঠেনি বোধহয়। সুহৃদ কী উঠেছে? নামী কি আর তার সামনে আসবে? যদি না আসে! সুহৃদকে কাছে পেতে মন মরিয়া হয়ে উঠল। তড়পাতে লাগল পিতৃ সত্তা। এরই মধ্যে বেজে উঠল কলিং বেল। ফলে কিঞ্চিৎ চমকাল সুহাস। এ বাড়িতে এই ভোরবেলা কে এলো আবার? তখন দরজা লাগিয়ে এসেই বসেছিল সে। তাই এখন আবার উঠে গেল দরজা খুলতে। ল্যালা ভেবেছিল দরজাটা নামী খুলবে। এত্ত সকালে আর কারো দরজা খোলার কথা নয়৷ কিন্তু দরজা খুলতে ধারণা পাল্টে গেল। নামী নয়। একজন অচেনা সুদর্শন যুবক দরজা খুলেছে। নিমেষে চোখ দু’টো কপালে উঠে গেল ল্যালার। আচমকা ইংরেজিতে প্রশ্ন করেও বসল,

‘ কে হে যুবক? ‘

সাতসকালে কলা গাছের মতো লম্বা একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর দর্শন পেয়ে কপাল কুঁচকে গেল সুহাসের। কোনোক্রমে ইংলিশে জবাব দিল,

‘ আমি এ বাড়ির অতিথি। আপনি? ‘

আকস্মিক মনের ভেতর লাড্ডু ফুটল ল্যালার। গতকাল সে জেনেভাতে এসেছে৷ তার মামাত বোন জামাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে মিটও করেছে। দূর্ভাগ্যবশত ছেলেটাকে পছন্দ হয়নি। অপছন্দের কারণ ছেলেটার বয়স বিয়াল্লিশ। আর ওজন বেশি। ব্লাড গ্রুপও তার সঙ্গে মিলে গেছে। ফলাফল রিজেক্ট করে দিয়েছে। এখন লিটল মমের বাসায় এসে অল্পবয়েসী সুদর্শন এই যুবকটিকে দেখে এক পলকেই মনে ধরে গেল। খুশিতে গদগদ হয়ে হাত বাড়াল ল্যালা। বলল,

‘ হাই, আমি ল্যালা। ‘

সুহাস হাত বাড়াতে গিয়েও বাড়াল না৷ এমনিতেই রিমান্ডে আছে সে। নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে আর জড়ানো যাবে না৷ দমে গেল মুহুর্তে। এক ঢোক গিলে সরে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ আমি সুহাস খন্দকার। পেশায় একজন ডক্টর। ‘

‘ ওহ মাই গড! ‘

ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে চ্যাঁচিয়ে উঠল ল্যালা। সুহাস দরজা আঁটকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ল্যালার পরনে জিন্সপ্যান্ট আর কালো রঙের লেডিস ব্লেজার৷ ভেতরে সাদা জাতীয় কিছু পরেছে। হতে পারে টিশার্ট বা শার্ট৷ এমনিতেই উচ্চতা বেশি এর ওপর পরেছে চার ইঞ্চি মতোন উঁচু জুতা৷ উঁচু জুতা পরাতে উচ্চতায় প্রায় সুহাসের সমানই লাগছে। সুহাস আপাদমস্তক ল্যালাকে দেখে নিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাল। যেন সে আশা করছে নামী আসবে বা আসতে পারে৷ আকস্মিক ল্যালা বলল,

‘ মিস্টার সুহাস, আসুন বসুন এখানে আমরা পরিচিত হই। ‘

সুহাসকে কথাটা বলেই গলার স্বর আরো উঁচু করে নামীকে দু’বার ডাকল। সহসা নামীর নাম নেয়াতে ঘাড় বাঁকিয়ে ফের ল্যালার দিকে তাকাল সুহাস। মেয়েটা নামীর পরিচিত! সে তাকালে ল্যালাও তাকাল। মুচকি হেসে ডাকল কাছে গিয়ে বসতে৷ সুহাস কাছে গেল। বসল পাশে। টুকটাক পরিচয় হলো দুজনার। সুহাস বাংলাদেশী শুনে ভীষণ খুশি হলো ল্যালা। মুসলিম শুনে একটু দুঃখও পেল। কারণ সে খ্রিস্টান। পরোক্ষণেই ভাবল, ‘ ভালোবাসা, প্রণয়ের সম্পর্কে ধর্ম বাঁধা হতে পারে না৷ ‘ এ ভাবনা থেকেও গড়গড় করে নিজের ব্যাপারে অনেক কিছু বলে ফেলল। বয়স বলতেও ভুল করল না৷ সবশেষে যখন বলল, সে দীর্ঘদিন যাবৎ বিয়ে করার জন্য পাত্র খুঁজছে। তক্ষুনি থতমত খেয়ে গেল সুহাস৷ ভুত দেখার মতো তাকাল ল্যালার পানে৷ আমতা আমতা করে বলল,

‘ আপনি আমার সিনিয়র দিদি। ‘

ল্যালা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। দিদি শব্দটা বেদনাদায়ক লাগল খুব৷ আপাদমস্তক সুহাসকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ বয়স কত? ‘

‘ একত্রিশ প্লাস। ‘

হেসে ফেলল ল্যালা৷ বলল,

‘ কয়েক মাসের ব্যাপার তো নো প্রবলেম। ম্যানেজ করে নিব। ‘

সুহাসের এবার গরম লাগতে শুরু করল। কান দিয়ে উষ্ণ হাওয়া বেরুচ্ছে৷ এই মহিলা তো তার থেকেও ফার্স্ট। বিশ মিনিটের আলাপে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল৷ এদিকে তার আমানদস্ত, বাঘিনী একটা বউ আছে। কিউট একটা বেবি আছে৷ রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সুহাস। ল্যালাকে বলতে উদ্যত হলো,

‘ সরি দিদি। আই এম ম্যারেড, এণ্ড আই হেভ অ্যা বিউটিফুল বেবি। ‘

কিন্তু বলতে পারল না। তার পূর্বেই সুহৃদকে কোলে করে নামী নিচে নেমে এলো। ল্যালা ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল নামীকে। কুশল বিনিময় করে এরপর সুহৃদকে কোলে তুলে আদর করতে লাগল। নামী এক পলক সুহাসের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ল্যালার আনন্দ, উল্লাস কমে এলে হঠাৎ নামীকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে এক দমে বলল,

‘ নামী ওই ছেলেটা বাংলাদেশী! অ্যালেনের বাবার দিকের আত্মীয় রাইট? ট্রাস্ট মি ক্রাশ খেয়ে গেছি সিস৷ তুমি জানো গতকাল আমি এক পাত্র দেখতে এসেছিলাম। পছন্দ হয়নি রিজেক্ট করে দিয়েছি। ভাগ্যিস ওটা পছন্দ হয়নি৷ নয়তো আজ এতবড় চমক পেতাম না। সো সুইট দেখতে তাই না? বুঝার উপায় নেই সে বাংলাদেশী। আমি অলরেডি প্রপোজ করে দিয়েছি বুঝলে। বাকিটা প্লিজ তুমি বুঝে নাও৷ কথাবার্তা বলে তোমার এই বান্ধবীটির ব্যবস্থা করে দাও৷ বিধাতা যা করে ভালোর জন্যই করে বলো। কে জানত শেষমেশ আমার শশুর বাড়ি হবে বাংলাদেশ। উফফ, কী যে খুশি লাগছে! ‘

খুশি, উত্তেজনায় তাল হারিয়ে ফেলেছে ল্যালা। একদমে কথাগুলো বলে নামীকে কিছু বলার সুযোগ দিল না৷ ত্বরিত সুহৃদকে কোলে নিয়েই সুহাসের কাছে চলে গেল৷ এদিকে নামী বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সে! কিয়ৎকাল সময় কাগল বিস্ময় কাটাতে। এরপর চোখ বুজে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলল। ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিল শুঁকিয়ে উঠা গলাটা। বারকয়েক পলক ফেলে তাকাল ড্রয়িংরুমে। পাশাপাশি বসে আছে ল্যালা, সুহাস৷ মাঝখানে সুহৃদ। দেখা মাত্র চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ল্যালাকে সে বন্ধু মানে। তাই বলে এই নয় সে সীমা লঙ্ঘন করবে। তীব্র ক্ষোভ নিয়েই এক পা বাড়ায় নামী৷ পরপরই আবার থেমে যায়৷ মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে। ভাবে, ল্যালা হয়তো জানে না সুহাস তার হাজব্যন্ড, সুহৃদের বাবা। আর ওই বেআক্কলটাও নিশ্চয়ই এই পরিচয় এখন অব্দি দেয় নি। দেবে কী করে? মেয়েদের সাথে ইটিশপিটিশ করতে তো ভালো লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করল নামী৷ এরপর মুখটা অত্যন্ত গম্ভীর করে উপস্থিত হলো সুহাস, ল্যালার সম্মুখে। সুহাস আশা করেনি নামী এভাবে, এত সহজে, স্বেচ্ছায় তার সামনে আসবে। তাই হকচকিয়ে গেল। ল্যালার চোখ দু’টো চকচক করছে। সে ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সুহাসের পানে। নামী বুদ্ধি করে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে ল্যালাকে বলে উঠল,

‘ ল্যালা, উনি সুহৃদের বাবা। ডক্টর সুহাস খন্দকার! ‘

এহেন বাক্য শুনে সহসা চমকে উঠল ল্যালা। হৃদয় গভীরে বজ্রপাত হলো বার কয়েক। থতমত খাওয়া চোখে একবার তাকাল নামীর পানে। আরেকবার তাকাল সুহাসের পানে। সুহাসের চোখ দু’টো নামীর গম্ভীর চোখ আর কৃত্রিম হাসি দেয়া মুখে স্থির৷ কর্ণে বেজে চলেছে একটিই বাক্য,

‘ ল্যালা উনি সুহৃদের বাবা। ডক্টর সুহাস খন্দকার। ‘

নিমেষে ল্যালার সমস্ত উত্তেজনা মিলিয়ে গেল। অপরাধী মুখে তাকাল নামীর পানে। নামী আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘ আমরা সেপারেশনে আছি৷ যদি উনি চায় তাহলে তোমরা সম্পর্কে যেতেই পারো। ‘

ল্যালা কিছু বুঝে ওঠতে পারল না৷ এদিকে কথা শুনে সুহাস সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ নামীর দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ সুহৃদের বাবা সুহৃদের মাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীর কথা ভাবতে পারে না। ‘

বাংলায় বলাতে ল্যালা সুহৃদ ছাড়া কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু নামী তাচ্ছিল্য হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মনে মনে ভেঙাল খুব৷ সুহাস টের পেয়ে দম্ভ ভরে বলল,

‘ আমার জীবনে সুহৃদের মা’ই শেষ নারী। ‘

ল্যালা কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না৷ শেষে কাঁদো কাঁদো মুখ করে সরি বলল নামী, সুহাস উভয়কে৷ অনুভব করল তার অতিরিক্ত পাগলামি, অধৈর্যতার ফলেই অঘটনটা ঘটে গেল ছিঃ!

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭৬

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৬|
মুখোমুখি সৌধ, নামী৷ বদ্ধ রুমে তারা দু’জন ব্যতীত আর কেউ নেই। নামীর মুখশ্রীতে নোনাপানি শুকিয়ে চামড়া টানটান হয়ে আছে৷ সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে সৌধ বুঝে ফেলল মেয়েটা কেঁদেছে। নামীর মতো মেয়েরা গোপনেই কাঁদে। লোক সম্মুখে কেঁদে, নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করার মতো মেয়ে নামীরা হয় না। যদিও বা কখনো এমন ঘটনা ঘটে যায় সেটা খুবই বিরল। নামীর গোপনে করা কান্না টের পেয়ে গেছে। এটা নামীকে বুঝতে দিল না সৌধ। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,

‘ ভালো আছো? ‘

ঈষৎ হেসে গায়ে জড়ানো চাদরটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিল নামী। শেষবার যে সৌধকে দেখেছিল। আর আজ যে সৌধকে দেখতে পেল দু’জন যেন আলাদা দু’টো মানুষ। আলাদা দু’টি মুখ। বিষাদ পূর্ণ সেই সৌধের চেয়ে সুখী সুখী চেহেরার এই সৌধকে দেখে ভীষণ ভালো লাগল। সৌধ ভাইয়া তবে সিমরানের সঙ্গে ভালোই আছে। তার ননদিনীও নিশ্চয়ই সুখে আছে? মনে মনে আনন্দিত হলো ভীষণ। সে কেমন আছে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল,

‘ আছি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া? ‘

সৌধর হাসি চওড়া হলো এবার৷ যা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল সে ভালো আছে। ভীষণ ভালো আছে। মুখে সেটুকুর স্বীকারোক্তিও দিল। ক্ষীণ বাক্যে বলতে ভুলল না,

‘ আমার বন্ধুটা যে ভালো নেই নামী। ‘

সহসা কথাটি এড়িয়ে গিয়ে নামী প্রশ্ন করল,

‘ সিনু কেমন আছে? ‘

‘ ভালো মন্দ মিশিয়ে। তোমাকে ভীষণ মিস করে।মনে মনে অভিমান পুষে রেখেও কথা বলতে ভীষণ আগ্রহী হয়ে আছে। ‘

অকপটে জবাব সৌধর। যা শুনে হৃদয় জুড়ে শিরশিরে অনুভূতি হলো নামীর। সেও যে ভীষণ মিস করে সবাইকে। ঢোক গিলল মেয়েটা। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে উঠছিল বার বার৷ নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে ফের প্রশ্ন করল,

‘ আইয়াজ, ফারাহর কী খবর? ‘

একপেশে হাসল সৌধ। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নামীর মুখশ্রীতে। শান্ত গলায় বলল,

‘ এত কঠোরতা ঠিক নয় বোন। এ যুগে এসে এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা মানুষ নিঃসন্দেহে কঠিন হৃদয়ের অধিকারী। অথচ হৃদয় হতে হয় নরম৷ একজনের ওপর অভিমান করে, একজনকে শাস্তি দিতে গিয়ে অসংখ্য প্রিয় মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছো। ওরা সবাই তোমাকে মিস করে নামী। ওরা সবাই তোমাকে ভালোবাসে। তোমার ফেরার অপেক্ষা করছে সবাই। ‘

চিত্ত বিগলিত হয় নামীর। চোখ দু’টো টলমল । যা দেখে আকস্মিক চুপ হয়ে গেল সৌধ। যত কঠিন হওয়ারই চেষ্টা করুক নামী। যতই শক্ত খোলসে নিজেকে আবৃত করে রাখুক। সত্যি কি সে কঠিন হৃদয়ের অধিকারী? তাই যদি হতো এভাবে পালিয়ে আসত? নিজের ব্যর্থতা, দুর্বলতা প্রকাশ করবে না বলেই তো একরাশ অভিমান বুকে পুষে সবার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সৌধ। মৃদু হেসে বলে,

‘ আইয়াজ, ফারাহও ভালো আছে। ফারাহ তোমাকে কতটা ভালোবাসে জানোই তো। ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সুহাসের সঙ্গে তোমার কাছে, অ্যামেরিকায় যাবে। জানো নিশ্চয়ই? শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না। ফারাহও প্রেগন্যান্ট হলো। কিছু কমপ্লিকেশনস রয়েছে। আইয়াজটা অনেক দুঃশ্চিন্তা করে। যতটা পারি মানসিক সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করছি। ওহ হ্যাঁ আমরা আরো দুই রাজপুত্র পেতে চলেছি। আইয়াজ, ফারাহর টুইন বেবি হবে। ‘

বিস্মিত হলো নামী। খুশিতে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। চট করে সে জলটুকু মুছেও নিল সে। মনে মনে মাশাআল্লাহ বলে একটু মজার ছলেই বলল,

‘ বাহ, বন্ধুরা মিলে ফুটবল টিম তৈরি করে ফেলবেন দেখছি। ‘

হাসল সৌধ। হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে বলল,

‘ প্রাচীও প্রেগন্যান্ট। এখানে আসার আগে কথা হয়েছিল। এরপর আর হয়নি৷ খোঁজ নিতে হবে ওর। যাক সে কথা। এবার তোমার কথা বলো। লাইফ নিয়ে পরিকল্পনা কী তোমার? আমার বন্ধুটাকে সারাজীবন দেবদাস করে রাখার ছক কষোনি তো! ‘

এ প্রশ্নের উত্তর দিল না নামী। চুপচাপ বসে রইল। ভেতরটা ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার৷ এ মুহুর্তে একছুটে বাংলাদেশে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কথায় আছে না? কায়া দেখলে মায়া বাড়ে। নামীর যেন ঠিক তাই হলো। এমনিতেই সুহৃদের সঙ্গে সুহাসকে দেখে আবেগান্বিত হয়ে পড়েছিল। এরওপর সৌধকে দেখে সবার গল্প শুনে ব্যাকুলিত হলো মন। অতিরিক্ত আবেগ বিবেক নষ্ট করে দেয়। এতদিনে তা হারে হারে টের পেয়েছে নামী। তার এবং সুহাসের জীবনের অনেক গুলো মাস নষ্ট হয়েছে। এর জন্য সে যতটুকু দায়ী তার চেয়েও অধিক দায়ী সুহাস৷ আচমকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিল নামী৷ তাকাল সৌধর ভারিক্কি মুখের দৃঢ় দৃষ্টি জোড়ায়। প্রশ্ন করল,

‘ সুহাস কি আমার জীবনের নষ্ট হয়ে যাওয়া সময় গুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে? পারবে আমার এত গুলো মাসের স্ট্রাগল গুলোতে একটা সুন্দর, সুস্থ অনুভূতি দিতে? ‘

‘ তুমি পারবে বাবা হওয়ার প্রথম অনুভূতি গুলো সুহাসকে ফিরিয়ে দিতে? ফিরে যেতে পারবে ওই সময় গুলোতে? সুহৃদকে সেই সদ্যজাত শিশুতে পরিণত করতে পারবে তুমি? পারবে না। যে সময় গুলো হারিয়ে যায় তা কখনো ফিরে পাওয়া সম্ভব হয় না৷ অনেক হয়েছে নামী৷ একটা মানুষ ভুল করেছে। সেই ভুলটাকে তুমি ভুল দিয়ে শাস্তি দিয়েছ। এবার থেমে যাও। এবার সত্যি থেমে যাওয়া উচিত। বন্ধু বলে আমি কখনো সুহাসের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি। বন্ধুর বউ, ছোটো বোন বলে তোমার ভুল গুলোকেও প্রশ্রয় দিব না৷ এটা আমার স্বভাবের সঙ্গে যায় না। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে৷ এবার একটা সহজ, সুন্দর সমাধানে আসো। কারণ, সুহাস তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তুমি যদি তোমার ভুল গুলো না বুঝে সুহাসের অনুতপ্ততাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের জেদে অটল থাকো৷ ভবিষ্যতে সুহৃদের চোখে চোখ রাখতে পারবে না৷ দ্যাটস ট্রু। ‘

শান্ত, দৃঢ় স্বর সৌধর৷ নামী স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের গভীরে শুরু হলো তোলপাড়। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌধর পানে। সন্তানের চোখে ছোটো হতে চায় না সে। তাই বলে সন্তানের দোহাই দিয়েও সম্পর্ক টেকাতে চায় না৷ কারণ তাদের সম্পর্কে সুহৃদ পরে এসেছে। ভালোবাসা, রাগ, অভিমান এসেছে আগে।
নামী গম্ভীর হয়ে গেলে সৌধ ওর মনোভাব টের পেল। পুনরায় বলল,

‘ আমি সুহাস নই নামী। আমি যা বলব সব লজিক্যালি, ব্রেইন খাঁটিয়ে, দুপক্ষের হয়েই বলব।
সুহাস তোমার সঙ্গে কখনো ব্রেইন খাঁটিয়ে কথা বলে না, মিশে না। ইভেন ও ওর কোনো কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষের সাথেই ব্রেইন খাঁটিয়ে চলতে পারে না৷ রাগ হয়েছে নিঃসংকোচে রাগ ঝেড়ে দেবে। কোনো কিছু অপছন্দ হয়েছে সরাসরি এসে বলে দেবে। কাছের মানুষদের সঙ্গে হিসেব, নিকেশ করে কথা বলতে পারে না ছেলেটা। আমি জানি সবক্ষেত্রে এটা ঠিক নয়। ওর এই স্বভাব সবাই মেনে নেবে না। আর এ স্বভাবের কারণে মারাত্মক, মারাত্মক ভুলও করে ফেলে। কিন্তু এটাই তো সুহাস৷ হি ইজ বিউটিফুল লাইক দ্যাট। তবু সময়ের স্রোতে, তোমার দূরত্বে শোকাহত হয়ে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এর বেশি পরিবর্তন হয়ে গেলে ও নিজের স্বকীয়তা হারাবে। তুমিও হয়তো মেনে নিতে পারবে না সেই সুহাসকে! ‘

নামীর শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হলো এবার৷ ব্রেইন খাঁটিয়ে কথা বলে না৷ তীক্ষ্ণ আঘাত তো ঠিকই করতে পারে।
ভেতরের রাগটা উপচে এলো নিমেষে। নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। চোখ গলে অশ্রু ঝরে পড়ল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে আচমকা প্রশ্ন করল,

‘ মা মারা যাওয়ার পর থেকে সুহাস আমার সঙ্গে কী কী করেছে তা সবারি জানা ভাইয়া। আমি কিন্তু সবটা মেনে নিচ্ছিলাম। কিন্তু সেদিন রাতে ও যা করেছিল তা কি মেনে নেয়ার মতো? কোন স্ত্রী সহ্য করবে গভীর রাতে স্বামী প্রাক্তনের সঙ্গে ফোনকলে আলাপে মজে থাকলে? ‘

‘ কোনো স্ত্রীই সহ্য করবে না নামী। আমি জানি সুহাসের ভুল গুলো বিস্তর ছিল। এটা অস্বীকার করার মুখ নেই। ‘

‘ আমি ওসব ভুলকে বড়ো করে দেখিনি ভাইয়া৷ সে সময় আমার শরীর খারাপ করছিল। আর আমার প্রতি ওর কোনো প্রকার কেয়ারনেসই ছিল না৷ নিজের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে সেদিন আমি একাই হসপিটালে গিয়েছিলাম। রাগ, অভিমান করেই কিছু বলে যাইনি ওকে। এরপর যখন সহৃদের আগমনী বার্তা পেলাম। ছুটে এসেছিলাম বাড়িতে৷ কিন্তু সুহাসের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি, প্রশ্নের কবলে পড়ে আমার সবকিছু গুলিয়ে যায়। ও যেমন আচরণ করেছে তেমন আচরণ ফেরত দিই। হুটহাট রেগে যাওয়া মানুষ আমি না হলেও সেদিন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি৷ প্রেগ্ন্যাসিতে যেসব পরিবর্তন ঘটে সেসব আমার শুরু থেকেই ঘটছিল। ঘন ঘন মেজাজ হারাচ্ছিলাম। অল্পতে বেশি আঘাত পাচ্ছিলাম। ঠিক একটা বাচ্চা মেয়ে যেমন পায় তেমনি। আর ওই মুহুর্তে সুহাস ওর ঘৃণ্য কথাবার্তা, আচরণ দিয়ে আমার হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে যখন ও আমার শ্বাসনালি চেপে ধরল আমার শরীর, মন কোনোটাই সহ্য করতে পারেনি। সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক তো এটাই ছিল ওই মুহুর্তটার স্বাক্ষী ছিল আমাদের সন্তান। আচ্ছা ভাইয়া, আমি কেন আমার সন্তানকে নিয়ে একটা অসুস্থ পরিবেশে থাকব? মা হিসেবে ওই সময়ে আমার মাথায় শুধু একটা বিষয়ই খেলেছে। তা হলো আমার সন্তানকে সুস্থ ভাবে দুনিয়ায় আনতে হবে। কিছু লেইম পরিবারের বাচ্চাদের মতো বেড়ে ওঠবে না আমার বাচ্চা। সুহাস কেমন, সুহাস কী? সুহাস আমাকে কতটা ভালোবাসে আমি সুহাসকে কতটা ভালোবাসি। সেই মুহুর্ত আমার মস্তিষ্কে এই অনুভূতি গুলো ক্যাচ করেনি৷ ওই মুহুর্তে আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট ছিল আমার গর্ভে একটা ছোট্ট প্রাণ আছে৷ সুহাস আমার চরিত্রে আঘাত করেছে, শরীরে আঘাত করেছে ব্যস। আর কিছু আমি ভাবতে পারিনি। ‘

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হুহু করে কাঁদতে শুরু করল নামী। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলতে লাগল হৃদয়বিদারক কিছু কথা।

‘ আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার জীবনের সব প্রদীপ নিভে গেছে ভাইয়া৷ চারদিকে শূন্যতা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার নিয়ে বেঁচে আছি। সুহাস কী, সুহাস কেমন আমি জানি৷ কিন্তু ওই সিচুয়েশনে আমি কতটুকু ধারণ করতে পারছিলাম, আমার ওপর দিয়ে কী গেছে ও জানে না। আপনারা কেউ জানেন না। ও আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একটা মেয়ে যাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসলো। এ পৃথিবীতে যাকে তার সর্বশেষ নির্ভরতা মনে করল। সেই মানুষটাই যদি চরিত্রে আঙুল তুলে, শরীরে আঘাত করে অনুভূতির জায়গাটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আমার সম্মান তো এতটা ঠুনকো নয়৷ আমি তো ওইসব মেয়েদের মতো নই। যারা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে লাথি, ঝাটা খেয়ে স্বামীর পদতলে পড়ে থাকে! আমার বাচ্চার মা কোনো নির্লজ্জ, ব্যক্তিত্বহীন, চরিত্রহীন নারী নয়। আর আমি এটাও চাই না আমার বাচ্চার বাবা ব্যক্তিত্বহীন, কাপুরুষ হোক। বাচ্চারা তার বাবাকে কতটুকু সম্মান করবে এর পুরোটাই নির্ভর করে তাদের মায়ের ওপর। আমি যদি ওই সময় সুহাসের থেকে দূরে সরে না যেতাম। প্রতিনিয়ত ওকে আমি ঘৃণার চোখে দেখতাম৷ না স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারতাম আর না সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারতাম স্বামীকে, বাচ্চার বাবাকে। ভেতর থেকে ওর প্রতি আমার ক্ষোভ ছাড়া কিছুই আসত না৷ যা আমি তৃপ্তি নিয়ে গ্রহণ করতে পারব না৷ তা বর্জন করাই শ্রেয় মনে করেছি। ‘

‘ আমি তোমার সিদ্ধান্তকে রেসপেক্ট করছি নামী। রেসপেক্ট করছি সুহাসের অনুতপ্ততাকেও। যার যার অবস্থান সে সেই বুঝে। দূর থেকে আমরা ভুল ধরতে পারি। মতামত দিতে পারি। কারো জায়গায় দাঁড়াতে পারি না৷ তাদের সমস্যা গুলোও ফেস করতে পারি না। ‘

কথাটির সমাপ্তি দিয়ে সহসা হাত বাড়াল সৌধ। নামীর মাথায় স্নেহভরে হাত রেখে বলল,

‘ এতগুলো দিন যে মেয়ে একা লড়াই করেছে তাকে আজ কাঁদলে বেমানান লাগে নামী। ‘

‘ সবাই আমাকে ভুল বুঝল। কেউ আমার জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করল না। যতদিন আমি সুহাসকে ভালোবাসিনি ততদিন মাথা উঁচু করে সবার সামনে দাঁড়াতে পেরেছি৷ কিন্তু ওকে ভালোবাসার পর আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। কী করে ওর অপমান, অসম্মান মেনে নিয়ে বাবা, সিনু, আপনাদের সবার সামনে দাঁড়াতাম বলুন। যার সূত্রে আপনারা আমাকে আপন করে নিয়েছেন। সেই মানুষটাই তো আমাকে চরিত্রহীন খেতাব দিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা গর্ভে থাকা একটি ছোট্ট প্রাণকে তার বাবার সঙ্গে আমার ভালোবাসাময় স্মৃতি নয় খুবই দগ্ধীভূত স্মৃতি হয়েছে। যা বাড়াতে চাইনি। ‘

সন্তর্পণে হাত সরিয়ে নিল সৌধ৷ চিন্তিত মুখে বসে রইল নিশ্চুপ। কাঁদতে দিল নামীকে। মেয়েটা যেন দীর্ঘদিন পর মন খুলে কাঁদছে। ভেতরে থাকা চাপা কষ্ট, অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরছে৷ অনেকক্ষণ পর কান্না থামল নামীর। চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। সৌধ গভীর চিন্তায় বুঁদ হয়ে থেকে আচমকা প্রশ্ন করল,

‘ তোমার জানা উচিত আমরা কেউ তোমাকে ভুল বুঝিনি। হ্যাঁ সোহান আংকেল, সিনু অভিমান করেছে। যা তুমি সুহৃদকে নিয়ে একবার সামনে দাঁড়ালেই শেষ হয়ে যাবে। ‘

কিয়ৎক্ষণ পিনপতন নীরবতা। এরপর ফের সৌধই বলল,

‘ একটা বাচ্চা ষোল মাস বাবা ছাড়া বড়ো হলো। সবকিছু থেকেও কিছু নেই এভাবে বেড়ে ওঠল। বিষয়টা সুহাসের জন্য যেমন পীড়াদায়ক। তেমনি তোমার জন্যও। পাশাপাশি আমাদের সবারি আফসোস সুন্দর একটা ফ্যামিলি ক্ষয়ে পড়ছে বলে।’

থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল নামী৷ সৌধ আলতো হেসে বলল,

‘ তুমি কি ভাবতে পারো ওই নিষ্পাপ বাচ্চাটা বাবা ছাড়া বড়ো হবে? যার বিশাল বাড়ি, গাড়ি রয়েছে। সে অন্যের বাড়িতে ভাড়াটিয়ার পরিচয়ে থাকবে? দাদা, চাচা, ফুপি কী নেই ওর? সব থেকে কিছু নেই এভাবে বেড়ে ওঠবে কেন? ‘

হতাশা ভরে নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ। নামীর হৃদয় বিদীর্ণ করে দিল সৌধর এসব কথা। এতদিন যা ভেবে কষ্ট পেয়েছে সে। তা সৌধ স্মরণ করিয়ে দিলে কষ্টটুকু প্রগাঢ় হলো। আবারো ঝাপসা হয়ে ওঠল দৃষ্টি জোড়া। সৌধ অসরল দৃষ্টিতে তা দেখে নিয়ে আচমকা বলল,

‘ আমি তোমাকে জোর করব না নামী। তোমার বিবেক যদি বলে, এবার সুহাসকে ক্ষমা করা যায়। তবেই ক্ষমা করো। তোমার হৃদয় যদি বলে সব ভুলের ঊর্ধ্বে গিয়ে সুহৃদের বাবার সঙ্গে সংসার পাতা যায়। তবেই ফিরে এসো। তোমার মাতৃ সত্তা যদি অনুভব করে সুহৃদের বাবা, মা দু’জনকে একসঙ্গে প্রয়োজন তবে আর দ্বিধা করো না৷ ‘

‘ আমি যদি বলি সুহাস শুধু ওর বাচ্চার জন্যই সমঝোতা চায়। ও আসলে নিজের ভুল গুলো বুঝতেই পারেনি৷ বড্ড স্বার্থপর একটা ছেলে। ‘

ফিচেল হাসে সৌধ। বলে,

‘ তুমি হয়তো জানো না তোমার প্রেগ্ন্যাসির বিষয়টা সুহাস জেনেছে আমার আর সিনুর বিয়ের দ্বিতীয়দিন। এর আগে আমি, আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছি ওর যন্ত্রণা গুলো। ও নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল এটা ভেবে যে তুমি মানসিক শান্তির জন্য, নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ওর থেকে পালিয়েছ। ছেলেটা ভেঙেচুরে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছিল। সামলাচ্ছিল পরিবারকে। সোহান আংকেল হজে চলে যাবে। বোনের বিয়ে। মা নেই, বউ নেই। একদিকে নিজেকে অন্যদিকে পরিবারকে সামলে দিন কাটছিল। এরপর যখন রিপোর্ট গুলো পেল, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। তুমি মা হচ্ছো জানার আগে যতটা অনুতপ্ততায় ভুগছিল জানার পর সে অনুতপ্ততা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রতিনিয়ত নিজেকে যন্ত্রণা দিয়েছে তোমার সঙ্গে করা আচরণ গুলোর কথা ভেবে। তুমি কীভাবে আছো? কীভাবে নিজেকে সামলাচ্ছো? ঠিক আছো তো? বাচ্চাটা ঠিক আছে? সব মিলিয়ে ওর অবস্থা কতটা শোচনীয় ছিল মুখে বলে প্রকাশ করা যাবে না। কী ভাবছ? আমরা শুধু ওর দিকটা দেখেছি তোমারটা না? সত্যিই তাই। তোমার স্ট্রাগল আমরা কেউ দেখিনি। ওরটা দেখেছি বলেই বিবৃতি করতে পারছি। তোমার প্রেগ্ন্যাসির খবর জানার আগেও তোমার প্রতি ওর প্রগাঢ় অনুভূতি দেখেছি বলেই বলছি, আমার বন্ধু তোমায় ভালোবাসে নামী, প্রচণ্ড ভালোবাসে। যে ভালোবাসা বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। আমরা মানুষ নামী। আমরা কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নেই। এই চিরন্তন সত্যিটা মেনে নিয়ে দিনশেষে যদি তোমার মন ওকে ক্ষমা করতে পারে, ভালোবাসতে পারে, ফিরে আসতে চায় ওর জীবনে তবে কিচ্ছু ভেবো না আর। জাস্ট ফিরে এসো। ‘

দৃষ্টি নত করে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে নামী৷ রাত বাড়ছে৷ ওদের ফিরতে হবে৷ সুহাস ফিরতে চাইবে কিনা জানে না৷ অন্যের বাড়িতে এক রাত থেকে যাওয়া শোভনীয় নয়৷ তাই কব্জিতে থাকা ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখল সোধ৷ এরপর বলল,

‘ আমি আবারো বলছি, দায়িত্বের খাতিরে নয়৷ বাচ্চার দোহাই দিয়ে নয়। যদি মন বলে তবেই ফিরো৷ আমি জানি তুমি কারো কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে না। তুমি শুধু তোমাকে এবং তোমার সিদ্ধান্তকেই গুরুত্ব দেবে। বিষয়টা সুন্দর। নিজের ইচ্ছে, অনুভূতিকেই প্রাধান্য দাও৷ আমার কথা এটাই, তুমি তোমার মনের বিরুদ্ধে কিছু করো না৷ সুহাসের প্রতি যদি প্রকৃত অর্থেই সম্মান, ভালোবাসা বিলীন হয়ে যায় তবে বিচ্ছেদটাই বেছে নাও। ভয় নেই আমার বন্ধু এতটা অমানুষ নয় যে তোমার থেকে সুহৃদকে কেড়ে নেবে। সুহৃদের প্রতি তোমার অধিকারই বেশি। শুধু অনুরোধ একটাই বাবা, ছেলের মাঝে আর দেয়াল তুলে দিও না৷ ‘

ওঠে দাঁড়াল সৌধ৷ নামী স্থির দেহে বসে। সৌধ ফিরে যেতে উদ্যত হয়েও আবার বসে পড়ে৷ আরো নরম হয়ে বলে,

‘ আমরা যতই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন হই না কেন যাকে ভালোবাসি তাকে কিন্তু সবটা বিলিয়ে দিয়েই ভালোবাসি। ভালোবাসায় ব্যক্তিত্বের চেয়েও নির্লজ্জতা বেশি সুন্দর। যার কাছে খোলা পাতা হিসেবে মেলে দিই৷ যাকে খোলা পাতা হিসেবে চাই। তার কাছে কিসের ব্যক্তিত্ব? এর মানে এই নয় লাথি, ঝাটা খেয়ে থাকতে হবে। এ যুগে কেউ লাঠি ঝাটা খায় না, দেয়ও না। আমি ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিয়ে নির্লজ্জের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরার ইঙ্গিত দিচ্ছি। আশা করি বুঝবে। ‘

কথার সমাপ্তি টেনে সহসা ওঠে দাঁড়াল সৌধ। আর এক মুহুর্ত ব্যয় করল না। বেরিয়ে গেল। নামী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌধর যাওয়ার পানে। বুকের গভীর তীক্ষ্ণ এক ব্যথা অনুভব করল।
.
.
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁয়েছে৷ সৌধ, সুহাসের জন্য খাবার তৈরি। ডাইনিং রুমে অপেক্ষা করছে অ্যালেন। ছেলেকে ছেড়ে কিছুতেই খেতে আসবে না সুহাস। শুধু তাই নয়৷ নামী সামনে না এলে এ বাড়িতে খাবার গ্রহণ তো দূরে থাকুক। পানিও পান করবে না৷ সুহাসের এহেন সিদ্ধান্ত নামীকে জানানো হলো। তবু সে সামনে আসার নাম নিল না। সুহাস খাবে না বলে সৌধও খেল না। বরং একান্তে সুহাসের সঙ্গে দেখা করে বলল,

‘ দোস্ত জানি তোর মন মানবে না। তবু আজকের রাতটার জন্য ফিরে চল। জরুরি কথা আছে। নামীর সঙ্গে আমার দেখা, কথা দু’টোই হয়েছে। ‘

সৌধর কথা শুনে ছেলের ঘোর কাটে সুহাসের। তবু বিদায় বেলা আবারো তার চোখ দু’টো ঝাপসা হয়। সৌধ স্বান্তনা দেয়,

‘ আরে ইয়ার জাস্ট রাতটুকুরই ব্যাপার৷ সকালেই চলে আসবি। দরকার পড়লে সারাদিনের জন্য আমাদের রাজপুত্রকে নিয়ে যাবি হোটেলে। ঘুরে বেড়াবি পুরো জেনেভা শহর। আর তুই ভুলে গেছিস ওর জন্য কতকিছু নিয়ে এসেছিস। সেগুলোও তো দিতে হবে নাকি? ‘

মাথা নাড়ল সুহাস৷ ঘুমন্ত সুহৃদের কপালে চুমু খেল বারকয়েক। বিড়বিড় করে বলল,

‘ আমার রাজকুমার। ‘

এরপর সৌধর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ মহারানি দেখা দেবেই না? ‘

‘ বরফ গলতে শুরু করেছে ব্রো। চল, ফিরে গিয়ে সব বলব। ‘
.
.
বাংলাদেশ – সময় দশটা। সোহান খন্দকার মেয়ের সঙ্গে সকালের খাবার সেরে হসপিটালে গেলেন। পুরো বাড়িতে এখন সিমরান একা। তাই সঙ্গী হিসেবে সৌধর দেওয়া ডায়ারিটাই বেছে নিল। একাকী রুমে বসে ফিরে গেল পনেরো বছর বয়সে৷ প্রথম প্রেমে পড়ার মুহুর্ত টুকু ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করেছে সে। সেটাতেই চোখ বুলাতে গিয়ে সৌধর গাওয়া গানটি দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠল। ক্লাস নাইন৷ সে যে স্কুলে পড়ে। সে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সৌধ, সুহাস। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসে দু’জন। ওই বয়স থেকেই দুই বন্ধু দারুণ গান গায় আর গিটার বাজায়৷ সেই সুবাদে সৌধ একটি গান গেয়েছিল৷ সুহাস বাজিয়েছিল গিটার।

” বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিওনা এমন জনকে,
যে ফুলে ফুলে উড়ে মধু পান করে অবশেষে ভাঙে মনকে, একটা হৃদয় বারবার নয়, একবারই প্রেমে পড়ে, সেই হৃদয়ের সুখ লুট হয় নিঠুর মৌনঝড়ে,

বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিওনা এমন জনকে
যে ফুলে ফুলে উড়ে মধু পান করে অবশেষে ভাঙে মনকে একটা হৃদয় বারবার নয়, একবারই প্রেমে পড়ে,সেই হৃদয়ের সুখ লুট হয় নিঠুর মৌনঝড়ে
হও হুশিয়ার মনের দুয়ারে নজর রাখো খুব
চোখের ফাঁকিতে, ঠোঁটের হাসিতে হয়োনা উৎসুক
বালিকা, পুড়ে যাবে সব সুখ।
বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিওনা এমন জনকে
যে ফুলে ফুলে উড়ে মধু পান করে অবশেষে ভাঙে মনকে —-
তোমাকে তুমি সামলে রেখো তোমার মতো করে
সস্তা প্রেমের ধোঁকায় নয়তো কাঁদবে বালিশ ধরে
বালিকা, পুড়ে যাবে সব সুখ
বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিওনা এমন জনকে
যে ফুলে ফুলে উড়ে মধু পান করে অবশেষে ভাঙে মনকে।
একটা হৃদয় বারবার নয়, একবারই প্রেমে পড়ে
সেই হৃদয়ের সুখ লুট হয় নিঠুর মৌনঝড়ে
হও হুশিয়ার মনের দুয়ারে নজর রাখো খুব
চোখের ফাঁকিতে, ঠোঁটের হাসিতে হয়োনা উৎসুক
বালিকা, পুড়ে যাবে সব সুখ।। ”

যে গান, যে গানের প্রতিটা শব্দ, বাক্যতেই হৃদয় গভীরে প্রেমের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। বালিকার মন ডুকরে ওঠে, ‘ অন্য কোনো পাড়াতো ভাই কে নয়। এই বালিকার মন তোমার জন্যই বরাদ্দ করে দিলাম সৌধ ভাই৷ ‘

সেই যে কিশোরী হৃদয়ে গানে গানে প্রণয়ের বীজ বুনে দিল সৌধ। যা বেড়ে ওঠতে ওঠতে ডালপালা ছড়িয়ে তার গোটা রাজ্যই ঘিরে ফেলল। পরিণয়ে পরিপূর্ণ হয়ে সফল হয়েছে ক্লাস নাইনের সেই ছোট্ট বালিকাটি। মধুর, উষ্ণ স্মৃতিচারণ করে আকস্মিক হৃদয় তরঙ্গিত হলো। সৌধকে এক পলক দেখার জন্য আগ্রাসী হলো মন। চোখ দু’টো হলো তৃষ্ণার্ত হয়। এরপর কোনোকিছু না ভেবে হোয়াটসঅ্যাপে প্রিয়তমকে ভিডিয়ো কল করল। সুইজারল্যান্ডে সময় তখন ভোর পাঁচটা। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সৌধ। সহসা ফোন বেজে ওঠলে কপাল কুঁচকে চোখ খুলে। পাশে তাকিয়ে দেখে বিছানা ফাঁকা। সুহাস কোথায়? ভাবল বাথরুমে গিয়েছে। এরপর গায়ের কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে ফোন রিসিভ করতেই বউয়ের মুখটা ভেসে ওঠল৷ সিমরান নিষ্পলক চেয়ে মিহি স্বরে বলল,

‘ গুডমর্নিং। ‘

‘ গুড মর্নিং ডিয়ার। মিস ইউ। ‘

এবারে লজ্জা পেল সিমরান। চোখ দু’টো সরিয়ে নিল ত্বরিত। যা দেখে নিঃশব্দে হাসল সৌধ। মৃদুস্বরে বলল,

‘ ডায়ারি লেখা হচ্ছিল? ‘

কোলের ওপর থেকে ডায়ারি সরিয়ে মাথা নাড়ল সিমরান৷ বলল,

‘ তোমার চোখ লাল লাগছে। আরেকটু ঘুমাবে? ‘

‘ বউ মিস করছে। তাকে রেখে একা একা ঘুমাই কী করে? ‘

গাল দু’টো রক্তিম হয়ে ওঠে এবার৷ লাজুক হেসে বলে,

‘ তুমি ঘুমাও। আমি তোমাকে দেখি। কথা বলতে হবে না। ‘

‘ ওরে পাকনামি! আমাকে দেখতে দেবে না? ‘

‘আমি ঘুমালে তুমি দেখবে। তাহলেই তো শোধবোধ হয়ে যাবে।’

শব্দ করে হেসে দিল সৌধ। সত্যি বলতে তার চোখ জোড়া জ্বলছে। ঘুমটা বিশেষ প্রয়োজন। তাই মেনে নিল বউয়ের কথা। সঙ্গে সুযোগ দিল তাকে মন ভরে দেখার জন্য। মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে চোখ বুজল সৌধ। পরোক্ষণেই আবার চোখ খুলে ঠোঁট জোড়া চৌকা করে গভীর একটি চুমু দিল বউপাখিকে। এরপর চট করে আবারো চোখ বুজে ফেলল। ঘটনা আকস্মিকতায় তীব্র লজ্জায় আঁতকে ওঠে সিমরান। ঠোঁটদ্বয় আপনাআপনি ফাঁক হয়ে যায় সৌধর দুষ্টুমি দেখে। মিটিমিটি হাসতে হাসতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সৌধ। আর সিমরান অতি লজ্জায় আরক্ত মুখে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে রয় স্বামীর পানে। এত দেখছে, এত দেখছে তবু যেন তৃষ্ণা মিটছে না।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭৪+৭৫

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৪|
” বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুক না।
ভিতর বলে দূরে থাকুক , বাহিরে বলে আসুক না।
ঢেউ জানা এক নদীর কাছে, গভীর কিছু শেখার আছে। সেই নদীতে নৌকো ভাসাই, ভাসাই করে ভাসাই না। না ডুবাই না ভাসাই, না ভাসাই না ডুবাই
জল ডাকে, আগুনও টানে আমি পড়ি মধ্যিখানে।
দুই দিকে দুই খন্ড হয়ে যায় আবার যায়না, না নিভায় না জ্বালায় না জ্বালায় না নিভায়। বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুকনা। ভিতর বলে দূরে থাকুক, বাহিরে বলে আসুকনা….। ”
—————-
আজ রবিবার। ভোর পাঁচটা। আব্রাম হক অ্যালেন রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজে আছে। শুনছে বাংলাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পি হাবিব ওয়াহিদ এবং ন্যান্সির গাওয়া গান। সে ইংলিশ গান, মুভির ভক্ত হলেও বাংলা গানের প্রতি আসক্তি জন্মেছে নামীর কারণে। মেয়েটা বেশ দারুণ গায়। এ সম্পর্কে অবগত হয়েছে জেনেভায় আসার পর পরই। অ্যালেনের স্ত্রী উইরা একজন প্যারালাইজড পেশেন্ট।
কাজের সূত্রে অ্যামেরিকায় নানার বাসায় গিয়েছিল অ্যালেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল একমাত্র কন্যা অ্যারিনকে। যার বয়স মাত্র ছয় বছর৷ অ্যালেনের নানা আর নামীর বাবা প্রতিবেশী। পাশাপাশি ফ্ল্যাট তাদের। সেই সুবাদে অ্যারিনের মাধ্যমেই নামীর সাথে প্রথম পরিচয় হয়৷ দীর্ঘ কয়েকটি মাসে যা বন্ধুত্বে রূপ নেয়। বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ওঠে নামীর ডেলিভারির সময়। আখতারুজ্জামান বাসায় ছিল না। আকস্মিক পেইন ওঠে নামীর। সৎ মা আলেয়া তখন পাশের ফ্ল্যাটের অ্যালেনের সাহায্য নেয়। হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হয় নামীকে। এরপর বাচ্চা দুনিয়াতে আসে। টানা কয়েকটি দিন সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে অ্যালেন। নিঃসন্দেহে উদার মনের অধিকারী লোকটা। আর প্রচণ্ড বন্ধুসুলভ৷ গাঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে প্রায়শই অ্যালেন আর নামী নিজেদের সুখ, দুঃখের গল্প করত। একদিন নামীর ভীষণ মন খারাপ দেখে অ্যালেন জেরা করে। নামী মন খারাপ হওয়ার পেছনের ঘটনা বলতে না চাইতেও বলে ফেলে। বয়সে বড়ো হবার সুবাধে অ্যালেনকে ভাইয়া বলেও সম্বোধন করে সে,

‘ ভাইয়া, আমি বাংলাদেশে ফিরে যাব৷ আমার এখানে আসা উচিত হয়নি। বোঝা উচিত ছিল, আমার মা নেই। বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর সে ঘরের বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত। এটাও বোঝা উচিত ছিল, যেদিন সে দ্বিতীয় বিয়ে করে, আর যেদিন আমাকে পাত্রস্থ করে দেয় সেদিন থেকেই সে আমার পর হয়ে গেছে। এখন যতটুকু সম্পর্ক স্রেফ দায়িত্ব, ভালোবাসা নয়। ‘

অ্যালেন নিশ্চুপ বসে সবটা শুনে। বারকয়েক শ্বাস নিয়ে নামী বলে,

‘ আমি এখানে এসে শুধু আমার মানসিক বিপর্যয়ই ঘটাইনি। ক্যারিয়ারটাও নষ্ট করেছি। ছোটো বাচ্চা নিয়ে কোনদিক সামলাবো বুঝতে পারছি না। স্বামীর ঘর ছেড়ে আসায় বাবা আর তার দ্বিতীয় পরিবার আমার প্রতি প্রচণ্ড রুষ্ট এটাও বুঝতে পারছি। ‘

‘ ফিরে যাবে তোমার হাজব্যন্ডের কাছে? ‘

‘ না, আমি জাস্ট বাংলাদেশে ফিরতে চাই। ‘

‘ আসল সমস্যাটি কী নামী? ‘

‘ সমস্যা আমারি। আমি সবার কাছে প্রপারলি রেসপেক্ট চাই, ভালোবাসা চাই। এটাই আমার অপরাধ। ‘

‘ তোমার ফ্যামিলি তোমাকে এটা দিচ্ছে না? ‘

‘ হয়তো তারা তাদের মতো করে দিচ্ছে। আমারি গায়ে লাগছে না। ‘

‘ ক্লিয়ার করে বলবা? ‘

‘ আসলে আমার যে জমজ দু’টো ভাই আছে। আবির আর আলিফ। কিছুদিন ধরে ওরা আমাকে দেখলেই গলা ছেড়ে কান্নাকাটি শুরু করে। ওদের বুঝিয়েও থামানো যায় না৷ তাই সেদিন বাবা বলল, আমি যেন ওদের থেকে দূরে থাকি। বিষয়টা আমার সম্মানে লেগেছে। খটকাও লেগেছে হঠাৎ বাচ্চা দু’টোর আচরণে। তাই গতকাল ওদের মা যখন শাওয়ারে যায়, আমি দু’টো চকলেট বক্স দু’জনের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করি, তোমরা আমাকে দেখে চিৎকার করো কেন? কী করেছি তোমাদের? ওরা চকলেট পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে বলে দেয়, ওদের মা বলেছে আমি ভালো মানুষ নই৷ এখানে এসেছি ওদের খামচি দিয়ে ব্লাড বের করতে। ওরা দু’জনই রক্ত খুব ভয় পায়। তাই এই ভয়টাই দেখিয়েছে। সবটা শুনে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘরে ফিরে যাই। আর বুঝতে পারি, সৎ মা সৎ মা’ই হয়৷ সে কখনো আপন হতে পারে না। আমার হাজব্যন্ডের আলাদা কোনো মুখোশ ছিল না৷ সে অনেস্ট। আমার সঙ্গে যা করেছে সেটাও হুঁশ জ্ঞান রেখে করেনি। আমি জানি প্রখর বুদ্ধিজ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ সে নয়। তবু সেদিন আত্মসম্মান আর আবেগে আঘাত লাগে। কঠিন জেদ, অভিমান নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে আসি৷ আমার ওকে ছাড়াটা ভুল না হলেও জেদকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়া ভুল হয়েছে। আমার বোঝা উচিত ছিল আমার ওপর শুধু আমি একা নির্ভরশীল নই। একটা ছোট্ট প্রাণও সম্পূর্ণভাবে আমাতে নির্ভরশীল। আমার সৎ মাকে আমি আগে থেকেই পছন্দ করতাম না৷ কেন জানি ফেইক ফেইক লাগত। এখন হারে হারে টের পাচ্ছি, সে পুরোটাই মুখোশধারী। খুবই তীক্ষ্ণ ষড়যন্ত্র করেছে আমার বিরুদ্ধে। এসব জানার পরও কী করে থাকব এখানে? সম্ভব না। ‘

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যালেন বলে,

‘ উনি এসব মিথ্যা কেন বলেছে? মজা করে? ‘

মলিন হাসে নামী। বলে,

‘ বাঙালি রমণীদের এই রাজনীতি আপনি বুঝবেন না অ্যালেন ভাই। ‘

নামীর চোখ দু’টো ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। অ্যালেন ব্যথিত হয়ে বলে,

‘ ওদেশ থেকে মানসিক শান্তির আশায় এদেশে এসে আরো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছ। এভাবেই ফিরে যাওয়া ঠিক হবে? আই নো দ্যাট তুমি ভীষণ লড়াকু মেয়ে। তাই তুমি যদি এভাবে হেরে ফিরে যাও বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারব না৷ সেদিন তো বললে সুইজারল্যান্ড তোমার স্বপ্নের দেশ, প্রিয় দেশ। চলো তবে আমার সঙ্গে। জেনেভাতে কিছুকাল কাটিয়ে মাইন্ড ফ্রেশ করে তারপর বাংলাদেশে ফিরে যেও। ‘

‘ আমি আর্থিক অস্বচ্ছলতায় ভুগছি ভাইয়া। এ মুহুর্তে সেটা সম্ভব হবে না। ‘

‘ কেন হবে না? তুমি একজন ইন্টেলিজেন্ট ডক্টর। আর্থিক অস্বচ্ছলতা দূর করা তোমার বা হাতের খেল। ‘

অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় নামী৷ অ্যালেন দেখায় আশার আলো। ফলশ্রুতিতে নামী সিদ্ধান্ত নেয় তার সঙ্গে জেনেভাতে যাওয়ার। এরপর অ্যালেনের সহায়তায় ট্যুরিস্ট ভিসায় জেনেভায় আসে। এখানে আসার পর মুখোমুখি হয় আরেক বিপত্তির। অ্যালেনের প্যারালাইজড স্ত্রী উইরা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ স্বামী অ্যালেন অ্যামেরিকায় বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে বাচ্চা সহ এক যুবতী নারীকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর কোনো নারী কি এ দৃশ্য সহ্য করতে পারে? পারে না। পারেনি অসুস্থ উইরাও। ফলে তার অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পায়। শশুর, শাশুড়ি, স্বামী আর ছয় বছর বয়সী কন্যা অ্যারিন। কারো সাধ্য হয়নি তাকে সামলানোর। উইরার ধারণা তার অসুস্থতার সুযোগ নিচ্ছে অ্যালেন৷ নেবে নাই বা কেন? অ্যালেনের বয়স সবেমাত্র আটত্রিশ৷ আর তার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে একচল্লিশে পড়েছে। শুধু তাই নয় একটি মেয়ে বাচ্চার জন্ম দিয়ে সুখী সংসার গড়ে তোলার আগেই দেহের বাম অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে উইরার৷ নিজের চেয়ে জুনিয়র এক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল সে। মাখোমাখো প্রেম, ভালোবাসা, সুখ। কোনোকিছুর কমতি ছিল না৷ তাদের সুন্দর, স্বাভাবিক সম্পর্ক আর সুখী সংসারে আকস্মিক বজ্রপাত ঘটে। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ ঘুমের ঘোরে স্ট্রোক করে উইরা। এরপর দেড়টা বছর চলে গেল। বিছানা আর হইল চেয়ারেই দিন, রাত কাটায় সে। শরীরের একাংশ অবশ থাকলেও মন, মস্তিষ্ক পুরোপুরি সবল। তাই প্রিয়তম স্বামীকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে এই নারী৷ যদি মন ঘুরে যায়? পৌরুষ চাহিদার কাছে যদি হেরে যায় অ্যালেনের পুরুষালি হৃদয়ের নিগূঢ় ভালোবাসা?

অ্যালেন খুবই কর্মনিষ্ঠ মানুষ। কাজের সূত্রেই দেশ, বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। নারী সঙ্গের দোষ কোনোকালেই ছিল না৷ তাই আকস্মিক নামীকে নিয়ে আসাতে হজম করতে পারেনি উইরা৷ দোষ নামী বা অ্যালেনকেও দেয়নি। নিজের অক্ষমতার প্রতি নিজেই রুষ্ট হয়েছে। চেয়েছে নিজেকে কঠিনভাবে আঘাত করতে। কিন্তু যখনি অ্যারিনের নিষ্পাপ মুখটা দেখেছে দমে গেছে। আর সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে অ্যালেনের ওপর। উইরার অবস্থা দেখে, অ্যালেনের দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করে
প্রচণ্ড লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল নামী। আত্মসম্মানেও আঘাত লেগেছিল খুব। তাই সকলের সম্মুখেই ঘোষণা দিয়েছিল, সে যতদ্রুত সম্ভব চলে যাবে। উইরা বাংলা বুঝে না। তাই ইংরেজিতে বুঝিয়েছিল,

” দেখুন আমি বিবাহিতা। আমার একটি মিষ্টি বাচ্চা আছে৷ পেশায় আমি একজন ডক্টরও। জেনেভাতে বেড়াতে এসেছি। জাস্ট কয়েক মাসের জন্য। অ্যালেন ভাইয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে অ্যামেরিকায়, আমার বাবার বাসাতে। সুইজারল্যান্ড আমার স্বপ্নের দেশ। ইচ্ছে ছিল জীবনে কখনো না কখনো এ শহরে ঘুরতে আসব৷ কিন্তু আমি ফিনান্সিয়াল ইনসল্ভেন্সিতে ভুগছিলাম। আসা যাওয়ার খরচ থাকলেও ছোটো বাচ্চা নিয়ে দীর্ঘদিন এখানে থাকার মতো অর্থ নেই৷ বাবার সঙ্গে মনোমালিন্য চলায় তার থেকেও কিছু নেয়ার আগ্রহ ছিল না৷ অ্যালেন ভাইয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। তাই কথার ছলে অ্যালেন ভাইয়াই বলল, এ শহরে তার দু’টো হসপিটাল রয়েছে। আমি চাইলে সুইজারল্যান্ড আসতে পারি। যতদিন থাকব সপ্তাহে দু’দিন করে তার হসপিটালে বসলে যা সম্মানী দেবে এতে সবটা কভার হয়ে যাবে৷”

অ্যালেনকে শ্রদ্ধাভরে ভাইয়া সম্বোধন এবং প্রফেশন সম্পর্কে জেনে উইরার বিচলিত ভাব দূর হয়৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নামীর পানে৷ স্পষ্ট ইংরেজিতে প্রশ্ন করে,

‘ প্রফেশনের ডিটেইলস জানতে চাই। শুধু ডক্টর বললেই বুঝব কী করে? ডক্টরদেরও ভাগ আছে।’

মৃদু হেসে নামী বলে,

‘ এ ফিজিসিয়ান ওর সার্জন কোয়ালিফায়েড টু প্রাকটিস ইন জিনেকোলজি। ‘

নামীর স্নিগ্ধ মুখের অমায়িক হাসি, দৃঢ়তা পূর্ণ একজোড়া চোখ আর সাবলীল কণ্ঠস্বর শুনে উইরা মুগ্ধ হয়ে যায়। এটুকু একটা মেয়ের দাম্ভিকতা, আত্মসম্মান বোধ আকর্ষণ সৃষ্টি করে মনে৷ নিমেষে সকলকে অবাক করে দিয়ে এক হাত তুলে হাতজোড় করে ক্ষমা চায় উইরা। অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে সরি বলে। অ্যালেন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। উৎফুল্ল দু’টি চোখ নিয়ে তাকায় নামীর পানে। নামী তবু তাদের বাসায় থাকতে রাজি হয় না৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেকে যায় উইরা, অ্যারিন আর নিজের সন্তানের জন্য। বাচ্চাটাকে নিয়ে অবিরাম ছুটোছুটি না করাই শ্রেয়। যতটুকু হয়েছে যথেষ্ট। নামী থেকে যায়। ছোট্ট অ্যারিন আর তার প্যারালাইজড মায়ের সঙ্গে সময় কাটায়। নামীর সঙ্গ পেয়ে উইরার মানসিক বিকাশে উন্নতি ঘটতে শুরু করে। নামীর মুখে বাংলাদেশের গল্প শুনে উইরা। ইউটিউব ঘেঁটে বাংলাদেশের দর্শনীয় কিছু স্থান সম্পর্কেও জানে৷ এভাবে একদিন নামীর পছন্দ সই কিছু বাংলা মুভি দেখা হয়। শোনা হয় হাবিব ওয়াহিদ নামক কণ্ঠশিল্পির গানও। বাংলা ভাষা বুঝে না উইরা। তবু গানের সুর গুলো তাকে টানে। এ জন্য মাঝে মাঝেই নামী তাকে গান শোনায়। এভাবেই একদিন নামীর কণ্ঠে গান শোনা হয়ে যায় অ্যালেনেরও। তার পূর্ব পুরুষদের জন্মস্থান বাংলাদেশে৷ দাদা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে অ্যামেরিকায় এসে ফরাসি এক মেয়ের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। যার বাসস্থান জেনেভা শহরে। এরপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা৷ পার্মানেন্টলি দেশে ফেরা হয়নি আর৷ জেনেভাতেই সেটলড করেছে দাদা। এছাড়া অ্যালেনের মা অ্যামেরিকান নাগরিক। বাবা জেনেভা শহরের নাম করা বিজনেস ম্যান৷ সেই সুবাদে আব্রাম হক অ্যালেনও বিজনেস ম্যান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অ্যালেন যেহেতু বাংলা ভাষা বুঝে তাই চটজলদি প্রেমে পড়ে যায় নামীর কণ্ঠে গাওয়া এই গানটির৷ এরপর থেকে প্রায় রোজই তার দিনের শুরু ঘটে একটি বাংলা গান শুনে।
.
পরিচিত গানের সুর তন্দ্রাচ্ছন্ন রমণীর কর্ণে শিহরণ জাগালো। সহসা কেঁপে ওঠল মৃদুভাবে। ঘুম ছুটে গেল। ত্বরিত আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসল নামী। ভাবল, অ্যালেন আজো ঘুম থেকে ওঠে বাংলা গান শুনছে? নিমেষে গানের কথা গুলোতে হারিয়ে গেল যেন৷ বর্তমানে তার হৃদয়ে চলা অনুভূতি গুলোকেই ছন্দে ছন্দে বুনছে কেউ। ক্ষণকাল পেরুলে গান থেমে যায়। নামীরও হুঁশ ফেরে। বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়। আজ যে রবিবার। তার হসপিটালে যাওয়ার দিন৷ নিশ্চয়ই সুহাস আর সৌধ ভাইয়া আসবে? হৃৎস্পন্দনে চঞ্চলতা বাড়ল নামীর। দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল সুহৃদের পানে। মুহুর্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠল। ঘুমুঘুমু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুহৃদ। তার হাসিতে তাল মিলিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসল কিঞ্চিৎ। নামীর হৃদয় বিগলিত হলো। আবেগে টইটুম্বুর হয়ে টলমল দৃষ্টিতে এগিয়ে গিয়ে ছেলের কপালে চুমু এঁটে বলল,

‘ আমার পাপাটা ওঠে গেছে! মনটা খুব খুশি খুশিও লাগছে। ঘটনা কী সুহৃদ বাবা, কোন বেয়ানের মেয়েকে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙিয়েছ আজ? ‘

ছেলের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠল নামী। তার ছেলেটা হাতে পায়ে ভীষণ ছটফটে হলেও এখন পর্যন্ত মুখে কোনো বুলি আওড়ায়নি। খিদে বা ব্যথা পেলে কাঁদে। কিছু নিয়ে খুশি হলে হাসে৷ এটুকুই। সবে ন’মাস চলছে বলে খুব একটা চিন্তিতও নয়। তবে সে অনেকের কাছে শুনেছিল, বাচ্চারা স্পষ্ট না হলেও আধো ভাবে ছ’মাস পর থেকে মা, বাবা ডাকা আরম্ভ করে। যদিও ডাক্তারি বিদ্যা অন্য কথা বলে। তবু মায়ের মন তো৷ খচখচ করেই। নামীরও করছিল। সে যেন বাচ্চার মুখ থেকে মা ডাক শুনতে মরিয়া হয়ে ওঠেছিল। সব সময় কাছে নিয়ে মা মা বলত। কিন্তু সুহৃদ সেদিকে পাত্তা দেয় না৷ সে তার মতো করেই থাকে৷ একদিন অভিমান করে তাই মোবাইল ঘেঁটে সুহাসের অনেক ভিডিয়ো, ছবি দেখিয়ে বলে,

‘ দেখো এটা তোমার বেআক্কল পাপা। পাপাকে ডাকো তো। ‘

আশ্চর্য হলেও সত্যি সেদিন সুহৃদ কী বুঝেছিল কে জানে? মায়ের কথা বলার ভঙ্গি আর ছবিতে হাঁটা, চলা করা দুষ্ট মতোন অচেনা লোকটাকে দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠেছিল। যে হাসিটা আত্মা শীতল করে দিয়েছিল নামীর। এরপর থেকে বেশ কয়েকদিন সুহাসের বিভিন্ন রকম ভিডিয়ো, ছবি দেখিয়েছে সুহৃদকে৷

দু’দিন আগে লেকের দিকে সুহৃদকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল অ্যালেন। ফেরার পর শুনেছে সুহৃদের মুখে নাকি অস্পষ্ট ভাবে পাপা ডাক শোনা গেছে কয়েকবার৷ নামী বিশ্বাস করেনি৷ তবে বিস্মিত হয়েছে। কীভাবে সম্ভব? অবিশ্বাসটা গাঢ় হয়েছে সুহৃদের মুখে কোনো প্রকার বুলি না শুনে। পাপা তো দূরে থাকুক। যদি সত্যি এমন শব্দ বলে থাকত তার সামনে একবারো বলল না কেন? যতই সে সুহাসের ভিডিয়ো দেখাক, ছবি দেখাক। ন’মাস বয়সের বাচ্চা কীভাবে মনে রাখবে? যদিও বাচ্চাদের ব্রেইন অনেক বেশি শার্প হয় তবু নামী মানতে নারাজ। কারণ, আটমাস পেটে রেখে নয় মাস লালন করার পর ছেলের প্রথম বুলি পাপা হোক চায় না সে৷ সুহাসের প্রতি হিংসেয় বুক ভরে ওঠে ঠিক এ জায়গাতেই। ক্ষণে ক্ষণে মুখও বাঁকায়। কক্ষনো তার সুহৃদ এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে না৷ সুন্দর হৃদয়ের ছেলে তার। এমন পাক্কা দুষ্টুমি করতেই পারে না।

সুহাস, সৌধ দু’জনই জেনেভাতে এসেছে। জানে নামী। ওদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুতও করে নিয়েছে। যখন জানতে পেরেছিল, সুহাস অ্যামেরিকায় যাবে। তখন তার রাগটা গাঢ় হয়। অ্যালেনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠার খাতিরে সুইজারল্যান্ডে চলে আসারও সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সুইজারল্যান্ড আসার পর যখন জানতে পারে সুহাস বদ্ধ উন্মাদ হয়ে জেনেভাতেই আসছে। তখন আর রাগটা প্রগাঢ় করতে পারেনি৷ শুধু অভিমান গাঢ় হয়েছে। সুহৃদকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে। মনে মনে আবার শান্তিও পেয়েছে। সুহাসের মাঝে পারফেক্ট স্বামী না দেখলেও পারফেক্ট বাবার আভাস পেয়ে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নামী। ভাবে এত কাঠখড় যখন পোহাচ্ছে। একটা ফয়সালা তো হওয়াই উচিত। ঝুলে থাকা সম্পর্ক কারোরই কাম্য নয়৷ হয় এসপার নয় উসপার। বাবা ছেলের কাছে অতি সহজে আসতেই পারে৷ কিন্তু ছেলের মা অব্দি আসা এত সহজ নয়। যদি তাই হতো দীর্ঘ এক বছর পাঁচ মাস যুদ্ধ করত না সে। শ্বাসরুদ্ধকর ভাবনা গুলো ভাবতে ভাবতে সুহৃদকে নিয়ে বেরুবার সিদ্ধান্ত নিল। ভোরের স্নিগ্ধ, কোমল পরিবেশে স্বচ্ছ শহরে বেবি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করার মজাই আলাদা। জেনেভা আসার পর রোজ সকালে এই অভ্যাসটা গড়ে তুলেছিল ডক্টর. নামী রহমান। আকস্মিক সিদ্ধান্তটি আতঙ্ক ছড়াল মনে। ডিসেম্বর মাস। শীতের প্রকোপ বেশি। এই ভোরবেলা স্নো পড়ে জেনেভা শহরের সৌন্দর্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে৷ সুহৃদকে নিয়ে দূরে থাক। এ মুহুর্তে তার নিজেরই বেরুনো উচিত হবে না। গত কয়েকটি সপ্তাহ অ্যালেন তাকে বেরুতে দেয়নি। সুহৃদকে একদম নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে মানুষটা৷ মারাত্মক পজেসিভ! সুহৃদও অ্যালেন মামাকে ভীষণ পছন্দ করে। করবে নাই বা কেন? জন্মানোর পর নার্স তো প্রথম অ্যালেনের কোলেই দিয়েছিল সুহৃদকে। অ্যালেন যেমন নামীর প্রিয় বন্ধু। সুহৃদেরও এ পৃথিবীতে মায়ের পর প্রথম বন্ধু।
.
.
বাবার বাড়িতে বাবার কাছে এসেছে সিমরান। বাবা, মেয়ে মিলে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছে। সকালবেলা সৌধ ফোন করে বাবার কাছে আসতে বলেছিল তাকে। কারণ, আজ নামীর সঙ্গে দেখা করার পর সে ভিডিয়ো কল করবে৷ দেখা করাবে নামী আর ক্ষুদে সদস্যটির সঙ্গে। সেই উত্তেজনাতেই দুপুরের খাবার খেয়ে সোহান খন্দকার আর সিমরান অপেক্ষা করছে। সুইজারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের সময় চার ঘন্টা এগিয়ে৷ তাই ওদের অপেক্ষার প্রহর বাড়তে লাগল। এদিকে দশটা থেকে হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৌধ, সুহাস৷ সময় গড়াতে গড়াতে দুপুর আড়াইটা৷ এমন সময় সহসা একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন পেল সৌধ৷ নিমেষে চোখে, মুখে দীপ্তি ছাড়িয়ে পড়ল। ঠিক এই ফোন কলটারই অপেক্ষা করছিল ওরা৷ নিধি গতকাল রাতে জানিয়েছিল, সঠিক সময়ে ঠিক নামী ফোন করবে তোকে৷ ধাতস্থ হয়ে ফোন রিসিভ করল সৌধ। সুহাস প্রায় লাফিয়ে কাছে এসে কান পেতে দিল ফোনে। শান্ত, শীতল, মিষ্টি সেই কণ্ঠটা শুনতেই বুকের গভীরে কম্পন ধরল সুহাসের। ঠিক ষোল মাস পর নামীর ভারিক্কি কণ্ঠ শুনে হৃদয়টা ঠান্ডা হয়ে গেল। যেন ষোল মাস নয় ষোলটা যুগ পর প্রিয়তমার কণ্ঠ শুনল সে। ফোন কেটে দিল সৌধ। আকস্মিক সুহাসকে জড়িয়ে ধরে উত্তেজিত গলায় অভিনন্দন জানালো,

‘ কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত, নামী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিকানা |******| ‘
.
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৫|
ধবধবে সাদা রঙে ঘেরা একটি আলিশান বাড়ি। চারপাশের ভূমি গাঢ় সবুজ, কৃত্রিম ঘাসে সজ্জিত। গাড়ির ভেতর থেকে এ পর্যন্ত দেখে ধীরেসুস্থে নেমে দাঁড়াল সৌধ। সুহাসকে ইশারা করল চটজলদি বেরুতে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে সুহাসের। উত্তেজনায় তলপেট মুচড়ে, মুচড়ে ওঠছে। চোখ, মুখের অবস্থা নাজেহাল। কণ্ঠনালি ক্ষণে ক্ষণে নীরস হচ্ছে। হৃৎস্পন্দন চলছে বিদ্যুৎ গতিতে। সৌধর ইশারা পেয়ে ধাতস্থ হলো। সচেতন ভাবে এক ঢোক গিলে নেমে দাঁড়াল গাড়ি থেকে। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ঝকঝকে, চকচকে আকর্ষণীয় বাড়িটায়। নিমেষে বুকের ভেতর হুহু করে ওঠল। আচমকা একটি হাত চলে গেল বুকের বা’পাশে। কী ভয়ানক ভাবে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা! নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না সুহাস। অদৃশ্য কোনো এক সুতোয় যেন বাঁধা পড়ল তার সমস্ত সত্তা। সৌধকে রেখেই কোনোদিকে না তাকিয়ে তরান্বিত হয়ে এগিয়ে গেল।

সৌধ বুঝতে পারল ওর অনুভূতি। তাই কিছু না বলে নিজেও ছুটে গেল। যেতে যেতে বাড়ির চারপাশটায় নজর বুলালো সুক্ষ্ম ভাবে। সম্মুখের একপাশ জুড়ে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম পশুপাখির মূর্তি, নাম জানা এবং না জানা অনেক ফুল গাছের সমাহার। আরেক পাশে পাশাপাশি দু’টো দোলনা, রাজকীয় একটি ডিভান আর সুইমিং পুল। এ বাড়ির মালিক ভীষণ রুচিশীল। বাড়ির সম্মুখে ছোটোখাটো, স্বচ্ছ, সুন্দর, আকর্ষণীয় পার্ক দেখে বাড়ির সদস্যদের প্রতি মনে মনে ইতিবাচক ধারণা করল সৌধ। ওরা দু’জন যখন সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপবে ভাবল ঠিক সেই মুহুর্তেই দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো, ধবধবে ফরসা দেহের বলিষ্ঠ এক পুরুষ। সৌধ, সুহাস দু’জনই থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল। সম্মুখের পুরুষ লোকটি চোখে মুখে দীপ্তি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল সুহাসের দিকে। বলল,

‘ হ্যালো, আই এম আব্রাম হক অ্যালেন। নামী’স বেস্ট উইশার। ‘

স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত বাড়াল সুহাস। অ্যালেন হাত মিলিয়ে সৌধর দিকেও হাত বাড়াল। সুহাস পলকহীন অ্যালেনকে দেখতে লাগল। ঢোক গিলল নীরস গলাটা ভেজাতে। ওর হৃৎস্পন্দন এবার থমকে আছে। কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে মস্তিষ্ক। কুর্ণিশ শেষে ওদের দু’জনকে ভেতরে নিয়ে গেল অ্যালেন৷ সৌধ সুহাসের পেটে কনুই দিয়ে গুঁতা দিল। নিচু স্বরে বলল,

‘ ভেড়ার মতো মুখ করে না থেকে মানুষের মতো থাক। নিজের বউ বাচ্চার কাছে আসছিস। আব্রাম হক অ্যালেনের না। ‘

সৌধর এহেন কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেল সুহাস। শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে ওঠল৷ নিমেষে উথাল-পাতাল শুরু হলো বুকে। নামী কোথায়? তার সন্তান কোথায়?

ওরা ভেতরে প্রবেশ করলে ড্রয়িংরুমে দু’জন ভদ্রমহিলা আর একটি ছোটো বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেল। ভদ্রমহিলাদের মধ্যে যার বয়স কম সে হুইলচেয়ারে বসা। অ্যালেন তাদের দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল,

‘ আমার মা আর স্ত্রী উইরা। ‘

অ্যালেনের চেহেরায় বাঙালির চিহ্ন বলতে ওই চোখ দু’টোই। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা, চুল গুলোও ব্রাউন কালার। তাই বাংলা বলাতে বিস্মিত হয়েছিল সৌধ, সুহাস। সেই বিস্ময় কাটিয়েছে অ্যালেন নিজেই৷ সগর্বে জানিয়েছে তার শরীরে বাঙালির রক্ত বইছে। অ্যালেনের বয়সটা ঠিক আঁচ করতে পারছিল না ওরা দু’জন৷ কিন্তু স্ত্রীর পরিচয় পেয়ে বুঝতে পারল ভদ্রলোক তাদের থেকে ঢের সিনিয়র। স্বস্তি পেল সুহাস। অ্যালেন বিবাহিত। হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল ছেলেটা। এরপর অ্যালেন অ্যারিনের সঙ্গে পরিচয় করানোর পূর্বেই গুটিগুটি পায়ে অ্যারিন সামনে এসে দাঁড়ায়। দু-হাত কোমরে রেখে পিটপিট করে তাকিয়ে সৌধ, সুহাসকে দেখে নিয়ে অ্যালেনকে প্রশ্ন করে,

‘ পাপা, হুইচ ওয়ান ইজ সহৃদ’স ফাদার? ‘

সৌধর চোখ দু’টো ছোটো ছোটো হয়ে গেল। ভাবল, সুহাসের ছেলের নাম তাহলে সুহৃদ? চমৎকার! সুহাস স্তম্ভিত! সুহৃদ? তাদের ছেলের নাম সুহৃদ রেখেছে নামী? মেয়ের প্রশ্নে অ্যালেন স্মিত হাসে প্রথমে সৌধ, সুহাসকে বলে,

‘ আমার একমাত্র মেয়ে অ্যারিন হক। ‘

এরপর অ্যারিনকে ইংরেজিতে বলে,

‘ তুমি দু’জনকে দেখে চিহ্নিত করো তো পাপা কোনটা সুহৃদের পাপা? ‘

ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল অ্যারিন৷ দু’জন আংকেলই ভীষণ স্মার্ট। সুহৃদও স্মার্ট বেবি। তাহলে সে বুঝবে কী করে কোনটা ওর পাপা? অ্যারিন চিন্তায় মশগুল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে সৌধ, সুহাসকে। অ্যালেন ওদের বসতে বলল। সৌধ বসলেও সুহাস বসল না। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,

‘ নামী? ‘

সুহাসের অস্থিরতা আর চোখ দু’টো দেখে অ্যারিন হঠাৎ চ্যাঁচিয়ে ওঠল৷ হাত তালি দিতে দিতে বলল,

‘ সুহৃদ’স ফাদার! ‘

অ্যালেন মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ টিপ্পু মাসিকে বলো, সুহৃদকে নিয়ে আসতে। ‘

সুহাসের বুকের ভেতর ধড়াস করে ওঠল। অ্যালেনের মা চলে গেল, গৃহকর্মীদের অতিথি আপ্যায়নে তাড়া দিতে। সুহাসের অবস্থা তখন বিধ্বস্ত প্রায়। সৌধ টের পেল অত্যাধিক উত্তেজিত হওয়ার ফলে ওর নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। তীব্র শীতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম৷ এক পর্যায়ে শরীরে জড়ানো শীতের পোশাকটা খুলে ফেলল সুহাস৷ বন্ধুর অবস্থা দেখে সৌধ আর চুপ থাকতে পারল না। অ্যালেনকে জিজ্ঞেস করল,

‘ মিস্টার অ্যালেন, নামী কোথায়? ‘

সৌধর এ প্রশ্নে অ্যালেনের মুখে হাসি বিলীন হয়ে গেল। অচঞ্চল পায়ে এসে বসল সৌধর পাশে। সুহাসের দিকে এক পলক তাকিয়ে মৃদু গলায় সৌধকে বলল,

‘ অনেক বুঝিয়েছি। সে কিছুতেই মিস্টার সুহাসের সামনে আসতে রাজি হলো না৷ তার বক্তব্য আপনারা যতদিন এখানে থাকবেন ততদিন মিস্টার সুহাস তার সন্তানের সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করার সুযোগ পাবে। বাকি সব ফয়সালা দীর্ঘ কিছু মাস পর বাংলাদেশে গিয়ে করবে৷ ‘

আকস্মিক যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল সুহাসের। সৌধ হতবাক! এ কেমন ছেলেমানুষী? অ্যালেন সুহাসের কাঁধে হাত রাখল। বিনয়ের সুরে বলল,

‘ মিস্টার সুহাস, হতাশ হবেন না৷ আপনার স্ত্রীর অভিমান ভীষণ প্রকট। দুর্ধর্ষ জেদ। নিঃসন্দেহে ভেতরে ভেতরে আপনার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা লালন করে সে। কিন্তু অদৃশ্য এক রাগ, জেদ আর তীব্র অভিমানের বেষ্টনে তা প্রকাশ করতে পারছে না৷’

অ্যালেনের স্বান্তনা বাণী কাজে দিল না। স্থির নেত্রে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুহাস৷ বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল। অস্থির চিত্তে বলল,

‘ নামী কোথায় মিস্টার অ্যালেন? আমি নামীর কাছে যাব। ওকে বলুন আমি এসেছি, ওর সুহাস এসেছে। আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি৷ স্টিল নাও স্বীকারও করছি৷ হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব। তবু প্লিজ ওকে আমার সামনে আসতে বলুন। আমি আর নিতে পারছি না, পারছি না নিতে৷ ‘

মন, মস্তিষ্ক জুড়ে তীব্র এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। বদ্ধ উন্মাদের মতো এক শব্দ, এক বাক্য বারবার উচ্চারণ করতে লাগল সুহাস। অ্যালেন আশ্চর্য হয়ে গেল সুহাসের অস্থিরতা দেখে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন যুবক কতটা ছেলেমানুষ হতে পারে স্বচক্ষে দেখে নিল সে। শুধু তাই নয়। নামীর মতো শক্ত ধাঁচের মেয়ের জীবনে এমন সরল, উন্মাদ প্রেমিকের সরূপ দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ তার বিপরীত স্বভাবের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়৷ সুহাস ঠিক তাই হয়েছে। যতটুকু বুঝেছে নামীও এই ছেলেকে ভালোবাসে। তবে কেন এই দূরত্ব? দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে, মেয়ের এই ছেলেমানুষি কি শোভা পায়? সম্পর্ক, ভালোবাসা, সন্তানের চেয়েও কি অভিমান, জেদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ? সহসা একটি কথা মনে পড়ে গেল অ্যালেনের। নামী সব সময় বলে, তার কাছে জীবনের চেয়েও সম্মান বড়ো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অ্যালেন৷ স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকাল সুহাসের পানে। সৌধ ওকে সামলানোর চেষ্টা করেও সামলাতে পারল না৷ শেষে বাধ্য হয়ে যে নাম্বার থেকে নামী তাকে ফোন করেছিল সেই নাম্বারে কল করতে উদ্যত হলো। দু’জন গৃহকর্মী হালকা নাস্তা নিয়ে এসেছে। ত্বরিত সেগুলো টেবিলে রেখে চলে গেল তারা৷ এরপরই বেবি রকারে সুহৃদকে নিয়ে হাজির হলো টিপ্পু মাসি আর অ্যারিন। ফলশ্রুতিতে সৌধর আর নামীকে কল করা হলো না৷

টিপ্পু মাসি ফিরে গেল। নামীর অবর্তমানে সুহৃদের দেখভাল সেই করে। ভেতর ঘর থেকে অ্যারিনকে শিখিয়ে দিয়েছে নামী৷ সুহাসকে জানাতে সুহৃদের পুরো নাম। তাই অ্যারিন ইংরেজিতে স্পষ্ট ভাষায় বলল,

‘ সুহাস আংকেল, আপনার ছেলে – নুহাস খন্দকার সুহৃদ। ‘

সহসা সকল উত্তেজনা মিলিয়ে গেল সুহাসের। বিস্ময়াপন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল, একটি ছোট্ট, কোমল নিষ্পাপ শিশু। যার শুভ্র দেহের, কোমল মুখটায় চোখ পড়া মাত্র সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল৷ ছোট্ট গোলগাল মুখটার টকটকে ঠোঁট, লম্বা নাক, ধূসর বর্ণের ছোট্ট ছোট্ট দু’টি চোখ আর মাথা ভর্তি হালকা ব্রাউন কালার চুল দেখে হৃদয় জুড়ে অনুভব করল শীতল শিহরণ। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার সৌধর দিকে চোখ ফিরাল। টলমল হয়ে ওঠল দৃষ্টি। চোয়ালদ্বয় কাঁপছে। মিলিয়ে যাওয়া উত্তেজনা পুনরায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে সামলাতে না পেরে ডান হাতটা ওঠিয়ে মুখে সামনে নিয়ে একবার কামড়ে ধরল। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সৌধকে বলল,

‘ আমার ছেলে! ‘

একটু থেমে ফের বলল,

‘ আমার সন্তান আমাকে চেনে সৌধ। সেদিন লেকের পাড়ে পাপা ডেকেছিল ওই তো! কী কপাল আমার প্রথম দর্শনে ছেলেকে চিনতে পারিনি, ছুঁতে পারিনি। ছেলে কিন্তু ঠিক বাবাকে চিনতে পেরেছে। ‘

চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে গেল সৌধর। বিস্ময়ে শিহরণ জাগল শরীর জুড়ে। হতভম্ব হয়ে গেল অ্যালেনও। পুরো বিষয়টা বুঝে ফেলল সৌধ। আচমকা সুহাসকে জাপ্টে ধরে স্বাভাবিক করতে বলল,

‘ আলহামদুলিল্লাহ! পৃথিবীতে কোইন্সিডেন্স শব্দটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি সুহাস৷ নিজেকে সামলা। ভাতিজা আমাদের মাশাআল্লাহ। যেমন দেখতে তেমনি ট্যালেন্ট। নজর না লাগুক৷ ‘

বন্ধুর বুকে বুক মিলিয়ে পিঠে শক্ত করে চাপড় দিতে দিতে ফের বলল,

‘ দেখ কীভাবে তাকিয়ে আছে। কাছে যা ব্রো, কাছে যা বুকে আগলে নে। এই বাচ্চাই তোকে আর নামীকে এক করবে দেখে নিস৷ তুই জাস্ট মাথাটা ঠান্ডা রেখে সব সামলে যা। ‘

নিজেকে সামলালো সুহাস। ধাতস্থ হয়ে চোখের পানি মুছে তাকাল সুহৃদের দিকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সুহৃদ। সুহাস, সৌধ ওর দিকে তাকাতেই এক পাশে মাথা কাত করে হাসল। সৌধর মুখটা হা হয়ে গেল বাচ্চার কাণ্ড দেখে। আর সুহাস ছেলের স্বাগতম পেয়ে আবেগে টইটুম্বুর। চোখ, নাক লাল হয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু করল তার। বুকে ধুকপুক নিয়ে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিমায় মৃদু পায়ে গিয়ে ছেলের সামনে এক হাঁটু গেঁড়ে বসল। কম্পিত দু’টো হাত বাড়িয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বন্ধ করল চোখ দু’টি। ভারিক্কি শ্বাসের পাশাপাশি অবিরাম অশ্রু ঝড়ল চোখ বেয়ে। সুহৃদ নিশ্চুপ। আপন, আপন উষ্ণ বুকে মিলিয়ে রইল। সুহাস চোখ বন্ধ রেখেই একের পর এক চুমু খেল ওর সারা গায়ে। পিতা পুত্রে এহেন মিলন দৃশ্যে উপস্থিত সকলের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। না চাইতেও সৌধর চোখ দু’টি ঝাপসা হয়ে ওঠল। সে ন্যায়, অন্যায়, ভুলচুকের ঊর্ধ্বে গিয়ে দীর্ঘ মাস ব্যাপি বন্ধুর করুণ দশা গুলো স্মরণ করে আজকের এই মুহুর্তে আবেগি না হয়ে থাকতে পারল না।

ড্রয়িং রুমের উত্তর কর্ণারে থাইগ্লাসের দেয়াল। দেয়ালের ওপারে ছোট্ট একটি রুম। অ্যারিনের খেলার ঘর এটি। যে ঘরের ভেতর থেকে বাইরের সবকিছু দেখা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে ভেতর দেখা সম্ভব না। ঠিক এই সুযোগটাই নিয়েছে নামী৷ আড়ালে থেকে সবটা অবলোকন করতে করতে কখন যে তার হৃৎস্পন্দন থমকে গেছে টেরই পায়নি। চোখ গলেও বেড়িয়েছে নোনা পানির ধারা…।
.
.
খুবই অল্প সময়ে সুহাসের সঙ্গে সুহৃদের সখ্যতা গড়ে ওঠল। ঘন্টা দুয়েক আগে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। সৌধ সম্মানার্থে একটু মুখে তুললেও সুহাস ছেলেতে মগ্ন। কখনো বুকে আগলে, কখনো বা কাঁধে তুলে ড্রয়িংরুম জুড়ে পায়চারি করছে সুহাস। একবার সোফায় বসে আদরে, আহ্লাদে গল্প করছে তো আরেকবার চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলছে বাচ্চাকে। টিপ্পু মাসি এরই মধ্যে দু’বার সুহৃদের খাবার নিয়ে এসেছে। আনাড়ি হাতে সুহাসই খাইয়ে দিয়েছে ছেলেকে। সৌধ ভিডিয়ো কলে সোহান আংকেল আর সিমরানকে সেসব কাণ্ড দেখিয়েছে। ওদেশে বাবা, মেয়ে মিলে কান্না, হাসিতে লুটোপুটি। সামনে ফোন ধরলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সুহৃদ। সোহান খন্দকার দাদুভাই দাদুভাই করে চ্যাঁচায়৷ চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে তার৷ সুহৃদ হাসে। সোহান খন্দকারের গলা যত বাড়ে সুহৃদের হাসি বিস্তৃত হয়৷ খিলখিল করে হাসে ছেলেটা। সিমরান মুখে হাত চেপে অবাক হয়। মনে পড়ে আম্মুকে। সুহৃদের হাসি, চোখ দু’টো ঠিক তার মায়ের মতো। হবে নাইবা কেন? তাদের পরিবারের ছেলে সুহৃদ। আহ্লাদে গদগদ হয় মেয়েটা। টলমল চোখে সৌধর পানে তাকায়৷ আফসোস করে, কেন তাকে নিয়ে গেল না? কেন সে সুহৃদকে ছুঁতে পারছে না? চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলতে পারছে না ওর গুলুমুলু গালটা? সৌধ স্মিত হাসে৷ সুহৃদের গাল টেনে আদর করে দেয়৷ যেন ভাতিজাকে নয় তার ফুপুমনির গালটাই টেনে আদর করে দিল। আড়াল থেকে সবটাই দেখে যায় নামী। সবকিছুর ভীড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল করে সুহাসকে। ছেলেতে বিভোর থাকলেও ওর দৃষ্টি ক্ষণে ক্ষণে অচঞ্চল হয়ে পড়ছে। অস্থির চিত্তে খুঁজে বেড়াচ্ছে শুধুই তাকে৷ এত আনন্দ, হাসিখুশির ভীড়ে সুহাসের ভেতরকার তীব্র বিষাদসিন্ধু দেখতে পেল সে। শরীরটা কেমন ভেঙে পড়েছে। আগের মতো সুস্বাস্থ্য নেই৷ সর্বাঙ্গ জুড়েই বিষণ্নতার ছাপ৷ বহু বছর আগের সেই হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা মনে পড়ল নামীর। কিন্তু ওই বয়সে ওই ছেলেটার হ্যাংলা, পাতলা রূপ মানানসই লাগলেও আজ এ বয়সে এসে একদম মানাচ্ছে না। মানুষের অভাবের চেয়ে বড়ো অভাব পৃথিবীতে আছে কী? নেই। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণার চেয়েও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা কী হতে পারে? নিজের ভুল কর্ম দ্বারা এ পৃথিবীতে অনেকেই মানুষ হারায়। ভালোবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। নিঃসঙ্গতা এক ভয়ানক ব্যাধি৷ এই ব্যাধিতে যে আক্রান্ত হয় সেই জানে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কী কঠিন! প্রিয় মানুষ ছাড়া জীবন কী দুর্বিষহ। রুদ্ধশ্বাস ফেলে নামী৷ সহসা দু’হাতে মুখ চেপে ধরে ডুকরে ওঠে।

বাংলাদেশে সময় যখন দু’টো ছুঁই ছুঁই। সুইজারল্যান্ডে তখন দশটা। আজ বাবার বুকেই ঘুমিয়ে গেছে সুহৃদ। যদিও দীর্ঘ সময় মাকে না পেয়ে ছটফট করছিল। কিছুক্ষণ গুনগুনিয়ে কেঁদেছেও। সুহাস কতবার অনুরোধ করেছে অ্যালেনের কাছে। একবার নামীকে আসতে বলুন। আসেনি। ছেলের ছটফট দেখে এরপর ওকে সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পিতৃ সত্তার জাদুবলে সামলে নিয়েছে সন্তানকে। এভাবেই এক সময় ঘুমিয়ে গিয়েছে সুহৃদ। সৌধও শশুর আর বউকে বিদায় দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। যদিও তারা নামীর সঙ্গে কথা বলার জন্য উৎকন্ঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু সৌধ নামীর সিদ্ধান্ত চেপে গিয়ে কৌশলে তাদের দমিয়ে রেখেছে। সুহৃদ ঘুমালেও ওকে ছাড়ল না সুহাস৷ এদিকে রাতের খাবার আয়োজন চলছে। হঠাৎ সৌধ বুদ্ধি করে অ্যালেনকে বলল,

‘ সুহৃদ তো ঘুমিয়ে গেছে। ওকে বেডরুমে নেয়া উচিত। ‘

এরপরই টুপ্পি মাসি এলো। হাত বাড়াল সুহৃদকে নিতে। রেগে গেল সুহাস৷ সুহৃদকে বুকে আগলে ধরে বলল,

‘ আমি দিব না৷ কোন ঘরে নিয়ে যাব ওকে তাই বলুন।’

টুপ্পি মাসি দৃঢ় দৃষ্টিতে অ্যালেনের দিকে তাকাল। অ্যালেন ইশারায় নিয়ে যেতে অনুমতি দিলে টুপ্পি মাসি আগে গেল। আর সুহাস গেল পিছন পিছন। নামীর ঘরেই নিয়ে গেল সুহাসকে। কিন্তু ও ঘরে নামী নেই৷ সুহাস হতাশ হলো এতে। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই বেবি বেবি ঘ্রাণ আর নামী নামী ঘ্রাণ মিলেমিশে তার নাকে ধাক্কা খেলো যেন। চারপাশে যা কিছু দেখল সবটাই ভীষণ আপন আপন মনে হলো। টুপ্পি মাসি সুহৃদের বিছানা ইশারা করলে সুহাস গিয়ে ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়ল। এক হাত সুহৃদের বুকের ওপর হালকা করে রেখে কপালে এঁটে দিল স্নেহময় পরশ। নিষ্পাপ মুখটা নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা সুহাস।

সুহাস ভেতর ঘরে চলে গেলে সৌধ বুদ্ধি করে অ্যালেনকে প্রশ্ন করল,

‘ নামী ওর ঘরে নেই রাইট? ‘

অ্যালেন মাথা নাড়ল। সৌধ মৃদু হেসে বলল,

‘ একটি সাহায্য চাই করবেন? ‘

‘ আমি ভীষণ সাহায্যপ্রিয় মানুষ। বলুন? ‘

‘ নামীকে গিয়ে বলবেন আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই? সুহাসের সঙ্গে দেখা না দিক সম্ভব হলে দশ মিনিটের জন্য আমার সঙ্গে একাকী যেন দেখা দেয়। জোর করছি না জাস্ট প্রস্তাব রাখছি। বাকিটা সম্পূর্ণ নামীর ইচ্ছে। ‘

হাসল অ্যালেন। বুঝল এই ছেলেটা অসম্ভব বুদ্ধিমান। এরপর চলে গেল নামীর কাছে৷ নামীকে গিয়ে সৌধর প্রস্তাবটি রাখলে এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল নামী। বলল,

‘ এ ঘরেই আসতে বলুন উনাকে। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
রিচেক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭৩

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৩|
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর৷ অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে পরিপাটি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সৌধ। ড্রাইভিং সিটে বসেছে সে। পাশে সিমরান৷ সৌধর চোখে স্টাইলিশ সানগ্লাস। পরনে ধূসর বর্ণের শার্ট, কালো প্যান্ট এবং শার্টের ওপর কালো রঙের কোটি ব্লেজার। সেই কিশোরী বয়স থেকে সৌধর স্মার্টনেস, গেটআপ আর ব্যক্তিত্বে ভীষণ দুর্বল সিমরান৷ সেই দুর্বলতা আজ গাঢ় হলো। কারণ মানুষটাকে আজ নতুন লাগছে। সম্পূর্ণ অন্যরকম। ঠিক যেমনটা সে চেয়ে এসেছে। যেভাবে পাওয়ার জন্য দিন গুনেছে। খুব বেশি দূরের পথ নয়৷ জায়গাটা পরিচিত সিমরানের। সাত্তার চাচার চা স্টলের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সৌধ। চৌধুরী বাড়ির গাড়ি দেখতে পেয়েও বৃদ্ধ সাত্তার চাচা এগিয়ে এলো। কুঁজো হয়ে হাঁটে লোকটা। গাড়ির কাছাকাছি এলে সৌধ কুশল বিনিময় করল৷ সিমরান একটু মাথা উঁচিয়ে এগিয়ে এসে শুধাল,

‘ ভালো আছেন? ‘

সাত্তার চাচা অমায়িক ভঙ্গিতে হেসে বলল,

‘ আলহামদুলিল্লাহ আম্মাজান। আপনি ভালো আছেন? ‘

সিমরান খুশিমনে মাথা দোলাল। সৌধ সাত্তার চাচাকে দু’টো দুধ চা, দু’টো ভাপা পিঠে আর দু’টো ডিম সিদ্ধ পাঠাতে বলে গাড়ি নিয়ে চলল বাংলোর দিকে। সিমরান বুঝল, আজ বাংলোতেই তাদের ব্রেকফাস্ট সারতে হবে৷ অল্প সময়ের জন্য যে আসা হয়নি এও বুঝল৷ পরিচিত জায়গাটিতে দ্বিতীয়বার এসে বুক ধুকপুক শুরু হলো সিমরানের। বুকের গভীরে প্রথমবারের সেই তিক্ত স্মৃতি হানা দিতে শুরু করল৷ ক্রমশ শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হতে শুরু করলে সৌধর দিকে তাকাল অসহায় দৃষ্টিতে।

এক বছরে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে বাংলোটার। ভেতরে গাড়ি পার্ক করার জায়গা করা হয়েছে। পুকুরের কাছটায় ছন দিয়ে ছাউনি তোলা হয়েছে। ছাউনির ভেতর পাশাপাশি ইট, সিমেন্টে তৈরি দুটো বসার জায়গা। সামনে ইট, সিমেন্টের গোলাকৃতির ছোট্ট টেবিল। দূর থেকে এসব আপ্লুত হয়ে গেল সিমরান৷ একদিকে সেদিনের প্রত্যাখ্যান মুহুর্ত, ম্রিয়মাণ হওয়া যন্ত্রণা অপরদিকে ভালোলাগা দুইয়ে মিলে মিশ্রিত অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে রইল। শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে মৃদু পায়ে হেঁটে চলেছে সিমরান৷ ওর পেছনে সৌধ। লং স্কার্টের সঙ্গে লেডিস শার্ট পরনে সিমরানের। গলায় পাতলা একটা স্কার্ফ ঝুলানো। পিঠ জুড়ে ব্রাউন কালার সিল্কি চুল কোমর অব্দি ছুঁয়ে যাচ্ছে। একপেশে হেসে পকেটে দু-হাত গুঁজে হাঁটছে সৌধ। একমনে অবলোকন করছে তার রৌদ্রময়ীকে। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে নেশাময়ীকে নেশাতুর প্রেম নিবেদনে।

ছাউনির নিচে গিয়ে বসতে বসতেই সাত্তার চাচা ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির হলো। সৌধ বাড়ি থেকে একটি ফ্রেশ ওয়াটার বোতল নিয়ে এসেছিল৷ তাই এখান থেকে আলাদা পানির প্রয়োজন পড়ল না। সিমরান চুপচাপ বসে আছে৷ সম্মুখের টেবিলে থাকা গরম গরম ভাপা পিঠে, ডিম সিদ্ধ, আর চা থেকে ধোঁয়া উড়ছে৷ সৌধ ইশারায় খেতে বললে সিমরান মৃদু হেসে আগে ডিম খেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। সৌধ ততক্ষণে ডিম সিদ্ধটা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ফেলেছে৷ সিমরানও এবার চায়ে চুমুক দিল। ফাঁকে আকস্মিক বলল,

‘ আমি এখানে পুরোপুরি কমফোর্ট ফিল করছি না সৌধ ভাই। ‘

‘ মি ঠুয়্যু। ‘

চমকে ওঠল সিমরান৷ সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সৌধর পানে৷ সৌধ ভ্রু বাঁকিয়ে শাসনি সুরে স্পষ্ট বাক্যে বলল,

‘ বউয়ের মুখে ভাই শুনতে ভালো লাগে না৷ আম্মা কতবার নিষেধ করেছে? আমিও তো কম শুধরে দিই নি৷ তবু সৌধ ভাই, সৌধ ভাই করে গলা শুঁকিয়ে ফেলিস কেন? এটার জন্যই কি বিয়ে করেছিস? আমাকে ভাই ভাই ডাকার জন্য তোর সঙ্গে আমি কোনো চুক্তি করিনি রাইট? ‘

কিঞ্চিৎ লজ্জা আর সীমাহীন বিস্ময় ভর করল সিমরানের মুখে। নিঃসন্দেহে এটা তার জন্য আনন্দদায়ক। মন থেকে বউ না মানলে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে বারবার নিষেধাজ্ঞা দিত না৷ এ বিষয়টা নিয়ে সে দাদুনির তোপের মুখে পড়েছে বহুবার৷ শাশুড়িও বুঝিয়েছে অনেক। তবু মন থেকে শুধু সৌধ ডাকটা আসেনি৷ কিছুটা অভিমান থেকেই৷ কারণ সৌধ এখনো তাকে তার পূর্ণ অধিকার দেয়নি। অবশ্য কথা ছিল এমনই। যতদিন না মানুষটা তাকে ভালোবাসতে পারবে, মনের দখলদারি দিতে পারবে। ততদিনে দৈহিক কোনো সম্পর্কে এগুবে না৷ আগে মনের সম্পর্ক গড়বে পরে দেহের মিলন। সিমরানের অভিমান একটা জায়গাতেই। তার এত ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, বিয়ের এতগুলো দিন একসঙ্গে কাটানো। তবু মানুষটার মনে সে জায়গা নিতে পারেনি? শুধু মুগ্ধতা আর ভালোলাগা ছাড়া বিশেষ কোনো জায়গা করতে পারেনি? তীব্র ভালোবাসা থাকলেও না পাওয়ার বেদনায় তীব্র অভিমানী হয়ে পড়ে সে। কিন্তু বুঝতে দেয় না কাউকেই৷ কারণ, সে সব জেনে-বুঝে আকাশসম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই সম্পর্কে জড়িয়েছে।
মনে মনে অনেক হিসেবনিকেশ করল সিমরান। এরপর অকপটে মিহি স্বরে জবাব দিল,

‘ আম্মা নিষেধ করেছে। কিন্তু সে তো জানে না আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক কোনো সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। যে কারণে পুরোনো অভ্যেস ইজিলি বদলে ফেলা যাবে। আর তুমিও এখন পর্যন্ত আমাকে সেভাবে ট্রিট করোনি৷ যাতে আমার মনে হবে এবার বরকে বরের মতো ট্রিট করা যাবে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আমি পরিপূর্ণ ভাবে স্ত্রীর অধিকার পাইনি। বয়সে সিনিয়র তুমি৷ নাম ধরে ডাকার সেই লাইসেন্সটা নেই। যে লাইসেন্স পেলে আমার কাছে আমি বেয়াদব হবো না। ‘

সিমরানের মুখে জড়তা-সংকোচ ছাড়া স্পষ্ট বাক্য গুলো শুনে থতমত খেয়ে গেল সৌধ। বিস্ময়ে টালমাটাল অবস্থা হলেও এক টুকরো সুখ এসে ভরে ওঠল হৃদয় কোণে৷ আবার প্রশ্ন জাগল, সিনু কি তার অপারগতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল? সে বউয়ের সম্পূর্ণ নিডস পূরণ করতে অপারগ? মুহুর্তেই চায়ের কাপটা ঠুশ শব্দ করে টেবিলে রাখল সৌধ। কেন যেন অস্থিরতা অনুভব করল নিজের ভেতর৷ চা খেয়ে নাকি বউয়ের সুপ্ত ব্যথাসূচক কথা শুনে বোধগম্য হলো না। এদিকে তার আচরণ দেখে সিমরান কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল। ভাবল, রেগে গেল কী? পরোক্ষণেই সৌধর কথা শুনে স্বাভাবিক হলো,

‘ তুই কেন কমফোর্ট ফিল করছিস না? ‘

এবার আর সৌধর দিকে দৃষ্টি রাখল না সিমরান। নত মস্তকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ তোমার তো বোঝা উচিত। দায়ী তো তুমিই। ‘

আকস্মিক সেদিনের সেই প্রত্যাখ্যান বাক্য, স্মৃতি মনে পড়ল সৌধর৷ কিছু বলল না আর। ভাপা পিঠে ঠান্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না। তাই এগিয়ে দিল বউকে। পাশাপাশি নিজেও খেয়ে পানি পান করল। অপেক্ষা করল সিমরানের খাওয়া শেষ হবার৷ এরপর সে পানি এগিয়ে দিল। সিমরান পানি পান করে সুস্থির হলে বলল,

‘ আজ আমার ত্রিশতম জন্মদিন। কী গিফট করবি আমায়? ‘

সৌধ জানত সিনু তার জন্য অনলাইন ঘেঁটে ঘুঁটে অনেক কিছু কিনেছে। পাশাপাশি এতদিন আম্মার থেকে শেখা রান্না গুলোও আজ সম্পূর্ণ একা করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবু জিজ্ঞেস করল প্রশ্নটা। প্রশ্নটি শুনে নিমেষে চোখ তুলে তাকাল সিমরান। চোখেমুখে ফুটে ওঠল দীপ্তি। মৃদু হেসে বলল,

‘ তোমার পছন্দের কিছু খাবার রান্না করে খাওয়াব৷ এছাড়া আরো গিফট আছে সেগুলো তো এখানে নিয়ে আসিনি৷ বাসায় গিয়ে দেখাব৷ ‘

চঞ্চলিত পাখির ন্যায় বলল সিমরান৷ মুখ ভরে হাসল সৌধ। অনেকটুকু দুষ্টুমি খেলা করল সে হাসিতে। বলল,

‘ আমার আরো স্পেশাল কিছু চাই। ‘

কথাটা বলে সিমরানকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়ে ফের ভরাট কণ্ঠে গভীরতা মিশিয়ে বলল,

‘ আজ এখানে কেন নিয়ে এসেছি জানো বউপাখি? ‘

জীবনে প্রথমবারের মতো সৌধর মুখে তুমি সম্বোধন শুনে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠল সিমরানের। তুমি, বউ আবার তার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়ে পাখি সম্বোধনে শরীরের শিরা-উপশিরায় বয়ে গেল অচীন তরঙ্গ। চকিতে তাকাল সুপুরুষটির পানে। তাকাল সৌধও। দু’জনার দৃষ্টি মিলন হতেই চোখ নামিয়ে নিল সিমরান। সৌধ স্মিত হেসে বলল,

‘ আমি হেরে গেছি এক মহিয়সী প্রণয়ীর কাছে। আমি হেরে গেছি গভীর সংযমী, তীক্ষ্ণ ভালোবাসা প্রবণ বউটির কাছে। হেরে গিয়েও নিখুঁত ভাবে জেতা যায়, অনুভব করা যায় স্বর্গীয় সুখ। বাঁধা পড়া যায় চিরতরে। আমি তোমাতে হেরেছি, তোমাতেই জিতেছি। তোমাতে পেয়েছি সুখ, বাঁধা পড়েছি চিরতরে। ‘

দম ছাড়ে সৌধ৷ ঢোক গিলে স্থিরনেত্রে তাকানো মুখশ্রীতে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় বলে,

‘ সিনু পাকনি? অনেক বছর আগে তোমার পাকা পাকা কথা, স্মার্টলি চলাফেরা আর প্রচণ্ড দাম্ভিকতা দেখে আমি বলেছিলাম মেয়েটা খুব পাকনি। একদম পাকা বুড়ি। সুহাসকে বহুবার বলেছি, তোর বোন ইঁচড়েপাকা। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি ভবিষ্যতে এই ইঁচড়েপাকা, পাকনি বুড়িটার পাকা ভালোবাসার জোরে আমার গভীর শোক সুখে পরিণত হবে৷ ‘

ফের একটুক্ষণ থামে সৌধ। শ্বাস নেয় লম্বা করে৷ সিমরান তখনো স্থির চোখে তাকিয়ে বাকহারা হয়ে বসে। সৌধ হাত বাড়ায়৷ একটুখানি গাল ছুঁয়ে নরম স্বরে বলে,

‘ সেদিন তুমি বলেছিলে আমি একজনের স্বার্থপরতা যেমন ভুলতে পারিনি৷ তেমন তুমিও আমার প্রত্যাখান ভুলতে পারবে না৷ বিলিভ মি. আমার মন মস্তিষ্ক চেয়েছে বলেই আমি নিজের জীবনের সঙ্গে তোমাকে জড়িয়েছি। কিন্তু প্রথমবারের মতো হুট করে প্রেমে পড়ে ভালোবাসায় জড়াতে চাইনি৷ সেদিন যখন আমি তোমার এই দু-চোখে তাকাই, গভীর মায়াময় ভালোবাসা খুঁজে পাই, ট্রাস্ট হারিয়ে যাই৷ অতল মায়া গহ্বরে হারিয়ে যাই আমি৷ কিন্তু যাকে কিছুক্ষণ পূর্বে প্রত্যাখ্যান করি তার মায়ায় হারিয়ে যাওয়ার স্বীকারোক্তি কোন মুখে দিই? সেদিন তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে তুমি ফিরে গেলে আর আমি ফিরে গেলাম গভীর সমুদ্রে ডুবে মরতে মরতে বাঁচার নিশানা পেয়ে। এরপর কতগুলো দিন আমার ঘোরেই চলে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। কী করা উচিত আমার? সবচেয়ে বেশি বিব্রত বোধ করছিলাম এটা ভেবে যে আমি একজন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া পুরুষ। আর তুমি স্বচ্ছ, পবিত্র মনের সেই নারী যার হৃদয়ের প্রথম পুরুষটি আমি। আমার কেবল মনে হচ্ছিল এটা অন্যায়, এটা ঠকানো। নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ লাগছিল। বাচ্চা একটা মেয়ে। আমাকে হারিয়ে দিল, তুচ্ছ করে দিল। ভালোবাসা নামক অনুভূতিটাতে আমার চেয়ে হাজার গুণ এগিয়ে গেল। এত এত চিন্তার ভীড়ে হঠাৎ যখন শুনলাম তুমি অন্য কারো হয়ে যাবে। ঠিক তক্ষুনি নিজের প্রতি ধিক্কার এলো। আমার ভেতরের সত্তায় জানান দিল, আমার কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রথমবার যেটা হারাই তার আভাস পাইনি। দ্বিতীয়বার যেটা হারাতে যাচ্ছি তার আভাস পেয়ে চুপ করে বসে থাকা নিজের প্রতি নিজের অন্যায়। কারো গভীর ভালোবাসাকে অসম্মান। এক নিষ্পাপ হৃদয় যে আমার সবটা জেনে আমাকে ভালোবাসতে চায় তাকে সেই অধিকার না দেয়া, নিজের করে না নেওয়া জঘন্যতম অপরাধ। আমি নিষ্ঠুরতার যন্ত্রণা জানি বলেই সেই যন্ত্রণায় তোমাকে ভুগাতে পারিনি। তোমার যন্ত্রণা হবে, তুমি অসুখী হবে। আমায় ভালোবাসতে না পেরে, আমার ভালোবাসা না পেয়ে তুমি দগ্ধীভূত হবে আমি জাস্ট এটাই মেনে নিতে পারিনি। এই যে মেনে নিতে না পারা। এটাই আমাকে ইশারা দিয়েছিল ওঠে দাঁড়ানোর, আলোর পথ আর দ্বিতীয়বার ভালোবাসার মতো সুন্দর অনুভূতিতে জড়িয়ে পড়ার৷ ‘

সৌধর নরম স্পর্শ, ঘন শীতল কণ্ঠের সুখী সুখী কথাগুলো শুনে আবেশে চোখ দু’টো বন্ধ করল সিমরান। যেখানে সেদিনের কথাটায় সে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি৷ প্রিয়জনকে পাওয়া মাত্র লুফে নিয়েছে। সেখানে সৌধ মনে রেখেছে তার কথা৷ এক জীবনে আর চাই? আবেগান্বিত হৃদয় থেকে কান্না উপচে এলো। টুপ করে গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে সৌধর হাতের পিঠে পড়ল৷ সৌধ যত্ন নিয়ে সে অশ্রুজল মুছে দিয়ে গাঢ় দৃষ্টি অটল রেখে বলল,

‘ সেদিনের সেই প্রত্যাখ্যান তোমায় ভুলতে বলব না। কিন্তু ওই প্রত্যাখ্যানের পরও তোমাকে নিজের করে নেয়া থেকে শুরু করে আজকের মুহুর্তটুকুও তুমি ভুলো না। দেখবে ওই সময়টা মলিন হয়ে যাবে৷ আর আজকের পর ওই কষ্টগুলো আমার ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেব৷ ‘

চট করে তাকাল সিমরান। অবাকান্বিত সে চোখ দেখে দৃঢ়তার সঙ্গে সৌধ বলল,

‘ ইয়েস ডিয়ার, ফাইনালি আই গট টু লাভ ইউ। ‘

মোহাবিষ্ট চোখে তাকিয়ে সৌধ কথাটা বলতেই বুকের ভেতর উথাল-পাতাল তরঙ্গ বয়ে গেল সিমরানের। পরিপূর্ণতায় বুক ভার হয়ে ওঠল৷ চোখের পানি হলো ছন্নছাড়া। সৌধ বিগলিত হলো ওর কান্না দেখে। যতটা কাছাকাছি ছিল তার চেয়েও অধিক কাছে এসে কপালে কপাল ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বলল,

‘ সিনু পাকনি? অনেক অপেক্ষা করিয়েছি, অনেক ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়েছ। ধৈর্য্যের পরীক্ষা আমিও দিয়েছি। আমি পারতাম তোমাকে আরো আগে কাছে টানতে৷ শুধুমাত্র মনের রানি হিসেবে তোমাকে পূর্ণ সম্মান, অধিকার দিতে চাই বলেই শারীরিক সব উত্তেজনাকে বেঁধে রেখেছি। বিয়ে মানেই আমার কাছে দৈহিক প্রয়োজন মেটানো নয়৷ বিয়ে মানে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের সব প্রয়োজনের পাশাপাশি মনের খোরাক মেটানোরও কারিগর। সব মানুষ সমান নয়৷ কেউ আগে শারীরিক মিলনের মাধ্যমে মনের মিলন ঘটায়৷ কেউ মনের মিলন ঘটিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আমি দ্বিতীয় জন। আমি জানি সবটা বুঝবে। তবু যদি এ বিষয়টা নিয়ে মনের ভেতর কষ্ট, চাপা অভিমান থাকে ক্ষমা করো। কারণ তুমি ক্ষমা না করলে পরপারে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছেও ক্ষমা পাব না৷ ‘

আচম্বিতে ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কেঁদে ফেলল সিমরান। একজন কঠিন, শক্তিশালী হৃদয়ের মানুষ যখন এত আবেগ, ভালোবাসা, আদর মিশিয়ে আকুল স্বরে আত্মনিবেদন করে তখন নিঃসন্দেহে আপনি তার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। সিমরান অনুভব করতে পারল সে সৌধর হৃদয়ে ঠিক কতখানি দখল করে নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে আনন্দানুভূতিতে সিক্তও হলো। সৌধ ওর কান্না থামাতে বুকে টেনে ভরসা যোগাল৷ এবার একটু দৃঢ় হয়ে বলল,

‘ প্রাপ্তির দিনে এভাবে কেউ কাঁদে? খুউব বোকামি এটা। ‘

ছাউনির সামনে একফালি রোদের দেখা মিলেছিল। হঠাৎ সে রোদ মিলিয়ে গেল। চারদিক আঁধার হতেও শুরু করল। সিমরানের কান্না থামলেও সৌধর বুকপকেট থেকে মাথা তুলল না৷ নীরবে, নিভৃতে শুধু অনুভব করতে লাগল মানুষটার ভালোবাসার গভীরতা। কয়েক মিনিট ব্যবধানে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। শীতের বৃষ্টি। সৌধ বলল ঘনীভূত গলায় বলল,

‘ উইন্টার রেইন। ‘

এবারে মাথা তুলল সিমরান৷ কিছুটা দূরে সরে গিয়ে নিজের এলোমেলো চুল ঠিক করল। সৌধ নেশাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ দাদুনি বলে বৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার রহমত। তাই বৃষ্টি এলে মন খারাপ বা বিরক্ত হতে নেই। উপভোগ করতে হয়।’

মৃদু হেসে সিমরান তাকাল ছাউনির বাইরে৷ হালকা শীতটা গাঢ় হলো হিম ধরা হাওয়া আর বৃষ্টিপাতে। সৌধ চেপে বসল সিমরানে দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘ ঠান্ডা লাগছে? ‘

সিমরান মাথা দুলিয়ে না করল। সৌধ থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ লাগছে। দেখতে পারছি আমি। ‘

চমকে তাকায় সিমরান৷ সৌধ নির্নিমেষে তাকিয়ে। সিমরান তাকালে আলতো হেসে বলে,

‘ একদিন যেখানে প্রত্যাখ্যান হলে আজ সেখানেই প্রিয়তম পুরুষ, স্বামী সৌধর প্রপোজাল পেলে অনুভূতি কেমন? ‘

সহসা চোখ সরিয়ে নিল সিমরান৷ শীত শীত বোধে ঠোঁট দু’টো রক্তিম হয়ে আছে তার। সৌধর কথায় এবার তীব্র উত্তেজনা আর লজ্জায় গাল দুটোও আরক্ত হয়ে ওঠল। ওরা একে অপরের এতটা কাছাকাছি বসা, যে দুজনই দুজনার ভারিক্কি শ্বাস, প্রশ্বাস গুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সিমরানের যুবতী হৃদয় ঝনঝনিয়ে ওঠছে ক্ষণে ক্ষণে। এমতাবস্থায়
হঠাৎ কানের কাছে উষ্ণ হাওয়া ছড়িয়ে পড়লেই থরথর করে কেঁপে ওঠে সে। বুকের ভেতর ছটফটানির তরঙ্গে দিশেহারা হয়। চট করে ওঠে দাঁড়ায়। চলে যায় ছাউনির কিনারায়। বৃষ্টি বাড়ে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এবার ঝমঝম শব্দে মুখরিত। উত্তেজনা দ্বিগুণ হয় সিমরানের। পেছন ঘুরে তাকাতে পারে না লজ্জায়। ছাউনি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিপাতে দৃষ্টি স্থির রেখেছে সে। কিয়ৎক্ষণ পর বুঝতে পারে সৌধও ওঠে দাঁড়িয়েছে। অচেনা ভয়, শিহরণে বুক ধক করে। অনুভূতির দাবানল ঠেকাতে সৌধর সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত হতে বলে,

‘ যদি বৃষ্টি না থামে? কী করে বাড়ি ফিরব?’

আকস্মিক সিমরান ওঠে যাওয়ায় বুকে মৃদু ধাক্কা খেয়েছে সৌধ। বলা যায় এক টুকরো ছ্যাঁকা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সিমরানের প্রশ্ন কানে এলেও উত্তর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না৷ মৃদ্যুপায়ে এগিয়ে এসে একদম পেছনে, গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তার লম্বা, বলিষ্ঠ শরীরটা এমন ভাবে সিমরানের পিছনে দাঁড় করাল যে বেচারি আর চাইলেও কোনো পাশে সরে যেতে পারবে না৷ সিমরান নিজের প্রশ্নটুকুর উত্তর না পেয়ে ফের কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘ বাড়ি যাব আমি৷ আজ কত রান্না করব ভেবেছি। আমি তো পাকা রাঁধুনি নই। আমার সময় লাগবে অনেক৷ তাই দুপুর থেকেই শুরু করব৷ চলো না বাড়ি যাই। ‘

কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়াতেই হাত বাড়িয়ে কোমর প্যাঁচিয়ে ধরে সৌধ। দুষ্টু হেসে বলে,

‘ কী সাংঘাতিক আচরণ হু? বাড়ি তো নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু এই জায়গাটায় মেমোরেবল কিছু না রেখে যাব ভাবলে কী করে? সেবারেরটা ভুলোনি আশা করি এবারেরটা আরো ভুলবে না। একদম প্রতিটা লোমকূপে, রক্তে রক্তে মিশিয়ে দিয়ে যাব৷ ‘

পোক্ত হাতের বাঁধন ছাড়ানো সম্ভব না৷ ছাড়াতে ব্যগ্রও হলো না। একে তো পুরুষ মানুষ। তারওপর মানুষটা সৌধ চৌধুরী। পৃথিবীতে কার সাধ্য তার থেকে তার বউকে ছাড়ানো? স্বয়ং বউটিরও যে নেই।
লজ্জায়, অস্বাভাবিক অনুভূতিতে মূর্ছা ধরল সিমরান। সৌধ ওর দেহশ্রী আগলে নিয়ে ডানহাতে থুতনী তুলে ধরল। এরপর আকস্মিক নিজের পুরো ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিল টকটকে গোলাপি রাঙা অধর জুড়ে৷ নিমেষে চোখ দুটো খিঁচিয়ে নিল সিমরান৷ দু’টো হাতের শক্ত খামচি পড়ল সৌধর পৃষ্ঠদেশে এবং বাহুতে৷ ঝুম বৃষ্টির সুরে বউয়ের কোমল অধরে নেশা ধরে গেল সৌধর। বৃষ্টির শব্দ যত তীক্ষ্ণ হয় ওর অধর চুম্বন ততই গাঢ়ত্বে রূপ নেয়। এদিকে প্রথমবার ‘ লিপ কিস ‘ নামক অনুভূতিটায় সিমরানের নড়বড়ে অবস্থা। পরিচিত মানুষটির অচেনা উন্মাদনায় দিশেহারা।

অকস্মাৎ ফোনের রিংটোনে থেমে যায় সৌধ। ছাড় পেয়ে হাঁপাতে শুরু করে সিমরান৷ একদিকে প্রথম পুরুষালি ঠোঁটের আক্রমণ, অপরদিকে গাল, থুতনীতে খোঁচা খোঁচা ঘন দাঁড়ির প্রবল ঘর্ষণ আর তীব্র লজ্জা। মুখশ্রীর শুভ্র রঙটা বিলীন হয়ে রক্তাম্বরে পরিণত হয়। নিজের ভারসাম্য টুকু ধরে রাখার শক্তি পায় না৷ সৌধ বারকয়েক ঢোক গিলে, বড়ো বড়ো করে শ্বাস নেয়। একহাতে সিমরানকে টেনে বসার জায়গায় বসিয়ে এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে। সুহাসের নামটা জ্বলজ্বল করছে। মুহুর্তেই মেজাজ সপ্ত আকাশে উঠে যায়। সিমরানের দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘোরায়। ফোন রিসিভ করে চাপা মেজাজে বলে,

‘ এই শালা ফোন করার আর সময় পাস না? ‘

সুহাস বন্ধুকে ত্রিশতম বার্থডে উইশ করার জন্য ফোন করেছিল। তার খুশি খুশি মুডটা নষ্ট করে দেয়ায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ কেন বোন জামাই, আপনি কি টয়লেটে? ‘

‘ নাহ, বেড রুমে। বউয়ের সাথে রোমান্স করি। ‘

ব্যস। এক বাক্যেই সুহাসের সমস্ত দুষ্টুমি, রসিকতা বন্ধ হয়ে গেল। সৌধ সত্যি বলুক বা মিথ্যা। সে লজ্জা পেল। কারণ, সৌধর বউটা যে তারই আদরের বোন।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৩| ‘ বর্ধিত অংশ ‘

সুহাসের সঙ্গে কথা বলা শেষ করার পর থেকে সৌধ সিমরানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু মেয়েটা কোনোভাবেই তার দিকে তাকাচ্ছে না। আর না একটি শব্দও উচ্চারণ করছে৷ টুকটাক যা উত্তর দেবার মাথা নেড়েই দিয়েছে। এভাবে ওদের ঠিক কতক্ষণ কেটে গেছে জানা নেই। এরপর বৃষ্টি থামলে সৌধ ছাউনি থেকে বেরিয়ে বলল,

‘ বাড়ি যাবেন? নাকি এখানেই লাল, নীল হয়ে বসে থাকবেন? ‘

আকস্মিক এমন প্রশ্নবাক্যে লজ্জায় এবার বেগুনি হওয়ার উপক্রম যেন। নিজের মুখটুকু দেখানো দায় হয়ে পড়েছে। তবু কোনোরকমে ওঠে দাঁড়িয়ে, লজ্জায় আরক্ত মুখে এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে৷ সৌধ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির দরজা খুলে রেখেছিল। সিমরান গিয়ে ওঠে বসলে আকস্মিক ওর মুখশ্রীতে চোখ পড়লে আঁতকে ওঠল। মুখটা মারাত্মক পর্যায়ে রক্তিম হয়ে আছে। টকটক করছে ঠোঁটজোড়া৷ ঢোক গিলল সৌধ। ত্বরিত পানির বোতল এগিয়ে ধরে বলল,

‘ চোখে, মুখে পানি দাও কুইক। ‘

চোখে মুখে পানি দিয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিল সিমরান। গাড়ি স্টার্ট দিল সৌধ৷ ওরা বাড়ি পৌঁছালে সবাই ওদের দেখে অবাক হলো। প্রশ্ন পেল দাদুনির থেকে ‘সাতসকালে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল?’ সিমরান কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। সৌধ সুখী সুখী চেহেরা নিয়ে দাদুনির পাশে বসল গিয়ে। ফিসফিস করে বলল,

‘ রোমান্টিক ওয়েদার৷ প্রেম করতে বেরিয়েছিলাম দাদুনি। ‘

চোখ, মুখ কুঁচকে এলেও কুঁচকালো না দাদুনি। গলা বাড়িয়ে তাহানীকে ডাকল,

‘ আমার পানের বাটা নিয়া আসো তো দাদুন। ‘

সৌধর রসিকতা দূর হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ এই ঘাসপাতি খেয়ে খেয়েই চেহেরার বারোটা বাজাচ্ছেন৷ ‘

বলেই উঠে দাঁড়াল। তানজিম চৌধুরী এসে বললেন,

‘ নাস্তা করবা না তোমরা? ‘

‘ করে আসছি আম্মা। আপনারা নাস্তা করেছেন? ‘

‘ হ্যাঁ করলাম মাত্র। আজ সিনু মা রান্নাবান্না করবে তোমার জন্য। তাই সব কিছু রেডি করে দিচ্ছি। কাটাকুটি শেষ প্রায়। মশলাও তৈরি, মাংস ভিজিয়েছি। ও এসে শুধু রাঁধবে। শুভ জন্মদিন আব্বা।’

আলতো হাসল সৌধ৷ ধন্যবাদ জানালো শ্রদ্ধেয় আম্মাকে। এরপর উপরে যেতে উদ্যত হতেই শুনতে পেল দাদুনির টিপ্পনী,

‘ সব যখন তোমরাই রেডি করছ চুলায় তোমরই তুলে দাও। ওর বউয়ের জন্য ওটুকু বাদ রাখবা কেন? এইগুলা তো কাজকাম না এইগুলা হলো নাম। ‘

হাঁটা পা থেমে গেল সৌধর। পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল তানজিম চৌধুরী ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলছে, চলে যেতে বলছে ঘরে৷ সৌধ ইশারায় তানজিম চৌধুরীকে বোঝালেন ধারালো কিছু নয় সুন্দর আর নরম একটি কথা বলবে। এরপর দাদুনি বলল,

‘ দাদুনি, বিয়ের আগে সিনুকে বলেই দিয়েছিলাম একদম রান্নাবান্না করা যাবে না। হাতে কাটাকুটির দাগ, এবড়া, থ্যাবড়া নখ আমার পছন্দ না। তবু সে রান্নাবান্না শিখেছে টুকটাক রাঁধেও। আজ নাকি আবার অনেক আইটেম রাঁধবে। কেমন লাগে বলো তো? কাজই হোক বা নাম৷ সবই তো নিষেধ তার জন্য। ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল দাদুনি। বলতে ইচ্ছা করল,

‘ সারাজীবন কি কাজের লোক আর আম্মাকে দিয়ে রান্না করাবা নাকি? বউ কি শোপিস! ‘

কিন্তু বলল না। ছেলে আর নাতিদের ওপর সে খুব বেশি তীক্ষ্ণ কথা বলতে পারে না৷ এরা তার ভীষণ ভালোবাসার। সৌধও আর দাঁড়াল না। চনমনে চিত্তে উপরে চলে গেল।
.
.
সারাদিন প্রচুর রান্নাবান্না হলো। সব সৌধর পছন্দ অনুযায়ী। বেশ আয়েশ করেই লাঞ্চ করল সৌধ। সঙ্গে ছিল বাবা আর বড়ো ভাই৷ আজ ঝুমায়নার মুখেও সিমরানের রান্নার প্রশংসা শোনা গেল। সৌধর হুশিয়ারীতে আর সিমরানের পিছু লাগতে পারেনি ঝুমায়না। খুব একটা পছন্দ করে না বলে এড়িয়েও চলেছে। সিমরানও ঝুমায়নাকে পছন্দ করে না। সেদিনের পর না ঝুমায়নার প্রতি আগ্রহী হয়েছে আর না কথা বলেছে। তবে সুরকে সুযোগ পেলেই আদর করে দিয়েছে। আজ তার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে মুচকি হেসে থ্যাংকস জানালো সিমরান। শশুর, ভাসুর, ভাবি আর বরের খাওয়া শেষে সিমরান যখন দাদুনি, শাশুড়ি আর তাহানীর সঙ্গে খেতে বসবে আকস্মিক তাহানী চমকিত কণ্ঠে বলল,

‘ ভাবিপা কীভাবে ব্যথা পেয়েছ এখানে? ‘

প্রশ্নটি করেই তর্জনী এগিয়ে সিমরানের নিচের ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করল সিমরান। তানজিম চৌধুরী, দাদুনি দু’জনই বিস্ময় ভরে তাকাল। দেখতে পেল সত্যিই কালশিটে দাগ বসেছে অধর কোণে। সিমরান নিজেও হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই তো সে কীভাবে ব্যথা পেল? তানজিম চৌধুরী কিছু প্রশ্ন করতে যেয়েও হঠাৎ কী যেন ভেবে থেমে গেলেন৷ সবাই সিমরানের দিকে তাকিয়ে। তাই সবাইকে খেতে মন দিতে বলে নিজেও খেতে শুরু করলেন। সিমরান আর চিন্তায় খেতে পারল না। বেশ তাড়া নিয়ে খাওয়া শেষ করে ঘরে গিয়ে ত্বরিত আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আঁতকে ওঠল।

সৌধ প্রাচীর সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলছিল। সময়ের ব্যবধানে সবার জীবনেই বেশ পরিবর্তন এসেছে। বিয়ের ছয় মাস চলছে প্রাচীর। এ মুহুর্তে স্বামীর সঙ্গে দেশের বাইরে রয়েছে সে। এছাড়াও আরো একটি শুভ সংবাদ হলো, প্রাচী তিন মাসের গর্ভবতী। সৌধকে বার্থডে উইশ করার পাশাপাশি নিজের এ সুখবরও জানালো। সিমরানকে চাইল কথা বলার জন্য। সৌধ ডাকল,

‘ সিনু এদিকে আসো। ‘

সিমরান মুখটা ব্যথাতুর করে এগিয়ে এলো৷ ফোন নিয়ে কুশল বিনিময় করলে প্রাচী বলল,

‘ মন খারাপ কেন বনু? ‘

‘ কীভাবে যেন ব্যথা পেয়েছি। ঠোঁটে জখম হয়ে গেছে একদম! ‘

নিমেষে বুকের ভেতর ধক করে ওঠল সোধর৷ তড়াক করে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে চোখ গরম করে তাকাল। এরপর ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখতে পেল প্রাচী কাশছে আর মিটিমিটি হাসছে। উপায়ন্তর না পেয়ে কলটা কেটে দিল সে। সিমরান হতভম্ব। কী হলো এটা! সৌধ ছোটো ছোটো দৃষ্টিতে তাকাল এবার৷ দেখল কতখানি দাগ বসেছে। এরপর দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘ মাথা পুরোপুরি গেছে না? সকালবেলা কী হয়েছে? লিপে কিস করেছি না? এটা আমার বান্ধবীকে বুঝিয়ে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করছ! ‘

থতমত খেয়ে গেল সিমরান৷ সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। চুমুর সাথে এই দাগের কী সম্পর্ক? মনের প্রশ্ন মুখে করতেই সৌধ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আরে ইডিয়ট, লিপ কিস করেছি না? সেজন্য এমন হয়েছে। ‘

‘ সে জন্য কেন হবে? লিপ কিস করলেই এমন রক্ত জমাট ধরে যাবে? দুনিয়াতে আর কেউ এসব করে না। আমি মনে হয় কিছুই জানি না, বুঝি না। ‘

মুখ ফস্কে কথাগুলো বলেই বিছানা থেকে চট করে ওঠে দাঁড়াল সিমরান। এরপর পিছ মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে লজ্জায় আরক্ত হয়ে রইল। কী বলে ফেলল এসব। ছিঃ! ওর আনাড়ি কথা শুনে সৌধর চোখ দু’টো বড়ো হয়ে গেছে৷ কয়েক পল সময় নিয়ে হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘ আমার বউয়ের ঠোঁট অতিরিক্ত নরম তাই এমন হয়েছে। আর হ্যাঁ, অন্যরা একে অপরকে মিলেমিশে চুমু খায় তাই জখম হয় না। আমাদেরটা একতরফা হয়েছে। মিলেমিশে হলে এমন স্পট পড়বে না। আশা করি রাতে এ বিষয়টা মাথায় থাকবে। ‘

শেষ বাক্যটি শুনে নিজেকে আর ঠাঁই রাখতে পারল না মেয়েটা৷ এক নিমেষে ছুটে পালালো। থামল একদম তাহানীর ঘরে গিয়ে। যদিও তাহানী এখনো একা থাকার অভ্যেস করেনি৷ তবু তার জন্য আলাদা ঘর আর প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে। তাই দ্রুত গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওর লিপস্টিক বাক্স ঘেঁটে একটি লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে তারপর বের হলো। মনে মনে ভাবল, বিপদে লিপস্টিকও রক্ষা করে, বন্ধু হয়ে পাশে থাকে।

এরপর দিনটা ওর তীব্র লজ্জা, শিহরণ আর ঘোরে কাটল৷ ঘোরটা ভাঙল সন্ধ্যার পর। যখন সৌধ ডেকে নিয়ে কালো রঙের একটি শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ পরে নাও ঝটপট। ‘

শাশুড়ি মায়ের কাছে শাড়ি পরাটা কব্জা করে নিলেও কুঁচি করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেল সিমরান৷ জর্জেট শাড়ির কুঁচি করা খুবই কঠিন ব্যাপার৷ সৌধকে ডাকবে কি ডাকবে না এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে হঠাৎ ডাকতে যাবে তক্ষুনি মনে পড়ল, কোনোভাবেই ভাই সম্বোধন করা যাবে না৷ আবার শুধু সৌধ বলতেও মনটা কেমন কষ্ট কষ্ট পাচ্ছে। বয়সে প্রায় সাত বছরের বড়ো। মানুষটা তার এত সম্মানের, ভালোবাসার, যত্নের৷ কীভাবে নাম ধরে ডাকে? আচমকা একটি সম্বোধন মনে পড়াতে বেলকনির দিকে গলা বাড়িয়ে বলল,

‘ হ্যালো ডক্টর, শুনছ? ‘

সৌধ ফোনে কথা বলছিল আইয়াজের সাথে। ঘরের ভেতর থেকে মিহি স্বরের ডাকটায় হৃদয় শিহরিত হলো৷ কান পেতে রইল ফের কিছু শোনার। শুনতেও পেল,

‘ হ্যালো ডক্টর? ‘

সৌধ নীরব। কান দু’টো সজাগ। সিমরান এবার গলার স্বর খানিকটা উঁচিয়ে ডাক দিল,

‘ চৌধুরী সাহেব? ‘

এবারে আর চুপ রইল না সৌধ। আইয়াজকে বিদায় জানিয়ে বউকে বলল,

‘ মিসেস চৌধুরী, ডক্টর চৌধুরী ইজ কামিং…’

খুব মন দিয়ে যত্ন নিয়ে বউয়ের কুঁচি ধরে পিন আঁটকে দিল সৌধ৷ শাড়ি পড়া শেষে চুল ছেড়ে বেশ অনেক গুলো সেলফি নিল দু’জন। পার্সনাল ক্যামেরা দিয়েও বউয়ের অগণিত ছবি তুলতে ভুলল না সৌধ। এরপর সুহাস এলো বাড়িতে। পরিবারের সবাই মিলে ছোট্ট পরিসরে বার্থডে সেলিব্রেশন করা হলো। রাতে একদম ডিনার সেরে ফিরে গেল সুহাস৷ তবে যাওয়ার আগে সৌধকে বুকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল,

‘ আমার বোনের মুখে আজ সত্যিকারের সুখ দেখতে পাচ্ছি সৌধ। ওয়েল ডান। ‘
.
সুহাসকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরতে রাত এগারটা বাজল। সিমরান বসে বসে তখন চিকেন পেটিস খাচ্ছিল। সৌধ এলে ওকে সাধল। সৌধ খাবে না বলে পোশাক চেঞ্জ করে শুধু একটি শর্ট প্যান্ট আর টিশার্ট পরে নিল৷ কেক কাটার সময় সিমরান বায়না ধরেছিল একটি গান শোনানোর জন্য। সৌধ তখন কোনোমতেই রাজি হয়নি৷ তুলেনি কোনো প্রকার সুর। কারণ আজ সে এমন এক মুডে আছে। যে মুডটা সিমরান ব্যতীত অন্যকারো সামনে প্রকাশ করা সম্ভব না৷ বায়না ধরেও গান শুনতে পারেনি বলে অভিমান হয়েছে সিমরানের। পণ করেছে আর কক্ষনো গান শুনাতে বলবে না৷ এদিকে সৌধ পণ করেছে আজ ওকে গান শোনাবেই। তবু যে সে গান নয়৷ মোস্ট হটেস্ট সং!

খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে এসে বাথরুমে যাওয়ার পায়তারা করছে সিমরান৷ টিশার্ট আর প্লাজো বের করেছে মাত্র। অমনি সৌধ সম্মুখে এসে দাঁড়াল ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ এগুলো কী হবে? ‘

‘ পরব, ঘুমাতে যাব যে। ‘

সৌধ ওর হাত থেকে কাপড়গুলো ছিনিয়ে নিয়ে বলল,

‘ এসব পরতে হবে না। ‘

‘ কী বলছ? এই শাড়ি পরে ঘুমাব? উফফ আর পরে থাকা যাচ্ছে না৷ ক্লান্ত লাগছে। ‘

থম মেরে তাকিয়ে রইল সৌধ। আকস্মিক আদেশ সূচকে বলল,

‘ জাস্ট মুখটা ক্লিন করে এসো। জুয়েলারি গুলোও খুলতে পারো। আর যদি শাড়িতে লাগানো পিন গুলো খুলো তবে উপকার হয়। ‘

স্তব্ধীভূত হয়ে গেল সিমরান। বুকের ভেতর কেমন কেমন করেও ওঠল। ঢোক গিলল সচেতন ভাবে। জোরপূর্বক হেসে বলল,

‘ আমার কিছু বলার ছিল। ‘

‘ হু? ‘

‘ আমার কিশোরী বয়সে প্রেমে পড়ার গল্প। ‘

সিনু পাকনির পাকনামো ধরে ফেলল সৌধ। এক চোখ টিপ দিয়ে অমায়িক হেসে বলল,

‘ আজ নয় আরেকদিন শুনব। ‘

শরীরের রক্তকণিকায় অসহ্য শিহরণ হলো। কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে চুপসে গেল মুখটা। মৃদু কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘরে এসে দেখল, সৌধ গিটার নিয়ে বসে আছে ডিভানে। তাকে দেখে বেলকনিতে চলে গেল। ইশারা করল তাকে আসতে। সিমরান ধাতস্থ হয়ে তোয়ালে তে মুখ মুছে যেতে যেতেই গিটারে সুর তুলল সৌধ। বেচারী গিয়ে বসতেও পারল না। তার আগেই সৌধর গভীর আবেদনীয় কণ্ঠে বলা গানটি শুনতেই চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল তার অতি সুদর্শন, শক্ত ব্যক্তিত্বধারী বরটার পানে। টের পেল পৃথিবীর সমস্ত কঠিন ব্যক্তিত্বধারী পুরুষরাই একটা জায়গাতে গিয়ে চরম নির্লজ্জ, বেহায়া আর লাগামছাড়া। এটা তো একদিন হওয়ারই ছিল। লুনার ভাষায় সৌধ চৌধুরী তো আর সত্যি সত্যি ইমপোট্যান্ট নয়।

ছোটোবেলা থেকেই হিন্দি, ইংলিশ ভাষাটা খুব বুঝে সিমরান৷ হিন্দি সিরিয়াল, মুভি, ইংলিশ মুভি দেখতে দেখতেই এসবে পটু হয়ে গেছে। তাই সৌধর গাওয়া গানের মিনিং বুঝতে তার এক মিনিটও সময় লাগল না৷ কানটা ঝাঁঝাঁ করে ওঠল ওই সুর, ওই গান শুনে,

***
আ ইস্ রাত কি লামহে
সাং মেরে সাথ কাট লে
নিন্দকো ছেড়কে তু
সাং মেরে জাগলে

ইন লবোকো তুভি আপনে হি লাবোপে জাগাহ দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
আপনি নাযদিক মুঝে আনে দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
তুঝে খুদকি কারিব লানে দে

ধিমি ধিমি আঁচ পে তেরে তান কি
থোরা থোরা ইউ জ্বালুন ম্যায়
জো ভি হ্যায় য়েআহান মেরে মন কি
আ সপুন আজ তুঝ হে হি ম্যায়

ইন লবোকো তুভি আপনে হি লাবোপে জাগাহ দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
আপনি নাযদিক মুঝে আনে দে
পেয়ার দে মুঝে তু পেয়ার দে
তুঝে খুদকি কারিব লানে দে

লজ্জায় দিশেহারা সিমরান। কাঁদো কাঁদো হৃদয়ে ভাবল, দুনিয়ায় আর কোনো গান ছিল না? রাত দুপুরে এসব কী গান? কান দিয়ে উষ্ণ হাওয়া বইছে তার। বর রূপে ধরা দেবে, প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠবে ঠিক আছে৷ এমন লাগামছাড়া প্রমিক হতে কে বলল? সে তো বলেনি। আকস্মিক সচেতন হয়। বারকয়েক ঢোক গিলে ভাবে সে পালাবে। ত্বরিত গিয়ে শাড়ি পাল্টে বিছানায় শুয়ে ঘুম দেবে৷ কঠিন ঘুম৷ যদি ঘুম না আসে তবে অভিনয় করবে ঘুমের।
ভীষণ ভয় লাগছে। অস্থিরতায় শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। এ কী নাজেহাল অবস্থা হচ্ছে তার? না না সে এই লোকটাকে সামলাতে পারবে না৷ এরচেয়ে পালানোই শ্রেয়। নিজের মনের সঙ্গে বোঝাশোনা করে যেই না এক পা পিছিয়েছে অমনি তার শাড়ির আঁচল টেনে ওকে পুরোটাই নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল সৌধ। এরপর অতি কৌশলে ওর দেহশ্রী পাঁজা কোলে তুলে নেশাভরা গলায় বলল,

‘ কী হচ্ছিল? সব তো বুঝেই ফেলেছ রাইট? তবে কেন পালানো হচ্ছে? ‘

লজ্জায় ভয়ে মূর্ছা ধরার উপক্রম সিমরান৷ সৌধ মিটিমিটি হাসল। আজ লজ্জা না ভাঙালে এ জীবনে আর তাদের মধ্যে স্বামী, স্ত্রীর সহজ, স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠবে না। তাছাড়া ক’দিন বাদে পাড়ি দেবে দূরান্তে। আর কতকাল নিজেকে আঁটকে রাখবে? আর কতকালই বা অপেক্ষা করাবে মেয়েটাকে। এখন যতই ভয় পাক, লজ্জিত হোক। দিনশেষে ঠিকি খুশি হবে। সে যদি এই লজ্জা, ভয় কে কেয়ার করে পিছিয়ে যায়, কাল সকালে ওঠে আফসোস করতেও ভুলবে না। আর কোনো আফসোস, অভিমান নয়৷ এবার শুধু প্রণয় আর পরিণয়ের পালা।

ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে শাড়িতে লাগানো পিন গুলো খুলতে বেগ পেতে হলো সৌধর। ভরাট কন্ঠে একবার বললও,

‘ সব সময় পাকামি, বলেছিলাম পিন গুলো খুলতে। ‘

তীব্র অনুভূতিতে লুটোপুটি দু’টো হৃদয়। এমতাবস্থায় শাড়ির পিন খুলতে গিয়ে মেজাজি খারাপ করল৷ তবু রয়েসয়ে অবশেষে সক্ষম হলো।নিস্তব্ধ রাত আর বদ্ধ ঘর। গভীর প্রণয়াস্পর্শে সিক্ত স্বামী, স্ত্রী। প্রথমবার পুরুষালি দেহের উত্তাপ ধারণে অবস্থা শোচনীয় সিমরানের। সৌধর অতি যত্নময় স্পর্শ গুলোতে ভূবন ভুলানো যন্ত্রণার পাশাপাশি সুখানুভূতিতেও সিক্ত হয়ে রইল। মেয়েদের শরীর প্রকৃতিগত ভাবেই পুরুষদের তুলনায় নরম হয়৷ এটাই জানত সৌধ৷ তাই বলে সিমরান এত বেশি নরম? থেকে থেকে ভয়ও কাজ করছিল বেচারার। দু ধাপ পেছালেও সাহস করে এগিয়েছে এক ধাপ।

প্রথম ঘনিষ্ঠ হওয়ার রাতটা পেরিয়ে গেল। এঁটে দিল কিঞ্চিৎ যন্ত্রণা আর সীমাহীন সুখ। চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি শুনতে পেয়ে চোখ খুলল সৌধ। ত্বরিত বিছানা ছেড়ে শাওয়ার নিয়ে নিল সে। এরপর এসে ঘুমন্ত সিমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে শুরু করল। ঘুম ভাঙলেও সিমরান ওঠল না। সৌধ বুঝতে পারে ওর অবস্থা। তাই কোনোকিছু না ভেবে এলোমেলো বেডশিট সহ সিমরানকে মুড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। বলে,

‘ গোসল সেরে নাও। ভালো লাগবে। তারপর ঘুমিও।’

সিমরানকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে সে ঝটপট নতুন বেডশিট পাতে৷ গোসল সেরে শুধু একটা টিশার্ট আর প্লাজো পরে বেরিয়ে আসে সিমরান। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার৷ দুর্বলতায় চোখে দেখছে না একদম। সৌধ ঠোঁট টিপে হেসে কাছে গিয়ে ধরে আনল ওকে। বিছানার কাছে আনতেই ও বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজল। তক্ষুনি সৌধর চোখ পড়ল ওর বাম হাতে৷ সাদা রঙের নেইলপালিশ দেয়া নখ গুলোতে। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বড়ো। নখ গুলো দেখে নিজের দেহের অনেকাংশে জ্বলন অনুভব করল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ একটু স্বাভাবিক হও এরপর এই পাঁচ আঙুলের ব্লেড গুলোকে শায়েস্তা করব। ‘
.
.
.
গুটিগুটি পায়ে কিছুদিন কেটে গেল। চারদিন পর সৌধ, সুহাসের ফ্লাইট। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত সময়টা ঘনিয়ে এলো। সুহাসের বুকের ভেতরটাও ছলকে উঠতে শুরু করল সময়ে, অসময়ে৷ এরই মধ্যে গোপন একটি বিষয় কব্জা করেছে সুহাস। তার এত বছরের জীবনে এ প্রথম বোধহয় একটি জ্ঞানমূলক কাজ করেছে। সেটি হলো, সে টের পেয়ে গেছে নামীর সঙ্গে এখন তার বাবার যোগাযোগ আছে! পূর্বে ছিল কিনা জানে না৷ তবে গত একমাস ধরে বাবার কিছু সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডেই সে ধরে ফেলেছে সব। শুধু তাই নয় বিষয়টা নিয়ে একদিন সরাসরি বাবাকে চেপে ধরেছিল। সোহান খন্দকার স্বীকার করেনি। শেষ পর্যায়ে বদ্ধ পাগলের মতো বাবার দু পা আঁকড়ে ধরে। হাউমাউ করে কান্না করে ভিক্ষা চায় বউ, বাচ্চাকে। তখন একটু নরম হয় মানুষটা। তবে কিছু চাপা রাগ আর অভিমান থেকে বলে,

‘ নামীর সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে ঠিক। তবে সে যোগাযোগ পুত্রবধূ হিসেবে হয়নি৷ হয়েছে প্রাক্তন আর প্রিয় বন্ধুর মেয়ে হিসেবে। সুহাস, তুই যদি পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে থাকিস। আমার যোগ্য ছেলে আর নামীর যোগ্য স্বামী হয়ে থাকিস আর ওই নিষ্পাপ শিশুর জন্মদাতা হয়ে থাকিস। তাহলে নিজ ক্ষমতা, যোগ্যতা দিয়ে বউ বাচ্চাকে ঘরে নিয়ে আসবি। মনে রাখিস, এটা শুধু তোর বাবার উপদেশ নয়৷ ওই অসহায় মেয়েটার রাগ, জেদ, তীব্র অভিমানের ঊর্ধ্বে গিয়েও সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা। ‘

সেদিন সুহাস একদম স্থির হয়ে যায়। থমকানো সুরে শুধায়,

‘ ও কোথায় আছে? ‘

‘ আমি নিজেও জানি না৷ সুইজারল্যান্ড আছে এটুকুই জানি। বাকি কিছুই বলেনি। ‘

‘ বাচ্চাটা? ‘

‘ তাকে দেখতে চেয়েছিলাম। বলেছে দেখাবে। এরপর আর যোগাযোগ করেনি। শুধু জানি তুই এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছিস। আমার বংশধর। তোর অপকর্মের জন্য তার ওপর সব অধিকার হারিয়েছি আমরা৷ চোখের দেখা টুকুর জন্যও অবিরাম সাধনা করতে হচ্ছে। ‘

সুহাস আর কিছু বলার সাহস করেনি। বুকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তার একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে! আর কিছু ভাবতে পারেনি৷ নামীর কাছে পৌঁছাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিল শুধু। বাবা সত্যি বলেছে কি মিথ্যা বলেছে এসব নিয়ে ভাবেনি আর। তবে মনে জেদ চেপেছিল নিজের যোগ্যতা দেখানোর। তাছাড়া নিধির থেকে যতটুকু তথ্য পেয়েছে এতে নামীকে খুঁজে পেতে আহামরি কঠিন হবে না। তাছাড়া তার মন বলছে রাগ, জেদ অভিমান শেষে নামীও অপেক্ষা করছে। নামীর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে আত্মসম্মান রক্ষার্থে ক্ষণিকের জন্য তাকে আর তার বাচ্চাকে আলাদা করলেও চিরজীবনের মতো করতে পারবে না৷ এটুকু বিশ্বাস রইল সুহাসের মনে।
হয়তো কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। ভয়াবহ যুদ্ধে নামতে হবে। দিনশেষে নামীদামিকে জয় করার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত সুহাস।
.
.
এরপর কাঙ্ক্ষিত দিন এবং সময়টা এসে গেল। ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়ার পূর্বে কিছুক্ষণ একান্ত মুহুর্ত কাটাল সৌধ, সিমরান। বেরুবার পূর্বে সিমরানের হাতে একটি ধূসর রঙের ডায়ারি তুলে দিয়ে সৌধ বলল,

‘ সেদিন তোমার কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেমে পড়ার গল্প কেন শুনিনি জানো? এটার জন্য। আমি যতদিন দূরে থাকব ততদিন এই ডায়ারিতে তোমার শুরু থেকে অনুভূতি গুলো নিংড়ে লিখবে। ফিরে এসে যেন পড়তে পারি। ‘

কান্না মিশ্রিত চোখ দু’টো হেসে ওঠে সিমরানের। তার বরের বুদ্ধি কতটা তীক্ষ্ণ। দূরে চলে যাচ্ছে তাতে কী? বউকে সারাক্ষণই নিজের জন্য ব্যস্ত রেখে যাওয়ার মন্ত্র দিয়ে যাচ্ছে। এক টুকরো সুখানুভূতিতে ছেয়ে গেল হৃদয়। ডায়ারিটা হাতে নিয়ে দু’হাতে সৌধকে জড়িয়ে ধরে বুকের বা’পাশে গাঢ় করে চুমু এঁটে বলল,
‘ ভালোবাসি। ‘

সৌধর ওর সমস্ত মুখশ্রীতে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলল,
‘ সাবধানে থেকো বউপাখি। ‘

আর এক মুহুর্ত দেরি না করে চোখ বুঁজে ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল সৌধ। সিমরান ডাকল,

‘ হ্যালো ডক্টর? ‘

সৌধ ঘুরে তাকাল না। এত্ত বেশি খারাপ লাগছে। এত বেশি মায়ায় পড়ে গেছে। যে ঘুরে তাকালে আর যাওয়া হবে না৷ শুধু থেমে দাঁড়াল মাত্র। সিমরান স্মিত হেসে বলল,

‘ তোমার বউপাখি তোমায় ভীষণ মিস করবে। ‘

~ অতীত শেষ ~

| চলবে |
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭১+৭২

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭১|
কেউ নতুন প্রণয়ানুভূতিতে সিক্ত৷ কেউ বিরহে নিবৃত্ত। সব ভুল চুকিয়ে কেউ ব্যস্ত সঠিক পথে চলতে। আবার কেউ পেশাগত ও সাংসারিক জটিলতার সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত৷ এমনই ভাবে কেটে গেল কয়েকটি মাস। আইয়াজ, ফারাহর জীবনে বহুমুখী সমস্যা এসেছে। আবার একটু সময় লাগলেও সক্ষম হয়েছে সমস্যা গুলোর সমাধান দিতে। দীর্ঘদিন তারা চেষ্টায় ছিল দু’জন মিলে একই হসপিটালে কর্মরত থাকার৷ অবশেষে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও ভিসা জটিলতার জন্য তাদের অ্যামেরিকায় যাওয়া আঁটকে ছিল। অবশেষে আইয়াজ, ফারাহ এবং সুহাস৷ তিনজনেরই ভিসা এসে গেছে। ওদের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও কেউ ঠিকঠাক খুশি হতে পারছে না৷ কারণ, হিসেবে অনুযায়ী নামীর ডেলিভারি হয়ে যাওয়ার কথা। আর বাচ্চার বয়স এখন দেড় থেকে দু’মাস। সহ্য হয়? কোনো বাবা পারে সহ্য করতে? পারে না। সুহাসও পারছে না৷ যদি শুধু আইয়াজ, ফারাহর ভিসা জটিলতা তৈরি হতো তাহলে সমস্যা ছিল না৷ ভিসা আঁটকে ছিল সুহাসেরও। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের বহু সংখ্যক মানুষও এই সমস্যার কবলে পড়েছিল। এবার সব ঝামেলা শেষ। বাকি যা করণীয় আছে তা সম্পন্ন হলেই নির্দিষ্ট সময়ে উড়াল দেবে তারা।
.
আইয়াজের বাসা ঢাকা মোহাম্মদ পুরে৷ গতকালই সে তার বউকে নিয়ে বাসায় এসেছে। তিনতলা বাড়ির পুরোটাই ভাড়া দেওয়া৷ শুধু দ্বিতীয় তলার তিনটা ফ্ল্যাট বাদে৷ দ্বিতীয় তলার সবচেয়ে বড়ো ফ্ল্যাটটাতেই ওর পরিবার থাকে৷ বাকি দু’টো ফ্ল্যাট ফাঁকা। কারণ ওগুলো তাদের দু’ভাইয়ের সংসার গুছানোর জন্য বাবার তরফ থেকে উপহার পেয়েছে। বড়ো ভাই প্রবাসী৷ তাই তার বউ আর সন্তান শশুর, শাশুড়ির সাথেই থাকে। ছোটো বোনকে বিয়ে দিয়েছে বনেদি পরিবারে। বাবার বাড়িতে আসার সময় হয়ে ওঠে না তার৷ আর রইল সে আর ফারাহ। তারা দু’জন পেশাগত কারণে নিজ বাসা ছেড়ে দূরে থাকে।

রাত প্রায় এগারোটা। রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের ব্যাগপ্যাক গুছানো শুরু করে দিয়েছে আইয়াজ। ফারাহ ডাইনিং রুমে শাশুড়ির সঙ্গে বসে আছে চুপচাপ। আইয়াজের মায়ের নাম রমেছা বেগম৷ অল্প শিক্ষিত হলেও বুদ্ধি ধারালো। ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে এ নিয়ে তার আপত্তি নেই। কারণ বাকি দুই ছেলে মেয়েও একই পথের পথিক৷ কিন্তু আইয়াজ একা একা বিয়ে করে নিয়েছে বাবা-মা হীন এক এতিম মেয়েকে। এই নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তুষ্টি না জানালেও ভেতরে ভেতরে পীড়িত হয়েছে। সেই পীড়ন ভাব গাঢ় হচ্ছে ছোটো ছেলের ঘরে এখনো সন্তানাদি আসছে না বলে৷ বাড়ির বউ চাকরি করুক চায় না রমেছা বেগম। তার সংসারে কীসের অভাব যে ছেলে বউদের চাকরি করতে হবে? বড়ো বউ নিয়ে চিন্তা নেই। একদম ঘরকুনো, সংসারী মেয়ে। যত চিন্তা এই ছোটো বউ নিয়ে৷ মেয়ে মানুষ এমন বাইর মুখী হলে সংসার চলে? স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু ছেলে বউ ডাক্তারনি হবে। এমন স্বপ্ন তো সে কখনো দেখেনি। যাক গে এসব পুরোনো কথা, মলিন ব্যথা। আজ রমেছা বেগমের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। ছেলে বউকে নিয়ে অ্যামেরিকায় ঘুরতে যাবে শুনে। ছোটো থেকেই এই ছেলেটা তার ভীষণ বোকা৷ যা জ্ঞান ওই পড়াশোনাতেই৷ নারী লোকের ছল বিষয়ে একেবারে মূর্খ। তা না হলে কি আর এমন মেয়ে বিয়ে করে? গায়ে সাদা চামড়া আর পড়াশোনা করে ডাক্তার হলেই তো কোনো মেয়ে তাদের পরিবারের যোগ্য হয়ে যায় না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমেছা। পাশে বসা ফারাহর দিকে তাকিয়ে থাকে ড্যাবড্যাব করে। শুরু থেকেই ফারাহর ভারিক্কি শরীর তার পছন্দ নয়। এখন এই মোটা স্বাস্থ্যই চক্ষুশূল হয়েছে। তার ধারণা অতিরিক্ত স্বাস্থ্যের কারণে পেটে তেল ধরেছে ফারাহ। এজন্যই বাচ্চা ধরে না৷ তাই প্রথমে যে কথাটা বলল তা হলো,

‘ ফারা, খাবারদাবার হিসেব কইরে খাইয়ো৷ দিনদিন চেহারার কী হাল হইতাছে দেখছ? আর কয়দিন পর তো আমার ছেলের ডাবল হইয়া যাবা। হিমারে দেখো এক পোলার মাও হইয়াও ফিনফিনা দেহ। ‘

হিমা ফারাহর জা৷ শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে তীব্র লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল মেয়েটার৷ শঙ্কিত হলো, এসব কথা আবার আইয়াজ না শুনে ফেলে৷ আইয়াজের কাছে মা ফেরেশতার মতো। বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ি মায়ের অনেক তীক্ষ্ণ কথার শিকার সে। শশুর বাড়ি সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা আছে বলে এসব মালুম করে না। এতিম মেয়ে। বোনের সংসারে কাটিয়েছে দীর্ঘকাল। তাই পূর্বের তুলনায় এটা তার কাছে খুবই নগণ্য। নিজের বোন, বান্ধবী নামী সবার শাশুড়ি সম্পর্কেই টুকিটাকি জানা আছে৷ তাই নিজের শাশুড়ির এহেন আচরণে খুব একটা কষ্ট পায় না৷ এই মানুষটা তার প্রিয় স্বামী, ভালোবাসার মানুষ আইয়াজের জন্মদাত্রী। এতেই যেন তার সাতখু ন মাফ করে দেয় সে৷ চারপাশে সচেতনতার দৃষ্টি বুলিয়ে স্মিত হাসে ফারাহ৷ মৃদু স্বরে শাশুড়িকে বলে,

‘ জি মা, ভাবছি ডায়েট করব। ‘

এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে রমেছা বেগম বলল,

‘ কয়দিন ছুটি কাটাবা দুইজন মিলা বাসাতেই কাটাইতা৷ বিদেশ যাওন লাগব ক্যান বুঝি না৷ বাচ্চা, কাচ্চা হইতাছে না ঘরে বসে আল্লাহরে ডাকবা। দুইজন তার দরবারে হাত তুইলা কান্নাকাটি করবা৷ তা না যাইতাছ আমেরিকাত৷ ‘

ফারাহ জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। বলল না কিছুই৷ রমেছা বেগম নিজে থেকেই বকবক করল। হতাশার সুরে বলল,

‘ শুনো, জামাই বউ মিলা চাকরি করার কী দরকার? লাভটা কী আমারে বুঝাও৷ হইছ তো শিশু বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তোমারি একটা শিশু নাই৷ লাভ আছে কোনো? আর হিমারে দেখো। উচ্চ মাধ্যমিক পইড়া পড়ার ক্ষ্যান্ত দিছে। স্বামী সন্তান নিয়া তার সুখের সংসার৷ ‘

এবারেও হাসি উপহার দিল ফারাহ৷ ভেতরে কতখানি যন্ত্রণা হলো, হৃদয় কতটুকু ছিন্নভিন্ন হলো বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। শাশুড়ি মায়ের মুখ চলতেই থাকল,

‘ শুনলাম দুইজন এখন এক সাথেই থাকবা। ঘুইরা আসো দোয়া করি আল্লাহর রহমতে শিগগিরই কোল ভরুক। ‘

এ পর্যায়ে একটু স্বস্তি পেল ফারাহ। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শাশুড়ির দিকে। রমেছা বেগম সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আপন মনেই বলল,

‘ আমার কথা শুইনা রাগ হইয়ো না। ভালার জন্যই বলতাছি৷ এখন তো ভেজাল নাই৷ একটা, দুইটা হোক তখন বুঝবা চাকরি করন কী কঠিন৷ একসাথে সব সামলানো যায় না। আমিও তো অনেক ভালো স্টুডেন্ট আছিলাম। পড়তে কি পারছি? বিরাট বড়ো সংসার৷ স্বামী, শশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর আবার তিনটা পোলাপান। এই ভীড়ে মেট্রিকেই পড়া ক্ষ্যান্ত দিছি৷ তোমারো ভেজাল বাড়ুক তুমিও বুঝবা৷ যাও ঘরে যাও। বিদেশ যাবা, ঘুরবা ফিরবা গোছগাছ করো গা। ‘

কথা শেষ করে উঠে পড়ল রমেছা বেগম। ফারাহ কিয়ৎক্ষণ চুপ করে বসে থেকে গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছে নিয়ে ঘরে চলে এলো৷ এসে দেখল, আইয়াজ নিজের কাপড় গুছিয়ে এখন তার জামা-কাপড় গোছাচ্ছে। সে কোনোকিছু না ভেবে আইয়াজের কাছে গিয়ে পাশে বসে বলল,

‘ কাল থেকে আমি ডায়েট করব আয়াজ। ‘

জামা ভাঁজ করছিল আইয়াজ হঠাৎ ফারাহর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ আবার ডায়েটের ভূত চাপল মাথায়? তোমাকে বলেছি না আমার এই তুমিটাকেই পারফেক্ট লাগে। তুমি সারাদিন পেট ভরে, মন ভরে খেয়ে যেমন থাকবে আমার এমনটাই চাই। এটাই আমার সুখ শান্তি। ‘

মুখ ঘুরিয়ে রইল ফারাহ। সে জানে তাকে নিয়ে তার আইয়াজের একবিন্দু সমস্যাও নেই৷ তবু শাশুড়ির কথা শুনে তীব্র খারাপ লাগা আর অভিমান থেকেই এসব বলছে। আইয়াজ ফের কাজে মন দিলে সে আবারো বলল,

‘ কেমন ডাক্তার আমি? কীসের চাইল্ড স্পেশালিস্ট, যার নিজেরই একটা চাইল্ড নেই। ‘

সহসা হাত থেমে গেল আইয়াজের। স্তব্ধ মুখে তাকাল ফারাহর দিকে। ত্বরিত জামাকাপড় গুলো এক সাইটে রেখে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল বউকে। চোখে চোখ রেখে নরম গলায় শুধাল,

‘ কার মুখের কথা এগুলো? ‘

কণ্ঠ নরম হলেও চোখ দু’টো দৃঢ়। ফারাহ ত্বরিত নিজেকে সামলে নিল। ঢোক গিলে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ আসলে আমারি খারাপ লাগছিল। তাই পাগলামি করছি। ‘

‘ তুমি মিথ্যা বলতে পারো না ফারাহ। সত্যি বলো।’

ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আকস্মিক আইয়াজকে জড়িয়ে ধরল ফারাহ। শক্ত করে। সে চায় না যে মাকে আইয়াজ ফেরেশতা ভেবে ভক্তি করে। বউয়ের জন্য সে মা সম্পর্কে তার নেতিবাচক ধারণা হোক। তাই স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল সে৷ আর বুঝালো সে নিজের আবেগ থেকে এসব বলছে। তীব্র খারাপ লাগা থেকেই তার বুকে আশ্রয় নিয়ে কাঁদছে। ব্যস আর কিছুই না। কিন্তু আইয়াজ বিশ্বাস করল না। ভালোবাসে তো এই নরম মনের মেয়েটাকে। এই মেয়েটার শরীরে শিরা, উপশিরা থেকে শুরু সমস্ত কিছু ওর চেনা। তাই এক মুহুর্ত স্তম্ভিত মুখে বসে রইল৷ বুকের গভীরে সুক্ষ্ম এক ব্যথা অনুভব করল। অর্ধাঙ্গিনীর যন্ত্রণায় সেও কাতর হয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ।
.
.
আগামী মাসের দশ তারিখ ফ্লাইট ওদের৷ তিন বন্ধুর যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। সৌধ ছুটি নেয়ার তোরজোর করছে। এমতাবস্থায় একদিন ভোরবেলা নিধির কল পেল সৌধ। জানতে পারল, নামী তাকে মেইল করেছে! জানিয়েছে, নেক্সট মন্থে সে তার বাচ্চাকে নিয়ে দীর্ঘ কিছু মাসের জন্য সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। নিধির ফোনকল পেয়ে নামী সম্পর্কে এসব শুনে মাথা হ্যাং হয়ে যায় সৌধর। এ কোন খেলা খেলছে নামী? এ কোন লীলায় জড়িয়ে পড়ছে সুহাস? ভাগ্য কোনদিকে মোড় নেবে? সুহাস, নামীর ভবিষ্যত কী? আর নিষ্পাপ ওই বাচ্চাটা? আর কিছু ভাবতে পারে না সৌধ। তীব্র উত্তেজিত হয়ে কল করে আইয়াজকে। বলে,

‘ সুহাসের অ্যামেরিকায় যাওয়া হচ্ছে না দোস্ত। ওকে সুইজারল্যান্ড যেতে হবে। তুই আর ফারাহই যা অ্যামেরিকায়। ‘

‘ হোয়াট! কী বলছিস? ‘

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আইয়াজ। সৌধ পুরো বিষয়টা খুলে বলে ওকে। মস্তিষ্ক স্থির হয়ে যায় আইয়াজেরও৷ এসব কী হচ্ছে! দাঁড়ানো ছেলেটা বসে পড়ে। এরপর সৌধ ফোন কেটে কল করে সিমরানকে। এদিকে আইয়াজের মুখে সবটা শুনে ঘামতে শুরু করে ফারাহ। এত স্ট্রাগল, জল্পনা কল্পনা শেষে ফলাফল দেখে মাথা ঘুরে যায় ওরও। ভেবে পায় না নামী এতটা পাষণ্ডতা কেন করছে? অতিরিক্ত দুঃশ্চিতায় শ্বাসনালি আঁটকে যায় ফারাহর। নিমেষে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে বিছানার কোণায়। ভাগ্যিস আইয়াজ খেয়াল করে তৎক্ষনাৎ আগলে ধরেছে। নয়তো এক্ষুনি বিপদ ঘটত। ফ্লোরে পড়ে আঘাত পেত খুব৷

‘ ফারাহ, এই ফারাহ, চোখ খুলো, ফারাহ! ‘

অকস্মাৎ ফারাহ জ্ঞান হারাতে ঘাবড়ে গেল আইয়াজ। গলা উঁচু করে ডাকতে লাগল, মা আর ভাবিকে।
.
.
মাস পেরুতে পেরুতে বছরটা ঘুরে গেল৷ সুহাস অ্যামেরিকায় যায়নি৷ যায়নি আইয়াজ, ফারাহও৷ অদৃষ্টের চমৎকার পালাবদল ঘটেছে৷ ফারাহ এখন সন্তান সম্ভবা। বর্তমানে তার গর্ভাবস্থার চার মাস চলছে৷ সেদিন নামীর সুইজারল্যান্ড চলে যাবার খবর আর নিজের গর্ভে আইয়াজের সন্তানের অস্তিত্ব আছে জানার পর তারা আর অ্যামেরিকায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি৷ কিন্তু সৌধ আর সুহাস প্রস্তুতি নিচ্ছে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার। ইতিমধ্যে তারা খবর পেয়েছে নামীর সঙ্গে তার সৎ মা আর বাবার সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের দুই জমজ ছেলের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই অবহেলা করেছে মেয়েকে৷ সেই অভিমানেই নামী বাবার ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব সরাসরি ওরা কেউ জানতে পারেনি৷ নিধিকে পাঠানো নামীর মেইল পড়ে এতটুকু আন্দাজ করেছে ওরা৷ নামীর মতো মেয়েদের জীবনে ভালোবাসা ঠিক পান করা পানির মতো। যে পানিতে এক বিন্দু ময়লা পড়ে থাকে সে পানি কি আমরা পান করি? করি না। মানুষ যেমন পরিষ্কার, স্বচ্ছ পানি পান করে জীবন বাঁচায় ঠিক তেমনি তারা ভালোবাসাতেও স্বচ্ছতা চায়৷ নামী মেয়েটা ভালোবাসার কাঙালিনী। তাই বলে ভেজাল যুক্ত ভালোবাসা সে গ্রহণ করতে পারে না৷ পানি এবং ভালোবাসা দু’টোর ক্ষেত্রেই সে মারাত্মক সেনসেটিভ। পর্যাপ্ত সম্মান বিহীন সে যেমন ভালোবাসা মেনে নিতে পারে না। ঠিক তেমনি অস্বচ্ছ ভালোবাসাও সহ্য করতে পারে না৷ কথায় বলে না অভাগা যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুকায়? নামীর জীবনটা বুঝি এমনই হয়ে গেল।
.
.
বিয়ের পর অনেক গুলো মাস পেরিয়ে গেছে। বিস্তর পরিবর্তন এসেছে সিমরানের জীবনে। সৌধর সঙ্গে একটি মিষ্টি সম্পর্ক, পড়াশোনা, টুকিটাকি সংসার, শাশুড়ির অগাধ স্নেহ আর দাদুনির অকারণ অল্পস্বল্প ক্ষোভ। ওদিকে আবার ভাই, ভাবিকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা।
সব মিলিয়ে তার জীবনটা ঠিক টক, ঝাল, মিষ্টিত্বে ভরপুর। বাপের বাড়ি ছিল সে। হঠাৎ ফোন পেল সৌধর। শুনতে পেল তার শীতল কণ্ঠস্বর,

‘ সিনু, পরশু বাড়ি ফিরছি। তুই বিকেলেই চলে যা৷ ‘

নিমেষে বুক ধক করে ওঠে সিমরানের। ইদানীং যে তার পাশাপাশি সৌধও মিস করা নামক শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে টের পায় সে৷ তাকে মিস করে মানুষটা৷ এইতো ক’দিন আগে এসে ভিসার আবদেন করে গেল। আবার এত তাড়াতাড়ি কেন আসছে? অজান্তেই নেচে ওঠে মন৷ আবার আকস্মিক মনে পড়ে যায় কাঙ্ক্ষিত একটি দিনের কথা। গত বছর এই দিনেই তো সে পার্বতী হতে হতেও হয়নি। আর সৌধ ভাই হয়নি দেবদাস৷ হৃৎস্পন্দন দ্রুত চলতে শুরু করে। সে বাপের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি চলে আসে৷ রাত পেরিয়ে একটা দিন একটা রাত কেটে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়। সারারাত কাটে নির্ঘুমে। বিছানায় ছটফট করে। ভোরের দিকে চোখ লেগে এলেই আকস্মিক কর্ণে বেজে ওঠে দরজার ঠকঠক শব্দ। তড়াক করে ওঠে বসে সিমরান। একছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই ক্লান্ত মুখে দাঁড়ানো সৌধকে দেখতে পায়৷ তার ঘুম জড়ানো চোখ আর ভোরের স্নিগ্ধ শীতলতায় টকটকে হয়ে থাকা ঠোঁটের পানে তাকিয়ে সৌধ মিটিমিটি হাসে। গাঢ় স্বরে বলে,

‘ গুড মর্নিং ডিয়ার। ‘

নিমেষে সরে দাঁড়ায় সিমরান৷ গলা ভিজিয়ে উত্তর করে,

‘ গুড মর্নিং। ‘

সৌধ খেয়াল করল ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে সিমরান। নিজের ভেতরে চলা উত্তেজনাটুকু লুকানোর চেষ্টা করেও লুকাতে পারছে না৷ ধরা পড়ে গেল। মনে মনে প্রচণ্ড হাসল সৌধ। এগিয়ে গিয়ে হাতের ব্যাগটা রেখে ফের সিমরানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। একদম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত ডুবিয়ে দিল প্যান্টের পকেটে। সিমরান কিছু বলতে উদ্যত হবে তার আগেই সে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গভীর গলায় বলল,

‘ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শার্টটা খুলে দিবি? ‘

চমকে ওঠে সিমরান৷ তীব্র মায়া হয়৷ ভাবে আহারে লম্বা জার্নি করে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার বরটার। তাই হাত বাড়িয়ে শার্টের বোতাম স্পর্শ করতেই আচমকা বুকে ধুকপুক শুরু হয়৷ ফিরিয়ে নেয় হাত দু’টো। এতে সৌধর গাঢ় চোখদ্বয় আরো বেশি গাঢ় হয়৷ লজ্জায় গাল দু’টো রক্তাভ হয়ে ওঠে সিমরানের। নিঃশ্বাস হয় ভারিক্কি। ইতস্তত করতে করতে আবারো হাত বাড়িয়ে বোতামে স্পর্শ করে৷ এক পা এগিয়ে একদম কাছাকাছি দাঁড়ায়। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সৌধ। যার পুরোটায় ছড়িয়ে পড়ে সিমরানের মুখশ্রীতে। সে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধ মুখের তরুণীটির পানে। দু’টো বোতাম খুলতেই সিমরানের হাত, পায়ে কম্পণ ধরে যায়। ঠোঁট দু’টো আপনাআপনি কাঁপতে শুরু করে। সৌধর মুখের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, উষ্ণ, শুভ্র বলিষ্ঠ বুকের কুচকুচে লোম গুলো ওর সমস্ত শিরা, উপশিরায় হিম ধরিয়ে দেয়। ভীষণ নাজেহাল হয়ে অবশেষে সবকটা বোতাম খুলতে সক্ষম হয়। গা থেকে পুরোপুরি শার্ট ছাড়াতে সাহায্য করে সৌধ নিজেই। সিমরান সেটা নিয়ে বাথরুমে জমিয়ে রাখা কাপড় গুলোর সঙ্গে রেখে আসে। এরপর দেখতে পায় শরীরে থাকা স্যান্ডো গেঞ্জিটাও খুলে ফেলেছে সৌধ ভাই। নিমেষে চোখ সরিয়ে নেয়। বলিষ্ঠ বুকটা দেখে এত বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে যে নড়ার শক্তিটুকুও পায় না। সে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি সৌধ ভাই এসেছে? নিশ্চিত হতে নিজের বা’হাতে চিমটি কাটে। ব্যথা পেতেই ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ চৌকা হয়ে যায়৷ সৌধ খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। হুঁশ ফেরে সিমরানের। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে যায়৷ সত্যিই তো সৌধ ভাই এসেছে। ঢোক গিলে ত্বরিত। ধড়ফড় করা বুকে এসে কাঁপা স্বরে বলে,

‘ সৌধ..’

ভাই টুকু বলার আগেই ওর ঠোঁটে তর্জনী চেপে ধরে সৌধ। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ভারী গলায় বলে,

‘ ডোন্ট কল ব্রো। ‘

স্তব্ধিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিমরান। সৌধ কথাটা বলেই তর্জনী সরায়। দু’হাত বাড়িয়ে চনমনে কণ্ঠে বলে,

‘ জাস্ট হাগ…। ‘

সৌধ কথাটা বললেও সিমরান জড়িয়ে ধরল না তাকে৷ বরং চিন্তায় পড়ে গেল ভীষণ। বিয়ের পর তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা হয়নি তেমন। এক বিছানায় থাকার সুবাধে যতটুকু কাছাকাছি গেছে ততটুকুকে ঘনিষ্ঠতা বলে না। ঘুমের ঘোরে বহুবার সে সৌধ ভাইকে জড়িয়ে ধরেছে৷ বিনিময়ে অবহেলা পায়নি৷ সৌধ ভাই ঠিক প্রশ্রয় দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। বুকে আগলে ধরে ঘুমিয়েছে। সেটাতে আলাদা কোনো চাওয়া, পাওয়া ছিল না। তবে আজ কেন অন্যরকম লাগছে? এই সুগভীর চোখ দু’টো যেন অন্য সুরে তাকাচ্ছে আজ। এই যে হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে তারও অন্যরকম চাহিদা৷ ওই প্রশস্ত বুকটাও যেন অন্যরকম আলিঙ্গনে ডাকছে। নিমেষে থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর দেহশ্রী। ঠিক কয়েক সেকেণ্ড ব্যবধানে সহসা সৌধ নিজেই ওকে টেনে ধরে বুকের ভেতর ভরে নেয়। উষ্ণ আলিঙ্গনে ডুবিয়ে রাখে দীর্ঘক্ষণ। দরজা খোলা আছে সেদিকে ওদের কারোরি হুঁশ নেই। সিমরান চোখ বুঁজে অনুভব করতে ব্যস্ত তার প্রণয় পুরুষটার বুকের বা’পাশের ধুকপুক শব্দ। আর সৌধ বিভোর অর্ধাঙ্গিনীকে গভীর আলিঙ্গনে…।

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭২|
উত্তরে হাওয়া নিয়ে আসছে শীতকাল৷ প্রকৃতি জুড়ে হিমহিম ঠান্ডা গায়ে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। সেই শিহরণ আজ দ্বিগুণ হলো, প্রণয় পুরুষটির প্রগাঢ় আর উষ্ণ আলিঙ্গনে। যে আলিঙ্গনে অন্তঃকরণ শত সহস্রবার প্রার্থনা করে, সময়টা থেমে যাক। এই নিরাপদ বুকটায় কেটে যাক যুগের পর যুগ। শেষতক এই বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বিদায় নিক পৃথিবী ছেড়ে। প্রশান্তির ঘুম ঘুমাক চিরতরে। আজ যেন দু’টো শরীর, দু’টো হৃদয় এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে৷ এক উষ্ণ অনুভূতিতে শিহরিত হচ্ছে দু’জন। একে অপরকে অনুভব করছে নিখুঁতভাবে৷ সৌধর বুকে একদম মিলিয়ে আছে মেয়েটা৷ ছোট্ট দেহশ্রীটুকু বিড়ালছানার মতো ঘাপটি মেরে আছে। এদিকে রোজকার নিয়মে তাহানী আসছে তার ভাবিপাকে ডাকতে। বিয়ের আগে সিমরানকে আপু, আপাই ডাকত তাহানী। তাই বিয়ের পর ভাই বউ হওয়ার সুবাদে ভাবি, আপা মিলিয়ে ভাবিপা ডাকে।

সিমরান মেয়েটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। সৌধ যখন কাছে থাকে তখন সৌধর আদুরে ডাকেই তার ভোরবেলা ঘুম ছুটে যায়৷ আর দূরে থাকলে নিয়ম করে ভোরবেলা ওঠতে পারে না। তার এই ব্যাধি সারাতেই সৌধ সাত বছরের তাহানীকে একদম রায় বাঘিনী ননদিনী হতে আদেশ করে। যত ভালোবাসাই থাকুক তার ভাবিপার প্রতি। কোনোক্রমেই যেন বেলা করে ঘুমাতে না দেয়। চৌধুরী বাড়িতে সবাই ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে৷ বেলা করে ঘুমানোর স্বভাব এক ঝুমায়না ভাবিরই আছে৷ ছোট্ট তাহানীকেও তার বাবা ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠতে শিখিয়েছে। বাবা যখন বাড়িতে থাকে তার সঙ্গে রোজ সকালে হাঁটতে বেরোয় সে। আর ব্যবসায়ীক কাজে বাবা ঢাকা চলে গেলে বড়ো মার সঙ্গেই সময় কাটায়। সৌধ তার পরিবারের সকলের গতিবিধি সম্পর্কে জানে৷ তাই তাহানীকেই বেছে নেয় সিমরানের প্রভাতের সঙ্গী হিসেবে। ছোটো ভাইয়ার আদেশ অনুযায়ী তাহানীও রোজ চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে, দরজা ধাক্কিয়ে ভাবিপাকে জাগিয়ে তুলে। এরপর ওরা ছাদে গিয়ে শরীর চর্চা করে বা বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, ফুল তুলে। কখনো কখনো সৌধ ওদের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে সঙ্গও দেয়। নিয়ম মেনে আজো তাহানী ডাকতে এলো। এসে দরজা খোলা দেখে খুশি হলো ভীষণ। ভাবল, ‘ বাহ আজ তো ভাবিপা গুড গার্ল হয়ে গেছে।’ এসব ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে যেই না ঘরে ঢুকল বুকের ভেতর অল্পখানি ভয়ে ছ্যাঁত করে ওঠে। আকস্মিক দু’হাতে চোখ দু’টো ঢেকে ভয়ে ভয়ে বলে,

‘ সরি সরি, আমি জানতাম না, ট্রাস্ট মি। ‘

মিহি, ভীত স্বরটি কর্ণে পৌঁছাতেই একে অপরের থেকে ছিটকে সরে যায় সৌধ, সিমরান। তীব্র লজ্জায় সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠে সিমরানের। গাল দু’টো হয়ে যায় রক্তাভ। তাহানী আর এক মুহুর্ত দেরি করে না। সে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে ভাবতেই চোখ দু’টো টলমল হয়ে যায়। মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো সিঁড়ি বেয়ে বড়ো মায়ের ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করে। ছোটোবেলা থেকে তাকে শেখানো হয়েছে কারো ঘরে গেলে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে যাবে। সাত বছর বয়স তার৷ বর্তমান জেনারেশনের বাচ্চারা অনেক বেশি স্মার্ট হয়। তাহানীর মাঝে সেই স্মার্টনেস পরিপূর্ণ ভাবে রয়েছে। এর পেছনে তার পরিবার এবং সুললের মতো কঠিন ব্যক্তিত্বধারী বাবার অবদান অপরিসীম। যে শিক্ষা তাকে দেয়া হয়েছে তাতে আজ যে ঘটনা ঘটে গেছে এই নিয়ে যেমন লজ্জিত তেমন ভীতও। স্মৃতি আপু তাকে বলেছিল, ‘ কারো ঘরে নক ছাড়া তো যাবেই না, ম্যারেড কাপলদের বেলায় আরো বেশি সতর্ক থাকবা। ‘ সে জানত ছোটো ভাইয়া আজ আসবে। তাই বলে এত সকালে এসে যাবে তা তো জানত না। ভাই, ভাবির ভালোবাসার সময় সে গিয়ে ডিস্টার্ব করল! ছোট্ট হৃদয়টুকু অস্বস্তি, লজ্জায় বিচলিত হয়ে রইল।

সিমরান লজ্জায় সেই যে মাথা নুইয়েছে আর তুলেনি। সৌধকে তেমন বিচলিত দেখাল না। সে শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে একহাত পকেটে গুঁজে দিল। এরপর অপর হাতে নিজের এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলল,

‘ সিনু সারারাত ঘুম হয়নি। আমি একটু ঘুমাব। তুই তাহানীর কাছে যা৷ ও ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। ভয়, লজ্জা দুটোই পেয়েছে। তুই গিয়ে ওকে স্বাভাবিক কর৷ বল, আমরা একটুও মাইন্ড করিনি। উই নো ইট’স আ স্মল মিস্টেক। ‘
.
.
সুজা এমপির বাড়িতে শুক্রবার মানেই আলাদা আমেজ৷ সেই আমেজে গাঢ় হয়ে ওঠল সুজা, সুলল দুই ভাই। সৌরভ, সৌধ দু’ভাই। আর সিমরান, ঝুমায়না দুই পুত্রবধূর উপস্থিতিতে। আজ তারা সবাই মিলে দুপুরের আহার একসঙ্গে গ্রহণ করবে৷ এত মানুষের ভীড়ে তাহানী মিস করছিল স্মৃতি আপুকে। যে বরের সাথে ফের কানাডায় পারি জমিয়েছে। রান্নাঘরে আজ এলাহি আয়োজন। কাজের মেয়েরা কা’টাকুটি, থালাবাসন ধোঁয়া এসবে ব্যস্ত। আর বউরা ব্যস্ত সুস্বাদু খাবার তৈরিতে। তাহানী ভিডিয়ো কলে তার স্মৃতি আপার সাথে গল্প করছে। পাশাপাশি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে আর বড়ো মা আর ভাবিপা মিলে কী দারুণ দারুণ রান্না করছে। দাদুনি ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছে আর ছোটো ছেলে সুললের বকুনি শুনছে৷ সুলল কাকু পান খাওয়া একদম পছন্দ করে না৷ তার ভাষ্যে পান খায় রুচিহীন মানুষেরা। এটা রুচির দুর্ভিক্ষ। ছেলে আর নাতিদের বেলায় দাদুনি যেন নতুন বউ৷ একদম মুখে কুলুপ এঁটে বকুনি খায়, জ্ঞান বাক্য শুনে৷ ঝুমায়না নীরব দর্শক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো দাদুনির কাছে এসে বসছে তো কখনো শাশুড়ি, জায়ের রান্নার ঘ্রাণ শুঁকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছেলে সুরের দুষ্টুমি গুলো ক্যামেরা বন্দি করে ফেসবুকে আপলোডও দিচ্ছে। এমন সময় আজান ধ্বনি শুনতে পেয়ে সিমরান তড়িঘড়ি করে উপরে ছুটল। সৌধ ভাইকে জাগিয়ে দিতে হবে এখন। বাবা, চাচা আর ভাইয়ের সঙ্গে নামাজে যাবে সে।

সৌধর ঘুম ছুটেছে আরো মিনিট, পাঁচেক আগে৷ ঘুমের ঘোরে আকস্মিক সিমরানের ফোনের রিংটোন শুনতে পায় সে। অমনি ত্বরিত ওঠে বসে ফোন হাতে নেয়৷ নাম্বার সেভ করা নেই বিধায় ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করে কানে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পায় একটি পুরুষালী কণ্ঠের উত্তেজিত কিছু বাক্য,

‘ সিমরান! ফোন ধরছ না কেন? আরে বাবা আমি সরি বলেছি তো৷ আই এম এক্সট্রিমলি সরি ইয়ার। তুমি প্লিজ বিকেলে বেরোও। লুনা, দিলারা ওরাও বেরুবে। উদ্যানে আসো প্লিজ। কান ধরে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু দাও। আমার আসলেই বোঝা উচিত ছিল, যে মেয়ে বিয়ের আগেই আমাকে একসেপ্ট করেনি সে বিয়ের পর কীভাবে করবে? তুমি ঠিক বলেছ বন্ধুত্বের মাঝে প্রেম শব্দটা আনাই মারাত্মক ভুল হয়েছে। ট্রাস্ট মি আমি তোমার বন্ধু হয়েই থাকব৷ প্রেম শব্দটা আনব না৷ তবু প্লিজ ব্লক লিস্ট থেকে আমার আইডি ছাড়াও। আমার নাম্বার গুলোও ব্ল্যাক লিস্ট থেকে মুক্ত করো। প্লিজ, প্লিজ। ‘

সদ্য ঘুম ভেঙে ছিল সৌধর৷ ঠিকঠাক মস্তিষ্ক সজাগ হতে না হতেই বউয়ের ফোন রিসিভ করে বসেছে৷ কিন্তু এমন একটা বিষয়ের সম্মুখীন হবে ভাবতেও পারেনি৷ সহসা মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ল ওর। বুকের ভেতর সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুভূতির সৃষ্টি হলো। এই অনুভূতিটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এক বালতি তীব্র গরম পানিতে কেউ মুখ ঠেশে ধরলে যেমন লাগে অমন নাকি সম্পূর্ণ অন্ধকার, বায়ু চলাচল ছাড়া গুমোট ঘরে বন্দি করে রাখলে যে অনুভূতি হয় তেমন বোধগম্য হলো না। তবে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে ভয়াবহ এক ক্রোধ। এই পৃথিবীতে কার এত স্পর্ধা? যে সৌধ চৌধুরীর অর্ধাঙ্গিনীকে প্রেম নিবেদন করবে। যে মেয়েটাকে এত যত্ন করে আগলে ধরে জীবনে জড়িয়েছে। যে মেয়েটাকে সম্পূর্ণ হালাল রূপে নিজের করে পেয়েছে। অথচ একবারটি গভীর করে ছুঁয়ে দেখেনি। তীব্র পৌরুষ চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য্য ধরে সময় গুনেছে। বিয়ের পর থেকে কত রাত সে না ঘুমিয়ে বিছানায় ছটফট করে কাটিয়েছে৷ পাশের মানুষটির থেকে সম্পূর্ণ আশকারা পেয়েও ভুলেও নিয়ন্ত্রণহারা হয়নি। তিলে তিলে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার পাশাপাশি বুকের ভেতর গড়ে তুলেছে মেয়েটার জন্য প্রগাঢ় প্রণয়, দৃঢ় ভালোবাসার মহাসিন্ধু। যার জন্য জীবনের খেই হারিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখেছে, শূন্য দু হাত আর শূন্য এক বুকে যে আকাশসম পূর্ণতা নিয়ে কাছে এসেছে। সেই তাকেই কিনা অন্য একটা পুরুষ প্রেম নিবেদন করেছে! চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল সৌধর। চোয়াল দু’টো দৃঢ় হতে হতে হাড় ফুলে ফেঁপে ওঠল। অত্যধিক ক্রোধে কান দু’টো গরম হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করল যেন। শ্বাসনালি আঁটকে রইল এক মুহুর্ত। ফোনের ওপাশে ছেলেটা বলেই যাচ্ছে,

‘ সিমরান, কথা বলছ না কেন? তুমি তো জানো হঠাৎ করে তোমার বিয়ের খবর শুনে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি। তাই পরবর্তী যা করেছি সব আবেগে পড়েই৷ কিন্তু তুমি আমাকে ব্লক করার পর আমার বিবেক জেগে ওঠেছে৷ প্লিজ ক্ষমা করো, আমাদের বন্ধুত্ব টুকু শেষ করে দিও না। ‘

আর নিতে পারল না সৌধ। বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে দাঁড়িয়ে কানে ফোন চেপে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘ স্ক’উন্ড্রেল, বাস্টা’র্ড তোর সাহস কী করে হয়? ‘

ক্রোধে জর্জরিত সৌধ উচ্চ কণ্ঠে এ পর্যন্ত বলতেই দরজার সামনে দাঁড়ানো সিমরান হতভম্ব হয়ে গেল। পায়ের গতি বাড়িয়ে ত্বরিত ঘরে ঢুকে বিচলিত কণ্ঠে বলল,

‘ কী হয়েছে সৌধ… ‘

ভাই টুকু উচ্চারণের পূর্বেই ফোন কানে ধরে ক্রোধে ভয়ানক রূপ ধরা সৌধ এমন করে তাকাল যে অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠল মেয়েটার৷ নিমেষে ঢোক গিলে স্তম্ভিত মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি ততক্ষণে ফোন কেটে বিপদের ভয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছে। সৌধ সিমরানের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফোনের দিকে রাখল। নিজেকে শান্ত করতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগল ওর৷ এরপর বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল কতক্ষণ। সিমরান সরাসরি দৃষ্টি না দিয়ে আড়চোখে দেখল ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে সৌধ ভাই। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে হাঁটু কাঁপতে শুরু করল ওর। মেরুদণ্ড দিয়ে বেয়ে গেল শীতল স্রোত। নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে দীর্ঘ সময় নিল সৌধ। এরপর ধীরেসুস্থে এসে দাঁড়াল সিমরানের মুখোমুখি। হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে ধরে চোয়াল কাঁপিয়ে দৃঢ় স্বরে শুধাল,

‘ নাম্বারটা কার? ‘

নাম্বারটা অচেনা। মন দিয়ে দেখল সিমরান৷ এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বুঝাল সে চিনে না। সৌধর দৃষ্টি কঠিন হলো। তপ্ত মেজাজে ধমকে বলল,

‘ কে বিরক্ত করে তোকে? ম্যারেড জেনেও কে তোকে প্রপোজাল দেয়? কতবার বলেছি এসব ছেলেমেয়ে সাথে মিশবি না। ‘

আকস্মিক বীভৎস ধমক খেয়ে কাঁধজোড়া কেঁপে ওঠে সিমরানের। নিমেষে ভোরের স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশের উষ্ণ আদরটুকু ভুলে গিয়ে একরাশ ভয় আর দুঃখে কাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করে। দমে যায় সৌধ। সরে যায় ওর সম্মুখ থেকে৷ তবে হাতে ধরিয়ে দেয় ফোনটা। সিমরান ফোন হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখে। ব্ল্যাক লিস্টে ঢুকে দেখতে পায় পরশের অগণিত ফোন আর ম্যাসেজ। তাহলে পরশই কল করেছিল? নিজের ক্রোধ টুকু সামলে নিয়েছে সৌধ৷ নিশ্চুপ বসে আছে বিছানায়। দু পা ফ্লোরে রাখা। হাঁটুতে কনুই ভর করে দু-হাত মুঠো করে কপালে মৃদু মৃদু ঘু ষি দিচ্ছে। সিমরানের বুক কাঁপতে শুরু করে। সৌধ ভাইকে পরশ কী বলেছে? ভুলভাল কিছু বলেনি তো? সৌধ ভাই তাকে ভুল বুঝল কী? সন্দেহ করল কী? এত রেগে গেছে কেন? কী বলেছে পরশ? না চাইতেও শব্দ করে কান্না চলে এলো মেয়েটার৷ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো সৌধর সামনে। এরপর ধপ করে বসে পড়ে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘ আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করো। তুমি ছাড়া আমার জীবনে কোনো পুরুষ আসেনি আর আসবেও না। ‘

সৌধর মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না৷ সিমরান যেন পাগলপ্রায় হয়ে গেল এবার। ওর সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ল পরশের ওপর৷ পরশকে পড়ে দেখে নেবে। আপাতত বরকে শান্ত করা চাই। সৌধ ভাই নিজ মুখে স্বীকারোক্তি না দিলেও সে টের পেয়েছে মানুষটা ধীরেধীরে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালোবাসাটাও তৈরি হয়ে গেছে। এবার শুধু গভীর প্রণয়ে সিক্ত হবার পালা। এত ফাইট করে, সেক্রিফাইস করে অবশেষে মানুষটাকে আপন করে পেতে চলেছে সে। আর আজ কিনা সেখানে সন্দেহ, ভুল বোঝাবুঝি আসবে? তাও কিনা পরশের কারণে? নিমেষে ফুঁসে ওঠে সিমরান৷ ত্বরিত কল করে পরশের নাম্বারে। নাম্বার বন্ধ দেখায়। হতাশ হয় সে। অশ্রুসিক্ত চোখ আর অসহায় মুখে তাকায় স্বামীর পানে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,

‘ সৌধ ভাই, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না৷ এত রেগে থেকো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘

অকস্মাৎ ভ্রু কুঁচকে তাকায় সৌধ। দেখতে পায় অশ্রুতে ভেজা লাল টকটকে মুখশ্রী। ঢোক গিলে ত্বরিত। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

‘ কেউ ডিস্টার্ব করলে আমাকে জানানো উচিত। ‘

‘ আসলে ও আমার বন্ধু ছিল। বন্ধু থেকে প্রেমিক হওয়ার আবদার করার পর থেকে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। আর সেদিন যখন আমি ম্যারেড জানার পরও পাগলামি করে এরপর থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিই। ‘

সৌধর চোখ দু’টো থমকে আছে৷ সিমরান সে চোখে তাকিয়ে ভাষা গুলো বুঝতে পারল না। বোঝার কথাও নয়। সৌধর মস্তিষ্ক জুড়ে যে আকস্মিক হানা দিয়েছে নিধি আর অর্পণ। সে যেন তার আর সিমরানের মাঝে আজ ওই দু’জনকে দেখে নিল। কিন্তু ওই ছেলেটার মাঝে সে নেই৷ কারণ নিধির প্রতি তীব্র অনুভূতি থাকার পরও সে অন্যের বউ জানার পর একবারো ভালোবাসার দাবি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়নি, ফোন করেনি। বরং সব সময় চেয়েছে নিধি ভালো থাকুক। মন দিয়ে সংসার করুক। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সৌধ। মনে প্রশ্ন জাগে আজ তার যে অনুভূতি হচ্ছে অর্পণেরও কি একই অনুভূতি হয়েছিল? নাহ তা কী করে হবে? সে তো কখনো ওদের জীবনে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। পরোক্ষণেই মনে পড়ল, ঝোঁকের বশে হলেও নিধি তো চেয়েছিল। একজন পুরুষের কাছে এটা কতখানি যন্ত্রণার সে আজ টের পেল। সিমরান অমন কিছু চায়নি। তাকে শুধু একটা ছেলে প্রপোজ করেছে ব্যস এতেই তার সবটা কেমন উথাল-পাতাল হয়ে যাচ্ছিল! স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌধ। সিমরানের চোখ গলে পানি পড়ছেই। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দু-চোখের পানি মুছে দিল সে। সিমরান ওর মন বুঝে ওঠে দাঁড়ালে সৌধ ওকে নিজের পাশে বসিয়ে শান্ত ভেজা কণ্ঠে বলল,

‘ নাম কী ছেলেটার? ‘

‘ পরশ। ‘

‘ থাকে কোথায়? ‘

সিমরান লোকেশন বলল ভয়ে ভয়ে। সৌধ ফের প্রশ্ন করল,

‘ কেমন বন্ধু?

ভীত হয় সিমরান৷ ক্ষীণ গলায় বলে,

‘ কী বলেছে পরশ? ‘

‘ ক্ষমা চেয়েছে। বিকেলে মিট করতে বলেছে।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সিমরান বলল,

‘ আমি মিট করব না। ওকে ক্ষমা করে দিলাম। পরেরবার যদি এমন ভুল করে তোমাকে জানাব। ‘

সৌধ শান্তি পেলো না। মনের ভেতর অদ্ভুত অশান্তি বিরাজ করতে লাগল। পরশ ছেলেটার খোঁজ নিতে হবে। এরপর যদি মনে হয় শায়েস্তা করা উচিত করবে নয়তো না। রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখল। এরপর সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ভয় পেয়েছিস? ‘

সিমরান ঠোঁট কামড়াল। সৌধ স্মিত হেসে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,

‘ তোর তো খুশি হওয়া উচিত সিনু। আমি আজ নিজের প্রতি নিজেই অবাক হয়েছি। পাশাপাশি অনেক বড়ো দু’টো সত্যি অনুভব করেছি। প্রথম সত্যিটা আগামীকাল ভোরবেলা বলব। দ্বিতীয় সত্যিটা কী জানিস? ‘

সিমরান কিছু বলল না। দু’হাতে সৌধর পিঠ জড়িয়ে বুকে মাথা চেপে রইল। সৌধ ওর মস্তকে গাঢ় চুম্বন করে বলল,

‘ পরশ আমার চোখে যেমন আমিও অর্পণের চোখে তেমনি বোধহয়। তবে পরশের মতো ছ্যাঁচড়া ব্যক্তিত্ব আমার নয়। যে পরের বউকে প্রেম নিবেদন করব। ‘

.
.
চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি শুনতেই চট করে চোখ খুলল সৌধ। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সিমরান। বাঁকা হাসল আচমকা। বরাবরের মতো তার ঘুম প্রেয়সীর উষ্ণ, নরম ঠোঁটে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে ত্বরিত ওঠে বসল৷ ঘুম কাতুরে সিমরান জানতেও পারল না এই নিয়ে ছ’বার তার অর্ধাঙ্গ তার অগোচরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখল৷ রয়েসয়ে শীতল কণ্ঠে ডাকতে শুরু করল সৌধ৷ শীত মৌসুমে এই সময়টায় ওঠা তীব্র কষ্টের সিমরানের জন্য। তবু ওঠতে হবে। তাই আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ওঠে বসল৷ এরপর ওরা দু’জন মিলে ফজরের নামাজটা সেরে নেওয়ার পর সৌধ বলল, জলদি পোশাক পরিবর্তন করতে। তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে সে। সিমরান প্রথমে বুঝতে না পরক্ষোণেই বুঝতে পারল জন্মদিন উপলক্ষেই তার বর তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুবে। বারোটায় উইশ করে ঘুমিয়েছিল সে৷ ফের এখন উইশ করে কাভার্ডের দিকে এগুলো। সৌধ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

‘ আজ সারাদিনটা যেমন স্মরণীয় হবে। তেমনি দিনশেষে যে রাতটা আসবে ওটাও তোর সমস্ত সত্তায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘

একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেলকনিতে গেল সৌধ৷ সিমরান গাঢ় সবুজ রঙের একটি স্কার্ট আর লাল রঙের লেডিস শার্ট বের করে বিছানায় রাখল৷ মনে পড়ল রুমটা ঝাড় দেয়া হয়নি৷ নিজের ঘর এখন নিজেই ঝাড়ু দেয় সে। তাই চটজলদি রুম ঝাড়ু দিয়েই বাথরুম ঢুকে পড়ল। অল্প পরিসরে গোসল সেরে নিলেও চুল ভেজাল না৷ ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরতে উদ্যত হতেই আচমকা খেয়াল হলো, সে রুম ঝাড়ু দিয়ে কাপড় না নিয়েই বাথরুমে ঢুকেছে!

বেলকনিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সুহাসের টেক্সট নজরে আসে সৌধর। রাত দু’টোয় টেক্সট এসেছে।

‘ দোস্ত দুই তারিখ ভিসা আসার কথা না? আর নয়দিন তাই না? সময় এত স্লো যাচ্ছে মেজাজটাই খারাপ লাগতাছে। ‘

টেক্সটটা পড়তে পড়তে ঘরের ভেতর এলো সে। সহসা নজড়ে পড়ল বিছানায় সিমরানের কাপড় আর বাথরুমের দরজা বন্ধ। ভ্রু কুঁচকে ফেলল অমনি। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ সিনু, কাপড় নিস নি কেন? ‘

প্রশ্নটা করেই মনে মনে ভাবল,

‘ আমার বোধহয় তুই ডাকটা শুধরানো উচিত। ‘

সিমরান ভেতর থেকে বলল,

‘ সৌধ ভাই, তাড়াহুড়োয় কাপড় রেখেই চলে আসছি। একটু দাও না।। ‘

ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসি ঠোঁটে এঁটে কাপড় গুলো নিয়ে সিমরানকে দিয়ে এসে বিছানায় বসল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে সহসা ডানপাশে চোখ যেতেই থমকে গেল হৃৎস্পন্দন। কাপড় গুলোর সাথে সাদা রঙের একটি অধোবস্ত্র ছিল। যা বিছানাতেই রয়ে গেছে। নিমেষে মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠল সৌধ৷ হালকা কাশিও ওঠল বেচারার৷ এরপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দু আঙুলে ছোট্ট বস্ত্রটা তুলে ধরে নিয়ে গেল বাথরুমের সামনে। সে নিশ্চিত এখন এটা দেয়া মানে আজ সারাদিন মেয়েটা লজ্জায় টইটম্বুর হয়ে থাকা। তবু পিছুপা হলো না৷ অনেক তো হলো জড়তা, ভীরুতা। অনেক হলো দূরত্ব। এবার সম্পর্কে পূর্ণতা দেয়ার পালা৷ তাছাড়া দিন পেরিয়ে রাত ঘনালেই আজ মেয়েটাকে সম্পূর্ণরূপে নিজের করে নেবে। উজার করে দেবে নিজের সবটুকু। এ মুহুর্তে হয়তো সিমরান অতি লজ্জায় কয়েকশতবার কোমা পেশেন্টদের মতো আচরণ করবে। ব্যাপার না, এখন থেকে বউয়ের সব লজ্জা শুষে নেয়ার দায়িত্ব তার৷

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৬৯+৭০

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৯|
আরো একটি নির্ঘুম রাত৷ এ কী বীভৎসতা? এ কোন দহনে পুড়াচ্ছে নামীদামি? সুহাস কী সইতে পারে তার সুহাসিনীর পাষণ্ডতা? পারে না তো… তাই তো তীব্র যন্ত্রণা বুকে পুষে দু’রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিল। গোটা একটা রাত কেটে গেল প্রিয়জন হারানোর শোকে। দীর্ঘদিন এই শোকে ঝিমিয়ে পড়েছিল সে।
যা দৃঢ় হয়ে ওঠেছে সে বাবা হচ্ছে বিষয়টি জানতে পেরে। নতুন অনুভূতি, প্রথম পরিচয় যা ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। বহুকষ্টে ভোরবেলা একটু চোখ বুজতে পারল৷ কিন্তু ঘুম হলো না ঠিকঠাক। মস্তিষ্ক জুড়ে কিলবিল শুরু করল, নামীর সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত। বেলা বাড়তে বাড়তে সেই মুহুর্ত গুলো পেরিয়ে পেরিয়ে চলে এলো, সেদিনের সেই ঝগড়ায়। এরপর বাস্তবের মতো স্বপ্নেও নামী হারিয়ে গেল৷ আর খুঁজে পেল না তাকে৷ বুকের ভেতর ছটফটিয়ে উঠলো। মস্তিষ্কে চাপ পড়ল ভীষণ। তীব্র যন্ত্রণায় স্বপ্নের ঘোরেই নড়তে শুরু করল সুহাস৷ আকস্মিক তখন আবার নামীর দেখা মিলে। গাঢ় গোলাপি রঙের একটি গোল জামা পরিহিত নামী। পেটের কাছটা অনেক উঁচু। দেখে মনে হচ্ছে সাত, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের বাড়িরই সিঁড়ি পেরিয়ে অসন্তুষ্ট মুখে নিচে নামছে৷ সুহাস সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে গর্ভবতী নামীর পানে। সহসা পা ফস্কে যায় নামীর। সিঁড়ি গড়িয়ে পড়ে নিচে। প্রতিটি সিঁড়ির ধাপে ধাপে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুহাসের বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে নিমেষে। চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। ভয়ে শিউরে ওঠে দেহ। বাড়ি কাঁপিয়ে আর্তচিৎকার করে ওঠে তার পুরুষালি কণ্ঠস্বর। একছুটে চলে আসে রক্তে মাখামাখি হয়ে পেটে দু’হাত চেপে ধরে কাতরাতে থাকা নামীর কাছে। শুনতে পায় কাঁপা কাঁপা স্বরে নামী বলছে,

‘ আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না সুহাস৷ তোমার মতো অযোগ্য লোকের স্ত্রী কখনো মাতৃসুখ পায় না। আমিও পেলাম না৷ ঠিক এই অপরাধেই আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব! ‘

দিকবিদিকশুন্য হয়ে গগনবিদারী এক চিৎকার দেয় সুহাস। হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসে৷ ঘুম ছুটে গেছে পুরোপুরি৷ হাঁপাচ্ছে ভীষণ। যেন সে ঘুমাচ্ছিল না, মাইলের পর মাইল দৌড়ে এসেছে। থরথর করে কাঁপছে ছেলেটা। এসি চলছে তবু শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। ভালোভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, আলো ফুটেছে। ঘড়ির কাঁটায় সময় ঠিক বেলা এগারোটা। অর্থাৎ, সে এতক্ষণ যাবৎ স্বপ্ন দেখছিল, দুঃস্বপ্ন! ফোঁস ফোঁস শব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস৷ কাঁপা হাতে সাইট টেবিলে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে এক শ্বাসে পানি খেল। এরপর শঙ্কিত চিত্তে সেলফোন খুঁজে ত্বরিত কল করল সৌধকে৷
.
ভারি বর্ষণ শেষে সবুজ, শ্যামল প্রকৃতিতে যেই সতেজতা বিরাজ করে। সিমরানের আপাদমস্তক আজ সেই সতেজতাতেই পরিপূর্ণ৷ তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না গত রাতে তার সঙ্গে একটি বিকৃত ঘটনা ঘটেছিল৷ সৌধ নামক ম্যাজিসিয়ান স্বামী যার আছে তার জীবনে কোনো বিকৃত ঘটনার চিহ্ন থাকতে পারে না৷ সদ্য বিবাহিতা সিমরানকে ঘিরে আছে যেন আশ্চর্য এক সুখ। জ্বলজ্বল করা এই সুখ হিংসে করার মতোন। সকাল থেকে চৌধুরী বাড়ি জুড়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে এক সুখী, সুশ্রী তরুণী৷ এ যেন চোখের শান্তি। সুজা চৌধুরী থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটি সদস্যই খেয়াল করেছে। সুন্দরী, প্রাণ চঞ্চল এক মেয়ে কী অমায়িক ভাবে মিশে আছে তাদের পরিবারের সঙ্গে। বয়সের তুলনায় মানসিক পরিপক্বতা আসেনি হয়তো। কাজেকর্মেও পটু নয়।
তবু তার মিষ্টি আচরণ, শিষ্টতাতেই মুগ্ধ সকলে। এ বাড়িতে সৌধ, তানজিম চৌধুরীর পর সিমরানের সবচেয়ে কাছের মানুষ তাহানী৷ তার সঙ্গে এখন সে এ বাড়ির বিরাট লাইব্রেরিতে ঢুকেছে৷ ওদিকে সৌধ খুঁজে বেড়াচ্ছে সিমরানকে৷ দুপুর হয়ে আসছে৷ এখনো জানানো হয়নি আজ সে নিধির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কাজের মেয়ে তুরিন জানালো সে তাহানীর সঙ্গে গ্রন্থাগারে গেছে৷ শুনে খুশি হলো সৌধ। ভেবেছিল চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার আগে সে নিজেই একবার ওখানে নিয়ে যাবে সিনুকে। যাতে অবসর সময় গুলো বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিয়ে বই, পুস্তক পড়ে কাটাতে পারে। ওর যা বন্ধুমহল ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ নয় সৌধর। সবগুলোই চেনে সে। তারা কোন পরিবারের, তাদের চলাফেরা কী সব ব্যাপারে অবগত। এতকাল তাদের সঙ্গে মেশা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিলেও আলাদা কোনো জোর ছিল না৷ এবার আছে। অন্তত কোনো পুরুষই চাইবে না তার বউয়ের সমাজে বিশৃঙ্খল সৃষ্টিকারী বন্ধু-বান্ধব থাকুক৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌধ। আকাঙ্ক্ষা জন্মায়, বইয়ের সঙ্গে সিনুর একটা নিবিড় সম্পর্ক হোক।

বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে বাগানের ডানপাশে চলে গেল সৌধ৷ ছোট্ট একটি দোতলা বিল্ডিং। নিচতলার প্রবেশদ্বারের সামনে নেম প্লেটে লিখা, ” বুক ফ্রেন্ড লাইব্রেরি ” মূলত লাইব্রেরিটা ছিল সুলল চৌধুরীর। এ বাড়িতে বইপ্রেমী মানুষ বলতে সুজা চৌধুরী, তানজিম চৌধুরী আর সুলল চৌধুরীই ছিল। সৌধ বড়ো হতে হতে কাকুর উৎসাহ, উদ্দীপনায় ধীরে ধীরে তুখোড় বইপ্রেমী হয়ে ওঠল৷ এরপর চাচা, ভাতিজা মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তারা বড়ো করে একটা লাইব্রেরি ঘর দেবে৷ সুলল কাকুর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটাই বড়ো করা হলো। দোতলার ছোট্ট ঘর বদলে নিচে এখানটায় রাজকীয় ভাবে স্থাপন করা হলো ” বুক ফ্রেন্ড লাইব্রেরি ” নিচতলায় ঢুকে সিমরানের দেখা পেল না সৌধ৷ উপর তলা থেকে শুনতে পেল দুটো মেয়ের খিলখিল করে হাসির শব্দ। যা পুরো বিল্ডিংয়ে ঝংকার তুলার পাশাপাশি সৌধর বুকেও তুলল। গতরাতে কাঁদতে কাঁদতে যার বেহাল দশা হয়েছিল আজ সে তাহানীর সঙ্গে খিলখিল করে হাসছে। অদ্ভুত ভালোলাগায় শিহরণ হলো সৌধ। উদ্ভাসিত চিত্তে পা বাড়াল দোতলার দিকে৷ এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে থেমে যায় সে। সুহাসের কল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সুহাস হড়বড় করে বলতে থাকে,

‘ দোস্ত আমি নামীকে স্বপ্নে দেখেছি!…’

এক নিঃশ্বাসে বিস্তারিত বলে থামে সুহাস৷ হাঁপাচ্ছে সে৷ প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে ত্বরিত সামলে নেয় সৌধ। বুঝতে পারে নামী আর আগত বাচ্চাকে নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ফল এই দুঃস্বপ্ন। তাই শান্ত গলায় বলে,

‘ অতিরিক্ত চিন্তা করতে নিষেধ করেছিলাম তোকে। ‘

‘ সৌধ নামী ভালো নেই। ওর নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে! ‘

‘ নামী ভালো নেই এটা জানা কথা৷ কিন্তু বিপদ ঘটেছে কিনা এটা অজানা৷ মনগড়া ভাবনা থেকে বের হো। অতিরিক্ত চিন্তা করেছিস বলে দুঃস্বপ্ন দেখেছিস ব্যস আর কিছুই না। ‘

‘ না সৌধ। আমাকে তুই বিশ্বাস কর। ‘

অসহায় স্বর সুহাসের। সৌধ চোখ বুঁজে ভাবল কিছু। এরপর বলল,

‘ তোকে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তোর এই অনুভূতিকে না। জাস্ট একটা দুঃস্বপ্ন এটা। কই এতদিন তো এমন কোনো স্বপ্ন দেখিসনি৷ তাহলে আজ কেন? কারণ তুই এখন ডেস্পারেট হয়ে দুঃশ্চিন্তা করছিস। ‘

উদ্বিগ্নতা কমে এলো সুহাসের। হতাশ কণ্ঠে বলল,

‘ বাবা এখনো আখতার আংকেলের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি সৌধ। ‘

‘ সো হোয়াট? চিন্তার কিছু নেই৷ অ্যামরিকায় আখতার আংকেল কোথায় থাকে এটা তো জানে সোহান আংকেল। ব্যস এতেই হবে৷ কোনোভাবে যোগাযোগ করতে না পারলে তুই চলে যাবি ওখানে৷ ‘

নিশ্চুপ সুহাস৷ সৌধ স্মিত হেসে বলল,

‘ রাতে ফোন করব। এখন রাখছি। ‘

ফোন কেটে ভেতরে ঢুকল সৌধ। আকস্মিক সিমরানের মুখোমুখিও হলো। সৌধ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘ দেখা শেষ? ‘

‘ না সবেই তো এলাম৷ এই দেখো দেবদাস। তুমি কি এটার কথাই বলেছিলে? ‘

সৌধ দেখল সিমরানের হাতে একটি চমৎকার প্রচ্ছদের দেবদাস বইটা৷ যেখানে দেবদাস, পার্বতীর বিচ্ছেদ চিহ্নও দৃশ্যমান। অমায়িক ভঙ্গিতে হাসল সৌধ৷ একহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে আরেক হাতে ডান ভ্রু চুলকাতে চুলকাতে এগিয়ে গেল ভেতরে৷ সিমরান একটু সরে গেল৷ এরপর সৌধর পিছু পিছু হাঁটতে লাগল৷ তাহানী এসে বলল,

‘ ছোটো ভাইয়া সিনুপাই এই বইঘরটা খুব লাইক করেছে। ‘

তাহানীর মাথায় হাত বুলিয়ে শেল্ফের সামনে দাঁড়াল সৌধ। দেখে দেখে সমরেশ মজুমদার আর শরৎচন্দ্রের কয়েকটি কালজয়ী উপন্যাস বের করে সিমরানের হাতে দিয়ে তাহানীকে বলল,

‘ কিউটি, একটু ওপাশে ঘুরে আসো তো। তোমার ভাবিপার সঙ্গে কিছু প্রাইভেট কথা বলব। ‘

ছয় বছর বয়সী তাহানী কী বুঝল কে জানে? মুখে হাত দিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেল। সিমরান তো তাজ্জব বনে গেল এ দৃশ্য দেখে। সৌধ মুচকি হেসে বলল,

‘ ভেরি ভেরি স্মার্ট। কার কন্যা দেখতে হবে না? ‘

সিমরান নাজুক হয়ে মনে মনে বলল,

‘ কার সিস্টার তাও তো দেখতে হবে। ‘

সৌধ হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে হাতে থাকা বইগুলো সিমরানের হাতে তুলে দিয়ে অকপটে বলল,

‘ সন্ধ্যার পর নিধির সঙ্গে মিট করতে যাচ্ছি। আমার প্রয়োজনে নয়। সুহাসের প্রয়োজনে। ‘

সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় মুখশ্রীতে আচমকা এক টুকরো আঁধার নামল বোধহয়। বুকের ভেতরটায় তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রণা অনুভব করল সিমরান। সৌধ ভাইয়ের কাছে তার এই অনুভূতি ধরা পড়ার ভয়ে জোর পূর্বক ঠোঁটে হাসি টেনে মিহি স্বরে বলল,

‘ ঠিক আছে৷ ‘

একপেশে হাসল সৌধ। হাতে থাকা বইগুলোর দিকে একধ্যানে তাকিয়ে বলল,

‘ পরিণীতা বইটা আমি পড়িনি বুঝলি৷ যতক্ষন বাইরে থাকব এ সময়ে এই বইটা শেষ করা যাবে৷ তুই পড়ে আমাকে কাহিনীটা বলিস তো। বুঝিসই তো কাজের চাপে আমার এখন এসব বই পড়ার সময় হয় না৷ তুই পড়ে গল্প শোনালে সময় কম লাগবে।
আমারো জানা হবে প্রিয় লেখকের আরেকটি বই সম্পর্কে। ‘

যে মিথ্যায় সুখ পাওয়া যায়, শান্তি আসে, দুঃখ দূর হয়ে কষ্ট মলিন হয় সেই মিথ্যাকে সম্মান করে সৌধ। শরৎচন্দ্রের প্রতিটা উপন্যাসই তার ঠোঁটের আগায়৷ পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছে বলায় যায়। পরিণীতা পড়েছিল, সেই ক্লাস নাইনে পড়াকালীন। তবু মিথ্যা বলল। কারণ আজ সন্ধ্যার পর সে বেরিয়ে গেলে সিমরান খুব অশান্তি নিয়ে কাটাবে৷ তাকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে৷ সংগোপনে নিধির প্রতি ইর্ষাও জন্মাতে পারে। তাই বুদ্ধি করে বই পড়ার কাজ দিল। এতে করে সন্ধ্যার পর সিমরান ব্যস্ততায় কাটাবে। তার অবর্তমানে বই বন্ধুর সঙ্গ পাবে৷ যদি কর্মহীন বসে থাকে তাহলে আলস্যতা চেপে ধরবে৷ আর অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। শুধু আজ নয় তার অবর্তমানে সিমরান যেন কোনো মুহুর্তেই নিঃসঙ্গতায় না ভুগে সে জন্য অনেক নির্দেশনাও দিল। সবটাই ছিল কোনো না কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা৷ ভার্সিটিতে যাওয়া, পড়াশোনা করা। বাড়িতে আম্মার সাথে রান্না শেখা, গল্প করা। তাহানীর সঙ্গে সময় কাটানো, বই পড়া। আরো কত কী বলল সৌধ। সবটা মন দিয়ে শুনে হঠাৎ সিমরান বলল,

‘ চট্টগ্রাম গিয়ে তুমি কি একটুও ফ্রি থাকবে না? একটা ফোনকল বা ম্যাসেজ করার? ‘

সহসা স্তব্ধ হয়ে যায় সৌধ। নিষ্পলক চেয়ে রয় সিমরানের সুশ্রী, ম্লান মুখটায়। এরপর হেসে ফেলে কিঞ্চিৎ। মুগ্ধ করা এক বাঁকা হাসি। পুরুষ মানুষের বাঁকা হাসি এমন মারাত্মক সুন্দর হয়? নাকি শুধু সৌধর বাঁকা হাসিটাই হৃদয় কাড়া সুন্দর? উত্তরের অপেক্ষায় সিমরান। সৌধ স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে শীতল কণ্ঠে উত্তর দিল,

‘ আরে বোকা, আমিত কল করবই। বিয়ে করেছি না? বাড়িতে বউ রেখে যাব আর তার খোঁজ, খবর নিব না? আমাকে ইররেস্পন্সিবল মনে হয় তোর? ‘

শেষ শব্দটায় একটু শাসনি সুর ছিল। যা টের পেয়ে আকস্মিক মাথা নেড়ে সিমরান জবাব দেয়,

‘ উহুম একটুও না৷ শুধু লাভলেস মনে হয়৷ অপ্রেমিক।’

ঘোরের মুখে কথাটা বলেই জিভ কাটে সিমরান। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে সরে পড়ে সৌধর সম্মুখ থেকে। সৌধ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রয় ঠাঁই। অস্ফুটে বিরবিরায় ‘ আমি অপ্রেমিক! ‘
.
.
শহরের ছোট্ট একটি কফিশপ। সৌধর পরিচিত এক বড়ো ভাই এক বছর হলো এটি উদ্ভোদন করেছে৷ যা অল্প সময়েই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে৷ স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাই বেশি আসে৷ তাও আবার যুগল হয়ে। আজ এক ঘন্টার জন্য কফিশপ বন্ধ। কারণ সৌধ চৌধুরী একঘন্টার জন্য তার এক বান্ধবীকে নিয়ে বসবে এখানে৷ ব্যক্তিগত ভাবে এখানে কর্মরত প্রতিটি সদস্য সৌধকে চেনে৷ তাই বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক কিছু ভাবল না। বরং গুরুত্বপূর্ণ কাজে বলেই বিবেচনা করল এবং সচেতন থাকল যাতে তাদের কোনো আচরণে ভুল না পায় সৌধ। সন্ধ্যার পর আবছা আলো আবছা আঁধারে প্রকৃতি। সৌধ এলো বাইকে করে। সঙ্গে ওর কাজিন সাদি ছিল। যাকে কফিশপের বাইরে রেখে ভেতরে প্রবেশ করল সে। কফিশপে দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন এসে সালাম দিল তাকে। বসার জন্য জায়গা দেখিয়ে দিল। সৌধ মৃদু হেসে গিয়ে বসল। ফোন বের করে কল করল নিধিকে৷ নিধি জানালো সে কফিশপের সামনে। সৌধও জানিয়ে দিল, সে ভেতরে আছে।

পুরো কফিশপ ফাঁকা। অবাক হলো না নিধি। সৌধকে চেনে সে। তাই ধারণা ছিল এমন কিছুই হবে৷ স্পেশালিটি থাকবেই থাকবে। চারপাশে ভালো করে নজর বুলিয়ে সৌধকে দেখতেই চোখে, মুখে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল। যা এগিয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে গেল আচমকা। শুভ্র রাঙা টিশার্ট পরনে সৌধর। চোখে পিউর ব্লাক সানগ্লাস। সদ্য সিগারেট ধরিয়েছে! নিধি সামনে এসে দাঁড়াল। কোনো প্রকার উদ্দীপনা দেখা গেল না সৌধর মাঝে। সে নির্লিপ্ত ভাবে একবার তাকাল। ঈষৎ হেসে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ বোস। ‘

এরপর ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরল। ধোঁয়া ছাড়ল পিছন দিকে যেন নিধির দিকে না যায়৷ তবু সিগারেটের ঘ্রাণ নাকে এলো নিধির। খুব একটা কড়া না। তবু নাকমুখ কুঁচকে বসল সে। অস্বস্তি হলো ভীষণ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সৌধ সিগারেট খাচ্ছে। তবু তার সামনে৷ পরোক্ষণেই স্মরণ হলো, আইয়াজ তাকে জানিয়েছিল সেদিনের পর সৌধ শুধু সিগারেট না নানারকম নেশাদ্রব্য পান করেছে। বারে পর্যন্ত গেছে! এসব আবার ত্যাগও করেছে শুনেছিল। তবে কী আইয়াজ ভুল জানে? কখনো সিগারেট না ছোঁয়া ছেলেটা এই তো দিব্যি সিগারেট খাচ্ছে। ঢোক গিলল নিধি৷ থমথমে গলায় প্রশ্ন করল,

‘ কেমন আছিস? ‘

‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘

নিঃসংকোচ উত্তর সৌধর। ওয়েটার এসে দু’টো কোল্ড কফি দিয়ে গেল৷ নিধির প্রিয় কোল্ড কফি। এজন্য সৌধ এটাই দিতে বলেছে। যা দেখে একটু শান্তি পেল নিধি৷ যাক তার পছন্দ মনে আছে। কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে সৌধর থেকে কোনো প্রশ্ন বা শব্দ না পেয়ে নিজেকে সুস্থির করল সে।এরপর পুনরায় প্রশ্ন করল,

‘ নিয়মিত সিগারেট খাস? ‘

‘ যখন ইচ্ছে হয় তখন খাই৷ ‘

ওড়না দিয়ে নাক ঢাকল নিধি৷ কিঞ্চিৎ রাগ হয়ে বলল,

‘ সিনুর সামনে বসেও খাস? ও কিছু বলে না? ওর বাপ, ভাই কেউ তো সিগারেটখোর না৷ মানিয়ে নিতে পারে? ‘

‘ হার্মফুল জিনিস ওর সামনে খাব কেন? এটা যে খায় এবং যে ঘ্রাণ পায় দু’জনের পক্ষেই ক্ষতিকর। ‘

ভ্রু বাঁকিয়ে ফেলে নিধি৷ চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে বলে,

‘ বাহ ডক্টর সাহেব আপনি যাতে মাতাল তালে ঠিক। তা এই হার্মফুল জিনিসটা খেতে কে পায়ে ধরে তোর? ‘

‘ বললাম না আমার ইচ্ছে? ‘

‘ বিশ্রী ইচ্ছে। ‘

শব্দ দুটো বলে হঠাৎ চ্যাঁচিয়ে ওঠে,

‘ ওই তুই নিজের ক্ষতি করার পাশাপাশি আমারো ক্ষতি করছিস৷ সিনুর ক্ষতি হবে বলে ওর সামনে যেমন খাস না আমার ক্ষতি চিন্তা করেও এখন তোর এটা খাওয়া উচিত না৷ যা ফেলে আয়। ‘

হাসল সৌধ। এতক্ষণ নিধির দিকে না তাকালেও এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অদ্ভুত সুরে বলল,

‘ আমার বউ আর বান্ধুবী তো এক নয়। বন্ধুর জন্য এটুকু সেক্রিফাইস তুই করতেই পারিস৷ আর আমি তোর অল্প ক্ষতি করতেই পারি। শুনেছি বন্ধুর জন্য আরেক বন্ধু প্রাণও দিতে পারে৷ ‘

আকস্মিক সমস্ত উদ্দীপনা মিশে গেল নিধির। বউ আর বান্ধবী এক নয়। সৌধ সিনুর সামনে সিগারেট খায় না৷ কারণ এতে সিনুর ক্ষতি হবে। অথচ তার সামনে খাচ্ছে। অর্থাৎ তার ক্ষতি হলে সৌধর এখন আর যায় আসে না! মুখটা ছোটো হয়ে গেল নিধির৷ পুরোনো দিনের অনেক কথা, অনেক স্মৃতি এসে মন পুড়াতে লাগল। সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগল, সৌধ কি অনায়াসে আমার বউ শব্দটা বলল। একদিকে অবশ্য খুশিই হলো সৌধ নিজেকে সামলে সবটা মেনে নিতে পেরেছে বলে। কিন্তু ওই যে কিছু স্মৃতি, কিছু অভ্যেস ঠিক তীক্ষ্ণ ভাবে জ্বালাতে শুরু করল। একটা সিগারেট অর্ধেকটা শেষ করে ফেলে দিল সৌধ। নিধি কফি খাচ্ছে আর গভীর কিছু ভাবছে৷ সৌধ তাকাল ওর দিকে৷ খেয়াল করল আগের চেয়ে মুটিয়ে গেছে মেয়েটা। তক্ষুনি মনে পড়ল, নিধি এখন একটা ফুটফুটে বাচ্চার মা৷ সহসা মনে পড়েছে এমন করেই জিজ্ঞেস করল,

‘ রূপ কেমন আছে? ‘

থমথমে কণ্ঠেই উত্তর দিল নিধি,

‘ ভালো আছে। টুকটাক কথা বলতে শিখেছে। সারাক্ষণ বাবাকে ডেকে বেড়ায়৷ দু একবার অবশ্য আমাকেও ডাকে। ‘

আচমকা মুখ ফস্কে কথাটা বলেই সচেতন চোখে সৌধর দিকে তাকাল। সৌধ নির্লিপ্ত। তবু কেন যেন মনে হলো ওর ভিতরে নির্লিপ্ততা নেই। আছে অন্যকিছু। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ে নিধি। ভাবে সৌধ যদি তার বউ, তার বউ অবলীলায় বলতে পারে সে কেন তার বাচ্চার বাবার গল্প করতে পারবে না? তাই অর্পণ স্যারকে নিয়েও কিছু গল্প শুরু করল৷ সৌধ গোপনে হাসল তাচ্ছিল্য ভরে৷ ধরে ফেলল নিধির মনোভাব। অথচ নিধি ধরতে পারল না সৌধ ইচ্ছে করেই তার সামনে সিগারেট খাচ্ছে। যা বলছে যা করছে সবটার পেছনে কারণ একটাই তাদের দু’জনের জীবনের পথ সুন্দর, স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে যাওয়া শ্রেয়। যেসব তিক্ত ঘটনা ঘটে গেছে সেসব থেকে বেরিয়ে এসে অন্তত বন্ধুত্বটুকু বাঁচিয়ে রাখা৷ যদি তারা একে অপরের কাছে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুলো সহজ ভাবে তুলে ধরতে না পারে তবে উভয়ের মনেই অতীত নিয়ে পিছুটান থাকবে। সেই পিছুটান যেন না থাকে এজন্যই এই প্রয়াস৷ অন্তত আজ থেকে বিশ বছর পর হঠাৎ দেখা হলে হাসি মুখে দুটো বাক্য বিনিময় করতে চায় সৌধ। এটা যদি না পারে তাহলে তারা দ্বিতীয় মানুষটাকে নিয়ে সুখী হতে পারবে না। সৌধ এখন মনে প্রাণে চায় নিধি অর্পণকে নিয়ে সুখী হোক। সে নিধির সুখ চায় বলেই যে অর্পণ স্যারকে নিয়ে এত এত ভালো ভালো কথা হজম করতে পারবে তা না৷ তাই তো ক্রোধটুকু সুপ্ত রেখে বাঁধা প্রদান করে শুধাল,

‘ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলি তোর বর জানে? ‘

‘ না। বলেছি বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই। কোন বন্ধু জিজ্ঞেস করেনি। আমিও বলার প্রয়োজন বোধ করিনি। ‘

স্মিত হাসে সৌধ। বলে,

‘ আমার বউ সন্ধ্যার পর একা বেরুতে পারবে না৷ এটা আমার বাড়ি এবং আমার রুলস। ‘

নিধি দম্ভ দেখিয়ে বলল,

‘ আশ্চর্য। ব্যক্তি স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার মতো ছেলে তো তুই নোস। ‘

এ বিষয়ে আর কথা বাড়াল না সৌধ। নিধি একশটা যুক্তি দেবে৷ কথা বাড়বে। তাই শুধু বলল,

‘ আমি কিন্তু সিনুকে জানিয়েই দেখা করতে এসেছি। ‘

অবাক হলো নিধি। বিস্ময় ভরে বলল,

‘ সিরিয়াসলি? ‘

মাথা নাড়ে সৌধ। নিধি ভাবুক হয় একটু। সৌধ অফ টপিক বদলে এবার আসল টপিকে চলে আসে৷ সহসা প্রশ্ন করে,

‘ নামীর বিষয়টা কেন গোপন করলি?’

হকচকিয়ে যায় নিধি৷ নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে বলে,

‘ ও বোন হিসেবে আমার সহায়তা নিয়েছিল সৌধ। সুহাস আর ওর তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। সুহাস নামীর গায়ে হাত তুলেছে এটা শুনে আমারো রাগ হয়েছিল ভীষণ। বউ পেটানো পুরুষ আমার বন্ধু! জাস্ট মেনে নিতে পারছিলাম না৷ বাবা, মা হীন মেয়ে নামী। বড়ো বোন হিসেবে একটু আশ্রয় চেয়েছিল। দিয়েছি। ‘

‘ সুহাসকে ছেড়ে অ্যামরিকায় চলে গেল। তোর উচিত ছিল না সুহাসকে এ ব্যাপারে জানানো? ‘

‘ বিশ্বাস কর আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু নামী আমাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাও ধরেছিল৷ ভাব ওর মতো মেয়ে কতটা অসহায় হয়ে এই কাজ করেছে। ও অনেক বিধ্বস্ত ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর মানসিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এমন একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ও যে সুহাসের কাছে গেলে সেই ট্রমা থেকে ও আর বেরুতে পারবে না৷ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ছিল সুহাসের প্রতি৷ আর এরজন্য দায়ী সুহাস নিজেই৷ একজন শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের ছেলে, পেশায় ডাক্তার। সে কী করে বউয়ের গায়ে হাত তোলে৷ ‘

‘ তুই সুহাসকে চিনিস। ‘

‘ তাই বলে বউকে মারবে? সরি, বন্ধু বলে আমি এক্ষেত্রে ওকে সাপোর্ট করতে পারব না। ‘

‘ বলিনি সাপোর্ট করতে। নামী যে প্র্যাগনেন্ট জানিস? ‘

চমকে ওঠে নিধি। ঢোক গিলে বলে,

‘ দেশে থাকাকালীন জানতাম না৷ চলে যাবার পর একদিন যোগাযোগ হয় আর তখন জানায়৷ আগে জানলে যেতেই দিতাম না৷ কারণ আমি তো জানি এই জার্নিটা। আসলে আমি এটা জানার পরই বুঝতে পারি নামী কেন মানসিক অসুস্থতার মধ্যে যাচ্ছিল। প্র্যাগ্নেসির সময় মেয়েদের মুড সুইং হয়। কিন্তু নামীর ওই সময়টা শুরু ছিল। হিউম্যান সাইকোলজি বলে, মেয়েদের হৃদয় গর্ভাবস্থা চলাকালীন শিশুসুলভ হয়ে যায়৷ ওরা অল্প আদরে যেমন অনেক বেশি খুশি হয়, তেমনি অল্প আঘাতে ভয়ংকর ভাবে ভেঙে পড়ে৷ আমার এক বান্ধবী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। ওর
কাছে এক প্যাশেন্ট এসেছিল৷ এটা তার মুখের গল্প। ভদ্রমহিলা যখন গর্ভবতী ছিল তার হাজব্যন্ড খুবই সামান্য একটি বিষয় নিয়ে বকাঝকা করে৷ ফলশ্রুতিতে ডেলিভারি হওয়ার আগ পর্যন্ত চক্ষুশূল হয়ে ছিল বর৷ অথচ বিয়ের পর থেকে শাশুড়ীর সঙ্গে উনার বনিবনা ছিল না৷ গর্ভবতী হওয়ার পর সে শাশুড়ি একদিন খিচুড়ি রেঁধে খাইয়েছিল বলে খুশিতে সেদিন শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছে। এরপর শাশুড়ি যতই রেগে কথা বলুক সে হাসিমুখেই সেগুলো এড়িয়ে চলে৷ ‘

একটু থামল নিধি। এরপর সৌধর দিকে সিরিয়াস হয়ে তাকিয়ে বলল,

‘ আসলে কী বলত আমাদের এই জার্নি কোনো ছেলের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। মানসিক, শারীরিক সবদিক দিয়ে আমরা দুর্বল হয়ে পড়ি৷ একদম বাচ্চাদের মতো। আমার ছেলের সামনে মোম জালিয়ে ধরিস৷ ও একবার হাত দিয়ে ছ্যাঁকা খেলে আর দ্বিতীয়বার সেটা ধরবে না। প্র্যাগ্নেসির সময় আমাদের মাইন্ডটা ঠিক ওরকমই থাকে। সুহাস স্টুপিডটা এত্ত কেয়ারলেস কী আর বলব। ‘
.
.
সৌধ, নিধির কথোপকথন শেষ৷ নামীর সঙ্গে প্রথম দিকে যোগাযোগ থাকলেও এখন আর যোগাযোগ নেই নিধির৷ টেক্সট করে না পেয়ে মেইল করে রেখেছে নিধি৷ সব শুনে সৌধ বলল,
‘ যখনি ওর সঙ্গে যোগাযোগ হবে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবি৷ ‘

নামীর মেইল ঠিকানা নিয়ে রাখল সৌধ। নিধিও সুহাসের বর্তমান অবস্থা জেনে দুঃখ প্রকাশ করল। সৌধকে অনুরোধ করল, সুহাস যেন না জানে নামী চলে যাবার সময় তার কাছে ছিল। সে সাপোর্ট করেছে নামীকে। সৌধ এমনিতেও সুহাসকে কিছু বলবে না। বড়োজোর এটা বলতে পারে নামী ওদেশ থেকে নিধির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল একদিন৷ এর বেশি কিছু নয়৷ কারণ সে চায় না নিধির সাথে কারো সম্পর্ক খারাপ হোক৷ কথা শেষে ওরা যখন ওঠবে তখন হঠাৎ নিধি প্রশ্ন করল,

‘ নতুন জীবন কেমন লাগছে বললি না তো? ‘

অমায়িক ভঙ্গিতে হাসল সৌধ। গর্ব করে বলল,

‘ দারুণ। ‘

‘ সিনু অনেক ভালো মেয়ে অনেক ভালো রাখবে তোকে। ‘

‘ আই নো। ‘

ওঠে দাঁড়াল নিধি৷ সাথে সাথে সৌধও ওঠল। কফিশপ থেকে বেরিয়ে রিকশা ডেকে তুলে দিল নিধিকে। রিকশায় বসে হঠাৎ নিধি মাথা এগুলো। সৌধ বলল,

‘ কী হলো কিছু রেখে গেছিস? ‘

আকস্মিক নেমে দাঁড়ায় নিধি। চারপাশে রাতের আঁধারে সজ্জিত। গাড়ির হর্ণ, রিকশার টুংটাং, মানুষের কোলাহল কর্ণে বাজছে। একটা রিকশা অপেক্ষা করছে নিধির জন্য৷ অথচ নিধি তার প্রিয় বন্ধু সৌধর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষীণ গলায় বলে,

‘ ভালোবাসা বিষয়টায় আমি অনেক আনাড়িরে সৌধ। এক বাচ্চার মা হয়েও ঠিকঠাক বুঝে ওঠতে পারছি না এই অনুভূতিটাকে৷ একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি? ‘

স্তম্ভিত মুখে সৌধ বলল,

‘ হু, প্রশ্নটা? ‘

‘ দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসা যায়? ‘

কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেও সহসা দ্বিধাহীন, তীব্র বিশ্বাস নিয়ে, স্পষ্ট ভাষায় সৌধ উত্তর দিল,

‘ কেন নয়? তুই যদি আমার হৃদয় কোণে ভালোবাসার আবছা অক্ষর হোস, সিনু আমার হৃদয় কোণে ভালোবাসার শেষ স্বাক্ষর। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭০|
একটি একটি করে দিন গড়াচ্ছে। পূর্বের চেয়েও অধিক অস্থির হয়ে ওঠছে সুহাস। প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে নামীর সাথে কাটানো এক একটা মুহুর্ত। রাত গভীর হলে যখনি দু’চোখের পাতা এক হয় দুঃস্বপ্নেরা ছিন্নভিন্ন করে দেয় হৃদয়। নির্ঘুম বা দুঃস্বপ্ন দু’টোর একটিকে নিয়েই প্রতিটি রাত পার করছে সে। যেন এক রাতজাগা পাখি৷ যার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস ঘুটঘুটে আঁধার মাখা বদ্ধ ঘরে গুমোট বেঁধে থাকে। এক টুকরো আলোর আশায় উতলা রয় সর্বক্ষণ। যেই আলোর নাম নামী। তার হৃদয় কোণে শিহরণ জাগানো সে এক সুহাসিনী।

সোহান খন্দকার কোনোভাবেই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে বাবা, ছেলেকে হতাশা জেঁকে ধরেছে। কিন্তু সেই হতাশা তাদের দিক বিভ্রান্ত করতে পারেনি৷ নিয়ম মেনে সুহাস ফিরে গেছে তার কর্মস্থলে। সোহান খন্দকার আগামী মাসে হজে চলে যাবে। ইতিমধ্যে সুহাস ভিসার জন্য আবেদন করতে চেয়েছিল। বাঁধা দিয়েছে আইয়াজ। কারণ সে আর ফারাহও সুহাসের সঙ্গে অ্যামেরিকা যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছে। আইয়াজের পাসপোর্ট করা ছিলই। ফারাহর পাসপোর্ট তৈরি হলেই ওরা তিনজন ভিসার আবেদন করবে৷ আইয়াজের এহেন সিদ্ধান্তের পেছনে অবশ্য বন্ধুত্বের চমৎকার একটি যত্ন লুকিয়ে আছে৷ সৌধ একা সুহাসকে অ্যামেরিকায় পাঠাতে রাজি না৷ আবার সে নিজেও সঙ্গ দিতে পারবে না৷ কারণ, হসপিটালে জয়েন করার পর অনেকদিন ছুটি কাটিয়ে ফেলেছে সে৷ সদ্য বিয়ে করেও ছুটি কাটাল। তাই নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে আইয়াজকে সঙ্গ দিতে বলেছে। সৌধর সঙ্গে পরামর্শ করে আইয়াজ, ফারাহ অ্যামেরিকার এই সফরটাকে হানিমুন সফর হিসেবেই বিবেচনা করে নিল। নিশ্চিন্ত হলো সুহাসও৷ কারণ নামী তাকে দেখে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে জানে না সে৷ তাই আইয়াজ, ফারাহ সঙ্গে থাকলে জোর পাবে। নামীর অতিপ্রিয় বান্ধবী ফারাহ। তাই বান্ধবী আর তার বরকে নিশ্চয়ই বাবার বাসা থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারবে না? নিজের কৃতকর্মের জন্য ঘাড় ধাক্কা খাওয়ার কিঞ্চিৎ ভয় পেলই সে।
.
.
আগামী সপ্তাহে সৌদির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবে সোহান খন্দকার। বিয়ের পর সৌধ সেই যে চট্টগ্রাম গেছে একবারও বাড়িতে আসেনি। এরজন্য অবশ্য শ্রদ্ধেয় আম্মা আর স্নেহময়ী স্ত্রীকে কৈফিয়ত দিতে কৃপণতা করেনি৷ শশুর আগামী সপ্তাহে চলে যাবে এ জন্য বেশ কিছুদিন ছুটি কাটাবে সে। মেয়ের জামাই হিসেবে আলাদা কিছু দায়দায়িত্ব আছে না? তাই এর আগে অল্প ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। তবে দূরত্ব তার বৈবাহিক জীবন বা স্ত্রীর মনে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেনি। বরং দূরত্বটুকুই
ওদের সম্পর্কে দারুণ এক মিষ্টতা এনে দিয়েছে। শত ব্যস্ততায়ও নিয়ম মেনে দিনের বেলা বারকয়েক ফোন করেছে সৌধ৷ অপ্রয়োজনীয় কথা বলেনি। খবরাখবর নিয়ে রেখে দিয়েছে। কখনো কখনো প্রয়োজনটাও প্রিয় হয়ে ওঠে ভীষণ। যার উদাহরণ সৌধর থেকে পেল সিমরান। এছাড়া রাতটা ছিল অন্যরকম অনুভূতিপ্রবণ। ন’টার পর থেকে দু’জনের ফোনালাপ শুরু হতো৷ কখনো অতি ব্যস্ততায় ন’টার জায়গায় বারোটা বাজিয়ে কল করত সৌধ৷ অনেক সময় ভিডিয়ো কলে থেকে টুকিটাকি কাজ করত দু’জনই। রাতের খাবারটা প্রায় সময়ই একসাথে খেত। ফোনের স্ক্রিনে মুখোমুখি হয়ে। যেদিন দেরিতে কল করত সেদিন দেরিতেই ফোন ছাড়া হতো। ভিডিয়ো কলে কথা অবশ্য কম বলত ওরা৷ কারণ অডিয়ো কলে সিমরান অনেক বেশি সহজ আর প্রাণ চঞ্চল হয়ে কথা বলতে পারে৷

সারাদিন সে কী করেছে, কোথায় গিয়েছে, আজ কী রান্না শিখল, আব্বা, আম্মা তার রান্না খেয়ে কী প্রশংসা করল, ভার্সিটিতে আজ কোন টপিকে ক্লাস হয়েছে, কাল কোন টপিক পড়াবে, ফাইনাল এক্সাম কবে ইত্যাদি যত কথা সব অনায়াসে উগ্রে দিত মেয়েটা। প্রেমের প্রথম ধাপে নারী, পুরুষের মাঝে যেই উত্তেজনা, আবেগ, ভালোলাগার শিহরণ তৈরি হয় তার সবটুকুরই আভাস পাওয়া যায় এই দম্পতির মাঝে৷ সিমরানের যত গল্প সব মন দিয়ে শুনত সৌধ।

ভিডিয়ো কলে দেখাদেখি ছাড়া ওরা দু’জন কিছুই বলতে পারে না। সিমরান এত বেশি লজ্জা পায় যে সৌধ কী বলবে ভেবে পায় না। পাছে অতি লজ্জায় কল কেটে দেয় যদি? দু একবার এমন হওয়াতে সে ভুল আর করেনি৷ মিষ্টি একটা বন্ধুত্ব আর টক, ঝাল অনুভূতিতে দু’জন সিক্ত হয়েছে সর্বদা৷ একে অপরের সঙ্গে সামনাসামনি তেমন সখ্যতা গড়ে তুলতে না পারলেও ফোনকলে ঠিকই গড়ে তুলল। আলাদা একটা অনুভূতি, অভ্যেসে দু’জন ডুবে রইল দু’জনাতে। প্রথম দিকে সৌধ কম কথা বললেও সিমরানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক সময় সেও তার প্রত্যাহিক জীবনের টুকিটাকি কথা জানাতে শুরু করে৷ সেদিন এক ঘটনাও শেয়ার করছিল। বলেছিল,

” আজ হসপিটালে এক প্যাশেন্ট এসেছিল। জানিস, উনার কী নিয়ে হার্টে সমস্যা হয়েছে? তার আদুরে কন্যা এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। একজন উকিলের মেয়ের জামাই ট্রাক ড্রাইভার। ইগোতে আঘাত পড়েছে ভীষণ। ব্যস এট্যাক করে বসেছে! ”

ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও খিলখিল করে হেসে ওঠে সিমরান৷ হাসিটা বোকা বোকা লাগে। চোখ, মুখ কুঁচকে ধমক দেয় সৌধ। কথার ছলে মুখ ফস্কে বলে ফেলে,

‘ হাসছিস কেন? হাসার জন্য বলিনি। বলেছি বর্তমানে সন্তানদের কী অধঃপতন হয়েছে। সেটা জেনে রাখার জন্য। বাচ্চা, কাচ্চাদের প্রতি কেয়ারলেস থাকা যাবে না বুঝেছিস? তারা কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেলামেশা করে সব খবর রাখতে হবে। ওই মেয়েটা যে ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে গেল, এটাত আর একদিনে হয়ে যায়নি। প্রেম করতে মিনিমাম কিছুদিন সময় লেগেছে। এরপর পালানো, বিয়ে। এতকিছু ঘটিয়ে ফেলল বাচ্চা একটা মেয়ে৷ পড়ে ক্লাস নাইনে। অথচ পরিবারের লোক টের পেল বিয়ে করে জামাই নিয়ে উপস্থিত হওয়ার পর? শোন সিনু, পড়াশোনা শেষ কর। আরেকটু বুদ্ধিশুদ্ধি বাড়া আই মিন ম্যাচিওর হয়ে নে৷ তারপর আমরা বেবি নিব। দু’জন মিলে পর্যাপ্ত কেয়ার করে সন্তান মানুষ করতে হবে। নাবালক, নাবালিকা অবস্থায় এক চুল অবহেলাও করা যাবে না ওদের। বর্তমান সমাজব্যবস্থার যেমন খুবই করুণ অবস্থা। উঠতি ছেলেমেয়েদের মানসিকতাও করুণ বিপর্যস্ত। ‘

সৌধ এ কথাগুলো খুবই সহজ, সাবলীল ভাবে বলে। সিমরান নিশ্চুপ থেকে মন দিয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎ থমকে যাক। চোখের পলক ফেলতে যেমন ভুলে যায় ঠিক তেমনি ভুলে যায় নিঃশ্বাস ছাড়তেও৷ কান দু’টোয় উষ্ণ ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে৷ শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণে টালমাটাল হয়ে রয়। সে জানত সৌধ ভাই একদিন মন থেকে পূর্ণরূপে তাকে ভালোবাসতে পারবে৷ সেটা এত তাড়াতাড়ি হয়ে যানে কল্পনা করতে পারেনি৷ সবচেয়ে বেশি ভালো লাগল, এটা ভেবে যে মানুষ অবচেতনে যা বলে তা একদম সত্যি বলে। পুরোপুরি মন থেকে বলে। ভেতর থেকে না এলে এভাবে কেউ বলতে পারে না৷ নিমেষে বুকে কম্পন সৃষ্টি হয় মেয়েটার। উথাল-পাতাল তরঙ্গে দুলতে থাকে ছোট্ট হৃদয়টুকু। দীর্ঘসময় নীরব থাকলে
চমকে ওঠে সৌধ৷ হুঁশ ফেরে আচমকা। টের পায় সে কী বলেছে? যেখানে আর পাঁচটা স্বামী, স্ত্রীর মতো সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি সেখানে সে ডিরেক্ট বাচ্চা, কাচ্চা নিয়ে কল্পনা করে ফেলেছে। তার বউ কি ধাক্কাটা নিতে পেরেছে? নিশ্চয়ই পেরেছে কিন্তু সামলে ওঠবে কখন? আকস্মিক কেশে ওঠে সৌধ। বিব্রত বোধটুকু আড়াল করে মেকি হেসে বলে,

‘ কী ব্যাপার এমন চুপসে গেলি কেন? এভাবে চুপসে গেলে তো চলবে না। সেদিন কী বলেছিলি মনে আছে? আমাকে তোর লাভলেস মনে হয়। আমি নাকি অপ্রেমিক! কত বড়ো স্পর্ধা নিয়ে এ কথা বলেছিস। ভাবতেই তো আমার দম বেড়িয়ে আসতে চায়! ‘

নড়েচড়ে ওঠে সিমরান৷ লজ্জায় মিলেমিশে একাকার হয়ে চাপা স্বরে প্রশ্ন করে বসে,

‘ বাচ্চা, কাচ্চার পরিকল্পনা করলেই বুঝি কেউ প্রেমিক মহাশয় হয়ে যায়? ‘

চোখ কপালে ওঠে যায় সৌধর। ধীরে ধীরে সিমরান স্বাভাবিক হয়ে ওঠছে তার সাথে। লজ্জা পেলেও মুখের ওপর প্রশ্ন করতে শঙ্কিত হচ্ছে না৷ ভালো লাগল বিষয়টা। মুচকি হেসে অনেক কিছুই বলতে উদ্যত হয়েও আবার থেমে গেল। মনে মনে নিজেকেই উত্তর করল,

‘ আমি তোকে মিথ্যা অনুভূতির জালে ফাঁসাতে চাই না ডিয়ার৷ বাচ্চা, কাচ্চার পরিকল্পনা করলেই প্রেমিক হওয়া যায় না৷ স্ত্রীর শরীরে উন্মত্ত হতে পারা পুরুষকেও প্রেমিক বলা অন্যায়৷ আমি তোকে একজন খাঁটি প্রেমিক রূপে ধরা দিতে চাই। ভালোবাসতে চাই নিজের সবটুকু দিয়ে৷ আমি জানি, ভালোবাসার পরিমাপে তোর ওজন অনেক বেশি। আমি তোর চেয়ে বেশি হতে না পারলেও সমকক্ষ রূপে ধরা দিতে চাই। আই ফিল ইউ এণ্ড আই মিস ইউ, দ্যান আই ওয়ান্ট টু লাভ ইউ ইনশাআল্লাহ। ‘

প্রণয়ের সূচনাতেই প্রিয়তমার সর্বস্ব লুট করে নিতে নেই৷ সবচেয়ে বড়ো লুটপাট তো করেই ফেলেছে। অর্ধাঙ্গিনীর হৃদয়টুকুর মালিকানা পেয়ে গেছে। বাকিটা না হয় রয়েসয়েই হোক। হঠাৎ একদিন খুব যত্ন নিয়ে নিজের হৃদয়টাও তুলে দেবে সে। বুঝিয়ে দেবে সৌধ চৌধুরী শুধু তার হৃদয় চুরিই করেনি নিজের হৃদয় স্বেচ্ছায় বিলিয়েও দিয়েছে। তবে কে মহান হলো? যে চুরি করে সে নাকি যে স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দেয় সে? এই প্রশ্ন সিনুকে একদিন করবেই সে। সেই মুহুর্তটুকু তাদের গভীর মিলনবেলায়ও আসতে পারে! তবে মুহুর্তটা এমন হতে হবে যেন মানুষটা শুধু তাকে অনুভবই করতে পারে৷ মুখ ফুটে উচ্চারণ না করতে পারে একটি শব্দও। প্রিয় খাবার যেমন গিলে খেলে তৃপ্তি আসে না। ঠিক তেমনি প্রিয়জনকে আচমকা বশ করে নেয়া বা আচমকা তার বশ মানাতে অনুভূতির গাঢ়ত্ব বা দৃঢ়ত্ব বজায় থাকে না৷ ভালোবাসতে হয় রয়েসয়ে খুব যতনে সংগোপনে।
.
.
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৬৭+৬৮

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৭|
দীর্ঘদিন পর সৌধর কল পায় নিধি৷ যে ছেলেটা এক সময় তার সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলত৷ আজ সে যেন প্রাণ বেঁধে উচ্চারণ করল এক একটা শব্দ। একদিন যার কণ্ঠস্বরের প্রগাঢ় নমনীয়তার স্পর্শ সে পেয়েছে। আজ তার প্রকট রুক্ষতা পেয়ে মনটা কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল। স্পষ্টভাষী সৌধ কণ্ঠে কাঠিন্য ধরে বলল,

‘ হ্যালো নিধি? ‘

ওপাশ থেকে তীব্র উত্তেজিত স্বর নিধির,

‘ হ্যাঁ সৌধ! ‘

ব্যস নিধিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে সৌধ বলল,

‘ আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে চাই। চাই মানে চাই’ই। কখন দেখা করতে পারবি? আজ সন্ধ্যা বা আগামীকাল সকাল দশটা। কুইকলি জানিয়ে দিবি। রাখছি। ‘

যে ছেলে এত গুলো দিন তাকে ফোন করেনি। সে হঠাৎ আজ কী মনে করে ফোন করল? অগণিত চিন্তা এসে ভর করে নিধির মাথায়৷ মন হয়ে ওঠে চঞ্চল। সাধারণ বা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নিয়ে সৌধ তাকে এভাবে ডাকবে না৷ নিশ্চয়ই বড়ো ধরনের কোনে সমস্যা হয়েছে। তবে কি সৌধ কোনোভাবে নামীর ব্যাপারে জেনে গেছে? আকস্মিক চমকে ওঠে নিধি৷ সে ভুলে গিয়েছিল, সৌধর প্রখর দৃষ্টিসীমা, শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষমতা আর প্রকট বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে। মনে মনে ঢোক গিলল নিধি। এমনিতেই তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে। বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে তৈরি হয়েছে দেয়াল।
যে দেয়াল ভাঙা সম্ভব। কিন্তু সৌধ, সুহাস বা আইয়াজ যদি কোনোভাবে নামীর ব্যাপার নিয়ে তাকে ভুল বুঝে তাহলে সে দেয়াল আর কোনোদিন ভাঙবে না৷ সচেতন হয় নিধি৷ সেদিন সে নামীকে স্রেফ বড়ো বোন, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সাহায্য করেছিল। একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল৷ সেই মুহূর্তে নামী যেমন নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি৷ ঠিক তেমনি সে নিজেও সুহাসের প্রতি বন্ধুত্বের আবেগকে প্রশ্রয় দিতে পারেনি৷ তার এই অনুভূতি সুহাস না বুঝলেও সৌধ, আইয়াজ ঠিক বুঝবে৷ কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সে ওই ঘটনা চেপে গেছে সব বলবে। তবু যেন ওরা কেউ বিশেষত সৌধ তাকে ভুল না বুঝে। যে কঠিন বোঝা নিয়ে, আত্মগ্লানি নিয়ে সে বেঁচে আছে। তার ভারই সহ্য হয় না৷ এর ওপর আরো একটি বোঝা যদি সৌধ এবং বাকি বন্ধুদের থেকে আসে সে সত্যি ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি৷ যদি সম্ভব হয় আগামীকাল সন্ধার পর দেখা করতে বলেছে সৌধ। আর নয়তো পরশু সকাল দশটায়। কী কারণে দেখা করবে সৌধ? সে যা ভাবছে এটা ছাড়া আর কোনো কারণ থাকার কথা নয়৷ মনে মনে তীব্র সংশয় হয়। ত্বরিত টেক্সট করে সৌধকে জানিয়ে দেয়, সে আগামীকাল সন্ধ্যার পরই দেখা করবে। পরশুও করা যেত৷ কিন্তু গোটা এক রাত এক দিন তীব্র দুঃশ্চিন্তা নিয়ে কাটানোই অসম্ভব হয়ে ওঠবে৷ সেখানে বাকি আরেকটা রাত বাড়াতে চাইল না। তাই এক্ষুনি টেক্সট করে দিল, সে আগামীকাল সন্ধ্যার পরই দেখা করবে। সঙ্গে সঙ্গে সৌধও ফিরতি বার্তা পাঠিয়ে, ঠিকানা বলে দিল।
.
.
ড্রয়িং রুমে বসে আছে সোহান খন্দকার। পাশে সুহাস আর সিমরান৷ সম্মুখে সুহাসের নানুমনি আর মামা, মামিরা। সকলেই স্তম্ভিত সুহাসের বক্তব্য শুনে৷ সোহান খন্দকার কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। নামী গর্ভবতী অবস্থায় তাদের বাড়ি ছেড়েছে? সে দাদু হতে চলেছে! তাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসবে! তার বংশধর! শরীরে মৃদু কম্পন অনুভব করল মানুষটা। নামীর ওপর রাগ, অভিমান দৃঢ় হলো৷ পাশে বসে থাকা ছেলের ওপর ক্ষুব্ধ হলো ভীষণ। ইচ্ছে করল, আচ্ছামত ধোলাই দিতে। পারল না শুধু এটা ভেবেই যে তার ছেলেটাও বাবা হতে চলেছে। তার ছোট্ট সুহাস। ডানপিটে স্বভাবের ছেলেটা কিনা ক’দিন পর বাবা হবে? চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে ওঠল৷ আকস্মিক মনে পড়ে গেল উদয়িনীর মুখটা। উদয়িনী বেঁচে থাকলে আজ নিশ্চয়ই তাদের বাড়িটা উৎসবমুখর হয়ে ওঠত?

কিছুদিন আগে নামীর বাবা আখতারুজ্জামান সোহান খন্দকারকে মেইল করেছিল৷ যেখানে লেখা ছিল, সুহাস কী করবে সে জানে না৷ কিন্তু নামী বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে পারে। সুহাস যদি একমত না হয় তবে এই সম্পর্কটা ভাঙতে দেয়া যাবে না৷ প্রয়োজনে সে বাংলাদেশে আসবে, ঘরোয়া ভাবে বসবে দুই পরিবার মিলে। সমস্যা যখন আছে সমাধানও পাওয়া যাবে। এরূপ কথাবার্তার শেষে আরো একটি বিশেষ লেখা ছিল এমন ” সোহান, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফ্রি হয়ে নে৷ এরপর তোর সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। সন্তানরা ভুল করবে৷ যা বাবা মাকে সংশোধন করে দিতে হবে৷ আমি মনে করি আবেগের বশে নামীও একটি ভুল করেছে। যা বাবা হিসেবে আমি সংশোধন করে দিতে চাই৷ এত সমস্যা, জটিলতার ভীড়ে তোর জন্য একটি শুভ সংবাদও রয়েছে। এটা জানার পর হয়তো আমার মেয়ের ওপর রাগ হবে৷ অভিমান বাড়বে। আমি এও জানি দিনশেষে এ খবর পেয়ে তুই’ই বেশি খুশি হবি৷ ”

আখতারুজ্জামানের সেই মেইলের কথা স্মরণ হতেই মনটা পুলকিত হলো সোহানের। পকেট হাতড়ে দেখল, সেলফোনটা নেই। তাই ত্বরিত উপরে চলে গেল বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সুহাসকে বলে গেল,

‘ টেনশন করিস না৷ আমি তোর শশুরের সঙ্গে যোগাযোগ করছি৷ ‘

সোহান খন্দকার উপরে ওঠে গেলে মুখ খুলল নানুমনি। হতাশার সুরে বলল,

‘ এ কেমন মেয়ে কপালে জুটল তোর? এখন তো মনে হচ্ছে উদিই ঠিক বলছিল। এই মেয়ের খুব তেজ। কেমন পাষাণ হলে এমন একটা কাণ্ড করা যায় ছিঃ ছিঃ। ‘

সিমরান মুখ ছোটো করে তাকিয়ে রইল। সদর দরজায় তখন সৌধর পা পড়েছে৷ সে স্পষ্টই শুনতে পেল নানুমনির কথা। যত এগুতে লাগল ততই যেন বেড়ে গেল নামীকে নিয়ে নানুমনি আর সুহাসের মামিদের সমালোচনা। সবাই মুখে একই কথা,

‘ এ কেমন মেয়ে সুহাসের বউ হলো? স্বামী, স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া, বিবাদ হবেই৷ তাই বলে পেটে বাচ্চা নিয়ে দেশান্তরি হতে হবে! আহারে বেচারা সুহাস। বিয়ে করে সংসার করতে পারল না৷ প্রথম বাচ্চা হবে তাও কিনা বউ বাচ্চা নিয়ে ফুড়ুৎ! ‘

অন্যের সমালোচনা পছন্দ নয় সৌধর৷ নামী সুহাসের বউ৷ তার ছোটো বোনের মতো৷ মেয়েটাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছে সে৷ দীর্ঘদিন। এই পৃথিবীতে কেউই ভুকের ঊর্ধ্বে নয়৷ আর নামী যা করেছে এমনি এমনি করেনি। তার বন্ধু কতখানি সাধু তাও জানে সে। তাই মেজাজ কিঞ্চিৎ খারাপ হলো। ধীর পদক্ষেপে এসে দাঁড়াল ড্রয়িংরুমে। দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সুহাসের স্তব্ধ মুখাবয়বে। সে মুহুর্তে সুহাসের বড়ো মামি অকস্মাৎ বলে ফেলল,

‘ আমার তো মনে হচ্ছে সুহাসের বউয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে। ভদ্র মেয়ে, চরিত্র ভালো মেয়েরা কোনোদিন এই সাহস করবে না। যতই বাপের টাকা থাকুক, নিজের টাকা থাকুক, চাকরিবাকরি করুক। তাই বলে পেটে প্রথম সন্তান আসছে সেটা কাউকে না জানিয়ে গোপনে চলে যাবে? আমি নিশ্চিত এই মেয়ের পরকীয়া আছে! ‘

উপস্থিত যারা নামীকে চেনে৷ অর্থাৎ, সুহাস, সিমরান, সৌধ প্রত্যেকেরই কর্ণদ্বয় উত্যক্ত হয়ে ওঠল। সৌধর চোয়াল দু’টো শক্ত হয়ে গেল আচমকা। নামী সুহাসের বউ। সুহাসের বউ সম্পর্কে এমন একটি কথা শুনতে তারই গায়ে কাঁ টা দিচ্ছে। সুহাস কী করে সহ্য করছে? তীব্র ক্রোধে ফুঁসে ওঠল সৌধ। সহসা কিছু বলতে উদ্যত হতেই শুনতে পেল, সুহাসের প্রতিবাদী, অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর,

‘ ব্যস! অনেক বলেছ তোমরা। নামীকে জড়িয়ে আর একটা অসম্মানজনক কথা আমি শুনতে চাই না। ‘

নাক, কান, মুখ লাল হয়ে ওঠেছে সুহাসের৷ কপালের নীল রগ ভাসমান। চোখ দু’টো কঠিন করে তাকিয়ে। মামিরা দমে গেল। ভাই রেগে গেছে বুঝতে পেরে সিমরান বলল,

‘ ভাবিপু অমন মেয়ে নয় মামি৷ সে একটু বেশি জেদি, তার ব্যক্তিত্ব অনেক বেশিই কঠিন৷ ভাইয়ার সাথে বনিবনা হয়নি তাই এই কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছে। আর কিছুই নয়। তোমরা প্লিজ এসব কথা বলে ভাইয়ার মন ভেঙে দিও না। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল সৌধকে দেখে। ত্বরিত ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ সৌধ ভাই, এসে বসো এখানে। ‘

নিজের জায়গাটা ছেড়ে দিল সিমরান। সৌধ ইশারায় বলল, সে বসবে না উপরে তার ঘরে যাবে। ইশারায় কথা বলে পুনরায় সুহাসের দিকে তাকাল। যেন সে চায় নামীকে সাপোর্ট দিয়ে আরো কিছু বলুক সুহাস। ঘরে বাইরে উভয় স্থানে নিজ স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করা প্রকৃত স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। যারা স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করতে পারে না তারা কাপুরুষ। সৌধর চোখে তাদের মন হীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। হোক সুহাস তার বন্ধু। চারদেয়ালে সে তার স্ত্রীকে যাই বলুক যাই করুক। চারদেয়ালের বাইরে লোক সম্মুখে স্ত্রীকে কতটুকু সম্মান দিতে পারে সে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। সৌধর অপেক্ষার অবসান অতি দ্রুতই ঘটল৷ সুহাসের অশান্ত হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো কিছু শান্ত বক্তব্য। সে তার নানুমনিকে বলল,

‘ নানুমনি, মা তোমাকে যখন নামীকে নিয়ে বলেছিল তখন নামীর সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না। মা আমাদের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। নামী সম্পর্কে সে অবগতও ছিল না৷ তাই হয়তো রাগ করে নেগেটিভ কিছু বলেছে। তার মানে সেগুলো ধরে পরবর্তীকালের কথা তুমি ভুলে যাবে। নামী সম্পূর্ণ আমার বিপরীত একটা মেয়ে। বিয়ের আগে আমার একাধিক সম্পর্ক থাকলেও নামীর ছিল না৷ বর্তমান জেনারেশনে থেকে যে মেয়ে বিয়ের আগেই কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়নি সে মেয়ে বিয়ের পর আমার সঙ্গে স্টিল ছয় বছর বিবাহিত জীবন পার করে, আমার সন্তান গর্ভে নিয়ে অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াবে এটা আমি না ভাবতে পারি আর না বিশ্বাস করি। তাই এসব উল্টাপাল্টা কথা বলাতে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। ওঠছি আমি। ‘

ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে অন্যের মুখে বদনাম সহ্য করা যায় না৷ মনের মানুষের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে৷ চোখ বুজল সুহাস৷ মনে পড়ে গেল, সেদিন চারদেয়ালের ভেতরে সে নামীকে কী কী বলেছিল। সেই বিধ্বংসী ঝগড়াগুলো স্মরণ করে কেঁপে ওঠে হৃদয়। চোখ খুলে সুহাস। নামী তার বউ। তাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, ঝগড়া হয়েছিল। সে জানত নামী কী ধরনের মেয়ে৷ তবু ইচ্ছে করে জব্দ করতে ওসব বলেছিল। যাতে রেগে গিয়ে অন্তত সত্যিটা বলে। নামী স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী। এই বিশ্বাস মনে থাকলেও মুখে উচ্চারণ করেছিল বিপরীত কিছু। তাই বলে অন্য কারো মুখে নামীকে নিয়ে সেসব শুনার শক্তি, আগ্রহ বা মানসিকতা কোনোটাই তার নেই৷ তারা একে অপরকে যাই বলুক, যাই করুক। সেগুলো একান্তই তাদের দুজনের ব্যক্তিগত বিষয়। তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সুহাস৷ নানুমনি চুপসে গেল একদম৷ মামিরা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে ঢোক গিলল। সুহাস বড়ো বড়ো করে বারকয়েক শ্বাস নিয়ে চলে গেল ড্রয়িং রুম ছেড়ে।

সুহাসের যাওয়ার পথে তাকিয়ে সৌধ৷ এতক্ষণে যেন দম ছাড়ল সে৷ মনে মনে হাসল ভীষণ। বাহবা দিল প্রিয় বন্ধুটিকে। পাশাপাশি নিশ্চিতও হলো, নামীর প্রতি সুহাসের অনুভূতি সম্পর্কে। প্রকৃতপক্ষে সুহাস, নামীর সম্পর্ক নিয়ে তারও কিঞ্চিৎ সন্দেহ জেগেছিল। আর যাইহোক ভালোবাসা, সম্মান ব্যতীত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না৷ এবার স্বস্তি পেল। সেই সঙ্গে মনে মনে করা পণটিও দৃঢ় হলো। সুহাস, নামীকে এক করতেই হবে। সিমরান মামিদের দিকে এক পলক স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সৌধর কাছে এসে বলল,

‘ চলো উপরে যাই। ‘
.
.
লাঞ্চ টাইম শেষে সৌধ বলে বসল নিজের বাড়ি ফিরবে। সিমরানকে একঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে বলা হলো। দ্বিতীয়বারের মতো শশুর বাড়ি যেতে তৈরি হলো সিমরান৷ প্রথমবারের মতোই মন ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। সৌধর ইচ্ছে ছিল বিকেল করে
বাড়ি ফিরবে। তার আম্মা এমনটাই বলে দিয়েছিল।
কিন্তু তখন নানুমনি আর মামিদের করা সমালোচনা গুলো মাথা থেকে যাচ্ছে না। এই মানুষ গুলোকে পছন্দ হচ্ছে না একদমই। তার একটি বদঅভ্যেস হলো, যে তার অপছন্দীয় কাজ করবে তার মুখ দর্শন করতে মন ভরে ওঠবে তীব্র বিতৃষ্ণায়। শুধুমাত্র দু’জনের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতীক্রম। সে দু’জন হলো তার দাদুনি আর সুহাস।

প্রথম বিদায়ে বোনের সঙ্গে সঙ্গ দেয়নি সুহাস। দ্বিতীয় বিদায়ে দিল। নিজ দায়িত্বে বোন এবং বোন জামাইকে পৌঁছে দিল চৌধুরী বাড়ি। ফলশ্রুতিতে সিমরানের কান্নাকাটি খুব বেশি দীর্ঘ হলো না৷ আজ তার প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সৌধর আদেশে বই, খাতাও বাদ যায়নি৷ নতুন বউ বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাড়ি জুড়ে খুশির আমেজে ভরে ওঠল। সবচেয়ে খুশি হলো তাহানী। সিমরানকে দেখা মাত্র ছুটে এসে কোমর জড়িয়ে ধরল৷ সিমরানও মৃদু হেসে জড়িয়ে নিল ওকে। আদর করে চুমু খেল গালে৷ দু’জন কাজের মেয়ে এসে লাগেজ দু’টো নিয়ে উপরের ঘরে দিয়ে এলো৷ সিমরান এসে বসল শাশুড়ির পাশে। সবাই মিলে গল্প গুজব করল অনেকক্ষণ। হালকা নাস্তাপানি দেয়া হলো সুহাসকে। মাগরিবের আজানের আগ মুহুর্তে সুহাস বিদায় নিল। তার সঙ্গে সৌধও বেরুলো। আম্মা আর বউ দু’জনকেই জানিয়ে গেল ফিরতে দেরি হবে।

পূর্বে থেকেই সিমরান সকলের খুব আদরের৷ যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বলা যায় আগের তুলনায় প্রকটও হয়েছে। এ বাড়ির বড়ো বউ ঝুমায়না। সেও বাবা, মায়ের একমাত্র মেয়ে। তিন ভাইয়ের অতি আদুরে ছোটো বোন৷ কানাডায় বিরাট বড়ো বিজনেস আছে তার বাবার৷ ছোটোবেলা থেকে অনেক বেশি আদরে, আর জমকালো ভাবে বড়ো হয়েছে। যা তার মন, মানসিকতাকে বিগড়ে দিয়েছে বীভৎসভাবে। নিজের সমকক্ষ কাউকে একদমই পছন্দ করে না ঝুমায়না। আর যদি নিজের সমকক্ষ মানুষকে তার চেয়ে অধিক প্রাধান্য দেয়া হয় তাহলে তো সে তার চোখের বিষ৷ বিয়ের পর থেকে সে যতবার এ বাড়িতে এসেছে। ততবারই প্রত্যেকের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। দাদুনি তাকে পছন্দ করে না বলে সে নিজেই সব সময় দাদুনিকে এড়িয়ে চলেছে। এছাড়া বাকি সবার চোখের মণি হিসেবেই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই এবার তার আদর, গুরুত্ব, সম্মান সবই যেন কম পড়ে গেল৷ কারণ ওসবের ভাগিদার এখন সৌধর বউ সিমরানও। ওর কেবল মনে হতে থাকল, এ বাড়ির সবাই ওর চেয়ে সিমরানকে বেশি ভালোবাসে। যা একেবারেই সহ্য করার মতো ছিল না৷ ওর বিরাগটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠল। কাল থেকে শাশুড়ি থেকে শুরু করে ননদ, কাজিন দেবর, ননদ সকলের মুখে এক সিমরানকে নিয়ে প্রশংসা। আজ যখন সিমরান এলো এরপর থেকে যে নাটক শুরু হলো তা আর দেখার মতো না৷ সে তাহানীকে কাছ ঘেঁষতে দেয় না। অথচ সিমরান তাহানীকে কেমন জড়িয়ে ধরে বসে আছে৷ সে কখনো শাশুড়ির সঙ্গে বসে অপ্রয়োজনীয় বকবক করে না৷ অথচ সিমরান একের পর এক অহেতুক গল্প করেই যাচ্ছে। মেয়েটাকে এতদিন শান্ত ভেবেছিল৷ এখন দেখছে, এই মেয়ে মারাত্মক চঞ্চল। কাজিন ননদ, আর দেবররাও কেমন গোল করে বসে আড্ডা জমাচ্ছে। কই সে তো কখনো এভাবে আড্ডা জমায়নি। সবচেয়ে বেশি আক্রোশ জন্মালো সিমরানের পরনে কামিজের সাথে জিন্স প্যান্ট দেখে৷ সৌধ বিয়ের দ্বিতীয় দিনই বউকে জিন্স প্যান্ট পরিয়ে এনেছে? অথচ তার বর এ বাড়িতে যখন তাকে প্রথম নিয়ে আসে। ওইসব ওয়েস্টার্ন ড্রেস বর্জন করতে বলেছিল৷ ঢাকা থেকে গাউন পরিয়ে লাগেজ ভর্তি সেলোয়ার-কামিজ আর গাউন নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। অর্থাৎ সৌধর বউয়ের বেলায় সব মাফ। যত খবরদারি তার ওপর? তীব্র ঈর্ষান্বিত হয়ে দাদুনির ঘরে হাঁটা দিল ঝুমায়না৷ যদিও দাদুনির সাথে তার সম্পর্ক ভালো না৷ তবুও শুনেছে দাদুনি সিমরানকে পছন্দ করে না৷ তাই তার কাছেই এই মেয়ের বিরুদ্ধে কথা লাগাতে হবে।

ঝুমায়না যতক্ষণে দাদুনিকে পড়িয়ে, ফুঁসিয়ে ফাঁসিয়ে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত করল। ততক্ষণে তানজিম চৌধুরী পোশাক পরিবর্তন করতে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে সিমরানকে। দাদুনি আসার পর তানজিম চৌধুরী হাসিমুখে বললেন,

‘ সিনু মা এসেছে আম্মা। পোশাক পাল্টাতে উপরে পাঠালাম। নিচে এলে রান্নাঘরে যাব৷ মেয়েটা নিজে থেকেই রান্না শেখার আবদার করল। ‘

চিকন ফ্রেমের দুইশ পাওয়ারের চশমাটা ঠিক করতে করতে দাদুনি গিয়ে সোফায় বসলেন৷ পান চিবুতে চিবুতে বললেন,

‘ শুনলাম সে নাকি জিন্স প্যান্ট পড়ে বাড়িতে ঢুকেছে! এই কি নতুন বউয়ের নমুনা? ‘

চমকে ওঠল তানজিম চৌধুরী। বিস্মিত চোখে তাকাল বড়ো বউ ঝুমায়নার দিকে। অবিশ্বাস্য ঠেকল, ঝুমায়না কথা লাগিয়েছে তার শাশুড়িকে। এ বাড়ির নিয়ম তো এটা নয়। হতভম্ব মুখে তানজিম চৌধুরী বললেন,

‘ আমি সিনুকে এ ব্যাপারে সচেতন করে দিব আম্মা৷ এ নিয়ে আর কথা বাড়াবেন না। ‘

তানজিম চৌধুরী জানেন, শাশুড়ি এ নিয়ে আর কথা বাড়াবে না৷ কিন্তু সিমরানকে যে অপছন্দের শীর্ষে রেখে দেবে তা ভালো মতোই বুঝতে পারল৷ শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল ঝুমায়নার দিকে। এ কোন ঝুমায়নার সম্মুখীন হলো আজ সে? কোনোভাবে সিনুর প্রতি হিংসা থেকে এটা করল ঝুমায়না? বুক কেঁপে ওঠল তানজিম চৌধুরীর। চোয়াল দৃঢ় হলো কিঞ্চিৎ। প্রথমবার বলে চুপ রইল। দ্বিতীয়বার এমন কিছু দেখলে অবশ্যই সাবধান করবে৷ এ বাড়ির প্রতিটি ছেলেমেয়ের মন পানির মতো স্বচ্ছ। সে আশা করবে তাদেরকে ঘিরে যারাই এ পরিবারের অংশ হবে তাদের হৃদয়কেও বরফের মতো শীতল, বৃষ্টির পানির মতো স্বচ্ছ, তুলোর মতো নমনীয় হতে হবে৷

রান্নাবান্না পারে না সিমরান। ঝুমায়নাও পারত না৷ টুকটাক শিখেছে শাশুড়ির থেকে৷ শেখা টুকুই৷ শখ করে কখনো কাউকে রান্না করে খাওয়াতে দেখা যায়নি৷ সিমরানের আজ রান্নাবান্নার হাতেখড়ি হলো। শাশুড়ি মায়ের কাছে। আজ রাতের খাবারে যা যা রান্না হলো। সবকিছুই মন দিয়ে দেখল সিমরান৷ মনে রাখতে পারল না। তবু দেখল৷ শাশুড়ি বলেছেন,

‘ একবারে হবে না। প্রতিদিন দেখতে দেখতে টুকটাক করতে করতেই শেখা হয়ে যাবে। ‘

রান্না শেষে শশুরমশাই খেতে এলেন। আজ সিমরানই খাবার বেড়ে দিল তাকে। বিয়ের পর থেকেই সুজা চৌধুরীর অভ্যাস, মা এবং বউকে পাশে বসিয়ে একসঙ্গে খাওয়া। আজো তার ব্যতীক্রম হলো না। সিমরান জানতে পারল, তার শাশুড়ি মাও স্বামী বাড়িতে থাকলে তাকে ছাড়া খেতে বসেন না। দূরে থাকলে আগে ফোন করে জেনে নেন, স্বামী খেয়েছে কিনা। সে খেলেই উনি তিনবেলা মুখে ভাত তুলেন। এটা কারো বলে দেয়া বা লিখে রাখা নিয়ম হিসেবে উনি করেন না৷ উনি এটা করেন স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা বোধ থেকে। শশুর, শাশুড়ির এই গল্প শুনতে শুনতে ঝুমায়না পেট ভরে খেয়ে ওঠল৷ কিন্তু সিমরান খেতে পারল না। সে মুখ ফস্কে বলে ফেলল,

‘ আন্টি, আমি সৌধ ভাই এলে খাব। ‘

সুজা চৌধুরী মুচকি হাসলেন। সিমরান লজ্জায় মাথা নত করল। তানজিম চৌধুরী বললেন,

‘ ওর তো আরো দেরি হবে সিনু৷ এতক্ষণ থাকতে পারবে? ‘

‘ পারব। ‘

মাথা নেড়ে বলল সিমরান। তানজিম চৌধুরী মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন,

‘ আচ্ছা। তা আমরা কবে আম্মা, আব্বা ডাক শুনব তোমার থেকে? ‘

আরক্ত মুখে সিমরান জবাব দিল,

‘ ধীরেধীরে অভ্যেস করে নিব। ‘

ঝুমায়না উপরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। শাশুড়ি আর সিমরানের কথা শুনে মুখ ভেঙচি দিয়ে বিরবির করল,

‘ যত্তসব ন্যাকামি! ডিজগাস্টিং। ‘
.
.
ঘরে বসে তাহানীর সঙ্গে গল্প করছে সিমরান৷ পাশাপাশি নিজের বই, খাতা গুছিয়ে রাখছে। সৌধ ভাই আসতে আসতে সব গুছিয়ে ফেলবে সে। এমন সময় ঝুমায়নার ঘর থেকে সুরের কান্নার শব্দ পেল। তাহানী গিয়ে দেখে এলো, বড়ো ভাবি ঘুমাবে কিন্তু সুর ঘুমাবে না৷ তাই মায়ের ধমক খেয়ে ভয় পেয়ে কাঁদছে সুর৷ তাহানীর মুখে এসব শুনে মায়া হলো সিমরানের। সুরের মুখ মনে করতে করতে সহসা মনে পড়ে গেল নামীপুর কথা। সে ফুপি হবে স্মরণ করে পুলকিত হলো মন। ভাবল, তার ভাতিজা বা ভাতিজি যাইহোক না কেন। সে যদি নামীপুকে ঘুমাতে না দেয় নামীপুও কি এভাবে ধমক দিয়ে কান্না করাবে? উঁহু সে থাকতে তার ছোট্ট সোনামুনিকে কেউ ধমক দিতে পারবে না৷ নামীপুও না৷ যখন নামীপুর ঘুম পাবে তখন সে বেবিকে নিজের কাছে রাখবে। কত আদর আর যত্নের বেবি হবে তাদের পরিবারে। মুহুর্তেই নামীর দূরে চলে যাওয়ার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চাটাকে তারা ঠিক সময় কাছে পাবে তো? বুক ভাড় হলো ভীষণ। ভাইয়ের কথা ভেবেও মনে ভীষণ মেঘ জমে গেল। ওদিকে সুরের কান্নার শব্দ বেড়েছে। সৌধ ভাইয়ের বড়ো ভাইয়ের সন্তান সুর৷ অর্থাৎ তারও বড়ো ভাই। সুর তারও ভাতিজা৷ কখনো বাচ্চাদের সামলায়নি সে৷ সেভাবে কোনো বাচ্চার সংস্পর্শে যাওয়াও হয়নি৷ এই এক তাহানীকেই পেয়েছে শুধু৷ তাই সুহাস ভাইয়ার বেবির কথা স্মরণ করে সুরের প্রতি গভীর আকর্ষণ বোধ করল। বইগুলো দ্রুত গুছিয়ে বাকি কাজ বাদ রেখে পা বাড়াল ঝুমায়না ভাবির ঘরে৷ অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বলল,

‘ ভাবি সুরকে আমার কাছে দাও। আমি ওকে রাখি কিছুক্ষণ। ‘

চোখমুখ কুঁচকে ফেলল ঝুমায়না৷ কঠিন গলায় বলল,

‘ তুমি করে বলছ যে? সম্পর্কে আমি তোমার বড়ো জা৷ বয়সেও বছর, পাঁচেক বড়ো। ‘

থতমত খেয়ে গেল সিমরান। আমতাআমতা করে বলল,

‘ সরি ভাবি। ‘

মনটা যেন মরেই গেল মেয়েটার। তীব্র অস্বস্তিতে পড়ে গেল৷ অপমানবোধও করল ভীষণ। ঝুমায়না ভাবি যে এতটা রাফ সে কল্পনাও করেনি। তবু এসে ফেঁসে গেছে বিধায় আর চলে গেল না। সুরের প্রতি আকর্ষণ তো ছিলই৷ তাই বলল,

‘ সুরকে কোলে নিতে পারি? ‘

ছেলের কান্না অসহ্য লাগছে ঝুমায়নার৷ সে সাধারণত ছেলেকে কারো কোলে দেয় না। শুচিবায়ু সমস্যাও আছে৷ বাড়ির কাজের লোকদের তো ধরতেই দেয় না বাচ্চাকে। হাঁটি হাঁটি করে যদিও সুর তাদের কাছে চলে যায় ঝুমায়না জোর কের নিয়ে আসে৷ সিমরানকে নিয়ে তার এসব সমস্যা নেই। তাই অনুমতি দিল। সিমরানও সুরকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে ঘরে থেকে যেন ভয়াবহ বিরক্ত সুর৷ কাঁদতে কাঁদতে কপাল কুঁচকে ছিল ওর৷ আলাদা ঘর আলাদা মানুষ পেয়ে সে কুঁচকে থাকা কপাল ধীরেধীরে সোজা হয়৷ সিমরান অবাক হয়ে দেখে বাচ্চা ছেলেটার কী মুড৷ সে প্রথমে মিষ্টি হেসে ওর সঙ্গে ভাব জমায়। তারপর ধীরেধীরে পরিচিত হয়৷ বলে,

‘ বলো তো বাবান আমি তোমার কী হই? ‘

তাহানী উল্লসিত গলায় বলল,

‘ ছোটো মা। ‘

সুর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। সিমরান ওর গাল টিপে দিয়ে কপালে চুমু খেল। বলল,

‘ হ্যাঁ। আমি তোমার ছোটো বাবার বউ হই৷ তাই ছোটো মা বলবে। ‘

এভাবে দীর্ঘ কিছু সময় কাটিয়ে দিলে ওদের ভাব হয়ে গেল। ঘরময় ছুটোছুটি করে দু’টো বাচ্চার সাথে খেলতে শুরু করল সিমরান৷ লুকোচুরি খেলা। ওদের খেলাটা যখন জমে ওঠেছে তখন তাহানীর পায়ের ঠেলা লেগে টি টেবিলের ওপর থাকা একটি গ্লাস পড়ে যায়। গ্লাস ভাঙার দৃশ্য দেখে শব্দ শুনে ভয় পেয়ে কাভার্ডের সাইটে লুকিয়ে থাকা সুর গুটিগুটি পায়ে ছুটে এলে পায়ে ছোট্ট একটি কাঁচ ফুটে যায়। নিমেষে পরিস্থিতি বিধ্বস্ত হয়ে ওঠে৷ সুরের গগনবিদারী চিৎকার, কান্নায় ভয় পেয়ে যায় সিমরান৷ বেলকনিতে থেকে ছুটে এসে দেখে কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে৷ সুরের পায়ের তলায় কাঁচ ফুটে কিঞ্চিৎ রক্তও বেরিয়েছে। ভয়ে তাহানী ছুটে গেছে ঝুমায়না ভাবিকে ডাকতে।

রক্ত দেখে ভীষণ ভয় পায় সিমরান৷ কাঁ টা ছেঁ ড়া দেখলেও মস্তিষ্ক আর মনে মারাত্মক সমস্যা হয়৷ তবু সুর বাচ্চা ছেলে৷ আর সে বড়ো মেয়ে৷ এ বাড়ির বউ৷ সুরের ছোটো মা৷ এই সম্পর্ক গুলোই যেন সাহসী করে তুলল ওকে। ছুটে এসে সুরকে কোলে তুলে বিছানায় বসল৷ এরপর কাঁপা হাতে পায়ের তলা থেকে ছোট্ট কাঁচটা বের করে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। ঝুমায়না দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল সেই দৃশ্য। নিমেষে মাথায় রক্ত চড়ে গেল যেন৷ বীভৎস মুখোভঙ্গিতে এগিয়ে এসে ছেলেকে ছিনিয়ে নিল। বলল,

‘ কী করেছ তুমি আমার ছেলেকে? ‘

সিমরান কোনো উত্তর না দিয়ে সৌধর ছোট্ট চিকিৎসা বাক্স নিয়ে এসে সুরের পা ড্রেসিং করে দিল৷ খুব বেশি ক্ষত নয়। ঝুমায়না বুঝতে পেরে ব্যান্ডেজ করে দিল। ততক্ষণে ছেলেটা শান্ত হয়েছে। কিন্তু সে শান্ত হতে পারল না৷ এমনিতেই মেয়েটার ওপর রাগ ছিল। সেই রাগ চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছেছে এবার৷ খাতির করে তার বাচ্চাকে নিয়ে এসে ব্যথা দিয়েছে কত বড়ো সাহস৷ ইচ্ছে করছে চিবিয়ে খেতে তা তো সম্ভব না তাই আপাতত কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরেই বুক শীতল করবে। ভাবামাত্র ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নিজের ঘরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ফিরে এলো পুনরায় । সিমরান বেরুচ্ছিলই তার ঘরে যাওয়ার জন্য৷ সুর ব্যথা পেল, বাচ্চা একটা ছেলে। মন কাঁদছে তার। এমন মুহুর্তে ঝুমায়না ভাবি ফের আসায় সে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

‘ সরি ভাবি। কীভাবে হলো বুঝতে পারছি না৷ এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। ‘

দাঁতে দাঁত পিষে, ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ঝুমায়না বলল,

‘ এক্সিডেন্ট? পাজি মেয়ে কোথাকার! ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে আমার ছেলেকে ব্যথা দিয়ে বলছ এক্সিডেন্ট। এজন্যই এত প্রেম দেখিয়ে ওকে নিয়ে এলে? ক্রিমিনাল কোথাকার। কার সাথে ক্রিমিনালি করেছ জানো তুমি? আমি ঝুমায়না আমার কলিজার ছেলে সুর। তোমার মতো ক্রিমিনালকে সাইজ করতে ঝুমায়নার এই হাতের একটা চড় ই যথেষ্ট। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিল সিমরানের ডান গালে। যে থাপ্পড়ে একপাশে মাথা বেঁকে গেল সিমরানের। ঝিমঝিম করে ওঠল মাথাটা৷ থরথর করে কেঁপে ওঠল শরীর। চোখের সামনে ভেসে ওঠল মা উদয়িনীর মুখশ্রী আর সৌধ ভাইয়ের মুখাবয়ব। নিমেষে বুজে থাকা চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনাপানির ধারা। বুকের ভেতর কী অসহ্য ব্যথা জেগে ওঠল৷ গালে অনুভব করল টনটনে যন্ত্রণা। ধীরে ধীরে একটি হাত দিয়ে টনটনে ব্যথা অনুভব করা গালে স্পর্শ করতেই কর্ণকুহরে শুনতে পেল কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ভারিক্কি কণ্ঠস্বর। যাকে ভালোবেসে, যাকে কেন্দ্র করে এ বাড়িতে সসম্মানে বউ হয়ে এসেছে সে। আজ এ বাড়িতে তার দ্বিতীয় রাত!

‘ ভাবি! ‘

বিমূঢ় দৃষ্টির, দৃঢ় চোয়ালের ভয়ংকর সে ধমকে কেঁপে ওঠল ঝুমায়না, সিমরান। কাঁদতে শুরু করল তাহানী। সৌধ বড়ো বড়ো পা ফেলে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে ঝুমায়নার মুখোমুখি হলো। এ বাড়িতে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। কোনো জুনিয়র সদস্য সিনিয়রকে ধমক তো দূরে থাকুক চোখ তুলে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলে না৷ সৌধ এই নিয়মে বরাবরই নিজের দৃঢ়তা বজায় রেখেছে। আজ সেই সৌধই কঠিন, শাসালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে, অবিশ্বাস্য কণ্ঠে দ্বিতীয় ধমকটি দিল বড়ো ভাইয়ের বউকে,

‘ হাউ ডেয়ার ইউ ঝুমায়না ভাবি! ‘

ডুকরে ওঠল সিমরান। ব্যথা, অপমান, রাগ, জেদ, ক্ষোভ সব মিলিয়ে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের ভেতরে চলে গেল৷ ক্রোধান্বিত লাল হয়ে আসা চোখ দু’টি দিয়ে এক পলক সিমরানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফের ঝুমায়নার দিকে তাকাল সৌধ। তাহানী কাঁদতে কাঁদতে বিবৃতি দিল ঠিক কী ঘটেছে। তাহানীর বিবৃতি শুনে ঘামতে শুরু করল ঝুমায়না। আর সৌধ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল ভাবির দিকে। মস্তিষ্ক এতটাই বিগড়ে গেল যে বড়ো ভাইয়ের বউ না হলে বয়স বিবেচনা করত না। কষিয়ে চার পাঁচটা থাপ্পড় দিয়ে বুঝিয়ে দিত, সৌধ চৌধুরীর বউয়ের গায়ে হাত তোলার যন্ত্রণা কী বীভৎস হতে পারে।

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৮|
পরিস্থিতি গুমোট। রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে সৌধ৷ ওর দৃঢ় চোয়াল আরো বেশি দৃঢ় হলো। পেশিবহুল দু’টো হাত চনমনে। যা তীব্র কষ্টে মুঠোবন্দি করল৷ ফুলে ফেঁপে ওঠল হাতের প্রতিটি নিল রগ৷ ঝুমায়নার দেহশ্রী কেঁপে ওঠল এ দৃশ্য দেখে। তীব্র ভয়ে সংকীর্ণ হয়ে গেল মুখশ্রী। অনুভব করল কণ্ঠনালী নীরস হয়ে আসছে। সৌধ সম্পর্কে কম ধারণা নেই ঝুমায়নার। তার স্বামী সৌরভ ছোটো ভাইকে প্রচণ্ড স্নেহ করে। বরাবরই ভাইকে নিয়ে গর্ব করতে দেখেছে সৌরভকে। শুনেছিল, খুব ছোটোবেলায় সৌধকে তার এক স্কুল ফ্রেন্ড গালে ঘুষি মেরেছিল। সৌধ বাড়িতে এসে কাউকে জানায়নি৷ কারণ এক টিচার তার বিচার করেছে৷ তবু সৌরভ অন্য একজন থেকে এ খবর পেয়ে সেই ফ্রেন্ডকে যে হাতে ঘুষি দিয়েছিল সে হাতে গোটা, দশেক কঞ্চি আঘাত করে। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সুজা চৌধুরীর বড়ো ছেলে বলে সৌরভ ছোটো থেকেই আলাদা দাপট নিয়ে চলে। ভাই, বোনকে ভীষণ ভালোও বাসে। সবচেয়ে বেশি দুর্বল ভাইয়ের প্রতি। কোনো একদিন কথার ছলে শুনেছিল, ভাই যদি তার প্রাণটুকুও আবদার করে সেটুকু দিতেও দ্বিধা করবে না৷ যদিও কথাটা গভীরভাবে ভালোবেসে আবেগান্বিত হয়ে বলে থাকে৷ তবু ক’জন পারে বড়ো মুখ করে এতটুকু বলতে? ঢোক গিলে ঝুমায়না। সৌরভ তাকেও কম ভালোবাসে না৷ কিন্তু এ বাড়ির প্রতিটি সদস্যের মতো সৌরভও অন্যায় সহ্য করতে পারে না। বাবার আদর্শে, চৌধুরী পরিবারের প্রতিটি নিয়মনীতি বুকে লালন করে বড়ো হয়েছে সৌরভ, সৌধ৷ আজ যা ঘটল এসব যদি সৌরভের কানে যায় তাকে আর আস্ত রাখবে না।

সৌধর বলিষ্ঠ হাত দু’টো কাঁপছে। যা সে সচেতনতার সাথে ধীরে ধীরে পিছনে নিয়ে নিল। এরপর বা হাত দিয়ে ডান হাতের কব্জিটা প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরল। ঝুমায়নার নিঃশ্বাস আঁটকে গেল এটুকু দেখেই৷ সে টের পেল সৌধর তাকে মারতে ইচ্ছে করছে। শুধুমাত্র বাড়ির বউ, বড়ো ভাইয়ের বউ বলে নিজেকে তীব্র কষ্টে সামলে নিল। দু’ভাইয়ের অনেক স্বভাবই মিলে যায়। সৌরভ যখন প্রচণ্ড রেগে যায় দোষী ব্যক্তিকে মারতে হাত নিশপিশ করে৷ অথচ মারতে পারবে না এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে এভাবেই এক হাত দিয়ে অপর হাত বেঁধে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। কানাডার বাসায় থাকাকালীন তাদের মধ্যে কঠিন ঝগড়া হয়েছিল। তার বড়ো ভাই এসেছিল তাকে নিয়ে যেতে৷ ঘোষণা দিয়েছিল, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে৷ সেদিন বড়ো ভাইয়ের সামনে সৌরভ ঠিক এভাবে দাঁড়িয়েই তর্ক করেছিল। যাতে শুধু মুখ টুকুই চলে, হাত নয়। সিনিয়র সদস্যদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম৷ জুনিয়র হলে হাতটাই বেশি চলে দু ভাইয়ের। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল ঝুমায়না৷ কাঁপা গলায় কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ আকস্মিক পাশে দাঁড়ানো কান্নারত তাহানীর দিকে তাকিয়ে আদেশ করে,

‘ তাহানী, আম্মার কাছে যাও। ঘুমাও গিয়ে। ‘

মাথা নিচু করে চলে গেল তাহানী। ঝুমায়নার বুক ধক করে ওঠল। দু’পায়ের হাঁটু কাঁপতে শুরু করল সমান তালে। সৌধ তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। যে হাতে সিমরানের গালে কষিয়ে থা প্পড় দিয়েছে সে। সহসা গমগমে কণ্ঠে বলল,

‘ এ বাড়ির বউদের হাত এতবেশি লম্বা হতে নেই। কারণ বাড়ির পুরুষরা সে লম্বা হাত খাটো করে দেয়!’

চমকে ওঠল ঝুমায়না। নিজের দোষ স্বীকার করে আরো বড়ো বিপদে পড়ার ভয়ে বলল,

‘ তোমার বউ সুরকে ব্যথা দিয়েছে। আমি ওর কোলে দিতেই চাইনি৷ প্ল্যান করে সুরকে এ ঘরে নিয়ে এসে ব্যথা দিল। ‘

কান্নাধরা গলায় বলল ঝুমায়না। অবিশ্বাস, ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে সৌধ বলল,

‘ আপনাকে ভাবি বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। এ বাড়ির কেউ মিথ্যা বলে না, আর না সহ্য করে। তাহানী যতটুকু বলেছে ততটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য।’

কেঁপে ওঠল ঝুমায়না৷ সৌধ কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে ওয়ার্নিং করে বলল,

‘ আমার সামনে থেকে দূর হন। আপনাকে আমার বা সিনুর ত্রিসীমানায়ও যেন না দেখি। ‘

সৌধ বাক্যটির সমাপ্তি দিতেই ঝুমায়না চলে যেতে উদ্যত হয়৷ তৎক্ষনাৎ আবার থেমে যায়। সৌধ তুড়ি বাজিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে,

‘ আজ যা ঘটল আপনার থেকে এটা অকল্পনীয় ছিল। তবু যখন ঘটেছে এরজন্য সিনুকে অবশ্যই সরি বলবেন। ‘

বিস্ময় নিয়ে তাকাল ঝুমায়না। সে সিনুকে সরি বলবে? তার মানে বাড়ির সবাই জেনে যাবে এই ঘটনা! আর সৌরভ, তার কানে গেলে কী হবে? ঘামতে শুরু করে সে। ভয়ে ভয়ে সৌধকে বলে,

‘ প্লিজ সৌধ বিষয়টা জানাজানি করো না। ‘

ফিচেল হাসে সৌধ। সে মোটেও চায় না আজকের ঘটনা আর কেউ জানুক। ঝুমায়না এ বাড়ির বড়ো বউ৷ তার বিকৃত রূপ আর সিনুর অসম্মান কোনোটাই প্রকাশ পাক সে চায় না৷ তাই সীনা টান টান করে দাঁড়িয়ে দাম্ভিকতা নিয়ে বলল,

‘ অকে, তাহলে এক্ষুনি গিয়ে সিনুকে সরি বলে বিদায় হন। ‘

ঝুমায়নার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল সে অসন্তুষ্টি নিয়ে ঘরে গেল। এর একটুক্ষণ পরই আবার বেরিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। হয়তো দায়সারা ভাবে নিজের অহংবোধে আঘাত করে সরি বলেছে। মন থেকে যে বলেনি এতে কোনো সংশয় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। আকস্মিক স্মরণ হলো, সিমরানের কথা। সে কাকে, কোন বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে তার থেকে ভালো কেউ জানে না৷ ওই মেয়েটা কতটুকু সহ্য করতে পারে, কতটুকু নিতে পারে এ সম্পর্কে তীক্ষ্ণ ধারণা আছে সৌধর। তাই তো বুকের গভীরে মুচড়ে ওঠল আচমকা। তীব্র লজ্জায় দুমড়ে মুচড়ে গেল মন। সিনু তার বউ। যাকে বিয়ের তৃতীয় রাতে সমাজের নিম্নশ্রেণীর কিছু পরিবারে ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো ছিঃ! এই দায় আর কারো নয় সম্পূর্ণ সৌধ চৌধুরীর।
.
.
বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে এমন একটি ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে ভাবতে পারেনি সৌধ। এমনিতেই দুঃশ্চিতার শেষ নেই৷ লম্বা একটি সময় নিজের জীবন নিয়ে ভোগান্তি পোহালো। অন্ধকার শেষে আলোর দেখা পেল, তুখোড় ঝড়, বৃষ্টি শেষে দেখা হলো ঝলমলে রোদের সঙ্গে। নিজের জীবন যখন একটু সুনিশ্চয়তা পেল তক্ষুনি শুরু হলো সুহাসের জীবনের টানাপোড়েন। এতক্ষণ সুহাসের সঙ্গেই ছিল সে। সোহান আংকেল নামীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছে না৷ মেইল করেছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুক কোনোটাই বাদ রাখেনি। ভয় হচ্ছে এখন। নামীর মতো সেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিল না তো? সুহাসকে সান্ত্বনা দিয়ে, ভরসা জুগিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরল সে। এসেই আরেক দফা অশান্তির সম্মুখীন হলো৷ তার জীবনে এই অশান্তি টুকু ছিল অত্যন্ত লেইম৷ তপ্ত মেজাজে নিজের ঘরে প্রবেশ করল সৌধ। দেখতে পেল এক পাশে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘুরালেই চোখ পড়ল ফ্লোরে। সিমরানের ওড়না পড়ে আছে। বিছানার বালিশ দু’টোও পড়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। নিমেষে একবার চোখ বুঁজল সে। ঠিক কী ঘটতে পারে আঁচ করে ফেলল। ঝুমায়না ভাবির থেকে অকারণে, বিনাদোষে থা প্পড় খেয়ে দুঃখের পাশাপাশি নিশ্চয়ই মাথা গরম হয়েছে? তীব্র ক্রোধে জর্জরিত হয়ে সমস্ত ক্ষোভ ঢেলেছে এসবের ওপর। সবকিছুর ওপর রাগ ঝেড়ে বিছানায় বসে কাঁদছে সিমরান। সৌধর বিগড়ে যাওয়া মেজাজ কিঞ্চিৎ ঠিক হলেও সিমরানকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু হলো। ত্বরিত কাছে গিয়ে পাশে বসতেই বউ তার ফুঁসতে শুরু করল। কিছু বলবে বলবে ভাব৷ কিন্তু বলতে পারছে না৷ কান্নার হিড়িকে কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। কিয়ৎক্ষণ সময় নিল সৌধ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রক্তিম বর্ণীয় ডান গালটায়। কতখানি জোর খাঁটিয়ে চ ড়টা মে রেছে! ভেবেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল আবারো। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল হঠাৎ। শুনতে পেল ফিকড়ে কাঁদতে কাঁদতে সিমরানের কণ্ঠস্বর,

‘ আমরা লুকোচুরি খেলছিলাম। কীভাবে গ্লাস পড়ে ভেঙেছে জানি না আমি। সুর কীভাবে ব্যথা পেল তাও দেখিনি৷ কান্না শুনে ছুটে এসে দেখি এই অবস্থা। আর ভাবি আমাকে মিথ্যা দোষ দিল! আমি সুরকে ভালোবেসেই কাছে এনেছিলাম। ‘

শেষ বাক্য দু’টো প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল সিমরান। কী ভয়ংকর দুঃখ পেয়েছে মেয়েটা! কী ভয়ানক রেগেও গেছে। স্বাভাবিক। ওর জায়গায় যে কেউ থাকলে রেগে যেত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। তার পুরুষালি পোক্ত হাতটা বাড়িয়ে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিল সিনুর ডান গালে। টনটনে ব্যথায় পুরুষালি উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে ঠোঁট ভাঙিয়ে কাঁদতে লাগল সিমরান। সৌধ শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ তাহানী বলেছে আমাকে। যদি ও নাও বলত, ঝুমায়না ভাবির কথা আমার বিশ্বাস হতো না। বিকজ, ঝুমায়না ভাবিকে চিনি মাত্র পাঁচ বছর, তোকে চিনি প্রায় পনেরো বছর৷ ডোন্ট অওরি, আই ট্রাস্ট ইউ। ‘

কান্নার বেগ কিছুটা কমলেও কিছুতেই ওই থাপ্প ড়টা ভুলতে পারল না সিমরান। কেন জানি প্রচণ্ড অভিমান হলো৷ কার ওপর হলো সে নিজেও জানে না। তাই নিজের মোবাইল খুঁজল। খুঁজে পেলে সুহাসের নাম্বার ডায়াল করতে উদ্যত হলে সৌধ কেঁড়ে নিল ফোনটা। বলল,

‘ উহুম, সুহাসকে কল করছিস কেন? ‘

দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে সিমরান বলল,

‘ আমি চলে যাব৷ থাকব না এ বাড়িতে। ‘

কথাটা বলেই আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ চোখ, গাল, নাক, ঠোঁট সর্বত্রই ভয়াবহ লালচে হয়ে আছে। সৌধ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর সিমরানের ফোন অফ করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ধৈর্য সহকারে বলল,

‘ বাচ্চাদের মতো করিস না সিনু। সুহাসের মতো ঝোঁকের বশে কোনো সিদ্ধান্তও নিস না। আমার কথা শোন, যা হয়েছে এরজন্য আমি সত্যি দুঃখীত! ‘

‘ ঐ মহিলার এতবড়ো সাহস কী করে হয় সৌধ ভাই?’

আকস্মিক চ্যাঁচিয়ে ওঠে সিমরান। চোখ বেয়ে পড়তে থাকে নোনাপানির ধারা৷ চমকে যায় সৌধ। সিনুর মুখের ভাষায় বিস্মিতও হয়। ফলে তার চোখ গরম হয় কিঞ্চিৎ। দৃঢ়, শীতল কণ্ঠে সতর্ক করে,

‘ মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ সিনু! উনি ভুল করেছে৷ অন্যায় করেছে। আমি এর প্রতিবাদ করেছি। উনার সঙ্গে যা বোঝাপড়া সব আমার হবে৷ তুই কিছু বলবি না৷ না উনার সামনে আর না আড়ালে। কারণ আমার বউকে এসব মানায় না। ‘

সহসা চুপ হয়ে গেল সিমরান। ক্রোধের বশে মাথা বিগড়ে গেছে তার৷ নিজেকে কেন জানি সামলাতে পারছে না৷ সৌধ ভাই এমন উগ্রতা পছন্দ করে না৷ জানে সে৷ তবু করে ফেলল৷ লজ্জায়, দুঃখে মাটির সঙ্গে যেন মিশে গেল মেয়েটা। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,

‘ সরি। ‘

সৌধ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এবারে তার দৃষ্টি সহজ হলো। সিমরান কাঁদছে। এবার নীরবে অশ্রু ঝড়ছে তার৷ ঢোক গিলল সৌধ। চোখ বুঁজে নিজেকে শান্ত করে পুনরায় তাকাল সিনুর দিকে। হাত বাড়ালো। মাথায় আলতো বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ আমি নিজেও সরি সিনু৷ যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। কথা দিচ্ছি, এটাই প্রথম এটাই শেষ এ বাড়িতে তোকে আর অসম্মানিত হতে হবে না। যদি হতে হয় তবে সেদিনই এ বাড়িতে তোর আর আমার শেষ দিন৷ ‘

একটু থেমে আবারো বলল,

‘ আমার স্ত্রীর অসম্মান মানে আমারো অসম্মান সিনু৷ আর সৌধ চৌধুরী অপমানিত, অসম্মানিত স্থানে নিজের ছায়াও মাড়ায় না। ‘

শিউরে ওঠল সিমরান। চট করে মাথা তুলতেই ওর গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছে দিল সৌধ। বলল,

‘ কাঁদিস না। আমি কেন জানি তোর কান্নাটা সহ্য করতে পারছি না৷ বিলিভ মি, ‘

আকস্মিক গলায় কান্না আঁটকে গেল সিমরানের৷ বিস্ময়াপন্ন দৃষ্টিতে, বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ নিয়ে তাকিয়ে রইল। সৌধ উঠে গিয়ে টিস্যু বক্স নিয়ে এসে বসল সম্মুখে। এরপর সযত্নে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,

‘ তুই আমার জীবনের সেই দ্যুতি সিনু। ঘন অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে থাকতে আচমকা যার দেখা পেয়েছি আমি। আমার সানশাইন রূপে ধরা দিয়েছিস তুই। ‘

থামল সৌধ। এরপর চোখের পানি মুছা শেষে মুখের ওপর এলোমেলো হয়ে থাকা ছোটো-ছোটো চুলগুলো ঠিকঠাক করে কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলল,

‘ আমার জীবনে দীর্ঘ বর্ষণ শেষে এক চিলতে ঝলমলে রোদ তুই। চৈত্রের খরা শেষে বৈশাখের অঝোরে বৃষ্টি তুই। যাই হয়ে যাক না কেন, আর কক্ষণো বলবি না, চলে যাবি৷ তোর শেষ ঠিকানা আমি৷ মহাপ্রলয় ঘটে গেলেও এই কথা যেন মুখ দিয়ে আর না বেরোয়৷ মনে থাকবে? ‘

মৃদু চমকে মাথা নাড়ল সিমরাম। অমোঘ এক ঘোরে চলে গেল যেন৷ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। সৌধ দেখল অশ্রুতে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়া পাপড়িতে আবৃত কৃষ্ণকালো হরিণী চোখ দু’টো বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে। যা তার হৃদয়ে শিহরণ জাগালো। মনে মনে হাসল একটু৷ এরপর ওই চোখে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় বলল,

‘ চলে যাবি? ‘

সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার ভঙ্গিতে চোখের পলক ফেলে মাথা নেড়ে না করল, সিমরান। সৌধ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসি ঠোঁটে লেপ্টে দু-হাত বাড়িয়ে বক্ষগহ্বর উন্মুক্ত করে আহ্বান করল,

‘ আয়, বুকে আয়। ‘

বুকের বা’পাশে ইশারা করে বলল,

‘ এখানটায় মাথা রেখে দেখ তো কিছু শুনতে পাস কিনা? ‘

সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল সিমরানের। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল ভীষণ। সাহস করে ওঠতে পারল না ওই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার। মেয়েটা যে কঠিন পর্যায়ের নাজুক। সৌধই যে তার জীবনের প্রথম প্রণয় পুরুষ। সিমরান সাহস করে ওঠল না বলেই হয়তো সৌধর ইন্দ্রিয়শক্তি আন্দোলন শুরু করল। হৃদয় তৃষ্ণার্ত হলো, একবারটি মেয়েটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়ার। মনটা চনমনে হলো, যে গালে ঝুমায়না ভাবি আঘাত করেছে সে গালে এক টুকরো আদুরে শীতল স্পর্শ দেয়ার। নাজুক মেয়েটা যে নিজে থেকে আগাবে না বুঝে ফেলল সৌধ। বউ একটু বেশি জুনিয়র হলে এটাই সমস্যা। তাদেরকে নিজের অনুভূতি, চাওয়া পাওয়া গুলো পড়াশোনার মতো করে বুঝাতে হয়, মুখস্থ, টুটস্থ করাতে হয়। আপাতত সৌধর কোনো চাওয়া, পাওয়া নেই। আছে এক টুকরো অনুভূতি। যে এক টুকরো অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে সে অনুভূতির সাগরেই ডুব দিতে চায় অল্প পরিসরে।

বউকে কষ্ট পেতে দেখে যে স্বামীর বুকে অশান্তি জাগে না পৃথিবীর বুকে সে স্বামী, সে পুরুষ কলঙ্কিত। সৌধ কলঙ্কিত স্বামী, পুরুষ কোনোটাই নয়। তাই তো নিজ উদ্যেগেই কাছে টেনে নিল সিনুকে। দু-হাতের অঞ্জলিতে কোমল গালদুটো ধরে টকটকে লাল বর্ণীয় গালটায় প্রগাঢ় ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। গভীর সে চুম্বন গালে দিলেও সিমরানের বুকের গহীনে থাকা হৃদয়টুকু স্বর্গীয় সুখে ছটফটিয়ে ওঠল। টের পেয়ে চুম্বন আর দীর্ঘ করল না সৌধ। সযত্নে বউয়ের দেহাশ্রী বুকের ভেতর জড়িয়ে নিল। মৃদুস্বরে বলল,

‘ চলে গেলে এই আদরটা মিস হয়ে যেত না? ‘
.
.
রোজকার নিয়মেই ভোরবেলা ঘুম ভাঙল সৌধর। তার অনেকটা কাছেই গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সিমরান। ওর সে ঘুমন্ত মুখশ্রীতে তাকিয়ে গতকাল রাতের কথা স্মরণ হয়ে গেল। মৃদু হাসল সে। গতরাতে কত বুঝিয়ে আদর দিয়ে শান্ত করতে হলো মেয়েটাকে। সহসা টের পেল ধীরে ধীরে সিনু তার সর্বস্ব জুড়ে রাজ করে বেড়াবে। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে ডাকতে উদ্যত হলো সিমরানকে। নামাজের সময় শেষ হয়নি৷ ভাবল, দু’জন মিলে নামাজ পড়ে, শরীর চর্চা করবে৷ এমন সময় মনে পড়ে গেল নিধির কথা। আজ তো নিধির সঙ্গে দেখা করতে যাবে সে। এ ব্যাপারে কি সিনুকে বলা উচিত? একবার ভাবল, কী দরকার। মুখে যতই প্রকাশ না করুক মনে মনে ঠিকই কষ্ট পাবে৷ পরোক্ষণেই আবার চিন্তা করল, কষ্ট পাবে ভেবে না জানিয়ে দেখাসাক্ষাৎ করে এলে পরবর্তীতে জেনে আরো বেশি কষ্ট পাবে। ভুলও বুঝতে পারে৷ উন্মাদের মতো ভালোবাসে বলে এই মেয়ে একদমই দুর্বল নয়৷ যেখানে বিয়ের প্রথম রাতে তারা একে অপরকে কথা দিয়েছে। কেউ কারো থেকে কিচ্ছু লুকাবে না। সেখানে আজ এটা লুকালে কথা ভঙ্গ করা হবে। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে তাই সিদ্ধান্ত নিল, সিমরানকে জানিয়ে তবেই যাবে নিধির সঙ্গে মিট করতে। সুহাস আর নামীকে এক করতে নিধির সাহায্য তার লাগবেই লাগবে। এটাও বোঝাতে হবে সিনুকে৷

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৬৫+৬৬

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৫|
ভোর রাত থেকে ঝুম বৃষ্টি। আজ সারাটা দিন বৃষ্টির জলে ভেজা৷ এই বৃষ্টিস্নাত পরিবেশেই সম্পন্ন হলো সৌধ, সিনুর বউভাতের আনুষ্ঠান৷ অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শেষে সিমরানকে তার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। ভারি পোশাক ছেড়ে হালকা পোশাকে তৈরি হতে বলেছে সবাই৷ সৌধ আত্মীয়, স্বজন বন্ধু, বান্ধবীদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত। তাদের বিদায় দিয়ে তবেই উপরে আসবে। ততক্ষণে সিমরান পোশাক ছেড়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। সৌধ এলো পঁচিশ মিনিট পর। সুট ছেড়ে টি-শার্ট, প্যান্ট পরবে। তাই কাভার্ডের কপাট খুলে সেগুলো বের করতে উদ্যত হতেই কল এলো আইয়াজের।
অমনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।
প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে সিমরানকে বলে গেল,

‘ সিনু, একটা টি-শার্ট আর তার সাথে মিলিয়ে জিন্স বের করে রাখ তো। আমি জাস্ট দু’মিনিটে আসছি। ‘

সৌধ বেরিয়ে গেল। সিমরান ত্বরিত কাভার্ডের সামনে গিয়ে নিজের পছন্দ সই টিশার্ট, প্যান্ট বের করে যত্ন সহকারে রেখে দিল বিছানায়। এরপর কী যেন ভেবে টি-শার্টটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। এ ঘরের সবকিছুতে আলাদা সৌন্দর্য বিরাজমান। এই যেমন এই টিশার্ট, প্যান্টের মাঝেও অন্যরকম সৌন্দর্য আর সুবাসে ভরপুর। হাত বাড়িয়ে টি-শার্টে ছুঁয়ে দিল সিমরান। খেয়াল করল, টি-শার্ট, প্যান্ট দু’টোই হুগো বস ব্র্যান্ডের। আনমনে হাসল মেয়েটা। সৌধ ভাইয়ের মাঝে বস বস একটা ব্যাপার পূর্ব থেকেই লক্ষণীয়। এজন্যই বোধহয় তাদের বন্ধু মহল নিয়ে গড়ে তোলা ক্লাবটির নামও দিয়েছে বিগ বস। একটুক্ষণ পরই সৌধ ফিরে এলো। হাতে একটি ফাইল নিয়ে। নিখুঁতভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে ওগুলো কারো প্রেসক্রিপশন। সৌধ কোনো ভণিতা ছাড়াই ওগুলো সিমরানকে এগিয়ে দিল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বিছানায় রেখে দেয়া পোশাক গুলো নিয়ে বলল,

‘ ভেতরে কী আছে এখন দেখার দরকার নেই। লাগেজে রেখে দে। ও বাড়িতে গিয়ে দেখব৷’

ভ্রু কুঁচকে গেল সিমরানের। অন্তঃকোণে জাগ্রত হলো কৌতূহল। হাতে থাকা জিনিসটির দিকে কয়েক পল তাকিয়ে থেকে ঢোক গিলে বলল,

‘ কী আছে? ‘

বাথরুমে ঢোকার পথে ফিরে তাকাল সৌধ। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

‘ কী বললাম আমি? ‘

চকিতে তাকাল সিমরান। সচেতন হয়ে মিহি স্বরে বলল,

‘ আচ্ছা বাড়ি গিয়েই দেখব। ‘

মৃদু আওয়াজে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল সৌধ। সিমরান ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে লাগেজে ওঠিয়ে রাখল অদম্য কৌতূহল জাগ্রত করা বস্তুটি৷ তার মাথায় এখন অন্য আরো একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কাল তাদের বিয়ে হলো। আজ সম্পন্ন হলো বউভাত। দুটো অনুষ্ঠানের কোনোটাতেই নিধি আপু উপস্থিত নেই৷ এত বন্ধু, বান্ধবের ভীড়ে নিধি আপু নেই৷ অথচ এটা নিয়ে কেউ টু শব্দটিও করল না৷ মুখ ফস্কেও কেউ উচ্চারণ করল না, ‘ নিধি আসেনি! ‘ বিষয়টা কেমন যেন লাগছে সিমরানের। সবাই কি ইচ্ছে করেই চুপচাপ আছে?
.
.
খন্দকার বাড়ি :

নতুন জামাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত সিমরানের মামিরা৷ কাজিনরা ঘিরে ধরেছে সৌধকে৷ এত আনন্দ, হৈচৈ ভালো লাগছে না সৌধর৷ বিরক্ত হচ্ছে। সুহাসের মামাত ভাই, বোন গুলা পাখির মতো কিচিরমিচির করছে। নতুন জামাই ট্যাগ লেগে যাওয়াতে ওঠতে পারছে না, আর না পারছে স্বস্তি নিয়ে বসে থাকতে। মনের ভেতর চলছে তীব্র উত্তেজনা। বন্ধু সুহাসকে নিয়ে মারাত্মক টেনশন ফিল করছে৷ তীব্র দুঃশ্চিন্তা মনে পুষে পারিপার্শ্বিক উল্লাসে মেতে থাকার সাধ্য হচ্ছে না৷ আইয়াজ আশপাশেই ছিল। দুঃশ্চিতার ছাপ পড়েছে ওর চোখেমুখেও। কী দুর্ধর্ষ এক মুহুর্ত আসতে চলেছে ওরা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। আইয়াজের ছুটি শেষ। ফারাহকে নিয়ে আগামীকালই চলে যাবে সে। বিয়ে উপলক্ষে সৌধ গুটিকয়েক দিন বেশি ছুটি পেয়েছে। ছুটি শেষ হলে সেও চলে যাবে। এরপর সুহাস কী করবে? সব সত্যি জানার পর সে কি পারবে প্রকৃতির নিয়মে জীবন অতিবাহিত করতে? কাজে মন যোগাতে? ভাবতে পারল না আর। সৌধ, আইয়াজ, ফারাহ তিনজনই রুদ্ধশ্বাস এক মুহুর্ত কাটাতে লাগল।

বান্ধবী লুনা চলে যাবে৷ তাই তাকে এগিয়ে দিতে গেল সিমরান। অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানেই লুনা সৌধকে নিয়ে ভূরিভূরি বদনাম শুরু করল। আর সিমরানের কানের বারোটা বাজানোর পাশাপাশি মাথা গরম করে, মনটা দিল বিগড়ে।
***
‘ তোর জামাই রসিক না রে সিনু। ‘

‘ কী একটা কর্কশ ছেলে বিয়ে করলি রে, হাসি তামাশাও করতে পারছি না। গাল দুইটা শক্ত করে কেমন করে জানি তাকায় থাকে। ‘

‘ এমন জামাই নিয়ে ক্যামনে সংসার করবি? ‘

‘ আহারে বেরসিক, আনরোমান্টিক জামাই জুটল তোর কপালে। ‘

‘ কী দেখে এমন ছেলের প্রতি দিওয়ানা হইছিলিরে বোন। ‘
***
এ রূপ নানারকম কথা বলে অকস্মাৎ আলতো হাতে সিমরানের গাল চেপে ধরল। এদিক, সেদিক মুখ ঘুরিয়ে গ্রীবাদেশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ কীইইরে ভাউ, তোর শরীরে কোনো চিহ্নই তো দেখি না। হারিকেন আনা লাগব নাকি দোস্ত? ‘

সিমরান গম্ভীর গলায় বলল,

‘ আমাদের মাঝে ওসব কিছু হয়নি। চিহ্ন আসবে কী করে। ‘

‘ হোয়াট! তোরা বাসরটাসর করিসনি? ‘

সরল উত্তর সিমরানের,

‘ না। ‘

প্রিয় বান্ধবী তাতে কী? ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে এত এত বদনাম সহ্য হয়? সিমরান মোটেই অবলা মেয়ে নয়। তার যত নমনীয়তা সব এক ঐ সৌধ ভাইয়ের জন্যই। বাকিদের সামনে সে মোটেই পুরোদস্তুর নরম নয়। সোহান খন্দকারের মেয়ে হিসেবে যেমন কোমলতা, নীতিবোধ রয়েছে তেমনি ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে হিসেবে আছে ক্রোধ, জেদ। আর আছে সুহাস খন্দকারের বোন হিসেবে লাগাম ছাড়া সব পাগলামি। লুনা ঠাওর করে ওঠতে পারেনি তার বান্ধবীটি হৃদয় গভীরে ডক্টর সৌধ চৌধুরীর জন্য কী ভয়ানক প্রেম, প্রগাঢ় ভালোবাসা, সীমাহীন শ্রদ্ধা পোষণ করে। তাই তো সে যখন তাদের প্রথম রাতে স্বাভাবিক যে সম্পর্কটি গড়ে ওঠে তা হয়নি বলে পিঞ্চ করে বলল,

‘ সর্বনাশ দোস্ত। তোর জামাই মানে তোর গ্রেট সৌধ ভাই ইমপোট্যান্ট নয়তো? ‘

নিমেষে মাথায় রক্ত ছলকে ওঠল সিমরানের। সৌধ ভাই পুরুষত্বহীন নয়তো! এমন একটি সন্দেহজনক প্রশ্ন লুনা কী করে করতে পারল! শরীর রিরি করে ওঠল রাগে। ইচ্ছে করল লুনাকে কষিয়ে দু’টো থাপ্পড় লাগাতে৷ পরোক্ষণেই দমে গেল এত বছরের বন্ধুত্বের খাতিরে৷ কেবল অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

‘ লুনা! সৌধ ভাইকে নিয়ে এত বড়ো কথা তুই কোন সাহসে বললি? ‘

কথাটা বলেই মৃদু ধাক্কা দিয়ে লুনাকে নিজের অনেকটা দূরে সরিয়ে দিল। ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ফের বলল,

‘ তুই লাগাম ছাড়া জানতাম। তাই বলে আমার হাজব্যন্ডের ব্যাপারেও এটা দেখাবি সেটা জানতাম না৷ আই হেট ইউ লুনা, আমার সৌধ ভাইকে নিয়ে এমন একটা শব্দ তুই বলবি কখনো ভাবিনি। আই জাস্ট হেট ইউ। ‘

কথাগুলো বলেই প্রায় ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল সিমরান। লুনা হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কী এমন বলল সে? যে সিনু তাকে আই হেট ইউ বলল। আশ্চর্য! একটা ছেলেকে এত স্ট্রাগল করে বিয়ে করলি। অথচ বাসর রাতে সে তোর সাথে বাসরই করল না। কেন করল না? পাশে একটা যুবতী মেয়ে শুয়ে থাকলে অটোমেটিকলি যুবক ছেলেদের দেহে সুড়সুড়ি জাগে৷ তোর বরের সুড়সুড়ি নেই বলেই তো তোকে কিছু করেনি৷ করলে নিশ্চয়ই আমি এভাবে বলতাম না। ঢং। প্রেমে পড়ে মাথা তো গেছেই। শখ, আহ্লাদও বিসর্জন দিয়ে দিছে। মুখ বাঁকালো লুনা৷ বুঝে গেল এই মেয়ে এখন আর তার সঙ্গে কথা বলবে না। যতক্ষণ না রাগ কমবে৷ তাই মিটিমিটি হাসতে হাসতে রিকশা ডাকল। রিকশায় ওঠার পর হঠাৎ মনে পড়ল সিনুকে আসল কথাটাই বলা হয়নি। সে যে তার ড্যাম কেয়ার চাচা শশুরের প্রেমে পড়েছে। এ খবর জানানো হয়নি। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল লুনা। তাহানীকে পটিয়ে ওর আব্বুর পার্সোনাল ফোন নম্বর কালেক্ট করে নিয়েছে। আগে পটাবে পরে বান্ধবীকে জানাবে৷ সে পর্যন্ত ওর মন থেকে তার প্রতি ঘৃণা কমে আসুক। রিকশা চলতে লাগল। লুনা ভাসতে লাগল নব্য প্রণয়ের বাতাসে। বরাবরই তার অল্প বয়সী ছেলেদের প্রতি বিতৃষ্ণা। সেই যে প্রথম এক অল্পবয়সের তরুণ থেকে ধোঁকা পেল, খেল প্রেমে কঠিন এক ছ্যাঁকা। এরপর আর প্রেমে পড়া হয়নি। সে সব সময় খুঁজেছে ডিফ্রেন্ট কাউকে। যার হৃদয় ভেঙেছে। প্রিয়জন হারিয়ে যে গভীর শোকাহত। সুলল চৌধুরীই সেই মানুষ। যাকে দেখে তার হৃদয়ে টান পড়েছে। ভারিক্কি দেহের, গম্ভীর মুখের আড়ালে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক ওই মনটাকে ভীষণ ভালো বেসে ফেলেছে। পরিহিত শার্টের কলার ঠিক করতে করতে লুনা ভাবল, সবই ঠিক আছে৷ হবু শশুর বাড়ির সবাইকে পছন্দ হয়েছে তার। অপছন্দ শুধু, হবু ভাতিজা সৌধ, আর বুড়িটা! আচমকা জিভ কাটল লুনা। শব্দটা শুধরে নিয়ে বলল, হবু শাশুড়ি আম্মাটা।
.
.
সকাল থেকে সন্ধ্যা অবিরাম বৃষ্টি ঝরল। সন্ধ্যার পর থেকে সে বৃষ্টি রূপ নিল তুমুল বর্ষণে। রাত বাড়তে বাড়তে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে প্রকট বজ্রপাতের শব্দও শোনা গেল। দীর্ঘমাস উত্তপ্ত আবহাওয়ায় কাটানোর পর হঠাৎ এই বৃষ্টিমুখর পরিবেশ, হিম ধরা আবহাওয়ায় সকলের দেহ, মনে আর্দ্র আরাম বোধ হলো৷ রাতের খাবার খেয়ে যে যার মতো চলে গেল উষ্ণ, নরম বিছানায়। প্রশান্তিময় একটি ঘুম দেবে বলে। কেবল ঘুমাতে গেল না, আইয়াজ, ফারাহ, সৌধ, সিনু আর সুহাস৷ তারা সকলে মিলে গোপন বৈঠক বসাল সুহাসের ঘরে। আকস্মিক বন্ধুদের এমন গোপন আসর বসানোর মানে টের পেল না সুহাস৷ যেহেতু ফারাহ, আর সিনুও উপস্থিত সেহেতু গভীর করে কিছু ভাবলও না৷ সে ভীষণ আয়েশ করে ডিভানে বসে ফোন হাতে নিল। দেখল, প্রাচীর ম্যাসেজ – ‘ দোস্ত পৌঁছে গেছিরে। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়েই ঘুম দিব৷ ‘ প্রাচীর ম্যাসেজটা নিজে পড়ে সকলকে জানালো,

‘ প্রাচী পৌঁছে গেছে। ‘

কথাটা বলে তাকাল সবার দিকে। কেউ যেন এ বিষয়ে আগ্রহই দেখালো না। তার মনে হলো সবাই অন্য জগতে বিভোর। নিমেষে কপালে ভাঁজ পড়ল সুহাসের। তার ছোটো ছোটো ধূসর রাঙা চোখ জোড়া আরো ছোটো হয়ে গেল। ফারাহ স্তব্ধ মুখে তার বিছানায় বসে আছে। পাশে সিনু। বোনের মুখটাও ভীষণ থমথমে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে এমন একটি ভাব। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে সুহাসের। বলে,

‘ কী হয়েছে রে সিনু? কোনো সমস্যা। ‘

সিনুকে প্রশ্নটি করলেও তাকায় টি টেবিলের ওপর বসে থাকা আইয়াজের দিকে। মুখ ভাড় আইয়াজের। টের পেল ওর ভীষণ মন খারাপ। পাশাপাশি মারাত্মক দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে। আইয়াজকে কিছু প্রশ্ন করতে উদ্যত হবে অমনি কাঁধে বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া পেল। মৃদু চমকে তাকাতেই সৌধর গুরুগম্ভীর মুখটা ভেসে ওঠে। এ পর্যায়ে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে সুহাস৷ কেন যেন তার অবচেতন মনে ভয়ের সঞ্চার হয়৷ আমতা আমতা করে বলে,

‘ কী হয়েছে বল তো? ‘

সৌধ ছোট্ট একটি ফাইল উঁচিয়ে ধরে। তাকায় সিমরানের দিকে। মেয়েটা বহু কষ্টে নিজের ইমোশন ধরে রেখেছে। সুহাসের ঘরে আসার আগে সিমরানের ঘরে মিটিং হয়েছে একঘন্টা। সব শুনে, নিজ চক্ষে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় সিমরান৷ উত্তেজনায় দেহ কাঁপতে শুরু করে ওর। অবিশ্বাসে, বিস্ময়ে একাকার হয়ে রয়৷ রাগ, দুঃখ, আফসোস ঘিরে ধরে। তাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসতে চলেছে! তার ভাবিপু প্র্যাগনেন্ট! ভাইয়া বাবা হবে, সে ফুপি হবে, আব্বু দাদান আর আম্মু দাদুনি। নিমেষে মুখে ওড়না চেপে ডুকরে ওঠে সিমরান। তাকে সামলায় সৌধ, ফারাহ। বুঝিয়ে, শুনিয়ে কান্না থামায়। কারণ এখন তাদের কাঁদলে চলবে না৷ এতবড়ো একটি খুশির খবর থেকে সুহাস বঞ্চিত। বঞ্চিত নিজের অধিকার থেকেও। সুহাসকে খুশির খবর জানাতে হবে। ওর অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আর এর জন্য তাদের সবাইকে এখন সুহাসের পাশে থাকতে হবে, সাপোর্ট দিতে হবে৷ সিনু যেমন অবুঝ তেমন বুঝদারও। সৌধ যখন তাকে শান্ত ভাবে শীতল কণ্ঠে বুঝাচ্ছিল। মাথায় দিয়েছিল ভরসা ভরা একটা হাত। কান্না থামিয়ে অনুভূতি লুকিয়ে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল সে৷

সৌধ যখন তাকায় সিমরান ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেবে প্রায়। ত্বরিত সৌধ দৃঢ় দৃষ্টিতে তর্জনী উঁচিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে তাকে চুপ থাকতে বলে। ইশারায় বোঝায়, সুহাসের পাশে এসে বোস। কিয়ৎক্ষণ পেরিয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে সিমরান গুটিগুটি পায়ে এসে বসে ভাইয়ের পাশে। সুহাস অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বোনের দিকে। পরোক্ষণেই খেয়াল যায় সৌধর হাতে থাকা ফাইলটায়৷ সৌধ মৃদুস্বরে বলে,

‘ মাথা ঠান্ডা রেখে, মন শান্ত করে এটা দেখ। ‘

সৌধ কথাটা বলতেই পাশ থেকে কাঁপা স্বরে সিমরান বলে,

‘ আমি ফুপি হতে চলেছি ব্রো। আর তুমি পাপা! ‘

আচম্বিতে বৈদ্যুতিক ঝটকা লাগে সুহাসের বুকে। তার ছোটো ছোটো চোখ দু’টোর আকার বড়ো হয়ে যায়। সিমরানের মুখ নত৷ কাঁপছে সে। সুক্ষ্ম চোখে বোঝা গেল মেয়েটা কাঁদছে। বারকয়েক পলক ফেলে সুহাস৷ নিঃশ্বাসে উদ্যেগ নেই। চোখে শুধু কিঞ্চিৎ বিস্ময়৷ সে অল্প বিস্ময়ই বিস্তর হয় যখন এপাশ থেকে সৌধ বলে,

‘ কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত, বাবা হচ্ছিস৷ কংগ্রাচুলেশনস টু মি একসঙ্গে চাচা, ফুপা দু’টোই হচ্ছি। ‘

টি টেবিল সহ এগিয়ে এলো আইয়াজ। সুহাসের মুখোমুখি হয়ে বসে বলল,

‘ কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত। ‘

এরপর স্মিত হেসে সৌধকে বলল,

‘ আমিও চাচা হওয়ার পাশাপাশি খালু হচ্ছি। ফারাহ তো সম্পর্কে খালাই হবে, না? ‘

আইয়াজের কথা শুনে চোখে জল এসে গেল ফারাহর৷ নিরবে সে জলটুকু মুছে নিয়ে তাকাল সুহাস ভাইয়ের দিকে। বোন এবং বন্ধুদের কথা শুনে বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল সুহাসের৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শেষ আশ্রয় হিসেবে তাকাল ফারাহর দিকে। ফারাহ মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। অর্থাৎ সবাই যা বলছে সব সত্যি। মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠল সুহাসের৷ অনুভব করল তার বুকের ভেতর কিছু একটা কাঁপছে। কণ্ঠনালী শুঁকিয়ে রুক্ষ। বহু কষ্টে একবার ঢোক গিলল। হাতে থাকা ফাইল ঘেঁটে দেখতে শুরু করল তৎক্ষনাৎ। এতক্ষণ ধরে দু’কানে যা সব শুনছিল তার সত্যতা মিললে তীব্র উত্তেজনায় হাত, পা কাঁপতে শুরু করল ছেলেটার৷ বুকজুড়ে কী ভীষণ সুখ সুখ সুবাস! অদ্ভুত এক আনন্দানুভূতিতে ডুবে গেল মন৷ বাবা, শব্দটি ছোট্ট। অথচ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবী সমান সব গভীরতা। বাবার ছায়াতলে থাকা ছেলেরাও একসময় বাবা হয়ে যায়। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরশিরানি অনুভব করল সুহাস। দীর্ঘসময় একটা ঘোরে থেকে তীব্র উত্তেজনায় ভোগার পর যখন রিপোর্টে থাকা তারিখে চোখ পড়ে নিমেষে থমকে যায় । নামী প্র্যাগনেন্ট, মা হতে চলেছে নামী আর সে বাবা। এই রিপোর্ট গুলো সেদিনের। যেদিন নামী আর তার মাঝে তুমুল ঝগড়া হয়। নামী সারাদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলে সেই ঝগড়া বিধ্বস্ততায় রূপ নেয়। সে রাগের বশে গায়ে হাত তুলে নামীর! মস্তিষ্কে রক্ত ছলকে উঠে সুহাসের। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয় তীব্র। স্তম্ভিত মুখাবয়ব নিয়ে তাকায় সৌধর পানে৷ সৌধ দেখে সুহাসের চোখ দু’টো রক্তিম আভায় ভরে ওঠেছে৷

গুমোট একটা পরিস্থিতি। নিজেকে কোনোমতেই স্থির করতে পারছে না সুহাস৷ বারবার, বারবার নামীর প্র্যাগ্নেসি রিপোর্ট গুলো দেখছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট দেখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বন্ধুর দিকে। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না নামী তার সন্তানের মা হতে চলেছে। এরচেয়েও বেশি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এমন একটা সময় নামী তাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে। একটা মেয়ে কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? প্রশ্নটি মাথায় আসতেই ঘেমে ওঠে সুহাস। আকস্মিক ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে,

‘ এটা কোথায় পেলি তোরা? ‘

তার এক চিৎকারে সিমরান, ফারাহ দু’জনেরই রূহ কেঁপে ওঠে৷ সৌধ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। আইয়াজ খুলে বলে কীভাবে ফারাহ রিপোর্টটা পেল। অসহনীয় হয়ে ওঠে সুহাস। রিপোর্ট গুলো সিমরানের দিকে ঠেলে দিয়ে দু-হাত মুঠো করে নিজেকেই আঘাত করতে শুরু করে আর বলতে থাকে,

‘ আমার সাথে এটা কেন হলো! ও কেন এটা করল আমার সাথে। নামীইইই! ‘

আইয়াজ এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। সৌধ উত্তেজিত গলায় বলে,

‘ সুহাস শান্ত হো। সব সময় মাথা গরম করে উল্টাপাল্টা কাজ করিস বলে তোকে ভুগতে হয়। প্লিজ দোস্ত এবার অন্তত মাথা ঠান্ডা রাখ। মাথা গরম করলে কিচ্ছু সমাধান হবে না। ‘

আইয়াজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে সুহাস৷ ভাইয়ের করুণ অবস্থা। অসহায় আর্তনাদ শুনে সিমরানের চোখ বেয়ে অবিরত জল গড়াচ্ছে। চোখ, মুখ ভয়াবহ লাল। সৌধ খেয়াল করে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ সিনু, ঘরে যা৷ আমরা সুহাসকে সামলাচ্ছি। ‘

কথা শুনল না সিমরান। সৌধ এবার ফারাহর দিকে তাকাল। বলল,

‘ সিনুকে নিয়ে বাইরে যাও ফারাহ। আমরা সুহাসকে সামলে নিব৷ ‘

ফারাহ বুঝতে পারল৷ তাই তাদের স্পেস দিয়ে জোরপূর্বক সিমরানকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সৌধ হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। দুই, ভাই বোন এত বেশি ইমোশনাল। একজন আরেকজন সামলাবে তো দূরের কথা। দু’জন দু’জনের গলা জড়িয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছিল! মনে মনে কথাগুলো বলেই সুহাসের দিকে তাকাল। সিমরান চলে যাওয়ার পর আইয়াজ বসেছে ওপাশে। সুহাস একটু থামলেও উদ্ভ্রান্তের মতো কী সব বিলাপ করছে। সৌধ ডাকতেই সে চিৎকার করে ওঠল,

‘ নামী এত বড়ো বেইমানি কী করে করল আমার সাথে? মানছি সেদিন আমার আচরণ উগ্র ছিল৷ মা মারা যাওয়ার পর বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না আমাকে নিয়ে মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়নি বলে। আর এর জন্য নামী দায়ী৷ ও কি অস্বীকার করতে পারবে ওর কোনো ভুল নেই? সবকিছুর পরও আমি ওকে ভালোবেসেছি সৌধ৷ আমি ওকে কতটা ভালোবেসেছি ও বুঝল না৷ ও শুধু আমার উগ্রতাটুকুই দেখল৷ ভালোবাসা, যন্ত্রণা কিচ্ছু দেখল না। আর শেষ পর্যন্ত দিয়ে গেল এতবড়ো একটা শাস্তি! ‘

কথাটা বলেই তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল। প্রলাপ করতে লাগল,

‘ আমি নামীর কাছে যাব। আমি আমার বাচ্চার কাছে যাব৷ নামী এতবড়ো শাস্তি আমাকে দিতে পারে না। আমি এতটা আঘাত পেতে পারি না। নামী আমার সাথে স্বার্থপরতা করতে পারে না৷ ও এতটা পাষাণ হতে পারে না। ‘

সুহাসের অবস্থা দেখে সৌধ আইয়াজ দু’জনি দুদিক থেকে কাঁধ চেপে ধরে বসিয়ে দিল ওকে। আইয়াজ থমথমে স্বরে বলল,

‘ কীভাবে যাবি নামীর কাছে? ও তো দেশেই নেই। ‘

সৌধ দৃঢ় গলায় বলল,

‘ সুহাস মাথা ঠান্ডা কর। নামী এখন অ্যামরিকায় আছে। চাইলেই এই মুহুর্তে সেখানে যাওয়া সম্ভব না৷’

আচমকা সামনে থাকা টি টেবিলটায় ভয়ংকর এক লাত্থি বসিয়ে দিল সুহাস৷ টেবিল ছিটকে বিছানার সাথে ধাক্কা খেয়ে শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে রইল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,

‘ কী করে মাথা ঠান্ডা রাখব আমি? নামী আমার সন্তানে মা হতে চলেছে। আর সেটা আমাকে না জানিয়ে চোরের মতো এদেশ থেকে পালিয়ে গেছে। ছাড়ব না ওকে আমি, জাস্ট ছাড়ব না। আমার ভালোবাসা, ইমোশন সব নিয়ে খেলেছে ও। কিন্তু আমার সন্তানকে নিয়ে খেলা করতে দিব না৷ ‘

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সৌধর। তড়াক করে ওঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত কোমরে রাখল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিয়ে আইয়াজের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ ডাফারটাকে তুই বোঝা। আমার হাত নিশপিশ করছে ওর মুখে ইচ্ছে রকম কয়টা ঘু ষি দিতে। ‘

হকচকিয়ে গেল আইয়াজ। চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

‘ আহা তুই মাথা গরম করলে চলবে? ‘

সৌধকে প্রশ্নটা করেই সুহাসের পিঠে হাত বুলাতে শুরু করল আইয়াজ। বলল,

‘ দোস্ত যা সিচুয়েশন মাথা গরম করে লাভ হবে না৷ একটু ঠান্ডা হো প্লিজ। ‘

সৌধ রাগান্বিত হয়েই সুহাসকে পিঞ্চ করল,

‘ ঠিক সময় নামীর কাছে পৌঁছাতে না পারলে তোর সন্তান নিয়ে নামীই আগে খেলা করবে। মুখে বড়ো বড়ো কথা আর তেজটাই আছে৷ তুই আমার বন্ধু, পেশায় ডাক্তার এসব ভাবতেই লজ্জা করছে। কী পরিমাণ অকর্মণ্য হলে একজন পুরুষের বউ গর্ভবতী হয়ে বাচ্চা নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে অ্যামরিকায় চলে যায়। আর সে সেটা জানতেই পারে না। আশ্চর্য! দোষ তো নামীর না, দোষ তোর৷ তুই কেমন পুরুষ যে বউকে কন্ট্রোল করতে পারিস না? কই আয়াজের বউ তো গেল না। তোর বউ কেন গেল? ‘

মাথা দপদপ করছে সুহাসের। সৌধ থেমে গেল। আইয়াজ হতভম্ব মুখে বসে। অনেক সময় পিনপতন নীরবতা চলার পর সুহাস মুখ খুলল,

‘ নামীর জেদ বেশি সৌধ৷ আমারো খামখেয়ালিপনা আছে। সেটা স্বীকার করছি৷ তাই বলে ও এভাবে ঠকাবে আমায়? ওই সন্তানটা তো ওর একার না। ‘

কথাটা বলেই আকস্মিক কেঁপে ওঠল সুহাস। ভীত গলায় বলল,

‘ এক মিনিট! নামী বাচ্চাটাকে রেখেছে তো? এমন তো নয় ও আমার ওপর জেদ করে মিসকারেজ করিয়ে তারপর অ্যামরিকায় চলে গেছে! ‘

ধমকে ওঠল সৌধ। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

‘ ইম্পসিবল। নামীর দ্বারা এটা সম্ভব না। ‘

তীব্র ক্ষোভ আর তাচ্ছিল্য সহকারে সুহাস বলল,

‘ ওর মতো নিষ্ঠুর, পাষাণ চরিত্রের মহিলার পক্ষে সবই সম্ভব। ‘

ক্ষুব্ধ হয়ে এ কথা বললেও মনে আশার আলো ঠিকই রয়ে গেল সুহাসের৷ ঝাপসা চোখে তাকাল সৌধর পানে। অনুনয়ের স্বরে বলল,

‘ দোস্ত আমার নামীকে চাই, ওর গর্ভের বেবিকে চাই আমার। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৬|
বৃষ্টি থেমেছে। জানালার থাই গ্লাসে বৃষ্টিফোঁটাদের চিহ্ন রয়ে গেছে। সেদিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে অজস্র চিন্তায় নিমজ্জিত সিমরান। এ পৃথিবীতে আগত সবকিছুই বিদায়বেলা চিহ্ন রেখে যায়। পৃথিবীতে বৃষ্টি নেমেছিল। সে বৃষ্টি থেমেও গেছে। রেখে গেছে জানালার থাই গ্লাসে চিহ্ন। ঠিক তেমনি নামী এসেছিল সুহাসের জীবনে। চলেও গেছে। চিহ্ন হিসেবে রেখে গেছে এক গুচ্ছ ভালোবাসাময় স্মৃতি। শুধু কি চিহ্ন রেখেই গেছে নিয়ে যায়নি? সুহাসের ভালোবাসা, রাগ, জেদ, অভিমান, অপমানের পাশাপাশি আরো অনেক বড়ো একটি চিহ্ন নিজের ভেতর নিয়ে যায়নি? গিয়েছে তো। এ পৃথিবীতে এখন তাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যা ঠিক তাই চিহ্ন হিসেবে নিয়ে গেছে নামীপু। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান৷ শান্ত দৃষ্টিতে দরজার পানে তাকাল। খোলা দরজা। দৃষ্টি যতটুকু যায় ততটুকুই দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। সৌধ ভাই বোধহয় আসবে না৷ তার ভাইটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি পাগলামি করছে? প্রিয় বন্ধুকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সৌধ আর আইয়াজ ভাই৷ বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল সিমরান৷ হাই তুলতে তুলতে ভাবল, সে ঘুমিয়ে পড়বে। মনটা ভারাক্রান্ত, দেহটাও আর সায় দিচ্ছে না। চোখ দু’টো খুলে রাখা দায় হয়ে পড়ছে। ধীরস্থির ভাবে হেঁটে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল৷ ফিরে আসার পথে বাঁধা পেল মনে। রাত এখনো শেষ হয়নি। কেবল মাঝরাত। যদি সৌধ ভাই তার ঘরে আসে? আকস্মিক সিমরান অনুভব করল, তার বুকে শীতল শিহরণ বইছে। সময় কী নিদারুণ ভাবেই না বদলে যায়৷ এতদিন সে এ বাড়িতে এ ঘরে রাজত্ব করে বেরিয়েছে। এ বাড়ির মেয়ে সে৷ এ ঘরটা তার একদম নিজস্ব। অথচ আজ ঘুমাতে গেলেও ভাবতে হচ্ছে। দরজা আটকাতে গেলেও বোধ করছে দ্বিধা। এটাকেই কি বলে দায়বদ্ধতা? ভালোবাসা থাকলে সব ধরনের দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেও শান্তি। সহসা ঘুরে গিয়ে দরজা খুলে ত্বরিত বিছানায় চলে এলো। সে এখন ঘুমাবে। যদি সৌধ ভাই আসে তাহলেও সমস্যা নেই। সে দরজা খোলাই রেখেছে। ওই মানুষটার জন্য তার মনের দরজা, ঘরের দরজা সব সময় খোলা। ভাবতে ভাবতে মনের কোণে মৃদু সুখ ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি বজায় রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
.
.
সুহাসের বিছানাটা আলিশান৷ হাত, পা মেলে দিয়ে তিনজন অনায়াসে ঘুমাতে পারবে৷ তাই তিন বন্ধুর পাশাপাশি শোয়াতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। দীর্ঘ একটা সময় পর শান্ত হয়েছে ছেলেটা৷ বলা যায় সৌধ আর আইয়াজ মিলে শান্ত করেছে ওকে। রাত গভীর হতে হতে এক পর্যায়ে শান্ত হয় উন্মাদ সুহাস৷ কিন্তু দু-চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে নোনাপানির ধারা। তিন বন্ধুর মাঝে সুহাস সবচেয়ে ডানপিটে স্বভাবের হলেও মনের দিকে প্রচণ্ড দুর্বল। এই দুষ্টুমি, অবুঝ রাগ আর দুর্বলতা গুলো আজ যেন ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখের সামনে সুহাস এভাবে ভেঙে পড়বে আর সৌধ, আইয়াজ সেটা দেখে চুপ থাকবে? এমনটা হতেই পারে না৷ তাই তো দু’জনই অর্ধাঙ্গিনীর কাছে না ফিরে বন্ধুর কাছে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল। সুহাসও লম্বা একটা সময় স্থবির হয়ে শুয়ে থাকার পর অকস্মাৎ মুখ খুলল। সেদিন তার আর নামীর মাঝে কী কী ঘটেছিল বিবৃতি করল সবটা। সৌধ পুরো ঘটনাটিই জানত। তাই ওর মাঝে নতুন করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কিন্তু আইয়াজ ঘেমে ওঠল। মৃদু ক্রোধ প্রকাশ করে বলল,

‘ এই রাগটাই তোর সব খাচ্ছে! আর গায়ে হাত তুলতে গেছিস কোন দুঃখে? কার গায়ে হাত তুলেছিস! তোর বউ নামী। ভাই, মেয়েটাকে এখনো চিনতে পারিসনি তুই। নামী কোন ধরনের মেয়ে এটা যদি এখনো না বুঝিস তবে তো ওর তোকে ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো। শোন সুহাস, মুখ থাকলেই সব বলা যায় না৷ গায়ে জোর থাকলেই সবকিছু করা যায় না। তুই ভুল করেছিস। বউ হচ্ছে আদরের জিনিস। তাকে আদরে রাখতে হয়। নারীদের কোমলপ্রাণ। তাদেরকে সব সময় কোমল আচরণই দিতে হয়। রাগ, দেখিয়ে ব কাব কি করে, মারধর করে বউকে না ধরে রাখা যায় আর না বউয়ের মন পাওয়া যায়। আর তোর বউ এমনিতে শান্তশিষ্ট হলেও প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়ে। যেমন একরোখা, তেমন জেদি। তাই এগুলো মাথায় রেখে বিবেচনা করে চলা উচিত ছিল। ‘

এক নিঃশ্বাসে বলা আইয়াজের কথা গুলো শুনে
সহমত পোষণ করল সৌধ। আইয়াজ ক্রোধান্বিত হয়ে কথাগুলো বললেও ওর কণ্ঠস্বর নিচে ছিল বলে সেগুলো স্বাভাবিকই শোনালো। সুহাস মন দিয়েই শুনল ওর কথা। এরপর সৌধ বলল,

‘ আমি সম্পূর্ণ দোষ আমার বন্ধুকে দিব না। কারণ এই পৃথিবীতে সব মানুষ সমান বোঝদার হয় না। সুহাসের উচিত হয়নি নামীর ক্যারেক্টার নিয়ে প্রশ্ন তোলার। নিঃসন্দেহে এটা ভুল। গায়ে হাত তুলেও অপরাধ করেছে। তাই নামীর অ্যাকশন এভাবে না নিয়ে অন্যভাবে নেয়া উচিত ছিল। যাইহোক এখন অনেক উচিত, অনুচিত কথা আমরা বলবই। কাল সকালে যখন বাড়ির সবাই এসব জানতে পারবে তারাও নানারকম মন্তব্য করবে৷ তবে সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়ালে আমরা নিজেরা কতটুকু উচিত কাজ করতে পারতাম তা অবশ্য জানা নেই। ‘

এ পর্যন্ত বলেই থামল সৌধ। সময় নিয়ে ফের বলল,

‘ নামীকে আমি বোন বলি। সে হিসেবে আমার বোনের গায়ে হাত তোলার জন্য, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য তোকে আমার মা রা উচিত সুহাস। আটকে গেছি দু’টো জায়গাতে, এক, বন্ধু আমার তুই, অপরাধ করে এতগুলো মাস ভুগছিস আজ থেকে ভুগান্তি আরো বেড়ে গেল। এতদিন বউয়ের জন্য মন কেঁদেছে এখন যোগ হলো বাচ্চার জন্য কান্না। মানসিক যন্ত্রণার উপর আর কোনো বড়ো শাস্তি আছে বলে জানা নাই। দুই নাম্বার হচ্ছে, তুই এখন সম্পর্কে সিনিয়র হয়ে গেছিস। ‘

তীব্র বিষাদ অনুভূতিও এক টুকরো হাসি দেখা দিল ওদের মাঝে৷ হঠাৎ তড়াক করে ওঠে বসল সুহাস৷ সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে সৌধ, সিনুর৷ আজ বিয়ের দ্বিতীয় দিন, দ্বিতীয় রাত। অথচ সৌধ কিনা তার বোনের কাছে না গিয়ে তার কাছে পড়ে আছে। ওরা দু’জন কাছাকাছি না থাকলে সম্পর্কটা এগুবে কী করে? নিজের জীবনে সমস্যা বলে সেই সমস্যায় সবাইকে জড়ানোর মানে হয় না। আইয়াজটাও বউ ছেড়ে তার কাছে পড়ে আছে। সে অনিচ্ছায় বউ ছেড়ে হাপিত্যেশে ম রে যাচ্ছে। আর এরা স্বেচ্ছায় বউ ছাড়া রয়েছে। ভেবেই সৌধর দিকে বিব্রত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘ সিনুর ঘরে যা সৌধ। ‘

থতমত খেয়ে গেল তিনজনই। নিমেষে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক করে ফেলল সৌধ৷ ওঠে বসে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ সিনু এখনো জেগে নেই। নিজের ঘরে, একান্ত বিছানায় নিজের মতো ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আপাতত তোর ঘর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না৷ তুই খুব একটা সুবিধার ছেলে না। এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। ‘

সৌধর কথা শুনে আইয়াজের দিকে তাকাল সুহাস। আইয়াজও ওঠে বসতে বসতে বলল,

‘ আমিও আজ ফারাহকে ফ্রি করে দিয়েছি। তোকে ফ্রি করে আপাতত যাওয়া সম্ভব না৷ যা ক্ষ্যাপাটে তুই। উল্টাপাল্টা করে বসলে নামী বিধবা হবে। আর হবু ভাতিজা/ ভাতিজি বাপ হারাবে। ‘

স্তব্ধ হয়ে গেল সুহাস। ওরা মজার সুরে কথাগুলো বললেও ওর ভেতরটা তোলপাড় শুরু হলো। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, নামী মা হতে চলেছে। আর এমন একটা সুখবর, রক্ত শীতল করা সংবাদ না জানিয়েই নামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে সুদূর অ্যামেরিকায়! সন্তর্পণে চোখ দুটো বুঁজে ফেলল সুহাস। নিশ্বাস ছাড়ল বড়ো বড়ো করে। অনুভব করল কাঁধে হাত রেখেছে সৌধ। আচমকা দৃষ্টি মেলে তাকাতেই ভরসার সঙ্গে সৌধ বলল,

‘ আমি জানি ভুল তুই করেছিস। সম্পূর্ণ দোষ তোর। কিন্তু নামীকে আমি সেভ সাইটে রাখতে পারছি না৷ তুই কেমন জানে ও। তাছাড়া সবকিছুর পরও তুই বাবা হতে যাচ্ছিস। তোরা স্বামী-স্ত্রী। তোর সন্তান ওর গর্ভে৷ ওর উচিত ছিল এটা তোকে জানানো৷ কী একটা কাণ্ড ঘটাল বলত। গর্ভের বাচ্চাকে মা একাই ক্যারি করে। নামীও করছে৷ কিন্তু সাপোর্ট হিসেবে তো স্বামীকে লাগে। পরিবারকেও প্রয়োজন হয়। ‘

নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহাস বলল,

‘ বেবি কনসিভ করলে মেয়েদের মুড সুইং হয় সৌধ। নামীরও হচ্ছিল বোধহয়। তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি। ওর মধ্যে অনেকরকম সিমটমস দেখা দিয়েছে। যা তখন খেয়াল না করলেও এখন করতে পারছি। হয়তো এজন্যই তখন ওর মাঝে রাগ, অভিমানটাই বেশি কাজ করেছে। ‘

‘ গ্রেট ইম্প্রুভমেন্ট! ‘

শব্দ দু’টো উচ্চারণ করেই পাশ থেকে আইয়াজ জাপ্টে ধরল সুহাসকে। সৌধর চোখ দু’টোও চকচক করতে লাগল। অনুভব করল, সুহাসের মাঝে এখন কোনো রাগ কাজ করছে না৷ এখন ওর মাঝে শুধু আবেগ, আর অনুতপ্ততা কাজ করছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সুহাস এখন বাবা হতে চলেছে। বাবারা উদার হয়৷ উদার হতেই হয় তাদের। প্রশান্তি ভরে শ্বাস নিয়ে মৃদু হাসল সৌধ। শুনতে পেল নিজে থেকেই সুহাস বলছে,

‘ আসলে কী বলব আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি আসলেই অমানুষ হয়ে গেছি সৌধ? আইয়াজ,
নামী নিশ্চয়ই আমাকে অমানুষ ভেবে কিছু জানায়নি। সেদিনের সেই আচরণ উফফ। ভাবতে পারছি না, আমাদের সন্তানও ছিল আমাদের মাঝে। মাই বেবি! ‘

তীব্র কষ্টে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল সুহাস। বলল,

‘ আচ্ছা ওর মায়ের মতো অও কি আমাকে খারাপ ছেলে ভাবল? অমানুষ ভাবল? ‘

পরোক্ষণেই চমকে গেল। বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে পলক ফেলল বারকয়েক। থেমে থেমে বলল,

‘ আমি সেদিন নামীর সাথে প্রচণ্ড চ্যাঁচামেচি করেছি। আচ্ছা ও কি ভয় পেয়েছে? পায়নি নারে। ওর মা তো খুব সাহসী। ও ওর মায়ের মতোই সাহসী হবে দেখিস। ‘

সুহাসের বুক কাঁপছে। চোয়াল দু’টোও কম্পমান। ঠোঁট দু’টো বার বার শুষ্ক হয়ে ওঠছে। যা ভিজিয়ে নিচ্ছে জিভ দ্বারা। বন্ধুর আবেগঘন কথা শুনে
আইয়াজের চোখ চিকচিক করে ওঠে। সৌধ ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শক্ত হাতে সুহাসের কাঁধ চেপে ধরে বলে,

‘ এত দুর্বল হলে চলবে না সুহাস। তোকে শক্ত থাকতে হবে। নিজের ভুলগুলো শুধরে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা এখন তোকে নামী অবধি পৌঁছাতে হবে, এট এনি কস্ট! ‘

‘ আমার মাথা কাজ করছে না। আমি ভুল করে ফেলেছি সৌধ। আমি আমার স্ত্রী, সন্তান দু’জনকেই কষ্ট দিয়েছি। নামী আমাকে ক্ষমা করবে না বলেই এভাবে দূরে চলে গিয়েছে। ও আমাকে অনেক বড়ো শাস্তি দিতে চায় সৌধ। ও আমাকে একেবারে নিঃশ্ব করে দিতে চায়। আমি নিঃশ্ব হতে চাই না। প্লিজ নামীকে বোঝা। ‘

মাথা নিচু করে কাঁপা স্বরে কথাগুলো বলতেই হঠাৎ সৌধ বলল,

‘ কাল সকালে তোর শশুরের সাথে যোগাযোগ করবি। যতদ্রুত সম্ভব ভিসা রেডি করে চলে যা অ্যামরিকায়। ফিরে আয়, নামী আর বাচ্চা দু’জন নিয়ে। ‘

চোখ দু’টো জ্বলে ওঠল সুহাসের৷ দপ করে মাথা তুলে টলমল দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ল।
.
.
স্বভাবসুলভ ভোরবেলা বিছানা ছাড়ল সৌধ৷ সারারাত তিনজনের কারোরি ঘুম হয়নি। শেষরাতে চোখ বুঁজলেও প্রকৃতপক্ষে কেউ ঘুমাতে পারেনি। শরীরচর্চা আজ করা হবে না৷ তাই ঘরের বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় হাঁটাহাঁটি করল সৌধ। এরপর ধীর পায়ে চলে এলো সিমরানের ঘরে। ভেবেছিল দরজা বন্ধ। নক করতে হবে। কিন্তু না বুঝতে পারল, দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছে। তবে কী সিনু অপেক্ষায় ছিল তার জন্য? এক মুহুর্ত থমকে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরের বাতি জ্বালানো। দরজাটাও খোলা। যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল সৌধর। ঘরে ঢুকতেই দৃষ্টি চলে গেল বিছানায়। নিমেষে দৃষ্টি সরিয়ে বিব্রত ভাবে বেলকনির দিকে চলে গেল৷ শুধুমাত্র একটি টিশার্ট আর ঢিলে পাজামা পরিহিত সিমরানের। আরামদায়ক এই পোশাকটা পরেই ঘুমিয়েছে সে। ঘুমের ঘোরে পাজামা উপরে ওঠে গেছে, ঢিলেঢালা টি-শার্টের লম্বা গলার জন্য বুকের কিঞ্চিৎ অংশ দৃশ্যমান৷ প্রথম দফায় স্ত্রীর ঘরে ঢুকছি এমন মনোভাব নিয়ে ঢুকলেও পরবর্তীতে সিনুকে এমন এলেমেলো দেখে, ঘুমন্ত অবস্থায় দেহশ্রীর আকর্ষিক অংশ গুলোয় চোখ পড়তেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। এক মন বলল, উচিত হয়নি ঘরে ঢোকা। আরেক মন বলল, সিনু আমার বউ, অনুচিতই বা হবে কেন? নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেকটা সময় লাগল সৌধর৷ পুবাকাশে সূর্যের দেখা মিলেছে। চারপাশে ফিকে কমলা বর্ণটা ধীরেধীরে গাঢ় কমলায় পরিণত হচ্ছে। প্রকৃতিতে দৃষ্টি বুলিয়ে অকস্মাৎ সমস্ত আড়ষ্টতা ত্যাগ করে ঘরে গেল সৌধ। তাকাল সিমরানের দিকে। গতকাল কেমন গুটিশুটি মেরে শুয়েছিল তার ঘরে আজ নিজের ঘর, নিজের বিছানা পেয়েই সমস্ত জড়তা ভুলে নিজ ছন্দে ঘুমুচ্ছে। বাঁকা হাসল সৌধ। ধীরপায়ে এগুলো বিছানার দিকে। সিনু নিঃসন্দেহে সুন্দরী আর অনেক বেশি আদুরে। কিন্তু ঘুমুন্ত অবস্থায় ওর সেই সৌন্দর্যের মাত্রা এতবেশি বেড়ে যায় জানা ছিল না। পিচ্চি পিচ্চি আদলের এই ঘুমন্ত মেয়েটা এখন তার বউ৷ ভাবতেই বুকের ভেতর অচেনা তরঙ্গ বইতে লাগল। বিছানার একপাশে থাকা পাতলা চাদরটা টেনে ত্বরিত জড়িয়ে দিল সিমরানের শরীরে। না হলে পরিপূর্ণ ভাবে তাকাতে পারছে না। শত হোক আবেদনময়ী তরুণী দেহশ্রী। তার মতো প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবকের চোখ সেখানে পড়লে শরীরের রক্তকণিকা ছুটোছুটি করবেই। বউয়ের শরীর ঢেকে দিয়ে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সৌধ৷ এরপর দৃঢ় গলায় ডাকতে আরম্ভ করল,

‘ সিনু, অ্যাঁই মেয়ে। ওঠ, সকাল হয়ে গেছে৷ বেলা করে ঘুমানো শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। ‘

নড়েচড়ে ওঠল সিমরান৷ হালকা সজাগ হয়েছে বুঝতেই গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করল সৌধ। বলল,

‘ ওঠে যা। এখন থেকে রোজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠবি৷ নামাজের অভ্যেস করতে হবে, শরীরচর্চা করতে হবে। বেলা বাড়িয়ে ঘুমিয়ে জীবন কাটানো যাবে না। ‘

চোখমুখ কুঁচকে ওঠে বসল সিমরান৷ ঘুম ছাড়িয়ে হাত, পা ছেড়ে বিরক্ত মুখে চোখ খুলতেই চোখের সামনে সৌধকে আবিষ্কার করল। নিমেষে কপালের সবগুলো ভাঁজ মিলিয়ে, ঘুম উড়ে গেল। শরীর ঝাড়া দিয়ে বসে স্তম্ভিত মুখে তাকিয়ে রইল। সৌধ ওর দিকেই তাকিয়ে। তাই টের পেল ওর ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি। মৃদু কেশে ওঠল সে। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,

‘ কফি ছাড়া সকাল শুরু হয় না আমার। তার ওপর সারারাত ঘুম হয়নি। মাথাটা ধরে আছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবি৷ কফি তো বানাতে পারিস? ‘

ত্বরিত মাথা ঝাঁকাল সিমরান। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওঠে দাঁড়াল সৌধ। বলল,

‘ অকে, দু মগ কফি নিয়ে আয়। বেলকনিতে বসে খাব। আর প্রাথমিক কিছু ব্যয়াম দেখাব ইউটিউবে। কাল থেকে এগুলো ফলো করবি। আমি যতদিন ছুটিতে আছি একসঙ্গে শরীরচর্চা করব। ‘
.
.
আইয়াজ আর ফারাহ ব্যাগপত্র রেডি করে বাড়ির সকলের থেকে বিদায় নিল। ওদের গাড়িতে ওঠিয়ে দিতে এগিয়ে এলো, বিষণ্ণ মুখের সুহাস৷ সৌধ আর সিমরানও এলো। ফারাহ সুহাস আর সৌধ ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে সিমরানের সামনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। কানে কানে বলল,

‘ নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা বনু। ধৈর্য রেখে শুধু ভালোবেসে যাও। আজ যতটুকু সেক্রিফাইস করছ কাল তারচে চারগুণ বেশি পাবে৷ কারণ তোমার নীতি ঠিক আর চয়েজটা মারাত্মক। ‘

আরক্ত মুখে হাসল সিমরান। বলল,

‘ দোয়া করো আপু। ‘

ফারাহ গাড়িতে ওঠে বসল। সৌধ আইয়াজকে বিদায় দেয়ার সময় বলল,

‘ টেনশন নিস না। আল্লাহ তায়ালা যখন চাইবে তোদের কোলজুড়েও ফেরেশতা আসবে। আর শোন, বউকে দূরে রাখিস না৷ চেষ্টা কর এক হসপিটালে থাকার। ‘

‘ করছিরে। টাকা, পয়সাও দিয়ে রাখছি। দু’জন এক জায়গায় থাকলে সুবিধা হয়। দূরে দূরে থেকে টাকা, পয়সার জন্য ছুটে জীবনে সংসার, পরিবার হয়ে ওঠে না৷ ‘

বুকে বুক মেলালো আইয়াজ, সৌধ। এরপর সুহাসের কাছে এসে সুহাসকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আইয়াজ বলল,

‘ চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘

বন্ধু, আর বন্ধুর বউ চলে গেলে সৌধ সিমরানকে বলল বাড়ির ভেতরে যেতে। সিমরান সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে গেল। সৌধ সুহাসের মুখোমুখি হয়ে বলল,

‘ ভেতরে গিয়ে আংকেলকে জানা বিষয়টা। আমি একটু বেরুচ্ছি। ‘

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুহাস ভেতরে চলে গেল। সৌধ তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে সেলফোন বের করে কল করল নিধিকে।

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৬২+৬৩+৬৪

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬২|

‘ বর এসেছে, বর এসেছে। ‘

চারিদিকে এহেন বাক্যে উচ্চরোল ভেসে এলো। ধক করে ওঠল তীব্র কষ্টে জর্জরিত কনের বুকখানি। তাকে ঘিরে রয়েছে সকলে। প্রাচী, ফারাহ আর কাজিনরা গেছে বরের গেট ধরতে৷ এমপি পুত্র, তার ওপর পেশায় একজন ডক্টর। কনে পক্ষের দাবি দেড় লাখ টাকা। তর্কবিতর্ক শেষে ছাড় দিতে পারে৷ তবে এক লাখের নিচে নামবে না। বর এসেছে ধ্বনি বাজতেই কনেকে ঘিরে থাকা সদস্যদের ভীড় কমতে শুরু করল। সিমরানও যেন বুক ভরে শ্বাস নিতে পারল এবার। ভীড় কমাতে স্বস্তি পেল ভীষণ। আশপাশে শুধু ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের পেল। খুঁজছিল সে লুনাকে। পেল না। সে দুলাভাই আর বেয়াইদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সৌধ লুনাকে পছন্দ করে না৷ কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয় সিমরান। কাল থেকে লুনাকে অনেক বুঝিয়েছে। সৌধ ভাই যেমন তার ভালোবাসার মানুষ। লুনাও প্রিয় বান্ধবী। বাজে স্বভাব আছে মেয়েটার৷ সেসবের পেছনেও রয়েছে তিক্ত অতীত। সবই জানে সে। তাই তো মেয়েটাকে ভালোবাসে। শত খারাপ অভ্যাস দেখেও দূরত্ব তৈরি করতে পারে না৷ সৌধর আদেশ অমান্য করা যেমন তার পক্ষে সম্ভব না। তেমনি লুনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাও অসম্ভব। তাই দু’দিক ঠিক রাখতে লুনাকে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। লুনা কথা দিয়েছে মেনে চলবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো পারবে না। তবে আগে যা জন সম্মুখে দ্বিধাহীন করে বেড়াতো। এখন তা করবে না৷ বন্ধুত্বের শক্তিতে দৃঢ় বিশ্বাস সিমরানের।

বধূ সাজে তরুণী। বুক ধুকপুক করছে। নিঃশ্বাসে বাড়ছে ক্রমশ অস্থিরতা। ধীরেধীরে চোখ দু’টো যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠল। লোভাতুর হলো মন৷ একরাশ লজ্জায় আরক্ত মুখে হঠাৎ ওঠে দাঁড়াল সে। লেহেঙ্গার দু’পাশ কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে ধরে মৃদু পায়ে চলে গেল বেলকনিতে। যেখান থেকে স্পষ্ট দৃশ্যমান বাড়ির প্রধান গেট। যেটা চমৎকার ডেকোরেশন করে বরের গেট বানানো হয়েছে। মধ্যস্থে ফুল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রশি। যে রশির ওপারে দাঁড়িয়ে আছে বরপক্ষ। এপারে কনে পক্ষ। বের বেশে সৌধ ভাইকে প্রথম দেখাতেই হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখতে লাগল সেই সুপুরুষকে। সগর্বে আজ যার নামে নিজেকে লিখে দেবে সে। ভেবেই সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠল এক চিলতে হাসি। অনুভব করল, বুকের ভেতরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে। এই কম্পন ভয়াবহ আকার ধারণ করার সম্ভাবনায় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো। অন্তঃকোণে প্রশ্ন জাগল, ‘ বিয়েতে কি প্রতিটা মেয়েই এমন নার্ভাস ফিল করে? নিজের মানুষটাকে আপন করে পাওয়ার তীব্র অনুভূতিতে তারই মতো ব্যাকুল হয়? ‘
.
.
সুজা এমপিকে আলাদাভাবে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হলো। তার সঙ্গে দু’জন দেহরক্ষী আর ছোটো ভাই সুললও আগেভাগে প্রবেশ করলেন। দু’জন পুলিশকে সর্বক্ষণ বাড়ির আশপাশে নজরদারির জন্য রাখা হয়েছে। যতক্ষণ না এমপি সাহেবের ছোটো পুত্র বিয়ে সম্পন্ন করে বউ নিয়ে স্মৃতিসৌধ নামে বাড়িতে পৌঁছায়৷ ততক্ষণ তারা তাদের দায়িত্ব থেকে এক চুলও নড়বে না। বর পক্ষের সঙ্গে কনে পক্ষের বাকবিতণ্ডা চলছে। আইয়াজ তালে আছে তার সুন্দরী বউকে নিজের দলে নিয়ে নেয়ার। কিন্তু ফারাহ যেন আটঘাট বেঁধেই হাজির হয়েছে। ওর মুখের ভাব, কথার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে সে আইয়াজকে চেনেই না৷ আজই নতুন দেখা। সুন্দর করে সাজুগুজু করার ফলে ফারাহকে দেখতে অত্যাশ্চর্য সুন্দরী লাগছে। আইয়াজের চোখে এমনিতেই সে বিশ্ব সুন্দরী। আজ তার ব্রাইডাল লুক আইয়াজের মাথাই ঘুরিয়ে দিল। তার বউ বোকাসোকা হলেও মারাত্মক রূপবতী জানত সে। কিন্তু আজকে কেন এত চালাক হয়ে গেল? কেন তার চোখের ইশারায় কাবু হচ্ছে না? ফারাহর পাশে থাকা প্রাচী আইয়াজের মনোভাব বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপে হাসল। আজিজকে বলল,

‘ এই আজিজ এখানে কি কেউ বউ নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েছে? ‘

ফারাহ লজ্জা পাচ্ছিল। তবু নিজের স্বামী আর তার বন্ধুদের নাস্তানাবুদ করতে পিছপা হলো না। প্রাচীর কথা শুনে এদিকে আজিজ চোখ বড়ো বড়ো করে, ঝগড়ার সুরে বলল,

‘ তোদের মেয়েলোকেদের এই গুণ হেভি। তোরা মুহুর্তেই গিরগিটির মতো পাল্টে যাস। ‘

এ পর্যন্ত বলেই আইয়াজের কাঁধ জড়িয়ে ধরল৷ কণ্ঠে মায়া মিশিয়ে বলল,

‘ আহারে আমার ইনোসেন্ট বন্ধুটার কত বড়ো সর্বনাশ হলো। বউও রঙ বদলালো। ‘

ফারাহর মুখ হা হয়ে গেল। আইয়াজ অসহায় চোখে তাকিয়ে। প্রাচী ত্বরিত ফারাহ কানে কানে বলল,

‘ এই এই একদম গলবে না। তোমাকে দুর্বল করতে এসব বলছে৷ আর তোমার বরটা কিন্তু কম সেয়ানা না বুঝছ? পাক্কা ধুরন্ধর। ইনোসেন্ট লুক দিচ্ছে তোমাকে কাবু করার জন্য। আমাদের দলের প্রত্যেককে শক্ত থাকতে হবে ফারাহ। বি কেয়ারফুল। তুমি আয়াজের দিকে তাকিয়োই না। ‘

প্রাচীর সতর্কবার্তা পেয়ে ফারাহ সত্যি সত্যি আর আইয়াজের দিকে তাকাল না। এরপর শুরু হলো তর্ক। সৌধ জানে বিয়ে বাড়িতে এসব খুবই সাধারণ ঘটনা৷ তবু কেন জানি বিরক্ত লাগছে। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ ঠেকছে। যেন ভেতরে গেলেই বাঁচে। তার পাশে স্মৃতি আপু, ভাবি দাঁড়িয়ে। তর্কবিতর্কে কান ধরে গেছে সবার৷ সৌধ অতিষ্ঠ হয়ে নিচু কণ্ঠে স্মৃতিকে বলল,

‘ আপা এদের থামা। ‘

স্মৃতি ভাইয়ের অবস্থা দেখে পার্স থেকে টিস্যু বের করল। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বলল,

‘ ভাই মুখটা এত গম্ভীর করে রাখছিস কেন? একটু হাসি হাসি রাখ। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সৌধর। আশপাশে তাকিয়ে সচেতন কণ্ঠে বলল,

‘ বরাবর যেমন থাকি তেমনি আছি আপা। ‘

‘ আরে ভাই বিয়ের দিনও এমন থাকতে হবে? ‘

সৌধ জবাব দিল না আর৷ স্মৃতি আপুও দমে গেল। তার হাজব্যান্ডকে বলল তর্ক থামিয়ে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। সৌধর দুলাভাই রায়ান আহম্মেদ মুক্ত এগিয়ে এলো। কনে পক্ষকে জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনাদের ডিমান্ড বলুন। ‘

দাঁত ক্যালিয়ে হাসল লুনা। প্রাচী খোঁচা দিল তাকে। লুনা বলল,

‘ এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। ‘

নিমেষে চটে গেল আজিজ। বলল,

‘ মামা বাড়ির আবদার? টাকা কি গাছে ধরে? ‘

লুনা বলল,

‘ আপনার বন্ধুর শালিকার আবদার। এখন টাকা গাছে ধরে নাকি মাটিতে গজায় তা আমার ডাক্তার দুলাভাই’ই বলতে পারবেন। ‘

হো হো করে হেসে ওঠল প্রাচী, ফারাহ, লুনা। বাকবিতণ্ডা চলল আরো কিছু সময়৷ এরপর সৌধর মুক্ত দুলাভাই চেক সাইন করে এগিয়ে দিলে কনে পক্ষ এবং পরিবেশ সবটাই ঠান্ডা হয়ে গেল৷ যদিও লুনাকে পছন্দ করে না সৌধ। তবু বউয়ের বান্ধবী হিসেবে তার হাতেই মিষ্টি মুখ করে ভেতরে প্রবেশ করতে হলো।
.
.
বর পক্ষদের আপ্যায়নে কোনো কমতি ছিল না। খানাপিনা শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল সকলে৷ উপরে কনের ফটোশুট চলছে। এছাড়া বিয়ের প্রায় প্রতিটি মুহুর্ত ভিডিয়ো করে রাখা হচ্ছে। এভাবে সময় গড়াল বেশ। এরপরই চলে এলো কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তটি। সকলের অনুমতি নিয়ে সিমরানকে নিচে নিয়ে আসা হলো। আকাশি নীল রঙা লেহেঙ্গা পরিহিত, ব্রাইডাল সাজে সিমরান যখন সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামছিল। দু’পাশে তার লেহেঙ্গা উঁচিয়ে ধরে সাপোর্ট দিচ্ছিল প্রাচী, ফারাহ৷ ক্যামেরা ম্যানও ছবি তুলতে তুলতে মুগ্ধ হয়ে গেল৷ উপস্থিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সিঁড়ির পানে। সৌধ বসে আছে তার জন্য বরাদ্দকৃত রাজকীয় সোফায়৷ যেখান থেকে অনায়াসে সিমরানকে দেখতে পাচ্ছে সে৷ বাকিদের মতো মুগ্ধতা নিয়ে সে প্রথমে না তাকালেও ধীরে ধীরে তার চোখ দু’টোয় মুগ্ধতা এসে ভীড় জমালো। বুকের ভেতর ছুঁইয়ে গেল শীতল স্পর্শ। সাধারণত বিয়েতে সবাই লাল টুকটুকে বউ সাজে। সিমরাম ডিফরেন্ট। সৌধর মনে হলো সারাজীবন নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে আলাদা ট্যাগ ধরে রাখাটা আজ সার্থক। কারণ তার বউ আর সবার মতো লাল টুকটুকে বউ হয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়নি। তার বউ যেমন হৃদয়ে তার জন্য আকাশসম ভালোবাসা পুষে রেখেছে। তেমনি আজ সর্বাঙ্গে ধারণ করেছে গোটা আকাশকে। আকাশি নীল পোশাকটাকে সৌধর কাছে ঠিক আকাশের মতোই মনে হলো। লেহেঙ্গা ছাড়া সিমরানের দেহের যে অংশ গুলো দৃশ্যমান সেগুলোকে মনে হলো শুভ্র মেঘ৷ আকাশের বিশালতা, প্রশান্তি, স্নিগ্ধতা, মুগ্ধতা সর্বস্বই যেন আজ আপাদমস্তক সিমরানে আবদ্ধ। বুকের গহিনে তীক্ষ্ণ এক স্পর্শ পেল সৌধ। মুগ্ধ চোখ দু’টো সন্তর্পণে নিচে নামিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল শব্দহীন। সিমরানকে ততক্ষণে তার মুখোমুখি এনে বসানো হয়েছে। দু’জনের মাঝখানে স্বল্প দূরত্ব রেখে সাদা রঙের একটি পাতলা পর্দা টানালো হলো চটপট। এরপর পরিবেশটা শান্ত আর সুস্থির হয়ে ওঠল। সুহাস স্তব্ধ মুখে এসে দাঁড়াল সৌধর পাশে। সৌধ বা’দিকে তাকিয়ে যখন সুহাসের অসহায়, রক্তিম চোখ দু’টো দেখল ভেতরটা নড়ে ওঠল ওর। মনে পড়ে গেল তার স্মৃতি আপার বিদায় মুহুর্ত। সুহাসের অনুভূতি তার চেয়েও গাঢ়। সবচেয়ে বড়ো কথা ছেলেটা একের পর এক ধাক্কা খেতে খেতে আজ আরো একটি ধাক্কার সম্মুখীন হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। হাত বাড়িয়ে সুহাসের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। স্মিত হেসে বলল,

‘ স্টে স্ট্রং দোস্ত। ‘

সহসা মৃদু কেঁপে ওঠল সুহাস। অনেকদিন পর প্রিয় বন্ধুর ভরসা মাখা বাণী, স্পর্শে অশান্ত মনটা শান্ত হলো কিঞ্চিৎ। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে ওঠল নিমেষে। ক্ষীণ গলায় বলল,

‘ কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছেরে। আমি জানি সিনুকে তুই অনেক সুখে রাখবি। তবু কোথাও একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। ‘

আলতো হাসল সৌধ। তার মতো করেই ক্ষীণ গলায় বলল,

‘ স্বাভাবিক। নিজেকে শক্ত রাখ। আর ভাব, নিজের খুব মূল্যবান সম্পদ, অতি যত্নের মানুষটাকে যার তার হাতে নয় তোরই প্রিয় বন্ধুর হাতে তুলে দিচ্ছিস।’

সৌধর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে মাথা নাড়ল সুহাস৷ এমন সময় সুজা চৌধুরী এলেন। ছেলের পাশে বসলেন। এগিয়ে এলো সোহান খন্দকারও। কাজি তৈরি৷ সবকিছু প্রস্তুত। এবার বিয়ে পড়ানো হবে। প্রথমে কনের তরফ থেকে কনের মামা গলার স্বর উঁচু করলেন৷ যাতে উপস্থিত সবাই শুনতে পায়। বললেন,

‘ তেরো লক্ষ তেরো টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া…আপনি, এমপি সুজা চৌধুরীর ছোট পুত্র ড.সৌধ চৌধুরী সোহান খন্দকারের একমাত্র কন্যা সাইয়্যারা সিমরান খন্দকারকে বিবাহ করিতে রাজি থাকিলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ‘

চারপাশ নীরবতায় আচ্ছন্ন। উপস্থিত প্রত্যেকে কান দু’টো সজাগ রেখে, উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পর্দার এপাশে বসে সিমরান৷ এতক্ষণ শুধু তার বুক ধুকপুক করছিল৷ এবারে সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। চোখ দু’টো নিচে নামিয়ে কান দু’টো সজাগ রাখল প্রিয়তম পুরুষটির মুখে তাকে কবুল করে নেয়ার শব্দটি শুনতে। সৌধ ক্ষণকাল সময় নিল। অনুভব করল গলা শুঁকিয়ে ওঠেছে৷ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ৷ সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতিতে হৃদয় সিক্ত। সুজা চৌধুরী ছেলেকে মৃদু ধাক্কা দিলেন৷ চমকে ওঠে পাতলা পর্দার দেয়ালে তাকাল সৌধ। নত দৃষ্টিতে ভীত মুখে সিমরানকে এক পলক দেখে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে, সুস্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

‘ আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ‘

নিমেষে দু’চোখ উপচে নোনাপানির ধারা নামল সিমরানের গাল বেয়ে। পরপর তিনবার কবুল পড়ল সৌধ৷ কান পেতে শুনে প্রতিবারই অঝোরে কাঁদল সিমরান৷ এই কান্নায় ব্যথা নেই, দুঃখ নেই আছে শুধু প্রাপ্তির সুখ। সিমরান যখন কান্নায় ডুবে তখন তার এক পাশে এসে দাঁড়াল সোহান। অপর পাশে সুহাস। আব্বু আর ভাইয়াকে দু’পাশে অনুভব করে কিছুক্ষণের জন্য কান্না থামে। এরপর যখন বরের পক্ষ থেকে একজন এসে বলতে শুরু করে,

‘ তেরো লক্ষ তেরো টাকা মোহরানা ধার্য করিয়া…আপনি, সোহান খন্দকারের একমাত্র কন্যা সাইয়্যারা সিমরান খন্দকার এমপি সুজা চৌধুরীর ছোট পুত্র ড.সৌধ চৌধুরীকে বিবাহ করিতে রাজি থাকিলে বলুন, আলহামদুলিল্লাহ কবুল। ‘

পর্দার ওপাশে বর বেশে বসা সৌধর সুক্ষ্ম দৃষ্টিজোড়া তাকিয়ে আছে স্থিরভাবে। কান দু’টো আশপাশের কোনো শব্দই নিচ্ছে না। কেবল অপেক্ষা করছে সিমরানের থেকে পাওয়া সম্মতিটুকুর। এরপরই তারা দু’জন বিয়ে, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে জড়িয়ে যাবে। একে একে প্রত্যেকেরই অপেক্ষা শুরু হলো। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা সিমরানের দিকে। সোহান খন্দকার টের পেলেন মেয়ে কাঁদছে। তীব্র কষ্টে তার শ্বাস নিতে বেগ পেতে হলো। সুহাস যেন শরীর ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারাজীবন দেখেছে বিয়ে মানেই আনন্দ, ফূর্তি। কনে বিদায়ে কান্না দেখেছে। কিন্তু সেগুলো এভাবে এত নিগূঢ় ভাবে স্পর্শ করেনি। স্মরণ হলো নিজের বিয়ের কথাও। নামীকে কাঁদতে দেখেছে সে। কিন্তু বুঝতে পারেনি, অনুভব করেনি ওর ভেতরকার তীব্র কষ্টটুকু। আজ নিজের বোনের বেলায় যে অনুভূতিটা হচ্ছে তা যেন প্রকৃতিরই এক চরম শিক্ষা। এত ভালোবাসার জিনিসটা অন্যকারো হাতে তুলে দিতে হবে? আজকের পর সিনুর ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকারবোধ কেবল সৌধরই। আহা, বুকের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল যেন। তবু হজম করতে হলো সব যন্ত্রণা। হাসি মুখে এসে বোনের সামনে বসতে হলো। মাথায় হাত রেখে বলতে হলো,

‘ কিরে বোনু সৌধকে স্বামী হিসেবে কবুল করে নিবি না? ও অপেক্ষায় আছে… ‘

সহসা নড়ে ওঠল সিমরান। স্মৃতি আপু, প্রাচী, ফারাহ সকলেই তাকে বোঝাতে শুরু করল। এ এক শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে এলো। মাথা ঘরতে থাকল বিশ্রীভাবে। বুকের ভেতর কী যেন একটা দুমড়েমুচড়ে গেল। এরপর! এরপর! সকলের লাগাতার অনুরোধে দু-চোখ বুজে নোনাপানির ধারা ছেড়ে, নিঃশ্বাস আঁটকে, কাঁপা কণ্ঠে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিল ড. সৌধ চৌধুরীকে। অর্জন করে নিল তার কিশোরী বয়সের ভয়ংকর প্রণয়কে। সিমরানের কান্নামিশ্রিত মিহি সুরে উচ্চারিত,

‘ আলহামদুলিল্লাহ কবুল ‘ শব্দ দুটোয় কী ছিল কে জানে। যা একেবারে সৌধ চৌধুরীর বুক ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে মিশে গেল।
.
.
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই আজিজ আর শান বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য চৌধুরী বাড়ি গিয়ে সৌধর জমকালো বাসর ঘরটা দখল করা। গুণে গুণে ষাট হাজার উশুল না করে ঘর ছাড়বে না৷

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৩|
কন্যাকে পাত্রস্থ করার পর বিদায়বেলা।হৃদয়বিদারক এক মুহুর্ত। প্রতিটি নারীর জীবনে এ মুহুর্তটি অত্যন্ত মর্মভেদী৷ সোহান খন্দকার একহাতে সৌধর হাত ধরে আছে। অপর হাতে সিমরানের হাত৷ নিজের আবেগ, মায়া, ভালোবাসা, স্নেহ সমস্ত কিছু বুকের ভেতর চাপা দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল সে। তীব্র কষ্টে আব্বুর শোচনীয় অবস্থা, অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিজোড়া দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না সিমরান। গা কাঁপিয়ে ফুঁপাতে শুরু করল। মেয়ের কান্না দেখে সোহান খন্দকার নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করে৷ তার একপাশে তীব যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সুহাস দাঁড়িয়ে। অন্য পাশে সুহাসের মামা। সিমরানের এক পাশে সৌধ অন্য পাশে ফারাহ। যে সিমরানকে থরথর করে কাঁপতে দেখে কাঁধ চেপে ধরেছে। সোহান খন্দকার সৌধের হাতে সিমরানের হাত তুলে দিল। আবেগমথিত হয়ে বলল,

‘ বাবা সৌধ, এই যে আজ সিনুকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। সিনু কে বলো তো? আমার মেয়ে? না বাবা ও শুধু আমার মেয়ে না, ও আমার কলিজার টুকরা। সারাজীবন মনে রেখো, আজ এক বাবার শরীর ভেদ করে কলিজার টুকরাকে বউ করে নিয়ে গেলে তুমি। ‘

আশ্বস্ত দৃষ্টিতে তাকাল সৌধ। কাঁপতে থাকা সিমরানের হাতটা যত্নসহকারে আগলে ধরল ৷ ধীরে ধীরে স্তম্ভিত হতে বাধ্য হলো সে। এক বাবার অসহায় মুখ তার হৃদয়ে বিরাট এক জায়গা দখল করে নিল৷
সোহান খন্দকার আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না৷ চোখের সামনে মেয়েকে শশুর ঘরে চলে যেতে দেখতে পারবে না৷ মেয়ের সামনে ভেঙে পড়তেও চায় না সে৷ তাই ত্বরিত সরে গেল। তার পেছন পেছন গেল সুহাসের মামা। বাবা সরে গেলে নত মাথা উঁচু করল সুহাস৷ সৌধ দেখল, তার ভঙ্গুর এক বন্ধুকে। যে আজ সর্বস্ব খুইয়ে স্তম্ভিত মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্ধশ্বাস একটি মুহুর্ত। তবু সৌধর মস্তিষ্ক ঠান্ডা। তাই তো সে মনে মনে পণ করল, একটু সময় লাগলেও প্রিয় বন্ধু সুহাসের জীবনে সবকিছু গুছিয়ে দেবে৷ ফিরিয়ে আনবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। ঘুচিয়ে দেবে সকল দুঃখ, কষ্ট একাকীত্বের ভয়ংকর যন্ত্রণা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সুহাস এগিয়ে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। সৌধ খেয়াল করল, সুহাসের চোয়াল কাঁপছে, নাকের ডগা লালচে। পানি টলমল করছে চোখ দু’টোতে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেদের মন অনেক নরম হয়। কিছু মানুষ আছে না? যত গর্জে তত বর্ষে না। সুহাস হলো সেই ধারার মানুষ। এই ছেলেটাকে আর কেউ চিনুক বা না চিনুক সৌধ খুব ভালো করে চেনে। সহসা কম্পিত চোয়ালে শাসানোর সুরে সুহাস বলল,

‘ আমার বোনকে সবসময় হাসিখুশি রাখবি৷ একটুও দুঃখ দিতে পারবি না। মনে রাখবি অন্য কেউ নয় তোর বউ সুহাসের বোন। ‘

এত দুঃখের ভীড়েও সুহাসের বাচ্চামো দেখে হাসি পেল সৌধর৷ কিন্তু পাশের জনের হৃদয় নাড়ানো কান্না দেখে আর নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার অজুহাতে হাসতে পারল না। বন্ধুকে বলতেও পারল না,

‘ তুই কি ডাক্তারি পেশা ছেড়ে গুণ্ডামি পেশায় যোগ দিলি নাকি৷ দ্য গ্রেট গ্যাংস্টার সুহাসের বোন বিয়ে করে তাহলে মুসিবত হয়ে গেল আমার! ‘

মনের কথা মনেই রয়ে গেল। বোনের বিদায় শোকে সুহাস আরো অনেক শাসানো বাক্য আওড়াল।সেসব আমলে নিল না সৌধ। এরই মধ্যে তার ছোটো কাকু সুলল এসে তাড়া দিল। সন্ধ্যার আগেই নতুন বউ ঘরে তোলার নিয়ম তাদের। রাত হলেই সৌধর দাদুনি আর বাড়ির বউ বরণ করবেন না। সৌধকে শাসিয়ে বোনের মাথায় হাত রাখল সুহাস। অকস্মাৎ শব্দ করে কেঁদে ফেলল সিমরান। ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল৷ বোনকে সামলাতে পারল না সুহাস৷ সৌধ হতভম্ব হয়ে গেল দুই ভাই, বোনের কাণ্ড দেখে। সুহাসও কাঁদছে! এ প্রথম সুহাসকে এভাবে কাঁদতে দেখল সে। এমতাবস্থায় হঠাৎ আইয়াজকে নজরে পড়ল ওর। তৎক্ষনাৎ ইশারায় বলল,

‘ আয়াজ, এই বেআক্কলটাকে দ্রুত সরা। ‘

ফারাহ সিমরানকে সামলে নিচ্ছিল। আইয়াজ গিয়ে সুহাসকে ধরায় সুবিধা হলো। জোরপূর্বক টেনে সুহাসকে সরিয়ে নিল আইয়াজ। ক্রন্দনরত অবস্থায় সিমরান অনুভব করল, যে হাত সৌধ ধরে ছিল তাতে শক্ত টান পড়েছে। অশ্রু ভেজা চোখে চকিতে তাকাতেই দেখল সৌধ তার হাত টেনে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে। ঠোঁট ভাঙিয়ে কেঁদে ফেলল ফের। হাতে টান পেয়ে আপনাআপনিই পা এগুলো। অনুভব করল বুকের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে হচ্ছে তীব্র কষ্ট। এত কষ্ট হচ্ছে কেন তার? চারপাশের সবাইকে এত নিষ্ঠুরই বা মনে হচ্ছে কেন? যেন সবাই তাকে জোর করে শশুর ঘরে পাঠাচ্ছে। অথচ সে সৌধ ভাইকে ভালোবেসে স্বেচ্ছায় তার বউ হয়ে নিজের বাড়ি, আপনজন ছেড়ে বিদায় নিচ্ছে।

গাড়িতে ওঠার পর হঠাৎ সুহাস ছুটে এলো। সৌধকে ডাকতে লাগল সমানতালে,

‘ সৌধ, সৌধ এই সৌধ? ‘

শেষ ডাক দিল উচ্চ গলায়। কপাল কুঁচকে জানালার কাঁচ নামালো সৌধ। মুখাবয়ব প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে আছে তার। সত্যি বলতে সুহাসকে এভাবে কাঁদিয়ে সিমরানকে নিয়ে যেতে তারও অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু এটাই তো জগতের নিয়ম৷ এ নিয়ম না মানলে বাড়াবাড়ি হবে। আজকের দিন থেকে গেলে দৃষ্টিকটুও লাগবে। লোকে আবার ঘরজামাই ট্যাগও দিয়ে দিতে পারে৷ তার মতো ছেলে আর যাইহোক এই ট্যাগ বয়ে বেড়াতে পারবে না৷ সুহাস এত বেশি অবুঝতা কেন করছে? মাথা ধরে গেল সৌধর। ভারিক্কি কণ্ঠে বলল,

‘ বল। ‘

‘ তুই কিন্তু রাগটা একটু কমাবি। সিনুর ওপর রাগ ঝাড়বি না কিছু নিয়ে। ‘

সুহাসের কণ্ঠে মিনতি। সৌধ পেছনে তাকিয়ে দেখল আইয়াজ, ফারাহ ওঠেছে কিনা। এরপর ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল। সুহাস এবার সিমরানের দিকে তাকাল। আদুরে গলায় বলল,

‘ কাঁদিস না বোন। আমি, বাবা সব সময় তোর পাশে আছি৷ ‘

বলেই হাত বাড়িয়ে বোনের গালের পানি মুছে দিল। সিমরান ভাঙা কণ্ঠে বলল,

‘ আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না৷ আব্বুর কাছে যাও এক্ষুনি। ‘

সিমরানের কণ্ঠে ভয়। মাকে হারিয়েছে আচমকা। মায়ের পাশে তারা কেউ ছিল না৷ না আব্বু আর না তারা দুই ভাইবোন। তাই এই কঠিন মুহুর্তে ভয় জেঁকে ধরল ওকে। বোনের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল সুহাস৷ সত্যিই তো! তাকে এখন বাবার পাশে থাকতে হবে। গাড়ি স্টার্ট দিলে হাত ফিরিয়ে নিল সুহাস। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল বোনের কথায়। সহসা শব্দ করে সামনে থেকে গাড়িটা সরে গেল। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠল সুহাসের৷ ঘুরে দাঁড়িয়ে পায়ের গতি বাড়াল বাবার কাছে যাওয়ার জন্য। মনে মনে বলল,

‘ সিনুকে সামলাতে সৌধ আছে, বাবাকে সামলাতে আমি আছি, আর আমাকে সামলাতে? কে আছে? কেউ নেই!’

বুকচিরে তার হতাশাগ্রস্ত নিঃশ্বাস বেরুলো। যা মিশেমিশে একাকার হয়ে গেল প্রকৃতির সাথে।
.
.
স্মৃতিসৌধ। চৌধুরী বাড়ি। বরের গাড়ি ছাড়া সব গাড়ি এসে পড়েছে। গাড়ি ভর্তি মানুষজন তাড়াহুড়ো নিয়ে ঢুকছে বাড়িতে। নতুন বউ বরণ দেখবে তারা৷ স্মৃতি আর তার হাজব্যন্ড মুক্ত বাড়িতে প্রবেশ করতেই দাদুনির প্রশ্নের মুখোমুখি হলো,

‘ মেয়ের সাথে ক’জন এসেছে? ‘

ক্লান্ত গলায় স্মৃতি বলল,

‘ নানুমনি আর সিনুর এক বান্ধবী লুনা মাত্র দু’জন। ‘

চোখ ফিরিয়ে নিল দাদুনি। স্মৃতিও চলে গেল উপরে৷ নিজের ঘরে গিয়ে ভারি পোশাক ছেড়ে হালকা, পাতলা সেলোয়ার-কামিজ পরে নিল। তার স্বামী মুক্ত বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

‘ জান, আমার আর কাজ নেই তো। এবার তোমাদের মেয়েলি কাজটাজ শুধু৷ আমি ফ্রেস হয়ে রেস্ট করব। ডিনারের সময় ছাড়া ডাকাডাকি করো না। ‘

‘ ওকে ফাইন, যখন নিচে যেতে বলব এসে পড়ো। ‘

‘ ওকে। ‘

স্মৃতি আপু ঝটপট চুল গুলো পেছনে ঝুঁটি করে নিচে নেমে এলো। এমন সময় দাদুনি ফের তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল,

‘ তাহানী কোথায় স্মৃতি? তোমাকে বলেছিলাম, ওর খেয়াল রাখতে? ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল স্মৃতি। তাহানীকে তো ঝুমায়না ভাবির সাথে বসিয়েছিল। কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল,

‘ ভাবি আসেনি? ‘

‘ সে তো ছেলেকে ঘুম পাড়াতে মাত্রই নিজের ঘরে গেল। ‘

আঁতকে ওঠল স্মৃতি।

‘ তাহানীকে তো ভাবির সাথে বসিয়েছিলাম! ‘

দাদুনি কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয়ে বলল,

‘ তোমাদের ওপর ভরসা করাই ভুল। কোন আক্কেলে ঝুমায়নার কাছে তাহানীকে রাখো। সে ছেলে সামলাতে গিয়ে হাপিত্যেশে মরে যায়। ‘

ঢোক গিলল স্মৃতি। আমতা আমতা করে বলল,

‘ দেখছি। আপনি টেনশন করবেন না। কারো না কারো সাথে আছেই। ‘

কথাগুলো বলে বাইরে যেতে উদ্যত হতেই দেখতে পেল, সিমরানের বান্ধবী লুনার হাত ধরে হাসিখুশি তাহানী সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল স্মৃতি। হাসিমুখে দাদুনির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ এইতো আমার বনু এসে গেছে। ‘
.
.
সদর দরজার বাইরে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৌধ। বাড়ির অর্ধেক সদস্য ভেতরে। বাকি অর্ধেক বাইরে সৌধ, সিমরানকে ঘিরে৷ সৌধর মা, দাদুনি, আপু আর ভাবি ঝুমায়না তাদের বরণ করার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। একটি বিশাল আকৃতির নোড়া রাখা বর,বউয়ের সামনে৷ তানজিম চৌধুরী ছেলেকে নোড়া দেখিয়ে বললেন,

‘ বাবা ওঠো এখানে। ‘

এরপর সিমরানকে বলল,

‘ ছোটো আম্মা, তুমিও ওঠো। ছোটো আব্বার বাম পাশে দাঁড়াও। ‘

আম্মার আদেশ চির ধার্য। যদিও এসব নিয়মকানুন ইসলামে নেই৷ কিন্তু প্রাচীন যুগ থেকে তাদের পূর্ব পুরুষরা মেনে আসছে৷ বংশপরম্পরায় মুরুব্বিরা এভাবেই নিয়ম মেনে নতুন বউ ঘরে তুলে। নিয়ম গুলো না মানলে কিছুই হবে না৷ কিন্তু মানলে বাড়ির মুরুব্বিরা সন্তুষ্ট হবে৷ তাদের নতুন জীবনের শুরুতে কেউ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হোক চায় না সৌধ। সংস্কৃতির প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই৷ তবে হ্যাঁ যেসব সংস্কৃতি তার ব্যক্তিত্বে আঘাত করে বা যেসব সংস্কৃতি অসম্মান বয়ে আনে সেসবের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। নোড়ার ওপর তারা স্বামী, স্ত্রী ওঠে দাঁড়ালে স্মৃতি একগ্লাস হালকা গরম দুধ এগিয়ে দেয় মাকে। তানজিম চৌধুরী দুধের গ্লাস মুখে ধরেন সৌধর৷ সৌধ এক চুমুক খেয়ে ফিরিয়ে দিলে বাকি দুধ সিমরানের মুখে ধরে। মাথা ঘুরছে সিমরানের। শরীরটা দুর্বল লাগছে খুব৷ দুধের গ্লাস দেখে গা গুলিয়ে ওঠল৷ তানজিম চৌধুরী স্নেহময় গলায় বলল,

‘ একটু মুখে দেও। ‘

তানজিম আন্টি আজ থেকে তার শাশুড়ি মা৷ বুকের ভেতর ধক করে ওঠল৷ এক পলক তাকিয়ে দেখল, চৌধুরী গিন্নিকে। এরপর চোখ নামিয়ে দুধের গ্লাসে ঠোঁট ছুঁয়ালো। এক ঢোক খেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলে তানজিম চৌধুরী মৃদু হাসলেন। সে সরে গেলে এগিয়ে এলেন দাদুনি। পাশে কাজের মেয়ে মিষ্টি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখান থেকে কাঁটাচামচে মিষ্টি তুলে প্রথমে নাতির মুখে ধরলেন৷ সৌধ মুখ বাড়িয়ে এক কামড় নিল। দাদুনি মৃদু হেসে একই মিষ্টি সিমরানের মুখে ধরলেন। শাশুড়ির বেলায় একবার দ্বিমত করলেও দাদুনির বেলায় ঝটপট মিষ্টি মুখে নিল সিমরান। এমনিতেই দাদুনি তাকে পছন্দ করেন না৷ মিষ্টি খেতে একদমই ভালো লাগবে না এখন৷ তবু দাদুনির তোপের মুখে পড়তে চায় না বলেই খেলো। এতক্ষণ এমন ভদ্র সুলভ থেকে তার বেলায় চটপট করার মানে কী? বোধগম্য হলো না দাদুনির৷ অসন্তোষ মুখে ঘাড় বাঁকিয়ে বড়ো নাত বউ ঝুমায়নার দিকে তাকালেন। ঝুমায়না পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলে পানি খাইয়ে দিলেন দু’জনকে। এরপর বড়ো বউকে ডাকলেন। তানজিম চৌধুরী এসে ছেলে আর ছেলে বউয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’হাতে দু’জনের হাত ধরলেন৷ এরপর এগিয়ে নিয়ে গেলেন চৌধুরী বাড়ির অন্দরমহলে। দৃশ্যটি সৌধর কাজিনরা ক্যামেরা বন্দি করে ফেলল। ভিডিয়োশুট চলল দীর্ঘ সময় ধরে৷

বর, বউ ভেতরে প্রবেশ করতেই বাকি সবাই যে যার মতো ভেতরে ঢুকল। লুনা তাহানীর সঙ্গে খেলা করছিল আর উশখুশ চোখে তাকাচ্ছিল বাড়ির সদর দরজার দিকে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল সে তার বান্ধবীর অপেক্ষায় ছিল৷ কিন্তু বান্ধবী আসার পরও যখন উশখুশ করতে লাগল তখন সন্দেহ হলো, ফারাহর। সে আইয়াজকে আড়ালে ডেকে বলল,

‘ সিনুর বান্ধবীর মতিগতি ঠিক লাগছে না। ‘

চোখের চশমা ঠিক করতে করতে আইয়াজ বলল,

‘ কেন কিছু বলেছে তোমায়? ‘

‘ আমাকে কী বলবে আজব! ‘

‘ তাহলে বেঠিকের কী দেখলে? ‘

ঠোঁট ফুলালো ফারাহ৷ কারো সম্পর্কে পুরোপুরি না বুঝে আন্দাজে কিছু বলা ঠিক হবে না। কিন্তু সিনুদের বাড়িতে খাওয়ার সময় থেকে খেয়াল করছে, লুনা সুলল কাকুর দিকে কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল৷ বিষয়টা দৃষ্টিকটু লেগেছে তার। সুলল চৌধুরী সৌধ ভাইয়ের কাকা। সে হিসেবে তাদেরও কাকা। সুলল কাকু নিঃসন্দেহে হ্যান্ডসাম। সৌধ ভাইয়ের ছোটো কাকা কোনো অংশে সৌধ ভাইয়ের থেকে কম কিছু নয়৷ লম্বা, চওড়া সুঠাম দেহের অধিকারী সুলল কাকু। তার আকর্ষণীয় চেহেরা, ব্যক্তিত্ব যে কোনো মেয়েকেই ঘায়েল করতে যথেষ্ট। আফসোস অল্পবয়সে বিপত্নীক হয়েছে মানুষটা৷ লুনা খ্রিস্টান ধর্মের মেয়ে। তার সাথে সুলল কাকুর বয়সের ফারাকও অনেক। তিতকুটে অনুভূতি হলো ফারাহর৷
ভাবল, লুনা হয়তো বাচবিচার না করেই যে কারো প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। তাছাড়া ওর স্বভাব সম্পর্কে টুকটাক শুনেছিল। সৌধ ভাই বোধহয় মেয়েটাকে পছন্দ করে না৷ নিশ্চয়ই এসব দোষ জানে বলেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারাহ৷ লুনা তাহানীর সঙ্গেও ভাব জমিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা সত্যি গুড মাইন্ডের নয়৷ আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া দরকার লুনার ব্যাপারে। তারপর আইয়াজকে জানাবে। এবং বড়ো বোন হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে লুনাকে সাবধান করবে। এ পর্যন্ত ভেবে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ফারাহ। চশমা ঠিক করতে করতে আইয়াজকে বলল,

‘ কিছু না। ‘

চেপে গেল তার মনে চলা কথাগুলো। লুনার হাবভাব পুরোপুরি না জেনে কিছু বলা উচিত হবে না৷ আইয়াজ বলল,

‘ রাগ করছ কেন? বলো না কী হয়েছে? ‘

‘ রাগ করছি না। কথাগুলো সঠিক সময়ে বলব। এবার চলো সিনুর কাছে যাই। ‘

কথাটা বলেই চলে আসতে উদ্যত হয় ফারাহ৷ সহসা আইয়াজ হাত টেনে ধরে ওর৷ একদম নিজের কাছে টেনে এনে বলে,

‘ এমন দূরে দূরে থাকো কেন? যেন আমি অচেনা কেউ। ‘

‘ ধূরর হাত ছাড়ো কত মানুষ! কেউ দেখে ফেলবে। ‘

বিরক্ত হলো আইয়াজ। যতটুকু কাছে টেনেছিল তার চেয়েও অধিক কাছে টেনে নিল। দূরত্ব কমিয়ে নিতে নিতে দুজনের মাঝে এক চুল ফাঁকও রাখল না৷ শাড়ি পরিহিত ফারাহ। একদম সাধারণ, হালকা সাজ। চুলগুলো পেছনে খোঁপা করা। ওর ফরসা গলায় রয়েছে পরপর তিনটে ভাঁজ। সেই ভাঁজে ঘাম জমেছে। আইয়াজ নেশাতুর দৃষ্টিতে সেখানে তাকিয়ে বলল,

‘ ঘেমে গেছ। চলো ঠান্ডা কোথাও গিয়ে বসি। মানুষের ভীড়ে গরম বেশি লাগছে। ‘

ওরা যখন একে অপরের সন্নিকটে। ঠিক সে মুহুর্তে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে ঝুমায়না ভাবি ছুটে আসছিল রান্না ঘরের দিকে। আচমকা একপাশে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আইয়াজ, ফারাহকে দেখে একহাতে চোখ ঢেকে ‘ সরি, সরি ‘ ধ্বনি তুলে পিছিয়ে গেল। তীব্র লজ্জায় পড়ে গিয়ে লাফিয়ে ওঠল ওরা স্বামী, স্ত্রী। ফারাহ ঈষৎ ক্রোধে কটমট করে তাকাল আইয়াজের দিকে। বুকে দু’টো কিল বসিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

‘ বলেছিলাম আমি কেউ এসে পড়বে। ‘

আইয়াজ ওর হাত চেপে ধরে মার খাওয়া আঁটকে নরম স্বরে বোঝালো,

‘ ডোন্ট ওউরি জান। আমরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড নই। এত ভয়, লজ্জা পাওয়ার কিছু হয়নি। ‘

গা ঝাড়া দিয়ে ওঠল ফারাহ ‘ ধ্যাৎ! ‘ বলেই মুখ ফুলিয়ে চলে গেল আইয়াজের সামনে থেকে। সহসা লাজুক হাসল আইয়াজ নিজেও। মাথা চুলকে ভাবল, সেও কি কম লজ্জা পেয়েছে নাকি? ঝুমায়না ভাবির সামনে আর পড়া যাবে না।
.
.
বসার ঘরে নববধূকে ঘিরে রয়েছে প্রত্যেকে। চেনা মুখগুলোর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করানো হচ্ছে। আছে অচেনা মুখও। যাদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব চলছে। সৌধ বসে ছিল সিমরানের পাশেই। এবার ওঠার প্রয়োজন বোধ করল। আশপাশে তাকিয়ে বন্ধুদের মধ্যে আইয়াজকেই পেল শুধু৷ আইয়াজ ঠোঁট টিপে হাসছে৷ যে হাসি কপালে ভাঁজ ফেলল ওর। ওঠতে উদ্যত হতেই আচমকা চোখ পড়ল পাশে। সিমরানের মুখশ্রীতে। যা উঠতে দিল না ওকে। থেমে গেল। আশপাশে এত মানুষ। কীভাবে প্রশ্নটা করবে ভাবতেই মনে মনে বিরবির করল, ‘ ধূরর কে কী ভাবল এটা ভেবে এ জীবনে যখন কিছু করেনি। আজ করবে কেন? ‘ তাই ছোট্ট করে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে শীতল গলায় প্রশ্ন করল,

‘ সমস্যা হচ্ছে? রেস্ট করবি উপরে গিয়ে? ‘

মৃদু চমকাল সিমরান। আড়চোখে তাকাল সৌধর ভারিক্কি চোয়ালে। সরাসরি তাকাতে লজ্জা লাগছিল। সামনে এত মানুষ তাই৷ মনে মনে অনুভূতির ফোয়ারা ছুটল। সত্যি বলতে তার শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে৷ মাথায় কিলবিল করছে এত মানুষ আর তাদের কথোপকথন। তীব্র অস্বস্তি, শারীরিক দুর্বলতা, মানিসক ভারাক্রান্ত সব মিলিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ সৌধ ভাই কি খেয়াল করেছে এসব? আবেগান্বিত হয়ে পড়ল সিমরান। নিজের সমস্যা হলেও মুখ ফুটে বলতে পারল না। মাথা নেড়ে বোঝাল তার সমস্যা হচ্ছে না। সৌধ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল৷ স্পষ্টই বুঝল, মিথ্যা বলল সিমরান। প্রথমদিনই মিথ্যা? দাঁতে দাঁত পিষে বাড়ির লোকজনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দেখতে পেল স্মৃতি আপু লুনার সাথে গল্পে মশগুল। তার মুখ দিয়ে রেডিওর মতো ছোটো কাকুর প্রশংসা বেরুচ্ছে। আর লুনা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেসব কথা গিলছে৷ বিরক্ত হলো সৌধ। মেয়েটাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে ওর। শান্ত কণ্ঠ কিঞ্চিৎ উঁচু করল সৌধ৷ বলল,

‘ আপা, এদিকে শোন তো। ‘

গল্পে বাঁধা পেয়ে থেমে গেল স্মৃতি। লুনাকে বসিয়ে রেখে সে ছুটে এলো ভাইয়ের কাছে। শুধাল,

‘ কী হয়েছে? ‘

‘ আম্মাকে জিজ্ঞেস কর সব ফর্মালিটি শেষ হয়েছে কিনা। ‘

একটু ভেবে স্মৃতি আপু বলল,

‘ শেষ তো। কেন? ওঠবি তুই ওঠ না৷ সমস্যা কী? ‘

শীতল দৃষ্টিতে তাকাল সৌধ। স্মৃতি আপার চঞ্চলতা ফুঁস হয়ে গেল। নরম সুরে বলল,

‘ কী হয়েছে? ‘

এবারে সিমরানকে ইশারা করল সৌধ। বলল,

‘ ওর মেবি সমস্যা হচ্ছে। ভারি পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বল। ‘

চমকে ওঠল স্মৃতি। সত্যিই তো এ ব্যাপারটা তো সে খেয়ালই করেনি। ইশ নিজের বিয়ের কথা স্মরণ হতেই সিমরানের জন্য মায়া হলো। আহারে বেচারি। নতুন বউদের যে কত জ্বালা! হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে জিভ কামড়ে ভাইকে বলল,

‘ ইশ ভাই, আমারি ভুল। আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল৷ আহারে সারাদিনের ধকলে সিনুটা মিইয়ে গেছে। ‘

বলেই মায়ের কাছে গিয়ে বলে এলো,

‘ আম্মা সিনুকে নিয়ে উপরে গেলাম। বিয়ের সাজ ছেড়ে ফ্রেস হয়ে নিক। ‘

তানজিম চৌধুরী বললেন,

‘ হ্যাঁ তাই কর। ‘

পরোক্ষণেই হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে বললেন,

‘ এই শোন, সৌধর রুম তো লক। পোলাপান দরজা আঁটকে বসে আছে৷ সৌধকে পাঠা আগে তারপর তোরা যা। ‘

মায়ের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল স্মৃতি। সৌধর কাছে এসে বলল,

‘ অ্যাঁই ভাইই। তোর ঘর তো আজিজ, শান ওদের দখলে। তুই গিয়ে ওদিকটা সামলা। তারপর আমরা আসছি। ‘

সৌধ আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ আমার ঘর ওদের দখলে মানে? ‘

স্মৃতি আপু বুঝিয়ে দিল বিষয়টা৷ সৌধর মেজাজ খারাপ করল ভীষণ। এরা শুরু করেছেটা কী? টাকা দিয়ে লোক লাগিয়ে ঘর সাজালো তার দুলাভাই। আর বন্ধু আর কাজিনরা সে টাকা উশুল করতে তাকে জব্দ করার পরিকল্পনা করল! চরম বিরক্তি নিয়ে উপরে ওঠল সৌধ। নিজের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় দু’টো থাবা দিয়ে গমগমে কণ্ঠে বলল,

‘ আজিজ, শান, বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে বেরিয়ে আয়। ঘর ফাঁকা করে দে। নয়তো লাভের পরিবর্তে লোকসান হবে। ‘

সৌধর এই এক বাক্যে কী এমন ছিল কে জানে? সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলো, দু’জন। আজিজ মিনমিন করে বলল,

‘ দোস্ত এইটা কিন্তু ঠিক না। ডর দেখাইয়া লস কইরা দিলি৷ ‘

বাঁকা হাসল সৌধ। বলল,

‘ কথা যখন শুনেছিস৷ লস হবে না। আপাতত রিলাক্স হতে দে। ‘

বলতে বলতে ঘরে ঢুকল সে। বেশ তাড়া নিয়ে একটি টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ঢুকে পড়ল বাথরুমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিনু এসে যাবে রুমে। বাথরুম প্রয়োজন পড়বে তারও৷ তাই অল্প সময় নিয়ে আগে নিজে ফ্রেস হয়ে নিল৷ এই ঘর এখন আর তার একার দখলে থাকবে না৷ শুধু ঘর কেন? বাথরুম থেকে শুরু করে ঘরে থাকা প্রতিটি আসবাবে সে ছাড়া একজন রমণীর দখলে চলে যাবে। মনে মনে হাসল কিঞ্চিৎ। সময়ের স্রোতে মানুষের জীবনের গতিবিধি কী নিদারুণ ভাবেই না পরিবর্তন হয়ে যায়।

সদ্য স্নান করে বেরিয়েছে সৌধ। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে৷ এমন সময় সিমরানকে নিয়ে ঘরে এলো স্মৃতি আপু। তার পেছন পেছন এলো প্রাচী, ফারাহ, লুনা৷ ঘরে ঢুকেই প্রাচী প্রায় এক চিৎকার দিল,

‘ ওররে বাস এত্ত সুন্দর সাজিয়েছে! হাউ সুইট! তোরা যেমন কাপল ঠিক তেমনি বাসর সাজিয়েছে। তোদের জুটির সঙ্গে একেবারে মেইড ফর ইচ আদার। ‘

বাসরঘরে হৈ-হুল্লোড় লেগে গেল। সিমরানের মাঝে কোনো খেয়াল নেই। তার শারীরিক অবস্থা শোচনীয়। নিজের শরীরটা ধরে রাখাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি আপু, ফারাহ দু’জনই বুঝতে পারল তার অবস্থা। যারা এসব ফেইস করে আসে তারাই কেবল বুঝে৷ বিয়ের দিন একটা মেয়ের ওপর দিয়ে কত ধকল যায়। শারীরিক, মানসিক দু’দিকেই চাপ পড়ে ভীষণ। প্রাচী আর লুনা গিয়ে বিছানায় বসে তাজা বেলি, গাঁধা আর গোলাপ ফুল গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে৷ বিছানার মাঝ বরাবর, তিন ফুলের পাপড়ির সমাহারে লেখা সৌধ লাভ সিনু৷ লুনা ছবি তুলছে সেটার৷ সৌধ এসে প্রাচীকে বলল,

‘ প্রাচী চল নিচে যাই। ‘

ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল প্রাচী। সৌধ ইশারায় কিছু বোঝাতে লুনাকে প্রায় জোর করে টেনে নিয়েই বেরিয়ে গেল সে। বলল,

‘ যত আড্ডা, গল্প নিচে হবে। উপরে এখন সৌধর বউ রেস্ট করবে রেস্ট৷ বাব্বাহ কী কেয়ারিং! জিউ সৌধ জিউ৷ ‘

প্রাচী বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই সৌধও বেরিয়ে এলো। সিমরান ভারি পোশাক ছেড়ে মেকআপ তুলে
লম্বা একটি শাওয়ার নিল। এরপর স্মৃতি আপু গাঢ় নীল রঙের একটি সুতি তাঁতের শাড়ি পরিয়ে দিল সুন্দর করে৷ হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুখিয়ে বিনুনি গেঁথেও দিল। এরপর জিজ্ঞেস করল,

‘ এখন আরাম লাগছে? ‘

‘ আগের চেয়ে হালকা লাগছে। ‘

মিষ্টি করে হাসল স্মৃতি। সিমরানের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আচ্ছা একটু শুয়ে থাক। একদম ডিনারের সময় ডাকতে আসব৷ রেস্ট কর কেমন? ‘

মাথা নাড়ল সিমরাম৷ সত্যি একটু আরাম করা উচিত। আর কুলাচ্ছে না। ফুলে সজ্জিত বিছানা৷ শুতে ইতস্তত করছিল সে৷ স্মৃতি আপু বলল,

‘ একপাশে শুয়ে পড়। ভাই না আসা পর্যন্ত এগুলো সরানো যাবে না। ‘

নিমেষে বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করে ওঠল মেয়েটার৷ লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠল মুখটা৷ অনুভূতিরা বুকের ভেতর ছুটোছুটি করতে লাগল। স্মৃতি আপু ওর গাল টিপে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ থাক, সুযোগ পেলে খাবার আগেই ভাইকে পাঠাব৷ ‘

আর দেরি না করে বেরিয়ে গেল সে। কিন্তু নিচে গিয়ে সৌধকে পেল না৷ জানতে পারল বন্ধুদের নিয়ে বাইরে গেছে সে। আজিজ নাকি বিয়ারের আবদার করেছে। এই নিয়ে গাল ফুলিয়েছে ফারাহ৷ মুখটা প্রায় কাঁদো কাঁদো। আইয়াজ কেন গেল ওদের সঙ্গে? সে জানে আইয়াজের সব বন্ধুরাই এসব খায়৷ সৌধ ভাইও বাদ যায়নি। তার ইনোসেন্ট জামাই এসব ভুলেও ছুঁয়ে দেখে না৷ আজ যে বন্ধুদের সঙ্গে গেল৷ যদি ঝোঁকের বশে ছুঁয়ে ফেলে? এক আতঙ্ক স্পর্শ করে রইল ফারাহর বুক।

সময় গড়াল ঘন্টাখানেক। ডিনারের সময় হয়ে এলে রেগেমেগে আইয়াজকে কল করল ফারাহ৷ আইয়াজ জানালো তারা বাড়ির সামনেই। এতগুলো বের হলো ফিরল কেবল দু’জন। আইয়াজ আর সৌধ। ডাইনিং টেবিলে দু’টো চেয়ারই ফাঁকা। একটা ফারাহর পাশে আরেকটা সিমরানের পাশে। নেভী ব্লু শাড়ি পরিহিত সিমরান। মাথায় অমায়িক ভঙ্গিতে ঘোমটা টানা। নব বধূ নব বধূ ছাপটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। একটু থামল সৌধ। হকচকিয়ে গেল কিঞ্চিৎ। ধীরপায়ে এসে বসল সিমরানের পাশে। মৃদু হেসে বলল,

‘ কী ব্যাপার আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে নাকি সবাই? শুরু করো, শুরু করো। ‘

সবাই খাওয়া শুরু করল। সিমরান এক দুইবার খাবার মুখে তুলে আর খেতে পারল না৷ বার বার পানি খেতে লাগল। ফারাহ বলল,

‘ সিনু, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না। ‘

স্মিত হাসল সিমরান৷ সৌধ খাওয়ার ফাঁকে একবার তাকাল ওর দিকে। দৃষ্টি খাবারে রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ পরিচিত ঘর, পরিচিত মানুষ। এত হেজিটেড ফিল কেন করছিস বুঝতে পারছি না। টেইক ইজি সিনু। ‘
.
.
রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। নিজের ঘরে এলো সৌধ। অন্যদিনের চেয়ে আজকে ঘরে ফেরার ব্যাপারটা আলাদা৷ এতদিন রাতবিরেতে ফিরলে শূন্য ঘরে ফিরত৷ কিন্তু আজ তার ঘরটা পূর্ণ। ঘরে ঢোকার পূর্বে মৃদু কেশে নিল সৌধ। হোক নিজের বউ৷ তাতে কী? তবু সরাসরি ঢুকতে দ্বিধা বোধ করল। চাইল না সিনু কোনোভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ুক৷ তাদের মাঝে আবছা এক দেয়াল রয়েছে। সিমরান যতই তাকে ভালোবাসুক৷ কঠিন এক জড়তা আছে ওর মাঝে৷ জড়তা তার মাঝেও আছে। দু’দিক থেকেই যে জড়তা, যে দ্বিধা আছে। সব কাটিয়ে ওঠা না পর্যন্ত এভাবে বুঝে শুনে চলতে হবে। বিয়ে মানেই দুজন দু’জনের প্রতি সমস্ত অধিকার পেয়ে যাওয়া নয়। সৌধ মনে করে তারা কেউই এখনো তাদের প্রতি পূর্ণ অধিকার পেয়ে যায়নি৷ পরিপূর্ণ ভাবে অধিকার পেতে আগে পরিপূর্ণ ভাবে একে অপরের হতে হবে। দু’জন, যখন দু’জনার হয়ে যাবে তখনি আসবে একে অপরের প্রতি অধিকার, প্রেমত্ববোধ। আর ভালোবাসা, মায়া? ধীরে ধীরে সেসবও তৈরি হয়ে যাবে।

সৌধর কাশির আওয়াজ পেয়ে ধাতস্থ হয়ে ওঠে বসল সিমরান। শাড়ির অবস্থা করুণ৷ হাসফাস লাগছে ওর৷ শাড়ি পরে ঘুমাতে অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেলেই শরীর থেকে শাড়ি সরে যাবে। সৌধ ভাই এসে ওভাবে দেখে ভাববে,
‘ কী নির্লজ্জ সিনু। প্রথমদিনই কেমন অর্ধন গ্ন হয়ে শুয়ে আছে! ‘

এসব চিন্তায় আর ঘুমাতে পারছে না সে। এমন সময় সৌধ এলে ঝট করে ওঠে বসে। দরজা আঁটকে সৌধ ঘুরে তাকাতেই বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়। সৌধ দেখতে পায় সবই। কিন্তু বুঝতে না দিয়ে মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে বেড সাইট টেবিলে ওয়ালেট, সেলফোন রাখে। সিমরান ইতস্তত করতে করতে বিছানার একপাশে সরে যায়৷ সৌধ তাকায়। ফুলে সজ্জিত বিছানায়৷ তার আর সিনুর নামে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,

‘ ফুলগুলো সরানো দরকার। ‘

মাথা নাড়ে সিমরান৷ লজ্জা লাগছে তার৷ এত বেশি লজ্জা কেন লাগছে? এই প্রথম কোনো পুরুষের সাথে এক ঘরে, এক বিছানায় রাত্রি যাপন করবে বলে? পুরুষটি আর কেউ নয়, স্বয়ং সৌধ ভাই। তার কিশোরী বয়সের প্রণয় পুরুষ। চিরকালের সঙ্গী। তার স্বামী ডক্টর. সৌধ চৌধুরী। বুকে কাঁপন ধরে মেয়েটার। সৌধ হাত বাড়িয়ে ফুল গুলো সরাতে থাকে। বলে,

‘ বিছানার ঝাড়ুটা নিয়ে আয়। ‘

মৃদু চমকায় সিমরান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়৷ সৌধ ‘ওহহো’ বলে। সিমরান জানবে কী করে তার বিছানা ঝাড়ু কোথায়? আনমনে হাসে সে। বলে দেয় ঝাড়ু কোথায় আছে। সিমরান নিঃশব্দে গিয়ে ঝাড়ু নিয়ে আসে। সৌধ হাত পাতলে দেয় না। মিহি গলায় বলে,

‘ আমি দিয়ে দিচ্ছি। ‘

আলতো হাসে সৌধ। বলে,

‘ ব্যাপার না। কাল থেকে তুই’ই ঝাড়বি। আজ আমি শিখিয়ে দিই। ‘

‘ আমি পারি। ‘

‘ জানি। তবু শিখাচ্ছি এনি প্রবলেম? ‘

ত্বরিত মাথা নাড়ে সিমরান।

‘ নো প্রবলেম। ‘

বিছানা ঝেড়ে ফুল গুলো ঘরের এক কোণে জমিয়ে রাখে। সিমরান বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে। সৌধর সুক্ষ্ম চোখে কোনো কিছুই এড়ায় না। তাই দেখতে পেল তার বউ মৃদু মৃদু কাঁপছে। অতিরিক্ত উত্তেজনার ফলে মেয়েদের কাঁপাকাঁপি হয়৷ সিমরানের মাঝে অতিরিক্ত লজ্জা, উত্তেজনা দু’টোই কাজ করছে৷ টের পায় সে। ধীরে সুস্থে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ওর পেছনে। একটুক্ষণ চোখ বুজে ভাবে, আজ তাদের বিয়ের প্রথম রাত৷ এটাকে শুধু প্রথম নয় বিশেষ রাতও বলে। ওর মনের অনুভূতি বুঝতে একটুও সময় নেয় না সৌধ। না চাইতেও তারও বুকের ভেতর মৃদু শিহরণ জাগে৷ এই শিহরণের নাম কী দেবে সে? ভালোবাসা নয় তবে কী? পৌরুষত্ব? নাহ নিজের ব্যক্তিত্ব এতটুকু নিচে সে নামাতে পারে না৷ এই শিহরণের নাম সে দেবে, ভালোলাগা, অপরিমেয় মুগ্ধতা। যা সময়ের স্রোতে একদিন ভয়ংকর ভালোবাসায় রূপ নেবে। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ে সৌধ। দু’হাতে সিমরানের কাঁধ স্পর্শ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়৷ নিমিষেই ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠে সিমরানের৷ আঁতকে ওঠে তাকায় সৌধর মুখপানে৷ তৎক্ষনাৎ আবার চোখ সরিয়ে নেয়৷ সৌধ মৃদুস্বরে বলে,

‘ আজ আমাদের নতুন জীবন শুরু সিনু। আমাদের মাঝে অজানা কোনো বিষয় নেই। আমি চাইও না থাকুক। সিনু, তাকা আমার দিকে। ‘

সহসা তাকায় সিমরান৷ সৌধ ওর চোখ দু’টোতে নিজের শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

‘ আমি মনের ওপর জোর দিয়ে কিছুই করতে পারি না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনো এক পা ও নড়ি না৷ তুই আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আমার কাছে তোর চাওয়া, পাওয়া থাকবে স্বাভাবিক। কিন্তু আমি নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তোকে কিছুই দিতে পারব না৷ ‘

‘ এভাবে বলছ কেন? মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু দিতে বলেছি আমি? ‘

‘ সেটাই বলছি। আমার মনের তীব্র ইচ্ছে থেকে যেমন তোকে আমি বউ করেছি ঠিক তেমনি ভয়ংকর আকাঙ্ক্ষা থেকেই তোকে সম্পূর্ণরূপে আমার করে নেব। ‘

শিউরে ওঠল সিমরান। চোখ দু’টো সরিয়ে নিল আচমকা। কাঁধ থেকে এক হাত সরিয়ে এনে সিমরানের নরম গালে আলতো ছুঁয়ে দিয়ে সৌধ পুনরায় বলল,

‘ তুই অনেক বুঝিস। এটা আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড়ো অর্জন। বিলিভ মি, আজ যদি তুই আমাকে না বুঝে নিজের চাওয়া, পাওয়া গুলো বুঝে নিতি। আমার কিছু করার থাকত না। আমার মন সায় না দিলেও পৌরুষ চাহিদা ঠিক সায় দিয়ে দিত৷ এই যে সাপোর্ট দিলি এরজন্য আমি বেঁচে গেলাম। ‘

তীব্র লজ্জায় অস্বস্তি লাগছে সিমরানের। সৌধ টের পেল। আসলে তার মাথা কাজ করছিল না৷ বিবেকের কাছে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল। তাই এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল। নিঃশ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে সৌধ। তার অন্য হাতও এসে সিমরানের গাল ছুঁয়েছে। দু’হাতে অতিযত্নে শুভ্র, নরম গাল দুটো চেপে ধরে হঠাৎ সে বলল,

‘ আমার ভালোবাসার বীজ বপন আজ থেকেই হোক সিনু। ‘

কথাটা বলেই আকস্মিক তার পুরুষালি ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিল সিমরানের ছোট্ট ললাটে। নিমেষে চোখ দুটো বুজে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান। সৌধ খেয়াল করল ওর চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। মৃদু হেসে দু’হাতের তর্জনী দিয়ে জল মুছে দিল সে। এরপর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসাল বিছানায়। শীতল গলায় বলল,

‘ আজ এই বিশেষ রাতে তুই আমার কাছে কী চাস বল? ‘

চোখ মেলে তাকাল সিমরান। এতক্ষণ হওয়া সমস্ত খারাপ লাগা পালিয়ে গেছে সৌধর থেকে পাওয়া এই এক টুকরো পরশে। সৌধ ভাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই না৷ ভেতর থেকে টান না এলে কারো প্রতি এক বিন্দু মায়া, ভালোবাসাও দেখায় না। তাই যতটুকু পেয়েছে এটুকুর জন্যই নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হলো। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল নিজের ভালোবাসার প্রতি। সৌধ ভাইয়ের যে ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছে, যে সৌধ ভাইকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে তার প্রতি। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল সিমরান। ইতস্ততা, লজ্জাবোধ দূরে ঠেলে মিহি স্বরে বলল,

‘ আমি তোমার কাছে তিনটে জিনিস চাই সৌধ ভাই।’

নিমেষে স্তম্ভিত হয়ে গেল সৌধ। সিমরান তাকে আগে থেকেই ভাই ডাকে৷ এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে বাসর রাতে এমন করে বলে ফেলবে বুঝতে পারেনি৷ কেন জানি অস্বস্তি ঠেকল। লজ্জাও পেল। কিন্তু পূর্বের সম্পর্কের কথা ভেবে কিছু বলতে পারল না। হতভম্ব মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ বল কী কী চাই। ‘

বিছানায় ওঠে বসল সিমরান। আশপাশে তাকিয়ে ত্বরিত কণ্ঠে বলল,

‘ তোমার গিটার কোথায়? আমি চাই আজ এই বিশেষ রাতে তুমি আমাকে উৎসর্গ করে একটি গান গাও। গান গাওয়ার আগে চোখ বন্ধ করে কেবল আমাকেই ভাবো। আমাকে ভেবে, শুধুমাত্র আমার জন্য তোমার মনের ভেতর যে গান আসবে সে গানটি শুনতে চাই আমি৷ ‘

বিস্ময়ান্বিত হয়ে গেল সৌধ। সে ভেবেছিল নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু, দামী কিছু চাইবে। পরোক্ষণেই ভাবল, মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওয়া ছোটোখাটো বিষয়ই অনেক বিশেষ আর মূল্যবান হয়। সিমরানের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল সৌধর। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। ভেতর থেকে কি একটু আফসোস হলো? এই গভীর ভালোবাসা আগে খুঁজে পায়নি কেন? নাহ, জীবনে কোনোকিছু নিয়ে আফসোস করতে নেই। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সঠিক সময়েই সঠিক জিনিস দেয়। কেবল আমরাই ভুল সময়ে, ভুলটা বাছাই করে কষ্ট পাই। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে হাত বাড়িয়ে সিমরানের দুটো হাত নিজের কাছে টেনে নিল সৌধ। শুভ্ররঙা, মেহেদি রাঙা নরম দু’হাতের উল্টো পিঠে গাঢ় করে দু’টো চুম্বন এঁকে দিল। সর্বাঙ্গে ঝংকার তুলে দিল যেন এই চুম্বন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিমরান। সৌধ সে দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে গিটার বের করে আনল। ফিরে এসে পাশে বসতে বসতে বলল,

‘ আর দু’টো চাওয়া কী? ‘

‘ আগে গান শুনাও পরে বলব। ‘

আর কিছু বলল না সৌধ৷ সিমরানের কথা মতো গিটারে আঙুল গুলো সেট করে চোখ বুজল। আচমকা স্মরণ হলো সেই ক্ষণ৷ যে ক্ষণে সিনুকে সে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যে ক্ষণে অশ্রুসিক্ত সিনু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,

‘ আমাকে ভালোবাসলে কি খুব ক্ষতি হতো সৌধ ভাই? ‘

যে ক্ষণে সিনু আবদার করেছিল,

‘ কিশোরী বয়স থেকে যে তোমাকে ভালোবাসে তার চোখে একবার তাকাবে? গভীরভাবে। ‘

অতঃপর সে তাকাল। তার ভগ্ন হৃদয় দেখা পেল সেই দু’টো চোখের যে চোখে তার জন্য সমুদ্রের অতল গভীরে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা জমে ছিল। যা খুঁজে পাওয়ার যন্ত্রণাই হোক বা আনন্দ। দীর্ঘকাল নির্বাক হয়ে ছিল সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সৌধ। আচমকা চোখ খুলে তাকায় সিমরানের দিকে। বুক ধক করে ওঠে সিমরানের। ভয় হয় কোনোভাবে নিধি আপুর কথা মনে পড়ে যায়নি তো? সে যখন সৌধর প্রথম ভালোবাসা নিয়ে ভয়ে জর্জরিত। সৌধ তখন নিজের শেষ ভালোবাসা আঁকড়ে ধরার সুখে বিমোহিত,

” আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই,
আমায় কতটা ভালোবাসো সে কথাটা জানতে চাই।
ভালোবাসার যতকথা, হৃদয়ে দিয়ে শুনতে চাই।
তুমি শুধু আমার হবে, পৃথিবীকে বলতে চাই।

এ হৃদয়ে জ্বলছে এক যাতন মোমবাতি,
তুমি আগুন হয়ে পুড়ছো আমায় সারা দিবা রাতি।(২)
এ হৃদয়ে ফুটছে ফুল প্রেমের বারমাস,
তুমি ফাগুন হয়ে রঙ ছোয়ালে মনেরো নীল আকাশ।
আমি তোমার মনের ভেতর একবার ঘুরে আসতে চাই,
আমায় কতটা ভালোবাসো সে কথাটা জানতে চাই।

এ প্রনয়ে অন্ধ হলাম, প্রানের আলো তুমি।
দঃখ এলে ভুলে যেওনা, বাঁচবোনাতো আমি।(২)
এ প্রনয়ে কথা দিলাম সূর্য চন্দ্র তারা,
সাক্ষী থেকো মরন যেনো হয়না তোমায় ছাড়া।

আমি তোমার মনের ভিতর একবার ঘরে আসতে চাই,
আমায় কতোটা ভালোবাসে সে কথাটা জানতে চাই।
ভালোবাসার যতোকথা, হৃদয়ে শুনতে চাই।
তুমি শুধু আমার হবে, পৃথিবীকে বলতে চাই।

চলবে।
®জান্নাতুল নাঈমা

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৪|
নিধি চমৎকার একটি মেয়ে৷ প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন নারী৷ ওর সম্পর্কে বিয়ের আগে এমনই ধারণা ছিল অর্পণের৷ বিয়ের পর সেই ধারণায় চিড় ধরতে শুরু করলেও ধারণাটি পুরোপুরি
মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি৷ কিছু ভুল, মানসিক দ্বন্দ্ব মেয়েটাকে গুলিয়ে ফেলেছিল৷ আঘাত এনেছিল ব্যক্তিত্বে৷ যা নিয়ে সংশয়ে ছিল অর্পণ। আজ সে সংশয় পুরোপুরি কেটে গেছে৷ বিয়ের পর তারা দু’জন সুখী দম্পতি হতে পারেনি৷ কিন্তু আজ তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে ছেলে এবং ছেলের মাকে নিয়ে সুখের একটি পরিবার গড়ে তুলতে পারবে৷

সকালবেলা নিধির আবদারে ওকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিল অর্পণ। রাত হয়ে যাওয়াতে আর বাসায় ফেরেনি৷ কাছাকাছি একটি রিসোর্টে ওঠেছে৷ রাতের খাবার খেয়ে ওরা এখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।অনেকক্ষণ ধরে কান্না করছে অনিরূপ৷ বুকে আগলে ঘরজুড়ে পায়চারি করেও ছেলের কান্না থামাতে পারছে না নিধি। অর্পণ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। মোবাইলের স্ক্রিনে গভীর মনোযোগ রেখেছে সে। আধঘন্টা আগে সৌধ চৌধুরীর আইডি থেকে গট ম্যারেড স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। সাইয়্যারা সিমরান আইডিতে ট্যাগ করার ফলশ্রুতিতে স্ট্যাটাসটি তার নিউজফিডেও ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ সিমরান তার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে রয়েছে। বুকভরে স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ছাড়ল অর্পণ। ঠিক কতদিন পর এমন একটি নিঃশ্বাস বেরুলো তার বুক চিড়ে? জানা নেই। সে শুধু জানে, অনেকটা রিলিফ ফিল করছে আজ৷ ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসে ফোন রেখে নিধির দিকে তাকাল সে। নিধি বাচ্চার কান্না থামাতে মহাব্যস্ত৷ যেন জগতের অন্য কিছুতে এখন ধ্যান নেই তার। যা অর্পণের অনুভূতিকে দ্বিগুণ আনন্দিত করল। আজ সৌধ বিয়ে করে নিজেকে সম্পূর্ণ লিখে দিয়েছে অন্য কারো নামে৷ সেই অন্য কারো সাথেই হয়তো এখন বাসরে বিভোর রয়েছে। তার জীবনে নিধির কোনো অস্তিত্ব নেই। পরোক্ষণেই শুধরালো। যদিও থাকে তা শুধুই বন্ধুত্ব৷ বন্ধুত্বের বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না৷ সৌধ যে ধরনের ছেলে তাতে করে বউ ব্যতীত অন্য কোনো, স্পেশালি পরের বউ নিয়ে সে এর বাইরে কিছু মনে রাখার কথা নয়৷ আর নিধি? স্বামী, সন্তান নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে রাতে সন্তান নিয়ে ব্যস্ততায় কাটাচ্ছে। ওর মনে কি সৌধর চিন্তা একবারো এসেছে? যদিও বা আসে এ মুহুর্তে সেটা কি ধোঁয়াশা নয়? বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল অর্পণ। এগিয়ে গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

‘ আমি দেখছি। ‘

নিধি যেন একটু স্বস্তি পেল। বাবার কোলে দীর্ঘক্ষণ থাকার পর ঘুমিয়ে গেল অনিরূপ৷ নিধি ছেলে ঘুমানোর বিছানা করে দিয়ে বলল,

‘ ঘুমিয়ে গেছে। নিয়ে আসুন। ‘

ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বুকে আলতো চাপড় দিতে লাগল অর্পণ। এরপর অপলকে ছেলের নিষ্পাপ মুখে তাকিয়ে কপালে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিল। বাবা, ছেলের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল নিধি৷ খেয়াল করে স্মিত হাসল অর্পণ। বলল,

‘ ও কার মতো দেখতে হয়েছে বলো তো? ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল নিধি। ছেলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বলল,

‘ পেটে রেখেছি আমি৷ কিন্তু হয়েছে আপনার মতো। ‘

বিস্তৃত এক হাসি দিল অর্পণ। বলল,

‘ ডেফিনেটলি, আমারি তো ছেলে। এছাড়া ও আরো একজনের মতো দেখতে জানো সে কে? ‘

জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল নিধি। অর্পণ পূর্বের হাসি অব্যাহত রেখে বলল,

‘ আমার বাবার মতো। খুব ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। অনিকে পেয়ে আমার সেই শূন্যতা পূরণ হয়ে গেছে৷ স্পেশাল থ্যাংকস টু ইউ নিধি। ‘

কথাটা বলেই ছেলের বাম পাশে শুয়ে পড়ল৷ নিধি শুয়েছে ডান পাশে৷ হঠাৎ তার মনে হলো, আজকের জন্য অর্পণকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি৷ এত সুন্দর দিন উপহার দেয়ার জন্য একটা ধন্যবাদ উনার প্রাপ্য। ভেবেই সহজ, স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘ ধন্যবাদ আজকের সুন্দর দিনটার জন্য। ‘

সহসা তাকাল অর্পণ। পুলকিত হৃদয়ে বলল,

‘ থ্যাংকসের প্রয়োজন নেই। অনির মা হ্যাপি থাকলেই আমি হ্যাপি। ‘

চকিতে তাকাল নিধি। ঠোঁটে আঁকল মৃদুময় হাসি৷ যে তাকানো আর হাসিতে বিমুগ্ধ হয়ে অর্পণ ইশারা করল, কাছে আসতে৷ নিধি অবাক হয়ে মুখ এগুতেই সন্তর্পণে ওর ললাটে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো অর্পণ। শীতল গলায় বলল,

‘ আজ থেকে আমাদের নতুনভাবে পথচলা শুরু। ‘

দৃষ্টি সরিয়ে নিল নিধি৷ চোখ বুজে অনুভব করার চেষ্টা করল অর্পণকে। পারল না বোধহয়। টলমল দৃষ্টিতে চোখ খুলল ফের। অর্পণ সে দৃষ্টি দেখে যা বোঝার বুঝে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি নিধি। আর আমি জানি একটু দেরি হলেও তুমি সে ভালোবাসা অনুভব করতে পারবে৷ আমাদের বন্ধন ঠুনকো নয়। আমরা সৃষ্টিকর্তার ইশারাতে এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। একটু সবুর করো। ধৈর্য্যহারা হইয়ো না৷ নিজেকে তো ঘৃণা করোই না৷ তুমি ঠিক আছো প্রপারলি ঠিক আছো। আমরা সবাই মানুষ। আমাদের মন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে যায়৷ খুবই স্বাভাবিক। আই রেসপেক্ট ইউ এণ্ড ইউর ফিলিংস। ‘

জড়সড় হয়ে শুয়ে রইল নিধি৷ অর্পণ ওকে মানসিক সাপোর্ট দিতে কাছে টেনে নিল৷ সন্তান এবং স্ত্রীকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে রাখল। নিধি অনুভব করল, অর্পণের একটি হাত নিগূঢ় ভরসার সাথে ওর মাথায় বুলিয়ে চলেছে। নিমেষে তার বিবেক বলে ওঠল, যে পুরুষ বুকে টেনে আশ্রয় দিচ্ছে, মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোদদান করছে সে পুরুষকে অনুভব না করা অন্যায়। ভালো না বাসা পাপ৷ দু-চোখ বেয়ে নোনাপানির ধারা নামল নিধির৷ যা বুঝতে দিল না অর্পণকে। দীর্ঘ একটা সময় পেরিয়ে অর্পণ অনুভব করল, নিধি হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরেছে তাকে। যা তার সমস্ত সত্তায় শিহরণ জাগিয়ে তুলল।
.
.
দু’দিনের আনুষ্ঠানিকতায় এত বেশি চাপ গেছে যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ফারাহ৷ অথচ আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি ঘটেনি৷ সমাপ্তি ঘটবে আগামীকাল। তারা ফিরে যাবে পরশুদিন। স্বামী, স্ত্রী হিসেবে আইয়াজ, ফারাহ একদম নিখুঁত। পৃথিবীতে এমন দম্পতি বিরল৷ দু’জন ভীষণ মেধাবী আর এস্টাব্লিশড
হলেও খুবই সহজ ব্যক্তিত্ব পোষণ করে। ওদের দু’জনের মানসিকতা এত বেশি ইতিবাচক যে দাম্পত্য জীবনে সুখী থাকা সহজ হয়ে গেছে। যদিও ফারাহ অনেক বেশি অভিমানি৷ তবে সে অভিমান আইয়াজের গভীর প্রণয়ে গলে যেতে বাধ্য। কোনো বিষয় নিয়ে সাময়িক অভিমান করলেও খুব সহজে মেনে যায় ফারাহ। আর আইয়াজ তাকে মাঝেসাঝে রাগতে দেখা গেলেও কঠিন রাগ দেখেনি ফারাহ। যা দেখেছে টুকটাক। সবচেয়ে বেশি দেখেছে মাথাভর্তি জ্ঞানবুদ্ধি আর বুকভর্তি আকাশের মতো বিশাল ভালোবাসা। আর চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটোতে নিজের প্রতি ভয়াবহ আসক্তি। ভীষণ ভালোবাসাময় আর যত্নশীল স্বামী পেয়ে নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে সৌভাগ্যবতী অনুভব করে ফারাহ৷ আর সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা জানায়, তার এই সুখে, এই প্রেমে, ভালোবাসায় কারো নজর না লাগুক।

পা দু’টোতে ভীষণ ব্যথা করছিল ফারাহ৷ যা নিয়ে একটু আগে কেঁদেছেও৷ তার কান্না সহ্য করার মতো শক্তি আইয়াজের নেই৷ তাই তো চোখ দু’টো লাল করে, মুখ ভার নিয়ে পায়ে মলম লাগিয়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে আরাম পেল ফারাহ৷ গোমরা হয়ে থাকা বরটার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ শুনছ ব্যথা কমে গেছে৷ কাছে এসো এখন। ‘

আইয়াজের মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না৷ সে তার কাজেই মগ্ন এমন সময় ফারাহ জোরপূর্বক পা দু’টো সরিয়ে নিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল,

‘ কেমন স্বামী তুমি? শুধু পা ব্যথাই সারাচ্ছ। এদিকে যে বুকে ব্যথা মনে যন্ত্রণা সেগুলোর কী হবে? ‘

হতভম্ব হয়ে গেল আইয়াজ। কাছে এসে বলল,

‘ এত দুষ্টুমি কে শেখালো তোমাকে? ‘

চট করে আইয়াজের গলা জড়িয়ে ধরে ফারাহ বলল,

‘ যাদের বর অনেক বেশি ইনোসেন্ট তাদের একটু দুষ্টু হতেই হয়। ‘

ঠোঁট কামড়ে হাসল আইয়াজ৷ ফারাহ যত্ন সহকারে ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিল। আইয়াজ ততক্ষণে গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়েছে বউকে। ভালোবাসার গভীর ছোঁয়াতে টালমাটাল হতে শুরু করেছে ফারাহ। একটি উষ্ণ রাত। দেহশ্রীতে অজস্র উন্মত্ত স্পর্শ। দু’টি হৃদয়ে প্রবল প্রেম তরঙ্গ সৃষ্টিতে বিভোর।
.
.
সৌধর কণ্ঠে গান শুনতে ভালোবাসে সিমরান। আজ তাদের বিশেষ রাতে বিশেষ মুহুর্ত উপহার দিল সৌধ। যা সিমরান তার গভীর ভালোবাসা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দ্বারা অর্জন করে নিয়েছে। গান শেষে যথাস্থানে গিটার রেখে ফিরে এলো সৌধ। সিমরান মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে তার স্বপ্ন পুরুষকে। যে সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে জীবনে৷ যার সাথে আজ তার প্রথমবার এক ঘরে, এক বিছানায় রাত্রি যাপন৷ বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক বেদনা অনুভব করল। এই বেদনায় কষ্ট নয় মিশে আছে অজস্র সুখ। পলক তাকিয়ে থাকা সিমরানের চোখে তাকাল সৌধ। মৃদু কেশে ভারিক্কি গলায় বলল,

‘ রাত বাড়ছে। বাকি দু’টো চাওয়া ঝটপট বলে ফেল।’

চমকে দৃষ্টি ঘোর কাটাল সিমরান৷ ত্বরিত আরক্ত মুখশ্রী ঘুরিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ল। সৌধ ভড়কে গেল ওর লজ্জা দেখে। এত অল্পতে লজ্জা পাওয়া রমণী দেখে অভ্যস্ত নয় সে। দেখবেই বা কাকে? তেমন কোনো নারীর সংস্পর্শে যাওয়াই তো হয়নি। বন্ধু, বান্ধব ছাড়া জুনিয়র কারো সঙ্গে স্পেশালি জুনিয়র মেয়েদের সঙ্গে তার কোনোকালেই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। এসবে পটু ছিল সুহাস৷ সে নয়৷ বান্ধবীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ছিল ওই প্রাচী, নিধিই। যারা এত অল্পতে লজ্জা পেতো না। নিধি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ছুঁয়ে দিলেই ওর লাজুক মুখ দেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। কিঞ্চিৎ মেজাজ খারাপ হলো। সে এখন বউয়ের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাচ্ছে। আজকের রাত, এই সময় এবং সে এখন পুরোপুরিই সিনুর৷ নাহ ভুল হলো শুধু আজকের রাত, আজকের সময় নয়। আজকের পর থেকে তার জীবনের প্রতিটি সময়ই সিনুর জন্য বরাদ্দ। নেভি ব্লু রঙের শাড়ি পরিহিত সিমরানের পানে এবার সে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ওর এই লজ্জাশীলতা তার কাছে নতুন। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর আরক্ত মুখ, তীব্র লজ্জায় ভারিক্কি নিঃশ্বাস সবকিছুতেই নতুনত্বের স্বাদ৷ যা তার পৌরুষেয় অনুভূতিতে শিহরণ জাগালো। টের পেল, সিমরানের প্রতি সে অন্যরকম টান অনুভব করছে৷ প্রকৃতপক্ষে এই টান স্বাভাবিক। কিন্তু সে মানতে নারাজ। কারণ তার ভেতরের শক্তিশালী এক সত্তা জানে এই টানে ভালোবাসা নেই। আছে সুপ্ত থাকা সেই পৌরুষ চাহিদা। সহসা মৃদু কেঁপে ওঠল সৌধ। নিজেকে কঠিন খোলসে আবৃত করে নিল ত্বরিত। ভাবল চুম্বকের ধর্মই আকর্ষণ করা। সিনু তার বউ হয়ে চুম্বকের ধর্ম পালন করছে। সে কোনো সাধারণ লোহা নয় যে এত সহজেই বিকর্ষণ করবে। সে সেই লোহা যে শুধু দৈহিক নয় হৃদয়গত ভাবে টান অনুভব না করা পর্যন্ত বউয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবে না। অর্থাৎ সিমরান নামক চুম্বকে সে নামক লোহা ততক্ষণ আটকাবে না যতক্ষণ না মনের গহিন বন থেকে প্রগাঢ় ভালোবাসা অনুভব করছে। যা তার প্রথম ভালোবাসাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে। সিমরানের পানে দৃষ্টি অটল রেখেই একপেশে হাসল সৌধ। বিরবির করে বলল,

‘ পরাস্ত তো হয়েই গেছে। মেয়েটা আমাকে জয় করে নিয়েছে। সৃষ্টিকর্তার লিখিত নিয়মের ঊর্ধ্বে যেতে পারিনি আমি। কঠিন বন্ধনে, ভয়াবহ মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গেছি। ‘

ঘার ফেরালো সিমরান। এখন অনেকটায় শান্ত। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। যেন বিরবির করে বলা কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। সত্যি শুনেছে কিনা নিশ্চিত হতে পারল না সৌধ। ঘড়ির কাঁটায় সময় একটা ছুঁই ছুঁই। বেশ রাত হয়ে গেছে। তারা উভয়ই যথেষ্ট ক্লান্ত। তবু প্রথম রাত বলে ঘুমানোর জোর দিতে পারছে না৷ তাদের কথা তো শেষ হয়নি। ঢোক গিলল সৌধ। বলল,

‘ বাকি দু’টো চাওয়া কী? ‘

স্পষ্ট কণ্ঠের সে বাক্যে হুঁশ ফিরল সিমরানের। নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে নিয়ে বলল,

‘ শুয়ে শুয়ে বলি? আর বসে থাকতে পারছি না৷ মেরুদণ্ড দিয়ে ব্যথা করছে। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সৌধর। সারাদিন কম ধকল যায়নি৷ আগে থেকেই ঠিকভাবে খাওয়া, দাওয়া করে না সিমরান৷ গত দু’দিনে যে আরো বেশি অনিয়ম হয়েছে ঢের বুঝতে পারল। সে খুবই নিয়ম মেনে জীবনযাপন করে। প্রচণ্ড স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। তার বউকেও এসব মেইনটেইন করে চলতে হবে। কোনোকিছুতে অবহেলা করা যাবে না। মনে মনে ভাবল, সিমরান খুব একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে থেকে বড়ো হয়নি৷ ওর সবকিছুতে অনিয়মের ছাপ রয়েছে। এই যেমন বাইশ বছর বয়সেও ওকে দেখতে ষোল বছরের কিশোরীর মতো। একেবারে ছিপছিপে গড়ন। ওজন কত হবে? আন্দাজ করা যায়, বিয়াল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের ওপরে যাবে না৷ তার বউকে তো এমন থাকলে চলবে না৷ কঠিন নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। রাত জাগা, বেলা করে ঘুমোনোর অভ্যাস, এলোমেলো ঘুরাঘুরি। সব বাদ দিতে হবে৷ মন দিয়ে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে৷ নিজের আলাদা একটা পরিচয় গড়ে তুলতে হবে৷ একটানা কথাগুলো ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সে। তার আদর্শ গুলোকে আচমকা আয়ত্ত করতে পারবে না সিনু৷ তাই এসবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করতে হবে৷

‘ কী হলো শুবো না? ‘

চমকাল সৌধ। সম্বিৎ ফিরে পেল এমনভাবে বলল,

‘ হ্যাঁ সিয়র। ‘

ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল সিমরান৷ শাড়ি পরে শুঁতে ভীষণ সমস্যা হলো। পায়ের দিক থেকে শাড়ি, পেটিকোট উপরে চলে আসতে চাইলে ত্বরিত সে নিচে নামিয়ে সচেতন ভাবে শুয়ে রইল। আঁচল যেন ঠিক থাকে সেজন্য আগেই সেফটিপিনের সাহায্য নিয়েছে। সৌধর নিজের শরীরটারও বিশ্রাম প্রয়োজন তাই সিমরান শুয়ে পড়লে সেও বেশ ব্যবধান রেখে পাশেই গা এলিয়ে দিল। নিমেষে বুকের ভেতর ধুকপুক করে ওঠল সিমরানের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় সর্বাঙ্গ শিহরিত হলো। বুকের ভেতর তরঙ্গ বইলো ছলাৎছলাৎ। ফরসা গাল দু’টোয় গোলাপি আভায় ভরে ওঠল। সৌধ ওর দিকে ঘুরে শুয়েছে৷ তাই সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেয়ে বলল,

‘ আর কত লজ্জা পাবি? এবার দু’টো চাওয়া বল৷ ঘুমাব আমি। ‘

অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে গিয়েও সহসা ফিরে এলো সিমরান৷ টালমাটাল হৃদয়টুকুতে স্থিরতা দিয়ে বলল,

‘ আমি জানি না তুমি আমার দ্বিতীয় চাওয়াটুকু সমর্থন করবে কিনা৷ কিন্তু আম্মু চলে যাওয়ার পর আমি সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশনে কাটিয়েছি আমার এই দ্বিতীয় চাওয়া কখনো পূর্ণ হবে কিনা তাই নিয়ে। কারণ আমার যে পরিবার সে পরিবারে এসব ভাবা মূর্খতা। আর আব্বু আমাকে যার সাথে বিয়ে দিচ্ছিল তার পরিবারে গিয়েও এই চাওয়াটুকু প্রাধান্য পেতো না৷ কারণ তাদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড এত বেশি হাই ছিল যে আমার চাওয়াটুকু সেখানে গ্রহণযোগ্য হতো না। ‘

থামল সিমরান। সৌধ চুপচাপ কথাগুলো শুনছিল। সে থামতেই কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,

‘ সরাসরি কথা বলা পছন্দ করি আমি। ‘

বুক কেঁপে ওঠল সিমরানের। সৌধর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বিছানার সাদা চাদরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থমথমে গলায় বলল,

‘ আমি কখনো চাকরিবাকরি করতে চাই না সৌধ ভাই। পড়াশোনা শেষ করে শুধু তুমি আর এই সংসারে পূর্ণ মনোযোগ দিতে চাই৷ আমি আমার অবিবাহিত জীবন উপভোগ করতে পারিনি৷ বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে চাই পরিপূর্ণ ভাবে।
আমি একজন বঞ্চিত সন্তান। যে ঠিকঠাক পরিবার পাইনি। বাবা, মাকে সেভাবে কাছে পাইনি। তাই শশুর, শাশুড়ি আর স্বামীর সংস্পর্শে থেকে বাকি জীবন কাটাতে চাই৷ স্বামী, সন্তান ঘিরে পূর্ণ সুখ চাই। আমি জানি না কখনো আমার সন্তান হবে কিনা৷ সেই সৌভাগ্য কখনো তুমি দান করতে পারবে কিনা। ‘

সৌধর স্বাভাবিক চোখ, মুখ নিমেষে রুক্ষতায় রূপ নিল৷ আকস্মিক তোপের মুখে পড়ল সিমরান।

‘ ওয়েট আ মিনিট, সন্তান হবে কিনা মানে? আমাকে নিয়ে তোর সংশয় আছে! ‘

চমকে ওঠল সিমরান৷ কাঁপা স্বরে আমতা আমতা করে বলল,

‘ আমি ওটা বলতে চাইনি। আসলে আমাদের মাঝে যদি.. না মানে তুমি যদি কোনোদিন আমাকে মন থেকে আপন করে নিতে না পারো তাহলে বেবি আসবে কী করে? এটা ভেবে বলেছি৷ এছাড়া তোমাকে নিয়ে কোনো প্রকার সংশয় নেই ট্রাস্ট মি। ‘

মুখটা চুপসে গেছে সিমরানের। বুক ধড়ফড় করছে খুব৷ ওর কথা শুনে একটু যেন শান্ত হলো সৌধ। বারকয়েক নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ বাকি কথা শেষ কর। ‘

ভয়ে জমে গিয়েছিল প্রায় সিমরান৷ এবার স্বস্তি মিলল। আল্লাহ! একটি সামান্য কথা কী ভয়ংকর দিকে মোড় নিচ্ছিল। সৌধ ভাই কি ভেবেছিল, সে তার পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ করেছে? ছিঃ ছিঃ এমন কিছু সে কল্পনাই করতে পারে না৷ এই ভয়ানক ভাবনাটা কেন এলো সৌধর ভাইয়ের মাথায়? আর কিছু ভাবতে পারল না সিমরান৷ সৌধ ভাই অপেক্ষায় আছে তার পুরো কথা শোনার জন্য৷ তাই ত্বরিত বলল,

‘ আমি জানি আজকাল মেয়েরা এস্টাব্লিশড হওয়ার জন্য অনেক স্ট্রাগল করছে। কত মেয়ে সুযোগের অভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না হিসেব নেই। আমার কাছে সুযোগ আছে। আমার নিজের পরিবার, শশুর বাড়ির প্রতিটি লোকের সাপোর্টও পাবো। তবু আমি এস্টাব্লিশড হতে চাই না। আমি জাস্ট পড়াশোনা শেষ করে সংসারে মন দিতে চাই৷ নিজের ক্যারিয়ারের জন্য পরিবার, সন্তানকে সেক্রিফাইস করতে চাই না আমি যেটা আম্মু করেছিল। শেষ পর্যায়ে পুরো জীবন ক্যারিয়ারের পিছনে খাঁটিয়ে অল্প কিছু সময় পরিবারের জন্য, স্বামী সন্তানের জন্য না রেখে বিদায় নিতে চাই না আমি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সৌধ ভাই। আমি তোমার সাথেই আমার প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহুর্ত কাটাতে চাই। তোমার বউ গৃহিণী হলে কি খুব অসুবিধা হবে? সম্মানে আঘাত লাগবে? আমি যদি ঘর, সংসার সামলাই তুমি কি বউ হিসেবে আমাকে মেনে নিতে পারবে না? প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে কী? ‘

কিয়ৎকাল চারপাশে থমথমে নীরবতা বিরাজ করল। সিমরান অসহায় মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইল সৌধর পানে। সৌধ স্তব্ধ মুখে শুয়ে আছে। সত্যি বলতে তার জীবনবোধ আলাদা। সে কখনো ভাবেনি তার ওয়াইফ একজন সাধারণ গৃহিণী থাকবে। পরোক্ষণেই নিজের আম্মার কথা মনে পড়ল। কেঁপে ওঠল নিমেষে। তবে কী সৃষ্টিকর্তা তার মায়ের মতো ব্যক্তিত্বধারী একজনকেই তার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাঠালো? আচমকাই ভেতর থেকে আলহামদুলিল্লাহ বেরিয়ে এলো তার। সিমরান চাতকিনীর মতো তাকিয়ে। চোখে কী অসহায়বোধ। কিন্তু তার মায়ের চোখে তো এমন অসহায়ত্ব কখনো দেখতে পায়নি৷ সে একজন দৃঢ় চিত্তের অধিকারী। চোয়াল দুটো শক্ত সৌধর। চোখ দু’টো স্থির সিমরানের মুখে৷ হঠাৎ কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটিয়ে বলল,

‘ তোর কেন মনে হচ্ছে হাউস ওয়াইফ হওয়া অতি সাধারণ ব্যাপার? গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন দেখিস অথচ আর দশজনের মতোই গৃহিণী শব্দটাকে হেয় করে উচ্চারণ করিস। যেখানে এ শব্দটাকে সম্মানই করতে পারছিস না সেখানে এটা হওয়ার আবদার করিস কীভাবে? শুধুমাত্র আবেগ থেকে এমন সিদ্ধান্ত? ‘

হতভম্ব হয়ে গেল সিমরান। সৌধ কিছুক্ষণ থেমে একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে পুনরায় বলল,

‘ তুই কি আমার আম্মাকে দেখিস না? সাধারণের মাঝে এক অসাধারণ মানুষ আমার আম্মা। যে শিক্ষিত হলেও সার্টিফিকেটের পাওয়ার নিয়ে কোনো পেশায় নিয়োজিত হয়নি৷ অথচ এ পরিবারের প্রত্যেকটা উচ্চশিক্ষিত সদস্য সার্টিফিকেট অর্জন করে সম্মানিত পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা তার হাতের মুঠোয় রয়েছে। উদাহরণ , আব্বা, আমি ভাইয়া, স্মৃতি আপা এণ্ড সুলল কাকুও। সো, তুই এভাবে অনুনয় না করে, মুখে অসহায়ত্ব না ফুটিয়ে প্রপারলি হাউজওয়াইফ হওয়ার এপ্লিকেশনটা রেসপেক্ট এণ্ড প্রাইডের সাথে দিতে পারতি৷ ‘

আকস্মিক ঘামতে শুরু করল সিমরান৷ তার সব কথাতেই ভুল! যা বলছে সবেতেই একটা করে ভুল ধরছে সৌধ ভাই। কান্না পেয়ে গেল এবার৷ কিন্তু কাঁদা যাবে না৷ ধমক খাওয়ার আশঙ্কা আছে। সৌধ ভাই সম্পর্কে ছোটো থেকে কম জানাশোনা হয়নি। সতর্ক হয় সিমরান। সৌধ একবার থেমে সিমরানকে দৃষ্টিপাত করে। এরপর দম্ভের সঙ্গে বলে,

‘ গ্রো আপ সিনু। ভীষণ ইমম্যাচিওর তুই। আগে তোকে ম্যাচিওর হতে হবে৷ আবেগের বশে এতবড়ো সিদ্ধান্ত নিতে নেই৷ পরে পস্তাতে হয়। ‘

‘ আমি বুঝেই নিয়েছি সিদ্ধান্ত। তুমি চাও তোমার বউ চাকরি করুক। এস্টাব্লিশড থাকুক। এজন্য মানছ না জানি আমি। ‘

‘ জানাটা বেশি হয়ে গেছে। এস্টাব্লিশড বলতে কী বুঝিস তুই? হাউসওয়াইফ মানে কি এস্টাব্লিশড নয়?’

চোখ দুটো চকচক করে ওঠল সিমরানের। আগ্রহ নিয়ে বলল,

‘ একটু বুঝিয়ে বলো না? ‘

দমে গেল সৌধ৷ কণ্ঠ নির্মল করে বলল,

‘ আমার বউ চাকরি করবে কি না করবে এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। বউ দিয়ে চাকরি করিয়ে তার টাকাপয়সা হাতানোর কোনো শখ নেই আমার। তোর সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি৷ একজন শিক্ষিত, আত্মসম্মান সম্পন্ন, সৎ চরিত্রবান মানুষকেই আমার স্ত্রী হিসেবে চাই৷ সে ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি করল কি না করল এটা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে না৷ আমার আম্মা বাইরে চাকরি করতে বেরোয় না। সে গৃহিণী জীবন যাপন করে তার মানে কি সে প্রতিষ্ঠিত নয়? এই উত্তর আমি দিব না। বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজেই উত্তর বের কর। আর রইল তোর গৃহিণী হয়ে থাকার বিষয়। এটা আমার সৌভাগ্য যে একজন সুন্দরী, শিক্ষিত, স্মার্ট গর্জিয়াস রমণী শুধুমাত্র আমাকে ভালোবেসে আমার সংসার সামলেই তার বাকি জীবন কাটাতে চায়। নিঃসন্দেহে আমার হৃদয় এটা শুনে পুলকিত হয়েছে। ‘

নিজেকে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলা সৌধর প্রতিটি কথা হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল সিমরানের। ভয়াবহ লজ্জায় আক্রান্ত হলো সে। চোখ তুলে তাকাতে অব্দি পারল না। সে সুন্দরী, স্মার্ট, গর্জিয়াস, শিক্ষিত তাকে পেয়ে সৌভাগ্যবান সৌধ ভাই! কথাগুলো শুধু কর্ণে নয় বক্ষগহ্বরেও প্রতিধ্বনি হতে শুরু করল। শিউরে ওঠল শরীরের প্রতিটি লোমকূপও। কিছু সময় পর শুনতে পেল সৌধর সুস্পষ্ট ভাষায় বলা দু’টো শব্দ,

‘ তৃতীয় চাওয়াটা কি? ‘

কোনোকিছু না ভেবেই সিমরান বলে দিল,

‘ আমাদের মাঝে কখনো কোনোকিছু নিয়ে গোপনীয়তা থাকবে না৷ সবকিছু জেনে শুনেই আমি তোমার বউ হয়েছি। ভালোবাসি তোমাকে। তাই পরবর্তীতে অজানা কিছু তৈরি না হোক। ‘

বাঁকা হাসল সৌধ। এতক্ষণ সিমরানের দিকে ঘুরে শুয়েছিল৷ এবার চিত হলো। দৃষ্টি উপরে রেখে মৃদুস্বরে বলল,

‘ একজন পুরুষের জীবনে স্ত্রী কী জানিস? তার অর্ধেক অঙ্গ। আমার অর্ধেক অঙ্গ হয়ে জীবনে এসেছিস তুই৷ এখন থেকে আমার জীবনে কিছু ঘটা মানে তোর জীবনেও ঘটা। তোর জীবনে কিছু ঘটেছে মানে সেটা আমার জীবনেও ঘটেছে। আমি অবুঝ নই আর না অমানুষ। আমার জীবনে এখন তোর চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু নেই। তুই ছাড়া বড়ো কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীও নেই। সেম টু ইউরস। আশা করি বোঝাতে পেরেছি৷ ‘

কয়েক পল চুপ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফের বলল,
‘ঘুমো এবার। ঘুম পেয়েছে আমার। ‘

কথাটা বলেই পাশ ফিরল সৌধ৷ পরোক্ষণেই হঠাৎ মনে পড়েছে এভাবে ঘুরে শুয়ে সিমরানের বিস্মিত দৃষ্টিতে নিজের শান্ত দৃষ্টির মিলন ঘটাল। হাত বাড়িয়ে আলতো স্পর্শ করল ওর নরম গালে। বিনয়ের সুরে বলল,

‘ গুরুত্বপূর্ণ টপিকটাই মিস করে গেছি! তোর মোহরানার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। দু’তিনের মধ্যেই একাউন্টে পৌঁছে যাবে৷ সুহাসের থেকে তোর একাউন্ট নাম্বার নিয়েছিলাম গতকাল। ‘

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা