Thursday, July 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 26



অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১৫+১৬

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৫.

সকাল সকাল উঠে মেঘালয়া ফ্রেস হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সকাল সাতটা বাজে ঘড়িতে। আজকে সূর্যের তেজ তুলনামূলক কম মনে হলো। এখনও তেমন ঝাঁজাল হয়ে ওঠেনি। সকালের নির্মল বাতাসে দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিলো মেঘালয়া। জীবনটাকে আজকাল একদম ভালো লাগে না তার। এই ছোট্র জীবনে কিছু দিনের ব্যবধানে তার সঙ্গে বহু তিক্ত ঘটনা ঘটে গেছে। যা ছিল তার জন্য সম্পূর্ণ ভাবনাতীত। একটা ভুল তাকে বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। সে মোটেই এত তাড়াতাড়ি এত বড়ো আর বুঝমতি হয়ে উঠতে চায়নি। তার সেই চঞ্চলতা, আহ্লাদ, আত্মমর্যাদাবোধ; সবই কেমন বাস্তবতার সংস্পর্শে জ্বলে ছাই হয়ে গেল। সে কতটা নিচু হয়ে উঠেছে সকলের চোখে। তাতে কি বিশেষ কোন লাভ হয়েছে! সে ভেবেছিল, এভাবে নিজের ভুলটা মেনে নিয়ে চুপ থাকলে হয়ত সকলের মন গলবে, তাকে সকলে আবারও গ্রহন করে নেবে।

ভুল এই ভাবনাটা ভেঙে দিয়েছে সকলে। সে এমনিতেও তাদের সম্মুখে খারাপ, আর ভালো হওয়ার চেষ্টাটাও করবে না। ইরাজের কথা মনে পড়ল। আপন মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল মেঘালয়া। ভালোবাসা! ইরাজ এটাকে ভালোবাসা বলে? যেখানে, তিক্ততা আর কিছুই নেই। মেঘালয়া নিজের জন্য কিছু করতে চায়। নিজেকে সে আত্মনির্ভর হিসেবে দেখতে চায়, যাতে সে প্রতিনিয়ত হাজারটা ভুল করে গেলেও কেউ যাতে তাকে নিচু চোখে দেখে, অবহেলা না করার সুযোগ পায়। সে করবে, আরো ভুল করবে, বারবার ভুল করবে। সে দেখতে চায় সকলে এবার কি করে?

ভয়ানক এক জিদের অঙ্গীকার করে বসল মেঘালয়া নিজের সঙ্গে। বারান্দা থেকে চলে এলো। রুম থেকে বেরোনোর সময় ভুলেও একবার তাকাল না বিছানায় শায়িত ঘুমন্ত ইরাজের দিকে। মুখভঙ্গি কঠিন তার, সেই বাচ্ছাসুলভ মেঘালয়াই যে এটা, তা চেনার উপায় নেই এই মেঘালয়াকে দেখে। রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল আস্তে করে। আনতারা খানম এখনও আসেন নি সেখানে। আয়েশা কাটাকুটি করছে। সে নিঃশব্দে রান্নাঘরে প্রবেশ করে ছোট একটি পাত্র হাতে নিলো। আয়েশা ব্যস্ত হয়ে বলে, “ভাবীমণি! আপনার কি লাগব, আমারে কন। আমি কইরে দিই।ʼʼ

মেঘালয়া গম্ভীর স্বরে জবাব দিল, “প্রয়োজন নেই। নিজের কাজ করুন, আমি করে নিচ্ছি।ʼʼ

আয়েশা আর কিছু বলতে পারল না। মেঘালয়া আপন মনে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিলো। তা কফিমগে ঢেলে ট্রেতে তুলে রান্নাঘর থেকে বের হবার মুহূর্তে আনতারা খানম আসলেন সেখানে। মেঘালয়া তাকাল না সেদিকে, নির্বিকার চিত্তে ট্রে নিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। আনতারা খানম লক্ষ্য করলেন, মেঘালয়ার মুখে স্পষ্ট তিক্ততা।

মেঘালয়া ইমতিয়াজ সাহেবের রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইমতিয়াজ সাহেবের সম্মুখে। তিনি বসে আছেন ল্যাপটপ কোলে। পাশেই খবরের কাগজ। হয়ত খবরের কাগজওয়ালা মাত্রই দিয়ে গেছে, তা ওভাবেই পাশে রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন তিনি। মেঘালয়ার উপস্থিতিতে চমকে তাকালেন সেদিকে। ওকে দেখেই সুন্দর এক হাসি দিয়ে বললেন, “আরে আম্মাজান যে! এত সকালে ঘুম ভেঙেছে আজ, ব্যাপার কি? প্রতিদিন তো দেখাই পাই না।ʼʼ

মেঘালয়া চমৎকার হাসল, “আজ থেকে পাবে। নাও তোমার কফি।ʼʼ

কফির মগ হাতে তুলে দিল মেঘালয়া। তা হাসিমুখে নিলেন ইমতিয়াজ সাহেব। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ইশারা করলেন মেঘালয়াকে সামনের মোড়ায় বসতে।

“শরীর কেমন যাচ্ছে তোমার, বাবাই!ʼʼ

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই যাচ্ছে রে, মা। তবে একটুতেই খুব ক্লান্ত হয়ে উঠি আজকাল বুঝলি! আমার বাঁদর কি করছে? নিশ্চয়ই চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। তার হাতে কাজবাজ দিয়ে যে নাতি-নাতনি নিয়ে অবসরে যাব; তা আর হয়ে উঠছে না বলেই আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।ʼʼ —শেষের কথাটা বেশ ঢং করে বললেন ইমতিয়াজ সাহেব।

মেঘালয়া মাথা নত করে হাসল। ইমতিয়াজ সাহেব যে, কথার মাঝে নাতি-নাতনির ইঙ্গিত দিলেন, তা বুঝেই মূলত মেঘালয়ার এই অদ্ভুত হাসি। প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,

“আব্বু কেমন আছে, বাবাই!ʼʼ

“তোর আব্বু আজকাল খুব অলস হয়ে গেছে রে! আমি তার জন্য অপেক্ষায়, তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মতো বিরহে ডুবে মরি, তার পাত্তা নেই। কল দিলে বলে, আজ একা চালিয়ে নে, পরে টরে দেখব।ʼʼ

মেঘালয়া এমন একটা কথা শুনে চোখ বড়ো-বড়ো করে তাকাল। তা দেখে ইমতিয়াজ সাহেব শব্দ করে হাসলেন। বললেন, “তোরাই শুধু পারিস? আমি আর হেলাল বয়সকালে কত মেয়ের ব্যাগের খাবার চুরি করে খেয়েছি। কত মেয়ের গায়ে ব্যাঙ ছুঁড়ে দে ছুট। সে মেয়ে ব্যাঙ দেখে পালাবে নাকি আমাদের তাড়া করবে।ʼʼ

এ পর্যায়ে মেঘালয়ার হাসতে হাসতে দম বন্ধ অবস্থা। ইমতিয়াজ সাহেব মুগ্ধ হয়ে দেখলেন, মনে হলো, সেই ছোট্র মেঘালয়া খিলখিলিয়ে হাসছে যেন! আস্তে করে বললেন, “মাশা-আল্লাহ!ʼʼ

তা বোধহয় কানে গেল মেঘালয়ার। হাসি থামিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। ইমতিয়াজ সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, “থামলি কেন, মেঘা! কতদিন পর তোর খিলখিল হাসির রব শুনলাম। হাসতে ভুলিস না, মা। হাসিই তো একমাত্র বস্ত; যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে অমর করে। যে হাসতে ভুলে যায়, সে তো দুনিয়া থেকে মুছে যায় রে, মেঘা!ʼʼ

মেঘালয়া চোখটা কি সিক্ত হয়ে উঠল না! সে দ্রুত মাথা নত করে নিলো। ইমতিয়াজ সাহেব আদুরে গলায় বললেন, “তোর মামনি যা বলে ওসব ধরিস না। ও এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। সংসার জীবন এমনই হয় বুঝলি! একটু টানপোড়েন না থাকলে যে তাকে সংসারধর্ম বলা যায় না। একটু মানিয়ে নিয়ে চল, সৃষ্টিকর্তা কোন কষ্টই তার সৃষ্টিকে বেশিদিন ভুগতে দেন না।ʼʼ

মেঘালয়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা তরল টপ করে পড়ল কোলের ওপর রাখা হাতের কব্জির ওপর। ইমতিয়াজ সাহেব এগিয়ে এসে মাথায় হাত দিলেন। মুখটা উচু করে ধরতেই ভেসে উঠল, মেঘালয়ার অশ্রুসজল মুখটা। বুকটা ভার হয়ে উঠল। যত্ন করে নিজের হাতে চোখের জল মুছে দিলেন তিনি। মেঘালয়া যেন আরও সায় পেয়ে গেল। ডুকরে কেঁদে উঠল আবারও। এবার একহাতে আগলে নিলেন ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়াকে। অপর হাত মেঘালয়ার মাথায় রেখে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,

“কি হয়েছে রে পাগলি! আব্বুর কথা মনে পড়ছে? যাবি? নিয়ে যাব!ʼʼ

মেঘালয়া মুখ তুলে চাইল, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “বাবাই! আমি যে ভুলটা করেছিলাম, তার শাস্তি ফুরোচ্ছে না কেন? আর কত সহ্য করলে এই ভুল আমার পিছু ছাড়বে বলো তো?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মৃদূ হাসলেন, “বোকা মেয়ে! কে বলেছে এসব ভুলের শাস্তি? তুই যা করেছিস, তোর বয়সে মানুষ তার চেয়ে বড়ো বড়ো ভুল এমনকি পাপ করে বসে। তোর সঙ্গে যা হচ্ছে তাকে ভুলের শাস্তি ভাবছিস, নিজের বোকামিতে। জীবনে এমন অনেক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়, যার জন্য কোন ভুলের প্রয়োজন হয় না। জীবন বড়োই বৈচিত্র্য রে মা! জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায় না, আর না যায় পরিকল্পনামাফিক পরিচালনা করা। বরং জীবন আমাদের যেভাবে পরিচালনা করে; সেভাবে চলা ছাড়া উপায় থাকে না। হেলাল তোকে বড়ো আহ্লাদে মানুষ করেছে, দুনিয়ার জটিলতা থেকে বাঁচিয়ে নিজের কাছে আগলে রেখেছিল, তাই এসব নতুন মনে হচ্ছে। অথচ সকলের জীবনেই এমন টানপোড়েন রয়েই যায় আজীবন; সেখানে ভুলের প্রয়োজন নেই।ʼʼ

কথাগুলো শুনতে শুনতে মেঘালয়ার ভেতরে অদ্ভুত এক সান্তনা চলে এলো। তবে ইমতিয়াজ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বড়ো মায়া অনুভূত হলো। মানুষটা আসলেই অমায়িক। এও যে বাপ, মেঘালয়ার আরেক বাপ; ওর বাবাই!

ইমতিয়াজ সাহেব ধমকে উঠলেন, “আবার কাঁদছিস? কিছু বলছি না বলে স্পর্ধা বেড়েছে? চোখ মুছে ফেল! নয়ত নিয়ে গিয়ে শিশুতোষ স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসব। এত বড়ো মেয়ে এভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে?ʼʼ

মেঘালয়ার জানে, বাবাই ওর মন ভালো করতে এসব বলছে। চোখে পানি নিয়েই ঠোঁটে হেসে ফেলল, সঙ্গে হাসলেন ইমতিয়াজ সাহেব। মেঘালয়ার গুমোট হয়ে থাকা মনটা আচমকা বড়ো হালকা লাগে। এতক্ষণে কফি নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে দুজনের!

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৬.

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ইরাজ এখনও বাড়ি ফেরেনি। মেঘালয়ার তা নিয়ে বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। সে নিজের মতো আধশোয়া হয়ে বসে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর, প্রায় এগারোটার দিকে ইরাজ আসলো। মেঘালয়া ইরাজের উপস্থিতি টের পেয়েও তাকাল না সেদিকে। ইরাজ পরনের কাপড় পরিবর্তন করে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে একেবারে বের হলো। মেঘালয়ার দিকে চোখ তুলে একবার তাকিয়ে দেখল, সে পড়ায় মগ্নতা দেখাচ্ছে। জিজ্ঞেস করল,

“তোর রেজাল্ট কবে?ʼʼ

মেঘালয়া আচমকা ইরাজের এমন ভারী গলা শুনে সামান্য চমকে তাকাল। যদিও চমকিত ভাবটা তার মুখে প্রকাশ পায় নি। আস্তে করে সংক্ষেপে জবাব দিল,
“আগামী পরশু।ʼʼ

ইরাজ আর বাক্য খরচ না করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আজ প্রায় সপ্তাহখানেক পর তাদের এই দুটো কথা হলো। মেঘালয়া ছোট্রো একটা শ্বাস ফেলে পড়ায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে।

খাবার টেবিলে ইমতিয়াজ সাহেব দেখলেন, তারা তিনজন থাকলেও মেঘালয়া নেই। এদের দুজনের মাঝে কেউ যে ডাকতে যাবে না, তা তিনি জানেন। তা ভেবে খুব একটা ভালো লাগল না। তিনিই গলা উঁচিয়ে ডাকলেন মেঘালয়াকে, “মেঘা! ও মেঘা! নিচে আয় তো!ʼʼ

মেঘালয়ার কানে গেল মৃদূ আকারে সেই ডাক। সে বুঝল, বাবাই কেন ডাকছে। সেও চেঁচিয়ে জবাব দেয়, “ক্ষুধা নেই, বাবাই। তোমরা খেয়ে নাও, আমি পড়ছি।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, “খেতে ডাকছি না। তুই শুনে যা।ʼʼ

বিরক্ত হয়ে বই, খাতা রেখে উঠে পড়ল মেঘালয়া। সিঁড়ির অর্ধেক অবধি নেমে বলল, “কি হয়েছে, বাবাই!ʼʼ

“এদিকে আয়, বলছি।ʼʼ

মেঘালয়া অলস ভঙ্গিতে নেমে এসে টেবিলের কাছে দাঁড়াল। ইমতিয়াজ সাহেব চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “বোস এখানে।ʼʼ

মেঘালয়া বলে ওঠে, “বাবাই..

ইমতিয়াজ সাহেব ধমকে উঠলেন, “বসতে বললাম তো!ʼʼ

অগত্যা বসে পড়ল মেঘালয়া। আনতারার মনে হয় এই ব্যাপারটা খুব একটা ভালো লাগল না। তা তার মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয়া নিজেই নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিলো। তরকারীর পাত্রটি মেঘালয়ার কাছে রাখা। খেতে খেতে ইরাজ তরকারী নেয়ার উদ্দেশ্যে মেঘালয়াকে বলল, “তরকারী তুলে দে তো!ʼʼ

মেঘালয়া ইরাজের কথায় পাত্তা না দিয়ে বরং আনতারা খানমের দিকে তাকাল। আশানুরূপ, সে মুখটি গোমরা করে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। মেঘালয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ইরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমার কাছে নয়। মামনির কাছে চান। তার ছেলে আপনি, এবং বাড়ির কর্তী সে।ʼʼ

মেঘালয়ার কথায় ইরাজ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও, আনতারা খানম কেমন করে যেন তাকলেন। মেঘালয়া তা দেখে হেসে ফেলল, “মামনি! তুমি শুধু শুধু ছেলেকে হারানোর চিন্তায় কাহিল হয়ে পড়ছো। ভেগে যাব না তাকে নিয়ে। চান্সই নেই, মামনি! বিশ্বাস করো, তোমার ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেরকমও নয়, যেমনটা রাস্তায় পরিচিত কারো সাথে হয়। তুমি শুধু শুধু এসব সস্তা ভাবনা, আর আচরণ দিয়ে নিজেকে তথাকথিত সকল মূর্খ শাশুড়ির মতো বানিয়ে তুলছো। তোমার কাছে যদিও এমনটা আশা ছিল না। তবে কি আর করার, তুমি যদি শাশুড়ি হয়ে ওঠো, আমারও বউমা হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না। তুমি শেখাবে আচরণ, আমি শিখব। যাহোক, নাও ছেলেকে নিজের হাতে খাওয়াও। ওসব দায়িত্ব পালন; এমনকি সংসারে কোন বিশেষ আগ্রহ নেই আমার।ʼʼ

আনতারা খানম মেঘালয়ার মুখের কথাগুলো শুনে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেলেন। কেবল বিষ্মিত চোখে চেয়ে রইলেন মেঘালয়ার দিকে। আরো অবাক হলেন, যখন দেখলেন মেঘালয়ার করা এরকম নিরব অপমানের পরিপেক্ষিতে ইরাজ বা ওর বাবা কোনরকম কিছুই বলেনি। বরং স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে। ইমতিয়াজ সাহেব খাচ্ছেন, আর ইরাজ তরকারীর অপেক্ষায় গম্ভীর মুখে বসে আছে।

_
রুমে এসে ইরাজ বসল বিছানার ওপর। মেঘালয়ার তার আগেই চলে এসেছে। খানিক বাদে মেঘালয়াকে ডেকে উঠল, “মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া বই থেকে মুখ না তুলে জবাব দিল, “হু!ʼʼ

“কয়েল জ্বালিয়েছিস?ʼʼ

মেঘালয়া তাকাল একবার, আবার নিচের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দিল, “হু।ʼʼ

“কেন?ʼʼ

মেঘালয়া বিরক্ত হয়ে তাকাল, “মশার কয়েল কেন জ্বালানো হয়?ʼʼ

“তোকে প্রশ্ন করতে বলেছি? নাকি উত্তর চেয়েছি?ʼʼ

“আপনার এরকম যুক্তিহীন প্রশ্নের কোন জবাব নেই আমার কাছে।ʼʼ

“নিভিয়ে দে। এক্ষুনি।ʼʼ

মেঘালয়া রেগে উঠল। চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বলল, “কী সমস্যা আপনার?ʼʼ

ইরাজ চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায়। মেঘালয়া চোয়াল শক্ত করে চেয়ে আছে। ইরাজ খোঁচা মেরে বলল, “গরীবের মেয়ে হলে তাও নাহয় বলতাম, বাপের বাড়ি এসি নেই, তুই কী করে বুঝবি, এসি চলা অবস্থায় কয়েল জ্বললে ধোঁয়া গুলো সব নাকে মুখে ঢোকে, আজরাইল সামনে এসে হাজির হওয়ার আশংকা থাকে। বা ল ডা এলার্জি আছে আমার। এক্ষুনি কাশি শুরু হবে। ফেলে দে কয়েল।ʼʼ

শেষের কথাটা এত জোরে ধমকে বলেছে ইরাজ, বন্ধ ঘরে বেজে উঠল চারদিকে। মেঘালয়া কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ইরাজের দিকে। শান্ত স্বরে বলল, “সিগারেটের পাঁজা পাঁজা ধোঁয়া গিলে হজম করে ফেলছেন অনায়াসে, কয়েলের ধোঁয়ায় ইন্তেকাল হয়ে যাবে, আপনার?ʼʼ

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আবার মুখটা স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করল, “অ্যারোসোল নেই?ʼʼ

“থাকলে কয়েল জ্বালিয়ে আপনার সাথে এই মধুর আলাপন করার শখ ছিল না আমার।ʼʼ

বলেই মেঘালয়া উঠে গিয়ে কয়েলের জলন্ত পাশের কিছুটা ভেঙে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে সেটা ফেলে দিয়ে এসে আবার পড়তে বসল।

প্রায় আধাঘন্টা পার হয়েছে। মেঘালয়া পড়ছে বসে। ইরাজ শুয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তবে ঘুম তাকে ধরা দিচ্ছে না। এপাশ-ওপাশ করে কেটে গেছে এতক্ষণ। অতিষ্ট হয়ে উঠে বসল। সোফার দিকে তাকাল, মেঘালয়া পড়ছে। ডাকল, “মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া বিরক্ত হয়ে তাকায়। রুমে মৃদূ আলো জ্বলছে। মেঘালয়া টেবিলল্যাম্পের আলোতে পড়ছে। তাই মেঘালয়া যে ফিরে তাকিয়েছে তা বুঝা গেলেও মেঘালয়ার বিরক্তিভরা চেহারা হয়ত টের পাওয়া গেল না।

“কয়েল জ্বালিয়ে দে।ʼʼ

মুহুর্তের মধ্যে ক্ষেপে উঠল মেঘালয়া এমন একটা কথা শুনে। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “এই বন্ধ ঘরে এখন মরবেন না, আপনি?ʼʼ

ইরাজ ভাবলেশহীন জবাব দেয়, “মরলেও ঘুমিয়ে মরা ভালো। ঘুমোতে না পারলেও এমনিতেই অসুস্থ হয়ে মরে যাব। কথা কম বল, কয়েল জ্বালিয়ে দে।ʼʼ

“পারব না।ʼʼ

মনে হলো না মেঘালয়ার কথা ইরাজের কানে গিয়েছে। ইরাজ মেঘালয়ার ‘পারব না’ কথার পরিপেক্ষিতে ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “হুম। তাড়াতাড়ি জ্বালিয়ে দে।ʼʼ

এমনিতে মেঘালয়ার নিজেরও মশা লাগছে টুকটাক। বিরক্তিতে বুদ হয়ে উঠে দাঁড়াল। ইরাজকে বলল, “এসি অফ করুন। বারান্দার দরজা খুলে দিই, ঠান্ডা বাতাস আসবে।ʼʼ

ইরাজ এসি অফ করে দিল। মেঘালয়া কয়েল জ্বালিয়ে আবার এসে বসল নিজের জায়গায়। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। বই,খাতা গুছিয়ে রেখে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো। যদিও সে জানে চেষ্টা বৃথা। ঘুম আসবে না।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ-ই রুমের আলো জ্বেলে ওঠায় মেঘালয়া চোখ খুলে তাকাল। দেখল ইরাজ টিশার্ট গায়ে দিচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, আবার তাকাল। আশ্চর্য! টিশার্ট কেন গায়ে দিচ্ছে! সে নাকি ঘুমাবে জন্য কয়েল জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এখন কোথায় বেরোবে? বিনা কারনে কয়েল জ্বালিয়ে নিয়েছে! মেঘালয়া হতাশ এক নিঃশ্বাস ফেলল। আল্লাহ তার সাথে এ কাকে জুড়ে দিয়েছে! এমন ছন্নছাড়া মানুষই কেন তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে হলো। ঘরের আলো নিভিয়ে ইরাজ দরজা খুলে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে। মেঘালয়া শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘুম নেই চোখে। আস্তে করে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। হালকা হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। মনটা আবারও এই অগোছালো, চলমান, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে যায় তার।


ইরাজ আম্মুর রুমের সামনে এসে দেখল, দরজা চাপিয়ে রাখা রুমের। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কয়েকবার ডাক দিল ‘আম্মু’ বলে। এই ডাকের মাঝে জানান দিল, সে এসেছে, এবং প্রবেশের অনুমতিও চেয়ে নিলো যেন! তার মতো ঘাঁড় ত্যাড়া তো আর সোজা কথায় অনুমতি নিয়ে ঢুকবে না!

দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে দেখল আব্বু বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। আনতারা খানম জায়নামাযে বসা। ইরাজের ভ্রু কুঁচকে গেল। এ সময় কোন ওয়াক্তের নামাযে বসেছে আম্মা! নাকি নফল নামাযে বসেছে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, আনতারা খানম মোনাজাতে বসেছেন। ঘরে জ্বলে থাকা মৃদু আলোতে ঝাপসা ভাবে দেখতে পেল মায়ের কান্নাজড়িত মুখখানা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। আনতারা খানম ওকে দেখে যেন আরো লম্বা করছে মোনাজাত। তা হয়ত বুঝল ইরাজ। চেয়ার টেনে বসল পাশে। একটু ঝুঁকে বলল, “আম্মা! তোমার মোনাজাত কিন্ত আমি আসার আগেই শেষ। আমি এসেছি টের পেয়ে আবার হাত তুলেছ, দেখে ফেলেছি আমি। এবার কী হবে?ʼʼ

আনতারা খানমের কী হলো কে জানে! হাত নামিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন এবার তিনি। ইরাজ ঘাঁড় ঝাঁকিয়ে চেয়ার সরিয়ে আম্মার পাশে নিচে বসল। গালটা ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। আনতারা অভিমানে ইরাজের হাতটা সরিয়ে দিতে চাইলে ইরাজ আরও খানিকটা চেপে ধরল। নিজের দিকে মুখ উচিয়ে ধরে, চোখে চোখ রেখে বলল, “কী হয়েছে? কাদছো কেন?ʼʼ

আনতারা খানম জবাব দিলেন না। একফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল ছেলের দিকে তাকিয়ে। ইরাজ একটু হাসল। বলল, “তখন মেঘের কথার জবাবে কিছু বলিনি বলে আল্লাহর কাছে আমার নামে নালিশ করছিলে?ʼʼ

কান্নাভেজা স্বরেই আনতারা বললেন, “না। সর, যা এখন।ʼʼ

“এত অনুগত, ভদ্র ছেলে তো নই আমি, তুমি বললেই চলে যাব?ʼʼ

আনতারা খানম মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ইরাজ আবারও নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “আম্মা! আজ মেঘ তোমাকে বলেছে, কিছু বলিনি। ও আজ প্রথমবার বলেছে। তুমি ওকে যখন কটুক্তি করেছ, ধিক্কারজনক কথা শুনিয়েছ, অপমান করেছ, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ; ও কিন্ত সবটা শুধু সহ্য করে গেছে। তখন তোমাকেও কিন্ত কিছু বলিনি।ʼʼ

“ওহ! তোর বউ, আর তোরা বাপ-ছেলে মিলে বদলা নিচ্ছিস?ʼʼ

“এরকম অবুঝ তো তুমি নও। তাহলে এভাবে কথা পেচানোর মানে কী?ʼʼ

“অবুঝই তো। তাই তো নিজের ছেলের মন বুঝতে
পারিনি।ʼʼ

ইরাজ একটা শ্বাস নিয়ে ঠেসে বসল এবার। বলল, “মেঘের প্রতি তোমার রাগটা কিসে? ও অন্যকারো সাথে চলে গিয়েছিল বলে? এ কথাটা বিয়ের আগে তোমায় জানানো হয়নি বলে? অথবা অন্যকিছু? এই মেঘালয়াকে তোমার চেয়ে ভালো কখনও আব্বুও বাসতে পারেনি। হঠাৎ-ই এমন কি হলো, সে তোমার চোখের বিষ হয়ে উঠল?ʼʼ

আনতারা খানম জবাব দিতে পারলেন না। ইরাজ আবার বলল, “যেভাবেই হোক, যাই হোক; মেঘ এখন বাড়ির বউ, আম্মা! আর পাঁচটা শাশুড়ির মতো আচরণ করে বাড়ির পরিবেশটাকে নাটকীয় করে তুলো না। এবার এটা বোলো না, আমি আমার বউয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলছি। তুমি নিজেও জানো তোমার এই আচরণ নিতান্তই যুক্তিহীন। কোন পুরুষের জীবনেই মা আর বউয়ের স্থান কখনোই এক হয় না, আম্মা। সকলের জন্য আলাদা আলাদা জায়গা থাকে মানুষের ভেতরে।ʼʼ

একটু থামল ইরাজ। আনতারা খানম নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইরাজ আবার বলল, “আর এমনিতেও মেঘের সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। তুমি যা ভেবে ওকে নিজের শত্রু ভেবে বসেছ, তা কেবল মূর্খতা, আম্মা! ও চাইলেও তোমার জায়গা নিতে পারবে না। আই থিংক, সেই জাতের মেয়েই না, মেঘ। সংসারের প্রতি কোন আগ্রহ নেই ওর। তবুও হেলাল আঙ্কেলের জন্য এতদিনে অনেক চেষ্টা করেছে এ বাড়িতে নিজের একটু জায়গা তৈরী করার। সুযোগ দেওয়া হয়নি। ছোটো মানুষ, এবার যদি ও আরো বিগড়ে যায়, তার দ্বায়ভার কাদের?ʼʼ

আনতারা খানম যেন খুব বুঝেছেন এমন ভঙ্গিমায় মাথা দুলালেন। নাক টানলেন কয়েকবার মৃদূ আওয়াজে। এরপর আচমকা জিজ্ঞেস করে উঠলেন,

“তোর এত ভালোবাসার পরেও তোদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয় কেন, রাজ? ছোটোবেলা থেকে ভালোবেসে গেলি, তুই। নজরে নজরে রেখে, নিরব যত্নে নিরাপত্তা দিয়ে বড়ো করে তুললি তুই। সেই নিমকহারাম মেয়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে তোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পালিয়ে গেল। তাকে তুই বাড়ির বউ করে আনলি, আর আমি ফুল চন্দন দিয়ে বরন করে নেব? ভুলে যাস না, রাজ! আমি তোরই মা। তুই আমারই গর্ভের নাঁড়ি-ছেঁড়া ধন। মেঘাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না। আর না ওকে আবার আপন করে নিতে পারব। যে মেয়ের চেহারা দেখলে আমার ছেলের বুক ফাঁটা যন্ত্রনার আভাস পাই, তাকে কোলে ঠাঁই দেওয়া যায় না। আমি ওকে মায়ের মতো ভালোবেসেছি, মায়ায় জড়িয়ে রেখেছিল ওর নিষ্পাপ মুখখানি। জানতাম না এত নিষ্ঠুর আর পাষাণ্ড সেই মেয়ের ভেতর। কী করে পারল তোর ভালোবাসাকে ঠুকরে অন্যের হয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে? হয়ে যেতও তো এতদিনে। যদি না সেদিন সেই ছেলে ওকে ছুঁড়ে না ফেলত। তখন তুই কী করতি? নেশাখোর হয়ে ঘুরে বেড়াতি, তাকিয়ে দেখতাম তোর ধ্বংস মা হয়ে? এখনই বা কী সুখে আছিস? আয়নায় দেখেছিস নিজের চেহারা? সিগারেটে পোড়া কালো ঠোঁট। ঘুমের অভাবে কালি পড়ে যাওয়া চোখ? তোর ওই বিষাদভরা, এলোমেলো ছন্নছাড়া হাসি বুঝি না, আমি?ʼʼ

আম্মুর বলা কথাগুলতে ইরাজের চটা পড়ে ঘা’য়ে আবারও যেন খোঁচা লাগল। বুকটা রক্তাক্ত হয়ে উঠল আবারও। উদ্ভ্রান্তের মতো বসে রইল নির্বিকার চাহনিতে। আম্মুর অভিযোগ গুলো তো ফেলা যায় না! যে কথাগুলো ইরাজকে প্রতিক্ষণে তুষের আগুনে পুড়িয়ে মারছে, আম্মু সেই কথাগুলো এত অকপটে জানতে পারল কি করে? আচমকা পা গুটিয়ে আম্মুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল ইরাজ। আনতারার বুকটা ভিজে ওঠে। ইরাজ বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, “আমি তো কোনদিন প্রকাশ করিনি আমার ভালোবাসা, আম্মু! তাই হয়ত, মেঘ বুঝতে
পারেনি!ʼʼ

আনতারা খানম মলিন হাসলেন, “এতদিন তুই যেভাবে, মিষ্টি শাসনে আগলে রেখেছিল ওকে, অন্য মেয়ে হলে, তোর মায়ায় জড়িয়ে তোর প্রেমে পাগলি হয়ে যেত। সব কথাই কি মুখে স্বীকার করতে হয়, রাজ! অন্তত, ভালোবাসা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষনা করে বেড়ানোর কিছু নয়। এ অনুভূতি বড়োই গোপন, আর তীব্র।ʼʼ

“ও বুঝতে পারেনি, ওর এই সরলতাই তো বড়ো টানত আমায়, আম্মু!ʼʼ

“তোর আর সাফাই গাইতে হবে না ওর হয়ে। তোর পাহাড়ের সম উচ্চ ভালোবাসা বুঝতে পারল না, আর ওই লম্পটের মিথ্যে ভালোবাসায় তার হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। হাহ!ʼʼ— তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন আনতারা।

ইরাজ আর কী বলবে এ কথার পরিপেক্ষিতে। আম্মা যে ওর বুকের সবটুকু জ্বালা মুখস্ত করে বসে আছে! তড়াক করে উঠে বসল। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিল বাইরের দিকে। আনতারা খানম কেবল বিষন্ন মুখে পেছনে চেয়ে দেখলেন বিক্ষিপ্ত, অশান্ত হয়ে ওঠা ইরাজের অগোছালো পদচারনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়নামাজ উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ইরাজ আম্মুর রুম থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বুকটা ভার লাগছে। বিষাদ ঘিরে ধরেছে চক্রাকারে। কোনভাবেই এখন রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। ধীর পায়ে হেলেদুলে হেঁটে বসার রুমে প্রবেশ করল। সেখানে সোফার পেছন থেকে দুটো বোতল দুহাতে বের করে নিয়ে ছাদের দিকে চলে গেল। এখন ইচ্ছে মতো গলায় ঢাললে, এই নেশা হয়ত ভুলিয়ে রাখবে বুকের ক্ষত-বিক্ষত হয়ে থাকা ঘা গুলোর যন্ত্রনা!

আনতারা বিছানায় গিয়ে ঘুমোতে অগ্রসর হলে, ইমতিয়াজ সাহেব বলে উঠলেন, “এক গ্লাস পানি ঢেলে দাও তো!ʼʼ

আনতারা চমকে উঠলেন, তাহলে কী ইমতিয়াজ সাহেব ঘুমাননি! তিনি চমকিত চিত্তেই গ্লাসে পানি ঢালতে ব্যস্ত হলেন। ইমতিয়াজ সাহেবের গলাটা কেমন যেন লাগল শুনতে! তিনি মা-ছেলের কথা সব শুনেছেন এতক্ষণে!

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১৩+১৪

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৩.

মাঝরাত। রুমে মৃদূ লাল আলো জ্বলছে। বাইরে খুব বেশি নয় তবে হালকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। আর তাতে খোলা জানালার পর্দাগুলো নড়েচড়ে উঠছে বারবার।
মেঘালয়া সোফার ওপর চিত হয়ে শুয়ে ঘাঁড় কাঁত করে উদাসীন চোখে তা দেখতে নিমগ্ন। চোখে ঘুম নেই। সে ঘুমানোর চেষ্টা করছেও না। বরং হাওয়ায় দুলতে থাকা ওই চঞ্চল পর্দার মাঝে কিছু খোঁজার চেষ্টায় রত সে।

ইরাজকে রাত এগারোটার দিকে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ শরীর, সে নিশ্চয়ই ঘুমে আচ্ছন্ন! একদমই নয়। বরং সে মেঘালয়ার ঘুমিয়ে পড়া নিয়ে ভাবছে। ঘড়ির কাঁটা যখন রাত দেড়টা পার করতে অগ্রসর হয়, ইরাজ খেয়াল করে, অনেকক্ষণ যাবৎ সবকিছু শান্ত একদম। নিশ্চয়ই মেঘালয়া শুয়ে পড়েছে! সে শোয়া থেকে আস্তে করে উঠে বসল। না চাইতেও কেশে উঠল দুবার, সাথে সর্দি টেনে নিলো। আধো-অন্ধকার রুমে ধীর গতিতে চোখ ঘুরাল, মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে এবার।
মেঘালয়া ইরাজের কাশির শব্দে দ্রুত ঘাঁড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায়। তড়িঘড়ি উঠে বসল। উঠে দাঁড়িয়ে আন্দাজ করে হেঁটে গিয়ে রুমের আলো জ্বালিয়ে দিল। দ্রুত পায়ে বিছানায় গিয়ে ইরাজের পাশে বসে উত্তেজিত কণ্ঠে শুধায়,

“খারাপ লাগছে আপনার? কেমন লাগছে? উঠে বসেছেন কেন! কিছু লাগবে..

ইরাজ হাত উঁচিয়ে ধরল। মেঘালয়া থেমে যায়। ধীর-স্থীর স্বরে নিশ্চিন্ত করে, “বিশেষ কিছু হয়নি, তুই ঘুমাস নি?ʼʼ

মেঘালয়া কেবল চেয়ে রয় ইরাজের ঘুরিয়ে রাখা শুকনো মুখের দিকে। করুণ চোখে অনিমেষ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর অদ্ভুত কণ্ঠে, আবেশি গলায় প্রশ্ন করল,

“আপনার নিরবতা প্রতি মুহূর্তে পুড়িয়ে ফেলছে আমায়। অভিযোগ গুলো চেপে কেন রেখেছেন? কিসের এই নিষ্ঠুর নিরবতা?ʼʼ

মেঘালয়ার এই উত্তেজনায় ইরাজ ঠোঁট এলিয়ে মলিন হাসল। ইশারা করল বালিশটা পিঠের পেছনে দিতে। অতঃপর তাতে পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসল। সামনের দেয়ালে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত স্বরে বলল, “মানুষ নিরব হয়ে যায় কখন জানিস? ভাষাগুলো যখন আর্তনাদে পরিণত হয়। আর আর্তনাদ তো বুকের র ক্তক্ষরণ! যা নিতান্তই ভেতর চিরে বয়ে যায় ভেতরেই। তা লোক-সম্মুখে প্রকাশ করার নয়, মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া সজল চোখে চেয়ে আছে এই নতুন ইরাজের দিকে। যে ইরাজকে সে এই মুহুর্তে আবিষ্কার করেছে, যাকে আগে কখনও দেখেনি। ইরাজের বলা কথাগুলোর গভিরতা কি মেঘালয়ার বোধগম্য হলো! কে জানে! তবে মেঘালয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে সামান্য হাসল। সে হাসিতে কি বিষাদ ঝরে পড়ল না!

“অভিমান জমেছে?ʼʼ

“নেই।ʼʼ

ইরাজের এই সংক্ষিপ্ত জবাবে মেঘালয়া যেন ছটফটিয়ে ওঠে। মুখটা নত করে বিষন্ন হাসল একটু, হাসিমুখেই জিজ্ঞেস বলল, “তা ভালো।ʼʼ একটু থামল, আবার জিজ্ঞেস করল, “কখনও ভালোবেসেছেন?ʼʼ

দেয়ালের দিকে নজর থামিয়ে ভরাট গলায় জবাব দেয় ইরাজ, “না।ʼʼ

“ঘৃনা করেছেন?ʼʼ

“করতে চেয়েছি, চাচ্ছি, তবে পারছি কতটুকু তা অজানা।ʼʼ

মেঘালয়া চোখ তুলে তাকাল। চোখের পলক ঝাপটে তা সন্তর্পণে নামিয়ে নিল নিচে। কিছুসময় চুপ রইল। ইরাজ চোখ বুঁজে নেয়। হেলান দিয়ে শুয়ে রয় ওভাবেই। মেঘালয়া আবারও চোখ তুলে তাকায় ইরাজের দিকে। সে ইরাজকে বুঝেও যেন বুঝে উঠছে না! সে যা ভাবতে চায়, ইরাজের আচরণ তার উল্টোটা বলে সর্বদা। আজ অবধি কখনোই ইরাজকে তার দিকে অনুরাগের নজরে তাকাতে দেখে নি মেঘালয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আস্তে করে। জিজ্ঞেস করল,

“কাল বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন কেন?ʼʼ

“মেঘ ভিজিয়েছে।ʼʼ

“মেঘ আপনাকে কতটা ভিজিয়েছে?ʼʼ

“যতটা ভিজলে বুকের হাহাকার আরও বেড়ে যায়।ʼʼ

মেঘালয়া অবাক চোখে তাকায়। এই ইরাজকে সে আসলেই গুলিয়ে ফেলছে। ইরাজের সঙ্গে মিলছে না মোটেই। তবে তার বোঝায় ভুল হয়েছে বলে মনে হয় না। সে সঠিক বুঝেছে, সে জানতে পেরেছে ইরাজের ভেতরে লুকায়িত আরেক ইরাজকে। অজান্তেই খানিকটা পুলকিত বোধ করল। সে অবাক হয় নিজের ভাবনার ওপর। চরম অপছন্দের মানুষটি তার সম্মুখে, যে– মেঘালয়ার সঙ্গে কখনও ভালো আচরণ করেনি, মিষ্টি করে কথা বলেনি, সর্বদা কড়া শাসন, কড়া আর খোঁচা দেওয়া কথা। নিদারুন অপছন্দের পুরুষ। অথচ আজ সেই পুরুষের ভেতরের লুকায়িত ক্ষোভকে খানিকটা জানতে পেরে এত খুশি কেন লাগছে!

“মেঘকে ক্ষমা করবেন না?ʼʼ

“এ প্রশ্ন কেন উঠছে?ʼʼ

“ওঠা উচিত নয়?ʼʼ

ইরাজ তাকাল মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়া চোখ সরায় না, সাহস করে চেয়ে রইল ইরাজের চোখের দিকে। ইরাজ নিজেই নজর ঘুরিয়ে নেয়। অসুস্থ শরীরেই তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল, দেখতে অদ্ভুত লাগে সেই হাসি।

“বিজ্ঞের মতো কথা বলছিস দেখছি।ʼʼ

“জটিল মানুষগুলোর সাথে এত কাছাকাছি বাস করলে কতদিন সরল আর নির্বোধ থাকা যায়?ʼʼ

মেঘালয়ার কথায় ইরাজ এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। বাহ-বা দেওয়ার মতো করে ঠোঁট বাঁকাল সামান্য। তারপরেই মুখটা কুঁচকে ডানহাতে বুক চেপে ধরল। হাঁ করে জোরে টেনে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে। মেঘালয়া ব্যাস্ত হয়ে ওঠে, উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে উদ্যেত হয়। ইরাজ থামিয়ে দিল,

“উমম! এভাবে নয়, এসব পোষায় না আমার।ʼʼ —অতঃপর বুকের বামপাশে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করল, “এখানে ব্যাথা লাগে। দূরেই ঠিক আছিস।ʼʼ

মেঘালয়া অসহায়ের মতো নির্বাক চোখে চেয়ে রইল এই কঠিন, নির্দয় পুরুষটির দিকে। সে তার জবাব পেয়ে গেল যেন ইরাজের এই অভিব্যাক্তির মাঝে– মেঘকে ক্ষমা করা যায় না। একদমই না।

মেঘালয়া সোফায় এসে বসল। ইরাজ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নেমে দাঁড়াল, মাথা টলমল করছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে জ্বলে যাচ্ছে, চুলকানোর ফলে। গলাসহ ঠোঁটটা কেমন শুকনো লাগল। ওভাবেই পা ফেলল সামনে। কয়েক কদম এগোতেই মাথাটা চক্কর কেটে উঠল। পা ফসকে যায় ইরাজের, নিয়ন্ত্রন হারায় দেহের। পড়ে যেতে নিয়ে হাতের জোর দিয়ে খাটের একপাশ চেপে ধরল। প্রায় বসে পড়ে ইরাজ। চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। ওভাবেই নিচু হয়ে বসে রইল চোখ বন্ধ করে।
ততক্ষনে মেঘালয়া এসে বাহু চেপে ধরল তার। ইরাজ মেঝের ওপর বসে পড়ল এবার। মেঘালয়া ঘাবরে যায়। কিছুসময় পর ইরাজ আস্তে করে মাথা তুলে তাকাল। মেঘালয়া ইরাজের হাতের ভেতরে নিজের হাত ঢুকিয়ে ইরাজের ভরটুকু নিলো। ইরাজ কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল মেঘালয়াকে অবলম্বন করে। মেঘালয়ার অতিরিক্ত ভার অনুভূত হয়, ইরাজের অত বড়ো শরীরের পুরো ভরটাই তার ওপর পড়েছে। তবুও ছাড়ল না।

বুকটা হঠাৎ-ই কেমন যেন করে ওঠে। আজ প্রথমবার মেঘালয়া ইরাজের এত কাছে এসেছে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে অনেকটা। ইরাজকে বাথরুমের দরজার সামনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। ইরাজ দেয়াল ধরে ধীরপায়ে হেঁটে ভেতরে যায়। মেঘালয়া সঙ্গে সঙ্গে বুকটা চেপে ধরল হাত দিয়ে। কিছু একটা অনুভূত হচ্ছে গাঢ়ভাবে। ওভাবেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত রইল ইরাজের বের হওয়ার।

_

দু’দিন কেটে গেছে এর মাঝে। ইরাজ এখন প্রায় সুস্থ তবে ইমতিয়াজ সাহেব কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, অন্তত সপ্তাহখানেক ইরাজ বাইরে বের হবে না। ইরাজকে এভাবে বললে, সে বাইরে বের হওয়ার পর যা হয় তাই করত অবশ্য। খ্যাতিমান ঘাঁড় ত্যাড়া বলে কথা। ইমতিয়াজ সাহেব ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে, আদুরে গলায় স্নেহ জানিয়ে গেছেন। ইরাজ বাবার ওপর বড়োই দুর্বল কিনা!
অগত্যা মুখটা ভোঁতা করে বিছানার ওপর বালিশে হেলান দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। মেঘালয়া সোফায় বসে বই নাড়াচাড়া করছে। একসময় পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র খুলে কিছু অঙ্ক কষায় মনোযোগ দিল।

ইরাজ ল্যাপটপে কোন জরুরী কাজ করছে তা নয়। সে মুভি ডাউনলোড করতে বসেছে। আচমকা মেঘালয়া এসে ধীর পায়ে দাঁড়াল পাশে। টের পেয়েও সেদিকে তাকাল না ইরাজ। সে এক পা গুটিয়ে অপর পা লম্বা করে মেলে বসে আছে। যেখানে মেঘালয়ার বসার জায়গাটা অবশিষ্ট নেই। মেঘালয়া দাঁড়িয়ে রইল, তবুও ইরাজ পা সরাল না। মেঘালয়া কঠিন কিছু বলতে যায়, আবার থেমে গেল। ডাকল, ‘শুনুন!’

ইরাজ তাকাল না, কিছুক্ষন পর জবাব দিল, ‘শুনছি।’

‘পা’টা সরিয়ে বসুন, আমি বসব।’

‘তাতে আমার কী?’

মেঘালয়া জবাব না দিয়ে ইরাজের পা’টা সরিয়ে দিল। তবে মনে হলো, ইরাজ নিজেই জেনো সরিয়ে নিয়িছে, নয়ত মেঘালয়ার ক্ষমতা ছিল না ইরাজের পা সরিয়ে দেয়। হাতে তার বই, খাতা, কলম। ইরাজ একবার তাকিয়ে দেখল তা, অতঃপর প্রতিক্রিয়াহীন আবারও ল্যাপটপে মনোযোগ দিল। মেঘালয়া বই, খাতা মেলে বসল ইরাজের সামনে। কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়েও বলতে না পেরে বসে রয় ওভাবেই। একসময় ইরাজ বিরক্ত হয়ে তাকাল,

‘কি সমস্যা?’

মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র না?’

‘পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হই অথবা অপদার্থবিজ্ঞানের। তোর ফাটছে কেন তাতে?’

মেঘালয়ার যেন সহ্য হলো না এবার। মাড়িতে মাড়ি চেপে চোখ বুঁজে নিলো। ভারী একটা শ্বাস ফেলে মুখটা বিকৃত করে জিজ্ঞেস করল, ‘জিলাপির দোকানে কাজ করতেন?’

‘করব সামনে।’

মেঘালয়ার তাচ্ছিল্য করে উৎসাহের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘খুব ভালো জিলাপি বানাবেন আপনি, আশা করি। কারন, আপনার মগজটা তো স্বাভাবিক নয় বরং জিলাপির আকৃতিরই।’

ইরাজ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ঘাঁড় বাঁকায়। মেঘালয়া শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘একটা সোজা কথাকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে মশার কয়েল বানিয়ে ফেলেন। এরকম জঘন্য মেধা আমদানী করেন কোথা থেকে?’

ইরাজ শান্ত চোখে চেয়ে শীতল জবাব দিল, ‘শুধু ভালো জিলাপি বানানোই না, উন্নতমানের থাপ্পড়ও মারতে পারি আমি।’

মেঘালয়া সায় দেয়, ‘হু হু নিশ্চয়ই। তা অন্তত আমার অজানা নয়।’

ইরাজ এবার বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ফ্যাচফ্যাচ না করে, কাজের কথা থাকলে বল নয়ত বিদায় হ।’

মেঘালয়া কপাল জড়িয়ে ফেলল। একটু সুস্থ হয়েছে কি-না, নিজস্ব রূপে ফিরে এসেছে, হাহ! বইয়ের নির্দিষ্ট পৃষ্ঠার মাঝে আঙুল দিয়ে রেখেছিল। তা খুলে মেলে ধরল বিছানার ওপর। ইরাজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখছে কেবল। মেঘালয়া বইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে জিহ্বা চালিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।

‘এই সূত্রটা বুঝিয়ে দিন।’

ইরাজের জড়িয়ে থাকা ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেল।

‘আমাকে তুই বিনামূল্যে একের ভিতর সব সমস্যার সমাধান পেয়েছিস?’

‘জি না।’

আর কিছু বলতে দিল না ইরাজ, নিজেই বলে উঠল, ‘একাডেমিকে কি করেছিস? এডমিশনে এসে যদি সূত্র পড়াতে হয়।’ একটু থেমে কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলল,

‘ওহহো! তুই তো প্রেমসূত্র মুখস্থে সময় ব্যায় করে ফেলেছিস সব।’

মেঘালয়া প্রতিবাদ করে ওঠে, ‘তাতে আপনার কী?’

ইরাজ নিরব হয়ে গেল হঠাৎ-ই। মেঘালয়ার হাত থেকে বইটা নিলো। জিজ্ঞেস করল, ‘আগে পড়েছিস অধ্যায়টা?’

‘পড়েছিলাম।’

‘মনে আছে কিছু?’

‘কিছুটা।’

‘কিছুটাতে কাজ নেই। আগে ব্যাসিক জানতে হবে।’

মেঘালয়া বাধ্যর মতো ঘাঁড় নাড়ল। ইরাজ বুঝাতে শুরু করল। মেঘালয়ার পড়ার চেয়ে ইরাজে মনোযোগ বেশি। দিন দিন সে নিত্য-নতুন ইরাজকে আবিষ্কার করছে। বারবার গুলিয়ে যায় ইরাজের এত এত জটিল রূপগুলো। কটু কথা শুনিয়ে আবার সেই কাজ যত্নসহকারে করে দেওয়া সমীকরণটা মেঘালয়া মেলাতে পারে না। অদ্ভুত মানুষ ইরাজ– এই ধারণাতেই আটকে যায় বারবার।

ইরাজ খাতা এগিয়ে নিয়ে কলম চাইল। মেঘালয়া কলম এগিয়ে দেয়। ইরাজ সূত্রগুলো আরও ভালোভাবে বুঝানোর উদ্দেশ্যে তা লিখতে শুরু করল। লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করল,

‘রেজাল্ট কবে বেরোবে?’

‘দু সপ্তাহখানেক পর।’

ইরাজ আর কিছু বলল না। মেঘালয়া নিজেই চিন্তিত কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘আচ্ছা যদি ফেইল করি আমি, তাহলে কি হবে?’

ইরাজ ভাবলেশহীন জবাব দিল, ‘কি আর হবে? তোর বাপ কোন অটোরিক্সা ওয়ালার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দেবে।’

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল মেঘালয়া, ‘হ্যাহ!’
কথাটা বুঝে নিজের অজান্তেই মুচকি হেসে ফেলল। বলল, বাপ আমায় বিয়ে তো দিয়ে দিয়েছে, তবে যার সাথে দিয়েছে সে আমি ফেইল করলে রিক্সা চালানো শুরু করলেই হয়।’

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ, এরপরই মাথাটা নিঁচু করে মৃদূ হেসে উঠল যেন! মেঘালয়া বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে দেখল সেই হাসি। হঠাৎ-ই মনটা বেশ হালকা লাগল। আচমকা বলে উঠল,

‘আপনি হাসতেও জানেন নাকি আবার?’

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৪.

ঘন্টাখানেকের মতো পড়ার পর মেঘালয়াকে অলসতা ঘিরে ধরল। কিন্ত ইরাজকে বলতে চেয়েও পারছে না, যে আর পড়তে ভালো লাগছে না। উশখুশ করতে লাগল কেমন। ইরাজ তা লক্ষ্য করে বলল, “এই মনোযোগ নিয়ে আবার পড়ব পড়ব ঢোল পিটিয়ে বেড়াস?ʼʼ

মেঘালয়া অসহায় মুখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “আপনি ভালো আচরণ শিখেন নি?ʼʼ

“ওই অধ্যায় যখন পড়াচ্ছিল, আমি ক্লাসের বাইরে
ছিলাম।ʼʼ

মেঘালয়া এমন একটা ভবঘুরে মার্কা জবাব শুনে অতিষ্ট ভঙ্গিতে মাথা দুলাল। ইরাজ জিজ্ঞেস করে, “কোথায় ভর্তি হওয়ার জন্য লাফাচ্ছিস?ʼʼ

মেঘালয়া শান্ত নজরে তাকাল। একটু ইতস্তত করে বলল,
“লাফালেই তো আর হয়ে যাবে না!ʼʼ

“এ কথাটা মস্তিষ্কের যে অংশ দিয়ে এখন ভাবছিস, আগে তা ব্যাংকে জমা রেখে এসেছিলি?ʼʼ

মেঘালয়া কটমট করে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, “ক্যাকটাস!ʼʼ

ইরাজ কথাটা শুনতে পেয়েছে কি-না তা বোঝার উপায় নেই, তবে বলে উঠল, “গালি দিলে ভালো জাতের গালি দিবি, এসব আওলা-ঝাওলা গালিতে এলার্জি আছে আমার।ʼʼ

ইরাজের কথায় মেঘালয়া মুখ বিকৃত করে তাকাল। আজব মানুষ তো! গালিতে এলার্জি! আর গালি আবার ভালো মানের.. মানে কোন গালি ভালো মানের? গালির কি কোন ব্রান্ড আছে? নিজের ভাবনাতে বিরক্ত হয়ে মাথা ঝাঁকাল।
শান্ত একটা শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন পড়তেন?ʼʼ

“শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।ʼʼ

মেঘালয়া আশা করেনি ইরাজ সোজা জবাব দেবে। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে হয়ত এই প্রথম ইরাজ সোজা উত্তর দিয়েছে। মেঘালয়া আবার জিজ্ঞেস করল, “এটা গুচ্ছতে না?ʼʼ

“হু।ʼʼ

মেঘালয়া উৎসাহিত হয়ে বলে, “তাহলে আমিও গুচ্ছরই কোন ভার্সিটিতে পড়ব। আপনি কি এডমিশনের সময় খুব বেশি পড়তেন?ʼʼ

ইরাজ এবার অপ্রস্তত বোধ করল। ওর অনিয়মিত লেখাপড়া কাউকে অনুপ্রাণিত করার বদলে ফেইল করিয়ে বসিয়ে রাখবে হয়ত। ও নিজে মানিয়ে নিতে পারত ওর নিজের বেপরোয়া চলনের সঙ্গে। কিন্ত আর কাউকে তা দ্বারা অনুপ্রাণিত অন্তত করা যায় না। ভাগ্য আর টুকটাক পরিশ্রমে সাস্টে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। বলল,

“প্রশ্ন কম কর। পারলে বেশি করে পড়। এমনিতেও তোর বাপ জেলার বাইরে যেতে দেবে না।ʼʼ

মেঘালয়া জিজ্ঞেস করল, “ আমাদের যশোরে কি গুচ্ছর বিশ্ববিদ্যালয় আছে?ʼʼ

ইরাজ বিরক্ত হয়ে বলে, “যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তির নাম শুনিস নি?ʼʼ

মেঘালয়া চুপ করে রইল। মনে মনে ঠিক করল, সে ওখানেই পরীক্ষা দেবে। হওয়া না হওয়া উপরওয়ালার হাতে। বই, খাতা গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ-ই মাথায় এলো– ইরাজ কথাগুলো বেশ সহজভাবেই বলেছে। এভাবে বিয়ের পর আজ অবধি কথা হয়নি। হাত থেমে গেল ওর। কিছু প্রশ্ন এসে ভিড় করল মনে। কিছুটা সময় নিলো প্রশ্ন করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে আস্তে করে বলল, “আমার জন্য তাবিরের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, এটাই কি কেবল আমার প্রতি ক্ষোভের কারন আপনার?ʼʼ

ইরাজ উত্তর দিল না বরং নিরবে উঠে দাঁড়াল। এখনও খানিকটা দুর্বলতা আছেই শরীরে। তবুও উঠে দাঁড়িয়ে টি-টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটি হাতে উঠিয়ে নিলো। সোজা হেঁটে বেলকনির দিকে চলে গেল। মেঘালয়ার ভেতরে জিদ চেপে বসে। বইগুলো উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে সোফার টেবিলের ওপর রেখে সেও বেলকনিতে গিয়ে ইরাজের পাশে দাঁড়ায়।

সন্ধ্যার পর অল্প খানিকটা সময় পেরিয়েছে। আকাশ সম্পূর্ণরূপে আঁধারে ঢেকে যায় নি এখনও। পরিবেশ মনোমুগ্ধকর। ইরাজ পকেট হাতরে লাইটার খুঁজল। পেল না। মেজাজ খারাপ হলো প্রচণ্ড।

“মেঘ, লাইটার এনে দে রুম থেকে।ʼʼ

“আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে এসেছেন আপনি।ʼʼ

“তারপর?ʼʼ

“এখন জবাব দিন।ʼʼ

“লাইটার’টা এনে দে।ʼʼ

ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মেঘালয়া, “আমার প্রশ্নের জবাব দিন, কথা কাটবেন না।ʼʼ

ইরাজ তাকাল উত্তেজিত মেঘালয়ার দিকে, চোখে চোখ মিলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, বলল, “আর যদি না দিই?ʼʼ

মেঘালয়ার চোখে-মুখে আক্রোশ ফুটে ওঠে, “আর কতদিন লুকোচুরি খেলবেন। চাপা কথাগুলো খুলে প্রকাশ করার সৎ সাহসটুকু নেই আপনার ভেতরে?ʼʼ

ইরাজ মেঘালয়ার কথায় আবারও হাসল, “আরে! এত উত্তেজনা, আমাকে জানার? অতি উত্তেজনা হানিকারক। শান্ত হ।ʼʼ

মেঘালয়া চোখ বুঁজে জোরে জোরে শ্বাস নেয়, ঠোঁট জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “আমার অপরাধটা কি আপনার কাছে? আপনার কি মনে হয়? আপনার চোখের অবহেলা গুলো বুঝি না আমি? বিয়ের পর থেকে আজ অবধি প্রতি মুহুর্তে যে পরিমাণ লাঞ্ছনা আমি গিলে ফেলেছি ভেতরে, নিতান্তই এক আত্মমর্যাদাহীন আবর্জনাতে পরিণত হয়েছি নিজের কাছে। তবুও প্রতি মুহুর্তে নিজেকে সান্তনা দিয়ে যাচ্ছি, আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এগুলো। তবে আজকাল কি মনে হয় জানেন, আমার ভুলের চেয়ে, মাশুল আমি অনেক গুন বেশি গুনে ফেলেছি। আমি ভুল যত বড়ো না করেছিলাম, আপনারা সকলে মিলে শাস্তি তার চেয়ে অনেকাংশ বেশি দিয়ে ফেলেছেন। এবার নাহয় জবাব দিন।ʼʼ

ইরাজ আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে শুনল মেঘালয়ার অভিযোগী ক্ষোভগুলো। হালকা হাসল। আস্তে আস্তে হাসি মিলিয়ে গিয়ে মুখটা বড্ড হিংস্র হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত পিষে মেঘালয়ার দিকে তাকায়, “শাস্তি তুই দিস নি, আমায়? যখন শুনেছিলাম বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিস অন্য কারো সঙ্গে, এবং তোকে উদ্ধারও আমার করতে যেতে হবে, তোকে ত্যাগ করেছি সেই মুহূর্তে। আর এতদিনের জমানো মসৃণ অনুভূতিতে ত্যাগের ধারাল আঘাত আমায় যা ক্ষত-বিক্ষত করেছিল, তার দাগগুলো আজও থকথকে ঘা হয়ে রয়ে গেছে ভেতরে। প্রতিক্ষণে জ্বলে পুড়ে যায়,
র ক্তা ক্ত হয়ে ওঠে বুকটা। তোকে দেখলেও সেই ক্ষততে খোঁচা লাগে। সেই তুই আমার তো হয়েছিস, তবে আমার অনুভূতিকে ছিন্নভিন্ন করার পর। তুই যতক্ষন চোখের সামনে থাকিস না, বুকের জ্বালা দমে থাকে। সামনে আসলে ধিক-ধিক করে জ্বলে ওঠে।ʼʼ

কথাগুলো বলে আচমকা শান্ত হয়ে উঠল ইরাজ। পরক্ষণে মুহূর্তে অদ্ভুত হেসে, শ্লেষের সঙ্গে বলল, “তুই তো ভুল করে মাশুল গুনছিস। আমি কিসের উত্তাপে পুড়ে ম রছি প্রতিক্ষণে? কারো প্রতি মায়া জন্মে যাওয়ার অপরাধে? সেই মায়াকে নিজ হাতে দাফন করেছি আমি। যা আর কোনদিন উতলে উঠবে না।ʼʼ শেষের কথাগুলোতে তীব্র ঘৃনা প্রকাশ পেল ইরাজের কণ্ঠে।

মেঘালয়া তাকিয়ে রইল কেবল, জবাব দিল না। ইরাজ এবার ঠোঁটটা আরও খানিকটা প্রসারিত করে হাসল। হাসির মাঝে কতশত লুকায়িত যন্ত্রনা ঝরে পড়ছে যেন!

মেঘালয়াও খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে অদ্ভুত গলায়, অবাঞ্ছিত এক প্রশ্ন করে বসল , “ভালোবাসেন, বলতে পারেন নি কেন?ʼʼ

ইরাজ যেন অবাক হলো না এমন একটা প্রশ্নেও। মৃদূ হেসে বলল, “যতদিনে বলব, তার আগেই দেখলাম আমার মেঘের বর্ষনে অন্য কেউ ভিজে উঠেছে। তারপর থেকে আর কোনদিন নিজের কাছেও স্বীকার করিনি– ওই মূর্খ মেঘকে আমি কোনদিন ভালোবেসেছি।ʼʼ

মেঘালয়া টলমলে চোখে ঘুরে তাকাল ইরাজের দিকে। চোখের পানিকে ছাপিয়ে ঠোঁটে হাসল, “অথচ সেই মূর্খতার পরিণাম হিসেবে মেঘকে পুড়াতে এত আয়োজন আপনার? এটাকে ভালোবাসা বলবেন আপনি? যেখানে ভালোবাসার চেয়ে ক্ষোভকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে? আপনার জিদ, অভিযোগ আর যন্ত্রনাগুলো আপনার কাছে এতটা প্রাধান্য পেয়েছে, আপনি সবটা ভুলিয়ে দিয়েছেন– মায়া, ভালোবাসা কিছুই অবশিষ্ট নেই।ʼʼ

ইরাজ শীতল কণ্ঠে বলল, “আমার ঘৃনা, ভালোবাসার চেয়ে বেশি সীমাহীন। আমার ত্যাগের ক্ষমতাকে এড়িয়ে চলা, যে কারো জন্য সাধ্যিহীন।ʼʼ

মেঘালয়া বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল, “ত্যাগ আপনার, সেই ত্যাগের তাপে ঝলসে গেছি আমি।ʼʼ

“সুখে ত্যাগ করিনি। একসময় ছুঁতে চাওয়ার মতো মনস্তাত্বিক অপরাধের দাম পরিশোধ করে, মূল্য চুকিয়ে তারপর ত্যাগ করেছি।ʼʼ

মেঘালয়া প্রশ্ন করে, “ত্যাগের মূল্য কি ছিল?ʼʼ

“মেঘকে আর এ জীবনে নিজের করে পেতে না চাওয়ার জিদ। অথচ শালার, ভাগ্যকে এড়িয়ে যেতে পারলাম কই।ʼʼ

মেঘালয়া হাসল। মুখে হাসি ঝুলিয়েই বলল, “আপনার প্রত্যেকটা কথা প্রমান করছে, ভালোবাসা কম, এ কাহিনিটা মূলত ঘৃনার। তাই পরবর্তিতে আর এই অনুভূতিকে ভালোবাসা বলে অপমান করবেন না।ʼʼ

তিরস্কারের মতো শোনায় যেন মেঘালয়ার কথাটা। একটু থেমে আবার বলল, “ সর্বস্থায় আমার ভুলগুলো সাথে ছিল। আর তাই ভুলগুলোকে বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে এখন আমার। সকলে মিলে যখন আমায় শাস্তি দিতে ব্যস্ত ছিল, তখন ভুলগুলো ছাড়া আমার বলতে আর কিছুকে পাশে পাইনি।ʼʼ

আর দাঁড়াল না মেঘালয়া এক মুহূর্তও। রুমে চলে গেল বিষন্ন পা ফেলে। ইরাজ রয়ে যায় একা। আকাশের বুক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দৃষ্টিপাত করল– মেঘালয়া যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আচমকা ভাবনায় এলো, সত্যিই কি ইরাজ ভালোবাসার চেয়ে যন্ত্রনাগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে? অভিযোগ গুলোকে ভালোবাসার মাঝখানে এনে, ভালোবাসাকে ক্ষয় করে ফেলেছে? নিজের ভাবনায় নিজেই পেচিয়ে যায় যেন! দোটানায় ডুবে গেল। মেঘালয়ার বলে যাওয়া কথাগুলো মস্তিষ্কে চক্রাকারে ঘুরতে থাকল। নিজেই নিজেকে বুঝাল, ইরাজ তো এমনই। তার যন্ত্রনাগুলো তার জন্য স্বরণীয়। তা সে ভুলতে চায় না, আর না চায় যন্ত্রনাদাতাকে মাফ করতে। ইরাজ শেখেনি এসব। সে বিশ্বাস করে, যে একবার ব্যাথার দিতে পারে, তার কাছে বারবার ব্যাথা প্রান্তির আশা রাখাই যায়। তাদের কোন ক্ষমা নেই ইরাজের কাছে।

নিজের ভাবনাগুলো, আর অনুভূতিতে ঠিক মেলাতে পারল না। ভেতরটা অশান্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। তড়িঘড়ি চারপাশে তাকাল। কিছু মনে পড়তেই পেছন ফিরে তাকাল। বেলকনির দেয়ালে ছোটো ছোট তাকের মতো কাঠ দ্বারা শো-পিছ রাখার ছোটো আসবাব বানানো হয়েছে। সেখানকার একটি তাকের মাঝে দিয়াশলাইয়ের বাক্স রাখা আছে।

সিগারেটে টান দিয়ে, ধোঁয়াটুকু মুখের ভেতরে চেপে রাখল কিছু সময়। ভেতটা অস্থির যন্ত্রনায় ঘিরে ধরছে ক্রমশ! ওপরে মুখ তুলে ধোঁয়ার কুন্ডলি ছাড়ল। তা এলোমেলো মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। সেদিকে চেয়ে কেশে উঠল কয়েকবার। থামল না, সিগারেটটা আবারও মুখে পুড়ে নিলো। মনের অগোছালো ব্যথাগুলোকে শান্ত করতে সিগারেটের বিকল্প নেই; বলেই ধারণা ইরাজের!

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১১+১২

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১১.

দুপুর প্রায় দু’টোর কাছাকাছি। ইরাজ গোসল শেষে রুমে এসে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াল। গলায় টাওয়াল ঝুলছে, অর্ধভেজা চুল, মুখটা মাত্রাতিরিক্ত ভারী লাগছে দেখতে।
মেঘালয়া সবে তৈরী হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। তা দেখে ইরাজ জিজ্ঞেস করল,

‘কোন বাণিজ্যে বের হবি তুই?’

এটা কোন প্রশ্নের ধরন হলো? মেঘালয়া এর চেয়ে বেশি কিছু অবশ্য আশাও করেনা ওই ঘাঁড় ত্যাড়ার কাছে।অসন্তুষ্ট নজরে চেয়ে বলল, ‘আব্বুর কাছে যাব।’

ইরাজ বলল, ‘তো?’

‘আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আর এর বিপরীতে কোন উল্টোপাল্টা কথা নয়।’

ইরাজ এ পর্যায়ে কিছু বলল না। মাথায় কয়েকবার টাওয়াল চালিয়ে টাওয়ালটা ছুঁড়ে মারল কোন একদিকে। এমন একটা দৃশ্য দেখে, রাগ উঠল মেঘালয়ার। কিছুক্ষন আগে ইরাজের অবুঝের মতো আচরণে এমনিতেই চটে আছে মেঘালয়া। এখন আবার এমন একটা কাজ। প্রায় চিৎকার করেই বলল,

‘আপনি গণ্ডমূর্খের চেয়েও অতি মূর্খ। টাওয়ালটা কোথায় ফেললেন, আর পড়লই বা কোথায়? সারাদিন রুমে থাকি আমি, রুমটাকে গুছিয়ে রাখি আমি। তা লণ্ডভণ্ড করেন আপনি, রুমের দাবিও করেন আপনি। যুক্তির বড়োই অভাব আপনার কর্মকান্ডে।’

ইরাজ ঘুরে তাকায়। ভাবলেশহীনভাবে আবার সামনের দিকে ফিরে তাকিয়ে নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘এক্সাক্টলি। রুমটা তো আমার, অথচ থাকিস তুই। এর ভাড়া তো আর তোর বাপে দেয় না। ভাড়ার বদলে রুমটা গুছিয়ে রাখিস। এ নিয়ে প্যানপ্যান করলে কানটা এক চড়ে গরম করে দেব।’

বলেই বিছানার ওপর থেকে ব্লেজারটা তুলে মেঘালয়ার ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘এটা আয়রন কর।’

মেঘালয়া সেটা হাতে ধরে বলল, ‘পারব না। আমি আপনার বেতনভুক্ত কর্মচারী না। আর আপনার এই মরুভুমি মার্কা বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকার মতো বোকা আমি নই। আজই যাচ্ছি আমার বাপের বাড়ি।’

শেষের কথাটিতে ইরাজ উপহাস করে হেসে ওঠে। বলল, ‘তা যা। আমার রুম খালি হোক, হাওয়া বাতাস আসুক। তবে এ কদিন যে থেকেছিস বিনা পয়সায়, তার বদলে আমার ব্লেজার আয়রন করে রেখে আস্তে করে চলে যা।’

মেঘালয়া কপাল জড়িয়ে ফেলল। ব্লেজার হাতে নিয়ে ইরাজের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাচ্ছেন কোথায়?’

‘জবাবদিহি করতে পারব না।’

‘আমিও।’

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমিও কী?’

‘আয়রন করতে পারব না।’

‘সময় খুব কম। কাজ না হলে তোর ঘটে শনি আছে।’

মেঘালয়া বলে উঠল, ‘ শনি থাক অথবা রবি। আমি যাব আপনার সঙ্গে।’

ইরাজ ঘুরে তাকাল। মেঘালয়াকে দেখল পরখ করে। অতঃপর খানিকটা পেছনে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুপাশে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তোর থেকে যথেষ্ট দূরে। তোকে ধরে রেখেছি বলে তো মনে হয় না।’

মেঘালয়া গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। নয়ত কোথাও একা বের হব, যা নয় তা কথা শুনতে হবে। এখন থেকে আপনার সঙ্গে বের হব।’ মেঘালয়ার কথায় চাপা ক্ষোভ ঝরে পড়ে।

ইরাজ তা বুঝেও বুঝল না যেন। উল্টো ওকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘তোর বাপের রাখা রক্ষী আমি তোর?’

মেঘালয়া আওয়াজ সামান্য নিঁচু করে বলল, ‘আপনি কী, তা আপনার নিজের জানা উচিত।’

বলেই ব্লেজারটি নিয়ে আয়রন করতে বসে গেল। ইরাজ বিছানায় বসে রিমোট হাতে তুলে নিয়ে এসির টেমপারেচার কমিয়ে দেয়। চারদিকে গুমোট গরম। পরিবেশ কেমন থেমে আছে। গাছের পাতা ভুলেও নড়ছে না। শান্ত পরিবেশে গরমটা প্রকট লাগছে। ইরাজ অতিষ্ট হয়ে তাড়া দিয়ে বলল,

‘দ্রুত কর, লেইট হচ্ছি আমি।’

মেঘালয়ার কিছুক্ষন ধরেই কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ইরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে চাই।’

ইরাজ উপহাস করে, ‘তোর রেজাল্ট কি আসবে কোন আইডিয়া আছে?’

এ কথা শুনে মেঘালয়া থমকে যায়। নিজেও চিন্তিত হয়ে উঠল। ইন্টারমিডিয়েট লাইফটায় সে আসলেই বড্ড অমনোযোগী ছিল। সর্বক্ষন তাবিরের জ্বালাতনে পড়ালেখার মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই ততক্ষনে হাত থেমে গেছে ওর। ইরাজ তাকিয়ে দেখল মেঘালয়ার উদাসীন ভাব। ভেতরে কেন জানি জ্বলে উঠল বোধহয়! ক্ষিপ্র গতিতে দ্রুত পায়ে উঠে এসে তড়াক করে ওর হাত থেকে আয়রন কেড়ে নিল। থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে হাত এগিয়ে নিয়ে যায়। মেঘালয়া চমকে উঠে ঘাঁড় কাঁত করল। ইরাজ কিছু একটা বলে বকে উঠল অস্পষ্ট স্বরে। ব্লেজারটা যদিও পুড়ে যায়নি তবে তা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। তা আর গায়ে চড়াল না। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,

‘আমার কোন কিছুতেই তুই মনোযোগ দিতে পারিস না, না? আমি তোর কাছে চিরদিন গুরুত্বহীনই থেকে গেলাম?
বা লে র একটা ছোট্র কাজ দিলাম, তার মধ্যে অন্য ভাবনার সাগরে ডুব দিয়েছিস? ডুবে মরে যাসনি?’

বলেই শার্ট তুলে কাঁধে চড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। মেঘালয়া কেবল মেঝের দিকে চেয়ে রয় নিরবে। ইরাজ কি বুঝাতে চায়! ইরাজ কি চায়! ইরাজ আচমকা ক্ষেপে ওঠে, কখনও স্বাভাবিক, কখনও দুষ্ট তো কখনও কেমন জটিল হয়ে ওঠে। এতসবের মাঝে মেঘালয়ার নিজেকেই কেমন উন্মাদ উন্মাদ লাগে। ক্ষুধাও লেগেছে এবার। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। আর বসে রইল না, রুম থেকে বেড়িয়ে ডাইনিং রুমে এলো। ততক্ষনে ইরাজ আপন মনে খেতে বসেছে। তবে আজ আরআনতারা খানমকে প্রতিদিনের মতো পাশে দাঁড়িয়ে আহ্লাদের সঙ্গে ইরাজকে খাওয়াতে দেখা গেল না। মেঘালয়া এসে দেখল, খাবার সব সাজিয়ে রাখা আছে। সে দীর্ঘশ্বাসটুকু গোপন করে নিরবে খেতে বসল।

গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। ইরাজের চেহারা গুরুগম্ভীর। স্থির চোখদুটো সামনের গাড়ির কাঁচ ভেদ করে রাস্তা মেপে গাড়ি চালনায় ব্যস্ত। মেঘালয়া দেখল, ইরাজ ওদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরিয়েছে। আর চুপ করে থাকা হলো না। জিজ্ঞেস করল,

‘এদিকে কেন? আব্বু তো এখন অফিসে..

ইরাজের কথায় থেমে গেল, ‘আজ বাড়িতে আছে।’ সংক্ষিপ্ত জবাব। শীতল স্বর। মেঘালয়া একবার তাকাল ইরাজের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তের সকল মগ্নতা ড্রাইভিংয়ে। অথচ মেঘালয়ার অন্য কিছু মনে হয়। যেন ইরাজ কোন এক অজানা উদাসীনতায় বুদ হয়ে আছে।

মেঘালয়াদের বাড়ির সম্মুখে এসে গাড়ি থামল। মেঘালয়া নিঃশব্দে নেমে দাঁড়াল। তবে ভেতরে যেতে অগ্রসর হলো না, আর না ইরাজ গাড়ি স্টার্ট করল। সামান্য কিছুসময় দুজনেই নিরবতায় কাটিয়ে, তা ভঙ্গ করতে চায় মেঘালয়া। ঠোঁট দিয়ে অপর ঠোঁট চেপে ধরল। কিছু বলার জন্য হাঁ করেও আবার থেমে যায়। ইরাজ অদ্ভুত আওয়াজে জিজ্ঞেস করে ওঠে,

‘একা ফিরতে পারবি?’

মেঘালয়া পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজও ঠিক ওই মুহুর্তে ওর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় অপরিকল্পিত ভাবে দুজনের। মেঘালয়া দ্রুত চোখের নজর নত করল। আস্তে ধীরে দু’দিকে ঘাঁড় নাড়ল। ইরাজ আচমকা শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে ধমকে ওঠে,

‘একা বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারিস, তবে একা ফিরতে পারিস না। ন্যাকামি!’

মেঘালয়া অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করে ওঠে, ‘এ কথা আর কতদিন শোনাবেন?’

দৃঢ় কণ্ঠে জবাব এলো, ‘আজীবন।’

মেঘালয়া সচকিত হয়। খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো এ মুহূর্তে, তাহলে কি আজীবন সঙ্গে রাখবেন! অন্তত এ কথা শোনানোর জন্য হলেও!

মুখে বলতে পারল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দুপুরের তেজ্বী সূর্যের তীর্যক তাপময় আলোর নিচে। ঘেমে উঠছে শরীর, তবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যেন! ইরাজ আদেশ করল, ‘যা ভেতরে যা।’

বলেই আবার কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর তোর পাঠ্যবই গুলো সঙ্গে নিবি।’

মেঘালয়ার মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই একটু চমকাল, সঙ্গে সঙ্গে আবার মনটা খুশিতে নেচে উঠল যেন। দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ইরাজের দিকে। সে গাড়ি স্টার্ট করতে ব্যস্ত। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে,

‘কখন আসবেন আপনি?’

ইরাজ সামনের দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, ‘এসে কল করব তোর বাপের বাড়ির নাম্বারে।’ বলে আর দাঁড়াল না। মেঘালয়াকে ফেলে, গাড়ি এগিয়ে চলল সামনের দিকে।

_

বিকেলের দিকে প্রকৃতি বেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে, চারদিকে বয়ে যাওয়া বাতাস জানান দিচ্ছে ঝড় না হলেও অন্তত বৃষ্টি হবেই। সেই সঙ্গেই আব্বুর সম্মুখে মেঘালয়া চোখ দুটোও যেন শ্রাবনের আকাশে মেঘ ঝরা বাঁধাহীন বৃষ্টির মতো বর্ষনে ভিজে উঠেছে। দুজনের মান-অভিমানের পালা ভেঙে এবার যেন অভিযোগগুলো উঠে এসেছে সম্মুখে। বাবা তো অভিযোগ করতে জানে না সন্তানের সম্মুখে। তাই মেঘালয়ার মুখেই ফুটে উঠল, অনুযোগের সুর,

‘আব্বু! ভুল কি কেবল তোমার মেয়েই করেছে? তোমার মেয়ের আব্বু করেনি?’

পাগলি মেয়ের এমন সরল অভিযোগে বাবার বুকটা ভিজে যায় নিমেষেই। সজল চোখে চেয়ে রইলেন কেবল হেলাল সাহেব মেয়ের ফুলো চোখদুটোর পানে। তার ছোট্র মেঘালয়া আজ শশুরবাড়ি থেকে এসেছে, তাও আবার শশুরবাড়ির নামে নালিশ জানাতে। ভাবতেই বুকে চাপ অনুভূত হলো। তিনি একদম চাননি তার সাজানো পুতুলটিকে নিজের থেকে দূর করতে। তবে পরিস্থিতি তো সায় দিল না সেদিন এ চাওয়াতে। তার বাড়ি জুরে তরতর করে আহ্লাদি পা ফেলে চষে বেড়ানো মেঘালয়া আজ অন্যের বাড়ির বউ!

মেঘালয়া ভেজা স্বরে আবারও বলে উঠল,

‘আব্বু! মামনি কবে যেন মামনি থেকে শাশুরি হয়ে উঠল! আজ আমি তার কাছে, তার বাড়িতে অবস্থানকারী এক অপ্রিয় সত্য। যা সে পারছে না উগরে ফেলে দিতে, গ্রহন করতে তো মোটেই পারছে না। তুমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নাও নি– ও বাড়িতে বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে? তুমি মেয়ের সুখের নেশায় মেয়েকে ছোটো করে তোলো নি? যে ভুল আমি আগে তোমার সঙ্গে করেছি, তা তুমি সুধরাতে গিয়ে পুনরায় আমার সঙ্গে করেছ, আব্বু!’

মেয়ের বুকে যে অন্তহীন চাপা আর্তনাদের স্তর জমেছে তা বেশ বুঝলেন হেলাল সাহেব। এ ব্যাপারে তিনি আন্দাজ সেদিনই করেছিলেন, যেদিন আনতারা খানম এখানে এসেছিল এবং তিনি আনতারার চোখে মুখ-চোখে অপ্রসন্নতার ক্ষোভ লক্ষ্য করেছিলেন। আজ সত্যিই তিনি বাকরুদ্ধ। মেয়ের অভিযোগের বিরুদ্ধে, নিজের পক্ষে সাফাই দেওয়ার মতো উপযুক্ত যুক্তি নেই তার কাছে।

_

আকাশ সেই বিকেল থেকে মেঘাচ্ছন্ন। তুলনামূলক তাড়াতাড়িই আজ বেড়িয়ে পড়ল ইরাজ অফিস থেকে। তাছাড়া মেঘালয়াকেও পিক করতে হবে। রাত আটটার বেজে গিয়েছে। ইরাজ রাস্তায় বেরোনোর কিছুক্ষণের মাঝে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল জমিনে। তার মাঝেই গাড়ি চালিয়ে সে মেঘালয়াদের বাড়ির রাস্তার দিকে অগ্রসর হয়। ক্রমেই বৃষ্টির ফোঁটা ভারী হতে লাগল। সাথে বাতাসও প্রবল বেগে বেড়ে গেল যেন! প্রায় এক তাণ্ডবপূর্ন ঝড়ের রূপ নিলো আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের রাশিগুলো।

এই দুর্যোগের মাঝে গাড়ি চালাতে চালাতে মেঘের এই প্রলঙ্কর রূপের কথা মাথায় আসতেই, মেঘালয়ার মুখটা স্মৃতিতে ভেসে উঠল এক পলকের জন্য। ইরাজ একটু বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে যেন! মেঘালয়া তার জীবনে অমাবস্যার রাতে এক খণ্ড মেঘ। তাইতো ইরাজ সর্বদাই মেঘালয়াকে ‘মেঘ’ বলেই সম্বোধন করে; সকলে যেখানে ছোটো করে মেঘালয়া বলে থাকে। বুকের ভেতরে সূক্ষ্ম ছিদ্রক ব্যাথারা নেচে উঠল যেন! মেঘ! এই এমনই তাণ্ডব চালিয়িছে তার জীবনে মেঘালয়া। ইরাজ নামক শান্ত প্রকৃতিকে অশান্ত, অস্থির, বিক্ষিপ্ত করে তুলেছে বারবার। জানায়-অজানায় বারবার আঘাত করেছে!

এসব ভাবতে ভাবতে এসে পৌঁছাল মেঘালয়াদের বাড়ির সম্মুখে। বিদ্যুতহীন অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকা। মাঝেমধ্যে মেঘে মেঘে ঘর্ষনে বিদ্যুতের ঝলকানি আকাশকে বিদীর্ণ করে পৃথীবিকে ক্ষণিকের জন্য আলোকিত করে তুলছে। এরই মাঝে একবার চোখ তুলে তাকাল মেঘালয়াদের সাদা বিল্ডিংটির দিকে। তৎক্ষনাৎ চোখ ফিরিয়ে নিলো। বুকের তিরতিরে ব্যথাগুলো সায় দিল না মেঘালয়াকে কল করতে। বাড়ির গেইট ভেতর থেকে আটকানো। এ ঝড়ের মাঝে ডাকলে লাভ হবে না।

গাড়ি ছেড়ে বাইরে বের হয়ে দাঁড়াল ইরাজ। মুহূর্তেই বৃষ্টির ঝাপটা ভিজিয়ে দেয় ইরাজকে। গাড়ি থেকে একটু সরে গিয়ে গাড়ির সম্মুখে গিয়ে ফাঁকা রাস্তার মাঝখানে হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ওই কালো মেঘের ঘনঘটা থেকে ঝরে পড়া বারিধারা ইরাজের সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে, ইরাজকে ছুঁয়ে ধুয়ে গড়িয়ে পড়ে জমিনে। ইরাজ চোখদুটো আবেশে বুজে নিলো। ওর ব্যাথাময় মেঘে বৃষ্টি হয়ে ওর শরীরে ঝরে পড়ে। আশপাশে খেয়াল করে দেখল, মেঘের বর্ষন শুধু ওকেই নয় বরং আশপাশের সকল বস্তুকেও ভিজিয়ে তুলেছে। বিষাদের হাসি ফুটে ওঠে ইরাজের ঠোঁটে। মেঘের বর্ষনে শুধু ইরাজই নয়; আশেপাশের বস্তদ্বয়ও সিক্ত হয়। ইরাজ তো সামান্য; সে তুলনায় ইরাজ ব্যাতিত অন্যকেই বেশি ভেজায় ওই নিষ্ঠুর, নির্বোধ, বোকা মেঘ!

হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল রাস্তার ওপর। ভাবল, মেঘের এই বোকামির জন্য হলেও সে আজও মেঘকে কাছে পেয়েও আপন করে নেয়নি। তার মেঘের চেয়েও, বুকে বেড়ে ওঠা যন্ত্রনাগুলোকে সে বরাবরই বেশি প্রাধান্য দিয়ে আসছে!

_

মেঘালয়া সেই সন্ধ্যা থেকে তৈরী হয়ে বসে আছে। এই বুঝি আসবে ইরাজ, একটু দেরী হলে খিটখিটে মেজাজের মানুষটা ক্ষেপে উঠবে নিশ্চয়ই! তাই সে তৈরী হয়ে বসে রইল ক্ষেপা মানুষটির অপেক্ষায়। তারপরই আকাশ বিদীর্ণ করে বৃষ্টি নেমেছে মুষল ধারে। সঙ্গে দমকা বাতাসের ঝাপটাও আছে।

রাত নয়টা বেজে যাওয়ার পরও যখন ইরাজের কোন খোঁজ নেই মেঘালয়ার মনটা অজ্ঞাত কারনেই কেমন চিন্তিত হয়ে উঠল যেন! আব্বুর মোবাইল দিয়ে ইরাজের কন্টাক্ট নম্বরে ট্রাই করল একাধিকবার। তবে ওপাশ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া নেই ইরাজের। ক্রমেই চিন্তা বাড়তে থাকে মেঘালয়ার, সঙ্গে রাতও!

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১২.

অপেক্ষা করতে করতে মেঘালয়ার একসময় অভিমান জাগল। গাল ফুলিয়ে আব্বুর কোলে মাথা রাখে। সেই পুরনো দিনের মতো আজও হেলাল সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এতদিন পর এই আদরমাখা ভালোবাসার স্পর্শে মেঘালয়া সব ভুলে যায়। আজ আর চিন্তা ভাবনার মাঝেও রাত জাগা গেল না। ঘুমিয়ে পড়ল ওভাবেই।

সকাল ন’টার দিকে ঘুম ভাঙল মেঘালয়ার। ঘুম ভেঙে দেখল আব্বু ওকে বিছানায় ঘুমোতে দিয়ে নিজে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েছে। আজও বেলা হয়ে গেছে ঘুম থেকে জাগ্রত হতে। মেঘালয়ার রাতের ঘটনা মনে পড়ে যায়। আবারও মনটা গুমোট হয়ে উঠল। তবে সিদ্ধান্ত নিলো আবারও একবার কল দেবে। আব্বুর ফোন থেকে ইরাজের কাছে কল করে। প্রথম দুবার বাজল তবে ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। তৃতীয়বার কল যেতেই লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে। মেঘালয়া অবাক হয়। কাল তো শেষবার যখন দেখা হয়েছিল এমন প্রায় ঠিকই ছিল সবটা। ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে এক দীর্ঘশ্বাস টেনে নিল। কিছুক্ষন ওভাবে বসে থেকে ঘুমন্ত আব্বুর মুখের দিকে তাকাল। অজানা এক প্রশান্তিতে বুক ভরে ওঠার সাথে সাথে আবার এক শঙ্কায় ভিতরটা আন্দোলিত হয়ে উঠল। ওই বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছেটুকু কোথাও খুঁজে পেল না। তবে আবার মনে পড়ল, কাল থেকে মেঘালয়ার অভিযোগ গুলো শোনার পর থেকে হেলাল সাহেব মেয়ের সামনে হাসছেন তো ঠিকই, তবে ভেতর ভেতরে তিনি কতটা অস্থির তা মেঘালয়ার দৃষ্টি এড়ায় নি। সে আর চাইল না আব্বুর অস্থিরতা বাড়াতে।

নিজেকে বুঝাল, যে আব্বুকে খুশি করতে সে এই বিষ পান করেছে, সেই আব্বুর খুশির জন্য নাহয় তা হজমও করে ফেলবে! এ মানুষটিকে আর কষ্ট দেবার সাধ্যি নেই মেঘালয়ার। মুখের অভিব্যাক্তি পরিবর্তন করে নিজের স্বভাবসুলভ চঞ্চলতায় ফিরতে সচেষ্ট হলো। সে কাল উত্তেজনায় যা বলেছে, যে ভাবনায় ফেলেছে আব্বুকে তা আজকের হাসিমুখের ঝলকে মিটিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে চায়। আবারও তৈরী হয়ে নিলো। আব্বুকে ডাকল। হেলাল সাহেব চোখ মেলে দেখলেন, মেয়ে প্রায় তৈরী। হন্তদন্ত উঠে বসলেন। বললেন,

‘কিরে মা! রাজ এসেছে?’

মেঘালয়া যেন মিথ্যেটা জিহ্বার ডগায় সাজিয়ে রেখেছিল, তা উৎফুল্লতা হিসেবে ফুটিয়ে তুলল আব্বুর সম্মুখে,

‘উহু, তবে কল করেছিল। কাল বৃষ্টির জন্য আটকে গিয়েছিল। সকাল হতেই কল করেছে, সেই কলেই তো আমার ঘুম ভেঙেছে, আব্বু।’

এই সাবলীল মিথ্যাচারের পেছনের বাস্তবতাটুকু গোপন হয়ে গেল বাবার কাছে। হেলাল সাহেব চাইছেন মেয়ে থাক আর কিছু সময় তার কাছে। তবে পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় তিনিও হাসিমুখে মেয়েকে বিদায় জানাতে তৎপর। বললেন,

‘যা খেতে বস। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।’

মেঘালয়া চলে যায়। মনটা সামান্য হলেও হালকা লাগল। ওই মা হারা পাগলিটা যে তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। ওই পাগলির একটু ভালো থাকা হেলান সাহেবের গোটা ভালো থাকার চাবিকাঠি।

_

আসতে চাইলেও যেন আসা হয় না। আব্বুর থেকে বিদায় নিয়ে আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার একটু আগে বের হলো মেঘালয়া। হেলাল সাহেবের গাড়িটি কিছুদিন যাবত নষ্ট হয়ে থাকায় তিনি পরিচিত এক গাড়ি রিজার্ভ করে মেঘালয়াকে তুলে দিয়েছেন। গাড়ি এসে নামিয়ে দিল ইমতিয়াজ সাহেবের বাড়ির সামনে। বইয়ে বোঝাই করা প্রকাণ্ড ব্যাগটি নিয়ে মেঘালয়া নেমে দাঁড়াল। এ বাড়ির ভেতরটা তার আতঙ্ক, বাড়ির মানুষগুলো তার আতঙ্ক, তবে তাকে এই সবটা মানিয়ে নিয়ে এ বাড়িতেই বসবাস করতে হবে। আব্বুর খুশির জন্য হলেও তাকে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে।

বাড়ির ভেতরে এমনিতেও সদস্য সংখ্যা কম। তবে আজ যেন আরও গম্ভীর লাগছে বাড়ির ভেতরটা। আনতারা খানমকে নিচে পেল না মেঘালয়া। ওপরে উঠে গেল। নিজের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঢুকতে একটু ইতস্তত হচ্ছে। হয়ত ইরাজের ওপর জমায়িত ক্ষোভই এর কারন। দরজা চাপিয়ে রাখা আছে। তা ঠেলে ভেতরে ঢূকেই সর্বপ্রথম নজর গেল রুমের কেন্দ্রে বিছানার দিকে। নজর ওদিকেই আটকে যায় মেঘালয়ার।

ইরাজ বেহুশের মতো পড়ে আছে। মাথার শিথানে বসে তার মাথায় জলপট্রি লাগাচ্ছেন আনতারা খানম। তার উপস্থিতি টের পেয়ে একবার তাকালেন ফিরে। মেঘালয়াকে দেখে প্রচণ্ড অনীহার সঙ্গে নজর ঘুরিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন আবার। মেঘালয়া অবাক হয়। কি হয়েছে ইরাজের এই এক রাতের মাঝে? সে ব্যাগটা একপাশে রেখে দ্রুত রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। খানিক দুরত্ব বজায় রেখে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শক্তপোক্ত ক্ষ্যাপা ইরাজ কেমন মিইয়ে গেছে। ঠোঁটের চামড়া শুকনো খড়খড়ে। তীর্যক চোখদুটো বসে গেছে, শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে যেন। শরীরে লাল ছোপ ছোপ দাগ। মাথার চুল উশকো-খুশকো। ওভাবেই চোখ দুটো অর্ধবোজা অবস্থায় টান হয়ে শুয়ে আছে ইরাজ।

মেঘালয়া এসেছে, তা কি টের পেয়েছে ইরাজ? পেলেও বা কি? সে তো আর মেঘালয়ার ভুক্তভোগী নয়! এটুকু ভেবে সেখান থেকে সরে আসতে চায় মেঘালয়া। অথচ কিসের টানে যেন আটকে দাঁড়িয়ে রইল। পা উঠল না তার। রুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে আনতারা খানম শক্ত স্বরে বললেন,

‘কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে রাজ কে? কোথাও বের হতে তোমারও যে কারও প্রয়োজন হয় তা জানা ছিল না। তুমি তো একাই চলে যাও বাড়ি থেকে। তবে এবার আমার ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজানোর কি দরকার ছিল?’

এই সকল কটুক্তি! মেঘালয়ার সয়ে যাওয়ার কথা। তবুও চেনা মানুষগুলোর অচেনা রূপে সে আজও নিত্য-নতুন ভাবে কষ্ট পায় এই তিরস্কার গুলোতে। আজও পেল, তবে তা লুকিয়ে গেল। এবং কোন জবাবও দিল না। সে তো কিছুই জানে না এসবের, তা নিয়েও যদি কথা শুনতে হয়, সেখানে বলার থাকে না কিছু।

‘রাজের এলার্জি আছে জানো তুমি?’

আনতারার ধমকে কিঞ্চিত কেঁপে উঠল মেঘালয়া। আনতারা আবারও বলে ওঠেন, ‘বৃষ্টি রাজের সহ্য হয় না জানতে না তুমি? কি করে ভিজল রাতভর বৃষ্টিতে? বায়না ধরেছিলে তুমি নিশ্চয়ই? এবার তবে সেবা করো।’

আরও কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে গেলেন যেন! সবটা গিলে ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে যান তিনি। মেঘালয়া যেন কিছু লক্ষ্য করল– আনতারার চোখ চিকচিক করছিল, কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠছিল। তবে কি তিনি কাঁদছিলেন!

ইরাজের দিকে তাকিয়ে, ক্ষোভে দুঃখে ইরাজের এই অবস্থার ওপর খুশি হওয়ার কথা থাকলেও মেঘালয়ার তেমন লাগল না। মিশ্র অনুভূতি নিয়ে চেয়ে রইল ইরাজের পাংশুটে চেহারার দিকে। তখনই ইরাজ ঘাঁড় ঘুরিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মেঘালয়া নিজের অজান্তেই দ্রুত ইরাজকে ধরল। আচমকা ইরাজ গলগল করে বমি করে দেয়। তা মেঘালয়ার শরীরেও লেগেছে। মেঘালয়ার ছিটকে সরে পড়ার কথা, তবে এমন কিছুই করল না সে বরং আরও আঁকড়ে ধরল ইরাজকে। ইরাজ নিভু নিভু চোখে তাকায় মেঘালয়ার পানে। মেঘালয়ার ব্যাথিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

‘খুব খারাপ লাগছে আপনার? এভাবে উল্টো হয়ে থাকলে আবারও বমি হতে পারে। আপনি সোজা হয়ে শুয়ে পড়ুন তো। নিন..

অপর হাতে বালিশটা ঠিকঠাক করে ইরাজকে ধরে শুইয়ে দিল। ইরাজ শরীর কেঁপে উঠল আদ্ভুত ভাবে। অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলতে চায় ইরাজ। মেঘালয়া ইরাজের হাত চেপে ধরল। মুখটা মুছিয়ে দিল সযত্নে। আচমকা খেয়াল করল ইরাজের হাত বেশ ঠাণ্ডা। সে দ্রুত আশপাশে তাকায়। পাশেই টি-টেবিলের ওপর সরিষার তেলের কৌটা। বুঝল, তার অনুপস্থিতিতেও এমন হয়েছিল, তেল মালিশ করা হয়েছিল। সে খানিকটা তেল হাতে মেখে ইরাজের হাত এবং পায়ে অনবরত নাড়তে থাকল। দ্রুত উঠে গিয়ে আলমারি থেকে পাতলা একটি কম্বল বের করে এনে ইরাজের গায়ে দিল। মেঘালয়ার এই ছুটাছুটি ইরাজ নিমজ্জিত চোখে নিরবে কেবল দেখে যাচ্ছে।

কিছুসময় বাদে মেঘালয়ার মনে পড়ে, ইরাজ বমি করেছে। তাতে নিশ্চয়ই ঔষধও বেরিয়ে গেছে! তবে কি আবার ঔষধ খাইয়ে দেবে! ইরাজের দিকে তাকাল সে। কিছুক্ষন আগে খুব ছটফট করলেও এখন তুলনামূলক শান্ত সে। মেঘালয়া চিন্তিত মুখে বসে রইল পাশেই। আরও খানিকটা সময় পার হলে দেখল, ইরাজ চোখ বুজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। মেঘালয়া ধীর কণ্ঠে শুধায়,

‘কেমন লাগছে আপনার? মামনি কে ডাকব?’

ইরাজ চোখ খুলে তাকাল। অর্ধবোজা চোখের দৃষ্টি। আস্তে করে ঘাঁড় নেড়ে না বোঝাল। পাশেই রাখা অনেকগুলো ঔষধ। মেঘালয়া ভাবল, একদিনে এত ঔষধ কোথা থেকে এলো? নাকি এমনটা আগেও হয়েছে ইরাজের? তখনই মনে পড়ল সেদিন বাবাই বলেছিল, ইরাজের এলার্জি আছে। আজ মামনিও তাই বলেছে। তবে তা জেনেশুনে ইরাজ বৃষ্টিতে ভিজল কেন? এলার্জি থাকলে তা থেকে অ্যাজমার সৃষ্টি হয়। আর এ কারনেই বৃষ্টির পানি ইরাজের সহ্য হয়নি, ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে। পুরো শরীর দাগ ত্বকের ওপর। মেঘালয়া শান্ত পরিশ্রান্ত চোখে কেবল অসুস্থ ইরাজের পানে চেয়ে রইল। এই মানুষটি কত তর্জন-গর্জন করে বেড়ায়। আশেপাশে থাকলেই মেঘালয়ার আতঙ্কের শেষ থাকে না। আজ কেমন স্তব্ধ, দুর্বল শরীরে পড়ে রয়েছে!

এক পর্যায়ে ইরাজের শরীর প্রচুর ঘামতে শুরু করে। ইরাজ ছটছট করতে শুরু করল কেমন। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘এসি অন কর, গরম লাগছে।’

মেঘালয়া আপত্তি জানায়, ‘ঘামলে শরীর থেকে জ্বর বেড়িয়ে যাবে। শুয়ে থাকুন এভাবেই।’

প্রত্যুত্তরে ইরাজ নিরব রইল। ঘাঁড় ঘুরিয়ে চারদিকে কিছু খুঁজল। মেঘালয়া বোঝে, ইরাজ কী খুঁজছে। আক্ষেপের স্বরে বলল, ‘সবকিছুতেই জিদ দেখিয়ে জিতে যাওয়া যায় না। এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় অসুখ বাড়লে ভোগান্তিটা কার হবে?’

ইরাজ কিছুক্ষন নিরবে ছাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নিরবতা ভেঙে গম্ভীর স্বরে বলল,

‘এখানে বসে থাকার প্রয়োজন দেখছি না তোর। উঠে যা।’

মেঘালয়া নিরস মুখে তাকাল ইরাজের দিকে। তার দৃষ্টি উপরের দিকে। আস্তে করে উঠে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়াল। ইরাজ এবার তাকাল সেখানে, যেখানে মেঘালয়া বসেছিল এতক্ষন। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে, চোখদুটো বুজে নিল। মুখে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট।

রাত প্রায় আটটা। মেঘালয়া সোফার ওপরে বসে অগোছালো কাপড় ভাজ করতে বসেছে। মাঝেমধ্যে আড়চোখে খেয়াল করছে অসুস্থ জেদি মানুষটিকে। ইরাজ ক্ষীণ আওয়াজে ডেকে ওঠে, ‘মেঘ!’

তৎক্ষনাৎ মেঘালয়া তাকাল সেদিকে। চোখের ইশারায় জানাল, ‘কী?’

উঠে গিয়ে কাছে দাঁড়াল। ইরাজের অভিব্যাক্তি শান্ত, ‘দুটো ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আয়। পারিস তো?’

মেঘালয়া কপাল কুঁচকে তাকাল। এটা কে পারে না? সবসময় খুঁত ধরার ছুতো না খুঁজলে হয় না? মুখে কিছু বলল না তবুও, কেবল মৃদূ মাথা ঝাঁকাল।

রান্নাঘরে যাওয়ার পথে ড্রইং রুমের সোফাতে আনতারা খানমের সঙ্গে দেখা হলো। মেঘালয়া মাথাটা ঝুঁকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। আনতারাকে দেখতে বড়োই বিষন্ন আর অস্থির লাগছে। মেঘালয়াকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে কলিজার ভিতরে পুড়ে উঠল যেন! ইরাজের ভয়ানক এলার্জি আছে বৃষ্টির পানিতে। আগে কিছুসময় এমনও হয়েছে, ইরাজ এলার্জিজনিত ঠাণ্ডায় শ্বাস আটকে পড়ে থেকেছে। গ্যাস দেওয়ার মাধ্যমে শ্বাসকষ্ট রোধ করা হয়েছে। এবার ঠাণ্ডার সঙ্গে ব্লাড প্রেসার লো। এমন হলে আনতারা খানম ছেলেকে সিদ্ধ ডিম, গরম দুধসহ আমিষ জাতীয় খাবার বানিয়ে বাচ্ছা ছেলের মতো পেছনে ঘুরে ঘুরে খাওয়াতেন। ইরাজ বরাবরই দুধ খেতে চায়না। এত বড়ো হওয়ার পরেও দুধ নিয়ে ইরাজের পেছনে দৌড়েছেন তিনি।

সেসব ভেবে, চোখ ভিজে উঠল যেন! মেঘালয়া যাওয়ার পানে চেয়ে রইলেন। ছেলে কি সত্যিই পর হয়ে গেল! আজ মায়ের প্রয়োজনীয়তা কি তবে ফুরিয়েছে? দেখাশুনা করার নতুন কেউ এসেছে তার পুত্ররত্নের জীবনে!

চলবে..

[রিচেইক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন❤️]

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১০

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১০.

ইরাজ ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে রইল নির্বিকার চিত্তে। আনতারা খানম থমথমে চেহারা, অপ্রসণ্ন নজরে পরখ করে দেখলেন মেঘালয়ার আপাদমস্তক। চরম অনীহার সঙ্গে ওকে উপেক্ষা করে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন ইরাজের পাশে। মেঘালয়া মুখটা ছোটো করে মাথাটা নত করে নিলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো। এরই মাঝে ইরাজের চড়া কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া খানিক সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তবে পিছনে ফিরল না। ইরাজ স্বাভাবিক স্বরেই আদেশ করল, “আব্বুকে ডেকে নিয়ে আয়, জলদি যা।ʼʼ

মেঘালয়ার ভিতরে তোলপাড় চলছে। যা শুরু হয়েছে আনতারা খানমের চোখে ভেসে থাকা আক্রোশের আগুন থেকে। ইরাজের কথা অমান্য করে এবার আর তামাশা বড়ো করতে চাইল না মেঘালয়া। এমনিতেই এ বাড়ির এমন কঠোর নিরবতা ওর চঞ্চলতা কেঁড়ে নিতে যথেষ্ট। হাতে থাকা ফুসকার প্যাকেটটি পাশে রেখে ইমতিয়াজ সাহেবের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।

আনতারা খানম বসলেন ছেলের মুখোমুখি। খানিক বাদে ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন, “রাজ! তুই কি মেনে নিয়েছিস পরপুরুষের সঙ্গে ভেগে যাওয়া ওই মেয়েটিকে?ʼʼ

ইরাজ চেপে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। ভারী এক ঢোক গিলে, চোখ খুলে তাকাল। শান্ত স্বরে বলল, “আমার চেয়ে সম্মানের পরোয়া তুমি বেশি করো, মম!ʼʼ

‘মম’ ডাকটা ইরাজ ছোটো বেলা থেকেই ক্ষেপে গেলে বা অসন্তুষ্ট হলে ডাকে। আর ইমতিয়াজ সাহেবকে ড্যাড ডাকে যতক্ষণ মনটা ভালো থাকে। তা আনতারা খানম বেশ জানেন। ইরাজের ‘আম্মা’ ডাকে মধু মিশ্রিত থাকলেও, ‘মম’ ডাকে আনতারা খানম কেবলই ছেলের সঙ্গে নিজের দূরত্বের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পান। আচমকা তাকালেন তিনি ছেলের দিকে। চোখে চোখ পড়ে যায়। ইরাজ অদ্ভুত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে তারই দৃষ্টি বরাবর। আনতারা খানম কিছু বলার আগেই ইরাজ বলল,

“কদিন আগে বিয়ে করে বউ ঘরে তুললাম, তারপর কোমরে লাথি দিয়ে সেই বউ বিদায় করব। লোকে কারন জানতে চাইলে বলব, বউ লোকের সাথে ভেগে গিয়েছিল। তা অবশ্য জানতাম আগে, তবে খারাপ লাগাটা বিয়ের পর কাজ করেছে তাই বউ বাড়ির বাইরে। ঠিক আছে না, মম?ʼʼ

আনতারা খানম চাপাস্বরে অভিযোগ করে, “তোরা বাপ-ছেলে জানলেও আমি জানতাম না। আর জানলে..ʼʼ

কথা শেষ করতে না দিয়ে ইরাজ বলে উঠল, “এজন্যই জানানো হয়নি তোমায়। রাত দুটো পার হয়ে যাচ্ছে। খাবার দেবে অথবা আমি রুমে যাব!ʼʼ

আনতারা খানম ছেলের গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বুঝতে চেষ্টা করলেন ছেলের ভেতরে প্যাচ লেগে থাকা জটিলতাকে। বরাবরের মতোই ব্যর্থ তিনি।

ইমতিয়াজ সাহেব এসে বসলেন চেয়ারে। যে কারনে মা-ছেলের আলাপে সমাপ্তি ঘটে। তাকে দেখেই আনতারা খানমের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কাজের ব্যস্ততা দেখালেন। মেঘালয়া পেছন থেকে চলে যেতে নেয়। তখনই ইরাজ ডেকে উঠল, “এদিকে আয়।ʼʼ

মেঘালয়া নিচু স্বরেই জবাব দিল, “ক্ষুধা নেই তেমন। আর তাছাড়া..ʼʼ

ইরাজ মেঘালয়ার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালে মেঘালয়া কথার মাঝেই চুপ হয়ে গেল। ইরাজ ঘাঁড় ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোকে এদিকে আসতে বলেছি। তুই ক্ষুধার ফিরিস্তি শোনাচ্ছিস কোন সুখে?ʼʼ

সে-সময় ইমতিয়াজ সাহেব ধমকে উঠলেন, “মেঘা! ক্ষুধা নেই এটা কেমন কথা? আর ক্ষুধা না থাকলেও খেয়ে ঘুমাবে। এদিকে এসো।ʼʼ

মেঘালয়া অগত্যা এসে দাঁড়াল সেখানে। আর তখনই আনতারা খানম এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। মেঘালয়া এসে দাঁড়াতেই তিনি সকলকে উপেক্ষা করে হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। ইমতিয়াজ সাহেব কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেঘালয়া মাথাটা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। ইরাজ আচমকা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। মুখ-চোখ শক্ত করে করে ধমকে উঠল,

“মাঝরাতে ইন্ডিয়ান ড্রামা সিরিয়াল দেখতে টেবিলে বসলাম নাকি? খাবার দিবি তো দে জলদি, বা ল ডা।ʼʼ

মেঘালয়া দ্রুত ইরাজের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল। চোখে-মুখে এক অবর্ননীয় ক্ষুদ্ধতাকে ঠেসে বসে রয়েছে ইরাজ। খাবারের ঢাকনা উঠিয়ে দেখল, দুরকমের তরকারী। সেটা ইরাজের প্লেটে উঠিয়ে দেওয়ার সময় আগে বড়ো চিংড়ি মাছের তরকারীটাই উঠিয়ে দিল। ইরাজ খাওয়া থামিয়ে দেয়। মেঘালয়া একটু থমকে উঠল। না জানি আবার কি কথা শোনাবে। ইমতিয়াজ সাহেব দ্রুত বলে উঠলেন,

‘রাজের এলার্জি আছে পাগলী। চিংড়ির গন্ধও সহ্য করতে পারবে না।’

তিনি একটু ভয় পেলেন। এমনিতেই ছেলের মন মেজাজ ভালো নয়, তা তার অজানা নয়। এখন আবার মেঘালয়াকে উল্টোপাল্টা কিছু বলে না বসে! অথচ এমন কিছুই হলো না। ইরাজ নির্বিকার শান্তভাবে নিজের প্লেটটি বাবার দিকে সরিয়ে দিয়ে, বাবার প্লেট টেনে নিলো। ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়াকে ইশারা করলেন, অন্য পাত্রে থাকা মুরগীর মাংস ইরাজকে উঠিয়ে দিতে।

আনতারা খানম রুমে এসে ধপ করে বসে পড়লেন বিছানার ওপর। চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। বুকটা আজ কেনো জানি জ্বলছে ভীষন। বুকে হাত রেখে কিছুসময় চোখ বন্ধ করে অনুভব করলেন বুকের জ্বলন। একসময় আবিষ্কৃত হয় তার এই জ্বলন, ইরাজকে হারিয়ে ফেলার ভীতি থেকে জন্মেছে। ইরাজের আগে ও পরে বহুবার গর্ভপাত হওয়ায়, ইরাজ ভাই-বোনহীন একা আজ। ওই ইরাজ যে কতটা দামে কেনা কলিজার একমাত্র রত্ন তা কেবল আনতারাই জানেন। এজন্যই তো ছোটবেলা থেকে ইরাজকে কোনদিন কোনকাজে বাঁধা প্রদান করেননি। যা যখন যেভাবে চেয়েছে ইরাজ কেবল তা হাজির করা হয়েছে ওর সম্মুখে। আজ হঠাৎ-ই সেই ইরাজকে হারানোর আশংকা জেগেছে মায়ের মনে।

ইরাজ কোথায় হারিয়ে যাবে? বউয়ের মায়ায়! মন সায় দেয় আনতারার— একদম তাই। ইরাজ মেঘালয়াকে এ কদিনে আনতারার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। বউয়ের জন্য মায়ের সাথে নিরবে লড়ছে। মেঘালয়াকে যেন আজ তার চেয়েও অধিক প্রাধান্য দিয়েছে ইরাজ! আনতারা খানম হঠাৎ-ই এক ভাবনায় আবারও থমকে উঠলেন, বুকটা ভার হলো। তিনি যখন চলে এলেন ডাইনিং রুম থেকে, তখনও ইরাজ তাকে থামায়নি! গভীর এক ক্ষত অনুভূত হলো বুকের ভেতরটায়। প্রায়প্রিয় পুত্র রত্নকে হারানোর এক নিরব আর্তনাদ বুকটা ছিদ্র করে চাইল যেন!

রুমে এসে রোজকার মতোই সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বেলকনিতে চলে যায় ইরাজ।

মেঘালয়া বুকে পাথর চেপে আছে। সে আসলেই জানত না সাংসারিক জীবনটা এমন নিষ্ঠুর আর কঠিন। কেমন যেনো লাগছে সবকিছু। এসবের সাথে মেঘালয়া একদম পরিচিত নয়। সে তো আব্বুর কাছে দেবীর মতো ছিল। যাকে আব্বু মুরগীর ডিম থেকে ফোঁটা সদ্যজাত ছানার মতো পাখার নিচে আগলে রেখেছিল। অথচ এই ভালোবাসাকে তাবির বলেছিল— ব্যাটারি চালিত পুতুল। আজ আরও একবার ঘৃনা হলো তাবিরের ওপর। খুব মন চাইল, আব্বু নামক ওই রাগী মানুষটির পাখার তলে গুটিশুটি মেরে আরও একবার আশ্রয় গ্রহন করতে। আবারও আব্বুর পুতুল হয়ে থাকতে। তবে কি মেঘালয়া আসলেই নির্বোধ! নিজের সুখের মহল হারিয়ে এই চারদেয়ালের শশুরবাড়ি নামক নিষ্ঠুর আলয়ে বন্দিনী হয়ে গিয়েছে? কুশনে মুখ চেপে চাপাস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। অস্পষ্ট স্বরে ‘আব্বু’ বলে ডেকে উঠল। ওপাশ থেকে আব্বুর জবাব নেই। খুব জানতে ইচ্ছে হলো, একাকী আব্বুটাও কি এখন এই মাঝরাতে মেঘালয়ার কথা ভেবে ছটফট করছে!

_

সপ্তাহখানেক ওভাবেই কেটে গেছে। এ বাড়িতে নিতান্তই আবর্জনার মতো রয়ে গেছে মেঘালয়া। ইরাজকে বুঝতে পারে না মেঘালয়া। আনতারা খানম সর্বদা মেঘালয়াকে এড়িয়ে নিরবে নিজের দায়িত্ব পালন করেন নিত্যদিন। যেন এ বাড়িতে মেহমান তিনি, কেবলই সবটা দায়িত্ব তার। মন থেকে কিছু করেন না মোটেই।

মেঘালয়াথ রাতে দেরীতে ঘুমানো আজকাল প্রায় অভ্যাসই হয়ে গিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হতে বেলা দশটা বেজে গেল। উঠে দেখল রুমের জানালার পর্দা বাতাসে সরে যাওয়ার কারনে ঘরজুরে সূর্যের ঝাঁঝাল আলোয় মাখামাখি। সে নিজে এবং ইরাজও আলোতে খুব একটা আরামবোধ করে না। একবার তাকাল ঘুমন্ত ইরাজের দিকে। আলোতে নাক ছিটকে চোখ জড়িয়ে বিরক্ত মুখে শুয়ে আছে উপুর হয়ে। নিরস মুখে ইরাজকে দেখে নিয়ে আস্তে করে হেঁটে গিয়ে জানালার পর্দাগুলো টেনে দিল। ঘড়িতে দশটা পার হচ্ছে।

দ্রুত কোনমত চোখে-মুখে পানি দিয়ে নিচে নেমে এলো। রান্নাঘরে এককোনে গিয়ে দাঁড়াল। আনতারা খানম তার সহকারীকে নিয়ে রান্নায় ব্যস্ত। মেঘালয়াকে দেখেও গ্রাহ্য করলেন না। মেঘালয়া কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল নিরবে। আনতারা খানম কাজের মেয়ে আয়েশাকে কিছু আদেশ করলে, মেঘালয়া ইশারায় আয়েশাকে থামিয়ে দিল। নিজে তা করতে যায়। তখনই আনতারা খানম কঠিন স্বরে বললেন,

‘মেঘা! আদিক্ষেতা দেখিও না তো মা। দেখছ তো সাহায্য করার লোক আছে। আর না থাকলেও আমি নিজের কাজ করে নিতে পারি। উপরে যাও। এ বাড়ির কোনকাজে প্রয়োজন নেই তোমাকে।’

মেঘালয়ার কাছে কথাগুলো বড্ড অগোছালো লাগল। শান্ত শীতল স্বরে প্রত্যাখান জানালেন আনতারা। পা উঠল না তার সেখান থেকে। এই আনতারার নিজের মেয়ে ছিল না। তেমনই মেঘালয়ার মা ছিল না। তবে যতবার, যতক্ষণ সময় মেঘালয়া আনতারা সহচর্যে থাকত, সে কখনোই মায়ের অভাব বোধ করেনি। আজ হঠাৎ-ই ভাবনায় এলো, তবে কি সম্পর্ক বদলেছে! আগে আনতারা মামনি ছিল। আজ কি শাশুড়ি হয়ে গিয়েছে! কয়েক দিনের ব্যাবধানে সবকিছু এভাবে পাল্টে যায় নাকি? আব্বু তবে ঠিকই
বলত— মেঘালয়া দুনিয়াটাকে কিঞ্চিত পরিমাণও জানে না। তবে এখন ধীরে-ধীরে জানতে শুরু করেছে। সেই ভুলে ভরা রাতের পর থেকে মেঘালয়ার জীবনে কেবলই বাস্তবতার কঠোর তাণ্ডব চলছে। আব্বুর কথা মনে পড়ল। দেখতে ইচ্ছে করল মানুষটিকে আজ। বুকে হামলে পড়ে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করল,

‘আব্বু! তুমি না মেয়ের ভালোর জন্য সবটা করলে! তবে কেন তোমার মেয়ে একদমই ভালো নেই? শশুরবাড়ি তো ভালো থাকার জায়গা নয়, আব্বু। তার ওপর তোমার মেয়ের করা ভুল পিছুই ছাড়ছে না।’

গলার কাছে আটকে এলো ব্যথাগুলো জড়ো হয়ে। ধীর-স্থির পা ফেলে সেখান থেকে চলে এলো মেঘালয়া। রুমে এসে দেখল ইরাজ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানেও রোদ। রুমে ফিরে এসে সোফাতে বসল। আজকাল মেঘালয়ার বারবার একই কথা মনে হয়, সেই আহ্লাদী মেঘালয়া খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক বেশি বড়ো হয়ে গিয়েছে। বুক ফুলিয়ে বড়ো করে এক শ্বাস নেয় সে। যন্ত্রনাগুলো ভেতরে কবর দেওয়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ-ই উঠে ইমতিয়াজ সাহেবের রুমের দিকে গেল। তবে ব্যর্থ হলো। তিনি নেই অর্থাৎ আজ হয়ত জরুরি কাজ পড়ায় জলদি বেরিয়ে গেছেন।

আবারও রুমে ফিরে এসে বসে পড়ল সোফায়। অনেকটা সময় কেটে গেল। আনতারা খানম মোটেই ডাকতে এলেন না সকালের খাবারের জন্য। মেঘালয়ারও ক্ষুধা মরে যায়। সে নিস্তব্ধতার চাদরে নিজেকে ঢেকে বসে রইল নির্বিকার বহুক্ষন। বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর সম্বিত ফিরল। আচমকা উঠে ওয়ারড্রোব থেকে নিজের নিত্য পরিহিত কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকল।

খুব শীঘ্রই যোহরের আজান হবে। সেসময় ঘুম ভাঙে ইরাজের। উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের ওপরই বিরক্ত হয় সে। মুখে ‘চ্যাহ’ এর মতো শব্দ করে বসা থেকে দাঁড়াল। নিজের টাওয়াল খুঁজল। পেল না। মেজাজ আরও চটে যায় এবার। বাথরুমের দিকে নজর যেতেই দেখল তা ভেতর থেকে লক করা। এবং সেখান থেকে শাওয়ারের শব্দ আসছে। ভ্রু জড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে চেয়ে রইল সেদিকে। ভারী পায়ে হেঁটে গিয়ে বাথরুমের দরজায় কষে থাবা মারল। ভেতর থেকে মেঘালয়া চমকে ওঠে প্রথমে। পরে যখন বুঝল, চিৎকার করে বলে ওঠে,

‘কী সমস্যা আপনার? দরজা ভাঙার পরিকল্পনা আছে নাকি?’

ইরাজ চিবিয়ে জবাব দেয়, ‘আমার সমস্যা তুই। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যদি বের না হোস, বিনা পরিকল্পনায় দরজা ভেঙে ফেলব।’

মেঘালয়া চোখ উল্টিয়ে, মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ভেঙে ফেলুন। বাবাই আবার একটা লাগিয়ে দেবে।’

ইরাজ ক্ষেপে ওঠে এবার, ‘মেঘ! অতিরিক্ত সাহস দেখাবি না মোটেই। বের হলেই তোকে আমার হাতে পড়তে হবে, ডোন্ট ফরগেট ইট।’

‘আপনি কি মূর্খ! ডিগ্রি তো ভালোই অর্জন করেছেন, অথচ মগজ খালি। এখানে ঘুমোতে তো আর আসিনি নিশ্চয়ই! গোসল করতে করতে কি করে বের হওয়া যায়?’ শেষের কথাটা চিল্লিয়ে বলে মেঘালয়া।

ইরাজ দাঁতের মাড়ি শক্ত করে বলে, ‘সেটা তুই ভাব, ড্যাম!’

‘আর কিছুক্ষন লাগবে আমার, ততক্ষণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন বাইরে।’

ইরাজের সচেতন নজরে তাকাল বাথরুমের দরজার দিকে। আচমকা দুটো লাথি বসাল দরজায়। ধমকে ওঠে, ‘জ্ঞান দিচ্ছিস আমায়? এখনই তোকে গোসলে ঢুকতে হলো? জীবনে তো গোসল করতে দেখিনি। আমার বাড়িতে এসে তোর গোসলের শখ হয়েছে, তাও আবার যখন আমি ঢুকব তখন?’

এমন একটা কথার কী জবাব দেবে মেঘালয়া। চুপ রইল।
ইরাজ রুমের মধ্যে পায়চারী করতে শুরু করে। বিরবির করে বলল,

‘বা লে র বিয়ে না করে একটা গরুর খামার দিলেও পারতাম। গরুর দুধ বিক্রি করে বড়োলোক হওয়া যেত। এসব মেয়েলোক ঘরে এনে এক্সট্রা ঝামেলা পোহানোর প্লান কোন শালার মাথায় এসেছিল?’

চলবে…

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৯

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

৯.

ইরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা হেঁটে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। মেঘালয়া চুপচাপ চেয়ে দেখল কেবল। বেশ অনেকটা সময় কেঁটে যাওয়ার পরও ইরাজ রুমে এলো না। মেঘালয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে, ফুসকার প্যাকেটটি টি-টেবিলের ওপর রেখে সোফার কুশন মাথার তলে রেখে আড়াআড়ি ভাবে— গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়।

প্রায় ঘন্টা-দুয়েক কেঁটে যাওয়ার পর ইরাজ রুমে এলো। একবার আড়চোখে দেখল। অতঃপর বিছানার দিকে অগ্রসর হয়। সেই মুহূর্তেই মেঘালয়া তড়াক করে উঠে বসল। তড়িঘড়ি ডেকে উঠল, “ইরাজ ভাই!ʼʼ

ইরাজ তাৎক্ষনিক ফিরে তাকায় না। একটু রয়েসয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। মেঘালয়া খানিক ইতস্ততঃ করে বলে, “একটু সময় হবে?ʼʼ

ইরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল, “কোন মহাকাজে সময় লাগবে তোর?ʼʼ

মেঘালয়ার অনুযোগের স্বর, “আমায় যেকোন কিছুতে আপনার টেমপারেচার হাই হয়ে যায়? একটু ভালো করে কথা বললেও তো পারেন।ʼʼ

ইরাজ ভাবলেশহীন জবাব দিল, “কখনও বলেছি?ʼʼ

“বদলাবেন না আপনি?ʼʼ

“আজীবনেও না।ʼʼ

মেঘালয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আস্তে করে বলল, “বসুন। কিছু পরামর্শ নেওয়ার আছে।ʼʼ

ইরাজ কঠিন কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। বিরক্তিতে বুদ হয়ে অতিষ্ট ভঙ্গিতে মেঘালয়ার সামনের সোফায় এসে বসল। মেঘালয়া মাথা নত করে হাতের নখ খুঁটছে। ইরাজ কপাল জড়িয়ে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মেঘালয়া বলে ওঠে, “কিছু জটিলতায় ভুগছি।ʼʼ

ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে ইরাজ, “কাব্যিক হয়ে উঠছিস নাকি?ʼʼ

মেঘালয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, “কাব্যিক? নাহ.. মানে! আমি নিজের ভেতরে অবস্থা বুঝতে পারছি না। মিশ্র অনুভূতি আর চিন্তারা জ্বালাতন করছে। অনেক কৌতৃহল আর প্রশ্ন জমেছে।ʼʼ

ইরাজ নির্লিপ্ত নজরে নিচের দিকে চেয়ে, সামনের চুলগুলো মুচরে ধরে পেছনে ঠেলে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত তোর?ʼʼ

মেঘালয়া নাক কুঁচকাল। তবে জবাব দিল, “হুম? আঠারো পার হয়েছে। বোধহয় ঊনিশ! না, হ্যাঁ! মানে আব্বু জানে। আসলে আমিও জানি, ঊনিশ।ʼʼ

ইরাজ শীতল দৃষ্টিতে সামান্য সময়ের জন্য মেঘালয়ার অতি চঞ্চল চোখে দৃষটিপাত করল। নজর নামিয়ে বলল, “এ বয়সে এমন অস্থিরতা কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। এমন হয়।ʼʼ

“কী হয়?ʼʼ সরল প্রশ্ন মেঘালয়ার।

ইরাজ এবার শান্ত দৃষ্টি ঠিক মেঘালয়ার দৃষ্টিতে ফেলল। তাতেই যেন আরও অশান্ত হয়ে ওঠে মেঘালয়া। শীতল স্বরে বলল ইরাজ, “তোর কী হচ্ছে?ʼʼ

মেঘালয়া মাথা দুদিকে দুলায়, “উহু। আমার সকল জটিল কৌতূহল আপনাকে ঘিরে। সবারই তো বয়স ঊনিশ হয়। তাদের কাছে তো আর আপনি থাকেন না! তো সবার কি হয় তাহলে? মানে— কি নিয়ে এমন অসস্তিতে ভোগে তারা?ʼʼ

ইরাজ সে-সবের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কৌতূহল গুলো বল।ʼʼ

মেঘালয়া থমকে যায় এবার। কিছুটা সময় নিলো। অতঃপর ধীর-স্থির কম্পমান কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “তাবির, তাবিরের সঙ্গে আপনার যে ঝামেলা হয়েছিল, তা আপনি আমাদের কলেজে যাওয়ার কারনেই হয়েছিল! আপনি কেন যেতেন আমাদের কলেজে?ʼʼ

বলেই ইরাজের দিকে তাকায়। ইরাজ ঠাণ্ডা নজরে তাকিয়ে আছে। মেঘালয়া ব্যস্ত হয়ে ওঠে, বুঝানোর মতো করে বলে ওঠে, “না মানে, আমি জানি, ওটা আপনারও কলেজ। আপনি সেখানকার প্রাক্তন ছাত্র। কিন্ত শুধু কি এ কারনেই যেতেন রোজ আমাদের কলেজে?ʼʼ

ইরাজ কিছুক্ষন চুপচাপ চেয়ে রইল মেঘালয়ার চোখের দিকে। মেঘালয়া চেয়েও দৃষ্টি সরাতে পারে না ইরাজের দৃষ্টি থেকে। আচমকা উঠে দাঁড়াল ইরাজ। অদ্ভুত স্বরে বলল,

“দামী জিনিস চোখে চোখে রাখতে হয়, জানিস তো! ওই কলেজে আমার এক মূল্যবান সম্পদ ছিল। তাতে নজর রাখতে যেতাম। এখন ঘুমা।ʼʼ

মেঘালয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকাল ইরাজের দিকে। কি বুঝল কে জানে! কিঞ্চিত হাসির ফুটে উঠল যেন ঠোঁটের কোনে। ইরাজ হাঁটতে অগ্রসর হলে পেছন থেকে চঞ্চল কণ্ঠে বলল, “আমার প্রশ্ন শেষ হয় নি।ʼʼ

ইরাজের কণ্ঠস্বর যেন গম্ভীর শোনায় এবার, “আমার উত্তর শেষ।ʼʼ

“আচ্ছা, আর প্রশ্ন করছি না। বসুন এবার।ʼʼ

ইরাজ কপাল জড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল।

“তোর সঙ্গে এই প্যানপ্যানানি প্যাঁচাল পারব রাতভর?ʼʼ

“উহু!ʼʼ মনঃক্ষুন্ন হয়ে ধীরে জবাব দেয় মেঘালয়া। মাথাটা নত করে বসে রইল। চমকে উঠল সেকেন্ড কয়েক পর— ইরাজ ধপ করে বসে পড়ে আবার সোফাটির ওপর। তবে মেঘালয়া তাকিয়ে দেখল না। ইরাজ ধমকে ওঠে, “ন্যাকামি চরম অপছন্দের আমার। কেন বসতে বললি?ʼʼ

মেঘালয়া কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “এ বাড়িতে এমনিতেও তো স্থায়ী নই আমি, তাই-না! খুব বেশি সময় জায়গা হবে না এখানে আমার।ʼʼ

আরও কিছু বলবে, তার পূর্বেই ইরাজ রসিকতা করে বলে ওঠে, “এত মোটা হয়ে যাবি তুই? আমার বাপের এত বড়ো বাড়িতে আঁটবে না তোর শরীর?ʼʼ

মেঘালয়া ধাক্কা খেল, এমন এক সময় এরকম একটা কথা শুনে। হাঁ হয়ে গেল মুখটা। ভেতরে নিঃশব্দে প্রশ্ন করে ওঠে, ‘অ্যাঁহ!’

কথাটা বুঝতেই কেন জানি অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে ওঠে। মাথাটা নামিয়ে নিলো হাসিমুখে। ইরাজ কেমন করে যেন চেয়ে রয় মেঘালয়ার বাঁকা চাঁদের ন্যায় হাস্যজ্জল ঠোঁটের দিকে। চোখ সরল না। ঠোঁটের দুকোন বেঁকে আছে মেঘালয়ার। মাথা নিঁচু করে থাকায়, সামান্য দেখতে পাওয়া যায় আকস্মিক হেসে ওঠা ঠোঁট। কোন এক আবেশে চেয়ে রইল ইরাজ। বুকে অদ্ভুত জ্বালা অনুভব করে। কোথাও তিরতির করে উঠছে, নিভু-নিভু আগুন যেন দমকা বাতাস পেয়েছে। আবার খড়ের গাদায় দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠতে চাইছে।

মেঘালয়া হাসিমুখেই তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজের এই অদ্ভুত দৃষ্টিপাত সম্পূর্ন নতুন। মেঘালয়ার ভেতর থমকে যায়। হাসিটুকু মিশে যায়, বাঁকানো ঠোঁট জায়গায় ফিরে মিলিত হলো। ইরাজ তাৎক্ষণিক দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাল। চোখ বুঁজে শ্বাস নিলো। অর্ধভেজা এক ঢোক গিলল। তাতে তার গলায় দৃশ্যমান স্বরযন্ত্রের উঁচুস্থানটি নড়ে উঠে ব্যাপক আন্দোলনে। নজর এড়ায় না মেঘালয়ার বিষয়টি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গলা অবধি নেমেছে হালকা করে। তার ওপর সেই পুরুষের বিশেষত্ব— উঁচু হয়ে থাকা দৃশ্যমান স্বরযন্ত্রের কম্পন দৃশ্যে মেঘালয়া কি বিমোহিত হলো!

মেঘালয়া দৃষ্টি সরে আসে ইরাজের কঠিন স্বরের বলা নিষেধাজ্ঞায়, “হাসবি না তুই, মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া কি বুঝল কে জানে! আবার লাজুক হেসে ওঠে। ইরাজ এবার কোনভাবেই তাকাল না। মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতায় কেঁটে যায়। দুজনের দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝেতে। নিরবতা ভঙ্গ করে মেঘালয়া।

“আপনি জটিল।ʼʼ

“কতটা?ʼʼ

“না পড়া বইয়ের মতো।ʼʼ

“তাতে কী?ʼʼ

“পড়ে দেখতে ইচ্ছুক আমি। শুরু করেছি পড়তে।ʼʼ

সামান্য চমকেই যেন তাকাল ইরাজ। হাসল সামান্য। মেঘালয়া আবার থেমে যায়। দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়। সাহস হয় না ওই পোড়া ঠোঁটের রহস্য হাসিতে দৃষ্টি ধরে রাখার। ইরাজ হাসিটা গিলে নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে, মেঘালয়াকে যেন তুচ্ছজ্ঞান করে বসল। ভাব নিয়ে বলল,

“জটিল কেন আমি?ʼʼ

মেঘালয়া সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বরঞ্চ নিজে প্রশ্ন করল,

“তখন ফুসকা খেতে চেয়েছিলাম, যে খিস্তি ঝাড়লেন— পরে আবার তা কিনে এনেছেন কেন?ʼʼ

ইরাজ চুপচাপ নিচের দিকে চেয়ে রয়। খানিক সময় পর মুখ তুলে, দুষ্টু হাসল। সেই বদ-হাসি ঠোঁটে রেখেই জবাব দেয়,

“মানুষের হউত-মউতের কথা বলা যায় না। অত করে চাইলি, না খেয়ে যদি এর মাঝেইʼ— বলেই হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে ওপরের ইশারা করে বলল, “টপকে যাস, তারপর পেত্নী হয়ে ভয় দেখাবি, আল্লাহর কাছে দায়ী থাকব এমনকি সবচেয়ে বড়ো ভয়, যদি দ্বিতীয় বউ নিয়ে সুখে সংসার করতে না দিস? ভয়ে এনেছি।ʼʼ বলেই মাথা দুলায়।

মেঘালয়া চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইল। ইরাজ মেঘালয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে এবার শব্দ করে হেসে উঠল। তা দেখে কি হলো কে জানে— মেঘালয়া নিজেও ফিক করে হেসে ওঠে।

অতঃপর বলল, “যতবার ফুসকা খেয়েছি— আব্বু আর নয়ত বান্ধবীরা সাথে থেকেছে। এ রুমে তো আর তাদের কেউ উপস্থিত নেই।ʼʼ

ইরাজ কথা কেড়ে নেয়, “তুই যদি মনে করে থাকিস, তাদের জায়গায় প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ার মাধ্যমে আমায় বসাবি, তাহলে খুব শীঘ্রই তোর কানটা গরম হতে যাচ্ছে।ʼʼ

মেঘালয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “একবার টেস্ট করে তো দেখুন। যত্ন করে নিজ হাতে বানিয়ে দেব।ʼʼ

ইরাজ তড়িঘড়ি উঠে দাড়ায়, “চটাং করে মারব এক চড়! তুই খা বেশি করে, আমার পোষাবে না ওসব আজুবাজু জিনিস।ʼʼ

মেঘালয়া ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। নির্বিকার চিত্তে ভাবলেশহীন জবাব দিল, “আমারও।ʼʼ

ইরাজ ঘুরে তাকাল। বসল সোফায় আরাম করে। মেঘালয়া খুশি হয়। দ্রুত প্যাকেট ছিঁড়ে ফুসকা বের করতে উদ্যেত হয়। ইরাজ আস্তে করে প্যাকেটটি মেঘালয়ার হাত থেকে নিলো। দারুন খোশ-মেজাজে বলল, “তুই তো আর আমায় ছাড়া খাবি না। এতে ডাস্টবিনের হক আছে, বুঝলাম। দে।ʼʼ

বলেই প্যাকেট নিয়ে হাঁটা ধরে। মেঘালয়া কয়েক সেকেন্ড অবুঝের মতো বসে থেকে, যখন বুঝল ব্যাপারটা— ইরাজের পেছনে দৌড় লাগায়, “দিন, বলছি। খেতে হবে না আপনার। ইরাজ ভাই, আমার ফুসকা।ʼʼ

বলতে বলতেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে সিঁড়ির প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে এলো দুজনে। পেছন থেকে মেঘালয়া তাড়া করতে করতে ডেকে ওঠে, “ইরাজ ভাই! আমার ফুসকা!ʼʼ

ইরাজও ওই একই সুরে বলল, “হ বইন, তোর ফুসকা। তা খুব শীঘ্রই ডাসটবিনে যাবে।ʼʼ

নিঁচে নেমে আসে দুজনে ধরাধরি করতে করতে। এক পর্যায়ে, ইরাজ নির্লিপ্ত আর মেঘালয়া থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সম্মুখে থমথমে মুখে দাড়িয়ে আছেন আনতারা খানম। ইরাজ ফুসকার প্যাকেটটি মেঘালয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় আস্তে করে। ভাবলেশহীন হেলেদুলে হেঁটে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। মেঘালয়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল কেবল।

রাত প্রায় দু’টোর কাছাকাছি!

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৮

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

৮.

রাস্তায় চলতে চলতেই ইশার আজান পড়ে গেল। মেঘালয়ার মনে অদ্ভুত কিছু চলছে। যা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। চারদিকের এই চলমান আধো-অন্ধকার রাতের পরিবেশ মনে দোলা দেয় ওর।

বাজারের মাঝ দিয়ে অতিক্রম করার সময়, আকস্মিক মেঘালয়া চিৎকার করে ওঠে, “থামুন, থামুন ইরাজ ভাই। থামুন!ʼʼ

ইরাজ বিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি বাইকের ব্রেক কষে ধরল। মেঘালয়া নেমে দাঁড়ায়। ইরাজ কপাল কুঞ্চিত করে তাকাল, “কি সমস্যা তোর?ʼʼ

এবার সংকোচে পড়ে যায় মেঘালয়া। উত্তেজনায় ইরাজকে থামিয়েছে তো। এবার? দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে হাতের বামদিকে আঙুল দ্বারা ইশারা করল। ইরাজ তাকায় সেদিকে। মুখ-চোখ জড়িয়ে চেয়ে রইল। সামনে ফুসকার স্টল। ফিরে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়া মাথাটা নত করে নিলো। আবার চোখ উঠিয়ে ইরাজের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল, “ফুসকা খাব।ʼʼ

“তো খা গিয়ে। নিষেধ কে করেছে?ʼʼ

“আর আপনি?ʼʼ

“তোর আর আমার রুচিবোধ গুলিয়ে ফেলছিস নাকি? ওসব থার্ডক্লাস, ফালতু জিনিস আমার পোষায় না।ʼʼ

মেঘালয়া এবার ক্ষেপে ওঠে, “ফুসকাকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবেন না। আপনার রুচিতে সমস্যা আছে। নয়ত ফুসকা অপছন্দ হতো না। আপনার মতো লোকের ভালো কিছু ভালো নাই লাগতে পারে। তাই বলে, সে জিনিস খারাপ না। আর এসব আপনার পোষাবে কেন, আপনার তো পোষায়— ঢকঢক করে যা গিললে টাল হয়ে পড়ে থাকা যায়।ʼʼ

ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। বলল, “আমার হাতে লাস্ট থাপ্পড় কবে খেয়েছিস!ʼʼ

মেঘালয়ার মনে পড়ে, ছোটবেলায় বহুত থাপ্পড় খেয়েছে নিজের উল্টো-পাল্টা কাজ কর্মের জন্য। মুখ শক্ত করে বলল, “টাকা দিন। আমি নিজেই গিয়ে খেয়ে আসছি।ʼʼ

ইরাজ বলল, “খাবি তুই, টাকা আমি কেন দেব, আজব! আর খেয়ে কোথায় আসছিস? তোর মনে হয়, আমি তোর খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব?ʼʼ

এবার মেঘালয়া খানিকটা দমে যায়, ভেতরে অদ্ভুত এক অভিমান চেপে গেল। সেই অভিমান নিয়েই বলল, “তো নিতে এসেছেন কেন?ʼʼ

“দায়িত্ববোধ।ʼʼ

মেঘালয়া প্রশ্ন করে, “শুধুই দায়িতববোধ?ʼʼ

‘হু, তোর বাপের তুলে দেওয়া আমার ঘাঁড়ে শুধুই এক দায়িত্ব আজ তুই।ʼʼ

মেঘালয়া হুট করে প্রশ্ন করে ওঠে, “আজ! আর আগে কি ছিলাম, ইরাজ ভাই।ʼʼ

ইরাজ সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। সে ভুলেও মেঘালয়ার দিকে তাকায় না সচরাচর। এখনও ওই সামনের দিকে তাকিয়েই, গম্ভীর ভারী আওয়াজে বলল,

“দু সেকেন্ডের মধ্যে বাইকে উঠবি, নয়ত তোকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া অসম্ভব না আমার জন্য, তুই জানিস।ʼʼ

মেঘালয়া দীর্ঘ এক প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নিলো। ইরাজ ওর কাছে দিন-দিন আরও দুর্বোধ্য আর জটিল হয়ে উঠছে। যাকে ধরা যায় না, বোঝা যায় না, না ছোঁয়া যায়, আর না যায় বিশ্লেষণ করা।


বাড়িতে প্রবেশ করেই মেঘালয়া আগে আগে ভেতরে যায়। থমথমে মুখে সম্মুখে এসে দাঁড়াল আনতারা খানম। ভারী মুখটা দেখে মেঘালয়ার বুকটা কিঞ্চিত কেঁপে ওঠে। তখন পেছনে এসে দাঁড়াল ইরাজ। মেঘালয়াকে উদ্দেশ্য করে আনতারা খানম বেজায় অসন্তুষ্ট চিত্তে কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তা কোথায় গিয়েছিলে আবার কার সাথে? আমার ছেলেকে তোমার বাবা রক্ষাকর্তা নিযুক্ত করেছে নাকি? তুমি যা অকাম-কুকাম করবে, যখন ইচ্ছে, যার সাথে ইচ্ছে চলে যাবে, রাজ গিয়ে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনবে!ʼʼ

মেঘালয়া মাথাটা সামান্য নত করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আনতারা খানম এবার চিৎকার উঠে উঠলেন,

“কি হলো কথা বলছ না কেন? তুমি কোথায় কি করে আসবে, তার দায় আমার ছেলে এবং আমরা নেব? লজ্জা করল না তোমার বাবা আর তোমার? এরকম একটা বিষয় লুকিয়ে মেয়েকে আমার ছেলের ঘরে তুলে দিলো?ʼʼ

মেঘালয়া মৃদূ প্রতিবাদের স্বরে বলল, “বাবাই আর ইরাজ ভাই জানত।ʼʼ

“বাহ। উত্তরও আছে দেখছি তোমার কাছে? আমার থেকে কেন লুকিয়েছে তোমার বাবা? বিয়ে হতে দিতাম না বলে? মেয়েকে বিদায় করতে এমন নিঁচু আয়োজন যার বাবার, তার মেয়ে এমন কিছু করবে, এটা অসম্ভব কিছুনা।ʼʼ

এবার আর মেঘালয়ার সইল না। ভেতর পুড়ে উঠল এমন কথায়। তবুও শক্ত হয়ে, কঠিন চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। ইরাজও গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে পাশেই। আনতারা খানম আকস্মিক দরজার দিকে আঙ্গুল ইশারা করে মেঘালয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,

“বেরিয়ে যাও। তুমি অন্তত ততদিন আমার সম্মুখে আসবে না, যতদিন না এর কোন বিহিত হয়। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।ʼʼ শেষের কথাটুকু জোর দিয়ে বললেন।

মেঘালয়া ধীর পায়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। আচমকা খপ করে ওর হাত চেপে ধরল ইরাজ। আজ প্রথমবার ইরাজ ইচ্ছাকৃত মেঘালয়াকে স্পর্শ করল। মেঘালয়া ফিরে চায়না। হাত মোচড়া-মুচড়ি করে ছাড়া পেতে। ইরাজ আরও শক্ত করে চেপে ধরে একটানে সামনে এনে দাঁড় করালো। মেঘালয়া চোখ লাল হয়ে উঠেছে। চোখে পানি টলমল। তবে গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না মেয়েটা। ইরাজ হুংকার ছেড়ে আদেশ করে, “ওপরে যা।ʼʼ

মেঘালয়া আগের মতোই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইরাজ অপর হাত দ্বারা এবার ওর মুখটা উঁচিয়ে ধরল। চোখাচোখি হতেই এক ফোঁটা পানি চোখ ছাপিয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ল, উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠা মেঘালয়ার গাল বেঁয়ে। ইরাজ শীতল স্বরে ভারী আওয়াজে আবারও বলে ওঠে, “ওপরে যেতে বলেছি, মেঘ। আমি আমার স্টাইলে কিছু করলে তা খারাপ হবে তুই জানিস। যা বলছি কর।ʼʼ

মেঘালয়া এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিড়ির দিকে চলে গেল। আর পেছনে ফিরে চায় না।

ইরাজ ঠোঁট গোল করে গাঢ় শ্বাস ফেলল। অতঃপর ভাবলেশহীন ভঙ্গিমায় বসার রুম অবধি হেঁটে যায়। আনতারা খানম চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। ইরাজ হেঁটে গিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা পানির পট বের করল। এসে সোফায় বসল। আনতারা খানম গম্ভীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন ছেলের সম্মুখে। ইরাজ ঢক-ঢক করে পানি গিলছে। আনতারা খানম যথাসম্ভব শান্ত করে নিলেন নিজেকে। ইরাজের সঙ্গে বাঁকা কথা বলে লাভ নেই। ধপ করে বসলেন ইরাজের সামনের সোফাটির ওপর। ইরাজ পানি খাওয়া শেষ করে ওয়াটার পট টি-টেবিলের ওপর রাখে।

“বড়ো মায়া জেগেছে ওই অন্য ছেলের সাথে ভেগে যাওয়া বউয়ের জন্য!ʼʼ মায়ের কণ্ঠে অভিমান স্পষ্ট।

ইরাজ তা দেখেও দেখল না। অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “আম্মা! আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে ভেগেছিল, মেঘ। অর্থাৎ তখন ও আমার বউ ছিল না।ʼʼ

আনতারা ছেলের দিকে তাকালেন, “তোর সবকিছু মজা লাগছে, রাজ?ʼʼ

“না।ʼʼ

“লজ্জা করেনি? ওই চরিত্রহীন মেয়েকে বিয়ে করতে, জেনে শুনে? তোর বাপ তো বন্ধুত্বে অন্ধ। আমি জানতাম আমার ছেলের আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল।ʼʼ

ইরাজ মায়ের দিকে তাকাল। শান্ত স্বরে বলল, “হেলাল আঙ্কেল খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।ʼʼ

“মেয়ের কুকর্ম ঢাকতে এরকম বহু নাটকে করে মানুষ।ʼʼ

“হুম, বুঝলাম।ʼʼ— ইরাজের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। যেন কিছুই হয়নি।

“ওই মেয়ে এ বাড়িতে থাকবেনা।ʼʼ

নির্বিকার জবাব দেয় ইরাজ, “ও আচ্ছা! কোথায় রাখতে চাইছ ওকে?ʼʼ

“জাহান্নামে।ʼʼ চিৎকার করে ওঠেন আনতারা খানম।

ইরাজ মুখ চেপে ধরল হাত দ্বারা, “আম্মা! তুমি মেঘাকে খু ন করার পরিকল্পনা করছ নাকি? না মরলে তো কেউ জাহান্নামে যায় বলে জানা নেই আমার।ʼʼ

ইরাজের এমন নির্লিপ্ত জবাব শুনে আনতারা খানম ক্রোধে ফেটে পড়েন যেন।

“পারলে আমি তুই আর তোর বাপকে খু ন করে ফেলতাম। লোকে আমাকে রাস্তায় ধরে অপমান করে? এই সুযোগটা তোরা দুজনে করে দিয়েছিস। এ বাড়িতে তোদের সামনে থাকতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার।’ʼʼ

ইরাজ মাথা দুলায়, “হুমমম, বুঝলাম। তারপর?ʼʼ

আনতারা খানম ইরাজের কাছে এর চেয়ে বেশি আশাও রাখেন না। তার ছেলে যে কত বড়ো ছন্নছাড়া তা তার অজানা নয়। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইলেন ইরাজের মুখের দিকে। ইরাজ ফোনে ব্যস্ত। খানিকটা শান্ত স্বরে ডাকলেন, “রাজ!ʼʼ

ইরাজ একটু পর চোখ তুলে মায়ের দিকে চাইল। মাথাটা একবার উপর-নিচ দুলিয়ে বলল, “জি!ʼʼ

“তুই মেঘাকে ছেড়ে দে। ওই মেয়ে যতদিন এ বাড়িতে তোর পরিচয়ে থাকবে, শুদুই বদনামী আর সম্মানহানীর কারন হবে, এ বাড়ি, তোর বাবা, তোর। ওকে বিদায় কর।ʼʼ

“হেলাল আঙ্কেলের স্ট্রোক হয়ে যাবে।ʼʼ

“হেলাল ভাইজানের চিন্তা করছিস নাকি নিজের? কারন তুই যে নিজের বাপের চিন্তাও করিস না, তাও সকলের জানা।ʼʼ

ইরাজ এড়িয়ে গেল কথাখানা। বুঝানোর মতো করে বলল, “আম্মা! তুমি এত রাগ করছ কেন, জানো? কারন তোমাকে আগে জানানো হয় নি। নয়ত আমার আম্মা এত নিষ্ঠুর না। আর কোন আক্রোশ নেই তোমার মেঘ এর প্রতি।ʼʼ

ইরাজের কথাটা খোশামদের মতো লাগে। নতুন লাগল ইরাজকে। এ ইরাজকে অপরিচিত লাগে কেমন জানি। কারণ ইরাজ মাত্রাতিরিক্ত বেপরোয়া। অথচ আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে ওর আচরণ। আনতারা খানম সন্দিগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকালেন ছেলের দিকে। বললেন,

“রাজ! তুই মেঘালয়ার প্রতি দুর্বল! তুই রাখতে চাইছিস ওকে? লজ্জা করছে না তোর?ʼʼ

“অন্তত লজ্জা আমার নেই।ʼʼ

বলেই উঠে দাঁড়াল। আনতারা খানম বলে ওঠেন, “প্রশ্ন এটা ছাড়াও আরও দুটো করেছি।ʼʼ

ইরাজ হেঁটে দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে পেছন না ফিরেই জবাব দিলো, “হুম, শুনেছি।ʼʼ

বলেই দরজা দিয়ে বের হয়ে বাইরে চলে গেল। আনতারা খানম চোখ-মুখ কুঞ্চিত করে, অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বসে রইলেন সোফায়।

_

মেঘালয়া ঘন্টাখানেক বালিশে মুখ গুঁজে পাগলের মতো কেঁদেছে। চিৎকার করে কেঁদেছে, তবে মুখ চেপে। যা গোঙানির মতো শুনতে লাগে। ঘন্টাখানেক পর উঠে বসল। কিছুক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো বসে থেকে, ওয়াশরুমে চলে যায়।চোখ-মুখ ফুলে উঠেছে। মুখ লাল, চোখের ভেতরের শিরা-উপশিরা রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। চোখে-মুখে পানি দিলো। অতঃপর আস্তে করে হেঁটে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়াল। এই ছোট্ট জীবনে কয়েকদিনের বিক্ষিপ্ততা ওকে অনেক অভিজ্ঞ করে তুলেছে। আকাশের দিকে চেয়ে রইল উদাস চোখে।

রাত এগারোটার দিকে ইরাজ বাড়ি ফেরে আবার। ওকে দেখেও আনতারা খানম আর কোন কথা বললেন না। ইরাজও নীরব পায়ে নিজের রুমে এলো। হাতে থলের মতো কিছু একটা। সেটা রাখল সোফার পাশে। মেঘালয়াকে রুমে না দেখে গম্ভীর সুরে ডাকে, “মেঘ! মেঘ! রুমে আয়, দ্রুত!ʼʼ

মেঘালয়ার আসতে ইচ্ছে করে না। কিছুই ভালো লাগছে না। ইরাজ আবার ডেকে ওঠে, এবার স্বরটা আরও ভারী শোনায়। না চাইতেও রুমে এসে দাড়ায় মেঘালয়া।

ইরাজ শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বলল, “চোখে কি মৌমাছির চাক বসেছিল নাকি?ʼʼ

মেঘালয়া উত্তর দেয় না। ইরাজ তাকাল ওর দিকে।

“বোবায় ধরেছে নাকি তোকে?ʼʼ ধমকে উঠল ইরাজ।

মেঘালয়া কণ্ঠ বসে গেছে অতিরিক্ত কাঁদার ফলে। ওভাবেই বলল, “বিশেষ কোন কাজ আছে? কেন ডাকছেন?ʼʼ

কঠিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ইরাজ। সোফার পাশে টেবিলে রাখা প্যাকেটের দিকে ইশারা করে বলল, “ওটা খোল।ʼʼ

বলেই তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়, হাত-মুখ ধোঁয়ার উদ্দেশ্যে।

মেঘালয়ার কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে, তাকিয়ে রইল প্যাকেটটির দিকে। কৌতুহল জাগে, কি আছে ওটাতে?
সোফায় গিয়ে বসে প্যাকেটটি হাতে নিলো। খুলে ফেলল। অবাক হয়ে বাথরুমের দরজার দিকে তাকায়। প্যাকেটে অনেকটা ফুসকা। যা মেঘালয়ার একার পক্ষে খেয়ে শেষ করা হয়ত সম্ভব না আপাতত। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বাথরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল কেবল অদ্ভুত চোখে!

চলবে।

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৭

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

৭.

সন্ধ্যার আকশে বাঁকা চাঁদের পাশে শুকতারা জ্বল জ্বল করছে। চারদিকটা বেশ নিরব প্রায়। মেঘালয়া পুরো শরীর ঘামছে। খুব অস্থির লাগছে। সামনে দাঁড়ানো ছেলে দুটো ওকে আপাদমস্তক পরখ করে দেখছে বারবার নির্লজ্জের মতো। ছেলেগুলোর মাঝে একজন বলে উঠল,

“একা বইসা আছো ক্যান? কোথাও যাইবা নাকি?ʼʼ

মেঘালয়া ঘাঁড় নাড়ল। ভেতরে ভয় কাজ করলেও, বাহ্যিকভাবে নিজেকে যথাসম্ভব দমন করে সামলে রেখেছে। ছেলে দুটো মিটিমিটি হাসছে। পাশে বসে থাকাগুলো নিজেদের মাঝেই কি আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। এদিকেই তাকিয়ে মাঝে মধ্যে হেসে উঠছে। ছেলেটি আবারও জিজ্ঞেস করল, “কোথাও গেলে চলো, আমরা নিয়ে যাই। সহি-সালামতে পৌঁছায়া দিতাম।’ʼ

পেছন থেকে আচমকা হাস্যজ্জল কণ্ঠস্বর ভেসে আসল, “অথচ সে সহি-সালামত ফিরতে চায়না।ʼʼ

ছেলেদুটোর মাঝে একজন বলে ওঠে, “তুই কে রে? যা এখান থেকে। আমাদের মামলা আমরা বুঝে নেব।ʼʼ

ইরাজ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত ওপরে তুলে মাথা নত করে বলল, “সরি, সরি ভাইজান। তবে এটা মামলা চলছে? উমমম, দেখে তো আদালত মনে হচ্ছে না?ʼʼ

অতঃপর হাত নিচে নামিয়ে, তীর্যক দৃষ্টি মেলে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। ছেলে দুটো সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘালয়ার। ইরাজ বেঞ্চের পেছনের দিকটায় দাঁড়ানো। ও চাইলেও ওদের পার করে ইরাজের কাছে আসতে পারবে না। ইরাজ কঠিন স্বরে ধমকে উঠল, “ওঠ! উঠে পড় ওখান থেকে, নয়ত আজীবনের মতো পঙ্গু করে দেব।ʼʼ

মেঘালয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। ইরাজ এবার এগিয়ে গেল হাসিমুখে। ছেলেদুটোকে মৃদূ ধাক্কা দিয়ে, সরিয়ে মেঘালয়ার হাতটা চেপে ধরল। মেঘালয়া ইরাজকে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়ায়। ইরাজ ওকে নিজের পাশে দাঁড় করাল। এসব এতক্ষণে পাশে বসে থাকা বখাটেগুলো দেখছিল। এবার উঠে এলো। এসেই পকেট থেকে মাঝারি এক ছুরি বের করল। ইরাজ দেখছে সবটা শান্ত চোখে। এসেই ছুরি নাচিয়ে ইরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কে রে তুই? মাইয়ারডার প্রতি দরদ দেখাইতাছস বড়ো?

ইরাজ হেসে উঠল। হাসিমুখেই বলল, “আমার বুকিংয়ে আছে রে। যা এডভান্স দিয়েছি, তা উসুল করে ছেড়ে দেব। তখন চান্স নিস না হয়। এখন যা।ʼʼ

এরকম একটা বিশ্রী ইঙ্গিতের কথায়, মেঘালয়া মুখ বিকৃত করল। ইরাজ এতক্ষণেও হাতটা ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো হাতটা ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্ত কিসের এক জড়তায়, কেন জানি ছাড়তে ইচ্ছে করল না।

ইরাজের বলা কথায় পরে আসা ছেলেগুলোর মাঝে একজনের কেমন কণ্ঠটা পরিচিত ঠেকল। সে ফোনের ফ্লাশ করে ইরাজের মুখ বরাবর ধরল। ইরাজ চোখ বুঁজে, মুখ কুঁচকে বকে ওঠে, “শা লা, মুখ আলো দিচ্ছিস?ʼʼ

ইরাজকে দেখে ছেলেটা থমকে গেল। দ্রুত বলে ওঠে, “ইরাজ ভাই!ʼʼ

ইরাজ শান্ত নজরে তাকাল। খানিকটা এগিয়ে গেল। আচমকা ঠাস করে থাপ্পড় বসাল ছেলেটির গালে। ছিটকে পড়তে নেয় ছেলেটি। তবে সামলে নিলো নিজেকে।


ফিরে যাওয়া নিয়ে বিপত্তি বাঁধল। মেঘালয়া বাড়ি ফিরবে না। ইরাজ মুখ বেঁকিয়ে বলল, “তো তখনই বলতি, ওদের সাথে যাওয়ার ছিল। আমি আর ওদের ভাগিয়ে দিতাম না। ন্যাকা! বাল, যাবি কিনা বল। আমি বাড়ি ফিরব। তোর পেছনে ফালতু সময় নষ্ট করার ইচ্ছে নেই।ʼʼ

মেঘালয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ইরাজের দিকে। অসন্তুষ্ট চিত্তে বলল, “আমি বলেছি যাব ওদের সাথে?ʼʼ

ইরাজ আর কথা বলল না। চুপচাপ ধীর পায়ে হেঁটে এসে মেঘালয়ার পাশে বসল। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। চারপাশে ঝিঝি পোকার ডাকে রাতের পরিবেশটা আজব রূপে সেজেছে।বেশ কিছুক্ষণ পর ধীর-স্থির কম্পমান স্বরে মেঘালয়া প্রশ্ন করে, “আপনি ঘৃনা করেন আমায়?ʼʼ

“দেরী হচ্ছে, যাবি তো চল।ʼʼ

“আমি বাড়ি না গেলেও, আপনি ফিরে যাবেন?ʼʼ

ইরাজ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, বিরক্ত হয়ে বলল, “আর কতক্ষণ বসে থাকবি এখানে?ʼʼ

“আপনি সোজা জবাব দিতে পারেন না?ʼʼ

“আমি গোটাটাই বাঁকা, উত্তর সোজা হবে কোন দুঃখে?ʼʼ

মেঘালয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর আবার জিজ্ঞেস করল, “কি করে জানলেন আমি এখানে?ʼʼ

“মোল্লার দৌড় মসজিদ অবধি।ʼʼ

মেঘালয়া তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজ পকেট থেকে সিগারেট বের করে তাতে আগুন জ্বালায়। নাক-মুখ ভরে ধোঁয়া ছাড়ল। মেঘালয়া বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আড়ষ্টতার সাথে প্রশ্ন করে, “আপনি কেন ঘৃনা করেন আমায়?ʼʼ

“তাবিরের কাছে ফিরতে চাস?ʼʼ

মেঘালয়া বিষ্মিত নয়নে চেয়ে রইল। কারণ ইরাজের জানার কথা নয়, সে কার সঙ্গে পালিয়েছিল। তাবির চলে যাওয়ার পর ইরাজ সেখানে পৌঁছেছিল। বলল, “আপনি চেনেন ওকে?ʼʼ

সিগারেটে বড়ো একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটুকু গিলে নিয়ে উত্তর দিলো, “তাবিরের তোর সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়া একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।ʼʼ

মেঘালয়া বিষ্মিত চোখ জোড়ায় এবার কৌতুহল ছেয়ে যায়। জিজ্ঞেস করল, “কিসের চ্যালেঞ্জ?ʼʼ


মেঘালয়া ইরাজের বাবার বন্ধুর মেয়ে। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই পরিচয় ছিল দুজনের। তবে ইরাজ একটু ঘাঁড় ত্যাড়া আর বাজে স্বভাবের। তার মুখে সোজা বা মিষ্টি কথা বিরল। মেঘালয়াকে সর্বদা চোখে চোখে রেখেছে। সবকিছুতে হেলাল সাহেবের চেয়ে বেশি কড়া শাসনে রাখত ইরাজ। এমনকি স্কুলের পড়া শেষে, মেঘালয়াকে নিজের প্রাক্তন কলেজে ভর্তি করিয়েছিল। মেঘালয়ার যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। হল থেকে বাড়ি ফিরলে প্রায় দিনই ইরাজ যেত মেঘালয়ার কলেজে ওকে দেখতে।

একদিন যখন কলেজের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ একটা ছেলের দল এসে দাঁড়াল সামনে। তাতে ইরাজের কোন যায়-আসে না। সে দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত। অথচ হঠাৎ-ই চোখে পড়ল, একটি মেয়ে ওদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়, ছেলেগুলোর মাঝে একজন হাত চেপে ধরল। মেয়েটির মুখে চোখে সংকোচ। ইরাজ ভ্রু কুঁচকে দেখছে সবটা। ছেলেটি এবার জোর করে একটা কাগজের টুকরো ও ফুল ধরিয়ে দিলো। মেয়েটি তা ফেলে দেয়। আচমকা ওদের মাঝ থেকে একটা ছেলে সকলের সামনে মেয়েটিকে কষে থাপ্পড় লাগাল। কর্কশ স্বরে বলে ওঠে, “অতিরিক্ত সাহস দেখাতে নেই। সিনিয়রদের সামনে তো মোটেই না।ʼʼ

ইরাজ এগিয়ে গিয়ে দ্বিগুন জোরে থাপ্পড় লাগায় ছেলেটির গালে। এবং সেই একই ভঙ্গিতে বলল, “অতিরিক্ত সাহস দেখাতে নেই। সিনিয়রদের সামনে তো মোটেই নয়।ʼʼ

অতঃপর গালের দুপাশ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, “তা সিনিয়র, নাম কি তোর?ʼʼ

ছেলেটি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে কেবল ইরাজের দিকে। ইরাজ আরও জোরে চেপে ধরল গালটা। ধমকে উঠল, “বল!ʼʼ

ছেলেটি ওভাবেই জবাব দিলো, “তাবির।ʼʼ

“কোন ইয়ার?ʼʼ

“অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।ʼʼ

“তো সিনিয়র হলে, মেয়েদের এভাবে ট্রিট করবি?ʼʼ

বলে গালটা ছেড়ে দিলো। তাবির দমল না যেন। বলে উঠল, “ভাই, আপনি কেন দাঁড়িয়ে থাকেন প্রায় দিন এখানে?ʼʼ

ইরাজ ভ্রু উচিয়ে বলে, “তোকে জবাব দিতে বাধ্য নাকি রে আমি?ʼʼ

“আপনি তো প্রতিদিন ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ের জন্য আসেন এখানে।ʼʼ

ইরাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল তাবিরের দিকে। বলল, “তোর মতো রাস্তাঘাটে থাপড়াচ্ছি নাকি তাকে?ʼʼ

তাবির বলে, “ঠিক আছে, আমিও আর থাপড়াব না। এবার আপনার মতোই সুপুষের মতো প্রেম করব তার সাথে।ʼʼ

ইরাজ সিংহর মতো গর্জন করে ওঠে। তাবিরের কলার চেপে ধরে বলল, “মেঘের দিকে তাকালে তোর চোখ দুটো
এ সি ড দিয়ে ঝলসে দেব। ওর ব্যাপারে কোন কথা বলবি তো জ্বিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব।ʼʼ— বিশ্রী ভাষায় বকে উঠল ইরাজ।

তাবির হেসে উঠল। বলল, “ভাই, মাইয়াই যদি দিওয়ানা হয়ে যায় আমার প্রেমে, তো?ʼʼ

ইরাজ ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছটফটিয়ে এবার। ওর গলা চেপে ধরে অশ্রাব্য ভাষায় বকে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “মেঘ ওরকম মেয়েই নয় রে শালা , বুঝেছিস তুই! ওর ধারে কাছে দেখলেও তোকে জীবন্ত পুঁতে রেখে দেব।ʼʼ

কয়েকজন এসে ছাড়াল তাবিরকে ইরাজের থাবা থেকে। তাবির অনবরত কাশতে থাকে। ইরাজকে থামানো যায় না। তাবির কিছুক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে ওভাবেই বলল, “বুঝলাম, আপনার মনে মেয়েটার জন্য বহুত মায়া। মেয়েটার আছে তো আবার এত মায়া আপনার প্রতি?ʼʼ

জলন্ত ইরাজ যেন ধপ করে নিভে যায় এবার। শীতল নজরে তাকাল তাবিরের দিকে। তাবির ভ্রু নাচায়। ইরাজ ভাবে, আসলেই তো! মেঘালয়ার কাছে তো সে কোনদিন নিজের ভেতরে লুকায়িত নরম অনুভূতি প্রকাশ করেনি। আর মেঘালয়ার মাঝেও ইরাজের জন্য তেমন অনুরাগ পরিলক্ষিত হয় নি। তাবির তো ঠিকই বলেছে। তবুও ওর বিশ্বাস ছিল, মেঘালয়া কখনোই তাবিরকে গ্রহন করবে না।

এখানেই একটা ডিল অথবা চ্যালেঞ্জ তৈরী হয়ে গেল, তাবির মেঘালয়াকে নিজের প্রেমে মজিয়ে, পাগল করে ছাড়বে। এবং শেষ অবধি ইরাজ হেরে গেল। জিতে গেল, জেদি তাবির।

এ পর্যন্ত শুনে মেঘালয়া যেন প্রাণহীন পাথর হয়ে গিয়েছে। প্রাণ-স্পন্দনহীন জড়ো বস্তর ন্যায় বসে রইল বেঞ্চের ওপর। ইশার আজান পড়ছে চারদিকে। মেঘালয়া বেশ কিছুক্ষণ পর একবার ঘুরে তাকায় ইরাজের দিকে। ইরাজের দৃষ্টি আকাশের পানে। দ্বিধা-সংকোচে একাকার হয়ে প্রশ্ন করল,

“আমায় নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটাও চ্যালেঞ্জ ছিল?ʼʼ

ইরাজ উত্তর দিলো না। তবে মেঘালয়া এতটাও অবুঝ নয়। নিজের প্রতি আজ নিজেরই বিবেক ঘৃণার বিষাক্ত বান ছুঁড়ছে। কত বোকা আর নির্বোধ মেঘালয়া! তাবিরের প্রতি তার যে অনুভূতিগুলো এই আবেগী বয়সে জন্মেছিল, তা শুধুই কারও অন্যায় জিদকে জিতিয়েছে। ভাবতেই, চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো। নিজেকে ঘৃণা হচ্ছে, বিরক্ত লাগছে নিজের বোকামিগুলো মনে করে নিজেকে। ভাবল, সে নিজেই যখন সহ্য করতে পারছে না নিজেকে, তাহলে আব্বুর রাগটুকু তো ভালোবাসা। ওর একটা ভালো ভবিষ্যতের আশায় আব্বু কী না করেছে! অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ভেতর চিরচির করে পুড়তে থাকে মেঘালয়ার। আপন মনেই নিঃশব্দে ডুকরে কেঁদে ওঠে, আব্বুর কথা মনে করে। মানুষটাকে কতখানি কষ্ট দিয়েছে, তার সবটুকু যেন আজ মেঘালয়ার বুকে ভারী পাথর রূপে চেপে বসেছে।

আচমকা কিছু একটা মনে পড়ায়, হুট করে ইরাজের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকাল।

“আপনি কেন যেতেন রোজ আমার কলেজের সম্মুখে?ʼʼ

ইরাজ উঠে দাঁড়াল। সোজা হাঁটতে হাঁটতে কঠিন স্বরে বলল,

“গেলে আয়, নয়ত তোর ফালতু প্যানপ্যানানি শোনার মতো খারাপ দিন আসে নি আমার।ʼʼ

মেঘালয়া ভেবে কূল হারায় যেন। এই মানুষটিকে বোঝা যায় না কেন! কিছু একটা ভেবে কেন জানি আনমনেই হেসে উঠল মুচকি। অতঃপর ইরাজের পেছনে এসে দাঁড়াল।

ইরাজ বাইক স্টার্ট করতে করতে, বিরক্তির স্বরে নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “হাঁ করে মশা গিলছিস? ওঠ!ʼʼ

“পারলে আপনাকে গিলে ফেলতাম।ʼʼ

মেঘালয়ার নিম্নস্বরে বলা কথাটাও ইরাজের কান অবধি পৌঁছায়। মেঘালয়ার দিকে ফিরে, ওর পা থেকে মাথা অবধি চোখ বুলিয়ে দেখল। অতঃপর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“নিজের এই ঝালকাঠির মতো বডিটা আয়নায় দেখিস একবার। আমার রুমের আয়না ঝকঝকে। সামনে দাঁড়ালেই দেখতে পাবি— তোর ওই চিরকুট মার্কা শরীরের
চড়ুই পাখির পেটে আমি আঁটব না।ʼʼ

মেঘালয়া কপাল জড়িয়ে বলল, “ঝালকাঠি? ঝালকাঠির মতো শরীর আবার কি, ইরাজ ভাই?ʼʼ

“বোন আমার! তোর শরীর কাঠির মতো, অথচ তুই ঝাল। মিলিয়ে নে, ঝালকাঠি হবে।ʼʼ

বাইকে উঠে বসল মেঘালয়া। বলল, “আমি আপনার কোন সম্পর্কের বোন লাগি, ইরাজ ভাই?ʼʼ

ইরাজ কিছুক্ষন পর জবাব দিলো, “কোন সম্পর্কের না, তুই ইরাজ ভাইয়ের বোন লাগিস।ʼʼ

নিজের কথায় ফেঁসে যায় মেঘালয়া। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ‘ভাই’ ডাকতে ডাকতে। অভ্যাস পরিবর্তন করার ইচ্ছেও ছিল না। তবে আজ কেন জানি, ইরাজের মুখে বোন ডাকটা ভালো লাগে নি।

বাইক চলতে শুরু করলেই, ধাক্কায় মেঘালয়া চোখ খিঁচে ইরাজকে খামচে ধরল। ইরাজ তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও, ভালো রাস্তা পেলে কর্কশ কণ্ঠে বলে ওঠে, “ছেড়ে বস আমাকে। এখন আর পড়ার চান্স নেই, থাকলেও পেছনে ধরার মতো কিছু আছে, তা ধরে বস।ʼʼ

মেঘালয়ার জিদ হলো ভেতরে। একটু ইগোতেও লাগল। জিদ ধরে বলল, “ছাড়ব না। আপনি বাইকে তুলেছেন কেন? আর চালাচ্ছেন তো হাওয়াই জাহাজের মতো। আমার বাইকে চড়ে অভ্যাস নেই।ʼʼ

“কেন তোর আশীক কোনদিন ঘুরতে নিয়ে বের হয় নি তোকে?ʼʼ

ইরাজের কথায় ঠাট্রা। মেঘালয়া চুপ করে গেল হঠাৎ-ই।

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৬

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

৬.

সকাল দশটা। নাশতা খেতে বসে ইমতিয়াজ সাহেব ইরাজের খোঁজ করলেন,

“মেঘা মা, রাজকে ডাক দিসনি!ʼʼ

মেঘালয়া গোপনে বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে চাইল, “রাতে মাল খেয়ে টাল হয়ে পড়ে আছে, আপনার রত্ন।ʼʼ তবে মুখে কিছু বলল না। চুপচাপ মাথা নত করে খেতে শুরু করল। ইমতিয়াজ সাহেব তাকিয়ে দেখলেন মেঘালয়ার দিকে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, দুজনের সম্পর্ক মোটেই স্বাভাবিক নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি ছেলেকে জানেন। ওই ঘাঁড় ত্যাড়াকে বোঝানোর সামর্থ তার কোনদিন হয়ে ওঠেনি। তবে এবার কিছু দরকার। প্রিয় বন্ধুর ঘরের আমানত তুলে এনেছেন। সেই আমানতকে সুখে না রাখতে পারলে, নিজেকে বন্ধুর কাছে বড্ড ছোটো মনে হবে যে!

খাওয়া শেষ করে উঠতে যাবেন তিনি, মেঘালয়া ইতস্তত করে বলে উঠল, “বাবাই!ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব ফিরে তাকালেন। মেঘালয়ার কথা শুনতে তৎপর হয়ে চেয়ে রইলেন। মেঘালয়া আড়ষ্টতায় কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে। তবুও সকল সংকোচ কাটিয়ে বলে উঠল, ধীর-স্থির স্বরে, “আব্বু হয়ত অনুমতি দেবে না। তবে আমি পড়া-লেখা চালিয়ে যেতে চাই।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব কেন জানি কথাটা শুনে অপ্রস্তুত বোধ করলেন। তবে মেঘালয়ার সুশ্রী, শ্রী মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রত্যাখান করার সাহস হলো না। জোরপূর্বক মৃদূ হেসে বললেন, “ঠিক আছে। রাজের সঙ্গে কথা বলে দেখি। তুই খাওয়া শেষ কর।ʼʼ

একরকম এড়িয়ে চলে গেলেন যেন তিনি।

মেঘালয়া রুমে চলে এলো। এসেই দেখল ইরাজ বিছানার সাথে মিশে ঘুমে বিভোর। কেন জানি সহ্য হলো না ইরাজের এমন শান্তির ঘুম দেখে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে পারফিউম হাতে তুলে নিয়ে তা সজোরে শব্দ করে রাখল। তাতে ইরাজ নড়লও না। অথচ মেঘালয়ার ওকে ঘুম থেকে ওঠাতেই হবে। পারফিউমের কৌটা হাতে তুলে নিয়ে বিছানার কাছে এসে বিকট আওয়াজে মেঝেতে ফেলে দিলো। এবার ইরাজ সামান্য নড়ে ওঠে। একটু এপাশ-ওপাশ হয়ে আবার শুয়ে পড়ল। মেঘালয়ার রাগ হচ্ছে। সরাসরি ডাকতে শুরু করল, “ইরাজ ভাই, কানে তুলো গুজে ঘুমান? ইরাজ ভাই? উঠবেন নাকি বাবাইকে গিয়ে বলে আসব, আপনি মাতাল হয়ে পড়ে আছেন!ʼʼ

কাজ হলো খানিকটা, তবে পুরোটা না। এবার ইরাজকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল। ইরাজ চোখ মেলে তাকায়। লাল টকটকে হয়ে আছে চোখ। মেঘালয়া ছিটকে সরে দুরে দাঁড়াল। দ্রুত সাফাই গাওয়ার স্বরে বলে উঠল, “রিল্যাক্স, ইরাজ ভাই। কথা বলার আছে আপনার সাথে। নয়ত, আপনি ম রে থাকলে আমারই শান্তি। আই মিন, আপনি ঘুমিয়ে থাকলে।ʼʼ

ইরাজ উঠে বসল। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। ব্যাথায় ভেঙে আসছে যেন। চেপে ধরে বসল। অ্যালকোহলের প্রভাব পুরোটা কাটেনি এখনও। মেঘালয়া ইরাজকে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে, আরও খানিকটা দুরে সরে দাঁড়াল। ইরাজ ওর দিকে না তাকিয়ে হেলেদুলে হেঁটে গিয়ে বাথরুমে ঢুকল। মেঘালয়া চিন্তিত মুখে, সোফায় গিয়ে বসে। এমন জাহিল পুরুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে আব্বু তাকে কত ঘটা করে এ বাড়িতে পাঠিয়েছে। নিজের ওপরই তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল।

ইরাজ বেশ কিছুক্ষণ পর একেবারে গোসল নিয়ে বের হলো। মেঘালয়া ভেবেছিল, বেরিয়ে চোটপাট শুরু করবে। তবে তেমন কিছুই হলো না। শান্ত পায়ে বেরিয়ে এসে বিছানার ওপর বসল। শীতল, ভারী স্বরে জিজ্ঞেস করল, “টক জাতীয় কী আছে বাড়িতে?ʼʼ

মেঘালয়া অবাক হয়ে চেয়ে রয়। ইরাজকে নিয়ে কি তার কোন ভাবনা-ই কখনও সঠিক হবে না? এ কেমন অদ্ভুত মানসিকতার মানুষ! বলল, “সকালে ফ্রিজে লেবু দেখেছি।ʼʼ

“শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়, সামান্য পানি দিবি লেবুর রসে।ʼʼ

এমন শান্ত স্বরের আদেশ শুনে, চোখ বুঁজে একটা নিশ্বাস নিলো মেঘালয়া। কেন জানি ইরাজের কথা মানতে ইচ্ছে না করলেও উঠে দাঁড়াল। এখন আর তামাশা না হোক।

লেবুর শরবত এনে দিলে, তা এক চুমুকে শেষ করল ইরাজ। মাথার দুপাশ চেপে ধরে, ওভাবেই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। মেঘালয়া মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করে ওঠে, “এসব না গিললে পাপ হয়? নাকি গিললে, নেকী!ʼʼ

ইরাজ অর্ধখোলা চোখ মেলে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার প্রশ্ন এড়িয়ে, শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কি বলবি?ʼʼ

মেঘালয়া প্রায় তেজী কণ্ঠে বলে উঠল, “আপনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবেন না। প্রশ্ন করেছি উত্তর দিন।ʼʼ

ইরাজ নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল, “তোর প্রশ্নে আমার কোন যায়-আসে বলে মনে হয়, তোর? ধাক্কা মেরে দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেই, তার আগে উপযুক্ত কিছু বল, যা বলতে চেয়েছিলি। তোর বলা কথা প্রয়োজনীয় মনে না হলে, জিহ্বাটা এক টানে ছিঁড়ে ফেলব।ʼʼ

শেষের কথাটুকু শুনতে কেমন হিংস্র শোনাল। মেঘালয়া এসবে অভ্যস্ত। সে আর ইরাজের কাছে অন্যকিছু আশাও রাখে না। চোখ বুঁজে দ্রুততার সাথে বলে ওঠে, “আমি পড়ালেখা কন্টিনিউ করতে চাই। আর বাবাই আপনার অনুমতি পেলে, অনুমতি দেবে।ʼʼ

এক ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল ইরাজ। অতঃপর মুখ বেঁকিয়ে হেসে ওঠে। তিরস্কার করে বলে, “পড়তে গিয়ে আবার পালিয়ে গেলে, এবার আমার বাপের মুখ পুড়বে। তোর বাপেরটা কালা করেই এসেছিস।ʼʼ

মেঘালয়ার বুকটা ভার হয়ে উঠল। চোখটা ঝাপসা লাগে। চোখে তরল জমেছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরল। গিলে নেয় কান্নাটুকু। তীর্যক কণ্ঠে জোর দিয়ে বলে ওঠে, “পালাব না আর। এবার গেলে আপনাদের জানিয়েই যাব। আর যদি আমাকে পড়তে না দেওয়া হওয়া হয়..

কথা শেষ করতে দিলো না ইরাজ। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “না দিলে? না দিলে কী? আমার তো এবার ভয় লাগছে রে মেঘ! না দিলে তুই আবার না কারও সাথে পালিয়ে যাস। প্লিজ যাস না। মেঘ! না দিলে কী?ʼʼ

ইরাজের ঠাট্টা মেঘালয়ার শরীরে জ্বালা ধরায়। চুপ হয়ে গেল একদম। আর কোন কথা না বলে, চুপচাপ উঠে চলে গেল সেখান থেকে। ইরাজও আর ফিরে তাকাল না সেদিকে।

ইরাজ দুপুর বারোটার দিকে, তৈরী হয়ে বাইরে চলে গেল। মেঘালয়া বসার রুমে বসে ছিল। ইরাজের বেরিয়ে যাওয়া দেখল। ইরাজের গাড়ি, বাড়ি থেকে দুর হতেই সে নিজেও বেরিয়ে পড়ল অজানার উদ্দেশ্যে। কোথায় যাবে জানা নেই। অথচ এত অপমান, আর গ্লানি নিয়ে অন্তত এ বাড়িতে থাকতে পারবে না। গভীর ক্ষত অনুভূত হচ্ছে বুকে। ভেতরে যেন রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। প্রায় দিন তিনেক তো কেটে গেল। আব্বু ভুলেও একবার তার খোঁজ নেয় নি। এত ঘৃন্য হয়ে উঠেছে, সকলের কাছে মেঘালয়া! তাহলে তার উচিত, নিজের খারাপ চরিত্র নিয়ে এই সম্মানী মানুষগুলো থেকে দুরে থাকা।

এসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলল, নিরুদ্দেশ। কিছুক্ষন পর মনে পড়ল, কাছে চার-আনা পয়সাও নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাছেই এক শিশুপার্ক। সেখানে ঢুকে একটা বেঞ্চির ওপর বসল। রোদ লাগছে গায়ে, তবে সেসবে আর আজ যায়-আসল না মেঘালয়ার। মনে মেঘ জমে আছে। একটু ঢিল দিলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়বে বৃষ্টি হয়ে দু চোখ বেঁয়ে।

_

আনতারা খানম সারাদিন ভেবেছিলেন, হয়ত না বলেই, আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে চলে গিয়েছে। কিন্ত বিকেল হয়ে আসার পরও মেঘালয়াকে ফিরতে না দেখে ভাবলেন, তিনি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসবেন। সাথে বেড়ানোও হয়ে যাবে। তিনি বেরিয়ে পড়লেন। হেলাল সাহেবের বাড়ির পাশেই তার বোনের ননদের বাড়ি। তার বাড়ি পার করে যেতে হয়, হেলাল সাহেবের বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে বাকিটুকু হাঁটার পথ। সামান্য খানিকটা রাস্তা। বাড়ির সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেই বোনের ননদ মেরিনা শিকদার। আনতারা খানমকে দেখেই মুখটা কালো করে ফেলল সে। একটু এগিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে থামল আনতারা খানম। মেরিনা নিজেই বলে ওঠে,

“কোথায় চললে? ছেলের শশুর বাড়ি?ʼʼ

চোখ-মুখ কেমন বিকৃত করেই বলেছে কথাটা। তা আনতারা খানমের চোখে লাগলেও, তিনি মৃদূ হেসে ঘাঁড় নাড়লেন। মেরিনা আবার নিজেই বলে ওঠে, “তোমরা নেহাত ভালো মানুষ গো বুবু। নইলে ওমন ভেগে যাওয়া মেয়েকে ঘরের বউ করে তুলতে নাকি?ʼʼ

এ পর্যায়ে আনতারা খানম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তার ঠিক বোধগম্য হয়নি মেরিনার কথাটা। হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কার কথা বলছো তুমি?ʼʼ

মেরিনা তাচ্ছিল্য করে বলে, “ছেলে কয়টা তোমার? আর বিয়েই বা কয়টা দিছো?ʼʼ

আনতারা খানম এবার থমকে গেলেন যেন। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললেন, “মেঘা। মেঘার কথা বলছো?ʼʼ

“মেঘাকেই তো ছেলের সাথে বিয়ে দিছো না?ʼʼ

“মেঘা পালিয়েছিল? কার সাথে? মজা করছো?ʼʼ— উদগ্রীব হয়ে ওঠেন আনতারা খানম।

যা শুনেছেন, তার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। দৌঁড়ে গেলেন হেলাল সাহেবের বাড়ির দিকে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন, মেঘালয়া এখানে আসেনি। আনতারা খানমের মুখটা কেমন কঠিন আকার ধারণ করেছে। ভেতরে তোলপাড় চলছে।

হেলাল সাহেব শুনলেন, মেয়ে ও বাড়িতে নেই। এখানেও আসেনি। তাহলে গিয়েছে কোথায়? অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে তার।

আনতারা খানম আর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে। হেলাল সাহেব, আনতারা খানমের মুখ দেখেই বুঝেছেন, এই অসন্তুষ্ট চাহনির পেছনের কারণ। তার বুকটা আবারও ধুক করে উঠল। মেয়ের ঘর ভেঙে যাবে এবার?

আনতারা খানম বেরিয়ে এসে, রাস্তার একপাশে দাঁড়ালেন।
মাগরিবের আজান হচ্ছে আশেপাশের মসজিদে। ইরাজকে কল করলেন। কয়েকবার রিসিভ হলো না। তিনি আবার চেষ্টা করলেন। এবার ইরাজ কল রিসিভ করেই, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, “কী সমস্যা, আম্মা! এতবারে যখন কল রিসিভ করছি না, মানে বোঝো না? আমি ব্যস্ত আছি।ʼʼ

আনতারা খানম কঠিন গলায় প্রশ্ন করলেন, “কোথায় আছিস তুই?ʼʼ

মায়ের কণ্ঠস্বর এমন গম্ভীর শুনে, ইরাজ বুঝে যায় কিছু একটা হয়েছে হয়ত। বিরক্ত হয়ে বলল, “এত শিরোনাম না দিয়ে, আসল কথা বলো।ʼʼ

আনতারা খানম তিরস্কার করে ওঠে, “ভেগে যাওয়া বউ ঘরে তুলেছিস বাপ-ব্যাটা জেনে শুনে। একটু সতর্ক থাকলেও তো পারিস। আবার যেতেই পারে।ʼʼ

ইরাজের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করল, “মেঘ, বাড়িতে নেই?ʼʼ

আনতারা খানম আর কোন কথা না বলে, কল কেটে দিলেন। তার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে আছে। তাকে না জানিয়ে এমন একটা কাজ করে ফেলেছে সকলে! যেখানে রাস্তায় ধরে লোকে কটু কথা শোনাচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? আজ হেলাল সাহেবের মুখ দেখে ঘৃণা হয়েছে তার। নিজের মেয়ে মুখ পুড়িয়েছে, তা ইরাজের ঘাঁড়ে ঠেলে দিলেন কি করে তিনি? আনতারা খানম বিক্ষিপ্ত পায়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন, এসব ভাবতে ভাবতে।

_

ইরাজ ক্লাবে বসে দলবল নিয়ে আড্ডায় মেতে ছিল। এমন একটা খবর শুনে, বিরক্তিতে মুখ কুঞ্চিত করে উঠে দাঁড়াল। পকেটে হাতরে বাইকের চাবি বের করে, চুপচাপ বেরিয়ে এলো ক্লাব থেকে।

বাড়িতে এসে, ছুটে নিজের রুমে গেল। আলমারী খুলে দেখল, সব ঠিকঠাক। কোন কাপড় বা টাকা কিছুই সরেনি। টি-টেবিলের ওপর মেঘালয়ার ফোন পড়ে আছে। অর্থাৎ মেঘালয়া খালি হাতে বেরিয়ে গেছে।

সেই দুপুর থেকে, এখন সন্ধ্যা পার হয়ে প্রায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। মেঘালয়া প্রানহীণের মতো বসে আছে। চারদিকের ঘটে যাওয়া চলমান পরিবেশের ঘটনা অথবা শব্দ, প্রকৃতির হাওয়া কোনকিছুই তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি আজ। প্রাণহীণের মতো বসে আছে সেই ঘন্টার পর ঘন্টা। পার্কের এক কর্নারের একটি বেঞ্চের ওপর বসে আছে সে। পার্কের বিভিন্ন স্থান আলোকিত হলেও মেঘালয়া যেখানে বসে আছে, সেখানে দূর থেকে আসা মৃদূ টিমটিমে আলো। চোখ দুটো শান্ত, অচঞ্চল মেঘালয়ার। ছটফটে, আহ্লাদী, চঞ্চল মেঘালয়া জীবনে ঘটে যাওয়া কয়েকদিনের টানপোড়েনে, কেমন স্তব্ধ, শান্ত আর বাস্তবতার জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে যেন। এ ক’দিনের সবটা যেন মিলছে না তার হিসেবে। কেমন কোথাও একটা গড়মিল রয়ে যাচ্ছে। তার মাঝে ইরাজের আচরণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে!

আচমকা কয়েকটি ছেলে এসে পাশেই দাঁড়াল ওর। সবগুলোর হাতে সিগারেট, কেউ কেউ আবার স্পিড অথবা টাইগারের বোতলে চুমুক দিচ্ছে। দেখতে অবশ্য ভালোমানের বখাটেই লাগছে সবগুলোকে। মেঘালয়া অত খেয়াল করল না। ছেলেগুলো মেঘালয়াকে ওভাবে একা বসে থাকতে দেখে, নিজেদের মধ্যেই কিছু বলে হাসাহাসি করছে। মেঘালয়া এতক্ষনে সম্বিত ফিরে পায়। এ পাশটা একটু নির্জন প্রায়। আর এটা শিশুপার্ক, বাচ্ছারা নিশ্চয়ই এই রাত করে এখানে আসবে না? পার্ক প্রায় ফাঁকা। আশেপাশে তাকিয়ে গা শিউরে উঠল, মেঘালয়ার।

কিছুক্ষণ পর ছেলেগুলোর মাঝে দুটো ছেলে উঠে এলো। মেঘালয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। মেঘালয়া মুখ তুলে তাকায় ওদের। বখাটেদের মুখের দিকে চেয়ে কেমন অদ্ভুত এক ভয় জেঁকে বসল বুকের মাঝে।

নিজেকে আজ দ্বিতীয়বার আবার এমন অসহায় লাগছে। প্রথমবার ইরাজ এসে দাঁড়িয়েছিল আল্লাহ প্রদত্ত দূতের মতো। আজও কেন জানি, নিজের অজান্তেই মেঘালয়া ওই চির অপছন্দের, অসভ্য, কঠিন রুক্ষ পুরুষকেই এদের সম্মুখে নিজের ঢাল হিসেবে আশা করল। নিজের ভাবনায়, নিজেই একবার শিউরে ওঠে মেঘালয়া। যার মুখ দেখবে না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এই মুসিবতের সম্মুখীন হয়েছে সে, সেই মুসিবত থেকে রক্ষা পেতে তাকেই কেন আশা করছে মেঘালয়া?

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৫

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

৫.

হেলাল সাহেব চাননি, বিধায় ইমতিয়াজ খানের বাড়িতেও বিশেষ কোন আয়োজন করা হয়নি। এভাবেই নিরবতার মাঝে কেটে গেছে সারাদিন। বাড়ি থেকে মেহমান যারা এসেছিল, তারাও বিদায় হয়েছে। মেঘালয়া রাতের খাবার শশুর-শাশুরির সঙ্গেই খেল। তবে ইরাজের দেখা নেই। রাত বারোটা বাজতে চলেছে ঘড়ির কাঁটায়। ইমতিয়াজ সাহেব অপেক্ষায় থেকে, এক পর্যায়ে মেঘালয়াকে পাশে বসিয়ে খেয়ে নিলেন। তিনি ছেলের স্বভাব সমন্ধে অবগত হলেও, নতুন ছেলে-বউয়ের সামনে আজ সামান্য লজ্জাবোধ করলেন। যদিও ইরাজের অনুপস্থিতিতে মেঘালয়া সারাদিন বেশ সাচ্ছন্দ্যেই আছে।

মেঘালয়া খেয়ে উঠে রুমে গেল। এতক্ষনে তার ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস থাকলেও, জীবনটা আর আগের মতো সুখী ও সুন্দর নেই। আস্তে করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল বেলকনিতে। আজ প্রকৃতিতে বেশ ভালোই ঠান্ডা বাতাস বইছে। ওড়নাটা, মাঝে মাঝে শরীর ছুঁয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ার তরে উড়ছে। অদ্ভুত অনুভূতিরা এসে বুকে জড়ো হলো। আচমকা চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল সেই ভুলে ভরা সময়ের ধারাটুকু।

তাবিরের সঙ্গে মেঘালয়ার পরিচয়, কলেজের বড়ো ভাই হিসেবে। অতঃপর একদিন তাবির প্রপোজ করে বসল মেঘালয়াকে। বান্ধবীদের সকলের বয়ফ্রেন্ড আছে। তার ছিল না। আর তাবিরকে সকলে যথেষ্ট স্মার্ট বলেও জানে কলেজে। সবাই যখন নিজেদের বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে বলত, ডেটে যেত। এসব দেখে, শুনে— মেঘালয়ার চরম কৌতুহল হতো। বলতে গেলে শখে পড়ে একদিন হুটহাট গ্রহন করে ফেলল তাবিরের প্রস্তাব। শুনতে হাস্যকর লাগলেও, মেঘালয়াকে হেলাল সাহেব বড়ো আহ্লাদের সাথে পালন করেছিলেন। যার কারনে সে বয়সের তুলনায় বিকশিত হয়ে ওঠেনি বাস্তবতা অথবা বাহিরের পরিবেশের সঙ্গে। নয়ত তেমন কোন জটিল অনুভূতি ছাড়া কোন সম্পর্কে জড়ানোর পর কেউ, কখনোই এমন পদক্ষেপ নিয়ে নেয় না। সবকিছুতে প্রশ্রয় পেতে পেতে মেঘালয়ার সেই আহ্লাদি, বাচ্চা মানসিকতাটা যেন রয়েই গিয়েছিল।

তাবির হঠাৎ-ই কিছুদিন ধরে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে বলত। অথচ মেঘালয়া বাবার অনুমতি পাবে না বলে মানা করে দিয়েছে বারবার। তাবির এবার সে-সব বাদ দিয়ে একদিন প্রস্তাব করে বসল, তাকে যদি মেঘালয়া সত্যিই ভালোবেসে থাকে, তবে তার সঙ্গে পালাতে হবে। সে-সময় মেঘালয়ার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তবে সে দেখেছে, বান্ধবীদের অনেকে নিজের ভালোবাসার প্রমান দিতে হাত কা টে, অথবা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করে। তবে তবুও সে চেয়েছিল না এমন একটা কাজ করতে। তাবির তাকে নানান কথা বলে উশকানি দিতে থাকল, ‘সে শুধুই মাত্র তার আব্বুর চালিত এক ব্যাটারি ওয়ালা পুতুল। তার নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আত্মনির্ভর্শীলতা নেই।’

আর এই কথাটিই মেঘালয়ার জিদে আঘাত করে বসল। সে সেদিনই তাবিরকে কথা দিয়ে দিলো, পরীক্ষা শেষ হতেই সে যাবে তাবিরের সঙ্গে। সে পারে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে। এটা প্রমান করে ছাড়বে, সে আব্বুর ব্যাটারি চালিত পুতুল নয়।

এতটুকু ভাবতেই মেঘালয়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসল। নজর উঁচিয়ে আকাশের পানে তাকাল। আজ অর্ধচাঁদ শোভা পাচ্ছে আকাশে। চেয়ে রইল চাঁদের দিকে।

রাত একটার কাছাকাছি সময়ে বাড়িতে প্রবেশ করে ইরাজ। ইমতিয়াজ সাহেব বসার রুমে সোফায় বসে ছিলেন। ইরাজ ঢুকতেই প্রশ্ন করে বসলেন, “তোর পরিবর্তন কি আশা করা যায়, রাজ?ʼʼ

ইরাজ দাঁড়াল। পেছন ফিরে দেখল বাবাকে। অতঃপর দায়সারা ভঙ্গিতে ঘাঁড় দুলিয়ে বলল, “উহু।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, “তোমাকে ছোটবেলা থেকে সবকিছুতে স্বাধীনতা দেওয়ার পরিণতি এটা?ʼʼ

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট বাঁকায়। দাম্ভিকতার সাথে বলে ওঠে, “তুমি স্বাধীনতা না দিলে, আমি পরাধীন নাকি?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মৃদূ ধমকে উঠলেন, “এখন আর ছন্নছাড়া জীবনযাপন চলবে না, সেটা বুঝিস না তুই! আগের মতো ব্যাচেলর না তুই আর। তোর পথ ও মুখ চেয়ে কেউ বসে থাকার মতো এসেছে, তোর ঘরে।ʼʼ

ইরাজ তাচ্ছিল্য করে হেসে ওঠে। ওভাবেই বলল, “ঘরে আমি নিয়ে আসিনি, আর না সে এসেছে। তোমার এনেছ। ড্যাড, আমি অবাক হচ্ছি আসলেই, যে তুমি আমার কাছে সংসার-ধর্ম পালনের আশা রাখছ?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মুখ কুঞ্চিত করলেন বিরক্তিতে। বললেন, “মেঘা এই ভুলটা না করলে, তুই ওকে ভালোভাবে গ্রহন করতি?ʼʼ

ইরাজ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। পেছনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইমতিয়াজ সাহেব। যাদের দুজনকে এমন অদ্ভুতভাবে এক ঘরে বন্দি করে দিয়েছেন তারা, এই দুই পথের পথচারীর শেষ পরিণতি কী আসলে?

রুমে গিয়ে পরনে থাকা পোশাক পরিবর্তন করে, টাউজার পরে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল ইরাজ। মেঘালয়া ইরাজের উপস্থিতি বুঝতে পারলেও, কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আপন মনে রাতের আকাশ দেখতে ব্যস্ত সে।

কিছুক্ষণ ওভাবেই কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ-ই পেছন থেকে গম্ভীর গলায় আওয়াজ এলো, “রুমে যা।ʼʼ তীক্ষ্ণ আদেশের স্বর। যেখানে ঝরে পড়ছে হয়ত, কতশত লুকায়িত ক্ষোভ আর আক্রোশ।

মেঘালয়া আকাশের দিকে চেয়ে থেকেই উত্তর দিলো, “বেলকনি যথেষ্ট বড়ো। আমি থাকলেও, আপনার এখানে থাকার মতো জায়গা আছে নিশ্চয়ই!ʼʼ

ইরাজ এতক্ষণে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে, আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। রুমের আলো নেভানো। মৃদূ লাল আলো জ্বলছে সেখানে। সেই আলো-ই ঝাপসা আলো ছড়াচ্ছে বেলকনিতে। আলো-আঁধারের এই অদ্ভুত সংমিশ্রনে পরিবেশটাকে খুব রহস্যময় লাগছে। ইরাজের হাতে সিগারেটের প্যাকেট। আকাশের দিকে তাকিয়ে, হাতে সেই প্যাকেট নাড়াচাড়া করতে-করতে শীতল স্বরে বলল,

“আমার চোখে, তুই কাঁটার মতো বিঁধে থাকা, এক যন্ত্রনা মাত্র। যথাসম্ভব, এই আমি থেকে দুরে রয়ে এই যন্ত্রনা খানিক কম কর।ʼʼ

মেঘালয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়। এত ঘৃণা ইরাজের— মেঘালয়ার ওপর? কই আগে তো এমন ছিল না! ইরাজ মেঘালয়াকে আগে-পরেই খুব শাসন এবং কড়া চোখে দেখেছে। এজন্য দুজন দুজনের কাছে নেগেটিভ দুটো চরিত্র হয়ে উঠেছিল। অথচ আজকাল ইরাজের আচরণে যা প্রকাশ পায়, তা ভয়ানক আক্রোশ অথবা ঘৃণার চেয়েও বেশি কিছু। আগে কখনও এমন কিছু লক্ষ করে নি মেঘালয়া ইরাজের চোখে। এখন যে হিংস্রতা পরিলক্ষিত হয়, তা আসলেই নতুন লাগে যেন!

চুপচাপ চলে এলো রুমে। বিছানায় শুতে গিয়েও আবার থেমে যায়। যে লোক, বারান্দায় একসঙ্গে থাকা সহ্য করতে পারছে না, সে এক বিছানা ভাগাভাগি করে নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারবে না? আর বাসর রাতেও যতক্ষণ মেঘালয়া বিছানায় ছিল, ইরাজ রুমেই আসে নি। ধীর-স্থীর পায়ে রোবটের মতো হেঁটে গিয়ে সোফায় বসল। জীবনটা খুব জটিল লাগে আজ কয়েকটা দিন। খুব সুখে ও আহ্লাদে পালিত হওয়া মেঘালয়া যেন, বাস্তবতার শিকলে বন্দি হয়ে পড়ছে সময়ের আবর্তনে! বুক ফেটে যাচ্ছে, অথচ আজ আর চোখ দিয়ে পানি ঝরল না। বুকে পাথরের মতো শক্ত কিছু চেপে আছে যেন! ওভাবেই আলোহীন রুমে বসে রইল সোফার ওপর।

ইরাজ পকেট থেকে কোন এক তরলের বোতল বের করে। কর্ক খুলতেই ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে এসে ঠেকে। অপর হাতের আঙুলের ভাজে জলন্ত সিগারেট। বোতলে ঠোঁট লাগিয়ে কয়েক ঢোক গিলে, তা মুখ থেকে নামাল। গলা দিয়ে পুড়তে পুড়তে নামছে। সিগারেটের ধোঁয়া টেনে নিলো এবার শ্বাস ভরে। নেশালো তরল ও ধোঁয়ার কুন্ডলি কি আসলেই সক্ষম ভেতরের আগুনের বহর কমাতে? ধিক-ধিক করে জ্বলছে ভেতরে।

ওভাবেই কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। আরও কয়েক ঢোক গিলতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। থামল না ইরাজ। আবার চুমুক দেয় বোতলের মুখে। সিগারেট পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে এসে, আগুন হাতে লাগছে। সেখানে হয়ত এতক্ষণে ফোসকা পড়ে গেছে। তাতে ইরাজের বিশেষ কোন যায়-আসল বলে মনে হলো না। বোতল শেষ, ইরাজের হিতাহিত জ্ঞানও বোধহয় লোপ পেয়ে এলো এবার। এলোমেলো পায়ে রেলিং ছেড়ে এসে সোফায় বসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে, ধপ করে পড়ল মেঝেতে।

শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকায় মেঘালয়া। দৌঁড়ে গেল বেলকনিতে। ইরাজ পড়ে আছে। মেঘালয়া টেনে তোলার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই, ইরাজ হাত উঁচিয়ে ধরে। থেমে গেল মেঘালয়া। নিজেই ওঠার চেষ্টা করে ইরাজ। একসময় উঠে দাঁড়ালও। নেশার চেয়ে জিদ মনে হলো, শরীরে এখনও খানিকটা বেশিই ইরাজের। নেশা, জিদে মরিচা ধরাতে পারে নি তবে! ওভাবেই এলোমেলো পায়ে হেঁটে রুম অবধি এলো। মেঘালয়া পেছনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রুম অবধি এলেও বিছানায় আর পৌঁছানো হলো না। তার আগেই আবার পড়তে নিলে এবার মেঘালয়া এসে ঝাপটে ধরে। ইরাজ টাল-মাতাল অবস্থায়ও ওকে সরানোর চেষ্টা করে। মেঘালয়ার নাকে এসে বিশ্রী গন্ধ ঠেকল। নাক-মুখ কুঞ্চিত করে তীর্যক কণ্ঠে বলে উঠল,

“ছেড়ে দিলেই তো হুড়মুড়িয়ে পড়বেন। তবুও ভাব কমছে না! আপনাকে স্পর্শ করার বিরহে মরে যাচ্ছি না আমি। আপনাকে বিছানা অবধি নিয়ে ছেড়ে দেব। এবার ছটফটানি বন্ধ করুন।ʼʼ

ইরাজের মনেহয় কানেই গেল না কথাগুলো। ছিটকে সরে গেল। মাতাল কণ্ঠে, দম্ভ করে বলে ওঠে, “এরকম বোতল আরও কয়েকটা পেটে পড়লেও, আমি এতটা মাতাল কখনোই হব না; যে আমার তোর সাহায্য লাগবে। দূরে থাকতে বলেছি না তোকে আমার থেকে? নির্লজ্জ মেয়েলোক।ʼʼ

মেঘালয়া কথাগুলো শুনে, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ইরাজ নিজেই কোনমতো হেঁটে গিয়ে বিছানায় ধপ করে পড়ল। মেঘালয়া কপাল কুঁচকে চেয়ে রয়। ওর ধারণা ছিল, ইরাজের স্বভাব-চরিত্রে দোষ আছে। তাই বলে, এমন ঘরে বসে নেশা করার মতো নিকৃষ্টতম অভ্যাস আছে; তা জানত না। দেখল, ইরাজ কিছু বিরবির করছে। ও শুনেছে, নেশা করলে মানুষ বাহ্যিক জ্ঞান হারায়। তখন সত্যি কথা বলে। কোন সত্যি শোনার আশায়, ইরাজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ইরাজ মাতাল কণ্ঠে মেঘালয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“তুই চলে যা, মেঘ। আমার কাছে থাকলে, এভাবে নিত্য-নতুন ভাবে জ্বলবি কেবল। আমি ধ্বংসাত্বক। আমার সংস্পর্শে কেবল, ব্যথা ছাড়া আজ আর তোর জন্য তেমন কিছু নেই। দুরে চলে যা। মুক্ত হয়ে যা…

থমকে দাঁড়িয়ে রইল মেঘালয়া। ইরাজের কথাগুলো বোধগম্য হচ্ছে না। কেমন ধোঁয়াশা, এই গোটা ইরাজটাই ধোঁয়াশা কেবল!

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৪

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

৪.

শেষ অবধি নিস্তার হয়নি আর মেঘালয়ার। বসেছে বিয়ের কনের সাজে। সামনেই বসে আছেন, হেলাল সাহেব। আজও তাকে দেখতে মোটেও খুশি লাগছে না। ঘরোয়া বিয়ে যেমন হয়, তেমনই সাধারন ভাবে আয়োজন করা হয়েছে। কাজী সাহেব এসে বসে আছেন। দুপুর গড়াতে যাচ্ছে। ব্যবসায়িক পরিচিত যে কয়েকজন এসেছিলেন, তাদের খাবার পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। সে-সব ভালোভাবে মিটে গেলেও বিপত্তি তো বাঁধারই ছিল। যেখানে বর স্বয়ং ইরাজ খান, সেখানে সুষ্ঠুভাবে সবটা ঘটতে পারে না। বিকেল তিনটে পেরিয়ে চারটে বাজতে চলল। তবে এখন অবধি ইরাজের দেখা পাওয়া যায়নি এ অলি-গলির আশেপাশেও।

মেঘালয়া সামান্য আশার আলো দেখতে পেল যেন। ইরাজ হয়ত আসবে না। আর আজকের বিয়েও হবে না। আরও অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও ইরাজের দেখা পাওয়া গেল না। মেঘালয়ার খুশি বাঁধ মানছে না। নিজের মনেই এই খুশিকে উপভোগ করতে করতে আচমকা আব্বুর দিকে নজর গেল। মানুষটা বড়ো উশখুশ করছে। অস্থির দেখাচ্ছে তাকে খুব। আর হাই-প্রেশারের রোগীর জন্য এটা মোটেও ভালো বার্তা বয়ে আনবে না। কেমন পাল্টে গেল মেঘালয়ার মনোভাব। আব্বুকে ওভাবে ছটফট করতে দেখে, এবার কেন জানি সেও চাইতে শুরু করল, ইরাজ জলদি পৌঁছাক এখানে। ইমতিয়াজ সাহেব বরাবর ছেলেকে ফোনে ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ছেলের পাত্তা নেই।

হেলাল সাহেব আরও কাঁতর হয়ে উঠলেন এবার। হয়ত আজও তার সম্মানহানীর দিন। আজও জঘন্যভাবে বেঁচে থাকা বাকি মানটুকু হারাতে চলেছেন তিনি। লোকে বলাবলি শুরু করেছে, পালানো মেয়েকে উদ্ধার করে আবার বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছে হেলাল আকবর শাহ। মানসিক পীড়া উঠে গেছে ইতোমধ্যে তার মাঝে।

ইরাজ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ঘটনাস্থলে এলো সন্ধ্যারও খানিক সময় পর। তার হাতে আঘাতের চিহ্ন, কপালের ডান পাশে খানিকটা জখম হয়ে আছে। চুল উশকো-খুশকো। শরীরে বরের পোষাক নেই, বরং সাধারন শার্ট-প্যান্ট পড়েই হাজির হয়েছে বর। ইমতিয়াজ খান এসব নিয়ে আর ব্যস্ত হলেন না। তার ছেলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নিত্য ঘটনা এসব।

মেঘালয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ইরাজের পানে একবার। আবারও একবার আশায় বুক বাঁধল, হয়ত ইরাজ এবার সামনা-সামনি আব্বুকে বোঝাবে, বিয়েটা ভেঙে যাবে।

ইরাজ এসে নীরবে বসল কাজীর সামনের চেয়ারে। অতঃপর গাঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ করল হেলাল সাহেবের পানে। মানুষটা কেমন মিইয়ে গেছে সম্মান হারানোর আতঙ্কে। ইরাজ শান্ত দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে কাজীর দিকে চেয়ে, ওনাকে কার্যক্রম শুরু করতে ইশারা করল। মেঘালয়ার বুকটা ছলকে ওঠে। ইরাজের অস্বীকৃতি, শেষ ভরসা ছিল। ইরাজ বাঁধা না দিয়ে চালিয়ে যেতে দিচ্ছে কেন!


অনেকদিন পর খান বাড়িতে প্রবেশ করল মেঘালয়া। তবে আগের দিনের মতো আজ আর হেলাল আকবর শাহ এর মেয়ে হয়ে নয়, খান বাড়ির বউ হয়ে। বুকটা থেকে-থেকে মুচরে উঠছে। আনতারা খানম সাদরে গ্রহন করে নিলেন ছেলের বউকে। বিয়ের সুবাদে ইমতিয়াজ খান এর বোন আশা খানম এবং তার ছেলে-মেয়েরা এসেছে। আনতারা খানমের বোনের বাড়ির লোকজনও এসেছে দুয়েকজন। এখানে আসতে আসতেই প্রায় রাত দশটা বেজে গেছে। তাই গ্রহন পর্ব দ্রুত শেষ করে মেঘালয়াকে রুমে পাঠানো হলো।

ভারী বুক নিয়ে ফুলহীন বাসরে প্রবেশ করল মেঘালয়া। এমনিতেও সজ্জার অভাব নেই ইরাজের রুমটিতে। অতিরিক্ত করে ফুলে সাজানো না হলেও খুব পরিপাটি আর অভিজাত লাগছে দেখতে কক্ষটি। সে-সবে সমীহ না করে ধীর পায়ে গিয়ে রুমের সোফার ওপর বসল মেঘালয়া। এখন আপাতত এ রুমে সে একাই। ইরাজের রুমটি আস্ত এক ফ্লাটের মতো দেখতে লাগছে। একটা রুমের মাঝেই একটা অদৃশ্য বিভাজনের মাধ্যমে দুটো ইউনিটের রূপ দেওয়া হয়েছে। যেটা দেখতে অনেকটা বেডরুমের পাশেই ডাইনিং অথবা লিভিং রুমের মতো লাগছে দেখতে। একাকিত্বের সুযোগে ভারী হয়ে থাকা শব্দহীন আত্মচিৎকার গুলো এবার অশ্রু হয়ে ঝরতে শুরু করল। জীবনে আবেগের বশে করা একটা ভুল আজ প্রিয় বাবার থেকে কত দুরে এনে ফেলেছে ওকে। আবার, যে মানুষটির সান্নিধ্যে পাঠানো হলো এ বাড়িতে, সে নিতান্তই অপছন্দের এক মানুষ।

প্রায় মাঝরাতে রুমে ফিরল ইরাজ। ততক্ষণে মেঘালয়া বিয়ের জন্য পরিহিত ভারী পোশাক খুলে সুতির একটি শাড়ি পড়েছে। যেটি বের করে দিয়ে গেছেন, আনতারা খানম। সান্তনাও দিয়েছেন, ইরাজ চলে আসবে। সকলেই জানে ইরাজ কেমন!

হালকা-পাতলা শরীরে হলুদ এবং লালের সংমিশ্রনে সজ্জিত শাড়িটিতে মেঘালয়াকে দেখতে নেহাত স্নিগ্ধ লাগছে। মাঝারী চুল গুলো হাতখোঁপা করা। ইরাজ রুমে প্রবেশ করে অবশ্য ভুলবসতও একবার মেঘালয়ার দিকে তাকায়নি। এবার দেখা গেল, আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে তার ব্যান্ডেজ লাগানো। সে অবস্থাতেই ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল নিয়ে বেরোল ইরাজ। মেঘালয়া স্তম্ভিত বসে রয়েছে সোফাতে। ইরাজ সাদা রঙা এক টিশার্ট গায়ে চড়িয়ে আচমকা এসে বসল মেঘালয়ার সম্মুখে থাকা কাউচের ওপর। মেঘালয়া চোখ তুলে তাকায় নি তবে। ইরাজ নিজেও কিছু সময় চুপ থেকে বেজায় ভারী স্বরে বলল,

“এতটা ত্যাগ স্বীকার করার মতো ছেলে আমি না, এ সকলেই জানে। অথচ তোর বাপের মন রক্ষার্থে আজ তোকে নিজের পরিচয়ে ঘরে তুলতে হলো। প্রেমিক নিয়ে পালিয়েছিস তুই, সে কর্ম ফলাফলের ভাগ আমার সঙ্গে বেটে নেওয়ার কোন যুক্তি আছে তোর কাছে?ʼʼ

মেঘালয়ার চোখে জমে থাকা অশ্রুকনাগুলো এবার ঝরঝর করে ঝরে পড়ল গাল বেয়ে। তা দেখে বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে ফেলে ইরাজ। এক পর্যায়ে ধমকে উঠল,

“স্টপ অল দিস, ননসেন্স। আমার সামনে ন্যাকামি করবি না অন্তত। প্রেমিক নিয়ে পালানো মেয়ে, নাজুক অথবা অবুঝ হয় না, আর না ছিচকাদুনেপনা মানায় তাদের। সে জ্ঞান থাকলে, সব জ্ঞান আছে।ʼʼ

মেঘালয়া যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বলল, “আপনি আজ চাইলে বিয়ে ভাঙতে পারতেন। তা করেন নি কেন?ʼʼ

ইরাজ তাচ্ছিল্য করে বলল, “তোর বাপে তাইলে এতক্ষণে আমাদের টাটা-বাই করে ওপরে টপকে যেত। দেখেছিলি তখন তোর বাপের শুকনো মুখখানা? সম্মানের তো ভরাডুবি হয়েছে তোর জন্য। অথচ আমি তো আর তোর মত নির্বোধ না, সম্মান বাঁচিয়ে যা হয় তাই করেছি।ʼʼ

মেঘালয়া ঠোঁট চেপে ধরে নিচের দিকে চেয়ে রইল। ধীর-স্থির কম্পমান কণ্ঠে বলল, “তাহলে আমিও আব্বুর মুখের দিকে চেয়েই বিয়ে করেছি, আপনি আমায় কথা শোনাবেন না।ʼʼ

পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল এবার ইরাজ মেঘালয়ার দিকে। খানিক সময় পরখ করে দেখে, তিরস্কারের স্বরে বলল,

“বুঝের কথা বলতে শিখেছিস? অন্যের সাথে পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে কবুল করেছি আজ। জীবনে, কারও হাতে কর্ক খোলা ড্রিংকের বোতলে চুমুক লাগাই নি। শালা, বউ বিয়ে করলাম কিনা অন্যের আমানত!ʼʼ

মেঘালয়া গম্ভীর মুখে তাকায় ইরাজের দিকে। ইরাজও তাকাল, মেঘালয়াকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করল। ক্ষ্যাপা স্বরে ধমকে উঠল, “ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তাকাবি না আমার দিকে, খবরদার। তোর নজর পড়লে এ জীবনে না জানি আর কত বড়ো-বড়ো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নজর সামলে এ বাড়িতে থাকবি।ʼʼ

মেঘালয়া এমন কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে? তবে ওর ধারনা, এখন চুপ থাকা শ্রেয়। খুব ভালো বুঝতে পারছে, ইরাজ কোন এক ঝামেলা বাঁধানোর ছুতো খুঁজছে। ইরাজ এবার তাকাল মেঘালয়ার দিকে। এক ভ্রু উঁচিয়ে পরখ করে দেখল ওকে। মেঘালয়া হাসফাস শুরু করেছে। অভদ্রর মতো চেয়ে আছে ইরাজ। কিছুক্ষণ ওভাবে দেখে, চোখ ছোট-ছোট করে ফেলল। মুখটা ফিরিয়ে ভারী কণ্ঠে বলল,

“কোন এক অজুহাতে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবি। তোকে আমার চোখের সামনে সহ্য হচ্ছে না, মেঘ। কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসি, তার আগে এ বাড়ি থেকে কাল্টি খা।ʼʼ

মেঘালয়া বুঝল, ইরাজ ক্ষেপে যাচ্ছে। এখন কোন তামাশা করার ইচ্ছে হলো না। মনটা নিজেরও খুব বিপর্যস্ত হয়ে আছে। প্রসঙ্গ বদলাতে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “শরীরে এত জায়গায় আঘাত পেয়েছেন কি করে?ʼʼ

“সে যেভাবেই পাই, তোর খুব আনন্দ হচ্ছে, না?ʼʼ

“হুম, তা তো একটু হচ্ছেই।ʼʼ

মুখ ফসকে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে মেঘালয়া। বুঝতে পেরে, দ্রুত হাত দ্বারা মুখ চেপে ধরল, ঘাঁড় নাড়ল দুপাশে। অতঃপর মুখে বলল,

“উহু। খুব কষ্ট হচ্ছে দেখে। ভালো কেন লাগবে? আপনার মতো ক্যাকটাস তো আর না আমি, যে কারও কষ্ট দেখে খুশি লাগবে।ʼʼ

আবারও ভুল কথা। এবার হয়ত আর রক্ষা নেই মেঘালয়ার। ইরাজ হাত চাপে ধরল মেঘালয়ার। মুচরে ধরল সজোরে। মাড়ি পিষে বলল,

“একদম ঠিক ধরেছিস। ক্যাকটাস না আমি? দুরে থাকবি আমার থেকে। কাঁটা ফুটে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার ভয় আছে। আর তুই আমার সঙ্গে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করবি না, এমনকি কথা বলতে আসবি না।ʼʼ শেষের কথাটি কেমন অদ্ভুত শোনাল ইরাজের কণ্ঠে।

বলেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাঁড়ে ঝোলানো তোয়ালেটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, ল্যাম্পটেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার হাতে নিয়ে, রুমের সাথের লাগোয়া প্রকান্ড বেলকনির দিকে পা বাড়াল।

মেঘালয়া সেদিকে আর না তাকিয়ে চোখদুটো বুঁজে নিলো চেপে। হাতের যে স্থানে ইরাজ চেপে ধরেছিল, জ্বলে যাচ্ছে খুব। বুক চিড়ে এক বিক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মাথাটা ঝুঁকিয়ে ওভাবেই অনেকক্ষণ বসে রইল। মিলছে না যে, এই গড়মিল হয়ে থাকা জটিল জীবনের ধারাবাহিকতার হিসেব! অনেকক্ষন পর, আস্তে করে উঠে গিয়ে রুমে রেখে যাওয়া খাবারের একাংশ খেতে বসে গেল।

ইরাজ সেই কখন থেকে একটা করে বের করছে। আর সমানতালে ধোঁয়া গিলে যাচ্ছে। আজ এই করতে করতেই এক নির্ঘুম রাত কাটবে বোধহয়। কাটা স্থানগুলোতে রাত বাড়ার সাথে সাথে টান ধরেছে। ব্যথা অনুভব হচ্ছে। অথচ শরীরের সে-সব ব্যথাকে পেছনে ফেলে, বুকের মাঝে জড়িয়ে আসা চিনচিনে অনুভূতি বেশি কঠিন হয়ে উঠছে কেন! প্যাকেটের শেষ সিগারেটটিও লাইটারের আগুনের সংস্পর্শে ধঁরল। জ্বলে উঠে, আবার নিভে যায় তা। তা মনোযোগ সহকারে দেখল ইরাজ। লাইটারের আগুনটুকু দু আঙ্গুলে চেপে পিষে নেভাল। আঙুলের স্থানটিও জ্বলে উঠল একটু। তাতে কি যায়-আসে? ব্যাথা যে অন্য কোথাও। এ ব্যাথার চেয়েও অধিক পীড়াদায়ক যেন!


ফজরের আজান শোনা গেল। মেঘালয়া দ্রুত চোখ মুছে নেয়। একটা ভুলে কত অবহেলার পাত্রী হয়ে উঠেছে সে। ইরাজও বোধহয় এবার ধোঁয়াকে বিদায় জানিয়ে, রুমের সান্নিধ্যে ফিরল। মেঘালয়া বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল। ইরাজ এসে বিছানার কাছে দাঁড়াতেই, উঠে বসল। শড়িটা ঠিক করে নিয়ে দ্রুত উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। ইরাজের সেসবে বিশেষ যায় আসল বলে মনে হলো না। সে ফাঁকা বিছানা পেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরে ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে পুরো রাত না ঘুমানোর কারনে মাথা খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে।

মেঘালয়া অযু করে এলো। হঠাৎ-ই মনে হয়েছে মনের এই আগুন হয়ত রবের কাছে প্রার্থনায় ঝরে পানিতে ঝরতে সম্ভব। ফজরের নামায আদায় করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। আজ না-হয় সূর্যাদয় দেখবে। বেলকনিতে সোফা রাখা আছে কয়েকটি। সেখানে বসে পড়ল। ওভাবে কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে চোখ লেগে যায়, ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল এই অসময়ে।

চলবে..