শেষ ঠিকানা পর্ব-০৭

0
223

#শেষ_ঠিকানা
#পর্ব_৭
#মেহরিন_রিম
একটা নির্জন জায়গায় একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে অর্নব এবং হিমি। অর্নবের চোখে মুখে খুশির আভা দেখা গেলেও হিমি রয়েছে নির্বিকার। সামনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রয়েছে সে। বেশ কিছুক্ষন কেটে যাওয়ার পরও হিমিকে চুপ থাকতে দেখে অর্নব বলে উঠলো,
_তুমি বিয়েতে রাজি, কথাটা জানাতেই আমাকে ডেকেছো তাই…

_দয়া করছেন আমার উপর?
হিমির স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে বলা কথায় চুপ করে গেলো অর্নব। চোখ ঘুরিয়ে হিমির দিকে তাকালো,সে এখনো একইভাবে বসে আছে। অর্নব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো হিমির দিকে। হিমি এক নজর তাকালো অর্নবের দিকে,তারপর স্থির কণ্ঠে বললো,
_বলুন? আমার উপর দয়া দেখাচ্ছেন?

অর্নব অবাক হয়ে বললো,
_হোয়াট!

হিমি আবারো সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_হ্যা,দয়াই তো দেখাচ্ছেন। নাহলে একটা পঙ্গু মেয়েকে কেনো বিয়ে করতে চাইবেন আপনি?

অর্নবের চোখেমুখে ধীরে ধীরে রাগের আভা ফুটে উঠতে লাগলো। তবে হিমি সেদিকে নজর না দিয়েই বলতে থাকলো,
_আসলে বিষয় টা কি বলুন তো, আপনি ভেবেছেন এমন একটা মেয়ের ভবিষ্যতে কি হবে?
কিছুটা থেমে আবার বললো,
_য যেই মেয়ে নিজের পায়ে হাটতেই পারে না তাকে কোন ছেলেই বা বিয়ে করবে। এসব ই ভেবেছেন তাই তো?

রাগের মাত্রা এবার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে অর্নবের। নিচের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে হিমির কথাগুলো শুনছে সে।

হিমি এবার তাকালো অর্নবের দিকে। বিচলিত কণ্ঠে বললো,
_বিশ্বাস করুন,আমার কারোর দয়া চাইনা। আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে…

_ইনাফ ইজ ইনাফ হিমি…

অর্নবের উচ্চস্বরের ধমকে কেপে উঠলো হিমি,চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সে। পরক্ষণে চোখ খুলতেই দেখতে পেলো অর্নবের চোখেমুখে কেমন রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। কপালের রগগুলো ফুলে আছে,রাগে পুরো শরীর কাঁপছে তার। অর্নবের এমন রূপ দেখে কিছুটা ভয় পেলো হিমি,চুপ করে রইলো সে। অর্নব হিমির সামনে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
_হাউ ডেয়ার ইউ হিমি! তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে এই ধরনের কথা বলার? আমার ভালোবাসাকে দয়া বলে আখ্যায়িত করার?

হিমি যতটা না ভয় পেলো তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি অবাক হলো সে। অস্ফূটস্বরে তার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো,
_আপনি আমাকে ভালোবাসের!

অর্নব হালকা হেসে বললো,
_এমনভাবে বলছো যেনো তুমি জানতেই না!

এবার আরো বেশি অবাক হলো হিমি,অবাক চোখে তাকিয়ে অর্নবের দিকে। অর্নব এবার অন্যদিকে ঘুরে বলতে লাগলো,
_সপ্তাহে তিনদিনের জায়গায় পাঁচদিন পড়াতে যাওয়ার কারণ টা তুমি বুঝতে পারোনি তাইনা? তোমার মনে আছে? পড়া কমপ্লিট না করায় অনেক বকতাম তোমাকে, যার কারণে তুমি রাগ করে আমার সঙ্গে কথাই বলতে না। পরদিন আবার এই আমিই চকলেট দিয়ে তোমার রাগ ভাঙাতাম। কেনো জানো?

চুপ করে রইলো হিমি,এসব বিষয় তো সে কখনো ভেবেও দেখেনি। অর্নব একইভাবে বলতে রইলো,
_কারণ টা তোমার কথা না বলা,তোমার অবহেলা। সহ্য করতে পারতাম না আমি।

কিছুক্ষন চুপ করে রইলো অর্নব। তারপর আবারো ধরা গলায় বললো,
_আমি তোমার টিচার আর তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে, এটা একটা সুন্দর সম্পর্ক। আমি তার মাঝে তোমাকে অন্য কিছু বলতে চাইনি হিমি, আর তুমিও এই ঘটনাগুলোকে গোনায় ধরোনি।

হিমির চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। অর্নব এবার ঘুরে তাকালো হিমির দিকে। করুন সুরে বললো,
_কিন্তু আমিতো তোমাকে জানিয়েছিলাম হিমি। জানিয়েছিলাম আমার মনের সব কথাগুলো। আর তুমি কিনা সেই সবকিছু ছিড়ে ফেলে দিলে!

অবাকের চরম পর্যায় পৌঁছে গেলো হিমি। হিমিকে এমন অবাক হতে দেখে অর্নব তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো,
_এত অবাক হচ্ছো যেন তুমি কিছু জানোই না! আচ্ছা যাও, মেনে নিলাম তুমি চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলে। তবে তার সঙ্গে আমার দেওয়া বইটাও ফেলে দিলে!এতটা অপমান আমাকে না করলেও পারতে হিমি।

বইয়ের কথা শুনে হিমির মাথায় এলো তার রেজাল্টের দিনের কথা। অর্নব তাকে একটা বই গিফট করেছিল সেদিন,বলেছিলো খুব মনোযোগ দিয়ে পরতে। সেদিন হিমি বাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে অপূর্বের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, তখন তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সবে বন্ধুত্ব থেকে একটু গভীর হতে শুরু করেছে।
অর্নবের দেওয়া বইটা বাড়িতেই ছিল। তবে হিমি বাড়িতে এসে তা আর খুজে পায়নি। তার চার বছরের খালাতো বোনের হাতে এক বইয়ের একটা পৃষ্ঠা দেখে বুঝতে পেরেছিল সেই এই অঘটন ঘটিয়েছে। হিমি মনে মনে ভাবতে লাগলো,
_তবে কি বইয়ের মাঝেই উনি কোনো চিঠি রেখেছিলেন! কিন্তু ওনাকে কি করে বোঝাবো আমি যে বইটা পড়তেই পারিনি।

অর্নব এবার কিছু একটা চিন্তা করে বললো,
_অবশ্য করবে নাই বা কেন। তখন তো তোমার মনে অন্য কেউ জায়গা করে নিয়েছিলো।

অবাক হলো হিমি,মনে মনে ভাবলো,
_তবে কি উনি সেদিন আমাকে আর অপূর্বকে দেখে ফেলেছিল।

অর্নব এবার হিমির কাছে এসে ওর দু কাধে হাত দিয়ে হালকা ঝাঁকিয়ে বললো,
_লিসেন হিমি, আমি একবার তোমাকে হারিয়েছি। দ্বিতীয়বার হারাতে দেবো না। তুমি নিজে থেকে রাজি না হলে আমি ঠিক কি কি করতে পারি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।

কথাটা বলেই সেখান থেকে চলে যেতে নিলো অর্নব। তবে তাকে বাধা দিয়ে হিমি পিছন থেকে বলে উঠলো,
_এই ভালোবাসা যে ক্ষণস্থায়ী নয় তার কি গ্যারিন্টি আছে ভাইয়া?

অর্নব পিছন ফিরে সরু চোখে তাকালো হিমির দিকে। হিমি অর্নবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
_আমি আর কখনো নিজের পায়ে হাটতে পারবো কিনা জানিনা। এটা মেনে নিতে পারবেন আপনি? পরবর্তীতে যদি এই ভালোবাসা বিরক্তিতে রূপ নেয়?

পাশে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো অর্নব। তারপর কিছুটা সামনে এসে বললো,
_ এই বিরক্তি ই তো চেয়েছিলাম আমি,পাইনি তো। তোমার প্রতি বিরক্ত হওয়ার জন্যই তো দূরে সরে গিয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না, দূরে থেকেও এই অনুভূতি ক্রমশ বেড়েই গেছে। সেখানে তোমার সঙ্গে থেকে বিরক্তির প্রশ্নই আসে না।

অর্নব এবার হিমির সামনে এলো,ওর সামনে বসে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
_ আমার ভালোবাসা এতো ঠুনকো নয় হিমি। এই ভালোবাসা আমরন শুধু বেড়েই যাবে,এক বিন্দু পরিমাণ ও কমবে না।

অশ্রুসজল চোখে অর্নবের দিকে তাকিয়ে আছে হিমি। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। সেদিন বইটা পড়তে পারলে হয়তো আজকের এই দিনটা দেখতেই হতোনা তার। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো হিমির, এই মুহূর্তে আফসোস করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।

____
নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে অর্নব। বেশ কয়েকদিন হলো ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে সে, চোখ সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অর্নব। জমিজমার কিছু কাজে তাকে গ্রামের বাড়িতে আসতে হয়েছে। এই পৃথিবীতে মা ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নেই। খুব ছোটবেলায় বাবা তাদের ছেড়ে চলে যায়, বিয়ে করার সুযোগ থাকলেও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি অপূর্বের মা।
সেদিন হিমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর অপূর্ব তার পিছনে যেতে চাইলেও তার মা তাকে আটকে দেয়। নিজের কসম দিয়ে বলে হিমির সাথে যেনো অপূর্ব আর কোনো যোগাযোগ না করে। অপূর্ব অনেকবার তার মাকে বুঝিয়েছে,অনুরোধ করেছে তবে কোনো লাভ হয়নি। পরদিনই কাজের জন্য তাকে গ্রামে আসতে হয়। ফোন অন থাকলেই হিমির কল আসে,আর তা রিসিভ না করতে পেরে নিজেকে অপরাধী মনে হয় অপূর্বের। তাই বাধ্য হয়ে ফোনটা অফ করে রাখতে হয়েছে তাকে।

ফোনটা হাতে নিয়ে অন করলো অপূর্ব,সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলো তার এক বন্ধু ২২ বার কল করেছে। ভ্রু কুচকে তার নম্বরে ডায়েল করতেই সে রিসিভ করলো ফোনটা। তার কথা শুনে অপূর্ব বসা থেকে দাঁড়িয়ে বেশ উচ্চস্বরে বললো,
_হোয়াট!কিন্তু এটা কি করে হতে পারে?…

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে