Tuesday, July 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 365



ওপারে আকাশ পর্ব-০১

0

#ওপারে_আকাশ

বিসমার্ক প্লাজার দোতলায় কসমেটিকসের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে সুবহা। ব্যাগে রাখার প্রিয় ছোটো আয়নাটা গতকাল সন্ধ্যায় ভেঙে ছয় টুকরো হয়েছে। তাছাড়া কিছু শীতের প্রসাধনী কেনারও প্রয়োজন ছিল। ইশতিকে পাশের টি-শার্টের দোকানে রেখেই কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে পড়ল সুবহা। দোকানটিতে এক জোড়া দম্পতি কেনাকাটা করছিল। লিপস্টিকের কালার দেখতে পুরুষলোকটা নিজ হাতে বউয়ের ঠোঁটে এই সেই কালার লাগিয়ে দিচ্ছে আবার টিস্যু দিয়ে মুছে নিচ্ছে। বউকে কোন কালারে সবচেয়ে সুন্দর লাগে সেটাই পরখ করে দেখছে খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে। কয়েক মিনিট এক দৃষ্টিতে বিষয়টা তাকিয়ে দেখল সুবহা। মনে মনে বলল, নারীরা আসলে বিবাহিত জীবনে তেমন কিছুই চায় না- যদি এমন একটু ভালোলাগা মাঝে মাঝে তাদেরকে ছুঁয়ে দিতে পারে।

আড়চোখে ওই দম্পতিকে দেখতে দেখতে সুবহা কেনাকাটা করে চলেছে। গ্লিসারিন, লোশন আর ক্রিম প্যাকেট করতে বলে মিনি আয়না বের করতে বলল দোকানিকে। ইশতি ততক্ষণে টি-শার্টের কর্ণার থেকে কসমেটিকস এর কর্ণারে চলে এসেছে।

“এই সুবহা, তোমার হোলো? একটু পর এই রাস্তায় জ্যাম পড়ে যাবে। জ্যামের আগেই কিন্তু বাসায় ফিরতে হবে। দ্রুত শেষ করো…”

“এই শোনো এদিকে আসবে একটু? দেখো না এই তিনটা আয়নার মধ্যে কোনটা বেশি সুন্দর?”

“নাও তোমার যেটা ভালো লাগে। ওসব আমি বুঝি না। একটু দ্রুত করো, ফিরতে হবে।”

“এসেছি আধাঘন্টাও হয়নি। আসার সাথেই যদি এমন করো তবে সাথে আনলে কেন?”

“আচ্ছা তোমার যতো সময় লাগে কেনাকাটা করো। ফিরতে কষ্ট হবে সেজন্যই বলছিলাম।”

“এই দুই জোড়া চুড়ির মধ্যে কোনটা সুন্দর একটু বোলো না।”

“আচ্ছা বারবার একই কথা বলছ কেন? মেয়েদের জিনিসপত্র মোটেও চিনি না আমি। যেটা ভালো মনে হয় নাও…”

হঠাৎ সুবহার চোখে পানি এল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে হাত থেকে চুড়ি রেখে দিয়ে আড়চোখে ওই দম্পতির দিকে তাকাল।
দুজন মিলে কানের দুল পছন্দ করে চলেছে তারা। পুরুষ লোকটি বউয়ের কানের সামনে একটা একটা করে দুল ধরে ট্রায়াল আয়নায় বউকে দেখছে…

সুবাহ ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল। ইশতিকে ক্রস করতেই ইশতি বলল, “সব নিয়েছ?”

“লাগবে না। দোকানদারকে ওগুলো রেখে দিতে বল। নামি চলো। জ্যাম পড়ে যাচ্ছে…”

ইশতি দ্রুত গিয়ে সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করল, “কত টাকা হয়েছে?”

দোকান থেকে টাকার অ্যামাউন্ট বললে ইশতি মূল্য শোধ করে দ্রুত বের হলো দোকান থেকে।

সুবাহ ততক্ষণে চলন্ত সিঁড়িতে। ইশতিও পা চালিয়ে দ্রুত সিঁড়িতে উঠে পড়ল। সারা রাস্তা সুবাহ দম আটকে বসে রইল। কোনো কথা নেই। ইশতির ফোন আসছে একের পর এক, বায়াররা কল করছে। কখনও আবার হোয়াটসঅ্যাপে কাস্টমারদের সাথে কানেক্ট হচ্ছে। সুবাহ যে রাগ করে বসে আছে ইশতি সেটা খেয়ালই করল না সারা রাস্তায়। যে যার মতো করেই সময় পার করল।

সুবাহকে বাসা অবধি পৌঁছে দিয়েই ইশতি আবার ছুটল অফিসে। বিদেশ থেকে কাস্টমারদের সাথে মিটিং হবে রাত আটটায়। ইশতি সেখানেই ছুটছে।

বাসায় ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করে অনেকক্ষণ ধরে ঠান্ডা পানির ঝাঁপটা নেয় সুবাহ। মন খারাপের জের তবুও কাটে না। রাতের রান্না করতে রান্নাঘরে ঢোকে। দুইপিস মাছ বের করে দ্রুত রান্না শেষ করে এসে বিছানায় চলে আসে।

ইশতির সাথে দেড় বছর হয় বিয়ে হয়েছে সুবহার। টানা দুই বছর প্রেমের পর অনেক কষ্টে পরিবারকে রাজি করাতে পেরেছিল দুজন। ইশতিকে পাওয়ার জন্য কী না করেছিল সুবাহ্। পাতা পাতা ঘুমের ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে পর্যন্ত গিয়েছিল। সুবাহ মনে মনে বলে, “বিয়ের আগেও ইশতির মধ্যে কি এই ছাড়া ছাড়া ভাবটা ছিল? কি জানি কিছুই মনে নেই এখন। বিষয়গুলো কিন্তু তখন পরখ করে নেওয়া দরকার ছিল। প্রেমের আবেগে এতটা ডুবে ছিলাম। আবেগের বশে খুব বেশি ভুল করে ফেললাম না তো জীবনে!”

ইফতি বাসায় ফেরে রাত এগারোটায়। এসেই হাত মুখ ধুয়ে এসে বলে খাবার দাও। ক্ষুধা পেয়েছে।
সুবাহ ভাত মাছ আর আগের রান্না করা ডাল সামনে দেয় ইশতির। “ঢেলে নিও। পুরোটা তোমার জন্যই বেড়েছি।”

ইশতি ‘খেয়েছ’ জিজ্ঞেস করলে সুবহা মাথা নেড়ে বলে,
” এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে পারি না। রান্নার পরপরই খেয়ে নিয়েছি।”

ভালো করেছ, বলে ডানে বামে আর তাকায় না ইশতি। চটপট খাবার খেতে থাকে। খেতে খেতে বলে, “রান্নার সময় অন্যমনস্ক ছিলে? খাবার খেতে পারছি না। স্বাদ লাগছে না।”

সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে প্লেট থেকে একটা মাছ উঠিয়ে বাটিতে রাখে। দ্রুতই খাবার শেষ করে উঠে পড়ে ইশতি। সুবহার মন খারাপের মাত্রা আরো বেড়েছে।
“প্রচণ্ড খিদেয় পেটও জ্বলছে। তার চেয়েও বেশি জ্বলছে চোখ। তার স্বামী একা একা খেয়ে উঠে গেল। একটা লোকমা মুখের সামনেও ধরল না। শেষমেশ আবার রান্নার বদনাম করতেও ছাড়ল না। এই মানুষটাকে এতো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম আমি!”

ঘুমোনোর সময় ইশতি জানায়, আগামীকাল বিকেলে তার এক বন্ধুর অ্যানিভার্সারির অনুষ্ঠান। ফোনে নিমন্ত্রণ করেছে তাদেরকে। পাঁচটার মধ্যে রেডি থেকো।

দুই
ইশতির বন্ধু জায়ান আর তার বউ মিতা বর-কনে সেজে স্টেজে ফটোসেশন করছে। ইশতির আরো বন্ধুরাও এসেছে অনুষ্ঠানে। কেউ বউ নিয়ে এসেছে। কেউ কেউ সিঙ্গেল। ইশতি, বউকে বন্ধুমহলে পরিচয় করিয়ে দিয়েই যথারীতি কাস্টমারদের ফোনকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে সবার মাঝে আনইজি বোধ করতে থাকে সুবাহ। অনুষ্ঠানে যে কাপলগুলো এসেছে তারা সবাই ফ্যামিলি ছবি তুলতে ব্যস্ত। কেউ কেউ ব্যস্ত বউয়ের ছবি তুলতে। জায়ান আর মিতার সাথে গ্রুপ ছবি তুলতেও মরিয়া কয়েকজন। সুবহা বিরক্তমুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে…

এমন সময় জায়ানের বন্ধু চয়ন সামনে এসে বলল, “পোজ দিয়ে দাঁড়ান তো ভাবী। সুন্দরী মানুষটার কিছু ছবি তুলে দিয়ে ধন্য হই।”

সুবহা ছবি তুলবে না বলে জানায়। কিন্তু চয়ন নানানভাবে দুষ্টুমীর স্বরে কথা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে সুবাহ কিছুটা ইজি হয়ে পোজ নিয়ে ছবি তুলতে দাঁড়ায়। ওদিকে ফোনের ঝামেলা শেষ করে ইশতিও এগিয়ে আসে। ইশতি এলে চয়ন তাকেও দাঁড়াতে বলে পাশে। বন্ধু আর বন্ধুর বউয়ের রোমান্টিক কিছু ছবি তোলে মধ্যস্থতা করে।
শেষ পর্যন্ত চয়নের দুষ্টুমী আর আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে সময়টা খুব একটা মন্দ কাটে না সুবহা’র। মন খারাপ ভাবটাও বেশ হালকা মনে হয়।

অনুষ্ঠান শেষ হলে ফেরার জন্য উবারের খোঁজ করে ইশতি। রাস্তার ওপারে উবার দাঁড়ানো বললে রাস্তা পার হতে থাকে দুজন। প্রায় কাছে চলে এসেছে এমন সময় এক রিকসার হুডে শাড়ির সুতা প্যাঁচিয়ে আঁচলের বেশ খানিকটা ছিঁড়ে যায়। যা দেখামাত্রই ক্ষেপে ওঠে ইশতি।

“রাস্তাঘাটে ডানে-বামে তাকিয়ে তো চলবে না! সবকিছুতে গা-ছাড়া ভাব…”
ঝাঁড়ি দিয়ে কথা বলতে থাকে। মাথা নিচু করে শান্ত হয়ে যায় সুবহা। চুপচাপ উবারে উঠে।

ঝাঁড়ির পর কেউ কাছে টেনে নিলে বিষয়টা আরো মিষ্টি হয়ে ওঠে। কিন্তু ইশতির মধ্যে সেসব নেই। উবারে উঠেই সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সে। সুবহা কতক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা সময় ইশতির দিকে তাকাল। নাক ডাকার মতো গভীর ঘুমের পর্যায়ে চলে গেছে সে। সুবহা মুখ ঘুরিয়ে আবার গাড়ির কাঁচের দিকে তাকায়।

তিন
একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক সুবহা। সারাদিন বাসায় ভালো লাগে না বলে চাকরিটা নিয়েছিল সে। স্কুলটা বেশ নামকরা। বেতনও ভালোই দেয়। ইশতি অনেকবার নিষেধ করেছে চাকরি-বাকরির মতো বাড়তি ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য। মেয়েদের জন্য ঘরে বাইরে সামলানো বেশ কঠিন এটা সবসময়ই বলে ইশতি। কিন্তু সুবহা যখন নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে বলে, কিছু না করলে এত কষ্টের লেখাপড়ার কোনো মূল্য থাকে না। এরপর আর এ সম্পর্কে হ্যাঁ অথবা না কিছু বলে না ইশতি।

গতরাতের মন খারাপ ভাবটা তেমন একটা নেই এখন। গা ছাড়া মানুষটা রাতে বেশ শক্ত বাঁধনে জড়িয়েছিল তাকে। রাতের অন্তরঙ্গতার পর ইশতির উপর থেকে রাগও পড়ে গেছে অনেকটাই।

বাসা থেকে বেরিয়ে সুবহা স্কুলের উদ্দেশে রিকসা নিল। স্কুলে যেতে রিকসায় পনেরো মিনিটের মতো সময় লাগে। অর্ধেক পথ আসতেই কে যেন ভাবী বলে একটা চিল্লানী দিয়ে ডাকল পেছন থেকে। সুবহা রিকসাকে থামতে বলে পেছনে তাকাল। ইশতির বন্ধু চয়নকে দেখা গেল। চয়ন ছুটে আসছে।
“ভাবী কেমন আছেন? অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে রিকসা পাচ্ছি না। আপনি কতদূর যাবেন?”

এইতো আর মিনিট দশেক লাগবে। আপনি এদিকে যে? আমি পপুলারের পাশেই নামব।

“আমি এদিকেই ভাড়া থাকি। কলাবাগান আমার অফিস। প্লিজ লিফট দেন আমাকে।”

এভাবে কাউকে লিফট দেওয়াটা পছন্দ নয় সুবহার। কিন্তু ইশতির বন্ধু এবং বেশ ভালো বন্ধু বলেই মনে হয়েছে দুজনকে। আমার কথায় যদি মাইন্ড করে! এই-সেই ভেবে সুবহা অনুমতি দিয়েই দেয়।
ঝট করে রিকসায় উঠে এই সেই বলে একইভাবে মুখ চালিয়ে যায় চয়ন।

“ভাবী আপনি এতো সুন্দর কেন বলুন তো? আপনার মতো দেখতে একটা মেয়ে খুঁজে দেন না। বিয়ের ঝামেলা টা মিটিয়ে ফেলি। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু মেয়ে তো পছন্দ হয় না আমার…”

“খুঁজতে থাকুন, যে ভাগ্যে আছে তাকে খুঁজে পেয়ে গেলেই হবে।”

“আপনার বোনটোন নেই? থাকলে এই সপ্তাহেই শুভ কাজ সেরে ফেলব, প্রমিস…”

“আপন বোন নেই আমার। ছোটো দুই ভাই আছে শুধু। চাচাতো আর খালাতোদের মধ্যে যে কজন বোন আছে হয় তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে অথবা অনেক ছোটো। বিয়ে দেবার মতো কেউ নেই।”

“ধ্যাত, এইটা কোনো কথা! এই জীবনে মনে হচ্ছে আমার আর বিয়েই হবে না।”

কথাটা শুনে সুবহা হাসি আটকে রাখতে পারল না। কিছুটা শব্দ করে হেসে ফেলল। চয়ন কয়েক সেকেন্ড নীরব হয়ে রইল। তারপর বলল, “এই প্রথম আপনাকে এভাবে হাসতে দেখলাম ভাবী। আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি সবসময় কেমন এক বিষন্নতায় ডুবে থাকেন। আচ্ছা আপনার ফোন নম্বরটা দেন তো। মাঝে মাঝে ফোন করব। বলতে গেলে সম্পর্কটা কিন্তু দেবর-ভাবীর। গল্প করার অধিকার আছে ষোলোআনা। আমি হাসতে পছন্দ করি তার চেয়েও পছন্দ করি হাসাতে। আপনার ভালো লাগবে।”

সুবহা তার পারসোনাল নাম্বারটি চয়নকে দিয়ে পপুলারের সামনে নেমে পড়ল।

চার
ইদানীং সুবহার সময়টা আগের মতো বোরিংফুল হয়ে ঝিমিয়ে থাকে না। চয়নের সাথে ফেসবুকে এড হবার পর থেকে কিছুক্ষণ পর পর এই-সেই ম্যাসেজ বেশ আনন্দ দেয় সুবহাকে। ইশতির প্রতিও প্রত্যাশার পরিমাণ আগের মতো মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে নেই।

আজ অনেকটা সারপ্রাইজড হয়েছে সুবহা। ঠিক সন্ধ্যাবেলা চয়নকে নিয়ে ইশতি হাজির। সুবহা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল-
“কী ব্যাপার দুই বন্ধু একেবারে একসাথে! তো আপনারা আসছেন এটা আমাকে একবারও জানাবেন না? অন্তত কিছু রান্না করে তো রাখতে পারতাম…”

কথাটা শেষ না হতেই চয়ন বলে ওঠে , কোনো সমস্যা নেই। রান্নাবান্না শুরু করে দিন ভাবী। আপনার হাতের খাবার না খেয়ে আমি যাবো না। খাবো-দাবো, আড্ডা দেব… ওকে?

একটু সরে গিয়ে ইশতি বলল, “ফেরার পথে চয়নের সাথে দেখা। বলল বাসায় আসবে। তাই নিয়ে এলাম। তুমি খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করো। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।”

ইশতি, চয়নকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলে ফ্রেশ হতে চলে গেল…

চয়নের জন্য শরবত করছিল সুবহা। চয়ন বসে না থেকে সরাসরি রান্নার রুমে ঢুকে গেল। বলল, কী কী কাটতে হবে আমাকে বলে দিন ভাবী। চাকু আর চপিং বোর্ড পেলে আমি কিন্তু রকেটের গতিতে সবজি কাটতে পারি।

সুবহার নিষেধ সত্ত্বেও রান্নায় অনেক সাহায্য করল চয়ন। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তিনজন মিলে মুভি দেখতে বসল। ইশতির কাজের তাড়া ছিল। সে সাড়ে এগারোটার দিকে চয়নকে স্যরি বলে রুমে এসে ল্যাপটপ নিয়ে পড়ল। চয়ন ঠাঁয় বসে মুভি দেখতে লাগল। ঠিক রাত বারোটা এক বাজল যখন, তখন একটা গোলাপ পকেট থেকে বের করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল সুবহাকে। সুবহা অবাক! কিভাবে জানল সে জন্মদিনের কথা! চয়ন জানাল ফেসবুক ঘেঁটে জেনেছে। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে চয়ন যখন নিজের বাসায় পৌঁছাল তখন রাত সাড়ে বারোটা।

এরপর থেকে সময় পেলেই চয়ন এসে ঢুঁ মেরে যায় ইশতি আর সুবহার বাসায়। এসে চা পান করতে করতে সুবহার সাথে দুষ্টুমিতে মাতে। তারপর চলে যায়। প্রথম দিনের পর ইশতির সাথে বাসায়ও দেখা হয় না চয়নের।

পাঁচ
রাতে ইশতির সাথে বেশ ঝামেলা চলল সুবহার…

চলবে…

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রণয়ের_রংধনু ❤️
#পর্ব-৫০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
সদরদরজায় নব-দম্পতি দেখে থমকে দাঁড়ায় ফারিশ! বধুবেশে ইয়ানার পাশে অভিকে দেখে কারো বুঝতে বাকি নেই বর্তমান পরিস্হিতি! ফারিশের সাথে হতভম্ব রুমা খান সকলে কিন্তু ইরাশের মুখস্রীতে নেই কোন আশ্চর্যের চিহ্ন! হয়তো সে পূর্ব থেকেই অবগত। ফারিশের বাবা রাশেদ খান মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে বললেন, ‘ এইসব কি মা? তুমি এই সাঁজে?’
‘ আমাদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, যখন অভি কানাডাতে ছিলো, সেই সম্পর্কের কারণে অভির বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারেনি, তাই অভিকে আমি বিয়ে করেছি। ‘
যথেষ্ট সাবলীলভাবে উত্তর গুছিয়ে বলে দিলো ইয়ানা,যেন সে প্রস্তুত ছিলো। ফারিশ ক্ষেপে গিয়ে, অভির কলার চেপে ধরে বলে, ‘ ইউ লাইয়ার! নিজে মিস অনন্যাকে ঠকিয়ে, এতোদিন ধরে মিস অনন্যাকে চরিত্রের সার্টিফিকেট দিচ্ছিলেন? ওয়াও, মি: অভি শিকদার! জাস্ট এক্সিলেন্ট!’

অভি মাথা নিচু করে উত্তর দিলো, ‘ আমি ইচ্ছে করেনি, অনন্যাকে ঠকাতে চাইনি। আমি নিজে জানি, আমি অনন্যাকে কতটা ভালোবাসি!’

ফারিশ অভির কলার চেপে হুংকার ছেড়ে বললো, ‘ স্টপ! আপনার মতো মানুষের মুখে অন্তত ভালোবাসা শব্দটা মানায় না। ‘
‘ কিন্তু তুমি এই বিয়ে কেন করলে ইয়ানা? আজ তো, অনন্যার এই জায়গায় থাকার কথা ছিলো। অনন্যার মন তো আবারোও তবে ভাঙ্গবে । ‘

রুমা খানের প্রশ্নের উত্তরে, ইয়ানা অভির দিকে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বললো, ‘ অনন্যা আপু, সবকিছুই জানতো আগে থেকে। কাল রাতেই, আপুকে আমি সব জানিয়ে দিয়েছিলাম। ‘

‘ তাহলে মিস অনন্যা কোথায় এখন ইয়ানা?’

ফারিশের প্রশ্নের জবাবে, মিষ্টি উপর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে, নীচে নেমে ফারিশের কাছে একটা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ বাপি, মায়ের চিঠি! তোমার জন্যে। ‘

ফারিশ হতবাক হয়ে, চিঠিটা হাতে নিয়ে খুলে বললো,

‘ মি.ফারিশ খান,
শুরুতেই আপনাকে প্রিয় বলে সম্মোধন করলাম না। অপ্রিয় থেকে প্রিয় এক মানুষ হয়ে উঠেছেন আপনি আমার জীবনে আজ। যার জন্যে একটা সময় আমার মনে জমে উঠেছিলো চরম ঘৃণা এবং তিক্ততা! আজ সেই ব্যাক্তিটি আমার জীবনের এক শ্রদ্ধেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ এক মানুষ! আমি অস্বীকার করছি না, আপনি কোন ভুল করেন নি। হ্যা, আপনি ভুল করেছেন, প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে, অন্যায়ের পথ বেছে নিয়েছিলেন কিন্তু একটা সত্যি কথা কী জানেন? এতোকিছুর মাঝেও আপনার চোখে আমার জন্যে আলাদা এক সম্মান আমি দেখতে পেয়েছি, যা আমি কখনোই অভির চোখে দেখতে পায়নি। অভিকে ভালোবেসে, ঘর বাঁধার স্বপ্ন পুষেছিলাম, তবে তা এই জীবনে বাস্তবায়ন করা হলো না। কথায় আছে না?৷ Destiny and Events had thier own plans! অভি এতোবার অন্যায় করার পরেও, আমি অভিকে শেষ অবদি বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম কিন্তু আমার কোথাও যেনো গিয়ে, খুব কষ্ট হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো আমার ভাগ্য অন্য কোথাও! হয়তো আমার ভাগ্য অজান্তেই জুড়ে গিয়েছে, আপনার সাথে।তাই আজ আমার জায়গায় ইয়ানার সাথে অভির বিয়েটা হয়েছে। আশা করি, আপনারা সকলে তাদের বিয়েটা মেনে নিবেন। অভি ছেলে হিসাবে খারাপ নয়। তবে অভির অবিশ্বাসের তীব্র যন্ত্রনা আমায় ঠায় দিয়েছে, আপনার ভালোবাসার প্রাঙ্গনে। আমি আপনাকে ভালোবাসি তা এখুনি বলবো না, তবে আমি সময় নিচ্ছি। আমার স্কলারশিপ হয়ে গিয়েছিলো অনেক আগে আমেরিকাতে। দুই বছর আমি সেখানে পড়াশোনা করে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, আপনার সামনে যথাসম্ভব উপস্হিত হবো। আশা করি, আপনি আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন। মিষ্টি মাকে আমি সবকিছু বুঝিয়ে গিয়েছে, সে আমার অনেক বুঝদার মেয়ে, সে বুঝেছে, সে তার দুই বাবার সাথে থেকে, খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করবে আমি জানি। মি: খারুশ থুরি ফারিশ খান আমার মেয়ের খেয়াল রাখবেন তাছাড়া ইরাশ ভাইয়া তো আছেই। নিজের দিকেও খেয়াল রাখবেন, সুস্হ থাকবেন। আজ তবে থাক, না জানিয়ে যাওয়ার জন্যে দু:খিত। ‘

ইতি,
আপনার মিস অনন্যা।

________________
লাগেজ হাতে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা চেকিং এর জন্যে। সে তার লাগেজ নিয়ে এগোতে নিলেই, চার-পাঁচটা কালো গাড়ি তাকে ঘিড়ে ধরে। সে থেমে যায়। গাড়ি থেকে ফারিশের দেহরক্ষীগণ বেডিয়ে আসে এবং অত:পর ফারিশ কালো ব্লাক ব্লেজারে, বেডিয়ে আসে। তার ফর্সা মুখস্রী কেমন যেনো লালচে দেখাচ্ছে। ফারিশ এবং সকলকে দেখে ঘাবড়ে যায় অনন্যা! অনন্যাকে অবাক করে দিয়ে, ফারিশ সকলের সামনে, অনন্যার গালে হাত রেখে ,শান্ত গলায় বলে, ‘ ভয় পাবেন না, মিস অনন্যা। আমি আপনার স্বপ্নের পথে কোনপ্রকার বাঁধা হতে আসেনি। আমি শুধু শেষবারের মতো, আপনায় একপলক দেখতে এসেছি। আপনার এক পলক দেখার সুখ পৃথিবীর সমস্ত সুখকে বিলিন করে দেয় মিস অনন্যা। ‘

অনন্যার আখিজোড়া বেয়ে জল গড়াতে থাকে। ফারিশ অনন্যার জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘ কাঁদবেন না আপনি, বলেছিলাম না আমি? আপনাকে কাঁদলে বাজে দেখায়, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ!’

দুজনেই হেসে উঠে। তখনি পিছন থেকে মিষ্টি বলে উঠে, ‘ আমিও আছি কিন্তু মা, মিষ্টির মাকে গুড বায় বলতে মিষ্টিও চলে এসেছে। ‘

অনন্যা মুচকি হেসে, মিষ্টিকে কোলে নিয়ে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ফারিশ দুজনকেই বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আলতো সুরে বললো, ‘ ইউ উইল মিসড মিস অনন্যা, আমি আপনার জন্যে জীবনের শেষ অবদি অপেক্ষা করে যাবো।’

_____________________

৭বছর বয়সী মিষ্টি সারা বাড়ি ঘুড়ে বেড়াচ্ছে অজানা এক আনন্দে। ইরাশ এবং এনা মিষ্টির খুশি দেখে, মিষ্টির কাছে যায়। মিষ্টি এখন কিছুটা লম্বা হয়েছে দুই বছরে, তাই ইরাশের ঝুঁকে কথা বলতে হয়না। ইরাশ প্রশ্ন করে, ‘ আমার মা যে, আজ বড্ড খুশি! তা কী ব্যাপার?’

মিষ্টি কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘ বাবা, তুমি কি জানো না? একটু পর ১২ টা বাজবে! ‘

ইরাশ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, ‘ তো?’

এনা কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘হাইরে আমার গাঁধা ভাইরে! তুমি কী জানো না?’

‘ কি?’

‘ আজ তো বাপির জন্মদিন! ‘

ইরাশ ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে, জিহবায় কামড় দিয়ে বলে, ‘ ইস রে! একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। ‘

এনা, ইরাশের কাধে আলতো চাপড় মে/রে বলে,’হয়েছে আর নাটক্ করতে হবে না। সারপ্রাইজ এর কি খবর?’

ইরাশ নিজের কলারের শার্ট উঁচিয়ে বলে, ‘ কোন চিন্তা নেই। ইরাশ থাকতে কোন কিছু নিয়েই টেনশন করবি না। তোরা জাস্ট ভাইয়াকে রেডি করে নীচে নিয়ে আয়। বাকিটা আমি দেখছি। ‘

এনা এবং মিষ্টি ইরাশের কথা শুনে ফারিশের ঘরে ঢুকে যায়। ইরাশ নিচে নামতেই, আরশ এগিয়ে এসে বলে, ‘ ভাই, তোমার কথামতো সব ব্যাব্সহা ডান!’

‘ আচ্ছা দাদি, কাকা, কাকি এবং বাবা কোথায়?’

আরশ মুচকি হেসে বলে, ‘ চিন্তা করো না। সবাই আছে। তুমি শুধু সারপ্রাইজ টা নিয়ে আসো, জলদি। বারোটা বাজতে কিন্তু বেশি দেরী নেই। ‘

‘ আচ্ছা যাচ্ছি কিন্তু অভি এবং ইয়ানা আসবে না?’

‘ তুমি তো জানোই ইয়ানার ছেলে আলভির সেই কাল থেকে জ্বর! কেবল দুই মাসের শিশু! তাছাড়া অভিও অনেকটা গিলটি ফিল করছে। আই থিংক এখুনি অনন্যার সামনাসামনি হলে, বিষয়টা অন্য দিকে গড়বে। তাছাড়া, সময় দাও, দেখবে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘

ইরাশ ও হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। তার সাথে সে আরশের কথাবার্তাতে অবাকও হয় বটে। সত্যিই দুই বছরে নিজেকে শুধরে নিয়েছে সে। জুঁইও থাইল্যান্ডে স্যাটেল হয়ে নিজেদের পারিবারিক ব্যাবসা দেখছে। তার মা ইশিকা বেগম জেলে রয়েছেন এখনো। সন্তান হিসাবে প্রায় তার সাথে দেখা করে, খবর নিয়ে আসে ইরাশ! ইরাশ ভেবে রেখেছে তার মা শুধরে গেলে, তার শাস্তি শেষ হলে, সে তার মাকে ঢাকার কোন ফ্ল্যাটে রেখে আসবে, কারণ সে জানে তার বাবা কিছুতেই তার মায়ের সাথে পুনরায় সংসার করবে না এবং তার বাবার সাথে সে নিজেও সহমত! ইরাশের ভাবনার মাঝে আর‍শ তাকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘ কি হলে ভাইয়া? এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

‘ ওহ, যাচ্ছি। ‘ বলে ইরাশ বেড়িয়ে যায়। ইরাশ বেড়িয়ে যেতেই, নিজের রুম থেকে বেড়োতে বেড়োতে ফারিশ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ মিষ্টি মা, তোমরা আমাকে এমন বিয়ের শেরওয়ানী পরিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’

‘ আমাদের ইচ্ছে হয়েছে তুমি এই পোষাকে বার্থডে সেলিব্রেট করবে, তাই।’

মিষ্টির জবাবে, এনাও সায় দিয়ে বলে, ‘ একদম! আর মেয়ে আবদার করেছে, সেখানে এতো কিসের প্রশ্ন তোমার?’

‘ তুইও কি বাচ্চা হয়ে গেলি নাকি এনা? দুইদিন পর শফিকের সাথে তোর বিয়ে, ভুলে গেলি? আমি জরুরী মিটিং ছেড়ে এসেছি। কাজের সময়, এইসময় বার্থডে সেলিব্রেশন আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ!’

এনা এবং মিষ্টি, ফারিশের কোন কথা না শুনিয়ে নীচে নামিয়ে আনলো। তারা নীচে নামতেই, সমস্ত আলো নিভে গেলো। কিছুক্ষন পর আলো জ্বলতেই, ফারিশ স্তব্ধ হয়ে যায়! কারণ তার সামনে স্বয়ং বধুবেশে অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে। আগের থেকে যেনো দ্বিগুন সুন্দর হয়েছে সে, লাল টুকটুকে শাড়িতে সেই সৌন্দর্য আরো বেশি ফুটে উঠেছে। ফারিশও লাল শেরওয়ানী পরেছে। চুলগুলো এলোমেলো তবে এখনো আখিতে সেই কাঠের ফ্রেমের মোটা চশমা! অনন্যা এগিয়ে এসে, ফারিশের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ শুভ জন্মদিন মি: ফারিশ খান। আপনার অপেক্ষার অবসান ঘটবে আজ, ফারিশ সাহেব! আমাদের প্রণয়ের রংধনুতে রঙ্গিন হয়ে উঠবে আজ গোটা আকাশ!’

পিছন থেকে এনা, আরশ, ইরাশ একসাথে বললো, ‘কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?’

ফারিশ অনন্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘বেষ্ট, বেষ্ট! ‘

অনন্যা ছলছল নয়নে জবাব দিলো, ‘ ভালোবাসি আপনাকে! অনেক ভালোবাসি। এই দুই বছরে, প্রতিটা মুহুর্তে উপলব্ধি করেছি, কতটা ভালোবাসি আপনাকে। ‘

ফারিশ অনন্যার কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘ আমিও যে তোমায় বড্ড ভালোবাসি। ‘
রুমা খান শিষ মে/রে বললেন, ‘ জিও! নাতী!’ খালেদ খান, রেশমি খান এবং রাশেদ খানও হেসে উঠলো। কাজি সাহেবও উপস্হিত হয়ে বললেন, ‘ তবে বিয়ের কাজ শুরু করে দেই?’

____________

ফারিশের রুমে বধুবেশে বসে আছে অনন্যা। আশে-পাশে কাঠগোলাপের সুবাস তার নাকে ভেসে আসছে। অদ্ভুদ ভালো লাগছে সবকিছু, সেই সাথে একঝাঁক ভয় এবং লজ্জাও তাকে আকড়ে ধরে রেখেছে। আজ সে ফারিশ খানের বউ! অদ্ভুদ এক উত্তেজনা! তার সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে, ফারিশ ঘরে প্রবেশ করে। ফারিশ প্রবেশ করতেই, অনন্যা উঠে দাঁড়াতেই, ফারিশ অনন্যার থুতনিতে হাত রেখে বলে, ‘ কি অপূর্ব স্নিগ্ধতা আপনার রুপে মিস অনন্যা! সেই স্নিগ্ধতাকে আজ বড্ড কাজ থেকে অনুভব করতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি দিবেন সেই অনুমতি আজ?’

অনন্যা লজ্জামাখায় গলায় বলে, ‘আসলে…’

সম্পূর্ন কথা শেষ করার পূর্বে, ফারিশ তার অধরে আঙ্গুল রেখে নেশাক্ত গলায় বলে, ‘ হুস! আর কোন কথা নয়। আজ আপনার অনুমুতি না পেলেও, আমি নিজেকে দমিয়ে রাখবো না। অনেক অপেক্ষা করিয়েছেন আপনি! আজ সবকিছুর হিসাব নিবো। ‘

কথাটা বলেই অনন্যাকে পাজকোলে তুলে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ফারিশ। অনন্যা লজ্জায় মুখ সরিয়ে নিতেই, ফারিশ তার মুখস্রীখানা আলতো করে ছুঁইয়ে, ললাটে অধর ছুঁইয়ে, শক্ত করে আকড়ে ধরে অনন্যার হাতজোড়া। অনন্যা ছটফট করলেও, আজ কোন বাঁধা মানে না ফারিশ। তাদের ভালোবাসার প্রণয়ের সাক্ষী হয়ে থাকে নি:শব্দ রাতের প্রহর!

______________
ভোর হতেই, খেয়াল করে ফারিশ তার পাশে অনন্যা নেই। ফারিশ ভয় পেয়ে, শার্ট গাঁয়ে জড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পায়, অনন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলতো করে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁইয়ে দেখছে। জানুয়ারী মাসের বৃষ্টিতে কিছুটা অবাক হলেও, ফারিশ মুচকি হেসে পিছন থেকে অনন্যাকে জডিয়ে ধরে বলে, ‘ এই কড়া শীতে, কী করা হচ্ছে মিস? সরি মিসেস ফারিশ খান?’

অনন্যা হাত উচিয়ে ফারিশকে ইশারা করে দেখায়, ‘ দেখুন, বৃষ্টির কারণে আকাশে কি সুন্দর রংধনু দেখা দিয়েছে। ‘

‘ উহুম! কিন্তু এইটা মিসেস খান, আপনি কি জানেন? এইটা কোন সাধারণ রংধনু নয়। ‘

‘ তবে?কিসের রংধনু?’

ফারিশ মুচকি হেসে জবাব দিলো,
‘ আমাদের ভালোবাসার প্রণয়ের রংধনু।’

সমাপ্ত।।

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৪৮+৪৯

0

#প্রণয়ের_রংধনু 🖤
#পর্ব-৪৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
জুঁইয়ের সামনে থাকা যুবকটি বর্তমানে ভয়ংকরভাবে রেগে আছে, তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে যেকোন মুহুর্তে বড় কোন ক্ষতি করতে পারে জুঁইয়ের। তার হাব- ভাব দেখে ঠিক তেমনই আন্দাজ করছে জুঁই, অপরদিকে হুইলচেয়ারে থাকা আরশও যথেষ্ট ভয়ে শিউরে উঠেছে। নার্স তার অক্সিজেন মাস্ক টা ধরেই, বুঝতে পারছে আরশ ভয়ে কাঁপছে। জুঁইয়ের সামনে থাকা যুবকটি পাইচারি করে যাচ্ছে, জুঁই ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে, ‘ ফারিশ তুমি আমায় এখানে কেন নিয়ে আসলে? তাও এমনভাবে কিডন্যাপ করে, আর তুমি ভাইকে হসপিটাল থেকে এইভাবে এখানে নিয়ে এসেছো কেন? ও তো অসুস্হ..’
জুঁই সম্পূর্ন কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই, ফারিশ হুংকার ছেড়ে বলে, ‘ চুপ! একদম চুপ! অনেক বলে ফেলেছো তুমি! এইবার আমি বলবো, তুমি শুনবে।’
জুঁই থেমে যায়। ফারিশ জুঁইয়ের চেয়ারটি নিজের দিকে টেনে, গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে, ‘ সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করছি, সোজাসোজি জবাব দিবে। ‘

‘ কি প্রশ্ন? ‘

‘মিস অনন্যাকে কিডন্যাপ করে, আরশকে দিয়ে রেপ করার প্ল্যান তোমার ছিলো, ইয়েস ওর নো!’

ফারিশের প্রশ্নে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে জুঁইয়ের। সে ভয়ে ভয়ে এক পলক আরশের দিকে তাঁকায়, আরশের দিকে তাঁকাতেই, আরশ অসহায় হয়ে, মাথা নিচু করে ফেলে। ফারিশ, আরশের দিকে তাঁকিয়ে বাঁকা হেসে বলে, ‘ আরশের দিকে তাঁকিয়ে লাভ নেই জুঁই। তোমার গুনধর ভাই, নিজের মুখেই সব স্বীকার করে নিয়েছে। ‘

জুঁই যেনো বিশাল বড় এক ধাক্কা খায়! সে কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। সেদিনের ঘটনার পর, শফিকের সাহায্যে নানা তথ্য জোগার করেছিলো ফারিশ। ফারিশের কেন যেন মনে হচ্ছিলো এর পিছনে শুধু একা আরশ নেই বরং আরো অনেকেই আছে, তাই আজ রেশমি খান এবং খালেদ খান যখন হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে যায়, তখনি ফারিশ তার দেহরক্ষীদের নিয়ে হসপিটালের ভিতরে ঢুকে, পুরো দেহরক্ষীদের দিয়ে, হসপিটাল ঘেরাও করে ফেলে, যেন কেউ আরশের কেবিনে যেতে না পারে। অত:পর ফারিশ তার দুজন দেহরক্ষীকে নিয়ে, ভিতরে প্রবেশ করে দেখে, আরশ শুয়ে আছে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক! ফারিশকে দেখেই বেশ বড়ভাবে চমকে যায় আরশ। সে ঘেমে একাকার হয়ে যায়, সেদিনের কথা মনে পরতেই, তার হাত- পায়ের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। ফারিশ সোজা গিয়ে, আরশের কাছে ঝুঁকে,শীতল গলায় প্রশ্ন করে,

‘ মিস অনন্যাকে কিডন্যাপ করে, রেপ করার আইডিটা কি শুধুমাত্র তোর ছিলো? নাকি এর পিছনে অন্য কেউ আছে?’

ফারিশের গলা স্বরটা সেসময় বেশ ভয়ংকর মনে হচ্ছিলো। আরশকে ভাবার সুযোগটাও দিলো না ফারিশ, সে তৎক্ষনাৎ আরশের অক্সিজেন মাস্কটা টেনে খুলে দিলো। আরশ জোড়ে জোড়ে নি:শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে উঠে, ‘ ভাইয়া কী করছো? আমার নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ‘

ফারিশ অক্সিজেন মাস্কটা ঘুড়াতে ঘুড়াতে বলে, ‘ দেখ, তুই আমার নিজের ভাই, আমি কি চাই বল তুই কষ্ট পাস কিন্তু কি করবো বল? আমাকে তোরা এমনভাবে বাধ্য করে ফেলিস, তখন আমি নিরুপায় হয়ে যাই! ‘

ফারিশ হঠাৎ অশান্ত হয়ে, আরশের মুখের কাছে গিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘ মিস অনন্যা আমার কাছে সবথেকে বেশি ইম্পোর্টেন্ট! উনার ক্ষতি কেউ করবে কন্টিনিউসলি,তা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না। তুই এখুনি নামটা কি বলবি নাকি আমি?’

আরশের শ্বাস-কষ্ট হওয়া শুরু হচ্ছিলো, সে জুঁই নাম উচ্চারন করতেই, ফারিশ তার মুখ অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে, দাঁড়িয়ে থাকে।

______
কিছুক্ষনের পূর্বের কথা শুনে জুঁই প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে বসে থাকে, যেন কিছু বলার মুখে বর্তমানে তার নেই। ফারিশ পকেট থেকে পি*স্তল বের করে, জুঁইয়ের কপাল বরাবর ঠেকিয়ে, চিৎকার করে বলে,
‘ ইউ আর ফিনিশড! জাস্ট ফিনিশড! তোমাকে আমি অনেকবার সুযোগ দিয়েছি জুঁই কিন্তু সেই সুযোগের বার বার তুমি অসৎ ব্যাবহার করেছো, বার বার আমার মিস অনন্যার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছো।’

জুঁই উত্তেজিত হয়ে উত্তর দেয়,
‘ হ্যা, হ্যা আমি করেছি বার বার ক্ষতি অনন্যার। কিন্তু কেন করেছে আমি এইসব তোমার জন্যে!’

‘ আমার জন্যে?’

‘ হ্যা, হ্যা! তোমার জন্যে। আমি তোমাকে ভালোবাসি ফারিশ, আমি সব তোমাকে অনেক ভালোবাসি। নিজের চোখের সামনে, ভালোবাসার মানুষ অন্য কারো হয়ে গেলে, তার তীব্র যন্ত্রনা ঠিক কতটা বেদনাদায়ক, তা তো অন্তত তুমি বুঝতে পারছো এখন? অনন্যার কাল বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অভির সাথে। তাই তুমি অন্তত আমার মনের অবস্হাটা বুঝো ফারিশ। আমি খারাপ হতে পারি, অনেক খারাপ! হ্যা অনেক ছেলের সাথে আমি সম্পর্কেও জড়িয়েছি কিন্তু ভালো শুধু আমি তোমাকেই বেসেছি। সেই ছোটবেলা থেকে তোমার থেকে প্রত্যাক্ষ্যান পেতে পেতে, আমি একদম মন বিষিয়ে গিয়েছিলো। মাকে ছাড়া বড় হয়েছি আমি। মমতা জিনিসটা কি আমি তা উপলব্ধি করেনি কিন্তু এতোকিছুর মধ্যে আমি তো তোমাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছি, তোমার জন্যে নিজের কাছের বন্ধুকেও ফাঁসিয়েছিলাম এবং যখন বুঝতে পারলাম, সেই বন্ধুই আমার থেকে তোমাকে কেড়ে নিতে চাইছে, আমি সহ্য করতে পারেনি, ফারিশ। বিশ্বাস করো! আমার একদম ঘেন্না ধরে গিয়েছিলো অনন্যার প্রতি! আমি জানি এখানে অনন্যার দোষ নেই কিন্তু কি করবো বলো? আমি তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি। তুমি যতই অপমান করো, দিনশেষে আমি বেহায়ার মতো তোমার পানেই ঘুড়ে ফিরে চলে আসি। ‘

কথাগুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে জুঁই! ফারিশ পি*স্তল টা ফেলে দিয়ে, এক মুহুর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো ঘর জুড়ে পিনপিন নিরবতা! অবশেষে ফারিশ বললো, ‘ আমি তোমার মনের অবস্হা বুঝতে পারছি জুঁই, তাই আমি তোমাকে নিজ হাতে শাস্তি দিবো না। তুমি যা করেছ, তার সত্যিই ক্ষমা নেই, তাই আমি তোমাকে আইনের হাতে তুলে দিবো এবং আরশও সুস্হ হলে, তাকে আইনের আওতায় নেয়া হবে। ‘

ফারিশ কথাটা বলেই বেড়িয়ে যায়।

_________

অপরদিকে, হলুদের অনুষ্টানে অনন্যার আখিজোড়া একজন মানুষকেই বারংবার খুঁজছে কিন্তু সে কি আদোও আজ ধরা দিবে অনন্যার চোখে? অনন্যার কেমন যেনো অস্হির অস্হির লাগছে।ফারিশ হঠাৎ কোথায় গেলো?মানুষটার শরীরের অবস্হাও ভালো ছিলো না, এমন অসুস্হ শরীর নিয়ে কিসের মিটিং এ গেলো, সেইটাই ধারনা করতে পারছে না।এনা, ইয়ানার কানে ফিসফিস করে বলে, ‘ ইয়ানা আপু, লক্ষ্য করেছো? ভাইয়াকে না দেখে অনন্যা আপুর একপ্রকার অস্হিরতা কাজ করছে। ‘

ইয়ানা মাথা নাড়ায়। কিন্তু কোনপ্রকার উত্তর দেয়না। মিষ্টি ইরাশের কোলে উঠে বলে, ‘ কাকাই, বাপি কোথায়? ‘
ইরাশ স্মিত হেসে উত্তর দেয়, ‘ এইতো মামুনি! বাপি এখুনি চলে আসবে, তুমি মায়ের কাছে যাও। ‘

মিষ্টি ইরাশের কোল থেকে নেমে গিয়ে, অনন্যার কাছে গিয়ে, অনন্যার পাশে বসে। সে আজ হলুদ শাড়ি পরেছে, অনন্যা তাকে নিজ হাতে শাড়ি পরিয়ে, সাঁজিয়ে দিয়েছে। ইরাশ হাতের ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে, এনা এবং ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ ভাইয়া হঠাৎ কোথায় চলে গেলো রে? আমি কতবার ফোন করছি, ধরছে ও না। ‘

‘ তো কি করবে ভাই? এখানে বসে বসে নিজের ভালোবাসার মানুষ, অন্য কারো হয়ে যাবে তা দেখবে?’

কিছুটা চেচিয়ে প্রশ্ন করলো ইয়ানা। ইয়াশ হতাশ গলায় বললো, ‘ আস্তে ইয়ানা! এইখানে একটা অনুষ্টান চলছে। মানুষ শুনলে, সমস্যা হবে। ‘

অভি গিয়ে, অনন্যার পাশে বসে কিছুটা অভিমানের সুরে বললো, ‘ আজ আমাদের গাঁয়ে হলুদে, তুমি এই শাড়িটা কেন পরেছো অনন্যা? আমার পছন্দের শাড়ি টা পরলে না কেন? ‘

‘ আমার এই শাড়িটা ভালো লেগেছে, তাই পরেছি, তাতে কোন সমস্যা?’

‘ না, সমস্যা নেই কিন্তু আমার দেওয়া শড়িটা পরলে আমার ভালো লাগতো। ‘

‘ সবার ভালো লাগার দায় কী আমার?’

‘ তুমি এইভাবে রিয়েক্ট করছো কেন অনন্যা?’

‘ তোমার খারাপ লাগেছে অভি?তাহলে আমি সরি। ‘

অভি কোন কথা বাড়াল না কিন্তু সে টের পাচ্ছে,অনন্যা ভালো নেই, তার আখিজোড়া টলমলে! মায়াবী মুখস্রীখানা ভিষন বিষন্ন! বেশ অস্হির দেখাচ্ছে তাকে। অভির বড্ড মায়া হচ্ছে অনন্যার প্রতি! কিন্তু অনন্যা কেন ভালো নেই? অভির ভাবনার মাঝেই, একজন ছেলে এসে, ‘ আপনাকে একজন আপু ডাকছে। ‘

‘ আমাকে?’

‘ হ্যা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। ‘

‘ কোথায় সে?’

‘ স্টোর রুমে, আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। ‘

কথাটি বলেই বাচ্চা ছেলেটি চলে যায়। অভি ভাবলো যাবে না কিন্তু মেয়েটা আসলে কে তা জানতে সে চলে যায়।

_________
অনুষ্টানের ফাঁকে ফাঁকে অনন্যা ফারিশকে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু ফারিশের নাম্বার বন্ধ! ঘাবড়ে যায় অনন্যা। মানুষটার হঠাৎ কি হলো? অনন্যার চিন্তার মাঝেই, তার ফোনে টুং করে মেসেজ আসে,

‘ মিস অনন্যা, আপনি বিষন্ন মুখে থাকবেন না, আপনার সুন্দর মুখস্রীতে একরাশ বিষন্নতা বেশ বাজে লাগছে, আপনি প্রানখুলে হাসুন না? আপনার অধরের কোণের মিষ্টি হাসি যে আমার বড্ড প্রিয়।’

চলবে।।

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ৪৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ ম্যাসেজ পেয়ে, অনন্যা আশে-পাশে তাঁকাচ্ছে বারংবার সে খুঁজে চলেছে ফারিশকে কিন্তু ফারিশ কোথায়? সে জানে ম্যাসেজ টা কার কিন্তু ফারিশ কেনো তার সামনে আসছে না? এনাও বুঝতে পারছে না অনন্যাকে এমন অস্হির দেখাচ্ছে কেন? তাই সে অনন্যার পাশে বসতেই, এনা অনন্যার হাত ধরে বলে,’ কি হয়েছে আপু? তোমাকে এতো চিন্তিত লাগছে কেন? ‘
‘ আমি বুঝতে পারছি না এনা। আসলে কেমন যেন অদ্ভুদ ফিল হচ্ছে। ‘
অনন্যা অত:পর মিষ্টিকে নিজের কোলে বসিয়ে নিজের ফোনটা দিয়ে, নিচু গলায় বলতে থাকে,
‘ মিষ্টি মা, তুমি তোমার বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করো তো, সে কোথায়? এখনো আসছে না কেন?’
এনা আলতো করে হেসে বললো, ‘ কেন আপু? ভাইয়ার জন্যে বুঝি তোমার চিন্তা হচ্ছে?’
অনন্যা মাথা নুইয়ে বলে, ‘ আসলে তা না….’
এনা অনন্যার কথা শুনে, অনন্যার কাধে হাত রেখে বললো, ‘তুমি কী সত্যিই বুঝতে পারছো না? ভাইয়া তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে? ‘

অনন্যা হঠাৎ করে থমকে যায়! হয়তো সে বুঝে ফারিশের মনের অবস্হা কিন্তু তবুও সে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে। অনন্যা এনার কথার কোনরকম প্রতিক্রিয়া না দিয়ে, পুনরায় আবারোও ফারিশের নাম্বারে ফোন করে কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে। এনা অনন্যার অনস্হার দেখে বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে, ‘ আরে ভাইয়া, কখন আসবে তুমি? এদিকে আপুর অবস্হা তো, বেহাল!’

_________________
অভি স্টোর রুমে যেতেই,পিছন থেকে কেউ একজন স্টোর রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। রুমটা বাড়ির একদম শেষের দিকে। তেমন একটা যাতায়াত নেই। ঘরের পুরনো আসবাবপত্র দিয়ে গুছানো রয়েছে। পুরনো ঘড়ির পাশে লাগানো রয়েছে একটি সামান্য ডিম লাইট! সেই আলোয় স্পষ্ট ইয়ানার মুখস্রীখানা খানিকটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে অভি। অভি ইয়ানাকে দেখে বিরক্তির সুরে বলে, ‘ সমস্যা কি আপনার? আজকে আমার গাঁয়ে হলুদ, সেই অনুষ্টান থেকে আমাকে একা নির্জন এই রুমে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন?’

‘ মি: অভি শিকদার এখানে আপাতত কেউ নেই। দয়া করে, ফরমালিটি করবে না। আমাকে তুমি করে বলতে পারেন। যতই হোক, আমাদের একটা পুরনো সম্পর্ক তো রয়েছে। ‘

‘ অবশ্যই নেই, হয়তো ছিলো কিন্তু সেই সম্পর্কের এখন আর কোন অস্তীত্ব নেই। ‘

‘ অস্তীত্ব নেই মানে? আমাদের মধ্যে কি কোন সম্পর্কেই আদোও ছিলো না অভি? তুমি কি সেই সম্পর্ককে অস্বীকার করবে?’

ইয়ানা কিছু বলতে চাইলে, তাকে থামিয়ে, আঙ্গুল উঁচিয়ে, অভি গম্ভীর সুরে বলে, ‘ আচ্ছা তুমি কি আমাকে এই মুহুর্তে, পুরনো সেই সম্পর্কের হিসাব নিকেষ করতে এখানে ডেকে পাঠিয়েছো? সমস্যা কি তোমার? তাছাডা আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিলো, সেই ২বছর আগেই, আমাদের মধ্যে যেই সম্পর্ক ছিলো কিংবা আমাদের মধ্যে যা যা হয়েছে, আমরা সব ভুলে যাবো। যদিও ভবিষ্যৎেও আমাদের দেখা হয়, তাহলে আমরা এমন ভাবে কথা বলবো যেন, কেউ মনে না করে, আমরা পূর্বপরিচিত! তুমিও তো এতোদিন সেই কথা অনুযায়ী নরমাল ভাবেই ছিলে, তবে আজ কি হলো?’

ইয়ানা দাঁতে দাঁত চেপে৷ নিচু গলায় বলে, ‘ আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি ভুলে যাওয়ার, জীবনে ভাবতে পারেনি জীবন আমাকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করাবে, যেখানে তোমার সাথে আবারোও আমার দেখা হয়ে যাবে অভি। তুমি কী করে ভুলতে পারো? আমরা ইন্টিমেটও হয়েছিলাম। ‘

অভি চুল খামচে, ইয়ানার বাহু চেপে বলে, ‘ হ্যা আমরা ভুল ক্রমে ফিজিকালি রিলেশনে জড়িয়েছিলাম কিন্তু সেদিনের পরেই আমরা আমাদের বন্ধুত্বকে শেষ করেছি এবং তোমাকে এইটাও বলেছিলাম বাংলাদেশে আমার প্রেমিকা আছে, যাকে আমি ভালোবাসি এবং বিয়ে করতে চাই। সে শুধুমাত্র অনন্যা। আমি ভুল করেছি তবে আমি ইচ্ছেকৃত সেদিন রাতে কিছুই করেনি ইয়ানা সেইটা তুমিও জানো। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড কালকে আমার বিয়ে। ‘

অভির কথা শুনে, হঠাৎ রেগে গিয়ে, ইয়ানা অভির কলার চেপে ধরে বলে, ‘ কালকে বিয়ে মানে? কিসের বিয়ে? ‘

‘ কিসের বিয়ে মানে? আমার এবং অনন্যার বিয়ে। ‘

‘ তুমি কী ভেবেছো? তুমি আমার চোখের সামনে বিয়ে করে ফেলবে অন্য কাউকে এবং তা চুপচাপ মেনে নিবো? একদমই নয়। ‘

অভি উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে, ‘ কিন্তু এতোবছরে যখন তোমার জীবনে তা কোন ইফেক্ট পড়ে নি তাহলে আজ তোমার কি হলো ইয়ানা? ‘

‘ তার এক্সপ্লেনেশন আমি তোমায় দিতে পারবো না অভি, কাল তুমি আমায় বিয়ে করবে।’

অভি যেনো বড়সড় ধাক্কা খায়, সে প্রশ্ন করে, ‘ তোমায় বিয়ে করবো মানে?’

ইয়ানা অভির কলার চেপে বলে, ‘ অবশ্যই, আমাকে কালকে বিয়ে করতে হবে, নাহলে কালকে আমাদের রাতের সেই ভিডিও টা আমি সবার সামনে এক্সপোজ করে দিবো! ‘

‘ ওয়াট? তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো ইয়ানা?’

‘ হ্যা, হয়েছি আমি। আমার ভাইয়া যেই কাজটা করেছিলো, সেই সেইম কাজই আমি করবো, যদিও সেইটা ছিলো ফেইক কিন্তু আমি যা করবো তা হবে রিয়েল! অনেক তো অনন্যা আপুর ক্যারেক্টারের জাস্টিফাই দিয়ে বেড়াও, যখন তোমার আসল রুপ, সবার সামনে বের হবে, তখন কেমন হবে অভি? ‘

অভি মাথা নিচু করে ফেলে, হ্যা সে দুইবছর আগে নেশার ঘরে ইয়ানার সাথে মিলিত হয়েছিলো তবে তা ইচ্ছেকৃত নয়। সে এবং ইয়ানা একই সাথে লয়ের প্র্যাক্টিস করেছিলো কানাডাতে, ইয়ানা তার জুনিয়র ছিলো এবং তারা যথেষ্ট ভালো বন্ধু ছিলো। সে কখনোই অনন্যাকে ভুলে, ইয়ানার প্রতি দূর্বল হয়নি কিন্তু সেই এক রাতের ভুল তাকে আজ এমন মুহুর্তে বয়ে বেড়াতে হবে তা দুশস্পনেও ভাবতে পারে নি। ইয়ানা যাওয়ার পূর্বে বলে গেলো, ‘ আজকের রাতটুকুই সময় আছে, তোমার কাছে। ভাবো, ভাবো! ভালো করে ভাবো!’

_______
অপরদিকে, অনন্যা আবারোও ফোন করতে চাইলে, গাড়ির হর্নে সে থেমে যায়। সে ছাদের রেলিং এ দাঁড়িয়ে দেখে, ফারিশ তার কালো গাড়ি থেকে বের হচ্ছে, অত:পর ছাদের উদ্দেশ্য রওনা হচ্ছে। ফারিশকে আসতে দেখে, কিছুটা শান্তি পেয়ে, নিজের স্টেজে বসে পরে অনন্যা। ফারিশকে দেখেই, মিষ্টি ‘বাপি ‘ বলে ছুটে গিয়ে, ফারিশকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টিকে কোলে নিয়েই, ফারিশ অনন্যার কাছে আসে। ফারিশকে দেখেই, ইরাশ প্রশ্ন করে, ‘ কই ছিলে ভাই?’

‘ আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো আজ আর আসবেনই না। ‘

ফারিশ কোনপ্রকার জবাব না দিয়ে, হলুদের বাটি থেকে সামান্য হুলুদ অনন্যার গালে আলতো করে ছুইঁয়ে দিতেই, অনন্যা চোখ বুজে ফেললো। ফারিশ অনন্যার কানে গিয়ে আলতো সুরে বললো, ‘ মিস অনন্যা, আমার জীবনের সমস্ত বিষাদের রেশ , আপনার আকাশে প্রণয়ের রংধনু হয়ে আসুক, শুভকামনা রইলো আপনার নতুন জীবনের জন্যে। ‘

অনন্যার আখিজোড়াতে জল, ফারিশেরও আখিজোড়া ছলছল হয়ে রয়েছে। এনা, ইরাশের কাছে গিয়ে বললো, ‘ অনন্যা আপুর হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সি আলসো লাভ ভাইয়া কিন্তু কেন আপু সব কিছু সয়ে যাচ্ছে?’

ইরাশ কোনপ্রকার উত্তর দেয় না। শুধু আলতো হাসে।

______________

অন্যদিকে, সকাল থেকে অনন্যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ি থেকে বউ পালিয়ে গেছে এমন একটা খবর রটানো হয়েছে। ফারিশও বুঝতে পারছে না অনন্যা হঠাৎ কোথায় গেলো? অনন্যার মায়ের অবস্হাও খারাপ, কোথায় তার মেয়ে? ফারিশের কাছে খবর পাওয়া মাত্রই সে ছুটে নিজের বাড়ি থেকে বের হতে নিলেই, দেখতে পায় সদর দরজায় বধু বেশে দাঁড়ানো…..

চলবে কী?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৪৬+৪৭

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অভি দ্রুত অনন্যার হাত শক্ত করে ধরে,মাথা নুইয়ের অনুনয়ের সুরে বলতে থাকে, ‘ আমি জানি অনন্যা, আমি এইবারও না জেনে, না বুঝে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আসলে ব্যাপারটা বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের বিষয় নয়, আসল বিষয় হলো আমি তোমাকে নিয়ে বড্ড বেশি সিকিউয়র, তাই না চাইতেও আমি তোমাকে সংদেহ করে ফেলি, আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দাও।’
ফারিশ ক্ষুদ্ধ নয়নে, অভির দিকে তাকিয়ে আছে, সে অনন্যার হাত ধরায় তার অসহ্য রকমের এক বিশ্রি অনুভুতি হচ্ছে! ইচ্ছে করছে প*কেটে থাকা পি*স্তল খানা অভির মাথায় ঠু*কে দিতে। ‘একজন প্রেমিক হয়ে বারংবার নিজের প্রেমিকার চরিত্রে কলঙ্ক ছিটানো আদোও জেলাসির মধ্যে পরে মি: অভি? ‘ ফারিশের কথা শুনে, অভি থমকে গেলো।ফারিশের দিকে তাকিয়ে,অনন্যা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো, অভির থেকে। অনন্যা কিছুটা পিছু হটে গিয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে অভির দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে বললো, ‘ আমি আজ সত্যিই ব্যর্থ একজন প্রেমিকা হিসাবে, যে নিজের প্রেমিকের বিশ্বাস কিংবা সম্মানটুকু পাওয়ার যোগ্য নয়। ‘
অভি হাত বাড়িয়ে, ফের গুটিয়ে নিয়ে বললো, ‘ আমি তো ক্ষমা চাইছি তো। ‘
অনন্যা তাচ্ছিল্য করে পুনরায় হাসলো, যেন অভি খুব সুন্দর করে কৈতুক সাজিয়ে বলছে। অত:পর অনন্যা নিজের আখিজোড়ার জল মুছতে মুছতে বললো, ‘ কিন্তু অভি! সত্যিই এইটাই, আমি এতোকিছুর পরেও তোমায় বিয়ে করবো। ‘
অনন্যার কথা শুনে, ফারিশ স্তব্ধ হয়ে যায়! সে অসহায় হয়ে প্রশ্ন করে, ‘ মিস অনন্যা! আপনি এতোকিছুর পরেও এমন একজন লোককে বিয়ে করবেন? যে আপনাকে না করে সম্মান, না করে বিশ্বাস! এতো কিছু জেনেও আপনি বিয়েটা করবেন?’
‘ হ্যা, করবো। ‘
অনন্যার উত্তরে খুশিতে দিশাহারা হয়ে, অভি অনন্যার গালে হাত দিয়ে বলে, ‘ আই প্রমিসড ইউ মাই ডার্লিং! আর কখনো তোমাকে আমি হতাশ করবো না। আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে, তোমায় ভালো রাখার চেষ্টা করবো। ‘
অনন্যা অভির হাত সরিয়ে, কঠিন গলায় বললো, ‘ তুমি আজকের মধ্যেই গাঁয়ে হলুদের আয়োজন করো অভি। কালকের মধ্যেই আমি বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই। যদি দেরী করো, তাহলে আমাকে হারানোর জন্যে প্রস্তুত থাকো। ‘
অনন্যার কথা শুনে উপস্হিত সকলে অবাক হয়ে যায়,সবথেকে বেশি অবাক হয় ফারিশ, কি করছে অনন্যা? তবে কি কালকেই হারিয়ে ফেলবে সে তার মিস অনন্যাকে? ফারিশের মস্তিষ্ক কাজ করছে না। অভিও অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বলে, ‘ কিন্তু এক দিনের মধ্যে এতো আয়োজন কীভাবে সম্ভব? ‘

‘ তা আমি জানিনা, আমি মাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি, তুমি আমায় বাসায় পৌঁছে দিবে। আমার আবার সন্ধ্যায় গাঁয়ে হলুদের জন্যে রেডি হতে হবে, তাছাড়া মি: খান আমাদের বিয়ের দায়িত্বে আছেন, আমি জানি উনি কম সময়েই সব আয়োজন করতে পারবেন। তাইনা মি: ফারিশ খান?’

ফারিশ হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে নেই কোন জবাব। ইয়ানা এগিয়ে এসে বললো, ‘ আমার ভাইয়া কেন তোমার বিয়ের আয়োজন করতে যাবে? তুমি কি জানো না ভাইয়ার কষ্ট…’
ইয়ানার সম্পূর্ন কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই, ফারিশ বলে উঠে, ‘ হ্যা, আমি আমার কোন কষ্ট হবেনা, আমি সব ম্যানেজ করে নিবো। ‘

অনন্যা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে, উপরে চলে গেলো তৈরি হতে। এতোকিছুর মাঝেও জুঁইয়ের যেন খুশির অন্ত নেই, সে খুশি কারণ অবশেষে তার এবং ফারিশের মাঝে পথের কাটা চলে যাচ্ছে। এখন ভালোই, ভালোই বিয়েটা হয়ে গেলেই, তার কোন চিন্তা নেই। অভিও বাইরে চলে যায়, গাড়ি বের করার জন্যে। ফারিশ কী ভেবে যেন নিজেও অনন্যার পিছনে পিছনে রুমে চলে আসলো, সেখানে অনন্যা মিষ্টিকে কী যেন বলছিলো, ফারিশ চলে আসায় সে থেমে যায়। ফারিশ মিষ্টিকে দেখে বলে, ‘ মা, তুমি একটু বাইরে যাও। আমার তোমার মিষ্টি মায়ের সাথে কিছু কথা আছে। ‘
মিষ্টি বাধ্য মেয়ের মতো ঘরের বাইরে চলে যেতেই, ফারিশ অনন্যার কাছে গিয়ে কিছুটা শান্ত গলায় বললো, ‘ আপনি ওই লোকটাকে একদম বিয়ে করবেন না, মিস অনন্যা। উনি আপনাকে একটুও সম্মান করে না, আপনাকে সে বিশ্বাসই করে না। এমন একটা মানুষটাকে আপনি কী করে বিয়ে করার কথা ভাবছেন?’

অনন্যা ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বললো, ‘ যাই হোক, অন্তত সে তো আমাকে ভালোবাসে। ‘

ফারিশ দ্রুত বলে উঠে, ‘ উহু একদমই নয়। কালকে অবদিও আমার মনে হতো অভি হয়তো আপনাকে অনেক ভালোবাসে, আপনাকে অনেক সুখে রাখবে কিন্তু সে আপনাকে ভালোবাসে না, আপনি তার জেদে পরিনত হয়েছেন, যাকে সে যেকোন মূল্যে পেতে চায়। ভালোবাসলে কেউ এইভাবে বারংবার অপমান করতে পারতো না!’

‘ তবে কি আপনি আমায় ভালোবাসেন মি: ফারিশ খান?’

অনন্যার এমন প্রশ্নে থেমে গেলো ফারিশ। অনন্যা আশাভরা নয়নে ফারিশের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারিশ ‘ আসলে.. আমি! ‘ বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে, পুনরায় বলে উঠলো, ‘ কিন্তু আপনি কালকে বিয়ের আসরে বসলে, মিষ্টির মনের অবস্হা কেমন হবে? সে আপনাকে নিজের মায়ের আসনে বসিয়েছে, তার মনের উপর কিরুপ প্রভাব পরবে। ‘

অনন্যা মুচকি হেসে, মিষ্টিকে ডাক দিয়ে বলে, ‘ মা, তুমি কোথায়?’

মিষ্টি দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে, ফারিশের কাছে এসে বায়না করে বলে, ‘ বাবা, আমি আজকে নানু বাসায়, মায়ের সাথেই থাকবো। কালকে মায়ের বিয়ে। আমি সো এক্সাইটেড! আমি নিজে আমার মায়ের বিয়ে দেখবো, ব্যাপারটা কতটা ইন্টারেস্টিং!’

মিষ্টির কথা শুনে, ফারিশ যেনো আকাশ থেকে পরে। অনন্যা ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ মিষ্টিকে নিয়ে অন্তত চিন্তা করবেন না, আমি ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছি, তাছাড়া আমার মেয়েও যথেষ্ট বুঝদার। ‘

ফারিশ অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনন্যা, মিষ্টিকে কোলে নিয়ে চলে যায়। তারা চলে যেতেই, ফারিশ তার পাশে থাকা ফুলের বাস্কেট তা ছুড়ে ফেলে, টুকরো টুকরো করে ফেলে এবং সোফায় চুল খামচে বসে পরে।এনা, ইয়ানা এবং ইরাশ দ্রুত ফারিশের কাছে যায়। ইরাশ ফারিশের কাধে হাত রেখে বলে, ‘ ভাই! কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছো তো?’

‘ আর কত যন্তনা তুমি বয়ে বেড়াবে ভাইয়া? তুমি না বললেও, আমরা বুঝতে পারি তুমি অনন্যা আপুকে কতটা ভালোবাসো। ‘

ইয়ানার কথার প্রতিউত্তরে, ফারিশ ভাঙ্গা গলায় জবাব দিলো, ‘ অথচ একজন মানুষই বুঝে উঠতে পারলো না। ‘

‘ কীভাবে বুঝবে ভাইয়া? তুমি তো একবারও অনন্যাকে আপুকে তোমার মনের কথা বলো নি। কালকে আপুর বিয়ে! তুমি তাকে আজীবনের জন্যে হারাতে চাইছো। ‘

এনার কথায় সায় দিয়ে, ইরাশও ফারিশকে বুঝানোর জন্য বলে, ‘ দেখো ভাই, আমি যেই ভুলটা করেছি, তুমি তা করো না। আমি আমার ভালোবাসার মানুষ ইশিতাকে হারিয়েছি নিজের পরিবারের জন্যে, আজ সে আমার উপর অভিমান করে, এতোটাই দূরে সরে গিয়েছে, তাকে এখন চাইলেও আমি আমার জীবনে আর ফিরে পাবো না, তুমিও সেই ভুল করো না ভাই। ভালোবাসা একবার হারিয়ে গেলে, তাকে ফিরিয়ে আনার সাধ্য কখনোই পাবে না, তুমি। ‘

_______________

গাঁয়ে হলুদের সাঁজে অনন্যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা কাঠ গোলাপ ফুলের সাঁজে, সাদা শাড়িতে অপরুপ সুন্দর দেখাচ্ছে। হলুদের অনুষ্টানে তার সাদা শাডি পরা নিয়ে, সকলের কৌতহূল থাকলেও, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কারণ সকলে তার সৌন্দর্যের প্রশংসায় মুখোর। তার বন্ধুরা তাকে সাঁজিয়ে, বাইরে স্টেজে চলে গেলো। অনন্যা একটু পর যাবে। মিষ্টিও বাইরে সকলের সঙ্গে আনন্দ করছে। এতোকিছুর মাঝেই, হঠাৎ ফারিশ এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। ফারিশকে দেখে অনন্যা উঠে দাঁড়ায়। ফারিশের গাঁয়ে ফরমাল সাদা শার্ট কিন্তু উপরের দুই- তিনটে বোতাম খোলা থাকায়, তার লোমহীন বুক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাথা উষ্ককষ্ক! চোখে সেই গম্ভীর টাইপ মোটা ফ্রেমের চশমা, তাই ফারিশের আখিজোড়ায় থাকা বিচ্ছেদের গভীর এক কষ্ট স্পষ্ট টের পাচ্ছে অনন্যা। ফারিশ খুড়াতে খুড়াতে, অনন্যার গাল চেপে ধরে বলে, ‘ অপূর্ব! আপনাকে বড্ড সুন্দর লাগছে মিস অনন্যা। আমার পছন্দের সাদা শাড়িটাও পরেছেন দেখি। ‘

অনন্যা কিছুটা বিব্রত হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ আপনি ড্রিংক করেছেন মি: ফারিশ খান?’

ফারিশ হেসে উত্তর দেয়, ‘ করেছি একটু আকটু! সেসব কথা বাদ! আপনি কিন্তু কিছুতেই বিয়েটা করবেন না।’

‘ কেন করবো না, আমি বিয়ে? আপনি আমাকে নিষেধ করার কে?’

কিছুটা চেচিয়ে প্রশ্ন করলো অনন্যা। ফারিশ আবারোও অনন্যার গালে হাত দিয়ে চেপে বললো, ‘ হ্যা, কারণ আমার অধিকার আছে আপনার প্রতি। সেই অধিকার আপনি আমায় না দিলেও, আমি তা ফলাবো। আমি ফারিশ খান। আপোষ করতে আমি শিখি নি! ছোটবেলা থেকে কাছের মানুষদের হারাতে হারাতে এই পর্যন্ত এসেছি, জীবনের এমন পর্যায়ে এসে, আমি আপনাকে হারাতে পারবো না, মিস অনন্যা। ‘

কথাটি বলেই ছোট্ট শিশুর ন্যায় কেঁদে ফেলে ফারিশ। অনন্যার বুকটা কেঁপে উঠে, মানুষটা আজ কাঁদছে? কতটা অসহায় হলে, একজন পুরুষ কেঁদে ফেলে? অনন্যা হাটু গেড়ে, ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনি কাঁদছেন মি: খান? আমি কে? যার জন্যে আপনার আখিজোড়ায় আজ অশ্রু। ‘
ফারিশ মুচকি হেসে জবাব দিলো, ‘ আমার হৃদপিন্ডের প্রতিটি স্পন্দনের এক একটি সুপ্ত অনুভুতি আপনি। ‘

চলবে।।

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ অনন্যার বুকে মাথা রেখে গভীর এক নি:শ্বাস ফেললো। অনন্যা শিউরে উঠলো। অনন্যা কম্পিত গলায় বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো, ‘ কী করছেন কি মি: খান? আপনি সরে দাঁড়ান প্লিজ! কেউ এসে পরলে সমস্যা হবে?’
‘ আমি আসলে একটা হিসাব কষছি। ‘
অনন্যা কেঁপে কেঁপে বলে, ‘ কিসের হিসাব?’
‘ আমার হৃদপিন্ড আপনার নামে যতবার কম্পিত হয়, আপনার হৃদপিন্ডেও কি ঠিক ততবার কম্পিত হয় আমার নাম?’
অনন্যা থেমে যায়। ফারিশ হঠাৎ অনন্যার গালে আলতো করে চুমু খেয়েই, সরে যায়! অনন্যা এক মুহুর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে ফারিশের দিকে বড় বড় নয়নে তাকিয়ে থাকে কিন্তু ফারিশ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, যেন অনন্যার এমন বিষ্ময়কর মুখস্রী তার বড্ড ভালো লাগছে। অনন্যা তোতলিয়ে বলে উঠে,
‘ আপ…নি কী করলেন এইটা?’
‘ কেন আবার করে দেখাতে হবে?’
ফারিশের এমন কথা শুনে লজ্জা পেয়ে, অনন্যা মাথা নুইয়ে ফেলে। ফারিশ মুগ্ধ গলায়, গালে হাত রেখে বলে,
‘ আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন মিস অনন্যা? আপনি কি জানেন? লজ্জা পেলে, আপনায় বড্ড স্নিগ্ধ লাগে! এন্ড ইউ নো ওয়াট? আই জাস্ট লাইক দিজ। হা হা ‘
বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠে ফারিশ। অনন্যা ফারিশকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে, ‘ চুপ! আর একটা কথাও নয়। আপনি ড্রিংক করেছেন ভালো কথা! কিন্তু এতো ওভারলোড করেছেন কেন? মিষ্টি দেখলে কি ভাব্বে হ্যা?’
ফারিশ হাত ভাজ করে গম্ভীর মুখে শুধায়, ‘ আমার কষ্ট লাগছিলো তাই ড্রিংক করেছি। ‘
অনন্যা গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
‘ তা কিসের এতো কষ্ট আপনার মি: ফারিশ খান?’
‘ আপনি কি কিছুই বুঝেন না?’
‘কি বুঝবো?’
‘ আপনি অন্য কারো হয়ে গেলে যে আমার বড্ড কষ্ট লাগবে! আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছে না এই জীবনে মায়ের পরে, আমার মেয়ের পরে, আপনাকে সবথেকে বেশি আপন মনে হয়েছে মিস অনন্যা। আপনিও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যান, আমি বড্ড ভেঙ্গে পরবো। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! ‘
ফারিশ অনন্যার হাত ধরে, মাথা ঠেকিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলে। অনন্যা ফারিশকে সামলিয়ে বলে, ‘ আপনি থাকুন, আমি এখুনি আসছি। ‘

কথাটি বলেই অনন্যা বেড়িয়ে যেতেই, লক্ষ্য করে দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। অনন্যা ‘ কে ‘ বলতেই, অপরপাশ থেকে ইয়ানা বলে উঠে, ‘ অনন্যা আপু, আমি ইয়ানা। ভাইয়া কি তোমার ঘরে?’

অনন্যা দ্রুত দরজা খুলতেই, ইয়ানা হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ইয়ানা ফারিশকে দেখে বলে, ‘ ভাইয়ার কি হয়েছে? ভাইয়া এমন করছে কেন?’
‘ তোমার ভাই ড্রিংক করে এসেছে। ‘

‘ সে কি কেন?’
‘ কারণ সে বর্তমান যুগের দেবদাস! আমি বরং লেবুর সরবত নিয়ে আসি৷ তুমি তোমার ভাইয়ের কাছে থাকো, মিষ্টিকে উনাকে এই অবস্হায় দেখে ফেললে সমস্যা হবে। তাছাড়া একটু পরেই, অনুষ্টান শুরু হবে। ‘

অনন্যা চলে যেতেই, ফারিশ ইয়ানার দিকে অসহায় নয়নে তাকিয়ে বলে, ‘ দেখলি? মিস অনন্যা ঠিক কতটা স্বার্থপর একজন মহিলা! এতোকিছুর পরেও ঢ্যান ঢ্যান করে, ওই অভি শিকদারকেই বিয়ে করবেন। যে মানুষটা উনাকে একদমই আমার কষ্টের কোন মূল্যই উনার কাছে নেই। ‘

ইয়ানা হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। ফারিশ উঠে দাঁড়িয়ে, ইয়ানার চোখের জল মুছিয়ে, হাল্কা হেসে বললে, ‘ কিরে পাগলি? তুই আবার কাঁদছিস কেন?’
‘ তুমি অনন্যা আপুকে খুব ভালোবাসো তাইনা? আর তুমি আপুকে মিথ্যে বললে কেন? তুমি তো একটুও ড্রিংক করো নি। ‘

‘ তুই বুঝলি কি করে?’

‘ আমি তোমার বোন ভাইয়া, আমি না বুঝলে, কে বুঝবে?’

ফারিশ ফিসফিসিয়ে বললো, ‘ কিছু মনের কথা জমা ছিলো, তা বলার সময়টুকু যে আজই ছিলো। আজ যদি বাহানা দিয়ে না আসতাম, তবে যে নিজের প্রিয় মানুষটাকে বলাই হতো না, কতটা জায়গা জুড়ে আছে সে আমার অস্তিত্বে। ‘

ইয়ানা মাথা নিচু করে বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো, ‘ ভাইয়া দেখো, আমি তোমার ভালোবাসাকে তোমার থেকে দূরে যেতে দিবো না। কেউ তোমার ভালোবাসাকে কেড়ে নিতে পারবে না, অন্তত অভি শিজদার তো নয়ই!’

ইয়ানার ভাবনার মাঝেই, ফারিশের ফোন বেজে উঠে। ফারিশ ফোনটা পেয়ে, কেটে দিয়ে, পকেটে রেখে, ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ আমাকে একটা ইম্পোর্টেন্ট কাজে এখুনি যেতে হবে। ‘

‘ কিন্তু কোথায় ভাইয়া?’

‘ আছে একটা অফেসিয়ালি কাজ। তুই বরং এদিকে সামলা, আমি এখুনি আসছি। ‘

‘ কিন্তু ভাইয়া?’
ইয়ানার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই, ফারিশ বেড়িয়ে চলে যায়। ফারিশ চলে যেতেই, লেবুর পানি নিয়ে অনন্যা ভিতরে প্রবেশ করে বলে, ‘ ইয়ানা, তোমার ভাই কোথায়?’

‘ আসলে, ভাই তো একটু বেড়িয়েছে। ‘

‘ কিন্তু এমন অবস্হায় উনি কোথায় বেড়িয়ে গেলেন?’

ইয়ানা অনন্যার হাত থেকে গ্লাস টা নিয়ে, টেবিলে রেখে বলে, ‘ ভাইয়ের নেশা কেটে গেছে, সেসব ছাড়ো! বাইরে সকলে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, তুমি আমার সাথে চলো তো!’ ‘

______________

রুমা খান সোফায় বসে ছিলেন, খালেদ খান এবং রেশমি খান বাইরে থেকে এসে কেবলমাত্র বাড়িতে ঢুকেছেন, তারা হসপিটালে আরশকে দেখতে গিয়েছিলেন।রুমা খান বসা থেকেই প্রশ্ন করলেন, ‘ আরশ কেমন আছে এখন?’
খালেদ খান কিছু বলার আগেই, রেশমি খান ক্ষোভ নিয়ে উত্তর দেন, ‘ তা জেনে আপনি কি করবেন মা? আপনার নাতি বলতে তো ইরাশ এবং ফারিশ এই দুজনেই! আমার ছেলেটা ম/রে গেছে নাকি বেঁচে আছে, সেদিকে কি আপনার আদোও কোন চিন্তা আছে? আপনি তো তাকে আর একটিবারও দেখতে ছুটে যান নি হসপিটালে।’

‘ সে তার কর্মের ফল পেয়েছে এবং আমি মনে করি এইটা তার জন্যে প্রয়োজনীয় ছিলো। এই শাস্তি এইবার তাকে মানুষ হতে সাহায্য করবে, যা আমি বা তোমরা কেউই করতে পারেনি। ‘

রেশমি খান চুপ হতেই, খালেদ খান বলে উঠেন, ‘ আরশ এখন ভালো আছে মা, কেবিনে শিফট করা হয়েছে তবে অক্সিজেন চালু আছে। আর মাত্র ৭-৮ দিনের মধ্যেই ওকে রিলিজ দিবে। ‘

‘ যাক, ভালো!’

তাদের কথোপকথের মাঝেই, রাশেদ খান ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে, সোফায় বসলেন। রাশেদ খান সোফায় বসে, হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বললেন,

‘ ডিভোর্সের এপ্লাই করে এসেছি, আশা করি খুব তাড়াতাড়ি ওই মহিলার সাথে ডিভোর্সটা হয়ে যাবে আমার। আমার জয়ার খুনিকে আমি জাস্ট সহ্য করতে পারছি না। ‘

‘ শুধু কি তারাই দায়ী? তুমি কি নও রাশেদ?’

রুমা খানের কথা শুনে রাশেদ খান মাথা নুইয়ে বলে, ‘ আমি সবথেকে বড় অপরাধী! জানি সেই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। ‘

রুমা খান সুদীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘ মা ! আমি শুনেছি, অনন্যার আজ গাঁয়ে হলুদ, কাল বিয়ে, তা কী সত্যি? ‘

‘ হুম, সত্যি! বাড়ির ছোটরা তো সেখানেই গিয়েছে।’

‘ কি বলছো মা! তাহলে আমার ছেলের কি হবে মা?’

‘ বাবাহ! আজকাল তুমি আবার ফারিশকে নিয়েও চিন্তা করছো? বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্যজনক! ‘

মায়ের তাচ্ছিল্যের বিপরীতে, রাশেদ খান নিচু গলায় বললেন,

‘ আমি তো ওর বাবা, আমি জানি। আমার ছেলেটা ঠিক কতটা ভালোবেসে ফেলেছে অনন্যাকে। ওর চোখের ভাষা স্পষ্ট তা বলে দেয়।আমার ছেলেটা ছোট বেলায় তার মাকে হারিয়েছে, আমার দোষে। আমি থেকেও তার পাশে ছিলাম না। সব হারিয়ে,সে যখন তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেলো, সে ও তাকে ফেলে চলে যাবে মা? আমার ছেলেটা তখন কি আকড়ে ধরবে মা?’

রুমা খানের আখিজোড়ায় অশ্রু টলটল করতে থাকে। তিনি তা দ্রুত মুছে, সোফায় হেলান দিয়ে, বসে পরলেন। এমন উত্তর যে তার কাছেও নেই।

________________

অপরদিকে
, হাত- পা বাঁধা অবস্হায় অন্ধকার এক রুমে বসে আছে জুঁই! সে বুঝতে পারছে না, সে এখানে কীভাবে আসলো? বাড়ি থেকে বেড়োবার সময়,পিছন থেকে কেউ তার মুখ চেপে ধরায় সে অজ্ঞান হয়ে পরে এবং জ্ঞান ফিরে আসলে, সে নিজেকে এমন জায়গায় আবিষ্কার করে। জুঁইয়ের ভাবনার মাঝেই, কেউ পিছন থেকে শীতল গলায় বলে উঠে, ‘ হ্যালো, জুঁই ডার্লিং!’

সেই কন্ঠে থমকে যায় জুঁই। তার থেকে সবথেকে বেশি অবাক হয়, সামনে থাকা হুইলচেয়ারে থাকা আরশকে দেখে। একজন নার্স তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে রেখেছে। জুঁই বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ ফারিশ?’

চলবে কী?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৪৪+৪৫

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
জুঁই পিছন থেকে ফারিশকে জড়িয়ে ধরে,কাঁদতে কাঁতে বলে, ‘ ফারিশ আমি সত্যিই পারছি না, আর কত শাস্তি দিবে আমাকে বলো তো? আমি জানি, আমিও অন্যায় করেছি কিন্তু এইসব কেন করেছি আমি? শুধু তোমাকে ভালোবেসে। প্লিয ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! ‘
ফারিশ নিজের থেকে জুঁইকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে, সরিয়ে হুংকার ছেড়ে বলে, ‘ হাও ডেয়ার টু টাচ মি? তোমার কি আদোও কোন লজ্জা নেই? এতো গাঁয়ে পরা স্বভাব কেন তোমার? দেখো আমাকে রাগিও না। নিজের ভাইকে আমি আধমরা করে হসপিটালে পাঠিয়েছি, সেখানে তোমার কি অবস্হা হতে আশা করে, তুমি বুঝতে পেরেছো?’জুঁই ফারিশের কথা শুনে, কিছুটা পিছনে চলে যায়। তাদের কথার মাঝেই, হঠাৎ অনন্যা মিষ্টিকে কোলে নিয়ে ঢুকে পরে। অনন্যাকে দেখেই জুঁই তেতিয়ে বলে উঠে, ‘ তোর কী কোন সেন্স নেই অনন্যা? দেখছিস আমি এখানে ফারিশের সাথে প্রাইভেট কথা বলছি, তুই সেখানে কোন প্রকার পারমিশন ছাড়াই ঢুকে গেলি।’
জুঁইয়ের কথা শুনে, মিষ্টি কোমরে হাত দিয়ে বলে,’ এইযে ব্যাড আন্টি মিষ্টির মা এখানে মিষ্টির জেদের জন্যে এসেছে। বিকজ মিষ্টির তার বাপির সাথে ইম্পোর্টেন্ট কথা আছে। বুঝেছো? আমার মিষ্টির মায়ের অনেক মেনার্স আছে, বকতে হলে, তুমি আমাকে বকো। ‘

জুঁই মুখ ঘুড়িয়ে ফেললো। ফারিশ কি ভেবে যেন প্রশ্ন করে উঠে, ‘ ওয়ান মিনিট! তুমি এখনো এই বাড়িতে কি করছো? তোমাকে আমি সবার সামনে বাড়ি থেকে বের করে দিলাম, তাতেও তোমার বিন্দুমাত্র কি লজ্জা হয়নি? আবারোও কী করে এই বাড়িতে পরে আছো?’

মিষ্টি মুখে হাত দিয়ে হেসে বললো, ‘ এমা! এই জুঁই আন্টির সত্যিই লজ্জা নেই। ‘

মিষ্টির কথা শুনে, অনন্যাও মুচকি হেসে ফেলে। জুঁই নিজের রাগটাকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রন রেখে বলে,
‘ আমি তো আসতে চাইনি, কিন্তু খালার যা অবস্হা! ছেলেটা তার হসপিটালে, এমন অবস্হায় আমি তাকে কীভাবে ফেলে চলে যেতে পারি? তোমরা আমাকে খারাপ ভাবতে পারো কিন্তু আমি তোমাকে আই মিং তোমাদের সবাইকেই ভালোবাসি। ‘

অত:পর জুঁই মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ এমনকি আমি আমার মিষ্টি সোনাকেও অনেক ভালোবাসি। একদম নিজের সন্তানের মতো। ‘

মিষ্টি তড়িৎ গতিতে জুঁইয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে, অনন্যার গলা জড়িয়ে বলে, ‘ আমি শুধু আমার মায়ের এবং বাবার সন্তান। তোমার মতো ব্যাড আন্টির না। তুমি আমাকে কচু ভালোবাসো, বাপি যখন থাকতো না, তখন কি আমাকে কম বকতে নাকি? ‘

মিষ্টির কথা শুনে জুঁইয়ের মুখস্রী কালো অন্ধকারে ঢেকে যায়। অনন্যার মিষ্টির হাত ধরে বলে, ‘ মা, উনি বড় না? এমনভাবে বলতে নেই। ‘

জুঁই দ্রুত বেড়িয়ে যায় সেখান থেকে। জুঁই চলে যেতেই, ফারিশ মুচকি হেসে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বলে,

‘ এখন কেমন লাগছে মা? ‘

‘ ভালো লাগছে বাপি। আচ্ছা শুনো, আমরা সবাই শপিং এ যাবো, তোমাকে কিন্তু আমাদের নিয়ে যেতে হবে। ‘

‘ কিন্তু কিসের শপিং?’

অনন্যা মুচকি হেসে বললো,
‘ এমা আপনি জানেন না? একটু আগেই তো বললাম আপনাকে। আমার বিয়ের…

সমপূর্ন কথা শেষ করার পূর্বেই, ফারিশ কিছুটা বিরক্ত হয়ে, মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ কিন্তু মা, এখন তুমি অসুস্হ, এই অবস্হায় তোমার শপিং এ যাওয়া ঠিক নয়। ‘

অনন্যা ফারিশের কথার বিপরীতে বললো, ‘ এই সময়ই ঠিক। এই টাইমে বাচ্চারা বাইরে ঘুডা-ফেরা করলে, মন-মাইন্ড একদম ফ্রেশ থাকবে। এই টাইপে শরীর যেমন সুস্হ থাকা দরকার, তেমনি দরকার মাইন্ড ফ্রেশ করা। তাছাড়া বাড়ির যা পরিস্হিতি। এই অবস্হায় সকলের বাইরে একটু ঘুড়াঘুড়ি করা প্রয়োজন। ইয়ানা আপু, এনা আপু এবং ইরাশ ভাইয়াও যাচ্ছে। আমি তাদের বলে এসেছি। শপিংও হবে, ঘুডাঘুড়িও হবে।

ফারিশ মুখটা শুকনো করে জবাব দেয়, ‘ তাহলে আপনারা যান, আমি ঘুডাঘুড়ি ভালো লাগে। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক ট্রাভেলিং!’

অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ এইযে খারুশ হাজির, তার বিশ্ববিখ্যাত ডায়লগ নিয়ে। ‘

ফারিশের কথা শুনে মিষ্টি বায়নার সুরে বলে, ‘ না, বাপি তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতেই হবে। আজকে আমি আমার মা এবং বাপি দুজনেরই সাথে ঘুড়বো। ‘

‘ কিন্তু মা?’

রুমা খান পিছন থেকে এসে বললেন, ‘ ফারিশ দাদুভাই, তখন থেকে কিসের কিন্তু কিন্তু করে যাচ্ছো। আমার মিষ্টির আবদার তুমি পূরণ করবে আর কিচ্ছু আমি শুনতে চাইনা। ‘

________________

ফারিশ, মিষ্টি, অনন্যা, এনা, ইরাশ এবং ইয়ানা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এক গাড়িতে ঠিক করা হলো ফারিশ, মিষ্টি, অনন্যা এবং ইরাশ যাবে এবং অন্য গাড়িতে ইয়ানা এবং এনা যাবে। ইরাশ বললো, ‘ তোদের সাথে আমিও আসি ওই গাড়িতে? ‘

‘ আরে ভাইয়া, তুমি মিষ্টির সাথেই বসো। তাছাড়া শফিক ভাই ও তো আছে। ‘

এনার কথা শুনে ফারিশ ভ্রু কুচকে দেখে, সাদা শার্ট পরিহিত তার ম্যানেজার শফিক ও এসে উপস্হিত! ফারিশ প্রশ্ন করে, ‘ শফিক তুমি এখানে হঠাৎ কেন?’

শফিক কিছু বলার আগেই, এনা নিজে থেকেই বলে উঠে, ‘ আসলে ভেবেছিলাম শফিক ভাই থাকলে ভালো হয়, অনেকগুলো ব্যাগ থাকবে তো, উনি আমাদের হেল্প করতে পারবেন। ‘

‘ তার জন্যে তো বডিগার্ড আছে এনা। ‘

ইরাশের কথায় শফিক কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,

‘ হ্যা, হ্যা। আমি তাহলে যাই। ‘

শফিকের কথা শুনে এনার মাথায় হাত! মানুষটা এতো বোকা কেন? এনা শফিককে চোখের ইশারায় দাঁড়াতে বলে এবং কিছুটা মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

‘ ভাইয়ার ওই কাইল্লা পোষাক পরা গার্ডদের শপিং এ একদম নেওয়া যাবে না। আশে-পাশের সাধারণ মানুষ দেখলে ঘাবড়ে যাবে। ‘

ইয়ানা তৎক্ষনাৎ মুচকি হেসে বলে, ‘ এনার কথায় যুক্তি আছে। আচ্ছা তোমার ভাইয়ার গাড়িতে যাও। ওই গাড়িতে, আমি শফিক ভাই এবং এনা আসছি। ‘

অনন্যা হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে, তাই সে নিজেও মুচকি হেসে, মিষ্টিকে কোলে করে গাড়িতে বসালো। মিষ্টিকে গাড়ি বসাতেই, মিষ্টি ইরাশের পাশে ঘেসে বললো, ‘ মা, তুমি সামনে বসো। এখানে আমি আমার চাচ্চুর সাথে বসবো। ‘

ইরাশ মিষ্টির কথা শুনে, তার গালে চুমু খেলো। ফারিশ ফ্রন্ট সিটে বসেছিলো, অনন্যাঅ গিয়ে তার পাশের সিটে বসে পরে কিন্তু সে তার সিট বেল্ট পরেনি। ফারিশ হঠাৎ মিরর গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ সিট বেল্ট টা লাগিয়ে পড়ুন। ‘

‘ আমার ইচ্ছে করছে না, আমি পারবো না। ‘

ফারিশ ক্ষেপে গিয়ে, অনন্যার কাছে গিয়ে, অনন্যার সিটে এক হাত রেখে, অন্য হাত দিয়ে সিট বেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে, বসে পরো। ইরাশ স্মিত হেসে ফেলে। অনন্যা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে, তার চুল কানের কাছে গুজে নেয়।

___________

অপরদিকে, অভি অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হচ্ছিলো, তখনি তার নাম্বারে জুঁইয়ের ফোন আসে। অভি প্রথমে ভেবেছিলো ধরবে না কিন্তু কি ভেবে যেনো ফোনটা রিসিভ করে বললো, ‘ হ্যালো?’

‘ হ্যালো, অভি তুমি কোথায়?’

‘ আমি আসলে, অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম ‘

‘ তুমি অফিসে যাচ্ছো? অথচ ওইদিকে অনন্যা ঘুড়তে বেড়িয়েছে ফারিশের সাথে। ‘

‘ ওয়াট? ‘

‘ হ্যা, তোমার সাথে সে বিয়ের শপিং এ যাইনি অথচ ফারিশ খানের হাত ধরা নাচতে নাচতে শপিং করতে বেড়িয়ে গেছে। ‘

‘ চুপ করো জুঁই! ‘

‘ আমি কেন চুপ করবো? তুমি নিজের বাগদত্তাকে সামলাও, এক সপ্তাহ পর তোমাদের বিয়ে অথচ সে পরপুরুষের সাথে রংঢং করে বেড়াচ্ছে। ‘

জুঁইয়ের কথা শুনে অভি রাগে ফোনটা কেটে দেয়! অনন্যা তার সাথে শপিং এ না গিয়ে, কেন ফারিশ খানের সাথে শপিং এ গেলো? এমনকি ফারিশের মেয়ের জন্যে রাতে ছুটে অবদি চলে গেলো! অনেক আজে বাজে চিন্তা অভির মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে। না চাইতেও অনন্যার প্রতি তার সংদেহ বাড়ছে!

__________

অন্যদিকে রাস্তার বেশ জ্যামের জন্যে অনেক্ষন যাবৎ গাড়ি থামিয়ে বসে আছে ফারিশ। মিষ্টি ক্লান্ত হয়ে ইরাশের কোলেই ঘুমিয়ে আছে। অনন্যা গালে হাত দিয়ে জানালা দিয়ে, বাইরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। হঠাৎই সেখানে মুষুলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। অনন্যার বৃষ্টি ছোটবেলা থেকেই পছন্দের। ডিসেম্বর মাসের বৃষ্টি তার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো, সে ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ এই জ্যাম এক ঘন্টার আগে ছাড়বে না। আমি একটু বরং যাই, খুব খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। ‘

ফারিশ ধমকে বলে, ‘ হোয়াট? এই টাইমে আপনি ভিজবেন? কিছুতেই না! বৃষ্টিতে ভিজলে আপনারও আবার জ্বর এসে পরবে। ‘

ফারিশের কথাকে একপ্রকার গুরুত্ব না দিয়েই, গাড়ি থেকে নেমে, পাশের ধানমণ্ডি লেকের ধারে চলে গেলো। খোলা চুলে কালো শাড়ি পরা রমনী লেকের ব্রিজে, মনপ্রান খুলে, বৃষ্টিতে ভিজে, বৃষ্টিবিলাস করছে। ফারিশও গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে, অনন্যার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাঁকিয়ে থাকে! পরম ভালোবাসা ছিলো সেই দৃষ্টিতে। হঠাৎ ফারিশ বলে উঠে, মিস, বৃষ্টিবিলাসী!’

ইরাশও ফারিশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো, সে হুট করে প্রশ্ন করে, ‘ ইউ লাভ হার? তুমি কী তাকে ভালোবাসো ভাই?’

ইরাশের এমন প্রশ্নে ফারিশ থমকে গিয়ে, পুনরায় তাচ্ছিল্য করে ফারিশ বলে উঠে, ‘ আমার মতো হার্টলেস মানুষের আবার ভালোবাসা! আমি শুধু মানুষকে কষ্ট দিতে পারি, মিস অনন্যার মতো নারীকে ভালোবাসার মতো বিশুদ্ধ মন আমার নেই। আমি যে বড্ড পাষাণ মানুষ রে!’

চলবে কী?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ এগিয়ে গেলো তার বৃষ্টিবিলাসীর দিকে। অনন্যা দুই হাত বাড়িয়ে, ব্রিজের উপরে মনের আনন্দে বৃষ্টিকে উপভোগ করছে। ইরাশ মুচকি হেসে গাড়ির দিকে চলে যায়। ফারিশ আশে-পাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ মিস অনন্যা? শুনছেন? এইবার গাড়িতে চলুন! ভিজে আপনার অবস্হা খারাপ। একবার না বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়ে ছিলেন, এখন জ্বর হলে কীভাবে চলবে? সাৃমনে আপনার বিয়ে। ‘
অনন্যা মন খারাপ করে নরম গলায় শুধালো,’ আমি ইচ্ছে করেই বৃষ্টিতে ভিজছি, যাতে আমাকে বিয়েটা করতে না হয়। বিয়ের দিন জ্বর হলে কেমন হবে মি: খান? ধরুন আমার জ্বর হয়ে, এমন অবস্হা হলো যে, আমি সোজা হসপিটালে! তখন কি আপনি খুশি হবেন?’
ফারিশ অনন্যার প্রশ্নে ভরকে গিয়ে বললো, ‘ কিসব যাতা বলছেন? আপনি অসুস্হ হয়ে, হসপিটালে ভর্তি থাকলে আমি খুশি কেন হবো?’

‘ এইযে আমার বিয়ে আটকে যাবে, তাই! কি খুশি হবেন না?’

‘ উহু, মোটেও খুশি হবো না। আপনি এবং অভি সাহেব নতুন করে পথ চলা শুরু করছেন, এতে বরং আমি খুশি হবো। ‘
অনন্যা ছলছল নয়নে প্রশ্ন করলো,
‘ আমার বিয়েতে আপনি খুশি হবেন?’
‘ অবশ্যই! আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে খুশি হবেন। আপনার খুশিতে, আমার খুশি মিস অনন্যা। আপনার আনন্দ আমাকে শান্তি দেয়। ‘
শেষের কথাগুলো ফারিশ ধীরকন্ঠে বললো। ফারিশ লক্ষ্য করলো কথাগুলো বলার সময়, তার গলা কেমন যেন আটকে আসছে। নি:শ্বাসেও বোধহয় কষ্ট হচ্ছে। অনন্যা ফারিশের শার্টের কলার চেপে ধরে, কান্নার সুরে বললো,
‘ আপনি একজন হার্টলেস মানুষ! আপনার মধ্যে কোন অনুভুতি নেই। আপনি কী তা জানেন?’

দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হয়ে গিয়েছে। ফারিশ ঠিকই খেয়াল করছে বৃষ্টির পানির মধ্যেও, অনন্যার আখিজোড়ায় নোনাজল এসে ধরা দিচ্ছে কিন্তু তা গড়িয়ে পরার আগেই, ফারিশ আলতো হাতে মুছিয়ে দিয়ে বলে,

‘ আমি হার্টলেস কিন্তু অভি সাহেব যথেষ্ট ভালো মানুষ, আপনাকে যথেষ্ট ভালোবাসবে। অনেক ভালোবাসবে। ‘

অনন্যা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। ফারিশ ফের প্রশ্ন করে,
‘ আমার কথা শুনে আপনি হাসছেন?’

‘ হাসবো না?’

‘ হাসির কথা কি আমি বলেছি?’

‘ অবশ্যই বলেছেন, নাহলে আমি অযথা হাসি না। আমার হাসির এই কারণটি আপনি খুব শীগ্রই জানতে পারবেন। আচ্ছা চলুন, আমরা এখন গাড়ির দিকে যাই। ‘

কথাটি বলে অনন্যা পা বাড়াতে নিলেই, হঠাৎ করে পা পিছলে পরে গিয়ে ‘ আহ ‘ করে চেচিয়ে উঠে। ফারিশ দ্রুত গতিতে অনন্যার কাছে গিয়ে বলে, ‘ আপনি এতো ছটফট করেন কেন? ইউ নো আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। দেখলেন তো? পরে গেলেন! ‘

‘ আপনার ডায়লগ না মে/রে আমাকে উঠান মি: খারুশ থুরি ফারিশ খান। ‘

ফারিশ চোখ গরম করে তাঁকায়। অনন্যা উঠতে নিলে, আবারোও পায়ের ব্যাথায় বসে পরে। ফারিশ খেয়াল করে অনন্যার পা মচকে যাওয়ায় সে ঠিক মতো হাটতে পারছে না।তাই সে অনন্যাকে পাজকোলে তুলতেই, অনন্যা হাত- পা ছুটাছুটি করতে করতে বলে, ‘ কি করছেন কি? আমাকে এইভাবে কোলে নিয়েছেন কেন? কেউ দেখলে কি ভাববে? আমাকে নামান বলছি। ‘

ফারিশ অনন্যার ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে বলে, ‘ হুসস! কোনো কথা নয়। আপনি যথেষ্ট বাদর টাইপ একজন রমনী! যা পিচ্ছিল রাস্তা, আপনি এখন বার বার পিছলে পরে যাবেন। দেখা যাবে আপনাকে নিয়ে পরে আমাকে হসপিটালে ছুটাছুটি করতে হবে। সো, নো রিস্ক!’

কথাটি বলেই, অনন্যা ফারিশকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ততক্ষনে মিষ্টিও উঠে গিয়েছিলো, সে ইরাশের সাথে গল্প করছিলো, অনন্যাকে কোলে নিয়ে ফারিশ গাড়ির সামনে আসায়, মিষ্টি উঠে হাতে তালি বাজাতে বাজাতে বলে, ‘ ওয়াও! বাপি ,মিষ্টির মাকে কোলে নিয়েছে, জাস্ট লাইক আ মুভির হিরোর মতো!’

ইরাশ ও বড় বড় চোখ করে বলে, ‘ কিরে ভাই! তুই কি আবার মুভির ভিলেনের মতো, নায়িকাকে কোলে নিয়ে, কাজি অফিসে যাওয়ার প্ল্যান করছিস? তাহলে আমাকে নামিয়ে দে ভাই! আমি ভিলেনের চামচার পার্টে থাকতে চাইনা। ‘

ইরাশের কথা শুনে মিষ্টি হু হা করে হেসে উঠে। ফারিশ চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে, ‘ উনি যা নাছরবান্দা মহিলা! মাঝে মাঝে মনে হয়,মিষ্টির থেকেও উনি ছোট। বৃষ্টিতে ঢ্যানঢ্যান করে ভিজতে গিয়ে, পা পিছলে পরেও গিয়েছেন। এখন ঠিকমতো হাটতেও পারছেন না।’

অনন্যা গাল ফুলিয়ে গাড়িতে বসে থাকে ফারিশের কথা শুনে। ইরাশ এবং মিষ্টি দুজনেই হেসে উঠে।

_______

অন্য গাড়িতে, এনা, ইয়ান এবং শফিক বসে ছিলো। ইয়ানা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিলো। পিছনের সিটে এনা এবং শফিক। শফিক যথেষ্ট দূরুত্ব বজিয়ে, এনার থেকে দূরে বসে আছে। যেন কাছে ঘেসলেই তার ফারিশ স্যার তার চাকরী নট করে দিবে। এনা জানালা ক্লাস খুলে, বৃষ্টিকে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে দেখছে। শফিক আড়চোখে এনার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে, নিচের দিকে তাকাচ্ছে। এনা হয়তো বিষয়টি লক্ষ্য করছে তাই সে নিজে থেকেই শফিকের কাছে একটু এগিয়ে বসলো কিন্তু তাতে বরং শফিক একটু অস্বস্হিবোধ করলো এবং জানালার সাথে আরেকটু ঘেষে বসলো। এনা মুচকি হেসে, প্রশ্ন করলো, ‘ শফিক ভাই, আপনি কি অস্বস্হি বোধ করছেন? যদি করে থাকেন, সামনে বসতে পারেন। আমি কি গাড়ি থামাতে বলবো?’

শফিকের বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো। এনা ম্যাম বৃষ্টির পানির সাথে খেলছে, দৃশ্যটি দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছে, সামনে গেলে কীভাবে দেখবে সে? শফিক মৃদ্যু সুরে জবাব দিলো,
‘ আমার অস্বস্হি বোধ হচ্ছে না, তবে আপনার যদি ইচ্ছে হয়, তাহলে আমি সামনে চলে যাবো। ‘

‘ সত্যিই আমার ইচ্ছেই সব? আপনার ইচ্ছের দাম নেই? তবে গাড়ি থামাতে বলি?’

শফিকের আখিজোড়া ছলছল করে উঠলো। তা দেখে এনা স্মিত হেসে বললো, ‘ শফিক ভাই আপনি কী জানেন? আমি আপনাকে ঠিক কতটা পছন্দ করি? আপনি একজন চমৎকার মানুষ। পছন্দ বলতে নরমাল মানুষ হিসাবে পছন্দ, হা হা হা। ‘

বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো এনা। শফিক মুগ্ধ নয়নে এনার দিকে তাকিয়ে আনমনে বললো, ‘ আপনার এই সুন্দর হাসির সাথে ঠিক কোন উপাধি দিবো ম্যাম? হয়তো আপনার সৌন্দর্যের বর্নণার কাছে আজ জগতের সমস্ত সুন্দরের উপাধি ফিকে হয়ে যাবে। ‘

_____________

শপিং শেষে, সকলে বাড়ি ফিরে এসেছে। মিষ্টি ক্লান্ত ছিলো বলে, তাকে কোলে নিয়েই রুমের দিকে চলে যাচ্ছিলো অনন্যা কিন্তু পিছন থেকে অভির ডাক শুনে সে থেমে যায়। অভি গাঁয়ে উকিলের কালো পোষাক কিন্তু বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আছে। নীচে ফারিশ, ইরাশ ছিলো। অভিকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব চিন্তিত এবং ক্লান্ত। অনন্যা অভিকে উদ্দেশ্য করে বলে,’ আমি মিষ্টিকে শুয়িয়ে দিয়ে, তারপর আসছি। ‘

অনন্যা উপরে চলে যেতেই, অভি ফারিশের মুখোমুখি হয়ে বলে, ‘ আপনি আমাকে ঠিক করে বলবেন? অনন্যার সাথে আপনার কি ঠিক কি সম্পর্ক?’৷

অভির প্রশ্ন শুনে, ফারিশ বলে উঠে, ‘ এক্সকিউজ মি!ওয়াট ইউ মিন, বাই দিজ? মিস অনন্যার সাথে, আমার সম্পর্ক ঠিক কেমন বলতে, আপনি ঠিক কী বুঝাচ্ছেন?’

অভির গলার টাইটা হাল্কা নাড়াতে নাড়াতে, উচু গলায় বলে,

‘ কেন আপনি বুঝতে পারছেন না? এইযে বাচ্চার বাহানা দিয়ে, মাঝরাতেই অনন্যার আপনাদের বাড়িতে আসা, তারপর ধানমণ্ডিতে বৃষ্টির মধ্যে আপনাদের একান্ত সময় কাটানোর দৃশ্য! সব আমি নিজে আড়ালে থেকে দেখছি মি: ফারিশ খান! এইসবের মানে কি? ঠিক কোন সম্পর্কের কারণে আপনাদের? ‘

ফারিশ অভির কলার চেপে দাতে দাত চেপে বলে, ‘ আপনি কিন্তু আবারোও মিস অনন্যার এবং আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। ভুলে যাবেন না, আপনি খন ফারিশ খানের বাড়িতে আছেন, জাস্ট দু সেকেন্ড লাগবে আমার, আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে। ‘

ইয়ানা রান্নাঘর থেকে এমন দৃশ্য দেখে, দ্রুত বেড়িয়ে, ফারিশের থেকে অভিকে ছাড়িয়ে, ফারিশকে শান্ত করে বলে, ‘ ভাইয়া কি করছো এইসব?’

‘ কি করছি মানে? এই মানুষটা এখনো বদলায়নি, আবারো মিস অনন্যার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, ঠিক কতটা খারাপ হতে পারে একজন মানুষ!’

‘ মি: খান, জাস্ট কুল ডাউন। আমি অভি শিকদারের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। ‘

কথাটি বলতে বলতে অনন্যা নীচে নেমে এসে, অভির কাছে একটা ফাইল ছুড়ে বলে, ‘ ভালো করে দেখো অভি! এতোটা খারাপ ও আমি নই যে একজন বাচ্চার অসুস্হতার বাহানা দিয়ে, এই বাড়িতে আসবো। ফাইলে মিষ্টির সব প্রস্ক্রিপশন আছে। ভালো করে চেক করে নাও এন্ড সেকেন্ডলি আমি একা মি; ফারিশ খানের সাথে যাইনি বরং সকলের সাথেই গিয়েছিলাম, যেন মিষ্টির মনটা ভালো থাকে এবং যখন জ্যামে পরেছিলো তখন আমি ইচ্ছে করেই, ধানমন্ডির লেকে যাই, বৃষ্টিতে ভিজতে যেন আমার পিছন পিছন মি: খানও সেখানে আসে এবং আমাদের ওইরকম দৃশ্য তোমার চোখে পরে ইউ নো ওয়াট?কারণ আমি জানতাম তুমি সেখানের টং এ বসে চা খাচ্ছিলে এবং আমি তোমাকে দেখেই নেমেছি, যেন তুমি এইগুলো দেখো এবং আমি দেখতে চেয়েছি এইসব দেখার পরে, তোমার রিয়াকশন ঠিক কি হয়! আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো এইবার আমাকে বিশ্বাস করবে, সবার আগে আমাকে ফোন করে, সবটা আমার থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার থেক শুনবে! বাট আই ওয়াজ টোটালি রং! তুমি আমার থেকে কিছু জানতে বা শুনতে চাও নি, সোজাসোজি এখানে এসে একটা তামাশা শুরু করে দিয়েছো, অভি! আমার চরিত্র নিয়ে আবারোও প্রশ্ন তুলেছো!’ বলতে বলতে অনন্যার আখিজোড়ায় জল চলে আসে।ফারিশের বুকের ভিতর হা হা করে উঠে। অভিও বুঝতে পারে সে আবারোও জুঁইয়ের কথা শুনে, সে তার অনন্যাকে অবিশ্বাস করে ফেলেছে, তাই সে দ্রুত অনন্যার হাত ধরে, মিনতির সুরে বলে, ‘ আমাকে ক্ষমা করে দাও অনন্যা। আমি জাস্ট ওই জুঁইয়ের কথা শুনে ইনফুলেন্স হয়ে গিয়েছিলাম। ‘

উপরে জুঁই দাঁড়িয়ে ছিলো। জুঁইয়ের নাম শুনতেই, ফারিশ ভয়ংকর চোখে উপরের দিকে তাঁকায়। জুঁই ভয়ে গুটিয়ে যায়। অনন্যা অভিকে হাত দিয়ে, থামিয়ে বলে, ‘ প্লিয অভি! থামো! অন্যের দোষ দিয়ে কি হবে? যেখানে নিজের ঘরই ঠিক নেই।কথায় আছে না? কিছু কিছু স্বভাব যায় রয়ে। আসলে অভি তুমি আমাকে কখনোই বিশ্বাস করতে পারবে না। আমার প্রতি তোমার অবিশ্বাস,তুমি আজীবন বয়ে বেড়াবে। ‘

অত:পর অনন্যা ফারিশের দিকে ঘুড়ে বললো, ‘ আমার তাচ্ছিল্য করে হাসির উত্তর কি আপনি পেয়েছেন মি: খান?’

চলবে।।

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৪২+৪৩

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যাকে গাড়িতে উঠতে দেখে বারান্দা থেকে ছোট্ট মিষ্টি হাত বাড়িয়ে ডাকতে থাকে, ‘ মা, মা! কোথায় যাচ্ছো তুমি? আমি তো এখানে! আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছো তুমি? ‘
অনন্যা মিষ্টির ডাক শুনে জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে, অসহায় পানে তাঁকিয়ে থাকে। তার বুকটাও কষ্টে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু কী করবে সে? তার তো আর কোন অধিকার নেই এই বাড়িতে থেকে যাওয়ার কারণ ফারিশ আজকে তাকে নিজে থেকে মুক্তি দিয়েছে, হ্যা সে নিজেই মুক্তিটা চেয়েছে তবুও তার মনে হচ্ছে আরো কয়েকটা দিন থাকতে পারলে কি এমন দোষ হতো? মিষ্টির মা হয়ে সে তো থাকতে পারতো কয়েকটাদিন কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, সে মিষ্টির নিজের মা নয়। যদি মিষ্টি তার নিজের সন্তান হতো, তাহলে সেই অধিকারে মিষ্টিকে নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে, নিয়ে যেতে পারতো। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, ফারিশ মিষ্টির কাছে এসে, মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বলতে থাকে,

‘ কি হয়েছে মা?’
মিষ্টি অনন্যার গাড়ির দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে, কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ বাবা! মা চলে যাচ্ছে। মিষ্টির মাকে ছেড়ে, মিষ্টি কীভাবে থাকবে বলো?’

ফারিশ মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,

‘ না, মা! উনি তোমার মা নন। তোমার মা তো আকাশের স্টার হয়ে গিয়েছে। ‘

ফারিশের কথা শুনে নীচ থেকে শুনতে পেয়ে, আখিজোড়া বেয়ে জল গড়িয়ে পরে অনন্যার! মিষ্টি মানতে নারাজ, সে রাগ দেখিয়ে বলে, ‘ না না! মিষ্টির মা স্টার হয়ে যায়নি! মিষ্টির মা একদম ঠিক আছে। ওইযে আমার মা! মা তুমি আসো না প্লিয! ‘

মিষ্টি আবারোও অনন্যাকে হাত দেখিয়ে ইশারা করে। অনন্যা থাকতে পারলো না, সে ঠিক করে নিলো সে বের হয়ে, ছুটে বেড়িয় তার মেয়েকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিবে কিন্তু তার পূর্বেই, ফারিশ ধমক দিয়ে বলে উঠে,

‘ এইসব কি হচ্ছে মা? বলছি না উনি তোমার মা নন! কতবার এক কথা বুঝাতে হবে তোমাকে? বড় হচ্ছো এইবার বুঝতে হবে তোমাকে। ভিতরে যাও বলছি এখুনি।’

ফারিশের কথা শুনে মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। অনন্যাও ফ্যালফ্যালে নয়নে ফারিশ নামক নির্দয় ব্যাক্তির পানে তাকালো কিন্তু ফারিশ একবারও অনন্যার দিকে তাঁকালো না। সে তার দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছে। অভি শেফা বেগমকে সাথে নিয়ে, গাড়ির মধ্যে বসিয়ে দিয়ে, অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ অনন্যা কি দেখছো তুমি?’

অভির ডাকে হুস ফিরে অনন্যার। অভি গাড়ির ভিতরে ঢুকে, ফ্রন্ট সিটে বসে বলে, ‘ উই সুড গো নাও। আন্টির অবস্হা ভালো লাগছে না। আই থিংক সি নিড আ রেস্ট। ‘

অনন্যা শুধু মাথা ঝাকিয়ে, আবারোও কি মনে করে যেনো বারান্দার দিকে তাঁকালো কিন্তু ফারিশ সেখানে ছিলো না। মন- খারাপ হয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ অনন্যার। তার মনে অজানা এক অভিমান জমা হলো ফারিশের প্রতি। গাড়ি চলতে লাগলো। গাড়ি গেটের কাছে চলে যেতেই, ফারিশ রুম থেকে এসে আবারোও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সে গাড়িটাকে যতদূর দেখা যায়, ততদূর সম্ভব তাঁকিয়ে রইলো। তখনি কেউ তার পিঠে হাত রাখে, ফারিশ পিছনে ঘুড়ে, রুমা খান দাঁড়িয়ে আছেন। রুমা খান ফারিশকে কিছু বললো না। শুধু অবাক নয়নে তাঁকিয়ে রইলেন। ফারিশ তার দাদির এমন তাঁকানো দেখে, হেসে প্রশ্ন করলো, ‘ কি দেখছো দাদি?’

‘ দেখছি আমার দাদুভাই সত্যিই বিরাট বড় হয়ে গেছে।পাহাড় -কষ্ট জমিয়ে রেখে কীভাবে হাসছো দাদুভাই?’

ফারিশ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বারান্দার হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ কিসের কষ্ট দাদি? আজ তো আমার খুশির দিন, আমার মায়ের অপরাধীরা তাদের শাস্তি পেয়েছে। তাই আমি আজ প্রান খুলে হাসবো, হা হা হা! দাদি তুমিও হাসো, হা হা। ‘

এনাও ততক্ষনে চলে আসে। এনা ফারিশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,

‘ তুমি কী সত্যিই হ্যাপি ভাইয়া?’

‘ আমি হ্যাপি হবো না কেন? মিস অনন্যার প্যারা থেকেও তো আজ বাঁচলাম! অনেক বকবক করতেন। জানিস? উনার বকবক খুবই বিরক্তিকর! আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ! হা হা হা। ‘

এনা বিরক্ত হয়ে বলে ফেলে, ‘ ভাইয়া আপাতত তুমি তোমার মিথ্যে হাসিটা বন্ধ করো। খুবই বিরক্ত লাগছে। ‘

ফারিশ থেমে গিয়ে, বারান্দা থেকে চলে যায়।

______________

অনন্যাদের গাড়ি হাওলাদার ভিলাতে প্রবেশ করে। গাড়ি থামানোর পর-পরেই, সর্বপ্রথম শেফা বেগম কাউকে কিছু না বলেই, গটগট পায়ে ভিতরে চলে যায়। সারারাস্তা স্বামীর কথা চিন্তা করে, তিনি কান্না করে গিয়েছেন। যাকে এতোটা ভালোবেসে এতোবছর ধরে, সংসার করে গিয়েছেন, তার অতীত এতোটা জঘন্য ভাবতেই তার ঘৃণা ধরে যাচ্ছে। সবথেকে বড় কথা, এইসব এর মাঝে তার নির্দোশ মেয়েটাকে মাঝখান থেকে এতোকিছু সহ্য করতে হলো। অনন্যা তার মায়ের মনের অবস্হা বুঝতে পেরে, নিশব্দে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। সে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে, পিছন থেকে অভি এসে খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। অভি তার হাত এইভাবে ধরে ফেলায়, অনন্যা প্রশ্ন করে, ‘ হাত ধরেছো কেন?’

অভি অনন্যার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,’ আসলে, অনেক তো হলো অনন্যা। আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি, সেই ভুলের শাস্তিও পেয়ে গিয়েছি। এখন আমি সেই ভুল শুধরে নিতে চাই। ‘

‘ ভুল? কোনটা ভুল অভি? ভরা বিয়ের আসরে, সকলের সামনে আমার গাঁয়ে হাত তুলেছিলে তুমি। সকলের সামনে আমার সাথে পতি/তার তুলনা করেছিলে তুমি। আমাকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলে। এইটা ভুল? ‘

অনন্যার কথা শুনে অভি মাথা নিচু করায়, অনন্যা আবারোও বলে উঠে, ‘ রাশেদ খানের মতো তুমিও সমান দোষী। আজ যদি আমিও মরে…. ‘

অনন্যার সম্পূর্ন কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই, অভি অনন্যার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

‘ কি বলছো তুমি? এইসব প্লিয বলো না। আমি জানি, আমি অন্যায় করেছি কিন্তু অনন্যা তুমি কি জানো? আমি তোমার জন্যে দিনের পর দিন কতটা যন্ত্রনার মধ্যে গিয়েছে, কতটা পু/ড়েছি, শুধুমাত্র আমিই জানি।’

অনন্যা তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,’ খুবই স্বার্থপর একজন মানুষ তুমি। ‘

‘ আমি স্বার্থপর?’

‘ তবে কি? শুধুই নিজের কষ্ট দেখলে তুমি অথচ আমাকে কতটা যন্ত্রনা দিয়েছো সেই হিসাব রেখেছো?’

‘ আমি তোমায় ভালোবাসি অনন্যা, তাই তোমায় পেতে চাইছি, আর কিছুই না। এখানে স্বার্থপরতার কি দেখলে তুমি?’

‘ আমি কোনপ্রকার তর্কে জড়াতে চাইছি না আপাতত। তুমি বিয়ের ব্যবস্হা করো, আমি তৈরি। ‘

কথাটি বলেই অনন্যা ভিতরে চলে গেলো। অভির আনন্দে ‘হুরেএ’ বলে চেচিয়ে উঠলো।

_________

অপরদিকে, মিষ্টির গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। সে সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি, সারাদিন কান্নাকাটি করার ফলে, অসুস্হ হয়ে পরেছে। ডক্টর নিয়ে আসা হয়েছে কিন্তু মিষ্টি কিছু না খাওয়ার ফলে, ওষুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না, সে শুধু বার বার মা মা করে যাচ্ছে। ইরাশ, ফারিশের কাছে এসে বলে, ‘ ভাই এখন কি হবে? এইভাবে চলতে থাকলে, আমাদের মেয়েটাকে তো হসপিটালে এডমিট করতে হবে। মিষ্টির অবস্হা একটুও ভালো না।’
ফারিশ বুঝতে পারছে না সে কি করবে, তখনি রুমা খান, ফারিশের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,’ এই সময়ে, মিষ্টির অনন্যাকে প্রয়োজন দাদুভাই। ‘

‘ কিন্তু মিস অনন্যাকে এখন নেই দাদি।’

‘ তুমি গিয়ে অনন্যাকে এখুনি নিয়ে আসবে।’

‘ কি বলছো দাদি? এতো রাতে? ‘

‘ নিজের মেয়ের জন্যে এইটুকু তোমাকে করতেই হবে।’

চলবে।।

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ওয়াশরুম থেকে ভেজা চুল নিয়ে বের হতেই, খাটে হঠাৎ ফারিশকে বসতে থাকতে দেখে থমকে যায় অনন্যা। ফারিশ খাটে বসে ছিলো, অনন্যাকে দেখেই সে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায়। অনন্যার ফারিশকে দেখে কেন যেন প্রচুর হৃদপৃন্ড দ্রুতগতিতে কম্পিত হতে শুরু করলো, গোলাপী ঠোট জোড়া কাঁপছে, অনন্যা বুঝতে পারছে না হঠাৎ তার এমন হচ্ছে কেন? হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তে ফারিশের উপস্হিতি তার অস্হিরতার কারণ! অনন্যার মন বারংবার বলছে, এই হয়তো ফারিশ তাকে বলবে, ‘ মিস অনন্যা! শুনছেন? বাড়ি ফিরে চলুন! আমার ভালো লাগছে না। আপনার বকবক শুনতে হবে। বাড়িতে কেমন যেনো, শান্ত হয়ে গিয়েছে। ইউ নো আপনাকে ছাড়া বাড়ির এমন অবস্হা, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ!’

কিন্তু অনন্যাকে হতাশ করে দিয়ে, ফারিশ নিচু সুরে শুধালো, ‘ মিস অনন্যা? কিছুটা বাধ্য হয়েই, আপনাকে বিরক্ত করতে এতো রাতে ছুটে এলাম। ‘

‘ বাধ্য হয়ে মানে? বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?’

‘ না, মানে আসলে সবকিছু ঠিক নেই। আমার মিষ্টির হঠাৎ খুব করে জ্বর এসে পরেছে। মেয়েটা সারাদিন মা, মা করে যাচ্ছে। আপনি যাওয়ার পর থেকে সকাল থেকে কিচ্ছুটি মুখে দেইনি সে।’

‘ আর আপনি আমাকে এতোক্ষনে বলছেন যে, মিষ্টির জ্বর এসেছে? সত্যিই আশ্বর্য! চলুন, এখুনি চলুন। ‘

অনন্যার কথা শুনে ফারিশ দ্রুত গতিতে মাথা নাডিয়ে, অনন্যাকে সাথে নিয়ে, ঘর থেকে বের হয়।

অপরদিকে,

জুঁই ড্রইংর‍ুমে পাইচারি করে যাচ্ছে, তার মধ্যেই অনন্যাকে নিয়ে ফারিশ প্রবেশ করে, সোজা উপরে চলে যায়। অনন্যাকে এতো রাতে হঠাৎ খান বাড়িতে দেখে, মেজাজ গরম হয়ে যায় তার! সে ভেবেছিলো এইবার হয়তো অনন্যা তার ফারিশকে ছেড়ে একেবারের জন্যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে কিন্তু মিষ্টির বাহানায় আবারোও সে খান বাড়িতে ফিরলো! কিন্তু এখন কী করবে সে? সবকিছু অসহ্য লাগছে তার।
অনন্যা দ্রুত পায়ে, মিষ্টির রুমে ঢুকে, মিষ্টির কাছে ছুটে গিয়ে, দ্রুত মিষ্টিকে বুকের সাথে মিশিয়ে, কপালের জ্বর মাপতে লাগলো। সেখানে ইরাশ, ইয়ানা, এনা এবং রুনা খান ছিলেন। রুনা খান অনন্যাকে দেখে নিশ্চিত হলেন।
ফারিশ ও ভিতরে ঢুকলো। অনন্যার গাঁয়ের ঘ্রাণ পেয়েই, ছোট্ট মিষ্টি ক্লান্ত গলায় শুধালো, ‘ মা, তুমি এসেছো! মিষ্টি তোমাকে অনেক মিস করছিলো। ‘

ছোট্ট মিষ্টির কথা শুনে, অনন্যার আখিজোড়া বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। সে মিষ্টির কপালে চুমু খেয়ে বলে,
‘ আমি চলে এসেছি মা, মা তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে না। কিন্তু মা, তোমাকে এইবার কিছু খেতে হবে। নাহলে ওষুধ কী করে খাবে? ওষুধ না খেলে যে, জ্বরটা কমবে না। ‘

মিষ্টি কোনপ্রকার জবাব দিলো না, শুধু অনন্যার বুকের সাথে লেপ্টে রইলো। অনন্যা ফারিশকে ইশারা করলো, যেন বিছানার পাশে থাকা স্যুপের বাটিটা তাকে দেওয়া হয়। ফারিশও স্যুপের বাটিটা অনন্যার হাতে এগিয়ে দিলো এবং অনন্যার পাশে বসে, মিষ্টিকে নিজের কোলে বসালো। অনন্যা চামচে আলতো করে, ফু দিয়ে মিষ্টিকে খাওয়াতে লাগলো। অসুস্হ মিষ্টুও কোনপ্রকার জেদ না করে, খেতে লাগলো। পাশে ডক্টর বসে ছিলেন। তিনি এমন দৃশ্য দেখে বললেন, ‘ এই তো বাচ্চাটা খাচ্ছে। আসলে ছোট বাচ্চা মানুষ তো, মাকে না পেলে, এমন খাওয়া- দাওয়া বাদ দিয়ে দেয়। ‘
ডক্টর সাহেব পুনরায় ফারিশকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ তা কী ফারিশ সাহেব? বউয়ের সাথে বেশি ঝগড়া করে ফেলেছেন, তাইনা? তাই মিসেস খান, বাচ্চা- সংসার ফেলে, বাপের বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। কি মশাই! দেখলেন তো? শুধু শুধু বউয়ের সাথে ঝগড়া করে লাভ নেই। সেই বউকেই আবারো রাত দুটো বাজে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হয়। আসলে নারী ছাড়া সংসার পুরোই অচল!’

ডক্টর সাহবের কথা শুনে, ইয়ানা এবং এনা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। অনন্যা কিছুটা অস্বস্হিতে পরে যায়। ফারিশ বিরক্ত হয়ে ভাবতে থাকে আজব ডাক্তার! তিল কে তাল বানিয়ে দিচ্ছে! ব্যাপারটা নিশ্চই হয়তো ভালো লাগছে না মিস অনন্যার। তাই সে বলে উঠলো, ‘ আপনি ভুল করছেন। উনি আমার বউ ন..’

সম্পূর্ন কথা শেষ করার পূর্বেই, রুমা খান বলে উঠলেন,

‘ ইউ আর টোটালি রাইট ডক্টর। সত্যিই নারীকে ছাড়া গোটা সংসার, পৃথিবী সবকিছুই মূল্যহীন! একজন সন্তানের যেমন বাবার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন তার মায়ের। ‘

ইরাশ হয়তো রুমা খানের কথাটি ধরতে পারলো। সত্যিই তার মনে হচ্ছে তার ভাই ফারিশ যেমন এতোদিন তার অভাব পূরণ করেছে ঠিক তেমনি আজ অনন্যা ইশিতার অভাবটা মিষ্টির জীবনে পূরণ করে দিচ্ছে। সত্যিই তার মেয়ে ভাগ্যবতী!

__________

মিষ্টিকে খায়িয়ে, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খায়িয়ে দিয়েছে অনন্যা এবং মিষ্টির মাথায় বারংবার জল পট্টি দিয়ে দিচ্ছে ফারিশ। অনন্যা তাকে অনেকবার বলেছিলো, ‘ আপনি যান, আজকের রাত টা তো আমি আছিই, আমিই জল পট্টি দিয়ে দিবো।’

কিন্তু ফারিশ যায়নি। সে কখনোই অসুস্হ অবস্হায় তার মেয়েকে একা ছেড়ে থাকে না। সারা রাতই পাশে বসে কাটিয়ে দেয় সে। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়না। সে রাত অবদি মিষ্টির পাশে বসে জলপট্টি দিতে দিতে, ভোরের দিকে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো, কিন্তু তখনো ও অবদি অনন্যা জেগে ছিলো। সে মিষ্টির মাথায় হাত দিয়ে দেখলো জ্বর নেই। খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে ফারিশের দিকে তাকাতেই দেখলো, হেলান দিয়ে চেয়ারে শুয়ে আছে ফারিশ কিন্তু হাতের উপর হাত ভাজ করা। যেন ঘুমানোতেও তার স্টাইল মেইনটেইন করা চাই! উস্ককষ্ক সিল্কি চুলগুলো কপালে এসে তার লেপ্টে রয়েছে। অনন্যা এগিয়ে গিয়ে, ফু দিয়ে চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে, ফিক করে হেসে উঠলো। সে টের পেলো, শীতে ফারিশ মৃদ্যু মৃদ্যু কাঁপছে, তাই সে গিয়ে, একটা কম্বল নিয়ে এসে, ফারিশের গাঁয়ে জড়তি দিতে দিতে বললো,

‘ জানিনা কেন কিন্তু আপনার জন্যে বড্ড মায়া লাগে মি: খারুশ থুরি ফারিশ খান। এর কারণ কী? বলতে পারেন?’

______________

অভি অনন্যার বাড়িতে এসে, শেফা বেগমের কাছে জানতে পারলো, অনন্যা বাড়িতে নেই। রাতেই সে ফারিশের সাথে খান বাড়িতে ফিরে গেছে। অনন্যার খান বাড়িতে ফিরে যাওয়াতে কিছুটা ঘাবড়ে যায় ফারিশ এবং অনন্যার নাম্বারে ফোন দিয়ে দেয় এবং সাথে সাথে অনন্যা ফোনটা রিসিভ করে বলে,
‘ হ্যালো অভি?’

‘ তুমি খান বাড়িতে হঠাৎ এতো রাতে ফিরে গেলে কেন? এভ্রিথিং ইজ ওকে?’

‘ আসলে, মিষ্টি আমাকে না পেয়ে, খাওয়া- দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। রাতের দিকে জ্বর বাধিয়ে অবস্হা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই চলে এসেছি।’

‘ কি বলছো? এখন কেমন আছে? ‘

‘ কিছুটা ভালো, জ্বর কমেছে। ‘

‘ তাহলে তো সমস্যাই নেই। আমি তাহলে তোমাকে নিতে আসছি, আমাদের বিয়ের শপিংটা শুরু করে দিতে হবে। হাতে মাত্র এক সপ্তাহ সময় অনন্যা। ‘

অভির এমন কথা শুনে, অনন্যা অবাক হয়ে বলে,

‘ এতো স্বার্থপরের মতো কথা কী করে বলতে পারো তুমি অভি? মিষ্টি এখনো সম্পূর্ন সুস্হ হয়নি, আমি এখন ওকে রেখে, বিয়ের শপিং করতে যাবো? তুমি বরং তোমার মাকে নিয়ে কেনাকাটা শুরু করে দাও। আমি এখন কিছুতেই যেতে পারবো না, রাখছি আমি।’

কথাটি বলেই ফোন কেটে দেয় অনন্যা। ফারিশ বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময়, অনন্যার কথা তার কানে আসে। তাই সে এগিয়ে পকেটে হাত রেখে বলে,

‘ মি: অভি সাহেব হয়তো আপনাকে নিয়ে বিয়ের শপিং এ যেতে যাচ্ছেন। আপনি চলে যেতে পারেন, মিষ্টি তো আপাতত ঠিকই আছে। ‘

অনন্যা গম্ভীর হয়ে বললো, ‘ আমি আপনার থেকে আপাতত কোনপ্রকার পরামর্শ চাচ্ছি না। তাছাড়া আমি ভেবেছি, মিষ্টি সুস্হ হলে, মিষ্টিকে সাথে নিয়ে, আপনার সাথে বিয়ের শপিংটা সেরে ফেলবো। তাছাড়া আমার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব আপনার। আমার বিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন আপনি। এখন নিজে আমার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব পালন আপ্নাকেই করতে হবে, মি: খান। হাতে সময়, একদমই কম। ‘

কথাটি বলেই মুচকি হেসে চলে যায় অনন্যা। ফারিশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে নিজ দায়িত্বে মিস অনন্যার বিয়ের আয়োজন করতে হবে ভেবে গলা শুকিয়ে আসছে তার, কিন্তু সে কেন মিস অনন্যার কথা শুনবে? সে কিছুতেই শুনবে না। সে কিছুতেই বিয়ের আয়োজন করতে পারবে না, দিনশেষে সেও একজন রক্ত/গড়া মানুষ। তার ভাবনার মাঝেই, জুঁই এসে…..

চলবে কী?

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৪০+৪১

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৪০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
হসপিটাল থেকে রুমা খানের জরুরী তলবে ডেকে পাঠানো হয়েছে রাশেদ খান, ইশিকা খান, খালেদ খান এবং রেশমি খানকে। এনা, ইয়ানা ও ইরাশ ও এসেছে। ফারিশের সাথে অনন্যা দাঁড়িয়ে ছিলো। ফারিশের সাথে অনন্যাকে দেখেই রুমা খানের কাছে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে, রেশমি খান বলতে থাকে, ‘ এই কালনাগিনী এখানে কি করছে মা? আজ শুধুমাত্র ওর জন্যে আমার ছেলের এই অবস্হা! ওর কথায় ইনফুলেয়েন্স হয়ে ফারিশ তার ভাইয়ের আজ এই অবস্হা করেছে। আপনারা কীভাবে এই মেয়েকে এলাও করছেন এখনো? কেন ঘা/ড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছেন না মেয়েটাকে? ওহ! তাহলে তো আমাকেই এই মেয়েকে বের করতে হবে তাইনা?’

কথাটি বলেই রেশমি খান অনন্যার দিকে তেড়ে যেতে নেয়, পিছন থেকে খালেদ খান এবং এনা তাকে আটকাতে চাইলেও সে শুনে না বরং অনন্যার হাত খপ করে ধরে চিৎকার করে বলে,

‘ চরিত্রহীনা মেয়ে, আমার ছেলেকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে, এখন ভালো সাঁজতে চাইছিস? প্রথমে ফারিশকে, তারপর ফারিশের ভাইয়ের সাথে! লজ্জা করে না তোর? আজকে আমি তোকে বের করেই ছাড়বো।’

রেশমি খান কথাটি বলেই অনন্যার হাত ধরে টানতে চাইলে, পিছন থেকে অনন্যার হাত শক্ত করে ধরে রাখে ফারিশ এবং রেশমি খানের থেকে জোড় করে অনন্যার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

‘ ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ হার। নাহলে আপনার ছেলেকে হসপিটালে গিয়েই এমন অবস্হা করবো যেন সরাসরি উপরে চলে যায়।এতোদিন ধরে মিস অনন্যার চরিত্রে অনেক কাঁদা ছুড়াছুড়ি করেছেন আপনারা, আনফরচুনেটলি আমার জন্যেই, কিন্তু আজকে প্রমাণ হবে কে আসল চরিত্রহীন! ‘

কথাটি বলেই রক্তচক্ষু নিয়ে ইশিকা খানের দিকে তাঁকায় ফারিশ। তা দেখে ভয়ে শিউরে উঠে ইশিকা। রুমা খান ফারিশের কাছে গিয়ে বলে, ‘ কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, তুমি কি প্রমাণ করতে আমাদের এখানে ডেকেছো ফারিশ দাদুভাই?’

ফারিশ রুমা খানের প্রশ্নের জবাবে ইশিকা খানের সামনে দাঁড়িয়ে, পকেটে হাত রেখে বাঁকা হেসে জবাব দেয়,

‘ দাদি, আজ অনেক অতীতের রহস্য উন্মোচন করা হবে। আমার মায়ের গাঁয়ে যেই চরিত্রহীনার কলঙ্ক লেপ্টে রাখা হয়েছে তার সত্যতা আজ প্রমানিত হবে। আর ইউ এক্সাইটেড মিসেস খান?’

ইশিকা খান ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়, ‘ ফারিশ তুমি আমার দিকে তাঁকিয়ে কথাগুলো বলছো কেন? মনে হচ্ছে তুমি আমাকে মিন করে বলছো?’

‘ মিসেস ইশিকা খান, আমি তো আপনাকে এখনো কিছুই বললাম না, কিন্তু কথায় আছে না? চোরের মন পুলিশ, পুলিশ! ওকে লেটস সি! আপনারা এইবার ভিতরে আসুন। ‘

ফারিশের কথা শুনে অনন্যার মা শেফা বেগম, লতিফ হাওলাদারকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেন। এমন মুহুর্তে লতিফ হাওলাদারকে দেখে রক্তশূন্য হয়ে যায় ইশিকা খানের মুখস্রী। এতোদিন পরে, নিজের বাবা- মাকে দেখে কিছুটা আবেগঘনিত হলেও, নিজেকে সংযত রাখে, কারণ তার মা তাকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো একটা সময়ে। এতোকিছুর পরেও, নিজের বাবাকে হুইলচেয়ারে দেখে, অনন্যা নিজেকে সামলাতে না পেরে, মায়ের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ‘ বাবার কি হয়েছে মা? বাবার কি ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি?’

‘হয়েছে রে মা! কিন্তু ভাগ্য! ভাগ্য আজ তোর বাবাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আজ তোর এই অবস্হার জন্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তোর বাবাও সমান দায়ী। তাই আজ তোর বাবার পা দুটো প্যারালাইসড হয়ে, অকেজো হয়ে গেছে। ‘

অনন্যা মুখে হাত দিয়ে বলে, ‘ এইসব কি বলছো মা?’ অনন্যা খেয়াল করছে তার বাবার চোখে জল! হয়তো কঠিন অনুতাপের ফল আজ এই জল ঝড়ছে! কিন্তু কিসের অনুতাপ? তার বাবা অতীতে কি এমন করেছে? কথাগুলো মাথায় ঢুকতেই, ভয়ে শিউরে উঠে অনন্যা।

ফারিশ পকেটে হাত গুজে অনন্যার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ আমি জানি মিস অনন্যা, আপনার মনে অনেক প্রশ্ন। তবে আমি সব বলি। ‘

ফারিশ চলে যায় তার অতীতের স্মৃতিতে,

রাশেদ খানের তখন ব্যাবসায় রমরমা অবস্হা। ফারিশের তখন কেবলমাত্র পাঁচ বছর। মায়ের কোলে সারাদিন ঘুড়ে বেড়াতো। ফারিশের মা জয়াও ছেলেকে সারাদিন নিজের বুকের মধ্যে ঝাপ্টে রেখে দিতো। ছেলে তার বড্ড আদরের। রাশেদের সাথে জয়ার প্রেমের বিয়ে ছিলো বিধায়, রাশেদের ভালোবাসার কোনপ্রকার ত্রুটি পেতো না জয়া। তার মধ্যে রুমা খান ও তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। জয়ার বাবা- মা কেউ ছিলো না, মামার সাহায্যে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ হয় জয়ার, সেখানেই রাশেদের সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো, রাশেদ তার ব্যাচম্যাট ছিলো। দুজনের প্রেমের পূর্নতা পায় তাদের বিয়েতে। জয়া তার গ্রেজুয়েসন শেষ করছিলো বাচ্চা সামলানোর সাথে সাথে এবং রাশেদ পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের ব্যাবসা দেখছিলো। তার কিছুদিনের মধ্যেই, খালেদের বিয়ে হয় রেশমির সাথে। রেশমি তখন নববধূ। তাদের বিয়ের ধূমধাম ভাবে হয়নি তবে রুমা খান ঠিক করেছিলেন তাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে বড় করে অনুষ্টান করে, শহরের সকল নামি দামি ব্যাক্তিবর্গকেও দাওয়াত করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। দিনটি ছিলো শুক্রবার।
খালেদ এবং রেশমির বিয়ে উপলক্ষ্যে সেদিন ইশিকা এবং লতিফ হাওলাদার ও এসেছিলেন। ইশিকা ছিলো রাশেদ খানের ফুপাতো বোন! এতো বছর পর বিদেশ থেকে এসে রাশেদ এর পাশে জয়াকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না অপরদিকে লতিফ ছিলেন জয়া এবং রাশেদ খানের ব্যাচম্যাট! সে বরাবরই জয়াকে ভালোবাসতো কিন্তু জয়া তাকে বিয়ে না করে, রাশেদকে বিয়ে করায়, তার জয়ার প্রতি বেশ গভীর ক্ষোভ ছিলো। তখনো লতিফ বিয়ে করেনি। লতিফের সেই ক্ষোভ টাই সেদিন কাজে লাগিয়েছিলো ইশিকা। অনুষ্টানের এক পর্যায়ে, জয়া ফারিশকে কোল থেকে নামিয়ে, রুমা খানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো, ‘ মা! বাবাকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম। আপনে একটু দেখিয়েন। আমি একটু ঘরে যাচ্ছি।’

‘ এই সময়ে ঘরে কেন? তুমি ঠিক আছো মা?’

‘ হ্যা, মা! আমি ঠিক আছি কিন্তু মাথা প্রচন্ড ধরেছে। আমি বরং ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে থাকি।’

বলেই জয়া নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তখনি ইশিকা লতিফের কানে কানে ফিসফিস করে বলে,

‘ এখনো সুযোগ আছে লতিফ ভাই! নিজের প্রতিশোধ পূরণ করুন। ওই মেয়ে আপনার ভালোবাসাকে প্রত্যাক্ষ্যান করে, স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখে আছে। অথচ আপনি কি করছেন? আমি কি বলতে চাইছি, আপনি বুঝতে পারছেন?’

লতিফ গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে, ‘ তাহলে কি করা যায়?’

‘ জয়াকে আমরা চরিত্রহীনা প্রমাণ করবো, তাহলে সে কীভাবে রাশেদের সংসার করবে? তখন রাশেদ তাকে নিজ দায়িত্বে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে।’

ইশিকার কথা শুনে লতিফ বাঁকা হেসে, ‘ বুঝেছি ‘ বলে জয়ার রুমের দিকে চলে যায়।

জয়া নিজের রুমের দরজা বেরিয়ে শুয়ে ছিলো তখনি লতিফ তার রুমে প্রবেশ করে এবং এসেই জয়াকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরে। লতিফের এমন আচরণে জয়া স্তব্ধ হয়ে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে, লতিফ তার শাড়ির আঁচলেও টান মারে এমন মুহুর্তেই ইশিকা রাশেদ এবং রুমা খানকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে! সকলেই স্তম্ভিত হয়ে যায়! সেদিন জয়ার সাথে লতিফের অবৈধ সম্পর্কে আছে বলে ইশিকা প্রমাণ করার চেষ্টা করে এবং লতিফ ও তা সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে কিন্তু রুমা খান জয়াকে বিশ্বাস করলেও, রাশেদ খান জয়ার গালে থাপ্পড় মে/রে বলেছিলো, ‘ চরিত্রহীনা মেয়ে- মানুষ কোথাকার! এতো নোংরা মহিলা তুমি? কিসের অভাব রেখেছিলাম আমি তোমায়? নিজের শরীর এইভাবে বিলিয়ে দিচ্ছো? ছিহ! তোমার থেকে একজন পতিতাও বেটার, আমি মনে করি। ‘

সেদিন জয়া নিজের আত্মসম্মান ভুলে বার বার রাশেদ খানের পায়ে ধরে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো, ‘ তুমি দয় করে আমাকে বিশ্বাস করো। আমি এমন কাজ করি নি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। ‘

‘ জয়া প্লিয! তোমার মতো মেয়ের মুখে ভালোবাসি কথাটি মানায় না। কীভাবে আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি? তোমার জায়গায় অন্য কেউ মেয়ে হলে, এতোদিনে গলায় দ/রি দিতো। ‘

বলেই নিজের পা সরিয়ে চলে যায় রাশেদ খান। জয়া সেদিন বিড়বিড়িয়ে বলেছিলো, ‘ একদিন তুমি খুব আফসোস করবে রাশেদ! একরাশ আফসোা নিয়ে তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। ‘

জয়া সেদিন নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো, ছোট্ট ফারিশ তখন সারারাত তার মায়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, ” মা, ও মা! তুমি আমাকে কোলে নিবে না? দরজা খুলো, আমি তোমার কাছে ঘুমাবো। আমার তো তোমাকে ছাড়া ঘুম আসে না। ‘

সেদিন জয়া দরজা খুলেনি। সারারাত ছোট্ট ফারিশ তার মায়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সকালে দরজা ভেঙ্গে সকলে তার মায়ের ঝুলন্ত মরদেহ বের করে। ছেট্ট ফারিশ বড় বড় নয়নে তার মায়ের ঝুলন্ত মরদেহ এর দিকে তাঁকিয়ে থাকে।

চলবে….

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ৪১
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশের মুখ থেকে তার অতীতের ভয়াবহ বর্ননা শুনে, অনন্যার আখিজোড়া থেকে টুপটুপ করে জল গড়িয়ে পরে। ততক্ষনে সেখানে অভি এসেও উপস্হিত হয়েছে। জুঁই উপরে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিলো। পরিবেশ থমথমে! ইশিকা খান বারবার ঘামছে। অনন্যার ভাবতেও অবাক লাগছে, তার বাবা এমন জঘন্যকাজটি করেছে তবুও সে বাবার দিকে এগিয়ে, বাবার কাছে হাটু গেড়ে বসে বলে, ‘ বাবা তুমি কী সত্যিই এই কাজটি করেছো?’
লতিফ হাওলাদার কোনপ্রকার জবাব না দিয়ে, মাথা নিচু করে বসে থাকেন। তার আখিজোড়াতেও জল। অনন্যা তার উত্তর পেয়ে গেছে। সে শব্দ করে কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে, ‘ বাবা তুমি! তুমি এই জঘন্য কাজটি করতে পারলে? তোমার জন্যে বাবা! তোমার জন্যে, একজন নির্দোশ মহিলার সংসার ভেঙ্গেছে, একজন ছোট্ট বাচ্চা তার মাকে হারিয়েছে বাবা! তুমি কী করে পারলে! প্রতিশোধপরানতা তোমাকে এইভাবে ধ্বংশের দিকে ধাবিত করলো?’

এতোকিছুর মাঝে ইশিকা খান হঠাৎ চেচিয়ে বলে, ‘ সব মিথ্যে! এই ছেলে তার চরিত্রহীনা মায়ের চরিত্র ঢাকতে, এতোবছর পরে, সব মিথ্যে নাটক সাঁজিয়ে প্রেশেন্ট করছেন। ‘

ফারিশ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘ আমি মিথ্যে বলছি না তা আপনি ভালো করেই জানেন। তাছাড়া আমি তখন সব ছোট এবং মা মারা যাওয়ার আগে আপনার এবং লতিফ হাওলাদারের সমস্ত কৃর্তী তার ডাইরিতে লিখে গিয়েছিলেন তা থেকেই আমি জানতে পেরেছি। একজন মৃত্যু মানুষ কখনো ম/রার আগে মিথ্যে কিছু লিখে যায় না মিসেস ইশিকা এবং সবথেকে বড় প্রমাণ আজ লতিফ হাওলাদার নিজে!’

রুমা খান মাথা ঘুড়ানোর অবস্হা তিনি নিজেকে কোনপ্রকার সামলে বললেন, ‘ ইশিকা! তুমি রাশেদকে বিয়ে করার জন্যে, এতোকিছু করলে? আমার ফারিশ আজ তার মাকে পায়নি, বাবাকে পেয়েও পায়নি, সব তোমার জন্যে। ডাইনি, রাক্ষসি একটা! রাশেদ- জয়ার সংসার খেয়ে এইভাবে খেয়ে ফেললে তুমি!’

ইশিকা খান রাশেদের হাত ধরে আকুতির সুরে বললেন, ‘ দেখো না! সবাই কি বলছে! তোমার ছেলে আমাকে ফাঁসাতে এইসব করছে। সবাই আমাকে ভুল বুঝলেও, তুমি তো জানো আমি এমন না। ‘

রাশেদ খান একপ্রকার ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু সবকিছু শুনে তিনি ইশিকা খানের গালে থা/প্পড় মা/রেন। ইশিকা খান রাশেদের এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে পরেন। রাশেদ খান বললেন,
‘ না না! ভেবো না সেদিনের কান্ডের জন্যে আজ তোমায় মা/রলাম। তোমার মে/রেছি, শুধুমাত্র আজকে এতোকিছুর পরেও এতোগুলো মিথ্যে বলার জন্যে। অন্যায় করেছো কিন্তু তা অন্তত স্বীকার করো। তোমার থেকে সবথেকে বড় পাপি আমি! আমার জয়া আমাকে কতকরে বুঝিয়েছে, সেদিন যদি একটু ওকে বুঝতাম। তোমরা তো বাইরের মানুষ, তোমাদের আচরণে এতোটা কষ্ট আমার জয়া পায়নি যতটা পেয়েছে আমার অপমানে, আমার অসম্মানে, আমার অবিশ্বাসে। শুধুমাত্র আমার জন্যেই আমার ছোট্ট ছেলেটা তার মাকে হারিয়েছে, আমি হারিয়েছি আমার জয়াকে। ‘

ফারিশের আখিজোড়াতেও জল। রুমা খান এগিয়ে এসে বললেন, ‘ তুই আমার ছেলে, তবুও তোকে বলছি রাশেদ। মানুষ সবথেকে বড় দোষ হলো, তারা অপাত্রে ভালোবাসা দান করতে পারে। জয়া মেয়েটা অপ্রাত্রে ভালোবাসা ঢেলেছিলো, তার শাস্তিস্বরুপ বিনাদোষে তাকে মর/তে হয়েছিলো। তোকে ভালোবেসে ঘর বাঁধাই তার সবথেকে বড় ভুল ছিলো। ‘

অনন্যা ফারিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ আমার বাবার জন্যে, আপনার মা/কে মরতে হয়েছে, তাই আপনি এতোদিন সেই প্রতিশোধ নিতে, আমাকে আপনার কাছে বন্দী রেখেছিলেন?’

ফারিশ তার আখির জলটুকু মুছে বলে, ‘ জ্বী হ্যা! আজ থেকে কয়েকবছর আগে, আমার মা যেই পরিস্হিতি থেকে গিয়েছিলো, সেই একি পরিস্হিতিতে আমি আপনাকে ভরা বিয়ের আসরে দাঁড় করিয়েছিলাম এবং সেদিন অভি সাহেব ও আমার বাবার মতো আপনাকে সকলের সামনে অপমান করে বসে! আপনাকে অবিশ্বাস করে। ‘

ফারিশের কথা শুনে অনুতপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অভি। কি করতে যাচ্ছিলো সে? হ্যা সে ও তো রাশেদ খানের মতো সমান দোষী। ফারিশ আবারোও বলে,

‘আমি ভেবেছিলাম সেই লজ্জায়, অপমানে আপনিও হয়তো সুইসাইড করবেন এবং লতিফ খান বুঝবে আপন মানুষকে হারানোর সেই কঠিনতম অনুভুতি। যা আমি পাঁচ বছর বয়সে উপলব্দি করেছিলাম। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে, আপনি নিজের মনোবলের জোড়ে, টিকে ছিলেন শেষ অবদি। ‘

‘ আমি তো আপনার বাড়িতে ছিলাম, তবে আমাকে আপনার বাড়িতে এনেও অনেক ক্ষতি করার সুযোগ ছিলো আপনার, তখন কেন ক্ষতি করে নিজের প্রতিশোধ নেন নি আপনি মি: ফারিশ খান?’

ফারিশ অনন্যার এমন কথা শুনে, মুখ ঘুড়িয়ে বলে,

‘ কারণ দিনশেষে আমি লতিফ হাওলাদার কিংবা ইশিকা খানের মতো অমা*নুষ নই। আমি মানুষ। সেই মনষ্যত্বের খাতিরেই, আজকে আপনাকে আমি সকলের সামনে নির্দোশ করে, মুক্ত করে দিচ্ছি। ‘

অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলে,’ সবকিছুই কি আপনার মনষ্যত্ব ছিলো মি: ফারিশ খান? এতো উদার মনের মানুষও বুঝি হয়? ‘

অন্যদিকে,রাশেদ খান এতোকিছুর মধ্যে চেচিয়ে বলে,

‘ আমি আমার অন্যায়ের শাস্তি আমি নিজেকে দিবো, আমি অনেক অনেক দূরে চলে যাবো, যেখানে আমি কেউ পাবে কিন্তু তার আগে ইশিকা আমি তোমায় ডিভোর্স দিবো এমন কোর্টে এমন ব্যাবস্হা করবো যাতে তোমার জেল হয় আমি কিন্তু তোমাকে কিছুতেই ছাড়বো না। ‘

‘ ডিভোর্স দিবো মানে? রাশেদ তুমি কি বলছো এইসব?’

ফারিশ হঠাৎ বলে উঠে, ‘ আপনাকে এতো কষ্ট না করলেও হবে মি: রাশেদ খান। অনেক উপকার করেছেন আপনি। আমি আমার উকিল কে দিয়ে, আমার মায়ের সেই সুইসাইড কেইস পুনরায় ফাইল করিয়েছি এবং লতিফ হাওলাদারের স্বাকীরক্তিকে, পুলিশ লতিফ হাওলাদারকে এবং ইশিকা খানকে এরেস্ট করবে এবং মামলাটা কোর্টে তুলা হবে।’

ইশিকা খান দেখতে পায় সত্যিই পুলিশ চলে এসেছে

ইশিকা খান দ্রুত তার মেয়ে ইয়ানা এবং ছেলে ইয়াশের কাছে গিয়ে বলে, ‘ তোরা দেখছিস? তোর বাবা নাকি আমাকে ডিভোর্স দিবে এবং পুলিশ নাকি আমাকে ধরেও নিয়ে যাবে। তোরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কেন কেউ কিছু বলছিস না?’

ইয়ানা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ এতোকিছুর পরেও কীভাবে বুক ফুলিয়ে আছো মা? ভাইয়ার মন সত্যিই উদার। আমি ভাইয়ার জায়গায় হলে, নিজের হাতে নিজের মায়ের খু*নিকে শেষ করে, প্রতিশোধ নিতাম। ‘

ইয়াশ তার হাত থেকে নিজের মায়ের হাত সরিয়ে বললো, ‘ জাস্ট শেইম অন ইউ মা! তোমাকে মা বলতেও আমার ঘৃণা লাগছে। ‘

ইরাশ কথাটি বলে উপরে চলে যায়। পুলিশ এসে ইশিকা খানকে নিয়ে যায় এবং লতিফ হাওলাদারকে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে, লতিফ হাওলাদার ফারিশ এবং অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ জানি, আমি ক্ষমার যোগ্য নই। তবুও বলছি,বাবা পারলে আমাকে ক্ষমা করো, মারে, তোর পাপি বাপটারে মাফ করে দিস। ‘

অনন্যা ঘৃণায় মুখ ঘুড়িয়ে ফেলে। শেফা বেগম আচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকেন। পুলিশ তাদের নিয়ে চলে যায়। রাশেদ খান তার গভীর অনুতাপে কাঁদতে কাঁদতে একপ্রকার ভেঙ্গে পরেন, খালেদ খান এসে তাকে কোনরকমে ধরে ফেলেন। সবকিছুর মাঝেই, অভি এসে হঠাৎ অনন্যার হাত ধরে বলে,

‘অনন্যা আমি জানি, মি: রাশেদ খানের মতো আমিও সমান দোষী কিন্তু অনেক তো হয়েছে! আমি প্রতিপদে পদে নিজের অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছি অনন্যা। এইবার অন্তত আমার সাথে ফিরে চলো! আমরা দুজন এইবার বিয়ে করে, এইবার একসাথে সংসার শুরু করবো।’

অভির কথা শুনে অনন্যা ফারিশের দিকে তাঁকায়। ফারিশের বুকটা কষ্টে জ্ব/লে যাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। অনন্যা ফারিশের সামনে আসতেই, ফারিশ নিজে থেকেই থমথমে গলায় বলে,

‘ মিস অনন্যা অন্যের দোষের জন্যে, আমি আপনাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি, আমি অনেক খারাপ মানুষ আপনার কাছে কিন্তু এই খারাপ মানুষটাই বলছে আপনি অভি সাহেবের সাথে সুখে সংসার করুন। আজ থেকে আপনি মুক্ত! উনি যা শিক্ষে পেয়েছেন, তাতে মনে হয়না উনি কখনো সেই ভুল দ্বিতীয়বার করবেন।’

‘ মুক্তি দিয়ে দেওয়া বুঝি এতোটাই সহজ ফারিশ খান?’

‘ যে মুক্ত হতে চায়, তাকে মুক্তি করা দেওয়াই ভালো!’

‘ মিষ্টির কি হবে? ‘

‘ ওকে আমি সামলে রাখবো, আপনি নিশ্চিন্তে যান। ‘

‘ আপনি কি কাঁদছেন মি: ফারিশ খান?’

‘ উহু! আমি কাঁদবো কেন? আপনিও কিন্তু আমাকে কম জ্বালাননি মিস অনন্যা! প্রচুর বকবক করে মাথা খেয়েছেন। ইউ নো, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। হা হা।’ বলেই হুট করে হেসে আবারোও চুপ হয়ে যায়।

অনন্যা শুকনো হেসে, ছলছল নয়নে ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে, কী ভেবে যেনো অভির কাছে গিয়ে বলে, ‘ অভি আমি তোমার গাড়িতে গিয়ে বসছি। তুমি কষ্ট করে মাকে নিয়ে এসো। ‘

বলেই অনন্যা ফারিশের দিকে না তাঁকিয়েই, চলে গেলো। অপরদিকে, ফারিশও তীব্র নি:শ্বাস ফেলে উপরে চলে গেলো। রুমা খান নিজের নাতির দিকে তাঁকিয়ে বুঝতে পারছেন, আজ তার ফারিশ ভালো নেই! ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা তবুও সে তার ভালোবাসাকে আজ মুক্ত করে দিয়েছে।

চলবে।।

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৩৮+৩৯

0

#প্রণয়ের_রংধনু ❤️‍
#পর্ব-৩৮
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
অনন্যার মুখে’ মুক্তি দিয়ে দিন ‘কথাটি শুনে খানিক্ষনের জন্যে স্তব্ধ হয়ে পরে ফারিশ, মুখস্রী তার ফ্যাকাশে, বুকে অসনীয় ব্যাথা,হয়তো কোন এক প্রিয় মানুষকে হারানোর তীব্র কষ্ট কিন্তু কেন এই কষ্ট হচ্ছে তা কী আদোও বুঝতে পারছে ফারিশ? ফারিশের ভাবনার মাঝেই, অনন্যা নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ব্যার্থ হয়, ফারিশ তার হাত ছাড়ে না, আকড়ে ধরে শক্ত করে। অনন্যা প্রশ্ন করে, ‘ কী করছেন? আমার হাত ছাড়ুন।’

‘ মুক্তি না হয় দিয়ে দিবো কিন্তু আপাতত যতটুকু সময় রয়েছে সেইটুকু সময় আপনার হাত ধরতে দিন!’

ফারিশের এমন অদ্ভুদ কথা শুনে থেমে গেলো। ফারিশ আরো শক্ত করে অনন্যার হাত আকড়ে ধরলো, তাতে আখিজোড়া বুজে অনন্যা বড় বড় নি:শ্বাস ফেলতে লাগলো। ফারিশ নিচু গলায় শুধালো,

‘ নিজের প্রতিশোধপরানয়তা থেকে আপনাকে দিনের পর দিন আমি কষ্ট দিয়েছে, অপমান করেছি আপনার চরিত্রে কলঙ্কও লাগিয়েছে, অতীতের জন্যে আপনার বর্তমানকে আমি নষ্ট করেছি, যেখানে অতীতের সাথে আপনার কোন যোগসুত্রই নেই, তবে আমি জানি আপনি আমার বাড়িতে নিজেকে নির্দোশ প্রমাণ করে, চলে যেতে চেয়েছিলেন, আমি বাড়ির সকলের সামনে, এমনকি আপনার প্রেমিক অভি সাহেবরও সামনেও সবকিছু ক্লিয়ার করবো এমনকি অতীতের সমস্তকিছু প্রকাশ করবো,কেন আমি এমনটা করেছি। আপনার ইচ্ছের মর্যাদা আমি দিবো, মিস অনন্যা। আপনাকে আমি মুক্তি দিবো, তবে আপনাকে সম্পূর্নরুপে নির্দোশ প্রমাণ করে, যেন ভবিষ্যৎ এ কেউ আপনার গাঁয়ে চরিত্রহীনার অপবাদ দিতে না পারে।’

ফারিশ কথাটি বলেই, অনন্যার হাত ছেড়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো। ফারিশের কথা শুনে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না অনন্যা! আদোও ফারিশ তাকে মুক্তি দিবে তাও সম্পূর্ন নিদোর্শ প্রমাণ করে? তাহলে মানুষটা নিজের ভুল বুঝতে পারলো অবশেষে? এখন অনন্যা তবে অতীত ও জানতে পারবে, যার কারণে তাকে এতোদিন সেই মাশুল দিতে হয়েছে, কিন্তু এতোকিছুর পরেও অনন্যার মনে একটা ‘কিন্তু’ রয়েছে। তার কাঙ্খিত মুক্তির দিশা অবশেষে সে পাচ্ছে তবুও সে কে আজ খুশি হতে পারছে না? বুকটা শূন্য শূন্য করছে যেন অজানা এক কারণে। যেই কারণের খোঁজ অনন্যার নেই। অনন্যার অজান্তেই তার আখিজোড়া বেয়ে, দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পরে।

_______
ইরাশের থেকে খবর পেয়ে, রেশমি খান, ইশিকা খান, এনা, ইয়ানা, খালেদ খান এবং রাশেদ খান এসে হসপিটালে পৌঁছেছে। আরশকে আইসিউতে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্হা করুন, মাথার দিকে চ/ট টা বেশ গুরুতর। ডক্টর বলেছেন ২৪ ঘন্টা অবযার্ববেশনে রাখবেন। রেশমি খান মুখে আঁচল গুজে কেঁদে যাচ্ছেন অনাবরত এবং বারংবার হায়-হুতাশ করে বলছেন,

‘ ওই গু*ন্ডা ছেলেটা আমার ছেলেটাকে মে/রে ফেললো। এরপরেও ফারিশের কোন শাস্তি হবে না। আমার বুকটা খালি হয়ে গেলো রে! ওহ আল্লাহ! তুমি কী দেখো না কিছু?’

ইশিকা খান রেশমি খানের পাশে বসে , রাশেদ খানকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ দেখলে তোমার মা*স্তান ছেলের কান্ড! নিজের ভাইয়ের এমন অবস্হা করেছে, আজ তার ভাইয়ের জীবন-মরণ অবস্হা! তোমাকে আমি বলেছিলাম ওর ছোটবেলা থেকেই বোর্ডিং স্কলে পাঠিয়ে দাও, এই ছেলে ন*ষ্ট হয়ে গেছে, তুমি শুনলে না আমার কথা, আজ যদি শুনতে তাহলে এমন অবস্হা হতো?’

ইশিকা খানের কথা শুনে রাশেদ খান ফারিশকে ফোন করে। ফারিশ অনন্যার কেবিনে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো, ফোনের শব্দে তার হুশ ফিরে। সে দেখে রাশেদ খানের ফোন, সে ভেবেছিলো ধরবে না অত,:পর কী ভেবে যেন ফোনটা রিসিভ করে বললো,
‘ হ্যালো!’

‘ ফারিশ তোমার এতো সাহস হয় কী করে? আরশের এমন অবস্হা করার। ‘

‘ ভাগ্য ভালো আপনাদের কু*কুরটাকে একটুর জন্যে মে/রে ফেলেনি। ‘

ফারিশের এমন কঠোর উত্তরে রাশেদ খান ক্ষেপে গিয়ে বলে,
‘কী বললে? তুমি জানো আমি তোমার নামে কেইস করতে পারি? তোমাকে আমার ভাইয়ের ছেলেকে এটেমটু মার্ডার কেসের দায়ে হাজতে ভরে দিতে পারি?’

ফারিশ শব্দ করে হেসে ফেললো। ফারিশের হাসি শুনে রাশেদ খান বিরক্তি হয়ে বললেন, ‘ হাসছো কেন?’

‘ এতো বড় বিসনেজম্যান হয়েও এমন হাসির কথা বললে, হাসবো না? মি: রাশেদ খান আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন, আপনার ভাইয়ের ছেলে ঠিক কী কী করেছে মিস অনন্যার সাথে, কিডন্যাপ করে, তাকে ধ*ষনের মতো জঘন্য কাজের চেষ্টা। সাক্ষ্যি আছে, প্রমাণ আছে এইসব মামলা ঘুড়িয়ে দেওয়া আমার ওয়ান, টুর খেল, মি: রাশেদ খান, এইটুকু বুঝা উচিৎ! আনফরচুনেটলি আমি আপনার ছেলে, এইসব মামলা ঘুড়ানো কোন ব্যাপারই না আমার কাছে। আপনার কিছু গুন হলেও আমি পেয়েছি। ‘

ফারিশের এমন তাচ্ছিল্যে সহ্য করতে না পেরে ফোনটা কেটে দেন ফারিশ খান, অত:পরগম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলেন,’ আজ মনে হচ্ছে ছেলেটাকে আমি মানুষ করতে পারেনি, অ*মানুষ হয়েছে একটা।’খালেদ খান নির্বাক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন, মুখে নেই তার কোন কথা।

‘ কে মানুষ হয়েছে এবং কে অ*মানুষ হয়েছে, তা বিচার করার বোধবুদ্ধি যদি তোমার থাকতো রাশেদ, তাহলে আমার ফারিশ দাদুভাইয়ের জীবনটা আজ এতো তিক্তময় হতো না। ‘

কথাটি বলতে বলতে ইরাশের সাথে করিডোরে প্রবেশ করেন রুমা খান। রুমা খানকে দেখেই, রেশমি খান খালেদ খানের দিকে তাঁকিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘ দেখেছো? তোমার মা এতোকিছুর পরেও নিজের জা*নুয়ার নাতির সাফাই গাইছে, যেই ছেলেকে আমরা কোলে পিঠে করে মানুষ করলাম, সেই ছেলে আজ আমাদের ছেলের জীবন কে/ড়ে নিতে উঠে পরে লেগেছে।’

‘ ভুল বললে বউমা, আমার নাতিকে তোমরা মানুষ করো নি, তোমরা বিশেষ করে তুমি শুধুমাত্র স্বার্থ খুঁজেছো, আমার ছত্রছায়ায়, আমার নাতী একা একা আজ এতোদূর অবদি এসেছে! আর অন্যের ছেলেকে তুমি কী মানুষ করবে? যেখানে তোমার নিজের ছেলেই একজন চরিত্রহীন, বদমাইশ! সে তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। ‘

‘ মা, তুমি এইসব কি বলছো? ফারিশ যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। ‘

রাশেদ খানের কথায় রুমা খান ধমকে বললেন, ‘ চুপ করো! কী ভেবেছো আমি সব জানিনা? সব জানি আমি। ইরাশ আমাকে সব বলেছে, আজ আমার অনন্যা দিদিভাইয়ের একটুর জন্যে বড় কোন সর্বনাশ হয়নি, নাহলে কী হতো আজ?’

এনাও কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়, ‘ নিজের ভাই হলেও, আজ ভাইয়ের প্রতি একজন মেয়ে হিসাবে আমার ঘৃণা হচ্ছে মা, ভাইয়া তো কম মেয়ের সর্বনাশ করেনি অথচ আমার ফ্যামেলি হয়ে কী করেছি? আজ যদি তুমি বা বাবা ভাইয়াকে শাসন করতে, তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। ফারিশ ভাই একদম ঠিক করেছে। আরশ ভাইয়াকে তার যোগ্য শাস্তি দিয়েছে। ‘

বলেই আরকদফা কেঁদে ফেলে এনা। এনার কথা শুনে রেশমি খান চুপ হয়ে যান। ইরাশের পাশে শফিক ছিলো, এনার কান্না কেন যেনো তার ভালো লাগছে না। বারংবার বলতে ইচ্ছে করছে,’ ম্যাডাম আপনি একজন রাজকুমারী। ওইযে ছোটবেলার ঠাকুমার ঝুলির সেই রাজকুমারী, কত মায়াবী! রাজকুমারীদের কাঁদলে মানায় না, আপনাকে হাসলেই ভালো লাগে। আমি তো আপনার রাজ্যের সামান্য এক সেনা মাত্র, তবুও আপনার কান্না সহ্য হয় না, বড্ড পিড়ন দেয় আপনার কান্না। ‘

এনা বাইরের দিকে চলে গেলো। শফিকও কি ভেবে যেন এনার পিছনে পিছনে গেলো। অত:পর দৌড়ে এনার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে, তাতে ঝাড় দিতে দিতে বললো, ‘ ম্যাডাম এই নিন, একদম পরিষ্কার রুমাল, আজ সকালে ৮০ টাকা দিয়ে কিনেছে। একদম ঝকঝকে আপনি আপনার চোখের জলটা মুছতে পারেন। ‘

এনা কোনপ্রকার অবাক হলো না বরং রুমাল টা হাতে নিয়ে চোখ মুছে, শফিককে ফেরত দিয়ে, আবারোও করিডোরের দিকে পা বাড়ালো।

_______
অপরদিকে, জুঁইয়ের ঠিক সামনাসামনি বসে আছে অভি পায়ের উপর পা তুলে। জুঁই বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ তুমি আসলে কী চাইছো আমাকে বলবে অভি?’

‘ ফারিশ খান সম্পূর্ন এক মিথ্যে নাটক সাঁজিয়েছে অনন্যার বিরুদ্ধে, তার প্রমাণ করে দিবে, তুমি। কেইস আবারো সাঁজাবো।’

জুঁই অবাক হয়ে বলে, ‘ আর ইউ ম্যাড? আমি আমার ভালোবাসার মানুষের বিরুদ্ধে প্রমাণ দিবো? কখনোই না।’

‘ তুমি তা করতে বাধ্য জুঁই, নাহলে আমার কাছে যেই ভিডিও টা আছে, সেই ভিডিওটা যদি একবার ফারিশের হাতে পরে এবং সে যদি জানতে পারে, সমস্ত প্ল্যান তোমার, তাহলে বুঝতেই পারছো কী হবে! ‘

জুঁই মাথা নিচু করে ফেলে তার হাত-পা কাঁপছে। অভি বাঁকা হেসে বেড়িয়ে যায়।

অপরদিকে,

অনন্যাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে ফারিশ। গাড়ি ড্রাইভ করছে সে নিরবে। অনন্যা হঠাৎ প্রশ্ন করে,

‘ আপনার হঠাৎ এমন পরিবর্তন?’

‘ মানে?’

‘ এইযে, আমাকে মুক্তি দিয়ে দিচ্ছেন। ‘

ফারিশ আনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে, ‘ আপনাকে আকড়ে ধরার সাধ্য যে নেই মিস অনন্যা। ‘

চলবে।

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ৩৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশের কাঁধে অনন্যার মাথা ঠেকতেই, ফারিশ এক মুহুর্তের জন্যে শিউরে উঠে। গাড়ির মিররে দেখতে পায় অনন্যা ঘুমিয়ে পরেছে, এমনিতেই সারাদিন যথেষ্ট ধকল গিয়েছে মেয়েটার শরীরের উপর দিয়ে, তার মধ্যে আবার লং জার্নি, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। ফারিশ এক হাত দিয়ে ড্রাইভ করছে এবং অপর হাত দিয়ে পরম যত্নে অনন্যার চুলগুলো কপাল থেকে যত্নের সাথে সরিয়ে দিলো। অত:পর কি ভেবে যেন গাড়ি থামিয়ে, মুগ্ধ নয়নে অনন্যার ক্লান্তিমাখা মুখস্রীর দিকে তাঁকিয়ে ক্ষীন্ন হেসে প্রশ্ন করলো, ‘ মিস অনন্যা! আপনি যখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন তখন সবথেকে বেশি কি মিস করবো জানেন?উহু,আমি বলছি, ঘুমন্ত অবস্হায় থাকা আপনার অপূর্ব মুখস্রীখানা। আচ্ছা আমি তো অনেক অন্যায় করেছি বুঝলাম কিন্তু যখন মাঝে মাঝে আপনার ঘুমন্ত মুখখানা একটু দেখতে ইচ্ছে করবে, তখন আমি আপনার জানালা টপকে আপনাকে বারান্দা থেকে জাস্ট একটু দেখে আসবো। অনুমতি দিবেন আমায়? অনুমতি না দিলেও আমি চলে যাবো, মিস অনন্যা। ফারিশ খানের এই অধিকারটুকু আপনি কেড়ে নিতে পারেন না। ‘

ফারিশ অনুভব করছে তার বুকখানা জ্বলে যাচ্ছে। ঠোটে অজস্র কাঁপুনি, হয়তো অনেক কথা জমে আছে তার বুকে কিন্তু তা প্রকাশ করার সময় বা অধিকার কোন কিছুই তার নেই। ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অনন্যার মাথা হাত বুলাতে থাকে, অনন্যা ঘুমের মাঝেই, ফারিশের বাহু চেপে ধরে ঘুমাতে থাকে, ফারিশ আরেকবার হেসে, গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়।

____
অপরদিকে, জুঁইয়ের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে অভি। জুঁই একপ্রকার বাধয় হয়েই বলেছে সে থানায় গিয়ে স্বাকারত্বি দিবে পুলিশের কাছে কিন্তু তবুও অভির মনে হচ্ছে জুঁই কোনপ্রকার গন্ডগোল করার প্রয়াস করতে পারে হয়তো অনন্যার কোন বড়সড় ক্ষতিও করতে পারে, অভি ভেবেছে যদি জুঁই কোনপ্রকার চালাকি করার চেষ্টা করে তাহলে সে ফারিশকে সব বলে দিবে, অভির কানে খবর এসেছে আরশকে কীভাবে মে/রে হসপিটালে পাঠিয়েছে ফারিশ, কিন্তু অনন্যার জন্যে সে নিজের ভাইয়ের এমন অবস্হা করলো কেন? অভির মনে বড় এক খটকা লাগছে, অনন্যা কি তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ফারিশের জন্যে। অভি কী মনে করে যেনো সেই হাসপাতালে ফোন দিয়ে খবর নিলো, সেখান থেকে জানানো হলো, ‘ মিস অনন্যার জ্ঞান ফিরার পর পরেই, মি: ফারিশ খান তাকে তার সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছেন। ‘
কথাটি শুনে অভি তার ফোনটা কেটে দিলো। তার মাথা কেন যেন কাজ করছে না, ফারিশ কি শুধু তার দায়িত্ব থেকেই এতোটা করছে নাকি এর পিছনে অন্য কারণ আছে? অভি কি ভেবে যেনো ভাবলো একবার আরশ যেখানে আছে, সেখানে যাবে। যে তার ভালোবাসার মানুষের দিকে হাত বাড়িয়েছে তার পরিনতি না দেখা অবদি তার শান্তি হবেনা। অভি হসপিটালের দিকে রওনা দিলো।

অপরদিকে, আরশের অবস্হার কথা জানতে পেরে জুঁই হসপিটালে এসে রেশমি খানের হাত ধরে বলে, ‘ ফারিশ আমার ভাইয়ের এমন অবস্হা করলো! অথচ তোমরা তাকে কিচ্ছুটি বলছো না খালা? ফারিশ কিন্তু কাজটি একদমই ঠিক করেনি।’

রেশমি খান মাথা উচু করে, কান্নামাখা গলায় বললো,

‘ যেখানে আমার ছেলের দোষ, সেখানে আমরা কী করতে পারি বল? এমন একটা কাজ করার চিন্তা ও পেলো কীভাবে? আজ যদি আমরা ফারিশের নামে কেইস ফাইল করতে যাই, সবার আগে আমার ছেলেটাই ফাঁসবে, তখন আমার অসুস্হ ছেলেটাকে নিয়ে টানাটানি। ‘

পুলিশের কথা শুনে জুঁইয়ের গলা শুকিয়ে আসে, সে ধরা গলায় বলে, ‘ এখানে ফারিশের দোষ কী? ফারিশকে সেই প্রথম দিন থেকে উষ্কাচ্ছে ওই অনন্যা, তা শারীরিক ভাবে হোক বা যেই ভাবেই হোক। আজ নিজের ভাইয়ের এমন অবস্হা কী ফারিশ নিজে নিজে করেছে কাকি? আজ আমার ভাই আরশের এমন অবস্হার জন্যে শুধুমাত্র ওই অনন্যা দায়ী। ‘

রেশমি খান জুঁইয়ের কথা শুনে আরেকদফা কেঁদে কেঁদে আরশের কেবিনের সামনে চলে যায়। অন্যদিকে, অভি আরশের খবর নিয়ে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু জুঁইয়ের কথা তার কানে আসতেই, সে তড়িৎ গতিতে ফিরে এসে, জুঁইয়ের হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। অভিকে এমন সময় দেখে ভয়ে শিউরে উঠে জুঁই,হয়তো এমন সময়ে সে অভিকে আশা করেনি। অভি জুঁইকে হেচকা টান দিয়ে উঠিয়ে, চেচিয়ে বলতে থাকে,

‘ কোন লজ্জা আছে তোমার? এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়েও আবারো তুমি অনন্যার নামে বিষ ঢালছো? মাইন্ড ইট জুঁই, তুমি জানো না ভিডিও টা কিন্তু আমার কাছে আছে। আমি কিন্তু চাইলেই ফারিশ খানের কাছে এখুনি তা পৌঁছে দিতে পারি। ‘

‘ আসলে….অভি!

তাদের কথার মাঝেই, ইয়ানা হঠাৎ এসে বলে, ‘ জুঁই আপু তুমি? কখন এলে? আর তোমার সাথে উনিই বা কে? ‘

ইয়ানার সাথে এনাও ছিলো, সে ইয়ানার কানে ফিসফিস করে বললো, ‘ আসলে উনিই সেই যার সাথে অনন্যা আপুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো এবং উনাদের বিয়ের দিনই ফারিশ ভাইয়া ওই কান্ডটা করে। ‘

‘ ওহ ‘ বলে অভির দিকে তাঁকায় ইয়ানা বড় বড় চোখ করে। সাদা ফরমাল শার্টে উঁচু লম্বা এক যুবক! মুখস্রী বেশ গম্ভীর! মুখে কোন দাড়ি নেই তবে ইয়ানার মতে লোকটার মুখে দাড়ি মানাবে না এমনিতেই ভালো লাগছে। জুঁই তাদের দেখে দ্রুত অভির থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে বললো, ‘ আমাকে খালা ওইদিকে ডাকছে, আমি বরং একটু যাই। ‘

বলেই জুঁই দৌড়ে চলে গেলো। অভি রাগান্বিত হয়ে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অভিকে দাঁড়াতে দেখে এনা এগিয়ে এসে বললো, ‘ আরে অভি ভাইয়া, আপনি কখন এলেন? ‘

‘ মাত্র এসেছি, আসলে যে আমার অনন্যার সাথে এতো বড় অন্যায় করতে গিয়েছিলো তার ঠিকমতো শাস্তি হয়েছে কিনা, সেইটাই দেখতে এসেছিলাম, তুমি কিন্তু ভেবে না তোমার অমানুষ ভাইয়ের খবরাখবর নিতে এসেছি। আমার ভালোবাসার মানুষের যে ক্ষতি করতে আসবে, তাকে আমি কখনোই ক্ষমা করবো না।’

অভির কথা শুনে এনা মাথা নিচু করে ফেলে, তা দেখে ইয়ানা প্রশ্ন করে, ‘ আপনার ভালোবাসা মানে?’

‘ হ্যা, অনন্যা আমার ভালোবাসা, আমার প্রেমিকা। আই লাভ হার।’

‘ তো আপনার অনন্যা যখন বিপদে পরেছিলো তখন কোথায় ছিলো আপনার ভালোবাসা, তখন কিন্তু আমার ভাইয়াই সবার আগে ছুটে গিয়েছিলো। ‘

‘ আমি কখন কী করেছি তার কৈফিয়ত আমি আপনাকে দিবো কেন মিস আহ কি নামে যেনো?’

‘ আমার নাম ইয়ানা খান। ‘

‘ ওই যাই হোক, মিস ইয়ানা খান, আপনি কী কোন ভাবে আমার সাথে আপনার ভাইয়ার কম্পেয়ার করছেন?’

ইয়ানা হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু এনার তার হাত চেপে তাকে চুপ করিয়ে দেয়। ইয়ানাও দমে যায়। অভি আর কোনপ্রকার কথা না বলে গটগট করে বেড়িয়ে যায়।

অপরদিকে,

অনন্যাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতেই, মিষ্টি ছুটে এসে ঝাপ্টে ধরে অনন্যাকে। অত:পর কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ মা, তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? তুমি জানো না? মিষ্টি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।’

অনন্যার মিষ্টির কপালে অজস্র চুমু খেয়ে বলে, ‘ আমি কোথাও যাইনি মাম্মা। আমাকে তো দুষ্টু লোক ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।’

মিষ্টি ফারিশের দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ আমি জানি, তোমাকে পঁচা লোকেরা ধরে নিয়েগিয়েছিলো এবং ড্যাড তাদের সাথে ফাইট করে, মিষ্টির মাকে আবারোও মিষ্টির কাছে ফিরিয়ে এনেছে, আই লাভ ইউ ড্যাডি। ‘

মিষ্টির কথা শুনে, ফারিশ অনন্যার কোল থেকে মিষ্টিকে নিয়ে, কপালে চুমু খেয়ে বুকে টেনে নেয়। অপরদিকে রুমা খানও অনন্যাকে দেখে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে বলে,

‘ ক্ষমা করিস রে বোন! কম অন্যায় হয়নি তোর সাথে, পারলে বুড়িটাকে ক্ষমা করে দিস। ‘

‘ ছিহ! দাদি, তুমি অন্তত এইসব বলিও না। ‘

তাদের কথার মাঝেই, ফারিশ হঠাৎ বলে, ‘ দাদি তুমি সবাইকে ডেকে পাঠাও, আমার সকলের সাথে অনেক জরুরী কথা আছে। এমনকি আমি অভি, অনন্যার বাড়ির লোকেদেরও খবর পাঠিয়েছি। তারাও চলে আসবে। ‘

ফারিশের কথা শুনে অনন্যা ভাবতে থাকে তবে কি এইবার সত্যি ফারিশ তার কথা রাখবে?

চলবে….

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৩৬+৩৭

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব- ৩৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরশ অনন্যার শরীরের দিকে কুৎসিত নজরে তাঁকিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠছে। অপরদিকে অনন্যা ভয়ে শিউরে গিয়ে বারংবার আল্লাহর নাম জপ করছে! এমন মুহুর্তে তাকে ভেঙ্গে পরলে চলবে না তাকে শক্ত থাকতে হবে। যেই মিথ্যে কলঙ্ক তার গাঁয়ে লেপ্টে আছে, তাকে সত্যিতে পরিণত হতে দিলে চলবে না। আরশ অনন্যার কাছে গিয়ে, অনন্যাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে, পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। অত:পর তার মুখটি অনন্যার দিকে এগিয়ে দিতেই, অনন্যা নিজের সর্বশক্তি ব্যাবহার করে , দ্রুত পা দিয়ে আরশের বুকে লাত্থি মারে, যার ফলে একটুর জন্যে ব্যাথায় কুকড়ে উঠে, আরশ অকথ্য ভাষায় চেঁচিয়ে উঠে, ‘ শা’লির তেজ এখনো যায়নি! আজকে তোকে পা’ড়ার মেয়ে বানিয়ে ছাড়বো! ব্লাডি গার্ল!’
কথাগুলো বলে আরশ আবারো এগিয়ে যেতে নিলে, অনন্যা সেসব কথাকে পরোয়া না করে, বাঁধা হাত দিয়েই, কোনরকমে বিছানার পাশে থাকা কাচের ছোট্ট ফুলের টবটি কোনরকমে আকড়ে ধরে, তা সোজা ছুড়ে মা/রে আরশের কপালে! আরশের কপাল বেয়ে রক্ত গড়াতে থাকে। তার দৃষ্টি হয়ে যায় অস্পষ্ট! সে ‘মাগো’ বলে ব্যাথায় কুকড়ে উঠে! সে সুযোগে বিছানা থেকে দ্রুত উঠে যায় অনন্যা, কিন্তু দরজার সামনে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পরে,কারণ আরশ তার ওড়না আকড়ে ধরেছে পিছন থেকে।

______________
অপরদিকে, ফারিশ এবং ইরাশ বাড়ি ফিরতেই, দেখলো ইশিকা খান এবং রেশমি খান বসে ছিলো ড্রাইনিং টেবিলে। রুমা খানের সাথে সোফায় বসে অনবরত কান্না করে যাচ্ছে মিষ্টি। মিষ্টিকে কাঁদতে দেখে ফারিশ এবং ইরাশ দ্রুত মিষ্টির কাছে এগিয়ে যায়। ফারিশ মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বলে, ‘ কি হয়েছে আমার মিষ্টি মায়ের? সে কাঁদছে কেন?’
ইরাশ রুমা খানকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ কি হলো দাদি? মিষ্টি কান্না করছে কেন এবং আমাদেরও বা কেন তুমি হঠাৎ ডেকে পাঠালে। ‘

র‍ুমা খান চিন্তুিত ভঙ্গিতে বলে, ‘আসলে….’

রুমা খানের কথার মাঝেই, রেশমি খান উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ মা আবার কী বলবে? তোমার সেই গুনধর সার্ভেন্ট! আজ সকালে, পালিয়ে গেছে। মেয়েটার যা চরিত্র! আগে থেকেই বলেছিলাম এই মেয়ে সুবিধার নয়! আজকে সুযোগ পেয়েছো, দেখো গে তার প্রেমিকের সাথে ভেগে গেছে! হু! ‘

রেশমি খানের কথা শুনে ফারিশ বলে উঠে, ‘ ওয়াট! পালিয়েছে মানে?’

ফারিশের বুকে লেপ্টে থাকা মিষ্টি দ্রুত প্রতিবাদ করে বলে, ‘ বাপি, বাপি! তুমি পঁচা রেশমি দাদির কথা শুনো না। আমার মা পালিয়ে যায়নি বরং আমার মাকে কেউ জোড় করে নিয়ে গেছে। ‘

ইশিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘ হ্যা, ওই মেয়ে তো কুচি খুকি, ছেলেধরা এসে ধরে নিয়ে যাবে। খুব তো আরশের চরিত্র নিয়ে কথা তুলেছিলো ফারিশ! তা ওই মেয়ে এখন কই? নির্ঘাত পালিয়েছে কোন নতুন আশিক ধরে….’

ইশিকা খানের কথা শুনে ফারিশ চেঁচিয়ে বলে, ‘ জাস্ট স্টপ! আমি অন্তত আপনার কাছে মিস অনন্যার চরিত্রে সার্টিফিকেট চাইবো না। উনি যাই হোন, পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে উনি নন। মিস অনন্যা একজন লড়াকু নারী। যুদ্ধের ময়দানে উনি যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে পালাবেন না। উনি নিজেকে এই বাড়িতে নির্দোশ প্রমাণ করতে এসেছেন আমি জানি, তা না করে উনি কিছুতেই পালাবার মেয়ে নন। ‘

রেশমি খান গলার স্বর উঁচু করে বলে, ‘ তাহলে তোমার সেই লড়াকু, মিস অনন্যা এখন কোথায় বাবা?’

ফারিশ চুপ হয়ে যেতেই, মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ বাপি আমি জানি, আমার মাকে কেউ ধরে নিয়ে গিয়েছে। ‘

ফারিশ দ্রুত মিষ্টির গালে হাত দিয়ে বলে, ‘ বলো মা! কে তোমার মাকে নিয়ে গেছে, তুমি কিছু জানো?’

মিষ্টি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে, ‘ মিষ্টির মা তো, মিষ্টির সামনেই বারান্দা দিয়ে হাঁটছিলো তখন এক কালো পোষাক পরা বডিগার্ড আংকেল এসে, মাকে ডেকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। তারপর থেকেই মিষ্টির মাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘

মিষ্টির কথা শুনে, ফারিশ মিষ্টিকে নামিয়ে দিয়ে হাক ছেড়ে ডাকতে থাকে, ‘গার্ডস, গার্ডস! এখুনি সবাই আমার সামনে এসে হাজির হন। ‘

ফারিশের বাড়ির দাঁড়োয়ান এবং দেহরক্ষীদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফারিশ। ফারিশ শান্ত পানে দাঁড়োয়ানের দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ আপনি মিস অনন্যাকে কখন বের হতে দেখেছেন? ‘

‘ আসলে স্যার, তখন আমিও বাইরে ছিলাম। গ্রেরামে টাকা পাঠানোর জন্যে দোকানে গেছিলাম। ‘

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে ‘ ড্যাম ইট’ বলে চেচিয়ে উঠে প্রশ্ন করে,’ বাকিরা? আপনারা কোথায় ছিলেন? দিনের পর দিন বেতন দিয়ে কয়েকটা স্টুপিডদের বাড়ির সিকিউরিটির জন্যে রেখেছি আমি। ‘

সকলে মাথা নিচু করে ফেলে। ফারিশ কি মনে যেন, মিষ্টির দিকে পুনরায় ঝুঁকে বলে, ‘ আচ্ছা মা, তুমি বলেছিলে, গার্ডদের মধ্যে কেউ একজন তোমাদের মাকে নিয়ে গেছে, তুমি দেখো তো, এদের মধ্যে কেউ কিনা। ‘

ফারিশের কথা শুনে মিষ্টি সকল কালো পোষাক পরিহিত লোকদের পানে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে, যার অর্থ যে সেই ব্যাক্তিটি তাদের মধ্যে একজনও নয় তবে সে কে? ফারিশ হয়তো মিষ্টির চোখের ভাষা বুঝতে পারলো, সে দ্রুত উপরে গিয়ে নিজের ল্যাপটপ বের করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো, কিন্তু অদ্ভুদ ব্যাপার হচ্ছে সিসিটিভির সমস্ত ফুটেজ উধাও! ফারিশ বুঝতে পারছে কোন ভিতরের লোক এইসবের মধ্যে জড়িত, সে কোনপ্রকার ক্লু রাখতে চাইনা বলে, সিটিটিভির সমস্ত রেকর্ড বড্ড গোপনে সরিয়ে ফেলেছে কিন্তু পরোক্ষনেই কি ভেবে যেন বাঁকা হেসে ফেলে ফারিশ অত:পর গম্ভীর মুখে নিজের ড্রয়ার থেকে আরেকটি ছোট্ট ল্যাপটপ বের করে।

_______________

অন্যদিকে,

অনন্যার ওড়না আকড়ে ধরায়, অনন্যা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়! এইবার তার বাঁচার উপায় নেই কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে, আরশ তার ওড়না হঠাৎ ছেড়ে দেয়, মাথা আকড়ে ধরে, মাটিতে লুটিয়ে পরে। হয়তো আ/ঘাত লাগায় সে অজ্ঞান হয়ে পরেছে। মনে মনে মহান আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করে, দ্রুত নিজের বাঁধনও খুলে ফেলে রুম থেকে ছুটে বেড়িয়ে যায় অনন্যা। অনন্যা বেড়িয়ে দেখে জনমানবহীন নির্জন এক বাঙ্গলো তে তাকে আরশ নিয়ে এসেছিলো। দূরেও কোথাও মানুষের আনাগোনা নেই। অনন্যা বুঝতে পারছে সে শহর থেকে খানিকটা দূরে রয়েছে কিন্তু কোথায় আছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। অনন্যা দৌড়ে যায় কিন্তু আশে পাশে শেয়ালের ডাকে সে থমকে দাঁড়ায়! এ কোন জায়গায় চলে এলো সে? কীভাবে উদ্ধার করবে সে নিজেকে এইবার?

_____________
ফারিশের সামনে সেই কালো পোষাক পরিহিত গার্ডটি দাঁড়িয়ে আছে, যিনি অনন্যাকে মিথ্যে বলে বাইরে নিয়ে গিয়েছিলো। ফারিশের গোপন ক্যামেরাও চারদিকে ফিট করা ছিলো বিধায়, সেই ক্যামেরাতে লোকটি ধরা পরে এবং সে কোন ফারিশের গার্ড নয় বরং আরশের লোক, আপাতত লোকটার মুখ থেকেই এতোটুকুই জানা গেছে। লোকটাকে ফারিশের স্টোর রুমে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। লোকটা ভয়ে কাঁপছে কারণ ফারিশের হাতে মেশিং গান! ফারিশ সহ্য করতে পেরে, উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার বুক বরাবর লাথি মে/রে বলে, ‘ আরশ কোথায় নিয়ে গেছে মিসেস অনন্যাকে, এখুনি বলবি? নাকি কপালে পিস্তল ঠু/কে দিবো?’

লোকটা দ্রুত ভয় পেয়ে বলে, ‘ আমাকে কিছু করবেন না। আমি বলছি….. ‘

ফারিশ সব জেনে ইরাশকে নিয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। ফারিশের চিন্তা হচ্ছে ওই আরশ কু*ত্তাটা মিসেস অনন্যার কোন ক্ষতি করে ফেললো কিনা! সে বিড়বিড়িয়ে বলছে, ‘ মিস অনন্যা একটু অপেক্ষাকরুন। আমি আসছি। ‘

এদিকে,অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিকে। ভয়ে বারংবার শিউরে উঠছে অনন্যা। সে আরেকটু এগিয়ে যেতেই কেউ তার পিঠে হাত রাখে, তখনি সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে।

চলবে।।

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৩৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
পিছন থেকে কেউ অনন্যার কাঁধে হাত রাখতেই, অনন্যা ভয়ে শিউরে উঠে ভাবে হয়তো তার পিছনে পিছনে আরশও চলে এসেছে এবং সেই ভয়েই সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে তৎক্ষনাৎ, কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। একজন বয়স্ক মহিলা কাঠ জোগাড় করতে এসেছিলেন, তিনি অনন্যাট মতো যুবতীকে এমন জনশূন্য জায়গায় একা দেখে এগিয়ে এসে, তখনি অনন্যা অজ্ঞান হয়ে পরে। বয়স্ক মহিলাটি আশে- পাশে কাউকে না দেখে দিশাহারা হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারছে না মেয়েটা কে? কোথা থেকেই বা এসেছে। মহিলাটির ভাবনার মাঝেই তিনি লক্ষ্য করলেন কয়েকজন ছেলের দল একসাথে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। তিনি দ্রুত তাদের কাছে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে গেলেন, ছেলেগুলোও দ্রুত মহিলার কথা শুনে, অনন্যাকে নিয়ে পাশের সরকারী হসপিটালে নিয়ে গেলো।

অপরদিকে, ফারিশ তার গার্ডদের নিয়ে ইরাশের সাথে সেই পুরনো বাংলোর সামনে গাড়ি থামিয়ে, দ্রুত বেড়িয়ে এলো। আরশের ফোনের লোকেশন ট্রাক করে তারা এখানে আসতে পেরেছে। ফারিশ দ্রুত দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো। উপরের রুমে লাইট জ্বলতে দেখে ভয়ে বুক কেঁপে উঠে তার,তার মনে সংশয় হচ্ছে তার মিসেস অনন্যার কোন বড়সড় ক্ষতি করে ফেলেনি তো আরশ? ফারিশ দ্রুত রুমের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়! ইরাশ ও এসে পরে। আরশ তার মাথায় হাত দিয়ে কোনকরম উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। অনন্যাকে দেখতে না পেয়ে, ফারিশ দ্রুত এগিয়ে, আরশের কলার উচুঁ করে বলে,

‘ অ*মানুষ কোথাকার! তোর এতো সাহস হয়ে গেলো? মিস অনন্যার দিকে শেষ অবধি তুই হাত বাড়িয়েছিস? কোথায় মিস অনন্যা? কী করেছিস তুই? বল নাহলে আজকে আমি তোকে ছাড়বোই না। ‘

আরশের উত্তরের অপেক্ষা না করে, ক্রমাগত তাকে ঘু*ষি মার/তে থাকে। অপরদিকে ইরাশ বাড়ির চারিদিকে অনন্যাকে খুঁজছে। আরশ বারংবার বলার কিছু চেষ্টা করছে কিন্তু সে পারছে না। ফারিশ পাগলের মতো তাকে লাথি – ঘু*ষি অনাবরত মে/রেই যাচ্ছে। ফারিশ আরশের কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বলে, ‘ শেষবারের মতো বলছি আরশ! মিস অনন্যা কোথায়? উনার কোন ক্ষ/তি করেছিস তুই? কোথায় উনি?’

আরশ জোড়ে জোড়ে নি:শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,

‘ ভাই বিশ্বাস করো, আমি জানিনা ওই মেয়ে কোথায়! আস্ত চালাক একটা মেয়ে, আমাকে অবধি মাথায় আঘা*ত করে চলে গেছে। ‘

আরশের কথা বিশ্বাস হলো না ফারিশের বরং সে দ্বিগুন গতিতে রেগে গিয়ে হুংকা ছেড়ে একজন দেহরক্ষীকে হকি স্টিক নিয়ে আসতে বলে। সে দ্রুত হটিস্টিক নিয়ে আসলে, আরশ কিছু বলার আগেই, ফারিশ ক্ষেপে গিয়ে হটিস্টিক দিয়ে ইচ্ছেমতো পিটানো শুরু করে। আরশের মুখ থেকে গলগল করে রক্ত গড়াতে থাকে। অবস্হা বেগতিক দেখে ইরাশ এগিয়ে এসে, ফারিশকে আটকাতে চাইলে, ফারিশ ইরাশকেও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলে হুমকির সুরে বলতে থাকে,

‘ আজকে যে আমাকে আটকাবে আমি তাকেই খু*ন করে ফেলবো। এই শু*য়োরকে আজকে ছাড় দিতে দিতে এই অবস্হায় নিয়ে এসেছি। আজকে ও আমার মিস অনন্যার দিকে হাত বাড়িয়েছে, আজকে ওকে আমি শেষ করেই ফেলবো। ‘

আরশের অবস্হা করুনপ্রায়, ইরাশ বারংবার ফারিশকে থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই পারছে না কিন্তু হঠাৎ ফারিশের ম্যানেজার শফিক দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে বলে, ‘ স্যার অনন্যা ম্যাডামের খবর পাওয়া গেছে, উনি একদম সেম আছেন কিন্তু অজ্ঞানরত অবস্হায় পাশের সরকারী হসপিতালে ভর্তি আছেন। ‘

শফিকের কথা শুনে আরশকে ছেড়ে দিয়ে হটিস্টিক ফেলে,ফারিশ দ্রুত বেড়িয়ে যায় দৌড়ে। অন্যদিকে আরশের অবস্হা করুন! রক্তা/ক্ত অবস্হায় মেঝেতে পরে আছে। ইরাশ দ্রুত আরশের কাছে বসে, হসপিটালে ফোন দিয়ে এম্বুলেন্সকে ফোন করে। সে জানে আরশ একজন জঘন্য মানুষ কিন্তু যতই হোক সে তাদের ভাই। তাই সে দ্রুততম সময়ে কিছু না ভেবে বাকিদের সাহায্যে এম্বুল্যান্স এর অপেক্ষা না করে আরশকে গাড়িতে করে নিয়ে, হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

___________

জুঁই নিজের ফোনে বার বার ফোন করে যাচ্ছে আরশকে। আরশকে সে কিছুতেই ফোনে পাচ্ছে না। জুঁইয়ের বুদ্ধিতেই আরশ অনন্যার থেকে প্রতিশোধ নিতে, অনন্যাকে কিডন্যাপ করেছিলো যেন ফারিশের জীবনে কোথাও অনন্যার ছায়া না পরে কিন্তু জুঁইয়ের এখন বড্ড চিন্তা হচ্ছে, কারণ সে জানে ফারিশের ক্ষমতা সম্পর্কে। সে যদি একবার সবকিছু জেনে যায়, তাহলে তাকে শেষ করে ফেলবে অপরদিকে তার আরশের জন্যে চিন্তা হচ্ছে। ফোনটা কেন ধরছে না সে? তার ভাবনার মাঝেই, তার বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। সে ভয়ে ঢুগ গিলে, এক পা, দু পা করে এগিয়ে দরজা খুলতেই, তড়িৎ গতিতে অভি ভিতরে ঢুকে। অভিকে দেখে চমকে উঠে জুঁই। অভি হাল্কা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘ কি অবাক হলে বুঝি? কাকে এক্সপেক্ট করেছিলে তোমার ফারিশ খানকে? তা কবে থাইল্যান্ড থেকে এসেছো?’

জুঁই জানতো অভি তার এবং ফারিশের নামে কেস সাঁজাচ্ছে তাই সে কিছুদিনের জন্যে থাইল্যান্ডে চলে গিয়েছিলো। জুঁইকে চিন্তিত অবস্হায় দেখে, অভি ঝুঁকে বলে, ‘ পৃথিবীর যে কোনাতেই থাকো না কেন, আমি ঠিক তোমাদের শাস্তি দিবোই। ‘

অভির কথা শুনে জুঁই ঘাবড়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘ তুমি কেন এসেছো এখানে এখন?’

অভি তার ফোনটা বের করে, একটা ভিডিও বের করে মেলে ধরে জুঁইয়ের সামনে। জুঁই স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ ভিডিওটি আরশ এবং জুঁইয়ের। যেখানে তারা অনন্যাকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করছিলো তার সিসিটিভি ফুটেজ, কিন্তু এই ভিডিও কখন বা কীভাবেই বা করলো অভি?

অভি সোফায় বসে আশে পাশে তাঁকিয়ে বলে, ‘ তোমার অনুপস্হিতে আমি তোমার রুমে একটা ক্যামেরা ফিট করে গিয়েছিলাম। যদিও আংকেল আমাকে সাহায্য না করলে, আমি পারতাম না। তিনি যথেষ্ট নীতিবান একজন মানুষ। আমি জানতাম তুমি অনন্যার বড় কোন ক্ষতি করবে। এতোটা ক্ষতি করেও তোমার শান্তি হয়নি তাইনা? ছিহ! এতো জঘন্য মেয়ে তুমি! একজন মেয়ে, আরেকজন মেয়ের সর্বনাশ করতে লজ্জা করে না?’

অভি জানতো অনন্যাকে কিডন্যাপ করা হবে কিন্তু অভি সেখানে পৌঁছানোর আগেই অনন্যা সেখান থেকে বেড়িয়ে চলে গিয়েছিলো এবং ফারিশ চলে এসেছিলো। অভি আড়ালেই ছিলো এমনকি অনন্যাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্যে ওই বৃদ্ধ মহিলার কাছে ছেলেগুলোকে অভি নিজেই পাঠিয়েছিলো। জুঁই বুঝতে পারছে না এখন সে কী করবে।

___________________

অনন্যা হাত ধরে হসপিটালের কেবিনে বসে আছে ফারিশ। নিজের কাছে আজ নিজেকেই বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। তার প্রতিশোধপরায়ানতা তাকে আজ এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। যেই মেয়েটাকে সে দিনের পর দিন অপমান, লাঞ্চনা এমনকি সবথেকে জঘন্যতম অপরাধ চরিত্রহীনার মতোও কলঙ্কও সে অনন্যার গাঁয়ে লাগিয়েছে কিন্তু এই অনন্যাই তার মেয়েকে মায়ের ভালোবাসা দিয়েছে তার দাদীকে দিয়েছে যত্ন, তাকে চিনিয়েছে ভালোলাগার এক নতুন মানে! আজ এই প্রথম কোন মেয়েকে হারানোর এতোটা ভয় পেয়েছে সে।ফারিশের শুধু মনে হচ্ছে আজকে যদি আরশ অনন্যার কোন বড় ক্ষ/তি করে ফেলতো তখন কি করতো সে? ফারিশের ভাবনার মাঝেই, অনন্যা আখিজোড়া মেলে ফারিশের দিকে তাঁকায়। অনন্যাকে তাঁকাতে দেখে ফারিশ দ্রুত অনন্যার গালে হাত রেখে বলে,

‘ মিস অনন্যা? আর ইউ ওকে? দেখুন আমি আপনার মি: ফারিশ খান। দেখুন আমি কিন্তু চলে এসেছি। আমি সত্যিই আপনার কাছে অনেক অনেক দু:খিত। আরশ নামক জা*নুয়ারটাকে নিজের ভাই বলতেও লজ্জা লাগছে আমার। আপনি কিছু বলুন মিস অনন্যা, আপনি ঠিক আছেন তো?’

অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারিশের পানে চেয়ে হাসে। ফারিশের মুখস্রীতে একরাশ অনুশোচনা। এই প্রথম ফারিশের দেখে তার মনে হচ্ছে, ফারিশ আজ অনুতপ্ত! অনন্যা শান্ত গলায় বলে, ‘ আপনি সত্যি অনুতপ্ত?’

‘ হ্যা। ‘

‘ আমার একটা কথা রাখবেন তাহলে?’

‘ আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। ‘

‘ তবে আমায় মুক্তি দিয়ে দিন।’

চলবে……

প্রণয়ের রংধনু পর্ব-৩৪+৩৫

0

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৩৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ মিষ্টির আসল বাবা নয় কথাটি বারংবার মাথা আসতেই, কেমন যেন মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে অনন্যার। সে অসহায় পানে তাকিয়ে বলে, ‘ ইরাশ খান এবং ইশিতা আপুর মেয়ে অনন্যা! কিন্তু ইশিতা ভাবি তো..’
অনন্যা সম্পূর্ন কথা শেষ করার পূর্বেই, সেখানে রুমা খান প্রবেশ করে বললেন, ‘ হ্যা ইশিতা বেঁচে নেই, অনন্যার জন্মের সময়ই সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে।’
‘ কিন্তু মি: ফারিশ খান কী করে মিষ্টির বাবা হয়ে উঠলেন দাদি এবং করিমা আপু বলছে ইশিতা ভাবি নাকি ইরাশ খানের প্রেমিকা, এইসব এর কি মানে কি? ‘

‘ মানে হচ্ছে, ওরা প্রেমিক- প্রেমিকা ছিলো দিদিভাই। মিষ্টি ওদের অবৈধ সন্তান। ‘
কথাটি বলেই থামলেন রুমা খান। অনন্যা থমকে গেলো একপ্রকার। করিমা হঠাৎ নিশব্দে কেঁদে ফেললো। ইশিতা নামক রমনী যথেষ্ট ভালো ছিলো, তার কথা উঠলেই সে কেঁদে ফেলে। তার আজও আফসোস হয়! ইস রে, ইশিতা ভাবি এবং ইরাশ ভাইয়ের ভালোবাসা পূর্ণতা পাইলো না কেইন? মাঝে মাঝে করিমার মনে হয় উপরওয়ালা বড় নিষ্ঠুর! নাহলে এমন বাজে ভাবে বিচ্ছেদ ও বুঝি ঘটে?

_____________
অপরদিকে, ফারিশের ফোনে থানা থেকে কল আসায় কিছুটা ভ্রু কুচকে গেলো ফারিশের। সে ফোনটা রিসিভ করলো, অপাশ থেকে একজন ভারি কন্ঠের অফিসার বললো, ‘ জ্বী! আমি ওসি সাহেব বলছি। আমি কী মি: ফারিশ খানের সাথে কথা বলছি?’

‘ যখন ফারিশ খানের নাম্বারে ফোন দিয়েছেন, তাহলে নিশ্চই তার নাম্বারে বাড়ির দাড়োয়ানের সাথে কথা বলবেন না, তাইনা?’

ফারিশের এমন জবাবে হচকিয়ে গেলেন ওসি সাহেব। তিনি গলার স্বর নরম করে বললেন,

‘ আসলে, আমি যতটুকু জানি, বড় বড় বিসনেজ ম্যানদের ফোন ধরারও আলাদা মানুষ থাকে, যেমন ধরেন ম্যানেজার, পিএ, ইত্যাদি। আমি ভাবলাম আপনার ক্ষেত্রেও বুঝি তাই হবে, আফটার অল আপনি শহরের এতো বড় একজন বিসনেজম্যান। হা হা হা। ‘

ফারিশের এই মুহুর্তে ওসি সাহেবের অযথা হাসি বিরক্ত লাগছে, তার ইচ্ছে করছে ফোন কেটে দিতে, সে ক্ষমতা তার আছে কিন্তু সে তা করলো না বরং শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো, ‘ ফোন করার কারণ?’

‘ আসলে, আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে। অভি শিকদার আপনার নামে একটা কেইস ফাইল করেছে, মিথ্যে মানহানির মামলা! বুঝতেই পারছেন বেশ বড় ধরণের উকিল। উনি যখন কেইস ফাইল করেছেন, সেই কেইস তো আমি হেলা- ফেলা করতে পারবো না। ‘

ফারিশ থামলো! অর্থাৎ সবকিছুই জেনে গিয়েছে কিন্তু কীভাবে জানলো? হয়তো জুঁই কিংবা শেফালি কারো মাধ্যমে জেনেছে বলে ফারিশের ধারণা। তবুও সেই বিষয়টি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে, ফারিশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

‘ আমি বিকেলের আগে আসতে পারবো না। জরুরী মিটিং আছে। ‘

‘ কিন্তু, মি: ফারিশ, আপনাকে এখুনি আসা প্রয়োজন। অভি শিকদার কেমন লোক, আপনাকে ঠিক বুঝাতে পারবো না। সে সকাল থেকে বসে আছেন। এমন ব্যাবস্হা করবে পরে, পুলিশ আপনার অফিসে যেতে বাধ্য হবে। ‘

ফারিশ বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, ‘ তবে পাঠান পুলিশ! তবে আমি আমার জায়গায় কমেটেড! যার – তার ফালতু কেইসের জন্যে আমি এখন মিটিং ছেড়ে থানায় যেতে পারবো না। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। আমিও অভি শিকদারের পাওয়ার দেখতে চাই।’

বলেই কট করে ফোন কেটে দিলো। ওসি সাহেবের সামনে অভি বসে ছিলো। সে টেবিলে সামান্য আঘাত করে, মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো,
‘ খুব তাড়াতাড়ি আপনার এই তেজ আমি শেষ করবো মি: ফারিশ খান। ওয়েট এন্ড সি। ‘

ফারিশ ফোনটা রেখেই বেডিয়ে যেতে নিলে, ইরাশ প্রশ্ন করে, ‘ ভাই কোথায় যাচ্ছো তুমি এই মুহুর্তে?’

‘ আসলে আমার অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে। আমি মিটিংটা সেরেই ফিরি আসবো। ডোন্ট ওয়ারি তুই বরং তোর ইশিতার সাথে আলাদা রিফ্রেশিং মোমেন্ট কাটা,ততক্ষনে আমি চট করে একবার অফিস থেকে আসি। ‘

বলেই ফারিশ বেড়িয়ে গেলো। ইরাশ ও মুচকি হেসে ইশিতার ছবি বুকে আকড়ে বসে থাকলো।

_____________

অনন্যা বাগানে দাঁড়িয়ে আনমনে হাটছে, বারান্দা থেকে মিষ্টিকে সে লক্ষ্য করছে। মিষ্টি আজ তার পোষা পাখি ময়নার সাথে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। হয়তো প্রতিদিনের মতো ময়নাকে তার নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করছে। ‘ এই ময়না? আমার নাম ধরে ডাক তো! বল মিষ্টি!’

ময়না অনন্যা দিনের মতোই বোধহয় ‘মি’ বলে থেমে যাচ্ছে কিন্তু মিষ্টি তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা দারুন! কিন্তু অনন্যার মনে চলছে নানা কৈতহূল! কিন্তু তার এইসব প্রশ্নের জবাব দিবে কে? কেন ইরাশ এবং ইশিতার প্রেম পূর্নতা পেলো না? আজ যদি তাদের ভালোবাসা পূর্নতা পেতো, তবে আজ মিষ্টির মতো ফুটফুটে মেয়েটিও তার বাবা- মায়ের সাথে সুন্দর করে বাঁচতো! মিষ্টির জন্যে তার বড্ড খারাপ লাগে, মাকে ছাড়া ছোট থেকে বড় হচ্ছে, তাইতো অনন্যাকে আকড়ে ধরেছে সে মা হিসেবে।অনন্যা নিজেও এখন মিষ্টিকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সন্তান হিসেবে।

কিন্তু অনন্যার ধারণা ফারিশ মানুষটা যতই খারাপ হোক, মিষ্টিকে কখনো তার নিজের বাবা- মায়ের অভাব বোধ করতে দেইনি। এতোদিন এই বাড়িতে থেকেও, অনন্যা বুঝতে পারলো না যে, মিষ্টি ফারিশের নিজের মেয়ে নয়। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, মিষ্টি উপর থেকে অনন্যাকে ‘ মা’ বলে ডাকছে। অনন্যা মুচকি হেসে হাত নাড়াচ্ছে, তখনি একজন দেহরক্ষী এসে বললো,

‘ অনন্যা মেম, স্যার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনাকে ডাকছে।’

‘ কে? মি: ফারিশ খান?’

‘ জ্বী, হ্যা। ‘

অনন্যার বেশ খটকা লাগলো, ফারিশ তাকে বাইরে ডাকবে কেন? কোন দরকার হলে তো, সে তাকে বাড়ির ভিতরে এসেই বলতে পারে। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, দেহরক্ষী বললেন,’ কি করছেন ম্যাম? জলদি চলুন! নাহলে স্যার রাগ করবে। ‘

অনন্যা আর কিছু না ভেবে বাইরে চলে গেলো। মিষ্টি অনন্যাকে বাইরে যেতে দেখে ভাবলো, তার মা হঠাৎ বাইরে গেলো কেন? তখন প্রায় সন্ধ্যা। সেখানে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। অনন্যা সেই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

‘ আপনি আমাকে বাইরে ডাকলেন কেন?’

অনন্যার কথা শুনে, গাড়ির ভিতর থেকে একজোড়া হাত দিয়ে, অনন্যার মুখে স্প্রে করে দিলো। অনন্যা তৎক্ষনাৎ মাটিয়ে লুটিয়ে পরলো। সে গাড়ি থেকে কালো মাস্ক পরা যুবকটি অনন্যাকে কোলে তুলে, গাড়িতে শুয়িয়ে, তৎক্ষনাৎ গাড়ি ঘুড়িয়ে ফেললো। সেই যুবকটি নিজের মাস্ক খুলে, অনন্যার দিকে তাঁকিয়ে ভয়ংকরভাবে হেসে বললো, ‘ আরশ খান নিজের রিভেঞ্জ ফুলফিল করেই ছাড়ে, মিস অনন্যা!’

_____________________

অপরদিকে, থানায় মুখোমুখি বসে আছে ফারিশ এবং অভি। নিজের চেয়ারে বসে আছেন ওসি সাহেব। ফারিশ তার দেওয়া সময় অনুয়ায়ী থানায় এসে পৌঁছেছে। পরিবেশ থমথমে! অভি একের পর এক ফাইল ওসি সাহেবের হাতে দিয়ে, মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বলে, ‘ অফিসার! এই লোকটা যে কত বড় ফ্রড তার প্রমাণ এতে আছে। দিনের পর দিন সে একটা মিথ্যে ভিডিওকে কেন্দ্র করে, আমার বাগদত্তাকে চরিত্রহীনা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। আমার কাছে সাক্ষ্যিও আছে। তাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জুঁইও জড়িত আছে। আপনি তাকেও অ্যারেস্ট করবেন। কেস টা কোর্টে উঠলে আমি আমার সাক্ষ্যিকেও হাজির করবো। ‘

ফারিশ পায়ের উপর পা তুলে সমস্ত কথা শুনছে। ওসি সাহেব সমস্ত ফাইল ঘেটে বললেন,

‘ সমস্ত প্রমাণ আপনার বিরুদ্ধে মি; খান, আপনাকে অ্যারেস্ট না করে, আমাদের কোন উপায় নেই।’

ওসি সাহেবের এমন কথা শুনে, ফারিশ গালে হাত দিয়ে বলে, ‘ তো জেল খানা খুলে দিন, আমি ঢুকে যাচ্ছি। ‘

ফারিশের এমন কথা শুনে অভি ক্ষীপ্ত সুরে বলে,

‘ আপনার মতো নির্লজ্জ মানুষ, আমি একটাও দেখি নি। এতো বড় অন্যায় করেও, এতো বড় বড় কথা!’

‘ মি: অভি শিকদার ডোন্ট বি হাইপার, আসলে বেশি কথা বলা, আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ।’

অভি তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ আপনাকে এখন জেলে পাঠালাম এবং এখন আমি আমার ভালোবাসার মানুষকেও ফিরিয়ে আনবো। ‘

ফারিশ বিদ্রুপের হাসি হাসলো। অভি ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো। ফারিশ বাঁকা হেসে বললো,

‘ আমার বন্দীনিকে আমার থেকে কেড়ে নেওয়া এতো সহজ নয় মি: অভি শিকদার। আপনার বাগদত্তা এখন আমার বন্দীনি সেইটা যেই ভাবেই হোক! জাস্ট ঘড়ি ধরে ৩০ মিনিট লাগবে আমার জেল থেকে বেড়োতে। ‘

বলেই জেলে ঢুকে পরলোআ ফারিশ।

চলবে কী?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৩৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আখিজোড়া খুলে মেলতেই, নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো অনন্যা। হাত- পা তার বাঁধা, মুখেও টেপ লাগানো। সে চারিদিকে তাঁকিয়ে পরিস্হিতি বুঝার চেষ্টা করছে কিন্তু সে ব্যার্থ! সে কিছুক্ষন আগের কথা করার চেষ্টা করছে তাকে ফারিশের কথা বলা বের করে নিয়ে আসা হয়েছিলো কিন্তু গাড়ির সামনে আসতেই সে অজ্ঞান হয়ে পরে, তারপর তার কিছু মনে নেই। সে মুখ দিয়ে ‘উম উম ‘ শব্দ করে যাচ্ছে এবং হাত- পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছটফট করছে, যেন কোনভাবে হাতের বাঁধন খুলে যায়, কিন্তু বরাবরের মতোই সে অসহায় হয়ে পরে! পাশের ঘর থেকে একজন যুবক এসে দরজার এসে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ এখুনি এতো ছটফট করলে কীভাবে হবে ডার্লিং? পিকচার তো আবি বাকি হে!’
বলেই ঘর কাঁপিয়ে কুৎসিত এক হাসি উপহার দিলো আরশ! স্তম্ভিত অনন্যা! সে আখিজোড়া বড় বড় করে মেলে চেয়ে আছে তার জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত যুবকটির দিকে, যে যেকোন সময়ে তার বড়সড় কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে।

_________

অপরদিকে, ফারিশকে জেলে ভিতরে ঢুকানো হলে, অভি ফারিশের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের উকালতির কালো কোর্টটি খুলে হাতে নিয়ে নেয়, তার পরনে সাদা শার্ট! সে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে লতে থাকে,

‘ আমিও দেখবো, কী করে আপনি এই জেলের ভিতর থেকে বের হন মি: ফারিশ খান। অনেক অন্যায় করেছেন আপনি দিনের পর দিন! সেই প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এখন এসেছে। আমি এখুনি গিয়ে আপনার বাড়ি থেকে আমার অনন্যাকে নিয়ে আসবো এবং এমন ব্যাবস্হা করবো যেন আপনি কিছুতেই জেল থেকে বের হতে না পারেন। ‘

ফারিশ কোনপ্রকার জবাব না দিয়ে বাঁকা হাসি দেয়। ফারিশের এমন তাচ্ছিল্যের হাসি দেখে রাগ উঠে যায় অভির। সে ক্ষিপ্ত সুরে বলে, ‘ আপনি নিজেকে বেশ স্মার্ট মনে করেন তাইনা মি: ফারিশ খান?’

‘ উহু ভূল বলে ফেললেন অভি সাহেব! এখনো উকালতিকে বেশ কাঁচা আপনি। ‘

অভি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?’

ফারিশ অভির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ আমি নিজেকে স্মার্ট নই, ওভারস্মার্ট মনে করি! লুক! ‘

ফারিশের ইশারা শুনে অভি পিছনে তাকিয়ে দেখে, ইরাশের সাথে একজন মধ্য বয়স্ক উকিল দাঁড়িয়ে আছেন, সবথেকে বড় অবাক হয়েছে অভি শেফালিকে তাদের সাথে দেখে। অভি এগিয়ে এসে বলে, ‘ শেফালি তুমি এখানে? ‘

শেফালি আমতা আমতা করে কিছু বলার পূর্বেই, সেই ইরাশের সাথে থাকা সেই মধ্য বয়স্ক উকিলটি অফিসারের দিকে তাঁকিয়ে বললেন, ‘ আসলে মেয়েটাকে টাকা খায়িয়ে, মি: খানের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ সাঁজিয়েছেন অভি শিকদার এমনকি কলের রেকর্ডিংও জুঁই এবং তারই প্লেন! এখানে শুধু শুধু মি: খানকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমার সাথে সমস্ত ডেটাও আছে। দেখুন অফিসার এবং তৎক্ষনাৎ মি: খানকে বের করুন। ‘

বলেই কয়েকটা ফাইল ওসি সাহেবের কাছে জমা রাখলেন উকিল সাহেব! অভি থমকে গিয়ে বললো, ‘ ওয়াট! এইসব কী হচ্ছে? শেফালি তুমি এইসব কি বলেছো এদের? প্লিয দেখো! তুমি তো নিজ থেকে অনন্যাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলে তবে এখন কেন এমন করছো? তুমি কী বুঝতে পারছো না অনন্যা এই নিকৃষ্ঠতম লোকের কাছে কত বড় বিপদে আছে?’

শেফালি কোনপ্রকার জবাব দিলো না শুধুমাত্র অসহায় ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ওসি সাহেব উপায় না পেয়ে, ফারিশকে বের করে দিলো। ফারিশ করিমার ফোন দেখেই সেদিন আন্দাজ করতে পেরেছিলো, শেফালির সাথে অনন্যার যোগাযোগ হয়েছে, তাই শেফালি অভির কাছেই সাহায্য চাইবে এবং অভিও সবকিছু জেনে, তার নামে কেইস তৈরি করে ফেলবে, তাই আজ সকালে থানা থেকে ফোন আসায়, ফারিশ সোজা শেফালির বাসায় গিয়ে, তাকে হুমকি দিয়ে দমিয়ে ফেলে ফারিশ, যেন সে তার স্ট্যাটমেন্ট বদলায় এবং অভিকে ভূল প্রমাণিত করে! নাহলে ফারিশ তার বাবা- মায়ের বড়সড় ক্ষতি করে ফেলবে।

ফারিশ বেড়িয়ে, অভির কানে গিয়ে বলে উঠে,
‘ বলেছিলাম না? জাস্ট ৩০ মিনিট লাগবে আমার জেল থেকে বেড়োতে! ঠিক ৩০ মিনিট শেষ হওয়ার ২সেকেন্ড আগে আমি বের হয়ে একদম আপনার সামনাসামনি মি: অভি শিকদার! বললাম না আপনি বড্ড কাঁচা! ‘

অভি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘ আমি জানি আপনি নিশ্চই কোনভাবে শেফালিকে ব্ল্যাকমেইল করেছেন। ‘

ফারিশের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘ ইয়েস! বিকজ এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার!’

__________________
অপরদিকে অনন্যা পরেছে বেশ বিপদে, তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আরশ! অনন্যা মুখ দিয়ে ‘উম উম ‘ করে যাচ্ছে। আরশ দ্রুত এগিয়ে, অনন্যার মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে বলে, ‘ উফফ সুইটহার্ট! ডোন্ট বি প্যানিকড! এমন ভাবে ছটফট করছো কেন? আজ তো তোমার সুখের দিন! আরশ খানের বেড পার্টনার হওয়ার এতো বড় সুযোগ এসেছে, তোমার কাছে। ‘

অনন্যা চিৎকার করে বলে, ‘ আমার হাতের বাঁধন খুলে দিন বলছি! অমানুষ, জা*নুয়ার কোথাকার! আপনি কী আদোও মানুষ? ‘

আরশ অনন্যার চুলের মুঠি ধরে বলে, ‘ কী বললি? আমি জা*নুয়ার? তাহলে তো সেইভাবেই কাজ করতে হয় তাইনা? অনেক অপমান সহ্য করেছি তোর! তোর জন্যে নিজের বাড়িতে, নিজের ভাইয়ের কাছে প্রতিনিয়ত হেনস্তা হতে হচ্ছে আমাকে। বলেছিলাম না? তোকে আমার বেড পার্টার করেই ছাড়বো! দেখ এখন কী করি!’

চলবে।।