Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 28



ব্রহ্মকমল পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0

(সতর্কতা: পর্বটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত)
#ব্রহ্মকমল
শেষাংশ
_______________

স্টেজের ওখানটায় গিয়েও একমুহূর্তের জন্য অংক আমার হাত ছাড়ল না। পাছে আমি নার্ভাসনেসে ধুপ করে পড়ে যাই! সেই আশংকায় নজরে নজরে রাখল আমাকে। এদিকে ও কথা শুরু করতেই কখন আরসালান আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আমি তো তখন অংকের স্মৃতিচারণে বুঁদ। মন দিয়ে শুনছি ওর একেকটা কথা,
— ভাইয়াকে আমি প্রথম আবিষ্কার করি আমাদের গোপন পারিবারিক এক বৈঠকে যেখানে বাচ্চারা স্ট্রিক্টলি নট অ্যালাওড৷

একটু থেমে মজার ছলে অংক একগাল হাসল,
— নিশ্চয়ই তোমরা সবাই ফেইস করেছ এমন একটা সময় যেখানে হুট করে বলা নেই কওয়া নেই বাড়িতে আত্মীয়স্বজনে ভরে যায়, তারপর পড়াশোনা লাটে তুলে সব বাচ্চাদের এক সাইডে পাঠানো হয় খেলাধুলো করার জন্য। অন্যদিকে বড়রা ড্রয়িংয়ে বসে খুব নীচু স্বরে কিসব পরামর্শ করে!

আমাদের বাসায়ও তেমন দিন প্রথম দেখলাম আমার হাইস্কুল ডেইজের একদিন। আমি তখন আপুর মতই ভীষণ চুপচাপ আর পড়ুয়া ধরনের। তারওপর আবার বোর্ড এক্স্যামস চলছিল। তাই স্বাভাবিক নিয়মে আমায় কাজিনদের সাথে পাঠিয়ে দিলেও কিছুটা খেলাধুলো করে জলদি বাড়ি ফিরে এলাম। শোনো, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে সেদিন ফ্যামিলি মিটিংয়ের কথা লুকিয়ে শুনিনি। আসলে মিটিংয়ের নামে এত বাকবিতণ্ডার শুরু হয়েছিল ড্রয়িং রুমে! আর পুরো বাকবিতণ্ডার অংশজুড়ে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল ব্রোর নাম! না চাইতেও আগ্রহ দমাতে পারিনি। আগ্রহ এতটুকুই ছিল,নতুন নামের এই মানুষটা কে? তাকে নিয়ে কেন ঝামেলা হচ্ছে বাসায়? মা একদিকে কাঁদছে, অন্যদিকে দাদি অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। জটিল অবস্থা।
— ভাইয়ার নামই তো তোমাদের ফ্যামিলিতে ব্লাস্টের মতো।

কে যেন মজার ছলে বলল। শুনে অংক আর আরসালান একসাথে হেসে উঠল। সমস্বরে উত্তর দিল,
— ট্রু।
— যাহোক, মিটিংয়ের আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও আরসালান নামটা আমার মাথায় গেঁথে রইল। তোমরা হয়তো জানো না, আমি ও-লেভেল থেকেই ফুপুর বাসায় থেকে পড়াশোনা করি। সেদিন মিটিংটাও কিন্তু ফুপুর বাসায় হলো। যদিও কথা ছিল মা আমার এক্সামের সময়টা থাকবে ওখানে, কিন্তু সেদিনের ঝামেলার পর ফিরে গেল বাসায়। এদিকে একটা প্রশ্ন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে ততক্ষণে। যে করেই হোক উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, কখন সবাই চলে যায় আর ফুপুকে সে ব্যাপারে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলি। জানতাম, আর কেউ হোক না হোক ফুপু আমার থেকে বিষয়টা লোকাতে পারবে না। আফটারঅল শী লাভস মি মোর দ্যান আদার্স রাইট!
যাহোক, এরপর আরসালান ভাই সম্পর্কে প্রথম জানালো আমাকে ফুপুই। অ্যান্ড শী ওয়াজ অলসো স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড ইন দিস ম্যাটার। সে ডিরেক্ট জানাল, দিস ম্যান ইজ মাই কাজিন অ্যান্ড উডবি ব্রাদার ইন’ল। সাথে এও জানতে চাইল, আমার কি তাকে পছন্দ হয়েছে আপুর জন্য?
ভালোবাসা, প্রেম এসব বিষয় বিশেষ অজানা থাকলেও আমার আপুর লাইফে একটা বিশাল চেঞ্জেস সে আনতে চাইছে এতটুকু বুঝতে পারছিলাম। সরাসরি তার প্রশ্নের উত্তর দেয়া হলো না। ডোন্ট নো হোয়াই আ লিটল হ্যাজিটেন্সি কামস, অ্যান্ড আই টুক এ্য পজ।

ফুপু কিন্তু এক্সাইটেড ছিল। ওরা সবাই-ই ভাইকে বেশ পছন্দ করত শুধু মা ছাড়া।
ছোট্ট শ্বাস ফেলে আমার পেছনে তাকাল অংক। তখুনি টের পেলাম কাঁধের কাছে অন্য আরেকজন মানুষের উষ্ণ শ্বাস। অজান্তেই কেঁপে উঠলাম আমি৷ দুরুদুরু বুকে মুখ ফিরিয়ে তাকালে নিজের থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরে একজোড়া সম্মোহিত চোখ অনুভব করে খুব অদ্ভুত অনুভূতি হলো।
এবং আমি সেই মুহুর্তটা থেকেই ঐ পরিস্থিতির হাত ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম। আমার আর ভালো লাগছিল না সময়টাকে, সন্ধ্যেটাকে, না জানা গল্পগুলোকে। কি দরকার আবারও পরিবার বলে শব্দটাকে টেনে এনে কাটাছেঁড়া করা! অযথা আমার ফেলে আসা সময়ের মিথ্যে স্মৃতিগুলো কড়া নেড়ে অশান্তি বাড়ানোর। কি আছে আমার মধ্যে? কেন কেউ এভাবে ছোট্ট একটা কারণে আমাকে এভাবে ভালোবাসবে! ভালোবাসা তো আমি চাই না৷

মনের ভেতরের দোলাচল বাড়লে চোখ ফিরিয়ে নিলাম তৎক্ষনাৎ। অংকের হাত টেনে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার আর ভালো লাগছে না এখানে, এসব বাদ দিয়ে প্লিজ ফিরে চল। আমি আর জানতে চাই না কিছু, নতুনত্বও চাই না জীবনে। প্লিজ অংক!

মনের ভেতর কথার পাহাড়, অথচ মুখ ফুটে বলার সুযোগ নেই। অংক নিজের মতো গল্প বলেই যাচ্ছে,
— সেদিনের পর ফুপুর মাধ্যমেই ভাইয়ার সাথে পরিচয়। তারপর আস্তে আস্তে কথাবার্তা নিয়মিত হওয়া। গোটা দেশের তফাৎ থাকলেও ভাইয়া আর আমার ফ্রেন্ডশিপ কিন্তু ইজিলি হয়ে গেল। ব্রাদার ইন ল, কাজিন এসব সম্পর্কের নাম আলাদাভাবে মনে করতেই দিল না সে। অ্যান্ড আ’ম প্রাউডলি সেয়িং টুডে, দ্য চার্ম অব মাই ব্রাদার ইজ রিইলি ডিফ্রেন্ট।
একজন ভাই হিসেবে বোনের জন্য এত দুর্দান্ত পার্টনার দেখা আমার জন্য ভীষণ ভীষণ ভাগ্যের। আমি তো ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমার প্রিটিয়েস্ট বোনটার দায়িত্ব ঐ চার্মবয়ের হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে পারব।

একরাশ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অংক এবারে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু আমার মন ততক্ষণে ঘুরে গেছে অন্যদিকে। ওর দৃষ্টি, কথা কিছুর সাথেই কানেক্ট করতে পারছি না। স্বাভাবিক তখনও পারলাম না৷ উল্টো হাত ছেড়ে দিয়ে দিশেহারার মত বিড়বিড় করে বললাম,
— আমি ফ্ল্যাটে যেতে চাই অংক। তুই কি আমায় নিয়ে যাবি?

ভাগ্যিস মাইকটা অন্যদিকে ঘোরানো ছিল। আমার কথা তাই কানে বাজল শুধু আমাকে ঘিরে থাকা কয়েকজন মানুষের কানে;অংক, আরসালান আর তার বন্ধুদের।

ইপশা তো বরাবর খোলা বইয়ের মতন। ভেতরের কথা চোখেমুখে ফুটে উঠে মানুষকে জানিয়ে দেয় সহজেই। তখনের পরিস্থিতিটাও হয়তোবা দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল করে দিয়েছিল অনায়াসে। মনি আপু এগিয়ে এসে পিঠে হাত রাখল আমার। নরম সুরে জানতে চাইল,
— খারাপ লাগছে?
জবাবে আমি ঘোরগ্রস্তের মতো ফিরে তাকালাম। তখন তো আমার সেন্স কাজ করছে না। মাথা নাড়ালাম কি না! হুট করে মনে হলো চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছি। তারপরের ঘটনা ধোঁয়াশা। সেই পুরনো রোগের দৌরাত্ম, ব্ল্যাকআউট৷
_____________

সম্পূর্ণরূপে চেতনা ফিরে পেলাম যখন, তখন আমি আমাদের ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর নীচে লেদারের সোফায় কারুর ঘাড়ে মাথা এলিয়ে। মানুষটাকে ঠিকঠাক চেনা লাগল না। কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাসজুড়ে এক মাতাল ঘ্রাণের দৌরাত্ম। যেন অচেনা অজানা বুনোফুল কতগুলো পিষে আমার সামনে রেখে দেয়া হয়েছে। মানুষের গায়ের ঘ্রাণ কখনো এত মনোমুগ্ধকর হতে পারে? একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ধরেছিল আমাকে। তবে তা বেশিক্ষণের জন্য নয়। অচিরে পাশের মানুষটা আমার চেনা নয় বুঝতে পেরে হুড়মুড়িয়ে সোজা হয়ে বসলাম। তাকালাম না ঠিক। কারণ ঘোরভাঙা আমার চোখজোড়া খুঁজছিল শুধুই ভাইকে। অংক বোধহয় পাশেই ছিল। আমায় চোখ খুলতে দেখে এগিয়ে এলো। কিন্তু আমায় কিছু না বলে সরাসরি পাশে বসে থাকা অচেনা মানুষটার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
— ভাইয়া কাজি ডাকব?
— উঁহু। তাড়াহুড়ো করো না অংক। ওকে একটু ধাতস্থ হতে দাও।

ভীষণ শান্ত স্বরে জবাব দিল মানুষটা। আমি চমকে সরে গিয়ে চোখ গোল গোল করে দেখলাম আরসালান। ক্লান্ত গম্ভীর মুখে বসে আছে সোফায় আমারই পাশে। সে অবশ্য আমার দিকে আর তাকাচ্ছে না। রাগ নাকি অভিমান কে জানে!
— কিন্তু ভাইয়া..
— এভ্রিথিং উইল বি অলরাইট।

পুনরায় অংককে থামিয়ে দিয়ে বলল আরসালান। আমি দুজনের কথার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। প্রতিক্রিয়া দেয়া দূরের ব্যাপার। বিভ্রান্ত চোখে দু’জনকে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না আসলে।
অবশ্য বিভ্রান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নিভু নিভু মোম দ্বিগুণ গতিতে জ্বলে ওঠার মতো করে অংক আমার পাশে এসে অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করল,
— আপু, তুই আরসালান ভাইকে বিয়ে করবি?
— আহ্ অংক!
মৃদু ধমকই দিল আরসালান। কিন্তু অংক তা গায়ে মাখল না। হাঁটু মুড়ে বসে আমার দুহাত নিজের মুঠোয় নিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
— বল না বিয়ে করবি?

ততক্ষণে আমি অনেকটা ধাতস্থ হয়েছি। কি, কেন এসব প্রশ্ন মাখছি না গায়ে। শুধু মনে পড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর দগদগে ক্ষত হয়ে আছে বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ঘটনাটা। মাথায় হাতুড়িপেটার মতো অনুরণিত হচ্ছে কয়েকটা কথা,
“সম্পর্ক ভালো নয়, ভালোবাসা ভালো নয়। যে ভালোবাসে সে আসলে ঠকে যায়”
— বল না রে আপু?
পরেরবার অংকের প্রশ্নে ভাবনাচিন্তায় আর সময় ব্যয় করলাম না আমি। দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝালাম,
“নাহ্ বিয়ে করব না।”

অংক যেন স্তব্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। আহত দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে, তারপর আরসালানের দিকে।
আমি জানি না কেন আরসালানের দিকে ফিরে তাকাতে এত কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল! মাথা নীচু করে কুন্ঠা লুকতে গিয়ে টের পাচ্ছিলাম উষ্ণ নোনাপানি টপটপ করে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে আমার হাতের ওপর। ভাবছিলাম প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপমানে আরসালান কি এবার আমাকে কড়া কথা শোনাবে? নাকি অংক ছুঁড়ে দেবে তীর্যক বাক্যবাণ!
আমার ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সম্ভাবনার একটাও কিন্তু হলো না। উল্টো অংককে ইশারায় সরিয়ে ওর জায়গায় আরসালান বসে পড়ল হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে। অনবরত ঝরে পড়া আমার চোখের পানিগুলোকে আলতো করে মুছে দিতে দিতে স্নেহার্দ্র স্বরে বলল,
— ইটস ওকে সুইটডল। ডোন্ট ক্রাই। আই ক্যান ওয়েট। আই হ্যাভ ক্রসড ওশন’স অফ টাইম টু ফাইন্ড ইউ রাইট? অপেক্ষাও করে নেব নাহয়। আই ওয়ান্ট ইওর লাভ, আই ওয়ান্ট হোল অফ ইউ সুইটি। কিন্তু তা জোর করে নয়। তোমার ইচ্ছেতেই।
— হাউ লং ক্যান ইউ ওয়েট?
কাঁপা কাঁপা স্বরে হুট করে জিজ্ঞেস করে বসি আমি। বিনিময়ে মৃদু হেসে সে দু’হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলে,
— ফর দ্য রেস্ট অব মাই লাইফ।

আমাদের প্রথম এবং শেষ প্রেমময় বাক্য বিনিময় বিয়ের আগে এটাই। তারপর তো সব আমার কাছে ফর্মালিটিজ। যাহোক, এরপর সেদিন আমাকে আর অংককে শান্ত করে বেরিয়ে যায় আরসালান ফ্ল্যাট থেকে। রাতে অংকর সাথেও কথা হয় না আমার। পরে অবশ্য জানতে পারি আমার শরীর খারাপ দেখে ওরা কাউকে বুঝতে না দিয়ে সংগোপনে আমায় নিয়ে সরে পড়েছিল। আর নিজের মতো করে গল্প শুনিয়ে আরসালানও সামলে নিয়েছিল পরিস্থিতি।
আমাকে যদিও তখন সরাসরি ফ্ল্যাটে আনা হয়নি, তবে বসিয়ে রাখা হয়েছিল এক কর্নারে। মনি আপু পুরোটা সময় পাশে বসেছিল আমায় আগলে। তারপর গল্পের পাঠ চুকে গেলে আরসালান গাড়ি করে আমাকে আর অংককে ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে৷ এরপরের সময়টুকু স্মৃতিতে জীবন্ত।
_________________

অংক আসলে ভীষণ ভালোবাসত আরসালানকে। পরদিন সুস্থ হতেই ও নিয়ম করে আমায় মানুষটার গল্প শোনাতে লাগল। কি করে সে প্রথমবার মাকে রাজি করাতে দেশে পা রাখল, কি করে নিয়মিত ফোনে, নেটে যোগাযোগ করে সে বোঝাতো অংককে যেন আমায় দেখে রাখে, যত্ন করে। এমনকি ও নাকি মাকে রাজি করাতে মায়ের পায়েও পড়েছিল সেবার। কিন্তু জেদ টলাতে পারেনি। অদ্ভুতভাবে খেয়াল করতাম, পুরনো এসব কথা তুলতে গেলেই রেগে যেত অংক। চোখমুখ লাল করে আমাকে বলত,
— তুই জানিস! মা এত কুটিল মহিলা, তোর সাথে ভাইয়ার দেখা করতে দেবে না বলে মেজো খালাকে ডেকে তার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছিল তোকে খুলনা। বিন্দুমাত্র আঁচ পেতে দেয়নি তোকে নিয়ে কি হচ্ছে আড়ালে।
আর মায়ের এতসব কুটচালের পেছনের কারণ জানিস?
— আমি জানতে চাই না অংক। কি, কেন, কোন কারণে এসব একটুও জানতে ইচ্ছে করে না আমার বিশ্বাস কর। যদি কিছু জানতে ইচ্ছে করে তা হলো, একটা মানুষের ভেতরে এত ভালোবাসা জমিয়ে রাখলে, পৃথিবীতে ঘৃণার গল্পগুলো কেন তৈরি হয়?
— আপু তুই না আমাদের পাস্ট থেকে বেরতে পারছিস না বোধহয়। দেখ, যে খারাপ পাস্টটাকে ধরে তুই সবসময় এত ভয় পাচ্ছিস, এত ইনসিকিউরড হচ্ছিস, সেটা কিন্তু চলে গেছে। আর যা চলে গেছে..

বোঝানোর চেষ্টা করে অংক। খারাপ লাগে ওর এসব অস্থিরতা। অজান্তে ব্যথার হাসি হেসে বলি,
— রেষটা তো রেখে গেছে রে।

শুনে অংক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
— ট্রাই টু মুভ অন আপু। এভাবে পাস্টে আটকে থেকে বৃথা এক পৃথিবী সুখ দূরে ঠেলে রাখছিস তুই বিশ্বাস কর। বৃথাই ঠেলে রাখছিস।

অংকের কথাগুলো আমায় ভাবাত প্রতি মুহুর্ত। আরসালানকে নিয়ে ওর গল্পগুলো, আমায় ভালোবেসে করা পাগলামিগুলো স্মৃতিতে জমা হয়ে সারাক্ষণ খোঁচাত। বোধহয় আবেগের তাড়নায় একবার করে বয়ে যেতে ইচ্ছেও হতো আমার। পরমুহূর্তে পুরনো ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে দু ধাপ পিছিয়ে যেতাম।
দোলাচল চলছিল এভাবে অনেকটা সময়৷ তার মধ্যে আরসালানের যাতায়াত নিয়মিত হলো, ওর সাথে অংকসমেত আউটিংয়েও গেলাম আমি। ফারাকটা তবু চোখে পড়ছিল না। আসলে সব আটকে ছিল আমার পাস্ট নামক লুপে। যার তলের হিসেব আমি পাইনি। যখন পেলাম, বিষে বিষক্ষয়ের মতো এক ভয় আরেকটাকে কেটে সম্পূর্ণ দোলাচল বিলীন করে দিল। যন্ত্রণাদায়ক ছিল, কিন্তু আজ মনে হয়, ভাগ্যিস ঐ ঘটনাটা ঘটেছিল। নইলে ইনসিকিউরিটির খাঁচা ভেঙে সত্যিকার সুখের পথে কখনো হাঁটতে পারতাম না নিশ্চয়ই।
______________

যন্ত্রণাদায়ক যে ঘটনার কথাটা এখন বলব, তা ঘটেছিল সময়ের থেকে আরও মাস ছয়েক পর৷ অফ ডেতে ল্যাব নিয়ে একটা মিটিং ছিল প্রফেসরের সাথে। সেটা শেষ করে ফাঁকা ক্যাম্পাস হেলেদুলে ঘুরে দেখছি, সেই সময় হঠাৎ আমার ফোনে বাংলাদেশ থেকে একটা কল এলো। যদিও খানিক অবাক হলাম প্রথম ও দেশের কল পেয়ে, তবে রিসিভ করতে দেরি হলো না। মিথ্যে বলব না, ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল এক মুহুর্তের জন্য আমার আত্মা উড়ে গেছে বোধহয়। আশংকা তো অনেক হচ্ছিল, কিন্তু সেসব বেড়ে ওঠার সময় পেল না। আমার হ্যালো বলবারও পূর্বে ফোনের ওপাশ থেকে বুলেট ছোঁড়ার মতো তীব্র গতিতে ভেসে এলো সুপরিচিত কণ্ঠের ঘৃণামিশ্রিত ধিক্কার,
— তুমিও তোমার বাবার দেখানো পথে হাঁটলে তাইনা? জানতাম, জানতাম আমি। ঠকবাজদের রক্ত শেষ পর্যন্ত ঠকিয়েই যাবে আমাকে। পেটে ধরলেও আসলে রক্ত তো তুমি তাদেরই!

হুট করে এত তীর্যক কথার কারণ আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সত্যি সত্যি ফোনটা আমার কাছে এসেছে কিনা! দ্বিতীয়বার চেক করে পুনরায় কানে ঠেকিয়ে অস্ফুটে বললাম,
— মা..
— খবরদার, খবরদার মা বলে ডাকবে না আমাকে। মা নই আমি তোমার। কেউ নই। কেউ না।
— কিন্তু মা আমি কি করেছি?

বজ্রগম্ভীর ধমকের পর দিশেহারার মতো আওড়ালাম আমি। জবাবে রাগে হিসহিসিয়ে মা জবাব দিল,
— কিচ্ছু করনি তুমি। যা ভুল করার আমিই করেছি। একটা নোংরা লোকের রক্তকে পেটে ধরেছি। তোমার জন্ম কীভাবে হয়েছিল জানো?

রাগে চিৎকার করে কথাটা বলে হুট করে থেমে গেল মা। ফোনের এপাশ থেকেও দিব্যি বুঝতে পারলাম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করছে। ভয়ে মুখে কোনো কথা জোগালো না। কান থেকে যে ফোনটা সরাবো তারও সাধ্য নেই। ওভাবেই ফোন কানে নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কান্নায় ভেসে যেতে লাগলাম আমি।

ওদিকে কিছুটা সময় নিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণের পর গম্ভীর গলায় মা পুনরায় বলতে লাগল,
— শোনো ইপশা, এই পৃথিবীর কাউকে যদি আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে ঘেন্না করি তাহলে সেটা তুমি। কেন জানো? কারণ তুমি তোমার বাবার মেয়ে। ঐ নোংরা লোকটার রক্ত। ভাবছ, আজ এই বয়সে এসে ও আমায় ধোঁকা দিয়েছে বলে এই কথা বলছি? হাহ। সত্যি তো হলো, তোমার বাবা এই বয়সে এসে ধোঁকা দিয়ে বরং অনেক বড় উপকারই করেছে আমার। এই উপকার তেইশ চব্বিশ বছর আগে করলে আমাকে নিশ্চয়ই জলন্ত আগুনের চুলোয় বসে জীবন কয়লা করতে হতো না।
— আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না মা।

কোনোরকমে শক্তি সঞ্চয় করে ভেজা গলায় বললাম আমি। মা বোধহয় হাসল একটু। তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
— বোঝার কথাও নয়। তোমার ঐ ইবলিশ শয়তান বাবা যেভাবে ফেরেশতার রূপ ধরে থাকে সবসময় তোমার সামনে! জানবে কি করে আসলে তো ও একটা দুমুখো জানোয়ার। যার সত্যি শুধু আমিই জানি। আমার জীবন ধ্বংস করেছে না! আমাকে তো জানতেই হতো।
যাহোক, সময় পাল্টেছে। অনেক আড়াল করেছি এসব নোংরা ইতিহাস। তোমাদের চোখ ধাঁধানো আলোর সামনে রেখে ভেতরে একা একা জ্বলে নিঃশেষ হয়ে গেছি। আমার জীবনে তো আর কিচ্ছু বেঁচে নেই। কিচ্ছু শেষ হবার নেই। কিন্তু তোমাদের এত সুখে দেখতেও ঘৃণা হচ্ছে।
ভাবছ এ কেমন মা? নিজের মেয়ের সাথেই প্রতিশোধের খেলায় মেতে উঠেছে! শুনে রাখো ইপশা, আমি তোমার মা হতে চাইনি। জন্ম দিতে চাইনি আমি তোমাকে। আমার জীবনে আসাটা তোমার যেমন অপ্রত্যাশিত ছিল, তেমনই তোমায় বাঁচিয়ে রাখাটাও আমার কাছে ভীষণ দুর্ভাগ্যের আর মনের বিরুদ্ধের ছিল।

এতটুকু বলে আবারও থামল মা। আমি ততক্ষণে জড়বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছি। একটা টুশব্দ বের করার সাহস আমার নেই। আমি জানি মা সবটাই বুঝতে পারছিল ওখানে বসে। কে জানে কোন আগুন জ্বলছিল তার বুকের ভেতর! সহজে সবটা বুঝতে পেরেও প্রতিশোধ চরিতার্থ করার মনোবাসনা অপূর্ণ রাখল না। বরং দ্রুতই তা চরিতার্থ করবে বলে আমার ভঙ্গুরতার তোয়াক্কা না করে একে একে পর্দা ওঠাতে লাগল নিজের পরিকল্পনামতো ফেলে আসা সে অতীতের বাক্স থেকে, যা আমার সামনে আসার আগেই মৃত্যুকে কামনা করতে আমি স্বস্তিবোধ করতাম৷

— শোনো ইপশা, এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গেছ তোমার বাবা আর আরসালানের বাবা জমজ ভাই? তবে এটা তোমাকে জানানো হয়নি, সদ্য একুশে পা দেয়া তরুণি আমার জীবনসঙ্গী হওয়ার কথা ছিল তোমার বাবার নয় বরং ওর ঐ জমজ ভাই ইরশাদের। কারণ ইরশাদকে আমি পছন্দ করতাম, ভালোবাসা বোঝার পর থেকেই ভালোবাসতাম পাগলের মতো। সবাই জানত আমার একতরফা ভালোবাসার কথা। প্রতিবেশী ছিলাম, যতটা ভালোবেসেছি ততটাই প্রকাশ করেছি সবার সামনে। একবিন্দু ছাড় দেইনি। আমার বিশ্বাস ছিল ইরশাদ আমাকে পায়ে ঠেলতে পারবে না। আমি তেমন মেয়েই ছিলাম না৷
আচ্ছা, আচ্ছা লোকের কথা নাইবা বললাম, কিন্তু তুমি তো আমায় দেখেছ, শুনেছ আমি কেমন ছিলাম তরুণি বয়সে। বলো তো ইপশা আমার মধ্যে কিসের কমতি ছিল? ইরশাদের মতো ভালো দেখতে, ভদ্র-নম্র ছেলেকে কি আমি ডিজার্ভ করতাম না? অফকোর্স করতাম। আমার কনফিডেন্স বিন্দুমাত্র মিথ্যে ছিল না জানি। তবু ইরশাদ আমাকে পছন্দ করত না৷ ভালোবাসত না সে আমাকে। কেন ভালোবাসত না কে কানে! এত চেষ্টা করেছি মানানোর, বোঝানোর। চিঠি লিখেছি, নানা বাহানায় তাদের বাড়িতে গিয়ে বসে থেকেছি শুধু তাকে একনজর দেখব বলেই। অথচ সে! বরাবর পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে আমার থেকে।

বলতে বলতে মনে হলো অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠল মা। রাগ আর ঘেন্নার মিশ্রণে অদ্ভুত স্বরে আস্ফালন করল কতক্ষণ। তারপর আবার সামলে উঠে ভেজা গলায় বলল,
— সেসময় কোনো মেয়ের সাধ্য ছিল না নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য এত পাগলামি করবে যা আমি করেছিলাম। সমাজ, পরিবার কিচ্ছুর তোয়াক্কা করিনি আমি, কিচ্ছুর না। ঐযে বিয়ের প্রস্তাবটা, সেটাও তো আমিই পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলাম বাবার দ্বারা। বিপরীতে কত যে মার খেতে হয়েছিল আমাকে, পায়ে পড়তে হয়েছিল বাবা-মার। কান্নাকাটি, অনুনয়-বিনয় এসবের পরেই কিন্তু মেনেছিল দু পরিবার। মেনেছিল ইরশাদও। অন্তত আমি তো তাই ভেবেছিলাম বিয়ে ঠিক হওয়ার মুহুর্তটায়। ভেবেছিলাম এত এত অপমান, অসম্মান, ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প শুনে বরফ গলেছে বোধহয়। ভালোবাসার বিনিময়ে তাহলে ভালোবাসা পেতে যাচ্ছি অবশেষে, বোধহয় শুধরে যাচ্ছে আমার জীবন;যেভাবে চাইছিলাম সেই পথেই এগচ্ছে।

কিন্তু নাহ্ সব এত সহজ ভাবলেও জীবন আমাকে সহজ কিছু দিতে যে কার্পণ্যই করত বরাবর। তাই তো তোমার বাবাকে পাঠালো আমার সুখে বাঁধা হিসেবে। কে জানে কোন অভিশাপে সহ্য হলো না তার আমার সুখ। ভাইয়ের বিয়েতে মত নেই, জোর করে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করছে এমন ধারণা করে সে কুমন্ত্রণা দিতে লাগল আমার আড়ালে আমারই হবু বরের কানে। কে জানে কখন কতটা ব্রেইন ওয়াশ করে ছাড়ল ইজাজ, ইরশাদের! হলুদের রাতে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে ইরশাদ একটা চিঠি লিখে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল আমায় একা ফেলে।

অনেক প্রতিক্ষার পর জীবন নিয়ে সাজানো গোছানো একটা পরিকল্পনা করতে বসেছিলাম আমি ইপশা, ভাবতে পারো, ভাবতে পারো চোখের নিমেষে অধরা স্বপ্নকে পুরোপুরি ভেঙে যেতে দেখে আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?

উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না মা। নিজেই পরক্ষনে বলল,
— পারো না। ভাবতে পারো না তুমি। এই পৃথিবীর কেউ ভাবতে পারবে না, বুঝতে পারবে না ঐ সময়টায় কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল আমার ভেতর দিয়ে। কি অপমানে, অসম্মানে ভেসে যাচ্ছিল আমার নারী সত্তা চোখের পানির সাথে। অপ্রত্যাশিত এই ধাক্কা কীভাবে সামলাবো যখন পাগলের মতো ভেবে যাচ্ছিলাম, সেসময় বলা নেই কওয়া নেই হলুদের আসরে কাজি ডেকে দু পরিবার জোর করে আমার বিয়ে পড়িয়ে দিল তোমার বাবা ইজাজের সাথে৷

কথাটা বলতে বলতে শব্দ করে কেঁদে ফেলল মা। মায়ের কান্নার আওয়াজেই কিনা! হুট করে আমার বিমূঢ় ভাব উড়ে গেল হাওয়ার সাথে। বাবার অন্যায়ের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমি অনুতপ্ত সুরে বললাম,
— স্যরি মা। স্যরি।

মা অবশ্য আমার কথায় গা করল না। নিজের মতই সে বলে গেল,
— ইজাজকে তো পছন্দও করতাম না আমি সেসময়। বেয়াদব, বখাটে;নোংরা একটা ছেলে। অল্প বয়স থেকেই যার মেয়েবাজির স্বভাব গোটা পাড়ার লোক জানত। জানত আমার বাবা-মাও। অথচ বর পালাতেই অপমানের হাত থেকে বাঁচতে সামনে পেছনে কিছু না ভেবে তারা ঐ মেয়েবাজ বখাটেটার সাথেই আমার শূলে চড়িয়ে দিল;আমার মতামতেরও অপেক্ষা করল না।
ইতোমধ্যে নিজের প্রিয় মানুষকে হারানোর যন্ত্রণায় স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম আমি, সেখানে আমার অমতে এতবড় সিদ্ধান্ত! তোমার বাবাকে নিজের পাশে কল্পনা করেও মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার।
এবং আমি মরতে গিয়েছিলামও। কেন যে মরতে পারলাম না সেদিন! অসহ্যকর জীবনের শেষ তখনই হয়ে যেত। কিন্তু তোমার বাবার সাথে তো আমার কোন জন্মের শত্রুতা! জোর করে বাঁচিয়ে আগুনের জীবন উপহার দিলো সে আমাকে। এবং যার প্রথম নিশানা হিসেবে কয়েকদিন বাদে ধরা দিলে তুমি।
তোমাকে আমি এত ঘৃণা করি কেন জানো ইপশা? কারণ তোমার জন্মটাই ঘৃণার ছিল।

মা যে আসলে কি বলতে চাইছে বুঝতে সমস্যা হলো না আমার। লজ্জায় অপমানে কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। শক্ত করে ফোন চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠলাম আমি,
— চুপ করো মা, চুপ করো। আল্লাহর দোহাই লাগে প্লিজ চুপ করো।
— কেন চুপ করব? তুই আর তোর বাপ মিলে আমার সর্বস্ব খেয়েছিস৷ রাক্ষসী। কেন জন্মের সময় মরে যাসনি তুই? তুই যে আমার কতবড় কলঙ্কের নাম তা টের পাস! জানোয়ার। আমার ছেলেটাকেও তো দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছিস আমাকে।

ফোনের ওপাশে কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলার তীব্র শব্দ শুনতে পেলাম আমি। হাফাতে হাফাতে গর্জন করে মা বলল,
— দীর্ঘদিন কলঙ্ক বয়ে বেড়ানোর পর ওই একটা সুখ এসেছিল আমার জীবনে৷ কিন্তু নাহ তোর তাও সহ্য হলো না। শুধু তোর কেন, ওই বাটপারের ছেলে আরসালান, ওরও তো সহ্য হতো না শুরু থেকে। বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে আমার ছেলেটাকে ফুঁসলাতো ও।
কে জানে কোন জাদুমন্ত্রণা জানে গোটা পরিবার। যাদের বলির পাঠা ঘুরেফিরে আমিই হয়ে যাই।
যাক, আরও একবার সফল হয়েছিস তো তোরা, তাইনা। এখন ওখানে গিয়ে নিশ্চয়ই মিলে গেছিস ওর সাথে? জারজ, মনে রাখিস বাপের পথে হেঁটে আরও একবার আমাকে নিঃস্ব করে দিলি তো! কোনোদিন সুখী হতে পারবি না তুই। তোর বাপটা, তারও এমন দশা হবে, পৃথিবীতে দোজখ দেখবে শয়তানটা। আর তুই আর তোর নাগর..
শেষটা শোনার সাধ্য হলো না আমার। তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম মাটিতে। এ কোন ভাষায় কথা বলছে আমার মা। কুমন্ত্রণা, নাগর.. আর সবচাইতে ভয়াবহ যেটা, আমি জারজ? আমি, আমি…

ভীষণ একটা ঘৃণায় গোটা গা গুলিয়ে উঠতে শুরু করল। আমার জন্মের ইতিহাস, আমাদের বাবা-মায়ের ফেলে আসা সময়ের ইতিহাস যে এত নোংরা কে জানত! কেনই বা এতবছর পর তা আমার সামনে আসতে হলো এভাবে? কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমি? কোন পাপের।
মনে হলো একটু একটু করে গুছিয়ে নিতে চাওয়া জীবনের টুকরোগুলো দ্বিতীয়বার ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল নিমেষে।
অনেকটাক্ষণ বসে ভাবতে লাগলাম, ঘৃণ্য এই জীবনের ইতি আজই হওয়া উচিৎ কি-না। আমি তো ভীতু, প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকে বের করতে পারলাম না। শেষে আহত, জীর্ণ যাযাবর পাখি শেষ চেষ্টায় দাদির দেখানো গোপনতম নীড়ে ঠকঠক করল।
ঐ নীড়ে ছিল আমার ঘরের মানুষ, সত্যিকার মানুষ যাকে পেয়েও পেতে চাইছিলাম না আমি। আপন করেও করতে পারছিলাম না অযাচিত ভয়ে। অথচ শেষ মুহুর্তে নিয়তির ঠিক করে দেয়া গল্পের মতই, অসহায় আমার আশ্রয় হয়ে উঠল কিন্তু সে।
অসহ্যকর বিকেলের কালো ছায়া থেকে টেনে নিয়ে বাহুবন্ধনীতে আগলে নিলো কি ভীষণ দৃঢ়তায়। ঐ যে ভীতু ভীতু প্রশ্নটা, জীবনের ইতি টেনে দেব কিনা!
এর উত্তরে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— ছিহ পুতুল। এভাবে ভেঙে পড়তে হয়? আমি আছি তো তোমার পাশে, সবসময়। সব ঠিক করে দেব একদিন। ভেঙেচুরে ছড়িয়ে পড়া সব।

তার জটিল কথাগুলো বোঝার সাধ্য যদিও আমার তখন ছিল না। কিন্তু ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতো একটা অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরতে বড্ড ইচ্ছে করছিল। সেবার প্রথম ভয়কে জিততে না দিয়ে আমি আমার মনের কথা শুনলাম। সে যতখানি দৃঢ়তায় বুকে চেপে ধরেছিল আমাকে, তার চাইতে কয়েকগুণ আমি আঁকড়ে ধরলাম তাকে।
ভাগ্যিস আঁকড়ে ধরেছিলাম! নইলে অসহ্য, কাঁটায় পরিপূর্ণ জীবনটা ফুলের মতো মসৃণ আর সুরভীত হতো কি করে?

— “পুতুল? এই অসময়ে ব্যালকনিতে কি করছ? ঠান্ডা লেগে যাবে তো পাগল।”

চিরচেনা স্নেহার্দ্র স্বরের মিষ্টিমধুর ধমকে চমকে ফিরে তাকালাম আমি। সাথেই কেটে গেল আমার বিদীর্ণ অতীতের দীর্ঘ ভাবনার প্রহর। ডায়েরির ফাঁকে কলম গুঁজে সুবোধের মতো তা পেছনে লুকিয়ে কাচুমাচু করে বললাম,
— নিউজে পড়লাম এ সপ্তাহে নাকি অরোরা দেখা যাবে। আর তুমি তো জানই…
— নিউজে বলেছে এ সপ্তাহে। একবারও বলেছে আজ? মিথ্যে গল্প বানাচ্ছ। একা একা বসে বসে ডায়েরি লিখছ তুমি তাই না?

ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল আরসালান। সাথে সাথে তীব্র বুনোফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠল আমার পুরো সত্তা। ইশশ এই মানুষটা পুরোটা একটা জাদুর মন্ত্র। এতবছড় গড়িয়ে গেল বিয়ের, ওর গায়ের পাগলাটে ঘ্রাণটা একটুও পাল্টালো না। বহ্মকমল কি, আমি জানি না, কিন্তু বহ্মকমল যদি কোনো অজানা সুগন্ধি ফুল হয় তাহলে সেই তকমা তো ওই ডিজার্ভ করে, আমি নই।

— কি ভাবছ সুইটডল। লুকতে চাইলেই আমি ধরতে পারব না?।
এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে আমায় পুরোপুরি বারান্দার রেলিংয়ের সাথে মিশিয়ে নাকে নাক ছুঁয়ে দিল আরসালান। ওর গায়ের ঘ্রাণ ছাপিয়ে সেই মুহুর্তে নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেল আফটার শেভিংয়ের কড়া স্মেল। ঘোরগ্রস্ত আমি চোখ বুঁজে নিভু নিভু স্বরে বললাম,
— প্লিজ আরসালান।
— কি লিখছ দেখি আমিও।
বলেই একহাতে আমার দু-হাত পিছমোড়া করে খপ করে ডায়েরি টেনে নিলো অন্যহাতে। নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বলল,
— আবারও অতীতকথন শুরু করেছ?

আমার জবাব দেয়ার ক্ষমতা নেই। এভাবে বলা নেই কওয়া নেই হুটহাট কাছে এসে কিছু জানতে চাইলেই উত্তর দিতে পারব নাকি! অদ্ভুত।
— আমাদের প্রেমের গল্পগুলো লিখেছ পুতুল?

আবারও প্রশ্ন করল সে। শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
— লিখব কীভাবে? আগেই তো থামিয়ে দিলে তুমি।

ফিসফিসিয়ে কোনোরকমে বলার চেষ্টা করলাম আমি। কে জানে তার কানে পৌঁছল কিনা! ঝুঁকে আমার থুতনি কামড়ে ধরল আলতো করে। পাগলের পাগলামি ছাড়ানোর বাহানায় এত ছটফট করলাম, কিন্তু গায়ে লাগল না তার। রীতিমতো হ্যান্ডকাফের মতো আমার দুটো কবজিকে এমনভাবে বন্দী করে রেখেছে সে তালুর মধ্যে! নড়বার সাধ্যি নেই। শেষে ওভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তার অত্যাচার সহ্য করার খানিক বাদে একা থেকেই ছেড়ে দিয়ে আমায় ধাতস্থ হওয়ার সময় দিল। তবে হাত ছাড়ল না। আমিও ছোটাছুটি করলাম না। রয়েসয়ে তার অতি প্রেমের ভার সামলে নিয়ে চোখ খুলতেই দেখলাম আমার বেহাল দশার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে সে। এত পাঁজি হয়েছে মানুষটা! ভালোবাসার প্রশ্রয়ে পাগলামো বাড়ছে বেশি করে। আমাকেও ওর প্রেমে এমনভাবে পাগল করে রেখেছে না কিছু বলতে পারি, আর না সইতে পারি। সত্যিই, জীবনের মোড় এভাবে ঘুরে যাবে কখনো ভাবিইনি কোনোদিন।
— ভাবনার দেবী, আবার কোন ভাবনায় হারিয়ে গেলে বলো তো?
— হারাইনি। ভাবছি।
— কি ভাবছ?
এক ভ্রু নাচিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল আরসালান।
— আচ্ছা তুমি আমাকে বহ্মকমল নাম দিয়েছ কেন?
— বলব না, সিক্রেট।
— আহা বলোই না। প্লিজ প্লিজ। কতদিন জিজ্ঞেস করেছি আমি। বলো না প্লিজ। এই?
— উহহু অযথা জিদ করে না পুতুল। চলো এখন শোবে চলো। পেটের ভেতরেরগুলো বোধহয় ঠান্ডায় এতক্ষণে বরফ হয়ে গেল। তারপর কাল সকালবেলা একটু কম নড়াচড়া করলেই তুমি কান্নাকাটি করে আমায় পাগল বানিয়ে দেবে। সেটা হবে না।
— তুমি কিন্তু ইগনোর করছ আমার কথা।

মুখ ফুলিয়ে ওর হাত টেনে ধরলাম আমি। শুনে মৃদু হেসে ও ফিরে তাকাল। অল্প ঝুঁকে মুখে একটা ফু দিয়ে বলল,
— তুমি তো জানই কেন। পড়েছ তো আমার তোমায় নিয়ে লেখা ডায়েরি থেকে।
— পড়েছি। কিন্তু তোমার মুখে তো শুনিনি আরসালান।
— পাগলি মেয়ে। চলো ঘরে চলো। বলছি।
— উহু এখানেই বলো। প্রকৃতির এত স্তব্ধতা, এত স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশ। এখানেই স্পেশাল ফীল করাও আমাকে।
— জিদ্দি মেয়ে। আমারও জিদ কম নাকি!

ভ্রু কুঁচকে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে আরসালান আমায় পাঁজা কোলা করে তুলে নিলো সবল বাহুতে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে চট করে ওর ব্লেজার খামচে ধরে চিৎকার করতে করতেও সামলে নিলাম আমি নিজেকে। অল্প হেসে ঘরের ভেতর পা রাখতে রাখতে ও বলল,
— ভারী হয়েছ বেশ।
— তো হব না। তোমার জুনিয়র ভার্সন দু’জনকে সামলে রেখেছি নিজের ভেতর। সারাটাদিন তো ক্ষিদে ক্ষিদে বলে চেঁচায় দুটো। ওদের চক্করে পড়েই..
যাকগে আর কথা কেটো না তো। বলো কেন আমায় ব্রহ্মকমল নাম দিয়েছিলে তুমি?
— না শুনে মানবে না। তাইতো? বেশ বলছি।

বিছানার এককোণে বসে আমায় কোলে টেনে নিয়ে মাথার তালুতে চুমু খেলো আরসালান। এরপর ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল,
— তোমার প্রতি আমার অবসেশান তো অনেক আগেই টের পেয়েছিলাম। কিন্তু ভালোবাসাটা টের পেলাম একবার এক হাইকিংয়ে যাওয়ার পর।
— হাইকিং?
— হু..হুম। আমার ফার্স্ট এভার হাইকিং। শহরের সবচাইতে উঁচু এক পাহাড়ে। যদিও ট্রিপটা ছিল আমার ইন্সটিটিউট থেকে, তবু গাইডের তোয়াক্কা না করে আমরা কয়েকজন ফ্রেন্ড এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতাম সুযোগ পেলে। ফুলটার যেদিন খোঁজ পেলাম,সেদিনও দুষ্টুমিতে সাড়া দিয়ে একা একা বেরিয়ে গিয়েছিলাম পাহাড়ের সবচাইতে রহস্যময় জঙ্গলে, নতুন কিছু আবিষ্কারের তাড়নায়।
বুঝতে পারিনি এতবড় দুঃসাহসিকতা দেখাতে গিয়ে শেষদিন কোনো বিপদে পড়ে যাব।
— বিপদে?
— হুমম। বাট বিস্তারিত জানতে চাইবে না। এতটুকু জেনে রাখো, ঐ বিপদের হাত থেকে বাঁচতে আমি যখন গহীন জঙ্গলে পাগলের মতো ছুটছি, সে সময় একঝাড় বহ্মকমলের ছায়া আমায় নিজের ভেতর আগলে নিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল জীবনমৃত্যুর ব্যবধান থেকে। ঠিক তুমি যেভাবে বাঁচিয়েছিলে একসময় তীব্র জ্বরের হাত থেকে।
— ব্যাস! তাতেই আমায় ঐ ফুলের সাথে তুলনা করে ফেললে!
— তুলনা নয়৷ তোমাকে ফুলটাই ভেবে ফেললাম। আমার ব্রহ্মকমল। ও যেমন আমার দৃষ্টিসীমার অনেক অনেক দূরে এক রহস্যময় আড়ালে নিজেকে ঢেকে রেখেছিল, প্রয়োজনে বেরিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে, তেমনই তুমিও তো আমার থেকে কতটা দূরে ছিলে এতকাল। তোমায় দেখেছি প্রতিমুহূর্তে, কণ্ঠ শুনেছি। কিন্তু ছুঁতে চেয়ে আর পারিনি। ধরা দাওনি তুমি আমার আঙুলের স্পর্শে।

বলতে গিয়ে কেমন একটা ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেল আরসালানের দৃষ্টি। এই দৃষ্টি আমার চেনা। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গেলে যখন আমাদের দূরত্বের হিসেবগুলো মনে পড়ে যায় তখনই অদ্ভুত অভিমান আর রাগে চোখ ঘোলাটে হয়ে যায় ওর। এই আরসালানকে সামলাতে পারি না আমি। ওর ব্যক্তিত্বের এই অংশটুকু চিরকালের মতো অধরা মনে হয় আমার কাছে।
— তুমি একটা পাগল ছেলে আরসালান।
— পাগল, ভীষণ পাগল। শুধু তোমার জন্য পুতুল। শুধু আমার রহস্যময়ী বহ্মকমলের জন্য।

ঘোলাটে চোখের ভাষা গহন হয়ে পরমুহূর্তে ছায়ার মতো নেমে আসে আমার ওপর। ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,
— পুতুল, ক্যান ইউ সে দ্যাট ইউ লাভ মি?
— আই জাস্ট ডোন্ট লাভ ইউ মাই ম্যান, আই ব্রিদ ইউ, আই লিভ ইন ইউ।

ঘোরের ভেলায় ভেসে উত্তর দেই আমি। শুনে সে উজ্জ্বল হাসে। তার নিঃশ্বাস নাকের ডগায় অনুভব করে শেষ মুহুর্তে চোখ বুজতে বুজতে আমি টের পাই থুতনির কাছটায় ব্যথার তীব্রতা এবার বেশি।
এই ছেলের ভালোবাসা আর অভিমান যেমন তীব্র, তেমনই তীব্র সেসবের বহিঃপ্রকাশ। ও বোধহয় জানে না, ওর স্বাভাবিক সত্তার চাইতে এই ক্ষ্যাপাটে সত্তা ঠিক কতটা ভিন্ন। যদি জানত তাহলে কি আর পাগলামি করত না? কে জানে। আমার অবশ্য দুটো আরসালানকেই ভীষণ পছন্দ। দুটোই যে আমার সারাবেলা বোঝায় পৃথিবীতে ভালোবাসার রূপে ভিন্নতা আছে। ভিন্নতা আছে ভালোবাসা প্রকাশের ধরণে। এক ভালোবাসা কারোর কাছে অভিশাপ হলে, অন্যের কাছে তা আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিতে পারে। তাই অন্যের গল্পের সাথে নিজের গল্পকে মেলাতে হয় না। এতে শুধু ভয় বাড়ে, নিয়তি পাল্টায় না।
আমরা ততটুকুই পাই যতটুকুর আশীর্বাদ নিয়ে স্রষ্টা আমাদের পৃথিবীতে পাঠান। এর বাইরে বাকি সব দুর্ভাবনা ছাড়া কিচ্ছু নয়;কিচ্ছু না। আর দুর্ভাবনায় সাড়া দিতে নেই। সাড়া শুধু দিতে হয় ভালোবাসায়। কারণ, ফেইট মেইকস নো মিস্টেকস।

পুনশ্চঃ
কিছুটা গল্প বাকি রয়ে গেল তাই না? আমি আর আরসালান বাদে বাকি চরিত্রদের গল্পটুকু বিস্তারিত বলা হলো না। অবশ্য বিস্তারিত তাদের নিয়ে বলবার কতটুকুই আছে?
মা যে অভিশাপের নাম দিয়ে পৃথিবীতে দোযখ দেখার কথা বলেছিল আমার আর বাবার উদ্দেশ্যে, তা আমার ক্ষেত্রে না ফললেও বাবার জীবনে প্রতিফলিত হলো ঠিক। বছর দেড়েকের মাথায় খুব ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বিছানায় পড়ে গেল বাবা। আমরা ফোনে খবর পেলাম দ্বিতীয় স্ত্রী তার এই দশা দেখে কিছুদিন সহ্য করে আর কূলতে পারেনি। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে চলে গিয়েছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের আশায়।
অপরদিকে মা? তার সাথে অন্যায় তো হয়েছিল অনেক। শেষ বয়সে সে অন্যায়েরই গেটিস হিসেবে সৃষ্টিকর্তা একজন যোগ্য জীবনসঙ্গীর খোঁজ পাইয়ে দিলেন তাকে। মা যদিও বিয়ে করতে দ্বিধান্বিত বোধ করছিল, ভাই এখানে বসে তাকে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় রাজি করিয়ে তবেই থেমেছে।
মা এখন ভালো আছে। তার ঐ সংসারে আগেরপক্ষের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীদের নিয়ে সুখে আছে। আমার সাথে যদিও সেদিনের পর আর কথা হয়নি। আমিই কথা বলিনি নিজে থেকে। আমি তো তার কলঙ্কের অংশ। তাই আমাকে সামনে দেখে কিংবা কথা বলেও অতীতের ক্ষত তাজা না হয়ে যাক সেই ভয়ে পারিনি যোগাযোগ ধরে রাখতে। মাকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যদি পারতাম, তাহলে সত্যিই নিজের এগজিস্টেন্সি পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতাম শুধু মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু আমি হারিয়ে গেলে যে হারিয়ে যাবে আরও দুটো মানুষ। চেয়েও এতগুলো জীবনের ওপর জুলুম করতে কি পারত ইপশা?
যাহোক এ তো গেল মায়ের খবর। এবার তবে আমার জীবনের অন্যতম সুপার হিরো অংকর কথা বলি?
মানুষকে জায়গার হাওয়া না বদলে দেয় অনেকটা। নইলে আমার চিরকালের চিরকুমার ব্রত নেয়া নার্ড ভাইটা ভিনদেশে এসে হঠাৎ সুন্দরী রমনির পাল্লায় পড়ে যাবে কেন এভাবে! জড়িয়ে যাবে ভালোবাসার জটিল জালে। যদিও সে মুখ ফুটে কিছু প্রকাশ করেনি আমার সামনে, তবে গোপনসূত্রে জানতে পেরেছি মেয়েটা অন্যকেউ নয়, মনি আপুর ছোটবোন মিলি, অংকরই ব্যাচমেট। ছবিতে দেখে মনে হয়েছে ভীষণ ভদ্র আর মিষ্টি দেখতে। অংকর পাশে কি দুর্দান্তভাবে যে মানিয়ে যায়! ভেবেছি রিলেশনশিপ নিয়ে দুটোই সিরিয়াস হলে বিয়ে দিয়ে দেব এখানে। আমার ভাইয়ের মতো পারফেক্ট একটা ছেলের থেকে বেশিদিন আলাদা থাকতে দেব না মিলিকে। আরও একটা মেয়ে জানুক ভালোবাসার রূপ কতটা বর্নিল হতে পারে। কতটা রঙিনভাবে আমাদের জীবন রাঙাতে পারে মাত্র চারটে অক্ষর;যে রঙকে আঁকড়ে ধরে আমরা বেঁচে থাকার প্রার্থনা করতে পারি অনেক অনেকটাকাল…

” শেষ “

ব্রহ্মকমল পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব (১)

0

#ব্রহ্মকমল
শেষ পর্ব (১)
___________________

দাদির কথামতো জীবন-মরণ সমস্যায় তখনও পড়িনি আমরা কেউ, তবু হাতে গুঁজে দেয়া চিরকুটের কথা মনে রয়ে গেল দিব্যি। সারাদিন পড়াশুনো, কাজ সামলেও চিরকুটের ঠিকানা আর ঐ ঠিকানার মানুষকে একটাবার দেখার, জানার আগ্রহ দিনকে দিন বাড়তে লাগল আমার।
প্রায়ই মনে হতো ক্লাস শেষে বেরিয়ে গাড়িতে চেপে ফট করে যদি ঠিকানাটায় গিয়ে উপস্থিত হই, কাকে দেখতে পাব সেখানে? কোন অপ্রত্যাশিত মানুষ অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য? সেকি ছেলে নাকি মেয়ে!
আমি তাকে চিনি?
ছোট্ট একখানি এবড়োখেবড়ো কাগজ নিয়ে হাজার প্রশ্নের বেলাভূমি। বয়ে যেতে যেতেই শেষ মুহুর্তে রাশ টেনে সামলাতাম নিজেকে। যদিও সে-বছরই মানুষটার মতো সব প্রশ্নের উত্তরও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল অধীর আগ্রহে; আমিই টের পাইনি।

প্রতিবছর স্প্রিং, ফল আর উইন্টারে যারা ভর্তি হয় অ্যালবার্টাতে, তাঁদের জন্য বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে ফ্রেশার’স রিসেপশনের আয়োজন করা হয়। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাকি বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের সাথে যেন নতুনরা মিলেমিশে যেতে পারে, এবং সবার একটা পরিচিতি পর্ব সারা হয়, সে উদ্দেশ্যেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এবং এই নবীন বরণের এত চমৎকার চমৎকার নামকরণ তাঁরা করে থাকেন! নিজেকে স্পেশাল না ভেবে যাবে কোথায় ব্যাচগুলো।

এডমান্টনে শিফট করার আগে অনলাইনে ঘাটাঘাটির সময় কিছুটা ধারণা নিয়ে এসেছিলাম আমি। বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্টিকেল পড়ে আর জমকালো ছবিটবি দেখে প্রোগ্রামটা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহও ছিল আমার। এতকাল খোলসের ভেতরে থেকে জীবন কাকে বলে সেটা তো জানতে পারিনি ঠিক করে। তাই গতিপথ পাল্টাতেই মনে হলো নিজেকেও পাল্টে ফেলা যাক সব উৎসব আনন্দে মেলে গিয়ে।
“অতীত মুছে ফেলার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো জায়গা পরিবর্তন”
শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত কথাটাকে বহুদিন আগে মনেপ্রাণে মেনে নিলেও নিজের আচরণে টের পেলাম সেবার থেকেই অল্প অল্প করে।

মোটামুটি স্টুডেন্টরা ভর্তি হয়ে যাওয়া অবধি আমার আগ্রহ তুঙ্গে উঠে রইল। কি পরে যাব রিসিপশানে, কেমন মেকআপ নেব, সবার সাথে কীভাবে পরিচিত হব; জল্পনা কল্পনা করেই কাটতে লাগল। তবে প্ল্যান যতটা আমি করলাম, তারচাইতে বেশি করল অংক। ওতো সুযোগ পেলে আমাকে বা ওর কোনো বন্ধুবান্ধবকে বগলদাবা করে রোজ একবার চক্কর কাটতে লাগল শহরের নানাকোণের নামকরা শপিংমলগুলোতে। দিব্যি টের পেলাম নিজে যতটা না তৈরি হবে, তারচে বেশি আমাকে রেডি করানোর জন্য পাগলপারা হয়েছে ছেলেটা।
ভীষণ অবাক হলেও চট করে প্রকাশ করা হলো না। আমি তো লোভী। লোভী এতটুকু কেয়ারের, স্নেহের। এক ভাইয়ের মধ্যে বাবা-মাসহ ফেলে আসা সব চেনা মানুষগুলোর ছাপ দেখতে চাইছিলাম। তাই তো খানিক লজ্জা পেলেও মুখ ফুটে বললাম না ওর বাচ্চামো অস্থিরতায় কি অবারিত খুশির ঝর্ণাধারা বইতে শুরু করেছে আমার ভেতরে। সেই ছোট্টবেলায় বাবার আঙুল ধরে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে পৃথিবীর সব বিস্ময় জানতে যেমন আনন্দ লাগত অনেকটা তেমনই।

আমার মতো চিরকাল নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা বোকা একটা মেয়ের জন্য কেউ নিঃস্বার্থ এতটা করতে পারে, নিজের ছোটভাইকে না দেখলে আসলে জানতে পারতাম না।
মাঝেমধ্যে খুব করে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত মাথায়; বুঝতে পারতাম না, গড়পড়তা বাঙালি পরিবারে জন্মে, বাবার মতো ওরম একটা মানুষের সন্তান হয়ে ছেলেটা এত ভয়াবহ ব্যক্তিত্বের হলো কীভাবে! ভালোবাসা কিংবা স্নেহের বিশেষ বহিঃপ্রকাশ তো কখনো আমরা দেখিনি সেভাবে। তবে কি ফুপুর বাড়িতে কাউকে দেখে.. নাহ্ তা কি করে হয়! ফুপা নিজেও বাড়িতে থাকেন না। ওনাদের বাড়িতে নেই কোনো ছেলে মানুষ কিংবা কেউ। তাহলে অংক’র এই পরিবর্তন হলো কার হাত ধরে?
তখন কি আর জানতাম ব্যক্তিত্ব সবসময় রক্ত থেকে আসে না, অনেক সময় আসে আনএক্সপেক্টেড কিছু মানুষের থেকে। যেমন অংকের ছিল একজন আইডল। যাকে মনেপ্রাণে অনুসরণ করে গড়ে উঠছিল সে এমন পারফেক্টভাবে।
অবশ্য গড়ে উঠছিল বলার চাইতে বলা ভাল গড়েপিঠে নিচ্ছিল মানুষটাই অংককে সুদূর এই ক্যানাডায় বসে, শুধু আমার খেয়াল রাখবার জন্যে, আমারই অজান্তে।
যখন প্রথম জেনেছিলাম তাকে, শুনেছিলাম আমার প্রতি তার এতবছরের অবসেশানগুলো, গোপন যত্নগুলোর সম্পর্কে; তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না, অবাক হয়ে শুধু ভাবছিলাম,
দু-হাত ভরা ভালোবাসা তবে কি একেই বলে? সৃষ্টিকর্তা আদৌ আমার জন্য এতবড় উপহার সাজিয়ে রেখেছিলেন পৃথিবীর একপ্রান্তে। সত্যিই?

ভালোবাসা, জটিল শব্দ। কখনো এর অর্থ বের করতে পারিনি আমি। তবে শিখেছি, দু’জন মানুষ হাতে ধরে শিখিয়েছে আমায়, ভালোবাসা মানে যত্ন, অপর মানুষটার ভালো থাকার সমস্ত দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয়া;কাছে থেকে হোক কিংবা দূরে..
মানুষদুটোর একজন তো নিঃসন্দেহে অংক। আর অন্যজন?
এবার বলব তাকে নিয়ে। যে কিনা আমার জীবনের চূড়ান্ত সারপ্রাইজের অন্যতম অংশ। নতুন শুরুর দোরগোড়ায় যাকে খুঁজে পেলাম ভিনদেশে সম্পূর্ণ নতুনভাবে। নামে আরসালান ইউসুফ হলেও যার প্রিয় পরিচয় সবসময় ইপশার স্বামীরূপে।

অদ্ভুত তাই না? পারিবারিক কিছু নোংরামির সাক্ষী হয়ে যে মেয়েটার সম্পর্কের ওপর থেকে একসময় বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল, তার জীবনেও ভালোবাসার একটা বিশাল জায়গা তৈরি হয়ে গেল সময়ের স্রোতে; সৃষ্টিকর্তা ভীষণ যত্নে গড়ে দিলেন তার খুশির জন্য সাতসমুদ্দুর তেরো নদী সেচে মুক্ত এনে দেয়ার মতো একজন সুপুরুষকে। ভালোবাসা শব্দের অর্থ না বুঝেও যার নামে আমার হৃদয় কলরব করে উঠতে লাগল “ভালোবাসি, ভালোবাসি” সুরে সারাবেলা।

লুকব না৷ ঘোরতর বিয়ে বিরোধী থেকে, স্বামীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেয়েতে কনভার্ট হওয়া কিন্তু সহজ ছিল না দ্বিধান্বিতা ইপশার জন্য। ভাগ্যিস আরসালানের এত ধৈর্য ছিল। তাই তো পাথরে ফুল ফোটাতে পেরেছিল সে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর।

____….________….__

আরসালানকে কিন্তু প্রথম দেখলাম আমাদের ফ্রেশারস রিসিপশনে; সিনিয়র হিসেবে। নাহ্ হঠাৎ দেখা নয়, বরং ওখানে উপস্থিত সবাই ঘটা করেই আমায় হোস্ট আরসালান ইউসুফের সাথে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিল! যেন গোটা পৃথিবী এতদিন থমকে ছিল শুধু এই মুহুর্তটার অপেক্ষায়। বিশাল ধৈর্য নিয়ে প্রহর গুনছিল, কবে ইপশা মুখোমুখি হবে তার হবু বরের সাথে, আর কবে বহুদিনের লুকনো কিছু সত্যের ওপর থেকে পর্দা উঠে যাবে এক ঝটকায়।

আমি ততদিনে বিস্মিত হতে হতে ক্লান্ত। তবু সেদিন সন্ধ্যের পার্টিতে অংকর এনে দেয়া অফহোয়াইট শাড়িতে নিজেকে তৈরি করে যখন হলে পা রাখলাম, তখন আমায় দেখেই সিনিয়ররা সবাই এমনভাবে আনন্দে হল্লা করে উঠল! একমুহূর্তের জন্য চমকে উঠে দরজায়ই দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম আমি।
তাঁদের হল্লার তেঁজ এত তীব্র ছিল! একরাশ দ্বিধা আর বিব্রতভাব নিয়ে একবার পার্টিতে উপস্থিত বাকিদের দিকে, আরেকবার নিজের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম,
একলা একলা মাতব্বরি করে তৈরি হতে গিয়ে কোনো ভুল করে ফেললাম নাকি? সামহাউ ড্রেসাপে কিংবা পথভুল করে ভুল জায়গায় এসে পড়লাম! কিন্তু ভ্যানিউ তো এটাই লেখা ছিল কার্ডে। ইশশ! অংকটা যে কোথায় গেল। ডানপিটে ছেলে কার পাল্লায় পড়েছে আজকাল কে জানে! নির্ঘাত ওর বয়েসী মেয়েগুলো মাথা ঘুরিয়ে দেবার জন্য ফিটফাট হতে সময় নিচ্ছে এভাবে। বয়সের দোষ কাকে বলে!

দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বিব্রতভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব নাকি ভেতরে যাব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি। লজ্জায় এমন দশা যে পরিচিত মুখগুলোও আর পরিচিত লাগছিল না ঐ মুহুর্তে।
ওরা হয়তোবা বুঝতে পেরেছিল আমার অবস্থা। গোলযোগের ভেতর একটা আপু অবশেষে সেভিওর হয়ে বন্ধুদের ধমকে টমকে সামলিয়ে সহাস্যে এগিয়ে এসে কাঁধ জড়িয়ে ধরে আমায় স্থির করল। থুতনিতে হাত বুলিয়ে গালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
— কি মিষ্টি লাগছে তোকে! একদম ঐ নামটার মতই ম্যাসম্যারাইজিং। “বহ্মকমল”
আরসালানের ব্রহ্মকমল।

এতক্ষণের অদ্ভুত মুহুর্ত কেটে সুপরিচিত স্বর শুনে স্থিত হতে হতেও মনি আপুর অস্ফুটে বলা শেষ কথাটা মাথায় আবারও একটা জট পাকিয়ে দিল। বিভ্রান্তের মত তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
— কি বললে?
— নাহ্ কিছু নয়। বললাম, তোকে তো দুর্দান্ত লাগছে। আজকের শোজ স্টপার তুই-ই হয়ে গেলি পিচ্চি।

দ্রুত কথা কাটিয়ে বেশ জোর দিয়ে বলে আমায় আবারও জড়িয়ে ধরল আপু। আমিও পাল্লা দিয়ে লাজুক হেসে মুখ লুকালাম ওর জড়িয়ে ধরার বাহানায়৷ কিন্তু মনের কোণে কাঁটার মত বিঁধে রইল “ব্রহ্মকমল” শব্দটা। বারবার মনে হতে লাগল শব্দটা আমি আগেও কোথাও শুনেছি। অথবা পড়েছি হয়তো। কোথায় পড়েছি? কোথায় পড়েছি? কোনো বইতে কি! চেষ্টা করেও ঐ মুহুর্তে মনে করতে পারলাম না। তবে বুঝলাম, কোনো কারণে সে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল হুট করে।
আচ্ছা, পুরো কথাটায় শুধু বহ্মকমল তো সে বলেনি। কারোর একটা বহ্মকমল বলেছিল। সে কে?
প্রশ্নের উত্তর তৎক্ষণাৎ পাওয়া হলো না। মনি আপুর হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে ভেতরে যেতে যেতেও বিষয়টা আমায় ভাবাতে লাগল। ঘুরেফিরে দু-চোখ অংককেই খুঁজছিল বারবার। আমার মুশকিল আসান, ছোট্ট ভাইটা। ও থাকলে নিশ্চয়ই চট করে একটা সমাধান করে দিত এই প্রশ্নজ্বালার। কেন যে ও না থাকা অবস্থাতেই আমার সাথে এতকিছু হয় কে জানে!
_______________

সচরাচর রিসেপশানগুলো যেভাবে হয়, নাচ-গানে আর হৈ-হুল্লোড়, আনন্দে। আমাদের ওয়েলকাম সেরেমানিও সেভাবেই হলো। তবে গোটা অনুষ্ঠানে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া লেগে রইল বিশেষভাবে। ড্রেসাপ, ডেকোরেশন থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া; সবকিছুতেই দেশীয় সংস্কৃতি এমনভাবে মিশে রইল! মনে হলো অচেনা ভীড়ে অচীনপুরে এই একখণ্ড স্বদেশ।

সিনিয়ররা আবার অধিকাংশই ম্যারেড। গল্পে গল্পে উঠে এলো সব্বার পড়াশোনার চাপে চিঁড়েচ্যাপটা সংসারের গল্প। আমি একদমই ওসব গল্পের সাথে কানেক্টেড হতে পারছিলাম না;তবু হা করে মুগ্ধ হয়ে শুনতে ভালো লাগছিল।
হ্যাঁ, নিজে বিশ্বাস করতে পারতাম না আর সম্পর্কে, তাইবলে কি লোকের সুখী হবার গল্পেও খুশি হব না! বরং একেকজনের সাকসেসফুল লাভস্টোরির গল্প শুনে এত অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে উঠছিল! ভাবছিলাম আমার বাবা-মায়ের বিষাক্ত সম্পর্কের মতন পৃথিবীর ঐ একাংশ নোংরামিটুকু বাদ দিলে বাকি সব বোধহয় এমনই স্বচ্ছ, এমনই নির্মল।

গল্পে অবশ্য শুধু সিনিয়রদের কথাই উঠে এলো না। উঠে এলো আমার সমবয়সী, এমনকি জুনিয়র ব্যাচমেটদের কথাও। তাঁদের মধ্যেও কেউ পার্টনারসমেত ড্রিম লাইফের আশায় পাড়ি জমিয়েছে, কেউবা লং ডিস্টেন্সের যন্ত্রণা মাত্র পেতে শুরু করেছে; মান অভিমান, ভালোবাসা.. কত কত এক্সপিরিয়েন্স!
বাহারি গল্পে এমনভাবে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে, ভাবিনি তখন, এত মানুষের এত এত গল্পের ভীড়ে মাইক ঘুরে হুট করে আমার হাতেও চলে আসবে একবার।
এর দায় অবশ্য গোটাটাই মনি আপুর। কোত্থেকে এক জুনিয়র মেয়ের ইমোশনাল এক লং ডিস্টেন্সের গল্প শেষে হুট করে মাইক কেড়ে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সে সারির মাঝামাঝি এসে আমার হাত ধরে টেনে তুলল ভীষণ অপ্রত্যাশিতভাবে। তারপর অনেক এক্সাইটেড হয়ে রীতিমতো অ্যানাউন্স করার মতো করে বলল,
— অনেক হয়েছে পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মিলেমিশে থাকা ইমোশনের মিষ্টি মিষ্টি গল্প শোনা। এবারে আমি স্পেশাল রিকোয়েস্ট করে আমার পার্সোনাল ফেভরেট পুতুলের থেকে ওর লাইফের সবচাইতে হ্যাপেনিং গল্পটা শুনতে চাই, যে গল্পের অপেক্ষায় দেশ-বিদেশ মিলে দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর কাটিয়ে দিয়েছি ভীষণ ভীষণ অস্থিরতায়। যদিও সে বড্ড চুপচাপ আর অনেকটা লাজুক। কতটা রেখে কতটা বলবে জানা নেই। তবু আজ এই বড় আপুর রিকোয়েস্ট তাকে রাখতেই হবে। ঝুলিভরা স্পেশাল গল্পটা শোনাতেই হবে। এ্যাই ইপশু শোনাবি তো?

ঐযে বলেছিলাম বিস্ময় শেষেও, বিস্ময়ের ভাগ কিছুটা বাকি ছিল। সেদিনে হুট করে মনি আপুর গ্র্যান্ড অ্যানাউন্সমেন্টে কিন্তু তার ষোলোকলা পূর্ণ হলো।
বলা বাহুল্য আমি তাঁর কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলাম না। উল্টো বজ্রাহতের মতো চোখ গোলগোল করে মাইক হাতে এমনভাবে তাকিয়ে রইলাম! আমার দৃষ্টিও সে অবাক হওয়া প্রকাশ করতে পারছিল না আর।
মুখ ফুটে কি বলব! কিইবা বলা যেতে পারে তা ভাবতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল আমায়। তবু অস্ফুটে আপুকে ডাকতে চাইলে, চোখের ইশারায় মেকি রাগ করে সে মাইক দেখিয়ে বলল,
— শুরু কর।

কি শুরু করব? এই প্রশ্নই তো করতে যাচ্ছিলাম আমি। কোন সাড়ে ছয় বছরের গল্প! কি গল্পই বা শুনতে চাইছে সে। আমার জীবনে স্যাড গল্প আছে জানতাম৷ স্পেশাল গল্পের খোঁজ আছে তা তো জানতাম না। সে আবার কোন ইপশার হ্যাপেনিং গল্প জানতে চাইছে। যার কানাকড়ি আমি ইপশা জানি না। অদ্ভুত!

#ব্রহ্মকমল
শেষ পর্ব-২
____________

গোটা হলের অগণিত চোখ নিশানার মতো আমার দিকে তাক করা বুঝতে পেরে নার্ভাসনেস বাড়ছিল তরতর করে। টের পাচ্ছিলাম জীবনে প্রথম যত্ন নিয়ে করা মেকআপ ঘামের সাথে ছেড়ে যাওয়ার দশা হচ্ছে দ্রুত। তবু মনি আপুর এক্সপেকটেশন মাঠে মারা যেতে দেখাও সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে। আফটার অল এখানে আসার পর সেই তো হাতে ধরে গাইড করে আমাদের অ্যাডজাস্টমেন্টে হেল্প করল। মিনিমাম কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেও তার মান রাখা আমার দায়িত্ব।
এদিকে ভেতরে বলার মতো একটা শব্দের খোঁজও জানা নেই; মাথা ব্ল্যাংক।
কি করতাম! কোমল মনের মিষ্টি যন্ত্রণা। কাউকে না বলার দুঃসাহস নেই। অগত্যা…

বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে নিতে ঐ নার্ভাসনেসে ঠোঁট আলগা করে বানিয়ে কিছু একটা বলতে চাইলাম যদিও, শেষ মুহুর্তে বলার প্রয়োজন পড়ল না;তার আগেই আলাদীনের প্রদীপ থেকে বেরুনো জিনির মতো কেউ এসে মাইক নিয়ে বাঁচিয়ে দিলো আমায় চরম দুর্বিপাক থেকে। ঘুরে তাকানোর সময় পেলাম না। শুধু টের পেলাম আঙুলের ডগায় একটা অপরিচিত আঙুলের অল্প স্পর্শ আর কানে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলা দুটো শব্দ,
— স্যরি সুইটডল।

যদিও পরমুহুর্তে তা চাপা পড়ে গেল হলভর্তি ছেলেমেয়েদের সমস্বরের হল্লায়; রিঅ্যাকশন দেবার সুযোগও হলো না বিপরীতে। বরং কণ্ঠের মালিক দূরে সরার সাথেসাথে টের পেলাম অন্য আরেকটা হাত কাঁধে উঠে এসেছে ভরসা যোগানোর বাহানায়। এবার আর চমকাতে হলো না। এ স্পর্শ যে আমার খুব আপন। হাতের মালিকও চেনা। আমার ভাই অংক।
অংককে পাশে পেয়েছি বুঝতে পেরে দুশ্চিন্তার মুহুর্তটায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো। ওদিকে আমাকে ধাতস্থ হতে দিয়ে খানিক বাদে হল্লা এড়িয়ে গলা খাঁদে নামিয়ে কানের কাছে মুখ এনে অংক বলল,
— জানি আপু, খুব অবাক হবি তুই এরপর। কিন্তু ট্রাস্ট মি যা শুনবি এখন, এটা তোর লাইফের সবচাইতে বেস্টেস্ট একটা ঘটনা৷ জাস্ট লাইক এ্য সারপ্রাইজ গিফট। গড নিজহাতে র‍্যাপিং পেপারে মুড়ে যে গিফটটা পাঠিয়েছেন তোর ঝুলিতে৷ আর আমাকে চ্যুজ করেছেন তোদের ডাকপিয়ন। যে ডাকপিয়ন বোকাসোকা, ভীষণ ইমোশনাল আপুটাকে হাজারবার লুকনো গিফট খুলে দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত এতদিন। উফফ! আনবিলিভাবল ম্যান। কীভাবে যে সামলাতাম নিজেকে।

শেষ বাক্যটা বলতে গিয়ে খানিক হাসল ও। ওর সেই হাসিটা টের পেয়েই আমি সুবোধের মতো ঘুরে তাকালাম। দেখলাম সত্যিই। আনন্দ আর অন্যরকম আবেগ মিশ্রিত এক অনুভূতি চোখে ফুটিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে অংক। ওর সেই আবেগতাড়িত চোখজুড়ে মিশে আছে এত স্নেহ! এত খুশির ঝলক। যেন বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত কিছু হাতে পেয়েছে, এমন মনে হলো।
অংকও বুঝতে পারল ওর খুশির পরিমাপটা আমি ধরতে পেরেছি। চোখের হাসি দ্রুত ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল। এরপর অপেক্ষার সময়টুকুকে সরিয়ে দিতে বিশেষ দেরি ও করল না। আমার আকাশকুসুম ভাবনার লাইনকে মাঝপথে থামিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে আঙুলে ইশারা করে মৃদু হেসে বলল,
— ওদিকে তাকা। ওই হ্যান্ডসাম মানুষটাকে দেখছিস, তোর দিকে কি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে? উনিই তোর গিফট। আরসালান ইউসুফ।

পরিচয়ের আগেই মানুষটার নাম শোনা সেই প্রথম।
_______________

ছোটভাইকে পাশে রেখে যদিও একটা ছেলের দিকে তাকাতে আমার ভীষণ কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল, তবু বাঁধনহীন আগ্রহ আর অংকর জোরাজোরিতে লজ্জা টিকতে পারল না। অজ্ঞাতের ভীড় ঠেলে বেরিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অজানা সত্যিকে জানার আশায় উদগ্রীব হয়ে মুখ ফেরালাম আমি। দেখতে পেলাম, আমার থেকে স্বল্প দূরত্বে এমারেল্ড কালারের ব্লেজারে ভীষণ হ্যান্ডসাম ড্যাশিং একটা ছেলে মাইক হাতে বিশাল হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে অপলক, অংকের কথামতো।
বুঝতে অসুবিধে হলো না, এতক্ষণ আমাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জলজ্যান্তরূপে ঐযে দাঁড়িয়ে আছে স্বল্প দূরত্বে।

অস্বীকার করব না৷ কিছুটা সময় একমনে সৌম্যদর্শন মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য মুগ্ধতার ঢেউ দোল দিয়ে গেল আমাকে। অস্ফুটে আওড়ালাম,
— জলজ্যান্ত মানুষ?
জবাবে জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে অংক বলল,
— হুম। জলজ্যান্ত মানুষই৷
— কিন্তু আমি তো এ ব্যাপারে…

কথা শেষ করার প্রয়োজন পড়ল না৷ বিস্ময় আর অসামঞ্জস্যতার হাত থেকে বেরিয়ে ধাতস্থ হতে হতে কানে ভেসে এলো ওই জলজ্যান্ত মানুষেরই গাঢ় স্বরে বলা কিছু কথা,
— ভেরি স্যরি তোমাদের আশার ওপর বাকেটভরা পানি ঢেলে দেয়ায়। কিন্তু রাইটার যে স্টোরি টেলিংয়ের ভার এখনো আমার কাঁধেই ফেলে রেখেছেন; তাই মনিসহ এই হলভর্তি সব মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আমিই দাঁড়িয়ে পড়লাম একা থেকে। কি, স্টোরিটেলার হিসেবে আমাকে চলবে তো?
— একদম না। আমি মোটেই তোর কাছে গল্প শুনব না না না। তুই একদম গল্প জমাতে পারিস না। আমি শুনলে শুধু পুতুলের কাছেই শুনব।

জিদ্দি মেয়ের মতো বায়না ধরল মনি আপু। জবাবে হাসির আকার আরও বিশাল করে আরসালান অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— জিজ্ঞেস করে দেখ তোর পুতুলকে, এসবের এক অংশও সে জানে কিনা! পাগল। মুখ দেখে বুঝতে পারছিস না?

এবারে যেন বিস্মিত হয়ে তাকাল আমার দিকে মনি আপু। মুখে কিছু বলল না, কিন্তু ওর চোখ দেখে বুঝলাম জানতে চাইছে,
— ইপশা, সত্যিই তুই কিচ্ছু জানিস না?

ভ্রু কোঁচকানো তার সেই অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দেখে এত অসহায় লাগল আমার! থাকতে না পেরে করুণ চোখে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম অংকর দিকে। অংকর অবশ্য হেলদোল নেই। তাকালে, ফিরতি ইশারায় আশ্বস্ত করে আরসালানের দিকে ফিরল ও।
আমারও করার কিছু ছিল না। নিজের জীবন নিয়ে অজানা এত থ্রিল, এত সাসপেন্স ক্রিয়েট হয়ে গেল কম সময়ে! বাকি মানুষগুলোর মতো মাইক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তীর্থের কাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিজের জীবনেরই অজানা গল্প জানতে।
আরসালান কিন্তু ততক্ষণে অসংখ্যবার ফিরে ফিরে তাকিয়েছে আমার দিকে। অবিশ্বাস্য লাগলেও মনে হচ্ছিল ইপশার চোখের তৃষ্ণা তার চোখকেও ছুঁয়ে ফেলেছে কোনোভাবে। অথবা বহুকাল ধরে এভাবেই সে অপেক্ষা করছিল চমৎকার সন্ধ্যেটার। কে জানে!

মনি আপু অন্যরকম একটা মেয়ে। ভীষণ ভীষণ ছেলেমানুষ। দিব্যি বুঝতে পারছিলাম জেদ আর অবিশ্বাসের ট্যানট্রাম আরও কিছুটা চালাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে সে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজেই বোঝা যাচ্ছিল। এদিকে অজানাকে জানার আগ্রহ এত প্রবলভাবে পেয়ে বসেছিল! ভীষণভাবে চাইছিলাম এবারে অন্তত কোনো ট্যানট্রাম সে না করুক। তার জিদে ফুলস্টপ লেগে যাক এক্ষুনি। নিশ্চিত আমি একাই শুধু ভাবছিলাম এমনটা, কারণ উপস্থিত সকলের মধ্যে বিস্ময়ের দৃষ্টি ছাড়া অন্যকিছুর উপস্থিতি তো ছিলই না।
রইল বাকি আরসালান? সে তো আমাকে দেখেই কূল পাচ্ছে না, বান্ধবীর দশা বুঝবে কীভাবে!

ইশশ, সেদিন কি পাগলামোটাই না করেছিল মানুষটা। মোটেই বুঝতে পারছিল না, তার অমন অস্থির দৃষ্টি কি বিপাকেই না ফেলে দিচ্ছিল আমাকে একটু একটু করে। আরে বাবা, জীবনে প্রথম অপ্রত্যাশিত একটা পরিবেশে অন্যরকম পরিচয়ে একজন মানুষকে নিজের জন্য আবিষ্কার করা। আবিষ্কারের মূলটা না জেনেই, স্বল্প দূরত্বে থেকে তার বহু পুরনো আবেগের তাড়না অনুভব করা; এযে কত অদ্ভুত আর লজ্জার ঘটনা, তা কি বলে দিতে হয়? নিজের জীবনে না দেখলে তো আমিও বিশ্বাস করতাম না। করতে পারতমই না। অথচ সে… আনবিলিভেবল!
সে যাকগে, আমি তো বরাবরই মুখচোরা। লজ্জাবতী গাছের মতই বিনা কারণে নুয়ে পড়ি। সেখানে এতবড় অস্বাভাবিক কান্ডে আমার দশা স্বাভাবিক। তেমনই স্বাভাবিক তার এসব না জানা। কখনো আদৌ দেখেছে আমাকে সামনে থেকে? হাহ।

কিন্তু আমি যে ভেবেছিলাম মনি আপুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ একলা থেকে আমি খেয়াল করেছি, অন্যকেউ নয়। তা খানিক পর ভুল প্রমাণিত হলো। স্টেজ থেকে কেউ একজন ছোট্ট করে ধমক দিয়ে বলল,
— আহ মনি, আরসালান হয়েছে তো। কথা থেকে কথা বাড়ে। তোরা আবার কথাকে পেঁচাচ্ছিস পাগলের দল। বুঝতে পারছিস না, হলভর্তি মানুষগুলো কি ভয়াবহ দশায় ফেঁসে গেছে। যাকে বলে হিট অব দ্য মোমেন্টে সবাই আটকে গেছে। এই সময়ে এসে সত্যি না বলে ট্যানট্রাম করে কেন আমাদের বিপি বাড়াচ্ছিস ভাই!

বিস্মিত চোখ গুলোর সম্বিত ফিরল ওই ভাইয়ের কথায়। তক্ষুনি সমস্বরে মৌঁমাছির ঝাঁকের মতো সবাই ঘিরে ধরল আরসালানকে, তার সাসপেন্স থ্রিলার স্টোরিবুকের ওপর থেকে পর্দা ওঠাতে।
আরসালানের বোধহয় আবদারটা ভারী পছন্দসই লাগল। আমার দিকে তার স্থির চোখজোড়া হেসে উঠল চঞ্চল ঢেউয়ের মতো। পরক্ষণে মৃদু হেসে ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে বলতে শুরু করল তার বহু আকাঙ্ক্ষিত গল্পকে, যা গল্প হলেও আসলে সত্যি;ইপশা জানত না।

— শুরুতেই ভেরি স্যরি অডিয়েন্স, ইপশা আর আমার অজানা অচেনা গল্পকে বলতে গেলে কিন্তু আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু টেনে বলতে হবে। তোমরা আবার বোরিং ফীল করবে না তো?
— একদম নাহ। বলুন আপনি।
সমস্বরে সবাই দ্বিতীয় দফা চিল্লিয়ে উঠল। জবাবে মাথা নাড়ল আরসালান।
— বেশ। শুরু থেকেই শুরু করছি তবে। হুমহ। ইপশা আসলে আমার কাজিন। আওয়ার ফাদার্স আর আইডেন্টিক্যাল টুইনস। বাট, ফর সাম রিজনস শী ডাজন্ট নো আবাউট দিস রিলেশন।

বলার ফাঁকে আঁড় চোখে আরেকবার চাইল সে আমার দিকে। নতুন সম্পর্কের খোঁজ পেয়ে আমি যে বিস্মিত হয়েছি তা বলা বাহুল্য। সেও বুঝতে পারল ষোলোআনা। মাইকে তার শ্বাস পড়ার শব্দ হলো। মনে হলো কঠিন একটা কথা চেপে গেল এর মাধ্যমে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য অংকর দিকে তাকাতে হলো না৷ তার আগেই ও কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে রাখল,
— লোকের সামনে সব সত্যি তো বলা যায় না। তাই বেচারাকে কিছু রেখে কিছু বলতে হচ্ছে।

আমি মাথা নাড়লাম। ওদিকে আরসালান আবারও বলতে শুরু করেছে,
— বাবার প্ল্যান ছিল অ্যালবার্টাতেই রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে জয়েন করবে, অফারও পেয়েছিল সে। কিন্তু মমের পোস্টিং! ওহ বলা হয়নি, আমার মম ডিফেন্সে ছিল। ড্রিম জব, ছেড়ে আসা পসিবল ছিল না।
অন্যদিকে মম, বাবার ড্রিম উমেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাই…

কথা শেষ হওয়ার আগেই হলরুমে কলরব উঠল “ওহহোওও”।
বাবা মায়ের হ্যাপিলি এভার আফটারের গল্প! বিষয়টা কত গৌরব, কত আনন্দের; স্পষ্ট ফুটে উঠল আরসালানের চোখেমুখে। মাইক হাত মাথা নামিয়ে আলতো করে হাসল সে। আমার এত মায়া হলো! ইশশ, কি লাকি ছেলেটা। সবাই যদি ওনার বাবা-মায়ের মতো হত.. সামনা সামনি দুটো পরিবারের ভিন্ন চিত্র দেখে মনের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

— নিজের সব কাজবাজ ফেলে আমার বউপাগলা বাবা কিছু না ভেবে কিন্তু উঠে গিয়েছিল বস্টনে, মমের ফ্ল্যাটে। মম যদিও তাঁকে অনেক পুশ করেছিল ফিরে এসে ক্যারিয়ারে সিরিয়াস হওয়ার জন্য। বাট বাবা চেয়েও তা কন্টিনিউ করতে পারেনি। আই মাস্ট সে, হি ওয়াজ ম্যাডলি ইন লাভ উইথ মাম। বাবা নাকি বলত, একই ছাদের নীচে থাকলে সারাদিনে একনজর তো কাছে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে, তার উপস্থিতি অনুভব করে প্রাণ জুড়নো যাচ্ছে। দূরে থাকলে শুধু কণ্ঠ শুনে কীভাবে কাটিয়ে দিত! হাহ্ ইনসেইন ম্যান হি ওয়াজ।

দ্বিতীয় দফা হাসির ফাঁকে একবার আমার দিকে নজর বোলাতে ভুলল না আরসালান। যেন বোঝালো, চোখ মেলে একবার দেখতো ইপশা, বাবার মতই প্রেমে ইনসেইন কি লাগে আমাকে?

প্রশ্নটা কল্পনা করে আমার ভারী লজ্জা লাগল। হাতড়ে অংকর ব্লেজারের হাতা খামচে ধরে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম আমি। পাশ থেকে মনি আপু বোধহয় তাকে টোকা দিয়ে বলল,
— ওহহ তাহলে আপনার সামনাসামনি না দেখে, না চিনে এক নারীর প্রেমে আশিক দিওয়ানা হয়ে ওঠা ডিএনএগত! হুমম?

আরসালান দুষ্টুমির ছলে ভ্রু নাচালো একবার। পরক্ষণে পাশ কাটিয়ে বলল,
— মমের থেকে আলাদা না হলেও বাবাকে একটা সার্ভিস কিংবা আউট ইনকামে তো ঢুকতে হতো! সেই সূত্রে হুট করে কোনোপ্রকার আইডিয়া না থাকা সত্বেও বাবা একটা ক্যাফে খুলে বসল আমাদের পুরনো বাড়ির কাছেই। অ্যাজ আই সেইড, হিজ লাক ওয়াজ ফ্যান্টাবিউলাস ফ্রম দ্য বিগিনিং। তাই খুব সহজে স্যাচুরেটেড মার্কেটেও স্টার্টআপটা দাঁড়িয়ে গেল। ডিউরিং দ্যাট পিরিয়ড আমার বেড়ে ওঠা। তখনও কিন্তু আমি জানতাম না, আমার শেকড় এখানে নয়। আই ওয়াজ মেন্ট টু বি বর্ন অ্যান্ড গ্রু আপ ইন বাংলাদেশ৷
— তাহলে পুতুলের খোঁজ পেলি কোথা থেকে তুই?
— হুমম! ইন্টারেস্টিং কোয়শ্চন।

একটু থেমে মাইক হাতে হেঁটে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে এলো আরসালান৷ মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
— পুতুলের খোঁজ পেলাম বাবার ওয়ালেট থেকে। ওর প্রথম জন্মদিনের ভারী মিষ্টি একটা ছবি যত্ন করে বাবা নিজের ওয়ালেটে রেখে দিয়েছিলেন ফ্যামিলি ফটোর সাথে।

হাতের ইশারা করতেই সামনের স্ক্রিনে একদিকে ফ্যামিলি ফটোটা আর তার পাশে আমার ১ বছর বয়সী ছবি ভেসে উঠল। ছবিতে বিছানার ওপর হালকা হলুদ ফ্রক পরা আমি চামচ মুখে নিয়ে বিস্মিত গোল গোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কারুর দিকে;নিশ্চয়ই সেটা ক্যামেরা!

— ওহ সুইটহার্ট!

ছবি দেখে আবেগে আপ্লুত মনি আপু চিৎকার দিয়ে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল দূর থেকে। আরসালান তা দেখে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে স্টেজের একদিকে বসল। নস্টালজিক স্বরে এরপর বলল,
— আমার সেবার ভীষণ জ্বর। একশো তিন অথবা চার। ছোট্ট ছেলে জ্বরের ঘোরে পাগলের মতো মমকে পাশে চাইছি। বাট দ্যাট টাইম মম ওয়াজ আউট অব টাউন। ডিউটি পারপাসে। তখন তো ফোনের এভাইলেবলিটি কম। ওদিকে ওয়েদারও এত খারাপ যে তাকে ল্যান্ডলাইনেও রিচ করা যাচ্ছিল না। শেষে উপায় না পেয়ে আমার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে বাবা ওয়ালেট থেকে ইপশার ছবিটা বের করে আমার সামনে রাখে। বলে, “এই যে ছবির জ্যান্ত পুতুলটাকে দেখছ? তোমার মম তো আসলে এই পুতুলটাকে আনতে গেছে শহরের বাইরে। এত জ্বর গায়ে, কীভাবে খেলবে পুতুল নিয়ে এলে? তারচেয়ে ওষুধ খেয়েছ, এখনের মতো ঘুমো। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেলে সক্কালবেলা দেখবে মমও এসছে, পুতুলও এসছে। ওকে?”

আমার বাবা খুব এলোমেলো মানুষ বুঝলে৷ মম ছাড়া সে খুব অগোছালো কাজকারবার করে ফেলে সবসময়। এই যে অদ্ভুত সময়ে ইপশার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া তার! এটাও কিন্তু অগোছালো কাজের মধ্যেই একটা।
— পাগল এটাকে বলে ডেস্টিনি। অগোছালো কাজ না।

পিঠে চাপড় মেরে তার কোনো এক বন্ধু পাশে বসতে বসতে বলল। শ্রাগ করল আরসালান।

— মেইবি। বাট আনওয়ান্টেড ঐ মোমেন্টটায় ইপশা আমার মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল শক্তপোক্তভাবে। আমি জানতাম না ও কে, কোথা থেকে ওকে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু মনে একটা আশার জন্ম হয়েছিল সত্যিই বোধহয় সকালবেলা মমের কোলে ছবির পুতুলকে দেখতে পারব আমি। জ্বর সেরে গেলেই পারব। আনফরচুনেটলি যদিও পারিনি। কিন্তু আমার জ্বর সেরে গিয়েছিল রাতারাতি।
— ইপশার জাদু!
সমস্বরে পুনরায় কলরব করে উঠল সবাই। আমার মনে হলো তক্ষুনি মাটি ফাঁক হোক আর আমি ঢুকে যাই। কিসব বলছে লোকটা। ইশশ! আমাকে জড়িয়ে এতসব সত্যিই হয়েছে? চোখ বুঁজে লজ্জাটাকে সামলে নিলাম। ওদিকে নস্টালজিক আরসালানের কথা চলছে,

— কাইন্ড অফ। বাট সকালবেলা ইপশাকে না দেখতে পেয়ে আমার কিন্তু আবারও জ্বর এসেছিল। সে জ্বর ছেড়েছে অনেক ঝামেলার পর। যে বাবা প্রথম ইপশার জেদ মাথায় তুলে দিয়েছিল, সামলাতে না পেরে তাকেই শেষে খেটেখুটে টেলিগ্রাম করে দেশ থেকে ইপশার ছোটবেলাকার ভিডিও সিডি আনাতে হয় শুধু আমার জ্বর সারাতেই।
— তারপর? প্রেমের শুরু?
— প্রেম নয় অবসেশান।

তীব্র অধিকারবোধ কণ্ঠে ফুটিয়ে অদ্ভুত গভীর স্বরে কথাটা বলে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ বাদে তাকাল আরসালান আমার দিকে। আমি যদিও তার দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু অংক পাশে থেকে থাম্বস আপ দেখালো এক্সাইটেড হয়ে।

— এরপর বলতে গেলে আমার গোটা বেড়ে ওঠার সঙ্গী হয়ে যায় ইপশা একটু একটু করে। আর ওকে সঙ্গী বানাতে হেল্প করে বাবা, দাদু অ্যান্ড চাচু;ইপশার বাবা। যেমন, টেকনোলজির আগে ওর ভিডিও ক্লিপস, ওর ফটোগ্র্যাফস এসব টেলিগ্রাম করত ওরা দেশ থেকে। জানাত আমাকে ইপশার বেড়ে ওঠার হিসেব। অ্যান্ড টেকনোলজির ডেভলপমেন্টের পরে রোজকার আপডেট পাঠানো জিনি হয়ে যায় দ্যাট হ্যান্ডসাম বয় আউট দ্যার। অংক। ইপশার ছোটভাই।

আরসালান পয়েন্ট করে দেখাতেই অংক সবাইকে হাত নেড়ে হ্যালো বলল। একজন জানতে চাইল,
— অংক তোকে চিনল কীভাবে?
— ইপশা বাদে সবাই চিনত তো আমাকে ওদের ফ্যামিলির। প্রথম পরিচয় বাবার ছেলে হিসেবে, আর দ্বিতীয়টা ওর উডবি।
ফান ফ্যাক্ট ইজ, আর্লি এইটিনেই কিন্তু আমি থাকতে না পেরে নিজেই নিজের বিয়ের প্রস্তাব রাখি ফ্যামিলির সামনে। আই হ্যাভ বিন স্ট্রেইটফরওয়ার্ড সিন্স চাইল্ডহুড। সার্টেইন টাইমের পর বুঝতে বাকি ছিল না আই ক্যান্ট লিভ উইদআউট দ্যাট গার্ল। এত দূরত্বের বাহানা, এত অপেক্ষা আমার পক্ষে টলারেট করা সম্ভব ছিল না।
— আরসালান ইউসুফ তো তার বাবারই ছেলে। কাজে কর্মে চিন্তায় বাবার ছাপ থাকবে স্বাভাবিক!

মনি আপু মৃদু ধাক্কা দিল ওকে। আরসালান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালো সহাস্যে। পাগলাটে প্রেমিকের মতো নাছোড় স্বরে বলল,
— ওকে পার্মানেন্টলি নিজের কাছে নিয়ে আসাটা আমার জন্য ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দো সেটা পারিনি সে-সময়। চাচি রাজি হয়নি বিয়েতে। অ্যান্ড তার রাজি না হওয়া কিন্তু আজ পর্যন্ত চলমান। অ্যাপ্রোচ করার সময়টাতে আমাদের বাগদান হয়নি শুধু ওই একজন মানুষ চায়নি বলেই।

— তোদের কি বিয়ের কথাবার্তা এগিয়েছিল।

আরসালানের বন্ধুরা জানতে চাইল।

— হ্যাঁ। আমাদের দু পরিবারের সাথে, ইপশার মমের সাইডের সাথেও কথা হয়। তাঁরা সবাই রাজি ছিলেন আমাদের বিয়েতে, ইভেন আমার ভীনদেশী মমও। শুধু রাজি ছিল না চাচি। শী হ্যাড হার রিজন। কিন্তু চাচিকে রাজি করাতে গিয়েই আমি প্রথমবারের মতো দেশে, আমার পৈতৃক বাড়িতে পা রাখি। অংকর সাথে দেখাটাও হয় তখন।

— ভাইয়া এর পরেরটুকু আমি বলি?

হঠাৎ হাত তুলে আবদারের সুরে বলে ওঠে অংক। আরসালান একটু থেমে সহাস্যে তাকায় ওর দিকে। কেন যে মেনে যায় সাথেসাথে! উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্রয়ের ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ে। অংক আমার হাত ধরে তৎক্ষনাৎ ছুটে যায় স্টেজের কাছটায় চঞ্চল ঘুড়ির মতো। লাজলজ্জা যেন আমারও উড়ে যায় স্বল্প ঐ মুহুর্তটুকুর জন্য। একরুম ভর্তি অচেনা মানুষকে মুছে ফেলে আমি টের পাই, এইমুহুর্তে অন্য সবাইকে আড়াল করে এই একটা মানুষ আমার দৃষ্টিজুড়ে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে নাকি সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে ঠিক করে দেয়া ইপশার জীবনের মুখ্য চরিত্র। এই মুলুকে ছিল তবে তার বাস! ভাগ্যের সুতো একই সুঁচে গেঁথে যার সাথে আমায় মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল এই প্রথম, এত অদ্ভুতভাবে।

★ এটা অনেক বড় একটা পর্ব ছিল। জানি না কেন একসাথে পোস্ট করতে গিয়ে ফেইলড দেখাচ্ছিল। পরে তাই কেটে হাফ করে পোস্ট করলাম। আরেকটা স্কেজউল করে দিয়েছি। কাল রাতে পোস্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

লেখা: সিনিন তাসনিম সারা’র গল্পসমূহ

ব্রহ্মকমল পর্ব-০৩

0

#ব্রহ্মকমল

________________

এতটুকু জীবনে নিজের পরিবার থেকে এত জঘন্য একটা অভিজ্ঞতা হওয়ার পর সম্পর্ক, বিয়ে, ভালোবাসা এসবের ওপর আমার আগ্রহ পুরোপুরি হারিয়ে গেল। একটা লম্বা সময়ে ওসব নিয়ে ভাবা হয়নি বলে কেউ আসেওনি জীবনে। যখন আসার সময় হলো, তখন চোখের সামনে সুস্থ স্বাভাবিক একটা সম্পর্ককে ইলিউশন হতে দেখা অপ্রত্যাশিত ছিল আমার জন্য।
কাউকে বলিনি কখনো, বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পরপর দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্নে দুটো হাত দেখতাম। দেখতাম একে অপরের আঙুল ছোঁয়ার বাহানায় কী তৃষার্তের মতো তারা ছুটছে তো ছুটছে সময়ের সমস্ত খেয়াল ভুলে। জানতে পারছে না তাদের সাথে পাল্টে যাচ্ছে প্রকৃতি। বুঝতে পারছে না কি করে একজোড়া হাতকে ছুঁয়ে যাচ্ছে অবারিত ঝড়-জলের ঝাপ্টা কিংবা ঋতুর পরিবর্তন। শুধু দেখছে অসহায় দুটো হাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দেয়ালসম এক বাঁধা৷ যে বাঁধার সামনে হাত দুটোর মালিকেরা সম্পূর্ণ নিরুপায়।

শুরু শুরুতে স্বপ্নটাকে আমি তেমন পাত্তা দিতাম না। মনে হতো বাবা-মায়ের এসব ছাড়াছাড়ি নিয়ে বেশি ভাবছি বলেই হয়ত..
কিন্তু একাধারে টানা স্বপ্নটা দেখে যাওয়ার পর কিছু একটা আমায় একটু একটু করে খোঁচাতে লাগল। মনে হলো কোনোভাবে নিজের ভবিষ্যৎ কি দেখতে পারছি? আদৌ একটা মানুষের পক্ষে নিজের ভবিষ্যৎ দেখা সম্ভব! তাও আবার স্বপ্নে। যতবার এমন সন্দেহ হতো, ততবারই তাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য অস্থির হয়ে যেত ইপশার অন্য আরেক সত্ত্বা। পুরোটা ঝেড়ে ফেলতে পারতাম না যদিও।
কারণ স্বপ্নে মেয়ের হাতটা দেখে বারবার মনে হতো ওটা আমি; দেয়ালের এপারে বহুকাল অপেক্ষা করছি কারোর জন্য যাকে চিনি না, দেখিনি কখনো। যার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ধূসর স্বপ্নে আবছা হয়ে চোখে লাগত শুধু বুড়ো আঙুলের কাছে লম্বা করে কাটা দাগ। এর বাইরে কিচ্ছু না, কিচ্ছু না।

স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতাম বারবার। ভাবতে বাধ্য হতাম। কারণ ওর কারণেই কতরাত ঘুম হতো না ঠিক করে। প্রায় সময়ই মাঝরাতে জ্বরগ্রস্তের মতো ঝাঁকি দিয়ে ঘুম ভেঙে যেত আমার। কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে টের পেতাম ঘুমের ঘোরে কোন গোপন কান্নায় ভেসে মাথার বালিশটা ভিজে গেছে অনেকটা। বুকের ভেতর এত এত আশংকার পূবালী হাওয়া বইত! দু চোখের পাতা আর এক করা হতো না।
নিজেকে নিয়ে ভাবনার সময় আমার ছিল শুধু এতটুকু।

কল্পনা তো কত রকমের হয় মানুষের। তাবলে মিছে স্বপ্নের পৃথিবী থেকে এভাবে না বলে না কয়ে উঠে আসতে পারে কেউ? এ কেমন কো-ইন্সিডেন্স! নাকি একে বলব আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ম্যাজিক! অন্যসব দুর্ঘটনার ভীড়ে যে ম্যাজিককে আমি একদম প্রত্যাশা করিনি; কোনোদিন না।

ঘটনা সে বছরেরই শেষের দিকে। অংকর ইন্টারের পরপর দাদুর দেয়া সম্পত্তিগুলোর বিরাট অংশ বিক্রি করে আমরা ভাইবোন পাড়ি জমালাম অ্যাডমান্টন, অ্যালবার্টা;দু’জনের থেমে থাকা পড়াশোনাগুলো আবার শুরু করতে।

যদিও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ততদিনে চলে গিয়েছে পুরোটাই৷ অংকই জোর করে ফর্ম ফিলাপসহ যাবতীয় কাজ ঠেলেঠুলে করাল আমাকে।

রেজাল্ট ভালো ছিল। স্টাডি গ্যাপের কজ হিসেবে কিছু লিগ্যাল ডকুমেন্টস সাবমিট করতে গিয়ে আমার সময় লেগে গেল কিছুটা। অংকর অবশ্য ততদিনে ভর্তি ডান। ক্লাসও শুরু হবে হবে করছে। আমার কাগজপত্র সাবমিশন হয়ে গেলে দু’জন একসাথে গুছিয়ে উঠে যাব।
সাইন্স ফ্যাকাল্টির সাবজেক্টগুলোতে প্রফেসরদের পেছনে ধর্না দিয়ে থাকতে হয় অনেক। মেডিক্যাল মিস হয়েছে বলে আমার ইচ্ছে ছিল ফার্মেসি কিংবা অ্যাপ্লাইড ক্যামেস্ট্রিতে যাওয়ার। কিন্তু ইচ্ছের নাকের ডগা দিয়ে শেষে ভর্তি হতে হলো বায়োলজিক্যাল সাইন্সেস’এ। অন্যদিকে অংক ওর নামের মতই ম্যাথামেটিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন শহরে নতুন রকমের পড়াশোনা। যাওয়ার আগে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম আন্ডারগ্র্যাডে আমাদের ডিপার্টমেন্টমেট কতজন আছে বাংলাদেশী৷ অনলাইনে খোঁজ করে বিশেষ সুবিধে হলো না। যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অথৈ সাগরে ভাসতে যাচ্ছি বলেই মনে হচ্ছিল আমার। যদিও ভয়ডর কিছু টের পাচ্ছিলাম না, শুধু বুক ভরে ভেসে বেড়াচ্ছিল অচেনা অজানা দীর্ঘশ্বাসের কুণ্ডলী। যেগুলো অদৃশ্যভাবে আঁকড়ে ধরে আমার সাথে সাথেই চলছিল অজানা যাত্রাপথে।

চলে আসার দিন এয়ারপোর্টে আমাদের ছাড়তে এসেছিল অনেকে। দাদি, ফুপু, চাচা; নানিরাও এসেছিল অবশ্য। আর এসেছিল মা।
মা কিন্তু পুরোটা সময় আমার সাথে কোনো কথা বলেনি, শুধু অংকর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একাধারে বোঝানোর চেষ্টা করেছে,

“মায়ের ওপর অভিমান করে যেতে হয় না এভাবে। মা, সেতো জন্ম দিয়েছে। ভুলভ্রান্তি কিছু হয়েই গেছে না-হয়। তাবলে এভাবে ছেড়ে যাবে চিরকালের মতো রাগ করে?”

অংক মায়ের সিনক্রিয়েটে একদম পার্টিসিপেট করেনি। পুরোটা সময় মুখ অন্ধকার করে মাথা নামিয়ে বসেছিল।
আমিও আগ বাড়িয়ে বলিনি কিছু। আমার বোধহয় একটু কান্না করা উচিৎ ছিল। এতবড় অপমানের সাক্ষী হয়েও প্রাণহীন পুতুলের মতো কীভাবে যে ছিলাম এমন প্রতিক্রিয়াহীন!সত্যিই৷

অবশ্য প্রতিক্রিয়াহীন কথাটা পুরোপুরি বোধহয় সঠিক নয়। আমি কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম কাঁদতে; পারিনি। শুধু বুকের ভেতরটা অচেনা সুরে ঢিপঢিপ করছিল। বিশাল একটা পাথরসাদৃশ্য কিছু আমার বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা মাংসপিণ্ডে একটু একটু করে চাপ দিচ্ছে টের পাচ্ছিলাম, মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না কাউকে।
তবে অন্যকেউ আমার দোলাচল অবস্থা বুঝতে না পারলেও দাদি আর নানি বুঝতে পেরেছিল কিছুটা। খুব অদ্ভুতভাবে মা যতক্ষণ অংককে অনুনয় বিনয় করে থেকে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি করছিল, ততক্ষণ এই দুটো মানুষ দুদিক থেকে আমার হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। কেউ কিচ্ছু বলেনি, মুখ ফুটে একটা সান্ত্বনা বাক্যও নয়। তবু তাঁদের উষ্ণ স্পর্শে ইপশা বুঝতে পারছিল, বাবা মা নাহোক, কিন্তু অভিভাবক হয়ে তার পাশেও আছে কেউ, তাকে জড়িয়ে সবসময়।

মিট অ্যান্ড গ্রিটের সময়টা অথোরিটি থেকে বেঁধে দেয়া ছিল। এর বাইরে এক মিনিট ব্যয় করার সুযোগ নেই। মা ততক্ষণে অংককে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত। অংকও যে মায়ের কথায় একদম কান দেবে না, সেটা প্রমাণ করতে সময়ের আগে লাগেজ টেনে আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকাল। আমি বিশেষ তাড়াহুড়ো করলাম না। স্বাভাবিকভাবে দাদি আর নানির কাছে বিদায় নিয়ে ওর সাথে পা বাড়ালাম। যেতে যেতে অনেক উপদেশের সাথে সবার আড়ালে হঠাৎ এক টুকরো কাগজ গুঁজে দিল দাদি আমার মুঠোর ভেতর। অবাক হয়ে তাকালে কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বলল,
— খুব বিপদে পড়লে কাগজের লেখা ঠিকানায় যোগাযোগ করিস। মনে রাখিস, পৃথিবীর সবাই তোকে ফিরিয়ে দিতে পারলেও এই ঠিকানা থেকে কখনো ফিরিয়ে দেবে না।

পাল্টা প্রশ্নের জন্য ঠোঁট নড়ে উঠলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে দাদিই আবার বলল,
— কিছু জানতে চাস না বুবু। বলতে পারব না। শুধু তোরা ভালো থাকিস, পুরনো সবকিছু ভুলে আনন্দে থাকিস কেমন?

উত্তরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানানো ছাড়া কিছু করার ছিল না। মনের ভেতর নতুন প্রশ্ন ইতোমধ্যে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু করেছিল। বৃথা চেষ্টায় তাকে থামাইনি আর। তাণ্ডব যা খেলার খেলে নিক বরং।
সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ে উত্তর অপেক্ষা করছে তো আমাদের জন্য। পৌঁছুতে যতটা দেরি।
________________________

অ্যালবার্টাতে আসার আগেও যে অসম্ভব ভাবনাগুলো ভয় হয়ে আমার বুকে চেপে শ্বাস বন্ধ করতে চাইছিল, সেসব হালকা হয়ে গেল কয়েকমাস কাটানোর পরপরই দেশীয়দের সাহচর্যে। রক্তের না হয়েও একাকী এই ভাইবোন দুটোকে সবার আগে যেভাবে আপন করে নিলো ওখানের BSACU- Bangladesh Student Association of Canada at the University of Alberta তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আসলে শেকড় ছাড়ার পরেই বোধহয় বোঝা যায় শেকড়ের প্রতি কত টান।
এবং কথাটা আরও বিশেষভাবে বুঝিয়ে দিতেই হয়তো অ্যাডমান্টনে পা রাখার পর থেকে অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারদের অতিথিয়ানা হলো এক্কেবারে বলবার মতো। গুছিয়ে বলতে গেলে তো লিস্ট শেষ হওয়ার নয়।
একদম আমাদের থাকার ব্যবস্থা পছন্দ না হওয়ায় কয়েকজন দলবেঁধে রি- অ্যাকোমোডেশনের সুবিধে করে দেয়া থেকে শুরু করে, ওখানের জীবনাচার, স্টুডেন্ট হেল্পডেস্কসহ সমস্ত রকমের ভালো-মন্দের খোঁজখবর এত দায়িত্ব নিয়ে ওরা দেখতে শুরু করল! আমি আর অংক অবাক হয়ে গেলাম এই ভেবে, পর হয়েও কেউ কীভাবে এতটা করতে পারে কারোর জন্য৷

শুধু ওরাই নয়, এই সাহায্যের জন্য আসলে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে হতো আমার প্রফেসরকে। তিনি নিজে যেভাবে হাতে ধরে এই মানুষগুলোর কাছে আমাদের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন!
তিনি না থাকলে মাঝদরিয়ায় পড়ে ভয়াবহ দশা হতো আমার, অংকর। নিশ্চিত।
_____________

বিদায়ের সময় দাদি বলেছিল নতুন জীবনে পুরনোর ছাপ রাখিস না ইপশা। জায়গা ছাড়লে সব স্মৃতি ফেলে রেখেই ছাড়তে হয়। এতে স্বস্তি মেলে।
আমি কতটা ছাড়তে পারলাম তা জানি না; তবে নতুন শহর, সদ্য হাতে পাওয়া পড়াশোনার চাপ আর সেসব নিয়ে নতুনভাবে গুছিয়ে নেয়ার ঝক্কি সামলাতে সামলাতে দীর্ঘদিন ওসব আর মনে পড়ল না৷ খারাপ লাগার মধ্যে একটা প্রশ্নই শুধু ছিল,
“এই যে জন্মস্থান ছেড়ে একা এতটুকু বয়সে কোন মুলুকে এসে বসে আছি দু’জন। শখ করে কিংবা মন খারাপেও আমাদের বিশেষভাবে মনে করার কেউ নেই। এতটা একা মানুষ সত্যিই হতে পারে কখনো?”

ফ্রেন্ডদের বাসায় কথা বলতে দেখলে মাঝেমধ্যেই পুরনো কষ্ট মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। সেসময়গুলোতে অংককে ডেকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। তখন একদম মনে থাকত না আমি ওর বড়বোন। উল্টো, ওকে বড়ভাই অবলম্বন করে নিজের সব যন্ত্রণা ভুলতে চাইতাম যেন৷ আফসোস হতো এই ভেবে, এতটাবছর কেন বাবা-মায়ের ওমে থেকে অভ্যেস খারাপ করে ফেললাম! ওরা ঝেড়ে ফেললেও ভেতরের ইপশার যে আজও ওদেরই চাই;আগের মত করে। এটা ওরা কখনো জানবে?

অংক বুঝত আমার মনের ভেতরের সবটা। শুরু শুরুতে রাগলেও একটা সময় পর আর রাগত না ও। চুপচাপ শুধু বসে থাকত ক্যাম্পাসের এককোণে আমাকে সঙ্গ দিতে। কে জানে ওর মনের ভেতরটা কেমন করত তখন। ও তো প্রকাশ করত না কিছুই। আচ্ছা ওরও কি আমার মতই মন কাঁদত?

চলিবে?

ব্রহ্মকমল পর্ব-০২

0

#ব্রহ্মকমল

_____________

কাস্টডি নিয়ে প্রথম দু বছর দু’জন খুব ছোটাছুটি করার চেষ্টা করলেও আমাদের ভাইবোনের রাগারাগির কারণে তা বন্ধ হলো। পারিবারিক বৈঠকে মৌখিক একটা সমাধান এলো,
আমি যেহেতু সাবালিকা হয়ে গিয়েছি তাই আমি চাইলে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে জীবন গুছিয়ে নিতে পারি। সে পড়াশোনা করে হোক কিংবা বিয়ে! খরচাপাতি যা প্রয়োজন হবে সবটা বাবা-মা’ই দেবে। ওদের তো আর কম নেই। এতদিন সংসারে যা করেছিল তা তো আমাদের দু ভাইবোনের জন্যই। যতই আলাদা হোক আমাদের প্রাপ্য ওরা বুঝিয়ে দেবে। শুনে আমার ভারী হাসি পেল। আমি তো মানুষদুটোকে জীবনে চেয়েছিলাম, আর ওরা পড়েছে টাকা নিয়ে!

তবে আমাকে এত সহজে ছাড়লেও অংককে নিয়ে টানাটানি থামল না ওদের। শেষ বৈঠকেও নানা প্রলোভন আর যুক্তিতর্ক দিয়ে দুজন দুদিক থেকে বোঝাতে চাইল, অংক আসলে একজন গার্ডিয়ানের সাথেই বেশি ভালো থাকবে। ও যেহেতু ছেলে মানুষ, পড়ে সরকারি কলেজে। বাঁধাধরা নিয়মের বালাই তো ওখানে নেই। পাছে পারিবারিক উত্থান-পতনের খারাপ প্রভাব না পড়ে ওর ওপর। তারচেয়ে গার্ডিয়ানের সাথে থাকবে, নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সেই তো ভালো। বাবা-মায়ের নির্মল স্নেহার্দ্র যুক্তি। কিন্তু অংক শুনে ভীষণ ক্ষেপে গেল। দুই পরিবারের অত মুরুব্বিদের সামনে ফুঁসে উঠে চোখ লাল করে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
— খুব ছোটবেলায় যখন আমাকে ভালো স্কুলের দোহাই দিয়ে ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়েছিলে তোমরা, তখন মনে পড়েনি আমি নষ্ট হয়ে যেতে পারি? লিগ্যাল গার্ডিয়ান তখন কি ফুপু ছিল? তোমরা আদৌ ভেবে দেখেছিলে নিজের পরিবার ছাড়া আট-ন বছর বয়সী একটা ছেলে কেমন থাকতে পারে।

এতটুকুন ছেলের মুখে এতবড় কথা অবিশ্বাস্য ছিল। বাবা-মাও ভীষণ অবাক হলো। সাথে অবাক হলো উপস্থিত পরিবারের লোকজন। দাদা-নানা তো ক্ষেপে একবার ধমকও দিলো ওকে। ফুপু পাশে থেকে হাত ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করল। তবে ওর গনগনে রাগ কমল না কিছুতেই। হাত ছাড়িয়ে ও সরাসরি আমার কাছে এসে টেনে ওঠালো আমাকে। এতক্ষণ যে ধমকটা বাবাকে দিচ্ছিল, ঐ একই সুরে চোখ লাল করে আমাকে বলল,

— শুনেছিস? একটু হলেও কি বুঝেছিস কতবড় বোকার স্বর্গে বাস করছিলি এতদিন। এই যে এই স্বার্থপর মানুষদুটো, এরা একবারও তোকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছে? চায়নি। আমাকে নিয়ে যে টানাটানি করছে, এর পেছনেও কোনো স্বার্থ আছে আমি জানি।
— অংক তুই ঠান্ডা হ। বাবা-মাকে নিয়ে কেউ এভাবে বলে?

পাশে থেকে বলল কে যেন। অংক তার দিকে ঘুরে শুধু এতটুকু উত্তর দিল,
— আমি বলি। এখন নিশ্চয়ই আমাকে বেয়াদব বলবেন?

আমি অংকের হাতে চাপ দিয়ে থামালাম। তারপর নরম সুরে বোঝাবার চেষ্টা করলাম,
— তুই ভুল বুঝছিস৷ এখানে তো শুধু..
— ভুল তুই বুঝেছিলি এতদিন৷ বোকার মতো অন্ধ হয়ে ছিলি। আর অন্ধ হয়ে থাকতে থাকতে তোর চোখদুটো এমনভাবে নাই হয়ে গেছে, এখন ঝকঝকে আলোতেও দেখতে পাচ্ছিস না কিছু।

বলার একপর্যায়ে ঝরঝর করে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল ওর। তবু রাগ আর বিষণ্নতার অনুভূতিটাকে সে কথায় ফুটতে দিল না৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বর একটু নরম করে বলল,
— তুই প্রমিস কর এদের একজনের থেকে এক সিকিপয়সাও নিবি না। আজকের পর থেকে আমরা দু’জন অনাথ। পৃথিবীতে বাবামাহীন ছেলেমেয়েরা যেভাবে সার্ভাইব করে আজ থেকে আমরা দু’জনও করব। আর এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

অংক ঠিকই বলত, আমি বোকা মেয়ে। পরগাছার মতো এতগুলো বছর কাটিয়ে দেবার পর এখন এসে স্বাবলম্বী হতে হবে, এমনকি নিজের সাথে ভাইয়ের দায়িত্বও বুঝে নিতে হবে এই ভয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম ভেতরে ভেতরে। মনে হলো শেষমুহুর্তে বাবা অথবা মায়ের মধ্যে একজন পিছু ডেকে ফেললেই হয়তো গলে যেতাম আমি। তখন অংকও হারিয়ে যেত জীবন থেকে। তাই তো সৃষ্টিকর্তার প্ল্যান অন্যরকম ছিল।
শেষ মুহুর্তে অসহায় চাহনিতে তাকালেও বাবা-মা আমার নাম ধরে একটাবারও ডাকল না। বরং ওদের দিকে শেষ আশা নিয়ে যখন তাকালাম, ফিরতি নজরে মা’র চোখভরা বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা আমাকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিল। বিস্ময়টুকু প্রকাশ করতে ঠোঁট নড়ে উঠল একবার, কিন্তু উথলে ওঠা কান্না ছাপিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম না।
বোধহয় তখনই পরগাছা ইপশার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল। বড্ড আশায় বাড়িয়ে রাখা ভাইয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে দৃঢ় গলায় বললাম,
— প্রমিস।

সেদিনের পর থেকে গোটা পরিবারের সামনে স্বঘোষিতভাবে আমরা অনাথ হয়ে গেলাম। জানি সমাজ, ধর্ম কোনোটাই সন্তানের চোখে বাবা-মায়ের প্রতি এত বিদ্বেষ সমর্থন করে না। কিন্তু আমরা ঐ মুহুর্তে ও দুটোর কোনোটাকেই মানার পরিস্থিতিতে ছিলাম না৷ সবাই বলেছিল,
“জেদাজেদি কয়েকদিনের। ইট-পাথরের শহরে একসন্ধ্যা যখন না খেয়ে থাকবে, তখন বেয়াদবি ছুটে যাবে দুটোর;ঠিক চোখ মুছতে মুছতে বাপ-মায়ের পায়ে পড়ে আশ্রয় নেবে। আমরাও দেখব তো জেদ কতদিনের থাকে।”

বেরিয়ে আসার সময় কথাগুলো শুনলাম দু’ভাইবোন চুপচাপ, কোনো উত্তর দিলাম না। মনে মনে জানতাম জেদ আমাদের মধ্যে বসে গিয়েছে। আর যার কাছেই সাহায্য নিই, ওই স্বার্থপর মানুষদুটোর পায়ে পড়ে অন্তত ভিক্ষা কখনো চাইব না।

শুরু শুরুতে রাগ-জেদের তেজ থাকে অপরিসীম, কিন্তু সময় গেলে তা ফুরিয়েও যায় স্বাভাবিক নিয়মে। আমাদের কতটা কি হলো বিষয়টা ধাঁধার মতো।
তবে অস্বীকার করার উপায় নেই শুরুর দিকে টাকা-পয়সাবিহীন, শক্তপোক্ত ছাদবিহীন শুধু বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে যাযাবরের মতো ঘুরেফিরে বেড়াতে ভীষণ কষ্ট হলো। অন্যের আশ্রয়ে থাকার ফোঁড় যে কত তা অল্প কয়েকদিনে বুঝতে সময় লাগল না আমাদের। তবু মাথানত করে হাত পাততে ছেড়ে আসা পথ মাড়ালাম না দুজনের কেউই। অল্পদিনে অনাহারে, অনাদরে আমাদের শরীর ভেঙে এলো। চেহারার দিকে তাকাতেও ভয় হতো। প্রকাশ করতাম না মুখে, প্রায়ই হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হতো, কিন্তু শেষ মুহুর্তে অংকর ঋজু ব্যক্তিত্বের দিকে তাকিয়ে সাহস ফিরে আসত। ভেঙে পড়তে পড়তেও সামলে নিতাম নিজেকে।
তবে এভাবেওবা কতদিন। জীবন তো আর বাংলা সিনেমা নয় যে সব ছেড়েছুড়ে বস্তিতে গিয়ে উঠব আর বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যাবে! উল্টো স্বাভাবিক নিয়মে কাছের বন্ধু কিংবা অনাত্মীয়-আত্মীয় যাঁদের বাড়িতে আমরা টেনিস বলের মতো ঘোরাফেরা করলাম, তারা এতটুকুন সময়ে আমাদের ওপর বেশ নাখোশ হয়ে উঠে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। চেয়েও “আশ্রয়” শব্দের ছায়াতলে থাকতে পারলাম না আর। চেষ্টা করেছিলাম টিউশন কিংবা অন্যকিছু করার। কিন্তু যে অল্প টাকা আসত, তা দিয়ে অতবড় শহরে আমাদের দুজনের হতো না। হেল্প নিতেই হতো জানতাম, তবু মাথা নত করার প্রশ্ন আসলে রক্ত গরম হয়ে যেত।
অংক এসবে বিশ্বাস না করলেও আমি টের পাচ্ছিলাম আমার মন চাইছে একটা মিরাকল। ইতোমধ্যে এত কষ্টে জর্জরিত আমাদের অপরিপক্ব মনদুটো, তারমধ্যে অভাবের তাড়না। এমন দিন কাটানোর প্রত্যাশা তো কখনো দুঃস্বপ্নেও করিনি তাই না?

মিরাকল জিনিসটা অন্যতম এক জটিল ধাঁধার নাম। আসলে সবই সৃষ্টিকর্তার খেলার মতো। তিনি চাইলে কাউকে যেমন ধ্বংস করে দিতে পারেন চোখের পলকে, তেমনই চাইলেই হাত ধরে সাহায্যও করতে পারেন অনেক কঠিন কঠিন সময়ে অনায়াসে। আমরা তো কত অবাধ্যতা করেছিলাম, তবু তিনি আমাদের প্রত্যেকটা খারাপ সময়ে দু-হাত ভরে সাহায্য করেছেন। যেমন সেবার করলেন।

সবে তখন টিউশন পেয়েছি একটা। স্টুডেন্ট যে গার্লস হোস্টেলে উঠেছি তার মালিকের ভাগ্নে। আমার আগে অনেক টিচার রাখা হলেও বাচ্চাটা দুষ্টু বলে কেউ টিকত না। আমি তো চুপচাপ ছিলাম, এছাড়াও আমার টাকা জমেছিল অনেক, তাই ওসব বিষয়ে কান দেয়ার সুযোগই ছিল না। যাহোক আমার সেসময় পড়াশোনা কিছু ছিল না। জীবন এলোমেলো হয়েছে বলে ওসব দিকে গুরুত্ব দেবার কথা মনেও নেই। ডেইট পার হয়েছে ন্যাশনালেরও ফর্ম তোলা হয়নি। দিন রাতের দৈর্ঘ্য এত বড় ছিল, কাটতেই চাইত না। তাই স্টুডেন্ট যত দুষ্টুই হোক ওকে সময় নিয়ে পড়াতে আমার ধৈর্য্যে কখনো টান লাগত না৷ তবে ওরা টাকা অনেক কম দিত। যা দিত তাতে একবেলার খাবারের খরচ উঠে যেত। অন্যকিছু দূরের ব্যাপার। টেনেটুনে এভাবেই চলছিলাম কোনোরকমে, সেসব দিনে একদিন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই কলেজ ড্রেসে অংকের আগমন। বিভ্রান্ত দৃষ্টি, চুল উসকোখুসকো, মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ভয়ের কারণ, ও যে তখন আগের মতো স্থির নেই আর। সবসময় মাথা গরম থাকত আর কেউ কিছু বললে ফুঁসে উঠে মারপিট। ভেবেছিলাম সেদিনও বোধহয় এমন কিছুই করেছে। নইলে ওর চেহারার এই দশা কেন!
কোনোরকমে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ছুটে গিয়ে ভীতু সন্ত্রস্ত গলায় ওর কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলাম,
— তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন বাবু? কোনো সমস্যা হয়েছে আবার?
— বাবা বিয়ে করেছে আপু।

একবাক্যে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে টলমল চোখে চাইল আমার দিকে। যতটা না ওর চোখভরা অসহায়ত্ব দেখলাম, তারচাইতে কয়েকগুণ উপলব্ধি করলাম, এই প্রথম ওর গলায় হেরে যাওয়ার ছাপ স্পষ্ট। এতদিন বাবা আলাদা হয়েছে, সন্তানদের নিয়ে স্বার্থপরতা করেছে সব যে ছেলেটা কষ্টেসৃষ্টে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে; সেই ছেলেটাই বাবা অন্যকারোর হয়ে গিয়েছে এতবড় সংবাদটা আর কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ঠিকঠাক বুঝলাম৷ আমাকে কিছু বলতে হলো না। মাথা নামিয়ে হাত মুঠ করে ভাঙা ভাঙা গলায় ও ই আবারও বলল,
— হাউ ক্যুড হি আপু? হাউ ক্যুড!

আমি বরাবরের মতো নিশ্চুপ ভূমিকায়। উত্তর দিতে পারলাম না।
অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়, আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। যেন এমনটাই হতো জেনে ছোট্ট শ্বাস ফেলে ওর কাঁধে হাত রাখলাম। খানিক পর জিজ্ঞেস করলাম,
— তুই কীভাবে জানলি?
— সিকান্দার এসেছিল। দাদি ওকে পাঠিয়েছিল আমার কলেজে। দাদু নাকি এই নিউজ শুনে অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। মেডিকেলে ভর্তি। তোকে আর আমাকে দেখতে চায়।
— কোন মেডিকেল? চল এ পথেই যাই।
— তুই যাবি?

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল অংক। আমি হেসে ওর গালে হাত রাখলাম।
— চল।

বলেছিলাম না একটা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করছিল আমার ভেতরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ভীতু ইপশা সত্বা? ঐ সত্বার তাড়নায় মেডিকেলে যাওয়া কিন্তু আমাদের জীবনে অন্যতম মোড় ঘোরানোর একটা প্রথম পদক্ষেপ ছিল। ভাগ্যিস শুনেছিলাম মনের কথা। তাই স্বল্প দিনের ভোগান্তির জীবন থেকে মুক্তি মিলেছিল দু ভাইবোনের মেডিকেলে যাওয়ার পর থেকে।

_______________

বাবা দ্বিতীয় বউ একদম আমার বয়সী। ডিভোর্সের কারণের এক অংশও যে ইপশা বিন্দুমাত্র শুনতে আগ্রহী ছিল না সেই ইপশাই বাবার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা আগাগোড়া মন দিয়ে শুনল।
দুঃখ হলো না আমার একফোঁটা। শুধু মায়ের প্রতি যে বিদ্বেষ জন্মেছিল সেদিনের ঘৃণার দৃষ্টি দেখে, সেটা কিছুটা হালকা হলো। ঐযে সাদা পাতায় পেন্সিলের মোটা দাগ দিয়ে আবার ইরেজার দিয়ে মেশালে যেমন হালকা হয়ে যায় না? অমনই কিছুটা। তা অবশ্য বললাম না কাউকে। অতটুকু সময়ে ফেস করা দুর্ঘটনাগুলো যেভাবে ট্রাস্ট ইস্যু তৈরি করে দিয়েছিল আমার মনে, মাকেও বা শতভাগ বিশ্বাস করতাম কীভাবে।
তবে দাদির কথায় বুঝতে পারলাম দ্বিতীয় এই বউটিকে চাচির তরফের কোনো আত্মীয় হিসেবে সে চিনত। সর্বপ্রথম চাচার বিয়েতে মেয়েটাকে দেখেছিল বছর চারেক আগে। তারপরেই হয়তো কোনোভাবে যোগাযোগ হয়ে দুজনের..
কি বিচ্ছিরি কান্ড। যার মেয়ের কিনা আর্লি এইজে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, সে ব্যক্তি উল্টো মেয়ের বয়সী একজনকে বিয়ে করে বীরদর্পে বাপের বাড়িতে উঠছে নতুন সংসারের খবর জানাতে।
ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠল আমার। দাদির গল্পের ফাঁকে হুড়মুড়িয়ে উঠে গিয়ে বমিও করলাম আমি। দাদি অবাক হলো না। সেও শক পেতে পেতে ততক্ষণে পাথর।
তবে বাবার বিয়ের ঘটনা এবারে আমি আগাগোড়া জানলেও লুকনো হলো অংকর থেকে। বাবা যে পরকীয়া করে আমার মাকে তালাক দিয়েছে, সেটা জেনে-বুঝে নিজের বুকের ভেতর মাটিচাপা দিয়ে রাখলাম আমি। সন্দেহ ছিল অংক হয়তোবা জানে, অথবা ধারণা করেছে ততক্ষণে। তবু মুখ ফুটে কিছু বললাম না। বরং ওর যেন এদিকটায় নজর না পড়ে তাই মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেভাবেই হোক মাইন্ডটা ডাইভার্ট হয়ে যাক ছেলেটার। অন্যকিছু ভাবনায় এতটা ব্যস্ত হয়ে যাক, নিজের বাবার জীবনে সদ্য ঘটে যাওয়া নোংরা ঘটনাটাও যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।

প্রার্থনা কাজে দিলো দু-তিনদিনে। যদিও অনেক শোকাবহ ভাবনার মাধ্যমে ওর মন সরল বিষয়টা থেকে তবু আমি স্বস্তি পেলাম।
হাসপাতালে এক সপ্তাহ প্রবল কষ্ট সহ্য করে দাদু আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন। মাইনর অ্যাটাকেই যদিও তাকে ভর্তি করা হয়েছিল, অবজারভেশনে থাকা অবস্থায় শরীরের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। হার্ট অ্যাটাক থেকে এক ধাক্কায় স্ট্রোক, তারপর কোমা আর সবশেষে..

অসুস্থ মানুষের মৃত্যুগুলো অদ্ভুত। টিমটিমে মোমবাতির শিখা নিভে যাওয়ার আগ মুহুর্তে যেমন দপ করে জ্বলে উঠে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, তেমনই রোগভোগে কাটানোর পর চলে যাওয়ার দিন দাদু সকালবেলা হুট করে ঠিক হয়ে গেল। চোখ খুলল, হাত পা নাড়াল, আমাকে আর অংককে পাশে বসিয়ে অস্পষ্ট স্বরে গল্পও করল। শেষে আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে দাদিকে ইশারা করে ঘটা করে উকিল ডেকে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে বাবার যে অংশটুকু ছিল, সে সম্পূর্ণ অংশটা আমাদের দু ভাইবোনের নামে করে দিয়ে সে হারিয়ে গেল আমাদের মধ্য থেকে।
লটারি পাওয়ার মতো দোদুল্যমান অবস্থাটায় আমরা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের চাবিকাঠি পেলাম মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটার থেকে।
প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত, আহত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও জানতাম এই আমাদের জীবন পাল্টে যাওয়ার প্রথম দিন। এরপর সবটা না হলেও কিছুটা তো অবশ্যই ঠিক হবে আমাদের। অবশ্যই।

চলবে,
Sara

ব্রহ্মকমল পর্ব-০১

0

#ব্রহ্মকমল
প্রথম পর্ব
Sinin Tasnim Sara

“বাবা-মায়ের যখন ডিভোর্স হলো তখন আমার এডমিশান পিরিয়ড চলছে।
প্রকৃতিতে সে এক ভয়াবহ ঋতু। ঠিক করে বলা যাচ্ছে না ভাদ্র নাকি আশ্বিন মাস। রোজ যেমন খুশি তেমন সাজো খেলার পার্ট চলছে যেন প্রকৃতিতে। আজ বৃষ্টি তো কাল কাঠফাটা রোদ। আমি পড়ে গেলাম মহা মুশকিলে৷ আমার না অতিরিক্ত গরম সহ্য হয় আর না ঠান্ডা। মাঝামাঝি পর্যায়ের আবহাওয়া না থাকলে বছর কাটে অসুস্থতায়। জ্বর, সর্দি হয়ে কি ভয়াবহ দশা!
বাবা মায়ের একমাত্র বড় মেয়ে; ভীষণ আদরের। সেই ছোট্টবেলা থেকে সামান্য হাঁচি পড়লে দুশ্চিন্তায় প্রেশার হাই হয়ে যায় দুজনের এমন অবস্থা। ডাক্তারি ভাষায় আমার ইমিউন সিস্টেমে বেশ গড়বড়, মানে দুর্বল আরকি। বাবা মায়ের দুশ্চিন্তাও তাই দুর্বলের বিপরীতে বেশ সবল। মা পাখি তার ডানায় আগলে যেমন শিশু পাখিটিকে যত্ন করে, বুকে করে রাখে; তেমনই আমার বাবা-মা আমায় বুকে করে রাখতেন বরাবর। আমি অবশ্য উপভোগ করতাম তাদের মাত্রাছাড়া ভালোবাসা। উপভোগ্য লাগত আমায় নিয়ে তাদের সমস্ত দুশ্চিন্তাও। মাঝেমধ্যে মনে হতো আমি বোধহয় ইচ্ছে করেই একটু নরম-সরম দুর্বল রাখার চেষ্টা করছি নিজেকে। আদর সোহাগ নইলে কমে যাবে না?

বছর বিশ পর্যন্ত আমার গোটা পৃথিবী ছিল শুধুমাত্র বাবা-মা আর পড়াশোনা কেন্দ্রিক। এই দুটো ভাবনার বাইরে জগতে অন্য কোনো ভাবনা থাকতে পারে আমার বিশ্বাস হতো না। বোধহয় মানতে চাইতাম না আমি অন্যকিছুকে। অনেকে বলত বাবা-মায়ের অতিরিক্ত ভালোবাসা আমায় অন্ধ বানিয়ে রেখেছে। হতে পারে। আমিও মনেপ্রাণে বিশ্বাসী ছিলাম এই পৃথিবীতে সমস্ত স্বচ্ছ নির্মল ভালোবাসার প্রতি আমার বিশেষ অধিকারবোধ আছে। জন্ম থেকেই আমি সমস্ত সৌভাগ্যের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী। কিন্তু লোকের ভাষায় বাস্তবতা যাকে বলে, সেই বাস্তবতা নামক বইয়ে আমার ভাবনা কি সত্যি কোনো পৃষ্ঠায় লেখা ছিল? নাকি সব ভুল ধারণা পুষে রেখেছিলাম বুকের ভেতর শুধু আমিই; বোকামি করে।

যে জগৎটা আমায় বিশ বছর গড়েপিঠে একটু একটু করে সাজিয়েছিল নিজের মত তা এক ধাক্কায় মিথ্যে হয়ে গেল আমার এডমিশানের সময় বাবা-মায়ের ডিভোর্সের মাধ্যমে। যে মিথ্যেটার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। এমনি থেকেই পরীক্ষার প্রেশার, রোগের ঝক্কি আর মেডিকেলের সিট ছুটে যাওয়া নিয়ে আমি পাগল পাগল দশায় পিষে যাচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত; তার ওপর গোদে বিষফোঁড়া হয়ে জুটল বাবা মায়ের আলাদা হওয়ার খবর৷

মজার ব্যাপার হলো খবরটা এত সাবলীলভাবে এসেছিল আমার সামনে! ওর ভীষণ স্বাভাবিকতা আমাকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না এটা আসলে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা, যার প্রভাব ভবিষ্যতে খুব খারাপভাবে এফেক্ট করতে যাচ্ছে আমার গোটা জীবনকে, আমাদের সবার অজান্তে।

দিনটা ভুলতে পারি না আজও। গড়পড়তা ঠিকঠাক দিনের মতোই সেদিনও সন্ধ্যাবেলা নাশতার টেবিলে আমি আর বাবা বসে। মা রান্নাঘরে খুটখাট কাজ করতে করতে একবার এসে চা-নাশতা রেখে গেলেন আমাদের সামনে। পড়ার ফাঁকে হাতড়ে হাতড়ে কোনোরকমে খাবার নেবার চেষ্টা করছি অমনি ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে ঠান্ডা গলায় বাবা বললেন,
— “আমি আর তোমার মা আলাদা হতে চাইছি ইপশা। প্রসিডিওর মোটামুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। পরের মাস থেকেই হয়তো আমরা লিবারল লাইফ লীড করতে পারব”

কথাটা আমি শুনিনি শুরুতে। খাবারের ট্রেতে হাত দুষ্টু ঘোরাফেরা করলেও আমি প্রাণপণে মুখস্থ করছি মিলনার্থক দ্বন্দ্ব সমাস। মা ও বাবা = মা-বাবা৷ আমার সবচেয়ে প্রিয় উদাহরণ, সবচেয়ে প্রিয় টপিক৷ বাবার কথায় কান দেব সময় কোথায়?
একবার তাকিয়েও প্রতিক্রিয়া দেখলাম না৷ বাবা বুঝলেন আমি শুনতে পাইনি অথবা বিশ্বাস করিনি কথাটা৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাপ নামিয়ে আবার বললেন,
— বাচ্চাদের কাস্টডি নিয়ে কথা উঠতে পারে। তুমি কার কাছে থাকতে চাও ইপশা? বাবার কাছে নাকি মা’র কাছে?

এবার আমাকে পড়া বন্ধ করতে হলো। হাত গুটিয়ে বইয়ের ভেতর আঙুল রেখে চশমার কাঁচ দিয়ে বিস্মিত চোখে তাকালাম। বলতে পারব না ওটা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি ছিল নাকি অবিশ্বাসের। বাবা অপেক্ষা করলেন ধৈর্য নিয়ে। আমি বুঝতে পারছিলাম কিছু বলা দরকার। একটা কিছু প্রতিক্রিয়া দেয়া দরকার বোধহয়। কিন্তু দিতে পারছিলাম না। শেষে একরাশ অসহায়ত্ব নিয়ে শুকনো কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললাম,
— সমাসটা যে এত কঠিন লাগছে বাবা! আমি যাই ঘরে গিয়ে পড়াটুকু কমপ্লিট করি। কেমন?

গায়ে শক্তি ছিল না একফোঁটা। মাথাটাও বনবন করে ঘুরছিল আমার। ভীষণ কষ্টে কোনোরকমে বই বুকে আগলে নিয়ে নিঃশব্দে ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে শরীর টলমল করতে লাগল। পাত্তা দিলাম না। তবে মনে হলো আমার দিকে তাকিয়ে বাবা আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বোধহয়। ঠিকঠাক শুনতে পেলাম না৷
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতেই মনে হলো আমি কাঁপছি। তৃষ্ণায় গলা চৌচির হয়ে বুকের ভেতরে ধুকপুক ধুকপুক করছে। আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছি? অতিরিক্ত পড়ার চিন্তায় ডিপ্রেশন থেকে ভুলভাল দেখছি, শুনছি?
প্রশ্ন করলাম নিজেকে বারবার। কিন্তু সঠিক কোনো উত্তর ভেসে এলো না। শিয়রের কাছে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু না ভেবে কল করলাম অংককে। অংক; আমার ছোটভাই। অংক সাবজেক্ট অনেক প্রিয় ছিল বলে অনেক শখ করে মা ওর নাম রেখেছিল অংক।
ওর আমার বয়সের তফাৎ বিশেষ নয়। তবে ছোটবেলা থেকে ও ফুপুর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে বলে আত্মিক টান আর পাঁচটা ভাইবোনের থেকে কম। তবু আমরা একে অপরের ভরসার জায়গা ছিলাম। অংকর জীবনের সব সুখ-দুঃখের গল্প যেমন আমার জানা ছিল, তেমনই আমারগুলো জমা ছিল অংকের কাছে। কিন্তু এমনি করে, এক দুঃখ সমানুপাতিক ভাবে আমাদের ঝুলিতে একসাথে কখনো এসে পড়বে আমরা কিন্তু তা জানতাম না। আমিই কখনো ভাবিনি। তাই আজ ভাবনার বাইরে ঘটনাটা যখন ঘটে গেল তখন মনে হলো আমার মতো পাগলাটে দশা কি বাচ্চা ছেলেটারও? নাকি ধ্বসে পড়া মিথ্যে পৃথিবীর বিপরীতে একমাত্র সত্যিটা এখনো ওর সামনে উন্মোচিত হয়নি?
প্রশ্ন এবার নিজেকে নয় সরাসরি অংককেই করলাম। জানতাম না উত্তরে চমকাতে হবে। ফোন ধরে আমাকে বিস্মিত করে ওই আগে জিজ্ঞেস করল,
— তোকে তাহলে জানাতে পেরেছে নিউজটা?
— কেন তুই আগে থেকে জানতি?

বিড়বিড় করে পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি। উত্তরে ও বাবার মতই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সময় নিয়ে বলল,
— ফুপির বাসায় চলে আয় আপু। ওদের একজনের সাথেও আমরা থাকব না। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জানিয়েছে? এখন তাহলে কাস্টডি নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেন।
— বাবা মাকে ছাড়া থাকতে পারব অংক?

ভয়ে কেঁদেই ফেললাম আমি। ফোনের ওপাশে অংক ধমকাল। ও যেন টুপ করে আমার বড় ভাই হয়ে গিয়েছে। তেমনই গম্ভীর আর কঠিনভাবে বলল,
— তাহলে কি দু’জনের জেদে বলি হয়ে পাগলাগারদে যাবি? সারাদিন পড়া পড়া করে পৃথিবী সম্পর্কে কোনো খবরই রাখিস না তুই আপু। বুঝতেও পারিসনি তোর কোচিং এ যাওয়ার সময়টুকুর সুযোগ নিয়ে, আমাকে দেখতে আসার বাহানায় কত কতবার ওরা পারিবারিক সালিশ ডেকেছে। একে অপরকে দোষারোপ করে গালমন্দ করে আমাদের মান কমিয়েছে গোটা পরিবারের সামনে। তোর কাছে মনে হয় ওরা ফেরেশতা তাই তো? জেনে রাখ ওরা দুজন হলো সাক্ষাৎ…

কথা অসম্পূর্ণ রেখে অংক লাইন কেটে দিল। দিব্যি টের পেয়েছি শেষের কথাগুলো বলার সময় কণ্ঠ ভিজে উঠেছিল অংকর। ভাইটাও নিশ্চয়ই টের পেয়েছে আমার অসহায়ত্ব। তাই কথা শেষ করার সাহস পায়নি।
ফোন কাটার পর অনেকক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমি ফ্যাল ফ্যাল করে স্ক্রিনে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। বুকের ভেতর অবিশ্বাসের পাহাড় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল আমার। মস্তিষ্কের একাংশে হাতুড়ি পেটা হতে লাগল মিলনাত্মক দ্বন্দ্ব সমাসের সংজ্ঞা। আচ্ছা এই সমাসের কোনো বিপরীত সমাস আছে কি? থাকলে তাকে কি বলে? আমার জানা নেই তো।
___________________

সম্পর্ক এমন একটা জিনিস। এখানে কখনো তৃতীয় পক্ষের শক্ত কোনো ভূমিকা থাকে না। হয়তোবা তৃতীয় পক্ষ বলতে যে শব্দটা আছে এটা কিছুটা ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্তের জায়গাটা সবসময় দুটো মানুষের হাতে।
তাই আমি কিংবা অংক সন্তান হয়ে বাবা-মায়ের আলাদা হওয়াটাকে যতই আটকানোর চেষ্টা করি, শেষ পর্যন্ত সফল হলাম না। অবশ্য অংক যে পুরোপুরি আমার সাথে তালে তাল মিলিয়ে আটকাতে চাইল তাঁদের বিচ্ছেদ তাও নয়। চেষ্টা শুধু আমি একা করলাম। কেঁদেকেটে, আত্মীয়দের কাছে ধর্না দিয়ে কিংবা বাবা-মায়ের পায়ে পড়েও!

আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম একটা। ছোটবেলা থেকে আমার জগৎ ছিল ওই মানুষদুটো। ওদের বিশ্বাস, ভালোবাসা…
বিশেষ কোনোকিছু দেখিনি কখনো, তবু ওরা আমার কাছে বিশেষই ছিল। ছিল কাপল হিসেবে আইডল। সেই আইডল যখন সেপারেটেড হয়ে যাচ্ছে, এটা আমার পক্ষে মানা কঠিন ব্যাপার তাই না?
বিষয়টা বুঝল পৃথিবীর সবাই। আমার ভাই, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি। বুঝল না শুধু দু’জন। যাদের ঘিরে আমার এত অস্থিরতা, এত পাগলামি;আমার বাবা মা।
বাবা-মায়ের জেদ বরাবর সমান। কেউ কাউকে একচুলও ছাড় দেয়ার অভ্যেস নেই। তাই হলো সেটাই যা ওদের প্ল্যান ছিল। ডিভোর্স।

চোখের সামনে দিনের আলোর মতো ছিলো হয়তোবা অনেককিছুই, তবু আজ পর্যন্ত বাবা-মায়ের ডিভোর্স কেন হয়েছিল আমি বলতে পারব না৷ শুনতে চাইনি ভয়ে। অংক বলে আমি খুব বোকা, আর ভীতুও। তাই পৃথিবীর সবার কাছে যা স্বাভাবিক তা যদি আমার মন না মানতে চায় তাহলে নাকি আমি সেটা ধরি না৷ দেখেও না দেখার ভাণ করি, জেনেও অবুঝ সাজার নাটক করি।
হতে পারে ওর অনুমান সত্যি। তাই তো ওরা যতবার এই নোংরা বিষয়টার পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্যি আমাকে শোনানোর চেষ্টা করেছে, ততবার পালিয়ে সত্যকে অগ্রাহ্য করে বেড়িয়েছি আমি;ভীতুর মতই।
অন্যদিকে ছোট হলেও অংক বেশ স্ট্রং হয়ে উঠেছে ততদিনে। যতটা আমাকে সামলেছে, তার চাইতে বেশি সামলেছে পরিস্থিতি। রোজ দেখতাম এই ছাড়াছাড়িটা নিয়ে ও কিছু অ্যাজামশন দাঁড় করাচ্ছে। আমি শুনতে না চাইলেও কানের কাছে এসে রহস্য রহস্য গলায় বলছে,
— বুঝলি আপু এই যে বাবা-মায়ের ডিভোর্স, এটা কিন্তু একদিনে হয়নি। এতবছর সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ওদের মধ্যেকার ভালোবাসা ফুরিয়ে গিয়েছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে ঘৃণা কিংবা তেঁতো ভাব।
— রিপ্লেসমেন্ট?
— হুমম রিপ্লেসমেন্ট।
— সত্যি ভালোবাসা পাল্টে ঘৃণা হতে পারে অংক?

আমার আহত প্রশ্ন শুনে ও আঁড়চোখে তাকাত তারপর। খুক খুক করে কেশে গলা ঝেড়ে বলত,
— এই থিওরি মেলানোর জন্য আমার বয়সটা কম। তুই কি কিছু বুঝতে পারিস?
— উঁহু।

দুদিকে মাথা নেড়ে জবাব দিই আমি। অংক ফস করে শ্বাস ছাড়ে। বলে,
— তাহলে প্রশ্নটা পেন্ডিং থাকুক। আরেকটু বড় হলে তোকে উত্তর দেব।

চুপচাপ মেনে নিই ওর ডিসিশন। মুখ ফুটে বলতে পারি না, ভালোবাসা তো কোনোদিন ঘৃণায় পাল্টে যেতে পারে না।
বইয়ে পড়েছি ভালোবাসা আর ঘৃণা দুটো বিপরীত শব্দ। দুই মেরুর দুটো শব্দ কোন লজিকে কোনো বিন্দুতে মিলিত হবে! এটা তো ত্রিভুজ নয়, বরং সরলরেখার দুই প্রান্তের মতো।
বলা হয় না, আমার আস্তে আস্তে মনে হতে শুরু করেছে বাবা মায়ের মধ্যে ভালোবাসা নামক কিছু তৈরিই হয়নি কখনো। হলে অন্তত মায়া থাকত, টান থাকত একে অপরের প্রতি। ভুলে যাওয়া কিংবা বিরক্তিবোধের জন্ম নিতো না। ঘৃণা আরও দূরের ব্যাপার।
কাউকে বুঝতে না দিয়ে বোধহয় জোর করে চাপিয়ে দেয়া একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়াচ্ছিল দুজনে এতদিন যাবৎ। ভেবেছিল সময়ের সাথে স্বাভাবিক হয়ে যাবে সবকিছু। সন্তান এলে টান হবে। ওরাও ভালোভাবে মেনে নিতে পারবে একে অপরকে। কিন্তু আদতে তা হয়নি। কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছিলই। যেটা সময়ে ডালপালা মেলে বেড়েছে। তারপর সম্পর্ক নামক বোঝার ভার যখন নিজের সীমানা ছাড়িয়েছে, তখন আর কাঁধ পেতে ওকে বয়ে নেয়ার সাহস ওরা দেখাতে চায়নি। তাই শেষে আলাদা হয়ে গিয়েছে।
খুব সহজ সমাধান তাই না? যে সমাধানকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে এর অপর পৃষ্ঠায় লেগে থাকা কাঁটার আঘাত কাদেরকে ঠিক সহ্য করতে হতে পারে এ ভাবনাও তাঁরা ভাবতে চায়নি। চাপিয়ে দেয়া সম্পর্কের ভার বুঝি এত?

ডিভোর্স থিওরির সলিউশন হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে এই প্রশ্নটা আমায় খোঁচাতে লাগল। আমি তো ভীতু, তাই অনেকবার চেষ্টা করেও শেষ মুহুর্তে উত্তর খোঁজার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতাম। কে জানে কেন বাঁচিয়েছি তখন! সৃষ্টিকর্তা নিজের জীবনে একটা চাপিয়ে দেয়া সম্পর্কের নতুন রূপ দেখাবেন বলেই হয়ত.. ”

চলবে,

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৪

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব১৪
জড়িয়ে ধরবেন ঠিক আছে কিন্তু নো কিসমিস
কিসমিস না খেলে মিষ্টিমুখ কি করে হবে! কিসমিস তো খেতেই হবে।

মিষ্টি ফ্রিজে রয়েছে এনে দিচ্ছি। ঠোঁটে মিষ্টি থাকে সেটা আপনাকে কে বললো মিস্টার পাইলট। ওপসস স্যরি মিস্টার প্লেন ড্রাইভার।
‘তা আমি কখন বললাম ঠোঁটে কিস করবো! মনে মনে এসব উল্টোপাল্টা ভাবো।
‘একদম আমাকে বোকা বানাবেন না।আপনার কাজই ওইটা৷
‘কোনটা বেবিডল?
‘কিসমিস খাওয়া। আপনার মিষ্টি দরকার হলে চকোলেট খান,রসগোল্লা খান,গোলাপজাম খান,রসমালাই খান, চমচম খান,বাতাসা খান, লাড্ডু খান,সন্দেশ খান।
‘আরে বাহহহ এতো খানদের নাম মুখস্থ তোমার!তা খান রেখে চৌধুরী সাহেবে মজলে কেন?
‘একদম ঠিক হচ্ছে না কিন্তু! আমি বলেছি খেতে।
‘উপসস স্যরি তবে, হুদা বিউটির স্টবেরি ফ্লেভারের গ্লাসি লিপস্টিকের টেস্ট সব মিষ্টির মিষ্টতাকে হার মানায়।
‘ওয়েট বলেই। নয়না নিজের রুম থেকে লিপস্টিক এনে জিয়ানের সামনে ধরে বলে,প্লিজ টেস্ট।
‘তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া না পেলে মিষ্টি লাগবে না তো?
‘দেরি হচ্ছে না আপনার?
‘তোমার বাবা মাকে কি বলবে?
‘বলব জামাই গেছে বিদ্যাশে। আমার পরিক্ষার পর আসবে।
‘তারপর।
‘তারপর পরিক্ষার পর একটা প্রেম করবো। এরপর তাকে বিয়ে করে নেবো৷ ব্যস কাহিনি খতম।
‘এতো সহজ সব কিছু?
‘হয়ত সহজ না। কারন মুখ দিয়ে বলে তো চাঁদেও ভ্রমন করা যায়। অথচ চাঁদে ভ্রমণ করা তো সহজ না!তবে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে তো বাঁধা নেই।আমিও স্বপ্ন দেখছি। চেষ্টা করবো পূর্ণ করার৷
‘জিয়ান নয়নার দিকে দৃষ্টি দিলো,বেগুনি রঙের সেলোয়ার-কামিজ। কোমড় ছাড়িয়ে লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে এলোমেলো হয়ে। স্নিগ্ধ শিশিরে ভেজা সদ্য ফোঁটা গোলাপের মত মায়াবী মুখখানা!
‘এভাবে কি দেখছেন? যাওয়ার আগে নজর দিচ্ছেন?
‘আর তো তোমাকে দেখা হবে না তাই দেখে নিচ্ছি৷
‘ভুলে যাবেন!তাহলে এভাবে দেখছেন কেনো? আপনার কি মনে হয় আপনি আমাকে ভুলতে পারবেন?
‘পারবো না?
‘আমার চেহারার দিকে তাকান৷ এই চেহারা দেখার পর ভোলা সম্ভব? সুনয়না তালুকদারকে যে একবার দেখেছে সে কখনো তাকে ভুলতে পারবে না৷
‘জিয়ান নয়নার নাক টেনে বলে,হয়ত অসম্ভব। আমাকে বের হতে হবে পিচ্চি তোমার আম্মুকে ডাকো।
‘আপনি ড্রয়িং রুমের সোফায় এসে বসুন মুরুব্বি আমি আম্মুকে ডাকছি।
‘মুরুব্বি? আমার মত ইয়াংম্যানকে তোমার মুরুব্বি মনে হচ্ছে!
‘আমার মত সুন্দরী ষোড়শী বালিকাকে যদি আপনার পিচ্চি মনে হয় তাহলে আপনি তো আমার দৃষ্টিতে মুরুব্বি তাই নয় কি?
‘ডিয়ার আদুরে পাখি আপনার আম্মুকে একটু ডেকে পাঠাবেন?
‘ঊখে দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম বয় যাস্ট ওয়েট৷
‘জিয়ান সোফায় বসে আছে,শ্বশুরের দেয়া ব্ল্যাক ব্লেজার, হোয়াইট শার্ট, চুলগুলো সেট করা। কড়া পারফিউমের স্মেল। হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ।
‘হুট করে একটা বাচ্চা এসে বলে,এই তুই কেরে? আমার বাসায় বসে আছিস হিরো সেজে?
‘জিয়ান তাকিয়ে দেখে সাত/আট বছরের এক বাচ্চা মেয়ে। কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷
‘আপনি কে গো দাদি আম্মা!
‘চুপ কর এতো বড় সাহস আমাকে দাদি আম্মা বলিস? আমার বাবাকে চিনিস?
‘স্যরি ভয় পাচ্ছি তো। আপনার বাবার নাম কি?
‘মাহবুব তালুকদার।
‘জাহানারা বেগম এসে বলেন, সূচনা তুমি এখানে কি করছো?
‘আম্মু এটা কে?
‘তোমার ভাইয়া।এবার যাও নিজের রুমে।
‘সূচনা দৌঁড়ে চলে গেলো।
‘কেমন আছো বাবা? আমাদের বাসায় কোন সমস্যা হয়নি তো?
‘ভালো আছি৷ নাহহ।
‘তুমি বস আমি নাস্তা রেডি করে আসছি ।
‘আমাকে বের হতে হবে। কাল থেকে আমার ফ্লাইট তাই আজ পৌঁছাতে হবে।
‘আবার ফিরবে কবে বাবা?
‘তিন চারমাস পর মেবি।
‘নাস্তা করে যাও বাবা।
‘জিয়ান সম্মতি জানাতেই জাহানারা বেগম নাস্তা রেডি করতে চলে গেলো৷
‘নয়না এসে জিয়ানের সামনে দাঁড়ালো। জিয়ানের দিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,’ছেলেদের একটু কম সুন্দর হতে হয়।এমন ধবধবে সাদা হলে মেয়েদের নজর বেশি পরে, তার উপর ধুসর রঙের চোখ! আপনার উচিৎ নজর টিকা লাগিয়ে ঘোরা।
‘তোমার নজর কি আমার উপর আটকে গেলো নাকি সুনয়না চৌধুরী!
‘বিগ মিস্টেক মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, আমি সুনয়না তালুকদার। মাহবুব তালুকদারের একমাত্র মেয়ে। আর আমার বয়েই গেছে আপনার উপর নজর দিতে! নজর দেয়ার জন্য বিলাল আব্বাস আছে তো। আমার নজর তার দিকে।
‘জিয়ান বসা থেকে উঠে এসে নয়নার সামনে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,সেটা আবার কোন ক্ষেতের মুলা?
‘সে আমার পার্মানেন্ট ক্রাশ একদম তার ব্যাপারে আজেবাজে বকবেন না! নিজেই তো ধলা মূলা৷
‘তা তোমর ক্রাশ কি ক্ষণে ক্ষণে চেঞ্জ হতে থাকে! এবার কও এই আব্বাসটা আবার কে?
‘আর ইউ জেলাস মিস্টার চৌধুরী?
‘আমার মত সুদর্শন ইয়াং পাইলট চোখের সামনে থাকতে অন্য কাউকে দেখে ক্রাশ খেলে জেলাস হবো না!
‘আপনি থ্রি মাচ সুদর্শন। তবে আমার বিল্লু বেস্ট।
‘বিল্লু!বাহহহ এতো প্রেম? তো রাতে বললা প্রেমিক নাই৷
‘কি শুরু করলেন মিস্টার ড্রাইভার? ও থাকে পাকিস্তান আমি বাংলাদেশে প্রেমটা হবে কি করে!
‘জিয়ান অট্টহাসি দিয়ে বলে,পাগলের সুখ মনে মনে৷
‘আপনার বৌ পাগল৷
‘আপাতত আমি পাগলের জামাই৷ এইযে বন্দী খাঁচার আদুরে পাখি।
‘মাজ নিচ্ছেন এটা বলে!
‘উঁহু মজা নেবো কেনো আদুরে পাখি! এই ডায়লগ ভালো লেগেছে। এই তোমার বোন আছে বললে না তো?
‘আমার বোন! আমি তো ওয়ান এন্ড অনলি।
‘সূচনা কে?
‘চাচ্চুর মেয়ে৷ নিশ্চিত বলেছে ওর বাবার নাম মাহবুব তালুকদার! ছোট বেলা থেকেই এমনটা বলে৷ আমার সাথে হিংসে করে। ওতো আপনার অর্ধেক বলে চুপ করে রইলো।
‘জিয়ান জিজ্ঞেস করতে যেয়েও চুপসে গেলো। সূচনা নীলাঞ্জনার বোন৷
‘আপনার মুখটা পেঁচার মত করে রেখেছেন কেনো?আপনার শ্বাশুড়ি আপনার জন্য হরেকরকম পিঠা নানা রকম নাস্তার ব্যবস্থা করেছে৷
‘আমাকে বের হতে হবে সময় নেই আমার৷
‘খেতে আসুন৷ শুনুন আমার আম্মু অনেক কষ্ট করে এতো সব কাল রাত থেকে নিজের হাতে বানিয়েছে।আমাদের মধ্যে যা কথা হয়েছে সেটা কাউকে জানাতে হবেনা। অনুগ্রহ করে আম্মুর কষ্টের মূল্য রাখবেন।
‘খাবার টেবিলে এতো খাবার দেখে জিয়ান বেশ অবাক হলো। এভাবে বিয়ে হওয়ার পরেও এতো ভালোবাসা!
যতটুকু সম্ভব খেলো। নয়নার আম্মুর রান্নার প্রশংসা করলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হবে৷সেসময় মাহমুব তালুকদার জিয়ানের হাতটা ধরে বলে,আমার মেয়েটাকে কখন কষ্ট দিওনা। বাহিরের দুনিয়া ও জানেনা৷ ওর দুনিয়ায় আমি কখনো দুঃখ স্পর্শ করতে দেইনি আজ থেকে এটা তোমার দ্বায়িত্ব।
জিয়ানের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,এটা তোমার জন্য। যা হয়েছে সব ভুলে যেও। নতুন ভাবে তোমাদের জীবনটা গুছিয়ে নিও।
‘নয়না নিজের রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো কেনো!মন খারাপ হলেই নয়নার আকাশ দেখতে ইচ্ছে করে৷ উদাস মনে দৃষ্টি স্থীর করে তাকিয়ে আছে কুয়াশার চাদার কে’টে ঝলমলে রোদের দিকে। কে বলবে,ঘন কুয়াশায় মোড়ানো শহরটা এভাবে আলোকিত হয়ে যাচ্ছে! একটু আগেই শহর জুড়ে আয়ত্ত করেছিলো ঘন কুয়াশা। অথচ রোদের ঝলকে এখন তার অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে!
🌿তোর বি লাভ বয়ফ্রেন্ড রেজা এই পাঁচদিন ধরে তোর কচি বোনের সাথে ফুলসজ্জা সেরেছে। আর তুই কিনা তার বিরহে বিভোর!
‘কি বলছো এসব তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার! নিজের রাগ জেদে নিজেকে কত নিচে নামাবে? আমার বোনের বয়স সবে মাত্র আট।
‘লাবিব নয়নার সামনে মোবাইলটা ধরলো। জিয়ান আর নয়নার রিসিপশনের পিক।
‘নীলাঞ্জনার নজর গেলো জিয়ানের ঠোঁটে। দেখেই বোঝাচ্ছে লাভ বাইটের চিহ্ন। তারমানে সত্যি পুরুষ মানুষের শরীর ছাড়া আর কিছু প্রয়োজন নেই!আমি নাহয় তাকে ঠকিয়েছি কিন্তু সে তো বলতো আমাকে ভালোবাসে? এই ভালোবাসার নমুনা! ভালোবাসা বলতে আদৌও কিছু আছে! নাকি ক্ষণিকের মোহকেই সবাই ভালোবাসার নাম দেয়?
‘কি ভাবছো ডার্লিং?
‘ওর বয়স ষোল। নাম সুনয়না। তোমার সাথে ওর একবার দেখা হয়েছিলো। কিন্তু বড় আব্বু এটা কিভাবে করলো!
‘খুব কষ্ট হচ্ছে বেবি! নিজের প্রাক্তনকে নিজের বোনের হ্যাসবেন্ড হিসেবে দেখে?
‘লাবিব তুমি বারবার তোমার লিমিট ক্রস করো? আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুললে আমি সেটা সহ্য করবো না৷ তোমাকে ছেড়ে চলে যেতেও দু’বার ভাববো না ।
‘লাবিব নীলাঞ্জনার মুখ ধরে বলে,উপসসস বেবি আমি তো ভয় পাচ্ছি! ইউ নো তুমি এখন যাস্ট ব্যবহারিত টিস্যুর মত। তাই ছেড়ে যাওয়ার ভয় আমাকে দেখাতে এসো না৷ ব্যাগ গুছিয়ে রেখো আজ আমরা ঢাকা ব্যাক করবো৷
‘নীলাঞ্জনা লাবীবের হাত ধরলো৷ করুন দৃষ্টিতে লাবিবের দিকে তাকিয়ে বলে,তুমি কি আমাকে কখনো ভালোবাসোনি?ভালো যদি নাই বাসো তাহলে আমাকে কলঙ্কিত করলে কেনো! আমি কাকে বলবো এই দুঃখ? তুমি আমাকে একা করে দিচ্ছো কেনো। সবাইকে ছেড়ে আমি তোমার হাত ধরেছি, আজ বিয়ের দুদিন যেতে না যেতেই আমি তোমার কাছে ইউজ করা টিস্যু! এই প্রতিশ্রুতি তো ছিলো না!
‘প্রতিশ্রুতি মাই ফুট। ওসব প্রতিশ্রুতি আমার পায়ের তলায় রোজ পিষ্ট হয়। সো ন্যাকা কান্না আর ইমোশনাল কথাবার্তা শুনে লাবিব গলে যায় না৷ মনে রেখো বেব।

#চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক দেয়ার সময় পাইনি৷
হ্যাপি রিডিং 🥰

প্রাণ বসন্ত পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব২০ (অন্তিমপাতা)
#রাউফুন

রওশন আরা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি সবসময় তাওহীদাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। তাই, এবার তিনি কালো জাদুর সাহায্যে তাওহীদাকে বশ করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন।

আহসান তাওহীদার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার শাশুড়ী এই কাজ করছিলেন তোমাকে বশে রাখার জন্য। তবে দেখো আল্লাহর ইচ্ছা! এই জাদুর প্রভাব তার ওপরেই ফিরে এসেছে।”

তাওহীদা ভীষণ খারাপ লাগলো কথাটা। যতোই অন্যায় করুন না কেন, তিঁনি তো আহসানের মা। আহসান রাগ থেকে যে এমন কথা বলছে তা জানে, কিন্তু তাওহীদার কথাটা ভালো লাগলো না। বাবা মা যতোই খারাপ হোক না কেন তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। সেখানে নিজের জন্মদাত্রী মা অসুস্থ, প্যারালাইজড হয়ে গেছেন যিনি তার প্রতি এমন বিরুপ মন্তব্য শুনতে মন্দ লাগছে।

সে আলতো স্বরে বললো, “আহসান, বাবা মা যেমনই হোন না কেন তাদের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলা উচিত না। বাবা-মায়ের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান এবং বিনম্রতা বজায় রাখতে হবে সেটা যেমন অবস্থায় হোক না কেন।
আল্লাহ বলেন:
“তোমার প্রভু আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ইবাদত করবে না এবং বাবা-মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে বিনম্রভাবে কথা বলো।”
(সূরা বনি ইসরাইল: ২৩)

অন্য হাদিসে রয়েছে,

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত:
“এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আল্লাহর রাসূল, আমার সঙ্গে উত্তম আচরণের সবচেয়ে বেশি অধিকার কার?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘এরপর?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘এরপর?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি বলল, ‘এরপর?’
তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা।’”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৭১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৪৮)

এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“ধ্বংস হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে তার মা-বাবাকে জীবিত অবস্থায় পেয়েও জান্নাতে যেতে পারল না।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৫১)”

“বুঝেছি আর কিছু বলতে হবে না।”

“হ্যাঁ মনে রেখো, আমরা যদি এখন বাবা, মায়ের সঙ্গে না থাকি তবে কে থাকবে? সুন্দর আচরণ দিয়ে যদি তুমি কাউকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসতে পারো তবে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হলেও আমি মায়ের সঙ্গে ভালো আচরণ করবো। আল্লাহ্‌ ক্ষমা করা নারীদের পছন্দ করেন। তাই আমিও সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। মায়ের আমার সঙ্গে করা সকল অন্যায়ও আমি ভুলে গেছি!”

হসপিটাল থেকে রওশন আরাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। রওশন আরা স্ট্রোক করে পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। তিনি কথা বলতে পারেন না, শুধু চোখের পানি ফেলেন আর ফ্যালফ্যাল করে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাওহীদা জানে, এটাই হইতো আল্লাহর বিচার। ফোস করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। বিছানায় প্রস্রাব-মল ত্যাগ করেন রওশন আরা। তাওহীদা সেসব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। মানুষের সেবা করার সুযোগ থাকলে অবশ্যই সেবা করা উচিত, সেটা যদিও শত্রু হয়। ইসলাম শান্তি, সহমর্মিতা ও দয়া শিক্ষা দেয়। মানুষকে সেবা করা, তারা যে ধর্মেরই হোক বা নিজের সঙ্গে যে সম্পর্কেই থাকুক না কেন, সেবা করা ইসলামের সার্বজনীন শিক্ষা। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মানুষের সেবা করে, আল্লাহ তাকে আখিরাতে এর চেয়েও বড় পুরস্কার প্রদান করবেন। এমনকি দুনিয়ার জীবনে শান্তি ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়।
(একবার এক ইহুদি নারী নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ক্রোধের কারণে প্রতিদিন তাঁর পথে ময়লা ফেলত। একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) খবর পেয়ে তার সেবা করতে গেলেন। তাঁর এই মহৎ আচরণ দেখে ইহুদি নারী এতটাই অভিভূত হলেন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।)

রওশন আরার অসুস্থতার কয়েক দিনের মাঝেই সালমা আর পারভীন এই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ রোজ সকালে অজানা ব্যথায় রওশন আরা চিৎকার চেঁচামেচি করেন। ওঁদের এসব চেঁচামেচি ভালো লাগে না। বিরক্ত হয়ে গেছে দুজনেই। সানোয়ার আর আনোয়ারও দুজন দুজনের নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যাবে।

তাওহীদা রওশন আরার এই অবস্থায় নিরব থাকতে পারে না। সে সালমা এবং পারভীনকে সবার সামনে প্রশ্ন করে,
“যখন মা সুস্থ ছিলেন, তখন তার সঙ্গে কতো ভাব, কতো মিশেছো আর কি না তারই বিপদের দিনে মা তোমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে গেছে? এখন অসুস্থ বলে পালিয়ে যাবেন? এটাই কি ইসলাম শিক্ষা দেয়, আপনাদের পরিবর্তন কি তবে ক্ষনিকের ছিলো?”

“দেখো, তুমি অনেক ভালো, মহৎ। তোমার দ্বারা এসব দুর্গন্ধ সহ্য করে কূটনী মহিলার সেবা করা সম্ভব হলেও আমাদের দ্বারা সম্ভব না। রোজ সকালে বিশ্রি গন্ধে পেটের নারীভুড়ি উলটে আসতে নেয়। এই বাড়িতে কি মানুষ থাকতে পারে! ইয়াক!”

“এভাবে বলবেন সালমা ভাবি, একবার ভাবুন তো আজ উনার জায়গায় যদি আপনার মা থাকতেন? অথবা ভাবুন, আপনি নিজেই যদি মায়ের অবস্থানে থাকতেন তবে কি হতো? আর আপনাকেও যদি কেউ এভাবে ঘৃণা করতো? সেবা না করতো তবে?”

“দেখো, সত্যিইই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সব কিছু বুঝতে পারছি কিন্তু আমরা আসলেই পারবো না এখানে থাকতে।”

পারভীনের কথা শেষ হতেই, সানোয়ার আর আনোয়ার তাড়া দিলো। বললো,“এই চলো। গাড়ি চলে এসেছে আমাদের। কাজের লোক কে বলে দিয়েছি ফ্ল্যাটের রুম গুলো পরিষ্কার করে ফেলতে। সব আসবাবপত্র তো আগে থেকেই সাজানোই।”

তাওহীদার মাথা ঘুরে উঠে। মফিজ উদ্দিন রওশন আরার শিয়রে বসে ছিলেন৷ বড়ো ছেলের কথায় উঠে এলেন৷ বললেন,“তার মানে তোমরা আরও থেকেই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলে!”

সানোয়ার অকপটে স্বীকার করলো। বললো,“দেখো বাবা, আমরা আর এখানে থাকতে পারবো না৷ এক সময় বিজনেসের ভাগ চাইতাম আর এখন তাও চাই না। আমাদের নামের যেটুকু সম্পত্তি আছে তা ভাগ বটরা করে দেবে। আমরা বুঝে নেবো।”

“ঠিক আছে, তোমরা এখন আসতে পারো। আনোয়ার তোরও কি আগে থেকেই ফ্ল্যাট বাড়ি কেনা ছিলো?”

“হ্যাঁ বাবা। ভাইয়া আর আমি এক সঙ্গে কিনেছি। আজ ওখানেই উঠবো। মা যা শুরু করেছিলো দেখা যাবে আবার কখন যেনো আমাদের উপর মনে মনেই বশী করণ করে ফেলে। তাই এতো ভয়, উৎকন্ঠা নিয়ে থাকা সম্ভব না।”

মফিজ উদ্দিন রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,“এই দিন দেখার জন্যই তোদের মানুষ করেছি? নিজেদের মতো ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছিস তোরা আর পিতা হয়ে একটা কথাও জানি না। আমাকে জীবিতই মে’রে ফেললি? এক বিন্দু মূল্যায়ন পেলাম না? পড়াশোন করালাম এতো কষ্ট করে আজকের এই দিন দেখতে?”

“তুমি বাবা হিসেবে তোমার দায়িত্ব পালন করেছো বাবা। আমরাও আমাদের সন্তান হলে তার দায়িত্ব পালন করবো।”

“তাই করিস, আর একদিন তোরাও আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকিস, তোদের ছেলেও যেনো তোদের সঙ্গে এমন আচরণই করে।”

আহসান নিজের ঘরে ছিলো। রিমির জন্য ভালো পাত্রের খোঁজ করছিলো সে। বোনকে তো বিয়ে দিতে হবে। নিচে এসে ভাইদের লাগেজ হাতে দেখেই যা বুঝার বুঝে গেলো। ও আগে থেকেই জানতো দুই ভাইয়ের আলাদা ফ্ল্যাট কেনার কথা। এই দিন যে আসবে তা বোধহয় ও আন্দাজ করেছিলো।

আনোয়ার আর সানোয়ার বিদায় নিলো স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে। তাওহীদা ওঁদের বারবার বারণ করলেও তাঁরা তাওহীদার কথা উপেক্ষা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আহসানও দুঃখ পাচ্ছে ভাইদের এই বিচ্ছেদে ভারাক্রান্ত। মফিজ উদ্দিন এমন শোক মেনে নিতে পারেন না, মেনে নিতে পারেন না এতো কষ্ট করে সন্তান লালন পালন করার পরেও তাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ার যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা যভ কতটা তীব্র তা বোধহয় এক সন্তানদের থেকে অবহেলিত পিতা-মাতায় বুঝেন। তীব্র ব্যথায় বুকে হাত চেপে বসে পড়েন মফিজ উদ্দিন। কাতর স্বরে বললেন,“আমি মা’রা গেলে তোরা আমার কবরে মাটি দিতে আসবি না। দরকার নেই তোদের মতো সন্তানের। বিদেয় হো। কুলাঙ্গার গুলো, বেইমান সন্তানদের কোনো প্রয়োজন নেই। ”

আহসান আর মফিজ উদ্দিন দৌড়ে এলো মফিজ উদ্দিন এর নিকট। ব্যথায় কুকড়ে যেতে যেতে মফিজ উদ্দিন বললেন,“আমার ব্যবসা, সম্পত্তির এক কানা কড়িও ওদের দেবে না আহসান, এটা আমার আদেশ। আমার সৎ পথে করা ইনকামের টাকা আমি কোনো অসৎ লোকের হাতে দিতে চাই না।”

“কথা বলবেন না বাবা। আপনার কষ্ট হচ্ছে।”

“আমার ছেলেটার হাত কখনো ছেড়ো না মা তাওহীদা!”

বলতে বলতে দু-চোখ বন্ধ করলেন মফিজ উদ্দিন! তাওহীদা বাবা বলে চিৎকার করে উঠলো৷ হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর জানালেন হার্ট ব্লকে মা”রা গেছেন পথিমধ্যে। আহসান উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেলো। তাওহীদা স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লো হসপিটালের ফ্লোরে। আস্তে আস্তে চোখ অন্ধকার হচ্ছিলো তার আর আবছা আবছা মফিজ উদ্দিনের হাসি মাখা মুখ টা দেখতে পাচ্ছিলো। দু-চোখ ভর্তি করে পানি গড়িয়ে পড়লো৷

শ্বশুর বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে গেলো। যে মানুষটি নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছিল, তাঁর স্নেহময় ছায়া থেকে বঞ্চিত হলো। প্রতিটি মুহূর্তে তিনি যেন ছিলেন একটি বটগাছের মতো—দুঃখের ঝড়ে যখন মন ভেঙে পড়ত, তখন তিনি ছায়া দিতেন। শ্বশুরের কাছে শাশুড়ি এবং স্বামীকে ছাড়াও তার নিজের জন্য আলাদা একটা জায়গা ছিল। তাঁর পরামর্শ, আদর, স্নেহমাখা কথা, সবই যেন ছিল এক বিশাল আশ্রয়ের মতো।

বাবার চলে যাওয়া যেন বুকের ভেতরে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করল। এই শূন্যতা শুধু একজন আপনজন হারানোর কষ্ট নয়, বরং হারানোর যন্ত্রণা যে আর কখনো এই পৃথিবীতে সেই স্নেহমাখা হাসি, চোখে ভালোবাসার মায়া কিংবা মাথার ওপরে সেই অভিভাবকত্বের ছায়া ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।

তিনি যখন বলতেন, “তুমি আমার মেয়ে, তোমার কোনো দুঃখ হতে দেব না,” তখন মনে হতো যেন সত্যিই একজন বাবার স্নেহের পরশ পাচ্ছে। আজ সেই মানুষটি নেই। সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই বাবার হাসি ভেসে ওঠে, তাঁর গলা ভেজা কথা, যত্ন করে খেতে বলার দৃশ্য। অথচ বাস্তবতার কোলাহলে আর কখনোই সেই দৃশ্য ফিরে আসবে না।

এখন মনে হচ্ছে, শ্বশুর শুধু একজন অভিভাবক নন, বরং তিনি ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় বাবা। আজ থেকে আর কেউ তাঁকে বকা দিয়ে ভালোবাসবে না, কেউ দুঃখের দিনে হাত ধরে বলবে না, “তুমি দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।” বটগাছটি যেন শেকড় সমেত উপড়ে গেছে।

কিন্তু বাবার স্মৃতি থেকে শেখা সব ভালোবাসা আর মমতার চর্চা করাই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা। বাবার দেখানো পথে যেন নিজেকে আরও দৃঢ় করে, অন্যদের জন্য সেই বটগাছের ভূমিকা নিতে পারা। বাবার শূন্যতা মুছবে না, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, আর ভালোবাসা চিরকাল বেঁচে থাকবে হৃদয়ের গভীরে।

পরিশিষ্ঠঃ

গ্রামে চেয়ারম্যানের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মমতাজ বেগম দুই মেয়ে এবং ছেলেকে নিয়ে শহরে চলে এসে ছিলেন। শহরের একটি বাজারে তিনি সবজি বিক্রি শুরু করেন। প্রতিদিন সকালে বাজারে যান, তারপর সন্ধ্যায় সন্তানদের নিয়ে ঘরে ফেরেন।
“মা, এভাবে কতদিন চলবে?” ছোট মেয়ে জানতে চায়।
“যতদিন বাঁচতে হবে, ততদিন এভাবেই লড়াই করব। আল্লাহ যদি চায়, আমাদের ভালো দিন আসবেই।”
শহরে আসার পর মেয়েকে জানিয়েছে তাঁরা শহরেই একটা টিনের বাসা ভাড়ায় নিয়ে থাকেন। তাওহীদা নিজের মায়ের খোঁজ পেয়ে তাদের নিতে এসেছিলো। কিন্তু আত্মসম্মান বোধ ওয়ালা মমতজা বেগম কোনো ভাবেই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি উঠতে চান নি। কষ্ট করে হলেও নিজের সন্তানদের তিঁনি মানুষ করবেন। তাওহীদাও মায়ের সঙ্গে আর জোর করেনি। তাওহীদার মা মমতাজ বেগম গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসার পর থেকেই নতুন জীবনের লড়াই শুরু করেন। তবে মনের গভীরে তার মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা থেমে থাকেনি। দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি নিজের সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শহরে তাদের বসবাস খুব কষ্টকর ছিল। প্রতিদিন ভোরে মমতাজ বেগম সবজি কিনতে বাজারে যেতেন এবং সারাদিন বাজারে বসে সেগুলো বিক্রি করতেন। এই সময়ে তার মেয়ে জোহরা আর মানহা মায়ের কাজে সাহায্য করত, আর ছোট ভাই স্বাধীন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত।
কাজের ফাঁকে জোহরা মাকে বলল,
“মা, তুমি সবজি বিক্রি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছো। আমি একটা চাকরি খুঁজব। আমাকে চেষ্টা করতে দাও।”
“না মা এখনো জীবিত আছি কি জন্য? যতদিন বেঁচে আছি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা খেটে খাওয়ার জন্য শক্তি শরীরে রেখেছেন ততদিন তোমাদের কোনো কাজ করতে দেবো না। আমি জানি আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন সব সময়, সব পরিস্থিতিতে।”

“আমি একটা টিউশনি করাই মা?”

মমতাজ বেগম কড়া গলায় বললেন, “তুমি এখনো ছোট। পড়াশোনায় মন দাও। আমার জীবনে অনেক কষ্ট হয়েছে, কিন্তু তোমাদের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমি লড়াই করে যাবো।”

তাওহীদার মা কখনো তাওহীদাকে তাদের কষ্টের কথা জানায়নি। কারণ তিনি জানতেন, তাওহীদার নিজের জীবনও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

রওশন আরার মৃত্যুর পর তাওহীদা একদিন সালমা আর পারভীনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তারা তখনও নিজেদের ভুল বুঝতে পারেনি। চার বছর ধরে তাওহীদা রওশন আরাকে সেবা করে। এই চার বছরে রওশন আরার ভেতরে একটা পরিবর্তন আসে। তিনি বুঝতে পারেন, জীবনে তিনি কত ভুল করেছেন। কিন্তু তার এই অনুশোচনাও তাকে বাঁচাতে পারে না। একদিন ভোরে তিনি চিরতরে চোখ বন্ধ করেন। তাওহীদা তার জন্য জানাজা পড়ার ব্যবস্থা করে এবং শেষ বিদায়ের দায়িত্ব নেয়।

সালমা আর পারভীন নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা সংসার পেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সংসারে কোনো শান্তি ছিল না। তাদের স্বামীরা তাদের ছেড়ে বিদেশে চলে যায়। তারা হতাশায় ডুবে যায়। কিন্তু তাওহীদা কখনো তাদের নিয়ে বিদ্বেষ পোষণ করেনি। তারা আবারও ক্ষমা চেয়ে এই বাড়িতে ফিরে এসেছে।

তাওহীদা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“তোমরা জানো, জীবনে সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটে। অন্যায় করলে তার শাস্তি একদিন না একদিন পাবেই। তোমরা নিজেরা নারী হয়ে কীভাবে একজন মায়ের প্রতি এতটা নির্মম হতে পারলে? একটা মানুষ মা’রা গেছে তাকেও শেষ দেখা দেখতে যাওনি। আজ তোমাদের নিজেদের জীবন দেখো। তাও আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন যদি তোমরা তার কাছে ফিরে যাও।”

রওশন আরার মৃত্যুর পর তাওহীদা আর আহসানের সুখের সংসার হয়, নিজেদের সংসার। তাওহীদা আর আহসানের একটি ছেলে হয়। তারা তার নাম রাখে “ইলহাম”। ইলহাম বড় হয়ে কোরআনের হাফেজ হবে এই প্রত্যাশায় ছেলেকে মানুষ করছে। যেনো বড়ো হয়ে তাদের সন্তান একটা সানোয়ার বা আনোয়ার তৈরি না হয় যে কিনা নিজের বাবাকে কথাঘাতে মে,’রে ফেলে।

রওশন আরার মৃত্যুর কয়েক বছর পর তাওহীদা তার স্বামী, সন্তান ইলহামকে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করে।

তাওহীদার বাড়িতে কোরআন পাঠের ধ্বনি শোনা যায় প্রতিদিন। আহসান ও তাওহীদা তাদের সন্তানকে এমনভাবে মানুষ করে, যাতে সে আল্লাহর পথে চলতে পারে। আহসান নিজেও মফিজ উদ্দিনের ব্যবসা হালাল ভাবে করছে তাঁর দেখানো পথে।

“জীবন যত কঠিনই হোক না কেন, সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। ভালোবাসা, ধৈর্য, আর সঠিক পথে থাকার শক্তি সব বাঁধাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা দেয়। অন্যায়কারীরা যতই শক্তিশালী হোক, তাদের পতন সুনিশ্চিত। অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, সত্যের আলো একদিন জ্বলে উঠবেই। যে মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে আসে, সে মুক্তি পায়। আর যে মানুষ তার অন্যায় থেকে বিরত থাকে না, সে নিজেই ধ্বংসের পথে চলে যায়।”

#সমাপ্ত

প্রাণ বসন্ত পর্ব-১৯

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৯
#রাউফুন

আগুন্তক কে জানার জন্য তাওহীদার ভেতর থেকে ছটফটানি বাড়ছে। জিজ্ঞাস্য ও কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাওহীদা আহসানের পানে। আহসান লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললো, “তিনি আমার বাবা, স্বয়ং মফিজ উদ্দিন। মায়ের কালো জাদু আর বশিকরণ বিদ্যার কারণে তিনি সরাসরি তোমাকে সাহায্য করতে পারতেন না। তাই বাইরে থেকে আগুন্তক সেজে তোমাকে সাবধান করতেন।”

তাওহীদা বিস্মিত হয়ে বললো,” আমি যেদিন বাজারে গেছিলাম তবে সেদিন তিঁনি কে ছিলেন?”

আহসান ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,“ তুমি বাইরে গেলে আমি নিজেও শঙ্কায় থাকতাম৷ তাই তুমি বাইরে গেলেই আমি আর বাবা কেউ না কেউ তোমাকে ছায়ার মতো ফলো করতাম। যেদিন বাজার থেকে আসার সময় তোমাকে বাজে লোকেরা পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো সেদিন আমিই ছিলাম। আমি ক্যারাটের পাশাপাশি মার্শাল আর্টও শিখেছি। তাই ওদের কাবু করা আমার জন্য কোনো ব্যাপার ছিলো না৷”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহ সুবহানাহু তাআ’লা আমাকে সত্যের পথ দেখিয়েছেন। এদিকে আগুন্তক কে জানার জন্য আমি কতটা চিন্তিত আর তৎপর থাকতাম। তুমি এমন কেন আহসান? আমি তবে এতোদিন সুস্থ মানুষের সেবা করে এসেছি?”

আহসান ঠোঁট এলিয়ে হেসে ফেললো। বললো,
“স্বামী সেবাই তো করেছেন ম্যাডাম!”

“তুমি জানো, আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন বাজার করে আনার সময়?”

“জানি, যখন ঘরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে উঠছিলে আর কাঁদছিলে তখনই বুঝেছিলাম! তাছাড়া একটা জিনিস আমি খুব বুঝেছিলাম, আমার বউ কতটা সৎ আমার প্রতি, কতটা গায়রত সম্পন্ন!”

“কিভাবে বুঝেছিলেন মশাই?”

“সেদিন আমি তোমাকে বাঁচালাম, হাত বাড়িয়ে দিলাম ধরে উঠানোর জন্য তুমি কিনা দূর্বল শরীরকে টেনে উঠিয়ে সোজা দৌঁটে চলে এলে। বুঝেছিলাম ভয় পেয়েছিলে কিন্তু যে তোমাকে বাঁচালো তাকেও?”

“আমি আর ঐ বিভৎস দিন মনে করতে চাই না!”

তারপর আহসান তাওহীদার সঙ্গে পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোকে মনে করালো। কিভাবে তাকে বশে রাখার চেষ্টা করছিলো তার মা রওশন আরা। সম্পত্তির লোভে মানুষ এতোটা বধির হয়ে যেতে পারে তা যেনো রওশন আরাকে না দেখলে বোঝা যেতো না। আহসান ক্ষণে ক্ষণে মায়ের এমন নিম্ন মানের কর্মকাণ্ডের কথা ভেবে ভয়ে নিমজ্জিত হয়ে রয়। আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করে সে যেনো তার মা আল্লাহর পথে ফিরে আসে। এমন গাফেল না থাকে।

সালমা আর পারভীন তাওহীদাকে সকালে জীবিত অবস্থায় রান্না করতে দেখে যেনো ওদের পিলে চমকে উঠলো। এই মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে?, নাকি তাদের মতিভ্রম হয়েছে? সবকিছুই কি হ্যালোসিনেশন হচ্ছে? তাওহীদা সালমাদের দেখতে পেয়ে মুচকি হেসে বললো,“ভাবি আপনারা আজ এতো সকালে? যাক ভালো করেছেন। সকাল সকাল উঠে নামাজ পড়বেন, একটু হাঁটাহাঁটি করবেন দেখবেন ভালো লাগছে। শরীর খারাপ ঝম্পট দিয়ে পালাবে!”

“তু-তুমি বেঁচে…!”

পারভীন সালমার মুখ চেপে ধরলো। আতংক যেনো ওদের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। জলদি শাশুড়ীকে খবরটা দিতে হবে। তাওহীদার মুখে তখনও মুচকি হাসি। কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটি করে বললো,“কি হলো পারভীন ভাবি? বড়ো ভাবিকে কথা সম্পুর্ন করতে দিন। ওভাবে মুখ চেপে ধরলো দম বন্ধ হবে তো!”

“না না কিছু বলবে না ভাবি। আমরা তো এমনিই চা খেতে এলাম।”

“ঠিক আছে এই নাও চা নিয়ে যাও।”

পারভীন আর সালমা দুজন দুজনের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে আমতাআমতা করে চা নিলো। ওঁদের হাত কাঁপছে। তাওহীদা আঁচ করতে পেরে বললো,“তোমরা কাঁপছো কেন?”

“কই না তো!” দুজনেই সমস্বরে বললো।

এরপর সালমা নিজেকে সামলে বললো,“আসলে, শীত বেড়েছে তো তাই কাঁপছি।”

“ঠিক আছে তুমি রান্না করো, আমরা যাই!”

তাওহীদার আচরণ আজ কেমন অদ্ভুত। ওর নরম চাহনীতেও সালমা আর পারভীন ভেজা বেড়ালের মতো চুপসে গেছে। দ্রুত গিয়ে শাশুড়ীকে ডাকতে লাগলো। মফিজ উদ্দিন গভীর রাতে এসেছেন৷ ফজরের নামাজ শেষ করে এসে আবার শুয়েছেন তিঁনি। এখন দরজায় ঠকঠক আওয়াজে বড্ড বিরক্তি বোধ করছেন। খানিক বিরক্তি গলায় বললেন“রওশন আরা, ওঠো, দেখো কে ডাকছে!”

“আমি পারবো না। ঘুমাতে দাও। বহুদিন এমন শান্তিতে ঘুমাইনি!”

পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠলেন তিঁনি। মনে পড়লো গতকাল রাতের কর্মকাণ্ডের কথা। তাওহীদার লাশ তো তিঁনি সরাননি৷ আশ্চর্য এতো কড়া ঘুমের কারণে আজ আবার বিপদে না পড়তে হয়। নিজের উপর এবং নিজের ঘুমের উপর বেজায় বিরক্ত হলেন রওশন আরা।

মফিজ উদ্দিন রওশন আরার ওমন লাফিয়ে উঠা দেখে খানিকটা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলেন৷ ক্লান্তিতে শরীর টা যেনো অসাড় হয়ে আসছে তার। রওশন আরা উঠে দরজা খুলেই দেখলেন সালমা আর পারভীন দাঁড়িয়ে আছে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে। রওশন আরার ঘুম ছুটে গেছে ততক্ষণে। বললেন,“চলো ছাদে চলো, এখনো তোমার শ্বশুর উঠেনি৷ বাকি কাজ শেষ করি গিয়ে!”
সালমা ভয়ে ভয়েই চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,“কোন কাজ মা?”
“স্মৃতি ভ্রষ্ট হইছে মাথামোটা মেয়ে?, তাওহীদার বডি সরাতে হবে চলো! বড্ড দেরি হলো। রাতেই কাজটা করা উচিত ছিলো।”

“জীবিত মানুষের বডি কিভাবে সরাবেন মা?” পারভীন বললো।

রওশন আরা যেনো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আলতো স্বরে বললেন,“জীবিত মানে? কি সব বলো? সকাল সকাল গাজা খেয়েছো?”

“মা, মেয়েরা কি গাজা খায়?”

“তাহলে এসব কথা বলো কিভাবে? গতকাল রাতে আমরা তিনজন ওকে শেষ করেছি। আমি আসার সময় পানির মোটর ছেড়ে এসেছি। ও জীবিত মানে? হেয়ালি করো? আমার সঙ্গে মশকারার ফল জানো?”

“ওতো কথা জানি না মা। আপনি স্বচক্ষে দেখে নিন। রান্না ঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে শুনছেন?”

রওশন আরা দৌঁড়ে গেলেন। ভারী শরীর এটুকুতেই যেনো হাঁপিয়ে উঠলেন৷ দেখলেন তাওহীদা কড়াইতে কিছু একটা রান্না করছে। একদম সুস্থ স্বাভাবিক। তাওহীদা ঘুরে তাকালো৷ শাশুড়ীকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে একটা হাসি দিলো। বলল,“মা আপনাকে চা দেবো?”

রওশন আরা যেনো চমকে উঠলেন৷ একটা ভ্রম বা চোখে ভুল দেখেছে এমন মনে হচ্ছে। কিভাবে সম্ভব এটা? কে বাঁচালো মেয়েটাকে? আহসান? নাকি মফিজ উদ্দিন? কে? রওশন আরার নানান প্রশ্নে মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। তাঁর বশীকরণ ব্যর্থ হলে যে তার বশীকরণের প্রভাব নিজের উপরেই পড়বে। নিজের বড়সড় ক্ষতি হবে। এতোদিন তাঁর বশীকরণ ব্যর্থ হয়নি, পরপর দুবার ব্যর্থ হওয়ার ফল তিনি জানেন। তার ব্যর্থতার ফলপ্রসূতিতে কতটা ভয়াবহ পরিণতি হবে ভাবতেই রওশন আরার আত্মা শুকিয়ে গেলো। তাওহীদা চায়ের কাপে সন্তর্পণে চা ঢেলে রওশন আরার সামনে ধরলো। হঠাৎই সারা শরীর কাঁপতে লাগলো রওশন আরার। কাঁপতে কাঁপতে গড়িয়ে পড়লেন মাটিতে। বুকে হাত চেপে ধরে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাওহীদা অনুভূতিশূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। যেনো সে পাথর হয়ে গেছে। যেনো তার কান ও অন্তর বধির হয়ে গেছে। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই এতো বড়ো একটা ঘটনায়। অথচ আগের বার যখন রওশন আরা এভাবে অসুস্থ হয়ে যায় তখন কেবল সেই সেবা করেছিলো, সে-ই সবার চাইতে বেশি চিন্তিত ছিলো।

সালমা আর পারভীন ছুটে এলো শাশুড়ীকে পড়তে দেখেই। চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির প্রত্যেকের ঘুম ছুটে গেলো৷ সানোয়ার, আর আনোয়ার দুজন বেরিয়ে এলো। দুজনের পড়নেই ট্রাওজার আর টি-শার্ট। মফিজ উদ্দিন লুঙ্গি পড়া অবস্থায় ছুটে এলেন। সবাই ধরাধরি করে রওশন আরাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। তাওহীদা সম্পুর্ন সময় ছিলো নির্বিকার। যেনো কিছুই ঘটেনি৷ সবাই চলে গেলে সে গিয়ে নিজের মতো রান্না করতে লাগলো। সবাই হাসপাতালে গেলেও সে আর আহসান বাড়িতেই রইলো।

বিকেলে ভয়ে কুন্ঠিত হয়ে সালমা আর পারভীন ছুটে এলো তাওহীদার কাছে। তাওহীদা আহসানের সঙ্গে বসে গল্প করছিলো। হঠাৎই ওদের দুজনকে দেখে তাওহীদা বলল,“তোমরা এভাবে? ছুটছিলে কেন?”

“শাশুড়ী মায়ের পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আমরাও তো নিকৃষ্ট পরিকল্পনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছিলাম। তুমি নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে কেঁদেছো, আল্লাহ তাই তোমার চোখের পানি সহ্য না করতে পেরে গজব দিয়েছেন। আমরা ওরকম পরিনতির স্বীকার হতে চাই না তাওহীদা। আমাদের ক্ষমা করো বোন। আমরা অনেক ভূল করেছি!”

তাওহীদা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো,“তোমরা কি করেছো?”

“তোমার সঙ্গে প্রতি মূহুর্তে অন্যায় করেছি। আমাদের ক্ষমা করো। আমরা আমাদের কৃত কর্মের জন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত। আমাদের ক্ষমা করো তাওহীদা।”

আহসান ঠোঁটে বিদ্রুপের হাদি টেনে বললো,“আমার বউকে জীবিত অবস্থায় ট্যাংকের মধ্যে ফেলে দিতে তোমাদের হাত কাঁপে নি? কিভাবে পারলে? তখন কলিজা কাঁপে নি?”

পারভীন আর সালমা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। ওরা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। এক সঙ্গে বললো,“তুমি সুস্থ আহসান?”

“অনেক আগে থেকেই!”

ওরা দুজনেই এসে আহসানের পায়ের কাছে পড়লো। ওর পা চেপে ধরে বললো,“ভাই, তাওহীদাকে বললো, আমাদের ক্ষমা করতে। ও যদি আমাদের ক্ষমা না করে তবে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লাও আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমরা সত্যিই আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি!”

“আমার পা ধরে তো লাভ নেই। যার সঙ্গে অন্যায় করেছো তার কাছে ক্ষমা চাও!”

ওরা তাওহীদার পা চেপে ধরলো। তাওহীদা পিছিয়ে গেলো।।বললো, “আমি কখনোই তোমাদের প্রতি রাগ বা ক্ষোভ পুষে রাখিনি। যাও ক্ষমা করে দিলাম।”

এরপর আহসানের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলো আহসান! আমিও যদি আমার মনে রাগ -বিরাগ পুষে রাখি, হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করি তবে ওদের আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি রইলো?
আমি সংযমী, আমি কোমলতার এক প্রতিচ্ছবি।
“আমি উদার, আমি আশ্রয়ের ছায়া।
আমি সাহসী, আমি সংকল্পের প্রতীক।
আমি ধৈর্যশীল, আমি সহনশীলতার অবয়ব।
আমি মায়াবী, আমি ভালোবাসার অমিয় সুর।
আমি দৃঢ়, আমি বিশ্বাসের ভিত্তি।
আমি বিনয়ী, আমি নম্রতার আলোকস্তম্ভ।
আমি নির্ভীক, আমি সত্যের পথপ্রদর্শক।
আমি আশাবাদী, আমি স্বপ্নের দিশারী।
আমি রহস্যময়, আমি অন্তরের গভীর স্রোত।
আমি সহমর্মী, আমি মানবতার ভাষা।
আমি প্রখর, আমি বুদ্ধির শাণিত ফলক।
আমি জাগ্রত, আমি আত্মার আলোকধারা।
আমি আমি—একটি জীবনের প্রতিচ্ছবি।”

আমাকে কঠোরতা মানায় না, আমি যেনো কোনো পরিস্থিতিতেই মানুষের জুলুমের কারণ না হয়। সৃষ্টি কর্তা যেনো আমাকে কখনোই গাফেল দের অন্তর্ভুক্ত না করেন।”

তাওহীদা জানে, আল্লাহ তার পাশে আছেন, এবং সে সত্যের পথে থেকেই তার জীবনকে পরিচালিত করবে। আহসান তাওহীদাকে নিয়ে চললো হসপিটালের উদ্দ্যেশ্যে। সে তার অর্ধাঙ্গিনীকে যতো দেখছে ততোই মুগ্ধ হচ্ছে। এই মেয়েটা এতো ভালো কেন?

সালমা আর পারভীন দুজনেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলো। তারা অত্যন্ত অনুশোচনায় ভুগছে। তারা একত্রে আল্লাহর পথে চলার জন্য দৃঢ় সংকল্প করলো।
তাওহীদা আর আহসান বুঝতে পারল, তাদের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ আসছে। কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে তারা এগিয়ে চলল।

“অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, সত্যের আলো একদিন তাকে নিভিয়ে দেয়। আর পাপের পরিণতি ভয়ংকর, সত্য কখনো পরাজিত হয় না।”

#চলবে।

প্রাণ বসন্ত পর্ব-১৮

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৮
#রাউফুন

রাতের অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে। তাওহীদা সহজ সরল মনে শাশুড়ীকে এযাবৎকাল নসীহা করেছে। কিন্তু কখনোই এরকম ভয় করেনি তার। কিন্তু আজ তার শরীর টা যেনো অদ্ভুত ভাবে নিজের আয়ত্ত্ব রাখতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে তার শরীরকে অন্য কেউ চালনা করছে। সে না কথা বলতে পারছে না কোনো উচ্চবাচ্চ করতে পারছে। সে যে কিছু মূহুর্ত পূর্বে কথা গুলো বলেছে তখনও তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে জোর করে এসব বলাচ্ছে।

“বসো তাওহীদা! কি যেনো বলছিলে?”

“কই কিছু না তো!” এক ধ্যানে সামনে তাকিয়ে জবাব দিলো তাওহীদা।

রওশন আরা তাওহীদার কথা শুনে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তাওহীদা নির্বিকার চিত্তে বসে রইলো। কূটিল হেসে দু হাতে হাততালি দিয়ে কাউকে ইশারায় ডাকলেন। তারপর খাটের উপর বসে এক অন্য পায়ের উপর রেখে বললেন, “তাওহীদা, তুমি কি ভাবছো, আমি তোমার কথা শুনে বদলে যাবো?” তার ঠোঁটের কোণে একপ্রকার স্নেহহীন বিদ্রূপ খেলা করছিল।

তার হাততালির সঙ্গে সঙ্গে সালমা আর পারভীন দ্রুত ঘরে ঢুকেছে। তাদের চোখে অদ্ভুত এক অন্ধকার খেলা করছে। সালমা বললো, “তোমার অনেক সাহস বেড়েছে দেখছি! তুমি ভাবছো আমাদের রাজত্বে এসে আমাদেরই শাসন করবে?”

তাওহীদা বুঝতেও পারলো কিছু একটা অস্বাভাবিক হচ্ছে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই যাবে কিন্তু কোনো ভাবেই পারছে না। রওশন আরা সামনে এগিয়ে এসে ধমক দিলো, “আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কে দিলো তোমাকে? তুমি কি মনে করেছো এখানে তুমি স্বেচ্ছায় এসেছো? তুমি জানতেও পারোনি তোমাকে আমি বশে রেখেছি। হ্যাঁ তোমায় আমি ঘন্টা খানেক আগে বশ করে ফেলেছি। মূলত তোমার মতো ইমানদার মেয়েকে বশে আনাটা টাফ ছিলো। মনে হচ্ছে পুরোপুরি বশে আসোনি তাই একটু হাদিস শুনিয়ে দিচ্ছিলে। তবুও তুমি এখন আমার বশে। অনেক কষ্টে বশ করতে সক্ষম হয়েছি ঘন্টা খানেকের জন্য। বশীকরণ বিদ্যায় আমি ভীষণ শক্তিশালী, তুমি যদি শিক্ষক হও আমি সেই স্কুলের হ্যাড মাস্টার। তোমার চাইতে অধিক জ্ঞান আমার আছে।”

তাওহীদা বুঝতে পারলো না কিছুই। কেবল এক ধ্যানে মুচকি হাসি মুখে এঁটে আছে। ঘরে এই মুহূর্তে আহসানও নেই। পারভীন শান্ত স্বরে বললো, “তোমরা যা খুশি করো, আমি আল্লাহকে একটু হলেও ভয় করি। আমি এসবে থাকতে চাই না। তাছাড়া তাওহীদা আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি তাই আমি ওর কোনো ক্ষতি করতে চাই না।”

এই কথা শুনেই রওশন আরা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “পারভীন, তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে একথা বলছো? ভূলে যেও না আমি তোমারও ঠিক তাওহীদার মতোই অবস্থা করতে পারি। তাই যেভাবে আছো থাকো। নতুবা তোমাকে শিক্ষা দিতে আমার হাত কাঁপবে না। তারাতাড়ি কাজ চালাও। ওর হুশ এসে গেলে কিছুই করা সম্ভব নয়।”

পারভীনের টনক নড়লো, ওর ভয়ে শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। এরপর সালমা আর পারভীন মিলে তাওহীদাকে জোর করে ধরে ফেলে। সে চিৎকার করতে গেলে রওশন আরা ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারা একত্রে তাওহীদাকে বেহুশ করার জন্য মাথায় আঘাত করে। তাওহীদা ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

আহসানকে চিলেকোঠার ঘরে আটকে রাখা হয়েছিলো। ঘরের বাইরে ছাদ থেকে দরজা আটকে দেওয়া হয়েছে। আহসান পাগল, সে অনুযায়ী সে ঘর থেকে বের হয় না বলে সে আহসানকে নিয়ে ভাবেনি৷ তবুও রিস্ক নিতে চাইলেন না রওশন আরা৷ সেজন্যে বাইরে থেকে দরজা আঁটকে দিলেন।

তাওহীদাকে অজ্ঞান অবস্থায় তারা পানির ট্যাঙ্কে নিয়ে যায়। পারভীন বললো, ” তাওহীদাকে যদি এখান থেকে সরানো যায়, তাহলে আমরা শান্তি পাবো। এর জন্য আমাদের বিপথে যেতে হলো। কথায় কথায় অন্তত শাশুড়ীর হুমকির সম্মুখীন হবো না।”

সালমা একমত হয়ে বললো, “ঠিক। কেউ জানবেও না কী হলো। নিশ্চয়ই শাশুড়ীই এর ব্যবস্থা করবেন। আমাদের কাজ আমরা করলাম। কাক পক্ষীও টের পাবে না। সবাই অফিস থেকে ফেরার পর আমরা কিছু একটা ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে দেবো সবাইকে।”

“এতো কথা কিসের? কাজ শেষে এখান থেকে যাও। আমি সবাই ঘুমোলে এর একটা ব্যবস্থা করবো। হয় ছাদ থেকে ফেলবো, না হলে মা’টিতে পু’তে ফেলবো। আমি শত্রু কেন, শত্রুর ছায়াও আমার উপর পড়তে দেয় না৷ সম্পুর্ন নিশ্চিহ্ন করে ফেলি, ওরও কোনো চিহ্ন রাখবো না।”

পারভীন আর সালমা তাওহীদার জীর্নশীর্ন শরীর টাকে ছেড়ে দিয়ে তাওহীদার মাথা ডুবিয়ে দিলো। তাওহীদার শারীরিক অবস্থা যেহেতু তেমন ভালো নয় ওজনের দিক থেকে৷ তারপর বয়স সবে আঠারো শেষে উনিশ ছুই ছুই। চল্লিশ পয়তাল্লিশ কেজি বহন করা সালমা আর পারভীনের জন্য খুব একটা কঠিন নয় কারণ তাদের স্বাস্থ্য, দৈহিক শক্তি মোটামুটি ভালো। গুটিগুটি পায়ে সুরসুর করে নেমে গেলো ওরা দুজন। ছাদ থেকে যাওয়ার আগে রওশন আরা মোটর ছেড়ে রেখে গেলেন।ট্যাংকে ছলছল করে পানি পড়তে লাগলো। তাওহীদার মুখের উপর পানির ফোয়ারা পড়তেই কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে সে।

আহসান আসলে ঘরে ছিলো না। রওশন আরা জানতো না যে সে মাওলানার কাছে গিয়েছে সাহায্যের জন্য। মাওলানার সঙ্গে কথা বলে আহসান দ্রুত ছাদ বেয়ে উঠে ফিরে আসে। চিলেকোঠার দরজা আঁটকে আছে দেখে সে কিছুটা সন্দেহ করে। তাওহীদাকে আবার কেউ ভেতরে আটকে রাখেনি তো? একবার এই প্রশ্নটা তার অগোচর মনে এলো৷ দেরি না সে চিলেকোঠার দরজা খুলতে গেলে দেখলো শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। রশি খুলে ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পায় তাওহীদা নেই। সাধারণত তাওহীদা কখনো দরজা এভাবে আঁটকায় না। রাত নয়টার বেশি বাজতে চললো। তাওহীদার তো এতক্ষণে রান্না শেষ হওয়ার কথা। সে এসময় নামাজ পড়ে এশারের। আহসান বুঝলো যেহেতু তাওহীদা নেই রুমে তার মানে তাকে আঁটকে রাখার জন্য বাইরে থেকে বাঁধা ছিলো। যে তাকে আঁটকে রাখার উদ্দেশ্যে বেঁধেছে সে নিশ্চয়ই জানে না ঘরে নেই আহসান। তাকে আঁটকে এমন কিছু করতে চাইছিলো না তো কেউ যেটা সে যেনো না জানতে পারে? তাওহীদাও দরজা আঁটকে রাখতে চাইবে দরজাটা কেন রশির সাহায্যে বেঁধে রাখবে? নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে তার। কোনো এক অশনি সংকেতে বুক কেঁপে উঠলো তার। অস্থির হয়ে সে একটু একটু করে নিচে নেমে এদিক সেদিক দেখলো সবকিছুই কেমন যেনো নিস্তব্ধ। সে দেখলো তাওহীদা নেই, রান্না ঘর থেকেও টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। সে মফিজ উদ্দিন অর্থাৎ তার বাবাকে ফোন করলো। শুনলো অফিসে কাজের চাপ, আসতে আসতে এগারোটা পেরিয়ে যাবে। আনোয়ার আর সানোয়ার নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করেছে, ব্যবসা আলাদা করতে চাইছে। দুজনের দুই মতে অতিষ্ঠ মফিজ উদ্দিন। এক পর্যায়ে ব্যবসা ভাগাভাগি করার জন্য তর্ক করতে থাকে। মফিজ উদ্দিন সরাসরি বলেন ব্যবসা ভাগ হবে না। তারপর দুই ছেলেকেই অফিস থেকে বের করে দিয়েছেন কিছুক্ষণ পূর্বে। আহসান সবটা শুনে বাবাকে আর চিন্তায় ফেলতে চাইলো না৷ নিজেই খোঁজা শুরু করলো পাগলের অভিনয় করে। এঘোর, সেঘোর কোথাও নেই। সে নিরুপায় হয়ে উপরে উঠতে লাগলো। রিমিও নেই, পড়াশোনায় বেজায় ব্যস্ত এখন সে।

খারাপ কিছু হয়েছে আন্দাজ করতে পেরে আহসানের মাথা দপদপ করছে। সে ছাদে উঠে বাইরে গিয়ে খোঁজ করতে চাইলো। কিন্তু নামার সময় হুট করেই সে পানির ট্যাঙ্কের কাছে একটা সুক্ষ্ম আওয়াজ পেলো। ছাদে পানির কলকল আওয়াজে ভরে উঠল। হইতো সদ্য পানি উঠানো হচ্ছে ভেবে সে ছাদ বেয়ে নামতে যাবে তখনই কি যেনো একটা ভেবে ট্যাংক এর কাছে এগিয়ে গেলো। তারপর সন্দেহ দূর করতেই ট্যাংক এর ঢাকনা খুললো। এবং দেখলো তাওহীদার ক্লান্ত দেহ সেখানে, সে সাতার কাটার মতো অল্প পা, হাত দিয়ে শব্দ করছে। আহসান চিৎকার করে বলে, “আল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন!”

সে তাওহীদাকে পানির ট্যাঙ্ক থেকে বের করলো বহু কষ্টে। তাওহীদার সারা মুখ নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। পানি থেকে তুলতেই তাওহীদার জ্ঞান হারালো আবারও। হইতো অল্প কিছুক্ষণ পূর্বে জ্ঞান ফিরতেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই আওয়াজ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলো। আহসান পাগলের মতো তাওহীদাকে ঘরে প্রবেশ করলো। ভেজা কাপড় বদলে দ্রুত মাথা মুছে দিয়ে শরীর দিয়ে উত্তাপ দেওয়ার চেষ্টা চালালো। এই শীতে শরীর বরফের মতো ঠেকলো আহসানের। ওর দু চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। পাগলের মতো তাওহীদাকে বুকের সঙ্গে আগলে রেখে চুমু খেতে লাগলো। মুখ দিয়ে শ্বাস দিতে লাগলো সমান তালে। কম্বল দিয়ে শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে তাওহীদার শরীর উষ্ণ করার চেষ্টা চালাতে থাকে সে। তাওহীদার শ্বাস চলছে এটাই যেনো আহসানকে ঠিক রাখার একটা তাগিদ দিচ্ছে। সে প্রায় আবোল তাবোল বকতে থাকে। সে জানে তাওহীদার পূর্বের ন্যায় এবারেও কিছুই মনে থাকবে না। বশীকরণের কারণে বশে থাকাকালীন যা কিছু হয় তার বিন্দুমাত্রও মনে থাকে না বশে থাকা ব্যাক্তির। তাই তাওহীদারও মনে থাকবে না। রাত দুটোর দিকে তাওহীদার শরীর উষ্ণ হলে আহসান প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো। ঘরেই সে সব ব্যবস্থা করে তাওহীদাকে সুস্থ করতে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে গেলো।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তাওহীদা তখন ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেলো। আহসানকে তার হাত ধরে বসে থাকতে আবারও চমকালো সে। কিছুদিন পূর্বেও তাওহীদাকে এভাবেই আগলে রেখে মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাথা তুলতে চাইলো তাওহীদা৷ কিন্তু শরীর ম্যাজমেজে লাগছে, মাথায় ব্যথা করছে৷ আশ্চর্য ঠিক সেদিনের মতোই অনুভব হচ্ছে তার। তাওহীদা আহসানের মাথায় আদুরে ভাবে স্পর্শ করতেই তখন আহসান নড়েচড়ে উঠলো। তাওহীদা বললো, “কি হয়েছে আপনার? নিচে কেন আপনি?”

“শরীর কেমন তোমার?”

“মাথাটা ব্যথা করছে। আমার কি কিছু হয়েছিলো?”

“আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর কি তুমি নিচে মায়ের ঘরে গেছিলে?”

“না তো, আমি তো রান্না ঘরে গেছিলাম। এরপর কি হলো? আমার তো মনে পড়ছে না রান্না করেছিলাম কি না। ইদানীং আমি অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি। আশ্চর্য!”

“তাওহীদা, অনেকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছিলাম। তোমাকে বশ করা হতো। এই নিয়ে দুবার তোমাকে বশ করা হয়েছে। সেসব মা করেছে। তুমি যাকে ভালোবাসো, শ্রদ্ধা করো।”

তাওহীদা যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে এখন আর অবিশ্বাসও হয় না। ডায়েরির ব্যাপারে জানার পর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার। তার অল্প মনে পড়লো সে হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে যায় রান্না ঘরে যেতেই। তাওহীদা আজ সাহসা করে বললো,“আমার বিপদ এই বিষয়ে কোনো এক আগুন্তক আমাকে সাবধান করতেন। আমি জানি না সে কে। তার চোখ গুলো আমার চেনা, বড্ড চেনা। আপনার চোখের সঙ্গে মিল পেতাম অল্প বিস্তর! প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েছি কেবল এটা দেখার জন্য যে সে আমার পরিচিত কি না।”
আহসান করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো তাওহীদার পানে। এই মেয়েটা কি জানে সে জীবন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে আজ বেঁচে আছে? সে তাওহীদাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

“আগুন্তকের পরিচয় তোমার জানা উচিত।”

তাওহীদা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আগুন্তক কে?”

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-১৬+১৭

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৬
#রাউফুন

মমতাজ বেগমের জীবনে আরেকটি নতুন বিপদ আসন্ন। তার মেজো মেয়ে মানহার বয়স হয়েছে মাত্র চৌদ্দ বছর। চেয়ারম্যান তার জন্য একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই প্রস্তাব মমতাজের জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দিতে পারে।
চেয়ারম্যান সেদিন তার বাড়িতে এসে বলল,
“তোমার মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে। গ্রামে নানা কথা হচ্ছে। আমার ছোট ভাইয়ের জন্য ওকে বিয়ে দিতে পারো। এতে তোমার সংসারের অভাব দূর হবে। আমরা খরচ সব দেখে নেব।”

মমতাজ হতবাক হয়ে গেল। ছোট মেয়েকে এত কম বয়সে বিয়ে দিতে হবে—এই চিন্তায় তার বুক ধকধক করতে লাগল।
“চেয়ারম্যান সাহেব, আমি আমার মেয়েকে এখনই বিয়ে দিতে চাই না। ওর বয়স হয়নি। ওকে আমি পড়াশোনা করাব। এভাবে কথা বলবেন না।”

চেয়ারম্যান রাগে লাল হয়ে বলল,
“দেখো, আমি তোমার উপকার করতে চাইছি। কর্জ তো দিতে পারছো না। আমি না চাইলে তোমরা এখানে টিকতে পারবে না। আর মেয়েকে বিয়ে না দিলে কিন্তু সমস্যা আরও বাড়বে। ভাবো সময় থাকতে। কখন কে ছি*ড়ে খেয়ে ফেলে***!”

“খবরদার চেয়ারম্যান, অনেক বলেছেন। আমার মেয়েকে আমি কিছুতেই বিয়ে দেবো না। জান দিয়ে দেবো প্রয়োজনে। আল্লাহ যদি আমাক এভাবেই পরীক্ষা করতে চান তবে আমি প্রস্তুত!”

”কতো বছর থেকেই তো কতো কষ্ট করছো, সব দিক থেকেই৷ আর্থিক, যৌবনের ….!”

মমতাজ বেগম ক্ষীপ্ত হয়ে ঘর থেকে বটি হাতে বের হয়ে এলেন। তার মাথা সহ উড়না দিয়ে প্যাঁচানো। সুন্নতি পোশাকে পা অব্দি ঢাকা। জোড়ালো কন্ঠে,কি তেজ৷

“যদি আর একটাও বাজে কথা বলিস চেয়ারম্যান, আজ তোর মা’থা আলাদা করে দেবো। অনেক সহ্য করেছি তোর অন্যায়, জুলুম। আমি মেয়ে মানুষ বলে দূর্বল ভাবিস না। তোর মতো কুলাঙ্গারকে শেষ করলে আমার পাপ হবে না। আমাকে যেভাবে হেনস্তা করেছিস তার জন্য তোকে হ’ত্যা করা আমার জায়েজ হয়ে গেছে। আমাকে চরম ভাবে হেনস্তা করার জন্য চাইলেই তোকে এখানেই শেষ করে ফেলতে পারতাম, তাতে আমার যা হওয়ার হতো কিন্তু আমি আল্লাহর উপর ভরসা করি, তিঁনি যা ফয়সালা করবেন তাই আমি মেনে নেবো। কিন্তু সব অন্যায় আল্লাহ মেনে নিতে বলেন নাই৷ আমিও মানবো না আর তোর সব জুলুম, অন্যায় ভাবে আমাকে করা হেনস্তা!”

চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুর যেনো পিলে চমকে উঠে। সাথে সাথে দু কদম পিছিয়ে ছুটে পালাতে থাকে৷ শান্ত কেউ যখন রেগে যায় তখন সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে হিংস্র হয়ে যায়। মমতাজ বেগম হাতের বটি টা দূরে উঠানে ছুড়ে মারলো। জোহরা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে মাকে জড়িয়ে ধরলো। ভাগ্যিস মেজো আপা আর তার ছোটো ভাই নেই। সে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে চেয়ারম্যান এর বলা সব কথায় স্পষ্ট শুনেছে। এতোদিন তাদের মা তাদের থেকে এইসব আড়াল করতো। আড়ালে চোখের পানি ফেলতেন, নামাজে বসে আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলে প্রার্থনা করতেও দেখেছে সে। মানহা কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“আম্মা, চেয়ারম্যান আমাদের বাড়ি থেকে ছুটে পালালো কেন? কি হয়েছে?”

মমতাজ বেগম জবাব দিলেন না৷ দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। মানহা আবার মাকে জিজ্ঞেস করলে মমতাজ কিছু বললেন না। কেবল নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে কেঁদে উঠলেন। সেই রাতে তাওহীদার সঙ্গে সব কথা শেয়ার করলেন। তাওহীদা খুব শান্তভাবে বলল,
“আম্মা, চিন্তা করো না। আমি কোনোভাবে টাকা জোগাড় করব। তোমাকে আর মানহাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আছি। আমাদের বাবা নাই, আমার মাথার উপর হইতো শক্ত কোনো হাত নাই কিন্তু আমাদের জন্য আল্লাহ আছেন। আল্লাহর উপর সব পরিস্থিতিতেই তায়াক্কুল করতে কিন্তু তুমিই আমাকে শিখিয়েছো আম্মা। এখনই ভেঙে পড়ো না৷ তুমি শহরে চলে আসবে প্রয়োজন পড়লে। আমি সব ব্যবস্থা করবো। ”

তাওহীদার কথায় মমতাজ বললেন,“শহরে গিয়ে কোথায় থাকবো, তোর বাবার কবরটা যে এখানেই। আমি তাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো? আমার শেষ সম্বল টা কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাই না। ”

“কিছু হবে না আম্মা, ভয় নেই। ভরসা রাখো আল্লাহর উপর, আমাদের সঙ্গে আল্লাহ আছেন। তুমি এখানে শহরে আসো আম্মা, আমি আছি!”

মমতাজ তার তাওহীদার দেওয়া সাহসে ভরসা পেলেও চেয়ারম্যানের ভয়াবহ প্রভাব তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।

ঘরের পরিস্থিতি জটিল হলেও তাওহীদা তার সিদ্ধান্তে অবিচল রইল, সে পড়াশোনার পাশাপাশি স্বামী, সংসার সামলাচ্ছে। মাদ্রাসায় গিয়ে তার আরও একজন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে পরিচিয় হলো। মেয়েটির নাম সাবিহা। বয়সে একটু বড় হলেও খুব শান্ত স্বভাবের। সাবিহার জীবনেও কিছু কঠিন সমস্যা ছিল। তার বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। সে তার মাকে সাহায্য করে সংসার চালায়। একটা ছোটো মাদ্রাসায় বাচ্চাদের আরবী শেখায় অর্থ সমেত।

তাওহীদা আর সাবিহার মধ্যে দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মাদ্রাসার বিরতিতে তারা একসঙ্গে গল্প করছিল। সাবিহাকে তাওহীদা বলল,
“তুমি অনেক ধৈর্যশীল মেয়ে। এত কিছু সহ্য করেও তুমি শক্ত থাকো।”

সাবিহা হেসে বলল,
“আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি বলেই শক্ত থাকতে পারি। এই দুনিয়ার সবকিছুই অস্থায়ী। বিপদ, কষ্ট—সবই পরীক্ষার অংশ। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা বাকারা: ১৫৫)”

তাওহীদা অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কোরআননের এত ভালো অর্থ জানো! আমারও শেখা উচিত। আল্লাহর দেওয়া নিদর্শনের কথা জানলে আমাদের জীবন সহজ হয়ে যাবে।”

তখন রুশদা এসে তাদের সঙ্গে এসে বসলো। সাবিহার সঙ্গে রুশদার আগে থেকেই পরিচয়। সাবিহার ব্যাক্তিগত কিছু কারণে এতোদিন মাদ্রাসায় আসতে পারেনি। রুশদা ওদের মাঝ খানে বসে বললো,“আমাকে ছাড়া তোমরা কি গল্প করছো?”

“অনেক কিছু, তোমাকে আমি মিস করছিলাম!” তাওহীদার কথায় অবাক হয়ে বলল,“সত্যিই তাহু? ইশ কি কিউট তুমি!”

”আমাকে তো কেউ চোখেই দেখছে না।”

সাবিহার কথায় হেসে ফেললো ওরা দুজনে। তম্বন্ধে হুজুর ক্লাসে প্রবেশ করলো। তারা তিনজনেই চুপচাপ হয়ে ক্লাসের পড়ায় মনোযোগ দিলো।

সেদিন মাদ্রাসা থেকে ফেরার পথে তাওহীদা লক্ষ্য করল, একজন অচেনা ব্যক্তি তাদের মাদ্রাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি মুখ ঢাকা। কিন্তু হুট করেই তাওহীদার সেই ব্যাক্তির চোখে চোখ পড়লো। সে চোখ জোড়া দেখেই চমকে উঠল। তাওহীদাও মনে মনে ভাবল,
“এই চোখগুলো আমার খুব চেনা খুব চেনা। মনে হচ্ছে কোথায় যেনো দেখেছি। কিন্ত কোথায় দেখেছি?”

লোকটি একটা কাগজে কি যেনো রেখে সেখান থেকে চলে গেল। তাওহীদা সেখানে গিয়ে কাগজে মোড়ানো জিনিসটা তুলে নিলো। অদ্ভুত সেই জিনিসটা হাতে নিয়েই যেনো ওর শরীর কাঁপতে লাগলো। কি এটা? তাওহীদা নিজের মনে কিছুক্ষণ ভাবল,
“কে হতে পারে এই লোক? কেন সে আমাকে এভাবে দেখে? আমার কাছে সে কি চায়?”

সেই সন্ধ্যায় আহসানের কাছে এই ঘটনা শেয়ার করতে গিয়েও সে কিছুই বলল না। তার মনে হলো, এখন এসব বলার সময় নয়। তবে তাওহীদা নিজের মায়ের সংকটের কথা জানালো। রাতে সবার খাওয়া দাওয়া হলে আহসান আর তাওহীদার মধ্যে ছোট্ট একটা সংলাপ হয়। তাওহীদা বললো,“আমার আম্মা এই জীবনে অনেক কষ্ট করেছে আহসান। এখন যে বিপদে পড়েছেন আম্মা, তা ভয়াবহ। চেয়ারম্যান লোকটা ডেঞ্জারাস। সে এখন মানহার উপর নজর দিয়েছে। আমার ছোট্ট একটা বোন, ওকে কি এখন বিয়ে দেওয়া সম্ভব? তাও যদি চেয়ারম্যান এর ভাই লোকটা যুৎসই হতো, ভালো মানুষ হতো!”

আহসান সবকিছু শুনলো। শান্ত গলায় বলল,
“তাওহীদা জানো, আমি একটা জিনিস শিখেছি। জীবনে যদি কষ্ট না থাকে, তাহলে মানুষ কখনো আল্লাহর দিকে ফিরে তাকায় না। আর এই কষ্টগুলোই আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। আল্লাহ মাকে সব দিক থেকে কুন্ঠিত করে তাকে পরীক্ষা করছেন। সকল পরিস্থিতিতে তিঁনি আল্লাহর প্রতি কতটা ভরসা করেন সেই পরীক্ষা। মুমিন ব্যাক্তিরা আল্লাহর অতি প্রিয়, আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তার প্রিয় বান্দা বান্দী দের পরদে পরদে পরীক্ষা করে ইমানের দূর্বলতা, সবলতা যাচাই করেন। ইন-শা-আল্লাহ সব কিছু একদিন ঠিক হয়ে যাবে। তুমি মাকে শহরে নিয়ে এসো। আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করবো। মা যদি এখানে নাও থাকতে চান সমস্যা নেই। আমি উনার ভালো থাকার ব্যবস্থা করবো! চিন্তা করো না, যেকোনো পরিস্থিতিতে তুমি আমাকে পাশে পাবে।”

তাওহীদা মৃদু হেসে বলল,
“ঠিক বলেছো। আল্লাহর পরীক্ষার মধ্যেই আমাদের ইমানের পরীক্ষা লুকিয়ে থাকে। সাহস আর ধৈর্য দিয়ে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। আমি কখনোই আল্লাহর উপর থেকে ভরসা হারাবো না ইন-শা-আল্লাহ।”

আহসান তার ললাটে নাক ঘষে বললো,“ঘুমাও, সকালে মাদ্রাসা আছে তো!”

“আমার পড়াশোনা মা পছন্দ করেন না আহসান। আমাকে মা এতোটা অপছন্দ করেন কেন বলবে? আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়। বড়ো ভাবি, মেজো ভাবি আমি তো তাদের কখনোই খারাপ চাইনি বা কখনোই খারাপ আচরণ করিনি তবে তারা কেন আমায় এতো অপছন্দ করেন? আমি জানি একদিন এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ নিজেদের শুধরে নেবে। আমি সবাইকেই আল্লাহর পথে নসিহা করেছি সব সময়। কিন্তু এক সময় এসে আমি বলা বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাকেই নসীহা করতে বলেছেন যে পরম করুণাময় আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করবে।”

আহসান করুণ চোখে তাওহীদার দিকে তাকালো। কপালে আর্দ্র ঠোঁটে চুমু এঁকে বললো,“তোমার মতো মেয়েকে একবার যে চিনবে সে কখনোই আর খারাপ ব্যবহার করবে না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার সঙ্গে, আমি সব ঠিক করে দেবো।”

হঠাৎই তাওহীদা আহসানের চোখের দিকে তাকালো৷ ভীষণ ভালো ভাবে পরখ করলো চোখ। মনে পড়লো সেই আগুন্তকের দেওয়া কাগজে মোড়ানো পুটুলির কথা। সেই কাগজটা এখনো খুলে দেখেনি সে। কি আছে সেটা দেখার সাহস তার হয়নি৷ কেন যেনো অদ্ভুত ভাবে একটা ভয় গ্রাস করছে তাকে। আহসান তাওহীদাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তাওহীদাও ভরসা পেয়ে আহসানের বুকের সঙ্গে মিশে রইলো। অনুভব করল, জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ তাকে আরও শক্তিশালী করবে যদি এই মানুষ টা তার পাশে থাকে। এই যে প্রতিটি দিন তাকে জা, শাশুড়ীর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে। সংসার টা যেনো একটা যুদ্ধক্ষে’ত্র আর সে এই সংসারের ঢাল। যে প্রতিটি বিষয় সুক্ষ্মভাবে সামলাচ্ছে।

মানুষের জীবনে যত ঝড়ই আসুক না কেন, সেই ঝড় তার ধৈর্য আর ইমানের মাধ্যমে থেমে যায়। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন এই কথাটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাওহীদা বেঁচে আছে। কোনো আক্ষেপ নেই এই জীবন নিয়ে।
বেশ তো চলছে জীবন। তাওহীদার মাথায় হাত বুলানোই সে ঘুমিয়ে পড়লো, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আহসান আস্তে আস্তে উঠে তাওহীদার ব্যাগ থেকে পুটলিটা নিয়ে ছাদে চলে গেলো।

#চলবে

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৭
#রাউফুন

তাওহীদা ভোরবেলা নামাজ পড়ে বাগানে বসে ছিল। চারদিকে শান্ত পরিবেশ, পাখির ডাকে মন ভরে যায়। এই ছোট ছোট সময়গুলোতেই সে নিজের শক্তি খুঁজে পায়। সেদিনও তার মন শান্ত হচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই কালো জাদুর ব্যাপারটা ভুলতে পারছিল না।

তার ভেতরে একটা সন্দেহ জন্ম নিচ্ছিল,
“কেন আমায় এভাবে কেউ আমার বিরুদ্ধে জাদু করবে? এর পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী? সেই আগুন্তক কে? তাকে পূর্ব থেকেই কিভাবে সাহায্য করছিলো? তার আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সে কিভাবে অবগত ছিলো? কেমন ধোয়াশা লাগছে সবকিছু আমার। কি করব আমি?”

এই ভাবনায় ডুবে থাকা অবস্থায় আহসান বাগানের দিকে এসে বলল,
“তাওহীদা, চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাই। তোমাকে কিছু দেখাতে চাই।”

তাওহীদা অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”

আহসান কিছু বলল না। তাওহীদাকে নিয়ে সে পুরনো একটা ছোট্ট বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেল। যেই বাড়িতে তাওহীদা কখনোই যায়নি৷ বাড়িটা আহসানের দাদুর। ভোর বেলায় বাড়ির কেউ উঠে না ঘুম থেকে৷ সেই সুযোগে সহজেই গিয়ে আবার ফিরে আসা যাবে। তাওহীদা বেশ চমকালো। এই বাড়িটা সে প্রায়ই বন্ধ অবস্থায় দেখতো। একটা ছোট্ট ঘর, এটা তাদের বাড়ির বাম দিকের আপার সাইডেই অবস্থিত। মাদ্রাসা যাওয়ার সময় অল্প একটু নজরে আসতো তাওহীদার। সে অবাক হলো। আহসানকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আহসান নিজে থেকেই বললো,“আমার দাদুর বাড়ি এটা।”

তাওহীদা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। বললো,
“ আগে তো কখনোই কেউ আমায় এ কথা বলেনি। এই বাড়িটা এমন অবহেলায় কেন ফেলে রাখা হয়েছে?”

“আমাদের হাতে সময় কম তাওহীদা। কথা বলে সময় নষ্ট করা যাবে না। যখন তখন যে কেউ উঠে পড়লে বিপদে পড়বো আমরা।”

দুজনেই এক দরজা বিশিষ্ট রুমে ঢুকলো। যেনো একটা ছোট্ট কুঠুরি। ভেতরে প্রবেশ করার পর তাওহীদার চমকানো বাড়লো। যদি দীর্ঘদিন কেউ এই বাড়িতে কেউ না এসে থাকে তবে তো অপরিষ্কার থাকার কথা৷ এখানে কি আসার পর তার মনে হলো রোজ কেউ এখানে আসে। আর সময় কাটায়। সে অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো,“এখানে কেউ আসে, কে আসে বলো তো?”

সেখানে একটা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আহসান বলল,
“এখানে একটা জিনিস রাখা আছে, যা হয়তো তোমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে।”

আলমারির ভেতর থেকে সে একটি পুরনো ডায়েরি বের করল। তাওহীদার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এই ডায়েরিটা আমার দাদুর। উনি অনেক কিছু লিখে গেছেন, যা হয়তো আমাদের এই ঘরে চলা ঝামেলার পেছনের কারণটা পরিষ্কার করবে।”

তাওহীদা ডায়েরিটা খুলে পড়া শুরু করল। সেখানে লেখা ছিল,
“আমার সম্পত্তির লোভে রওশন আরা এমন কিছু কাজ করিতেছে, যা একদিন আমাদের পুরো পরিবার, এই সংসার, পুরো প্রজন্ম ধ্বংস করিয়া দিতে পারে। আমি জানি, সে কালো জাদুর আশ্রয় নিয়াছে আমাকে বশ করার জন্য, কিন্তু সে হইতো এই বিষয়টাতে অজ্ঞ, কালো জাদু একজন ইমানদার ব্যাক্তির উপর প্রভাব ফেলিতে পারার পূর্বেই তাহা তার কাছে প্রকাশ পাইবে। সে আমার পুত্রের স্ত্রী, আমার কন্যা সমতুল্য, আমি তাকে স্নেহ করি। তাই আমি কিছু কাহোকে বলিতে পারিবো না আর না তাহার কোনো ক্ষতি করিতে পারিবো। আমার মৃত্যু হইলেও তাকে এক কানা কড়িও দিবো না। যদি আমি জানিতাম সে লোভি নয় তবেই তাকে দিতাম। আমার মূল্যবান সম্পদ আমি এই ছোট্ট কুঠুরির আমার গোপন এক স্থানে জ্বীন দের দ্বারা পাহারায় লুকাইয়া রাখা আছে, যা কেহো জানে না৷ এই ডায়েরিটা তোমাদের জন্য রাখিয়া গেলুম, যাতে সত্য প্রকাশ পায়। আর তোমরা সাবধান হতে পারো। আমার প্রিয় পুত্র মফিজ, তোমার কাছে এই ডায়েরি টা যেনো পড়ে এই আশায় করিবো, না হইলে এমন কেউ জানিতে পারুক যে কি না আমার সম্পত্তির লোভ করিবে না। আর পুত্র মজিফ, আমাদের বংশে কেউ কখনো স্ত্রীকে তালাক দেয় না, আমি জানি সত্য জানিলে তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাহিবে, তা কখনো করিও না। ইহা আমার আদেশ।”

তাওহীদার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
“এত বড় একটা সত্য এতদিন ধরে আড়াল রয়েছে? মা এসবের সঙ্গে জড়িত?”

তাওহীদার চোখের পানি গড়িয়ে গাল বেড়ে পড়লো। তাওহীদার চোখের পানি মুছে দিয়ে আলগোছে তাওহীদাকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো আহসান৷ সবার জেগে উঠার আগেই নিজেদের রুমে ফিরে এলো। পুরো টা সময় তাওহীদা স্তব্ধ হয়ে ছিলো। আহসান তাকে গ্লাসে পানি দিলে ঢকঢক করে পান করলো তাওহীদা। তাওহীদার মনে হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতেই আহসান বলতে লাগলো,

“আমার দাদুর ভীষণ বুদ্ধি ছিলো। তিনি সেই সাথে জ্বীনদের সঙ্গে কথাও বলতেন। তুমি যদি ডায়েরিটা পুরো টা পড়ো তবে দেখবে সেখানে সকল কিছুর সমাধান আছে। আর রইলো দাদুর গুপ্ত সম্পদের কথা, সেগুলো দাদুর রেখে যাওয়া জ্বীন পাহারা দিচ্ছে। জ্বীনরা মন্দ, বদকারলোক দেখলে চিনতে পারে। বদকাররা যদি এই ঘরের আশেপাশেও আসে তবে তাকে ভয় দেখিয়ে জ্বীন তাড়িয়ে দেয়। আর সেই ঘরে যে গুপ্ত সম্পদ লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা মা জেনে যায়। আমি যখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন কৌতূহল বশত এই বাড়িতে প্রবেশ করি। আমি মাঝে মধ্যেই দেখতাম বাবা এই বাড়িতে আসতেন, আর দাদুকে স্মরণ করে চোখের পানি ফেলতেন৷ মাও জেনে যায় এই ঘরটা আমার দাদুর, যেখানে গুপ্ত সম্পদ লুকানো রয়েছে। বাবা জানলেও দাদুর সম্পদে হাত লাগাতেন না দাদুর স্মৃতি ধরে রাখতে। কিন্তু মায়ের লোভ তীব্র। ছোটো বেলা থেকে অভাব অনটন দেখে বড়ো হওয়া মায়ের বড়ো বাড়িতে বিয়ে হওয়ার দরুণ মায়ের উচ্চাঙ্ক্ষা বেড়ে যায় দিনকে দিন। মা সম্পত্তি পাওয়ার লোভে কালো জাদুর আশ্রয় নিয়ে দাদুকে বশে রাখতে চাইতেন। কিন্তু দাদুর সঙ্গে থাকা জ্বীনের জন্য দাদুর উপর জাদু কাজ করেনি, কয়েকদিন জাদুর প্রভাব পড়লেও দাদু আবার সুস্থও হয়ে যান। বাবা, আমি এই ডায়েরি পড়েই সবটা জেনেছি। মায়ের বাড়াবাড়ি টা আমার সহ্য হয়নি। আমি মাকে এই বাড়াবাড়ি করতে বাঁধা দেওয়াই মা আমাকে কালো জাদু করলেন। একবারও ভাবলেন না আমি তার সবচেয়ে আদরের সন্তান। তার গর্ভেই আমার বিচরণ ছিলো দশটা মাস। সেই মা যে শুধু মাত্র কিছু মূল্যবান সম্পদের জন্য এতোটা নিম্ন মানের কাজ করেছে, ভাবলেই আমার গা কা’টা দিয়ে উঠে। আমি দুই বছর পাগল ছিলাম, বাকি এক বছর থেকেই পাগলের অভিনয় করছি। যদি মা কোনো ভাবেই জেনে যায় তবে আমাকে আবারও কালো জাদু করবেন। তাই আমি লুকিয়ে চুরিয়ে কালো জাদু থেকে বাঁচার জন্য একজন রাকিনের সঙ্গে দেখা করি। সবটাই বাবা করান৷ বাবার সাহায্যেই আমি সুস্থ হয়ে যায়। বাবা যে দেরি করে আসতেন মাঝে মধ্যে সেটা আমার জন্যই।”

“এতোদিনে বাড়ির কেউ-ই শাশুড়ী মায়ের ব্যাপারে কিছুই টের পেলেন না?”

“সবাই জানে, শুধু তুমি ব্যতীত। বড়ো ভাইয়া, মেজো ভাইয়া তাদের স্ত্রীরা সবাই জানে। ওরা জানে তুমি নির্লোভ, নিরহংকারী নারী। তুমি যদি কোনো ভাবে ধন সম্পদের ব্যাপারে জেনে গিয়ে সেসবের সন্ধানে কুঠুরিতে যাও, আর জেনে যাও সবকিছু তবে ওদের বিপদ। জ্বীন নির্লোভ একজনের হাতে তুলে দেবে। তুমি নির্লোভ তাই সবচেয়ে ভয় তোমাকেই ওদের। টার্গেট আমি থেকে তোমাতে পড়লো ওদের।”

“আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না আহসান। প্লিজ আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন। আমি যে আর এসব নিতে পারছি না।”

তাওহীদাকে জাপটে ধরলো আহসান। তাওহীদা অনাক্রমণ ভাবে সত্যি টা জেনে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। ক্ষনে ক্ষণে হাতের বাঁধন শক্ত হতে লাগলো।

এদিকে গ্রামের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠেছে। চেয়ারম্যান তার হুমকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মমতাজ বেগমকে গলা পর্যন্ত ঋণের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছেন না তিনি।

এচেয়ারম্যান সরাসরি তার বাড়িতে রুমেও ঢুকে গেলো। আজ সে একা আসেনি। লোকজন নিয়ে এসেছে। সেদিনের মমতাজের তাড়া খেয়ে আজ আর সাহস করেনি একা আসার। শামসুজ্জামান দুদু বাকা হেসে বলল,
“দেখো, আর সময় নেই। তোমার মেয়ে জোহরাকে আমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দাও। নইলে এই বাড়ি ছাড়তে হবে।”

মমতাজ অসহায়ের মতো বলল,
“আমার মেয়েকে এভাবে বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে সময় দিন।”

চেয়ারম্যান হেসে বলল,
“আল্লাহ তোমাকে বাঁচাবে? টাকা-পয়সা ছাড়া এই দুনিয়ায় কিছু হয় না। আর তোমার এই পুচকে ছেলেকে বলো, যেন আমাদের ঋণ মিটিয়ে বোনকে বাঁচায়। এটুকু ন্যাংটা ছোড়ার কি দম্ভ, আমাকে হুমকি দেয়।”

রাগে কাঁপছিল ছোটো স্বাধীন। বয়স তার অল্প কিন্তু তেজ ভীষণ প্রখর। সে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“আপনার অন্যায় কাজ আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
মমতাজ ছেলের কথা শুনে চমকে উঠলেন। এইটুকু ছেলে আইনের কথা বলছে? কোত্থেকে শুনেছে? আশ্চর্য হয়ে ছোটো ছেলেকে দেখতে লাগলেন মমতাজ। জোহরা আর মানহা রুমের এক কোণে একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে ভয়ে।

“মমতাজ বেগম, বেগম সাহেবা, তোমার পোলার দেহি ম্যালা সাহস। ওরে কও মুখে লাগাম টানতে। এতো তেজ দেখানো উচিত না রক্ত গরম তাই টগবগ করে ফুটছে৷ কিন্তু আমি সেই টগবগ করা রক্ত থামিয়ে দিতে পারি এক নিমিষেই। বলা তো যাই না কখন কি হয়।”

মমতাজ স্বাধীনকে জড়িয়ে ধরলেন। করুণ কন্ঠে বললেন,“আপনি চলে যান আমি একটা ব্যবস্থা করে রাখবো।”

“বেগম সাহেবার হুকুম যথার্থ। তবে এখন আমি যাই, বিকেলে আবার আসবো। বিকেল অব্দি তোমার সময়!”

চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার পর মমতাজ স্বাধীনকে বলল,
“তুই মাথা ঠান্ডা রাখ। ওরা প্রভাবশালী লোক। আমাদের কিছু হলে কে দেখবে? দেড় ইঞ্চির ছেলে হয়ে এতো বড়ো বড়ো কথা বলিস? তোর কি বাপ আছে যে তোর কিছু হলে বাঁচাবে?”

ছোটো স্বাধীন মৃদু স্বরে বললো,
“আম্মা, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। অন্যায় কখনো টিকে থাকে না। তুমি আর কাঁদবে না আম্মা। আমি বড়ো হয়ে ওদের একেকটাকে লাথি মা’রবো।”

ডায়েরির তথ্য জেনে তাওহীদা নিজের সিদ্ধান্ত নিল। সে চুপ করে আর সব সহ্য করবে না। প্রথমে সে রওশন আরার মুখোমুখি হলো। কিন্তু সে বুঝতেও পারলো না আহসানকে না জানিয়ে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সে সরাসরি রওশন আরার কক্ষে গিয়ে বললো,

“মা, আপনি কেন আমার সঙ্গে এরকম নোংরা একটা কাজ করেছেন? কালো জাদু করে আপনি কি কিছু অর্জন করতে পারবেন? আল্লাহ সব দেখেন, শুনেন। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেবেন না। আপনি যদি এখনো নিজের ভুল শোধরাতে চান, তাহলে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে সঠিক পথে আসুন। আল্লাহকে ভয় করুন, কুফরি করবেন না আর। আমি আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি, একই সঙ্গে ভালোবাসি। আমি চাইবো না আপনার বাজে কিছু হোক, পরকালে আপনি দোজখের আগুনে পুড়েন। এখনো সময় আছে মা। ”

রওশন আরা প্রথমে মনে মনে ভড়কে গেলেও কিছু বললো না। নির্বিকার চিত্তে পান মুখে পুড়ে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাওহীদা যেনো সেই চাহনীতে ভয়ে গুটিয়ে গেলো। এই চাহনী এতো ভয়ংকর কেন? মায়েদের চোখ বুঝি এমন ভয়াবহ হয়? মায়েদের চোখে তো থাকে কোমলতা, এক আকাশ সম স্নেহ!

#চলবে