Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 27



অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৩

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩.

রাত গভীর। হাসপাতালের দেয়ালগুলো সহ নিস্তব্ধতায় গুম। মেঘালয়ার মনটাও সাথে গুমোট হয়ে উঠল, এই রাতে নিস্তব্ধতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ইরাজ বসে আছে, তবে বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বলছে না। মুখটা অতিরিক্ত গম্ভীর করে মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। মেঘালয়া একবার তাকাল সেদিকে, তৎক্ষণাৎ আবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো।

মেঘালয়ার বুকটা ভারী অনুভূত হলো। কি এমন করেছিল! তাবিরকে ভালো লাগত। তাবিরই বলেছিল, ওর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার কথা। আব্বুকে বললে কখনোই মানত না, বিধায় পালিয়ে গিয়েছিল। তবুও প্রথমদিকে যেতে চায়নি। কিন্ত ভালোবাসার প্রমান দিতে, যেতে হলো শেষমেষ। চট্রগ্রাম পৌঁছে কিছু স ন্ত্রা সের হাতে পড়েছিল ওরা। তখন সেই দু র্বৃ ত্তগুলো শর্ত আরোপ করল, মেয়েটিকে ওদের হাতে তুলে দিলে, তাবিরের জান ভিক্ষা দেবে। মেঘালয়ার দৃঢ় বিশ্বাস, তাবির কখনোই এ শর্তে রাজি হবে না। বিশ্বাস মোতাবেক সর্বদা বাস্তবতার ধারা প্রবাহিত হয় না। তাই-তো তাবির মেঘালয়াকে ওখানেই জিম্মি রেখে নিজের জান বাঁচিয়ে পালিয়ে গেল। মেঘালয়া আজ নিজেও মানে, ও আসলেই মূর্খ এবং নির্বোধ। আব্বু তো ভুল কিছু বলেনি!

আচমকা ইরাজের রাশভারী কণ্ঠস্বরে মেঘালয়ার ভাবনার সুঁতো ছিঁড়ল, “ওঠ, উঠে বস।ʼʼ

মেঘালয়া কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে, চেয়ে রইল ইরাজের দিকে। ইরাজ এবার ঝাঁঝাল স্বরে ধমকে ওঠে, “কানে সমস্যা? ধরাম করে এক থাপ্পড় লাগিয়ে কানটা ক্লিয়ার করতে হবে? আই সেইড, সিট আপ। ড্যাম!ʼʼ

মেঘালয়া কোনরকমে উঠে বসল। আবার শুয়ে পড়ল। ইরাজ আবারও সেই ভারী স্বরেই বলল, “যা। তোর বাপ বাইরেই বসে আছে। গিয়ে বল, তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস না। নয়ত তোকে খু ন করে রেখে যাব এখানে।ʼʼ

মেঘালয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল ইরাজের ক্রোধান্বিত মুখের দিকে। অতঃপর তাচ্ছিল্য করে বলে উঠল, “প্রয়োজন পড়লে বি ষ খেয়ে নেব। এমনকি আপনি লাগেনই আমার কাছে এত বিষাক্ত। আপনার কেন মনে হয়, আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি ব্রত পালন করছি?ʼʼ

“তাইলে চুপ করে আমার চেহারা গিলছিস কেন? এতে যে, তোর নীরবতাকে সম্মতির লক্ষন হিসেবে ধরে, তোর বাপ বিয়ের তোড়-জোড় শুরু করে দিয়েছে!ʼʼ

ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলো মেঘালয়া, “আপনি তো সর্ব-মহান মনে করেন নিজেকে। আর বেশ দাপটে চলেন। এই শুভ কাজটাও না-হয় আপনার দ্বারাই সম্পন্ন হোক!ʼʼ

ইরাজ উঠে দাঁড়াল। মেঘালয়ার একহাত ধরে টান দিয়ে উঠিয়ে বসাল। মেঘালয়া মৃদূ আর্তনাদ করে ওঠে। ওর মনে হলো, হাতটা যেন আলাদা হয়ে গেছে কনুই থেকে। ইরাজ নিজেই ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিলো হাতটা। অতঃপর চিবিয়ে বলল, “তুই আমায় পরামর্শ দিবি না। বরং আমি যা বলব, শুনতে হবে তোকে।ʼʼ

মেঘালয়া তেজী কণ্ঠে বলে ওঠে, “আমি আপনার বাধ্য নই, আর না ভয় পাই আপনাকে। সুতরাং, আপনি আদেশ করবেন না আমায়।ʼʼ

ইরাজ এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। সন্তর্পণে নিজের ক্রোধটুকু এ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করে গিলে নিলো। চোখে-মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে মেঘালয়ার দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর-স্থির কণ্ঠে জানাল, “জোর যার, মুল্লুক তার’ শুনিস নি? আর এই সূত্র অনুযায়ী, তোকে আমার কথা শুনতে হবে। নয়ত তুই জানিস, আমি একদম ভালো মানুষ নই।ʼʼ

মেঘালয়া চোয়াল শক্ত করে চোখ বুঁজে নেয়। ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে-মনে ঠিক করে ফেলে, জীবনে আর যাই-হোক এমন কোন লোকের সঙ্গে এক সূত্রে বেঁধে যাওয়াটা নিতান্তই গজব ছাড়া আর কিছু নয়। আর এতবড়ো গজবে সে নিজেকে কোনক্রমেই পতিত করবে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইল বেডের ওপর। কিছুটা সময় নিয়ে বলল, “আপনি বললে, বাবাই না করবেন না। আপনিই বললেন— জোর যার, মুল্লুক তার। এ ব্যাপারে নিজের জোরটুকু খাঁটিয়ে আমাকে রেহাই দিন, আর নিজের জোরের প্রমানও।ʼʼ

ইরাজ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে, দু-ঠোঁটের ভাজে চেপে ধরে, অপর হাত দ্বারা পকেট হাতরে লাইটার বের করল। মেঘালয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমার বাপ, হেলাল আঙ্কেলকে না করলে, উনার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আঙ্কেল যেকোন উপায়ে তোকে আমার গলায় ঝোলাতে চায়। তুই নিজে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানা, কোন কাজ হলেও হতে পারে।ʼʼ

মেঘালয়া অনুযোগের সুরে টেনে-টেনে বলে, “আপনার আসলেই মনে হয়, আমি আব্বুকে অস্বীকৃতি জানাই নি? সে আজকাল আমার কোন কথাই শুনছে না।ʼʼ

ইরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ফেলল। ওভাবেই বলল, “তোর বাপ তোর কথা আরও শুনবে বলে, তোর মনে হয়? সম্মানের তো ফ্রাইড-রাইস বানিয়ে খেয়ে ফেলেছিস তার। সে-সব আমার দেখার বিষয় না। আজ সোমবার পেরিয়ে গেল। কাল সারাদিন মঙ্গলবার। শুক্রবার, ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে বিয়ের। যা করবি, কাল এখান থেকে রিলিজ পাওয়ার পর শুরু করে দে। নয়ত আমার হাতে পড়লে, তুই জানে বাঁচবি না, মেঘ।ʼʼ

বলেই লাইটারের আগুনে সিগারেট জ্বালায় ইরাজ। লম্বা এক শ্বাস টেনে নিয়ে, গায়ে থাকা জ্যাকেটটা টেনে-টুনে ঠিক করে নিলো। অতঃপর মেঘালয়ার দিকে এগিয়ে এসে মুখের ভেতরে থাকা সবটুকু ধোঁয়া ওর নাকে-মুখে ছাড়ল। মেঘালয়া দম আটকে, সিগারেটের বাজে গন্ধে কেশে ওঠে। তা দেখে ইরাজের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি পরিলক্ষিত হয়। চোখ-মুখে দারুন এক দুষ্টু প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে রাতের শেষ প্রহরে বের হয়ে আসল মেঘালয়ার কেবিন থেকে। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখল, কোথাও হেলাল সাহেব আছেন নাকি। দেখল, আপাতত নেই। হতে পারে ওয়াশরুমে অথবা কোথাও হাঁটতে গিয়েছেন। কতক্ষণ বসে থাকা যায়। সামনে যত যাই বলুক না! মেয়েকে হাসপাতালে রেখে বাড়িতে থাকা সম্ভব হয়নি। অথচ মেঘালয়া জানতই না, তিনি হাসপাতালেই বসে আছেন।

_

ইরাজ ও মেঘালয়ার সম্বন্ধের ব্যাপারটি আনতারা খানম সহজভাবেই নিয়েছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী আসলেই আগে থেকে চাইতেন, মেঘালয়াকে ইরাজের বউ করে আনতে। ব্যাবসা একই। হেলাল আকবর সাহেবের আর কোন সন্তান সন্ততি তো নেই। সবটা মেঘালয়ারই। তাছাড়া, এতো পুরাতন বন্ধুত্ব। সবদিকে বিবেচনা করে, এ সম্পর্কটি দু পরিবারের বন্ধন আরও মজবুত করবে বলেই ধারনা সকলের। আর তো মাত্র, দিন তিনেক আছে মাঝখানে। আনতারা খানম আজ চাইলেন, মেঘালয়াকে বাড়ি গিয়ে একবার দেখে আসতে। যদি মেয়েটি তেমন সুস্থ থাকে, তবে আজই টুকটাক বিয়ের বাজারও করে ফেলতেন সঙ্গে করে।

আনতারা খানম একদম তৈরী হয়েই নিচে নামলেন। ইরাজ নিজের রুমে মরার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছে। গতকাল শেষ রাতে বাড়ি ফিরেছে। তিনি বের হতেই যাবেন, সে-সময় বাড়িতে প্রবেশ করলেন, ইমতিয়াজ খান সাহেব। হন্তদন্ত জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় বের হলে এখন আবার?ʼʼ

আনতারা খানম মৃদূ হেসে বললেন, “বউমাকে দেখে আসি। বুঝলে রাজের বাবা! মেঘা ভালো মেয়ে। সে এলে তোমার ছন্নছাঁড়া মারকুটে ছেলের যদি একটু-আধটু হুশ হয়।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব আঁতকে উঠলেন স্ত্রীর কথায় ।আশপাশের লোকের মুখে মুখে মেঘালয়ার কথা। আনতারা গেলে, কারও না কারও মুখে শুনে ফেলতেই পারে কথাটি। আর তাতে, মেঘালয়াকে বাড়ির বউ করে আনতে আজীবনেও রাজী হবে না আনতারা। হেলাল তা কখনোই সহ্য করতে পারবে না। তিনি জানেন, মেঘালয়া ঠিক কতবড়ো বোঝা হয়ে আছে হেলালের কাঁধে।

তিনি কথা কাটানোর উদ্দেশ্যে, বেশ ক্লান্তি ভাব নিয়ে বললেন, “সবে বাড়ি ফিরলাম, না জানি একটু সেবাযত্ন করবে। এখন ছুটছো? প্রয়োজন পড়লে আমি গিয়ে নিয়ে আসব মেঘাকে। বাজার সেড়ে নেবে। এখন আমাকে খেতে দাও।ʼʼ

আনতারা খানম মনঃক্ষুন্ন হলেও, তা প্রকাশ করলেন না। নেহাত গৃহিনী মেয়েলোক, স্বামীর কথা ফেলতে তো পারবেন না। মুখ ভার করে বললেন, “তবে আজই কিন্ত যাব একবার মার্কেটে। খেয়ে নাও, আমায় দিয়ে আসবে হেলাল ভাইজানের বাড়ি।ʼʼ

“সেই ওই একই কথা? বললাম না যেতে হবে না ওখানে! আমি নিয়ে আসব মেঘাকে।ʼʼ আচমকা অজ্ঞাত কারনে ক্ষেপে উঠলেন ইমতিয়াজ খান। যার কারন বুঝতে না পেরে আনতারা খানম হতভম্বের ন্যায় চেয়ে রইলেন স্বামীর দিকে।

ইমতিয়াজ খান স্ত্রীর মনোভাব বুঝে, সাফাই গাওয়ার সুরে বললেন, “কুটুম বাড়ি বেশি-বেশি যেতে নেই। আদর কমে যায়। খেতে দাও এখন।ʼʼ

আনতারা খানম এটা বুঝলেন না, বেশি-বেশি কবে গেল ও বাড়িতে। কম করে হলেও ছয়মাস আগে গিয়েছিল, মেঘালয়ার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। তবুও স্বামীর ওপর অভিমানে কিছুই বললেন না আর। চুপচাপ নিজের কাজ করে গেলেন।

_

নিজের রুমে শুয়ে একটা ব্যাপারই ভেবে কুল হারাচ্ছে মেঘালয়া, কি করে বিয়ে বন্ধ করবে! ইরাজের বলা কথাগুলো মনে পড়লেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বহুক্ষন অস্থির চিত্তে রুমের মাঝেই পায়চারী করে, শেষ অবধি আব্বুর রুমের দিকে পা বাড়াল এবার। আজ না বলতে পারলে, সর্বনাশ যা হওয়ার খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ইমতিয়াজ খানের কল এসেছিল, আধঘন্টার মধ্যে তিনি স্বয়ং নিতে আসবেন মেঘালয়াকে।

দ্বিধা-সংকোচে পা জড়িয়ে আসছে। কি করে বলবে আবারও কথাটা আব্বুকে জানা নেই। আব্বুর প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে দ্বিতীয়বার এ-কথা শুনে— তা ভাবলেও পা থেমে আসছে। তবুও কোনমতো গিয়ে দাঁড়াল আব্বুর রুমের সম্মুখে। জড়তাটুকু গিলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। হেলাল আকবর সাহেব ল্যাপটপে কোন কাজে ব্যস্ত। মেঘালয়া মাথা নত করে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। সেকেন্ড কয়েক মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। কিছু বলতেই যাবে, তখনই ভারী স্বরে হেলাল সাহেব বলে উঠলেন,

“তুমি যা বলতে এসেছ, তা না আমি মানব, আর না এমন কথা শুনতে পর্যন্ত চাই। এই তিনদিনে আর একবারও যদি এমন কোন কথা নিয়ে আমার কাছে এসেছ, বিশ্বাস করো মেঘ, যা আমি এই কয়েকদিনে এখনও অবধি করিনি তা করতে দ্বিধা করব না। তোমাকে ত্যাগ না করে বসি আমি আর কোন অবাধ্যতা দেখলে। কথাটা খেয়ালে রেখে তুমি যেকোন কিছু করতে পারো।ʼʼ

এরপর আর বলার মতো থাকে কি কিছু? মেঘালয়ার পা জোড়া আটকে গেল আড়ষ্টতায়। কেবল ছলছল চোখে প্রিয়তম আব্বুর কঠোর মুখশ্রীর দিকে চেয়ে রইল। এই আব্বুর অতি প্রশ্রয় ওকে বিগড়েছে জীবনে। তাই-তো এত বড়ো একটা কাজ করে ফেলতে খুব বেশি ভাবতে হয় নি। আব্বুর এমন কঠোর রূপ দেখা হয়েছিল না আগে। ও ভাবেও নি সম্মানহানীর দায়ে হেলাল আকবর শাহ এতটা শক্ত হয়ে উঠবেন। আবারও সেই রাশভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল মেঘালয়া,

“নিজের রুমে যাও, তৈরী হয়ে নাও। ইমতিয়াজ চলে আসবে।ʼʼ

নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো মেঘালয়া। এবার আর মন মানছে না। ইরাজকে বিয়ে করার চেয়ে হয়ত নরক-বাস উত্তম। অথচ শেষ অবধি কি ওকে তাই-ই করতে হবে? আর ভাবতে পারল না সে। দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে মেঝেতে আহাজারী করতে লুটিয়ে পড়ল।

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০২

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মুর্তজা

২.

মেঘালয়া তার নিজের রুমে থাকা উল্টোপাল্টা, বেশ অনেকগুলো ঔষধ খেয়ে নিয়েছে। যার মাঝে শক্তিশালী মিগ্রা’র— প্যারাসিটামল, এন্টিবায়োটিক ও পেইনকিলারও ছিল। যা ওর শরীর সহ্য করতে পারেনি এবং জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল মেঝেতেই। যথাসম্ভব দ্রূত হাসপাতালে ভর্তি করানোর ফলে বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি, তবে শারীরিক দুর্বলতা ও ওষধের প্রভাব পুরোপুরি শরীর থেকে যেতে দু-একদিন সময় লাগবে।

ফোনে এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইমতিয়াজ সাহেব হায়-হায় করতে শুরু করলেন। চিন্তিত হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আনতারা খানম। এবার কি বলে বোঝাবেন, ইমতিয়াজ সাহেব স্ত্রীকে। বললেন, “মেঘালয়ার প্রেশার ফল করেছে। সে এখন হাসপাতালে আছে, দ্রুত সেখানে যেতে হবে।ʼʼ

বের হওয়ার পূর্বমুহুর্তে তার মনে পড়ল, ছেলের কথা। দৌঁড়ে ওপরে গেলেন। ইরাজের রুমের দরজা হালকা চাপানো। রুমে প্রবেশ করে দেখলেন, উদাম শরীরে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে সে। শিয়রে বসে কয়েকবার মৃদূ ধাক্কা দিলে, হঠাৎ ঘুম ভাঙায় ইরাজ র ক্তলাল চোখ খুলে তাকায়। বাবাকে দেখে সামান্য শান্ত হলো। চোখের ইশারায় শুধাল, কি হয়েছে!

ইমতিয়াজ সাহেব হন্তদন্ত বলে উঠলেন, “মেঘা হাসপাতালে। কি জানি কি-সব উল্টোপাল্টা ঔষধ খেয়ে ফেলেছে। আমরা যাচ্ছি, তুমি য..

ইরাজ হাত উচিয়ে ধরল। কথা শেষ করতে দিলো না। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, “প্রশ্নই ওঠে না। হাসপাতালে, মানে এখনও মরে নি। মরলে খবর দিও, জানাজা পড়ে আসব।ʼʼ

ছেলের এমন মন্তব্যে ইমতিয়াজ সাহেব ক্ষেপে উঠলেন। তবে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ভারী পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন ইরাজের রুম থেকে।


হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারী করছেন হেলাল সাহেব। এবার মেয়ে যা করেছে, সে কর্মের আসলেই আর কোন ক্ষমা নেই তার কাছে। ইমতিয়াজ খান গিয়ে পৌঁছে দেখলেন, হেলাল সাহেব অস্থির চিত্তে এদিক-ওদিক হাঁটছেন। ওনাকে ধরে নিয়ে এসে পাশে থাকা বেঞ্চের ওপর বসালেন।
প্রাইভেট হাসপাতাল হওয়ায়, তেমন লোকজন নেই। হাসপাতালের পরিবেশও পরিচ্ছন্ন ও শান্ত। হেলাল সাহেবের মুখ মেঘাচ্ছন্নতার চাদরে ঢাকা। যা তিনি ইমতিয়াজকে বলবেন বলে মনে পুষেছেন, তা তার অসস্থি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়ের এতসব কুকর্ম জেনে, কোন বাবা কখনোই এমন মেয়েকে নিজের একমাত্র ছেলের বউ করে ঘরে তুলবেন না নিশ্চয়ই! এ প্রস্তাব রেখে, শেষে অপমানিত না হতে হয়। হতে পারে ব্যাবসায়িক কিংবা বন্ধুত্ব— যে সুসম্পর্ক ছিল তাদের মাঝে; এ প্রস্তাবের মাঝ দিয়ে তা নষ্ট হয়ে যাবে!

তার অস্থিরতা তর-তর করে বেড়ে যাচ্ছে এসব ভেবে। ইমতিয়াজ সাহেব নিজে থেকেই কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,

“এত কিসের চিন্তা করছিস? মেঘা মা তো ঠিক আছে এখন। যা হওয়ার হয়ে তো গিয়েছে। দেখ ভাই, এ বয়সে ভুল তো সকলেই করে থাকে। বয়সটাই এমন, বুঝলি! আর খারাপ কিছু তো হয়ে যায়নি, রাজ ফিরিয়ে এনেছে তো নাকি? তুই তো এমনভাবে ভেঙে পড়ছিস, যেন মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছিস, আর ফেরেনি মেয়ে। মেঘার ছোট বয়স, বুঝতে পারেনি, করে ফেলেছে একটা ভুল। এসব ধরে বসে থেকে নিজের প্রেসার বাড়াস না, হেলাল। আর আনতারাকে জানতে দিস না এসব, আমিও বলিনি। মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপার। খুব নাজুক হয়। আমার মেঘা মা যাই করেছে, করেছে। পঁচে যায় নি।ʼʼ

এমন সব কথা শুনে হেলাল সাহেব আবেগী হয়ে পড়লেন। আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন বন্ধুকে। অতঃপর ভেজা কণ্ঠেই বলতে শুরু করলেন,

“কিসের অভাব দিয়ে মানুষ করেছিলাম ওকে, বলতো? মা মারা গেল ছোট রেখে। দ্বিতীয় বিয়ে করিনি, কেবল ওর জন্য। সকল সমৃদ্ধি দিয়ে বড়ো করে তুলেছি। আজ সে আমার সম্মান রাস্তায় লুটিয়ে এসেছে। সমাজে যে নামটুকু গড়েছিলাম এত বছরের পরিশ্রমে, তা এক রাতের ব্যবধানে ভেঙে খান-খান করে বাড়ি ফিরেছে। চারদিকের কথা কানে আসছে। হেলাল আকবর শাহ এর মেয়ে ভেগে গিয়েছিল।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব বললেন, “যখন দুজন মিলে ব্যবসা দাঁড় করছিলাম, তখনও লোকে কত কটুক্তি করেছিল। সে-সবে কান দিলে আজ, তুই-আমি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হতে পারতাম না, হেলাল। লোকে বলবেই, তুই কেন গায়ে তুলবি সে-সব?ʼʼ

হেলাল সাহেব আর কিছু বললেন না এ পর্যায়ে। চুপ রইলেন। ভেতরে খুব চিট-চিটে অনুভূত হচ্ছে। দোটানা হানা দিচ্ছে। কথাটা বলবেন কি-না! বললে, কিভাবে বলবেন? ইমতিয়াজ কেমন ভাবে নেবে কথাটা! মুখে এসেও আটকে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন, “দেখেছিস মেঘাকে?’

ইমতিয়াজ সাহেব জবাব দিলেন, “দেখেছি। কি সুন্দর স্নিগ্ধ মুখখানা জড়িয়ে গেছে মেঘা মায়ের। আনতারা তো মেঘার কেবিনেই বসে আছে। ভাবীর মতোই সুন্দর হয়েছিল তোর মেয়ে, মা’শা-আল্লাহ! এই অসুস্থ শরীরেও তাকিয়ে দেখার মতো।ʼʼ

এবার যেন সায় পেয়ে গেলেন হেলাল সাহেব। বলে উঠলেন, “সুন্দর হয়েই বা কি? কলঙ্ক যা লাগিয়েছে, তাতে কার ঘরে যাবে ও? এতসব আজেবাজে রটে যাওয়ার পরও কোন ভালো পাত্র আসবে ওকে গ্রহন করে নিয়ে যেতে? পড়তে চায় সে। অথচ এ অবস্থায় কি করে কি করব?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব ঘোর আপত্তি জানান এ কথায়, “তুই বেশিই ভাবছিস না কি? কে বলেছে বিয়ে হবে না? আশ্চর্য হচ্ছি তোর মতো শিক্ষিত মানুষের এমন মূর্খের মতো ভাবনায়। এই ছোট বিষয় নিয়ে, মেয়ের জীবনে বিয়ে না হওয়া অবধি চলে গিয়েছিস?ʼʼ

হেলাল সাহেব দ্রুত বলে উঠলেন, “কে নেবে ওই মেয়ে? তুই নিবি তোর ছেলের জন্য?ʼʼ

বলেই অসহায় মুখ বানালেন। আর অপেক্ষারত রইলেন ইমতিয়াজ সাহেবের প্রতিক্রিয়া দেখার।

ইমতিয়াজ সাহেব এমন একটা কথায় আসলেই থমকে গিয়েছেন। কিছু মুহূর্তের জন্য ঠিক মেলাতে পারেনি তার মস্তিষ্ক হেলাল সাহেবের কথাটুকু। বুঝে উঠতেই, চোখ ফিরিয়ে তাকালেন হেলাল সাহেবের দিকে। তিনি সামনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পাংশুটে মুখে বসে রয়েছেন। ইমতিয়াজ সাহেব এবার নিজেও অপ্রস্তুত বোধ করলেন। কি বলবেন, হেলালের বলা এ কথার পরিপেক্ষিতে! কিছুটা সময় নিয়ে, সংশয়াপন্ন কণ্ঠে বললেন, “তুই মেয়ে দিবি আমার ঘরে?ʼʼ

কথাটা কানে যেতেই হেলাল সাহেবের চোখ চিকচিক করে ওঠে। মনে সুপ্ত এক বাসনা জেগে উঠল। অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকালেন ইমতিয়াজ খানের দিকে। দু’বন্ধুর চোখে-চোখে অনেক কথা হয়। এভাবে কিছুক্ষন দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থেকে— আচমকা ইমতিয়াজ সাহেব মৃদূ হেসে ফেললেন। তবে হেলাল সাহেবের বুকে হাতুরি পিটছে। ইমতিয়াজের এই হাসির সঠিক মানে উদ্ধার করতে পারলেন না তৎক্ষনাৎ। ইমতিয়াজ সাহেব কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসলেন এবার। হেলাল সাহেব বন্ধুর মুখে যে-কোনো এক উত্তরের আশায় চেয়ে রইলেন।

ইমতিয়াজ খান ধীর-স্থির কণ্ঠে বললেন এবার, “বহু আগে থেকেই চেয়েছিলাম, মেঘাকে ইরাজের জন্য তোর কাছে চেয়ে নেব। তবে সাহস হয়নি কখনও, ইরাজের বাজে স্বভাবগুলোকে কেন্দ্র করে। বন্ধু হয়ে মেঘার মতো লক্ষী মেয়ের হাত আমার ওই বাঁদর ছেলের জন্য চাইতে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়তাম বরাবর। তবে আজ মেয়ে এক ভুল করে ফেলায় তুই খুব লজ্জায় পড়েছিস, হেলাল!ʼʼ

হেলাল সাহেব মাথা নত করে নিলেন। ইমতিয়াজ খান তা দেখে আবারও সামান্য হাসলেন। বললেন, “সমস্যা তো আমার ছেলেরও আছে। বাবা হয়ে জানি, ছেলের স্বভাব- চরিত্রের ব্যাপারে। ও ছেলে নির্ঘাত হাড়ে বজ্জাত। এ ব্যাপারে লজ্জা আমারও আছে। আর সম্প্রতি মেয়ের করা ভুল নিয়ে লজ্জা তোরও আছে। চল এবার লজ্জা-লজ্জায় কাটাকাটি করে ফেলি।ʼʼ

বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল যেন এবার হেলাল আকবরের। বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ইমতিয়াজ খানকে। তিনি আসলেই বড়ো সৌভাগ্যতে পেয়েছিলেন সেই জীবনের প্রথমকালে এমন এক বন্ধু। ইমতিয়াজ সাহেব নিজেকে ছাড়িয়ে মুখ ভার করে বলল, “আদিক্ষেতা কম দেখা। আর আমার বউ যেন কিছু জানতে না পারে মেঘার ব্যাপারে। চল আরেকবার দেখে আসি মেঘা মাকে।ʼʼ

ঘাঁড় নাড়লেন হেলাল আকবর। যাবেন না তিনি ওই অকৃতজ্ঞ মেয়েকে দেখতে। যে মেয়ে বাপের ভালোবাসা বোঝে না; বলেছিলেন ক্ষেপে গিয়ে কথাগুলো, এবং যা মেয়ের প্রাপ্য। অথচ সেই মেয়ে জান দিতে প্রস্তত! অনেক বুঝিয়েও ওনাকে নিতে পারলেন না ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়ার কেবিনে। অগত্যা নিজেই অগ্রসর হলেন সেদিকে।


সে-সবের দুদিন পেরিয়ে গেছে। এখন রাতের প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে যাচ্ছে। রাত দেড়টা পার হয়ে ঘড়ির কাটা দু’টোতে পৌঁছাবে। এখন মেঘালয়া সুস্থই। হয়ত আগামী কাল সকালেই বাড়ি যেতে পারবে। সে আপাতত কেবিনের বেডে শুয়ে চার-দিন আগে ঘটে যাওয়া সেই অভিশপ্ত দুর্ঘটনাকে মনে করছে ছাদের দিকে দৃষ্টি দিয়ে। সেদিন ইরাজ সঠিক সময়ে না পৌঁছালে হয়ত খারাপ কিছু হয়ে যেত ওর সঙ্গে। এ ব্যাপারে ইরাজের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা থাকলেও, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সময় গাড়িতে যে কথাগুলো ইরাজ শুনিয়েছে ওকে, তাতে করে ইরাজের ওপর মেঘালয়ার কেবল ঘৃনার বহর বৃদ্ধি পেয়েছে। সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ জন্মাতে গিয়েও যেন আবার সুপ্ত অবস্থায় ভেতরে লুকিয়ে পড়েছে।

আস্তে করে কেবিনের ভিড়িয়ে রাখা দরজা পার করে, কোন পুরুষ অবয়ব ভেতরে প্রবেশ করল। মেঘালয়া তা টের পেয়ে তীক্ষ্ণ নজর মেলে চেয়ে আছে সেদিকে। ইরাজ এসে কেবিনের আলো জ্বালিয়ে, সেখানে থাকা সোফার সম্মুখে দাঁড়াল। সোফার ওপরে মেঘালয়ার দু-একটা ওড়না বা কাপড় রাখা ছিল। সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে। হয়ত সেগুলো সরিয়ে সোফায় বসবে! মেঘালয়া দাঁত চেপে ধরে দেখছে সবটা নিরবে।

অথচ ইরাজ সেখান থেকে হেঁটে এসে বেডের অদূরে থাকা চেয়ারের সামনে দাঁড়াল। মেঘালয়ার প্রশ্ন, তাহলে কাপড়গুলো ফেলার মানে কি? মুখে কিছু বলে শুধু-শুধু খিস্তি শোনার ইচ্ছে নেই এই বদমাশ লোকের মুখে। যা ইচ্ছে করুক, দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই হলো।

চেয়ারটা টেনে নিয়ে মেঘালয়ার কাছে গিয়ে বসল ইরাজ। নিচের দিকে মাথা নত করে খানিকটা ঝুঁকে বসল। অদ্ভুত গম্ভীর চোখে কিছুক্ষন নিরবে তাকিয়ে থেকে, শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তোর বাপ কী ভাবে আমায়?ʼʼ

“আপনি যা, তা-ই ভাবে। আপনি জানেন না, আপনি কী?ʼʼ

মেঘালয়ার দেওয়া চটপটে জবাবে, কপাল কুঞ্চিত করে চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে।

“তর্ক করছিস নাকি? থাপ্পড় মেরে সবগুলো দাঁত নড়িয়ে দেব, অসভ্য!ʼʼ

মেঘালয়া তাচ্ছিল্য কোরে মনে-মনে ভাবল, অথচ আপনার সভ্যতার চোটে হাসপাতালের বেডে শুয়েও ধন্য আমি। কিন্ত মুখে কিছু বলল না।

চোখ ছোট-ছোট করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ ইরাজ। আপাদমস্তক পরখ করে নিলো। অতঃপর স্বাভাবিক গলায় আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “মরিস নি কেন এখনও? বেঁচে আছিস বলেই তো তোর বাপ এখন তোকে আমার গলায় ঝোলাতে এনার্জি ড্রিংক খেয়ে লেগেছে।ʼʼ

ভ্রু কুঁচকে তাকাল মেঘালয়া। শান্ত স্বরে বলল, “আপনার জন্যই হয়েছে সব, তাই আমার কানের কাছে প্যানপ্যান করে লাভ নেই।ʼʼ

ইরাজ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিপাত করে কেবল চেয়ে আছে মেঘালয়ার দিকে। ওর নজর বলছে, যখন তখন একটা থাপ্পড় পড়ে যাবে মেঘালয়ার গালে। মেঘালয়া তার আগেই বলে ওঠে,

“আব্বুর সামনে তো আপনি সাআআধু! আব্বুর ওপর পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণ করেও বোঝানো যাবে না, যে আপনার মতো ক্যাকটাস সাহারা মরুভূমির বুকেও দ্বিতীয় জন্মায় নি।ʼʼ

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০১

0

#সূচনা_পর্ব
#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মুর্তজা

“আব্বু, আমি বিয়ে করতে চাইনা আপাতত। পড়ালেখা শেষ করতে চাই।ʼʼ

মেয়ের ভেজা চোখে, আকুতি করে বলা কথায় মনে হলো না, সামান্যও টলেছে হেলাল আকবর সাহেবের হৃদয়। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলেন তিনি, “এজন্যই তো প্রেমিক নিয়ে চট্রগ্রাম পাড়ি দিয়েছিলে? তার সঙ্গে পড়ালেখা শেষ করতেই তো বাবাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছিলে। তাই-না?ʼʼ

মেঘালয়া মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠল বাবার কথায়। কলিজা ছিদ্র করে ঢুকেছে আব্বুর বলা কথাখানি। তবুও আবার নতজানু হয়ে অনুরোধ জানায়, “আব্বু, ভুল করে ফেলেছি। ক্ষমা করে দাও। তবুও আমায় আমার ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগটুকু দাও।ʼʼ

হেলাল সাহেব হুংকার ছেড়ে বললেন, “উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা তো দিয়েছ। কী করে দিয়েছ বলতো! পড়ালেখার সময়ে তো প্রেম করেছ। তাহলে পরীক্ষার খাতায় কি লিখে এসেছ? আবার সেই ফলাফলের আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নও দেখছ?ʼʼ

আব্বুর এত এত তিরস্কারের ভিড়েও কেবল বুক চিড়ে ঠোঁটে ভেঙে মলিন হাসিই ফুটে উঠল মেঘালয়ার মুখে। মাথাটা নত করে নিলো। হেলাল সাহেব নিজেই আবার জানানোর উদ্দেশ্যে বললেন, “আগামী শুক্রবার তোমার বিয়ে হবে। এবং তা রাজের সঙ্গেই। আর তোমার মতো বাপের সম্মান নিয়ে খেলা করা মেয়ের, মত-অমতের পরোয়া আমি করব না। তৈরী থাকবে।ʼʼ

এবার যেন মেঘালয়া ছটফটিয়ে উঠল। তড়াক করে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “কার সঙ্গে বিয়ের কথা বললে আব্বু? ইরাজ ভাই?ʼʼ

হেলাল সাহেব গম্ভীর স্বরে সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, “হু।ʼʼ

মেঘালয়া তাচ্ছিল্য হেসে ওঠে। ব্যাপক অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে ওকে। ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠল, “আব্বু তুমি আমাকে শূলে চড়িয়ে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলো। তবুও এত বড়ো শাস্তি দিও না। আমি মৃত্যুকে তো সাদরে গ্রহন করব, তবুও ইরাজের মতো বদমেজাজি, রগচটা, ক্ষ্যাপাটে অমানুষকে বিয়ে করে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে এক-বার করে মেরে ফেলতে পারব না।ʼʼ

এবার হেলাল সাহেব নিজের ওপরই ভৎসনা করে উঠলেন,

“বুঝলে মেঘ! আমি আসলেই তোমার মতো নির্বোধ, মূর্খ আর অকৃতজ্ঞ মেয়েকে নিয়ে এতদিন অযথা গর্ব করে এসেছি। রাজ তোমার মতো, প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া সম্মান ডোবানো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হবে কিনা, সে চিন্তা করছি আমি। আর তুমি কিনা আজও ভ্রান্তিতে পড়ে আছো? স্বয়ং রাজই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে তোমায় চট্রগ্রাম থেকে। পড়ালেখা শেষ করে বাপের ব্যবসা সামাল দিচ্ছে। নিজের কোম্পানি গড়ে তুলতে সচেষ্ট সে। দেখতে, শুনতে কি নেই তার? তো অহংকারবোধ তার থাকবে না? তোমার মতো মূর্খ মেয়ের থাকবে?ʼʼ

কত আদরের মেয়ে মেঘালয়া, আজ বাবার মুখে এমন সব কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে কেবল শুনছে বাবার কথাগুলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠল, “আব্বু, ইরাজ ভাই আর আমার বয়সের তফাৎ প্রায় নয়-দশ বছরের। তাছাড়া সে আমাকে অতিরিক্ত অপছন্দ করে। তার বদমেজাজ আর বাজে স্বভাবের ব্যপারে সবটা জেনেও তুমি আমাকে তার হাতে সারাজীবনের জন্য তুলে দিতে এত আগ্রহী?ʼʼ

হেলাল সাহেব মেয়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালেন এবার। মেঘালয়া দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়। আজ আব্বুর চোখে চোখ রাখার সাহসটুকু সে জঘন্য ভাবে হারিয়ে ফেলেছে। হেলাল সাহেব আক্রোশের সঙ্গে বললেন,

“যে মেয়েকে সর্বোচ্চ আদর-যত্নে বড়ো করে তুলেছি, কত কত বড়ো কথা বলেছি মেয়েকে নিয়ে সমাজে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। সে যদি আমার মান-সম্মানকে পা দিয়ে পিষে নিজের ইচ্ছেমতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে— আমিই বা এত ভালো কবে ছিলাম, যে এবার আর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া করব! আর নিশ্চিন্ত থেকো, বাবা আমি তোমার। তোমার মতো ছোটোলোকি কাজ করব না। রাজের নেই কি! সুখে থাকবে। সে আমারই বিজনেস পার্টনারের ছেলে। আর আমি, তোমার মতো, বাবার ভালোবাসার প্রতিদান, মন ভেঙে দেব না।ʼʼ

শেষের কথাগুলোতে ক্ষোভ আর মনের কষ্ট ঝরে পড়ল যেন হেলাল সাহেবের কথায়। কথাগুলো বলেই তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, মেঘালয়ার রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।

মেঘালয়া কেঁদে ওঠে এবার শব্দ করে। আব্বুকে সে কষ্ট দিয়েছে, সমাজে আব্বুর সম্মান নষ্ট করেছে— সব মানছে সে। তার বদলে আব্বু ওকে এত জঘন্যতম শাস্তি দেবে, এটা আশাতীত ছিল ওর কাছে। মেঝেতে পড়ে বুক ফাঁটা আত্মচিৎকারে ফেটে পড়ল মেঘালয়া। ইরাজ তার জীবনে অভিশাপ হয়ে আসতে চলেছে। সে প্রয়োজন পড়লে আবার নাহয় একবার পালিয়ে যাবে, তবুও ইরাজকে বিয়ে করার মতো বিদঘুটে কাজ করবে না।


ইরাজ বাড়িতে প্রবেশ করে সোজা সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে সোফাতে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন, ইমতিয়াজ খান। ছেলেকে প্রবেশ করতে দেখেই, কথা বলতে উদ্যত হলেন। ইরাজ ঢুকেই সোজা সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে। মনঃক্ষুন্ন হয়ে পেছন থেকে ডাক দিলেন,

“মেঘাকে পাওয়া গিয়েছে, রাজ?ʼʼ

পা থামিয়ে দাঁড়াল ইরাজ, তবে ঘাঁড় না ঘুরিয়েই জবাব দিলো, “ড্যাড, আ’ম সো টায়ার্ড, ডোন্ট আস্ক এনি কোয়েশ্চেন ফর নাও।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব বুঝলেন, ছেলের মন-মেজাজ ভালো নেই, তবুও জানা দরকার মেয়েটার কি খবর এখন। তাই আবারও স্বরটা আরও আদুরে করে জিজ্ঞেস করলেন,

“টেনশন হচ্ছে বাপ, সংক্ষেপেই বল নাহয়।ʼʼ

ইরাজ নেমে এলো সিঁড়ি থেকে। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে, ওয়াটার পট থেকে হাফ-গ্লাস পানি ঢালল। অতঃপর রেফ্রিজারেটর থেকে কয়েকটি আইস কিউব এনে পানিতে মিশিয়ে নিলো। গ্লাসটি নিয়ে এসে সোফাতে বাবার পাশে গা এলিয়ে বসে পড়ল। ওভাবেই কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে বসে রইল। ইমতিয়াজ সাহেব ইরাজের গায়ের শার্টের উপরের বোতামগুলো আলগা করে দিলেন। মাথায় দুয়েকবার একটু আদুরে হাতও বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ ছেলের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো হাসলেন। এই বেপরোয়া বাঁদরটা একমাত্র তার কাছে আজও আহ্লাদের।

আরও কিছুক্ষণ ওভাবেই নিরব থেকে জিজ্ঞেস করল ইরাজ, “আম্মু ফেরেনি এখনও?ʼʼ

“চলে আসবে। কিছু লাগবে তোর? খাবি না?ʼʼ

মৃদূ মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝাল ইরাজ। এতক্ষণে শান্ত স্বরে ইমতিয়াজ সাহেব প্রশ্ন করলেন, “হাত কেটেছে কি-করে? কোথাও মারপিট করে এসেছিস?ʼʼ

বাবার এমন শীতল কণ্ঠস্বরে, চোখ খুলে তাকাল ইরাজ বাবার দিকে, মুহূর্তে চোখ-মুখ শক্ত হয়ে উঠল। ইমতিয়াজ সাহেব কেবল চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে।

বরফ মেশানো পানিটুকু ঢক-ঢক করে গিলে নিয়ে, গ্লাসটা শব্দ করে টেবিলের ওপর রাখল ইরাজ। অতঃপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল, “কি জানো তুমি, ড্যাড? তোমার আদরের বন্ধুকন্যা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল চট্রগ্রাম, আর তাকে উদ্ধার করে আনতে গিয়েছিলাম?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব নিরব শ্রোতার মতো চেয়ে আছেন ইরাজের ক্ষুব্ধ মুখপানে। ইরাজ আচমকা শান্ত হয়ে গেল। দুষ্টু হাসি ছেয়ে গেল চোখে-মুখে। সেই হাসি যেন ভেতরের কিছু লুকোতেই ঠোঁটে হানা দিয়েছে! বদমাশি একটা হাসি দিয়ে বলে উঠল, “মেঘা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালিয়েছিল, ড্যাড। এবার আবার অবিশ্বাস কোরো না যেন! এটা আধুনিক যুগ, ড্যাড। মুখ দেখে নয়, কাজ দেখে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হয়— কে কী করতে পারে!ʼʼ

বলেই ব্লেজারটা কাঁধে চড়িয়ে, হেলে-দুলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।

পেছনে ইমতিয়াজ সাহেব, বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে প্রাণহীনের মতো পড়ে রইলেন। আসলেই, মেঘালয়া কে নিয়ে এমন ভাবনা কেউ ভাবলেও তাকে মারতে উদ্যত হতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না তিনি। অথচ তিনি জানেন, ইরাজ যাই হোক, মিথ্যা কথা বলে না।

তার ধ্যান ভাঙল হলরুমে কারো পদার্পনের আওয়াজে। সেদিকে না দেখেও তিনি বুঝলেন, তার মিসেস এর আগমন ঘটল। আনতারা খানম এসে তিনিও স্বামীর পাশে বসে পড়লেন। তার বোনের মেয়ে অদ্বিতার পাত্র বাছাই পর্ব চলছে। সেখানেই গিয়েছিলেন গতকাল। অবশ্য তার বোনের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল অদ্বিতাকে ইরাজের ঘাঁড়ে ঝোলানোর। তবে ইরাজ; সে তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সাহস হয়নি কারোই, ওর কাছে এমন প্রস্তাব করে যা-তা খিস্তি শোনার।

আনতারা খানম বসেই সর্বপ্রথম মেঘালয়ার খোঁজ লাগালেন, “পেয়েছে নাকি মেঘাকে? ওমন আদুরে মেয়েকে ওতদূর বন্ধুদের সঙ্গে পাঠাবারই কি দরকার হেলাল ভাইজানের। নাজুক মেয়ে, পথঘাট হারানোরই কথা। রাজ ফিরেছে?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব দ্বিধায় পড়ে গেলেন। যে মেয়ে পরিচিতদের কাছে লক্ষী হিসেবে নামকরা। সে মেয়ের ব্যাপারে এমন একটা কথা স্ত্রীর কাছে ব্যাক্ত করতে একটু বাঁধল যেন জিহ্বায়। কথাটা কাটিয়ে, বরং স্ত্রী যা জানে, সে-ভাবেই জানিয়ে দিলেন,

“না পাওয়ার কি আছে? তোমার ছেলে গিয়েছিল কিনা খুঁজতে! ওকে বাড়িতে দিয়ে সবে বাড়ি ফিরল রাজ।ʼʼ

আনতারা খানম স্বস্তি পেলেন যেন, “আলহামদুলিল্লাহ, বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরেছে। চলো তোমাদের খাবার দেই। রাজকে ডাকো তো। সারাদিনে না জানি কত ধকল পেরিয়ে এসেছে।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন ব্যাপারটি। মহিলাদের কাছে স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যাওয়াকে উত্তম মনে করেন তিনি। আর যেখানে মেয়ের সম্মান জড়িয়ে আছে, সেখানে না জানি আনতারা বেগম কত বিরূপ মন্তব্যে ভরে ফেলবেন মেয়েটির চরিত্রকে। আনতারা খানম নিজেই উঠে গেলেন ইরাজকে ডাকতে। তখনই ফোন বেজে উঠল হলরুম কাঁপিয়ে।

ইমতিয়াজ সাহেব স্ক্রিনে দেখলেন, হেলাল আকবর শাহ এর নম্বর। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। আল্লাহ তায়ালা জানেন, কি ব্যপারে কল করেছে, হেলাল! এ আশঙ্কা বুকে চেপে ফোন কানে তুলে নিলেন।

চলবে..

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৫

1

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৫
“আমাকে বিদায় না দিয়ে এখানে কি করছো?
‘নয়না হুট করে জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে, নিম্ন স্বরে বলে,আপনি সুনামির মত এসে তুফানের মত কেনো চলে যাচ্ছেন?
‘কি কথা ছিলো?
‘নয়না চোখ মুছে বলে, আপনি এতো নিষ্ঠুরমানব!
‘নয়নার ললাটে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো পরম মমতায়।
‘কপালে চুমু খাওয়া ভালোবাসার নিদর্শন। তারমানে আপনি ফিরবেন আমার জন্য? আমি কি আপনার অপেক্ষা করবো আপনার বিরহিণী হয়ে?
‘বাচ্চাদের কপালে চুমু খেতে হয় আদর করে৷ যাওয়ার সময় তোমাকে স্নেহের চাদরে মুড়িয়ে দিয়ে গেলাম।
‘আমাদের কি সত্যি আর দেখা হবে না মিস্টার পাইলট মহাশয়।
‘জিয়ান বেশ অবাক হলো নয়নার মুখে পাইলট ডাকটা শুনে! কেনো যেনো ইচ্ছে হচ্ছে প্লেন ড্রাইভার ডাকটা শুনতে! মানুষের মন মাঝে মাঝে অদ্ভুত আবদার করে বসে! নয়নার নয়ন কোনে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু নিজের হাতে মুছে দিয়ে বলে,তোমার নামের মতই তোমার চোখ দুটো সুনয়না। চোখের গভীরতা তোমার চোখদুটো আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
‘উত্তর দেবেন না?
‘যাচ্ছি। হয়ত দেখা হবে। ভালো থেকো। ঠিকমতো পড়ালেখা করবে। রেজাল্ট যেনো টপ লেভেলের হয়৷
‘ কথাটার উত্তর দিলেন না তো?
‘সব উত্তর জানা হয়ে গেলে আমাকে মনে করবে কিভাবে?কিছু উত্তর অজানা থাকুক আমাকে স্বরণ করার উৎস হিসেবে।
‘এখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে যাবেন?
‘হ্যা আমার ফ্লাইট একটা বাজে৷
‘আপনি কোন দেশের বিমান ড্রাইভার?
‘কানাডা টু আরব আমিরাত। আসছি সুকেশীনি।
‘নয়না দরজা পর্যন্ত আসলো না৷ এই কয়দিনে তার হৃদয়ে ভালোই জায়গা করে নিয়েছে লোকটা৷ নয়না মনযোগ বসালো আকাশ দেখায়। মানুষ ও কি আকাশের মতই ক্ষণে ক্ষণে রুপ বদল করে! হঠাৎ নিচে চোখ পরতেই চার চোখের মিলন ঘটালো। নিচ থেকে আরো দুটি নয়ন তার দিকে স্থীর করলো। হাত দিয়ে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে বসলো৷ গাড়ির গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছে নয়নার দিকে। নয়নাও দৃষ্টি এদিক সেদিক করেনি। চোখে চোখে কথা হচ্ছে। যে কথা শব্দ হয়ে ফুটতা না ঠোঁটে।
নয়নার চোখের ভাষা বুঝতে পারছে জিয়ান৷ কিন্তু দ্বিতীয় বার ভালোবাসার মত ভুল করতে চায় না৷ ভালোবাসা মন্দবাসা খনিকের মোহ।জিয়ান চলে গেলো নয়নার দৃষ্টি সিমার বাহিরে।
‘নয়না কিছু সময় আকাশের পানে আনমনে তাকিয়ে থেকে রুমে আসলো।
‘কাল রাতে জিয়ানের হাতের উপর মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পরেছিলো নয়না৷ একদিনে নিজের রুম জুড়ে অন্য আরেকজন বাস জেনো ভিষন মিস করছে নয়না৷ বেডে এখনো ছড়িয়ে আছে জিয়ানের রেখে যাও শার্ট, জিন্স।শার্ট হাতে উঠালো নাকের সামনে নিয়ে অনুভব করতে লাগলো জিয়ানের অস্তিত্বের ঘ্রাণ। হঠাৎ নিজের অজান্তেই শার্টটা জড়িয়ে ধরল। চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গাড়িয়ে পরলো, শার্ট হাত থেকে ফেলে দিয়ে নিজের হৃদয়ে হাত রেখে বলে,আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারি না! এটা আমার ক্ষনিকের মোহ মায়া, নয়ত আবেগ। সাইড টেবিলের উপর নজর স্থীর হলো। দ্রুত যেয়ে জিয়ানের ওয়ালেট হাতে নিলো। আইডি কার্ড সহ আরো কিছু প্রয়োজনীয় কার্ড সাথে বেশ কিছু টাকা৷
নয়না নিজের ফোন থেকে জিয়ানকে কল করতে যেয়ে খেয়াল করলো নাম্বার নেয়া হয়নি। জব কার্ডে যে নাম্বার দেয়া সেটা এদেশের না। দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হলো৷
‘জাহানারা বেগম সোফায় বসে চা পান করছিলেন৷ মেয়েকে দেখে বলে,কিরে মা মন খারাপ?
‘আম্মু ওনার নাম্বার আছে তোমার কাছে?
‘কার? জামাইয়ের নাম্বার?
‘হ্যা।
‘আমার কাছে তো নেই। কোন প্রয়োজন?
‘আমারো খেয়াল ছিলো না নাম্বার রাখতে৷ ওনার ওয়ালেট রেখে গেছে। এটার মধ্যে অনেক দরকারী জিনিস আছে৷
‘নিচে ড্রাইভার আছে তুই রেডি হয়ে আয় আমি বোরখা পরছি।
‘রেডি হয়ে আসবো মানে?
‘এয়ারপোর্টে দিয়ে আসি৷
‘আচ্ছা দ্রুত করো।
‘জিয়ান কিছুদূর এসে বাসায় কল করলো,ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই মিতা বেগম বলেন, একবার আমার সাথে দেখা করবি না বাবা?
‘আমার সময় নেই আম্মু।শোন নয়নাকে কোন জোড়াজুড়ি করবে না৷ সামনে ওর এক্সাম সেখানে ফোকাস করতে দাও।
‘রেজা বিয়েটা কিন্তু পুতুল খেলা নয়। মেয়েটা তোর বৌ আল্লাহ তায়ালার কালাম পরে সবাইকে সাক্ষী রেখে তোদের বিয়েটা হয়েছে মাথায় রাখিস৷ নিজের দ্বায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় না।
‘আম্মু আমি ছোট বাচ্চা না৷ সো আমাকে লেকচার দিতে হবে না। বাবাকে বলে দিও কথাটা৷ তার বেহুদা রেপুটেশনের জন্য নয়নার এক্সামে কোন রকম ত্রুটি যেনো না হয়।
‘মিতা বেগম আর কিছু বলার আগেই খট করে কল কেটে গেলো। মিতা বেগম দ্রুত উঠে আসলো জিয়ানের রুমে। আজ সকালে অনিকেত এসেছিলো বাসায়। তারমানে পাসপোর্ট, টিকেট সব অনিকেত নিয়ে গেছে! জিয়ানের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে আসলো।নাজিম চৌধুরী খুব মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করছেন। মিতা বেগম বললেন, শুনছো রেজা চলে যাচ্ছে।
‘ছুটি শেষ যাচ্ছে মানে কি!যেতে তো হবেই!
‘আমাদের সাথে দেখা না করে!
‘মিতা ছেলে বড় হলো অযথা ইমোশনাল হবে না তাদের নিয়ে৷ ওরা বড় হয়েছে ওদের পার্সোনাল লাইফ আছে ওদের মত থাকতে দাও। আর হ্যা দু’দিন পর তালুকদার বাড়ি থেকে চৌধুরী বংশের বৌমাকে নিয়ে আসবে৷
‘রেজা কল করেছিলো৷ বলেছে সুনয়নার এক্সাম সামনে তাই ডিস্টার্ব করতে না৷
‘সব কথা শুনলে হবে? মন মর্জি মত বিয়ে করেছে। চৌধুরী বাড়ির বৌ বাপের বাড়িতে পরে থাকবে! আমি যেটা বললাম সেটাই শেষ কথা। আর হ্যা তোমার ছোট নবাবের খবর কি?
‘ আগামীকাল ফিরবে৷
‘তাকে বলে দিও দেশ ভ্রমণ শেষ হলে যেনো অফিস ভ্রমণে যায়। আমার বয়স হচ্ছে একা সম্ভব না পুরোটা হ্যান্ডেল করা৷
মিতা বেগম মনে মনে একটা মেয়ের কমতি অনুভব করছে। ছেলেরা যেমন তার হ্যাসবেন্ডও তেমন। তার মন কেউ বুঝতে চায় না৷ এই যে ছেলেটা তার সাথে দেখা না করে চলে গেলো?তার তো হৃদয় পুড়ছে! ইচ্ছে করছে নিজের ছেলের কপালে চুমু খেতে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে, ঠিকমত খাবার খাবি, ঠিকমত ঘুমাবি। নিজের খেয়াল রাখিস বাবা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রুম থেকে বের হয়ে জিয়ানের রুমে আসলো৷ ছোট বেলায় ছেলে দুটো তার আঁচল ধরে সারা বাড়ি ঘুরতো৷ কোন আবদার থাকলে সেদিন আর আঁচল ছাড়তো না আবদার পূরণ না হওয়া পর্যন্ত। তার হাতের রান্না ছাড়া পেট পুরতো না।খাবার খেয়ে হাত মোছার জন্য বেছে নিতো মায়ের আঁচল,পরে গিয়ে সামান্য কে’টে গেলেও সে কি বায়না! সন্তান বড় হলে তাদের ভালোবাসা কি কমে যায় বাবা মায়ের প্রতি! মিতা বেগম জিয়ানের বেডে বসলো,মনে মনে বলে,এবার তোকে তোর পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ানো হলো না।আবার কবে ফিরবি বাবা!
🌿এই তোর বৌকে দেখা বিয়েতে যেতে পারিনি বৌ দেখা দ্রুত।
‘আমার বৌ দেখে তোর বুকে ব্যথা বাড়ুক আমি চাইনা৷
‘শা’লা বুকে ব্যথায় হার্ট অ্যাটাক হলেও ভাবিকে দেখবো৷
‘জিয়ান মেবাইল বের করে বলে এই দেখ আমার অস্থায়ী বৌ।
‘আরেহহহ বাহহহ ভাবি তো মাশা আল্লাহ কিউটের ড্রাম। অস্থায়ী বৌ মানে কি?
‘মেয়ের বয়স ষোল বছর। আর তাছাড়া নীলাঞ্জনার বোন৷ তাই এই বিয়ে বাতিল করে দিবো ওর আঠারো বছর হলেই।
‘আহ বুকে ব্যথা পেলুম! তোর কি কপাল এতো সুন্দর বৌ পেয়েও অস্থায়ী! আর এদিকে একটা প্রেমিকাও কপালে জুটলো না৷ স্থায়ী অস্থায়ী বৌ তো দূরের কথা।
‘তোর কপালে বিয়ে নাই। মেয়ে দেখলে তার একশটা খুঁত খোঁজা শুরু করিস!সিঙ্গেল মরবি এমন চলতে থাকলে৷
‘ইহা হতে পারে না। আমার বৌ চাই একদম পার্ফেক্ট বৌ।
‘বৌয়ের কি অভাব একটার সাথে থাকা শুরু করে কার বৌ দেখা দরকার নাই। বলে আওয়াজ করে আসলো৷
‘চুপ কর আমি নিজে বিয়ে করে নিজস্ব বৌ বানাবো।
‘সে কি? বৌ তৈরির ফ্যাক্টরি থাকতে তুই এখনো সিঙ্গেল!
🌿বাসে পাশাপাশি বসে আছে লাবিব আর নীলাঞ্জনা৷ জানালার সাথে হেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে নীলঞ্জনা।
‘এভাবে মন মরা হয়ে আছো মনে হচ্ছে সদ্য বিধবা হয়েছো!
‘মুখে কিছু আটকায় না? আর কিছু না হোক নিজের মৃত্যু কামনা কি করে করো?
‘আরেহহহ বাহহহ বৌয়ের দেখছি আমার প্রতি ভালোবাসা উতলে পরছে! তা বিরহে অনলে এখনো পুরো পুরো পুড়িয়ে ফেলোনি নিজেকে! বেশ অবাক হলাম!বাইদা ওয়ে আমি মুখে যাই বলি থাকবো কিন্তু তোমার সাথেই।
‘সাথে থাকালেই হবে? ভালোবাসা ছাড়া সাথে থাকা তো যায় তবে শূন্যতা ঘিরে থাকে হৃদয় জুড়ে৷ শরীর তৃপ্ত হলেও মন অতৃপ্ত রয়ে যায়।
‘এতো সব ভাবার সময় কই? সারাদিন কাজ রাতে বেড রেস্ট। ব্যাস এতোটুকু হলেই হয়।
‘লাবিব মনে আছে তুমি বলেছিলে,আমায় ভালো না বেসে তুমি থাকতে পারো না তাই ভালোবাসো৷ নয়ত বন্ধুর প্রেমিক জানার পরেও আমার পিছু নিতে না?
‘আমার কথার ভ্যালু ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ আমি যা চাই তা হাসিল না হয়। পেয়ে গেলেই কথা শেষ। আর শুনে রাখো রেজা যখন জানতে পারবে তুমি আমার সাথে পালিয়েছো তখন কি বলবে?
‘বলার কি আছে? আমরা একে অপরকে ভালোবাসি এই কথাটা ছাড়া?
‘উঁহু আমি তোমাকে ভালোবাসি না৷ তুমি জোড় করে আমাকে বাধ্য করেছো।
‘লাবিব!নিজেকে আর কত নিচে নামাবো তোমার জন্য!
#চলবে

তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
শেষপর্ব
মাহবুবা বিথী

অনেক দ্বিধা থাকা সত্বেও যুবরাজ সুজানাকে সানজানা ভেবে সংসার করে যাচ্ছে। সুজানাও আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে যুবরাজকে সুখী করতে। সে কারণে যুবরাজও সবকিছুতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর মাঝে জীবনের ন’মাস সময় গড়িয়ে গিয়েছে। সুজানা কনসিভ করেছে। ওদের বেবির আটমাস সময় পার হয়েছে। শুরু থেকেই সুজানার প্রচন্ড বমি হতো । সে কারনে দুবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে স্যালাইন দিতে হয়েছে। শারীরিক কন্ডিশন খুব খারাপ থাকাতে ডাক্তার যুবরাজকে বলেছে, ওকে যেন কোনো প্রকার মানসিক চাপ দেওয়া না হয়। এতে মা এবং বাচ্চার জীবনহানির শঙ্কা দেখা দিতে পারে। সে কারনে সুজানাকে নিয়ে অনেক অসঙ্গতি দেখা দিলেও ও চুপ থাকতে বাধ্য হয়। এর মাঝে ওর ফ্রেন্ড মেহদি ফোন করে ওকে বলে,
—সানজানা ইউকে তে গেল তোরা একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?
কথাটা শুনে যুবরাজ যেন বিষম খেলো। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকলো। ওর নিরবতায় মেহদি মজা করে বললো,
—-সমস্যা নাই। এই কারনে তোর কাছে ট্রিট চাইবো না। এতো টেনশন করিস না।
যুবরাজ নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো,
—-আসলে অনেক তাড়াহুড়া ছিলো সে কারনে তোদের সবাইকে বলে যেতে পারেনি।
—-তোদের বিয়ের পরপর চলে গিয়েছে?
—-হুম, তুই কোথা থেকে খবর পাইলি?
—-তুই তো জানিস ও আর আমি একই স্যারের আন্ডারে থিসিস জমা দিয়েছি। গতকাল স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানেই শুনলাম।
—আচ্ছা,আমার একটু ব্যস্ততা আছে দোস্ত। এখন রাখছি পরে কথা হবে।
ফোনটা রেখে অফিসে ও কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। ভাবছে ওর সাথে এটা কি হলো? কেন সানজানা ওর বোনকে ওর কাছে গছিয়ে দিয়ে এভাবে প্রতারণা করলো। কি এমন কারণ ছিলো যার কারনে ওকে এইভাবে ফেলে রেখে চলে গেল। মনে মনে ও সুজানার উপরও খুব রেগে গেল। ঐ বা কেন এতোদিন ধরে ওর সাথে সানজানার অভিনয় করলো? ওকে এভাবে থম মেরে বসে থাকতে দেখে ওর এক কলিগ আকিব চৌধুরী কাছে এসে বললেন,
—- এভাবে মুখ ভার করে বসে আছেন কেন? ভাবির জন্য খুব টেনশন হচ্ছে।
আকিব চৌধুরীর ডাকে ভাবনার অতল থেকে যুবরাজ ফিরে এসে বললো,
—-টেনশন কিছুটা হয় বৈকি! ওর শরীরটা খুব একটা ভালো থাকে না। কনসিভ করার কারনে কিছু কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে।
এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে ওর মা ফোন দিয়েছে। এই অসময়ে ওর মায়ের ফোন দেখে অবাক হলো। সুজানার শরীর আবার খারাপ করলো নাকি? চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে বললো,
—-আম্মু তুমি হঠাৎ এ সময়ে ফোন দিলে?
—সানজানা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমরা ওকে নিয়ে ইউনাইটেট হাসপাতালে যাচ্ছি। তুইও চলে আয়।
ফোনটা রেখেই বসের কাছে ছুটি নিয়ে যুবরাজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। হাসপাতালে পৌঁছাতে ওর দুপুর দুটো বেজে যায়। সুজানাকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয়েছে। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত বমির কারনে ওর এমনটা হয়েছে। তখনও ওর জ্ঞান ফিরে আসেনি। এর মাঝে সুজানার বাবা মা চলে আসে। ওদিকে যুবরাজের বাবা মায়ের লাঞ্চ করা হয়নি। লাঞ্চ করার পর দুজনেরই প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে। এসব নানাবিধ কারনে যুবরাজ ওর বাবা মাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তাছাড়া সানজানার বিষয়ে কথা বলার এটাই একটা বড় সুযোগ। ওর বাবা মা চলে যাবার পর যুবরাজের শ্বশুর ওর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে,
—-সানজানার জ্ঞান ফিরেছে বাবা?
যুবরাজ ওর শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললো,
—সানজানার তো জ্ঞান হারায়নি তো ফেরার কথা উঠছে কেন?
—-আমি বুঝতে পারছি বাবা তুমি মানসিকভাবে একদম ভালো নেই। সে কারনে তোমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। এতো চিন্তা করো না। সানজানা ঠিক সামলে উঠবে।
—-আপনার এই বয়সে মিথ্যা বলা উচিত না। কেন আপনারা আমার সাথে এমন খেলা খেললেন? আর সানজানাই বা কোন অধিকারে আমার ভালোবাসাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমাকে যদি গ্রহন নাই বা করবে তবে আমাকে স্বপ্ন দেখালো কেন? কি দোষ ছিলো আমার? যার কারনে আমাকে এভাবে ঠকালো।
সানজানার মা যুবরাজের মুখে এই কথাগুলো শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-ও তোমাকে ঠকায়নি বাবা। বরং ওর ভাগ্য ওকে ঠকিয়েছে।
—-শুধু শুধু ভাগ্যের ঘাড়ে দোষ দিবেন না মা। মানুষ যখন কোনো কারনের অজুহাত খোঁজে তখন খুব সহজে ভাগ্যের উপর চাপিয়ে দেয়। সত্যি বলতে কি যে মানুষটাকে ঘিরে আমি আমার পৃথিবীটা গড়তে চেয়েছি অথচ আমি কোনোদিনই তার পৃথিবীর অংশ ছিলাম না। সেকারনে বিনা দ্বিধায় সে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পেরেছে। মানুষের অনুভূতীগুলো কোনো ছেলে খেলা নয়। অথচ সানাজানার কাছে আমার অনুভূতীগুলো ছেলেখেলায় রুপান্তরিত হলো। আমি তো ওর জীবন সঙ্গিনী হতে চেয়েছিলাম অথচ ও আমাকে ওর জীবনের অংশ হতে দিলো না। ওর ভালোবাসাকে যতটা খাঁটি আমি ভেবেছিলাম বাস্তবিক অর্থে ততটা খাঁটি ছিলো না। সে কারনে এতো সহজে ভেঙ্গে গেল।
এবার সানজানার বাবাও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—তুমি এভাবে আমার মেয়েটাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিও না। আগে ওর জীবনের ঘটনাগুলো শুনো তারপর তুমি এর বিচার বিবেচনা করবে। আমার মেয়েটা পরিপূর্ণ নারী ছিলো না। জন্মগতভাবে ও ত্রুটিযুক্ত।আরো সহজ করে বলতে গেলে ও একজন হিঁজড়া। ওর ধারণা ওর শারীরিক অপূর্ণতার কারনে তুমি কখনও সুখী হবে না। সেকারনে সেদিন ওভাবে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো।
যুবরাজ ওর শ্বশুরের মুখে একথা শুনে বললো,
—-এখানে তো ওর কোনো দোষ নেই। তাছাড়া আমি ওকে শরীর দেখে ভালোবাসেনি। প্রতিটি মানুষের বায়োলজিক্যাল নিড থাকে। কিন্তু সেটা জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হতে পারে না।
—কিন্তু তুমি আবেগের বশবর্তী হয়ে আজ এই কথাগুলো বলছো। কিন্তু একটা সময় পর আবেগ যখন ফুরিয়ে যাবে তখন বাস্তবতা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে। তখন তুমি তাকে অস্বীকার করতে পারবে না।
—-বুঝলাম মা আপনার কথায় যুক্তি আছে। তবে আমার কথা হচ্ছে শরীর দেখে যে ভালোবাসা হয় সেটাকে ভালোবাসা বলে না। সেটা হলো লালসা।
এমন সময় ডাক্তার এসে বললো,
—-এখানে পেশেন্ট সানজানার কে আছেন?
যুবরাজ দৌড়ে এসে বললো,
—আমি পেশেন্টের স্বামী। আমার পেশেন্ট কেমন আছে?
—খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। ওর প্রিক্লাম্পশিয়া দেখা দিয়েছে। ওর অতিসত্বর সিজার করতে হবে। তা,নাহলে বাচ্চা এবং মায়ের জীবন হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। আপনাকে বন্ড সই দিতে হবে। এরপর পেশেন্টকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে। হাতে সময় খুব কম। আপনাকে এখুনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় যুবরাজ যেন খেই হারিয়ে ফেললো। ডাক্তারের কথায় রোবটের মতো পেপারসগুলোতে সই করে গেল। সুজানাকে ওটিতে নেওয়ার সময় যুবরাজ সুজানা বলে ডাকে। সাথে সাথে সুজানার চোখের পাতাটা নড়ে উঠে। দুচোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা পানি দুচোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সুজানার বিষাদমাখা মুখটা দেখে যুবরাজের বুকের ভেতরটা ব্যথায় মুঁচড়াতে থাকে। ও মনে মনে ভাবে সুজানা এই বিপদ পার হয়ে যখন ওর কাছে ফিরে আসবে তখন যুবরাজ ওর সমস্ত সত্তা দিয়ে ওকে ভালোবাসবে। যে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে তার কথা ও আর কখনও ভাববে না। কারণ ও কখনও যুবরাজের ছিলো না।

আলো ঝলমল নগরী লন্ডন। এর বুকচিরে এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে রাজপথ। তার পাশে রেলপথ। হুসহাঁস করে কখনও বাস যাচ্ছে আবার কখনও বা ট্রেন যাচ্ছে। শহরের বড় বড় হাইরাইস বিল্ডিংগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর রাতেও এই শহরে ব্যস্ততার শেষ নেই। রবিবার হওয়াতে শহরের দামী পানশালাগুলোতে উপচে পড়া ভীড়। হালকা মেজাজে মিউজিক বেজে চলেছে। এখন সময়টা সামারের। কিছু মানুষ ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেও কেউ কেউ শরীরটাকে গরম করতে পানশালাতে চলে এসেছে। স্বল্পবসনা কিছু তরুনী অ্যালকোহলের পেয়ালা হাতে শরীরি বিভঙ্গে পানশালার পরিবেশটাকে মাদকতায় ভরিয়ে রাখছে। পাশের রেস্তোরায় বসে সানজানা এই দৃশ্যগুলো দেখে নিজের কষ্টগুলোকে ভুলে থাকতে চাইছে।
সানজানা ভাবছে মানুষের ভালোবাসার ক্ষেত্রে শারীরিক চাহিদা কি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নাকি ওর এটা ভুল ধারণা?কিন্তি এটাও তো সত্যি সানজানা কখনও যুবরাজকে নারীত্বের কাঙ্খিত সুখ দিতে পারবে না সে কারনে ও নিজ থেকেই যুবরাজের জীবন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ওর জীবন যতই পরিহাসের স্বীকার হোক কিন্তু ও সেই পরিহাসের কাছে হার মানেনি। বরং নিজেকে যুবরাজের জীবন থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের মতো বাঁচতে শিখে গেছে।এটা ভেবে সানজানা খুব প্রশান্তি অনুভব করে।

সুজানার শারীরিক কন্ডিশন ভালো না। খবরটা জানার পর থেকে ও খুব অস্থিরতায় ভুগছে। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ পর ওর ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা ফোন দিয়েছে। কম্পিত হাতে ফোনটা রিসিভ করে বলে,
—-আব্বু সুজানা কেমন আছে?
আশরাফ চৌধুরী সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
—-সুজানার একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে।
—বাবা, সুজানা কেমন আছে?
—-সুজানা আর বেঁচে নাইরে মা।
একথা বলে আশরাফ চৌধুরী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
সানজানা ফোন রেখে আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে টিকিট কেটে দেশের পথে পা বাড়ায়। যদিও ও জানে সুজানাকে দেখতে পাবে না তারপরও ওর মনে হয় এই সময়টায় ওর বাবা মায়ের পাশে ওর থাকা উচিত। তাছাড়া যুবরাজ বাচ্চাটা কিভাবে সামলাচ্ছে কে জানে? ঐ শিশুটি এখন সুজানার একমাত্র চিহ্ন।

সকাল থেকে বাচ্চাটা অনবরত কেঁদে চলেছে। গতকাল ওর মায়ের দাফন হয়েছে। যুবরাজ ভাবছে, হয়তো এই মাসুম বাচ্চাটা বুঝতে পেরেছে ওর মা দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে। যুবরাজ ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বাচ্চাটাকে কোলে হাঁটছে আর অবাক হয়ে নিজের ভাগ্য নিয়ে ভাবছে। যাকেই ও ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতে চায় সেই ওর জীবন থেকে হারিয়ে যায়। কি অদ্ভূত জীবন ওর! হঠাৎ ওর কাঁধের উপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। আর বহুদিন পর ওর ভীষণ পরিচিত একজন প্রিয় মানুষের সুঘ্রান ওর নাসিকা গ্রন্থিতে এসে লাগে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সানজানা ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সানজানা যুবরাজের কাজ থেকে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। সাথে সাথে বাচ্চাটার কান্না থেমে যায়।

তিন মাস পর——
আজ যুবরাজ আর সানজানার বিয়ে। একরকম জোর করেই যুবরাজ সানজানাকে বিয়ে করেছে। কারণ ওর কাছে ভালোবাসা মানে এক স্বর্গীয় অনভূতী। যেখানে শারীরিক অসঙ্গতি কোনো ম্যাটার করে না। ওর তিনজন আজ একসাথে বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে। ছোটো রাজপুত্র সানজানার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। সানজানা ওকে বিছানায় শুয়ে দিলো। বাচ্চাটাকে মাঝখানে রেখে ওরা দুজন দুপাশে বসলো। যুবরাজ সানজানার দিকে তাকিয়ে বলে,
—আজকে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনটা আজ পরিপূর্ণতা পেলো।
সানজানা যুবরাজের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
—-বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরে ঠেলিয়া দেয়।
আর মনে মনে বললো,সুজানার ছেলেটার কথা ভেবেই আমি তোমার সাথে আমি আমার জীবনটাকে জড়িয়ে নিলাম।

সমাপ্ত

তীরভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০৫

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তীরভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

নিজের আজকের এই অবস্থার জন্য ও কাউকে দোষারোপ করে না। কারণ যদি দোষারোপ করতেই হয় তাহলে সবার আগে ওর নিজেকে দোষারোপ করা উচিত। এই প্রেম ওর বোকামীর ফসল। প্রেমে পড়লে মানুষ বোকা হয়ে যায় সানজানা যেন নিজের ক্ষেত্রে তাই অনুভব করলো।
রুমের লাগোয়া বারান্দায় এসে সানজানা গার্ডেন চেয়ারটায় বসে দূরে সাগরের ঢেউগুলো দেখতে লাগলো। আর মনে হতে লাগলো, প্রেম ভালোবাসা অনেকটা গাছের মতন। বীজ থেকে প্রথম গাছ হয়। তারপর সেই গাছটা বৃদ্ধি পেয়ে শাখা প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে। তারপর সেই গাছ ফলে ফুলে শোভিত হয়। যদি মাঝপথে গাছটার অকাল মৃত্যু ঘটে তাহলে এসবের কিছুই হয় না। ভালোবাসাও তেমনি। দুটো মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে তারপর তারা বিয়ে করে সংসার সাজায়, সেখানে তাদের সন্তান হয় ভালোবাসাও আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ ঘটে। কিছু মাঝপথে ভালেবাসাটার মৃত্যু ঘটলে সব কিছু থেমে যায়।
সানজানার কিছুই ভালো লাগছে না। ভাবনার জগতে বিচরণ করতে গিয়ে কতোটা সময় পার হয়ে গিয়েছে ওর সেদিকে খেয়াল নেই। রুমের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা তিনটা বাজে। ও লাঞ্চ করেনি কিংবা করতে ইচ্ছা হয়নি। ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে যোহর আর আসরের কসর নামাজ আদায় করে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে বীচের দিকে হাঁটতে লাগলো। সাগরের বিশুদ্ধ বাতাস, উত্তাল ঢেউয়ের সৌন্দর্য যদি ওর মনটাকে ভালো করে দিতে পারে? ও আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে পানিতে নেমে পড়ে। কতদূর হেঁটে গিয়েছে ওর মনে নেই। পানিতে নেমে মনে হতে লাগলো একটা ঢেউ এসে যদি ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো তাহলে অন্তর্দহনের জ্বালা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারতো। এমনসময় একটা ঢেউ এসে ওকে ধাক্কা দিলো। প্রায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে পরক্ষণেই মনে হলো, এ ও কি ভাবছে? এরকম চিন্তা করা পাপ। ও তাড়াতাড়ি পানি থেকে উপরে উঠে আসলো। ওর মনে হলো যত দ্রুত ও দেশের বাইরে চলে যাবে ততই ওর জন্য মঙ্গল হবে। আজ রাতে সুজানা আর যুবরাজ ওদের বাসায় আসবে। কাল ওরা হানিমুনের উদ্দেশ্য থাইল্যান্ডে যাবে। সানজানা আগামীকাল রাতের বাসে ঢাকায় ফিরবে। এরপর একসপ্তাহের মধ্যে ইউকে তে পাড়ি জমাবে। ওর মনে হলো দূরে গেলেই ও একমাত্র যুবরাজকে ভুলে থাকতে পারবে।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। যুবরাজ ওর বউকে রেডী হতে বললো। আজকের রাতটা যুবরাজ শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে কাল সকাল দশটার ফ্লাইটে হানিমুনের উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ডের পথে রওয়ানা দিবে। রাতটা থেকেই খুব ভোরে যুবরাজ বউকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে। বাবা মায়ের সাথে দেখা করে এয়ারপোর্টে চলে যাবে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যুবরাজের বাবা ওকে মিষ্টি কিনে শ্বশুরবাড়িতে যেতে বললেন। যুবরাজ নীচে নেমে গ্যারেজ থেকে ওর বাইকটা বের করলো। হেলমেট পরে নিয়ে আর একটা হেলমেট সুজানার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—-এটা পড়ে নাও।
বাইক দেখে সুজানা চমকে উঠে বলে,
—-,আমি বাইকে চড়বো না।
—-কেন?
—-আমি কখনও বাইকে চড়ি নাই।
—-আমার সাথে পুরোটা সময় প্রেম করলে বাইকে চড়ে আর এখন বলছো তুমি কখনও বাইকে চড়ো নাই?
সুজানা যুবরাজের কথায় হোঁচট খেলো। আসলে ওতো এখানে সুজানা নয় ওতো সানজানা। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললো,
— আমি বলতে চেয়েছিলাম, শাড়ি পরে আমি কখনও বাইকে চড়ি নাই।
—-কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি দু,একবার শাড়ি পরে আমার বাইকে উঠেছো।
—-আমার মনে নেই। তবে এখন আমি চড়তে পারবো না। বাইকটা রেখে চলো আমরা রিকশা করে যাই। আমার রিকশায় ঘুরতে খুব ভালো লাগে।
—তাতো জানি,কিন্তু অনেকটা পথ যেতে হবে।
—-ইস্কাটন থেকে মোহাম্মদপুর খুব একটা দূর নয়।
সুজানার তাগাদায় যুবরাজ গ্যারেজে বাইকটা রেখে দিলো। এরপর সুজানাকে নিয়ে রিকশা করে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। পথ থেকে যুবরাজ পাঁচকেজি মিষ্টি কিনে নিলো। শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছানোর পর সুজানার বাবা মা যুবরাজকে সুজানার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু সুজানার চেহারায় চিন্তার ভাঁজ দেখে ওর মা জিজ্ঞাসা করলেন,
—-সব ঠিক আছে তো মা।
—-আছে কিন্ত আমি তো ঠিক থাকতে পারছি না। প্রতিমুহুর্তে ধরা পড়ার ভয় আমাকে তাড়িত করছে। ওর সাথে তোমাদের কথা হয়েছে? ওখানে সব ঠিকঠাক আছে তো?
—-আছে,তোরা থাইল্যান্ডে রওয়ানা দিলে ও ঢাকায় ফিরে আসবে।
রাতে খাবার টেবিলে যুবরাজ ওর শ্বশুরকে বললো,
—-বাবা,সুজানা কবে ফিরবে?
সুজানার কথা বলাতে উনি সামনে বসা সুজানার দিকে তাকালেন। পরিস্থিতি সামলাতে সুজানার মা বললো,
—-তুমি তো সানজানার কাছে শুনেছো ও কতোটা ক্যারিয়ারিস্ট। আসলে চাকরিটা একটা বিদেশী সংস্থায় হয়েছে। দুদিন ট্রেনিং হবে। এরপর হয়তো পোস্টিং দেশের বাইরে হবে।
—তাহলে কি ওর সাথে আমার দেখা হবে না?
—-কেন হবে না? এ বাড়ির জামাই যখন হয়েছো তখন আজ না হোক কাল অবশ্যই দেখা হবে।

পরদিন খুব ভোরে যুবরাজ আর সুজানা ইস্কাটনে ফিরে আসলো। এরপর লাগেজপত্র নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। এয়ারপোর্টের সব আনুষ্টানিকতা শেষ করে ওরা লাউঞ্জে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। নিদিষ্ট সময়ে বিমানে উঠে পড়লো। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে ওরা ব্যাংককে পৌঁছে গেল।
সুবর্ণভূমি বিমান বন্দরে নেমে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা পাতায়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। পথে একটা বাঙ্গালি রেস্টুরেন্টে শাক ডাল ভর্তা আর ডিমভুনা দিয়ে ভাত খেয়ে নিলো। হোটেলে পৌঁছে যুবরাজ ওয়াশরুমে ঢুকলো। গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে রুমে এসে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে নিলো। মিররের সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনী করার সময় সুজানার দিকে চোখ পড়লো। সুজানা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যুবরাজ সেদিকে তাকিয়ে বললো,
—-এভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কি দেখছো?
—-না তেমন কিছু না
—তা বললে তো হবে না। তোমাকে বলতেই হবে কি ভাবছো?
–তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে।
—তুমি আমার পুরো শরীরের অলিগলি দেখে নিতে পারো। চাইলে খুলে দেখাতে পারি। আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো মানুষটাই সুন্দর।
—ছিঃ এসব নোংরা কথা বলতে তোমার মুখে আটকায় না?
—-,গাঙ পাড়ার কারো সাথে তো বলছি না। নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথে বলছি।
যুবরাজের ভাবসাব সুজানার কাছে কেমন যেন লাগছে। সেকারনে সে সোফা থেকে উঠে নিজের পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতেই যুবরাজ হ্যাঁচকা টানে নিজের বুকের কাছে টেনে আনলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—বিয়ে নিয়ে আমার কতকিছু কল্পনা ছিলো। আর বিয়ের পর থেকেই তুমি কেমন যেন দূরে দূরে থাকছো। এখানে কিন্তু আমি সবকিছু উসুল করে নিবো।
সুজানা যুবরাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

সানজানা রাতের বাসে ঢাকায় ফিরে আসলো। ওর জীবনের একটা অধ্যায় সাঙ্গ হলো। আর একটা অধ্যায়ের সুচনা হলো। ওর জীবনে যা ঘটে গেল তাকে এখন ওর মেনে নিতে হবে। অবশ্য ওর সিদ্ধান্তেই এই অধ্যায়ের সুচনা হয়েছে। সানজানা ভাবছে ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় বটে। তবে তা ঠিক না ভুল তা শুধু সময়ই বলে দিতে পারে। আজ ওর কেন যেন মনে হচ্ছে,যুবরাজকে ভালোবাসার সিদ্ধান্তটা হটকারী সিদ্ধান্ত ছিলো। বরং এখন ওর জীবন থেকে যুবরাজকে সরিয়ে দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে সানজানা মাস্টার্স প্রোগ্রামে ইউকে তে পাড়ি জমালো। কিম্তু যে কারনে এতো দূরে চলে আসলো বাস্তবিক অর্থে সেই মানুষটাকে কি ও ভুলতে পেরেছে? পারেনিতো। দূরে যাওয়া মানে শুধুই দূরে যাওয়া ভুলে যাওয়া নয়। মানুষ মাঝে মাঝে এমন অনেক কাজ করে যা সে করতে চায়নি। কোনো মানুষ কি পারে তার ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যে হাতে তুলে দিতে? পারে না। কিন্তু সানজানাকে পারতে হয়েছে। কারণ সানজানা চায়নি যুবরাজ ওকে নিয়ে অসুখী থাকুক।

চলবে

তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০৪

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

সানজানা সেদিন বুঝতে না পারলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে ঠিকই বুঝেছে কেন তাকে তার মা ছোটোবেলায় সেদিন বাথরুমে আটকে রেখেছিলো। আসলে সে যে একটা ত্রুটিযুক্ত মানুষ। এই সমাজ জানতে পারলে তাদেরকে একঘরে করে রাখবে। কিংবা ওকে অনেক কটুক্তি সইতে হবে।
জীবনটা আসলে একটা রঙ্গমঞ্চ। সানজানা যদিও জানতো প্রেম ভালোবাসা তার জন্য নয় তারপরও যুবরাজের প্রেমকে ও প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। কেন পারবে? মানুষ হিসাবে ওর তো ভালোবাসার অধিকার আছে। সেকারনে কি পাবে, কি পাবেনা সেসবের চিন্তা বিন্দুমাত্র না করে নিজের সবটা দিয়ে যুবরাজকে ভালোবেসে গিয়েছে। যদিও আজ এই মুহুর্তে সব অতীত। কিন্তু মানুষ কখনও তার অতীতকে ভুলে যেতে পারে না। সেকারনে সানজানার অতীতের প্রিয় স্মৃতিগুলো ওকে আজ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওরও ইচ্ছে হচ্ছে সেই ফেলে আসা অতীত স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতে লঞ্চ ঘাটে ভিড়লো। সানজানা লঞ্চ থেকে নেমে ওর বাবার ভাড়া করা গাড়িতে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে ছুটে চললো।

খুব ভোরেই সুজানার ঘুম ভেঙ্গে গেল। শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসলো। পাশে যুবরাজ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মুখটা খুব শিশুর মতো লাগছে। ওকে যতই দেখছে সুজানার ভীষণ ভালো লাগছে। ওর প্রতি একধরণের মায়া অনুভব করছে। হঠাৎ সুজানার মনে হলো যদি কোনোদিন যুবরাজ জানতে পারে ও সানজানা নয় সুজানা সেদিন কি ওকে ফেলে রেখে ও চলে যাবে? সেদিন ওর কি হবে? এই ভাবনায় ওর চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। সুজানা ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে আসলো। এরপর ফজরের নামাজ আদায় করে ওর আর যুবরাজের জন্য মন খুলে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করলো। নামাজ শেষ করার পর ওর ভিতরে এক ধরণের শান্তি অনুভব হলো। মনে হলো আল্লাহপাক ওর সাথে যুবরাজের রিজিক বেঁধে দিয়েছেন বলেই ওদের দুজনার বিয়ে হয়েছে। এরমাঝে যুবরাজের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ও সুজানাকে জায়নামাজে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কারণ সানজানার এই রুপটা ওর কখনও দেখা হয়নি। সুজানা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-কি দেখছো এমন করে?
—-তোমাকে দেখছি। ভীষণ সুন্দর লাগছে। নিস্পাপ মুখচ্ছবি। তোমার এই রুপ তো আমার দেখা হয়নি।
সুজানা জায়নামাজ থেকে উঠে পড়লো। জায়নামাজ টা ভাঁজ করে ক্লসেটে তুলে রেখে যুবরাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-এখন যাও ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসো।
—-তুমি শাড়ি পরে রেডী হয়ে থাকো। নাস্তা করে দু’জনে একসাথে ঘুরতে বের হবো।
যুবরাজ ওয়াশরুমে চলে গেল। এদিকে সুজানা বিপদে পড়লো। ওতো শাড়ি পড়তেই পারে না। সানজানা ওকে সবসময় শাড়ি পরিয়ে দিতো। এখন ও কি করবে? সুজানা মনে মনে একটা ফন্দি আঁটলো। যুবরাজ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সুজানার দিকে তাকিয়ে বললো,
— বিয়ে করে কি তোমার ঘাড়ে দুমণ বোঝা চাপিয়েছি?
—-মানে কি? তোমার কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারছি না?
—-মুখটা ওরকম প্যাঁচার মতো করে রেখেছো কেন?
—-তোমার জন্য।
—-আমি আবার কি করলাম?
—-শাড়ি পরতে বললে কেন?
—-কেন তুমি তো সুন্দর করে শাড়ি পরতে পারো।
—-আমাকে সুজানা পরিয়ে দিতো।
—-ঠিক আছে। আজ আমি তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিবো।
সুজানার ভীষণ অস্বস্তি হতে শুরু করলো। পৌষের এই শীতের মাঝেও ওর শরীর যেন ঘামতে লাগলো। ওর দিকে তাকিয়ে যুবরাজ বললো,
—শুধু তো শাড়ি পরিয়ে দিতে চেয়েছি এতেই তোমার ঘামাঘামি শুরু হয়ে গেল। আর তো সব কাজ এখন বাকি রয়ে গিয়েছে। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি আর ব্লাউজটা পরে আসো। আমি তোমাকে শাড়িটা পরিয়ে দিচ্ছি।
সুজানা শাড়ি ব্লাউজ আর পেটিকোর্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। সুজানাকে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে দেখে যুবরাজ বললো,
—-শাড়ি নিয়ে যাচ্ছো কেন?
সুজানা চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। কিন্তু শাড়ি তো কিছুতেই পড়তে পারছে না। কুচিগুলো কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে যুবরাজের ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই ওর মা বলে উঠলো,
—-কিরে তোরা নাস্তা খাবি না?
—-এখনি আসছি আম্মু।
ফোনটা রেখে যুবরাজ ওয়াশরুমের দরজা নক করে বলছে,
—- আধঘন্টা হয়ে গেল তুমি এখনও বের হচ্ছো না কেন? ওদিকে আম্মু নাস্তা করতে ডাকছে।
সুজানা শাড়িটা সামাল দিতে না পেরে কোনো রকমে শরীরে পেঁচিয়ে বের হয়ে আসলো। ওকে এ অবস্থায় দেখে যুবরাজ হাসতে হাসতে বললো,
—-গরীবের কথা বাসি হলে ফলে। কি পরিয়ে দিবো নাকি এভাবে আম্মুর সামনে যাবে?
সুজানা আর কিছু না বলে মাথা নীচু করে শাড়ির কুঁচিগুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। যুবরাজ মৌনতা সম্মতির লক্ষণ বলে সুজানার কাছে গিয়ে শাড়ির কুঁচিগুলো গুছিয়ে ঠিকঠাক করে দিতেই ওর হাত সুজানার নাভি স্পর্শ করলো। সুজানা লজ্জায় আড়ষ্টতায় চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। যুবরাজেরও ভিতরে কাঁপন লাগলো। জীবনের প্রথম নারীর ছোঁয়া ওকে যেন শিহরিত করে দিলো। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সানজানাকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে। এতোদিন ওর সাথে সম্পর্কে ছিলো অথচ সানজানা কোনোদিন ওকে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ দেয়নি। একারণে সানজানার প্রতি ভালোবাসার সাথে সাথে এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ ওর কাজ করতো। শাড়িটা পরানো শেষ হলে যুবরাজ ওকে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে বললো,
—-লজ্জাবতী, এবার চোখটা খুলে দেখুন আপনাকে কেমন লাগছে?
সুজানা আয়নার পানে দৃষ্টি মেলে ধরতেই অবাক হয়ে গেল। যুবরাজ একজন পুরুষ মানুষ হয়ে ওকে কি সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দিয়েছে! এরপর যুবরাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তুমি এতো সুন্দর করে শাড়ি পরানো কার কাছ থেকে শিখেছো?
—-আম্মুর কাছ থেকে। আমি ছোটোবেলা থেকেই আম্মুকে শাড়ি পরতে সাহায্য করতাম। সেই থেকে আস্তে আস্তে শিখে গিয়েছি।
এরপর ওরা দুজনে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসলো। যুবরাজের আম্মু রুটি পরোটা দুটোই তৈরী করেছে। সবজি ডালভুনা আর কলিজা ভুনাও করেছে। সাথে পায়েশ আর রসে ভেজানো চিতই পিঠা তৈরী করেছে। সুজানা রুটি আর সবজি আর ডাল নিয়ে খেতে বসলো। যুবরাজ অবাক হয়ে সুজানার খাওয়া দেখছিলো। খাওয়া শেষে সুজানা পিঠা আর পায়েশ দুটোই খেলো। ওর খাওয়া দেখে যুবরাজ বললো,
—-দুধের জিনিস খেলে তো গ্যাসের সমস্যা হয়। তোমার এতো খাওয়া ঠিক না।
যুবরাজের বাবা ওকে বাঁধা দিয়ে বললো,
—ও পছন্দ করে খাচ্ছে ; ওকে খেতে দে। তুই বাঁধা দিচ্ছিস কেন?
যুবরাজের মা বললো,
—-আমি ওর কথা ভেবেই এগুলো বানিয়েছি। তোমার মুখে তো বার্গার স্যান্ডউইচ সুশি আরো কত কি নাম মনে পড়ছে না ওগুলো ছাড়া চলে না।
—-আম্মু আগে তো ও এগুলো কিছুই খেতো না। ভার্সিটির ক্যান্টিনে ওর পছন্দের খাবার ছিলো পরোটা আর দুধ চা। একবার বন্ধুরা মিলে মাওয়া ঘাটে গেলাম।গরম গরম রসগোল্লা বানাচ্ছিলো। আমরা সবাই খেলাম।ও কিছুতেই খেলো না। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে?
সুজানা চমকে উঠলো। ওর এই চমকে উঠা যুবরাজের দৃষ্টিতে এড়ালো না। সে কারণে সুজানাকে চমকে দিয়ে বললো,
—ও মনে হয় সানজানার ভূত।
—-কি সব আবোল তাবোল বকছিস?
—-না আম্মু আমি ঠিকই বলেছি। যুবরাজের কথা শুনে সুজানা যেন হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলো। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এই বুঝি যুবরাজ বলে বসে তুমি সানজানা না সুজানা।
যুবরাজের বাবা ও বুঝতে পেরেছেন সুজানা একটু ঘাবড়ে গিয়েছে। সে কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যুবরাজকে বললো,
—-তুই ওকে নিয়ে রমনা পার্কটায় একটু ঘুরে আয়।
যুবরাজ মুখে কিছু না বললেও বিয়ের পরের সানজানার সাথে বিয়ের আগের সানজানার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না। আবার সুজানা কেনইবা বিয়ের দিন উপস্থিত থাকলো না। যুবরাজ কৌতূহল দমন করতে না পেরে বললো,
—-সানজানা, সুজানা আমাদের বিয়ের দিন থাকতে পারলো না কেন?
—তোমাকে তো বলেছি ;ও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস।
—-তাই বলে বোনের বিয়েকে উপেক্ষা করে?
—-আমাদের এই সুন্দর মুহুর্তে তুমি কেন সুজানার কথা তুলছো। আমরা এখন নিজেদের মতো করে সময় কাটাবো।
যুবরাজও আর কথা বাড়ালো না। মনের কৌতূহল মনেই চেপে রাখলো। যুবরাজদের বাসা ইস্কাটনে। ওর বাবা বিজনেস করেন। ওখানেই বারো’শ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্লাট কিনেছেন। ওদের বাসা থেকে রমনা পার্কটা বেশ কাছে। পার্কে পৌছে যুবরাজ ওর সুজানার ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে। সাথে সাথে অনেক লাইক কমেন্ট পড়তে শুরু করেছে।

এদিকে সানজানা কুয়াকাটা পৌঁছে হোটেলে উঠে দ্রুত লাঞ্চটা করে নেয়। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। লঞ্চের কেবিনে ঘুমটা আসলে গাঢ় হয়নি। একটু টেনশন তো ছিলোই। রুমে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ফেসবুকে ঢুকা মাত্রই যুবরাজ আর সুজানার কাপল ছবিটা চোখে পড়লো। সাথে সাথে ওর বুকের ভিতরে তীব্র ব্যথা হতে লাগলো। ও ফেসবুক থেকে বের হয়ে এসে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। সেই কান্নার স্রোতে ও ওর যন্ত্রণাগুলোকে ভাসিয়ে দিতে চাইলো।

চলবে

তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০৩

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

সুজানা শিহরিত তবে যুবরাজের সাথে কেন যেন সহজ হতে পারছে না। সে কারনে ওর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
“এমন একটা রোমান্টিক মুহুর্তে দুকাপ কফি হলে মন্দ হয় না।”
সুজানার কথায় যুবরাজ অবাক হয়ে বললো,
—-তুমি তো কফির গন্ধ সহ্য করতে পারো না। আজ হঠাৎ কফি খেতে চাইলে কেন? একসময় তোমাকে কতো জোর করেছি।কিন্তু কিছুতেই খাওনি।
যুবরাজের কথা শুনে সুজানা মনে মনে বললো,”বড্ড ভুল হয়ে গেল। আসলেই তো সানজানা দুধ চা খেতে পছন্দ করতো।”
পরিস্থিতি দ্রুত সামলাতে সুজানা বললো,
—-এখনও যে পছন্দ করি তা নয়। তোমার মন রক্ষার্থে বলেছি। তুমি খুশী হওনি।
—-কিন্তু তুমি তো কারো মন রক্ষার্থে কিছু বলো না। ভালো লাগুক কি খারাপ লাগুক অকপটে সব বলে দাও। তোমার এই আচরণটা আমার ভীষণ ভালো লাগে।
—আজ এই বিশেষ দিনে আমি তোমার খুশীর জন্য এটুকু করতেই পারি।
—-না,থাক কফি বানিয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে আমরা দুজনা বসে চাঁদনী রাত উপভোগ করি।
সুজানা মনে মনে ভাবলো,ওকে আরো সতর্ক হতে হবে। তা,না হলে ধরা পড়ার ভয় আছে।
গল্প করতে করতে রাত গভীর হতে চললো। একসময় সুজানার চোখে ঘুম পরীরা নেমে আসতে শুরু করলো। যুবরাজ ওকে ঘরে গিয়ে ঘুমাতে বললো। সুজানা চলে যাওয়ার পর যুবরাজ ভাবছে এই কয়দিনে মানুষের আচরণ এতো বদলে যেতে পারে? বিয়ের আগের সানজানার সাথে বিয়ের পরের সানজানার কোনো মিল ও খুঁজে পাচ্ছে না। ওর কাছে খুব অবাক লাগছে।

রাতে হঠাৎ সানজানার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে প্রথমে একটু ধাক্কা খেলো। ও কোথায় বুঝতে পারছে না। মেন্টাল স্ট্রেস বেশী থাকার কারনে সব ক্যামন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে দৃষ্টি ওর বাইরে নিবদ্ধ হলো। এখন সবকিছু মনে পড়ছে। ওর শুধু টেনশন হচ্ছে সুজানা সব ঠিকঠাক মতো সামলাতে পারবে তো। এরাত নিয়ে ও আর যুবরাজ কতকিছু ভেবে রেখেছিলো।
মানুষ তার প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না নাকি যাকে অন্তরের সবটুকু আবেগ দিয়ে ভালোবাসে তাকে কখনও ভোলা যায় না। সানজানা ভাবছে ওকি কখনও যুবরাজকে ভুলতে পারবে? সানজানা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত তিনটা বাজে। পূর্ণশশীটা অস্তরাগে যেতে বসেছে। আবারও ও স্মৃতির আঙ্গিনায় হারিয়ে গেল।
সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। সানজানার কখনও নববর্ষ পালন করা হয়নি কিংবা ইচ্ছে করেই করেনি। কারণ ঐদিন সানজানার জন্মদিন। জন্মই যার আজন্ম পাপ তাই তাকে বরণ করার ইচ্ছে কোনোদিন সানজানার হয়নি। সেদিন ছুটির দিন থাকাতে সানজানা বাড়িতেই ছিলো। হঠাৎ সকাল এগারোটার দিকে যুবরাজের ফোন আসলো। রিসিভ করতেই আমাকে বললো,
—-হ্যালো সাঁজি, টিএসসি একটু আসতে পারবি?
—-কেন?
—-আসো তারপর বলছি। আজ একটু শাড়ি পরে আসবে?
—-না,ওসব শাড়ি টারি পরতে পারবো না। তাহলে আমি আসবো না।
—-আচ্ছা ঠিক আছে, তোমাকে পরতে হবে না। তুমি যেটাতে কমফোর্ট ফিল করো সেটা পরে আয়।
সানজানা জিন্স আর লম্বা ফতুয়া গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মাথায় হেজাব পরে রওয়ানা দিলো। মনে মনে সানজানা প্রচন্ড বিরক্ত। কারণ রাস্তায় অসম্ভব ভীর থাকে আজকের দিনে। ধানমন্ডী সাতাশ নাম্বার থেকে গলির ভিতর দিয়ে আস্তে আস্তে চাঁদনিচকে পৌঁছালো। পরে সেখান থেকে অনেক কষ্টে টিএসসি পৌঁছালো। টিএসসি পৌঁছাতে ওর বিকেল হয়ে গেল। যুবরাজ ওকে নিয়ে নিরিবিলি একটা জায়গায় নিয়ে হাটু গেড়ে বসে সানজানার হাতে একটা বিশাল টকটকে লাল গোলাপ ফুলের তোড়া উপহার দিলো। সানজানা ওর আচরণে খুব অবাক হলো। ও নিজেকে খুব কন্ট্রোল করে রাখে। কারণ নদী যেমন সাগরের পানে ছুটে গিয়ে মিশে যেতে চায় তেমনি সানজানার কাছে যুবরাজ একটা সমুদ্রের মতন। সানজানা দেখতে সুন্দরী ছিলো বলে বড় হওয়ার পর থেকেই অনেকেই ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ও জানতো ঐ পথ ওর জন্য নয়। তাই সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। কিন্তু আজ যেন যুবরাজের আহ্বানকে ও সরিয়ে দিতে পারছে না। ওর হৃদয় নদীতে প্রেমের জোয়ার উঠেছে। একুল ওকুল দুকুলই ভেসে যাচ্ছে। ওর হৃদয় নদীটা আজ যুবরাজ নামক এক মহাসাগরের অতলে মিশে যেতে চাইছে। ও যুবরাজের দিকে তাকিয়ে এসব আকাশ পাতাল ভেবে যাচ্ছে। যুবরাজ একসময় আঙ্গুল দিয়ে তুরি বাজিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছো কেন?
সানজানা বাস্তবে ফিরে আসলো। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—এসবের মানে কি?
—-কেবল তো শুরু, আরো চমক আছে।
এরপর যুবরাজ কেকের বক্সটা সানজানার সামনে মেলে ধরে বললো,
—-শুভ জন্মদিন।
সানজানার আচরণে যুবরাজ অবাক হয়ে গেল। কোথায় এই সারপ্রাইজে ও খুশী হবে সেটা না করে ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। ঘটনার আকস্মিকতায় যুবরাজ অবাক হয়ে বললো,
—-তুমি কি আমার কোনো আচরণে কষ্ট পেয়েছো?
চোখের পানি মুছে সানজানা ধরা গলায় বললো,
—আমার এসব পালন করতে ভালো লাগে না।
মনে মনে বললো,”আমার জন্ম তো আমাকে পূর্ণতা দেয়নি। হয়তো এটাই আমার জন্য মঙ্গল। কারণ মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আল্লাহ তার বান্দার জন্য যা করেন সেটাতেই মঙ্গল লুকিয়ে থাকে।”
এরপর যুবরাজ সানজানাকে বললো,
—-আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি সাঁজি।তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
সানজানা চমকে উঠেছিলো। ও জানে এ ভালোবাসা মরিচিকার মতো। একে ছুঁতে গেলেই হারিয়ে যাবে। সেদিন সানজানা ওকে ফিরিয়ে না দিলেও নিজের দুর্বলতার কথা জানাতে পারেনি। মাঝে মাঝে সানজানা সাহসী হয়ে যুবরাজকে নিজের কথা বলতে চেয়েছিলো। ক্ষীণ আশার আলো দেখেছিলো। যদি যুবরাজ মেনে নেয়। পরক্ষণেই যুবরাজকে হারানোর ভয়ে সত্যিটা সানজানা বলে উঠতে পারেনি। পাঠকরা নিশ্চয় ভাবছেন সেই সত্যটা কি?
আসল সত্যটা হচ্ছে সানজানা দেখতে নারীর মতো হলেও ও পরিপূর্ণ নারী নয়। সেকারনেই ওর ভয়। যুবরাজ ওকে ক্রমাগত বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো। কিন্তু ওতো জানে বিয়ের পর যুবরাজের বায়োলজিক্যাল নিড ও মেটাতে পারবে না। ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়ে যদি নিজেকে সারিয়ে তোলা যায় সেই ভরসায় সম্পর্কটাকে সানজানা এগিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে ওর শারীরিক কন্ডিশনে ডাক্তার জানিয়েছিলো অপারেশন করলেও ওর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৫%। সে কারনে সানজানা মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়ে। সানজানা তখন প্রতিনিয়ত নিজের সাথে লড়াই করতে থাকে। নিজের সাথে নিজের টিকে থাকার লড়াই। যদিও সানজানা জানে ওর জন্মে কোনো লজ্জা নেই কিংবা এতে ওর কিংবা ওর বাবা মায়ের কারোরই দোষ নেই তবুও সমাজ কি ওদের ছেড়ে দিবে? সানজানার এই শারীরিক ত্রুটি জানাজানি হয়ে গেলে সমাজ ওকে নিয়ে কটুক্তি করতে ছাড়বে না। কিংবা বলবে ওর বাপ মায়ের পাপের ফল। এসব নানা প্রশ্নবানে ওদের পুরো পরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। এরকম হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই সানাজানার পরিবারের সদস্য ছাড়া ওদের আত্মীয়স্বজন কেউ সানজানার এই ত্রুটির কথা জানে না। আর দশটা মেয়ের মতো সানজানার হৃদয়ের আঙ্গিনায় ভালবাসার ফুলটা যুবরাজ নামক এক ভ্রমরের ছোঁয়ায় কেবলি তখন ফুটতে শুরু করেছে সেদিনও সানজানা নিজের আবেগকে কন্ট্রোল করেছে। কারণ ওর সত্যিটা ও যুবরাজকে বলার জন্য নিজেকে সেদিন প্রস্তুত করেছিলো। কিন্ত ও জানে সত্যিটা জানলে যুবরাজ ওকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাবে।
একবার ছোটোবেলায় ওদের বাসায় হিজড়া এসে ওর খোঁজ করছিলো। কার কাছে ওরা কি শুনেছে কে জানে। কিন্তু ওর মা প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো। সেদিন ওকে হারানোর ভয়ে ওর মা ওকে বাথরুমে আটকে রাখে।

চলবে

তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০২

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

সানজানা যুবরাজের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই থেকে যুবরাজের জীবনে সানজানা অপরিহার্য অংশ হতে শুরু করলো। সানজানাও মনে মনে ভাবলো আর কিছু করতে পারুক না পারুক মানুষটার বুকের উপর চেপে থাকা কষ্টের পাথরটা যেন ও সরিয়ে দিতে পারে। ওর কাঁদার কারনটা সানজানা জানতে চাওয়া মাত্রই যুবরাজ সাথে সাথে বললো,
—-আমার ভালোবাসার মানুষটা অন্য কাউকে বিয়ে করে পরবাসী হতে চলেছে।
ওর কথা শুনে সানজানা মনে মনে বললো,
“সত্যিকারের ভালোবাসা কি কখনও ছেড়ে যেতে পারে।”
কৌতূহল দমন করতে না পেরে সানজানা বলেই ফেললো,
—-ও যদি তোমাকে ভালোইবাসতো তাহলে তো ছেড়ে যেতে পারতো না,তাই না?
—-ও নিজ থেকে যায়নি। ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
—-ওতো আটকাতে পারতো?
—-চেষ্টা করেছিলো। আমার কথা ওর বাবা মাকে বলেছিলো। কিন্তু ওর বাবা মা বেকার ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে নারাজ। তুমি কি পারবে আমার হয়ে কাকলীকে বুঝাতে?
যদিও সানজানা কাকলীকে চিনতো না এমনকি কাকলী ওর কথা শুনবে কিনা ও জানতো না। তারপর ও যুবরাজের ঐ করুন চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
—-ঠিক আছে তুমি আমাকে ওর কন্ট্রাক নাম্বারটা দিও। আমি চেষ্টা করে দেখবো।
সানজানার কাছ থেকে এরকম আশার কথা শুনে যুবরাজ সানজানার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলো,
—-সত্যিই তুমি কাকলীর সাথে কথা বলবে?
—-বলবো,তবে এবার তুমি একটু শান্ত হও।
তবে যুবরাজের কথামতো সানজানা কাকলীর সাথে কথা বলেছিলো। কিন্তু কাকলী ওকে বলেছে,পরিবারের কথার বাইরে গিয়ে ওর পক্ষে যুবরাজকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। সানজানার সহযোগিতায় যুবরাজ সেই ট্রমা থেকে খুব সহজেই বের হতে পেরেছিলো। তবে সানজানা সেসময় যুবরাজের দুচোখে ওর প্রতি এক ভালো লাগা লক্ষ্য করেছিলো। বিষয়টা অনেকটা এমন, উত্তাল সাগরে কোনো মানুষ যখন ডুবে যায় তখন শেষ মুহুর্তে সে সামান্য খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। সানজানা সেদিন যুবরাজের কাছে খড়কুটোর সমতুল্য ছিলো। সানজানাও যুবরাজের বন্ধুত্বের হাতকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। যা পরবর্তীতে একটা ভালোলাগার সম্পর্কে রুপ নেয়। তবে যুবরাজ যতই সানজানার উপর নির্ভর হয়ে যাচ্ছে ভয় আর অনিশ্চয়তা সানজানাকে গ্রাস করছিলো। কারণ সানজানা জানতো তেল আর পানিতে যেমন মিশে না তেমনি যুবরাজের সাথে ওর ভালোবাসা কোনোদিন সফলতার মুখ দেখবে না। সে কারনে ও যুবরাজের কাছ থেকে সবসময় একটু দুরত্ব বজায় রেখে চলতো। সেটা বুঝতে পেরে যুবরাজ একদিন খুব দুঃখ করে সানজানাকে বলেছিলো,
—-জানো সানজানা,আমি যাকেই আঁকড়ে ধরতে চাই সেই আমাকে ফেলে রেখে চলে যায়। তুমি আমাকে কথা দাও, কোনোদিন আমাকে ফেলে রেখে চলে যাবে না।”
কথাটা মনে হতেই সানজানা আকুল হয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। আর মনে মনে বললো,”যুবরাজ আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না। আমি তোমাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে এসেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
এর পর রুম থেকে বের হয়ে লঞ্চের ডেকে পেতে রাখা চেয়ারে বসলো। ঘড়িতে দেখলো রাত বারোটা বাজে। বেশ গভীর রাত। চাঁদের আলোয় চারিদিকে সব ফকফকা। আজ তো পূর্ণিমা। যুবরাজ চেয়েছিলো,ওর বাসর যেন চাঁদনি রাতে হয়। সেকারনেই পূর্ণিমায় ওর বিয়ের তারিখ ঠিক করে নেয়।
পূর্ণ চাঁদের ছবিটা নদীর পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। কি অপরুপ এই দৃশ্য! আহা,যুবরাজ যদি পাশে থাকতো এই রাত কতো না মধুর হতো?
সাথে সাথে সানজানার মনে হলো,এ ও কি ভাবছে? যাকে নিজ হাতে বোনের কাছে সঁপে দিয়ে আসলো তাকে আজ আবার কেন নিজের করে পেতে চাইছে? এ যে পাপ! শুধু পাপ নয় মহা পাপ। ফোনটা বেজে উঠলো। সানজানা যেন একটু চমকে উঠলো। কার ফোন আসলো। মোবাইল ওপেন করতেই দেখে বাবা ফোন দিয়েছে।
—+হ্যালো সানজানা,কোনো সমস্যা হচ্ছে নাতো? সব ঠিক আছে।
—-হা বাবা,আমি ঠিক আছি। বিয়েটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে? বাবা ওরা কিছু বুঝতে পারেনিতো?
—-,না, এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে। তবে ওরা সুজানার খোঁজ করেছিলো।
—-তুমি কি বলেছো?
—-বলেছি চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে।
—-যাক ভালোই বলেছো। ফোন রাখছি।
—-সাবধানে থাকিস মা।
—-আচ্ছা,আমাকে নিয়ে অত ভেবো না। তোমরা নিজেদের শরীরের যত্ন নিও।
ফোনটা রেখে সানাজানা ভাবছে,যুবরাজ নিশ্চয় এতোক্ষণে বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে। সুজানা সামলে নিতে পারবে তো। সানজানার প্রচন্ড শীত লাগছে। ও ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে মনে মনে ভাবলো, সবার জীবন হয়তো একই সরল রেখায় চলে না। যেমন হাতের পাঁচটা আঙ্গুল একসমান নয়। তেমনি ও আর সুজানা দেখতে একই রকম হলেও ওদের জীবনটা এক নয়। চোখটা যেন একটু লেগে এসেছে।
সুজানা বাসর খাটে বসে পৌষ মাসের শীতেও দরদর করে ঘামতে লাগলো। ওর শুধু ভয় হতে লাগলো যুবরাজের কাছে ধরা পড়ে যাবে নাতো? এমন সময় দরজাটা কে যেন নক করছে। সুজানা খাটে বসে অবাক হয়ে ভাবছে,
এসময় দরজা আবার কে নক করছে? রাত বারোটা বেজে গিয়েছে অথচ যুবরাজের পাত্তা নেই। ও খাট থেকে নেমে দরজা খুলে দেখে যুবরাজ দাঁড়িয়ে আছে। সুজানার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এরই মাঝে ভুলে গেলে আমাদের কি কথা ছিলো?
—-না,মানে বিয়ের ঝামেলায় আমার মাথা কাজ করছে না।
—আচ্ছা তোমার হাতটা বাড়িয়ে দাও।
সুজানা হাত বাড়িয়ে দিলো। যুবরাজ সুজানার হাত ধরে রুমে প্রবেশ করে বললো,
—তোমার অনুমতি নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকবো। তুমিই তো বলেছিলে। আর এখন তুমি ভুলে গিয়েছো।
সুজানা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। প্রসঙ্গ এড়াতে বললো,
—বলেছি তো অনেক কিছু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘুমানোটা জরুরী। মাইগ্রেনের ব্যথাটা উঠেছে। না ঘুমালে কিছুতেই কমবে না।
যুবরাজ জানে সানজানার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে বেশ প্রকট হয়। তখন ওর বমিও হয়। সে কারনে ও একটু নার্ভাস ফিল করতে লাগলো। সুজানার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তুমি পোশাক বদলে ফ্রেস হয়ে আসো। ওজু করে নিও। আমরা দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে নিবো। এরপর তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
ওয়াশরুমে গিয়ে সুজানা মনে মনে বললো,
“আপুরে তুই আমাকে এই কোন ঝামেলায় ফেলে দিয়ে চলে গেলি। আমি কি করে পরিস্থিতি সামলাবো বুঝতে পারছি না।”
তবে প্রথম দেখাতে যুবরাজকে সুজানার বেশ ভালো লেগেছে। মাথা ভর্তি কোকড়া চুল, শ্যামলা রং ছ,ফিটের মতো লম্বা বেশ ম্যানলি চেহারা। পুরো অবয়বে একটা মায়া ছড়িয়ে আছে।
সুজানা ওয়াশরুম থেকে ওজু করে আসলো। এরপর দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করে নিলো। যুবরাজ সুজানার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-বুঝতে পারছি,মাইগ্রেনের ব্যথায় তুমি সব ভুলে গিয়েছো। তোমার মনে আছে আমি তোমাকে বলেছিলাম,সোনার গয়না তোমায় আমি এখন গড়িয়ে দিতে পারবো না। তবে একমাত্র ছেলের বউ হিসাবে আমার বাবা মা তোমাকে প্রচুর দিবে। তবে আমি দিবো বেলী ফুলের গয়না।
একথা বলে একটা সুন্দর প্যাকেট যুবরাজ সুজানার হাতে তুলে দিয়ে ঘরের পাশে লাগোয়া বেলকনিতে গিয়ে বসলো। সুজানা প্যাকেটা খুলে দেখে বেলী ফুল দিয়ে তৈরী হাতেরচুড়ি কানেরদুল গলারহার মাথার টিকলি সাথে একটা সাদা রংয়ের জামদানি। যুবরাজের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো এতো আবেগ মিশ্রিত উপহারটা মর্যাদা দেওয়া উচিত। এই ফুলগুলো সকাল হতেই নেতিয়ে পড়বে। আর বেচারা এতো শখ করে আনলো। গয়নাগুলো ওর পরা উচিত।
সুজানা ওয়াশরুমে গিয়ে সাদা জামদানীটা পরে নিলো। বেলী ফুলের গয়নায় নিজেকে সাজিয়ে যুবরাজের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঝুল বারান্দার চাঁদের আলো এসে সুজানার উপর পড়েছে। সেই আলোতে সুজানাকে যুবরাজের কাছে জান্নাতের হুর মনে হতে লাগলো। ও সুজানার কাছে এসে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো,
—আমাদের এতো বছরের সম্পর্কে এই প্রথম আমি তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম।তবে কি জানো তোমার একটা পরিচিত সুবাস আছে। যেটা আমি আজকে পাচ্ছি না।
যুবরাজের স্পর্শে সুজানা শিহরিত হলো। তবে কেন যেন ওর মনে হতে লাগলো যুবরাজ এ সব কিছুই করছে ওকে সানজানা ভেবে। তাহলে কি যুবরাজের জীবনে ওর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না?

চলবে

তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০১

0

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

বিয়ের আগের দিন বিয়ের কনে পালিয়ে গিয়েছে। তবে প্রেমিকের হাত ধরে নয়। বরং নিজের প্রেমিককে জমজ বোনের হাতে সঁপে দিয়ে পালিয়েছে। এটাকে এক অর্থে পালানো বলা যায় না। কেননা সানজানার চলে যাওয়াটা ওর পরিবারের সবাই জানে। তবে ওর মনে হচ্ছে নিজের কাছ থেকে ও পালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যে আর কোনো কোনো অপশন সানজানার হাতে ছিলো না। পরিবারের সম্মান বাঁচাতে আজ ওকে এই কাজটা করতে হয়েছে। যুবরাজ ওর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সানজানাকে উনাদের ভীষণ পছন্দ। এরকম একটা কেয়ারিং পুত্রবধু নিজের ছেলের জন্য পেয়ে ওরাই বিয়ের জন্য তড়িঘড়ি শুরু করে। ওদের কেন যেন সানজানাকে হারানোর ভয় ছিলো।
সৎ পাত্রে কন্যা দান করতে পেরে যেখানে বাবা মা নিজেদের অনেক হালকা অনুভব করে সেখানে সানজানার পরিবারে উল্টা মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। অর্থাৎ ওর বিয়ে ঠিক হওয়াতে বাবা মায়ের দুজনের অবস্থা ক্রিটিক্যালের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বাবার প্রেসার সিস্টেলিক ১৮০ আর ডায়াস্টোলিক ১১০। আর ওর মায়ের সুগার বেড়ে গিয়েছে। ও যদি যুবরাজকে বিয়ে করতো তাতেও ওদের পরিবারের এতোদিনের সম্মান ধুলায় মিশে যেতো। পরিবারের গোপন বিষয় প্রকাশ হয়ে যেতো। আর যদি বিয়ে না করে পালিয়ে যেতো তাতেও সম্মানহানি ঘটতো। সবাই ভাবতো ও হয়তো দ্বিচারিনী। যাক অসম্মানের হাত থেকে ওদের পরিবারটিকে বাঁচাতে সুজানা এগিয়ে এসেছে। এজন্য ও চিরকাল সুজানার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। অবশ্য যুবরাজের মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বুয়েটে মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টে যুবরাজ ফাস্ট বয়। সামনের মাসে বুয়েটে টিচার হিসাবে জয়েন করবে। সানজানাও একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। তবে ওর রেজাল্ট যুবরাজের মতো নয়। তবে একদম খারাপও না। এভারেজের একটু উপরে। যুবরাজকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে সুজানা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। যদিও সুজানা আর সানজানা দেখতে হুবহু এক তারপরও সুজানার টেনশন হচ্ছে। যদি কখনও যুবরাজের কাছে ধরা পড়ে যায় তখন ও কি করবে? সানজানা বলেছে পরের কথা পরে ভাবা যাবে। তবে এই মুহুর্তেটাকে আগে সামলে নিতে হবে।
সানজানা ব্যাগটা চেক করে আবারো দেখে নিলো পাসপোর্ট আর আইডি কার্ড নিয়েছে কিনা? কারণ এক সপ্তাহ পর ও লন্ডনের পথে পাড়ি জমাবে। ওখানে কিংস ইউনিভার্সিটিতে ও মাস্টার্সের প্রোগ্রামে ভর্তি হবে। মোটামুটি একটা প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছিলো। ও মনে মনে এটাই ভেবে নিয়েছিলো । তবে ভয় ছিলো যুবরাজ যদি কোনো অঘটন ঘটায়? খুব নরম মনের মানুষ যুবরাজ।সানাজানা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না।
কারণ ওতো যুবরাজকে নিজের পুরোটা দিয়ে ভালোবেসেছে। তাই ও চায়নি বিয়ের পরে যুবরাজ ওকে নিয়ে মানসিক কষ্টে থাকুক। তবে যুবরাজের জন্য চিন্তা হচ্ছিলো। বেশ কিছুদিন থেকে এই বিষয়টা ওকে ভাবিয়ে তুলছিলো। সুজানার কাছে শেয়ার করাতে প্রথমে সুজানা রাজী হয়নি। পরে যখন সানজানা ওকে বললো,ওর পক্ষে যুবরাজকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। তবে একথা যুবরাজকে জানালে ও একটা অঘটন ঘটাতে পারে। ওর আগে একটা ব্রেকআপ হয়েছিলো। তখন ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলো। সে সময় সানজানা ওর পাশে ছায়ার মতো থেকেছে। অবশেষে বিয়ের আগেরদিন সুজানা যুবরাজকে বিয়ে করার ব্যাপারে মত দেয়।
আসরের নামাজ পড়ে সানজানা আর সুজানা পারলারে যায়। সেখানে ঘন্টা দুয়েক বসে থাকে। সানজানার বুকের পাঁজরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। সুজানার সাজানো কমপ্লিট হলে সানজানা পারলার থেকে বেরিয়ে আসে। লিফট দিয়ে নামার সাথে সাথে হিমেল বাতাসের ধাক্কা শরীরে এসে লাগে। সন্ধার আবীর তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। সানজানা একটা সিএনজি ভাড়া করে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সেখান থেকে আপাতত সুন্দরবন লঞ্চের ভিআইপি কেবিনে করে বরিশালের পথে রওয়ানা দিবে বলে ঠিক করেছে। তারপর সড়ক পথে কুয়াকাটা যাবে।
আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে যত সহজ ভাবা যাচ্ছে সানজানার কাছে বিষয়টা অত সহজ ছিলো না। সানজানা যদিও জানতো ওর আর যুবরাজের ভালোবাসাটা কোনোদিন সফলতা পাবে না। তারপরও যুবরাজকে হারানোর ভয়ে ও ছেড়ে যেতে পারেনি। কারণ যুবরাজের সাথে যখন ওর প্রেমিকের ব্রেকআপ হয় তখন ও চরম ডিপ্রেশনে চলে যায়। সেসময় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে সানজানা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তখন খুব কাছ থেকে যুবরাজের কষ্টগুলো অনুভব করেছে। তবে সানজানার বন্ধুত্ব কখন যে ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে তা ও নিজেও জানে না।

পৌষের কুয়াশা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সিএনজির সাথে পাল্লা দিয়ে সানজানার চোখের পানি অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে। ওর বাবা মা ওকে এভাবে একা বরিশাল যেতে দিতে প্রথমে রাজী হয়নি। কিন্তু সানজানাই জোর করে রাজী করিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধা সাড়ে ছ,টা বাজে। সুজানা নিশ্চয় এতোক্ষনে বিয়ের আসরে পৌঁছে গিয়েছে। সানজানা ওর মোবাইলটাও সুজানাকে দিয়ে এসেছে। আর ও সাথে করে একটা নতুন মোবাইল এনেছে। ও ভাবছে, যুবরাজকে নওশা সাজে নিশ্চয় খুব সুন্দর লাগছে। ওদের দুজনকে বেশ মানাবে।
এই পৃথিবীতে সবার জীবন একসুত্রে গাঁথা হয় না। যেমন ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছে ও পরীর মতো সুন্দর। অথচ ওর কপালে ঘরবর কিছুই জুটলো না। অথচ ওর সংসার করতে ভালো লাগে। হয়তো এই জীবনে সংসার নামক বন্ধন ওকে জড়িয়ে রাখবে না। যুবরাজকে নিয়ে সানজানা কতো স্বপ্নের জাল একসময় বুনেছে। অপ্রাপ্তির অনলে সেই স্বপ্নগুলো ওকে বাঁচিয়ে রাখার সাহস যোগাতো। আজ এগুলো সব মিথ্যা মনে হলেও এগুলোই একসময় ওর জীবনটাকে পরম আনন্দে ভরে রেখেছিলো। যেখানে আজ ওর থাকার কথা সেখানে আজ অন্যজন।
সব কিছু শেষ হলেও কোথাও না কোথাও এর রেশটুকু ঠিক থেকে যায়। তাই আজ আজন্ম লালিত বেদনাগুলো সানজানা চোখের জলের মাধ্যমে লাঘব করার চেষ্টা করছে।
গাড়ি সদরঘাট পৌঁছে গেল।সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে সানজানা আস্তে আস্তে লঞ্চে উঠে নিজের কেবিনে গিয়ে বসলো। দরজাটা লক করে দিলো।
সানজানারা আর্থিক দিক থেকে অনেক রিচ। ওর বাবার শিপিং এর বিজনেস আছে। এই লঞ্চের মালিক ওর বাবার বন্ধু। সে কারনে অতটা টেনশন লাগছে না। লঞ্চ ছাড়ার সাইরেন শোনা যাচ্ছে। মনে হয় একটু পরেই লঞ্চটা ছেড়ে দিবে। জানালা দিয়ে নদীর ঢেউগুলো দেখছে। আর ওর চোখের পানিগুলো নদীর মতো এঁকে বেঁকে ওর গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত সাড়ে আটটা বাজে। এতোক্ষণে মনে হয় কবুল বলা হয়ে গেছে। কবুল বলার সাথে সাথে যুবরাজের উপর থেকে ওর সব অধিকারবোধগুলো হারিয়ে গেছে। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত হাড়গুলো যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙ্গছে।
তারিখটা ঠিক মনে হয়। তবে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস তখন শুরু হয়েছে। সেদিন ক্লাসরুমে কেউ ছিলো না। যুবরাজের সব বন্ধুরা ক্লাস থেকে বের হয়ে গেছে। সানজানা বের হতে যাবে এমন সময় যুবরাজের দিকে চোখ পড়লো। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। একটা পরিনত বয়সের ছেলের চোখে জল। ও আস্তে আস্তে যুবরাজের দিকে এগিয়ে গেল। পাশে গিয়ে বসে সানজানা টিস্যু দিয়ে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
—-তুমি কাঁদছো কেন? তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলের চোখে পানি মানায় না।
যুবরাজ চোখের পানি মুছে শুকনো হাসি হেসে বললো,
—-তোমার কি ধারণা পুরুষের অন্তর পাথর দিয়ে গড়া।
—-না আমি সে কথা মিন করে বলিনি।
সানজানা তখনও ভাবেনি এই যুবরাজকে ও একদিন ভালোবেসে ফেলবে। তবে ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিলো। হয়তো প্রথম দিন থেকে সানজানা যুবরাজের কাছ থেকে বন্ধুত্বের বিশ্বাসটা অর্জন করতে পেরেছিলো। তাই সেদিন যুবরাজ ওর একান্ত ব্যাক্তিগত কথাগুলো সানজানার কাছে খুলে বলতে পেরেছিলো।

চলবে