Tuesday, July 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 363



প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-১৩

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৩

হৃদিতার তিনদিন যাবৎ জ্বর। তিনদিনে একটা বারের জন্যও কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি সে। তার মা-বাবা দুজন মিলেই মেয়ের কাছে আছেন, মেয়ের দেখাশোনা করছেন। তিনটা দিন পর জ্বর খানিকটা কমতে শুরু করেছে। হৃদিতা এখন নিজেই একা টুকটাক এটা ওটা করতে পারছে। ভাড়াবাসায় মা-বাবার এই প্রথম আসা। বাবা-মার সঙ্গ দিনগুলো যেন রঙিন করে তুলেছে হৃদিতার।

মেয়েকে আগের তুলনায় বেশ সুস্থ দেখে রাসেল সাহেব এখানকারই বাজারে গিয়েছিলেন ছোটোমাছ আর টাটকা কিছু সবজি কিনে আনতে। নাহার বেগম চাচ্ছিলেন গোরুর মাংস আর খিচুড়ি রান্না করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাসেল সাহেব আবদার করেছেন ছোটোমাছ খাওয়ার। নাহার বেগম না পেরে ছোটোমাছও রান্না করতে রাজি হয়েছেন। নাহার বেগম রাজি হওয়ার সাথে সাথে রাসেল সাহেব বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজারের দিকে বেরিয়ে গিয়েছেন।

নাহার বেগম ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে রেখেছেন অনেকক্ষণ আগে। রান্নাঘরেই কাজ করছিলেন।

হৃদিতাকে রান্নাঘরের দরজায় দেখে নাহার বেগম মৃদু হেসে বলেন,“ভালো লাগছে এখন একটু?”

হৃদিতা বসার নিচু টুল টেনে নিয়ে বসে। ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে বলে,“ আজহার রেজা আঙ্কেল কল দিয়েছিলেন। আমাকে একটু যেতে বলল।”

নাহার বেগম মেয়ের কথায় কাজ থামিয়ে বললেন,“ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছো না আর তুমি কি না বাহিরে যেতে চাইছো? তোমার হাতে কী ওটা?”

হৃদিতার হাতে সাদা পৃষ্টা দেখে কথাটা বললেন নাহার বেগম। হৃদিতা কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“রিজাইন লেটার। আমি আমার শখের জব ছেড়ে দিচ্ছি, আম্মু।”

আরেক দফায় চমকে গেলেন নাহার বেগম। পাত্রে রাখা পানিতে হাত ধুয়ে, হাতের পানি ঝেরে ওরনায় মুছতে মুছতে বললেন,“ ছেড়ে দিচ্ছিস কেন? তুই-ই তো আমাদের কথার অবাধ্য হয়ে এই জবে এসেছিলি। ”

হৃদিতা মাথানিচু করে বলে,“আমি এখানে শান্তি পাই না, আম্মু। কেমন অশান্তি লাগে। এখানে এসে আমি মানুষের আরেকটা বিচ্ছিরি চেহারা দেখতে পাই। হয়তো এই পেশা আমার জন্য না। তুমি ভাবতে পারো একটা মেয়ে কতটা নিকৃষ্ট হলে নিজের ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কাউকে খু**ন করতে পারে? যে ভাই কি না কোনো মেয়েকে ধর্ষ**ণ করেছিল? আর তাকে খু**ন করেছে যে কি সেই ধর্ষি**তার ভাই! বোনের জন্য লড়তে এসেছিল তাকেই কি নির্মমভাবে জাল বিছিয়ে খু*ন করল! এখন যেই খারাপ অবস্থা, মৃ*ত্যুর সাথে লড়ছে তখন নিজের দোষ স্বীকার করেছে। আয়ু শেষ হওয়ার সময় সবাই কেমন ধোয়া তুলসীপাতা হতে চায়! ”

কথাগুলো বলে আরেকবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হৃদিতা। নাহার বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,“ বেরিয়ে আয় মা। ওসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নে। যে যেমন করবে তার ফল সে ভোগ করবেই।”

নাহার বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলে,“ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কী জানো, আম্মু?”

নাহার বেগম ভ্রু কুচকে বলেন,“কী?”
“এতগুলো বছর পর একজনকে এক দেখায় ভালো লেগেছিল। সে-ও কি না সেই মেয়েকে এই কাজে উস্কানি দিয়েছিল। সেই মেয়ে এত বড়ো অমানবিক, অন্যায় করার পর সেই পুরুষই তাকে সবদিক থেকে আগলে রেখেছে। ”

নাহার বেগম ভ্রু কুচকে বলে,“ তুই আবরারকে পছন্দ করিস?”

হৃদিতা মাথানিচু করে বলে,“ প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিল। ইথারের পর আর কাউকে সেরকম ভালো লাগেনি। ”

নাহার বেগম উঠে দাঁড়ায় চোয়াল শক্ত করে বলে,“ হৃদি, আমি তোর মুখ ইথার নামটা একদমই শুনতে চাই না। ওই নামটা অভিশপ্ত। ”

হৃদিতা দুইহাত দিয়ে নিজের পা জড়িয়ে মাথা ঠেকিয়ে বলে,“স্যরি। আমি কি বের হব একটু? ”
“ সাবধানে।”

হৃদিতা উঠে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে বাসা থেকেও বের হয়। বাসার নিচে এসে আজহার সাহেবকে কল দেয়। দুইবার রিং হয়ে কেটে যায়। হৃদিতা একটা রিকশা নিয়ে অফিসের দিকে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিলে আজহার সাহেব কলব্যাক করেন।

ফোন বেজে উঠতেই হৃদিতা ফোনটা পার্সব্যাগ থেকে বের করে কলটা রিসিভ করে। আজহার রেজা ওপাশ থেকে বলে ওঠেন,“ হৃদিতা, আমি হাসপাতালে আছি। তুমিও এখানেই চলে এসো। এশার অপারেশন হয়েছে তোমাকে বলেছিলাম তখন, ওর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসার কথা কিন্তু ডাক্তাররা বলছে কোনো আশা দেখছে না তারা।”

হৃদিতা ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “শা*স্তি তো পেতেই হবে স্যার। কম অন্যায় তো করেনি। আবরার সাহেবের কী খবর?”
“উনি অনেকটা সুস্থ।”
“ উনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম।”
“তুমি এসো আগে এখানে।”
“ঠিক আছে, স্যার।”

হৃদিতা কল কেটে ফোনটা আবার রেখে দেয়। রিকশাওয়ালাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলে চুপচাপ বসে থাকে।
___

ময়না বেগম বাড়ি ফিরেছেন বেশ কয়েকদিন পরে। বাড়ি ফেরার পরপরই শুনেছেন উমেদ ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। ছোট ছেলের এমন একটা খবরে তিনি বেশ খুশি। বাড়িতে যে-ই আসছে তাকে ছেলের চাকরির কথা বলছেন তিনি।
ঘরে বসে এক প্রতিবেশী মহিলার সাথে গল্প করছিলেন ময়না বেগম। সুরাইয়া দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মহিলাটি হেসে বলে ওঠে,“ কী গো বউমা, নাতি-নাতনির মুখ দেখব কবে? কম দিন তো হলো না। এবার তোমার শাশুড়ির জন্য সময় কাটানোর সঙ্গী নিয়ে এসো। আর কতদিন সে এভাবে আমাদের সাথে গল্প করবে? তার তো নাতি নাতনিদের সাথে খেলাধুলার বয়স হয়েছে।”

সুরাইয়া চা এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে,“ আমার শাশুড়ি কিন্তু কখনো বলেনি তার খেলার সঙ্গী লাগবে। বললে না হয় ব্যবস্থা করা যেত।”

ময়না বেগম চায়ের কাপ নিয়ে বলেন,“ এতদিন বলিনি এখন বলছি, জলদি বাচ্চা নাও বয়স তো অনেক হচ্ছে। নাতি-নাতনির মুখ দেখাও। ”

সুরাইয়া পাশে দাঁড়াতেই আশরাফ মায়ের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। মাথা চুলকে বলে,“ মা, একটু কথা ছিল তোমার সাথে।”

পাশে প্রতিবেশীকে দেখে আবার বলে ওঠে,“ কেমন আছেন চাচি? শরীর ভালো তো?”

মহিলাটি সহাস্য বলে,“ হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷ তুমি ভালো আছো তো?”

আশরাফ হ্যাঁসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,“ হ্যাঁ আমিও ভালো আছি।”

ময়না বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,“ কী বলতে এসেছিলি? কোনো দরকার?”

আশরাফ সুরাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মায়ের দিকে তাকায়৷ নরমস্বরে বলে,“ ভাবছিলাম সুরাইয়াকে নিয়ে তিনদিনের জন্য বেড়াতে যাব কক্সবাজার। এই সময়ে সমুদ্র অন্যরকম সুন্দর হয়ে ওঠে। না আছে রোদ, গরম আর না আছে বৃষ্টি। আবহাওয়া অনেক বেশি সুন্দর থাকে। সুরাইয়াকে নিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয়নি তাই ভাবলাম এবার ওকে নিয়ে একটু দূরে ঘুরতে যাই। ”

পাশে থেকে মহিলাটি বলে ওঠে,“ বাহ, বেশ ভালো তো। বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবে এটা তো বেশ ভালো কথা। আমার মেয়ে-জামাইও গত বছর গিয়েছিল ওখানে। কতরকম শুটকিমাছ এনেছিল, আমাকে অনেক দিয়েছিল আমার মেয়ে। আচ্ছা ভাবি, আপনারা কথা বলেন, আমি বরং বাড়ি যাই।”

মহিলাটি চলে যেতেই ময়না বেগম বলে ওঠে,“ তুই একটু বেশিই বউ-পাগল হয়ে যাচ্ছিস না আশরাফ? বাড়ির বউকে নিয়ে বেড়াবি মানে? বউকে নিয়ে কেন এতদূর যেতে হবে? কোথাও যাবি না তোরা। তোর বউ তো একেবারেই না।”

সুরাইয়া মা-ছেলের সামনে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সে জানে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে অযথা কথা শুনতে হবে। তার ছেলের ইচ্ছের জন্য নিজেকে দোষারোপ শুনতে হবে।

সুরাইয়া চলে যেতেই আশরাফ আবার বলে ওঠে,“ আম্মা প্লিজ, তিনটা দিনেরই তো ব্যাপার। এর আগে তো সুরাইয়াকে নিয়ে আমি কোথাও যাইনি। আমি চাইলে তোমার অনুমতি ছাড়া অনেককিছুই করতে পারি কিন্তু করি না। আমি চাই সবকিছুই তোমার অনুমতিতে হোক। ”

ময়না বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন,“অনেক টাকার ব্যাপার। এতগুলো টাকা জলে ফেলতে আমি দেব না। ”

#চলবে….

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-১২

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১২

আবরার হৃদিতার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নির্জীব গলায় বলে,“আর থেকে যেতে বললে?”

হৃদিতা জোরপূর্বক হেসে বলে,“বড়োজোর কিছু সময় সঙ্গ দিতে পারি, থেকে যাওয়া আমার হবে না।”

আবরার চোখ বন্ধ করে নেয়। হৃদিতা এগিয়ে এসে আবরারকে বলে,“আমি আসছি তবে।”
“যেতেই হচ্ছে?” বলেই হৃদিতার দিকে তাকায় আবরার।

হৃদিতা আবরারের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে বাহিরের দিকে চলে যায়। আবরার এক পলকে সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেদিনের কথা মাথায় আসতেই চোখ বন্ধ করে নেয় সে।

হৃদিতা ওষুধ কিনতে যাচ্ছিল এমন সময় বাহিরের দিকেই আজহার রেজা কারো সাথে কলে কথা বলছিলেন। হৃদিতাকে কাছাকাছি আসতে দেখে তিনি হাত দিয়ে ইশারায় হৃদিতাকে থামতে বলেন। হৃদিতা প্রেসক্রিপশন হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।

আজহার রেজা ফোনে কথা শেষ করে হৃদিতাকে বলেন,“সকালে হসপিটালে আসার সময় কেউ তোমাকে দেখেছে৷ বলছে সে তোমাকে চেনে। বাহিরে অপেক্ষায় আছে, তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।”

হৃদিতা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,“আমার সাথে দেখা করতে এসেছে! কে?”
“দেখা হলেই জানতে পারবে।”
“ঠিক আছে। স্যার আরেকটা কথা, এশার কী খবর? এখান থেকে নাকি অন্যকোথাও নেওয়া হবে?”

আজহার রেজা ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বললেন,“ সে এখন একটু সুস্থ। নেওয়ার ভাবনা বাদ দেয়া হয়েছে। আরেকটা খবর আছে।”
“জি স্যার?”
“ অফিস থেকে জানিয়েছে এশাই মেইন কালপ্রিট। খু*নের ক্ষেত্রে প্রথমবারে সফল হয়েছে কি না সেটার দ্বিধাদ্বন্দে ছিল বিধায় দ্বিতীয়বার ছুরিকাঘাত করেছিল। এশাকে অ্যারেস্ট করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এখন শুধু তার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা।”

হৃদিতা বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলে,“সবকিছু এত সহজে কীভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে আঙ্কেল? আমি নিজে হাতে..”

আজহার রেজা হৃদিতাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি চেয়েছিলে একটা মেয়ের আর তার ভাইয়ের খু*নের সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে। সেটা এখন সম্ভব। এশা গতকাল রাতে নিজের মুখেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে।”

হৃদিতা হঠাৎ বলে ওঠে,“ আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই আঙ্কেল।”
”সেটা এখন সম্ভব নয়। তুমি বাহিরে যাও তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে। তুমি আপাতত এই কেইস নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দাও। এবার যা হবে ইন শা আল্লাহ ভালো হবে। তুমি এটা জাস্ট মাথা থেকে বের করে দাও।”

হৃদিতা বাহিরে যাওয়ার জন্য এগুতেই আবার থেমে যায়। পিছে ফিরে তাকিয়ে বলে,“আঙ্কেল, আরেকটা কথা।”

আজহার রেজা এগিয়ে এসে বলেন,“হ্যাঁ বলো।”

হৃদিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,“স্যার, আবরার সাহেব তো এশাকে অসম্ভব ভালোবাসে। আমি নিজেই দেখেছি কিন্তু এখন উনি এশার নামই শুনতে চাইছেন না। কী হয়েছে বলেন তো? যাকে এত ভালোবাসে, তার অবস্থা এত খারাপ হওয়ার পরও এমন চুপচাপ কীভাবে আছে? নামই শুনতে চাইছে না।”

আজহার রেজা বলেন,“তুমি আছ কী করতে? জেনে নিবে। এখন যাও, জলদি যাও। বাহিরে ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তোমাকে আসার সময় দেখেছে। এই দিকে তো কারো আসার অনুমতি নেই তাই আসতে পারেনি। জলদি যাও।”

হৃদিতা আজহার রেজার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে হৃদিতা বাহিরের দিকে চলে যায়। বাহিরে এসে একজনকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আশেপাশে কাউকে খুঁজছে সে কিন্তু পরিচিত কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কে এসেছে তার সাথে দেখা করতে? কোথায় সে?

একজনকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে হৃদিতা। ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ায়। বয়সে হয়তো তার চেয়ে খুব একটা বড়োও হবে না।
ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়িয়েই বলে উঠল,“আপনি হৃদিতা না?”
হৃদিতা আন্তরিকতার সঙ্গে বলল,“জি আমি হৃদিতা। আপনি কে? আসলে চিনতে পারছি না আপনাকে।”

ছেলেটা জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলল,“ আমি ইথারের বন্ধু। আপনি আমাকে দেখেননি তাই চিনতে পারেননি কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে একবিন্দু দেরি করিনি। ইথার তো আপনার কথা সবসময় বলতো। ছবিও দেখিয়েছিল।”

‘ইথার’ নামটা শোনামাত্র বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করে ওঠে। চোখ বন্ধ করে নেয় সে।

ছেলেটা হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বলে,“আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা ছিল, আপনার যদি সমস্যা না হয় তাহলে আমরা কি সামনের রেস্টুরেন্টে বসতে পারি?”

হৃদিতা চোখ তুলে তাকায় ছেলেটার দিকে। এতদিন পর পুরোনো মানুষ কেন সামনে এলো! আর ব্যক্তিগত কথা! সেটাই বা কী!
_____

সুরাইয়া শাশুড়ির রুমের সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখছিল। আজ ময়না বেগমের বাড়ি ফেরার কথা। সুরাইয়া রুমের সবটা গুছিয়ে রেখে বের হবে তখনই নাহার বেগম গেইটে এসে ডাকতে থাকেন। সুরাইয়া তাড়াতাড়ি গিয়ে গেইট খুলে দেয়।

নাহার বেগমকে দেখে সুরাইয়া বলে ওঠে,“ কী হয়েছে কাকি?”

নাহার বেগম ভারি গলায় বলেন,“চাবিটা একটু রাখো তো, মা। আমি একটু হৃদির কাছে যাব। ওর নাকি রাত থেকে জ্বর। তোমার কাকা তো বাড়ি নেই। বাড়ি আসলে চাবিটা উনাকে দিও। আমি উনাকে বলেছি চাবি তোমার কাছে রেখে যাব। আমি রান্না করে রেখেছি। ”

নাহার বেগম চাবির গোছা এগিয়ে দিলে সুরাইয়া চাবিটা নিয়ে বলে,“অনেক বেশি জ্বর?”
“হ্যাঁ বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না। তাই আমি গিয়ে দুদিন থেকে আসি মেয়েটার কাছে। মেয়েটাকে খুব মনে পড়ছে। সময়মতো কিছু রান্না করে খাওয়াতে তো পারব। ”

সুরাইয়া নাহার বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,“ আপনি এক মিনিট দাঁড়ান। আচার রেখেছিলাম ওর জন্য, নিয়ে যান। জ্বরমুখে খেতে ভালো লাগবে।”
“ঠিক আছে দাও।”

সুরাইয়া দৌঁড়ে রুমে গিয়ে তখনই ফিরে আসে। একটা মাঝারি আকৃতির আচারের বৈয়ম নাহার বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,“ সাবধানে যাবেন কিন্তু কাকি। আমি এখানে সবকিছু দেখে রাখব, আপনি একদম চিন্তা করবেন না।”

নাহার বেগম সুরাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,“ তুমি সাবধানে থেকো।”

নাহার বেগম চলে যেতেই সুরাইয়া গেইট আটকে ভেতরে চলে আসে।
আশরাফ তখনো গোসল শেষ করে বের হয়নি। সুরাইয়া আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা শার্ট বের করে বিছানার ওপর রেখে ফোনটা নিয়ে বিছানার একপাশে বসে। ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হতেই সেদিকে তাকায়।

আশরাফ চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে সুরাইয়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে বলে,“ পুরুষ মানুষের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগে না? এই আপনি সুশীল নারী? নজর সামলান মিসেস শেখ। ”

সুরাইয়া হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে আশরাফের দিকে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।
মৃদু হেসে বলে,“ পুরুষ যদি তার নারীর কাছে নির্লজ্জ হতে পারে তাহলে নারী কেন তার পুরুষের কাছে লজ্জায় নুইয়ে পড়বে? নিজে যখন আমাকে সবসময় টিজ করেন তখন কিছু না আর আমি তাকালেই দোষ তাই না? সুন্দর হতে কে বলেছে আপনাকে? ”

আশরাফ সুরাইয়াকে হাত ধরে টেনে নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে মাথা ঝাঁকায়। চুলের পানির ফোটা সুরাইয়ার মুখে পড়ে। সুরাইয়া চোখ বন্ধ করে নেয়।

আশরাফ নিজের ঠান্ডা গাল সুরাইয়ার গালে ঠেঁকিয়ে বলে,“ বউয়ের নজর যেন অন্য পুরুষের দিকে না যায় তাই সুন্দর হতে হয়। সেজন্যই হয়তো সুন্দর হয়েছি।”

সুরাইয়া আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,“আমি এক পুরুষে আসক্ত নারী। আপনার চেহারা, আপনার টাকা কোনোকিছুই আমার কাছে বড়ো কোনো বিষয় না। আমার এসব প্রয়োজন নেই। পুরুষ মানুষ দেখতে যত খারাপ হবে ততো ভালো, অন্য নারীর নজর যেন না লাগে। এখন মেয়েদের নজর খারাপ। আপনার মুখে তো কালি মেখে রাখা উচিৎ। ”

আশরাফ সুরাইয়ার কথায় হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে,“ আমি ওরকম সুন্দরও নই যে কালি মেখে ঘুরতে হবে।”

সুরাইয়া আশরাফের হাসি একপলকে তাকিয়ে থাকে। আশরাফ হাসি থামিয়ে সুরাইয়ার তাকানো খেয়াল করে বলে,“কী?”

সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,“আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”

#চলবে…..

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-১১

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১১

সুরাইয়া বিছানা ঠিক করছিল। আশরাফ বাহিরে দাঁড়িয়ে উমেদের সাথে ফোনে কথা বলছিল। উমেদ ঢাকা চলে গিয়েছে দুইদিন ধরে। ভাইয়ের সাথে কথা বলা হয়ে ওঠেনি সেভাবে তাই রাতে কলে কথা বলছিল। ময়না বেগম বোনের বাড়িতেই আছেন তিনি এখনো বাড়ি ফেরার কথা জানাননি।

উমেদের সাথে কথা শেষ করে আশরাফ রুমে চলে আসে। সুরাইয়া মাত্রই কাজ শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বসেছে।
আশরাফকে রুমে ঢুকতে দেখে সুরাইয়া বলে ওঠে,“চা করে দেব?”

আশরাফ চুলগুলো নেড়ে পিছনের দিকে দিয়ে বলে,“চলো বের হই।”

সুরাইয়া ভ্রু কুচকে বলে,“এখন? কেন?”
“বউকে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করছে তাই। গন্তব্য কোথাও না শুধু বাইক নিয়ে দুজনে রাস্তায় ঘুরব। খোলা আকাশ, চারদিক অন্ধকার আর মাঝেমাঝে আলোর ছটা, দারুণ না?”

সুরাইয়া মুচকি হাসে৷ তৎক্ষণাতই আবার মুখটা কালো হয়ে যায়। আশরাফ পাশে এসে বসে সুরাইয়ার চিবুক স্পর্শ করে মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করে,“কী হয়েছে? শরীর খারাপ? যাবে না?”

সুরাইয়া মাথানিচু করে নরমস্বরে বলে,“আমাদের কত টাকা হয়েছে?”

আশরাফ কপালের ভাজ বিস্তৃত করে বলে,“কেন? হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?”
“তুমি তো আমাকে সেরকম কিছু বলো না। আমি জানিও না কত টাকা হয়েছে জমানো৷ আচ্ছা যে টাকা হয়েছে সেই টাকা দিয়ে এখানে কিছু করে সংসার চলবে না? তোমার সাথে সংসার করার ইচ্ছে আমার কবে পূরণ হবে? দুই, তিন বছর পর দুই আড়াইমাস করে না আমি বছরের প্রতিটা দিন তোমার সাথে কাটাতে চাই। বিশ্বাস করো আমি সব পরিবেশে মানিয়ে নেব নিজেকে। আমি ভাত ডালে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব কিন্তু তোমার অনুপস্থিতি ভালো লাগে না। তুমি চলে গেলে তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো আমার গলা চেপে ধরবে। আমি শ্বাস নিতে পারব না। ”

আশরাফ একহাত দিয়ে সুরাইয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মাথায় চুমু দিয়ে বলে,“তুমি বললে আমি আর যাব না। বলো তুমি কী চাও?”
“এখানেই থেকে যাও। সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে অন্তত রাতে এই বুকটায় মাথা রাখতে চাই।”
“ঠিক আছে। আমি দেখছি কী করা যায়।”
“হুম।”

সুরাইয়াকে ছেড়ে তার দুইগালে হাত রেখে আশরাফ বলে,“যাও এখন তৈরি হও আমরা বের হব। রাত হয়ে গেছে।”
“ দশ মিনিটে রেডি হয়ে নিচ্ছি।”
“তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হও আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।”

সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,“ঠিক আছে।”
______

আবরারের জ্ঞান ফিরতে ফিরতে তিনদিন গত হয়। হৃদিতা এই তিনদিন গোসল, খাওয়ার সময় আর খুব প্রয়োজন ছাড়া সবসময় আবরারের কেবিনেই ছিল।
হৃদিতা মাত্রই একটু বাহিরে দাঁড়িয়ে আজহার রেজার সাথে কথা বলছিল। তখনই নার্স কেবিন থেকে হৃদিতাকে ডাক দেয়।

হৃদিতা আজহার সাহেবকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে চলে যায়। কেবিনে আসতেই নার্স বলে,“উনার হাতের আঙুল নড়ছে। এখনই হয়তো তাকাবে। জ্ঞান ফিরেছে উনার।”

হৃদিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নার্সটা আবার বলে ওঠে,“আপনি কে হন উনার? সারাক্ষণ এখানে পড়ে আছেন। উনার বাড়ির আর কেউ নেই?”

হৃদিতা আমতা আমতা করে বলে,“উনার বাড়িতে একাই থাকতে দেখেছি। হয়তো উনার বাবা-মা গ্রামে থাকেন। খবর দেয়া হয়নি হয়তো।”
“আচ্ছা৷ আপনি তাহলে এখানেই থাকুন৷ আমি গিয়ে ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

নার্স যেতে শুরু করলে হৃদিতা পিছন থেকে ডাক দিয়ে নার্সকে থামিয়ে দেয়। নার্স জিজ্ঞাসু চোখে হৃদিতার দিকে তাকালে হৃদিতা বলে ওঠে,“এশা ম্যামের কী অবস্থা? উন্নতি দেখা দিয়েছে কি?”

নার্স একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মুখে অন্ধকার নামিয়ে বলে,“উনার অবস্থা একদম ভালো না। দূর্ঘটনা যখন ঘটে তখন হয়তো উনি সিটবেল্ট বাঁধেননি তাই ছিটকে পড়েছিলেন। মুখের অবস্থা খুবই খারাপ। বেঁচে গেলেও প্লাস্টিক সার্জারি করা ছাড়া উপায় নেই। তবে…”

নার্স থেমে যেতে হৃদিতা আবার প্রশ্ন করে ওঠে,“তবে কী?”
নার্স কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,“ উনি হয়তো আর কাম ব্যাক করবেন না। কোমায় আছেন এখন।কোনো৷ আশা দেখতে পাচ্ছি না।”
হৃদিতা চোখ বন্ধ করে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলে,“আচ্ছা। ঠিক আছে আপনি আসুন। ডাক্তারকে নিয়ে আসবেন বললেন তো।”

“ জি।” বলেই নার্স সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। হৃদিতা আজহার সাহেবের দিকে তাকালে তিনি ইশারায় হৃদিতাকে সেখানেই থাকতে বলেই বড়ো বড়ো ধাপ ফেলে চলে যান।

হৃদিতা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে আবরার ছোটো ছোটো চোখে তার দিকেই দেখছে আর তাকিয়ে থাকতে না পেরে বারবার চোখের পলক ফেলছে। বেডের পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসে হৃদিতা।

আবরার তখনো হৃদিতার দিকেই তাকিয়ে আছে। তিনদিনে শরীরের বেশ অবনতি দেখা যাচ্ছে আবরারের। সুশ্রী চেহারার মানুষটার মুখটায় কালসিটে দাগে ভর্তি। তার সামনে আয়না নিয়ে আসলে হয়তো আরেক প্রকার দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে সে।

হৃদিতা আবরারের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,“কেমন আছেন এখন? ভালো লাগছে কি?”

আবরার মলিনমুখে নির্জীবকণ্ঠে বলে ওঠে,“ আ আপনি এখানে কেন?”

“উনি তো খুব প্রয়োজন ছাড়া আপনার কেবিন থেকে বের হয়নি। তিনটা দিন আমাদের চেয়ে উনিই আপনার দেখাশোনা বেশি করেছে।” কথাগুলো বলতে বলতে নার্স ভেতরে প্রবেশ করে।

নার্সের সাথে এবারডাক্তার এসেছেন। তিনি অনেকটা সময় নিয়ে চেকআপ করে হাসিমুখে বলেন,“ সব তো এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালোই দেখছি, কেমন অনুভব করছেন আবরার সাহেব?”

আবরার নার্সের বলা কথা শোনার পর থেকেই পলকহীন দৃষ্টিতে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারের কথা কানে পৌঁছতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,“একটু ভালো লাগছে। কারো পরিশ্রম তো বৃথা যেতে দিতে পারি না। তাই হয়তো এবারের মতো ফিরে এলাম মৃত্যুর দুয়ার থেকে।”

ডাক্তার সাহেব স্টেথোস্কোপ হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,“যা বলেছেন। হৃদিতা ম্যামের জন্য হসপিটালের নার্সগুলো অন্তত এখান থেকে ছুটি পেয়েছিল। তিনটা দিন উনি খুব পরিশ্রম করেছেন। সে যাই হোক, আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিবেন। রাত থেকেই খাওয়া শুরু করুন। আপাতত বেশ কিছুদিন আপনাকে হসপিটালের বাসিন্দা হয়েই থাকতে হবে।”

ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে হৃদিতার হাতে দিয়ে চলে যায়। নার্স প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয় কখন কোনটা খেতে হবে।
নার্স বেরিয়ে যেতেই হৃদিতা আবরারের উদ্দেশ্যে বলে,“আপনি কি মিনিট পাঁচেক একা থাকতে পারবেন? আমি ওষুধগুলো সামনের ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসতাম।”

আবরার দরজার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,“কেন আছেন এখানে?”

হৃদিতা এদিক ওদিক দেখে আমতা আমতা করে বলে,“ ক কেন আছি মানে? আপনি অসুস্থ তাই।”
“দুনিয়ার সবাই অসুস্থ থাকলে নিশ্চয়ই তাদের সাথে থাকেন না।”

হৃদিতা মাথা নিচু করে মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে বলে,“সবাই নিশ্চয়ই আমার বেকারত্ব ঘোচাতে আমার জন্য ভাবেনি। ”
“ওহ আচ্ছে পরিশোধ করছেন?”
“টাকার ঋণ পরিশোধ করা যায়, সাহায্যের না। আপনি আমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন সেখানে আমি নাহয় আপনার জন্য কিছু করলাম।”
“সত্যি করে বলুন এটাই শুধু কারণ এখানে থাকার?”
“আর কী কারণ থাকবে? আমি এখানে আছি জন্য আপনার অসুবিধা হচ্ছে?”
“এখন থেকে নারীকে বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হবে। মানুষকেই আর বিশ্বাস করতে চাই না আর সেখানে তো মেয়ে মানুষ। ”

হৃদিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,“আপনি একবার এশার কথা জিজ্ঞেস করলেন না কেন? উনাকে তো আপনি খুব ভালোবাসেন। সেদিন বললেনও যে আপনার শেষ..”

হৃদিতাকে থামিয়ে দিয়ে আবরার বলে ওঠে,”প্লিজ, ওর কথা আর আমাকে বলবেন না। ওর নামটাও আমি শুনতে চাই না।”

হৃদিতা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,“কেন?”
“এত প্রশ্ন ভালো লাগছে না আমার। প্লিজ চুপ থাকুন।”
“আমাকে অসহ্য লাগছে? লাগলে বলতে পারেন আমি চলে যাব। নার্স তো আছেই।”
“আমি বললেই আপনি শুনবেন?”
“হ্যাঁ শুনতে তো হবেই। আপনার সঙ্গ প্রয়োজন না হলে, আমাকে সহ্য না হলে শুধু শুধু বিরক্ত করব কেন?”

আবরার হৃদিতার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নির্জীব গলায় বলে,“আর থেকে যেতে বললে?”

#চলবে…..

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-১০

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১০

রাগ আর ঘৃণায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে আবরারের। শক্ত গলায় বলে ওঠে,“তোর জান আমার কাছে শু*তে এসেছে।”

কল কেটে দেয় আবরার। এশা ফোনটা একপ্রকার ছিনিয়ে নেয় আবরারের কাছে থেকে৷ আবরার রক্তিমচোখে এশার দিকে তাকিয়ে আছে৷ এশা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

আবরার এশার চিবুক শক্ত করে চেপে ধরে বলে,“ আমাকে তবে অপশনাল রেখেছিলে? আর কত বদগুন বাকি আছে তোমার? একাধারে চিটার, চরিত্রহীনা, খু*নী আর কী বাকি আছে?”

এশা আবরারের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,“ ভালোই হলো৷ জেনেই যেহেতু গেলে তাহলে আমার আর লুকানোর কিছু রইল না। আমাকে আর নেক্সট টাইম বিরক্ত করবে না।”
“আমি না তোমাকে আজ অবধি বুঝে উঠতে পারলাম না। ভালোবাসনি তাই না?”
“হ্যাঁ, তোমার মতো মানুষকে ভালোবাসা যায় না। আর কী যেন বলছ আমি খু*নী? তুমি কি ধোয়া তুলসীপাতা নাকি?”
“তোমার মতো জঘন্য নই।”
“তুমি দুর্গন্ধময় ডাস্টবিনের নোংরা। আমার আশেপাশে থেকে আমাকেও তাই বানাতে চেয়েছ।”

মেজাজ খারাপের চরম পর্যায়ে গিয়ে এশার গালে জোরেশোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আবরার। চোখের সাদা অংশ রাগে লাল হতে শুরু করেছে। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,“তোদের মতো মেয়েদের বাঁচাতে লড়াই না করে ধাক্কা দিয়ে মাঝ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া উচিৎ। তোরা মেয়েরা ছলনাময়ী। চোখে পানি নিয়েও ছলনা করতে পারিস তোরা।”

আবরার এশার হাত ধরে বলে,“খুব অন্যকারো হওয়ার ইচ্ছে তাই না? চল তার কাছেই পৌঁছে দিয়ে আসব। আমি আবার অন্যকারো মানুষ তো দূরের কথা বস্তুও রাখতে পছন্দ করি না। যেটা অন্যকারো সেটার এক কোণাও আমার না। আমার মানে পুরোটাই আমার৷ হোক সেটা ভালো বা খারাপ।”

এশার হাত শুক্ত করে ধরে আবরার। এশাকে বাহিরে নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। এশা গাড়ি থেকে নামার জন্য ছটফট করেই যাচ্ছে তবুও কোনো কাজ হচ্ছে না৷
আবরার গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করে। গাড়ির গতিটা যেন স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। এশার ভয় লাগছে৷

সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে, “গাড়ির গতি কমাও আবরার। তোমার তো ফালতু জীবন না আমার। আমার জীবনের মায়া আছে৷ তোমারটা গোল্লায় যাক আমার দেখার নেই। আমাকে নামিয়ে দাও।”

আবরার এশার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,“এখন মনে হচ্ছে তোমাকে অন্যকারো হতে দেয়া যায় না৷ বেঁচে থাকতে তুমি আমার। মরে গেলে সেটা ভিন্ন বিষয়। তুমি আমার সাথে চিট করেছ।”

এশা আমতা আমতা করে বলে,” ম মা মানে?”
আবরার মৃদু হেসে বলে,“সামনে দেখো।”
এশা শুকনো ঢোক গিলে বলে,“ আমাকে মাফ করে দাও, আবরার। বিশ্বাস করো আমি তোমাকেই ভালোবাসি, তোমাকেই চাই। তুমি ছাড়া বাকিসব মিথ্যা।”

আবরার গাড়ির স্পিড আরও বাড়িয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলে,“ আমি তোমার কোনো ক্ষতি করে থাকলে আমার মৃত্যু চেয়ো আমাকে আর চেয়ো না।”
______

হৃদিতা সুরাইয়ার সাথে বসে বসে গল্প করছিল। নাহার বেগম চা নিয়ে হৃদিতার রুমে আসে। তাদের দুজনের সাথে তিনিও আড্ডায় যোগ দেন। রাসেল শেখ বসে বসে ল্যাপটপে কোনো কাজ করছিলেন।
হৃদিতা চায়ে চুমুক দিয়ে সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,“তারপর? ফুপি হচ্ছি কবে? তোমরা দুজন কি আমাকে নিয়ে ভাবছ না?”

নাহার বেগম মৃদু হেসে বলেন,“ হৃদ কিন্তু ভুল কিছু বলেনি, সুরাইয়া। আর কত একা থাকবে? একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। বাচ্চার সাথে থাকলে সময় কেটে যাবে।”

সুরাইয়া সে বিষয়ে কথা না বলে হৃদিতাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “ আমাদের নন্দাই কবে হবে সেটা বলো। নন্দাইয়ের খবর দাও, ফুপিও বানিয়ে দেব।”

নাহার বেগম উঠে দাঁড়ান। বাহিরের দিকে যেতে যেতে হাসতে হাসতে বলেন,“ তোমরা চোখকান খোলা রাখো৷ ভালো ছেলে হলেই ননদকে খবর দাও। এসব আবার বলে দেওয়া লাগে নাকি?”

নাহার বেগম চলে যেতেই হৃদিতা বলে ওঠে,“ দুইটা কেস আমার হাতে। একটা প্রায় কমপ্লিট হয়তো দুই একেই সেটা ক্লোজ হয়ে যাবে। আরেকটার জন্য দোয়া করো আমি যেন নিজেকে সঠিক রায় শোনাতে পারি। এসবের পর হয়তো একাই থাকব নইলে যদি কখনো কেউ আমার জীবনে আসে তবে তাকে নিয়ে ভাববো।”

সুরাইয়া মৃদুগলায় বলে,“ সেইরাত আমি এখনো ভুলতে পারি না হৃদি।”

হৃদিতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে,“ আর আমি ভুলতে চাই না।”

বেশ কিছুক্ষণ ধরে দুজনের কথা চলতে থাকে৷ নাহার বেগম বাহিরে থেকে উচ্চস্বরে হৃদিতাকে ডেকে বলেন,“ হৃদি, তোর ফোন বাজছে। দুইবার বেজে কেটে গিয়েছে। দেখ তো কে কল দিল!”

হৃদিতা সুরাইয়াকে বসতে বলে বাহিরে চলে আসে। কিছুক্ষণ আগে বাহিরেই বসে ছিল তখন ফোনটা বাহিরে রেখেই হয়তো সুরাইয়ার সাথে রুমে চলে এসেছিল।
সে এসে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে আজহার রেজা আঙ্কেল নামটা ফোনস্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে। হৃদিতা তাড়াতাড়ি করে কলটা রিসিভ করে।

সালাম দিতেই ওপাশ থেকে আজহার সাহেব বলে ওঠেন,“কোথায় আছ? জলদি সদরের হসপিটালে চলে এসো।”

হৃদিতা তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করে,” ইজ এভ্রিথিং অলরাইট, স্যার?”
“ কিচ্ছু ঠিক নেই। তুমি জলদি এখানে চলে এসো। আমি আর সময় দিতে পারছি না তোমাকে।”
“ স্যার কী হয়েছে সেটা তো বলুন।”

হৃদিতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ওপাশে থাকা ব্যক্তি কল কেটে দেয়। হৃদিতা মাকে গিয়ে জানায় তার এখনই বের হতে হবে অফিস থেকে কল দিয়েছিল। নাহার বেগম মনটা মলিন করে বলেন,“গতকালই তো বাসায় আসলি, এখনই যেতে হবে?”

মাকে সামলে, বাবা-মা দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় হৃদিতা। ঘণ্টাখানেকের মাঝে হাসপাতালের সামনে পৌঁছেও যায়। নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে পৌঁছলেও কিছুতেই ভেতরে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না সে। বারবার আজহার রেজাকে কল দিয়ে যাচ্ছে। ছয় বারের সময় ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো।

হৃদিতা ভিড় ছেড়ে একপাশে চলে যায়। সামনের দিকে তাকিয়ে ফোন কানে নিয়ে বলে,“স্যার, কোথায় আপনি? বাহিরে এত ভিড় কেন?”

ওপাশ থেকে পুরুষালি গলা ভেসে আসে,“ তুমি চলে এসেছ? দুই মিনিট দাঁড়াও। আমি অফিস থেকে এক্ষুনি আসছি। তুমি কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা ভিড় থেকে দূরে এসে সামনের দিকে দাঁড়াও।”
“ ঠিক আছে স্যার।”

বাহিরে ভিড় বাড়ছে। গেইটের দিকে দারোয়ান দুইজন দাঁড়িয়ে মানুষগুলো সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। মানুষ যেন গেইট ভেঙেই ভেতরে ঢুকে যাবে। হৃদিতা সামনের দিকে এসে দাঁড়ায়।

পরিচিত একজনকে সেখানে দেখে হৃদিতা এগিয়ে যেতেই আজহার সাহেব গাড়ি নিয়ে হৃদিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। হৃদিতা দাঁড়িয়ে যেতেই তিনি বলে ওঠেন,“ গাড়িতে উঠে বসো। পিছনের গেইট দিয়ে যেতে হবে আমাদের। সামনে দিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।”

হৃদিতা একমুহূর্ত দেরি না করে গাড়িতে উঠে বসে। আজহার সাহেব ড্রাইভ শুরু করে রাস্তা পরিবর্তন করে নেন। হৃদিতা পাশে থেকে বলে ওঠে,“ স্যার, আবরার সাহেবের নাম শুনতে পাচ্ছিলাম। উনার কিছু হয়েছে?”
আজহার রেজা সামনেই মনোযোগ রেখে বলে ওঠেন,“ হ্যাঁ। এক্সিডেন্ট হয়েছে। গাড়ির অবস্থা আর বোঝার উপায় নেই। এশা, আবরার সাহেবের হবু স্ত্রী যিনি ছিলেন উনার অবস্থা ভয়াবহ। আবরার সাহেবেরও জ্ঞান ফিরেনি।”

হৃদিতা অপ্রস্তুত স্বরে বলে ওঠে,“ কী বলছেন, স্যার? এরকম কখন হলো? এশা এভাবে কীভাবে ম*রতে পারে? ওকে তো আমি মা*র*বো। ও এভাবে কষ্ট সহ্য না করে এমনি এমনি কীভাবে মা*রা যেতে পারে? ”

আজহার রেজা বিদ্যুদ্বেগে বলে ওঠেন,” আপাতত এসব মাথা থেকে ঝেরে ফেলো। তোমাকে এখানে একটা কাজে রাখা হবে। নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করবে। আবরার সাহেবের কেবিনে লক্ষ্য রাখতে হবে তোমার। উনার রুমে যেন বাহিরের কেউ প্রবেশ করতে না পারে। এশার বাবা আবরারকে ভালো চোখে দেখছে না।”

হৃদিতা দুই হাত দিয়ে কপালে আর চোখ ঢেকে আফসোসের স্বরে বলে ওঠে,” এটা ঠিক হলো না, আঙ্কেল। ওই মেয়ের মৃ*ত্যু এভাবে হতে পারে না। আমি খুব করে চাই ও বেঁচে যাক। আমি নিজে শা*স্তি দিতে চাই ওকে। খুব কঠিন শা*স্তি।”

#চলবে_

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৯

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৯

আশরাফ যেতে গিয়েও থেমে যায়। পিছনে ফিরে বলে,” ইয়্যুর হাজবেন্ড লাভস্ ইয়্যু।”

সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,” খান সাহেব, ইয়্যুর ওয়াইফ লাভস্ ইয়্যু ঠু।”
” একটা চুমু দেই এসো।”
আশরাফের এমন লাগামহীন কথায় সুরাইয়া লজ্জায় লাল হয়ে যায়। লজ্জামাখা মুখে বলে ওঠে,” কী অশ্লীল! যাও তো।”

আশরাফ হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। সুরাইয়াও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে ময়না বেগমের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বাহির পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আশরাফ বাইকের পিছনে মাকে বসিয়ে নিয়ে রওয়ানা দেয়। সুরাইয়া কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। যখন তারা দৃষ্টিরেখার বাহিরে চলে যায় তখন সে বাড়ির দিকে ফিরতেই নাহার বেগম পিছন থেকে ডাকেন।

সুরাইয়া পিছনে তাকালেই নাহার বেগম বলে ওঠেন,” হৃদি এসেছে। দেখা করে যেও৷ ”
সুরাইয়া একবার বাড়ির দিকে তাকিয়ে আবার নাহার বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,” উমেদও টিকেট কাটতে যাবে, ও বের হলেই আমি সব ঠিকঠাক করে আসছি। কখন এসেছে হৃদি?”
” কিছুক্ষণ আগেই এসেছে।”
” আচ্ছা চাচি, আমি আসছি।”

সুরাইয়া নিজের রুমটাই ঠিক করছিল। পানির বোতলটা খালি দেখে সেটায় পানি আনতে বের হতেই উমেদের সাথে দেখা হয়ে যায়। উমেদ কালো একটা শার্ট পরেছে সাথে জিন্সের প্যান্ট। চুলগুলো বরাবরের মতো পিছন সাইডে ফেলে রাখা।

সুরাইকে দেখেই উমেদ বলে ওঠে,” ভাইয়া ফিরেনি?”

সুরাইয়া সংক্ষিপ্ত বাক্যে বলে,” গেলই তো মাত্র।”
” আমি স্টেশনে যাচ্ছি। বাড়িতে তো তুই একা, সাবধানে থাকিস।”
” জি।”

সুরাইয়া চলে যেতে লাগলে উমেদ আবার বলে ওঠে,” আমাকে মাফ করে দেওয়া যায় না?”

দাঁড়িয়ে যায় সুরাইয়া। পিছন ফিরে বলে,” মাফ কেন? কী করেছেন?”
” আমার প্রেমিকা থাকাকালীনও আমি বুঝিনি তুই আমাকে পছন্দ করতি। আমি তো তোকে সবসময় বন্ধুর মতোই ভাবতাম। খুব গাধা ছিলাম আমি। নইলে কি কেউ ভালোবাসার মানুষকে বড়ো ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়? বড়ো ভাইয়ার সাথে বিয়ের পর যখন ওর সাথে তোকে দেখতাম শুরু করলাম ভেতরটা জ্ব*লে যেত। তাই তো কিছু করতে না পেরে বাড়িছাড়া হলাম।”

সুরাইয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ” কঁচি খোকা ছিলেন আপনি। যাই হোক এসব আর দ্বিতীয়বার আমাকে বলবেন না। আমি আশরাফের সাথে ভালো আছি।”
” আমি ভালো নেই।”
” সেটা আমার দেখার বিষয় না। এটা আপনার দেখার বিষয়, নারী ভালোবাসা বন্ধ করে দিলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অসুস্থতা ঘিরে ধরে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন!”
” আমি অন্যকাউকে মনে জায়গা দিতে পারি না, সুরাইয়া। সবসময় তোর কথা মাথা ব্লক করে রাখে। ”
” মনে জায়গা দেবেন না কেন? আমার এতো বড়ো একটা উপকার করছেন! আপনার জন্যও দোয়া রইল। অনুরোধ, আমার সামনে আসবেন না। এসব কথাও আর বলবেন না। ভালো লাগে না শুনতে। আমি স্বামী নিয়ে ভালো আছি। সে খাটি মনের মানুষ । আমি তাকে ভালোবাসি। ”

উমেদ আনমনে বলে ওঠে,” তুই কতটা ভাগ্যবতী তাই না? ভালোবাসা বোঝার পর আমি তোকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসিনি৷ দূর থেকে আমি তোকে ভালোবাসি, এখানে কোনো চাওয়া পাওয়া নেই৷ কল্পনায় আমার আর তোর একটা ছোটো সংসার আছে যেখানে আমি তোর অপছন্দের কোনো কাজ করলেই তুই গাল ফুলিয়ে বসে থাকিস। আমার ব্যথায় চিৎকার করে কান্না করিস, আমার খুশিতে খিলখিল করে হাসিস। বড্ডো ভালো আছি কল্পনার তোকে নিয়ে৷ ”

উমেদ বেরিয়ে যায়। বোতল হাতেই দাঁড়িয়ে উমেদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ টলমল করে ওঠে। পরক্ষণেই বড়ো বড়ো কয়েকটা শ্বাস ফেলে বলে ওঠে,” আমি আশরাফকে ভালোবাসি। আমার স্বামী আমার জন্য যথেষ্ট। আমি তার বাস্তবেই আছি, আর কে কোথায় রাখল সেটা দেখার নেই।”
___

আবরার বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ির সদর দরজা লক করছিল। তখনই পিছন থেকে কেউ এসে জড়িয়ে ধরে। আবরার হকচকিয়ে যায়। দ্রুত গতিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই বলে ওঠে,” তুমি!”

এশা পাতলা জরজেটের একটা কালো শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি লেপ্টে আছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে৷ আবরার এই প্রথম এশাকে শাড়িতে দেখছে। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে শাড়িতে হয়তো একটু বেশিই ভালো লাগছে।

এশা হাসিমুখে বলে ওঠে,” কেমন লাগছে আমাকে?”

আবরার মৃদুস্বরে বলে ওঠে,” সিগারেটের শেষটানের মতো। শেষটানে এসে যেমন পূর্ণ তৃপ্তি দিয়ে দেয় তবুও ছাড়তে ইচ্ছে করে না সেরকম তোমাকে শাড়িতে আজ পরিপূর্ণ প্রেমিকা লাগছে। নেশা চড়ছে আমার। ”

এশা হেসে বলে,” হয়েছে হয়েছে। দরজা খুলো এবার। বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?”
” তোমাকে তো সবসময় বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছি, বাহিরে কেন থাকবে?”

আবরার দরজার লক খুলে ডান হাত এগিয়ে ইশারায় ভেতরে যেতে বলে এশাকে। এশা ভেতরে এসে সোজা আবরারের বেডরুমে চলে যায়। আবরার রুমে প্রবেশ করতেই এশা বলে ওঠে,” বাসায় এলাম কীভাবে আপ্যায়ন করবে বলো?”

আবরার সামনের সিঙ্গেল সোফায় বসতে বসতে বলে,” কী করতে পারি আপনার জন্য?”

এশা বিছানা ছেড়ে আবরারের পাশে এসে বসে। দুই হাত আবরারের কাধে রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে,” তোমাকে দিয়ে দিতে পারো।”

আবরার এশার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ” পাওনি আমাকে?”
” কোথায় পেলাম?”
” পাওনি এখনো?”
” উহু৷ পেতেই তো এসেছি আজ।”

আবরার বিস্ময়ভরা চোখে এশার দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,” কী বললে?”
এশা অকপটে বলে দেয়,” তোমার কাছে এসেছি৷ তোমাকে পেতে। ”
” বুঝলাম না।”
” এতো অবুঝ তুমি নও আবরার। যেটা বুঝেছ সেটাই বলেছি।”

আবরার কপালে হাতে দিয়ে ঘষতে থাকে আর বলতে থাকে,” মাথা ঠিক আছে তোমার? কী আবোলতাবোল বলছ!”
” ঠিক নেই মাথা। আমি তোমাকে ছাড়া আর এক মুহূর্ত থাকতে পারছি না। তোমাকে আমার চাই।”
” এশা, এশা, এশা শোনো, আমরা বিয়ে করিনি। তুমি যা চাইছ তা এই মুহূর্তে কোনোভাবেই সম্ভব না। আমাদের সম্মান আছে। আমরা এরকম করতে পারি না।”

এশা আবরারের ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বলে। আবরারও চুপ হয়ে যায়৷ আবরারকে থামিয়ে দিয়ে এশা বলে ওঠে, ” আমি নিজেই তোমার কাছে এসেছি আবরার। সমস্ত দুনিয়া এখন ভুলে যাও প্লিজ।”

আবরার উঠে দাঁড়ায়। এশার হাত ধরে টেনে দাঁড় করায়৷ বলে ওঠে,” চলো বিয়ে করে নিই। তাহলে কোনো বাধা থাকবে না।”

এশা শুকনো ঢোক গিলে বলে,” বিয়ে! ”
” হ্যাঁ, বিয়ে করব। তোমার বাবাকে কল দিয়ে ব্যবস্থা করতে বলি। ”
” বিয়ের এতো তাড়া কেন তোমার?”

আবরার চোয়াল শক্ত করে বলে,” কারণ আমি আর ঠকতে চাইছি না।”
এশা আমতা আমতা করে বলে,” ঠ ঠকতে মানে?”
” মানে যা করেছ ভুলে যাও। চল বিয়ে করে ফেলি। নাকি সেটাও পারবে না?”

এশা কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কোনোকিছুর হিসাব মেলানোর চেষ্টায় আছে সে। আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,” কী হলো? আমি সবকিছু জেনেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি।”
” সবকিছু জেনে মানে?”
” যা যা লুকিয়েছ।”
” কী লুকিয়েছি?”
” কিছু না বাদ দাও।”

এশা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,” বলো আমাকে। কী লুকিয়েছি আমি তোমার থেকে?”

আবরার গিয়ে নিজের বিছানায় বসে। পিছন দিকে একটু হেলে গিয়ে বলে,” তোমরা সত্যিই খু*নী।”

এশার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। বেঁধে যাওয়া গলায় বলে,” তোমরা বলতে?”
” তুমি আর তোমার ভাই। ”

দ্রুতগতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে এশার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চিবুক ধরে বলে,” তোমার ভাই একটা মেয়েকে ধ*র্ষণ করল, যাকে ধর্ষ*ণ করল তার পক্ষ থেকে কেউ এসে যখন তোমার ভাইকে মা*রধর করল, সোশ্যাল মিডিয়ায় জানালো তার কিছুদিন পর তোমরা দুজন মিলে ছেলেটাকেই মে*রে ফেললে? আমি তোমাকে বাঁচাতে ভেতরে ভেতরে কত অন্যা*য় করলাম। তোমাকে সাপোর্ট দিলাম আর তুমিই আমাকে ঠকালে?”

এশা আবরারের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,” তুমি মোটেও আমাকে বাঁচাওনি। আমি নিজেই এসব থেকে বেরিয়ে এসেছি। ”

কথা শেষ করার আগেই এশার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই আবরারের মেজাজ যেন আরও খারাপ হয়ে যায়। এশার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে পুরুষালি গলায় কেউ বলে ওঠে,” জান, আ’ম ওয়েটিং। কখন আসছ?”

আবরার রক্তচোখে এশার দিকে তাকায়। রাগ আর ঘৃণায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে আবরারের। শক্ত গলায় বলে ওঠে,” তোর জান আমার কাছে শু*তে এসেছে।”

#চলবে……

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৮

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৮

চোখে ঘুম চলে আসে হৃদিতার। ফোনটা চার্জে দিয়ে ঘুমুবে ভেবে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে আবরারের নম্বর থেকে চারবার কল এসেছিল। ফোনস্ক্রিনটা এই মুহূর্তে একটু হলেও আনন্দ দেয় হৃদিতাকে।

মৃদু হেসে বলে, ” আবরার সাহেব! ”

কল রিসিভ করে সালাম দেয় হৃদিতা। ওপাশ থেকে সালামের জবাবও আসে তৎক্ষনাৎ। হৃদিতা আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে,” কল দিলেন যে? কোনো প্রয়োজন?”
ওপাশ থেকে আবরার বলে ওঠে,” জি। কল দিয়েছি একটা কারণে। আপনি আগামীকাল থেকে এশার সাথে সাথে থাকতে পারবেন না?”

হৃদিতা ভাবনায় পড়ে যায়। কী বলবে সে? থাকতে পারলে ভালোই হতো কিন্তু ওখানে থাকলে নিজের কাজে কচ্ছপ গতিতে এগুতে হবে।

হৃদিতাকে চুপ থাকতে দেখে আবরার আবার বলে ওঠে,” আপনি কি শুনছেন আমার কথা? এশা রাজি হয়েছে।”

হৃদিতা আমতা আমতা করে বলে,” উনি রাজি হলেও আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতে আর তাছাড়া আমি শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এরকম কোনো জব করতে পারি না৷ আপনি আমার জন্য ভেবেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যদি দুই একদিনের মাঝে অন্যকোথাও কিছু করতে পারি তবে আপনাকে জানাবো।”
” হুম। খুব ভালোবাসেন আপনি উনাকে?”

প্রশ্নটা করেই চুপ মেরে যায় হৃদিতা। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে এটা ভেবে যে ওপাশ থেকে হয়তো শক্তপোক্ত কিছু কথা ভেসে আসবে কিন্তু এলো না।

হৃদিতাকে অবাক করে দিয়ে আবরার বলে ওঠে,” হ্যাঁ, অনেক বেশি ভালোবাসি। এশা একটু খিটখিটে মেজাজের মেয়ে কিন্তু সহজ সরল খুবই ভালো একটা মেয়ে। ওর জন্য আমি সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারি৷ ”
” পুরুষ মানুষ কোনো নারীকে ভালোবাসলে সেই ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখে না তাই না?”
” সবার কথা জানি না তবে নিজের কথা বলতে পারব৷ আমি এশাকে অনেক ভালোবাসি৷ ”

হৃদিতা বিছানা ছেড়ে বেলকনির দিকে আসে। সামনে প্রচন্ড রোদ। মেঝেটাও গরম হয়ে আছে রোদের তাপে, দুই মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না বলে আবার রুমে ফিরে এসে বিছানার একপাশে বসে।

নরমস্বরে বলে,” এতো ভালোবাসেন কেন উনাকে?”
ওপাশ থেকে সাথে সাথে জবাব আসে,” জানি না তবে ভালোবাসি।”

হৃদিতার এই ভালোবাসা পছন্দ হলো না। নিজের এই অপছন্দের কথা মাথায় রেখেই বলে উঠল,” আপনি আমাকে আর কল দিবেন না৷ বাসার সামনেও আসবেন না। কোনো খবর আর নিবেন না৷ বাড়ির সামনে যে লোকটাকে রেখেছেন তাকে তুলে নেবেন। ”
আবরার আশ্চর্য গলায় বলে,” কী বলছেন আপনি? বাড়ির সামনের লোক মানে? কে আছে সামনে?”

হৃদিতা কিছু একটা মনে করে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য বলে,” দুইদিন ধরে একজনকে সামনের স্টলে দেখা যাচ্ছে তাই বলছিলাম। আমার মনে হয় ভুল বুঝেছি। বাদ দিন। ”

” আপনার জব চাই না?” প্রশ্নের উত্তরে হৃদিতা সহজেই ‘না ‘ বলে দেয়।
আবরার হৃদিতার গলায় ভিন্নতা বুঝতে পারে। মেয়েটাকে তার কোনোভাবেই খারাপ লাগেনি৷ সহজ সরল লেগেছিল বলেই সাহায্য করার কথা ভেবেছিল সে।

আবরারকে চুপ থাকতে দেখে হৃদিতা নিজেই বলে ওঠে,” ফোন রাখছি।”
____

সুরাইয়া দুপুরের জন্য খাবার টেবিলে খাবার রেখে ময়না বেগমকে খাওয়ার জন্য ডাকতে যায়। ময়না বেগম বসে বসে জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির একজনের সাথে কথা বলছিল।
সুরাইয়া এগিয়ে এসে ময়না বেগমকে খাবারের কথা বলতেই বাহিরের মহিলাটি বলে,” কী ভাগ্য, ভাবি! ছেলের বউ রান্না করে খেতে ডাকছে। আপনারও ভাগ্য আর আমাদেরও ভাগ্য। ”

ময়না বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,” হ্যাঁ, সারা দুনিয়াই তো ওরে দিয়ে দিছি ওইটুক করবে না?”

সুরাইয়া কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। আশরাফ গোসল দিয়ে বের হতেই সুরাইয়া বাহিরে থেকে ভেতরে প্রবেশ করে। আশরাফ হাত দিয়ে নিজের চুল নাড়তে নাড়তে এসে সুরাইয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সুরাইয়া বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পেরে ওঠে না।

সুরাইয়া বলে ওঠে,” ছাড়ো।”
” ছাড়ব কেন? বউকে এতো তাড়াতাড়ি ছাড়ে কেউ? বোকা…”
” খেতে চলুন।”
আশরাফ সুরাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলে, ” কিছু হয়েছে?”

সুরাইয়া আশরাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” কিছু না। চলো, খাবে চলো।”

সুরাইয়া ঘর থেকে বের হবে তখনই উমেদ এসে দরজায় দাঁড়ায়। আশরাফ এগিয়ে এসে বলে,” কিছু বলবি?”
উমেদ মাথা চুলকে বলে,” দুই হাজার টাকা হবে তোর কাছে? ঢাকা ফিরব, পকেটে টাকা নাই। ”
” কবে যাবি? কিছু বলিসনি তো!”
” কাল বিকেলে যাব। ভাবলাম এখন স্টেশনে যাই, টিকেট কেটে আসি।”

” দাঁড়া।” বলেই আশরাফ ওয়ালেট থেকে দুইটা এক হাজার টাকার নোট বের করে উমেদকে দিয়ে দেয়।

উমেদ বাড়ি থেকে বের হবে তখনই সুরাইয়া পিছন থেকে ডেকে বলে,” এখন দুপুরবেলা। বিকেলে কাটলেই হবে টিকেট৷ এখন সবাই একসাথে খেতে বসবেন আসুন।”

উমেদ কোনো কথা না বলে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে। ময়না বেগমও এসে নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েন। সুরাইয়ার আসতে দেরি হলে ময়না বেগম নিজেই একটা ঢাকনা তুলে চিংড়ি মাছ দেখে ভ্রু কুচকে সুরাইয়াকে ডাক দেন।

সুরাইয়া নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ময়না বেগম বলে ওঠেন,” গলা টি*পে মে*রে ফেলতে পারছো না বলে কি চিংড়ি খাইয়ে মা*র*বে নাকি? কী ক্ষতি করেছি আমি তোমার?”

সুরাইয়া খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে মাছের তরকারির পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,” অপছন্দ তো আমি, আপনার। আপনার অপছন্দনীয় হতে আমার কোনোকিছুই করতে হয় না এমনিতেই দোষ হয়ে যায়। আমি যখন এতই চক্ষুশূল তাহলে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কেন? আমি তো আপনার ছেলের ঘরে উঠে আসিনি। সবসময় কোনো না কোনো ভুল ধরতে বসেই থাকেন। ”

আশরাফ এসে সুরাইয়ার পিছনে এসে দাঁড়ায়। ময়না বেগম বিলাপ করতে করতে খাবার টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যান।

আশরাফ কিছু বলার আগেই উমেদ বলে ওঠে,” মা, তোমাদের সমস্যাটা কী? দুজনের কেউ কাউকে পছন্দ করো না। আর তুমি আজ কী করলে?খাবারের একটা ঢাকনা তুলেই এমন ব্যবহার শুরু করে দিলে? সুরাইয়া কী ক্ষতি করেছে তোমার? বাড়ি তো আসিই না, আসা বাদ দিয়েছি। বছরে একবার, দুইবার আসলেও এমন অবস্থা দেখতে হয়। মেয়েটা বাপের বাড়ি ছেড়ে এখানে পড়ে আছে আর তুমি সারাক্ষণ খারাপ ব্যবহার করেই যাচ্ছ।”

ময়না বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন,” আমার দোষটাই শুধু দেখলি? তোর ভাইয়ের বউ কেমন ব্যবহার করে আমার সাথে সেটা দেখলি না? মায়ের পক্ষ না নিয়ে ভাবির হয়ে কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? এই আমি তোকে পেটে ধরেছিলাম?”

আশরাফ ইশারায় উমেদকে চুপ করতে বলে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। মিনতির স্বরে বলে,” মা, সুরাইয়ার হয়ে আমি মাফ চাইছি। তুমি এসো খেতে এসো। ”

আশরাফ ময়না বেগমের হাত ধরতেই তিনি টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেন। আদেশের ভঙ্গিতে বলেন,” আমাকে তুই আমার বোনের বাড়িতে রেখে আয়। আমি এ বাড়িতে থাকব না। তুই তোর বউকে নিয়ে এ বাড়িতে থাক। ”

সুরাইয়া সামনে থেকে বলে ওঠে,” সমস্যা আমার না, সমস্যা হলো আপনার, মা। আপনি আমাকে দেখতেই পারেন না। যদি এতই তিক্ততা চলে আসে তাহলে বলুন আমি আজই বাড়িতে বলি আমাকে নিয়ে যেতে। এভাবে আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব হচ্ছে না।”

আশরাফ সুরাইয়ার দিকে ফিরে বলে,” তুমি একটু চুপ করো প্লিজ। দুজনই কেন যে এরকম হয়ে যাও হঠাৎ করে!”

ময়না বেগম সুরাইয়াকে কথা শোনাতে শোনাতে ঘরে গিয়ে ব্যাগে নিজের কাপড় নিতে থাকেন। আশরাফ ব্যাগ কেড়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বোঝায় তাতে একটু মানলেও ময়না বেগম বোনের বাড়ি যাবেনই বলে পণ করে বসেন। আশরাফ একটা শর্ত দেয়, তিনি যদি এখন খেতে বসেন তাহলে আশরাফ নিজে গিয়ে রেখে আসবেন। আর কোনো উপায় না পেয়ে ময়না বেগম রাজিও হয়ে যান।

বিকেলের দিকে আশরাফ রেডি হচ্ছে মাকে রেখে আসতে। সুরাইয়া এসে সামনে দাঁড়ায়। আশরাফ শার্টের হাতা ঠিক করছিল।

সুরাইয়া বলে ওঠে,” আম্মা যেতে চাইলো আর নিয়ে যাচ্ছ? আমার কী ভুল ছিল বলো আমায়?”
আশরাফ মৃদু হেসে বলে,” তোমার কোনো ভুল ছিল না। মা’র ও তো বয়স হয়ে যাচ্ছে তাই ওমন করেছে। মা তো অনেক দিন কোথাও যায় না আজ রেখে আসি। তুমি একটু হাসিমুখে কথা বলে এসো দেখবে ভালো লাগবে। ”

আশরাফের কথামতো সুরাইয়া শাশুড়ির রুমে চলে যায়। কথা বলার চেষ্টা করলে ময়না বেগম বলে ওঠে,” যাচ্ছি, এবার শান্তি করে থাকো। ভয় পাওয়ার দরকার নাই আমি আমার বোনের বাড়ি যেয়ে তোমার সম্পর্কে কিছু বলব না।”

সুরাইয়া বারবার মাফ চাইছে, বোঝানোর চেষ্টা করছে ময়না বেগম সেই আগের মতোই গম্ভীরস্বরে কথা বলে যাচ্ছেন।
আশরাফের ডাক শুনতেই সুরাইয়া নিজের ঘরে চলে আসে। আশরাফ নিজের ওয়ালেটে কিছু টাকা দিয়ে দিতে বলায় সুরাইয়া টাকাও বের করে দিয়ে দেয়। আশরাফ মাকে ডেকে বের হতে বলে।

সুরাইয়া আশরাফের হাত ধরে বলে,” মাকে একটু বুঝিয়ে বললে হতো না? কালকে রেখে আসতে। আজই দুপুরে ওরকম হলো আর আজই চলে যাচ্ছে। আমার ভালো লাগছে না।”

আশরাফ সুরাইয়ার দুইগালে হাত রেখে কপালে চুম্বন দিয়ে বলে,” চিন্তা কোরো না। কিছুই হবে না।”
” কিন্তু চিন্তা হচ্ছে তো।”
” কিছু হবে না। আমি মাকে রেখেই চলে আসব। উনি অনেকদিন এখানে ওখানে যান না জন্য মেজাজ খিটমিটে হয়ে গেছে। ঘুরে এলেই ভালো হয়ে যাবে। তুমি সাবধানে থেকো। আমি আসছি। ”

আশরাফ যেতে গিয়েও থেমে যায়। পিছনে ফিরে বলে,” ইয়্যুর হাজবেন্ড লাভস্ ইয়্যু।”
#চলবে…….

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৭

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৭

সুরাইয়া বিকেলে একটু উপন্যাসের বই নিয়ে বসেছিল। আশরাফ পাশেই শুয়ে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। বইয়ের পাতায় কিছুতেই মন দিতে পারছে না সুরাইয়া। বারবার আশরাফের মুখের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। কে বলেছে ঘুমানোর সময় শুধু নারীকে নিষ্পাপ লাগে? কোনো নারী কি ব্যক্তিগত পুরুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় এরকম পলকহীন চোখে দেখেছে? দেখলে বুঝতো ঘুমন্ত পুরুষের মুখে এক রাজ্যের মায়ামাখা থাকে।

সুরাইয়া বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে দেয়। ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নেয় আশরাফের। ছবিগুলো একেএকে দেখে মিটিমিটি হাসতে থাকে। মনে পড়ে দুদিন আগের কথা। সুরাইয়া যখন স্বর্ণ পেয়ে খুশিতে লালশাড়িটা পরেছিল তখন আশরাফ তাকে সীমাহীন লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল।

সুরাইয়া শাড়ি পরে যখন চোখে গাঢ় করে কাজল দিচ্ছিল তখন আশরাফ আচমকা বলে ওঠে,” চোখে কাজল দিচ্ছ, দাও। ঠোঁটে লিপস্টিক দিও না। তোমাকে কষ্ট দিয়ে তোমার চোখে পানি এনে কাজল নষ্ট না করলেও লিপস্টিকের দায়ভার আমি নিতে পারব না। ”

আশরাফের কথা কানে আসতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে সুরাইয়া। মনে হচ্ছিল মাটি ফাঁকা হয়ে গেলে সে ভেতরে ঢুকে যাবে। সুরাইয়ার অবস্থা দেখে আশরাফ উচ্চস্বরে হেসে উঠেছিল। সুরাইয়া শুধু মুখে আঁধার নামিয়ে বলেছিল,” লাগাম ছাড়া কথা বলবেন না একদম। ”

সেদিনের কথা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে ফেলে সুরাইয়া। আশরাফ ঘুম ঘুম চোখে বলে ওঠে,” হাসছ কেন? জ্বীনে ধরল নাকি আমার বউকে?”

সুরাইয়া ফোনটা পাশে রেখে বলে,” ধরলেই বা কী করবেন? নাক ডেকে ঘুমিয়েই যাচ্ছেন, ঘরে যে আরেকজন মানুষ আছে তার কোনো খেয়াল নেই।”

” কে বলেছে খেয়াল নেই?” বলেই সুরাইয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসে কোলে মাথা রেখে চোখবন্ধ করে ফেলে আশরাফ।
সুরাইয়া আশরাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,” চা খাবে? বানিয়ে নিয়ে আসব?”
” মন্দ হয় না। তোমার হাতের চায়ে কখনো ‘না’ বলা যায় না। ”

কথাটা শুনতেই বুকের ভেতর সূচালো ব্যথার সৃষ্টি হয় সুরাইয়ার। যতই মানুষটাকে ভুলে থাকতে চায় কোনো না কোনো কথায় তার কথা ঠিক মনে পড়ে যায়।
সুরাইয়া আস্তে করে উঠে বলে,” আমি চা নিয়ে আসছি।”
সুরাইয়া রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে। কাকতালীয়ভাবে তখনই উমেদ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,” চা করতে যাচ্ছিস?”

উমেদের গলা শুনে তাড়াতাড়ি করে মাথায় কাপড় দেয় সুরাইয়া। থেমে গিয়ে বলে,” হ্যাঁ। লাগবে?”
” এক কাপ চা পেলে ভালো হতো।”
” ঠিক আছে। পেয়ে যাবেন।”

সুরাইয়া কথা না বাড়িয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে যায়। চায়ের জন্য পানি বসিয়ে দেয় চুলায়। অতীত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেদিন ছিল শুক্রবার। ক্লাস বন্ধ। হঠাৎ উমেদের মেসেজের নোটিফিকেশন পেয়ে মুখে হাসি ফোটে সুরাইয়ার। মেসেঞ্জারে গিয়ে দেখে উমেদ মেসেজ করেছে।
” বাড়ি আছিস?”
সুরাইয়া তৎক্ষনাৎ রিপ্লাই করে,” নাহ, তোর মনের মধ্যে আছি। খুঁজে পাচ্ছিস না?”

ওপাশ থেকে অ্যাংরি ইমোজিসহ মেসেজ এলো,” ধুর মজা করিস না তো। বাড়ি আছিস কি না বল।”
সুরাইয়াও আর মজা না করে লেখে,” হ্যাঁ বাড়িতেই তো থাকার কথা।”
” আমি আসছি তোর বাসায়।”
” কেন?”
” একটা কথা বলার আছে আর তার চেয়ে বড়ো কথা আমার চায়ের নেশা উঠছে।”
” চা খেতে আসবি আয় কিন্তু কথাটা কী?”
” এসে বলছি।”
” এখনই বল।”

মেসেজ আর সিন হলো না। পরপর আরও কয়েকটা মেসেজ পাঠালো সুরাইয়া কিন্তু সেই আগেই মতোই কোনো রিপ্লাই তো দূর সিনও হলো না। কথাটা জানতে আর অপেক্ষা করতে মন চাইছে না সুরাইয়ার। লাস্ট দুই তিন বছরে সে যে কথা শোনার অপেক্ষায় ছিল সেই কথাটা বলবে না তো উমেদ? হাজারটা প্রশ্ন মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল সুরাইয়ার। প্রশ্নগুলো উত্তর না পেয়ে চা করতে চলে যায় সে। দশ মিনিটের মাথায় উমেদ সুরাইয়ার বাড়িতে চলে এসেছিল। সুরাইয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখে উমেদ তার বাবা-মার সাথে তাদের ঘরে কথা বলছে। সুরাইয়ার মা-বাবাও হাসি হাসি মুখ করে কথা বলছে। সুরাইয়ার চিন্তা বেড়ে যায়। ভালোও লাগছিল এটা ভেবে যে উমেদ হয়তো তার সাথে আগে কথা না বলে তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলছে।
কিছুক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে সে কিন্তু কোনো কথায় কানে এসে পৌঁছায় না। চা নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে সুরাইয়া।

দুই তিন মিনিটের মাথায় উমেদ সুরাইয়ার ঘরে এসে দরজায় নক করে বলে,” আসব?”
সুরাইয়া উমেদের দিকে তাকিয়ে বলে,” আয়। আজ অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন?”

উমেদ ভেতরে এসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলে,” এখন থেকে অভ্যাস করতে হবে।”
সুরাইয়া ভ্রু কুচকে বলে,” অভ্যাস? মানে? ”

উমেদ পকেট থেকে কয়েকটা চকলেট বের করে সুরাইয়ার হাতে দিয়ে বলে,” চকলেট খা। ভাইয়া নিয়ে আসছে।”

সুরাইয়া চকলেটগুলো টেবিলের ওপর রেখে বলে,” কথা শেষ কর। ”
উমেদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,” বলছি, এত অধৈর্য্য হচ্ছিস কেন?”
” হচ্ছি তার কারণ আছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছিস। বল জলদি।”

” কথাটা হচ্ছে…” বলেই মিটিমিটি হাসতে থাকে উমেদ। উমেদের এই হাসি সবসময় সুরাইয়া মুগ্ধ হয়ে দেখে এসেছে কিন্তু আজ যেন রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সুরাইয়া চোয়াল শক্ত করে বলে,” বলবি নাকি ঘর থেকে বের করে দেব?”
উমেদ হাসতে হাসতে বলে,” আরে থাম এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?”
” বল।”
” তোর বিয়ে নিয়ে এসেছি আমি আজ। ঘটকের সাথে এটা কেমন ব্যবহার? ”

সুরাইয়া ভ্রু কুচকে বলে,” বিয়ে মানে? কীসের বিয়ে? কার বিয়ে?”
” কার আবার তোর বিয়ে।”
” আমার?”
” হ্যাঁ৷ আমার ভাইয়া তোকে পছন্দ করে, সুরাইয়া। ”

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে সুরাইয়ার। আমতা আমতা করে বলে,” ম মজা ন নিচ্ছিস? ”
” আরে না রে ভাই। সত্যিই আশরাফ ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। গতকাল বাড়িতে ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিল তখন ভাইয়া তোর কথা বলল। আমি তো হেব্বি খুশি। তুই আমার ভাবি হবি ভাব একবার! আমি আর তুই এক বাড়িতে থাকব, একসাথে পড়াশোনা কত ভালো হবে!”
” তুই খুশি হচ্ছিস এসবে?”
” হ্যাঁ, খুশি হব না? তুই আমার ভাবি হচ্ছিস। ভাবিবন্ধু।”

উঠে দাঁড়ায় সুরাইয়া। দ্রুতগতিতে বলে,” তোর ভাইকে বলিস আমি বিয়ে করতে পারব না।”
উমেদ ভ্রু কুচকে বলে,” ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারবি না মানে? তাছাড়া তোর তো বয়ফ্রেন্ডও নেই। ”
” বয়ফ্রেন্ড নেই জন্য ধেই ধেই করে বিয়ে করতে বসব নাকি?”
বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি চলে দুজনের। শেষ পর্যন্ত উমেদ বলে ওঠে,” তুই আমাকে আজ অপমান করলি সুরাইয়া। আশা নিয়ে এসেছিলাম আমি তোর কাছে। আমার ভাইয়াকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। যে যেহেতু মুখ ফুটে বলেছিল তোর কথা সেহেতু ভেবেছিলাম ভাইয়ার ভালোবাসা হয়তো আমি পাইয়ে দিতে পারব। নিজের ওপর ভরসা ছিল। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিলি। ”
” তোকে না তোর ভাইকে ফিরিয়ে দিলাম।”

সুরাইয়ার কথার অর্থ সেদিন উমেদ বুঝতে পারেনি। না বুঝেই বলেছিল,” তুই আমার ভাইকে বিয়ে না করলে আমার সাথে কোনোদিন কথা বলিস না। ”

উমেদ চলে যাওয়ার পর সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উমেদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হোক তবুও ভালোবাসার মানুষের বড়ো ভাইকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। কাউকে দূর থেকেও ভালোবাসা যায়।
নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি সুরাইয়া। পরিবার ভালো একটা ঘর পেয়ে তার সিদ্ধান্ত পা দিয়ে পিষে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিল। পরিবারের ওপর সেদিন রাগ হয়নি, সব পরিবারই চায় মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে হোক মেয়ে ভালো থাকুক কিন্তু উমেদ! এতোগুলো বছর একসাথে থেকেও তার অনুভূতি বুঝল না! ভালোবাসাটা খুব জলদি অভিমান আর ঘৃণায় রূপ নিয়েছিল তার।

পিঠে কারো স্পর্শ পেতেই চমকে ওঠে সুরাইয়া। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার শাশুড়ি ময়না বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছেন। সুরাইয়া চুলার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখে পাতিলের সবটুকু পানি শুকিয়ে পাতিল পুড়*তে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি করে চুলা বন্ধ করে দেয় সে।

ময়না বেগম চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,” গ্যাস কি ফ্রিতে দেয় নাকি দোকানদার? ”

সুরাইয়া কোনো উত্তর না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্বিতীয়বারের মতো পানি বসিয়ে দেয়।
______

” তার মানে ফরেনসিক রিপোর্টে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল? স্যার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ”

হৃদিতার সামনেই বসে যাচ্ছে প্রায় পয়তাল্লিশ বছর বয়সী এক লোক। পেশায় তিনি সিবিআই অফিসার আজহার রেজা। হৃদিতার কথায় তিনি প্রথম থেকে সাজিয়ে বলা শুরু করেন,” আবার বলছি মন দিয়ে শোনো যাকে খু*ন করা হয়েছে তার খু*ন ছু*ড়ির আঘা*তে হয়নি। খু*ন হয়ে বালিশ চাপা দেওয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে। এই খবরটা হয়তো ওপরমহল থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ আর এখানে জড়াবে না। যেহেতু মিস এশাকে সেখানে দেখা গিয়েছিল আর খু*ন হওয়া ব্যক্তির সাথে শ*ত্রুতা ছিল তাই সে পুলিশের চোখে পড়েছিল। তাছাড়া ছু*ড়িতে এশার হাতের ছাপও পাওয়া গিয়েছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে আগের রিপোর্ট সামনে আনা হয়েছে। মানে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে ছু*ড়ির আঘাতে নয় বালিশ চাপা দেওয়ায় শ্বাস আটকে মৃ*তু হয়েছে কিন্তু বালিশে এশার হাতের কোনো ছাপ নেই। যে খু*ন করেছে সে সামনে আসবে না বলেই এশাকে সামনে রেখে এসেছে এতোদিন। দেখা যাবে কেস চলাকালীন টাকা দিয়ে সব বদলে ফেলা হয়েছে। এশাকে নির্দোষ প্রমাণ করে ফেলবে।টাকাওয়ালাদের খেলা এখানে। বর্তমানে এমন অবস্থা যে টাকা যার আইন তার। ”

কথা শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় হৃদিতা। ছলছল চোখে বলে,” তার মানে আমরা কিছু করতে পারব না, স্যার?”
আজহার রেজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” আমরা যেখানে অবস্থান করছি গায়ে সেই ট্যাগ থাকাকালীন তো নয়।”
” আর যদি অন্যভাবে কিছু করা হয়?”

আজহার রেজা উলটো প্রশ্ন করেন,” কীভাবে?”
” যেভাবেই হোক খু*নীকে তো আমি খুঁজে বের করবই আর শা*স্তিও আমিই দেব। আপনি শুধু আমাকে সাহায্য করবেন, কথা দিন স্যার।”

আজহার রেজা হৃদিতার মাথায় হাত রেখে বলে,” তোমার জন্য আমি সবসময় আছি। তোমার আঙ্কেলের দোয়াও সবসময় তোমার সাথে থাকবে।”

হৃদিতা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,” সবকিছু এত কঠিন কেন, আল্লাহ? যত কঠিনই হোক না কেন এর শেষ আমি খুঁজে বের করবই। খুঁজে বের করবই। ”

হৃদিতা রুমে আসতেই মায়ের কল আসে। হৃদিতা গলা ঠিক করে নিয়ে কলটা রিসিভ করে নেয়। ফোনের ওপাশ থেকে নাহার বেগম বলে ওঠেন,” হৃদি?”

হৃদিতা মৃদু গলায় বলে,” হ্যাঁ আম্মু। কী করছো?”
” সেলাইয়ে বসেছিলাম। তোর শরীর ভালো? খেয়েছিস?”
” হ্যাঁ মা খেয়েছি। শরীরও ভালো। আব্বু কোথায়?”
” তোর আব্বুও ভালো আছে৷ বাড়ি আসবি না, মা? তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
” গোরুর মাংস রান্না করে রাখেন ম্যাম আমি কালই চলে আসছি।”

নাহার বেগম মৃদু হেসে বলে,” আর পায়েস?”
” কেয়া বাত হ্যেয় নাহার-জি। সাবকুচ পাকালো মেরে লিয়ে, ম্যেয় জালদি আ’যাউঙ্গি।”

” আ’যাউ।” বলেই নাহার বেগম কল কাটলে হৃদিতা ল্যাপটপ নিয়ে বসে। অনেকক্ষণ বসে বসে সেটাই ঘাটাঘাটি করতে থাকে।

চোখে ঘুম চলে আসে হৃদিতার। ফোনটা চার্জে দিয়ে ঘুমুবে ভেবে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে আবরারের নম্বর থেকে চারবার কল এসেছিল। ফোনস্ক্রিনটা এই মুহূর্তে একটু হলেও আনন্দ দেয় হৃদিতাকে।

মৃদু হেসে বলে, ” আবরার সাহেব! ”

#চলবে……

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৬

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৬

” তোমার কি মনে হয় আমাকে অপমান করা মেয়েটাকে আমি আমার সাথে সাথে নিয়ে ঘুরব সারাক্ষণ? আমার কথা ভাবতে কে বলেছে তোমায়? আমি বলেছি তোমাকে কখনো? তুমি আমার বাবার পছন্দ বলেই আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি, ইচ্ছে হলে ভেঙেও দিতে পারি এটা আমার কাছে বড়ো বিষয় না। তুমি আমার ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে আসবে না একদম। তোমার সাথে মাস দুয়েক সময় কাটিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা মনে হয়েছিল কিন্তু যেই লাউ সে কদু বেরিয়ে আসলে। আমি আমার ওপর আঙুল নাচানো মানুষ বরদাস্ত করব না। ”

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে এশা। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে, স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে এশার সবগুলো কথা শুনতে থাকে আবরার।
আবরার ভীষণ ঠান্ডা মেজাজের পুরুষ। সহজে কোনোকিছু তাকে উত্তেজিত করতে পারে না। তাই এশার এতোগুলো কথাও আবরারকে টলাতে পারেনি। আবরার আগের মতো স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে।

আবরারকে চুপ থাকতে দেখে এশা আবারও বলে ওঠে,” দেখো আবরার, আমি আমার বাবাকেও এসবে সহ্য করতে পারি না আর তুমি তো বাহিরের কেউ। বাহিরের কেউ বলছি কারণ আমাদের বিয়ে এখনো হয়নি আর বিয়ে হলেই বা কি তুমি যখনই আমাকে তোমার ইচ্ছেতে চলতে বলবে সেদিনই আমাদের একসাথে শেষদিন হবে৷ তুমি নিশ্চয়ই আমার রাগ,জিদ সম্পর্কে জেনে গিয়েছ? তোমার যদি মনে হয় আমি যেমন সেভাবেই আমাকে বিয়ে করে সারাজীবন থাকতে পারবে তাহলে আমার জীবনে তোমাকে স্বাগতম আর যদি না পারো তাহলে ধন্যবাদ, তুমি এখন আসতে পারো।”

আবরার এতক্ষণে দুইহাত বুকের দুইপাশে বেধে দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে বলে ওঠে,” তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ তুমি কী করেছ। মামলি কোনো ব্যাপারের সাথে তুমি জড়িয়ে নেই আর সাধারণ কোনো কাজ করোনি। পুলিশ এখনো তোমার পিছনে পড়ে আছে, পড়ে আছে ফরহাদ সাহেবও। ফরহাদ সাহেবকে নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি, ভুলে যাওয়ার কথাও না। আমি তোমার সিকিউরিটির জন্য মেয়েটাকে তোমার সাথে রাখতে চেয়েছিলাম যেন সব খবরাখবর সে আমাকে সবসময় দিতে পারে। ”

আবরার থামতে না থামতেই এশা বলে ওঠে,” তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ ওই হারাম*জাদা আমার ভাইকে মেরেছিল। র*ক্তের বদলে র*ক্ত। আর আমি যদি কোনো বিপদেও পড়ি তাহলে কি ওই দুই টাকার মেয়ে আমাকে বাঁচাবে? ”
” সে দুই টাকার মেয়ে না, এশা। কথায় আন্তরিকতা রাখো।”
” তুমি আমাকে এখন কথাবার্তা শেখাবে? যাও বেরিয়ে যাও তো এখান থেকে৷ একদম জ্ঞান দিতে আসবে না, এটা আমার সবচেয়ে অপছন্দের। ”
” বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া মেয়ের মতো কথা বলবে না, এশা। হৃদিতাকে রাখা হচ্ছে তোমার সাথে থাকার জন্য বাকিটা আমি দেখে নেব। আমি যেভাবে বলছি সেভাবে চলো কয়েকটা মাস। পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে গেলে ওকে বাদ দেওয়া যাবে।”

এশা আবরারের দিকে এগিয়ে এসে আবরারের মুখ বরাবর আঙুল উঁচিয়ে বলে,” তোমাকে আমি নিষেধ করেছি আবরার। বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। তুমি যে কথা বলছ সেটা আমি, তুমি, বাবা ছাড়া কেউ জানে না আর বাকি রইল পুলিশ তারা শুধু সন্দেহ করেছিল তাছাড়া কিছু না।”

আবরার ধৈর্য্যহীন না হয়ে আবার বলে,” নিজেকে নিয়ে একটু ভাবো, এশা। জীবনটা ছেলেখেলা নয়। তুমি হৃদিতাকে চাইছো না তাই না? আমি অন্যকাউকে ঠিক করে দিই।”
” তুমি জাস্ট এই রুম থেকে বেরিয়ে যাও সাথে আমার জীবন থেকে। তোমাকে সহ্য হয় না আমার।”
” ভেবে বলছো?”
” এতে ভাবাভাবির কী আছে? তোমারে ভাল্লাগে না এই কথা বাবাকে বলেছিও সে শুনেনি। আজ তোমাকেই বলে দিলাম। যাও বেরিয়ে যাও।”

আবরার টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে দ্রুতগতিতে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আবরারকে বেরিয়ে আসতেই দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় হৃদিতা। আবরারের দিকে দুই এক পা এগিয়ে এসে বলে,” কী বলল উনি? আমাকে মাফ করতে পেরেছেন?”

আবরার হৃদিতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে ওঠে,” চলুন আমার সাথে। ”
” যাব কেন?”
” আমার কিছু করতে হবে না এখন?”
” এখন না কখনোই কিছু করতে হবে না।”
” ক্লিয়ারলি কিছু বলছেন না কেন?”

আবরার দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” চলুন আমার সাথে।”
____

আশরাফ দুইটা গহনার বাক্স নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই ময়না বেগম আশরাফকে নিজের রুমে ডেকে পাঠান৷ সুরাইয়া রান্নাঘরে কাজ করছিল। আশরাফ মায়ের ডাক শুনে মায়ের রুমে যাওয়ার আগে সুরাইয়ার দিকে তাকাতেই সুরাইয়া চোখ নামিয়ে কাজে মন দেয়। সে এই পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সে জানে এখন কী ঘটবে। সবকিছু ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরাইয়া।

আশরাফ ঘরে ঢোকার পরই ময়না বেগমের চোখ যায় গহনার বাক্সের দিকে। হাত বাড়িয়ে বলেন,” দেখি কী এনেছিস?”

আশরাফ বাক্সের দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,” সুরাইয়ার জন্য ছোটোখাটো কিছু উপহার নিয়ে এসেছি। বাহিরে থেকে আসার সময় তো কিছু আনতে পারিনি তাই ভাবলাম ওকে কিছু দেই। সে তো নিজে থেকে কিছু চাইতেই ভুলে গেছে। ”

ময়না বেগম একটা বাক্স খুলে ভেতরে স্বর্ণের দুজোড়া কানের দুল দেখে আরেকটা খুলে সেখানে দুইটা স্বর্ণের আংটি দেখতে পায়। সেগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলে ওঠেন,” এই সবগুলো বউয়ের জন্য?”
” হ্যাঁ মা, সুরাইয়ার জন্য নিয়ে আসলাম। ওকে তো তেমন কিছু দিতে পারিনি৷”
” মায়ের জন্য কী এনেছিস?”
” তোমার কিছু চাই? আমাকে বলো তোমার কী লাগবে?”
” আমি বলব তারপর নিয়ে আসবি?”
” না মানে, তোমার জন্য গতবার নিয়ে এসেছিলাম তাই আর আজ কিছু নিয়ে আসিনি। তোমার কিছু লাগলে বলো আমি নিয়ে আসছি।”
” লাগবে না। তোর বউয়ের গুলো আমার কাছে রাখতে বলিস। যখন কোনো অনুষ্ঠান হবে পরতে হলে তখন যেন নেয়, নিয়ে পরে। ”

আশরাফ মাথানিচু করে বলে,” মা, এগুলো প্রতিদিন ব্যবহার করার জন্য। এক জোড়া কানের দুল পরবে আর একজোড়া ও নিজেই রেখে দেব। যখন ইচ্ছে হয় পরবে। মেয়েদের গায়ে গহনা আলাদা শ্রী সৃষ্টি করে।”
” তোমার বউকে বোলো আমার থেকে নিতে। এত দামি জিনিস সামলাতে পারবে না।”

আশরাফ বুঝতে পারে এগুলো হয়তো সুরাইয়ার ভাগ্যে আর জুটবে না। মায়ের কাছে থাকলে সুরাইয়া নিজের ইচ্ছেমতো পরতেও পারবে না। সে বুঝে গেছে তার মা সুরাইয়াকে খুব একটা পছন্দ করে না। এই পরিবেশটাই একটা পুরুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন। মায়ের মন রাখলে বউ অখুশী আর বউয়ের মন রাখলে মা অখুশী।

আশরাফ কপাল চুলকে বলে,” মা, এগুলো সুরাইয়া পরে থাকবে। সামলে রাখার বা না রাখার কী আছে? ”
আশরাফ গহনাগুলো বাক্সে রেখে মায়ের হাত নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলে,” মা, সুরাইয়া পুরো সংসার সামলায়। রান্না থেকে শুরু করে বাজার, বাড়ির কাজ,তোমার সেবা, সবার দেখভাল সবই করছে। এতকিছু সামলাতে পারলে সামান্য এই গহনা সামলাতে পারবে না? কী যে বলো না! ”

আশরাফ বাক্সগুলো নিজের হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” মা তুমি রেস্ট নাও আমি পরে আবার আসব।”

ময়না বেগম কিছু না বলে ছেলের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকেন৷ তিনি ছেলের পরিবর্তন বেশ বুঝতে পারছেন। সংসারটা হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে ভেবে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে ময়না বেগম। সুরাইয়ার প্রতি রাগ যেন এবার আরেকটু বড়ো আকার ধারণ করেন।

সুরাইয়া ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে নিজের রুমে চলে এসেছে। এক কাপ চা নিয়ে বসে বসে টিভি দেখছিল। পাশেই আরেক কাপ চা রাখা আশরাফের জন্য। চায়ে চুমুক দিতেই রুমে আশরাফের উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিকে আর দেখে না আশরাফকে।

আশরাফ বুঝতে পারে সুরাইয়া রেগে আছে। আশরাফ গহনার বক্স দুইটা পাশের চেয়ারে আস্তে করে রাখে৷ সুরাইয়া সেটা বুঝতেও পারে না। সুরাইয়ার পাশে বসতেই সুরাইয়া অন্যদিকে সরে যেতেই আশরাফ হাত ধরে সেখানেই আটকে রাখে।

সুরাইয়া বিরক্তভাব নিয়ে বিরসভাবে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,” কী চাই?”

আশরাফ মৃদু হেসে বলে,” হাতটা দাও।”
” কেন?”
” আংটি পরবে না? তোমার তো শখ ছিল। ”
সুরাইয়া ভ্রু কুচকে বলে,” তোমার মা রেখে দেয়নি? বলেনি আমি স্বর্ণ সামলে রাখতে পারব না?”
” মা’র কথা এতো ধরে বসে থেকো না তো। হাত দাও।”

সুরাইয়া হাত বাড়িয়ে দিয়ে আশরাফ পাশে রাখা বক্স থেকে দুইটা আংটি বের করে সুরাইয়ার আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলে,” দেখো তো পছন্দ হয়েছে কি না?”

সুরাইয়া নিজের আঙুলের আংটি দুইটা পলকহীন চোখে দেখতে থাকে। বিষয়টা যেন অবিশ্বাস্য লাগছে তার কাছে। বাবা যে টাকা উপার্জন করত তাতে স্বর্ণ তো দূরের কথা তিনবেলা ঠিকমতো খেতেও পেত না। মা খুব কষ্ট করে কয়েক বছর টাকা জমিয়ে এক জোড়া কানের দুল বানিয়ে দিয়েছিল সেটাও বাবার অসুখের সময় বিক্রি করে চিকিৎসা করতে হয়েছিল। বিয়েতে যা গহনা পেয়েছিল সেটা বিয়ের পর শাশুড়ি দেখতেও দেয়নি।

সুরাইয়া টলমল চোখে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,” এগুলো আমার?”
আশরাফ হেসে বলে,” কানের দুলও আছে।”
সে গহনার বক্সটা সুরাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” এখানে দুই জোড়া আছে। যখন যেটা ইচ্ছে পরতে পারো। ”

সুরাইয়া কানের দুলজোড়া দেখে মুচকি হেসে বলে,” এগুলোর সাথে শাড়ি পরি? তোমার দেওয়া ওই লাল টকটকে শাড়িটা?”

#চলবে……

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৫

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৫

হৃদিতা নিজের বামে তাকাতেই আবরারকে দেখে বলে ওঠে,” আপনার বন্ধুকে সামলান আবরার সাহেব। তাকে বুঝিয়ে দেন আমি তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে পারব না। ”

আবরার আন্তরিকতার সাথে বলে,” দুঃখিত৷ এশার পক্ষ থেকে আমি মাফ চাইছি।”

মেয়েটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চোয়াল শক্ত করে বলে,” কী বলছো এসব, আবরার?”
” চুপ করো। তোমার এখানে আসতে হবে কেন? আমরা তো যাচ্ছিলাম রেস্টুরেন্টে তাই না? হঠাৎ করে তোমার এখানে আসার জন্য মন কাঁদলো কেন বলো তো? এত আনহাইজেনিক খাবার কেন খেতে হবে তোমার? আসলেও যেহেতু, দেখছো একজন বসে আছে তাকে তুলে দিয়ে কেন তোমার বসতে হবে? তুমি তোমার অভ্যাস…”

হৃদিতা আবরারকে থামিয়ে দিয়ে বলে,” আপনার এই নিব্বি গার্লফ্রেন্ডকে বোঝান৷ তার বুদ্ধি হয়তো স্বাভাবিকের চেয়ে কম আছে নইলে বুদ্ধিহীন। এখান্র আমার সামনে না বুঝিয়ে রুমে নিয়ে তোতাপাখির মতো বোঝান।”

হৃদিতা চলে যেতে লাগলে পাশে থেকে এশা হাত খপ করে ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। র*ক্তিমচোখে বলে,” কাজটা একদম ঠিক করলে না। পিঁপড়ের মতো পা দিয়ে পিষে পিষে মা*র*ব।”
” তাহলে তো আজই থানায় জিডি করে রাখতে হচ্ছে কখন মা*রা পড়তে হয় বা যে মা*রতে আসবে সে মা*রা পড়ে এসবের দায়ভার তো আমি নেব না। ”
” তোকে তো আমি…. ”

আবরার ধমক দিয়ে বলে ওঠে,” উফ কী শুরু করলে এশা? চলো তো এখান থেকে৷ আমরা যেখানে যাচ্ছিলাম আমি সেখানেই যাব।”

আবরার এশাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে রাস্তার পাশে রাখা গাড়িতে বসিয়ে কিছু একটা ভেবে হৃদিতার দিকে ফিরে যায়। হৃদিতা রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ আবরারকে পাশে দেখে হকচকিয়ে যায় সে।

সাগ্রহে বলে ওঠে,” কিছু বলবেন?”
” জি, অনুমতি দিলে বলতাম। ”
” সমস্যা নেই বলুন। আপনি তো আপনার প্রেমিকার মতো না তাই না?”
” আপনি ওকে ভুল বুঝেছেন। একটু রাগ বেশি তবে ভালো মনের মেয়ে। ”
” উনার বাহ্যিক, অঅভ্যন্তরীণ গুণাবলি জানাতে এসেছেন?”
” না, তা কেন হবে? আপনি বোধ হয় চাকরি খুঁজছিলেন। আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারব, একটু কষ্ট হবে তবে স্যালারি ভালো পাবেন।”
” ধন্যবাদ, আমি আমার ব্যবস্থা করে নেব। ”

হৃদিতা আর এক মুহূর্ত সেখানে দেরি না করে রাস্তা পার হয়ে চলে যায়। আবরার সেদিকেই পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে বুঝতে পারে এ মেয়ের আত্মসম্মান আর আত্মনির্ভরশীলতা প্রচুর।
_____

শীতল হাওয়া বইছে। চারপাশটায় অন্ধকারে পরিপূর্ণ। কিছুটা দূরে একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছে। দোকানিরা দোকানের ঝাপ ফেলে বন্ধ করে বাসায় ফেরা শুরু করেছে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল অনেকটা কমে গিয়েছে।

ছাদে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ প্রকৃতির স্তব্ধতার সাক্ষী হিসেবে খাতায় নাম লিখিয়েছে৷ সুরাইয়া সেই কখন থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না কী দেখছে কে জানে!
তবে আশরাফ পলকহীন চোখে আকাশ দেখা নারীকে দেখে যাচ্ছে।

সুরাইয়া মাথা বাঁকিয়ে আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,” কী দেখছো?”
আশরাফ মৃদু হেসে বলে,” তোমাকে।”
” ভালোবাসো?”
” ভালো না বাসলে সংসার করছি কেন?”
” সংসার না করেও তো ভালোবাসা যায় তাই না? মানুষ সংসার করে কেন বলো তো?”
” কী সব বলছ! সংসার না করলে ভালোবাসার পূর্ণতা কোথায়? ”
” আমাদের সংসার কতদিনের? ”

আশরাফ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে,” পাঁচমাসের। ”
” চার বছরের বিবাহিত জীবনে আমাদের সংসার পাঁচ মাসের। তোমার মনে হয় না আমাদের এবার মন দিয়ে সংসারটা করা উচিৎ? বিয়ের সময় আড়াইমাস আর তারপর একবার ছুটিতে এসেছিলে। আচ্ছা ডালভাতে সংসার চালানোর মতো টাকা হয়নি আমাদের?”

আশরাফ সুরাইয়ার দুইগালে আলতো করে হাত রেখে বলে,” এই তো এবারই শেষ। আর দুইটা বছর থেকে আসি তারপর শুধু তুমি আর আমি। দেশে ফিরে তখন জমানো টাকায় কিছু একটা শুরু করে দেব।”
” আমাদের এই হাজার মাইলের দূরত্ব আমার আর ভালো লাগে না, আশরাফ। ”
” এই দুইটা বছর দেখতে দেখতে চলে যাবে দেখো তুমি।”
” সত্যিই ফিরবে তো আমার কাছে?”
” পুরুষ তার ব্যক্তিগত নারীর কাছে না ফিরে যাবে কোথায়!” বলেই সুরাইয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয় আশরাফ। সুরাইয়া শ্বাস প্রলম্বিত করে নিশ্চিন্তে আশরাফের বুকে মাথা রাখে।
____

” আবরার সাহেব আমাকে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তিনি নাকি আমার জবের বিষয়টা দেখবেন। আমার মনে হয় এই অফারটা আমার কাজে লাগানো উচিৎ। ”

হৃদিতার কথা শেষ হতেই ওপাশ থেকে কেউ অল্পশব্দে বলে ওঠে,” আপনি আজ বিকেলে আমার সাথে দেখা করুন। ওহ হ্যাঁ আরেকটা কথা, আবরার সাহেবের বাসাটা কোথায় জানা আছে আপনার?”

হৃদিতা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে ঘষতে ঘষতে বলে,” স্যার, উনি যেহেতু সেরকম বড়ো কোন নেতা নন তাই এই বিষয়ে কারো তেমন আগ্রহ থাকার কথা না। তবুও আমি এখানে বাসা নেওয়ার আগেই খুঁজে নিয়েছি। উনি আমার বাসার সামনে দিয়েই যাতায়াত করেন। আমি বাসা দেখতে আসার দিনই এখানেই সামনের স্টলে দেখেছিলাম।”
” ঠিক আছে নজরে রাখবেন।
” জি স্যার। বিকেলে আমি অফিসে আসছি।”
” অফিসে না। আপনি ভার্সিটির সামনের রেস্টুরেন্টে বিকেল পাঁচটায় চলে আসুন।”
” জি স্যার।”

হৃদিতা ফোনটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে নিজেও বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। কপালে দুইহাত রেখে ভাবতে থাকে পরবর্তীতে কী কী করবে? অলসতা ঘিরে ধরার আগেই চটপট করে রেডি হয়ে নেয় হৃদিতা। আজ একজনের সাথে দেখা করার কথা আছে তার।
_____

দুইদিন পরে সুরাইয়া আর আশরাফ বাড়ি ফিরেছে। দুইটা দিন এতো তাড়াতাড়ি কেটে গেল যে এখনই সুরাইয়ার শ্বশুরবাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। আধাঘণ্টা আগে ময়না বেগম আশরাফ কল দিয়ে জানালো উনার নাকি শরীর খারাপ করেছে আবার তাই তো তড়িঘড়ি করে বাড়ির সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরেছে আশরাফ আর সুরাইয়া।

সুরাইয়া বাড়ি ফিরেই শাশুড়ির রুমে চলে যায় আশরাফের সাথে। রুমে গিয়ে দেখতে পায় ময়না বেগম বিছানায় নেই। আশরাফ ‘মা’ বলে ডাকতেই রান্নাঘর থেকে ময়না বেগমের গলা শুনতে পাওয়া যায়। দুজনই সেদিকে এগিয়ে যায়।

রান্নাঘরের বাহিরে ধোয়া দিয়ে ছেয়ে গিয়েছে। আশরাফ হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে সামনের পথটুকু পরিষ্কার করে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

ময়না বেগম রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। আশরাফকে দেখে বলে ওঠেন,” এসে গেছিস, বাবা?”

আশরাফের পরপরই সুরাইয়া এসে আশরাফের পাশে এসে দাঁড়ায়। ময়না বেগমকে রান্নায় ব্যস্ত দেখে বলে, ” মা, আপনি না অসুস্থ, রান্নাঘরে কী করছেন? ”
ময়না বেগম আশরাফের গালে হাত দিয়ে বলেন,” আমার ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই আসতে বলছি। তুমি ওখানে থেকে গেলেই পারতে।”

আশরাফ এতোক্ষণে পুরো বিষয়টা ক্লিয়ারলি বুঝতে পেরে বলে,” মা, সে তুমি এমনি আসতে বললেই চলে আসতাম। মিথ্যার আশ্রয় কেন নিতে হবে তোমার?”
” চুপ কর তো। এমনি এমনি আসতে বললে তোর বউ আসতে দিত নাকি?”

” না, আসতে দিতাম না৷ দেবই বা কেন? আপনার ছেলেকে তো আমি আঁচলে বেধে রেখেছিলাম। ” সুরাইয়া এবার বেশ কড়া গলায় বলে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
” দেখেছিস তোর বউয়ের সাহস? বুলি ফুটেছে কেমন!”
আশরাফ একবার মাকে দেখে আর একবার সুরাইয়ার যাওয়া৷ দুইটা হাত মাথায় দিয়ে বলে,” তোমরাও না!”
_____

হৃদিতা সালোয়ার-কামিজের সাথে সাদা একটা ওরনা নিয়ে নেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখেও নেয় সব ঠিকঠাক আছে কি না। ঠোঁটের গাঢ় লিপস্টিক মুছে হালকা করে নেয়। আর দেরি না করে বিছানার ওপর রাখা ফোন আর পার্সব্যাগটা নিয়ে রুমটা লক করে বেরিয়ে যায়। গতকাল সে আবরারকে কল করেছিল আবরার নিজেই তাকে আজ দেখা করতে বলেছে। হৃদিতা বাসার সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে নির্দষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে।

প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায় রিকশা। হৃদিতা ভাড়া দিয়ে নিজের কাছে টাকার এমাউন্টটা একবার চেক করে নেয়। এখানে কিছু খাওয়া দাওয়া করলে টাকার সমস্যায় পড়তে হবে কি না সেটাও বুঝে নেয়।

দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই একদম ভেতরের দিক থেকে একজন হাত উঁচিয়ে ডাকে। হৃদিতা সেদিকে খেয়াল করতেই দেখে আবরার বসে আছে। হৃদিতাও আর দেরি না করে সেখানে গিয়ে বসে।

আবরার হাতের ফোনটা টেবিলের ওপর উলটো করে রেখে বলে,” কেমন আছেন?”
হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,” জি আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
” হুম ভালো আছি।”
আবরার খাবারের মেন্যু এগিয়ে দিয়ে বলে, ” নিন দেখুন তো কী নেওয়া যায়?”
” আপনার যেটা ইচ্ছে হয় সেটা নিন। আমার সবেতেই চলবে।”
আবরার মেন্যু দেখতে দেখতে বলে,” আপনি এখানে একাই থাকেন? বাসায় কে কে আছেন আপনার? ”

নিজের আসল পরিচয় দেওয়া ঠিক হবে কি না ভেবে পায় না সে। হঠাৎ বলে ওঠে,” আমার বাবা-মা নেই। চাচার বাসায় ছিলাম প্রায় চার বছর। তারা বিয়ে দিতে চাইছে তাই সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। পনেরো হাজার টাকার মধ্যে কোনো জব হলেই হয়ে যাবে। ”

আবরার খাবারের অর্ডার দিয়ে হৃদিতার দিকে তাকায়। একবার পর্যবেক্ষণ করে নেয় তাকে তারপর বলে,” সিভি এনেছেন?”
” জি।”

হৃদিতা ব্যাগ থেকে সিভি বের করে আবরারের হাতে দেয়। আবরার পুরো সিভিতে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। ফিরিয়ে দিয়ে বলে,” আপনার বাবা-মা কবে মারা গিয়েছে?”

হৃদিতা চকিতে বলে দেয়,” কভিডে। দুজন একসাথে আক্রান্ত হয়েছিল।”
” আচ্ছা আচ্ছা। কম্পিউটার ইউজ করতে পারেন তো তাই না?”
” জি।”
” ঠিক আছে। আমি রাতে আপনার সাথে কথা বলে নেব। ”

হৃদিতা হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ে। আবরার আবার বলে,” এশার সাথে সাথে থাকতে পারবেন?”

হৃদিতা বুঝতে না পেরে বলে ওঠে,” স্যরি! বুঝতে পারিনি।”
” এশার সাথে থাকতে হবে পারবেন? যার সাথে সেদিন আপনার ঝগড়া টাইপ বেধেছিল। ”

হৃদিতা মুখ গোমড়া করে বলে,” এই বাচ্চা মেয়েটাকে সিংহীর কাছে দিবেন?”
হৃদিতার কথা শুনে আবরার হো হো করে হেসে ফেলে। হৃদিতা মাথানিচু করে ছিল। আবরারের হাসি শুনে সামনে তাকালে আবরারের হাসিমাখা মুখটা দেখে একপলকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে কী সুন্দর হাসতে পারে এই লোকটা!

#চলবে……

প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-০৪

0

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৪

রাসেল শেখ-এর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার অভ্যাস আছে। ঘুম ভেঙে গেলে তিনি হয়তো টুকিটাকি লিখতে বসেন নইলে সমস্ত রুম হেটে বেড়ান। অন্যসব দিনের মতো আজও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। ডাইনিং টেবিল থেকে পানির বোতলটা নিয়ে রুমে ঢুকবেন ডানপাশে চোখ যেতেই দেখেন মেয়ের রুমের দরজা খোলা। বোতলটা রেখে হৃদিতার রুমের দিকে চলে যায় রাসেল শেখ। ভেতরে ঢুকে মেয়েকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখেন হৃদিতা বেলকনিতে রাখা সোফায় ঘুমিয়ে গিয়েছে। রাসেল শেখ আর মেয়ের ঘুম না ভাঙিয়ে বিছানা থেকে পাতলা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যান।

রাসেল শেখ চলে যাওয়ার সাথে সাথে হৃদিতা উঠে বসে। হাতে থাকা ফ্রেমটায় হাত বুলিয়ে গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে…

Mujhe neend aati nahi hai akele
Khwabon mein aaya karo
Nahi chal sakunga tumhare bina main
Mera tum sahaara bano

Ik tumhein chahne ke alaawa
Aur kuch humse hoga nahi

Bol do na zara
Dil mein jo hai chhipa
Main kisi se kahunga nahi
Main kisi se kahunga nahi
____

” বুঝি না বাপু, আগে দুইজন বন্ধু ছিলে। ইন্টার থেকে একসাথে অনার্স কমপ্লিট করেছ, আগে তুই করে কথা বলতে আর এখন আপনি করে তো বলোই উমেদের সামনেই আসতে চাও না।”

খাবার টেবিলে বসে ময়না বেগম রুটির টুকরো মুখে দিয়ে কথাখানা সুরাইয়ার উদ্দেশ্যে বলেন। সুরাইয়া আশরাফের পাশে বসেই নাস্তা করছিল। মাথায় ওরনা কপাল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া। মাথানিচু করে নিজের প্লেটের দিকেই তাকিয়ে নাস্তা করছিল। শাশুড়ির কথায় মাথা তুলে আশরাফের দিকে একবার তাকিয়ে আবার শাশুড়ির দিকে তাকায়।

উমেদ মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” মা, এখন ও আমার বড়ো ভাবি। আগের মতো আচরণ করা তো শোভা পায় না। ”
” কী জানি বাপু, এসব নিয়ে তো কোনোদিন কিছু বলিনি। ননদের সাথে যেভাবে চলে দেবরের সাথেও তো একটু বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ থাকতে হবে। কেমন গা ছাড়া ভাব।”

সুরাইয়া খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় বলে,” আম্মা, আগে কী ছিল না ছিল সেটা বাদ। এখন উমেদ আমার দেবর৷ দেবরের সাথে মাখোমাখো সম্পর্ক মেইনটেইন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমাদের সম্পর্কটা যে খারাপ সেরকম তো না আর চার বছর হয়ে গেছে উমেদে সেরকম বাড়িতেও আসে না। দূরত্ব তো একটা সৃষ্টি হয়েছেই তাতে। আমার মনে হয় আমার ব্যবহারে উমেদের খারাপ লাগারও কিছু নেই।”

ময়না বেগম কথার পৃষ্ঠে বলে ওঠেন,” বাদ দাও। তোমার শরীর কেমন এখন?”
” জি আম্মা, ভালো। আমি আপনাকে বলেছিলাম একটু বাড়ি যাব। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার বড়ো ছেলের সাথে আমার একটু ঘুরে আসতাম। ”
” ঠিক আছে। বিকেলে চলে যেও।”
” শুকরিয়া আম্মা।”

সুরাইয়া উঠে চলে গেলে আশরাফ বলে,” মা, আমি তাহলে আর আজ ফিরব না। বিকেলে গেলে শাশুড়িও আসতে দিতে চাইবে না। তখন কল দিয়েছিল যাওয়ার কথা শুনে কতকিছুর যে আয়োজন করা শুরু করেছে!”

” দেখিস বাপ, শাশুড়ির ভালোবাসায় মাকে ভুলে যাস না আবার।”
” মা কী যে কও না! সবাই তো নিজের নিজের জায়গায় আছে কারো মতো কেউ হয় না। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা তোমার ছেলে এত ভালোবাসা পাচ্ছে।”

ময়না বেগম আর কিছু না বলে প্রস্থান করেন। আশরাফ উমেদকে উদ্দেশ্য করে বলে,” সুরাইয়ার সাথে তোর কিছু হয়েছে? বিয়ের আগে ভেবেছিলাম দুজন মিলেমিশে থাকবি আর এখন দেখছি কেউ কারো মুখটাও দেখছিস না!”

উমেদ চকিতে বলে ওঠে,” তোর তো ভাগ্য ভালো ভাইয়া। তোর বউ মাহরাম, নন-মাহরাম মেনে চলার চেষ্টা করতেছে। শুধু আমার সাথে না সবার সাথেই এমন করে আর তোদের চোখে শুধু আমিই পড়ি তাই না?”
” তাই বলে তুই থেকে সোজা আপনি!”

দুপুরে খাওয়া শেষ করে একটা ঘুম দেওয়া হৃদিতার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন বাসায় প্রয়োজনীয় আসবাব পরশু তুলেছে সে।৷ তবে সেখানে আজ ওঠার কথা। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো তার একটু বের হওয়া প্রয়োজন৷ বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা নাহার বেগমের কাছে চলে গেল সে। নাহার বেগম বসে বসে নিজের হাতের কাজ করছিলেন।

হৃদিতা পাশে বসে বলে,” আম্মু চলো বাহিরে থেকে ঘুরে আসি।”

নাহার বেগম কাঁথায় সেলাই শেষ করে বলেন,” আমার আজ অনেক কাজ মা। এখন উঠে রান্না করতে হবে। ”
” ভাবলাম একটু খাওয়া দাওয়া করে আসি।”
” সুরাইয়া- আশরাফ যায় কি না দেখো।”
” কাপলের সাথে গিয়ে কী করব?”
” উমেদকে চেপে ধরে নিয়ে যা, মা। আমার হাতে সময় নেই।”

হৃদিতা সোজা আশরাফদের বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে ঢুকতেই ময়না বেগমের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। সুরাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই জানায় সুরাইয়া বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। বের হওয়ার আর কোনো উপায় নেই দেখে সুরাইয়ার সাথে দেখা করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় উমেদের সাথে দেখা হয়ে যায়।

উমেদ হৃদিতাকে দেখেই বলে,” কী রে কী খবর? দেখাই যায় না যে তোকে!”
” বাসায় গিয়েছিস যে দেখবি?”
” তুইও তো আসিসনি। ”
” না আসলে দেখলি কীভাবে? বিয়ে কর বিয়ের এক সপ্তাহ চোখের সামনে থেকে নাচগান করব। ”
” বিয়ে করে ম*রতে চাই না। সিঙ্গেল আছি ভালো আছি। তুই বিয়ে করছিস কবে?”
” আপাতত ওসব নিয়ে আর ভাবছি না।”
” কাকা বলল তোর নাকি জব হয়েছে?”
” হ্যাঁ, এই তো অল্পকিছু দিন।”
” কাজ কী তোদের?”
” এই যে ধর কিছু অ*ন্যায়কারী বহাল তবিয়তে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ চাইলেও কিছু করতে পারছে না তখন সেই কাজটা আমাদের কাছে চলে আসে। প্রমাণ যোগাড় করা আমাদের কাজ। পুলিশ যখন কিছু করতে পারে না তখন তাদের কাজটা আমাদের করতে হয়।”
” ভালোই হয়েছে ইথারের জবটা পেয়ে গেছিস তুই। শুনলাম বাসা নিয়েছিস।”
” ইথারের জবটা পাইনি তবে ওর জন্যই আমার এপথে আসা৷ আর হ্যাঁ আজ চলে যাব। একটা কেস এসেছে হাতে। বাসায় থেকে যাতায়াত করা মুশকিল। যখন তখন কেউ সন্দেহের বশে ফলো করলে পরিবারের জন্য বিপদ।”

দুজনের মাঝে বেশকিছুক্ষণ কথা চলে৷ উমেদ জানায় সন্ধ্যায় সে নিজে গিয়ে হৃদিতাকে শহরে রেখে আসবে। হৃদিতাও উমেদের কথায় রাজি হয়ে যায়।
____

চারদিকে অন্ধকার, আকাশে স্বল্প দৈর্ঘের একটা চাঁদ মাঝেমাঝে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে। সন্ধ্যা পর বাবা-মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে উমেদের সাথে বেরিয়েছে হৃদিতা। উমেদের বাইক একই গতিতে চলছে। তাদের বাড়ি থেকে শহর পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। উমেদের বাইকে গতি বেশি রাখা হয়েছে বিধায় আধাঘন্টার মাঝেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায়। হৃদিতা বাইক থেকে নামতেই বলে, ” ভাইয়া, এখানেই পাশে একটা ছোটো মাঠ আছে জানিস? দারুণ স্ট্রিটফুড পাওয়া যায়। খাবি?”

উমেদ বাইক থেকে নেমে হৃদিতার ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে,” এখন! আমার আবার ফিরতে হবে।”
” ধুর, তুই কি মেয়ে নাকি যে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে তোর? চল বাহিরে খাওয়া দাওয়া করে চলে যাবি তখন আর আটকাবো না আর এমন তো না যে তোকে এখানে প্রতিদিন পাওয়া যাবে।”

উমেদ এক দৃষ্টিতে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। চার বছর আগে একটা মেয়ে যে কি না তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল সেই মেয়েটাও ঠিক এরকমই আবদার করে বসতো। আজ তার জীবনে ওরকম আর কেউ জায়গা করে নিতে পারেনি। আগের সেই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটা কত নিরব আর জেদি হয়ে গিয়েছে ভাবতেই বুক চিরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।

উমেদকে চুপ থাকতে দেখে হৃদিতা আবার বলে ওঠে,” মাঝেমাঝে এমন সাইলেন্ট হয়ে যাস কেন? যাবি নাকি এখানে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবি?”

উমেদ হাটা শুরু করে বল,” চল যাচ্ছি।”

মেইনরাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকেই হৃদিতার বাসা। তিনতলা বিল্ডিংয়ের বাড়িটার চিলেকোঠার পাশেই একটা ছোটরুম নিয়েছে সে। বাসায় জিনিসপত্র, ব্যাগ রেখে দুজনই আবার বেরিয়ে আসে। হৃদিতার বাড়ির সামনেই যে রাস্তাটা আছে তার বিপরীত পাশেই মাঠটা।

উমেদ আর হৃদিতা মাঠে বেশ খানিকটা সময় পার করে। দুইজন চাচাতো ভাইবোন হলেও প্রগাঢ় একটা সম্পর্ক রয়েছে তাদের মধ্যে। হৃদিতার নিজের ভাই নেই বলে উমেদকেই সে ছোটবেলা থেকে ভাই বলে জেনে এসেছে। তার সাথে ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে সে। কয়েকটা বছর হলো তাদের এই দারুণ সম্পর্কে অনেকটা দূরত্ব বেড়েছে। উমেদও ঠিকমতো বাড়ি আসে না, হৃদিতার জীবনেও কিছু অঘটন সব মিলিয়ে দুজন দুদিকে ছিটকে পড়েছিল।

দুজন খুব ভালো সময় কাটিয়ে হৃদিতার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।

হৃদিতা পাশের চেয়ারের ওপর থেকে নিজের ফোন আর বাসার চাবিটা নিয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে তখনই একটা মেয়ে এসে পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে আঙুলের ইশারায় হৃদিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” জলদি চেয়ার ছাড়ো মামনি৷ এখানে লোক আছে।”

হৃদিতার কাছে কথাটা ভালো লাগে না। মেয়েটার কথা শুনেও যেন না শোনার অভিনয় করে সেখানেই আবার ঠিকঠাক করে বসে ফুসকাওয়ালাকে ডেকে বলে,” মামা, ফুসকাটা জোশ ছিল আরেক প্লেট দেন তো।”

পাশে থাকা মেয়েটা ভ্রু কুচকে হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বলে,” উঠতে বললাম না?”

হৃদিতা এবার তার দিকে নজর ফেলে বলে,” আমাকে বললেন?”
” হ্যাঁ, তোকে।”
” স্যরি গার্ল। এখানে আধাঘণ্টার বেশি সময় ধরে আছি। আপনার সমস্যা হলে অন্যকোথাও বসুন।”
” আমি উঠতে বলেছি মানে তোকে উঠতেই হবে। আমার মুখের ওপর কথা বলার দুঃসাহস দেখাস না।”
” দেখালে?”

মেয়েটা থাপ্পড় দিতে হলে হৃদিতা মেয়েটার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে,” এতো রাগ ভালো না। কেউ আপনার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে বসে নেই এখানে।”

পাশে একজন পুরুষ উপস্থিত হতেই মেয়েটা বলে ওঠে,” দ্যাখো জান, মেয়েটা উঠছে না। বাজে ব্যবহার করছে আমার সাথে।”

হৃদিতা নিজের বামে তাকাতেই আবরারকে দেখে বলে ওঠে,” আপনার বন্ধুকে সামলান আবরার সাহেব। তাকে বুঝিয়ে দেন আমি তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে পারব না। ”

#চলবে……