Monday, June 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 313



শেষ ঠিকানা পর্ব-১১

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_১১
#মেহরিন_রিম
_হ্যালো, কে বলছেন?
_আমি হিমি, আপনি আজ দুপুরের দিকে আমাকে কল করেছিলেন। কিছু একটা বলবেন বলছিলেন।

অপর পাশের ব্যাক্তি হিমির কথা শুনে কিছুটা হকচকিয়ে উঠে বললো,
_তেমন কিছু না, আসলে আমি তোমার সাথেই পরি। আমাদের এক্সাম এর ডেট ঠিক হয়েছিল। তুমি খবর পেয়েছো কিনা সেটা জানাতে ফোন করেছিলাম আরকি।

হিমির কিছুটা খটকা লাগলো। ভ্রু কুচকে বললো,
_হ্যা সেটাতো আমি জানি, ডেট তো আরো আগেই ঠিক করা হয়ে গেছে।

_ওহ আচ্ছা,ঠিক আছে আমি তাহলে রাখি হ্যা।

_এক মিনিট, আমিতো তখন ফোনটা না কেটেই চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি ৪ মিনিট পর্যন্ত কলটা ধরে রেখেছিলেন কেন?

_আমার একটু কাজ আছে,আমি রাখছি।

_আরে উত্তর টা তো…

হিমি আর কিছু বলার আগেই কলটা কেটে যায়। হিমি তাকে আবার কল করতে যাবে তার আগেই কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে থেমে যায় সে।
অর্নব ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে হিমির দিকে একবার তাকায়। তারপর দরজা আটকে দিয়ে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঘড়ি খুলতে থাকে। হিমি তখনো তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
অর্নব হিমির দিকে তাকাতেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। বেশ কিছুটা সময় সেভাবেই কেটে যায়,অর্নব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিমির দিকে।
অর্নবকে চুপ থাকতে দেখে হিমি কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো। কাপা কাপা গলায় বললো,
_আ আমার আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।

হিমির কথায় অর্নবের ধ্যান ভাঙলো, তবে কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষন সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলতে লাগলো,
_কি আর বলবে? তোমার অতীত সম্পর্কে? বিশ্বাস করো আমার সেই বিষয়ে জানার কোনো ইচ্ছে নেই। অপূর্বর ব্যাপারে আমি সবটাই জানি, আর এর চেয়ে বেশি কিছুও যদি হয়ে থাকে তাতেও আমার কোনো প্রবলেন নেই। সর্বোচ্চ তোমাদের মধ্যে ফিজিক্যাল…

_প্লিজ…চুপ করুন আপনি।
হিমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে কথাটা বললো। অর্নব আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। হিমি চোখ তুলে অর্নবের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আমাদের সম্পর্কের মধ্যে খারাপ কিছুই ছিলোনা। আমরা একে অপরকে মন থেকে ভালোবাসতাম।

অর্নব কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো হিমির দিকে। তারপর ধীর পায়ে তার পাশে এসে বসলো। হিমির চোখে চোখ রেখে বললো,
_তুমি নাহয় মন থেকে ভালোবাসতে,কিন্তু অপর পাশের লোকটার কথা গ্যারিন্টি নিয়ে কি করে বলতে পারো তুমি?

_মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন?

অর্নব চোখ সরিয়ে নিলো। সামনের দিকে তাকিয়েই বললো,
_কিছুনা। রাত অনেক হয়েছে, তুমি ঘুমিয়ে পরো।

_আর আপনি?

অর্নব একনজর হিমির দিকে তাকালো। কোনো উত্তর না দিয়েই উঠে ব্যালকনি তে চলে গেলো। হিমি তাকিয়ে রইলো অর্নবের দিকে,বোঝার চেষ্টা করছে তাকে।

____
কেটে গেছে আরো দুটো মাস। এতদিনে হিমির অনেকটা উন্নতি হয়েছে, থেরাপি দেওয়ার ফলে হিমি হুইল চেয়ার ছেড়ে দুটো ক্রাচ নিয়েই হাটতে পারে। দুদিন আগে থেকে একটা ক্রাচ নিয়েও হাটার চেষ্টা করছে।
অর্নবের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ধীরে ধীরে গভীর হতে শুরু করেছে,অন্তত তাদের মধ্যকার গম্ভীর্যতা কিছুটা হলেও কেটেছে। হিমিও মেনে নিয়েছে নিজের ভাগ্যকে। এতদিনেও অপূর্ব তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি, হিমিও আর সেদিনের পর থেকে খোজ নেওয়ার চেষ্টা করেনি। হিমিও অর্নবকে বোঝার চেষ্টা করছে, চেষ্টা করছে তার সঙ্গে সম্পর্ক টা স্বাভাবিক করে তোলার।

বিয়ের পর থেকেই হিমি খেয়াল করছে অর্নব রেগুলার সিগারেট খায়,ব্যাপারটা একদমই পছন্দ না হিমির। তবে সরাসরি কিছু বলে ওঠার সাহস পায়নি। তবে আজ ঠিক করেছে,অর্নবকে এই বিষয়ে কিছু বলবে।

রাত প্রায় ১১ টা বাজে। ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে অর্নব। হিমি অনেক্ষন রুমে বসে সেটা দেখছে,এবার ক্রাচ টা নিয়ে উঠে দাড়ালো। ধীরে ধীরে গিয়ে দাড়ালো অর্নবের পাশে। অর্নব একবার হিমির দিকে তাকালেও কিছু বলল না। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর হিমি অর্নবের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আপনি এত স্মোক করেন কেনো?

অর্নব তাকালো হিমির দিকে,তারপর আবারো চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
_এমনি।

_আগে থেকেই করতেন?

অর্নব হিমির দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলল,
_কেন? আগে কখনো স্মেল পেয়েছিলে বুঝি?

হিমি সরু চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়লো।
অর্নব আবারো বললো,
_তাহলে?

_যদি আগে নাই করে থাকেন। তাহলে শুরু করলেন কেন?

অর্নব চোখ সরিয়ে আবারো আকাশের দিকে তাকালো। হিমি কিছুক্ষন চুপ থেকে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললো,
_যদি আমার জন্য শুরু করে থাকেন,তাহলে আমার জন্য নাহয় ছেড়েও দিন।

হিমির কথা শুনে অর্নব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। কিছুক্ষন এভাবেই তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। হিমি এবার চোখ নামিয়ে সেখান থেকে যেতে চাইলেই অর্নব তাকে আটকে দেয়। হিমির সামনে গিয়ে বলে,
_অর্ডার করলে?

_আপনি চাইলে ভাবতে পারেন।

অর্নব হিমির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। তারপর ঘরে গিয়ে ড্রয়ার থেকে সিগারেট এর প্যাকেট টা এনে ব্যালকনি তে থাকা ডাস্টবিন এ ফেলে দিয়ে আবারো হিমির সামনে গিয়ে দাড়ালো। হিমির কানের কাছে কিছুটা ঝুকে বললো,
_মাঝেমাঝে এমন ছোটখাটো অর্ডার পেলে মন্দ হয়না।

মুচকি হাসলো হিমি। অত:পর অর্নবের পাশ থেকে ঘরে চলে এলো সে। এখন আর তার নিজের সিদ্ধান্তের উপর সন্দেহ হয়না। হিমি বুঝতে পারছে, সে সঠিক সিদ্ধান্তই নিতে পেরেছে।
____
অর্নবের বাবা দেশে ফিরে আসায় হিমি-অর্নবের বিয়ের অনুষ্ঠান এর দিন ঠিক করা হয়েছে। হিমিও এতে কোনো আপত্তি করেনি, এখনো দিবা ছাড়া আর কোনো বন্ধুকেই সে নিজের বিয়ের কথা জানায়নি।
হিমি,অর্নব,দিবা,হুর,অরি সবাই একসাথে বিয়ের শপিং এ এসেছে। অরি আর হুর তো নিজেদের খুশি সামলাতেই পারছে না। বিয়েতে কি কি করবে সেই প্লান করতে করতেই তাদের দিন কেটে যাচ্ছে। হিমিও এখন বেশ হাসিখুশি ভাবেই দিন কাটাচ্ছে,যতটা সম্ভব অপূর্বকে ভুলে থাকছে সে।

শপিং শেষে দিবা নিজের বাড়িতে চলে যায়। অরি আর হুর কে বাড়িতে ড্রপ করে অর্নব আবারো হিমিকে নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
বেশ কিছুক্ষন গাড়িতে বসে থাকার পর হিমি জিজ্ঞেস করে,
_কোথায় যাচ্ছি আমরা?

অর্নব সামনের দিকে নজর রেখেই বলল,
_তুমি বল কোথায় যেতে চাও?

হিমি অতি উৎসাহ নিয়ে বলল,
_আমার তো রাসেল মামার ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে, চলুন না সেখানে যাই। আপনার মনে আছে..

_মনে থাকবেনা কেন! আচ্ছা চলো সেখানেই যাওয়া যাক।

নিজেদের গন্তব্যের কিছুটা আগেই নেমে যায় হিমি আর অর্নব। এখানে গাড়ি পার্ক করে তারপর ফুচকা খেতে যাবে। সেখানেও আসেপাশে কিছু ফুচকার দোকান ছিলো, অর্নব হিমিকে পাশে বসতে বলে গাড়ি পার্ক করতে চলে যায়।
হিমিও অর্নবের কথা অনুযায়ী একটা চেয়ারে বসে পরে। হিমি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকে,অনেকদিন হলো ওই জায়গায় আসেনা সে। আগে প্রায়ই অপূর্বের সাথে এখানে আসা হতো।
হিমির এসব চিন্তার মাঝেই হঠাৎ পিছন থেকে কেউ তাকে ডাক দিলো।

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-১০

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_১০
#মেহরিন_রিম
_মা,আপনি কি বিয়েতে রাজি? রাজি থাকলে বলুন কবুল।

চুপ করে রইলো হিমি। গলা দিয়ে যেনো আওয়াজ বের করতে পারছেনা সে। বেশ কিছুক্ষন হিমিকে চুপ থাকতে দেখে অর্নব এর এবার কিছুটা চিন্তা হচ্ছে। দিবা হিমির কানের কাছে গিয়ে বললো,
_হিমি,কবুল বল।

হিমি এবার চোখ বন্ধ করে কবুল বলে দিলো। অর্নব এতক্ষন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো হিমির দিকে, কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গেই যেনো অর্নবের বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেলো। সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে, এরপর সেও কবুল বলে দিলো। অত:পর সম্পূর্ন হলো হিমি-অর্নবের বিয়ে।
নিজের হাতে কারোর স্পর্ষ অনুভব করতেই চোখ তুলে তাকালো হিমি। অর্নব ঠোঁটের কোণে স্বস্তির হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্নব তার হাতটা এবার কিছুটা শক্ত করে ধরে চোখের ইশারায় বোঝালো,
_আমি আছি তোমার পাশে।

হিমিও তাকিয়ে রইলো অর্নব এর দিকে। এই মানুষটার জীবনের সঙ্গে সে এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চোখ সরালো না হিমি, আসলেই কি এই মানুষটার সঙ্গে সে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে?

____
অর্নবের মা চান হিমিকে আজই তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। পড়ে নাহয় ইচ্ছে হলে আসবে এখানে,অর্নব ও তাই চায়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো তারা আজই হিমিকে বাড়িতে নিয়ে যাবে,হুর ও যাবে হিমির সঙ্গে। হিমি একবার দিবাকে বলেছিল তার সঙ্গে যেতে তবে তার বাসা থেকে না বলায় সে আর যেতে পারছেনা।
রিপা অনেকক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও বিদায়ের বেলায় আর নিজেকে আটকাতে পারলোনা,মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো সে। হিমির কষ্ট হলেও সে যেন গভীরভাবে এ সবকিছু অনুভব ই করতে পারছে না। মাথার মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘুড়ছে,
“বিয়েটা করে আমি ঠিক করলাম তো?”

মানিক সাহেব চশমাটা খুলে নিজের চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু হাত দিয়ে মুছে অর্নবের কাছে গেলেন। তার হাত ধরে অনুরোধ এর সুরে বললেন,
_বাবা, অনেক ভরসা করে আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি ওকে দেখে রেখো বাবা।

অর্নব সামান্য হেসে মানিক সাহেব এর হাটদুটো ধরে হিমির দিকে তাকিয়ে বলল,
_নিজের প্রাণ থাকতে আমি হিমির কোনো ক্ষতি হতে দেবোনা,কথা দিচ্ছি আপনাকে।

___
সবেমাত্র বাড়িতে এসে পৌঁছেছে তারা। হিমিকে ধরে সোফায় বসিরে দিলো অরি,তারা একই বয়সের। অরি হিমির পাশে বসে হেসে বললো,
_যদিও তুমি আমার চেয়ে বয়সে পুরো চার মাসের ছোট। কিন্তু তবুও, সম্পর্কে যেহেতু তুমি আমার ভাবি হও তাই আমি তোমাকে ভাবি বলেই ডাকবো। ঠিক আছে?

হিমি মুচকি হেসে মাথা নেড়ে হ্যা বোঝালো। অরিকে বেশ মজার মানুষ মনে হয়েছে হিমির। এতক্ষনে হুরের সঙ্গেও ভাব জমে গেছে তার। নতুন বউ আসবে শুনে অনেক আত্মীয় স্বজন ই বাড়িতে ছিল আগে থেকে। এখন ধীরেধীরে প্রতিবেশীরাও আসছে হিমিকে দেখতে। এত মানুষের মাঝে যেন অস্বস্তি টা আরো বেড়ে যাচ্ছে হিমির। বাইরে থেকে যারাই আসছে সকলেই অদ্ভুত চোখে পাশে থাকা হুইল চেয়ারটার দিকে তাকাচ্ছে। অর্নবের মা তাদের আত্মীয় স্বজনদের হিমির কথা জানানোতে তারা খুব একটা অবাক চোখে তাকায়নি। তবে প্রতিবেশীরা হয়তো জানতোনা বিষয়টা।

হিমি এসবের সঙ্গে অনেকটাই অভ্যস্ত,তবে নতুন জায়গা হওয়ায় কিছুটা অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে তাকে। পাশে কিছুটা দূড়ে দাঁড়িয়ে দুজন মহিলা অদ্ভুত চোখে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল হিমির দিকে।
এবার তারা কিছুটা আফসোস এর সুরে বলতে লাগলেন,
_শেষমেশ কিনা অর্নব এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করলো? আর তার মা ও কি সুন্দর হাসিখুশি দেখো, যেন কোন পরি নিয়ে এসেছেন বাড়িতে। আমি এতদিন কত ভালোভালো মেয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলাম,কই তাদের তো পছন্দ হলো না।
পাশের মহিলা বললেন,
_আসলে যার যেমন রুচি আরকি।

এতক্ষন খারাপ না লাগলেও এবার হিমির কিছুটা কষ্ট হচ্ছে তাদের কথা শুনে।
অর্নব এতক্ষন বাহিরেই ছিল, মাত্র ভিতরে ঢুকতেই এসব কথা কানে আসায় মেজাজ টা বিগড়ে গেলো তার। সেই দুজন মহিলার কাছে গিয়ে সামান্য হেসে বললো,
_আরে আন্টি,আপনারা এখানে?

_ওমা, এটা আবার কেমন কথা। তোমার বউকে দেখতে এলাম।

_কিন্তু আমার তো সেটা মনে হচ্ছেনা।

মহিলা দুজন অবাক হয়ে বললো,
_মানে?

_ফার্স্ট অফ অল, আমার বউ কোনো শো পিস নয় যে সবাই তাকে দেখে কমেন্ট করবে। আপনারা তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেই পারেন, তবে তার সম্পর্কে কমেন্ট করার অধিকার কিন্তু আমি কাউকে দেইনি। আর আমি কেমন মেয়েকে বিয়ে করবো সেটা নিশ্চই আপনাদেরকে জানাবোনা।

_এটা কেমন ব্যাবহার অর্নব?

অর্নব আশেপাশে তাকিয়ে ঘারে হাত ঘসে বিরক্তির সুরে বললো,
_এখনো আমি বেশি কিছু বলি নি,আর চাইও না বলতে। আশা করি আপনারা যে কাজে এসেছিলেন সেই কাজে সফল হয়েছেন,এখন আপনারা আসতে পারেন।

মহিলা দুজন অর্নবের দিকে কিছুটা রাগী চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। অর্নব এবার হিমির দিকে তাকালো। হিমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্নব গিয়ে হিমির পাশে বসলো। তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিয়া করে বললো,
_এর আগে কি হয়েছে না হয়েছে আমি জানিনা। বাট আই প্রমিস, এখন থেকে আমার সামনে কেউ তোমাকে অপমান করতে পারবেনা হিমপরি।

কথাটা বলেই সেখান থেকে উঠে গেলো অর্নব। হিমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো অর্নবের যাওয়ার পানে। এর আগে কেউ তাকে এভাবে প্রটেক্ট করেনি। হ্যা অপূর্ব তার হয়ে প্রতিবাদ করলেও ধরণটা ভিন্ন। অবশ্য অপূর্বের সঙ্গে অর্নবের তুলনা করতেও চায়না হিমি। অপূর্ব আর অর্নব দুজন দুই মেরুর মানুষ। অপূর্ব অত্যন্ত সাধারণ একটা ছেলে, রাগ জিনিসটা তার মধ্যে খুব একটা লক্ষ্য করাই যায়না। অন্যদিকে অর্নবের দুটো রূপ,সে যখন শান্ত থাকে তখন একরকম আর রেগে গেলে সম্পূর্ন অন্যরকম মানুষ।
অপূর্বকে তার মতো করেই ভালোবেসেছিল হবে। তবে তার থেকে সম্পূর্ন বিপরীত প্রকৃতির একটা মানুষকে কি পারবে ভালোবাসতে।
এসব চিন্তার মাঝেই অরি তার কাছে এসে বললো,
_চলো ভাবি তোমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাই। তুমি জানো, ভাইয়া তোমার জন্য নিজের ঘরও চেঞ্জ করে ফেলেছে।

কথাটা বলে অরি হিমিকে নিয়ে ঘরে যেতে লাগলো।

___
অর্নবের রুমে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে হিমি। অরির কথা অনুযায়ী নতুন ঘর বলে এখনো ঠিকভাবে গোছানো হয়নি। তবুও ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো।

অর্নব এখনো আসেনি। ঐসময়ের কল টার কথা মনে পড়তেই হিমি নিজের ফোনটা হাতে নিলো। তবে ডায়েল এ গিয়ে ঐ নম্বর টা দেখেই ভ্রু কুচকে গেলো তার। এখানে পাঁচ মিনিট সময় দেখাচ্ছে,তবে তার যতটা মনে আছে কল রিসিভ করার এক মিনিটের মধ্যেই হুর এসে তাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। তাহলে একটা লোক বাকি চার মিনিট কেন কলটা ধরে রাখবে!
এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই লোকটার নম্বরে কল দিলো হিমি।

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০৯

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৯
#মেহরিন_রিম
বিছানার একপাশে বসে সরু চোখে হিমির দিকে তাকিয়ে আছে দিবা। বেশ কিছুক্ষন একইভাবে থাকার পর দিবা হিমির কাছে গিয়ে বললো,
_তুই সিরিয়াসলি বিয়েতে রাজি?

হিমি ফোনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
_বলেছি যখন, মিথ্যে তো বলবনা তাইনা।

_কিন্তু তুই হুট করে মত চেঞ্জ করলি কেন?

হিমি দিবার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_সেদিন অর্নবের বাড়ি থেকে লোক আসার কিছুক্ষন আগে ওর মা আমাকে কল করে।

—–
_হ্যালো,কে বলছেন?

_আমি অর্নবের মা বলছি।

হিমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
_জি আন্টি বলুন।

_আমার ছেলেটা তোমায় বড্ড ভালোবাসে মা, তুমি দয়া করে ওকে ফিরিয়ে দিও না। ও তোমাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে,আমিতো ওর মা আমি বুঝতে পারি। এর আগে তোমার সঙ্গে ওর কি হয়েছিল আমি জানিনা, কিন্তু আমার ছেলেটা হঠাৎ করে একদম বদলে গেলো জানতো। ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করতো না, সবসময় একা একা থাকতো, ওর শরীর এতো দূর্বল হয়ে গিয়েছিল যে ওকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছিল। আর তারপর তো সে বিদেশেই চলে গেলো, আমি ওকে যেতে দিতে চাইনি জানো। কিন্তু ও আমাকে বললো এখানে থাকলে ও নিজেকে সামলাতে পারবেনা, নিজের অমত থাকা সত্ত্বেও ছেলেকে দূরে যেতে দিতে হয়েছিল তখন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি মা, আমি মা হয়ে বুঝতে পারি আমার ছেলে ভালো নেই। আমার ছেলেটা তোমাকে খুব ভালো রাখবে মা, তোমার কাছে আমি অনুরোধ করছি,তুমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাও।

——
_তুই ওনার কথায় বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি?

_আমি ওনার কথায় বিয়েতে রাজি হইনি দিবু, আমি এরপরো অপূর্বকে কল করেছি কিন্তু ও একবারের জন্যও আমার ফোনটা রিসিভ করেনি। আমার মাথায় কাজ করছিলোনা তখন। তারপর চিন্তা করলাম,যে আমাকে এতটা ভালোবাসে আমি তাকে ফিরিয়ে দেবো? যদি অপূর্ব সত্যি ই বিয়ে করে থাকে তাহলে? তাহলে তো এটা অর্নব ভাইয়ার সাথে অন্যায় করা হবে। তুই বিশ্বাস কর দিবু, অপু যদি একবার আমাকে বলতো ও শুধু আমাকে ভালোবাসে, আমি কখনো এসব চিন্তাও করতাম না।

হিমি কিছুটা থেমে আবারো বললো,
_অর্নবের মায়ের কথাগুলো শোনার পর থেকে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। যে মানুষটা আমাকে এতটা ভালোবাসে,আমি তাকে অবহেলা করছি। তাও কার জন্য?যেই মানুষটা আমি হসপিটালে জানার পরও একবার আমার খোজ নেয়নি!

_তোর সব কথাই ঠিক আছে, কিন্তু তুই কি অপূর্ব কে ভুলতে পারবি? পারবি ওকে ভুলে গিয়ে অর্নব ভাইয়ার সঙ্গে সংসার করতে?

_এটাই তো আমার চিন্তার জায়গা দিবু। বারবার মনে হচ্ছে, আমি অর্নব ভাইয়াকে ঠকাচ্ছি না তো?

কোনো উত্তর দিলোনা দিবা, হিমিও আর কিছু বললোনা। এত দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে থাকতে থাকতে অসহ্য লাগছে তার, কেন অর্নব তাকে এতটা ভালোবাসতে গেলো? কি এমন আছে তার মধ্যে?

____
_জানিনা,কেন তোমাকে ভালোবাসি এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আমার।

_কিন্তু আমি যে আপনাকে ভালোবাসি না।

হিমির কথা শুনে তার দিকে তাকালো অর্নব। তারপর আবারো ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_এখন বাসোনা, ভবিষ্যৎ এ বাসবে।

_আমি কিন্তু এখনো অপূর্বকেই ভালোবাসি।
অর্নবের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো হিমি। অর্নব এক পলক হিমির দিকে তাকালো,তবে কোনো উত্তর দিলোনা।

হিমি একইভাবে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো,
_খারাপ লাগছে না আপনার?

_খারাপ লাগবে কেনো?

_নিজের হবু বউয়ের মুখে অন্য কারোর কথা শুনে একটুও রাগ হচ্ছেনা আপনার? আমি অপূর্বকে ভালোবাসি, কথাটা শুনে আপনার একটুও কষ্ট হচ্ছেনা?

ফোনটা রেখে দিলো অর্নব। হিমির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
_তোমাকে না পাওয়ার কষ্টের কাছে এগুলো কিছুই না।

হিমি চুপ করে রইলো। কিছুক্ষন পর বললো,
_আপনার সেদিনের দেওয়া চিঠিটা কিন্তু আমি পড়তে পারিনি।

অর্নব অবাক হয়ে বললো,
_মানে?

হিমি ওকে সবটা খুলে বললো। সবটা শুনে অর্নব খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হিমির দিকে। অত:পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_এটাই হয়তো আমার ভাগ্যে ছিল, তোমার জন্য প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পাওয়া।

কিছুক্ষন চুপ করে রইলো অর্নব। তারপর আবারো হিমির কাছে এসে ওর হাত ধরে বললো,
_আমি আর এগুলো নিয়ে ভাবতে চাইনা হিমপরি। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু থিংক অ্যাবাউট দা ফিউচার। যা হয়েছে না হয়েছে সবকিছু আমি ভুলে যেতে চাই। আর এখন থেকে যা হবে সবটা ভালো হবে।

হিমি তাকিয়ে রইলো অর্নব এর দিকে। সত্যি ই কি তাই?সবটা কি আদতেও ভালো হচ্ছে? অর্নবের সাথে কি সে সত্যি ই ভালো থাকতে পারবে!

_____
সেদিনের পর কেটে গেছে আরো পাঁচদিন। আজ অর্নব আর হিমির বিয়ে। অর্নবের বাবা দেশের বাহিরে থাকায় এখনই কোনো বড় অনুষ্ঠান করা হবে না,শুধু পারিবারিকভাবেই বিয়ে পড়ানো হবে। সকলে যদিও চেয়েছিল অর্নবের বাবা দেশে ফেরার পরই ওদের বিয়ের ডেট ঠিক করতে। তবে অর্নব তাতে রাজি হয়নি, সে আর কোনোভাবেই দেড়ি করতে চায়না। যার কারণেই এত তাড়াতাড়ি বিয়ের আয়োজন করা হয়।

হুর এদিক ওদিক ঘুড়ে সবকিছু দেখছে, রিপা রান্নাঘরের সব কাজ ঠিক করে হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখছে। মানিক সাহেব বাড়িতে যে দু একজন লোক এসেছেন তাদের আপ্যায়ন করছে।

কিন্তু এই সবকিছুর মধ্যে হিমি যেন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। সবটাই নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে সে,তবুও তার মনের মাঝে খচখচ করছে। ভুল সিদ্ধান্ত নিলোনা তো? পরক্ষণেই চিন্তা করছে, আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে।

মেহরুন কালারের শাড়ি পড়ে বউ সেজে বসে আছে হিমি। হাতের মেহেন্দির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো ঠিক মাঝবরাবর ইংরেজি অক্ষরের A লেখা। মুচকি হাসলো হিমি, অক্ষর টা একই থাকলেও মানুষটা এক নয়। অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা হাতে নিয়ে অপূর্বের নম্বর বের করে রেখেছে হিমি। শেষবারের মতো চেষ্টা করবে কিনা ভাবছে সে, অবশেষে কলটা করলো।
হিমি মনে মনে বললো,
_প্লিজ অপু,শুধু একবার কলটা রিসিভ করো।

কিন্তু না, শেষ চেষ্টাতেও সফল হলোনা হিমি। চোখ বন্ধ করে কয়েকবার গভীর নিঃশ্বাস নিলো। অত:পর কাপা কাপা হাতে অপূর্বের নম্বরটা ব্লক করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই অন্য একটা নম্বর থেকে কল এলো হিমির ফোনে। মনের মাঝে যেনো এক আশার সঞ্চার হলো হিমির। ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে এক ব্যাক্তি বললো,
_হ্যালো?এটাকি হিমির নম্বর।

কণ্ঠ শুনেই হিমি বুঝে গেলো এটা অপূর্ব নয়। চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলো,
_জি বলুন।

_তোমাকে কিছু কথা..

আর শুনতে পারলোনা হিমি। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে দিয়ে হুর তড়িঘড়ি করে বললো,
_সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে আপু, চল।

_আরে কিন্তু আমার ফোনটা দে,আমি কথা বলে..

_কথা পড়ে বলবি, এখন চল তো।

কথাটা বলেই হুর ফোনটা বিছানায় ফেলে দিয়ে হিমিকে নিয়ে চলে যেতে লাগলো। ফোনের অপর পাশ থেকে এখনো সেই ব্যাক্তি হ্যালো হ্যালো বলে চলেছে তবে তা কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

হিমি পিছন ফিরে একবার ফোনের দিকে তাকালো। তারপর আবারো সামনে তাকালো হিমি। হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে চলেছে তার। যেনো এক নতুন জীবনে পা দিচ্ছে সে। মনে মনে ভাবলো,
_আমি কি আদতেও ঠিক করছি! এর পরিণতি ভালো হবে তো?

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০৮

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৮
#মেহরিন_রিম
_আমি ঠিক ই বলছি,তোর বাসার আশেপাশের লোকেরা তো তাই বলছে যে তুই বিয়ে করতে গ্রামে গেছিস। এমনকি তোদের বাসায় যে আন্টি কাজ করে সেও তো এই কথাই বললো।

বন্ধুর কথা শুনে যেনো অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো অপূর্ব। অস্থির কণ্ঠে বললো,
_ক কিন্তু এমনটা কি করে হতে পারে! মানুষ মিথ্যে কথাই বা বলবে কেন? আমরা এতটা তাড়াতাড়ি এসেছি যে কাওকে তো কিছু জানাতেও পারিনি।

_আমি কি করে জানবো বল তো? আমার তো সন্দেহ হলো বলেই তোকে ফোন করলাম। তুই হিমিকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবি,আমার তো বিশ্বাস ই হয়নি। এখন আরো শিওর হয়ে গেলাম।

অপূর্ব কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ভাবলো এমন গুজব কে ছড়াতে পারে। অত:পর মাথায় কিছু একটা চিন্তা আসতেই তার চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেলো। মুখ থেকে অস্ফূটস্বরে বেড়িয়ে এলো,
_মা..

_কিছু বললি?

বন্ধুর কথা কানে আসতেই ধ্যান ভাঙলো অপূর্বের। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো,
_হ্যা..না কিছুনা। তোকে অনেক অনেক থ্যাংকস দোস্ত,কথাটা জানানোর জন্য।

_সেটা ঠিক আছে,কিন্তু এই খবরটা কে ছড়ালো বুঝতে পারছিস?

_হয়তোবা।

_মানে?

_আমি তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি।
কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিলো। দ্রুত পায়ে হেটে মাকে খুঁজতে লাগলো,কিছুক্ষন এর মধ্যেই তাকে পেয়েও গেলো।
ফরিদা বেগমের পিছনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো,
_মা..

ছেলের কণ্ঠ শুনে নিজের কাজ রেখে ঘুড়ে দাড়ালেন ফরিদা বেগম। আঁচলে হাত মুছে ছেলের সামনে এসে বললেন,
_হ্যা বল।

অপূর্ব কিছুক্ষন তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সরাসরি বললো,
_তুমি সবাইকে বলেছো যে আমি এখানে বিয়ে করতে এসেছি?

অপূর্বের প্রশ্ন শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লেন ফরিদা বেগম। বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলেন অপূর্বের দিকে। মাকে চুপ থাকতে দেখে অপূর্ব আবারো গম্ভীর গলায় বললো,
_চুপ করে থেকোনা মা,উত্তর দাও।

ফরিদা বেগম আশেপাশে তাকিয়ে নিচের নজর লুকোনোর চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললেন,
_আ আমি ক কেনো বলতে য যাবো।

_তোমার কথার ধরণই বলে দিচ্ছে মা যে এই কাজটা তুমি ই করেছো।

ফরিদা বেগম বুঝতে পারলেন তার ছেলে সবটাই বুঝে গেছে। চোরের ন্যায় নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। অপূর্ব এবার জোড়ে জোড়ে হাততালি দিয়ে বললো,
_বাহ মা বাহ, কি অসাধারণ কাজ করেছো তুমি। তার মানে এই সবটাই তোমার পূর্বপরিকল্পিত।

_দেখ অপু তুই ভুল বুঝছিস আমাকে।

_আর কি বুঝবো মা? সবটা তো আমার কাছে একদম পরিষ্কার। তুমি আগে থেকেই জানতে হিমি হাটতে পারে না, আর সেটা জেনেই তুমি ওকে বাড়িতে আনতে বলেছিলে যেন তুমি ওকে অপমান করতে পারো।

ফরিদা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে,অপূর্ব যে এতকিছু বুঝতে পেরে যাবে সেটা তিনি ভাবতেও পারেন নি। অপূর্ব আবারো বলতে লাগলো,
_আমার আগেই সন্দেহ হচ্ছিল, হুট করে এই সময়েই কেন জমিজমা নিয়ে ঝামেলা হবে? আবার সামান্য কিছু পেপারের কাজেই বা এতদিন সময় লাগছে কেন? এখন বুঝতে পারছি সবটাই তোমার প্লান।

ফরিদা বেগম অপূর্বের গায়ে হাত বুলিয়ে করুণ সুরে বললেন,
_অপু,বাবা আমার কথাটা একটু শোন।

অপূর্ব এক ঝটকায় মায়ের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
_কি শুনবো মা? তুমি যানো সেদিনের ঘটনার পর হিমি সু*ই*সা*ই*ড করতে গিয়েছিলো!

ফরিদা বেগম অবাক চোখে তাকালেন অপূর্বের দিকে,যার অর্থ তিনি কিছুই জানেন না। অপূর্ব আবারো বলতে লাগলো,
_সেদিন যদি ওর কিছু হয়ে যেতো? আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম মা? পারতাম না, এই অপরাধবোধ শেষ করে দিতো আমাকে। আমি যে হিমিকে কতটা ভালোবাসি সেটা তুমি নিজেও জানো মা, তবুও তুমি এমন কাজ করতে পারলে?

ফরিদা বেগম অপরাধীর ন্যায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন,তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। অপূর্ব তার কাছে এসে বললো,
_তোমার কথা অনিযায়ী একটা পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করে আমি ভালো থাকতে পারবোনা, আচ্ছা যদি এমন কোনো দূর্ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটতো তাহলে?

_অপু! এমন কথা বলতে নেই বাবা।

_তাহলে আর কি বলবো মা? আচ্ছা ঠিক আছে আমার সাথে না হোক, আমি একটা সুস্থ সবল মেয়েকেই বিয়ে করলাম। বিয়ের পর যে তার সঙ্গে কোনো দূর্ঘটনা ঘটবে না, তার কি গ্যারিন্টি দেবে তুমি?

ফরিদা বেগম চুপ করে দাডিয়ে আছেন। ছেলের প্রশ্নের কোনো উত্তর তার জানা নেই। অপূর্ব এবার কিছুটা দূড়ে সরে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
_ব্যাস,অনেক হয়েছে মা। আর না, আর তুমি আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি হিমিকে,আর কষ্ট দিতে পারবো না আমি ওকে। আমি আজ এখনি চলে যাবো এখান থেকে,তুমি যদি চাও তাহলে চলো আমার সঙ্গে। আর না যেতে চাইলে আমি একাই যাবো।

কথাটা বলেই সেখান থেকে চলে গেলো অপূর্ব। ঘরে গিয়ে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে নিতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো,
_আমি আসছি হিমি, তুমি আমাকে যে শাস্তি দেবে তাই আমি মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তবুও তোমার অভিমান আমি ভাঙাবোই।
কথাটা ভাবতে ভাবতে অপূর্বের ফোনে হিমির কল এলো। তবে সে কলটা ধরতে গিয়েও ধরলোনা,মনে মনে ভাবলো,
_না এভাবে নয়,আমি সামনাসামনি তোমার সঙ্গে কথা বললো। আর একটু অপেক্ষা করো হিমি, জাস্ট আ লিটেল মোর টাইম…

____
শেষ রিংটাও হয়ে গেলো,কিন্তু অপূর্ব ফোনটা তুললো না। হিমি এবার কিছুটা উচ্চস্বরেই কেঁদে ফেললো। ফোনটাকে বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
_আমি কি অপরাধ করেছি অপু?কেনো আমার সঙ্গে এমনটা করলে তুমি,কেন?

ড্রইং রুমে অর্নব সহ তার পরিবার এর সকলে বসে আছে। হুর এসে হিমিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে,যদিও তার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা তার। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সে। অর্নব এর কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে হিমির,লোকটা যে ওকে ভিষণ ভালোবাসে সেটা বুঝে গেছে সে। কিন্তু হিমি যে এখনো নিজের সবটা দিয়ে অপূর্ব কেই ভালোবাসে। এই দ্বিধা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য শেষবারের মতো কল করেছিল অপূর্ব কে, তবে এবারো সে কলটা রিসিভ করলোনা।
কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে কান্না থামিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিলো হিমি। রিপা রুমে এসে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই তার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। রিপা হিমির সামনে এসে খাটে বসলেন। হিমির দিকে তাকিয়ে বললেন,
_আমি আজও তোমায় জোড় করবোনা হিমি। শুধু একটা কথা মাথায় রেখো, সত্যিকারের ভালোবাসা কিন্তু সবাই পায়না। এমন সিদ্ধান্ত নিওনা,যার কারণে তোমাকে পরবর্তীতে অনুশোচনায় ভুগতে হয়।

রিপা মায়ের দিকে তাকালো, সে তো অপূর্বের চোখেও নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছে। রিপা এবার হিমিকে নিয়ে ড্রইং রুমে এলো। তাকে ধরে সোফায় বসালো। অর্নব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হিমির দিকে, তবে হিমির সেদিকে কোনো নজর নেই। সে স্থির দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
অর্নবের পরিবার এর সঙ্গে হিমির বাবা মা আরো কিছু কথা বললো,তবে তার কিছুই যেন হিমির কানে গেলোনা। পরিশেষে রিপা হিমির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
_হিমি, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি?

হিমি চুপ করে রইলো,অর্নব হিমির দিকে তাকিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার উত্তর শোনার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে যাওয়ার পর মানিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,
_আমাদের মেয়ে যদি রাজি না থাকে তাহলে…

_আমি রাজি বাবা।
অশ্রুসজল চোখে কথাটা বলে চোখের পলক ফেলতেই জমে থাকা জলটুকু গড়িয়ে পরলো হিমির।
অর্নবের চোখেমুখে যেন বিশ্বজয়ের আনন্দ ফুটে উঠলো। মুচকি হেসে হিমির দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
_ব্যাস,এইটুকুর ই প্রয়োজন ছিলো আমার হিমপরি। তোমার এই চোখের জল আমি ঠিক মুছিয়ে দেবো, আর কোনো কষ্টের ছোঁয়াও লাগতে দেবোনা তোমার জীবনে। এবার তুমি আমার হবে হিমপরি,শুধুই অর্নবের।

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০৭

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৭
#মেহরিন_রিম
একটা নির্জন জায়গায় একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে অর্নব এবং হিমি। অর্নবের চোখে মুখে খুশির আভা দেখা গেলেও হিমি রয়েছে নির্বিকার। সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রয়েছে সে। বেশ কিছুক্ষন কেটে যাওয়ার পরও হিমিকে চুপ থাকতে দেখে অর্নব বলে উঠলো,
_তুমি বিয়েতে রাজি, কথাটা জানাতেই আমাকে ডেকেছো তাই…

_দয়া করছেন আমার উপর?
হিমির স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে বলা কথায় চুপ করে গেলো অর্নব। চোখ ঘুরিয়ে হিমির দিকে তাকালো,সে এখনো একইভাবে বসে আছে। অর্নব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো হিমির দিকে। হিমি এক নজর তাকালো অর্নবের দিকে,তারপর স্থির কণ্ঠে বললো,
_বলুন? আমার উপর দয়া দেখাচ্ছেন?

অর্নব অবাক হয়ে বললো,
_হোয়াট!

হিমি আবারো সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_হ্যা,দয়াই তো দেখাচ্ছেন। নাহলে একটা পঙ্গু মেয়েকে কেনো বিয়ে করতে চাইবেন আপনি?

অর্নবের চোখেমুখে ধীরে ধীরে রাগের আভা ফুটে উঠতে লাগলো। তবে হিমি সেদিকে নজর না দিয়েই বলতে থাকলো,
_আসলে বিষয় টা কি বলুন তো, আপনি ভেবেছেন এমন একটা মেয়ের ভবিষ্যতে কি হবে?
কিছুটা থেমে আবার বললো,
_য যেই মেয়ে নিজের পায়ে হাটতেই পারে না তাকে কোন ছেলেই বা বিয়ে করবে। এসব ই ভেবেছেন তাই তো?

রাগের মাত্রা এবার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে অর্নবের। নিচের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে হিমির কথাগুলো শুনছে সে।

হিমি এবার তাকালো অর্নবের দিকে। বিচলিত কণ্ঠে বললো,
_বিশ্বাস করুন,আমার কারোর দয়া চাইনা। আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে…

_ইনাফ ইজ ইনাফ হিমি…

অর্নবের উচ্চস্বরের ধমকে কেপে উঠলো হিমি,চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সে। পরক্ষণে চোখ খুলতেই দেখতে পেলো অর্নবের চোখেমুখে কেমন রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। কপালের রগগুলো ফুলে আছে,রাগে পুরো শরীর কাঁপছে তার। অর্নবের এমন রূপ দেখে কিছুটা ভয় পেলো হিমি,চুপ করে রইলো সে। অর্নব হিমির সামনে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
_হাউ ডেয়ার ইউ হিমি! তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে এই ধরনের কথা বলার? আমার ভালোবাসাকে দয়া বলে আখ্যায়িত করার?

হিমি যতটা না ভয় পেলো তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি অবাক হলো সে। অস্ফূটস্বরে তার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো,
_আপনি আমাকে ভালোবাসের!

অর্নব হালকা হেসে বললো,
_এমনভাবে বলছো যেনো তুমি জানতেই না!

এবার আরো বেশি অবাক হলো হিমি,অবাক চোখে তাকিয়ে অর্নবের দিকে। অর্নব এবার অন্যদিকে ঘুরে বলতে লাগলো,
_সপ্তাহে তিনদিনের জায়গায় পাঁচদিন পড়াতে যাওয়ার কারণ টা তুমি বুঝতে পারোনি তাইনা? তোমার মনে আছে? পড়া কমপ্লিট না করায় অনেক বকতাম তোমাকে, যার কারণে তুমি রাগ করে আমার সঙ্গে কথাই বলতে না। পরদিন আবার এই আমিই চকলেট দিয়ে তোমার রাগ ভাঙাতাম। কেনো জানো?

চুপ করে রইলো হিমি,এসব বিষয় তো সে কখনো ভেবেও দেখেনি। অর্নব একইভাবে বলতে রইলো,
_কারণ টা তোমার কথা না বলা,তোমার অবহেলা। সহ্য করতে পারতাম না আমি।

কিছুক্ষন চুপ করে রইলো অর্নব। তারপর আবারো ধরা গলায় বললো,
_আমি তোমার টিচার আর তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে, এটা একটা সুন্দর সম্পর্ক। আমি তার মাঝে তোমাকে অন্য কিছু বলতে চাইনি হিমি, আর তুমিও এই ঘটনাগুলোকে গোনায় ধরোনি।

হিমির চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। অর্নব এবার ঘুরে তাকালো হিমির দিকে। করুন সুরে বললো,
_কিন্তু আমিতো তোমাকে জানিয়েছিলাম হিমি। জানিয়েছিলাম আমার মনের সব কথাগুলো। আর তুমি কিনা সেই সবকিছু ছিড়ে ফেলে দিলে!

অবাকের চরম পর্যায় পৌঁছে গেলো হিমি। হিমিকে এমন অবাক হতে দেখে অর্নব তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো,
_এত অবাক হচ্ছো যেন তুমি কিছু জানোই না! আচ্ছা যাও, মেনে নিলাম তুমি চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলে। তবে তার সঙ্গে আমার দেওয়া বইটাও ফেলে দিলে!এতটা অপমান আমাকে না করলেও পারতে হিমি।

বইয়ের কথা শুনে হিমির মাথায় এলো তার রেজাল্টের দিনের কথা। অর্নব তাকে একটা বই গিফট করেছিল সেদিন,বলেছিলো খুব মনোযোগ দিয়ে পরতে। সেদিন হিমি বাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে অপূর্বের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, তখন তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সবে বন্ধুত্ব থেকে একটু গভীর হতে শুরু করেছে।
অর্নবের দেওয়া বইটা বাড়িতেই ছিল। তবে হিমি বাড়িতে এসে তা আর খুজে পায়নি। তার চার বছরের খালাতো বোনের হাতে এক বইয়ের একটা পৃষ্ঠা দেখে বুঝতে পেরেছিল সেই এই অঘটন ঘটিয়েছে। হিমি মনে মনে ভাবতে লাগলো,
_তবে কি বইয়ের মাঝেই উনি কোনো চিঠি রেখেছিলেন! কিন্তু ওনাকে কি করে বোঝাবো আমি যে বইটা পড়তেই পারিনি।

অর্নব এবার কিছু একটা চিন্তা করে বললো,
_অবশ্য করবে নাই বা কেন। তখন তো তোমার মনে অন্য কেউ জায়গা করে নিয়েছিলো।

অবাক হলো হিমি,মনে মনে ভাবলো,
_তবে কি উনি সেদিন আমাকে আর অপূর্বকে দেখে ফেলেছিল।

অর্নব এবার হিমির কাছে এসে ওর দু কাধে হাত দিয়ে হালকা ঝাঁকিয়ে বললো,
_লিসেন হিমি, আমি একবার তোমাকে হারিয়েছি। দ্বিতীয়বার হারাতে দেবো না। তুমি নিজে থেকে রাজি না হলে আমি ঠিক কি কি করতে পারি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।

কথাটা বলেই সেখান থেকে চলে যেতে নিলো অর্নব। তবে তাকে বাধা দিয়ে হিমি পিছন থেকে বলে উঠলো,
_এই ভালোবাসা যে ক্ষণস্থায়ী নয় তার কি গ্যারিন্টি আছে ভাইয়া?

অর্নব পিছন ফিরে সরু চোখে তাকালো হিমির দিকে। হিমি অর্নবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_আমি আর কখনো নিজের পায়ে হাটতে পারবো কিনা জানিনা। এটা মেনে নিতে পারবেন আপনি? পরবর্তীতে যদি এই ভালোবাসা বিরক্তিতে রূপ নেয়?

পাশে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো অর্নব। তারপর কিছুটা সামনে এসে বললো,
_ এই বিরক্তি ই তো চেয়েছিলাম আমি,পাইনি তো। তোমার প্রতি বিরক্ত হওয়ার জন্যই তো দূরে সরে গিয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না, দূরে থেকেও এই অনুভূতি ক্রমশ বেড়েই গেছে। সেখানে তোমার সঙ্গে থেকে বিরক্তির প্রশ্নই আসে না।

অর্নব এবার হিমির সামনে এলো,ওর সামনে বসে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
_ আমার ভালোবাসা এতো ঠুনকো নয় হিমি। এই ভালোবাসা আমরন শুধু বেড়েই যাবে,এক বিন্দু পরিমাণ ও কমবে না।

অশ্রুসজল চোখে অর্নবের দিকে তাকিয়ে আছে হিমি। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। সেদিন বইটা পড়তে পারলে হয়তো আজকের এই দিনটা দেখতেই হতোনা তার। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো হিমির, এই মুহূর্তে আফসোস করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

____
নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে অর্নব। বেশ কয়েকদিন হলো ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে সে, চোখ সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অর্নব। জমিজমার কিছু কাজে তাকে গ্রামের বাড়িতে আসতে হয়েছে। এই পৃথিবীতে মা ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নেই। খুব ছোটবেলায় বাবা তাদের ছেড়ে চলে যায়, বিয়ে করার সুযোগ থাকলেও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি অপূর্বের মা।
সেদিন হিমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর অপূর্ব তার পিছনে যেতে চাইলেও তার মা তাকে আটকে দেয়। নিজের কসম দিয়ে বলে হিমির সাথে যেনো অপূর্ব আর কোনো যোগাযোগ না করে। অপূর্ব অনেকবার তার মাকে বুঝিয়েছে,অনুরোধ করেছে তবে কোনো লাভ হয়নি। পরদিনই কাজের জন্য তাকে গ্রামে আসতে হয়। ফোন অন থাকলেই হিমির কল আসে,আর তা রিসিভ না করতে পেরে নিজেকে অপরাধী মনে হয় অপূর্বের। তাই বাধ্য হয়ে ফোনটা অফ করে রাখতে হয়েছে তাকে।

ফোনটা হাতে নিয়ে অন করলো অপূর্ব,সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলো তার এক বন্ধু ২২ বার কল করেছে। ভ্রু কুচকে তার নম্বরে ডায়েল করতেই সে রিসিভ করলো ফোনটা। তার কথা শুনে অপূর্ব বসা থেকে দাঁড়িয়ে বেশ উচ্চস্বরে বললো,
_হোয়াট!কিন্তু এটা কি করে হতে পারে?…

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০৬

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৬
#মেহরিন_রিম
হসপিটালে বসে আছে হিমি, সঙ্গে তার বাবা এবং হুর ও এসেছে। চেকাপের জন্য তাকে মাসে এক দুবার হসপিটালে আসতেই হয়। সকাল ১১ টার দিকে এসেছে তারা, এখন প্রায় ১ টা বাজে। তবে ডাক্তার ওটিতে থাকায় এতক্ষন ধরে কেবিনের বাহিরে ওয়েট করতে হচ্ছে। হুর এবার বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো বলো তো, আর কিছুক্ষন বসে থাকলে আমার কোমর ঠিক ই লক হয়ে যাবে। আপু তোরা থাক,আমি একটু ক্যান্টিনে যাচ্ছি।

হিমি কিছু বলার আগেই হুর সেখান থেকে চলে গেলো। হিমিও অনেকটা বিরক্ত হচ্ছে,একেতো মাথার মধ্যে এতো চিন্তা। এর মধ্যে চেকাপের জন্য আসতেই চায়নি সে,তবে বাবা জোড় করে নিয়ে এসেছে। এখন বসে বসে ওয়েট করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
হুর মনের সুখে হাটতে হাটতে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছে,তবে এর মাঝেই তার চোখ পড়ে পাশের ওয়ার্ড এর দিকে। কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়েছিলো সে, মাথার মধ্যে ওয়ার্ড এর চিত্র ভেসে উঠতেই আবার পিছনে গেলো সে। একদম সামনের বেডে থাকা রোগীর প্রেশার চেক করছে একটা ছেলে, হয়তোবা ইন্টার্নি করছে এখানে। ছেলেটিকে দেখেই যেনো মনে মাঝে লাড্ডু ফুটে উঠলো হুরের,নিজের অজান্তেই ক্রাশ নামক বাশ খেয়ে বসলো সে।
গালে হাত দিয়ে মাথা হালকা বাকিয়ে আনমনেই বলে উঠলো,
_হায়য়য়…একটা ছেলে এতটা কিউট কিভাবে হতে পারে!

_এই আপা সরেন তো।
কথাটা বলে হুরকে সামান্য ধাক্কা দিয়েই ওয়ার্ড এ ঢুকলেন একজন আয়া। ধাক্কা খেয়ে হুর পরে যেতে নিলেও নিজেকে সামনে নিলো,রাগী চোখে তাকালো তার দিকে। তবে এতে সেই মহিলার মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো নাম হুর নিজের চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেলো ছেলেটা এদিকেই আসছে। হুট ঝটপট নিজের ঝুটি করা চুলগুলো এক পাশে এনে লাজুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। তবে ছেলেটা আসার আগেই তার সামনে বাধা হয়ে দাড়ালো আরেকটি ছেলে। কাধে হাত রেখে বললো,
_কিরে দোস্ত চলনা আজকে লাঞ্চ এ যাই, পাশেই একটা নিউ রেস্টুরেন্ট হিয়েছে।

ছেলেটা নিচের দিকে তাকিয়ে খানিকটা বাচ্চাদের মতো আচরণ করে বললো,
_কিন্তু বাহিরের খাবার খেলে তো মা বকবে। আমি কালকে মার থেকে পারমিশন নিয়ে আসব কেমন।
কথাটা বলেই স্থান ত্যাগ করলো হুরের সদ্য ক্রাশ খাওয়া ছেলেটি। এদিকে তার কথা শুনে যেন হুরের মনটা বেলুনের মতো ঠুশ করে ফেটে গেলো। ঠোট উল্টে কিছুটা কাঁদোকাঁদো মুখ করে চলে এলো হুর।

এতক্ষনে ডাক্তার চলে এসেছে। হিমিকে যে টেস্ট গুলো দেওয়া হয়েছিলো তার রিপোর্ট চেক করছেন তিনি। রিপোর্ট চেক করা শেষে হিমির কাছে এসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
_আমার সাপোর্ট নিয়ে একটু উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করো তো।
ডাক্তারের কথা অনুযায়ী হিমি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো তবে কোনো লাভ হলো। কিছু উঠতে গিয়েও আবার বসে পড়লো সে হতাশার সুরে বললো,-
_পারছিনা তো ডক্টর।

ডাক্তার এবার তাকে আরো অনেকভাবে চেক করতে লাগলো। চেকাপ শেষে নিজের চেয়ারে বসে মানিক সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
_দেখুন আঙ্কেল,আমি যতটা বুঝতে পারছি হিমি ওর ডান পায়ে কিছুটা বল পাচ্ছে।

মানিক সাহেব উৎসাহিত হয়ে বললেন,
_ও কি আবার হাটতে পারবে বাবা?

_একদম যে ঠিকভাবে হাটতে পারবে তার গ্যারিন্টি আমি দিতে পারছি না। তবে ডান পায়ে যেহেতু একটু হলেও বল পাচ্ছে এটা খুবই ভালো লক্ষন। সম্পূর্ন ঠিকভাবে হাটতে না পারলেও থেরাপির মাধ্যমে অন্তত ক্রাচ এর এর সাহায্য নিয়েও যদি হাটতে পারে সেটাও তো অনেক কিছু। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি অনেকটাই আশাবাদী এ বিষয়ে।

___
ডাক্তারের কথা শুনে বাড়ির সকলে খুশিতে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হলেও হিমির মাঝে খুব বেশি ভাবান্তর সৃষ্টি হয়নি। তার মাথায় তো অর্নবের দেওয়া সেই শান্ত হুমকির কথা ঘুড়ছে। উদাস মনে বসে ছিলো হিমি, এমন সময় দিবার কল আসে। হিমি ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করতেই দিবা বলে ওঠে,
_হ্যালো হিমি।

_বল।

_কি ব্যাপার বল তো,কোনো খোজ খবর ই পাচ্ছিনা তোর।

হিমি বিরক্তির সুরে বললো,
_এমন ভাব করছিস যেনো কিছুই জানিস না তুই।

দিবা এবার উৎসাহিত কণ্ঠে বললো,
_দেখ আমার কাছে তোর জন্য একটা প্লান আছে।

হিমি ভ্রু কুচকে বললো,
_কি প্লান?

_মন দিয়ে শোন,তুই অর্নব ভাইয়াকে বলবি তোর সঙ্গে দেখা করতে। তারপর তাকে প্রশ্ন করবি সে কেনো তোকে বিয়ে করতে চায়,উনি তোকে ভালোবাসে কিনা।

_আমি জিজ্ঞেস করবো!

_হ্যা তুই নয়তো কি আমি জিজ্ঞেস করবো?

_কিন্তু ওনার সামনে গেলেই তো আমার নার্ভাস লাগে।

_দেখ দোস্ত,নার্ভাস হলে চলবে না। এটা তোর পুরো লাইফের বিষয়। তাই আমি যেটা বলছি সেটা কর।

ফোন্টা রেখে দিলো হিমি। নিজেও মনে মনে ভাবলো অর্নবকে আসলেই কিছু প্রশ্ন করা দরকার। অত:পর অর্নবের হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে মেসেজ করলো,
_আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

____
ফোনটা হাতে নিতেই হিমির মেসেজ দেখে ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো অর্নবের। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো অর্নব। হাসির রেখে টেনে চোখ বন্ধ করে বললো,
_ তুমি আমার হিমপরি, তুমি শুধুমাত্র আমাকেই ভালোবাসবে। আমি জানি, তুমি ঠিক এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে।

ফোনকলের আওয়াজে চিন্তা ভঙ্গ হলো অর্নবের। বিরক্তির ভাব নিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই যেন তার সব বিরক্তি কেটে গেলো। ফোনটা রিসিভ করতে অপর প্রান্তে থাকা ব্যাক্তি বললো,
_আমাকে তো ভুলেই গেলেন বোধহয়।

_আরে কি বলছো,তোমাকে কি করে ভুলে যাই বলো তো। তুমি আমার যে উপকার করেছো, তাতে করে তোমার কাছে তো আমার ঋণী হয়ে থাকা উচিৎ।

_হাহ, ভালোই তো পাম দিতে পারেন।

_আমি সত্যি কথা বলছি, আই এম রিয়েলি গ্রেটফুল টু ইউ।

_ঠিক আছে বুঝলাম, এখন বলুন সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?

_হ্যা,সবই তো ঠিক আছে। তোমার জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে আবারও নিজের করে পাওয়ার সুযোগ পেয়েছি,এবার আমি আর কিছু ভুল হতে দেবোনা।

অপর প্রান্তে থাকা ব্যাক্তি বললো,
_ঠিক আছে তবে আমি এখন রাখি।

কলটা কেটে দিলো সে। চোখে মুখে থাকা মিথ্যে খুশির রেশ মুহূর্তেই কেটে গেলো। আনমনেই বলে উঠলো,
_আপনার মানুষটিকে তো আপনি পেয়ে গেলেন,তবে আমার ভালোবাসার মানুষ? তাকে কি আমি কখনই নিজের করে পাবোনা!

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০৫

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৫ (বোনাস পার্ট)
#মেহরিন_রিম
_অর্নবকে হসপিটালে দেখতে পেয়ে আমরা সবাই অনেকটা অবাক হয়ে যাই কারণ আমি জানতাম ও ইতালিতে আছে। আমরা তখন অনেক টেনশন এ থাকায় ওকে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তুমি ভালো আছো জানার পর ও আমাদের সাথে কথা বলতে চায়।

হিমি মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার মা রিপার বলা কথাগুলো, মনে মনে ভাবছে,
_সেদিন উনি হসপিটালে এসেছিলেন!কই আমি দেখলাম না তো।

রিপা কিছুটা থেমে আবার বললেন,
_অর্নব সরাসরি এসে বলে ও তোমাকে বিয়ে করতে চায়। ঐ পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে এসব নিয়ে ভাবা সম্ভব ছিলো না বলে আমরা ওর থেকে কিছুটা সময় চাই। হসপিটাল থেকে ফেরার পর অর্নব আবারো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, বলেছিলো যেন তোমাকে ওর ব্যাপারে কিছু না বলি। তাই..

_তাই তোমরা আমার থেকে এসব লুকিয়ে যাবে মা? তোমাদের কাছে আমার থেকে ঐ লোকটা বেশি দামি হয়ে গেলো? বাবা তুমিও!
মায়ের কথার মাঝেই রাগী স্বরে কথাটা বললো হিমি। রিপা আবারও বললেন,
_আমরা প্রথমে বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি হিমি। পরবর্তীতে অর্নব পারিবারিকভাবে তোমাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠায়।

চুপ করে রইলো হিমি,বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের উপর কখনো কিছু বলেনি হিমি। এখন যদি বাবা মা তাকে বিয়ের জন্য জোর করে, কথাটা ভেবেই ভয় হচ্ছে হিমির। মানিক সাহেব এবার বসা থেকে উঠে দাড়ালেন,হিমির কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বললেন,
_তোকে আমি কখনো কোনো বিষয়ে জোড় করিনি মা। অর্নব অত্যন্ত ভালো একটা ছেলে,প্রতিটা বাবা মা ই চায় তাদের সন্তানের জন্য যোগ্য পাত্র খুজে বের করতে। অর্নবকে তুইও চিনিস,আর আমরাও খুব ভালো করেই চিনি। ও কেমন ছেলে সেটা আমরা সবাই জানি।

কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন মানিক সাহেব। তারপর আবারো বললেন,
_তবে আমি তোকে জোড় করবো না। তুই যেই সিদ্ধান্ত নিবি সেটাই হবে।
কথাটা বলেই নিজের ঘরে চলে গেলেন মানিক সাহেব।
রিপা এবার হিমির কাছে এসে হালকা হেসে বললেন,
_আশা করি তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

রিপাও চলে গেলো সেখান থেকে। তবে একই জায়গায় রোবট এর ন্যায় বসে রইলো হিমি। বাবা মা তাকে সোজাসুজি কিছু না বললেও হিমি ঠিক ই বুঝতে পেরেছে যে, তারাও চায় হিমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাক। তবে তারা কি করে বুঝবে হিমির মন যে এখনো অপূর্বের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো তার,আনমনেই বলে উঠলো,
_কেন অপু? কেন এমন করছো আমার সঙ্গে,আমি যে তোমাকে মন থেকে ভালোবেসেছি।

____
_আমাকে ডেকেছিস আপু?
হিমির ঘরে এসে প্রশ্নটা করলো হুর। হিমি জানালার পাশে বসে ছিলো। হুরের গলার আওয়াজ পেয়ে কিছুটা ঘুরে বললো,
_হুম,কথা আছে তোর সাথে।

হুর বিছানায় বসে বললো,
_হ্যা বলনা কি বলবি?

হিমি নিচের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
_অর্নব ভাইয়া হসপিটালে এসেছিলো,তুই আমাকে বলিসনি কেন?

হিমির প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলো হুর। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি লুকোনোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। হুরকে চুপ থাকতে দেখে হিমি এবার তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি হুর। চুপ করে থেকে আমার মাথা গরম করাস না।

হুর এবার আমতা আমতা করে বললো,
_ব বলতে গিয়েছিলাম তো,কিন্তু মা।

হিমির এবার মনে পরলো হসপিটাল এর কথা। হুর তাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল তবে মা বাধা দেওয়ায় আর বলতে পারেনি।
হুর এবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো,
_তবে এখন যেহেতু তুই জেনেই গেছিস, তাহলে আর লুকিয়ে লাভ নেই।

হিমি ভ্রু কুচকে তাকালো হুর এর দিকে। হুর বিছানা থেকে উঠে এসে হিমির সামনে বসে বললো,
_জানিস আপু, তোকে যখন ডাক্তাররা অবজারভেসন এ রেখেছিল, অর্নব ভাইয়ার পাগলামি চোখে পরার মতো ছিল। পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল, বারবার ডাক্তারদের থেকে তোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলো। আমরা তো ওনার কাজ থেকে থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কি মনে হয় জানিস আপু?

হিমি হুরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_কি?
হুর বললো,
_অর্নব ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসে, ভালো না বাসলে কেউ কারোর জন্য এতটা পাগলামি করতে পারেনা আপু। তুই নিজের চোখে দেখলে বুঝতে পারতি।

নিরব হয়ে গেলো হিমি, কানের কাছে একটা কথাই বাজতে লাগলো, “অর্নব তোকে ভালোবাসে”।
হিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে হুর কিছু বলতে যাবে তখন ই কলিং বেল বেজে ওঠে। হুর তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_এই আপু,ম্যাম চলে এসেছে বোধ হয়। আমি যাই হ্যা।

কথায়টা বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো বেড়িয়ে গেলো হুর। কিন্তু হিমির মনটা যেনো আরো অশান্ত হয়ে উঠলো। হুরের বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলো। সত্যিই কি ও কখনো নিজের চোখে অর্নবের পাগলামি গুলো দেখেনি?
হিমির মনে পড়ে গেলো কয়েক বছর আগের কথা। অর্নব হিমিকে ক্লাস এইট থেকে টেন পর্যন্ত তিন বছর প্রাইভেট পড়িয়েছিল। তবে হিমি তাকে ভাইয়া বলেই ডাকতো।
তখন হিমি ক্লাস নাইনে পড়ে, গ্রামে গিয়ে বোনেদের সাথে গাছে ওঠা শিখতে গিয়ে হাতের অনেকটা অংশ কেটে গিয়েছিল তার। সাতটা সেলাই পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। বাড়িতে ফেরার পর যেদিন অর্নব তাকে পড়াতে এসেছিল সেদিনের কথা মনে করতে লাগলো হিমি।
——-
_ফিজিক্স বই বের করো। যে ম্যাথগুলো দিয়েছিলাম শেষ করেছো সবগুলো?
ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে কথাগুলো বললো অর্নব। হিমি একটা শুকনো ঢোক গিলল। ওড়নার আড়ালে বাম হাত লুকোনোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। ডান হাত দিয়ে বই খাতা বের করে হোমওয়ার্ক দেখালো। অর্নবের দৃষ্টি এতক্ষনে ফোন থেকে সরে হিমির দিকে আবদ্ধ হয়েছে। কপালে ভাজ দেখা গেলো তার, হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_কি হয়েছে ঐ হাতে?

_ক কিছু না তো ভাইয়া। আপনি দেখুন না,আমি সবগুলো করে রেখেছি।

অর্নব আবারো হিমির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
_হাত দেখাও।
হিমি ফট করে নিজের ডান হাতটা অর্নবের সামনে ধরলো।অর্নব এবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
_হিমি আমি অন্য হাত দেখাতে বলেছি।

হিমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে হাতটা সামনে আনলো, ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হলেও সেলাই এর দাগ এখনো স্পষ্ট। কিছুক্ষন অর্নবকে চুপ থাকতে দেখে এক চোখ খুললো হিমি,তারপর দুটো চোখ খুলে ঢোক গিললো। এই নিরবতা যে ঝড়ের পূর্বাভাস তা হিমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। অর্নবের চোখেমুখে এতক্ষনে রাগের আভা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। রাগী চোখে হিমির দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো সে। জোড়ালো কণ্ঠে ধমকের সুরে বললো,
_বেড়াতে গিয়ে এসব করে বেরাচ্ছ তাইনা? নিজের খেয়াল তো পাগলেও রাখতে জানে কিন্তু তুমি জানো না। এসব প্ল্যান করে করা হয়েছে তাইনা? ভেবেছ যে পড়ায় ফাঁকি দিতে পারবে, আন্টি ও কিছু বলবে না। তোমার এসব ফাঁকিবাজি ধান্দা না আমার খুব ভালো করে জানা আছে হিমি।

অর্নবের ধমকে কেপে উঠলো হিমি,চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে সবটা শুনে যাচ্ছে হিমি। এতক্ষনে অর্নবের গলার আওয়াজ শুনে রিপাও সেখানে উপস্থিত হয়েছে। রিপা অর্নবের কাছে গিয়ে বললো,
_কি হয়েছে বাবা?এত বকছো যে ওকে,হিমি কিছু করেছে?

অর্নব রিপার দিকে তাকিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ এর চেষ্টা করে বললো,
_ওকে একটু শাসন করুন আন্টি,আমার কথা তো ওর কানে যায়না। এত ছোটাছুটি করলে ব্যাথা তো পাবেই। বাম হাত কেটেছে বলে ঝামেলা হচ্ছে না,ডান হাত কাটলে কি হতো বুঝতে পারছেন? এক দুমাস এর জন্য সব পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিতেন তিনি। এভাবে চললে তো রেজাল্ট ভালো করতে পারবে না আন্টি, লাস্ট এক্সাম এ যা রেজাল্ট করেছে তার চেয়ে আরো বেশি আশা করা যায় ওর থেকে।এখনো ফাঁকিবাজি করলে তো চলবে না তাইনা!
কথাটা বলে অর্নব রাগী চোখে একবার হিমির দিকে তাকিয়েই বেড়িয়ে গেছিলো বাসা থেকে।

———-
সেদিন অর্নবের ব্যাবহারে রাগ হয়েছিলো হিমির,কষ্ট ও পেয়েছিলো প্রচুর। তবে আজ যেন সেই অদ্ভুত ব্যাবহারের কারণ অন্য কিছুই মনে হচ্ছে হিমির কাছে। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
_উনি কি আসলেই আমাকে ভালোবাসেন! না না, যদি তেমনটাই হতো তাহলে তো আমাকে বলতেন উনি।

চোখ বন্ধ করে নিলো হিমি। এই মুহূর্তে ঘুমের ভীষণ প্রয়োজন তার,এই কয়েক ঘন্টাই যেন সব চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারে সে। আবারো রাত পেরিয়ে সকাল আসবে,আর সেই সঙ্গে চিন্তার পাহাড় নেমে আসবে তার মাথায়।

_____
রাতের আধার এখনো সম্পূর্ন কাটেনি। বাড়ির পাশের পুকুর পারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অপূর্ব। ঘুম নামক বস্তুর সঙ্গে তার বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়েছে এই কদিনে।
ফরিদা বেগম পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
_অপু,এখানে কি করছিস তুই?

পিছনে তাকালো না অপূর্ব, মায়ের প্রশ্নের উত্তর ও দিলোনা সে। ফরিদা বেগম এবার অপূর্বের পাশে এসে তার কাধে হাত দিয়ে বললো,
_অপু,মায়ের উপর এভাবে রাগ করে থাকতে নেই বাবা। আমি যা করছি তোর ভালোর জন্যই তো করছি নাকি।

এক হাত দিয়ে কাধ থেকে মায়ের হাতটা সরিয়ে দিলো অপূর্ব। মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
_হাহ..এটাই তো মা। আমি না সবসময় জেনে এসেছি মায়েরা সন্তানদের মনের কথা বুঝে যায়,অথচ তোমার কথা চিন্তা করে দেখো। নিজের ছেলের খুশিটাই তুমি কেড়ে নিচ্ছো।

_অপু..তুই এই কথাটা বলতে পারলি আমাকে। এত কষ্ট করে তোকে বড় করেছি আমি।

অপূর্ব তার মায়ের দু কাধে হাত রেখে করুণ সুরে বললো,
_আমি জানি মা, আর সেই কারনেই তোমার কথার অভাধ্য হওয়ার সাধ্য আমার নেই। তুমি এতদিন ধরে যেভাবে আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে চলেছো, এটা আমি তোমার থেকে কখনো আশা করিনি মা।

ফরিদা বেগম চোখের জল মুছে ছেলের দিকে তাকালেন। অপূর্বর ও চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় জমিয়েছে,গড়িয়ে পড়ার আগেই তা মুছে নিলো সে। মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারো বললো,
_তুমিতো এমন ছিলেনা মা, আমিতো আমার মাকে চিনি। আমার মা আমার সুখটাকেই আমার থেকে কেড়ে নিচ্ছে, এটা আমি মানতে পারছি না মা।
অপূর্ব আবারো তার মায়ের দু কাধে হাত দিয়ে বললো,
_তুমি এমন কেনো হয়ে গেলে মা? এতটাই বদলে গেলে যে নিজের ছেলের ভালোটাই তুমি বুঝতে পারছো না।

ফরিদা বেগম চুপ করে রইলেন। অপূর্ব তার কাধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। নিজের চোখের জল লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে চলে গেলো সেখান থেকে।

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০৪

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৪
#মেহরিন_রিম
হিমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত অর্নব এর দিকে। আজ প্রায় চার বছর পর অর্নবকে দেখছে সে, শেষ তার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো হিমির এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট এর দিন। তারপর থেকে আর অর্নব কে দেখতে পায়নি হিমি, তার ব্যাপারে খবর নেওয়ার অবশ্য কোনো চেষ্টাও করেনি।
হিমির অবাক চাহনি দেখে নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো অর্নব। ধীরেধীরে এগিয়ে গেলো হিমির দিকে,হিমি এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্নবের দিকে। অর্নব হিমির পাশে এসে বসলো। হিমির দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললো,
_যাক,তাহলে আমার নামটা মনে রেখেছ অন্তত।

হিমির ধ্যান ভাঙলো এবার। চোখ সরিয়ে নিলো অর্নবের দিক থেকে, এদিক ওদিক তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভাঙ্গিতে বললো,
_ভ ভাইয়া আপনি এ এখানে!

অর্নব ঠোঁটে হাসির রেখে টেনে বললো,
_কেন?খুশি হওনি?

_এ এখানে খুশি হওয়ার কথা আসছে কেন? আ আপনি কি কোনো কাজে এসেছেন?

অর্নব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, হিমির দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললো,
_তুমিই না বললে,সাহস থাকলে সামনে আসতে। আমার সাহস সম্পর্কে এতটুকু ধারণা তোমার আছে আশা করি।

হিমির মনে থাকা সন্দেহটুকুও কেটে গেলো এবার। অর্নবের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকালো হিমি, নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে তার। সেই অচেনা লোকটি যে অর্নব তা বিশ্বাস করতে এখনো কষ্ট হচ্ছে হিমির।

_আমাকে এখানে আশা করোনি তাইনা?
অর্নবের শান্ত কন্ঠের আওয়াজে পাশে তাকালো হিমি। অর্নব দুহাত মাথার পিছনে দিয়েয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে কথাটা বলেছে। হিমির তাকানো দেখে সেও তাকালো হিমির দিকে। তারপর হুট করে আবারো স্বাভাবিক ভাবে বসলো। হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_জানি আশা করোনি।

কথাটা বলেই উঠে দাড়ালো অর্নব। হিমি কোনো কথা না বলে শুধু অর্নবের কর্মকাণ্ড দেখছে।
অর্ণব এবার হিমির সামনে হাটতে হাটতে দুহাত নাড়িয়ে বলতে লাগলো,
_আসলে ব্যাপার টা কি জানো? আমাদের লাইফ এ এমন কিছু জিনিস আছে যা আমরা খুব করে পেতে চাই, কিন্তু শত চেষ্টা করেও পেতে পারি না।
হাটা থামালো অর্নব,স্থির দৃষ্টিতে হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_আবার কিছু জিনিস অপরিকল্পিত ভাবে জীবনে চলে আসে,যা থেকে চাইলেও বের হওয়া সম্ভব নয়।

অর্নবের এমন ভারি কথার কারণ খুজে না পেলেও খুব বেশি অবাক হলোনা হিমি,তার এমন ভারি কথা আগেও অনেক শুনেছে হিমি।
অর্নব আবারো স্বাভাবিক ভাবে বসে পড়লো হিমির পাশে। হিমির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
_তোমার কথামতো কিন্তু নিজের সাহস ও প্রকাশ করে দিলাম আমি। এবার বলো,বিয়েতে রাজি তো?

হিমি অবাক হয়ে তাকালো অর্নবের দিকে তাকিয়ে বললো,
_কিন্তু কেনো? পৃথিবীতে এতো মেয়ে থাকতে আপনি আমাকে কেনো বিয়ে করতে চাইছেন?

অর্নবের মুখ থেকে বিরক্তিসূচক আওয়াজ বেরিয়ে এলো। কপালে ভাজ ফুটে উঠলো তার। চোখ বন্ধ করে দু আঙুল কপালে রেখে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর আবারো হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোমার এই বেশি প্রশ্ন করার অভ্যাস টা গেলো না তাইনা?

হিমি এবার নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। সামনের দিকে তাকিয়েই বললো,
_দেখুন ভাইয়া,আমি আপনাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সোজা ভাবেই একটা কথা বলে দিতে চাই।

অর্নব বুকে দু হাত গুজে বললো,
_হুম,বলো। তোমার কথা শুনতেই তো এলাম,যা খুশি বলতে পারো।

হিমি জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,
_আমি অন্য কাউকে ভ ভালোবাসি..

কথাটা বলে চোখ খুলে তাকালো হিমি,অর্নবের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো সে একইভাবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশ অবাক হলো হিমি, হিমিকে চুপ থাকতে দেখে অর্নব বললো,
_হুম তারপর?

ভ্রু কুচকে গেলো হিমির। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_তারপর মানে? বললাম, আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।

নিচের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো অর্নব। তারপর আবারো আড়চোখে হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোমাকে একটা কথা বলেছিলাম,বোধ হয় মনে নেই তোমার। ব্যাপার না মনে করিয়ে দিচ্ছি।
কথাটা বলেই বেঞ্চ থেকে উঠে হিমির সামনে বসে পড়লো অর্নব। হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোমার ব্যাপারে সব খবর জানি আমি,আর এই সামান্য বিষয় টা জানবো না?

অর্নবের ব্যবহারে যেন এবার অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে হিমি। জিহ্বা দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,
_যদি জেনেই থাকেন,তাহলে এসব অবান্তর কথা বলছেন কেনো?

অর্নব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_তুমি বোধ হয় আমার কথাটা এখনো বুঝে উঠতে পারোনি হিমপরি। আমি বলেছি তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো সেটা আমি জানি, তবে তুমি যে ভবিষ্যৎ এও অন্য কাউকেই ভালোবাসবে সেটাতো আমি বলিনি।

অর্নবের কথার মানে বুঝে উঠতে না পেরে হিমি জিজ্ঞেস করলো,
_আপনি কি বলতে চাইছেন?

অর্নব কিছু না বলে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। পাঞ্জাবি তে লেগে থাকা ধুলো হাত দিয়ে ঝাড়তে লাগলো।অর্নব কে চুপ থাকতে দেখে হিমি আবারো বললো,
_আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি আপনাকে।

অর্নবের মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেলোনা। সে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। প্রায় এক মিনিট পর হিমির সামনে এসে বললো,
_তোমাকে আমি এক সপ্তাহ সময় দিলাম,এর মধ্যে তোমার যত চিন্তা করার করতে পারো। আমি চাই এর মধ্যে তুমি নিজে থেকে বিয়েতে রাজি হয়ে যাও, আর তা নাহলে…

_তা নাহলে?

অর্নব এবার কাধে হাত ঘষে হিমির দিকে সামান্য ঝুকে বললো,
_তুমি আমাকে ঠিক যতটা ভালো মনে করো,আমি ঠিক ততটাই খারাপ হতে পারি।

কথাটা বলেই স্থান ত্যাগ করলো অর্নব। হিমি চোখ বড়বড় করে অর্নবের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। তার বলা শেষের কথাটা একপ্রকার হুমকি মনে হলো হিমির কাছে। শুকনো ঢোক গিলে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। এমন সময়ে হাতে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো দিবা। মনের আনন্দে হাওয়াই মিঠাই খেতে খেতে হিমির পাশে বসে বললো,
_কিরে দোস্ত? তোর উড বি আসলো?

দিবার কথা শুনে হিমি রাগে কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো হিমি। হিমির এমন রাগী চাহনী দেখে দিবা একবার হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাই এর দিকে তাকিয়ে সেটা নিচের দিকে নামিয়ে নিলো। তার একদম স্বাভাবিক হয়ে কিছুটা চিন্তিত সুরে বললো,
_কি হলো দোস্ত?সব ঠিক আছে তো?

হিমি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
_তোকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার জন্য তাইনা?

_না, তা নয়। কিন্তু এত টেস্টি জিনিস দেখে আমি লোভ সামলাই কি করে বল তো?

হিমি এবার সোজা হয়ে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_তোকে তো আমি পড়ে দেখতেছি। এখন জলদি বাসায় চল, আমার আর এক মুহূর্ত ও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

_হ্যা হ্যা চল।

কথাটা বলেই দিবা হিমিকে হেল্প করলো হুইল চেয়ারে বসতে। তারপর দুজনে গাড়িতে উঠে বাসার দিকে যেতে লাগলো, যেতে যেতে হিমি দিবাকে সবকিছু বলতে লাগলো।
সবটা শুনে দিবা উৎসাহিত কণ্ঠে বললো,
_ওয়ে হয়ে,একদম ফিল্মি ডায়লগ। আমি যে কেন মিস করলাম সিন টা।

_দিবু…
হিমির উচ্চস্বরের ধমক শুনে চুপ হয়ে গেলো দিবা, সারা রাস্তা তাদের মাঝে নিরবতা বজায় রইলো। হিমির চিন্তা যেনো ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মনে মনে ভাবলো,
_না,এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গেই আগে কথা বলতে হবে।

___
ড্রইং রুমের সোফায় বসে আছে মানিক সাহেব,রিপা এবং হিমি। হুর তার এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছে বলে সে এখন অনুপস্থিত।
থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে বাড়ি জুড়ে। হিমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিপা এবং মানিক সাহেব এর দিকে আর তারা স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে।
বেশ কিছুক্ষন নিরবতা শেষে হিমি বলে উঠলো,
_তাহলে তোমরা এসব প্ল্যান করে করছো আমার সঙ্গে তাইনা?

রিপা হালকা নড়েচড়ে বসে বললেন,
_এখানে প্ল্যান করার কি আছে?

হিমি করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_প্ল্যান না তো কি মা? তোমরা জানতে লোকটা অর্নব ভাইয়া,তাহলে এটা আমার থেকে লুকোলে কেনো?

হিমির বাবা মানিক সাহেব নিরবতা কাটিয়ে বললেন,
_কারণ অর্নব বারণ করেছিলো।

বেশ অবাক হলো হিমি। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
_কিন্তু কখন,আর কেনো?

রিপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলেন,
_সেদিন তোকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষন পরই সেখানে অর্নব উপস্থিত হয়…..

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০৩

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৩
#মেহরিন_রিম
_অপূর্বর মা নাকি ওর জন্য পাত্রী ঠিক করেছেন। ওদের গ্রামের বাড়িতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে বোধ হয়, তার কারণেই ওদের পুরো পরিবার গ্রামে গেছে আরো এক সপ্তাহ আগে।
অপূর্বের খবর পাওয়া গেছে কথাটা শুনেই যেনো ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো হিমির। তবে সেই হাসির স্থায়িত্বকাল ছিল খুবই কম। দিবার পরবর্তী কথা যেন বিশ্বাস করতে পারলো না হিমি। জিহ্বা দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,
_ত তুই আমার সঙ্গে মজা করছিস তাইনা? অপু এভাবে আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতেই পারেনা,দেখ তোর কোথাও ভুল..

কথা শেষ করতে পারলো না হিমি, তার কথার মাঝেই দিবা বলল,
_আমি মজা করছিনা হিমি। অপূর্বর ফ্রেন্ড ই বললো আমাকে। ওদের বাড়িতে তালা দেখে আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করার পর তারা সকলে একই কথা বলেছে।

চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। অপর পাশ থেকে দিবা বলে চলেছে,
_হ্যালো হিমি?তুই শুনতে পারছিস?হ্যালো..

কোনো কথাই যেনো কানে যাচ্ছেনা হিমির। চোখের সামনে ভাসতে লাগলো অপূর্বের সঙ্গে কাটানো সকল সুন্দর মুহূর্তগুলো। দিবার কথা বিশ্বাস করতে চাইলো না হিমি,কাপা কাপা হাতে ফোনটা নিয়ে অপূর্বের নম্বরে ডায়েল করতেই অপর পাশ থেকে শোনা গেলো,
_আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে।

শেষ আশাটুকুও যেনো একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে হিমির। না চাইতেও বিশ্বাস করতে হচ্ছে দিবার বলা কথাগুলো। অশান্ত মনে আরো কয়েকবার কল দিলো অপূর্বর নম্বর এ, কিন্তু প্রতিবারই একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগলো। ফোনটা রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো হিমি। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসলো। জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,
_কি হচ্ছে আমার সাথে এসব? আমি তো কারোর ক্ষতি করিনি, তাহলে কেন এমনটা হচ্ছে আমার সঙ্গে?

____
নিজের ঘরে মাথা চেপে ধরে বিছানার পাশে বসে আছে অর্ণব। এমন সময় হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দরজার কাছে এলেন আমেনা আহমেদ। দরজায় সামান্য টোকা দিয়ে বললেন,
_আসবো বাবা?

মায়ের গলার আওয়াজ শুনে অর্ণব দরজার দিকে তাকালো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_আরে মা তুমি,দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভিতরে এসো, তুমি আবার কবে থেকে আমার ঘরে ঢোকার জন্য পারমিশন নিতে শুরু করলে?

আমেনা হালকা হেসে ঘরে প্রবেশ করলেন। খাবারের প্লেটটা টেবিলে রেখে অর্নবকে তার পাশে এসে বসতে বললেন। মায়ের কথামতোই অর্নব তার পাশে গিয়ে বসলো। আমেনা এবার পাশে থাকা প্লেটটা হাতে নিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,
_কতদিন তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দেইনা বলতো! আজ তোকে আমি নিজের হাতে খাইয়ে দেবো।
কথাটা বলেই আমেনা এক লোকমা খাবার অর্নবের মুখের সামনে ধরলো। অর্নবের খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও মায়ের মুখের উপর না বলতে পারলো না। হালকা হেসে খাবার টা মুখে নিলো অর্নব। আমেনা মনের সুখে ছেলেকে খাইয়ে দিতে লাগলেন।
খাবার শেষ হতেই আমেনা প্লেটটা পাশে রেখে বাম হাত দ্বারা অর্নবের হাত চেপে ধরলেন। করুন সুরে বলতে লাগলেন,
_তুই যেমনটা চেয়েছিস সবটা সেভাবেই হচ্ছে বাবা। তোর সব সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিয়েছি। শুধু এবার আমার একটা অনুরোধ রাখ, আমাদের ছেড়ে আর দূড়ে চলে যাসনা বাবা।

অর্নব কিছুক্ষন মায়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দুহাত দিয়ে মায়ের হাত ধরে তার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললো,
_আমি এমনিতেও যেতাম না মা। তুমি এ বিষয়ে ভেবো না তো।
আমেনার চোখে মুখে খুশির আভা ফুটে উঠলো,চোখের কোণে অশ্রুরা এসে ভিড় জমালো। ছেলের হাত দুটো মুখের সামনে এনে চুমু খেলেন তিনি,বাম হাতে নিজের চোখদুটো মুছে প্লেটটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন।
অর্নব এখনো একই ভাবে বসে আছে। হঠাৎ তার চোখ মুখের শান্ত আভার পরিবর্তন ঘটলো। নিচের দিকে তাকিয়েই শক্ত গলায় বললো,
_একবার আমি যে ভুল করেছি, দ্বিতীয়বার সেই ভুল আমি করবোনা মা। নেভার এভার..

___
হিমি এখনো একইভাবে জানালার পাশে বসে আছে। নিজের রুমে অন্য কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ টা মুছে পিছনে ঘুরলো সে। রিপাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বললো,
_মা,কখন এলে তুমি? আমাকে ডাকলেনা তো।

রিপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটের পাশে বসলেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে হিমির দিকে তাকিয়ে বললেন,
_আশা করি তুমি তখনকার সব কথাই শুনতে পেরেছো।

হিমি অশান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। হিমিকে চুপ থাকতে দেখে তার মা বললেন,
_আমি তোমাকে কখনো কোনো বিষয়ে জোড় করিনি হিমি,আজও করবো না। আমি শুধু একটা কথাই বলবো, যা সিদ্ধান্ত নেবে ভেবে চিন্তে নেবে।

হিমির এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
_কিন্তু মা, আমিতো লোকটাকে চিনিও না। আর..

হিমির কথার মাঝেই রিপা বললো,
_তুমি ওকে চেনো হিম, অনেক ভালো করেই চেনো।

হিমি অবাক চোখে রিপার দিকে তাকিয়ে বললো,
_আমি চিনি?
_হুম চেনো।
_তাহলে তোমরা আমাকে লোকটার নাম বলছো না কেনো? তার পরিচয় জানাচ্ছো না কেনো আমাকে?

রিপা বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হিমির সামনে এসে বললেন,
_জানতে পারবে,খুব তাড়াতাড়িই জানতে পারবে।

কথাটা বলেই রিপা চলে যেতে নিলে হিমি তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_কিন্তু মা, এই অবস্থাতে কোনো ছেলে কেনো আমাকে বিয়ে করতে চাইবে?

রিপা পিছনে ঘুরে হিমির দিকে তাকালেন,তারপর আবারো তার সামনে এসে বললেন,
_উত্তর টা আমার থেকে ভালো সে নিজেই দিতে পারবে।

হিমি এবার বিরক্তির সুরে বললো,
_তাহলে দিচ্ছে না কেনো? সবাই মিলে কেনো তার পরিচয় আমার থেকে লুকাচ্ছো?

রিপা কোনো উত্তর দিলেন না। হিমির দিকে একনজর তাকিয়ে বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে। হিমি চোখ বন্ধ করে নিলো, তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে বিরক্তির ছাপ। অপূর্বের কথা ভেবেই নিজেকে সামলাতে পারছে না হিমি,তার মাঝে এই নতুন ব্যাক্তির উদ্ভব। এতকিছুর চাপ যেনো সহ্য করতে পারছে না হিমি।
হিমির ধ্যান কাটলো ফোনের মেসেজ এর আওয়াজে। ভ্রু কুচকে ফোন হাতে নিতেই দেখলো একই আননোন নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে,
_আমার কথা ভাবছিলে বুঝি?

ভিতরে জমে থাকা রাগটা তড়তড় করে বারতে লাগলো হিমির। রেগে গিয়ে মেসেজ এর রিপ্লাই দিলো,
_আপনি কে হন আমার যে আপনার কথা ভাবতে যাবো?

অপর প্রান্তে থাকা লোকটি মুচকি হেসে লিখলো,
_রেগে আছো বুঝি আমার উপর?

হিমি আবারো রিপ্লাই দিলো,
_স্বাভাবিক নয় কি? আপনি হুট করে এসে আমার জীবনে ঢুকতে চাইছেন, তার উপর নিজের পরিচয় ও গোপন করছেন। আমার রাগ হওয়াটাকি অবান্তর?

অপর প্রান্তে থাকা ব্যাক্তি এবার লিখলো,
_আমাকে দেখতে চাও তুমি?

_হ্যা চাই, সাহস থাকলে সামনাসামনি কথা বলুন আমার সঙ্গে। চোরের মতো নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন কেনো?

_ওকে, কাল বিকেল চারটায় এই ঠিকানায় চলে এসো।
মেসেজ টা দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে জায়গার নামও বলে দিলো সে।

হিমি এবার খানিকটা অবাক হলো। ও বুঝতেই পারেনি লোকটা সত্যি সত্যি ই দেখা করতে চাইবে। তবুও মনে মনে কিছুটা খুশি হলো হিমি, সামনাসামনি ই লোকটাকে বিয়েতে না করে দেবে ভেবে নিলো সে। এত চিন্তার মাঝেও কিছুটা স্বস্তি পেলো হিমি। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরতেই ঘুম চলে এলো তার চোখে,রাতে ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় আর জেগে থাকতে পারলো না হিমি। পারি দিলো ঘুমের রাজ্যে।

___
লোকটার বলা ঠিকানা অনুযায়ী একটা পার্কে এসে বেঞ্চে বসে আছে হিমি। একা একা আসা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না বলে দিবাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, তবে সে সামনে থাকবে না বলে দূড়ে এক বেঞ্চে বসে আছে।
প্রায় দশ মিনিট ধরে এখানে বসে আছে হিমি, তবে যার কথায় এসেছে সে এখনো উপস্থিত হয়নি। খানিকটা বিরক্ত হলো হিমি,মনে মনে ভাবতে লাগলো,
_লোকটা আমাকে মিথ্যে কথা বললো না তো!

তবে হিমির চিন্তা ভুল প্রমাণিত হলো। পিছন থেকে একটি পুরুষালি কণ্ঠে শুনতে পেলো,
_বেশি দেড়ি করে ফেললাম বুঝি?

কণ্ঠটা কেমন পরিচিত মনে হলো হিমির কাছে। তবে পিছন ফিরে তাকাতেই অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো সে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
_অর্ণব!…

#চলবে

শেষ ঠিকানা পর্ব-০২

0

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_২
#মেহরিন_রিম

নীল রঙের শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে বসে আছে হিমি, হুর তাকে শাড়ি পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। মায়ের কথা কানে আসতেই বুঝতে পারলো পাত্রপক্ষ এখনি চলে আসবে। সবকিছু যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে হিমির,কে বা কারা তাকে দেখতে আসছে কিছুই জানেনা সে। এক ঘণ্টা যাবৎ মা আর বোনকে জিজ্ঞেস করলেও তারা স্পষ্টভাবে কিছুই বলেনি।

হিমি হুইল চেয়ার নিয়ে কিছুটা পিছনে এসে বিছানার পাশের টেবিল থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিলো। অপূর্বের নম্বর বের করে অনেক্ষন তাকিয়ে রইলো সেদিকে,তারপর ফোনটা অফ করে একই জায়গায় রেখে দিলো। কিছুটা সামনে এগোতেই আবারো কিছু একটা চিন্তা করে পিছনে এলো হিমি। ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলো অপূর্বের নম্বরে,বেশ কিছুক্ষন রিং হলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ কলটা রিসিভ করলো না। ফোনটা কানে থাকা অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হিমি। অত:পর ফোনটা আগের স্থানে রেখে আবারো ড্রেসিং টেবিল এর সামনে এলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখলো কিছুক্ষন, আহামরি সুন্দর না হলেও হালকা সাজে বেশ মানিয়েছে তাকে। সবাই বলে ওর চেহারায় অন্যরকম মায়া আছে।
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হালকা হাসলো হিমি, মানুষের মুখে বর্তমানে নিজের সম্পর্কে কিছু শুনতেও ইচ্ছে হয়না তার। অপূর্ব ও তো এক সময় তাকে নিয়ে কতো কিছু বলতো, নিজের গুণাগুণ শুনতে খারাপ লাগতো না হিমির। কলিং বেল এর আওয়াজে চিন্তাভঙ্গ হলো হিমির। তবে এই নিয়ে সে বেশিকিছু ভাবছে না। এর আগেও একবার পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল তাকে, তবে হিমির পায়ের কথা জানতে পেরে তারা তখন ই চলে যায়। হিমি ভাবছে হয়তো এবারো তেমন কিছুই হবে।

একইভাবে রুমে বেশ কিছুক্ষন বসে রইলো হিমি, তবে অবাক করা বিষয় ত্রিশ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরও কেউ ওকে ডাকতে আসেনি। হিমি ভাবলো হয়তো তার পায়ের কথা শুনে সবাই চলে গেছে। তাচ্ছিল্যের সূরে হাসলো কিছুক্ষন।
হিমির জীবনটা এমন ছিলোনা। আর পাঁচটা মানুষের মতো সেও হাটতে পারতো,দৌড়াতে পারতো। প্রচুর চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে হিমি, একজায়গায় স্থির থাকা তার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব কাজ ছিলো। হিমির এই চঞ্চলতাই ছিল অপূর্বের সবচেয়ে পছন্দের।
এত হাসিখুশি মেয়েটার জীবন বদলে যায় একটা দিনের ব্যাবধানে। বাইকে চড়তে সে বরাবরেই কিছুটা ভয় পেতো, কে জানতো এই বাইকই একদিন তার কাল হয়ে দাঁড়াবে!
এক বছর আগে এক বাইক এক্সিডেন্ট এর ফলে হিমির পা দুটো অকেজো হয়ে যায়, অপারেশন এর সুযোগ থাকলেও তাতে অনেকটা রিস্ক ছিল। অপারেশন সাকসেসফুল না হলে হিমির পা দুটো বাদ দিতেও হতে পারে। এমন কথা শুনে মানিক সাহেব আর ঝুঁকি নেননি। তখন থেকেই হিমির জীবন বন্দি হয়ে যায় হুইল চেয়ারের মাঝে। সারাদিন ছোটাছুটি করে বেড়ানো হিমিকে এখন সামান্য কাজেও অন্যের সাহায্য নিতে হয়।
তবে সেই কঠিন মুহূর্তেও অপূর্ব হিমির পাশে ছিলো। হিমির দু হাত ধরে সেদিন সে বলেছিল,
_যাই হয়ে যাক না কেন,আমি তোমার পাশে আছি।

কথাটা ভেবে কিছুটা হাসি পেলো হিমির। এর মাঝেই তার মনে হলো ড্রইং রুম থেকে কিছু কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হিমির ঘর এখন নিচেই, এক্সিডেন্ট এর পরই তার ঘর উপর থেকে শিফট করে নিচে ঠিক করা হয়েছে।
হিমি নিজের ঘরের দরজার কাছে যেতেই চলতে থাকা কথা বার্তা কিছুটা শুনতে পেলো। হালকা পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কারা এসেছেন, তবে একজন মহিলা এবং তার সঙ্গে হিমির বয়সী একটি মেয়ে ছাড়া নতুন কাউকে দেখতে পেলো না।

হিমি শুনতে পেল সেই মহিলা তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলছেন,
_দেখুন,আপনারা তো সবটাই জানেন। দয়া করে আর আপত্তি করবেন না।

প্রতিত্তরে রিপা বললেন,
_আমি বুঝতে পারছি আপা,তবে আমার মেয়ের সিদ্ধান্ত ব্যতীত আমি কিছুই বলতে পারবো না।

মহিলা এবার খানিকটা করুণ সূরে বললেন,
_আমার ছেলেকে আমি একবার হারিয়েছি, আর হারাতে চাইনা। হিমিকে ও ঠিক রাজি করিয়ে নেবে,আপনি এ বিষয়ে চিন্তা করবেন না।

রিপা এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হুরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
_যা তো হিমিকে ডেকে নিয়ে আয়।

হুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই সেই মহিলা তাকে বাধা দিয়ে বললেন,
_তার কোনো দরকার নেই আপা, আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। আমি বিয়ে পাকা করেই মেয়েকে দেখবো নাহয়।

রিপা তার উদ্দেশ্যে বললেন,
_আপনার দিকটা আমি বুঝতে পারছি,তবে আমাদের কিছুটা সময় দরকার। আমি তো আমার মেয়েকে চিনি, ও এত সহজেই রাজি হবেনা তাও জানি। তাই আরকি..

উক্ত মহিলা এবার হালকা হেসে বললেন,
_আপনার সিদ্ধান্তকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। আপনারা সময় নিন,আমার কোন আপত্তি নেই। আমরা বরং আসি আজকে।

কথাটা বলেই সেই মহিলা মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলেন।কথাগুলো স্পষ্ট না শুনতে পেলেও কিছুটা শুনতে পেরেছে হিমি। রিপা বসা থেকে উঠে দাড়াতেই তার চোখ পরে হিমির দিকে,তিনি বুঝতে পারলেন হিমি এতক্ষন তাদের তাদের কথা শুনেছে। তবে কতটা শুনতে পেয়েছে তা আন্দাজ করতে পারলেন না।

মাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিমি দরজার সামনে থেকে সরে গেলো। ভিতরে গিয়ে তাদের কথার অর্থ খুজতে লাগলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো,
_আমার সঙ্গে তার ছেলেকে হারানোর কি সম্পর্ক আছে? তার ছেলে কি আমাকে চেনে? আর সে আমাকে রাজি করিয়ে নেবে বলতে উনি কি বোঝালেন?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের পরিচিত ছেলেদের কে মনে করতে লাগলো। তবে তাদের কাউকেই সন্দেহ হলোনা হিমির। অপূর্বের সঙ্গে রিলেশন শুরু হওয়ার পর থেকে খুব একটা ছেলেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ও করেনি। ভার্সিটির ক্লাসমেট দের মধ্য থেকেও কাউকেই এমন মনে হয়নি হিমির।
কথাগুলো চিন্তা করতেই অপূর্বর কথা মাথায় এলো হিমির। বেড এর পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়েই দিবার নম্বরে কল দিলো।
কল টা রিসিভ হতেই বলতে লাগলো,
_কোনো খবর পেলি অপুর?

অপর পাশ থেকে দিবা কিছুটা বিরক্তির সুরে বললো,
_আমিতো আপনার এসিস্টেন্ট তাইনা! নিজের কাজকর্ম বাদ দিয়ে আপনার প্রেমিক পুরুষকে খুজতে বের হবো আমি!

হিমি এবার করুন সুরে বললো,
_প্লিজ দিবু এমন করিস না। এতগুলো দিন হয়ে গেলো অপুর কোনো খোজ নেই। তুই প্লিজ একটু খোজ নে।

দিবা এবার স্বাভাবিকভাবে বললো,
_অনেকজন কেই জিজ্ঞেস করেছি, কেউই কিছু বলতে পারছে না। আমি আরো কয়েকজন কে বলে রেখেছি, কোনো খবর পেলে জানাবে বললো।

হিমি খানিকটা চিন্তিত সুরে বললো,
_আমার এবার খুব টেনশন হচ্ছে দিবু, ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো?

দিবা হিমির অবস্থাটা বুঝতে পেরে ওকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল,
_কিচ্ছু হয়নি ওনার,দেখ গিয়ে কোন চিপায় লুকিয়ে আছে।

হিমি বিরক্ত হয়ে বললো,
_দিবু প্লিজ!

কলটা কেটে দিলো হিমি। বিরক্ত হয়ে ফোনটা টেবিলে রাখতে যাবে সেই মুহূর্তে তার হোয়াটসঅ্যাপ এ আননোন নম্বর থেকে একটি মেসেজ আসে। হিমি মেসেজ এর উপর ক্লিক করলো। সেখানে লেখা আছে,
_কি ব্যাপার হিমপরি, আমাকে রিজেক্ট করে দিলে বুঝি?

কথাটা মাথার উপর দিয়ে গেলো হিমির। সে আবার কাকে রিজেক্ট করলো? আর এই লোকটাই বা কে?
হিমি ভ্রু কুচকে মেসেজ এর রিপ্লাই দিলো,
_কে আপনি? আমি আপনাকে রিজেক্ট করতে যাবো কেন?আমিতো আপনাকে চিনি ই না, আর আপনি আমার নম্বর ই বা পেলেন কোথায়?

মেসেজ সেন্ড হওয়ার দশ সেকেন্ড এর মাথায় রিপ্লাই এলো,
_আরে আরে এত প্রশ্ন একসঙ্গে করলে তো চলবে না। বাকি রইলো নম্বর এর কথা, শুধু নম্বর নয় তোমার সকল খবর ই আছে আমার কাছে।

লোকটার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছে না হিমি। নিজে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরো একটি মেসেজ এলো। আর তাতে লেখা আছে,
_বিয়েতে রাজি হয়ে যাও হিমপরি।

এবার যেনো সবটা পরিস্কার হলো হিমির কাছে। তার মানে এই লোকটার মা ই এসেছিলো বাড়িতে। বেশ রাগ হলো হিমির। মেসেজের এ লিখলো,
_ওহ আচ্ছা, তাহলে আপনি ই সেই লোক। বিয়েটা মামা বাড়ির আবদার বুঝি? আমি আপনাকে চিনিনা জানিনা,হুট করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবো?

বিপরীত পাশ থেকে রিপ্লাই এলো,
_লেটস সি…
মেসেজ টা সেন্ড করে বিপরীত পাশে থাকা লোকটা বাকা হাসলো। ফোনে হিমির একটা ছবি বের করে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
_ “তুমি শুধু আমার হবে হিমপরি,
শুধুই আমার”

অন্যদিকে হিমি আরও বেশ কিছু মেসেজ দিলো লোকটাকে তবে কোনো রিপ্লাই এলোনা। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে ফোনটা রেখে দিলো। লোকটার লাস্ট মেসেজ এর কথা চিন্তা করে মনে মনে বললো,
_উনি কি আমাকে হুমকি দিলেন!

___
রাতের খাবার শেষে বিছানায় বসে লোকটার সম্পর্কে চিন্তা করছে হিমি। তার মাঝেই দিবার কল এলো। হিমি পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করতেই দিবা বলতে লাগলো,
_অপূর্বের খোজ পাওয়া গেছে হিমি…

চলবে।