Saturday, July 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 323



আগুনের দিন পর্ব-১০

0

আগুনের দিন – ১০

‘এই চিঠি কোথায় পেয়েছিস? কে দিয়েছে তোকে’ কাগজটাতে চোখ বুলিয়েই জিজ্ঞাসা করল রেজিনা।

হঠাৎ করে উত্তর এলো না নিশার কাছ থেকে। ও থতমত খেয়ে চুপ করে থাকল।

‘বল? কার চিঠি? কে লিখেছে?’

‘ময়নার চিঠি, মা। ময়নাকে একজন দিয়েছে’ মরিয়া হয়ে জবাব দিলো নিশা। ‘তুমি কাউকে বোলো না, মা, ওর মা তাহলে ওকে খুব বকবে।’

‘ময়নার চিঠি তোর কাছে কেন’ নিশার উত্তরে সন্তুষ্ট না রেজিনা।

‘আমাকে দেখতে দিয়েছিল। তারপর আমার কাছেই রেখেছি। তুমি কাউকে বোলো না মা।’

‘এসব করতেই গ্রামে এসেছ, বুঝেছি আমি। আমার সারাজীবন বেগার খেটেই গেল। তোমাদের মানুষ বানাতে পারলাম না। আমি এখনই সবাইকে বলব।’

‘আম্মু প্লিজ। প্লিজ আম্মু। আমি রিকোয়েস্ট করছি তোমাকে। প্লিজ!’

রেজিনা নিশাকে কোনো উত্তর না দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে গোসল করতে শুরু করল। টিউবওয়েলের চাতাল বেয়ে ইট বসানো পানির নালা দিয়ে সরসর করে পানি চলে যাচ্ছে। নিশারও সবকিছু সেই পানির সাথে তীব্রস্রোতে ভেসে যাচ্ছে মনে হলো ওর। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি করে সরে এলো নিশা। দুচোখ হন্যে হয়ে ময়নাকে খুঁজছে।

ময়না গোসল করে এসে চুল ঝাড়ছে। নিশা হন্তদন্ত হয়ে ওকে চেপে ধরল ‘ময়না, বিপদ হয়েছে।’

‘কী? কী করছ তুমি আবার?’

‘মা চিঠিটা পেয়ে গেছে’ কাচুমাচু হয়ে বলল নিশা।

‘কোনটা? কেমনে পাইলো? কই রাখছিলা তুমি?’

‘ময়না, প্লিজ। মা জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবা ওটা তোমার চিঠি।’

‘আমার চিঠি মানে?’

‘মানে, কেউ তোমাকে লিখেছে।’

‘কে? কে লিখেছে?’

‘সুমনের কথাই বলবা।’

‘অসম্ভব’ নিজের এতদিনের গোছানো পরিকল্পনা চোখের সামনে মাঠে মারা যেতে দেখল ময়না। সুমনের নামটা প্রকাশ্যে এসে গেলে ওর মহাসর্বনাশ। প্রায় বেকার ছেলের সাথে ময়নাকে কেউ বিয়ে তো দেবেই না, উলটো এমন কিছু হবে যাতে সুমনের নামও আর কোনোদিন মুখে আনার জো থাকবে না। ‘একটা চিঠি সামলায়ে রাখতে পারো না, তোমার দায় আমি নেবো কেন? এইটা পারব না নিশা।’

ততক্ষণে বাড়ির ভেতর তুলকালাম করে নিয়েছেন রেজিনা। সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে এসে সামলে রাখতে পারেনি বলে শাশুড়ী, দেবর, জা সবাইকে দোষারোপ করলেন। সবাইকে চিঠির টুকরোটা খুলে জোরে জোরে পড়ে শোনালেন। লজ্জায় নিশা দশহাত মাটির নিচে চলে যাচ্ছে যেন।

রেজিনা মইন সাহেবকে ফোনে গালাগাল করে বাড়ি মাথায় করে নিলেন, ‘এই প্ল্যানে তুমিও আছ? তোমার মা কারসাজি করে মেয়ে নিয়ে গ্রামে এলো, এইখানে তারে নিয়ে এই ষড়যন্ত্র তুমিই করিয়েছ? এইজন্যই তো বলি, মেয়ে আমার কখনো অনুমতি ছাড়া চোখের পলক ফেলে না, আজ এতবড় কাহিনি কীভাবে ঘটিয়ে ফেলল?’

‘সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তুমি অনেক দূর চলে গেছ। এইবয়সে এইরকম চিঠিফিঠি আসেই। মেয়েরাও দেয়। কয়েকদিন যেতেযেতেই সব ভুলে যাবে।’

রেজিনাও জানে তা। কিন্তু তার যে ফেসলস হলো সেটাই সে হজম করে উঠতে পারছে না। নিজের সন্তান লালনপালন নিয়ে তার অহংকার ছিলো সেটা আজকে গুঁড়িয়ে গেছে, আর তাও যাদের তিনি শত্রুপক্ষ মনে করেন সেই দেবর, জা, শাশুড়ীর সামনে। একটা এসপার ওসপার করতেই হবে।

‘শোনো নিশার আব্বু, এই ব্যাপারে একটা কথাও আমি শুনব না।’

‘কী করবে তুমি? এত বাড়াবাড়ি করছ কোন সাহসে? আমি নেই তাই?’

ফোনটা কেটে দিলেন রেজিনা, তারপর বাতাসী বেগমকে ফোন করলেন।

‘হ্যালো বাতাসী আপা?’

‘হ্যাঁ আপা বলো?’

‘কেমন আছ?’

‘আছি ভালো। কুশল জিগাইতে ফোন দিছো?’

‘না ঠিক তাও না। ওই যে তুমি একটা প্রস্তাব এনেছিলে, নিশার জন্য। আমি ওর আব্বুর সাথে কথা বলছিলাম। ভেবে দেখলাম, মেয়ে বিয়ে তো দেবোই, তো বছরদুই আগে দিলেই বা সমস্যা কী?’

‘এই তো লাইনে আসছ।’

‘কিন্তু আমরা একটু খোঁজখবর নেব’

‘সে ঠিক আছে। কিন্তু সেইদিক তো তুমি খেদায়ে দিলা। তারা এখন ছেলের বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক করছে কীনা কইতে পারি না। আমি কথা বইলে তোমারে জানাচ্ছি।’

‘আচ্ছা। ফোন দিও তাড়াতাড়ি। আমারও তো গোছগাছ আছে। কিছু নেবে না বললেই কিছু দেবো না, তা তো না।’

‘আচ্ছা, এই আধাঘন্টা একঘন্টার ভেতর ফোন দিচ্ছি আমি।’

নিশা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো, রেজিনার কথা শেষ হতেই পা জড়িয়ে ধরল। ‘আম্মু আমি কিছু করিনি৷ কোনো অন্যায় করিনি।’

‘করোনি। সুযোগ পাওনি তাই। সুযোগ পেলে অবশ্যই করতে। কিন্তু তুমি কবে সুযোগ পাবে আর আমার মুখে চুনকালি লাগাবে সেইপর্যন্ত তো তোমাকে সময় দিতে পারব না, মা।’

‘আম্মু আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।’

নিশার দাদি চুপ করে থাকতে পারলেন না আর এগিয়ে এলেন, ‘আহা, নিশার মা৷ করো কী? একটা না হয় ভুল মেয়ে করেছেই, তাই বলে বাপ-মা হয়ে তাকে শাস্তি দেওয়াও কিন্তু আমাগো কাজ না, আমরা শোধরাই দিতে পারি।’

‘তো কী করব? ওই যাত্রার নটির সাথে নিশারে বিয়ে দেবো? কথায় আছে না, শকুন উপরে থাকলেও নজর থাকে নিচের দিকে। যেমন গুষ্টি তেমনিই তো হবে মেয়ে। যতই ভালো শিক্ষা-দীক্ষা দিই না কেন, নজর তো ছোটোলোকের দিকেই থাকবে।’

বারবার বংশ তুলে কথা বললেও কেউ প্রতিবাদ করল না, রেজিনা ক্ষেপে আছে বুঝতে পেরে। আর নিশার দাদিও দায় অস্বীকার করতে পারছেন না, নাতনিকে রেজিনার অসম্মতিতে নিজের সাথে এনেছিলেন বলে। আরও খেয়াল রাখা উচিত ছিলো তার। তবুও বিয়ে দেওয়া খুব খারাপ হবে ভেবে বললেন ‘তাই বলে চিনপরিচয় নাই এমন পোলার সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবা?’

‘হ্যাঁ দেবো। চেনাজানা লাগবে কেন? আমার বিয়ের সময় আপনার ছেলের সাথে চেনাজানা ছিলো? আপনার বিয়ের সময় ছিলো? নাকি দিন পাল্টাইছে, এখন শুয়ে দেখে চেনাজানা করা লাগবে? কীরে নিশা ওই যাত্রার নটির সাথে শোয়াটোয়া হয়ে গেছে নাকি শুয়ে দেখবি? কী শেখাইছে এইকয়দিনে এরা?’

ঘৃণায় নিশার বুক ভারী হয়ে আসলো। এই বাড়ির লোকদেরকে নিচ দেখিয়ে নিজেকে উঁচু করতে গিয়ে নিজেকে কতটা ছোটো করল রেজিনা আর নিশাকে কতটা অসম্মান আর হীনতা দিলো তা একবারও ভেবে দেখল না।
নিশা ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল আর নিজের মৃত্যুকামনা করতে থাকল। কিন্তু মরণ কি এত সহজে আসে কারো কাছে?
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নিশা।

*****
‘নিশা ও নিশা?’ ময়না ধাক্কা দিয়ে ডাকল নিশাকে।

নিশার রাগ হয়েছে ময়নার উপরে। ও ইচ্ছা করলেই এই খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো না নিশাকে। শুধু নিশার মাকে বললেই হতো, যে চিঠিটা ময়নার। মা তাহলে লুকিয়ে যেত ব্যাপারটা। আর ময়নারই তো দোষ সবটা। ও কেন চিঠি নিয়ে এলো? নিশা কি বলেছিল ওকে কারও চিঠি এনে দিতে? কারো সাথে প্রেম করিয়ে দিতে?

‘তুমি রাগ করছ, নিশা’ প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ময়না নিজেই বলতে থাকল ‘আমি কী করতাম নিশা, কও। আমার নামে চিঠি এই কথা শুনলে আমারে তো আজই পার করতো। কানা-ল্যাংড়া বিচার করত না। সুমনের সাথে বিয়ে না হইলে আমি মইরা যাব নিশা। নিজের প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া, আমি তোমারে বাঁচাইতে পারলাম না’ তবুও নিশার দিক থেকে সাড়া এলো না।
ময়না আবার বলল ‘বাতাসী খালা ফোন দিছে। কোন পোলার সাথে বিয়ের কথা হইছিল তোমার, হ্যারা নাকি প্রস্তুত। পরশুদিনই আসবে। কালই বড়চাচি তোমারে নিয়ে যাবেগা।’

নিশা নিথর হয়ে শুধু চোখের কোল ভিজিয়ে কাঁদতে থাকল।

‘এইটা কোনো বিয়া? এইভাবে বিয়া দেওন যায়? এরচাইতে মইরা যাওয়াও ভালো নিশা।’ নিশার মাথায় হাত বুলালো ময়না। খুব যত্ন করে চোখের পানি মুছে দিলো। ‘কাইন্দো না। বোন না তুমি আমার। কাইন্দো না। শফিক ভাই রাস্তায় দাঁড়ায়ে আছে।’

লাফ দিয়ে উঠল নিশা। ‘কে? কে দাঁড়িয়ে আছে?’

‘শফিক ভাই। এইসব ঘটনা হ্যারে কইছি আমি। সে খুব কষ্ট পাইতেছে। তোমার সাথে একবার কথা বলতে চায়।’

‘খবরদার ময়না। আমি কারো সাথে কোনো কথা বলব না।’

‘আমি বলছি নিশা। সেইকথা সব বলছি আমি। সে যেন আর তোমারে বিরক্ত না করে, সেইসব বলছি। কিন্তু মানতেছে না। রাস্তার মাথায় দাঁড়ায়েই আছে। তুমি নিজে না বললে সে এখান থেকে যাবে না।’

‘আমি বলব না ময়না। তুমি যাও এখান থেকে।’

ময়না ফোন লাউড স্পিকারে রাখে। নিশা শুনতে চায় না, কিন্তু কানে ঠিকই পৌঁছে যায়। শফিক কাঁদছে। নিশার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। হৃদয় নামের রক্তসঞ্চালক যন্ত্রটা হয়তো অকেজো যায় একটুখানি সময়ের জন্য।

‘নিশা, আমার প্রিয়া। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। তোমার অন্য কোথাই বিয়ে হতে পারে না। আমি মরে যাবো নিশা, একদম মরে যাবো। মরে যাবো একেবারে৷’

এপাশে নিশা কাঁদতে থাকে।

‘প্রিয়া? আমি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আসো। সব ছেড়ে চলে আসো। আমি তোমাকে রাণি বানিয়ে রাখব। এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি বাঁচব না। অন্য কারো সাথে তোমার বিয়ে হবে, এইকথা যখন ময়না বলেছে, তখনই তো মরে গিয়েছি আমি।’

নিশা ফোঁপাতে থাকে।

‘আমি জানি তুমি সব শুনছ। আমি অপেক্ষা করে আছি প্রিয়া। তুমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করো, আমাকে ভালোবাসো কীনা, মন কী উত্তর দেয় দেখো? চোখ বন্ধ করে ভাবো, আমার মুখই কল্পনায় আসবে, দেখো? আর তখনই কিন্তু সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবে তুমি।’

একটু আগে নিশার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল, এখন মনে হলো, বেশ তো, মরে গিয়ে মরার পরে যদি আরেকটা জীবন পাওয়া যায়, ক্ষতি কী? আর সেই জীবনের হাতছানি যদি এমন সুন্দর হয়? এমন ভালোবেসে কেউ যদি একটা নতুন জীবনের দরজা খুলে দেয়, তবে সেই জীবনটা একবার বেঁচে দেখাই যায়!

তারপর হাতের উপর মাথা রেখে চুপ করে রইল।

চলবে…

আগুনের দিন পর্ব-৮+৯

0

আগুনের দিন ৮ ও ৯

‘ময়না একটু শুনে যা?’

‘কী বলবা? ওই দেখো সাব্বির দাঁড়ায় আছে। ব্যাটাপোলার সাথে কথা কইতেছি দাঁড়ায় দাঁড়ায়, এইটা দেখলে, মায়রে গিয়া নালিশ দেবে আর আমার বাড়ির বাইর হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। যাও তো?’

‘আচ্ছা, যা গিয়া। এইটা নিয়া যা!’

একটা কাগজের টুকরো ঢিলের মতো ছুঁড়ে মারে শফিক। সেটা ময়নার পায়ের কাছে পড়ে। ময়না পায়ের স্যান্ডেল ঠিক করছে এমনভাব করে সেটা হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। জিজ্ঞাসা করে ‘কী এইটা?’

‘বুঝিস না যেন। ন্যাদা কুঁদি!’

ময়না আর কিছু বলে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শফিকের সাথে কথা বলাটা ওকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। সুমনের সাথে সম্পর্কের মিলনাত্মক পরিণতি পেতে ও অনেকটা পরিকল্পনা করে রেখেছে। ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে হবে, সংসারের কাজ শিখে নিতে হবে আর সুমনকেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এভাবে ছেলেদের সাথে কথা বলা অবস্থায় কারো চোখে একেবারেই পড়া যাবে না। মাঠ থেকে শুকনো কাপড় তুলে, ঝেঁড়ে ঝেঁড়ে নিশার হাতে দিয়ে দুজনে মিলে বাড়িতে ঢুকে গেল। অনেকটা জায়গা জুড়ে নিশার দাদাবাড়ি। সীমানা ধরে সারি সারি নারিকেল গাছ, কাঁঠালবাগান, সুপারি বাগান, মেহগনি গাছের বাগান, সবরকম ফলগাছ – কাঠগাছের বাগান, মস্ত পুকুর। বাড়িতে ঢুকেই একপাশে ওর দাদার কবর। তারপর বড় একটা বাঁশঝাড় আর কাঁঠালবাগান। কাঁঠালবাগানের নিচে অনেকগুলো কাঠের লগ ফেলে রাখা হয়েছে নতুন ঘরের জানালা-দরজা বানানোর জন্য। এখন সেগুলোতে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য বেশ জায়গা। ময়না একটা লগের উপর বসে নিশাকেও বসতে ইশারা করল। ওড়নায় গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা কাঁচা তেঁতুলের টুকরোয় কামড় দিয়ে, শফিকের দেওয়া কাগজের টুকরোটা খুলে ভুঁরু কুঁচকে ফেলল। দুইটুকরো কাগজ। দুটোই পড়ল। তারপর টুকরো দুটো ভাঁজ করে বুকের ভেতর চালান করে দিলো। নিশার দিকে তাকিয়ে বলল ‘প্রেমপত্র বুজছ, প্রেমের চিঠি?’

নিশা উত্তর দিলো না। হাসল একটু। এইজন্যই সুমন এসেছিল।

‘আজকাল কেউ চিঠিফিঠি দিয়ে প্রেম করে না। টুং করে একখান মেসেজ লিখে দেয়। তুমি মোবাইল কিনো না ক্যান?’

‘মা দেয় না। আর আমার লাগেও না।’

‘তুমি ইন্টারনেট চালাও না?’

‘ল্যাপটপে চালাই। মাঝে মাঝে।’

‘ফেসবুক চালাও না? মেসেঞ্জার? ইমো?’

‘ফেসবুক একাউন্ট আছে কিন্তু লগইন করা হয় না তেমন।’

‘আল্লাহ কী কও। কোন দুনিয়ায় বসত করো তুমি? আমি তো ইউটিউবে সিনেমা না দেখলে ঘুমই আসি না।’

‘আচ্ছা ময়না, তুমি কত সুন্দর করে কথা বলতে পারো, কিন্তু সবসময় বল না কেন?’

‘ধুর ধুর! অতো শুদ্ধ ভাষায় নাটকের মতো কথা কইতে জুত হয় না। স্টাইল করে কথা কই মাঝে মাঝে, সবসময় কওয়া যায়? বিরানি তুমি একবেলা মজা পাইবা, পরের ওক্তে ঠিকই ভাত চাইয়া খাইবা। বুঝছ?’

‘হুম।’

‘আচ্ছা নিশা, শহরের ছেলেমেয়েরা তো অনেক চালু, মানে এডভান্স আরকী, তুমি প্রেম করো না?’

‘আরেহ না।’ লজ্জা পায় নিশা।

‘সত্য? কেউ প্রস্তাব দেয়নাই কোনোদিন?’

নিশা উত্তর করে না। ময়না আবার বলে ‘কেমন ছেলে তোমার পছন্দ? শিক্ষিত নাকি সুন্দর? বড়লোক? স্মার্ট?’

নিশা হেসে ফেলল। এভাবে চিন্তা করে কেউ ভালোবাসে? ভালোবাসা তো কবিতার মতো অনুভূতি। সেটা চেপে গিয়ে বলল ‘আমি এসব ভাবিনি, ময়না।’

‘ভাববা না ক্যান? ধরো, এইরকম একখান চিঠিফিঠি আইজ যদি কেউ তোমারে দেয়?’

‘যাহ।’

‘না। সত্য কইতাছি। কী করবা কও।’

‘এইসব কী কথা বলো?’

‘আরে কও না?’

‘সত্যি বলছি, আমি এইসব ভাবিনি কখনো।’

‘তাইলে ভাবো এটটু?’

‘মানে?’ নিশা বুঝতে পারে না ময়নার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা।

‘মানে? মানে হচ্ছে, তোমার জন্য চিঠি আসছে।’

‘অসম্ভব!’ বিড়বিড় করে নিশা।’

‘হয় রে। সত্যি কইতেছি। শফিক ভাই তোমারে পছন্দ করে। তোমার সাথে রিলেশন করতে চায়।’

নিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ময়নার দিকে, কথা বলতে ভুলে যায়। ময়না একটা কাগজের টুকরো নিশার হাতে দেয়। নিশা ভয় পেয়ে আঁতকে ওঠে। গরম কয়লা হাতে পড়েছে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কাগজটা। তারপর ময়নাকে বলে ‘অসম্ভব ময়না। আমি এটা নেবো না!’

‘কেন?’

‘এইগুলো ঠিক না। ভালো না।’

‘আচ্ছা, ভালো না লাগলে রিলেশন করবা না। কেউ কি জোর খাটাইতেছে? একটু দেখো কী লিখছে? তুমি এত ভয় পাও কেন? কেউ জানবে না।’

‘না।’

‘আরেহ পড়তে তো দোষ নাই। আমি কবো তুমি চিঠি পড় নাই।’

নিশা ভয়ে ভয়ে চিঠিটা খুলল। খুলেই ওর মনটা তেতো হয়ে গেলো। সস্তা বাংলা গান আর ভুল বানানে লেখা চিরকুট।

“প্রাণের প্রিয়া,

জীবনে প্রথম যারে, লেগেছে ভাল
যে আমার এই বুকে, প্রাণের-ই আলো
সে আর কেউ নয়, শুধু যে তুমি
বলছি তোমায় গানে গানে

এ বুকে কান পেতে শোন
এ হৃদয় কি বলে হায়
বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে
তোমাকে যদি হারায়

এ চোখে চোখ রেখে দেখো
কি বলে চোখ ইশারায়
অন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে
তোমাকে যদি হারায়।

ইতি
তোমারই শফিক”

হাতের ভেতর মুঠ করে ফেলে নিশা কাগজটা।

‘কী? কী করবা?’ ময়না নিশার উত্তর জানতে চায় কিন্তু ওর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংবরণ করে নেয়। নিশার হাত ধরে বলে ‘বাদ দাও৷ বাড়িত চলো।’

ময়না খুবই বুদ্ধিমতি। ও জানে মায়ের অত্যন্ত কড়াশাসনে বড় হওয়া নিশার জন্য এসব বিষয় একটু সময়সাপেক্ষ। সময়টুকু দেয় ও নিশাকে। নিশার বা শফিকের ব্যাপারে এতটা আগ্রহ ও দেখাত না একেবারেই যদি না আরেকটুকরো কাগজে শফিক, ময়না আর সুমনের সম্পর্কে সাহায্য করবে এই প্রতিশ্রুতি দিতো। দুই পরিবারের সম্মতিতে সুমনের বউ হওয়া ছাড়া ওর আর কারো কোনো বিষয়েই আগ্রহ নেই।

****

‘তোমার আর কী, তোমার ময়নার যে গায়ের রঙ আর যে চেহারা তাতে রাজপুত্র আসবে মেয়ে সেধে নিতে। আর আমি পেটে ধরেছি দুটো কালির পুতুল। তায় নাকচোখেরও ঢঙ নেই। মেথরেও তো ঘুরে তাকাবে না।’

‘এইগুলা কী বলেন বড়ভাবি? নিশা আপনার যে লক্ষি মেয়ে!’

‘ছাড়ো! কীভাবে পার করব, এই চিন্তায় নিজের কোনো সখ-আহ্লাদ করলাম না কোনোদিন, শুধু টাকা জমাও, মেয়ে বিয়ের খরচ।’

‘আপনার নিশা, ঊষা তো পড়াশোনায়ও ভালো খুব।’

‘তাতে কী? পড়াশুনা গোণে কে? সেই বিয়ে তো দিতেই হবে, গাঁট গাঁট টাকা খরচ করে। এমন পোড়াকাঠের মতো দেখতে যে, আটদশলাখের কমে মেয়ে পার করতে পারব না।’

‘বাবাহ এত টাকা?’

‘এতো শুধু গয়না আর ফার্নিচার দেবো। বিয়ের খরচ তো আলাদা।’

‘ওরেহ বাবা।’ রেজিনার বড় বড় গালগল্প পোষায় না ছোটোবউয়ের। সে নিজের মেয়েকে তাড়া দেয় ‘ওই ময়না কাপড় তুলতে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেছিস? তোর চাচি আসছে কখন, ঘর খুইলা দে, আমার হাতে তো গোবর লাগা।’

ছোটোবউ চুলার জ্বালানি বানাতে গোবর দিয়ে বোড়ে বানাচ্ছে। নিশা মায়ের কন্ঠ শুনে আনন্দে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে অনেক্ক্ষণ আগে। রেজিনার কথা শুনে চুপ হয়ে গেছে। রেজিনার অভ্যাস আছে, নিজের টাকাপয়সার গল্প করার প্রয়োজনে মেয়েদের সম্পর্কে কটুক্তি করতে তার আটকায় না। আজকে নিশার খুব কষ্ট হলো। গায়ের রঙ আর চেহারা নিয়ে এমনিতেই হীনমন্যতায় ভোগে, তার উপর রেজিনার বাজে কথায় ওর অভিমান হলো।

আসলেই তো সত্যি কথা, ও কুৎসিত দেখতে তাই ওকে কেউ পছন্দ করে না। জীবনে বারবার, বহুবার, বহুজনের মুখে এই কথা শুনেছে ও। প্রতিবারই সংকুচিত হয়ে গেছে। ও বোঝে না, কালো হওয়াতে ওর দায় কী? ও যদি নিজে নিজেকে তৈরি করত তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে করেই পৃথিবীতে আসত। যেখানে ওর হাত নেই সেখানে ওর দায় কেন?

এতদিন কষ্টগুলো বুকে পাথরচাপা দিয়ে রাখত, আজ জেদের মতো হলো। হাতের মুঠোয় দলামোচড়া করে রাখা কাগজটার প্রতি তীব্র আকর্ষণ তৈরি হলো। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক যে আকর্ষণ, মুখচোরা নিশা নিজের কাছেই গোপন করে রেখে এসেছে এতদিন আজ সেটা মেলে দিতে ইচ্ছে করল। দাদীর ভাঙা ঘরের ফাঁকফোঁকর দিয়ে গোধুলির যে আলো নেমে যাচ্ছে, তার মাঝে ভুল বানানের সস্তা সেই চিঠিখানা মেলে ধরল নিশা। আর বড় ভালো লাগল ওর। অজানা শিহরণে বুক কাঁপতে থাকল। কারো চোখে নিজেকে প্রেয়সী জানতে পেরে, সাদা কাগজে আঁকা কালো অক্ষরগুলো প্রিয় উঠতে লাগল।

আগুনের দিন ৯।

রেজিনা আসে নিশার কাছে। মাকে দেখে নিশার মন লাফিয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে মাকে। রেজিনারও ইচ্ছে করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। কিন্তু এসব ন্যাকামিতে অভ্যাস নেই, অনভ্যস্ততায় কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। কন্যাকে স্নেহ দেওয়ার পরিবর্তে আরও খানিক তিক্ততা দিয়ে বসেন তিনি। কেউ যেন না শোনে এমনভাবে বলেন ‘পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, বাপের মানসম্মান সব রাস্তায় রেখে দাও নাই তো?’

নিশা চুপ করে থাকে।

‘যে চালু ওই ময়না। ওর সাথে মিলে কোনো সর্বনাশ করো নাই তো?’

‘আম্মু?’

‘উহ! আম্মু? যেই না চ্যালাকাঠের মতো চেহারা, ওই মুখ নিয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়। এমন করে নাচতে নাচতে দাদির সাথে দৌঁড় দিতে হয় না!’

এসব কথা শোনায় অভ্যাস আছে নিশার। তবুও আজকে বারবার অভিমান হচ্ছে। চোখ ভিজে গেল আবারও।

*****

‘নিশা, ঘুমাইছ?’ ফিসফিস করে ময়না।
‘ও নিশা?’

দুবার ডাকার পরে নিশা আর চুপ করে থাকতে পারে না, সাড়া দেয়।

‘কী হইছে বলো?’

‘কী করবা কইলা না? আমারে চাইরবার ফোন দিছে শফিক ভাই।

নিশার বুক ঢিপঢিপ করছে। ময়না যে সম্বোধন পালটে ‘শফিইক্যা’ থেকে ‘শফিক ভাই’ করে ফেলেছে, তা আর খেয়াল করল না।

‘কী কবো, শফিক ভাইরে? কও তো?’

‘আমার ভয় লাগে ময়না।’

‘সে সবারই ভয় লাগে।’

‘আম্মু জানলে জানে মেরে ফেলবে।’

‘কেউ প্রেম করছে আর বাপ-মা মাইনা নিছে, এমন হইতে কোনোদিন দেখছ নাকি শুনছ? সেইটা না, শফিক ভাইরে পছন্দ কীনা সেইটা বলো?’

নিশা চুপ করে থাকে। আসলেই কি শফিককে ওর পছন্দ? এই প্রথম কেউ নিশাকে পছন্দ করেছে, প্রিয়া বলে চিঠি লিখেছে। নিশা উপেক্ষা করে কী করে? এত অবহেলা পেয়েছে যে মুখশ্রীর জন্য, সেই মুখটাকে কেউ ভালোবাসে জানলেও তো মরে যাওয়ার মতো সুখ লাগে।

নিশা কিছু বলল না তবুও। ভীরু মনের কথাটা মুখে আনতে পারল না।

ময়নাই বলল ‘তোমার ফোন নাম্বার চাইতেছে। দেবো?’

নিশা উত্তর না করলে ময়না কায়দা করল ‘দিলাম কিন্তু। না কওনাই কিন্তু। বইতে পড়ছ না, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ?’

‘আমার কোনো ফোন নাই, ময়না। এই কথাটা তুমিও জানো।’

‘চাচিরটাই দিলাম!’

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?’

‘ধুরো! তুমি তো প্রাচিনকাল থেকে টাইমমেশিনে কইরা এই সময়ে আইসা পড়ছো! মোবাইল নাই! কেউ বিশ্বাস যাইবো। শফিক ভাই ভাবতেছে, আমি না জানি মিছা কথা কই!’

গরমের ভেতরও নিশা কাঁথা টেনে মুখে চাপা দিলো। ময়না হেসে কন্ঠ আরও নামিয়ে বলল ‘শফিক ভাইর নাকি রাতের ঘুমটুম সব শেষ! শুধু তোমারেই নাকি চোখের সামনে দেখতেছে। পোলার মাথাডা তো পুরাই খাইয়া ফেলছ, নিশা!’

নিশার বুকের ভেতর কেমন একটা সুখের মতো জ্বালা করে, চিনচিন করে শব্দ হয়।

‘নিশা? এইটা নেও?’

আবার এক টুকরো কাগজ নিশার হাতে গুঁজে দেয় ময়না। ও কেঁপে ওঠে। বুক কাঁপতে থাকে। পা ভারী হয়ে আসে। রেজিনা আছে এখন এখানে। কোনোভাবে টের পেয়ে গেলে নিশার কপালে সর্বনাশ আছে। ওর খুব পানির পিপাসা পেল। শুকনো ঢোক গিলে বলল ‘এক গ্লাস পানি দিতে পারবে, ময়না?’

‘উঁহু। এত রাতে দরজা খুলে পানি আনতে পারব না।’

‘ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে আমার।’

‘এত ভয় পাও তুমি, বড়চাচিরে?’

‘ভয়?’ অসহায় তাকায় নিশা। একটু হাসার চেষ্টা করে। ও চেনে নিজের মাকে। মেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের আলাদা ব্যাক্তিত্ব আছে, আলাদা সত্ত্বা আছে, আত্মসম্মানবোধ আছে এসব থিওরি রেজিনার সিলেবাসের বাইরের চ্যাপ্টার। বাচ্চাদের ভুল কথা বা ভুল পায়ে জুতো পরা নিয়ে সবাই যেমিন সবার সামনেই মজা করে, তেমনি নিশা বা উষাকে নিয়েও রেজিনা সবার সামনে মজা করে। লজ্জায় এতটুকুন হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় ওরা কিন্তু রেজিনার একটুও অনুতাপ হয় না। মা তো, মায়েরা কিছু বললে কি তাতে অপমান হয়?

নিশা কাগজের ভাঁজ খুলল। কালচে খয়েরিটাইপ রঙের কালিতে লেখা চিঠি একটা। সেই আগের মতোই ভুল বানানা, সস্তা সিনেমার ডায়লগ।

‘ও আমার প্রিয়া।
আমার আঁধার রাতের আলো, আমার শূন্য আকাশের চাঁদ। মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছ তুমি আমার জীবনে। তোমাকে ভেবেভেবেই সারাদিন আর রাত গুলিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে আমার।
তুমি কেন আমার চিঠির উত্তর দিচ্ছ না? আমাকে কি তোমার পছন্দ না? তুমি পাশে থাকলে আমি অনেক বড় কেউ হবো, দেখে নিও। সব পারব আমি, পরীক্ষা করে দেখো, সব পারব। এই যে রক্ত দিয়ে লিখে দিলাম প্রেমের কথা। আর আমার হাত আর হৃদয় রক্তাক্ত করে লিখেছি তোমার নাম। হাতেও, হৃদয়েও …’
ইতি
তোমার প্রেম

রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি? অরুচিকর একটা ব্যাপার। নিশার মন খারাপ হয়ে গেল। ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইল কাগজটুকু। কিন্তু কী মনে করে ফেলল না। উদ্যত হাত নামিয়ে নিয়ে চিরকুটটা ময়নার দেখানো পদ্ধতিতে অন্তর্বাসের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল।

একটু বাদেই ময়না আবার কাছাকাছি সরে এলো। ‘ও নিশা, কিছু যে কইলা না!’

‘ময়না, আমি কিন্তু তোমাকে মানা করছি, এইসব চিঠিটিটি আমাকে আর দিও না। আমার ভালো লাগছে না।’

ময়নার মুখ কালো হয়ে গেল। শফিক প্রমিজ করেছে, চেয়ারম্যানের ছেলেকে ধরে সুমনকে সরকারি দলের স্থানীয় কমিটির একটা বড়পদ দেওয়ায় দেবে। সেটা হলে তো সুমনের জন্য ময়নাকে চাইতে আসার পথ অনেক বেশি সুগম হয়ে যাবে। একটু আগে অন্ধকারের ভেতর সুমন আর শফিক এসেছিল এই চিঠিটা দিতে। ময়না একা একা আগানবাগান পেরিয়ে গিয়েছিল। শফিক বলেছিল ‘খালি লাইনডা করায়ে দে ময়না। তোর আর সুমনের লাইন একদম ক্লিয়ার করে দেবো।’

‘পারবা?’

‘পারব না ক্যান? শফিকের ক্ষমতা তুই জানিস না কিছুই।’

‘তা নিজের জন্য করো না কেন?’

‘এইসব আমার জন্য না ময়না। এইসব ছোটোমোটো কাজ আমার জন্য না। আমি বিরাট কাজ করব। সবাই একনামে চিনবি!’

‘হুহ! তা বিরাট কিছু হওয়ার পরেই আইতি নিশার সাথে লাইন করতে! ভাদাইম্মা কোনখানকার!’ মনে মনে গালাগাল করেছিল ময়না শফিককে।

ময়না আবার ডাকল নিশাকে ‘কেন পছন্দ না শফিক ভাইরে?’

‘এইসব কথা বাদ দাও, ময়না।’

‘দেখতে কী সুন্দর কও তো! জমিজাতির অভাব নাই কিন্তু। পড়াশোনাও করছে। বিএ পাশ দেছে। চাকরি করতে চাইলেই পারবে। কিন্তু বড়ছেলে তো। বাড়ি ছাড়লে কেমনে হবে? তা তুমি কইলে সবই করবে।’

‘আমি কেন বলব?’

‘তুমিই তো বলবা এখন। তোমার কথাও শুধু শুনবে। যা বলবা তাই করবে। তুমি বলবা চাকরি করতে।’

‘আমি বলব না ময়না’ রেগে যায় নিশা।

তবুও ময়না বলে ‘ইশ, ব্লেড দিয়ে হাত কাটছে নিশা। তোমার নাম লেখছে। কী পাগল যে হইছে তোমার জন্য!’

‘সত্যিই হাত কেটেছে? ছিঃ!’

‘ছিঃ কও কেন? ভালোবাসে তোমারে। সব ভালো শফিক ভাইয়ের। শুধু বিড়িখোর। তয় বলছে, একবার তুমি হ্যাঁ বললে আর সিগারেট ছুঁয়ে দেখবে না।’

‘ঘুমাও ময়না। মা শুনতে পাবে।’

‘তুমি একটু ভাবো নিশা। আমরা কাছাকাছি থাকব, বিয়ের পরে। তোমার একাএকা লাগবে না।’

‘তুমি বিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছ?’

‘ভাবতে কি টাকা লাগে নাকি? হিহিহি’ খিলখিল করে ওঠে ময়না। ‘বিয়ের কথা তো আমি সবসময়ই ভাবি। তুমি ভাবো না?’

‘বিয়ে ছাড়াও ভাববার মতো অনেককিছু আছে ময়না। ঊষা কী বলে জানো? মানুষের মেরুদণ্ডের শক্তি হাত হয়ে আসে। আমরা কাজ করি, পরিশ্রম করি, আমাদের আয় টাকা হয়ে আমাদের হাতে আসে। সেই টাকা আমাদের ইচ্ছে, স্বপ্ন, বাস্তব, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ শক্তিশালী করে দেয়।’

‘অনেক কঠিন কথা। জীবন এত কঠিন না। সহজ করে ভাবলেই সব সহজ।’

‘হয়তো’ ময়নার কথাটা মনে ধরে নিশার।

*****

‘ছাদও দিয়া দিছে?’ নতুন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উষ্মা প্রকাশ করছিল রেজিনা৷ ‘আর আমি শুধু মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাও, মেয়েবিয়ের টাকা জোগাও। এই করতে করতে কিছুই হলো না। দুইটা মেয়ে দিছে আল্লাহ, চেহারা একেবারে বাপের গুষ্ঠির মতো। কিন্তু সেই গুষ্ঠির কেউ তো ভার নেবে না। আমার আর আমার বাপভাইরই মরতে হবে মেয়ে পার করার খরচ জোগাইতে গিয়ে।’

‘এমন করে কও ক্যান বউ। মাইয়া বড় হইছে না? মনে দুখ লাগবে। কালোই ভালো। কী সুন্দর মুখ আমার নিশার!’

‘হ্যাঁ। সুন্দর মুখ আগে মনে ছিলো না? কালো ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় ফর্সা মেয়ে খুঁজলেন কেন তখন?’

‘এইসব পুরান কথা বাদ দেও, বউ?’

‘হ্যাঁ। পুরান কথা। কী বলেছিলেন মনে আছে? বীজ যেমন তেমন বাচ্চা হবে। এখন ফর্সা বীজে এমন কালো বাচ্চা কীভাবে হলো? এই দুই মেয়ের চিন্তায় আমার আর ছাদ দেওয়া হলো না!’

‘এরাও অনেক কষ্ট করে বউ। খেয়ে না খেয়ে বিল্ডিং বানছে।’

‘এমন করে বলেন যেন আমি রাণির মতো সিংহাসনে বসে থাকি?’

‘কেন তোমার হাইস্কুলে পড়া পোলারেই তো হোন্ডা কিনে দিছো! এইটার দরকার ছিলো কোনো?’

‘ওইটাই যে চোখে লাগবে তা জানতাম ঠিক। ওর মামাবাড়ি থেকে দিয়েছে, আপনার ছেলের কোনো টাকা খরচ হয়নি। ছেলে সখ করছে, তাদের মামারা মিটাইছে, আপনাদের চোখ পোড়ায় কেন?’

‘না বউ, সেই কথা বলিনি। সখের কথা তুমি না বললে তারা তো জানত না। এইসব সব সখই এরা চাপা দিয়ে ঘরটা তুলছে। ইদেচান্দে কাপড়ও নেয় না কোনো বউ।’

‘এইগুলা সত্যি না। ময়না যে একেকটা ড্রেস পরে, আমার দুইমেয়েরে কখনো হাত খুলে দেইনাই ওইরকম। আপনার ছেলের সংসারে যত কষ্ট করি সেটা আপনি কখনো স্বীকার করেন না’ বলতে বলতেই রেজিনার চোখ গেল নিশার দিকে। ময়নার সাথে পুকুরে গোসল করার জন্য নেমেছে। ঘাটলা বাঁধানো। অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে। বর্ষাকালে সবগুলো ধাপই পানিতে ডুবে থাকে, এখন একেবারে শেষের ধাপটা শুধু পানির নিচে। সেটার উপরে বসে কোমর ভিজিয়ে পানি ছিটিয়ে জলকেলি করছে নিশা, ময়না, আরজিনা, সীমা। রেজিনার মেজার গরম ছিলো, এবারে সবটা ঢাললেন নিশার উপর।

‘নিশা? তুই পুকুরে নামছিস? জংলী কোথাকার?’

‘আম্মু প্রতিদিন তো পুকুরেই গোসল করেছি’ হঠাৎ করে বুঝে পায় না নিশা সমস্যাটা কোথায়?

‘উঠে আয়। অসভ্য মেয়ে। পচা পানিতে গোসল করছিস আবার বলে প্রতিদিন করেছি।’

এতদিন একসাথে থাকা বান্ধবীদের সামনে এমন অপমানিত হয়ে নিশার পা আর নড়ছিল না। ও চুপ করে থাকল।

‘এখনো আসলি না? উঠে আয়?’

‘আম্মু আরেকটু প্লিজ! গোসল প্রায় শেষ।’

‘ছিঃ একদম গাঁইয়া হয়ে গিয়েছিস। এত পড়াশুনা করিয়ে কী লাভ হলো? একটা ভ্যানওয়ালা ডেকে বিয়ে দিয়ে দিই!’

‘আম্মু?’

‘আয় কিন্তু। নইলে খুব খারাপ হবে।’

‘উইঠা আসো বু। মা রাগ হইছে, উইঠা আসো। তুমি কলে গিয়া গুসল করো?’ নিশার দাদী এগিয়ে আসে তাড়াতাড়ি করে।

নিশা উঠে কলে গিয়ে রাগেরাগে পানি চাপে আর মাথায় ঢালতে থাকে ঝুপঝুপ করে। রাগের কারণে অন্তর্বাসের ভেতর লুকিয়ে রাখা চিরকুটটার কথা ভুলে, শরীরে টাওয়েল পেঁচিয়ে ভেজা কাপড় খুলতেই পড়বি তো পড় একেবারে মালির ঘাড়ে, ঝুপ করে আধাভেজা কাগজখানি রেজিনার পায়ের কাছেই পড়ল…

চলবে…
আফসানা আশা

আগুনের দিন পর্ব-৬+৭

0

আগুনের দিন ৬ ও ৭।

১০.
নিশা টক খাবার তেমন একটা পছন্দ করে না। ও বসে বসে ময়নার কাজ দেখতে থাকল। ময়না বাঁহাতে ধরে কট করে এক একটা কামড় বসাচ্ছে কাঁচা তেঁতুলে আর চোখমুখ কুঁচকে শরীর ঝাড়া দিচ্ছে – নিশার জিভেও জল চলে আসছে। বঁটি দিয়ে বিঁচিটুকু আঁচরে ফেলে পাটায় মিহি করে বাঁটল ময়না, তারপরে লবণ আর কাঁচামরিচ বেঁটে নিলো, ধনেপাতাও বাঁটল, কাঁচাতেঁতুলের সবুজ রঙ আরও গাঢ় হলো। একটু সর্ষের তেল আর সামান্য চিনি ছিটিয়ে ফিনিশিং দিলো। কলাপাতা কেটে এনে আগে থেকেই ছিঁড়ে ভাগ করে রাখা আছে। নিশা ধরতে থাকল আর ময়না এক এক ভাগে তেঁতুলভর্তা রাখতে থাকল।

‘শোনো নিশা, তুমি এইখান দিয়া নড়বা না। কাউরে হাতও দিতে দিবা না। আমি এক দৌঁড়ে কান্তা, বাশার ভাই আর সীমারে দিআসতাছি।’

‘কেউ খেতে চাইলে আমি কী বলব?’

‘দিবা না!’

‘আমি কাউকে আটকাতে পারব না।’

‘আচ্ছা আমি সরায় রাইখা যাইতাছি। তুমি আমার কথা বলবা। বলবা ময়না মানা করছে। আমি একমিনিটে যাব আর আসব। কান্তারে বাড়িত্তে বাইরাইতে দেয় না। চুরি কইরাই তো গেল রাইতে। আর বাশার ভাই যে আয়োজন করে যাত্রা দেখায়া নিয়া আইলো, হেরে এটটু না দিলে হয়?’

বলতে বলতেই দুই হাতে ভাঁজ করা কলাপাতার মোচা নিয়ে দৌঁড় দিলো ময়না। করিৎকর্মা মেয়ে, ভাবল নিশা। গতকাল যাত্রা দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র যাত্রা দেখা ছিলো না এটা এখন পরিস্কার ওর কাছে। সেখানে সুমনকেও দেখেছিল ও, কিন্তু তখন বোঝেনি কিছু। এসবকিছু বাশার বা কান্তারাও সবাই জানে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশা। ওরা দুইবোনই শুধু হাজাররকম শাসনের বেড়াজালে আটকে থাকে। এই করা যাবে না, সেই করা যাবে না, কলেজ ছুটির পরে কোথাও যাওয়া যাবে না, রাতে কোথাও যাওয়া? বাপরে বাপ! এমনকি বান্ধবিরা কেউ ফোন করলেও রেজিনার হাজারটা প্রশ্নের উত্তর হয়ে আসতে হয়! ময়নাকে খুব হিংসা হতে থাকে নিশার। অত চটপটে মেয়ে আর কী সুন্দর দেখতে! নিশা কালো, অনেক কালো। রেজিনার গায়ের রঙ পায়নি দুবোনের কেউই। দুজনেই মইন সাহেবের মতো হয়েছে। রেজিনার খেদ যায় না তাই। কটু কথা শোনাতেই থাকেন নিশা আর ঊষাকে। ঊষা অতটা পাত্তা দেয় না কিন্তু রেজিনা যখন ‘ওই কালি? ওই মা কালি?’ বলে ডেকে ওঠে নিশার বড় বড় দুই চোখ ছলছল করে ওঠে। ঊষা অনেক বুঝদার। ও সুন্দর করে বোঝায় নিশাকে ‘বুবু, কাটতে ধারও লাগে ভারও লাগে। আমাদের ধার নেই, আমরা ভারে কাটব।’

ঊষা কোমর বেঁধে নিজের ভার বাড়াতে পড়াশোনা করে আর নিশাও তাই। বইখাতা, স্কুল আর কলেজ ছাড়া যে জগতটা তার সাথে নিশা-ঊষার পরিচয় হয়নি। আজকে বয়সে অনেক ছোটো ময়নাকে একটা অন্য পৃথিবীতে চলতে দেখে তাই নিশার লোভ হয়, ময়নাকে ঈর্ষা হতে থাকে।

সত্যি সত্যি এক দেড় মিনিটের মাথায় চলে এলো ময়না। অনেক চঞ্চল হলেও কাজেকর্মে নিপুণা ও। পরিবেশন করাটাও ভালো গৃহিনীর মতো বোঝে। বাড়ির সবাইকে সামান্য তেঁতুল দিয়ে খুশি করে দেওয়ার উপায়ও জানে। তারপর নিশাকে নিয়ে বা
বাধানো পুকুরঘাটে গিয়ে বসল। কলাপাতার কোণের নিচের সরু ফাঁকা দিয়ে রসটুকু চোঁচোঁ করে টানতে নিশাকেও শিখিয়ে দিলো। দুজনে ঘাটে পা দোলাতে দোলাতে টক, ঝাল, মিষ্টি স্বাদের রসটুকু টেনে চোখ বন্ধ করে হেসে ফেলল। সবাইকে দ্রুত আপন করে নিতে পারে ময়না।

ময়নার বাবা বিল্ডিং এর কাজ শেষ করে ফেলেছে প্রায়। আশিভাগ কাজ হয়ে গেছে। ছাদ ঢালাই হয়েছে। জানালা, দরজা লেগেছে। বাইরের প্লাস্টার বসেছে। ভেতরের প্লাস্টার হয়ে রঙের কাজ হলেই নতুন ঘরে ওঠা যাবে। দুইবোনে গোসল সেরে সেই ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে বসে গল্প করতে করতে বাড়ির সামনে হৈহল্লা করে ভ্যান থামতে দেখল। নিশা উঁকি মেরে দেখল, বিরাট ডেগ লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো। চার পাঁচটা ভ্যান। নিশার মেজচাচার ছেলে শান্ত দৌঁড়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বড় বোল নিয়ে আসছে। সেই বোল ভ্যানের কাছে নিলে একজন পাতিল থেকে খাবার বেড়ে বোল ভরে দিচ্ছে। সেগুলো নিয়ে শান্ত আবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। আজকে দুপুরে বাড়ির মেয়েদের খাবার চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে এসেছে। গরুর মাংস দিয়ে মোটা চাল-ডালের খিচুড়ি। নিশা এরকম ঘটনা আগে কখনো দেখেনি, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এই গ্রামে বিভিন্ন উৎসব আয়োজন, মিলাদ মাহফিলে এরকম আয়োজন প্রচলিত আছে। গ্রামবাসি সবাই চাঁদা দিয়ে প্রায়ই একবেলার খাবার একসাথে খায়; টাকা দিতে না পারলে ঘরের চাল, ডাল দিয়ে হলেও শামিল হয়। এবারের আয়োজন পুরোটাই চেয়ারম্যানের খরচে।

শুকনো সুপারিপাতা আর কলাপাতা ঝুলিয়ে দিয়ে বাড়ির সীমানায় মেয়েবউদের পর্দার ব্যবস্থা করা আছে। রাস্তা থেকে সহজে নজর পড়ে না বাড়ির ভেতরটা। ভেতর থেকে নজর করলে আবার রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যায়। সেই পাতার গেট ঠেলে শফিককে ভেতরে ঢুকতে দেখল নিশা। লুঙ্গিটা কোচা দিয়ে হাঁটুর উপরে ওঠানো। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। মেদহীন শরীরের টানটান পেশিগুলো একেবারে উন্মুক্ত হয়ে আছে। ফর্সা ত্বকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম চিকচিক করছে শিশিরবিন্দুর মতো। একঢাল মসৃণ কালোচুলের ডালা মাথায় নিয়ে শফিক দাদিকে ডাকতে থাকে ‘ও দাদি? কই গেলা? পানি খাব। একটু পানি খাওয়াও।’

দাদি উঠানেই ছিলো। মুরগির জন্য ভুষি মাখছে সকালের ভাতের ফ্যান দিয়ে। গলা উঁচিয়ে বলল ‘আমার হাতজোড়া ভাই। দাঁড়াও ময়নারে কইতেছি।’ দাদি গলার স্বর আরও উঁচু বলল ‘ওই ময়না? শফিকরে এক গ্লাস পানি খাওয়া। খালি পানি আনিস না যেন আবার? দুইটা বিস্কুট দিস সাথে।’

গলা নামিয়ে শফিককে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কীরে, কী বুঝতেছিস? জিতব ইউনুস্যা এইবার?’

‘কী যে কও দাদি? যে খরচ যাইতেছে? পানির মতো খরচ করতেছে। যেই লোকটা বাড়ির পরে যাইতেছে, ধামাভইরা ধান দিয়ে দিতেছে। খাওন লওনের তো কম নাইই নাই। আর কেডায় জিতব? কলিম বখশি? হুহ, চা পানি ছাড়া হের খরচ কই?এইযে সাতদিনে সাতটা গরু নামাইলাম। তাও বাছা বাছা ষাঁড়গরু। কোনো ফাঁকি নাই।’

‘কয় মণ গোস্ত হইছেরে আজকে, শফিক?’

‘চার মণ দাদি। ছোটো ছিলো গরুটা। কিন্তু মাংস নামছে জবর। চর্বি নাই।’

‘রানতেছে কেডা? শুক্কুরের পোলা?’

‘হয়। বিল্লাল কাকায়ই রানছে। হের মতো আছে নাকি কেউ আর? ঘ্রাণ যা ছুটছে, সাতগ্রামে চাউর হইছে, বেতলাতে আজকে ডেগ চড়ছে।’

‘হ। ভালো বাসনাই তো পাইতেছি। ও শফিক তোর মায় কেমন আছে? বেগুন ক্ষেত নাকি পোকায় ধরছে?’

দাদির গল্প বলার মুড দেখে শফিক রাস্তার দিকে হাঁক দিলো ‘ওই শাহিন্যা, তোরা আগাইতে থাক, আমি আসতেছি।’ বলে পায়ে ভর দিয়ে বসল নিশার দাদির পাশে।

‘আর কইয়ো না দাদি? ওষুধ ছিটাইতে দুইদিন দেরি হইছে, একটা বেগুনও পাইলাম না পোকায় কাটতে বাকি রাখছে। পুরা লস গেল এইবার।’

‘কয়খান জমিতে বেগুন লাগাইছিলি?’

‘পুরা আটখান দাদি?’

‘আয় হায় কস কী? বড় ক্ষতি হইলো তো?’

‘হয়। লাখের উপরে গেল। আব্বা তো ক্ষেইপে থাকে সারাদিন। এখন ক্ষেপলে আমরার কী করার আছে?’

‘তুই চাকরিবাকরি কিছু করবি না?’

‘পরের মাহেনদারি করব আমি? কী কও না কও দাদি?’

‘তাইলে চলবি কেমনে? তর বাপের ওই জমিগুলাই তো আছে?’

‘ওইয়া খাইয়া শেষ করতে পারব?’

‘ক্যান বইন বিয়া দিবি না? তাতে খরচ আছে না? কতখান জমি বেঁচতে হয় তখন দেখিস? আর তুই বিয়া বইবিনা? টুকটুইক্যা বউ আনবি না। হেরে রাঙা শাড়ি পিন্দাবি না? টাকা লাগব না?’

‘ধুরো দাদি, জ্ঞান দিও না। বইলাম পানি খাওয়াবা বইলা, তুমিও সেই ফাওপ্যাঁচাল নিয়া বইলা? যাইগা।’

এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁক দিলো শফিক ‘ওই ময়না, পানি কি খাওয়াইবি? পুকুর কাইটা পানি আনতেছিস নাকি?’

ময়না একটা কাচের গ্লাসে পানি আর একটা পিরিচে চার পিস বিস্কিট এনে শফিকের সামনে মুখ ভেংচি দেয়। শফিক বিস্কিটের পিরিচটা হাতে নিয়ে একপিস মুখে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ময়নাদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল ‘দাদি, মারুফ কাকার বাড়ির কাজ তো শেষ। যা কাজ আছে দুই চার সপ্তাহেই তো শেষ হয়ে যাবে।’

‘হয়, নবীন মিস্ত্রী একটু তাড়া দিয়ে কাজ করলে তো এতোদিনেই হয়ে যাইত।’ দাদির কন্ঠে উষ্মা!

শফিক একটু দিয়ে ঘরের ভিতর তাকিয়ে বলে ‘ভালো ডিজাইন দেছে তো কাকা? রান্নাঘর, বাথরুম সব বাড়ির ভেতর দিয়েছে?’

‘হয় হয়, চারখান শোয়ার ঘর, বসার ঘর, খাওয়ার ঘর, দুইখান বাথরুম, রান্নাঘর সব আছে। আর কিছু? তাড়াতাড়ি গেলাসটা নিয়া আমারে উদ্ধার করো তো?’ ময়নার মেজাজ খারাপ হলো।

‘তুই বড় অস্থির ময়না। দেখ, নিশার কাছ থেকে শেখ। শহরের মেয়েরা কেমন চুপচাপ থাকে? মেয়েমানুষ এইরকম শান্ত থাকলে কত ভালো লাগে। একদম নদীর মতো শান্ত কিন্তু বুকের ভেতর সমুদ্রের মতো তুফান তোলে।’

পরের কথাগুলো আস্তে করে বলল শফিক, বসে থাকা নিশার দিকে একটু ঝুঁকে এসে।

তারপর নিশার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ‐
চোখ।”

নিশার সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠল!

আগুনের দিন ৭।

১১.
কালো আর অসুন্দর শুনতে শুনতে বাইশ বছর কেটে গেছে নিশার। কখনো কেউ মুগ্ধ চোখে তাকায়নি, ভালোবেসে চায়নি। আজকে শফিকের চোখে ভালো লাগা দেখে নিশা একেবারে অস্থির হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতি কখনো আসেনি ওর জীবনে। শঙ্কা আর আনন্দ একসাথে ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি ওকে পাগল করে দিতে থাকল। কিন্তু এ যে কাউকে বলার না। সামান্য একটা কবিতা শুনিয়েছে ওকে শফিক। তাতেই এতকিছু ভেবে নিলো ও? কিন্তু এই সামান্যটুকুই যে নিশার কাছে কতখানি অসামান্য তা কাউকে বলে বোঝানোর মতো না। ও কাউকে বোঝানোর সেই চেষ্টাটাও করল না। নিজেও ভুলে থাকতে চাইল। কিন্তু বারেবারে অভদ্র, অসভ্য আর ইতর শফিকের আবৃত্তি করা কবিতাটার প্রতিটি অক্ষর ওর কানে ভেসে ভেসে আসতে লাগল, শফিকের উদোম পায়ের দৃপ্ত চলার ভঙ্গি ওকে মোহাবিষ্ট করে দিতে থাকল। প্রেমে পড়ল নিশা। কিন্তু সেই প্রেম নিজের মনে নিজেই স্বীকার করবে এমন সাহসই ওর নেই।

চৈত্র মাসের রাতের আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। নতুন ঘরে উঠবে বলে এই আশ্রয়গুলো যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে সেদিকে কারো নজর নেই। টিনের বেড়া খুলে গেছে অনেক জায়গায়, জঙ ধরে ভেঙে গেছে। ভাঙা টিনের বেড়ার ছোটো ছোটো ফাঁক দিয়ে আকাশের কিয়দংশ দেখা যাচ্ছে। মেঘে ঢাকা ঘুটঘুটে আকাশ। সেদিকে তাকিয়ে নিশার মনে পড়ল, অমাবস্যা বলে ডাকে ওকে অনেকেই। কেউ বলত নিগ্রো। কেউ কালি বলে ডাকত। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। কান্না পেতো। পরে ধাতে সয়ে গেছে। আজ অনেকদিন পরে শরীর নিংড়ে কান্না পেলো ওর। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল। ময়না ফোনে কথা বলছিল সেইরকম নিঃশব্দেই। নিশা কাঁদছে টের পেয়ে বলল ‘ও নিশা? কানতাছো? কাকির কথা মনে হইছে? কথা কইবা? রিং দিয়া দেবো?’

ময়নার ফোন দিয়েই রেজিনাকে প্রতিদিনের খুঁটিনাটি তথ্য দিতে হয় নিশার। ও মাথাটা উঁচুনিচু করে সায় দিলো। মাঝরাতে ময়নার ফোন পেয়ে রেজিনা বিস্মিত হলেন, ভয় পেয়ে গেলেন।

‘ময়না?’

‘হয় কাকি। আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী হইছে ময়না? কোনো সমস্যা? নিশা কই?’

‘নিশা কানতাছে কাকি। নেন কথা কন।’

নিশা ফোনটা নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে ‘আম্মু ভালো লাগে না। আমি বাড়ি যাব।’

‘যাওয়ার জন্য তো ম্যালা লাফালাফি করছিস, এখন ভালো লাগে না কেন? মা তো খারাপ, দজ্জাল, অত্যাচার করে শুধু ; এখন কান্না পায় কেন? মা ছাড়া কোথাও গেলে কদর পাওয়া যায় না, সেইটা বুঝছিস?’

‘আম্মু?’ নিশার ফোঁপানি কমে না।

‘কী করব আমি? কে নিয়ে আসবে তোরে? আছে কেউ? সেই তোর বাপের গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। স্কুল ছেড়ে সে যাবে কীভাবে? ছুটি ম্যানেজ করতে হবে না? কান্দিস না, ঘুমা?’

ফোনটা রেখে আবারও অন্ধকারে চোখ পেতে ঘুমিয়ে যায় নিশা। অন্ধকার রাতের মতো কালো বলে ওর নাম দিয়েছিল নিশা। রাতের আরেক নাম নিশি।

১২.
চৈত্রের দুপুরগুলো অসহ্য হয়ে থাকে। কটকটে রোদের সাথে গরমের তীব্রতাও এতো বেশি যে মানুষের সাথেসাথে প্রকৃতিও হাঁপাচ্ছে। ময়নাদের বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। আগে ইটভাটা ছিলো এখানে। এখন পরিত্যক্ত। ইটভাটার জন্য মাটি এনে স্তুপ করে রাখা হতো, উঁচু হতে হতে ছোটোখাটো একটা পাহাড়ে রূপ নিয়েছে সেটা। সেই পাহাড়ের পাশেই ইটভাটার প্রয়োজনে পানি সরবরাহের জন্য কাটা পুকুর। পেছনে বেঁতফলের বাগান। বেঁতের ঝোপ নিচু হয়ে মিশে গেছে জংলামতো জায়গায়। জংলার পানি ঘন সবুজ দেখা যায়। জংলা পার হয়েই বাঁশবাগান। ছোটো বাঁশের সাঁকো দেখা যায় একটা। নিশার মনে হয় বেড়ানোর জন্য জায়গাটা খুব সুন্দর। মাঠ পেরিয়ে হালকা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের। ময়না, কান্তা, সীমা সবাই আছে এখানে। ময়না এক এক খন্ড করে কাঁচা তেঁতুল ধরিয়ে দিয়েছে সবার হাতে। সেই তেঁতুলে কামড় বসাতে বসাতে গল্প করছে সবাই। গল্পের বিষয়বস্তু একই। প্রেম আর বয়ফ্রেন্ড। সবারই ঝুলি ভরা প্রেমের গল্প; হাত ধরা আর চুমুর ফ্যান্টাসি। সেইসব গল্প কখনো কখনো আরও ভয়াবহ মোড় নিতে থাকে৷

দুপুরের রোদ নিভে গিয়ে বিকেলের নরম ছায়া পড়তে শুরু করলেই সীমা বলে ওঠে, ‘চলো মালোপাড়ায় যাই।’

‘ক্যান?’

‘যাত্রার নায়িকার নাম সুন্দরী। সে আজকে সন্ধ্যায় জনিগো বাড়িতে গান শুনাইবে।’

‘সন্ধ্যার সময় মা বাড়িত্তে বাইর হইতে দেবে?’ ময়না নাকচ করে দেয় কান্তার প্রস্তাব।

‘এইজন্যই তো এখন যাব। নায়িকারে দেইখাই চলে আসব।’

‘তোর ভাই যাইবে?’ কান্তার আগ্রহ সাহেবের প্রতি। সীমাও জানে সাহেব-কান্তার প্রেমের গল্প। অনেকসময় সংবাদ আদান-প্রদানের ডাকপিয়ন সেই হয়।

নিশারও আগ্রহ জাগে। নিষিদ্ধ আগ্রহ। গোপন কিন্তু অদম্য।
জনি মানে জোনাকি। শফিকের বোন।

থারটিন থেকে নাইনটিন – নাম্বারগুলোর শেষে টিন সিলেবলটুকু আছে তাই এদেরকে বলে টিনএইজ। বাংলায় কৈশোরকাল। এডোলসেন্স পিরিয়ড। বয়ঃসন্ধি। শৈশব ছেড়ে তারুণ্যের পথে এগিয়ে যেতে নতুন জ্ঞান, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অনুভব, নতুন শিক্ষা। মস্ত এক রঙিন চশমা এঁটে যায় অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত চোখে। ভুল, বেঠিক কিছুও বড় সুন্দর দেখায়। শরীর আর মনের এই পরম্পরা কী ব্যাকরণের বেঁধে দেওয়া ‘টিন’ শব্দটাতে আটকে থাকে? নবজাতককে স্তন চুষে দুগ্ধ খাওয়ার কথা কেউ যেমন শিখিয়ে দেয় না, বেসিক ইন্সটিংকট তাকে বেঁচে থাকার তাগিদেই খাদ্যগ্রহনের উপায় জানিয়ে দেয় তেমনি নিজের অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখতেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয় মানুষ, বয়সন্ধিতে। এই আবেগ কেউ চাইলেই আটকে রাখতে পারে না, কেউ থামিয়ে দিতে পারে না, হয়তো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো দমিয়ে রাখে। দমিয়ে রাখা এই আগ্রহ বাইশের কৈশোর ছেড়ে না যাওয়া তরুণী নিশাকে কুপোকাত করে ফেলল। শফিকের চোখে নিশা অন্য কিছু একটা পড়ে ফেলেছে যা ওকে আটশো কোটি মানুষের তাবৎ দুনিয়া থেকে আলাদা করে দিয়েছে, নিশার দৃষ্টিতে।

‘নারে মা যাইতে দেবে না। পলায়েও যাইতে পারব না। মাঠ ভরা কাপড়। শুকায়ে মচমচা হয়ে আছে।
এইগুলা নিয়ে, গোছায়ে রাখা লাগবে। খড়ি নাড়ছিলাম উঠোন ভরে। সেইগুলো রান্নাঘরে মাচায় উঠায় দিতে হবে। দাদির হাঁসগুলা বড় খারাপ। খোপে ওঠে না। সেইগুলারে খুঁজে খুঁজে খোপে ভরা লাগবে।’

‘আর সুমইন্যার সাথে প্রেমও তো করা লাগবে?’ সীমা মুখ বাঁকায়। সীমার আগ্রহ অন্যজায়গায়। মালোপাড়ায় ঢোকার আগেই মক্তব পড়ে। মক্তবের ছোটোহুজুরের চোখে চোখ পড়লেই কেমন অদ্ভুত লাগে ওর। হুজুর মক্তবের ভেতরে থাকলে, তাকে দেখা যায় না, তবুও ওই রাস্তায় হেঁটে আসতে ভালো লাগে ওর। ময়নার উপর রাগ হলো ওর। ওকে খুব অহংকারী আর স্বার্থপর মনে হলো। ‘নিজের বেলায় ষোলোআনা, হুহ।’ মনে মনেই বলে ও। ‘কেন তোর জন্য যে আমি ধানসেদ্ধ কাজ বাদ দিয়ে সুমইন্যার দোকানে খাতা কিনতে যাই?’

কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ছোটোহুজুরের প্রতি এই টান এরা টের পেলে হাসিঠাট্টায় পাগল করে দেবে৷ আর এটা হওয়ারও নয় ভালো করেই জানে সীমা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হয়তো অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে ওর। এই পছন্দের কথা কাউকে কোনোদিন বলার সুযোগও পাবে না।
উদাস হলো সীমা।

সূর্যটা গড়াতে গড়াতে একেবারে সাগরের বাগানের পেছনে চলে গেছে। পুরো মাঠজুড়ে ছায়া নেমে এসেছে। মাঠগুলোতে ফসল বোনার জন্য চাষ দেওয়া হয়েছে। একবার চাষ দেওয়া শেষ। বেশ ভালোরকম বৃষ্টি হয়ে মাটি নরম হলে আরেকবার চাষ দিয়ে বীজ বপন করা হবে। মাটি এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। আল ধরে না হাঁটলে, হাঁটতে কষ্ট হয়।

‘ময়না ওইটা তোর সুমইন্যা না?’ ময়না, নিশা, আর কান্তা, সীমার কথায় ঘুরে তাকায় মাঠের পাশের পুকুরটার দিকে।
আসলেই তো সুমন। সাথে শফিক। সুমনকে পিঠে চড়িয়েছে শফিক। দুইপা এসেই আবার নামিয়ে দিয়ে নিজে সুমনের কাঁধে চড়ার চেষ্টা করছে। ওই চারটে মেয়ে ছাড়া অন্য কোনো কেউ দেখলেই বুঝে যেত, ছেলেদুটো লোকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু এখানে লোক তো ওই চারটে মেয়েই শুধু।
ময়না চোখ সরু করে ফেলল। সুমনকে ওর অনেকবার বারণ করা আছে, ময়নাদের বাড়ির ত্রিসীমানায়ও যেন ওকে দেখা না যায়।
শফিকের হাভভাবও ওর ভালো লাগছে না৷ বয়সে কত বড় ওদের চেয়ে, কিন্তু ছেলেছোকড়াদের মতো আচরণ করছে। ময়না চকিতে নিশার দিকে তাকাল। নিশার গালের দুপাশের সলজ্জ আভা ওর চোখে পড়ে গেল।

শফিক আর সুমন খোঁচাখুঁচি করতে করতে ওদের কাছে এসে গেল।

‘কীরে এখন কি দিনেদুপুরে মাঠের মধ্যে তোরা প্রেম করবি? এইটা কি শহরের পার্ক?’ সীমার ঠেস দেওয়া মন্তব্যর উত্তর করল শফিক ‘সমস্যা কী তোর? আমরা গ্রামে থাকি বলে শহরের মতো প্রেম করতে পারব না? নাকি শহরের মানুষের সাথেও প্রেম করতে পারব না? কম কী আমরা শহরের মানুষের চাইতে?’ সিগারেটের শলায় ম্যাচলাইট দিয়ে আগুন দিলো বলতে বলতেই। তারপর দু’আঙ্গুলে চেপে ধরে ঠোঁটে লাগিয়ে মস্ত জোরে বাতাস টেনে নিয়ে তার চেয়েও জোরে ধোঁয়া ছাড়ল।

সিগারেটের ধোঁয়া নিশার অসহ্য লাগে। মাথা ঘুরে ওঠে, বমি বমিও লাগে। ও চোখমুখ কুঁচকে নাকে ওড়নার আঁচলচাপা দেয়। মেজাজও খারাপ হয়। এত সুন্দর একটা ছেলে, কেন সিগারেটে ঠোঁট পোড়ায়? নিশা মনে মনে ভাবে ও যদি ওই ছেলেটার নিজের কেউ হতো তো সিগারেটটা টেনে ফেলে দিত।

‘এইখানে কেন এসেছ? তোমাকে মানা করেছি না?’ চড়া গলা ধরে ময়না, সুমনকে উদ্দেশ্য করে।

‘না, শফিক ভাই বলল ওদের বাড়িতে যাত্রার নায়িকা আসছে আজকে। তোমরা গেলে ভ্যান পাঠায়ে দেই?’ হঠাৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় সুমন।

‘না। নিশা আসো বাড়ি যাই।’ বলেই নিশার হাত ধরে হনহন করে মাঠের আল ধরে হাঁটতে শুরু করে ময়না।

চলবে….
আফসানা আশা

আগুনের দিন পর্ব-৪+৫

0

আগুনের দিন ৪ ও ৫

৮.
নিশার ঘুম ভাঙল একঝাঁক মুরগির কককক আর হাঁসের প্যাকপ্যাক শব্দে। ওর দাদির পালা হাসমুরগির পালকে খাবার দেওয়ার সময় শব্দে কান পাতা দায়। নিশা চোখ কচলে বাইরে এলো। গনগনে রোদ বাইরে। চোখ ধরে যাচ্ছে। ময়নাকে দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকেই ময়না খুব ব্যস্ত থাকে। ওর মাকে সব কাজে সাহায্য করতে হয়। সকালের ধোয়ামোছা, তারপর সবার খাবার বেড়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া – কেউ কেউ রান্নাঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে খেতে বসে কিন্তু উঠোন মাড়িয়ে কেউ আবার আসতেও চায় না। পুরুষ লোকেদের খাবার যার যার ঘরে দিয়ে আসতে হয়। ঘর বলতে সব মাটির মেঝে আর বেড়ার দেওয়াল, মাথার উপর গোলের ছাউনি। তাতেও ময়নার কাজ শেষ হয় না। এরপরে দুপুরের রান্নার কুটনো কোটা, বাটনা বাঁটা সব ওকেই করে দিতে হয়। মাঝে মাঝে ভাতটা গড় দেওয়া, ডালটা বাগাড় দেওয়ার কাজও করতে হয়। মোটকথা বেলা গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগে ময়নার ফুরসত নেই। এই সময়টা তাই নিশার খুব বিরক্ত আর একঘেয়ে লাগে। ও ময়নার পাশে বসে থাকে কিছুক্ষণ দাদির সাথে গল্প করে একটু – দাদিও তার হাস মুরগি, গরুর দেখাশোনায় ব্যস্ত। প্রতিবেশি রিমা, কান্তা, আরজিনারও একই রকম ব্যস্ততা। আর রাতে লুকিয়ে বাশার আর সাহেবের সাথে যাত্রা দেখতে যাওয়া যতটা সহজ হয়েছে দিনের বেলায় তাদের সাথে কথা বলা, পাশাপাশি দাঁড়ানো ততটাই কঠিন। মা সাথে আসেনি বলে নিশার উপর কড়াকড়িও বেশি।

সকালের খাবারে কমন থাকে আলুভর্তা। মাটির চুলার পিঠে মরিচ রেখে মুচমুচে করে রাখা হয়। সকালের ভাত রান্নাশেষে চুলার আগুন নিভিয়ে সেই গনগনে কয়লার উপর, নারকেল পাতার শলায় গেঁথে মরিচপোড়া দেওয়া হয়। মিহি কাটা পেয়াজ, অল্প রসুনকুঁচি, ঝাঁঝওয়ালা সর্ষের তেল আর লবণের সাথে হালকা করে হলুদগুঁড়ো দেওয়া হয় আলুভর্তার সাথে। চেনা ভর্তার রঙ পালটে যায়, ভিন্ন ফ্লেভার আসে আর স্বাদটাও অন্যরকম হয়ে যায়। বেশ ভালোই লাগে নিশার। আর এর সাথে দাদির মুরগির খোপ থেকে বের করা টাটকা ডিমভাজি। বড় এক বোলে কেজিখানেক আলুর ভর্তা করা হয়। ময়না পেয়াজ আর রসুন কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। ছোটোবউ মরিচ পোড়াচ্ছে আর বিড়বিড় করে যাচ্ছে। গতরাতে নিশার দাদির বাতব্যথাটা বেড়েছিল। রাত জেগে তার পা টিপে দিতে গিয়ে ছোটোবউয়ের আর ঘুম হয়নি। সে নিশাকে দেখে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বলল ‘তোমার মা তো সব আমাদের ঘাড়ে দিয়ে শহরে গিয়ে রাণির মতো থাকে। কী আরামেই না আছে সে, তাই না, নিশা?’

নিশা উত্তর দেয় না। ও জানে এসব আক্ষেপের উত্তর করতে হয় না। ময়না ওকে ডেকে একটা পিঁড়ি এগিয়ে দেয় বসার জন্য ‘বসো। আজকে কাজ নাই বেশি। বাড়ির পুরুষ লোকেরা সবাই আজকে পার্টি অফিসে খাবে। আর আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবে। রান্না হবে না, দুপুরের জন্য। আজকে আমরা মালোপাড়ায় যাব, তেঁতুল আনতে।’

‘পার্টি অফিসে কেন?’

‘আল্লাহ, তুমি শোনো নাই? এইযে যাত্রাপালার আসর বসছে, একী শুধু চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ের জন্য? বিয়া তো কবেই শেষ। ইইউনিয়ন পরিষদ ইলেকশন না সামনে? তালাচাবি মার্কার লোক হেভি খাওয়াইতেছে সবাইরে। প্রতিদিনই গরু মারতেছে। আজকে আমাদের এইদিকে খাওন দেবে। পুরুষ লোকেরা গিয়ে খেয়ে আসবে। আর মেয়েদের খাবার বাড়িতে বাড়িতে পাঠায়ে দেবে।’

‘আমাদের বাড়ির সবাই কি তালাচাবি মার্কার ভোটার?’

‘তা তো জানি নে। তবে দাওয়াত সবারই। অনেক টাকা ঢালতেছে ইউনুস চেয়ারম্যান। আগে তার বাবা চেয়ারম্যান ছিলো, তারপর তার ভাই। সেও দুইবার চেয়ারম্যানি করছে। আগেরবার শুধু হাইরে গেছিলো। তাই এইবার জেততেই হবে তার। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পাকা করে দেবে বলেছে।’

‘বাঃ! ভালো হবে তো। যে কাদা হয় বৃষ্টিতে।’

‘করলে হয়। আব্বা কয় ভোটের পরে আর ফস করে না!’

‘মানে কী এর?’

‘হিহিহি। এর মানে শুনলে হাইসেই মরে যাবা। আগে যখন কোকাকোলা, সেভেনাপ নতুন নতুন আসছে এই দেশে, নির্বাচনের আগে এক নেতা ভোটারকে কোক খাওয়ায়োতো। প্রত্যেকদিনই। বোতলটা খুললেই ফস করে উঠত। এইরকম করে ভোটার লোকটা তো মজা পেয়ে গেল। সে প্রতিদিনই নেতার কাছে যায়, আলাপসালাপ করে আর একটা করে কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে আসে। তো ভোট শেষ হলো। ভোটের পরেরদিনও লোকটা গেছে নেতার কাছে, অভ্যাসমতো। নেতার চাকর একটা বোতল দিয়েছে, যেমন প্রতিদিন দেয়। কিন্তু এইদিন বোতল খুললেই আর গ্যাস বেরোনোর ফস করে ওঠা শব্দটা বেরোলো না। লোকটা জিজ্ঞাসা করতেই নেতা জানালো, ভোটের পরে আর ফস করে না! হিহিহি!’

‘ফস করল না কেন?’

‘আরে বোকা, ভোটের পরে তো আর কোল্ড ড্রিংকস দেয় নাই। বোতলে পানি ভরে দেছে। হিহিহি!’

নিশাও একচোট হাসল ময়নার সাথে। মজার গল্প৷

সব কাজ শেষ করে ময়না নিশাকে নিয়ে তেঁতুল আনতে মালোপাড়ার দিকে চলল।

ময়না দেখতে সুন্দর। নিশা কালো বলে যে খেদ আছে ওর মনে তা আরও বেড়ে যায় ময়নাকে দেখলে। আর গ্রামে থেকেও এত সুন্দর করে সাজে যে নিশার অবাক লাগে। নিশা নিজে পারে না আর সাজগোঁজে ওর আগ্রহও কম। ক্লাস এইটের ক্লাসপার্টিতে সখ করে আম্মুর লিপস্টিক লাগিয়েছিল ঠোঁটে। রেজিনা দেখে বলেছিল ‘কয়লার গাড়িতে আগুন!’ চাপা স্বভাবের নিশার রুচি হয়নি আর কোনোদিন ঠোঁট রাঙানোর।

ময়না পালাজ্জো সালোয়ার আর শর্ট কামিজ পড়েছে। ওড়নাটা একদিকে লম্বা হয়ে মাটি ছুঁয়েছে। দেখে মনে হতে পারে এলোমেলো হয়ে আছে, কিন্তু ও ওভাবেই পিনআপ করেছে ওড়না। মাথার সুন্দর চুলগুলোকে চুড়ো করে বেঁধে, দুইগাছি আবার চোখের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। হালকা কাজল আর লিপলাইনারে আঁকা ঠোঁট। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। নিশার মনে কেমন খচখচ করে, একটু হয়তো জ্বলুনি। নিজে কালো বলে আজীবন কটু কথা শুনে আসার অভিমানও!

তেঁতুল পাড়তে আসার জন্য যে এই সাজ না ময়নার সেটা নিশা অনুধাবন করল একটু বাদেই। মালোপাড়ায় যাওয়ার পরিবর্তে ময়না ওকে নিয়ে এসেছে বাজারের কিছু আগের ফ্লেক্সিলোড, বিকাশের দোকানে। দোকানে ঢোকার আগেই ময়না আমূল বদলে গেল, আঞ্চলিক ভাষা আর শুদ্ধ বাংলার খিচুড়ি করে কথা বলা মেয়েটা স্মার্ট বাংলায় নিশাকে বলল ‘নিশা, আমরা যে এখানে এসেছি, এই কথাটা তুমি কাউকে বোলো না, প্লিইইইজ!’

দোকানটাতে কিছু বইপত্রও আছে৷ টেক্সট, গল্প-উপন্যাস। ময়না সেগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল আর নিচু স্বরে দোকানের ছেলেটার সাথে কথা বলতে লাগল। ময়নার গালের লাল রঙ আর ছেলেটার চোখের ঢুলুঢুলু ভাব দেখে অনেক কিছুই বুঝে গেল ও। ছোটচাচি যেভাবে নিশার মায়ের শহরে থাকে, সুযোগ সুবিধা পাওয়া, ছেলেমেয়েদের শহুরে স্টাইলে মানুষ করার অভিযোগ করতে থাকেন তা একেবারেই সত্যি না। শুধু ভালো স্কুলে পড়া বাদে অনেক কিছু থেকেই নিশারা দুই বোন পিছিয়ে, গ্রামে থাকা ময়নার থেকে। অনেক কান্নাকাটি, আহ্লাদ করে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ল্যাপটপ আদায় করেছে ওরা মইনুল ইসলামের কাছ থেকে, নিজেদের কয়েকবছরের ইদি আর টিউশনির টাকাগুলোও দিতে হয়েছে সাথে, অথচ ময়নার হাতে ট্রেন্ডি স্মার্টফোনে, তাতে ডাটাপ্যাকেজ থাকে সবসময়ই। অনলাইনে অর্ডার করে হালফ্যাশনের জামা, রূপচর্চার সামগ্রী আনিয়ে নেয় ময়না, যেগুলোর নামও হয়তো শোনেনি নিশা।

নিশা বিরক্ত হচ্ছে। আধাঘন্টার বেশি এই মিহিকন্ঠের প্রেমালাপ চলছে। দুইহাত দূরে দাঁড়িয়েও একটা কথা কানে আসছে না নিশার। এতো আস্তে কেউ কথা বলে কীভাবে আর তার কথা অন্যজন বুঝছেই বা কীভাবে? বিরক্তির সাথে সাথে ও বিস্মিতও হচ্ছে ময়নার সাহস আর স্পর্ধা দেখে। বোঝাই যাচ্ছে ও প্রায়ই আসে এই দোকানে। ধরা পড়ার ভয় নেই ওর? যদি কেউ দেখে ফেলে? নিশার বুক ঢিপঢিপও শুরু হয়ে যায়।

থাই গ্লাসের স্লাইডডোর টেনে দেওয়া ছিলো, ফস করে টেনে একটা ছেলে ঢুকল। গ্যাবার্ডিনের ছয় পকেটের মোবাইল প্যান্ট হাওয়াই শার্টের সাথে মিসম্যাচ চটি স্যান্ডেল। ধুলোমাখা পায়ে ধপধপ করে ছেলেটি ঢুকে বলতে লাগল ‘ওই সুমইন্যা ফ্লেক্সি দিস নাই ক্যান? আধাঘন্টার উপরে হয়ে গেছে।’

সুমন মানে ময়নার বয়ফ্রেন্ড ছেলেটি তাড়াতাড়ি করে বলল ‘ভাই এইযে দিয়ে দিছি।’

নিশা চিনল ছেলেটাকে। আগেরদিন যাত্রায় সখি সাজা ছেলেটা যে পরে নিশার সাথে কুৎসিত ব্যবহার করেছিল। দিনের আলোয় ছেলেটাকে দেখে নিশার ধারণা পাল্টালো। ছেলেটা সুদর্শন, হেসে ফেললে দারুণ দেখায়! আর চোখদুটো খুব, খুব, খুব সুন্দর। পুরুষালী এমন মিষ্টি চেহারা আগে কখনো দেখেছে কীনা নিশা মনে করতে পারে না!

আগুনের দিন ৫।

৯.
‘ওই সুমইন্যা, এইটা বুঝি শালী? ভালো তো শহরের শালীও পেয়ে গেছিস। তা আমরা বড় ভাই যারা সিংগেল আছি, তাদের জন্যও একটু কিছু কর? শালী তো সুন্দর আছে?’ ছেলেটা একদম নিশার চোখে চোখ রেখে বলল। অদ্ভুত অনুভূতি হলো নিশার, চোখ ফিরিয়ে নিলো।

‘শফিইক্যা, ও নরম মেয়ে। একদম বিরক্ত করবি না।’ ময়না চোখ পাকিয়ে শাসায় শফিককে। সুমন তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে বাটন টিপতে টিপতে বলে, ‘শফিক ভাই, এইযে ফ্লেক্সি দিয়ে দিছি। তুমি একটু পরে আসো। এদের এখনই বিদায় দিচ্ছি।’

‘তাড়াই দিতাছিস? শুধু তোর শহুরে শালীর প্রশংসাই তো করলাম। ইংরেজিতে বলে কমপ্লিমেন্ট। একা একাই প্রেম করবি? ভাইদেরকে একটু ভাবি খুঁজে দিবি না? যাক, না দিলে নাই…’ মন খারাপের ভঙ্গিতে বলতে বলতে শফিক গান ধরল ‘নদীর জল ঘোলা ভালোওওও…. জাতের মেয়ে কালোই আলোওওওও!’

লজ্জাই পেলো নিশা। ঈষৎ লাল হয়ে মুখটা বেগুনি রঙ নিলো।

সুমন কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল ‘নিশা আপু, তুমি কিছু মনে কোরো না। শফিক ভাই একটু মুখ আলগা কিন্তু ভালো ছেলে। কী সুন্দর অভিনয় করে। কবিতা পড়ে। শিক্ষিত কিন্তু। বিএসসি পাশ।’

হলোইবা! নিশার তাতে কী? কী বিশ্রী করে গতরাতে ধমকেছিল ওকে!

‘চা খাবা নিশা আপু?’

‘না না, কিছু খাব না।’ সুমনের অফার ফিরিয়ে দেয় নিশা।’

‘খাবে না কেন? খেয়ে দেখো? এইখানের মালাই চা খুব মজা, খেয়েই দেখো না!’ নিশাকে বলে ময়না সুমনকে বলে ‘বেশি করে মালাই দেয় যেন। স্পেশাল।’

সুমন একমিনিটের মাথায় চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেরত আসে। ওদের গল্প, হাসি, চোখে চোখে চাওয়া, টেবিলের নিচে দিয়ে হাত ধরাধরি খুঁনসুটি চলতে থাকে। সাত আট মিনিটের মাথায় একটা বাচ্চাছেলে ছোটো ছোটো গ্লাসে করে চা দিয়ে যায়। চায়ে চুমুক দিয়ে নিশা বোঝে, এমন আহামরি কিছু না।চা শুধুই একটা বাহানা। আরেকটু সময় এখানে থাকা আর নিশাকে ব্যস্ত রাখার বাহানা মাত্র।

১০
‘ও নিশা তুমি কি কাউরে কয়ে দিবা?’

‘না।’

‘সত্যি কচ্ছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আল্লার কিরা? মাথায় হাত দিয়ে কও?’

‘ময়না, তুই ভালো করেই জানিস আমি কাউকে বলব না। নাহলে তুই আমাকে নিয়ে এখানে আসতি না।’

‘অনেকদিন ওর সাথে দেখা করতে পারি না। রাগ করে ও। মা তো আমাকে বাজারে তো আসতেই দেয় না। আজকে তোমারে সাথে নিয়ে আইছি বলে কিছু কবে না।’

‘এইটা আমার খারাপ লেগেছে ময়না। কোনো সমস্যা হবে না, বিশ্বাস করো? সুমনের দোকানটা দাঁড়ায় গেলেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে ওরা।’

‘দিলেই ভালো!’ অনাগ্রহের সাথেই শুভেচ্ছা জানায় নিশা। খুব মন খারাপ হয়েছে ওর। এতগুলো বসন্ত চলে গেছে জীবন থেকে। বয়সে ছোটো কতজনকে দেখে প্রেম করতে। ক্লাসমেট বা বান্ধবীদের প্রপোজ করার জন্য কতজন ওকেই মিডিয়া বানিয়েছে। বোন হয়েছে কতজনের, একসময় তো জাতীয় বোন খেতাব লেগে গিয়েছিল ওর সাথে! যে কেউই ওর কোনো বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক করতে চেয়েছে, সেই আগে ওকে বোন ডেকে রাস্তাটা সহজ করেছে। কিন্তু ওর জীবনে কখনো প্রেম আসেনি। কখনো কেউ মুগ্ধ চোখে চায়নি। একে নিজের গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। তারউপর বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশি এমনকী রেজিনার বিদ্রুপেও ও আরও গুটিয়ে থাকে। বয়সে অনেক ছোটো ময়নাকে প্রেম করতে দেখে তাই খুব হিংসা হচ্ছে ওর।

মন থেকে হিংসাত্মক ভাবনাগুলো জোর করেই সরিয়ে দিলো ও। ময়নাকে বলল ‘তেঁতুল নিবি না? বাড়ি গিয়ে কী বলবি?’

‘হয়, হয়? মনে করায়ে দিলা। থ্যাঙ্কিউ নিশা। আসলে কতদিন পরে ওর সাথে দেখা হলো, সব ভুলে গেছিলাম!’

‘তুই রাতে দাদির সাথে ঘুমাস কি সুমনের সাথে ফোনে কথা বলার জন্যই?’

‘হয়। বুড়ি তো কানে শোনে না। আর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমায় যায়।’

মালোপাড়ায় ঢোকার মুখে পরিত্যক্ত কূয়ার পাশে এক চিলতে মাঠ। গরু চড়ে। বিকেলে ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। এই মাঠ পার হতে সেকেন্ড ত্রিশ লাগে। তারপরেই ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। এখনো পাকেনি। কাঁচা কাঁচা তেতুল ঝুলছে। কী মোটা মোটা তেঁতুল? আর এত বেশি ধরেছে যে পাতা দেখা যাচ্ছে না। গাছ ঝুঁকেও এসেছে খানিক। একটু লাফ দিয়ে একটা ডাল ধরল ময়না আর ঝাঁকি দিতেই টপটপ করে কতগুলো তেঁতুল পড়ল। সেগুলো ওড়নার কোচড়ে ঝুলিয়ে, কয়েকটা তেঁতুলপাতা ছিঁড়ে নিলো ময়না। কিছু মাতা নিজের মুখে পুরল আর কিছু নিশাকে দিলো। খুব মজা লাগল নিশার। হালকা টকটক। একটু মিষ্টি মিষ্টি। তেঁতুলের মতো অত কড়া না টকস্বাদটা। নিশার মনে হলো মানুষ তেঁতুল গাছে পাতা কেন রাখে? গাছটা ওর হলে ও সব পাতা পেড়ে, বেটে ভর্তা করে খেয়ে ফেলত!

বাড়ি যাওয়ার পথ ধরতেই ময়না বলল, ‘জনিগো বাড়ি বিলাতি ধইনাপাতা আছে। চলো নিয়ে আসি। তেঁতুলভর্তায় দিলে কী যে ঘ্রাণ হবে? আংগুল চাটতেই থাকবা!’

‘চাইলেই দেবে?’

‘কেন দেবে না? ব্যাপক হইছে তো?’

জোনাকির নাম ছোটো করে জনি। শফিক, শহীদ, জোনাকি আর সোনাই চার ভাইবোন। জোনাকি, ময়নার বন্ধু। বেশ ভাব দুজনের। ময়না ‘জনি, ও জনি? আছিস?’ বলে ডাকতে ডাকতে বাড়ি ঢুকল। বাড়িটা খুব সুন্দর। গেরস্ত বাড়ি। সব ফসল হয়। টিনের চাল দেওয়া সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো ঘর। সব ঘরেই কাঠের ছাদ করা আছে ফসল রাখার জন্য। উঠানে সারাবছর ধান শুকানো হয়। কখনো মরিচ, কখনো হলুদ নাড়া থাকে। উঠোনের চারিদিকে ঘর। ঘরগুলোর সামনে সিমেন্টঢালা বসার জায়গা। সেখানে আচারের বয়ম রোদ পোহাচ্ছে। ময়না একটা বয়ম তুলে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে আচার বের করে আনল। ‘খাবা নিশা? জনির মা যে সুন্দর বরইয়ের আচার বানায়? খেয়ে দেখ?’

‘না। তুমি হাত ধোও নাই!’

‘ধুরো! হাত ধুইতে গেলে জনির মা টের পেয়ে যাবে না? ক্যাক্যা শুরু করবে আইসে?’

‘এটাতো চুরি?’

‘জনি জানে।’

‘হুহ!’ মুখ ভার করে রইল নিশা। কতশত অন্যায় কাজ একদিনে করে ময়না? ওর ভয় করে না? গতকাল রাতে চুরি করে যাত্রা দেখতে গেল, নিশাকেও জোর করে নিয়ে গেল। দাদিকে লুকিয়ে যেতে কী অপরাধী মনে হচ্ছিল নিশার, নিজেকে নিজের!

পুরুষেরা কেউ বাড়ি নেই, মহিলারা হয়তো রান্নাঘরে ব্যস্ত। ময়না আরও দুবার ডাক দিলো ‘জনি? ওই হারামজাদি, মরছিস নাকি?’

ময়নার ডাক জোনাকির কানপর্যন্ত যাওয়ার আগেই বাদামীরঙা একটা বেশ নাদুসনুদুস কুকুর জিভ বের করতে করতে ছুটে এলো আর ঘেউঘেউ শুরু করে দিলো। নিশার খুব কুকুরে ভয়। ও লাফ দিয়ে একটা ঘরের দাওয়ায় উঠে গেল আর চিৎকার করে কাঁদতে থাকল। নিশা যত জোরে কাঁদে, কুকুরটা তত জোরে ঘেউঘেউ করে! মিনিট দুয়ের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গেলো আর শফিক কুকুরটাকে ডাক-তে ডাকতে গলায় হাত দিয়ে টেনে নিলো ‘এই, এই প্রেমা? থাম, থাম? আতুউউউ। এই প্রেমা? থাম, মা?’

নিশা স্তম্ভিত হয়ে কুকুর আর কুকুরের মালিকের কথোপকথন শুনতে লাগল।

ময়না হাত ধরে টানল নিশার ‘এত ডাকতেছি, তোমারতো একেবারেই হুঁশ নাই। এত ভীতু তুমি? আল্লাহ গো! বলতেছি এইডা পালা কুকুর, কামড়াবে না। তুমি শোনোই না। আসো?’ ওদের বয়সী একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল ‘ওই জনির বাচ্চা? কই মরতে গেছিলি? ডাকতে ডাকতে জান শেষ?’

‘আজকে মেজবান না?’

‘তগো কী?’

‘চেয়ারম্যান কাকায় তো সব আমাগো উপরেই দিছে? মশলা বানাইলাম, গুস্ত বানাইলাম। তুই আইছিস ক্যান?’

‘আইরে পারব না?’

‘সেইডা কইনাই। ক্যান আইছিস জিগাইছি!’

‘ধইন্যাপাতা দিবি?’

‘হ। আস্তে ক? মা শুনলে রাগ করব। কান্তাগো গরু অদ্দেক পাতা সাফ কইরা দিয়া গেছে। তুই বাইরে যা, আমি চটপট কয়ডা পাতা ছিঁড়া আনতাছি?’

ময়না আর নিশা বাড়ির বাইরে এলে জোনাকিও হাতের মুঠোয় ধনেপাতা এনে ময়নার কোচরে ফেলে দিলো। ‘কী করবিরে পাতা দিয়া?’

‘তেঁতুলভর্তা খাব?’

‘আমারে দিয়া যাইস?’

‘এতো দূরে আবার আসব? সোনাইরে পাঠাইস?’

‘সোনাইরে মা যাইতে দেবে না। রান্না চড়ছে। একটু পরে ভাই বাড়ি বাড়ি দিতে যাইবে। ভাইর হাতে দিয়া দিস তখন?’

‘আচ্ছা।’

১০

‘এটাই কী ওই শফিকদের বাড়ি?’

‘হয়। সুন্দর না বাড়িটা? এলাকায় এতবড় বাড়ি আর কারো নাই। চেয়ারম্যান কাকার বাড়িও এতবড় না।’

‘ওরা কয় ভাইবোন?’

‘চাইরজন। শফিইক্যা, শহীদে, জনি আর সনি। শফিইক্যা বড় পোলা বলেইতো অত বাইড়!’

শফিকের উল্লেখে অকারণেই নিশার গাল লাল হয়ে গেলো। ও অস্ফুটে বলল ‘আর ওই কুকুরটা?’

‘ওইটা শফিইক্যার কুত্তা। নিজের চাইতে বেশি যত্ন করে ও কুত্তাডারে। যে খাবার দেয়, বাপরে বাপ! সপ্তায় দুই কেজি গরুর গুস্ত কেনে ওই কুত্তাডার জন্য।’

‘কুকুরটার নাম কী? কী নামে যেন ডাকছিল…?

হাসতে হাসতে নিশার গায়ে ঢলে পড়ে ময়না। ‘ওরে ঢঙ ওই কুত্তা নিয়া? কুত্তার নাম হইল প্রেমা! বুঝছ প্রেমা?’
হাসির দমকে কথা ঢাকা পড়ে যায় ময়নার। বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলে ‘ওই শফিইক্যা নিজের নাম দেছে প্রেম; আর ওর বউয়ের নাম বলে প্রিয়া! আর ওই কুত্তাডা হইলো ওর মেয়ে, কুত্তার নাম নিজের নামে মিলায়ে রাখছে প্রেমা!

হাসতে হাসতে তেঁতুল, তেঁতুলপাতা, ধনেপাতা কোচর থেকে ফেলে দেয় ময়না। সেগুলো দুজন মিলে খুঁটে তুলে আবার হাসতে থাকে। ‘কুত্তার নাম প্রেমা! হিহিহি!…’

নিশাও হাসতে থাকে প্রাণখুলে।

চলবে..
আফসানা আশা

আগুনের দিন পর্ব-২+৩

0

আগুনের দিন ২ ও ৩।

৫.
মেঠো রাস্তার একপাশে কাউন আর পেঁয়াজের ক্ষেত। ফসল তোলা হয়ে গেছে অধিকাংশ। যা কিছু এখনো কৃষকের উঠোনে পৌঁছায়নি তা পাহারা দেওয়ার জন্য লোক আছে ক্ষেতেই। পালা করে সবার ফসল পাহারা দেওয়া হয়। একজন পাহারাদার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত ফসলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তার হাতে থাকে শক্ত বাইন কাঠের লাঠি আর সূচালো বল্লম। একটা রাত কেউ না থাকলেই মাঠ উজার হয়ে যাবে। রাস্তার অন্যপাশের মাঠ জুড়ে পাট বোনা হয়েছে। চারাগুলো মাথা উঁচু করতে শুরু করেছে। চার পাঁচদিন বয়স হবে এদের। মাথার উপরে মেঘহীন আকাশের মস্ত চাঁদের আলোয় ওদেরকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবুও নিশা ভয়ে ভয়ে ময়নার হাত চেপে ধরে আছে। ময়না হাসছে, ‘তুমি এত্ত বড় হইছো, তাও ডরাও বুঝি? ভুত ভয় পাও, এখনো?’

ভুতের ভয় অনেক বেশি নিশার। কিন্তু হরর মুভিগুলো পছন্দের লিস্টে সবার আগে। এক্সরজিস্ট সিরিজ, কনজ্যুরিং দেখার লোভ সামলাতে পারে না, দেখতেই হয়। মুভিগুলো স্ক্রিনে থাকার সময় ভয় লাগে না। ও তো জানেই এগুলো সব মেকআপ, আলোর কারসাজি আর দারুণ দারুণ সব ভিজ্যুয়াল গ্র‍্যাফিক্সের কারসাজি। কিন্তু লাইট বন্ধ হলেই সব যুক্তি মাথা থেকে উড়ে যায়। খাটের নিচে কারো অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, পাশ ফিরলেই হয়তো কোনো কদাকার মুখ দেখা যাবে সেই ভয় লাগে বলে সোজা হয়ে শুয়ে থাকে। ভয়ের নাটক সিনেমা অধিকাংশতেই দেখা যায়, বাথরুমের ট্যাপ থেকে টাটকা রক্ত আসছে, এই ভয়ে প্রাকৃতিক বেগ সামলে সুমলে রাখা লাগে। সিনেমা দেখার গরম গরম রাতগুলোতে ঘুমও যেন পালায়, পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে থাকে। রাত তিনটের ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই মনে হয় এই বুঝি রক্তপিপাসু আত্মারা ছুটে ছুটে এলো! এখনও এই মাঝরাতে দলে ভারী হলেও বুক ভয়ে টিপটিপ করছে, এই যদি কেউ একটু পেছনে পড়ে যায় আর ভয়ংকর কোনো আত্মা তাকে ‘পজেশনে’ নিয়ে নেয়! সাহেব, ময়না, রিমা, কান্তা, আরজিনা, বাশার, চৈতি, বন্যা এরা সবাই পাশাপাশি বাড়িতেই থাকে।

‘ওই বাশার, কথা বলিস না ক্যান? যাত্রা ভাল্লাগে নাই?’

‘সাহেববাই, ব্যাপক লাগছে। বাজনাগুলা ক্যামনে দেয় দেখছ? একেবারে খাপে খাপ!’

‘বাংলা সিনেমা যেগুলা বিটিবিতে দেখায়, তার চাইতে তো ভালোই, কী বলিস নিশা?’

কান্তার কথার উত্তর নিশা না দিলেও ময়না বলে উঠল ‘তয় নাইকাটারে কী সাজ দেয় এইগুলা! আর নাইকাটাতো মেয়েই ছিলো, কিন্তু ক্যামন জানি মরদের মতো, না?’

‘হ্যাঁ, নায়িকাটা সুন্দর না। কিন্তু ডাকাত সর্দারটারে দেখছ, কেমন পালোয়ান?’

‘আমার কাছে খারাপ লাগেনি। যেটা যেরকম সেটার প্রতি এক্সপেকটেশনও সেরকমই থাকে। এখন যাত্রা দেখতে এসে টলিউডের ঋতুপর্ণর সিনেমা দেখব সেটা আশা করলে তো হবে না।’ নিশা নিজের মতামত জানায়।

‘ঋতুপর্ণারে আমারও খুব ভালো লাগে। প্রসেনজিৎ এর সাথে সব সিনেমা করে।’

ময়নার কথার উত্তরে নিশা আবার বলে ‘ঋতুপর্ণা না ঋতুপর্ণ। ঋতুপর্ণ ঘোষ।’

‘ওই ব্যাটাটা যেইটা মাইয়া সাইজা থাকে?’ বাশার অবাক হয়েছে এমনভাবে বলল। ‘হিজরা লাগে ওইটারে পুরাই।’

‘ছিঃ, বাশার ভাই। মানুষকে তার কাজ দিয়ে মূল্যায়ন করতে হয়। সে কেমন দেখতে, কী পোশাক পরে বা কীভাবে কথা বলে এটা ইম্পর্ট্যান্ট না। সে খুব সুন্দর সুন্দর সিনেমা বানায়, তাই তাকে পছন্দ করি।’

‘আতামাথা সিনেমা বানায়। ঘুম আসে হের সিনেমা দেখতে বসলে। ফাইট নাই, গান নাই!’

নিশা হাসে। উত্তর দেয় না। সবাই যে সমান শিল্পবোদ্ধা হবে এমন ভাবাটা বোকামি। নিশা নিজেকে বোকা ভাবে না। তাই অকারণ তর্ক করে না।

মাঠ ফেলে গ্রামে ঢুকতেই ভয় আরও বেড়ে গেলো নিশার। ঠিক মোড়ের মাথায় ছোটো মাঠটার কোণা ঘেঁষে পরিত্যক্ত কুয়োর পাড়ে ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। তার পাশে ছোটো ছোটো ডুমুর গাছ আর কাঁটাঝোপের জঙ্গল, খানিকটা জায়গা আড়াল করে রেখেছে। সেই মোড়টা পার হলে ঘন গাছপালাঘেরা সাগরের বাগান। দিনের বেলায় ঢুকতেই ভয় হয়। সেই বাগানের সীমানা লাগিয়ে তিনটে তালগাছ, একটা আবার আরেকটাকে পেঁচিয়ে উঠে গেছে। এই তালগাছের অনেক গল্প আছে, ময়না আর নিশার দাদির ঝুলিতে। সব গল্পই ছমছমে রহস্যময়তা নিয়ে শেষ হয়। পল্লী বিদ্যুৎ এর সুবিধা পৌঁছে গেছে সবখানেই, ইলেকট্রিক আলো সব ঘরে। কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে জিরো পাওয়ার নামে এক বালবের প্রচলন আছে, ঘুটঘুটে অন্ধকারকে যা আরও বাড়িয়ে তোলে। নিশার হাতে তিন ব্যাটারির বড় টর্চলাইট। সেই আলো ও হিসেব করে ফেলছে, যেন রাস্তা ছেড়ে কোনোভাবেই পাশের বাগানগুলোর দিকে আলো না যায়। আলো গেলেই কোনো অশরীরী দেহধারী হয়ে উঠবে এ ও নিশ্চিত জানে! সবাই সবার মতো করে কথা বলছে, কিন্তু না চাইতেও নিশার চোখ রাস্তার পাশে পাশে অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। কী একটা অদ্ভুত রকম জিনিস দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রাস্তার উপর কিছু একটা আছে। কেউ একজন গবরের বোড়ে বানিয়ে শুকোতে দিয়েছে রাস্তার উপরেই। বাঁশের আড়ে ঠেস দিয়ে একেকটা বোড়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া আছে। এরই আড়ালে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ভয় পেলে ওর এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ প্রবল। ও খুব ভালোভাবে টর্চের আলো ওইজায়গায় ফেলতে লাগল আর কেউ একজন খেঁকিয়ে উঠল ‘এই কে রে? কে আলো ফেলে? একদম চোখের উপর আলো ফেলতেছে। জ্ঞানবুদ্ধি নাই কিছু? বেআক্কেল নাকি?’

নিশা হতভম্ব হয়ে যায়। ওখানে দুটো ছেলে দাঁড়ানো। একজন বসে আছে আর একজন দাঁড়িয়ে। নিশার টর্চের আলো বসে থাকা ছেলেটার চোখে লেগেছে। নিশা চিনতে পারল ওকে। যাত্রায় নায়িকার সখি সেজে থাকা ছেলেটা। লজ্জায় নিশার ঠোঁট ফুলতে থাকল। এভাবে বলে কেউ?

সাহেব উত্তর দিলো ‘ওই আকাইম্মা? তুই ওইখানে পলায় আছিস, ও জানবে কেমনে?’

নিশাও কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল ‘সরি। আমি বুঝতে পারিনি।’

ছেলেটা অতিমাত্রায় অসভ্য। নিশার সরি বলাটা ওর উপর কোনো প্রভাব ফেলল না। ‘ওহ তুমিই মইন কাকার মেয়ে? শহর থেকে এসে ভাব নেও? আমরা কেউ যেন শহরে যাইনাই কোনোদিন? গ্রামে এসে শহরের ভাব মারাবা না। এইভাবে চোখে আলো ফেলাটা বেয়াদবি। মেয়েমানুষ না হলে এখনই হাত ভেঙে থুয়ে দিতাম! শিখে রাখো এইগুলা!’

‘ওই শফিইক্যা? কী বলস এইগুলা? ভালো কইরা কথা বল? কাক্কায় জানলে তোর খবর আছে।’

‘হুহ!’ বলে শফিক নামের ছেলেটা, সাথে থাকা অন্যজনকে নিয়ে ওদের আগে আগে হনহন করে হেঁটে চলে গেলো।

এই বয়সটাতে আত্মসম্মানবোধ থাকে চড়া। সমবয়সী ভাইবোন আর বন্ধুদের সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে নিশা একেবারে মিইয়ে গেল!

রাত বারোটা বাজে। এমন কোনো দেরি না, কিন্তু গ্রামে এটাই ভয়াবহ রকম নিশুতি রাত। ডান হাতে শূণ্য গোচারণভূমি। হুহু করছে। এখানে নাকি চারটা আমগাছে কখনো আম হতে দেখা যায়নি। রাস্তার উপর বড় বড় অর্জুন,বহেরা,হরিতকি গাছ। সরকারি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় রাস্তার দুপাশে নানারকম ওষধি গাছ লাগানো হয়েছে। যার যার বাড়ির সামনের গাছগুলো সেই বাড়ির লোকেরাই দেখাশুনা করে। বলা আছে, এই গাছ বিক্রির টাকা অর্ধের যাবে সরকারি কোষাগারে আর অর্ধেক গ্রামবাসিরা পাবে। গাছগুলোর কারণে রাস্তাটা আরও অন্ধকার হয়ে আছে। ভরা চাঁদ আকাশে ভেসে বেরালেও নিচে ঘুটঘুটে আঁধার। টর্চটা ময়নার হাতে দিয়ে দিয়েছে নিশা। একটু আগের অপমানটা বারবার মনে আসছে। সামান্যতেই গলা ফেনিয়ে আসে ওর এখনো। ময়নার হাত ধরে আনমনা হয়ে যায়।

ওরা অর্জুন গাছগুলোর নিচে যেতেই গাছগুলো ভয়াবহভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। মনে হলো কোনো দৈববলে গাছগুলো ধরে নাড়া দেওয়া হয়েছে। কোনো বাতাস নেই, মানুষ নেই কিছু নেই, এমন হলো কেন? নিশা পাথর হয়ে গেল। ময়নাও ‘আল্লাহ গো’ ‘মা গো’ বলে কাঁদতে লাগল। ঠিক পেছনে ছিলো সাহেব, গালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল ‘এই শুয়োরের বাচ্চা! এইভাবে ভয় দেখানির মতো চেংড়া আছিস তুই এখনো?’

বলতে না বলতেই দুটো ছেলে ধুপ ধুপ করে লাফ দিয়ে গাছ থেকে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে আর হুউউ, আয়ায়া করে আওয়াজ করতে করতে বলে উঠল ‘শহরের মানুষ নাকি ভীতু হয়, সেইটা পরীক্ষা করলাম। একটু আগে আমাদের বিরক্ত করছিলা – শোধবোধ!’ হিহিহি করতে করতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ওরা। বাশার সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘আদদামড়া বেটা, ছোটো ছেলেদের মতো লাফাস। বান্দরের বাচ্চা। দাঁড়া তোর বাপেরে কচ্ছি। কী হাল হয় তোরা দেখিস।’

‘বাপে মেম্বার বলে শফিইক্যার এত বাইড় বাড়ছে। শয়তান একটা!’ সাহেব উষ্মা প্রকাশ করে।

‘বাপের জন্য না। ওর মায় এমন আল্লাদ দেয়, এইজন্যই পোলাডা এমন আখাস্তা হইছে।’ বলতে বলতে ময়না জড়িয়ে নেয় ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া নিশাকে।

আগুনের দিন ৩।

শহরে থাকেন শুনলেই গ্রামের মানুষেরা খুব কেউকেটা কেউ মনে করে ফেলে। আদতে মইনুল ইসলাম খুব সাধারণ, একেবারেই ছাপোষা মানুষ। প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক। স্কুলের নামমাত্র বেতন আর কয়েকব্যাচ ছাত্র পড়িয়ে শহরের এক প্রান্তে, এক চিলতে জমি কিনে চার কামরার ঘর উঠিয়েছেন। তাও ছাদ দিতে পারেন নি, টিনের চারচালা। সেটুকু ওঠাতেও ধারদেনা হয়ে আছে – ইট,সিমেন্টের দোকানে। প্রতি মাসেই কিছু কিছু করে শোধ দেন। আবার তিনছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারের আর দশটা প্রয়োজন মেটাতে সবসময়ই ধারদেনার উপর থাকতে হয়। এইমাসে ধার করে পরের মাসে বেতন পেয়েই শোধ দেন। আবার মাসশেষের টানাটানিতে, মাসের শেষ সপ্তাহে কারো কাছে হাত পাততে হয়। স্ত্রী রেজিনা খুব হিসেব করে সংসার সামাল দেন, একটা পাইপয়সা অতিরিক্ত খরচ করেন না; উলটে বাপের বাড়ি থেকে এটা ওটা এনে গ্যাটিস দিতে থাকেন। মইন সাহেব জানেন ভালো করেই, তবু খরচ বেশি হচ্ছে বলে পরোক্ষ চাপ তৈরি করেন আর নিজের মনে স্বান্তনা খোঁজেন। রেজিনা মাঝেমঝেই ফোঁস করে ওঠেন, তবুই হাজারটা সামাজিকতা, লৌকিকতা মেনে সংসারের নৌকা টালমাটাল হতে দেন না। বাচ্চাদের নিয়েও মইন সাহেবের কোনো অভিযোগ নেই। মেয়েগুলো ভারী মিষ্টি স্বভাবের, শান্ত, চাহিদা কম। ছেলের আকাংক্ষায় সংসার বড় করেছেন, অথচ ছেলেটাই উড়নচণ্ডী, কিন্তু ছেলেরা তো একটু এরকমই হয়। দুটো বকাবাজি করেই মইন সাহেব কর্তব্য শেষ করেন। বড়মেয়েটা বাবা অন্তপ্রাণ। বাবার ভালো খাওয়া, ভালো থাকার দিকে চিলের মতো নজর থাকে। মইন সাহেব একবিন্দু টেনশন বেশি করলে মেয়েটা চোখ দেখেই বলে দিতে পারে। তখন বাবার মাথা মালিশ করে চিন্তাগুলো সব বাতাসে মিলিয়ে দেয় সে। কয়েকদিন হলো মেয়েটা দাদাবাড়ি গেছে। বাড়িতে ঢুকেই মেয়েটার মুখ দেখতে না পেলে মইন সাহেব অস্থির থাকেন। কিন্তু কিছু বলতেও পারেন না। রেজিনা মেয়েকে গ্রামে পাঠানোর ঘোর বিরোধী। মা ছাড়া উঠতি বয়সের মেয়েদেরকে একা রাখা একেবারেই পছন্দ না তার কিন্তু মেয়েরও ইচ্ছে ছিলো আর শাশুড়িও নাতনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ করেছিল।

বাড়িতে ঢুকেই মইন সাহেব দুবার ডাক দিলেন ‘নিশা? ও মা নিশা?’

ছোটোমেয়ে ঊষা দৌঁড়ে এলো। ‘আব্বু শুধু বুবুরেই ডাকো?’

অভিমানী মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করেন মইন সাহেব। তার দুটো মেয়েই তার মতো গায়ের রঙ পেয়েছে। নাক মুখও বাবার মতোই। কী হতো রেজিনার মতো উজ্জ্বল রঙ হলে? দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। এই মুখগুলো তার কাছে দিনশেষে শান্তির উৎস অথচ বিয়ে দেবেন কীভাবে সেই ভাবনাতেই রাতের ঘুম কমে এসেছে।

‘তোমার বুবুরে না দেখলে শান্তি পাই না গো মা! তুমি আর তোমার বুবু এই দুইজনই তো আমার দুই চোখের দুইটা মণি?’

‘আর ছোটোভাই?’ জিজ্ঞাসু হয় ঊষা। যদিও সে উত্তরটা জানে। একমাত্র পুত্রকে মুখে মুখে গালিগালাজ করলেও সে যে বাবা-মায়ের কলিজা সেটা দুইবোনই ভালো জানে।

‘সে তো তোমার আম্মু আর তোমাদের দুই বোনের মাথার মুকুট। ধাড়ি ছেলে, এখনো মুখে তুলে খাবার খাওয়ানো লাগে। এই তোমার মায়ের জন্যই ও উচ্ছ্বনে যাচ্ছে। কোনোদিন কিছু করে খাওয়া লাগবে না। বাপের হোটেলে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করবে শুধু।’

ঊষা এইচ এস সি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভাইয়ের উচ্ছনে যাওয়ার জন্য অতি আদরই যে একমাত্র কারণ তা সে ভালমতোই বোঝে আর এই অতি আদর দিয়ে তাকে অকর্মণ্য করে রাখার পেছনে মা-বাবা দুজনেরই যে সমান অংশীদারিত্ব তাও বেশ জানে। তাই ও কিছু বলল না। সংসারের বিষয় ও একটু বেশিই ভালো বোঝে। অকারণ কথাও বলে না। বড়বোন নিশার মতো অতিআবেগীও না।
‘তোমার মা কই, মাগো?’

‘আম্মু মুড়ি ভাজছে। মেজাজ অনেক হাই দেখলাম। তুমি কি কিছু করেছ, আব্বু?’

‘না, মাগো! আমি তো আসলামই এখন। আর মেজাজের কী? উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। যেমন তোমার নানি ছিলো, তেমনি তোমার আম্মু। মেজাজ একখান। খানদানী। সবসময়ই চুলার পিঠের মতো গনগনে।’

মইন সাহেবের এভাবে রেজিনার মা তুলে কথা বলাটা ঊষার পছন্দ না একেবারেই। কিন্তু কথা বাড়াতে ওর ভালো লাগে না। আর রেজিনাই যখন প্রতিবাদ করে না, তখন উপযাচক হয়ে কিছু বলতেও ওর বাধে।

পেঁয়াজ, মরিচ আর প্রচুর রসুন দিয়ে তেলেভাজা মুচমুচে মুড়ি আর লেবু দেওয়া রংচা – সন্ধ্যায় রেজিনার আয়োজন। অল্প খরচে খাবার সুস্বাদু করতে তার জুড়ি নেই। মইন সাহেব একমুঠো মুড়ি দাঁতের তলায় চালান করে দিয়েই তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। রেজিনা সেই আরামে সিঁদ কাটলেন। ‘শুনছ?’

‘হুম!’

‘আসিয়ার জাল আসছিল।’

‘আচ্ছা!’

‘নিশার জন্য একটা প্রস্তাব এনেছে।’

‘কার জন্য?’

‘কার আবার? নিশা।’

‘আমাদের নিশা?’

‘আর কে?’

‘তুমি বলোনাই, মেয়ে পড়াশুনা করছে?’

‘বলেছি। একেবারে না করেই দিয়েছি। কিন্তু.. ‘

‘এর মধ্যে আবার কিন্তু কোথায়?’

‘ভালো বংশীয় পরিবার। ঢাকায় ভালো চাকরি করে। বাড়িও আছে ঢাকায়। বয়সও বেশি না। দেখতেও সুন্দর… ‘

‘ছবিও দেখে নিয়েছ?’

‘না। শুনছি শুধু। আমি একেবারেই না করে দিয়েছি কিন্তু ভাবছি মেয়ে বিয়ে তো একদিন দিতেই হবে। বছর কয় আগে হলে সমস্যা কী?’

‘সমস্যা নিয়ে তোমার ভাবা লাগবে না। অশিক্ষিত মহিলা, শিক্ষাদীক্ষার গুরুত্ব তুমি কী বোঝো? পারো খালি দুনিয়ার তেল দিয়ে তরকারি রানতে। আর আমার মা বোনরে নিয়ে কুটনামি করতে। যা পারো সেইটাই করো? আমার মেয়েদের বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবনাচিন্তা করা লাগবে না।’

‘নিজে কী পারো যে আমার পারার হিসাবের খাতা খুলে বইছো। দুইটা ভাত দেওয়া ছাড়া আর কী দেও? ঈদে চান্দে পরনের কাপড়ের জন্যও তো ভাইগো কাছে হাত বিছায়া রাখি। লজ্জা নাই, পুরুষমানুষ? আবার বড় কথা!’

‘কী বললি হারামজাদি?’

‘খবরদার বাপ মা তুলে গালি দিবা না!’

রেজিনার বলতে দেরি হয়, মইনুল ইসলাম মেলে রাখা কাঠের বাটলাগানো ছাতাটা তুলে, রেজিনাকে আচ্ছামতো দুঘা লাগাতে ভুল হয় না!


মইনুল ইসলামের চার কামরার বাড়িতে একটা ঘর স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘর। বিছানা ছাড়াও আলমারি, শোকেস, লেপ,কাঁথা, শীতের কাপড় রাখার ট্র‍্যাংক, আলনা এই ঘরের শোভাবর্ধক। দুই মেয়ের জন্য একটা ঘরই বরাদ্দ, ছেলে মাহিন ক্লাস সেভেনে পড়ে – তার পড়ার সুবিধার্তে আলাদা একটা ঘরের মালিকানা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর একটা ঘর আলাদা করে বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বেশ কেতাদুরস্ত ফিটফাট সেটা। দেয়ালে দেতালে সূচিকর্ম করে ওয়ালমেট, রুমালে সাজানো সোফাসেট, টেবিলে রঙচঙে টেবিলক্লথ, ফুলদানিতে প্লাস্টিকের ফুল – মেয়েদের সখে সাজে ঘরটা। বাইরের ঘরে মা-বাবার লংকাকান্ড দেখে মাহিন দৌঁড়ে আসে ঊষার কাছে ‘ছোটোবুবু, আব্বু মারছে আম্মুকে। তুমি যাও আটকাও।’

‘কেন? আগে কোনোদিন দেখিসনি?’

‘যাও না ছোটোবুবু? বুবু থাকলে তো ঠিকই আটকাতো?’

‘তোর বুবু মাথায় এক বালতি আবেগ নিয়ে ঘোরে। সেই বালতি সবসময় টাপেটুপে ভরা থাকে। মাথা বেয়ে বেয়ে অতিরিক্ত আবেগ চুইয়ে চুইয়ে পড়ে!’

‘তুমি যাও না?’

‘এদিকে শোন। চুপ করে বসে থাক। এইযে আম্মু মার খাবে। কাঁদবে কিছুক্ষণ। রাতে খাবে না। তারপর অসুস্থ হওয়ার নাটক করবে। তখন আব্বু ভয় পাবে। না, আম্মুর অসুস্থতার ভয় না। লোকে কী বলবে, সেই ভয়। তাকে তো মানুষ ভদ্রলোক বলে জানে, সে যে নির্মমভাবে বউ পেটায় সেটা তো মানুষ জানে না। সেটা যদি জেনে যায়, সেই ভয় পাবে আব্বু। আর তারপর গিয়ে আম্মুকে তেলাবে। আদর করে খাওয়াবে। ব্যাস, আমাদের আম্মু গলে জল! কিছু মানুষ আছে যারা কেঁদেকেঁদে জিততে চায়। আম্মু হচ্ছে সেই দলের। তার উপর যে অন্যায় হচ্ছে সেই বোধই তার নেই। সে সকালে সুখি সুখি মুখ নিয়ে, আঁচলে বাড়ির চাবি ঝুলিয়ে, সামনের বাড়ির রুম্পার মায়ের কাছে যাবে – পরের বছর টিন ফেলে ছাদ দেওয়ার গল্প জুড়তে, নইলে কোরবানির আগে কেমন ফ্রিজ কিনবে সেই পরামর্শ করতে। আম্মুর জন্য আমার কোনো সহানুভূতি নেই।’

‘তো আব্বুকে কিছু বল?’

‘কেন? তাদেরকে আমি বিয়ে দিয়েছিলাম? একসাথে থাকতে বলেছিলাম?’

‘এইজন্য আব্বু আম্মুর ঝগড়া হবে আর তুই কিছু করবি না?’

‘না। এটা যদি নতুন নতুন হতো বা হঠাৎ করে একদিন ঘটত তবে কিছু করতাম। একসময় আমি আর বুবু অনেক কান্নাকাটি করতাম, ভয় পেতাম। আব্বুকে আটকাতাম। আম্মুর মাথায় তেল দিয়ে দিতাম। বুবু এখনো করে। কিন্তু আমার উপর এসবের কোনো প্রভাব পড়ে না। এসব আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আব্বুরও অভ্যাস আম্মুকে মার দেওয়া, আম্মুরও অভ্যাস মার খাওয়া। তুইও অভ্যাস করে নে। মনে কর কিছু হচ্ছে না, কিছু শুনছিস না।’

‘তুই অনেক স্বার্থপর, ছোটোবুবু! বুবু এরকম না।’

‘একটু স্বার্থপর না হলে দুনিয়ায় টেকা মুশকিল রে। আর তোর বুবুর কপালেও এরকম পড়ে পড়ে মার খাওয়া লেখা আছে। আগাবেও না, পথও ছাড়বে না। একজায়গায় খুঁটি গেঁড়ে মার খাবে।’

‘এহ, তুইতো একেবারে জ্যোতিষী হয়ে গেছিস?’

‘যা তো যা! আমাকে বিরক্ত করিস না। পড়ালেখার নামগন্ধ নাই, সারাদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছিস, এই বয়সেই- আবার ঘরের সমস্যা দেখতে আইছে! যা, যা!’

চলবে…

আফসানা আশা
(কত বানান ভুল করতাম রে বাবা)

আগুনের দিন পর্ব-০১

0

আগুনের দিন ১।

দুটো বড় বড় পান, একটা কাঁচাসুপারীর পুরো অর্ধেকটা, তিন আঙ্গুলের মাথায় সুরভী জর্দা মুখে পুরে, ডান হাতের তর্জনীতে বেশ খানিকটা চুন টেনে নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বাতাসী বেগম বলল ‘আপা, শোনো, ছেলেপক্ষ কিন্তু কিছু চায় না। আসবে, বিয়ে হবে, মেয়ে নিয়ে চলে যাবে। বুঝছ?

‘সে ঠিক আছে। কিন্তু… ‘ ইতস্তত করে রেজিনা। মেয়ের বাবা মেয়েকে এখনই বিয়ে দিতে রাজি না, যদিও স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাথায়ই জোড়ামেয়ে পার করা নিয়ে আকাশসমান দুঃশ্চিন্তা।

‘কিন্তু কিন্তু কিছু না, কাবিন করে মেয়ে রেখেও যাবে না, নিয়ে যাবে একবারেই।’ ঘাড় কাত করে আরেকটু জোর দিয়েই বলে বাতাসী।

‘আরে শোনো না, আমার কথাটা…’

‘তুমিও শোনো, আসবেও ধরো এই চার পাঁচজন। হঠাৎ করে আয়োজন করতে যে ঝামেলা হয়, সেইটা তারা বুঝে। যেমন বুঝদার ছেলে তেমনি বুঝনেওয়ালা ফ্যামিলি। কোনো ঝামেলা তারা করবে না, কোনো চাহিদাও নাই। মেয়েরে যা দেওয়ার তারাই দিয়ে মেয়ে নিয়ে যাবে।’

‘আরে আপা, শোনো না?’ রেজিনা থামাতে চেষ্টা করে বাতাসীকে।

‘আপা, ওরা আগামী পরশুদিনই আসতে চায়। দেখাদেখি হলো, কাজি ডাকা থাকল, কথাবার্তাও হতে থাকল, আসবে, বসবে – চারহাত মিলায় দেবো।’

‘এতো তাড়াহুড়া কেন?’

‘আরেহ, মজার কথা। আমি শুনে তো হাসতে হাসতেই শেষ!’

‘কী ব্যাপার?’

‘আরেহ, ছেলের বন্ধুরা সব যাবে কক্সবাজার। বেড়াতে। আনন্দ করবে। সবাই যাবে বউসহ। এখন এই ছেলের প্রেস্টিজে লাগতেছে। তাই একটু তাড়াতাড়ি করতে চায়।’

রেজিনা অবাক হলো। বিয়ে সারাজীবনের সিদ্ধান্ত। লক্ষ কথা খরচ না করে নাকি বিয়ে হতে নেই। কত আয়োজন, কত দেখাদেখি, কত চেনাশোনা করে তারপর না বিয়ে? বিয়ে কি শুধু আচার-অনুষ্ঠান যে কম করলেও চলে? দুটি মানুষ একসাথে থাকতে পারবে, দুজনের সব দোষ গুণ ভালো মন্দ মেনে নিতে পারবে এটা বোঝার পরই বিয়ে পর্যন্ত যাওয়া উচিত। এখানে তাড়াহুড়ো করে নেওয়া একটা ভুল মারাত্মক হতে পারে। সেখানে এমন একটা ফালতু কারণএ বিয়ে করাটা খুবই অগ্রহণযোগ্য মনে হলো রেজিনার কাছে। কিন্তু ঘটকও নাছোড়বান্দা। সম্ভবত ছেলেপক্ষে বেশ ভালোমতো নাজরানা দেওয়ার লোভ দেখিয়েছে। রেজিনার রাগ হলো, কিন্তু মেয়ের জন্য আসা প্রথম বিয়ের প্রস্তাব, একেবারে না করে দিতেও সংস্কারে আটকাচ্ছে। আবার কালো মেয়েকে পার করার চিন্তাও আছে। কিন্তু এখানে মন টানছে না। আরেকটা পান বানিয়ে পানের খিলিটা বাতাসীর দিয়ে বললেন ‘কিন্তু আপা, আমার মেয়েটা তো ছোটো এখনো।’

‘আরে ছোটো আর কই এতো? আয়ে পাশ দিয়ে দিয়েছে। অনাসসে পড়ে না? এই বয়সে আমার, তোমার বিয়ে হয়নি? আমার তো দুটো বাচ্চাও হয়ে গিয়েছিল।’

‘ওর বাবা বিয়ে দেবে না এখন। তার ইচ্ছে মেয়েকে আরও পড়াশোনা করাবে।’ এবারে শক্ত করেই বলল রেজিনা।

‘বাদ দেও তো? পুরুষ মানুষের সংসারের বুদ্ধি আছে? আমরা মেয়েরা সংসার ধরে না রাখলে কবে সব ভাসিয়ে দিতো? হুহ, মেয়ে বিয়ে দেবে না! ভালো করে বুঝিয়ে বলবা।’

‘না আপা। শোনো তুমি, এখন আমি মেয়ে বিয়ে দেবো না।’

‘সেটাই বলো? তুমিই রাজি না। যেমন ঘর বাড়ি আর যেমন বংশ দেখে মাথা ঘুরে যাবে। তখন আর রাজি না হয়ে পারবা না।’

‘না আপা। মেয়েটা আরেকটু বড় হোক।’

‘আর বড়? বলো বুড়ি হলে নিজে নাগর ধরবে, সেই আশায় আছো?
ঢঙ!’

মূহুর্তে মহিলার পরিবর্তন দেখে চমকে গেল রেজিনা। একে তো রেজিনা ডেকেও আনেনি। মেয়ে বিয়ে দেবে এমন কথাও কাউকে বলেনি। এই মহিলা নিজে সেধে বাড়ি বয়ে এসে অপমান করছে। রেজিনার ননদের জা হয় সম্পর্কে তাই এতোক্ষণ তোয়াজ করেছে সে।
বাতাসী আবার বলতে থাকল ‘ওই তো মেয়ের গায়ের রঙ, পাতিলের তলা! তার উপর নাক মুখের ওই তো ছাঁদ আর ছিরি। বয়স কম, বিয়ে দেবে না! হুহ। বয়স কম বলেই তো প্রস্তাব নিয়ে আসছি। ওই বয়সের চটক ছাড়া আর আছে কী? ওই তো খাপরাখান, বুড়ি হলে আর চলবে?’

বিব্রত, লজ্জিত আর ক্রুদ্ধ রেজিনার খুব ইচ্ছে করল চটাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দেয় বাতাসীর গাল বরাবর! কিন্তু নিজেকে সামলাল। এভাবে রাগ করে কিছু বলে ফেললে, ননদ এসে রেজিনার উপরেই ঝাল ঝাড়বে।

নিজে হাজারবার মেয়েকে কালো বলে নিন্দামন্দ করলেও অন্যের মুখে শুনতে খারাপই লাগল।

২.

‘ওইযে সোনাবানের সখি, ওই সোন্দর মেয়েটা, ওইটা কিন্তু মেয়ে না, বুঝছ? ওইটা ছেলে। আমাগো গ্রামের মেম্বারের পোলা। আলগা চুল লাগাইছে মাথায়। মেয়ে সাইজা ওবিনয় করে। বুঝছ?’

ময়নার কথায় নিশা মাথা নাড়ল। ও বুঝেছে। ক্রস-জেন্ডার একটিং ওর কাছে নতুন কিছু না। প্রাচিন গ্রীসে, অধুনা ভারত, জাপান, চায়না, ইউরোপ সবজায়গাতেই নারীদের নাটকে আসাটা সমাজের অপছন্দ ছিলো। বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিলো। তাই পুরুষেরা মেয়েলি জামা পরে আর নকল চুল মাথায় জুড়ে, নারীসুলভ বাচনভঙ্গি দিয়ে নারীচরিত্র করে যেতো সাবলীলভাবে। যদিও প্রতিষ্ঠা মেলার উদাহরণ কম কিন্তু কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতো। শিল্পের প্রতি অনুরাগী মানুষের, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লোভও কাজ করে কম।

অতিরিক্ত ঢঙ করে, অকারণ মাথা বাঁকিয়ে, মুখেচোখে অতিরিক্ত অভিব্যাক্তি প্রকাশ করা পুরুষালি চওড়া কাঁধের, লম্বা ছেলেটাকে বরং নারী বলে ভ্রম হয় না কোনোভাবেই।
ছোটো আর অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বলে অতটা চোখেও লাগে না, হালকা কমিক রিলিফ সুবিধা দেয়। নিশা যাত্রায় মন দিলো। লোকজ একদা অতি জনপ্রিয় যাত্রা উঠে গেছে এখন সবখান থেকেই। আগে পালা পার্বণে গ্রামে গ্রামে যাত্রা, পালাগান হতো – বাবার মুখে গল্প শুনেছে নিশা। ওর এক কাকা যাত্রা করতেন। অভিনেতা হিসেবে নামডাক ছিলো। ক্ষুধায় কাতর এক অনাহারীর ডায়লগ ‘আমি এখন গাছের পাতা খাই, গাছের পাতা খাই’; এই অংশে সামনে থাকা দর্শক তো বটেই গাছের পাতারাই নাকি কেঁদে দিতো।

নিশারা থাকে শহরে। গ্রামে দাদার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। এসে যাত্রার নাম শুনে কাজিনদের সাথে দেখতে এসেছে। পাবনা থেকে যাত্রার দল ভাড়া করে এনেছে এলাকার চেয়ারম্যান, মেয়ের বিয়ের জাঁকালো আয়োজনে আরেকটু জাঁকান্দানি করতে। যাত্রা একেবারে খারাপ লাগছে না নিশার কাছে। টিভিতে দেখতে যতটা হাস্যকর লাগত তেমন না একেবারেই। বেশ ভালোই লাগচজে ওর। জরির ফিতে দিয়ে ঝলমলে সাজপোশাক, নাগরাজুতো পরা অভিনেতা, তাদের হাহাহা করে অট্টহাসি, রাংতা জড়ানো ঢাল- তলোয়ারের যুদ্ধ, আর একদম পেছনে বসা দর্শকের কানে সংলাপ পৌঁছে দিতে অস্বাভাবিক জোরে ডায়লগ ডেলিভারি – গ্রামের সতেজ হাওয়ার মতোই শতভাগ নির্মল বিনোদন।

যাত্রার জন্য আদর্শ সময় হচ্ছে শীতকাল। ফাল্গুনের শেষবেলায় চৈত্রের গরম পড়তে শুরু করেছে, প্যান্ডেল কাপড়ে মুড়ে রাখায় সেই গরম তীব্র হয়েছে। তবুও টিভি, স্যাটেলাইটের এই যুগে নতুন এই বিনোদনে কারোরই উৎসাহের কমতি নেই। রাত বাড়ছে, তলোয়ারের ঝনঝনানির সাথে সাথে উত্তেজনাও বাড়ছে। ছোটোদের উৎসাহ ছিলো সবচেয়ে বেশি, তারা কেউ কেউ নিচে বিছানো মাদুরে ঢলে পড়েছে।

৪.
‘আমি তোমাকে এমনই জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখব, তোমাকে কেউ খুঁজেই পাবে না!’

‘নাহ। আপনার এই কুপ্রস্তাব আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। আপনার সাথে আমি কিছুতেই যাব না। আপনি চলে যান এখান থেকে, চলে যান বলছি…’

‘যাব, যাব, যাবই পেয়ারি? তবে একা নয়, তোমাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যাব। হুহুহাহা!’

‘নাহ, নাহ, নাহ, আমি যাবোহ না!’ সিপাহসালার দবির খাঁর একমাত্র পুত্র নাসির খাঁ ঝাঁপিয়ে পড়েছে পেয়ারিরূপি সোনাভানের উপর। নাসির খাঁ চিৎকার করছে ‘স্বেচ্ছায় না গেলে জোর করে নিয়ে যাব সুন্দরী!’

‘নাহ, নাহ নাহ, কেউ বাঁচাও, বাঁচাও আমাকে?’

লাল নীল আলোগুলো নিভে গেছে, বাজনাগুলোও ক্লাইম্যাক্সে, সবাই অপেক্ষা করছে ডাকাত সর্দারের আগমণের ; অত্যন্ত উত্তেজনাকর এই দৃশ্যের ভিতর কে যেনো নিশার কাঁধ ধরে নাড়া দিলো। মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা। ও ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটার চেহারা দেখতে পারল না, স্টেজ থেকে পড়া আলোর কারণে। ‘তোমার সামনে চ্যাগায়ে আছে মনিরের বাচ্চা, ওর প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকায়ে দেখো, সিগারেটের প্যাকেট আর গ্যাসলাইট আছে। বের করে দাও তো!’

নায়কের প্রবেশ ঘটেছে মঞ্চে, নাসির খাঁর হাত থেকে সোনাভানকে বাঁচাতে – সবগুলো আলো জ্বলে উঠল, স্পষ্ট হলো মঞ্চ, সেই আলোতে ছেলেটার মুখও দেখল নিশা।
একটু আগে নায়িকের বান্ধবির পার্টে অভিনয় করেছে এই ছেলেটাই। মুখে ধুয়েছে। কিন্তু কাজল আর লিপিস্টিক এখনো ওকে ছেড়ে যায়নি।
কি নির্বিকার ছেলেটার কন্ঠ। যেনো নিশা আগেও বহুবার ওর সিগারেট এনে দেওয়ার কাজ করেছে!

চলবে…
আফসানা আশা

অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩১(সমাপ্তির প্রথমাংশ)

তাবাসসুম আফরাজ কে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাগ হাতড়ে সিরিঞ্জ-টা বের করে। চোখে তীব্র নেশা নিয়ে ধীরপায়ে সামনে আগায়। আফরাজ ফোনে হেড-স্যার এর নাম্বারে কল দিচ্ছে। কিন্তু তিনি কল ধরছে না দেখে বারংবার কল দিয়ে যাচ্ছে। তাবাসসুম তার পেছনে এসে ঘাড়ের কাছে সিরিঞ্জ-টা লাগাতে গিয়েও পারল না। তৎক্ষণাৎ গাড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়ে। কেননা হেড-স্যার চলে আসেন। তিনি এসে আফরাজ এর সাথে ‘হাই-হ্যালো’ বলে ভেতরে নিয়ে যায়। তাবাসসুম চোখের নেশা নিয়ন্ত্রণ করে সিরিঞ্জ-টা ব্যাগে রেখে দেয়। কিন্তু নিজের সাথে হওয়া অপমানের শোধ তুলতে নতুন ফন্দি আঁটে। শিক্ষক-মণ্ডলীর কাছে নতুন নিয়ম জারি করে। নিয়ম বাস্তবায়নের জন্য সে বাসায় থাকাকালীন কৌশলে নাজীবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার লেকচার খাতা চুরি করে খাতার কিছু পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে ছিল। যা নাজীবার অজানা। ক্লাসে নাজীবা মনযোগ সহকারে ফিজিক্স ক্লাস করছে। তখনি ফিজিক্স স্যার পূর্বের লেকচার কপি চেক করতে চাইলেন। নাজীবার দিকে এগিয়ে এসে তার খাতা দেখার আক্ষেপ করেন।

“মিসেস নাজীবা আপনার ফিজিক্স লেকচারের কপি কোথায়?”

স্যারের কথা শুনে হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী নিয়ে ব্যাগ খুলে খাতা বের করলে দেখতে পেল তার খাতার কিছু অংশ ছেঁড়া। ভয় পেল নাজীবা। পুনরায় খাতা উল্টে পাল্টে চোখ বুলাল। নিজের মাথায় জোড় দিয়ে ভেবেও কুল পেল না। স্যার কিছু বলার পূর্বেই ক্লাসরুমে প্রবেশ করলেন মিস তাবাসসুম। অন্য ম্যাম কে দেখে ছাত্র-ছাত্রীগণ কিছুটা উদগ্রীব হয়ে পড়ল। তাবাসসুম মনেমন বেশ খুশি। আজকে অহেতুক রুলস সে ফলেছে টিচার্সের উপর। তাবাসসুম কলিগদের সঙ্গে অন্তমর্মী স্বরূপ আচরণ করে বলে তারা তাকে সম্মান দেয়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) সেই প্রেক্ষিতে তাবাসসুম নোটিশ পড়ে শোনাতে নাজীবার ক্লাসরুমে এসেছে। নাজীবাও স্থীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। গলা ঝেড়ে তাবাসসুম বলে,

“আজকের নতুন নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সবাইকে স্যার/ ম্যাডামের দেওয়া লেকচারার কপি কালেক্ট করে রাখতে হবে। নাহলে তার উপস্থিতির নামে ক্রস মার্ক করা হবে। এতে স্টুডেন্ট’স এর ১০পাসেন্ট করে মার্কিং করার আদেশ জারি করা হয়েছে। সেই সাথে শাস্তি আবশ্যক। তাই সকল টিচার্স কে অনুরোধ করা হচ্ছে আজ থেকে এ প্রসেস চালু করতে। ধন্যবাদ।”

কথা শেষ করে তাবাসসুম ক্লাসে উপস্থিত তার কলিগের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এখন স্যার আশা করি আপনি আপনার কাজ পরিপূর্ণ ভাবে পালন করবেন। মতের বিরোধ যাবেন না। যে লেকচার কপি দেখাতে পারবে না তাকে অত্যন্ত দশমিনিট কানে হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”

কথাটুকু বলে তাবাসসুম বাঁকা হেসে নাজীবার দিকে একপলক চেয়ে চলে যায়। নাজীবার খারাপ লাগছে সে উপস্থিত থেকেও তার নামের পাশে ক্রস মার্কিং দেওয়া হয়েছে। স্যার অসহায় দৃষ্টিতে নাজীবার দিকে চাইলেন। তিনিও আদেশের বিরোধ যেতে পারবেন না। নাজীবা কে না চাইতেও শাস্তির দাবি মান্য করতে হলো। কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এতে স্যার লজ্জিত বোধ করলেও কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু নাজীবা-র সঙ্গ দেয় কয়েকজন ছেলেমেয়ে। যা দেখে নাজীবা হাসল। কেননা যারা দাঁড়িয়েছে তারা নাজীবা-কে হাসির পাত্রী হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। জানালার বাহির থেকে এ দৃশ্য দেখে রে’গে জ্বলে যাচ্ছে তাবাসসুম। মাটিতে পা’রা মে’রে সেখান থেকে সরে যায়।
অন্যথায়, হেড-স্যার এর সামনে কপালে হাত রেখে বসে আছে আফরাজ। হেড-স্যার ঘামছেন। তিনি ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলেন,

“আসলে আফরাজ বাবা প্রিন্সিপাল স্যার আমার অনুপস্থিতিতে এসে ছিলেন। কিন্তু আমি আসার পর পর চলে যান। আমি তো এসবের কিছুই জানি না।”

“আপনি আমার বাবার বয়সী তাই বয়সের দিকে তাকিয়ে আপনার সঙ্গে বেদম প্রহার করছি না। বরং সতর্ক করছি পরবর্তীতে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোনো প্রকার অশ্লীল কর্ম হয়ে থাকে। তবে আপনার এই ভার্সিটি ভার্সিটি হিসেবে থাকবে কিন্তু আপনি আর হেড-স্যার থাকবেন না। আপনার কুকীর্তি ফাঁস করে দেওয়া আমরা একসেকেন্ড এর ব্যাপার। সো বি কেয়ারফুল স্যার।”

আফরাজ দাঁড়িয়ে যায়। তাকে দেখে হেড-স্যার ও দাঁড়িয়ে বাহির পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। হঠাৎ তার মুখোমুখি হলো তাবাসসুম। স্বেচ্ছায় হাত ধরতে গেলে আফরাজ দূরে সরে গেল। হাত গুটিয়ে নিল তাবাসসুম। তবুও দ্বিরুক্তিময় গলায় বলে,

“তোমার প্রথম বউ তো ক্লাসে তাই দ্বিতীয় বউয়ের সাথে আলাপ করতে সমস্যা থাকার কথা নয়। একটুও মন চাই না তোমার প্রথম ভালবাসার…”

তাবাসসুম কে মাঝপথে থামিয়ে আফরাজ নিজেই বলতে লাগল।

“না প্রথম , না দ্বিতীয় আমার ভালোবাসার একমাত্র রমণী হলো আমার বিবিজান। তুমি ছিলে সাময়িক সময়ের মোহজাত প্রডাক্ট। যার মূল্য ছিল মুখের কথায়,যার মূল্য ছিল ভোগের বস্তুতে এবং যার শরীর নিজেই হেয়তায় বিক্রি করেছে। তোমার আর আমার বিবিজান এর মাঝে বিস্তর ফারাক। এই ফারাকের সীমানা কখনো তুমি পেরিয়ে যেতে পারবে না।
সে আমার #অন্যরকম_হৃদয়ের_আঙিনায়_ঘুমন্ত_পরী।
এখনো বলছি সময় আছে শোধরে নাও নিজেকে। নাহলে তুমি আর তোমার মায়ের চেহারা লোকানোর স্থান খোঁজে পাবে না। এই আফরাজ ফাহিম তার কথায় অনড়।”

কথাটুকু বলে আকস্মিক তাবাসসুম এর মুখের কাছে এলো আফরাজ। হিংস্র চাহনি নিয়ে বলে,’দোয়া করো চেয়ারম্যানের যে অবস্থা হয়েছিল সে অবস্থা যেনো তোমাদের সাথে না হোক। বাঁচতে চাইলে রাস্তা অনেক খোলা,মরণ চাইলে সোজা নরকের রাস্তা দেখাবো।’
পকেটে হাত গুঁজে শিস বাজাতে বাজাতে গাড়ির কাছে চলে গেলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তাবাসসুম স্তদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ক্ষোভের চেয়েও বেশি তার মনেপ্রাণে হিংসার স্তর পর্যায় বেড়ে চলেছে। যতবার সে আফরাজ এর নিকটে যেতে চেয়েছে ততবার আফরাজ তার অতীতের কথা টেনে নাজীবার সঙ্গে তুলনা করেছে। তার চোখ-মুখে শোধরানোর কোনো ভাবান্তর নেই। বরং সে এবার প্রাণ নিয়েই ছাড়বে। বিরবিরিয়ে আফরাজ এর দিকে চেয়ে বলে,

“হয়ত তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে মেনে নেবে নাহয় তোমার নাজীবার এমন অবস্থা করব যাতে সে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে দেয়।”

ব্যাগ থেকে ফোন বের করে এক মেয়ে কে ডাক দেয়। পুষ্প নামের এক মেয়ে এসে হাজির হলো ক্যান্টিনে। তার আগমনের সহিতে তাবাসসুমও হাজির হলো। সে পুষ্পর হাতে দশ লাখ টাকা দিয়ে বলে,

“তোমাকে নাজীবার পিছু নিতে হবে। ক্লাস শেষে আমি চাই তুমি এক বাচ্চাকে ডেকে তাকে পুকুরপাড়ের দিকে নিয়ে যাবে। তারপর সুযোগ বুঝে তাকে পুকুরপাড়ে ধাক্কা মে’রে পালিয়ে যাবে। আমি কন্ট্রোলার রুমে গিয়ে ক্যামেরার ফুটেজ অফ করে দেবো। কোনো অসুবিধা হবে না। পুকুরের পানি খুব গভীর। আমি চাইছি আজ আমি যেমন অপদস্থ হয়েছি তেমনি নাজীবাও অপমানিত লাঞ্ছিত হোক। তার শরীরের দিকে যেনো শকুনের নজর পড়ুক। বুঝতে পেরেছো কি বলেছি? আর শোনো মুখে ঘোমটা দিয়ে বেশ-ভূষা পরিবর্তন করে যাবা। যেনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। সবচেয়ে বড় কথা তোমাকে রিসোর্টেও যেতে হবে। তার প্ল্যানিং আমি রাতে কলে বুঝিয়ে দেবো। ঐ কাজের পর বাকি দশ-লাখ টাকা পে করব।”

পুষ্প বাঁকা হেসে মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারা সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে কথা বলেছে বলে কেউ তাদের চিনতে পারল না। পুষ্প নাজীবার ক্লাস রুমের পাশে থাকা চেয়ারে বসে ফোন ঘাঁটছে। ভাব এমন যেনো সে এ ভার্সিটির স্টুডেন্ট। নাজীবা বের হতেই আফরাজ কে গাড়ির ভেতর বসারত দেখতে পাই। মুচকি হেসে এগোতে নিলে কেউ তার বোরকার হাতা ধরে টান দেয়। থেমে যায় নাজীবার কদম। চোখের দৃষ্টি সেই মালিকের দিকে নিলে দেখল এক বাচ্চা তাকে ইঙ্গিতে পুকুর পাড়ের দিকে যেতে ইশারা করছে। ব্যাপারটায় কেমন যেন মনে হলো তার। সেও ইশারায় না বোধক মাথা নেড়ে চলে যেতে গেলে বাচ্চাটা কেঁদে দেয়। এতে সে অস্থির হয়ে ‘ঠিক আছে যাচ্ছি যাচ্ছি’ বলে উল্টো দিকে পা ফেলে পুকুরপাড়ের দিকে পা বাড়ায়। আফরাজ সময় দেখে চোখ ফিরিয়ে দেখল নাজীবা গাড়ির কাছে না এসে অন্য খানে যাচ্ছে‌। চিন্তিত হলো। তৎক্ষণাৎ গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে নাজীবার পিছু নিতে চাইলে কিছু মেয়েরা হৈচৈ করে তার সামনে এসে পড়ে‌। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) বিরক্ত হলেও শান্ত মনে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তার চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ নাজীবার দিকে‌। কিন্তু মেয়েটাও কেমন একটুও পিছু ফিরছে না! মেয়েদের সামলে উঠতে না উঠতে ছাত্রদল কিছু শলাপরামর্শ করতে চলে এলো। আফরাজ পড়ল যেনো মাইঙ্কার চিপায়। কোনো প্রকার গার্ডস আনেনি। এখন লোকগণের সমাহার শেষ হচ্ছে না।

নাজীবাকে পুকুরপাড়ে রেখে বাচ্চাটি কোথায় যেনো পালালো। সে উঁকিঝুঁকি মে’রে দেখার চেষ্টা করে। তবে কাউকেও চোখে পড়েনি তার। না পারতে ফিরে যেতে মুখ ঘোরানোর পূর্বেই তার পিঠে জোরালো ধাক্কা লাগে। পা পিছলে পানির উপর আঁচড়ে পড়ে। পানির গভীরতা অনেক। সে তার শরীরের ভর উপরে রাখার চেষ্টা করে চিল্লিয়ে ‘বাঁচাও প্লিজ’ বলে উঠে। আফরাজ ছাত্রদলের নানান কথার জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত। তার উপর মেয়েদের গ্যাঞ্জাম। ক্যাচাল সহ্য হলো না তার। হঠাৎ ফোনে কল আসায় আফরাজ তাদেরকে হাতের ইশারায় থামতে বলে ফোন রিসিভ করে। অপরপাশ থেকে নাদিম উত্তেজিত গলায় বলে,

“আফরাজ নাজীবা কোথায়? আমি এসে থেকে দেখছি নাজীবা ভার্সিটির ভেতরে নেই।”

বজ্রপাতের ন্যায় শোনালো কথাটা। তৎক্ষণাৎ গা’র্ন বের করে আকাশের দিকে শু’ট করে। শব্দের সমাগম থেমে যায়।ছাত্রদল পেরিয়ে নাজীবার যাওয়ার পথে দৌড় লাগায়। ছাত্রদল বিষয়টা ঘেঁটে দেখতে আগায়। আফরাজ ছুটে এসে দেখে নাজীবা ডুবচ্ছে। ‘নাজীবাআআআ’ চিৎকার করে ডেকে উঠে আফরাজ। পরণের শার্ট খোলে ঠান্ডা পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেয়। নাজীবার মুখটা পানির ভেতর ডুবে যায়। আফরাজ সাঁতরে নাজীবার কাছে গিয়ে কোলে নেয়। খেয়াল করে দেখল চোখ বন্ধ, জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে মেয়েটা। পুকুরের ধারে গিয়ে ফেলে যাওয়া শার্টটা বিবিজান এর শরীরে জড়িয়ে জোরে জোরে বুকের উপরে চাপ প্রয়োগ করে। প্রচন্ড চাপের ফলে জোরালো তেজে নাজীবা কাশতে লাগে। মুখের থেকে লাগাতার পানি বের হতে থাকে। যা দেখে আফরাজ আলতো হাতে বিবিজান কে জড়িয়ে ধরে স্থীরভাবে মাটির উপরে বসে থাকে। নাজীবা শরীর ঠান্ডায় তড়তড় করে কাঁপছে। আফরাজ বিবিজান কে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসায়। গাড়ির হিটার অন করে দেয়। যার হাওয়ায় মোটামুটি স্বস্তি পায় নাজীবা। আফরাজ বাহিরে ভার্সিটির লোকগণের দিকে গম্ভীর নজরে তাকিয়ে বসে পড়ল। বাক্যহীন গাড়ি চালু করতেই আফরাজ বাসার রাস্তার দিকে গাড়ি ঘোরায়।
তাবাসসুম বেশ খুশি হলো‌। নাজীবার পানিতে জুবু-থুবু শরীরের ছবি তুলেছে সে। এই ছবিই সে খদ্দরের কাছে পাঠিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতাবে। খদ্দর চাইলেই লোক লাগিয়ে নাজীবা-কে হাতড়ে খদ্দরের কাছে পাঠাবে। কেননা তার ইচ্ছে করছে না এত সহজে নাজীবা-কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে! সে শোধ তুলবে। এত মাস যাবত হয়ে আসা অপমানের শোধ গুণে গুণে নিতে চাই সে।

____
ঘণ্টাখানেক পর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো নাজীবা-র। তার পাশে জলপট্টি এনে বসে আফরাজ। বাসার কাউকে ব্যাপারটা জানাল না। হিতে চিন্তায় পড়বে বলে! আকবর এর মাঝে এসে ওষুধপত্র দিয়ে চলে গিয়েছে। নাজীবা-র শরীরের তাপমাত্রা মেপে আস্তেধীরে জলপট্টি দিতে লাগে। রাফি লাগাতার কল-ম্যাসেজ করে যাচ্ছে। এতে আফরাজ অসহায় ভঙ্গিতে ফোনের দিকে একপলকে তাকিয়ে পুনরায় বিবিজান কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যথায়, রাফি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আকবর স্যারের রুমে প্রবেশ করবে কি করবে না সেটা ভেবে ভীতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের দরজায় কাঁপা হাতে নক করল। আকবর সবেই কুসুমাকে ওষুধ সেবনের জন্য ওষুধ হাতে নিয়ে ছিল। কেউ আসায় কুসুমা উঠতে চাইলে আকবর বারণ করে দিল। সে নিজ দায়িত্বে গিয়ে দরজা খুলল। বাহিরে রাফিকে ঘাবড়ানো নজরে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। রাফির নজর আকবর স্যারের হাতের উপর পড়ে। হাতে সেই ওষুধ দেখে তৎক্ষণাৎ ঢোক গিলে বলে,’স্যার আপনার হাতের ওষুধটা ভুল। এটা তাবাসসুম এর মা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আসলটা আমি কিনে এনেছি। হিয়া চুন্নী ম্যামের আসল ওষুধ ফেলে দিয়েছে।’
কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আকবর। হাতে থাকা ওষুধ উল্টেপাল্টে দেখে পকেটে ফুরে নেয়। ফামের্সীতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখবে কিসের ওষুধ ঐ ডাইনি মহিলা রেখেছিল? মনেমন কথা ভেবে রাফির হাত থেকে ওষুধ নিয়ে তার পিঠ চাপড়ে সাবাসী দিয়ে যেতে বলল। তৃপ্ত শ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করে কুসুমার কাছে আসে। সে প্রশ্ন করতে চাইলে আকবর তাকে চুপ করিয়ে ওষুধ খাওয়ে দেয়। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ঘুমাতে বলে আকবর। স্বামীর আদেশে মুখ ফুলিয়ে কুসুমাও চোখ বুজে নেয়।

নাজীবা-কে হালকা পাতলা বিস্কুট খাওয়ে ওষুধ সেবন করালো আফরাজ। বালিশে শুয়ে দিয়ে জলপট্টি দিল পুনরায়। প-ট্টি পানিতে ভিজিয়ে নাজীবার কপালে মেলে দেয়। পরণের শার্ট পরিবর্তন করে ফোন হাতে নেয়। রাফির নাম্বারে কল লাগায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)সে কল রিসিভ করে পুরো ঘটনা খুলে বলল। এমনকি তার বাবা-মায়ের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নতুন কিনে আগের স্থানে রেখেছে বলে জানায় রাফি। শুনে কপাল বুড়ো আঙুল বুলিয়ে রাফিকে বলে,

“নাদিম ভাইকে বল রিসোর্টে আজ রাতেই যাবো। দেখি এই মেয়ে আর মেয়ের মা দু’জনে কত কান্ড ঘটাতে পারে? নাজীবার সঙ্গে হওয়া ঘটনাটা কোনো দুর্ঘটনা নয় বরং কারো জাল মনে হচ্ছে আমার। এই জালের মূলে যে, তাবাসসুম তা আমি হলফ করে বলতে পারি। দেখি তোকে যা বলছি কাজে লেগে পড়। অন্যান্য মেইডদের সাথে কানাঘুষা করে এই কথা ছড়িয়ে দেয় আমি আর নাজীবা রাতেই রিসোর্টে যাবো। ঠিক মাগরিবের পরপর।”
“ওকে স্যার আপনার কথামত কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।”

আফরাজ কল রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো। তখন নাজীবার শুকনো কাঁশির শব্দে এগিয়ে গিয়ে রুমাল দিয়ে নাক মুছে দেয়। পানি খাওয়ে পুনরায় বালিশে মাথা হেলিয়ে দেয় নাজীবার। জ্বরে কাবু হয়ে আছে মেয়েটা। তড়তড় করে কাঁপা বিবিজান এর ছোট শরীরে উষ্ণতার ছোঁয়া দিতে আফরাজ কম্বলের ভেতর ঢুকে বিবিজান-কে আঁকড়ে ধরে। উষ্ণ পুরুষেলী শরীরের লোমশ বুকে নাজীবা-র শরীরও কেঁপে উঠে। জ্বরের ঘোরেও স্বামীকে পরম আনন্দে উষ্ণতা অনুভব করার লোভে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আফরাজ তার বিবিজান এর কান্ডে মৃদু হাসল। চোখের উপর চলে আসা ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেয়। কপালে গভীর চুম্বন দিয়ে কম্বলটা ভালো করে মোড়ে নেয়। যেনো তার উষ্ণতা শুধু তার বিবিজান অনুভব করে যায়।

চলবে……
(কালকে ইন শা আল্লাহ শেষ পর্ব দেওয়া হবে।)

অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব-৩০ + বোনাস পর্ব

0

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩০ (সারপ্রাইজ)

নাজীবার প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট দেখে স্তদ্ধ হয়ে গেল আফরাজ। নাজীবা দুই কোর্স সাবজেক্টে ফেইল করেছে। কিন্তু তা কেমনে সম্ভব? তার বিবিজান প্রতিনিয়ত এক্সামের জন্য যে খাটুনি খেটেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। হঠাৎ কল আসায় ধ্যান ভাঙ্গল তার। ফোনের স্ক্রিনে হেড-স্যার এর কল দেখে। নিজেকে ধাতস্থ করে কলটি রিসিভ করল। অপরপাশ থেকে হেড-স্যার গম্ভীরতার সুরে বলেন,

“আফরাজ বাবা এসব কি নাজীবা মামুনি পড়াশোনা ঠিকভাবে করছে না কেনো? তার দু’দুটো কোর্সে ফেইল করার কারণে তাকে আবারো প্রথম সেমিস্টারের মধ্যে এডমিশন নিতে হবে। আপনি হাজবেন্ড আমি ভেবেছিলাম আপনি পুরোপুরি তাকে দায়িত্বে রাখবেন। কিন্তু…..।”

“আপনার হলে স্যার আমিও যদি কিছু বলতাম? মে আই?”

হেড-স্যার ভড়কে গেলেন। ঢোক গিলে ‘জ্বি জ্বি বলুন’ বলে তিনি তার সিটে বসে গেলেন। আফরাজ গাড়ির দরজা খুলে এক পা বাহিরে রাখল। বাসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগল।

“আপনি এত কথা শুনাচ্ছেন ‌যেনো আপনি কথাগুলো মুখস্থ করে রেখেছেন। ফোন দিয়ে বলার জন্য তড়ফড় করছিলেন। আমি বলি কি শুনেন? আমার বিশ্বাসের মর্যাদা যারা দেবে না, তাদের নূন্যতম পরিমাণ ছাড় আমি দেয় না। এখন সে যেই হোক না কেনো!”

হেড-স্যার কে আর কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দেয় আফরাজ। বাসার ভেতরে ঢুকে সকলের নীরবতা দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারল। আকবর কুসুমা কে রুমে খাওয়ে দিয়ে বিশ্রাম করতে বলে বেরিয়ে এলো। জনাব ইসমাইল এর চেহারার মধ্যেও মলিনতা দেখা যাচ্ছে। আফরাজ ঠোঁট কামড়ে গলা ঝাড়ল। জনাব ইসমাইল আর মিসেস ফেরদৌসীর নজর ছেলের দিকে গিয়ে পড়ে। দু’জনেই নাজীবার খোঁজ রুমের দিকে ইশারা করে বোঝালেন। আফরাজ মাথা নেড়ে রুমের দিকে এগালো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)দরজা খুলতে নিলে খেয়াল করল দরজা ভেতর হতেই বন্ধ। বিধেয় নম্র আদুরীয় গলায় ‘বিবিজান’ বলে ডাক দিল। পুনরায় ডাক দেওয়ার পূর্বেই দরজা খুলে দেয় নাজীবা। হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী দেখালেও তার মুখে কান্নার রেশ ফুটে আছে। বোধ হয় স্বামীর আগমন বুঝতে পেরে ব্যর্থ কান্না থামানোর প্রচেষ্টা করছিল। আফরাজ নিজ দায়িত্বে দরজাটা আটকে দেয়। বিবিজান কে কোলে নিয়ে বিছানার উপর বসালো। গালে হাত রেখে আদুরীয় গলায় আওড়ায়।

“বিবিজান কেনো কাঁদছে? এই সামান্য ফেইলের কারণে কাঁদতে নেই বুঝলে?”

“আপনি বলছেন আমি না কাঁদতাম? কেনো কাঁদবো না বলুন? আপনি জানেন আমি যা লিখেছি কারেক্ট লিখেছি। কোনো ধরনের ভুল হওয়ার চান্স ছিল না। হ্যা পুরোপুরি সিজিপি ফোর না দিলেও অত্যন্ত থ্রি পয়েন্ট নাইনের মধ্যে তো অবশ্যই আমার থাকার কথা। বুঝছি না কেমনে আমার ফেইল আসলো। বিশ্বাস করুন আমি সত্যি ভালো করে লিখেছি।”

বিবিজান বিলাপের সুরে বকতে বকতে আফরাজ এর বুকে ঘুমিয়ে পড়ল। হয়ত লাগাতার কান্না করেছে। ফলাফল যে পরীক্ষারই হোক না কেনো, খারাপ ফলাফল আসলে শোকাহত হবেই। আফরাজ বিবিজান-এর মাথা বালিশের উপর রেখে ফ্রেশ হতে গেলো। তার মনে হাজারো প্রশ্নের ঘুরপাক খাচ্ছে। সে নিজ চোখে দেখেছে নাজীবা পুরো একটা মাস মন দিয়ে পড়াশোনা করেছে। তন্মধ্যে তাবাসসুম কেও চোখে চোখে রেখেছিল। কারণ তার মনে আতংক ছিল যদি তাবাসসুম নাজীবার কোনো ক্ষতি করে দেয়! সে নির্ভয়ে কাজ করার জন্য বাসার মধ্যে গার্ডস বাড়িয়ে ফেলেছিল। তাবাসসুম কি করে না করে তার জন্য রাফিকে লাগিয়ে রেখে ছিল। তবে? মনের ভাবনায় ইতি টেনে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলের কাছে গেল। সবার মলিন মুখ দেখতে পেলেও তাবাসসুম আর তার মায়ের স্বাভাবিক আচরণ দেখে কিছু একটা ভাবল। চেয়ার টেনে বসে বলে,

“আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনো ষড়যন্ত্র নিশ্চয় আছে।”

ভাতের লোকমা চিবিয়ে খেতে গিয়েও পারল না তাবাসসুম। ভর্য়াত নজরে একপলক নিজের মায়ের দিকে তাকালো। তিনি চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলেন। একেবারে শান্ থাকতে ইঙ্গিত দিলেন। যা কারো নজরে না পড়লেও কুসুমা চোখে পড়েছে। সে স্বামীর প্লেটে খাবার দিয়ে তার হাতা চেপে কাছে আসতে ইশারা দিল। আকবর কান কাছে নিলে সে বলে,

“এই কালনাগিনী কিছু করলো না তো আবার?”

“আমার তো একেবারে ও এরে পছন্দ না। এই হয়ত সব ফ্যাসাদের মূল।”

আফরাজ নিশ্চুপে প্লেটে খাবার বাড়তে নিলে, তাবাসসুম নাজীবার অনুপস্থিতির সুযোগ নিল। গলা ঝেড়ে চামচ হাতে নিয়ে বলে,

“আফরাজ আমাকে দাও প্লেটটা। আমি বেড়ে দেয়।”

চামচটি আর ধরল না আফরাজ। মৃদু হেসে বলে,

“খাবারটা আমার বিবিজান এর জন্য।”

“ওহ ঐ ফেল্টুস মেয়ের জন্য দরদ দেখি শেষ হয় না তোমার।”

“আমি বিশ্বাস করি আমার বিবিজান হারতে শিখেনি,তার কদমে কাটা থাকলেও সে কাটা উপ্রে ফেলার দায়িত্ব আমার, তবুও আমার বিবিজান সর্ব ঊর্ধ্বে অন্যরকম হৃদয়াঙ্গণী। যার সাথে অন্য নারীর তুলনা হয় না। সে আমারি বিবিজান।”

খাবার বাড়া শেষে রুমের দিকে চলে গেলো সে। সকলের চোখ-মুখে হাসি প্রাধান্য পেলেও তাবাসসুম আর তার মায়ের চেহারায় ক্ষোভ স্পষ্ট। হাত ধুয়ে তৎক্ষণাৎ বাহিরে বেরিয়ে যায়। হিয়া দেয়ান থামাতে চেয়েও পারলেন না। তিনিও ক্লান্ত প্রায়। তার আর ছুটাছুটি করার মত শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে চাইছে মৃত্যু।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)ফাহিম পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু আর তার আর তার মেয়ের রাজত্ব ধারণ। মিসেস ফেরদৌসী তাবাসসুম এর অনৈতিকতা দেখে মুখ বাঁকালেন। হিয়া দেয়ান এর দিকে তাকিয়ে বলেন,

“কেমন মেয়ে আপনার? যে আপনার কথা অব্দি শুনতে চাইলো না। উল্টো মুখ ঝামটা মে’রে চলে গেলো।”

“আপনারা যেমন আচরণ আমার মেয়ের সাথে করছেন তার এটুকু ক্ষোভ প্রকাশ করাটাও কম।”

“হাহ্ আমার দোয়া আমার সন্তানের সঙ্গে আছে। আল্লাহ নিশ্চয় ভালো কোনো ফলাফল রেখেছেন।”

___
রাতের নয়টা বাজছে,

নাজীবার ম্লান মুখশ্রী মোটেও সহ্য হচ্ছে না আফরাজ এর। সে বুদ্ধি করে একটা ওয়াইনের বোতল তার হাতে দিল। ওয়াইনের বোতল দেখে চমকে ‘আসতাগফিরুল্লাহ ছিঃ ছিঃ’ করে বোতলটা ছুঁড়ে মা’রল। আফরাজ হা করে তাকিয়ে রইল। ভাঙ্গা কাঁচের বোতল টির দিকে চেয়ে বিবিজান এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,

“বিবিজান তোমার প্লানমাফিক ওয়াইন এনে ছিলাম। তাও চারহাজার টাকা দিয়ে। এত সহজে নেশাধায়ক ওয়াইন কেউ দিতে চাই না। সেলারের পকেট গরম করে আনলাম একনিমিষে ছু’ড়মা’র করে দিলে। তোমার তো বলার হওয়া উচিৎ একবার মা’রার পরপরই বলিং হয়ে যেতো।”

নাজীবা মুখ ফুলিয়ে বলে,

“তাহলে আনলেন কেনো আমি কী আনতে বলে ছিলাম? যতসব অভদ্রতামি।”

আফরাজ তপ্তশ্বআস ফেলে ওয়াইন ভর্তি একটি গ্লাস নাজীবার হাতে দিল। সে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ‘কি এটা?’
আফরাজ হাতের ইশারায় ওয়াইন বোঝাল। নাজীবা পুনরায় চিৎকার করে ফেলতে নিলে এবার আফরাজ ধরে ফেলল। বিবিজান এর হাত চেপে ধরে বলে,

“আরে বিবিজান তালাকনামা রেডি তোমার থেকে তাবাসসুম কে ওয়াইন খাওয়ে জ্ঞানশূন্য করে হাতের টিপসই নিতে হবে। তারপর এটা জমা দিয়ে দিলেই তাবাসসুম এর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।”

নাজীবা পুরো কথা বুঝতে পেরে ওয়াইনের গ্লাসটা ঠিক করে রাখল। রাতের খাবার পরিবেশন করা হলে নাজীবা স্বাভাবিক আচরণ করে। তাবাসসুম মনেমন ক্ষিপ্ত। কেননা মেয়েটার কান্নাকাটি করে ঘর উজার করা উচিৎ ছিল। আর সেখানে মেয়েটার স্বাভাবিক রুপ যেনো তার হজম হচ্ছে না। হিতে আর পাত্তা না দিয়ে তাবাসসুম খাবার বাড়তে গেলে তার ফোনে কল চলে আসে। চেয়ারম্যান মোস্তাক এর কল দেখে চোখ বড় হয়ে গেল তার। ঢোক গিলে পাশে বসারত মা’কেও ফোনে কল আসা ব্যক্তির নাম দেখালো। তিনি দেখে ঘাবড়ে গেলেন। ফোনটা কেড়ে নিয়ে সকলের সামনে ভান ধরে বলেন,

“মা’রে আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। আমার জন্য তুই একটু খাবারটা বেড়ে রুমে নিয়ে আয়।”

কথার ইতি টেনে তিনি তৎক্ষণাৎ বসা থেকে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে ছুটে গেলেন। আফরাজ সন্দেহাতীত নজরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সে পাশে বসা ম্লান মুখশ্রী নিয়ে বিবিজান কে খেতে দেখে তার মুখে এক লোকমা ভাত এগিয়ে দেয়। স্বামীর আদুরীয় যত্নতায় মুচকি হেসে নাজীবা খেতে লাগল। মিসেস ফেরদৌসী স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরে নিম্ন গলায় আওড়ান।

“দোয়া করছি যাতে আমাদের ছেলে-বউমাদের মাঝে আর কোনো দূরত্ব না হোক।”

“চিন্তে করো না আফরাজ সামলে নেবে।”

অন্যথায় হিয়া দেয়ান ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে চেয়ারম্যান কর্কশ গলায় গা’লি ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘মা** তুইও বিশ্বাসঘাতকতা করলি। তোর কারণে আমার রেপুটেশন ডুবে গেলো। তাইত বলি তুই দিনে কেন আমার কাছে এসেছিলি। এই তোর আমার সুখ দেওয়ার পথ? শুনে রাখ তোকেও ধ্বংস করে দেবো আমি। তুই আর তোর মা জেলের ভাত খাবি সারাজীবন মরে রাখিস।’
কথার সমাপ্তি টেনে চেয়ারম্যান ফোন কেটে দিল। তার পালানোর রাস্তা নেই বললেই চলে। তার স্ত্রী সন্তান সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন না কেমনে তার কীর্তিকলাপ ফাঁস হলো। কিন্তু তার ধারণা এসবের পেছনে নিশ্চিন্তে তাবাসসুম এর হাত রয়েছে। কেননা শারীরিক সম্পর্কের জোড় বেশিরভাগ ঘটেছিল তাবাসসুম এর সঙ্গেই। আজ দিনেও সে এসে আফরাজ এর নামে ক্ষোভ প্রকাশ করে শারীরিক ভাবে মিলিত হয়েছে। তাহলে তখনি বোধহয় সে ফুটেজ বানিয়ে ছেড়েছে। চেয়ারম্যান তড়িঘড়ি গাড়িতে যেয়ে বসে পড়েন। তার গাড়ির ইঞ্জিন চালু করার পূর্বেই পুলিশের গাড়ি তাকে আটক করে নেয়। প্রেস রিপোর্টার এসে ভীড় জমালো। তাদের রিপোর্টিং এ একটা কথায় বারংবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ‘ভিডিও ফুটেজ গুলো সত্য কিনা?’ চেয়ারম্যান এর স্ত্রী সন্তানদের কথা চিন্তা করে হ্যা বলে দেন। কেননা তিনি চান না স্বামীর কুপথে তার সন্তানরাও পা দিক। বিধেয় হ্যা বলে তিনি সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন। চেয়ারম্যান ছুটাছুটির চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেউ তাকে ছেড়ে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে উম্মাদনায় পুলিশের পকেট থেকে গু’লি নিয়ে সবার দিকে ট্যাগ করে বলেন,

“কেউ কাছে আসবি না। যেতে দেহ্ আমাকে। নাহলে…..।”

এক পুলিশ পা বাড়াতে নেওয়ায় চেয়ারম্যান গু’লি ছাড়ল। বাকি পুলিশরাও ক্ষেপে গেল। তারা পরপর গু’লিবিদ্ধ করে চেয়ারম্যান এর এনকাউন্টার করে দিল। খবরের মধ্যে এতক্ষণ যাবত হওয়া ঘটনার দৃশ্য কিংবদন্তি হয়ে দেখছিল ফাহিম পরিবারের সদস্যগণ। তাবাসসুম স্তদ্ধ। হিয়া দেয়ান এর হাতে থাকা ফোন স্পিকারে ছিল। সে শুনতে পেয়ে থমকে আছে। তৎক্ষণাৎ রুমের বাহিরে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগে। কিন্তু খবরের দুরন্ত টেলিকাস্ট ভিডিও দেখে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার মত অবস্থা তার। আফরাজ টিভি অফ করে হাতের আঙ্গুল টিপে ফোন হাতে নিয়ে রাফিকে কল দিল। রাফি কল রিসিভ করতেই আফরাজ ‘থ্যাংকস তোর পেমেন্ট পেয়ে যাবি।’ বলল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
রাফি খুশি হলো তার স্যারের খুশিতে সেও আপ্লুত। নাজীবার হাতে ফোন ছিল। তার ফোনে তাদের ডিপার্টমেন্টের এডভাইজার এর পক্ষ থেকে কল আসছে। আফরাজ চোখের ইশারায় কল রিসিভ করতে আশ্বস্ত করল। সে কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে মিসেস সেলিনা খুশির চোটে বলেন,

“নাজীবা তুমি ফাস্ট গ্রেটেড হয়েছো। তুমি কোনো সাবজেক্টে ফেইল করোনি। বরং ঐ দুই কোর্স টিচার্স এর কাছে তোমার খাতা চেঞ্জ হয়ে গিয়ে ছিল। তারা পুনরায় তোমার খাতা পেয়ে চেক করেছে। তুমি দুটো কোর্সেই এইটি ফাইভ মার্কস পেয়েছো। কংগ্রাচুলেশন মিসেস ফাহিম। তুমি সামনে নিউ সেমিস্টারের জন্য অভিজ্ঞ তা আমি নিঃস্বার্থে বলতে পারি।”

নাজীবার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটল। কান্না চেপে ‘থ্যাংকিউ ম্যাম’ বলল। কল রেখে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল সে ফাস্ট গ্রেট পেয়েছে। জনাব ইসমাইল উচ্চ আওয়াজে ‘মাশাআল্লাহ’বললেন। মিসেস ফেরদৌসী ও মুচকি হেসে ‘আলহামদুল্লিল্লাহ্’বলে মিষ্টিমুখ করলেন। আফরাজ আড়চোখে তাবাসসুম এর দিকে তাকাল। তাবাসসুম এপাশ ওপাশ তাকিয়ে রুমে চলে গেলো। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আফরাজ বলে,

“যার হৃদয়ে তুমি ছেদ করতে চেয়েছো, সেই হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার আঙ্গিনার রাণী আমার বিবিজান। তার প্রতি সদয় হলে তুমি রেহাই পেতে, কিন্তু তুমি নির্দয়তার পরিচয় দিলে। শাস্তি তোমার প্রাপ্য। কালকের সকালের অপেক্ষা করো। এই ঘরের থেকে জেলের ঘরে পাঠানোর রাস্তা তুমি নিজ হাতে তৈরি করেছো।”

নাজীবার হাসিমাখা মুখের দিকে চেয়ে আফরাজ ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল। সবার ঘুমানোর সময় নাজীবা এক ফাঁকে জেগে উঠে। চোরের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে রান্নাঘরে দৌড় দিল। রান্নাঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে নিলে আফরাজ এসে ধরে ফেলল। নাজীবা দেখে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে স্বামীর গালে চুমু এঁকে দেয়। রান্নাঘরের দরজার পেছনে দু’জনে দাঁড়িয়ে যায়। আফরাজ বিরক্তিকর গলায় বলে,

“সারাক্ষণ এসবের ফাজলামিই তোমার মাথায় ঘুরপাক খাই? ভালো কোনো বুদ্ধি নেই তোমার? তোমার জ্বালায় না ঘুমও চোখে আসে না। এই আফরাজ ফাহিম যে কিনা নামকরা ব্যবসায়ী। তার থেকে তার বিবিজান এর জন্য রাতবিরাতে চোরের বেশে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে।”

নাজীবা তার কোমর থেকে স্বামীর হাত সরিয়ে বলে,

“উফফ আপনি এসবের মজা কি বুঝবেন? জীবনে কখনো চুরি করে ছিলেন? আমি আর নাদিম ভাই করে ছিলাম। জানেন ঐসময় ভুঁড়িওয়ালা প্রতিবেশী সবসময় তার বাসায় আমের গাছ লাগাতো। আমি আর ভাইয়া মিলে আম চুরি করে এনে সেই মজা করে খেতাম।”

আফরাজ কপাল চাপড়ে বলে,’ইয়া আল্লাহ তুমি তো দেখি চুরুনিও। আর কি কি করছিলে জীবনে?”

নাজীবা তার কথার ঝুড়ি খুলতে নিলে আফরাজ তার মুখ চেপে হুঁশ চুপ করতে বলে। কেননা কারো পায়ের শব্দ কানে ভেসে আসায় তারাও এলার্ট হয়ে যায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)দেখতে পেল হিয়া দেয়ান রান্নাঘরে ঢুকে চুলার মধ্যে পাতিল রেখে দুধের পেকেট খুলে দুধ গরম করতে দিলেন। তিনি চুলার আঁচ কমিয়ে একপলক মেয়েকে দেখতে রুমের দিকে যান। মেয়ে তার ঘুমোয়নি। চিন্তাচেতনায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। নাজীবা সেই সুযোগে ঘুমের ওষুধ দুধের উপর ঢেলে দেয়। আফরাজ তড়িঘড়ি বিবিজান কে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। হিয়া দেয়ান চৌপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন সব স্বাভাবিক আছে। ফলে তিনি মেয়ে আর তার জন্য গ্লাসে দুধ ঢেলে নিয়ে যান। রাতের তিনটার সময় চলছে, আফরাজ চোখ পিটপিট করে বিবিজান-কে দেখছে। বিবিজান তার ফোনে গেইম খেলছে। চোখ বন্ধ করার নাম নিচ্ছে না। আজ তার প্ল্যান সাকসেসফুল করবেই সেই পণ করে রেখেছে। গালে হাত দিয়ে বিবিজান-কে দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ল আফরাজ। নাজীবা ফোন রেখে স্বামীর কপালে ওষ্ঠজোড়া ছুঁয়ে দিলো। আস্তেধীরে তালাকনামা হাতে নিয়ে তাবাসসুমের রুমে গেল। তাদের বাসার সব দরজার ডুবলিকেট চাবি আছে। তাই সে নির্দ্বিধায় ভেতরে প্রবেশ করল। তাবাসসুম এর নাইটি পরা রুপ দেখে ঘৃণায় চোখ বুজে নিল নাজীবা। সে আন্দাজ করে ছিল মেয়েটা এমনি। তাইত স্বামীর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল। সে চাই না তার স্বামী তাকে ছাড়া অন্য কারো শরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করুক। নির্ভয়ে ঘুমন্ত তাবাসসুম এর টিপসই নিয়ে পুনরায় নিজ রুমে চলে এলো। দরজাও লক করে এসেছে। যেনো তারা টের না পায়। তালাকনামায় আফরাজ এর সাইন তো ছিলই এখন তাবাসসুম এর সাইনের জায়গায় টিপসই দেখে তার বুকে প্রশান্তির ঝড় বইল। বালিশের নিচে পেপার্স রেখে নিশ্চিন্তে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

চলবে…….

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#বোনাস_পর্ব

আফরাজ এর রুমের দরজা খোলা দেখে তাবাসসুম উঁকি দিল। আফরাজ ঘুমিয়ে আছে। আশপাশে নাজীবা-কে দেখা যাচ্ছে না। সুবর্ণ সুযোগ হাতে পেল তাবাসসুম। চটজলদি ভেতরে প্রবেশ করতে নিলে কারো পায়ের শব্দে তাবাসসুম এগালো না। উত্তেজনাধায়ক সিরিঞ্জটা শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে দরজা থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে গেল সে। শোপিচের পেছনে নিজেকে আড়াল করে নেয় তাবাসসুম। নাজীবা গুনগুন করে দরজার সামনে এসে থেমে যায়। ঘুমন্ত আফরাজ কে একপলক দেখে দরজাটা লক করে চাবিটা শাড়ির আঁচলে বেঁধে নেয়। পুনরায় গুনগুন করে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। আজ আফরাজ-দের অফিস নেই। উইন্টার হলিডে হিসেবে অফ দেওয়া হয়েছে তাদের। নাজীবার ভার্সিটি আছে কিন্তু ক্লাস শুধু একটা। যেটা জরুরি তার জন্য। সময় এগারোটা। এখনো নয়টার সময় চলছে। নাজীবার যাওয়া দেখে ক্ষোভে নিজের রুমে চলে গেল তাবাসসুম। আফরাজ এর রুমে যাওয়ার পথ স্বয়ং নাজীবা বন্ধ করে দিয়েছে। হিয়া দেয়ান মেয়ে-কে পায়চারী করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন।

“কি হলো? তুই রেগে আছিস কেন?”

“এই নাজীবা-কে মে’রে ফেললেই আমার রাস্তা ক্লিয়ার হবে মম। নাহলে আমি কখনো আফরাজ এর বউয়ের অধিকার পাবো না। আজকে সুযোগ বুঝে আফরাজ কে নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য সিরিঞ্জটা জোগাড় করে ছিলাম‌। ঐ নাজীবার জন্য সব ওয়েস্ট হয়ে গেল।”

হিয়া দেয়ান মেয়ে-কে শান্ত হতে বলেন,

“শোন এখনো তুই তারই বউ। তোর পরিপূর্ণ অধিকার আছে। নাজীবা লক করেছে তুই নিজে গিয়ে চাবি কেড়ে নেহ্। তোর বরের রুম তোর যাওয়ার হক আছে।”

তাবাসসুম মাথা নাড়ল। তৎক্ষণাৎ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। নাজীবার ফোনে কল এলো। আফরাজ কল দিয়েছে দেখে মুখ টিপে হাসল। কল রিসিভ করে রোমান্টিক কণ্ঠে,’ইয়েস হাজবেন্ড’ বলল। শুনে শোয়ারত আফরাজ বুকের উপর হাতের চা’প’ড় দিয়ে বলে,’হায় হায় বিবিজান এভাবে ডেকে উঠো না। বুকের তোলপাড় সৃষ্টি হলে তোমাকেও সর্বনাশ করে দেবো।’
‘হিহি পারবেন না আপনি রুমের ভেতর লকড হয়ে আছেন।’
‘তাইত বিবিজান এর কাছে অসহায়ের মত দরজা খোলার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
‘আপনি আজ সারাদিন রুমের মধ্যে বন্দি অবস্থায় থাকবেন।’
‘বিবিজান এটা কিন্তু ঠিক নয়। আমাকে বেঁধে রেখে নিজে ঘুরে বেড়াবে। তা আমি হতে দেবো না। বেঁধে রাখতে হলে দু’জনে একসঙ্গে বিছানার মধ্যে কম্বলের ভেতর আবদ্ধ হয়ে থাকব। কি বলো হবে নাকি আরেক রাউন্ড?’
ঠোঁট কামড়ে আফরাজ জিজ্ঞেস করল। নাজীবার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। কাজের মহিলাগুলো বড় বউয়ের লাজুক চেহারা লক্ষ করল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তারাও মিটমিটে হাসি ছাড়ল। নাজীবা না পারতে তাদেরকে নাস্তা প্রস্তুত করতে বলে ছুটে রুমের দিকে পালাল। মিসেস ফেরদৌসীর সাথে আকস্মিক ধাক্কা লাগায় ধ্যান ফিরল নাজীবার। তিনি হকচকিয়ে বউ-মাকে বলেন,

“তুমি এভাবে ছুটে যাচ্ছো কেনো মা? কিছু কি হয়েছে?”

“না না আসলে আম্মা রুমের দিকে যাচ্ছি।”

আমতা আমতা করে শ্বাশুড়ির পাশে কেটে রুমের দিকে চলে যায়। তিনিও মৃদু হেসে রান্নাঘরে নাস্তার প্রস্তুতি পর্ব কতদূর পর্যবেক্ষণ করতে গেলেন। আফরাজ গোসল সেরে এসে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে দেখল রাফির কল। সে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ম্যাসেজ পড়ে তার যা বোঝার বুঝে গেল। সন্তপর্ণে ট্রাউজার, শার্ট,কোট পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে রেডি হয়ে গেল। তখনি তার নজর পড়ল নাজীবার বালিশের নিচে থাকা ফাইলের দিকে। ফাইলটি দেখে তড়িঘড়ি গিয়ে হাতে নিল। ফাইল ঘেঁটেঘুটে তাবাসসুম এর সিগনেচার দেখে তৃপ্তির হাসি ছাড়ল আফরাজ। লেপটপের ব্যাগে ভরে রাখল যেনো উকিলের কাছে জমা দিয়ে কোর্টে পাঠানোর হয়। তখনি দরজা খোলার শব্দ হলো। খরগোশের মত নাজীবা ভেতরের দিকে উঁকি দিলো। বিছানা টানটান করা দেখে ভ্রু কুঁচকে ওয়াশরুমের দিকে দৃষ্টিপাত দেয়। কোনো ছায়া অব্দি না দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে রুমের ভেতর পা রাখল নাজীবা। ওমনি তাকে হেঁচকা টানে দরজা বন্ধ করে দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে নেয় আফরাজ। নাজীবা প্রথমে ভয় পেলেও পরক্ষণে রেগে আফরাজ এর বুকে এলোথেরাপি মা’র বসাল। বিবিজান এর বাচ্চার মত পিটুনিতে তার সুঠাম দেহের কোনো ব্যথাও লাগল না। বিধেয় সে ফট করে বিবিজান এর গালে ওষ্ঠের ছোঁয়া লাগিয়ে কোমর সরিয়ে নেয়। নাজীবা ঘোরে যেতে গিয়েও ফুড়ৎ করে ঘোর ভেঙ্গে গেল দেখে মুখ ফুলাল। অভিমানী গলায় বলে,

“আদর করতে না চাইলে বললেই পারতেন। আমি কি স্বেচ্ছায় এসে ছিলাম? হুহ্ অসভ্য জামাই।”

কথাটা বলে মুখ ঝামটা মে’রে বিছানার কাছে গেল। বালিশের নিচে খালি দেখে বুক কেঁপে উঠল তার। কাঁপা কণ্ঠে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল।
‘এখানে পেপার্স রাখছিলাম গত রাতে কই সেগুলো?’

বিবিজান এর হঠাৎ কাঁপা কণ্ঠে চিন্তিত নয়নে তাকে জড়িয়ে ধরে আফরাজ। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘হুশ আমার কাছে আছে। আমি আজ কোর্টে জমা দেওয়ার জন্য উকিলের কাছে যাবো।’
নাজীবা তৃপ্ত শ্বাস ফেলে স্বামীর বুকে মিলিয়ে রইল। তখনি ফোনের শব্দে হলো। আফরাজ এর ফোনে কল এসেছে। নাম আননোন দেখাচ্ছে। ছোট পিটপিটিয়ে চাইল নাজীবা। আফরাজ সেভাবে বিবিজান কে আঁকড়ে রেখে কল’টি রিসিভ করল। নাজীবা ছু মে’রে ফোন হাতে নিয়ে স্পিকারে দিলো।
‘হ্যালো স্যার গুড মর্নিং। স্যার রাফি ভাই বলেছেন আপনাকে আর আকবর স্যার-কে বিশেষ অনুরোধে সভাপতির আসনে নেওয়ায় জনাব নাকিব মুনসিফ স্যার তাদের রিসোর্টে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কালকে। আপনি বললে আমি কি আমন্ত্রণ গ্রহণ করব নাকি বারণ করে দেবো?’
মেয়েলী কণ্ঠে নাজীবা দাঁতে দাঁত চেপে তার শ্যামব্যাডার বুকের লোম শক্ত করে টেনে ছিঁড়ে দিল। ‘আউচচ’ করে উঠল আফরাজ। ফোনের ওপারে থাকা মেয়েটি স্যারের এহেন কণ্ঠে ঢোক গিলে বলে,’ইটস ওকে স্যার আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি আপনি ইনজয় করুন নও প্রবলেম‌।’ ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মে’রে স্বামীর ব্যথাপ্রাপ্ত স্থানে ওষ্ঠজোড়া চেপে ধরল। মৃদু হাসল আফরাজ। বিবিজান এর কানের কাছে ওষ্ঠ এগিয়ে নিয়ে বলে,

“উই উইল গো ইন দ্যা রিসোর্ট টুমোরো। গেট রেডি টু সিলেব্রেট এ পার্টি।”

নাজীবা বাচ্চাদের মত খিলখিলিয়ে উঠে। তৎক্ষণাৎ আলমারি খুলে কোন কাপড় নিবে যাচাই বাছাই করার জন্য লেগে পড়ে। অন্যথায় দরজার বাহিরে আড়াল থেকে নীরবে সবটা শোনছিল তাবাসসুম। সে চাবি নিতে গিয়ে নাজীবা কে রান্নাঘরে না পেয়ে বেডরুমের দিকে চলে এসে ছিল। রুমের দরজা বন্ধ ছিল। কিন্তু সে শব্দহীন খোলে চোখের দৃষ্টি দেয়।দরজা ভিড়িয়ে তার চোখের মধ্যে আফরাজ আর নাজীবার মুহূর্তগুলো ধরা পড়ল। তাবাসসুম পারছে না এই মেয়ে-কে এখনই খু’ন করে ফেলতে। ফলে সে ধারণা করে রাখল খাওয়ার টেবিলে সেও একদিনের জন্য কালকে বাহিরে থাকবে বলে জানিয়ে দেবে। কেউ আসার পূর্বেই সে সরে গেল। মিসেস ফেরদৌসী স্বামীর সঙ্গে গার্ডেনে হাঁটতে বেরিয়েছেন। হিয়া দেয়ান তাদের দিকে একপলক চেয়ে তাদের বেডরুমের দিকে পা বাড়ালেন। দরজা খোলা দেখে অবাক হলেন। পরক্ষণে সিসি-ক্যামেরার কথা মনে পড়তেই তিনি আশপাশে চোখ বুলিয়ে সিসি-ক্যামেরা দেখতে পেলেন। মাথা চুলকানোর ভান ধরে তিনি ডাইনিং রুমের টেবিলের কাছে গেলেন। এক গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে জনাব ইসমাইল এর রুমের পাশ দিয়ে কেটে যান। কিন্তু যাওয়ার পথে তিনি হাত থেকে আচমকা গ্লাসটি ফেলে দিলেন। দেখে মনে হবে তিনি ভুলকৃত ফেলে দিয়েছে।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)কাজের মেইডস এলো। তিনি তদারকি করে মোছার তাগিদ দিলেন। এতে ঠোঁট কামড়ে তিনি রুমের ভেতর ঢুকে মিসেস ফেরদৌসীর আর জনাব ইসমাইল এর গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধের পেকেট পরিবর্তন করে দিলেন। একই পেকেটজাত অন্য ওষুধ রাখলেন। যা খেলে আজীবনের জন্য প্যারালাইজড হয়ে যাবে মানুষ। তিনি চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পদের ভোগ মেটানোর। তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে যান। ক্যামেরা সেটা ক্যাপচর করতে পারল না।
তিনি চালাকি করে কুসুমার প্রেগন্যান্সির জন্য যে ওষুধ খেতে বলেছে ডাক্তারে সেটাও তিনি চেঞ্জ করে দিলেন। নিজের রুমে এসে শ’য়’তানি হেসে বলতে লাগলেন।

“মেয়ে নাহয় বাহিরের দিক সামলিয়ে নিক। আমি ভেতরের দিক পুরো সাফসুতরো করে নেয়। তাতে একবিন্দু প্রমাণ রইবে না।”

_____
নাজীবা-কে ক্লাস করতে পাঠানোর জন্য আফরাজ তৈরি হয়ে গাড়ির কাছে গেল। তাবাসসুম সময় দেখছিল কখন আফরাজ বাহিরে আসে! নাজীবা বোরকায় পিনআপ করছিল। তাবাসসুম গিয়ে অসহায়ের মুখ নিয়ে বলে,

“আমাকে একটু ভার্সিটি ছেড়ে দিলে হেল্পফুল হতো‌।”

আফরাজ শ’য়’তান মেয়েটার চেহারা অব্দি দেখতে চাই না। সেখানে হেল্পের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ল। মনেমন তাবাসসুম দাঁতে দাঁত চাপল। বিরবিরিয়ে বলে,’তুই আমার নাহলে তোর মৃত্যু নিশ্চিত।’
নাজীবা এসে পরনারী কে স্বামীর কাছে দেখে তেঁতে উঠল। গাড়ির কাছে গিয়ে চুপচাপ গাড়ির দরজা খুলে বসতে নিলে তখনি পুনরায় তাবাসসুম এই এক কথা বলে। নাজীবা কিছু একটা ভেবে স্বামীর হাতের হাতা চেপে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) আফরাজ অবাক হলো। তবুও বিবিজান এর ইশারা দেখে মাথা নেড়ে হেঁটে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে পড়ে। তার পাশেই ফট করে বসে পড়ল নাজীবা। তাবাসসুম মুখ ভেটকিয়ে পেছনের সিটে বসে পড়ে। একঘণ্টা পর,
গাড়ি মাঝরাস্তায় এসে থামিয়ে দেয় আফরাজ। নাজীবা নীরব রইল। তাবাসসুম গাড়ি থামার কারণ জিজ্ঞাসা করে। আফরাজ আফসোসের গলায় আওড়ায়।

“সরি টু সে গাড়ির গ্যাস শেষ। অত-দূর এখন যাওয়া পসেবল না।”

নাজীবা মন খারাপের ভান ধরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। আফরাজ ও পিছু পিছু বেরোলো। তাবাসসুম না পারতে থা’বা মে’রে ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে রিক্সা ধরল। তাদের ঢং দেখার সময় তার হাতে নেই । সে রিক্সা করে যেতেই নাজীবা ভাব নিয়ে বলে,

“দেখলে মিয়া-বিবির মাঝের কাটা কিভাবে তুললাম? আমাদের ঢং একেবারে সেরা ঢং।”

পাত্তা-হীন আফরাজ বিবিজান এর হাত টেনে গাড়িতে বসালো। ভার্সিটির কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে দেয়। ভার্সিটির অন্য বিভাগের ছেলে-মেয়েরা ভিআইপি গাড়ির মধ্যে থেকে আফরাজ আর নাজীবা-কে বের হতে দেখে বড়জোর চমক পেলো। রিক্সা থেকে শাড়ি টেনেটুনে তাবাসসুম নেমে পড়ে। রিক্সার টায়ারে তার শাড়ির আঁচল লেগে বারংবার আটকে পড়ছিল। রিক্সা থেকে নামতে পেরেই শান্তি অনুভব করে।
কিন্তু আফরাজ আর নাজীবা-কে কাপল বেশে দেখে হাত মুঠোবদ্ধ করে তাকিয়ে রইল। জুনিয়র মেয়েরা তো বেশিরভাগ নাজীবার কপালকে সাবাসী দিচ্ছিল। সিনিয়ররা পারলে এখনই গিয়ে আফরাজ এর সাথে কথাবার্তা চালিয়ে দিবে। কিন্তু নাজীবার চোখ রাঙানো থেকে তা অসম্ভব বুঝতে পেরেছে। ইচ্ছেকৃত তাবাসসুম সকলের সামনে গিয়ে আফরাজ কে জড়িয়ে ধরল। তর্কহীন আফরাজ এর হাত ধরে হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট চেপে ধরে। ভার্সিটির সকলের চোখ ছানাবড়া আর নাজীবার তো চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। আফরাজ নিজেও হতভম্ব সে খেয়ালও করেনি কখন তাবাসসুম এলো আর এ কান্ড করে বসলো? তড়িঘড়ি হাত সরিয়ে নেয়। তাবাসসুম এ দেখে মন খারাপ করল না। বরং বাঁকা হেসে নাজীবার সামনে ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা আফরাজ এর স্পর্শতা ছুঁয়ে দেখালো। নাজীবার নিশ্চুপতাই ঝড়ের পূর্বাভাস। সেও কম কিসে! পাবলিক প্লেসে মেয়েটার বেহায়াপনার সুযোগ হাতড়ে নিজের হাত সাফসুতরো করার উদ্দেশ্যে পরপর তিনটে চ’ড় লাগাল। তাবাসসুমও ধাক্কা দিতে নিলে নাজীবা পথ থেকে সরে যায়। হিতে বিপরীত হয়ে যায় তাবাসসুম মুখ থুবড়ে বড় ডাস্টবিনের মুখের ভেতর পড়ে। সকলে হাসতে লাগে। তাবাসসুম ভার্সিটির টিচার। তার উচিৎ হয়নি নিষেধাজ্ঞার বিরোধ হওয়া। এজন্য আফরাজ মনেমন ভেবে নাজীবা-কে ক্লাসে পাঠিয়ে হেড-স্যার এর রুমের দিকে চলে যায়। তাবাসসুম এর গালের একপাশে কলার খোসা,চুলে চুইংগাম, গালের অন্যপাশে কারো কফ,হাতে পলিথিন মোড়ে গেছে। নোংরা অবস্থা হয়ে যাওয়ায় একাকী চিৎকার দিল। কেউ তার শব্দ শোনার মত নেই‌। সকলের ক্লাস পিরিয়ড স্টার্ট হওয়ায় যে তার মত ক্লাসে চলে যায়।

চলবে……

অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব-২৮+২৯

0

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৮ (চমক)

“আফরাজ আমারো স্বামী। আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী। কানে যায় না আপনাদের? এই আমাকে সম্মানের সহিতে গ্রহণ করা আপনাদের দায়িত্ব। নাহলে আমি আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।”

নাজীবার কান ঝালাপালা করে উঠল। তার স্বামীজান এর দ্বিতীয় স্ত্রী তাবাসসুম! কথাটা যেনো সে মোটেও হজম করতে পারছে না। আফরাজ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আকবর, কুসুমা,জনাব ইসমাইল আর মিসেস ফেরদৌসী বিস্ময় চেহারায় আফরাজ এর দিকে তাকায়। মিসেস ফেরদৌসীর বিশ্বাস হচ্ছে না তার ছেলে কেমনে এই বে’শ্যা’ মেয়ে-কে বিয়ে করল? সকলের দৃষ্টি জোড়া দেখেও কোনো পরোয়া না করে নিজস্ব অর্ধাঙ্গিণীর দিকে তাকায়। তার চোখ-মুখে অসহায়ত্ব, বিশ্বাসের অভাব ফুটে উঠায় বুক কেঁপে উঠল আফরাজ এর। তার মন বলছে, বিবিজান তাকে অবিশ্বাস করবে না। তবুও নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রেখে তাবাসসুম এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“দেখো তাবাসসুম ফাজলামি করা বন্ধ করো। যেখান থেকে এসেছো সেখানেই ফিরে যাও। তোমার এখন নিজের মায়ের পাশে থাকা খুব জরুরী। শুধু শুধু আমার বিবিজান এর অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের সিনক্রিয়েট করো না। নাহলে আমি বাধ্য হবো তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। নাউ গেট আউট ফম হেয়ার।”

“না না যাবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি আফরাজ। এই মেয়েটা যখন থেকে তোমার জীবনে এসেছে তখন থেকেই নানান সমস্যা তোমার জীবনে। এই মেয়ে একটা আপদ বুঝতেছো না কেনো? না জানে আর কত কিছু লুকিয়ে রেখেছে শরীরের মধ্যে। এই মেয়ের কারণেই তো আমার নানাভাই আমার বাবার মৃত্যু হলো। ছিঃ বলতেও লজ্জা লাগছে মেয়েটা কিনা আমার নানাভাই কে বশ করেছিল।”

শেষের কথায় ‘ঠাসস’ করে চ’ড় বসিয়ে দেয় আফরাজ। চ’ড় এর প্রতিক্রিয়ায় টাইলার্সের উপর পড়ে যায়। আফরাজ এর রা’গে মাথা ফেটে যাচ্ছে। নাজীবা সকলের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকের দিনটাও কি তবে ব্যর্থতায় কাটবে? একটুখানি প্রশ্নের ঘুরপাক গেল যেনো। মিসেস ফেরদৌসী তার বউমা-র উপর বলা অপবাদ সহ্য করতে পারলেন না। রান্নাঘরে গিয়ে কালো গুঁড়ার বালি পানিতে গুলিয়ে নেন। বাটির মধ্যে ঢেলে তৎক্ষণাৎ তাবাসসুম এর কাছে চলে আসেন। কথাহীন তার মাথার উপর ঢেলে দেন। ক্ষোভে তাবাসসুম যেনো উম্মাদ হয়ে উঠল। মিসেস ফেরদৌসীর হাত থেকে বাটি নিয়ে ছুঁড়ে মা’রল। বাটি ভেঙ্গে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। সকলে উম্মাদী এক মেয়ের কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তাবাসসুম সবার দিকে তাকিয়ে মুখের কালো পানি হাত দিয়ে সরিয়ে বলে,

“আফরাজ আমার স্বামী। বুঝছেন আপনারা? এতদিন আমি এই কথা বলিনি নিজের স্বার্থের জন্যে। আজ এই মুহূর্তে আমি বলছি আমি আফরাজ এর দ্বিতীয় স্ত্রী। এই কথা আপনারা মানতে না চাইলেও আমার কিছু যায় আসে না। এই বাসায় এই বাসার আঙ্গিনায় আমারও হক-ধারী আছে।”

বিরক্ত হয়ে আফরাজ তার গার্ডস কে ইশারা করল। তারা তাবাসসুম কে ধরতে নিলে সে কৌশলে গার্ডের পকেট থেকে পি’স্তল বের করে স্বয়ং আফরাজ এর দিকে ট্যাগ করে বলে,

“ভালোবাসি তোমাকে। তাই এক কথা কান দিয়ে শুনে নাও। বউ হয় তোমার। যত অন্যায় করি না কেনো? সবগুলোর ঊর্ধ্বে একটাই সত্য আমি তোমার স্ত্রী। আর তোমাকে অবশ্যই আমাকে স্বীকৃতি দিতে হবে।”

“ওও যাস্ট সেট আপ ননসেন্স। কি প্রুভ আছে আমি তোমার স্বামী? আমার যতদূর মনে পড়ছে! একসময় আমি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেও তুমি তা অস্বীকার করেছিলে। তারপর আমার বিয়ে আমার বিবিজান এর সাথে হয়ে যায়। তোমার সাথে কানেক্টেড হওয়ার কোনো রাস্তাই নেই বুঝলে? যাও দরজা ঐদিকে নিজের রাস্তা মাপো।”

তাবাসসুম পৈশাচিক ভাবে হেসে উঠল। তার একেক ব্যবহারে নাজীবার মনপ্রান্তে উথাল পাতাল ঢেউ বয়েছে। আফরাজ এর শার্টের হাতা চেপে ধরে মাথা নুইয়ে রেখেছে সে। তার মন চাইছে না পুনরায় চোখ তুলে এই ক’ল’ঙ্কীনির চেহারা দেখতে। তন্মধ্যে ক্ষোভের অগ্নিকাণ্ড তার মস্তিষ্কে দাউ দাউ করে জ্বলছে। আফরাজ আড়চোখে বিবিজানের আগলানো দেখে মনেমন প্রশান্তির হাসল। নচেৎ ভয়ে সে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতো না। বিবিজানের বিশ্বাস আছে দেখে তার মনের সন্দেহ দূরীভূত হয়ে গেল। কর্কশ গলায় বলে,

“দেখো তোমার মুখে কালো পানি মেখে থাকার স্বত্তেও এখনো সম্মান দিয়ে কথা বলছি। নাহলে তুই-তোকারি করে ঘাড় ধাক্কিয়ে তোমার যোগ্যতা বুঝিয়ে দিতাম। সো গেট লস্ট ফম হেয়ার।”

তাবাসসুম শান্ত ভাবে তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে কিছু পেপার্স নিয়ে নাজীবার সামনে গেলো। আফরাজ ভীরু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তাবাসসুম নম্র গলায় বলে,

“এই দেখো ম্যারেজ সার্টিফিকেট এ তোমার স্বামীর সিগনেচার। তিনি অস্বীকার করলেও তুমি তো এখন বুঝদার। ভালোই বুঝো কোনটা নকল , কোনটা আসল? সো ফয়সালা তোমার হাতে।” কথাটা বলে তাবাসসুম নোংরা মুখে নাজীবার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে,
‘ভালো করে দেখেশুনে ফয়সালা নিবে। নাহয় কারো না কারো জীবন যাবে। এখন তোমার হাতে পরিবারের জীবন সঁপে দিলাম।’
কথাটুকু বলে দূরে সরে গেল তাবাসসুম। নাজীবা স্তদ্ধ দৃষ্টিতে পেপার্স ঘেঁটেঘুটে দেখল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)কোনো ভাবেও দেখতে নকল মনে হচ্ছে না! ঢোক গিলে আফরাজ এর দিকে এগিয়ে দেয়। সে পেপার্স নিয়ে পুরো পেপার্স ঘেঁটে দেখে। তার সাইন এ পেপার্সে কেমনে আসল? তার মাথা হ্যাং হওয়ার মত অবস্থা। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আফরাজ তাবাসসুম কে তাচ্ছিল্যে করে বলে,

“তোমার কি মনে হয়? অন্যকাউকে দিয়ে আমার সাইন কপি করিয়ে ম্যারেজ সার্টিফিকেট এ লাগিয়ে দিবে আর আমরা তোমার বোকামি ধরতে পারবো না ভাবছিলে?”

কথার ইতি টেনে আফরাজ তাবাসসুমের চোখের সামনে পেপার্স ছিঁড়ে ফেলল। টুকরো করে পাশে থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দিল। তাবাসসুম এর সামনে গিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে বলে,

“দেখো তোমার প্ল্যান তো ফ্লপ করে দিলাম। এখন কি করবে?”

দাঁতে দাঁত চেপে তাবাসসুম বলে,

“তোমার কি মনে আমি তোমাকে আসল পেপার্স দিয়েছি? না কখনো দেবো না। যা ছিঁড়েছো তা হচ্ছে একদমই ফটোকপি করা পেপার্স। আসল পেপার্স খুঁজে পাবে না। এত কষ্টের ফল সহজে তো নষ্ট হতে দিতে পারি না। তাইত, তোমার পিএ হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফাইল সিগনেচার করানোর নামে কৌশলে ম্যারেজ সার্টিফিকেটেও সিগনেচার করিয়ে নিলাম। তুমি আমার আইনগত স্বামী এটা মানতে বাধ্য তুমি। কিছুক্ষণ পর আমার কথা সত্য হবে। ওয়েট করুন।”

তাবাসসুম এর কথা শেষ না হতেই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
“ওয়েট করতে হবে না মিসেস তাবাসসুম। আপনার কথা সত্য।”

একজন লয়ার-কে দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে সকলের নজর তার উপর গিয়ে পড়ে। লয়ারের সঙ্গে হিংস্র চাহনি নিয়ে ফাহিম মহলের ভেতর প্রবেশ করলেন হিয়া দেয়ান। চোখের দৃষ্টি পুরো মহলের দিকে বুলিয়ে নিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির খাতিরে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক রেখে সামনে এগিয়ে গেলেন। লয়ার জনাব ইসমাইল এর সামনে গিয়ে বলে,

“এই পেপার্স হাজারো চেকিং করিয়েও লাভ হবে না মিস্টার ইসমাইল। কারণ আপনার ছেলেকে হতবুদ্ধির মধ্যে ফেলে এই মেয়ে সিগনেচার করিয়ে নিয়েছে। আইনত তাদের বিয়ের সময় চলছে মাত্র তিনমাস। আফরাজ ব্যাটা চাইলে ডিভোর্স এর এপ্লাই করতে পারবে। কিন্তু তা কার্যকর হবে তিন মাস পর। না চাইতেও আপনাদের থেকে তাবাসসুম কে গ্রহণ করতে হবে। উক্ত ছয়মাস পূর্ণ না হওয়া অব্দি তাকে ডিভোর্স দেওয়া সম্ভব নয়।”

জনাব ইসমাইল এই লয়ার-কে চিনেন। জানা-পরিচিত মুখ। বিধেয় অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকান। সকলে কথাগুলো শুনেছে। বাহিরের মানুষগুলো তো কানাঘুষা করা শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ ছেলে-কে খারাপ বলছে তো কেউ কেউ নাজীবা-র চরিত্র নিয়ে কথা তুলছে। আফরাজ তাদের কথায় ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে তাবাসসুমের গলা চেপে ধরল। নাজীবা হতবাক হয়ে গেল। আফরাজ এর হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু সে যে শক্ত করে চেপে ধরেছে। ছাড়ার নাম অব্দি নিচ্ছে না। নাজীবা না পারতে জোরেসরে তাকে ধাক্কা মা’র’ল। আফরাজ ফোঁস ফোঁস করে বিবিজান এর দিকে অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে রুমের দিকে চলে গেল।
তাবাসসুম কাঁশতে লাগল। নাজীবা শান্ত দৃষ্টিতে পানি এগিয়ে দেয়। সে পানি খেয়ে বলে,’ধন্যবাদ’। নিজেকে স্বাভাবিক করে পুনরায় বলে,

“ছাড়ো এসব। যাও গিয়ে আমার ভরণের জন্য ভরণঢালার ব্যবস্থা করো। আফটার অল আইম হিজ সেকেন্ড ওয়াইফ।”

“ইয়েস আপনাকে স্বাগতম জানানোর জন্য আমি আছি না!”

নাজীবার কথায় উপস্থিত সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আফরাজ রুমে পায়চারী করছিল। পুনরায় বাহিরে এসে কান্ড ঘটাতে চেয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু বিবিজান এর কথা শুনে বোধশূন্য চোখে তাকিয়ে রইল। নাজীবা বাঁকা হেসে তাবাসসুমের হাত ধরে বলে,

“আপনার কোনো চিন্তে করতে হবে না। এই ঘরে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।”

কথাটা বলে নাজীবা বাসায় উপস্থিত অতিথিগণের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আপনারা খাবার খেয়ে যেতে পারেন। যা হয়েছে ভুলে যান। কয়েকদিনের মধ্যেই সত্যের সন্ধান পাবেন। আজকের জন্য এটুকু ড্রামা যথেষ্ট।”

অতিথিগণ নিজেদের মাঝে ফসুরফাসুর করে খাবার খেতে চলে যায়। একঘণ্টা পর অতিথিগণ চলে যায়। তাবাসসুম কে হিয়া দেয়ান সুন্দর করে সাজিয়ে দেন। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)মিসেস ফেরদৌসী কাপড় দিয়ে চলে গিয়ে ছিলেন। নাজীবা শ্বাশুড়ির কাছে গেলে তিনি মুখ ফিরিয়ে ছেলের কাছে চলে যান। সবার গম্ভীর অভিমানি চেহারা লক্ষ করে মুচকি হাসল। কিন্তু সে যে বুদ্ধি এঁটেছে। তা সকলের ধারণাতীত। তাবাসসুম আয়নার সামনে নিজেকে পরোখ করছে। নাজীবার স্বাভাবিক আচরণ দেখে হিয়া দেয়ান এর মনে খটকা কাজ করছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“এতো কষ্ট করে তোর ঐ খু’নীর বউ হওয়ার দরকার ছিল না। তাদের কেকের মধ্যেই বিষ মিশিয়ে কাজটা সম্পন্ন করে ফেলতে পারতাম। তোর জেদের কারণে এই ঘৃণ্য পরিবারের কাছে হাজির হওয়া।”

“উফ মম তাহলে কোথায় থাকতে? ঐ বস্তির জীবনে টিকে থাকতে পারতে? ঐ নোংরা পরিবেশে কয়েকদিনেই জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেল। সেখানে তুমি বলছো এতো জলদি আফরাজ কে হাতছাড়া করতে? নো নো মম। আফরাজ সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তাকে ত্যাগ করা মানে আলিশান মহলের আরাম বিসর্জন দেওয়া। আমি চাই এই মহলে বংশোদ্ভূত করতে। ভাবো মা ছেলে জম্ম দিতে পারলে এই মহলে আমারই রাজ চলবে।”

“হাহ্ বললেই হলো ঐ কুসুমা মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। তার উপর নাজীবার প্রেগন্যান্ট হওয়ার ক্ষমতা আছে। আমি তো বুঝতেছি না তুই আসলে চাসটা কি?”

“আহ্ মম তুমি কি আমাকে কাঁচা খেলোয়াড় ভাবো? আমি তো আর প্ল্যান ছাড়া এই গেমে নামিনি। প্ল্যান রেডি বলেই নিজের দাপট নিয়ে বলছি আমার গর্ভে আফরাজ এর পুত্র শীঘ্রই আসবে। আর দু’জন মেয়ের কাছ থেকে গর্ভবতী হওয়ার ক্ষমতা একে বারে ছিনিয়ে নেবো।”

মেয়ের কথা শুনে তিনি যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। তিনি মুচকি হেসে বলেন,

“তুইও তোর বাপের র’ক্ত পেয়েছিস। শ’য়’তান শ’য়’তানকে ভালোই বংশপরম্পরার অস্ত্র দিয়ে থাকে বলে না? সেই অস্ত্রের মধ্যে তোকে দিয়ে গেল শ’য়’তানি বুদ্ধি। ভালোই হলো আমিও রাজি।”

“আপনারা রেডি তো?”

নাজীবার কণ্ঠে দু’জন চমকে ঘাবড়ে যায়। তাবাসসুম আমতা আমতা করে বলে,

“হ্যা আমরা রেডি!”

“কি হলো আপু আপনি এমনে তুতলাচ্ছেন কেনো? আমি কি ভুল সময়ে চলে এসেছি? আসলে তাড়াহুড়ো চলছে নিচে। তাই আপনাদের নিতে ছুটে আসলাম।”

দু’জনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় নাজীবার পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। শ’য়’তানি হাসি দিয়ে নাজীবা বুকের উপর হাত গুঁজে মনেমন বলে,

“তোরা যদি চলিস বুদ্ধি নিয়ে তাহলে আমি চলি বুদ্ধির বাপ-মাকে নিয়ে হাহ্।”

নাজীবা এটিটিউড নিয়ে যেতে নিলে একজোড়া পুরুষেলী হাত তাকে টেনে বেডরুমে নিয়ে গেল। দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে জোরপূর্বক ওষ্ঠজোড়া মিলিয়ে দেয়। ব্যথার চটে নাজীবা গুঙ্গিয়ে উঠে। কারণ তার স্বামীজান হুট করে এসেই ক্ষোভের বশে তার ওষ্ঠের উপর ক্ষোভ ঝাড়ছে। কষ্টে ব্যথাটা হজম করতে লাগল সে। কয়েক মুহূর্ত পরে আফরাজ বিবিজান-কে ছেড়ে কোলে উঠিয়ে বিছানার উপর শুয়ে দেয়। তার শরীরের উপর নিজের ভার ছেড়ে কম্বল মোড়ে নিল আফরাজ। গম্ভীর গলায় বলে,

“আর যদি বের হয়েছো। তাহলে ঠ্যাং ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেবো।”

“আরে তা কেমনে হবে? আমি যে প্ল্যান করেছি তা না করলে আমার উত্তেজনা শেষ হবে না।”

“দেখো তোমার ফাজলামির চটে এতদিনের জমানো আদর ধরে রাখতে পারব না। আই নিড ইউ এন্ড রাইট নাও। তোমার প্ল্যান আকবর আর ভাবী মিলে করে দেবে। আর কাজিনপক্ষ ভিডিও করে রাখবে। নাও কিস মি!”

লজ্জার সহিতে নাজীবা চোখ বুজে নিলো। আফরাজ বিবিজান এর কাছ থেকে পাওনার অপেক্ষা করল না। সে নিজেই ডুবে গেল তার বিবিজান এর সঙ্গে সুখের সাগরে।

চলবে….

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৯ (চমক-রহস্য এলার্ট পার্ট)

“জামাইজান শুনেন এখন আমরা নিচে যাবো। আপনিও কিন্তু নাটক শুরু করবেন। সতীনের চু’লাচু’লি কিরকম সেটা তাবাসসুম কে বোঝানো দরকার‌। ভাগ-ভাটুয়ারা করার খুব শখ তার? দেখাব কত ধানে কত চাল।”

আফরাজ রেডি হয়ে বিবিজান এর কপালে চুমু এঁকে দিল। তার গাল ধরে বলে,

“একমাত্র তোমার খুশির জন্য ঐ মেয়েটাকে সহ্য করা। নাহলে আমি যে, কি করতাম তা তোমার চেয়ে বেটার আর কেউ জানে না।”

নাজীবা হাসল। ধোঁয়া উঠা গরম কফি স্বামীর হাতে দিয়ে সেও এক মগ কফি নিয়ে বসল। আফরাজ বিবিজান এর চুলে হাত বুলাতে থেকে জানালার দিকে চেয়ে রইল। তন্মধ্যে গরম কফির স্বাদ নিচ্ছে। নাজীবা শুকনো কেশে বলে,

“আসলে তাবাসসুম আপনাকে ছলে ফেলে কাজটা করেছে। তাই আপনার মানতে হবে। নাহলে সে প্রতারণার নামে আইনত আপনার উপর কেস ঠুকে দিতে পারে। এজন্য আমি সেসময় পরিকল্পনা করলাম। যাবত কয়েকদিন ভালো ব্যবহার করব। আপনিও তালাকনামা রেডি করে ফেলবেন। আমি সুযোগ বুঝে তাকে নেশাধায়ক ওয়াইন খাওয়ে বশ করে সিগনেচার করিয়ে নেবো। ব্যস তারপর তাবাসসুম এর আর এক-মুহুর্ত ও বাসায় থাকার আর্জি আমি মানবো না। উল্টো ঘাড় ধাক্কিয়ে বের করে দেবো মা-বেটিকে।”

“হিয়া দেয়ান কি করেছে? গত রাত থেকে দেখতেছি কেমন নজরে যেনো তুমি তাবাসসুম এর মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকো।”

নাজীবা তপ্তশ্বাস ফেলে স্বামীর হাত ধরে তার শোনা সে-সময়কার পুরো কথা শেয়ার করল। শুনে আফরাজ এর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে উঠলে! নাজীবা হাত চেপে রেখে আঁটকে নেয়। মৃদু গলায় আওড়ায়।

“রাগ দেখালে খেলায় আমরা হেরে যাবো। তাই সাবধানে পা ফেলতে হবে।”

“ঠিকাছে এই কাজে সহায়তা করবে নাকিব ভাই।”

নামটা নিয়ে আড়চোখে বিবিজানের দিকে তাকাল। নাজীবার ভাবাবেগ হলো না। আফরাজ ঠোঁট কামড়ে বলে,

“ওহ তোমাকে তো বলাই হলো না নাকিব ভাইয়ের কথা।”

“কে উনি?”

বিবিজান কে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,’এক আপন মানুষ বলতে পারো। সে কালকে আসবে তাকেও সব ঘটনা খুলে বলবে কেমন?’
নাজীবা অবাক হলেও মাথা নাড়ল। হঠাৎ জোরেসরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে দু’জনে মুখে বিস্ময়তা ফুটে উঠল। সকাল নয়টা বাজছে। এখন কে আসতে পারে তাদের রুমে? সেই ভেবে নাজীবা স্বামীকে থামিয়ে নিজে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলতে না খুলতেই ‘ঠাসস’ করে শব্দ হলো। হাত মুঠোবদ্ধ করে নেয় আফরাজ। চোয়াল চেপে তাবাসসুম এর দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলে,

“এসব কি ধরনের ব্যবহার তাবাসসুম?”

“দেখছো কেমনে আমার স্বামীকে নিজের বাহুডোরে চেপে রাখছে এই মা**। দরজাও বন্ধ করে রেখেছে।”

কথা না বলে আফরাজ হাত উঠাতে নেওয়ার পূর্বেই দু’দুটি চ’ড় তাবাসসুম এর গালে লাগিয়ে দেয় নাজীবা। হিংস্র চাহনি নিয়ে বলে,

“ঐ বে**শ্যা তুই আমার সংসারে এসে আগুন লাগিয়েছিস। তাও কিছু বললাম না। সেই আমি সম্মানের সহিতে দ্বিতীয় সতীন হিসেবে বরণ করলাম। সেই তোর সাহস কত বড় আমাকে চ’ড় মা’রার? তুই সতীন সতীনের মত থাকবি। তুই কেন আমার সঙ্গে পাঙ্গাবাজি করতে আসবি বল? এখন কেমন লাগছে গাল জ্বলতেছে তো। আরেকটা খাবি? নাকি এখান থেকে সোজা ড্রাইনিং এ গিয়ে আমার আর আফরাজ এর জন্য নাস্তা রেডি করবি?”

তাবাসসুম এর গাল প্রচন্ড ব্যথা করায় নীরব মাথা নাড়ল। নাজীবা তার বাহু শক্ত করে ধরে দরজার বাহিরে ঠেলে জোরে দরজা বন্ধ করে দেয়। তাবাসসুম গালে হাত রেখে মনেমন গালি ছুঁড়ল। নাজীবার সামনে তার কথা শোনতে সে বাধ্য। কেননা আফরাজ স্বামী হলেও তাকে গ্রহণ করবে না বরং নাজীবার সঙ্গপাতিত করবে। সেই কারণবশত না চাইতেও বাধ্য হয়ে তাবাসসুম নাস্তা রেডি করতে গেল। আফরাজ রাগী দৃষ্টিতে নাজীবার দিকে তাকিয়ে বলে,

“চ’ড় দিয়েছো ঠিকই। কিন্তু আমার শাস্তি আমি নিজেই দেবো।”

কথাটুকুর অর্থ বুঝতে মোটেও কষ্ট হলো না নাজীবা-র। মুচকি হেসে রাগী স্বামীর পিছু পিছু গেল। ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে একে একে সবাই বসে পড়ল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তাবাসসুম ন্যাকা সেজে পরিবেশনের দায়িত্ব নেয়। মিসেস ফেরদৌসী হাত উঁচিয়ে ‘লাগবে না’ বোঝায়। তাবাসসুম থেমে যায়। আকবর আর কুসুমার দিকে এগিয়ে দিতে নিলেও, কুসুমা গম্ভীরতা বজায় রেখে নিজ হাতে নাস্তা বাড়ল তাদের দু’জন এর জন্য। তাবাসসুম উপায়ন্তর না পেয়ে জোরপূর্বক হেসে নিজের মা অর্থাৎ হিয়া দেয়ান পাশে এসে বসল। আফরাজ ডাইনিং-রুমের এসে সামনে দাঁড়িয়ে যায়। স্বামীর দাঁড়ানো দেখে নাজীবাও থমকে দাঁড়ায়। প্রশ্নাতীত নজরে তাকিয়ে ‘কি’ বোঝায়? সে দুষ্টুমি চেহারা করে বলে,

“তুমিও যদি নাটকের মজা নাও আমারও তো কিছুটা বেনিফিট থাকা দরকার রাইট?”

ফ্যালফ্যাল করে চোখ পিটপিটিয়ে কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করল নাজীবা। পরক্ষণে বুঝতে পেরে তেতে উঠল। স্বামীর হাতা চেপে ধরে বলে,

“বেশি না বেনিফিট থাকার প্রয়োজন নেই। নাহলে আপনার হাড়মাংস চিবিয়ে খাবো মনে রাখিয়েন।”

কথাটুকু বলে পরিপাটি হয়ে গলা ঝাড়ল। সকলের নজর কাপলের দিকে গেলো। আফরাজ মুচকি হেসে টেবিলের কাছে এসে প্রথমে নাজীবা-কে বসালো। তাবাসসুম ভেতরে অসহায়ত্ব বোধ করছে। সেও তো তার স্ত্রী। ছলে হলেও কোনো না কোনো একসময় আফরাজ কে ভালোবেসে ছিল সে। তবে কেনো এই অবহেলা, তিরস্কার? ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত রাখল। আমতা আমতা করে বলে,

“আমারও প্লেট খালি। কেউ যদি আমাকে নাস্তা বেড়ে খাওয়ে দিতো।”

নাজীবা চোখ ছোট ছোট করে স্বামীর দিকে একপলক তাকাল। পরেই হিংস্র চাহনী নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ধুপধাপ পা ফেলে তাবাসসুম এর নিকটে গিয়ে দাঁড়ায়। নাজীবার আকস্মিক কাছে আসাটা ভড়কে দিল তাকে। তোতলামি করে বলে,

“ক ককি হলো উঠে এলে কেনো? তোমাকে বলেছি নাকি আসতে?”

“না আপু আপনি আমাকে না বললেও ইঙ্গিত জামাইকেই করছিলে। আসলে আমার জামাই একনারীতে আসক্ত পুরুষ। এখন পরনারীর স্বেচ্ছায় ডাক দেওয়াটা তিনি নিতে পারেননা। বরং ক্ষেপে সিংহ হয়ে যায়। তাই আমিই এলাম আপনার পেটে খাবার টুসতে।”
কথার প্রেক্ষিতে কাজও আরম্ভ করে দেয়। এক টুকরো বড় পরোটার পিচে সুজি মেখে তাবাসসুম এর মুখে চেপে ধরে। হিয়া দেয়ান অবাক। তিনি নাজীবার হাত সরাতে বলে উঠেন,

“এই মেয়ে কি করছো? আমার মেয়ে গিলতে পারছে না। হাত ছাড়ো আমার। পানি খাওয়াতে দাও। নাজীবা প্লিজ ছাড়ো দেখো এতটা নিষ্ঠুর তুমি হতে পারো না। নাহলে কিন্তু….।”

“কিন্তু ফ্যাডের ফ্যাডের আরকি? রাইট! আই ডোন্ট কেয়ার হাহ্।”

চুলগুচ্ছ নেড়ে ভাব নিয়ে স্বামীর পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আফরাজ নাটকের মজা নিয়ে বিবিজানের মুখে ছোট পিচ পরোটার মধ্যে ডাল নিয়ে খাওয়ে দেয়। নাজীবাও তার পক্ষ থেকে খাওয়ে দিতে থাকে। বাকিরা মিটমিটিয়ে হাসল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তাবাসসুম কোনোমতে পানি খেয়ে হাঁপাতে লাগল। আজ তো নাহয় গলা আটকে মা’রা যেতো। হাত মুঠোবদ্ধ করে নাস্তা খাওয়ায় মন দেয়।
একঘণ্টার মধ্যে সবার খাওয়া হয়ে গেলে কাজের মহিলা চায়ের মগ এগিয়ে দেয়। আফরাজ আর আকবর খেলো না। তাদের অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। নাজীবাও হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিয়ে আফরাজ এর সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। তাবাসসুম পরিপাটি হয়ে বের হতে গেলে কোথার থেকে ময়লার পানি এসে তার মাথার উপরে পড়ে যায়। নাজীবা মুখ টেপে হাসল। এ কাজ তার পরিকল্পনার অংশ ছিল। আফরাজ বোকা নজরে বিবিজান এর হাসিমাখা মুখ দেখে তৃপ্তি পেলো। কটমটে তাবাসসুম নাজীবার দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নাজীবা বাঁকা হেসে মনেমন বলে,’আভি তো ব্যস শুরুওয়াত হেয়। আগে আগে দেখো হতা হে কেয়া?’
আফরাজ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে নেয়। নাজীবা-কে ভার্সিটিতে ছেড়ে সে অফিসের দিকে যাবে।

____

তাবাসসুম শীতের কটি পড়ে ক্লাস রুমের দিকে এগোচ্ছে। তার ঠোঁটের কোণায় পৈশাচিক হাসি জুড়ে আছে। আফরাজ যত কিছুই করুক না কেনো! ভার্সিটির টিচার হওয়ার সুবিধার্থে তাবাসসুম ইচ্ছেকৃত নাজীবা-কে বুলিং করতে পারবে। তবে খুব সাবধানে। নাজীবা তার ক্লাসে বসে তার বান্ধবী মারজান,ফাবিহার সঙ্গে প্রশ্ন এর মধ্যে কেমন প্রশ্ন আসতে পারে তা নিয়ে আলাপ করছিল। নাজীবা ক্লাসে কম কথা বলে। কিন্তু ফ্রেন্ডদের সাথে মিশুক প্রকৃতির। নিলয়ও আফরাজ এর কথামত সর্বদা তাদের সঙ্গে থাকে। চারজনই সামনের দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তখনও ক্লাসে কোনো টিচার্স আসেনি। তাদের প্রথম সেমিস্টারের ফাইনাল টার্ম পরীক্ষা স্টার্ট হবে। গতমাসে তাদের লাগাতার ক্লাসের প্যারার সমাপ্তি ঘটে ছিল। নতুন মাসে এই তাদের প্রথম সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিধেয় তাদের মন উত্তেজিত। রুমে তখন কটি পরিহিত ম্যাডামকে প্রবেশ করতে দেখে যে যার সিটে গিয়ে বসে। নাজীবাও তখন তাকাল। তার চোখজোড়া হতবাক। তাবাসসুম ক্ষিপ্ত নজরে নাজীবা-র দিকে চেয়ে আছে। তবুও এতে কোনোরুপ ভয় পেলো না সে। কারণ তার নিজের উপর কনফিডেন্স আছে। তাবাসসুম সবাইকে খাতা বিলিয়ে পনেরো মিনিট সময় দিল। এতে সকলে খাতা মার্জিনে মন দেয়। হাতের ঘড়ি দেখে প্রশ্ন একসাথে করে বিলিয়ে দিতে লাগল। নাজীবার কাছে গিয়ে ইচ্ছেকৃত প্রশ্নটি নিচে ফেলে দিল। নাজীবা-কে ছাত্রীর চোখে দেখছে এমনটা ভাব নিয়ে ‘সরি’ বলল। সে তাবাসসুম এর কাণ্ড সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারছে। এমুহুর্তে লেখায় মন দিতে সে নিজেই প্রশ্নটি তুলে লেখা আরম্ভ করে।
পরীক্ষার সময় তিনঘণ্টা….
তাবাসসুম এর সঙ্গ দিতে একজন টিচার কলিগ এলেন। বয়স্ক বটে। তিনি হাসিমুখে কথা বলছেন। তাবাসসুম এর চোখ বয়স্ক লোকটির দিকে থাকলেও তার মন কেমনে নাজীবা-কে হারাবে সে পরিকল্পনায় ব্যস্ত। আকস্মিক তার নাম ডেকে উঠায় তাবাসসুম চোখের দৃষ্টি সেদিকে নেয়। দপ্তরি এসে তাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ডাকছে বলল। তাবাসসুম কলিগকে পাহারা দিতে বলে চেয়ারম্যানের রুমের দিকে পা বাড়াল। চেয়ারম্যান এর রুমটি কিছুটা গলির মুখে চাপা। তাই ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সম্পর্কে কেউ অবগত হতে পারে না। তার প্রয়োজন মনে হলে তিনি নিজে কল করে ডাকেন। যেমনটা তাবাসসুম কে ডেকেছেন।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকচ্ছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব। তাবাসসুম এসেই দরজা ভালো করে লাগিয়ে দিল। চেয়ারম্যানের পাশে গিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে যায়। পর্দা টেনে বলে,

“বুড়োর কি ভীমরতি জাগলো নাকি? গত পরশুর মজা কি শরীরের থেকে সরেনি মিস্টার মোস্তাক মিয়া? বাসায় সুন্দরী বউ-বাচ্চা রেখে খুব তো বাহিরে ফুল শুঁকে বেড়াও। কখনো যদি জানিয়ে দেয় তখন কি করবে?”

মিস্টার মোস্তাক তাবাসসুম এর কটির বুকের উপর থাকা বোতাম খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। বাঁকা হেসে বলেন,

“বয়স যতই হয়ে যাক না কেনো? ফুল তো ফুলই এখন তা খারাপ হোক বা ভালো। শুঁকতেই মজা। তোমার কি মনে হয় তুমি প্রমাণ দেখিয়ে ব’দ’মান করতে চাইলে আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো? কখনো না। আমার কাছে ভিডিও আছে আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের জানে’মান।”

তাবাসসুম ঘাবড়ালেও বহিঃপ্রকাশ করল না। ইচ্ছেকৃত চেয়ারম্যানের হাত ভেতরে চেপে ধরে বলে,

“দেখো তোমার যা চাই দেবো। আমি শুধু আমার প্রতিশোধ পূর্ণ করতে চাইছি। নাজীবা-কে ব’দ’মান করে এই ভার্সিটি থেকে আর আফরাজ এর লাইফ থেকে বের করতে না পারলে শান্তিতে বাঁচব না। নাজীবার মরণ না দেখে নিজেও মরব না। তাইত তোমার কাছে হেল্প চেয়ে ছিলাম। কেননা তুমিই সেই ক্লাইন্ট যার সাথে ফাস্ট টাইম আমি ফিজিক্যালি এটার্চ হয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে ছিলাম। পরবর্তীতে এবরশন করে ফেলি। তুমিই তো আমাকে আফরাজ এর বউ হওয়ার সত্যতা প্রমাণে হেল্প করলে। লয়ার দিয়ে আমার ম্যারেজ সার্টিফিকেট এর সত্যতা যাচাই করে আমার মায়ের সাথে ফাহিম মহলে পাঠিয়ে দিলে। আমার প্রতিশোধের আগুনে তাদের পুড়িয়ে না মা’রলে আমার অন্তআত্মা প্রতিনিয়ত খোঁচাবে আমায়। কিন্তু একটা কথা এখনো আমাকে কনফিউজড করে দেয়। তুমি কেন আফরাজ এর প্রফেশনাল লাইফ ডুবাতে চাইছো? কি এমন রিজন?”

দরজা বন্ধরত অবস্থায় এতক্ষণ তাবাসসুমের একেক কথা মন দিয়ে শোনছিলেন তিনি। তন্মধ্যে মেয়েটার শরীরে গোপন অঙ্গে হাত বোলাতে থেকে বলেন,

“হাহ্ আমার শোধ আফরাজ না বরং তার বাবার সঙ্গে। ইসমাইল ফাহিম শহরের জানা পরিচিত বিরাট ব্যবসায়ী। যার কারণে আমার প্রেমিকা একসময় আমাকেই পলাশপুর শহরে ধ’র্ষ’কে’র তকমা লাগিয়ে ছিল। আমি তো প্রচন্ড ভালোবাসতাম থাকে। কিন্তু সে আমাতে নয় ইসমাইলের প্রেমে মগ্ন ছিল। ইসমাইল তো এসবের ব্যাপারে জানতো অব্দি না। সে তো ক্লাসের ছাত্র হিসেবে ভালো সুনাম অর্জন করে ছিল। আমার প্রেমিকা আমারই সামনে ইসমাইলের জন্য উম্মাদনা প্রকাশ করতো। মন চাইতো দু’জন কেই খু’ন করে দেয়। কিন্তু ভালোবাসার খেতাবে হাত ফিরিয়ে নিতাম। একসময় খেয়াল করলাম আমার প্রেমিকা ধীরে ধীরে আমার দিকে ঘুরছিল। আমাতে উম্মাদ হচ্ছিল। সেই সুযোগে পাঁচ-ছয়েক বার ই’ন্টি’মেন্ট ও হয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ সব পাল্টে গেল সে স্বেচ্ছায় ইসমাইল কে গিয়ে আমার নামে মিথ্যা মামলা দেয়। আমি তাকে ধ’র্ষ’ণ করেছি আর আমার কারণে সে প্রেগন্যান্ট। আমার মাথা হ্যাং হয়ে যায়। তাকে বাসায় এনে মা’রধর করে জিজ্ঞেস করে ছিলাম। জানো কি বলে ছিল? সে বলে ছিল ইসমাইল তার অসহায় অবস্থা দেখে হলেও তাকে গ্রহণ করবে। ব্যস আমার মাথায় খু’নের নে’শা ধরে গেলো। তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে পৈশাচিকভাবে মিলিত হয়ে তার শরীরকে নিস্তেজ করে দিলাম। দম আঁটকে যাচ্ছিল সে শহরে। তাই কোনোমতে প্রেমিকার ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে এই শহরে চলে এলাম। এখানে এসে যেদিন আফরাজ এর উন্নতির খবর টেলিকাস্টে দেখলাম। সেদিন আমার পুরোনো শোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমিই প্রিন্সিপাল কে বলে ছিলাম নাজীবা-কে আফরাজ এর কথামত ভর্তি করিয়ে নিতে। পুরো ভার্সিটির সবাই তাকে রেসপেক্ট করলেও তুমি তাকে বুলিং করবে তা আমি নিশ্চিত। সেই সুযোগ আমি করে দেবো। কিন্তু তোমার কাজ হলো আমার হাতে মিসেস ফেরদৌসী-কে শপে দেওয়া। আমার প্রেমিকার ভুলের শোধের পেছনে ইসমাইল দায়ী। তার কষ্টের ভাগীদার হবে তারই স্ত্রী।”

কথার ইতি টেনে রুম কাঁপিয়ে পৈশাচিক হাসি দিলেন তিনি। তাবাসসুম কে সোফার উপর ফেলে রুমের বাতি নিভিয়ে দিলেন। মোস্তাক মিয়ার কথায় তাবাসসুম আঁচ করতে পেরেছে লোকটা একপ্রকারে সা’ই’কো। সে নিজেই দোষ করেছে অথচ দোষের সাব্যস্ত করছে তার শ্বশুর কে। নট ব্যড অলসো! মনেমন কথা ভেবে তাবাসসুম কামুক হাসি দিয়ে তার শরীরের উপর টেনে নেয় চেয়ারম্যান কে। তিনি ইচ্ছেকৃত তার রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাননি। এই ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান পদ তার বাবার খেতাবে পেয়েছিলেন তিনি। তাই তার রাজত্ব তো থাকবেই বটে।

চলবে……

অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব-২৬+২৭

0

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৬ (শাস্তি)

দাহাব এহসান এর হাতের মধ্যে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে। চোখের অক্ষিপল্লব ছিঁলে দেওয়া হয়েছে। ঘুমের জন্য ছটফটানি হচ্ছে তার শরীরে। কিন্তু কেউ নেই তাকে মুক্তি দেওয়ার। আকস্মিক খেয়াল করে দেখল ফোস্কা পড়া হাতের উপর বিষধর সাপ উঠে এসেছে। সে আশপাশ চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগল কেউ আছে কিনা! বাহিরে থাকা বাতির কারণে রুমটা-র মধ্যে ঝাপসা আলো আসছে। সাপটি দাহাব এর পুরো হাতকে পেঁচিয়ে ফেলে। যার কারণে আতংকে চিৎকার করতে লাগলেন। কিন্তু কেউ চিৎকার শোনার মত নেই। অপরদিকে, অন্ধকার রুমের বাহির থেকে নাদিম পৈশাচিক দৃষ্টিতে দাহাবের মত ন’র’পশুর মৃত্যু উপভোগ করছে। খেলাটা তখনও শেষ হলে পারতো কিন্তু আফরাজ তার বিবিজান-এর উপর হওয়া নির্যাতনের শোধ তোলবে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)যার কারণে নাদিম সঙ্গে সঙ্গে মে’রে ফেলল না। অন্তিম পরিক্রমা আফরাজ এর হাতে রেখে দিলো। নাদিম হাতঘড়ি চেক করল। ফজরের সময় হচ্ছে। গার্ডসের দিকে তাকিয়ে বলে,

“শোন সবাই ঐ কু’ত্তার দিকে নজর রাখবি‌। ভুলেও যাতে না মরে। ভেতরে গিয়ে পানি খাওয়ে চলে আসবি। খাবারের দানাও যেনো তার পেটে না যায়।”

গার্ডস একসাথে ‘ইয়েস বস’ বলে গার্ন নিয়ে পাহারা দেওয়া আরম্ভ করে। নাদিম তার গার্ডস এর দিকে আড়পল্লক চেয়ে চলে গেল।

___
আকস্মিক চোখের উপর বিন্দু বিন্দু পানির পড়ায় ঘুম উবে গেল আফরাজ এর। সূর্যের কারণে সদ্য গোসল সেরে আসা রমণীকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল তার। নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নাজীবা গুনগুন করে চুল মুছে চেয়ারে বসল। ড্রেসিং-টেবিলের পাশ থেকে হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে চুল শোকা-তে লাগল। আফরাজ বুকের উপর হাত ভাঁজ করে চেয়ে রইল তার অর্ধাঙ্গিণী-র দিকে। তখনও স্বামীকে খেয়াল করেনি নাজীবা। হিতে শাড়ির আঁচল ভাঁজ করার জন্য সেফটিপিন খুলে নেয়। এতে তার আঁচল বুক থেকে সরে ফ্লোরের উপর গড়িয়ে পড়ে। ঢোক গিলে নাজীবা চোরা-চোখে বিছানার দিকে তাকায়। ওমাহ্? বান্দা তো কবেই উঠে পড়েছে আর কেমনে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ভেবেই লজ্জায় বুকের উপর তোয়ালে চেপে ধরে। উম্মাদী দৃষ্টিতে বিবিজান-কে দেখতে থেকে পরণে শর্ট ট্রাউজার আর ঢিলাঢালা শার্ট পরে নেয় আফরাজ। সন্তপর্ণে বিবিজান এর নিকটে গিয়ে দাঁড়ায়। নাজীবা চোখের পলক অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। বিবিজান এর ফর্সা পিঠে পানির বিন্দুকণা দেখে মুখ ঝুঁকে আনল। ওষ্ঠদ্বয় কাছে নিয়ে গেল। লেহন করে পানি-গুলো চু’ষে নেয়। শিহরণে নাজীবা বসে থাকতে পারল না। চট করে দাঁড়িয়ে আঁচলটা বুকে জড়িয়ে নেয়। আফরাজ দেখে হা হয়ে গেল। বিরক্তির গলায় আওড়ায়।

“নেশা দেখিয়ে পালিয়ে যাচ্ছো কেন বিবিজান হুম? একে তো রাতে ঘুমাতে দাওনি। তার উপর সকাল সকাল চুলের পানি ছিটকে ঘুম ভেঙ্গে দিলে। এসবের শোধ তুলব। কাছে আসো।”

“এই একদম কথা উল্টা পাল্টা বলবেন না। আমি কবে আপনাকে ঘুমাতে দিলাম না হুম? আপনি নিজে করে এখন সব আমার উপরে দোষ চাপাচ্ছেন। বলি এত রোমান্স আসছে কোথার থেকে হুম?”

“প্রেমিক পুরুষের মন তার স্ত্রীর জন্য খোলা বইয়ের মত। অবশ্য তুমি যদি এভাবে আঁচল ফেলে সিডিউস করার চেষ্টা করো তাহলে আমি পাগল হবোই তাই না? আর বলি কি শোনো! আমি তোমার জামাই এসব থার্ড ক্লাস কাজ না করে ডাইরেক্ট এসে বলবে জামাই আমার আদর লাগবে। আইম অলওয়েজ রেডি টু মেইক ইউ এ হেপি ওয়াইফ। জামাইকে সিডিউস না করে কোলের উপর এসে বসে যাবা। বাকি কাজ আমার ডোন্ট ওয়ারি মাই গার্ল।”

বেশরমের মত স্বামীকে বকতে দেখে নাজীবা নীরবতা পালন করতে লাগল। সেই বা কি বলবে তার জামাই যে যে কথা বলেছে মনে তো হয় না সে তাকে রেহাই দিবে। বুদ্ধি এঁটে আফরাজ এর নিকটে গেল। তার হাতে পিন দিয়ে বলে,

“আমার আঁচলে পিন লাগিয়ে দিন। তাহলেই আমি আপনাকে মনিং কিস দেবো।”

আফরাজ খুশিতে আপ্লুত হলো। পিন করে দিয়ে ‘হয়ছে’ বলে। পরক্ষণে কাজল হাতে ধরিয়ে বলে,

“এবার কাজল লাগিয়ে দিন তো।”

বিবিজান এর কথামত সে চুমু খাওয়ার লোভে একের পর এক সাজ সাজিয়ে দেয়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)আয়নায় নাজীবা নিজেকে দেখে ব্লাশিং হলো। আফরাজ এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“এই জামাই যাও এবার ফ্রেশ হয়ে সোজা নাস্তার টেবিলে চলে আসুন।”

সে মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। আয়নায় নিজেকে দেখে বোকার মত বলে,

“কি রে বিবিজান আবারো আমাকে বকা বানালো? মন তো চাইছে কোলে নিয়ে আছাড় দেওয়ার। আমারে দিয়ে নিজের সাজ পূরণ করলো‌ অথচ আমাকেই বকশিশ দিলো না। অন্যায় হলো-রে। বকশিশ তো নেবোই।”

নিজেরমত বকতে থেকে গোসল সেরে বের হলো আফরাজ। শীতে কাঁপতে থেকে চুল শুকিয়ে নেয়। বিছানার উপর কাপড় রেডি করা দেখে খোশমনে কাপড় পরে নিল। রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলো। সামনে আকবর-কে গোমড়ামুখো দেখে তার কাছে গেলো। বন্ধু-কে দেখে আকবর অসহায়ের সহিতে বলে,

“বন্ধু ও বন্ধু তুই অপরাধী-রে। আমার কষ্টে ভরা ভালোবাসা দেহ্ ফিরাইয়া দেহ্। আমাকে তুই বন্ধুর লিস্ট থেকে বাতিল করে দিলি। মনে থাকবে। আজকাল খুব ঐ নাদিম্মার সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি চলছে কি হুম? আমাকে কি বন্ধু মনে হয় না? ঐ ব্যাটার লগে তোর এতো কি হুম? যেমনে ইগনোর মা’রতেছিস, মনে হয় না আর আমার লগে চলাফেরা করবি। এখন তো বড়লোক্সী বন্ধু পাইলা আমি আর কি করুম এইহানে? আজই চলে যাবো।”

মুখ ভেটকিয়ে আফরাজ এর পাশ কেটে চলে গেল। সে হাসল তার বন্ধুর জেলাসি দেখে। কিন্তু কোথাও না কোথাও তার মনে একটা প্রশ্নের উঁকি দেয়। নাজীবার ছোটবেলায় কি কোনোরূপ বান্ধবী ছিল না? ভার্সিটি-তেও কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলাম না। ব্যাপার কি? আফরাজ সময় ব্যয় না করে নাস্তার টেবিলে চলে আসল। নাজীবা সবাই-কে নাস্তা পরিবেশন করছে। দাদি শ্বাশুড়ি-র চেয়ার খালি দেখে ভ্রু কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকায়। স্বামীর প্লেটে পরোটা,সবজি ভাজি দিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

“আমি কি দাদি-কে নিয়ে আসতে পারব? না মানে সবাই খেতে শুরু করেছে আমি নাহয় দাদিকে নিয়ে আসি। ঐদিনের পর থেকে আর কথা বা দেখাও হলো না। খুব মনে পড়ছে আমি কি যেতে পারি?”

নাজীবা নম্রতার সহিতে কথাগুলো বললেও চেয়ারে বসা সদস্যদের মধ্যে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। আকবর আর কুসুমা নড়েচড়ে বসল। মিসেস ফেরদৌসী করুণ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকান। মেয়েটা অসময়ে কথাগুলো বলেছে। না জানে তিনি কিরূপ আচরণ করে উঠেন? ঢোক গিলে স্বামীর জ্যাকেটের হাতা চেপে ধরলেন মিসেস ফেরদৌসী। জনাব ইসমাইল মুচকি হাসলেন। স্ত্রীর দিকে নম্রতা দেখিয়ে বউমা-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“বউমা সেই কষ্ট আর করতে না দেওয়ার জন্যেই তোমার দাদি শ্বাশুড়ি পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। হয়ত তিনি জানতেন তাঁর শরীর নানান ব্যাধিক্রমায় নেতিয়ে পড়বে। তাইত কিছুটি না বলে চলে গেলেন আম্মা। তুমি বসো না বউমা। আফরাজ এটা কেমন ব্যবহার? বউমা কে সামলাও।”

স্তদ্ধ দৃষ্টিতে শ্বশুরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল নাজীবা। মুখ খুলতে নিলে আফরাজ চট করে বিবিজান-কে টেনে বসিয়ে দেয়। মুখে এক টুকরো পরোটা চুবিয়ে দেয়। নাজীবা পরিবেশের শান্ততার জন্য নীরবে খেতে লাগল। আফরাজ নিজেও খেয়ে নেয়। কেননা বিবিজান-কে রুমের মধ্যে নিয়ে স্বাভাবিক করতে হবে। নাহয় সে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করবে। শেষ টুকরো খাওয়াতে নিলে নাজীবা খেতে অস্বীকৃতি দিল। বসা থেকে উঠে রান্নাঘরে চলে যায়। সবাই এখন চা খেতে চাইবে। সেই বাহানায় রান্নাঘরে গিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে লাগল। তার কারণে দাদি-কে জীবন দিতে হলো। বুঝতে পেরেছে এই কাজটা দাহাব এহসান এর ছিল। তৎক্ষণাৎ তার মনে এক প্রশ্নের হাতছানি দেয়। চায়ের কেটলি নামিয়ে মগে চিনি-দুধ মিশিয়ে ভাবনায় পড়ে গেল। আনমনে বলে উঠে,

“সে রাতে কি হয়ে ছিল? আমিও বা কেমনে আফরাজ এর কাছে এলাম? আফরাজকেও তো স্বাভাবিক দেখে অবাক হচ্ছি। আল্লাহ জানেন এ পরিবারের সঙ্গে কতকিছু হয়ে গেল। আর সবার মূল্যে আমি দোষী। আমি যদি আফরাজ এর জীবনে না থাকতাম, তবে হয়ত আফরাজ তার দাদির আদরের সোহাগ নিতে পারতো।”

হঠাৎ গরম কিছুর স্পর্শে মৃদু চিৎকার করে উঠল নাজীবা। ধ্যান ভেঙ্গে মগের দিকে খেয়াল করে দেখল, গরম চায়ের পানি তার হাতে ছিটকে পড়েছে। কিন্তু তার হাতের চেয়ে অন্য কারো হাতের উপর মাত্রাতিরিক্ত পড়েছে। হাতের মালিককে দেখে চমকে গেল। আফরাজ হাস্যজ্জ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা কি পাগল নাকি ভেবে পেল না নাজীবা। তড়িঘড়ি কেটলি রেখে স্বামীর হাত বেসিনের সামনে এনে কল ছেড়ে দিল। ঠান্ডা পানির স্পর্শে আফরাজ এর হাতের লালাচে ভাব কিছুটা কমেছে। রাগান্বিত নজরে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

“আপনার কি আক্কেল জ্ঞান নেই? এত গরম পানির নিচে নিজের হাত কেনো রাখছেন হুম? আমার হুঁশ না আসলে তো আপনার হাতের চামড়াও ছিঁলে যেতো।”

“বিবিজান তখন ভাবনায় মগ্ন নিজেও ভাবলাম আক্কেলজ্ঞান কে গু’লিবিদ্ধ করে হাতটা এগিয়ে রাখি। দেখা যাক কতটা পানি গরম হলো? যদি কম গরম হতো তখন তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি-র বকা খেতে হতো। তার চেয়ে বরং আমি আমার বিবিজান-কে বাঁচিয়ে নিলাম। এত সুন্দরী বিবিজান থাকলে এই এক সমস্যা স্বামীর মন অন্যদিকে যেতেই পারে না। এই মেয়ে এই গরম লালাচে জায়গায় একটু চুমু এঁকে দাও না। দেখবে ফুঁস করে ব্যথা উবে গেলো।”

আফরাজ এর কথা শুনে মুচকি হেসে ওষ্ঠদ্বয় তার হাতে ছুঁয়ে দেয়। কারো কাশির শব্দে দু’জন আলাদা সরে গেলো। কুসুমা ভাবী-কে দেখে চোখজোড়া বড় হয়ে গেল তাদের। সে হেসে বলে,

“বলছিলাম কি আপনাদের রোমান্সের ঠেলায় চা খাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে।”

“আ আ ভাবী আমি আনছি তুমি যাও বসো গিয়ে। এই শরীরে হাঁটাচলা সাবধানে করতে হবে।”

“হুম হুম শেষ কথাটা তুমিও মেনে চলবা বুঝলে?”

মিটমিটে হাসল কুসুমা। আফরাজ মাথা চুলকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নাজীবা লজ্জায় না পারতে জলদি চা বানিয়ে পুনরায় গরম করে টেবিলের কাছে নিয়ে এলো। কুসুমার এ অবস্থায় চা খেতে মন চাইছে না বলে রুমে বিশ্রাম করতে গেল।
____

“কি গো দাদাজান? কেমন অনুভূতি হচ্ছে আপনার? ফিলিং নাইচ রাইট? আই নো আমার মতো শত্রু আপনি হাজারের মধ্যে খুঁজলেও পাবেন না। সাপটা আপনার আদর যত্ন করছে তো? একমিনিট কিছু খাননাই? ইশ আপনার তো পেটে র’ক্ত ছাড়া আর কিছু যায় না মনে হয় রাইট?”

আফরাজ অফিসের নাম করে আকবর কে নিয়ে দাহাবের সেই গুলিস্তানে চলে আসে। যেখানে তার বিবিজান-কে বন্দীদশায় রেখে ছিল। এখন সেখানে বন্দীদশায় নিজের জীবনের শেষ সময় গুনছেন দাহাব এহসান। আকবর ভাবীর শক্রর এরূপ অবস্থা দেখে বমি করার মত অবস্থা প্রায়। তৎক্ষণাৎ রুম থেকে পালিয়ে যায়। সে মুহূর্তে নাদিম প্রবেশ করে। আফরাজ কে দেখে হেসে বলে,

“কাম শেষ করে হাত সাফ করে ফেলতে এসেছিস নাকি?”

“নোপ এতসহজে মৃত্যু কাম্য নয় এই জা’নো’য়া’র-এর। এর শাস্তি না আমি,না তুই দিবি। দিবে শুধু তোর বোন। অনেক তো সহ্য করেছে। তারও কিছু পাওনা অবশ্য আছে‌। যে শাস্তি আমার দেওয়ার কথা ছিল সেটা আমি আগেই বাস্তবায়ন করে ফেলেছি। যে যে অঙ্গ দিয়ে আমার বিবিজান-এর দিকে কুদৃষ্টি দিয়ে ছিল সবটা উপ্রে ফেলেছি। বাকিটুকু তোর বোন সাফসুতরো করে দেবে। এমনেই তোর বোন সংসারী হয়ে উঠেছে বটে।”

দাহাব কাতর গলায় ‘পানি পানি’ করে তৃষ্ণার্ত চোখে চাইল। আফরাজ বাঁকা হেসে গার্ডসের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে। তারা গরম র’ক্ত জল এনেছে। দাহাবের মুখ খুলে সবটা ঢেলে দেয়। বেচারার গরম র’ক্ত জলে গলার অংশটুকু জ্বলছে যাচ্ছে। নাদিম পৈশাচিক তৃপ্তিতা অনুভব করল। আফরাজ দেখে মনে মনে খুশির হাসল। সময়ের প্রতিক্রমায় তারাও চলে গেলো।
অফিসে বসে বিবিজান এর কথা ভাবতে থেকে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলো।

সে-রাতে দাহাবের ভাড়াটে লোকদের প্রতিঘাত করার পরপরই যখন নাজীবার দর্শন পেল। চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে যায়। তার পরীর এই কি হাল? শাড়ির ব্লাউজ ছিঁড়ে পড়েছে, আঁচলের অংশটুকুও কোথাও নেই। পেট-পিঠের জায়গায় মা’ই’রের দাগ। হাতের বাহু আর কবজিতে সিগারেট এর ছাইয়ের দাগ। তার মধ্যে বিবিজান ঘুমে নাকি অজ্ঞান সেটাও বোঝার জ্ঞান রইল না আফরাজ এর। ক্ষোভে রুমের মধ্যে পাহারা দেওয়া লোকদের গু’লিবিদ্ধ করে ফেলে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)নাজিমের সহায়তায় হাসপাতালে এনে প্রথমে চিকিৎসার আওতায় নেয় নাজীবা-কে। নাদিমকে খেয়াল রাখতে বলে দাহাব-কে ধরার উদ্দেশ্যে হিংস্র চাহনি নিয়ে বেরিয়ে যায় সে। ভাগ্য সহায় থাকায় রাস্তার মাথায় আসতেই দাহাবের গাড়ির সাথে আফরাজ এর গাড়ির টক্কর লাগে। দাহাব তাকে দেখেই ঘাবড়ে তার ভাড়াটে লোক-কে গাড়ি ঘোরাতে বলে। কিন্তু সময় সাথ দিল না তার। আফরাজ গু’লি করে দেয় ড্রাইভার-কে। দাহাব এর কলার ধরে তার ঘাড়ে অজ্ঞানের ইন’জেক’শন চুবিয়ে দেয়। একে তো নাজীবার আহত করা হাত নিয়ে সে ফিরছিল। পরক্ষণে আফরাজ এর আক্রমণে হুঁশ হারিয়ে ফেলল। সেই তখন গুলিস্তানে নিয়ে আসে। নাদিম কে আসতে বলে সে চলে গেল নাজীবার কাছে‌। নাদিম বুঝতে পেরেছিল তার ক্ষোভের অর্ধ প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ হাতে পেয়েছে সে। বিধেয় কোনো দিকবেদিক না ভেবে লা’থি মে’রে লাঠি হাতে নেয়। দাহাব এর পেট-পিঠের অংশে লাগাতার বা’রি দিতে থাকে। ততক্ষণ যতক্ষণ সে ক্লান্ত হয়নি। তার হাতব্যথা উঠতেই থেমে যায়। হাঁপাতে থাকে। মাটির অংশ দাহাবের র’ক্তে মেখে গেছে। নাদিম পুনরায় আঘাত করতে গেলে আফরাজ কল দিয়ে বারণ করে দেয়। তার কথায় দাহাব কে বন্দি করে রাখা হলো।
ভাবনার ইতি ঘটল আকস্মিক ফোনের আওয়াজে।
ভ্রু কুঁচকে ফোন হাতে নেয়। ‘মিসেস হিয়া’ নামটা দেখে অবাক হলো না। স্বামীর লা’শ বোধহয় পেয়েছেন তিনি। কল দিয়ে ফালতু আলাপ করবে ভেবে কল’টি রিসিভ করল না।

চলবে……

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৭(ধামাকা স্পেশাল)

“এই ব’দ’মাই’শ মাইয়া আমার জামাইজান এর সাথে চিপকে আছিস কেন হুম? হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই গায়ে পড়তে মন চাই তাই না? এখনি চোখের সামনে থেকে দূর হও। নাহলে তোর চুল টেনে ছিঁড়ে তোর মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবো। আর আপনি কি হ্যা? এখনি হাত ছাড়েন নচেৎ আজ আপনার সাথে কেয়ামত হবে বলে দিলাম।”

বিবিজান এর অগ্নিশর্মা রূপ দেখে ঢোক গিলে হাতজোড়া ছেড়ে দিল আফরাজ। ধপাস করে মেয়েটা মাটির উপরে পড়ে যায়। ‘আহহহ’ করে চিল্লিয়ে তার বান্ধবীদের কাছে হাত ধরার জন্য সহায়তা চাইল। তারা সহায় হয়ে তুলল মেয়েটিকে। ধরে অন্যখানে নিয়ে গেল। তারা যেতেই আফরাজ আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিল। নাজীবা স্বামীর চেহারার ধরণ বুঝতে পেরে মুখ ঝামটা মে’রে ক্লাসরুমের দিকে চলে যায়। আফরাজ কপাল চাপড়ে বলে,

“হয়েছে আজ তো মেরা কের নেহি। কে জানে কতক্ষণ ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে বোকা ফুল রাগ করে থাকে। যাই হোক মহারাণী আন্দাজে ক্লাসে ঢুকে গেল। এর এডমিশন নতুনভাবে করিয়ে দিয়ে আসি।”

নিজের মত কথা শেষে আফরাজ সোজা হেড-অফিস রুমের দিকে গেলো। আফরাজ পূর্বপরিচিত হওয়ায় হেড-স্যার তার স্ত্রীর এডমিশন গ্রান্টেড করলেন। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন,

“তুমি চিন্তে করো না। তোমার ওয়াইফের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি সবাইকে এলার্ট করে দেবো। তুমি নিশ্চিন্তে অফিসে যেতে পারো।”

মাথা নেড়ে বেরিয়ে যায় আফরাজ। হেড-স্যার নিজের কথা যথারীতি পালন করলেন। নাজীবার ক্লাসে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পূর্বে ক্লাস করলেও মাঝে তার বিরাট গ্যাপ যায়। যার ফলে পরিচিত মুখগুলি পরের সেমিস্টারে পর্দাপণ করেছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)সে নতুন হওয়ায় সকলের দৃষ্টি তার দিকে। ঢোক গিলে নিজের দিকে ভালো করে পরখ করে নেয়। বোরকার সাথে হিজাব পিনআপ করা, মুখে মাস্ক লাগানো। খারাপের তো কিছু দেখছে না। একটা ছেলে তার পাশে এসে বসে পড়ল। শিউরে তৎক্ষণাৎ জানালার পাশ ঘেঁষে বসে নাজীবা। সে মুখ খুলতে নিলেই ক্লাসের মধ্যে ম্যাডাম চলে আসে। মিস ফারহানা ফিজিক্স নিয়ে পড়াবেন বলে বই খুললেন। নাজীবার একটা মাস গ্যাপ গেল। তাই সে এবারের পড়ায় নিজের দক্ষতা দেখিয়ে দিবে বলে ভেবে রেখেছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)অফিসের কাজ শেষ করে আফরাজ খেয়াল করল একটা ত্রিশ মিনিট পার হয়েছে। তড়িঘড়ি বিবিজান এর কথা মাথায় আসতেই সে ভার্সিটির দিকে চলে এলো। কলার ঠিকঠাক করে সামনে এগোতে নিলেই তার পা-জোড়া থেমে যায়। হাত মুঠোবদ্ধ করে সামনের দিকে চেয়ে রইল। হেসে হেসে নাজীবা তার ক্লাসমেট যে তার পাশে বসে ছিল তার সঙ্গেই কথা বলছে। ছেলেটা মন্দ নয়। নাম নিলয় চশমা এঁটে রাখা বোকা ছেলের মত দেখতে হওয়ায়। কেউ তার সঙ্গী হয় না। বিধেয় নাজীবা-কে পেয়ে সেও এক বান্ধবী পেলো ভেবে খুশি হলো। হঠাৎ নাকে ঘু’ষি লাগায় চিৎকার করে মাটির উপরে পড়ে যায় নিলয়। বেচারা হতভম্ব হয়ে গেল। তার সামনে অচেনা যুবক-কে দেখে ঘাবড়ে গেল। ভাবল সে কোনো ভুলভাল কিছু করেছে কিনা সেই চিন্তায়। কিন্তু নাজীবার আচরণে দ্বিগুণ চমকালো। সে যুবক-কে আকড়ে ধরে ফসুরফাসুর কি যেনো বলে তার কাছে এলো। নাজীবা-কে দেখে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করা শুরু করে দিল। আফরাজ বোকা বনে গেল। তার বিবিজান এর সঙ্গে অন্য পুরুষ কে দেখে মাথা গরম হয়ে গিয়ে ছিল। তাইত দিকবেদিক ভুলে ঘু’ষি মা’রল। মাথা চুলকে নিলয়-কে টেনে দাঁড় করায়। তার পিঠে চা’প’ড় মে’রে বলে,

“ওহ আমার ওয়াইফ এর সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব করছো দেখি। শোনো তোমাদের বন্ধুত্ব আজীবন অটুট রাখতে তোমাকে একটা কাজ দেবো পাশে আসো।”

নাজীবা অতীব আগ্রহ নিয়ে শোনচ্ছিল। শেষের কথায় মুখ বাঁকাল। এত কি পার্সোনাল কথা কে জানে? আফরাজ আড়চোখে বিবিজান-কে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“শোন একদম ন্যাকামি করবি না। আমার বউয়ের সঙ্গে উল্টাপাল্টা কিছু করার চিন্তাও করলে না? ডাইরেক্ট পকেট থেকে গু’লি বের করে আখিরাতের টিকেট তোর হাতে ধরিয়ে দেবো। এবার থেকে তুই ওর গার্ড বুঝছিস। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যত ঘণ্টা নাজীবা ভার্সিটির মধ্যে কাটায়। তার সেফটির পুরো দায়িত্ব তোর উপর দিলাম। কোনো ভুল হলে??”

পকেটে হাত রেখে গু’লির দিকে ইশারা করে বোঝাল। নিলয় ভীতিকর মুখে বলে, ‘না না বস আপনি যা বলবেন তাই। ভাবী আমার বোন সমান। একদম উপরওয়ালার নামে কসম খেয়ে বললাম।’
আফরাজ মাথা নেড়ে বলে,’হয়ছে হাত নামা। প্রিটেন্ট বি নরমাল ইয়াংম্যান।’
‘নরমালের চেয়ে গু’লি দেখেই হিসি ধরে গেলো।’ মনেমন নিলয় বলল। ঢোক গিলে হাতের বেবি ফিঙ্গার দেখাল। আফরাজ যাওয়ার জন্য ইশারা করে। তাকে আর পাই কে? পালিয়ে যায় একেবারে। আফরাজ বাঁকা হেসে বিবিজান এর কাছে আসতে গেলে দেখল মহারাণী আগেই গাড়িতে বসে পড়েছে। সেও মুচকি হেসে গাড়িতে গিয়ে বসে।
অথচ তাদের গাড়ির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একজোড়া চোখের মালিক চেয়ে রইল। তার হাতের মধ্যে থাকা ফাইল চেপে ধরে মুচড়ে ফেলে দেয়। আফরাজ এর গাড়ির চলে যেতেই সেই চোখের মালিকও নিশ্চুপে চলে গেলো।

____

চারমাস পর,
কুসুমা ভারী পেট নিয়ে বেলকনিতে বসে আছে‌। চেহারায় মলিনতা ভাব। বলা যায়, গর্ভবতী নারীদের সৌন্দর্য্যের আদল বাড়তে থাকে। কিন্তু যাবত কয়েক মাস চিন্তা চেতনায় তার শরীরটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। আজকাল স্বপ্নেও অদ্ভুত কিছু দৃশ্য দেখতে পায়। যা তার মন-কে খিটখিটে স্বভাবের করে দিয়েছে। নাজীবা রুমের বাহিরে এসে দরজা নাড়ল। কুসুমার ধ্যান ফিরল। তপ্তশ্বাস ফেলে বলে,

“আসো ভাবী।”

নাজীবা এসে কুসুমার মলিনতা দেখে কপাল চাপড়ে বলে,

“আহারে ভাবী জি ভাইয়া মাত্র একমাস এর জন্য ঢাকা গেছেন। এ নিয়ে মন খারাপ করে থাকলে হয় নাকি? চার মাস শেষ হতে চলেছে আপনার। যত জলদি সম্ভব আমাদের চাম্পকে আমাদের কোলের ঝুড়িতে দিয়ে দাও।”

“মাশাআল্লাহ নাজীবা তুমি পারোও বটে। তোমার মন খারাপ হয় না? আফরাজ ভাইয়া তো দুমাস অব্দি বাসায় ফিরছেন না। অফিসের নাম করে তিনি আগে গিয়েছেন। তারপর তো তোমার ভাইয়া। তিনি নাহয় কল দেন আমায়। আফরাজ ভাইয়া তো কল অব্দি দেন না। আপনি কেমনে সহ্য করছেন ভাবী?”

কুসুমার কথায় মুচকি হাসল। নম্র গলায় আওড়ায়।

“কে বলছে উনার সাথে কথা হয় না? হয়ত কথা স্বপ্নে আর মনে। তিনি আমার অপেক্ষার পরীক্ষা নিচ্ছেন। তিনিও আমায় তত ভালোবাসে যতটা আমি বাসি।
ভাবী আপনি তো জানেন না চার মাস আগের কাহিনী। এখন নাহয় বলি, ভার্সিটির অফ ডে-তে আফরাজ এর সাথে ঘোরার প্ল্যান করে ছিলাম। কিন্তু তার আজেন্ট কোথাও যেতে হচ্ছিল বলে তড়-জড় করে চলে যায়। কি এমন কাজ? আমার সন্দেহ হওয়ায় পিছু নিলাম। তখন যা দেখলাম। বিশ্বাস করুন ভাবী যেখানে দাহাব আমায় বন্দি রেখেছিল সেখানেই তাকে বন্দি বানিয়ে রেখেছিল আফরাজ। তাকে জানেপ্রাণে মা’র’ল না কেনো তা আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আফরাজ যতক্ষণ ছিল টর্চার করেছিল তবুও মা’রেনি। দাহাব এহসান এর শরীরে ক’ঙ্কাল ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। তখনি আমি খেয়াল করলাম আফরাজ চলে যায়। রুমের আশপাশে কোনো গার্ডসও নেই। আমার চোখে বাবা-মায়ের খু’নের দৃশ্য,আমায় শারীরিক-মানসিক অত্যাচার এর দৃশ্য ফুটে উঠায় কাউকে না বলে আমি নিজ হাতে খু’ন করে দেয়। না জানে পুলিশ কেমনে জেনে ছিল? পুলিশ অব্দি জেনে গিয়ে ছিল। তাইত পরিস্থিতি সামলাতে আফরাজ এর খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি আমার দোষও স্বীকার করেছি। কিন্তু তিনি যে রাগ করে দুমাস কথা বলবেন না আর দুমাস পরই ঢাকা চলে যাবেন কে জানত?”

বেদনাময় চোখের জল মুছে কুসুমার হাত ধরে বলে,

“বাদ দাও ঐসব কথা। দেখবে ভাইয়াও ফিরবেন উনিও ফিরবেন।”

তড়ফড়িয়ে রুমের মধ্যে চলে এলেন মিসেস ফেরদৌসী। দু’বউমা কে ঘাপটি মে’রে বসে থাকতে দেখে হা হয়ে গেলেন। কোমরে হাত রেখে নাজীবার কান মলে দেন। সে মৃদু চিৎকার করে বলে,’আরে আরে ডোন্ট বিহেইভ লাইক এ ট্রিপিক্যাল শ্বাশুড়ি- মম। ইউ আর মাই রিয়াল মম। উম্মআহহ।’
মিসেস ফেরদৌসীর‌ গালে চুমু দেয়। তিনি হেসে বলেন,

“পাকা বিচ্চু তুই একটা। যাহ রেডি হো আজ তোর বউভাতের অনুষ্ঠান। এমনিতে পড়ালেখার মাঝে অনুষ্ঠান রাখার সময় পাস না। এখন পেয়েও হাতছাড়া করছিস। এখনি রুমে যাহ্।”

নাজীবা শুনে মলিন হেসে বলে,

“কিই বা হবে এই অনুষ্ঠানে বলুন? আপনার ছেলের তো আমাকে একা ফেলে যাওয়ার বেশি শখ। কাছে আসতে না আসতেই দূরে চলে যান। এতটুকু ভাবে না আমার হৃদয়ের আঙ্গিনায় কি রকম অনুভুতি কাজ করছে? অত্যন্ত ক্ষমা করে হলেও কাছে আসতে পারতেন। একটুখানি বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারতেন,ভালোবাসি বিশ্বাস করি তোমায়। তাও বললেন না।”

আর কিছুটি না বলে নীরবে রুম ত্যাগ করল। মিসেস ফেরদৌসী আর কুসুমা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসল। কুসুমা একলা হাতে রেডি হতে পারবে না বলেই মিসেস ফেরদৌসী এসেছেন। রুমে এসে বিছানার উপর জর্জেট শাড়ি সেই সাথে মেচিং জুয়েলারি রাখা দেখে সেগুলো-তে হাত বুলাল নাজীবা। শাড়ির রংটা হলো সিলভার-ব্ল্যাক। তার ফেভারিট কালার বটে। ভেবে নিল তার শ্বাশুড়ি মা রেখেছেন এই সেট। সন্তপর্ণে গুনগুন করে মনের কষ্ট লুকাতে মুখের ফেসিয়াল করতে লেগে পড়ে।

রাত প্রায় নয়টা বাজছে,
জনাব ইসমাইল হেসে সকলের সাথে বউমা-র পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তার ছেলের অতীব উন্নতির গুঞ্জে তিনি গর্বিত। কুসুমাকে সাথে নিয়ে গোমড়া মুখে বসে আছে নাজীবা। তার কাছে মনে হচ্ছে সে একটা পুতুল। আর সবাই পুতুল কে দেখে কমপ্লিমেন্ট মে’রে টেরে চলে যাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে উঠতে গিয়েও পারল না। তার শ্বশুর শ্বাশুড়ির হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীতে গম্ভীরতা শোভা পাক তা সে মোটেও চাইছে না। আফরাজ এর ফুপি-ফুপার ছেলে-মেয়েরা এসে ভীড় জমাল। সবার চোখের দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে যায়। কোনো ইনভেস্টিগেশন করবে ভেবে ভয়ে জমে গেল। কুসুমা মুচকি হেসে বলে,

“এই ফাজিল তোরা নতুন বউরে ভয় লাগাচ্ছিস কেন? যাহ্ ভাগ এখান থেকে।”

“এহ বললেই হলো নাকি? একদম যাবো না ভাবী তুমি জানো আমাদের নতুন ভাবীর জন্য অনেক শর্ত জমিয়ে রেখেছি। যদি না মানো তাহলে আফরাজ ভাইয়া কে বলে তোমাকে বিদায় করে দেবো।”

“আচ্ছা বাচ্চু? আগে আমাকে চিনে এসো তারপর কথার কথা বলিও।”

মেয়েটিকে চোখ টিপ দিল নাজীবা। কথাটি শুনে ঢোক গিলল মেয়েটি। তবুও আফরাজ এর কাজিনের দল তাকে ছাড়ল না। মুরব্বিগণ কে একসাথে রেখে নাজীবা-কে নিয়ে কাজিনপক্ষ ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে ঠান্ডা হাওয়ার কারণে নাজীবা সমেত সকলেই জ্যাকেট পরে নেয়। যেনো ঠান্ডার কারণে অসুস্থ নাহয়। এর মাঝে হিটার অন করে দেয় আফরাজ এর কাজিন। নাজীবা-কে মাঝখানে বসিয়ে সকলে আবদার করে উঠল একটা গান শুনানোর জন্য।
নাজীবা আমতা আমতা করে বলে,

“আসলে আমি না গান পারি না। আমার গলার সুর ভালো না মোটেও।”

কথাটি বলে সে মাথানিচু করে নিল। এ কথায় কারো মাঝে প্রভাব ফেলল বলে মনে হলো না। বরং তারা একসাথে হেসে বলে,

“আপনি না পারলেও আপনার পার্টনার তো আছেই। তার সাথে ডান্স উইড সং দু’টোই দেখান।”

নাজীবা চমকে গেল। মুখ খুলতে নিলে কেউ তার হাত চেপে ধরে। গরম পুরুষালি হাতের স্পর্শে শিহরিত হলো সে। ছলছল চোখে হাতের মালিকের দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি আফরাজ এর। সকলের দৃষ্টি অপেক্ষা করে বিবিজান এর কানের কাছে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে বলে,’হেপ্পি বার্থডে মাই গার্ল। উইশিং ইউ অলওয়েজ উইড মি ইন শা আল্লাহ্।’ নাজীবা হতবাক আজ তার জন্মদিন অথচ তারই মনে নেই। সে প্রশ্নাতীত দৃষ্টিতে তাকায়। কুসুমা এসে বলে,

“ভাইয়া তোমার জন্মদিনের জন্য আগেভাগে কাজ সেরে ফেলতে দুমাসের জন্য ঢাকা চলে গিয়ে ছিল। তার পূর্বের দু’মাস তোমার উপর রাগে নয় বরং কাজের চাপে পড়ে কথা অব্দি বলার সময় সুযোগ পাননি তিনি। তাইত আজ তোমার জন্মদিনে স্বয়ং সামনে দাঁড়ানো। তিনি যে আসবেন এটা আমরা সবাই জানতাম শুধু তুমি ছাড়া।”

নাজীবা মুখ ফুলিয়ে রেলিং ধরে বুকের উপর হাত গুজে দাঁড়িয়ে যায়। তার অভিমান হলো এত কষ্ট না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললেও পারত মানুষটা। তা-না বলে নিজের মত কাজ-কাজ করে বেড়ালো।
হঠাৎ কোমরে হাতের স্পর্শে চোখ বুজে নিল নাজীবা। মৌন ভাবে বিবিজান-কে ধরে মুখোমুখি ঘুরিয়ে নিল। গানের টিউন বেজে উঠায় আফরাজ তার বিবিজান কে পুনরায় ঘুরিয়ে নেয়।

Samajh na aaye samjhaun ton,
Bas ch naa aaye kise hor ton ,
Dilawara aa,Mera Dil awara AA

নাজীবা-কে উল্টো পিঠ ঘুরিয়ে দুজন তাদের বিপরীত দিকে মুখ করে দাড় করিয়ে নেয় আফরাজ। লজ্জায় নাজীবা চোখ বুজে রইল।

Sangda ae challa nehde aaun ton,
Darda ae tainu billo khon ton,
Dilawara aa,Mera Dil awara AA

Dil Mera AA AAA AAA… aaaaa A. aA yeah!

আফরাজ নাজীবার কোমরে হাত রেখে একহাতে তার পিঠ চেপে ধরল। মুখটা ফিরিয়ে নেয় কপালে চুমু খেলো। সকলে দেখে মিটমিটে হেসে শিস বাজাতে লাগল।

গানের টিউন টেনে একসাইডে করা হলো।

Humm Chori Chori lukk lukk ke mein,
Dil naal la liyan,
Hauli hauli Ruk Ruk ke mein,
Massa no sambhaliyan.
Na Manda ae mere kehna,
tere Naina che hi rehna,
If I tell u , if I tell u,
Tabaah hi ho jaana.

নাজীবা-হাতজোড়া আবদ্ধ রেখে আফরাজ এর দিকে তাকিয়ে রইল। দু’জন মৃদু মৃদু হাঁপাচ্ছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) নাজীবার তো লজ্জায় কাতর অবস্থা। সে না পারছে পালাতে , না পারছে স্বামীকে থামাতে। কিন্তু বলতে গেলে তারও এই মুহূর্ত এমন সুন্দর দিনের অপেক্ষা ছিল। আজ নাহয় লজ্জা কে আটক করে নিল।

Samajh na aaye samjhaun ton,
Bas ch naa aaye kise hor ton ,
Dilawara aa,Mera Dil awara AA
Sangda ae challa nehde aaun ton,
Darda ae tainu billo khon ton,
Dilawara aa,Mera Dil awara AA

Dil Mera AA AAA AAA… aaaaa A. aA
Dil Mera ohhho ohho ohh AAA.

নাজীবার মাথা হালকা করে ঝুঁকে থাকায় তার ওষ্ঠজোড়া কাঁপছে। আফরাজ একপা ভাঁজ করে বিবিজান-কে ঝুঁকিয়েছে। সকলে তাদের কাপল পারফরম্যান্সের মুগ্ধতায় হাত তালি দিয়ে উঠে। দু’জনের ধ্যান ফিরল। নাজীবা লজ্জার রেশ পুরোপুরি আকড়ে ধরল। একছুটে ছাদ থেকে পালিয়ে যায়। আফরাজ সমেত সকলে হেসে দিল। তারাও নিচে চলে আসে। আফরাজ কেক অর্ডার করেছিল। তা পরিবেশন করা শেষ। নাজীবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। দু’জনে একে অপরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কয়েকপলক। পরক্ষণে মুচকি হেসে আফরাজ এর গালে মৃদু চা’প’ড় দিয়ে ছু’ড়ি হাতে নিল। কেক কাটতে নিলেই হঠাৎ করে বড়জড় ব্লাস্ট হয়।

চলবে…..