Tuesday, July 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 366



প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৩২+৩৩

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৩২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
‘ আপনার বউকে বুঝি আপনি খুব ভালোবাসতেন?’
অনন্যার এমন অদ্ভুদ প্রশ্নে চমকে উঠলো ফারিশ। অত:পর বিছানার দিকে তাঁকাতেই সে বুঝতে পারলো হঠাৎ অনন্যার এমন প্রশ্নের কারণ! বিছানা ভর্তি মিষ্টির মায়ের ছবির ফ্রেম সাঁজানো। কি সুন্দর সুন্দর সব ছবি! মিষ্টির মা যথেষ্ট সুন্দরী ছিলো তা, তার প্রতিটি ছবি দেখলেই বুঝা যায় এবং প্রতিটি ছবিই ক্যান্ডিড ফটো, অনন্যার মতে। কারণ ছবিগুলো দেখলেই বুঝা যায় কোন প্রেমিক আড়াল থেকে তার প্রেয়সীর অজান্তেই তার ছবি তুলে নিয়েছে যত্ন করে। ছবি তুলার কথাগুলো মনে পরতেই, অনন্যার মনে পরলো রমনা পার্কের সেই দিনের কথা! অনন্যা এবং অভি সেদিন পার্কে বসে ছিলো। অনন্যা বায়না ধরেছিলো তাকে আইস্ক্রিম কিনে না দিলে সে কিছুতেই গান ধরবে না। প্রেমিক অভি তখন গাজরাখানা বেঞ্চে রেখে দিয়ে, আইস্ক্রিম নিতে চলে গেলে, অনন্যা খেয়াল করে কয়েকজন বাচ্চা মিলে কানামাছি খেলছে। তাদের দেখে অনন্যারও বড্ড শখ হলো সে নিজেও কানামাছি খেলবে, যেমন ভাবা তেমন কাজ! অনন্যা নিজেও বাচ্চা কাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলা শুরু করে দিয়েছিলো। অভি আইস্ক্রিম নিয়ে এসে অনন্যার এমন কান্ড দেখে মুচকি হেসে, পকেট থেকে ফোনটা বের করে, চট করে ছবি তুলে বলে,

‘ সত্যি অনন্যা! তুমি একটা বাচ্চা! আমার বাচ্চা বউ।’

অনন্যার অজান্তেই কত ছবি তুলে ফেলতো অভি। সেই ছবি দেখে অনন্যার সে কি হাসি! সে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো। তার অতীতের ভাবনার মাঝেই, ফারিশ বিছানা থেকে একটা ছবির ফ্রেম তুলে, অনন্যার দিকে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

‘ কি ভাবছেন?’

অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ‘ উহুম! তেমন কিছু না। আপনি আপনার উইফের ছবিগুলো দেয়ালে না টাঙ্গিয়ে, বিছানায় রেখে দিয়েছেন কেন?’

ফারিশের মুখস্রীতে একরাশ বিরক্তির ছাপ দেখা গেলো। সে কোনপ্রকার জবাব না দিয়ে, ছবিগুলো কয়েকটা নিজের দুই হাতে নিয়ে, অনন্যাকে বললো,

‘ বাকি ছবিগুলো নিয়ে আপনি নিয়ে আসুন পাশের রুমে। দেখবেন ভুলেও যাতে কোন ছবি নষ্ট না হয়।’

অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে, মিষ্টির মায়ের ছবিগুলো হাতে তুলে নেয়। ফারিশ পাশের রুমে চলে যায়। অনন্যাও ফারিশের পিছনে পিছনে চলে যায়। ফারিশ পাশের রুমের দরজা খুলে, ছবির ফ্রেম গুলো একে – একে পরম যত্নের সাথে দেয়ালে লাগাতে থাকে। অনন্যা তার হাতে থাকা ফ্রেম গুলো নিয়ে, বিছানায় রাখতে দিলে, তার হাত ছিটকে একটা ফ্রেম পরে গিয়ে, টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ফারিশ তৎক্ষনাৎ ঘুড়ে, অনন্যার কাছে এসে ধমক দিয়ে বললো,
‘ কি করলেন আপনি? ফ্রেমটা এইভাবে ভেঙ্গে দিলেন? আপনি কি আদোও কোন কাজ ঠিক মতো করতে পারেন না?’

‘ আসলে……’

‘ আসলে আমি কী? আমার সত্যিই বড় ভুল হয়ে গিয়েছে, আপনাকে দিকে এইসব কাজ করানো। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ মিস অনন্যা। কাজের প্রতি অবহেলা আমার একদমই পছন্দ হয় না। ‘

‘ আসলে আমার ভুল হয়ে গিয়েছে, আমি সত্যি সরি।’

অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে নীচে বসে কাচ গুলো তুলতে নিলে, একটা কাচ তার হাতের সাথে বিধে যায়। অনন্যার হাত থেকে র/ক্ত বের হলেও, অনন্যা চোখ বন্ধ করে সয়ে নেয়। অনন্যার হাত কেটে গেছে দেখে ফারিশ ‘ওহ শিট’ বলে দ্রুত ওষুধের বক্স নিয়ে এসে, ঝুকে বলে, ‘ আপনার তো হাত কেটে গেছে। দ্রুত কাচ বের না করলে, ইনফেকশন হবে। ‘

ফারিশ অনন্যার হাত ধরতে চাইলে, অনন্যা দ্রুত নিজের হাত সরিয়ে, নিজের আখিজোড়ার জল আড়াল করে, শান্ত গলায় বলে,

‘ আমার ভিতরে প্রতিনিয়ত যে বিচ্ছিরি ভয়ংকর রক্তখনন হচ্ছে সেই রক্তখননের ওষুধ কোথায় পাবো মি: ফারিশ খান?’

ফারিশ থমকে গেলো। অনন্যা সেই কাটা হাত নিয়েই ফ্রেমের কাচ গুলো তুলে রেখে দিয়ে বলতে থাকলো,

‘ বুঝলাম! অনেক ভালোবাসেন আপনি আপনার বউকে, তার একটা ছবির ফ্রেম ভেঙ্গে গেলে আপনার বুকে গিয়ে লাগে কিন্তু আমার সাথে এই প্রতিশোধের ইতি কবে ঘটবে, আদোও আমায় বলবেন দয়া করে?’

কথাগুলো বলে অনন্যা চলে যেতে নিলেই, পিছন থেকে খপ করে অনন্যার হাত ধরে ফারিশ হেচকা টান মারতেই, অনন্যা গিয়ে ফারিশের বুকে গিয়ে পরে। ফারিশ আখিজোড়া বন্ধ করে বললো,

‘ আইম রেইলি সরি! আমি আসলে হুট করে রেগে কথাগুলো বলে ফেলেছি।’

ফারিশের মুখে ‘ সরি ‘ শুনে আখিজোড়া বড় বড় হয়ে যায় অনন্যার। সে দ্রুত ফারিশের থেকে সরে আসতে চাইলেও, ফারিশ তার হাত ছাড়ে না বরং অনন্যার আঙ্গুল থেকে এক টানে কাচখানা বের করে ফেলে। ব্যাথায় সামান্য ‘ উহ ‘ করে উঠে অনন্যা। ফারিশ অনন্যার হাতে ব্যান্ডিজ বাঁধতে গিয়ে বলে,

‘ যা জানেন না তা নিয়ে কমেন্টস করতে যান কেন? কি কখন ধরে ভালোবাসা, বউ করে যাচ্ছেন?’

‘ তো বলবো না? আপনার বউয়ের প্রতি আপনার সে কি ভালোবাসা! ঠিক আছে বউকে ভালোবাসেন ভালো কথা! বউকে ভালোবাসবেন না তো কী পাশের বাসার ভাবিকে ভালোবাসবেন? তাই বলে আমাকে এইভাবে কথা শুনিয়ে ফেললেন? অথচ আমি ইচ্ছে করে ভেঙ্গেও দেইনি!’

ফারিশ মুচকি হেসে ফেলে। অনন্যা মুখ বেকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ আপনি হাসছেন কেন?’

‘ আপনি কী একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন মিস অনন্যা?’

ফারিশ খুবই ধীর কন্ঠে শুধালো,
‘ আপনি আমার বুকে আসলে, হার্টব্রিট কেমন ফার্স্ট হয়ে যায়, অদ্ভুদ এক শান্তি অনুভব করি! ‘

‘ কি বললেন শুনতে পেলাম না। ‘

‘ শুনতে হবেনা। আপনি এখন আসতে পারেন। ‘

ফারিশের কথা শুনে, অনন্যা দ্রুত হাত সরিয়ে, নীচে চলে গেলো। ফারিশ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।

________________

অপরদিকে, শেফালির বাড়িতে বসে ছিলো অভি। অভির জন্যে চায়ের কাপ নিয়ে এসে, সোফার অপর প্রান্তে বসে শেফালি প্রশ্ন করে, ‘ অভি তুমি এমন সময়ে? কোন প্রয়োজনে?’

অভি পায়ের উপর পা তুলে, গম্ভীর গলায় জবাব দেয়, ‘ আসলে তোমাকে আমার সাথে থানায় যেতে হবে।’

শেফালি সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে বলে, ‘ থানায়? তুমি আমাকে জেলে পাঠাবে অভি? কিন্তু আমি তো তোমাকে সব বলে দিয়েছি। ‘

অভি সঙ্গে সঙ্গে শেফালিকে শান্ত করে বলে, ‘ কাম ডাউন শেফালি! ফারিশ খানের বিরুদ্ধে বেশ স্ট্রং একটা কেস ফাইল করছি, সেখানে তোমার জবানবন্দী খুবই প্রয়োজনীয়! আমি শুধু চাই, ফারিশ খানকে শাস্তি দিয়ে অনন্যাকে দ্রুত ওই ফারিশ খানের বন্ধীখানা থেকে বের করতে, আই থিংক তুমিও তা চাও। ‘

‘ কিন্তু ফারিশ খান অনেক চালাক! তাকে এতো সহজে জেলে পাঠানো কী সহজ হবে?’

‘ এইবার তার বিরুদ্ধে অভি শিকদার কেইস ফাইল করছে! এমন অনেক ফারিশ খানদের আমি উচিৎ শিক্ষা দিয়েছি। নিজের ভালোবাসাকে পেতে, সবটুকু দিয়ে হলেও আমি লড়ে যাবো। তুমি আমাকে হেল্প করবে তো শেফালি শেষবারের মতো?’

শেফালি মাথা নাড়িয়ে ‘ হ্যা ‘ সূচক জবাব দেয়।

অপরদিকে, অনন্যা নীচে নেমে রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়ে নিজের আখিজোড়ার জল মুছে যাচ্ছে তার শুধু মনে হচ্ছে সে কোনভাবে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার সাথে এমন হচ্ছে কেন? তার তো ভুললে চলবে না তাকে নিজেকে নির্দোশ করে এই বাড়ি থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেড়োতে হবে, এমনকি ফারিশ নামক খারাপ মানুষটাকেও মিথ্যে প্রমাণিত করতে হবে তাকে, যে তাকে বিয়ের দিনে সকলের সামনে চরিত্রহীনা করে তুলেছিলো। অনন্যা আপন মনে বলতে থাকে, ‘ বি স্ট্রং অনন্যা! কি হয়েছে তোমার? তুমি নিজের উদ্দেশ্য থেকে এইভাবে ছিটকে যাচ্ছো কেন?’

অনন্যার ভাবনার মাঝেই, মিষ্টি এসে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ মা! আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।’

অনন্যা ঝুঁকে মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,

‘ ঠিক আছে আমি খাবার নিয়ে, উপরের ঘরে যাচ্ছি। তুমি নিশ্চই বাপির হাতে খাবে তাইনা?’

মিষ্টি ফোকলা দাঁতে হেসে বলে, ‘ হ্যা! একদিন বাপির হাতে আরেকদিন মিষ্টির মায়ের হাতে। ফিফটি ফিফটি! হি হি। ‘

অনন্যা হেসে ফেলে। তাদের কথার মাঝেই একজন সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ মিষ্টি মা! তোমার ডেড চলে এসেছে! কাম হেয়ার মাই প্রিন্সেস!’

চলবে কী?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৩৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
সদর দরজায় দাঁড়ানো সুদর্শন এক যুবক হঠাৎ নিজেকে মিষ্টির বাবা বলে নিজেকে পরিচিত করায় অনন্যা ভিষণভাবে চমকে উঠলো। লোকটার চেহারা কেমন যেনো ফারিশের বাবার সাথে মিলে যাচ্ছে কিন্তু ভদ্র লোকটির চোখে ফারিশ কিংবা ফারিশের বাবার মতো নেই কোন মোটা ফ্রেমের চশমা! বড় বড় বাদামী মনি বিশিষ্ট আখিজোড়া।ভদ্র লোক বললে ভুল হবে অনন্যার ধারণামতে মানুষটির বয়স তেমন নয়! ফারিশের থেকে কিছুটা ছোট হবে কিংবা ফারিশের সমবয়সী ছেলে হবে। যুবকটি হাটু গেড়ে বসে, মিষ্টির গাল আলতোভাবে ধরে, সর্বপ্রথমে মিষ্টির কপালে চুমু খেলো এবং অত:পর মিষ্টিকে জড়িয়ে, আখিজোড়া বন্ধ করে কান্নার সুরে বললো, ‘ মিষ্টি মা আমার! ড্যাডের কথা কী তোমার মনে পরে না? আমার যে বড্ড মনে পরে। দেখো সবকিছু ফেলে, শুধুমাত্র তোমার জন্যে ছুটে এসেছি। ‘

অনন্যার মাথার উপর দিয়ে যেনো সব যাচ্ছে। মিষ্টি কেমন যেনো যুবকটির গাঁয়ের সাথে মিশে আছে, শান্ত হয়ে। যুবকটির পিছনে পিছনে একজন মেয়েও প্রবেশ করলো। তার গাঁয়ে মডার্ণ ড্রেস। চুলগুলো কাধ অব্দি! চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। তাদের দেখে করিমা এগিয়ে এসে বলে,

‘ আরে ইরাশ স্যার এবং ইয়ানা আফা আপনারা আইছেন? বড় স্যারসহ, ম্যাডাম ছোড স্যার এমনকি আরশ ভাই এবং এনা আপুও বিয়ে বাড়ি গেছে। আপ্নারা আইবেন জানতাম কিন্তু আইজক্যা আইবেন, জানতাম না। ‘

অনন্যা আপনমনে বলতে লাগলো, ‘ উনারা তাহলে, ইশিকা খান এবং রাশেদ খানের ছেলে- মেয়ে অর্থাৎ মি: ফারিশ খানের সৎ ভাই- বোন কিন্তু উনার ভাই নিজের সৎ ভাইয়ের মেয়েকে ড্যাড বলতে বলছে কেন?’

অনন্যার ভাবনার মাঝেই, নীচে চলে আসে ফারিশ এবং রুমা খান। ফারিশ ইরাশকে দেখেই মুচকি হেসে বলে, ‘ ফাইনালি, চলে এসেছিস তোরা!’

ফারিশকে দেখেই ইরাশকে ছেড়ে মিষ্টি গিয়ে, ফারিশকে জড়িয়ে ধরে, প্রশ্ন করে,

‘ বাপি! ইরাশ চাচ্চু আমাকে ড্যাড বলতে বলছে কেন? তুমিই তো আমার বাবা, ড্যাড, বাপি এবং ইরাশ চাচ্চু আমার চাচ্চু। বাবার ভাই চাচ্চুই হয় তাইনা বাপি?’

মিষ্টির প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে ফেলে ফারিশ। ইরাশ মুখস্রীখানা চুপ হয়ে যায়। ফারিশ শুকনো গলায় বলে,

‘ আসলে….’

ইরাশ হয়তো ফারিশের মনের অবস্হা বুঝতে পেরেছে, তাই সে এগিয়ে মিষ্টির কাছে হাটু গেড়ে বসে বলে, ‘ আমি জানি মাম্মাম! ফারিশ ভাইয়াই তোমার আসল ড্যাড, বাপি! আমি তো তোমার চাচ্চু! ইটস ওকে সোনা! তুমি বড় হও, আশা করি নিজে থেকেই সব বুঝে যাবে। ‘

ইরাশ কথাটি বলে ফারিশকে নিজের আখিজোড়া দিয়ে আস্বস্হ করে এবং ফারিশ ও শুকনো হাসি উপহার দেয়। এতোকিছুর মধ্যে ইয়ানা এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ কেমন আছো ভাইয়া তুমি?’

ইয়ানা দুই হাত দিয়ে, তার দুই ভাই বোন ইরাশ এবং ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ এখন তোরা চলে এসেছিস, এখন কী করে খারাপ থাকতে পারি?’

অনন্যা মুগ্ধ নয়নে ভাই-বোনদের ভালোবাসা দেখছে। ইরাশ এবং ইয়ানার সাথে ফারিশ যেন অন্য এক মানুষ! তাদের বাবা- মাকে সহ্য করতে না পারলেও মানুষটা তার সৎ ভাই- বোনদের ঠিকই ভালোবাসে এমনকি ইরাশ এবং ইয়ানাও যথেষ্ট সম্মান করে ফারিশকে। রুমা খান অনন্যার পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ কীরে বোন? অবাক হচ্ছিস নাকি? ফারিশ তার ভাই-বোনদের খুব ভালোবাসে সেই ছোট থেকে। যখন ওরা বিদেশে চলে গিয়েছিলো তখন আমার ছোট্ট ফারিশ দাদুভাইয়ের সে কি কান্না! শুধুমাত্র ছোট্ট ভাই- বোনদের দিকে তাঁকিয়ে, সে এখনো সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছে। এদের জন্যেই এতো অন্যায় করেও রাশেদ এবং ইশিকা এখনো অবদি টিকে আছে। বলেছিলাম না? আমার দাদুভাই অনেক ভালো মানুষ রে! যতই খারাপ হওয়ার চেষ্টা করুক, দিনশেষে আমার ফারিশ দাদুভাই একজন খাটি হিরে রে!’

অনন্যা রুমা খানের দিকে ছলছল নয়নে তাঁকায়! সত্যি যত দিন যাচ্ছে তত যেন নতুন করে চিনছে ফারিশকে সে। রুমা খান হঠাৎ বলে উঠলেন,

‘ কিরে ইরাশ এবং ইয়ানা! বয়স হয়ে যাচ্ছে বলে কী এই বুড়ি দাদিকেও মনে রাখবি না?’

রুমা খানের কথা শুনে ইরাশ এবং ইয়ানা গিয়ে রুমা খানকে জড়িয়ে, নানা ধরণের কথা বলা শুরু করে।

এতোকিছুর মধ্যে মিষ্টি গিয়ে, অনন্যার হাত ধরে সকলের সামনে এনে বলে, ‘ এইযে ইরাশ চাচ্চু এবং ইয়ানা ফুপি তোমরা কী মিষ্টির মাকে ভুলে গেলে? আমার মা ও যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখছো না?’

অনন্যার রান্নাঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলো বলে, ইরাশ কিংবা ইয়ানা কারো চোখই সেদিকে যায়নি। ইরাশ অনন্যার দিকে কেমন অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে হুট করে বলতে থাকে,’ ইশিতা! ‘

অনন্যা চমকে উঠে! ফারিশও চমকে উঠলো ইরাশের কথা শুনে। ইরাশ সঙ্গে সঙ্গে ঘোর কাটিয়ে বলতে থাকে, ‘ সরি! আমার মিস্টেক! আপনার এবং ইশিতার ফেসের কিছুটা মিল রয়েছে। কিছু মনে করবেন না। আপনিই বুঝি সেই অনন্যা? আমার মেয়ে তো আপনাকে পেয়ে নিজের মায়ের অভাব একপ্রকার পূরণ করেই নিয়েছে। ভাইয়ার মুখে শুনেছি আপনিও যথেষ্ট ভালোবাসেন আমার মেয়েকে। ‘

ইরাশের মুখে ‘ আমার মেয়ে ‘ শব্দটি শুনে বেশ খটকা লাগছে অনন্যার। মনে হচ্ছে এইখানেও রহস্য! অনন্যার ধারণামতে ইশিতা মিষ্টির আসল মা এবং ফারিশের স্ত্রী! তবে এই ছেলেটির সম্পর্কে সে ভাবি হবে তবে তাকে নাম ধরে ডাকছে কেন? অনন্যা নিজের কৈতিহূলকে দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে,

‘ আপনার ইশিতা ভাবির সাথে আমার ফেসের কিছু মিল থাকায়, মিষ্টিও আমাকে তার মায়ের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে, যদিও মি: ফারিশ খান তার ওয়াইফের সাথে আমার কোন মিল নেই এমনটাই বলে বেড়ায়!’

অনন্যার কথা শুনে কাশতে থাকে ইরাশ! ফারিশের মাথায় হাত! করিমাও মুখ চেপে হাসতে থাকে। রুমা খান এবং ইয়ানাও মুচকি হাসতে থাকে। ইরাশ নিজেকে সামলে বলে উঠে, ‘ ইশিতা আমার ভাবি?’

‘ তো? নিজের বড় ভাইয়ের বউ ভাবি নয় তো কী? ‘

অনন্যার কথা শুনে ইরাশ ফ্যালফ্যালে নয়নে তাঁকায় ফারিশের দিকে। ফারিশ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে। অত:পর অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে ধমকে বলে উঠে,

‘ কি কখন ধরে আপনি ওয়াইফ ওয়াউফ করে যাচ্ছে?জাস্ট শাট আপ!’

অনন্যা পাল্টা জবাব দিয়ে বলে, ‘কিসের শাট আপ?
আপনি নিজের বউকে নিয়ে কথা বলতে এতো লজ্জা পান কেন? আপনি নিজের বউকে ভালোবাসেন আমি তো জানি! এইযে আপনারা জানেন? আমার থেকে সামান্য একটা ছবির ফ্রেম পরে গিয়েছিলো বলে, কীভাবে রেগে গিয়েছিলো? উনি যথেষ্ট পসিসিভ নিজের বউকে নিয়ে। ‘

ইরাশ বড় বড় চোখ করে বলে, ‘ বউ! কিসব বলছেন উনি?’

ফারিশ দ্রুত ইরাশকে উপরে নিয়ে যেতে যেতে, করিমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ করিমা উনাকে নিয়ে যাও। না জেনে শুনে যাতা বলে!এই ক্রেজি গার্লের জন্যে আজকে আমার ভাই হার্ট অ্যাটাক করবে।’

অনন্যা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে, ‘ এই এই! কি বললেন! আমি ক্রেজি গার্ল?’

অনন্যা হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু করিমাকে তাকে টেনে ঘরে নিয়ে যায়। অনন্যা রেগে বলে, ‘ তুমি আমাকে নিয়ে এলে কেন করিমা আপু? উনি আমাকে ক্রেজি গার্ল বললো! আমি কী এমন ভুল বলেছি হ্যা?’

করিমা মাথা চাপড়ে বলতে থাকে, ‘ আপনে ভুল বলেন নাই? অবিবাহিত একজন পুরুষকে আপনি বার বার বিবাহিত বানাইয়া দিতাছেন! তার মধ্যে আবার তার ভাইয়ের গার্ল ফ্রেরেন্ডকে তার বউ বানাইয়া দিতাছেন।’

‘ মানে কিসব বলে যাচ্ছো করিমা আপু? উনি কী করে অবিবাহিত হয়? তাহলে উনার মেয়ে আসলো কী করে এবং উনার বউ ইশিতা…..’

অনন্যার সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বেই, করিমা বলে উঠে, ‘ মিষ্টি ফারিশ স্যারের না বরং ইশিতা ম্যাডাম এবং ইরাশ স্যারের মেয়ে। ‘

অনন্যা তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ কিহ!’

_______________________

অপরদিকে, ফারিশের মুখ থেকে সবকিছু শুনে হাসতে হাসতে শেষ ইরাশ। সে বিছানায় শুয়ে থেকেই বলতে থাকে, ‘ বাহ ভাই! আমার সিংগাল ভাইটার গাঁয়ে কিনা শেষে গিয়ে, বিবাহিত এর ট্যাম্প লেগে গেলো? ওয়্যাট দ্যা…’

‘ শাট আপ ইরাশ! হাসবি না একদম। মিস অনন্যা একজন ইডিয়েট টাইপ মানুষ! ভালো করে কিছু জানবে না, না জেনেই নিজের মনে মনে কাহিনী বানিয়ে ফেলে। এতো বোকা ও হয় মানুষ?আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ!’

ইরাশ হাসি থামিয়ে, হঠাৎ বলে উঠে, ‘ বাট ব্রো! আমার মনে হচ্ছে ইউ লাইক হার!’

ফারিশ তৎক্ষনাৎ চমকে বলে, ‘ কিসব বলছিস? আই ডোন্ট লাইক হার অলসো! উনি আমার এনেমির মেয়ে, তাই আমি উনাকে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য সফল করাতে নিয়ে এসেছি! এখন এইসব নোনসেন্স কথা বাদ দে এবং আমার সাথে আয়। ‘

ইরাশ ফারিশের কথা শুনে, উঠে ফারিশের সাথে পাশের ঘরে গিয়ে একদম অবাক হয়ে যায়। পুরো ঘর জুড়ে, ইশিতার ছবি! ইরাশ সেই ছবি ভালো করে ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,

‘ এই ছবিগুলো তো আমি তুলেছিলাম, ইশিতার আড়ালে! তুই এখনো সামলে রেখে দিয়েছিস ভাই?’

ফারিশ মুচকি হেসে বলে, ‘ তোর পছন্দ হয়েছে ঘরটা? আমি সাঁজিয়েছে উহু! শুধু আমি না, ওই মিসেস অনন্যা ও টুকটাক হেল্প করেছে আমাকে।’

ইরাশ খুশি হয়ে ফারিশকে জড়িয়ে বলতে থাকে, ‘ থ্যাংক ইউ ভাই! থ্যাংকস ফর এভ্রিথিং। ‘

ফারিশ কিছু বলার পূর্বেই, তার ফোনে কল চলে আসে। সে একটু সাইডে গিয়ে দেখে থানা থেকে ফোন এসেছে।

চলবে কী?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৩০+৩১

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ৩০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যার বলা ‘ আপনার হাসি খুব সুন্দর ‘ কথাটি গিয়ে বুকে গিয়ে লাগলো ফারিশের। অনন্যার অধরের কোণে মুচকি মুচকি হাসি বিদ্যমান! সেই দৃশ্যটাও আজ বড্ড ভালো লাগলো ফারিশের কাছে।
তার নিজের কাছে নিজেকেই বড্ড অদ্ভুদ লাগছে! কি এমন হলো তার? সে অনন্যার প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট বিষয় অতি নিঁখুত ভাবে পর্যবেক্ষন করছে ইদানিং, শুধুমাত্র পর্যবেক্ষন করেনি বরং তাতে মুগ্ধ হয়েছে বারংবার। সে শুধু উঠে দাঁড়িয়ে, মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে, ওয়াশরুমে চলে যেতে নিলে, অনন্যা হাসি থামিয়ে হঠাৎ বললো, ‘ আপনার টাওয়াল নিতে ভুলে যাচ্ছেন। ‘

বলেই বারান্দা থেকে টাওয়াল নিয়ে, ফারিশের হাতে ধরিয়ে দিলো অনন্যা। ফারিশ ছোট্ট করে ‘ থ্যাংকস’
বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ফারিশের এমন ব্যাবহারে কিছুটা চমকে উঠলো অনন্যা। তার ধারণামতে ফারিশ নামক লোকটি তাকে হুকুম করে নিজে থেকেই এইসব কাজ করার আদেশ দেয় দাম্ভিকতার সাথে, সেখানে আজ পুরো উল্টো! তাকে ধন্যবাদ জানালো বিষয়টি ঠিকমতো হজম করে উঠতে পারলো না অনন্যা। আজকাল ফারিশের আচরণ বেশ অদ্ভুদ লাগে তার কাছে, মানুষটা কেমন যেনো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, মিষ্টি অনন্যার ওড়না টান দিয়ে বলে,

‘ মিষ্টি মা! আমার তো স্কুলের জন্যে লেট হয়ে যাচ্ছে। ‘

‘ ওহ হ্যা! একদম লেট হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা আমি এখুনি নিচে গিয়ে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে ফেলি, ততক্ষনে তোমার খারুশ বাপিও গোসল করে চলে আসবে। ‘

মিষ্টি ‘খারুশ বাপি ‘ শব্দটি পুনরায় শুনে হেসে লুটিপুটি খেতে লাগলো। সে অনেকটা ভাবনার ভঙ্গিমায় থুত্নিতে হাত রেখে বললো, ‘ আচ্ছা মিষ্টি মা, আমি যদি তোমার মতো বাপিকে খারুশ বাপি বলে ডাকি, তবে কেমন হবে? ‘

‘ অনেক ভয়ংকর হবে। তোমার খারুশ বাপ শুনলে, মিষ্টি এবং মিষ্টির মা দুজনকেই পানিশ করবে। হা হা। এখন নীচে চলো মা। ‘

‘ উহু! আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আজকেও ব্রেকফাস্টে দুধ থাকবে। ‘

‘ এইসব কি কথা মা? আজকে না কম্পিটিশন? তোমাকে তো জিততে হবে তাইনা?তুমি তো দাদি সেঁজেছো তাইনা? আর আমাদের দাদি মিসেস রুনা খান কি উইক বলো? সে কত স্ট্রং এই বিষয়েও! কারণ দাদি প্রতিদিন দুধ খায়, তাই তোমাক শুধু দাদি সাঁজলেই চলবে না তার মতো স্ট্রং ও হতে হবে। আজকে কিন্তু কোন বাহানা চলবে না মা। ‘

কথাগুলো বলেই মিষ্টিকে কোলে নিয়ে নীচে চলে গেলো অনন্যা।

____________________

অভি অফিসের ব্যাগ হাতে নিয়ে, বের হতে নিচ্ছিলো তখন পিছন থেকে অভির মা ছেলেকে দেখে, রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বললেন, ‘ কিরে অভি? কোথায় যাচ্ছিস তুই? ‘

‘ অফিসে যাচ্ছি আর্জেন্ট অনেক কাজ পরে আছে।’

‘ আর্জেন্ট কাজ বলতে? কি এমন কাজ যে ব্রেকফাস্ট না করে বেড়িয়ে যাচ্ছো। ‘

অভি মায়ের দিকে ঘুড়ে, মায়ের কাধে হাত রেখে তীব্র কন্ঠে বলে উঠে, ‘ ক্যাস সাঁজাবো, মি: ফারিশ খান এবং জুঁইয়ের বিরুদ্ধে, সমস্ত প্রমাণ গুছিয়ে রাখা আছে। আমাকে এবং আমার অনন্যাকে যারা দিনের পর দিন দূরে সরিয়ে রেখেছে, এতো বড় অন্যায় করেছে তাদের কি আমি ছেড়ে দিবো? ওদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে ছাড়বো। ‘

‘ কিন্তু অভি! এইসব করে কী আদোও লাভ হবে?’

‘ অবশ্যই হবে। দেখো, অনন্যা আমাকে যতই দূরে সরিয়ে রাখুক, আমি ওকে জেনে বুঝে কষ্ট পেতে দেখতে পারি না। ফারিশ খানের মতো জঘন্য মানুষের অত্যাচারের মধ্যে আমি আমার অনন্যাকে কিছুতেই থাকতে দিবো না। ফারিশ খানকে জেলে পাঠিয়ে, আমি আমার অনন্যাকে নিয়ে আসবো। তারপর সকলের সামনে সামাজিক মর্যাদা দিয়ে, আমার ভালোবাসার মানুষকে, আমার বউ করে ঘরে তুলবো।’

অভির মা নিষ্পলকভাবে ছেলের দিকে তাঁকালেন। তার ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে অনন্যা কিন্তু তার ভয় হয় এতো ভালোবাসার কারণে কিছু কিছু মানুষ দিনশেষে তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলে।
অভির বেলায় তা হলে কী হবে তখন? অভির মা বললেন, ‘ তোমাকে কেমন দুশ্চিন্তগ্রস্হ লাগছে।’

‘ কেমন যেনো ভয় করছে। বারংবার শুধু বিয়ের দিনে বলা অনন্যার কথাগুলো মনে পরছে, মনে হচ্ছে…..’

‘ কি মনে হচ্ছে? ‘

অভি বিড়বিড়িয়ে বলছে, ‘ মনে হচ্ছে বিচ্ছেদ অতী নিকটে, কিন্তু বিচ্ছেদের স্বাদ যে বড় বিষাদময়! সইতে পাওয়া ক্ষমতা কই?’

____________________

অপরদিকে, অনন্যাকে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে, টেবিলে বসিয়ে দিলো রান্নাঘরে। অত:পর টেবিলে একে একে খালেদ খান, রেশমি খান, আরশ এবং এনাও চলে আসলো। সকলেই বেশ মুগ্ধ হয়ে মিষ্টির দিকে তাঁকালো। এনা মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বললো,

‘ আমার মিষ্টি ফুপি বুঝি আজ দাদি সেঁজেছে, বাহ! একদম পুরো দাদির মতো দেখতে লাগছে। ‘

আরশ মাঝখান থেকে বলে, ‘ পুরো জুনিয়ার দাদী লাগছে আমার চাচ্চুকে। ‘

মিষ্টি ফোঁকলা দাত দিয়ে হেসে বলে, ‘ থ্যাংক ইউ। ‘

এনা ‘ওলে সোনা ‘ বলে মিষ্টির গাল টিপে দিয়ে হেসে উঠলো। রান্নাঘর থেকে সবকিছু শুনে অনন্যাও বেশ খুশি হলো। তাদের কথাবার্তার মাঝখানে রুমা খান ও এসেই মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বললেন, ‘ আমার মিষ্টি মাকে তো দেখি চেনাই যাচ্ছে না। এমা! কি সুন্দর লাগছে। পুরো আমার পাকনা বুড়ি। ‘

এনা হেসে বলে, ‘ নেক্সট জেনারেশনের জুনিয়র রুমা খান হতে চলেছেন তিনি। ‘

‘ তা এমন সুন্দর করে কে সাঁজিয়েছে আমার পাঁকা বুড়িটাকে? ‘

অনন্যা টেবিলে নাস্তা নিয়ে আসতেই, রুমা খানের প্রশ্নের জবাবে মিষ্টি তাকে ইশারা করে বলে, ‘ কে আবার? আমার মিষ্টি মা আমাকে সাঁজিয়েছে, যেমন খুশি, তেমন সাঁজো প্রতিযোগিতার জন্য। ‘

‘ বাহ! বাহ সত্যি অনন্যা তুমি একটা জিনিয়াস। ‘

এনাও সায় দিয়ে বললো, ‘ অনন্যা তুমি যেমন ভালো করে সাঁজিয়েছো, আমাদের বুড়ি ফার্স্ট হয়েই যাবে।’

অনন্যা হাল্কা হেসে ব্রেডে জেল লাগিয়ে, মিষ্টিকে খায়িয়ে দিতে লাগলো। রেশমি খান সবকিছু শুনে মুখ ভেংচি দিয়ে কাটলো। অপরদিকে আরশ অনন্যার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাটা চামচ হাতে নিয়ে শক্ত হাতে ধরে আছে। সে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, ‘ জাস্ট একটা চান্স! তোমার জন্যে আমার বোনকে বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে, আমাকে এবং আমার মাকে এতো বাজে ভাবে অপমান করা হয়েছে, আমি তো তোমাকে কিছুতেই ছাড়বো না অনন্যা। চরিত্রহীনার ট্যাগ খুব ভালোভাবে লাগিয়ে দিবো, তোমাকে। আরশ খান তার শিকার ধরতে কখনো ভুল করে না।’

‘ এমনভাবে কি দেখছিস আরশ? মনে হচ্ছে যেনো চোখ দিয়েই গিলে ফেলবি? ‘

হঠাৎ ফারিশের এমন কথা শুনে দ্রুত পিছনে ঘুড়ে তাঁকাশ আরশ। ফারিশের আস্তে করে কথাটি বলায়, আরশ ছাড়া তেমন কেউ শুনতে পায়নি। আরশ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে, কিছু বলতে চাইলে, ফারিশ পুনরায় আরশের কানে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,

‘ সেই প্রবাদ বাক্যটা মনে আছে আরশ? পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। সো বি কেয়ারফুল মাই ব্রাদার। ‘

ফারিশ আরশের কাঁধে হাত রেখে কথাটি বলেই, আরেকটি চেয়ার নিয়ে বসে পরে। আরশ শুকনো ঢুগ গিললো। সে বুঝতে পারছে না ফারিশ তাকে কি বুঝাতে চাইছে? ফারিশ কী কোনভাবে তাকে থ্রেট দিচ্ছে? আরশের ভাবনার মাঝেই, রুমা খান খালেদ খানকে প্রশ্ন করলো, ‘ তোকে এতো চিন্তিত লাগছে কেন খালেদ? কিছু হয়েছে? ‘

খালেদ খান মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। মায়ের এমন কথা শুনে, অসহায় ভঙ্গিতে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে ফারিশের দিকে তাঁকালেন। অত:পর বললেন,

‘ ফারিশ একটা কথা বলবো বলে ভাবছিলাম, অনেক্ষন যাবৎ! রাগ করবে বলে, ঠিক বলে উঠতে পারেনি। ‘

‘ কি কথা? ‘

খালেদ খান বলার পূর্বেই,মিষ্টি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আমার কম্পিটিশন তো এখুনি শুরু হয়ে যাবে। ‘

অনন্যাও তড়িৎ গতিতে ফারিশের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে বললো, ‘ আপনি তাড়াতাড়ি মিষ্টিকে নিয়ে যান। লেট হলে আবার মার্কস কেটে নিতে পারে। ‘

ফারিশ দ্রুত চা শেষ করে, মিষ্টির ব্যাগ হাতে নিয়ে, মিষ্টিকে নিয়ে বাইরের দিকে চলে গেলো। তাদের পিছন পিছন দরজা অবদি এগিয়ে দিতে অনন্যাও পিছনে গেলো। এমন দৃশ্য দেখে মুচকি হেসে রুমা খান ধীর কন্ঠে বললো, ‘ বর্তমানে একটি সুন্দর ফ্যামেলির সিকিউয়্যাল চলছে। বাবা- মা এবং তাদের মিষ্টি মেয়ে। বেশ মানিয়েছে। কনটিনিউ। ‘
এতোসব কিছুর মধ্যে খালেদ খানের সেই জরুরী কথাগুলো বলা হয়ে উঠতে পারলো না অথচ কথাগুলো অত্যান্ত জরুরী। তিনি আচ করতে পারছেন আজ বাড়িতে বেশ বড় ঝামেলা হবে।

_________________

অনন্যা রান্নার মাঝে ভাবলো মরিচ গুড়ো দেওয়া প্রয়োজন। তরকারীতে ঝাল না হলে ভালো লাগে না যদিও ফারিশ ঝাল তেমন খেতে পারে না কিন্তু সামান্য পরিনান হলেও অনন্যা রান্নাতে মরিচের গুড়ো দেয় এতে তরকারী সুস্বাদু হয়। অনন্যা উপরে তাঁকিয়ে দেখলো বেশ বড় সেল্ফ মরিচের গুড়ো রাখা। অনন্যার আশে পাশে কেউ নেই যে তাকে ডেকে বলবে, ‘ শুনো ভাই? উপরের সেল্ফ অবদি আমার হাত পৌঁছোচ্ছে না, আমি খাটু মানুষ তো! একটু পেরে দিবে? রান্নায় ঝাল মিশিয়ে মি: খারুশ খানকে আজ উচিৎ শিক্ষা দিবো। ‘

কিন্তু তা বলা হলো না অনন্যার। আশে পাশে কাউকেই দেখতে পারছে না সে। তা সে নিজেই চেয়ার টেনে হাত উচু করে মরিচ গুরোর পাত্র টা নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অনন্যা রান্নার চামচ হাতে নিয়ে, পাত্রটা টেনে নামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে বারংবার ব্যার্থ! সে বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘ কি মসিবতে পরলাম ভাই! এরা এতো উঁচুতে জিনিসপত্র রাখে কেন? পৃথিবীতে খাটো মানুষও আছে তা কী এরা ভুলে যায়? দূর ছাই। ‘

অনন্যা আরেকটু উচুঁ হতেই, পিছলে চেয়ার থেকে পরে যেতে নিলে, ফারিশ এসে দ্রুত অনন্যাকে কোলে তুলে নেয়। অনন্যাও ভয়ে ভয়ে ফারিশের গলা জড়িয়ে, বড় বড় নি:শ্বাস ফেলতে থাকে। ফারিশ ধমকে বলে উঠে, ‘ বাচ্চাদের মতো এইসব কী করছেন আপনি? কোন সেন্স আছে আপনার?’

‘ আসলে……’

তাদের কথার মাঝেই, মধ্য বয়স্ক মহিলা এবং মধ্য বয়ষ্ক একজন পুরুষ ঢুকে পরে। তাদের দেখেই অনন্যা এবং ফারিশ দুজনেই অবাক হয়ে যায়। ফারিশ বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘ রাশেদ খান! ‘

চলবে কী?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৩১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ তার বাবার সাথে তার সৎ মাকে দেখে ভ্রু কুচকে তাঁকিয়ে, অনন্যাকে নামিয়ে দিলো। অনন্যা অবাক হয়ে সেই মধ্যবয়স্ক নর-নারীর দিকে তাঁকিয়ে আছে। মধ্যবয়স্ক মহিলাটি কেমন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, সোনালী রংয়ের কাচ করা শাড়ি পরিহিত। খোঁপা চুল, কিন্তু সাঁজের জন্যে মনে হচ্ছে কোন পূর্নবয়স্ক রমনী। অপরদিকে কালো প্যান্ট -স্যুট পরে ফরমাল ড্রেসে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন রাশেদ খান! ভদ্রলোকের মাথায় চুম কম তাতেও পাঁক ধরে গেছে। মুখস্রীতে রয়েছে একপ্রকার স্নিগ্ধতা, চোখে সেই ফারিশের মতো মোটা ফ্রেমের চিরচেনা চশমা। অনন্যা লোকটিকে দেখেই চট করে বুঝে ফেললো, লোকটা আর কেউ নয় বরং ফারিশের বাবা রাশেদ খান এবং তার পাশে ভদ্র মহিলাটি রাশেদ খানের দ্বিতীয় স্ত্রী ইশিকা খান। রাশেদ খানের চুল যদি ফারিশের মতো এই বয়সে এসেও বেশি থাকতো তবে হয়তো দুজনকে একে- অপরের ভাই মনে হতো। ফারিশের ঘরে থাকা সেই ফ্রেমে দেখে অনন্যার মতে, লোকটি যুবক বয়সে একদম ফারিশের মতো দেখতে সুদর্শন ছিলো, কিন্তু এতো কিছুর পরেও একটা কিন্তু থেকে যায়। হ্যা লোকটাকে আজ সামনাসামনি দেখে কেমন যেনো পরিচিত মনে হচ্ছে। তাহলে কী লোকটির সাথে অনন্যার কোন যোগসূত্র আছে? অনন্যার ভাবনার মাঝেই, লোকটি এগিয়ে আসলো অনন্যার দিকে, অত:পর স্তম্ভিত গলায় প্রশ্ন করলো, ‘ মা! তোমাকে কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে, তুমি কী লতিফের মেয়ে অনন্যা? ‘

অনন্যা অবাক হয়ে গেলো! ফারিশের বাবা এবং তার বাবা কী পূর্বপরিচিত? ইশিকাও কেমন অদ্ভুদ নয়নে অনন্যার পানে চেয়ে রয়েছে। তা দেখে অধরের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। ফারিশের সেই অদ্ভুদ হাসির কোন মানে খুঁজে পেলো না অনন্যা। অনন্যা কোনপ্রকার জবাব দেওয়ার পূর্বেই, উপর থেকে রেশমি খান, আরশ এবং এনা ছুটে নেমে আসে। রেশমি খান এসেই, ইশিকা খানকে জড়িয়ে বলে,

‘ আরে ভাবি! ওয়াট অ্যা সারপ্রাইজ! তোমরা আসবে আগে বলো নি কেন? যদিও তোমার দেবর বলেছিলো তোমরা আসছো কিন্তু তা যে আজকেই আসবে তা তো জানতামই না। ‘

‘ খালেদ সবই জানতো কিন্তু কাউকে বলেনি কারণ আমরা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। ‘ বলেই এনা এবং আরশের মাথায় হাত বুলিয়ে সামান্য হাসলেন ইশিকা খান। এনা ইশিকার হাত ধরে প্রশ্ন করলো,

‘ কিন্তু ইরাশ ভাইয়া এবং ইয়ানা আপু আসে নি?’

‘ ওরা হয়তো কাল- পরশু আসবে। আসলে ইরাশের কয়েকটা আর্জেন্ট মিটিং আছে এবং ইয়ানারও কালকে একটা এক্সাম আছে। হয়তো ওরা কালকের ফ্লাইট ধরে চলে আসবে, ডোন্ট ওয়ারি। ‘

সকলের কথাবার্তার মাঝে, রুমা খান ও চলে এলেন।
তিনি এসেই রাশেদ খানকে দেখে বললেন, ‘ আমাদের কথা মনে পরলো তবে?’

রাশেদ খান তার মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ অনেক বছর পরে দেখলাম তোমায়, আমায় তো তোমরা ভুলেই গেলে, আরেকজনের কথা কী আর বলবো? আমি যে তার বাবা! এতো বছর পর এসেছি, তবুও কোন হেলদোল নেই। ‘

রাশেদ খান কথাটি যে ফারিশকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তা সকলেই বুঝতে পেরেছে! রুমা খান ভয় পেয়ে যান। বাবা- ছেলের যুদ্ধ আবার শুরু না হয়ে যায় এ ভয়ে তিনি আড়ষ্ট! ফারিশ শান্ত ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে থেকে, সোফায় গিয়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে বসে থেকে জবাব দেয়, ‘যেই ঘৃণিত ব্যাক্তিকেই, আমি বাবা বলেই পরিচয় দেইনি সে কী করে এমন এক্সপেক্টশন আমার থেকে রাখে? আমি আদোও বুঝে উঠতে পারে না। ‘

ফারিশের এমন কথা শুনে রাগে ফুশে উঠলেন ইশিকা খান। তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

‘ কিসব ব্যাবহার! ছিহ! নিজের বাবাকে অবদি এই ছেলে আজ পর্যন্ত সম্মানটুকু করে উঠতে পারলো না, যাই হোক মা যেমন ছেলে তো তেমন হবেই। ‘

ইশিকার এমন কথা শুনে, রাশেদ খান হাল্কা স্বরে বলে, ‘ আহ ইশিকা! তুমি আবার ওইসব কথা তুলে আনছো কেন?’

ফারিশ বসে থেকেই জবাব দেয়,

‘ আমি আমার বাড়িতে কাকে কীভাবে ট্রিট করবো, ইটস মাই অনলি মাই অপেনিয়ন মিসেস রাশেদ খান! হ্যা এই নামের ট্যাগ পাওয়ার যোগ্য আপনি কারণ আমার মায়ের সম্মান অনেক উপরে অন্তত আপনার মতো মহিলার থেকে। আজ মায়ের শিক্ষাতেই আপনি এখনো আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন। ‘

ইশিকা খান রেগেমেগে বললেন, ‘ দেখলে রাশেদ? তোমার ছেলে কীভাবে কন্টিনিউসলি আমাদের অপমান করে যাচ্ছে? এর জন্যেই আমি এই বাড়িতে আসতে চাইনা, কিন্তু তুমি তো তুমিই! ফ্যামেলি – ছেলে ছাড়া তো তোমার চলেই না। এতো অপমানের পরেও কীভাবে আমি এই বাড়িতে থাকতে পারি?’

ফারিশ বাঁকা হেসে বলে, ‘ তো কী? চলে যাবেন? কোথায় যাবেন ক্যানাডা? সেখানের ও ৭০℅ শেয়ার আমার! আমার জাস্ট এক কল লাগবে, আপনাদের কম্পানি টোটালি ডিস্ট্রয় করার জন্যে, সো কিপ শাট! আমার মায়ের উপরে কোন ধরণের বাজে মন্তব্য করার আগে, নিজেদের জায়গাটা ভালো করে বিবেচনা করে নিবেন। যেই ভদ্র মহিলাকে আপনি অসম্মান করছেন তার ছেলের দয়াতেই আপনারা এখনো টিকে আছেন। ‘

ফারিশের কথা শুনে ইশিকা খানসহ উপস্হিত সকলে চুপ হয়ে যায়। অপরদিকে দুশ্চিন্তাগ্রস্হ হয়ে পরে অনন্যা! ইশিকা খানের যেমন মায়ের তেমন ছেলে কথাটির অর্থ কী দাঁড়ায়? বাবা- ছেলের মধ্যে কি এমন হয়েছে অতীতে যার ফলে এতো তিক্ততা? এদিকে কোনভাবে তার বাবা লতিফ হাওলাদারও এইসবের মধ্যে কোনভাবে জড়িত, কিন্তু কীভাবে? যার ফলস্বরুপ ফারিশ আজ এমন ভয়ংকরভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে তার উপর, কিন্তু সেই অতীত কী করে জানবে সে? অনন্যা হয়তো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার পূর্বেই, ফারিশ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ মিস অনন্যা! দ্রুত ব্লাক কফি আমার ঘরে নিয়ে আসুন। ফাস্ট! ‘

বলেই উপরে চলে যায় ফারিশ। অনন্যাও আর কিছু না ভেবে রান্নাঘরে চলে যায়। এতোকিছুর মধ্যে রুমা খানের একটি বড় খটকা লাগছে, অন্যসময় তো রাশেদ এবং স্ত্রী চলে আসলে, ফারিশ বাড়ি থেকেই চলে যায়, সেখানে ফারিশ বাড়িতে আছে এবং অদ্ভুদ ভাবে অনয়সময়ের তুলনায় শান্তও আছে। রুমা খান বিড়বিড়িয়ে বললো, ‘মনে হচ্ছে বড় কোন ঝড় আসার পূর্বের অবস্হা বর্তমানে বিরাজমান।’

__________________

অভি তার অফিসে বসে বেশ কিছু ফাইল ঘাটছে এতো কিছুর পরেও তার দুশ্চিন্তা কিছুতেই কমছে না এতো কিছু করার পরেও কি আদোও তার অনন্যা তার কাছে ফিরবে! সে জানেনা তবে তার মনে হচ্ছে অনন্যা তার ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দিতে পারবে না। কারণ দিনশেষে অনন্যা নিজেও অভিকে ভালোবাসে। অভি ফাইলগুলো পাশে রেখে, অনন্যার ছবিখানা বের করে, গুনগুনিয়ে গাইতে থাকলো,

‘ কি জ্বালা দিয়া গেলা মোরে।
নয়নের কাজলের পরানের বন্ধুরে, না দেখিলে পরান পোড়ে, কি দু:খ দিয়ে গেলা মোরে, নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে……’

________________

অনন্যা ফারিশের কফি নিয়ে ঢুকতেই, দেখতে পেলো একটা ট্রাউজার পরে, গাঁয়ে টাওয়াল জড়িয়ে, ফারিশ জেল হাতে নিয়ে চুল স্পাইক করছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। অনন্যার চোখ কিছুক্ষনের জন্যেও সেদিকে আটকে যায়! অনন্যা খেয়াল করেছে, চশমা ছাড়া ফারিশের আখিজোড়া অদ্ভুদ সুন্দর দেখায়। কাঠ বাদামির হালকা রং রয়েছে ফারিশের আখিজোড়ার মণিতে। অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে, ‘ লোকটা খারাপ হলেও, দেখতে একদম বলিউড হিরোদের মতো! ইসস! আমিও না কিসব বলে যাচ্ছি একজন বিয়াত্তা বেডার নামে। আল্লাহ উনার বউ উপর থেকে দেখে যদি আমার ঘাড় মটকে দেয় তখন? না, বাবা! উনার দিকে ভুলেও তাঁকানো যাবে না। কি হয়েছে তোর অনন্যা?’

অনন্যার বিড়বিড় স্পষ্ট আয়নায় দেখতে পাচ্ছে ফারিশ। ফারিশ মুচকি হেসে উঠে। অনন্যা তা দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘ আপনি আবার আজ হাসলেন?’

‘ কেন আমি হাসলে বুঝি আপনার প্রব্লেম? ‘

কিছুটা গম্ভীর ভাবেই প্রশ্ন করলো ফারিশ। অনন্যা কফি হাতে রুমে প্রবেশ করে বললো,
‘আপনাকে সবসময় ভিলেন মার্কা হাসিতে দেখা যায়, বাট এমন নরমাল হাসিতে তেমন দেখা যায় না।’

‘ আপনি বলেছিলেন আমাকে হাসলে নাকি সুন্দর লাগে, তাই সুন্দর হওয়ার প্রচেষ্টা!’

‘ আমার কথার বুঝি আপনার কাছে দাম আছে?’

ফারিশ বিড়বিড়িয়ে বললো,
‘ তা জানি না তবে যত দিন যাচ্ছে আপনার প্রয়োজনীয়তা তত গভীরভাবে অনুভব করছি মিস অনন্যা! এমন কেন হচ্ছে বলতে পারেন?’

চলবে কী?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-২৮+২৯

0

#প্রণয়ের_রংধনু 🖤
#পর্ব-২৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যা ফারিশ এসেছে ভেবে পিছনে ঘুড়ে অভিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। অভি কেমন অসহায় পানে অনন্যার দিকে চেঁয়ে আছে। অভি থমথমে গলায় শুধালো, ‘ ওই লোক কেন আসবে? আমি এসেছি অনন্যা! আমি তোমার অভি। তোমার ভালোবাসার মানুষ। ‘

‘ তুমি? তুমি এখানে এতো রাতে কি করছো? তুমি এই বাড়িতে ঢুকলেই বা কী করে?’

অভি মাথা নিচু করে, নিচু গলায় জবাব দেয়, ‘ দেয়াল টপকে, অনেক কষ্টে বাগানের দিক থেকে এই স্টোর রুমে ঢুকেছি। খবর নিয়েছিলাম আজকে গার্ডসরা পাহাড়া দিচ্ছে না কোন কারণে। তাই সুযোগ হাতছাড়া না করে, একপলক তোমাকে দেখতে ছুটে এসেছি, এতো রিস্কের মধ্যেও। ‘

অভির আচরণে অবাক না হয়ে পারে না অনন্যা। অভির রাতারাতি এতো পরিবর্তন হলো কীভাবে? তা ঠিক মতো ঠাওড় করতে পারছে না সে। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, আচমকা অভি অনন্যার হাত ধরে, অনুতাপের সুরে বলে, ‘ আমি সব জেনে গিয়েছে। কী করে দিনের পর দিন জুঁই এবং ওই নিকৃষ্ট ফারিশ খান ষড়যন্ত্র করে এসেছে, তোমার বিরুদ্ধে। এতো বাজে মিথ্যে ভিডিও বানিয়েছে শুধুমাত্র আমার চোখে, পুরো সমাজের চোখে তোমাকে চরিত্রহীনা প্রমাণ করার জন্যে, শেফালি আমাকে সবকিছু বলেছে। এমনকি জুঁই এবং শেফালির কলের রেকর্ডিংও আমার কাছে আছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না অনন্যা। ফারিশ খান এবং জুঁইয়ের এমন অবস্হা করবো, ওদের জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়বো আমি।কিন্তু তার আগে তোমাকে আমি মুক্ত করবো। অনন্যা আমার সাথে এসো। আমাদের এখুনি বের হতে হবে। ‘

বলেই অনন্যার হাত ধরে এগোতে নিলে, থেমে যায় অভি, কারণ অনন্যা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। মুখস্রী শক্ত। আখিজোড়ায় অশ্রু এসে ধরা দিচ্ছে তার। হয়তো এখুনি টুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে যাবে। অনন্যা নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে, অভির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলে,

‘ তোমার আজ মনে হলো অভি? আমি সম্পূর্ণ নির্দোশ? কই সেদিন যখন তোমাকে আমার সবার মধ্যে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিলো তখন তো তুমি ছিলে না। আমাকে জাস্ট ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলে। আমার কথার উপর কোন বিশ্বাস নেই তোমার, অথচ শেফালি কথা শুনে এবং সামান্য রেকর্ডিং দেখে এখন তুমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলে যে, হ্যা আমি নির্দোশ! সেদিন আমার আর্তনাদ তোমার কানে পৌঁছায় নি। ভরা বিয়ের আসরে আমার গাঁয়ে হাত তুলে, তুমি বারংবার আমাকে অপমান করেছো অভি। তোমার দেওয়া অপমান সহ্য না করতে পেরে, আমার বাপির এতো খারাপ অবস্হা হয়েছে, যার ফলে আজ আমি এখানে। সেদিন যদি একটু আমায়
বুঝতে। ভালোবাসো? তো সেদিন কোথায় ছিলো তোমার ভালোবাসা?’

‘ আসলে…অনন্যা….’

অভিকে থামিয়ে অনন্যা আবারো বলতে থাকে,

‘ এতোকিছুর পরেও আমি তোমার কাছে বাধ্য হয়ে সাহায্যের জন্যে ছুটে গিয়েছিলাম। আমার বাপির তখন মরণঅবস্হা। টাকার জন্যে আমি চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম, বিয়ের বেনারশি পরে। কত অসহায়ত্ব, কত হাহাকার! তুমি আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলে, অভি। এমনকি কালকেও তুমি আমার পাশে ছিলে না, যত বাজে ভাবে অপমান করা যায়,সবকিছু করেছিলে তুমি। অপমানে লজ্জায়
ম/রে যেতে চেয়েছিলাম,সেই তুমি আজ আমাকে মুক্ত করতে এসেছো? ওয়াট আ ফানি জোক!’

অভি হাটু গেড়ে বসে পরে। অত:পর অনন্যার হাতজোড়া পুনরায় আকড়ে ধরে বলে, ‘ আমি জানি আমি যা করেছি তার কোন ক্ষমা নেই তবুও বলছি আমাকে মারো, বকো যত খুশি শাস্তি দাও অনন্যা,তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিও না। বিচ্ছেদের যন্ত্রনা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি জানো? আমি প্রতি ক্ষনে ক্ষনে তোমায় মনে রেখেছি। আমার একটা দিনও তোমায় হীনা কাটেনি। আমি তোমায় ভালোবাসি, অনন্যা। প্লিয ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! ‘

‘ অভির বিয়ের দিনের সেই কথাগুলো মনে আছে? যা আমি তোমায় বলেছিলাম?’

অনন্যার কথা শুনে, অভির মনে পরে যায়, অনন্যার বলা সেই কথাগুলো,

বিয়ের আসরে,অভির মা ছেলেকে এবং বাকি বরপক্ষকে নিয়ে, চলে যেতে উদ্বত হলে, পিছন থেকে অভিকে উদ্দেশ্য করে, অনন্যা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

‘ মি: অভি শিকদার, কে বলতে পারে? এই নষ্ট মেয়ের কাছেই হয়তো আপনাকে একদিন ফিরে আসতে হবে, কিন্তু সেদিন চাইলেও আপনি আর ফিরতে পারবেন না। সমস্ত পথ আজ নিজ হাতে আপনি বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছেন। যেই কঠিন মুহুর্তে আপনার সঙ্গ আমার যেখানে সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয়, সেখানে আপনি আমাকে একা করে চলে যাচ্ছেন। আজ না হয় কাল, বিরাট বড় এক ধাক্কা আপনি খাবেনই। মনে রাখবেন, কিন্তু। ‘

সেদিনের কথাগুলো মনে পরতেই, অনন্যার হাত ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে অভি। কত বড় ভুল করে ফেলেছে সে। নিজের গালে নিজেরই ঠাটিয়ে চর বসাতে ইচ্ছে করছে তার। অনন্যাও তার আখিজোড়ার অশ্রুটুকু মুছে, শক্ত গলায় বলে,

‘ যেই বিচ্ছেদের তীব্র আগুনে আমি প্রতিনিয়ত জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়েছি, সেই আগুন এতে সহজে তুমি নিভিয়ে দিতে পারবে না। বিশ্বাস একটি সম্পর্কের ভিত্তি। সেখানে অবিশ্বাস নামক বিষাক্ত শব্দকে তুমি আমাদের সম্পর্কের মাঝে এনে, আমাদের সম্পর্ককে সম্পূর্ন ভিত্তিহীন করে তুলেছো আজ! ‘

বলেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে ঘুড়ে দাঁড়ায় অনন্যা। অভি উঠে দাঁড়ায়। অসহায় পানে চেয়ে আছে সে। অনন্যা অভির দিকে না তাঁকিয়েই বলে,

‘ তুমি দয়া করে চলে যাও অভি। আমি জানি কীভাবে নিজেকে প্রটেক্ট করতে হয়।কীভাবে এই বাড়ি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হয়। আমি ঠিক বের হবো কিন্তু তার জন্যে তোমার কোনপ্রকার সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই। তুমি বেশিক্ষন থাকলে, যদি আবার কেউ এসে পরে তাহলে সেই চরিত্রহীনার ট্যাগ কিন্তু আমার দিকেই ধেঁয়ে আসবে। এইসব সো ক্লড পুরুষশাসিত সমাজে, তোমাদের দোষ কিন্তু কখনোই কেউ দেখবে না। ‘

অভি বুঝতে পারছে না বর্তমানে তার কি করা উচিৎ! সে কী করে থাকবে তার অনন্যাকে ছেড়ে? অভি আর কিছু না ভেবে তড়িৎ গতিতে বেড়িয়ে যায়। অভি বেড়িয়ে যেতেই, হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্যা। তখনি রুমা খান দরজায় কড়া নাড়ে। রুমা খানের ডাক শুনে অনন্যা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে বলে,

‘ দাদি! তুমি এতো রাতে? এখনো ঘুমাও নি?’

রুমা খান অস্হিরতার সুরে বললেন, ‘ কীভাবে ঘুমাবো? ফারিশ যে এখনো বাড়ি ফিরে নি। মিষ্টি বাপি বাপি বলে খুঁজছে। মেয়েটাও ঘুমাচ্ছে না। কত রাত হয়ে গিয়েছে! এতো রাত অব্দি তো ফারিশ বাইরে থাকে না। কি হয়েছে ওর কে জানে? আমার বড্ড চিন্তা হচ্ছে রে। ‘

রুমা খানের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় অনন্যার। যে মানুষটি তাকে সেবা যত্ন করে সুস্হ করলো, তাকেই সকালে এতো বাজেভাবে অপমান করলো অনন্যা, তার জন্যেই কি সে বাড়ি ফিরছে না? তবে অনন্যার মতো সামান্য কাজের লোকের কথা তার কেন গাঁয়ে লাগবে? আগেও তো কত কথা শুনেয়েছি সে কিন্তু কই? ফারিশ তো গাঁয়ে মাখেনি তেমন তবে আজ কি হলো তার?

‘ উনার অফিসে থেকে খবর নিয়েছিলেন দাদি?’

‘ নিয়েছিলাম, আজ সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়েছে ছেলেটা কিন্তু কোথায় গিয়েছে কেউ কিচ্ছু জানে না। এমন রাত অবদি বাইরে থাকার ছেলে তো আমার ফারিশ না, বুঝতে পারছি না, কী হয়েছে!’

অনন্যা রুমা খানকে শান্ত করতে বলে, ‘ তুমি শান্ত হও দাদি। আমি দেখছি বিষয়টি। তুমি চিন্তা করো না, উনি ঠিক ফিরবে। আচ্ছা উনার মেনেজারের কি নাম যেন? ‘

‘ শফিক?’

‘ হ্যা! হ্যা। শফিক ভাইয়ের নাম্বার আমায় একটু দিবে দাদি?’

‘ আচ্ছ, দিচ্ছি। ‘

শফিকের নাম্বার পেয়ে, অনন্যা শফিকের নাম্বারে ডায়াল করে, কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর পরেই, শফিক নাম্বার টা রিসিভ করে বলে, ‘ হ্যালো! কে বলছেন?’

‘ আমি অনন্যা। ‘

‘ অনন্যা ম্যাম! আপনি এতো রাতে? ‘

‘ আসলে মি: ফারিশ এখনো ফিরেনি। বাসার সবাই বেশ চিন্তা করছে। দাদি, মিষ্টি কেউ ঘুমাচ্ছে না। আপনি কী দয়া করে বলতে পারবেন উনি কোথায়?’

‘ আমি সঠিক বলতে পারবো না কিন্তু স্যার বোধহয় হপ্স নামক বারে গেলেও যেতে পারেন। ‘

‘ বারে? এইসময়ে? ‘

‘ আমি সিউর না কিন্তু যেতে পারেন হয়তো ‘

‘ আচ্ছা, আপনি কী আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারবেন? ‘

‘ আপনি এতো রাতে বের হবেন ম্যাম? কিন্তু স্যার জানলে অনেক রাগ করবে। পরে আবার আমার চাকরী নিয়ে টানাটানি পরবে।’

‘ আমি দাদির পার্মিশন নিয়ে বের হবো, আপনি শুধু আমাকে সেখানে নিয়ে যান। আপনার কোন সমস্যা নেই, আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি। ‘

__________________

শহরের একটি নামে দামে বারে বসে একের পর এক বিয়ারের বোতল শেষ করে দিচ্ছে ফারিশ। ফারিশ বিয়ারের দিকে তাঁকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ আমি অনেক খারাপ! আইম দ্যা গ্রেট হার্টলেস! সবার শুধু আমার রাগ, জেদ, আমার ইগো চোখে পরে। কিন্তু আমিও যে একজন রক্তে মাংসে মানুষ। কারো আমার যন্ত্রনা, আমার বেদনা চোখে পরে না। ‘

বলেই নিজের বুকে হাত রেখে আখিজোড়া বন্ধ করে, ফের বিড়বিড়িয়ে ফারিশ বলতে থাকে, ‘ আমারোও ঠিক বুকের এখানে অনেক জ্বলে! ছোটবেলা থেকে সেই যন্ত্রনাগুলোকে বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে বড় হয়েছি, কিন্তু সেই যন্ত্রনা কখনো কেউ উপলব্ধি করেছে?আমারোও অনুভুতি আছে। দিনশেষে আমি বড্ড একা! ‘

দূরে ডান্স ফ্লোরে ছোট ছোট জামা পরিহিত মেয়েরা দূর থেকে ফারিশকে একপ্রকার চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে এমন অবস্হা! ফারিশ তা দেখে সামান্য বাঁকা হেসে আবারোও বিয়ারের বোতলে চুমুক দেয়।তখনি একজন মেয়ে, ফারিশের সামনে বসে, হাত এগিয়ে বলে, ‘ হ্যাই! আম নেন্সি! ইউ আর ফারিশ খান রাইট? ডু ইউ ওয়ান্ট টু ডেট ইউথ মি রাইট নাও হ্যান্ডসাম? ইউ নো? আমি আপনার অনেক ম্যাগাজিন দেখেছি, আপনার সব ইন্টারভিউ আমার দেখা। ইউ আর মাই চার্ম পিন্স! প্লিয ডোন্ট টার্ন মি এওয়ে। ‘

ফারিশ মেয়েটার দিকে ঝুঁকে, ফিসফিস করে বলে,

‘ ফারিশ খান সেকেন্ড হ্যান্ড পছন্দ করে না। বিকজ আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ! অনলি ব্রেন্ড ইজ রিয়েল। ‘

ফারিশের কথা শুনে নেন্সি ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ‘ তুমি আমাকে সেকেন্ড হ্যান্ড বললে? তুমি জানো কত ছেলে এই ন্যান্সির জন্যে পাগল? আমি শহরের নামকড়া মডেল এন্ড তুমি আমাকে অপমান করলে? এইভাবে রিযেক্ট করলে?’

ফারিশ ন্যান্সিকে ভালো করে পর্যবেক্ষন করে, সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বললো, ‘ সেসব ছেলেরা অন্ধ হবে নাহলে তাদের চোখ ট্যারা। নাও গেট লস্ট!’

ন্যান্সি রাগে অপমানে চলে যায় সেখান থেকে।

‘ যত্তসব! ‘ বলে আবারোও বিয়ারে চুমুক দিতে গেলে, কেউ এসে ফারিশের হাত ধরে বলে। ফারিশ এইবার ক্ষেপে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ এতো অপমান করার পরেও, আবারোও এসেছো?স্টুপিড ওমেন…..’

চলবে কী?
শব্দসংখ্যা- ১৫০০

#প্রণয়ের_রংধনু 🖤
#পর্ব-২৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যাকে এতো রাতে বারে দেখে কিছুটা চমকে উঠে
ফারিশ। সে বারবার চোখ কচলিয়ে ভালো করে তাঁকায়, তার ধারণা সে ভুল দেখছে! অনন্যা কেন এতো রাতে বারে আসবে? তার খোঁজে নিশ্চই আসবে না তবে? সে নিজের মনের ভূল করে আবারোও টেবিলে বসে, বিয়ারের বোতলে চুমুক দিলো। অনন্যা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! মানুষটা এতো অদ্ভুদ কেন? অনন্যার ধারণামতে, এতো রাতে অনন্যাকে বারে দেখে নানা প্রশ্ন করবে ফারিশ, নাহলে চিৎকার, চেচামেচি করবে অথচ ফারিশ সম্পূর্ণ শান্ত!অনন্যা নামক রমনী তার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে অবদি খেয়ালও নেই তার। অনন্যা ফারিশের পাশের চেয়ারে বসে বললো, ‘ আপনি ড্রিংক করেন? ‘

ফারিশ অনন্যার দিকে না তাঁকিয়েই বললো, ‘ আপনি আমার এতো বাজে অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছেন, যার ফলে আজকাল আপনি আমার কল্পনাতে এসেও হানা দেন। বড্ড জ্বালাতন করেন।’

‘ আমি আপনাকে জ্বালাতন করি?’

‘ করেন না বুঝি?’

‘ উহু! আমার ধারণামতে আপনি আমাকে জ্বালাতন করেন, শাস্তি দেন কঠিন, কঠিন! ‘

‘ আমি কি আপনাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলি?’

ফারিশের এমন প্রশ্নে কিছুটা থেমে গেলো অনন্যা। ফারিশ হঠাৎ অনন্যার হাত ধরে ঠোটজোড়া উল্টো করে বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমিও অনেক কষ্ট পেয়েছি ছোটবেলা থেকে। আমি হার্টলেস নই! আমাকে খারাপ বানানো হয়েছে। আমার থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছে ওরা। ‘

ফারিশের থেকে তার মাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে কথাটি মস্তিষ্কে প্রবেশ করতেই, অনন্যা ভাবতে থাকে ফারিশ খান কিসব বলছেন? উনার মাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে মানে? তবে উনার মায়ের মৃত্যু কি স্বাভাবিক নয়? তবে এর পিছনের রহস্যে কী? সেই মৃত্যু কে ঘিড়েই তবে আজ এই পরিস্হিতি? ফারিশ আবারো ক্লান্তমাখা গলায় বলে উঠলো,

‘এখন আমি আপনাকে চাইলেও কঠিন শাস্তি দিতে পারি না। জানেন? কেন যেন মায়া হয় আপনাকে দেখলে। আপনি খুব মায়াবতী! আপনাকে দেখলে বুক কেঁপে উঠে। কেন হয় এমন? ‘

ফারিশ আখিজোড়ায় অদ্ভুদ অস্হিরতা! কন্ঠে রয়েছে জড়তা! অনন্যার বুক ধক করে উঠলো! কি বলে যাচ্ছে মানুষটা? ফারিশের কথা শুনেই সে বুঝলো ফারিশ নেশাগ্রস্ত অবস্হায় কথাগুলো বলছে। কোথায় যেন অনন্যা শুনেছিলো মানুষ নেশাগ্রস্হ অবস্হায় অনেকসময় সত্যি কথা বলে। অনন্যা সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে, ফারিশের হাত ধরেই, ফারিশকে উঠানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,

‘ আপনি এখন উঠুন! বাসায় যেতে হবে। ‘

ফারিশ উঠে দাঁড়িয়ে অভিমানের সুরে বললো, ‘ কিন্তু আমি কেন যাবো? আমি তো খারাপ লোক, বাজে লোক! হার্টলেস! আমি না গেলে কি এমন মহাভারত অশাদ্ধ হয়ে যাবে? ‘

ফারিশের এমন কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো অনন্যা। লোকটা বাইরে থেকে যতটা শক্ত, কঠোর কিংবা নিজেকে খারাপ দেখানোর চেষ্টা করুক, ভিতর থেকে মানুষটা একদম অন্যরকম। আজ তা গভীরভাবে উপলব্দি করছে অনন্যা। অনন্যার হাত ধরতে গিয়ে কী ভেবে যেন পরক্ষনে নিজের হাত সরিয়ে, ফারিশ বলে উঠে, ‘ ফারিশ খান নিজেই নিজেকে সামলাতে পারেন। আপনি এখন যান। আমার কল্পনাতে আসবেন না প্লিয! ‘

অনন্যা মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘ হায় খোদা! মি: খারুশ থুরি ফারিশ খান আমি আপনার কল্পনা না, আমি বাস্তবে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। ‘

‘ আপনি বাস্তব হন বা কল্পনা হন ফারিশ খান কেন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে হাঁটবে? সে একাই নিজেকে সামলাতে পারে সেই ছোট বেলা থেকে।’

বলেই ফারিশ একপা এগোতে নিলে, হোচট খেয়ে পরে যেতে নিলে, অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে ফারিশের হাত নিজের কাঁধে রেখে, ফারিশকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় বলে, ‘ খারুশ বেটা এক নাম্বারের! হাঁটতে পারছে না নেশারঝোঁকে অথচ তার এটেট্যুয়েড ল্যাভেল এক পার্সেন্ট ও কম নেই। ‘

বলেই ফারিশকে নিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো অনন্যা, যদিও সেখানে মেয়েরা কেমন করে তাঁকাচ্ছিলো অনন্যা এবং ফারিশের দিকে। ফারিশের থেকে রিযেক্টেড ন্যান্সিও রাগে ফুসফুস করে তাদের দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। তার মতে এই মেয়েটার জন্যেই আজ হয়তো ফারিশ খান তাকে এতো বাজেভাবে রিযেক্ট করলো।

______________
অভি বাসায় আসতেই, অভির মা তড়িৎ গতিতে এসে বললেন, ‘ কি অবস্হা অভি? তোমার মুখস্রী এমন দেখাচ্ছে কেন? সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি? কালকের থেকে লক্ষ্য করছি, তুমি যেন নিজের মধ্যে নেই। ‘

‘ আমি অনন্যার কাছে গিয়েছিলাম মা!’

‘ অনন্যার কাছে গিয়েছিলে মানে? তুমি ওই চরিত্রহীনা…..’

নিজের মায়ের কথাকে সম্পূর্ন শেষ করতে না দিয়ে, অভি হাত জোড় করে বললো, ‘ মা! দয়া করে, অনন্যার সাথে কোনপ্রকার অসম্মানজনক শব্দ যুক্ত করবে না। আমাদের বিশেষ করে আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। ‘

‘ কিসের ভুল হয়েছে? অভি আমাকে সব খুলে বলো। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে কোন গন্ডগোল হয়েছে। ‘

অভি শুরু থেকে সবকিছু তার মাকে খুলে বলে। সবকিছু শুনে অভির মায়ের মাথায় হাত! এতো বড় ভুল কী করে করলেন তারা? অভি কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে ধপ করে বসে, তার মায়ের পা আকড়ে ধরে বলে, ‘ মা! যেইভাবেই হোক! আমার অনন্যাকে আমার কাছে এনে দাও! তুমি তো জানো, আমি অনন্যাকে কতটা ভালোবাসি। অনেক বড় ভুল করেছি আমি জানি, তার জন্যে শাস্তি পেতে আমি রাজি কিন্তু শাস্তিস্বরূপ আমি অনন্যাকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমার অনন্যাকে এনে দাও না মা। আমি আর পারছি না। ‘

ছেলের এমন অনুরোধে অভির মায়ের আখিতেও অশ্রুে এসে ধরা দেয়। ছোট্ট বাচ্চা ছেলে যেমন তার সবথেকে পছন্দের খেলনা পাওয়ার জন্যে কেঁদে কেটে বাবা- মায়ের কাছে বায়না ধরে সেই খেলনা এনে দেওয়ার জন্যে তেমনি আজ অভিও তার ভালোবাসার মানুষকে পেতে ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় অনুরোধ করছে। অভির মা ঝুঁকে ছেলেকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নেন।

_________________

ফারিশকে কোনমতে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে, নিজেও গাড়িতে বসে পরে। গাড়িতে শফিক ও ছিলো। শফিক ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ছিলো।
সে পিছনে তাঁকিয়ে বলে, ‘ স্যারের অবস্হা তো ভালো না, ম্যাম! ‘

‘ হ্যা! উনি ড্রাংক! আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বাড়ি গিয়ে উনাকে লেবুর পানি খায়িয়ে দিবো। আমাদের সবার আগে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। ‘

শফিক মাথা নাড়িয়ে, ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে। অপরদিকে ফারিশ বিড়বিড়িয়ে বলছে,

‘ দিনশেষে আমি বড্ড একা! আমারও কষ্ট হয়। আমার অন্তরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায় কিন্তু সেই খবর কে রাখে? আমি খারাপ নই…! ‘

বাকিটুকু শুনতে পেলো না অনন্যা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অত:পর বাড়িতে ফোন করে রুমা খানকে জানিয়ে দিলো, তিনি যেন মিষ্টিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়, বর্তমানে ফারিশ নেশাগ্রস্ত অবস্হায় রয়েছে, এমন অবস্হায় ফারিশকে দেখলে মিষ্টি হয়তো অন্যকিছু ভাবতে পারে। ফোনটা কেটে অনন্যা জানালার দিকে তাঁকাতেই, ফারিশ অনন্যার কাঁধে ঘুমিয়ে পরে। ফারিশের গরম নি:শ্বাস অনন্যার কাঁধে উপচে পরছে। অনন্যারও নি:শ্বাসের গতি বাড়ছে ঘন ঘন! সে ভাবলো হয়তো ফারিশকে সরিয়ে দিবে কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যাবে ভেবে সরালো না বরং ফারিশের কোকড়া চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দিলো।

_____________________

সকালে বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো ফারিশের। সে আড়মোড় করে বিছানা থেকে উঠলো। তার ব্লেজার টা বিছানার এক কোনে যত্ন করে রাখা এবং জুতা ও ঠিক জায়গায় রেখে দেওয়া! কালকের রাতের কথা ঠিক করে মনে করার চেষ্টা করতে করতে, দরজা খুলতেই দেখতে পায়,ছোট্ট অনন্যা গোল্ডেন পারের সাদা শাড়ি পরে, সাদা চুলের উইক পরে এবং চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে , লাঠি হাতে নিয়ে, গলার স্বর কিছুটা ভারি করে, খেক খেক গলায় বলছে,

‘ কিগো নাতী? কালকে রাতে কোথায় ছিলে তুমি? তুমি কী জানো না? রুমা খানের বাড়িতে লেট করে ফেরা নট এলাও। ‘

মিষ্টি একদম রুমা খানের মতো সেঁজেছে যেন সে আরেকজন ছোট্ট রুমা খান। মিষ্টিকে দেখে ফারিশ ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে বললো,’ মা! তুমি দাদি সেঁজেছো?’

মিষ্টি ফোঁকলা দাঁত দিয়ে হেসে বললো, ‘ হ্যা! যেমন খুশি, তেমন সাঁজোর কম্পিটিশনের জন্যে। মা সাঁজিয়ে দিয়েছে।’

পিছনে অনন্যাও দাঁড়িয়ে ছিলো। সে এই প্রথমবার ফারিশকে এতো প্রানখুলে হাসতে দেখলো। সে ফারিশের হাসি দেখে মুগ্ধ গলায় বললো, ‘ আপনার হাসি বড্ড সুন্দর, তবে সবসময় ঘুমড়ো মুখে থাকেন কেন? আপনাকে হাসলে সুন্দর লাগে। ‘

চলবে কী?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-২৬+২৭

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-২৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যার ফারিশের হাত ধরে ক্রমাগত বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। ফারিশের হাত শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে, যেন ছেড়ে দিলেই, ফারিশ পালিয়ে যাবে। ফারিশের কানে এখনো অবদি ‘ভালোবাসা ‘ শব্দটি বেজে যাচ্ছে। সে পিছনে ঘুড়ে অনন্যার কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে, হাতটা অনন্যার কপালের কাছে ঠেকায়। অনন্যার আবারো জোড় এসেছে। পূর্বের থেকেও বেশি জ্বর হয়েছে। ফারিশের মনে পরলো, ডাক্তার সাহেব তাকে যাওয়ার পূর্বে বলে গিয়েছিলো, ‘ তোমার স্ত্রীকে একা ছাড়বে না কিন্তু। মাথার চটের জন্যে রাতে কিন্তু জ্বর হওয়ার একটা সম্ভবনা রয়েছে। ‘

ফারিশ ভাবলো আগের মতো করিমাকে ডেকে পাঠাবে কিন্তু রাত অনেক হয়েছে। করিমা হয়তো দরজা আটকে ঘুমিয়ে আছে। সে কি এখন করিমার দরজায় নক করে বলবে, ‘ মিস অনন্যার বেশ জ্বর উঠেছে। উনার এখন আপনাকে প্রয়োজন। আপনি এখন ঘুমাবেন না। উনার খেয়াল রাখুন।

ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুদ ঠেকলো ফারিশের কাছে। সে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ফার্স্টটেড বক্স বের করে, থার্মোমিটার বের করে। সেই থার্মোমিটার টা অনন্যার মুখে লাগিয়ে দিয়ে, জ্বরটা মাপার জন্যে। কিছুক্ষন পরে, থার্মোমিটার টা নিয়ে ফারিশের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। জ্বর প্রায় ১০০ ডিগ্রির উপরে। ফারিশ বুঝতে পারছে না বর্তমানে তার কি করার উচিৎ! সে আবারো বক্স থেকে একটা ওষুধ বের করে যা ডাক্তার দিয়েছিলো। তিনি বলে গিয়েছেন জ্বর বেশি হলে যেন ট্যাবলেটটি অনন্যাকে খাওয়ানো হয়, তাহলে আস্তে ধীরে জ্বরটা কমে যাবে। ফারিশ তাই করলো। অনন্যার কাছে গিয়ে বলে ঠান্ডায় গলায় বলে উঠলো, ‘ মিস অনন্যা একটু উঠুন! আপনার গাঁয়ে অনেক জ্বর। আপনি মেডিসিন টা খেয়ে নিন।’

অনন্যা জ্বরে কেঁপে চলেছে। ফারিশের কথাগুলো বোধহয় তার কানে যায়নি। সে শুধু অনবরত বিড়বিড় করে যাচ্ছে। ফারিশ বাধ্য হয়ে, নিজেই অনন্যার পিঠে হাত দিয়ে, অনন্যাকে বসানোর চেষ্টা করলে, অনন্যা গিয়ে ফারিশের বুকে ঢলে পরে। ফারিশ স্তব্ধ হয়ে যায়। আখিজোড়া হয়ে যায় তার বন্ধ। তার হৃদস্পন্দন বৃষ্টিভেজা সেই দিনের থেকেও তড়িৎ গতিতে চলতে শুরু করে। তার হাত এখনো অনন্যার পিঠে। সে আকড়ে ধরে আছে অনন্যাকে। অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলেই যাচ্ছে, ‘ আমাকে ভালোবাসবে একটু? আমার ভালোবাসা খুব প্রয়োজন। আমাকে ভালোবাসো না কেন তুমি?’

ফারিশের কানে অনন্যার প্রতিটি কথা পৌঁছাছে। সেই কথাগুলো যেন ফারিশের বুক ভেদ করে, হৃদয়ের গভীরে গিয়ে ঠেকছে। আজ ফারিশের কাছে নিজেকে কেন যেনো বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে অনন্যা বর্তমানে নিজের মধ্যে নেই, থাকলে বোধহয় এতোক্ষনে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যেতো। হয়তো মুখস্রী খানা টকটকে লাল হয়ে যেতো। ফারিশ খেয়াল করেছে লজ্জায় সেই মুখস্রীখানা অধিকতর সুন্দর হয়ে উঠে। ফারিশের মস্তিকে এইসব কথা চলে আসতেই, ফারিশ আপনমনে বলতে থাকে,’ওহ শিট! আমি এইসব স্টুপিডের মতো কিসব ভেবে যাচ্ছি?হাও কেন আই থট দিজ? পুরো মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার। ‘
সে আলতো করে অনন্যাকে নিজের থেকে সরিয়ে, অনন্যাকে বিছানার সাথে ঠেকিয়ে বসায়। অনন্যা অনাবরত বিড়বিড় করেই যাচ্ছে। ফারিশ কোনভাবে অনন্যার মুখটা নিজের দিকে এনে, জোড় করে মুখে ট্যাবলেটটা ঢুকিয়ে দিয়ে, পানি খায়িয়ে দেয়। অত:পর অনন্যাকে শুয়িয়ে দিয়ে সে।

____________________

অভি নিজের বাড়িতে এসে দরজা আটকে বসে আছে। সে আজকে রাতে খায়নি অবদি। তার মা দরজায় অনেক্ষন নক করেছেন এবং বার বার জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ অভি! কি হয়েছে তোর? আজকে তো তোর জুঁইকে নিয়া আসার কথা ছিলো! তুই কি আদোও জুঁইয়ের খালার বাড়িতে গিয়েছিলি? কি হলো হঠাৎ? উত্তর দিচ্ছিস না কেন? ‘

অভির থেকে কোনপ্রকার উত্তর না পেয়ে, অভির মা বাধ্য হয়ে চলে যান। অভি তার ফোন বের করে, অনন্যার সাথে প্রত্যেকটা মুহুর্তের ছবিগুলো ভালো করে দেখছে। বারবার জুম করে অনন্যার হাসিমাখা মুখস্রীখানা দেখছে। এমন হাসিখুশি সরল সোজা মেয়েটাকে সে দিনের পর দিন বাজে ভাবে অপমান করে গিয়েছে! মেয়েটা কত কেঁদে কেঁদে বলেছে সে নির্দোশ অথচ তাকে বিশ্বাস না করে, সামান্য একটা ভিডিও দেখে সে তাকে অপমান করেই গিয়েছে। এমনকি আজও তার কঠিন সময়ে তার ঢাল না হয়ে তাকে আরো বাজে ভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এসেছে। কথাগুলো মস্তিষ্কে চলে আসতেই, ‘ অনন্যা ‘ বলে মেঝেতে বসে অঝরে কাঁদতে থাকে অভি। সে ঠিক করেছে শেফালির থেকে কালকে শুরু থেকে সবকিছু শুনে, এইসব পিছনে যারা যারা তাদের প্রত্যেককে শাস্তি দিয়ে সে তার অনন্যাকে ফিরিয়ে আনবে।সে অপলক দৃষ্টিতে আকাশের চাঁদখানার দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় বলতে থাকে, ‘ অনন্যা আজ মনে হচ্ছে, আজ আকাশের চাঁদের থেকেও তুমি সুন্দর। কারণ তোমার কলঙ্ক নেই। তুমি সবসময়ই স্নিগ্ধ, অপূর্ব সুন্দর। ‘
অভির মনে হচ্ছে ছবিতে থাকা অনন্যা যেন বিড়বিড় করে বলছে, ‘ তুমি কাঁদছো কেন অভি? তুমি কী জানো না? ছেলেদের স্ট্রং থাকতে হয়। তাদের কাঁদলে মানায় না। বি স্ট্রং! ‘

____________________

অনন্যা বিছানায় শুয়ে কেঁপে কেঁপে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। ফারিশ রুমে পাইচারি করে যাচ্ছে। সে আবারো অনন্যার কাছে গিয়ে, অনন্যার গালে হাত দিয়ে দেখে অনন্যার জ্বর এখনো কমছে না। সে আর কিছু না ভেবে রুম থেকে বেড়িয়ে, পাশে থাকা বেসিং থেকে এক বাটি নিয়ে আবারো রুমে ঢুকে, রুমালটা বের করে, অনন্যার কাছে বসে। অত:পর রুমালটা পানিতে ভালো করে ভিজিয়ে, অনন্যার কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। মিষ্টির যখন জ্বর হয় তখন সে এইভাবেই মিষ্টির পাশে বসে সারারাত মিষ্টির কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। ফারিশ সারারাত ধরে অনন্যার কপালে অনাবরত জলপট্টি দিতে থাকে পাশে বসে। একটা সময় ভোরের দিকে সে চেয়ারে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পরে। রুমা খান ফজরের নামায পরে, অনন্যাকে এক পলক দেখতে এসে নিজেই অবাক হয়ে যান। অনন্যা ফারিশের আকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়, অপরদিকে ফারিশও অনন্যার হাত ধরে চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে। খাটের পাশে থাকা জলপট্টির পানিভরা বাটি দেখে রুমা খানের বুঝতে বাকি নেই, ফারিশ নিজে সারারাত জেগে অনন্যার সেবা করেছে। রুমা খান বুঝতে পারছেন কালকের ঘটনার পর অনন্যার অবস্হার জন্যে মনে মনে বেশ অপরাধবোধে ভুগছিলো ফারিশ। তাই বলে যাকে শত্রু ভেবে বাড়িতে এনেছিলো, তাকেই রাত জেগে সেবা করলো? আদোও শুধুমাত্র অপরাধবোধের জন্যে নাকি ফারিশের মনেও নানারকম অনুভুতি ঘিড়ে ধরেছে অনন্যাকে নিয়ে? কথাগুলো মস্তুিষ্কে আসতেই, মুচকি হেসে ফেললেন রুমা খান। সে ভাবলেন অন্য কেউ যদি এখন দুজনকে একসাথে দেখে ফেলে, তাহলে তিলকে তাল বানিয়ে ফেলবে, কালকের মতো। রুমা খান ঝাঁকিয়ে, ফারিশকে ডাকতে থাকে। রুমা খানের ডাক পেয়ে ফারিশ তড়িৎ গতিতে, উঠে গিয়ে বলে, ‘ দাদি! তুমি এখন? ‘

‘ হ্যা! আমি। তা এখানে কি হচ্ছিলো?’

ফারিশ আমতা আমতা করে বলে, ‘ আসলে দাদি..

ফারিশকে থামিয়ে বলে, ‘ এখন অনন্যার হাতটা ছেড়ে দিয়ে, নিজের রুমে যাও। এভ্রিথিং ইজ ওকে নাও। ‘

রুমা খানের কথা শুনে ফারিশ দ্রুত অনন্যার হাত তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিয়ে, চলে যেতে নিলে, কি মনে করে যেনো আবারো অনন্যার কাছে যায়। অত:পর অনন্যার কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর নেই। অনন্যার জ্বর কমে গেছে বিধায় ফারিশ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে, দ্রুত চলে যায়। নাতীর এমন কান্ডে রুমা খান অবাক না হয়ে পারেন না। তিনি ফের হেসে উঠেন, যেনো বর্তমানে নায়ক- নায়িকার মজাদার সিকিউওয়্যাল চলছে।

_______________

সকালে অফিসের জন্যে রেডি হয়ে ফারিশ ড্রাইনিং টেবিলে বসে। সেখানে তার কাকাও বসে ছিলো। তিনি খাওয়ার মাঝে হুট করে বলে উঠলাম, ‘ শুনলাম দুই, একদিনের মধ্যেই ভাই দেশে আসছে।’

চলবে কী?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-২৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ঘুমন্ত অনন্যার দিকে নিষ্পলকভাবে তাঁকিয়ে রয়েছে ফারিশ। নিষ্পাপ সুন্দর মুখস্রী মেয়েটার। কালকের রাতের পর থেকে এক বাজে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ফারিশের। তা বাজে নাকি অদ্ভুদ অভ্যাস তা ঠিক বুঝে উঠতেপ পারছ না সে। অনন্যার ঘুমন্ত মুখস্রী দিকে তাঁকালেই তার সমস্ত ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। আজ যখন নীচে তার কাকার খালেদ খানের থেকে শুনলো তার বাবা রাশেদ খান প্রায় ৫বছর পরে আবারোও দেশে ফিরছে, তখনি তার মেজাজটা বিগড়ে গিলো। সে খাবার টেবিলে থাকা খাবার গুলো একপ্রকার ছুড়ে ফেলে, রেগে হনহন করে উপরে চলে গেলো। সবকিছু নিরবের মতো পরিদর্শন করলেন খালেদ খান। তখন রুমা খান তার ছেলের কাছে এসে বললেন, ‘ তুমি এখুনি কেন বলতে গেলে যে, রাশেদ আসছে। তুমি কী জানো না? যেই কয়েকদিন রাশেদ থাকবে, সেই কয়েকদিন তো বাড়িতেই থাকবে না আমার নাতীটা। দেখবে এখুনি বাড়ি ছেড়ে গেলো বোধহয়। ‘

‘ তার মানে কি মা? তাই বলে কী ভাই আসবে না? তেমারও তো ভাইকে দেখার ইচ্ছে করে তাই না?’

‘ হ্যা। ইচ্ছে করে। ‘

‘ তাহলে? আগে জানালেও কি বা পরে জানালেও কি? ভাইয়া আসার খবর এমনিই পেয়ে যাবে ফারিশ, তখন তুমি তাকে চাইলেও আটকাতে পারবে না। ‘

ছেলের কথা শুনে রুমা খান হতাশার দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফারিশ উপরে উঠেই আশে পাশে যা পায় তাই ছুড়ে ফেলতে থাকে। রাশেদ খান নামক লোকটিকে আবারোও দেখতে হবে, ভেবেই কেমন গা শিউরে উঠে তার ঘৃণায়! ফারিশের ভাষ্যমতে লোকটা আগেও জঘন্য ছিলো এখনো আছে, এমনকি ভবিষ্যৎও থাকবে। এতো রাগ, ক্ষোভের মধ্যেও ফারিশের নজর যখন ঘুমন্ত অনন্যার দিকে যায় তখন সে স্হীর হয়ে যায়। সে আরেকটু এগিয়ে, অনন্যার রুমে ঢুকে, অনন্যার কাছে গিয়ে, অনন্যার কপালে হাত দিতে চাইলে তখনি চট করে আখিজোড়া খুলে ফেলে অনন্যা। অনন্যাকে বড় বড় চোখ করে ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। ফারিশ হাল্কা করে হেসে দ্রুত সরে যায়। অনন্যা বিছানায় বসে, নিজের ওড়না ভালো করে জড়িয়ে, আশে পাশের অবস্হান বুঝার চেষ্টা করে। সে বিলাশবহুল একটি ঘরের বিছানায় রয়েছে। যেই রুমটা ফারিশের রুমের পাশে, কিন্তু সে কী করে এলো? সে তো রাস্তায় চলে গিয়েছিলো তখনি একটা ট্রাক তার দিকে তেড়ে আসে কিন্তু তারপর? তারপর কি হলো?
ফারিশ অনন্যার মুখস্রী দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, আসলে অনন্যা কি ভাবছে। ফারিশ পকেটে হাত দিয়ে, গম্ভীর সুরে বলে, ‘ মিস অনন্যা! আমি জানি, আপনি আসলে কী ভাবছেন। কিন্তু আপনি কি ভেবে দেখেছেন আপনি আসলে কী করছিলেন? কোন সেন্স আছে আপনার? আমি ঠিক সময়ে না আসলে কী হতো হ্যা? নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে, মেইন রোডে চলে গেলেন দৌড়াতে দৌড়াতে। সেখানে ট্রাকটা যেই গতিতে আপনার দিকে ধেয়ে আসছিলো, একটুর জন্যে আপনি বেঁচে গেছেন।’

ফারিশের কথার মাঝেই, চেঁচিয়ে বলে অনন্যা জবাব দিলো, ‘তো ম/রে যেতে দিতেন আমায়। কেন বাঁচিয়েছেন? ওহ হ্যা! কি যেন পুরনো প্রতিশোধের খেলা খেলছেন আপনি। সেই খেলা তো আর খেলতে পারতেন না। আমি যদি এতো সহজেই ম/রে যাই, তাহলে তো আপনার মজা শেষ! আপনার আনন্দ, আপনার ইঞ্জয়মেন্ট তো আমাকে তিলে তিলে মরতে দেখার মধ্যে বেশি রয়েছে এন্ড ফার্স্ট অফ অল! আমি রাগে নয় দু:খে আফসোসে কালকে বেড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম মি: ফারিশ খান। নিজের চরিত্রের পর দিনের পর দিন এমন নিকৃষ্ট অপবাদ আমি মেনে নিতে পারছি না। আমিও মানুষ! আপনার প্রতিশোধের জন্যে আপনি দিনের পর দিন আমাকে আপনার নোংরা গেমে জাস্ট ইউজ করে যাচ্ছেন। আমি আর পারছি না! জাস্ট পারছি না। ‘

বলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকে অনন্যা। তার মধ্যে জমে থাকা সমস্ত দু:খ, ক্ষোভ, কালকের করা প্রতিটা অপমানের জন্যে জমে থাকা রাগ সবকিছু সে ফারিশের উপর উগড়ে দিয়েছে। অদ্ভুদের বিষয় হলো ফারিশ সবকিছু শুনলো শান্ত ভাবে, অথচ সে কোনপ্রকার উত্তর দিলো না। সে কোনপ্রকার জবাব না দিয়েই বেড়িয়ে গেলো। ফারিশ বেড়িয়ে যেতেই, হাটু গেড়ে বসে কাঁদতে থাকে অনন্যা। তার ধারণামতে আজ বোধহয় সে ম/রে গেলেই সবকিছু শান্ত হয়ে যেতো। এতো অত্যাচার, অপমানের অবসান ঘটতো।

তার ভাবনার মাঝেই, রুমা খান রুমে ঢুকে বললেন, ‘ দিদিভাই কেমন লাগছে শরীরটা?’

অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে নিজের অশ্রু মুছে বলতে লাগলো, ‘ দাদি আপনি এইসময়ে। ‘

রুমা খান অনন্যার পাশে বসে, অনন্যার মাথয় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘ কাল রাতে মাথায় চট পাওয়ার জন্যে তোমার অনেক জ্বর উঠেছিলো তা জানো অনন্যা? ‘

অনন্যা অবাক হয়ে বলে, ‘ আমার জ্বরও এসেছিলো।’

‘হ্যা! তুমি কালকে থেকে আজ অবদি সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে ছিলে। কোন হুশ ছিলো না। জ্বর ১০০ ডিগ্রির উপরে ছিলো তখন কে সারারাত জেগে সেবা করেছিলো, জানো?’

‘কে?’

অনন্যার এমন প্রশ্নের উত্তরে করিমা রুমে দুধের গ্লাস নিয়ে, ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘ কে আবার? ফারিশ স্যার! মাগো মা! আমি তো আপনারে ভোর বেলায় দেখতে আইছিলাম আপা। দাদিও দেখছে। বেডায় সারারাত৷ আপ্নারে ওষুধ খাওয়াইয়া,জ্বলপট্টি দিতে দিতে চেয়ারে ঘুমায় গেছিলো, বাবা যায়? ওইযে দেহেন আপনার বিছানার টেবিলেই, ওষুধ এবং জলপট্টির বাটিডা আছে। ‘

করিমা কথা শুনে বিছানার পাশে থাকা ওষুধ এবং বাটি দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় এক মুহুর্তের জন্যে অনন্যা।
যেই মানুষটা এতোটা কঠোর, নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ, সে তাকে সারারাত জেগে সেবা করে সুস্হ করলো অথচ তাকেই এতো বাজে ভাবে কথা শুনিয়ে দিলো।

করিমা আবারোও বলে উঠে, ‘ শুধু কি তাই? ফারিশ স্যার ওই কুটনি জুঁইরেও বাইর কইরা দিছে এমনকি মা- পোলারেও উচিৎ শিক্ষা দিছে, যারা আপ্নারে কালকে এতোগুলো অপমান করছিলো। ‘

করিমার কথার মাঝেই, রুমা খান অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকেন, ‘ আমার নাতীটা খারাপ নয় রে দিদিভাই।কিছু খারাপ মানুষ দিনের পর দিন সেই শিশু ফারিশের মনে একরাশ বিষাক্ত বেদনার উৎপত্তি ঘটিয়ে, আজ তাকে এমন কঠোর হতে বাধ্য করেছে। না পেয়েছে মাকে না পেয়েছে বাবাকে, কিন্তু কালকের ঘটনার পরে আমার কি মনে হচ্ছিলো জানো? তুমিপাথরের বুকে ফুল ফুটিয়েছো। কালকে আমি ফারিশের চোখে মিষ্টির পরে, কারো জন্যে দুশ্চিন্তা উদ্নীগ্ন খুঁজে পেলাম, সেই কালকে থেকেই কিছুটা অনুতাপ ছিলো। আজকে তোমার কথা শুনে সেই কষ্টটা আরো বেড়ে গিয়েছে তার। যাই বলো, আমার নাতীটা খারাপ না। তাকে বাধ্য করা হয়েছে দিনের পর দিন। ‘

বলেই আচলে মুখ ঢেকে রুমা খান বেড়িয়ে গেলেন। রুমা খানের সাথে করিমাও চলে গেলো।

____________________

ফাইভ স্টোরের একটি টেবিলে, শেফালি এবং অভি পরস্পর একে অপরের সামনাসামনি বসে আছে। শেফালি বারংবার নিজের ওড়না পেঁচিয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি নীচে। অপরদিকে অভি তার বিরক্তির দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। কথাগুলো না বলে, মেয়েটা এমন অদ্ভুদ আচরণ করে যাচ্ছে কেন? যেন সে এক সদ্য বিবাহিত নববধু এবং কবুল বলার পূর্বে একজন বধুর মধ্যে লজ্জামাখা অস্বস্হিবোধ দেখা যায়, তেমনি অবস্হা লক্ষনীয় শেফালির মাঝে অভির ধারণামতে। অভি টেবিলে শব্দ করে নিজের হাতজোড়া দিয়ে ভর দিয়ে খানিক্টা দাঁড়িয়ে বলে,

‘ তুমি লজ্জা পাওয়া বন্ধ করো, আপাতত। আমার সবকিছু শুরু থেকে জানতে হবে।’

অভির কথা শুনে শেফালি মুখ তুলে তাঁকিয়ে বলে,

‘ লজ্জা পাচ্ছি না বরং অপরাধবোধের তীব্র আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি। ‘

‘ সত্যি তোমরা বন্ধু হয়ে যা করেছো, তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য কিন্তু তুমি এতোকিছুর মধ্যেও নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে, আমাকে সব না হলেও কিছুটা জানিয়েছো। তাই আমি মনে করি তোমাকে ক্ষমা করা যায়, কিন্তু অপরদিকে জুঁই! ছিহ! এতো নোংরা একটা গেম খেললো, শুধুমাত্র অনন্যাকে চরিত্রহীনা প্রমাণ করার জন্যে। এখন তুমি বলবে প্লিয? সেদিন কি হয়েছিলো?’

শেফালি সংক্ষেপে বলতে থাকে, ‘ সেদিন আমার জন্মদিনে জুঁইয়ের কথামতো অনন্যাকে নেশা করিয়ে, আমার জন্মদিন যেই রেসর্টে করা হয়েছিলো, সেখানের একটি ঘরে অনন্যাকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে বলা হয়েছিলো, অনন্যার সাথে ঘনিষ্টভাবে ছবি, ভিডিও তুলা হবে, তার কোনপ্রকার ক্ষতি কিংবা তার পোষাকে অবদি হাত দিবে না। সে অনুযায়ী জুঁই এবং আমার সাহায্যে ফারিশ খান শুধুমাত্র অনন্যার সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার মিথ্যে ভিডিও ক্লিপ্স বানায়,যা সম্পূর্ন মিথ্যা। অর্থাৎ তখন অনন্যা অজ্ঞানরত অবস্হায় ছিলো এবং ফারিশ খান অনন্যাকে জড়িয়ে এমনভাবে ছবিগুলো নিয়েছে যেন মনে হয় তাদের দেখে মনে হয়, তারা ঘনিষ্ট অবস্হায় আছে। ব্যাস!’

শেফালি কথাগুলো বলে থেমে গেলো। অভির আখিজোড়া রাগে, ক্ষোভে লাল আভা ধারণ করা আছে। তার থেকে তার অনন্যাকে কেড়ে নিতে এতো বড় ষড়যন্ত্র করা হলো দিনের পর দিন এবং সে কোন কিছু যাচাই না করেই, এতোদিন ধরে অনন্যাকে অপমান করে গেলো। অভি উঠে দাঁড়ালো। শেফালি প্রশ্ন করলো, ‘ কোথায় যাচ্ছো?’

অভি অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে, হাল্কা হেসে বললো, ‘ নিজের ভালোবাসাকে ফিরিয়ে নিতে। ‘

___________________

রাত বাজে ১২টা, অনন্যা পাইচারি করে যাচ্ছে, ফারিশ এখনো ফিরে নি। তার কেন যেনো প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে। তখনি কেউ তার কাঁধে হাত রাখলো। অনন্যা না ঘুড়েই বললো, ‘ আপনি এসেছেন মি: ফারিশ খান?’

চলবে।।

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-২৩+২৪+২৫

0

#প্রণয়ের_রংধনু ❤️
#পর্ব- ২৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অভি এসে অনন্যাকে আকড়ে ধরে তৎক্ষনাৎ, যেন অনন্যা পরে না যায়। অভিকে দেখে বেশ বড়সড় ধাক্কা খায় অনন্যা। অভি অনন্যাকে ভালো করে দাঁড় করায়। অভি মায়াবী নয়নে তার স্নিগ্ধময়ী অনন্যাকে ভালো করে দেখতে থাকে। কতদিন পর দেখলো সে তাকে! কতদিনের না দেখার তৃষ্ণা আজ নিবারন হলো তার। অনন্যা উঠে দাঁড়িয়ে,অভিকে কিছু বলতে চাইলে, জুঁই তাদের মাঝখানে এসে বলে, ‘ অভি! তুমি এখানে হঠাৎ? ‘
অভি উত্তর না দিয়ে, একপলক অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে, জুঁইয়ের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করে, ‘ তুমি এখানে কি করছো? ফারিশ খানের সাথে তোমার কী কানেকশন?’
ততক্ষনে রেশমি খান, এনা এবং আরশও চলে আসে। রুমা খান এবং খালেদ খানও অফিসের সমস্যার কারণে, সকাল থেকে অফিসে। জুঁই আমতা আমতা করে জবাব দিলো, ‘ আসলে! তোমাকে বলা হয়নি। আমার খালা রেশমি খান সম্পর্কে ফারিশের ছোট কাকি। ওইযে আমার খালা এবং ভাই- বোন দাঁড়িয়ে আছে। ‘

বলেই রেশমি খানকে দেখিয়ে দিলো। এনা ভ্রু কুচকে তাঁকালো অভির দিকে। অত:পর জুঁইয়ের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘ তাহলে উনি সেই অভি? যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে? বাপরে! কি হ্যান্ডসাম!’

অভি ফের প্রশ্ন করলো, ‘ ফারিশ খান সম্পর্কে তোমার আত্বীয় হয় , তা আগে বলো নাই কেন জুঁই?’

জুঁই বুঝতে পারছে না সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। রেশমি খান দ্রুত এগিয়ে এসে বললেন, ‘ তুমি তো অভি, তাইনা? আরে বাবা! বসো তুমি। কথা পরে হবে। আগে একটু চা খেয়ে নাও। ‘

অভি বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে বর্তমানে! তার কাছে সবকিছু স্পষ্ট লাগছে। বর্তমানের পরিস্হিতি ঠিক মতো সামলে উঠতে পারছে না। এখানে এসে এতো ধাক্কা খাবে সে বুঝতে পারেনি। অনন্যা যে ফারিশের বাড়িতে রয়েছে তা অনেক আগে থেকেই জানতো সে কিন্তু জুঁই? সে ফারিশের আত্বীয়! তা কেন বলেনি অভিকে? অভির মনে হচ্ছে কোন একটা বড় কারণ আছে এর পিছনে। অভির মনে হচ্ছে সবাই মিলে কোন একটা কিছু লুকাতে চাইছে তার থেকে!

জুঁই গিয়ে অভির হাত ধরে সোফায় বসিয়ে, অনন্যাকে আদেশ করে বলে, ‘ অনন্যা যা তো, আমাদের সবার জন্যে ভালো করে চা নিয়ে আয় এন্ড অভির চায়ে নো সুগার! বিকজ অভির কিন্তু সুগার একদমই সহ্য হয়না। ‘

‘ উনি সুগার কম খান তবে সুগার একদমই পছন্দ নয় এমন নয়। ‘

অনন্যার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে যায় জুঁইয়ের। সে ভাবতে তাকে আজ অনন্যাকে সে আরো বাজেভাবে অপমান করবে! তার মনে হচ্ছে আজ ফারিশ তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে শুধুমাত্র অনন্যা নামক রমনীর জন্যে! সে এক বড় বাঁধা! তাই অনন্যাকে আজ তার ভালোবাসার সামনে আরো বাজেভাবে অপমান করিয়ে, শিক্ষা দিবে।অন্যদিকে অভির অধরের কোণে অজান্তেই মুচকি হাসি ফুটে উঠে। এতোদিন পেরিয়ে গিয়েছে তবুও অনন্যার প্রতিটা পছন্দ – অপছন্দকে কত ভালোভাবে মনে রেখেছে। অনন্যাকে দেখিয়ে জুঁই অভিকে উদ্দেশ্য করে বললো,’ চিনতে পারছো নিশ্চই? বর্তমানে ফারিশ খানের একমাত্র পার্সোনাল সার্ভেন্ট! ‘

মিষ্টি দ্রুত দৌড়ে এসে অনন্যাকে আকড়ে ধরে বলে, ‘ জুঁই আন্টি তুমি দেখি ভারি দুষ্টু আন্টি হয়ে যাচ্ছো। এইসব কি বলছো? আমার মা কোন সার্ভেট না।আমার মা হচ্ছে শুধুই মিষ্টির মা। ‘

অভি অবাক হয়ে যায়! বাচ্চা মেয়েটি অনন্যাকে ‘ মা’ বলে সম্মোধন করছে কেন? কে বাচ্চা মেয়েটি? অনন্যা ঝুঁকে, মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ মা! তুমি এখন উপরে চলে যাও। বড়রা কথা বলছো তো। বড়দের মধ্যে থাকতে নেই। ‘

‘ কিন্তু মা..ওই দুষ্টু আন্টি তো তোমায় কষ্ট দিচ্ছে। আমি তোমাকে রেখে গেলে, যদি আরো কষ্ট দেয়? বাপিও নেই, বাপি থাকলে এই দুষ্টু আন্টিকে বকে দিতো। ‘

‘ না, মা! আন্টি কিচ্ছু বলবে না আমাকে। তুমি না গুড গার্ল? তুমি উপরে চলে যাও। ‘

মিষ্টি কিছু না বলে, অনন্যার কথা অনুযায়ী উপরে চলে যায় কিন্তু তার কেমন যেনো ভয় করছে।

মিষ্টি চলে যেতেই, জুঁই ভেংচি কাটে। রেশমি খান জুঁইয়ের কথার মাঝখানে বলে উঠে, ‘ শুধুই কি সার্ভেন্ট? ‘

‘ উহু, ভাইয়ের রক্ষিতাও বটে। ভাইয়ের পার্সোনাল চাহিদা মেটানোর দায়িত্বও বটে রয়েছে মিসেস অনন্যার উপরে। হা হা ‘

বলেই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে আরশ। আরশের সাথে
রেশমি খান এবং জুঁইও হেসে উঠে। এনার এইসব ভালো লাগছে না। তার মনে হচ্ছে বিরাট বড় অন্যায় হচ্ছে বর্তমানে। অনন্যা হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার দৃষ্টি অভির দিকে। অভি মাথা নিচু করে ফেলেছে। এইসব কথা শুনে তার আবারোও বিয়ের দিনের সেই ভিডিওয়ের কথা মনে পরে যাচ্ছে। অনন্যা আর সহ্য করতে না পেরে জুঁই এবং রেশমি খানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে, ‘ আপনারা দয়া করে চুপ করবেন? আপনারা কি মানুষ নাকি অন্যকিছু? আরশ খান না হয় একজন কা-পুরুষ কিন্তু আপনারা? আপনারা তো একজন নারী! একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর সম্মোন্ধে এতোটা বানোয়াট কথা কী করে কথা বলতে পারেন? আপনারা কি আদোও মানুষ ছিহ! আজ একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি হয়তো ফারিশ খান খারাপ মানুষ কিন্তু আরশ খানের মতো চরিত্রহীন নয়! সে আমাকে এখনো অব্দি বাজেভাবে স্পর্শ করেনি। তাই এইসব…… ‘

অনন্যার কথা সম্পূর্ন শেষ হওয়ার পূর্বে তাতে বাঁধা দিয়ে, অভি দ্রুত অনন্যার কাছে এসে বলে,

‘ বাহ! ভালোই তো ফারিশ খানের নামে সাফাই গাঁইছো। যতবারই আমি তোমার সম্পর্কে ভুল ভাবি, ততবারই তুমি আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দাও, আসলে কতটা নিচু, খারাপ মেয়ে তুমি! লজ্জা করে নিজের প্রতি,যে এখনো তোমার কথা আমি ভাবি।এখনো তোমায় ভালোবাসি।বিয়ের দিনে এতো বড় কান্ড করে লজ্জা হয়নি? এতো কিছু থাকতেও শুধু আরো চাই! নিজের বাবার টাকাতে হয়না। শেষে ফারিশ খানের টাকার লোভে পরে, তার পার্মানেন্ট র/ক্ষিতা অবদি হয়ে গেলে?

অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে সহ্য করতে না পেরে, অভির গালে ঠাটিয়ে চ/র বসিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার মুখে আর যাই হোক ভালোবাসি কথাটি মানায় না! যেই ভালোবাসায় কোন বিশ্বাস নেই। সেই ভালোবাসা অর্থহীন! এতো অপমান করলে আমায়! কীভাবে পারো তুমি? এই ভুল তোমার যখন ভাঙ্গবে, আই টল্ড ইউ, তুমি অনেক কাঁদবে, অনেক পস্তাবে অভি! জাস্ট গু টু হেল, রাইট নাও।’

অভি গালে হাত দিয়ে রেগে দ্রুত বেড়িয়ে যায়! অভি চলে যেতেই, কাঁদতে থাকে অনন্যা।

________
অফিসে বসে রুমা খানের সাথে ফাইল ঘাটছিলো ফারিশ। রুমা খান ফারিশকে খানিক্টা চিন্তিত অবস্হায় দেখে বললেন, ‘ কি হয়েছে ফারিশ? সমস্যা তো সলভড হয়ে গিয়েছে তাহলে তোমাকে এতো চিন্তিত লাগছে কেন?’

ফারিশ মাথা নিচু রেখে, গলার স্বর নিচু করে বলে, ‘ জানিনা দাদি। আমার কেমন যেন ফিল হচ্ছে। মনে হচ্ছে সামথিং ইজ রঙ্গ! ‘

‘ হঠাৎ এমন লাগছে কেন?’

ফারিশ কোনপ্রকার জবাব না দিয়ে, ল্যাপটপ টা খুলে কি যেন দেখতে থাকে। অত:পর তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়! সে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। রুমা খান প্রশ্ন করলেন, ‘ কি হয়েছে ফারিশ?’

ফারিশ দ্রুত গলায় বলে,’ কিচ্ছু ঠিক নেই। এভ্রিথিং ইজ রঙ্গ! আই হেভ টু গু নাও। আমি বেড়োচ্ছি। ‘

রুমা খান অবাক হয়ে যায়! তিনি আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলেন কিন্তু ফারিশ দাঁড়ায় না, সে দ্রুত বেড়িয়ে পরে।

___________________________

অভি গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে যায়। গাড়ি নিয়ে ধানমন্ডি লেকের সামনে দাঁড় করিয়ে, মাথা নিচু করে বসে থাকে। এই লেকে প্রায় অনন্যা এসে বসে থাকতো যখন তার মন খারাপ থাকতো। তখন পিছন থেকে অনন্যার পছন্দের চকলেট নিয়ে এসে, অনন্যার রাগ ভাঙ্গাতো অভি। সেই চকলেট দেখে অনন্যা মুখ ঘুড়িয়ে বলতো ‘ চকলেট দিয়ে ঘুষ দিচ্ছো আমায়? কিন্তু আজ ঘুষে কোন লাভ হবেনা মি:। আমি অনেক রেগে আছি! তুমি আমায় একদম সময় দাও না। ‘

অভি তখন কানে হাত দিয়ে একদম ছোট্ট বাচ্চাদের মতো করে বলতো, ‘ আম রেইলি সরি! এমন ভুল কখনো হবেনা। এইযে কান মুলছি। ওহে নিষ্টুর প্রেয়সী দয়া করে এই অভাগা প্রেমিককে ক্ষমা করে, তার সামান্য উপহারকে ঘুষ না ভেবে, ভালোবাসা ভেবে তা গ্রহণ করুন। ‘

অভির কথা শুনে তখন ফিক করে হেঁসে ফেলতো অনন্যা। অভি সেই হাসির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাঁকিয়ে থাকতো।

অতীতের কথা মনে পরতেই অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আজ তার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে! বুকটা খাঁ খাঁ করছে। অনন্যা কেন এতো নীচ হয়ে গেলো! সে তো এই অনন্যাকে ভালোবাসে নি! অভি কি মনে করে যেনো, নিজের ফোনটা অন করলো, তখনি হোয়াটস্যাপে শেফালির দেওয়া একটি ভয়েস রেকর্ডটি পেলো। কি ভেবে যেন সে ভয়েস রেকর্ডটি শুনলো।

___________________

অপরদিকে, জুঁই আরশকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,

‘ বুঝলি আরশ? কিছু মানুষের সত্যিই লজ্জা নেই। এতো অপমান সহ্য করে কীভাবে বেঁচে আছে কে জানে? রক্ষি/তাকে তো মানুষ রক্ষিতা/ই বলবে সেইটাই স্বাভাবিক! তাইনা? ‘

আরশ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘ আইম টোটালি এগরি!’
অনন্যা ঠোট কামড়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। অনন্যা দৌড়ে গেট দিয়ে বেড়িয়ে, মেইন রোডের দিকে চলে যায় কাঁদতে কাঁদতে, সে যতই শক্ত থাকুক, একজন মেয়ে হয়ে, নিজের এতো অপমান সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। অনন্যাকে বেড়িয়ে যেতে দেখে, দাড়োয়ান দ্রুত ফারিশের দেহরক্ষীদের ফোন দিয়ে খবর দেয়! অনন্যার পিছনে পিছনে ফারিশের বডিগার্ডও যেতে থাকে। অপরদিকে ফারিশও দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে থাকে। অনন্যা দৌড়ে মেইন রোডে চলে আসায়, সেখানে একটি মাঝারি ট্রাক……..[নীচের লেখাগুলো দয়া করে পড়ুন]
চলবে কী?
শব্দসংখ্যা- ১৫০০

#প্রণয়ের_রংধনু ❤️
#পর্ব- ২৪+২৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যার দিকে মাঝারি একটি ট্রাক তড়িৎ গতিতে ধেঁয়ে আসছে। অনন্যা আখিজোড়া ঝাপ্সা হয়ে আসছে, সে কিছু বুঝে উঠার আগেই অজ্ঞান হয়ে পরে যেতে নিলে, দ্বিগুন গতিতে দৌড়ে এসে, অনন্যাকে টেনে নিজের বাহুতে নিয়ে আসে ফলে দুজনেই রোডের অপরপ্রান্তে ছিটকে গিয়ে পরে যায়।
অপরদিকে ট্রাকটাও থেমে যায়! কারণ সামনে প্রায় ৫০জনের মতো কালো পোষাক পরিহিত ফারিশের দেহরক্ষীগণ দাঁড়িয়ে ছিলো বিধায়, ট্রাকটি কোনভাবে ব্রেক কষে যথাসময়ে। ফারিশ পরে গেলেও সে শক্তভাবে অনন্যাকে জড়িয়ে রেখেছে কিন্তু তবুও অনন্যার কপালখানি কিছুটা কেটে গিয়েছে। যদিও ফারিশের হাত- পাও খানিক্টা ছিলে গিয়েছে কিন্তু সেদিকে তার হুশ নেই, সে হাক ছেড়ে ডাকতে লাগলো, ‘ ড্রাইভার! কাম ফার্স্ট! সি নিড ট্রিটমেন্ট! ‘

ফারিশের কথা শুনে ড্রাইভার গাড়ি ঘুড়িয়ে ফেলে, ফারিশ চটজলদিতে অনন্যাকে কোলে নিয়ে, গাড়িতে উঠে পরে, বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

____________________

অপরদিকে অভি বেশ মনোযোগ সহকারে সেই কলের রেকর্ডটা শুনছে। যেখানে শেফালি এবং জুঁই ফোনে কথা বলছিলো। কল রেকর্ডে জুঁই বারংবার শেফালিকে হুমকির সুরে বলছে,

‘ তুই আমাকে চিনিস না শেফালি! আমি ঠিক কতটা খারাপ হতে পারি। ফারিশকে ভালোবেসে, ওর কথামতো নিজের বন্ধুকে অবদি সকলের সামনে চরিত্রহীনা বানিয়েছি। এমনকি মিথ্যে ভালোবাসার নাটকও করেছি অভির সাথে, যেন অভিকেও অনন্যা তার ক্রাইসিসে পাশে না পায়, সেখানে তুই এমন মুহুর্তে অভিকে সবকিছু বলে দিতে চাইছিস?’

‘ কিন্তু জুঁই! এইসব করে নির্দোশ অনন্যা বার বার দোষী হচ্ছে, ও তো সত্যিই নির্দোশ। আমাদের কাজটা করা মোটেও ঠিক হয়নি, শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে, আমি বারংবার নির্দোশ অনন্যাকে ফাঁশিয়ে দিচ্ছি। ‘

শেফালির কথার বিপরীতে, খানিক্টা ধমকি দিয়ে জুঁই বলে,

‘তোকে আমি কী বলেছি? নিজেরটা ভাব ঠিক করে, আমাকে একদম জ্ঞান দিতে আসবি না। মাইন্ড ইট। ‘

কলরেকর্ডটি বন্ধ করে দিলো অভি। সে স্তব্ধ হয়ে বসে
আছে। তার কাছে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার না হলেও সে বুঝতে পেরেছে সে বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে! তাকে সর্বপ্রথম শেফালির সাথে দেখা করতে হবে। তার গলা শুকিয়ে আসছে! সে ভুল নয় একপ্রকার বিরাট বড় অন্যায় করে ফেলেছে, যার আদোও হয়তো কোন ক্ষমা নেই, অভির ধারনামতে। অভি নিজের ফোনটা ভালো করে ঘেটে দেখে, শেফালির অনেকগুলো মিসডকল ঝুলে আছে। অভির হাত-পা কাঁপছে, তবুও সে নিজেকে সামলিয়ে ঠোট ভিজিয়ে, শেফালির নাম্বারে ফোন দেয়। শেফালি অভির ফোন পেয়েই, দ্রুত রিসিভ করে বলে, ‘ হ্যালো অভি! আমার তোমার সাথে কিছু..’
শেফালিকে সম্পূর্ন কথা শেষ করতে দিলো না অভি। তার পূর্বেই শান্ত গলায় শুধালো, ‘ আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই শেফালি। আমি সবকিছু শুরু থেকে জানতে চাই। ‘

শেফালি বুঝতে পারলো অভি সেই কল রেকর্ডটি সব শুনে ফেলেছে। শেফালি সুদীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,

‘ কোথায় দেখা করতে হবে? ‘

‘ আমি এড্রেস টা সেন্ড করে দিয়েছি। ‘

‘ আচ্ছা। ‘ বলে ফোনটা কেটে দিলো শেফালি। সে অনেক সাহস সংচয় করে অভিকে ইতিমধ্যে অনেকটায় জানিয়ে ফেলেছে। সে জানে জুঁই জানতে পারলে হয়তো তার বড়সড় ক্ষতি করে ফেলবে কিন্তু বিবেকের কাছে আজ সে অন্তত অপরাধী নয়।

_________________

রেশমি খান পাইচারি করে যাচ্ছন। কপালে তার দুশ্চিন্তার রেশ স্পষ্ট! আরশ ভ্রু কুচকে তার মাকে
পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছে। রেশমি খান বসছে না। তিনি শুধু একটু পর পর সদর দরজার দিকে তাঁকাচ্ছেন। এনাও দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে নিজেও যথেষ্ট চিন্তিত! তার ধারণামতে অনন্যাকে অযথা কারণে এমন বাজেভাবে অপমান করার জন্যে, ফারিশ ভাই এসে তার মা, ভাই- বোনের অবস্হা খারাপ করে ছাড়বে! জুঁই সোফায় বসে, বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,’ কি করছো, খালা? এইভাবে পাইচারি করছো কেন?’

রেশমি খান গলা উঁচু করে জবাব দিলেন, ‘ কেন? তুমি জানো না? মেয়েটা অপমানিত হয়ে, আমাদের জন্যে বেড়িয়ে গিয়েছে। এইসব কিছু যদি একবার ফারিশ জানতে পারে, তাহলে কী হবে ভাবতে পারছো?’

‘ জানতে পারবে মানে? ভাইয়ের কানে বোধহয় অলরেডি চলেও গিয়েছে। ওই মেয়েটা তো ভাইয়ার বন্দিনী, সে আজকে অপমান সহ্য করতে না পেরে, কোন বাঁধাকে পরোয়া না করে বেড়িয়ে গিয়েছে। তাইতো পিছনে পিছনে ভাইয়ের বর্ডিগার্ডসরা ও গিয়েছে কিন্তু ওকে না পেলে কিন্তু ভাই আমাদেরকেই
একেবারে শেষ করে দিবে। ‘

আরশের কথা শুনে এনা সঙ্গে সঙ্গে হাত ভাজ করে বলে, ‘ এখন এইগুলো ভাবছো ভাইয়া? অথচ যখন মেয়েটাকে তারই প্রাক্তনের সামনে অকারণে হ্যারাস করেছিলে, তখন এইগুলো মনে ছিলো না? ‘

জুঁই মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। কালকে ফারিশ তাকে এতো ভয়ংকর ভাবে হুমকি দিয়েছিলো আজ তাহলে কী করবে? তাদের ভাবনার মাঝেই, গাড়ির হর্নের শব্দ তাদের কানে ভেঁসে উঠে। তাদের বুঝে উঠতে বাকি নেই, ফারিশ চলে এসেছে। তাদের অবাক করে দিয়ে, ফারিশ কোলে করে অনন্যাকে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে। পিছনে পিছনে ফারিশের ম্যানেজরও ভিতরে আসেন। তিনি কলে বলতে থাকেন, ‘ ডক্টর আপনি জলদি চলে আসুন। হ্যা প্যাসেন্ট অজ্ঞান অবস্হায়! মাথা চ/ট পেয়েছে, যার ফলে কিছুটা ব্লাডলস ও হয়ে গিয়েছে। ‘

ফারিশকে দেখে, রেশমি খান এবং আরশের ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলেও, ফারিশ যখন অনন্যাকে কলে নিয়ে উপরে যাচ্ছিলো, তখন তড়িৎ গতিতে জুঁই ফারিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ তুমি ওকে কোলে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? দেখো ও একটা নাটকবাজ..’

জুঁইয়ের কথা সম্পূর্ন শেষ হওয়ার পূর্বে, ফারিশ গর্জে উঠে বলে, জুঁই! তোমার সাথে হিসাব আমি পরে ক্লিয়ার করছি। আপাতত ডোন্ট ডির্স্টার্ভ মি! জাস্ট ব্লাডি ইডিয়েট গার্ল! ‘

কথাটি বলেই অনন্যাকে কোলে নিয়ে উপরে চলে যায়। জুঁই সেখানে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে থাকে।

_________________
ডক্টর এসেছেন এবং বেশ অনেক্ষন যাবত অনন্যার চে-কাপ করছেন। কপালের কা/টা অংশটি পরিষ্কার করে, ইতিমধ্যে ভালো করে ব্যান্ডিজ করে দিয়েছেন।
ছোট্ট মিষ্টি অনন্যাকে এমন অবস্হায় দেখে কেঁদে যাচ্ছে, অনন্যার হাত ধরে। ফারিশ এবং রুমা খান অনেকবার মিষ্টিকে অন্য ঘরে নিয়ে যেতে নিয়েছে, কিন্তু সে জেদ ধরে বসে আছে সে তার মাকে ছাড়া কোথাও যাবে না। আগেরবার মাকে ছেড়ে, উপরে চলে এসেছিলো তার মায়ের এমন ক্ষতি হয়েছে। তার ধারণা এখন যদি সে চলে যায়, তবে হয়তো তার মা তাকে ফের ছেড়ে চলে যাবে। তাই সে শক্তভাবে অনন্যার হাত ধরে আছে। মিষ্টিট সাথে রুমা খানও বিছানার একপাশে বসে আছেন। তার মুখস্রীতে ফুটে উঠেছে অসহায়ত্ব! আজ তার বাড়িতে, মেয়েটাকে এতো বাজে ভাবে অপমানিত হতে হলো, অথচ তিনি কিছু জানতেই পারলেন না। ফারিশ রুমের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যাকে এমনভাবে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকতে দেখে আজ তারও ভালো লাগছে না। অসহ্য খারাপ লাগা ঘিড়ে ধরেছে তাকে কিন্তু এমন হচ্ছে কেন? ডক্টর বেশ কিছুক্ষন পরে বললো, ‘ উনার বোধহয় ফোবিয়া আছে। ফোবিয়া থেকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। মাথায় ভালোই আ/ঘাত পেয়েছে। বেশ ব্লাডলস হয়েছে। আমি ড্রেসিং করে দিয়েছি। ইঞ্জেকশনও পুশ করে দিয়েছি। ভয়ের আপাতত কোন কারণ নেই। আশা করছি রাতের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে এবং কিছু ওষুধ প্যাসকাইব করে দিচ্ছি। খায়িয়ে দিবেন। ‘

রুমা খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডক্টর। আপনি সঠিক সময়ে এসেছেন। ‘

‘ মিসেস খান, দয়া করে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে লজ্জা করবেন না। ইটস মাই ডিউটি। পেশেন্ট অনেক দূর্বল, পেশেন্টকে অনেক দুধ, ডিম খাওয়াতে হবে। না খেলে বাচ্চাদের মতো জোড় করিয়ে খায়িয়ে দিতে হবে। হা হা হা। ‘

হুট করে কথাগুলো বলে হেঁসে ফেললেন ডাক্তার, যেন অনেক মজাদার কথোপকথন চলছে বর্তমানে। ডাক্তার চরিত্রে থাকা লোকটির যেন দায়িত্ব কিছুক্ষন পর পর হেঁসে একটা হাস্যরস পরিবেশ তৈরি করা। মিষ্টি কোমড়ে হাত দিয়ে বলে, ‘ মিষ্টি যখন দুধ খেতে ইচ্ছে করে না তখন বাপি জোড় করে দুধ খায়িয়ে দেয় তাহলে মিষ্টির মা দুধ খেতে না চাইলে তখন কি বাপিও মিষ্টির মাকে মিষ্টির মতো দুধ খায়িয়ে দিবে?’

ডাক্তার ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে হেসে বললেন, ‘ প্রয়োজন পরলে তাই করতে হবে। মি: ফারিশ খান আপনার কিন্তু এখন ডিউটি ডাবল হয়ে গেলো বাচ্চার সাথে এখন বউকেও জোড় করে দুধ খায়িয়ে দিতে হবে। হা হা হা। ‘

ডাক্তারের এমন কথা শুনে ফারিশ কেঁশে উঠলো!
সে হয়তো ডাক্তারের ভুল ভাঙ্গাতে চেয়েছিলো কিন্তু রুমা খানের কথা শুনে থেমে গেলো। রুমা খান বললেন, ‘ ফারিশ তুমি দ্রুত ওষুধ আনানোর ব্যাব্সহা করো। ‘

ফারিশ ভদ্র ছেলের মতো ‘জ্বী আচ্ছা’ বললো।অত:পর হাক ছেড়ে নিজের ম্যানেজারকে ডেকে বললো, ‘ শফিক? এই শফিক? ‘

ফারিশের ম্যানেজার শফিক দ্রুত এসে বললো, ‘ জ্বী স্যার? ‘

‘ ডক্টরকে গাড়ি অবদি পৌঁছে দিয়ে আসো এবং উনার দেওয়া প্রেস্ক্রিপশন দিয়ে ওষুধগুলো নিয়ে আসবে। ‘

‘ আচ্ছা। ‘বলে শফিক, ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে বাইরের দিকে চলে গেলো। ডাক্তার চলে যেতেই, ফারিশ গিয়ে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বললো, ‘ ডাক্তার বলেছে মিষ্টির মা একদম ঠিক হয়ে যাবে। এখন চলো মা কিছু খেয়ে নিবে। ‘

মিষ্টি ফারিশের কোলে থেকে ছটফট করতে করতে বললো, ‘ আমি খাবো না। ‘

‘কেন? ‘

‘আমার মিষ্টির মাকে ওই দুষ্টু আন্টি এবং দুষ্টু গ্রেনিরা মিলে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তুমি সবাইকে গিয়ে পানিশ করে দাও বাপি। ‘

মিষ্টির কথায় সায় দিয়ে, রুমা খানও বললেন, ‘ আজকে যা হয়েছে, তা মোটেও ভালো হয়নি। আমি বুঝতে পারছি না ফারিশ। মেয়েটা আর কত কিছু সহ্য করবে? ‘

ফারিশ কোনপ্রকার উত্তর দিলোনা। সে নিষ্পলক অনন্যার দিকে তাঁকালো। মেয়েটার মুখস্রীখানা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। সে কোনপ্রকার উত্তর না দিয়েই নীচে নেমে গেলো। নীচে নেমেই সে দেখতে পেলো, জুঁই রেশমি খান এবং আরশের সাথে কথা বলছে ফিসফিসিয়ে। এনা টেবিলে বসে ছিলো। ফারিশ দ্রুত নেমেই, পকেটে হাত গুজে জুঁইকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ অভি কার অনুমতিতে আমার বাড়িতে এসেছিলো জু্ঁই?’

‘ আসলে ফারিশ, আমি আসলে সবকিছু বলবো তোমাকে। ‘

জুঁই কথাটি বলেই থামলো। ফারিশ দ্রুত এগিয়ে এসে, জুঁইয়ের হাত ধরে তাকে একপ্রকার টানতে টানতে সদর দরজা দিয়ে, বাড়ির বাইরে বাইর করে দাঁড়িয়ে, গম্ভীর সুরে বললো, ‘ তোমার মতো মেয়েদের মুখে এক্সপ্লেইনেশন শুনার কোনপ্রকার ইচ্ছে নেই। তোমাকে যেন আমার বাড়ির সীমানায় কখনোই না দেখি, নাহলে কালকে যেই থ্রেট টা দিয়েছিলাম তা কিন্তু রিয়ালিটিতে করবো। তুমি আমাকে চিনো, আই থিংক বেটার! সো কিপ ডিস্টেন্স ফ্রম মাই হাউস। জাস্ট গু টু হেল। ‘

‘ ফারিশ! ফারিশ আমার কথা তো শুনো। ‘

জুঁইয়ের কোনপ্রকার কথা শুনলো না ফারিশ। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। ফারিশের দাড়েয়ান জুঁইকে দেখে এগিয়ে এসে বললো, ‘ম্যাম! আপনি বেড়িয়ে যান, নাহলে আমরা বাধ্য হবো আপনাকে গার্ডস দিয়ে বের করাতে। ‘

জুঁইয়ের রাগে দু:খে আখিজোড়ায় জল চলে আসলো। এতোটা বাজেভাবে তাকে অপমানিত হতে হবে, সে ভাবেনি। আজ অনন্যা বেড রুমে এবং সে বাড়ির বাইরের বাইরে। তার সমস্ত রাগ -ক্ষোভ অনন্যার প্রতি দ্বিগুনভাবে বাড়তে রইলো। সে অপেক্ষা না করে দ্রুত বেড়িয়ে গেলো।

জুঁইকে বের করায়, রেশমি খান ফারিশের দিকে একপ্রকার তেড়ে এসে প্রশ্ন করলো, ‘ তুমি কেন আমার ভাগ্নিকে এইভাবে বের করে দিলে ফারিশ? তুমি কী ভুলে যাচ্ছো এই বাড়িতে যেমন তোমার অধিকার রয়েছে, তেমনি আমাদের ও সমান অধিকার রয়েছে। ‘

‘ ওহো! রেইলি? আপনি আজ অধিকারের কথা বলছেন? লেট মি এক্সপ্লেইন! ফার্স্ট অফ অল! এই বাড়ির ৭৫℅ আমার এবং বাকি ২৫℅ গ্রেনির। নিশ্চই আপনাদের জানা আছে? আপনার গুনধর ছেলে ব্যাবসার হাল ধরে, বাড়িটা পুরো বাড়ি নিমালে তুলে ফেলেছিলো তখন আমি আমার ব্যাবসার পয়সা দিয়ে বাংলাদেশের কম্পানি গুলো কিনেছিলাম। আপনারা আমার আশ্রয় থাকেন, আমি নয়। আজ জুঁইকে বের করে দিয়েছি, দরকার পরলে কালকে আপনাদেরকেও বের করে দিতে আমার বিন্দুমাত্র হাত কাঁপবে না। সো কিপ সাইলেন্ট! ‘

ফারিশের কথা শুনে রেশমি খান দমে যায়। ফারিশ উপরে চলে যেতে যেতে, আরশকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ আজ থেকে তোমার ১০ দিনের জন্যে হাত-খরচ টোটালি বন্ধু! ‘

আরশ তৎক্ষনাৎ রেগে ফুশ করে উঠে বলে, ‘ ওয়াট হ্যাপেন্ড উইথ ইউ ভাইয়া? তুমি আমার হাত-খরচ বন্ধ করে দিলে?’

‘ একদম! এইবস ড্রামা করার আগে যদি ভাবতে, তাহলে এমন কিছুই হতো না। ‘

‘ তুমি সামান্য একজন সার্ভেন্ট এর জন্যে আমাদের এইভাবে অপমান করছো ভাইয়া? ‘

আরশের প্রশ্নের উত্তরে, ফারিশ পকেটে হাত গুজে বলে, ‘ উনাকে শুধু তোমরা অপমান করো নি বরং বার বার উনার সাথে আমার নামটাকে জড়িয়ে আমাকেও অপমান করেছো, এর জন্যে জুঁইয়ের সাথে সাথে তোমাদের প্রত্যেককে আমি বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি কিন্তু শুধুমাত্র গ্রেনির জন্যে থেমে গেলাম। তাছাড়া আমার মেয়ে উনাকে নিজের মা মনে করে। আমার মেয়েকে উনি নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখছেন। ভালোবাসা দিচ্ছেন।সে হিসাবে উনার প্রতি কিছুটা হলেও আমার মনে সম্মান জন্মেছে।যতই শত্রুতা থাকুক কিন্তু আমার মেয়ের জন্যে হলেও উনার প্রতি আমার একটা রেস্পেক্ট থাকবেই। ‘

কথাটি বলেই উপরে চলে গেলো ফারিশ। অপরপাশ থেকে সবকিছুই শুনেছেন রুমা খান। তার অধরে অজান্তেই মুচকি হাসি ফুঠে উঠে। তিনি আনমনে বলে উঠলেন, ‘ আমার নাতীর মনের বরফ তবে গলছে। ‘

_______________

রাত প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে। মিষ্টিকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে ঘুম পারিয়ে এসেছে ফারিশ। নিজের ঘরের পাশের ঘরেই ছিলো অনন্যা। ফারিশ কি মনে করে যেন, নিজের ঘরের দিকে না গিয়ে, অনন্যার রুমের দিকে পা বাড়ালো। অনন্যা এখনো অজ্ঞান হয়ে আছে, কিন্তু ডক্টর তো বলেছিলো অনন্যার জ্ঞান রাতে ফিরে আসবে। ফারিশ তখনি খেয়াল করলো অনন্যার হাত-পা নড়ছে। সে অধর নাড়িয়ে
কিছু বলতে চাইছে। ফারিশ দ্রুত অনন্যার দিকে এগিয়ে বললো, ‘ মিস অনন্যা! আপনি ঠিক আছেন? ‘

অনন্যার জ্ঞান ফিরছে কিছুটা। ফারিশ ভাবলো করিমাকে ডেকে পাঠাবে। হয়তো অনন্যার এখন করিমাকে প্রয়োজন। ফারিশ চলে যেতে নিলে, পিছন থেকে অনন্যা ফারিশের হাত আকড়ে ধরে, কম্পিত গলায় বললো, ‘ তুমি বড্ড নির্দয়! কেন বার বার ছেড়ে চলে যাও?আমার খুব ভালোবাসার প্রয়োজন। আমাকে ভালোবাসবে একটু? ‘

শব্দসংখ্যা-২০০০

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-২১+২২

0

#প্রণয়ের_রংধনু ❤️‍
#পর্ব-২১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
‘ আমি ফারিশকে অনেক ভালোবাসি, যেকোন মূল্যে আমার ফারিশকে চাই। আমি কিছুতেই এই মুহুর্তে ফিরে যেতে পারবো না বাপি। তুমি উনাদের সবকিছু বুঝিয়ে বলো। আমার পক্ষে এই বিয়ে, কোনভাবেই সম্ভব না। ‘
জুঁইয়ের বাবা মেয়ের এমন কথা শুনে তড়িৎ গতিতে, ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘ এইসব কোন ধরনের ছেলেমানুষী জুঁই? উনাদের এইসময় মানা কীভাবে করবো? সমস্ত এন্গেজমেন্টের ব্যাবস্হা করা হয়ে গিয়েছে, উনারা তোর হাতের আঙ্গুলের মাপ অনুযায়ী, এন্গেজমেন্টের আংটি অবদি কিনে ফেলেছে। ‘

‘ তো? আমি কী করবো?’

‘ আমি কী করবো মানে? ভুলে যেও না জুঁই। তুমি এই বিয়ে করতে চেয়েছিলে, আমি কিন্তু প্রথম থেকে এই বিয়ের অমতেই ছিলাম, নিজের বন্ধুর ঘর ভেঙ্গে তার হবু বরের সঙ্গে সংসার করার বিরুদ্ধে আমি ছিলাম, কিন্তু তোমার জেদের কাছে হেরে, বাধ্য হয়ে সবকিছু ঠিক করেছি। এমন একটা টার্নিং পয়েন্টে এসে সব শেষ করা যায় না জুঁই। ‘

জুঁই তার বাবার কথা শুনে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো। শুকনো অধরজোড়া খানিক্টা ভিজিয়ে, খানিক্টা চেঁচিয়েই উত্তর দিলো, ‘ আমি তোমাকে সেদিন ও বলছি আজও বলছি, তখন আমি অনন্যার থেকে অভিকে আলাদা করার জন্যে, বিয়েটা ঠিক করেছিলাম কিন্তু আমি কিছুতেই এখন অভিকে বিয়ে করবো না। আমি ফারিশকেই বিয়ে করবো। তুমি তাদের সাথে কথা বলে সবকিছু ডিসমিশ করে দাও।’

বলেই কট করে ফোনটা কেটে দিলো জুঁই। ফোনের অপাশ থেকে টুট..টুট শব্দ শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জুঁইয়ের বাবা। অভির মা, তার থেকে কৈশলে খান বাড়ির ঠিকানা নিয়েছেন। সেখানে নিশ্চই তিনি কিংবা তার ছেলেকে পাঠাবেন তখন কি হবে? বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে জুঁইয়ের বাবার, তিনি বসে এক কাপ গরম চা ঢগঢগ করে পান করতে লাগলেন! কি সাংঘাতিক অবস্হা! অতি দুশ্চিন্তায় গরম তিনি অনুভব করতে ব্যার্থ হলেন।জুঁইয়ের রুমের দরজা অপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রেশমি খান। রেশমি খানের উপস্হিতি টের পেয়ে, জুঁই পিছনে ঘুড়ে বললো,

‘ খালা তুমি এখানে?’

রেশমি খান জুঁইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ তুই এখানে থাকলে কী আর ফারিশকে বিয়ে করতে পারবি? ফারিশের তো এখন আর বউ লাগবে না। পার্সোনাল সার্ভেন্ট একটা এনেছে, তাকে দিয়েই সব চাহিদা পূরণ করিয়ে নিচ্ছে। ‘

‘কিসব বলে যাচ্ছো? তুমি কি অনন্যার কথা বলছো?’

‘ তো কার কথা বলছি রে? ওই মেয়ে দিন নেই রাত নেই, সারাক্ষন ফারিশের ঘরে পরে থাকে। শাস্তি দিতে এনেছে, নাকি মস্তি করতে এনেছে সেইটাই হচ্ছে এখন কথা! সেই কথা মুখের উপর বললে, মেয়ে আবার তেড়ে আসে! সে কি সাংঘাতিক মেয়ে! রেশমি খানের মুখের উপর কথা বলে। ভেবে দেখ একবার। ‘

‘ তুমি এইসব কি বলে যাচ্ছো খালা? ফারিশ এমন ছেলে না। ‘

রেশমি খান বিপরীতে কোনপ্রকার জবাব না দিয়ে খানিক্টা হাসলেন। জুঁই ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো,

‘ এইভাবে হাসছো কেন খালা?’

‘ তোর খালা এমনি এমনি তো আর এতো বড় বাড়ির বউ হয়নি। কতকিছুই তো দেখলাম রে মা। তুই ও দেখ ভালো করে। দেখলেই বুঝতে পারবি।’

রেশমি খান ইচ্ছে করেই কথাটি বললেন, কারণ সে জানে জুঁইয়ের মনের ইচ্ছে কখনো পূরণ হবেনা। তার থেকে সে এইসব জেনে যদি চলে যায়,তাহলে তা রেশমি খানের জন্যেই মঙ্গল! নাহলে ফারিশ যেমন ভয়ংকর ছেলে! জুঁইয়ের কোন কান্ডে সে রেগে গেলে, যেমন জুঁইয়ের অবস্হা খারাপ হবে তার থেকে দ্বিগুনভাবে অবস্হা খারাপ হবে রেশমি খানের।

______________________________

অনন্যা ফারিশের রুমের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখস্রীতে একরাশ ভয়ের ছাপ। হাত-পা প্রচুর কাঁপছে। কারণ তার সামনের টেবিলে থাকা ল্যাপটপে স্পষ্টভাবে দেখানো হচ্ছে, ফারিশের অনুপস্হিতে, অনন্যা ফারিশের ফোনে হাত দিয়েছিলো। ফারিশের বাড়িটির প্রতিটা কোণায় কোণায় সিসিটিভি রয়েছে। ফারিশ দিনরাত অনন্যার প্রতি নজর রেখেছে, কথাটি মাথায় আসতেই, নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে অনন্যার। এতো বড় ভুল সে কি করে করলো? তার তো জানাই ছিলো, ফারিশ তার প্রতি সর্বোক্ষন নজর রেখে চলেছে। এখন সে কি করবে? সবকিছু কীভাবে সামলাবে? অনন্যার ভাবনার মাঝেই, ফারিশ সোফায় বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো। অত:পর অনন্যার চারিপাশে ঘুড়তে ঘুড়তে সিগারেট ধরাতে লাগলো। অনন্যা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশ সিগারেটের আগুন ধরিয়ে, অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে বললো, ‘ সিগারেটের ছ্যাকার কথা মনে আছে মিস?’

ফারিশের কথা শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে অনন্যার। তা দেখে বাঁকা হেসে ফারিশ বলে,

‘ আপনি এইভাবে ভয় পাচ্ছেন কেন মিস অনন্যা? আপনি তো যথেষ্ট সাহসী! নিজেকে নির্দোশ প্রমান করে, এই বাড়ি থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন, এই স্ট্রাটাজি নিয়েই তো এই বাড়িতে এসেছিলেন তাইনা মিস? ‘

ফারিশের কথা শুনে, বেশ বড় ধাক্কা খায় অনন্যা! ফারিশ কীভাবে জানলো এইসব? ফারিশ অনন্যার দিকে এগোতে এগোতে বললো, ‘ আপনি গেমে বড্ড কাঁচা মিস অনন্যা! গেমের সর্বপ্রথম শর্ত হলো, নিজের অপরপক্ষের খেলোয়ারকে কখনোই দুর্বল ভাবতে নেই! আপনি কী ভাবেন? আপনিই একা চালাক? বাকি সবাই বোকা? আমার বাড়িতে থেকে, আপনি আমার বিরুদ্ধে নিজের স্ট্রাটাজি ফুলফিল করবেন, অথচ আমি কিচ্ছু টের পাবো না? করিমার ফোন দিয়ে, আপনি অলরেডি আপনার বন্ধুকে মেসেজও করে দিয়েছেন, যেন সে আপনাকে সাহায্য করে! বাহ, বাহ! অথচ আমি কিছুই জানতে পারবো না। কি ভাবেন আমাকে? আমি দূর্বল? এতোটা দূর্বল হলে, এতো ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এমন একটা অবস্হানে ফারিশ খান কখনোই আসতে পারতো না। ‘

‘ আসলে…. আমি। ‘

বলেই জানালার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইছিলো অনন্যা কিন্তু অনন্যার অধরজোড়াতে আঙ্গুল দিয়ে ‘হুশ ‘ করে থামিয়ে দেয় ফারিশ। ফারিশ ফিসফিস করে বলে,

‘ মিস অনন্যা! আপনার সবটা জুড়ে ফারিশ খানের বিচরণ। ফারিশ খানের নজর থেকে নিজেকে বাঁচানোর কোন উপায় নেই আপনার কাছে। আজীবন আমার বন্দীনী হয়েই কাটাতে হবে আপনাকে। ‘

কথাটি বলেই ফের বাঁকা হাসলো ফারিশ। ফারিশের কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে, নিজের থেকে ফারিশকে আলতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো অনন্যা। তিক্ত গলায় উত্তর দিলো, ‘ আজ না হয় কাল, আমি ঠিক আপনার থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছাড়বো মি: ফারিশ খান। আপনি চাইলেও আমাকে আটকাতে পারবেন না। ‘

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে তালি দিয়ে বললো, ‘ ওহো! তাই? সো সুইট অফ ইউ! অনেক সাহস আপনার! বুঝলাম।এখন দয়া করে বাইরে যান। ‘

‘ মানে? ‘

‘ মানে, আজ সারারাত আপনি বাইরে গার্ডেনে কাটাবেন এইটাই আপনার শাস্তি। বললাম না মিস? ফারিশ খানের রাজ্যে পদে পদে ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করছে মিস আপনার জন্যে। ‘

বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো ফারিশ। অনন্যা অবাক হয়ে বাইরের দিকে চলে আসলো।

_____________

অনন্যার দেওয়া মেসেজটি পেয়েছে শেফালি। সে ঠিকই ভেবেছিলো অনন্যা বড় এক বিপদে রয়েছে। তাইতো সে বাধ্য হয়ে শেফালিকে মেসেজ করেছে। শেফালি বুঝতে পারছে সে বিরাট বড় অন্যায় করেছে, যার জন্যে সে অনুতপ্ত! কিন্তু সে কি করবে এখন? সে কী করে সাহায্য করবে অনন্যাকে? আজ সে নিজেও সর্বহারা! জুঁইয়ের দেওয়া হুমকি পেয়ে কিছুতেই কোনভাবে এগোতে পারছে না শেফালি কিন্তু তবুও সে মনে সাহস সংশয় করলো। তার অপরাধের একটা প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ এসেছে। সে কোন কিছু না ভেবে অভির নাম্বারে ফোন করলো, কিন্তু অপাশ থেকে নাম্বার টা বন্ধ দেখাচ্ছে! শেফালি ফোনটা রেখে হতাশার সাথে মাথায় হাত রেখে বলতে লাগলো, ‘ অভি ছাড়া কেউ এই মুহুর্তে আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। অভির সাথে যোগাযোগ করাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু অভির সিম তো বন্ধ! তাহলে কী করবো? ‘

শেফালি অনেক্ষন ভাবলো তারপর আবার ফোনটা হাতে নিয়ে, জুঁই এবং তার একটা ভয়েস রেকর্ড যা তার ফোনে অনেকদিন ধরে আছে, সেইটা অভির ওয়াটসাপ নাম্বারে পাঠিয়ে দিলো। অত:পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ আই হোপ! কালকের মধ্যে এই ভয়েস রেকর্ডটা অভি পেয়ে, আমার সাথে যোগাযোগ করবে। অভিকে সবটা বলে দিতে হবে।আমার যাই হয়ে যাক অন্তত এইসব অপরাধের বোঝা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবো। ‘
_______________

অক্টোবর মাস এখন। শীত শুরু হওয়ার আগে, একপ্রকার ভয়ংকর মুষূলধারা বৃষ্টি সর্বজায়গায় বিরাজমান হয়। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। মুষূলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, তার মধ্যে বজ্রপাতের শব্দও শুনা যাচ্ছে মৃদ্যুভাবে! সেই শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে অনন্যা। এই তীব্র বৃষ্টিতে সেই বাগানে দাঁড়িয়ে আছে এবং খান বাড়ির দিকে তাঁকিয়ে আছে সে।মিষ্টি হয়তো তাকে খুঁজছে! মেয়েটা তাকে ছাড়া এখন খেতেই চায় না, মেয়েটা আদোও খেয়েছে তো? আচ্ছা সেই ফারিশ নামক খারুশকে বলে কী পাঁচ মিনিটের জন্যে অনুমতি নেওয়া যাবে না?যেন সে শুধু গিয়ে মিষ্টিকে খায়িয়ে চলে আসতে পারে, তারপর না হয় ভালোভাবে শাস্তিটুকু সম্পূর্ন করবে। প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গিয়েছে সে বাইরে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির মাত্রা পূর্বের থেকে আরো দ্বিগুন হয়েছে। চারদিকে শীতল হাওয়া তীব্রভাবে বইছে। অনন্যার ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টির মধ্যে থাকা বজ্রপাতে ভিষনভাবে এক ছোটখাটো ফোবিয়া রয়েছে। বজ্রপাতের শব্দ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। বৃষ্টি তার পছন্দ হলেও, বজ্রপাতের জন্যে সর্বক্ষন সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো! বজ্রপাতের শব্দে নিজের দুই কানে হাত দিয়ে, শীতে কেঁপে চলেছে অনন্যা। ফারিশ কফি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মিষ্টি অনেক্ষন যাবত অনন্যাকে খুঁজে চলেছে! সে নাকি বায়না ধরেছে সে অনন্যাকে ছাড়া কিছুতেই রাতে খাবে না। ফারিশ বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিৎ? ফারিশ বারান্দায় থেকেই দেখতে পেলো, বাগানে দাঁড়িয়ে দু কানে হাত রেখে বাচ্চাদের মতো কেঁপে চলেছে অনন্যা। ফারিশ ভ্রু কুচকে সেদিকে তাঁকালো। অত:পর কফিটা টেবিলে রেখে, নীচে ছাতা নিয়ে বাগানে চলে আসলো। ফারিশ ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, গম্ভীর সুরে বললো, ‘ মিস অনন্যা? আপনি এখন গিয়ে মিষ্টিকে খায়িয়ে আসুন, তারপর আবারো দাঁড়িয়ে থাকবেন। বৃষ্টির জন্যে আপনার শাস্তির এক অংশও কিন্তু কমবে না। ইউ নো না? ফাঁকিবাজি, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

ফারিশের কথা শুনে অনন্যা কোনপ্রকার জবাব দেয়নি। সে নিচের দিকে তাঁকিয়ে আছে, হয়তো সে খেয়ালই করেনি তার সামনে ফারিশ দাঁড়িয়ে আছে।
বৃষ্টির প্রবল শব্দে ফারিশের ধীর কন্ঠে বলা আওয়াজটুকুও অবদি হয়তো তার কানে যায়নি।ফারিশ অনন্যার দিকে এগোতেই বুঝতে পারলো, অনন্যা কি যেন বিড়বিড় করে চলেছে। অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলছে, ‘ বেটা লুইচ্ছা! বউ নেই তার অন্য মেয়েকে দিয়ে শার্ট পরায়। আবার এতো ঠান্ডায় আমার মতো ছোট্ট একটা মেয়েকে, এতো ঠা/ডার মধ্যে একা রেখে দিয়েছে। আমার কত ভয় করছে! মা গো! এতো অত্যাচার কেমনে করতে পারে মানুষ? আল্লাহ! তুমি কী এইসব পাষাণ খারুশদের দেখো না? এইসব ঠা/ডা এদের উপর ফেলতে পারো না? ভালো হইছে খারুশ বেটার বউ এরে ফেলে চলে গেছে। বেটা খারুশ একটা। তোর সেকেন্ড বিয়ে হবে
না কোনোদিন। আল্লাহ গো বাঁচাও! এই একটা ঠা/ডা
যদি এখন মাথার উপর পরে, তখন কি হবে? আমি তো ফিনিশড! ‘

অনন্যার এইসব কথা শুনে রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছে ফারিশ। ফারিশ হুংকার ছেড়ে বলে,

‘ মিস অনন্যা? কিসব বলছেন আপনি? ‘

অনন্যা ফারিশের হুংকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে, মাথা তুলে জবাব দেয়,

‘ মি: খারুশ খান থুরি ফারিশ খান ! আপনি এখানে?’

তখনি বিরাট বড় বজ্রপাত হয়! সেই শব্দে ‘মাগো’ বলে ফারিশকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপতে থাকে অনন্যা। নিজের বারান্দা থেকে এমন দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় জুঁই!

শব্দসংখ্যা- ১৬০০

চলবে কি?

#প্রণয়ের_রংধনু ❤️‍
#পর্ব- ২২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যা ফারিশকে জড়িয়ে, তার শার্ট খামচে ধরে রেখেছে। ভয়ে দাঁতের কিড়মিড় শব্দ কানে আসছে ফারিশের। অনন্যার অসম্ভব কাঁপুনি,ফারিশের বুকেও উত্তালের স্রোত বয়েই দিচ্ছে! ফারিশের বুকে ঘাপটি মেরে রয়েছে অনন্যা। ফারিশের কী হলো কে জানে? সে অনন্যাকে সামলাতে, তার হাত অনন্যার মাথায় রেখে, শান্ত গলায় ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ জাস্ট কাম ডাউন! প্লিয! জাস্ট চিল! কিচ্ছু হবেনা আপনার। আমি আছি তো। ‘
অনন্যা ফারিশের কথায় বোধহয় কিছুটা হলেও ভরসা পেলো, সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো। ফারিশ বুঝতে পারছে তার বুকে এক ঝড় বইছে, কিন্তু সেই ঝড় কিসের ইংগিত দিচ্ছে তাকে?
বাগানে অনন্যা এবং ফারিশের এমন ঘনিষ্ঠতা সবকিছুই বারান্দা থেকে দেখে যাচ্ছে জুঁই। একরাশ ক্ষোভ তার মস্তিষ্কে এসে হানা দিচ্ছে, তবুও সে নিজেকে সামলে রেখেছে। এমন দৃশ্য দেখে সে এখন প্রায় নিশ্চিত তার খালা তাকে ভুল কিছু বলেনি বরং ঠিক কথাই বলেছে। অনন্যাকে শুধু ফারিশ শাস্তি দিতে আনেনি বরং তাকে দিয়ে নিজের চাহিদাও পূরণ করছে। অনন্যা যখন বুঝতে পারে, সে ভয়ের মধ্যে ফারিশকে জড়িয়ে ধরেছে, তখনি সে তৎক্ষনাৎ ফারিশের বুক থেকে সরে এসে, মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলে, ‘ আসলে..আমি.. ভুলে….’
অনন্যার কথা শেষ হওয়ার পূর্বে, ফারিশ অনন্যাকে থামিয়ে, নিজের গাঁয়ে থাকা জ্যাকেট টা অনন্যার গাঁয়ে জড়িয়ে দিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিকে ঘুড়ে তাঁকালো। অনন্যা বুঝতে পারছে না তাকে এইভাবে কেন জ্যাকেট জড়িয়ে দিলো ফারিশ? ফারিশ অন্য দিকে ঘুড়েই গলায় কিছুটা অস্বস্হি নিয়ে বললো,

‘ ভিজে একাকার হয়ে গেছেন আপনি! ঘরে গিয়ে নিজের পোষাক পাল্টে নিন। তাছাড়া প্রচুর বজ্রপাত হচ্ছে, জায়গাটা সেফ নয়। আজকের জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট! ‘

ফারিশের কথা শুনে নিজের দিকে ভালো করে তাঁকায় অনন্যা। সে সাদা রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরেছিলো, ভিজে যাওয়ায়, পোষাকটি তার শরীরের সঙ্গে একদম লেপ্টে গিয়েছে। লেপ্টে যাওয়ার ফলে, বেশ বাজে দেখাচ্ছে! শরীরের কিছু অংশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অনন্যা ভালো করে জ্যাকেটটা গাঁয়ে জড়িয়ে নেয়, অত:পর লজ্জায় দ্রুত সে দৌড়ে চলে যেতে নিলে, বাগানের কিছু অংশ পিচ্ছিল হওয়ায়, সে পরে যেতে নিয়েছিলো কিন্তু পিছন থেকে ফারিশ শক্ত করে অনন্যাকে আকড়ে ধরে বলে,

‘ আর ইউ ওকে? বৃষ্টির সময় এইভাবে দৌড়ায় কেউ? এখুনি তো পরে যেতেন। ‘

অনন্যাকে নিজে সামলে নিয়ে, ফারিশের থেকে দূরে সরে গিয়ে, নিচু গলায় বলে, ‘ আমার জন্যে তো আপনিও ভিজে গেলেন। আপনিও দ্রুত ঘরে গিয়ে, চেঞ্জ করে নিয়েন। ‘

অনন্যা কথাটি বলেই, বাড়ির দিকে চলে গেলো! ফারিশ সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো! অনন্যার বলা কথাটি তার কাছে অদ্ভুদ ঠাওড়ালো তবুও সে ছাতা টা হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। অনন্যা নিজের রুমে দৌড়ে এসে জোড়ে জোড়ে নি:শ্বাস নিলো। তার কেমন যেনো লজ্জা লাগছে, সে কি করে পারলো বেহায়ার মতো ভেজা শরীরে ফারিশ নামক খারুশকে জড়িয়ে ধরতে? আবার সে কীভাবে দরদ দেখিয়ে বললো, যেন ফারিশ নামক খারুশও ঘরে নিয়ে গিয়ে পোষাক বদলে নেয় অথচ সে এমন করলো কেন? তার ভাষ্যমতে এমন নির্দয়, কঠোর মানুষের প্রতি কোনপ্রকার দরদ দেখানো দন্ডনীয় অপরাধের মধ্যে পরে এবং এই অপরাধ যদি আইনে পাশ হয়ে যেতো, তবে এখন সে জেলে বসে বসে শক্ত রুটি খেতো। সবকিছু অনন্যার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সে আর কিছু ভাবতে পারলো না, পোষাক হাতে নিয়ে বাথরুমে পোষাক বদলাতে চলে গেলো।

_____________________

ফারিশ তার রুমে আসতেই দেখতে পেলো জুঁই তার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো,

‘ তুমি এইসময়ে এখানে কী করছো?’

‘ ওহ আচ্ছা! এইসময়ে অনন্যা থাকলে বুঝি ভালো হতো?’

জুঁইয়ের এমন কথা শুনে ফারিশ একপ্রকার তেড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘ কিসব যাতা বলে যাচ্ছো তুমি? তুমি কী একবারও ভেবে দেখেছো জুঁই? তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো?’

জুঁই কিছুটা তাচ্ছিল্য করেই হেসেই বললো, ‘ হ্যা হ্যা জানি! আগেই বলতে পারতে ফারিশ! তোমার পার্সোনাল সার্ভেন্ট নয় রক্ষিতা লাগবে! তাহলে অন্তত অনন্যার থেকে বেটার কাউকে হাইয়ার করতাম! অনন্যার মধ্যে এমন কী কি দেখলে?’

ফারিশ নিজের হাত উঁচিয়ে হুংকার ছেড়ে বলে, ‘ নাও জাস্ট স্টপ জুঁই! তুমি কিন্তু মাত্রাধিক করে ফেলছো!’

ফারিশের সেই হাতটি তৎক্ষনাৎ ধরে ফেলে, উত্তেজিত গলায় জুঁই বলতে থাকে, ‘ কি করবে না থামলে? তুমি কী করে ভুলে গেলে? আমি তোমায় সাহায্য করবো বলে, অনন্যাকে ঠকিয়েছি। অভির সাথে মিথ্যে প্রেমের নাটক করেছি। আমি কিন্তু চাইলেই……’

জুঁই সম্পূর্ণ কথা বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না, তার পূর্বেই ফারিশ তৎক্ষনাৎ ভ্রু কুচকে বলে, ‘ তুমি কী কোনভাবে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো বা থ্রেট করছো? তুমি ব্ড্ড বোকা জুঁই, রেশমি খানও অব্দি জানে, আমার জাস্ট ৩০ মিনিট, জাস্ট অনলি থার্টি মিনিটস লাগবে তোমাকে গাঁয়েব করে দিতে, আর আমি ঠিক যা বলি, তাই করি,আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো। ‘

জুঁই ফারিশের কথা শুনে কিছুটা দমে গিয়ে দুই হাত দিয়ে ফারিশের হাত আকড়ে ধরে, নিচু গলায় বলে,
‘সবকিছু করেছি তোমার জন্যে অথচ তুমি কী করলে? আমাকে ফেলে, ওই অনন্যার কাছে চলে যাচ্ছো? ওর মধ্যে এমন কী আছে যা আমার মধ্যে নেই। একবার আমার কাছে তুমি কিছু চেয়ো দেখো, আমি তোমায় সবটা বিলিয়ে দিবো। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তবুও তুমি ওই রক্ষিতার কাছে যেও না। ‘

ফারিশ জুঁইয়ের কথা শুনে বিরক্ত এবং তার সঙ্গে প্রচুর রেগেও গেলো তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে, জুঁইয়ের কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘ তোমার কাছে ভার্জিনিটি নেই, যা মিস অনন্যার কাছে আছে। তাইতো বারবার তোমাকে রেখে, উনার কাছে যাই। ইউ নো না? ফ্রেশ সবকিছুই আমার ভালো লাগে, বাট কারো ইউজড করা জিনিস আবারোও ইউজ করা, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ! আই থিংক ইউ গট দ্যা কনটেক্স! ‘

বলেই জুঁইয়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে, রুমে ঢুকে জুঁইয়ের মুখের সামনে দরজা লাগিয়ে দিলো ফারিশ। তাতে ক্ষীন্ন কেঁপে উঠলো জুঁই! তার বলার ভাষা নেই! ফারিশ তার অতীত সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত, তা বুঝতে বেশিক্ষন লাগলো না জুঁইয়ের।
_________________

অনন্যা ভাত মেখে মিষ্টিকে খায়িয়ে দিচ্ছে এবং রুমা খান মিষ্টিকে গল্প শুনাচ্ছে। ফারিশ মিষ্টিকে একঝলক দেখতে, মিষ্টির রুমে এসেছিলো কিন্তু এমন দৃশ্য দেখে সে দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু মিষ্টি ঠিক খেয়াল করে ফারিশকে। মিষ্টি হাক ছেড়ে ডাকে,

‘ বাপি এসো! তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

ফারিশকে দেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো অনন্যা। তার এখনো লজ্জা লাগছে! ফারিশও ঘরে ঢুকে আমতা আমতা গলায় বললো, ‘ মা! তুমি খেয়ো নাও। তারপর আমি এবং তুমি অনেকক্ষন গল্প করবো। আসলে দাদি তোমার কিছু মেডিসিন দরকার ছিলো না? আমি আনিয়ে রেখেছি তোমার ঘরে। ‘

রুমা খান ‘ আচ্ছা ‘ বলে একপলক অনন্যার দিকে তাঁকালো এবং আরেকবার ফারিশের দিকে তাঁকালো! আজ ফারিশ কিংবা অনন্যা এক-অপরের প্রতি কোন রাগ-ক্ষোভ নিয়ে তাঁকাচ্ছে না বরং যখনই চোখাচোখি হচ্ছে দুজনেই যেন অস্বস্হিতে পরে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কি আসলে বুঝতে পারছে না রুমা খান তবে তার বেশ মজা লাগছে বিষয়টি! বিশেষ করে আজ তাকে অনন্যাকে অদ্ভুদ সুন্দরী এক রমনী মনে হচ্ছে। অনন্যার লজ্জায় গালে কেমন লাল আভার রেশ দেখা দিচ্ছে! অসম্ভব সুন্দর!তিনি সামান্য হেসে বললেন, ‘ ফারিশ তুমি কি আরো কিছু বলবে?’

‘ না। আচ্ছা আমি যাচ্ছি, তাহলে। আমার কয়েকটা ফাইলস চেক করতে হবে। ‘

কথাটি বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায় ফারিশ তড়িৎগতিতে। ফারিশ চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে অনন্যা।

______________________

রাতে জানালার ধারে বসে বসে সেই ফুলের গাজরাটা দেখে যাচ্ছে অভি। গাজরাটা দেখলে তার মনে হয়, অনন্যা এখুনি তার পাশে এসে বলবে, ‘ কি হলো? গাজরাটা পরিয়ে দাও। আমি কিন্তু তোমার পছন্দের লাল পারের, সাদা রংয়ের শাড়ি পরেছি এবং তোমার পছন্দের খোঁপাও করেছি। এখন তাড়াতাড়ি পরিয়ে যাও তো। নাহলে কিন্তু গান ধরবো না। ‘

অভি খোপাটা পরালো না। শুধু চেয়ে রইলো তার স্নিগ্ধময়ী অনন্যার দিকে। অত:পর ফিসফিস করে বললো, ‘ উহু! আজকে তোমায় গাজরা পরিয়ে দিবো না।’

‘ কেন পরিয়ে দিবে না? ওহ আচ্ছা! অন্য কারো জন্যে বুঝি নিয়ে এসেছো?

‘ একদম ভুল ভাবছো। তা হবে কেন? এমন কারো কী সাধ্য আছে বলো,যে অনন্যা হাওলাদারের জায়গা নিতে পারবে। ‘

বলেই মুচকি হাসলো অভি।

‘ তাহলে পরিয়ে দিচ্ছো না কেন?

‘ভয় লাগে, গাজরা পেয়ে যদি হারিয়ে যাও আবার! আজকাল তুমি বড্ড দুষ্টিমি করো অনন্যা। আসো আবার ফাঁকি দিয়ে চলে যাও। আজকে ফাঁকি দিও না, কিছুক্ষন থেকে যাও। আজকে তোমায় নয়ন ভরে দেখবো শুধু! অনেকদিন তোমায় দেখি না। ‘

________________________

সকালে অনন্যা রান্নাঘরে করিমার সাথে মিলে ফারিশ এবং মিষ্টির জন্যে নাস্তা বানাচ্ছিলো। মিষ্টি এসে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ গুড মর্নিং মা।’

অনন্যার মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ গুড মর্নিং, সোনা। আমি তোমার জন্যে নাস্তা বানাচ্ছি। তুমি গুড গার্লের মতো টেবিলো বসো। তারপর বাপির সাথে স্কুলে যেতে হবে তাইনা?’

মিষ্টি মা দুলিয়ে টেবিলে গিয়ে বসে পরে। করিমা অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে, ব্রেডে জেল লাগাতে লাগাতে বলে, ‘ কিন্তু আফা! স্যার তো বাড়িতে নাই। ভোরের একডা কামের লেইগা বাইর হইছে। ‘

‘ কি বলো? কখন আমি তো জানিনা। ‘

‘ কি জানি কম্পানির সমস্যা। অনেক তাড়াহুরা নিয়ে বাইর হইছে। ‘

‘ আচ্ছা, তাহলে আমি উনার জন্যে পরে বানাবো নাস্তা। বাসি জিনিশ তো উনি কিছুতেই খান না। সবকিছু উনার ফ্রেশ লাগে। ‘

কথাটি বলেই নিজের মাথার উড়নাটা ভালো করে টেনে, রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে জুঁইয়ের সামনে পরলো
অনন্যা। অনন্যাকে দেখে জুঁই তাচ্ছিল্যে করে বললো,

‘ কি রে? কোথায় যাচ্ছিস? রাতে ঘুম ভালো হয়েছে তো নাকি সারারাত সার্ভিস দিতে দিতেই পার হয়ে যায়?’

‘কিসব যাতা বলে যাচ্ছিস? নিজের মুখ সামলা জুঁই!
এতোবার অন্যায় করার পরেও কীভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস?’

‘ওহ আচ্ছা! তাহলে একজন রক্ষিতার সামনে আমাকে কীকরে কথা বলতে হবে, তা আমাকে তুই শিখিয়ে দিবি?’

অনন্যা৷ জুঁইয়ের এমন জঘন্য কথায় রেগে গেলেও মিষ্টিকে দেখে সে থেমে যায়। অত:পর নিম্ন গলায় বলে, ‘ প্লিয থেমে যা। এখানে মিষ্টি আছে। নাহলে কিন্তু ফল খারাপ হবে।’

জুঁই অনন্যার বাহু আকড়ে ধরে ক্ষেপে গিয়ে জবাব দেয়, ‘ থামবো কেন? খারাপ করার আর কী বাকি রেখেছিস তুই? আজকে সবাইকে জানাতে হবে, তোর আসল চরিত্র টা আসলে কী। যদিও সবাই জানে, বাট তুই যে একটা চরিত্রহীনা আজকে আরো ভালো করে, সবাই জানবে। ‘

মিষ্টি টেবিল থেকে নেমে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে, ‘ জুঁই আন্টি তুমি তো অনেক দুষ্টু। মিষ্টির মাকে ছেড়ে দাও। মিষ্টির মা ব্যাথা পাচ্ছে। ‘

অনন্যা জুঁইয়ের থেকে নিজেকে সরাতে চাইলে, জুঁই আরো জোড়ে আকড়ে ধরে বলে, ‘ খুব শখ না? এই শরীর দিয়ে ছেলেদের বশ করার। রক্ষিতা একটা। ‘

বলেই ধাক্কা দিয়ে অনন্যাকে সরিয়ে দেয় সে। জুঁইয়ের ধাক্কাতে অনন্যা পরে যেতে নিলে, পিছন থেকে তাকে আকড়ে ধরে কেউ। জুঁই তাকে দেখে আমতা আমতা করে বলে, ‘ অভি তুমি?’
চলবে কী?
শব্দসংখ্যা-১৬০০

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-১৯+২০

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-১৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
জুঁই সকলের সামনে এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরায়, অনন্যা ভ্রু কুচকে তাঁকায় জুঁইয়ের দিকে। রেশমি খান এবং এনাও কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। ফারিশ স্হীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখমুখ শক্ত! জুঁই ফারিশকে জড়িয়ে থেকেই ফিসফিস করে বললো, ‘ অফিস থেকে না হয় বিদায় করে দিয়েছো, কিন্তু? এই বাড়ি থেকে আমাকে কি করে বিদায় করবে তুমি ফারিশ? তুমি যতই আমাকে দূরে সরাতে চাইবে, আমি ততই তোমার কাছাকাছি চলে আসবো।’
ফারিশ কোনপ্রকার জবাব দিলো না। এমন পরিস্হিতিতে খালেদ খান কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার মা রুমা খান উপর থেকে নেমে গাম্ভীর্যের সাথে চেচিয়ে উঠে বললেন, ‘ এইসব কি হচ্ছে এখানে?’

রুমা খানের আওয়াজ শুনে, ফারিশ তৎক্ষনাৎ জুঁইকে একপ্রকার ঠেলে নিজের থেকে সরিয়ে ফেললো। জুঁই ধাক্কা সামলাতে না পেরে,নীচে পরে যেতে নিয়েছিলো কিন্তু আরশ এসে জুঁইকে ধরে ফেলে। জুঁইকে এইভাবে ধাক্কা দেওয়ায় আরশ কিছু বলতে চাইলে, জুঁই আরশকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে।জুঁই আরশকে আকড়ে ধরে কোনরকম জোড় করে হেসে বলে, ‘ আসলে অনেকদিন পর, সবাইকে দেখলাম তো! তাই আর কি এক্সাইটেডমেন্টে! যাই হোক, এনা ও আরশ তোরা আয়! লেটস গিভ মি হাগস! কতদিন পর তোদের দেখলাম। ‘

এনা ও আরশও একসাথে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে। আরশের থেকে বয়সে জুঁই ছোট হওয়ায়, আরশ জুঁইকে এনার মতোই ভালোবাসে, অপরদিকে এনাও বড় বোন হিসেবে জুঁইকে অনেক পছন্দ করে। জুঁই, এনা ও আরশের সাথে কুশল বিনিময় করে, রেশমি বেগমকে জড়িয়ে ধরে, ‘ খালা! কি অবস্হা তোমার?’

রেশমি বেগম উত্তর দিলেন না, তবে তাকে খুব দুশ্চিন্তিত লাগছে! ড্রইয়ং রুমে ৪টার মতো এসি! বাইরে আজ মেঘলা আবহাওয়া, তবুও সে ঘামছে! তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন, জুঁই মোটেও তাদের জন্যে আসেনি। ছোটবেলা থেকে সে ফারিশকে পছন্দ করে, সে একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠেছে ফারিশকে পাওয়ার জন্যে। নিশ্চই কোন পরিকল্পনা নিয়েই সে আজ এসেছে খান বাড়িতে কিন্তু তিনি ফারিশকেও ভালো করে চিনেন। একরোখা, জেদি টাইপ ছেলে। সে বেশকয়েকবারই জুঁই এবং ফারিশের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন প্রতিবারই তীব্রভাবে অপমানের সহিত সেই প্রস্তাব নাখোচ করেছে ফারিশ! বাড়িতে জুঁই চলে আসায় বেশ বড়সড় ঝামেলা হবে ভাবতেই মাথা ঘুড়াচ্ছে রেশমির! কিন্তু তার অজ্ঞান হলে চলবে না! নাহলে সবকিছু সামলাবে কে?

এতোকিছুর মাঝে সবেমাত্র ঘোর কাটলো অনন্যার! এতোক্ষন সে একটা বিরাট বড় ঘোরের মধ্যে ছিলো , জুঁই সম্পর্কে রেশমি খানের বোনের মেয়ে হয়! তার মানে ফারিশের সাথে তার আত্বীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। সেদিন অভির সাথে জুঁইয়ের হুট করে বিয়ে ঠিক হওয়ায়, প্রথম থেকেই অনন্যার সংদেহ হচ্ছিলো,সবকিছুর মধ্যে কোথাও না কোথাও জুঁইয়ের হাত রয়েছে। আজ সে পুরো নিশ্চিত, এতো বড় ষড়যন্ত্রে জুঁইয়েরও হাত রয়েছে। অনন্যার এখন মনে হচ্ছে সেদিনের ভিডিও হয়তো মিথ্যে না! সেদিন রাতের পুরো ঘটনা তার মনে নেই! এর পিছনে শেফালি এবং জুঁই সমানভাবে জড়িত! জুঁইকে সে ভালো করে চিনে, সে কিছুতেই সত্য কথা স্বীকার করবে না, অন্যদিকে বাকি রয়েছে শেফালি কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করবে কীভাবে অনন্যা? তার ফোনটাও তো ফারিশের কাছে জমা রয়েছে।

অনন্যা ভাবনার মাঝেই, জুঁইয়ের নজর গিয়ে পরে, অনন্যার উপর। অনন্যা দেখেই ইচ্ছে করেই, খানিক্টা হেসে প্রশ্ন করে , ‘ এই মেয়ে কে? আজ নতুন দেখলাম। নতুন সার্ভেন্ট নাকি?’

রেশমি খান হাল্কা হেসে বললেন, ‘ হ্যা! আমাদের বাড়ির কাজের লোক। ‘

‘ রেশমি খান একটা কথা আপনাকে কতবার বলতে হবে? মিস অনন্যা শুধুমাত্র আমার পার্সোনাল কাজের লোক! সব বিষয়ে আপনি কেন এতো ইন্টারফেয়ার করেন?’

ফারিশের প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলো রেশমি খান। এনা এগিয়ে গিয়ে জুইকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ আপু! চলো তো উপরে।কতদিন পর, তোমায় দেখলাম। অনেক গল্প করা বাকি আছে। ‘

এনার কথার বিপরীতে, জুঁইও ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ সমস্যা নেই। এসেছি যখন, বেশ কয়েকদিন থেকে তবেই যাবো। ‘

ফারিশ আগের ন্যায় কোনপ্রকার উত্তর দেয় না কিন্তু বাঁকা হাসি দিয়ে নীচের দিকে তাঁকায়! তার মষ্তিষ্কে হয়তো এমন কিছু এসেছে তা ভয়ংকর! তবেই সে এতোটা শান্ত। তাদের কথার মাঝেই, আরশের ফোন আসে। অপাশ থেকে একটা মেয়ের নাম্বার দেখে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিয়ে, মেয়েটার নাম্বারে মেসেজ করে লিখে, ‘ তুমি রেডি থাকো বেবি! আমি জাস্ট কিছুক্ষনের মধ্যে হোটেল রুমে পৌঁছে যাচ্ছি। ‘

আরশ ফোনটা রেখে, জুঁই এবং এনার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে ছোটখাটো একটা পার্টি আছে, তোমরা যাও! আমি পার্টিটা শেষ করে, জলদি চলে আসবো। ‘

‘ ওকে ভাইয়া, কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। ‘

এনা কথাটি বলেই, জুঁইকে নিয়ে উপরে যেতে থাকলে, জুঁই খেয়াল করে অনন্যা ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে, কিন্তু তা সে একপ্রকার এড়িয়েই উপরে চলে গেলো। ফারিশও অফিসের উদ্দেশ্য যাচ্ছিলো কিন্তু পিছন থেকে খালেদ খান ড্রাইনিং টেবিলে বসে থেকে প্রশ্ন করে, ‘ ফারিশ শোনো একটু! আমাদের নেক্সট ক্লাইন্টকে হ্যান্ডেল করতে, ভাইকে দেশে আসতে বলবো ভাবছি। জাপানের ক্লাইন্ট তো! বেশ ঝামেলা করে এরা। ভাই আবার জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে উঠাবসা। তিনি সবকিছু ভালো করে হেন্ডেল করতে পারবে। তোমার কি মতামত? ‘

ফারিশ পিছনে না ঘুড়েই জবাব দিলো,’ মি: খালেদ খান, আপনার কি কোনভাবে আমার স্ট্রাটাজির উপর সংদেহ রয়েছে? থাকলে বলুন। এই অর্ডার থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে ফেলবো। ‘

‘ এইসব কি বলছো ফারিশ? তোমার উপর আমি কী করে সংদেহ করতে পারি? আসলে জাপানের পার্টি তো বুঝতেই পারছো! তার মধ্যে প্রায় ১০০কোটি টাকার অর্ডার, তাই আর কি…..

সম্পূর্ন কথা শেষ করতে পারলেন না খালেদ তার আগেই ফারিশ উচ্চগলায় বলে উঠে, ‘ আজকেই আমি সেই জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে বসে, অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। তার জন্যে রাশেদ খানকে, সদূর জাপান থেকে চলে আসতে হবেনা। তিনি যদি কোনভাবে আমার কাজে ইন্টারফেয়ার করে, তবে আমি নিজেকে বিসনেজ থেকে সরিয়ে ফেলবো। আমার লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিসিশন। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

ফারিশ কথাটি বলেই বেড়িয়ে যায়। খালেদ খান ও কথা বাড়ালেন না, তিনিও বেশ ভয় পান তার ভাইয়ের ছেলে। ছেলে যখন একবার সতর্ক করে দিয়েছে তখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করলে, ঝামেলা হবে বড়! ফারিশ ব্যাবসায়ী ছেলে বাবার মতো!এতো বছর ধরে সাফল্যের সাথে খান বাড়ির ব্যাবসা সামলাচ্ছে যদিও ফারিশ ডিগ্রি পেয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। কিন্তু ব্যাবসায়ীক ক্ষেত্রে সে তুখোর! তাইতো খান ইন্ড্রাস্টির এমডি সে। খালেদ খানের ধারণা, ফারিশ যখন বলে দিয়েছে তখন সে তাকে নিরাশ করবে না আজ। সে একাই এতো বড় অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। অপরদিকে এইসব দেখে রুমা খান হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নিজের বাবার প্রতি ফারিশের এমন বিদ্বেষ দেখে, অনন্যা রুমা খানের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ দাদি! অনেক দিন ধরেই একটা কথা বার বার জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম। ‘

‘ কি কথা রে দিদিভাই?’

‘ এই বাড়িতে সবাই আছে, কিন্তু ফারিশ খানের বাবা-মা এই বাড়িতে থাকে না কেন? উনারা কি দুজনেই বিদেশে থাকে?’

অনন্যার এমন প্রশ্নে রুমা খানের মুখস্রী শুকনো হয়ে যায়। তিনি থমথমে গলায় জবাব দেয়, ‘ ফারিশ দাদুভাইয়ের যখন ৭বছর তখন তার মা মারা যায়। রোকেয়া মারা যাওয়ার ৮মাসের মাথায় ফারিশের কথা ভেবে, রাশেদ আরেকটা বিয়ে করে। কিন্তু সেই মাকে কিছুতেই মেনে নেয় না ফারিশ এবং সেই ঘরে বাচ্চা- কাচ্চা হওয়ার পরে, রাশেদের স্ত্রীও রাশেদকে নিয়ে বিদেশে চলে যায়, ছেলেটাকে একা করে। কতই বা বয়স ছিলো ছেলেটার? অতটুকু বয়সে বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে ফেলে সে। সৎ মা তো সৎ মা’ই হয়। এখন রাশেদ বউ, ছেলে- মেয়ে নিয়ে বিদেশেই থাকে। শীতের মধ্যে একবার করে তারা আসে শুধু এতটুকুই।’

রুমা খানের কথা অবাক হয়ে যায় অনন্যা! নিজের বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে ফারিশ। ছোট বয়স থেকেই বিষাক্ত দুনিয়াকে অনুভব করেছে সে, তাইতো তার মনে মায়া -দয়া জিনিসটা কম। অনন্যা প্রশ্ন করলো, ‘ আপনি তার বাবা কে, এতটুকু ছেলেকে রেখে, বিদেশে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন কেন দাদী?’

‘ সৎ মায়ের ছায়ায় বড় হওয়ার থেকে, তার থেকে দূরে থাকাই ভালো দিদিভাই। আমি তো দুনিয়াটি বুঝি রে দিদিভাই। তাই সেদিন রাশেদকে আটকায়নি, নাহলে আমার অনুমতি ব্যাতীত রাশেদ কখনোই যেতে পারতো না। আমি তো জানি ইশিকা ঠিক কেমন মানুষ! আমার নাতীকে সে কখনোই মমতা দিয়ে কাছে ডাকেনি। তার জন্যেই আজ বাবা- ছেলের মধ্যে এতোটা দূরুত্ব! ‘

বলেই আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন রুমা খান। অনন্যা নিজের রুমে এসে, নিজে নিজেই বলতে লাগলো, ‘ লোকটার হার্টলেস হওয়ার পিছনে কারণ আছে। ছোটবেলা থেকে বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে। বিয়ে করার পরও সংসার সুখ জুটলো না। বউটাও মারা গেলো। মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছে এখন। ‘

এইসব বলতে বলতে পরক্ষনে অনন্যা ভাবলো কিন্তু এতোকিছুর মধ্যে তার বা তার ফ্যামেলির কি যোগসুত্র রয়েছে? যার কারণে এইভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে ফারিশ। ফারিশের করা কাজের কথা পুনরায় মস্তিষ্কে আসতেই, তৎক্ষনাৎ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় অনন্যা! যত যাই হয়ে থাক। ফারিশ একজন নিকৃষ্ট মানব, তাকে নিয়ে মায়া করা বিরাট বড় অন্যায় বলে অনন্যার ধারণা। আজ তার প্রতিশোধের
নেশাতে, ভালোবাসা, পরিবার হারিয়ে শূন্য অনন্যা।

___________________

অফিস শেষে গাড়ি করে বাড়ির দিকে ফিরছিলো অভি, কিন্তু ঢাকা শহর বলে কথা! ঢাকা শহরে জ্যাম থাকবে না তা প্রত্যাশা করা সবথেকে বড় ভুল! আধাঘন্টা যাবত জ্যামে বসে আছে অভি। বিরক্ত হয়ে অভি গাড়ির মিউজিক অপশনে গিয়ে, একটি রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দেয়। মিউজিক সিস্টেম থেকে ভেঁসে আসে, সেই পরিচিত গানটি….

‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে’

গানটি শুনে অভির মনে পরে পুরনো কিছু স্মৃতি! প্রত্যেক শুক্রবার যখন সে অনন্যার সাথে দেখা করতে যেতো, তখন লাল পাড়ের মধ্যে তাতের সাদা শাড়ি পরতো অনন্যা। মুখস্রীতে থাকতো হাল্কা সাঁজের প্রলেপ! কপালে একখানা ছোট্ট কালো টিপ! লম্বা চুলে করা থাকতো খোপা। কি সুন্দর স্নিগ্ধ দেখাতো মেয়েটাকে। অভি তার কাছে গান শুনতে চাইলে, সে প্রথমেই বলতো, ‘ আগে বলো? বেলীফুলের গাজরা এনেছো? গাজরা না আনলে, নো সিনগিং! ‘

অভি তখন মুচকি হেসে গাজরা সামনে রাখতো অনন্যার। তা দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিতো অনন্যা। অভি অনন্যার খোপায় গাজরা পরিয়ে দিতো এবং অনন্যা তার মিষ্টি গলায় গাইতো সেই রবীন্দ্রসংগীত..

‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে ‘

সেই পুরনো দিনের কথা মনে পরতেই, অভি কি মনে করে যেনো গাড়ি থেকে চট করে নেমে গেলো। পাশে ছিলো ফুলের দোকান! সে দোকানে গিয়ে একটি গাজরা কিনে ফেললো। গাজরাটা কেন কিনলো সে জানেনা। তবে পরম ভালোবাসা নিয়ে সে গাজরাটির দিকে তাঁকিয়ে ছিলো।

________________

সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরে এলো ফারিশ। অন্যদিনের তুলনায় আজ তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। কারণ আজ সে একাই এতো বড় অর্ডার কনর্ফাম করিয়েছে জাপানি ক্লাইন্টদের দিয়ে। ফারিশ উপরে গিয়েই, নিজের ফোন মানিব্যাগটা রেখে, চটজলদি ওয়াশরুমে চলে যায়। অনন্যা ফারিশের রুমে এসেছিলো কফি নিয়ে। ফারিশকে ওয়াশরুমে যেতে দেখে, সে চট করে ফারিশের ফেনটা হাতে নিয়ে নেয়। সকালে মিষ্টি যখন ফারিশের ফোনে গেম খেলছিলো, তখন ফারিশের ফোনের পার্সওয়ার্ড সে দেখেছিলো। এই বাড়িতে একজন সার্ভেন্ট এর কাছেও ফোন নেই, তার মধ্যে বাড়ির কেউই তাকে নিজের ফোন দিচ্ছিলো না, তাই বাধ্য হয়ে, ফারিশের ফোন থেকেই শেফালির নাম্বারে ডায়েল করে অনন্যা। সে জানে পাক্কা ২০ মিনিট এর আগে ওয়াশরুম থেকে বের হবেনা ফারিশ কিন্তু…..

শব্দসংখ্যা-১৬১৫
চলবে কি?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-২০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ শুনে, ডায়াল করা নাম্বার টা ডিলেট করে দিয়ে, ফোনটি তার আগের অবস্হানে দ্রুত রেখে দেয় অনন্যা। সে চটজলদি পিছনে ঘুড়তেই, ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল গাঁয়ে বেড়িয়ে আসে ফারিশ। অনন্যা তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। ফারিশ ভ্রু কুচকে স্বাভাবিকভাবেই কফি হাতে নিয়ে, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সে জানে তাকে খালি গাঁয়ে দেখে এইভাবে চোখ বন্ধ করে ফেলা, নিত্যদিনের কাজ অনন্যার। ফারিশ কফি খেতেই খেতেই, গম্ভীর সুরে অনন্যাকে আদেশ করলো, ‘ মিস অনন্যা?’
‘ জ্বী?’
‘ কাবার্ডে আমার সাদা রংয়ের শার্টটি আছে। চটজলদি নিয়ে আসুন। ‘

অনন্যা নিশব্দে কাবার্ড থেকে ফারিশের শার্টটি এনে, বারান্দায় দরজার দাঁড়িয়ে থেকে, মাথা নিচু করে বললো, ‘ এনেছি, নিন। ‘

ফারিশ নিলো না। কফি খেতে খেতেই বাঁকা হেসে বললো, ‘ মিস অনন্যা! আমার পার্সোনাল সার্ভেন্ট থাকতে, আমি নিজে নিজে শার্ট পরবো? ইটস টু মাচ বেড! আই থিংক ইউ স্যুড ডু দিজ, ইটস ইউর ডিউটি। ‘

ফারিশের কথা শুনে আকাশ থেকে একপ্রকার পরলো অনন্যা।লোকটাকে এতোদিন তার শুধু নিষ্ঠুর মনে হতো! কিন্তু লোকটা তাকে জ্বালানোর জন্যে এমন অসভ্যমার্কা কাজও করাবে? এখন তাকে গিয়ে এই লোককে শার্টও পরিয়ে দিতে হবে? উহু! সে জীবনেও করবে না। অনন্যা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললো, ‘ আমি একদম পারবো না! পারবো না, মানে পারবো না। ‘

ফারিশ তড়িৎগতিতে অনন্যার কাছে গিয়ে রেগে প্রশ্ন করলো, ‘ পারবেন না মানে? আপনি কী ভুলে গিয়েছেন? আমি ঠিক কী কারণে আপনাকে এই বাড়িতে এনেছি। শুধু রান্না করতে নিয়ে আনেনি, আমার পার্সোনাল কাজও আপনার কাজের মধ্যে পরে। ‘

ফারিশকে এইভাবে কাছে আসতে দেখে বড় বড় নি:শ্বাস ফেলে, কিছুটা দূরত্ব বজিয়ে দাঁড়ালো অনন্যা। অত:পর বিড়বিড়িয়ে বললো, ‘ ফারিশ দ্যা খারুশ তো না,যেনো কচি খোঁকা! তার পার্সোনাল কাজ এখন আমার কাজের মধ্যে পরে। কয়েকদিন পরে বলবে মিস অনন্যা! আপনি থাকতে আমি কেন একা একা গোসল করবো? আসুন, আমাকে গোসল করিয়ে দিন, উহু! বাথরুমে না। আমার আজকে মুড হয়েছে, আমি ছাদের সুইমিংপুলে গোসল করবো। সেখানে আপনি সারা গাঁয়ে সাবান লাগিয়ে দিয়ে, আমাকে একটা ধাক্কা মেরে দিবেন পুলে। ব্যাস! গোসল শেষ। বেটা আসলেই একটা খারুশ! ‘

অনন্যাকে বিড়বিড় করতে দেখে, ফারিশ ভ্রু কুচকে বলে উঠে, ‘ কি এতো বিড়বিড় করছেন? একদম টাইম ওয়েস্ট করবেন না। আপনি তো জানেন, টাইম ওয়েস্টিং আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

অনন্যা মনে মনে বেশ কয়েকবার ফারিশকে একপ্রকার ধুয়ে দিয়ে, শার্টটা হাতে নিয়ে, কাঁপাকাঁপা হাতে ফারিশের কাছে যেতে চাইলে, ফারিশ নিজ থেকেই অনন্যার কাছে চলে আসায়, অনন্যার হাত দ্বিগুনভাবে কাঁপতে থাকে। ফারিশ বিরক্ত হলেও, স্হীর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশের মজাও লাগছে! অনন্যাকে শাস্তি দিলে কিংবা তাকে অস্বস্হিতে রাখলে একপ্রকার দারুন অনুভুতি অনুভব করে সে। অনন্যা কাঁপাকাঁপা হাতে শার্টটি ফারিশের গাঁয়ে জড়িয়ে দেয়। সে শার্টের বোতামে, হাত দিতেই, ফারিশ শক্তভাবে তার হাত ধরে ফেলে। এতে তীব্রভাবে পূর্বের ন্যায় কেঁপে উঠে অনন্যা। ফারিশ কাঠিন্যের সাথে বলে, ‘ হোয়াট আ নোনসেন্স! এমন কাঁপাকাঁপি করছেন যেন, আমরা এখন বাসর ঘরে এবং আপনি সদ্য বিবাহিত নববধু! একটু পর আপনার সাথে কি হবে না হবে ভেবে ভয়ে কাঁপছেন। ‘

‘ ছিহ! আপনার মুখে কী কিছু আটকায় না? ‘

‘ ছিহ করার কি আছে? আমি চাইলেই কিন্তু এখুনি করতে পারি মিস, যাই বলুন। সেই ক্ষমতা ফারিশ খানের আছে। ‘

কথাটি বলেই বাঁকা হাসি দিয়ে উঠে ফারিশ। আসলে সে অনন্যাকে ভয় দেখাতে কথাটি বলেছে কিন্তু অনন্যা সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে, দ্রুত শার্টের বোতাম লাগাতে থাকে। মিষ্টি তার টেডি হাতে একপ্রকার লাফাতে লাফাতে রুমে ঢুকে, এমন দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পরে। তারপর টেডি রেখে, খুশিতে লাফাতে লাফাতে বলে, ‘ কি মজা! আমার বাপিকেও মা নিজের হাতে শার্ট পরিয়ে দিচ্ছে। কি মজা! ‘

মিষ্টির আওয়াজ শুনে ফারিশ এবং অনন্যা দুজনেই দ্রুত সরে দাঁড়িয়ে মিষ্টির দিকে অবাক হয়ে তাঁকায়। মিষ্টি ফারিশ এবং অনন্যার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের ফোঁকলা দাঁতে হেসে বলে, ‘ এতোদিন আমার সব বন্ধুরা আমাকে শুনাতো, তাদের বাবা- মায়ের গল্প। তাদের মা নাকি তাদের বাবাকে অফিসে যাওয়ার সময় শার্ট- টাই পরিয়ে দেয় কিন্তু মিষ্টির মা তো এতোদিন ছিলো না, তাই এমন গল্প মিষ্টি বলতে পারতো না, কিন্তু কালকে গিয়ে মিষ্টি তার বন্ধুদেরকেও তার বাবা- মায়ের গল্প বলবে। আজ মিষ্টির মাও মিষ্টির বাপিকে শার্ট পরিয়ে দিয়েছে। কি মজার ঘটনা! হুরেএএ। ‘

মিষ্টির কথা শুনে ফারিশ এবং অনন্যা দুজনেই ভরকে যায়। ফারিশ আমতা আমতা করে বলে,

‘ মা, তুমি যা ভাবছো তেমন না। আসলে….’

ফারিশের কথাকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে, দৌড়ে নীচের দিকে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায় মিষ্টি।

‘ মিষ্টি মা! শুনো মা। এইভাবে যেও না। তুমি আমার কথা তো শুনো। ‘

মিষ্টিকে হাক ছেড়ে ডাকতে ডাকতে, অনন্যাও নীচে চলে যায়, যেনো মিষ্টি এইসব কথা ভুলেও বাড়িতে না বলে। তাদের চলে যেতে দেখে ফারিশ সুদীর্ঘশ্বাস ফেলে, সোফায় নিজের ল্যাপটপ খুলতেই, তার মুখস্রীতে গাম্ভীর্য এসে হাতছানি দেয়।

_______________

অভি গাজরাটা হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই, মায়ের সমক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। ছেলেকে দেখেই অভির মা অস্হির হয়ে বলতে লাগলেন, ‘ জানিস, অভি কি কান্ড হয়েছে?’

অভি গাজরটা হাতে নিয়েই, সোফায় বসে উত্তর দিলো, ‘ না, জানিনা। তুমি না বললে কী করে জানবো? এক গ্লাস পানি দাও মা। তারপর জেনে নিবো। ‘

অভির মা ছেলেকে পানি দেওয়া অবদি অপেক্ষা করলেন না। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,

‘ জুঁইয়ের কথা আর কি বলবো? তার এন্গেজমেন্ট এক সপ্তাহ পরে, অথচ সে নাকি এখন খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।’

বলেই ছেলের দিকে পানির এগিয়ে দিলেন অভির মা। অভি ‘ ওহ, আচ্ছা। ‘ বলে নিশব্দে পানি পান করতে লাগলো।

‘ তুই একবার ভেবে দেখ! এই সময় কী ঘুড়ে বেড়াবার সময়? মেয়ে তো ফোন ধরেই না, তার বাবা ফোন ধরে আমাকে এইসব জানালো। আমি কিছু শুনতে চাইনা, তুই কালকে গিয়ে তাকে খালার বাড়ি থেকে নিয়ে আসবি। বিয়ের পরে না হয়, তুই এবং সে গিয়ে খালা, চাচাদের বাড়ি ঘুড়ে বেড়াবি কিন্তু এখন কাজের সময়! কত শপিং করা বাকি আছে। এখন কী ঘুড়ার সময় তুই বল? তুই কিন্তু কালকে যাবি। ‘

‘ আচ্ছা, যাবো। ‘

‘ এড্রেস দিয়েছে কোন এক খান বাড়ির। তা তো চিনেনা তবে তুই এড্রেস মিলিয়ে মিলিয়ে, চলে যাস। ভদ্র লোক তো দিতেই চাচ্ছিলো না কিন্তু আমি জোড় করে নিয়েছে। মনে হচ্ছে বাপ- মেয়ের মধ্যে কিছু চলছে। হয়তো বিয়ে পিছানোর ধান্ধা করতে পারে। কেন এমন করবে, তা জানিনা। তবে করছে। বুঝলি?’

‘ হ্যা, বুঝলাম। ‘

বলেই আবারো গাজরার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। অভির মা বিরক্ত হয়ে, ছেলের থেকে গাজরা টা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘ এইসব কি ধরনের খামখেয়ালি অভি? তুই হু, আচ্ছা করছিস কেন? মনে তো হচ্ছে এই বিয়ে নিয়ে তোর কোন ইন্টারেস্টই নেই। ‘

মায়ের কথা শুনে সোফা থেকে উঠে, কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে অভি চেঁচিয়ে বলে, ‘ তুমিও বা এই বিয়েটা দেওয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছো কেন মা? ‘

‘ এইসব কি বলছিস তুই? তুই নিজেই তো বিয়েটা করতে চেয়েছিলি। ‘

‘ হ্যা, কিন্তু তখন রাগের বশে অনন্যাকে দেখিয়ে নিজের বিয়ের কথাটি বলেছিলাম, কিন্তু তাই বলে ১০ দিনের মাথাতেই তুমি বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে? শুনো মা! অনন্যা আমাকে ঠকিয়েছে আমি জানি। সে যত খারাপ হোক, আফটারঅল আমি তাকে সবর্চ্চটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম! তুমি এখন যতই আমাকে দ্রুত বিয়ে করিয়ে, অনন্যাকে আমার মন থেকে মুছে ফেলতে চাও, তা পারবে না কখনো। ‘

‘ তুই এখন ওই মেয়ের জন্যে নিজের মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করবি? দিনশেষে ওই ঠকবাজ মেয়েটা, তোর কাছে বেশি ইম্পোর্টেন্ট হয়ে গেলো?’

কথাটি বলেই অভির মা কাঁদতে লাগলেন। অভি তার মাকে থামালো না। শুধুমাত্র অভির মায়ের থেকে জুঁইয়ের খালার এড্রেসেট কাগজটি নিয়ে,ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে উপরে চলে গেলো। ছেলেকে উপরে যেতে দেখে, অভির মা দ্রুত আখিজোড়া মুছে বললেন, ‘ কালকে কিন্তু অফিসে না গিয়ে, দ্রুত জুঁইয়ের বাসা থেকে জুঁইকে নিয়ে আসবি। ‘

অভির থেকে কোনপ্রকার উত্তর না পেলেও, অভির মা বুঝতে পেরেছেন অভি কালকে জুঁইকে আনতে, তার খালার বাড়ি যাবে। কারণ অভি তার মায়ের আখির অশ্রু সহ্য করতে পারে না।

_______________________

রান্নাঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে মিষ্টির জন্যে লুডুলস বানাচ্ছিলো অনন্যা। আজকেও সে কোনভাবে শেফালির সাথে যোগাযোগ করতে পারলো না! এইভাবে চলতে থাকলে সে এই বাড়ি থেকে নিজেকে নির্দোশ প্রমাণ করে বের হবে কীভাবে? জানেনা অনন্যা। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, করিমা লুকিয়ে লুকিয়ে অনন্যার কাছে এসে, ফিসফিস করে বলে,

‘ আফা! আমার একটা বাটন ফোন আছে। সবসময় লুকাইয়া রাখি। বাড়ির মানুষগুলো জানলে সমস্যা হইবো, বুঝলেন? আপনার না কালকে কি যেনো দরকার আছিলো। এইযে নেন। ‘

করিমার থেকে বাটন ফোনটা পেয়ে, আনন্দের সহিত অনন্যা বলে উঠে, ‘ করিমা আপু! তুমি যে আমার কত বড় উপকার করলে। ‘

কথাটি বলেই অনন্যা শেফালির নাম্বারে ডায়াল করে ফোন করে লুকিয়ে, কিন্তু প্রথমে শেফালি ফোন ধরে না। তারমাঝে উপর থেকে ফারিশ হাক ছেড়ে ‘ মিস অনন্যা ‘ বলে ডাকতে শুরু করে। ফারিশের ডাক শুনে করিমা বলে, ‘ আফা জলদি যান! স্যার ডাকতাছে। ‘

করিমার কথা শুনে, অনন্যা উপায় না পেয়ে শেফালির নাম্বারে মেসেজ করে লিখে, ‘ আমি অনন্যা বলছি শেফালি। আমি অনেক বড় বিপদে। এই বিপদে তুই আমাকে নির্দোশ প্রমাণ করতে পারিস। আমি ফারিশ খানের বাড়িতে বন্দী। I just need your help!’ ম্যাসেজটা স্যান্ড করে দিয়েই, করিমার হাতে ফোনটা দিয়ে, দ্রুত উপরে চলে যায় অনন্যা।

চলবে কী?
শব্দসংখ্যা- ১৩৭৫

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ১৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যা ফারিশের থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলে, ফারিশ আরো শক্ত করে চেপে ধরে অনন্যার হাত। অনন্যা ক্ষিপ্ত গলায় শুধায়, ‘ কি করছেন কি? ছাড়ুন বলছি। এইসব কথা বলার মানে কী এখন? ‘
‘ আমি কেন বলছি আপনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন মিস অনন্যা। আপনি নিজেও খুব ভালো করে জানেন, যার স্মৃতির চিহ্ন আপনি দিনের পর দিন বয়ে বেড়াচ্ছেন সে কিন্তু সামান্য একটা ভিডিও ক্লিপ দেখেই, আমার মতো অচেনা মানুষকে বিশ্বাস করে, নিজের ভালোবাসাকে অবিশ্বাস করেছে। অত:পর দীর্ঘদিনের ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটিয়ে, আপনাকে ভরা বিয়ের আসরে একা করে ছেড়ে চলে গিয়েছে। এইসব রিডিকিউলাস লাভ অন্তত আমি ভালোবাসা বলে গণ্য করি না। যেখানে বিশ্বাসটুকুই নেই, সেখানে ভালোবাসার কোন স্হান নেই।’

ফারিশের কথা শুনে,অনন্যা থেমে যায়। ফারিশ বেসিন থেকে আংটি টা উঠিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়, সেই আংটিটা সোজা বাগানের সুইমিংপুলে গিয়ে পরে। অনন্যার আখিজোড়ায় জল চলে এলো। হ্যা! তাকে অভি অবিশ্বাস করে গিয়েছে দিনের পর দিন! কিন্তু তাই বলে অভির ভালোবাসাও মিথ্যে হয়ে গেলো? মানতে নারাজ অনন্যা। অনন্যা গলা উচিয়ে ফারিশকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ বিশ্বাস ভালোবাসার একটি বিরাট বড় অংশ! হ্যা,অবিশ্বাস করেছে সে আমাকে, কিন্তু তাই বলে তার ভালোবাসা সম্পূর্ন মিথ্যে হয়ে যায় না, আর আপনি কী বা বুঝেন ভালোবাসা নিয়ে? আপনার নিজের তো কোন হার্ট নেই, হার্টলোস লোক! সে নাকি আমাকে ভালোবাসা নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে। ‘

ফারিশ অনন্যার কথা শুনে প্রথমবারের মতো কোনধরনের চিৎকার চেচামেচি কিংবা রাগারাগি করলো না। অনন্যা ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে সমানতালে। তার হাতের যন্ত্রনার জন্যে নয়, অভির দেওয়া আংটিটার জন্যে আজ সে কাঁদছে। অভির দেওয়া শেষ ভালোবাসার স্মৃতিটুকুও আজ নি:শেষ করে দিলো, ফারিশ নামক পাষাণ লোকটা।ফারিশ শান্ত ভাবে পাশে থাকা সোফায় বসে, পায়ের উপর পা রাখলো। অত:পর উপরে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাঁকিয়ে, গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় বললো,

‘ ইউ নো না? অন্য কাউকে কৈফিয়ত দেওয়া, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ, বাট আজকে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে, বিশ্বাস ভালোবাসার বিরাট বড় অংশ নয় বরং বিশ্বাসই ভালোবাসা! ভালোবাসাই বিশ্বাস। শুধুমাত্র একটা অবিশ্বাসের জন্যে একটা সুখী পরিবার নিমিষেই শেষ! ভালোবাসা তো কম ছিলো না সেখানে কিন্তু তবুও আজ সেই পরিবারের কোন অস্তিত্ব নেই, শুধুমাত্র বিশ্বাসে ফাটল ধরেছিলো বলে, আর কি যেন বলছিলেন? হার্টলেস! রাইট! আম আ হার্টলেস! ‘

কথাগুলো বলতে বলতে সোফা থেকে উঠে ফারিশ একেবারেই অনন্যার সামনে চলে আসে, যার ফলে কিছুটা ঘাবড়ে যায় অনন্যা। ফারিশ অনন্যার কানে ফিসফিস করে বলে উঠে, ‘ এই অবিশ্বাস নামক জিনিসটাই আজ আমায় হার্টলেসে পরিণত করেছে, মিস অনন্যা। হ্যা, আমি বড্ড বাজে লোক! যে শুধু মানুষকে হার্ট করতে পারে। ‘

কথাটি বলেই দূরে সরে গিয়ে, রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো ফারিশ। অপরদিকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা। আজ ফারিশের প্রতিটা কথার মধ্যে এক অদ্ভুদ ব্যাথা, আর্তনাদ লুকিয়ে ছিলো। অনেক কথা ছিলো যা লোকটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনি অনন্যাকে। কোন পরিবারের কথা বলছিলো ফারিশ তাকে? যেই পরিবারটা শুধুমাত্র একটা অবিশ্বাসকে ঘিড়ে নিমিষেই ধবংশ হয়ে গিয়েছিলো! অনন্যার মনে হচ্ছে অতীতের কোন এক ভয়ংকর ঘটনার জন্যে তার আজ এমন পরিনতি! তাই তাকে সর্বপ্রথম ফারিশের অতীত সম্পর্কে জানতে হবে। অনন্যা জানে এই বাড়ির কোন লোক, তাকে সহজে সবকিছু বলবে না, তাকে কৈশলে সবকিছু জানতে হবে।

_____________________

শিফালি জুঁইকে ফোন করে যাচ্ছে অনেকক্ষন যাবৎ, কিন্তু জুঁইকে সে পাচ্ছে না। শিফালিকে হতাশ করে বারংবার অপাশ থেকে মিষ্টি সুরে একজন মহিলার জবাব আসে, ‘ আপনি যেই নাম্বারে ফোন করেছেন, তা এই মুহুর্তে ব্যস্ত আছে। দয়া করে, কিছুক্ষন পর আবার কল করুন, ধন্যবাদ। ‘

শিফালি মন আজকে ভিষন খারাপ। তার বিয়ে ভাঙ্গতে বসেছে, তার বয়ফ্রেন্ড তার সাথে প্রতারণা করে, অন্য নারীকে বিয়ে করবে বলে, সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছে। এইসব বিষয়ের জন্যে আজ তার অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে অনন্যার প্রতি। অনন্যার বিয়ে ভাঙ্গতে সেদিন নিজের পার্টিতে সে জুঁইকে সাহায্য করেছিলো, তার বিনিময়ে মোটা অংকের টাকাও সে পেয়েছিলো। নিজের বন্ধুর প্রতি অবিচারের শাস্তিই আজ সে প্রতিক্ষনে ক্ষনে সে পাচ্ছে, সে ঠিক করেছে জুঁইয়ের সাথে কথা বলে, অভিকে সবকিছু বলে দিবে, কিন্তু জুঁইয়ের সাথে সে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছে না। তার ভাবনার মাঝেই, জুঁইয়ের ফোন আসে। সে কিচ্ছুক্ষন ভেবে তৎক্ষনাৎ ফোন রিসিভ করে। অপাশ থেকে জুঁই বিরক্তি গলায় প্রশ্ন করে, ‘ এতোবার ফোন করছিস কেন? সমস্যা কী তোর?’

‘ আমি আসলে..জুঁই। ভাবছিলাম যে, আমরা সবাই অনেক অপরাধ করেছি অনন্যার সাথে। অনন্যা তো নির্দোশ! আমার মনে হয়, অভিকে আমার সবকিছু বলে দেয়া উচিৎ। ‘

সঙ্গে সঙ্গে জুঁই শাসিয়ে বলে উঠে, ‘ চুপ, একদম চুপ!
এতো বেশি ভাবতে কে বলেছে তোকে? আরো টাকা লাগলে বল, কিন্তু এইসব জ্ঞান ফ্যানের কথা আমাকে বলিস না। একটা কথা ভালো করে মাথায় রাখ, আমি চাই না ফারিশের কোনরকম অসুবিধা হোক। এইসব কথা যেনো আমি দ্বিতীয়বার না শুনি। নাহলে তুই জানিস, আমি ঠিক কতটা খারাপ। বন্ধু বলে ছাড় পাবি না তুই। অভি যেনো কিছু না জানতে পারে। ‘

শেফালি ফোনটা রেখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে ভেবে উঠতে পারছে না, এই মুহুর্তে তার কি করা উচিৎ! নিসংদেহে জুঁই একজন ভয়ংকর মেয়ে! সে যা বলবে তাই করবে।

_______________

অনন্যা নিজের রুম থেকে বেড়িয়েই, আরশের মুখোমুখি হয়। আরশ অনন্যা দেখেই বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠে বলে, ‘ মিস…হু! কি নাম যেনো? আচ্ছা যাই হোক, তা আপনার সার্ভিস কেমন চলছে? ফারিশ খানকে খুশি করতে পারছেন ঠিক মতো? ‘

আরশের বলা পুনরায় এমন কুৎসিত কথাতে, অনন্যা নিজের গাঁয়ের ওড়না ঠিক করে কঠোর গলায় জবাব দেয়, ‘ গালের থা/প্পড়ের কথা কি ভুলে গিয়েছেন? ‘

অনন্যার কথা শুনে, রাগে নিজের গালে হাত রাখে আরশ। আরশ কিছুটা এগিয়ে, অনন্যাকে শাসিয়ে বলে উঠে, ‘ আরশ খানের নজর যার উপর একবার পরে, তাকে সে একদিনের জন্যে হলেও নিজের বিছানায় এনে ফেলে। সেখানের তোমার মতো মেয়েকে তো…..’

আরশ হয়তো আরো কিছু বলতে চাইছিলো, কিন্তু পিছন থেকে ফারিশ এসে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

‘ এখানে কি হচ্ছে? ‘

ফারিশের কথা শুনে, আরশ থেমে যায়। দ্রুত দূরে সরে আসে। ফারিশকে দেখে স্বস্হির নি:শ্বাস ফেলে অনন্যা। ফারিশ আরশের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ তুই এই মুহুর্তে! এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’

আরশ মাথা নিচু করেই জবাব দিতে গিয়ে, আমতা আমতা করে জবাব দেয়, ‘ আসলে ভাই। আমি তো এখানে মানে…. ‘

ফারিশ পকেটে হাত রেখে, আরশের দিকে তাঁকিয়ে বাঁকা হেসে বলে, ‘ বাংলাতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে ইউ নো আরশ?অতি বাড় বেড়ো না, ঝরে পড়ে যাবে। ‘

ফারিশের কথা শুনে, আরশ এবং অনন্যা দুজনেই অবাক হয়! বিশেষ করে আরশের গলা ভয়ে শুকিয়ে আসে, তার মস্তিষ্কে একটা কথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে, ফারিশ কি কোন কিছু আন্দাজ করেছে? ‘

‘ ইউ নো না আরশ? বেশি কথা বলা, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

অনন্যা শুধু থ মে/রে ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে আছে।
আরশ কিছু না বলে বেড়িয়ে যায়। অপরদিকে, অনন্যা হয়তো ফারিশকে কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু ফারিশ গম্ভীর হয়ে বাইরের দিকে চলে যায়। ফারিশের পিছনে পিছনে অনন্যাও আসে। ফারিশ ড্রইংরুমে চলে আসে। সেখানে তার চাচা – চাচী এবং এনা বসে ছিলো। ফারিশ অফিসের উদ্দেশ্য বের হচ্ছিলো কিন্তু হুট করে সেখানে জুঁই এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরে।

চলবে কী?।

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-১৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
জুঁই সকলের সামনে এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরায়, অনন্যা ভ্রু কুচকে তাঁকায় জুঁইয়ের দিকে। রেশমি খান এবং এনাও কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। ফারিশ স্হীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখমুখ শক্ত! জুঁই ফারিশকে জড়িয়ে থেকেই ফিসফিস করে বললো, ‘ অফিস থেকে না হয় বিদায় করে দিয়েছো, কিন্তু? এই বাড়ি থেকে আমাকে কি করে বিদায় করবে তুমি ফারিশ? তুমি যতই আমাকে দূরে সরাতে চাইবে, আমি ততই তোমার কাছাকাছি চলে আসবো।’
ফারিশ কোনপ্রকার জবাব দিলো না। এমন পরিস্হিতিতে খালেদ খান কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার মা রুমা খান উপর থেকে নেমে গাম্ভীর্যের সাথে চেচিয়ে উঠে বললেন, ‘ এইসব কি হচ্ছে এখানে?’

রুমা খানের আওয়াজ শুনে, ফারিশ তৎক্ষনাৎ জুঁইকে একপ্রকার ঠেলে নিজের থেকে সরিয়ে ফেললো। জুঁই ধাক্কা সামলাতে না পেরে,নীচে পরে যেতে নিয়েছিলো কিন্তু আরশ এসে জুঁইকে ধরে ফেলে। জুঁইকে এইভাবে ধাক্কা দেওয়ায় আরশ কিছু বলতে চাইলে, জুঁই আরশকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে।জুঁই আরশকে আকড়ে ধরে কোনরকম জোড় করে হেসে বলে, ‘ আসলে অনেকদিন পর, সবাইকে দেখলাম তো! তাই আর কি এক্সাইটেডমেন্টে! যাই হোক, এনা ও আরশ তোরা আয়! লেটস গিভ মি হাগস! কতদিন পর তোদের দেখলাম। ‘

এনা ও আরশও একসাথে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে। আরশের থেকে বয়সে জুঁই ছোট হওয়ায়, আরশ জুঁইকে এনার মতোই ভালোবাসে, অপরদিকে এনাও বড় বোন হিসেবে জুঁইকে অনেক পছন্দ করে। জুঁই, এনা ও আরশের সাথে কুশল বিনিময় করে, রেশমি বেগমকে জড়িয়ে ধরে, ‘ খালা! কি অবস্হা তোমার?’

রেশমি বেগম উত্তর দিলেন না, তবে তাকে খুব দুশ্চিন্তিত লাগছে! ড্রইয়ং রুমে ৪টার মতো এসি! বাইরে আজ মেঘলা আবহাওয়া, তবুও সে ঘামছে! তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন, জুঁই মোটেও তাদের জন্যে আসেনি। ছোটবেলা থেকে সে ফারিশকে পছন্দ করে, সে একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠেছে ফারিশকে পাওয়ার জন্যে। নিশ্চই কোন পরিকল্পনা নিয়েই সে আজ এসেছে খান বাড়িতে কিন্তু তিনি ফারিশকেও ভালো করে চিনেন। একরোখা, জেদি টাইপ ছেলে। সে বেশকয়েকবারই জুঁই এবং ফারিশের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন প্রতিবারই তীব্রভাবে অপমানের সহিত সেই প্রস্তাব নাখোচ করেছে ফারিশ! বাড়িতে জুঁই চলে আসায় বেশ বড়সড় ঝামেলা হবে ভাবতেই মাথা ঘুড়াচ্ছে রেশমির! কিন্তু তার অজ্ঞান হলে চলবে না! নাহলে সবকিছু সামলাবে কে?

এতোকিছুর মাঝে সবেমাত্র ঘোর কাটলো অনন্যার! এতোক্ষন সে একটা বিরাট বড় ঘোরের মধ্যে ছিলো , জুঁই সম্পর্কে রেশমি খানের বোনের মেয়ে হয়! তার মানে ফারিশের সাথে তার আত্বীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। সেদিন অভির সাথে জুঁইয়ের হুট করে বিয়ে ঠিক হওয়ায়, প্রথম থেকেই অনন্যার সংদেহ হচ্ছিলো,সবকিছুর মধ্যে কোথাও না কোথাও জুঁইয়ের হাত রয়েছে। আজ সে পুরো নিশ্চিত, এতো বড় ষড়যন্ত্রে জুঁইয়েরও হাত রয়েছে। অনন্যার এখন মনে হচ্ছে সেদিনের ভিডিও হয়তো মিথ্যে না! সেদিন রাতের পুরো ঘটনা তার মনে নেই! এর পিছনে শেফালি এবং জুঁই সমানভাবে জড়িত! জুঁইকে সে ভালো করে চিনে, সে কিছুতেই সত্য কথা স্বীকার করবে না, অন্যদিকে বাকি রয়েছে শেফালি কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করবে কীভাবে অনন্যা? তার ফোনটাও তো ফারিশের কাছে জমা রয়েছে।

অনন্যা ভাবনার মাঝেই, জুঁইয়ের নজর গিয়ে পরে, অনন্যার উপর। অনন্যা দেখেই ইচ্ছে করেই, খানিক্টা হেসে প্রশ্ন করে , ‘ এই মেয়ে কে? আজ নতুন দেখলাম। নতুন সার্ভেন্ট নাকি?’

রেশমি খান হাল্কা হেসে বললেন, ‘ হ্যা! আমাদের বাড়ির কাজের লোক। ‘

‘ রেশমি খান একটা কথা আপনাকে কতবার বলতে হবে? মিস অনন্যা শুধুমাত্র আমার পার্সোনাল কাজের লোক! সব বিষয়ে আপনি কেন এতো ইন্টারফেয়ার করেন?’

ফারিশের প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলো রেশমি খান। এনা এগিয়ে গিয়ে জুইকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ আপু! চলো তো উপরে।কতদিন পর, তোমায় দেখলাম। অনেক গল্প করা বাকি আছে। ‘

এনার কথার বিপরীতে, জুঁইও ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ সমস্যা নেই। এসেছি যখন, বেশ কয়েকদিন থেকে তবেই যাবো। ‘

ফারিশ আগের ন্যায় কোনপ্রকার উত্তর দেয় না কিন্তু বাঁকা হাসি দিয়ে নীচের দিকে তাঁকায়! তার মষ্তিষ্কে হয়তো এমন কিছু এসেছে তা ভয়ংকর! তবেই সে এতোটা শান্ত। তাদের কথার মাঝেই, আরশের ফোন আসে। অপাশ থেকে একটা মেয়ের নাম্বার দেখে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিয়ে, মেয়েটার নাম্বারে মেসেজ করে লিখে, ‘ তুমি রেডি থাকো বেবি! আমি জাস্ট কিছুক্ষনের মধ্যে হোটেল রুমে পৌঁছে যাচ্ছি। ‘

আরশ ফোনটা রেখে, জুঁই এবং এনার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে ছোটখাটো একটা পার্টি আছে, তোমরা যাও! আমি পার্টিটা শেষ করে, জলদি চলে আসবো। ‘

‘ ওকে ভাইয়া, কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। ‘

এনা কথাটি বলেই, জুঁইকে নিয়ে উপরে যেতে থাকলে, জুঁই খেয়াল করে অনন্যা ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে, কিন্তু তা সে একপ্রকার এড়িয়েই উপরে চলে গেলো। ফারিশও অফিসের উদ্দেশ্য যাচ্ছিলো কিন্তু পিছন থেকে খালেদ খান ড্রাইনিং টেবিলে বসে থেকে প্রশ্ন করে, ‘ ফারিশ শোনো একটু! আমাদের নেক্সট ক্লাইন্টকে হ্যান্ডেল করতে, ভাইকে দেশে আসতে বলবো ভাবছি। জাপানের ক্লাইন্ট তো! বেশ ঝামেলা করে এরা। ভাই আবার জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে উঠাবসা। তিনি সবকিছু ভালো করে হেন্ডেল করতে পারবে। তোমার কি মতামত? ‘

ফারিশ পিছনে না ঘুড়েই জবাব দিলো,’ মি: খালেদ খান, আপনার কি কোনভাবে আমার স্ট্রাটাজির উপর সংদেহ রয়েছে? থাকলে বলুন। এই অর্ডার থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে ফেলবো। ‘

‘ এইসব কি বলছো ফারিশ? তোমার উপর আমি কী করে সংদেহ করতে পারি? আসলে জাপানের পার্টি তো বুঝতেই পারছো! তার মধ্যে প্রায় ১০০কোটি টাকার অর্ডার, তাই আর কি…..

সম্পূর্ন কথা শেষ করতে পারলেন না খালেদ তার আগেই ফারিশ উচ্চগলায় বলে উঠে, ‘ আজকেই আমি সেই জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে বসে, অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। তার জন্যে রাশেদ খানকে, সদূর জাপান থেকে চলে আসতে হবেনা। তিনি যদি কোনভাবে আমার কাজে ইন্টারফেয়ার করে, তবে আমি নিজেকে বিসনেজ থেকে সরিয়ে ফেলবো। আমার লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিসিশন। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

ফারিশ কথাটি বলেই বেড়িয়ে যায়। খালেদ খান ও কথা বাড়ালেন না, তিনিও বেশ ভয় পান তার ভাইয়ের ছেলে। ছেলে যখন একবার সতর্ক করে দিয়েছে তখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করলে, ঝামেলা হবে বড়! ফারিশ ব্যাবসায়ী ছেলে বাবার মতো!এতো বছর ধরে সাফল্যের সাথে খান বাড়ির ব্যাবসা সামলাচ্ছে যদিও ফারিশ ডিগ্রি পেয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। কিন্তু ব্যাবসায়ীক ক্ষেত্রে সে তুখোর! তাইতো খান ইন্ড্রাস্টির এমডি সে। খালেদ খানের ধারণা, ফারিশ যখন বলে দিয়েছে তখন সে তাকে নিরাশ করবে না আজ। সে একাই এতো বড় অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। অপরদিকে এইসব দেখে রুমা খান হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নিজের বাবার প্রতি ফারিশের এমন বিদ্বেষ দেখে, অনন্যা রুমা খানের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ দাদি! অনেক দিন ধরেই একটা কথা বার বার জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম। ‘

‘ কি কথা রে দিদিভাই?’

‘ এই বাড়িতে সবাই আছে, কিন্তু ফারিশ খানের বাবা-মা এই বাড়িতে থাকে না কেন? উনারা কি দুজনেই বিদেশে থাকে?’

অনন্যার এমন প্রশ্নে রুমা খানের মুখস্রী শুকনো হয়ে যায়। তিনি থমথমে গলায় জবাব দেয়, ‘ ফারিশ দাদুভাইয়ের যখন ৭বছর তখন তার মা মারা যায়। রোকেয়া মারা যাওয়ার ৮মাসের মাথায় ফারিশের কথা ভেবে, রাশেদ আরেকটা বিয়ে করে। কিন্তু সেই মাকে কিছুতেই মেনে নেয় না ফারিশ এবং সেই ঘরে বাচ্চা- কাচ্চা হওয়ার পরে, রাশেদের স্ত্রীও রাশেদকে নিয়ে বিদেশে চলে যায়, ছেলেটাকে একা করে। কতই বা বয়স ছিলো ছেলেটার? অতটুকু বয়সে বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে ফেলে সে। সৎ মা তো সৎ মা’ই হয়। এখন রাশেদ বউ, ছেলে- মেয়ে নিয়ে বিদেশেই থাকে। শীতের মধ্যে একবার করে তারা আসে শুধু এতটুকুই।’

রুমা খানের কথা অবাক হয়ে যায় অনন্যা! নিজের বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে ফারিশ। ছোট বয়স থেকেই বিষাক্ত দুনিয়াকে অনুভব করেছে সে, তাইতো তার মনে মায়া -দয়া জিনিসটা কম। অনন্যা প্রশ্ন করলো, ‘ আপনি তার বাবা কে, এতটুকু ছেলেকে রেখে, বিদেশে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন কেন দাদী?’

‘ সৎ মায়ের ছায়ায় বড় হওয়ার থেকে, তার থেকে দূরে থাকাই ভালো দিদিভাই। আমি তো দুনিয়াটি বুঝি রে দিদিভাই। তাই সেদিন রাশেদকে আটকায়নি, নাহলে আমার অনুমতি ব্যাতীত রাশেদ কখনোই যেতে পারতো না। আমি তো জানি ইশিকা ঠিক কেমন মানুষ! আমার নাতীকে সে কখনোই মমতা দিয়ে কাছে ডাকেনি। তার জন্যেই আজ বাবা- ছেলের মধ্যে এতোটা দূরুত্ব! ‘

বলেই আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন রুমা খান। অনন্যা নিজের রুমে এসে, নিজে নিজেই বলতে লাগলো, ‘ লোকটার হার্টলেস হওয়ার পিছনে কারণ আছে। ছোটবেলা থেকে বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে। বিয়ে করার পরও সংসার সুখ জুটলো না। বউটাও মারা গেলো। মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছে এখন। ‘

এইসব বলতে বলতে পরক্ষনে অনন্যা ভাবলো কিন্তু এতোকিছুর মধ্যে তার বা তার ফ্যামেলির কি যোগসুত্র রয়েছে? যার কারণে এইভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে ফারিশ। ফারিশের করা কাজের কথা পুনরায় মস্তিষ্কে আসতেই, তৎক্ষনাৎ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় অনন্যা! যত যাই হয়ে থাক। ফারিশ একজন নিকৃষ্ট মানব, তাকে নিয়ে মায়া করা বিরাট বড় অন্যায় বলে অনন্যার ধারণা। আজ তার প্রতিশোধের
নেশাতে, ভালোবাসা, পরিবার হারিয়ে শূন্য অনন্যা।

___________________

অফিস শেষে গাড়ি করে বাড়ির দিকে ফিরছিলো অভি, কিন্তু ঢাকা শহর বলে কথা! ঢাকা শহরে জ্যাম থাকবে না তা প্রত্যাশা করা সবথেকে বড় ভুল! আধাঘন্টা যাবত জ্যামে বসে আছে অভি। বিরক্ত হয়ে অভি গাড়ির মিউজিক অপশনে গিয়ে, একটি রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দেয়। মিউজিক সিস্টেম থেকে ভেঁসে আসে, সেই পরিচিত গানটি….

‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে’

গানটি শুনে অভির মনে পরে পুরনো কিছু স্মৃতি! প্রত্যেক শুক্রবার যখন সে অনন্যার সাথে দেখা করতে যেতো, তখন লাল পাড়ের মধ্যে তাতের সাদা শাড়ি পরতো অনন্যা। মুখস্রীতে থাকতো হাল্কা সাঁজের প্রলেপ! কপালে একখানা ছোট্ট কালো টিপ! লম্বা চুলে করা থাকতো খোপা। কি সুন্দর স্নিগ্ধ দেখাতো মেয়েটাকে। অভি তার কাছে গান শুনতে চাইলে, সে প্রথমেই বলতো, ‘ আগে বলো? বেলীফুলের গাজরা এনেছো? গাজরা না আনলে, নো সিনগিং! ‘

অভি তখন মুচকি হেসে গাজরা সামনে রাখতো অনন্যার। তা দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিতো অনন্যা। অভি অনন্যার খোপায় গাজরা পরিয়ে দিতো এবং অনন্যা তার মিষ্টি গলায় গাইতো সেই রবীন্দ্রসংগীত..

‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে ‘

সেই পুরনো দিনের কথা মনে পরতেই, অভি কি মনে করে যেনো গাড়ি থেকে চট করে নেমে গেলো। পাশে ছিলো ফুলের দোকান! সে দোকানে গিয়ে একটি গাজরা কিনে ফেললো। গাজরাটা কেন কিনলো সে জানেনা। তবে পরম ভালোবাসা নিয়ে সে গাজরাটির দিকে তাঁকিয়ে ছিলো।

________________

সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরে এলো ফারিশ। অন্যদিনের তুলনায় আজ তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। কারণ আজ সে একাই এতো বড় অর্ডার কনর্ফাম করিয়েছে জাপানি ক্লাইন্টদের দিয়ে। ফারিশ উপরে গিয়েই, নিজের ফোন মানিব্যাগটা রেখে, চটজলদি ওয়াশরুমে চলে যায়। অনন্যা ফারিশের রুমে এসেছিলো কফি নিয়ে। ফারিশকে ওয়াশরুমে যেতে দেখে, সে চট করে ফারিশের ফেনটা হাতে নিয়ে নেয়। সকালে মিষ্টি যখন ফারিশের ফোনে গেম খেলছিলো, তখন ফারিশের ফোনের পার্সওয়ার্ড সে দেখেছিলো। এই বাড়িতে একজন সার্ভেন্ট এর কাছেও ফোন নেই, তার মধ্যে বাড়ির কেউই তাকে নিজের ফোন দিচ্ছিলো না, তাই বাধ্য হয়ে, ফারিশের ফোন থেকেই শেফালির নাম্বারে ডায়েল করে অনন্যা। সে জানে পাক্কা ২০ মিনিট এর আগে ওয়াশরুম থেকে বের হবেনা ফারিশ কিন্তু…..

শব্দসংখ্যা-১৬১৫
চলবে কি?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-১৬+১৭

0

#প্রণয়ের_রংধনু 🖤
#পর্ব- ১৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
‘ আমি অভিকে বিয়ে করতে পারবো না বাপি, আই জাস্ট ওয়ান্ট মাই ফারিশ। ‘
‘ এমন মুহুর্তে এইসব কি বলছো তুমি জুঁই? ফারিশকে চাও মানে কি? বিয়ে কী তোমার কাছে পুতুলখেলা? আজ একজন, কালকে অন্যজন। ‘

‘ আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না বাপি। আমি সেই ছোটবেলা থেকে ফারিশকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করলে ফারিশকেই বিয়ে করবো। আমি তো অভিকে ভালোবাসি না, জাস্ট একটু নাটক করেছিলাম, কিন্তু তাই বলে আমাকে কেন অভিকে বিয়ে করতে হবে?’

কথাটি বলে জুঁই সোফায় বসে কপালে হাত রাখলো। আনোয়ার নিজের মেয়ের এমন কথাবার্তায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।ম/মরা মেয়েকে নিজের হাতে মানুষ করেছেন তিনি। মেয়েটার বড্ড জেদ! আনোয়ার ভাবতে পারছেন না তিনি এখন কি করবেন? জুঁইয়ের কথাতেই অভির মায়ের সাথে তিনি বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা এগিয়েছিলেন কিন্তু মাঝখানে তার মেয়ে এইভাবে বিষয়টাকে জটিল করে দিবে না স্বপ্নেও ভাবেন নি তিনি, ভাবলে হয়তো বিয়ের বিষয়টি এতোদূর এগিয়ে নিয়ে যেতেন না। কয়েকদিন সময় নিতেন, ভাবতেন। অত:পর ভেবে চিন্তে একটি সিদ্বান্তে আসতেন। এদিকে অভির মা এন্গেজমেন্ট এর জন্যে ইতিমধ্যে ফাইভ স্টার হোটেল বুকিং করে ফেলেছেন। ভদ্রমহিলাকে এইবার কী জবাব দিবেন তিনি? ভাবতে পারছেন না। শরীর ঘামছে তার। জুঁইয়ের সাথে তিনি আর কথা বাড়ালেন না। উপরে চলে গেলেন, আপাতত জুঁইকে একা ছেড়ে দেওয়া মঙ্গল,নয়তো সে বেঁকে বসবে, তবে তিনি বুঝাবেন। রাতে খাবার টেবিলে আরেক দফা জুঁইকে নিজের পাশে বসিয়ে ভালো ভাবে বুঝাবেন। জুঁইকে বুঝতে হবে দুনিয়াটা এতো সহজ নয়! সবকিছু ছেলেখেলা ভাবলে চলবে না।

আনোয়ার সাহেবকে উপরে যেতে দেখে জুঁই ফের আরেকবার ফেসবুকের মেসেঞ্জারের দিকে দৃষ্টি ফেললো। ফারিশ তার মেসেজ দেখেছে তবে এখনো অব্দি কোনপ্রকার উত্তর দিচ্ছে না। জুঁইয়ের অস্হির অস্হির লাগছে সবকিছু! সে পারছে না, ফারিশকে ছাড়া থাকতে। ফারিশ কেন বুঝতে পারছে না তার অনুভুতি? উহু, ফারিশকে বুঝতে হবে, ফারিশকে অনুভব করতে হবে, জুঁই ঠিক কতটা তাকে মন থেকে চায়। ফারিশকে ভালোবেসে, নিজের বন্ধুর সাথে প্রতারণা অব্দি করেছে তবুও কেন জুঁইয়ের ভালোবাসা নিয়ে সংশয় আজ ফারিশের মনে? জুঁই ঠিক করেছে সে খান বাড়ি যাবে, এই মুহুর্ত তার খালা রেশমা খান তাকে হয়তো সহায়তা করবে।

অপরদিকে…জুঁইয়ের মেসেজ দেখে একপ্রকার তা এড়িয়ে, গাড়ি ঘুড়িয়ে অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দিলো ফারিশ, বেশ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে তার আজ! জুঁইয়ের এইসব কথাবার্তা নিত্য নতুন। শুধুমাত্র সে সম্পর্কে আত্বীয় বলে, জুঁইকে এড়িয়ে চলছে, সবকিছু সহ্য করছে কিন্তু জুঁই এইসব বারংবার করলে সে মোটেও সহ্য করবে না বরং ভয়ংকর পদক্ষেপ নিবে।

____________
অনন্যা নিজের রুমে বসে ছিলো, করিমা এসে অনন্যার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে, ‘ আফা খাইবেন না। ‘

‘ হ্যা খাবো, তবে এখন না। ‘

‘ বেলা পেরিয়ে দুপুর হইয়া যাইবো। আহেন কিছু খাইয়া লন। এহনো অবদি সকালের খাওয়ান ডাই খান নাই। ‘

করিমার কথা শুনে, অনন্যা রান্নাঘরে গিয়ে তার জন্যে খাবার খুঁজতে গিয়ে পায় না। সে পাশে থাকা কাজের মেয়ে লতাকে প্রশ্ন করে, ‘ আমার জন্যে প্লেটে রুটি বানিয়ে রেখেছিলাম। তুমি কী কোথাও রেখেছো?’

‘ আসলে আফা, রেশমি ম্যাডাম বলেছেন ফেলে দিতে, তাই ফেলে দিয়েছি। ‘

‘ ফেলে দিয়েছো মানে? ‘

রেশমি খান হাতে পার্স নিয়ে শপিং এর উদ্দেশ্য বাইরে যাচ্ছিলেন, অনন্যার প্রশ্ন শুনে সে থেমে যান। অত:পর রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

‘ আমাদের বাড়িতে এক বেলার খাবার অন্য বেলা অবদি এতোক্ষন থাকে না। সেই খাবার হয়ে যায় বাসি। এখানে সব হয় ফ্রেশ এন্ড ফ্রেশ! সকালের খাবার দুপুরের ১২ টার পর একদম এলাও না। এখন লাট সাহেবের বেটির জন্যে তো আর বাড়ির রুলস ব্রেক করবো না। মনে রাখবে মেয়ে, তোমার পরিচয় টা। ‘

করিমাও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,’ আপনার দেওয়া এতো কাম করতে করতেই তো আফা নিজের নাস্তাডা সারতে পারলো না, আর আপনেই তার খাবার ফালাইয়া দিলেন? ফারিশ স্যার কিন্তু কইছিলো, আফা শুধু স্যারের কাম করবো কিন্তু আপনে গুরুজন মানুষ দেইখ্যা আফায়, আপনার বেডশিট ধুইয়া শুখাইলো, বাগানে যাইয়া মালির কাম অবদি করলো। ‘

করিমার এমন উত্তর তেঁতে উঠেন রেশমি খান। ঝাঁঝালো গলায় বলেন, ‘ বাহ! এই লাট সাহেবের বেটির সাথে থেকে, তোরও দেখি মুখে বলি ফুটেছে। কাজের লোকেদের মুখে এতো বড় বড় কথা মানায় না! ওই লাট সাহেবের মেয়ে না হয় ফারিশের লোক, কিন্তু তুই? তুই অন্তত ভুলে যাস না, তোর চাকরী নট করতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না।’

গরীব মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বারংবার তাদের চাকরী নিয়ে ভয় দেখানোর মালিকদের একধরণের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোন অন্যায়, কিংবা ভুল হলে তারা তখন চাকরীর ভয়ে অসহায় হয়ে পরে, চাইলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। তখন তারা হয়ে যায় চরম অসহায়!
সেই কষ্টের সীমা থাকে না তখন। করিমাকে মাথা নিচু করতে দেখে, অনন্যা কঠিন গলায় বলে,

‘ মনিব হোক কিংবা কাজের লোক, প্রতিটা মানুষের জন্যেই সমান কিছু রুলস আছে ম্যাডাম। খাবার নষ্ট করা আদোও কোন রুলসের মধ্যে পরে বলে, আমার মনে পরে না। আপনি আমার খাবার টা ফেলে না দিয়ে কোন গরীব দু:খিকে খায়িয়ে দিতেন, যারা দিনের পর দিন অনাহারে কোনরকমে বেঁচে আছেন। আপনি কী জানেন? খাবার জিনিস টা কী? একটা ছোট্ট মাসুম বাচ্চা রাস্তায় ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে, শুধু একটা মাত্র রুটির আসায়, একটু খাবারের আসায়। ক্ষুধা এমন এক ভয়ংর জিনিস , যার ফলে মানুষ ক্ষুধার্ত থাকলে, খাবার না পেয়ে, ক্ষুধার যন্ত্রনায় রাস্তার নোংরা আবর্জনা থেকে অব্দি খাবার কুড়িয়ে, নিজের ক্ষুধার জ্বালাকে নিবারণ করে।আপনি কি জানেন?বিশ্বজুড়ে গত বছর তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগেছে অন্তত ৭৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। সেখানে আপনি খাবার ফেলে দিচ্ছেন? যদি এমনই হয় এই বাড়ির রুলস, তবে আমি কখনোই মানবো না, এমন রুলস।’

অনন্যার কথা শুনে রেশমি খান চুপ হয়ে যায়। মাথা নিচু করেই, হাতে তালি বাজিয়ে, ‘ জিও আপামনি। ‘ বলে মুচকি হাসে।রেশমি খান বিরক্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। অনন্যা নামক মেয়েটির কাছে প্রতিবার তাকে যুক্তিতে হারিয়ে ব্যাপারটা সত্যি তার অপমানজনক।

রেশমি খানকে বেড়োতে দেখে, হাফ ছেড়ে জোড়ে নি:শ্বাস নিয়ে, করিমা বলে, ‘ আপামনি আপনে আইজক্যা যা কইলেন না, একদম ফাটাইয়া দিছেন। দজ্জাল বেডির মুখডা দেখছেন আফা? কেমনে শুখাই গেছিলো। দজ্জাল বেডি শুধু পারে পায়ের উপর পা রেখে, হুকুম দিতে, আর আকাম করতে। কুটনি বেডি একটা।’

‘ আহ, করিমা আপু, এইভাবে বলিও না। ‘

‘ আফা, আমি চট করে আরেকটা রুটি বানাই? আপনার ক্ষুধা লাগছে, দেইখাই বুঝা যাইতাছে। আপনার মুখডা অনেক শুকনা। ‘

‘ না, এখন আর খাবো না। আমার চট করে দুপুরের খাবারের ব্যাবস্হা করতে হবে। মিষ্টির স্কুল থেকে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে, উনার লিস্ট মতো রান্নাও করতে হবে। দুপুরে এসে, খাবেন। সময়ের হের ফের হলে, সমস্যা হবে। ‘

‘ কিন্তু আফা আপনে না খাইয়া থাকবেন এতোক্ষন। আপনার কষ্ট হইবো না?শরীর খারাপ হইবো তো।’

‘ রিযিকের মালিক আল্লাহ, তিনি যদি নসিবে রাখেন, তাহলে তোমার আফা মনি না খেয়ে থাকবে না। ‘

বলেই ক্ষীন্ন হাসলো অনন্যা। করিমাও সামান্য হাসলো।

_____________
অপরদিকে অভির মাথায় শুধু লতিফ হাওলাদেরের কথা গুলো ঘুড়পাক খাচ্ছে, ‘ আমার মেয়ে নির্দোষ, সব দোষ আমার। ‘ এমন কথা বলার মানে কি দাঁড়ায়? সব দোষ উনার মানে? অভি আরো কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলো, কিন্তু লতিফ হাওলাদার উত্তেজিত হওয়ার ফলে, উনার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যায়। শেফা বেগম ঘাবড়ে গিয়ে হাক ডেকে ডক্টরদের ডাকেন। ডক্টরও চলে এসে, অক্সিজেনের পাওয়ার বাড়িয়ে দেয়। শেফা বেগম দ্রুত অভির কাছে এসে বলে, ‘ কেন এসেছো তুমি? কিসের এতো প্রশ্ন তোমার হ্যা? আমার মেয়ে এখন তোমার কেউ না। ওর যা ইচ্ছে হোক, তাতে তোমার কী? তোমার জন্যে উনি আরো অসুস্হ হয়ে পড়লেন। এখন যাও তো। দয়া করে আর এসো না। আমরা কেউ তোমার সাথে কথা কিংবা দেখা করতে চাই না। ‘

‘ কিন্তু আন্টি…….

‘ কোন কিন্তু নয় অভি। বেড়িয়ে যাও চুপচাপ। উনাকে একটু সুস্হ হতে দাও। আমাদের মেয়েকে আমরা ঠিক ফিরিয়ে আনবো কিন্তু তোমাকে যেনো আমি আর না দেখি। এখুনি বেড়িয়ে যাও। ‘

শেফা বেগমের কাঠিন্যে বলা কথাগুলো শুনে অভি নিশব্দে বেড়িয়ে যায়। সে এমন এক পরিস্হিতিতে রয়েছে, যেখানে সবকিছু তার কাছে অপস্পষ্ট! এমন পরিস্হিতিতে কী করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। কেউ তাকে সাহায্য করছে না, সত্য মিথ্যার বেড়াজালে ফেঁসে তার অবস্হা খারাপ! এমন পরিস্হিতিতে তার করনীয় কী? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার ভাবনার মাঝেই, তার মায়ের ফোন আসে। অভির মা আজ ঠিক করেছেন ছেলেকে নিয়ে, জুঁইয়ের জন্যে এন্গেজম্যান্ট রিং কিনতে যাবেন। জুঁইয়ের বাবার থেকে কয়েকদিন আগেই জুঁইয়ের আংটির মাপ নেওয়া হয়েছিলো তার। অভির অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, মায়ের ফোনে করা অনুরোধে সে শপিং মলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

___________________
করিমা এবং অনন্যার কথার মাঝে মিষ্টি লাফাতে লাফাতে স্কুল থেকে ফিরে এসে। এসেই অনন্যাকে ‘ মা ‘ বলে জড়িয়ে ধরে। অনন্যাও মিষ্টির কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘ কি ব্যাপার? মিষ্টি মা! আজ এতো খুশি লাগছে যে বরং! স্পেশাল কিছু ঘটেছে?’

মিষ্টি তার ফোকলা দাঁত দিয়ে মুচকি হেসে, তার টিফিন বক্স বের করে, অনন্যার সামনে ধরে বলে,

‘ আজকে আমাদের স্কুলে, কুকিং ক্লাস হয়েছে সেখানে আমি নিজের হাতে ফার্স্ট টাইম টিচারের হেল্প নিয়ে পরোটা বানিয়েছি, একটা তোমার, আরেকটা বাপির এন্ড আরেকটা বড় গ্রেনির। তুমি খেয়ে দেখো, মিষ্টি কেমন রান্না করেছে। ‘

বলেই, মিষ্টি অনন্যার মুখে পরোটা দিয়ে দিলো। অনন্যার আখিজোড়ায় জল চলে আসে। সে না খেয়ে থাকলে, তার মা শেফা বেগম পরোটা বানিয়ে, অনন্যাকে খায়িয়ে দিতো। অনন্যাও তার মাকে খায়িয়ে দিয়ে হাসতো। মা-মেয়ের কত সুন্দর মুহুর্ত ছিলো! আজ মিষ্টিকে তার আরেকটা মা মনে হচ্ছে। তার ছোট্ট মা! অনন্যা কিছুটা খেয়ে মিষ্টিকেও খায়িয়ে দিলো। ফারিশের মিটিংটা হঠাৎ ক্যান্সাল হয়ে যাওয়ায়, সে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে এমন মুহুর্তে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। না চাইতেও সে মুগ্ধ হয়!

________________

রেশমি বেগম গাড়ির ভিতরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ জুঁইয়ের ফোন পেয়ে তিনি ভ্রু কুচকে তা রিসিভ করে বলে, ‘ হ্যালো!’

‘ হ্যালো খালা, তুমি কোথায়? ‘

‘ আমি তো মার্কেট যাচ্ছি এখন, কেন?’

‘ আমি কাল বা পরশু তোমাদের বাড়ি আসছি। ‘

‘ হঠাৎ, আমাদের বাড়িতে? ‘

‘ এতোকিছু বলার সময় নেই। আমি আসছি। জানিয়ে দিলাম। ‘

বলেই কট করে ফোনটা রেখে দিলো জুঁই।

পর্বসংখ্যা-১৫০০
চলবে কী?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-১৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ পকেটে হাত গুজে মুগ্ধ নয়নে অনন্যা এবং মিষ্টিকে দেখছে। করিমা দরজা দাঁড়িয়ে থাকা মুগ্ধ নয়নে দাঁড়িয়ে থাকা ফারিশ নামক যুবককে খেয়াল করে তৎক্ষনাৎ , মাথা নিচু করে বললো,
‘ আরে ভাইজান! আপনে? এই সময়। ‘
করিমার কথা শুনে অনন্যা ফারিশের দিকে তাকালো, মিষ্টিও ছুটে তার বাপির কোলে ঝাপিয়ে পরে বললো, ‘ বাপি জানো, আজ আমি নিজ হাতে কুকিং ক্লাসে রান্না করেছি, তুমি খাবে না? মিষ্টির মা কিন্তু খেয়েছে।’
ফারিশ কিছুটা গম্ভীর গলায় শুধায়, ‘ কিন্তু মা, তুমি রান্না কেন করেছো? যদি কোন ক্ষতি হয়ে যেতো তখন? আমি কালকেই স্কুলে গিয়ে বলে দিয়ে আসবো, এইসব কুকিং ক্লাস ফ্লাসে যেনো তোমাকে এন্টারফেয়ার না করা হয়।’

‘ কিন্তু বাপি…..

‘কোন কিন্তু নয়। এখন উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও মা। আমাকে লাঞ্চ করেই আবার বেড়িয়ে পরতে হবে।’

‘ কিন্তু বাপি, আমি যে নিজ হাতে রান্না করলাম, তুমি কী খাবে না?’

‘ না, মা! তুমি তো জানো, এইসব ওয়েলি ফুড আমি ক্যারি করতে পারি না। আমি ডায়েটে থাকি সবসময়। তুমি এখন উপরে যাও বরং। ‘

ফারিশের কথা শুনে ফারিশের কোল থেকে নেমে, মিষ্টি টিফিন বক্স টা টেবিলে রেখে মন খারাপ করে উপরে চলে যায়। মিষ্টিকে চলে যেতে দেখে, অনন্যা ফারিশকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ মেয়েটা শখ করে রান্না করে, আপনার জন্যে পরোটা নিয়ে এসছিলো অথচ আপনি ওর মন এইভাবে ভেঙ্গে দিলেন? একটু পরোটা খেলে কি এমন হয়ে যেতো? আপনি কোন সিনেমার হিরো হবেন? যার জন্যে সবসময় টাইগার শফের মতো বডি মেইন্টেইন করতে হচ্ছে। নিজের মেয়ের মন রক্ষার্থে যদি একদিন ডায়েট মিস হয়, তাহলে কোন মহাভারড অসাধ্য হবে?’

‘ আমাদের বাবা- মেয়ের ব্যাপারে আপনি ইন্টারফেয়ার না করলেও চলবে মিস। ইউ নো না? ফারিশ খান নিজের মন মর্জি মতো চলে। কাউকে কৈফিয়ত দিতে সে বাধ্য নয়। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ টাইপ অফ কুইশ্চেনস। ‘

অনন্যা প্রতিউত্তরে কিছু বলে না, শুধু ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফারিশও গলার টাই টা খানিক্টা ঢিলা করে নিয়ে, উপরে উঠতে গিয়ে, অনন্যার কাছে এসে বলে, ‘ জলদি ব্ল্যাক কফি বানিয়ে উপরে আসুন। অনলি ফাইভ মিনিসটস এর মধ্যে। আপনি তো জানিনই সময় নষ্ট করা! আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। সো ফাস্ট!’

কথাটি বলেই উপরে চলে যায় ফারিশ। ফারিশকে চলে যেতে দেখে মুখ বেকিয়ে কিছুটা ব্যাঙ্গ করে অনন্যা বলে,

‘ আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ! এই এক কথা আর মানুষকে হার্ট করা ছাড়া আর কী পারে এই লোক? ফারিশ না হয়ে, এই লোকের নাম খারুশ হলে একদম ঠিক হতো। একদম হার্টলেস লোক!ছোট্ট মেয়েটার মনটা অবদি খারাপ করে দিলো।কি খারুশ লোক রে বাবা! ঠিক বলেছে না করিমা আপু?’

করিমা হেসে বলে, ‘ হ্যা আফা, একদম ঠিক কইছেন।’

‘ আমি বরং যাই, মেয়েটাকে দেখে আসি। ছোট্ট মেয়েটার মন টা খারাপ হয়ে আছে। ‘

‘ কিন্তু আফা আপনে আগে কফি লইয়া যান, নাইলে স্যার রাগ কইরা আবার শাস্তি দিবো আপনারে।’

অনন্যা করিমার কথা গুরুত্ব না দিয়ে উপরে যেতে যেতে বললো, ‘ বাদ দাও তো আপু! উনার কথা সবসময় শুনতে হবে নাকি?’

করিমা মাথায় হাত দিয়ে দিলো।

___________________

অভি তার মায়ের সাথে শপিংমলের একটি বিরাট বড় ডায়মন্ড এর শো – রুমে ঢুকেছে। অভির মা নানারকমের রিং বের করিয়ে, বাছাই করার একটি কঠিন পক্রিয়া করছেন। তবে পক্রিয়াটা তার কাছে বেশ জটিল মনে হচ্ছে। একটার মধ্যে ডিজাইন ভালো লাগলে,ডায়মন্ডের ওজনের দিকে থেকে কম মনে হয়, অন্যদিকে ডিজাইন ভালো লাগলে কালারটা ঠিক ভালো লাগে না। বেশ ঝামেলার ব্যাপার! অভির মা চেয়েছিলেন জুঁই নিজে এসে, নিজের এন্গেজমেন্টের রিং টা পছন্দ করে যাক, কিন্তু সে এলো না, তার সাথে কথা হয়নি। সে ফোন ধরে নি তবে তার বাবা আনোয়ার সাহেব বলেছেন তার মেয়ে কিছুটা অসুস্সু। তাদের পছন্দ করা রিং বিনা শর্তে পরে নিবে জুঁই বলে, আসস্হ অবদি করেছেন আনোয়ার সাহেব, তবুও অভির মায়ের চিন্তার অন্তর নেই, আদো ও জুঁইয়ের তার পছন্দ করা আংটি পছন্দ হবে কিনা? শো- রুমে অভি ঘুড়তে ঘুড়তে একটি ডায়মন্ড রিং এর দিকে নজর যায়। অভি এগিয়ে গিয়ে দোকানদারকে বলে, আংটি টি বের করিয়ে দিতে। দোকানদার আংটি টি বের করে, অভির হাতে ধরিয়ে দেয়। অভি আংটি টি ভালো করে খেয়াল করে দেখে ডায়মন্ডের মধ্যে হাল্কা গোল্ডেল শেডের মধ্যে পিংক পাথর! অদ্ভুদ এক সুন্দর! রিং টা অনন্যার ফর্সা হাতের অনামিকায় পরালে, রিংটার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পাবে! অভির মনে হচ্ছে আংটিটি তৈরিই হয়েছে অনন্যার জন্যে। অনন্যার হাতের রিং এর মাপ অভি জানে। তাদের এন্গেজমেন্ট এর সময়ে, সে এবং অনন্যা এসে তাদের এন্গেজমেন্টের আংটি কিনে গিয়েছিলো। সব ঠিক থাকলে, আজ তাদের ভালোবাসা পূর্নতা পেতো!কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো । অভি আংটিটার দিকে তাঁকিয়ে ভাবতে লাগলো,আচ্ছা তার দেওয়া এন্গেজমেন্টের আংটি কি এখনো অনন্যার হাতে রয়েছে? অভির ভাবনার মাঝেই, অভির হাত থেকে খপ করে আংটি টা নিয়ে নেয় অভির মা। আংটি টা দেখে তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, ‘ বাহ, বাহ! আংটি টা বেশ চমৎকার! এতোক্ষন অবদি একটা আংটিও পছন্দ হচ্ছিলো না কিন্তু এই আংটি টা দেখেই মনে হচ্ছে বিশেষ। জুঁইয়ের হাতে ভালো মানাবে। এইটাই ফাইনাল করে নেই বরং। ‘

অভির মা আংটি টা নিয়ে কাউন্টারে চলে গেলেন। অভির বড্ড আটকাতে ইচ্ছে করলো তার মাকে। বলত ইচ্ছে করলো, ‘ মা এই আংটি টা জুঁইয়ের হাতে একদম মানাবে না। ভালো করে খেয়াল করে দেখো, আংটি টা দেখে মনে হচ্ছে, আংটা টা অনন্যার জন্যে তৈরি করা হয়েছে। অনন্যার হাতেই বড্ড সুন্দরভাবে মানাবে। আমি কী ফারিশ খানের বাড়িতে গিয়ে অনন্যাকে আংটি টা দিয়ে আসবো মা?’

কিন্তু আফসোস! কথাগুলো চাইলেও বলতে পারবে না অভি। পরক্ষনে নিজের অদ্ভুদ ভাবনার উপর নিজেরই রাগ উঠে যায় অভির! সে কি ভেবে চলেছে এইসব?

__________________________
অনন্যা মিষ্টির রুমে উঁকি দিয়ে দেখে, ছোট্ট মিষ্টি মন খারাপ করে, তার ময়না পাখির সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘ জানিস ময়না? আমি এতো কষ্ট করে পরোটা বানিয়ে নিয়ে আসলাম, অথচ বাপি খেলোই না। আমাকে বকে দিলো উল্টো। বাপি একদম ভালো না, বাপি খারুশ বাপি হয়ে গিয়েছে। আজ থেকে মিষ্টি তার বাপি খারুশ বাপি বলে ডাকবে, যেমনটা মিষ্টির মা তার বাপিকে ফারিশ দ্যা খারুশ বলে ডাকে, ঠিক তেমনি, বুঝলি? এইবার তুই বল তো! খারুশ বাপি, বল, বল……’

দরজার অপাশ থেকেই মিষ্টির কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে অনন্যা। মিষ্টি অনন্যার হাসি শুনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, কোমরে হাত রেখে,

‘ তুমি হাসছো কেন, মিষ্টির মা? তুমি কী জানো না? মিষ্টি তার খারুশ বাপির উপর রেগে আছে, মিষ্টি রেগে থাকলে কিন্তু বেশ সিরিয়াস হয়ে যায়। সিরিয়াস টাইমে নো লাফিং। ‘

অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত দিয়ে বললো, ‘ ইস! বড্ড বড় মিস্টেক হয়ে গিয়েছে। সিরিয়াস মোমেন্টে তো একদমই হাসা উচিৎ হয়নি আমার। ‘

মিষ্টি কিছু না বলে, মাথা নিচু করে থাকে। অনন্যা হাটু গেড়ে বসে, মিষ্টির গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে,

‘ রাগ করে আছো বেশি?’

‘ হু! খারুশ বাপি আমায় একদম ভালোবাসে না। দেখলে না? আমার বানানো পরোটা টা অবদি খেলো না। ‘

অনন্যা গালে হাত রেখে কিছুটা ভাবার অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে বলে, ‘ মিষ্টির বাপি খারুশ বটে কিন্তু সে তার প্রিন্সেস কে অনেক ভালোবাসে। অনেক অনেক! তা নিয়ে কোন সংদেহ নেই। ‘

‘ সত্যি বলছো? ‘

‘ একদম পাক্কা সত্যি। আচ্ছা আমরা তোমার বড় গ্রেনিকে দিয়ে তোমার খারুশ বাপিকে বকা খাওয়াবো। তাহলে আমার মিষ্টি বুড়ির রাগ কমে যাবে তো?’

‘ একদম, একদম! আই লাভ ইউ মাম্মা। ‘

কথাটি বলেই অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি।

_________________

মিষ্টির রুম থেকে এসে দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে, কফি বানিয়ে ফারিশের রুমের সামনে এসে নক করলো অনন্যা। ফারিশ ফাইল হাতে নিয়ে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘ টাইম দেখেছেন আপনি? কখন কফি টা নিয়ে আসতে বলেছিলাম আমি?’

ফারিশের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে অনন্যা।

ফারিশ তার হাতের সবগুলো আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, ‘ ঠিক ১০ মিনিট পর আপনি কফি নিয়ে এসেছেন। ৫মিনিটই লেইট আপনি। টাইমের কি আদোও কোন মূল্য আছে আপনার কাছে?’ জাস্ট রিডিউকিউলাস! ‘

বলেই কফি টা হাতে নিয়ে, অনন্যার দিকে এগিয়ে যায় ফারিশ। ফারিশকে দেখে অনন্যা পিছিয়ে আমতা আমতা করে বলতে থাকে,’আসলে…আমি…’

কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই, ফারিশ স্বাভাবিক ভাবেই অনন্যার হাতে গরম কফি ঢেলে দেয়, অনন্যা ব্যাথায় চেচিয়ে উঠলে, সঙ্গে সঙ্গে অনন্যার মুখ চেপে ধরে ফারিশ। শান্ত গলাতেই বলে, ‘ ডোন্ট সাউন্টিং! বলেছিলাম আপনাকে। ফারিশ খানের রাজ্যে এসেছেন আপনি, ছোট্ট একটা ভুলে পদে পদে শাস্তি পাবেন। ভোগ করবেন চরম ভয়ংকর যন্ত্রনা! ‘

অনন্যার আখিজোড়া বেয়ে জল গড়িয়ে পরে সে চাইলেও বর্তমানে আর্তনাদ করতে পারছে না। ঠিক পাঁচ মিনিট পর, অনন্যার মুখ ছেড়ে দেয় ফারিশ। অনন্যা চিৎকার না করলেও, ফুঁপাতে থাকে ব্যাথায়। ফারিশ অনন্যার হাত ধরে, সামনে থাকা বেসিং এর সামনে দাঁড় করিয়ে, পাশে থাকা ফ্রিজ থেকে বরফের একটা টুকরা বের করে, হাল্কা করে ঘষে দেয়, যেন অনন্যার হাতে ফোসকা না পরে তবুও হাল্কা দাগ হয়ে গিয়েছে। অনন্যা পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে ফারিশের কার্যকলাপ গুলো দেখে যাচ্ছে।ফারিশ এমনভাবে বরফ দিয়ে ঘষছে যার ফলে অনন্যার বাম হাতের অনামিকা থেকে অভির দেওয়া সেই এন্গেজমেন্ট রিং টা খুলে বেসিং এ পরে যায়। অনন্যা আংটি টা তুলতে নিলে, ফারিশ তাতে বাঁধা দিয়ে বলে,

‘যেই সম্পর্কের অস্তিত্ব নেই, সেই সম্পর্কের স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রনা, আপনার পুড়ে যাওয়া হাতের যন্ত্রনার থেকেও মাত্রাধিক বেদনাদায়ক মিস। বুঝলেন?’

শব্দসংখ্যা- ১৩৮০
চলবে কি?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রণয়ের_রংধনু ✨
#পর্ব- ১৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যা হাত বাড়িয়ে ফারিশের দেয়ালে থেকে একজন অল্প বয়স্ক সুন্দর রমনীর ছবি পেলো। তাকে এই বাড়িতে কখনো দেখে নি অনন্যা। রমনীর কোলে চার-পাঁচ বছরের ছেলে, বাচ্চা ছেলেটা কেমন করে মায়ের আচল খামচে ধরে আছে। দূর থেকে একজন কম বয়স্ক যুবক গাঁয়ে স্যুট কোর্ট পরা। মুখস্রী খানিক্টা ফারিশের ন্যায়! তবে আখিজোড়াতে ফারিশের মতো লম্বা ফ্রেমের চশমা নেই। লোকটিকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে সম্পর্কে ফারিশের বাবা হন এবং বাচ্চা ছেলেটার মুখশ্রীতেও ফারিশের মুখশ্রীর এক স্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান!সুতরাং ধরে নেওয়া যায় ছবিতে থাকা সুন্দর ফ্যামেলি ফটোটি স্বয়ং ফারিশ এবং তার বাবা- মায়ের, কিন্তু ফারিশের বাবা কিংবা মা তারা বর্তমানে কোথায়? একটা বিষয় ভেবে অনন্যার বেশ অদ্ভুদ লাগছে, ছবিতে থাকা পরিবারটি তাকে কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে। তার বারংবার মনে হচ্ছে ছবিতে থাকা যুবক-যুবতীকে সে বোধহয় কোনদিন দেখেছে! কিন্তু কোথায় দেখেছে? আশ্চর্য ব্যাপ্যার! কিন্তু ফারিশের সাথে তার কোন পূর্ব পরিচিতি ছিলো না, তবে এমন অদ্ভুদ অনুভুতি তার হচ্ছে কেন? বাড়িতে এসে অনন্যা ফারিশের বাড়ির প্রায় সবাইকেই দেখেছে কিন্তু ফারিশের বাবা – মা কাউকেই সে এখনো অব্দি দেখি নি, কিন্তু তারা কোথায়? জানার বড্ড কৌতহূল জন্ম নিলো অনন্যার। অনন্যা আর কিছু ভাবতে পারলো না। ক্লান্তিতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।

অপরদিকে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে, চাঁদের দিকে এক পলক তাঁকিয়ে রইলো ফারিশ।কিছুক্ষন পরেই, সেই চাঁদকে একরাশ
অন্ধকারছন্ন কালো মেঘ ঢেকে দিলো আকাশকে। আকাশের ন্যায় ফারিশের জীবনেও আজ কালো একরাশ মেঘের অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে আছে, যার থেকে কোনদিনও মুক্ত নেই ফারিশের। ফারিশের আজকাল ঘুমাতে ইচ্ছে হয় না। ঘুমালে বড্ড বাজে স্বপ্ন হাতছানি দেয়। আখিজোড়া বুঝলেই, তার আখিজোড়াতে ভয়ংকর এক দৃশ্য ধরা দেয়। স্বপ্নে দেখা যায়,সে নি:শ্বাস নিতে পারছে না, চারদিকে অন্ধকার, এবং অন্ধকার! ফারিশের দম বন্ধ হয়ে আসে সেই অন্ধকারে। কোথাও নেই কোন আলোর রেশ। এক এক করে সকল আপনজন ফারিশের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়ে, তাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। ফারিশ সবসময় সাহায্য চায়, তার প্রিয়জনেদের কাছ থেকে। সে এক ভরসার হাত খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কাউকে পায় না।স্বপ্নগুলোর কথা ভেবে ফারিশ সুইমিংপুলের পাশে থাকা রকিং চেয়ারে বসে বসেই হঠাৎ ঘুমের দেশের তলিয়ে পরলো তবে আজ অন্যদিনের ন্যায় স্বপ্ন সে দেখিনি। আজ সে দেখলো সে সুন্দর এক ফুলের বাগানে একা দাঁড়িয়ে আছে, সূর্যে ঝমকালো আলোতে থাকা আকাশ নিমিষেই কালো মেঘে ঢেকে গিলো, কি ভয়ংকর অন্ধকার চারিপাশে। ফারিশের শ্বাসকষ্ট শুরু হতে লাগলো! ধরনীর বুকে বৃষ্টি এসে পতিত হলো। মুষুলধারায় বৃষ্টি হতে লাগলো চারিপাশে, ফারিশের ফের নি:শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম,কিন্তু সাদা শাড়ি পরে, এক রমনী এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো ফারিশের দিকে। ফারিশের আখিজোড়া খুলে রমনীকে দেখার চেষ্টা করছে, তবে সে ব্যার্থ! রমনীর মুখস্রীখানা অস্পষ্ট! মুখে লম্বা করে ঘুমটা দেওয়া। ফারিশ উপায় না পেয়ে চট করে রমনীর হাত ধরে ফেললো। রমনী মুচকি হাসলো ঘুমটার আড়ালে। তৎক্ষনাৎ বৃষ্টি থেমে গিয়ে, আকাশে দেখা গেলো অদ্ভুদ সুন্দর এক রংধনু। ফারিশ মুগ্ধ হয়ে তাঁকালো সেই রংধনুর দিকে। সে রমনীর দিকে তাঁকিয়ে বললো, ‘ কে আপনি?’
রমনী উত্তর না দিয়ে, পিছনে ঘুড়ে গেলো। বাতাসে তার ঘুমটা পরে গেলো। ফারিশ তার মুখস্রী দেখতে না পেলো না, তবে দেখলো রমনীর কোমড় ছুই ছুই কালো রেশমি চুল উপচে পরছে। সে ফারিশের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো নিম্ন গলায় প্রশ্ন করলো,

‘ আজকের রংধনু অদ্ভুদ সুন্দর তাইনা? ‘

‘ হ্যা, সুন্দর কিন্ত মনে হচ্ছে বিশেষ এক রংধনু।’

‘ বিশেষ তো বটেই, এই রংধনু সবসময় দেখা যায় না। এই রংধনু প্রনয়ের রংধনু। আপনার জীবনে প্রনয়ের রংধনুর আগমন হতে চলেছে, মি: ফারিশ খান। তা কী আপনি জানেন?

‘কিসব হেয়ালি করছেন? প্রনয়ের রংধনু টা কী আবার? ‘

‘ ধরে নিন, যেই অন্ধকারকে বয়ে বেড়াচ্ছেন এতো বছর যাবত, সেই অন্ধকার থেকে মুক্তির এক পথ! ‘

ফারিশ সেই রমনীর উত্তরে ফের বিরক্ত হয়ে বললো,

‘আপনি আবারোও হেয়ালি করে যাচ্ছেন। আমার সাথে একদম হেয়ালি করবেন না। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘

সেই রমনী কোনপ্রকার উত্তর দিলো না। সে ফের মুচকি হেসে ধোঁয়ার মাঝেই মিলিয়ে গেলো। ফারিশ চাইলেও তাকে আটকাতে পারলো না। তবে সেই হেয়ালিগুলো নিয়ে ভাবতে থাকলো, কে সেই রমনী?

ফারিশ সেই রমনীর পিছনে পিছনে যেতে থাকলো তাকে একটিবার দেখতে তবে সে ব্যর্থ হলো! তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে আখিজোড়া মেলে তাকিয়ে দেখলো ভোরের আলো ফুটেছে। নতুন এক দিনের আগমন হয়েছে। ফারিশ ভাবতে লাগলো তার দেখা স্বপ্নটি নিয়ে। অদ্ভুদ স্বপ্নটির পিছনে কী কোন সংকেত ছিলো? কেন দেখলো আজ সে ভিন্ন স্বপ্ন?

________________________
অনন্যা সকালে উঠে খেয়াল করলো তার জ্বর নেই, সে যথেষ্ট সুস্হ বোধ করছে। মনটাও বেশ ফুড়ফুড়ে লাগছে তার। সে দ্রুত ফারিশের রুম থেকে বের হওয়ার পূর্বেই, ফারিশের মুখোমুখি হলো। ফারিশ অনন্যাকে দেখে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

‘ হাও ইউ ফিল নাও? ‘

‘জ্বী! এখন ভালো লাগছে ।সুস্হ বোধ করছি। ‘

‘ এখুনি কফি বানিয়ে, আমার রুমে নিয়ে আসুন। একদম লেট করবেন না। সময়ের অপচয় ,আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। আর হ্যা অবশ্যই ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিয়ে আসবেন। খেতে ভালো না লাগলে আরো ১০বার আপনাকে দিয়ে বানাবো, মাইন্ট ইট। ‘

অনন্যা কোনপ্রকার উত্তর দিলো না। ছোট্ট করে নি:শ্বাস ফেলে, রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। সে জানে এই লোকের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।ফারিশও
ওয়াশরুমে চলে যায়। অনন্যা ফারিশের রুম থেকে বেড়োতেই, রেশমি খানের মুখোমুখি হয়ে যায়। রেশমি খান অনন্যাকে উপর থেকে নীচ অব্দি পর্যবেক্ষন করে বললো, ‘ ভালোই তো সেবা যত্ন চলছে। এক ঘরে থাকছো অবিবাহিত হয়ে। তা মতলব কী? শরীর দিয়ে বুঝি আমাদের বাড়ির ছেলেকে বশ করতে চাইছো। ‘

রেশমি খানের কথাতে ঘৃণায় গা শিউরে উঠলো অনন্যার। বাড়ির মানুষগুলোর মন-মানষিকতা এতোটা বাজে? অনন্যা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো, ‘ শরীর দিয়ে বশ করার হলে, আপনার ছেলেকে সবার আগে করতাম, তার যা চরিত্র! একদম বশ হয়ে যেতো, কিন্তু কী আর করার বলুন?
আফসোস! আমি তেমন মেয়ে নই, আর আপনাকে ভালো করে জানিয়ে নেই, আমি এবং ফারিশ খান কালকে এক ঘরে ছিলাম না। ‘

রেশমি খান খুব ভালো করেই, তার ছেলের চরিত্র সম্পর্কে অবগত, তাই তিনি চুপ হয়ে গেলেন। অনন্যা ফের বললো,

‘আমাকে এইসব ভুল তথ্য দিয়ে অপমান করার পূর্বে দয়া করিয়া, সম্পূর্ন সঠিক তথ্য জেনে তারপর অপমান করতে আসবেন। আমি মাথা পেতে আপনার অপমান সহ্য করবো। অন্যের চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করার পূর্বে, দয়া করে নিজের ছেলের চরিত্র শুধরানোর চেষ্টা করুন। আই থিংক সেইটা বেটার হবে। ‘

কথাগুলো বলেই চলে যায় অনন্যা। রেশমি খান মুখ বেকিয়ে বলে, ‘ কাজের মেয়ের এত্তো বড় সাহস! রেশমি খানের মুখে- মুখে তর্ক! এই মেয়েকে আমিও বুঝিয়ে দিবো কাজের লোকের জায়গা ঠিক কী। ‘

অনন্যা সর্বপ্রথম মিষ্টির রুমে গেলো। ঘুমন্ত নিষ্পাপ মিষ্টিকে দেখে মুচকি হাসলো সে। মিষ্টির মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় ডাকলো, ‘ মিষ্টি মা, উঠে পড়ো সোনা। নাহলে যে স্কুলের জন্যে লেট হয়ে যাবে।’

অনন্যার গলার স্বর শুনে চট করে চোখ মিলে তাঁকালো মিষ্টি। অনন্যাকে দেখে হাই তুলে, ‘মাম্মা, গুড মর্নিং’ বলে অনন্যার গলা জডিয়ে ধরলো। অনন্যা হেসে বললো, ‘ গুড মর্নিং সোনা। এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে, নীচে চলে আসো। ব্রেকফাস্ট করে, স্কুলে যেতে হবে তাইনা?’

মিষ্টি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।অনন্যাও নীচে নেমে রান্নাঘরে এসে কফি বানাতে থাকে, করিমা অনন্যাকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,

‘ আফা কাল রাইত আপনে কই আছিলেন? আপনারে দেখলাম না যে। ‘

‘ পরে সব খুলে বলবো করিমা আপু। আপাতত উনাকে কফি দিয়ে আসি, নাহলে উনি আবার হাক- ডাক শুরু করবে। ‘

বলেই কফি হাতে উপরে ফারিশের রুমে চলে গেলো। ফারিশের রুমে গিয়ে, অনন্যা ফারিশের বিছানার কাছে কফি রেখে বললো, ‘ কফি রেখে গেলাম কিন্তু, খেয়ে নিবেন….

অনন্যার কথা শেষ হওয়ার মাঝেই, নীচে টাওয়াল পেচিয়ে খালি গায়ে, চুল ঝাকাতে ঝাকাতে বেড়িয়ে আসে ফারিশ। ফারিশকে খালি গায়ে দেখে হুট করে
‘আ………’ বলে চেঁচিয়ে উঠে অনন্যা।

‘ ইউ স্টুপিড, ওয়াই ইউ আর সাউটিং লাইক দিজ?’

কথাটি বলেই, অনন্যাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে, অনন্যার মুখ চেপে ধরে ফারিশ।

_________

অপরদিকে অভি সকাল সকাল হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছে। উদ্দেশ্য শেফা বেগমের সাথে দেখা করা, তিনিই একমাত্র তাকে সঠিক তথ্য দিতে পারবে, কেন অনন্যা আজ ফারিশের বাড়িতে। তার পিছনের কারণ নিশ্চই হয়তো জানেন
শেফা বেগম।
চলবে কি?

#প্রণয়ের_রংধনু ✨
#পর্ব-১৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ অনন্যাকে তার কাছে টেনে, মুখ চেপে ধরেছে। দুজনের মধ্যে সমান্যতম দূরত্ব। ফারিশের উত্তপ্ত নি:শ্বাস উপচে পরছে অনন্যার ঘাড়ে, যার ফলে ক্ষনে ক্ষনে খানিক্টা শিউড়ে উঠছে অনন্যা। ফারিশ রেগে প্রশ্ন করে, ‘ স্টুপিডের মতো চেঁচানোর কি হলো?’
অনন্যা আখিজোড়া নামিয়ে’ উম..উম’ করতে থাকে।
‘ উত্তর না দিয়ে, এমন উম উম করছেন কেন? আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ টাইপ অফ এক্টিভিটিস। স্ট্রিটলি আন্সার দিবেন। ‘
ফারিশের কথা শুনে আখিজোড়া মেলে, ইশারা দিয়ে ফের ‘ উম উম ‘ করে অনন্যা। যার অর্থ ‘ আরে হাদারাম লোক! আমার মুখ থেকে হাত তো সরান। নাহলে কীভাবে উত্তর দিবো?’

ফারিশের হয়তো অনন্যার আখিজোড়ার ইশারা বুঝলো কিছুটা তা সে হাত সরানোর পূর্বে বলে উঠলো, ‘ ওকে ওকে আমি সরাচ্ছি, বাট ডোন্ট সাউন্টিং।’

ফারিশ অনন্যার হাত থেকে মুখ সরাতেই, জোড়ে জোড়ে নি:শ্বাস নিতে নিতে বললো, ‘ আপনি কী পাগল? এইভাবে কেউ মুখ চেপে ধরে, আমার যদি নি:শ্বাস আটকে যেতো, তখন? ‘

ফারিশ ফের চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উত্তর দিলো,

‘ ফারিশ খান, কাউকে কৈফিয়ত দিতে পছন্দ করে না, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ, কিন্তু আপনি বলুন তো, আপনি চিল্লাচ্ছিলেন কেন? কি এমন দেখে ফেলেছেন?’

ফারিশের কথায় হুশ ফেরে অনন্যায়। সে লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে, ‘ আপনি নিজের দিকে ভালো করে তাঁকান! এইভাবে অন্য মেয়ের সামনে শার্টলেস ভাবে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন, আপনি কি লজ্জা শরম নেই?’

অনন্যার কথা শুনে ফারিশ নিজের দিকে তাঁকিয়ে গম্ভীর গলায় জবাব দেয়, ‘ ওহো! আই সি, কিন্তু মিস অনন্যা, আমার তো মনে হয়, আপনি লজ্জাতে নয়, বরং আমার মতো হট, চকলেট বয়কে এমন শার্টলেস দেখে এক্সাইটেডমেন্টে চেঁচিয়ে ফেলেছেন, যদিও ব্যাপারটা আমার জন্যে স্বাভাবিক! কিন্তু এইভাবে চিল্লাবেন না, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। এখন আপনি আসুন। ‘

ফারিশের কথা শুনে লজ্জায় কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে অনন্যার। লোকটা কী বললো তাকে? সে এইসব দেখে এক্সাইটেডমেন্টে চিৎকার করেছে? নিজেকে কী ভাবে কি লোকটা? হ্যা লোকটা তামিল হিরোদের মতো হ্যান্ডসাম বলে অনন্যার ধারণা, কিন্তু তার মন অত্যান্ত কুৎসিত! ফারিশকে অনেকগুলো কথা শুনাতে ইচ্ছে হলেও, রাগে -দু:খে মুখ বেকিয়ে বেডিয়ে গেলো অনন্যা। অনন্যা বেডিয়ে হাল্কা বাঁকা হেসে, কফির কাপে চুমুক দিয়ে, মাথা নাড়িয়ে ফারিশ বলে, ‘ না! কফি টা ভালোই করেন উনি। ভালো না করলে, আজ উনাকে আবারো শাস্তি দিতাম।’

________________

অভি হসপিটালের করিডোরে পাইচারি করছে। কেবিনে যাবে কী যাবে না ভেবে দিদ্বায় ভোগছেন। তবে ওয়ার্ডের একজন ছেলেকে দিয়ে ভিতরে শেফা বেগমকে খবর পাঠিয়েছেন, তিনি অনুমতি দিলে সে ভিতরে ঢুকবে অন্যথায় ঢুকবে না। ওয়ার্ড বয় কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো। সে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে অভিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ আপনে ভিতরে যান।’

অনুমতি পেয়ে অভি ভিতরে প্রবেশ করলো। সেখানে শেফা বেগম বসে ছিলেন। লতিফ হাওলাদারের মুখে মাস্ক, তিনি এক দৃষ্টিতে অভির দিকে তাঁকিয়ে আছে। অভি হাতে থাকা ফলের ব্যাগগুলো পাশের টেবিলে রাখলো। শেফা বেগম থমথমে গলায় বললেন,

‘ চেয়ারটা নিয়ে বসো, অভি। ‘

অভি চেয়ার টেনে বসলো।

‘ তা কী খবর? এতোদিন পর আসলে যে? হঠাৎ কি মনে করে? ‘

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলেন শেফা বেগম, অভি কিছু বলতে চাইলে তাতে বাঁধ সেধে শেফা বেগম বললেন, ‘ নিশ্চই তোমার আংকেল কে দেখতে আসো নি। তাইনা? যদি তাকে দেখতে আসার হতো, তাহলে অনেক আগেই আসতে। যখন অনেক ফিনালশিয়াল ক্রাইসিসে ছিলাম, তখন এগিয়ে আসতে। ‘

‘ আসলে…….’

‘ কোন জরুরী কাজে এসেছো, বুঝতে পেরেছ।একটা কথা মনে রেখো, আজ তোমার আংকেলের এমন করুন অবস্হার পিছনে তুমিও কম দায়ী নও।
সেদিন আমার মেয়েটাকে বিয়ের আসরে ফেলে চলে গেলে, সেই দু:খেই মানুষটার আজ এই অবস্হা। ‘

অভি নিচু গলাতেই জবাব দেয়, ‘ আমি জানি, তবে আমি কিছু কথা আজ জানতে এসেছি, কিছু সত্যি মিথ্যার বেড়াজালে আমি আটকে পরেছি, ভিডিও টাকেও অস্বীকার করা যায় না। আপনিও তো দেখেছিলেন, কিন্তু আমি আপাতত জানতে এসেছে, যদি ফারিশ খানের সাথে অনন্যার কোন সম্পর্ক না থেকে থাকে, তবে অনন্যা কেন এখন ফারিশ খানের বাড়িতে?’

অভির এমন প্রশ্নে লতিফ হাওলাদার তৎক্ষনাৎ মুখ থেকে মাস্ক খুলে উত্তেজিত কন্ঠে আওড়াতে থাকে,

‘ আমার মেয়েকে তোমরা কেউ ভুল বুঝো না। আমার মেয়ের কোন দোষ নেই। আসল দোষী তো আমি….’

‘ ওগো! তুমি এইভাবে মাস্ক খুলে ফেললে কেন? তুমি এইভাবে উত্তেজিত হইয়ো না। অভি তুমি এখন দয়া করে যাও। উনার অবস্হা ভালো না।’

কথাটি বলেই, স্বামীর দিকে এগিয়ে গেলেন শেফা বেগম। অভি স্তব্ধ হয়ে গেলো কিছুক্ষনের জন্যে। লতিফ হাওলাদারের শেষের কথাগুলো তার খুব কানে বাজতে লাগলো, ‘ আমার মেয়ের কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার….’

_______________________

অনন্যা ফারিশের রুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এসে, ফারিশের বলা ব্রেকফাস্ট বানাতে শুরু করলো, তখনি এমা এবং আরশ নীচে নেমে, ড্রাইনিং টেবিলে এসে বসলো। এমা ফোন চালাতে চালাতে কফি খেতে লাগলো অনন্যা সার্ভেন্টরা এসে, ব্রেকফাস্ট গুলো টেবিলে পরিবেশন করলো, এমা নিজের মতো খেতে থাকলেও, আরশের আখিজোড়া অনন্যার দিকে। গতকালের অপমান এখনো ভুলতে পারছে না সে। তার একমাত্র লক্ষ্য অনন্যাকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া, শুধুমাত্র একটা সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষা! আরশের বিচ্ছিরি দৃষ্টিতে বেশ অস্বস্হিতে ভুগছিলো অনন্যা তবুও কিছু বলে না এতো মানুষের মধ্যে। ছোট্ট মিষ্টি নীচে নেমে কি যেনো ভেবে আরশের কাছে গিয়ে বললো, ‘ কাকাই! তুমি এইভাবে মিষ্টির মায়ের দিকে রাক্ষসের মতো তাঁকিয়ে আছো কেন? মনে হচ্ছে রাক্ষসের মতো গিলে ফেলবে। ‘

মিষ্টির কথা শুনে করিমা এবং অনন্যা ফিক করে হেসে ফেলে। আরশ বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বললো, ‘ পাঁকা মেয়ে একটা! বেশি কথা বলে। ‘

আরশ হয়তো মিষ্টিকে ধমক দিতে চেয়েছিলো কিন্তু ফারিশকে আসতে দেখে, থেমে যায়। মিষ্টি ফারিশকে দেখে ‘ বাপি ‘ বলে দৌড়ে যায়। ফারিশও মিষ্টিকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘ গুড মর্নিং প্রিন্সেস! আর ইউ ফাইন?’

‘ ইয়েস বাপি! আম টোটালি ফাইন। ‘

‘ তাহলে চলো মা! তাড়তাড়ি ব্রেকফাস্ট করে নেই, তারপর তো তোমাকে স্কুলেও ড্রপ করে দিতে হবে তাইনা?’

মিষ্টি মুচকি হেসে, ফারিশের কোলে ড্রাইনিং টেবিলে বসে থাকে। ফারিশ এবং মিষ্টি দেখে মনে মনে অনন্যা
ভাবে, ‘ লোকটা মানুষ হিসেবে খারাপ হলেও, বাবা হিসেবে একদম ভিন্ন, আলাদা। ‘

অনন্যা ফারিশের ব্রেকফাস্ট নিয়ে, টেবিলে পরিবেশন করে। ফারিশ মিষ্টিকে কোলে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করছিলো এবং অনন্যা নিজে ব্রেডে জেল লাগিয়ে, মিষ্টিকে খায়িয়ে দিচ্ছিলো। ফারিশ চাইলেও কিছু বলতে পারে না, কারণ মিষ্টি এখন অনন্যা বলতে অজ্ঞান!

উপর থেকে এমন দৃশ্য দেখে মুচকি হাসে রুমা খান। তার মনে হচ্ছে নীচে থাকা ড্রাইনিং টেবিলে একটা ছোট্ট পরিবারের চিত্র ফুটে উঠেছে। মা তাড়াহুড়ো করে মেয়েকে খায়িয়ে স্কুলের জন্যে রেডি করছে অত:পর বাবাও মেয়েকে নিয়ে স্কুলের জন্যে বেড়িয়ে পরেছে । কি সুন্দর দৃশ্য!

_________________

ফারিশ মিষ্টিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে, অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দিতেই, একটা ম্যাসেজ পেয়ে থেমে যায়। ম্যাসেজটি ছিলো জুঁইয়ের। যেখানে লেখা,

‘ আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই ফারিশ। ‘

চলবে কী?