Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 334



জনম জনমে পর্ব-০৭

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৭
#ইসরাত_ইতি

দোলা চোখ খুলে না তাকালেও দুহাতে গালে লেপ্টে থাকা নোনাজল মুছে নেয়। দরজা ভাঙার তোরজোর চলছে বাইরে। জারিফ উঠে ধীরপায়ে হেঁটে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে কুঠার,শাবল হাতে দবির আর দবিরের ছোটো ভগ্নিপতি দাঁড়িয়ে। দরজা খোলার সাথে সাথে দবির হাত থেকে কুঠার ফেলে দিয়ে জারিফের কলার চেপে ধরে। চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,“জানোয়ার!”

দবিরের ভগ্নপতি সোহেল তালুকদার ছুটে এসে দবিরকে সরিয়ে নিয়ে বলে,“আরে করছেন কি ভাইজান। চেচাবেন না, ছেলেপক্ষ শুনে ফেলবে। শান্ত হোন।”

তারপর সোহেল তালুকদার জারিফের হাত দু’টো ধরে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে,“বাবা দেখো,তোমার পায়ে ধরতে পারবো না আমরা। দয়া করে চলে যাও, মেয়েটার এতো বড় সর্বনাশ করো না। হাতজোড় করছি।”

দোলা নেত্রদ্বয় বুজিয়ে রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দুহাতে খামচে ধরে গাঁয়ের বেনারসী। জারিফ সোহেল তালুকদার আর দবির রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে,“ওর বিয়ে হয়ে গেলে চলে যাবো। আমি এখানে বসি।”

ভীষণ অবাক দবির রহমান আর সোহেল তালুকদার। জারিফ ঘরের কোণে একটা কাঠের চেয়ারে বসে পরে, চুপচাপ তাকিয়ে আছে দোলার দিকে। দোলা তখনও চোখ বুজে আছে।

দবির আমতা আমতা করতে থাকে, উচ্চবাচ্য কিছু করতেও পারছে না। তার হাত পা কাঁপছে,সে শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছে। তীরে এসে তরী যেনো না ডোবে!

জারিফ নির্বিকার,নিষ্প্রভ। কিয়ৎক্ষন তার পারুর মুখের দিকে তাকিয়ে দবিরকে বলে,“কাজী নিয়ে আসুন ফুপা।”

দোলাদের বসার ঘরটা বেশ ছোটোখাটো,একসেট ঘুনে ধরা কাঠের সোফা,একটা আলমারি,একটা ছত্রিশ ইঞ্চির বোকা বাক্স আর রয়েছে দুটো ফুলদানি তাতে রয়েছে প্লাস্টিকের ফুল। তবুও পরিচ্ছন্ন এবং গোছালো দেখতে ঘরটা। বসার ঘরে ছেলেপক্ষ থেকে আসা মুরব্বিরা বসে আছে। শেখ বাড়ি থেকে পুরুষরাই এসেছে,কোনো মহিলা আসেনি। তৌসিফের বাবা তৌফিকুল আহমেদ,বড় ভাই তৌকির আহমেদ,মেজো ভাই তন্ময় আহমেদ,তৌসিফের ছোটো দুইবোনের স্বামীরা, তৌসিফের দু’জন চাচা, একজন মামা আর কাজী সাহেব বসে আছে বসার ঘরে। তাদের শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। তৌসিফকে নিয়ে দোলার ছোটো দুইবোন এবং চাচাতো, ফুপাতো ভাইবোনেরা বসার ঘর সংলগ্ন একটা ছোট কামরায় বসেছে। শেখ তৌসিফ আহমেদ গাঁয়ে চাপিয়েছে একটা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি। শ্যালক শ্যালিকাদের সাথে টুকটাক গল্প করছে সে। দোলার ভাইবোনেরা নতুন জামাইয়ের চেহারা এবং ব্যবহার দেখে মুগ্ধ। ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির চাচী ভাবীরা উকি দিয়ে নতুন জামাইকে দেখতে ব্যস্ত।

বাড়িতে ঢুকেই দোলার মুমুর্ষ দাদীর কাছে তার নাতনি জামাইকে নিয়ে সাক্ষাৎ করিয়ে আনা হয়েছে, কাজী এখন কাগজ পত্র গোছাতে ব্যস্ত। একটু পরেই বিয়ে পড়ানো হবে। বরপক্ষের সবাই মিলে ঠিক করেছে বিয়ে পরিয়ে রাতের বেলাতেই বৌ নিয়ে শেখ বাড়ি ফিরতে চায় তারা। বাকি যা অনুষ্ঠান হবে ও বাড়ি থেকেই হবে। এ যেনো দবিরের কাছে একটা খুশির খবর! কিছুটা খরচও বাঁচিয়ে দিয়েছে তার। নাহ! পাত্র একটা পেয়েছে বটে মেরুদন্ডহীন দবির রহমান!

দোলাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নিঃশ্বাস অবধি নিচ্ছে না,পাথরের মূর্তির মতো দু’চোখ বন্ধ করে বসে আছে। জারিফ শুধু তার দুলিকেই দেখছে। খানিকবাদে দোলার ছোটো ফুপু হুরমুর করে ঘরে ঢুকে একবার আতঙ্কিত মুখ নিয়ে জারিফের দিকে তাকিয়ে দোলার কাছে যায়। দোলার পাশে, বিছানার ওপরে রাখা লাল-সোনালী দোপাট্টা উঠিয়ে দোলার মাথা ঢেকে দেয়। তখনই দোলার ঘরে কাজীকে নিয়ে প্রবেশ করে দবির রহমান,খসরু মাহমুদ এবং সোহেল তালুকদার। তন্ময় আহমেদ আর তানিয়া শেখের স্বামী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আড়াল হয়ে।

কাজী আড়চোখে জারিফের দিকে তাকায়। সোহেল তালুকদার কাজীকে একটা কাঠের চেয়ার টেনে দিয়ে বলে,“দোলার মামাতো ভাই!”

কাজী বিয়ে পড়াতে শুরু করে। দোলা ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে নিজের ভেতর খানিক প্রানের সঞ্চার করার চেষ্টা করছে, কবুল বলতে দম লাগবে তো!

“পাত্র বরগুনা পৌরসভার খারাকান্দা রোড নিবাসী মোহাম্মদ তৌফিকুল আহমেদের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ তৌসিফ আহমেদ তোমাকে নগদ সাত লক্ষ টাকা মোহরানা প্রদান করিয়া বিবাহ করিতে চায়, তোমার যদি এই বিয়েতে সম্মতি থাকে তাহলে কবুল বলো।”

সাত লক্ষ টাকা মোহরানার কথা শুনে দোলার শ্রদ্ধেয় বাপ চাচাদের মুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, এ তল্লাটে সর্বোচ্চ তিন লক্ষ টাকার উপরে কোনো মেয়েকে মোহরানা দেওয়া হয়নি। তাদের দোলার কপালই বটে।

দোলা নীরব। জারিফের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা, হঠাৎ তার মনে আশা জাগলো তার আশারা জিতে গেলো। কিন্তু না, অত্যল্পকাল পরেই কাজী কোনো শব্দ বলার আগেই দোলা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,“কবুল!”

জারিফ তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টে। তার চোখের পাতাও নড়ছে না। এতক্ষণ টানটান হয় চেয়ারে ঠেসে বসে থাকা সুঠাম দেহটা ছেড়ে দেয়,কিছুটা এলিয়ে পরে পেছনে, তবুও সে তাকিয়ে আছে,তার দুলির দিকে, একদৃষ্টে।

কাজী বলতে থাকে,“আবারও বলো মা।”

দোলা বন্ধ দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে তার সমস্ত অনুভূতিদের পালাতে দিয়ে বল,“কবুল। কবুল। কবুল।”

দবির রহমানের ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি। কাজী বলে ওঠে,“আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা সবাই শুনেছেন তো?”

দরজার বাইরে থেকে শেখ তৌসিফ আহমেদের মেজো ভাই এবং ভগ্নিপতি বলে ওঠে,“জি আমরা শুনতে পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।”

এবার বরের কবুল বলার পালা। কাজীকে নিয়ে সবাই বসার ঘরে যায়। দবির তার ছোটোবোনের দিকে তাকিয়ে বলে,“শিগগির খাওয়ার বন্দোবস্ত কর, উনুন ঘরে গিয়ে তাড়া দে সবাইকে যা।”

শাহিদা চলে যায়। বাইরে থেকে বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসছে। তাদের ধ’ম’কে চুপ করিয়ে দেয় খসরু মাহমুদ। কাজী পাত্রের কাছে গিয়ে বিয়ে পড়াতে থাকে।

শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। কাজী নব দম্পতির জন্য দোয়াপাঠ করতে থাকে। বসার ঘর থেকে ভেসে আসা গুনগুন আওয়াজ জারিফের মস্তিস্কে তীর ছুঁড়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে,অথচ জারিফ নির্বিকার। কিছুক্ষণ নিজের সামনে, বিছানায় গুটিসুটি মেরে, চোখ খিচে বন্ধ করে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে বিছানার দিকে এসে বিছানায় বসে। দোলার নাকে জারিফের পারফিউমের সুগন্ধ এসে লাগতেই দোলার বুক ফেটে কান্না আসে। বিছানার চাদর খামচে ধরে সে বসে থাকে। জারিফ নরম গলায় বলে,“দুলি।”

দোলা নিশ্চুপ। জারিফ ম্লান হেসে বলে,“শেখ তৌসিফ আহমেদের বৌ!”

দোলা আরো,আরো শক্ত করে খামচে ধরে বিছানার চাদর। জারিফ বলতে থাকে,“চোখ খুলবি না?”

দোলা ঘনঘন ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেয় সে চোখ খুলবে না। জারিফ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে,“শেষমেশ আমাকে দেবদাস বানিয়েই ছাড়লি!”

দোলা ভাঙে না তার নীরবতা,মানুষটাকে যে এসব বলতে নিষেধ করবে সেটুকুও পারছে না, সে কি করবে? কান চেপে ধরবে এখন?

জারিফ মৃদু হেসে বলে,“দেবদা তো তার পারুর কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিলো। তোকে কি করবো বল। নিষ্কলঙ্ক ছেড়ে দেবো?”

দোলা টলছে। শরীরটা হঠাৎ এলিয়ে পরতে চাইছে বিছানায়। জারিফ দোলার থুতনি ধরে বলে,“এই বদনে আঘাত আমি করতে পারবো না। তুই ভালো থাক। তোর প্রতি আমার রাগ নেই। না মায়ের প্রতি রাগ আছে। হুট করে রাগটা পরে গেলো তোদের উপর থেকে।”

“চলে যাও।”
ক্ষীণ স্বরে দোলা বলে ওঠে।

জারিফ বলে,“তা কেনো? ফুপাতো বোনের বিয়ে হলো। বোনকে বিদায় না দিয়ে কোথায় যাবো!”

দোলা ফুঁপিয়ে ওঠে,তবুও সে তাকাতে পারলো না জারিফের দিকে। বরপক্ষের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে। এবার মেয়ে বিদায়ের পালা। নিয়মানুসারে শুরু হয়েছে নতুন বৌয়ের মাতৃশ্রেনীর মহিলাদের মরা কান্না, কেউ কাঁদছে নিচু স্বরে,কেউ উঁচু স্বরে,কেউ ভান করে,কেউ জোর করে। না কাঁদলে কেমন দেখায় না? তাই কাঁদছে সবাই।

কাঁদছে না শুধু দোলা। তার ছোটো ফুপু এসে এর মাঝে দু’টো মোটা মোটা স্বর্নের বালা পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে দোলার হাতে। এক ঝাক মহিলারা দোলার গায়ে থাকা স্বর্নালংকারের পরিমাণ এবং মূল্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করছে।

জারিফ এসে পুনরায় কাঠের চেয়ারটিতে ঠেসে বসে আছে। তার অধর কোণে উপহাসের হাসি, নিজের প্রতি।

দোলার ছোটো মা কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যাওয়ার ভান ধরলো, তাকে সামলাতে ব্যস্ত প্রতিবেশী চাচিরা।

বড় ফুপি দোলাকে ধ’ম’ক দিয়ে বললো,“কিরে তুই চোখ খুলছিস না কেন? গাড়িতে উঠবি কিভাবে? তোর শশুর বাড়ীর লোক যে অপেক্ষা করছে।”

_ওর চোখ খুলতে হবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি ফুপু।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বলে জারিফ। ঘরের ভেতরে থাকা প্রত্যেকে চ’ম’কে ওঠে জারিফের কথায়। দবির রহমান এবং তার ভাইয়েরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। কিন্তু তাদের হাত পা বাঁধা, উচ্চবাচ্য করলে যদি দোলার শশুর বাড়ীর লোক জেনে যায়? তবে তারা চোখ কান খোলা রাখছে যাতে জারিফ কোনো অঘটন ঘটাতে না পারে।

জারিফ কোনো অঘটন ঘটায় না। শান্ত ভাবে দোলার হাত ধরে টানতে টানতে এনে উঠানে দাড় করায়। বাড়ির সবাই ছুটতে ছুটতে আসছে তাদের পেছন পেছন।

নতুন বৌয়ের হাত অন্য পুরুষের মুঠোবন্দী দেখে শেখ তৌসিফ আহমেদের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। দবির রহমান নতুন জামাইয়ের নারাজ মুখ দেখে চোরের মতো ভাব করছিলো, সোহেল তালুকদার ইনিয়ে বিনিয়ে বরপক্ষকে বলে,“ও দোলার মামাতো ভাই।”

শেখ বাড়ির মুরব্বিরা সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। জানিয়ে দিয়ে যায় আপাতত বৌকে নিয়ে বাড়িতে ফিরবেন তারা। পরবর্তী অনুষ্ঠানের সময়সূচি নিয়ে বৈঠক হবে আগামীকাল।
দোলার লাগেজ ডিকিতে তোলা হচ্ছে। দোলার ফুপুরা এগিয়ে আসে দোলাকে বিদায়ী আলিঙ্গন করবে বলে , জারিফ তাদের কোন সুযোগ না দিয়ে দোলাকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। তৌসিফ একবার সে দৃশ্য দেখে মাথা ঘুরিয়ে দোলার বাড়ির প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকায়। সবার আতঙ্কিত মুখভঙ্গি তার দৃষ্টি গোচর হয়না। কিন্তু পরপর গিয়ে সে গাড়িতে দোলার পাশে বসে।

আঙিনায় দাঁড়িয়ে সবাই কনে বিদায়ের অপেক্ষায়। শেখ বাড়ির দু’টো গাড়ি চলতে শুরু করলে জারিফ ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে। শেখ বাড়ির গাড়ি দুটো দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতেই বিয়ে বাড়ির সবাই হাঁফ ছাড়ল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো জারিফকে, জারিফের এপাচি আরটিআর চলতে শুরু করে বিপরীত রাস্তা ধরে।

★★★

গাড়ি চলতে শুরু করার সাথে সাথেই দোলা দু’চোখ মেলে তাকায়। মাথার দোপাট্টাটা নাক অবধি টানা তার। হাত দিয়ে সেটা টেনে নিজের মুখটাকে খানিকটা উন্মুক্ত করে ঘনঘন নিশ্বাস নেয়।
তার পাশে বসা মানুষটার গা থেকে ভিন্ন পারফিউমের সুগন্ধ তার নাকে গিয়ে লাগছে। কিন্তু এই গন্ধটা দোলার নিঃশ্বাস আটকে দিতে চাইছে যেন। সে হাঁসফাঁস করছে। তৌসিফ আড়চোখে দোলাকে একপলক দেখে গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয়। বাইরে থেকে শীতল বাতাস এসে চেষ্টা করে দোলাকে স্বস্তি দিতে,কিন্তু বিপরীতে দোলার বিরক্ত লাগছে।
তাদের গাড়িতে দোলা আর তৌসিফ ব্যাতীত বসে রয়েছে শেখ তৌকির আহমেদ এবং তানিয়া,তারানার স্বামী সুমন এবং সাঈদ। সুমন বারবার ফোন তুলে তানিয়াকে জানাচ্ছে শেখ বাড়ি পৌঁছাতে তাদের আর কত সময় লাগবে।

তৌসিফ আড়চোখে দোলার দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের ফোনে মনোযোগ দেয়। বন্ধু বান্ধবরা সবাই নতুন ভাবীর ছবি দেখবে বলে একের পর এক বার্তা পাঠাচ্ছে। তৌসিফের চোখ মুখ কঠিন হয়ে যায় ঐ বার্তা গুলো দেখে। তার বৌয়ের ছবি অন্যকে কেনো দেখাবে? সে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বন্ধুদেরকে ছোটো করে লিখে পাঠায়,“ছবি দেয়া যাবে না।”

ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে আনমনে ডান হাতটা পাশে রাখতেই দোলার হাতে স্পর্শ লাগে। দোলা তড়িৎবেগে নিজের হাত সরিয়ে গুটিয়ে যায়।
তৌসিফের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে মাথা ঘুরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখে।

শেখ তৌকির আহমেদ নীরবতা ভেঙে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে,“দোলা এখন থেকে ইউরাকে তিনবেলা পড়াতে হবে যে!”

সাঈদ আর সুমন হোহো করে হেসে ওঠে। সাঈদ বলে ওঠে,“বেচারী দোলা ভাবী। কি বাজে ভাবে ফেঁসে গিয়েছে!”

দোলা নির্বিকার। সাঈদের কথায় তৌসিফের ঠোঁটে বক্রহাসি ফুটেছে। সে মনে মনে আওড়ায়,“আসলেই ফেঁসে গিয়েছে!”

★★★

আঙিনায় বাইক এসে থেমেছে। জাহিদা বেগম ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে টলছিলেন, বাইকের আওয়াজে মাথা তুলে তাকায়। পর পর কলাপসিবল গেট খোলা এবং বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হয়। জাহিদা ছুটে গিয়ে সদর দরজা খুলে দাড়িয়ে থাকে । জারিফ খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাইকটাকে সিড়ির কাছে দাড় করিয়ে রেখে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকে।

ত্রস্ত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকে জারিফ ফ্রেশ হয়ে নেয়। একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজারে নিজের শরীর গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে বলে,“রেধেছো কি মা?”

জাহিদা আনাম একদৃষ্টে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জারিফ প্লেটে ভাত তুলে নিতে নিতে বলে,“বলো রেধেছো কি?”

_করলা ভাজি, ডাল আর ইলিশ মাছ ভুনা।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় জাহিদা।

জারিফ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,“রাতে করলা ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে না। মাছটাও না। একটা ডিমে ভেজে দাও।”

জাহিদা ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চুপচাপ গিয়ে একটা ডিম ভেজে নিয়ে এসে ছেলের পাতে তুলে দেয়। জারিফ বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। জাহিদা দেখছে ছেলেকে।

খাওয়া শেষ করে বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে মাকে বলে,“শুয়ে পরো মা ‌। আর হ্যা আমার ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘুমাবো কেমন? যাতে তোমার ভয় না হয় তোমার ছেলে সুই’সাই’ড করলো কিনা।”

হেঁটে হেঁটে ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দরজার কপাট একেবারে দেয়ালের সাথে ভিরিয়ে দিয়ে বলে,“এই যে মা। খোলা থাকলো। তুমি ঘুমাও।”

মায়ের দিকে হাসি হাসি মুখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জারিফ বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে।

জাহিদা ডাইনিং রুমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ছেলের ঘরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে।

★★★

নব বর বৌয়ের গাড়ি শেখ বাড়ির গেটে এসে পৌঁছাতেই শেখবাড়ির সব লোক হুরমুর করে গেটে এসে দাঁড়ায়। রাত তখন বারোটা প্রায়। তৌসিফ গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দোলার পাশের দরজাটা খুলে দেয়। দোলা চুপচাপ নেমে পরে। মুরুব্বিরা সবাই বর বৌকে রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে, তারানা তৌসিফ আর দোলাকে দেখে বলে ওঠে,“আরে আরে ভাবী। তুমি হনহন করে ঢুকছো কেন বাড়িতে? তুমি ইউরাকে পড়াতে আসোনি। এসেছো এ বাড়ির বৌ হয়ে। একটু স্বাগতম জানাতে দেবে না আমাদের?”

ফারিন হেসে তৌসিফকে বলে,“বৌকে কোলে নিয়ে দাদীর ঘরে নিয়ে যাও। দু’জনে দোয়া নেবে ওনার থেকে। রাত অনেক হয়েছে। আজ দোলা ইউরার ঘরে থাকবে। কাল গাঁয়ে হলুদ দেবো দু’জনের, তারপর বৌকে তার নিজের ঘরে পাঠাবো, ঠিকাছে?”

তৌসিফ নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে ছিলো। তানিয়া তারানা তাড়া দিলে সে দোলার দিকে এগিয়ে যায়। তুলে নেয় দোলাকে পাঁজাকোলা করে। দোলা দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিঃশ্বাস অবধি নিতে ইচ্ছে করলো না তার যেন। মিনিট তিনেক যেতে সে টের পায় তাকে কোথাও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। চোখ খুলে দেখে সে গুলবাহার বেগমের ঘরে। তার পাশে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে তার স্বামী নামের মানুষটা।

★★★

জাহিদা আনাম ডাইনিং রুমের মেঝেতে চুপচাপ বসে আছে। তাকিয়ে আছে জারিফের ঘরের খোলা দরজার দিকে।

জারিফ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে। দু ঘন্টা চেষ্টা করেও ব্যর্থ সে। ঘুম আসছে না তার চোখে, অথচ ঘুমটা তার খুব খুব খুব দরকার নয়তো অঘটন ঘটে যাবে আজ, লজ্জায় মাথা কাটা যাবে জারিফের, একজন পুরুষ হয়ে এই লজ্জায় সে পরতে চায়না, একেবারেই না।
চোখে ঘুম না আসলেও তার গলায় কিছু একটা এসেছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। পেশীবহুল দুহাতে নিজের গলা নিজে চেপে ধরে গলায় আটকে থাকা জিনিসটাকে পিষে ফেলতে চায়। কিন্তু পারলো না, ঐ জিনিসটা বেশ আটঘাট বেঁধে এসেছে। জারিফ দ্রুত উপুড় হয়ে বালিশের নিচে মাথা ঢুকিয়ে নেয়। হাতরে আরো একটা বালিশ উঠিয়ে দু’টো বালিশ দিয়ে নিজের মাথাটা চেপে রেখে বিকট চিৎকার করে ওঠে। পুরুষ হয়ে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো কাজটা জারিফ করেই ফেলে শেষমেশ।

জাহিদা আনাম কেঁপে ওঠে সেই চিৎকারে। রাতের নিস্তব্ধতায় ভয়ংকর শোনায় চিৎকারের শব্দ। সে উঠে দাড়িয়ে ছুটে যায় ছেলের ঘরের দিকে,দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পরে।

জারিফ প্রানপন চেষ্টা করছে তার কান্নার আওয়াজ চাপা দিতে। বালিশ দু’টো দিয়ে নিজের মাথাটাকে চেপে রেখেছে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে। তবুও সে ব্যর্থ।

গোঙানির আওয়াজে জাহিনের ঘুম ভেঙে যায়, কি ভয়ংকর লাগছে শব্দটা। জাহিনের বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে শব্দটা শুনে। তার কাছে মনে হচ্ছে কাউকে মেরে ফেলা হচ্ছে। জাহিন ঘুম ঘুম চোখে,মস্তিষ্কে তখনও টের পায়নি আজ কাউকে আসলেই মেরে ফেলা হয়েছে!

চলমান……

জনম জনমে পর্ব-০৬

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৬
#ইসরাত_ইতি

দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই জাহিদা আনামের নজর চলে যায় জারিফের দিকে। জারিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে,ছেলের চোখের দৃষ্টি দেখে তার অনুভূতি পড়তে পারছেনা জাহিদা।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় সে। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ছোটোবোনের বাড়িতে গিয়েছিলো,সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত বেজেছে আটটা। কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগটা নামিয়ে হাতে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই জারিফ বলে ওঠে,“দোলাকে অপমান করলে!”

জাহিদা আনাম দাঁড়িয়ে পরে। মাথা ঘুরিয়ে ছেলের দিকে, ছেলের চোখের দিকে দৃষ্টি রাখে। জারিফের দৃষ্টি শান্ত। শান্ত,নিচু কিন্তু দৃঢ় কন্ঠস্বর, পুনরায় জিজ্ঞেস করে,“অপমান করে কি শান্তি পেলে? কতটা?”

জাহিদা আনাম শুকনো হাসি হাসে,বলে,“নালিশ করাটাও খুব ভালোই জানে দেখছি মায়ের মতো।”

জারিফ দাঁতে দাঁত চেপে ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে একটা গ্লাস উঠিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। জাহিদা নির্বিকার। জারিফ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,“ও নালিশ করেনি,ওর বান্ধবীদের থেকে জেনেছি। বলো কি শান্তি পেলে!”

_অপমান করিনি। শুধু বলেছি ওর গাঁয়ে আমার ছেলের দেওয়া বেনারসী উঠলে কিছু টাকা যেন বাঁচিয়ে রাখে আমার কাফনের কাপড় কেনার জন্য।
খুবই শান্ত জাহিদার কন্ঠস্বর।

জারিফ আহত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাহিদা জারিফের সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

★★★

আফ্রা আর তৃপ্তি ছুটতে ছুটতে এসে দোলার কামরার জানালা দিয়ে উকি দেয় ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে। জারিফের কানে ফোন,অত উঁচু থেকেও তৃপ্তির নজরে আসে জারিফের বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি। সে তাকিয়ে আছে দোলার কামরার জানালার দিকে। হঠাৎ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,“ওকে আনো। টেনে ওঠাও বিছানা থেকে। আমি ওকে দেখতে চাই।”

তৃপ্তির হাতে ফোন। কলটা লাউড স্পিকারে দেয়া। আফ্রা আর তৃপ্তি বিচলিত হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। আফ্রা আমতা আমতা করে বলে,“ভাইয়া এভাবে চেচাবেন না। ও অসুস্থ। আসতে পারবে না। আপনি যান। টহল পুলিশ আসলে ঝামেলায় পড়বেন ভাইয়া।”

_আই সেইড আই ওয়ান্ট টু সি হার।
ক্ষিপ্ত কন্ঠে জবাব দেয় জারিফ। দোলার কর্নকুহরে তা পৌঁছেছে। তবে সে নির্লিপ্ত হয়ে শুয়ে আছে।

আফ্রা জারিফকে বলে,“ভাইয়া। বোঝার চেষ্টা করুন। ইনহেলারে কাজ হয়নি। পরে প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়ে ফার্মেসী থেকে হাই ডোজের ট্যাবলেট টা এনে খাইয়েছি। শান্ত হোন আপনি।”

জারিফ এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে মানুষ জন তাকেই দেখছে। রাত খুব বেশি গভীর নয়,পশ্চিমে টংয়ের দোকানে পরিচিত কিছু ছোটো ভাই চায়ের কাপ হাতে তার দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে,য়যাদের জারিফ উঠতে বসতে মেয়েদেরকে বিরক্ত না করার জ্ঞান দেয়। তাকে এভাবে রাত বিরেতে ছাত্রী হোস্টেলের পেছনে দাঁড়িয়ে উগ্রদের মতো চেঁচাতে দেখে তারা বেশ অবাকই হচ্ছে।

জারিফ নিজের কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে আফ্রাকে বলে,“শোনো আফ্রা! ওকে সকাল নয়টায় হোস্টেল থেকে বের করবে। যেভাবে হোক। মাইন্ড ইট।”

আফ্রা আর তৃপ্তি অবাক হয়ে বলে,“কেনো ভাইয়া?”

_ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আরো কাজ আছে। তুমি আর তৃপ্তি তৈরি থেকো।

ফোন কাটে, আওয়াজ তুলে এপাচি আরটিআর চলে যায় ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলি থেকে। আফ্রা আর তৃপ্তি জানালা বন্ধ করে ঘুরে দোলার দিকে তাকায়। আধো অন্ধকারে দোলা সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে, ওরা দুজন ওর কাছে এগিয়ে যায়। তৃপ্তি আফ্রাকে বলে,“তুই আজ রাতটা ওর কাছে থাক।”

_নাহ।
ক্ষীণ স্বরে বলে দোলা। তৃপ্তি কিছু বলার আগেই পুনরায় বলে ওঠে,“তোরা আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে চলে যা।”

★★★

অভিভাবক মিটিং রুমে হোস্টেলের ওয়ার্ডেন খালেকুজ্জামান স্যার ও রোজি ম্যাম দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথে দোলার ছোটো ফুপু আর বড় চাচা বেশ রসিয়ে কষিয়ে আলাপ জুড়ে দিয়েছে দোলার বিয়ের ব্যাপারে। পাত্রের নাম বলতে গিয়ে যেনো তাদের বুকের ছাতি ফুলে উঠছে গর্বে,অহংকারে। হোস্টেলের মেয়েরা সবাই অবাক হয়েছে দোলার বিয়ের কথা শুনে, বিশেষ করে পাত্রের নাম যখন শুনেছে শেখ তৌসিফ আহমেদ। খুব একটা দোলাকে লক্ষ্য না করা মেয়েটিও আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে দোলাকে। রূপ ব্যতীত দোলার মতো সাদামাটা মেয়ের আর কি যোগ্যতা আছে শেখ বাড়ির বৌ হওয়ার সেটাই ভাবাচ্ছে তাদের। তিনশো পনেরো নাম্বার কামরায় থাকে প্রথম বর্ষের নীড়া, সে রীতিমতো হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে কারন তার ফুপাতো বোন,যে মেডিকেলের স্টুডেন্ট,তার প্রস্তাব নাকচ হয়েছিলো শেখ বাড়ি থেকে। তার কাজিনের থেকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন একটা মেয়ে কিভাবে ঐ বাড়ির বৌ হচ্ছে সেটা সে বুঝে উঠছে না!

দবির রহমান মুখ হাসি হাসি করে সবার সাথে কথা বলছে, মুখে সবাইকে দাওয়াত জানিয়েছে দোলার বিয়ের, সবাইকে আশ্বাস দিয়েছে আগামী কাল পরশু কার্ডও পেয়ে যাবে সবাই। বিয়েটা তার বাড়িতে হলেও বিয়ের রিসিপশন হবে বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সে।

তৃপ্তি আর আফ্রা দোলাকে ধরে ধরে নিচ তলায় অভিভাবক মিটিং রুমে নিয়ে যায়। দোলার গোছানো ব্যাগ দুটো নিয়ে আরো দুজন মেয়ে সেই রুমে ঢোকে। দোলার ফুপু শাহিদা বিরক্ত হওয়ার ভান করে অহংকার মিশিয়ে বলে,“আরে এতো ব্যাগপত্র নিতে হবে না। ওখানে,ও বাড়িতে দোলার জন্য ইতিমধ্যে রাজ্যের পয়নামা (উপহার সামগ্রী) পাঠিয়ে দিয়েছে শেখ বাড়ি থেকে।”

দোলা নির্বিকার। তৃপ্তি বিরক্ত হয়ে যায় দোলার ফুপির অতিরঞ্জিত কথায়,সে বলে,“ব্যাগ গুলো তো নিতেই হবে ফুপু। এগুলো এখানে রেখে কি হবে!”

দবির রহমান দোলাকে স্যার আর ম্যামের থেকে দোয়া চাইতে বলে। দোলা নিশ্চুপ, চোখ তুলে তাকায়ও না অবধি।

দোলার স্যার আর ম্যাম দোলাকে আন্তরিকতার সাথে দোয়া করে দেয়, তাদের খুব পছন্দের এবং প্রিয় ছাত্রী ছিলো ফোর্থ ইয়ারের দোলা রহমান। সবশেষে তারা বিয়ে হলেও কখনও পড়াশোনা না ছাড়ার উপদেশ দিয়ে দোলাকে বিদায় জানান।

ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দোলা তার ফুপু এবং চাচার সাথে। দবির রহমান একটু সামনে গিয়েছেন একটা অটো রিকশা ঠিক করতে। পরিচিত সিনিয়র এবং জুনিয়র বোনেরা দোলাকে বিদায় জানিয়ে গেট থেকে ফিরে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে আছে শুধু তৃপ্তি আর আফ্রা। দু’জনে শুকনো মুখে দেখছে তাদের বান্ধবীকে। কিছু সময় পরে দোলাকে টেনে কিছুটা পেছনে নিয়ে তৃপ্তি অনুরোধের সুরে ফিসফিসিয়ে বলে,“দোলা সাহস কর। ভাইয়া সবটা সামলে নেবে। হাল ছাড়িস না প্লিজ!”

দোলা জবাব দেয়না,শুধু চোখ তুলে তৃপ্তির মুখের দিকে তাকায়। তখনই সেখানে জারিফের বাইক এসে থামে। দোলা পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। তৃপ্তি আর আফ্রা দোলাকে দুপাশ থেকে ধরে রেখেছে।

জারিফকে দেখে দোলার ফুপু আর চাচা শুকনো হাসি হাসে। জারিফ তাদের দু’জনকে সালাম দিয়ে দোলার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলে,“কোথায় যাচ্ছিস!”

_বাড়িতে। বিয়ে আমার।
দোলাও ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়।

জারিফ ম্লান হেসে দোলার একটা হাত শক্ত করে ধরে। দোলার ফুপু আর চাঁচার ভ্রু কুঞ্চিত হয় এই দৃশ্য দেখে। জারিফ কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,“চল আমার সাথে।”

_কোথায়?

_কাজী অফিসে।

“আল্লাহ গো!”
হতভম্ব শাহিদা বোরখার ও’ড়না মুখে চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে। দোলার বড় চাচা খসরু মাহমুদ এগিয়ে এসে জারিফকে বলে,“কি সমস্যা জারিফ?”

জারিফ কোনোদিকেই দৃষ্টি ফেরায় না,না কারো কথায় জবাব দেয়। তার দৃষ্টি দোলার মায়াভরা মুখটার দিকে স্থির। দোলা জারিফের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,“এটা হয়না জারিফ।”

_হয়। দোলা চল আমরা বিয়ে করি। মা ঠিক মানবে দোলা। আমি তোকে কথা দিচ্ছি!

দোলা চোখ তুলে জারিফের দিকে তাকায়,তার টানা টানা চোখ দু’টো ভরে উঠেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,“মামীর থেকে অনুমতি না নিয়েই? তাহলে তো গতকাল বলা মামীর কথাটা সত্যি হয়ে যাবে,আমাকে আমার খারাপ মা জন্ম দিয়ে রেখে গিয়েছে তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

“দুলি।”
দোলার দুই বাহু ধরে জারিফ ঝাঁকুনি দিয়ে চেঁ’চি’য়ে ওঠে। দম নিয়ে আবার বলে,“দুলি ওসব মা এখন বলছে। ঠিক হয়ে যাবে সব দুলি। প্লিজ। প্লিজ চল কাজী অফিস।”

দোলা চুপচাপ নিজের বাহু থেকে জারিফের হাত দু’টো সরিয়ে দেয়। দবির রহমান অটো নিয়ে এসে ছাত্রী নিবাসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ঐ দৃশ্য দেখে থ’ম’কে যায়। সে দ্বিতীয় দফায় চ’ম’কে ওঠে দোলার সাথে জারিফের প্রনয়ের সম্পর্ক এই সত্যিটা জেনে।

দ্রুত পায়ে এসে দোলা আর জারিফের মধ্যে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে দবির জারিফের দিকে কঠিন দৃষ্টি দেয়,গর্জে উঠে বলে,“এসব কোন ধরনের অ’স’ভ্যতামি জারিফ!”

_আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি ফুপা। আমাদের চার বছরের সম্পর্ক।
অসহায়ের মতো বলে জারিফ।

দবির হতভম্ব হয়ে জারিফের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকায়। দোলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দবির জারিফের দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় বলে ওঠে,“মুখ সামলে কথা বলো জারিফ। দোলার সামনে বিয়ে।”

জারিফ নির্বিকার। পুনরায় দোলার হাতটা খপ করে ধরে বলে,“চল কাজী অফিস।”

দোলা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,“মামীকে কষ্ট দিতে পারবো না, বেচারী অনেক কষ্ট পেয়েছে।”

_আর তুই? আমি? আমাদের কি হবে দোলা?

_কিছুই হবে না জারিফ ছাড়ো আমার হাত।

_মাকে মানিয়ে নেবো দুলি। না মানলে নাই। মা আলাদা বাড়িতে থাকবে তুই আলাদা বাড়িতে থাকবি, দু’জনকেই ভালো রাখবো আমি।

_সহজ হবে না জারিফ।

_কঠিন কিছুও না দুলি চল কাজী অফিস।

_অনেক বড়ো আঘাত পাবে মামী।

_আর আমরা দুজন ম’রে যাবো।

চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হচ্ছে। দবির আতঙ্কিত হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। এসব কথা শেখ বাড়ির লোকের কানে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখন তবে উপায়!

সে ক্ষিপ্ত হয়ে দোলার হাত জারিফের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জারিফকে ধ’ম’কে বলে,“তুমি ভাবলে কি করে তোমার কাছে আমার মেয়ে দেবো। আর তোমার ঐ শিক্ষিত অহংকারী মা,আমার সমন্ধি মরার পরে একবেলা দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায়নি তাকে বলে দিও আমার বয়েই গিয়েছে তার বেকার নিষ্কর্মা ছেলের কাছে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে, আমার মেয়ে রাজরানী হবে। যাও এখান থেকে।”

_আব্বু চুপ করো! একেবারে চুপ করো। চেঁচিও না। চলো আমি যাচ্ছি। ওকে এভাবে বেকার বলবে না। বলবে না বেকার ,খবরদার!

চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে দোলা দবিরকে জারিফের সামনে থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।
জারিফ দোলার হাতদুটো ধরে, আকুল হয়ে বলে,“দুলি পাগলামি করিস না। ”

_এমনটা হবে জানা ছিলো শুরুতেই, কোন আশায় বুক বেঁধেছিলাম!

_দুলি চল কাজী অফিস। চলনা একটু স্বার্থপর হই।

শাহিদা এসে ভাইঝিকে আড়াল করে নেয়। লোকজন কৌতুহলী হয়ে তাদের দেখছে। তৃপ্তি আর আফ্রা ছলোছলো নয়নে একবার দোলা আর একবার জারিফকে দেখছে।

দবির মেয়ের দুর্নাম হওয়ার ভয়ে বড়ো ভাইকে চোখ দিয়ে ইশারা করে। খসরু মাহমুদ দোলাকে টানতে টানতে নিয়ে অটোতে তুলে বসিয়ে অটো ছাড়ার নির্দেশ দেয়।

জারিফ চেঁ’চি’য়ে যাচ্ছে,“দুলি! দুলি এটা ঠিকনা। এমন কিছু আশা করি না তোর থেকে। দুলি এমন হবার কথা ছিলো না।”

অটো চলে যায় দৃষ্টি সীমার বাইরে। দবির জারিফের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, কন্ঠে তেজ নিয়ে জারিফকে বলে,“উগ্রদের মতো করবে না। এখান থেকে থানায় যেতে দুমিনিট লাগবে।”

জারিফ অনূভুতিহীন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে দবিরের দিকে। দবির একটা রিকশা থামিয়ে স্থান ত্যাগ করে, বাড়ি পৌঁছে তার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। শেখ তৌকির আহমেদকে কিছু একটা বলে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বিয়েটা আজ রাতের মধ্যে পড়াতে হবে। নয়তো মেয়ের মত ঘুরতে কতক্ষন? এমনিতেই মেয়েটিকে দেখে তার সুবিধার মনে হচ্ছে না, দেখেই মনে হচ্ছে জারিফের প্রতি দুর্বল। একবার বেঁকে বসলে দবিরের স্বপ্ন চুড়মার হয়ে যাবে। তাছাড়া জারিফের থেকে পাত্র হিসেবে তৌসিফ দশগুণ ভালো। আর এমনটা নয় যে দবির শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবছে, সে মেয়ের ভবিষ্যতের কথাও ভাবছে। ঐ মৃধা বাড়ির ছেলেরা মা ভক্ত, মা বোনের কথায় বৌকে মারে এটা তো দবিরের অজানা নয়, এমন কিছু ভবিষ্যতে দোলার সাথে হোক তা তিনি কখনোই চায়না।

দবিরের রিকশা আড়াল হতেই লোকজন আরো কিছু মুহূর্ত জারিফকে দেখে সেখান থেকে চলে যায়। মা বাবার অবাধ্য,বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানো এক জোড়া প্রেমীর দুরাবস্থা দেখে একটু বিনোদন পেয়ে তারা খুশি, তারা আবারও ব্যস্ত হয়ে পরে নিজের জীবন নিয়ে।

জারিফ রাস্তায় ধপ করে বসে পরে। আফ্রা আর তৃপ্তি ছুটে এসে জারিফের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। জারিফ চোখ তুলে আফ্রাকে দেখে বলে,“কেমন ভীতু দেখলে। এখন আমি কি করবো আফ্রা? আমার পাগল পাগল লাগছে!”

তৃপ্তি কেঁদে ফেলে, ঝুঁকে জারিফের সামনে বসে বলে,“আন্টিকে একটু বুঝিয়ে যদি পারতেন ভাইয়া।”

জারিফ কোনো জবাব দেয়না। তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠছে সে না চাইতেও। সে তার সামনের দুজন মেয়ের থেকে তা আড়াল করেনা। ভাগ্যিস এখানে দুলি নেই, তাহলে সে জারিফকে এই অবস্থায় দেখে বলতো,“অপদার্থ প্রেমিক!”

★★★

নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে দবির। সে তার ভগ্নিপতিদের এবং ভাইদের চোখ কান খোলা রাখতে বলেছে। এমন অনেক হয়েছে এই মফস্বলে, শেষমেশ বিয়ের পাত্রী প্রেমিকের উষ্কানিতে পালিয়ে গিয়েছে। দোলাকে পালাতে দেওয়া যাবে না। দোলার চাচীদের কড়া নজরদারি দোলার উপর। বারবার এসে তারা চেক করছে দোলার কাছে কোনো মোবাইল ফোন আছে কিনা! কোনো মোবাইল ফোন তারা পায়নি, শুধুমাত্র পেয়েছে একটা কাঠের পুতুলকে। যাকে তারা বিয়ের একটা বেনারসী পরিয়ে বসিয়ে রেখেছে দুপুর থেকে। কাঠের পুতুলটা চুপ করে বসেও আছে,তার দৃষ্টি পশ্চিমের জানালার বাইরে। বাড়ির পশ্চিম আঙিনায় পাত্রপক্ষকে খাওয়ানোর জন্য একটা খাসি জবাই করা হচ্ছে। প্রতিবেশী চাচীরা উনুন ঘরে হাতে হাতে সাহায্য করছে দোলার বাড়ির মহিলাদের। রান্না বান্না আগেভাগেই সেরে ফেলতে চায় তারা। বাদ মাগরিব দোলার বিয়ে পড়ানো হবে।

গায়ে হলুদ হবে না।গায়ে হলুদ হওয়াটা আবশ্যকীয় নয়, মুসলিম বিয়ের রীতি নয় এই প্রথা, দবির সবাইকে এই কথা বলে চুপ করিয়ে দিয়েছে, সবাইকে মাথা ঘামাতে বলেছে শুধু বিয়েটা নিয়ে।

দবির বাড়িতে গিয়েই একটা অভিনব চাল চেলেছে। দুপুরে তৌফিকুল আহমেদকে ফোন করে কান্নার ভান করে জানিয়েছে দোলার দাদীর শ্বাস টান উঠেছে। আর বোধহয় বেশিক্ষণ বাঁচবে না। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা এসে ভিড় করেছে। এমতাবস্থায় দোলার দাদী চাইছেন বংশের বড় নাতনির বিয়ে দেখে যেতে, দোলা যে বড় অভাগী! মা মরা। তাই দবির তৌকির আর তৌফিকুল আহমেদের কাছে অনুরোধ করেছে সব অনুষ্ঠান পরে না হয় করা যাবে। যদি আজকের ভেতরে বিয়েটা পড়ানো যায় তাহলে খুব ভালো হয়।

একজন মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধার কথা শুনে রাজি হয়েছে শেখ বাড়ির সবাই। তারা জানিয়েছে বাদ মাগরিব কাজী নিয়ে আসবে, ঠিক যোহরের ওয়াক্তে তানিয়া শেখ এসে বড় বড় দুটো লাগেজ দিয়ে গিয়েছে,যাতে আছে দোলার জন্য কেনা উপহার সামগ্রী। দোলার গাঁয়ের টকটকে লাল বেনারসী শাড়িটাও সেই লাগেজ থেকে বের করা হয়েছে।

মাগরিবের আজান হতে এখনও ঢের দেরী, পরিশ্রম বেশী করছে বাড়ির মহিলারা তবে সেই তুলনায় বাড়ির পুরুষদের হাক ডাক বেশি শোনা যাচ্ছে। তার সাথে যোগ হয়েছে বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি। কিন্তু তার মাঝেই সব ধরণের শব্দ ছাপিয়ে দোলার কানে এসে পৌঁছায় একটা অতি পরিচিত শব্দ।
বাড়ির আঙিনায় বাইক থেমেছে। দোলার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো, বাইক থামার আওয়াজ মাথা তুলে তাকায়। সামনের বারান্দায় দোলার বাবা চাচাদের হাঁক ডাক শুরু হয়, দবির রহমান ক্ষ্যাপা গলায় কাউকে বলে,“তুমি! তোমার সাহস তো কম না! পুলিশ ডাকবো নাকি!”

ওপাশের ব্যাক্তি কোনো জবাব দেয়না। শুধু দোলা শুনতে পায় কারো পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ, কেউ তার ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। দোলা শাড়ির আঁচল খামচে ধরে বসে থাকে, সাথে সাথে দু’চোখ বন্ধ করে নেয়, সে দেখবে না। দেখবে না ঐ লোকটাকে আর। জারিফ দরজা ঠেলে হুরমুর করে ঢুকে পরে দোলার ঘরে। ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে তাকায় দোলার দিকে। দবির আর তার ভাইয়েরা এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে জারিফকে পুলিশ ডাকার হুমকি দিতে থাকে।

দোলার দু’চোখ বন্ধ । জারিফ দোলার দিকে এগিয়ে এসে বলে,“চল সময় আছে এখনও,কাজী অফিসে যাই।”

_মামীকে মানিয়েছো?
দু’চোখ বন্ধ করেই ঠান্ডা গলায় জানতে চায় দোলা।

জারিফ দোলার দুই বাহু ধরে বলে,“না পারিনি। তুই চল। কারো মানতে হবে না। চল দুলি।”

_চলে যাও জারিফ। জেদ করো না,আমার দুর্নাম হবে।

জারিফ হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পরে, দোলার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো করে বলে,“এতো ইগো তোর? এতো ইগো?”

দোলা নীরব। জারিফ অনুনয় করতে থাকে,“মা মেনে যাবে দুলি। একদিন না একদিন মা মেনে যাবে। একটু সাহস কর না দুলি! হাতজোড় করছি আমি।”

দুলি নিশ্চুপ। জারিফ দোলার থুতনি ধরে বলে,“চোখ খোল বলছি দুলি। চোখ খোল!”

দোলা চোখ খোলে না,সে খুলবে না কিছুতেই। ঐ মানুষটার দিকে সে তাকাতে পারবে না।

মাগরিবের আজান দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। ঠিক সময়েই বাড়ির আঙিনায় শেখ বাড়ির গাড়ি এসে থামে।

দবির রহমান আর তার ভাইয়েরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। বুদ্ধি করে একদল চলে যায় বরপক্ষকে সাদরে গ্রহণ করতে। আরেকদল লাথি মেরে বন্ধ দরজার সিটকিনি ভাঙার চেষ্টায়। তবে মুখে কেউ টু টা শব্দ করে না, পাছে লোকে জেনে যায় সবটা।

দোলা নিশ্চুপ হয়ে দু’চোখ বন্ধ করেই বসে থাকে, দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পরে তার। জারিফ উঠে দাঁড়ায়। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,“সাহস করলি না তো? আজ আমিও দেখতে চাই তুই কিভাবে কবুল বলিস। আমি এখানেই থাকবো, দেখতে চাই তুই আমার সামনে কি করে কবুল বলিস দুলি।”

চলমান….

জনম জনমে পর্ব-০৫

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৫
#ইসরাত_ইতি

দোলাকে দেখে বসার ঘরে থাকা শেখ বাড়ির সবাই অবাক হয়ে যায়। তানিয়া আর তারানা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। এই সময়ে দোলার আগমন কারো প্রত্যাশিত ছিলো না। তানিয়া তারানা দোলার কাছে এক গাল হাসি হেসে এগিয়ে যায়। দোলা বিনিময়ে শুকনো হাসি ফিরিয়ে দিয়ে সালাম দিয়ে বলে,“ফারিন ভাবীর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

সিঁড়ির দিকে যাওয়ার পথে তৌফিকুল আহমেদ সামনে পরলে দোলা বিনীত হয়ে তাকেও সালাম দেয়। অতঃপর ধীরপায়ে হেঁটে দোতলায় ফারিনের ঘরে যায়।

“ভাবী আসবো!”

আচমকা দোলার গলার আওয়াজে ফারিন, শান্তা, তৌসিফ তিনজনই অবাক হয়।

তিনজন ঘুরে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দোলা ফারিনের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। সাদা রঙের একটা সাধারণ সুতি সালোয়ার কামিজ পরনে, মাথায় ওড়না টেনে দেয়া। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। মুখে নেই কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া। বরাবরের মতো সাধারণ তবে আকর্ষণীয়,যে সৌন্দর্য সোজা আ’ঘাত হানে বক্ষপটে।

তৌসিফ কয়েক পলকের ব্যবধানে দোলাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তবে সে ঘর থেকে বেরোয় না,টান টান হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে দৃষ্টি স্থির রেখে চায়ের মগে চুমুক বসায়।

ফারিন অবাক হলেও হাসি মুখে এগিয়ে যায়, দোলার হাত টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে বলে,”ওমাহ! দোলা যে! এসো বসো!”

শান্তা এক পলক তৌসিফের দিকে তাকিয়ে,তৌসিফকে শুনিয়ে শুনিয়ে দোলাকে বলে,”বেশ সুন্দর হয়ে গেছো দোলা আগের থেকেও। আমার তো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।”

দোলা কোনো ভনিতা না করে শুধুমাত্র ফারিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”কথা ছিলো!”

_কি কথা দোলা।

দোলা হাতের শপিং ব্যাগটা ফারিনের হাতে দিয়ে বলে,”আপনার শাড়িটা,যেটা কলেজের প্রোগ্রামে পরবো বলে নিয়েছিলাম!”

_ওমা। এটা দিতে এই সময়ে আসতে হয়? একটা সামান্য শাড়ি দোলা। এতো রোদে বাইরে বেরিও না এখন,এই রূপ মলিন না হোক!

কথাটা বলে ফারিন ঠোঁট টিপে হাসে। দোলা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে জড়তা কাটিয়ে বলে,”আর হয়তো ইউরাকে পড়াতে পারবো না ভাবী,তাই দিয়ে গেলাম শাড়িটা, কখনো এই বাড়িতে আসা হয় কি না!

তৌসিফের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। চায়ের মগে চুমুক বসাতে গিয়েও বসায় না,তবে তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। ফারিন দোলার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

দোলা মাথা নিচু করে কথাটা বলেছিলো। এবার মাথা তুলে একপলক তৌসিফের দিকে তাকিয়ে পুনরায় মাথা নিচু করে ফারিনকে বলে,”আমি বিয়েতে রাজি নই ভাবী । আপনি প্লিজ তৌকির ভাইয়াকে বলবেন উনি যেন বিকেলে বাবার সাথে কথা না বলেন। এটা নিয়ে আর না আগানোর অনুরোধ।”

ফারিন আর শান্তা হতভম্ব হয়ে সাথে সাথে ঘুরে তৌসিফের দিকে তাকায়। তৌসিফ খুবই শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে । নির্বিকার চিত্তে, এবং চুপচাপ চায়ের মগে চুমুক বসায়।

দোলা ফারিনকে বলতে থাকে,”বাবাকে বললে বাবা মানবে না,তাই সরাসরি আপনাদেরকেই বলা। আসছি ভাবী,ভালো থাকবেন। মেসেঞ্জারে কথা হবে। ইউরাকে আরেকজন ভালো টিচার দেবো।”

কথাটা বলে দোলা হন্তদন্ত হয়ে চলে যায়। ফারিন আর শান্তা মুখ শুকনো করে একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর তৌসিফকে দেখে। তৌসিফ তখনও চুপচাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো। পরপর গভীর,শান্ত চোখ দু’টো তুলে ভাবীর দিকে তাকায় ‌। ফারিন আমতা আমতা করে বলে,”তৌসিফ,তোমার ভাইয়াকে কি বলবো!”

_ভাইয়াকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
গম্ভীর কিন্তু অস্বাভাবিক শান্ত তৌসিফের কন্ঠস্বর।

_মানে? তোমার ভাইয়া জরুরি কাজ ফেলে দোলার বাবার সাথে বসতে চেয়েছিলো এখন যদি…

_বলেছি তো ভাইয়াকে কিছু বলার দরকার নেই!

উঁচু গলায় বলে ওঠে তৌসিফ। শান্তা আর আর ফারিন দু’জনেই চ’ম’কে ওঠে।

মুহুর্তের ব্যবধানে তৌসিফকে অস্বাভাবিক লাগছে। অস্বাভাবিক ক্রোধান্বিত লাগছে।

ফারিন ই’তস্তত করে,”বললো ও বিয়েতে রাজি না….!”

_ভাইয়া ওর বাবার সাথে কথা বলতে যাবে।
কন্ঠে পুনরায় শান্ত এবং গম্ভীর ভাব ফিরিয়ে এনে স্পষ্ট করে বলে ওঠে তৌসিফ।

ফারিন আর শান্তা হা করে তাকিয়ে আছে তৌসিফের দিকে। তৌসিফ চায়ের মগে শেষ চুমুক বসিয়ে ফারিনের দিকে তাকিয়ে খুবই স্পষ্ট করে বলে,”ওকে লাগবে!”

★★★

রাতের নিস্তব্ধতায় ‌ঢাকা পরেছে পুরো মহল্লা। হাওলাদার ভিলার সামনে দু তিনটে কুকুর তখনও সাংসারিক আলাপ করছে। আজও দেরী জারিফের। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দোলার সাথে দেখা করেছে, ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ঘন্টাখানেক ফোনালাপ করেছে মশার কামড় খেয়ে। মন ভালো নেই দোলার, জারিফ তার মন ভালো করতে পারেনি,উল্টো নিজেই মনখারাপ নিয়ে ফিরেছে। শেখ তৌসিফ আহমেদের নাম বারবার তাকে যন্ত্রনা দিচ্ছে। দেশে কি আর মেয়ে নেই! তার দুলির দিকে নজর দেয়,কি সাহস!
দোলার উপরও হঠাৎ রাগ ওঠে জারিফের,আজ বোরখা পরে চলাফেরা করলে এমন হতো না! পরপর নিজের ওপর ক্ষেপে যায় জারিফ, মেয়েটাকে শুধু শুধু দুষছে কেনো। দোলা তো ইচ্ছে থাকলেও শ্বাসকষ্ট সমস্যার জন্য বোরখা পরতে পারেনা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় জারিফের ভেতর থেকে। কেনো অহেতুক একে তাকে দুষছে সে, তার ব্যর্থতা দোলাকে এখনও সে বৌ করতে পারেনি। তার ব্যর্থতাকে ঢাকতে কেনো অন্যদের দোষ দেওয়া?

কলাপসিবল গেট খুলে বাইক উঠিয়ে সিড়ির কাছে দাড় করিয়ে গেট বন্ধ করে সদর দরজার কাছে যায়,হাত বাড়িয়ে কলিং বেল চাপার আগেই দেখে দরজা খোলা। ভ্রু কুঞ্চিত হয় জারিফের। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বসার ঘর পর্যন্ত যেতেই থ’ম’কে দাঁড়িয়ে যায়, জাহিদা আনাম বসার ঘরের সাথে লাগোয়া ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে আছে। মায়ের বিধ্বস্ত মুখটা দেখে জারিফ উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে যায়, নরম গলায় বলে,”কি হয়েছে মা! শরীর খারাপ?”

জাহিদা আনাম ছেলের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। অত্যল্পকাল পেরিয়ে যেতেই সে কন্ঠ খাদে নামিয়ে দৃঢ় ভাবে জিজ্ঞেস করে,“কতদিন ধরে চলছে এসব?”

★★★

দোলার বিয়েতে অমত সেকথা তৌকির আহমেদের কান অবধি পৌঁছায়নি তার স্ত্রী ফারিন। শান্তাও এ ব্যাপারে একটা কথাও বলেনি তৌসিফের বারণ শুনে। এদিকে তৌকির আহমেদ নিজে গিয়ে দোলার বাবার সাথে বিনয়ী হয়ে কথা বলেছে,জানতে চেয়েছে দবির রহমানের মতামত। মেরুদণ্ডহীন দবির রহমান নিজের বাড়িতে স্বয়ং উপজেলা চেয়ারম্যানকে পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন। আশ্বাস দিয়ে দিলেন তিনি বিয়েতে রাজি। কথা আগাবে। আত্মীয়তা হবে। তৌকির আহমেদ আশ্বাস দিলেন দোলাকে পড়তে দেওয়া হবে,চাইলে চাকুরীও করতে দেওয়া হবে। এতো এতো প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেওয়া হলো বিকেলে, সবার অজানা রয়ে গেলো বিয়ের পাত্রী এই বিয়েতে রাজী নয়। দবির রহমান একথা জানলেও চেপে গেলেন, তার বিশ্বাস মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বললে বিয়েতে রাজি হবেই। সে ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, বেশি ত্যাড়ামি করলে একটু না হয় চোখের পানি ফেলবে মিছিমিছি। বাড়াবাড়ি করলে দু একটা চ’ড় থাপ্পড়ও মারবে না হয়, মেয়ের ভালোর জন্য সব করবে দবির। একসময় মেয়ে ঠিকই বুঝবে। এতো ভালো পরিবার কি করে হাত ছাড়া করবে সে? সারাজীবন শেখ ট্রেডার্সের মালিকদের প্রতিপত্তির কথা মফস্বলে শুনে এসেছে দবির, আজ সে বাড়ি থেকে প্রস্তাব এসেছে তার মেয়ের জন্য! ভাবা যায়। কোনো ঘটক পাঠিয়ে নয়, শেখ ট্রেডার্সের কর্ণধার তৌফিকুল আহমেদ নিজে এসেছিলেন। নিজের প্রতি বেশ গর্ব হচ্ছে দবিরের হঠাৎ করে। আজ বিকেল থেকে পাড়ায় দোলার বিয়ে নিয়ে বেশ চর্চা হচ্ছে। এই তল্লাটেও কেউ কল্পনা করেছিলো দবিরের মেয়ের বিয়ে এতো বড় ঘরে হবে? যেখানে এই পাড়ার সব মেয়েদের বিয়ে হয়েছে দোকানদার অথবা অর্ধশিক্ষিত প্রবাসী শ্রেনীর ছেলের সাথে। সে তুলনায় দবির পেয়েছে আকাশের চাঁদ।

★★★

কাঁচের পানির জগটা টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পরে আছে। জারিফ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে। জাহিদা আনাম শাড়ির আঁচল মুখে চে’পে ধরে কাঁদছে। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর।

জারিফ কিয়ৎক্ষন মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে দৃষ্টি সরিয়ে মাকে দেখে। অসহায়ের মতো বললো,”মা,ছাড়তে পারবো না ওকে!”

জাহিদা আনাম মুখ তুলে তাকায় না ছেলের দিকে, শুধু একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, হন্তদন্ত হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ধপপ করে দরজা লাগিয়ে দেয় ‌। জারিফ ছুটে যায় দরজার কাছে, আকুল হয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে, চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,”মা ফুপি তোমার সাথে যা করেছে এতে দোলার দোষ কোথায়? তুমি আমাকে এটুকু বোঝাও শুধু। এটুকু বোঝাও!”

জারিফের চেঁচামেচিতে জাহিনের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ ডলতে ডলতে এসে বসার ঘরে দাঁড়িয়ে পরে। জারিফ মায়ের দরজায় অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। আকুল হয়ে বলছে,”মা দুলি খুব ভালো মেয়ে। ও আমাদের সবাইকে ভালো রাখবে মা। তুমি বিশ্বাস করো!”

দরজার ওপাশে জাহিদা আনাম চুপচাপ বসে আছে। জারিফ পুনরায় বলে ওঠে,”মা ওর অন্যায় কি একটু বলো, কেনো ওকে সহ্য করতে পারো না, একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ বলো,বলো আমাকে।”

নীরবতা ভাঙে জাহিদার,সে খুবই শান্তস্বরে বলে,”ওর দোষ আছে, অবশ্যই আছে। ওর দোষ হচ্ছে ও সেই মহিলার মেয়ে যে মহিলা তোর মাকে তোর বাবার কাছে খারাপ সাজাতে তোর মায়ের ঘরে পরপুরুষ ঢুকিয়েছিলো। আর যে মহিলা আর তার মায়ের কারনে তোদের বাবার সাথে আমার কখনও ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি। আর তোরা দুইভাই, তোরা দুইভাই ভালাবাসা বাসিহীন একটা বৈবাহিক সম্পর্কের ফসল। ঐ মহিলা আর তার মায়ের জন্য আমার বাপকে স্ট্রো’ক করে মরতে হয়েছিলো। ঐ মেয়েটার দোষ এটাই,ও ঐ মহিলার মেয়ে। ভয়াবহ দোষ করেছে তোর প্রেমিকা। ভয়াবহ দোষ!”

জারিফ চুপ হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে দরজার বাইরে চুপ করে। জাহিদা আনাম হাপাচ্ছে। একটু দম নিয়ে পুনরায় বলে ওঠে,”কি করবি? আমি না মানলে একা একা বিয়ে করে নিবি? নে বাবা। আমার কাজ ছিলো তোকে জন্ম দেওয়া,দিয়েছি, তোকে বড় করা ,করেছি। আমার মায়ের দায়িত্ব শেষ। এছাড়া সন্তানের জীবনে একটা মায়ের কি ভূমিকা? সারাজীবন তোরা সংসার করবি আমি আর ক’দিন বাঁচব। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য কেনো দিবি। জীবন তোদের! যা বিয়ে করে আন। যা।”
কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরে জাহিদা আনাম।

জারিফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে,জাহিদা দীর্ঘসময় পরে আর্তনাদ থামিয়ে নীরব হয়ে যায়। জাহিন মায়ের ঘরের সামনে মাথা নিচু করে দরজায় হেলান দিয়ে বসে থাকা বড় ভাইকে অবাক চোখে দেখতে থাকে।

★★★

গত একদিন জারিফের সাথে কথা হয়ে ওঠেনি দোলার। ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুত করতে হবে জারিফের নিজেকে,এই সময়ে দোলা নিজের বিষন্নতা দিয়ে লোকটাকে অমনোযোগী করতে চায়নি। শুধু তিনবেলা নিয়ম করে তিনটা মেসেজ পাঠিয়েছে দোলা। যদিও জারিফ জবাব দেয়নি। দোলা ভাবলো,নিজেকে সময় দিচ্ছে সম্ভবত,দিক!

হোস্টেলে দোলার ঘরের দু’পাশের ঘরে থাকে দোলার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দুজন। তৃপ্তি এবং আফ্রা। ওদের সাথেই টুকটাক কথা বলে নিজেকে হালকা করেছে দোলা ক্ষনিকের জন্য। নিজের কামরা ছেড়ে তৃপ্তির কামরায় এসে বসেছে দীর্ঘক্ষণ।

তৃপ্তি আর আফ্রা ব্যস্ত মুড়ি মাখাতে। দোলা চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। এখান থেকে দৃষ্টি দিলেই কিছুটা দূরে একটা বিশাল দোতলা বাড়ি। ছাদে দুজন পুরুষ রমনী বৈকালিক আড্ডায় ব্যস্ত। দু’জনের হাতে দুটো চায়ের কাপ সম্ভবত ‌। হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে একে অপরের গায়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছরে পরছে। দোলার অবচেতন মন দেখলো ওখানে দোলা আর জারিফই দাঁড়িয়ে। দোলা একটা লাল রঙের সুতি শাড়ি পরেছে, জারিফ একটা বাটিকের পাঞ্জাবি।

দৃশ্যটা কল্পনা করেই গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দোলা। কখনও কি এমন সুন্দর কল্পিত দৃশ্যটা বাস্তব হয়ে দোলার সামনে আসবে? রোজ বিকেলে জারিফ অফিস থেকে ফিরলে দুজন মিলে ওভাবে ছাদে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে চা পান করবে। ঠিক ঐ যুগলের মতোন।

এদিকে তার ফোন বেজে চলেছে সেই তখন থেকে। দোলা ফোন হাতে তুলে আবার রেখে দেয়। দোলার বড় ফুপু ফোন দিয়েছে। এভাবে একের পর এক ফোন এসেই চলেছে বাড়ি থেকে। ফুপুরা, ফুপারা,চাচারা,চাচীরা,সবাই যেন হঠাৎ করে খুব দায়িত্বশীল অভিভাবক হয়ে উঠেছে দোলার। যারা দোলার জীবন গঠনে কাজ করছে তার বিশিষ্ট মেরুদন্ডহীন বাবা দবির রহমানের আন্ডারে!
দোলা ফুপুর ফোন ধরলো না, তৃপ্তি আর আফ্রার সাথে মুড়ি মাখাও খেলো না। তার ইচ্ছে করছে ছুটে যেতে জারিফের কাছে। ছুটে গিয়ে বলতে,“জারিফ আমাকে তুমি বিয়ে করে নাও,মামী না মানলেও করে নাও।”

“এই তোদের এখানে দোলা এসেছে?”

হোস্টেলের ওয়ার্ডেনের সহকারী এসে তিনশো তিনের দরজায় দাঁড়িয়েছে। দোলার মলিন মুখটা তার নজরে পরতেই বিরক্ত হয়ে বলে,“তুই এখানে দোলা? তোকে পুরো হোস্টেল খুঁজে এলাম। চল আমার সাথে। ওয়ার্ডেন স্যার তোকে ডেকেছে।”

দোলা নিস্তেজ কন্ঠে বলে,“আমাকে? কেনো?”

_তোর সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।

দোলার ইচ্ছে করছে না বাড়ির কারো সাথে দেখা করতে। একেবারেই ইচ্ছে করছে না।

ওয়ার্ডেনের সহকারী সানজিদা বিরক্তি নিয়েই বলে,“আরে কি হলো কি! চল তোর মামী এসেছে।”

দোলা চ’ম’কে ওঠে। তৃপ্তি আর আফ্রাও সানজিদার মুখের দিকে তাকায়। তারপর ঘুরে দোলার দিকে তাকায়। দোলা আটকে আটকে বলে,“কে এসেছে?”

_তোর মামী। জাহিদা আনাম নাম,কদমতলা হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষিকা।

★★★

সদর রোডের মসজিদে মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে । জানালা থেকে যেটুকো আলো আসছিলো তা এখন নেই। অভিভাবক মিটিং রুমের বাতি নেভানো। জাহিদা আনাম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি দোলার সিঁথির দিকে। যে কিনা তার দু’টো পা জরিয়ে ধরে মেঝেতে বসে আছে। এখন আর কাঁদছে না দোলা,শুধু মাথাটা জাহিদা আনামের হাঁটুতে ঠেকিয়ে রেখেছে।

জাহিদা আনাম খুবই শান্ত ভঙ্গিতে দোলাকে বলে,“পা ছাড়ো দোলা।”

_মামী প্লিজ।
অদ্ভুত শোনাচ্ছে দোলার কন্ঠস্বর, শব্দ দুটো কন্ঠনালী ছিঁড়ে বেরিয়েছে যেন।

জাহিদা আনাম দু’চোখ বন্ধ করে আবারও চোখ মেলে তাকিয়ে বলে,“দোলা পা ছাড়ো।”

_মামী আজীবন আপনার দাসী হয়ে থাকবো!

এবার দোলা ডুকরে ওঠে। সে কাঁদছে,বাঁধ ভাঙা কান্না। জাহিদা আনাম ভাবলেশহীন। দোলা আরো শক্ত করে জাহিদা আনামের পা জরিয়ে ধরে, আকুল হয়ে বলতে থাকে,“দয়া চাইছি মামী!”

জাহিদা আনাম এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে তাকায়, তারপর কিছুটা ঝুঁকে জোর করে দোলার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দোলা মেঝেতে ওভাবেই পরে থাকে। বিধ্বস্ত হয়ে, উচ্ছিষ্টের মতোন।

★★★

তৃপ্তি আফ্রা দোলাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। একঘন্টা হয়েছে প্রায়, এখনও কামরায় ফেরেনি দেখে দু’জনেই খুঁজতে নেমেছে তাকে। পুরো হোস্টেল খুঁজে অবশেষে এক সিনিয়র আপুর থেকে জানতে পারলো দোলা অভিভাবক মিটিং রুমে আছে। দোতলা থেকে সিড়ি বেয়ে লবি ধরে নাক বরাবর হাঁটতে থাকে দ্রুত পায়ে। নিচতলার স্টোর রুমের কাছে এসে ডানে ঘুরতেই পা থ’ম’কে যায় আফ্রা তৃপ্তির। দোলা বিধ্বস্ত হয়ে দেয়াল ধরে ধরে হাঁটছে।

বি’কট চিৎকার দিয়ে তৃপ্তি এগিয়ে যায়। দু’জনে দুপাশ থেকে ধরে দোলাকে। উৎকণ্ঠা নিয়ে তৃপ্তি বলে,“একি হাল তোর ‌। কি হয়েছে? বুকে ব্যাথা করছে?”

দোলা জবাব দেয়না, দিতে পারেনা। তবে ওরা দুজন এটুকু বুঝলো দোলার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাড়তি প্রশ্ন না করে ধরে ধরে দোলাকে তিনশো চারে এনে বিছানায় বসায়। তৃপ্তি দোলার গা থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলে। পেছন থেকে কামিজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পিঠে মাসাজ করতে থাকে। আফ্রা ছুটে গিয়ে দোলার ড্রয়ার থেকে ইনহেলার এনে দোলাকে দেয়।
নিস্তেজ,নিস্প্রান,মরা মাছের মতো তৃপ্তির গায়ে পিঠ এলিয়ে পরে আছে দোলা। ওরা দুজন দোলার থেকে জানতে চায়না কি হয়েছিলো এই এক ঘন্টায়। সহানুভূতি মাখা হাতে দোলাকে আকরে ধরে বসে থাকে। শুধু দোলার ফোন বেজে উঠলে আফ্রা ফোনটা হাতে নিয়ে দোলার দিকে তাকিয়ে বলে,“আংকেল কল দিয়েছে। কেটে দেই?”

_রিসিভ কর।
ক্ষীণ স্বরে বলে দোলা।

আফ্রা কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রেখে দেয়, ওপাশ থেকে দবির রহমান তেতে ওঠে,“এসব কি বেয়াদবি দোলা। চাচা ফুপুদের ফোন ধরছো না! কি শুরু করেছো কি তুমি,আমার স্ট্রো’ক না করিয়ে তোমার শান্তি…”

_আব্বু।

দোলার অসুস্থ কন্ঠস্বর দবিরকে থামিয়ে দেয়। খানিকটা বিচলিত হয়ে বলে,“ঠিক আছো তুমি! কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো।”

দোলা সেসব কিছুর জবাব না দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,“আমি বিয়েতে রাজি আব্বু।”

চলমান…..

জনম জনমে পর্ব-০৪

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৪
#ইসরাত_ইতি

জারিফ মায়ের দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জাহিনের দিকে তাকায়। জাহিন বলতেই থাকে,”তারপর শার্ট টা কিনে আপু বললো আমাকে আইসক্রিম খাওয়াবে,আমার সাইকেলে আপুকে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরলাম!”

জারিফ নিচুগলায় বলে,”তাই নাকি! বেশ!”

জাহিন বলে,”তুমি কোথা থেকে নিলে শার্ট টা? তুমিও জেন্টস পয়েন্ট থেকে নিয়েছো?”

জারিফ জাহিনের কথার উত্তর না দিয়ে মায়ের দিকে আরেক পলক তাকিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। জাহিদা আনাম নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে সেই বন্ধ দরজার দিকে।

★★★

“ঐ কে যায়,ঐখান দিয়া কে যায়!”

বাচ্চাসুলভ রিনরিনে কন্ঠস্বর দোলার পায়ের গতি থামিয়ে দেয়। সে শেখ বাড়ির দোতলার পুর্ব দিকের সবথেকে কোণের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পরেছে। ঘরটা এ বাড়ির সবথেকে প্রবীণ ব্যক্তি, তৌকির আহমেদ ও তৌসিফ আহমেদের দাদী গুলবাহার বেগমের। বয়স প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি। চোখে খুব কম দেখে। ওয়াকার ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারেন না, মাঝে মাঝে তিন চারদিনের জন্য পুরোপুরি বিছানা নেন। তবে এত অক্ষমতার পরেও ওনার মুখটা খুব চলে। এই বাড়িতে বোজো আর বোজোর মনিবের পরে দোলার আরো একজন অস্বস্তি হচ্ছে এই গুলবাহার বেগম। বৃদ্ধা মানুষ,অতিরিক্ত কথা বলবে স্বাভাবিক,তবে এই বৃদ্ধা এক লাইন কথা বললে দশটা গালাগাল দেয়। সব সময় অশ্লীল, অশালীন কথা বলে অন্যদের সাথে। এটাই দোলার বিরক্তির কারন। সেদিন দোলার সামনে এই বাড়ির মেয়ে তারানা,যার সপ্তাহখানেক আগে বিয়ে হয়েছে,সে কথায় কথায় ফারিনকে বলছিলো,”আমি এখনও ছোটো ভাবী।”
পাশ থেকে গুলবাহার বেগম তার দন্তবিহীন কুঁ’চ’কে যাওয়া মুখ নে’ড়ে নে’ড়ে সাথে সাথে উত্তর দেয়,”কিয়ের ছোডো? যে মাইয়া একবার ভাতারের তলে যায় হে মাইয়া আর ছোডো থাহে না।”

কথাটা মনে পরায় পুনরায় দোলার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছে। একে এই বাড়ির সবাই সহ্য কিভাবে করে কে জানে! তবে বৃদ্ধার স্মৃতি শক্তি খুবই কম। কাউকে মনে রাখতে পারে না।
দোলা বরাবর এই বৃদ্ধা মহিলাকে এড়িয়ে চলে। তবে আজ ইউরার ওয়াশরুম ব্যস্ত, তাই দোলা দোতলার গেস্টরুমের ওয়াশরুমে ঢুকেছিলো। গেস্টরুম টা গুলবাহার বেগমের ঘরের ঠিক পাশেই।

দোলা থমথমে মুখে গুলবাহারের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখন সে দু’টো কাজ করতে পারে,হয় এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া নয় দুমিনিট ঐ অশ্লীল বৃদ্ধার যৌন বিষয়ক লেকচার শোনা। দোলা পালিয়ে যাওয়ার মনস্থির করলো, এক পা সামনে বাড়াতেই গুলবাহার আবারও চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”ঐ ছেড়ি! তুই কেডা! আয় এম্মে আয়! আয় কইছি! পানি খাওয়াইয়া যা মোরে।”

একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দোলা গুলবাহারের ঘরে ঢোকে। গুলবাহার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিলো,পরনে তার সুতি কাপড়ের মেক্সি ধরনের পোশাক। সে চোখ সরু করে দোলাকে দেখছে।
দোলা একটা গ্লাসে পানি ঢালে। গুলবাহার বলে ওঠে,”তুই কার বৌ!”

দোলা পানিটা গুলবাহারকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে,”আমি ইউরার টিচার।”

_তুই কিচার? হুরা কেডা?

_আপনি পানি খান দাদী।

দোলা পানি খাইয়ে দিতেই গুলবাহার বলে ওঠে,”তোর গায়ে গোস্ত নাই ক্যান। শেখ বাড়ির বৌরা থাকপি থলথলা। এই শরীর নিয়া এই গুষ্টির পোলাগো সামলান যায়না,তোর ধরবে কোনহানে…..!”

“ছিহ!!!”
চেঁচিয়ে ওঠে দোলা। দোলার আওয়াজে গুলবাহার বেগমও কেঁ’পে ওঠে। দোলা এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে হাতের গ্লাসটা টেবিলে বেশ শব্দ করে রেখে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে কারো সাথে ধাক্কা লেগে তিনপা পিছিয়ে যায়।

তৌসিফ দোলার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। দোলা ব্যস্ত হাতে ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকে। তৌসিফ গুলবাহারের ঘরের দরজা থেকে সরে ভেতরে ঢোকে। দোলা পালিয়ে যাওয়ার মতো ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে,আড়চোখে দোলাকে একপলক দেখে তৌসিফ দাদীর দিকে তাকায়। গুলবাহার তখন থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে দোলার ওপর,”ঐ ছেড়ি তুই কার লগে চিল্লাইয়া উডলি। ঐ ছেড়ি! ঐ মইষের মতো দৌরাও ক্যা।ঐ”

তৌসিফ শান্ত স্বরে দাদীকে বলে,”চেচাচ্ছো কেনো!”

_তুই কেডা? তোকি?

_না তসু!

_ঐ ছেড়ি কেডা? কার বৌ। ও চিল্লাইয়া উডলো ক্যান। কার বৌ ও?

তৌসিফ দাদীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত, গম্ভীর স্বরেই বলে,”তৌসিফের।”

★★★

টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের টিচার্স রুমে চুপচাপ বসে ছিলো জাহিদা আনাম। মাথাটা বেশ ধরেছে। আজ সকালে ঘুম থেকেও সময়মতো উঠতে পারেনি,সকালের রান্নাটাও হয়নি ঠিকভাবে। কোনোমতে ডালে চালে খিচুড়ি বসিয়ে ফুটিয়েছেন। ঐ দিয়েই আজ দুপুর পর্যন্ত চালিয়ে নিতে হবে সবার। একটা ঠিকা কাজের লোক রাখলে ভালো হতো। তবে অসুবিধা হচ্ছে আঠাশ হাজার টাকা বেতনের ছয় হাজার টাকাই যাবে কাজের লোকের বেতন দিতে। জারিফ এখনও বেকার,জাহিন বড় হয়েছে,সংসারের খরচ বাড়ছে। জারিফ যদিও খুব কমই নেয় জাহিদার থেকে,জোর করে দিলে তবেই নেয়। তবুও জাহিদা টাকা পয়সার খরচ বাড়াতে চাচ্ছে না কাজের লোক রেখে। দুই ছেলের জন্য সেভিংস করতে হবে। তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। জারিফের বাবা তো একটা বাড়ি ছাড়া অর্থ কিছুই রেখে যেতে পারেনি। ছেলে দু’টোকে বড় জাহিদা একা করেছে।

তবুও মাঝে মাঝে জাহিদার ইচ্ছে করে একটু আরাম করতে এই বয়সে। তাড়াতাড়ি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। নবম-দশম শ্রেনীর যে তিনটে ব্যাচ পড়ায় বাড়িতে সেগুলো বাদ দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। শরীর আর সায় দেয় না এসবে। যুবতী বয়সে শাশুড়ি ননদ স্বামীর মা’র খেতে খেতে শরীরটা এখন অকেজোই হয়ে গিয়েছে প্রায়। কখন হুস করে প্রান পাখিটা উড়ে যায় তা বলা যায়না। গত তিনদিন থেকে ব্লাড প্রেসার একটু হাই হয়ে ছিলো, তার ওপর গতকাল রাতের পর মনটা কোনো কারনে বেশ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে জাহিদার। মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না,অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে।

জাহিদাকে এভাবে একা টিচার্স রুমে বসে থাকতে দেখে একজন সহ শিক্ষিকা ভেতরে ঢোকে।

“কি জাহিদা আপা! অসুস্থ নাকি!”

জাহিদা নড়েচড়ে বসে। রিহানা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে। বললো,”না আপা। বসুন।”

রিহানা বসে,জাহিদার দিকে তাকিয়ে বলে,“অসুস্থ দেখাচ্ছে আপনাকে।”

_আসলে বয়স হয়ে গিয়েছে তো আপা। শরীর টা আর আগের মতো সায় দেয়না পরিশ্রমে।

_কেন করেন পরিশ্রম। দু দু’টো ছেলে আপনার, বিয়ে করিয়ে ঘরে বৌ নিয়ে আসুন। সেবা যত্ন করবে।

জাহিদা হাসে। রিহানা ম্যাম বলতে থাকে,”জারিফের চাকরির কি খবর? হলো কিছু?”

_ঐ তো,সব যায়গা থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক আসছে।

_বেশ,ভালোয় ভালোয় একটা চাকরি পেয়ে গেলেই হয়। তারপর বিয়ে করিয়ে দেবেন ছেলেকে।

_হু। দোয়া করবেন। আমার ছোটো বোনের মেয়ে অরিনকে তো চিনেন?এই স্কুলের ছাত্রী ছিলো,এস.এস.সি. ২০১৮ ব্যাচ। এখন একাউন্টিং নিয়ে পড়ছে, দ্বিতীয় বর্ষে আছে। ওকে পছন্দ করে রেখেছি জারিফের জন্য।

রিহানা এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচুগলায় বলে,”জারিফের অন্যত্র রিলেশন আছে নাকি তা না জেনেই পছন্দ করে ফেললেন?”

জাহিদা চিন্তিত ভঙ্গিতে রিহানার দিকে তাকায়,বলে,”বুঝলাম না আপা।”

_আসলে প্রায়ই জারিফের সাথে একটা মেয়েকে দেখি,সার্কিট হাউসে। স্টাফ কোয়ার্টারের দিঘির পাড়েও দেখেছি বেশ ক’দিন। ভেবেছি হয়তো প্রেমিকা। মেয়েটি সুন্দর, দু’জনকে ভালোই লেগেছে একসাথে।

জাহিদা আনাম রিহানার দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থেকে তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে। অনেক খুঁজে খুঁজে দোলার একটা ছবি বের করে রিহানার সামনে তুলে ধরে বলে,”আপনি কি এই মেয়েটার কথা বলছেন আপা!”

_হ্যা হ্যা। এই মেয়েটাই তো। আপনি একে চিনেন নাকি!

ধাক্কাটা সামলে উঠতে জাহিদার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। তার সমস্ত শরীর ভেঙেচুরে যাচ্ছে। রিহানা অবাক হয়ে বলে,”কি হলো আপা। শরীর খারাপ লাগছে নাকি! আর এই মেয়ে কি হয় জারিফের!”

জাহিদা ঝাপসা চোখে রিহানার দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”ও জারিফের ফুপাতো বোন। আর কিচ্ছু না।”

★★★

দুপুরের সময়। অলসতায় চোখ দুটো লেগে যাচ্ছে বারবার। বইটা বুকের ওপর নিয়ে চিৎ হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। ইউরার অর্ধবার্ষিক পরিক্ষা শেষ,দোলারও পরীক্ষা সামনে তাই পনেরো দিনের জন্য ফারিনের সাথে কথা বলে এই টিউশনি টা বন্ধ রেখেছে, অথচ পড়াশোনা কিছুই হচ্ছে না। সারাদিন ঝিম মেরে রুমে বসে থাকে।

তৃতীয় বারের মতো ফোন বেজে ওঠে। দোলা বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে দবির রহমান বলে ওঠে,”ব্যস্ত নাকি তুমি!”

_না পড়ছিলাম। বলো।

_তা তোমার পরিক্ষা কবে? ডেট দিয়েছে?

_হঠাৎ আমার পরিক্ষা নিয়ে পরলে যে আব্বু। ব্যাপার কি!

_তোমার জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। সেটা নিয়েই আলোচনা করতে চাই তোমার সাথে।

_মানে! সেদিন না বললাম আমি বিয়ে করবো না এখনি। আবার কেনো!
দোলা কিছুটা উঁচু গলায় বলে ওঠে।

_শোনো আগে কথাটা, বেশ ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে কোনো ইন্টারমিডিয়েট পাশ কসমেটিকসের দোকানদার না। ছেলে উচ্চ শিক্ষিত,ঢাকায় পড়াশোনা করেছে…..

_থামো থামো আব্বু। তুমি ভেবেছো আমি প্রস্তাব গুলো ফিরিয়ে দিই শুধুমাত্র পাত্র দোকানদার আর অল্পশিক্ষিত থাকতো বলে?

_তবে? অন্য কোনো কারণও তো তুমি বলো নি। পড়াশোনা করতে চাও,করবে পড়াশোনা। এই ছেলে পড়াবে তোমাকে। দিয়ার বিয়েটা আটকে আছে তোমার জন্য,আসিফ বিয়ের অনুমতি পেয়েছে। তুমি এখন এতো নটাঙ্কি করো না।

_তো দিয়ার বিয়ে নিয়ে সমস্যা? তো দিয়ে দাও না ওর বিয়ে। কে বারণ করেছে তোমাদের!

_তুমি অনুমতি দিলেই তো হয়ে যায়না মা। আমরা তো আমেরিকায় থাকি না, এই মফস্বলের সমাজে বড়বোনের আগে ছোটো বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে বড়বোনের খুত আছে বলে ধরে নেয় লোকে। জীবিত থাকতে মেয়ের এতো বড় ক্ষতি তো করতে পারবো না। ভালোয় ভালোয় তোমার বিয়েটা দিয়ে তবেই দিয়ার বিয়েটা দেবো।

_মেয়ের ক্ষতি চাওনা? তো মেয়েকে জোর করে যার তার গলায় ঝুলিয়ে কোন উপকার করতে চাও মেয়ের?

_গলা নামিয়ে কথা বলো, একেবারে মায়ের মতো বেয়াদব হয়েছো। মুখ চালাতে জানো। সবাই খুব একটা খারাপ বলে না, মায়ে মান ঝি!

আচমকাই দোলার দু’চোখ ভিজে ওঠে। সে চুপ হয়ে যায়। দবির বলতে থাকে,”যার তার গলায় ঝোলাবো কে বললো তোমাকে? আমাকে কি এতো অবিবেচক মনে হয়? উপজেলা চেয়ারম্যান তৌকির আহমেদের ছোটোভাই তার বাবাকে দিয়ে তোমার ছোটো চাচার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বিয়ের। যার তার গলায় ঝুলবে না, সারাজীবন রানী বানিয়ে রাখবে তোমায়!”

দোলা ভীষণ অবাক হয়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা কান্না দমিয়ে ফেলে বলে ওঠে,”কার কথা বললে?”

_ছেলের নাম শেখ তৌসিফ আহমেদ। তৌকির আহমেদের ছোটোভাই। ঢাকা থেকে পড়াশোনা শেষ করে বরগুনা এসে বাপের ব্যাবসা সামলাচ্ছে। তোমাকে পছন্দ করেছে। আজ বিকেলে তৌকির আহমেদ নিজে আসবেন আমার সাথে কথা বলতে,ফোনে বললো….

দোলা আর কিছু না শুনেই ফোন কে’টে দেয়। কিছুক্ষণ বিছানায় নিষ্প্রভ হয়ে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে । রেডি হয়ে সে নিচে নেমে একটা রিকশা দাড় করায়। রিকশা ওয়ালা দোলার গন্তব্যের ঠিকানা জানতে চাইলে দোলা বলে,”উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাবো।”

★★★

শেখ বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব। তৌকির-তৌসিফের বাবা তৌফিকুল আহমেদ সপ্তাহখানেক আগে তামিলনাডু থেকে ফিরেছেন চিকিৎসা নিয়ে। তার আসা উপলক্ষে বাড়িতে রাজ্যের মেহমান এসেছে।
তন্ময় আহমেদ,এ বাড়ির মেজো ছেলে স্ত্রী পুত্র নিয়ে এসেছে বরিশাল থেকে। সে তৌকিরের থেকে তিনবছরের ছোটো এবং তৌসিফের থেকে সাত বছরের বড়। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের প্রফেসর তন্ময় , পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকে। তৌসিফেরা পাঁচ ভাইবোন, তৌকির, তন্ময়, তৌসিফ,তানিয়া,তারানা। তৌসিফের ভাই বোন সবার বিয়ে হয়েছে। শুধুমাত্র তৌসিফ বাকি ছিলো। তৌসিফই বিয়েতে আগ্রহ দেখাতো না। বাড়ির সবাই এতোদিন চুপ ছিলো, কিন্তু শেখ তৌসিফ আহমেদ পড়াশোনা শেষ করে আঠাশে পা রাখতে না রাখতেই তৌকির আহমেদের ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে। বেশ খোজ খবর লাগিয়েছিলো ঢাকায় তৌসিফের কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা এটা জানতে। কিন্তু সেরকম কিছু জানা যায়নি। বাড়ির ছোটো ছেলেকে নিয়ে সবার একটু অন্যরকম আশা। পাত্রী দেখাও শুরু করেছিল সবাই।
হুট করেই একদিন বড় ভাবী ফারিনের কাছে তৌসিফ সরাসরি জানিয়ে দিলো দোলাকে তার ভালো লেগেছে,বিয়ে করতে চায়। সবাই প্রথমে অবাক হয়েছে কিছুটা। পরে চিন্তা করে দেখলো দোলা তৌসিফের উপযুক্ত। অসম্ভব সুন্দরী, চব্বিশ বছর বয়স, বয়স অতি অল্প নয়-বেশিও নয়, একেবারে ঠিকঠাক। সবথেকে বড় কথা দোলার মতো শান্তশিষ্ট ভদ্র মেয়ে খুব কমই দেখা যায় আজকালকার দিনে। তাই সামাজিক অবস্থান নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই সবাই একবাক্যে খুশি মনে তৌসিফের পছন্দকে মেনে নিয়েছে। এর মাঝে তৌসিফের বাবা তৌফিকুল আহমেদ ইন্ডিয়া চলে যায়। সিদ্ধান্ত হয় সে ফিরলেই বিয়ের কথা আগাবে। হলোও তাই, তৌফিকুল আহমেদ ফেরার দিনই ফারিন গিয়ে শশুরকে বলে,“এবার তবে প্রস্তাব টা পাঠিয়ে দিন।”

শেখ বাড়ির সবাই ধরেই নিয়েছে সপ্তাহখানেকের ভেতরে বিয়েটা হয়ে যাবে। এই মফস্বলে শেখরা নামী লোক,বিত্তবান, তা কারো অজানা নয়। দোলার পরিবার নিশ্চয়ই এক বাক্যে রাজি হবে এই প্রস্তাবে। তাই এখন থেকেই তারা প্রস্তুতি শুরু করেছে বিয়ের। তানিয়া আর তারিন তো শশুরবাড়ি থেকে আগেভাগেই চলে এসেছে।

ল্যাপটপে কিছু হিসেব দেখছিলো তৌসিফ। হঠাৎ ইউরা এসে দরজার বাইরে থেকে ডাকে,”চাচ্চু!”

তৌসিফ মাথা তুলে তাকায়।

“কিছু বলবি?”

_মা তোমাকে ডেকেছে।

তৌসিফ ল্যাপটপ রেখে পাশ থেকে টি-মগ টা তুলে উঠে দাঁড়ায়। সোজা হেঁটে ভাই ভাবীর ঘরে যায়। ফারিনের ঘরে তৌসিফের মেজো ভাবী শান্তাও ছিলো। দুই ভাবী তৌসিফকে দেখে মজার ছলে বলে ওঠে,”এখনই ঘরকুনো হয়ে গিয়েছো! বৌ আসলে তো সপ্তাহে একদিন ঘর থেকে বেরোবে ভাই!”

ভাবীদের মস্করায় তৌসিফ নির্বিকার। গম্ভীর হয়েই বললো,”কিছু হিসেব দেখছিলাম। বলো!”

শান্তা খানিকটা খোঁচা মেরেই তৌসিফকে বলে,”ভেবেছিলাম ঢাকা থেকে এ বাড়ির ছোটো বৌ আসবে। কিন্তু দেখছি তুমিও তোমার ভাইদের মতো বাড়ির পাশের নদীতেই ডুবলে!”

তৌসিফ বাঁকা হাসি হাসে। শান্তা বলতে থাকে,”এভাবে বিয়ে করবে বুঝতে পারিনি। কিছুদিন প্রেম করে নিতে পারতে। একটু বাজিয়ে দেখতে।”

_আমার যা দেখার দেখে নিয়েছি।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় তৌসিফ।

শান্তা মজার ছলে বলে,”তাই নাকি! তা কি কি দেখালো? মুখটা তো ওড়নার নিচেই থাকে।”

ফারিন শান্তাকে থামিয়ে তৌসিফকে বলে,”তোমাকে ডেকেছি এক জরুরি কাজে ভাই। আমার শাশুড়ি মায়ের যা গয়না তার ছোটো ছেলের বৌয়ের জন্য রেখে গিয়েছে তার বাইরে আর কি কি গড়াতে দেবো! একটা লিস্ট করছি। তুমি একটু দেখবে?”

_লিস্ট দেখার প্রয়োজন নেই। যা যা দিয়ে অলংকৃত হওয়া যায় সব লাগবে। তবে সবকিছুই বেস্ট আর ইউনিক হতে হবে, তৌসিফের পছন্দের মতো ইউনিক!

চলমান…..

জনম জনমে পর্ব-০৩

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৩
#ইসরাত_ইতি

পরীক্ষার দেড় মাসও সম্ভবত বাকি নেই। অথচ দোলার কাছে এই সেমিস্টারের সব বই নতুন, একেবারে ঝা চকচকে। হাতে নিয়ে একটি বার দেখেওনি। সিজিপিএ ডাউন হলে ফুপু ফুপারা ঢোল বাজাতে বাজাতে চলে আসবে তাদের বাড়ি নতুন সম্বন্ধ নিয়ে,পাত্র ইতালি প্রবাসী অথবা সদরে বড় কসমেটিকসের দোকান আছে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে নৃত্য করবে মাকসুদা। দবির রহমানের আদরের ছোটোবৌ। দোলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবে ,”লেখাপড়া করে কতদূর যেতে পারবে! পাতিলের কালি কপালে না লাগিয়ে পারবে? বাপের অবাধ্য হলে সেই মেয়ের কোনোদিন সুখ আসে না কপালে।”
দোলার বাবাও মিনমিন করে বলবে,”দিয়ার জন্য বাড়িতে প্রস্তাব আসছে,দিয়ার মা চাচ্ছে বিয়েটা দিতে। তুমিও বিয়েতে অমত করো না। ছেলে ভালো,বিয়েটা করে নাও। আমার বয়স বাড়ছে। তোমাদের একটা গতি করে যেতে চাই।”

আরো অনেক অনেক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা হবে দোলাকে। একদিকে বাড়ি থেকে ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানি,অন্যদিকে জারিফের মায়ের দোলার প্রতি বিতৃষ্ণা। সবকিছুর মধ্যে পরে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হতে হবে দোলাকে।

আচ্ছা দোলা যদি জারিফের সাথে পালিয়ে যায় তাহলে কেমন হয়? লেকের স্বচ্ছ পানিতে নিজের দোদুল্যমান প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রশ্নটি করে সে।
তাহলে কেমন হবে? পরমুহূর্তেই তার হাসি পায়। আচ্ছা সে না হয় পালালো, কিংবা জারিফ তাকে নিয়ে আলাদা হলো,তারা দুজন সুখী হলো আর ঐ মানুষটা? যে জারিফকে দশমাস পেটে ধরেছিলো,সে? তাকে কাঁদিয়ে দোলা আর জারিফ পাবে সুখ? তাকে খুশি করতে হলেও যে দোলাকে কাঁদতে হবে। মোদ্দাকথা একজনকে কাঁদতে হবেই। সেই একজন কে হবে? দোলার সাহস হয়না সেই একজন হতে। বড্ড মায়ায় পরে গিয়েছে ঐ অপদার্থ বেকার নড়বড়ে শিরদাঁড়ার ভীতু ভীতু মানুষটার। তার কিনে দেওয়া ওষুধ পত্র, তার কিনে দেওয়া কাচ্চি তার “দুলি” ডাকটার। সবকিছুর মায়ায় পরে গিয়েছে দোলা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ায়,”কেনো লাই দিলি! এড়িয়ে গেলিনা কেনো! বুঝ হবার পর থেকে জড়ো হওয়া অনুভূতিদের কেনো বেহায়ার মতো সামনে আনলি। ওরটাও কেনো বুঝে নিয়ে মন বাগানে গোলাপ ফুটালি। এখন কি হবে দোলা? যতটা সাধারণ বলে তুই ভেবেছিলি সমস্যাটা, এখন কেমন ঠেকছে?”

দোলা পুনরায় ফোঁস শব্দ করে নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বরগুনা নাথপট্টি লেকপাড় হয়ে হেঁটে যাচ্ছে ফার্মেসী পট্টি। স্যানিটারি প্যাড ফুরিয়ে গিয়েছে,নিতে হবে।

হাতের মুঠিতে তার বেতনের টাকা,সাথে বোনাসও। হাঁটতে হাঁটতে সে গার্মেন্টস পট্টিতে এসে থেমে যায়। একবার হাতের টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে আশেপাশে তাকায়। বাড়তি দুই হাজার টাকা দিয়ে তার খুব ইচ্ছে করলো জারিফের জন্য একটা শার্ট নিতে। সবসময় দোলাকে দেয়,দোলা খুব কমই দেয়। বলতে গেলে দেয়ই না। জারিফকে শুধু শুধু অযোগ্য প্রেমিক বলে দোলা, সে নিজে কি? না কখনো উপহার দিয়েছে না দিয়েছে একটা শুকনো চু’মু, যা সব প্রেমিকারাই কালে ভদ্রে দিয়ে থাকে প্রেমিককে। ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলে সে।

একটা পরিচিত দোকানে ঢুকেই দোকানদারকে মিডিয়াম সাইজের কটনের শার্ট দেখাতে বলে দোলা। বেশ সময় নিয়ে একটা পছন্দও করে ফেলে। গাঢ় নীল রঙের শার্ট টা। জারিফ এককথায় সুদর্শন, সুদেহী একজন যুবক। না যুবক নয়, পুরুষ। ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশে পরতে চলেছে বয়স,সে তো পুরুষই। দোলা কল্পনা করে দেখলো তাকে ভীষণ মানিয়েছে শার্টটাতে। তার ঠোঁটের কোনে হাসি‌ ফুটে ওঠে জারিফের গায়ে এই শার্ট টা কল্পনা করে।

“দোলা আপু!”
বাচ্চা বাচ্চা পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে দোলা চকিতে ঘুরে তাকায়। জাহিন তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। জারিফের ছোটোভাই অবিকল জারিফের মতোই দেখতে। তবে তার এখনও গোঁফ ওঠেনি। উঠবো উঠবো করছে। সে ছাত্র এবার ক্লাস সেভেনের। পড়ছে বরগুনা জিলা স্কুলে।

দোলা খুশি হয়ে এগিয়ে যায়। জাহিনকে জরিয়ে ধরে,উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,”কেমন আছিস?”

_আমি ভালো। তুমি?

_আমিও ভীষণ ভালো আছি।

_এখানে কি? সেই তখন থেকে সাইকেলের বেল বাজিয়ে তোমাকে ডেকে যাচ্ছিলাম। তোমার কানেই গেলো না।

দোলা হাসে,জাহিনের গালে হাত বুলিয়ে বলে,”কানে একটু কম শুনছি ইদানিং।”

_তাই নাকি! তবে তো বর জুটবে না।

_তোকে বিয়ে করবো। তুই আছিস তো।

জাহিন হাসে‌। দোলা দোকানদারকে পছন্দ করা শার্ট টা প্যাক করে দিতে বলে জাহিনের দিকে তাকায়,বলে,”চল তোকে আইসক্রিম খাওয়াই।”

★★★

দোলার বাবা দবির রহমান অতীত জীবনে একজন কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন, পরবর্তীতে ব্যাবসায় লস খেয়ে গৃহস্থী হয়েছেন। যা জমিজমা আছে সব বর্গাচাষীদের দিয়ে বছরটা ভালোয় ভালোয় কেটেই যায়। খুবই শান্ত প্রকৃতির লোক। তার কোনো শত্রু নেই। এতটাই নিরীহ সে। হাটার সময় যদি কোনো ল্যাম্পোস্টের সাথে ধাক্কা খায় তাহলে দাঁড়িয়ে সে সেই ল্যাম্পোস্টের কাছে মাফ চাইবে। এই ধরনের মানুষের কোনো শত্রু থাকতে পারে না। বরং যার ঘরে এতো সুন্দর তিনটি কন্যা রয়েছে তার এলাকায় একটু অন্যরকম মান। বিশেষ করে এলাকার ছোকরা সম্প্রদায়ের কাছে।

বাইরে সে যে কারনেই মান পাক,ঘরে তার মান নেই-ই বলতে গেলে,মানে নিজের স্ত্রীর কাছে। প্রথম জীবনে দোলার মা মিলাও মান দেয়নি, বর্তমান স্ত্রীও সেরকম।

মাকসুদা এক কাপ আদা চা এনে দবির রহমানের সামনে রেখে বলে,”কথা ছিলো।”

_বলো।

_একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে দোলার জন্য।

_নতুন কি। আসতেই পারে। মেয়ে রাজি না,বললো।

_দিয়ার বিয়ে দেবে না?

_দেবো।

মাকসুদা বসে দবিরের দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ে বলে ওঠে,”তো দোলার বিয়েটা না হলে ওর বিয়েটা কিভাবে দিই?”

দবির মাথা তুলে স্ত্রীর দিকে তাকায়। মাকসুদা বলতে থাকে,”আসিফ অনুমতি পেয়েছে বিয়ের। মঞ্জু আপাও আর দেরি করতে চাইছে না। আমাকে বলে দিয়েছে সামনের মাঘে আসিফ ছুটিতে এলেই কাবিন করে রাখবে দিয়া আসিফের। এদিকে তোমার বড় মেয়ে বিয়ে করবে না বলে পণ করেছে। আচ্ছা এখন ওর আগে দিয়ার বিয়ে দিলে সেটা তোমার ভালো লাগবে? লোকে পাঁচ কথা না শুনিয়ে ছেড়ে দেবে?”

দবির শুধু চেয়ে রয় স্ত্রীর দিকে। মাকসুদা বলতেই থাকে,”এমনিতেই সারাবছর শহরে হোস্টেলে পরে থাকে। চরিত্রে দাগ লাগা নিয়ে এখনি কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছে। বড় পুকুর পাড়ে গেলেই শুনতে পাবে। সৎ মা হতে পারি আমি, তবে অতটাও খারাপ না যে এসব শুনলে আমার খুব ভালো লাগে। মেয়েকে বোঝাও। বিয়েটা করে নিক।”

দবির রহমান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন মাকসুদার কথা। মনে হলো তিনি আমলেও নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,”সম্বন্ধ এসেছে বললে! ছেলে কি করে?”

মাকসুদার ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি। সে স্বামীর দিকে কিছুটা এগিয়ে যায় পাত্রের নাম ঠিকানা বলার জন্য।

★★★

দশহাজার স্টেপ কম্প্লিট। শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ঘর্মাক্ত টি শার্ট টা খুলে কাউচের ওপরে রেখে কিছুক্ষণ ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নেয় । ফোনের রিংটোনে তার মনোযোগ বাধাপ্রাপ্ত হতেই সে ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলে,হাতে তুলে নেয় ফোনটা।‌ জরুরি ফোনকল, দুমিনিট হু হা করে কিছু বলে ফোনটা আনলক করে হুট করেই ফটো গ্যালারিতে ঢোকে। এখানে দোলার একটা ছবি আছে। ছবিটা ক্যান্ডিড, ছবিতে দোলার আতঙ্কিত,লালাভ মুখবিবর। কপালের কাছে কিছু অগোছালো চুল।
তৌসিফের ছোটো বোন তারানার পান চিনির দিনে দোলা ইউরাকে পড়াতে এসেছিলো। তৌসিফ তখন তারানার ছবি তুলছিলো। আচমকাই,অজান্তে মাঝখানে চলে এসেছিলো গোলাপী রঙের সুতি সালোয়ার কামিজ পরিহিতা,মাথায় ওড়না টেনে দেয়া ছিমছাম গড়নের মেয়েটি। তৌসিফ ক্যামেরার সামনে কারো অযাচিত আগমনে ভ্রু কুঞ্চিত করলেও মেয়েটার মুখদর্শন করতেই তার কপালের ভাজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ক্ষনকালের জন্য দু’জনের চোখাচোখি হয়, মেয়েটা ঘা’ব’ড়ে যাওয়া শুকনো মুখটা নিয়ে একছুটে ইউরার ঘরে ঢুকে যায়। বেচারী জানতেও পারেনি সে পালাতে পারলেও তার ঐ ঘাবড়ানো রূপীয়সী বদন পালাতে পারেনি,বন্দী হয়েছে ক্যামেরায়,বন্দী হয়েছে শেখ বাড়ির জেদী ছোটো পুত্রের চিত্তে।

তৌসিফ ছবিটা জুম করে দেখতে দেখতে পানির বোতল তুলে পানি খেয়ে নেয়।

শরীরে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। ফোনটা রেখে তোয়ালে উঠিয়ে ওয়াশরুমে যায়। দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার নেয়। এখন সময় বিকাল সাড়ে চারটা। দোলা ইউরাকে পড়াতে এসেছে আড়াইটায়। এখন সম্ভবত বেরোবে।
ধূসর রঙের ট্রাউজার আর কালো রঙের টিশার্টে নিজের সুঠাম তনু গলিয়ে নিয়ে ট্রাউজারের দু পকেটে হাত গুজে রুম থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরে, ইউরার ঘরের দিকে তাকায়। তারপর নিচে নামে।

মিনিট খানেক পরে দোলা আর ফারিন কথা বলতে বলতে সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে। তৌসিফ বসার ঘরের বড় সোফাটাতে বসে ছিলো,সেন্টার টেবিলটা মুখোমুখি টেনে তার ওপর ল্যাপটপ রেখেছে। গম্ভীর মুখে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে ল্যাপটপে।

দোলা নামতেই তৌসিফকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পরপর সে স্বস্তি পায় এটা দেখে যে তৌসিফ নামের অদ্ভুত চাউনীর লোকটার মনযোগ ল্যাপটপে,তার দিকে নয়। ফারিনের পিছু পিছু সে তৌসিফের সামনে থেকে দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যায়। তাড়াহুড়ো,সংকোচে সে দেখেনি তৌসিফ দোলার দিকে না তাকালেও একজোড়া রঙিন পাথরের পায়েলে অলংকৃত দোলার ধবধবে ফর্সা সুগঠিত পদযুগলের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিতে কসুর করে নি।

ঐ আশ্চর্য মোহিত করা সুডৌল চরণদ্বয় দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতেই তৌসিফ ফিচেল হাসে। পর পর সে হাসি মিলিয়ে যায়, সে কাজে মন দেয়।

★★★

রাত বাড়ছে, দোলা বুঝতে পারছে তার ঘুমানো উচিত কিন্তু তার মধ্যে বিছানায় যাওয়ার কোনো তৎপরতা দেখা যায়া না। একপ্রকার জোর করে চেয়ারে ঠেসে বসে আছে। হাতে তার ফিন্যান্স বইটা। গোটা পাঁচ মাস ফাঁকি দিয়ে দোলা “সময়ের একফোড় অসময়ের দশ ফোড়” কথাটার মর্মার্থ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু এখন বুঝে লাভ কি! কোনমতে ফেইল ঠেকাতে পারলেই হলো,সামনে মানোন্নয়ন পরিক্ষা দিয়ে পুষিয়ে নেবে না হয়!
টিউশনি করে নিজের খরচ মেটাতে গিয়ে দোলার ছাত্রীজীবন অধঃপতনে গিয়ে পৌঁছেছে দোলা বুঝতে পারছে।

ফোনের রিংটোনে চোখ থেকে,যেটুকু ঘুম ভাব ছিলো, কে’টে যায়। সোৎসাহে রিসিভ করে আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,”বলো।”

জারিফ বলে,”ঘুমাচ্ছিস না কেনো। বাতি জ্বেলে এতো রাত অবধি কি করছিস!”

দোলা সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে তার কামরার জানালার কাছে যায়। ব্যস্ত হাতে জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারে পশ্চিমের ল্যাম্পোস্টে। ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলির রাস্তায় পশ্চিম পাশের মরচে ধরা ল্যাম্পোস্টের টিমটিমে আলোর নিচে দাড় করানো নীল রঙের বাইকটাতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফজিলাতুন্নেসা হোস্টেলের তিনতলার তিনশো চার নাম্বার কক্ষের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা জারিফকে দেখে চোখ জুড়িয়ে নেয় দোলা।

ভাণ করে আপত্তি তুলে বলে ওঠে,”রাত কত গভীর। যাচ্ছো না কেনো! এলে কেনো!”

এমন ভাবে বললো যেন দোলা অতীষ্ঠ হয়ে গিয়েছে জারিফকে দেখে। জারিফ দোলার অভিনয় ধরে ফেলেছে,সে নিরব হেঁসে
বলে,”শার্ট টা পরেছি। কেমন লাগছে!”

_খারাপ না।

_আন্সার ইন পজিটিভ!

_ঠিকঠাক।

দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে কানে ফোন চেপে রেখে। শুনছে কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ,আলো আধারিতে আবছা দেখতে পাচ্ছে একে অন্যের মুখটা। মুখাবয়াব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

খনিক বাদে জারিফ নীরবতা তাড়িয়ে বলে,”কাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছে,যদি চাকরিটা এখানেই হয়ে যায় তবে আর অপেক্ষা না করে মাকে…..”

_থামো, বলো না। এতো পরিকল্পনার কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না, বর্তমানটাকে একটু উপভোগ করতে দাও। অনিশ্চিত দিনের কথা বর্তমানে টেনে এনে যন্ত্রনা দ্বিগুণ করো না।

জারিফ চুপ হয়ে যায়। দোলাও চুপ। কে’টে যায় আরো কিছুক্ষণ সময়। গলির সরু রাস্তা থেকে শেষ দু’টো রিক্সা চলে গেলো ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে। উত্তর পাশে শেফা ফার্মেসির সামনে হঠাৎ দু তিনটে কুকুর ডেকে উঠতেই দোলা আর জারিফ দু’জনেই চ’ম’কে ওঠে।

জারিফ এদিক ওদিক খুজে একটা ইটের টুকরা তুলে কুকুর গুলোকে তাড়িয়ে দোলাকে বলে,”ঘুমিয়ে পর।”

ফোন কাটে। জানালার পর্দা টেনে জানালা লাগিয়েও দেয় দোলা, জারিফ তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। দোলা ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে বাইক স্টার্ট হয়। আওয়াজ তুলে ছুটে যায় নীল রঙের এপাচি আরটিআর।

★★★

জাহিদা আনাম ডিভানে বসে নবম শ্রেণীর অর্ধবার্ষিক পরিক্ষার বাংলা খাতা দেখছিলেন। চোখে তার সোনালী ফ্রেমের চশমা।

জাহিন হাই তুলতে তুলতে মায়ের পাশে এসে বসে মায়ের গায়ে ঢলে পরে। জাহিদা খাতা থেকে চোখ না সরিয়ে বলে,”দেড়টা বাজে প্রায়। ঘুমাচ্ছো না কেন! সকালে স্কুল মিস যাবে!”

জাহিন জবাব না দিয়ে গুটিসুটি মে’রে বসে থাকে। এতক্ষণ কম্পিউটারে গেমস খেলছিলো,এখন বেশ খিদে পেয়েছে। মাকে বললেই মা বলবে,”ভাত খাও।”
কিন্তু জাহিনের এখন চাউমিন খেতে ইচ্ছে করছে,মাকে বলার সাহস হচ্ছে না।

বাইরের আঙ্গিনায় বাইক থামে,পর পর কলাপসিবল গেট খোলার আওয়াজ হয়। জারিফ বাইক উঠিয়ে,গেট বন্ধ করে সদর দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপার আগেই দরজা খুলে যায়। জারিফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হেঁসে বলে,”সরি মা! সিয়ামের মা ছাড়তে চাচ্ছিলো না।”

_বয়স ছাব্বিশ টা মায়ের বকুনি খাওয়ার বয়স না,তাই সেরকম চলবে।

জারিফ ঘা’ড় কাত করে, ঘা’ড়ের কাছে ট্রিম করা চুলে হাত বুলিয়ে বসার ঘরে পা রাখে। জাহিদা আনাম গিয়ে তার খাতা দেখতে বসে। জাহিন ভাইকে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসে। কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলে,”নতুন শার্ট!”

জারিফ ই’তস্তত করে বলে,”হু। আজ নিলাম।”

জাহিন কয়েক মুহূর্ত কিছু মনে করার চেষ্টা করে বলে,”আরেহ! কি আশ্চর্য। ভাইয়া জানিস গতকাল গার্মেন্টস পট্টিতে দোলা আপুর সাথে দেখা হয়েছিলো, সেও জেন্টস পয়েন্ট থেকে হুবহু এরকম একটা শার্ট নিয়েছে। একেবারে সেইম!”

জাহিদা ছাত্রের খাতায় প্রাপ্ত নাম্বার লিখতে যাচ্ছিলো,ছোটো ছেলের কথায় তার হাত থেমে যায়।

জারিফ এক প্রকার হোঁচট খেয়ে সরাসরি মায়ের দিকে তাকায়। দেখতে পায় মা তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে।

জাহিন বকবক করে যাচ্ছে গতকাল দোলা আপুর সাথে দেখা হবার পরে কি কি হয়েছে। সেকথা জাহিদা আনাম আর তার বড়ছেলের কানে পৌঁছায় না। দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে। একজনের দৃষ্টিতে ধরা পরার আতঙ্ক আরেকজন তাকিয়ে আছে অবাক চোখে, হতবাক হয়ে।

চলমান….

জনম জনমে পর্ব-০২

0

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_২
#ইসরাত_ইতি

“আমরা বিয়েটা কবে করছি জারিফ?”

সরাসরি এই প্রশ্নটিতে জারিফ কিছুটা হকচকায়। এমনিতে দোলা কখনও সরাসরি বিয়ের কথা তোলে না। আজই প্রথম এমন হলো,কন্ঠে ছিলো অধীরতা।

জারিফের থেকে দোলা কোনো উত্তর না পেয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। তার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। জারিফ নিস্প্রভ বসেই ছিলো,দোলাকে হাত ধুতে দেখে সে টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু বের করে দোলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বরাবরের মতো বলে,”পেট ভরেছে?”

বরাবরের মতো দোলারও চোখ ভিজে উঠতে চায়। এবং সে বরাবরের মতো তা পাত্তা না দিয়ে উপর নিচে মাথা ঝাঁকায়। মুখে বলে,”চলো ওঠো। আড়াইটা বেজে গিয়েছে। তুমি বাড়িতে যাবে, খাবে!”

ওয়েটার এসে বিল নিয়ে যায়। জারিফ চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। দোলা নিজের ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয়।

রেস্তোরাঁর বাইরে এসে জারিফের বাইকের কাছে এসে দাঁড়ায় দোলা।জারিফ বাইকে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে উঁচু গলায় ডেকে একটা রিক্সা দাড় করায়।

দোলাকে ইশারা করে রিক্সাতে উঠতে। দোলা রিক্সায় উঠে বসতেই জারিফ রিক্সাওয়ালাকে বলে,”সার্কিট হাউস মাঠে নিয়ে যান।”

দোলা জারিফের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। জারিফ উত্তর দেয়না। রিক্সা চলতে শুরু করলে বাইক নিয়ে রিক্সার পিছু পিছু যেতে থাকে।

বরগুনা সদরের সার্কিট হাউস মাঠটা দুপুর সময়টাতে বরাবর শান্ত, নিড়িবিলি এবং নিস্তব্ধ একটা স্থান, শুধুমাত্র বিকেল এবং সকালের সময়টায় ভিন্ন রূপ থাকে, বিকেল সময়টায় লোকসমাগম বাড়ে। ফুচকার ভ্যান আসে, আসে তরুণ-তরুণীরা, আসে মধ্যবয়সী অভিভাবকের দল তাদের বাচ্চাদের নিয়ে,বৈকালিক ভ্রমণে। সকালেও সরকারি কর্মকর্তারা জগিং করতে আসে এই স্থানে।

এখন সময় তিনটা সাতাশ মিনিট। আশেপাশে তাকালে কাকপক্ষীও দেখা যাচ্ছে না। শুধু মহিলা কলেজ থেকে সদর হাসপাতাল বরাবর রাস্তা টাতে দুয়েকটা পায়ে চালিত রিকশা দেখা যাচ্ছে।
আকাশটাও কেমন গুমোট হয়ে যাচ্ছে,তবে মেঘের দলা এতো তাড়াতাড়ি যে এই মফস্বলে ঝাঁপিয়ে পরবে না তা নিশ্চিত। জারিফের ফোনের ওয়েদার ট্র্যাকার তাই বলছে। সে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে চুপচাপ, নির্বিকার চিত্তে। তার ডানপাশে বসেছে দোলা। মাঝখানে এক হাত দূরত্ব। সেখানে রাখা দোলার ব্যাগ আর একটা বই। জারিফের বাম পাশে একটা শপিং ব্যাগ।

দোলা নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে,”তুমিও রেস্তোরাঁয় খেয়ে নিলেই পারতে!”

_আসলে খিদে নেই। ব্রেকফাস্ট করেছি সাড়ে বারোটার সময়। তাই ভাবলাম যখন খিদে পাবে তখনই বাড়িতে যাবো।

_খাওয়া দাওয়া নিয়ে বড্ড অনিয়ম করো তুমি।

_হ্যা,অনিয়ম আমি করি আর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ মাসভর তুই খাস।

দোলা মুখ শুকনো করে বসে আছে। জারিফ তার বাম পাশ থেকে একটা প্যাকেট উঠিয়ে দোলার ব্যাগের ওপর রাখে।

দোলা বলে,”কি এটা?”

_ওষুধ।

_আবার! আমার প্রেসক্রিপশন কই পেলে তুমি!

_সেটা বড় কথা না,বড় কথা হচ্ছে এখানে একমাসের ওষুধ আছে। শেষ হলে আমাকে বলবি।

দোলা চুপ করে থাকে। মানুষটাকে নিষেধ করেও লাভ নেই। সে এসব করবেই। সে নিচু স্বরে বলে,”তুমি প্লিজ তুই তোকারি করাটা বন্ধ করবে?”

জারিফ হেসে ফেলে, বলে,”কি সমস্যা বললে? তোর মান কমবে?তুই বলতেই বেশি ভালো লাগে।”

দোলা মাথা ঘুরিয়ে নেয়। জারিফ খানিক বাদে বলে ওঠে,”বিয়ের কথা তুলছে বাড়ি থেকে তোমার?”

দোলা তাকায় না জারিফের দিকে,শুধু মুখে বলে,”হু।”

জারিফ পুনরায় চুপ হয়ে যায়। কেউ আর কোনো কথা বলে না। বেলা গড়িয়ে পরেছে। সার্কিট হাউস মাঠে দু একজন লোকের টিকি দেখা যাচ্ছে। একটা ফুচকার ভ্যান চলে এসেছে। জারিফ সেদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আর ছ’মাস সময় দিতে পারবি না?”

_তারপর কি হবে?

_শিরদারায় জোর আসবে। কারো দায়িত্ব নেয়ার মতো জোর।

_এখন কিভাবে নিচ্ছো তবে!

_এগুলো খুচরা দায়িত্ব। বেকাররা এসব নিতে পারে।

_কথা সাজাতে হবে না, মামী আমাকে মানবে না তা আমি জানি। সেসব জেনেই তো আগুনে ঝাঁপ দিয়েছি,পুড়বো বলে। তবে তুমি যদি ভেবে থাকো মামীকে মানাতে না পারলে চাকরি টা পেয়েই আমাকে নিয়ে আলাদা হবে, এমন পরিকল্পনা করলে জেনে নাও,অমন বিয়েতে আমার সম্মতি নেই।

_তাহলে কি চাস তুই?
সরাসরি দোলার মুখের পানে চেয়ে প্রশ্ন করে বসে জারিফ।

_তোমার মতো কেউ জানে না জারিফ আমি কি চাই!

_চাকরিটা পেয়ে মাকেও মানিয়ে নেবো।

_ঠিকাছে তবে, বললাম তো অপেক্ষায় আছি।

দু’জনই নীরবতা পালন করতে ব্যস্ত। অদ্ভুত এক জোড়া প্রেমীর অদ্ভুত নীরব প্রেমবিনিময়। না কেউ মুখে বললো দু’টো প্রেমময় কথা, না আঙুলে আঙুল ছুঁলো তাদের। যেভাবে চুপিচুপি নীরবে সবটা শুরু হয়েছিলো বছর চারেক আগে। সেভাবেই দুজন বসে আছে,নীরব হয়ে।

দোলার ব্যাগের পাশ থেকে শরৎচন্দ্রের “দেবদাস” উপন্যাসটা তুলে নিয়ে জারিফ দোলার দিকে তাকিয়ে বলে,“এটা সাথে নিয়ে ঘুরছিস কেনো?”

_এশা চেয়েছে, নাথপট্টি ওর বাড়িতে দিয়ে যাবো যাওয়ার সময়।

কিছুক্ষণ বইটা উল্টেপাল্টে জারিফ স্মিত হাসি হাসে,বলে,”দেবদাস…তোর আর মায়ের ইগোর চক্করে কোনদিন না জানি আমার অবস্থা এমন হয়।”

দোলা না চ’মকালো,না ঘাব’ড়ালো,সে শুধু একপলক জারিফের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

জারিফ বললো,“আচ্ছা একটু মজা করছি,রেগে যাসনা! একটা দৃশ্য কল্পনা কর। ধর তুই পারু। আমি তোর দেবদা। পারিবারিক দ্বন্দ্বে তোর অমন করে অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হলো। আমি ওভাবে মাতাল হয়ে তোর দুয়ারে গিয়ে চেগিয়ে পরে থাকলাম। তুই শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দৌড়ে দৌড়ে এলি, কাঁদতে কাঁদতে। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা বিষাদের সুর বাজতে থাকবে আর তুই আমার কাছে পৌঁছানোর আগেই…….”

দোলা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে জারিফের দিকে,তবুও জারিফ দমে যায়। কথা থামিয়ে বোকা বোকা হেসে বলে,“সরি!”

দোলার নাকের পেশী প্রসারিত-সংকুচিত হচ্ছে। জারিফ উচ্চশব্দে হেসে উঠতে চেয়েও ওঠে না। নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে, বলে,”বললাম সরি!”

_এতো অনিশ্চয়তার ডর লাগছে এখন? হাঁটু কাঁপছে? ম’রলে কেনো আমার মাঝে তবে! ম’রতে এসেছিলে কেনো?

_তুই তো তোর কপালে স্ট্যাম্প মে’রে লিখে রাখিস নি,এখানে ম’রা যাবে না!

_সংযত হওয়া উচিত ছিলো।

_সামান্য মজা করেছি দুলি! তুই টেনে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস! আচ্ছা সরি। প্লিজ বাদ দে!

_হু,বাদ।

একজন দুজন করে লোকজন আসতে শুরু করেছে সার্কিট হাউস মাঠে,কেউ বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে,কেউ তাদের পোষ্য,কেউ কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে আসছে, সম্ভবত কোচিং সেন্টার থেকে বন্ধুদের সাথে হাওয়া খেতে এসেছে।

জারিফ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে উঠে দাঁড়ায়,উঠে দাঁড়ায় দোলাও,বেলা গড়িয়ে গিয়েছে বেশ,বিকেল পাঁচটার আগে হোস্টেলে ফিরতে হবে। মাঠের একপাশে এক ফুলওয়ালি কিছু গোলাপ বিক্রি করছিলো। দোলা সেদিকে তাকিয়ে, জারিফ কখনো তাকে একটা গোলাপ তো দূরে থাক,কখনও একটা পাপড়িও দেয়নি। নিজের অপদার্থ প্রেমিকের কথা ভেবে সে মুচকি হাসে। জারিফের তা দৃষ্টিগোচর হয়না, সে খুব স্বাভাবিক ভাবে বেঞ্চের ওপর থেকে অবশিষ্ট প্যাকেটটা উঠিয়ে দোলার হাত থেকে ব্যাগ কে’ড়ে নিয়ে প্যাকেটটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বলে,“তাজের কাচ্চি। সন্ধ্যে নাগাদ গরম গরম খেয়ে নিস!”

দোলা অন্যদিকে ঘুরে ঠোঁট টিপে হাসে,স্বস্তি মাখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে আওড়ায়,“অপদার্থ প্রেমিক!”

★★★

চারদিন হলো বিষয়টি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। কোনো এক বস্তু দোলার নাড়ির ভেতর পাক খেতে খেতে ওপরে উঠছে ‌। ব্যাথাটা সমস্ত বক্ষপটে ছড়িয়ে যায়। গ্যাস্ট্রিকের জন্য দোলা নিয়মিত ওষুধ সেবন করে। এই সমস্যাটা নতুন। হাতে কিছু টাকা চলে আসলেই ডাক্তারের কাছে যাবে বলে ঠিক করলো দোলা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই স্টুডেন্টের টাকাটা এখন অবধি সে পায়নি, কখনো দেরী করে না ওনারা। মাস হতে না হতেই দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে বোনাসও পায় দোলা। এবারই এই প্রথম হলো। দোলা মুখ ফুটে কখনো চায়না,তাই এবারও পারলো না। তার চক্ষু লজ্জা আছে, সবসময় আগেভাগে তার বেতন এবং মাঝে মাঝে বোনাস দেয়,তাদের কাছে চাওয়াটা খারাপ দেখায়। হয়তো এ মাসে একটু অসুবিধা হয়েছে, এদের মতো উচ্চবিত্তদের অর্থসমস্যা হয়না দোলা জানে,হয়তো ভুলে গিয়েছে। মনে পরলেই দিয়ে দেবে।

“ম্যাম। আমার ছুটি?”

সাত বছর বয়সী ইউরার কথায় দোলার ঘোর কাটে। তাকিয়ে তার দিকে হেসে বলে,”জি না। শুধু পড়া ফাঁকি দেওয়া তাই না? চুপচাপ যা লিখতে দিয়েছি,লিখে দাও।”

ফোনটা বিপবিপ আওয়াজ করে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখতে পায় “জন্মদাতা” নামে সেভ করা নাম্বারটা থেকে ফোন এসেছে। দোলা তপ্ত শ্বাস ফেলে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে দবির রহমান রাশভারী গলায় বলল,”বাড়ি আসছো শিগগিরই?”

_না, কেন?

_পুকুর থেকে মাছ তুলেছি। চিংড়ি গুলো ফ্রিজে রেখেছি।

_তোমরা খেয়ে ফেলো। আমার চিংড়িতে এলার্জি।

_কবে থেকে?

দোলার ইচ্ছে করলো চেঁচিয়ে বলতে,“জন্ম থেকে। জন্ম থেকেই এলার্জি। শুধু চিংড়িতে না। আমার জীবনে এলার্জি,আমার বাবাতে এলার্জি,আমার মা’তে এলার্জি,আমার সৎ মা’তে এলার্জি।”

কিন্তু বললো না,শুধু বললো,“কিছুদিন হলো।”

ওপাশ থেকে দবির কোনো কথা বলে না। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ পেলো দোলা। পর পর বললো,”টাকা পাঠাতে হবে না। বোনকে জুতো কিনে দিও ঐ টাকায়। আমার চলছে বেশ।”

ফোন রেখে দোলা ভেজা দু’চোখ মুছে নেয় ওড়নার কোণা দিয়ে। ইউরা ম্যামকে দেখে আবারও লেখায় মনোনিবেশ করে। একবাটি কাস্টার্ড হাতে ঘরে ঢোকে ইউরার মা ফারিন। দোলা নিজেকে সামলে নিয়ে মেকি হাসে।

ফারিনের ঠোঁট জুরে আন্তরিক হাসি। দোলার হাতে কাস্টার্ডের পেয়ালা তুলে দিয়ে বলে,”খাও। শুরুটা তুমিই করো।”

দোলা পরে খাবে বলে রেখে দিতে চায় পাশে,ফারিন বাধা দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,”বলছি খাও।”

দোলা বাধ্য মেয়ের মতো খেতে থাকে। ফারিন মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে দোলাকে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মেয়েটা ভারি মিষ্টি, আকর্ষণীয় মুখশ্রী, গাঁয়ের রং টাও নজরকাড়া। কেউ একবার তাকালে দুবার মুগ্ধ হয়ে তাকাতে ভুলবে না।

খাওয়া শেষ করে দোলা ইউরার পড়া বুঝিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ফারিন তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে,”নাও।”

দোলা এভাবে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে ভীষণ খুশি হলেও শুকনো হাসি হেসে ধন্যবাদ জানায় ফারিনকে। ফারিন মনমরা হয়ে বলে,”এমাসে যে কি হলো দোলা। দুই ননদের বিয়ে, দেবরের এখানে ফেরা, সবকিছু মিলিয়ে এতো অন্যমনস্ক ছিলাম যে তোমার বেতনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আর তোমাকেও বলি, সাতদিন হয়ে গেলো,একটু মনে করিয়ে দেবে না? গতকাল রাতে ইউরার বাবা মনে করালো। যাই হোক খামটা খোলো।”

দোলা অবাক হলেও বাধ্য মেয়ের মতো খামটা খোলে। খাম খুলে দেখে তার বেতনের চার হাজার টাকার সাথে আরো দু হাজার টাকা বাড়তি। দোলার চোখে মুখে বিস্ময়। ফারিন হেসে বলে,”তোমাকে ইউরার বাবা দিলো খুশি হয়ে।”

দোলা খুবই স্বাভাবিক থাকে। তার এভাবে জারিফ ব্যতীত অন্য কারো থেকে বাড়তি নেওয়ার অভ্যাস নেই তবে এখানে ফারিন আর তার স্বামী তৌকির যথেষ্ট আন্তরিক দোলার প্রতি। এর আগেও এমন হয়েছে। দোলা ফেরাতে পারে না এই আন্তরিকতাটুকু।

ফারিন গিয়ে ইউরার কম্পিউটার টেবিলের ওপরে রাখা একটা শপিং ব্যাগ এনে দোলার হাতে দেয়।

দোলা দ্বিতীয় দফায় বিস্মিত হয়ে বলে,”এটা কি ভাবী!”

_তারানা আর তানিয়ার বিয়েতে সবার জন্য এনেছিলাম ঢাকা থেকে। তোমার জন্যও নিয়েছিলাম ফোর পিস টা। তুমি তো বিয়েতে এলে না,তাই দেওয়াও হলো না। এটা নাও। তোমার ভাইয়া নিজে পছন্দ করেছে তোমার জন্য রং টা।

দোলা বেশ কিছুক্ষণ দোনামোনা করে ফারিনের কাছ হার মানে,নিতে হয় উপহার টাকেও।

ফারিনের স্বামী শেখ তৌকির আহমেদ বরগুনা উপজেলার নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান। আল্লাহ দিয়েছেন তাই বিত্তবৈভবের কোনো অভাব নেই তার। তার বাবা শেখ তৌফিকুল আহমেদের জেষ্ঠ সন্তান সে। সামাজিক গণমাধ্যমে একটা গ্রুপে দোলা বছরখানেক আগে টিউশনির খোজ পেতে একটা পোস্ট করেছিলো সেখান থেকেই ফারিনের সাথে দোলার পরিচয়। ইউরাকে পড়ানোর জন্য ফারিন আর তৌকির ঠিক করে দোলাকে। তারপর থেকেই দোলার নিয়মিত যাতায়াত এই শেখ বাড়িতে।

বাড়িটা বেশ পুরনো। ১৯৯১ সালের দিকে বাড়িটা তুলেছিলো শেখ তৌফিকুল আহমেদ। তখনকার দিনেই দু দু’টো ইটের ভাটার মালিক ছিলেন সে। দুই হাজার তেইশে ধনসম্পদ বেড়েছে দশগুণ। মফস্বলের বড়লোকদের অস্থিমজ্জায় অহংকার মিশে থাকে। এ বাড়ির কারো মধ্যেই এসব কিছু দেখেনি দোলা। পরিবারটাকে বেশ হাসিখুশিই মনে হয়।

ফারিনের থেকে বিদায় নিয়ে দোলা ইউরার পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে বসার ঘর পর্যন্ত আসে, ফারিনও আসে পিছু পিছু। এটা ফারিনের অভ্যাস। রোজ দোলাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়।

হঠাৎ করেই “ঘেউ ঘেউ” আওয়াজে দোলা চ’ম’কে ওঠে। বরাবর কুকুর ভীতি তার। এ বাড়িতে নতুন একটা আপদ উদয় হয়েছে “বোজো” নামের। কুকুরটার জাত কি দোলা জানে না, বিদেশি। কিন্তু অতি ভয়ংকর দেখতে। বাড়ির আঙিনায় আউটহাউজে থাকে। এতদিন ছিলো না এই আপদটা, মাসখানেক হয় এসেছে,যবে থেকে ইউরার ছোটো চাচ্চু ঢাকা থেকে এসেছে। বোজো ইউরার ঐ ছোটোচাচ্চুর পোষ্য। যেই লোকটা দোলার কাছে বোজোর মতোই স্রেফ একটা অস্বস্তি।

অস্বস্তি থেকে পালাতে দোলা ওড়না তুলে গা-মাথা ঢেকে নেয় পুরোপুরি।

বাড়ির সদরদরজা পর্যন্ত নিজেকে আড়াল করে নিয়ে এগোতে পারলো না দোলা। বোজো ছুটে আসলো তার দিকে। এমনটা রোজ হয়। দোলা আঁ’তকে উঠে ফারিনকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। বোজো ঠিক দোলা নয়,দোলার পেছনে কয়েক গজ দূরে তার মালিকের কাছে ছুটে যায়।

শেখ তৌসিফ আহমেদ,এবাড়ির সর্বকনিষ্ঠ পুত্র,গম্ভীর কণ্ঠে বোজোকে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিতেই বোজো বাধ্যতা দেখিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়।
দোলা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেও অত্যল্পকাল যেতেই তার চেহারার কানায় কানায় ছেয়ে যায় অস্বস্তি। আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফারিনের পেছনে।

তৌসিফ দোলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়, গম্ভীর স্বরে ফারিনকে বলে,”ভাবি আমার গ্রে জ্যাকেট কোথায়।”

_ওয়্যারড্রোবে রেখেছি। পেয়ে যাবে।

_তুমি দিয়ে যাও।

দোলা আর দাঁড়ালো না,বোজো যখন চলে গিয়েছেই সেও দেরী না করে ফারিনকে আস্তে করে,”আসি” বলে বেরিয়ে যায়। তার পায়ের গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার তার বড্ড তাড়া।

শেখ বাড়ি থেকে দোলার প্রস্থান ঘটলে ফারিন নিজের দেবরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তৌসিফ ফিচেল হাসলো। হঠাৎ করে সে হাসি মিলিয়েও গেলো, কন্ঠস্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখে ভাবীকে প্রশ্ন করলো,”উপহার টা নিলো?”

_হু নিলো।

তৌসিফ চুপ। ফারিন বলে ওঠে,”ধৈর্য ধরো। আমার শশুর তামিলনাডু থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরলেই প্রস্তাব পাঠাবো। যেভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকো! মেয়েটা কেমন ঘা’ব’ড়ে যায়। কোন দিন না জানি বলে ওঠে ইউরাকে পড়াবো না আর!”

_আমি কখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছি?

_যেটুকুই তাকাও। তোমাকে দেখলেই হাসিখুশি মেয়েটা কেমন গুটিয়ে যায়। মেয়েরা পুরুষের দৃষ্টি খুব ভালো করে বোঝে।

তৌসিফ না কথা বাড়ায়,না ভাবীকে এই ব্যাপারে আর এক শব্দ বলার আস্কারা দেয়। ডান হাতটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে বলিষ্ঠ শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে সদর দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,”ব্যাকইয়ার্ডে যাচ্ছি, মিতুকে দিয়ে গ্রীন টি পাঠিয়ে দাও। আর প্লিজ চাপকলের পানি দিও না।”

চলমান….

জনম জনমে পর্ব-০১

0

জনম_জনমে
#সূচনা_পর্ব
#Esrat_Ety

“মেয়েটা তো কোনো দোষ করে নি,মেয়েটাকে বছরের একটা দিন বাড়িতে ডেকে দু’টো ভালোমন্দ খাওয়ালে তো তোমার জাত যাবে না বৌ।”

পাশের বাড়ির দূরসম্পর্কের বৃদ্ধা খালা শাশুড়ির কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই হাত থেমে যায় জাহিদার। একপলক খালা শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় চপিং বোর্ডে পেঁয়াজ কুচি করতে থাকে, পোলাও টা হয়ে এসেছে। এখন বেরেস্তা ছড়িয়ে দিয়ে নামিয়ে ফেলবে।

“মৃধা ম্যানশনে” আজ বিরাট আয়োজন। এ বাড়ির কর্ত্রী জাহিদা আনামের বাপের বাড়ি থেকে হুট করেই মেহমান এসেছে। তাদের জন্য ভালোমন্দ খাবার দাবারের ব্যবস্থা করেছে। সকাল থেকে রান্নাঘরে ভীষণ ব্যস্ত কদমতলা হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা জাহিদা আনাম। আজ বারেও শনিবার। তার ছুটির দিন।

জাহিদার প্রতিবেশী মুরব্বি আবারও বলে ওঠে,”যা করার ওর মা করছে তোমার লগে, দোলা তো কিছু করেনাই। মাইয়াডা কত ভালো, কত নরম,সহজ সরল, না বাপের রক্ত পাইছে না মায়ের। ওর সাথে তুমি সবসময় এমন করো কেন? শুনছি হোস্টেলে পরে থাকে, সৎ মায়ের যন্ত্রনায় বাড়িতে গিয়াও থাকতে পারেনা ঠিক ঠাক‌। ওর আপন বলতে আর কে আছে? জামানও বেঁচে নেই, তুমি একমাত্র মামী, একটু আদর করলে কি হয়?”

জাহিদা উত্তেজিত হয়না। শুধু হাতের গতি থামিয়ে দিয়ে বলে,”কি বলেন তো খালা। কালসাপের পেট থেকে সবসময় কালসাপই বের হয়। কখনও দেখেছেন কালসাপের পেট থেকে বিড়াল ছানা বের হতে? আমি এটা বিশ্বাস করি। আর কি যেনো বললেন ? আদর করি না কেনো! ওর মা বিয়ের পর থেকে আমার জীবনটা ন’রক বানিয়ে রেখেছিলো, মিলা ননদ ছিলো না আমার,ওর মা আমার জন্য ছিলো য’ম। প্রতিটা দিন কি অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিলো আমার ওপর আমার ননদ-শাশুড়ি মিলে, জারিফ-জাহিনের বাবা পরে থাকতো বিদেশে। আর এখানে ননদ শাশুড়ির অত্যাচারে এক একটা দিন কত কষ্টে কাটিয়েছি। যাই হোক, তিনজন মানুষের কেউই এখন জীবিত নেই। তাদের সম্পর্কে ভালো খারাপ বলার ইচ্ছা নেই। শুধু ঐ মেয়েকে আমি সহ্য করতে পারি না এটাই সত্যি, ওকে দেখলেই ওর মায়ের কথা মনে পরে যায় আমার,যে সুযোগ পেলেই আমার চুলের মুঠি ধরতো,জারিফের বাবাকে দিয়ে আমায় মা’র খাওয়াতো। ঐ মেয়েটাকে দেখতে পারি না আমি,ও একেবারেই ওর মায়ের মতো দেখতে। যা আমাকে আরো রাগিয়ে দেয়।”

জারিফ থ’ম’কে দাঁড়ায়,মায়ের কথাগুলো তার ঘর থেকেই শোনা যাচ্ছিলো। তবুও সে এখানে এসেছিলো শুনতে, মায়ের চেঁচামেচির কেন্দ্রবিন্দু দোলাই কিনা! তার ধারণা ঠিক,দোলার নাম ছাড়া অন্যকারো নাম উঠলে মা এতটা রিয়্যাক্ট করেন না।

সে চুপচাপ খাবার টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস নিয়ে ওয়াটার ফিল্টার থেকে পানি ঢেলে নেয়।
বাড়িভর্তি মেহমান,সবাই জারিফের নানা বাড়ি থেকে। দাদাবাড়ির কাউকে তার মা কখনও বাড়িতে ডাকেননা,বলতে গেলে জারিফের বাবা জামান মৃধার মৃত্যুর পরে সম্পর্কই চুকেবুকে গিয়েছে সবার সাথে তাদের।

পানি খেয়ে জারিফ মাথা ঘুরিয়ে একপলক তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। জাহিদা তখনও বকবক করে যাচ্ছে,পাশের বাড়ির জীবনন্নেছা দাদীকে শুনিয়ে যাচ্ছে দোলার প্রতি তার বিতৃষ্ণা ঠিক কতখানি।

জারিফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়, দোলাকে এ বাড়িতে এক বেলা ভালোবেসে দাওয়াত করে খাওয়াতেই মায়ের কত আপত্তি! যখন জারিফ গিয়ে কোনো একদিন মাকে বলবে,”মা আমি দোলাকে বিয়ে করতে চাই!” তখন? তখন কি করবে জাহিদা আনাম? সেদিনের তো বেশি দেরি নেই, শুধু জারিফের চাকরিটা পাওয়ার অপেক্ষায়!

★★★

শেখ ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের তিন তলার তিনশ’চার নাম্বার ঘরটা দোলার কাছে একটা ছোটোখাটো সুখের রাজ্য। হতে পারে এই হোস্টেলের টাংকিতে সবসময় পানি থাকে না, হতে পারে এই হোস্টেলের মিলের শাক ভাজিতে পোকা পাওয়া যায়,হতে পারে সপ্তাহে একদিন মাংস কপালে জোটে,তাও পোল্ট্রি মুরগির যাতে কখনো কখনো মুরগির খুঁজে পায় দোলা, কিন্তু এখানে,এই নিড়িবিলিতে সেই শান্তিটুকু পাওয়া যায় যা বাবার বাড়িতে দোলা পায়না।

এই যে এখন পি’রিয়ডের পেট ব্যাথা নিয়ে চিৎ হয়ে হাত পা ছড়িয়ে দোলা শুয়ে আছে,কেউ এসে এখন দোলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবে না,”সারাদিন শুয়ে থাকে সবাই! সব কাজ আমাকে একাই করতে হয়!”
সৎ মায়ের মা’র খেলেও দোলার এতোটা কষ্ট হতো না,কিন্তু ভদ্রমহিলা হাতে না মেরে দোলাকে মুখে মা’রে। কথার বাণে দোলার কষ্ট হয় বেশি।

পিকপিক যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে ফোনটা কাঁপছে বিছানার ওপর। দোলা টিউশনি করাতে গিয়েছিলো সকালে, তখনই ভাইব্রেশন মোডে ফেলে রেখেছিলো ফোনটাকে। নিড়িবিলি কামরায় হঠাৎ এই যান্ত্রিক আওয়াজ টা দোলাকে চ’ম’কে দেয়। মনে করিয়ে দেয় জারিফের বলা ঐ গল্পটা,“একটা ছাত্রী নিবাসে একটা কামরায় দুজন বান্ধবী থাকতো। একবার ঈদের ছুটিতে যখন সবাই হোস্টেল ছেড়ে যার যার বাড়ি চলে গিয়েছিলো,তখন থেকে গিয়েছিলো ঐ বান্ধবী দুজন। গভীর রাতে যখন দু’জনের মধ্যে একজন হোস্টেলের ওয়াশরুমে যায় তখন দেখতে পায় ওপর থেকে দুটো লম্বা লম্বা টকটকে লাল রঙের পা ধীরে ধীরে নিচে নামছে। মেয়েটা আতঙ্কে একটা বি’কট চিৎকার দিয়ে ছুটে যায় তার বান্ধবীর কাছে। মেয়েটার সেই বান্ধবী তাকে আগলে নিয়ে বলে,“কি হয়েছে দোস্ত? এমন করছিস কেন?”
তখন মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে সেই লাল রঙের পা দু’টোর কথা তার বান্ধবীকে জানায়। সবটা শুনে তার বান্ধবী হেসে নিজের পাজামা পায়ের কাছ থেকে কিছুটা ওপরে তুলে মেয়েটিকে বলে,”দোস্ত দ্যাখ তো পা দুটো এমন টকটকে ছিলো কিনা!”

যতবার এই গল্পটার কথা দোলার মনে পরে ততবার তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। যদিও দোলা সবসময় আয়াতুল কুরসি পাঠ করে।

ফোনটা লাগামহীন বেজে চলেছে। দোলা জানে এই সময়ে কে ফোন দিতে পারে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে তার অনুমান সঠিক হয়েছে দেখে দোলা মুচকি হাসে। বিলম্ব না করেই দ্রুত স্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে কলটা রিসিভ করে চুপ করে থাকে। ওপাশ থেকে কাঙ্খিত,প্রিয় কন্ঠস্বরে প্রিয় ডাকটা শুনতে পায়,”দুলি!”

দোলা দু চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নেয়। এই ডাকটা যতবার সে ঐ মানুষটার থেকে শোনে,আরো একবার শোনার তৃষ্ণা পায় তার।

জারিফ বলে,”চুপ করে আছিস কেনো।”

_শুনছি! বলো! আর তুই তোকারি করবে না।

জারিফ নিশ্চুপ হেসে বলে,

_দুপুরে একবার বেরোতে পারবে? এই আধাঘণ্টা পরেই।

_আধাঘন্টা পরেই!
দোলা অবাক হয়।

_হু।

_খুব কি প্রয়োজন?

_অপ্রয়োজন বলতে চাইছিস…সরি চাইছো?

নীরব দোলা। জারিফ তার স্বভাব সুলভ নম্রস্বরে বলে ওঠে,“কুটুমবাড়ির সামনে চলে আয়…ধূরর এসো…ধূরর,আয়।”

দোলা হেসে ফেলে, কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে সে চুপ হয়ে যায়।
দোলার আর কোনো কথা থাকে না,থাকলেও মানুষটার কথার সামনে টিকবে না। তাই বাধ্য মেয়ের মতো বলে,”রাখছি। তৈরি হবো।”

★★★

শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা বিষখালি নদীর কোলে এই রেস্তোরাঁ। এখান থেকে সরাসরি নদীটাকে উপভোগ করা যায়, খাবারের মানও বেশ ভালোই, জারিফ সবসময় দোলাকে এখানেই নিয়ে আসে, শহরের প্রাণকেন্দ্রে বড় বড় নামী রেস্তোরাঁগুলোর থেকে দোলা এখানেই এসে স্বস্তি পায়,তার কারণ যায়গাটা বেশ নিড়িবিলি।

রিকশাওয়ালাকে থামিয়ে দোলা নেমে পরে, ঠিক তখনই তার পাশেই একটা বাইক এসে থামে। দোলা পাশ ফিরে তাকিয়ে জারিফকে আবিষ্কার করে, জারিফ দোলার দিকে একপলক তাকিয়ে রিকশা ওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে নিচু স্বরে বলে,”ভেতরে যা! তিন নাম্বার কেবিন বুক করা। আমি বাইক টা পার্ক করে আসছি।”

রেস্তোরাঁ মোটামুটি মানের হলেও এর ভেতরের ঠাট-কাট চমৎকার। এখানে রিভার সাইডে ছোটো ছোটো গুটি কয়েক কেবিনের মতো কামরা তৈরি করা, কামরা গুলোতে দরজা নেই,পর্দা দেওয়া। থাকে দুটো চেয়ার,একটা টেবিল। প্রেমী যুগলের জন্য আদর্শ স্থান। একবার প্রথম বর্ষে থাকতে দোলার জন্মদিনের দিন জারিফ নিয়ে এসেছিলো তারপর থেকে অন্য কোনো রেস্তোরাঁয় তারা দেখা করে না। এখানে ,এই কুটুমবাড়ি রিভারভিউ কিচেনেই আসে।

দোলা নদী দেখছিলো। এই খড়খড়ে রোদে গুটিকয়েক জেলে নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর মাঝখানে। এখান থেকে কিছুটা দূরেই জেলার লঞ্চ টার্মিনাল। “বাহাদুর চার” নামের একটা বিশাল লঞ্চ ভিরে আছে টার্মিনালে। সম্ভবত সেটির ধোয়া মোছার কাজ চলছে। শ’য়ে শ’য়ে যাত্রী নিয়ে বিকেল চারটায় বরগুনা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে বলে।

জারিফ কেবিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে, অত্যল্পকাল পরেই জারিফের ম্যান পারফিউমের সুগন্ধে আলোড়িত হয়ে যায় ক্ষুদ্র কামরা টা। আলোড়ন তোলে দোলার অন্তরে।
দোলা নড়েচড়ে বসে,সে এই সুগন্ধটাতেই স্বস্তি খুঁজে পায়। চোখ তুলে জারিফের দিকে তাকিয়ে বলে,“আজ না তোমাদের বাড়িতে মেহমান।”

জারিফ দোলার মুখোমুখি চেয়ারে বসতে বসতে বলে,“হু!”

_কেনো ডেকেছো? মানে এই অসময়ে,বিকেলেও তো ডাকতে পারতে।

জারিফ এতক্ষণে দোলার মুখের দিকে ভালো করে তাকায়। প্রসঙ্গ পাল্টে দোলার চোখে চোখ রেখে বলে,“সকালে কি ছিলো তোদের মিলে?”

_আবার তুই!!

_বল।
জারিফ তার বাইকের চাবি আর মোবাইল ফোনটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলে।

_তুমি জানো তো কি থাকে!
মিনমিন করে বলে দোলা।

_আলুভর্তা আর পাতলা ডাল?

_হু।

ওয়েটার আসে অর্ডার নিতে। জারিফ এক প্লেট ভাত, খাসির মাংস,ইলিশ মাছ, ইলিশের ডিম ভাজা, চিংড়ির দোপেঁয়াজা অর্ডার করে দোলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”রসমালাই খাবি নাকি দই?”

দোলা অস্ফুট স্বরে বলে,“দই।”

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যায়। জারিফ দোলার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তোর সেমিষ্টার ফাইনাল কবে?”

_সম্ভবত সামনের মাসের চৌদ্দ তারিখ!

_পড়িস ঠিকমতো? নাকি সারাদিন টিউশনি করিয়ে বেরাস!

দোলা চুপ। জারিফ বলতে থাকে,”তোর এতো ইগো কেনো?”

_তুই তোকারি বন্ধ করো, তবে জবাব দেবো।

_করবো না!

_তাহলে দেবোও না!

ওয়েটার এসে খাবার পরিবেশন করে দিয়ে যায় টেবিলে। জারিফ বলে,”নে খা।”

_তুমি খাবে না?

_না বাড়িতে গিয়ে খাবো।

_তাহলে এলে কেনো এখন?

_কারন তুই খাবি তাই। এখন খা।

_রোজ রোজ এসব কি!

_তোকে সামনে বসিয়ে খেতে দেখতে ভালো লাগে।

_তুমি বোধ হয় প্রথম প্রেমিক যার প্রেমিকাকে শাড়িতে নয়, এঁটো হাতে গাপুস গুপুস মুখে লোকমা তুলতে দেখতে ভালো লাগে।

জারিফ নিষ্প্রভ। দোলা একদৃষ্টে জারিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। জারিফ নিষ্প্রভতা ঠেলে সরিয়ে বলে ওঠে,”আমার পাঠানো টাকাটা ফিরিয়ে দিলি কেন!”

_কেন নেবো? কেনো তুমি আমায় পালবে? আমি কি তোমার বৌ?

_হবি তো!

_যখন হবো তখন। আর এতো টাকা কই পাও? নিজেই তো মামীর কাছ থেকে নাও।

_ওটা আমার টাকা! আমার কামাই করা!

দোলা কিছু না বলে খাওয়া শুরু করে। জারিফ দেখতে থাকে দোলাকে। দোলা একপলক জারিফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,“তুমি খুব বাজে প্রেমিক!”

_কিন্তু খুব ভালো স্বামী হবো!
সাথে সাথে জবাব দেয় জারিফ। দোলা খাওয়া থামিয়ে মানুষটার দিকে তাকায়,কতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে জারিফ বলেছে কথাটা। দোলার মন ও মস্তিষ্কে ছেয়ে যায় সুখানুভূতি,কিন্তু কিছুসময়ের জন্য।

চোখ নামিয়ে আবারও খাওয়ায় মন দেয়।

জারিফ বলে,“গান শুনবি দুলি?”

দোলা কিছু বলার আগেই জারিফ নদীর পানিতে দৃষ্টি স্থির রেখে গাইতে শুরু করে,
“আর কিছুদিন তারপরে বেলা মুক্তি,
কসবার ঐ নীল দেয়ালের ঘর,
সাদা কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে,
তোমার আমার লাল নীল সংসার!”

চারটা লাইন গেয়ে জারিফ দোলার সুশ্রী,গোলগাল,মায়া ভরা মুখটার দিকে তাকায়। ঐ চাহনি সরাসরি আঘাত হানে দোলার বক্ষপটে। দোলা খাওয়া বাদ দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জারিফ বলে,”আরে খাচ্ছিস না কেনো? খা!”

দোলা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”

চলবে।

প্রেমের মেলা পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেমের_মেলা
শেষ_পর্ব
#বর্ষা
ইনায়া হসপিটালের বেডে সুয়ে আছে।আশিয়ান ইনায়ার হাত ধরে কেঁদেই চলেছে। ইনায়া চোখ বেয়ে নিরব অশ্রু ঝড়ছে আর মুখে ভেসে আছে তাচ্ছিল্যময় হাসি।সেদিন নিজের মনের অহরহ প্রশ্নে আশিয়ান মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুতে রুপান্তরিত হয়েছিলো।যে পশু যৌন ক্ষুধার্ত।ইনায়া বুঝে ওঠার পূর্বেই সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।ইনায়া অসহায় ছিলো একজন পশুর ন্যায় আচরণকারী পুরুষের শক্তির কাছে।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ইনায়া জ্ঞান হারিয়েছিলো।তারপর জ্ঞান যখন ফিরলো তখন থেকেই একদম নিশ্চুপ সে।না,একটা কথাও সে এখনো অব্দি মুখ খুলে বলেনি।সেই যে নিশ্চুপ হলো মেয়েটা।

”জান আমাকে ক্ষমা করে দেও।জান প্লিজ জান।আমি আমার মাঝে ছিলাম না তখন। আমার ভয় হচ্ছিলো তোমায় হারিয়ে ফেলার।জান আই লাভ ইউ।জান প্লিজ টক উইথ মি”

ইনায়া চুপই রইলো।আশিয়ান বুকে একফালি কষ্ট নিয়ে কেবিন ত্যাগ করলো।একটু পর ইশান এসে পাশে বসে ইনায়ার।ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

”ইয়ু,আমার সাথে কথা বলবি না?”

ইনায়া তাকায়।তবে এবারও কথা বলে না।একে একে ফাবিহা সারওয়ারের পর যখন ইসরাক খান আসেন তখন ইনায়া ক্যানোলা হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পাপাইয়ের ওপর।তার হাত থেকে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করে।ইনায়াকে দ্রুত একজন নার্স ঘুমের ঔষধ দেন। কেননা ইনায়া অনেক উত্তেজিত হয়ে কান্না করছিলো।ঘুমানোর পূর্বে অস্পষ্ট স্বরে সে বলে,

”পাপাই…”

ওয়েটিং রুমে চেয়ারে বসে আছে আশিয়ান,ইশান, ফাবিহা সারওয়ার।লিফট থেকে বেরিয়ে আসেন ইসরাক খান।ইনায়ার কেবিন পাঁচতলায়।আর ওয়েটিং রুম নিজ তলায়। জাপানিজ হসপিটাল এটা। নিয়মগুলো দেশীয় হসপিটাল থেকে অনেকটাই অন্যরকম।

ইসরাক খান চুপসে থাকা মুখশ্রীতেই বলেন,”আমার বেটা আমাকে ডেকেছিলো..তবে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সে ”

আশিয়ান খুশি হয় ইনায়া শেষমেশ কিছু তো বলেছে তা শুনে।তবে আহত হয় ইনায়ার উত্তেজিত হয়ে পড়ার ঘটনা শুনে। কেননা সে বুঝতে পেরেছে ইনায়া কেন এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছে!

দিন চারেক পর,,,,

হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে ইনায়া।পাপাইয়ের ওভজার্ভেশনে থাকবে সে আরো কিছুদিন তাইতো স্বামীর বাড়ি না গিয়ে বাপের বাড়ি আসা। ফাবিহা সারওয়ার মেয়ের যত্নে যেন ত্রুটি না হয় তার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখছেন।ইশানও বোনের যত্নে একদমই ত্রুটি রাখছে।চকলেট, তেঁতুল,ফুচকা,বেগুনি,বার্গার,পিৎজা,চাইনিজ কতকিছুই না এনে দিচ্ছে।তবে তেমন কিছুই ইনায়া খায়নি চকলেট ছাড়া।

মেয়েকে নিয়ে নিরালয়ে বসেছেন ইসরাক খান।প্রশ্ন এখনো আছে যে মেয়ে কি বলতে চেয়েছিলো সেদিন!তবে আজও ইনায়া কিছুই বলে না।ইনায়া জানে যে ইসরাক খান ওই ঘটনা জানতে পারলে আশিয়ানকে একদমই ছাড়বেন না।উপরি কন্টাক্টের সহযোগিতায় আশিয়ানের এদেশ থেকে সিঙ্গাপুর ফিরে যাওয়া একদমই বন্ধ করে দিবেন।অর্থাৎ মেরিটাল রেপ কেসে হাজতে ঢোকাবেন।ইনায়ার আইন সম্পর্কে বেশ ধারণা আছে কেননা সেও তো তেমনই একজন।

ফাবিহা সারওয়ারকে ইনায়া বলেছিলো আশিয়ানের সাথে তার কি সমস্যা হয়েছে তা। ফাবিহা সারওয়ার এখানে তেতে উঠলেও মুহূর্তেই মোমের মতো গলে ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

”ইনায়া মা তুমি বুঝদার মেয়ে।আমি তোমাকে বেশি কিছু বলবো না।তবে এটা বলবো যে আশিয়ান তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাছাড়া এ সমাজ তোমাদের ডিভোর্স হলে আশিয়ানের কর্মকে দোষারোপ করবে না বরং তোমাকেই দোষারোপ করবে।তোমার জীবনটা বিভৎস করে তুলবে। আরো তো রয়েছে সমাজের নিচু মানসিকতার মানুষদের কুৎসিত প্রস্তাব!মা আমি তো একা ছিলাম আমি বুঝি”

ইনায়া ভাবে।পরে ঠিকই বুঝতে পারে সমাজ আসলে কেমন!তাইতো ইনায়া আর আগায়নি।সে হয়তো প্রসাশনের সদস্য বলেই। কেননা যখন লোকবল জানতে পারবে ইনায়া প্রসাশনের সদস্য তখন কথা উঠবে,

”নিজ ক্ষমতার অপব্যবহারে এক নির্দোষ ব্যবসায়ীকে হাজতে পুরেছে সেহরিশ খান”

সময় সত্যিই চলমান।দেখতে দেখতেই সময় রুপ বদলায়।বদলায় সম্পর্কের ভীত।আবার অনেক সময় সম্পর্ক এক থাকলেও, মাহাত্ম্যের মাঝে আসে ব্যাপক পরিবর্তন।তেমনি অনেক পরিবর্তন এসেছে সম্পর্কগুলো মাঝে।এসেছে নতুন কয়েক জন। নতুন প্রজন্ম।আটবছর অতিক্রান্ত হয়েছে।কম তো নয় সময়।আবারো শীতের আগমন হয়েছে।এইতো আর কিছুদিন পরই নয়তম বিবাহ বার্ষিকী আসছে ইনায়া,আশিয়ানের।

ইনায়া কাঁধে ব্লেজার ঝুলিয়ে বা’হাতে লাগেজ টেনে ফুল এটিটিউডে অতিক্রম করছে এয়ারপোর্ট।তারই পেছন পেছন আসছে আরো দু’জন। পাঁচ কি ছয় বছরের একটা ছেলে আর আশিয়ান। তাদের হাতেও লাগেজ।তবে ইনায়া কিন্তু আগের তুলনায় আরো সুন্দর হয়েছে।

”মাম্মাম”

বাচ্চাটার ডাকে ইনায়া পেছন ফিরে।বাচ্চাটা ছুটে গিয়ে ইনায়ার পা ধরে।ইনায়া নিচু হয়ে বসতেই ইনায়ার গালে টুকুস করে চুমু খায় বাচ্চাটা।ইনায়া ফোনে কাউকে বলে,

”আই উইল বি ব্যাক আফটার সাম টাইম”

ইনায়া ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বাচ্চাটার গালে চুম্বন করে জড়িয়ে ধরে বলে,

”বাবাই তোমাদের তো আরো দু’দিন পরে আসার কথা ছিলো!আজ কিভাবে?”

”সারপ্রাইজ”

আশিয়ানের কথায় ইনায়া মুচকি হাসে। আশিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

”কোথায় ছিলে তোমরা দেখলাম না যে”

”আমরা পেছনের দিকে ছিলাম।তাই হয়তো খেয়াল করোনি জান”

ইনায়া আশিয়ানকে আর কিছু না বলেই বাবুটার সাথে দুষ্টুমি করতে করতে বেরিয়ে যায় এয়ারপোর্ট থেকে।আশিয়ান প্রতিবারের মতো এবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কেননা আটবছর যাবৎ জৈবিক চাহিদা পূরণ হলেও মানসিক চাহিদাটা অপূর্ণ।ইনায়া একদিন অধিকার দেখিয়ে কথা বলেছিলো।আশিয়ান ধমকে উঠেছিলো সেই কারণে। কেননা অনেক পুরুষই আছে যে যারা নিজেদের ওপর অন্য কারো অধিকার দেখানো পছন্দ না।তেমনি আশিয়ানও। তাইতো সেদিন ধমকে উঠেছিলো সে।তবে ভাবেনি যে তাই হবে ইনায়ার তার প্রতি দেখানো শেষ অধিকারবোধ।

”আহান বাবাই,দুইদিন বাদে তো তোমার তিতির জন্মদিন।তাকে কি গিফট দিবে তুমি?”

আহান মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”মাম্মাম আমরা না তিতিরকে একটা মাম্মাম গিফট করবো।তুমি ছাড়া তো আমি একটুও থাকতে পারিনা।তাহলে তিতির কিভাবে থাকবে?”

ইনায়া ঠোঁট কামড়ে নেয়।তিতির হলো ইশান আর রিনির মেয়ে।হ্যা রিনি আর নেই।মেয়েটা তিতিরকে জন্ম দিতে গিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে।রিনির ইচ্ছে ছিলো নরমাল ডেলিভারি করাবে। তাইতো ব্যথা ওঠার অপেক্ষায় ছিলো।তবে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বেবি না হওয়ায় ইমার্জেন্সিতে সিজার করা হয়।রক্তক্ষরণ হয় অনেক বেশি।তাইতো আর বাঁচানো যায়নি মেয়েটাকে!বছর তিনেকের তিতিরটা মা মা করে।তবে মায়ের চেহারাটা ছাড়া কিছুই বোঝে না।

ইসরাক খান মেয়েকে দেখেই এগিয়ে যান।আহান লাফ দিয়ে নানার কোলে উঠে গাল টেনে ধরে বলে,

”গ্র্যান্ডপা,আমি চলে এসেছি।”

ইসরাক খানও মেয়ের একমাত্র অংশটাকে নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসা দেন।ফ্লাটে ঢুকতেই তিতির সোনা ছুটে আসে।পিপি,পিপি করে ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে।আহান তার নানুর কোল থেকে নেমে ছুটে এসে বলে,

”তিতির তুমি আমায় আর পাপাইকে আগে না দেখে আমার মাম্মাকে আগে দেখেছো বলে এই চকলেটটা তোমার জন্য ”

ইনায়া হেসে দেয় ছেলের কথায়।আশিয়ানও হাসে।ইনায়া আর আশিয়ান একে অন্যের দিকে তাকিয়ে অনেকদিন কিংবা বছর খানেক বাদে হাসে।ইনায়া খোলামেলা বলে,

”আশিয়ান দেখেছো তোমার ছেলে তোমার চেয়েও বেশি আমায় ভালোবাসে”

”বাসবেই তো!আমার বোন যে ভালোবাসার মতোই মানুষ ”

ইশান সদর দরজা প্রবেশ করতে করতেই বলে।তবে আহান ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে না তার মামুকে।কেননা ইনায়া তাকে এতোটুকু বুঝিয়েছে যে আহান যেন কখনো তিতির আগের ইশানের কোলে ওঠার চেষ্টা না করে কেননা আহান বাবা-মা দুজনের ভালোবাসা পেলেও তিতির তো শুধু তার পাপাইয়ের ভালোবাসাই পায়। আমাদের ছোট্ট আহানও তা বোঝে।কথায় আছে, বুঝদার বাবা-মা চাইলেই বুঝদার সন্তান গড়তে পারে!

ইশান তিতিরকে কোলে নিয়ে এদিকে এসে বসতেই আহান করে বলে,

”মামু আমি তিতিরকে বিয়ে করবো বড় হয়ে”

আহানের কথায় ইনায়া হেসে দেয় শব্দ করে।আশিয়ান ক্ষেপে আহানের হাত ধরে টান দিয়ে বলে,

”এই ছেলে তুমি এগুলো কার কাছে শিখেছে। থাপড়ে ঠিক করবো তোমায়”

ইসরাক খান,ফাবিহা সারওয়ার টি টেবিলে নাস্তা রাখে হাসতে হাসতে।ইনায়ার হাসির প্রবলতা আরো বেড়েছে।ইশানও হাসছে।আর তিতির সে তো তার পাপাইয়ের হাসিটা গভীর ভাবে দেখছে। চার বছরের ছোট্ট তিতির সোনা যে খুব অল্প সময়ই তার পাপাইকে হাসতে দেখেছে।তবে আজকের হাসিটা প্রাণবন্ত।যা ছোট্ট তিতিরের হৃদয়ে দাগ কেটেছে।

সমাপ্ত

প্রেমের মেলা পর্ব-১৬+১৭

0

#প্রেমের_মেলা
পর্ব:[১৬]
#বর্ষা

ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ইসরাক খান।অনেক খোঁজাখুঁজি এবং বিভিন্ন মানুষের মাধ্যমে মেয়ের সন্ধান পেয়েছেন। তাইতো ছুটে আসা এদিকটায়।ইনায়া অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে নেয়।ইসরাক খান মেয়ের হাত ধরে ছলছল নয়নে বলেন,

”পাপাইয়ের ওপর অভিমান করে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছো বেটা?”

ইনায়া অভিমানী কন্ঠে বলে,”আমার মতো মেয়ে থাকার চেয়ে মেয়ে না থাকাই তো উত্তম কে যেন বলেছিলো”

”তুমি আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।আর সেই তোমার ভয়ানক অবস্থার কথা শুনে কি করে টিকে থাকতে পারি! তুমি যেদিন মা হবে সেদিন বুঝবে সন্তানের অসুস্থতার কথা শুনলে পিতা-মাতার ওপর দিয়ে কি বয়ে যায়। সেদিন আমার বলা ছোট্ট কথাটায় তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো তা আমি জানি।তাহলে বলো তোমার এতো বড় মিথ্যে কথায় আমি কতটা কষ্ট পেতে পারি!”

ইনায়া কেঁদে দেয়। ইসরাক খান ধমক দেন।ইনায়া চোখ তুলে তাকায়।ইসরাক খান বলেন,

”আমার বেটা দূর্বল না যে সে কাঁদবে।আমার বেটা নিজের অনুভূতি লুকানো কি ভুলে যাচ্ছে!যাইহোক,আমাকে কি সে জড়িয়ে ধরবে না?”

ইনায়া ছুটে গিয়ে ইসরাক খানকে জড়িয়ে ধরে।গুলি চলায় রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছিলো।তা থেমে গেছে।অনেকে আবার তাদের দিকে দেখছে। মানুষের কাজই বা কি!ইনায়া চারপাশের মানুষদের এভাবে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে দেখে পাপাইকে বলে,

”পাপাই চলো তুমি আমায় ড্রপ করে দিবে”

ইনায়া গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক তখনই অগোছালো আশিয়ানকে চোখে পড়ে তার।আশিয়ান ছুটে আসছে তারই দিকে।বুকটা ধক করে ওঠে।কি অগোছালো লাগছে গোছালো ছেলেটাকে। ভালোবাসা যেমন মানুষকে গোছালো করে,ঠিক তেমনি আগের চেয়েও অনেকাংশ অগোছালোও করে!ভালোবাসা যেমন বাঁচতে শেখায়,ঠিক তেমনি জীবন্ত লাশও বানায়!

আশিয়ান এসে জড়িয়ে ধরে ইনায়াকে।ইসরাক খান আশিয়ানকে দেখে আর বেরিয়ে আসেন না।তিনি জানেন ছেলেটা তার মেয়েকে বড্ড ভালোবাসে।তবে সব ভালোবাসার স্থায়িত্ব থাকে না। অধিকাংশ পুরুষ মানুষ ভালোবাসার মানুষটিকে স্ত্রী হিসেবে পেলে সম্মান করতে ভুলে যান।ভুলে যান ভালোবাসতে।যা অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের দিকে বর্তিত হয়।তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা প্রেমিকের সাথে বিয়ে করলে আরো বেশি সন্দিহান হয়ে ওঠে,বেড়ে যায় ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক গুণ।তখন তাদের এই ক্ষুদ্র তবে সম্পর্কের বিশালতা সৃষ্টিকারী অংশগুলো তারা না পেলেই ভাবে পুরুষ হয়তো অন্য নারীতে আসক্ত,তাকে আর তার পুরুষের চাই না!যেমনটা ফাবিহা সারওয়ারও একসময় ভেবেছিলেন। তবে ভুল বোঝাবুঝিগুলো এখন পানসে হয়েছে।

আশিয়ান ইনায়া জড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভাবুক ইসরাক খানকে গাড়িতে দেখেন।ইনায়াকে ছেড়ে দ্রুত গাড়ির কাছে গিয়ে ইসরাক খানকে অনুরোধ করে,

”বাবাই আমি চাই না আমার জানকে হারাতে।প্লিজ বাবাই আমাদের বিয়ের তারিখ এখনই ফালাও।আজই কোর্ট ম্যারেজ করবো আমরা।প্লিজ বাবাই,প্লিজ”

ইসরাক খান কি বলবেন বুঝতে পারলেন না।তিনি ইনায়ার দিকে তাকিয়ে।ইনায়াও ইসরাক খানের দিকে তাকিয়ে।ইসরাক খান রাজি হলেন আশিয়ানের কথায়।আশিয়ান ঠোঁট কামড়ে ইসরাক খানের হাত দুটো ধরে মাথা ঝুঁকিয়ে দিলো।ইসরাক খান উপলব্ধি করলেন ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ছে তার হাতে।তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন।মেয়ের জন্য এরূপ ভালোবাসায় আবৃত মেয়ে জামাই পেয়ে।

ইনায়া ওনাদের এরূপ কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে করতেই চারপাশে নজর বুলায়।চোখ আটকে যায় অদ্ভুত দেখতে এক লোকের ওপর।রোগা পাতলা হলেও কি অদ্ভুত ভাবে চোরাদৃষ্টিতে বারবার ইনায়াদের দিকে তাকাচ্ছে। ইনায়া যখনই সেদিকে যেতে নিবে লোকটা ছুটে চলে গেল।ইনায়ার যা বোঝার সে বুঝে ফেলেছে।আগেই দেখেছিলো ওইদিকটায় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে একবাসায়।সে সূত্রে লোকটার ছবি পাওয়া কষ্ট সাধ্য হবে না একদমই।

কাজী অফিসে বসে আছে আশিয়ান,ইনায়া এবং ইসরাক খান। অপেক্ষা করছেন ইশান আর ফাবিহা সারওয়ারের।মেয়ে করে বড় নাই বা করুক তারই তো মেয়ে ইনায়া। ফাবিহা সারওয়ার অতি দ্রুত এসে পৌঁছান।ইনায়াকে সামনে দেখে জড়িয়ে ধরেন।সেদিন ইনায়ার ওপর রাগ করে তাকে না সামলানোটা তার ভুল ছিল।তার তো বোঝা উচিত ছিল যে মেয়ে পাপাইয়ের স্নেহে,ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছে, তার ওপর তার পাপাইয়ের কর্কষ ব্যবহার কি ইফেক্ট ফেলতে পারে!

”মাম্মামের সাথে এতো অভিমান যে কথাই বলবে না?”

ইনায়া মুচকি হেসে বলে,”ইনায়া সেহরিশ খান কারো সাথে অভিমান করে না”

ফাবিহা সারওয়ার বুঝতে পারেন মেয়ের বেশ অভিমান হয়েছে। তিনি আর কিছু বলার পূর্বেই ঝড়ের গতিতে ইশান এসে টর্নেডোর গতিতে ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে চারপাশে ঘুরতে থাকে।তারপর দুজনেই পরে যেতে নিলে আশিয়ান ধরে ফেলে ওদের।তিনজন হেসে দেয়।ইশান ইনায়ার মাথায় গাট্টা মেরে দুষ্টামি করে বলে,

”চলে যখন গিয়েছিলি আমার ফিরে আসলি কেন?”

”আমি ফিরে আসায় বুঝি তোর কষ্ট হচ্ছে?”

ইনায়া ইশানকে আলতো হাতে মারে।ইশান ইনায়ার মাথায় চুমু খেয়ে বলে,

”প্লিজ ইয়ু আর হারিয়ে যাস না।চল এখন বাসায় যাই”

ইনায়া থেমে যায়।ইসরাক খানের দিকে ইনায়া তাকাতে ইশানও তার দিকে তাকায়।ইসরাক খান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,

”আজ ইনায়া আর আশিয়ানের বিয়ে।আর কিছুদিন পরেই আমার বেটা সিঙ্গাপুর আশিয়ানের কাছে ব্যাক করবে আমার সাথে ”

ইনায়া অবাক হয়ে তাকায়।ইনায়া ইসরাক খানকে টেনে আরেকপাশে নিয়ে বলেন,

”পাপাই কি বলছো তুমি। তোমার সাথে মানে?ইশান আর মাম্মা ওরা কোথায় থাকবে?”

ভাবলেশহীন ইসরাক খান বলেন,”এতোদিন যেখানে ছিল সেখানেই ”

”পাপাই তুমি ভুল করছো!আরেকবার তো দিয়েছিলে তোমাদের সম্পর্ককে সুযোগ,তাহলে আবার কি হলো?”

ইসরাক খান ছোট থেকেই ইনায়ার সাথে বেষ্ট ফ্রেন্ডের ন্যায় আচরণ করেছেন।ইনায়ার ছোট বড় বহু বিষয় সম্পর্কেই তিনি অবগত।এই যে তিনি এটাও জানেন তার মেয়ে কারো প্রেমে পড়েছিলো,তবে কে সে তা এখনো অব্দি জানেন না।ইসরাক খানও মেয়েকে নিজের মনের অধিকাংশ কথাই নির্দ্বিধায় বলেন।তাইতো অশ্রুশিক্ত নয়নে ইনায়ার হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে তিনি বলেন,

”আমি যে ভালোবাসার জন্য আর ক্ষত-বিক্ষত হতে পারবো না।বেটা আমি তোমার একটি সুখী পরিবারের ইচ্ছে পূর্তিতেই শুধুমাত্র এখানে ওদের সাথে ছিলাম।বেটা যে নারী অন্যের মিথ্যে প্রমাণের কারণে আমাকে ভুল বুঝেছিলো,সে তো আবারও আমাকে অবিশ্বাস করতে পারে।যেই নারীর কারণে ইশানের সাথে আমার সম্পর্ক বাপ-ছেলের মতো নয়,ঠিক সেই নারীকেই কিভাবে আমি আবারো আপন করবো বল?আমার যে বড্ড ভয় হয় তোমাদের হারিয়ে ফেলার!আমার জীবনে এসে যদিওবা তারা হারিয়ে যায় আমি ততটা ক্ষত-বিক্ষত হবো না,যদিনা তারা আমার জীবন থেকে তোমায় কেড়ে না নেয়”

”পাপাই,আই প্রমিস ইউ ইনায়া সেহরিশ খান কখনো তার পাপাইকে ছেড়ে যাবে না।মরে গেলেও তোমার স্মৃতিতে বাসা বাঁধবে!পাপাই প্লিজ মাম্মামকে লাস্ট চান্স দেওনা।এতে ইশান পাপাই পাবে আর আমি মাম্মাম..প্লিজ পাপাই”

ইসরাক খান কি বলবেন বুঝতে পারলেন না।তার মেয়েটা যে খুব অল্প সময়ই তার কাছে আবদার করেছে।মায়ের মতো শাসন করেছে বটে তবে আবদার করেছে খুব কম। তবে দু’জনে মিলে বহু দেশ ঘুরে বেরিয়েছে।ইনায়ার ওপর তিনি কিছুই কখনো চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অবশ্য করেননি।তবে এখন তিনি কিভাবে মনের ভয়কে জয় করবেন তাই ভেবে পাচ্ছেন না!

চলবে,

#প্রেমের_মেলা
পর্ব:[১৭]
#বর্ষা

আহত দৃষ্টিতে ইনায়া সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। হাঁটু গেড়ে মাথা নত করে তার সামনেই অশ্রু বিসর্জন করছে এক পুরুষ। চুলগুলো বেশ বড় বড়।হাত থেকেও রক্ত ঝরছে তার।ইনায়াও আহত তবে তার শুধু হাতেই গুলিবিদ্ধ।তবে হাঁটু গেড়ে থাকা লোকটার শরীর যে বেশ ক্ষত-বিক্ষত তা বেশ বোঝা যাচ্ছে তার শরীর রক্তাক্ত দেখে।

রক্তাক্ত পুরুষটি কাতর কন্ঠে ইনায়ার দিকে চোখ তুলে বলে,

”আমাকে মেরে ফেলো..না আমি সক্ষম হলাম আমার বোনের হত্যাকারীদের হত্যা করতে..আর না আমি সক্ষম হলাম তোমার কাছে বিজয়ী হতে”

ইনায়া ঠোঁট কামড়ে মুচকি হেসে একপায়ে ভর করে বসলো।ইনায়া বন্দুকটা কোমড়ে গুঁজে রক্তাক্ত পুরুষের দিকে তাকিয়ে বললো,

”ইশা তোমার দোষ এটা নয় যে তুমি খুনি..তোমার দোষ কি তা তুমি জানো?”

ইশা চমকায়। চকিত চাহনি স্থাপন করে।ইনায়া আবারো স্মিত হেসে বলে,

”তোমার দোষ একটাই তুমি প্রশাসনের কোনো সদস্য নও। প্রশাসনের সদস্য হলে ই.কে এর মতো তোমায়ও কেউ ধরতে পারতো না।আমি তোমায় অ্যাপ্রেসিয়েট করি তোমার নজির সৃষ্টিকারী কাজের মতো।তবে ওইযে আগেই বললাম তোমার দোষ কোথায়”

ইশা বুঝতে পারে না।এ কেমন পুলিশ যে কিনা তার অপরাধকে নয় বরং আফসোস করছে তার প্রশাসনের সদস্য না হওয়ায়। ইশা আশ্চর্যচকিত কেননা এ মেয়ে তাকে তার কাজের জন্য তাচ্ছিল্য,ঘৃণা না করে অ্যাপ্রেশিয়েট করছে।

ইনায়া হাতের ব্যথা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে আবারো বলে ওঠে,”ভাবছেন তো আমি কেন এতো অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছি!”

”হুম”

ইনায়া মুচকি হেসে বলে,”ই.কে কি কাজ করে তা সম্পর্কে তো নিশ্চয়ই অবগত আপনি”

”হুম,ই.কে কয়েকশত রেপিস্টকে হত্যা করেছে। অবশ্য তাদের প্রাপ্য দিয়েছে।আই প্রাইড অফ হিম”

”সে কিন্তু মেয়েও হতে পারে ইশা”

বলে না বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট, ঠিক তেমনি ইশাকে ইনায়ার আর কিছুই বোঝাতে হলো না।ইশার প্রাণপাখি কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো উড়ে যাবে।ইশা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,

”আমি জানি আপনার জন্য আমাকে খুঁজে পাওয়া বড় বিষয় নয়।তবুও জিজ্ঞেস করবো কিভাবে খুঁজে পেলেন আমায়?”

পরিত্যক্ত গোডাউনে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ইনায়া দাঁড়ালো বহু কষ্টে। এবং বললো,

”আপনি যেমন আমার পেছনে ছিলেন, ঠিক তেমনি আপনার পেছনে আমার ছায়া ছিলো ”

”মানে?”

”সিক্রেট‌”

”আ..

আর কিছু বলার পূর্বেই জ্ঞানহীন হয়ে পরে থাকে ইশা।ইনায়া বুঝে যায় ইশা আর বেঁচে নেয়। কেননা প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে ইশার। অবশ্য ইনায়া চাইলেও যে বাঁচাতে পারতো না ইশাকে।সে যে ভুলবশত হোক আর অন্যের প্ররোচনায় হোক না কেন কয়েক নির্দোষ ব্যক্তির প্রাণ কেড়েছে।আর যারা নির্দোষদের ওপর জুলুম করে তাদের নিকট কখনোই ইনায়া সহানুভূতিশীল নয়।

প্রেস-মিডিয়া একটি সংবাদই বারবার আঘাত করছে।কুখ্যাত ক্রিমিনাল ইশা প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশই ছিলো এই ক্রিমিনালের মাতৃভূমি।তবে কেন,কিভাবে কোথায় ছিলো এতদিন সে তা রহস্য। পুলিশদের জয়জয়কারে মিডিয়ার লোকেরা কোনো কসর ছাড়ছে না।

ইনায়া টিভিতে এই নিউজই দেখছিলো।তখনই ফোন আসে মোস্তফা জালালের।তিনি ওপাশ থেকে কোনো কথাই বলেন না।ইনায়াও কথা বলে না। কেননা সে মোস্তফা জালালের সাথে রাগ করে আছে তাই। অবশ্য মোস্তফা স্যার ওর ভালো এবং সেফটির জন্যই ওকে একা যেতে নিষেধ করেছিলেন।

”সরি মামনি,কংগ্রেচুলেশন।আর একটি সুখবর হলো-তোমার প্রমোশনের কথা আমি আলোচনা করেছি সিনিয়রদের সাথে।”

ইনায়া প্রমোশনের কথা শুনেও কোনো রিয়াক্ট না করে কথা ঘুরিয়ে ফেলে।বলে,

”বাবাই জানো আমার হাতটা কি যে ব্যথা করছে।আমি না দুই সপ্তাহের ছুটি নিলাম। একসপ্তাহ অবশ্য আমাকে দেওয়া হয়েছে।আর একসপ্তাহ নিলাম ভার্সিটিতে গিয়ে নোট কালেক্ট করতে হবে।ইশান দ্যা পড়াকুতে নিজের সুবিধা মতো একটু একটু লিখেছে।আমার ওতে হবে না”

”আচ্ছা মামনি,তুমি লিভ এ্যাপ্লিগেশন ইমেইল করো।আমি অ্যাপ্রুভ করে নিবোনি ”

ইনায়া কল রাখতেই কলিংবেল বেজে ওঠে।দরজা খুলতেই অবাক হয় কেননা আশিয়ান দাঁড়িয়ে আছে রক্তচক্ষু নিয়ে।ইনায়া কিছু জিজ্ঞেস করবে তার পূর্বেই গটগট করে রুমে চলে যায় সে।ইনায়া ফ্রিজ থেকে জুস বের করে আশিয়ানকে দেওয়ার জন্য রুমে যায়।দেখে আশিয়ান ফ্রেশ না হয়ে মাথা চেপে ধরে বসে আছে।

”আশিয়ান আর ইউ ওকে?”

আশিয়ান মাথা তুলে তাকায়।চোখ দু’টো প্রচন্ড লাল তার।জ্বালা করছে।আশিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

”ইনায়া আমার একটু একাকী সময় চাই প্লিজ ”

ইনায়া বুঝে যায় আশিয়ানের কিছু একটা হয়েছে। কেননা আশিয়ান ইনায়াকে সহজে ইনায়া বলে ডাকে না।জান,কলিজা এই শব্দগুলোই ব্যবহার করে। ইনায়া জুসের গ্লাসটা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।ইনায়া বেরিয়ে যেতেই দরজা আটকে দেয় আশিয়ান।মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বলে,

”কেন জান কেন?কেন আমার কোনো গুরুত্ব নেই তোমার কাছে!আমার স্টাফ শুভ্রত্বের বিয়ে হয়েছে একবছর তারা এখনো একজন আরেকজনকে চোখে হারায়।আর তুমি আমার খোঁজটাও নেও না সারাদিনে।আদৌ তুমি আমায় ভালোবাসো তো!”

হায় রে বোকা!সে হয়তো জানেই না এই মেয়েটার নিকট সে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। উপরি ভালোবাসাই কি সব!কিছু ভালোবাসা তো গোপনীয় হয়।প্রকৃত ভালোবাসা তো প্রকাশ করা যায় না।আবার অনেকে প্রকাশ করতেই তো চায় না।যেমন ইনায়া। আশিয়ানের পেছনে তার সুরক্ষার জন্য কয়েকজন লোক লাগানো। অবশ্য এটা কিন্তু রহস্য ইনায়া সামান্য স্পেশাল ফোর্সের সদস্য হয়ে এতো টাকা কোথায় পাচ্ছে লোকজন হায়ার করার!

ইসরাক খান সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। নতুনত্বের স্বাদ নিতে ইচ্ছে হওয়ায় কফি রেখে আজ চা খাওয়া। ফাবিহা সারওয়ার তারই পাশে বসে গল্প করছেন। সারাদিন দু’জন দু’জনের কর্মস্থলে কি কি করলো।ইশান অবশ্য ওখানে নেই কেননা সে তার বাবা-মায়ের কোয়ালিটি টাইম নষ্ট করতে একদমই আগ্রহী নয়।ইশান ঘরে এসেই বোনকে কল দেয়।বিয়ের পর জামাই নিয়ে আলাদা উঠেছে ইনায়া। অবশ্য এটা বড় বিষয় না বড় বিষয় হলো ইনায়া আহত আর যা ওর বাবা-মা কেউই জানে না। অবশ্য জানানো হয়নি।

—ইয়ু কেমন আছিস বনু

ইনায়া ভিডিও কলে অস্বস্তি বোধ করলেও ভাইয়ের কল তো আর কাটতে পারে না।রিসিভ করে। ইশানের প্রশ্নের উত্তরে বলে,

—আলহামদুলিল্লাহ, তুই

—ইয়ু আমি তোর বড় কিন্তু..তাই আমাকে ভাই বলে ডাকবি

—আসছে আমার বড় ভাই!

ইনায়া ভেংচি কেটে কথাটা বলে।ইশান খুনসুটিময় রাগ দেখায়। বেশ অনেকক্ষণ খুনসুটি করে দু’ভাইবোন। ভাই-বোনের সম্পর্কটা যে মধুময়।বড়/ছোট/জমজ ভাই-বোন থাকা ভাগ্যের বিষয়।তবে এই সম্পর্কের মানে বুঝতে হলে অবশ্যই কিছুটা দূরত্বের প্রয়োজন হয় কেননা সহজে পাওয়া জিনিসের মূল্যায়ন মানুষ করতে পারে না।তেমনি ইশান ইনায়াকে খোঁজেনি তাই তো হঠাৎ করেই ইশান বদলে গিয়েছিলো।তবে ইনায়া ইশানকে খুঁজে বের করেছিলো বিশাল জনসংখ্যার ক্ষুদ্র দেশে।তাইতো গোপনে হলেও ভাইকে সে ভালোবেসেই গিয়েছে।

চলবে?

প্রেমের মেলা পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রেমের_মেলা
পর্ব: [ ১৪ ]
#বর্ষা

ইনায়া মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আজ প্রথমবার পাপাইয়ের হাতে চড় খেয়েছে সে। চোখের অশ্রুগুলো আজ বাঁধ মানতে নারাজ। বাঁধাকে অগ্রাহ্য করে কপোল শুকানোর পূর্বেই তা আবারো ভিজে উঠছে।ইসরাক খান মেয়ের সাথে রাগ দেখিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। ফাবিহা সারওয়ার ইনায়ার সাথে কোনো কথা না বলেই নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়েছেন। ইনায়া ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।বারবার ভাবছে পাপাইয়ের বলা কথাটা।

”তোমার মতো প্রতারক মেয়ে থাকার চেয়ে মেয়ে না থাকাই ভালো।”

ইশান বোনকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে আসলে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় ইনায়া তাকে।ইসরাক খান যখন ইনায়াকে থাপ্পর মেরেছিলো,বকেছিলো তখন ইশান সেখানে উপস্থিত ছিলো। বোনের হয়ে একটা কথাও সে বলেনি।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইনায়ার অনেক কষ্ট লেগেছে ব্যাপারটায়।তাইতো আর একমিনিটও না,সে দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।সেই নীল কভারের ডাইরিটা নিতেও ভুল হয়না ওর। কাউকে ফোন করে বলে,

”সেহরিশ ইজ কামিং ”

হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পরিবর্তন করে ব্যাগ/ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।সারা শরীর কাঁপছে ওর।তবুও স্থির আর থাকে না সে।প্রথমে গাড়ির কাছে গেলেও তা আর নেয় না কেন নেবে?এটা কি তার গাড়ি নাকি!এটা তো ইসরাক খানের গাড়ি যে কিনা ইনায়াকে মেয়ে হিসেবে/সন্তান হিসেবে চায় না।তাইতো বাড়ির সামনে থেকে রিকশায় উঠে পড়ে।ইশান বারান্দায় ছিলো তখন।রিনির সাথে কথা বলছিলো।ইশান ইনায়াকে ট্রলি হাতে যেতে দেখে দ্রুত ফ্লাট থেকে বেরিয়ে লিফটের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসে।তবে ততক্ষণে বাইরে এসে ইনায়ার আর হদিস সে পায়না।

গাড়ি নিয়ে খুঁজতে বের হয় যেদিক সে ইনায়াকে যেতে দেখেছিলো সেদিক।তবে দিকবিদিক করেও আর খোঁজ মেলে না ইনায়ার। সকালবেলা ইনায়ার পেছনে বেরিয়ে ছিল ইশান।আর এখন বিকাল।না,এখনো অব্দি খোঁজ মেলেনি!সন্ধ্যার আঁধার ছড়িয়ে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে নিজেদের ফ্লাটে আসে সে।ইশানকে একলা দেখে ইসরাক খান প্রশ্ন করেন,

”তুমি একা কেন?তোমার বোন কোথায়?”

ইশান কখনো বড়দের সাথে মুখেমুখে কথা না বললেও ইনায়ার জন্য আজ তার সেই রেকর্ড ভেঙে ফেললো।বললো,

”তুমি না বলেছিলে ইনায়ার মতো মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো,তাহলে আবার ওর খোঁজ করছো কেন?”

ফাবিহা সারওয়ার রান্না ঘর থেকেই ধমকে ওঠেন ইশানকে।ইশান নিশ্চুপ হয়না তবুও। ফাবিহা সারওয়ারের ধমকে অগ্রাহ্য করে আবারো বলে,

”তোমাদের মেয়ে হারিয়ে গেছে।ওফস সরি তোমাদের মেয়ে না,আমার বোন হারিয়ে গেছে।আমার বোনটার কি দোষ ছিল?দোষ ছিল তোমাদের দুজনকে এক করার জন্য মিথ্যে অভিনয় করাটা।ইনায়ার দোষ ছিলো আমাদের একটা খুশি পরিবার তৈরি করা।”

ফাবিহা সারওয়ার কিছুই আর বলেন না।ইসরাক খান নিস্তব্ধ চোখের জল বিসর্জন করছেন। তিনি যে তার আদুরিনীকে বেশ কষ্ট দিয়েছেন আজ। কি করে সেই অভিমান হ্রাস করবেন তিনি।ইশান নিজ ঘরে চলে যেতে নিবে ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে।ইশান ভাবে হয়তো ইনায়া ফিরে এসেছে তাই দ্রুত দরজা খোলে।আশিয়ানকে দেখে মাথা গরম হয়ে যায় ইশানের।এই ছেলের কি খেয়েদেয়ে কাজকর্ম নেই, তখন বাংলাদেশে এর কি কাজ!আর এই ছেলেটাও তো ওর বোনকে কষ্ট দিয়েছে।ইশান কিছু বলবে তার পূর্বে আশিয়ানের বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে করুণা হয় তার।তাইতো রাগ না দেখিয়ে শান্ত মস্তিষ্কে কথা বলার প্রয়াস করে।

”কি চাই”

”ইনায়াকে”

”ইনায়া বাড়িতে নেই।আপনি আসতে পারেন”

ইশান দরজা লাগিয়ে নিতে নিলে আশিয়ান দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে।ইশান খেপে যায়।আশিয়ান ফ্লাটে প্রবেশ করেই চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে ইনায়াকে ”জান,জান”বলে। ইসরাক খান এগিয়ে এসে দাঁড়ান আশিয়ানের সামনে‌। নিজেকে যথাসম্ভব আয়ত্তে এনে আশিয়ানকে জিজ্ঞেস করেন,

”তুমি এখানে?”

”বাবাই,ইনায়া কোথায়?আমার ওর সাথে অনেক কথা আছে।বলো না বাবাই ইনায়া কোথায়?”

ইসরাক খান কেঁদে ওঠেন। আশিয়ান ভয় পায়। ভীতি কন্ঠে বলে,

”বাবাই আমার জান ঠিক আছে তো?আমি তো আমার জানের সাথে অন্যায় করেছি।বলোনা বাবাই আমার জান কোথায়?”

আশিয়ান কাঁদতে কাঁদতে ইসরাক খানের হাত জড়িয়ে নেয়।কত ভালোবাসলে পুরুষ মানুষ অন্যদের সামনে কাঁদতে পারে তা বোঝাই যাচ্ছে।মাঝে মাঝে মস্তিষ্কে ভুলভাল খেয়াল আসে, ভুলভাল প্রশ্ন আসে তার একটির উত্তর আমাদের মন মতো না এসে উল্টা পাল্টা উত্তর আসলেই পুরুষ আর নারী নেই সবাই আউট অফ মাইন্ড হয়ে যায়।কি বলতে কি বলেছে তা তারা নিজেরাও জানে না।যখন অনেক দেরি হয়ে যায় তখন বুঝতে পারে তার দোষটা আসলে কোথায়!আর যতই ভালোবাসা থাকুক না কেনো মানুষ আউট অফ মাইন্ড হলে মানুষ ভালোবাসার মানুষটিকেও ভুলভাল বলে ফেলে।

ইনায়া বসে আছে মোস্তফা জালালের কেবিনে। মোস্তফা জালাল এখনো তাকিয়ে আছে ইনায়ার মুখশ্রীর দিকে। চোখ দু’টো ফোলা ফোলা। মোস্তফা জালাল রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বলেন,

”এই মেয়ে তোমার এই অবস্থা কেন?আর ব্রিজের ওপরই বা কি করছিলে? তুমি জানো না ওই স্থানটা কতটা বিপদজ্জনক!”

ইনায়া চোখ তুলে তাকায়।ছুটে গিয়ে মোস্তফা জালালের হাত ধরে মেঝেতে বসে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

”বাবাই জানো আজ পাপাই না আমাকে বলেছে যে আমার মতো মেয়ে থাকার চেয়ে মেয়ে না থাকাই ভালো”

ইনায়ার কথায় মোস্তফা জালাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।তারা যে হীরের কদর করেনি।যেখানে মোস্তফা জালালের আফসোস ইনায়ার মতো মেয়ে না পেয়ে সেখানে নাকি নাকি ইনায়ার পাপাইয়ের দুঃখ ইনায়াকে মেয়ে হিসেবে পেয়ে! মোস্তফা জালাল ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

”বাবাই কিন্তু প্রাউড ফিল করি এই পুচকি অফিসারের ওপর!”

ইনায়াকে পুচকি বলায় ইনায়া হেসে ফেলে। কেননা অনেকদিন পর এই পুচকি ডাকটা শোনা।ইনায়া যখন প্রথমবার অর্থাৎ একবছর আগে স্পেশাল রেকোমেডিশনে ইনায়াকে নেওয়া হয় এই স্পেশাল ফোর্সে।ইনায়ার অফিসার হিসেবে রেকর্ড মাত্র একবছরের ছিল তখন। অবশ্য একজন অফিসার হতে তাকে কতগুলো দিন যে প্যারা সহ্য করতে হয়েছে তা শুধু সেই জানে। অবশ্য সার্প সুটার হওয়ায় এবং নিজ বুদ্ধিমত্তায় অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেতেই মাত্র তিনমাসে দশটা ধর্ষণের কেস,তিনটা নারী পাচার চক্রের উত্থান হয়েছে।

মোস্তফা জালাল ইনায়াকে স্বাভাবিক হওয়ার কথা বলে বাইরে যান।ইনায়া কেবিন সংলগ্ন ওয়াসরুম থেকে হাতমুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে আসতেই মোস্তফা জালাল বলেন,,,,

”ইনায়া প্রস্তুত তো সবার সামনে প্রকাশ্যে আসার জন্য?এতে কিন্তু তোমার ওপর বিপদের ছায়া দৃষ্টি স্থাপন করবে!”

”বাবাই ইনায়া এক চরিত্র আর সেহরিশ এক চরিত্র।সেহরিশ আজ সকলের সামনে যাবে ইনায়া নয়।আর ইনায়া সেদিনই সামনে আসবে যেদিন সেহরিশ বিপদে পড়বে!”

ইনায়ার রহস্যঘেরা কথাগুলো মোস্তফা জালাল অল্প হলেও বুঝতে পারেন।এই মেয়ের জীবনটাই একটা রহস্য।যতটা সহজ-সরল জীবন সে অন্যদের দেখায় ঠিক ততটুকুই গোলকধাধায় ঘেরা তার জীবন।এই ধাঁধা কি আদৌ কেউ সমাধান করে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে!

অত্যাধিক আলোতে চোখ খোলা অসম্ভব।যেন চোখের মণিই ঝলছে যাবে এ আলোতে।একটা লোককে বেঁধে রাখা হয়েছে চেয়ারে।লোকটা বারবার বাঁচার জন্য চিৎকার করছে।না পারছে চোখ খুলে রাখতে,আর না পারছে শান্তিতে একটু বসতে!

লোকটা যখন বাঁচার জন্য ক্ষমা চাচ্ছে তখন এক পুরুষনালী কন্ঠস্বর কানে বাজে,

”মেয়ে মানুষ দেখলে গতরে জ্বালা হয় তাই না!তুই যখন তোর মালিকের বছর সাতেকের মেয়ের সাথে নোংরা কাজ করছিলি তখন মনে হয় নাই তোর বাড়িতেও তো ওই বয়সের মেয়ে আছে। ওর সাথেই যদি এমন হয়!”

লোকটা আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে এবং বলে,

”আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার ভুল হয়েছে ”

পুরুষনালী কন্ঠস্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়,”তুই ভুল না অন্যায় করেছিস।আর অন্যায়ের শাস্তি তুই পাবি”

তারপর সব নিরবতায় ছেয়ে যায়।একটু পর ওই তীব্র আলোর রশ্মি নিক্ষেপনও থেমে যায়।লোকটা ভাবে হয়তো এ যাত্রায় সে বেঁচে যাবে!তবে না পূর্বের পুরুষনালী সেই লোকটা এগিয়ে আসে এবং বলে,

”কি ভেবেছিলি বেঁচে গিয়েছিস?কখনোই না।আমার পুচকির সাথে যা হয়েছিলো তা আমি রুখতে পারিনি তবে অন্যের বোনদের সাথে ঘটা ঘটনার প্রতিশোধ তো ইশা নিতেই পারে!তোমরা আসো”

কয়েকজন লোক এগিয়ে আসে।পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রুক্ষ হাসে। বাঁধা অবস্থার লোকটা ঝাঁপসা চোখে তাকায়। উপস্থিত সকলে ইশার আদেশ পাওয়া মাত্রই লোকটার জৈনাঙ্গ কেটে ফেলে।গলা কাটা মুরগীর মতো ঝটপট করতে করতে জ্ঞান হারায় লোকটা।ইশা মুখের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,

”তোমরা জানো একে কি করতে হবে।যাও ”

চলবে?

#প্রেমের_মেলা
পর্ব: [ ১৫ ]
#বর্ষা
”সেহরিশ ম্যাম, আপনার বলা ফাইলগুলো ”

একজন লোক কয়েকটা ফাইল এগিয়ে দেয় ইনায়ার দিকে।ইনায়া প্রথমে উঠে দাঁড়ায় এবং তারপর ফাইলগুলো নিয়ে হাঁটা ধরে।তমাল নামক এই লোকটা অনেকটাই চিপকু টাইপের।যখন থেকে মোস্তফা স্যার ইনায়ার পরিচয় করিয়েছেন তখন থেকেই যেন কেমন করে তাকায়।নিজ থেকেই এটা ওটা জিজ্ঞেস করে, সাহায্য করতে আসে। যেখানে মায়ের কাছে না কাঁদা অব্দি সে তার দুধের শিশুর ক্ষুধা লেগেছে বুঝছে পারে না,সেখানে তমালের এই ঘন ঘন সাহায্যের হাত বাড়ানোর ইনায়ার নিকট সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।তবে সে যেহেতু স্পেশাল ফোর্সের অফিসার, সেহেতু ইনায়া যদি সন্দেহ না করতো তবেই তা অস্বাভাবিক হতো।

ইনায়া ক্রেডিট কার্ড ইউজ করা বন্ধ করেছে। পাশাপাশি সিমটাও বন্ধ করে রেখেছে।আর মোবাইল পুরোপুরি রিফ্রেশ করে নতুন সিম লাগিয়েছে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে সে এখন। সাথের লাগেজটা অবশ্য এখন সাথে নেই। পাপাইয়ের গাড়িটাও একজন লোকের মাধ্যমে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশ্য লোকটা ইনায়ার কলিগ ছিল।

একটু পর বাস থামতেই সে নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য জিজ্ঞেস করে বাসে উঠে পড়ে।রাত দশটা।এতো রাতে মেয়ে হয়ে বাসে করে বাইরে ঘুরে বেড়ানো প্রচন্ড রিস্কি।বাসে হাতে গোনা দশ পনেরোজন।আজ এত কম যাত্রী কেন তা ইনায়ার মাথায় আসলো না।ইনায়া কিছুক্ষণ ভেবে বুঝতে পারলো কিছু না কিছু গড়বড় আছেই এখানে।ব্যাগ থেকে গোপনে বন্দুকটা বের করে রেডি হয়ে রইলো।নিজ সিট থেকে পেছনের দিকে তাকিয়ে সামনে ঘুরে বসলো।চোখ বন্ধ করে পেছনে বসা ব্যক্তিদের কে কেরম আচরণ করছিলো তা ভেবে দেখলো। সন্দেহের দৃষ্টি পড়লো ব্ল্যাক শার্ট আর হোয়াইট শার্টের দুইটা লোক এবং পারপেল কালারের টপস পড়া একজন রমনীর ওপর। তাদের আচরণ অনেকটাই অদ্ভুত।তারাও চারপাশ স্ক্যান করছে।ইনায়ার সন্দেহ দৃঢ় হয়।তার মনে হয় এরা হয়তো পুলিশের সদস্য নয়তো ক্রিমিনাল।

বাস থেকে একে একে সবাই নেমে যায়।ইনায়া লাস্ট স্টপেজের টিকেট কিনেছে। তাইতো এখনো সে টাইপিং এর মাধ্যমে টিমকে খবরাখবর পাঠাচ্ছে।ইনায়া তিনদিন হলো স্পেশাল ফোর্স জয়েন করেছে সশরীরে। তাইতো ইশার কেসের পাশাপাশি আরো কয়েকটা কেসের তদারকিও করছে সে।

বাসে মাত্র চারজন পেসেঞ্জার আছে।ইনায়া ঘুমিয়ে পড়েছে।সাথে বাসে থাকা আরেকটা মেয়েও ঘুমঘুম।ব্ল্যাক শার্টের লোকটা গেম খেলছে।আর হোয়াইট শার্টের লোকটা কনটেকটারের সাথে কি নিয়ে কথা বলছে।আর মিটিমিটি হাসছে। কনটেকটার সামনে গিয়ে বাস ড্রাইভারের সাথে কিছু কথা বলে। দুইজনে পৈশাচিক হাসে। কনটেকটার গিয়ে ব্ল্যাক শার্টের লোকটাকে বলে,

”ভাই কখনো টাচ করছেন?”

”হুম,ফোন তো প্রতিদিনই টাচ করি।এখনও তো তাই করছি”

”আরে ভাই অন্যের মা* টাচ করছেন?আজকে কিন্তু সুযোগ আছে।দুই দুইটা পরী আর আমরা চারজন পুরুষ।বুঝতে পারছেন নিশ্চিত?”

”ভাই কীসব বলছেন! এগুলো অন্যায়।আর ধরা পড়লে পুলিশ কেস আর মান-সম্মান ধূলিসাৎ।”

”আরে ভাই ধরা পড়বেন কিভাবে? এগুলোকে আমাদের গোডাউনে নিয়ে যাবো।তারপর নিজেদের কাজ করে সেল করে দিবো অর্গেন সেলারদের কাছে!হা হা হা”

ব্ল্যাক শার্টের লোকটা আর হোয়াইট শার্টের লোকটার সাথে কনটেকটার হাসতে থাকে।এ হাসিতে আছে কুৎসিত আকাঙ্ক্ষা।বাস রাস্তা বদলায়। জঙ্গলের রাস্তা ধরে পুরাতন এক কারখানা জাতীয় স্থানে পৌঁছায়।ইনায়া চোখটা নিভু নিভু চোখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে। কনটেকটার হাতের উল্টো দিকে কোনো কিছু নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।তাই ইনায়া ঝটপট চোখ খুলতেই রুমাল দিয়ে মুখটা চেপে ধরে ওর।জ্ঞান হারায় ইনায়া।

বদ্ধ রুমে পোশাক খুলতে ব্যস্ত কনটেকটার আর ড্রাইভার।অবৈধ কর্ম সাধন করতেই এই কর্ম। কনটেকটার ইনায়ার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই গোপনাঙ্গে প্রচন্ড জোরে লাথি মেরে উঠে দাঁড়ায় সে।একটু দূরে রাখা ব্যাগ থেকে দ্রুত বন্দুক আনতে চায়।তবে পারে না।তার পূর্বেই ওই ড্রাইভার ঝাঁপিয়ে পড়তে নেয় ইনায়ার ওপর।ইনায়া ড্রাইভারের চুলে ধরে সামনে পেছন করে ছুঁড়ে মারে দেয়ালে। এতক্ষণ চুপ করে থাকার একটাই কারণ ছিলো তা হলো প্রমাণ জোগাড়।এই শয়তানগুলো নিজ মুখে এতক্ষণে সব কথা গলগল করে বলছিলো।আর যা ইনায়ার ব্যাগে আর পোশাকে থাকা গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে।তাইতো এখন আত্মরক্ষা করছে সে।

ইনায়া দুইটাকে এতক্ষণ ইচ্ছে মতো পেটায়।পালিয়ে যেতে নিলেই একজনের পা ভেঙে ফেলে ইনায়া। আরেকজনের পায়ে গুলি করে ন্যাংড়া করে ফেলে। তখনই ব্ল্যাক শার্ট আর হোয়াইট শার্টের লোক দুটো ঢোকে।তবে তারা অবাক হয় ইনায়াকে জাগ্রত দেখে এবং লোক দুটোর এ অবস্থা দেখে।ইনায়া ওই লোক দুটোর দিকেও বন্দুক স্থাপন করে।

”একপাও নড়াচড়া করা চেষ্টা করবেন না। গুলি করতে কিন্তু আমার হাত একফোঁটাও কাঁপবে না”

ব্ল্যাক শার্টের লোকটা হাত উপরে রেখেই বলে,”মিস আমরা পুলিশের লোক।প্লিজ বন্দুক নামান।”

ইনায়া গম্ভীর কন্ঠে বলে,”প্রমাণ কি আপনারা পুলিশের লোক?”

হোয়াইট শার্টের লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে একটা আই.কার্ড ইনায়ার দিকে গড়িয়ে দেয়।ইনায়া লক্ষ্য স্থির রেখেই আই.কার্ডটা দেখে নেয়।বন্দুক নামায়।তখনই প্রবেশ করে আরো তিন চারেক মানুষ। তাদের মাঝেই একজন বলে ওঠে,

”অফিসার আপনারা যেতে পারেন।এই দুটোর দায়িত্ব আমাদের ”

মোস্তফা জালালকে দেখে স্যালুট জানায় দুইজন।হোয়াইট শার্টের লোকটার নাম খোকন মিয়া।আর ব্ল্যাক শার্টের লোকটার নাম নোমান।আর জ্ঞানহীন মেয়েটার নাম শম্পা আক্তার।এরা পুলিশ কি করে হলো ইনায়া বুঝতে পারছে না। ক্রিমিনাল ধরতে এসে যদি পুলিশ অফিসাররাই জ্ঞান হারিয়ে ভিক্টিম হয়ে ওঠে তাহলে সাধারণ জনগণের কি হবে!

ইনায়া বেরিয়ে আসে তার সহকর্মীদের সাথে। মোস্তফা জালালের সাথে ইনায়া,খোকন মিয়া,নোমাক এবং শম্পা চলে যায়।আর তমাল,শাহেদ,রেজা ওনারা যান ওই ক্রিমিনালগুলোকে নিয়ে।

কিঞ্চিত সময়ের ব্যবধানেই জঙ্গলের মাঝে একটা গাড়ির লাইট জ্বলে ওঠে।গাড়ির ভেতর বসে থাকা লোকটা মুচকি হেসে বলে,

” প্রাউড অফ ইউ অফিসার সেহরিশ খান।প্রাউড অফ ইউ।তোমার সাথে খেলতে মজা হবে।তবে আসলে কি জানো? তোমার মতো অফিসার যদি আগে থাকতো তবে আমাকে ইশা হতে আর হতো না ”

পরদিন দুপুরে ইশান দাঁড়িয়ে আছে রিনির সামনে।রিনি গাল ফুলিয়ে বসে আছে।কারণ একটাই ইশান এতদিন ভার্সিটিতে আসেনি।এমনকি কারো সাথে যোগাযোগও‌ রাখেনি।রিনি গাল ফুলিয়ে বলে,

”ইশান তুমি একা কেন আমার ননদিনী কোথায়?”

”ইনায়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে”

রিনি অতি অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে,”হোয়াট?”

”হুম”

”ইশান তুমি ওকে খোঁজার চেষ্টা করেছো?”

”না”

”কেন?”

”যে হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজে আনা সম্ভব।তবে যে আত্মগোপন করে তাকে খোঁজা অসম্ভব ”

ইশান আর রিনির কথার মাঝেই আশিক আর রুমানা এসে হাজির হয়।আশিক এসে ইশানের কাঁধে হাত রাখে।রুমানা রিনির দিকে তাকিয়ে একটু হাসে।আশিক আর রুমানা একসাথেই জিজ্ঞেস করে ওঠে,

”দোস্ত ইনায়া কোথায়?”

”আত্মগোপন করেছে!”

রিনির কথার মানে দুজনের কেউ বোঝে না।ইশান চলে যাচ্ছে ওখান থেকে।নিশ্চুপ সে।আশিক আর রুমানা চেপে ধরে রিনিকে।রিনি ইশানের বলা কথাগুলোরই আবৃত্তি করে।আশিক আর রুমানার মস্তিষ্কে চিন্তারা বাসা বাঁধে।সিনিয়র ভাই তিতাস আজ তাদের কাছে ইনায়ার খবর জানতে চেয়েছে।তবে তারা দিতে ব্যর্থ ছিলো।

ইশান বাসায় আসতেই দেখতে পায় ইসরাক খানও মাত্রই বাড়ি ফিরেছেন।গায়ের থেকে ব্লেজার খুলে হাতে নিয়েই ফোনের ওপর ফোন করে চলেছেন তিনি।শেষবার কলটা হয়তো রিসিভ হয়।কিছু কথোপকথনও যে হয় ইশান তা বেশ বুঝতে পারে।ইসরাক খান নিজ ফ্লাটে না গিয়ে পার্কিং থেকেই আবারো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসেন।

ইসরাক খান আজিমপুরে একটা গলিতে গাড়ি পার্ক করে সামনে এগিয়ে যান।সামনে থেকে আসা কাঙ্ক্ষিত রমনীকে দেখে নিস্তব্ধ চোখের জল ফেলেন।ইসরাক খান এগিয়েও যান না আবার ফিরেও আসেন না।ঠিক তখনই কোথা থেকে ধেয়ে আসা একটা গুলি লাগে তার সামনে থাকা দোকানে। অবশ্য সেখানে তো সেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই ধ্যান ভাঙতে বুঝতে পারে কাঙ্ক্ষিত ওই রমনীটিই তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। বাঁচিয়ে দিয়েছে।

আশিয়ান পাগলের মতো এদিক সেদিক ঘুরছে গাড়ি নিয়ে।ইনায়াকে খুঁজছে।পত্রিকাতেও মিসিং সংবাদ দিয়ে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে।ইনায়া খবরের কাগজে নিজেকে দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি আশিয়ানের বাংলাদেশের নাম্বার দেওয়া দেখে আরো বেশি অবাক হয়।

আশিয়ানের কাছে কয়েকটা ফেক কল এখনো অব্দি এসেছে। আশিয়ানের রাগ লাগছে।অনেক বেশি রাগ লাগছে।মনে হচ্ছে সে সবকিছু পুড়িয়ে দিবে। আশিয়ান নিজ মনে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

”জান তোমাকে যে আমার চাই।তুমিহীন জীবনটা মরণের মতোই লাগছে।জান,ও‌ জান পৃথিবীর মানুষগুলো কেন আমার অনুভূতি নিয়ে খেলছে?কেন আমাকে ফেক কল করছে!”

চলবে?