আগুনের দিন পর্ব-০১

0
387

আগুনের দিন ১।

দুটো বড় বড় পান, একটা কাঁচাসুপারীর পুরো অর্ধেকটা, তিন আঙ্গুলের মাথায় সুরভী জর্দা মুখে পুরে, ডান হাতের তর্জনীতে বেশ খানিকটা চুন টেনে নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বাতাসী বেগম বলল ‘আপা, শোনো, ছেলেপক্ষ কিন্তু কিছু চায় না। আসবে, বিয়ে হবে, মেয়ে নিয়ে চলে যাবে। বুঝছ?

‘সে ঠিক আছে। কিন্তু… ‘ ইতস্তত করে রেজিনা। মেয়ের বাবা মেয়েকে এখনই বিয়ে দিতে রাজি না, যদিও স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাথায়ই জোড়ামেয়ে পার করা নিয়ে আকাশসমান দুঃশ্চিন্তা।

‘কিন্তু কিন্তু কিছু না, কাবিন করে মেয়ে রেখেও যাবে না, নিয়ে যাবে একবারেই।’ ঘাড় কাত করে আরেকটু জোর দিয়েই বলে বাতাসী।

‘আরে শোনো না, আমার কথাটা…’

‘তুমিও শোনো, আসবেও ধরো এই চার পাঁচজন। হঠাৎ করে আয়োজন করতে যে ঝামেলা হয়, সেইটা তারা বুঝে। যেমন বুঝদার ছেলে তেমনি বুঝনেওয়ালা ফ্যামিলি। কোনো ঝামেলা তারা করবে না, কোনো চাহিদাও নাই। মেয়েরে যা দেওয়ার তারাই দিয়ে মেয়ে নিয়ে যাবে।’

‘আরে আপা, শোনো না?’ রেজিনা থামাতে চেষ্টা করে বাতাসীকে।

‘আপা, ওরা আগামী পরশুদিনই আসতে চায়। দেখাদেখি হলো, কাজি ডাকা থাকল, কথাবার্তাও হতে থাকল, আসবে, বসবে – চারহাত মিলায় দেবো।’

‘এতো তাড়াহুড়া কেন?’

‘আরেহ, মজার কথা। আমি শুনে তো হাসতে হাসতেই শেষ!’

‘কী ব্যাপার?’

‘আরেহ, ছেলের বন্ধুরা সব যাবে কক্সবাজার। বেড়াতে। আনন্দ করবে। সবাই যাবে বউসহ। এখন এই ছেলের প্রেস্টিজে লাগতেছে। তাই একটু তাড়াতাড়ি করতে চায়।’

রেজিনা অবাক হলো। বিয়ে সারাজীবনের সিদ্ধান্ত। লক্ষ কথা খরচ না করে নাকি বিয়ে হতে নেই। কত আয়োজন, কত দেখাদেখি, কত চেনাশোনা করে তারপর না বিয়ে? বিয়ে কি শুধু আচার-অনুষ্ঠান যে কম করলেও চলে? দুটি মানুষ একসাথে থাকতে পারবে, দুজনের সব দোষ গুণ ভালো মন্দ মেনে নিতে পারবে এটা বোঝার পরই বিয়ে পর্যন্ত যাওয়া উচিত। এখানে তাড়াহুড়ো করে নেওয়া একটা ভুল মারাত্মক হতে পারে। সেখানে এমন একটা ফালতু কারণএ বিয়ে করাটা খুবই অগ্রহণযোগ্য মনে হলো রেজিনার কাছে। কিন্তু ঘটকও নাছোড়বান্দা। সম্ভবত ছেলেপক্ষে বেশ ভালোমতো নাজরানা দেওয়ার লোভ দেখিয়েছে। রেজিনার রাগ হলো, কিন্তু মেয়ের জন্য আসা প্রথম বিয়ের প্রস্তাব, একেবারে না করে দিতেও সংস্কারে আটকাচ্ছে। আবার কালো মেয়েকে পার করার চিন্তাও আছে। কিন্তু এখানে মন টানছে না। আরেকটা পান বানিয়ে পানের খিলিটা বাতাসীর দিয়ে বললেন ‘কিন্তু আপা, আমার মেয়েটা তো ছোটো এখনো।’

‘আরে ছোটো আর কই এতো? আয়ে পাশ দিয়ে দিয়েছে। অনাসসে পড়ে না? এই বয়সে আমার, তোমার বিয়ে হয়নি? আমার তো দুটো বাচ্চাও হয়ে গিয়েছিল।’

‘ওর বাবা বিয়ে দেবে না এখন। তার ইচ্ছে মেয়েকে আরও পড়াশোনা করাবে।’ এবারে শক্ত করেই বলল রেজিনা।

‘বাদ দেও তো? পুরুষ মানুষের সংসারের বুদ্ধি আছে? আমরা মেয়েরা সংসার ধরে না রাখলে কবে সব ভাসিয়ে দিতো? হুহ, মেয়ে বিয়ে দেবে না! ভালো করে বুঝিয়ে বলবা।’

‘না আপা। শোনো তুমি, এখন আমি মেয়ে বিয়ে দেবো না।’

‘সেটাই বলো? তুমিই রাজি না। যেমন ঘর বাড়ি আর যেমন বংশ দেখে মাথা ঘুরে যাবে। তখন আর রাজি না হয়ে পারবা না।’

‘না আপা। মেয়েটা আরেকটু বড় হোক।’

‘আর বড়? বলো বুড়ি হলে নিজে নাগর ধরবে, সেই আশায় আছো?
ঢঙ!’

মূহুর্তে মহিলার পরিবর্তন দেখে চমকে গেল রেজিনা। একে তো রেজিনা ডেকেও আনেনি। মেয়ে বিয়ে দেবে এমন কথাও কাউকে বলেনি। এই মহিলা নিজে সেধে বাড়ি বয়ে এসে অপমান করছে। রেজিনার ননদের জা হয় সম্পর্কে তাই এতোক্ষণ তোয়াজ করেছে সে।
বাতাসী আবার বলতে থাকল ‘ওই তো মেয়ের গায়ের রঙ, পাতিলের তলা! তার উপর নাক মুখের ওই তো ছাঁদ আর ছিরি। বয়স কম, বিয়ে দেবে না! হুহ। বয়স কম বলেই তো প্রস্তাব নিয়ে আসছি। ওই বয়সের চটক ছাড়া আর আছে কী? ওই তো খাপরাখান, বুড়ি হলে আর চলবে?’

বিব্রত, লজ্জিত আর ক্রুদ্ধ রেজিনার খুব ইচ্ছে করল চটাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দেয় বাতাসীর গাল বরাবর! কিন্তু নিজেকে সামলাল। এভাবে রাগ করে কিছু বলে ফেললে, ননদ এসে রেজিনার উপরেই ঝাল ঝাড়বে।

নিজে হাজারবার মেয়েকে কালো বলে নিন্দামন্দ করলেও অন্যের মুখে শুনতে খারাপই লাগল।

২.

‘ওইযে সোনাবানের সখি, ওই সোন্দর মেয়েটা, ওইটা কিন্তু মেয়ে না, বুঝছ? ওইটা ছেলে। আমাগো গ্রামের মেম্বারের পোলা। আলগা চুল লাগাইছে মাথায়। মেয়ে সাইজা ওবিনয় করে। বুঝছ?’

ময়নার কথায় নিশা মাথা নাড়ল। ও বুঝেছে। ক্রস-জেন্ডার একটিং ওর কাছে নতুন কিছু না। প্রাচিন গ্রীসে, অধুনা ভারত, জাপান, চায়না, ইউরোপ সবজায়গাতেই নারীদের নাটকে আসাটা সমাজের অপছন্দ ছিলো। বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিলো। তাই পুরুষেরা মেয়েলি জামা পরে আর নকল চুল মাথায় জুড়ে, নারীসুলভ বাচনভঙ্গি দিয়ে নারীচরিত্র করে যেতো সাবলীলভাবে। যদিও প্রতিষ্ঠা মেলার উদাহরণ কম কিন্তু কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতো। শিল্পের প্রতি অনুরাগী মানুষের, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লোভও কাজ করে কম।

অতিরিক্ত ঢঙ করে, অকারণ মাথা বাঁকিয়ে, মুখেচোখে অতিরিক্ত অভিব্যাক্তি প্রকাশ করা পুরুষালি চওড়া কাঁধের, লম্বা ছেলেটাকে বরং নারী বলে ভ্রম হয় না কোনোভাবেই।
ছোটো আর অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বলে অতটা চোখেও লাগে না, হালকা কমিক রিলিফ সুবিধা দেয়। নিশা যাত্রায় মন দিলো। লোকজ একদা অতি জনপ্রিয় যাত্রা উঠে গেছে এখন সবখান থেকেই। আগে পালা পার্বণে গ্রামে গ্রামে যাত্রা, পালাগান হতো – বাবার মুখে গল্প শুনেছে নিশা। ওর এক কাকা যাত্রা করতেন। অভিনেতা হিসেবে নামডাক ছিলো। ক্ষুধায় কাতর এক অনাহারীর ডায়লগ ‘আমি এখন গাছের পাতা খাই, গাছের পাতা খাই’; এই অংশে সামনে থাকা দর্শক তো বটেই গাছের পাতারাই নাকি কেঁদে দিতো।

নিশারা থাকে শহরে। গ্রামে দাদার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। এসে যাত্রার নাম শুনে কাজিনদের সাথে দেখতে এসেছে। পাবনা থেকে যাত্রার দল ভাড়া করে এনেছে এলাকার চেয়ারম্যান, মেয়ের বিয়ের জাঁকালো আয়োজনে আরেকটু জাঁকান্দানি করতে। যাত্রা একেবারে খারাপ লাগছে না নিশার কাছে। টিভিতে দেখতে যতটা হাস্যকর লাগত তেমন না একেবারেই। বেশ ভালোই লাগচজে ওর। জরির ফিতে দিয়ে ঝলমলে সাজপোশাক, নাগরাজুতো পরা অভিনেতা, তাদের হাহাহা করে অট্টহাসি, রাংতা জড়ানো ঢাল- তলোয়ারের যুদ্ধ, আর একদম পেছনে বসা দর্শকের কানে সংলাপ পৌঁছে দিতে অস্বাভাবিক জোরে ডায়লগ ডেলিভারি – গ্রামের সতেজ হাওয়ার মতোই শতভাগ নির্মল বিনোদন।

যাত্রার জন্য আদর্শ সময় হচ্ছে শীতকাল। ফাল্গুনের শেষবেলায় চৈত্রের গরম পড়তে শুরু করেছে, প্যান্ডেল কাপড়ে মুড়ে রাখায় সেই গরম তীব্র হয়েছে। তবুও টিভি, স্যাটেলাইটের এই যুগে নতুন এই বিনোদনে কারোরই উৎসাহের কমতি নেই। রাত বাড়ছে, তলোয়ারের ঝনঝনানির সাথে সাথে উত্তেজনাও বাড়ছে। ছোটোদের উৎসাহ ছিলো সবচেয়ে বেশি, তারা কেউ কেউ নিচে বিছানো মাদুরে ঢলে পড়েছে।

৪.
‘আমি তোমাকে এমনই জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখব, তোমাকে কেউ খুঁজেই পাবে না!’

‘নাহ। আপনার এই কুপ্রস্তাব আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। আপনার সাথে আমি কিছুতেই যাব না। আপনি চলে যান এখান থেকে, চলে যান বলছি…’

‘যাব, যাব, যাবই পেয়ারি? তবে একা নয়, তোমাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যাব। হুহুহাহা!’

‘নাহ, নাহ, নাহ, আমি যাবোহ না!’ সিপাহসালার দবির খাঁর একমাত্র পুত্র নাসির খাঁ ঝাঁপিয়ে পড়েছে পেয়ারিরূপি সোনাভানের উপর। নাসির খাঁ চিৎকার করছে ‘স্বেচ্ছায় না গেলে জোর করে নিয়ে যাব সুন্দরী!’

‘নাহ, নাহ নাহ, কেউ বাঁচাও, বাঁচাও আমাকে?’

লাল নীল আলোগুলো নিভে গেছে, বাজনাগুলোও ক্লাইম্যাক্সে, সবাই অপেক্ষা করছে ডাকাত সর্দারের আগমণের ; অত্যন্ত উত্তেজনাকর এই দৃশ্যের ভিতর কে যেনো নিশার কাঁধ ধরে নাড়া দিলো। মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা। ও ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটার চেহারা দেখতে পারল না, স্টেজ থেকে পড়া আলোর কারণে। ‘তোমার সামনে চ্যাগায়ে আছে মনিরের বাচ্চা, ওর প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকায়ে দেখো, সিগারেটের প্যাকেট আর গ্যাসলাইট আছে। বের করে দাও তো!’

নায়কের প্রবেশ ঘটেছে মঞ্চে, নাসির খাঁর হাত থেকে সোনাভানকে বাঁচাতে – সবগুলো আলো জ্বলে উঠল, স্পষ্ট হলো মঞ্চ, সেই আলোতে ছেলেটার মুখও দেখল নিশা।
একটু আগে নায়িকের বান্ধবির পার্টে অভিনয় করেছে এই ছেলেটাই। মুখে ধুয়েছে। কিন্তু কাজল আর লিপিস্টিক এখনো ওকে ছেড়ে যায়নি।
কি নির্বিকার ছেলেটার কন্ঠ। যেনো নিশা আগেও বহুবার ওর সিগারেট এনে দেওয়ার কাজ করেছে!

চলবে…
আফসানা আশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে