Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 29



প্রাণ বসন্ত পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৪
#রাউফুন

তাওহীদা যখন চোখ মেলে চাইলো দেখলো আহসান তার হাত ধরে বসে আছে। খাটের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। সে নড়েচড়ে বসতেই আহসান চমকপ্রদ ভাবে তাকালো। বললো,“তোমার ঘুম ভেঙে গেছে তাওহীদা?”

“হুহ?”
“মাথা ব্যথা করছে?”
“আপনার গলার স্বর এমন লাগছে কেন? আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকলেন?”

আহসান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই পকেটে হাত রাখলো। খুব স্বাভাবিক তার আচরণ। তাওহীদা এক আকাশসম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আহসানের পানে। আশ্চর্য মানুষ টাকে আজ অন্য রকম লাগছে কেন? মাথায় প্রেসার ক্রিয়েট হতেই তাওহীদা মাথা চেপে ধরলো। মাথায় এতো যন্ত্রণা করছে কেন?

“নিজের মাথাকে এতো চাপ দিও না৷ অসুস্থ তুমি!”
“আপনার কি হয়েছে? এমন অস্বাভাবিক কেন লাগছে?”
“আসলেই? অস্বাভাবিক লাগছে?”
আহসানের হেয়ালিপূর্ণ কথায় বিছানা থেকে নামলো তাওহীদা। সোজা আহসানের সামনে গিয়ে গালে মুখে হাত ছুঁয়ে দেখলো৷
“তুমি রেস্ট নাও। এতো অস্থিরতা তোমার শরীরের জন্য ভালো নয়!”
“আপনাকে অস্বাভাবিক নয়, একদম সুস্থ, স্বাভাবিক লাগছে। আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন। আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন৷ আল্লাহর কাছে হাজার কোটি লাখ লাখ শুকরিয়া। এক্ষুনি বাবাকে জানাতে হবে। বাবা, বাবা!”
আহসান তাওহীদার ছোটাছুটি থামিয়ে দিলো হাত ধরে। তাওহীদা অঝরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। এই কাঁন্না আনন্দের, এমন একটা দিনের স্বপ্ন সে কতো দেখে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তার ডাক শুনেছে।
“রিল্যাক্স, শান্ত হয়ে বসো। কই যাচ্ছো?”
“আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন, বাবাকে জানাতে হবে, সবাইকে জানাতে হবে!”
“কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই, তুমি চুপচাপ বসো স্থির হয়ে। এতো অস্থিরতা তোমার শরীরের জন্য ভালো নয়।”

তাওহীদা কিছু না ভেবে আহসানের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। হুহু করে স্বশব্দে কাঁদতে লাগলো।
“কেঁদো না। তোমাকে কিছু প্রশ্ন করছি, বলো তো কি হয়েছিলো তোমার? রান্না ঘরে ওভাবে পড়ে ছিলে কেন?”

তাওহীদার চমকে যাওয়া পালাক্রমে বেড়েই চলেছে। আশ্চর্য মানুষ টা তবে আরও আগে থেকে সুস্থ? রান্না ঘরে সে কখন গেলো? তার কিছু মনে পড়ছে না কেন?
সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো,“আমি রান্না ঘরে পড়ে থাকবো কেন? আমি তো ঘরেই ছিলাম। কাল আপনাকে বললাম না? মা আমাকে অনেক আদর করে খাইয়ে দিয়েছেন৷ আমি খেয়ে দেয়ে ঘরে চলে এসেছি!”

আহসান চট করে দাঁড়ালো। ত্যাছড়া ভাবে বললো,“আমার মিথ্যা পছন্দ নয়, তুমি তো মিথ্যা বলো না!”

“আমি মিথ্যা বলছি না৷ সত্যিই আমি কিছু মনে করতে পারছি না৷ আপনি এমন রেগে যাচ্ছেন কেন? বাপরে আপনি রাগ করতেও জানেন?”
“আমি সুস্থ এটা কাউকে জানাবে না৷”

কথা শেষ করেই আহসান রুম থেকে প্রস্থান করলো। তাওহীদার সুস্থতার জন্য সে সবটুকু চেষ্টা করেছে। প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। আপাতত তাওহীদা সুস্থ। জাদুর প্রভাব তাওহীদার উপর পড়বে না৷ এরকমই একটা দিন তো তার জীবনেও এসেছিলো। কি ভয়ংকর ছিলো সেই দিন। তাওহীদা আহসানকে দেখে বোঝার চেষ্টা চালালো। মানুষটার মনে কি চলছে কারোর বোঝার উপায় নেই।
আহসান ছাদের রেলিঙে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। গতকাল রাতে সে যদি সময় মতো না যেতো কি হতো মেয়েটার? একবারও ভেবেছে? তার মায়ের হঠাৎই বদলে গিয়ে অতিরিক্ত ভালো মানুষি দেখানোই মেয়েটা একটুও বুঝলো না ভেতরে ঘাপলা থাকতে পারে? মেয়েটা এতো বোকা আর সহজ সরল কেন?

তাওহীদা আহসানের পিছনে পিছনে ছাদে এসে দাঁড়ালো। রাগান্বিত আহসানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললো,“আমি জানি না আপনি কেন কাউকে কিছু জানাতে বারণ করেছেন, যদি সত্যিইই না চান তবে এটা লুকায়িতই থাকবে। স্বামীর আনুগত্য করা প্রত্যেক স্ত্রীর কর্তব্য।”

আহসানের রাগে মাথা দপদপ করছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। কিন্তু এই বোকা মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই? সে ঘুরে তাওহীদাকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরলো। তাওহীদার সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি হলো৷ অসুস্থ অবস্থায় তো মানুষ জড়িয়ে ধরতো, তখন তো অনুভূতি এতটা তীব্র ছিলো না৷ সুস্থ অবস্থায়, সুস্থ মস্তিষ্কে তাকে আদর করছে বলেই কি এতোটা প্রবল এই অনুভূতি? লজ্জায় নতজানু বুক থেকে মুখ তুলতে পারলো না তাওহীদা।

“এমন ছটফট করছো কেন? চুপচাপ থাকো।”

তাওহীদার কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে। গলার স্বর যেনো কেউ চেপে ধরেছে। একটাও কথা কণ্ঠনালী হতে নির্গত হলো না৷ আহসান কিঞ্চিত হেসে রুদ্ধ কন্ঠে বললো,“রুমে চলো৷ ছাদ আমার জন্য এখন নিরাপদ নয়! তাছাড়া তুমি বড্ড নড়াচড়া করছো।”

পরক্ষনেই তাওহীদাকে নড়াচড়া না করতে দেখে আহসান ঠোঁট চেপে হাসলো। কিছু তম্বন্ধে তাওহীদাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। তাওহীদার শরীর আবারও কেঁপে উঠলো। দুই হাতে চেপে ধরলো আহসানের ঘাড়। বক্ষে নিজের মুখ লুকিয়ে একদম মিশে রইলো। রুমে যাওয়ার পর কি হবে? নিশ্চয়ই ভয়াবহ কিছু। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া তাওহীদা মাথা আরও চেপে ধরলো আহসানের বক্ষে। সে এবারে বুঝি লজ্জায় মারায় যাবে। মানুষটা কি করবে? যদি কিছু….না না আর ভাবতে পারছে না তাওহীদা। নিজের ভাবনায় নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানালো। ইশ কি ভয়াবহ চিন্তা ভাবনা তার! কি আশ্চর্য, এমন ভাবনা নিজের মস্তিষ্কে কেন বিচরণ করছে? সে একদমই এই ভাবনা গুলো নিতে পারছে না।

“এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন? এতোদিন তো আমাকে গোসল করিয়ে, পোশাকও বদলে দিতে তখন লজ্জা করেনি?”

সুস্থ আহসান যে এমন বেফাঁস কথা বলবে তাকে বেসামাল করে দিতে সে ঘুনাক্ষরেও ভাবে নি। এমন কিছুর আভাঁস পেলে বা আন্দাজ করতে পারলে সে চাইতো আহসান সব সময় সেই বাচ্চার মতো অসুস্থ অবস্থায় থাকতো আর সে সেবা-যত্ন করতো নির্দ্বিধায়! সে কখনোই ক্লান্ত হতো না। এতো দিন সে সব সময় চাইতো মানুষ টা সুস্থ হয়ে যাক দ্রুত, কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর অবাধ্য মন চাইছে মানুষটা অসুস্থ ছিলো বেশ তো ছিলো। এমন ঠোঁট কা’টা, বেহায়া লোকটাকে সে সামলাবে কিভাবে? আহসান রিনরিনে, পুরুষালী কন্ঠে বললো,

“কথা বলছো না কেন?”
“কোল থেকে নামান!”
“নামাবো?”
আহসানের ঘোর লাগা কন্ঠের প্রশ্নে আলতো মাথা নাড়লো তাওহীদা। যার অর্থ হ্যাঁ! আহসান তাওহীদাকে জ্বালাতে বললো,
“মুখে বলো, বুঝতে পারছি না!”

তাওহীদা আরও মিইয়ে গেলো। সে রা টিও কাটতে পারলো না। আহসান মৃদু শব্দে হো হো করে হাসলো।

মাদ্রাসার জন্য তৈরি হলো তাওহীদা। ব্যাগ কাধে নিয়ে বের হতেই রওশন আরা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাওহীদা থমকে দাঁড়ালো। আমতাআমতা করে বললো,“আজ উঠতে দেরি হয়েছে মা। দ্রুত মাদ্রাসায় যেতে হবে। সময় নেই!”
“রান্না কে করবে?”
পেছন থেকে রিমি বললো,“কেন মা? তুমি আর আমি করবো! ছোটো ভাবি তুমি যাও!”
রওশন আরা আপাদমস্তক অবলোকন করলো তাওহীদাকে। এই মেয়ে এমন ঝলমলে, খুশি খুশি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে? ওষুধের প্রভাব কি একটুও পড়লো না? পড়লে তো আজ মাদ্রাসায় যাওয়ার নামই মুখে নিতো না অন্তত। সে ভাবলো আস্তে আস্তে কাজ করবে। সে হাসার অভিনয় করে বললো,“রিমি তুই সব সময় আমাকে কেন কাঠগড়ায় করাস? আমি তো বলতে চাইছি না খেয়ে কেন যাবে ও?”

রিমির ভ্রুদ্বয় আপনাআপনি কুঞ্চিত হলো। তাওহীদার ভয় কিছুটা দূর হলো। শাশুড়ীর এটুকু যত্ন নেওয়া দেখে আবেগে আপ্লুত হলো। তার কপালে বুঝি সুখেরা এসে ধরা দিলো তবে! সে কোনো রকমে বললো, “ক্যান্টিনে খাবো মা! আজ সময় নেই একদম!”

রওশন আরা আঁচল থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে একটা পাঁচশো টাকার নোট তাওহীদার হাতে গুজে দিলো। বললো,“ভালো কিছু কিনে খেও। আজেবাজে খাবার খেয়ো না।”

তাওহীদার দুই চোখে অশ্রুরা ভীড় জমালো। রিমি আশ্চর্য হতেই যেনো ভুলে গেলো। এটা সে কোন দৃশ্য দেখছে। দু চোখ কচলে সে আবার মায়ের দিকে তাকালো। সে ঠিকই তো দেখছে। আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে? তাওহীদা বিদায় নিয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্য বের হলে রিমি রওশন আরাকে অবিশ্বাস্য কন্ঠে শুধালো,“মা, এটা তুমিই তো? দেখি একটু চিমটি কেটে!”
রওশন আরা ধমকে বললেন,“সর অসভ্য মেয়ে! মশকারা করিস আমার সঙ্গে? আয় রান্না ঘরে!”

এদিকে ভেতরে ভেতরে তার যেনো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রান্না ঘরে প্রবেশ করলেন৷ আজ প্রায় দেড় বছর পর রান্না ঘরের চৌকাঠ মাড়ালেন তিনি! এর হিসেব তিনি কড়ায় গন্ডায় নেবেন!

তাওহীদা রোজকার মতোই থেকে মাদ্রাসা বাড়ি ফিরে বসে রান্না ঘরে গেলো। রান্না ঘরে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলো। সবকিছু রান্না করা আছে। রান্না ঘর থেকে বের হতে গিয়েও সে থেমে যায়৷ হঠাৎ সে দেখে, আহসান বাগানের একটা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আজ তার আচরণ অন্যরকম। যেন সে কিছু একটা খুঁজছে। মানুষ টা তো সুস্থ, তবে এমন অসুস্থতা নাটক কেন করছে আজও? তখনই তার মনে পড়লো সকালে আহসানের বলা কথা। এখনই আহসান নিজের সুস্থতার কথা চাইছে না কাউকে জানাতে।
তাওহীদা জানালা খুলে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি খুঁজছো?”
আহসান হাসি দিয়ে বলে,
“তোমার প্রশ্নটা অদ্ভুত। আমি তো সবসময় কিছু না কিছু খুঁজি। আজ হয়তো নিজের মন খুঁজছি।”
জোরে জোরে এই কথা বললো সে। যেনো কারোর কোনো সন্দেহ তার উপর না হয়। ছায়ার মতো কেউ না কেউ তাকে অবলোকন করছে, তা সে ঠিক বুঝতে পারছে। তা কেন সেটাও সে জানে।

তাওহীদা কিছুটা বিরক্ত হয়, তবে তার সন্দেহ বাড়ে। আহসান কি খুঁজছে? এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? সে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে শাশুড়ীর রুমের দিকে পা বাড়ালো।

রাতে নামাজ শেষে তাওহীদা আল্লাহর কাছে দোয়া করে। তার মন শান্ত করতে চায়। কিন্তু তার জানালার পাশে একটা শব্দ হয়। সে দ্রুত জানালা খুলে দেখে, কোনো এক আগন্তুক ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাওহীদা ভয়ে কেঁপে উঠে। আহসান ঘরে নেই, কোথায় গেলো সে?

#চলবে

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৫
#রাউফুন

তাওহীদা সেদিন সকালবেলা উঠেই ঘরের কাজ শুরু করে। শাশুড়ি রওশন আরার নির্দেশে ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়েছিল। ঝাড়ু দিতে দিতে সে খাটের তলা পরিষ্কার করছিল, হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা কাপড়ের পুটুলি। পুটুলিটা দেখে কৌতূহল হয় তার। ধীরে ধীরে পুটুলিটা খুলতেই সে চমকে ওঠে। ভেতরে ছিল কালো জাদুর বিভিন্ন সামগ্রী—পান পাতায় মুড়ানো কিছু মন্ত্রলিখিত কাগজ, লাল সুতো, পেরেক, আর আরও কিছু অদ্ভুত জিনিস।

তাওহীদার মন উতলা হয়ে উঠল।

“এগুলো কীভাবে এখানে এল? এগুলো কি রওশন আরা আনছেন?” তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল।

ঠিক সেই মুহূর্তে আহসান ঘরে ঢুকল। তাওহীদা তখনো হতভম্ব হয়ে হাতে পুটুলিটা ধরে দাঁড়িয়ে। যদিও সে জানে যে তাওহীদাদ হাতে কি রয়েছে, দেখেই তার আন্দাজ করতে পেরেছে। তাওহীদাকে স্বাভাবিক করতে আহসান রসিকতার স্বরে একটু হেসে বলল,
“তাওহীদা, এত কী ভাবছো? কোনো গুপ্তধন পেয়েছো নাকি? হাতে এটা কি?”

তাওহীদা একটু দম নিয়ে বলল, “এটা….এটার ভেতর কিছু অদ্ভুত জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা আমাদের খাটের তলায় কেন?”

আহসান চোখ বড় করে বলল, “ কি পেয়েছো দেখি?!“

আহসান হাত থেকে নিয়ে সবকিছু দেখলো। তারপর বলল,“তুমি কি আসলেই জানো না এ ধরনের জিনিস দিয়ে কী করা হয়?”

তাওহীদ না বোধক মাথা নাড়ল দুদিকে। নিচু স্বরে বললো,“তুমি এখনো মজা করছো আহসান? আমি অনেকটাই ঘাবড়ে গেছি।”

আহসান হাসি থামিয়ে হালকা গম্ভীর গলায় বলল, “এগুলো ব্যবহার করে মানুষকে আটকানোর জন্য বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জাদু করা হয়। হয়তো কেউ কাউকে বশে রাখার জন্য এটা করেছে!”

“কালো জাদু!” তাওহীদা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কে এমনটা করতে পারে, এটা যেহেতু তাদের ঘরেই পাওয়া গেছে তার মানে তাদের মধ্যেই কারোর উপর।

আহসান তাওহীদার দুই কাধে হাত রেখে হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“তাওহীদা, ভয় পেয়ো না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তারা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।’ (সূরা বাকারা: ১০২)। তোমার ইমান যদি শক্ত থাকে, এইসব জাদু তোমার বা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”

তাওহীদার শরীরের লোমকূপ কেঁপে উঠে মূহুর্তেই। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, “আমাকে এই জিনিসগুলো সরিয়ে, পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আমি এগুলো নষ্ট করলে তো আর কোনো ক্ষতি হবে না। কালো জাদু যে করলো সে যে কুফরির মতো বড়ো পাপ করলো, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা হলো। এর প্রভাব যদি পড়ে তবে যে ভয়াবহ কিছু হবে।”

আহসান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ঠিক বলেছো। তবে সাবধান থেকো। এই ব্যাপারে কাউকেই জানানো দরকার নেই। কারণ এদের পরিণতি কী হতে পারে, তা আল্লাহ ভালো জানেন।”

মমতাজ বেগম দুই মেয়ে আর ছোট ছেলেকে নিয়ে বড় কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন। ফসলী যে জমিটুকুন ছিলো সেটাও চেয়ারম্যান দখল করেছে নিজের ক্ষমতা আর দাপটে। স্বামী মা*রা যাওয়ার পর থেকে গ্রামের চেয়ারম্যান তার পরিবারকে নানা ভাবে হয়রানি করেই আসছে। মমতাজ উঠোনে বসে নকশী কাথা সেলাই করছিলেন। শীতের সময় রোদ ভীষণ মিষ্টি লাগে। সেসময় বলা নেই কওয়া নেই চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাড়িতে এসে হাজির। হুড়মুড়িয়ে মমতাজ ঘরের ভেতর গিয়ে নিজের মুখ ঢাকে। মেয়ে দুটো মাদ্রাসায় গেছে, ছেলেটাও খেলতে গেছে, এখন তিনি ব্যতীত বাড়িতে আর কেউ নেই। এমতাবস্থায় ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো চেয়ারম্যানকে দেখে। চেয়ারম্যান বিশ্রি হেসে বলল,
“এই বেগম, কর্জের টাকা কি দিতে পারবা না? কতদিন ধরে শুনছি দেবে, কিন্তু কিছুই দেখছি না। আজ তো শেষবার বললাম। তোমার স্বামী মারা যাওয়ার পূর্বে টাকা নিসিলো, তার দলিল তো দেখাইছি। সই সাবুত সহ ই দেখাইছি। আবার কইবা চেয়ারম্যান হয়ে আমি সাধারণ জনগণের হক মাইরা দিতেই টাকা চাইতে আসি।”

মমতাজ ঘর থেকে বের হন না। চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করলেন। খুব শান্তভাবে বললেন, “চেয়ারম্যান সাহেব, এক আল্লাহই ভালো জানেন, আমার স্বামী আপনার থেকে ঠিক কতো টাকা নিয়েছেন। টাকা নিয়েছে বলে বলে জমিটুকুও কাড়লেন, এখনো কর্জ কর্জ করছেন।“

“এক লাখের জমি নিসি, তোমার সোয়ামী টাকা নিসে তিন লাখ। বিদেশ যাইবো কইয়া ট্যাকা নিসিলো। সেই টাকা কই, কারে দিসে সেইডা তো আর আমরা জানি না।”

মমতাজের মাথায় কিছুতেই এই কথা ঢুকছে না যে এতো টাকা নিয়ে কেন তার স্বামী বিদেশে গেলেন না৷ আর কবেই বা নিলেন? চেয়ারম্যান যে দলিল, দরখাস্ত দেখিয়েছে টাকা নেওয়ার সেটা সত্য না মিথ্যা তা কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষ জনকেও দেখানো হয়েছে টাকার রশিদ। এরকম বাজে পরিস্থিতিতে সে আল্লাহ ব্যতীত তাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। তিনি শুধু মাত্র আল্লাহকে ডাকছেন।

“মমতাজ বেগম, ও বেগম সাহেবা, শোনো কোনো কর্জ শোধ করন লাগবো না, তুমি কেবল আমারে বিয়া করো। একদম রানী হইয়া থাকবা। আমি আইলেই এমন পলায় পলায় করো ক্যারে? আহো দেহি বাইরে। তোমার বাচ্চা কাচ্চার সব দায়িত্বও আমি নিমু। ওদের তো আর ফালায় দিমু না৷ এতো সুবিধা কোন নাগরে তোমারে দিবো? শুধু শুধু জেদ করো! নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে! আর না হলে এক্ষুনি দুই লাখ টাকা ফালাও!”

“স্বয়ং মহান আল্লাহ আমাদের রিজিকের ব্যবস্থা করবেন। আমি এই মুহূর্তে আপনাকে কোনো টাকা দিতে পারব না। দয়া করে আমাদের সময় দিন।”

চেয়ারম্যান বিদ্রুপ করে বলল, “আল্লাহ! আল্লাহ তো আসবেন না তোমার কর্জ মেটাতে। আল্লাহকে এত বিশ্বাস করো, তাহলে তার কাছে গিয়ে কিছু নিয়ে আসো।”

মমতাজ ধীর তব রাগত্ব স্বরে বললেন,
“আপনাকে কিছু কথা বলি চেয়ারম্যান সাহেব, আপনার মতো জালিম, কাফের ফাসেক দের জন্য আমার আল্লাহ যথেষ্ট। আল্লাহ ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না। এই যে আমাদের উপর অযাচিত জুলুম করছেন তার প্রত্যেকটা বিষয়ের খেসারত আপনাকে আল্লাহর দরবারে দিতে হবে। আর রইলো আমার আল্লাহর উপর ভরসা? কোরআনে বলা আছে, ‘আর আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করো। আর ভরসাকারীর জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা আহযাব: ৩)। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে কাজ করছি। তিনি আমাদের জন্য কোনো না কোনো রাস্তা বের করবেন। অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন!”

চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধমক দিয়ে বলল,“রাখো তোমার জ্ঞান, আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে আর এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এর মধ্যে কর্জ না মেটালে তোমার বাড়ি দখল করা হবে।”

মমতাজ বেগম দরজা আঁটকেই বসে রইলেন। একটা রুমের ছোটো ঘরটাও বুঝি হাত ছাড়া হবে এবারে।

তাওহীদা রাতে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল। বিছানায় শুয়ে এপিঠ ওপিঠ করছিলো। কালো জাদুর কথায় মাথায় ঘুরছিলো তার।

“এই দুনিয়ার সব সমস্যা এবং সংকটের সমাধান একমাত্র আল্লাহই জানেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া আমরা কেউ কিছু করতে পারি না।”

আহসানও তখন জাগ্রত। সে তাওহীদাকে এমন অস্থির হতে দেখে মৃদু গলায় বলল,
“তাওহীদা, তুমি জানো, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।’ (তিরমিজি)। তাই সাহস রেখো, এতো চিন্তা করো না। ইমানের শক্তি সেই একমাত্র শক্তি যা মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপদেও শান্ত রাখে। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখলে কোনো অপশক্তি তাকে হারাতে পারে না।”

তাওহীদা গুটিশুটি মে’রে আহসানের বুকে মুখ ডুবিয়ে জাপটে ধরলো। আহসান তাওহীদার কপালে উষ্ণ চুমু খেয়ে বললো,“ বউ থাকতেও আমাকে বউ হাফা এতিমের মতো রাত কাটাতে হচ্ছে। বউয়ের আদর যার কপালে নাই তার মতো হতভাগা আর দুটি এই ভ্রম্মান্ডে নাই৷”

অন্য সময় হলে হইতো তাওহীদা লজ্জায় শেষ হয়ে যেতো কিন্তু এই মুহূর্তে তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। আহসানের দেওয়া ভরসা, আর রশিকতাও যেনো দুশ্চিন্তা সরছিলো না তাওহীদার মাথা থেকে। আহসান বুঝলো এতো সহজেই এসব তাওহীদা মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারবে না, তাই চুপ রইলো।

সেদিন সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না তাওহীদা। বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল খাটের তলায় পাওয়া জিনিসগুলো। কালো জাদুর ভয়াবহতা সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে তার গা শিউরে উঠছে বারংবার।
“কালো জাদু! কাকে বশে রাখার জন্য এমনটা করতে পারে? আর যদি এসবের পেছনে সত্যিই আমাদের বাড়ির কেউ-ই থাকেন, তবে কেন? কার আমাদের উপর এতো ক্ষোভ?”

আহসান ঘুমালে তাওহীদা তাহাজ্জুদ নামাজে অনেকক্ষণ বসে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করল। তার মনে একটাই প্রার্থনা ছিল,
“হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এই অন্ধকার থেকে বাঁচান। আমার অন্তরে সাহস দিন, আমার ইমানকে শক্ত করুন। আমার স্বামীকে এসব কুমন্ত্রণা আর দুষ্ট শক্তি থেকে আমাদের পানাহ দান করুন। আপনার রহমত ব্যতীত রক্ষা পাওয়া যে অসম্ভব।”

সকালে নামাজ থেকে উঠেই সে সিদ্ধান্ত নিল, এই ব্যাপারে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে নিজেই একটা বড়ো হুজুরের সঙ্গে কথা বলবে।

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-১২+১৩

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১২
#রাউফুন

তাওহীদা এখন মাদ্রাসার পড়াশোনায় ব্যস্ত। রুশদার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আরও গভীর হচ্ছে। ক্লাসে বসে দু’জন গল্প করছিলো। রুশদা তাওহীদা বিবাহিত সে শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। বিস্ময় নিয়ে বলে,
“তাওহীদা, তোমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি আছে। তুমি এত স্থিরভাবে কীভাবে সব সামলাও? মানে সংসার, স্বামী, তারপর পড়াশোনা। আমি হলে জীবনেও পারতাম না।”
তাওহীদা হাসি দিয়ে বলে,
“আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখেই চলি। তিনিই আমাকে শক্তি দেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা নারীদের মাঝে আলাদা ধৈর্য্য শক্তি এবং মনোবল দিয়ে তৈরি করেছেন। ইসলামে নারীদের সম্মান সবচেয়ে বেশি। নারীদের যেমন ধৈর্য্য শক্তি আর সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছেন তেমন ধৈর্য্য বা সহ্যশক্তি কোনো পুরুষ মানুষকে দেননি৷ নারীরা চাইলেই সব দিক থেকেই পারদর্শী উঠতে পারে। তুমিও পারবে!”

“আমি আসলেই পারবো না তোমার মতো।”

ক্লাসে বসে দুজনে গল্প করছিলো। একজন শিক্ষিকা এলেন এমন সময় ক্লাসে। তিনি ক্লাস শুরু করলে আর কোন কথা হলো না রুশদার সঙ্গে। ক্লাসের প্রায় সবার সঙ্গেই তাওহীদার ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। যেহেতু এটা গার্লস মাদ্রাসা তাই ছেলেদের নিয়ে ইন সিকিউরিটির কোনো চান্স নেই।তবে পুরুষ শুধু শিক্ষক রয়েছে।

মাদ্রাসা থেকে যাওয়ার পথে তাওহীদা ব্যাগে একটি চিঠি পেলো, আশ্চর্য এটা কিভাবে এলো তার ব্যাগে? যখন সে টিফিন টাইমে বাইরে এসেছিল তখন কেউ রেখে আসেনি তো? সে কাগজের ভাজ খুলে পড়লো। চিঠিটি খুবই সংক্ষিপ্ত:
“আমি সব সময় আপনার পাশে আছি। আমাকে চিনতে পারলেন না? অথচ আমি আপনাকে প্রথম দেখাতেই চিনেছি।”

তাওহীদা ভয়ে কেঁপে ওঠে। তার মনে হয়, হয়তো তাকে আবারও কেউ নজরে রেখেছে। এই মাদ্রাসার কেউ? কে হতে পারে? এই ব্যাপারে ও রুশদাকে কিছু জানালো না। সে ভয়ে তটস্থ হয়ে বাসায় এলো। আশে পাশে বার বার ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে বাড়ি এলো সে। রোজকার মতোই আজও ঝামেলা হলো। সে জানে তাকে এসব সহ্য করতে হবে তাই নিজেকে প্রস্তুতই রাখে সে। কানের মধ্যে তুলো গুঁজে চুপ করে থাকে। বুদ্ধি টা তার না, আহসানের। হঠাৎই আহসান তার কাছে এসে কানে তুলো গুঁজে দিয়ে বলে, “তোমাকে কেউ কিছু বললে কানে এগুলো দিয়ে রেখো৷ হাহা, সবাই শুধু বলবে তুমি শুনবে না।”

কাজটি করে সে হাত তালি দিতে দিতে বাচ্চাদের মতো হাসছিলো। তাওহীদা কতক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আহসান হুটহাট এমন সব কর্মকাণ্ড করে যে তার মনে সন্দেহ ঢুকে যায়। পরক্ষণেই ভাবে হইতো মানুষ টা আস্তে আস্তে সুস্থ হচ্ছে। তাই তার দিকে একটু খেয়াল রাখতে শুরু করেছে।

রাতের খাবার তৈরি করছিলো তাওহীদা। এমন সময় সালমা তার হাতে একটা কাগজ নিয়ে এলো।

“তা মাদ্রাসার নাম করে কি এসবই করিস তুই? এসব কি তোর ব্যাগে?”

বড়ো জা সালমা কথা শুনে তাওহীদার হাতের কাজ থেমে গেলো। সালমা হাঁক ছেড়ে সবাইকে ডাকলো। সালমা ছাদের নাম করে তবে তার রুমে গিয়ে ব্যাগ সার্চ করছিলো? কিন্তু হঠাৎ কেন এমন কাজ করলো? সালমা মূলত তাওহীদার বই খাতা ছিড়তে গেছিলো। ছিড়েও এসেছে। আসার সময় ব্যাগে দেখে এউ চিঠি টা। বই ছেড়ার আগে পাগল আহসানকে বাথরুমে আঁটকে রেখেছিলো।

রওশন আরা সহ রিমি আর পারভীনও বাইরে এলো। পুরুষ তিনজন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। পারভীন বললো, “ঘুমাচ্ছিলাম, এমন সময় তোমার ডাক। কি হয়েছে ভাবি?”

“এই যে আমাদের স্বতী সাবিত্রী মেয়ের ব্যাগে তার প্রেমিকের দেওয়া চিঠি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে একবার নিজেরাই দেখো। শুনেছি, কিছু মেয়ে পর্দার আড়ালেও কেমন যেন সব কিছু করে ফেলে। আহসান তো পাগল, সে তো কিছু বলবেও না। তাই ভাবে, সব চলবে!”

পারভীনও কটাক্ষ-বানে বিদ্ধ করলো তাওহীদাকে।,
“তোর মতো বউ এনে এই বাড়ির মান-ইজ্জত চলে যাবে দেখছি। শাশুড়ির কথাও শুনিস না, জেদ করে পড়তে যাস আবার বড় গিন্নি হওয়ার শখ করিস!”

রওশন আরা বিক্ষিপ্ত হয়ে তাওহীদার গালে থাপড় বসিয়ে দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে তাওহীদা নিচে পড়ে গেলো। রিমি ছুটে এলো তাকে ধরতে। টনটন করে উঠলো তাওহীদার গাল। এমনিতেই পোড়া ক্ষ’ত রয়েছে, তারপর আবার নতুন আগ’ঘা’ত। তাওহীদার মনে হলো ওর গাল ছিড়েখুঁড়ে কেউ খুব’লে নিচ্ছে।

“তোর এতো তবে এই অধঃপতন পড়াশোনার নামে? নতুন নাগর জুটিয়েছিস, তাই না? পাগল স্বামী রেখে আরেক জনের সঙ্গে লটরপটর করিস!”

তাওহীদা অবাক হয়ে শোনে। বড় জা, মেজো জা, আর শাশুড়ীর একে একে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। তাদের কথা যেন আগুনে ঘি ঢালে। রওশন আরা আবার আঘাত করতে নিলে রিমি নিজের মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।

“খবরদার কেউ ভাবির নামে এমন মিথ্যা, নেক্কারজনক অপবাদ দেবে না৷ ঐ চিঠি টাই এমন কোনো কথা লেখা নেই যাতে প্রমাণ হয় ভাবি তার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত অথবা কোনো জানা শোনা আছে, বরং বোঝা যাচ্ছে ভাবি তাকে চেনেইনি৷”

“এক কানা আরেক কানার সই। নিজেও তো এমন দুশ্চরিত্রা মেয়ে, আবার আরেকজন দুশ্চরিত্রা মেয়ের হয়ে সাফাই গাইছে।”

তাওহীদা এবার আর নিজেকে থামাতে পারলো না। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো। তার চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। বললো, “আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার আগে নিজের চরিত্র ঠিক করুন ভাবি। আপনিও জানেন আপনি নিজে কি, কারোর কোনো পাপ নিয়ে খোটা দেওয়ার মতো মন মানসিকতা আমার নেই। যদি কারোর পাপ গোপন করা হয় তবে তাকে সৃষ্টি কর্তা উত্তম প্রতিদান দেন৷ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।”
আমি এই বাড়িতে সবার সব কাজ করি। তবু আপনাদের কথা থামে না। আজ যদি আমার স্বামী সুস্থ হতো, তাহলে কেউ এভাবে কথা বলতো না। আমি আমার চরিত্র নিয়ে একটা কথাও বললে মেনে নেব না।”

তাওহীদার প্রতিবাদে পুরো বাড়ি চুপ হয়ে গেলো। প্রথমবারের মতো তাওহীদা তার জায়গা থেকে কথা বললো। তার এই দৃঢ়তায় কেউ কিছু বলার সাহস পেলো না। সালমাও কেমন যেনো ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। এবারে সবার নজর সালমার উপর। তাওহীদা আরও বললো,

“কারোর সম্পর্কে সঠিক ভাবে না জেনে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলবেন না৷ যদি বলতেই হয় তবে চার জন সাক্ষী আনুন, আপনার কথার যথাক্রমে প্রমাণ দিন
সুরা নূরে, বলা হয়েছে,
“আর যারা সৎ নারীদের ওপর অপবাদ আরোপ করে, কিন্তু চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারে না, তাদেরকে আশি দফা বেত্রাঘাত কর এবং কখনোই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। তারাই হলো পাপী।”
অনুরূপ অন্য একটি হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের কোনো গোপন ত্রুটি নিয়ে মিথ্যা বলে বা অভিযোগ করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।”

কাউকে চরিত্রহীনতা বা অপবাদ দেওয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যদি কেউ এই ধরনের অভিযোগ করে, তবে তাকে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে, যারা সেই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। যদি সাক্ষ্য দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অভিযোগকারীকে “কাজফ” (মিথ্যা অপবাদ) শাস্তি দেওয়া হবে, যা অত্যন্ত গুণাহের কাজ।

আর রইলো চিঠির কথা, আমি নিজেও জানি না কে এই কাগজ আমার ব্যাগে রেখেছে৷ চিঠিতেও কিন্তু এটা প্রমাণ হয় না আমাকে সেই ব্যাক্তি প্রেম পত্র দিয়েছে অথবা সেই ব্যাক্তি টি কোনো পুরুষই, সে তো মহিলাও হতে পারে!”

তাওহীদার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। সে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো৷ সবাই যার যার রুমে চলে গেলো। রিমি তাকে সামলে বলে, “ভাবি একদিন সবার বিচার করবেন আল্লাহ! শুধু তুমি নিজেকে শক্ত করো। সব সময় এতো নরম গলায় কথা বললে হবে না। মনে রেখো, নরম মানুষের ভাত নে। জোর যার মূলুক তার।”

তাওহীদা উঠে রান্না ঘরে চলে গেলো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো যেনো সবার হেদায়েত দান করেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা। কিচেনের জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কে ওই আগুন্তুক? যে তাকে দেখতে পায় সব সময়? কে তাকে এতো ভালো ভাবে চেনে? ভালো ভাবে না চিনলে অবশ্যই শুধু মাত্র চোখ দেখে চেনা সম্ভব নয়? কে সে? তাওহীদার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে যেনো এসব ভাবতে ভাবতে। তাওহীদা জানে, এই বাড়িতে তার জায়গা কোথাও নেই। সবাই কেবল তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারই করে। কিন্তু সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, এখন থেকে আর সে এসব সহ্য করবে না, কিছুতেই না। একদিন সে সবাইকে বুঝিয়ে দেবে, তার চরিত্র নিয়ে কটু কথা বলা সহজ, কিন্তু সেই চরিত্রের পবিত্রতা কেউ নষ্ট করতে পারবে না।

রুমে গিয়ে তাওহীদা নিজের ব্যাগ আর বইয়ের করুণ পরিনতি দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। এদিকে বাথরুম থেকে দরজা ধাক্কানোর শব্দ পেলো। জলদি গিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে দেখলো আহসান হাঁপাচ্ছে। তাওহীদা আহসানের এমন অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আহসানের সারা মুখ লাল হয়ে আছে রীতিমতো। মানুষ টা এতক্ষণ তবে এই বাথরুমে আঁটকা পড়েছিলো?

#চলবে.

রেফারেন্স১:— (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৯০)
রেফারেন্স:২(কুরআন: সুরা নূর, আয়াত ৪)
রেফারেন্স:৩(সহীহ মুসলিম)

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৩
#রাউফুন

বাড়িতে মফিজ উদ্দিন তাওহীদার পড়াশোনার জন্য নতুন করে বই কিনে আনেন। সালমার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি তাওহীদার বই ছিঁড়ে ফেলার ঘটনায়। মফিজ উদ্দিন এই বিষয়ে খুব রাগান্বিত হন এবং সবার সামনে ঘোষণা দেন,
“আজ থেকে কেউ যদি তাওহীদার পড়াশোনায় বাঁধা দেয়, তাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেব। এতোদিন অনেক কিছু চোখের সামনে দেখেও চুপচাপ দেখেছি, কারণ আমি ঝামেলা চাইনি। কিন্তু এরপর তাওহীদার অধিকার বা ওর চলার পথে কেউ বাধা হলে তাকে আমার সঙ্গে আগে মোকাবিলা করতে হবে। ওর বিষয়ে কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করলে আমি তাকে দেখে নেবো। মনে রেখো এই সাম্রাজ্যের অধিকারী এখনো আমি মফিজ উদ্দিন।”

সবাই থমথমে পরিবেশ দেখে সটকে পড়ে। তাওহীদা চুপচাপ নিজের বই নিয়ে উপরে চলে যায়। সকালটা অন্য দিনের মতোই শুরু হয়। তাওহীদা মাদ্রাসায় যেতে প্রস্তুত হয়। তবে আজ তার মনে অজানা এক উদ্বেগ কাজ করছে। আগন্তুকের সেই চিঠি তার মনের ভেতরে শিকড় গেড়ে বসেছে। রুশদার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পেলেও, প্রতিটি মুহূর্তে যেন তার মনে হয়, কেউ তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে।

মাদ্রাসায় ঢোকার পরেই সে দেখে, একটি ছায়ামূর্তি গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখামাত্রই সেই আগুন্তক সরে যায়। তাওহীদা বুঝতে পারে এটা হইতো সেই আগন্তুক! তাওহীদা মাথা নিচু করে দ্রুত ক্লাসে ঢুকে পড়ে। এভাবে কি আদোও কোনো সুস্থ মানুষ ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করতে পারে? যখন যেখানে সে যাচ্ছে সেখানেই কেন আগুন্তককে দেখতে পাচ্ছে সে? কি চায় সেই আগুন্তক তার থেকে? আহঃ তাওহীদার মাথা ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। যদি তার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তাকে অনুসরণ করে লোকটা? পরক্ষণেই সাহস জোগায় সে,মনে মনে আওড়ায়,

“আমি কেন ভয় পাবো? আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় পাবো না আমি।”

রুশদা তাওহীদার পাশে বসে। তাওহীদা বুঝতে পারলো না। রুশদা তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “কি হইছে তোমার? কি ভাবো?”
“হাহ্‌?”
“কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি?”
“না,তেমন কিছু না। তুমি কখন এলে?”
“যখন তুমি কোনো ভাবনায় নিমজ্জিত ছিলে তখনি!”

তাওহীদা চুপ করে ভাবতে লাগলো। এতো অল্প পরিচয়ে কি সব কথা বলা যায়? তখনই টিচার প্রবেশ করলো শ্রেণী কক্ষে। সবাই সমস্বরে সালাম দিলো হুজুরকে।যেহেতু এটা নূরানি মাদ্রাসা সব হুজুর আর হুজুরানী রয়েছেন শিক্ষক -শিক্ষিকা হিসেবে। দুই বান্ধবী একসঙ্গে পড়াশোনা করছে। হঠাৎ রুশদা বলে,
“তাওহীদা, তুমি কি কোনো বিষয়ে অনেক বেশিইই চিন্তায় আছো? আমি লক্ষ্য করছি, তুমি খুবই অস্বস্তি বোধ করছো, পড়ায় মন দিতে পারছো না।”

তাওহীদা একটু দ্বিধা করে রুশদাকে সবকিছু খুলে বলে। চিঠি থেকে শুরু করে আগন্তুকের তাকে প্রতিটি মূহুর্তে অনুসরণ করা, সব কথা জানায়।

রুশদা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“তুমি কি পুলিশে জানাবে? সত্যিই তো যদি কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে তোমায় ফলো করে তবে তো এটা খুব ভয়ের ব্যাপার। তোমাকে সাবধানে থাকতে হবে। পুলিশ স্টেশনে যাবে?”
“না,” তাওহীদা জবাব দেয়।
শান্ত স্বরে বলে, “আমি আগে বুঝতে চাই, সে আসলে কে এবং তার উদ্দেশ্য কী।”
রুশদা তার সিদ্ধান্তে সম্মতি জানায়।

ছুটির ঘণ্টা পড়ার পর, তাওহীদা স্কুলের ব্যাগ খুলে আরেকটি চিঠি দেখতে পায়। এবার চিঠিটি আরও অদ্ভুত:
“তোমার ভীত মুখ দেখতে পেলাম। ভয় পেও না। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি তুমি অনেক বুদ্ধিমতী এবং সাহসী। আমি তোমাতে মুগ্ধ। আচ্ছা, তুমি কি জানো? তোমার চারপাশে অনেক শত্রু? সাবধান থেকো। হুহ?”

তাওহীদার গা শিউরে ওঠে। কে তার শত্রু হতে পারে? সালমা আর পারভীন? নাকি আরও বেশি ভয়ংকর কেউ? লোকটা তার ব্যাগে চিঠি রাখে কখন? সে কেন দেখতে পায় না? আশ্চর্য, ব্যাগ টিফিন টাইম ক্লাসে রাখা হয়। তখনই কেবল চিঠি রাখা যেতে পারে। কিন্তু সে তো আজ কোনো ভাবেই ব্যাগ হাত ছাড়া করেনি, তবে কখন রাখলো চিঠি? তাওহীদার মস্তিষ্কে এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগলো৷ রুশদাও চিন্তা করতে লাগলো তাওহীদার মতোই।

“লোকটা কি জীন ভূত নাকি? কখন রাখলো চিঠি? আর তোমার শত্রু কে হতে পারে?”
“আমি জানি না।”
“আন্দাজ নেই একটুও?”
“উঁহু!”

রুশদার বাবা আসার পর সে চলে গেলো। তাওহীদা একায় বাড়ি ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে রাতের রান্না সেরে রুমে গিয়ে আবার ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসলো। আহসান এসে তার কাছে ঘুরঘুর করতে লাগলো৷ তাওহীদা লক্ষ্য করলো আহসানের ছটফট করা চেহেরা।

“কি হয়েছে তোমার?”
“খিদে, খিদে! খাইনি! আমাকে খেতে দেয়নি ওরা।”

তাওহীদা দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে ধরলো। মাদ্রাসা, রান্না বান্না, বাড়ির সমস্ত কাজ করতে গিয়ে তাওহীদা কেমন যেনো আহসানের যত্ন নিতেই ভুল গেছে। বড্ড মন খারাপ হলো তার। সে কিভাবে অসুস্থ স্বামীর সেবা করতে ভুলে গেলো? অসুস্থ মানুষ টা কিছু বলতে পারে না বলে এই অবহেলা? ইশ কিভাবে পারলো সে? অপরাধ বোধে ভেতরটা দগদগে ক্ষতর সৃষ্টি করলো যেনো। সে বই বন্ধ করে বললো,“একটু বসো হ্যাঁ? আমি এই যাবো আর আসবো।”

আহসান বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লো। তাওহীদা দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলো। প্লেটে খাবার নিয়ে আসার সময় শাশুড়ীর মুখোমুখি হলো সে। সে বিনয়ী কন্ঠে বললো, “কিছু বলবেন মা?”

“কি আর বলবো? আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি কিছু মনে করো না। সেদিন তোমার মুখে চা ছুড়েছিলাম।আমাকে পারলে ক্ষমা করিও। এই বুড়ো মায়ের উপর রাগ, -ক্ষোভ রেখো না। আমি তোমার বড়ো, বড়ো হয়ে ক্ষমা চাইছি।”

“মা, মা, দয়া করে এভাবে ক্ষমা চাইবেন না। আমি কখনোই আপনার উপর রেগে থাকতে পারি না। মায়েরা সন্তানদের শাসন করবে ভুল হলে এটাই তো নীতির মধ্যে পড়ে। আপনি আমার মায়ের মতো, শাসন করবেন এটাই স্বাভাবিক। আমি সবকিছু মাথা নেবো। শাসন করা আপনার অধিকার।”
“তোমার মতো এমন ভালো মেয়েকে কিনা আমি কাচ ভেবে পায়ে মারাতাম? এমন হিরের টুকরা মেয়ে তুমি। আমার আসলেই মতিভ্রম হয়েছিলো। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি মা। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

তাওহহীদার দুই চোখ ভরে উঠল। এই প্রথম বোধহয় তার শাশুড়ী নামক মানুষটা তার সঙ্গে এতো মিষ্টি স্বরে কথা বলছে। তাওহীদার হৃদয়ে বেশ প্রভাব পড়লো। সে খাবারের প্লেট রেখে রওশন আরার হাত ধরে বললো, “মা আপনি যে আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক। আপনি আমার হলেন আরেকটা মা, তাই আমি ভুলে গেছি সবকিছু।”

তাওহীদা কান্নায় ঠিক ভাবে কথা বলতে পারছিলো না। রওশন আরা মাথায় হাত রাখলো তাওহীদার।
“যাও আহসানের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিলে তো? যাও। আমি ওকে খাওয়াতে গেছিলাম, কিন্তু ছেলেটা আমাকে কেন যেনো ভয় পায়। আর শোনো, আজ তুমি আমার সঙ্গে বসে খাবে। যদি না খাও আমি মনে করবো, তুমি এখনো মনে আমার জন্য দুঃখ পুষছো।”
“আচ্ছা আমি আপনার সঙ্গেই খাবো। আর আমি আহসানকেও বলে দেবো, এবার থেকে আপনাকে আর ভয় পাবে না মা।”

রওশন আরা হাসলেন। তাওহীদা খাবার নিয়ে রুমে গেলো। আহসান টেবিলের কাছে বসে কি যেনো করছিলো। কাগজ হাতে কি যেনো করছে। তাওহীদা অংকন টা দেখলো। কি অদ্ভুত ছবিটা। কি সব এঁকেছে। একটা মেয়েলী ছবি, যেনো মাটি খুড়ছে, অন্য পাশে একটা ছায়া যেনো সে পাহারা দিচ্ছে। খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যেনো কেউ কিছু মাটিতে পুঁতে রাখছে। কোনো পুটুলী। এই অদ্ভুত ছবির মানে কি? হঠাৎই এমন ছবি কেন আঁকলো আহসান?

“আহসান, এই ছবিটি কেন আঁকলে হঠাৎ? ”

“আজ কি হয়েছে জানো বউ? ঐ ডাইনিটা এলো একবার, কি যেনো করছিলো। আমার ঘরেও এলো। কি করলো কে জানে। ঐ তো ছাদ থেকে দেখেছি ডাইনিকে।”

তাওহীদা আশ্চর্যান্বিত হয়ে আহসানের মুখপানে তাকিয়ে রইলো৷ কোনো ভাবেই ভ্রম থেকে তো একটা অসুস্থ মানুষ এসব কথা বলার কথা না। তবে কি বোঝাতে চাইছে আহসান? এখানে আসার পর তো অসুস্থ আহসানকে কখনো মিথ্যা বলতে দেখেনি৷ আর এমনি এমন সন্দেহ জনক একটা ছবিই বা কেন আঁকতে যাবে? তাওহীদা সকল ভাবনা বাদ দিয়ে বললো,“আচ্ছা, এখন খাবে এসো৷ তোমার তো খিদে পেয়েছে বললে!”

“ডাইনি এসেছিলো যে। ওকে মারবে না তুমি?”
“এই ডাইনি কাকে বলছো?”
“ঐ বুড়িটাকে!”
“আহসান, আর এভাবে বলবে না। উনি তোমার মা হয়। উনাকে কেন ভয় পাও? শোনো, মায়েরা কখনোই খারাপ হতেই পারে না৷ আজ আমাকে কতো স্নেহ করলো জানো? আজ অব্দি এমন ভাবে কখনোই কথা বলেন নি তিঁনি। আমি তো সব সময় এমনটাই চাইতাম। একটা সুখী পরিবার।”

অনেক দিন পর তাওহীদা হাসলো। আহসান তার হাসির দিকে তাকিয়ে হাত তালি দিয়ে বললো,“বউ হেসেছে, বউ হেসেছে৷ সুন্দর, সুন্দর!”

তাওহীদা আবারও মিষ্টি করে হাসলো। রাতের খাবার খেতে সে নিচে নামলো। কথা মতো আজ সে রওশন আরার সঙ্গে খাবে। আজ ডাইনিং টেবিলে যেনো একটা সুখ সুখ বিরাজমান। এমন একটা সুখী পরিবারের স্বপ্নই তো তাওহীদা এতো দিন দেখে এসেছে। রিমিকেও হাসিখুশি দেখাচ্ছে, এমন কি এই প্রথম সালমা আর পারভীন খাবার টেবিলে একটিও কটূ কথা বলেনি৷ তাওহীদার সুখে কেমন কান্না পাচ্ছে। তবে মফিজ উদ্দিন যেনো এই নিঃশব্দটা মানতে পারছেন না। তাওহীদার খুশি খুশি মুখ দেখে প্রবল সন্দেহ হওয়া সত্ত্বেও চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন। একে একে সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেলো। তাওহীদা খুশি মনে সবকিছু গুছিয়ে রাখছিলো। রওশন আরা তখন রান্না ঘরে এসে বললেন,

“তাওহীদা, মা আমাকে এক গ্লাস দুধ দাও তো!”
“আপনি তো দুধ খান না মা।”
“আহা দাও ই না।”
তাওহীদা গ্লাসে দুধ দিলো। রওশন আরা গ্লাস হাতে নিয়ে তাওহীদার মুখের কাছে ধরলো। নরম গলায় বললেন,“এখন তোমার দুধ খাওয়া প্রয়োজন। কতো চাপ মাথায়। পড়াশোনা করছো, দুধ না খেলে হবে? নাও হা করো দেখি। এখন থেকে রোজ এক গ্লাস করে দুধ খাবে!”

তাওহীদা মানা করতে গিয়েও কেন যেনো করতে পারলো না৷ এতোদিন পর অবহেলিত তাওহীদা অল্প স্নেহে গলে গেলো। এই ভালোবাসা টা সে সাদরে গ্রহণ করতে চাইলো। রওশন আরা নিজ হাতে তাকে এক গ্লাস দুধ পুরো টা খাইয়ে দিলেন৷ তাওহীদা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো শাশুড়ী স্নেহ পেয়ে। খাওয়া শেষে আদর আঁচলে মুখ মুছে দিলো রওশন আরা দুধটা খাওয়ার পাঁচ মিনিট এর মধ্যে তাওহীদা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো। রওশন আরা খিটখিট করে হাসলেন৷ আহা শখ করে স্নেহ পেতে এসে কি হালটাই না হলো। রওশন আরা অজ্ঞানরত তাওহীদাকে সেভাবেই রেখে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ আহ শান্তি!

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-১১

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১১
#রাউফুন

তাওহীদার জীবন যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। মফিজ উদ্দিন তার জন্য স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন। গ্রাম থেকে তার পুরোনো সার্টিফিকেট এনে শহরের একটি দাখিলিয়া নুরানি মাদ্রাসায় ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়েছেন। যদিও পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে এই বিষয়ে নানা রকম গুঞ্জন চলতে থাকে, তাওহীদা তার মনে স্থির করে নেয়, আল্লাহর ওপর ভরসা করেই সে এগিয়ে যাবে।

সকালবেলা তাওহীদা তার নামাজ সেরে পড়ার টেবিলে বসে। তার হাতে নতুন বইয়ের মিষ্টি গন্ধ। বইয়ের পাতাগুলো স্পর্শ করে সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়।
“হে আল্লাহ, আমাকে সঠিক পথে চালিত করুন। এই শিক্ষা যেন আপনার পথে ব্যয় করতে পারি।”

সকালের সব কাজ তাওহীদা পূর্বেই করে রেখেছে। তার সংসার আর পড়াশোনা দুটোই এগিয়ে নিতে হবে। রওশন আরাও এমনই শর্ত আরোপ করে তাওহীদার পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু টা মত দিয়েছে। খাবার শেষে মফিজ উদ্দিন তাওহীদাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন মাদ্রাসায়। তাওহীদার প্রথম দিন। মাদ্রাসার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তার মনে একধরনের অস্বস্তি শুরু হয়। এত মানুষ, এত ভিড়। এতগুলো বছরের পর আবারও সে শিক্ষার আলোয় ফিরেছে।

ক্লাসে ঢুকে একটি কোণার বেঞ্চে গিয়ে বসে। বই নিয়ে পডতে থাকে, এমন সময় একটি মেয়ে এসে তার পাশে বসে। শুরুতেই মেয়েটি হাসিমুখে বলল,
“আমি রুশদা। তুমি নতুন এসেছো?”
তাওহীদা প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। আচমকা একটা মেয়ে এসে এভাবে কথা বলায় ভড়কে যায় সে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বই বন্ধ করে। মেয়েটি তার পাশে বসেই বললো,“আসলে নতুন কাউকে দেখলেই আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চলে আসি। তোমাকে দেখেই নতুন বুঝেছি। তাই বন্ধুত্ব করতে এলাম। আমি কারোর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারি না।

তাওহীদা প্রথমে অস্বস্তি বোধ করলেও মেয়েটির বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে স্বস্তি পেয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“হ্যাঁ, আমি তাওহীদা।”

রুশদা কথা বলতে বলতে তাকে পুরো মাদ্রাসার নিয়মকানুন আর শিক্ষকদের সম্পর্কে জানায়। তাওহীদা নিজের ভেতরে যেন এক নতুন শক্তি অনুভব করে।
লাঞ্চ টাইমে তাওহীদা আর রুশদা মাদ্রাসার ক্যান্টিনের দিকে হাঁটছিল। হঠাৎ তাওহীদার মনে হলো কেউ তাকে দূর থেকে দেখছে। সে পেছনে তাকিয়ে দেখে, দূর থেকে একটি ছায়ামূর্তি। পুরো মুখ ঢাকা। শুধু চোখ দুটো দৃশ্যমান। সেই চোখ যেন কোথায় দেখা।

তাওহীদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। রুশদা জিজ্ঞাসা করে,
“কী হলো? তুমি থেমে গেলে কেন?”
“ও কিছু না,” তাওহীদা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে।

তবে তার মনের ভেতর অস্থিরতা বাড়তে থাকে। কে সে?? সে কি ভুল দেখলো? এখানে সে একদম নতুন তবে কে ছিলো ওখানে? কেন তার মনে হচ্ছিলো ছায়ামূর্তি টা তাকেই দেখছিলো।

“তাহু, তুমি কি সব সময় এমন অল্প কথা বলো?”
“হু?”
“তুমি ওমন ভড়কালে কেন? আমি এমনই। সবার নাম শর্ট করে নামের দফারফা করে ফেলি। তুমিও কিন্তু আমাকে রুশদা না বলে রুশু ডাকতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।”
“আচ্ছা।” তাওহীদা নিকাবের নিচে সামান্য হাসলে রুশদা টের পেয়ে বললো,“তুমি হাসতে জানো তাহলে!”

তাওহীদা ভ্রুকুটি করে তাকালে রুশদা খিলখিল করে হাসলো। তাওহীদা মনে মনে বললো,“বাহ বেশ মিষ্টি হাসি তো মেয়েটার!”

বাড়িতে সালমা আর পারভীন নতুন এক ষড়যন্ত্র আঁটছে। তাদের মনে হচ্ছে, তাওহীদার পড়াশোনায় সফলতা পেলে তারা পরিবারের গুরুত্ব হারাবে। তারা ঠিক করে, তাওহীদাকে এখন থেকে কাজে আরও বেশি ব্যস্ত রাখবে।

“কি করা যাই বল তো? এই মেয়ের এখনি যে রওয়াব। এরপর পড়াশোনা শিখলে আমাদের সমান হবে না? তখন দেখবি আমাদের মাথায় উঠে নাচবে। আমাদের পাত্তায় দেবে না। বাড়ির সব কাজ আমাদের করতে হবে! ”
“আমরা করবো কেন? ঐ বুড়িকে দিয়েই করাবো!”

উহুম উহুম করে কেশে উঠলেন রওশন আরা। দুজনেই হেসে অপ্রস্তুত হয়ে বললো,“মা আপনি এখানে? কিছু বলবেন?”
“বুড়ি মানুষ কি বলবো বলো তো? চা করে দিও তো আমাকে।”
“আমরা কেউ-ই চা করতে জানি না। আপনার চা আপনি করে খান।”
“আমার প্রেসার বেড়েছে, আগুনের ধারে যেতে পারি না। সামান্য চা করে দিতে বলেছি আর আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?”

পারভীন বললো,”দেখেন মা, আমরা না এই বাড়িতে চাকরানী করতে আসিনি। এই বাড়িতে অর্ধেক খরচা আমার স্বামী দেয়৷ তাই কাজ করার প্রশ্নই আসে না।”

“তোর স্বামী একা দেয় নাকি? বাড়ির কারেন্ট বিল থেকে শুরু করে পানির বিল, গ্যাস বিল সবই আমার স্বামী দেয়৷ এই এতো বাড়ির এসব খরচা তো আর কম না।”

সালমার কথা শুনে রওশন আরা বললেন,“আর আমি বুঝি ভেসে এসেছি? তোমাদের শ্বশুর বাড়ির প্রত্যেক বিষয় টেকেল দেন। আমি কেন কাজ করবো? তোমাদের কথামতো তো এই কথায় আসছে!”

“দেখেন মা, চা খাবেন আপনি আপনার চা কেন আমরা বানাবো?”

মূহুর্তের মধ্যে রওশন আরার তাওহীদার কথা মনে পড়লো। বলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বিনাবাক্যে সকলরেই সব কাজ করে দেয়। তখনই পারভীন ফোড়ন কেটে বলে,“যার স্বামী এই সংসারে আগাছার মতো পড়ে আছে তার বউয়ের নতুন ডানা গজিয়েছে। তার ডানা কেটে দিন মা। দেখবেন আপনার স্বামান্য চায়ের জন্য এর ওর কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে হবে না।”

রিমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,“আমার বুঝি ছোটো ভাইয়াকেই পেতে ধরেছে? বড়ো ভাইয়া আর মেজো ভাইয়া কি মাটি ফে’টে বের হইছে? ছোটো ভাইয়ার বউ যদি আমার মায়ের সেবা করতে পারে তাহলে তোমরা কেন পারবে না?”

“তুমি তো কথায় বলো না। চোর কোথাকার। লজ্জা করে না এখানে আমাদের সামনে এসে বড়ো বড়ো জ্ঞান দাও?”

“নাহ করে না। আমি একটা ভুল করেছি তার মানে এই না যে তোমরা আমাকে মাটিতে ফেলে পিষ্ট করবে আর আমি মেনে নেবো। আমি যেমন এখন ভালো হয়েছি তেমনই আগে কিন্তু জঘন্য ছিলাম। সেই আগের রূপ তোমাদের জন্য দরকার হলে আবার নিজের মধ্যে ইনক্লুড করবো। কারণ শয়তানকে শয়তানি দিয়েই শায়েস্তা করতে হয়।”

এক কথা দুই কথায় তুমুল ঝামেলা হলো এখানে। সামান্য চা করা নিয়ে কি পরিমাণ ঝামেলা দেখতে হচ্ছে রওশন আরাকে। রওশন আরার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো তাওহীদার উপর। এই মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করাতেই হবে তাকে। রোজ রোজ এই ঝামেলা নিতে পারবেন না এই বয়সে।

মাদ্রাসা থেকে ফিরে তাওহীদা ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢোকার আগে অবশ্য শাশুড়ীর গম্ভীর রাগী মুখটা নজর এড়াইনি তার। এসব যে হবে তার সেই ধারণা আছে। তাই সে সম্পুর্ন ভাবেই প্রস্তুত আছে। আসরের নামাজ পড়ে রান্না ঘরে ঢুকতেই দেখে শাশুড়ী এখনো গোমড়া মুখে বসে আছে। তাওহীদা চা করে শাশুড়ীর সামনে ধরতেই গরম চা নিয়ে সোজা তাওহীদার মুখে ছুড়ে মারলো। আকস্মিক ঘটনায় আহত তাওহীদা চিৎকার করে উঠলো। রিমি চিৎকার শুনে ছুটে এলো। দেখলো তাওহীদা মুখে হাত দিয়ে আর্তনাদ করছে। মায়ের হাতে চায়ের কাপ দেখে রিমির আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে। দ্রুত ডিম ভেঙে তাওহীদার মুখে মেখে দিলো। তাওহীদার ডিমের গন্ধে গা গুলিয়ে বমি করে দিলো। রিমি বললো,“ডিম না দিলে তোমার মুখে ফোসকাল উঠবে ভাবি। প্লিজ একটু সহ্য করো।”

“তুমি কি মানুষ মা? এতোটা নির্দয়া, পাষবিক কেউ হয়? তোমাকে আমার মা বলতে ঘেন্না হচ্ছে। আমাকে বলো না আমি দুশ্চরিত্রা মেয়ে? দুশ্চরিত্রা হওয়াও বোধহয় ভালো তোমার মতো নিষ্ঠুর হওয়ার চাইতে।”

হনহনিয়ে চলে গেলেন রওশন আরা। মনে মনে রাগ জমেছিলো এখন কিছুটা শান্তি লাগছে তার। রিমি বললো,“কেঁদো না ভাবি। আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ভাগ্যিস চোখ বন্ধ করেছিলে। চোখে গরম চা পড়লে মারাত্মক ক্ষতি হতো!”

তাওহীদা ডিমের গন্ধে আরেক দফায় বমি করলো। রিমি নিজেই তাওহীদার মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে রান্না ঘর পরিষ্কার করলো। আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে সে। তাওহীদার মুখের এক পাশে গরম চা লেগে লাল হয়ে গেছে। রিমির এতো কষ্ট হচ্ছে দেখে৷ সেও তো এই নিরীহ মেয়েটার উপর কতটা অমানবিক জুলুম করতো। মনে মনে সে অনুতাপে দগ্ধ হতে লাগলো।

তাওহীদা ঘরে ঢুকলো। আহসান বসে বসে কি যেনো খুঁজছে। তাওহীদা আলতো স্বরে বললো,

“তুমি এখানে কী করছো?”
আহসান উত্তর দিয়ে বলে,
“ওষুধ খুঁজে পাচ্ছি না!”
“কিসের ওষুধ?”
আহসান খুঁজতে খুঁজতে কাঙ্ক্ষিত ওষুধ পেয়ে বললো,“এটাই খুঁজছিলাম।”

তাওহীদা কিছু না বলে বিছানায় বসলো। আহসান আলতো হাতে ফু দিচ্ছে তার গালে। তাওহীদা চমকে তাকালো তার দিকে। আহসান বললো,“তোমার গালে ব্যথা। ওষুধ দেবে না?”

তাওহীদা এতক্ষণে চেপে রাখা কান্না এবারে স্বশব্দে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আহসানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। আহসান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে আসতেই তাওহীদা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে আহসানের দিকে। আহসান জানলো কিভাবে তার মুখে পুড়েছে?
তার মনে অদ্ভুত এক খটকা তৈরি হয়। আহসানের এই আচরণ কি সত্যি পাগলামি, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে?

“ওষুধ নাও। গালে ব্যথা, ব্যথা!”
“তুমি জানলে কিভাবে আমার মুখ পুড়েছে?”
আহসান স্বাভাবিক তবে পাগলামি করতে করতে বললো,“আমি সব দেখেছি।ঐ ডাইনি টা তোমাকে আগুন লাগিয়ে দিলো!”
“কিভাবে দেখলে?”
“আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। দেখলাম তোমার মুখে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে এক ডাইনি!”
“তুমি স্বপ্ন দেখেছো, আহসান!”

আহসান মাথা নাড়লো। তাওহীদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“তাই এমন অস্থির হয়ে ওষুধ খুঁজছিলে?”

তাওহীদার কথায় আহসান আবারও মাথা নাড়লো। তারপর ওষুধ এগিয়ে দিলো। তাওহীদা ওষুধ হাতে নিয়ে দেখলো আহসান একদম সঠিক ওষুধ টাই তাকে দিয়েছে। মনের মধ্যে আবারও একটা সন্দেহের বীজ বপন হতে লাগলো। কি হচ্ছে এসব?

“তুমি জানলে কিভাবে এই ওষুধই লাগাতে হয় মুখ পুড়লে?”
“আমি জানি তো। এই দেখো, আমারও পুড়েছিলো!”

তাওহীদা তাকিয়ে দেখলো আহসানের হাতে পুড়নো পোড়া দাগ! লম্বা করে শ্বাস ফেললো তাওহীদা। আহসান যত্ন করে তাওহীদার পুড়ে যাওয়া মুখে মলম লাগাতে লাগলো। আহসানের কম্পনরত হাতের স্পর্শে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিলো তাওহীদার। সর্বাঙ্গ শিরশির অনুভব হলো। স্বামীর স্পর্শ বুঝি এমনই? ওর দুচোখ ভরে উঠলো কিছু না পাওয়ার বেদনায়। একটা অদ্ভুত শুন্যতায়। আহসানের এই যত্নে সে আরও বেশি আবেগী হয়ে কান্না করতে লাগলো। আহসান কেমন হাসফাস করতে করতে তার দুচোখ মুছে দিচ্ছে। যেনো তার কষ্ট এই মানুষটারও কষ্ট।

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-১০

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১০
#রাউফুন

রিমি একসময় সবকিছু নিয়ে পালিয়েছিল, সেই জমানো টাকার পাহাড় নিয়ে সে তার প্রেমিকের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই পাহাড় গলে যায়। প্রেমিক তার থেকে টাকা নিয়ে এক রাতে চুপিসারে পালিয়ে যায়। রিমি যখন বুঝতে পারে সে পুরোপুরি প্রতারিত, তখন তার পৃথিবী যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।

শহরের এক কোণে, নোংরা এবং ভাঙাচোরা এক ঘরে বসে রিমি চোখের জল ফেলছিল। কিছু খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। শরীর দুর্বল, মাথা ঘুরছে। তার মনের ভেতর শুধুই একটাই প্রশ্ন, “এ কি করলাম আমি? নিজের পরিবারের এত ক্ষতি করে আমি আজ একা, নিঃস্ব। মা-বাবাকে ফেলে, ভাইয়ের বউকে ফাঁসিয়ে নিজের জীবনে আগুন দিলাম। আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন?”

হাহুতাশ করতে করতে রিমি ঠিক করল বাড়ি ফিরে যাবে। সেখানে তার শাস্তি হবে, অপমান হবে—তবু অন্তত নিজেকে শুধরে নিয়ে কিছুটা হলেও পাপ মুক্ত হতে পারবে। অনেক কষ্টে ভাঙা শরীর নিয়ে সে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

বাড়িতে তখনও সবাই রিমিকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। পারভীন আর সালমার ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বাড়ছিল। তারা নিজেরাই বুঝতে পারছিল, তারা তাওহীদাকে অকারণে অপমান করেছে, এই জন্য তাদের মাঝে কোনো অপবাদ নেই বরং তাওহীদা এই অপবাদ থেকে নিস্তার পেয়ে যাবে এটাই যেনো মানতে পারছে না তারা। তারপর নিজেদের অনেক দামী গিফট, মূল্যবান জিনিস হাত ছাড়া হওয়ায় কপাল চাপড়াচ্ছে।

সেদিন দুপুরে রিমি বাড়ি ফিরে আসে। তার চেহারা দেখে কেউ চিনতে পারছিল না। চুল এলোমেলো, চোখে কালো দাগ, শরীর ক্লান্ত। বাড়ির সবাই রিমিকে একত্রে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করল। রওশন আরা এক দৌড়ে এসে বললেন, “তুই এ কী অবস্থা করেছিস রিমি? তুই কোথায় ছিলি?”

রিমি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে।

“মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাদের সবার সঙ্গে অন্যায় করেছি। আমার যে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি একবারের জন্যও ভাবিনি আমার করা বোকামো, আর ভুল এত বড় শাস্তি নিয়ে আসবে আমার জীবনে।”

মফিজ উদ্দিন কড়া স্বরে বললেন, “তোর এ অবস্থার জন্য তুই নিজেই দায়ী। আমরা তোকে কতবার সাবধান করেছিলাম, তাও শুনিসনি। এখন আবার কী চাস? তুই কি করেছিস গয়না, টাকা পয়সা, কার সঙ্গে গিয়েছিলিস তা আদ্যোপান্ত কিছুই জানতে চাইনা৷ শুধু এটা জানি তোর এই বাড়িতে জায়গা হবে না। যেখানে গেছিলি সেখানেই ফিরে যা৷”

রিমি মুখ নিচু করে বলল, “বাবা, আমি কোনো কিছু চাইতে আসিনি। আমি শুধু তাওহীদার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমি তার সঙ্গে যা করেছি, তার কোনো ক্ষমা নেই।”

রওশন আরা হতবাক হয়ে বলল,
“তুই এমন করলি কেন? তুই আমাদের এভাবে বিশ্বাস ভাঙলি?”

রিমি অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“আমি শুধু নিজের কথা ভেবেছিলাম, ভালো থাকতে চেয়েছিলাম। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।”

সালমা তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিমির দিকে৷ পারভীনও আক্রমনাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। আনোয়ার সানোয়ারও কম না। বোনের এমন অধঃপতন দেখে রাগে, ক্রোধে মাথা জ্বলে যাচ্ছে দুই ভাইয়ের। সালমা তেড়ে এসে বললো,

”তোমার উপায় ছিলো কি ছিলো না তা দেখা আমাদের কাজ নয় রিমি। আমাদের যা কিছু চুরি করে নিয়ে গেছিলে সবকিছু আমাদের ফিরিয়ে দাও।”

পারভীনও রিমিকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে বললো,“আমার হিরের নেকলেস টা এক্ষুনি ফেরত দেবে। তোমার এতো বিষ? মনে মনে এই ফন্দিই করতে আমাদের বাজারে পাঠিয়েছিলে। নোংরা মেয়ে ছেলে। এখন তো মনে হচ্ছে এসব চোরেদের জন্য এই বাড়িতে থাকা দায় হয়ে যাবে।”

আনোয়ার বোনের দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে নাক ছিটকে বললো,
“মা, তোমার মেয়েকে বেরিয়ে যেতে বলো। না জানি কার সঙ্গে নোংরামি করে ফিরে এসেছে তোমার মেয়ে। ঘেন্নায় বমি আসছে আমার। ওকে নিজের বোন বলতেও ঘেন্না হচ্ছে।”

রওশন আরা বড়ো ছেলের কথা শুনে নিজের নিয়ন্ত্রণ করা রাগ, দুঃখ কষ্ট সব উগড়ে দিলেন যা এতক্ষণ নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিলেন তিনি। মেয়ের কাছে এসে দমাদম কিল, থাপ্পড় মা’র’তে লাগলেন। কেউ কিছু বলার মতো বা আঁটকানোর মতো সাহস পেলো না৷ মফিজ উদ্দিন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের আদরের কন্যার এ কি অবস্থা? মেয়ের নোংরা কর্মকাণ্ড পিতা মাতার জন্য যে কতটা পীড়াদায়ক তা কেবল সেইসব পিতা মাতায় উপলব্ধি করেন যারা এই পরিস্থিতি ফেস করেন। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে রওশন আরা দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়েন। সালমা আর পারভীনের যেনো ক্রোধ কমে না। সানোয়ার ব্যতীত সবাই একের পর এক কটুবাক্য ছুড়তে থাকে। সানোয়ার বোনকে একটু বেশিই ভালোবাসে।

সবার কথা যেনো রিমির হৃদয়ে তীরের ফলার ন্যায় আঘাত করে। তাওহীদা স্তব্ধ হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। রিমির করুণ অবস্থায় দেখে তার চোখেমুখে দয়া আর ক্ষমার ছাপ। রিমি তার পায়ের কাছে বসে পায়ে রাখতে নিলে দু কদম পিছিয়ে গেলো সে। রিমির এই অবস্থা দেখে তার ভেতরটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। ইশ কি নিষ্ঠুর পরিনতি। রিমি বলল, “তাওহীদা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমাকে এত অপমান করেছি, তোমার জীবন বিষিয়ে তুলেছি। আমি তোমাকে ফাঁসাতে তোমার নুপুর জোড়া নিয়ে আলমারির কাছে রেখেছিলাম। কিন্তু সবকিছু করেছি, আমিই দোষী, আমাকে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।”

তাওহীদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আপু, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভুল ক্ষমা করেন। তবে তাঁর কাছে ক্ষমা পেতে হলে নিজের অন্যায়ের জন্য তওবা করতে হয়। আমি তোমাকে মাফ করলাম। কিন্তু আজ থেকে এই ঘরে আর কোনো মিথ্যা, অপবাদ, এবং অন্যায় থাকবে না। আমরা সবাই মিলে নতুন ভাবে শুরু করব।”

রিমি মাথা নিচু করে বলল, “তোমার কথাই সত্য, তাওহীদা। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, নিজের জীবন আল্লাহর পথে নিয়ে যাব, তুমি আমাকে একটু শিখিয়ে দিও।”

সবাই একে একে শান্ত হলেও রাগ যেনো কমলো না কারোর। মফিজ উদ্দিন বললেন, “ তোমার মতো মেয়েকে এই বাড়িতে দেখতে চাই না আমি। বের হয়ে যাও।”

তাওহীদা মফিজ উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,“বাবা, আপু নিজের ভুল বুঝে ফিরে এসেছে এটাই কি অনেক না? ভুল মানুষ মাত্রই হয়, আপুকে ক্ষমা করে দিন বাবা। আমি জানি আপনি আমার এই কথাটা রাখবেন। আপুকে আর একটা সুযোগ দিন বাবা। ফাসির আসামীও কিন্তু একটা সুযোগ পায়।”

মফিজ উদ্দিন কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আর সঙ্গে বাকিরাও যে যার যার ঘরে ফিরে গেলো। রওশন আরা কতক্ষণ স্থব্ধ হয়ে বসে ছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তাওহীদা এবং সবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর রিমি নিজের ঘরে ফিরে যায়। তবে ঘরে ঢুকেই সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। মাথায় আজেবাজে চিন্তা ভড় করতে থাকে। বাইরে থেকে যতই সব ঠিকঠাক মনে হোক, তার অন্তর এক অজানা কষ্টে ভেঙে পড়ছে।

সালমা আর পারভীন তাওহীদার দয়া ও ক্ষমার কথা শুনলেও, তাদের মনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং তারা মনে মনে নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের ছক কষছিল। এমনকি রওশন আরাও তাওহীদার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখলেও, তার মনে একটা গোপন অস্বস্তি কাজ করছিল। পরিবারের এই দ্বন্দ্ব যেন থামবার নয়।

এদিকে মফিজ উদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন, তাওহীদার গ্রামে গিয়ে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, মেয়েটার জীবন অনেক কষ্টে কেটেছে, এখন তাকে একটু হলেও এগিয়ে দিতে হবে। গ্রামে গিয়ে তিনি তাওহীদার মা, মমতাজ বেগমের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি মমতাজকে বললেন, “আপনার মেয়ে খুবই সৎ আর মেধাবী। আমি ওর পড়াশোনা আবার শুরু করাতে চাই। আপনি ওর সার্টিফিকেটটা আমাকে দিন, আমি ওকে শহরে ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়ে দেব।”

প্রথম বার মেয়ের শ্বশুর তার বাড়িতে এসেছে, তাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করবেন তা নিয়ে ভাবছিলেন৷ শরবত হাতে নিয়ে সামনে রেখে অল্প আলাপ করেই মফিজ উদ্দিন নিজের মনোভাব প্রকাশ করলেন। মমতাজ বেগম কেঁদে ফেললেন। বললেন,

“আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালো করুক। আমার মেয়ে যে কত কষ্ট করেছে, তা শুধু আল্লাহই জানেন। আপনার এ সাহায্য ওর জীবন বদলে দেবে।”

মমতাজ বেগম নিজের সাধ্যের মধ্যে মেয়ের শ্বশুরকে আপ্যায়ন করতে ভুললেন না। সেদিনই মফিজ উদ্দিন তাওহীদার এইটের সার্টিফিকেট নিয়ে শহরে ফিরে আসেন। বাড়ি ফিরে তিনি তাওহীদাকে ডেকে বললেন, “তাওহীদা, তোর পড়াশোনা শুরু করার সময় হয়েছে। তুই এখন ক্লাস নাইনে ভর্তি হবি। আর পরীক্ষায় ভালো ফল করে দেখাবি, যাতে সবাই বুঝতে পারে তুই কতটা মেধাবী।”

তাওহীদা প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও মফিজ উদ্দিনের দৃঢ়তা দেখে সাহস পেল। সে মৃদু হেসে বলল, “আপনার কথা মতো আমি চেষ্টা করব। আল্লাহ যদি চান, তাহলে অবশ্যই আমি পড়াশোনা শুরু করবো।”

তাওহীদা এবার থেকে পড়াশোনা করবে ভাবতেই তার অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে। মফিজ উদ্দিন নিজে তাওহীদার পড়াশোনার ব্যবস্থা করলেন এবং নিশ্চিত করলেন, যেন সে সব বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে।

আহসান ও তাওহীদার মধ্যে ছোটখাটো কিছু মুহূর্ত তৈরি হচ্ছিল, যা তাদের সম্পর্কের মাঝে এক নতুন মাত্রা যোগ করছিল। আহসান তার স্বভাবসুলভ পাগলামি চালিয়েই যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তে তাওহীদার মনে অদ্ভুত সন্দেহ জাগছিল।

একদিন বিকেলে তাওহীদা বারান্দা দিয়ে দেখল আহসান নামাজ পড়ছে। বিষয়টি দেখে সে কিছুটা অবাক হলো। এতদিন তো এমন কিছু সে দেখেনি! মনের মধ্যে খটকা লাগল, আহসান কি আসলেই পাগল নাকি সে অন্য কিছু লুকাচ্ছে?

তাওহীদা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। এরপর সোজা গিয়ে আহসানকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি নামাজ পড়ছো? তুমি নামাজ পড়তে জানো?!”

আহসান তার পাগলামী ভাব বজায় রেখে বলল, “তাওহীদা, তোমাকে নামাজ পড়তে দেখেছি, তুমিও তো এরকম করে নামাজ পড়ো তাই না? তাই ভাবলাম আমিও এভাবে দোয়া করবো!”

তাওহীদা কোনো কথা না বলে শুধু তাকিয়ে রইলো আহসানের দিকে। তার মনের সন্দেহটা পুরোপুরি দূর হলো না। আহসানের আচরণে যেন কিছু একটা লুকানো আছে, কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না।

এদিকে পরিবারের মধ্যে নতুন নতুন ঝামেলা চলতেই থাকে। সালমা আর পারভীন নিজেদের মধ্যে কথা বলে নতুন কোনো পরিকল্পনা করছে। রওশন আরাও তাদের সাথে মাঝে মাঝে যোগ দেয়। রওশন আরার ধারণা এখন তাওহীদার সঙ্গে কোনো ভাবেই পাওয়া যাবে না। তাওহীদাকে হাতে না রাখতে পারলে যে এই সংসারে তার দাম শুন্যে ভাসবে।

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৯

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৯
#রাউফুন

তাওহীদার ঘর থেকে কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। এই ঘটনা যেন তাওহীদার পক্ষে আল্লাহর কুদরত দেখানোর মতোই। মফিজ উদ্দিন আশ্বস্ত হয়ে বললেন, “আমি জানতাম, আমার তাওহীদা এমন কাজ কখনও করতে পারে না। ওর মুখের কথাই যথেষ্ট ছিল।”

কিন্তু ঘরে ফেরার পথে রওশন আরা আর পারভীনের চেহারা দেখে বোঝা গেল, তারা এখনো নিজেরা বিশ্বাস করতে পারছে না বা মানতে চাইছে না। তাওহীদা তখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। তার চোখে পানি। ভাঙা কণ্ঠে বলল, “আমি কি আপনাদের কাছে এতটাই ছোট মানসিকতার বা খারাপ যে আমার কথাগুলো কখনো বিশ্বাস করতে পারেন না? আমি যদি আপনাদের সবার মতোই পরিবারের সদস্য হয়ে থাকি, তবে কেন আমাকেই বারবার সততার প্রমাণ দিতে হয়?”

“কারণ তোমাকেই আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, তুমি ব্যতীত বাসায় কেউ ছিলো না। আর তুমি ঘরে যে টাকা, গহনা রাখবে না তা আমরা জানি। তুমি অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির মেয়ে!”

সানোয়ারের কথায় তাওহীদা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বললো,“যার স্বামী পাগল তাকে তো ধূর্ত হতেই হয়। তা না হলে আমাকে আগাছা ভেবে উপড়ে ফেলতে চাইবে সবাই! আর আমি কেমন ধারা ধূর্ত তা আপনার বউ ভালোই জানে। তাই না ভাবি”

হঠাৎই সালমা কেমন যেনো চুপসে গেলো। মনে পড়ে গেলো পুরনো একটা কথা, যা কেবলই তাওহীদা ই জানে। তাই সালমা বললো,“আচ্ছা, তাওহীদা নিজেকে প্রমাণ করুক, যে ও কিছুই নেয়নি৷ প্রমাণ করতে পারলে সেটা ওর জন্যই ভালো। সানোয়ার চলো নিচে যাই!”

সানোয়ার তখন হঠাৎ চুপ হয়ে সালমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার মাথায় কি চলছে সেই ভালো জানে। সালমা যেন কিছু একটা ভাবছে। রওশন আরা হঠাৎ বলে উঠল, “তুই জানতিস রিমি কি করছে? কিছু লুকাস নাকি?”

তাওহীদা শান্ত স্বরে জবাব দিল, “মা, আমি কিছুই জানতাম না। কিন্তু রিমি আপু গতকাল যা বলেছিল, তাতে আমি সন্দেহ করেছিলাম। আমি জানি না উনি কোথায় গেছেন, কিন্তু আমার ওপর দয়া করে মিথ্যা দোষ চাপাবেন না।”

মফিজ উদ্দিন এবার রওশন আরার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাওহীদা ঠিক বলছে। আগে তো রিমির কোনো খোঁজ পাওয়া যাক। যা হয়েছে তার দায় তাওহীদার নয়। বরং আমাদের নিজেদের দায়িত্বহীনতার কারণে এমনটা হয়েছে।”

রওশন আরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার চোখেমুখে এক ধরনের হাসফাস ভাব দেখা গেল। তাওহীদা শেষবার বলল, “জীবন আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষা। এই দুনিয়ায় সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। আজ হয়তো আমি আপনাদের কাছে অপরাধী, কিন্তু আল্লাহ জানেন সত্য কি। এই পরীক্ষায় আমি নিজের ইমান ও সততাকে হারাবো না, ইন-শা-আল্লাহ।”

মফিজ উদ্দিন ধীরে ধীরে বললেন, “তাওহীদা, তুই আমাদের সবার চেয়ে অনেক বড় মনের। আল্লাহ তোরপরীক্ষা নিচ্ছেন, তুই শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ধৈর্য ধর।”

আনোয়ার বললো,“তোমার উপর আমাদের সন্দেহ এখনো প্রবল, নিজেকে প্রমাণ করতে হবে তোমাকে। তারপর আমরা বিশ্বাস করবো নিতান্তপক্ষে তুমি সত্য বলছো।”

তাওহীদার উপর অপবাদ ও চক্রান্তের জালে ফাঁসানোর পর দিনগুলো যেন আরও বেশি অন্ধকার হয়ে উঠল। বাড়ির সবাই তাকে আরও বেশি অবজ্ঞা করতে শুরু করল। শুধু আহসান পাগলামী আচরণের মধ্যেও তার পাশে থাকল।

রওশন আরা নিজের মেয়েকে বাঁচারে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকল। তিনি বুঝেছিলেন, এই মুহূর্তে তাওহীদাকে দুর্বল করে রাখাই সবচেয়ে কার্যকর। কিন্তু তাওহীদা নিজের ভেতরে অদ্ভুত শক্তি অনুভব করতে শুরু করল। সে জানত, সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই।

তাওহীদা তার ঘরে একা বসে বলল,
“আমি আর এভাবে চুপ থাকতে পারব না। আমাকে সত্যের জন্য লড়াই করতে হবে।”

সে বাড়ির প্রতিটি ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল। রিমির কথাবার্তা, সালমা আর পারভীনের প্রতি তার আচরণ সবই সন্দেহজনক ছিল। তাওহীদা ভাবতে থাকে,
“রিমি সেদিন সবাইকে বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করল কেন? আর মায়ের চায়ের কাপে ঘুমের ওষুধের গন্ধ আমি ঠিকই পেয়েছিলাম। এই কাণ্ডের পেছনে ওর হাত থাকতে পারে।”

সালমা হঠাৎ আলমারিতে বিদেশ থেকে আনা কয়েন খুঁজে পায়। সে রওশন আরাকে দেখিয়ে বলে,
“মা, সব কিছু তো চুরি হয়ে গেল। কিন্তু এখানে এই কয়েনগুলো কীভাবে রইল?”

রওশন আরা বিরক্ত হয়ে বলল,
“সবই যদি চুরি হয়েছে, এগুলো তো আলমারিতে থাকার কথা না। তাহলে কি পুরো চুরি হয়নি?”

সালমা বিষ্মিত হয়ে বলে,
“কী জানি! তাওহীদা যদি দোষী হতো, তাহলে কি এভাবে আলমারিতে এসব রাখতো? একেবারে খালি করত না? তারপর এগুলো স্বর্ণের!”

পারভীনও কিছুটা নরম সুরে বলে,
“সত্যি বলতে, আমারও মনে হচ্ছে কোথাও একটা গড়বড় আছে। রিমি সেদিন বাড়িতে ছিল, আমাদের মিথ্যা বলে বাজারে বিশেষ ছাড়ের কথা বলে পাঠালো আর ফিরে এসে তো দেখলাম সব গন্ডগোল।”

সালমা আর পারভীনের আলোচনায় রওশন আরার মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। সে মেয়েকে মানুষ করতে পারেন নি এটা নিয়ে এবারে সবাই তাকে প্রশ্ন বিধ্ব করবে৷ যা অনেক অপমানের হবে । কি করবেন তিনি? সবার সামনে নিজের উঁচু নাক, একটা দাপট সবকিছু যে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে।
তাওহীদা রাতের আঁধারে চুপিচুপি বাড়ির সব জায়গা খুঁজতে শুরু করে। সে জানত, কিছু না কিছু প্রমাণ থাকতে পারে যা রিমির সত্যিকারের চরিত্র প্রকাশ করবে। মাথায় এক অদ্ভুত চিন্তা নিয়ে পান মুখে দিয়ে অন্য ভাবনায় ডুবে গেলেন। তাওহীদার উপর নজর রাখতে তাকে।

তাওহীদা ঘর পরিষ্কার করার নাম করে রিমির রুমে ঢুকে। একে একে সব ঘর পরিষ্কার শেষে হঠাৎ সে রিমির ঘরের একটি ট্রাঙ্ক খুঁজে পায়। সেখানে লুকানো কিছু রসিদ আর ছোট্ট একটি নোটবুক দেখতে পায়। নোটবুকে রিমি নিজের হিসাব লিখেছে—টাকা কোথায় রেখেছে, কীভাবে নেবে, সব মিলিয়ে কত টাকা হবে সবকিছুই।

তাওহীদার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
“এটাই আমার নির্দোষ হওয়ার জন্য যথেষ্ট, এটাই প্রমাণ হিসেবে দেখাতে হবে সবাইকে! আমি জানতাম, আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবেন না।”

পরদিন তাওহীদা সবাইকে ডেকে বলল,
“আমি দোষী নই। আমি কোনো চুরি করিনি। আমার প্রমাণ আছে। রিমি আপুর ঘর থেকে আমি এসব পেয়েছি। আপনারা যদি বিশ্বাস না করেন, নিজেরাই যাচাই করে দেখুন।”

রওশন আরা চিৎকার করে বলল,
“তুই আবার রিমির ঘরে কী কারণে গেছিলি? তোকে কে অনুমতি দিয়েছে?”

তাওহীদা শান্ত গলায় বলল,
“আমাকে অনেক অপমান করেছেন। আমাকে প্রমাণের সুযোগ দিন। তারপর যে শাস্তি দেবেন, আমি মেনে নেব।”

সবাই মিলে রিমির ঘর থেকে খুঁজে পাওয়া নোটবুক হিসেবের রসিদ দেখতে পায়।
আনোয়ার খানিকটা হেসে বললো,“এসব তো তুমি নিজেও লিখে আমাদের দেখাতে পারো। এগুলো তুমিই পেলে কেন? আমরা কেউ তো পেলাম না!”

রিমি যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো। ও একদমই এভাবে ভাবে নি ব্যাপারটা। সে যুক্তি খুঁজে পেয়ে বললো,“আমার লেখা আর রিমি আপুর লেখা মিলিয়ে দেখতে পারেন। আপনারা চাইলে লিখে দেখাতে পারি।”

সবাই তাওহীদার লেখা আর রসিদে লেখা মিলিয়ে দেখলো, লেখা মিলছে না। বরং রিমির লেখা তাওহীদার লেখার তুলনায় অত্যন্ত বাজে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রীর এমন ধারা লেখা? আশ্চর্যের শেষ সীমা যেনো পেড়িয়ে গেলো। রওশন আরা ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়৷ এবারে বুঝি সবাই তাকেই চোরের মা বলবে? কেউ বুঝি তাকে আগের মতো আর মূল্যায়ন করবে না? দরদর করে ঘামতে থাকেন তিনি। সারা শরীর দুলে উঠে তার। হড়বড় করে বমি করে অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। ঘটনা টা এতো দ্রুত ঘটলো যে সবাই বিষয় টা ধরতে একটু সময় নিলো। দ্রুত ধরে রওশন আরাকে ঘরে নিয়ে শোয়ানো হলো।

সেই রাতে রিমির খোঁজে লোক পাঠানো হলো। কিন্তু কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। এদিকে পারভীন আর সালমার মনের ভেতরেও সন্দেহের কাঁটা নাড়াচাড়া দিতে লাগল। তারা একে অপরকে বলতে লাগল, “রিমি সত্যিই এতো কিছু করেছে কি না.. নাকি এইসবই তাওহীদার চাল?”

তাওহীদা শাশুড়ীর মাথার কাছে থেকে তার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে। মফিজ উদ্দিন চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছেন।

“মেয়েটাকে মানুষ করতে পারিনি আমরা বুঝলি মা? কি একটা কান্ড বাঁধিয়ে কেমন তোকে ফাসিয়ে গেলো দেখলি?”

“বাবা, এখন মায়ের শরীর ভালো নেই। এখন এসব কথা থাক!”

“তুই এখনো এই মহিলার কথা ভাবছিস? যে কি না তোকে সমানে দোষারোপ করছিলো? শোন, এখন এতো ভালো আর নরন মানুষের না দাম নেই। প্রয়োজনে একটু শক্ত হতে হয়! যে যেভাবে পারে, সুযোগ পেলেই তারা তোকে অপমান করতে এক চুল ছাড় দেয় না তাদের জন্য এতো চিন্তা করিস না। এই মহিলার এতো সহজে কিছু হবে না।”

“বাবা, তাদের মতো যদি আমিও করি তবে তাদের আর আমার মাঝে পার্থক্য রইলো কোথায়? নবী করিম (সাঃ) জীবনের এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যা থেকে আমরা সবাই শিক্ষা নিয়ে থাকি। এক বৃদ্ধা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পথের মাঝে কাঁটা বিছিয়ে দিতেন যাতে তিনি কষ্ট পান। নবীজী কখনোই এর প্রতিশোধ নেননি। বরং কাটা গুলো তিনি সরাতেন এবং মুচকি মুচকি হাসতেন। কিন্তু হঠাৎই একদিন তিনি দেখলেন সেই বৃদ্ধা কোনো কাঁটা রাখেননি। তখন তিনি তাঁর খোঁজ নিয়ে জানলেন যে তিনি অসুস্থ। নবীজী তাকে দেখতে গেলেন এবং তার সেবা করলেন। এ ঘটনায় বৃদ্ধা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। নবী করিম (সা.)-এর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যারা আমাদের বিরুদ্ধে খারাপ আচরণ করে, তাদের প্রতিও আমাদের ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল হওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে তাদের আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। তাঁর এই উদাহরণ আমাদের জীবনে অনুসরণ করার মতো। (এই ঘটনাটির কোনো সহীহ্ বোখারীতে নেই তবে নবীজির সিরাত পড়লে জানা যাবে)

“তায়েফে নবী (সা.)-কে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। জিবরাঈল (আ.) তাঁকে বলেছিলেন, যদি নবীজী চান, তাহলে তিনি তায়েফের লোকদের ধ্বংস করবেন। কিন্তু নবী (সা.) বলেছিলেন:
“না, বরং আমি আশা করি, আল্লাহ তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন, যারা আল্লাহর ইবাদত করবে।”

“মা গো, তুমি এতো কিছু জানো, এই হাদিস আমিও ভালো ভাবে জানি না।”

“বাবা, আপনাদের জানা উচিত। আমরা সবাই মুসলিম তবে কেন আমরা আল্লাহর নবী খলিফা আর হাবিবের সম্পর্কে জানবো না? আমাদের জীবনকে তো আমাদের হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জীবন ধারায় সাজাতে হবে। বাবা আপনাকে দেখি আপনি মাঝে মধ্যে নামাজ আদায় করেন আবার অনেক সময় কাজা করেন, যদিও তা ইচ্ছাকৃত নয় তবে তার হিসাব অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা নেবেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“আমাদের এবং তাদের (কাফেরদের) মধ্যে চুক্তি হলো নামাজ। যে ব্যক্তি নামাজ ত্যাগ করে, সে কুফরির মধ্যে পড়ে গেছে।”

নামাজহীন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে মূল্যহীন। অন্য হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ত্যাগ করে, তার কোনো ধর্ম নেই, সে যেনো কুফরি অন্তর্ভুক্ত হলো।”
বাবা অবশ্যই চেষ্টা করবেন যেনো কাজা না হয়। কাজকে না বলুন নামাজকে নয়!”

মফিজ উদ্দিন তাওহীদার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন৷ তখনই দেখলেন রওশন আরা খানিকটা নড়াচড়া করছেন। মফিজ উদ্দিন গম্ভীরমুখে বললেন,“ডাইনী মহিলা শতান্নীর জ্ঞান ফিরলো। এখানে আর থাকা যাবে না!”

তাওহীদা শ্বশুরের দিকে পিটপিট করে তাকালো। মফিজ উদ্দিন উলটো ঘুরে ঘরের বাইরে চলে গেলেন। তাওহীদা শাশুড়ীকে ধরে বসিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়াতে লাগলো। যতোই হোক এভাবে তো একটা মানুষকে ফেলে রাখা যায় না? সে যথা সম্ভব সেবা করলো।

#চলবে

( চোখের সমস্যার জন্য লেখায় ভুল, খাপছাড়াও লাগতে পারে।

রেফারেন্সঃ১ (সহীহ বুখারি, হাদিস: ৩২৩১)

রেফারেন্সঃ২ (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৮২; সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২৬২১)

রেফারেন্সঃ৩ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস: ২০৩৮৪; সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২৬২২)

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৮

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৮
#রাউফুন

বিকেল হয়ে গেলে সালমা, পারভীন, মার্কেট থেকে ফিরে এলো। এসে দেখে রওশন আরা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন, আর আলমারির সব জিনিস লুট হয়ে গেছে। চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। শোরগোল শুনে তাওহীদা তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
রওশন আরাকে পানির ছিটে দেওয়ার পর ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকে। এরপর ঘটনার আদ্যোপান্ত বুঝে মেয়ের করা কাজের কথা মনে পড়ে। শুকনো ঢোক গিলে মেয়ের দোষ তাওহীদার উপর চাপাতে তার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে,
“তোরই কাজ এটা! কারণ বাড়িতে তো তুই-ই ছিলি। তুই-ই লুট করেছিস সবকিছু, ফকিন্নির বাচ্চা, লোভ আর সামলাতে পারিস নি!”

সালমা আর পারভীনও সাথে যোগ দেয়। ক্রোধান্বিত হয়ে বলে,
“এই মেয়েটা তো এমনিতেই সন্দেহজনক। কী জানি কী করে বেড়ায়! যদি আমাদের গহনাদি না দিস পুলিশের কাছে ফোন দেবো এসে কোমড়ে দরি বেঁধে নিয়ে যাবে। দু”ঘা পড়লেও পেট থেকে সুরসুর করে কথা বের হবে।”

তাওহীদা যেনো অষ্টম আশ্চর্য হয়ে গেলো এমন নিম্নমানের অপবাদে। সে শপথ করে বলে,
“আমি কিছু করিনি! তোমরা যা ইচ্ছে তাই বলছ, কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি এই চক্রান্তে জড়িত নই। মা, আপনি জানেন না, না জেনে কারোর উপর অপবাদ দেওয়া কতটা জঘন্যরকম পাপ? অন্যায়ভাবে অপবাদ দিলে শাস্তি কি ভয়াবহ?
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইকে এমন একটি দোষে অভিযুক্ত করে, যা সে করেনি, আল্লাহ তা’আলা তাকে এমন একটি দোষে ফাঁসিয়ে দেবেন, যাতে সে মুক্তি পাবে না।”
অপবাদ দেওয়া একটি মারাত্মক পাপ। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কিছু বলা ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি মুমিনদের সম্পর্ক নষ্ট করে এবং আল্লাহর কাছে বড় গুনাহ হিসেবে গণ্য হয়। সবসময় সত্য কথা বলা এবং নিজের জবান নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।”

“শোন, তোর এসব হাদিস আমাদের শুনাতে আসিস না। সবকিছু কোথায় রেখেছিস বের করে আন। চুরি করে আবার বড়ো বড়ো কথা।”

শাশুড়ীর তিক্ত কথায় তাওহীদা শব্দ করে কেঁদে উঠে বলে, “আমি নিই নি কোনো কিছু। আপনি আমাকে এমন নোংরা অপবাদ দেবেন না৷ চুরি করা মহাপাপ, আমি আল্লাহকে ভয় করি, এই পাপ আমি কখনোই করতে পারি না।”

কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। চেঁচামেচি শুনে তো রিমির বের হওয়ার কথা? তাহলে বের হলো না কেন? তাওহীদার সন্দেহ হয়। সে কান্না থামিয়ে নরম স্বরে শুধায়,“রিমি আপু কই মা?”

রওশন আরার মুখ চুপসে যায়। মেয়ে যে তাকে এভাবে ঘোল খাওয়াবেন তিনি বুঝতেই পারেন নি। এভাবে চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে বকা বানালো? মেয়েটা কি তবে সত্যিই বাড়ি ছাড়া হলো? কিন্তু এ কথা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। তিনি চূড়ান্ত রাগে বললেন,
“তোর জায়গা এই বাড়িতে নেই! আমি তোকে এই বাড়িতে থাকতে দেব না। তোর জন্য ওরা আমার মেয়ের দিকে আঙুল তুলবে এখন। কত বড়ো সাহস আমার মেয়ের নামে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চিন্তা করিস! আমার মেয়ে আমাকে বলেই আমার সামনে থেকে চলে গেছে ভার্সিটির হলে। আমার মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা বললে জিব টেনে ছিড়ে ফেলবো একদম।”

“আমি আপুর নামে মিথ্যা বলছি না, আর আমার মিথ্যা বলার প্রয়োজনও নেই। কারণ আমি আপুর নামে কিছুই বলিনি, আপনি নিজেই বলছেন৷ আর এখন যা বলা হচ্ছে সব কিছু আমাকে ঘিরে। কেন আমাকেই কেন সবকিছুতে দায় করা হয়?”

সালমা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ীর দিকে। কেমন ঘাবড়ে আছে মনে হচ্ছে। সে বললো, “আমরা যাওয়ার পরেই ও কেন চলে গেলো মা? আর ও কিন্তু আমাদের মার্কেটে বিশেষ ছাড়ের কথা বলে মার্কেটে পাঠায় , অথচ গিয়ে দেখি কোনো ছাড় নেই। হতেই তো পারে আপনার মেয়েই সবকিছু সরিয়েছে? ওর হইতো টোপ ছিলো আমাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে সব নিয়ে চলে যাবে।!”

“মুখ সামলায়ে কথা বলো সালমা। আমার মাইয়ার গয়নাদি কম নাই যে তোমাদের জিনিসে হাত দেবে। এতোদিন তোমাদের জিনিস তো ছিলো কখনোই কি রিমি তোমাদের কোনো জিনিস না বলে নিয়েছে? এমনি আমার মেয়ের উপর দোষ না চাপিয়ে এই ফকিন্নির ঝি কে চেপে ধরো।”

শাশুড়ীর যুক্তি শুনে তাওহীদা বোঝে, তার উপর অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এই পরিস্থিতিতে আহসানও কিছু করতে পারে না। পাগলামি করে সে তাওহীদাকে আড়াল করার চেষ্টা করলেও এখনকার পরিস্থিতিতে তাকে বাঁচাতে পারবে না।

পারচীন তির্যক কন্ঠে বললো,“মা, আর যাই বলুন, আপনার মেয়েকেই এখন সন্দেহ হচ্ছে। আপনার ছেলেদের আনা জিনিস তো ওকে আমরা দিইনি, হতেই পারে ও নিজে রাগে আমাদের সব কিছু নিয়ে ভেগেছে। আপনার ছেলেরা আসুক এরপর এর একটা বিহিত হবে।”

পারভীন আর সালমা ভেতরে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে রইলো। আহা শখের গয়না গুলো কিনা হাত ছাড়া হলো? দুজনেই বসে বসে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে থাকে।

আনোয়ার আর সানোয়ার দুইজন মফিজ উদ্দিন এর সঙ্গে অফিসে জয়েন করেছে। এখন ব্যবসা বুঝে নেবে কারণ এখন ব্যবসার অবস্থা রমরমা। দুই ভাইয়ের কেউ-ই সেটা হাত ছাড়া করতে চাইলো না। তাওহীদা মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক, আর কি কি তাকে সহ্য করতে হবে? রাতে মফিজ উদ্দিন আর সানোয়ার আর আনোয়ার দুজন ফিরলে সবকিছু শুনলো। মফিজ উদ্দিন রিমির ভার্সিটি হলে খোঁজ নিলো, রিমি ওখানে আছে।

পারভীনের হঠাৎই চোখ পড়লো নিজের ঘরে তাওহীদার নূপুর পড়ে থাকতে দেখে। সে চিৎকার করে তাওহীদাকে ডাকতে থাকে। সবাই যে যার যার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তাওহীদাও বেরিয়ে এলো উপর থেকে। মুখ ঢেকে বেরিয়ে আসে সে। মফিজ উদ্দিন বললেন, “কি হয়েছে পারভীন? এভাবে চিৎকার করছো কেন?”

“বাবা চুরি আপনার আদরের ছোটো বৌমা ই করেছে। এই দেখুন তার নুপুর আমার ঘরে পড়ে ছিলো। ঠিক আলমারির কাছ টাই ছিলো!”

তাওহীদার মাথা ঘুরে উঠে৷ সে ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখে ওটা তার মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতি। তাওহীদার মনে পড়লো রিমির তার থেকে তার মায়ের দেওয়া শেষ কিভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। সে তৎক্ষনাৎ ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,“আমার নুপুর জোড়া তো রিমি আপু আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো!”

“কিহ, কি বললে বউ? আবার আমার মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা?”

“তোমার থেকে যদি রিমি নুপুর নিয়েও থাকে তাহলে সেটা কখন নিয়েছে? আমাদের তো কাউকে বলোনি? এখন মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাও না? আর রিমি তো ভার্সিটির হলেই আছে। বাবা নিজে ফোন দিয়ে জেনেছে।” আনোয়ার বাকবিতন্ডার মাঝে যুক্তি দিয়ে কথাটা তুলে ধরলো৷

তাওহীদা চোখ মুছে জবাব দিলো,“নুপুর জোড়া আমার মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতি, আমি দিতে চাইনি বলে আপু জোর করে সেটা নিয়ে নেয়৷ আমি যে কাউকে বলবো, সেই ফুরসতটাও পাইনি। কারণ এই বাড়ির কেউ-ই আমাকে সহ্য করতে পারে না আর না বিশ্বাস করে আমার কথা!”

“বাহ যুক্তি ত ভালোই দেখাইলি। ভালোই ভালোই আমাদের জিনিস আমাদের ফেরত দে তাওহিদা৷“

সালমার কথা শুনে তাওহীদা আবারও বললো,“আপনারা চাইলে আমার ঘরের সবকিছু খুঁজে দেখতে পারেন।”

এই কথা বলে তাওহীদা অপমানে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো কখন এই আধার কেটে আলোর মুখ দেখবে সে? সবাই তাওহীদার ঘরের দিকে পা বাড়াতে নিলে মফিজ উদ্দিন তাদের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,“খবরদার ওর ঘর কেউ সার্চ করবে না। আমি জানি তাওহিদা কেমন। তাই ওর মুখের কথায় যথেষ্ট!”

পারভীন বললো,“বাবা প্রমাণ দেখানোর পরেও আপনি এই কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ বলছি কারণ ও কখনোই এমন কিছু করবে না৷ যে মেয়েটা গভীর রাতে উঠে আল্লাহর ডাকে সারা দিয়ে তাহাজ্জুদ পড়ে, যে মেয়েটা গভীর রাতে কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকে তোমরা তার উপর দোষ দিচ্ছো?”

“বাবা, ওসব লোক দেখানো। ভেতরে ভেতরে ও জঘন্য!”

“চুপ করো।” মফিজ উদ্দিন হুংকার ছাড়লেন।

তাওহীদা বললো,“বাবা ওদের আমার ঘর খুঁজতে দিন। প্রমাণ হোক আমি কিছু নেয়নি।”

রওশন আরা তো জানেন কিছুই পাওয়া যাবে না তাই তিনি হকচকিয়ে বলেন,“তাওহীদা ঘরে দেখতে বলছে মানে ও নিশ্চয়ই ঘরে কোথাও ওসব জিনিস রাখবে না? দেখছো না কেমন গলার জোর? চোরের মায়ের বড়ো গলা!”

সানোয়ার তাল মিলিয়ে বললো,“হ্যাঁ তাই তো,কেউ চুরি করে সেসব কেন ঘরে রাখতে যাবে? নিশ্চয়ই সবকিছু বিক্রি করেছে সেই সুযোগে!”

“দুদিনে আমি কোথাও যাইনি। আমাকে আর যাই বলুন, আল্লাহর দোহায় লাগে চুরির অপবাদ দেবেন না।”

”অপবাদ তো সাধে দেওয়া হয়নি। তোর নুপুর আমার ঘরে পাওয়া গেছে বলেই দেওয়া হচ্ছে।”

“আমি একশোবার বললেও বলবো এসব চুরি আমি করিনি। আপনারা সত্যতা উদঘাটন না করে আমাকে বললে তার দায় সম্পুর্ন আপনাদের। আমার আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন!”

রওশন আরার ভেতরটা ঘাবড়ানো। কিন্তু উপরে উপরে জোর গলায় বললেন,
”আজ মুখে বড়ো খই ফুটছে যেনো। এতো সাহস অন্যায় করে আবার বড়ো বড়ো কথা!”

“সব সইবো কিন্তু মিথ্যা অপবাদ না মা। আমি চুপ থাকি তাই বলে এই না যে প্রতিবাদের ভাষা আমার জানা নেই। আমি অপবাদ মানবো না”

মফিজ উদ্দিন তাওহীদার মাথায় স্নেহের হাত রেখে ভরসা দিলেন। তাওহীদা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললো,“আপনারা আমার ঘর খুঁজে দেখুন।”

সবাই উপরে গেলো তাওহীদার ঘর খুঁজতে। আর তাওহীদা ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। রওশন আরা ঘামতে থাকে। চিন্তায় তার মাথা ঘুরছে। না জানি মেয়েটা কার হাত ধরে পালালো। গতকাল রাতে তাওহীদার বলা কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। মেয়েটা তাকে পূর্বেই সতর্ক করেছিলো।

তাওহীদা শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েকে বাঁচাতে তাকে ফাসিয়ে দিলো? সেও তো কারোর না কারোর মেয়ে?

জীবন হলো এক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা, যা তার আলোয় সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়ে পথ দেখায়। কিন্তু মৃত্যু? সে তো সেই শিখার নিভে গিয়ে ভষ্মে পরিণত হওয়ার অন্তিম সত্য, যা আমাদের দম্ভ আর অহংকারকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। কিন্তু এই জ্বলন্ত শিখার মাঝেই আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নেন—কখনও ধৈর্যের, কখনও ইমানের। যিনি এই আগুনের তাপে নিজেকে শুদ্ধ করতে পারেন, তিনিই আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেন।

#চলবে

রেফারেন্সঃ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৮৪)

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৭

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৭
#রাউফুন

গ্রামের এক কোণে ছোট্ট মাটির ঘর। ঘরের বারান্দায় বসে মমতাজ বেগম কোরআনের আয়াত উচ্চারণ করছেন। তার সামনে একদল শিশু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তাওহীদার মা মমতাজ বেগম কেবল একজন মা নন, তিনি এলাকার মানুষের জন্য একজন মমতাময়ী অভিভাবক। নিজের দুঃখ-কষ্টের জীবন ভুলে প্রতিদিন মানুষকে ভালো কিছু শেখানোর চেষ্টায় লেগে থাকেন। পর্দাশীল, সততা আর ঈমানদারি হলো তাঁর জীবন চালনার যে লড়াই তা সর্বোত্তম উদাহরণ।

মমতাজ বেগমের তৎকালীন সময়ে মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়। প্রথম সন্তান হয় তার বিয়ের তিন বছর পরেই। পর পর তিনটি কন্যা সন্তান হওয়ার পর শাশুড়ী, পাড়া প্রতিবেশি সবার থেকে নানান কটূক্তি শুনেছেন তিনি। তাওহীদার বাবা মারা যাওয়ার সময় মমতাজ ছিলেন মাত্র মাত্র বিশ বছর বয়সী। তিনটি কন্যা সন্তান আর গর্ভে অনাগত সন্তান নিয়ে দুনিয়ার বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার ছোটো ছেলে জন্মের পূর্ব থেকেই জীবন তাকে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

প্রতিদিন সকালবেলা বাচ্চাদের কোরআন শেখানো তার কাজের অংশ। যা সামান্য টাকা আয় হয়, তাতে কোনোরকমে দিন চলে। বাকি সময় নিজের জমিতে সবজি চাষ করেন। নিজের হাতে ফলানো লাউ, কুমড়ো, বেগুন বিক্রি করে সংসার চালান। তবুও গ্রামে মানুষ তাকে নিয়ে নানা ধরনের কটূক্তি করতে ছাড়ে না।

“স্বামী হারা মেয়ে, একটু মেপে চলা উচিত, তার আবার কি না বাজারে সবজি বিক্রি করেন, পুরুষ মানুষ তো পাগলা হইবোই।” কিছু কিছু মহিলারা এসব বলে হাসাহাসি করে। মূলত তারা অকারণেই মমতাজকে হিংসে করে।

বিকেলে মমতাজ বাজার থেকে ফেরার সময় রাত হয়। এমন সময় মমতাজ এর সামনে গ্রামের চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। মমতাজের সারা শরীর রাগে কাঁপতে থাকে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। তিনি শামসুজ্জামানকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে সাইড কেটে সামনে অগ্রসর হয়। শামসুজ্জামানের লেলিহান দৃষ্টিতে ঘৃণায় ভেতরটা রগরে উঠছে। উগ্র স্বরে চেয়ারম্যান বলে উঠলো,

“মমতাজ, তুমি আর কত দিন এইভাবে একা থাকবে? একটু ভেবে দেখো তো। তোমার বয়সই বা কত? জীবনে নতুন করে শুরু করতে দোষ কী? আমি কি দেখতে খারাপ? আমি কি তোমাকে সুখ দিতে পারবো না?”

মমতাজ কোনো জবাব দেন না। চোখ নামিয়ে কেবল নিজের পথে হাঁটেন। শামসুজ্জামান দুদুর এমন কথা শুনতে শুনতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, কিন্তু আজকের ঘটনা ভিন্ন। এমন কদাচিৎ, বিশ্রি বাক্য মন খারাপ টা তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এদিকে মেয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি তারপর এই লোকের অসহ্য রকমের কথা। শামসুজ্জামান দুদু প্রায়ই তাকে বাজে প্রস্তাব দিয়ে অস্বস্তিতে ফেলে। যা তিনি অনেক দিন থেকেই সহ্য করে আসছেন। আল্লাহ তার প্রতি সদয় না হলে হইতো তিনি এই গ্রামে টিকতে পারতেন না।

বিকেল তিনটাই বাজারে গিয়েছিলেন মমতাজ। বাজারের মাঝখানে হঠাৎ চেয়ারম্যান তার পথ রোধ করে দাঁড়াবে তিনি ভাবতে পারেন নি।

“তোমার মেয়েদের নিয়ে তো অনেক কষ্ট করলে, আমি ওদেরও দায়িত্ব নেবো। এবার তোমার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবো।” বলে হাত বাড়িয়ে তার পথ আবার আটকায়।

মমতাজ কঠোর কণ্ঠে বলেন, “চেয়ারম্যান সাহেব, আল্লাহ আমাকে সব দিক থেকেই সামলানোর শক্তি দিয়েছেন। দয়া করে আমার পথ ছাড়ুন। আমাকে আর কখনোই এই ধরনের কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেবেন না৷ আর যদি আপনি এমন কিছু করেন তবে আমি গ্রামের সবাইকে এসব জানাতে বাধ্য হবো। নিশ্চয়ই এটুকু জানেন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আমাকে সম্মান করেন, আর এটাও জানেন আমি আজগুবি কিছু তাদের বলবো না।”

মমতাজের জোরে বলা কথায় চারপাশে লোকজন জড়ো হতে থাকে। চেয়ারম্যান লোকজন থেকে কেটে পড়লেন। তার একটা ইমেজ আছে, তা তিনি খোয়াতে চান না।

সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে তিনি খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেলেন। জোহরা আর মানহা দুই মেয়ে এবং ছেলে স্বাধীনকে দেখে তার মন খারাপ কিছু টা দূর হলো। ওরা তিন ভাই বোন হাসাহাসি, খুনসুটি করতে ব্যস্ত। মাকে দেখেই তারা ছুটে এলো।

“মা কিছু এনেছো? খিদে পেয়েছে।”

“চুপ কর স্বাধীন, সব সময় খাই খাই করিস না। মা এখন ক্লান্ত। ” মেজো মেয়ে জোহরার কথায় মৃদু হাসলেন মমতাজ। মাঝখান থেকে সেজো মেয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি স্বরে বললো,“মা এই নাও পানি। এরপর হাত মুখ ধুয়ে এসো খাবে।”

মমতাজ বেগম ভ্রুকুটি করে চাইলেন জোহরার দিকে। বললেন,“রান্না কে করলো? রান্না তো করা ছিলো না!”

“আপু আর আমি করেছি মা। আমরা ঠিক করেছি আজ থেকে আমি আর আপুও তোমাকে কাজে সাহায্য করবো যেভাবে বড়ো আপু করতো।”

মমতাজের দুচোখ ভিজে উঠলো। তিনি ছেলে মেয়েদের আদর করে কাছে ডেকে গল্পের মতো করে বলেন, “মা, দুনিয়াটা কঠিন। মেয়ে হয়ে জন্মালে লড়াই করা শিখতে হয়। দেখো, আমি তোমাদের জন্য কত কিছু সহ্য করি। কিন্তু একদিন আমরা আমাদের লড়াইয়ের দাম পাব।”

জোহরা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বোঝে, তার মা কতটা কষ্টে সংসার চালান। গর্বে জোহরার বুকটা ফুলে উঠে। মমতাজ পর্দাশীল থাকার কারণে গ্রামের অনেক মেয়ের কাছে অনুপ্রেরণা। বাচ্চাদের কোরআন শেখানোর সময় তিনি প্রায়ই বলেন, “মেয়েরা পর্দায় থাকলে তাদের সম্মান বেড়ে যায়। আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, মেয়েদের শালীনতা তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।”

নিজের সংগ্রাম ভুলে তিনি গ্রামে শান্তি আর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যান। তবে দিনশেষে, চোরাগোপ্তা বাজে প্রস্তাব আর অপমানের কথা ভাবলে তার বুকের ভেতর পুড়ে যায়।

রাতের খাবারের পর মফিজ উদ্দিন চুপচাপ তাওহীদার জন্য খাবার নিয়ে উপরে উঠতে থাকেন। দরজার সামনে গিয়ে তিনি তাওহীদাকে ডাকলেন।

“তাওহীদা, একটু দরজাটা খুলবি মা। বাবা এসেছি!”

তাওহীদা এলোমেলো হয়ে শুয়ে ছিলো। শ্বশুরের ডাক কর্ণকুহরে পোঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই উঠে ভালো ভাবে মাথা ঢেকে বেরিয়ে এলো। দরজা খুলতেই মফিজ উদ্দিন তাওহীদার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার।

“মা, তোর জন্য আমি খাবার এনেছি।”

“বাবা, আপনি আবার কষ্ট করে এসব করতে গেলেন কেন? আমিই যেতাম।”

“আমি জানি তুমি যেতে কি না যেতে না। আমি তোর সঙ্গে যে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি রে মা। জানি, আহসানকে এমন অবস্থায় তোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমি তোর জীবন নষ্ট করেছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন কিনা জানি না।”

তাওহীদা মৃদু হেসে শ্বশুরকে ঘরে আসার জন্য জায়গা করে দিলো। ঘরের চেয়ারে বসতে দিয়ে কোমল স্বরে বলল,
“বাবা, আপনি কেন এমন কথা বলছেন? আপনি কি জানেন, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়? আমার জীবনে যা হয়েছে, তা আল্লাহর পরিকল্পনা। এখানে আপনার কোনো ভুল নেই। বরং আপনি তো আমার অভিভাবক। আপনার ছেলের সঙ্গে যদি না বিয়ে দিতেন তাহলে কি খুব ভালো থাকতাম? আমার পরিবারের অবস্থাও তো খুব একটা ভালো ছিল না। আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তাছাড়া নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম কিছুই আমার জন্য ভেবে রেখেছেন বলেই এই বাড়িতে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার দ্বারা যদি ভালো কিছু হয় তবে তা তো আমার জন্য অনেক পূন্যের কাজ হবে। হইতো এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যের হিদায়াতের জন্য সঠিক পথের সন্ধান আমার দ্বারাই আল্লাহ দিতে চান।”

তাওহীদা আহসানের দিকে তাকালো। মানুষ টা ঘুমাচ্ছে। মফিজ উদ্দিন হতভম্ব হয়ে তাওহীদার দিকে তাকালেন। এমন ভাবেও কেউ ভাবতে পারে? তার চোখে জল ভরতে শুরু করল। তিনি বললেন,
“তোর মতো মেয়ে আমার সংসারে এনে আমি হয়তো একটা বড় পুণ্য করেছি। তুই এই সংসারটাকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে পারবি, এই বিশ্বাসটা আমাকে বারবার সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু তাওহীদা, সবার এত অপমান, এত খোঁটা, তুই কীভাবে সহ্য করিস?”

তাওহীদা মাথা নিচু করে মৃদু হেসে বলল,
“বাবা, অপমান কেউ মরে সহ্য করে না। আমি তো বাঁচি ভালোবাসার জন্য। আমার স্বামী, তার সরলতা, তার হাসি – এগুলো আমার জীবনের শক্তি। আর আপনি তো আছেন আমার পাশে। তাই অপমান আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।”

মফিজ উদ্দিন তাওহীদার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
“তুই যদি এমন করে আমাকে সাহস না দিতিস, তাহলে আমি এতদিনে হয়তো নিজের ভুলেই মরে যেতাম। আল্লাহ তোর মঙ্গল করুক।”

তাওহীদা মিষ্টি হেসে বললো,“বাবা আমাকে খাইয়ে দেবেন না?”

মফিজ উদ্দিন এবারে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন৷ তাওহীদা হতচকিত হয়ে শ্বশুরকে দেখতে থাকে। বলে,“বাবা, আপনি এভাবে কাঁদলে আমরা কোথাও যাবো? আমার হারানো শক্তি, মনোবল কিভাবে ফিরে পাবো?”

মফিজ উদ্দিন কান্না থামিয়ে তাওহীদার মুখের সামনে খাবার ধরতেই আহসান ততক্ষণে উঠে বসে বলে,“আমাকে আগে খাইয়ে দাও তুমি!”

“উনি তোমার বাবা হয়! ” হেসে বললো তাওহীদা!

মফিজ উদ্দিন দুই ছেলে মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন। উনার চোখ বারংবার ভিজে উঠছিলো। তাওহীদা মুগ্ধ হয়ে নিজের শ্বশুরকে দেখে।

তাওহীদা এখন তেমন একটা ঘর থেকে বের হয় না। পর্দা সরানোর অপমানের পর নিজের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিবারের অশান্তি যেন থামার কোনো নাম নেই। রওশন আরা তাওহীদার প্রতি তার তিক্ততা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাকে নিয়ে নিত্য নতুন অপবাদ ছড়ায়, আর তাওহীদা চুপচাপ সহ্য করে।

এদিকে রিমি তার পরিকল্পনা শুরু করে। বাড়ির টাকা-পয়সা ও গহনা হাতানোর জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে চালাকি করে বড় ভাবি সালমা আর মেজো ভাবি পারভীনকে প্রলুব্ধ করে বলে,
“বড়ো ভাবি, মেজো ভাবি তোমরা শুনেছো তো? আজ গয়নার দোকানে বিশাল ছাড়! এত কম দামে এমন জিনিস আর পাবা না। তোমরা কি গয়না কিনবে?”

সালমা আর পারভীনের চোখ চকচকে ভাব ফুঁটে উঠলো।

সালমা খুশি মনে বলে, “চল মেজো, একসাথে গিয়ে কিছু কিনে আসি।”

সালমা আর পারভীন তো এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। রওশন আরাও তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রিমি কৌশলে তাকে বুঝিয়ে দেয়, “মা, তুমি থাকো। আমরা সামলে নিতে পারব। তুমি তো হাঁটাচলা করতে ক্লান্ত হয়ে যাও।”

সবাইকে পাঠিয়ে রিমি দ্রুত নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সে তার মাকে বলল,
“মা, একটা দুধ চা করে দাও তো। মাথাটা খুব ধরে আছে।”
রওশন আরা তেমন কিছু সন্দেহ করেনি। চায়ের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মা’কে খাইয়ে দিল রিমি। রওশন আরা কিছুক্ষণ পরেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেলেন।

এরপর রিমি বাড়ির আলমারি খুলে গয়না, টাকা-পয়সা সব ব্যাগে ভরতে শুরু করে। দ্রুততার সঙ্গে সব কিছু গুছিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৬

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৬
#রাউফুন

“তাওহীদা,এই তাওহীদা? আমি কি আমার সকালের লেবুর চা পাবো না? তুমি কি জানো না, আমি সকাল সকাল লেবু চা খাই?”

তাওহীদা রান্নার প্রসেস শুরু করছে, হাতে মাছ মাখানোর মশলা লেগে আছে৷ তাই সে একটু উচ্চ স্বরেই জবাব দিলো,“আপু একটু পরেই দিচ্ছি, বসুন আপনি!”

রিমি ড্রয়িংরুমে বসে কর্কশ কন্ঠে বললো,

“তুমি কি এমন করছো যে আমার চা দিতে দেরি হচ্ছে? নাকি আমার সুন্দর ফিটনেস দেখে হিংসে করো? সেজন্যই আমার সকালের চা দিতে চাও না? আমি যেনো তোমার মতো মুটিয়ে যাই এটাই চাও আমি বুঝি না মনে করেছো?”

তাওহীদা হতভম্ব হয়ে গেলো। অবাক হয়ে বলল,“কোন কথার জন্য কোন কি কথা বলছেন আপু? আমি আপনাকে হিংসে করবো কোন দুঃখে?”

“আমার মতো সুন্দরী কে যে সবাই হিংসে করে তা আমি জানি। যাই হোক দ্রুত চা দাও!”

পারভীন ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হলো। বললো,“তাওহীদা, আমার মাথা টা খুব ব্যথা করছে কড়া এক কাপ আদা চা দে!”

তাওহীদা রিমির লেবু চা দিতে দিতে লক্ষ্য করলো পারভীনকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। সদ্য গোসল করে আসায় নাকি সামী সোহাগে রূপ চকচক করছে তাওহীদা বুঝলো না। আহসান আর তার সুন্দর কোনো দিন এমন মূহুর্ত আসবে ভেবেই লজ্জায় নতজানু হয়ে গেলো তাওহীদা। ইশ, কি অবস্থা হয়েছে তার। কি সব ভাবছে। পারভীন ওকে লজ্জা পেতে দেখে বললো,“তুই আমাকে দেখে এমন লজ্জা পাচ্ছিস কেন? সমস্যা কি?”

“মেজো ভাবি আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!”

পারভীন এ কথা শুনে নিজেও খানিক লজ্জা পেলো। পরক্ষণেই চেহেরায় কাঠিন্যতা এনে বললো, “আমাকে এতো পাম দিতে হবে না। কাজ কর যাহ! তুই ভেবেছিস আমাকে একটু মিষ্টি কথা বলবি আর আমি গলে যাবো? আসলে এসব কিছুই না, আমার ভেজা চুল দেখে তোর হিংসা হচ্ছে। নিজে তো এমন সকাল কখনো পাস নি। খবরদার আমার সুখে নজর লাগাস তো।”

তাওহীদার হাসি হাসি মুখটা মুহুর্তেই পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,“আমি নজর লাগাবো কেন? আপনাকে সুন্দর লাগছে এটা বলেছি শুধু!”

“এতো বলতে হবে না যাহ, আমি জানি আমি সুন্দরী!”

এই কথা শুনে রিমি একবার পারভীনের দিকে তাকালো। ঠোঁট বাকিয়ে ওখান থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। যে করেই হোক নিজের পরিকল্পনা ও ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেবেই সে। পরিকল্পনা টা আরও জোড়ালো করতে হবে যেনো তার নিজের ঘাড়ে কোনো ভাবেই দোষ না পড়ে। ক্রুর হাসলো সে নিজের মাথায় সর্ব নিম্নমানের একটা বুদ্ধি আসায়।

তাওহীদার বুকের ভেতর টা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠলো। সবাই কেন তাকে এতো বেশি অবহেলা করে? গ্রামের মেয়েরা কি মানুষ না? গ্রামের মেয়ে বলে বুঝি এতো কূটক্তি শুনতে হয় তাকে? আড়ালে চোখ মুছে নিলো তাওহীদা! রান্নায় মনোযোগ দিলো সে সবকিছু ভুলে।

আনোয়ার সালমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,“আহসানের বউকে তো দেখালে না। তোমরা চাইলেই কিন্তু সুযোগ করে দিতে পারবে। অথচ সেটা একবারও করলে না।”

সালমা হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো। রেগে বললো,“লজ্জা করে না, নিজের বউ থাকতে অন্যের বউকে দেখার জন্য উতলা হচ্ছো? তোমার ঐ মেয়েকে দেখতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।”

“আরে রাগো করো না লক্ষীটি। আমি শুধু এই জন্য দেখতে চাচ্ছি যে আমার বউয়ের থেকে ঐ মেয়ে কি এমন স্মার্ট যে ওমন রূপের বহর করে?”

“ও হিংসা করার মতোই রূপবতী। আমি মেয়ে হয়েই ওকে আড়াল থেকে দেখি। মুখে ওর আলাদা একটা লাবন্যময়, আলাদা একটা গ্লো কাজ করে। যেনো নূর ভাসছে মুখে।”

আনোয়ারের যেনো এবারে আরও লোভ জাগলো তাওহীদাকে দেখার। সে অন্য ভঙ্গিমায় বললো,“আমার বউয়ের চাইতে কেউ সুন্দরী হতেই পারে না। আমি এটা বিশ্বাস করিই না বুঝলে?”

“ছাড়ো, এতো পাম দেবে না। আমি জানি কেন এসব বলছো!”

“তুমি আমাকে এই চিনলে? আচ্ছা আগে আহসানের বউকে দেখানোর সুযোগ করে দাও পরে আমি দেখবো আসলেই আমার বউয়ের চাইতে ঐ মেয়েটা সুন্দরী কিনা।”

“আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করবো। এখন সরো।”

সানোয়ার মিনমিন করে পারভীনের কাছে গেলো। বললো, ”মা আর রিমির জন্য যে দুটো চেইন এনেছিলাম ওঁদের দিলে ভালো হয় না?”

“এতো দরদ কেন? তোমার বিদেশ যাওয়ার সময় তোমাকে আমার বাপের বাড়ি থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলো। তোমার বাপের বিজনেস ত তখন ডুবতে বসেছিলো মনে নেই? তাই বিদেশ থেকে আনা কোনো কিছুই আমি তাদের দেবো না। চেইন দুটো আমি আমার মা বোনকে দেবো। আমি কথা দিয়েছি তাদের।”

“তাদের জন্য তো আমি আলাদা করে গিফট এনেছি, ওগুলোই দাও।”

“তোমার ঐ দুটো চিকন চিকন চেনের দাম কি পাঁচ লাখ টাকা হবে? সরো চোখের সামনে থেকে। তোমাকে দেখলেই গা জ্বলে যাচ্ছে আমার!”

আজ সালমা আর পারভীন একে অন্যের সঙ্গে যুক্তি করে একটা নিকৃষ্ট পরিকল্পনা করলো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কি যেন চক্রান্তের ইঙ্গিত করলো। তাওহীদা তখন টেবিলে সকালের খাবার রাখছিলো৷ আনোয়ার আর সানোয়ার দুজন রুম থেকে বের হচ্ছে বুঝতে পেরে তাওহীদা দ্রুত প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নিলো। তখনই সালমা আর পারভীন তারা দুজন মিলে তাওহীদার কাছে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বললো,

“ চেহেরা নিয়ে এতো বড়াই কেন তোর? আজ তোর মুখের কাপড় সরিয়েই দেবো। এতো কিসের রূপের অহংকার তোর যে আমার স্বামী দেখতে পারবে না?”

তাওহীদার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। হতচকিত হয়ে অন্য রাস্তা ধরলো। মুখের নিকাব দুই হাতে চেপে ধরলো। তারা জোর করে তাওহীদার মুখ থেকে কাপড় সরানোর চেষ্টা করলো। তাওহীদা এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে তার নিকাব। কিন্তু দুই জা’র চেষ্টায় সে যেন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। বিধ্বস্ত কন্ঠে বললো,“আমি আপনাদের ছোটো বোনের মতো ভাবি, আমার উপর নোংরা জুলুম চালাবেন না। আমাকে যেতে দিন এখান থেকে!”

“জুলুম করছি না তো, তোর পর্দা, আবেদগিরি ছুটাচ্ছি! খুব নাটক হয়েছে তোর, সব ভন্ডামি আমি ছুটাবো।”

“আমার আত্মসম্মানে আপনারা হাত দিলে আল্লাহ্‌ সইবে না। আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে ভাবি। দোহাই লাগে আমাকে ছাড়ুন।”

আনোয়ার আর সানোয়ার দুইজন উৎসুক জনতা হিসেবে সবটা উপভোগ করছে। তাদের বউদের নিয়ে মনে মনে একটু গর্ব করছে। ওদের দৌলতে আহসানের কুমারী বউটাকে একবার অন্তত দেখতে পারবে। তাদের চোখে যেনো লালসায় চকচক করছিলো। সালমা আর পারভীন পৈশাচিক আনন্দে কুটিল হাসছে শব্দ করে। তাওহীদা দু হাত জোর করে মিনতি করছে। দু চোখে তার পানি ঝড়ছে অনবরত এই ভয়ে যে আজ বুঝি তার পর্দা ছুটে যাবে। ছোটো বেলা থেকে মায়ের শিক্ষায় সে বড়ো হয়েছে। মা আয়েশা (রাঃ), মা ফাতেমা (রাঃ) আর রাবেয়া বসরীর আদর্শকে নিজের মনে লালন করেছে। আজ বুঝি তা ভঙ্গ হবে? সে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে। হঠাৎই এমন আক্রমনাত্মক কিছু ঘটবে তা বিন্দুমাত্র ঠাহরও করতে পারেনি তাওহীদা। যখন সবকিছুই হাতের বাহিরে চলে যাওয়ার উপক্রম ঠিক তখনই আহসান ছুটে এলো। তার বাচ্চাদের মতো সরল চেহারায় এক গভীর উত্তেজনা। সে সালমা আর পারভীনকে সরিয়ে দিয়ে তাওহীদার সামনে দাঁড়ালো। দুই হাত মেলে তাওহীদাকে আড়াল করলো। তার চোখে একরকম শিশুসুলভ জেদ আর সতর্কতা।

“বউকে কেউ হাত দিবি না! এটা আমার বউ!” আহসান চিৎকার করে বললো।

সবার কুৎসিত, বিকৃত, অত্যন্ত নোংরা আনন্দে যেনো ভাটা পড়লো, পরিবেশ যেনো থমকে গেলো। যে আহসান বছর তিনের মধ্যেও নিচে নামেনি সে কি না এতো বছর পর নিচে নেমেছে বউকে বাঁচাতে? এতক্ষণের ঝামেলা আর আহাজারিতে রিমিও বেরিয়ে এসেছিলো। আর রওশন আরা ছিলেন ওয়াশরুম। নিজের কার্য সম্পন্ন না করেই চেঁচামেচি শুনে জলদি বেরিয়ে এসেছেন ঘরের বাইরে। রিমি মুখ টিপে হেসে বললো,
“দেখেছো? এই পাগল মানুষটা এখন বউয়ের বডিগার্ড হয়ে গেছে!”

পারভীন বিরক্ত হয়ে বললো,
“তাওহীদা কী এমন মন্ত্র দিয়েছে এই পাগলকে, যে ওর জন্য এত বড় কাণ্ড করছে, সোজা আমাদের ধাক্কা দিলো? অথচ এতো বছরেও বাইরে আসেনি সে কি না বউকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে!”

সালমা খানিকটা সন্দিহান হয়ে বললো,“তুমি আসলেই পাগল তো আহসান?”

ঠিক সেই সময় মফিজ উদ্দিনও আক্রোশে হুংকার ছুড়লেন। পুরো দৃশ্য দেখে তার চেহারা রাগে ফুঁসে উঠেছে। তিনি গর্জে উঠলেন,
“এটা কী হচ্ছে? তাওহীদাকে জোর করে ওর পর্দা সরানোর সাহস হলো কার? বাড়িতে এতটা নোংরামি কখনো বরদাস্ত করবো না! আমি না থাকাই কি ভেবেছো তোমরা যা খুশি করবে? ছিঃ তোমাদের অধঃপতন দেখে আমার ঘেন্না হচ্ছে। দুদিন পর বাইরে থেকে ফিরে যে এমন জঘন্যরকম দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে কল্পনাও করিনি।”

সবাই চুপ হয়ে গেলো। মফিজ উদ্দিন তাওহীদার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন,
“তুমি যাও, তোমার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আর কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না।”

তাওহীদা মাথা নিচু করে দ্রুত সরে গেলো। আহসান পাগলামী ভঙ্গিতে হাত বেকিয়ে বললো,
“ওরা সন্ত্রাসী, আমার তাওহীদাকে, আমার বউকে, ওরা, ওরা মারছিলো।”

আহসানকে ধরে মফিজ উদ্দিন উপরে নিয়ে গেলেন। তাওহীদা দরজা আঁটকে হামলে কেঁদে উঠলো। এমন জঘন্যতম একটা দিন কেন আসলো তার জীবনে? বাইরে থেকে মফিজ উদ্দিন তাওহীদার কাঁন্না শুনে নিজেকে আরও অপরাধী ভাবতে লাগলেন৷ এই নিরীহ মেয়েটার জীবন তিনি কতটা নরকে পরিনত করেছেন। নিজেকে ধিক জানাতে লাগলেন। কতটা স্বার্থপর তিনি নিজের ছেলের জন্য ভালো একটা মেয়ের জীবন অন্ধকার করে তুলেছেন। তার জন্যই মেয়েটার জীবন এমন অন্ধকারে নিমজ্জিত।

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৫

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৫
#রাউফুন

তাওহীদা রিমির রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনলো কাকে যেনো বলছে,“পালানো কি মুখের কথা? তুমি বললেই কি এখন আমি পালাতে পারবো? আমি ভেবেছিলাম ভাইয়ারা আসবে, আমার জন্য দামী দামী উপহার আনবে, কিন্তু আমার দুই ভাইয়ের খাইষ্টা দুই বউ আমাকে কোনো কিছুতেই হাত লাগাতে দেয়নি। শুনো এমনি মেজাজা খারাপ আছে, এর মধ্যে তুমি পালায় পালায় করে মাথা খেয়ো না! ”

তাওহীদা না চাইতেও তার কর্ণকুহরে এই কথাগুলো এসে পৌঁছালো। ওর মাথায় শুধু এই কথাটাই বাজছে রিমি পালানোর কথা বলছে। এই বাড়ির মান সম্মান ডুববে যে এমন কিছু হলে। কারোর ঘরের সামনে আড়ি পাতাটা শোভনীয় নয়,কিন্তু সে তো ইচ্ছে করে কথা গুলো শুনে নি৷ আল্লাহ যেহেতু তাকে এই কথাটা শুনিয়েছেন নিশ্চয়ই সেটার ভালো দিক রয়েছে।

“তুই আবার পালানোর কথা বললে তোর সঙ্গে ব্রেক-আপ৷ তোর যদি এতোই শখ থাকে বিয়ে করার তবে তোর বাপ মাকে আমার বাড়িতে পাঠা, আমি আমার বাসায় ম্যানেজ করবো। না পারলে ধৈর্য্য ধর, আমি টাকা পয়সা আর গহনা যা পারি নিয়ে সুযোগ মতো কেটে পড়বো এখান থেকে!”

তাওহীদার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। সে কোনো রকমে হেঁটে গিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো সে৷ তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই সন্ধ্যায় কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিলো রিমি? এখন সে কি করবে? কাকে জানাবে? তার কথা কি বিশ্বাস করবে কেউ? শাশুড়ী মাকে জানাবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। কতক্ষণ সে ওরকম ভাবে বসে ছিলো তার ইয়ত্তা নেই। সে শুধু রিমির শোনা কথা গুলো ভুলতে পারছে না। যদি সত্যিই গহনা নিয়ে পালিয়ে যায় রিমি? কি করবে সে? এই বাড়ির মান সম্মান তো ধুলোয় মিশে যাবে। তার হুশ এলো শাশুড়ী রওশন আরার ডাকে।

“কি রে বউ? কি হইছে? ওমন তব্দা খেয়ে বসে আছো কেন? রাতের রান্দন কি রাত বারোটাই বসাইবা?”

“হাহ হাহ?” হুরমুর করে জবাব দিলো তাওহীদা। রওশন আরা খানিকটা চমকালো। বললো,

“তোমারে কি সন্ধ্যে বেলায় জ্বীনে ধরছে নাকি? কি বলি আর কি জবাব দেও? হাহ হা না করে রান্না চাপাও!”

তাওহীদা উঠে দাঁড়ালো। দোনামোনা করতে লাগলো রিমির ঘটনা টা শাশুড়ী কে বলবে কি না। তারপর কি যেনো ভেবে বিষয়টা চেপে গেলো সে।

তাওহীদা পর্দা বজায় রেখে কাজ চালিয়ে যায়। রাতে খাওয়ার সময়ও সে সামনে যায় না। বড় জা আর মেজো জা এখন বড়ো কাজ দেখাচ্ছে স্বামীর সামনে। যেখানে সব আয়োজন করেছে তাওহীদা, অথচ স্বামীর পছন্দ সই রান্না করার জন্য নিজেরা রান্নাঘরে ঢোকেনি একবারও। রাতেও খাবার ঠান্ডা বা কম মশলাদার বলে দুই ভাসুরের স্ত্রীরা অভিযোগ করলো।

সানোয়ার তিক্ত স্বরে বললো,
“মা, তোমার বউমা কি আমাদের সহ্য করতে পারছে না? এইভাবে নুনে পোড়া ডাল তারকারি কি খাওয়া যায়? এমন টা করলে কিন্তু আমরা আর থাকবো না এখানে!”

রওশন আরা হতচকিত হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। ভাতের হাত ঝেড়ে বললেন,“বিদেশ থেকে আসতে না আসতেই এসব কি কথা বাবা?”

“তো কি বলবো মা? তোমার বউমা ইচ্ছে করেই নুন ঝাল বেশি দিয়ে রান্না করেছে। বিদেশে তো আর আমরা এমন নুনে পোড়া খাবার খেতাম না।”

পারভীন সঙ্গে সঙ্গেই বললো,
“এটাই তো সে চায়। আমরা এখানে না থাকলে ওর অনেক স্বস্তি, বাবার সম্পত্তির সব ভাগ পাবে ওর স্বামী। এই জন্যই এভাবে আমাদের তাড়ানোর বন্দোবস্ত করছে। রান্নার নামে কী খাবার দিয়েছে, দেখো তো!”

আনোয়ার তেমন কিছু না বললেও সালমা বললো,“দুপুরে যে ওকে খেতে দেওয়া হয়নি সেটারই প্রতিশোধ নিলো বুঝলে মা?”

রিমি চুপচাপ খাচ্ছে। তার মনে অন্য রকম পরিকল্পনা। এদিকে চিন্তিত তাওহীদা বার বার রিমির দিকে তাকাচ্ছিলো। মনে প্রার্থনা করলো আল্লাহর কাছে, যেনো সবকিছু ঠিক থাকে। রিমি বললো,“তাওহীদা, আমাকে মাংস দাও তো! মাংস ভালো হয়েছে!”

“এই রান্না তোর কাছে ভালো লাগছে?” প্রশ্ন করলো আনোয়ার।

“হ্যাঁ লাগবে না কেন? তোমরা বিদেশ ছিলে আমি তো ছিলাম না। তোমরা বাবা মা ভাই বোনদের ভুলতেই পারো, এই ক’বছর বিদেশে থেকে বিদেশি কালচার নিজেদের মধ্যে ইনক্লুড করতেই পারো আমরা আবার বাপু ওমন না যে সব ভুলে বসবো।”

বোনের খোচা মেরে বলা কথা কারোর ই বুঝতে অসুবিধা হলো না। রিমি মাংস নিয়ে খাবার প্লেট হাতে নিজের রুমের দিকে গটগট করে হেঁটে চলে গেলো।
রওশন আরা খানিকটা বিরক্ত গলায় বললেন,”পরের বার যেনো আমাদের ছেলেদের পছন্দ সই রান্না করা হয়। তা না হলে দেখবি কি করি!”

তাওহীদা কিছু বললো না। সে জানে, এখন কিছু বললে কথা আরও বাড়বে। সবার খাওয়া শেষ হলে নিজেদের রুমে চলে গেলো। সেই সুযোগে তাওহীদা শাশুড়ীকে একা পেলো। সাহস সঞ্চার করে বললো,“ মা, রিমি আপু, টাকা পয়সা, গহনা নিয়ে কার সঙ্গে যেনো পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলো। বড়ো কোনো অঘটন ঘটার আগে আপুকে আপনি আপুর উপর নজর রাখতে থাকুন। আপনি আজ থেকে আপুর সঙ্গে ঘুমান মা! আপুর উপর নজর রাখুন!”

রওশন আরা ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। তাওহীদার গালে সপাটে চড় মেরে বললেন,
“তোর সাহস কতো বড়, তাওহীদা! আমার বাড়ির মেয়েকে তুই নিয়ে এমন নিচু মানের কথা বলিস! আজ বলেছিস, মেনে নিলাম আর যদি কখনোই এসব বলিস জবান কে’টে, মা’টিতে পুতে ফেলবো।”

তাওহীদা গালে হাত দিয়ে বললো,“আমি যে মিথ্যা কথা বলি না আপনি নিশ্চয়ই এতোদিনে তা জেনে গেছেন? আপুর খেয়াল রাখবেন মা। আমি যাচ্ছি!”

তাওহীদা রান্না ঘরে গিয়ে সব এঁটো থালাগুলো ধুয়ে মুছে রাখলো। এরপর আহসান এবং নিজের জন্য প্লেটে খাবার নিয়ে উপরে গেলো। সারাদিন থেকে পেটে দানাটিও পড়েনি। এদিকে আহসানও ঘরের অবস্থা একদম বাজে করে রেখেছে। কাগজ, কাপড় চোপড় সব এলোমেলো করে বিদিকিচ্ছির অবস্থা।

ঘরের কোথাও আহসানকে দেখতে পেলো না তাওহীদা। ভ্রুকুটি করে সারা ঘর খুঁজলো আহসানকে। বার দুই ডাকলো,“আহসান, আহসান। কোথায় তুমি?”

কোথা থেকে যেনো লাফ দিয়ে এসে তাওহীদার সামনে এসে পড়লো আহসান। স্বশ্বব্দে “হাউউউ!” বলে ভয় দেখালো তাওহীদাকে।

তাওহীদা ভয়ে কিছুটা ছিটকে সরে গেলো। ভাগ্যিস ভাতের থালাটা দুই হাতে ধরে রেখেছিলো সে। ভয়ে বুকে থুথু ছেটালো তাওহীদা।

“তুমি কি হ্যাঁ? এদিকে তোমাকে ঘরে না দেখে আমার কলিজা শুকিয়ে গেছিলো। কোথায় গেছিলে?”

আহসান আলনার দিকে আঙুলের ইশারা করে দেখালো,”ওখানে বউ!”

“ওখানে কি করছিলে?”

“ওখানে ইয়্যায়ায়া বিশাল একটা ইদুর। অনেক ইদুর। এই দেখো তোমার কাপড় কেঁ’টে’ছে, কেঁ’টে’ছে।”

তাওহীদা দেখলো তার একটা শাড়ী কে’টে কুচিকুচি করেছে। এই এখানে এমন ইদুরের উপদ্রব হলো কিভাবে? এসব ভাবনা রেখে সে আহসানকে খাটে বসালো। শান্ত স্বরে বললো,

“আচ্ছা ওটা রাখো৷ সারাদিন পেটে তো কিছু পড়েনি। আসো খাবে।”

আহসান খানিক চুপ থেকে বললো,“তুমি আগে আসো, তোমার চুলে আদর করে দিই!”

তাওহীদা অবাক হয়ে চমকে তাকালো আহসানের দিকে৷ আহসান শিশুসুলভ চোখে তাকিয়ে রইলো। সময় নিয়ে বললো,“আমি দেখেছি, বুড়িটা তোমাকে মে’রেছে!”

তাওহীদা খাটের মধ্যখানে বসলো। আহসান লক্ষী ছেলের মতো বসে রইলো। তাওহীদা ধীরে সুস্থে বললো,“তুমি যা দেখেছো, তা ভুল দেখেছো। আর যাকে তুমি বুড়ি বলছো উনি তোমার মা। মাকে কেউ বুড়ি বলে?”

“বুড়িটা তোমাকে মা”রছিলো! খুব খারাপ, খারাপ।”

তাওহীদা চোখ রাঙালো। আহসানকে খানিকটা শাসনের ভঙ্গিমায় বললো,“বলেছি না মাকে বুড়ি বলতে নেই?”

আহসান খাবার খেতে খেতে বললো,“পঁচা মা। মা পঁচা।”

“আবার আহসান? মায়েরা ভালো। মায়েরা কখনোই পঁচা হয় না!”

আহসান খাচ্ছিলো। হঠাৎই ও নিজে হাতে ভাত মেখে তাওহীদার মুখের সামনে ধরলো৷ তাওহীদা অবাক চোখে তাকালে বললো,“তুমি না রোজ আমার সঙ্গে খাও, আজ খাও না কেন? কেন?”

তাওহীদার দু চোখ ভিজে উঠলো এই সামান্য যত্ন পেয়ে। অসুস্থতা অবস্থাতেও মানুষটার কি সুন্দর সবকিছু খেয়াল থাকে, এমন একজন মানুষের কেন এমন দূর অবস্থা? তাওহীদার দুই গাল বেয়ে শীতল পানি গড়িয়ে পড়লে অসুস্থ আহসান স্বযত্নে তার দু চোখ মুছে দিলো। কে বলবে মানুষ টা অসুস্থ? এই তো কেমন সুস্থ, আর প্রানোচ্ছল লাগছে! তাওহীদা কি কখনোই সুস্থ অবস্থায় স্বামী সোহাগ পাবে? স্বামীকে একটা সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিতে কি সে সক্ষম হবে? সবকিছুই যে আল্লাহর হাতে। সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা যে কেউ ধরতে পারবে না কস্মিনকালেও। কারোর সেই ক্ষমতা নেই। তাই সে সবকিছুই আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলো।

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৪

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৪
#রাউফুন

তাওহীদা তিনটে বাজে ঘুম থেকে উঠে বসলো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য। নামাজে বসে তাওহীদা কেঁদে আল্লাহর কাছে স্বামীর অসুস্থতার জন্য পানাহ চাইলো। বাড়ির প্রতিটি সদস্যদের জন্য মঙ্গল কামনা করলো। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে সাহায্য চাইলো। তাহাজ্জুদ নামাজে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাকে ফেরান না। নামাজ শেষে কোর-আন পড়লো, তারপর ফজরের আজান দেওয়ার পর ফজর শেষে রুম থেকে বেরোনোর আগে দেখলো আহসান ঘুমাচ্ছে। ওর দিকে এগিয়ে কপালে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিলো। মানুষ টা স্বেচ্ছায় তাকে কাছেই টানে নি কখনো। হইতো সেই বোধহয় টাই নেই তার। তবে মাঝে মধ্যে ঘুমের ঘোরে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। তাওহীদা আহসানকে নিষ্পলক চোখে দেখে নিলো। স্বামীর দিকে নেক নজরে তাকানোও সওয়াব। তাওহীদা সব সময় স্বামীর দিকে নেক নজরে তাকিয়ে থাকে। ইশ কি মায়া মানুষটার মুখ জুড়ে।

সকাল থেকেই ব্যস্ত হাতে কাজ করে যাচ্ছে তাওহীদা। পানি পান করার জো যেনো নেই তার। বাড়িতে বড় আয়োজন। দুই ভাসুর বিদেশ থেকে গভীর রাতেই ফিরেছে। শাশুড়ী রওশন আরার নির্দেশে ঘরদোর ঝাড়ামোছা থেকে শুরু করে রান্নার বিশাল আয়োজন সবই তাওহীদার ওপর চাপানো হয়েছে। বড় জা সালমা আর মেজো জা পারভীন এখনো ওঠেনি । ওদের স্বামী বিদেশ থেকে এতোদিন পর এসেছে, এখন বের হবেও না তাওহীদার জানা কথা। রান্নাঘরের ভাপ উঠতে থাকা গরমে তাওহীদার শরীর ভেঙে পড়ার উপক্রম হলেও সে কিছুই বলতে পারছে না। কাউকে বলার নেই। এমন সময় তাওহীদার শাশুড়ী হাক ছেড়ে বললেন,

“চা দিয়ে যেও তো৷ এখন কি এই বাড়িতে কিছু না চাইলে পাবো না? নাকি আমাকে চা করে খেতে হবে।”

তাওহীদা নরম গলায় বললো,“আসছি মা।”

তাওহীদা চা করে শাশুড়ীর ঘরে নিয়ে দিয়ে এলো। পানের বাটা থেকে পান বের করে পান সাজছিলো রওশন আরা। তাওহীদাকে দেখতে মুখ ঝামটা দিয়ে অন্য দিকে ফিরলেন।

“তোমার মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। চা দিয়ে বিদেয় হও দেখি!”

তাওহীদার দুই চোখ ভরে উঠলো। বললো,“মা, আপনি আমার সঙ্গে সব সময় এমন করেন কেন? আপনার অন্য ছেলেদের বউদের সঙ্গে তো এমন করেন না। ওদের মতো আমিও তো আপনার একটা ছেলের বউ।”

“ওদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করো না। ওরা শিক্ষিত আর তুমি অশিক্ষিত গাইয়া মেয়ে। উহ আসছে নিজেকে বড়ো দেখাতে। যাও তো যাও, ম্যালা ফ্যাচ ফ্যাচ করো না।”

তাওহীদা আর কথা বাড়ালো না। বেরিয়ে এলো চায়ের কাপটা রেখে।

বাড়িটা যেনো উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। রওশন আরা কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েকবার বড়ো ছেলে আর মেজো ছেলের ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। ছেলেরা এসে একটাবার তার সঙ্গে দেখা করলো না? দশটা বেজে যাচ্ছে কেউ-ই ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এদিকে ছেলেরা বিদেশ থেকে তার জন্য কি এনেছে তা জানার জন্য মনটা আনচান করছে। কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। নিশ্চয়ই তার জন্য সোনার চেইন আর বালা নিয়ে এসেছে। বড়ো ছেলে আর মেজো ছেলে তার বড্ড ভালোবাসে। অবশ্যই সবচেয়ে দামী গিফট তার জন্যই বরাদ্দ। এমন সময় মেয়ে রিমির গলা পেলেন রওশন আরা।

রিমি ছুটে আসলো মায়ের দিকে৷ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,“ভাইয়া আমার জন্য কি এনেছে আম্মা?”

“হুরু তোর আর লকলকানি গেলো না। আসার পরে পোলাগোর মুখ দর্শন হলো না আর ও কিনা গিফট নিয়ে পড়েছে। শুন, আগেই এতো কি নিয়ে এসেছে এসব নিয়ে পড়িস না৷ গভীর রাতে আইছে তাই আমি জাগতে পারি নাই। জানিস ই তো আগের মতো শরীর নাই।”

“হইছে মা, তোমার সব রোগ ধরছে তোমার পাগল ছেলের বউ আসার পরে। আগে তো দেখতাম কি খাটুনি খাটতে। ফায়ফরমায়েশ খাটতে খাটতেই বেলা ফুরাইতো।”

“তুই কি কম খাটাইছস? এখন আর মুখ ছুটাইস না। আমার মেজাজ ভালো আছে, খারাপ করতে চাই না। যাহ ঘরে যা।”

তাওহীদা রান্নাঘরের কাজ শেষ করে টেবিলে সব খাবার সাজাচ্ছিলো। রিমি তাকে দেখে বললো,“তাওহীদা, আমাকে লেবুর চা দাও তো।”

“তোর এই আচরণ হলে তোরে বিয়ে দেবো কেমনে? ছোটো ভাবি না বলে নাম ধরিস কোন আক্কেলে?”

“থাক মা, আমি তো আপুর বয়সে ছোটোই। এই বাড়িতে কেই বা কবে আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলেছে? রিমি আপু আপনি ফ্রেশ হোন আমি শরবত নিয়ে যাচ্ছি।”

তাওহীদার কথায় মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো রিমি নিজের রুমে। কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই রুম কেন ময়লা হয়ে আছে তা নিয়ে চেচামেচি শুরু করলো রিমি। তাওহীদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায় বললো,“আপু আমি ভেবেছিলাম আপনি আরও দেরি করে আসবেন, তাই হাতের কাজ গুলো করেই পরিষ্কার করবো আপনার রুম।”

“থাক, তোমার এতো অজুহাত শুনতে চাচ্ছি না আমি। যাও চোখের সামনে থেকে।”

“এই রিমি তুই আবার এমন চেচাচ্ছিস? স্বভাব ভালো কর, না হলে তোর যা মেজাজ পুরো পাড়ায় মুখ দেখানো দায়৷ তোকে কে বিয়ে করবে এমন হলে? দিন দিন বুড়ী হচ্ছিস, সেই খেয়াল আছে? কবে বুঝবি তুই?”

তাওহীদা আগে রিমির রুম পরিষ্কার করে দিলো। তারপর গিয়ে আবার টেবিল সাজিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। শাশুড়ীর তার হয়ে হঠাৎ এতো কথা বলছে কেন? এখন সে বুঝলো। নিজের মেয়ের এমন মেজাজ তুঙ্গে উঠে থাকলে বিয়ে দিতে পারবেন না, তাই স্বভাবতই মায়েরা নিজের মেয়ের ভালোর জন্যই এই সাধারণ শাসন টা করেই থাকে। তাওহীদা কেমন যেনো নিষ্প্রাণ হাসি হাসলো। খিদেতে পেটের মধ্যে কেমন গুড়গুড় করছে। সে পেটে এক গ্লাস পানি ছাড়া কিছুই পড়েনি। আহসানকেও খাওয়ানো হয়নি। সে ফ্রেশ হয়ে ছুটলো, এক প্লেট খাবার আনতে। আহসান ছাদেই কোথাও আছে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলো সে।

খাবার আনতে গিয়ে দেখলো তার অপরিচিত পুরুষ কন্ঠ। বুঝলো এটা নিশ্চয়ই তার ভাসুরদের একজনের গলায় হবে। রওশন আরা ছেলের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর বড় ভাসুর তার মাকে বললো,
“মা, তোমার ছোট বউমা কোথায়? তাকে দেখতে পাচ্ছি না যে।”

মেজো ভাসুরও যোগ করলো,
“হ্যাঁ, মা। আমাদের ছোট বউকে তো আমরা দেখিই নি। ওকে ডেকে আনো।”

পারভীন বললো,

“পেট ভরে খাও তো তোমরা। ওকে এতো দেখতে হবে না।”

সালমা প্লেটে মাছ নিতে নিতে লক্ষ্য করলো তাওহীদা দাঁড়িয়ে আছে মুখ ঢেকে। ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে কটাক্ষ করে বললো,“ওকে দেখলে তোমাদের বমি পাবে। তাই আগে ভাগেই খেয়ে নাও! পরে আবার খাওয়ার রুচি চলে যাবে।”

“ওমা, তুমি না মাঝে মধ্যে বলো ছোটো বউ সুন্দর, হিংসেও হয় তোমার!”

কটমট করে তাকালো সালমা স্বামী আনোয়ারের দিকে। আনোয়ার শুকনো ঢোক গিলে খাবার মুখে দিলো। সানোয়ার বললো,“মা তুমি ডাকো তো দেখি আমাদের আহসানের বউকে।”

রওশন আরা তাওহীদাকে ডাক পাঠালেন। তাওহীদা মাথা, মুখ ঢেকে তাদের সামনে গেলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। বড় ভাসুর আনোয়ার একটু বিরক্ত গলায় বললো,
“এটা কী? মুখ ঢেকে থাকলে আমরা তোমাকে দেখবো কীভাবে? আমাদের সামনে তোমার লজ্জা কিসের?”

মেজো ভাসুর সানোয়ার হাসতে হাসতে বললো,
“আমাদের আহসানের বউ তো পুরো মোল্লানির মতো হয়ে আছে!”

তাওহীদা কোনো কথা বললো না। তার মুখের পর্দা সরানোর কোনো চেষ্টাও করলো না। রওশন আরা বিরক্ত হয়ে বললেন,
“এমন পাগলামী করার কী আছে! তোমার ভাসুরেরা কি অন্য কেউ? মুখ দেখালে কী এমন ক্ষতি হবে?”

তাওহীদা ধীর কিন্তু দৃঢ় গলায় বললো,
“বড়রা বরং আমাকে মাফ করবেন। আমি পর্দা করি, পর্দার নিয়ম আমি ভাঙতে পারবো না। আপনারা আমার জন্য নন-মাহরাম। তাই প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলাও নিষিদ্ধ।”

তাওহীদার এই আচরণে সবাই যেন একটু অবাক হয়ে গেলো। পারভীনের কন্ঠে ব্যাঙ্গাত্মক শোনালো,
“বাহ! আমাদের স্বামীকে কি দুশ্চরিত্রের মনে হয় তোর? যেই না আমার রূপ তার আবার কতো বাহার। আসলে ওর কদাচিৎ মুখ খানা না দেখানোর অজুহাত আর কি! এমন ভাব ধরেছে যেন কী এক মহারানী এসেছে !”

সালমা যোগ করলো,
“এই মেয়ে আসার পর থেকে বাড়িতে কী কী কাণ্ড চলছে দেখো! আমাদেরও অপমানিত হতে হয়েছে এখন তোমাদের অপমানিত হতে হচ্ছে এখন। মা, আপনার ছোটো বউমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন এমন দেমাগ আর রূপের বড়াই যেনো না করে।”

রওশন আরা মনে মনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাওহীদার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। ছেলেরা এখন বিদেশ থেকে এসেছে। সোনার ডিম পাড়া হাস, ওদের খাতির ভালো ভাবে না করলে পাছে যদি তাকে আর কিছুই না দেয়? এখন এদের একটু কদর করতেই হবে। রওশন আরা সুবিধাবাদী মহিলা তাই নিজের সুবিধার জন্যই চড়াও হলেন ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে। রওশন আরা তেড়ে গেলেন তাওহীদার দিকে। দু কদম পিছিয়ে গেলো তাওহীদা, কিন্তু বাঁচতে সক্ষম হলো না শাশুড়ীর তোপ থেকে। উড়নার উপর দিয়েই তাওহীদার চুলের গোছা ধরে গর্জে উঠলেন,
“ওরা তোর ভাসুর। তাদের সঙ্গে এমন আচরণ কেউ করে? রান্নাঘরে কাজ ছাড়া তোকে কিছু শিখায়নি তোর বাপ-মা! নাটক দেখাস মা***!”

তাওহীদা ব্যথিত কন্ঠে বললো,
“মা, আমার লাগছে। চুলে আঘাত করবেন না। আপনার পাপ লাগবে।”

“তুই এখন আমাকে পাপ পূন্য শিখাবি? বের হো, এখান থেকে। আজ তোর খাওয়া বন্ধ।”

তাওহীদা ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। যতো অপমানই তাকে সহ্য করতে হোক না কেন, তাকে তো খাবার নিয়ে যেতেই হবে আহসানের জন্য। সে সব কিছু সহ্য করবে কিন্তু আহসানকে অভুক্ত রাখবে না। তার যত্নের ত্রুটি সে করবে না। জীবন থাকতে না। পাগল হোক কিন্তু মানুষ টাই তার শেষ সম্বল। তাওহীদা ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত ভেঙে পড়ছে, কিন্তু বাইরে থেকে তার নীরবতাই টিকে রইলো। সে জানে, এই অপমান আর অবজ্ঞার স্রোতে ডুবে না গিয়ে তাকে টিকে থাকতে হবে। একদিন তার এই নীরবতাই শক্তির ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।

রিমি কিছুক্ষন পর ছুটে বেরিয়ে এলো। হাতে সুন্দর একটা গলার সেট ধরে এনে বড়ো ভাইকে দেখিয়ে বললো, “বড়ো ভাইয়া এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে এটা আমি নিচ্ছি!”

সালমা তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো রিমির দিকে। চেয়ার ছেড়ে উঠে রিমির হাত থেকে নেকলেস টা কেড়ে নিয়ে বললেন,“তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি আমি, তোমার সাহস হলো কি করে আমার নেকলেসে হাত দাও? এটা আমাকে তোমার ভাইয়া দিয়েছে!”

আনোয়ার শুকনো কন্ঠে বললো,”আহা নিক না, ও আমাদের একটা মাত্র বোন। পছন্দ হয়েছে নিয়ে নিক তোমাকে না হয় কিনে দেবো আর একটা। ”

সালমা বললো,“আমার পেট ভরে গেছে, রুমে যাচ্ছি তুমিও আসো!”

রওশন আরা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। রিমি আক্রোশে ফোসফাস করছে। মেজো ভাইকে রিমি বললো,“ভাইয়া তুমি আমার জন্য কি এনেছো? নাকি তুমিও শুধু তোমার বউয়ের জন্যই সব এনেছো?”

সানোয়ার কিছু বলবে তার আগেই পারভীন বললো, “আমারও পেট ভরে গেছে। তোমার খাওয়া হলে রুমে আসো।”

চেয়ার ছেড়ে উঠেই হনহনিয়ে চলে গেলো পারভীন। তাওহীদা ওখানেই নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে রইলো স্বামীর জন্য চারটে ভাত নেবে বলে।

#চলবে