Tuesday, July 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 364



প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৩

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৩

মুখ্য মঞ্চের পাশেই শিক্ষার্থীদের গান, নৃত্য বা বক্তৃতার জন্য আলাদা মঞ্চ করা হয়েছে। তার পাশেই সবার বসার জায়গা। সবাইকে পার করে হৃদিতা নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। একজন এসে একটা চেয়ার আর মাইক্রোফোন এনে ঠিক করে সামনে রেখে দেয়।

হৃদিতা গলা ঠিক করে গিটারে আওয়াজ তুলতে শুরু করে। সামনে সবাই ধীরেধীরে চুপ হয়ে যেতে শুরু করে। হৃদিতা আশেপাশে তাকিয়ে মৃদু হেসে নিজের অতি পছন্দের গানটা শুরু করে৷

আমার ভিনদেশি তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে?
আমার রাত জাগা তারা (রাত জাগা তারা)
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি (অন্য পাড়ায় বাড়ি)
আমার ভয় পাওয়া চেহারা (ভয় পাওয়া চেহারা)
আমি আদতে আনাড়ি (আদতে আনাড়ি)
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার চোখ বেঁধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি
তুমি মায়ের মতোই ভালো
আমি একলাটি পথ হাঁটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা (বিচ্ছিরি এক তারা)
তুমি নাও না কথা কানে (নাও না কথা কানে)
তোমার কীসের এত তাড়া? (কীসের এত তাড়া?)
রাস্তা পার হবে সাবধানে (পার হবে সাবধানে)
তোমার গায় লাগে না ধুলো
আমার দু’মুঠো চাল-চুলো
তোমার গায়ে লাগে না ধুলো
আমার দু’মুঠো চাল-চুলো
রাখো শরীরে হাত যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
Please ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী।।

হৃদিতার গান শেষ হতেই চারপাশে হাতে তালি আর গানের গলার প্রশংসার ধুম পড়ে যায়৷ জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। গান গাওয়ার সময় অন্যসবার সাথে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির নজরেও নজর মিলিয়েছে হৃদিতা। সুদর্শন পুরুষের নজরে অহংকার থাকে, তারা মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে মেয়েদের মন জিতে নিতে চায়। এজন্যই হয়তো হৃদিতা যখন কিছুক্ষণের জন্য আবরার ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে গান গাইছিল তখন সে নিজের ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত ছিল।

হৃদিতা সিঁড়ি দিয়ে নামবে তখনই বিভাগীয় প্রধান শরীফ আহমেদ তাকে কাছে ডাকে। হৃদিতা এসে পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়৷ শরীফ আহমেদের পাশেই বসে ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে আবরার।

শরীফ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বলেন,” আছ কোথায় এখন? কেমন চলছে, কী করছ? আর বিয়ে! বিয়ে হয়েছে তোমার?”

হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,” না স্যার। বিয়ে করিনি এখনো৷ জব খুঁজছি, একটা ভালো জব প্রয়োজন। বিয়ে নিয়ে এখনো কোনো ভাবনা নেই৷ ”
” তোমার সিভিটা ড্রপ কোরো তো আমার ইমেইলে। আমি তোমার জন্য কথা বলব৷ কত ভালো স্টুডেন্ট ছিলে তুমি আর তোমার কি না জবের জন্য ঘুরতে হচ্ছে!”
” কৃতজ্ঞতা, স্যার।”

হৃদিতা গিটারটা রেখে ফোন হাতে নিতেই দেখে উমেদের নম্বর থেকে চারবার কল এসেছে। হৃদিতা ফোনটা হাতে নিয়ে ইশিতাকে বলে,” তোরা এখানেই থাকিস আমি একটু কথা বলে আসছি, কল এসেছিল।”
” কে কল করেছে?”
” উমেদ ভাই, আমাদের শেখ সাহেব।”
____

” এতো মানুষের সামনে গান শুনে মজা আছে নাকি সুন্দরী? ফোন নম্বরটা দাও, রাতে কল দিয়ে তোমার এই সুমধুর সুরে গান শুনব।”

হৃদিতা উমেদের সাথে কথা শেষ করে নিজের জায়গার উদ্দেশ্যে ফিরছিল এমন সময় বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন ছেলে হৃদিতাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলে।

হৃদিতা পিছনে না তাকিয়েই দুই তিনপা পিছিয়ে এসে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,” কার কার নম্বর লাগবে?”

বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন হাত দিয়ে সবাইকে পিছিয়ে দিয়ে বলে,” শুধু আমার।”

হৃদিতা আরেকটু কাছে গিয়ে বলে,” কী চাই?”
ছেলেটাও বেহায়ার মতো মুখ এগিয়ে বলে,” আপাতত নম্বর, তারপর কী কী চাই সেটা চেয়ে নেব।”
” ছোঁয়া চাই না?”
” চাই তো!”

হৃদিতা গায়ের সব শক্তি দিয়ে প্রবল বেগে একটা চড় বসিয়ে দেয় ছেলেটার গালে। তার দুইপাশ থেকে দুইজন এগিয়ে আসতে লাগলে গালে চড় পড়া ছেলেটা তাদের থামিয়ে দেয়। আঙুল দিয়ে দাঁতের গোড়ায় হাত দিয়ে বের করে দেখতেই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। র*ক্ত ঝরছে!

হৃদিতা আঙুল উঁচিয়ে বলে,” সব মেয়েকে এক ভেবে ভুল করবি না। সব মেয়ে মাথানিচু করে সব সহ্য করে নিতে জানে না। একটা আ*ঘা*তের পরিবর্তে কেউ কেউ জানটাও নিয়ে নিতে পারে। নেক্সট টাইম আমার সামনে তোদের কাউকে যদি অন্যকোনো মেয়েকে টিজ করতে দেখেছি চোখ একদম উপড়ে নেব। ”

হৃদিতা মেইন গেইটের দিকে তাকিয়ে দুজন পুলিশকে দেখেই শয়তানি হাসি হেসে বলে,” ওই যে দুজন ভূত দেখতে পাচ্ছি। বলব নাকি ঘাড় মটকে দিতে?”

ছেলেগুলো পিছনে তাকিয়ে লাঠি হাতে দুজন পুলিশকে দেখে শুকনো ঢোক গিলে নেয়৷ তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে,” স্যরি ম্যাম। এরকম ভুল আর হবে না।”

হৃদিতা তাকে হাত দিয়ে ইশারায় কাছে ডেকে বলে,” আমার বাবা উকিল। রাসেল শেখকে চেনা আছে? একটা করে ধরবে, জেলে ভরবে আর টিপে টিপে মা*রবে।”

ছেলেগুলো অনুনয় বিনয় শুরু করে দেয়। তারা বয়সে ছোটো হওয়ায় তাদের ভয় দেখাতে হৃদিতার মজাই লাগছিল তবে আফসোসও হচ্ছিল এটা ভেবে যে এতটুকু ছেলেগুলো ভদ্রতার প্রকাশের বয়সে কী অভদ্রতাটাই না করছে!

হৃদিতা নিজের আসনের দিকে যেতে থাকে। মোড় ঘুরতেই ধাক্কা লাগতে লাগতে বেঁচে যায় সে। কিছু বলবে ওমনি সামনে তাকিয়ে কানে ফোন সমেত আবরার ফাইয়াজকে দেখে থমকে যায় সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখের দিকে তাকাতেই দমে যায় সে।

আবরার ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটাকে বলে,” ফোন রাখো, আমি পরে কলব্যাক করছি।”

হৃদিতা পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এমন সময় ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখে আবরার হৃদিতাকে ডেকে বলে,” দাঁড়ান।”

হৃদিতা দাঁড়িয়ে যায়। মাথানিচু করে বলে ,” জি বলুন।”
” আপনিই তো গান গাইলেন তাই না?”
” জি আমি।”
” সুন্দর গান করেন। গান নিয়ে এগুনোর ইচ্ছে আছে?”
” উহু৷ শখে গাই। ”
” শখ তো প্রফেশনও হতে পারে।”
” না, শখকে প্রতিটা মানুষ ভালোবাসে, শখ হচ্ছে একেকটা আবেগ। সবাই নিজের প্রফেশনকে পছন্দ করে না।”
” বাহ! ভালো বলেছেন কিন্তু। গানের সাথে ভালো কথাও বলতে পারেন দেখছি।”
” শুকরিয়া।”
” বাসায় কোথায় আপনার?”
” সামনেই বাসা ভাড়ায় থাকি, টার্মিনালের মেইন রাস্তায় ওঠার ঠিক আগে হাতের বাম সাইডে গোলাপি রঙের বাসা। দুজন রুমমেটের সাথে থাকতে হয়।”
” আচ্ছা৷ জব খুঁজছেন হয়তো। এটা আমার কার্ড, প্রয়োজন মনে হলে কল দিতে পারেন। ” বলেই হৃদিতার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় আবরার।

হৃদিতা আবরারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, ” আপনাকে ভালো লেগে গেছে, নেতা সাহেব। আমার যেটা পছন্দ সেটাকে প্রয়োজন নয় প্রিয়জন বানিয়ে নিতে অভ্যস্ত আমি। ”
______

উমেদ বাড়ি ফিরেছে অনেকক্ষণ। আসার পর থেকেই বিছানায় উল্টাসিধা হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ময়না বেগম কয়েকবার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন উমেদ কিছু খাবে কি না। উমেদ সব খাবারের কথায় নাকচ করে দিয়েছে।
বাড়ি আসার পর একটাবারের জন্যও সে সুরাইয়াকে দেখেনি। তার কাছে এটা আর নতুন কী? আশরাফ আর সুরাইয়ার বিয়ে হয়েছে চার বছর। আশরাফ আগে থেকেই বাহিরে থাকতো। দুই বছর আগে যখন বাসায় আসলো বিয়ে করতে তখন প্রথমেই উমেদকে ডেকে বলেছিল সুরাইয়ার কথা। জানিয়েছিল সে সুরাইয়াকে বিয়ে করতে চায়। এই যে বিয়ে হলো তারপর থেকেই যেন সবকিছুর নতুন সূচনা হলো। আশরাফের বিয়ের পরই মূলত বুঝতে শিখেছিল সে সুরাইয়াকে ভালোবাসে। বিয়ের আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়লেই বুক ভারি হয়ে আসে মনে হয় কেউ বুকের ওপর বসে আছে এখনই গলা টিপে ধরবে। নিজের দোষে হারিয়ে ফেলা ভালোবাসার সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে, যন্ত্রণায় সে বাড়ি ফেরার পথ ভুলে গিয়েছে। চার বছরে যতটা কম আসা সম্ভব সে এসেছে।

রুমের বাহিরে থেকে মেয়েলী গলায় কেউ বলে,” চা পাঠিয়ে দিব আপনার জন্য?”

গলাটা কানে পৌঁছতেই বুকটা কেঁপে ওঠে উমেদের। ভাঙা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করে,” কেমন আছিস?”
” ভালো আছি৷ চা খেলে বলেন পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
” তোর হাতের চা হলে খাওয়া যায়।”
” ক’ চামচ চিনি দিতে হবে?”
” ভুলে গেছিস সব?”
” ক’ চামচ?”
” এক।”

উমেদ আবার বলে ওঠে,” আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা একদমই গোল্লায় গেছে তাই না?”

” সম্পর্ক ভিন্ন করেছিলেন আপনি, যার বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আশায় বাঁচতে শুরু করেছিলাম তার ভাইয়ের বউ হয়ে বসে আছি, দারুণ না! আজ আপনি আমার নিষিদ্ধ পুরুষ, আপনার সামনে যাওয়া তো দূর আপনার দিকে তাকানোও অন্যা*য়। সব পুরুষ তো বোকা হয় না, শখের নারীকে ছাড়ে না আপনি ছাড়লেন কেন? ওহ স্যরি আমি আপনার বন্ধু ছিলাম, শখের নারী নই। ”

উমেদ কিছু বলে না৷ এক বিশ্রী যন্ত্রণা তাকে চেপে ধরে। গলা আটকে যায় শব্দ বেরোয় না, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার।

বাহিরে থেকে সুরাইয়ার গলা ভেসে আসে,” অতীত ভুলে বর্তমানে ফিরে আসুন। আমি আপনার বড়ো ভাইয়ের বউ৷ সম্পর্কে বড়ো ভাবি। আপনি অযথা এরকম কথাবার্তা তুলবেন না। একাকী কোনো সময় সামনে আসবেন না, অনুরোধ। ভালো চেয়েছিলেন আমার, ভালো থাকতে দিন। ”

#চলবে……

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০২

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০২

আশরাফ এসে সুরাইয়ার দুই বাহু শক্ত করে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়। সুরাইয়া সেভাবে থেকেই বলে ওঠে,” শরীরের আগে মনের খোরাক মেটাতে শিখুন শেখ সাহেব।”

আশরাফ চোখ বন্ধ করে কপালে হাত দিয়ে মুহূর্ত কয়েক দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। সুরাইয়া পাশেই বসে আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে।

আশরাফ সুরাইয়ার হাত ধরে নরমস্বরে বলে,” আ’ম স্যরি সুরাইয়া৷ এই তিনটা দিনের জন্য স্যরি। তুমি জানোই তো বাহিরের মানুষের সামনে আমার লজ্জা বেশি আর তাছাড়া মা অসুস্থ ছিল। আমাকে কাছে থেকে ছাড়ছিলই না৷ আমি যখনই বাড়ির বাহির বা মার কাছে থেকে ছাড় পেয়েছি ওমনি রুমে এসেছি। কখনো পেয়েছি তোমাকে তো কখনো পাইনি। দূর থেকে তোমাকে দেখতে হয়েছে আমার। আর কী বলছ তোমার জ্বর আমি জানি না? জ্বর আসলে তো তোমার জ্ঞানই থাকে না৷ রাতে যখন আমি রুমে এসে তোমার গালে চুমু দিতে গিয়েছি কপালে থাকা ছোটো চুল সরাতে গিয়ে দেখি তোমার গায়ে প্রচন্ড জ্বর। আমি রাত দুইটা পর্যন্ত জলপট্টি দিয়েছি, ভেজা কাপড় দিয়ে যতটুকু পেরেছি শরীর মুছে দিয়েছি যেন তাপমাত্রা কমে যায়। সকাল সকাল বের হয়ে ওষুধও নিয়ে এসেছি৷ তুমি আমার সাথে কথা বলছিলে না জন্য আমারও অভিমান হয়েছিল। ওষুধের পলিতে চিরকুট লিখে রেখেছিলাম সেটাও দেখছি দেখোনি৷ ”

আশরাফ কথা শেষ করে খাটের নিচে থেকে একটা বাটি বের করে সুরাইয়াকে দেখায়। দরজার পিছনে থাকা সাদা কাপড়টাও ইশারায় দেখায় সুরাইয়াকে।

আশরাফ বাটিটা আবার নামিয়ে রেখে বলে,” নারীর ভালোবাসা অল্পতেই চোখে পড়ে কিন্তু পুরুষ লুকিয়ে ভালোবাসতে পছন্দ করে। তুমি কখনো একটা কথা মাথায়ও এনো না যে আমি তোমার জন্য নেই। আমার জীবনে মা আর তুমি দুজনই দুদিক দিয়ে জরুরি৷ তোমাকে ভালোবেসে রাগ দেখাতে পারব, বকতে পারব, অভিমান করতে পারব কিন্তু মায়ের সাথে এগুলো করে ওঠা সম্ভব না। আমি আসলেই দুঃখিত সুরাইয়া। আমি তোমাকে নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে চিন্তিত হয়তো ছিলাম না।”

আশরাফ বিছানা ছেড়ে উঠে বাহিরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে যেতে পা বাড়ালে সুরাইয়া বলে ওঠে, ” শুনুন।”

আসরাফের পা থেমে যায়। পিছনে ফিরে বলে,” হুম।”
” কাল অন্তত আমার জন্য সন্ধ্যায় সময় রাখুন। অনেকদিন বের হওয়া হয় না।”
” ঠিক আছে।”
” শুনুন।”
” বলো।”
” স্যরি।”
” ভালোবাসি বলতে শিখো।”
_____

হৃদিতা আর ইশিতা ভার্সিটিতে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ আগে। সাহিল, ফাউজিয়া আর অনয়ের আসার কথা অনেক আগেই কিন্তু তারা এখনো এসে পৌঁছায়নি।

হৃদিতা ক্যাম্পাসে এসে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছে ফাউজিয়াকে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ইশিতা।

কল রিসিভ হতেই হৃদিতা বলে উঠল,” কী রে কই তোরা? সোয়ামি-বউ ঘর থেকে বেরোসনি? এদিক আসবি না নাকি? তোরা দেরি করে আসবি সেটা বললেই হতো তাহলে আমি আর ইশুও দেরি করে আসতাম। ”

ফোনের ওপাশ থেকে ফাউজিয়া বলে ওঠে,” গেইটে দ্যাখ একটু। ”

হৃদিতা সাথে সাথে তাকিয়ে দেখে ফাউজিয়া আসছে, একা আসছে। সাথে সাহিল নেই। ফাউজিয়া হেটে সোজা হৃদিতা আর ইশিতার কাছে এসে দাঁড়ায়।

ইশিতা তাৎক্ষণিক বলে ওঠে,” কী লাগতেছে ভাই! সাহিল কি এমনি এমনি বউয়ের আঁচলের নিচ থেকে বের হয় না নাকি? ঘরে এরকম মারকাটারি ফিগারের সুন্দরী বউ থাকলে কি অন্যদিকে নজর যায় নাকি? ”

ইশিতার কথায় লজ্জা পেয়ে যায় ফাউজিয়া। হৃদিতা এদিক ওদিক দেখে বলে,” তোর বর কই? বউকে একা ছাড়ল কেন আজ?”

ফাউজিয়া ক্যাম্পাসের বাহিরে ইশারা করে দেখিয়ে বলল, ” খাবার কিনতে গেছে। শুকনো মুখে অনুষ্ঠান দেখব নাকি? ”

ইশিতা কাউকে ফোন করতে করতে বলে,” এই অনয়ের বাচ্চা কই ক’ তো? এই বা*লডারে দেখলাম না সময়মতো আসতে। কোথাও হয়তো দাঁড়ায় দাঁড়ায় সিগারেট ফুঁকছে। বান্দর একটা।”

ফাউজিয়া ইশিতার ফোনটা নিয়ে অনয়কে দেওয়া কলটা কেটে দিয়ে বলে,” অনয়, সাহিলের সাথেই আসছে। চল আমরা ভেতরে যাই।”
” আগে বলবি তো..”

হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,” মিস করতেছিলা অনয়বাবুরে?”

লজ্জায় নুইয়ে যায় ইশিতা। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,” চলতো। ওই বা*লডারে কেডায় মিস করবে? একটা চাকরিও ঠিকঠাক করছে না। তুই মেয়ে হয়ে পেয়ে গেলি আর ও! ”
” আমি কীভাবে পেয়েছি সেটা তো জানিসই।”

ফাউজিয়া পাশে থেকে বলে ওঠে,” তোকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয় হৃদি।”
____

” সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে রাতের রান্না চড়াবে কখন তুমি? বাড়িত যে এতগুলান মানুষ রইছে সেইদিকে দেখি কোনো খেয়ালই নাই তোমার, সুরাইয়া!”

ময়না বেগমের কথায় বিছানা থেকে উঠে বসে সুরাইয়া। গম্ভীরমুখে বলে,” লতার মা রান্নার ব্যবস্থা করতেছে। আজ থেকে সে-ই রান্না করবে।”

ময়না বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কপাল সটান ছড়িয়ে বললেন,” কাজের লোকের হাতের রান্না খাওয়া লাগবে এখন? এমন দিন চলে আসলো যে বাড়ির মানুষ রান্না না করে কাজের লোককে দিয়ে রান্না করাবে?”
” হ্যাঁ আসলোই তো। আপনারাও তো বাড়ির মানুষকে বাড়ির মানুষের মতো না রেখে কাজের মানুষের মতোই রাখতে চান। কাজের মানুষ, কাজের মানুষের মতো থাকলে সমস্যা কোথায়?”
” তোমারে কাজের মানুষের মতোন রাখা হয়?”
” হয় না বলছেন? সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত কে কামলা খাটে কন তো?”
” বাড়ির বউরা বাড়িতে কাজ করবেই, তোমারও করতে হবে।”
” বাড়ির বউ আর কাজের মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাছাড়া আপনার মেয়েরে দিয়ে দিন-রাত এতো কাজ করাতে পারতেন, মা?”

ময়না বেগম যেন আ*গুনে জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” আমার মেয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য বেড়াতে এসে কাম করবে?”
” শ্বশুরবাড়িতে নিজেদের সাথে শ্বাশুড়ির রান্না করা লাগবে জন্য বাসাভাড়া নিছে। ভাবছি আপনার ছেলেকেও বলব হয় নতুন বাসা নিবে নয়তো আমি এ সংসার করব না। ”
” সাহস বেড়ে গেছে তোমার।”
” মেয়ের কথা ভাবলে আমার কথা কেন ভাববেন না? ছেলের বউ বলে? মেয়ের শাশুড়ি মেয়ের সাথে একদিন খারাপ ব্যবহার করেছিল বলে বাসা নিয়ে দিলেন আর আপনি যে প্রতিদিন অত্যা*চার করেন খারাপ ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে? আপনি যদি বাড়ির বউয়ের মতো আমার সাথে ট্রিট না করেন তবে আমি আমার অধিকার বুঝে নিতে বাধ্য হব।”

ময়না বেগম রাগে গটগট করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যান।
_____

অনুষ্ঠানের মাঝে ঘোষণা করা হলো বিশেষ অতিথি চলে এসেছে। এক্ষণি এখানে অবস্থান করবেন। হৃদিতা বোতলের ক্যাপ খুলে কিছুটা পানি খেয়ে অনয়কে বলে ওঠে,” এটাই সেই নেতা?”

অনয় মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,” হ্যাঁ। এটাই। ভাই দেখতে যেরকম আ*গুন, ব্যবহারেও সেরকম আ*গুন। কেউ তার কথার বিরুদ্ধে গেলেই জ্বা*লিয়ে পু*ড়িয়ে ছাড়খা*ড় করে দেয়। ”
” পুরুষ মানুষের এমন না হলে দাম নাই। দেখতে কেমন? ইশিতার সাথে মানাবে?”

ইশিতা হৃদিতাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে,” আমার সাথে মানাতে হবে কেন? তুই নিজের জন্য রেজিস্ট্রি করে নে। আমার লাগবে না।”

হৃদিতা ইশিতাকে ইশারায় চুপ করতে বলে ফাউজিয়া আর সাহিলকে দেখায়। ফাউজিয়া আর সাহিল একপাশে বসে অনুষ্ঠান দেখছে আর কথা বলছে।

অনয় হেসে বলে,” কে বলেছে বন্ধুদের মধ্যে বিয়ে করলে বিয়ে টিকে না? বন্ধুরাই তো বন্ধুকে ভালোমতো চিনে। সাহিল আর ফাউজিয়াকে দেখ, পরিবার থেকে দুজনকে ইন্টারের পরপরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে আজ এতগুলো বছরেও ওদের ভালোবাসা কমেনি। ”

হৃদিতা অনয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,” তোরাও বিয়েটা করে নে। কোনো না কোনো রাস্তা বেরিয়ে যাবে।”
অনয় মুখ গম্ভীর করে ওঠে, ” ওর পরিবার আমাকে মানবে না, হৃদি।”

তাদের কথার মাঝেই চারপাশে জোরেসোরে হৈ হৈ আওয়াজ শোনা যায়। বাহিরে থেকে সেটা গেইট পর্যন্ত এসেছে। কয়েকজনের সাথে ফুলের মালা গলায় ভেতরে প্রবেশ করে আবরার ফাইয়াজ। দুই পাশে খয়েরী শাড়ি পরিহিত মেয়েরা ফুলের পাপড়ি ছড়াচ্ছে। চোখের সানগ্লাসটা খুকে পকেটে রেখে হাত মিলিয়ে সোজা মঞ্চে গিয়ে বসে। দুপাশে আরও কয়েকজন সম্মানিত অতিথি এবং শিক্ষকগণ বসে আছেন।

হৃদিতা প্রথমদিকের সাড়িতে বসায় আবরারকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সাহিলের পাশে থেকে ফাউজিয়া ইশিতাকে ডেকে বলে,” ইশু, লোকটা কী জোশ দেখতে রে!”

ইশিতা ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,” আরেকটা বিয়ে করবি? নাজায়েজ কামকাজ!”
” দেখতে ভালো হইলেই ক্যান বিয়ে করে নেওয়া লাগবে? আমার আছে।”
” তাইলে চুপ থাক।”
” মেজাজ গরম নাকি?”
” তোর কথায় হচ্ছে।”
” চাল হাট..” বলেই ফাউজিয়া সামনের দিকে তাকায়।

একদল মেয়ের নৃত্য পরিবেশনের পরই আবরার ফাইয়াজকে ডাকা হয় তার মূল্যবান বক্তব্যের জন্য। আবরার নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই সামনে বসে, দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে-মেয়ে চিৎকার করে উঠে তালি দিতে থাকে। মেয়েদের গলার স্বর বেশিই কানে আসে সবার। আবরার অবিবাহিত সুদর্শন যুবক বলে একটু বেশিই পরিচিত সবার কাছে। মাইক্রোফোনের কাছে এসে দাঁড়ায় সে।

ভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা বিষয়ক কথা বলতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পার হতেই সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে সে।

এবার গানের পালা। প্রথমেই অনার্স প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী এসে গান গাইতে শুরু করে। চারপাশটা গানের সুরে মেলাচ্ছে কেউ বা বান্ধবীর সাথেই হাতে হাত ধরে নৃত্য করছে আবার কেউ গানের সাথে নিজে গলা মিলিয়ে ধীরে ধীরে হাতে তালি দিয়ে তাল মেলাচ্ছে।

কিচ্ছুক্ষণ বাদের মাইক্রোফোনে গানের জন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী হৃদিকা শেখকে ডাকা হয় সাথে তার পড়াশোনা, ব্যবহারের প্রশংসা চলতে থাকে। হৃদিতার ডাক পড়তেই অনয়ের হাতে থাকা গিটারটা হৃদিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,” অল দ্যি বেস্ট, দোস্ত।”

সাহিল, ফাউজিয়া, ইশিতা সবাই অনয়ের মতো বেস্ট অব লাক জানিয়ে দেয়। সামনে থেকে হৃদিতাকে উঠতে দেখে আশেপাশের শিক্ষার্থীরা তালি দিয়ে ওঠে। সবুজ রঙা শাড়ি, চুল কাধে এসে পড়েছে, ঠোঁটে গাঢ় ম্যাট লিপস্টিক যেন পুরো মুখের শ্রী বাড়িয়ে দিয়েছে। সব নারীকে সুন্দর দেখাতে কোমর বা হাটু পর্যন্ত কেশ থাকা যে জরুরী কোনো বিষয় নয় তা হৃদিতাকে দেখেই অবলোকন করা যায়।

হৃদিতা এগিয়ে যেতে যেতে দেখলো দুটো চোখ যে চোখে মেয়েরা ডুবে যেতে রাজি সে দুটো চোখ ঘুরেফিরে তার দিকে এসে থামছে।

হৃদিতা মুচকি হেসে মনে মনে বলে,” আপনি এবার ম*রেছেন আবরার ফাইয়াজ। ডুবে ডুবে জল খেয়ে ম*রবেন।”

#চলবে……

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০১

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#সূচনা_পর্ব

” আমার স্বামী বিদেশ থেকে আসার পর থেকে বাড়ির মানুষগুলোর সাথেই ব্যস্ত। আমার কাছে আসার সময়ই সে পায় না। বলতে গেলে আমার শাশুড়ি তাকে চুম্বকের মতো আটকে রেখেছে। সে বিদেশ থেকে এসেছে জন্য আমার ননদ, ননদের স্বামী সবাই এসেছে। বাড়ির মানুষগুলো তো বাড়ি ছাড়ছেই না। কেউ যাচ্ছে তো আবার কেউ আসছে। এতগুলো মানুষের জন্য রান্না করতে হচ্ছে। শুধু তিনবেলার রান্না নয়, যখন যে যা খেতে চাইছে তাই রান্না করতে হচ্ছে। সারাদিন রান্নায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। রান্নাবান্না, খাওয়া শেষ করে রাত এগারোটার দিকে বিছানায় একটু শরীর এলিয়ে দিতে পারি কিন্তু তখনো রুমে যেয়ে দেখি উনি ঘরে আসেননি। এভাবেই দিন যাচ্ছে। সংসার সংসার করে পরে আছি অথচ সংসারের মানুষগুলো আমার না।”

বলেই সুরাইয়া মুখটা ভারি করে ফেলল। হৃদিতা শাড়ির আঁচলটা কাধের ওপরে রেখে নাভির দিকের কুচিগুলো ঠিক করতে করতে বলল,” বাদ দাও ভাবি এসব। তোমাকে কিছু শিখিয়ে দিলে তুমি সেটা করো না। আমি কি তোমার খারাপ চেয়ে ওগুলো বলি নাকি? আমি এ পর্যন্ত যা যা বলেছি সেগুলো করলে বড়মা এগুলো করার সাহস পেত না। খচ্চর মহিলা একটা। ছেলেকে বউয়ের কাছে পাঠাবে না তাহলে কি রূপ দেখতে বিয়ে দিছিল নাকি? নিজেরটা তো ঠিকই সাথে সাথে রাখে সবসময়৷”

পাশে নাহার বেগম কড়া নজরে হৃদিতাকে চোখ রাঙিয়ে বলে,” হৃদ, তোমার এসব অশ্লীল কথাবার্তা আমি কিন্তু একদম বরদাস্ত করব না। মুখের ভাষার কি শ্রী! ”

হৃদিতা মায়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে সুরাইয়া বলে ওঠে,” অ্যাই থামো, কুচি ঠিক করে দিচ্ছি না? এতো নড়লে ঠিক করব কীভাবে?”

নাহার বেগম চশমাটা খুলে পাশে রেখে বলে,” রাখো তো সুরাইয়া। এতো বড়ো মেয়ে হয়ে গেছে তাও শাড়িটা পরতে পারে না।”
” রান্না পারি তো? রান্না পারলেই হবে৷ আমি শাড়ি পরে কারো সামনে চৌদ্দপাক দেব না। আমার হাতের রান্না খেয়ে পটে যাবে। আজ অনুষ্ঠান জন্য ভাবিকে ডেকেছি। ” বলে হৃদিতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

নাহার বেগম সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,” আশরাফ এখনো তোমার সাথে সময় কাটায়নি?”

সুরাইয়া মুখ গম্ভীর করে বলে,” না কাকি।”
” কী বলো! এসেছে তো দুই তিনদিন হয়ে গেল।”
” হ্যাঁ, রাতে কখন এসে ঘুমায় টের পাই না। সারাদিন অনেক কাজ করে বিছানায় পিঠ ঠেকালেই ঘুম চলে আসে। শরীরটা সবসময় ক্লান্ত থাকে৷ শরীরটা আর পারছে না এতোকিছু সহ্য করতে।”

“শোনো ভাবি, এখন গিয়ে বাড়িতে বলো তোমার আব্বা অসুস্থ। তোমার বাপের বাড়ি যেতে হবে নয়তো এমন শক্ত হও যেন এরকম কাজের মানুষ হয়ে থাকতে না হয়। যে যেমন তার সাথে তেমন হতে শেখো। এরকম মুখবন্ধ করে সহ্য করতে থাকলে তোমাকে বোবা বানিয়ে দেওয়া হবে৷ এটাই সময়, বর এসেছে তার সাথে সময় কাটাবে, ঘুরতে যাবে তা না বাড়ির মানুষের ফরমায়েশ খাটতে হচ্ছে। আমার কথা শোনো নইলে পস্তাতে হবে। ভাইয়া তিনমাসের জন্য এসেছে, এভাবে চললে দেখবে কবে যেন সময় শেষ হয়ে যায়!” বলেই নিজের ঘরে চলে যায় হৃদিতা।
সে ঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলে,” আমাদের শেখ সাহেব কবে আসবে? সে আসলেই তো তোমার শাশুড়ি সোজা হয়ে যেত।”

সুরাইয়া বাহিরে রাখা চেয়ারে বসতে বসতে বলে,” উমেদ ভাই? সে হয়তো আজই আসবে।”

হৃদিতা বলে ওঠে,” তোমরা নাকি বন্ধু ছিলে আগে? বিয়ের পর তুই থেকে আপনি আর দোস্ত থেকে ভাই ক্যামনে বলো আমার মাথায় ঢোকে না। বন্ধুকে কোনোদিন সম্মান দেওয়া যায় নাকি!”

সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,” এখন তো সম্পর্ক ভিন্ন। বিয়ে হোক আগে তারপর বুঝবে।”
হৃদিতা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,” আমার আবার বিয়ে!”

সে আবার নাহার বেগমের হাতে হাত রেখে বলে,” কাকি, আমি যাই তবে৷ এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আবার কথা শুনতে হবে। ”
” আমার মেয়ে কিন্তু ভুল বলেনি সুরাইয়া। নিজেকে আগে শক্ত করো তারপর এ বাড়িতে তোমার জায়গা। বড়ো আপা এখনো আগের দিনের মানসিকতায় চলছে৷ চোখে আঙুল দিয়ে ভুল দেখিয়ে দাও। ”

সুরাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বলে,” হুম। ”

সুরাইয়া বেরিয়ে চলে যায়। নাহার বেগম সুরাইয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে আফসোস করতে থাকেন তিনি।
হৃদিতা ঘর থেকে মাকে ডেকে বলে,” আম্মা, আজ বাসায় আসতে লেট হবে। আমার ব্যাচের সবাই আসবে। আজ প্লিজ প্যারা দিও না প্লিজ। ”

নাহার বেগম রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,” তোর বাবা বাসায় আসবে। ”
” তোমার স্বামীকে বলে দিও সে সাতদিন ট্যুর দিয়ে বাসায় আসছে আমি কিছু বলিনি। আমার কয়েকটা ঘণ্টা যেন নষ্ট না করে দেয়। ”
” মুখের ভাষা ঠিক কর হৃদি। বাবা হয় তোর।”
” তোমার বর হয় না? বাড়ির সব দোষ আমার, তাই না? টাকা দাও।”
” কীসের টাকা?”
” বাহিরে যাচ্ছি লাগবে। আমার গতমাসের পুরো টাকা দিবে আজ শুধু আয়েশ করব।”
” উমেদ আসলে ওকে পাঠিয়ে দেব?”
” না, আমি চলে আসব।”
” ড্রয়ারে টাকা আছে নিয়ে যা।”
হৃদিতার হাতে গিটার দেখে বলে,” গিটার কেন?”
” গান গাইতে হবে।”

নাহার বেগম নিজের কাজে মন দেন। তিনি জানেন মেয়েকে কিছু বলে লাভ নেই। ওর বিরুদ্ধে গিয়ে কোনোকাজ করলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে ভালো চুপচাপ থাকা। নিজেকে রক্ষা করতে জানে সে।

হৃদিতা রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিতে রান্নাঘরে গিয়ে নাহার বেগমকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে চিবুক রেখে বলে,” তোমার সাইড ব্যাগ লাগবে, তাই না?”
নাহার বেগম পেয়াজ কাটতে কাটতে বলে, ” আমার কিচ্ছু লাগবে না। তোমার বাবা কক্সবাজার গেছে আসার সময় এগুলো নিয়েই আসবে।”
” কোনো ব্যাপার না। আমার টাকা বেঁচে গেল। থাকো আসছি।” বলেই হৃদিতা বেরিয়ে যায়।

নাহার বেগম গলা উঁচিয়ে বলেন,” ফেরার পথে মিষ্টি নিয়ে এসো আর হ্যাঁ পাতলা শালটা নিয়ে যাও। সন্ধ্যা পর শীত লাগবে।”
হৃদিতা সদর দরজায় এসে বলে,” ওহ আম্মু, কালকে থেকে তাহলে আমি নতুন বাসায় উঠছি।”

নাহার বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন,” এসব না করলে হয় না?”

হৃদিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” না, হয় না। আমার খুব কষ্ট হয়।”
__

সুরাইয়া ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিল। ময়না বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,” নেহা আর রাহাত চলে যাচ্ছে। বের হয়ে এসো।”

সুরাইয়া পিছনে না তাকিয়েই বলল,” আম্মা, আপনার বড়ো ছেলেকে একটু বলবেন আমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসতে? সে না গেলেও যেন আমাকে বলে দেয়। ”

ময়না বেগম এগিয়ে এসে বলেন,” তা বাড়ি যাচ্ছ কেন?”
” ভালো লাগছে না। আব্বাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। একটু মায়ের আদর পেতে মন চাইছে।”
” এখানে কি খারাপ আছ? কথা শুনে মনে হচ্ছে এখানে কেউ তোমাকে ভালোবাসে না।”
” বাসেন ভালো? সারাদিন যে বাড়ির এতো এতো কাজ, রান্নাবান্না করি রাত এগারোটায় বিছানায় পিঠ দিতে পারি, দুদিন ধরে গায়ে জ্বর বয়ে বেড়াচ্ছি, জানতে চেয়েছেন কখনো আমার শরীর কেমন আছে?”
” কইছো কিছু? একবারও কইছো যে তোমার জ্বর? না কইলে টের পামু ক্যামনে?”

সুরাইয়া ময়না বেগমের দিকে ফিরে তাকান। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,” দেখেন তো আম্মা, আমার দিকে ভালো করে দেখেই বলেন বোঝা যায় কি না? আসল ব্যাপার কী বলেন তো, এ বাড়ির সবার জন্য আমি থাকলেও আমার জন্য কেউ নাই, কেউ নাই।”

আশরাফ দরজায় এসে দাঁড়ালে সুরাইয়া তাকে দেখে বলে,” আমার স্বামীও নাই আমার জন্য। আমার আসলে কেউ নাই এখানে। তাই এখানে আর মন টিকছে না। জনমানবহীন জায়গায় একা দিন কাটানো যায় কিন্তু যেখানে মানুষ দিয়ে ভর্তি অথচ নিজের মানুষ নাই সেখানে দম বন্ধ হয়ে আসে।”

” বউকে সামলা আশরাফ, বউয়ের সাহস আর আহ্লাদ দুইডাই বাড়ছে।” আশরাফের উপস্থিতি বুঝে ময়না বেগম কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

সুরাইয়ার চোখ টলমল করছে। বারবার চোখের পাতা ফেলে পানি লুকিয়ে ফেলে সে। আশরাফ এগিয়ে আসে সুরাইয়ার দিকে।

বিছানায় বসে ব্যাগ সরিয়ে রেখে বলে,” কী হয়েছে?”

সুরাইয়া অল্পশব্দ ব্যয়ে বলে,” কিছু না। বাড়ি যাব।”
” বাড়ি কেন?”
” ভালো লাগছে না। শান্তিতে শ্বাস নিতে চাই।”
” অশান্তিতে আছ?”
” তুমি প্রশ্ন করছ? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তো কেমন রেখেছ আমাকে?”

আশরাফ কিছু বলে না। সুরাইয়া এবার ফুঁপিয়ে ওঠে। ভাঙা গলায় বলে,” দুই তিনদিনের বেশি হয়ে গেছে এসেছ৷ আমাকে কতটুকু সময় দিয়েছ বলো তো? সারাদিন রাত আমার রান্নাঘরে কেটে যাচ্ছে, খোঁজ নিয়েছ আমার? রাতে কখন এসে পাশে শুয়ে পড়ো সেটাও জানি না। স্বামী-স্ত্রীর যে ব্যক্তিগত সময় কাটানো প্রয়োজন সেটা উপলব্ধি করতে পারো না? ”

আশরাফ নিম্নস্বরে বলে,” জানোই তো আম্মা অসুস্থ আর বাড়ি ভর্তি মানুষ। সবাইকে সময় দিতে হয় তো।”
” সবার জন্য সময় বরাদ্দ আছে আমার জন্য কোথায়? আম্মা অসুস্থ সেবা করছো আর আমি অসুস্থ সেটার খবর পর্যন্ত নাওনি। অদ্ভুত না?”
” আচ্ছা স্যরি৷ নেহা চলে যাচ্ছে ওদের বিদায় দিয়ে এসো আমরা এটা নিয়ে কথা বলছি।”
” আমি বাড়ি যাব, ওদের সাথে আমাকেও বিদায় দাও তুমি।”
” এমন কোরো না। বোঝার চেষ্টা করো একটু।”
” আমি যথেষ্ট বুঝি, তুমি একটু বুঝলে ভালো হয় আর পুরুষ মানুষ শরীরে না ব্যবহারেও হতে শেখো। সবদিকে ব্যালেন্স রাখতে শেখো। একদিকে সরে গেলে আরেকদিক হারাবে সুতরাং বুঝদার তোমার হওয়া উচিৎ। যে পুরুষ নারীর মন রাখতে পারে না তাকে কী বলে জানো তো? মেরুদন্ডহীন পুরুষ বলে।”

আশরাফ র*ক্তলাল চোখে সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” মুখ সামলে কথা বলবে। কী চাই তোমার? শরীরের ক্ষুধা বেড়েছে?” বলেই দরজা আটকে দেয় সে। আশরাফের কথা শুনে ঘৃণায় সুরাইয়ার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কথা দিয়েও যে কাউকে ক্ষ*তবিক্ষ*ত করে দেওয়া যায় এই মুহূর্তটা যেন তার প্রমাণ।

আশরাফ এসে সুরাইয়ার দুই বাহু শক্ত করে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়। সুরাইয়া সেভাবে থেকেই বলে ওঠে,” শরীরের আগে মনের খোরাক মেটাতে শিখুন শেখ সাহেব।”

#চলবে…..

ঘরে ফেরার গান পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#ঘরে_ফেরার_গান (৪)

সবুজের সাথে কথা বলে তানভীর। সবটা শুনে সবুজ জানায় সে সাহায্য করবে তানভীরকে। অবশেষে তানভীর পৌঁছে লাবিবার নীড়ে। দুতলায় ছোট্ট একটা রুম ভাড়া করে সে আর তার রুমমেট থাকে। তানভীরকে ভেতরে যেতে বললে তানভীর সবুজকে বলে,
‘ ভেতরে যাবো না মেয়ে মানুষ আছেন আরেকজন। আমি এখানেই বসছি।ডাকো তোমার বোনকে। ‘
নিচ তলার বারান্দায় তানভীর বেঞ্চে বসে।

সবুজ লাবিবাকে ডেকে নিয়ে আসে। লাবিবা জিজ্ঞেস করে, ‘ নীচ তলায় যেতে বলছো কেনো? তুমি বসো আমার রুমে।’
‘ তোমার পরিচিত একজন দেখা করতে এসেছে।’
‘ কে? কেউ নেই তো এমন যে আমার সাথে দেখা করতে আসবে।’

তানভীরকে দেখে লাবিবা দাঁড়িয়ে যায়। কি হচ্ছে বুঝতে পেরে সিড়ির দিকে দৌড় দেয়। তানভীর সাথে সাথে সবুজ কে বলে, ‘ আটকাও ওকে। ‘
লাবিবা বলে, ‘ সবুজ ভাই এটা তুমি ঠিক করলে না। ‘
তানভীর সবুজের হাত থেকে লাবিবার হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় নিজের দিকে টেনে আনে। ব্যাথা পেয়ে লাবিবা মৃদু চিৎকার করে। তানভীর হাতের চাপ কমিয়ে দেয়। আলতো ভাবে ধরে কিন্তু হাত ছাড়ে না। তানভীর বলে,
‘ প্রথম স্পর্শ ঠিক প্রথম পরিচয়ের মতোই বেদনা দায়ক। কিন্তু আস্তে আস্তে সব কোমল হয়ে এসেছে। সম্পর্কটাকেও কোমলতার চাদরে মুড়িয়ে নিতে চাই। আমার সাথে চলো। প্লিজ। ‘
‘ আপনার সাথে কেনো যাবো?’
‘ স্বামীর ঘরে যেতে হবে না? আর কতো লুকোচুরি খেলবে?’
‘ আপনি আমার স্বামী না। ঐটা কোনো বিয়েই না। মতের বিরুদ্ধে বিয়ে হয় না। না আপনার মত ছিলো না আমি বুঝে উঠতে পেরেছিলাম। কোনো ডকুমেন্টস নেই। সেই সময়টা আমার জন্য একটা দুঃস্বপ্ন।’
‘ আম্মুকে ডাকো। আমি আম্মুর সাথে কথা বলবো।’
‘নেই। বাবার কাছে চলে গেছে। ‘
তানভীর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে । লাবিবার চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছে। অবাধ্য জল গুলো এই যেনো টুপ টুপ করে পরবে পরবে। সুনসান নীরবতায় ভরে যায় চারিপাশ। ততোক্ষনে বারান্দায় দু একজন উঁকি দিচ্ছে। সবার মনে কৌতুহল লাবিবার হাত ধরে লোকটা কে? বেশ কিছুক্ষন পর তানভীর বলে,
‘ তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে আমার। তোমাকে সব শুনতেই হবে লাবিবা।’
‘ আমার কিছু শুনার নেই। ছোটবেলার সেই এক্সিডেন্টটার কথা আমি ভুলে গেছি। আপনিও ভুলে যান। আপনার ভাই আমাকে অপহরণ করেছিলো একটুকুই সত্য। বাকি সব মিথ্যে। ‘
‘ তিন কবুল কখনো মিথ্যে হতে পারে না।’
‘ স্মৃতি থেকে মুছে দিলেই শেষ।’
‘ শেষ নয়। ইউনিয়নের শতাধিক মানুষকে সাক্ষী রেখে আল্লাহর কালাম পড়ে বিয়ে করেছি আমরা।’
‘ সাক্ষী সাক্ষীর জায়গায় আর আমি আজ আমার জায়গায়। ফিরে যান আপনি। ‘
‘ আমার সাথে চলো। প্লিজ। ‘
লাবিবা হাত ছাড়িয়ে নিতেই তানভীর আবার ধরে ফেলে। লাবিবা জোরে শ্বাস ফেলে বলে,
‘ জোর খাটাবেন না। আপনাদের বাড়ির সকলেই জোর খাটায়। আমি দুর্বল। দুর্বলের সাথে জোর খাটাতে নেই।’
তানভীর হাত ছেড়ে দেয়। লাবিবা ধীরে ধীরে দুতলায় উঠে যায়। সবুজকে বলে,
‘ সবুজ ভাই উনাকে নিয়ে চলে যান। উনাকে বলে দিবেন যেনো আমার কাছে না আসে আর। ‘

পরেরদিন রাতে একটা কল আসে। লাবিবা রিসিভ করে জানতে চায়, ‘ কে?’
‘ ভাবি আমি ইকবাল। ‘
‘ আমি কোনো ইকবালকে চিনি না। ‘
‘ ভাবি শুনুন আমার কথা। ‘
লাবিবা ফোন কেটে দেয়। আসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে মাথায়। স্লিপিং পিল নিয়ে ঘুমাতে হয় তাকে। সে অনুভব করেছিলো একদিন টুপ করে মরে পরে থাকবে। কেউ জানতেও পারবে না। সেজন্য একজন রুমমেট রেখেছে সাথে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পাওয়া যায় তাকে। লাবিবা ডাকে,
‘ রিনি?’
‘ জি আপু?’
‘ পড়া শেষ করে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরিস। আমি ঘুমালাম। ‘
‘ আচ্ছা আপু। ‘
ঘুমের মাঝে লাবিবা ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখে। যেনো তার বাবা মা দুজনেই তার মাথায় বার বার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর গুনগুন করে কাঁদছে। এই ধরনের স্বপ্ন কেনো দেখলো সে? বাবা মাকে স্বপ্ন দেখে কিন্তু কখনো একসাথে দেখে না। তারা কাঁদছে কেনো? তাহলে কি তারা ভালো নেই? ছোট্ট মনটা ভয়ার্ত হয় লাবিবার। জুম্মাবারে ফজরের পর বড় মসজিদে আসে। ইমামের সাথে কথা বলে ফেরার পথে ইকবাল এসে পথ আটকায়। ভাবি ভাবি বলে সামনে এসে দাঁড়ায়। লাবিবা দেখেও না দেখার ভান করে এগিয়ে যায়। ইকবাল আবার পথ আটকায়। লাবিবা দাঁড়িয়ে যায়। লাবিবা এবার রিয়েক্ট করতে গিয়েও ধৈর্য্য নিয়ে বলে,
‘কি বলবেন?’
‘ আপনাকে অনেক কিছুই বলবো ভাবি যা আপনি জানেন না। ‘
‘ কি জানি না?’
‘ সাইডে এসে দাঁড়ান। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো ঠিক না। ‘
দুজনে একটা মিষ্টির দোকানে এসে বসে। ইকবাল লাবিবার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সবটা লাবিবাকে খুলে বলে। তারপর হাত জোড় করে বলে,
‘ ভাইকে গ্ৰহণ করেন ভাবি। ভাই দ্বিতীয় বার বিয়ে করে নি। আপনার জন্য অপেক্ষা করেছে এতোগুলো বছর।’
‘ সেজন্য আপনার ভাইকে ধন্যবাদ। এতোবড় ত্যাগ সত্যি কেউ কখনও করতে পারেনা। আপনার ভাই করে দেখিয়েছে। ‘
‘ ভাবি একবার বোঝার চেষ্টা করেন।’
‘ আমার সামনে আসবেন না ইকবাল ভাই। আপনি যতবার আমার সামনে এসেছেন ততোবার আমার জীবনের অকারেন্স ঘটেছে। আবার কোনো অকারেন্সের মুখোমুখি হতে পারবো না আমি। আমার সেই ক্ষমতা নেই। ‘
‘ ক্ষমা করবেন আমাকে ভাবি। আসলে বয়সটাই ঐরকম ছিলো যে __’
লাবিবা একবার ইকবালকে ভালো করে দেখে নেয়। সত্যিই চেঞ্জ! সময়ের সাথে সাথে আমাদের চেঞ্জ যেনো আবশ্যক। শুধু বদলাতে পারলো না লাবিবা। কেনো শক্ত হতে পারে না সে? কেনো কষ্ট সহ্য করতে পারে না? মা বাবার কথা মনে পড়লেই তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। ক্লাস নাইনের সেই অপহরণ, গ্ৰাম পঞ্চায়েত, বিয়ে সবকিছু সে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেয়েও পারে না। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠে সেই চড়ের দৃশ্য। কিভাবে অপমানিত হয়েছে সে আর তার বাবা মা! আর তানভীর? সে হচ্ছে সব থেকে বড় অপরাধী। তাকে লাবিবা কিভাবে ক্ষমা করবে সে জানে না। ঐ লোকটা ঠিক কতোটা পরিমাণ দোষী সেটাও লাবিবা পরিমাপ করতে পারে না। ইকবালের কথা গুলো যদি সত্যি হয় তাহলে তারা দুজনেই পরিস্থিতির শিকার। ভাগ্য খেলা করছে তাদের নিয়ে। লাবিবার হাস ফাস লাগে। এই বিষাক্ত অনুভুতি থেকে বেরোতে চায়। শহর ছেড়ে সে ছুটে চলে অন্য শহরে। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। একটা হোস্টেলে উঠেই কাজের সন্ধান করে। স্যালসম্যানের কাজ পায় একটা শো রুমে। সেভাবেই তার দিন যাচ্ছে। কিন্তু হোস্টেলের রুমমেট দের সাথে বনিবনা হচ্ছে না। মেয়ে গুলো বেশ উগ্ৰ। অনান্যরাও একেকজন একেকরকম। সেই থেকে সে সাবলেটে একটা বাসা খুঁজছে। এই খবর শোনার পরে শো রুমের ম্যানেজার লাবিবাকে অফার করে,
‘ আমাদের শো রুমের ওনার যে তার একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে। স্যার খুব একটা থাকেন না বললেই চলে। তাই এমন একজনকে প্রয়োজন যে সেই বাড়িতে থাকবে এবং বাড়ির খেয়াল রাখবে। মানে কেয়ার টেকার আর কি। ‘
‘ দারোয়ান নেই?’
‘ সব সুবিধাই আছে। এতে তোমার কাজের টাকাও পেলে আবার এখানকার টাকাও পেলে। ডাবল বেতন। তুমি চাইলে পরিচিত কাউকে পরে নিজের কাছে রেখেও দিতে পারো। সুযোগটা হাত ছাড়া করলে সত্যিই প্রস্তাবে। ‘
লাবিবাও ভেবে দেখলো তার হাতে সত্যিই ভালো সুযোগ এটি। এরকম সুযোগ সে কখনোই পাবে না। তার উপর সে যেখানে কাজ করছে সেই ব্যান্ড কোম্পানির মালিকের ই বাসা। ফেভার ও পাবে। অবশেষে সে হ্যা বলে দেয়। নিজের লাগেজ নিয়ে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে আসে শো রুমে। ম্যানেজার মুচকি হেসে আবারো বলে, ‘ আপনি কি শিউর যে নতুন কাজটি নিচ্ছেন?’
‘ জি স্যার।’
‘ পরে মত পাল্টাবেন না তো?’
‘ না স্যার। তবে শর্ত একটাই আমাকে দুই জায়গাতেই কাজ করতে দিতে হবে। শুধু টাকার জন্য না। আমি যদি লোকালয়ে না আসতে পারি তাহলে আমার মাঝে ডিপ্রেশন কাজ করে। ‘
‘ সে আমরা জানি মিসেস। তবে কনফার্ম করছেন।’
‘ অবশ্যই। ‘
‘ দুপুর দিকে স্যারের অফিসে যাবো আপনাকে নিয়ে। স্মার্টলি ড্রেসাপে যাবেন। স্যার স্মার্ট কাউকে খুঁজছেন যিনি বাড়ি এবং বাহির সমানভাবে সামলে নিতে পারবেন। ‘
‘ আমি চেষ্টা করবো। ‘

অফিসে এসে লাবিবার শরীর মৃদু কেঁপে উঠে। এই সে কোথায় চলে এসেছে? সে ভেবেছিলো শহর ছেড়ে সে তানভীরের আওতার বাহিরে চলে এসেছে। কিন্তু না আরো আরো বেশি জড়িয়ে গেছে। তানভীরের চাচী দৌড়ে এসে লাবিবাকে জড়িয়ে ধরে চোঁখের পানি ছেড়ে দেয়।
‘ ওরে মা কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই? তোর শোকে আমার ছেলেটা একেবারে ছন্নছাড়া। কোথায় কোথায় না খুঁজেছে তোকে। এতোটা মান মনে পুষে রাখতে হয় মা? স্বামীর জন্য কলিজায় টান পড়ে না?ভালো আছিস তো?হ্যা?’
লাবিবার অবাক হবার পালা এখনো শেষ হয়নি। ইকবাল, ইকবালের বউ, বাচ্চা, উকিল, সেই বড় মসজিদের ইমাম, সবুজ, রিনি সবাই উপস্থিত। সবার পেছনে চোখ পড়ে তানভীরের উপর। লাবিবা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। চাচীর বাহু ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নেয়। চাচী খপ করে হাত ধরে ফেলে তাকে। লাবিবা চিৎকার করে বলে,
‘ ছাড়ুন আমাকে । মিথ্যা বলে আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে। চলে যাবো আমি এখান থেকে।’
‘ কোথায় যাবি মা? আমরা ছাড়া তোর আপন বলতে কে আছে? আমাদের সাথে চল। তোর আসল ঠিকানাতে।’
‘ যে বাড়ি থেকে একবার অপমানিত হয়ে আমাকে আমার বাবা মাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলো বার বার চেষ্টা করেও সেই বাড়িতে গ্ৰহণ করা হয়নি সেই বাড়িতে আমি যাবো না। আমার কেউ নেই। আপনারা আমার কেউ নন। আমার আপন বলতে শুধুই আমি। ‘
তানভীর এই মুহূর্তে কথা বলে,
‘ চাচী ওকে বলে দাও যেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছিলো আমি সেই বাড়ির কোনো অস্তিত্বই রাখিনি। যে তাকে বের করে দিয়েছিলো সে এখন কবরে আল্লাহর নিকট হিসাব দিতে ব্যস্ত। আর আমি ক্ষমা প্রার্থী। ও যেনো আমাকে অস্বীকার না করে বরং আমাদের সম্পর্ক যেনো অটুট রাখে। ‘
‘ যে সম্পর্ক তৈরীই হয়নি সেই সম্পর্ক অটুট রাখার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? ‘
‘ সব হবে। সব।’
ম্যানেজার বলে,
‘ ম্যাম আপনি কিন্তু সিউর হয়েই এসেছেন। বলেছেন পরে মত পাল্টাবেন না। ‘
লাবিবা এমন ভাবে তাকায় যে ম্যানেজার ভয়ে আমতা আমতা শুরু করে।
‘ এতো বড় বড় চোখে এমন করে তাকাবেন না ম্যাম। শো রুমেও আপনি কাজ করবেন পাশাপাশি বাড়ি দেখাশুনার কাজ নিতে গেলেও এগ্ৰিমেন্টে সাইন দিয়ে তো নিতে হবে। উকিল সাহেব এখানেই আছেন পেপার্স গুলো দেখান তবে।’
‘ আমাকে বন্দি করার চেষ্টা করা হচ্ছে আর আপনি এখনো শোরুম, বাড়ি বলে ডপ দিয়ে যাচ্ছেন?’
রিনি ফিক করে হেসে দিলে উপস্থিত ব্যাক্তিবর্গ মুখ টিপে হাসে। তানভীরও আড়ালে মুখ করে অল্প হাসে। লাবিবাকে চাচী সোফায় এনে বসায়। লাবিবা কাঁদছে। তার মনে হচ্ছে সে বড্ড অসহায়। চাচী বলে,
‘ আয় হায়! কাঁদছিস কেনো? এই দেখবি ইকবালটার কতো সুন্দর মেয়ে হয়েছে? আমি তো চেয়েছিলাম তোর মতো বড় বড় চোখ হোক। কিন্তু তুই তো ছিলি না সেজন্য ছোটবউ তুতুলকে পেটে নিয়ে তোকে দেখতেও পারতো না। রোজ সকালে উঠে তোর মুখ দেখলে তোর মতোই মুখখানা পেতো বল।’
লাবিবার কান্না আরো বেড়ে যায়। তুতুল এসে কোলে চাপে। তার হাতে চিপস। সে আআআআ করে লাবিবাকে খাওয়াতে চায়। লাবিবা মুখ সরিয়ে নেয়। ইকবাল বলে, ‘ উকিল সাহেব আপনাদের কাজ শুরু করুন। ‘
তারা সায় দেয়। তানভীর কিছু মুহূর্ত লাবিবার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
‘ চাচী আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। ততোক্ষনে ওকে বোঝাও, কান্না বন্ধ করাও। ও স্বাভাবিক হবার পরেই বিয়েটা হবে। ‘
ইকবালের বউ লাবিবাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ইকবাল ও রিকুয়েস্ট করে। চাচী বলে,
‘ আমিই আজ থেকে তোর মা। ‘
তানভীর ফিরে প্রায় পঁচিশ মিনিট লাগিয়ে। একটা ব্যাগ ভাইয়ের বউয়ের হাতে দিয়ে বলে,
‘ তোমার ঝা কে রেডি করিয়ে দাও আমরিন। ‘
চাচীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তানভীরকে পাশে ডেকে বলে, ‘ কি কি এনেছিস?’
‘ একটা শাড়ি আর একটা ব্রাইডাল সেট, জুতা আর যা যা লাগে। ‘
‘ দেখে শুনে সোনা নিয়েছো তো? আমারই ভুল বাবা। একদমই মনে ছিলো না নতুন বউয়ের কেনাকাটার কথা।’
‘ ইটস ওকে। সমস্যা নেই। তুমি যেটুকু করছো সেটুকু তো আমার মা ও আমার জন্য করেনি। ছোট বেলা থেকেই তোমার কাছেই বড় হয়েছি। তোমাকেই দ্বিতীয় মা বলে জেনেছি। আমি তাড়াহুড়োতে পরশ জুয়েলার্স থেকে যা পছন্দ হয়েছে তাই নিয়ে এসেছি আপাতত । পরেরটা তুমি দেখে নিও । ‘
‘ ঠিক আছে। আমি কাল বউমার যা যা লাগে সব নিয়ে আসবো। ‘

লম্বা ঘোমটা মাথায় লাবিবাকে নিয়ে আসে আমরিন। দ্বিতীয় বার বসে বিয়েতে। প্রথমবার অবুঝ অবস্থায় দ্বিতীয়বার মনের বিরুদ্ধে। দুটোই পরিস্থিতির চাপে। লাবিবার ইচ্ছে করছে দৌড়ে এই ভিড় থেকে পালিয়ে যেতে। যেখানে গেলে সে একটু স্বস্তি পাবে। ঠিক তখনই হাতের উপর হাত রাখে তানভীর। একদিন স্কুল ড্রেসে বিয়েতে বসতে হয়েছিলো তাকে। আজ তানভীর শাড়ি গহনায় বউ সাজিয়ে বসিয়েছে তাকে। ধর্ম এবং আইনমতে বাঁধা পড়ে দুজনে। ইকবাল মিষ্টি বিতরণ করে সবার মাঝে। লাবিবা এবং তানভীরের মাঝামাঝি এসে বলে,
‘ শোনো দুজনকেই বলছি, বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে। তাড়াতাড়ি চাচ্চু ডাক শোনাবে আমাকে। ‘
লাবিবা ঘাড় ফিরিয়ে ইকবালের দিকে তাকায় খেয়ে ফেলবো দৃষ্টিতে। ইকবাল ঝটপট সেখান থেকে সরে যায়।

সাদা রঙের ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তাঁদের গাড়ি। ইকবালরা থাকে অন্য বাড়িতে। আগামীকাল আসবে বলে তানভীর লাবিবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। তানভীর গাড়ির দরজা খুলে দেয়। লাবিবা একপলক সুন্দর বাড়িটা দেখে নিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তানভীর বলে, ‘ নেমে আসো। ‘
‘ আপনারা শুধু জোর জবরদস্তিই করতে পারেন। আমি নিষেধ করেছিলাম আপনাকে। তানভীর আমাকে যেতে দিন আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না আপনাকে।’
‘ আমি বুড়ো বলে?’
লাবিবা মাথা তুলে তাকায় তানভীরের দিকে। তানভীর গাড়ির ভেতরে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে লাবিবার মুখোমুখি হয়। আলতো হেসে বলে,
‘ সকল চিন্তা দূরে সরিয়ে ঠান্ডা মাথায় একটা ব্যাপার ক্যালকুলেট করে দেখো মনের বিরুদ্ধে কাউকে মেনে নিতে ঠিক কেমন ফিলিংস হয়। ঠিক এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমিও গিয়েছি একটা সময়, যখন আমি প্রায় এসটাবলিশড একজন ছেলে আর তুমি স্কুল পড়ুয়া একটা বাচ্চা মেয়ে। অচেনা অজানা একটা মেয়ে। যতদিনে তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হলে আমি তোমাকে গ্ৰহণ করতে চাইলাম আর তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে। যখন তোমাকে খুঁজে পেলাম তুমি আবার হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে। ‘
তানভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘ নেমে আসো।’
লাবিবা তখনো ঠায় বসে আছে। তানভীর ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে লাবিবাকে কোলে তুলে নেয়। লাবিবা আচমকা ভয় পেয়ে তানভীরের গলা জড়িয়ে ধরে। তাকে এনে নামায় সদর দরজার সামনে। পকেট থেকে চাবিটা বের করে দরজা খুলে দেয়।
‘ ভেতরে যাও। এই বাড়িটা আমি বানিয়েছি তোমার জন্যে। আসার সময় খেয়াল করো নি। গেইটের পাশে লেখা আছে “লাবিবা কটেজ” । পরে দেখে নিবে।
লাবিবা এগিয়ে যেতেই তানভীর বলে,
‘ ডান পা রাখবে প্রথমে। ‘
লাবিবা বা পা তুলেছিলো। সেই পা নামিয়ে ডান পা রেখে প্রবেশ করে তার নতুন ঘরে। সুইচ টিপতেই আলোকিত হয়ে উঠে। সপ্নের মতো একটা ঘর। লাবিবা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ভেতর দিকে। তার পাশেই হাঁটছে তানভীর। হুট করেই লাবিবার আঁচলে টান পরে। ফিরে তাকালে দেখে তানভীর অনেক গুলো চাবির একটা গোছা বেঁধে দিচ্ছে লাবিবার বেনারসীর আঁচলে। লাবিবাকে তাকাতে দেখে তানভীর বলে,
‘ আমাকে এখন মেনে নিতেই হবে তার কোনো জোর নেই। আস্তে ধীরে সব হবে। ঘরটা তোমার, স্বযত্নে রেখো আগলে। আমার শুধু এতোটুকুই চাওয়া কাজ শেষে ঘরে ফেরার টান যেনো জন্মে। মন যেনো তাড়া দেয় আমার অপেক্ষায় ঘরে অপেক্ষায় আছে একটা চাঁদ,এই বলে। ‘

(সমাপ্ত)

ঘরে ফেরার গান পর্ব-০৩

0

#ঘরে_ফেরার_গান (৩)

কতো মানুষের নামই তো এক হয়। তানভীর এই ভেবে আর খোঁজ নিতে যায়নি সেই রেস্টুরেন্টে। বর্ষা শেষে এখন শরৎ।আকাশটা ভীষন পরিষ্কার। তানভীর আবার বাবুবাজার রোডে । ভ্যাপসা গরম ছুটেছে। ঠান্ডা কিছু খাওয়া দরকার ভেবে গাড়ি থামায় সেই রেস্টুরেন্টের সামনে। অর্ডার দিয়ে বসে টেরেসে দাড়ায়। ক্ষনে ক্ষনে একটু একটু হাওয়া আসছে এদিকে। এসির বাতাস অপেক্ষা প্রাকৃতিক বাতাস ঢের ভালো। সেসময়ই নিচের দিকে তাকাতেই দেখে হাসি হাসি মুখে একজন রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। গোলাপী বোরখা হিজাবে মুখখানাই শুধু দেখা যাচ্ছে। তানভীর বুকে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। দৌড়ে ছুটে যায় ভেতর দিকে। ওয়েটার তানভীরের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘ য়্যার য়্যু ওকে স্যার? ‘
তানভীর থেমে যায়। আশপাশ তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা টেবিল ফিলাপ। তানভীর জোরে শ্বাস নেয়। ওয়েটারকে বলে, ‘ আমার অর্ডার মেক হতে কতক্ষন? ‘
‘ এইতো হয়ে যাবে স্যার। আপনি প্লিজ বসুন। ‘
‘ আপনাদের শেফ কি যেনো নাম? উমম মিস লাবিবা নাকি?’
‘ মিসেস লাবিবা স্যার। ‘
তানভীর একটা ফাঁকা ঢুক গিলে। মনের ভেতর আনাগোনা করে কিছু ভয়। মাথায় অপ্রত্যাশিত কিছু বাক্য। সেসবকে পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘ উনাকে একবার আমার টেবিলে আসতে বলবেন।’
‘ উনি মাত্র আসলেন। এখন ব্যস্ত আছেন স্যার। ‘
‘ ফ্রি হয়ে আসতে বলবেন। ততোক্ষন আমি অপেক্ষা করছি। ‘

প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর লাবিবাকে তানভীরের দিকে আসতে দেখা যায়।বোরখা ছেড়ে এখন পরনে শেফের কষ্টিউম। তানভীর অর্ডারের ড্রিংকস গুলো এখনো নেয়নি। তার গলা দিয়ে নামবে না সেসব এখন। লাবিবা মিষ্টি কন্ঠে সালাম জানায়।
‘ সরি ফর লেট। আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি স্যার? ‘
তানভীর সামনের চেয়ারে ইশারা করে বসার জন্য।
লাবিবা বসে। এখন আর তার মুখে হাসি নেই।
তানভীর বলে, ‘ লুক এট মি। বিশ মিনিট সময় চাইছি। কিছু কথা আছে আপনার সাথে। ‘
‘ জি স্যার বলুন। ‘
‘ আমি তানভীর খান। নওয়াবগঞ্জ গ্ৰামের লাবিবার হাজব্যান্ড। তুমি কি চিনতে পেরেছো আমাকে?’
লাবিবা অমাইক হাসে।
‘ সরি স্যার আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। ‘
‘ বাট আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। অফ কয়টায় তোমার? আমি নিতে আসবো তোমাকে।’
‘ সরি স্যার। আপনি কোনো আমাকে নিতে আসবেন? আমি সত্যি আপনাকে চিনতে পারছি না। ‘
‘ আবার বিয়ে করেছো?’
‘ মানে? আ’ ম অলরেডি ম্যারিড স্যার। আমার হাজব্যান্ড আছে। ‘
তানভীর ছুটে যায় রিসিপশনের দিকে। সেখান থেকে জেনে নেয় এমপ্লয়িদের ডকুমেন্টস কোথায় আছে এবং ওনার কে? বায়ো তে হাজব্যান্ডের নামের জায়গায় নিজের নামটা পেয়ে তবেই তানভীর ক্ষান্ত হয়।
তানভীরকে বেরিয়ে যেতে দেখে লাবিবা নিজের কাজে ফিরে। সবুজ এসে জিজ্ঞেস করে,
‘ কে লোকটি?’
‘ মি. তানভীর খান। ‘
‘ হুয়াট? তোমার হাজব্যান্ড?’
লাবিবা উত্তর দেয়না।
‘ এই লোকটাই তো একদিন বৃষ্টির মধ্যে এসে শুঁটকি ভর্তা ডিম ভাজি ভাত খেয়ে গেছে। তুমি বললে না কেনো এই তোমার হাজব্যান্ড? তোমার হাতের রান্না খেয়েও লোকটা বুঝতে পারলো না?’
সবুজ থামে। একটু চিন্তা করে বলে,
‘ ওয়েট ওয়েট রাগারাগি হয়েছিলো তোমাদের মধ্যে? কিভাবে কি? আমি না ঠিক বুঝতে পারছিনা। আর এই লোক তো দেখেই বোঝা যায় টাকার কুমির। তুমি কাজ করছো কেনো তবে এই রেস্টুরেন্টে? লাবিবা তাকাও আমার দিকে। ‘
লাবিবাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েই সবুজ অবাক হয়। লাবিবা কাঁদছে। এই কান্নার মানে কি?
‘ সবুজ ভাই।’
‘ কি হয়েছে? বলো আমাকে। ‘
‘ শরীর খারাপ লাগছে। ছুটির কথা বলে আসুন আমি বেরিয়ে যাচ্ছি বাসার দিকে। ‘
রাতে তানভীর এসে লাবিবাকে পায়না। দুদিন পর জানতে পারে লাবিবা রিজাইন দিয়ে দিয়েছে। তানভীর মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। এতো খোঁজাখুঁজির পর পেয়েও কি হারালো লাবিবা কে!

তানভীরের মা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না বিয়েটা। আজ বাদে কাল ছেলে ব্যবসায় বসবে তারপর ধুমধাম করে বিয়ে দিবে বান্ধুবীর মেয়ের সাথে যা অনেক আগে থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে সেখানে স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়েকে ছেলের পাশে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে মেয়েটাকে তার দেবরের ছেলে অপহরণ করেছে। ঐ দুশ্চরিত্র ছেলে পালিয়ে গেছে এখন বোঝা এসেছে পরেছে তার ছেলের ঘাড়ে। দুদিন পর তো এটাও মানুষ বলবে এক ভাইয়ের ফেলে দেওয়া জিনিস আরেক ভাই গ্ৰহণ করে। ছি ছি! সে কান্নায় ভেঙে পরে। রাগের মাথায় লাবিবার গালে থাপ্পড় দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। লাবিবা বাবার বাহুতে এসে পরে। সে জলভরা শুধু দেখছে তার দিকে সবাই কেমন কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছে। অল্প বয়সেই ভালো গ্ৰোথ হওয়ায় বাবা তাকে সব সময় আগলে রেখেছে। স্কুল বাদে কোনো বিয়ে বাড়ি অব্দি যেতে দেয়নি। আজ সে কতো লোকের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। অস্বস্তিতে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে রাখে। তার বাবা তানভীরের পরিবারের সাথে কথা বলছে। সেই যে গিয়েছে আর মেয়ের কাছে আসতে পারছেনা। মেয়েকে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছেনা। তার উপর নতুন বেইনীর বিরূপ মনোভাব তাকে ভাবাচ্ছে। সব শেষে তানভীরের বাবা প্রস্তাব রাখে তার ছেলেও এসটাবলিশ হোক আর মেয়েও বাবার কাছে থেকে পড়াশুনা করুক। বয়স আঠারো হলে তারপর অনুষ্ঠান করে ঘরে তোলা যাবে।
সেদিন মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসে লাবিবার বাবা। তারপর আর দুই পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই। তানভীরও ততোদিনে ভুলে গেছে যে তার বিয়ে হয়েছিল। তার একটা ছোট্ট বউ আছে। নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। তার মনে পরে সেদিন যেদিন তার বাবা ফোন করে বলে,
‘ তানভীর তোমার শ্বশুড় মারা গেছে। কাল সকাল নয়টায় জানাজা হবে। ‘
সেদিন রাতেই ঢাকা থেকে রওনা দেয়। প্রায় পাঁচ বছর পর স্মৃতিতে আসে সেই পিচ্চি মেয়েটা। সবুজ সাদা স্কুল ড্রেসে লাল উড়না মাথায় দেওয়া বউ টি। বাবা চাচার সাথে দাঁড়িয়ে শ্বশুড়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করে। বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া হয়। তানভীরের বাবা জানতে চায়, লাবিবার সাথে দেখা করে আসবে?
বাড়ির ভেতর থেকে গুনগুনিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। তানভীর মাথা নাড়িয়ে ভেতরে যায়। তাকে দেখেই মহিলাদের মাঝে গুণগুণ শব্দ উঠে, এইটাই লাবিবার জামাই? জামাইরে লাবিবার কাছে নিয়ে যাও। একটা টুল আনো জামাইরে বসতে দাও। আহারে মেয়েটা স্বামীর বাড়ি যাওয়ার আগেই বাপটা হারালো। বড় ঘরে অনুষ্টান করে তুলে দিতে লাবিবার মা কোথা থেকে এতো টাকা পয়সা জোগাড় করবো?

তানভীর তার চাচার কাছে সকালে সব শুনেছে দুই বছর থেকে মরণব্যাধির চিকিৎসা করতে করতে তাদের প্রায় সব ফুরিয়েছে। এখন শুধু আছে বাড়িটাই। এরমাঝে কয়েকবার মেয়েকে ঘরে তুলার ফরিয়াদ জানিয়েছে ভদ্রলোক। পরে পরে করতে করতে আজ এতোদূর। ভীড় ঠেলে কয়েকজন মহিলা বাড়ির পেছনের ইয়ার্ডে নিয়ে যায় তানভীরকে। সেখানেই কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যাওয়া মায়ের মাথা কোলে নিয়ে পাথরের মতো বসে আছে লাবিবা। ধুলোবালি লেগে আছে জামাতে। মাথার কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। গলার উড়না ঝুলছে একপাশে। সেদিনের পিচ্চি মেয়ে আর নেই। তানভীরের সামনে ব্যাথিত এক রক্তচোখী ফুটন্ত গোলাপ অনাদরে বসে আছে মাটিতে। সে ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে যায়। হাঁটু গেড়ে সামনে বসে। মৃদু স্বরে ডাকে,
‘ লাবিবা?’
লাবিবা চোখ তুলে তাকায়। তানভীর কোনো কথা খুঁজে পায় না। দুজনেই দুজনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়। ভেতরে অনেক কথা জমা আছে। মুখ ফুটে তা প্রকাশ পায় না। চোখের কোনে জল চিকচিক করে। তানভীর অনুভব করে তার বুকে ব্যাথা হচ্ছে। অসহ্য এক ব্যাথা।

বাড়ি ফিরে জানায় লাবিবাকে ঘরে তুলবে।বড় কোনো অনুষ্ঠান লাগবে না। রেজিঃ করতে ছোট একটা অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলবে। তানভীরের মা এ সম্পর্কে কিছুই বলে না। তার বান্ধুবী অনেক আগেই তার কথা ফিরিয়ে নিয়েছে। বিবাহিত ছেলের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে দিবে না। তানভীর যে লাবিবাকে দেখে এসেছে পাঁচ বছর আগেই তাকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলো তার বাবা। আজ বাবা নেই। তানভীর যদি লেট করে তাহলে এই ফুল নষ্ট হতে সময় লাগবে না। তিনদিনের দোয়ার পরে তানভীরের বাবা যায় লাবিবার মায়ের সাথে কথা বলতে। কিন্তু গিয়ে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারে বাড়িটা মেম্বারের কাছে বিক্রি করে দিয়ে মা মেয়ে গ্ৰাম ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানে না। আত্মীয় স্বজনদের থেকে খবর নেওয়া হয়। হুট করেই দুটো মানুষ উধাও হয়ে গেলো। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারে না। সেই থেকে অশান্তি শুরু। তানভীর নিজেকে দোষী ভাবতে থাকে। তার নিজের দোষে সে লাবিবাকে হারিয়েছে। পরিবার লাবিবা আর তার মাকে দোষ দিলেও তানভীর জানে তারা কোনো অন্যায় করেনি। সকল অপরাধ তার। কোন ভরসাই বা লাবিবা তানভীরকে জানাবে? তার কাছে আসবে? তানভীর কি একবারো তাকে সেই সুযোগ দিয়েছে? না। বুঝিয়েছে তার জীবনে লাবিবার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু সেই মেয়েটাই আজ তানভীরের পুরোটা জায়গা দখল করে আছে।

চলবে।

ঘরে ফেরার গান পর্ব-০২

0

#ঘরে_ফেরার_গান (২)

‘ লাবিবা ‘
তিন অক্ষরের এই নামটাতেই তানভীর আটকে যায়। ভীষণ আপন অনুভব হয়। সময় থাকতে এই অনুভূতি গুলো কেনো হয়নি? কবুলের এতো জোর! বছরের পর বছর যায় বিন্দু পরিমাণ তার হ্রাস নেই বরং বেড়েই চলেছে। তানভীরের জীবনে লাবিবা একজন অনাকাঙ্খিত ব্যাক্তি। যাদের শুরুটাই হয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তাঁদের সমাপ্তি। সমাপ্তি কিনা জানা নেই তবে তানভীর আজো তাকে খুঁজে চলেছে।

তানভীর তখন মাস্টার্স শেষের পথে। পরিক্ষা শেষে হল ছেড়ে বাড়ি ফিরছে। পথিমধ্যেই তার কানে আসে খারাপ কিছু কথা তার চাচাতো ভাই ইকবালের নামে। কোথা থেকে এক মেয়ে তুলে নিয়ে এসেছে। মেয়ে নাবালক। ক্লাস নাইনে পড়ে। মেয়ের বাবা নানা পুলিশ রেব নিয়ে এসে বাসায় হামলা চালিয়েছে। তানভীর তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে। কি হতে চলেছে তার জানা নেই। চেনা পরিচিত দুইজন বড় ভাই আছে একজন এসপি আরেকজনের বাবা হলেন এসপি। তাদের দুজনকেই কল করে। সাহায্য চায়। ইকবালকে যেনো রক্ষা করতে পারে। ইকবাল ছেলেটা ছোট থেকেই একটু সাইকো। তার অতিরিক্ত জেদ আর পাগলামি সামলাতে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে খুব ভোগতে হয়। তানভীর যখন বাড়িতে ঢুকবে তখন বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভীড়। তানভীরকে দেখে সবাই ফিরে ফিরে তাকায়। নিজেদের মধ্যে গসিপ করে। বিষয়টা এরকম মনে হচ্ছে যে সে হচ্ছে আসল অপরাধী। পাড়ার বন্ধুরা ভিড় ঠেলে তানভীরকে বাড়ির গেইট অব্দি পৌঁছে দেয়। পাশ থেকে আশিক বলে, ‘ তোর ভাই মেয়ে কেলেঙ্কারিতে ফেসেছে। এতো শাসন করিস তার পরেও একটা স্ক্যান্ডাল করে ফেললো । ‘
‘ কি করেছে?’
‘ রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে এসে বলছে বিয়ে করবে। মেয়েটা চিৎকার করে করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। এখন মেয়ের বাবা আসছে প্রশাসন ম্যানেজ করে। ‘
‘ এখনো এসে পৌঁছায়নি তবে? ‘
‘ না। ‘
‘ মেয়েটা কতোটা ছোট হবে?’
‘ আনুমানিক তেরো চৌদ্দ। ‘
‘ সীট্ ।’

তানভীরকে দেখে ছোট চাচী হাউমাউ করে কেঁদে তানভীরকে জড়িয়ে ধরে।
‘ ওরে বাপরে! তুমি আসছো? তোমার ভাই দেখো কি কান্ড ঘটাইছে। ‘
তানভীর ছোট চাচীর মাথায় হাত রাখে। আশপাশ তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। সোফায় বাপ চারারা গম্ভীর মুখে বসে আছে। তার সামনেই টি টেবিলের উপর নত মুখে বসে আছে ইকবাল। ডান পাশের গালটা লাল হয়ে আছে। ইকবালের পেছনে গলা জড়িয়ে ধরে তানিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এক রাউন্ড যে হয়ে গেছে সেটা খুব ভালো করেই বোঝতে পেরেছে। তানভীর জিজ্ঞেস করে,
‘ মা কোথায়?’
চাচী বলে , ‘ ভাবী কি আর ঝামেলার মাঝে আসবে? উপরতলায় বসে টিভি দেখছে। আমার ছেলেটাকে তো দেখতেই পারে না। এখন ছেলে যদি এরকম হয় আমি কি করতে পারি বল? কম চেষ্টা তো আর করি না। ‘
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি কেঁদো না। মেয়েটাকে কোথায় রেখেছো? ‘
‘ তুলির ঘরে। ‘

তানভীর তুলির ঘরের দরজা নক করে। তুলি এসে দরজা খুলে দেয়। তানভীরকে দেখে যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
‘ ভাইয়া আসছো! ‘
‘ মেয়েটা কোথায়?’
‘ ভেতরে আসো। শুধু কাঁদছে। এইযে থামতে বলছি থামছেই না।’

তানভীর ভেতরে ঢুকে। বিছানার উপর গুটিশুটি হয়ে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে একটা বাচ্চা মেয়ে। সবুজ সাদা স্কুল ড্রেস তার পড়নে। চুল গুলো দুপাশে দুটো বেণী করা সাদা ফিতা দিয়ে। বড় চোখের গোল গাল দেহের গড়ন। মুখটা যেনো মায়ার আঁধার। এই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে এসেছে ইকবাল! তানভীর এগিয়ে যায়। লাবিবা বড় বড় চোখ করে তার দিকেই তাকিয়ে। দুই গালে চোখের জলের দাগ পড়ে গেছে। লাবিবার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘ ভয় পেও না। নাম কি তোমার?’
‘ লাবিবা। ‘
‘ কোন স্কুল?’
তুলি বলে, ‘ আমাদের স্কুলেই পড়ে ভাইয়া। ‘
‘ চিনিস ওকে?’
‘ চিনি। নাইনে পড়ে। আমার এইটের বইগুলো ওকে দিয়েছিলাম পড়তে। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
লাবিবাকে বলে, ‘ কান্না করে না বেবী গার্ল। তোমার বাবা আসবে তোমাকে নিতে। ইকবালকে আগে চিনতে তুমি?’
লাবিবা মাথা নাড়ায়।
‘ খারাপ ছেলে। স্কুলের ছাদে উঠে সিগারেট খায়। ‘
তানভীরের যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।

ইকবালকে ড্রয়িং রুম থেকে হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে আসে।ইকবাল যেনো আরো বিরক্ত হয়। তানভীরের সাথে তার সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। সব সময় অকারেন্স ঘটিয়ে আসে। তানভীর শাসন করতে গেলেই ইকবাল গালাগালি শুরু করে। ছোট ভাই কিছু করলে বংশের নাম খারাপ হবে। সেজন্য বাধ্য হয়ে তানভীর ইকবালকে শাসন করে।
‘ মেয়েটাকে কেনো তুলে নিয়ে এসেছিস?’
‘ তোমাকে কেনো বলবো?’
‘ যদি বলিস তাহলে তোকে বাঁচানোর চেষ্টা করবো।’
‘ পাক্কা?’
‘ পাক্কা। ‘
‘ জাহিদের সাথে বাজি ধরেছি রাস্তায় যদি কোনো সুন্দরী মেয়ে পাই তাকে যদি বিয়ে করতে পারি তাহলে ফাইনাল পরিক্ষায় আমাকে সব দেখিয়ে পাশ করিয়ে দিবে। এইবার আর ফেল আসবে না। ‘
‘ মেয়ে তুলতে গিয়ে একটা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে এসেছিস তুই।’
‘ কোন এঙ্গেলে লাগে?’
‘ কি? ‘
‘ বাচ্চা?’
‘ ইকবাল ভদ্র ফ্যামিলির ছেলে তুই। এসব তোকে যায় না। ‘
‘ বিশ্বাস না হলে তুলির ঘরে আছে। দেখে আসো যাও। ভাইয়ের বউ হবার পর তো আর ভদ্রতা বজায় রাখতে দেখতেও পারবেনা। ‘
তানভীরের ভীষন রাগ হয়। ইকবালকে বলে,
‘ সরি। তোকে আমি হেল্প করতে পারলাম না। ‘
ইকবাল তানভীরের হাত টেনে ধরে।
‘ আরে ভাই এইটা তো কথা ছিলো না। কিছু একটা ব্যবস্থা করো। বাবা চাচ্চুর হাবভাবে ভরসা করতে পারছিনা। জেলে যেতে হবে আমাকে। ‘
‘ যা ইচ্ছা কর। খারাপ সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে গেছিস। আমার বারণ শুনিস নি। আজ দেখ তোর কি হয়।’

লাবিবার বাবা যখন পুলিশ, নিয়ে আসে ততোক্ষনে তানভীরের যাকে খবর দিয়েছে সেই এসপি দারোগাকে ফোন করে দিয়েছে। বাবাকে দেখে পাখির মতো ছুটে যায় । বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাবিবা। কাঁদতে কাঁদতে বাবার বুকেই ক্লান্ত হয়ে মিশে থাকে। তাকে পুলিশ জিজ্ঞেস করে,
‘ এই ছেলেটার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক আছে? ‘
লাবিবা মাথা নাড়ে। সম্পর্ক নেই।
‘ শত্রুতা আছে?
তাও নেই। লাবিবার সাথে এই ছেলের কোনো লেনাদেনা নেই। যখন বিয়ের আলাপ উঠে তখন লাবিবার আব্বু মেয়ের জম্মনিবন্ধন সাবমিট করে এবং অপহরণ অপরাধে ইকবালকে ধরে নিয়ে যেতে বলে। ইকবালের বাবা বাধ্য হয়ে প্রস্তাব রাখে লাবিবাকে তাঁদের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। লাবিবার বাবা বেঁকে বসে ‌। কখনোই না। বখাটে ছেলের সাথে তার একমাত্র ফুটফুটে মেয়ের কখনোই বিয়ে দিবে না। নাবালক ছোট্ট মেয়ে তার!
চেয়ারম্যানের কাছে বিচার বসে। পুলিশ এই বিচারের অপেক্ষা করছে। দারোগা তানভীরকে বলে,
‘ তোমার ভাইকে থানায় নিতেই হবে। একেতো অপহরণ করেছে। তার উপর মেয়েটা নাবালক।‌তোমরা যদি বিয়ে করাতে চাও তাহলে বাল্যবিবাহ হবে। সব মিলিয়ে কঠিন শাস্তি হবে তোমার ভাইয়ের।’
‘ তাহলে কি করবো ভাই?’
‘ আপোষ করে যাও। বিয়ের দিকে এগিও না। ‘
পঞ্চায়েত কি আর তা মানে? তানভীররা অনেক চেষ্টা করেও দমাতে পারে না। বংশের মান সম্মান শেষ। মুখ দেখানোর আর জায়গা রইলো না। ইকবালের বাবা ক্ষুব্দ হয়ে ইকবালকে ডাকে। ততোক্ষনে ইকবাল আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি টের পেয়ে পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে। লাবিবার বাবা মিনতি করে,
‘ আমাকে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেন চেয়ারম্যান সাহেব। ‘
‘ তা নয় ফিরবে। কিন্তু তোমার মেয়ের তো কলঙ্ক লেগে গেলো। কে বিয়ে করবে তোমার মেয়েকে?’
‘ কি বলেন? আমার মেয়ে নাবালক। বাচ্চা মেয়ে। ‘
‘ তোমার মেয়ের থেকে কতো ছোট ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছে! তারা কান্দির জামালের মেয়েটা, সেভেনে পড়ে। এক ছেলের সাথে ভেগে গেছে। কয়েকদিন হলো ছেলে বাচ্চা হয়ছে। আর তোমার মেয়ে তো উচা লম্বায় ভালোই ডাঙর হয়ছে। ‘
মেম্বার বলে, ‘ একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কলঙ্কিনী মেয়ে গ্ৰামে রাখলে গ্ৰামের পোলাপান গুলা নষ্ট হয়ে যাবে। ‘
নিদোর্ষ মেয়ে সম্পর্কে এমন কথা শুনে লাবিবার বাবা ভেঙে পরে। তাকে গ্ৰামের লোকজন বোঝায় মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।
তানভীরের বাবাকে বলে, ‘ আপনাদের ছেলে দোষ করেছে এবার আপনারাই মেয়েটার দায়িত্ব নিবেন। ‘
‘ কিন্তু ইকবাল যে পলাতক। কে বিয়ে করবে?’
লাবিবার বাবা বলে, ‘ আমার মেয়েকে আমি নদীতে কেটে ভাসিয়ে দিবো। কিন্তু ঐ বখাটের সাথে বিয়ে দিবোনা মেম্বার সাহেব। মেয়ে আমার নিদোর্ষ এখানে সবাই জানে। কেনো আপনারা আমার মেয়ের গায়ে জোর করে কলঙ্ক লাগিয়ে দিচ্ছেন?’
‘ কতজনের মুখ বন্ধ করবেন আপনি? ‘
ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। চেয়ারম্যান দারোগার সাথে কি যেনো ফিসফিস করে। তানভীরের বাবা বলে,
‘ আমাদের ছেলেকে খুঁজে বের করি। বিষয়টা পরে দেখা যাবে। ‘
‘ আরে মিয়া কিসের পরে দেখা যাবে? এক ছেলে নাই আরেক ছেলে তো আছে। আর মেয়ের বাবা তো বলেই দিছে আপনার ঐ বখাটে ছেলের সাথে বিয়ে দেবেনা মেয়ের। ‘
‘ ভাইসাব আমাদের বড় ছেলে আর আপনাদের মেয়ের বয়সের অনেক ফারাক। নাবালক মেয়ে আপনাদের বাল্যবিবাহ দেওয়া অন্যায় হবে। ‘
‘ ছেলে মানুষের বয়স কোনো বয়সই না। আর রেজিঃ না করালেন আল্লার কালাম পরায়ে রাখেন। তাহলে তো কোনো সমস্যাই না। ‘
তানভীর প্রতিবাদ করে, ‘ অসম্ভব। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। ‘
এলাকার ছেলে গুলো ভিডিও করছে দেখে মারামারি লেগে যায়। তানভীরের বাবা বলে,
‘ চেয়ারম্যান সাহেব আইন সামলাবেন। বংশের মান না বাচাইলেও মেয়েটার মান বাঁচাও আব্বা। ‘

ইউনিয়ন পরিষদেই তানভীর লাবিবার বিয়েটা হয়ে যায়। কে যেনো কোথা থেকে একটা লাল উড়না জোগাড় করে আনে। স্কুল ড্রেস পরে লাল উড়না মাথায় দিয়ে তানভীরের নাম কবুল পড়ে লাবিবা। কি হচ্ছে বোঝে উঠতেই ছোট্ট মনে বেশ কৌতুহল হয়। পুরোটা সময় তানভীরের দিকে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে থাকে লাবিবা। লম্বা করে রাগী রাগী চেহারার লোকটা! গলায় এডামস এ্যাপল ফুঁসে উঠছে বারবার। নাকটাও বেশ চোখা। কবুল বলেই তানভীর উঠে গেলো একবারের জন্যও লাবিবাকে তাকিয়ে দেখলো না।

®লাবিবা_তানহা_এলিজা

ঘরে ফেরার গান পর্ব-০১

0

#ঘরে_ফেরার_গান (১)

আমাদের জীবনে সামান্যতম ভুল কখনো কখনো বিশাল প্রভাব ফেলে। জনাব তানভীর খানের করা সামান্য ভুলটাকে নেহাত সামান্য বলা যায় না। তার জীবনের সেরা ভুলটা ছিলো পরিস্থিতির সৃষ্টি মাত্র একটি অপ্রিতিকর ঘটনা। একজন আটত্রিশ বছর বয়সী পুরুষ হয়েও তার কোনো গন্তব্য নেই। তার এই গন্তব্যহীন পথ চলা একজনের খোঁজে। যে দিবে তাকে আহ্বান । গাইবে ঘরে ফেরার গান। আজ রাতটাও তার অফিসেই কেটে যাবে। বারিপ্লাজা এবং উত্তরায় দুটি শো রুমের পাশাপাশি আরো দুটি শো রুম খোলা হবে। নেক্সট টার্গেট তার বাটারফ্লাই অথবা আল হেরার বিল্ডিং এ। ম্যানেজার আশসাব জানতে চান,
‘ স্যারের জন্য ডিনার অর্ডার করবো?’
‘ রেস্টুরেন্ট খোলা আছে আশেপাশে?’
‘শুধুমাত্র বাবুবাজার রোড়ে নতুন রেস্টুরেন্টটি খোলা আছে স্যার। বাকিগুলো এতোক্ষনে ক্লোজ হয়ে গেছে।’
তানভীর এক হাতে গলাবন্ধনী টেনে ঢিলে করে কিছুটা নামিয়ে নেয়। ঘড়িতে মাত্র নয়টা সতেরো। ম্যানেজারের দিকে কনফিউজড লুক দিয়ে জানতে চায়,
‘ ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘরে। এতো আর্লি কেনো শহরের রেস্টুরেন্ট গুলো বন্ধ হবে?’
‘ দুদিন থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এক মিনিটের জন্য থামাথামির নাম নেই। রোডে পানি জমে মানুষের স্বাভাবিক চলা ফেরার ব্যাঘাত ঘটেছে। ঢোলাদিয়ার দিকে তো বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর দ্বারা চলছে।ফোরকাস্টে দেখাচ্ছে পরশু অব্দি চলবে টানা বর্ষণ।’
জানালার পর্দা সরিয়ে ভারি বর্ষণ অবজার্ভ করলো তানভীর। সত্যি মনে হলো আজ আর থামবেনা। মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে তানভীর। চাকায় জল ছিটিয়ে ছুটে চলে তার হুয়াইট কালার নোহা কার। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় এক হাঁটু পরিমান জল জমে যায়। চলাচলে কি একটা সমস্যা! দশমিনিটের রাস্তা ত্রিশ মিনিটে পৌঁছালো তানভীর। রেস্টুরেন্টের ভেতরে কোনো কাস্টমার নেই। এটিও ক্লোজ হবার পথে । তানভীরকে বসতে দেখে একজন ওয়েটার এগিয়ে এলেন।
‘ রেস্টুরেন্ট কিছুক্ষনের মধ্যে ক্লোজ হয়ে যাবে। আপনি লেট স্যার। ‘
‘ ওকে। লাস্ট কাস্টমার হতে চাই। ‘
‘ কি খাবেন স্যার? ‘
‘ থাই আইটেম। ‘
‘ সরি স্যার। আমাদের সকল স্টাফ ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। আমি এবং একজন শেফ , আমরা এই দুজনই আছি মাত্র। আজ আমাদের বুফে ডে ছিলো। আপনি চাইলে মিট আইটেম গুলো গরম করে সার্ভ করতে পারি। ‘
‘ মিট ছাড়া অন্য কিছু নেই? ‘
‘ সরি স্যার। ‘
তানভীর কিছুক্ষন বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। টেরেসে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি ফেইড়ি লাইট দিয়ে সাজানো। তার উপর ঝম ঝম করে পরছে বৃষ্টিকণা। অর্ডারের আশায় ওয়েটারও দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষন না তানভীর কিছু মেনু ঠিকঠাক বলে।
‘ শেফ, যিনি আছেন উনি কি লোকাল ?’
‘ জি স্যার। ‘
‘ উনাকে বলুন ধোঁয়া উঠা গরম ভাতের ব্যবস্থা করতে। সাথে ঝাল চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা উইথ পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে পোড়া পোড়া একটা ডিমভাজা। ‘
‘ স্যার!’
‘ এক্সটা পে করবো। হাফ আউয়ার টাইম দিচ্ছি। ‘
‘ ওকে স্যার। ‘

ওয়েটার কিচেনের দিকে দৌড়ে যায়।
‘ গরম ভাত হবে? ‘
‘ হবে।’
‘ ঝাল করে চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা করে ফেলো। বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ কুচি দিয়ে পোড়া পোড়া করে একটা ডিমও ভেজে দাও। সময় আধাঘণ্টা। ‘
‘ এসব আমাদের রেস্টুরেন্টের ম্যানু না।
‘ লাস্ট কাস্টমার। এক্সটা পে করবে বলেছে। ‘
‘ কি আশ্চর্য! সবাই চলে গেছে। আমি বাসায় কখন যাবো সবুজ ভাই?’
‘ রেস্টুরেন্ট ক্লোজ হবার পর। কিচ্ছু করার নাই।’
সবুজ ঠোঁট উল্টে দাঁড়ায়। লাবিবা বিরক্তি নিয়ে পেঁয়াজ এগিয়ে দেয় সবুজের দিকে।
‘ হেল্প করো। আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে সবুজ নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলে। লাবিবা দেখা মাত্রই হাত থেকে নাইফ কেড়ে নেয়। সবুজকে দেখে তার গা গুলিয়ে আসে। আঙুল তুলে শাষায় সবুজকে,
‘ এই কি করছো! ছি ছি যাও এখান থেকে। নিশ্চিত আজ তোমার ডার্টি পেটে গেলে লোকটার ডিসেন্ট্রি শুরু হবে। ‘
সবুজ বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে পানি দেয়। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে। মুখ মুছে লাবিবার পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘ কিছুই হবে না। ছোট বেলায় কতো খেয়েছি জানো? ললিপপের সাথে মিক্স করে দারুন টেস্টি ভুলা যায় না।’
লাবিবার কল্পনায় সেই দৃশ্য ভেসে উঠে। গ্লাবস খুলে বেসিনে দৌড়ায়। কয়েকবার ওক্ ওক্ করেও বমি হয় না। সে সবুজকে বলে বেরিয়ে যেতে। উচিত ই হয়নি তাকে কিচেনে ঢুকতে দেওয়া।
ছত্রিশ মিনিট পর টেবিলে ধোয়া উঠা ভাত, চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা, আলু ভর্তা,ডিম ভাজা সাথে মগজ ভুনা দেওয়া হয়। তানভীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সবুজ বলে,
‘ শেফের পক্ষ থেকে। পছন্দ হলে অবশ্যই ট্রাই করবেন।’
‘ ঠিক আছে।’

তৃপ্তিভরে খাওয়া শেষে তানভীর ওয়েটারকে বলে,
‘ শেফ কে ডাকুন। লাস্ট কাস্টমারকে খাতিরদারি করার জন্য তার অবশ্যই টিপস প্রাপ্ত। নিজ হাতে দিতে চাই। ‘
‘ সরি স্যার। শেফ এই মাত্র বেরিয়ে গেছে।’
‘ ঠিক আছে। খাবারগুলোর টেস্ট ভালো ছিলো। স্পেশালি চ্যাপা শুঁটকি ভর্তাটা অসাধারণ ছিলো।’
‘ এসব আইটেম আমাদের ম্যানু বহির্ভূত। ‘
‘নেক্সট টাইম যদি আসি এটাই প্রথমে আবদার করবো।’
‘ ধন্যবাদ স্যার। আবার আসবেন। ‘

তানভীর রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখে হ্যান্ড ব্যাগ হাতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে গোলাপী রঙের হিজাব, বোরখা। একটা রিকশা যাচ্ছে সামনে দিয়ে। মেয়েটি ডেকে উঠে,
‘ এই মামা যাবেন?’
‘ কই যাবেন?’
‘ সার্কিট হাউজ।’
‘ একশ টাকা।’
‘ বিশ টাকার ভাড়া বৃষ্টির কারণে বড়জোড় পঞ্চাশ টাকাই নেন। এতো চান কেনো মামা? ‘
‘ একশ টাকার নিচে যাবো না। ‘
মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে আরেকটা রিকশা পাওয়ার আশায়। তানভীরের অফিসে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। নরম বিছানায় কম্বলমুড়ি দিয়ে অনেক ভালো একটা ঘুম হবে মনে হচ্ছে। তাই সে কল করে আশসাবকে জানিয়ে দেয় বাসায় যাচ্ছে,অফিসে ফিরবেনা। ততোক্ষনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সবুজ বেরিয়েছে তার হিরো মটরসাইকেল নিয়ে। তানভীর গিয়ে গাড়িতে উঠে। সিটবেল্ট লাগিয়ে নেয়। গাড়ি স্টার্ট করে পার্কিং থেকে বের করবে এমন সময় স্পষ্ট কানে আসে, ‘এই লাবিবা, মটরসাইকেলের পেছনে উঠো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই। ‘
‘ রিকশা নিয়ে চলে যাবো সবুজ ভাই। ‘
‘ রিকশা পাবে না। ছাতা মাথায় তাড়াতাড়ি উঠোতো লাবিবা।’
তানভীর স্পষ্ট শুনলো নামটা।
‘ লাবিবা’
যতক্ষনে সে গাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে স্পটে আসে ততোক্ষনে দূর থেকে শুধু মটরসাইকেলের পেছনের ক্ষীন আলো দেখা যায়।

®লাবিবা তানহা এলিজা

যোগদান পত্র পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#যোগদান_পত্র
— লামইয়া চৌধুরী।
শেষ পর্বঃ

সেই চিঠিটি পড়ে আমার খুবই অদ্ভুত লেগেছিল। চেনা নেই, জানা নেই হুট করে এতসব ভেবে ফেললেন। তাঁকে পাগল ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি, অরুণিমা। তাছাড়া, কাজটা তিনি মোটেও ঠিক করেননি। চিঠি, চাকুরি এবং ঐ আধপাগলের অধ্যায় গুটিয়ে নিজের জীবন সংগ্রামের তাগিদে নেমে পড়লাম নতুন পথে। যে পথে হাঁটা যায় স্বাধীনভাবে। যে পথে চলতে পায়ে মাখতে হয়না পরাধীনতার শেকল। ঠিক করলাম বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে টাকা এনে স্বল্প পুঁজিতে কোনো ব্যবসা শুরু করব। কি ভাবছ, অরুণিমা? সহজ পথ বাছাই করে নিয়েছি? তাহলে ভুল ভাবছ। বরং সবচেয়ে কঠিন পথটিই আমি বাছাই করেছিলাম। আত্মীয়স্বজনের কানাঘোষা সহ্য করতে পারলেও কর্পোরেট দুনিয়ায় দাপিয়ে বেড়ানো ব্যাচমেটগুলোর পৈশাচিক মুচকি হাসিগুলো আমাকে ভেতরে ভেতরে মেরে ফেলত। সহজ ছিল না, অরুণিমা। একটুও সহজ ছিল না। একটা ঘটনা বলি তোমাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ব্যাচমেট একদিন আমার দোকানে এলো। সাথে তার অফিসের ক্রয় কমিটির অন্য সদস্যরাও আছেন। আমাকে দেখেও সে কোনো কুশলবিনিময় করল না। না কোনো বন্ধুত্বের ডাক। আমি কিছু মনে করলাম না। আমিও তার সাথে একজন বিক্রেতার মতই ব্যবহার করলাম। কি দরকার তাকে তার সহকর্মীদের সামনে লজ্জিত করবার? তাঁরা অফিসের গাড়ির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্টস কিনলেন। কিন্তু চলে যাবার সময় সে আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাল। খানিকটা বিরক্তি আর অনেকটা তাচ্ছিল্যের হাসি। যেন বলে গেল, “শেষ পর্যন্ত তোমার যদি এটাই করার ছিল তবে সিজির পেছনে এত ছুটলে কেন, কিবরিয়া?”
তোমাকে শুধু ঘটনাটিই বলতে পেরেছি, অরুণিমা। আমার অনুভূতিটা বলতে পারিনি। আমার জায়গায় থাকলে হয়তো বুঝতে সেদিন আমার কেমন লেগেছিল। তবু সর্বোচ্চ খেটে গেলাম। চাকুরি ভাগ্য আমার মন্দ হলেও ব্যবসা আর আমি ছিলাম সোনায় সোহাগা। বছর তিন, সাড়ে তিনের মাঝে তরতর করে হয়ে উঠলাম সফল ব্যবসায়ী। ভাড়া দোকান ছেড়ে নিজে দোকান কিনলাম। তাও আবার দুটো। একটা ঢাকায়, আরেকটা গাজীপুরে। গাজীপুরে বড় বড় গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি থাকায় ঢাকার চেয়ে গাজীপুরের দোকান বেশি রমরমা। আমিও গাজীপুরের দোকানে বেশি বেশি সময় দিতাম। ঢাকার দোকান কর্মচারীরা সামলাতো। শুধু শনিবার সকালে আমি ঢাকার দোকানে বসতাম। দুপুরে খেয়ে দেয়ে আবার গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতাম। এক তপ্ত দুপুরে আমি মাত্র দোকান ছেড়ে বেরিয়েছি। হঠাৎ, পরিচিত একটা মুখকে সাদা গাড়ি থেকে নেমে আমার দোকানের দিকে যেতে দেখে থমকালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাতেই স্পষ্ট করে চিনলাম তাঁকে। তিনি সাদা চুলের নাকে চশমাওয়ালা স্যার, ঐ ম্যাডামের বাবা। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি কাজ সেড়ে গাড়িতে করে চলে যেতেই আমি দোকানে ফিরে গেলাম। জানতে চাইলাম কেন এসেছিলেন?
এক কর্মচারী বলল, “গাড়ির কুলিং সিস্টেম নিলেন।”
“ঠিক আছে।” বলে আমি বেরিয়ে এলাম। ম্যাডামের বাবাকে দেখে আমার সেই চিঠির কথাগুলো মনে পড়ল। মনে পড়ল সেই মাথায় গন্ডগোল থাকা অহঙ্কারী ম্যাডামকেও। সাথে এটিও মনে হলো চিঠি পড়ে আমি কি ভেবেছিলাম সেটি ম্যাডামকে জানানো উচিত ছিল। তিনি অপেক্ষা করে বসে থাকলে সেই দায়ভার তো আমারই। আর বসে না থাকলে বাঁচা গেল। ঠিক করলাম আমি তাঁকে গিয়ে জানিয়ে দিব আমি এমন কিছুই ভাবছি না এবং আমি তাঁর প্রতি আগ্রহী নই। যেই ভাবা, সেই কাজ। সুযোগ করে একদিন গেলাম ম্যাডামের অফিসে। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর আমাকে দেখেও তিনি বললেন, “বলেছিলাম অফিস আওয়ারে দেখা করতে আসবেন না। আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটে।”
আমি বললাম, “এখনও চাকুরি পাইনি।”
“চেষ্টা করে যান।”
“ব্যবসা করি।”
“তাহলে অভিনন্দন।”
আমি নিজ থেকে আরো বললাম, “গাড়ির পার্টস এর ব্যবসা।”
“হুম গুড ক্যাচ, শুভ কামনা রইল।”
আমি পকেট থেকে আমার দোকানের কার্ড বের করে ম্যাডামের টেবিলে রাখলাম। বললাম, “গাড়ির কিছু কিনতে হলে আমাকে স্মরণ করবেন।”
“আমার পরিচিতদেরকে আপনার দোকানের কথা অবশ্যই বলব।”
“আসছি, ম্যাডাম।”
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতেই তিনি বললেন, “আর কিছু?”
আমি বললাম, “জি, না।”
.
একসময় টাকার হাহাকারে বাড়ি যেতে চাইতাম না। কিন্তু সবকিছু বদলে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়ানো আমিই তখন মাস শেষ হবার অপেক্ষা করতাম। সবসময় শুধু কবে মাস শেষ হবে, আর কবে বাড়ি যাব সেই ধান্দায় থাকতাম। নিয়মানুযায়ী, সে মাসের শেষের দিকেও বাড়ি গেলাম। বাড়িতে তখন আনন্দ থৈ থৈ। পাকা ঘর, বাবার উজ্জ্বল মুখ, মায়ের গায়ে নতুন নতুন রঙবেরঙের শাড়ি। বোনেদেরও বিয়ে দিয়েছি। ছোট বোনটার ছেলে হয়েছে। ভাগ্নেকে কোলে নেওয়া হয়নি। সেবার প্রথম কোলে নিয়ে বোনকে বললাম, “তোর মেয়ে হলো না কেন? ছোট বোনগুলোকে কখনো সাজিয়ে রাখতে পারিনি। ভেবেছিলাম ভাগ্নীকে সাজাব। এই দেখ ছোট ছোট হাতের জন্য স্বর্ণের রুলি বালা নিয়ে এসেছিলাম।”
আম্মা ফাঁকে দিয়ে বললেন, “এখন একটা বউ নিয়ে আয়। নাকি আমি সাথে করে বউ দিয়ে দিব?”
প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করা যে আমার স্বভাব তা হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছ, অরুণিমা। তাই আম্মার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি আরেকজনকে পাল্টা প্রশ্ন লিখলাম,
ডালিয়া শফিক ম্যাডাম,
আম্মা আমার বিয়ের কথা বলছিলেন। ইদানিং প্রায়ই বলেন। চিঠিতে বলেন, টেলিফোনে বলেন, বাড়ি গেলেও বলেন। কথা সেটা না, কথা হলো আমি আশ্চর্যান্বিত কারণ আম্মা যতবার’ই আমাকে বিয়ের কথা বলেন ততবারই আমার মাথায় প্রথম যে বিষয়টি আসে সেটি হলো আপনাকে আগে “না” বলতে হবে। তারপর পাত্রী খোঁজা শুরু করব। অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছি আপনাকে না বলবার, কিন্তু কেন যেন পারছি না। সেদিন আপনার অফিসে আপনাকে সরাসরি না বলতেই গিয়েছিলাম। এক “না” বাদে বাকি সব’ই বলে এলাম। শুধু “না” বলা হলো না। বাড়ি যাবার সময়ও বগুড়ার বাসে আচমকা মনে হলো আমার পাশের সিটে আপনি এসে বসবেন। আমি যুক্তিহীন অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষার ফলাফল হিসেবে পেন্সিলের মত সরু এক ছেলে এসে আমার পাশে বসল। আমি শুধু শুধু হতাশ হলাম। বাড়ি গেলাম এবং অস্থির হয়ে খুব দ্রুত ঢাকায় ফিরে এলাম। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি তো? আমার আবার সময় খানিক বেশি’ই লাগে। আপনার তো জানার কথা। এখন আমি আপনার জীবনসঙ্গী হওয়ার চাকুরিটা নিতে চাই। আশা করি, পদটা এখনও খালি আছে।
আপনার একান্ত বাধ্যগত,
— গোলাম কিবরিয়া।

অরুণিমা মামণি, এভাবেই তোমার মা আমার জীবনে আঁধার ক্ষণে জোনাকি হয়ে এসেছিল।

সমাপ্ত।

যোগদান পত্র পর্ব-০১

0

#যোগদান_পত্র
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১

অরুণিমা, তোমাকে আমি প্রথম থেকে সবটা বলি। তুমি শুনো। সেটি ছিল শীতের সন্ধ্যা। বাস কুয়াশার চাদর গায়ে ঢাকা থেকে বগুড়া যাচ্ছিল। আর আমি যাচ্ছিলাম ডিপ্রেশনে। আরো একটা চাকুরি হাতছাড়া করে বাসে উঠলাম। তখন না আমি বাড়ি যেতে চাইতাম না। তবুও বাস বাড়ি যাচ্ছে। বাস কি বুঝে না বাড়ি গেলেই আমাকে দেখতে হবে মায়ের ছেঁড়া শাড়ি, বাবার ক্লান্ত মুখ, ছোট বোনগুলোর অত্যাবশ্যকীয় প্রসাধনীর অভাব আর বর্ষাকালে কান্না করা টিনের চাল? ওসব ভাবতাম। শীত শীত লাগতেই খেয়াল হলো তখন শীত চলছে। শীতকালে ফুটো হওয়া টিনের চাল কান্নাকাটি করে না। স্বস্তি পেলাম। কি কপাল ছিল আমার জানো? সামান্য সস্তিও বেশিক্ষণ জুটল না। কারণ যিনি পাশের সিটে বসেছিলেন তিনি আর কেউ নন আমার চাকুরি মেরে দেয়া ইন্টারভিউয়ার। তিনি আমায় চিনলেন না, কিন্তু আমি চিনলাম। শত শত মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া ম্যাডাম ছাপোষা আমায় চিনবেন তা সম্ভব নয়। কি করব ভাবছিলাম। বাস থামিয়ে নেমে পড়ব? নাকি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিব? আরো ভাবলাম, তাঁর গলা টিপে ধরলে কেমন হয়? আমি আমার হাত দুটোর দিকে তাকালাম, উল্টেপাল্টে পরখ করলাম। যথেষ্ট শক্ত, হাতের জোরও কম নয়। তাঁর গলা টিপে বলব, “গলা টিপে ধরলে কেমন লাগে ইংরেজীতে বলুন। আমেরিকান নয় ঝকঝকে মুখ গোল করে অর্ধেক শব্দ খেয়ে ফেলা ব্রিটিশ ইংরেজী দরকার আমার।”
তিনি হাঁসফাঁস করতে করতে জিহ্ব বের করে দিবেন। গলা ব্যথায় আমার হাত থেকে ছাড়া পেতে চাইবেন। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে কুঁইকুঁই করবেন। তবু কোনো কথা বলতে পারবেন না। একটি শব্দও নয়।
অসহনীয় কষ্টে পাগল পাগল হয়ে এসব ভাবলেও শেষ পর্যন্ত হাত গুটিয়ে, সিটে মাথা এলিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তোমাকে আমার তখনকার অবস্থাটা বুঝানো সত্যিই খুব কঠিন। কেউ জানে না, আমি প্রায়ই অসহায়ের মত কাঁদতাম। আমার কান্না বর্ষাকালের টিনের চালের কান্না ছিল না যে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে কাঁদতে হবে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে চিৎকার করে কাঁদতাম। যাইহোক, বাসের তালে দুলতে দুলতে ঘুম ঘুম ভাব চলে এলো। তখনই আচমকা ম্যাডাম আমায় ডাকলেন, “এক্সকিউজ মি, আপনার কাছে পাঁচশ টাকার ভাঙতি হবে?”
আমি চোখ বন্ধ রেখেই শক্তভাবে বললাম, “বেকারদের পকেটে এত টাকা থাকে না।”
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে আপনাকে কোথাও দেখেছি!”
জবাবে কিছুই বলিনি। অবিলম্বে, তিনি আমায় চিনে ফেললেন। বললেন, “দুঃখিত, এত মানুষের ইন্টারভিউ নেওয়ায় সবার চেহারা মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।”
আমি চোখ খুললাম। আমার চোখজোড়া টকটকে লাল। কঠিন মুখ করে কড়া গলায় বললাম, “আমিও এত এত ইন্টারভিউ দিয়েছি যে সব ইন্টারভিউয়ারদের চেহারা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
উঠে দাঁড়ালাম, সুপারভাইজার সাহেবকে ডেকে বাস থামালাম এবং দুমদাম করে রাতের অন্ধকারে বাস থেকে নেমে গেলাম। আরেকটু বসলে আমি বোধহয় উনাকে সত্যি সত্যি মেরেই ফেলতাম। এত অসহ্য লাগছিল! বাড়ি তো আর যাওয়া হয়নি। ঢাকায় ফিরে গেলাম। আবারো দিন কাটতে লাগল পত্রিকা, চাকুরির বিজ্ঞপ্তি এবং পিশাচ ইন্টারভিউয়ারদের দুয়ারে দুয়ারে। এর মাঝে আব্বা এলেন গ্রাম থেকে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “বাড়িতে সব ঠিকঠাক?”
আব্বা গম্ভীর হলেন, “তোর নাকি বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল?”
আমি মিথ্যে বললাম, “নাতো।”
আব্বাও আমার মত মিথ্যে বললেন, “রোজ রোজ কান্নাকাটি শুনতে কার ভাল্লাগে? তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো।”
আমি মনে মনে হাসলাম। আম্মা আব্বার সামনে কাঁদেন না। আম্মা কাঁদেন লুকিয়ে লুকিয়ে কলতলায়।
“তোর চাকরি কতদূর?”
“অনেকদূর। কটার গাড়িতে এলেন? ভাত আনি ভাত খান।”
আব্বা চুপ করে রইলেন। আমি সেন্টু গেঞ্জি গায়েই ঘর থেকে বেরুচ্ছি। ঠিক দরজার কাছে চলে এসেছি তখন শুনলাম তিনি আপন মনে বিড়বিড় করছেন, “কিবরিয়ার না কত ভালো সিজিপিএ ছিল? এমন কেন হচ্ছে? আর কতদিন, আল্লাহ?”
মুমূর্ষু মনে আমি গলির সস্তা হোটেলের ভাত, ডাল আর সবজি নিয়ে ফিরে গেলাম। আব্বা চৌকিতে বসে খাচ্ছেন। আমি মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে বললাম, “ইন্টারভিউয়ারকে তোষামোদ করতে হয়, সিজির কোনো দোষ নেই।”
আব্বা কাঁচা মরিচ কামড়ে বললেন, “ঠাশ ঠাশ কথা একটু কম বললে কি হয়?”
আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে শব্দ না করে হাসলাম। আব্বা আর কিছু বললেন না। খাওয়া দাওয়া করে মেস থেকে চলে গেলেন। ওহ ভালো কথা মনে পড়ল। তোমাকে বলাই হয়নি তখন আমি বন্ধুর দয়ায় বন্ধুর মেসে থাকতাম। মেস ভাড়া দেয়ার মত পয়সা ছিল না। থাকার অন্য কোনো জায়গাও ছিল না। এমন দিনগুলোতে একদিন মেসে ফিরতেই বন্ধু আমার কাঁথা বালিশ আমার মুখে ছুঁড়ে ফেলল। চেঁচিয়ে বলল, “বের হো।”
আমি ছেঁড়া কাঁথা আর পুরোনো নরম বালিশটা বুকে নিয়ে বললাম, “কি করেছি?”
বন্ধু বিছানার তোশকের নীচ থেকে একখানা খাম বের করে বাতাস করতে করতে বলল, “তুই না বললি তোর একটা ইন্টারভিউও ভালো হয়নি? তোকে ডেকেছে কেন?”
আমার হাত থেকে কাঁথা বালিশ পড়ে গেল। খাম হাতে অবাক হলাম। বন্ধু হাসতে হাসতে পিঠ চাপড়ে বলল, “এবার অন্তত বের হো, শালা। আমার চৌকির জোর কম। দুজনে থাকলে লড়েচড়ে। আরামে ঘুম হয়না।”
আমার বিশ্বাস হয়নি। তখনও পর্যন্ত এটিকে সত্যি মনে করতে না পারা আমি পরদিন সেই অফিসে গেলাম। ভাবছো বিশ্বাস না হলে কেন গেলাম? কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কতটুকু স্বপ্ন আর কতটুকু বাস্তব তখন অতসব ভাববার মত পরিস্থিতি আমার ছিল না। সাহারায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের মত মরীচিকা পেলেও খুশি হতাম। মরীচিকার পেছনে ছুটে গিয়ে সেখানে পিশাচ ইন্টারভিউয়ারদের জায়গায় দেখা মেলল পিশাচিনী ইন্টারভিউয়ারের। পিঠ সোজা করে শক্ত হয়ে বসলাম, “আসসালামু আলাইকুম, ম্যাডাম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি বোধহয় আপনার ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। চাকুরিটা আপনাকে দিইনি। আপনি কি নিজেকে সেই চাকুরিটা পাবার যোগ্য মনে করেন?”
আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, “জি, ম্যাডাম যোগ্য মনে করি।”
ম্যাডাম ভ্রু উঁচিয়ে মাথা দুলাতে দুলাতে প্রশ্ন করলেন, “তাহলে চাকুরিটা আমি আপনাকে দিইনি কেন? অন্যায় করেছি আপনার সাথে?”
“আপনি কোনো অন্যায় করেননি।”
“আপনি যোগ্য আবার আমিও কোনো অন্যায় করিনি তাহলে হলোটা কি?”
“সেটি আমার নিজের কাছেই অজুহাত মনে হচ্ছে। তাই বলছি না।”
ম্যাডামকে না বললেও কারণটা তোমাকে বলছি, গুনগুন। ইন্টারভিউর দিন আমার ছিল তীব্র জ্বর। জ্বর নিয়ে ইন্টারভিউ খুব একটা ভালো হয়নি। ম্যাডাম হেসে কটাক্ষ করলেন, “অনেক ভালো সিজিপিএ থাকলেই কেউ চাকুরি পাবার যোগ্য হয়ে যায় না।”
আমি নিশ্চুপ। ম্যাডাম’ই আবার বললেন, “যাই হোক, আপনাকে এখানে চাকুরি দেয়ার জন্য ডাকা হয়নি।”
আমি বললাম, “জি, জানি।”
“তাহলে কেন এলেন?”
“আগে বুঝিনি। আপনাকে দেখে বুঝেছি। আমি কি চলে যাব?”
“জি চলে যাবেন। তার আগে আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন।”
“ক্ষমা চাইছি। আপনি কোনো অন্যায় করেননি। বরং, বাসে আমি আপনার সাথে বেয়াদবি করেছি।”
ম্যাডাম আমার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আমিও তাই মনে করি।”
আমি কার্ডটা হাতে নিলাম। তিনি আরো বললেন, “আমাদের অফিসে আপনাকে নিয়োগ দেয়ার মত একটাও কারণ খুঁজে পাইনি। আপনি বরং এখানে যোগাযোগ করুন।”
আমি কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম। তার আগেই তিনি হাত দিয়ে দরজা দেখালেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম, “জি, আসসালামু আলাইকুম।
ম্যাডাম কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে পড়তে বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম সেখানে যাব কি যাব না। একবার ভাবছিলাম কেন যাব? আমি একদিন নিজের যোগ্যতাবলেই চাকুরি পাব। আরেকবার ভাবলাম সেখানে গেলেও চাকুরিটা নিজের যোগ্যতাবলেই আমাকে অর্জন করতে হবে। আমি গেলেই তো ওরা আমায় চাকুরি দিয়ে দেবে না। যোগ্য মনে করলে দেবে আর নাহয় দেবে না। সোজা হিসাব। অবশেষে, দ্বিধা নিয়েই ম্যাডামের দেয়া কার্ডকে সম্বল করে ঐ অফিসে হাজির হলাম। সাদা ধবধবে চুল মাথার স্যার চশমার উপর দিয়ে আমাকে দেখে বললেন, “আজ হচ্ছে না। আপনাকে সামনের সপ্তাহে আবার আসতে হবে।”
এসব নতুন কিছু নয় তাই গায়ে লাগানোর প্রয়োজন মনে করিনি। চুপচাপ দিন গুনতে লাগলাম। দিন সপ্তাহে রূপ নিলো। সেখানে আবার গেলাম। তাঁরা আমার ইন্টারভিউ শুরু করল। বলে রাখি, অরুণিমা এটা আমার দেওয়া শেষ ইন্টারভিউ ছিল। এটিই আমার জীবন বদলেছে, আমাকে বদলেছে। এখান থেকেই শিখেছি আঘাত বা অপমানের আরেক নাম শিক্ষা। এজন্যই সবসময় সবাইকে বলি, যে আঘাত করে তাকে ভালবাসো। সে যাই হোক, ইন্টারভিউ রুমে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল মোটা ফ্রেমের চশমা পরা সেই সাদা ধবধবে চুল মাথার স্যারকে। মিথ্যে বলব না, চশমা ভেদ করে দেখা তার চোখ দুটো আমার আত্মবিশ্বাসে একটু হলেও চিড় ধরিয়েছিল।
যত দূর মনে পড়ে তাঁকে প্রসন্ন করতে সর্বোচ্চ সুন্দর হাসি দিয়েছিলাম। কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই তিনি হাসির প্রত্যুত্তর করেননি। আর আমাকে কোনো প্রশ্নও করেননি। পুরো সময় জুড়ে তিনি বারবার হাত ঘড়ি দেখছিলেন। যেন শুধু শুধু আমার পেছনে তাঁর সময় নষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন করলেন বাকি দুজন। বাকি দুজনের একজন ছিলেন থমথমে মুখের অথচ, সুদর্শন এক স্যার। অল্পবয়স্ক তবে মুখ জুড়ে ছিল চালাক চতুর একটা ভাব। ভাবছ, তোমাকে এত এভাবে কেন বলছি? বললাম না, সেদিনটি ছিল পরিবর্তনের দিন। তাই হয়তো সব এভাবে মনে রেখেছি। পাশের হাস্যজ্জ্বল এক বয়স্ক ম্যাডাম প্রথমেই জানতে চাইলেন, “এটি আপনার কততম ইন্টারভিউ?”
“গুনে বলতে হবে, ম্যাডাম।”
কমবয়সী স্যারটির চোখে মুখে তখন উপহাস, যেন এমনটিই তিনি আশা করেছিলেন। মুচকি হেসে বলে উঠলেন, “নিজেকে প্রমাণ করতে এত সময় কেন?
আমিও ঝটপট উত্তর দিয়েছিলাম, “প্রমাণের জন্য তো শুধু নিজেকে না বরং খাঁটি জহুরির চোখও দরকার পড়ে।”
উত্তরে ম্যাডামকে প্রসন্ন করতে পেরেছি বলেই মনে হয়েছিল। তিনি হেসে আমার দিকে কলম আর খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “প্রমাণের জন্য নিজেকে আরো একটু প্রকাশ করুন। আপনি যে চাকুরি পাচ্ছেন না আপনার সর্বোপরি অবস্থাকে আপনি কীভাবে প্রকাশ করবেন? ভয় নেই, আমরা খাঁটি জহুরির চোখ নিয়েই বসে আছি।”
আমি খাতা কলম নিয়ে দাগ টেনে বললাম, “ধরুন, আপনার সামনে এই একটা কর্দমাক্ত পথ। পাশেই এই আরেকটি ভালো পথ। কর্দমাক্ত পথটির অপরপাশে গন্তব্যস্থান। একটি কুকুর আর একটি মানুষকে এই একই জায়গা অর্থাৎ কদর্মাক্ত পথটির পাশ থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। বলুন তো কে আগে গন্তব্যস্থানে পৌঁছুবে?”
চশমা নাকের স্যার এ পর্যায়ে তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠেই পড়লেন। নীরবে বুঝিয়ে দিলেন আমি ওয়েস্ট অব টাইম।
কমবয়সী স্যারটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আপনার কাছে উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছে, প্রশ্ন না।”
আমি সোজা চোখে চোখ রেখে বললাম, “দুঃখিত। আমি প্রশ্ন করছি না, প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি।”
ম্যাডাম বললেন, “কুকুরটি আগে পৌঁছুবে।”
আমি তখন বললাম, “সম্ভবত, আমি উত্তরটা দিতে পেরেছি।”
অল্পবয়সী স্যারটির কুঞ্চিত ভ্রু দেখে বুঝতে পারলাম আমাকে আরো ব্যাখ্যা করতে হবে। স্যারটি কীভাবে ভ্রু কুঁচকায় জানো, অরুণিমা? আচ্ছা এটা পরে বলছি। বাকিটা শোনো, আমি অধ্যবসায়ী শিক্ষকের মত তাঁদের বোঝালাম, “আমার কাছে আমার লক্ষ্যকে যেকোনো মূল্যে অর্জন করার চেয়ে ভালো এবং সঠিক পথ দিয়ে চলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর ভালো পথ দিয়ে চলতে গেলে সময় বেশি লাগবেই। আমাকে ধৈর্য্য রাখতে হবে। তাছাড়া, আগে পৌঁছানো মানে সবসময়ই ভালো বা সেরা হওয়া নয়। ভালোর জন্য সাধারণত সময় প্রয়োজন, সময়! ঠিক যেমনটি ভালো পথ দিয়ে যেতে ব্যক্তিটির কুকুরটির চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হবে।”
কমবয়সী স্যারটির চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সাথে সাথেই তিনি সেটি গোপন করলেন। মনে কু ডেকে উঠল, “তবে কি এখানেও আগে থেকেই প্রার্থী ঠিক করা আছে? আবারও শুধু শুধু আসা? মেজাজ বিগড়ে গেল। ধৈর্য্য আর কত ধরা যায় বলো, অরুণিমা? নাটক দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। যতটা উদ্দ্যম আর প্রবল আগ্রহের সাথে প্রথমদিকের প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করেছিলাম শেষে এসে ততটাই দায়সারাভাবে বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলাম। চাকুরী নয় তখন আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ঐ ঘর থেকে দ্রুত বের হতে পারা। একসময় এভাবেই ইন্টারভিউ পর্ব শেষ হলো। আমাকে বলা হলো, “ঠিক আছে আপনি আসতে পারেন।”
আর ইন্টারভিউ নয় এমন মনস্থির করেই সেদিন বের হয়েছিলাম। মন জুড়ে তখন শুধু রাগ আর ক্ষোভ। কিন্তু ভাবিনি পরদিন সব পাল্টে যাবে, সব। পরদিন দেখি মেসে আমার নামে খাকি রঙের খাম এসেছে একটা। সেই আমাকে বাতিল করে দেয়া ম্যাডামের পাঠানো। খামের ভেতরের কাগজে টাইপ করা কালো অক্ষরে লেখা:
জনাব,
গোলাম কিবরিয়া,
আপনার চরিত্রে তোষামোদি ব্যাপারটি নেই সেটি বাসেই টের পেয়েছিলাম। সত্যি বলতে পোড় খাওয়া ব্যর্থ এক যুবকের এমন স্বভাব অবাক করেছিল। চাকুরি পেতে একটু সহানুভূতি পাবার চেষ্টা তো অন্তত করতে পারতেন? করলেন না। বিশ্বাস করুন, গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা আপনার স্বভাব বারবার আমাকে জ্বালাতন করছিল। বারবার মন বলছিল, একে পাশ ছাড়া করিস না। তাই আমার অফিসে আপনাকে নিয়োগ দেয়ার মত একটিও কারণ খুঁজে না পেলেও, আমার জীবনে আপনাকে নিয়োগ দেয়ার মত কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। এজন্যই আপনাকে আমি আমার বাবা, মা এবং ভাইয়ের সামনে হাজির করাতে বাবার অফিসে পাঠিয়েছি। এটি কোনো চাকুরির ইন্টারভিউ ছিল না। আমি পরিবারকে আপনার ঝলক দেখাতে চেয়েছিলাম। আমার এই অপরাধ ক্ষমা করবেন না? ইন্টারভিউর ফলাফলের কথা বললে বলব
আপনি নির্বাচিত হয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম চাকুরিহীন বেকার কোনো যুবককে পছন্দ করার দায়ে পরিবার আমার পছন্দকে অগ্রাহ্য করবে। ভেবেছিলাম, আমাকে আলাদা করে আপনার জন্য সুপারিশ করতে হবে। কিন্তু তা করতে হয়নি বলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
আপনি কি ভাবছেন আমাকে দ্রুত জানাবেন। অফিস আওয়ারে দেখা করতে আসবেন না। আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটে।”
শুভাকাঙ্ক্ষী,
ডালিয়া শফিক।
চলবে…

ওপারে আকাশ পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#ওপারে_আকাশ: (শেষ পর্ব)

পাঁচ
রাতে ইশতির সাথে বেশ ঝামেলা চলল সুবহার। ঝামেলাটা একটা আলমারি কেনা নিয়ে। এ মাসে একটা তিন তাকের আলমারি আনার কথা ছিল ইশতির। কিন্তু ইশতির বাবা হঠাৎ ফোন করে টাকা চাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। ইশতির বাবা গ্রামেন
স্থানীয় একটা দোকান কিনেছে হঠাৎ করেই। এভাবে নিজের অনেকদিনের শখে জল পড়তে দেখে সুবহাও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ঝগড়া শেষে দুজনই দুদিকে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে। সুবহা আশা করে আছে, ইশতি মুখ ঘুরিয়ে কাছে এলেই সব মিটমাট করে নেবে। কিন্তু সেটা আর হলো না। গভীর রাত পর্যন্ত ইশতির অপেক্ষায় থেকে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঘুমাল সুবহা।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলো। উঠেই দেখে সারা বাড়িতে ইশতি নেই। না বলেই কাজে চলে গেছে। অনেকক্ষণ মন খারাপ করে বিছানায় পড়ে রইল সুবহা। তারপর প্রথমবারের মতো চয়নকে আগবাড়িয়ে নক করল। মনখারাপের কথা বলে সময় করে একবার বাসায় আসতে বলল।

দুপুরের দিকটায় চয়ন এল বাসায়। চয়ন এলে মনের দুঃখগুলো উগড়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল সুবহা। অন্যান্যদিনের মতো চয়ন চঞ্চল আচরণ করল না। সে চুপচাপ সুবহাকে শুনে যাচ্ছে। আচমকা একটা কাজ করে বসল চয়ন। দুহাতে জাপ্টে কাছে টেনে নিজের ঠোঁট দিয়ে সুবহাকে ছুঁয়ে দিতে লাগল। তারপর দ্রুত বের হয়ে গেল বাসা থেকে।

এই ঘটনার পর থেকে ইশতির সাথে শারীরিক সম্পর্কও অসহ্য হয়ে উঠল সুবহার কাছে। সারা দিনের কষ্টগুলোকে যেখানে ডুবিয়ে মন ভালো করে ফেলত সেই পথটাও একদমই হারাল। ধীরে ধীরে ইশতির সবকিছুই বিষের মতো হয়ে উঠতে লাগল সুবহার কাছে।

ঘটনার পনেরো দিনবাদে সুবহা নিজেই নিজেকে সঁপে দিল চয়নের কাছে। উকিলের কাছে গিয়ে ইশতিকে ডিভোর্স দিয়ে চিরদিনের জন্য চয়নের হাত ধরল।

ইশতি সেদিন তিন পার্টের আলমারি নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। সুবহার ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া ব্যবহার দেখে দিগ্বিদিক ইশতি মনে করেছিল আলমারি না কেনার জন্যই বুঝি বউয়ের এই পরিবর্তন। তাই এই প্রথম সুবহার জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে হাজির হয়েছিল ইশতি। কিন্তু কে জানত তার জন্য বদ্ধ ঘরে যেই একখানা কাগজ অপেক্ষা করছিল- সেই কাগজখানার ভার সদ্য কেনা আলমারির থেকেও অনেক বেশি হবে।

ছয়

দুই বছর পরে…

স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে সুবহা। অনেক খুঁজে পেল চাকরিটা। ওই বেতনে খরচে
কুলিয়ে উঠতে পারছিল না।

সিমলা নামের এক নারী সুবহার পাশের ডেস্কেই বসে। নতুন বিয়ে হয়েছে সম্ভবত মেয়েটার। প্রায়ই দেখা যায় ফোন করে মুখ ভার করে থাকে। মুখে ভেংচি কাটে একা একা।

বেশ কিছুদিন সুবহার নজরে পড়ে বিষয়টি। কিন্তু আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে না কিছুই।

ক্যান্টিনে আজ হঠাৎ সামনাসামনি পড়ে গেল সিমলা। সুবহা নিজ থেকেই হাই বলল।
“কী খাবেন, চলুন এক টেবিলে বসি”- বলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে কিছুটা সহজ হয়ে এল। এক ফাঁকে জানতে চাইল, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন- প্রায়ই দেখি ফোন করে আপনি কথা না বলে মুখ বাঁকান একা একা। কার সাথে এতো অভিমান করেন?

হেসে ওঠে সিমলা। বলতে থাকে, “কখন খেয়াল করলেন? কার আবার আমার সাহেবের উপর। আরে বলবেন না এতো উদাসীন বর আমার। সারাদিনে একবার ফোন করবে না। কেবল কাজ আর কাজ। আশেপাশের সবাই কত রোমান্টিক অথচ আমার ভাগ্যে জুটেছে পুরোই আনরোমান্টিক এক মানুষ। নিজেকে প্রকাশটাই করতে পারে না কখনো। এত্ত কাজপাগল…

গতরাতে কী হয়েছে জানেন। সাহেব কাজ থেকে ফিরেছে রাত এগারোটারও পরে। আমি বেচারা খাবার নিয়ে বসে। সারাদিন অফিস শেষ করে অতরাত পর্যন্ত খাবার নিয়ে বসে থাকাও কঠিন। এত্ত রাগ লাগছিল। না খেয়েই ঠাঁয় ফুঁসছিলাম। সাহেব বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এল। যেটুকু রান্না করেছি বাটিতে করে তার সামনে পুরোটাই বেড়ে দিয়েছি। সে প্লেট নিতেই দুটো ইলিশ মাছও পাতে তুলে দিলাম। রাতে কম খাওয়া হয়। সামান্য সবজি আর দুটো মাছ ফ্রাই করেছিলাম। আমি খাইনি। ওকে ফেলে খেতে ভালো লাগে না। তবু রাগ থেকে ওকে বললাম আমার খাওয়া শেষ। এগুলো তোমার জন্যই রেখেছি।

ওমা কিছুক্ষণ খাওয়ার পর বর মুখ বাঁকা করে বলে কি না খাবার স্বাদ হয়নি। বলেই, ভ্রু নাচিয়ে একটা মাছ উঠিয়ে রাখল। তারপর দ্রুত খাওয়া শেষ করে রুমে গেল।

কী যে রাগ উঠছিল না আমার। কতক্ষণ ঝিম ধরে বসে বসে ফুঁসলাম। এক লোকমা খাবার মুখে তুলে তো দিলই না উল্টো খাবারের বদনাম করল। কতক্ষণ ঝিম ধরে বসে বসে ফুঁসলাম।
কিছুক্ষণ বাদে আজব এক বিষয় মাথায় এল। বিয়ের পর থেকে দেখছি যেদিন রাতেই আমি রাগ করে পুরো খাবার ওর পাতে তুলেছি সেদিনগুলোতেই সে খাবার বিস্বাদ বলে খাবার তুলে রেখেছে। এর মানে কী?

সুবহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন বুকটা খামচে ধরছে কথাগুলো…

সিমলা বলেই চলেছে। “ঝড়ের বেগে রুমে গিয়ে বরকে দু ঘা মেরে বললাম, আমার রান্না বিস্বাদ হয়েছে না?”
বলতেই সে মুচকি হাসল। আবার রাগ উঠল আমার। চুল টানতে টানতে বললাম,
“ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারো না কিন্তু নাটকটা তো বেশ পারো। একটু খাইয়ে দিলে কী হয় হ্যাঁ? হাত ক্ষয়ে যায়…”

আমার কথা শুনে বর কেমন যেন শূন্যে তাকিয়ে রইল। ব্যাটা যন্ত্রমানব- টোটালি আনরোমান্টিক হলো যা হয় আরকি…

সুবহা আর দাঁড়াল না। লাঞ্চের সময় শেষ হয়ে আসছে বলে দ্রুত ক্যান্টিনের ভেতরে ঢুকে গেল। অথচ একরত্তি খিদে নেই তার মধ্যে। খিদে উবে গেছে। কেন যেন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে সুবহার, খুব।

কিছু জরুরি কেনাকাটায় নিউ মার্কেটের এদিকে আসতেই সামনে পড়ল বিসমার্ক প্লাজায়। সিঁড়ি ধরে এগিয়ে গেল সুবহা। দোতালার সামনেই সেই কসমেটিকস এর দোকানটা। এক পা দু পা করে ভেতরে ঢুকল সে। চয়ন পেছন পেছনেই এল। এসেই দোকানদারকে বলল, “ম্যাডাম কী নিতে চায় বের করুন তো!”

সুবহা এক জোড়া চুড়ি ধরল হাতে। চয়ন তৎক্ষণাৎ পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখি দেখি চুড়িদুটো তোমার হাতে কেমন লাগে?”

প্যাকেট থেকে চুড়ি খুলে সুবহার হাতে পরাতে লাগল চয়ন।

“নাহ্ এটা না, ওই জোড়াটা তোমার হাতে মানাবে ভালো। দেখি দেখি…”

সুবহা চুড়ি পরছে না কি করছে বোধে কিছু কাজ করছে না। ও ফিরে গেছে দুই বছর আগের সেই দিনটায়। ইশতিকে শত বলেও আয়না অথবা চুড়ি পছন্দ করাতে পারছিল না। অথচ তাদের পাশের একজোড়া দম্পতি ছিল খুবই রোমান্টিক। ঠিক চয়নেরই মতো…

চুড়ি প্যাকেট করা হয়ে গেছে। যা যা কিনতে বেরিয়েছিল একে একে সব মনে করিয়ে দিচ্ছে চয়ন। সব কেনাকাটা শেষ। জিনিসপত্রের টোটাল মূল্য জানিয়ে দেয় দোকানদার।

চয়ন এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় সুবহার হাতের পার্স বরাবর। হাত থেকে পার্সটা নিয়ে টাকা বের করে গুণে দেয় দোকানিকে। তারপর পার্সটা ফেরত দেয় সুবহার হাতে।

কেনাকাটা শেষ করে দুজন বের হচ্ছে। চয়ন এই সেই বকবক করেই যাচ্ছে। ওদিকে সুবহা নিশ্চুপ। যেন কোনো পাথর পা পেয়ে হেঁটে চলেছে। নিচতলায় আসতেই বড়ো ফাস্টফুডের দোকানটায় সুবহার হাত টেনে ঢোকে চয়ন। একটা কর্ণার দেখে বসে পড়ে। পছন্দমতো খাবার অর্ডার করে দেয় চয়ন। সুবহা তখনও অন্যরাজ্যে…

খাওয়া শেষ হলে এবার আর নিজেই পার্সটা টেনে নিল না চয়ন। বিলের বইটা সুবহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “পরিশোধ করে আসো। আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।”

পাথর চোখ থেকে হঠাৎ দু ফোঁটা পানি বেয়ে পড়ল চোয়ালে।

বিয়ের পর থেকে লোক দেখানো আদিখ্যেতা বাদে সুবহার কোনোরকম দায়িত্ব নেয়নি চয়ন। এমনকি সংসারের পেছনে একদমই টাকা খরচ করতে চায় না সে। এসব নিয়ে অশান্তি করতে চেয়েও সাহসে কুলোয় না সুবহার। এসব তার প্রাপ্য অসম্মান বলে চুপিসারে মেনে নেয়। মনে মনে বলে, “একজীবনে কতবারই বা ঘর ভাঙা যায়…”

বিল কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল সুবহা। একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর বিল পরিশোধ করছিল। কেঁপে উঠল সুবহা…

“ইশতি…”

মৃদুস্বরের ডাকটা পাশের মানুষটির কানপর্যন্ত পৌঁছাতে সময় নিল না। মানুষটি পিছু ফিরে তাকাল।

হ্যাঁ ইশতি, ইশতিই তো। সুবহা তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে…

ইশতি চোখ নামিয়ে অন্যদিকে ফিরল মুহূর্তেই। ঠিক তখনই কয়েক কদম দূর থেকে এগিয়ে এল ঝলমলে চেহারার এক নারী। সুবহার অতি পরিচিত কলিগ সে যদিও। তবুও আজ কেমন অচেনা লাগছে সিমলাকে। খুব গর্জিয়াস।
সিমলার চোখে চোখ পড়লেও সুবহা অন্য দিকে ফিরল। সিমলাও আর কিছু বলল না।

সিমলা এগিয়ে গিয়ে ইশতিকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল,

“বিল দেওয়া শেষ? আমি দোতালায় যাচ্ছি। কিছু কসমেটিকস কেনার ছিল! বিল পরিশোধ বাদে তুমি তো আর কিছু পছন্দ করে দেওয়ার মধ্যে নেই। নাও ধীরেসুস্থে উপরে উঠে এসো।”

সিমলা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকাল সুবহা। ইশতি উঠে যাচ্ছে। মানুষটা একই রকম রয়ে গেছে না! চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়াতে লাগল।
সুবহা খেয়াল করল, যন্ত্রমানব টা একপলকের মতোই বুঝি তাকাল পেছনে…

#Mina_Sharmin