Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 333



তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-০৭

0

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ৭

রাত বাজে ১১ টা। ছাঁদে বসে আছে পাভেল চৌধুরী, শরীফ শিকদার, পারফি ও শাফিন। খুবি সিরিয়াস মুডে কিছু একটা নিয়ে চারজন আলোচনা করছে।

পাভেল চৌধুরী বলে উঠলো কে বা কারা আমাদের পিছে এভাবে উঠে পড়ে লেগেছে তা বুঝতে পারছি না কিন্তু মনে হচ্ছে পুরোনো কোনো শত্রু। আর নাহলে এতো চালাকি করে পার পেতো না। সব কিছু বহুদিনের প্লান মতোই সব কিছু করছে। আমি আর শরীফ কয়েকমাস ধরে একটা রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই ওদের নাগাল পাচ্ছি না। কিছু দিন পর পর মানুষ মিসিং হচ্ছে মনে হচ্ছে ওদের ধরে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।বিষয়টা খুবি জটিল অনেক চেষ্টার পর ও কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছি না।

শরীফ শিকদার বললো বুঝতে পারছি না কারা এমন করছে। এমন কি আমাদের বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি ও দিচ্ছে এই ব্যপারে তদন্ত না করতে। মেসেজ পাঠিয়ে সাথে সাথে ওই সিম খুলে ফেলে যার জন্য ওদের কোনো ভাবে ধরা যাচ্ছে না।

পারফি বললো বিষয়টা জটিল কিন্তু খুঁজে বের করতে হবে। কোনো না কোনো ক্লু তো পাওয়া যাবেই। বিষয়টা আমি আর শাফিন দেখছি।

পাভেল বললো খুঁজে তো বের করতে হবেই সেই সাথে বাসার সেফটি বাড়িয়ে দিতে হবে। ওরা ওত পেতে আছে যেকোনো সময় আক্রমণ করে বসতে পারে।

শাফিন বললো তা না হয় বুঝলাম আঙ্কেল। আচ্ছা যেহেতু মনে হচ্ছে এরা পুরোনো কোনো শত্রু তাহলে কি আপনাদের কাউকে সন্দেহ হয়? কারা এমনটা করতে পারে?

পাভেল চৌধুরী বললো আমাদের অতীত সম্পর্কে তো তোমরা অবগত। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা-মাকে হত্যা করে নাসির খান। বাবা তার কালোবাজারি কাজকারবার ফাঁস করতে চেয়েছিলো দেখে বাবা-মাকে হত্যা করে ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই। তারপর বড় হয়ে বাবা-মার মৃত্যুর বদলা নিতে আমিও একজন জার্নালিস্ট হই। সেখান থেকেই শরীফের এর সাথে আমার পরিচয় হলো। আমার একার পক্ষে ওদের ধরা সম্ভব ছিলো না তখন আমার পাশে দাঁড়ায় শরীফ। তারপর আমরা দুজন মিলে নাসির খানের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ যোগার করে ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেই। অনেক খু/নে/র আসামি হওয়ায় নাসির খানকে ফা/শি দেওয়া হয়।
নাসির খানের দুই ছেলে ছিলো কিছু বছর পর জানতে পারলাম ওর দুই ছেলেও এসব কাজে লিপ্ত হয়েছে। বড় ছেলে ছিলো রফিক খান আর ছোট ছেলে কে ছিলো সেটা আমরা জানতে পারি নি। খুব সতর্কতার সাথে নিজের পরিচয় গোপন রেখে এসব কালোবাজারি কাজ করতে লাগলো। যেহেতু রফিক খানের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা ছিলো তাই কয়েক বছরের ভিতরে ওকে ধরতে পারি। তখন তোমরা খুব ছোট তখন রফিক খানকে পুলিশে ধরিয়ে দেই। কিন্তু ক্ষমতার জোরে কয়েক বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে অন্য দেশে চলে যায় তারপর থেকে ওদের আর কোনো খোঁজ পাই নি। কিন্তু এখন কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই সব কাজ ওরা দুই ভাই মিলেই করছে।

পারফি বললো তাহলে মূল কালপ্রিট হলে রফিক খান আর ওর ভাই। তাহলে সবার আগে রফিক খানকে খুঁজে বের করতে হবে। আঙ্কেল আর আব্বু তোমরা এক কাজ করো রফিক খানের সব ডিটেইলস আমাদের দেখাও। তারপর যা করার আমি আর শাফিন করছি।

তাদের কথায় মাঝে পিয়াসা বেগম এসে বললো তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শেষ হলে এবার নিচে আসো খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

পাভেল চৌধুরী বললো তুমি যাও আসছি আমরা।

পিয়াসা বকবক করতে করতে নিচে নেমে খাবার সাজাতে লাগলো। তাকে হেল্প করছে শাহানা বেগম। প্রীতি সোফায় বসে বসে ফোন টিপছিলো তা দেখে পিয়াসা বেগম ক্ষেপে গিয়ে বললো ফোনের ভিতরে ঢুকে যা একদম। পড়া নাই লেখা নাই সারা দিন শুধু ফোন আর ফোন এই বাপ ছেলে-মেয়ের জ্বালায় কবে জানি আমি পাগল হয়ে যাবো।

শাহানা বেগম বললো আহ মেয়েটাকে বকছো কেনো? পড়া শেষ করেইতো এখানে আসলো।

ভাবি তোমাদের লাইতে আজ ও মাথায় চড়ে বসে আছে। কতদূর পরেছে তা আমার ভালো করেই জানা আছে।

প্রিতি ঠোঁট উল্টে শাহানা বেগমকে পিছ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো আন্টি মাকে কিছু বলো না সব সময় আমার সাথে এমন করে আমি থাকবোই না এই বাসায় তোমার সাথে আজি চলে যাবো তোমাদের বাসায়।

ওলে আমার সোনামেয়ে আচ্ছা তোকে আমি এই নিয়ে যাবো কত বড় সাহস আমার সোনা মেয়েটাকে বকা দেয়।

হ্যা নিয়ে যাও তোমার আহ্লাদের এই বাদর মেয়েকে।

একদম ঠিক বলেছো আন্টি এটা আসলেই একটা বাদর বলতে বলতে নিচে নামলো শাফিন।

প্রিতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে কিছু বলতে যাবে তখন দেখে বাবারা আসছে তাই দাঁতে দাঁত চেপে গিলে ফেললো মুখে যেই কথা আসছিলো তা।
তা দেখে বাঁকা হাসলো শাফিন, আজ ভালোই জব্দ করতে পেরেছে।

শাফিনকে গাট্টা মেরে ডাইনিং টেবিলে বসতে বসতে পারফি বললো শুধু শুধু ওর পিছে লেগে থেকে ক্ষেপাস কেনো?

আরে পাগলা, ক্ষ্যাপা গোড়াকে আরো ক্ষেপিয়ে দেওয়ার মজাই আলাদা।

শাফিনের কথায় পারফির ইয়ানার কথা মনে পড়ে গেলো। মেয়েটাকে বিড়াল ছানা বললে ঠোঁট উল্টে ফেলে একদম বাচ্চাদের মতো। এই মেয়ে কি জানে না ওর এভাবে ঠোঁট উল্টানোতে কারো মনে ঝড় বয়ে যায়?কতটা মারাত্মক লাগে দেখতে? ভাবতেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো পারফির।

শাফিন ভ্রু নাচিয়ে পারফির দিকে তাকি বললো একা একা হাসছিস ক্যান মামা? এটাতো প্রেমের লক্ষন কার প্রেমে পড়েছিস?

শালা মা/র খেতে না চাইলে মুখ বন্ধ কর সারা দিন শুধু আজাইরা কথা।

মামা কথা লুকালে তো হবে না তারাতাড়ি বল কার প্রেমে পড়েছিস। লাস্টের কথাটা বেখেয়ালি ভাবে শাফিন জোরে বলে ফলেছে।

ডাইনিং টেবিলের উপস্থিত সবাই এক সাথে তাকালো শাফিন আর পারফির দিকে।

পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারফির খাবার গলায় আঁটকে কাশি উঠে গেলো। পিয়াসা বেগম তারাতাড়ি পানি এগিয়ে দিলো পারফির দিকে। পানি খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে পারফি দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো শাফিনের দিকে তা দেখে শাফিন ভয়ে ঢোক গিললো। বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে সবার সামনে এখন পারফি যে ওর বারোটা বাজাবে তা মনে করতে গলা শুকিয়ে গেলো।

তখন ও সবাই ওদের দিকেই সন্দেহর চোখে তাকিয়ে রইলো। শাফিন বোকার মতো হেসে বললো হে হে মজা করছি আজব তোমরা এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?

শাফিনের কথায় কেউ আর বিষয়টা নিয়ে ঘাটলো না যে যার মতো খাওয়ায় মন দিলো কিন্তু প্রীতির মনে খটকা লেগে গেলো ভাইয়া প্রেমে পরেছে? কিন্তু কার? জানতে হবে সবটা এর জন্য শাফিন ভাইয়ার সাথে খাতির জমাতে হবে।

পারফি দাঁতে দাঁত চেপে খাবার খেতে লাগলো আর শাফিন পালানোর ফন্দি খুঁজতে লাগলো। পারফির হাতে পড়লে যে আর রক্ষা নেই।
————————-
রাতে খাবার টেবিলে ইসহাক আহমেদ ইয়ানাকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। ইয়ানার হাত কাঁটার পর থেকে এখনো মেয়েকে হাত দিয়ে খেতে দেন না যদি হাতে ব্যথা পায় তাই নিজ হাতে মেয়েকে খাইয়ে দেয়। এসব দেখে ইতি বেগম বিরবির করে বলে উঠলো আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচি না।

কথাটা ইয়ানা আর ইসহাক আহমেদের কানেও আসলো। ইসহাক একবার স্ত্রীর পানে তাকালেন কিন্তু মেয়ের সামনে কিছু বললে না।

ইতি বেগমের কথায় ইয়ানার হাসিখুশি মুখটা চুপসে গেলো। চোখ জোরা চিকচিক করে উঠলো। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বাবার হাতে পুরোটা খেয়ে রুমে চলে গেলো। রুমে এসে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। মায়ের এই আচরণ গুলো খুবি কষ্ট দেয় ওকে। কষ্ট গুলো চোখের পানি দ্বারা ধুয়ে দিচ্ছে কিন্তু এতে কি আর কষ্ট কমে?

ইয়ানার কান্নার মাঝে রুমে আসলো ইসহাক আহমেদ। বাবাকে দেখে তারাতাড়ি চোখে পানি মুছে ফেললো ইয়ানা।
ইসহাক আহমেদের ভিতরেও কষ্টে ফেটে যাচ্ছে মেয়ের কষ্ট দেখে। কিন্তু তিনি আদো পারলো না স্ত্রীকে বোঝাতে এই নিস্পাপ মেয়েটার সাথে এমন করা থেকে আটকাতে। তিনি নিজেকে সামলে ইয়ানার দিকে ঔষধ বাড়িয়ে দিয়ে বললো মামনী এগুলো খেয়ে নেও।

ইয়ানা হাসার চেষ্টা করে চুপচাপ ঔষধ খেয়ে নিলো। ঔষধ খাওয়া হলে ইসহাক আহমেদ মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ইয়ানা এবার নিজেকে সামলাতে না পেরে বাবার কেলে মাথা রেখে ফুপিয়ে কান্না করে দিলো।

ইসহাক আহমেদ মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো কান্না করে মামনী একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবে তখন মা অনেক ভালোবাসবে।

ইয়ানা ভেজা গলায় বললো সেই ছোট বেলা থেকে এই কথা শুনে আসছি বাবা। আর কত সান্ত্বনা দিবে?

ইসহাক আহমেদ বলার মতো কিছু পেলো না চুপ করে রইলো।

তা দেখে ইয়ানা বললো আমি কি মায়ের কোনো ক্ষতি করেছি বাবা? মা কেনো এমন করে আমার সাথে? আমার ও যে সবার মতো মায়ের ভালোবাসা পেতে খুব ইচ্ছে হয় বাবা বলতে বলতে ইয়ানার চোখ ভিজে উঠলো।

ইসহাক আহমেদের চোখ ও ভিজে উঠলো। মেয়েকে শান্ত করতে বললো সব হবে মামনী এখন ঘুমাও এতগুলো নিয়ে ভেবো না।

ইয়ানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো একটা কথা জিজ্ঞেস করি বাবা সত্যি করে বলবে?

কি কথা?

আমি কি মায়ের আসল মেয়ে না বাবা? সত্যি করে বলো না বাবা মা কি সত্যি আমার মা?

কি বলছো এসব মামনী? আমি তোমার বাবা হলে ইতি তোমার আসল মা হবে না কেনো? বোকার মতো কথা বলছো মা। ইতি হয়তো তোমার উপর কিছু নিয়ে রেগে আছে তাই এমন করে কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসে সেটা প্রকাশ করে না। এ ধরনের কথা আর কখনো বলবে না তাহলে বাবা কিন্তু কষ্ট পাবো।
আর কোনো কথা না এখন চোখ বুঁজে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমালে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ইয়ানা আর কথা বাড়ালো না বাবার কোলে মাথা রেখে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়লো।

ইসহাক আহমেদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বালিশে শুইয়ে দিয়ে গায়ে ব্লাংকেট টেনে দিয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে চলে গেলো।
—————————
কনকনে শীতের ভিতর সুইমিংপুলের ভিতরে হাবুডুবু খাচ্ছে শাফিন। জমে বরফ হওয়ার মতো অবস্থা। তখন খাবার টেবিল থেকে পালাতে লেগেছিলো মতো পারফি ধরে ছাঁদে নিয়ে আসে। শাস্তিস্বরূপ এই ঠান্ডার ভিতর পুলে ফেলে দেয় তখম বেফাঁস কথা সবার সামনে বলার জন্য।

শাফিন এবার বললো শা/লা পাষাণ এখন তো উঠতে দে জমে বরফ হয়ে গেলাম। মানলাম ভুলে বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি সবার সামনে তাই বলে এভাবে শাস্তি দিবি?তোর দিলে কি মায়া দয়া নেই? আমার মতো অবলা ছেলেটাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছিস শা/লা জীবনেও বউ পাবি না তুই আমি অভিশাপ দিলাম।

মুখ দিয়ে যদি আর একটা কথা বলিস তাহলে কিন্তু এই পুলে তোকে সারারাত চুবিয়ে রাখবো বলে দিলাম।

এই না না আর একটা কথাও বলবো না এবার অন্তত তোল উপরে হাত বারিয়ে দিয়ে বললো শাফিন।

শাস্তি ঢের হয়েছে তাই পারফি হাত বাড়িয়ে দিলো শাফিনকে উঠানোর জন্য কিন্তু শাফিন পাল্টি খেয়ে পারফির হাত ধরে টান দিয়ে ওকেও পুলে ফেলে দিলো।

কি হয়েছে বুঝে উঠতে পারফি হামলে পড়লো শাফিনের উপরে। দু’জনে পুরো সুইমিংপুল জুড়ে ছোটাছুটি মা/রা/মা/রি করতে লাগলো।
এক পর্যায়ে দুজনে শীতে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা তাই আপাতত নিজেদের লড়াই বন্ধ করে উপরে উঠে আসলো।

পারফি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো তোকে পড়ে দেখে নিবো আমি।

দোষ তো তোর এই। তুই আমাকে আগে কেনো পুলে ফেলেছিস?

তুই বেফাঁস কথা কেনো বলেছিস তাহলে সবার সামনে?

ঠিকি তো বলেছি এবার তারাতাড়ি বল কার প্রেমে পেরেছিস?

আবার যদি পুলে পড়তে না চাস তাহলে মুখ বন্ধ কর।

শাফিন ভয়ে আর কিছু বললো না এখন আবার পুলে পড়লে নির্ঘাত বরফে জমে যাবে। তাই চুপচাপ পারফির সাথে নিচে নেমে আসলো।

নিচে নামতে সম্মুখীন হলো বাসার সবার সামনে। সবাই অবাক হয়ে বললো একি তোমাদের এই অবস্থা কেনো?

পারফি শাফিনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো দুই বন্ধুর এই রাত ১২ টায় সাঁতার কাটার ইচ্ছে জেগেছে তাই এক সাথে সাঁতার কেটেছি। আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করো না এবার ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে যাবো চেঞ্জ করে আসছি। এ বলে পারাফি আর শাফিন চলে গেলো চেঞ্জ করতে।

ওরা যেতে সবাই এক সাথে উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো। শাহানা বেগম বললো দেখলে ছেলে দুটি এখনো বড় হলো না বাচ্চাদের মতো এখনো মা/রা/মা/রি করে।

শাহানার কথা শুনে সবাই আরো একধাপ হাসলো।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-০৬

0

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ৬

কেটে গেলো এক সপ্তাহ ইয়ানা এখন পুরোপুরি সুস্থ। আজ কলেজে যাবে তাই রেডি হয়ে নিচে আসলো। ইসহাক আহমেদ কলেজে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এতো করে বললো একা যেতে পারবে কিন্তু ইসহাক আহমেদ কিছুতেই একা ছাড়বে না মেয়েকে। শেষে বাবার কাছে হার মেনে তার বাইকের পিছে উঠে বসলো। ইসহাক আহমেদ ইয়ানাকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো।

ইয়ানা কলেজের ভিতর ঢুকতে যাবে তখন সেখানে প্রীতিদের গাড়ি এসে থামলো। প্রীতিকে দেখে ইয়ানার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।

প্রীতি গাড়ি থেকে নেমেই ইয়ানাকে ঝাপটে ধরলো।
তা দেখে শাফিন গাড়ি থেকে নেমে বলে উঠলো ড্রামা বাজের ড্রামা শুরু হয়ে গেছে।

কথাটা শুনে প্রীতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। শাফিনের দিকে তেরে যেয়ে বললে কি বললে আমি ড্রামা করি?

শাফিন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো আমি কারো নাম উল্লেখ করেছি নাকি?

নাম উল্লেখ করা লাগবে না কথাটা তুমি আমাকেই বলেছো দাঁতে দাঁত চেপে বললো প্রীতি।

তোর সাথে ঝগড়া করার মুড নেই সর সামনে থেকে এ বলে হাত দিয়ে প্রীতিকে সরিয়ে দিয়ে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো আমার বোনটা কেমন আছে?

ইয়ানা খুশি হয়ে বললো আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া আপনি কেমন আছেন?

প্রীতিকে টিটকারি মেরে বললো আশেপাশে এমন শাঁকচুন্নি থাকলে ভালো থাকি কি করে বলো।

শাফিনের কথায় ইয়ামা খিলখিল করে হেঁসে ফেললো আর প্রীতি ক্ষেপে যেয়ে আবারো শাফিনের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিলো। ওদের ঝগড়া দেখে বেশ মজা উপভোগ করছে ইয়ানা। হাসির মাঝে ইয়ানার চোখ গাড়ির ভিতরে পড়তে হাসি আঁটকে গেলো। সেই নীলমনি, সেই ধারালো চাওনি ইয়ানার ভিতরে ঝড় উঠিয়ে দিলো। কেনো যেনো ওই নীলমনির ধারালো চাওনি দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারে না। দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেললো।

পারফি এতো সময় ইয়ানার হাসিখুশি মুখটাই দেখছিলো। কেনো যেনো এই স্নিগ্ধ মুখপানে একবার তাকালে চোখ সরানো দায় হয়ে পরে। পারফি যখন ইয়ানাকে মন দিয়ে দেখতে ব্যস্ত তখন ইয়ানাও তাকালো। চোখে চোখ পড়তে ইয়ানাকে এমন হাসফাস করতে দেখে মুচকি হাসলো।

এদিকে শাফিন আর প্রীতির ঝগড়া বেড়েই চলেছে। এই ঝগড়া যে এতো সহজে থামবে না বুঝতে পেরে পারফি গাড়ি থেকে নেমে শাফিনের মাথায় গাট্টা মেরে বললো কি বাচ্চাদের সাথে ঝগড়া লাগালি এবার থাম।

ঝগড়া আমি লাগিয়েছি নাকি তোর বাঁদর বোন লাগিয়েছে।

প্রীতি ক্ষেপে যেয়ে বললো তুই বাঁদর তোর বউ বাঁদর তোর চৌদ্দ গুষ্টি বাঁদর।

কতো বড় সাহস তুই আমাকে তুই তোকারি করছিস তোকে তো আমি এ বলে প্রীতির দিকে এগিয়ে যেতে নিলে পারফি আঁটকে ধরে বললো কি শুরু করেছিস এটা বাসা না কলেজ সেই দিকে একটু তাকা।

তারপর ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো বিড়াল ছানা ওটাকে নিয়ে ভিতরে যাও আর নাহলে এদের ঝগড়া সারা দিন ও থামবে না।

বিড়াল ছানা ডাকটা শুনে ইয়ানা ঠোঁট উল্টালো। আর কোনো নাম পেলো না শেষে কিনা বিড়াল ছানা বানিয়ে দিলো। কিছু বলতে ইচ্ছে করলো কিন্তু ওই নীল চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস হলো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে প্রীতির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।

প্রীতি এখনো রেগে বোম হয়ে আছে ইয়ানার দিকে রাগি লুকে তাকিয়ে বললো তুই আমাকে নিয়ে আসলি কেনো? ওই খবিশ বদমাশটাকে আমি ছাড়বো না।

আরে ইয়ার আর কত ঝগড়া করবি এবার অন্তত থাম। তোদের ঝগড়ার জন্য ক্লাসে লেট হয়ে যাচ্ছে।

প্রীতি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলো।
দুটি ক্লাস করে আর ইচ্ছে করলো না ক্লাস করতে। মন মেজাজ ভালো নেই তাই ক্লাসে মন বসছিলো না।
তাই ইয়ানা আর প্রীতি ঠিক করলো আশপাশে ঘুরে একটু মনটা ফ্রেশ করবে। যেই ভাবা সেই কাজ দুজন মিলে লুকিয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে পাশেই একটা লেক পার্কে চলে গেলো। পরিবেশটা নিরিবিলি মন ভালো করার মত একটা পরিবেশ। প্রীতি আর ইয়ানা লেকের পানিতে পা ভিজিয়ে পাশাপাশি বসলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই দু’জনেই পরিবেশ টা উপভোগ করতে ব্যস্ত।

নীরবতা ভেঙে ইয়ানা বললো আমার না বিশ্বাস এই হয় না তুই শাফিন ভাইয়াকে ভালোবাসিস। যেভাবে শাফিন ভাইয়ার সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিস মনে হয় তোর চিরশত্রু সে। এমন শত্রুতামির মাঝে ভালোটা বাসলি কখন?

আর ভালোবাসা শালা খবিশ আমাকে পাত্তাই দেয় না। সব সময় খোঁচা মেরে কথা বলে আমাকে রাগিয়ে দেয়।
ভালোবাসিস না বুঝলাম কিন্তু তাই বলে সারাদিন এমন খাটাশের মত আমার পিছু লেগে থাকিস ক্যান? জীবনের সব চেয়ে বড় ভুল ওই খবিশটার প্রেমে পড়া।

আর যাই বলিস না কেনো শাফিন ভাইয়া মানুষটা কিন্তু খুবি ভালো। ভাইয়া একা লাগে নাকি তোর পিছে তুই নিজে ওতো সারা দিন ভাইয়ার পিছনে পড়ে থাকিস৷

এহ আসছে রে ভাইয়ের সাফাই গাইতে। ওই খবিশটা তোকেও বস করে নিজের দলে নিয়ে গেছে। যা তোর সাথে আমার কথা নেই এই বলে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে ঘুরে বসে রইলো।

ইয়ানা পড়ে গেলো এবার বিপাকে। সত্যি কথা বলেও এখন বিপদে পড়ে গেলো। প্রীতির রাগ ভাঙানোর জন্য পিছ থেকে প্রীতি জড়িয়ে ধরে বললো আরে ইয়ার রাগ করছিস কেনো আমিতো মজা করছিলাম।

হয়েছে এখন ঢং করা লাগবে না।

রাগ করে না জানু চল ফুসকা খাই।

ফুসকার কথা শুনে প্রীতির রাগ গলে পানি হয়ে গেলো। ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো চল চল খেয়ে আসি।

ইয়ানা ভ্রু কুঁচকে বললো তুইনা রাগ করেছিস?

প্রীতি ইয়ানার গাল টেনে দিয়ে বললো তোর সাথে আমি রাগ করে থাকতে পারি নাকি আমার বিড়াল ছানা।

ইয়ানা কপাট রাগ দেখিয়ে বললো এখন তোর ভাইয়ের মতো তুই ও আমাকে বিড়াল ছানা ডাকা শুরু করে দিলি?

ভাইয়াতো ঠিকি বলেছে তুই একটা আদুরে বিড়াল ছানা দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে।

আর একবার যদি বিড়াল ছানা বলিস না তাহলে কিন্তু এবার সত্যি বিড়ালের মতো খামছি মেরে দিবো।

বিড়াল ছানা, বিড়াল ছানা, বিড়াল ছানা একবার না তিনবার বলেছি এবার কি করবি শুনি?

তবে রে দেখাচ্ছি মাজ এবে প্রীতিকে ধরতে নিলে প্রীতি উঠে দিলো দৌড়। ইয়ানাও প্রীতিকে তারা করতে লাগলো এভাবে দুজনে ছোটাছুটি হাসাহাসি করে পুরো লেকপার্ক ঘুরতে লাগলো।
—————————–
পারফি কেবিনে বসে ল্যাপটপে প্রীতি আর ইয়ানার কার্যকলাপ দেখতে লাগলো। প্রীতিরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে লেকপার্ক ঘুরতে গেছে সেটা দেখে গার্ডরা পারফিকে ফোন করে জানালো।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এভাবে ঘুরতে যাওয়ার জন্য প্রথমে রেগে গেলেও পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে আর কিছু বললো না।
গার্ডের সাথে পারফি কথা বলছিলো তখন কারো হাসির শব্দ শুনে হার্টবিট বেরে গেলো। কি মধুর সেই হাসির শব্দ, বুঝলো যে এটা প্রীতি আর বিড়াল ছানার হাসি। কেনো যেনো আদুরে বিড়াল ছানার হাসিমাখা মুখটা দেখার তীব্র ইচ্ছে জাগলো মনে। তাই গার্ডকে ভিডিও কল করে ওদের দিকে ফোনটা ঘুড়িয়ে রাখতে বললো। গার্ড পারফির কথা মতো কাজ করতেই ল্যাপটপের সামনে ভেসে উঠলো স্নিগ্ধ সেই হাসি। পার্কে দুজন ছোটাছুটি করছে আর প্রাণ খুলে হাসছে। এই প্রাণবন্ত স্নিগ্ধ হাসি দেখে ঘোররে মাঝে আটকে গেলো পারফি। এই মেয়েকে একবার দেখলে পুরো দুনিয়া থমকে যায়।

পারফি যখন ইয়ানাকে দেখতে ব্যস্ত তখন কেউ একজন দরজায় নক করলো।
এই সময় কেউ আসাতে বিরক্ত হলো পারফি। একরাশ বিরক্ত দিয়ে আসার অনুমতি দিতে সেখানে প্রবেশ করলো ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়া সুন্দরী এক রমনি।

পারফি একবার চোখ তুলে তাকালো ও না ল্যাপটপের মাঝে ডুবে আছে তা দেখে মেয়েটা মনে মনে ফুঁসে উঠলো। নিজেকে সামলে পারফির সামনের চেয়ারে বসে পারফির দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললো পাপা বিজনেস ডিল নিয়ে কালকে মিটিং করতে চাচ্ছে সেটা তোমাকে জানানোর জন্য এসেছি। আর এই ফাইলের ভিতরে সব ডকুমেন্টস আছে চেক করে নিতে পারো।

পারফি এবার ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে শান্ত গলায় বললো মিস এলিজা আমি আপনার বয়ফ্রেন্ড না, আমরা জাস্ট বিজনেস পার্টনার সো আপনি বলে সম্মোধন করলে খুশি হবো।

এমন সরাসরি অপমানে এলিজা ভিতরে ভিতরে ক্ষোবে ফেটে পড়লো কিন্তু নিজের রাগটা প্রকাশ না করে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বললো এতবছর আমরা এক সাথে বিজনেস করছি। সবসময় তোমার কাছাকাছি থেকেছি তুৃমি কি বুঝতে পারছো না আমি তোমাকে ভালোবাসি? সব সময় এভাবে আমাকে অপমান করে কি মজা পাও তুৃমি?

গায়ে পড়া টাইপের মেয়ে আমার পছন্দ না। আশা করি আমার থেকে ডিস্টেন্ট মেইনটেইন করে চলবেন আর নাহলে আমি বাধ্য হবো আপনার বাবার সাথে বিজনেস ডিল ক্যানসেল করতে। এবার আপনি আসতে পারেন মিস।

এতো অপমানে এলিজার মুখ লাল হয়ে গেলো। রাগে হনহনিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলো।
এলিজা বাসায় এসে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো। এ খবর এনামুল খান কানে যেতে দ্রুত বাসায় ফিরে এসে মেয়েকে থামাতে চাইলেন।
এলিজা চিৎকার করে বলে উঠলো পাপা ও সবসময় আমাকে অপমান করে এটা আমি আর মেনে নিতে পারছি না।

তুমি শান্ত হও মামনী কি হয়েছে আমাকে সব খুলে বলো।

এলিজা সব খুলে বললো এনামুল খানকে। সব শুনে তিনি বললো মাথা গরম করলে হবে না মামনী সব কিছু ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। আবরার পারফি চৌধুরী আমাদের সাথে ডিল ক্যানসেল করলে আমাদের কম্পানির কি ক্ষতি হবে তাতো বুঝতেই পারছো। যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। এভাবে রেগে গেলে আমাদের প্লান সাকসেস হবে কিভাবে?

তুমি চাচ্চুকে দেশে আসতে বলো দ্রুত, চাচ্চু না থাকলে আমরা একা কিছুই করতে পারবো না।

তুমি টেনশন করো না মামনী খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে ও। তখনই তো হবে আসল খেলা। এ বলে ভাইকে ফোন লাগালো।

ওপাশে ফোন রিসিভ হতেই এনামুল খান বলে উঠলো তুমি দেশে আসছো কবে ভাই?

আমার সময় হলে চলে আসবো তোমাকে যেই কাজ দিয়েছি সেটা করেছো ঠিক ভাবে?

হ্যা ভাই সময় মতো সব মাল পৌঁছে যাবে। আর মেয়েটার দিকেও নজর রাখা হচ্ছে। ওই মেয়ে দুটোকে আটকাতে পারলে চৌধুরী পরিবার আর শিকদার পরিবার আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসে পিষে দিতে পারবো। পুরোনো শত্রু বলে কথা….. এখনো অনেক হিসেব নিকেশ বাকি।

সেতো বটেই প্রতিটি হিসাবের মূল্য দিতে হবে চৌধুরী পরিবারকে এ বলে ক্রুদ্ধ হাসতে লাগলো ওপাশে থাকা লোকটা।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-০৫

0

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ৫

শাফিন প্রীতির হাত ধরে ফেলে বললো এখন কোথায় পালাচ্ছিস? তখন না দাঁত কেলিয়ে হাসছিলি এখন সেই হাসি গেলো কোথায়?

প্রীতি এভাবে ফেঁসে যাবে বুঝতে পারে নি। কিভাবে এখন এখান থেকে ছাড়া পাবে তাই ভাবতে লাগলো। পরে শাফিনের দিকে তাকিয়ে বোকা হেসে বললো আসলে হয়েছে কি আজ সকালে সুন্দর করে দাঁত ব্রাশ করে দাঁত একদম সাদা করে ফেলেছি তাই দাঁত দেখাচ্ছিলাম, সত্যি আমি হাসছিলাম না।

ওহ তাই নাকি তাহলে তোর সেই সাদা দাঁত এখন একটা একটা করে উপরে ফেললে কেমন হয়? এ বলে প্রীতির একদম কাছে এগিয়ে গেলো।

শাফিনের এভাবে কাছে আসাতে প্রীতি ভয় পেয়ে গেলো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো আ..আমি কিন্তু আ..আন্টিকে ড..ডাক দিবো।

দে আমি কি তোকে আঁটকে রেখেছি নাকি?

শাফিনের এমন ভাবলেসহীন জবাব দেখে প্রীতি ভরকে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কিভাবে এখান থেকে পালাবে।

শাফিন এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো তোর সাহস হলো কি করে মায়ের কাছে আমার নামে বিচার দেওয়ার? আজতো তোকে আমি….

আর কিছু বলার আগে প্রীতি শাফিনের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। আকস্মিক আক্রমণে শাফিন হাত ছেড়ে দেওয়াতে প্রীতি দৌড়ে পালিয়ে গেলো।

শাফিন প্রীতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বেকুব বনে গেলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো দাঁতের দাগ পড়ে গেছে। রাক্ষসের মতো কামরে দিয়ে পালিয়ে গেলো একে তো পরে দেখে নিবো আমি এ বলে দাঁতে দাঁত চেপে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে দেখলো প্রীতি শাহানা বেগমকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।

শাফিনকে দেখে শাহানা বেগম বললো বোস আমি নাস্তা দেই।

লেট হয়ে যাচ্ছে আম্মু বাহিরে খেয়ে নিবো এখন যাই এ বলে প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো তারাতাড়ি আয়।

শাহানা বেগম শাফিনকে বললো আমার মেয়েকে সাবধানে পৌঁছে দিবি যদি কোনো বকাঝকা করিস তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।

মায়ের কথায় শাফিন ঠোঁট উল্টে বললো এমন ভাবে বলো যেনো এই শাঁকচুন্নি তোমার আসল মেয়ে আর আমাকে কুড়িয়ে এনেছো।

শাফিনের এমন করে কথা বলাতে শাহানা বেগম আর প্রীতি হেঁসে ফেললো।

শাহানা বেগম প্রীতিকে একটু বেশি এই ভালোবাসেন। তার মেয়ে আর প্রীতি এক বয়সী। তার মেয়েটাকে জন্মের পর এই হারিয়ে ফেলেছে। মেয়ের শোকে পাগল প্রায় অবস্থা তার তখন। শরীফ শিকদার (শাফিনের বাবা) আর পাভেল চৌধুরী ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। তাদের শত্রুপক্ষরাই শরীফ শিকদারের মেয়ের জন্মের একদিন পর অপহরণ করে নিয়ে যায়। মেয়ের শোকে শাহানা বেগম পাগলের মতো করতো। প্রীতির বয়স তখন এক সপ্তাহ। শাহানা বেগমের করুণ অবস্থা শুনে পিয়াসা বেগম মেয়েকে নিয়ে ছুটে আসলো। প্রীতিকে পেয়ে তিনি একটু শান্ত হলেন। প্রিতির মাঝে নিজের মেয়েকে খুঁজে পেতেন। প্রীতিকে নিয়ে গেলেই পাগলামো করতেন শেষে কোনো উপায় না পেয়ে শরীফ শিকদার বন্ধু পাভেল চৌধুরীর বাসার পাশে বাড়ি উঠালেন। তারপর থেকেই তারা দুই পরিবার এক সাথে থাকে। শাহানা বেগম ও প্রীতিকে কাছে পেয়ে মেয়ের শোক একটু ভুলে থাকতেন। এভাবে কেটে গেলো ১৭ টি বছর।
—————————–
প্রীতি ভয়ে ভয়ে গাড়িতে যেয়ে উঠলো। ভাবলো শফিন কিছু বলবে কিন্তু প্রীতিকে অবাক করে দিয়ে শাফিন কিছু না বলে চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগলো।

হঠাৎ প্রীতির চোখ গেলো শাফিনের হাতের দিকে। ফর্সা হাতে লালচে দাগ পড়ে গেছে দাঁতের ছাপ। তা দেখে প্রীতির মায়া লাগলো এতো জোরে কামর না দিলেও পারতো। কিন্তু কিছু বললো না। কলেজের সামনে গাড়ি আসাতে শাফিন প্রীতিকে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলো। অফিসে পৌঁছে চলে গেলো পারফির কেবিনে।

পারফির সাথে কথা বলে যে যার কাজে লেগে গেলো।
দুপুরে পারফি পৌঁছে গেলো প্রিতির কলেজের সামনে। পারফি যাওয়ার কিছুক্ষণ পর প্রীতি আসলো। প্রীতিকে গাড়িতে উঠতে না দেখে পারফি জিজ্ঞেস করলো কি হলো গাড়িতে উঠছিস না কেনো?

প্রীতি আমতা আমতা করে বললে আসলে ভাইয়া একটা কথা বলার ছিলো।

প্রীতিকে এমন আমতা আমতা করতে দেখে পারফি ভ্রু কুঁচকে বললো কি?

আসলে চাইছিলাম ইয়ানাকে একটু দেখতে যাবো, নিয়ে যাবে?

পারফি কিছুক্ষণ ভেবে সংক্ষেপে জবাব দিলো ওঠ।

প্রীতি খুশি বললো সত্যি নিয়ে যাবে? থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া।

পারফি কিছু বললো না গাড়ি ঘুড়িয়ে ইয়ানাদের বাসার সামনে এসে থামলো।

প্রীতি গাড়ি থেকে নেমে বললো তুমিও চলো ভিতরে।

না তুই যা, আমি আছি এখানে দেখা করে আয়।

প্রীতি আর জোর করলো না কারণ জানে পারফি উপরে যাবে না তাই একাই চলে গেলো।

প্রীতি যেতে পারফি তাকালো দোতলার বারান্দায় দিকে। কেনো যেনো সেই স্নিগ্ধ মুখটা একটাবার দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। এখন আফসোস হলো তখন কেনো প্রীতির সাথে গেলো না। গেলে অন্তত স্নিগ্ধ ফুলের মুখটা একটাবার দেখতে পেতো।
আচ্ছা এমন নিস্পাপ স্নিগ্ধ ফুলকে কিভাবে মানুষ আঘাত করে? আমার কাছে এমন একটা স্নিগ্ধ ফুল থাকলে যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিতাম।

নিজের আজগুবি ভাবনায় পারফি নিজেই হেঁসে ফেললো। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। স্নিগ্ধ ফুল আসলেই খুব ভয়ানক এক দিনেই আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে।

পারফি ফের দোতালার বেলকনির দিকে তাকালো যদি একটা বার আসে বেলকনিতে সেই আশায়। কিন্তু পারফিকে হতাশ করে বেলকনির দরজা একটা বারের জন্য ও কেউ খুললো না তা দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ নিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে বেলকনির দিকে তাকিয়ে রইলো।

প্রীতিকে পেয়ে ইয়ানা সে কি খুশি। প্রীতি ইয়ানার খোঁজ খবর নিতে লাগলো এখন কেমন লাগছে, জ্বর কমেছে কিনা, হাতে ব্যথা কমেছে কিনা, খুব বেশি কি ব্যথা করছে আরো কত কি।

প্রীতিকে এতো ব্যাকুল হতে দেখে ইয়ানা প্রীতিকে একপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো আমি ঠিক আছি ইয়ার। বাবা, ইমা আপু এসেছে এখন ঠিক না হয়ে পারি?বাবা আর ইমা আপু এক দিনেই আমাকে সুস্থ করে দিয়েছে। যতটুকু অসুস্থ ছিলাম তা তোকে দেখে এখন সব সেরে গেছে।

হয়েছে কত সুস্থ হয়েছেন তাতো দেখতেই পারছি একদম বেড থেকে নামবি না। সারাদিন রেস্ট করবি তারাতাড়ি সুস্থ হবি তোকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না জানু।
কলেজে একা একা নিজেকে এতিম এতিম লাগে।

প্রীতির কথা বলার ধরন দেখে হেঁসে ফেললো ইয়ানা। তখন কিছু নাস্তা নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে করতে ইমা বলে উঠলো এতো হাসাহাসি হচ্ছে কি নিয়ে শুনি একটু।

না তোমাকে বলা যাবে না তুমি তো বিয়ে করে আমাদের ভুলেই গেছো আপু বললো প্রীতি।

ভুলি নি রে খুব মিস করি তোদের।

আমরাও তোমাকে খুব খুব মিস করি আপু এ বলে ইয়ানা আর প্রীতি ইমাকে জড়িয়ে ধরলো।

ইমা বললো হয়েছে হয়েছে এবার কিছু খেয়ে নে আর প্রীতি ওটাকে কিছু বলে যা কিছু খেতে চায় না জোর করে খাওয়ানো লাগে।

ইমার এ কথা শুনে প্রীতি ইয়ানার দিকে দাঁত কটমট করে চাইলো না দেখে ইয়ানা বোকা হেঁসে বললো হেহে আপু মজা করছে আমি খাই সারা দিন খাই ইসস।

হয়েছে আপনি যে কতো খান তা আমার জানা আছে এ বলে প্রীতি ইয়ানাকে কিছু ফল খাইয়ে দিলো আর বকাঝকা করতে লাগলো ঠিক মতো না খাওয়ার জন্য ।
ইয়ানা ঠোঁট উল্টে বকা খেতে লাগলো। এভাবে তিনজনের আড্ডার মাঝে অনেক সময় কেটে গেলো।

প্রীতি এবার ইয়ানাকে বললো দোস্ত এবার আমার যেতে হবে। আবার আসবো সময় করে নিজের খেয়াল রাখিস ভালো করে।

প্রীতির চলে যাওয়ার কথা শুনে ইয়ানার মন খারাপ হয়ে গেলো৷ মন খারাপ নিয়ে বললো মাত্রই তো আসলি এখনি চলে যাবি? আরেকটু থাক না…

থাকতাম কিন্তু ভাইয়া নিচে দাঁড়িয়ে আছে আবার আসবো সময় করে দেখে যাবো মন খারাপ করিস না কলিজা আমার।

পারফি নিচে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আর জোর করলো না। ইয়ানা মন খারাপ নিয়ে বললো তাহলে নিচ পর্যন্ত তোকে দিয়ে আসি।

মার চিনিস? নাকি আমি চিনিয়ে দিবো? এখন চুপচাপ ঘুমাবি।

ইয়ানা ঠোঁট উল্টে বললো আচ্ছা।

ইয়ানার ঠোঁট উল্টানো দেখে প্রীতি হেঁসে ফেললো।হেঁসে ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরলো তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখা হলো ইসহাক আহমেদের সাথে। তাকে দেখে প্রিতি সালাম দিলো।

ইসহাক আহমেদ সালামের জবাব দিয়ে বললো কেমন আছো মামনী?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আঙ্কেল আপনি কেমন আছেন?

আছি মা আলহামদুলিল্লাহ, তা চলে যাচ্ছো কেনো? থাকো না আজ…

আরেকদিন থাকবো আঙ্কেল আজ যাই ভাইয়া নিচে ওয়েট করছে।

আচ্ছা চলো তোমাকে দিয়ে আসি।

প্রীতি সম্মতি দিতে ইসহাক আহমেদ প্রিতিকে নিয়ে নিচে নামলো।

পারফি মন খারাপ নিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তখনি বেলকনির দরজা খুলে ইয়ানা বের হলো তা দেখে মুহূর্তের মাঝে পারফির ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা গেলো। তাকালো সেই স্নিগ্ধ মুখ পানে। যে মুখে নেই কোনো হাসি আছে একরাশ মন খারাপ। মন খারাপ নিয়ে কাউকে হাতের ইশারায় বাই জানাচ্ছে।
পারফি মুগ্ধ হয়ে সবটা দেখতে লাগলো। কেনো যেনো না চাইতেও এই মেয়ের মায়ায় আঁটকে যাচ্ছে পারফি। স্নিগ্ধ ফুলের মন খারাপ টা যেনো ওর নিজের ও মন খারাপ করে দিলো। ওই স্নিগ্ধ মুখে যে শুধু হাসিটাই মানায়।

ইয়ানা একরাশ মন খারাপ নিয়ে প্রীতিকে বিদায় জানিয়ে রুমে চলে যেতে নিলো তখন চোখে পড়লো দূরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পারফির দিকে। ওর দিকেই এক ধ্যানে তাকি আছে তাই ইয়ানা তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেলো। এতে ইয়ানার ভিতরে ধক করে উঠলো। নীলমনির সেই চোখ তার ধারালো চাওনি ইয়ানার বুকের ভিতর ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিলো। ওই চোখের দিকে বেশি সময় তাকানোর সাধ্য হলো না ইয়ানার। চোখ নামিয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো।

ইয়ানার এভাবে চলে যাওয়াতে মুচকি হাসলো পারফি তখন সেখানে উপস্থিত হলো প্রীতি। প্রীতির সাথে আরেকজন ভদ্রলোককে দেখে পারফি বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো কে লোকটা।
তখন প্রীতি বলে উঠলো ভাইয়া উনি হলো ইয়ানার বাবা।

পারফি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।

ওয়ালাইকুমুস সালাম বাবা, তা এখানে দাঁড়িয়ে কেনো বাসায় চলো।

পারফি মুচকি হেঁসে বললো আরেকদিন আসবো আঙ্কেল আজ যেতে হবে।

আচ্ছা এসো বাবা সময় করে প্রীতি মামনীকে নিয়ে।

ইন শা আল্লাহ আসবো আঙ্কেল।

কি বলে তোমাকে ধন্যবাদ দিবো বাবা তা বুঝতে পারছি না। আমার কলিজার টুকরো মেয়েটাকে তোমরা বাঁচিয়েছো। তোমরা না থাকলে কি হতো ভাবতেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। তোমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইলাম বাবা।

এভাবে বলবেন না আঙ্কেল আল্লাহ সহায় ছিলো তাই আমরা সময় মতো সেখানে ছিলাম আর বড় কোনো ক্ষতি হয় নি।

জানিনা কারা আমার কলিজার উপর এভাবে হামলা করলো। মেয়েটা আমার বড্ড সহজসরল কখন কে কি ক্ষতি করে ফেলে সেই ভয়ে থাকি সব সময় আর এখন তো ভয় টা আরো বেরে গেলো।

সব ঠিক হয়ে যাবে আঙ্কেল টেনশন করবেন না।

আচ্ছা বাবা সাবধানে যেও তাহলে। অনেক অনেক দোয়া রইলো তোমাদের জন্য। আবার এসো বাবা…

পারফি ইসহাক আহমেদের সাথে হাত হ্যান্ডশেক করে বললো যাই তাহলে ভালো থাকবেন।
তারপর বিদায় জানিয়ে প্রিতিকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পারফি ভাবতে লাগলো মা আর বাবার মধ্যে কতো পার্থক্য। বাবা মেয়ের জন্য কতোটা ব্যাকুল হয়ে আছে আর মায়ের মেয়ের দিকে কোনো খেয়াল এই নেই। এ কেমন মা?

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-০৪

0

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ৪

রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসলো ইয়ানার। মাথা যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে উঠে বসলো, হাত ব্যথায় টইটুম্বুর হয়ে আছে। এই ব্যথা থেকেই শরীর পুড়িয়ে জ্বর আনলো। দূর্বল শরীর নিয়ে ঔষধ খুঁজতে লাগলো। বেডের পাশে টেবিলে চোখ পড়লো ঔষধের প্যাকেট। অনেক কষ্টে গ্লাসে পানি ঢেলে খালি পেটেই ঔষধ খেয়ে নিলো। শরীরে বিন্দু পরিমাণ শক্তি নেই যে উঠে যেয়ে কিছু খেয়ে নিবে। মায়ের কথা মনে পড়তে তাচ্ছিল্য হাসলো। পরে কাঁথা গায় দিয়ে শুয়ে পড়লো।
——————
সকাল সকাল উপস্থিত হলো ইসহাক আহমেদ (ইয়ানার বাবা)। এসেই মেয়ের খোঁজ নিতে লাগলো।

ইতি বেগমের এবার ভয় লাগতে লাগলো কালকের ঘটনার জন্য। ভয়ে ভয়ে বললো ওর রুমে আছে ঘুমাচ্ছে।

ইসহাক আহমেদ মেয়ের রুমের যেয়ে নক দিলো। দরজার করাঘাতে ইয়ানার ঘুম ভাঙলো। বাবার কণ্ঠস্বর শুনে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। দরজা খোলার জন্য উঠতে যাবে ওমনি মাথা ঘুরে উঠলো। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো।
আস্তে ধীরে উঠে দরজা খুলে বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো ইয়ানা।

ইসহাক আহমেদ হালকা হেসে মেয়ের গায়ে হাত দিতে আঁতকে উঠলো। শরীর প্রচুর গরম হয়ে আছে তা দেখে তিনি বিচলিত হয়ে ইয়ানাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু বলতে যাবে তখন চোখ পড়লো হাতের ব্যান্ডেজের দিকে। মেয়ের এমন করুন অবস্থা দেখে তার পুরো দুনিয়াটা ঘুরে উঠলো। তার কলিজার টুকরোটাকে এভাবে কে আঘাত করলো? তিনি বিচলিত হয়ে ইয়ানাকে বেডে বসিয়ে দিলো বলতে লাগলো আম্মু কি হয়েছে তোমার? হাতে ব্যান্ডেজ কেনো? জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এগুলে কবে হলো? আমাকে কিছু জানাও নি কেনো? খুব কষ্টে হচ্ছে তোমার? ডক্টর ডাকবো?

ইয়ানা বাবাকে এতো বিচলিত হতে দেখে তাকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে ধির গলায় বললো এতো হাইপার হয়ো না বাবা। আমি ঠিক আছি এটা সামান্য একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। পরে ইয়ানা সবটা খুলে বললো।

সব শুনে ইসহাক আহমেদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো কে তার নিস্পাপ মেয়েটার উপর এভাবে হামলা চালালো। মেয়েকে তিনি বড্ড বেশি ভালোবাসে, মেয়ের একটু আঘাতে তার বুক কাপে সেখানে তার ফুলের মত মেয়েটা এমন আঘাত পেলো আর তা তিনি জানেন এই না। রাগে কপালের রগ ফুলে উঠলো, হাঁক ছেড়ে ইতি বেগম কে ডাকতে লাগলো। ইতে বেগম আসতেই তিনি হুংকার দিয়ে বলো উঠলো আমার কলিজার টুকরোর এই অবস্থা এই খবর তুমি কোন সাহসে আমাকে জানাও নি?

ইতি বেগম ভয়ে কেঁপে উঠলো। কি জবাব দিবে বুঝতে উঠতে পারলো না। ভয়ে ভয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো আ..আসলে

ইতি বেগমকে এমন আমতা আমতা করতে দেখে ইসহাক আরো গর্জে উঠলো। এতে ইতি বেগমর পরান পাখি যায় যায় অবস্থা।

ইয়ানা একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে ইসহাক আহমেদের উদ্দেশ্যে বললো বাবা মাকে বকো না। মায়ের কোনো দোষ নেই আমি এই মাকে না করেছি তোমাকে জানাতে। তুমি এমনি ঢাকার বাহিরে ছিলে আমার এই অবস্থা শুনলে টেনশন করবে এমনি তোমার হাই প্রেশার তাই আর টেনশন দিতে চাই নি। তুমি বিচলিত হয়ো না আমি ঠিক আছি এ বলে মলিন হাসলো ইয়ানা।

ইসহাক আহমেদ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মেয়ে অসুস্থ তাই আর ইতি বেগমকে কিছু বললো না। বাসায় ডক্টর আনতে চাইলে ইয়ানা না করে দিলো। বললো ঔষধ আছে ওগুলো খেলে ঠিক হয়ে যাবে।

ইসহাক আহমেদ মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলেন। তারপর শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ইয়ানা আবেশে চোখ বুঁজে নিলো, বাবার এত স্নেহে চোখ জোরা ভোরে উঠলো। মায়ের আদর কখনো না পেলেও বাবা মায়ের আদরটা পুষিয়ে দিয়েছে। সব সময় বুকের ভিতর আগলে রেখেছে।
———————————
পারফি সারারাত ঘুমাতে পারলো না। বারবার শুধু ইয়ানার মুখশ্রী ভেসে উঠছে চোখের সামনে। চোখ জোরা অসম্ভব পরিমান লাল হয়ে আছে। অনেক খোঁজ নেওয়ার পর ও আসল কালপ্রিট এর খোঁজ মিললো না। কে এমন পিছু লেগেছে, কেনোই বা লেগেছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তাই রেডি হয়ে নিচে নেমে গেলো। যেখানে সবাই উপস্থিত ছিলো ওর জন্যই ওয়েট করছিলো।

পারফি যেয়ে চেয়ার টেনে বসতে পাভেল চৌধুরী বললো শুনলাম কাল প্রীতির ফ্রেন্ডের উপরে কেউ অ্যাটাক করেছে। কে বা কারা করেছে কোনো খোঁজ পেয়েছো?

হুম ছেলেটাকে ধরে ছিলাম আব্বু বাট ওকে দিয়ে আরেকজন করিয়েছে কাজটা। যে কাজটা করিয়েছে সে ভেবেছে স্নি.. না মানে মেয়েটা আমার উইকনেস তাই ওর উপরে অ্যাটাক করেছে।

যেহেতু ভেবেছে মেয়েটা তোমার উইকনেস তাই ওর উপরে আরো অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওর সেফটির ব্যবস্থা করো। আর এর পিছনে কারা আছে তা খুঁজে বের করো।

খুঁজে তো বের করবোই সে যেখানেই লুকিয়ে থাক না কেনো।

পাভেল চৌধুরী মুচকি হেসে বললো এই নাহলে আমার ছেলে।

পিয়াসা বেগম এবার তেতে উঠে বললো যেমন নিজে হয়েছো অমন ছেলেকেও বানিয়েছো। কতবার করে বলেছি এই রিস্কি কাজ ছেড়ে দাও। আজ তোমাদের এই কাজের জন্য একটা স্বাভাবিক জীবন জাপান করতে পারি না আমরা। সব সময় গার্ডের ছায়াতলে থাকা লাগে। এই কাজ ছেড়ে দিয়ে একটা স্বাভাবিক জীবন জাপান করতে কি সমস্যা তোমার?

পাভেল চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো পিয়াসা আজ সবার মতো খোলামেলা স্বাভাবিক একটা জীবন পাচ্ছো না দেখে তুমি চেতে যাচ্ছো। আর আমি এ কাজ না করলে হাজারো জনগণ হারাবে তার পরিবার। অন্যায় অবিচারে হাজারো মেয়ে হারায় তার স্বামীকে, হাজারো সন্তান হারায় তার বাবা-মাকে। এগুলো মুখ বুঁজে কি করে সহ্য করি বলো? এই পরিস্থিতির সম্মুখে আমিও পড়েছি তাই বুঝি এর কষ্ট। অন্যায় মুখ বুঁজে দেখার ক্ষমতা আমার নেই পিয়াসা এতে যদি নিজের জীবন ও দিতে হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই।

পিয়াসা এবার চুপ হয়ে গেলো। পাভেল চৌধুরীর ভয়ংকর অতীত এর কথা মনে পরে গেলো৷ পাভেল চৌধুরীর বাবা ও ছিলো একজন জার্নালিস্ট। তিনি যখন খুব ছোট ছিলেন তখন তার বাবা- মাকে শত্রুপক্ষরা হত্যা করে সেই থেকে তিনিও প্রতিজ্ঞা করে এদের কাউকে তিনি ছাড়বে না। বড় হয়ে নিজেও একজন বড় জার্নালিস্ট হয়ে উঠে বাবার খুনিদের সবাইকে ধরে তাদের উপর্যুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে। এভাবেই দেশের যেকোনো সন্ত্রাসদের নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কখনো অন্যায় দেখে তার প্রশ্রয় দেয় না। এই জন্য তার শত্রুর কোনো অভাব নেই। এতো শত্রুর ভেরাজালে থেকে পিয়াস বেগম মাঝে মাঝে রেগে যায় কিন্তু মন থেকে স্বামীর এমন সৎ কাজকে শ্রদ্ধা করে।

পাভেল চৌধুরী নাস্তা শেষ করে কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো নিজের কাজে৷

পাভেল চৌধুরীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চোখ জোরা চিকচিক করে উঠলো পিয়াসার।

পারফি খাবার ছেড়ে উঠে মাকে বুকে আগলে নিলো। পিয়াসা বেগম নিজেকে সামলাতে না পেরে ফুপিয়ে কান্না করে উঠলো। পারফি মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো তুমি এতো টেনশন করো কেনো আম্মু? আমরা আছিতো কেউ কিছু করতে পারবে না আমাদের। আমরা যদি অন্যায় দেখে চুপ থাকি তাহলে দেশের অসহায় মানুষদের কি হবে বলো? আমি জানি আব্বুর পেশাকে তুমি মন থেকে শ্রদ্ধা করো কিন্তু আমাদের হারিয়ে ফেলার ভয় পাও তুমি তাই বাবাকে এই পেশা থেকে সরে যেতে বলো। আমাদের কিছু হবে না তুমি এতো টেনশন করো না এতে তোমার শরীর খারাপ করবে। তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে আব্বু নিজেও কষ্ট পায়। কারো কিছু হবে না, আব্বুর পাশে আমরা আছি, আব্বু আমাদের পাশে আছে এর চেয়ে বেশি কি লাগে বলো? আমরা সবাই এক সাথে হয়ে থাকলে শত্রুপক্ষ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আব্বুর অতীত তো সব জানোই তাই এভাবে ভেঙে না পরে সাহস দেও দেখবে মানুষটা শান্তি পাবে।

পিয়াস বেগম বুঝদারের মত মাথা নাড়লো। পারফি মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো টেনশন করবে না একদম আমি আছি তো। এবার অফিসে যাই লেট হয়ে যাচ্ছে।

পিয়াসা বেগম ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললো সাবধানে যাস।

পারফি মুচকি হেসে বাসা থেকে বের হতে নিয়েও আবার মায়ের কাছে ফিরে এসে বললো প্রীতির ফ্রেন্ড মানে ইয়ানার লাইফ যে এখন ঝুঁকিপূর্ণ সেটা প্রীতিকে জানিও না। টেনশন করবে তাহলে, এখন টেনশন দেওয়ার সময় না তাহলে ওর পড়ালেখায় ক্ষতি হবে। আমি আমার সবটা দিয়ে মেয়েটাকে রক্ষা করবো।

ইয়ানার যেনো কোনো ক্ষতি না হয় সে দিকে ভালো করে খেয়াল রেখো। মেয়েটা খুব সহজসরল, মায়ের কাছ থেকে সব সময় অবহেলা পেয়ে এসেছে। ওই নিস্পাপ মেয়েটাকে কষ্ট পেতে দিয়ো না। না চাইতেও ফুলের মতো মেয়েটা আমাদের শত্রুর কবলে পরে গেলো এখন ওকে রক্ষা করা পুরোটাই আমাদের দায়িত্ব।

ওর কোনো ক্ষতি হবে না টেনশন করো না তুমি। আর প্রীতিকে শাফিন কেলেজে পৌঁছে দিয়ে আসবে আমি বলে দিবো শাফিনকে। অফিসে জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাই তারাতাড়ি যাওয়া লাগছে। আসার সময় আমি ওকে নিয়ে আসবো এ বলে চলে গেলো পারফি।
————————————
প্রীতির ঘুম ভাঙতে ইয়ানার সাথে আগে কথা বলে নিলো। ওর বাবা ফিরে এসেছে শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভাবলো কলেজ শেষ হলে একবার যেয়ে দেখে আসবে ইয়ানাকে।
কলেজের জন্য রেডি হয়ে নিচে নামতে মায়ের থেকে জানতে পারলো শাফিন পৌঁছে দিয়ে আসবে। তাই নাস্তা শেষ করে বাসা থেকে বের হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো শাফিনের কিন্তু তার আসার নাম গন্ধ ও নেই। প্রীতি এবার বিরক্ত হয়ে শাফিনদের বাসায় গেলো। শাফিনদের আর প্রীতিদের বাসা পাশাপাশি।

বাসায় প্রবেশ করতেই দেখা হলো শাহানা বেগমের সাথে ( শাফিনের মা)। শাহানা বেগমকে দেখে প্রীতি জড়িয়ে ধরে বললো কেমন আছো আন্টি।

শাহানা বেগম গাল ফুলিয়ে বললো এতক্ষণে সময় হলো আন্টির আছে আসা, তোর সাথে আমার কথা নেই যা।

প্রিতি কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো রাগ করো না কলিজার টুকরো আন্টি। তোমাকে তো বলাই হয় নি কালকে কি হয়েছে যার জন্য আসতে পারি নি।

শাফিনের কাছে শুনলাম তোর ফ্রেন্ডকে কারা নাকি হাতে ছু/রি বসিয়ে দিয়েছে। কি অবস্থা এখন ওর?

এখন একটু সুস্থ। এই ঘটনার জন্যই তোমার সাথে কাল দেখা করতে পারি নি, আর রাগ করে থেকো না প্লিজ।

বুঝেছি এখন রাগ করে নেই। কিছু খেয়েছিস? খাইয়ে দিবো?

না না মাত্র খেয়েই আসলাম এবার বলো তোমার গুনধর ছেলে কোথায়? আমাকে কলেজে দিয়ে বাসার কথা এখন তো তার কোনো খবর এই নেই। কখন থেকে বাহিরে অপেক্ষা করছি।

ফাজিলটা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে দাঁড়া জাগিয়ে দিচ্ছি। এ বলে উপরে উঠে গেলো তার পিছু পিছু প্রীতি ও উঠলো।

শাফিন ঘুমের মাঝে অনুভব করলো কেউ কান ধরে টানছে। হঠাৎ কানে ব্যথা অনুভব করতে ধরফরিয়ে উঠলো।

শাফিনের অবস্থা দেখে প্রীতি খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। শাফিন একবার প্রীতির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। সব কিছু বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো। সব বুঝতে প্রীতির দিকে রাগি লুকে তাকালো তা দেখে প্রীতি জিভ বের করে ভেংচি কাটলো। শাফিনের তা দেখে রাগ আরে বারলো পারলে প্রীতিকে চিবিয়ে খায়। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো মা আমি এখন বড় হয়েছি এখনো এভাবে কান মলা দিয়ে ঘুম থেকে উঠানো কি ঠিক?

শুধু তো কান মলা দিয়েছি মার দেই নাই এটা তোর ভাগ্য। আমার মেয়েকে কোন সাহসে এত সময় অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিস? মেয়েটা সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে।

মায়ের কথায় শাফিনের মনে পরলো পারফি ওকে ফোন করে বলেছিলো প্রীতিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যেতে ও আচ্ছা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলো ভাবতেই ঢোক গিললো। এখন যে শাহানা বেগম ওকে আস্ত রাখবে না ভাবতেই ঢোক গিললো।

শাফিনের অবস্থা দেখে প্রীতি মুখ টিপে হেসেই চলেছে। শাফিন মনে মনে ফুঁসতে লাগলো প্রীতির কাজে।মনে মনে ভাবলো একবার শুধু তোমাকে বাগে পাই চান্দু তারপর দেখাবো মজা।

শাহানা বেগম পারফিকে একধাপ বকাঝকা করে নিচে চলে গেলো। বললো তারাতাড়ি রেডি হয়ে প্রীতিকে নিয়ে কলেজে যেতে।

শাহানা বেগমের যেতে শাফিন বাঁকা হাসলো। শাফিনের এমন হাসি দেখে প্রীতি বুঝলো যে ওর কপালে শনি আছে তাই দৌড়ে রুম থেকে বের হতে যাবে অমনি ক্ষপ করে শাফিন প্রীতির হাত ধরে ফেললো।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-০৩

0

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ৩

কলিংবেল চপতেই ইতি বেগম দরজা খুলে দিলো। এমনি তার মেজাজ খুব গরম ছিলো, দরজা খুলে ইয়ানাকে সামনে পেয়ে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সজোরে ইয়ানার গালে চর বসিয়ে দিলো।
আকস্মিক আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো প্রীতি, কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইতি বেগম গর্জে বলে উঠলো এত রাতে বাসায় আসার সময় হলো? কোথায় ছিলি এত সময়? কোন নষ্টামি করে এতো রাতে বাড়ি ফিরেছিস হুম? আজকে তো তোকে আমি মেরেই ফেলবো এ বলে আবার থাপ্পড় দিতে নিবে অমনি কেউ একজন হাতটা ধরে ফেললো।

ইয়ানার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এমনি শরীর দূর্বল তার উপর আবার এতো জোরে চর খেলো সাথে ধারালো কথা তো আছে। সব মিলিয়ে নিজেকে আর সামলে উঠতে পারছে না। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ম/ রে যেতে ইচ্ছে করলো। আফসোস লাগলো আজ ছু/রি/টা ওর হাতে না চলিয়ে গলায় কেনো চালালো না।
ইতি বেগম থাপ্পড় উঠাতে ও নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে কিন্তু থাপ্পড় টা পড়ার আগে কেউ হাত ধরে ফেলাতে দুর্বল চোখে সেদিকে একবার তাকালো। অস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠলো একটা মুখশ্রী। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হলো সেই মুখশ্রী অধিকারি ব্যক্তিকে।

ইতি বেগমের হাত কেউ ধরে ফেলাতে তিনি আরো তেতে গেলেন। সামনে তাকাতে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরো রেগে গেলো। তেজ নিয়ে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো নষ্টামি করে নাগর নিয়ে বাসায় ও হাজির হয়েছিস এত বড় স্পর্ধা তোর?তোর বাবা আসুক শুধু লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠিছে না এবার দেখবে তার ফল। তোর মতো নো…

আর কিছু বলার আগে পারফি হুংকার দিয়ে বলে উঠলো জাস্ট শাট আপ ওই মুখ দিয়ে আর একটা বাজে কথা বের করবেন না। রাগে শরীর কাঁপতে লাগলো পারফির। মা হয়ে মেয়েকে এতটা জঘন্য কথা কেউ বলতে পারে তার ধারণা ও ছিলো না। তাকালো ইয়ানার অশ্রুসিক্ত মুখপানে। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে। হয়তো মায়ের মুখে এমন জঘন্য কথার কাছে এই ব্যথা কিছুই না। এরকম স্নিগ্ধ ফুলকে এভাবে কেউ কষ্ট দিতে পারে? রাগ লাগলো খুব পারফির এমন স্নিগ্ধ ফুলকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য। ভাগ্যেস ঔষধের প্যাকেটটা দিয়ে যেতে এসেছিলো আর নাহলে অসুস্থ মেয়েটাকে আরো কতগুলো আঘাত সহ্য করতে হতো।

পারফি এবার ইতি বেগমের হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁতে চেপে বললো কেমন মা আপনি যে নিজের মেয়েকে এমন জঘন্য কথা শুনাতে মুখে বাজলো না। মায়েরা নাকি সব থেকে মমতাময়ী হয় আর আপনি মা নামের কলঙ্ক। মেয়ে এত রাতে কেনো এসেছে সেটা না যেনে নিজের মতো নোংরা ভাবনা চিনতা ভেবে নিলেন। কোনো বিপদ ওতো ঘটতে পারে যার জন্য বাসায় আসতে দেরি হয়ে গেছে।
পারফি এবার ইয়ানার কাটা হাতটা আলতো করে ধরে ইতি বেগমের সামনে ধরলো।
এতক্ষণে ইতি বেগমের চোখ পড়লো ভালো করে ইয়ানার দিকে। হাতে ব্যন্ডেজ দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো কিন্তু তার ভিতর কোনো বিচলিত হতে দেখা গেলো না, কেমন মা এ? ভাবতেই অবাক লাগলো।
পারফি আবারো দাঁতে দাঁত চেপে বললো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আজ বাসায় ফিরেছে আর আপনি কিনা মা হয়ে সেদিকে খেয়াল না দিয়ে নিজের রাগ মিটাচ্ছেন। বড়ই অদ্ভুত মা আপনি।
ইতি বেগম কোনো প্রতিত্তোর করলো না চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন তা দেখে পারফি আর কিছু বললো না। চলে যেতে নিবে তখন ইয়ানার দিকে একবার তাকিয়ে বললো ভালো থাকতে হলে নিজেকে শক্ত করে গড়ে তোলো মেয়ে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে দূর্বলদের কোনো জায়গা নেই। এ বলে ইয়ানার হাতে ঔষধের প্যাকেটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ইয়ানা সেদিক পানে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো।

ইয়ানার অবস্থা দেখে প্রীতির বুক ফেটে কান্না আসছে। নিজের কলিজার বেস্টুর এভাবে কষ্টে দিন পার করা লাগে ভাবতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। প্রীতি ইয়ানাকে ধরে রুমে নিয়ে এসে ওকে ঝাপটে ধরে কান্না করে দিলো। ইয়ানা নির্বিকার ভাবে দাঁড়ায়ে আছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
প্রীতি ইয়ানাকে ছেড়ে দিয়ে বললো ইয়ানা এই মহিলার কাছে তোর আর থাকা লাগবে না। তুই আমার সাথে চল, তুই আমার কাছে থাকবি।
ইয়ানা দূর্বল হেসে বললো ধুর বোকা কি বলছিস, মা আজ খুব রেগে ছিলো হয়তো তাই এমন করেছে। অনেক রাত হয়েছে এবার তুই বাড়ি যা আন্টিরা চিন্তা করবে।

তোকে এভাবে ফেলে আমি কিছুতেই যাবো না। এখন তোর যত্নের প্রয়োজন। ওই মহিলা তোর যত্নে নেওয়াতো দূরের কথা তোকে আরো কষ্ট দিবে সেটা আমি মেনে নিবো না।

এতো চিন্তা করিস না কিছু হবে না আমার। আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো। এগুলোতে এখন অভ্যস্ত আমি আর কালকে বাবা চলে আসবে, বাবা আসলে মা এমন করবে না দেখিস। আজকের রাতটা আমি সামলে নিতে পারবো বাবা তো কাল আসছেই।

প্রীতি কিছুতেই ইয়ানাকে এভাবে ছেড়ে যেতে রাজি হলো না কিন্তু ইয়ানা ওকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিলো। প্রীতিকে পাঠিয়ে দরজা আঁটকে চুপটি করে বেডে শুয়ে পড়লো। মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলো, নিঃশব্দে চোখের অশ্রু ফেলতে লাগলো।
————————–
প্রীতিরা বাসায় ফিরে আসতেই পিয়াসা বেগম বিচলিত হয়ে জানতে চাইলো এতো দেরি কেনো হলো৷ আর ওদের এই অবস্থাই বা কেনো..
পারফি কোনো কথা না বলে উপরে চলে গেলো।
প্রীতি সবটা খুলে বলতে পিয়াসা বেগম এর ও মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আফসোস লাগলো খুব অমন ফুলের মত একটা মেয়েকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে৷ তিনি প্রীতিকে শান্তনা দিয়ে বললো সব ঠিক হয়ে যাবে মন খারাপ করিস না৷ সারাদিন কিছু খাস নি যা ফ্রেশ হয়ে নিচে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।
আর হ্যা আসার সময় পারফিকে নিয়ে আসিস।
প্রীতি সম্মতি দিয়ে উপরে উঠে গেলো।

এদিকে পারফি রুমে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। গায়ের শার্ট এ এখনো রক্ত লেগে আছে তবুও চেঞ্জ করার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। যে ছেলে তার পোশাকে এক চিমটি পরিমান দাগ লাগলে সাথে সাথে সেটা চেঞ্জ করে ফেলে আর আজ সেই ছেলে রক্তমাখা শার্ট পরে এত সময় কাটিয়ে দিলো তবুও পালটানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলো না।
কেমন যেনো নিজেকে খুব অগোছালো লাগছে পারফির। আজকে একটা দিনের ভিতরে সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। চোখের সামনে বারংবার একটা মুখেই ভেসে উঠছে। সকালের সেই স্নিগ্ধ মুখশ্রী, স্নিগ্ধ সেই ভেজা চোখ, স্নিগ্ধ হাসি। সব শেষ ভেসে উঠলো অচেতন সেই ফ্যাকাশে মুখশ্রী। যেটা ভেসে উঠতেই মনে ভিতর এক অজানা অস্থিরতা অনুভব করছে।
ফোনের সাউন্ডে ভাবনা থেকে বের হলো পারফি। ফোন বের করে দেখে শাফিন ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করতে শাফিন কিছু একটা বলতেই পারফি বললো তুই থাক আমি আসছি এ বলে ফোন কেটে দিয়ে শার্টটা চেঞ্জ করে সাথে সাথে বেড়িয়ে গেলো।

নিচে নামতে পিয়াসা বেগম বললো একি এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?
ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আম্মু এখন যেতে হবে। ফিরতে রাত হবে আমার জন্য অপেক্ষা করো না।

মাত্রই তো আসলি কিছু খেয়ে যা।

আমি বাহিরে খেয়ে নিবো তুমি চিন্তা করো না এ বলে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো। পিয়াসা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এই বাপ ছেলেকে নিয়ে আর পারে না তিনি। রাত নেই দিন নেই যখন তখন হুটহাট করে বেড়িয়ে পড়ে। শুধু কাজ আর কাজ। কতবার করে বলেছে এইসব ঝুকিপূর্ণ কাজ ছেড়ে দিতে কিন্তু কে শুনে কার কথা। যেমন বাপ তেমন তার ছেলে।
————————-
পারফি চলে আসলো ওদের গোপন আস্তানায়। সেখানে প্রবেশ করতে কিছু গার্ড এসে একটা রুমে নিয়ে গেলো। যেখানে শাফিন আগে থেকে বসা ছিলো আর তার অপজিট পাশে একটা ছেলের হাতপা বাঁধা অবস্থায় প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।
পারফি হাতের ইশারায় গার্ডের বেড়িয়ে যেতে বললো। গার্ডরা বিনা বাক্যে সেই স্থান ত্যাগ করলো।
পারফি কাছে এগিয়ে যেতে শাফিন বললো শালা মুখ খুলছে না। মারতে মারতে আধমরা করে ফেলেছি তবুও মুখ খোলে নি।
পারফি এবার বাঁকা হাসি দিয়ে বললো কিভাবে মুখ খুলতে হয় তা খুব ভালো করেই জানা আছে আমার এ বলে সামনের চেয়ারটায় বসা ছেলেটার মুখ বরাবর বসে পড়লো।
ছেলেটা পারফিকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলো। বার বার ঢোক গিলতে লাগলো।
পারফি এবার আগুন চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললো এবার বল কেনো সকালে ওর উপরে হামলা চালিয়েছিস? ওর সাথে তোর কিসের শত্রুতামি?

ছেলেটা ভয়ে কেঁপে উঠলো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো আ..আমি ক..কিছু করি ন..নি।

পারফির এবার মাথায় রক্ত উঠে গেলো নাক বারবার ঘুষি মেরে দিলো যার ফলে নাক ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো। পারফি হুংকার দিয়ে ফের বললো শেষ বারের মতো বলছি কেনো ওর উপর আক্রমণ করেছিস।

ছেলেটি এবার ও কিছু শিকার না করাতে পারফি আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। শাফিনের হাতে থাকা লাঠি নিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো ছেলেটাকে। ছেলেটা ব্যথায় আর্তনাদ করতে লাগলো এক পর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে কোনো মতে বললো ব..বলছি আমি, আ..আমি সব বলছি।

পারফি এবার লাঠিটা শব্দ করে নিচে ছুঁড়ে মেরে ফের চেয়ারে বসে বললো বল।

ছেলেটা একটু দম নিয়ে বললো আমি এই কাজ একজনের কথায় করেছি। লোকটা কে তাকে আমি দেখিনি। তার সাথে আমার শুধু ফোনে কথা হয়েছে। সে আমাকে অনেক টাকার অফার করে একটা মেয়েট পিক দিয়ে বললো একে মে/রে দিতে। এতো টাকার অফার পেয়ে আমিও নিজের লোভ সামলাতে না পেরে রাজি হয়ে যাই। আমি সাকাল থেকে মেয়েটাকে ফলো করতে থাকি কিন্তু মা/রার মতো কোনো সুযোগ পাই নি। এর পর মেয়েটা ভির থেকে বেড়িয়ে মাঠে আসাতে আমার কাজটা সহজ হয়ে গেলো তখন সুযোগ বুঝে আমি হাতের শিরায় ছু/রি চালিয়ে চলে যাই। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন শেষ বারের জন্য। আমি এমন কাজ আর কখনো করবো না। প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দিন।

সব শুনে পারফি আরো রেগে গেলো। ছেলেটার কলার টেনে ধরে বললো লোকটা কে? কে তোকে এই কাজ করতে বলেছে সব সত্যি বল আর নাহলে আজ তোকে জানে মে/রে ফেলবো।

আমি সত্যি জানিনা লোকটা কে। তার সাথে আমার শুধু ফোনে কথা হয়েছে। বিশ্বাস করুন আমি দেখিনি লোকটাকে। তবে লোকটার কথা শুনে মনে হয়েছিলো সে আপনার পুরোনো কোনো শত্রু। মেয়েটা আপনার প্রিয় কেউ হয় এই জন্য আপনার প্রিয় মানুষকে আপনার থেকে দূরে সরাতে চায়।

পারফি বুঝতে পারছে না কে এমন করছে। আর মেয়েটাকে ওর প্রিয় কেউ বা কেনো ভাববে? আমার সাথে তো আগে মেয়েটার পরিচয় ছিলো না….এক মিনিট আজ কাকতালীয় ভাবে মেয়েটার শাড়ির সাথে আমার
শার্টের কালার ম্যাচিং হয়ে গিয়েছিল তার মানে এই জন্য কেউ ভেবে নিয়েছে মেয়েটা আমার দূর্বল কেউ। ওহ্ শীট
স্নিগ্ধ ফুলের মতো নিস্পাপ মেয়েটা না চাইতেও আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেলো। এখন যে ওর পদে পদে বিপদ। কে এমন করছে ওর সাথে তা মাথায় আসছে না। কিছু একটা ভেবে ছেলেটার পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার চেক করতে লাগলো। কিন্তু না নাম্বারটা চিনতে পারছে না। ফোনটা শাফিনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। শাফিন ওই নাম্বারে ফোন লাগালো কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। বুঝলো যে কাজ শেষ করে সিম খুলে ফেলেছে।

শাফিন রেগে গিয়ে ছেলেটাকে এলোপাতাড়ি কয়েটা ঘুষি দিয়ে বললো একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না সত্যি করে বল লোকটাকে চিনিস কিনা।
ছেলেটা আর্তনাদ করে বলে উঠলো আমি সত্যি বলছি আমি চিনি না। আমাকে দয়া করে ছেড়েদিন। আমাকে যেতে দিন এবারের মত, এরকম কাজ আর কখনো করবো না কথা দিচ্ছি ।

পারফি শাফিনকে ইশারা করলো হাতের বাঁধন খুলে দিতে। শাফিল বাঁধা হাত পা খুলে দিতে লোকটা খুশি হয়ে দৌড়ে চলে যেতে নিবে তখনি পারফি কলার ধরে সামনে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো তোকে চলে যেতে দেওয়ার জন্য বাঁধন খোলা হয় নি। যেই হাত দিয়ে স্নিগ্ধ ফুলকে তুই আঘাত করেছিস সেই হাত অক্ষত অবস্থায় কি করে রাখি বল? এ বলে পাশ থেকে ছু/রি নিয়ে ছেলেটার হাত বরাবর ছু/রি চালিয়ে দিলো। সেখান দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়া শুরি করলো। ছেলেটা হাত চেপে ধরে আর্তনাদ করতে লাগলো। পারফি ফের আরেক হাতে ছু/রি বসিয়ে দিলো। এরপর ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে বললো এবার দেখ কেমন লাগে। যেই হাত দিয়ে ওই নিস্পাপ মেয়েটাকে আঘাত করেছিস আজ সেই হাত সারাজীবনের জন্য অকেজো করে দিলাম যাতে ভবিষ্যৎ এ কোনো দিন এমন কাজ করার সুযোগ ও না পাস। আজ তোর ভাগ্য ভালো তাই জানে মা/র/লাম না এ বলে গার্ডের হাতে ছেড়ে দিয়ে শাফিনকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-০২

0

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ২

ভাইয়া……
প্রীতির ডাকে হুঁশ আসলো পারফির। নিজের কাজে নিজেই অবাক হলো পারফি। সকাল থেকে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজেকে স্বাভাবিক করে গলা পরিস্কার করে বললো.. হ..হুম?

কি হলো কোথায় হারিয়ে গেলে? কখন থেকে ডাকছি।

প্রীতির কথায় পারফি পাশে তাকালো দেখলো সেই মেয়েটা গুটিশুটি হয়ে প্রীতির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এবার চোখ পড়লো মেয়েটার চোখের দিকে। চোখ জোরা কেমন লাল হয়ে আছে। মেয়েটা কি কান্না করেছে? কিন্তু কেনো?
নিজের ভাবনার মাঝে পারফি নিজেই এবার বিরক্ত হয়ে গেলো কি ভাবছে তখন থেকে। এই মেয়ে জাদু জানে নাকি? কেমন এক ঘোরের ভিতর বারবার ফেলে দিচ্ছে। এই মেয়ের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। মেয়ে মানেই ভেজাল।
জিভ দিয়ে পারফি ঠোঁট ভিজিয়ে বললো ১৫ মিনিটের জায়গায় কয় মিনিট লাগিয়েছিস?
উফফ ভাইয়া ১৫ মিনিটে কি একটা মেয়ের রেডি হওয়া সম্ভব?
হয়েছে গাড়িতে ওঠ এবার।
প্রীতি ইয়ানার হাত ধরে গাড়িতে উঠতে যাবে তখন ইয়ানা ফিসফিস করে বললো উনি কে?
ওহ্ তোর সাথে পরিচয় করাতে তো ভুলেই গিয়েছি। এটা হলো আমার একমাত্র ভাই পারফি ভাইয়া। আর ভাইয়া ও হলো আমার জানের বেস্টু ইয়ানা।
ইয়ানা এবার তাকালো পারফির দিকে, লম্বা চওড়া সুদর্শন এক যুবক। মুখে চাপ দাড়ি এতে যেনো ফর্সা মুখের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সব চেয়ে আকর্ষণীয় হলো নীলমনি। যে কারো নজর কারার জন্য এই মনিটাই যথেষ্ট। ইয়ানা এবার খেয়াল করলো কাকতালীয় ভাবে পারফির শার্টের কালারের সাথে ওর শাড়ীর কালার ম্যাচিং হয়ে গেছে। যে কেউ দেখলে ভাববে এরা কাপল। এসব ভেবে কেমন যেনো এক অসস্তিতে পড়ে গেলো। ইয়ানা এবার আমতা আমতা করে বললো আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

পারফি সালামের জাবাব দিয়ে প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো এ তাহলে তোর সেই বিড়াল ছানা?
বিড়াল ছানা ডাকটা শুনে ইয়ানার সকালের কথা মনে পড়ে গেলো। সকালে ফোনেও বিড়াল বললো আর এখন ও বিড়াল বলছে। রাগ লাগলো ইয়ানার কিন্তু কিছু বললো না নাকের পাটা ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

পারফি সে দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো তা দেখে ইয়ানার রাগ আরো বাড়লো। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না।
প্রীতি এবার বললো ভাইয়া একদম আমার জানুকে বিড়াল ছানা বলবা না বলে দিলাম এবার তাড়াতাড়ি চলো অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।
গাড়িতে না উঠলে যাবো কিভাবে? এখন কি কোলে করে গাড়িতে উঠানো লাগবে?
প্রীতি দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললো এ যা খেয়াল এই নেই যে গাড়িতে উঠি নি এ বলে ইয়ানার হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসলো।
গাড়িতে উঠার পর পারফি গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি চলতে লাগলো আপন গতিতে। হঠাৎ পারফির সামনে থাকা লুকিং গ্লাস এর দিকে চোখ চলে গেলো যেখানে ফুটে উঠলো স্নিগ্ধ ফুলের স্নিগ্ধ হাসি। কিছু নিয়ে প্রীতির সাথে কথা বলছে আর হালকা করে মুচকি হাসছে। যেই হাসি দেখে কয়েকবার হার্টবিট মিস করলো পারফি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। এক হাত দিয়ে পাশে থাকা পানির বোতল নিয়ে পানি খেতে লাগলো। পানি খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ভাবতে লাগলো এ মেয়ে খুবি ভয়ানক, আর তাকানো যাবে না। নিশ্চয়ই এই মেয়ে কোনো জাদু যানে। জাদু দিয়ে আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। এই মেয়ের থেকে ১০ হাত দূরে থাকতে হবে।

দেখতে দেখতে কলেজের সামনে এসে পড়লো গাড়ি। প্রীতি আর ইয়ানাকে নামিয়ে দিয়ে বললো আমি আশেপাশেই আছি। কোনো প্রয়োজন হলে ফোন করিস এ বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে সবাই সিটে যেয়ে বসলো। যেহেতু ইয়ানারা কলেজে নতুন তাই তেমন একটা ফ্রেন্ডস এখনো হয়নি। তাই ওরা দুজন এক সাথে বসে বসে স্টেজে চলতে থাকা নাচ গান দেখতে লাগলো।

হাসি আনন্দের মাঝে অনুষ্ঠান কাটতে লাগলো।এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে এবার বোরিং লাগছে। তাই
প্রীতি বললো ইয়ানা এত সময় বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। একটু হেঁটে আসলে ভালো হবে। চলনা একটু হেটে আসি।
ইয়ানার ও বোরিং লাগছে তাই দুজন উঠে আশেপাশে একটু হাটতে লাগলো। হঠাৎ ইয়ানার পাশ দিয়ে কেউ একজন দ্রুত বেগে হেঁটে গেলো আর ইয়ানা হাতে ধারালো কিছুর আঘাত অনুভব করলো। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা দেখতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা হাতটা চোখে সামনে আনতে চোখের সামনে অস্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠলো তাজা রক্ত। কি হয়েছে বুঝে ওঠার আগেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো নিচে। হারিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে।

এদিকে প্রীতি ইয়ানার হঠাৎ এভাবে পড়ে যাওয়াতে ইয়ানা বলে চিৎকার দিয়ে ইয়ানার পাশে বসে পড়লো। ইয়ানার হাতের দিকে চোখ যেতে আঁতকে উঠলো। যেখান দিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরতাছে। প্রিতি চিৎকার দিয়ে ইয়ানার হাত চেপে ধরে রক্ত আটকানো চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু কিছুতে রক্ত থামানো যাচ্ছে না।
পারফি আর ওর বন্ধু শাফিন মিলে প্রীতিকে নিয়ে যেতে আসছিলো। তখন বোনের চিৎকার শুনে পারফির বুকের ভিতর কামর মেরে উঠলো এক দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। ইয়ানা মাটিতে লুটিয়ে আছে রক্তে শাড়ির একপাশ ভিজে গেছে। কি হয়েছে বুঝতে বিচলিত হয়ে বোনের পাশে বসতে প্রীতি পাগলের মত কান্না করতে করতে বললো ভ..ভাইয়া আমার ইয়ানা…. আমার ইয়ানা ওকে বাঁচাও। কিছু এ..কটা করো ভাইয়া প্লিজ র..রক্ত পড়া আটকাও না ভাইয়া আর নাহলে আমার ইয়ানা ব..বাঁচবে না বলে আহাজারি করে কান্না করতে লাগলো।

পারফ দ্রুত অবচেতন ইয়ানাকে কোলে তুলে নিয়ে শাফিনের উদ্দেশ্যে বললো আমার গাড়ি নিয়ে আয় কুয়িক।

শাফিন দৌড়ে গাড়ির কাছে যেয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসলো। সবাই গাড়িতে উঠতে গাড়ি দ্রুত চালাতে লাগলো হসপিটালের দিকে। পারফি রুমাল বের করে হাত বেধে দিলো তাও রক্ত পড়া কমছে না। এক হাত দিয়ে কাটা হাত চেপে রেখে আরেক হাত দিয়ে ইয়ানাকে আগলে ধরে বসে রইলো। বুকের ভিতর কোনো এক অজানা কারনে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো। তাকালো ইয়ানার অচেতন মুখ পানে। সকালের সেই স্নিগ্ধ মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বার বার মাথায় একটা কথাই আসছে এরকম স্নিগ্ধ একটা ফুলের গায়ে কে এভাবে আঘাত করলো?কেনোই বা করলো। এতটুকু একটা মেয়ের এমন শত্রুই বা থাকবে কেনো? এর পিছে নিশ্চিই কোনো কারণ আছে।
হসপিটালের পৌছে পারফি ইয়ানাকে আবার কোলে তুলে নিলো। পরিচিত হসপিটাল হওয়াতে দ্রুত ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা করা হলো। ইয়ানাকে কেবিন এর ভিতরে নিয়ে গেলো। বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো প্রীতি, পারফি আর শাফিন।

প্রীতি এখনো কান্না করেই যাচ্ছে তা দেখে পারফি বোনকে বুকে আগলে নিলো।
প্রিতি পারফিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলতে লাগলো ভাইয়া আমার ইয়ানা ঠিক হয়ে যাবে তো? বলো না ভাইয়া ওর কিছু হবে নাতো? আমার ইয়ানাকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দেওনা ভাইয়া।

বোনের এমন আহাজারি দেখে পারফি মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রীতিকে শান্ত করতে লাগলো..চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো কিছু হবে না তোর ইয়ানার। কান্না করে না বোন আমার, ও ঠিক হয়ে যাবে।
পারফির কথায় প্রীতি কিছুটা শান্ত হলো।
তখন কেবিন থেকে ডক্টর বের হয়ে বললো পেশেন্টের শরীর থেকে প্রচুর ব্লাড বেরিয়ে গেছে এখন ইমার্জেন্সি ও পজিটিভ রক্ত লাগবে।
ডক্টরের কথায় পারফি আর প্রীতি একে অপরের দিকে তাকালো কারণ ওদের কারোই ও পজিটিভ রক্ত না। তখন শাফিন বলে উঠলো আমার ও পজিটিভ রক্ত, আমার থেকে নিতে পারেন।
ডক্টর শাফিনকে নিয়ে দ্রুত চলে গেলো।
রক্ত দেওয়া শেষ হলে শাফিন এসে বসলো পারফির পাশে। প্রীতি কৃতজ্ঞতার সহিতে শাফিনের উদ্দেশ্যে বললো আমার কলিজার জীবন বাঁচানোর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।

শাফিন মুচকি হেসে বললো জীবন বাঁচানোর আমি কেউ না। সবি আল্লাহর হাতে বুঝলি। এবার বল এরকম হলো কিভাবে?
প্রীতি সবটা খুলে বললো ওদের, সবটা শুনে পারফি বলে উঠলো এইটুকু একটা মেয়ের এরকম শত্রুই বা কেনো থাকবে?
বুঝতে পারছি না কেনো এমন হচ্ছে। আগে তো কখনো এমন কিছু ঘটে নি। আচ্ছা ভাইয়া আমাদের কোনো শত্রুপক্ষ এরকমটা করলো নাতো আবার?

প্রীতির এবারের কথায় টনক নড়লো পারফি আর শাফিনের।
পারফি আর শাফিনের বাবা দুজন বন্ধু। দুজনেই জার্নালিস্ট যার জন্য ওদের শত্রুর অভাব নেই। তার উপরে পারফি আর শাফিন মিলে বিজনেস সামলায়। টপ বিজনেসম্যান হওয়ায় এ দিক থেকেও শত্রু কোনো অংশে কম না। এই শত্রুতামির জন্য শাফিন হারিয়েছে ওর ছোট বোনকে। যাকে জন্মের পর এই হসপিটাল থেকে শত্রুপক্ষের কেউ নিয়ে গেছে। আদো বোনটা বেঁচে আছে কিনা কারো জানা নেই। পারফি আর শাফিনের পরিবার মিলে কম চেষ্টা করে নি খোঁজার কিন্তু কোনো খোঁজ পায় নি।

পারফি ফোন বের করে কাউকে ফোন করলো। তারপর বললো কলেজের সিসিটিভির ফুটেজ কালেক্ট করতে। এই আক্রমণের পিছে কারা আছে তা জানা খুব দরকার। আজ তাদের জন্য এই নিস্পাপ মেয়েটা এতটা কষ্ট পেলো এর একটা বিহিত তো করতে হবেই।
——————-
কয়েক ঘন্টা পরে ইয়ানার জ্ঞান ফেরলো। জ্ঞান ফেরার পর বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো কোথায় আছে, কি হয়েছে ওর সাথে। আস্তে আস্তে মনে পরলো হঠাৎ আক্রমণের কথা। তাকালো হাতের দিকে যেখানে ব্যান্ডেজ করা। অন্য হাতে স্যালাইন চলছে। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো ইয়ানা।
ইয়ানার জ্ঞান ফিরেছে দেখে প্রীতি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কান্না করে ফেললো। কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো খুব ব্যথা করছে হাতে?
ইয়ানা এত কষ্টের মাঝেও মুচকি হাসলো প্রীতির এতো গভীর ভালোবাসা দেখে। এই মেয়েটা ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসে আগলে রাখে সবসময়।

তখন কেবিনে প্রবেশ করে পারফি আর শাফিন। ইয়ানার জ্ঞান ফিরেছে দেখে দুজনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। স্যালাইন শেষ হলে একজন নার্স এসে সেটা খুলে দিলো। প্রীতির সাহায্যে ইয়ানা উঠে বসলো।
সবাই টুকটাক কথা বললো ইয়ানার সাথে। শাফিনের সাথেও পরিচয় হলো। কথায় মাঝে জানতে পারলো শাফিন এই ওকে রক্ত দিয়েছে। শাফিন খুবি মিশুক তাই অল্পতে ইয়ানার সাথে মিশে গেলো। বিভিন্ন কথা বলে সবাইকে হাসাতে লাগলো। এক কথায় সবার মন খারাপটা নিমিষেই ভালো করে দিলো।
পারফি কিছুটা দূরে বসে এদের কান্ড কালাপ দেখে গেলো কিন্তু কিছু বললো না। মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরছে কে এমন আক্রমণ করলো আর কেনোই বা করলো।

ইয়ানা এখন একটু সুস্থ বাসায় নিয়ে যেতে পারবে ডক্টর জানালো। রাত ৯ টা বেজে গেছে তা দেখে ইয়ানার চোখ কপালে। মাথা ঘুরতে লাগলো এখন বাসায় গেলে কি হবে? বাবা তো বাসায় নেই কাজের জন্য ঢাকার বাহিরে গেছে। আর মা তো আমাকে শেষ করে দিবে একদম। ভয়ে চুপসে গেলো ইয়ানা, প্রীতিকে তাড়া দিয়ে বললো বাসায় যাওয়া দরকার।
ইয়ানার অবস্থাটা হয়তো প্রীতি কিছুটা বুঝেছে তাই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। হসপিটালের বাহিরে এসে শাফিন বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
পারফি গাড়ি স্টার্ট দিলো, অনেক সময় পর গাড়ি এসে থামলো ইয়ানাদের বাসায়।
ভাইয়া তুমি এখানে একটু ওয়েট করো আমি ওকে দিয়ে আসি।
পারফি সম্মতি দিতে প্রীতি ইয়ানাকে নিয়ে চলে গেলো। পারফি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো তখন চোখে পরলো ঔষধের প্যাকেট গাড়িতে পড়ে আছে। কিছু একটা ভেবে ঔষধের প্যাকেট টা নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-০১

0

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ১

মা শাড়িটা একটু পড়িয়ে দিবে?
ইয়ানা এতো ন্যাকা করার কি হয়েছে নিজেরটা নিজেই পড়ে নিতে পারিস না।
মায়ের কথায় হাসিখুশি মুখটা চুপসে গেলো। চোখের কোটরে পানি জমা হয়ে গেলো। কান্না আটকে ছোট করে বললো আমি কখনো শাড়ি পড়িনি তাই পড়তে পারি না।

না পারলে পড়ার দরকার নেই। কলেজে কি পড়তে যাস নাকি নিজের রুপ দেখাতে যাস? নাটক না করে নিজের টা নিজের করে নে। এই বাপ মেয়ের জ্বালায় আমার জীবনটা অতিষ্ট হয়ে গেলো। যেমন বাপ তেমন তার মেয়ে।
মায়ের কথায় এবার আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু। সেখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে ছুটে রুমে যেয়ে দরজা আঁটকে বালিশে মুখ গুজে অশ্রু ফলতে লাগলাম। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মা সবাসময় আমার সাথে এমন করে। কোথায় ইমা আপুর সাথে তো এমন করে না। তাহলে আমার সাথে কেনো এমন করে? কেনো সবসময় আমার সাথে রেগে থাকে? মা থাকতেও কখনো মায়ের ভালোবাসা পাই নি। সবসময় মা আমার উপরে রেগে থাকে। কিন্তু কেনো? কি দোষ করেছি আমি?
ইমা আপুকে আজ খুব মিস করছি। আপু থাকলে হয়তো মায়ের কথা শোনা লাগতো না। আপু নিজে আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতো। খুব করে কান্না পাচ্ছে আপুর বিয়ে হয়ে কেনো গেলো সেই জন্য।

অনেক কষ্টে নিজের কান্না থামিয়ে চোখমুখে পানি দিয়ে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে কল করলাম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড প্রীতির কাছে। প্রথম বার কল রিসিভ হলো না তাই একটু পরে আবার কল করলাম। খুব করে কান্না আটকাতে চাচ্ছি কিন্তু কান্না আটকাতে বরাবরই এই ব্যর্থ হলাম। এই একমাত্র একটা মেয়ে যার কাছে কিছু লুকাতে পারি না। বলা বাহুল্য ভাগ্য করে একটা বেস্ট ফ্রেন্ড পেয়েছি। নিজের বোনের থেকে কোনো অংশে কম না।
আজকে আমাদের কলেজে নবীন বরন তাই সবাই শাড়ি পড়ে যাবে। আমি এটা শুনে না করে দিয়েছিলাম কিন্তু এতে প্রীতির কান্না কারার মত অবস্থা। কোনো মতেই ও আমাকে শাড়ি পড়া ছাড়া যেতে দিবে না। অনেক জোরাজোরির পর প্রীতির কাছে হার মেনে রাজি হলাম শাড়ি পড়ার জন্য। কিন্তু কে জানতো সেই শেষে এসে শাড়ি আর পড়া হবে না আমার।
ভাবনার মাঝে কল রিসিভ হতেই নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে প্রীতিকে বলতে লাগলো প্রীতি একটা কথা বলি প্লিজ রাগ করিস না। আমি শাড়ি পড়তে পারবো নারে। জানিস তো আমি শাড়ি পড়তে পারি না। মাকে বলেছিলাম কিন্তু মা পড়িয়ে দেয় নি রে বলতে বলতে চোখ ভিজে উঠলো ইয়ানার।
ফোনের অপর পাশ থেকে কোনো সারা শব্দ না পেয়ে ইয়ানা ভেজা গলায় বলে উঠলো হ্যালো..প্রীতি শুনতে পারছিস?
এবার ও কোনো উত্তর আসলো না। ইয়ানা কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বললো কিন্তু কোনো সারা না পেয়ে ফোন কাটতে যাবে তখন শুনতে পেলো কিছু কথা।

ভাইয়া কে ফোন করেছে?প্রীতি রুমে ডুকতে ডুকতে পারফির উদ্দেশ্যে বললো।
প্রীতির কথায় পারফি একটা ঘোর থেকে বের হলো। প্রীতির ফোনে একটু সমস্যা হয়েছিলো সেটা ঠিক করার জন্য পারফির কাছে ফোনটা দিয়ে ও নিজের রুমে চলে গেছিলো রেডি হতে। পারফি ফোন ঠিক করছিলো তখন কলিজা নামে সেভ করা একটা নাম্বর থেকে ফোন আসলো। পারফি কৌতুল জাগলো এটা কে হতে পারে। ভাবনার মাঝে কল কেটে গেলো একটু পরে আবার কল আসলো। পারফি কৌতুহল বসতো ফোন রিসিভ করতে কারো ভেজা কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেলো। কন্ঠ শুনে বুঝা গেলো অনেক সময় কান্না করেছে। কান্না করার পর কারো কন্ঠস্বর এত আদুরে লাগে তা জানা ছিলো না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলো। কেনো যেনো সেই কান্না ভেজা মুখটা দেখার অদম্য ইচ্ছে জাগলো মনে। পরক্ষণে নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো পারফি। একটা মেয়ের কন্ঠ শুনে মনে এমন ভাবনা জাগার জন্য নিজে বেকুব বনে গেলো।

কি হলো ভাইয়া কথা বলছো না কেনো? কে ফোন করেছে?

পারফি ভাবনা থেকে বেড়িয়ে রসিকতার সাথে বলে উঠলো তোর কলিজা ফোন করেছে। কলিজা বললে ভুল হবে মনে হলো কোনো বিড়াল ছানা ম্যাও ম্যাও করে কথা বলেছে।
পারফির কথা শুনে প্রীতি হেসে ফেলে বললো কে ইয়ানা ফোন করেছে?
তোর কোন কলিজা ফোন করেছে তা তুই দেখ এ বলে ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো যা ভাগ এবার এখান থেকে।
প্রীতি ফোন হাতে নিয়ে মুখ ভেঙচিয়ে ফোন নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
এদিকে ইয়ানা থম মেরে বসে রইলো। এত সময় কি হলো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কে ফোন ধরলো? আর কি বললো? আমি বিড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করেছি?

হ্যালো ইয়ানা আছিস?
প্রীতির কন্ঠ শুনে ইয়ানা নড়েচড়ে বসলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে আমতা আমতা করে বললো তখন ফোন রিসিভ কে করেছিলো?
পারফি ভাইয়া ধরেছিলো। এখন কি হয়েছে বল, তুই কি রেডি হয়েছিস?
পারফি নামটা ইয়ানা অনেক শুনেছে। প্রীতির ভাই পারফি, লোকটাকে কখনো দেখা হয় নি। ফাজিল লোক আমাকে বিড়ালের বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছে।
ইয়ানা ঠোঁট উল্টে বললো তোর ভাই আমাকে বিড়ালের বাচ্চা বানিয়ে দিলো।
ইয়ানার কথায় প্রীতি খিলখিল কারে হেসে দিয়ে বললো ভাইয়া তো ঠিকি বলেছে। তুই আসলেই একটা বিড়াল ছানা। আমার কলিজার বেস্টু বিড়াল ছানা।
প্রীতির কথায় ইয়ানা গাল ফুলিয়ে বললো থামবি তুই নাকি ফোন কেটে দিবো?
এই না না এবার বল কি হয়েছে?
ইয়ানার মুখটা চুপসে গেলো। মন খারাপ করে সব খুলে বললো।
সব শুনে প্রীতির মন ও খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ নিয়ে বললো আন্টি যে কেনো তোর সাথে এরকম করে বুঝি না। থাক মন খারাপ করিস না। আমি আসছি তোদের বাসায়, আমি তোকে শাড়ি পড়িয়ে দিবো তবুও তোর শাড়ি পড়া লাগবে।
কি বলছিস তুই আবার কষ্ট করে আসবি, এর থেকে আমি না পড়লে হয় না?
আর একটা কথা বলবি তাহলে তোর মুখ একদম সেলাই করে দিবো। চুপচাপ ফোন রাখ আমি আধা ঘণ্টার ভিতরেই আসছি এ বলে ইয়ানাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।
ইয়ানা ফোনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েকে কোনো কথা শুনানো যায় না। যেটা বলবে সেটা করেই ছাড়বে।
প্রীতি ইয়ানার সাথে কথা শেষ করে পারফির রুমে গিয়ে বললো ভাইয়া আজ তো তুমি অফিসে যাবে না। আমাকে একটা হেল্প করতে পারবে?

প্রীতির কথায় পারফি ভ্রু কুঁচকে বললো কী হেল্প?
আসলে ভাইয়া আমাকে একটু ইয়ানাদের বাসায় দিয়ে আসতে পারবে?
পারফি রসিকতার সাথে বললো কে তোর ওই বিড়াল ছানার বাসায়?
ভাইয়া একদম আমার কলিজার বেস্টুকে নিয়ে হাসবে না তাহলে ঘুসি দিয়ে তোমার সব দাঁত ফেলে দিবো।

বিড়াল ছানাকে বিড়াল বললেও দোষ যা বাবা।

প্রীতি কপাট রাগ দেখিয়ে বললো ভাইয়া তুমি চুপ করবে। আমাকে প্লিজ একটু তারাতাড়ি দিয়ে আসো না।

আমি কি তোর ড্রাইভার নাকি যে তুই বললি আর দিয়ে আসবো?
ভাইয়া এবার কিন্তু বেশি করছো। আমি কিন্তু আম্মুকে ডাক দিবো এবার।
তুই কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছিস? ভেবেছিলাম যাবো কিন্তু এখন যাবো না, যা ভাগ আমার রুম থেকে।
প্রীতি এবার কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো প্লিজ ভাইয়া চলো না লেট হয়ে যাচ্ছে।

আমি গার্ডকে বলে দিচ্ছি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

এএ না গার্ড দের সাথে আমি যেতে পারবো না। কেমন তাদের সাথে গেলে রোবোটের মত বসে থাকতে হয় যা পুরোই বোরিং লাগে। আজকে আমার মুডটা খুব ভালো আছে এই আজাইরা গার্ডদের সাথে যেয়ে মুডের ১২ টা বাজাতে চাই না।
আমার কাজ আছে আমি যেতে পারবো না।
প্রীতিও নাছোড়বান্দা পারফিকে রাজি না করানো পর্যন্ত দম নিলো না। অবশেষে প্রীতির কাছে হার মেনে যেতে রাজি হতে হলো। পাফিকে রাজি করাতে পেরে প্রীতি খুশিতে নিচে নেমে গেলো।

পারফি রেডি হয়ে নিচে নামছিলো তখন পিয়াসা বেগম বললো অফিসে যাচ্ছিস নাকি? আজ তো অফিসে যাবি না বললি।
তোমার মেয়েকে নাকি তার বিড়াল ছানার বাসায় দিয়ে আসতে হবে। তাই দিয়ে আসতে যাচ্ছি।
পিয়াসা বেগম কথায় মানে বুঝতে না পেরে বললো মানে?
তখন প্রীতি বললো মা ভাইয়াকে কিছু বলো। আমার জানের বেস্টুকে আর একবার যদি বিড়াল ছানা বলে তাহলে কিন্তু খবর আছে।
দুই ভাই বোনের কথা শুনে পিয়াসা বেগম হেসে ফেললেন। হেসে বললো ও ইয়ানার কথার বলছিস। মেয়েটা কত ভদ্র কিউট বাচ্চা, সেই কবে দেখেছি আর দেখা হলো না। একদিন সময় করে ইয়ানাকে নিয়ে আসিস তো।
আচ্ছা আনবো এবার যাই আম্মু লেট হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা সাবধানে যাস। আর পারফি তুইতো আজ ফ্রী আছিস তাহলে ওদের দুজনকে এক সাথে নিয়ে ওদের কলেজে যাস। রাস্তা ঘাট ভালো না তার উপর শত্রুর ও ওভাব নেই এর ভিতরে ওরা দুটো মেয়ে একা একা গেলে যদি কোনো বিপদ হয়। এমনিতেও আজ কলেজে অনুষ্ঠান কখন কি বিপদ এসে পরে বলা যায় না।

পারফি আচ্ছা বলে বিদায় জানিয়ে প্রীতিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। পরে প্রীতির দেওয়া ঠিকানায় যেয়ে গাড়ি থামালো।
প্রীতি নেমে যাবে তখন পারফি গম্ভীর কন্ঠে বললো ১৫ মিনিট এর ভিতরে রেডি হয়ে নিচে নামবি আমি আছি এখানে।

আচ্ছা তুমি একটু ওয়েট করো আমি এই যাচ্ছি আর এই চলে আসবে এ বলে দৌড়ে উপরে চলে গেলো।
বোনের কান্ড দেখে মুচকি হাসলো পারফি। পকেট থেকে ফোন বের করে ফোন স্ক্রোল করতে লাগলো।

প্রীতি দৌরে দোতলায় উঠে হাঁপাতে লাগলো। নিজেকে একটু শান্ত করে কলিংবেল চাপ দিলো। কিছুক্ষণ পর দরজা খুললেন ইতি বেগম (ইয়ানার মা)
ইতি বেগম কে দেখে প্রিতি সালাম দিয়ে জানতে চাইলো ইয়ানা কোথায়।
ইতি বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললো ওর রুমে আছে এ বলে নিজের কাজে চলে গেলো।
প্রীতি ইতি বেগম এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তিনি যে কেনো সবসময় এমন গম্ভীর হয়ে থাকে তা আদো বুঝে উঠতে পারলো না।
প্রীতি ইয়ানার রুমে এসে নক দিতে ইয়ানা দরজা খুলে প্রীতিকে দেখে ঝাপটে ধরলো।
প্রীতি ইয়ানার পিঠে চাপর মেরে বললো হয়েছে হয়েছে এবার ছাড় লেট হয়ে যাচ্ছে।
ইয়ানা আরো জোরে ঝাপটে ধরে বললো ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
হাতে সময় কম ১৫ মিনিটের ভিতরে রেডি হতে হবে ছাড় না এবার।
ইয়ানা ছেড়ে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো ১৫ মিনিট কেনো? অনুষ্ঠান শুরু হতে তো আরো ১ ঘন্টার মতো বাকি।
এতো কিছু বলার এখন সময় নেই যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় এ বলে জোর করে ওয়াশরুমের পাঠিয়ে দিলো।
প্রীতির কাজে ইয়ানা বোকা বনে গেলো। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকলো না। পরক্ষণে নিজের ভাবনা বাদ দিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই প্রিতি রেডি করে দিতে লাগলো।
রেডি হওয়া শেষ হলে দুজন রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। ড্রয়িংরুমে এসে ইয়ানা ইতি বেগমের উদ্দেশ্যে বললো মা আমি যাচ্ছি।
ইতি বেগম কোনো জবাব দিলো না তা দেখে ইয়ানার মনটা বিষিয়ে গেলো। চোখ জোরা চিকচিক করে উঠলো জলে। অন্য মায়েদের মত যদি একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো সাবধানে যাস তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? ইয়ানা ভেজা চোখে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রীতিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
———————–
এদিকে পারফি বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ১৫ মিনিটের জায়গায় ৩০ মিনিট হয়ে গেলো এখনো প্রীতির আসার নাম নেই। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেলো, রাগ লাগছে এবার খুব। বিরক্ত নিয়ে গেটের দিকে তাকাতে থমকে গেলো পারফি।
গেট পেরিয়ে বেবি পিঙ্ক কালার শাড়ি পরিহিত একটি মেয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে আসছে। স্নিগ্ধ মুখশ্রী যেখানে নেই কোনো মেকআপ এর ছোয়া। মেকআপ ছাড়া বেবি পিঙ্ক কালার শাড়ি পরিহিত মেয়েটিকে স্নিগ্ধ ফুলের চেয়ে কোনো অংশে কম লাগছে না। অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার দরুন গুলুমুলু গাল দুটি রোদের তাপে লাল আভা ধারণা করেছে। গোলাপি ঠোঁট, টানা টানা চোখ যেনো মনে হচ্ছে সকালে ফুটে ওঠা স্নিগ্ধ এক গোলাপ ফুল। এতক্ষণ বিরক্তিতে কুঁচকে থাকা ভ্রু শীতল হয়ে গেলো। এক ঘোরের মাঝে হারিয়ে গেলো পারফি। আশেপাশে আর কোনো কিছুর দিকে খেয়াল নেই। হারিয়ে গেলো সামনে আসা রমনির মাঝে।

#চলবে?

জনম জনমে পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_১০ [অন্তিম পর্ব]
#ইসরাত_ইতি

প্রাসাদের সিংহদুয়ার রুদ্ধ করে দেওয়া হলো। দ্বারের দিকে ছুটতে ছুটতে যেতে থাকা পারু চোখের পানি মুছছে। কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার দেবদার বলা সেই কথাগুলো,

“আচ্ছা দুলি একটু মজা করছি,রেগে যাসনা! একটা দৃশ্য কল্পনা কর। ধর তুই পারু। আমি তোর দেবদা। পারিবারিক দ্বন্দ্বে তোর অমন করে অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হলো। আমি ওভাবে মাতাল হয়ে তোর দুয়ারে গিয়ে চেগিয়ে পরে থাকলাম। তুই শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দৌড়ে দৌড়ে এলি, কাঁদতে কাঁদতে। তুই আমার কাছে এসে পৌঁছানোর আগেই সিংহদ্বার বন্ধ হয়ে গেলো।”

তার দেবদা আসেনি, অভিমানী দেবদা আসেনি দোলার কাছে। শুধু অভিমানেই দূর থেকে আরেকটু দূরে চলে যেতে চাইলো। আসেনি দোলার দোরে। তাতে কি? জারিফের স্বার্থপর পারু যাবে। গিয়ে শুধু বলবে,“জারিফ শাস্তি আমরা দু’জনেই পেয়েছি দেখো! আমিও ভালো নেই। তুমি ভেবো না আমাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে! ভেবো না।”

আর কি কি বলবে দোলা সাজাতে লাগলো,তবে গিয়ে দেখলো সিংহদ্বারে তালা ঝোলানো। বড় একটা তালা। তবে এখন উপায়?

হাপাচ্ছে দোলা। বাড়ির কাজের লোকেরা আঙিনায় দাঁড়িয়ে ভ্রষ্টাচারিনী দোলার ছটফটানি দেখছে। কিছু মুখে না বললেও মনে মনে ধিক্কার দিচ্ছে দোলাকে। দোলা দাড়োয়ান চাচাকে বললো গেটের তালা খুলতে। দাড়োয়ান চাচা নির্বিকার। কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যেতে চাইলো দোলা। তখনই তার বৈধ পুরুষ এসে তার চুলের মুঠি ধরলো। ধরবেই তো! স্বাভাবিক! ভ্রষ্টাচারিনীকে শাস্তি দেওয়া উচিত।

টেনে হিচরে শেখ বাড়িতে ঢোকানো হলো পারুকে। পারু শুধু বলতে লাগলো,“মাত্র আধাঘণ্টা। দূর থেকে দেখে চলে আসবো!”

বৈধ পুরুষ অমন মুখপুড়ি,চরিত্রহীনাকে টেনে হিচরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। পুরো দোতলা ফাঁকা। আজ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কেউ ঢুকবে না। সবাই যার যার ঘরে দরজা লাগিয়েছে।

ঘরে ঢুকিয়ে বিছানার উপরে ফেলে ঘরের দরজা বন্ধ করা হলো। পারু কাঁদছে। কাঁদার প্রয়োজন কি এখন? সে গেলেই কি দেবদা সুস্থ হয়ে যাবে?

বৈধ স্বামী ভ্রষ্টাচারিনী স্ত্রীকে শাস্তি স্বরূপ চামড়ার বেল্ট দিয়ে কিছুক্ষণ মা’রলো। কত বড় দুঃসাহস! আজ জন্মের তরে দ্বিচারিতার শখ ঘুচিয়ে দিলো। হাপাচ্ছে সে। ততক্ষণে চুপ হয়ে গিয়েছে দোলা। শরীরের যন্ত্রনা আর টের পেলো না সে। উপুড় হয়ে পরে রইলো। বৈধ পুরুষ এসে চুলের মুঠি ধরে স্ত্রীকে ঘুরিয়ে শুইয়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,“এই প্রথম আর এই শেষ। এরপর পরপুরুষের জন্য চোখের পানি ফেলতে দেখলে শক্তি অপচয় করবো না আর। জানে মে’রে বাড়ির আঙিনায় কবর দিয়ে দেবো।”

দোলা নিষ্পলক সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোয়াল চে’পে ধরে বৈধ পুরুষ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,“শরীরে স্বামীর গন্ধ নিয়ে মামাতো ভাইয়ের জন্য শোক? এই তোর হয়না? কি কম দিয়েছি তোকে? জবাব দে! জবাব দে!”

জবাব পাওয়ার জন্য শেখ তৌসিফ আহমেদ প্রশ্নটা করেনি। স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এতটুকু মা’র যথেষ্ট ছিলো।

শেখ বাড়ি নিস্তব্ধ এখন। তৌসিফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘন্টা খানেক সিগারেট ফুঁকতে থাকে। শরীরকে আটকানো যায়,কিন্তু মন? মন কিভাবে আটকাবে তৌসিফ বুঝতে পারছে না। শেখ তৌসিফ আহমেদ জীবিত থাকতে তার বৌকে তালাক দেবে না, তাহলে মানুষ বলার সুযোগ পাবে বৌ দ্বিচারীনি হুলো কারণ শেখ তৌসিফ আহমেদ ব্যর্থ! হয়তো তার ত্রুটি আছে! সে দেবে না তালাক। সে ঐ বৌকেই মানুষ বানিয়ে সংসার করবে। কুমারী ছিলো, শুদ্ধ শরীর ছিলো। মনটা শুধু বেহায়া। ঐ বেহায়া মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে মনটাকেই ন’ষ্ট করবে তৌসিফ।

রাগ আর প্রচন্ড জেদেও তৌসিফ উত্তেজিত হয়না। এক হাতে মাথার চুল খামচে ধরে,চার নাম্বার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সে বারান্দা থেকে ঘরে ঢোকে।

বিছানায় স্ত্রীর কাছে এগিয়ে যায়। আজ একে একেবারে জব্দ করে তবেই তৌসিফ থামবে। যেন ভবিষ্যতে এমন পাপ করার সাহস না পায়। একটানে শাড়ির আঁচল সরিয়ে হামলে পরে। পারু শুধু সিলিংয়ের দিকেই তাকিয়ে। তার বৈধ পুরুষ তার অবস্থান বুঝিয়ে দিতে তাকে আরো একবার দখল করে নিলো।

সময় গড়ায়। শেখ তৌসিফ তার স্বামীত্ব ফলিয়ে তার স্ত্রীর থেকে সরে গিয়ে আবারও চোয়াল চে’পে ধরে বলে,“হয়নি? নাকি আরো লাগবে? এখনও মামাতো ভাইয়ের কথা মনে পরছে?”

দোলা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ঘরের সিলিংয়ের দিকে।

তৌসিফ দোলার খুলে ফেলা লাল রঙের শাড়িটা তুলে দোলার শরীর ঢেকে, নিজে টি-শার্ট পরতে পরতে উঠে দাঁড়ায়। হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়ার থেকে সবধরনের জন্মনিরোধক ওষুধের পাতা ন’ষ্ট করে বিনে ছুঁড়ে ফেলে একটা সিগারেট ধরায়। মন আটকানোর একটা অভিনব উপায় পেয়ে গিয়েছে শেখ তৌসিফ আহমেদ।

সিগারেট টা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে যায় তৌসিফ।

বিছানায় স্বামীর অত্যাচার আর সম্ভোগের চিহ্ন শরীরে নিয়ে পরে হয় দোলা। আর মেঝেতে পরে রয় শেখ তৌসিফ আহমেদের চামড়ার বেল্ট। যেটা একজন ভ্রষ্টাচারিনীকে শাস্তি দিয়েছে আজ।

★★★

বাড়ির বৌয়ের এমন আচরণ কারোরই সহ্য হচ্ছে না। রাতে খেতে বসে এই নিয়ে বিশদ আলোচনা সভা বসেছে শেখ বাড়ির পুরুষদের মধ্যে। এ বাড়ির মানসম্মান জড়িত,তাই তৌফিকুল ইসলাম ছেলের কাছে জানতে চাইছে তার ছেলে এখন কি করবে। শেখ তৌসিফ আহমেদ সাফ জানিয়ে দিলো সে বৌ তালাক দেবে না,বৌকে মানুষ বানিয়ে ফেলবে।

তৌসিফ বৌকে মানুষ বানাতে কি কি করতে চায় তা কেউ জানতে চাইলো না। রাতের খাবার শেষে তৌসিফ বৌয়ের জন্য প্লেটে খাবার আর একটা মলম নিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেলো। শরীরে যতো আঘাত পরেছে সেগুলোতে মলম লাগাবে তৌসিফ আহমেদ। পথভ্রষ্টা হলেও বৌ তো! মেজাজ টা তার রাতে ঠিক হয়েছে খানিকটা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন একটু বোঝাবে। এমনিতেও কম মা’র পরেনি গায়ে। অত সুন্দর নরম শরীর, কিভাবে এতো মা’র খেয়েও না চেঁ’চি’য়ে পারলো তৌসিফকে বেশ অবাক করেছে।

দরজার সিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে দোলা তখনও বিছানায়। তৌসিফ বেড সাইডের টেবিলে খাবার প্লেট টা রেখে গিয়ে দরজা লাগিয়ে মলম নিয়ে এগিয়ে যায় বৌয়ের কাছে। চোখ বন্ধ দোলার। গা থেকে শাড়িটা সরিয়ে তৌসিফ দেখলো সায়া-ব্লাউজ পরিহিতা অর্ধনগ্ন শরীরে রক্ত লাল আঘাতের দাগ।

মেজাজ তখন পরেই গিয়েছিলো পুরোপুরি, বৌয়ের জন্য খানিকটা দরদও লাগলো তার। ভীষণ শখের বৌ তার। কখনও কোনো মেয়েকে দেখে এক দেখায় তৌসিফের মাথায় বিয়ের ভুত চাপেনি।

সে দোলাকে না ডেকে দরদ নিয়ে মলম আঙুলে নিয়ে দোলার পেটের কাছে আঘাতে লাগিয়ে দিতেই চ’ম’কে ওঠে।

মুহুর্তও লাগলো না তার,দোলাকে আগলে নিয়ে গালে চা’পড় মেরে বলে,“দোলা! দোলা!”

দোলা সাড়া দেয়না। তৌসিফের বুঝতে বাকি নেই দোলা কখনোই আর সাড়া দেবে না। শরীরটা কাঁপছে তার। এসব কেনো! এসব কি! কেনো হলো!

★★★

ক্ষীণ আশা দোলা বেঁচে আছে। দোলার দায়িত্ববান বৈধ পুরুষ অ্যাম্বুলেন্সে দোলার হাত ধরে বসে ছিলো। বাকরুদ্ধ সে।‌ দোলার অর্ধনগ্ন শরীরটা তার স্বামীর কেনা চার হাজারের লাল শাড়িতে মোড়া।

অ্যাম্বুলেন্স থেকে দোলাকে নামানো হলো,ডাক্তার দেখলেন, জানালেন দোলা নেই।

মৃত্যুর কারণ অজানা,শরীরে শুধু আঘাতের চিহ্ন।

দোলার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে এলো দোলাকে হসপিটালে নিয়ে আসার তিনঘন্টা আগে দোলা মারা গিয়েছে। মৃত্যুর কারণ “কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট!”

দোলার গল্প ফুরিয়ে গেলো। বাকি রইলো দোলার জীবনে বৈধ মানুষ গুলো। তারা শোকাহত হলেন, বিষন্ন মনে দোলার দাফন কার্য সম্পন্ন করলেন। পুলিশ কেস হয়নি,কারন দোলা দোলার স্বামীর হাতে তো মরেনি। রিপোর্টে “কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট” থাকলেও দোলার মৃত্যুর আসল কারণ দোলা ব্যতীত এই পৃথিবীর কেউ না জানুক। ওটা রহস্য হয়েই থাকুক।

দোলার কবর শেখ বাড়ির পূর্ব পাশের পারিবারিক কবরস্থানে। দোলার শ্বশুর ভাসুর মনে মনে পছন্দ করলো না অমন দ্বিচারীনি বৌয়ের কবর এবাড়িতে হোক। কিন্তু তবুও দোলার কবর স্বামীর বাড়িতেই হলো। এতে শেখ বাড়ির মান সম্মান জড়িত। বাড়ির বৌয়ের কবর অন্যখানে কেনো হবে?

শোক যথাযথ ভাবে পালন হলো দোলার মৃত্যুর। দোলার দায়িত্ববান স্বামী দোলার দাফনের দিন থেকে এতিম খাইয়েই যাচ্ছেন। এখন অবধি মাথা থেকে টুপিটা খোলেনি, সিগারেট হাতে নেয়নি।

আত্মহত্যা মহাপাপ। পাপী দোলার এই মহাপাপ টা করতে হলো না। তার প্রতি সৃষ্টিকর্তা সদয় হলেন। অত্যন্ত সুখের মৃ’ত্যু ছিলো ওটা।

বৌ মরে গেলো,আত্মীয়তা ফুরিয়ে গেলো। শেখ বাড়ির ছোট ছেলে বিপত্নীক হলেন। দোলার কবরের পাশে লাগানো পাতাবাহার গাছগুলো ডালপালা ছাড়ার আগেই শেখ বাড়ির মুরব্বিরা শেখ তৌসিফ আহমেদের জন্য মেয়ে খুঁজতে লাগলেন। এবার তারা নিজেরা পছন্দ করবেন, ভালো মেয়ে।

শেখ তৌসিফ আহমেদ বিষন্ন ভঙ্গিতে সরাসরি বারণ না করলেও সময় চাইলেন। সম্ভবত তিনি ভুলে গিয়েছেন সময়ের দরকার হয়না স্বামী হতে,একদলা মাংস পিন্ড হাতের কাছে পেলে আর শারীরিক সক্ষমতা থাকলেই স্বামী হওয়া যায়।

সময় লাগে তো স্ত্রী হতে, এতগুলো দিন নিজের মনকে মানিয়েও যা হতে পারেনি দোলা, বেঁচে থাকলে হয়তো পারতো, যদি তৌসিফের পরিকল্পনা মাফিক তৌসিফের বাচ্চা তার পেটে আসতো।

কবরস্থান নতুন। দোলার কবর রাজমিস্ত্রীরা মার্বেল পাথরের দেয়ালে ঘেরাও দিয়ে দিতে এসেছেন। শেখ তৌসিফ আহমেদ জীবিত থাকতে বৌকে অলংকারে আবৃত করে রাখতে চাইতেন,মরে যাওয়ার পর বৌয়ের কবরটাও পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করলেন। স্বামী হিসেবে তিনি যে দায়িত্ববান।

রাজমিস্ত্রীরা তাদের কাজ করছে, শেখ তৌসিফ তার ঘরের বারান্দা দিয়ে তা দেখছেন, একদৃষ্টে। কাজের মেয়ে এসে তৌসিফের হাতে একটা নোংরা কাগজ দিয়ে বলে এটা ময়লার ঝুড়িতে পেয়েছে সে,দেখে মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাগজ।

কাগজটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, একটা চেক তাতে রয়েছে সাত লক্ষ টাকা। যার বিনিময়ে সে তার বৌকে পেয়েছিলো, তবে শুধু শরীরটা। মন নয়। কারন তার বৌ ছিলো যে ভ্রষ্টাচারিনী।

★★★

দোলা মরলো,সব ল্যাটা চুকে গেলো।

গল্পে তো দেবদা মরে যায়। বাস্তবে একটু ভিন্নই থাক। পারু মরুক। দেবদারা বেঁচে থাকুক।
আর এই পৃথিবীর সব দুধে ধোয়া তুলসী পাতা মানুষ গুলো বেঁচে থাকুক। যারা খুব গুছিয়ে জীবন যাপন করতে পারে, দোলার মতো অগোছালো নয়, হটকারী নয়, অসহায় নয়, স্বার্থপর নয়,চরিত্রহীনা নয় সবশেষে যারা দোলা নয়।

পারু মরেছে, পৌষ গিয়ে মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন এসেছে। শেখ বাড়ির ছোট ছেলের বৌয়ের কবর ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছে। দোলার স্বামী নিয়ম করে সপ্তাহে একবার পরিষ্কার করায়, দায়িত্ব থেকে।

আচ্ছা দোলার স্বামীর কথা বাদ দিই। চলুন পারুর দেবদার কাছে যাই। সে কি করছে জানতে ইচ্ছে করছে না?

★★★

অ্যাক্সিডেন্টের পরে তিনমাস সময় নিয়ে দোলার দেবদা সুস্থ হলো। গল্পের মতো দেবদা কখনও জানতে পারেনি পারু তার কাছে আসবে বলে ছুটছিলো। দেবদার জানার প্রয়োজন তো নেই, সে জানলে তার কষ্ট বাড়তো বৈ কমতো না। রাগও হতো। দেবদা জানেনি ভালো হয়েছে।

আজকাল দেবদা দেখে শুনে বাইক চালায়। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে সে জীবনের মানে বুঝতে পারলো, এবারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার টা ছিড়লো না সে। চাকুরী টা গ্রহণ করলো, জীবনে ফিরলো দেবদা। নিজেকে বদলে ফেললো। শুধু বদলাতে পারলো না পারুর প্রতি তার ভালোবাসা,কমাতে পারলো না কিছুতেই।

পারু ম’রেছে তা সে জেনেছে। তবে তাতে কি? পারুর শরীরটা ম’রেছে। ঐ শরীরের সাথে দেবদার কি লেনা দেনা?

সে তো ভালোবাসে ঐ নামটিকেই,তার দুলিকে। অফিস শেষে ফাঁকা সময়ে ছুটে যায় জারিফ দুলির পছন্দের যায়গাগুলোতে। রাতে নিস্তব্ধ মফস্বলে হেটে বেড়ায়। হাটতে হাটতে ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে যায়। আজও গেলো,শেফা ফার্মেসির সামনে কুকুর ডাকে। সে তাড়িয়ে দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনশো চারের কামরার জানালার দিকে তাকায়। তাকিয়ে আজ জারিফ অবাক হলো,তার বুকে কাঁপন ধরলো। তিন তলার রুমটাতে আলো জ্বলছে আজ।

দেবদার শরীর কাঁপছে। থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। জানালা খুলে যায়। দেখে এক অন্য মেয়ে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ঐ রুমে নতুন এসেছে। তার কানেও ফোন চে’পে ধরে রাখা।

জারিফ মেয়েটিকে দেখে। ঠিক তখনই গলিতে একটা বাইক এসে থামে। একটা ছেলে বাইক থেকে নেমে ফোন কানে চেপে ধরে কথা বলছে, ছেলেটার দৃষ্টি তিনশো চারের কামরায়।

জারিফ দুজনকেই দেখে। তারপর স্মৃতিচারণ করে। জারিফের একবার ইচ্ছে করলো ওদের থামিয়ে দিতে,বলতে,“অনিশ্চয়তা নিয়ে স্বপ্ন বুনতে নেই।”

কিন্তু সে থামালো না। দেখুক না স্বপ্ন, মন ভাঙবে বলে স্বপ্ন দেখা বারণ নাকি!

কিছুক্ষণ দেখে জারিফ চলে যায়। কাল হয়তো আর আসবে না এখানে। এদেরকে বিরক্ত করা যাবে না,স্বপ্ন দেখতে দিতে হবে,যে স্বপ্ন ভাঙবে বছর চারেক পরে।

রাত করে হলেও জারিফ বাড়িতে যায়, আজও গিয়েছে। পরপর কলাপসিবল গেট খোলার শব্দ হয়, বন্ধ হয় গেট। জারিফ ভেতরে ঢুকে দেখে জাহিদা আনাম খাবার নিয়ে বসে আছে। জারিফ ফ্রেশ হয়ে বাধ্য ছেলের মতো মায়ের সামনে বসে রাতের খাবার খায়। কি কি বাজার লাগবে তা জানতে চায়। খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে পরে। তারপর বলে,“তোমার তেইশতম পাত্রী রিজেক্টেড মা। পছন্দ হলোনা!”

জাহিদা শোনে। জারিফ নিজের ঘরের দরজা খোলা রেখে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শোয়। মাথাটা ঢুকিয়ে দেয় বালিশের নিচে। বালিশ দিয়ে চেপে ধরে মাথা।

জাহিদা আনাম ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে রোজ অর্ধেক রাত ছেলের চাপা আর্তনাদ শোনে। খুব ক্ষীণ স্বরে। কিছুক্ষণ পর থেমেও যায়। জারিফ ঘুমিয়ে যায়। তার ছেলে তাকে শাস্তি দিচ্ছে,রোজ।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে জারিফ, নাস্তা খেয়ে মায়ের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নেয় ওষুধ আনবে বলে। রোজ খুব মন লাগিয়ে অফিস করে,অফিস শেষে ছুটে যায় আবারও তার দুলির পছন্দের যায়গা গুলোতে।

মাঝে মাঝে জারিফের খুব ইচ্ছে করে দোলার কবরটা একটু দেখতে। সবসময় না। মাঝে মাঝে। তবে সে নিজেকে সংযত করে নেয়। পারু পরস্ত্রী তাই। ওটা তো পরস্ত্রীর কবর। দুলি তো তার মনেই আছে,যার কখনো দাফন হয়নি। এইতো এখনও জারিফ স্টাফ কোয়ার্টারের দিঘির পাড়ে বসে আছে। তার পারুকে সাথে নিয়ে। তবে পাশে নয়,মনে।

সূর্যি মামা পশ্চিমে ঢলে পরলো,আজান হলো,জারিফও তার দুলিকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আর তারপর?

তারপর আর কি! ইতির গল্প ফুরালো,নটে গাছটিও মুড়ালো।

~~~~~সমাপ্ত~~~~~

জনম জনমে পর্ব-০৯

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৯
#ইসরাত_ইতি

জারিফের হাত থেকে অরিনকে কোনোমতে ছাড়িয়ে নেন জবা আর জেসমিন। জারিফ পুনরায় তে’ড়ে গিয়ে বলে,“ফের আমার আশেপাশে দেখলে থা’বড়া মেরে চেহারার মানচিত্র চেঞ্জ করে ফেলবো।”

জাহিদা আনাম জারিফকে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দিয়ে ধ’ম’কে ওঠে,“কি হচ্ছে কি জারিফ! এসব কোন ধরনের অ’স’ভ্যতামি!”

অরিন এতটাই আ’ত’ঙ্কি’ত হয়ে পরেছে যে সে কান্না অবধি করতে পারছে না। মায়ের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে আছে।

জারিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,“কি মেয়ে পছন্দ করো মা আমার জন্য? দেখলেই তো থুথু দিতে ইচ্ছে করে। তুমি না ভালো মা? আরো বেস্ট কাউকে খুঁজে বের করো।”

জাহিদা আনাম নির্বাক। জারিফ বিছানা থেকে শার্ট টা উঠিয়ে গায়ে চাপিয়ে ফোন আর বাইকের চাবি নেয়। তারপর হন্তদন্ত হয়ে সদর দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,“তোমার পছন্দ করা এই পাত্রী রিজেক্টেড। বিকেলে এসে যেনো ওর ঐ বদন না দেখি!”

★★★

অগ্রহায়ণের শুরুতে,প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল করে নিজের। দুপুরে কাঠ ফাটা রোদ,রাতের বাতাস নাতিশীতোষ্ণ। তবে ভোরের দিকটা আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা। গাঁয়ে চাদর না টেনে উপায় নেই, কখনো কখনো এই পাতলা চাদরেও শীত মানতে চাচ্ছে না যেন। ঘরের জানালাটা রাতে খোলাই ছিলো, ভোর রাতের মৃদু মন্দ বাতাস ঢুকে ঘরের শোভা বর্ধনে ব্যবহৃত ফুলদানিতে থাকা প্লাস্টিকের টিউলিপ গুলোকে নাচাচ্ছে। ঘরের বাতি নেভানো থাকলেও বেলকনি থেকে আসা আলোতে দোলা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে শক্ত করে আকড়ে ধরে রেখেছে স্বামী নামের মানুষটা। লোকটা হয়তো বুঝতে পেরেছে তার বৌ পালাতে পারে,তবে লোকটা জানে না দোলারা বাস্তবতা থেকে পালাতে পারেনা। আর সেটা যদি নিজের দোষে হয় তবে তো কথাই নেই! দোলার দোষ, দোলার ভুল,দোলার অন্যায়, দোলার পাপ, দোলার মহাপাপ। সবকিছু দোলারই ছিলো। দোলা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অলিখিত একটা লিস্ট করে ফেলে সবকিছুর।
নাম্বার এক: দোলা একজন ত্রুটিপূর্ণ মহিলার গর্ভে জন্ম নিয়েছে।
নাম্বার দুই: দোলা নিষিদ্ধ মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছে।
নাম্বার তিন: একজন মায়ের অনুভূতির দাম দিতে গিয়ে ঐ মানুষটাকে ভেঙেছে।
নাম্বার চার: দোলা নিঃস্বার্থ হতে গিয়ে স্বার্থপর হয়েছে।

আরো আরো আরো লম্বা এই লিস্ট টা, দোলা আর এগোতে পারলো না সামনে। এতো এতো দোষ দোলার। সে তুলনায় দোলার এই শাস্তিটা এখন ঠিক লাগছে দোলার কাছে। দোলা মনে মনে ভাবলো এমনই চলুক, ওর এই অনূভুতিহীন, ভালোবাসাবাসিহীন, প্রেমহীন, দরদ বিহীন ছোঁয়া ছুয়ি এই কদিনে সয়ে গিয়েছে। শাস্তি টা তেমন কঠিন নয়, সামান্য কষ্ট হয়, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা যায়। এই স্পর্শ গুলো দোলা শাস্তি হিসেবেই চায়, যদি কখনও দোলা এই স্পর্শের মাঝে দরদ,স্নেহ,টান খুঁজে পায় তাহলে যে মুখপুড়ি দোলার শাস্তি হলো না।

তৌসিফ নড়েচড়ে উঠে হাতের বাঁধন দৃঢ় করে। দোলার হাসি পেলো, দোলা কি পালাবে? না। বাস্তবতা থেকে তো একদমই না। এই যে পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা,এই মানুষটা একটা আস্ত বাস্তবতা বৈ কিছুই না।

বাস্তবতার প্রসঙ্গে দোলা ভাবতে থাকলো,স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে হয়তো বাস্তবতা হচ্ছে দেওয়া এবং নেওয়া। এইতো রাতে দোলার পা দু’টোতে এক জোড়া দামী পায়েল পরিয়ে দিলো শেখ তৌসিফ আহমেদ। এটা হচ্ছে দেওয়া। তারপর যখন দোলার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলো,দোলা অনুরোধের সুরে বলেছিলো,“আমার না আজ একটু মাথা ব্যথা করছে। আজ থাক!”
লোকটা শুনলোই না, সে দিয়েছে, এখন যে তার নেওয়ার পালা। নয়তো হিসেব বরাবর হবে কি করে ? শুধু কন্ঠে একটু দরদ ঢেলে বলেছিলো,“মাথা‌ ব্যথা একদম ভ্যানিশ করে দেবো জান।”

দোলা মানতে না চাইলে মেজাজ দেখালো, চ’ড় থাপ্পড় খাওয়ার আগেই দোলা রাজি হয়ে গেলো।

দোলার মাথা ব্যথা রাতে আসলেই ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলো,কারন ব্যথা টা উপলব্ধি করার মতো অনূভুতি অবশিষ্ট ছিলোনা। প্রত্যেকবার অনূভুতি শূন্য হয়ে পরে থাকে।

গলার কাছে পুরুষালি উষ্ণ অধরের স্পর্শে দোলা বুঝতে পারে তার জীবনের বাস্তবতা জেগে উঠেছে। আবারও, আরও এক দফা দেওয়া নেওয়ার হিসেব শুরু হবে এই ভোররাতে,দোলা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এতে।

কিন্তু না,এবার লোকটা যেন একটু সদয় হয়েছে দোলার প্রতি। ঘুমঘুম কন্ঠে জানতে চাইলো,“রাতে শরীর খারাপ লাগছিলো বললে। এখন ঠিক আছো?”

আটঘন্টা! আট ঘন্টা পরে লোকটা আগ্রাসী স্বামীর চরিত্র থেকে বেরিয়েছে, হঠাৎ তার মনে পরেছে তার বৌয়ের শরীর ভালো নেই।

দোলার নীরবতা ভাঙতে তৌসিফ আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে,“বলো জান‌। এখন মাথা ব্যথা করছে?”

দোলা অস্ফুট স্বরে বলে,“নাহ।”

দোলার চুলের মধ্যে আঙুল বিচরণ করে তৌসিফের। আঙুল গুলো কিছুক্ষণের ব্যবধানে অবাধ্য হয়ে দোলার স্পর্শকাতর স্থান ছোঁয়। ঐ যে শুনলো,দোলার শরীর এখন ঠিক আছে। আরো একবার আস্কারা পেলো স্বামীত্ব ফলাতে। কারন এটাই বাস্তবতা। আর কার জীবনে হয় কি না দোলা জানে না, তবে দোলার জীবনে হচ্ছে। বাস্তবতা যা এড়ানোর উপায় নেই।

★★★

শেখ বাড়ির ছোটো ছেলের বৌ দোলার কাজ কর্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ শ্বশুর বাড়ির সবাই। কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও সবকিছু হাতে হাতে করে। দোলা যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে এসব করে তা জানে না কেউই। বারোদিন পেরিয়েছে বিয়ের। তিনদিন ব্যাপী রিসিপশন শেষ হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে,বাড়ি থেকে মেহমান সব চলে গিয়েছে। বাড়িটা আগের মতোই ফাঁকা। তৌসিফ সদরের অফিসে বসা শুরু করেছে। দিনটা দোলার ইউরার সাথে কাটে,রাতটা কাটে স্বামীর সাথে দেওয়া নেওয়ার হিসেব করে। দোলার প্রাত্যহিক রুটিন এখন থেকে এটাই। মাঝে মাঝে দোলাদের বাড়ি থেকে দোলার ফুপু,চাচীরা আসে দোলার সুখ দেখতে,নির্লজ্জের মতো। দোলা বাক্স খুলে খুলে তাদেরকে তার সুখ দেখায়। দামী পায়েল,দামী ব্রেসলেট, নতুন গয়না। আরো কত সুখ দোলার। আলমারি ভর্তি সুখ দোলার। অন্যের কাছ থেকে ধার করে শাড়ি পরা দোলার আলমারি ভর্তি শাড়ি, থুড়ি সুখ। ওয়্যারড্রোবে আছে তিন চার রঙের পাতলা ফিনফিনে দামী নাইটি। যেগুলো মাঝে মাঝে রাতে স্বামী আদেশ দিলে পরে স্বামীর সামনে যেতে হয়। দোলার ইচ্ছে করে ফুপু চাচীদের সেসবও দেখিয়ে দিতে। গয়নার ডিজাইন দেখে দোলার চাচী ফুপুরা বলে তাদের জামাই কতো রুচিশীল! নাইটিগুলো দেখলে বলবে তাদের জামাই কত শৌখিন!

কথাটা ভাবতে ভাবতেই দোলা হেসে ওঠে। রান্নাঘরে আনমনে দাঁড়িয়ে ছিলো দোলা। একা একা পাগলের মতো কিছুক্ষণ হাসার পর টের পায় দু’চোখে পানি জমেছে । এতো ব্যস্ত জীবনেও হুট করে কখনো কখনো ঐ মানুষটার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কানে শুনতে পায় কেউ বললো,“চলনা একটু স্বার্থপর হই।”

এটা কি ঠিক? ঠিক না তো। সেদিন তৃপ্তির সাথে ফোনালাপের সময় শুনেছে মানুষটা রোগা হয়ে গিয়েছে এই কদিনে। দোলার খুব ইচ্ছা করেছিলো মামীকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতে কেনো এই হাল? সে মা হয়ে কি করছে এখন?

★★★

রিসিপশনে পুরুষ বলতে জারিফ একাই। এই অফিসে জারিফ এর আগেও দুবার এসেছে। শেষবার এসেছিলো জুলাইয়ে, ইন্টারভিউ দিতে। চাকরিটা তখন কনফার্ম ছিলো না।
এতো মহিলাদের মধ্যে জারিফের সংকোচ বোধ হচ্ছে কিছুটা। কিন্তু সে পাত্তা না দিয়ে ফোন ঘাঁটতে থাকে। সময় গড়াতেই তার ডাক পরে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় সে।

তার সামনে এই অফিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক,মুখ হাসি হাসি করে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। জারিফ পাথুরে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার কি করা উচিত এখন? হাসির বিনিময়ে হাসি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত?

লোকটা জারিফের দিকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে বলে,“চারমাস ধরে পেন্ডিংয়ে ছিলেন। নিন আপনার অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার।”

জারিফ একদৃষ্টে তার হাতের অ্যাপয়েনমেন্ট লেটারটার দিকে তাকিয়ে। লোকটা বলতে থাকে,“এখন কেমন বোধ করছেন? চাকরি টা পেয়ে কেমন লাগছে?”

জারিফ লোকটার কথায় গা দুলিয়ে হাসতে থাকে। লোকটা রীতিমতো অবাক, হতবাক। জারিফ লোকটাকে আরো অবাক করে দিয়ে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার টা ছিঁড়ে ফেলে হাসতে হাসতেই বলে,“জঘন্য লাগছে।”

★★★
দেবদাসের এই গল্পটাতে পারুও চেষ্টা করছিলো মেনে না নিলেও মানিয়ে নিতে, চলছিলো সবকিছু চলার মতোই। দুলির দেবদা কখনও চন্দ্রমুখীর কাছে যায়নি,আর না এসেছে পারুর সিংহদুয়ারে।দুলির দেবদা কখনো তার সিংহদুয়ারে এসে মুখ থুবড়ে না পরলেও পারুর গল্পের শেষ পরিচ্ছেদ লেখার সময় হয়ে এলো।

“কফিইই”
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তৌসিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে। রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকা দোলার ঘোর কে’টে যায়। সে ভুলেই গিয়েছিলো তৌসিফ আজ বাড়িতে। স্বামীর আদেশ পেয়ে দোলা তাড়াহুড়ো করে কফির পানি ফুটিয়ে নেয়।

কফি বানানোর সময় ফারিন বললো,“একি দোলা! তৌসিফ তো এক চামচ চিনি খায়। তুমি তো চিনি দিয়েই যাচ্ছো!”

ফারিনের কথায় দোলার অন্যমনস্ক ভাব কেটে যায়,হাতে কফির মগটা তুলে ঠান্ডা গলায় বলে,“অসুবিধে নেই। উনি এই কফি ছুঁয়েও দেখবে না।”

ফারিন দোলার কথা বুঝলো না। দোলা হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। ফারিনকে বলা দোলার কথার মানে হলো কফি ছিলো একটা ইশারা। এই ভরদুপুরে শেখ তৌসিফ আহমেদের তার বৌকে চাই। ডাইনিং টেবিলে বসা বাবা ভাইয়ের সামনে বৌকে সরাসরি ডাকতে পারছিলো না। তাই কফি চেয়েছে। দোলা এই কদিনে তার স্বামীর ইশারাও শিখে গিয়েছে। দোলা কি লক্ষি বৌ!

ঘরে ঢুকে বেড সাইডের টেবিলে কফির মগ টা রাখতেই তৌসিফ দোলাকে বলে ওঠে,“দরজার লাগিয়ে এসো।”

★★★

অ্যাপয়েন্ট লেটার ছিঁড়ে জারিফ শহর চষতে বেরোয়। ছুটে যায় তার পছন্দের জায়গাগুলোতে,তার দুলির পছন্দের জায়গা গুলোতে। ইদানিং জারিফ বাইক নিয়েও বেরোয় না। হাঁটতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠে, মাকে দেখিয়ে সুন্দর ভাবে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায়,ভালো লাগলে দুয়েকটা টিউশনি করায়। ছকবাঁধা জীবন ভালো লাগে না জারিফের। ছুটে যায় কুটুম বাড়িতে খেতে। রাতে ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রীনিবাসের পেছনের গলিতে যায়। রুম নাম্বার তিনশো চারে এখনো কোনো ছাত্রী ওঠেনি। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরে মাকে দেখিয়ে রাতের খাবার খায়। ঘরের দরজা খোলা রেখে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের মাথাটাকে বালিশের নিচে ঢুকিয়ে নেয়। তবে জারিফ এখন আর কাঁদে না। ওভাবে ঘুমাতে ভালো লাগে তাই ঘুমায়।

হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে জারিফ তার স্টুডেন্টের বাসার সামনে যায়,সেখানে তার বাইকটা পার্ক করে রাখা,আজ অনেকদিন পরে বাইকে উঠবে সে, উদ্দেশ্য উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাইওয়েতে ঘুরবে। ভবঘুরে জীবনে আজ একটু অ্যাডভেঞ্চার করবে সে।

★★★

দোলা সিটিকিনি তুলে স্বামীর দিকে ঘুরে তাকায়। না আজ ভরদুপুরে ডাকার কারন দেওয়া-নেওয়া নয়,কারন অন্যকিছু!

তৌসিফ নির্বিকার চিত্তে হাতের ফোনে থাকা জারিফ আর দোলার ছবি গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দোলার দিকে তাকায়। দোলা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে কি ঘটেছে। সে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তারপর ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে, হাঁটু মুড়ে। তৌসিফ ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে,“তো এজন্য প্রথমে মত দাওনি বিয়েতে। তো তারপর কেনো দিলে?”

দোলা শুকনো গলায় কাঠ কাঠ বলে,“আপনার টাকা দেখে। আপনি বড়লোক দেখে রাজি হয়েছি।”

তৌসিফ হাসে। কিছুক্ষণ হেসে দোলার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে বলে,“তোমরা মফস্বলের মেয়েরাও খুব চালু। এতো গভীর প্রনয় ছিলো অথচ আমি খোঁজ লাগিয়েও কিছু জানতে পারলাম না। অবশ্য আমার এসবে কিছু যেতো আসতো না। বিয়ে তোমাকে করতামই।”

দোলা কোনো জবাব দেয়না। শুধু ফিচেল হাসে। তৌসিফ হাতের ফোন থেকে ছবিগুলো ডিলিট করে ফেলে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে দোলাকে বলে,“বিয়ের দিন সন্দেহ হয়েছিলো যদিও। এনিওয়ে, ওসব নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তুমি শেখ তৌসিফ আহমেদের বৌ এটাই চিরন্তন সত্যি। এবং তৌসিফ আহমেদ খুব ভালো করে জানে কিভাবে বৌ পালতে হয়! আজ থেকে বাড়ির বাইরে যাওয়া,কোনো বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ। পরিক্ষার সময় আমার সাথে যাবে।”

দোলাও সাথে সাথে তাচ্ছিল্যের সহিত জবাব দেয়,“জো হুকুম মেরে আকাহ।”

তৌসিফ উঠে দাঁড়াতেই দোলার ফোন বেজে ওঠে, দোলা উঠে ফোনটা তুলে হাতে নিতেই তৌসিফ বলে,“কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দাও।”

দোলা তাই করে। ওপাশ থেকে তৃপ্তির কান্নাভেজা গলার আওয়াজ ভেসে আসে,“দুলি রে! জারিফ ভাইয়ের অ্যা’ক্সি’ডেন্ট হয়েছে!”

★★★

দুলির দেবদা মুখ থুবড়ে তার সিংহদুয়ারে এসে পরেনি। তবে দেবদার ঘোর বিপদ অবশেষে হয়েইছে। হয়তো তার দুলির কারনেই।

খবরটা পেয়ে দোলা বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে। চিৎকারে তালা লেগে যায় শেখ বাড়ির সবার কানে। ছুটে আসে সবাই,কি হয়েছে জানতে চায়।

দোলা ত’ড়পাতে থাকে। শেখ তৌসিফ আহমেদ শান্ত চোখে দেখতে থাকে দোলাকে।

সত্যিটা জেনে পুরো শেখ বাড়িতে ছি ছি পরে গেলো। বাড়ির বৌ পরপুরুষের জন্য চোখের পানি ফেলছে? কি পাপ! এতো মহাপাপ! আগে হলে দোররা মে’রে মে’রে মেরেই ফেলতো!

দোলা কারো কথা গাঁয়ে মাখলো না, সে একটুও কার্পন্য করলো না তার দেবদার জন্য গলা ফাটিয়ে কাঁদতে।

শেখ তৌসিফ আহমেদ বৌকে নিয়ন্ত্রণের আনার সম্পূর্ণ চেষ্টা করলো, টেনে হিচরে ঘরে ঢোকালো। দোলা শুধু বলেই যাচ্ছে,“আমাকে একটি বারের জন্য যেতে দিন! অল্প কিছু সময়!”

তৌসিফ শান্ত ভঙ্গিতে বলে,“না! তুমি আমার স্ত্রী!”

দোলাকে ধমকাতে লাগলেন তার ভাসুর, শ্বশুর। দোলা যেন সেসব কিছু গায়েই মাখলো না। সে ছুটে পা বাড়াতে চাইলো সামনে। পেছন থেকে বৈধ পুরুষ তার পথরোধ করলো। দোলা উন্মাদের মতো কেঁ’দে কেঁ’দে বলে,“অল্প কিছু সময়!”

_তুমি আমার স্ত্রী দোলা। ভুলে যেওনা।

_হ্যা জানি। জানি তো। বিশ্বাস করুন,আপনি রাতে সময়মতো আপনার স্ত্রীকে আপনার বিছানায় পাবেন। শুধু অল্প কিছু সময়ের জন্য যেতে দিন।

কি ভয়ংকর কথা বলে ফেললো বাড়ির বৌ শ্বশুর ভাসুরের সামনে। ছিঃছিৎকারে গুমোট হয়ে উঠলো পরিবেশ। মুখ ফিরিয়ে যে যার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো, তৌসিফকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো বৌয়ের রাশ টানতে। নইলে শেখ বাড়ির মান ধুলোয় মিশে যাবে।

দোলা নিজের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত, আর্তনাদ করেই যাচ্ছে,“দয়া করে যেতে দিন।”

_না। তুমি আমার স্ত্রী।

_দয়া চাইছি! এ জীবনে আর কখনও কিছু চাইবো না আপনার থেকে। শুধু এক ঘন্টা! আর কখনও আপনার বাড়ি থেকে বেরোবো না আমি, আমার সীমা হবে আপনার রান্নাঘর আর বিছানা।
হাতজোড় করে তৌসিফকে দোলা।।

তৌসিফ নির্বিকার ঘরের ভেতরে টেনে ঢোকানোর চেষ্টা করে দোলাকে।

দোলা ধা’ক্কা দিয়ে পা বাড়ায় সামনে। তৌসিফ শান্ত স্বরেই বলতে থাকে,“শোনো দোলা,আজ যদি এ বাড়ি থেকে আমার অনুমতি ব্যতীত তুমি বের হও তাহলে দুনিয়ার কাছে তুমি ভ্রষ্টাচারিনী হবে ‌।”

দোলা শুনলো,তবে পা থামালো না। হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি ভাঙে। ছুটতে থাকে সিংহদুয়ারের দিকে। তার দেবদা এলো না! সে যাবে। যাবেই!

তৌসিফ দোতলায় শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে,ফারিনের দিকে তাকিয়ে বলে,“ঘরের ভেতর যাও। আজ এখানে যাই হয়ে যাক না কেনো আমি না বলা পর্যন্ত ঘর থেকে বেরোবে না,কেউই।”

ফারিন চলে যায় দেবরের আদেশে। তৌসিফ পকেট থেকে ফোনটা বের করে গেট দাড়োয়ানকে কল দেয়, তারপর অত্যন্ত শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলে,“গেটে তালা দাও!”

চলমান…..

জনম জনমে পর্ব-০৮

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৮
#ইসরাত_ইতি

[কঠোরভাবে ১৮+ সতর্কতা]

“মৃত্যুর রাতটা” জারিফ নিদ্রাহীন কাটালেও দোলা ঘুমিয়েছে। ইউরার ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে গভীর ঘুমে ঢলে পরেছে। বেশ লম্বা ঘুম। তার ঘুম ভেঙেছে হৈ হুল্লোড়ের শব্দে। তখন সকাল নয়টার কাছাকাছি। শেখ বাড়িতে ঘরোয়া ভাবে গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে বর বৌয়ের। তারপর হবে তাদের বাসর।
ব্যাকইয়ার্ডে ভোরে কেটারিংয়ের লোক এসে বিশাল বড় প্যান্ডেল সাজিয়ে দিয়েছে। একপাশে বাবুর্চিরা রান্নার তোরজোর চালাচ্ছে। মোটামুটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান। স্বল্পসংখ্যক আত্মীয় স্বজন নিমন্ত্রিত। বিয়ের রিসিপশন হবে ধুমধাম করে,তিন দিন ব্যাপী।

দোলার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো চুপচাপ। ধুপধাপ আওয়াজে সে দরজার দিকে তাকায়। বুঝতে পারলো অনেকেই আসছে তার ঘরে।

দরজা ঠেলে হুরমুর করে ঢুকে পরলো বাড়ির মহিলারা। তারা এলো দোলাকে নিতে। নতুন বৌয়ের নাস্তা খাওয়া হলেই বর বৌকে একসাথে বসিয়ে হলুদ মেখে গোসল করানো হবে।

জাহিদা আনাম অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুদিনের ছুটি নিয়েছে। জাহিনও আজ স্কুলে গেলো না, চুপচাপ ঘরে বসে রইলো। কম্পিউটারে গেমসও খেললো না, মা ভাইয়ের ফোন নিতেও চাইলো না। ঘরটা মাতিয়ে রাখা জাহিন যেখানে চুপচাপ সেখানে পুরো ঘরটা নিস্তব্ধ থাকবে স্বাভাবিক। জারিফের কামরার নিস্তব্ধতা কাটে ফোনের রিংটোনের শব্দে। একবার, দুবার, তিনবার করে বারবার বেজে চলেছে ফোনটা। জারিফ উপুর হয়েই বিছানার সাথে লেপ্টে ছিলো। আরো এক দফা ফোন বেজে উঠলে তার নির্লিপ্ততায় ভাটা পরে। মাথা না তুলেই হাতরে ফোনটা হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,“হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।”

ওপাশ থেকে নারীকন্ঠ ভেসে আসে,“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি প্রত্যাশা ব্যংক থেকে বলছিলাম,আমি কি জারিফ হোসাইনের সাথে কথা বলছি? আপনাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে…”

_সরি রং নাম্বার।

ফোন কেটে দিয়ে জারিফ ফোনটাকে দূরে ছুড়ে মেরে হাতরে একটা বালিশ তুলে নিয়ে মাথাটাকে আবারও চাপা দিয়ে রাখে।

★★★

বিয়ে বাড়ি গমগম করছে। প্রত্যেকটা স্তন্যপায়ীর মনে সে কি আনন্দ! নাচানাচি, লম্ফঝম্প আরো কত কি! দোলাকে হলুদ শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হলো, দোলার স্বামীকে ইউরার ঘরে ডেকে আনা হলো, তাকে দোলাকে কোলে করে গাঁয়ে হলুদের স্টেজে নিতে হবে। দোলা তার স্বামীর কোলে চ’ড়ে স্টেজে পৌঁছালো। ভাবী শ্রেনীর মহিলারা নবদম্পতিকে হলুদ মাখিয়ে দিলো দু’গালে। কলসী ভর্তি করে পানি ঢালা হলো দু’জনের মাথার ওপর থেকে।

কুমারী মেয়েদের দল গানের তালে তালে কোমর দোলাচ্ছে। দোলার বাড়ি থেকে চাচা ফুপুর দল,দোলার ভাইবোনেরা এসেছে দোলার সুখ দেখতে। সবটা দেখে ওবাড়িতে ফিরে পাড়ায় দোলার শশুরবাড়ির গুনগান করতে হবে তো!
হলুদ ছোঁয়ার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে একদল মেয়ে এসে দোলাকে ইউরার ঘরে নিয়ে প্রস্তুত করাতে লাগলো। খয়েরী রঙের একটা চমৎকার বেনারসীর মোড়কে মোড়ানো হলো একটা কাঠের পুতুলকে। কি যে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো দোলাকে! সবাই অবচেতন মনেই নজর লাগিয়ে দিতে চাইলো নতুন বৌকে। চেহারায় কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া অবধি দিতে হলো না,তার আগেই ঐ সর্বনাশা রূপ সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। একটু কাজল লাগিয়ে দিলো শুধু টানা টানা ঐ পাথুরে চোখ দুটোতে।

ওদিকে দোলার জায়েরা ব্যস্ত বাসরের খাট সাজাতে। কাঁচা,তাজা ফুলের সুগন্ধে শেখ তৌসিফ আহমেদের ঘরটা আলোড়িত হয়ে গিয়েছে। বিছানায় একচিলতে যায়গা বাকি নেই যেখানে ফুলের পাপড়ি ছড়ানো হয়নি। বিছানার মাথার কাছটাও আনাড়ি হাতে প্রফেশনালদের মতো করে অর্কিড, রজনীগন্ধা,জারবেরা দিয়ে সুসজ্জিত করেছে ফারিন। আর বিছানার মাঝখানটায়, সেখানে তো গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লিখে দিয়েছে “তৌসিফ+দোলা”।

দোলার ঠোঁটে লিপস্টিক পড়ানো হলো না, এমনিতেই ঠোঁট দুটো লাল টুকটুকে। ভাবী শ্রেনীর মহিলারা মস্করা করে বললো,“লিপস্টিক পরানোর কি দরকার? তাদের দেবরের নেশা ধরে গেলে তখন যে ভারী বিপদ দোলার!”

দোলা শুনেও শুনলো না সেসব কথা। প্রতিবেশী দাদীরা মজার ছলে দোলাকে ফিসফিসিয়ে উপদেশ দিচ্ছে, শেখাচ্ছে বাসর রাতে স্ত্রীর কর্তব্য কি! এ রাতে স্বামীকে নারাজ করা যাবে না। শুধু এ রাতে কেনো? কোনো রাতেই স্বামীকে নারাজ করা যাবে না। দাদীরা দোলার কানের কাছে বলতে লাগলো,“ইস্তিরি হইতেছে স্বামীর জমি। স্বামী যেমন ভাবে ইচ্ছা সেই জমি চাষ করবে,ইস্তিরি বাঁধা দিলে হ্যারে ফেরেস্তা লানত দেয়। গজব পরে।”

দোলা শুনলো দাদীদের বানী চুপচাপ। আরো কিছুসময় তাকে শুনতে হলো তাকে আজ রাতে কি কি করতে হবে। কিভাবে স্বামীকে খুশি করতে হবে। দোলাকে সবকিছু শিখিয়ে পরিয়ে দিয়ে দাদী শাশুড়িরা ঘর ছাড়লেন। সবার মুখ চললেও হাঁটুতে বেশ ব্যথা। বেশি রাত জাগতে পারেন না তারা।

এদিকে দোলাকে সাজানো হলো,সাজানো বলতে চুল গুলো খোঁপা করে কিছু গোলাপ লাগিয়ে দেওয়া হলো, অতঃপর দোলার স্বামীর কেনা স্বর্নের গয়না গুলোতে দোলাকে মোড়ানো হলো। দোলা চকচক করছে সৌন্দর্যে। দোলার নিষ্প্রভ,মলিন মুখটা ঢাকা পরলো তার স্বামীর কেনা সাড়ে চার লাখের গয়নার নিচে।

সম্পর্কে জা ও ননদেরা দোলাকে নিয়ে বসিয়ে দিলো বাসরের খাটে। দোলার বড় বড় লাগেজ দুটো ঘরের কোণে এনে রাখা হলো। বেড সাইড টেবিলের ওপর একটা দুধের গ্লাস রেখে এক ভাবী দোলাকে বললো এটা স্বামীর হাতেই দিতে।
আর কিছু সময়, সামান্য কিছু সময় তারাও বিষাক্ত শ্বাস ফেলে দোলাকে দোলার কর্তব্য গুলো বুঝিয়ে দিয়ে ঘর ফাঁকা করলো। যাওয়ার আগে বালিশের নিচে জন্মনিরোধক ওষুধের পাতা রেখে যেতে ভুললো না।

দোলা চুপচাপ হাঁটু ভেঙে বসেই ছিলো, ঐ যে সিনেমায় নতুন বৌ যেভাবে বসে থাকে না? ঠিক সেভাবে। মেহেদী রাঙ্গা,দুই ভরি স্বর্ণের মোটা মোটা বালা পরিহিত হাত দুটো হাঁটুর উপরে রেখে। আড়চোখে একবার বিছানার মধ্যিখানে তাকাতেই দেখলো সেখানে লেখা জারিফ+দোলা। দোলা চ’ম’কে উঠলেও পুনরায় দু’চোখ বন্ধ করে ভালো করে তাকিয়ে দেখে লেখাটা “তৌসিফ+দোলা”।

বাইরে মেঘ ডাকতে শুরু করলো যেন হঠাৎ। আজ কি বৃষ্টি হবে? দোলা তবে আজ খুব বৃষ্টিতে ভিজবে। একটু পর স্বামী নামের একজন অধিকারে ঠাসা মানুষ যখন তার শরীরটা নিয়ে কিছুক্ষণ ছানাছানি করবে তারপর দোলা ছুটে যাবে ছাদে,মন ভরে ভিজিয়ে নিবে নিজেকে, বৃষ্টিতে।

দোলা অপেক্ষায়,স্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য পালনের। তার অপেক্ষা দীর্ঘ হয়না। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় সিটিকিনি লাগানোর শব্দ হয়।

★★★
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। জারিফ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিছানায় লেপ্টে থাকলেও দুপুরের পরে আর পারেনি। খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পরেছিলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে সেটা পুড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে ঘরে ঢুকেছে। জাহিদা আনাম ছেলের সকালের নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে তখনও বসে ছিলো। বাড়িতে এসেছে তার ছোট দুইবোন জেসমিন আর জবা।

দীর্ঘসময় ধরে গোসল করে জারিফ দোলার পছন্দের কালো রঙের শার্ট টা পরে নিয়েছিলো। এই শার্ট টা জারিফের ফরসা গায়ে বেশ মানায়। দোলা আড়চোখে বারে বারে তাকিয়ে দেখতো এটা গায়ে চাপালে। বাইকের চাবি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ম্লান হেসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দোলার পছন্দের পারফিউমটা গাঁয়ে মাখতে ভুললো না।

ঘরভর্তি জারিফের নানু বাড়ির লোক। অরিন নামের একুশে পা দেওয়া জারিফের খালাতো বোন,আড় চোখে জারিফকে বার কয়েক দেখেছে। সুদর্শন, সুদেহী জারিফকে দেখে বারবার তার হৃদস্পন্দন বাড়ে, তার ওপর সেদিন আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছে খালাদের মুখে,জারিফ আর তাকে নিয়ে পরিকল্পনা আছে জাহিদা আর তার ছোটো বোন জবার। সেদিন থেকে তার মনের মধ্যেও অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। তাইতো মা একবার বলাতেই চলে এসেছে খালার বাড়িতে।

ঘর থেকে বেরোনোর আগে জারিফ মাকে বলেনি কোথায় যাচ্ছে, এই যে এতো মেহমান বাড়িতে, তাদের কারো সাথেই কুশল বিনিময় করেনি। শুধু হন্তদন্ত হয়ে ঘর ছাড়ার আগে বললো,“রাত হবে ফিরতে।”

আঙিনায় বাইক স্টার্ট হবার আওয়াজ হতেই জাহিদার দু’চোখ ভরে উঠেছিলো।

জারিফ দুপুরের খাবার বিকেলে খেয়েছিলো,সে গিয়েছিলো বিশখালীর কোলঘেঁষা কুটুম বাড়ি রেস্তোরাঁয় খেতে। অর্ডার করেছিলো দোলার পছন্দের সব আইটেম, পছন্দের ডেজার্ট। ওয়েটার এসে জারিফকে যখন বললো,“আজ আপু এলো না যে?”

জারিফ মেন্যু কার্ড দেখতে দেখতে শান্ত স্বরে বলেছিলো,“আপু আর আসবে না। এখন থেকে আমি রোজ আসবো। দুইটার পরে এই কেবিনটা আমার জন্য ফাঁকা রাখবে।”

কুটুম বাড়ি থেকে বেরিয়ে জারিফ বিকেলটা স্টাফ কোয়ার্টার দিঘির পাড়ে কাটিয়েছে। বটগাছের মোটা শিকড়ের উপর বসে দিঘির জলে একের পর এক ঢিল ছুড়েছে । সেখান থেকে বেরিয়ে সার্কিট হাউস মাঠে মেলা দেখতে গিয়েছে। সেখানে বসেছে বিশাল এক মেলা। আগে হলে দোলাকে নিয়ে আসতো জারিফ। দোলা খুব উপভোগ করতো। আচ্ছা এই মেলা ক’দিন ব্যাপী? দোলার স্বামী যেন দোলাকে নিয়ে আসে এখানে, মেয়েটার মন ভালো হয়ে যাবে তবে।

রাত গভীর হয়েছে, আকাশে মেঘ ডাকছে হঠাৎ, মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে জারিফ মফস্বলের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছে। বাইকটাকে এক স্টুডেন্টের বাসার সামনে পার্ক করে রেখে হাঁটতে হাঁটতে সে ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে। গলি পুরো ফাঁকা। রাত যে খুব গভীর। দূরে শেফা ফার্মেসির সামনে কয়েকটা কুকুর দাঁড়িয়ে তাদের সাংসারিক আলাপ করছিলো। জারিফ তাদের তাড়িয়ে দেয়। ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের তিনতলার তিনশো চারের কাঁচের জানালা বন্ধ, জ্বলছে না আলো। জারিফ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

দু’দিন আগেও না মেয়েটা ওখানে ,ঐ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কানে ফোন চেপে ধরে বললো,“আর পাঁচ মিনিট থাকো।”
আজ সে কোথায়? স্বামীর ঘরে,স্বামীর বিছানায়। তাদের বাসর হয়ে গিয়েছে গতকাল। আজ নিশ্চয়ই স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।
একদিন খেই হারিয়ে দোলার গালে চুমু খেতে গিয়েছিলো জারিফ,মেয়েটা আ’তঙ্কে,রাগে দুঃখে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো।
চু’মুটা জারিফ খায়নি সেদিন, তারপর থেকে কখনই দোলার হাতটা অবধি ধরেনি। লিখিত অধিকারনামা তো ছিলো না। আজ তাকে কেউ অধিকার নিয়ে ছোবে, নিশ্চয়ই পাপ হবার ভয়ে কাঁদবে না মেয়েটা, সহাস্যে সায় দেবে স্বামীকে।

★★★

তৌসিফ ঘরের সিটকিনি তুলে দোলার দিকে ফিরে তাকায়। ঘোমটা মাথায় বসে আছে দোলা। ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়েও মাথা তুললো না। নতুন বৌয়ের লজ্জা,সংকোচ থাকা উচিত। তৌসিফ এতেও মুগ্ধ হলো। রাজধানীতে নির্লজ্জ মেয়ে দেখতে দেখতে চোখ পচে গিয়েছিলো। দোলা নামের মেয়েটি তার চক্ষু শীতল করেছিলো।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে গাঁয়ের পাঞ্জাবি পালটে একটা টি-শার্ট পরে বিছানায় দোলার কাছে এগিয়ে যায় তৌসিফ। দোলা তখনও মাথা নিচু করে বসে। তৌসিফ দোলার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে দোলার ঘোমটা টেনে সরিয়ে দেয় কিছুটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে দোলার মুখ,কাছ থেকে। দোলা চোখ নামিয়েই ছিলো। তৌসিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,“তখন বোজো তোমার ওপর ওভাবে চড়াও হয়েছিলো,ভয় পেয়েছিলে? আসলে আমাকে নিয়ে ও খুব জেলাস।”

দোলা নিশ্চুপ। তৌসিফ ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি নামিয়ে দোলার হাতে রাখে,পর পর দোলার ডান হাতটা টেনে একটা হীরের আংটি দোলার অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে বলে,“আমিও বোজোর মতোই জেলাস, তবে তোমাকে নিয়ে।”

দোলা একদৃষ্টে নিজের অনামিকা আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই আঙুলে একদিন তার বেকার প্রেমিক পাথরের আংটি পরিয়ে দিয়েছিলো মজা করে। গায়ে হলুদের সময় দোলার জা সেই আংটিটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো আঙুল থেকে। আচ্ছা এই আংটি টার দাম কত? লাখ টাকা তো হবেই। দোলার বাপের বাড়ির লোকজন দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে তাদের।

দোলার ঘোর কাটে তৌসিফের দ্বিতীয় পদক্ষেপে। দোলার ডান হাত টেনে সে হাতে একটা চেক তুলে দেয়। মোহরানার টাকা পরিশোধ করলো দোলার স্বামী। এর মানে ইশারা দিলো,তোমার প্রাপ্য তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম,এবার আমার প্রাপ্যও আমি বুঝে নিতে চাই।

দোলা চুপচাপ চেকটা বেডসাইডের টেবিলে রেখে দিলো,সাত লক্ষ টাকার ওজন সইতে পারছিলো না তার হাত।

তৌসিফ বাঁকা হেসে দোলার কাছে এগিয়ে যায়। খয়েরী বেনারসীর ঘোমটাটা পুরো সরিয়ে ফেলে দোলার থুতনিটা উঁচু করে তুলে ধরে দোলার মুখটাকে দেখে। দু’চোখ বন্ধ করে দোলা বেনারসী খামচে ধরে থাকে। কিয়ৎক্ষন যেতেই নিজের কপালে পুরুষালি উষ্ণ অধরের ছোঁয়া পেতেই দোলা শিউরে ওঠে, গুটিয়ে যায়। ঘনঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে। কোনমতে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,“আমি এখনই প্রস্তুত নই।”

তৌসিফ মৃদু হেসে ফেলে। দোলা অবাক হয়ে তাকায়, তার কাছে মনে হলো যেনো সে একটা মজার কথা বলেছে আর তাই তৌসিফ হাসছে। তৌসিফের হাসির রহস্য বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে সে তৌসিফের বুকে আবিষ্কার করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আঁতকে ওঠে দোলা, মানুষটা শান্ত তবে তার হাতের বাঁধন দৃঢ়। দোলার সাধ্য নেই নিজেকে দূরে সরানোর। তৌসিফ খুবই শান্তভাবে,এক হাতে দোলার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। দোলা আরেকবার বলে ওঠে,“প্রস্তুত নই আমি!”

তৌসিফ ঠোঁটে বক্র হাসির রেখা ফুটিয়ে দোলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,“কেউই থাকে না!”

দোলা আর কোনো কথা বাড়ায় না,বাড়ানোর প্রয়োজন বোধও করে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। বৈধ পুরুষ তার ঠোঁটের স্পর্শে দোলার কপাল,গাল,নাকের ডগা সিক্ত করে দিচ্ছে। দোলার খুব বিরক্ত লাগছে,তার এতো অযাচিত পরমস্পর্শ নিতে ইচ্ছে করছে না। তার চেঁ’চি’য়ে বলতে ইচ্ছে করছে,“আপনার যা প্রয়োজন আপনি নিয়ে নিন। আমার এসব অযাচিত আহ্লাদের স্পর্শ প্রয়োজন নেই।”
কিন্তু সে চেঁচিয়ে বলতে পারলো না,শুধু বুঝে গেলো তার চেঁ’চি’য়ে বলাতেই কিছু যাবে আসবে না।
বন্ধ দু’চোখ,কিছু শ্বাসরুদ্ধকর স্পর্শ, হঠাৎ মাথার নিচে বালিশ ঠেকে। বুক থেকে শাড়ীর আঁচল সরিয়ে নেওয়া হয়। গলার কাছে কারো অসামাল উৎপীড়ন। স্পর্শ গুলো অচেনা-অজানা, হয়তো এই স্পর্শ গুলোই নিত্যদিনের অভ্যাস হবে। এই ছোঁয়া গুলো এখন পীড়া দিচ্ছে, হয়তো সময়ের সাথে সাথে আনন্দও দেবে। মানিয়ে নেওয়া হবে,সন্তান সন্ততি হবে,আর তারপর? তারপর দোলার ভাবনা ফুরালো,নটে গাছটিও মুড়ালো।

শরীর থেকে শেষ ভূষণ-বসন অতি সন্তর্পণে খোলা হয়। হাস্যকর! এতো ভদ্রতা, সংবেদনশীলতা দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। নেই প্রয়োজন। পুরুষটার এই ভণ্ডামিতে দোলার খুব হাসি পেলো। তবে হাসার অবকাশ পেলো না, শরীরের ওপর একটা পেটানো শরীর তার অধিকার আদায়ে ব্যস্ত,তার মনোযোগ ভাঙা যাবে না,নারাজ করা যাবে না তাকে। দোলার পাপ হবে পাপ। ফেরেস্তারা লানত দেবে স্বামী মানুষটা নারাজ হলে।

স্ত্রীর কর্তব্য পালনের মুহূর্তে তীব্র যন্ত্রনায় ফুঁপিয়ে ওঠা দোলার চোখে হঠাৎ করে তার দেবদার মুখটা ভেসে উঠলো। নিজেকে নিজে দোলা ধিক্কার দিলো,“ছিঃ দোলা, ভ্রষ্টাচারী। দেবদা এখন পরপুরুষ।”

স্বামী নামের মানুষটা দোলার চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছে। দোলার প্রচন্ড বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে গেলো। এইসব কেনো? স্বামীর কাজ শুধু তার অধিকার আদায় করা। সে দোলার চোখের পানি মুছিয়ে দেবে কেন? দোলা হঠাৎ ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে মানুষটাকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু না,এতে দোলার পাপ হবে।

দু’চোখ বন্ধ করেই আকাশ কুসুম ভাবছে দোলা। আচ্ছা তার দেবদা এখন কি করছে? বা কি করবে? চন্দ্রমুখী! হ্যা একটা চন্দ্রমুখী যেন আসে তার দেবদার জীবনে। পার্মানেন্ট চন্দ্রমুখী। কখনও যেনো পারুর কথা মাথাতেই আনতে না দেয় দেবদার। কখনও যেন দেবদাকে ছুটে আসতে না হয় তার পারুর সিংহদুয়ারে।

ঘাড়ের কাছে বৈধ পুরুষের অস্থির নিঃশ্বাস। থেমে গিয়ে দোলাকে একটু বিশ্রাম দিচ্ছে নাকি? কাবিন কত টাকার ছিলো যেন? হ্যা সাত লাখ, সাত লাখ টাকা এতো তাড়াতাড়ি উসুল তো হবে না।
দোলার ধারণা সঠিক। সাত লাখ টাকা অত সহজে উসুল হয়ওনি রাতে। তবে দোলার খুব একটা কষ্ট হয়নি, দোলা তো নিজের কল্পনার জগতে বিচরণ করছিলো। একটা দোতলা বাড়ির ছাদ,পরন্ত বিকেল,তার গায়ে একটা সুতির লাল শাড়ি,জারিফের গায়ে একটা বাটিকের পাঞ্জাবি,দু কাপ চা। আরো কত কি। এসব কিছু চোখের সামনে ভাসছিলো তাই যন্ত্রনার ছিটেফোঁটাও অনুভব করেনি দোলার শরীর। শুধু মাঝে মাঝে বিরক্তি এসেছিলো যখন দোলার কপালে স্বামী বলে লোকটা ঠোঁট ছুঁইয়েছে, দরকার নেই দোলার এতো আদর কপালে। দরকার নেই।

★★★

রাতে বৃষ্টি নামলো না। দোলার ভীষণ মন খারাপই হলো। বড় সাধ করেছিলো আজ শরীর বিসর্জনের রাতে বৃষ্টিতে গা ভেজাবে বলে। দোলার কোনো সাধ পূরন হয়না,তাই এটাও হলো না। ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দোলা তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে, সারারাত দোলাকে আহ্লাদ করে বুকের সাথে লেপ্টে রেখে এখন ক্লান্ত হয়ে ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। দোলার ঠোঁটের কোণে কারণ ছাড়াই এক চিলতে হাসি। শরীরের ওপর থেকে যখন ঐ স্বামী নামের মানুষটা সরে গিয়েছিলো তখন দোলা চোখ খুলে একপলকের জন্য দেখেছিলো মানুষটার মুখে পরিপূর্ণতার হাসি,নিজেকে সার্থক পুরুষ হিসেবে দেখে। দোলা কুমারী,দোলার জীবনে সেই প্রথম পুরুষ এটা প্রমাণিত হওয়ায় লোকটা দোলাকে পুরষ্কার স্বরূপ কপালে আরো একটা চুমু দিয়েছিলো।

চাদরটা গায়ে লেপ্টে ধীরে ধীরে দোলা উঠে বসে, বৃষ্টি না হোক, শাওয়ার ছেড়ে দোলা এখন বৃষ্টি বিলাস করবে। খুলে ফেলা বেনারসী তুলে নিতে গিয়ে দেখে বেনারসীর একাংশ স্বামীর পিঠের নিচে চাপা পরেছে। দোলা শাড়িটা তোলে না। কোনোমতে চাদরে নিজের নগ্ন শরীর ঢেকে লাগেজ থেকে নতুন শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সময় গড়াতে থাকে, হঠাৎ করে দোলা না চাইতেও ফুঁপিয়ে ওঠে, তারপর বিকট আর্তনাদ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দেয়াল ঘেঁষেই মেঝেতে বসে থাকে। কান্নার আওয়াজ জোরালো থেকেও জোরালো হয়। দোলা নিজেকে নিজে থামাতে পারছে না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের গালে নিজেই চ’ড় থাপ্পড় মারছে পরপর।

ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা পরে। দোলার অনুভূতি থিতিয়ে যায়। শাওয়ার বন্ধ করে ভেজা কাপড় পাল্টে নতুন রঙিন শাড়িতে নিজেকে মুরিয়ে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলে দেয়।

তৌসিফ দোলার দিকে তাকিয়ে আছে। দোলা স্বামীর নজরে নজর না মিলিয়ে চুপচাপ হেটে বিছানায় গিয়ে বসে। তৌসিফ দোলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে হেটে তার পাশে গিয়ে বসে। এক হাতে দোলাকে আগলে নিয়ে অন্য হাতে দোলার থুতনি ধরে দোলার নাকে ডগায়,কপালে চুমু খেয়ে আহ্লাদী সুরে ফিসফিসিয়ে বলে,“ব্যাথা হচ্ছে জান?”

দোলা দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। লোকটা এতো কেনো কপালে চুমু খাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মেজাজ হারিয়ে লোকটার গলা টিপে ধরবে দোলা,তখন দাদীরা বলবে,“লানত লানত!”

তৌসিফ নিজের মতো তার বৌকে কিছুক্ষণ শুকনো আদর করে নিজের হাতে বৌকে পেইন কিলার খাইয়ে পানি খাইয়ে দেয়। তারপর দোলাকে শুইয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,“বিশ্রাম করো।”

দোলা স্বামীর বাধ্য বৌ,স্বামীকে রাতে নারাজ করেনি দোলা, তাই সে স্বামীর কথায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তার স্বামী একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে গিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দোলা দু’চোখ বন্ধ করে নেয়, আবারও জারিফের মুখটা ভেসে ওঠে। দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে অবিরত জল গড়াতে থাকে তার। দোলা তা রুখতে চায়না। ঝরুক। স্বামী যদি দেখে তবে তো বলবে,“ব্যাথা করছে জান? সেজন্য কাঁদছো?”
আর সে বলবে,“হ্যা। পেইনকিলার খেলেই কমে যাবে।”

★★★

রাতে বেশ দেরী করেই ফিরেছিলো জারিফ। এসে কোনো মতে শার্ট টা খুলে বিছানায় উপুড় হয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে আজ রাতে ভালোই ঘুম হয়েছে তার, এখনও ঘুমাচ্ছে।

অরিন এক কাপ চা নিয়ে জারিফের ঘরে ঢোকে। গতকালকের ন্যায় আজও জারিফ ঘরের দরজা খুলে রেখে ঘুমিয়ে ছিলো।

উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ফরসা, সুঠাম চওড়া পিঠ টা দেখে অরিন ঢোক গিলে নেয়। লজ্জাও লাগছিলো বেশ। সে হাতের চায়ের কাপটা জারিফের বেড সাইডের টেবিলের ওপর রেখে ঘুরে দাড়াতেই জারিফ পেছন থেকে বলে ওঠে,“এই দাড়া!”

অরিন কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। জারিফ উঠে নিজের উন্মুক্ত শরীর ঢাকতে কাঁধের ওপর একটা তোয়ালে রেখে দেয়। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে অরিনের সামনে এসে দাড়িয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে,“আমি ঘুমাচ্ছিলাম,তুই চা নিয়ে এলি কার জন্য?”

অরিন থতমত খেয়ে যায়। সে তো বাহানা দেখিয়ে ঢুকেছিল এই ঘরে,চা দিতে নয়। সে আমতা আমতা করে,“ভেবেছি তোমার ঘুম ভেঙেছে জারিফ।”

_ঐ তুই জারিফ কাকে বললি!
ধ’ম’কে ওঠে জারিফ। অরিন কেঁ’পে ওঠে।

জারিফ অরিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে অরিনের চুলের মুঠি ধরে। অরিন বিকট চিৎকার দিয়ে তার মা খালাদের ডাকতে থাকে। জারিফ চেঁ’চি’য়ে ওঠে অরিনের ওপর,“খুব চন্দ্রমুখী হওয়ার শখ জেগেছে? তুলে একটা আ’ছাড় মারবো।”

জাহিদা, জেসমিন,জবা ছুটে এসে জারিফের হাত থেকে অরিনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। জারিফ ছাড়ে না,ক্ষ্যাপা কন্ঠে চেঁ’চি’য়ে যাচ্ছে,“চন্দ্রমুখী হওয়ার শখ একেবারে ঘুচিয়ে দেবো।”

চলমান…..