Saturday, July 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 322



তোমাতে বিলীন হবো পর্ব-০২

0

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_২

মাগরিবের নামাজের পর তনন বাড়িতে প্রবেশ করলো। তখন খাবার খেয়ে বন্ধুর সাথে বেরিয়ে গেছিল।
তনন গ্রিলের সিটকিনি খুলে ঢুকতেই সেলিনা শেখের সামনে পড়লো।
-“এই কোথা থেকে আসা হচ্ছে? বাড়িতে আসতে না আসতেই বন্ধুদের সাথে বেরানো। ঢাকা তে তো মনে হয় আরো রাত করিস, তাই না?”

-“না আম্মু। জায়ান এসেছিল তাই চলে গিয়েছি।”

সেলিনা শেখ বিকালের দিকে বাড়ি এসেছেন। ঘরে ঢুকে কাউকে পেলেন না। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সোজা ছেলের রুমেও যেতে পারছেন না। নিজের অস্বস্তি একপাশে রেখে কথা বলতে বলতে ছেলের রুমের দিকে গেলেন। আগে থেকেই ভেবেছেন দরজা চাপানো থাকলে আর ডাকবেন না। কিন্তু দরজা খোলায় ছিল। চোখ পড়তেই দেখলেন তাহসী ঘুমাচ্ছে। তনন কে না দেখে এগিয়ে গেলেন। ওয়াশরুম চেক করেও পেলেন না। সেলিনা শেখ ফিরে আসলেন নিজের ঘরে। তাহসী কে জাগালেন না। পরে ঘুম থেকে উঠলেই শুনবে তনন কোথায়।
পরবর্তীতে তাহসীর কাছে জিজ্ঞেস করলে তাহসী বলেছে জানেনা। শুধু বলেছে বন্ধু এসেছিল। সেলিনা শেখ অনেকটা রেগেই গেছিলেন তননের এমন কাজে।

-“না বলে কেন গিয়েছিস?”

-“তুমি ছিলে না তো। আচ্ছা এবার অন্তত ছাড়ো। আর হবে না।”

সেলিনা শেখ আর কিছু বললেন না। তনন নিজের রুমে চলে গেল। রুমে যেয়ে তাহসী কে না দেখে ভ্রু কুঁচকালো। পাশের রুম থেকে তাহসীর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। পাশের রুমটা তনুর। তনন বুঝলো তনুর কাছেই তাহসী। এটা নিয়ে আর মাথা ঘামালো না। বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়লো।

সেলিনা শেখ মেয়ের রুমের দিকে গেলেন। তনু মায়ের আওয়াজ পেয়ে আঁতকে উঠলো। তাহসী হাসলো। সেলিনা শেখ দুইজনকে দেখে নিয়ে বললেন,
-“কি ব্যাপার তনু?”

-“কিছু না। তুমি যাও।”

তনুর এক হাত পিছনে। সেই দিকে তাকিয়ে সেলিনা শেখ বললেন,
-“কি লুকানো হচ্ছে তাই বল!”

তাহসী মৃদু স্বরে বললো,
-“আরে বলে দাও। কিছু বলবে না।”

-“তুমি বলো ভাবী।”

তনু মুখ কাচুমাচু করে পিছনে রাখা হাত সামনে আনলো। তাহসীর কিছু বলতে হলো না।
সেলিনা শেখ কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
-“সন্ধ্যাবেলার সময় তেঁতুল খাওয়া হচ্ছে দুইজনের। এখন এসব খেলে রাতে ভাত মুখে যাবে?”

-“কিছু হবে না মামুনি। আপনিও নিন।”

-“না, তোমরা খাও। তবে যদি শুনি কেউ বলেছে ভাত খাবো না, তাহলে তাকে মা’র দিবো।”
সেলিনা শেখ হাসিমুখে কথাগুলো বলে চলে গেলেন।

তাহসী কে দিয়ে বেশ করে তেঁতুল মখিয়েছে তনু। তনু দের একটা বড় তেঁতুলের গাছ আছে। তনু কালকে পেরে রেখেছিল তেঁতুল। সেইটা দেখেই খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তাহসী। তবে রাত করে তনু এটার আবদার নিয়ে বসবে এটা তাহসী বুঝেনি। তবে তাহসীর জন্য ভালো হয়েছে। আগ বাড়িয়ে নিজে কিছু চাইতে তাহসীর ঘোর আপত্তি।

সেইদিন রাতে অস্বস্তি নিয়ে তাহসী ঘুমাতে গেল। তনন‌ তাহসীকে দেখেও কিছু বললো না। তাহসী মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো,
-“লাইট অফ করবো?”

-“হুম।”

তাহসী রুমের লাইট বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিল। এরপর ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে আসলো। শাড়ি খুলে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তাহসী দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আজকে দিয়ে পাঁচটা রাত হচ্ছে তননের সাথে ঘুমানোর। তননের বাড়ি আসার কারণ সম্পর্কে জানতে মন চাইলেও তাহসী জড়তা নিয়ে কিছু বললো না। তননও কিছু বললো না। তনন ক্লান্ত থাকায় তাহসীর আগেই ঘুমিয়ে পড়লো। তনন ঘুমিয়ে পড়েছে এটা বুঝে তাহসীর অস্বস্তি কেটে গেল। তননের ভারি শ্বাস প্রশ্বাসের মৃদু শব্দে তাহসী কাত হয়ে পাশে তাকালো। খুশি হলো মনে মনে তাহসী। তনন নাক ডাকে না ঘুমের মধ্যে। তাহসী -ও একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

🍁🍁🍁
দুইদিন বাদে তননের সাথে তাহসী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। গতকাল তাহসী নিজের বাড়ি যেয়ে প্রয়োজনীয় সব নিয়ে এসেছিল। তাহসীর বাড়ি তননের গ্রামের দুই গ্রাম পরেই। তাদের দুজনের পরিচয় ছোট বেলা থেকেই। একসাথেই বেড়ে ওঠা। তারা দুজনেই ঢাকায় থাকে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে।
তাহসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর তনন বুয়েটে পড়াশোনা করে। চতুর্থ বর্ষে পড়ে। তনন সেখানেই হোস্টেলে থাকে। তাহসী তার তিনজন বান্ধবীর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই এক বাসাতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে।

তনন, তাহসী দুজন দুজনকে মনে মনে পছন্দ করতো। তবে এখন পর্যন্ত কেউ কাউকে সেইটা বলেনি। অনেকটা নাটকীয় ভাবেই তাদের বিয়ে হয়েছিল।

ফ্ল্যাশব্যাক……………
সকাল সকাল বন্ধুকে নিজের বাড়িতে দেখে অনেকটা অবাকই হলো তাহসী। তাও আবার ছোটবেলার বন্ধু। তবে শুধু বন্ধু হলে অবাক হতো না। দেখা করতে আসতেই পারে। এখন তাদের পড়াশোনার প্রতিষ্ঠান আলাদা। কিন্তু এ তো ফ্যামিলি নিয়ে উপস্থিত। এইজন্যই তাহসীর অবাক হওয়া।
তাহসী ছাদে দাঁড়িয়েই উঁকি ঝুঁকি দিল। সকালে আর বিকালে ছাদে উঠে ফুল গাছে পানি দেওয়া তাহসীর কাজ। অবশ্য এখন সে গ্রামে থাকে না,তাই প্রতিদিন পানি দিতে পারে না। যে ক’দিন থাকে সেই ক’দিন তাহসী-ই এই কাজ করে।
গ্রামে শুধু তাদেরই দোতলা বাড়ি। আশেপাশে আর কারো নেই। এই বাড়িটি তার দাদার করা।

বাড়ির উঠানে তাদের বসতে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের প্রায় সবাই সেখানে। মূলত বাড়ির সবাই উঠানে চেয়ার, বেঞ্চ পেতে বসে ছিল, সেখানেই বসেছেন ওনারা। তনন, তননের আম্মু আর বোন বসে আছে চেয়ারে। আর সবাই ঘিরে রেখেছে। সবাই বলতে তাহসীর দুই চাচুর পরিবার, দাদা দাদি আর তাহসীর পরিবার।
তাহসী ছাদ থেকেই দেখলো তাহসীর ছোট চাচুর মেয়ে শশী দোতলার বিল্ডিং এ ঢুকলো। কিছুক্ষণ পরেই ছাদে শশীর অস্তিত্ব পেল তাহসী। শশী হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-“তুমি এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো আপু। ওদিকে তোমার বিয়ের কথা চলছে!”

-“কিসের বিয়ে? ওই ছেলেকে না বাবা না করে দিল।”
তাহসী চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
কিছুদিন ধরে গ্রামের চেয়ারম্যান জ্বালাচ্ছে বিয়ে নিয়ে। তাহসীর বাবা নিষেধ করার পরেও বারবার বলছে। তাহসীর দাদা প্রথমে কিছু বলেননি। ভেবেছে তাহসীর বাবায় নিষেধ করে দিবে। কিন্তু তাকেও চেয়ারম্যান এসে ধরেছে। পরে ওর দাদা কঠোর ভাবে নিষেধ করতেই চেয়ারম্যান পিছু ছেড়েছে।

-“আরে চেয়ারম্যান তো বাদ গেছে। ওইযে তোমার বন্ধু, বুয়েটে পড়ে। ধুর! নাম ভুলে গেছি।”

তাহসী বিস্ময় নিয়ে চাপা স্বরে বললো,
-“তনন! নিচে তো তনন-ই!”

-“হ্যা হ্যা। ওনার বোন তনু। আমাদের নিচের ক্লাসে মানে নাইনে পড়ে।”

-“কি বলিস তুই!”

ওদের কথার মাঝেই নিচ থেকে তাহসীর ডাক পড়লো। তাহসীর পিলে চমকে উঠলো এই ডাক শুনে।।

তাহসী নিচে নেমে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বাবার পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। তৎক্ষণাৎ তাহসীর বাবা তৌহিদ হোসেন তাহসীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
-“তনন কে তুমি ডেকেছো?”

বাবার শীতল কন্ঠ শুনে তাহসী ভয় পেল। এমনটা তো সে ভাবেনি দোষ তার উপর আসতে পারে! তাহসীর রাগ হচ্ছে তননের এমন কাজে। অবশ্য সেই সাথে মনে ভালো লাগা ছেয়ে যাচ্ছে।
তাহসী মৃদু স্বরে বললো,
-“না, বাবা।”

-“তোমাদের সম্পর্ক আছে?”

-“না, বাবা।”
তাহসী অবাক হয়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নে। পরক্ষণেই মনে হলো এসব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

তৌহিদ হোসেন বললেন,
-“সত্যি বলবে তাহসী। তাহলে তনন আসলো কেন?”

সেলিনা শেখ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তৌহিদ হোসেন তাকে থামিয়ে দিলেন।
তাহসী জড়তা নিয়ে বললো,
-“আমি সত্যিই এই‌ ব্যাপারে কিছুই জানিনা বাবা।”

-“তোমাকে চেয়ারম্যান এর ছেলে বিয়ে করতে চেয়েছে এটা তুমি তননকে বলেছো?”

-“না, বাবা। তননের সাথে তো আমার অনেকদিন কোনো কথায় হয়না।”

তৌহিদ হোসেন এবার তননের দিকে তাকালেন। বললেন,
-“কোথা থেকে শুনেছো তনন?”

-“আঁখির থেকে।”
এটা ওদের আরেক ফ্রেন্ড সাথে তাহসীর রুমমেট। তাহসীর সাথেই পড়ে।

-“আচ্ছা। এবার বলো তাহসী তোমার মত কি?”

-“আমা…র মত মা..নে? কিসের?”

-“এইযে তোমার বন্ধু তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে।”

তাহসী কিছু বলার আগেই তাহসীর মেজো চাচি শিরিন কথা বললেন।
-“ভাই বলছিলাম কি তাহসীর তো পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে তো বিয়ে দিতে চান না আর দিবেনও না। তাহলে আমার মেয়ে রেবার কথা‌ বলেন না হয়।ওনারা কি খালি হাতে ফিরে…”
অনেকক্ষণ ধরেই তিনি এই কথা বলার জন্য স্বামীকে খোঁচাচ্ছেন। তাহসীর মেজো চাচা রাগ করেছেন ওনাকে। তবুও শুনলেন না। শেষ পর্যন্ত নিজেই বলে দিলেন।

তনন চোখ মুখ কুঁচকালো। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। সারারাত জার্নি‌ করে এসেছে সে। সকালে খেয়েই মায়ের সাথে এখানে এসেছে। ঘুম হয়নি। চোখ লাল হয়ে আছে। তার মধ্যে এইসব কথার কোনো মানে হয়না।

তৌহিদ হোসেন ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
-”

চলবে ইনশাআল্লাহ;

তোমাতে বিলীন হবো পর্ব-০১

0

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#সূচনা_পর্ব(১)

দুপুরবেলা উঠানের মাঝখানে চেয়ারে বসে চুল শুকাচ্ছে তাহসী। সাথে হাতে ফোন নিয়ে স্ক্রল করছে। হঠাৎ মূল গেট দিয়ে কারো প্রবেশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকালো সেদিকে। তাহসী অনেকটাই চমকালো। অবাক হলো মাত্রারিক্ত। মনে মনে প্রশ্নে’রা উঁকি দিল, ‘এই ছেলে এখানে কেন? কোথায় তার আসার কথা তো সে শুনেনি।’
ছেলেটি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে অফ হোয়াইট কালারের শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। এতেই যেন অনেক সুন্দর লাগছে তাহসীর কাছে। ছেলেটাও তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এটা বেশ বুঝতে পারছে তাহসী।

তহসী সেদিক থেকে নিজের মুগ্ধ দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের দিকে চোখ যেতেই দেখলো বারান্দার গ্রিলে তালা দেওয়া। তহসী নিজেই বলেছে তার শাশুড়ি কে বারান্দায় তালা দিয়ে যেতে। এখন মনে হচ্ছে বলেই ভুল করেছে।

গ্রামের বাড়ি সাধারণত যেমন হয় মোটেও তেমনটা নয় এই বাড়িটা। চাররুম বিশিষ্ট এক তলা বাড়িটার সামনে বারান্দা দেওয়া। বারান্দা পুরো গ্রিল দিয়ে ঘেরা। বাথরুম ও ভিতরেই; বারান্দায় একটা, আর একটা ঘরের ভিতরে। বারান্দার একপাশে ডাইনিং টেবিল পাতা। আর ঘরের পাশেই রান্নাঘর।

তাহসী কিছু না বলে পুকুরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। দুই পা ফেলেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। হাতে থাকা ফোনে কন্ট্যাক্ট নাম্বার বের করে ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ বাদেই বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে তাহসী এর শাশুড়ি আসলো মেয়েকে সাথে নিয়ে।
তাহসী এর শাশুড়ি সেলিনা শেখ চাবি দিয়ে তালা খুলতে খুলতে বললেন,
-“তুমি না একটু আগে বললে তালা মেরে যান মামুনি। এখন কি হলো?”

তাহসী কে ডাইনিং টেবিলে থাকা খাবার দেখতে বলায় তাহসী বলেছে তালা মেরে যেতে। এমনিতে পাশের বাড়ি গেলেও সেলিনা শেখ তালা দিয়ে যায় বাড়িতে। হুটহাট তালা দেওয়া দেখে তাহসী ও সেই কথায় বলেছে। বিড়ালের উৎপাত আছে এই বাড়িতে। তাহসী বরাবরই বড্ড অলস। ডাইনিং পাহারা দেওয়ার থেকে তালা মেরে দেওয়ায় ভালো। এতে সেলিনা শেখ ও কিছু বলেননি।

শাশুড়ির কথায় তাহসী প্রতিত্তর করলো না। ছেলেটি এগিয়ে এসে বললো,
-“আম্মু আমাকে কি তোমার চোখে পড়ে না?”

সেলিনা শেখ পিছনে তাকিয়ে বললো,
-“কখন আসলি, তনন? পথে সমস্যা হয়নি তো?”

-“না, আম্মু। আমি কিছুক্ষণ আগেই এসেছি। তোমার চোখ তো আজকাল আমার উপর পড়ছে না।”

এতক্ষণ চুপ করে ছিল তননের বোন তনু। এবার সে কথা বলে উঠলো,
-“তুমি কি ভাবীকে হিংসে করছো ভাইয়া?”

তাহসীর মুখে লাজুকতা ছড়িয়ে পড়লো। সে আবার পুনরায় চেয়ারে বসলো। তনন কোনো উত্তর না দিয়ে বোনের মাথায় টোকা দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
আজ ঢাকা থেকে ফিরলো সে। সেই সকালে রওনা দিয়ে অবশেষে পৌঁছালো। সারাদিন বাস জার্নি করার ফলে শরীরে ঘাম শুকিয়ে বসে গেছে। এখন তার উদ্দেশ্য গোসল করা। তা নাহলে শান্তি লাগবে না।

তাহসী বসতেই সেলিনা শেখ বললেন,
-“এই তাহসী এখানে না বসে রুমে যাও তো। তননের খাবার টা দাও কষ্ট করে। আমি পাশের বাড়ি তোমার চাচি শাশুড়ির কাছে যাচ্ছি।”
এই বলেই তিনি চলে গেলেন। তনু ও মায়ের পিছু পিছু চলে গেল।

তাহসী পড়লো বিপাকে। সেলিনা শেখ পরশু ফোন দিয়ে কাল তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তনন আসবে জানলে কখনোই আসতো না সে। তাহসী চোখ মুখ কুঁচকে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আজ গোসলের পর শাশুড়ি তাকে শাড়ি পড়িয়েছে। তাহসীর জীবনে আজ দিয়ে তিনদিন হচ্ছে শাড়ি পড়া। সে এতে মোটেও সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। তাহসী আস্তে আস্তে হেটে রুমে যেয়ে উঁকি দিল।
তননকে দেখলো না রুমে। ওয়াশরুমে পানির পড়ার শব্দে বুঝলো ভিতরে। তাহসী এখানে বসবে নাকি বাইরে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আর কিছু না ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানার এক কোণে যেয়ে বসলো তাহসী। চুপ করে বসে থেকে শাড়ির আঁচলের এক কোনা আঙ্গুল দিয়ে পেঁচাতে লাগলো। সেইটা ফেলে রেখে আবার ফোন হাত নিল।

কিছুক্ষণ বাদেই তনন বের হলো গোসল সেরে।‌ তাহসী কে দেখে অবাক হলো। মোটেও এখানে থাকার মানুষ নয় তাহসী; বোধহয় মা পাঠিয়েছে এটা ভেবেই তনন মুচকি হাসলো। বলে উঠলো,
-“কি ব্যাপার? এখানে তুই?”

তাহসী সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। আমতা আমতা করে বললো,
-“এখানে বলতে এই রুমে নাকি এই বাড়িতে?”

-“দুইটাই। তা আমার জন্যে এসেছিস বুঝি?”

তাহসী উঠে দাঁড়ালো।‌ বললো,
-“মোটেও না। আমি জানতামই না আসার কথা। মামুনি এনেছে ফোন দিয়ে। আচ্ছা এখন কি খাবার দিবো? মামুনি সিমি’দের বাড়ি গেছে। আমাকে খাবার দিতে বলেছে।”

সিমি তননের চাচাতো বোনের নাম। তনন নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠলো,
-“বাব্বাহ! যে নিজে খাবার নিয়ে খায় না, সে আমাকে খাবার দিবে? আমার ভাগ্য আছে বলতে হবে!”

তাহসী কিছুই বললো না। সবসময় তার আম্মুই খাবার বেড়ে দেয়। অবশ্য এখন যেখানে থেকে পড়াশোনা করে সেখানে নিজেরই নিয়ে খাওয়া লাগে।

তনন হাতে থাকা টাওয়েল বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে তাহসীর দুই পাশে হাত রেখে তাহসী কে বন্দি করলো। হঠাৎ এমন হওয়াতে তাহসী চমকে উঠলো। সে আর তাকায়নি তননের দিকে। ফলে বুঝতেও পারিনি তনন কখন তার কাছে এসেছে। তাহসী পিছনে কিছুটা হেলতে যেয়ে সোজা বিছানায় পড়ে গেল। তনন আরো ঝুঁকে গেল তাহসীর দিকে। তাহসীর কাঁপাকাঁপি বেড়ে গেল দ্বিগুণ।
-“কি-ইই হচ..ছে?”

তনন মুচকি হেসে তাহসীর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। তাহসী ঠান্ডা ঠোঁটের ছোঁয়ায় পুনরায় কেঁপে উঠলো। মনে হলো এই কাঁপাকাঁপি তে জান টাই না বের হয়ে যায়!
তনন এবার তাহসীর গলায় মুখ গুজলো। হাত চলে গেল তাহসীর পেটে। তাহসী চোখ খিঁচে বন্ধ করলো। একে তো সে শাড়ি সামলাতে পারে না। তারপর এই অনুভূতি! তা সহ্য করার মতো নয় তাহসীর কাছে।

উঠান থেকে কেউ তননের নাম ধরে ডেকে উঠলো। তনন ছেড়ে দিল তাহসী কে। তাহসীর পাশে উঠে বসে তাহসী কেও টেনে তুললো।
তনন গলা উঁচিয়ে বাইরের মানুষটির উদ্দেশ্যে বললো,
-“আসছি।”

এবার তাহসীর দিকে তাকালো তনন। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
-“জায়ানের জন্য ছাড়া পেলে। আমি নিজেই খাবার নিচ্ছি। তুমি শাড়ি পরে কোনো ছেলের সামনে যাবে না। যেহেতু আমার জন্য শাড়ি পরেছিলে তাই শাড়ি পরার কারণ পরিপূর্ণ করে দিয়ে গেলাম।”
তনন আর তাহসী দুজনে বন্ধু। দুজনে তুই সম্বোধন করেই কথা বলতো। বিয়ের পর তনন মাঝে মাঝে তুই বলে আবার তুমি বলে। তাহসী তার সাথে মিল রেখে কথা বলে। তুমি বললে তুমি, তুই বললে তুই।

তাহসী চাইলেও মুখ খুলে বলতে পারলো না সে নিজ ইচ্ছায় শাড়ি পরেনি। আর সে তো জানতোই না তননের আসার কথা।

তনন উঠে চলে গেল বারান্দায়। গ্রিল খুলে জায়ান কে বারান্দায় এসে বসতে বললো। জায়ান তনন আর তাহসী দুজনের বন্ধু। তনন ডাইনিং টেবিলের কাছে যেয়ে চেয়ার টেনে বসে জায়ান কেও বসতে বললো সাথে তার সাথে লাঞ্চ করার প্রস্তাব দিল। জায়ান বসলেও খাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করে দিল। তনন খেতে খেতে কথা বলতে লাগলো। তননের আসার খবর শুনেই সে এসেছে।

তাহসী শাড়ি ঠিক করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। শাড়ি পড়ে মোটেও শুতে ইচ্ছা করছে না, তবুও পরিবর্তন করলো না। সেলিনা শেখ এসে দেখার পর কি ভাববে এই ভেবে। তাহসীর মন থেকে তননের শীতল স্পর্শের অনুভূতি যাচ্ছেই না। তাহসীর কাছে পুরো অপ্রত্যাশিত ছিল ঘটনাটা। বিয়ের রাতেও তনন তাকে এতোটা ছুঁয় নি। তাদের বিয়েও হয়েছে মাত্র তিন মাস। তবুও তাহসী এখনো তননের সাথে ফ্রি হতে পারিনি।

চলবে ইনশাআল্লাহ;

তুমি আমার ব্যাকুলতা পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#তুমি_আমার_ব্যাকুলতা
#পর্ব-০৩ ও শেষ
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

যেখান থেকে মানহা কে কিডন্যাপ করা হয়, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আবার সেখানেই দিয়ে যায় তারা! অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি।

দুদিন পর,
মানহা কল করে হাসান কে তাদের বাসায় আসতে বলে। মানহার কল পেয়ে হাসান মায়ের কাছে বলে চলে যায় সেখানে।
শশুরের বাসায় গিয়ে দেখতে পায় ড্রয়িং রুমে সবাই তার জন্য‌ই অপেক্ষা করে বসে আছে, বিশেষ করে মানহা।
সজিব নিজের আসন ছেড়ে দুলাভাই কে বসার সুযোগ করে দিয়ে, নিজে একটা মোড়া নিয়ে এসে বসে। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে এতোদিন মেয়েটা কোথায় ছিল, কি পরিস্থিতে ছিল তা জানার জন্য।

মানহা বলতে শুরু করে,
তার শশুর বাড়ির কাছাকাছি যে পার্কটা আছে ওখানে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসেছিল সে। তখন পড়ন্ত বিকেল ছিল, যখন সে এসেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন আলোর রেখা নিভু হয়ে যাচ্ছিল তখন পার্ক জনশূন্য হতে শুরু হলো। মানহা ঠাঁয় বসেই ছিল ভেবেছিল কেউ একজন তার রাগ ভাঙিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে। কারণ সে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে এখানে এসে বসেছিল।
তারপর যখন পুরো পার্ক জনশূন্য হয়ে গেল তখন, আবছা আলোর রেশ শুধু ছিল তখন ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। আর তাই বেঞ্চ থেকে উঠে সামনের দিকে পা বাড়ায়। তখনি কেউ মুখ চেপে ধরে…… এরপরের সমস্ত ঘটনা বলার পর মাকে ধরে আবারো কেঁদে দেয় মেয়েটা। খুব ভয় পেয়েছে, এখনো মনে হয় এই বুঝি আবারো ধরে নিয়ে যাবে। সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে।
সবাই খুব চিন্তিত কে কিসের জন্য এমন করলো তা নিয়ে। রোজিনা বলে উঠে,
–” আমার মেয়েটা কোথায় পা ফেলতেও চিন্তা করে ফেলে যদি না কোন ভুল হয়ে যায়। অথচ সেই মেয়েকে কে এমন নিষ্ঠুর ভাবে বন্দি করে রেখেছে? তারপর মানহার বাবা করিম সাহেব হাসান কে উদ্দেশ্য করে বলে,
–” জানি না বাবা তুমি আর তোমার পরিবার বিষয়টা কিভাবে নিচ্ছ বা নিবে? তবে জানো আমার মেয়েটা কে আমি নিজ হাতে মানুষ করেছি তাই ও কি করতে পারে আর না পারে, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মেয়েটাকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করিয়েছি। জ্ঞান হ‌ওয়ার পর থেকে ওর কাজিনরাও ওকে দেখতে পায়না সেখানে অন্য…

করিম সাহেব কে থামিয়ে দিয়ে হাসান বলল,
–” প্লিজ বাবা আর বলবেন না। আমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হতে চলেছে, তাই মানহা কেমন মেয়ে এটা অন্যকারো থেকে জানতে হবে না আমার। আমি আমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আমার পরিবার যদি কিছু বলে তাহলে তাদের কে বুঝানোর দায়িত্ব আমার। আপনি এগুলো নিয়ে একদল দুশ্চিন্তা করবেন না।

জামাই এর কথায় করিম সাহেব দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়। হাসান তখন মানহা কে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বললে, রোজিনা বলে,
–” মেয়েটার উপর দিয়ে কতটা ঝড় গেল তার উপর প্রেগন্যান্ট! এই অবস্থায় কিছুদিন এখানে থেকে গেলে হয় না বাবা?

মানহা প্রেগন্যান্ট শুনে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো তাকায় মানহার দিকে। কিছুটা অভিমান হয় তার। সে বাবা হতে চলেছে অথচ মানহা একবার ও তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না?

হাসান কে চুপ করে বসে থাকতে দেখে রোজিনা ইতস্তত বোধ করে বললেন,
–” কি হলো বাবা কিছু বললে না যে?
হাসান ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,
–” জ্বি?
–” মানহাকে এখানে থাকার ব্যাপারে বলছিলাম যে।
হাসান সম্মতি দিয়ে বলল,
–” ঠিক আছে আপনারা যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই হবে। আমি তাহলে আজকে উঠি?
–” সেকি এই রাতের বেলায় কোথায় যাবে? আজকে কোথাও যাওয়া নেই। কিছুদিন এখানে মানহার সাথে থাকো তোমার ও ভালো লাগবে।

তারপর মানহা কে বলে হাসান কে নিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয় রোজিনা। এর কিছুক্ষণ পর সজীব নাস্তার ট্রে নিয়ে দরজা নক করে। হাসান শালাবাবুর সাথে কিছুক্ষণ মজা করে নাস্তা খায়। খাওয়া শেষে সজীব চলে গেলে হাসান ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে মানহার খুব কাছে বসে। অভিমানী কন্ঠে বলে,
–” খুশীর খবরটা আমাকে আগে জানালে না কেন?

মানহা মাথা নিচু করে বলে,
–” তুমি যদি ভুল বুঝ তাই..
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হাসান বলল,
–” প্লিজ এসব মুখেও আনবে না। যাই হোক, ঐ ঘটনা গুলো নিছক একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও। যে আসছে তার কথা ভেবে অন্তত নিজেকে সুস্থ করে তুল।
.
.
২ বছর পর,
মানহা রান্না ঘরে থেকে মেয়ের কান্না শুনে দৌড়ে আসে। দশ মিনিট আগে খুব কষ্ট করে মেয়েকে ঘুম পারিয়ে রান্না করতে যায় সে, এর মধ্যেই উঠে গেছে। মেয়েকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে মানহা। কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দেয় না পুঁচকে মেয়েটা। মাকে যেন সবসময় চোখে হারায়।

মেয়ের ডায়াপার চেঞ্জ করতে নিলে কলিং বেল বেজে উঠে। দ্রুত চেঞ্জ করে হিজাবের নিকাব টা লাগিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
মানহা সবসময় সুতি কাপড়ের হিজাব পরে থাকে বাসায়। যখন কোন প্রয়োজন হয় তখন নিকাব টা লাগিয়ে নেয়।
যাই হোক,
দরজা খোলার পর একজন ভদ্রলোক বললেন,
–” ম্যাম আপনার পার্সেল!
তারপর মানহার সাইন নিয়ে, পার্সেল দিয়ে চলে যায় ভদ্রলোক। মানহা বুঝতে পারছে না কে দিতে পারে এটা? মেয়েকে পাশে বসিয়ে পার্সেল খোলা শুরু করে।
তার মেয়ের জন্য দুটো পার্টি ড্রেস আর সাথে একটা চিঠি দেখতে পায়। চিঠির খাম খুলে ভিতরে চিরকুট পড়া শুরু করে,
প্রিয় সম্বোধন করে আবার কেটে লেখা হয়েছে বোন!
আমি তোমার বড় খালার ছেলে সাফ‌ওয়ান। যে তোমার কিডন্যাপারার! ভাগ্যক্রমে আমি তোমাকে একবার দেখেছিলাম! সেই থেকেই ভীষণ পছন্দ করে ফেলি। ভেবেছিলাম ভালো একটা চাকরি পেলে মাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। কিন্তু ততদিনে খালু তোমার বিয়ে দিয়ে দেয়। তবুও তোমার বিয়ের কথা শুনে মাকে রাজি করিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেই কিন্তু খালু রাজি হয় না। ঐ মুহুর্তে বিয়ে ভাঙ্গতে পারবে না বলে অযুহাত দেখায়। আমি বুঝতে পারি তোমার স্বামীর মতো তো সরকারি চাকরি করি না তাই দাম নেই আমার। তাই ঠিক করি এর প্রতি*শোধ নিব আমি! আর সেটা তোমার সংসার নষ্ট করে। সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছিলাম। তোমাকে দিয়ে মিথ্যা চিঠি ও লিখিয়েছিলাম তোমার স্বামীকে পাঠাবো বলে! কিন্তু তোমার চোখে তোমার স্বামীর জন্য ভালোবাসা দেখে আর বেশিদূর এগোতে পারলাম না। রা*গ ছিল খালুর উপর কিন্তু তুমি তো কোন দোষ করোনি। একসময় বুঝতে পারলাম অন্যের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি আমার পছন্দের মানুষটিকে কষ্ট দিচ্ছি। তাই তোমাকে আবার ফিরিয়ে দিলাম। তুমি সুখী হও আমি না হয় দূর থেকেই ভালোবাসবো তোমায়। চিন্তা করো না বোন হিসাবেই ভালোবাসবো। কারণ কোন বেগানা নারীকে কল্পনা করা ও আকাঙ্ক্ষা করা মনের যিনা। তাই নিজেকে সুধরে নিব ইনশা আল্লাহ। আমাকে মাফ করে দিও আর পারলে আমার হেদায়েত এর জন্য দুআ ক‌ইরো। আল্লাহ হাফেজ।
সাফ‌ওয়ান।
.
চিঠিটা পড়ে মানহা কি রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না। তার মেয়ে নাযাহ কেঁদে উঠলে তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কান্না থামানোর চেষ্টা করে তখন ফোনে কল আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে মা কল করেছে। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে রোজিনা বললেন, তার বড় বোনের ছেলে সাফ‌ওয়ান আজকে ভোরের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর চলে গেছে!
মানহা উত্তরে শুধু বলে,
–” অহ আচ্ছা।

মানহা নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতে পছন্দ করতো। তাছাড়া কোন এক কারনে সাফ‌ওয়ান এর বাবার সাথে করিম সাহেবের সম্পর্কটা স্বাভাবিক ছিল না। তাই দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসা নাই বললেই চলে। শুধু রোজিনা আর তার বোনের মধ্যে সম্পর্ক টা টিকে আছে। যাই হোক মানহা অতীত নিয়ে ভবিষ্যত নষ্ট করতে চায় না।তাই এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। চিঠিটা ছিঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে ড্রেস গুলো আলমারির এক কোনায় রেখে দেয়। যদি কখনো ইচ্ছে হয় মেয়েকে পরাবে আর না হয় এমনেই পরে থাকবে।
রাতের বেলা ঘুমানোর সময় হাসান কে সবটা বলে মানহা। সবটা শুনে হাসান বলে আলহামদুলিল্লাহ।
মানহা অবাক হয়ে তাকালে হাসান বলে,
–” সবশেষে তো তুমি আমার স্ত্রী, আমার হয়ে থাকবে। আজকে যদি অন্যত্র তোমার বিয়ে হতো তাহলে তো আর তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া হতো না আমার সেই জন্য আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল।
স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা লজ্জা পায় মানহা। তখন হাসান তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে বলে এখন ঘুমাও। আমাদের কথা শুনে কখন আবার নাযাহ কেঁদে উঠবে তার ঠিক নেই।

(সমাপ্ত)

তুমি আমার ব্যাকুলতা পর্ব-০২

0

#তুমি_আমার_ব্যাকুলতা
#পর্ব-০২
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

চোখে রোদ চশমা, মুখে মাস্ক পড়া যুবক কে খুবই পরিচিত বলে মনে হলো মানহার কাছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছিল? যদি সম্পুর্ন মুখ খোলা থাকতো তাহলে নিমিষেই চেনা যেত। যাই হোক মানহা আর সময় নষ্ট করতে চাইছে না। তাকে এখান থেকে পালাতে হবে মনে পড়তেই দুই হাতে বোরকা একটু উঁচু করে ধরে, যেন প্রথমবারের মতো পরে না যায়।
তারপর যুবক ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে দৌড় দিতে নিলে পুরুষালি একটা শক্ত হাত ধরে নেয় তার হাত! মানহা ছুটতে চাইলে আরো শক্ত করে চেপে ধরে তার হাত। তারপর টানতে টানতে ঐ বাড়িটার দিকে নেওয়া শুরু করে। তখন মানহা চিৎকার করে বলে,
–” ছারুন আমাকে। আমাকে যেতে দিন? কেন এমন করছেন? আমার সাথে। কি দোষ করেছি আমি? যার জন্য বলা নাই ক‌ওয়া নাই এভাবে ধরে বেঁধে রাখছেন। আপনাদের পুলি*শে দিব আমি! ছারেন আমাকে।
.
ছেলেটি বরাবরই নিশ্চুপ, নিরবতা পালন করে চলেছে। যেন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না।
.
.
আবারো মানহার হাত পা বেঁধে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। মেয়ে দুটোকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন দ্বিতীয় বার এক‌ই ভুল না হয়। আজকে যদি সে সময় মতো না আসতো তাহলে সব পরিকল্পনা বৃথা যেত। মেয়ে দুটো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলে আর এমন হবে না।

দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকায় মানহা। তখনকার সেই ছেলেটি এসেছে। মানহা ক্লান্ত, তাই নিস্তেজ গলায় বলে,
–” কেন আটকে রেখেছেন আমাকে? যেতে দিন। ধীর পায়ে হেঁটে আসে ছেলেটা। এসে একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে,
–” এখানে সাইন করে দিন তাহলেই ছেড়ে দেওয়া হবে আপনাকে!
–“কিসের পেপার এটা?
মানহার জবাবে ছেলেটা বলে,
— “ডিবোর্স পেপার”!

মানহা অবিশ্বাসের গলায় বলল,
–” কার ডিবোর্স পেপার এটা?
ছেলেটি খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল,
–” আপনার ডিবোর্স পেপার।

মানহা নিজের ক্লান্ত শরীরের কথা ভুলে গেল। রেগে মেজাজটা চড়া হয়ে উঠলো। বলল,
–” হেই হু আর ইউ? আপনার কথায় আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দিব, ভাবলেন কিভাবে?

ছেলেটি গভীর এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে, ধীর স্বরে বলল,
–” তাহলে এভাবেই ব*ন্দি হয়ে থাকবেন সারাজীবন।
আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ঘটঘট পায়ে বেড়িয়ে যায় ছেলেটা। যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করতে ভুলে না। মানহা উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ছেলেটি কি চায়? তার জীবনটাই যেন চেয়ে বসে আছে! সে যে তার প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবাসে তার স্বামীকে। সেই স্বামীকে ডিভোর্স দিতে বলছে! কেন করছে এমন নিষ্ঠুরতা? স্তব্ধ ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মানহা।

কেটে যায় আরো কিছুদিন। এর মাঝে মানহা নিজের শারীরিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে। কিন্তু মেয়ে দুটোকে বুঝতে দেয় না। চোখের পানি ফেলে সারাক্ষণ পরম করুণাময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কে ডাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার এর জন্য। কারণ সমস্ত অসম্ভব কে সম্ভব করার মালিক যে একমাত্র তিনিই, যিনি সৃষ্টি করেছেন এই দুনিয়া। দুনিয়ার ক্ষুদ্র হতে বৃহত্তর সমস্ত কিছু। তবে দুনিয়ার অসম্ভব কে তিনি কাদের জন্য সম্ভব করে দেন, বলতে পারেন? কোরআন বলছে_ “আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তৈরি করে দেন (বিপদ হতে) উত্তরণের পথ”। “আলহামদুলিল্লাহ ” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কতোই না মহান।

মেয়ে দুটো মানহাকে অনেক বোঝায় ডিবোর্স পেপারে সাইন করে দেওয়ার জন্য। তাহলেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মানহা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুল পরিমান ও নড়ে না।
মাস পেরিয়ে যায়। সুন্দর মুখশ্রীটা শুকিয়ে আসে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পরে। কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে জানে না সে। তবে মনে মনে এখনো বিশ্বাস করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যা করে আমাদের ভালোর জন্যই করেন।
.
.
শরীরে কিঞ্চিত ব্যাথা অনুভব করে শোয়া থেকে উঠে বসে মানহা। এতোক্ষণ বেঞ্চে শুয়ে ছিল সে, তাই শরীর ব্যথা অনুভব করে।
কিন্তু চোখ মেলে সামনে তাকাতে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এই জায়গাটা তার ভীষণ পরিচিত যে! না চেনার উপায় নেই একদম। সে কি স্বপ্ন দেখছে? একটু পরেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে সেকি আবার নিজেকে চার দেয়ালে বন্দী অবস্থায় দেখতে পাবে? নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিজের পায়ে কিছু একটা পরায় কিঞ্চিত ব্যাথা অনুভব করে মুখ দিয়ে আহ্ শব্দ বের হয়ে আসে। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ক্রিকেট বল। বল টা হাতে নিতেই দুটো বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে বলল,
–” সরি আন্টি আমরা ইচ্ছা করে ব্যাথা দেইনি আপনাকে।
মানহা যারপরনাই বিস্মিত হয়ে, চঞ্চল চোখ জোড়া এদিক ওদিক দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খুশিতে চোখের পানি চলে আসে তার। সে স্বপ্ন দেখছে না।এটা বাস্তব! হাত থেকে বল টা ফেলে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। বাচ্চা দুটো আহাম্মক বনে গেল! কোথায় ভাবলো ওদের এখন ভীষণ বকে দিব। তা না এভাবে ছোটে চলল কেন? আজব মহিলা!
.
.

বিরতিহীন কলিং বেলের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল, বিরক্ত হয়ে নাসিমা বেগম দরজা খোলার সাথে সাথে গা*লি দিতে উদ্যত হতে ছেলের বউ কে দেখে থেমে যায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
–” এতোদিন পর কোথায় থেকে বের হয়ে এলে? নির্ল*জ্জ মেয়ে মানুষ কোথাকার।
আরো কিছু বলতে নিলে পেছন থেকে হাসান মাহবুব মানে মানহার স্বামী তার মা’কে থামিয়ে দিয়ে স্ত্রীর কাছে যায়। উদ্বিগ্ন মুখে বলে,
–” আমার সাথে রাগ করে কোথায় চলে গিয়েছিলে? সামান্য একটু রাগ অভিমানের জন্য এভাবে শাস্তি দিলে আমায়? কোথায় না কোথায় তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি, তোমার বান্ধবী, আত্মীয়স্বজন কারো বাসায় খুজ নেওয়া বাকি রাখিনি। কেন করলে এরকম?

ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে নাসিমা বেগম বলে,
–” এই মেয়ের ভাবভঙ্গি আগেই সুবিধার মনে হয়নি আমার। তুই এক্ষুনি ওর বাবা কে ডেকে এর একটা বিহিত করবি। না হয় আবার কখন আমাদের মুখে চুনকালি মাখাবে তার কোন ঠিক নেই!

মায়ের কথায় খানিকটা রেগে যায় হাসান। জ্বলে উঠে বলল,
–” তোমার জন্য আমি সেদিন মানহার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি মা! তাই আজকে তুমি আর কোন কথা বলো না আমাদের মাঝে। আমাদের ঝামেলা আমাদের কে মেটাতে দাও প্লিজ?

ছেলের রাগ দেখে ধমে যায় নাসিমা বেগম। আপাতত স্থান ত্যাগ করাই ভালো মনে করলেন। তারপর হাসান মানহা কে নিয়ে গিয়ে রুমের দরজা লাগায়। মানহার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, সে ছাড়া পেয়েছে ঐ দুষ্টু লোকের থেকে।
সামনে থাকা স্বামীকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। হাসান তার প্রিয়তমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে?
–” কাঁদছো কেন বলো আমাকে? এতোদিন আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়নি?

কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার হেঁচকি উঠে যায়। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। হাসান বুঝতে পেরে আর কোন প্রশ্ন করে না। আলতো করে জড়িয়ে রাখে নিজের সাথে।
.
.
মানহার পরিবারের সদস্যরা খবর পেয়ে চলে আসে। মেয়েকে দেখে আঁতকে উঠে রোজিনা ইসলাম। এই কয়েক দিনেই মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে। সবাই কৌতুহল মানহা এতোদিন কোথায় ছিল?
কি করেছে? তবে মেয়ের অবস্থা দেখে তা জানার জন্য চাপ দেয় না। মেয়েটা একটু সুস্থ হলে জানা যাবে।

মানহার বাবা জামাইকে অনুরোধ করে, তার মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যেতে। সুস্থ হলে আবার আসবে, কয়েকটা দিন ওর মায়ের কাছে থাকলে ভালো লাগবে।
অনেক দিন পর স্ত্রী কে কাছে পেয়ে বাপের বাড়ি যেতে দিতে ইচ্ছা করে না হাসানের। কিন্তু স্ত্রীর শরীরের কথা ভেবে রাজি হয়। কিন্তু মনে মনে চায় সেও যেতে। কিন্তু তাকে কেউ একটিবার বলছে না যেতে। ভেবেছিল মানহা অন্তত বলবে কিন্তু সেও বলল না…..

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

তুমি আমার ব্যাকুলতা পর্ব-০১

0

#তুমি_আমার_ব্যাকুলতা
#সূচনা_পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

অন্ধকার রুমে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মানহা! হাত পা বেঁ*ধে রাখা হয়েছে তার। চোখ দুটো খোলা থাকলেও ঘুটঘুটে অন্ধকারের জন্য নিজের অবস্থান ঠাওর করতে পারছে না সে। ঠিক কতো সময় আগে তার সাথে এই ঘটনা ঘটেছে তাও বলতে পারবে না সে। এতটুকু মনে আছে,বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটা পার্ক আছে ওখানে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসেছিল মানহা। তখন পড়ন্ত বিকেল ছিল, যখন সে এসেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন আলোর রেখা নিভু হয়ে যাচ্ছিল তখন পার্ক জনশূন্য হতে শুরু হলো। মানহা ঠাঁয় বসেই ছিল ভেবেছিল কেউ একজন তার রাগ ভাঙিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে। কারণ সে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে এখানে এসে বসেছিল।
তারপর যখন পুরো পার্ক জনশূন্য হয়ে গেল তখন, আবছা আলোর রেশ শুধু ছিল তখন ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। আর তাই বেঞ্চ থেকে উঠে সামনের দিকে পা বাড়ায়। তখনি কেউ মুখ চেপে ধরে। তারপরের আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন এই অন্ধকারে আবিষ্কার করে নিজেকে।
.
.
ভাবনার মাঝে তীব্র আলোর প্রতিফলনে চোখ ঝল*সে যাওয়ার উপক্রম হয় মানহার। ঘন্টা খানেক অন্ধকারে থাকার ফলে এরকম হয়। প্রায় দুই মিনিট পর চোখের পাতা ঝাপটে ঠিক করে তাকাতে পারে।
ওয়েস্টান ড্রেস পরিহিত দুজন মেয়ে তাকে ধরে চেয়ারে বসায়। তারপর একটা মেয়ে তার মুখের কাপড় সরিয়ে পানির গ্লাস সামনে ধরে। মানহা ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। যেন বহুদিন সে তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল।
তারপর জিজ্ঞাসা করে,
–” আমাকে এভাবে ব*ন্দি করে রাখা হয়েছে কেন? আমার পরিবার আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। আমাকে যেতে দিন?

মানহার কথার জবাব না দিয়ে পুনরায় তার মুখ বেঁ*ধে দেওয়া হয়! ছটফট করেও ঠেকাতে পারে না। আবারো তাকে একা রুমে রেখে মেয়ে দুটো চলে যায়। মানহার চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে আসে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। বুঝতে পারছে না কি অপরাধ করেছে সে? যার জন্য এমন শাস্তি পেতে হচ্ছে তাকে? মাথার মধ্যে হাজারো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে তার।

রাতের বেলা আবারো ঐ দুজন মেয়ে খাবার নিয়ে আসে। মানহা মুখের বাঁধন মুক্ত পেয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়ে দুজন এর প্রতিউত্তরে হু হা কিছুই বলছে না। যেন তারা কানেই শুনতে পাচ্ছে না! দুটো আজব প্রাণী বলে মনে হলো মানহার কাছে তারা।
একটা মেয়ে যখন মুখের সামনে খাবার ধরে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় মানহা। অর্থাৎ সে খাবে না। বেশ কয়েক বার খেতে বলার পর ও যখন খাচ্ছে না তখন তারা খাবার নিয়ে চলে গেল।
এমনিতেই রাগ করে বাসায় না খেয়ে ছিল তারপর থেকে না খাওয়া। তাই ক্ষীদায় পেট জ্বলছে তবুও বেঁধে রাখার কারণে খাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে যেকারো ই খেতে ইচ্ছা করবে না স্বাভাবিক।
.
.
সকাল বেলা,
জানালার কাঁচ বেধ করে সূর্যের আলোয় ঘুম ভাঙ্গে মানহার। রাতে ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে চোখটা লেগে আসছিল। চারিদিকে এক পলক তাকিয়ে দেখলো রুমটা খুব সাজানো গোছানো। রাতে খেয়াল করেনি সে। খাটের সাথে একটা চেয়ারে বেঁ*ধে রাখা হয়েছে তাকে। পিটপিট চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো গাছপালা কিন্তু কোন বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তাকে কোন গ্রামে আনা হয়েছে!

কিছুক্ষণ পর মেয়ে দুটো নাস্তা নিয়ে এসে সব বাঁধন খুলে দিল! রুমের সাথে এটাচ বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিতে বলে রুমের দরজা বাহিরে থেকে বন্ধ করে চলে গেল তারা।
বাঁধন মুক্ত হয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন মানহা। আপাতত হাঁটা চলা তো করতে পারবে। ওয়াশরুমের কথা স্মরণ হতে ঢুকে পড়লো।
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। খেতে ইচ্ছা করছে না কিন্তু পেটের মুচড় দেওয়ার কথা স্মরণ হতে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় খাবারের দিকে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে খাওয়া শুরু করে। বাবা বলতো খাবারের উপর যে রাগ করে সে প্রথম স্তরের বোকা। এই মুহূর্তে বাবার কথা মনে করে খেয়ে নেয় মানহা। কারণ এখান থেকে বের হতে হলেও তার শক্তি প্রয়োজন যা খাবার না খেলে কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
.
.
দ্বিতীয় দিন,
তাকে দিয়ে জোর করে কিছু লেখানো হয়। শূন্য স্থানের মতো কিছু যায়গা ফাঁকা রেখে লিখতে দেওয়া হয়! মানহা প্রথমে লিখতে না চাইলে তাকে ভ*য় দেখিয়ে বাধ্য করা হয়। ফলে মানহা লিখে দেয়। কিন্তু ঠিক কি লিখছে তা বুঝতে পারে না সে!
তৃতীয় দিন তার জন্য কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে আসে মেয়ে দুটো। বাসা থেকে নরমাল সেলোয়ার কামিজ আর উপরে বোরকা পরে বের হয়েছিল, সেই পোশাকে আজকে তিনদিন। কিন্তু সেই দিকে খেয়াল ছিল না তার। কাপড় গুলো দেখে মনে পড়লো। যাই হোক তবে জেদ ধরে কাপড় চেঞ্জ করে না সে। এই কাপড়েই আরো দুই দিন পার করে। তার কোন কিছুতে মেয়ে দুটো জোর করে না। শুধু বন্দি করে রেখেছে।

মানহা সবসময় ই মেয়ে দুটো কে জিজ্ঞেস করে কেন তাকে এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে? কিন্তু তারা কিছু বলে না। একদিন দুপুর বেলা একটা মেয়ে খাবার নিয়ে আসলে মানহা আবারো জিজ্ঞাসা করল,
–” আমাকে আর কতোদিন এভাবে বন্দি করে রাখবেন? আমি কি সারাজীবন এভাবে বন্দি হয়ে জীবন কাটাবো? কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে? আমার পরিবার ছাড়া এভাবে কাটাতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।

বলতে বলতে কেঁদে দেয় মানহা।
মানহার কান্না দেখে মেয়েটার বোধহয় মায়া হলো। তাই চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
–” আমি নিরুপায় বোন! আমাকে মাফ করবেন। আপনাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে আমি নিজেও জানি না! তবে খুব শীঘ্রই স্যার দেখা করবেন আপনার সাথে। তখন স্যারের কাছ থেকে জেনে নিবেন।

মানহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
–” স্যার কে?
–” যার ইচ্ছায় আপনি এখানে সে!
–” কে সে?

মেয়েটি আর কিছু বলল না রুমের দরজা লক করে চলে গেল।
.
.
মানহা প্রতিনিয়ত পালানোর ফন্দি আঁটে, কিন্তু কিছুতেই সুযোগ পায় না। পঞ্চম দিন দুপুর বেলা একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। যে সময় মেয়ে দুটো খাবার নিয়ে আসে ঐ সময় দরজার কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল! যেই মেয়ে দুটো দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো তখন মানহা দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে মেয়ে দুটো কে রুমে রেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিল! চারিদিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মেইন গেইট খুঁজে বের করে, বাড়িটা থেকে বের হয়ে আসে বাহিরে!

মানহা ঠিকই ভেবেছিল এটা একটা গ্রাম। আশেপাশে ফসলের জমি দেখা যাচ্ছে। আর সময় নষ্ট না করে বাড়ি থেকে বের হয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে দৌড়ে যেতে নিলে কারো সাথে লেগে পরে যায় মানহা। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যাথার কথা না ভেবে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়াতেই সামনে থাকা লম্বা দেহের, সুদর্শন যুবককে দেখে দু-কদম পিছিয়ে যায় সে…

#চলবে?

আগুনের দিন পর্ব-১১+১২ এবং শেষ পর্ব

0

আগুনের দিন ১১ ও ১২
শেষ পর্ব

নিশা একটা ঘোরের ভেতর ছিল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ওর সেই ঘোর আরও বাড়িয়ে দিলো।
নিশার মেজকাকার ছেলে শান্ত বাড়ির বাইরে শফিকসহ আরও দুইজনকে ঘোরাফেরা করতে রেজিনাকে এসে জানাল গোপনে।
মেয়ের বদনাম ছড়ানোতে তার নিজেরই ভূমিকা অনেক বেশি, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে রেজিনা বুঝে দেখল। মেয়েদের নামি জায়গায় পাত্রস্থ করার স্বপ্ন রেজিনার মাথায়। শফিকের কোনো আয় রোজগারের ব্যবস্থা নেই। সম্পত্তির কথা যেটা শোনা যায় সেটা ফাঁকা। যে জমিগুলো শফিকের বাবা দেখাশোনা করে তাতে শরীক আছে সাতঘর। এখন সব আয় শফিকরা ভোগ করলেও কোনো না কোনোদিন তো শরীক সম্পত্তি বুঝিয়েই দেওয়া লাগবে।
নিশার ছোটোকাকা মারুফ শফিককে জিজ্ঞেস করলেন ‘এতরাইতে বাড়ির সামনে কী করিস, শফিক?’
নিশ্চুপ শফিকের হয়ে উত্তর দেয় আকবর ‘এমনেই কাকা। কী একটা গরম পড়ছে না, তাই রাস্তা দিয়ে হাঁটতেছি।’
‘আমার তো তা মনে হইলো না।’
রেজিনার আর সহ্য হলো না। অধীর হয়ে বলে উঠলেন, ‘নিশার কাছে চিঠি কে দিছো? তুমি?’
কেউই কোনো উত্তর করল না।
‘কাল সকালে আমরা বাড়ি চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিন কোনোভাবে আমার মেয়ের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবা না। আমার মেয়েটা অনেক নরম। ওর মনে আর কোনো কষ্ট হতে আমি দেবো না।
শফিক বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।

রেজিনা ওর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তোমরা হলে খোঁয়ারের মোরগ। খোঁয়ার থেকে বের হও সকালে, সন্ধ্যেবেলায় সেই খোঁয়ারেই ঢোকো। এদিক ওদিক পরের ধানক্ষেতে মুখ দেওয়া কেন বাপু? যেমন যোগ্যতা তেমন মেয়েকে চিঠি দিতে পারো না? তোমার ওই চিঠিতে এত বানান ভুল তত ভুল তো আমার মেয়ে সারাজীবন পরীক্ষার খাতায়ও করেনি।’

শফিক মাথা নিচু করে সবটা হজম করে নিলেও, নিশা কাল সকালে চলে যাবে, এই সংবাদটা ওর বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। ও অপেক্ষা করতে পারত, নিশার মুখ থেকে কোনো একটা আশ্বাস পেলে ও ঠিক অপেক্ষা করে থাকতে পারত কিন্তু এখন যেন আর সেটা সম্ভবই না।

*****

মস্ত এক পরিকল্পনা করল শফিক। সেটা জহির আর আকবরকে বলতেই ওরা অবাক হয়, ‘কী কও? সত্যি সত্যি বিয়া করবা?’
‘না, করব না তো করব কী?’ শফিককে চিন্তিত দেখায়।
‘এইডা কেমন হইলো? প্রেম করা দূরের কথা, মাইয়ার সাথে কথাই তো বলতে পারলা না। আমি কিছুই বুঝতেছি না।’
‘বোঝা না বোঝার কিছু নাই। এখন পিছায়ে আসলে ভাইয়ের মানসম্মান থাকবে? সবাই বলবে না, ভাই ভয় খাইছে? ভাইয়ের পাওয়ার নাই?’ আকবরের কথায় আরও চিন্তিত দেখায় শফিককে।
‘যাই বলো, এইটা কেমন? থানা পুলিশ হতে পারে। মারামারিও লাগতে পারে!’ জহির ফুট কাটে।

‘লাগবে না? মাইয়ার মা আদর করে ডাকবে, আসো আমার মেয়ের সাথে প্রেম করো?’ জহির ভেংচি কাটে।

‘আরে তোরা থাম? হইছে তো হইছে। নিশারে আমার পছন্দ হইছে, বিয়া করবো। কাজ শেষ৷ হইছে, হবে একটু ঝামেলা। সমস্যা কী?’

‘সত্যিই ভাই। এত পছন্দ হইছে তোমার? কেমনে?’ আকবর আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে।

‘ওই, কেমনে মানে কী? তোগো ভাবি হবে। সামলায় কথা বল!’

জহির খিলখিল করে হাসে ‘ভাই বড় গাছে নাও বানছে! বুঝস না ক্যান আকবইরা? রূপ ধুইয়া পানি খাবে? রূপ তো অন্দরে থাকে। ভাই টাকার বিছানাত ঘুমাইবে, ভার্শন থ্রি চালাইবে! ভুউউম ভুউউম!’

‘বাজে কথা কইস না। যা যা ভাগ তোরা, আমি সবাইরে ডাকি। রাত পোহাবার আগেই রেডি থাকতে হবে।’

‘ভাই তুমি শিওর? ভাইবা দেখো কিন্তু!’

‘এখন আর ভাবাভাবির কিছু নাই। চ্যালেঞ্জ দিলো আমারে নিশার মা। শফিকরে না চিনেই চ্যালেঞ্জ দিলো। ভাবছে আমি ভয় খাবো। ভয় খেয়ে পিছিয়ে যাবো। এখন পিছায়ে আসার কোনো সুযোগ নাই। ফসকাইলে মানুষ মাইজ্ঞা বলবে।’

‘সেইটা বলুক, মেয়েটারে কি আসলেই পছন্দ তোমার? নাকি ঢিল ছুঁড়ছিলা শুধু?’

‘আবার বাজে কথা বলিস। নিশারে আমার পছন্দ। জোর করতেছি এইটা হতে পারে, কিন্তু ওরে আমি সত্যিই মন দিছি। ভালোবাসছি।’

‘একদম সিনেমার মতো ভালোবাসা দেখি, ভাই? আয় হায় ভাই, তুমি তো একদম ফিল্মের হিরোদের মতো কথা কচ্ছ!’

আকবরের কথায় শফিকের বুকের ছাতি আরও একহাত ফুলে ওঠে!

*****

নিশা কেঁদেকেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বিনাকারণে এত কটু কথা শোনার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। এখন ওর মরে যেতেই ইচ্ছে করছে। রেজিনাকে ভালোমতো চেনা আছে ওর, প্রতিদিন অন্তত একবার করে নিশাকে এই ঘটনার খোঁটা দেবে সে। এই তো একটু আগেই বলে গেল ‘কী রুচি তোর নিশা? প্রিয়া? ছিঃ! সাধে কি আমি বলি, শকুন উপরে থাকলেও নজর থাকে নিচের দিকে।’

আবার ঘুরে এসে ব্যাঙ্গ করে যাচ্ছে ‘ও প্রিয়া, প্রিয়া রে? এখন থেকে তোকে আমি প্রিয়া বলে ডাকব। ঠিক আছে?’

নিশা বুঝে গেছে, সামনের দিনগুলো অসহ্য হতে যাচ্ছে ওর জন্য!

ব্যাগ গুছিয়ে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তেমাথা পর্যন্ত যেতে যেতেই নিশাদের রিকশাভ্যানটা পথে আটকালো শফিক।
‘এই ছেলে কী সমস্যা?’ রেজিনা ঝাড়ি দিয়ে উঠল।
‘নিশা যাইতে পারবে না!’
‘তোমার কথায়?’
‘শুধু আমার কথা না, নিশাও এইটা চায়! ওরে জিজ্ঞাসা করেন?’
রেজিনা চোখ উঁচু করে তাকাল মেয়ের দিকে, ‘তাই? তুই এইটা চাস? উত্তর দে? বল, না বল?’
থাপ্পড় খেয়েও চুপ করে থাকল নিশা।
রেজিনা বুঝে গেল মেয়েও এটাই চাইছে।
চার পাঁচটা ছেলে ঘিরে ধরেছে ওদের ভ্যানটাকে। রেজিনা উপায় না পেয়ে বলল,
‘তোমার বাপেরে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারবা?’

*****

‘এইগুলো মনে হয় ইমিটিশন, নাকি নাতবউ?’ মহিলাটা নিশার মুখের অনেকখানি কাছে এসে একটা একটা গয়না পরখ করে দেখছে আর কথা বলছে। পানখাওয়া গাল থেকে থুতু ছিটকে এসে নিশার সারামুখ ভরে যাচ্ছে।

নিশা উত্তর দেওয়ার আগেই শফিকের মা বলে উঠলেন ‘না, কইলো তো সবই সোনা। মেমোবিলও সাথে দিয়ে দেছে।’

‘ওরে বাবা!’ ঠোঁট উল্টালো মধ্যবয়সী মহিলাটা। তারপর ফার্নিচারগুলো দেখতে থাকল আর খুঁত খুঁজতে থাকল ‘নারে নাতবউ, ভালো ঠকানি ঠকছিস তো, এইগুলো একটাও সেগুনকাঠ না। সব আকাশীকাঠ। দুইপাঁচবছরেই ঘুনে খাইবো।’

একটু ঘুরে এসে বলল ‘ফিরিজও আনছে বউ?’ বিস্ময় ঝরে পড়া গলা সামলে নিয়ে বলল ‘আমাগো বাড়ির শাহজাহানের বউ আরও বড় ফিরিজ আনছে। আর কী ঢক সেই ফিরিজের, আয়না লাগে না, মুখ দেখা যায় চকচকা।’

‘হু’ আস্তে করে উত্তর দিলো শফিকের মা৷ ছেলের বউ হিসেবে নিশাকে তার একেবারেই পছন্দ না। নিতান্তই ছেলের জেদের কাছে হেরে গিয়েছেন। এই গয়না আর ফার্নিচারগুলোই তার স্বান্তনা। তাতেও দোষ ধরায় তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে৷

বয়স্কা মহিলাটা এবার কথা ঘোরালেন ‘কইস কী আলেয়া , এত জিনিস দেছে? সব বউর বাপেই দেছে? খাট, সোকেস, আলমারি, ওয়াড্রুপ, টিবি সব? সত্যই? বউর বাপে কী রাজা নাকি? তোগো গ্রামেরই পোলা নাকি শুনছি?’

‘হয় খালা। তারা শহরের বড় মানুষ সত্যই।’

‘কী কইস। এমন আচানক লাগে। কী দেইখা তোর পোলারে এত জিনিস দিলো?’

এইবার মেজাজ হারালেন শফিকের মা ‘তাগো মাইয়ারও তো তেমন শ্রী কিছু নাই। ওই চেহারা পার করতে এমন বহুৎ কিছু দেয়াথোয়া লাগে। একখান গাড়িও তো দেওয়া উচিত শফিকরে।’

‘দিবো কইছে?’

‘কয়নাই৷ শফিকের অনেক শখ একখান গাড়ির। আমরাই দিতাম। পোলার বিয়া দিয়া এখন হাতটান। এখন বউই বলবে তার স্বামীর শখের কতা। আমাগো কী, যা থাকবে তার আর তার স্বামীরই থাকবে। মেয়ে যা বুইঝা আনতে পারে।’

বয়স্ক মহিলাটা সম্পর্কে শফিকের মায়ের খালা হন, ভাগ্নির কথার জোর আরও বাড়াতে বললেন ‘হয় হয় আনবো না তো কী! আনবে। নইলে ওই চেহারা নিয়ে স্বামীরে বানবে ক্যামনে!’

নিশা মনে মনে শফিককে খুঁজতে থাকল। বিয়েবাড়ির ঝামেলায় অনেক রাত হয়েছে, এইঘরে নিশাকে বসিয়ে রেখে কোথায় চলে গেছে শফিক, ও থাকলে অন্তত জবাব দিতো এইসব বিশ্রী আলোচনার।

কিন্তু জবাব এলো ঊষার কাছ থেকে। নিশাকে চুপিচুপি বলল ‘বুবু, হাউ ডু ইউ উইল গেট ফিট ইন দিজ? দিজ উইমেন আর রিয়েলি স্যাভেজ।’

‘প্লিজ ঊষা, স্টপ ইট!’

‘ইউ কান্ট সারভাইভ হেয়ার, আই ক্যান ফোরসি ইট!’

‘শফিক লাভস মি!’

‘হুহ! হি ইজ দ্য মেইন কালপ্রিট। আ প্রিটেন্ডার, ইমপোসটার!’

‘প্লিজ, ঊষা!’ ফিসফিস করে বলে নিশা।

‘শান্ত, মাহিন আছে এখনো। ওদের সাথে করে আমি দাদির কাছে চলে যাচ্ছি। তোর এই দারুণ শশুরবাড়িতে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার!’

যাওয়ার আগে আবার এসে নিশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে ‘পড়াশুনা কি ছেড়ে দিচ্ছিস বুবু?’

‘না তো! কেন বললি এইকথা?’

‘এরা তোকে পড়তে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। চাকরিবাকরি করা তো অনেক দূর! যৌতুকের টাকায় ঘর সাজাবে কিন্তু বাড়ির বৌ চাকরি করলে ইজ্জতশেষ – এরা সেই দলের মানুষ!’

‘শফিক সব সামলে নেবে।’

‘তোকে বলেছে সে?’

‘না আমি জানি। আমার মন জানে। ও আমাকে ভালোবাসে ঊষা।’

ঊষাও আর তর্ক করল না। বয়সের চাইতে বুদ্ধি বেশি ওর। ও তাকিয়ে বড়বোনের আনন্দ ঢলঢল মুখ দেখতে থাকল। ওর খুব বলতে ইচ্ছে করল ‘মন বলে কিছু নাই বুবু। সব মস্তিশকের ছোট খুপরিটাকে থাকে। ওইখানে দুইরকম তথ্য, অনুভূতি তৈরি হয়। যেটা ইললজ্যিকায়াল ইনফরমেশন, আমরা জানি সেটা লজিক্যাল না, জেনেও সেটাকে মনের দোহাই দিয়ে আমরা যাস্টিফাই করার চেষ্টা করি!’

আজকে বাসররাত নিশার। শফিকের। নিশা অনেক অপেক্ষা করে আছে, শফিকের জন্য। শফিক এলো একটু রাত করে। নিশার জন্য দুটো গোলাপ নিয়ে এসেছে। লালগোলাপ। ওদের বাজারে পাওয়া যায় না। পাশের গ্রামে অজিত কুমার নামে এক লোকের বাগান আছে গোলাপের। সেখানে লোক পাঠিয়ে আনতে দেরি হয়েছে।

গোলাপের সুরভিতে ঘরের দমবন্ধ পরিবেশ আর নিশার মনের সমস্ত বন্ধ অলিগলি একসাথে খুলে গেল। ভীষণ আহ্লাদে পরিপূর্ণ হলো নতুন দাম্পত্য। এত ভালোবাসাও অপেক্ষা করেছিল ওর জন্য, এত সুখ – অবাক হলো নিশা!

এক জীবনে মনে হয় আর চাওয়ার কিছু নেই ওর, সুখী দাম্পত্যের ক্লান্তিতে বিলীন হতে হতে মনে হলো নিশার!

১২.

‘এইগুলো কী রান্না করছ মা? ভাত না জাউ?’

নিশা প্রমাদ গোণে। শফিকের মা না, ভাত রান্না করেছে নিশা। এই বাড়ির নিয়ম ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগে ঘুম থেকে উঠে, অযুগোসল করে ভাত রাঁধতে হয়। বেলা শুরু হওয়ার আগেই বাড়ির পুরুষেরা ভাত খেয়ে নেয়। তারপর তারা মাঠে চলে যায়। কৃষিভিত্তি গ্রামবাংলায় এই প্রচলন নাকি আবহমান কাল থেকে। সোনালি রোদে ঝিকিমিকি করার আগেই, পেটপুরে ভাত খেয়ে, কৃষক ক্ষেতে চলে যেত – গামছায় বেধে সানকিভরা নুন আর পানিদেওয়া ভাত, কাঁচা পেঁয়াজ, মরিচ নিয়ে। দুপুর পর্যন্ত কাজ করে, কোনো এক ছায়ায় বসে সেই পান্তায় পেট ভরিয়ে, খানিক জিরিয়ে তারা আবার কাজ করত। বিকেলের দিকে দুটো কুঁচোচিংড়ি নইলে জালে টানা জ্যান্ত মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরলে আবার রাতের রান্নার আয়োজনে বসত বউঝিরা। হাটবার ছাড়া বড় মাছ বা মাংসের জোগান পাওয়া যেত না, তাই গাছের কলাটা, মুলোটা দিয়েই দিন পার হয়ে যেত। সেই সময় আর নেই, কৃষকের সেইদিন নেই, হাটবাজার এখন রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু কিছু কিছু বাড়িতে এখনও ওইসব নিয়ম মেনে চলে। শফিকদের বাড়িতেও সেইরকম৷ সকালে আর রাতের খাবারই প্রধান। দুপুরে কোনোরকম ভাতেভর্তার ব্যবস্থা।

রেজিনার কড়া শাসনে, নিশাদেরও অভ্যাস সকালে ঘুম থেকে ওঠা। ছটা বা সাতটায় ঘুম ভাঙত নিশার, তারপর হাতমুখে পানি না দিয়েই পড়তে বসা। কিন্তু সেই ঘুম ভাঙা আর এই ভোরভেলায় উঠে দশবারোজনের ভাত লাকড়ির চুলায় রান্না করা এক কথা নয়। আজ একটু ঘুমের ঢুলুঢুলু হয়েছিল চোখদুটো, বসে থেকে চোখ লেগে এসেছিল, তাতেই ভাত বেশিসেদ্ধ হয়ে গিয়েছে। শফিক ভাতের থালায় লাথি মেরে উঠে চলে গেল।

শাশুড়ি বলে উঠল ‘ভাত হইবো ঝরঝরা, একটার গায় আরেকটা লাগবে না আবার চাইলের মাইঝও থাকা চলব না। ভাত রানতে হবে যত্ন দিয়া। একটু চোখের আড়াল করবা, একটু অযত্ন করবা, একটু তাড়াহুড়া তো শেষ! হয় চাইল নইলে জাউ! বউ আনছি ঘরে, যেমন সুরত তেমনি কামকাজ। সংসারে একটা টাকা দেওয়া নেই, গণ্ডেপিণ্ডে গেলার কামেই আছে শুধু!’

শফিক ভালোবাসে নিশাকে, তাই সব সহ্য করে নেয় নিশা। কিন্তু এই খাওয়ার খোঁটা বড় কষ্ট দেয় ওকে। শফিককে বড় আদর করে কোনো একটা কাজ করার কথা বলে ও। তাতেই শফিক একেবারে ছ্যাৎ করে ওঠে। ‘না খাইয়া থাকো তুমি? ল্যাঙটা থাকো? এত চাহিদা কেন? আমাকে চাকরি করতে বলছ? আমি করব চাকরি? পরের মাহেনদারি? চাকর হবো, আমি শফিক?’

নিশা বোঝাতে চেষ্টা করে ‘কোনো কাজই ছোটো না শফিক। আর চাকরি করলেই তাকে চাকর বলে না।’

‘এই বিদ্যা তোমার? চাকরি যে করে তাকেই চাকর বলে। চাকর – চাকরি, সোজা হিসাব তো! বিএপাশ করলে বুঝতে।’

নিজের শিক্ষা জাহির করতে যায় না নিশা, আস্তে করে বলে ‘কিন্তু বেকার থাকা কি ভালো?’

‘মা কিছু বলছে, না? ভাইবো না। ভালো একটা লাইন পাইছি। ধরতে পারলেই লাখ লাখ টাকা। এখন আসো তো, আমার নিশিরাণি, নিশির রাণি, কাছে আসো, আদর করে দাও আমাকে।’

শফিকের সামর্থ্যবান বাহুতে মুখ লুকাতে লুকাতে নিশা ভাবে, সত্যিই তো এই এতখানি ভালোবাসা পাওয়ার পরেও এত কীসের চাহিদা ওর!

*****

শফিকের দুইবোন নিশার বয়সীই, ওরা বাড়ির মেয়ে বলে জামা, সালোয়ার পরায় বাধা না থাকলেও বাড়ির বউ হিসেবে নিশার শাড়ি পরা বাধ্যতামূলক। শাড়ি সামলাতে ওস্তাদ এখন নিশা। আরও আরও কাজে ওস্তাদ না হতে পারলেও সবকিছুই করতে হয় ওকে। ধান সিদ্ধ করা, চাল ঝাড়া, হাত পুড়িয়ে মরিচ পরিস্কার করা, মাছ কাটা, রান্না – গেরস্তবাড়ির সব কাজ।
সব পারলেও গোবরের ঘুঁটে দিতে একেবারেই রুচি হয় না ওর। জনি আর সনি টিটকারি করে তখন, গান করে ‘বড়লোকের বেটি লোওওও!’

নিশা চেষ্টা করে হাতে হাতে দ্রুত কাজ করে দিতে। কিন্তু শাশুড়ির মনমতো হয় না। সবকিছুতে দোষ ধরা পড়ে। ‘আলুর চুকলা এর মোটা করে ফালাইলা ক্যান? আমি কী রাজার হাতিশাল খুইলে বসছি?’

‘রুটি গোল হয় না ক্যামনে? মায় শিখায়নাই? জামাই নিয়া ভরসন্ধ্যায় দরজা দিতে তো ঠিকই শিখাইছে।’

‘জামাকাপড়ে এত সাবান মাখানি কীসের। অল্প একটু গুঁড়ো নিয়ে ভালো করে খেচে খেচে কাপড় ধুতে হবে। সাবান তোমার বাপে দিয়ে যায় না। দুইটা মানুষ বসায়ে খাওয়াচ্ছি। একটু তো রহম করো!’

প্রতিদিন খাওয়ার খোঁটা নিশার অভ্যাস হতে চায় না কিছুতেই। শফিককেও কিছু বলা যায় না। চেষ্টা তো করেই শফিক! একটা সেলুন দেওয়ার আগ্রহ খুব। নাপিত পাওয়া গেছে। খুব ভালো কাজ জানে। বাজারের উপর ভালো জায়গায় দোকান বসিয়ে, ডেকোরেশনও সুন্দর করতে পারলে আর ঠেকায় কে? বুড়োনাপতে সমাদ্দারের দিন শেষ। শফিককে আর পায় কে তখন?

মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতিরও এখন চালু ব্যবসা। তিন পার্সেন্ট হাতে জমা টাকার ঋণের উপর পনেরো পার্সেন্ট সুদ। লোকের টাকা দিয়েই ব্যবসা, লোকে টাকা জমা রাখবে, সেই টাকা লোন নেবে, সেই লোনের সুদ নিয়ে শফিক মালামাল।

শহরে একটা রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকানও দেওয়া যায়। মোবাইল আর মোবাইল এক্সেসরিজেরও বিরাট ব্যবসা এখন।

এত এত ব্যবসার আইডিয়া ঘুমাতে দেয় না শফিককে। অল্প পরিশ্রমে অনেক টাকা আয় করার কত কত কায়দা জানা আছে ওর!

কিন্তু সবকিছুর আগে সিনেমায় যেতে হবে। সিনেমার নায়ক হতে হবে৷ শফিকের চেহারা যেকোনো নায়কের চাইতে ভালো, এই কথা সবাই বলে। আর একটিং তো ও জানেই। মালোপাড়ার তাপস, এফডিসির পাশেই এক রেস্টুরেন্টে চাকরি করে। পরিচালক মালেক আফসারি নাকি প্রায়ই ওখানে আসে। তার ড্রাইভারের সাথে তাপসের ভালো খাতির আছে। একটা লাইন ও করে দিতে পারবে। তবে কিছু টাকা লাগবে। বাবার কাছ থেকে এই টাকাটা বের করা যাচ্ছে না। কোথা থেকে বের হবে, সারাবছরের এতবড় পরিবার আর সমাজ নিয়ে চলার খরচ সব আসে জমির বিভিন্ন ফসল থেকে। জমি আছে প্রচুর কিন্তু শরিকও তো অনেক। সবাই জমিটাই দেখে। এই জমিগুলো কতগুলো মানুষের অন্নসংস্থান যোগায় তা দেখে না। শফিকদের ভাগে কতটুকু সম্পত্তি তার আয়ে ভালো খেয়েপরে চলা যায় শুধু। জনি, সনির বিয়ে দিতে হলেও জমি বেচা লাগবে। রফিকের পড়াশোনার জন্যও গতবছর তামাকের ক্ষেত বেচা লেগেছে দুইখান। তাই তো শফিকের বাবা সারাদিন খিটমিট করে, ছেলেরা এখনো ইনকাম করছে না কেন?

শফিক দুএকবার ভেবেছে নিশাকে বলবে ওর বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা এনে দিতে। কিন্তু বিয়েটাই হয়েছে এক অদ্ভুতরকমভাবে। নিশার মা নিজে বিয়ের কথা বলেছিল শফিককে, নিশার বাবার অমতেই। শফিক শর্তমত, বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনদিনের মাথাতেই বিয়ের আয়োজন করে ফেলে রেজিনা। মইন সাহেব এসে সব দেখে রেগে গিয়েছিলেন, লোকমুখে শফিক শুনেছে মেরেছেনও নাকি তিনি নিশার মাকে। সে ওইরকম দজ্জাল মহিলার ওইরকম শাস্তিই হওয়া উচিত, শফিক খুশি হয়েছে মনে মনে। নিশার দাদির হস্তক্ষেপে বিয়েটা নিয়ে মইন সাহেব আর ঝামেলা করেননি, অলংকার, ফার্নিচার সবই দিয়েছেন নিশাকে। কিন্তু নিশার মা আবার পল্টি খেয়েছে। নিশার সাথে সম্পর্কছেদ করেছে। নিশার নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে, এই বিয়ে তিনি মেনে নিয়েছেন কিন্তু নিশার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। নিশাকে আর ঘরে নেবেন না তিনি। বিয়ে, বউ পেলেও শ্বশুরবাড়ি আর পাওয়া হয়নি শফিকের। আর নিশার মাও মিথ্যা হুমকি দেয়নি, সত্যি সত্যিই সে আর যোগাযোগ করেনি নিশার সাথে। ঊষা, মাহিন, নিশার বাবা ফোন করে খোঁজ নেয়, কিন্তু মহিলা অতি পাষান।

নিশাকে টাকার দরকারের কথা বলতে গিয়েও শফিক থেমে যায় তাই। এই বিয়েটার আসলেই ওর কোনো দরকার ছিল না মনে হয়। সাততাড়াতাড়ি বিয়ে, শ্বশুরবাড়ি নিলো না একবারও জামাইকে, একটা মটরসাইকেলের শখ ছিলো তাও মিটলো না। বেকার বলে আগে খোঁটা শুনলেও মা আড়াল করে নিতো, এখন শফিকের মা নিজেই ছেলের উপার্জনে অক্ষমতা নিয়ে কথা শোনান। নিশাকেই শোনান কথা, কিন্তু তা শফিকের কানে এসেও ঢোকে।

নিশাকে ভালোবাসে শফিক। এটা সেটা কিনে দিতে ইচ্ছে করে। নতুন বউকে উপহার দিতে ইচ্ছে করে।অথচ প্রয়োজনীয় জিনিস আনতেই বাবার কাছে হাত পাততে হয়। নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে না ও, তাই ভালোবাসা ভারী পড়ে যায়। পরিস্থিতিতে পড়ে এখন মনে হয়, বিয়েটা না করলেই ভালো হতো।

*****
পড়াশোনাটাও করা দরকার, নিশার মনে হয় এখন। সব কাজ সেরে দুপুরে খাওয়ার পর ও দাদীর কাছে যায়। এইবাড়িতে কোনো না কোনো কাজে ডাক পড়ে যায়। হয়তো শ্বশুরের কাছে কেউ এসেছে, চা করে দিতে হবে। ডাক পড়বে ‘বড় বৌ?’

রান্না শেষে ভাতের হাড়ি চুলার পাশেই রাখা ছিলো, কুকুরে মুখ দিলো কীনা। ‘বড় বৌ? ভুলুক দিয়ে দেখো তো?’

‘মুরগির ছাওগুলারে বেজিতে নিলো নাকি?’

‘দুইটা চাইল ভাজো, বৌ? নারকেল কোরায়ে দেও সাথে।’

সনি এসে বলবে ‘ভাবি মাথায় তেল লাগায়ে দিতে পারবা?’ তো আরেকজন বলবে ‘কলেজের জামা ইস্ত্রি করে দিছো?’

অথৈ সংসারে নিশা খাবি খেতে থাকে। তাই দাদির কাছে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ। ঘন্টাখানেক বইখাতা নাড়াচাড়া করে। ভর্তিপরীক্ষা তো দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কত স্বপ্ন। কোচিং করা হলো না। এখন পড়াও হচ্ছে না! তবু একটু চেষ্টা করে ও।

মাঝেমাঝে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে যায়। মাগরিবের আযান পড়ে যায়। একা একা ফিরতে গেলে, রাস্তার দুইপাশের গাছের মাথার অন্ধকার আর বাগানের মাঝে নেমে আসা অন্ধকার থেকে ভুত পেত্নি সব নেমে আসে। শফিক নিতে আসে তখন ওকে। বাড়ির ভেতর ঢোকে না ও। বাইরে থেকে নিশাকে ডাকে। নিশার নাম ধরে ডাকে না। ‘প্রিয়া’ বলে ঠিক দুবার ডাকে। ডাকটা কানে আসতেই নিশার কানলাল হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য কানে অন্য কোনো শব্দ ঢোকে না। সব পাওয়া আর না পাওয়া মিলিয়ে যেতে থাকে চোখের সামনে। অনভ্যস্ততায় গৃহস্থ চাষীবাড়িতে সারাদিনের পরিশ্রমের মূল্য হাতের মুঠোয় ধরা দেয় যেন…

উড়তে উড়তে এসে শফিকের হাত ধরে ও। দুজনে অর্জুন গাছের নিচে দিয়ে হেঁটে যায়। কখনো চাঁদের আলোয় একটু বসে। পাশ দিয়ে কেউ যাওয়ার সময় পরিচয় জানতে চায়। শফিক সলজ্জ হেসে জানায় ‘আমি কাকা, শফিক। আর আমার বউ।’

আফসানা আশা

প্রিয় পাঠক আগুনের দিনের সমাপ্তি এখানেই। আমরা ভেবে নিই নিশা সুখী হয়েছে।

আগুনের দিন পর্ব-১০

0

আগুনের দিন – ১০

‘এই চিঠি কোথায় পেয়েছিস? কে দিয়েছে তোকে’ কাগজটাতে চোখ বুলিয়েই জিজ্ঞাসা করল রেজিনা।

হঠাৎ করে উত্তর এলো না নিশার কাছ থেকে। ও থতমত খেয়ে চুপ করে থাকল।

‘বল? কার চিঠি? কে লিখেছে?’

‘ময়নার চিঠি, মা। ময়নাকে একজন দিয়েছে’ মরিয়া হয়ে জবাব দিলো নিশা। ‘তুমি কাউকে বোলো না, মা, ওর মা তাহলে ওকে খুব বকবে।’

‘ময়নার চিঠি তোর কাছে কেন’ নিশার উত্তরে সন্তুষ্ট না রেজিনা।

‘আমাকে দেখতে দিয়েছিল। তারপর আমার কাছেই রেখেছি। তুমি কাউকে বোলো না মা।’

‘এসব করতেই গ্রামে এসেছ, বুঝেছি আমি। আমার সারাজীবন বেগার খেটেই গেল। তোমাদের মানুষ বানাতে পারলাম না। আমি এখনই সবাইকে বলব।’

‘আম্মু প্লিজ। প্লিজ আম্মু। আমি রিকোয়েস্ট করছি তোমাকে। প্লিজ!’

রেজিনা নিশাকে কোনো উত্তর না দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে গোসল করতে শুরু করল। টিউবওয়েলের চাতাল বেয়ে ইট বসানো পানির নালা দিয়ে সরসর করে পানি চলে যাচ্ছে। নিশারও সবকিছু সেই পানির সাথে তীব্রস্রোতে ভেসে যাচ্ছে মনে হলো ওর। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি করে সরে এলো নিশা। দুচোখ হন্যে হয়ে ময়নাকে খুঁজছে।

ময়না গোসল করে এসে চুল ঝাড়ছে। নিশা হন্তদন্ত হয়ে ওকে চেপে ধরল ‘ময়না, বিপদ হয়েছে।’

‘কী? কী করছ তুমি আবার?’

‘মা চিঠিটা পেয়ে গেছে’ কাচুমাচু হয়ে বলল নিশা।

‘কোনটা? কেমনে পাইলো? কই রাখছিলা তুমি?’

‘ময়না, প্লিজ। মা জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবা ওটা তোমার চিঠি।’

‘আমার চিঠি মানে?’

‘মানে, কেউ তোমাকে লিখেছে।’

‘কে? কে লিখেছে?’

‘সুমনের কথাই বলবা।’

‘অসম্ভব’ নিজের এতদিনের গোছানো পরিকল্পনা চোখের সামনে মাঠে মারা যেতে দেখল ময়না। সুমনের নামটা প্রকাশ্যে এসে গেলে ওর মহাসর্বনাশ। প্রায় বেকার ছেলের সাথে ময়নাকে কেউ বিয়ে তো দেবেই না, উলটো এমন কিছু হবে যাতে সুমনের নামও আর কোনোদিন মুখে আনার জো থাকবে না। ‘একটা চিঠি সামলায়ে রাখতে পারো না, তোমার দায় আমি নেবো কেন? এইটা পারব না নিশা।’

ততক্ষণে বাড়ির ভেতর তুলকালাম করে নিয়েছেন রেজিনা। সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে এসে সামলে রাখতে পারেনি বলে শাশুড়ী, দেবর, জা সবাইকে দোষারোপ করলেন। সবাইকে চিঠির টুকরোটা খুলে জোরে জোরে পড়ে শোনালেন। লজ্জায় নিশা দশহাত মাটির নিচে চলে যাচ্ছে যেন।

রেজিনা মইন সাহেবকে ফোনে গালাগাল করে বাড়ি মাথায় করে নিলেন, ‘এই প্ল্যানে তুমিও আছ? তোমার মা কারসাজি করে মেয়ে নিয়ে গ্রামে এলো, এইখানে তারে নিয়ে এই ষড়যন্ত্র তুমিই করিয়েছ? এইজন্যই তো বলি, মেয়ে আমার কখনো অনুমতি ছাড়া চোখের পলক ফেলে না, আজ এতবড় কাহিনি কীভাবে ঘটিয়ে ফেলল?’

‘সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তুমি অনেক দূর চলে গেছ। এইবয়সে এইরকম চিঠিফিঠি আসেই। মেয়েরাও দেয়। কয়েকদিন যেতেযেতেই সব ভুলে যাবে।’

রেজিনাও জানে তা। কিন্তু তার যে ফেসলস হলো সেটাই সে হজম করে উঠতে পারছে না। নিজের সন্তান লালনপালন নিয়ে তার অহংকার ছিলো সেটা আজকে গুঁড়িয়ে গেছে, আর তাও যাদের তিনি শত্রুপক্ষ মনে করেন সেই দেবর, জা, শাশুড়ীর সামনে। একটা এসপার ওসপার করতেই হবে।

‘শোনো নিশার আব্বু, এই ব্যাপারে একটা কথাও আমি শুনব না।’

‘কী করবে তুমি? এত বাড়াবাড়ি করছ কোন সাহসে? আমি নেই তাই?’

ফোনটা কেটে দিলেন রেজিনা, তারপর বাতাসী বেগমকে ফোন করলেন।

‘হ্যালো বাতাসী আপা?’

‘হ্যাঁ আপা বলো?’

‘কেমন আছ?’

‘আছি ভালো। কুশল জিগাইতে ফোন দিছো?’

‘না ঠিক তাও না। ওই যে তুমি একটা প্রস্তাব এনেছিলে, নিশার জন্য। আমি ওর আব্বুর সাথে কথা বলছিলাম। ভেবে দেখলাম, মেয়ে বিয়ে তো দেবোই, তো বছরদুই আগে দিলেই বা সমস্যা কী?’

‘এই তো লাইনে আসছ।’

‘কিন্তু আমরা একটু খোঁজখবর নেব’

‘সে ঠিক আছে। কিন্তু সেইদিক তো তুমি খেদায়ে দিলা। তারা এখন ছেলের বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক করছে কীনা কইতে পারি না। আমি কথা বইলে তোমারে জানাচ্ছি।’

‘আচ্ছা। ফোন দিও তাড়াতাড়ি। আমারও তো গোছগাছ আছে। কিছু নেবে না বললেই কিছু দেবো না, তা তো না।’

‘আচ্ছা, এই আধাঘন্টা একঘন্টার ভেতর ফোন দিচ্ছি আমি।’

নিশা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো, রেজিনার কথা শেষ হতেই পা জড়িয়ে ধরল। ‘আম্মু আমি কিছু করিনি৷ কোনো অন্যায় করিনি।’

‘করোনি। সুযোগ পাওনি তাই। সুযোগ পেলে অবশ্যই করতে। কিন্তু তুমি কবে সুযোগ পাবে আর আমার মুখে চুনকালি লাগাবে সেইপর্যন্ত তো তোমাকে সময় দিতে পারব না, মা।’

‘আম্মু আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।’

নিশার দাদি চুপ করে থাকতে পারলেন না আর এগিয়ে এলেন, ‘আহা, নিশার মা৷ করো কী? একটা না হয় ভুল মেয়ে করেছেই, তাই বলে বাপ-মা হয়ে তাকে শাস্তি দেওয়াও কিন্তু আমাগো কাজ না, আমরা শোধরাই দিতে পারি।’

‘তো কী করব? ওই যাত্রার নটির সাথে নিশারে বিয়ে দেবো? কথায় আছে না, শকুন উপরে থাকলেও নজর থাকে নিচের দিকে। যেমন গুষ্টি তেমনিই তো হবে মেয়ে। যতই ভালো শিক্ষা-দীক্ষা দিই না কেন, নজর তো ছোটোলোকের দিকেই থাকবে।’

বারবার বংশ তুলে কথা বললেও কেউ প্রতিবাদ করল না, রেজিনা ক্ষেপে আছে বুঝতে পেরে। আর নিশার দাদিও দায় অস্বীকার করতে পারছেন না, নাতনিকে রেজিনার অসম্মতিতে নিজের সাথে এনেছিলেন বলে। আরও খেয়াল রাখা উচিত ছিলো তার। তবুও বিয়ে দেওয়া খুব খারাপ হবে ভেবে বললেন ‘তাই বলে চিনপরিচয় নাই এমন পোলার সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবা?’

‘হ্যাঁ দেবো। চেনাজানা লাগবে কেন? আমার বিয়ের সময় আপনার ছেলের সাথে চেনাজানা ছিলো? আপনার বিয়ের সময় ছিলো? নাকি দিন পাল্টাইছে, এখন শুয়ে দেখে চেনাজানা করা লাগবে? কীরে নিশা ওই যাত্রার নটির সাথে শোয়াটোয়া হয়ে গেছে নাকি শুয়ে দেখবি? কী শেখাইছে এইকয়দিনে এরা?’

ঘৃণায় নিশার বুক ভারী হয়ে আসলো। এই বাড়ির লোকদেরকে নিচ দেখিয়ে নিজেকে উঁচু করতে গিয়ে নিজেকে কতটা ছোটো করল রেজিনা আর নিশাকে কতটা অসম্মান আর হীনতা দিলো তা একবারও ভেবে দেখল না।
নিশা ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল আর নিজের মৃত্যুকামনা করতে থাকল। কিন্তু মরণ কি এত সহজে আসে কারো কাছে?
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নিশা।

*****
‘নিশা ও নিশা?’ ময়না ধাক্কা দিয়ে ডাকল নিশাকে।

নিশার রাগ হয়েছে ময়নার উপরে। ও ইচ্ছা করলেই এই খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো না নিশাকে। শুধু নিশার মাকে বললেই হতো, যে চিঠিটা ময়নার। মা তাহলে লুকিয়ে যেত ব্যাপারটা। আর ময়নারই তো দোষ সবটা। ও কেন চিঠি নিয়ে এলো? নিশা কি বলেছিল ওকে কারও চিঠি এনে দিতে? কারো সাথে প্রেম করিয়ে দিতে?

‘তুমি রাগ করছ, নিশা’ প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ময়না নিজেই বলতে থাকল ‘আমি কী করতাম নিশা, কও। আমার নামে চিঠি এই কথা শুনলে আমারে তো আজই পার করতো। কানা-ল্যাংড়া বিচার করত না। সুমনের সাথে বিয়ে না হইলে আমি মইরা যাব নিশা। নিজের প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া, আমি তোমারে বাঁচাইতে পারলাম না’ তবুও নিশার দিক থেকে সাড়া এলো না।
ময়না আবার বলল ‘বাতাসী খালা ফোন দিছে। কোন পোলার সাথে বিয়ের কথা হইছিল তোমার, হ্যারা নাকি প্রস্তুত। পরশুদিনই আসবে। কালই বড়চাচি তোমারে নিয়ে যাবেগা।’

নিশা নিথর হয়ে শুধু চোখের কোল ভিজিয়ে কাঁদতে থাকল।

‘এইটা কোনো বিয়া? এইভাবে বিয়া দেওন যায়? এরচাইতে মইরা যাওয়াও ভালো নিশা।’ নিশার মাথায় হাত বুলালো ময়না। খুব যত্ন করে চোখের পানি মুছে দিলো। ‘কাইন্দো না। বোন না তুমি আমার। কাইন্দো না। শফিক ভাই রাস্তায় দাঁড়ায়ে আছে।’

লাফ দিয়ে উঠল নিশা। ‘কে? কে দাঁড়িয়ে আছে?’

‘শফিক ভাই। এইসব ঘটনা হ্যারে কইছি আমি। সে খুব কষ্ট পাইতেছে। তোমার সাথে একবার কথা বলতে চায়।’

‘খবরদার ময়না। আমি কারো সাথে কোনো কথা বলব না।’

‘আমি বলছি নিশা। সেইকথা সব বলছি আমি। সে যেন আর তোমারে বিরক্ত না করে, সেইসব বলছি। কিন্তু মানতেছে না। রাস্তার মাথায় দাঁড়ায়েই আছে। তুমি নিজে না বললে সে এখান থেকে যাবে না।’

‘আমি বলব না ময়না। তুমি যাও এখান থেকে।’

ময়না ফোন লাউড স্পিকারে রাখে। নিশা শুনতে চায় না, কিন্তু কানে ঠিকই পৌঁছে যায়। শফিক কাঁদছে। নিশার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। হৃদয় নামের রক্তসঞ্চালক যন্ত্রটা হয়তো অকেজো যায় একটুখানি সময়ের জন্য।

‘নিশা, আমার প্রিয়া। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। তোমার অন্য কোথাই বিয়ে হতে পারে না। আমি মরে যাবো নিশা, একদম মরে যাবো। মরে যাবো একেবারে৷’

এপাশে নিশা কাঁদতে থাকে।

‘প্রিয়া? আমি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আসো। সব ছেড়ে চলে আসো। আমি তোমাকে রাণি বানিয়ে রাখব। এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি বাঁচব না। অন্য কারো সাথে তোমার বিয়ে হবে, এইকথা যখন ময়না বলেছে, তখনই তো মরে গিয়েছি আমি।’

নিশা ফোঁপাতে থাকে।

‘আমি জানি তুমি সব শুনছ। আমি অপেক্ষা করে আছি প্রিয়া। তুমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করো, আমাকে ভালোবাসো কীনা, মন কী উত্তর দেয় দেখো? চোখ বন্ধ করে ভাবো, আমার মুখই কল্পনায় আসবে, দেখো? আর তখনই কিন্তু সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবে তুমি।’

একটু আগে নিশার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল, এখন মনে হলো, বেশ তো, মরে গিয়ে মরার পরে যদি আরেকটা জীবন পাওয়া যায়, ক্ষতি কী? আর সেই জীবনের হাতছানি যদি এমন সুন্দর হয়? এমন ভালোবেসে কেউ যদি একটা নতুন জীবনের দরজা খুলে দেয়, তবে সেই জীবনটা একবার বেঁচে দেখাই যায়!

তারপর হাতের উপর মাথা রেখে চুপ করে রইল।

চলবে…

আগুনের দিন পর্ব-৮+৯

0

আগুনের দিন ৮ ও ৯

‘ময়না একটু শুনে যা?’

‘কী বলবা? ওই দেখো সাব্বির দাঁড়ায় আছে। ব্যাটাপোলার সাথে কথা কইতেছি দাঁড়ায় দাঁড়ায়, এইটা দেখলে, মায়রে গিয়া নালিশ দেবে আর আমার বাড়ির বাইর হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। যাও তো?’

‘আচ্ছা, যা গিয়া। এইটা নিয়া যা!’

একটা কাগজের টুকরো ঢিলের মতো ছুঁড়ে মারে শফিক। সেটা ময়নার পায়ের কাছে পড়ে। ময়না পায়ের স্যান্ডেল ঠিক করছে এমনভাব করে সেটা হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। জিজ্ঞাসা করে ‘কী এইটা?’

‘বুঝিস না যেন। ন্যাদা কুঁদি!’

ময়না আর কিছু বলে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শফিকের সাথে কথা বলাটা ওকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। সুমনের সাথে সম্পর্কের মিলনাত্মক পরিণতি পেতে ও অনেকটা পরিকল্পনা করে রেখেছে। ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে হবে, সংসারের কাজ শিখে নিতে হবে আর সুমনকেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এভাবে ছেলেদের সাথে কথা বলা অবস্থায় কারো চোখে একেবারেই পড়া যাবে না। মাঠ থেকে শুকনো কাপড় তুলে, ঝেঁড়ে ঝেঁড়ে নিশার হাতে দিয়ে দুজনে মিলে বাড়িতে ঢুকে গেল। অনেকটা জায়গা জুড়ে নিশার দাদাবাড়ি। সীমানা ধরে সারি সারি নারিকেল গাছ, কাঁঠালবাগান, সুপারি বাগান, মেহগনি গাছের বাগান, সবরকম ফলগাছ – কাঠগাছের বাগান, মস্ত পুকুর। বাড়িতে ঢুকেই একপাশে ওর দাদার কবর। তারপর বড় একটা বাঁশঝাড় আর কাঁঠালবাগান। কাঁঠালবাগানের নিচে অনেকগুলো কাঠের লগ ফেলে রাখা হয়েছে নতুন ঘরের জানালা-দরজা বানানোর জন্য। এখন সেগুলোতে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য বেশ জায়গা। ময়না একটা লগের উপর বসে নিশাকেও বসতে ইশারা করল। ওড়নায় গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা কাঁচা তেঁতুলের টুকরোয় কামড় দিয়ে, শফিকের দেওয়া কাগজের টুকরোটা খুলে ভুঁরু কুঁচকে ফেলল। দুইটুকরো কাগজ। দুটোই পড়ল। তারপর টুকরো দুটো ভাঁজ করে বুকের ভেতর চালান করে দিলো। নিশার দিকে তাকিয়ে বলল ‘প্রেমপত্র বুজছ, প্রেমের চিঠি?’

নিশা উত্তর দিলো না। হাসল একটু। এইজন্যই সুমন এসেছিল।

‘আজকাল কেউ চিঠিফিঠি দিয়ে প্রেম করে না। টুং করে একখান মেসেজ লিখে দেয়। তুমি মোবাইল কিনো না ক্যান?’

‘মা দেয় না। আর আমার লাগেও না।’

‘তুমি ইন্টারনেট চালাও না?’

‘ল্যাপটপে চালাই। মাঝে মাঝে।’

‘ফেসবুক চালাও না? মেসেঞ্জার? ইমো?’

‘ফেসবুক একাউন্ট আছে কিন্তু লগইন করা হয় না তেমন।’

‘আল্লাহ কী কও। কোন দুনিয়ায় বসত করো তুমি? আমি তো ইউটিউবে সিনেমা না দেখলে ঘুমই আসি না।’

‘আচ্ছা ময়না, তুমি কত সুন্দর করে কথা বলতে পারো, কিন্তু সবসময় বল না কেন?’

‘ধুর ধুর! অতো শুদ্ধ ভাষায় নাটকের মতো কথা কইতে জুত হয় না। স্টাইল করে কথা কই মাঝে মাঝে, সবসময় কওয়া যায়? বিরানি তুমি একবেলা মজা পাইবা, পরের ওক্তে ঠিকই ভাত চাইয়া খাইবা। বুঝছ?’

‘হুম।’

‘আচ্ছা নিশা, শহরের ছেলেমেয়েরা তো অনেক চালু, মানে এডভান্স আরকী, তুমি প্রেম করো না?’

‘আরেহ না।’ লজ্জা পায় নিশা।

‘সত্য? কেউ প্রস্তাব দেয়নাই কোনোদিন?’

নিশা উত্তর করে না। ময়না আবার বলে ‘কেমন ছেলে তোমার পছন্দ? শিক্ষিত নাকি সুন্দর? বড়লোক? স্মার্ট?’

নিশা হেসে ফেলল। এভাবে চিন্তা করে কেউ ভালোবাসে? ভালোবাসা তো কবিতার মতো অনুভূতি। সেটা চেপে গিয়ে বলল ‘আমি এসব ভাবিনি, ময়না।’

‘ভাববা না ক্যান? ধরো, এইরকম একখান চিঠিফিঠি আইজ যদি কেউ তোমারে দেয়?’

‘যাহ।’

‘না। সত্য কইতাছি। কী করবা কও।’

‘এইসব কী কথা বলো?’

‘আরে কও না?’

‘সত্যি বলছি, আমি এইসব ভাবিনি কখনো।’

‘তাইলে ভাবো এটটু?’

‘মানে?’ নিশা বুঝতে পারে না ময়নার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা।

‘মানে? মানে হচ্ছে, তোমার জন্য চিঠি আসছে।’

‘অসম্ভব!’ বিড়বিড় করে নিশা।’

‘হয় রে। সত্যি কইতেছি। শফিক ভাই তোমারে পছন্দ করে। তোমার সাথে রিলেশন করতে চায়।’

নিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ময়নার দিকে, কথা বলতে ভুলে যায়। ময়না একটা কাগজের টুকরো নিশার হাতে দেয়। নিশা ভয় পেয়ে আঁতকে ওঠে। গরম কয়লা হাতে পড়েছে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কাগজটা। তারপর ময়নাকে বলে ‘অসম্ভব ময়না। আমি এটা নেবো না!’

‘কেন?’

‘এইগুলো ঠিক না। ভালো না।’

‘আচ্ছা, ভালো না লাগলে রিলেশন করবা না। কেউ কি জোর খাটাইতেছে? একটু দেখো কী লিখছে? তুমি এত ভয় পাও কেন? কেউ জানবে না।’

‘না।’

‘আরেহ পড়তে তো দোষ নাই। আমি কবো তুমি চিঠি পড় নাই।’

নিশা ভয়ে ভয়ে চিঠিটা খুলল। খুলেই ওর মনটা তেতো হয়ে গেলো। সস্তা বাংলা গান আর ভুল বানানে লেখা চিরকুট।

“প্রাণের প্রিয়া,

জীবনে প্রথম যারে, লেগেছে ভাল
যে আমার এই বুকে, প্রাণের-ই আলো
সে আর কেউ নয়, শুধু যে তুমি
বলছি তোমায় গানে গানে

এ বুকে কান পেতে শোন
এ হৃদয় কি বলে হায়
বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে
তোমাকে যদি হারায়

এ চোখে চোখ রেখে দেখো
কি বলে চোখ ইশারায়
অন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে
তোমাকে যদি হারায়।

ইতি
তোমারই শফিক”

হাতের ভেতর মুঠ করে ফেলে নিশা কাগজটা।

‘কী? কী করবা?’ ময়না নিশার উত্তর জানতে চায় কিন্তু ওর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংবরণ করে নেয়। নিশার হাত ধরে বলে ‘বাদ দাও৷ বাড়িত চলো।’

ময়না খুবই বুদ্ধিমতি। ও জানে মায়ের অত্যন্ত কড়াশাসনে বড় হওয়া নিশার জন্য এসব বিষয় একটু সময়সাপেক্ষ। সময়টুকু দেয় ও নিশাকে। নিশার বা শফিকের ব্যাপারে এতটা আগ্রহ ও দেখাত না একেবারেই যদি না আরেকটুকরো কাগজে শফিক, ময়না আর সুমনের সম্পর্কে সাহায্য করবে এই প্রতিশ্রুতি দিতো। দুই পরিবারের সম্মতিতে সুমনের বউ হওয়া ছাড়া ওর আর কারো কোনো বিষয়েই আগ্রহ নেই।

****

‘তোমার আর কী, তোমার ময়নার যে গায়ের রঙ আর যে চেহারা তাতে রাজপুত্র আসবে মেয়ে সেধে নিতে। আর আমি পেটে ধরেছি দুটো কালির পুতুল। তায় নাকচোখেরও ঢঙ নেই। মেথরেও তো ঘুরে তাকাবে না।’

‘এইগুলা কী বলেন বড়ভাবি? নিশা আপনার যে লক্ষি মেয়ে!’

‘ছাড়ো! কীভাবে পার করব, এই চিন্তায় নিজের কোনো সখ-আহ্লাদ করলাম না কোনোদিন, শুধু টাকা জমাও, মেয়ে বিয়ের খরচ।’

‘আপনার নিশা, ঊষা তো পড়াশোনায়ও ভালো খুব।’

‘তাতে কী? পড়াশুনা গোণে কে? সেই বিয়ে তো দিতেই হবে, গাঁট গাঁট টাকা খরচ করে। এমন পোড়াকাঠের মতো দেখতে যে, আটদশলাখের কমে মেয়ে পার করতে পারব না।’

‘বাবাহ এত টাকা?’

‘এতো শুধু গয়না আর ফার্নিচার দেবো। বিয়ের খরচ তো আলাদা।’

‘ওরেহ বাবা।’ রেজিনার বড় বড় গালগল্প পোষায় না ছোটোবউয়ের। সে নিজের মেয়েকে তাড়া দেয় ‘ওই ময়না কাপড় তুলতে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেছিস? তোর চাচি আসছে কখন, ঘর খুইলা দে, আমার হাতে তো গোবর লাগা।’

ছোটোবউ চুলার জ্বালানি বানাতে গোবর দিয়ে বোড়ে বানাচ্ছে। নিশা মায়ের কন্ঠ শুনে আনন্দে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে অনেক্ক্ষণ আগে। রেজিনার কথা শুনে চুপ হয়ে গেছে। রেজিনার অভ্যাস আছে, নিজের টাকাপয়সার গল্প করার প্রয়োজনে মেয়েদের সম্পর্কে কটুক্তি করতে তার আটকায় না। আজকে নিশার খুব কষ্ট হলো। গায়ের রঙ আর চেহারা নিয়ে এমনিতেই হীনমন্যতায় ভোগে, তার উপর রেজিনার বাজে কথায় ওর অভিমান হলো।

আসলেই তো সত্যি কথা, ও কুৎসিত দেখতে তাই ওকে কেউ পছন্দ করে না। জীবনে বারবার, বহুবার, বহুজনের মুখে এই কথা শুনেছে ও। প্রতিবারই সংকুচিত হয়ে গেছে। ও বোঝে না, কালো হওয়াতে ওর দায় কী? ও যদি নিজে নিজেকে তৈরি করত তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে করেই পৃথিবীতে আসত। যেখানে ওর হাত নেই সেখানে ওর দায় কেন?

এতদিন কষ্টগুলো বুকে পাথরচাপা দিয়ে রাখত, আজ জেদের মতো হলো। হাতের মুঠোয় দলামোচড়া করে রাখা কাগজটার প্রতি তীব্র আকর্ষণ তৈরি হলো। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক যে আকর্ষণ, মুখচোরা নিশা নিজের কাছেই গোপন করে রেখে এসেছে এতদিন আজ সেটা মেলে দিতে ইচ্ছে করল। দাদীর ভাঙা ঘরের ফাঁকফোঁকর দিয়ে গোধুলির যে আলো নেমে যাচ্ছে, তার মাঝে ভুল বানানের সস্তা সেই চিঠিখানা মেলে ধরল নিশা। আর বড় ভালো লাগল ওর। অজানা শিহরণে বুক কাঁপতে থাকল। কারো চোখে নিজেকে প্রেয়সী জানতে পেরে, সাদা কাগজে আঁকা কালো অক্ষরগুলো প্রিয় উঠতে লাগল।

আগুনের দিন ৯।

রেজিনা আসে নিশার কাছে। মাকে দেখে নিশার মন লাফিয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে মাকে। রেজিনারও ইচ্ছে করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। কিন্তু এসব ন্যাকামিতে অভ্যাস নেই, অনভ্যস্ততায় কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। কন্যাকে স্নেহ দেওয়ার পরিবর্তে আরও খানিক তিক্ততা দিয়ে বসেন তিনি। কেউ যেন না শোনে এমনভাবে বলেন ‘পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, বাপের মানসম্মান সব রাস্তায় রেখে দাও নাই তো?’

নিশা চুপ করে থাকে।

‘যে চালু ওই ময়না। ওর সাথে মিলে কোনো সর্বনাশ করো নাই তো?’

‘আম্মু?’

‘উহ! আম্মু? যেই না চ্যালাকাঠের মতো চেহারা, ওই মুখ নিয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়। এমন করে নাচতে নাচতে দাদির সাথে দৌঁড় দিতে হয় না!’

এসব কথা শোনায় অভ্যাস আছে নিশার। তবুও আজকে বারবার অভিমান হচ্ছে। চোখ ভিজে গেল আবারও।

*****

‘নিশা, ঘুমাইছ?’ ফিসফিস করে ময়না।
‘ও নিশা?’

দুবার ডাকার পরে নিশা আর চুপ করে থাকতে পারে না, সাড়া দেয়।

‘কী হইছে বলো?’

‘কী করবা কইলা না? আমারে চাইরবার ফোন দিছে শফিক ভাই।

নিশার বুক ঢিপঢিপ করছে। ময়না যে সম্বোধন পালটে ‘শফিইক্যা’ থেকে ‘শফিক ভাই’ করে ফেলেছে, তা আর খেয়াল করল না।

‘কী কবো, শফিক ভাইরে? কও তো?’

‘আমার ভয় লাগে ময়না।’

‘সে সবারই ভয় লাগে।’

‘আম্মু জানলে জানে মেরে ফেলবে।’

‘কেউ প্রেম করছে আর বাপ-মা মাইনা নিছে, এমন হইতে কোনোদিন দেখছ নাকি শুনছ? সেইটা না, শফিক ভাইরে পছন্দ কীনা সেইটা বলো?’

নিশা চুপ করে থাকে। আসলেই কি শফিককে ওর পছন্দ? এই প্রথম কেউ নিশাকে পছন্দ করেছে, প্রিয়া বলে চিঠি লিখেছে। নিশা উপেক্ষা করে কী করে? এত অবহেলা পেয়েছে যে মুখশ্রীর জন্য, সেই মুখটাকে কেউ ভালোবাসে জানলেও তো মরে যাওয়ার মতো সুখ লাগে।

নিশা কিছু বলল না তবুও। ভীরু মনের কথাটা মুখে আনতে পারল না।

ময়নাই বলল ‘তোমার ফোন নাম্বার চাইতেছে। দেবো?’

নিশা উত্তর না করলে ময়না কায়দা করল ‘দিলাম কিন্তু। না কওনাই কিন্তু। বইতে পড়ছ না, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ?’

‘আমার কোনো ফোন নাই, ময়না। এই কথাটা তুমিও জানো।’

‘চাচিরটাই দিলাম!’

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?’

‘ধুরো! তুমি তো প্রাচিনকাল থেকে টাইমমেশিনে কইরা এই সময়ে আইসা পড়ছো! মোবাইল নাই! কেউ বিশ্বাস যাইবো। শফিক ভাই ভাবতেছে, আমি না জানি মিছা কথা কই!’

গরমের ভেতরও নিশা কাঁথা টেনে মুখে চাপা দিলো। ময়না হেসে কন্ঠ আরও নামিয়ে বলল ‘শফিক ভাইর নাকি রাতের ঘুমটুম সব শেষ! শুধু তোমারেই নাকি চোখের সামনে দেখতেছে। পোলার মাথাডা তো পুরাই খাইয়া ফেলছ, নিশা!’

নিশার বুকের ভেতর কেমন একটা সুখের মতো জ্বালা করে, চিনচিন করে শব্দ হয়।

‘নিশা? এইটা নেও?’

আবার এক টুকরো কাগজ নিশার হাতে গুঁজে দেয় ময়না। ও কেঁপে ওঠে। বুক কাঁপতে থাকে। পা ভারী হয়ে আসে। রেজিনা আছে এখন এখানে। কোনোভাবে টের পেয়ে গেলে নিশার কপালে সর্বনাশ আছে। ওর খুব পানির পিপাসা পেল। শুকনো ঢোক গিলে বলল ‘এক গ্লাস পানি দিতে পারবে, ময়না?’

‘উঁহু। এত রাতে দরজা খুলে পানি আনতে পারব না।’

‘ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে আমার।’

‘এত ভয় পাও তুমি, বড়চাচিরে?’

‘ভয়?’ অসহায় তাকায় নিশা। একটু হাসার চেষ্টা করে। ও চেনে নিজের মাকে। মেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের আলাদা ব্যাক্তিত্ব আছে, আলাদা সত্ত্বা আছে, আত্মসম্মানবোধ আছে এসব থিওরি রেজিনার সিলেবাসের বাইরের চ্যাপ্টার। বাচ্চাদের ভুল কথা বা ভুল পায়ে জুতো পরা নিয়ে সবাই যেমিন সবার সামনেই মজা করে, তেমনি নিশা বা উষাকে নিয়েও রেজিনা সবার সামনে মজা করে। লজ্জায় এতটুকুন হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় ওরা কিন্তু রেজিনার একটুও অনুতাপ হয় না। মা তো, মায়েরা কিছু বললে কি তাতে অপমান হয়?

নিশা কাগজের ভাঁজ খুলল। কালচে খয়েরিটাইপ রঙের কালিতে লেখা চিঠি একটা। সেই আগের মতোই ভুল বানানা, সস্তা সিনেমার ডায়লগ।

‘ও আমার প্রিয়া।
আমার আঁধার রাতের আলো, আমার শূন্য আকাশের চাঁদ। মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছ তুমি আমার জীবনে। তোমাকে ভেবেভেবেই সারাদিন আর রাত গুলিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে আমার।
তুমি কেন আমার চিঠির উত্তর দিচ্ছ না? আমাকে কি তোমার পছন্দ না? তুমি পাশে থাকলে আমি অনেক বড় কেউ হবো, দেখে নিও। সব পারব আমি, পরীক্ষা করে দেখো, সব পারব। এই যে রক্ত দিয়ে লিখে দিলাম প্রেমের কথা। আর আমার হাত আর হৃদয় রক্তাক্ত করে লিখেছি তোমার নাম। হাতেও, হৃদয়েও …’
ইতি
তোমার প্রেম

রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি? অরুচিকর একটা ব্যাপার। নিশার মন খারাপ হয়ে গেল। ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইল কাগজটুকু। কিন্তু কী মনে করে ফেলল না। উদ্যত হাত নামিয়ে নিয়ে চিরকুটটা ময়নার দেখানো পদ্ধতিতে অন্তর্বাসের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল।

একটু বাদেই ময়না আবার কাছাকাছি সরে এলো। ‘ও নিশা, কিছু যে কইলা না!’

‘ময়না, আমি কিন্তু তোমাকে মানা করছি, এইসব চিঠিটিটি আমাকে আর দিও না। আমার ভালো লাগছে না।’

ময়নার মুখ কালো হয়ে গেল। শফিক প্রমিজ করেছে, চেয়ারম্যানের ছেলেকে ধরে সুমনকে সরকারি দলের স্থানীয় কমিটির একটা বড়পদ দেওয়ায় দেবে। সেটা হলে তো সুমনের জন্য ময়নাকে চাইতে আসার পথ অনেক বেশি সুগম হয়ে যাবে। একটু আগে অন্ধকারের ভেতর সুমন আর শফিক এসেছিল এই চিঠিটা দিতে। ময়না একা একা আগানবাগান পেরিয়ে গিয়েছিল। শফিক বলেছিল ‘খালি লাইনডা করায়ে দে ময়না। তোর আর সুমনের লাইন একদম ক্লিয়ার করে দেবো।’

‘পারবা?’

‘পারব না ক্যান? শফিকের ক্ষমতা তুই জানিস না কিছুই।’

‘তা নিজের জন্য করো না কেন?’

‘এইসব আমার জন্য না ময়না। এইসব ছোটোমোটো কাজ আমার জন্য না। আমি বিরাট কাজ করব। সবাই একনামে চিনবি!’

‘হুহ! তা বিরাট কিছু হওয়ার পরেই আইতি নিশার সাথে লাইন করতে! ভাদাইম্মা কোনখানকার!’ মনে মনে গালাগাল করেছিল ময়না শফিককে।

ময়না আবার ডাকল নিশাকে ‘কেন পছন্দ না শফিক ভাইরে?’

‘এইসব কথা বাদ দাও, ময়না।’

‘দেখতে কী সুন্দর কও তো! জমিজাতির অভাব নাই কিন্তু। পড়াশোনাও করছে। বিএ পাশ দেছে। চাকরি করতে চাইলেই পারবে। কিন্তু বড়ছেলে তো। বাড়ি ছাড়লে কেমনে হবে? তা তুমি কইলে সবই করবে।’

‘আমি কেন বলব?’

‘তুমিই তো বলবা এখন। তোমার কথাও শুধু শুনবে। যা বলবা তাই করবে। তুমি বলবা চাকরি করতে।’

‘আমি বলব না ময়না’ রেগে যায় নিশা।

তবুও ময়না বলে ‘ইশ, ব্লেড দিয়ে হাত কাটছে নিশা। তোমার নাম লেখছে। কী পাগল যে হইছে তোমার জন্য!’

‘সত্যিই হাত কেটেছে? ছিঃ!’

‘ছিঃ কও কেন? ভালোবাসে তোমারে। সব ভালো শফিক ভাইয়ের। শুধু বিড়িখোর। তয় বলছে, একবার তুমি হ্যাঁ বললে আর সিগারেট ছুঁয়ে দেখবে না।’

‘ঘুমাও ময়না। মা শুনতে পাবে।’

‘তুমি একটু ভাবো নিশা। আমরা কাছাকাছি থাকব, বিয়ের পরে। তোমার একাএকা লাগবে না।’

‘তুমি বিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছ?’

‘ভাবতে কি টাকা লাগে নাকি? হিহিহি’ খিলখিল করে ওঠে ময়না। ‘বিয়ের কথা তো আমি সবসময়ই ভাবি। তুমি ভাবো না?’

‘বিয়ে ছাড়াও ভাববার মতো অনেককিছু আছে ময়না। ঊষা কী বলে জানো? মানুষের মেরুদণ্ডের শক্তি হাত হয়ে আসে। আমরা কাজ করি, পরিশ্রম করি, আমাদের আয় টাকা হয়ে আমাদের হাতে আসে। সেই টাকা আমাদের ইচ্ছে, স্বপ্ন, বাস্তব, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ শক্তিশালী করে দেয়।’

‘অনেক কঠিন কথা। জীবন এত কঠিন না। সহজ করে ভাবলেই সব সহজ।’

‘হয়তো’ ময়নার কথাটা মনে ধরে নিশার।

*****

‘ছাদও দিয়া দিছে?’ নতুন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উষ্মা প্রকাশ করছিল রেজিনা৷ ‘আর আমি শুধু মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাও, মেয়েবিয়ের টাকা জোগাও। এই করতে করতে কিছুই হলো না। দুইটা মেয়ে দিছে আল্লাহ, চেহারা একেবারে বাপের গুষ্ঠির মতো। কিন্তু সেই গুষ্ঠির কেউ তো ভার নেবে না। আমার আর আমার বাপভাইরই মরতে হবে মেয়ে পার করার খরচ জোগাইতে গিয়ে।’

‘এমন করে কও ক্যান বউ। মাইয়া বড় হইছে না? মনে দুখ লাগবে। কালোই ভালো। কী সুন্দর মুখ আমার নিশার!’

‘হ্যাঁ। সুন্দর মুখ আগে মনে ছিলো না? কালো ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় ফর্সা মেয়ে খুঁজলেন কেন তখন?’

‘এইসব পুরান কথা বাদ দেও, বউ?’

‘হ্যাঁ। পুরান কথা। কী বলেছিলেন মনে আছে? বীজ যেমন তেমন বাচ্চা হবে। এখন ফর্সা বীজে এমন কালো বাচ্চা কীভাবে হলো? এই দুই মেয়ের চিন্তায় আমার আর ছাদ দেওয়া হলো না!’

‘এরাও অনেক কষ্ট করে বউ। খেয়ে না খেয়ে বিল্ডিং বানছে।’

‘এমন করে বলেন যেন আমি রাণির মতো সিংহাসনে বসে থাকি?’

‘কেন তোমার হাইস্কুলে পড়া পোলারেই তো হোন্ডা কিনে দিছো! এইটার দরকার ছিলো কোনো?’

‘ওইটাই যে চোখে লাগবে তা জানতাম ঠিক। ওর মামাবাড়ি থেকে দিয়েছে, আপনার ছেলের কোনো টাকা খরচ হয়নি। ছেলে সখ করছে, তাদের মামারা মিটাইছে, আপনাদের চোখ পোড়ায় কেন?’

‘না বউ, সেই কথা বলিনি। সখের কথা তুমি না বললে তারা তো জানত না। এইসব সব সখই এরা চাপা দিয়ে ঘরটা তুলছে। ইদেচান্দে কাপড়ও নেয় না কোনো বউ।’

‘এইগুলা সত্যি না। ময়না যে একেকটা ড্রেস পরে, আমার দুইমেয়েরে কখনো হাত খুলে দেইনাই ওইরকম। আপনার ছেলের সংসারে যত কষ্ট করি সেটা আপনি কখনো স্বীকার করেন না’ বলতে বলতেই রেজিনার চোখ গেল নিশার দিকে। ময়নার সাথে পুকুরে গোসল করার জন্য নেমেছে। ঘাটলা বাঁধানো। অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে। বর্ষাকালে সবগুলো ধাপই পানিতে ডুবে থাকে, এখন একেবারে শেষের ধাপটা শুধু পানির নিচে। সেটার উপরে বসে কোমর ভিজিয়ে পানি ছিটিয়ে জলকেলি করছে নিশা, ময়না, আরজিনা, সীমা। রেজিনার মেজার গরম ছিলো, এবারে সবটা ঢাললেন নিশার উপর।

‘নিশা? তুই পুকুরে নামছিস? জংলী কোথাকার?’

‘আম্মু প্রতিদিন তো পুকুরেই গোসল করেছি’ হঠাৎ করে বুঝে পায় না নিশা সমস্যাটা কোথায়?

‘উঠে আয়। অসভ্য মেয়ে। পচা পানিতে গোসল করছিস আবার বলে প্রতিদিন করেছি।’

এতদিন একসাথে থাকা বান্ধবীদের সামনে এমন অপমানিত হয়ে নিশার পা আর নড়ছিল না। ও চুপ করে থাকল।

‘এখনো আসলি না? উঠে আয়?’

‘আম্মু আরেকটু প্লিজ! গোসল প্রায় শেষ।’

‘ছিঃ একদম গাঁইয়া হয়ে গিয়েছিস। এত পড়াশুনা করিয়ে কী লাভ হলো? একটা ভ্যানওয়ালা ডেকে বিয়ে দিয়ে দিই!’

‘আম্মু?’

‘আয় কিন্তু। নইলে খুব খারাপ হবে।’

‘উইঠা আসো বু। মা রাগ হইছে, উইঠা আসো। তুমি কলে গিয়া গুসল করো?’ নিশার দাদী এগিয়ে আসে তাড়াতাড়ি করে।

নিশা উঠে কলে গিয়ে রাগেরাগে পানি চাপে আর মাথায় ঢালতে থাকে ঝুপঝুপ করে। রাগের কারণে অন্তর্বাসের ভেতর লুকিয়ে রাখা চিরকুটটার কথা ভুলে, শরীরে টাওয়েল পেঁচিয়ে ভেজা কাপড় খুলতেই পড়বি তো পড় একেবারে মালির ঘাড়ে, ঝুপ করে আধাভেজা কাগজখানি রেজিনার পায়ের কাছেই পড়ল…

চলবে…
আফসানা আশা

আগুনের দিন পর্ব-৬+৭

0

আগুনের দিন ৬ ও ৭।

১০.
নিশা টক খাবার তেমন একটা পছন্দ করে না। ও বসে বসে ময়নার কাজ দেখতে থাকল। ময়না বাঁহাতে ধরে কট করে এক একটা কামড় বসাচ্ছে কাঁচা তেঁতুলে আর চোখমুখ কুঁচকে শরীর ঝাড়া দিচ্ছে – নিশার জিভেও জল চলে আসছে। বঁটি দিয়ে বিঁচিটুকু আঁচরে ফেলে পাটায় মিহি করে বাঁটল ময়না, তারপরে লবণ আর কাঁচামরিচ বেঁটে নিলো, ধনেপাতাও বাঁটল, কাঁচাতেঁতুলের সবুজ রঙ আরও গাঢ় হলো। একটু সর্ষের তেল আর সামান্য চিনি ছিটিয়ে ফিনিশিং দিলো। কলাপাতা কেটে এনে আগে থেকেই ছিঁড়ে ভাগ করে রাখা আছে। নিশা ধরতে থাকল আর ময়না এক এক ভাগে তেঁতুলভর্তা রাখতে থাকল।

‘শোনো নিশা, তুমি এইখান দিয়া নড়বা না। কাউরে হাতও দিতে দিবা না। আমি এক দৌঁড়ে কান্তা, বাশার ভাই আর সীমারে দিআসতাছি।’

‘কেউ খেতে চাইলে আমি কী বলব?’

‘দিবা না!’

‘আমি কাউকে আটকাতে পারব না।’

‘আচ্ছা আমি সরায় রাইখা যাইতাছি। তুমি আমার কথা বলবা। বলবা ময়না মানা করছে। আমি একমিনিটে যাব আর আসব। কান্তারে বাড়িত্তে বাইরাইতে দেয় না। চুরি কইরাই তো গেল রাইতে। আর বাশার ভাই যে আয়োজন করে যাত্রা দেখায়া নিয়া আইলো, হেরে এটটু না দিলে হয়?’

বলতে বলতেই দুই হাতে ভাঁজ করা কলাপাতার মোচা নিয়ে দৌঁড় দিলো ময়না। করিৎকর্মা মেয়ে, ভাবল নিশা। গতকাল যাত্রা দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র যাত্রা দেখা ছিলো না এটা এখন পরিস্কার ওর কাছে। সেখানে সুমনকেও দেখেছিল ও, কিন্তু তখন বোঝেনি কিছু। এসবকিছু বাশার বা কান্তারাও সবাই জানে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশা। ওরা দুইবোনই শুধু হাজাররকম শাসনের বেড়াজালে আটকে থাকে। এই করা যাবে না, সেই করা যাবে না, কলেজ ছুটির পরে কোথাও যাওয়া যাবে না, রাতে কোথাও যাওয়া? বাপরে বাপ! এমনকি বান্ধবিরা কেউ ফোন করলেও রেজিনার হাজারটা প্রশ্নের উত্তর হয়ে আসতে হয়! ময়নাকে খুব হিংসা হতে থাকে নিশার। অত চটপটে মেয়ে আর কী সুন্দর দেখতে! নিশা কালো, অনেক কালো। রেজিনার গায়ের রঙ পায়নি দুবোনের কেউই। দুজনেই মইন সাহেবের মতো হয়েছে। রেজিনার খেদ যায় না তাই। কটু কথা শোনাতেই থাকেন নিশা আর ঊষাকে। ঊষা অতটা পাত্তা দেয় না কিন্তু রেজিনা যখন ‘ওই কালি? ওই মা কালি?’ বলে ডেকে ওঠে নিশার বড় বড় দুই চোখ ছলছল করে ওঠে। ঊষা অনেক বুঝদার। ও সুন্দর করে বোঝায় নিশাকে ‘বুবু, কাটতে ধারও লাগে ভারও লাগে। আমাদের ধার নেই, আমরা ভারে কাটব।’

ঊষা কোমর বেঁধে নিজের ভার বাড়াতে পড়াশোনা করে আর নিশাও তাই। বইখাতা, স্কুল আর কলেজ ছাড়া যে জগতটা তার সাথে নিশা-ঊষার পরিচয় হয়নি। আজকে বয়সে অনেক ছোটো ময়নাকে একটা অন্য পৃথিবীতে চলতে দেখে তাই নিশার লোভ হয়, ময়নাকে ঈর্ষা হতে থাকে।

সত্যি সত্যি এক দেড় মিনিটের মাথায় চলে এলো ময়না। অনেক চঞ্চল হলেও কাজেকর্মে নিপুণা ও। পরিবেশন করাটাও ভালো গৃহিনীর মতো বোঝে। বাড়ির সবাইকে সামান্য তেঁতুল দিয়ে খুশি করে দেওয়ার উপায়ও জানে। তারপর নিশাকে নিয়ে বা
বাধানো পুকুরঘাটে গিয়ে বসল। কলাপাতার কোণের নিচের সরু ফাঁকা দিয়ে রসটুকু চোঁচোঁ করে টানতে নিশাকেও শিখিয়ে দিলো। দুজনে ঘাটে পা দোলাতে দোলাতে টক, ঝাল, মিষ্টি স্বাদের রসটুকু টেনে চোখ বন্ধ করে হেসে ফেলল। সবাইকে দ্রুত আপন করে নিতে পারে ময়না।

ময়নার বাবা বিল্ডিং এর কাজ শেষ করে ফেলেছে প্রায়। আশিভাগ কাজ হয়ে গেছে। ছাদ ঢালাই হয়েছে। জানালা, দরজা লেগেছে। বাইরের প্লাস্টার বসেছে। ভেতরের প্লাস্টার হয়ে রঙের কাজ হলেই নতুন ঘরে ওঠা যাবে। দুইবোনে গোসল সেরে সেই ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে বসে গল্প করতে করতে বাড়ির সামনে হৈহল্লা করে ভ্যান থামতে দেখল। নিশা উঁকি মেরে দেখল, বিরাট ডেগ লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো। চার পাঁচটা ভ্যান। নিশার মেজচাচার ছেলে শান্ত দৌঁড়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বড় বোল নিয়ে আসছে। সেই বোল ভ্যানের কাছে নিলে একজন পাতিল থেকে খাবার বেড়ে বোল ভরে দিচ্ছে। সেগুলো নিয়ে শান্ত আবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। আজকে দুপুরে বাড়ির মেয়েদের খাবার চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে এসেছে। গরুর মাংস দিয়ে মোটা চাল-ডালের খিচুড়ি। নিশা এরকম ঘটনা আগে কখনো দেখেনি, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এই গ্রামে বিভিন্ন উৎসব আয়োজন, মিলাদ মাহফিলে এরকম আয়োজন প্রচলিত আছে। গ্রামবাসি সবাই চাঁদা দিয়ে প্রায়ই একবেলার খাবার একসাথে খায়; টাকা দিতে না পারলে ঘরের চাল, ডাল দিয়ে হলেও শামিল হয়। এবারের আয়োজন পুরোটাই চেয়ারম্যানের খরচে।

শুকনো সুপারিপাতা আর কলাপাতা ঝুলিয়ে দিয়ে বাড়ির সীমানায় মেয়েবউদের পর্দার ব্যবস্থা করা আছে। রাস্তা থেকে সহজে নজর পড়ে না বাড়ির ভেতরটা। ভেতর থেকে নজর করলে আবার রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যায়। সেই পাতার গেট ঠেলে শফিককে ভেতরে ঢুকতে দেখল নিশা। লুঙ্গিটা কোচা দিয়ে হাঁটুর উপরে ওঠানো। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। মেদহীন শরীরের টানটান পেশিগুলো একেবারে উন্মুক্ত হয়ে আছে। ফর্সা ত্বকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম চিকচিক করছে শিশিরবিন্দুর মতো। একঢাল মসৃণ কালোচুলের ডালা মাথায় নিয়ে শফিক দাদিকে ডাকতে থাকে ‘ও দাদি? কই গেলা? পানি খাব। একটু পানি খাওয়াও।’

দাদি উঠানেই ছিলো। মুরগির জন্য ভুষি মাখছে সকালের ভাতের ফ্যান দিয়ে। গলা উঁচিয়ে বলল ‘আমার হাতজোড়া ভাই। দাঁড়াও ময়নারে কইতেছি।’ দাদি গলার স্বর আরও উঁচু বলল ‘ওই ময়না? শফিকরে এক গ্লাস পানি খাওয়া। খালি পানি আনিস না যেন আবার? দুইটা বিস্কুট দিস সাথে।’

গলা নামিয়ে শফিককে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কীরে, কী বুঝতেছিস? জিতব ইউনুস্যা এইবার?’

‘কী যে কও দাদি? যে খরচ যাইতেছে? পানির মতো খরচ করতেছে। যেই লোকটা বাড়ির পরে যাইতেছে, ধামাভইরা ধান দিয়ে দিতেছে। খাওন লওনের তো কম নাইই নাই। আর কেডায় জিতব? কলিম বখশি? হুহ, চা পানি ছাড়া হের খরচ কই?এইযে সাতদিনে সাতটা গরু নামাইলাম। তাও বাছা বাছা ষাঁড়গরু। কোনো ফাঁকি নাই।’

‘কয় মণ গোস্ত হইছেরে আজকে, শফিক?’

‘চার মণ দাদি। ছোটো ছিলো গরুটা। কিন্তু মাংস নামছে জবর। চর্বি নাই।’

‘রানতেছে কেডা? শুক্কুরের পোলা?’

‘হয়। বিল্লাল কাকায়ই রানছে। হের মতো আছে নাকি কেউ আর? ঘ্রাণ যা ছুটছে, সাতগ্রামে চাউর হইছে, বেতলাতে আজকে ডেগ চড়ছে।’

‘হ। ভালো বাসনাই তো পাইতেছি। ও শফিক তোর মায় কেমন আছে? বেগুন ক্ষেত নাকি পোকায় ধরছে?’

দাদির গল্প বলার মুড দেখে শফিক রাস্তার দিকে হাঁক দিলো ‘ওই শাহিন্যা, তোরা আগাইতে থাক, আমি আসতেছি।’ বলে পায়ে ভর দিয়ে বসল নিশার দাদির পাশে।

‘আর কইয়ো না দাদি? ওষুধ ছিটাইতে দুইদিন দেরি হইছে, একটা বেগুনও পাইলাম না পোকায় কাটতে বাকি রাখছে। পুরা লস গেল এইবার।’

‘কয়খান জমিতে বেগুন লাগাইছিলি?’

‘পুরা আটখান দাদি?’

‘আয় হায় কস কী? বড় ক্ষতি হইলো তো?’

‘হয়। লাখের উপরে গেল। আব্বা তো ক্ষেইপে থাকে সারাদিন। এখন ক্ষেপলে আমরার কী করার আছে?’

‘তুই চাকরিবাকরি কিছু করবি না?’

‘পরের মাহেনদারি করব আমি? কী কও না কও দাদি?’

‘তাইলে চলবি কেমনে? তর বাপের ওই জমিগুলাই তো আছে?’

‘ওইয়া খাইয়া শেষ করতে পারব?’

‘ক্যান বইন বিয়া দিবি না? তাতে খরচ আছে না? কতখান জমি বেঁচতে হয় তখন দেখিস? আর তুই বিয়া বইবিনা? টুকটুইক্যা বউ আনবি না। হেরে রাঙা শাড়ি পিন্দাবি না? টাকা লাগব না?’

‘ধুরো দাদি, জ্ঞান দিও না। বইলাম পানি খাওয়াবা বইলা, তুমিও সেই ফাওপ্যাঁচাল নিয়া বইলা? যাইগা।’

এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁক দিলো শফিক ‘ওই ময়না, পানি কি খাওয়াইবি? পুকুর কাইটা পানি আনতেছিস নাকি?’

ময়না একটা কাচের গ্লাসে পানি আর একটা পিরিচে চার পিস বিস্কিট এনে শফিকের সামনে মুখ ভেংচি দেয়। শফিক বিস্কিটের পিরিচটা হাতে নিয়ে একপিস মুখে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ময়নাদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল ‘দাদি, মারুফ কাকার বাড়ির কাজ তো শেষ। যা কাজ আছে দুই চার সপ্তাহেই তো শেষ হয়ে যাবে।’

‘হয়, নবীন মিস্ত্রী একটু তাড়া দিয়ে কাজ করলে তো এতোদিনেই হয়ে যাইত।’ দাদির কন্ঠে উষ্মা!

শফিক একটু দিয়ে ঘরের ভিতর তাকিয়ে বলে ‘ভালো ডিজাইন দেছে তো কাকা? রান্নাঘর, বাথরুম সব বাড়ির ভেতর দিয়েছে?’

‘হয় হয়, চারখান শোয়ার ঘর, বসার ঘর, খাওয়ার ঘর, দুইখান বাথরুম, রান্নাঘর সব আছে। আর কিছু? তাড়াতাড়ি গেলাসটা নিয়া আমারে উদ্ধার করো তো?’ ময়নার মেজাজ খারাপ হলো।

‘তুই বড় অস্থির ময়না। দেখ, নিশার কাছ থেকে শেখ। শহরের মেয়েরা কেমন চুপচাপ থাকে? মেয়েমানুষ এইরকম শান্ত থাকলে কত ভালো লাগে। একদম নদীর মতো শান্ত কিন্তু বুকের ভেতর সমুদ্রের মতো তুফান তোলে।’

পরের কথাগুলো আস্তে করে বলল শফিক, বসে থাকা নিশার দিকে একটু ঝুঁকে এসে।

তারপর নিশার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ‐
চোখ।”

নিশার সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠল!

আগুনের দিন ৭।

১১.
কালো আর অসুন্দর শুনতে শুনতে বাইশ বছর কেটে গেছে নিশার। কখনো কেউ মুগ্ধ চোখে তাকায়নি, ভালোবেসে চায়নি। আজকে শফিকের চোখে ভালো লাগা দেখে নিশা একেবারে অস্থির হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতি কখনো আসেনি ওর জীবনে। শঙ্কা আর আনন্দ একসাথে ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি ওকে পাগল করে দিতে থাকল। কিন্তু এ যে কাউকে বলার না। সামান্য একটা কবিতা শুনিয়েছে ওকে শফিক। তাতেই এতকিছু ভেবে নিলো ও? কিন্তু এই সামান্যটুকুই যে নিশার কাছে কতখানি অসামান্য তা কাউকে বলে বোঝানোর মতো না। ও কাউকে বোঝানোর সেই চেষ্টাটাও করল না। নিজেও ভুলে থাকতে চাইল। কিন্তু বারেবারে অভদ্র, অসভ্য আর ইতর শফিকের আবৃত্তি করা কবিতাটার প্রতিটি অক্ষর ওর কানে ভেসে ভেসে আসতে লাগল, শফিকের উদোম পায়ের দৃপ্ত চলার ভঙ্গি ওকে মোহাবিষ্ট করে দিতে থাকল। প্রেমে পড়ল নিশা। কিন্তু সেই প্রেম নিজের মনে নিজেই স্বীকার করবে এমন সাহসই ওর নেই।

চৈত্র মাসের রাতের আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। নতুন ঘরে উঠবে বলে এই আশ্রয়গুলো যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে সেদিকে কারো নজর নেই। টিনের বেড়া খুলে গেছে অনেক জায়গায়, জঙ ধরে ভেঙে গেছে। ভাঙা টিনের বেড়ার ছোটো ছোটো ফাঁক দিয়ে আকাশের কিয়দংশ দেখা যাচ্ছে। মেঘে ঢাকা ঘুটঘুটে আকাশ। সেদিকে তাকিয়ে নিশার মনে পড়ল, অমাবস্যা বলে ডাকে ওকে অনেকেই। কেউ বলত নিগ্রো। কেউ কালি বলে ডাকত। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। কান্না পেতো। পরে ধাতে সয়ে গেছে। আজ অনেকদিন পরে শরীর নিংড়ে কান্না পেলো ওর। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল। ময়না ফোনে কথা বলছিল সেইরকম নিঃশব্দেই। নিশা কাঁদছে টের পেয়ে বলল ‘ও নিশা? কানতাছো? কাকির কথা মনে হইছে? কথা কইবা? রিং দিয়া দেবো?’

ময়নার ফোন দিয়েই রেজিনাকে প্রতিদিনের খুঁটিনাটি তথ্য দিতে হয় নিশার। ও মাথাটা উঁচুনিচু করে সায় দিলো। মাঝরাতে ময়নার ফোন পেয়ে রেজিনা বিস্মিত হলেন, ভয় পেয়ে গেলেন।

‘ময়না?’

‘হয় কাকি। আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী হইছে ময়না? কোনো সমস্যা? নিশা কই?’

‘নিশা কানতাছে কাকি। নেন কথা কন।’

নিশা ফোনটা নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে ‘আম্মু ভালো লাগে না। আমি বাড়ি যাব।’

‘যাওয়ার জন্য তো ম্যালা লাফালাফি করছিস, এখন ভালো লাগে না কেন? মা তো খারাপ, দজ্জাল, অত্যাচার করে শুধু ; এখন কান্না পায় কেন? মা ছাড়া কোথাও গেলে কদর পাওয়া যায় না, সেইটা বুঝছিস?’

‘আম্মু?’ নিশার ফোঁপানি কমে না।

‘কী করব আমি? কে নিয়ে আসবে তোরে? আছে কেউ? সেই তোর বাপের গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। স্কুল ছেড়ে সে যাবে কীভাবে? ছুটি ম্যানেজ করতে হবে না? কান্দিস না, ঘুমা?’

ফোনটা রেখে আবারও অন্ধকারে চোখ পেতে ঘুমিয়ে যায় নিশা। অন্ধকার রাতের মতো কালো বলে ওর নাম দিয়েছিল নিশা। রাতের আরেক নাম নিশি।

১২.
চৈত্রের দুপুরগুলো অসহ্য হয়ে থাকে। কটকটে রোদের সাথে গরমের তীব্রতাও এতো বেশি যে মানুষের সাথেসাথে প্রকৃতিও হাঁপাচ্ছে। ময়নাদের বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। আগে ইটভাটা ছিলো এখানে। এখন পরিত্যক্ত। ইটভাটার জন্য মাটি এনে স্তুপ করে রাখা হতো, উঁচু হতে হতে ছোটোখাটো একটা পাহাড়ে রূপ নিয়েছে সেটা। সেই পাহাড়ের পাশেই ইটভাটার প্রয়োজনে পানি সরবরাহের জন্য কাটা পুকুর। পেছনে বেঁতফলের বাগান। বেঁতের ঝোপ নিচু হয়ে মিশে গেছে জংলামতো জায়গায়। জংলার পানি ঘন সবুজ দেখা যায়। জংলা পার হয়েই বাঁশবাগান। ছোটো বাঁশের সাঁকো দেখা যায় একটা। নিশার মনে হয় বেড়ানোর জন্য জায়গাটা খুব সুন্দর। মাঠ পেরিয়ে হালকা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের। ময়না, কান্তা, সীমা সবাই আছে এখানে। ময়না এক এক খন্ড করে কাঁচা তেঁতুল ধরিয়ে দিয়েছে সবার হাতে। সেই তেঁতুলে কামড় বসাতে বসাতে গল্প করছে সবাই। গল্পের বিষয়বস্তু একই। প্রেম আর বয়ফ্রেন্ড। সবারই ঝুলি ভরা প্রেমের গল্প; হাত ধরা আর চুমুর ফ্যান্টাসি। সেইসব গল্প কখনো কখনো আরও ভয়াবহ মোড় নিতে থাকে৷

দুপুরের রোদ নিভে গিয়ে বিকেলের নরম ছায়া পড়তে শুরু করলেই সীমা বলে ওঠে, ‘চলো মালোপাড়ায় যাই।’

‘ক্যান?’

‘যাত্রার নায়িকার নাম সুন্দরী। সে আজকে সন্ধ্যায় জনিগো বাড়িতে গান শুনাইবে।’

‘সন্ধ্যার সময় মা বাড়িত্তে বাইর হইতে দেবে?’ ময়না নাকচ করে দেয় কান্তার প্রস্তাব।

‘এইজন্যই তো এখন যাব। নায়িকারে দেইখাই চলে আসব।’

‘তোর ভাই যাইবে?’ কান্তার আগ্রহ সাহেবের প্রতি। সীমাও জানে সাহেব-কান্তার প্রেমের গল্প। অনেকসময় সংবাদ আদান-প্রদানের ডাকপিয়ন সেই হয়।

নিশারও আগ্রহ জাগে। নিষিদ্ধ আগ্রহ। গোপন কিন্তু অদম্য।
জনি মানে জোনাকি। শফিকের বোন।

থারটিন থেকে নাইনটিন – নাম্বারগুলোর শেষে টিন সিলেবলটুকু আছে তাই এদেরকে বলে টিনএইজ। বাংলায় কৈশোরকাল। এডোলসেন্স পিরিয়ড। বয়ঃসন্ধি। শৈশব ছেড়ে তারুণ্যের পথে এগিয়ে যেতে নতুন জ্ঞান, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অনুভব, নতুন শিক্ষা। মস্ত এক রঙিন চশমা এঁটে যায় অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত চোখে। ভুল, বেঠিক কিছুও বড় সুন্দর দেখায়। শরীর আর মনের এই পরম্পরা কী ব্যাকরণের বেঁধে দেওয়া ‘টিন’ শব্দটাতে আটকে থাকে? নবজাতককে স্তন চুষে দুগ্ধ খাওয়ার কথা কেউ যেমন শিখিয়ে দেয় না, বেসিক ইন্সটিংকট তাকে বেঁচে থাকার তাগিদেই খাদ্যগ্রহনের উপায় জানিয়ে দেয় তেমনি নিজের অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখতেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয় মানুষ, বয়সন্ধিতে। এই আবেগ কেউ চাইলেই আটকে রাখতে পারে না, কেউ থামিয়ে দিতে পারে না, হয়তো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো দমিয়ে রাখে। দমিয়ে রাখা এই আগ্রহ বাইশের কৈশোর ছেড়ে না যাওয়া তরুণী নিশাকে কুপোকাত করে ফেলল। শফিকের চোখে নিশা অন্য কিছু একটা পড়ে ফেলেছে যা ওকে আটশো কোটি মানুষের তাবৎ দুনিয়া থেকে আলাদা করে দিয়েছে, নিশার দৃষ্টিতে।

‘নারে মা যাইতে দেবে না। পলায়েও যাইতে পারব না। মাঠ ভরা কাপড়। শুকায়ে মচমচা হয়ে আছে।
এইগুলা নিয়ে, গোছায়ে রাখা লাগবে। খড়ি নাড়ছিলাম উঠোন ভরে। সেইগুলো রান্নাঘরে মাচায় উঠায় দিতে হবে। দাদির হাঁসগুলা বড় খারাপ। খোপে ওঠে না। সেইগুলারে খুঁজে খুঁজে খোপে ভরা লাগবে।’

‘আর সুমইন্যার সাথে প্রেমও তো করা লাগবে?’ সীমা মুখ বাঁকায়। সীমার আগ্রহ অন্যজায়গায়। মালোপাড়ায় ঢোকার আগেই মক্তব পড়ে। মক্তবের ছোটোহুজুরের চোখে চোখ পড়লেই কেমন অদ্ভুত লাগে ওর। হুজুর মক্তবের ভেতরে থাকলে, তাকে দেখা যায় না, তবুও ওই রাস্তায় হেঁটে আসতে ভালো লাগে ওর। ময়নার উপর রাগ হলো ওর। ওকে খুব অহংকারী আর স্বার্থপর মনে হলো। ‘নিজের বেলায় ষোলোআনা, হুহ।’ মনে মনেই বলে ও। ‘কেন তোর জন্য যে আমি ধানসেদ্ধ কাজ বাদ দিয়ে সুমইন্যার দোকানে খাতা কিনতে যাই?’

কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ছোটোহুজুরের প্রতি এই টান এরা টের পেলে হাসিঠাট্টায় পাগল করে দেবে৷ আর এটা হওয়ারও নয় ভালো করেই জানে সীমা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হয়তো অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে ওর। এই পছন্দের কথা কাউকে কোনোদিন বলার সুযোগও পাবে না।
উদাস হলো সীমা।

সূর্যটা গড়াতে গড়াতে একেবারে সাগরের বাগানের পেছনে চলে গেছে। পুরো মাঠজুড়ে ছায়া নেমে এসেছে। মাঠগুলোতে ফসল বোনার জন্য চাষ দেওয়া হয়েছে। একবার চাষ দেওয়া শেষ। বেশ ভালোরকম বৃষ্টি হয়ে মাটি নরম হলে আরেকবার চাষ দিয়ে বীজ বপন করা হবে। মাটি এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। আল ধরে না হাঁটলে, হাঁটতে কষ্ট হয়।

‘ময়না ওইটা তোর সুমইন্যা না?’ ময়না, নিশা, আর কান্তা, সীমার কথায় ঘুরে তাকায় মাঠের পাশের পুকুরটার দিকে।
আসলেই তো সুমন। সাথে শফিক। সুমনকে পিঠে চড়িয়েছে শফিক। দুইপা এসেই আবার নামিয়ে দিয়ে নিজে সুমনের কাঁধে চড়ার চেষ্টা করছে। ওই চারটে মেয়ে ছাড়া অন্য কোনো কেউ দেখলেই বুঝে যেত, ছেলেদুটো লোকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু এখানে লোক তো ওই চারটে মেয়েই শুধু।
ময়না চোখ সরু করে ফেলল। সুমনকে ওর অনেকবার বারণ করা আছে, ময়নাদের বাড়ির ত্রিসীমানায়ও যেন ওকে দেখা না যায়।
শফিকের হাভভাবও ওর ভালো লাগছে না৷ বয়সে কত বড় ওদের চেয়ে, কিন্তু ছেলেছোকড়াদের মতো আচরণ করছে। ময়না চকিতে নিশার দিকে তাকাল। নিশার গালের দুপাশের সলজ্জ আভা ওর চোখে পড়ে গেল।

শফিক আর সুমন খোঁচাখুঁচি করতে করতে ওদের কাছে এসে গেল।

‘কীরে এখন কি দিনেদুপুরে মাঠের মধ্যে তোরা প্রেম করবি? এইটা কি শহরের পার্ক?’ সীমার ঠেস দেওয়া মন্তব্যর উত্তর করল শফিক ‘সমস্যা কী তোর? আমরা গ্রামে থাকি বলে শহরের মতো প্রেম করতে পারব না? নাকি শহরের মানুষের সাথেও প্রেম করতে পারব না? কম কী আমরা শহরের মানুষের চাইতে?’ সিগারেটের শলায় ম্যাচলাইট দিয়ে আগুন দিলো বলতে বলতেই। তারপর দু’আঙ্গুলে চেপে ধরে ঠোঁটে লাগিয়ে মস্ত জোরে বাতাস টেনে নিয়ে তার চেয়েও জোরে ধোঁয়া ছাড়ল।

সিগারেটের ধোঁয়া নিশার অসহ্য লাগে। মাথা ঘুরে ওঠে, বমি বমিও লাগে। ও চোখমুখ কুঁচকে নাকে ওড়নার আঁচলচাপা দেয়। মেজাজও খারাপ হয়। এত সুন্দর একটা ছেলে, কেন সিগারেটে ঠোঁট পোড়ায়? নিশা মনে মনে ভাবে ও যদি ওই ছেলেটার নিজের কেউ হতো তো সিগারেটটা টেনে ফেলে দিত।

‘এইখানে কেন এসেছ? তোমাকে মানা করেছি না?’ চড়া গলা ধরে ময়না, সুমনকে উদ্দেশ্য করে।

‘না, শফিক ভাই বলল ওদের বাড়িতে যাত্রার নায়িকা আসছে আজকে। তোমরা গেলে ভ্যান পাঠায়ে দেই?’ হঠাৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় সুমন।

‘না। নিশা আসো বাড়ি যাই।’ বলেই নিশার হাত ধরে হনহন করে মাঠের আল ধরে হাঁটতে শুরু করে ময়না।

চলবে….
আফসানা আশা

আগুনের দিন পর্ব-৪+৫

0

আগুনের দিন ৪ ও ৫

৮.
নিশার ঘুম ভাঙল একঝাঁক মুরগির কককক আর হাঁসের প্যাকপ্যাক শব্দে। ওর দাদির পালা হাসমুরগির পালকে খাবার দেওয়ার সময় শব্দে কান পাতা দায়। নিশা চোখ কচলে বাইরে এলো। গনগনে রোদ বাইরে। চোখ ধরে যাচ্ছে। ময়নাকে দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকেই ময়না খুব ব্যস্ত থাকে। ওর মাকে সব কাজে সাহায্য করতে হয়। সকালের ধোয়ামোছা, তারপর সবার খাবার বেড়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া – কেউ কেউ রান্নাঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে খেতে বসে কিন্তু উঠোন মাড়িয়ে কেউ আবার আসতেও চায় না। পুরুষ লোকেদের খাবার যার যার ঘরে দিয়ে আসতে হয়। ঘর বলতে সব মাটির মেঝে আর বেড়ার দেওয়াল, মাথার উপর গোলের ছাউনি। তাতেও ময়নার কাজ শেষ হয় না। এরপরে দুপুরের রান্নার কুটনো কোটা, বাটনা বাঁটা সব ওকেই করে দিতে হয়। মাঝে মাঝে ভাতটা গড় দেওয়া, ডালটা বাগাড় দেওয়ার কাজও করতে হয়। মোটকথা বেলা গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগে ময়নার ফুরসত নেই। এই সময়টা তাই নিশার খুব বিরক্ত আর একঘেয়ে লাগে। ও ময়নার পাশে বসে থাকে কিছুক্ষণ দাদির সাথে গল্প করে একটু – দাদিও তার হাস মুরগি, গরুর দেখাশোনায় ব্যস্ত। প্রতিবেশি রিমা, কান্তা, আরজিনারও একই রকম ব্যস্ততা। আর রাতে লুকিয়ে বাশার আর সাহেবের সাথে যাত্রা দেখতে যাওয়া যতটা সহজ হয়েছে দিনের বেলায় তাদের সাথে কথা বলা, পাশাপাশি দাঁড়ানো ততটাই কঠিন। মা সাথে আসেনি বলে নিশার উপর কড়াকড়িও বেশি।

সকালের খাবারে কমন থাকে আলুভর্তা। মাটির চুলার পিঠে মরিচ রেখে মুচমুচে করে রাখা হয়। সকালের ভাত রান্নাশেষে চুলার আগুন নিভিয়ে সেই গনগনে কয়লার উপর, নারকেল পাতার শলায় গেঁথে মরিচপোড়া দেওয়া হয়। মিহি কাটা পেয়াজ, অল্প রসুনকুঁচি, ঝাঁঝওয়ালা সর্ষের তেল আর লবণের সাথে হালকা করে হলুদগুঁড়ো দেওয়া হয় আলুভর্তার সাথে। চেনা ভর্তার রঙ পালটে যায়, ভিন্ন ফ্লেভার আসে আর স্বাদটাও অন্যরকম হয়ে যায়। বেশ ভালোই লাগে নিশার। আর এর সাথে দাদির মুরগির খোপ থেকে বের করা টাটকা ডিমভাজি। বড় এক বোলে কেজিখানেক আলুর ভর্তা করা হয়। ময়না পেয়াজ আর রসুন কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। ছোটোবউ মরিচ পোড়াচ্ছে আর বিড়বিড় করে যাচ্ছে। গতরাতে নিশার দাদির বাতব্যথাটা বেড়েছিল। রাত জেগে তার পা টিপে দিতে গিয়ে ছোটোবউয়ের আর ঘুম হয়নি। সে নিশাকে দেখে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বলল ‘তোমার মা তো সব আমাদের ঘাড়ে দিয়ে শহরে গিয়ে রাণির মতো থাকে। কী আরামেই না আছে সে, তাই না, নিশা?’

নিশা উত্তর দেয় না। ও জানে এসব আক্ষেপের উত্তর করতে হয় না। ময়না ওকে ডেকে একটা পিঁড়ি এগিয়ে দেয় বসার জন্য ‘বসো। আজকে কাজ নাই বেশি। বাড়ির পুরুষ লোকেরা সবাই আজকে পার্টি অফিসে খাবে। আর আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবে। রান্না হবে না, দুপুরের জন্য। আজকে আমরা মালোপাড়ায় যাব, তেঁতুল আনতে।’

‘পার্টি অফিসে কেন?’

‘আল্লাহ, তুমি শোনো নাই? এইযে যাত্রাপালার আসর বসছে, একী শুধু চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ের জন্য? বিয়া তো কবেই শেষ। ইইউনিয়ন পরিষদ ইলেকশন না সামনে? তালাচাবি মার্কার লোক হেভি খাওয়াইতেছে সবাইরে। প্রতিদিনই গরু মারতেছে। আজকে আমাদের এইদিকে খাওন দেবে। পুরুষ লোকেরা গিয়ে খেয়ে আসবে। আর মেয়েদের খাবার বাড়িতে বাড়িতে পাঠায়ে দেবে।’

‘আমাদের বাড়ির সবাই কি তালাচাবি মার্কার ভোটার?’

‘তা তো জানি নে। তবে দাওয়াত সবারই। অনেক টাকা ঢালতেছে ইউনুস চেয়ারম্যান। আগে তার বাবা চেয়ারম্যান ছিলো, তারপর তার ভাই। সেও দুইবার চেয়ারম্যানি করছে। আগেরবার শুধু হাইরে গেছিলো। তাই এইবার জেততেই হবে তার। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পাকা করে দেবে বলেছে।’

‘বাঃ! ভালো হবে তো। যে কাদা হয় বৃষ্টিতে।’

‘করলে হয়। আব্বা কয় ভোটের পরে আর ফস করে না!’

‘মানে কী এর?’

‘হিহিহি। এর মানে শুনলে হাইসেই মরে যাবা। আগে যখন কোকাকোলা, সেভেনাপ নতুন নতুন আসছে এই দেশে, নির্বাচনের আগে এক নেতা ভোটারকে কোক খাওয়ায়োতো। প্রত্যেকদিনই। বোতলটা খুললেই ফস করে উঠত। এইরকম করে ভোটার লোকটা তো মজা পেয়ে গেল। সে প্রতিদিনই নেতার কাছে যায়, আলাপসালাপ করে আর একটা করে কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে আসে। তো ভোট শেষ হলো। ভোটের পরেরদিনও লোকটা গেছে নেতার কাছে, অভ্যাসমতো। নেতার চাকর একটা বোতল দিয়েছে, যেমন প্রতিদিন দেয়। কিন্তু এইদিন বোতল খুললেই আর গ্যাস বেরোনোর ফস করে ওঠা শব্দটা বেরোলো না। লোকটা জিজ্ঞাসা করতেই নেতা জানালো, ভোটের পরে আর ফস করে না! হিহিহি!’

‘ফস করল না কেন?’

‘আরে বোকা, ভোটের পরে তো আর কোল্ড ড্রিংকস দেয় নাই। বোতলে পানি ভরে দেছে। হিহিহি!’

নিশাও একচোট হাসল ময়নার সাথে। মজার গল্প৷

সব কাজ শেষ করে ময়না নিশাকে নিয়ে তেঁতুল আনতে মালোপাড়ার দিকে চলল।

ময়না দেখতে সুন্দর। নিশা কালো বলে যে খেদ আছে ওর মনে তা আরও বেড়ে যায় ময়নাকে দেখলে। আর গ্রামে থেকেও এত সুন্দর করে সাজে যে নিশার অবাক লাগে। নিশা নিজে পারে না আর সাজগোঁজে ওর আগ্রহও কম। ক্লাস এইটের ক্লাসপার্টিতে সখ করে আম্মুর লিপস্টিক লাগিয়েছিল ঠোঁটে। রেজিনা দেখে বলেছিল ‘কয়লার গাড়িতে আগুন!’ চাপা স্বভাবের নিশার রুচি হয়নি আর কোনোদিন ঠোঁট রাঙানোর।

ময়না পালাজ্জো সালোয়ার আর শর্ট কামিজ পড়েছে। ওড়নাটা একদিকে লম্বা হয়ে মাটি ছুঁয়েছে। দেখে মনে হতে পারে এলোমেলো হয়ে আছে, কিন্তু ও ওভাবেই পিনআপ করেছে ওড়না। মাথার সুন্দর চুলগুলোকে চুড়ো করে বেঁধে, দুইগাছি আবার চোখের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। হালকা কাজল আর লিপলাইনারে আঁকা ঠোঁট। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। নিশার মনে কেমন খচখচ করে, একটু হয়তো জ্বলুনি। নিজে কালো বলে আজীবন কটু কথা শুনে আসার অভিমানও!

তেঁতুল পাড়তে আসার জন্য যে এই সাজ না ময়নার সেটা নিশা অনুধাবন করল একটু বাদেই। মালোপাড়ায় যাওয়ার পরিবর্তে ময়না ওকে নিয়ে এসেছে বাজারের কিছু আগের ফ্লেক্সিলোড, বিকাশের দোকানে। দোকানে ঢোকার আগেই ময়না আমূল বদলে গেল, আঞ্চলিক ভাষা আর শুদ্ধ বাংলার খিচুড়ি করে কথা বলা মেয়েটা স্মার্ট বাংলায় নিশাকে বলল ‘নিশা, আমরা যে এখানে এসেছি, এই কথাটা তুমি কাউকে বোলো না, প্লিইইইজ!’

দোকানটাতে কিছু বইপত্রও আছে৷ টেক্সট, গল্প-উপন্যাস। ময়না সেগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল আর নিচু স্বরে দোকানের ছেলেটার সাথে কথা বলতে লাগল। ময়নার গালের লাল রঙ আর ছেলেটার চোখের ঢুলুঢুলু ভাব দেখে অনেক কিছুই বুঝে গেল ও। ছোটচাচি যেভাবে নিশার মায়ের শহরে থাকে, সুযোগ সুবিধা পাওয়া, ছেলেমেয়েদের শহুরে স্টাইলে মানুষ করার অভিযোগ করতে থাকেন তা একেবারেই সত্যি না। শুধু ভালো স্কুলে পড়া বাদে অনেক কিছু থেকেই নিশারা দুই বোন পিছিয়ে, গ্রামে থাকা ময়নার থেকে। অনেক কান্নাকাটি, আহ্লাদ করে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ল্যাপটপ আদায় করেছে ওরা মইনুল ইসলামের কাছ থেকে, নিজেদের কয়েকবছরের ইদি আর টিউশনির টাকাগুলোও দিতে হয়েছে সাথে, অথচ ময়নার হাতে ট্রেন্ডি স্মার্টফোনে, তাতে ডাটাপ্যাকেজ থাকে সবসময়ই। অনলাইনে অর্ডার করে হালফ্যাশনের জামা, রূপচর্চার সামগ্রী আনিয়ে নেয় ময়না, যেগুলোর নামও হয়তো শোনেনি নিশা।

নিশা বিরক্ত হচ্ছে। আধাঘন্টার বেশি এই মিহিকন্ঠের প্রেমালাপ চলছে। দুইহাত দূরে দাঁড়িয়েও একটা কথা কানে আসছে না নিশার। এতো আস্তে কেউ কথা বলে কীভাবে আর তার কথা অন্যজন বুঝছেই বা কীভাবে? বিরক্তির সাথে সাথে ও বিস্মিতও হচ্ছে ময়নার সাহস আর স্পর্ধা দেখে। বোঝাই যাচ্ছে ও প্রায়ই আসে এই দোকানে। ধরা পড়ার ভয় নেই ওর? যদি কেউ দেখে ফেলে? নিশার বুক ঢিপঢিপও শুরু হয়ে যায়।

থাই গ্লাসের স্লাইডডোর টেনে দেওয়া ছিলো, ফস করে টেনে একটা ছেলে ঢুকল। গ্যাবার্ডিনের ছয় পকেটের মোবাইল প্যান্ট হাওয়াই শার্টের সাথে মিসম্যাচ চটি স্যান্ডেল। ধুলোমাখা পায়ে ধপধপ করে ছেলেটি ঢুকে বলতে লাগল ‘ওই সুমইন্যা ফ্লেক্সি দিস নাই ক্যান? আধাঘন্টার উপরে হয়ে গেছে।’

সুমন মানে ময়নার বয়ফ্রেন্ড ছেলেটি তাড়াতাড়ি করে বলল ‘ভাই এইযে দিয়ে দিছি।’

নিশা চিনল ছেলেটাকে। আগেরদিন যাত্রায় সখি সাজা ছেলেটা যে পরে নিশার সাথে কুৎসিত ব্যবহার করেছিল। দিনের আলোয় ছেলেটাকে দেখে নিশার ধারণা পাল্টালো। ছেলেটা সুদর্শন, হেসে ফেললে দারুণ দেখায়! আর চোখদুটো খুব, খুব, খুব সুন্দর। পুরুষালী এমন মিষ্টি চেহারা আগে কখনো দেখেছে কীনা নিশা মনে করতে পারে না!

আগুনের দিন ৫।

৯.
‘ওই সুমইন্যা, এইটা বুঝি শালী? ভালো তো শহরের শালীও পেয়ে গেছিস। তা আমরা বড় ভাই যারা সিংগেল আছি, তাদের জন্যও একটু কিছু কর? শালী তো সুন্দর আছে?’ ছেলেটা একদম নিশার চোখে চোখ রেখে বলল। অদ্ভুত অনুভূতি হলো নিশার, চোখ ফিরিয়ে নিলো।

‘শফিইক্যা, ও নরম মেয়ে। একদম বিরক্ত করবি না।’ ময়না চোখ পাকিয়ে শাসায় শফিককে। সুমন তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে বাটন টিপতে টিপতে বলে, ‘শফিক ভাই, এইযে ফ্লেক্সি দিয়ে দিছি। তুমি একটু পরে আসো। এদের এখনই বিদায় দিচ্ছি।’

‘তাড়াই দিতাছিস? শুধু তোর শহুরে শালীর প্রশংসাই তো করলাম। ইংরেজিতে বলে কমপ্লিমেন্ট। একা একাই প্রেম করবি? ভাইদেরকে একটু ভাবি খুঁজে দিবি না? যাক, না দিলে নাই…’ মন খারাপের ভঙ্গিতে বলতে বলতে শফিক গান ধরল ‘নদীর জল ঘোলা ভালোওওও…. জাতের মেয়ে কালোই আলোওওওও!’

লজ্জাই পেলো নিশা। ঈষৎ লাল হয়ে মুখটা বেগুনি রঙ নিলো।

সুমন কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল ‘নিশা আপু, তুমি কিছু মনে কোরো না। শফিক ভাই একটু মুখ আলগা কিন্তু ভালো ছেলে। কী সুন্দর অভিনয় করে। কবিতা পড়ে। শিক্ষিত কিন্তু। বিএসসি পাশ।’

হলোইবা! নিশার তাতে কী? কী বিশ্রী করে গতরাতে ধমকেছিল ওকে!

‘চা খাবা নিশা আপু?’

‘না না, কিছু খাব না।’ সুমনের অফার ফিরিয়ে দেয় নিশা।’

‘খাবে না কেন? খেয়ে দেখো? এইখানের মালাই চা খুব মজা, খেয়েই দেখো না!’ নিশাকে বলে ময়না সুমনকে বলে ‘বেশি করে মালাই দেয় যেন। স্পেশাল।’

সুমন একমিনিটের মাথায় চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেরত আসে। ওদের গল্প, হাসি, চোখে চোখে চাওয়া, টেবিলের নিচে দিয়ে হাত ধরাধরি খুঁনসুটি চলতে থাকে। সাত আট মিনিটের মাথায় একটা বাচ্চাছেলে ছোটো ছোটো গ্লাসে করে চা দিয়ে যায়। চায়ে চুমুক দিয়ে নিশা বোঝে, এমন আহামরি কিছু না।চা শুধুই একটা বাহানা। আরেকটু সময় এখানে থাকা আর নিশাকে ব্যস্ত রাখার বাহানা মাত্র।

১০
‘ও নিশা তুমি কি কাউরে কয়ে দিবা?’

‘না।’

‘সত্যি কচ্ছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আল্লার কিরা? মাথায় হাত দিয়ে কও?’

‘ময়না, তুই ভালো করেই জানিস আমি কাউকে বলব না। নাহলে তুই আমাকে নিয়ে এখানে আসতি না।’

‘অনেকদিন ওর সাথে দেখা করতে পারি না। রাগ করে ও। মা তো আমাকে বাজারে তো আসতেই দেয় না। আজকে তোমারে সাথে নিয়ে আইছি বলে কিছু কবে না।’

‘এইটা আমার খারাপ লেগেছে ময়না। কোনো সমস্যা হবে না, বিশ্বাস করো? সুমনের দোকানটা দাঁড়ায় গেলেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে ওরা।’

‘দিলেই ভালো!’ অনাগ্রহের সাথেই শুভেচ্ছা জানায় নিশা। খুব মন খারাপ হয়েছে ওর। এতগুলো বসন্ত চলে গেছে জীবন থেকে। বয়সে ছোটো কতজনকে দেখে প্রেম করতে। ক্লাসমেট বা বান্ধবীদের প্রপোজ করার জন্য কতজন ওকেই মিডিয়া বানিয়েছে। বোন হয়েছে কতজনের, একসময় তো জাতীয় বোন খেতাব লেগে গিয়েছিল ওর সাথে! যে কেউই ওর কোনো বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক করতে চেয়েছে, সেই আগে ওকে বোন ডেকে রাস্তাটা সহজ করেছে। কিন্তু ওর জীবনে কখনো প্রেম আসেনি। কখনো কেউ মুগ্ধ চোখে চায়নি। একে নিজের গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। তারউপর বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশি এমনকী রেজিনার বিদ্রুপেও ও আরও গুটিয়ে থাকে। বয়সে অনেক ছোটো ময়নাকে প্রেম করতে দেখে তাই খুব হিংসা হচ্ছে ওর।

মন থেকে হিংসাত্মক ভাবনাগুলো জোর করেই সরিয়ে দিলো ও। ময়নাকে বলল ‘তেঁতুল নিবি না? বাড়ি গিয়ে কী বলবি?’

‘হয়, হয়? মনে করায়ে দিলা। থ্যাঙ্কিউ নিশা। আসলে কতদিন পরে ওর সাথে দেখা হলো, সব ভুলে গেছিলাম!’

‘তুই রাতে দাদির সাথে ঘুমাস কি সুমনের সাথে ফোনে কথা বলার জন্যই?’

‘হয়। বুড়ি তো কানে শোনে না। আর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমায় যায়।’

মালোপাড়ায় ঢোকার মুখে পরিত্যক্ত কূয়ার পাশে এক চিলতে মাঠ। গরু চড়ে। বিকেলে ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। এই মাঠ পার হতে সেকেন্ড ত্রিশ লাগে। তারপরেই ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। এখনো পাকেনি। কাঁচা কাঁচা তেতুল ঝুলছে। কী মোটা মোটা তেঁতুল? আর এত বেশি ধরেছে যে পাতা দেখা যাচ্ছে না। গাছ ঝুঁকেও এসেছে খানিক। একটু লাফ দিয়ে একটা ডাল ধরল ময়না আর ঝাঁকি দিতেই টপটপ করে কতগুলো তেঁতুল পড়ল। সেগুলো ওড়নার কোচড়ে ঝুলিয়ে, কয়েকটা তেঁতুলপাতা ছিঁড়ে নিলো ময়না। কিছু মাতা নিজের মুখে পুরল আর কিছু নিশাকে দিলো। খুব মজা লাগল নিশার। হালকা টকটক। একটু মিষ্টি মিষ্টি। তেঁতুলের মতো অত কড়া না টকস্বাদটা। নিশার মনে হলো মানুষ তেঁতুল গাছে পাতা কেন রাখে? গাছটা ওর হলে ও সব পাতা পেড়ে, বেটে ভর্তা করে খেয়ে ফেলত!

বাড়ি যাওয়ার পথ ধরতেই ময়না বলল, ‘জনিগো বাড়ি বিলাতি ধইনাপাতা আছে। চলো নিয়ে আসি। তেঁতুলভর্তায় দিলে কী যে ঘ্রাণ হবে? আংগুল চাটতেই থাকবা!’

‘চাইলেই দেবে?’

‘কেন দেবে না? ব্যাপক হইছে তো?’

জোনাকির নাম ছোটো করে জনি। শফিক, শহীদ, জোনাকি আর সোনাই চার ভাইবোন। জোনাকি, ময়নার বন্ধু। বেশ ভাব দুজনের। ময়না ‘জনি, ও জনি? আছিস?’ বলে ডাকতে ডাকতে বাড়ি ঢুকল। বাড়িটা খুব সুন্দর। গেরস্ত বাড়ি। সব ফসল হয়। টিনের চাল দেওয়া সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো ঘর। সব ঘরেই কাঠের ছাদ করা আছে ফসল রাখার জন্য। উঠানে সারাবছর ধান শুকানো হয়। কখনো মরিচ, কখনো হলুদ নাড়া থাকে। উঠোনের চারিদিকে ঘর। ঘরগুলোর সামনে সিমেন্টঢালা বসার জায়গা। সেখানে আচারের বয়ম রোদ পোহাচ্ছে। ময়না একটা বয়ম তুলে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে আচার বের করে আনল। ‘খাবা নিশা? জনির মা যে সুন্দর বরইয়ের আচার বানায়? খেয়ে দেখ?’

‘না। তুমি হাত ধোও নাই!’

‘ধুরো! হাত ধুইতে গেলে জনির মা টের পেয়ে যাবে না? ক্যাক্যা শুরু করবে আইসে?’

‘এটাতো চুরি?’

‘জনি জানে।’

‘হুহ!’ মুখ ভার করে রইল নিশা। কতশত অন্যায় কাজ একদিনে করে ময়না? ওর ভয় করে না? গতকাল রাতে চুরি করে যাত্রা দেখতে গেল, নিশাকেও জোর করে নিয়ে গেল। দাদিকে লুকিয়ে যেতে কী অপরাধী মনে হচ্ছিল নিশার, নিজেকে নিজের!

পুরুষেরা কেউ বাড়ি নেই, মহিলারা হয়তো রান্নাঘরে ব্যস্ত। ময়না আরও দুবার ডাক দিলো ‘জনি? ওই হারামজাদি, মরছিস নাকি?’

ময়নার ডাক জোনাকির কানপর্যন্ত যাওয়ার আগেই বাদামীরঙা একটা বেশ নাদুসনুদুস কুকুর জিভ বের করতে করতে ছুটে এলো আর ঘেউঘেউ শুরু করে দিলো। নিশার খুব কুকুরে ভয়। ও লাফ দিয়ে একটা ঘরের দাওয়ায় উঠে গেল আর চিৎকার করে কাঁদতে থাকল। নিশা যত জোরে কাঁদে, কুকুরটা তত জোরে ঘেউঘেউ করে! মিনিট দুয়ের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গেলো আর শফিক কুকুরটাকে ডাক-তে ডাকতে গলায় হাত দিয়ে টেনে নিলো ‘এই, এই প্রেমা? থাম, থাম? আতুউউউ। এই প্রেমা? থাম, মা?’

নিশা স্তম্ভিত হয়ে কুকুর আর কুকুরের মালিকের কথোপকথন শুনতে লাগল।

ময়না হাত ধরে টানল নিশার ‘এত ডাকতেছি, তোমারতো একেবারেই হুঁশ নাই। এত ভীতু তুমি? আল্লাহ গো! বলতেছি এইডা পালা কুকুর, কামড়াবে না। তুমি শোনোই না। আসো?’ ওদের বয়সী একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল ‘ওই জনির বাচ্চা? কই মরতে গেছিলি? ডাকতে ডাকতে জান শেষ?’

‘আজকে মেজবান না?’

‘তগো কী?’

‘চেয়ারম্যান কাকায় তো সব আমাগো উপরেই দিছে? মশলা বানাইলাম, গুস্ত বানাইলাম। তুই আইছিস ক্যান?’

‘আইরে পারব না?’

‘সেইডা কইনাই। ক্যান আইছিস জিগাইছি!’

‘ধইন্যাপাতা দিবি?’

‘হ। আস্তে ক? মা শুনলে রাগ করব। কান্তাগো গরু অদ্দেক পাতা সাফ কইরা দিয়া গেছে। তুই বাইরে যা, আমি চটপট কয়ডা পাতা ছিঁড়া আনতাছি?’

ময়না আর নিশা বাড়ির বাইরে এলে জোনাকিও হাতের মুঠোয় ধনেপাতা এনে ময়নার কোচরে ফেলে দিলো। ‘কী করবিরে পাতা দিয়া?’

‘তেঁতুলভর্তা খাব?’

‘আমারে দিয়া যাইস?’

‘এতো দূরে আবার আসব? সোনাইরে পাঠাইস?’

‘সোনাইরে মা যাইতে দেবে না। রান্না চড়ছে। একটু পরে ভাই বাড়ি বাড়ি দিতে যাইবে। ভাইর হাতে দিয়া দিস তখন?’

‘আচ্ছা।’

১০

‘এটাই কী ওই শফিকদের বাড়ি?’

‘হয়। সুন্দর না বাড়িটা? এলাকায় এতবড় বাড়ি আর কারো নাই। চেয়ারম্যান কাকার বাড়িও এতবড় না।’

‘ওরা কয় ভাইবোন?’

‘চাইরজন। শফিইক্যা, শহীদে, জনি আর সনি। শফিইক্যা বড় পোলা বলেইতো অত বাইড়!’

শফিকের উল্লেখে অকারণেই নিশার গাল লাল হয়ে গেলো। ও অস্ফুটে বলল ‘আর ওই কুকুরটা?’

‘ওইটা শফিইক্যার কুত্তা। নিজের চাইতে বেশি যত্ন করে ও কুত্তাডারে। যে খাবার দেয়, বাপরে বাপ! সপ্তায় দুই কেজি গরুর গুস্ত কেনে ওই কুত্তাডার জন্য।’

‘কুকুরটার নাম কী? কী নামে যেন ডাকছিল…?

হাসতে হাসতে নিশার গায়ে ঢলে পড়ে ময়না। ‘ওরে ঢঙ ওই কুত্তা নিয়া? কুত্তার নাম হইল প্রেমা! বুঝছ প্রেমা?’
হাসির দমকে কথা ঢাকা পড়ে যায় ময়নার। বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলে ‘ওই শফিইক্যা নিজের নাম দেছে প্রেম; আর ওর বউয়ের নাম বলে প্রিয়া! আর ওই কুত্তাডা হইলো ওর মেয়ে, কুত্তার নাম নিজের নামে মিলায়ে রাখছে প্রেমা!

হাসতে হাসতে তেঁতুল, তেঁতুলপাতা, ধনেপাতা কোচর থেকে ফেলে দেয় ময়না। সেগুলো দুজন মিলে খুঁটে তুলে আবার হাসতে থাকে। ‘কুত্তার নাম প্রেমা! হিহিহি!…’

নিশাও হাসতে থাকে প্রাণখুলে।

চলবে..
আফসানা আশা