Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 30



প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৩

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৩
#রাউফুন

তাওহীদা আজকে রাতেও ঘুমাতে পারলো না। তার শরীরের আঘাত এখনো শুকাইনি। বড় জায়ের দেওয়া গরম খুন্তির ছ্যাকা আর কথার কষ্ট দুইটাই যেন তার হৃদয়ে একেকটা বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধে আছে। আহসান বাচ্চাদের মতো পাশেই ঘুমিয়ে আছে। তার সরল চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজের দুর্বল মনকে আবার শক্ত করার চেষ্টা করলো তাওহীদা। আহসান ঘুমের ঘোরে তাওহীদাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। তাওহীদার কেমন দম বন্ধ লাগছে। এক বছরের স্বামীর সত্যিকারের ভালোবাসা কি তা সে অনুভব করেনি। আহসান শুধু ঘুমের মধ্যে তাকে জাপ্টে ধরে ঘুমাই। এতেই যেনো তাওহীদার সারাদিনের সকল ক্লান্তি, গ্লানি মোচন হয়ে যায়। আহসানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাওহীদা। তার বয়স সবে আঠারো পড়েছে। সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তার। অথচ এই বয়সেই তাকে কতো কিছুই না সইতে হচ্ছে।

পরদিন সকাল থেকেই বাড়িতে অন্যরকম ব্যস্ততা। দুই ভাসুর বিদেশ থেকে আসবে। গোটা বাড়ি যেন উৎসবের আমেজে ভরে উঠেছে। রওশন আরা তাকে সকাল থেকেই নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। নির্দেশনা দিতে দিতে তাওহীদার কাজে নানান ভুল ধরতে থাকে আর এটা সেটা বলে খোচাতে থাকেন। তাওহীদা কানে তুলো গুজে রাখার মতো সারাদিন কাজ করতে থাকে। বিকেলে তার শাশুড়ী তাকে ডেকে বলেন,

“তাওহীদা, বাজারে যাও। মুরগি, মাছ, সবজি সব কিনে আনতে হবে। আমার বড়ো ছেলে আর মেজো ছেলে আসবে আজ। সব যেন একদম পারফেক্ট হয়। আর ভুল করলে এবার কিন্তু খবর আছে।”

“ মা, কি কি আনবো তার একটা ফর্দ দিয়ে দিন। আমি যাচ্ছি।”

“আমার ছেলেরা যা যা পছন্দ করে সবকিছুই এখানে লেখা আছে৷ আর এই নাও টাকা, বাজার করার জন্য রাখো। আবার লোভে পড়ে টাকা হাতিয়ে নিও না যেন!”

“তাওহীদা আর যাই হোক চোর নয় মা। এটুকু নিশ্চয়ই আপনি নিজেও বিশ্বাস করেন। অথচ আমায় কথাঘাতে কষ্ট দেওয়ার জন্য কি সুন্দর তৎপর থাকেন।”

কথাটা বলেই তাওহীদা সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। রওশন আরা সামান্য এই কথাতেই যেনো জ্বলে উঠলেন। কর্কশ গলায় বললেন,

“ছোটো বউ! মুখে লাগাম টানো। যত বড় মুখ বা তত বড়ো কথা? আমি শুধু তোমাকে কথায় শোনায়?”

“এই প্রশ্নের উত্তর টা আপনার কাছে আছে মা। যাই হোক, আমি রেডি হয়ে যাচ্ছি বাজারে।”

রওশন আরা হতভম্ব হয়ে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটা কি তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে নাকি? এভাবে চললে তো তার হাত থেকে সবকিছু বেরিয়ে যাবে। না না সবকিছু নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতে যা কিছু করার তাকে করতেই হবে। সংসারের চাবি কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না। নিজের দাপট দাপিয়ে রাখলে তাঁর নিজের মূল্যায়ন কমে যাবে। এটা তো কোনো ভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।

তাওহীদা জানে, এসবের দায়দায়িত্ব তার ওপরই পড়বে। আগে দুজন কাজের লোক ছিলো সে বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পর তাদের ছাড়িয়ে দিয়েছে। দুই জায়ের একজনও যে এখন কেউ ঘর থেকে বের হবে না সে সম্পর্কে তাওহীদা অবগত। তারা আজ নিজেদের সাজগোজ আর আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। তাওহীদা আর বলার সাহসও পেলো না তাদের কিছু বলার। সকালেই ব্যবসার কাজে তার শ্বশুর মফিজ উদ্দিন চট্টগ্রাম গেছেন। ফলে এই পরিস্থিতিতে তাকেই বাজারে যেতে হবে। তার ভাসুরেরা বাসায় আসতে আসতে রাত হবে। বাজার থেকে আসতে আসতে তার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। যাওয়ার আগে থেকে তার ভেতর টা কেমন যেনো ভয়ে তটস্থ হয়ে রইলো।

ফর্দ অনুযায়ী সবকিছুই কিনে নিলো তাওহীদা। সবকিছু আবারও একবার পর্যবেক্ষণ করে মিলিয়ে নিলো। আবার কোনো জিনিস যদি নিতে ভুল হয় তবে তা নিয়েও অনেক কথা হবে। তাই সে বার বার সবকিছু মিলিয়ে নিলো। বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে সরু গলি দিয়ে আসার সময় তাওহীদার মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে।

ক্ষনকাল যেতেই কিছু বাজে ছেলের কটূক্তি শুনে তাওহীদা দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো । কিন্তু হঠাৎ করেই একটা ছেলে লাফ দিয়ে তার সামনে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। তাওহীদা ভয়ে ছিটকে গেলো। পেছনে পিছিয়ে যেতে নিলেই মনে হলো পেছনেও কেউ আছে। সে দোয়া পড়তে শুরু করলো। বিপদের সময় ঘাবড়ে গেলে চলবে না৷ আল্লাহকে মনে প্রাণে ডাকলে অবশ্যই আল্লাহ তাকে সাহায্য করবে। সে দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলো। তখনই একটা বিদঘুটে গন্ধ ওর নাকে লাগলো৷ ছেলে দুটোর মধ্যে একজন বললো,

“কি সুন্দরী! এত কাজকর্ম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছো, না? একটু আমাদের সঙ্গে চলো! আমরা আদর যত্ন করবো। আহারে ব্যাগ গুলো ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে আমাদের কাছে দাও আমরা নিয়ে যাচ্ছি। ”

তাওহীদার চোখ ব্যতীত কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ অথচ লোক গুলো তাকে কি বাজে ভাবে উত্যক্ত করছে। এই রাস্তাটা এতো সুনশান কেন? সরু চিকন গলি ধিরেই বড়ো রাস্তায় উঠতে হয়৷ এরপর রিকশা বা অটো পাওয়া যায়৷ তাওহীদা সাহস করে চিৎকার করলো, “আল্লাহর ভয় করুন! আমাকে যেতে দিন।”

তাওহীদার কথা শুনে লোক দুটো খিকখিক করে কুটিল হাসলো।
তারা আরও এগিয়ে এলো। তাওহীদা অনুনয় করে বললো,“আমি আপনাদের ছোটো বোনের মতো, আমাকে যেতে দিন ভাইয়া! দয়া করুন।”

”সুন্দরী রা থাকবে ঘরের মধ্যে, তা বাইরে কি? তোমাকে তো ছাড়া যাবে না সুন্দরী!”

“আল্লাহ্‌ আমাকে সাহায্য করুন।”

করুণ গলায় তাওহীদা আল্লাহর কাছে পানাহ চাইলো। তাওহীদা একদম গুটিশুটি মেরে নিচে বসে পড়লো৷ একটা ছেলে তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে, এক ইঞ্চির গ্যাপ ঠিক তখনই, এক আগুন্তুক ছায়ার মতো হাজির হলো। তার গতিবিধি এমন ছিলো যেন সিনেমার কোনো মার্শাল আর্ট জানা লোক এসে ঢাম করে ছেলেটার ঘাড়ে আঘাত করলো। একে সঙ্গে দুটো ছেলেকেই মাত করে দিলো।

“কে তুই? আমাদের গায়ে হাত দিস?”

ছেলেটা বোধহয় উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। দুজনকে দুই হাতে ধরে ধুমধামে পে’টা’তে লাগলো। আর বিড়বিড় করতে লাগলো,“মেয়েদের একা পেলেই তাদের হেনস্তা করা? জীবনের মতো বিকলাঙ্গ করে দেবো আজ! সাহস দেখাবি না ইহ জীবনে কোনো মেয়েকে উত্যক্ত করার।”

আগুন্তক ইচ্ছে মতো দুজনকে আঘাত করেই যাচ্ছে। তাওহীদা অষ্টম আশ্চর্য হয়ে শুধু সামনের দৃশ্য দেখতে লাগলো। আঘাতের পর আঘাত সহ্য করতে না পেরে ছেলে দুটো ছুটে পালিয়ে গেলো। আগুন্তকও ছুটলো তাদের পিছনে তাদের ধরার জন্য। তাওহীদা যেনো নড়াচড়া করতেই ভুলে গেলো। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে এসব কি হয়ে গেলো। ঘটনা টা এতো দ্রুত ঘটলো যে তাওহীদার সবকি মাথার উপর দিয়ে গেলো।

আগুন্তক কিছুক্ষণ পর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। তাওহীদা আতঙ্ক আর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। আগুন্তুকের মুখে কালো মাস্ক। চোখ সানগ্লাস। তাওহীদার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, “ উঠে আসুন, আপনি ঠিক আছেন?”

ঘোর থেকে বেরিয়েই তাওহীদা শুকনো কণ্ঠে শুধু বললো, “শুকরিয়া।”

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দৌঁড় লাগালো আগুন্তককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। ব্যাগ হাতে দৌঁড়াতে গিয়ে তার মনে হলো, দুটো পাথর হাতে দৌঁড়াচ্ছে সে। আগুন্তক কি যেনো ভেবে নিজের রাস্তা ধরে চলে এলো। বড়ো রাস্তায় উঠে তাওহীদা মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো আল্লাহর কাছে। তার মনের মধ্যে ওই আগুন্তুকের সাহসী আচরণ যেন একটা গভীর ছাপ ফেলে গেলো। আগুন্তকের কন্ঠটা গম্ভীর আর শীতল। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দর কন্ঠঃস্বর লোকটার। তাওহীদার কানে বার বার সেই কন্ঠঃস্বরটা বাজতে লাগলো। ভয়ে এখনো তার বুকটা ধড়ফড় করছে।

তাওহীদা যখন বাড়ি ফিরলো, তখন রওশন আরা চিৎকার করে উঠলেন, “ বাড়ির বাইরে পা দিয়ে কি পাখা গঁজিয়েছে দুটো? সন্ধ্যা লাগিয়ে দিলে একটু বাজার করতে গিয়ে। কি করছিলে যে এতো দেরি হলো?”

“বাজারের ফর্দ সব মিলিয়ে দেখুন, আমি ঘর থেকে এসে রান্না চাপাবো।”

তাওহীদা বাজারের ব্যাগ রেখে চিলেকোঠার ঘরের দিকে ছুটলো৷ ঘরে ঢুকেই ধপাস করে দরজা আঁটকে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে বাজারে গেছিলো একটা মেয়ে হয়ে অথচ, তাকে একবারও জিজ্ঞেস করলো না কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। অথচ কটুবাক্য ছুড়তে ভুল হয়নি তার শাশুড়ী মায়ের। এই পর্যায়ে এসে তাওহীদা হামলে কেঁদে উঠলো। আহসান বিছানায় বসে খুটখুট করছিলো। তাওহীদার কান্নায় সে ছুটে এলো।

“কি হয়েছে বউ? কাঁদো কেন? কাঁদো কেন?”

তাওহীদা আহসানের বুকে হামলে পড়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আহসান তাওহীদার মাথায় হাত রেখে বলে,“ওরা তোমাকে আবার বকেছে?”

“নাহ!”

“আমি জানি বকেছে! আমি ওদের পি’ট্টি দিয়ে দেবো। তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার কান্না আসে! এই দেখো!”

তাওহীদা চোখ মুছলো। আহসানের চোখে সত্যিই পানি। সে ঝটপট তার চোখ মুছে দিলো। বললো,“এই দেখো আমি কাঁদছি না। সব সহ্য করতে পারবো তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারবো না৷”

“আমিও পারি না,আমিও পারি না৷ বউ তুমি কোথায় গেছিলে শুনি?”

তাওহীদা উত্তর দেওয়ার পূর্বেই নিচ থেকে শাশুড়ীর হাকডাক শুনতে পেলো।

“মহারানী কি ঘরে গিয়ে কুড়োর মতো শুয়ে পড়লো নাকি? বলি এতো সব রান্না কখন হবে শুনি?”

তাওহীদা ঘর থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত শরীরে রান্নাঘরে ঢুকলো। বাজারে যে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটা তার মন থেকে এখনো মুছে যায়নি। কিন্তু সে জানে, এই বাড়িতে এসব নিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয় না। উল্টো তিরস্কার আর অপমানের পাহাড় গড়াবে।

রওশন আরার আবার সেই কথা,

“এত সময় লাগলো কেন? এত দেরি করার মানে কী? বাজারে কি গল্প করতে গিয়েছিলে?”

তাওহীদা চুপ। কোনো উত্তর দিলো না। সে জানে, উত্তর দিলেই কথা আরও বাড়বে। তাওহীদা মাথা নিচু করে সব শুনলো। তার হাত দিয়ে রান্নার সব কাজ করছে, কিন্তু মনের ভেতর যেন কোনো একটা কিছু জ্বলছে। আজকের হেনস্তার কথা মনে পড়ছে। ওই আগুন্তুকের কথা মনে পড়ছে। যদি সে না থাকতো, তাহলে আজ কী হতো?

তাওহীদা চুপচাপ কাজ করতেই থাকে। রান্নাঘরে একা সে গোটা বাড়ির লোকের জন্য খাবার তৈরি করছে। তার এখনো থেকে থেকে শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। কিন্তু কেউ সেটি দেখতে পায় না। একবারও কেউ জানতে চায় না, কেন তার বাজার করতে এত দেরি হলো।

#চলবে

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০২

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব২
#রাউফুন

“পাগল স্বামীরে নিয়ে এতো দেমাগ কই থেকে আসে তোর? তোর স্বামী তো কিছু করে না। দুই স্বামী বউ মিলে যে আমাদের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাচ্ছিস, লজ্জা করে না আবার আমাদেরই মুখে মুখে তর্ক করিস?”

তাওহীদা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এতক্ষণে সে একটু হলেও জবাব দিতে পারছিলো কিন্তু এই খানটাই এসে সে বারংবার আঁটকে যায়৷ করুণ চোখে শাশুড়ীর দিকে তাকালো সে। দেখলো নির্বিকার চিত্তে তার শাশুড়ী পান মুখে দিচ্ছে।

“মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো কেন ছোটো বউ? আমি করবো? আমি কি বলছিলাম তুমি বড় বউর মুখে মুখে চোপা করো?”

তাওহীদা নরম গলায় উত্তর দিলো,
“আমার স্বামী তো আপনারই ছেলে আম্মা, তাকে এভাবে পাগল বলছে আর আপনি কিছুই বলবেন না? আমার স্বামী হওয়ার আগে তো সে আপনার সন্তান।”

“কি বলবো? পোলায় তো আমার পাগলাই। যে যেমন তারে সেটা ডাকতে আবার কিসের বাঁধা।”

তাওহীদার দুই চোখ ফেঁটে কান্না আসে। এই বাড়িতে বিয়ে হওয়ার এখন এক বছর হলো অথচ বিয়ের পর দিন থেকে শুরু করে এখনো অব্দি সে একটা দিনও শান্তিতে সংসার করতে পারেনি। স্বামী মানসিক ভাবে পাগল। হাতে তুলে খেতে পর্যন্ত পারে না। ভাগ্যক্রমে তার বিয়ে হলো এই পাগলের সঙ্গে। আল্লাহ তার কপালে যা রেখেছেন তাই তো হবে। সে আফসোস করে না নিজের ভাগ্য নিয়ে। কিন্তু সব সহ্য হলেও যখন আহসানকে কেউ পাগল বলে সে কোনো ভাবেই যেনো মানতে পারে না। যে-মনই হোক, লোকটা তো তার স্বামী।

তারা তাওহীদাকে নিম্নমানের ভেবে প্রতিনিয়ত খোঁটা দেয়। আসলেই তো যার স্বামী পাগল তার আবার মুখে মুখে এতো চোপা চলে না। সে নত মস্তকে বড়ো জায়ের ফেলা ময়লা গুলো তুলে আবার ঘর মুছলো। সে ঘর মুছছিলো সেই মোছা স্থানে ইচ্ছে করে তার বড়ো জা ময়লা ফেলে। কথার মধ্যে সে শুধু বলেছিলো,

“ঘরের ময়লা গুলো এনে এখানে না ফেলে ময়লা ফেলার বাক্সে ফেলতেন ভাবি!”

সালমা তীর্যক কন্ঠে বলে,

“এখানেই ফেলবো। তোর সাহস কি করে হলো আমার ঘর না ঝাড়ু দিয়ে ঘর মুছিস? সকালে সবার ঘরই তো ঝাড়ু দিয়েছিস আমার ঘর কেন ঝাড়ু দিস নি?”

তাওহীদা উত্তর দিয়েছিলো,“ভাবি, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, তাই আর ডেকে ঘর ঝাড়ু দিই নি।”

“পরে তো উঠেছিলাম, তখন কেন দেস নি?”

“তখন তো আমি অন্য কাজ করছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সামান্য ঘরটা আপনি নিজেই ঝাড়ু দিতে পারবেন!”

পরবর্তীতে কথার পরিপ্রেক্ষিতে উপরের কথাটা তাকে খোটা দিয়ে ঠেস মেরে বলে।তাওহীদার ইচ্ছে করছিলো গলা ফাঁটিয়ে কান্না করতে। কিন্তু সে নিশ্চুপে অশ্রু আড়াল করতে ব্যস্ত হয়। অন্যের সামনে নিজের দূর্বলতা দেখানোর কোনো মানেই নেই৷ সে সব সময় চুপ থাকে তাই বলে এটা না যে সে প্রতিবাদের ভাষা জানে না।

তর্কে জিততে চাইলেও চুপ করে থাকা এবং বিনয়ী আচরণ করা সম্পর্কে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস আছে।
আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তর্কে জিতে যাওয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা ছেড়ে দেয়, আমি তার জন্য জান্নাতের প্রান্তে একটি ঘর নিশ্চিত করছি। আর যে মিথ্যা বলা ছেড়ে দেয়, যদিও তা কৌতুকের উদ্দেশ্যে হয়, আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘর নিশ্চিত করছি।”

এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, অহংকার বা অন্যায় উদ্দেশ্যে তর্ক করা ইসলাম সম্মত নয়। সঠিক থাকা সত্ত্বেও বিনয় বজায় রাখা একটি মহৎ গুণ।

তাওহীদার মা অনেক নেককার মানুষ। কোর-আনে হাফেজা। তাকে স্কুলে পড়ালেও পাশাপাশি নিজেই তার মা সব কিছু তাকে শেখাতেন। সে যে পর্দা করে এটাও এই বাড়িতে কারোর সহ্য হয় না।

আজ শুক্রবার। আজকে তার শ্বশুর বাড়িতেই আছে। মফিজ উদ্দিন শুক্রবার,শনিবার কখনোই অফিসে যান না অত্যন্ত প্রয়োজনেও।
দুপুরের খাবারের পর মফিজ উদ্দিন তাওহীদাকে ডেকে নিলেন। তিনিই একমাত্র মানুষ, যিনি তাওহীদাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন না। তাওহীদা হাত মুছতে মুছতে মাথায় আচল ভালো ভাবে টেনে দিলো। নম্র গলায় শুধালো,

“বাবা ডাকছিলেন?”

“এই নে মা কিছু টাকা আছে এখানে, তোর প্রয়োজন পড়বে। আগামীকাল তোর ভাসুরেরা বিদেশ থেকে ফিরবে। আমার এতো বড়ো ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও ছেলে গুলো কেন যে বিদেশে গেলো ওরাই ভালো জানে। ওদের নাকি ব্যবসা ভালো লাগে না। ওরা আসলে তো তোর পর্দার অসুবিধা হবে। যা কিছু প্রয়োজন কিনে নিস,মা।”

তাওহীদা না চাইতেও টাকা টা নিলো। কারণ এখানে তার পর্দার ব্যাপার টা এসেছে। টাকা টা নেওয়ার পর দেখলো বেশ কিছু টাকা। সে বলে,

“বাবা এতো গুলো টাকা তো লাগবে না। এক হাজারের মধ্যেই হবে।”

“এতো কথা বলো না বাপু৷ এখানে এসেছো থেকে ক’ টাকা দিয়েছি তোমাকে? তুমি রেখে দাও, যা দিয়েছি। এখানের মার্কেটে তো যাওনি তাই জানো না জিনিস পত্রের কি দাম।”

শাশুড়ী মা নিশ্চয়ই তার ঐ ছেলের বউদের নিয়ে ব্যস্ত? কারণ উনি রুমে থাকলে তাকে তার শ্বশুর তাকে খুব একটা কাছে ডাকেন না। তাওহীদা আর কথা বাড়ালো না। আঁচলে টাকা বেঁধে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালে মফিজ উদ্দিন তাকে আবার ডাকলেন। তাওহীদার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“মা, আহসানকে নিয়ে সব সময় এতো চিন্তা করিস না। ওর যা সমস্যা, সেটা সব এই গত দুই তিন বছর ধরে। আমার ছেলেটা ভীষণ ভালো আর মেধাবী ছিলো। আল্লাহ জানেন সে কেনো এমন পাগলে পরিণত হলো। কিন্তু তুই এমন মেয়ে যে আমার ছেলেকে ঠিক সামলে নিতে পারবি। এই বাড়ির সবার কথায় কষ্ট পাবি না। আমার অলক্ষে এই বাড়িতে অনেক কিছুই হয়, ঝামেলা হবে, সেজন্য আমি কিছু বলতে পারি না। ”

তাওহীদার চোখ ভিজে গেল। শ্বশুরের এমন কথাগুলো তার শক্তি জোগায়। সে মাথা নিচু করে বলল,
“বাবা, আপনি শুধু আমাদের দোয়া করবেন। আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী সব করব।”

আহসান যে ছোটো থেকেই পাগল নয় তা প্রথমে তাওহীদা জানতো না। এখন কিছুদিন পূর্বের জেনেছে, তাই সে সবর করে আছে। সবর কারীকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা পছন্দ করেন। সে বললো,

“বাবা কোর-আনে একটি আয়াতে আছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।”

আরও একটি হাদিসে আছে, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“তুমি জেনে রাখো, ধৈর্য ধারণ করার ফলে তোমার মধ্যে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে, আর তোমার অবস্থান উঁচু হবে।” তাই আমি সম্পুর্ন ধৈর্য্য ধরে এই সংসারে পড়ে আছি। কেউ না ভালোবাসলেও আমি তো আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন বাবা। এটাই যে আমার পরম পাওয়া।”

মফিজ উদ্দিনের বড়ো মায়া হয় এই মেয়েটার জন্য। যখনই উনার খারাপ লাগে মেয়েটার সঙ্গে দুটো কথা বলে মনটা হালকা করেন। নিজের মেয়েটা তো মনের ভুলেও এসে বাবা ডাকে না। কেন যে মেয়েটা তার এমন হলো। আগে তো এমন ছিলো না। ভার্সিটির হলে উঠার পর তিনিই স্বেচ্ছায় অনেক ফোন দিয়েছে কিন্তু তার মেয়েটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে দু একটা কথার উত্তর দেয়। বুকে চাপা কষ্টের আবির্ভাব হলো মুহুর্তের মধ্যেই। তাই তাওহীদা যখন সব সময় তাকে বাবা বাবা বলে ডাকে অন্তর টা জুড়িয়ে যায়। বেশ স্নেহ জাগে ভেতর থেকে মেয়েটার জন্য। মেয়েটা এতোটাই নাজুক যে কখনোই মুখ ফুটে নিজের জন্য কিছু চাইবে না।

সারাদিন পর তাওহীদা আজ ওতো সময় পায়নি আহসানের খেয়াল রাখার। আগামীকাল তার ভাসুর দুজন আসায় অনেক ধকল গিয়েছে। আজ মানুষ টা অনাহারে। তাওহীদার আবারও বুক ফেটে কান্না এলো। সে নিজেও খাইনি কিছু। খাবার হাতে ঘরে ঢোকার সময় আহসানকে দেখলো তার সহজ সরল স্বামীটা বরাবরের মতোই খাতায় মুখ গুজে আছে। তাকে দেখা মাত্রই আহসান শিশুদের মতো হাততালি দিয়ে বলল,

“বউ, আমি আরও ছবি একেঁছি। এই দেখো, দেখো।”

পর মূহুর্তেই কিছু একটা মনে পড়তেই মুখ গোমড়া করে বললো,“আমি আজ আড়ি করেছি। কথা নাই।”

তাওহীদা পলক ঝাপটালো। চোখ মুছে ব্যস্ত হয়ে বলল,

“কেন, কেন?”

“সারাদিনে এখন এসেছো উপরে?”

তাওহীদা হাসল। বলল, “কি ছবি একেঁছো দেখি?”

“দেখাবো না। আমার খিদে পেয়েছে!”

তাওহীদার দু চোখে অশ্রুরা ভীড় জমালো। তাদের ঘরটা উপরে দোতালায় চিলেকোঠায়। এত বড়ো বাড়িতে তাদের স্থান হলো চিলেকোঠার ঘুপসি দেওয়া ঘরে। অথচ এ নিয়েও কোনো অভিযোগ নেই তার মনে। তাওহীদা স্বামীর রাগ ভাঙাতে বলল, “এই যে কানে ধরেছি। আর কখনোই এমন হবে না।”

গাল ভরে হাসলো আহসান। তাওহীদাকে পাশে টেনে বসিয়ে বলল, “তুমি বলো আমি কি ছবি আঁকবো?”

“তুমি আমাদের স্বপ্নের ছবি আঁকো, আহসান। একটা এমন ঘর, যেখানে কেউ কাউকে ছোট করবে না। সবাই ভালোবাসবে। সেখানে আমরা সবাই থাকব, সুখে।”

আহসান যেন কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু বলল,
“তাই তো বলি! আমরা সুখেই তো আছি। তুমি আমার বউ, আমি তোমার স্বামী। এর চেয়ে সুখ আর কিসে?”

তাওহীদা আহসানের সরল কথায় বিস্মিত হয়ে গেল। আহসানের অসুস্থতার মধ্যেও সে তাওহীদার জন্য ভালোবাসার এক আশ্রয়।

তাওহীদা মনে মনে ভাবল, এই সরলতাই তো তার শক্তি। আল্লাহ তাকে যদি কোনো পরীক্ষার জন্যই এই সংসারে পাঠিয়ে থাকেন, তবে সে মাথা উঁচু করে সেই পরীক্ষা পার করবে। ভালোবাসা দিয়ে, ধৈর্য দিয়ে। সে আহসানকে খাওয়াচ্ছিলো সঙ্গে নিজেও খাচ্ছিলো। আহসান ছবি আকঁছে। তার হাত খুব দ্রুত চলছে।

তাওহীদা খাতার দিকে তাকিয়ে দেখল, আহসান একটা ছোট্ট ঘর এঁকেছে। ঘরটার সামনে দুজন মানুষ। একজন হাসছে, আরেকজন গাছের নিচে বসে আছে। আহসান ছবিটা দেখিয়ে বলল,
“বউ, এটা আমাদের ঘর। আমরা এখানেই থাকব, কেউ আমাদের কিছু বলবে না। তুমি খুশি থাকবে, আমিও।”

তাওহীদা কান্না চেপে হেসে বলল,
“আমাদের ঘর তো এখানেই আছে, আহসান। আমরা তো সুখেই আছি, তাই না?”

আহসান সরল মনে মাথা নেড়ে বলল,
“তাই তো! তুমি আছো, আর কি চাই!”

#চলবে

রেফারেন্স ১.) (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৪৮০০; তিরমিজি, হাদিস নম্বর: ১৯৯৩)৷

রেফারেন্স ২.) (সুরা আল-বাকারা: ১৫৩)

রেফারেন্স৩.(মুসলিম শরীফ: ২৯৯৯)

প্রাণ বসন্ত পর্ব-০১

0

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১
#রাউফুন

ব্যথায় তাওহীদা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল। রান্নাঘরের কোণে নিজের হাত চেপে ধরে বসে পড়ল। চোখ বেয়ে শীতল অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দুই গাল থেকে ফ্লোরে। তার ডানহাতে লাল দাগ, ছ্যাকার যন্ত্রণা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ইশ এতো জ্বালা করছে, যে সে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। বড় জা সালমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এই তো হলো গৃহস্থ মেয়ে! একটু মশলা বাটতে বলেছিলাম, সেটাও করতে পারে না। এমন ফাঁকিবাজ হলে তো এভাবেই শিখাতে হবে। গায়ে ছ্যাকা লাগলে শিখবি ঠিকই তাই এখনকার এই সামান্য ছ্যাকা। কেমন লাগলো বল?”

একটা মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হলে ছ্যাকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন লাগছে তা তাওহীদার জানা নেই। এরকমও হয় বুঝি মানুষ? তাওহীদা ব্যথায় মুখ চেপে ধরে। গরুর পেট থেকে বেরোলে সে গরুই হয়, ছাগলের পেট থেকে ছাগল, কিন্তু মানুষের পেট থেকে হলে সে মানুষ হয় না তাকে মানুষ বানাতে হয়। তাওহীদার মায়ের এই কথাটা এই মূহুর্তে মনে পড়লো। এরা কি তবে অমানুষ হয়েছে, শিক্ষিত অমানুষ? শিক্ষিত কিন্তু সুশিক্ষিত নয়? তাওহীদা করুণ, রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলল,
“ভাবি, আমি তো বলেছিলাম মশলা পরে বাটব। ভাতের হাঁড়িটা নামাতে গিয়ে…”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মেজো জা পারভীন রান্নাঘরে ঢুকল। গলায় বিদ্রূপের সুর, বড়ো জা কে আরও একটু ক্ষ্যাপিয়ে দিতেই সে মুখ বেকিয়ে বললো,

“বাহ ছোটো বউ, অন্যায় করে আবার ভাবির মুখে মুখে তর্ক করিস? নিজে ভুল করেছিস স্বীকার না করে আবার সাফাই গাওয়া? ঠিক হয়েছে ছ্যাকা দিয়েছে। তোর কাজকর্ম তো বাচ্চাদের মতো। তুই কী ভেবেছিস, এ বাড়িতে তোর মতো অলস মানুষকে আমরা বেশি দিন রাখব? আহসানের বউ বলে সহ্য করছি, কিন্তু এমন দিন আসবে যে তোকে হাতজোড় করে বিদায় দেব। আমাদের পায়ে পড়েও কুল কিনারা পাবি না।”

তাওহীদা মুখ নিচু করে উঠে দাঁড়ালো। তার চোখের কোনায় আবারও অশ্রু জমছে, সে বরাবরের মতোই কোনো উত্তর দিল না। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই জায়ের ঠোঁট থেকে বিদ্রূপের তীর একের পর এক তার দিকে আসছিল। সে তা দুই চোখ বন্ধ করে সহ্য করলো।

বড় জা সালমা এবার তেড়ে এসে তার দিকে গরম খুন্তিটা ধরে বলল,
“আবার যদি আমার কথা না শুনে তোর মতলব চালাস, এইবার হাতের জায়গায় গরম খুন্তিটা তোর মুখে লাগাব। তখন কেমন সুন্দর দেখাবি!”

তাওহীদা দুই কদম পিছিয়ে গেলো আর কিছু বলল না। সে ধীরে ধীরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল। তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়িটা যেন এক জ্বলন্ত নরক, আর সে যেন আগুনের মধ্যে আটকে পড়েছে। এই যে সে চিৎকার করলো, আজ যদি তার স্বামী সুস্থ সবল মানুষ হতো তবে বোধহয় আজ এই দিন দেখতে হতো না। একজন মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত, পাগল মানুষ নিশ্চয়ই বউয়ের কষ্ট বুঝবে না? সে ঘরে যাওয়ার আগে দেখলো তার শাশুড়ী নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। দেখলো তার পাগল বরটা ঘুমাচ্ছে বাচ্চাদের মতো করে। তার একটা শাড়ী হাতের মুষ্ঠিতে চেপে ধরা। ইশ, এতো নিষ্পাপ, সুন্দর একজন মানুষ কিনা পাগল? দেখে বোঝার উপায় আছে?

রাতে যখন সব কাজ শেষ হয়ে গেল, তাওহীদা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে শ্বশুর মফিজ উদ্দিনের ঘরে ঢুকল। হাতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বললো,

“বাবা, পানি।”

মফিজ উদ্দিন তাওহীদার হাতে ছ্যাকার দাগ দেখে আঁতকে উঠলেন।
“মা, এটা কী হলো? তোর হাতে এত বড়ো দাগ কেন?”

তাওহীদা কিছু বলতে চাইল না, কিন্তু মফিজ উদ্দিন জোর করলেন।
“তুই আমাকে সত্যি বলবি। কে করল এমন?”

তাওহীদা মাথা নিচু করে বলল,
“বড় ভাবি… রান্নার সময় একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল, তাই…”

মফিজ উদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার চোখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট।
“তোর মতো মেয়ে এমন শাস্তি পায়, এটা ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি তোকে এই বাড়িতে এনে ভুল করেছি, মা। আমার জন্য তোর জীবন নষ্ট হয়ে গেল।”

তাওহীদা শ্বশুরের সামনে মাথা নিচু করে বসে পড়ল। তার কণ্ঠে দৃঢ়তা,
“বাবা, আপনি কেন এমন বলেন? ভাগ্য আল্লাহর হাতে। এখানে আপনি কিছুই করতে পারেন না। আর আমি ভালো আছি। এই সংসার আমার, আমি এটাকে আপন করেই রাখব। হাজার বেদনা সহ্য করেও আমি এইখানেই থাকবো। কারণ আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই বাবা। মৃত্যুর পূর্বে এটাই যে আমার আসল ঠিকানা আর মৃত্যুর পর হবে কবর।”

মফিজ উদ্দিন ভেজা চোখে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এমন সময় তার শাশুড়ী মা রুমে প্রবেশ করে। তিনি কর্কশ কন্ঠে কটাক্ষ করে বলেন, “তোমার মা কি তোমাকে ভালো কিছুই শেখায় নি? কাপড় যে ধুয়ে দিয়েছো দেখো তো পরিষ্কার হইছে? নাকি এই আমি যেনো আর না ধুতে বলি সেজন্য ইচ্ছে করে এমন করো?”

তাওহীদা শাড়ীর দিকে তাকালো। আশ্চর্য এই দাগ কিভাবে এলো? সে তো খুব ভালো ভাবে কাপড় ধুয়েছে! রওশন আরা কাপড় টা তাওহীদার মুখের মধ্যে ছুড়ে মেরে ফুসতে লাগলেন। মফিজ উদ্দিন বললেন, “আহা, এমন সাপের মতো ফুসছো কেন? না হয় একটু ভুল হয়েই গেছে। ছোটো মানুষ বুঝতে পারেনি।”

“এই তোমার জন্যই ওর এত সাহস হইছে। লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো একেবারে।”

তাওহীদা আর ক্ষনকালও দাঁড়ালো না। বেরিয়ে এলো ঐ ঘর থেকে। কেমন সবকিছু বিষাদ লাগছে। নিশ্চয়ই এই দাগ কেউ ইচ্ছে করে লাগিয়েছে।

তাওহীদা খাবার গুছাতে গিয়েও বড় জা সালমার কটাক্ষ এড়াতে পারল না। সালমা ভাতের ডেকচি থেকে চামচ দিয়ে ভাত তুলে দেখাল আর বলল,

“এতো নরম ভাত কি মানুষ খেতে পারবে? তোর মা-ও কি এমন পচা রান্না করত?”

তাওহীদা কিছু বলল না। চুপচাপ কাজ করছিল। কিন্তু সালমা থামল না। তীরের ফলার ন্যায় কথাঘাত করেই যাচ্ছিলো।

“হাসব্যান্ড পাগল, বউটা রান্নারও অযোগ্য। আল্লাহ জানে কিসের শাস্তি পেলাম আমরা। তোর জায়গা হওয়ার কথা ছিল ময়লা ফেলার জায়গায়। এখানে কি করে আসলি ? আসলে সবই কপাল বুঝলি মেজো? একটা অজপাড়াগাঁ এর মেয়ে শহরে এসে কি আমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে নাকি?”

“ওর সেই যোগ্যতায় নেই ভাবি। যাই হোক, ভাতে এতো বেশি পানি দিয়েছে ইচ্ছে করেই। যেনো আমরা খেতে না পারি।”

তাওহীদা এবারও কিছু বলল না। ওকে চুপ থাকতে দেখে দু’জন যেনো আরও রেগে গেলো। আশ্চর্য এই মেয়েটার শরীরে কি মানুষের চামড় নাকি গন্ডারের? কোনো ভাবেই যে একে টলানো যাই না। দুজনেই হনহনিয়ে চলে গেলো। তাওহীদা ভাত দেখলো সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু শুধুই তাকে এতক্ষণ কথা শোনাচ্ছিলো৷ যেনো সেও দু একটা কথা বলে আর ওরা তার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে আর একটা ঝামেলা বেধে যায়। তাওহীদার অল্প বিদ্যা হলেও প্রচন্ড বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে। সে শুধু মনে মনে দোয়া করল, “হে আল্লাহ, আমাকে সহ্য করার শক্তি দাও। আমি যেনো আমার স্বামীকে ভালো রাখতে পারি।”

তাওহীদা নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দেখল আহসান একটা খাতা নিয়ে বসে আছে। তাকে দেখে আহসান বলল,
“বউ, তোমার হাতটা কি ব্যথা করছে?”

তাওহীদা চমকে গেল। আহসান কীভাবে জানল? সে উত্তর না দিয়ে তার পাশে বসল। আহসান তার হাতে মলম লাগানোর চেষ্টা করল।
“বউ, তুমি কান্না করো না। আমি তোমার জন্য সুন্দর ছবি আঁকব। তুমি খুশি হবে অনেক।”

তাওহীদা চোখের জল মুছল। তার এই সরল স্বামীই তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। সে বললো, “আচ্ছা, তুমি ছবি আঁকো আমি তোমার জন্য খাবার আনি!”

আহসান মাথা নেড়ে সাই জানালো। কাজ শেষ করে এক থালা ভাত নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে গিয়ে দেখে তার নিষ্পাপ স্বামীটা বসে বসে খাতায় মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। তাওহীদা অনেক কষ্টে ক্লাস এইট অব্দি পড়েছে। এরপর অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা আর করা হয়ে উঠেনি। তাওহীদাকে দেখেই আহসান বাচ্চাদের মতো হেসে উঠলো। বললো,“বউ দেখো আমি ছবি এঁকেছি।”

“কি ছবি দেখি?”

আহসান খাতা তার সম্মুখে ধরে দেখালো। তাওহীদার দুই চোখ ভরে উঠল। একটা বাচ্চার ছবি এঁকেছে আহসান। তারপর তাওহীদার চোখে পানি দেখে সে শুধায়,

“বউ কাঁদতে নেই, আমি ছবি এঁকেছি বলে কাঁদো? তাহলে আমি এটা এক্ষুনি ছিড়ে ফেলছি!”

তাওহীদা দ্রুত হাত দিয়ে আহসানের খাতা চেপে ধরল। মুখে হাসি আনার চেষ্টা করেও তার কণ্ঠ বুজে আসছিল। বলল,

“না, না! ছিঁড়বে কেন? খুব সুন্দর ছবি এঁকেছ। আমিও তো এমন দুর্দান্ত ছবি আঁকতে পারি না!”

আহসান শিশু সুলভ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“সত্যি? তুমি মিথ্যে বলছো না তো?”

“না, একদম না। তুমি তো অনেক বড় আর্টিস্ট হয়ে যাবে। আমার কথা শোনো, এই ছবিগুলো যত্ন করে রেখে দাও।”

আহসানের খুশি দেখে তাওহীদার বুকটা হু হু করে উঠল। আহসানের মানসিক অসুস্থতা হয়তো তাকে সামাজিকভাবে ছোট করে তুলেছে, কিন্তু এই সরলতা, এই নির্মল আনন্দ, এটাই তাকে অন্যরকমভাবে আলোকিত করে।

ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকা আহসানের এমন খুশি মুহূর্তগুলোই তাওহীদার বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু বাইরে? বাইরে এই বাড়িতে তার প্রতিদিনই এক যুদ্ধ।

তাওহীদার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। গ্রামের সাধারণ ঘরের মেয়ে সে। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। চার বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়ো তাওহীদা। তার মা রাবেয়া খাতুন অনেক কষ্টে সন্তানদের মানুষ করেছেন। তাওহীদা কখনোই বিশেষ কিছু চায়নি। শ্যামলা রঙ হলেও তাওহীদার মুখে অদ্ভুত এক মায়া, আর তার সহজ-সরল স্বভাব সবাইকে আকৃষ্ট করতো। তবে তার বড় গুণ হলো, সে কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নতিস্বীকার করে না।

বিয়ে হলো এক সচ্ছল ঘরে। তাওহীদার স্বামী আহসান সে সময় তাকে দেখে পছন্দ করে। আহসানকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে পাগল। তার শ্বশুর বাবা মফিজ উদ্দিন তাকে স্নেহ করেন। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের আচরণ তাওহীদার জন্য এক বিষময় অভিজ্ঞতায় পরিণত হলো। আহসানের মা রওশন আরা, বড় জা সালমা, মেজো জা পারভীন, আর ননদ রিমি – সবাই অহংকারী। উঠতে বসতে কথা শোনায়, চড় থাপ্পড় দিতেও ভুলে না শাশুড়ী জায়েরা মিলে। বিশ্রী তিক্ত স্মৃতি মনে হতেই তাওহীদা এবার চোখ বন্ধ করল। সে জানে, এই জীবন সহজ নয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল,

“হে আল্লাহ, আমাকে সব পরিস্থিতিতে শক্ত থাকার সাহস দাও। আমি আমার স্বামী আর এই সংসার সামলাব। যতই কষ্ট আসুক, আমি নত হব না।”

#চলবে

কাঁটামুকুট পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব- ৮ (শেষ পর্ব)

খুব ছোটোবেলায় একবার সিমরানের জ্বর হয়েছিল। জ্বরের ঘোরে সে বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। এদিকে বাবার দু’দিন অফিস কামাই হয়ে গিয়েছিল। তার তখন নতুন চাকরি। তৃতীয় দিন যেতেই হলো। সকালবেলা সিমরানকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তিনি চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু দুপুরে সিমরানের কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল, বাবাকে তার এক্ষুনি চাই। মা চেষ্টা করছিলেন ওকে নিজেই কোনোভাবে বুঝিয়ে থামাতে, কিন্তু কিছুতেই মেয়ে থামছিল না। শেষে তিনি যখন ওর বাবাকে ফোন করতে গেলেন, তখন কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে দেখলেন তার স্বামী বাড়ি চলে এসেছে৷ বাবা দৌড়ে ঘরে ঢুকে সিমরানকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামালেন। তার নাকি অফিসে বসে মনে হচ্ছিল মেয়ে কেঁদে কেঁদে তাকে ডাকছে। নতুন চাকরির মায়া না করেই তিনি চলে এসেছেন।

আজও যখন সিমরান শেষরাতে কেঁদে কেঁদে বাবাকে ডাকছিল, তার পক্ষে বাড়িতে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। সেই ছোটোবেলার মতো মেয়ের টানে তিনি সেই সময়েই বাড়ি থেকে রওনা দিলেন ইশতিয়াকের বাড়ির উদ্দেশ্যে। এমনকি স্ত্রীকেও কিছু বললেন না।

বেল বাজলে দরজাটা সিমরানই খুলল। খুলেই জড়িয়ে ধরল বাবাকে। কাঁদতে থাকল ফুঁপিয়ে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? লোকটা কী করেছে তোর সাথে?”

সিমরান কোনো উত্তর দিতে পারল না৷ সে শুধু বলল, “আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। এখানে থাকলে আমি মরে যাব।”

বাবা তাকে তখনই নিয়ে রওনা দিলেন। ইশতিয়াক তখন বাড়িতে নেই। আর মুশফিক পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।

সিমরানকে দেখে মা ভয়ানক আশ্চর্য হলেন। রেগেও গেলেন। রাগ ঝাড়তে শুরু করলেন স্বামীর সাথে, “তোমার দরদ দেখে তো আমি বাঁচি না! এই মেয়ের শোকে স্ট্রোক করলে, মেয়ে তোমার খোঁজও নিল না৷ আর তার এক ডাকে শেষ রাতে পাগল হয়ে চলে গেলে? তোমার লজ্জা নেই?”

সিমরান এদিকে মেঝেতে বসে পাগলের মতো কাঁদছে।

মা এগিয়ে এলেন ওর দিকে, “আবার কী করে এসেছিস? তাড়িয়ে দিল নাকি? এত তাড়াতাড়ি মিটে গেল শখ?”

বাবা মাকে থামিয়ে সিমরানের কাছে এসে ওকে ধরে সোফায় বসালেন। ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে মা? বল আমাকে? কী করেছে ও তোর সাথে?”

সিমরান একটু ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে সবটা বলল। মা দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়ে কাঁপতে লাগলেন। আর বাবার চোখ টকটকে লাল হয়ে গেল। তার ইচ্ছে হতে লাগল পৃথিবী থেকেই চলে যেতে। কিংবা আগুন জ্বালিয়ে দিতে পুরো জগতে। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? সে কোন অপরাধ করেছিল?

*********

ইশতিয়াক তার বহুদিনের প্রেমিকা যামিনীর কাছে গিয়েছিল। মহিলা পেশায় অভিনেত্রী, স্বামী নেই, ডিভোর্সড। ইশতিয়াক তার অসংখ্য প্রেমিকের একজন। তবে ইশতিয়াকের সাথে তার কিছু ইমোশনাল সম্পর্ক আছে। দু’জনেই বেশি স্ট্রেসেড হয়ে পড়লে দু’জনের কাছে আশ্রয় খুঁজে নেয়। দু’জন দু’জনার স্ট্রেস দূর করতে পারে চমৎকারভাবে। এমনিতে এদের মাঝে কোনো মান অভিমানের সম্পর্ক নেই।

যামিনী তার নতুন বিয়ের খবর শুনে, বিশেষত এত ছোটো একটা মেয়ে বিয়ে করেছে শুনে একটু বিরক্তই হয়েছে। ইশতিয়াক তাকে সব খুলে বলায় সে সারারাত ওকে বুঝিয়েছে, মেয়েটাকে তার রাখা উচিত না৷ অল্পবয়সী মেয়েরা প্রচুর ঝামেলা বাঁধাতে পারে। এই সুযোগে যেন মেয়েটাকে সে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। এমন মেয়েদের দামী গিফট দিয়ে প্রেম করা যায়, বিয়ে করাটা একটু বাড়াবাড়িই। এই মেয়ে তাকে চুষে খেয়ে নেবে, আর ওদিকে দেখা যাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কমবয়সী প্রেমিকের সাথে।

ইশতিয়াকের মনে ধরেছে যামিনীর প্রস্তাব৷ এদিকে অনেকদিন পর যামিনীকে পেয়ে তার ভালোও লাগছে। গতরাত কথায় কথায় কেটে গেছে। আজ জমিয়ে প্রেম করা যাবে ভেবে সে পরের রাতও সেখানেই রয়ে গেল। যামিনীর কাছে থাকার সময় সে পৃথিবী থেকে যাবতীয় কানেকশন বন্ধ করে শুধুই ওর মাঝে ডুবে থাকতে পছন্দ করে।

রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে সে যখন বাড়ি ফিরল তখন জানতে পাগল মুশফিককে রেপ কেসে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কেস করেছে সিমরান। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

*********

মুশফিকের বেইল ইশতিয়াক সেদিনই করিয়ে ফেলল। কিন্তু কেস সময়মতো কোর্টে পৌঁছে গেল। শুনানি শুরু হলো। সিমরানের পক্ষে জোরালো প্রমান আছে। তার শরীরে মুশফিকের সিমেন পাওয়া গেছে। উকিলও আশা দিয়েছেন তিনি অপরাধীকে শাস্তি পাইয়ে ছাড়বেন।

কিন্তু ইশতিয়াকের হায়ার করা নামীদামী উকিল দানই পাল্টে দিলেন। দোষ সব সিমরানের ঘাড়ে এসেই পড়তে লাগল একটা একটা করে।

ইশতিয়াকের বাড়ির সকল কাজের লোকের বয়ান থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে সিমরান আর মুশফিকের ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা একসাথে এক ঘরে যথেষ্ট সময় কাটাতো, একসাথে ঘর অন্ধকার করে সিনেমা দেখত, সেজেগুজে কাপলের মতো ঘুরতে যেত। মুশফিকের উকিলের দাবি হলো সিমরান মুশফিককে সিডিউস করত। সে বাড়িতে ছোটো ছোটো পোশাক পরে ঘুরে বেড়াত। এসবের কোনোটাই সিমরানের অস্বীকার করার উপায় নেই। যদিও সে কখনোই মুশফিককে সিডিউস করার চেষ্টা করেনি। সে মুশফিকের প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিল এটা অবশ্য সত্য। তবে সময় থাকতেই সে সেদিক থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে।

ইশতিয়াকের সেই মেয়েদের সাথে ছবিগুলোর কথাও কোর্টে উঠল, তবে সেগুলো সিমরান নিজের কাছে নিয়ে রাখেনি বলে কোনোকিছুই প্রমাণ হলো না।

সবশেষ চালটা এবার মুশফিকের উকিল চেলেই ফেলল।

সে রাতের ঘটনায় মুশফিক জানাল, সিমরান নিজে তাকে ডেকে নিয়েছিল। তার মোবাইলে মেসেজ আছে। মেসেজটা পেশ করা হলো আদালতে। তাতে লেখা, “ইশতিয়াক আজ বাড়িতে নেই। আসবেও না বোধহয়। চলে এসো আমার ঘরে। পাগল হয়ে আছি তোমার জন্য।” সিমরানের মোবাইলে মেসেজটা নেই। তবে সিম কোম্পানি থেকে তার সিমের সব তথ্য সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সেখানেও দেখা গেল মেসেজটা গেছে।

আসলে মেসেজটা মুশফিকই পাঠিয়েছিল সিমরানের ফোন থেকে, সিমরানের হাতগুলো বেঁধে দেবার পর। পাঠিয়ে আবার ডিলিটও করে দিয়েছিল। মুশফিকের ধারণা ছিল না ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়াবে৷ সে বাবার কাছে নিজেকে পরিষ্কার রাখতে কাজটা করেছিল। সেটাই কাজে লেগে গেল।

আদালতে সিমরানের অভিযোগ মিথ্যে ঘোষণা করে মুশফিককে বেকসুর খালাস করে দেয়া হলো।

বাপ ছেলে হাসতে হাসতে কোর্টের চত্ত্বর থেকে বিদায় নিল।

হেরে যাওয়া মেয়ে আর তার বাবা মা বাড়ি ফিরে এলো। ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি বাইতে বাইতে মনে হলো এভারেস্টে চড়তে হচ্ছে, শরীরটা বড় ভারী হয়ে গেছে। পৃথিবী এত নিষ্ঠুর!

সিমরান এতক্ষণ কিছু বলেনি। তার মনে হচ্ছিল মেসেজের ব্যাপারটায় বাবা মাও তাকে অবিশ্বাস করেছে, যদিও তারা কিছুই বলেননি।

সিমরান বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে চুপ করে বসে রইল। সময় যেতে থাকল, সে জায়গা থেকে নড়ল না, কিছু খেল না। বাবা মায়েরও মনের অবস্থা নেই তাকে জোর করার। কিন্তু তিনদিন পার হয়ে গেলেও সে যখন অনঢ় হয়ে রইল, তখন বাবা মা তার ঘরে গিয়ে বোঝাতে শুরু করলেন। অনেকক্ষণ বোঝানোর পর সিমরান নড়ল। দুই হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কেঁদে বলল, “তোমরা বিশ্বাস করো, আমি মুশফিককে সেই রাতে ডাকিনি। আমি জানি আমি অনেক খারাপ, আমি লোভী, আমি বেয়াদব, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার এত দুশ্চরিত্র নই। আমি সত্যি কথা বলছি। সবাই যাই ভাবুক না কেন, তোমরা আমাকে খারাপ ভাবলে আমি মরে যাব। সত্যিই মরে যাব।”

বাবা সিমরানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমি ওটা কোনেদিন বিশ্বাস করিনি মা। একবারের জন্যও বিশ্বাস করিনি।”

“ওদের কোনো শাস্তি হলো না বাবা। শুধু আমিই কেন শাস্তি পেলাম বলো তো?”

বাবা ধীর স্বরে বললেন, “সবার শাস্তি পৃথিবীতে হয় না রে মা। দেখবি ইবলিশগুলো ঠিকই হেসেখেলে দুনিয়ার জীবন পার করে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ছেড়ে দেন না রে মা। মরনের আগে হোক বা পরে, শাস্তি তারা পাবেই।”

**********

অনেক বছর কেটে গেল। ইশতিয়াকের সাথে ডিভোর্সের পর সিমরান আর বিয়ে করল না। পড়াশুনা শেষ করল। বেশ চমৎকার রেজাল্ট হলো। ডাবল মাস্টার্স আর পিএইচডি শেষ করার পর একটা প্রাইভেট ভার্সিটির শিক্ষক হিসেবে জয়েন করল সে। প্রতি বছর ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের একদিন এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে সে নিজের গল্পটা শোনায়। বিশেষ করে ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে গল্পটা বলে সে। নিজের জীবনের ঘটনা হিসেবে বলে না, বলে বন্ধুর নাম নিয়ে। চরিত্রগুলোর নামও থাকে অন্য। তার উদ্দেশ্য একটাই, তার মতো ভুল যেন আর কেউ না করে।

এমনই একদিন ঘটনাটা বলে শেষ করল সে। ক্লাস থেকে বের হয়ে করিডোর দিয়ে যাবার সময় একটা মেয়ে দৌড়ে এলো তার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ম্যাম, থ্যাংক ইউ সো মাচ!”

“ফর হোয়াই?”

চমৎকার দেখতে মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল, “এমনি।”

সিমরান ওর চিবুক ধরে একটু আদর করে দিয়ে বললেন, “ওকে মাই গার্ল! সাবধানে থেকো।”

মেয়েটা ফিরে এসে ঠান্ডা মাথায় একটা নাম্বারে মেসেজ পাঠাল, “স্যরি মি. মুশফিক, আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে ইন্টারেস্টেড নই। আপনার উপহারগুলো আপনার অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব৷ আমার সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না।”

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

কাঁটামুকুট পর্ব-০৭

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব- ৭

শেষ মুহূর্তে সিমরানের হঠাৎ মন বদলে গেল। কেমন করে কয়েক সেকেন্ডে সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল বুঝতে পারল না৷ শুধু মনে হলো কাজটা খুব ভুল হবে। চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মতো ভেসে উঠল দু’জনের চেহারা, একজন ইশতিয়াক, অন্যজন বাবা৷ ইশতিয়াক যদি এখানে থাকত তাহলে সে তাকে কী ভাবত? কত ভালোবাসে ইশতিয়াক তাকে! আর বাবা! বাবা সারাজীবন তাকে শিখিয়েছে, চিটিং ইজ ভেরি ব্যাড! বাবার তোতাপাখির মতো কথাটা তাকে এমনভাবে মুখস্থ করাতো যে পরীক্ষায় অন্য কারো খাতা দেখে লিখতে গিয়েও বারবার কথাটা মনে পড়ে যেত, আর নকল তো অনেক দূরের বিষয়। আজকের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করার জন্য তার মস্তিষ্ক কয়েক মুহূর্তই সময় পেল। এত দ্রুত মগজ কেমন করে চলে? দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে নবের দিকে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা সরিয়ে নিল সিমরান। যত দ্রুত সম্ভব জামাটা ছাড়িয়ে নিল গা থেকে। একটা ঢিলা কুর্তা পড়ল। ততক্ষণে বাইরে অস্থির হয়ে গেছে মুশফিক। “দরজা খুলবে না নাকি? চলে যাব? হট কফি কোল্ড হয়ে গেছে।”

দরজা খোলার সময় সিমরানেরও কথাটা চিন্তা করে খুব হাসি পেয়ে গেল, হট সিমরানও কফির সাথে সাথে কোল্ড হয়ে গেছে।

সেদিনের গল্পটা তেমন জমল না৷ সিমরান বারবার অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছে দেখে মুশফিক খানিক পরেই চলে গেল নিজের ঘরে। জিজ্ঞেস করে গেল সন্ধ্যায় একসাথে মুভি দেখবে কি না৷ সিমরান তাতেও না করে দিলে মুশফিক বেশ অবাক হলো। মুভির ব্যাপারে সিমরান কখনো না করে না৷ সে মারাত্মক সিনেমা ফ্রিক। আজ কী হলো?

সেদিন রাতে ইশতিয়াক ফিরল সিমরানের জন্য দারুণ একটা সারপ্রাইজ নিয়ে। ইশতিয়াকের হাতে সাদা গোলাপের বিশাল এক বুকে। সিমরান বুকেটা জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্যাংস! তুমি জানলে কী করে আমার সাদা গোলাপ পছন্দ? কখনো তো বলিনি।”

ইশতিয়াক চোখ মটকে বলল, “ম্যাডাম, আমি এখন আপনাকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করি!”

সিমরান খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর খেয়াল করল বুকের সাথে আছে দুটো প্লেনের টিকিট! লাফিয়ে উঠল সিমরান। “আমরা তাহলে যাচ্ছি!”

“হ্যাঁ আগামী সপ্তাহেই।”

“তোমার শরীর..”

“ডক্টরের সাথে কথা বলে নিয়েছি। আই অ্যাম অ্যাবসলুটলি ফাইন ডার্লিং!”

সিমরান খুশিতে জড়িয়ে ধরল ইশতিয়াককে।

ইশতিয়াক আজ আলাদাই মুডে রয়েছে। ভীষণ খুশির আমেজে যেন দুজনেই বাকবাকুম হয়ে আছে। সিমরানের মনটা খুশিতে নেচে উঠছে বারংবার৷ সে সেই রাতে গোলাপি নাইট ড্রেসটা আবার পরল। হ্যাঁ, ইশতিয়াকের জন্যই পরল। ইশতিয়াক যখন ওকে দেখল তখন তার মুখ হা হয়ে রইল। এত সুন্দর লাগছে সিমরানকে! তার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না এই বয়সে এসে সে এরকম একটা মেয়েকে নিজের করে পেয়েছে! আর মেয়েটাও তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে!

সে রাতে সিমরানের শখ পূরণ হলো। তার বিয়ে করা বর তার জামার প্রত্যেকটা ফিতে খুঁজে বের করে একটা একটা করে খুলল। সেজন্য ঝক্কিও কম পোহাতে হলো না ইশতিয়াকের। তবে দু’জনে যেন আরো বেশি করে সময়টা উপভোগ করল। ঘুমানোর আগে সিমরানের নিজের বিকেলে নেয়া সিদ্ধান্তের কথাটা ভেবে খুব শান্তি লাগল।

পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে সিমরানের ঘাড়ের কাছে একটা সদ্য তৈরি গাঢ় দাগ দেখতে পেয়ে মুশফিকের শরীরের ভেতরটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। তার ইদানীং আর সহ্য হয় না৷ ইচ্ছে করে সিমরানকে পিষে ফেলতে, নিজেও মরে যেতে৷

সেদিন আর ক্লাসে গেল না মুশফিক৷ প্রেমিকাকে নিয়ে একটা হোটেলে চলে গেল। একান্ত সময় কাটাবার সময়ও তার ভালো লাগল না। এই মেয়েটাকে কোনোভাবেই সিমরানের সাথে তুলনা করা যায় না৷ সিমরানের তুলনা সে নিজেই৷ সে অনেক চেষ্টা করল মেয়েটাকে সিমরান ভাবতে। কিন্তু সিমরানের গলার স্বর, দুষ্টু মিষ্টি হাসি, ওর ফিগার, সব যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে। মাঝপথে থেমে গেল মুশফিক। হচ্ছে না তার। মেয়েটাকে হোটেলে ফেলে চলে এলো সে।

সিমরানের সাথে খাতির জমাবার বহু চেষ্টা সে এরপর থেকে করতে লাগল। রীতিমতো পেছনে পেছনে ঘুরতে শুরু করল। কিন্তু সিমরান যেন আজকাল তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটা। কোনো কথা, কোনো ঘটনা যেন ওর গায়ে লাগছে না।

আগে সিমরানের সাথে হাতের ছোঁয়া লাগলে মেয়েটা লজ্জা পেত। গতকাল কিচেনে সে কফি বানাচ্ছিল, সিমরান বানাচ্ছিল সালাদ৷ মুশফিক ইচ্ছে করেই কফির বয়াম নিতে গিয়ে সিমরানের কাছে গিয়ে তার বাহু ছুঁয়ে দিল। সিমরান এত বিরক্ত হয়ে তাকাল যে মুশফিককে ‘স্যরি’ বলে চলে আসতে হলো। ব্যাপারটা বড্ড ভাবাতে লাগল তাকে। সে কাছে যেতে চাইছে দেখে কি সিমরানের ভাব বেড়ে গেল? সে কি ইচ্ছে করে এমন করছে যাতে সে আরো ছটফট করে? সুন্দরী মেয়েগুলো নিজেকে কী ভাবে?

**********

সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার আগেরদিন সকালে সিমরান ইশতিয়াককে হঠাৎ বলল, “আমি একবার বাড়ি যাব।”

ইশতিয়াক অবাক হয়ে বলল, “কোন বাড়ি?”

“আমার বাবার বাড়ি।”

“কেন?”

“মা বাবার কথা মনে পড়ছে।”

“হঠাৎ?”

“হঠাৎ না, সবসময়ই মনে পড়ে।”

“ওরা তোমাকে রেখে দেবে। আর আসতে দেবে না৷ এমনিতেও মামলা করে বিচ্ছিরি অবস্থা করে রেখেছে। অফিসেও তোমার বাবা আমার রেপুটেশন খারাপ করে ফেলেছে। তুমি তবুও তাদের কাছে যেতে চাও?”

সিমরান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার মেয়ের একটু জ্বর হলেও তুমি অস্থির হয়ে যাও ইশতিয়াক। রোজ ভিডিও কলে কথা না বললে তোমার ঘুম হয় না৷ আমি তোমাকে কখনো এজন্য কিছু বলিনি। সামান্য অভিযোগও করিনি। কারন আমি জানি বাবারা মেয়েদের জন্য কেমন অনুভব করে। আমার বাবাও আমাকে অতটাই ভালোবাসে। বরং আরো বেশি ভালোবাসে। এতদিন আমাকে ছাড়া থাকতে তাদের কত কষ্ট হয়েছে আমি জানি না। তখন আবেগের বশে ডেস্পারেট হয়ে আমি চলে এসেছিলাম৷ কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আমি ওদের ভয়ানক মিস করছি। কখনো ওদের ছাড়া এক রাতও বাইরে থাকিনি। আর দেখো, কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে ওদের দেখি না৷ আমি নিজের জেদ ধরে রাখতে ওদের সাথে যোগাযোগ করিনি, কথা বলিনি, দেখাও করতে যাইনি৷ কিন্তু আজ যাব। এতদূর ঘুরতে যাব, ওদের না দেখে গেলে আমি শান্তি পাব না।”

ইশতিয়াক অগত্যা রাজি হলো। “ঠিক আছে, যাও। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না। গোছগাছও করা লাগবে। কালই তো ফ্লাইট।”

“আমি একবার দেখা করেই চলে আসব।”

“এখন যাবে?”

“না, রাতে। বাবা অফিস থেকে ফেরার পর।”

“আচ্ছা।”

রাতে সিমরান গাড়ি করে ওর বাবার বাড়িতে গেল। কতদিন পর চেনা গলি, চেনা বাড়িটার সামনে এলো সে! সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু বদলে গেছে সে নিজে। দুরুদুরু বুকে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। শেষদিন পাগলের মতো এই সিঁড়ি বেয়েই নেমে পালিয়েছিল সে।

নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সাহস হচ্ছে না কলিংবেল চাপার। ওদের কেমন রিয়েকশন হবে ওকে দেখে?

শেষ পর্যন্ত কলিংবেল চেপেই ফেলল সিমরান। মিনিটখানেকের অপেক্ষা যেন কয়েক বছর মনে হতে লাগল। ওর মা দরজা খুললেন। ওকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলেন। তারপর সিমরানকে অবাক করে দিয়ে নির্লিপ্ত মুখে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আসুন।”

সিমরান অবাক হলো। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সে প্রশ্ন করল, “কেমন আছো মা?”

মা উত্তর দিলেন না। সে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে। বুঝল মায়ের শরীর কেঁপে উঠেছে৷ কিন্তু তিনি সিমরানকে জড়িয়ে ধরলেন না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠিক সে সময় বাবাকে দেখা গেল আসতে। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তিনি চেয়ে রইলেন সিমরানের দিকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ও এখানে এসে সশরীর দাঁড়িয়ে আছে৷

সিমরান ছুটে গিয়ে বাবাকেও জড়িয়ে ধরল। তবে এবার সে দেখল বাবাও তাকে ধরল না৷ মায়ের মতো জড়বৎ দাঁড়িয়ে রইল।

সিমরান প্রায় আধঘন্টা সেখানে রইল। এই পুরোটা সময়ে মা, বাবা কেউই তার সাথে তেমন কোনো কথা বললেন না। তাদের ব্যবহার এত শীতল যে সিমরানের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল বারবার। এরা যেন জীবন্ত থেকেও একেকটা লা/শ হয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি থেকে চলাফেরা সবই যেন মৃ/ত মানুষের মতো, অনুভূতিশূন্য দুটো শরীর মাত্র।

সিমরানের অনেক কথার কোনোটারই জবাব তারা দিলেন না। ও অনেকবার করে ক্ষমা চাইল, সেটাও যেন মা বাবা শুনতেই পেলেন না। শেষে ভয় পেয়ে সিমরান ফিরে এলো।

সে রাতে সিমরান বারবার ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। কিসের ভয় সে জানে না। তবে বড় ভয় করছে। ভয়ের একটা চাদর ঘিরে আছে তার চারদিকে। ইশতিয়াক পুরো রাত তাকে জড়িয়ে ধরে রইল শক্ত করে। তবুও সিমরানের মনে হলো সে ভীষণ একা৷ এত একা যে শীতল কোনো এক দানব তাকে হা করে গিলতে আসছে।

********

পরদিন সকালে রোদ ওঠার পর সিমরানের ভয় কমে এলো। যোগ হলো সুইজারল্যান্ড যাবার উত্তেজনা। জীবনের প্রথম দেশের বাইরে যাবে সে। মনের ভয়গুলো কেমন করে যেন দিন বাড়ার সাথে সাথে উবে যেতে থাকল। সেখানে জমা হতে লাগল আগমনী ভ্রমণের স্বপ্ন।

এবার আর ইশতিয়াকের শরীর খারাপ হলো না, দু’জনে মধুচন্দ্রিমার উদ্দেশ্যে ভালোভাবেই বেরিয়ে পড়ল।

সেখানে গিয়ে ঘোরাফেরা করে সিমরানের মনে হলো সে নিজের জীবনের সবচেয়ে চমৎকার সময়টা কাটিয়ে ফেলছে। সে এত আনন্দ করল, এত জায়গায় ঘুরল, এত ভালো হোটেলে থাকল আর এত চমৎকার সব ছবি তুলল যে জীবনটা সার্থক মনে হতে লাগল। এত সুখ! এত আনন্দ! এত আহ্লাদ! ইশতিয়াক যেন তাকে পুরো পৃথিবীটা কিনে দিয়েছে! তাকে আত্মীয় বন্ধুরা মিলে খুব বলেছিল, তুই ওকে বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করছিস৷ তাদেরকে সিমরানের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, তোমরা ভুল। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি ইশতিয়াককে বিয়ে করে।

অসাধারণ একটা সপ্তাহ কাটিয়ে দেশে ফিরল ইশতিয়াক আর সিমরান। ফিরেই দু’জন প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ল যার যার কাজে। সিমরানের মিড টার্ম শুরু হয়ে গেল। এতদিন পড়াশুনা হয়নি বলে চাপ পড়ল দ্বিগুণ। আর ইশতিয়াকের অফিসেও ডাবল কাজ করা শুরু করতে হলো।

এসবের মাঝেই একদিন সিমরান একটা ভয়ানক জিনিস আবিষ্কার করল। তার ইমেইল আইডিতে কী একটা ঝামেলা হচ্ছিল৷ কোনোভাবেই মেইল পাঠাতে পারছিল না কাউকে। এদিকে আজই এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে। সে আরেকটা মেইল আইডি না খুলে ইশতিয়াকের আইডি দিয়ে পাঠানোর চেষ্টা করল। যে ল্যাপটপে সে কাজ করে সেটা ইশতিয়াকের অনেক আগের ল্যাপটপ। এটাতে তার রেগুলার ব্যবহারের মেইল আইডি ছাড়াও আরেকটা আইডি লগইন করা ছিল। সেটা এখন ইশতিয়াক আর ব্যবহার করে না। সেই আইডি দিয়েই সে পাঠিয়ে দিল মেইল। স্যারকে সমস্যাটা সাথে লিখেও দিল।

এসাইনমেন্ট সাবমিট করে খানিকটা রিলাক্স লাগতে শুরু করল তার। সে ল্যাপটপে আনমনে ঘোরাফেরা করতে করতে হঠাৎ কী মনে করে সেই ইমেইল আইডির গুগল ফটোজে চলে গেল। সেখানে গিয়েই সে বিশাল একটা ধাক্কা খেল।

অজস্র মেয়েদের সাথে ইশতিয়াকের অন্তরঙ্গ ছবি। এখানে আলাদা আলাদাভাবে ক’টা মেয়ে আছে তা যেন সিমরান গুনেও শেষ করতে পারবে না৷ কারো সাথে হোটেলে, কারো সাথে রিসোর্টে, এমনকি ইশতিয়াকের অফিসের একজন বিবাহিত মহিলা কলিগ, যাকে বাবার কলিগ হিসেবে সিমরান চেনেও, তার সাথেও নোংরা অনেক ছবি। সিমরানের দমবন্ধ হয়ে এলো। এখানকার অনেক মেয়ে যে কলগার্ল সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

গা গুলিয়ে উঠল সিমরানের। বাথরুমে ঢুকে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল সে। তবুও যেন গা গোলানো কমছে না৷ একসময় বমিই করে ফেলল। বেসিন শক্ত করে ধরেও নিজেকে সামলাতে পারল না৷ পড়ে গেল নিচে।

তার জ্ঞান ফিরল কাজের মেয়ের ঝাঁকুনিতে। চোখ মেলেও তার মনে হতে লাগল পুরো পৃথিবী ঘুরছে। ছবিগুলো কিছুতেই চোখের সামনে থেকে সরছে না৷ নিজেকে পর্যন্ত নোংরা লাগছে। সেও তো বিয়ের আগেই লোকটার সাথে বিছানায় গিয়েছিল! ছি!

ভাবতে ভাবতে আবারও বমি করল সিমরান। কাজের মেয়েটা তাকে পরিষ্কার করে দিয়ে ধরে এনে শুইয়ে দিল ওর ঘরে। ইশতিয়াক নেই বলে মুশফিকের ডাক পড়ল।

সিমরান মুশফিককে কিছুই বলল না। বলল, উল্টোপাল্টা খেয়ে বোধহয় এমন হয়েছে। মুশফিক ডাক্তার ডাকতে চাইলে সিমরান নিষেধ করে দিল।

বিকেলের দিকে একটু ভালো লাগতে লাগল তার। উঠে জানালার পাশে বসে রইল। সেটা দেখে মুশফিক দু’জনের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আড্ডা দিতে এলো।

সিমরান আজ যেন কথাই বলতে পারছে না। মুশফিক অনেক কথা বলছে। কথায় কথায় মুশফিকের মায়ের কথা উঠলে সিমরান আচমকা জিজ্ঞেস করল, “তোমার মায়ের সাথে ইশতিয়াকের ডিভোর্স হয়েছিল কেন?”

মুশফিক প্রশ্নটা শুনে যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে বলতে চাইল না৷ এদিকে সিমরান নাছোড়বান্দা। সে মুশফিকের হাত ধরে অনুরোধ করল, “প্লিজ বলো! আমি তোমার বাবাকে বলব না যে তুমি কিছু বলেছ। এমন কী ঘটনা যে বলতে চাইছো না?”

এতদিন ধরে মুশফিক সিমরানের সান্নিধ্য চাইছিল। আজ সিমরান নিজেই তার হাত ধরে কিছু অনুরোধ করছে। সে ফেলতে পারল না৷ যত লজ্জারই হোক, ব্যাপারটা বলে ফেলল। অবশ্য বলে তার পৈশাচিক আনন্দও হলো। “বাবা মাকে চিট করেছিল, তাও একটা কাজের মেয়ের সাথে… বুঝতেই পারছো কী মিন করছি।”

সিমরান শক্ত হয়ে গেল। সব বুঝতে পারছে সে। পরকীয়ার জন্য লোকটার প্রথম বউ চলে গেছে৷ এরপর অবাধে নিজের লাগামছাড়া জীবন সে চালিয়েছে। এরপর হঠাৎ সিমরানের দেখা পেয়েছে। সিমরান অল্পবয়সী, সুন্দরী, ঝামেলা বিহীন বলে পারমানেন্টলি কাছে রেখে দিতে বিয়েও করে নিয়েছে৷ আর সিমরান ভাবত লোকটা তাকে ভালোবাসে!

সিমরান হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুশফিক যেন সুযোগ পেয়েই জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকল তাকে৷ তবে সিমরানের সহ্য হলো না ওকে৷ চিৎকার করে বের করে দিল ঘর থেকে।

সেদিন ইশতিয়াকের সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হলো সিমরানের। ওর ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিয়েছে বলে ইশতিয়াক ভয়ানক রেগে গেল। আর সিমরান আগে থেকেই ছবিগুলো দেখে ভেতরে ভেতরে আগ্নেয়গিরির মতো ফুসছিল। প্রবল ঝগড়া আর জিনিসপত্র ভাঙচুর হলো। সিমরান সে রাতে ওদের বেডরুম থেকে বের হয়ে গিয়ে গেস্টরুমে শুয়ে পড়ল।

সিমরানের ইচ্ছে ছিল বাপের বাড়িতে চলে যাবার। কিন্তু বাবা মায়ের সেদিনকার ব্যবহারের কথা মনে পড়লে তার যেন আরো বেশি সংকোচ হতে থাকে। ভেতরে ভেতরে ক্রমশ সে নিজের কাছে ছোটো হতে থাকে।

ইশতিয়াকের সাথে ঝগড়া এদিকে চলমান রইল। সিমরান ভেবেছিল ইশতিয়াক আসবে তার রাগ ভাঙাতে, কোনো ব্যাখ্যা দিতে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল তেমন কিছু হলো না। বরং ইশতিয়াক যেন তার ওপর উল্টো রাগ দেখাচ্ছে। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন তার কোনো দোষ নেই, সব দোষ সিমরানের।

এমনই এক রাতে ইশতিয়াক বাড়ি ফিরল না। কেন ফিরল না সেটাও জানতে পারল না সিমরান। জানার চেষ্টাও করল না। সে যথারীতি গেস্টরুমে শুয়ে পড়ল।

মাঝরাতে দরজায় টোকা পড়ল। সিমরান দরজা খুলে দেখল মুশফিক দাঁড়িয়ে আছে।

“কী হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল সিমরান।

“ঘুম আসছে না।” বলল মুশফিক।

“তো? সেজন্য আমার ঘুম ভাঙাবে?”

“তোমারই বা কোথায় ঘুম হচ্ছে? জানি তো বড্ড বিরহে আছো। কতদিন স্বামীর সাথে থাকো না। এসো আজ আমি তোমার স্বামীর জায়গাটা পূরণ করে দেই…”

মুশফিককে বিপজ্জনকভাবে কাছে আসতে দেখে চিৎকার করতে গেল সিমরান। কিন্তু মুশফিক আগেই ওর মুখ চেপে ধরল। একটা কাপড় বেঁধে দিল মুখে। অনায়েসেই সিমরানের হালকা পাতলা শরীরটা তুলে ফেলল সে৷ বিছানায় নিয়ে গিয়ে চেপে ধরে ওর দুটো হাত খাটের স্ট্যান্ডের সাথে আটকে ফেলল হ্যান্ডকাফ দিয়ে। তারপর ওর শরীর থেকে সব জামাকাপড় খুলে ফেলল।

সিমরানের ইচ্ছে হলো মরে যেতে। সে যত ছটফট করতে লাগল মুশফিক যেন ততই মজা পেতে থাকল৷ সে বহুক্ষণ কিছু না করে স্রেফ বসে বসে সিমরানের নগ্ন শরীরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর একসময় ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ভোরবেলা ওকে মুক্ত করে দিয়ে চলে গেল মুশফিক। বলে গেল, “যদি বাবা জানতে পারে, তাহলে আমার কিছু হবে না। উল্টো তোমাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হবে৷ এই বাড়ির এত আরাম আয়েশ আর লাক্সারি চাইলে মুখ বন্ধ করে যা হচ্ছে সেসব মেনে নিয়ে থাকতে হবে। কথাটা মনে রেখো। আর যদি এসব এনজয় করো, তাহলে দেখবে জীবনটা কত আনন্দের। ভেবে দেখো সুইটহার্ট।”

মুশফিক চলে যাবার পর জামাকাপড় পরে নিয়ে সিমরান হতবুদ্ধির মতো বসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। ওর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। কী করবে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। সে ফোনটা নিয়ে কাঁপা হাতে বাবার নাম্বারটা ডায়াল করল। বাবা ফোন ধরলেন। তিনি ‘হ্যালো’ বলতেই সিমরান চিৎকার করে কেঁদে উঠল, “বাবা, আমাকে বাঁচাও, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমাকে বাঁচাও বাবা। প্লিজ! প্লিজ আমাকে বাঁচাও।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

কাঁটামুকুট পর্ব-০৬

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব-৬

সিমরান রাগে দুঃখে নাইট ড্রেস বদলে সাধারণ একটা টিশার্ট পরে বিছানার অপর প্রান্তে শুয়ে পড়ল। মনে মনে ঠিক করল এই ড্রেস সে আর কোনোদিনই ইশতিয়াকের সামনে পরবে না। একটা সুন্দর রাত লোকটা তাকে উপহার দিতে পারল না? এটা কোনো বাসর রাত হলো? সিমরানের চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকল। রাত গভীর হতে হতে ওর চোখে একসময় ঘুম নেমে হলো।

সিমরানের ঘুম ভাঙল সকাল এগারোটায়। ভারী পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ ঢুকছে ঘরে। সে উঠে পর্দা সরিয়ে দিল। দোতলার জানালা থেকে লন দেখা যাচ্ছে। নানা রঙের চমৎকার সব গোলাপ ফুটেছে। সে ওঠার পরপরই কাজের মেয়ে এসে চা দিয়ে গেল। সিমরান ডিভানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবল এরকম একটা সকালের স্বপ্নই সে দেখত। আরামদায়ক আলস্য ছড়িয়ে আছে ওর শরীর জুড়ে। নিজেকে বড্ড সুখী সুখী লাগছে। গতরাতের দুঃখের কথা আর মনে রইল না তার।

ইশতিয়াক ভোরেই অফিসে চলে গেছে এটা সে শুনল কাজের মেয়েটার কাছ থেকেই। মেয়েটা জানতে চাইল, নাশতা রেডি আছে, এনে দেবে কি না। সিমরান বলল সে নিজেই নিচে গিয়ে খাবে।

সিমরান গোসল করে সুন্দর একটা আকাশী-নীল রঙের জামা পরল। হালকা সাজগোজ করে নিচে নামল৷ নাশতা করতে করতে খেয়াল করল বাড়িটা একেবারে নিরব৷ জানতে চাইল, মুশফিক বাড়িতে নেই?

মেয়েটা জানাল, মুশফিকও সকালেই ক্লাসে চলে গেছে।

সিমরান নাস্তা সেরে সোফায় গা ডুবিয়ে বসে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতে শুরু করল। গতকালের ছবিগুলো থেকে একটা ছবি সে আপলোডও করে দিল। তার আর ইশতিয়াকের হাতের ছবি। ইশতিয়াকের হাতের ওপরের পিঠটা যাতে দেখা না যায় এমনভাবেই ছবিটা তোলা হয়েছিল। সাথে লিখে দিল, “Finally found my soulmate”.

প্রচুর কমেন্ট আসতে লাগল। ওর ফলোয়ার্স ছেলেগুলোর স্যাড রিয়েক্টে ভরে গেল। ওর বান্ধবীরা অবাক হয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে শুরু করল। ভালোই উপভোগ করতে লাগল সিমরান।

এভাবেই শুয়ে বসে দিনটা কেটে গেল ওর। বিকেলের দিকে মুশফিক ফিরে এলেও সিমরানের সাথে কথা হলো না তার। সে নিজের ঘরে চলে গেল। সিমরানও নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে নিউজফিডে পড়ে রইল। ইশতিয়াক এলো সন্ধ্যার একটু পরে।

সে ঘরে ঢুকে শাহরুখ খানের মতো দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, “সিমরান! সুইটি! আই মিসড ইউ আ লট!”

সিমরানের রাগ কখন পড়ে গেছে সে নিজেও জানে না। দৌড়ে গিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইশতিয়াকের ওপর। যেন কতদিন পর দেখা হলো প্রেমিকযুগলের!

ইশতিয়াক সিমরানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল। এদিকে ইশতিয়াকের গা থেকে ঘামের গন্ধ আর সিগারেটের গন্ধ মিলে বিদঘুটে একটা গন্ধ আসছে। কোথায় সেই চমৎকার পারফিউমের ঘ্রাণ আর কোথায় মাউথ ফ্রেশনারের সুগন্ধ! সিমরানের গা গুলিয়ে এলো। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। এদিকে ইশতিয়াক যেন পণ করেছে আজ তাকে ছাড়বে না। সিমরান ছটফট করতে লাগল। তার মনে হলো ঘন্টাখানেক পর ইশতিয়াক তাকে ছাড়ল। যদিও সেটা মাত্র কয়েক মিনিট ছিল।

ইশতিয়াক জিজ্ঞেস করল, “সারাদিন কী করেছ সুইটি?”

“এইতো…” সিমরানের ইচ্ছে ছিল সে বলবে ‘তোমাকে মিস করেছি’। কিন্তু কথাটা ওর ভেতর থেকে আর এলো না। অবশ্য সত্যিটা হলো সে ইশতিয়াককে মোটেও মিস করেনি। আরামে আয়েশে দিনটা তার ভালোই কেটেছে৷

ইশতিয়াক ফ্রেশ হতে চলে গেলে সিমরান কাজের মেয়েটাকে চা দিয়ে যেতে বলল। দুজন চা খেতে খেতে গল্প করল। এর মাঝে সিমরানের গা গোলানো ভাবটা কেটে গেছে। ইশতিয়াকের হাতে হাত রেখে গল্প করতে ভালোই লাগছে।

রাতে খাওয়ার সময় মুশফিকের সাথে দেখা হলো। সে একটু যেন চিন্তিত৷ ইশতিয়াক কারন জিজ্ঞেস করায় বলল, “মুসকান তোমার বিয়ের খবর শুনে বেশ ধাক্কা খেয়েছে। অস্থির হয়ে গেছে একেবারে। মেনে নিতে পারছে না খবরটা৷”

“তোমার মাকে বলো সামলে নিতে।”

“তা তো নিচ্ছেই। তবুও ওর সেন্টিমেন্ট একটু বেশিই। একটু সময় লাগবে স্বাভাবিক হতে।”

“হুম। বেচারি এখনো আমার আর ওর মায়ের সেপারেশনটাই ভালোমতো মেনে নিতে পারেনি।”

সিমরান খেয়াল করল ইশতিয়াকের বেশ মন খারাপ হয়ে গেছে মেয়ের কথা ভেবে। হঠাৎ তার নিজের বাবার কথা মনে পড়ল। একটা কথা মনে পড়লে হুড়মুড়িয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে যায়৷ যেমন এখনই মনে পড়ল তার বাবার পছন্দের একটা খাবার হলো কাতল মাছের ঝোল। সে ঠিক এটা দিয়েই এখন ভাত খাচ্ছিল। ক্লাস টেন পর্যন্ত প্রতি রাতে বাবা তাকে খাইয়ে দিতেন নিজের হাতে। নিজের হাতে খেতে শিখতে তার বেশ কষ্ট হয়েছে। কিছুদিন আগেও নিজের খেতে ইচ্ছে না করলে বাবার সামনে গিয়ে বসে গেলেই হতো। বাবা যত্ন করে খাবার মুখে তুলে দিতেন। ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল সিমরানের।

মুশফিক খেয়াল করল ব্যাপারটা। সে জিজ্ঞেস করল, “আর ইউ ওকে সিমরান?”

“হুম।” হাসার চেষ্টা করল সে।

“বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”

“আরে নাহ।”

ইশতিয়াক হেসে বলল, “ওই জাহান্নাম থেকে বেঁচে ফিরেছে যে এটাই বেশি। আবার ওখানকার কথা মনে পড়বে কেন?”

সিমরানের কথাটা মোটেও পছন্দ হলো না৷ সে খাবার টেবিলে বসে আর কোনো কথাই বলল না।

খাওয়া শেষে একটু লনে একটু হাঁটাহাঁটি করে এলো সিমরান। ইশতিয়াক আগেই ঘরে চলে গেছে৷ তার তক্ষুনি যেতে ইচ্ছে করছিল না৷ তাছাড়া মা বাবার কথা হঠাৎ করেই একটু বেশিই মনে পড়ছে৷

রাত বাড়তে থাকলে সিমরান নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেল। যাবার সময় মুশফিকের ঘর পড়ল। দরজা খোলা ছিল। সে দেখল ঘরের দেয়ালে একটা গিটার ঝোলানো। বাহ! গিটার বাজাতে পারে নাকি মুশফিক? তার শেখার খুব ইচ্ছে ছিল। আবার এটাও ইচ্ছে ছিল যে কেউ গিটার বাজিয়ে তাকে প্রপোজ করুক।

নিজের ঘরে ঢুকে সিমরান বিষ্ময়ে ছোটোখাটো চিৎকার দিয়ে উঠল৷ বিছানায় লাল চাদর পাতা, ঘরের সবগুলো ফুলদানিতে লাল গোলাপ সাজানো, সাদা টাইলসের মেঝেতে দরজা থেকে শুরু করে বিছানা পর্যন্ত লাল গোলাপের পাপড়ি বিছানো। ইশতিয়াক দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে। তার গায়ে সাদা শার্ট৷ শার্টের বুকের কাছে লাল রঙের হৃদয় আঁকা। সে আবারও শাহরুক খানের স্টাইলে দুই হাত ছড়িয়ে দিল। “সিমরান! মাই বেইবী! প্লিজ কাম!”

সিমরানের সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা মনে করে একটু সংকোচ হলো। তবে এটাও মনে পড়ল যে ইশতিয়াক এসেই ভালোমতো গোসল করে পারফিউম মেখে নিয়েছিল। তাই দ্বিধা ঝেড়ে সে দৌড়ে গিয়ে সেদিন দ্বিতীয়বারের ঝাঁপিয়ে পড়ল ইশতিয়াকের ওপর। এবার আর খারাপ লাগল না।

ইশতিয়াক তাকে নতুন একটা ড্রেস ধরিয়ে দিল। লাল টকটকে সিল্কের জামা৷ শুধু একটা বোতাম দিয়ে জামাটা শরীরের সাথে আটকানো থাকবে। ড্রেসটা এত পছন্দ হলো সিমরানের যে সে তক্ষুনি ইশতিয়াককে আরো খানিকটা আদর করে দিল।

সেই রাতটা চমৎকার কাটল!

তবে ভোর হতেই ইশতিয়াকের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল সিমরানের। ইশতিয়াকের গায়ে শুধু তোয়ালে। শরীর আধভেজা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে সে অর্ধেক গোসল করে। সিমরান আতঙ্কিত হয়ে জানতে চাইল, “কী হয়েছে?”

ইশতিয়াক ততক্ষণে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের থুতনি চেপে ধরে কী যেন দেখছে৷ হঠাৎই সে সিমরানের দিকে ঘুরে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, “তুমি এটা কী করেছ সিমরান? আমি এখন অফিসে যাব কিভাবে?”

সিমরান দেখল অতিরিক্ত উত্তেজনার ফলে গতরাতে সে ইশতিয়াকের থুতনির কাছে একটা গাঢ় দাগ বানিয়ে দিয়েছে। সেটা স্পষ্ট বোঝাও যাচ্ছে।

ইশতিয়াক চিন্তিত মুখে বলল, “আজ দুটে মিটিং আছে৷ হায় হায়! এই বয়সে এই অবস্থা হলে লোকে কী বলবে? কন্ট্রোল করতে শিখতে হবে সিমরান!”

সিমরান রেগে গিয়ে বলল, “আর তুমি কী কী করেছ দেখাব?”

“তুমি তো আর অফিসে যাবে না।”

সকালবেলা দু’জনের একদফা ঝগড়া হয়ে গেল। ইশতিয়াক থুতনিতে একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে চলে গেল। আর সিমরান আবার শুয়ে বসে দিন পার করে দিল। এভাবে ভালোমন্দ মিলিয়ে সপ্তাহখানেক কেটে গেল। পুলিশি ঝামেলা ইশতিয়াক সামলে নিয়েছে। মা বাবাও সিমরানের সাথে যোগাযোগ করে ঝামেলা বাড়াবার চেষ্টা করেনি। বাবাকে নাকি অন্য ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করে দেয়া হয়েছে, তাই ইশতিয়াকের সাথে তার দেখাও হয় না এখন। দুজনের জন্যই সেটা ভালো হয়েছে। এর মাঝে ইশতিয়াকের ব্যস্ততাও কমে গেল। প্রোজেক্টটা সফলভাবে শেষ হলো। ইশতিয়াক তখনই ঠিক করে ফেলল কিছুদিন ছুটি নিয়ে হানিমুনে যাওয়া হবে। হানিমুনে যাবার সব প্ল্যানও তৈরি করা হয়ে গেল। ইশতিয়াকের ইচ্ছে ছিল সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাবার, কিন্তু বিয়েতে বেশ খরচ হয়ে যাওয়ায় বাজেট কমিয়ে আপাতত বালিতে যাওয়া হবে বলে ঠিক হলো৷

সিমরান এটা নিয়েও মহা এক্সাইটেড। সে ফেসবুকে পোস্ট করে সবাইকে জানিয়েও দিল আসন্ন হানিমুনের কথা।

যেদিন ওদের ফ্লাইট, সেদিন সকালে হঠাৎ করেই ইশতিয়াকের ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেল। এত বেড়ে গেল যে স্বয়ং ডাক্তারই চেক করে ঘাবড়ে গেলেন। ইশতিয়াককে কমপ্লিট বেড রেস্ট দিয়ে গেলেন তিনি। আর সিমরানকে বলে গেলেন ইশতিয়াককে বেশি উত্তেজিত না করতে। সে নাকি নতুন বউ পেয়ে বেশি উত্তেজনায় প্রেশার বাড়িয়ে ফেলেছে।

সিমরানের মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। হানিমুনে তো যাওয়া হলোই না, এদিকে ইশতিয়াকের থেকেও দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে বলে সিমরানের মন মেজাজ একেবারে তিরিক্ষি হয়ে রইল।

সিমরানের অনেক ক্লাস মিস হয়ে গেছে। তার ইচ্ছে ছিল এই সেমিস্টার ড্রপ করে পরের সেমিস্টার থেকে কন্টিনিউ করবে। কিন্তু ইশতিয়াক বলল সে ম্যানেজ করে দিতে পারবে। শুধু শুধু গ্যাপ দেবার কোনো দরকার নেই। এতদিন ক্লাস এটেন্ড না করেও ইশতিয়াকের রেফারেন্সে তাকে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে দেয়া হলো।

ফাইনাল এগিয়ে আসছে, এদিকে ক্লাস না করায় পড়াশুনা কিছুই মাথায় ঢুকছে না সিমরানের। তার হঠাৎ মনে পড়ল মুশফিক তারই সাবজেক্টে পড়ে। তার কাছে গেলে কেমন হয়?

সিমরান এক বিকেলে মুশফিককে ধরে বসল, তাকে পড়া বুঝিয়ে দিতে হবে।

মুশফিক অরাজি হলো না। সুন্দরী সিমরানের সাথে সময় কাটাবার সুযোগ সে পারতপক্ষে ছাড়ে না৷ যতই সে বাবার বউ হোক না কেন, একটা আগুন সুন্দরী মেয়ে সারাদিন চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ালে নজর কার না যায়? তার ওপর মেয়েটা স্লিভলেস, শর্টস পরে এলোমেলোভাবে একেক সময় সোফায় পড়ে থাকে। মুশফিকের তখন নিজেকে সামলানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। সেই সিমরানের সাথে পড়াশুনার বদৌলতে সময় কাটাবার সুযোগ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না৷ সিমরান আসার পর থেকে তার নিজের প্রেমিকাকে অসহ্য লাগতে শুরু করেছে৷ প্রতিটা ব্যাপারে সিমরানের সাথে তুলনা করে ওকে নিতান্তই সাধারণ মনে হচ্ছে। ওর সাথে সময় কাটাতেও এখন আর ভালো লাগছে না৷ মুশফিক বলে দিল পড়লে আজ থেকেই পড়তে হবে, নয়তো বেশি দেরি হয়ে গেলে আর পড়িয়েও কাজ হবে না।

সিমরান সেদিন থেকেই মুশফিকের কাছে পড়তে শুরু করল। মুশফিকের ঘরেই পড়াশুনা হয়। পড়াশোনা প্রথম প্রথম কয়েকদিন ভালোই হলো, তারপর একটু একটু করে তাতে ফাঁকিবাজি ঢুকে গেল। ওরা গল্প করে, খুনসুটি করে, মুশফিক কখনো গিটার বাজিয়ে শোনায়, কখনো সিমরান গান গেয়ে শোনায়, সময়টা দু’জনেরই ভালো কাটে। সিমরানেরও আস্তে আস্তে মুশফিককে ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করে। ইশতিয়াকের সাথে তুলনা করতে শুরু করে ওর। ও হচ্ছে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একটা ছেলে। আর ইশতিয়াক তো এখন একটু কাছে এলেও বাকি রাতটা ছটফট করে কাটায়৷ সিমরান তাই ভয়ে ওর থেকে দূরে দূরেই থাকে।

দেখতে দেখতে সিমরানের পরীক্ষাগুলো হয়ে গেল। ভালো না হলেও ফেল করার মতো পরীক্ষাও হলো না। পাশ করার মতো পরীক্ষা দিয়ে খুশিতে সিমরান মুশফিককে ট্রিট দিতে চাইল। মুশফিক মজা করে বলল, “যেতে পারি, যদি তুমি সুন্দর করে সেজে আসো। সবাই যেন ভাবে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড। ডেট করতে না পারলাম, সবাইকে দেখাতে পারব এত সুন্দর একটা মেয়ে নিয়ে ঘুরছি।”

সিমরানও হাসতে হাসতে উত্তর দিল, “ওকে।”

সেদিন ওরা কাপলের মতোই ম্যাচিং ড্রেস পরে খেতে গেল। খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল। মুশফিক সিমরানকে ঝিলমিল বেলুন কিনে দিল। সিমরানের কী যে ভালো লাগল ঘোরাঘুরি করতে!

সেই রাতে ওর ভীষণ ইচ্ছে করছিল ইশতিয়াককে কাছে পেতে। সেটা ইশতিয়াককে বলতেই সে করুণ চোখে চেয়ে বলল, “স্যরি সুইটি! আজ শরীরটা একটু বেশিই খারাপ লাগছে।”

ইশতিয়াক ঘুমিয়ে পড়লেও সিমরানের আর ঘুম এলো না। সে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে পড়ল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল মুশফিক লনে হাঁটাহাঁটি করছে। হাতে কফি। মুশফিকেরও পরীক্ষা চলছে। আজ তাকে সময় দিতে গিয়ে পড়তে পারেনি। এজন্য হয়তো রাত জেগে আছে। সিমরানের ভীষণ ইচ্ছে হলো মুশফিকের কাছে গিয়ে বলতে, তাকেও যেন এক কাপ কফি করে দেয়।

********

মাস দেড়েক ভুগে ইশতিয়াকের শরীর আস্তে আস্তে ভালো হয়ে এলো। সে সিমরানকে কথা দিয়ে রেখেছে পুরোপুরি সুস্থ হলেই সে তাকে নিয়ে হানিমুনে যাবে। এবার বালি না, সুইজারল্যান্ডেই যাবে, যত খরচ হবে হোক। পৈতৃক সম্পত্তিও তো কম নেই ইশতিয়াকের।

হানিমুনে যাবার কথা শুনেই সিমরান আবার যেন আনন্দে বাক-বাকুম হয়ে গেছে।

এক ঝড়বৃষ্টিময় বিকেলে কিছু করার নেই বলে সে তার ওয়্যারড্রোব থেকে জামাকাপড় বের করে একটা একটা করে ট্রায়াল দিতে শুরু করল। এখনই সিলেক্ট করে ফেলবে কোনটা নেবে আর কোনটা নেবে না।

জামাকাপড়গুলোর মাঝে বিয়ের রাতে পরা সেই গোলাপি নাইট ড্রেসটাও পেয়ে গেল। ভাবল একবার ট্রায়াল দিয়ে ফেললে ক্ষতি কী? ইশতিয়াকের সামনে পরবে না ঠিক করেছে, নিজের সামনে তো পরতেই পারে!

ড্রেসটা পরল সিমরান। বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখল সে। তার স্বাস্থ্য আরো ভালো হয়েছে। রঙ খোলতাই হয়েছে আগের তুলনায়। এত সুন্দর লাগছে তাকে! নিজেই যেন চোখ ফেরাতে পারছে না। জামার সাথে ম্যাচিং লিপস্টিক আর ব্লাশ দিয়ে আরো কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে।

হঠাৎ দরজায় ধাক্কার শব্দ হলো। মুশফিকের গলা পাওয়া গেল, “সিমরান! বিজি নাকি? কফি এনেছি তোমার জন্য। দরজা খুললে একসাথে খেতে পারি।”

“খু্লছি!” বলে তাড়াতাড়ি জামাটা বদলানোর জন্য ফিতা খুঁজতে লাগল সে। তারপর চট করেই মনে হলো, কী দরকার জামা বদলাবার? এভাবে তো তাকে খারাপ লাগছে না। মুশফিকও দেখুক সে ঠিক কতটা সুন্দর।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

কাঁটামুকুট পর্ব-০৫

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব-৫

সারাদিন বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি, তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিমরানের গাড়িতে চলে পালিয়ে যাওয়া অনেকেরই চোখে পড়ায় ঘটনা জানাজানি হতে দেরি হলো না। গলির মোড়ের চায়ের দোকানদার আর বাউণ্ডুলে কিছু ছেলেপুলের বদৌলতে সবাই এটাও জেনে গেল যে সিমরান যার সাথে পালিয়েছে সে তার বাবার বয়সী আধবুড়ো লোক। সে নাকি ইদানীং প্রায়ই সিমরানকে বাড়ির সামনে গাড়িতে করে ছেড়ে দিয়ে যেত। অনেকেই এসব শোনার পর ওদের বাড়িতে এলো, কিন্তু সিমরানের মা বাবা কেউই দরজা খুলল না। তালা দিয়ে ভেতরে বসে রইল। দু’জনের মনের অবস্থা অকল্পনীয়। এত আদরে বড় করা একমাত্র মেয়ে তাদের জীবনে এভাবে কালিমা লেপন করে দিয়ে যাবে তা কি তারা কোনোদিন ভেবেছিলেন? সেই রাতে দুজন না বিছানায় পিঠ ঠেকাতে পারলেন, না তাদের দুচোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও এক হলো।

পরদিন সকালে সারোয়ার সাহেব তৈরি হয়ে অফিসে গেলেন। গিয়েই প্রথমে দুটো লেটার টাইপ করলেন। একটা এইচআর ডিপার্টমেন্টের কাছে ইশতিয়াকের নামে তার ফ্যামিলিতে সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য অভিযোগপত্র আর একটা রেজিগনেশন লেটার৷ যদি কোম্পানি ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় তাহলে তিনি চাকরি করবেন আর যদি না নেয় তাহলে রিজাইন করে চলে যাবেন। ওই লোকটার জুনিয়র হয়ে কাজ করার প্রশ্নই আসে না।

*******

রাতেই ইশতিয়াক বলে রেখেছিল আগামীকাল তারা বিয়ে করবে। সিমরান খুশি হয়ে সম্মতি জানিয়েছে। বিয়ের উদ্দেশ্যে শপিং করতে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল তারা৷ সিমরান জীবনের প্রথমবার যেন মন ভরে শপিং করল। ইশতিয়াক আগেই বলে দিয়েছে যা পছন্দ হবে সব নিয়ে নিতে। যেহেতু সে বাড়ি থেকে কিছু আনেনি, তাই বিয়ের জামাকাপড় ছাড়াও সবসময়ের জন্য প্রয়োজনীয় জামা, জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি যেন এখনই কিনে নেয়। সিমরান নিলও। যেসব জামাকাপড় দেখে আগে দাম জিজ্ঞেস করে চলে যেতে হলো সেসব তুলে নিল নির্দ্বিধায়, সেই সব মেকআপের সামগ্রী কিনল যেগুলো এতদিন তার উইলিস্ট ভারী করে বসে থাকত। যেসব জুতোর দোকানে জুতোর ট্রায়াল দিতেও সংকোচ হতো সেখান থেকে কয়েক জোড়া জুতো নিয়ে নিল। আর বিয়ের জন্য পছন্দ করল সোনালী সুতোর কাজ করা চমৎকার একটা গাঢ় বেগুনী ল্যাহেঙ্গা৷ ইশিতয়াকের জন্য বিয়ের পোশাকও সে পছন্দ করে কিনল৷ সব কেনাকাটা শেষে ফেরার সময় সিমরানের এত ভালো লাগতে লাগল যা কোনোদিন লাগেনি। আজ যেন তার সব না পাওয়া, সব অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে গেছে।

যদিও বিয়েটা গ্র্যান্ড স্টাইলে হবে এমন আশাও সিমরানের ছিল, কিন্তু সেসব হলো না৷ কয়েকজন সাক্ষী সমেত সাদামাটা বিয়েই হলো। তবে সিমরান সাজল প্রাণ ভরে। বাড়িতে মেকআপ আর্টিস্ট এসে সাজিয়ে দিয়ে গেল। বাড়িটা সুন্দর করে ডেকোরেটও করা হয়ে গেছে দুপুরের মধ্যে। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার এসেছে। বিয়ের পরপর শুরু হলো ফটোশ্যুট৷ সিমরান মন ভরে ছবি তুলল। একা একা তুলল অজস্র ছবি, কাপল ছবিও তোলা হলো অনেক।

সন্ধ্যার পরপর ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসল সিমরান। তাকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বেগুনী রঙটা তার ফর্সা শরীরে ফুটে আছে একেবারে। সোফায় আধশোয়া হয়ে সে মোবাইল স্ক্রল করতে লাগল। আগের সিম সে ফেলে দিয়েছে। গতরাতে এত পরিমানে কল আসছিল যে অসহ্য হয়ে পড়েছিল সে। নতুন সিম কিনে দিয়েছে ইশতিয়াক। আর ফেসবুক থেকে ফ্যামিলির সবাইকে ধরে ধরে ব্লক করে দিয়েছে গতরাতেই। তাই এখন আর ঝামেলা নেই, রিলাক্সে ফেসবুকের পাতায় ঘোরাফেরা করা যাচ্ছে। কিছু ছবি তার মোবাইলেও তোলা হয়েছে। সে ঠিক করতে পারছে না কোন ছবি প্রোফাইল ফটোতে দেবে, মোবাইলের ছবিই আগে আপলোড করবে নাকি ফটোগ্রাফারের তোলা ছবি হাতে পেলে তারপর দেবে? তার যে তর সইছে না৷

হঠাৎ পাশ থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ কানে আসতেই চমকে তাকাল সিমরান। মুশফিক এসে বসেছে পাশে। তার হাতে দুটো কফির কাপ। একটা সিমরানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করলল, “কফি খাবে?”

সিমরান কাপটা তুলে নিল। মুশফিক বলল, “তুমি অফিশিয়ালি আমার বাবার বউ হয়ে গেলেও বয়সে কিন্তু আমার থেকে ছোটো। তোমাকে আমি তুমি করেই বলব। আশা করি মা-মামনী বলে ডাকার এক্সপেক্ট করবে না।”

সিমরান হেসে বলল, “পাগল নাকি? তুমি আমার নাম ধরেই ডেকো।”

“ঠিক আছে। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

“ধন্যবাদ। কফিটা ভালো হয়েছে। তুমি বানিয়েছ?”

“হ্যাঁ। আমি নিজের হাতের কফি ছাড়া খেতে পারি না।”

“এরপর থেকে আমাকেও দিও।”

“অবশ্যই।”

ইশতিয়াক জরুরি কাজ আছে বলে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। এই ফাঁকে মুশফিকের সাথে ভালোই গল্প হলো সিমরানের। ওরা একই সাবজেক্টে পড়ে বলে কথাবার্তার টপিকেরও অভাব হলো না।

********

সারোয়ার সাহেব সারাদিন এলোমেলো চক্কর কাটলেন। অফিস থেকে থানা, থানা থেকে অফিস। একবার ভাবলেন ইশতিয়াকের বাড়ি যাবেন কি না, কিন্তু সেই রুচি তার হলো না। মনে হলো গিয়েও লাভ নেই, মেয়েকে তিনি কুমিরের পেট থেকে বের করে আনতে পারবেন না।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন বাড়ি লোকে লোকারন্য। আত্মীয়স্বজন কেমন করে যেন খবর পেয়ে গেছে। সব ভিড় করে এসেছে যেন সার্কাস দেখতে। তার স্ত্রী কী করবেন কিছুই বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে বসে রয়েছেন সবার মাঝে। কোনো কথাবার্তা বলছেন না।

সারোয়ার সাহেবও মুখে তালা লাগিয়েই ভেতরে ঢুকলেন। বলার তো কিছু নেই।

***********

বাসর রাত নিয়ে সিমরানের জল্পনা কল্পনার অন্ত ছিল না। যদিও তাদের হানিমুন সেই রিসোর্টেই হয়ে গেছে, তবুও তার শখ ছিল বহু কিছু৷ বরং রিসোর্টে কাটানো সময়টুকুই যেন তার আকাঙ্খা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বিয়ের সাজ একটুও নষ্ট হতে দেয়নি। সারাদিন ব্যস্ততায় চলে গেছে, ইশতিয়াক তাকে ভালো করে দেখেওনি৷ একমাত্র স্বামী, একমাত্র প্রেমিকের কাছে কমপ্লিমেন্ট না পেয়ে সাজ নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।

ইশতিয়াকের ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। সে ঘরে ঢুকল বিরক্ত মুখে। ঢুকতেই সিমরান অভিযোগ করে বসল, “আজকের দিনেও এত্ত কাজ!”

ইশতিয়াক যেন আরো একটু বিরক্ত হলো। বলল, “তোমার বাবা যে পুলিশে কেস করে বসবে তাই তো ভাবতে পারিনি। এত বিরক্তিকর একটা লোক! এতক্ষণ সেই ঝামেলা সামলে এলাম৷ পুলিশও আছে, সেই টাকাই খাবে, তবুও ঘোরাবে, নখরা করবে। ভাব এমন যেন নিজেরা একেকটা সাধু পুরুষ!”

সিমরান ভয়ার্ত মুখে বলল, “তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো?”

“আরে নাহ৷ ম্যানেজ করে এসেছি৷ তবে তোমার বাবা বেশি বাড়াবাড়ি করলে আদালত পর্যন্ত যেতে হতে পারে। তাও ঝামেলা হবে না। তুমি সাক্ষ্য দেবে যে ইচ্ছে করেই আমার সাথে এসেছ। আর তাছাড়া তুমি প্রাপ্তবয়স্কা। সার্টিফিকেট দেখিয়ে বয়স প্রমাণ করতে পারলে এমনিতেই ঝামেলা মিটে যাবে।”

“কিন্তু সার্টিফিকেট তো আনিনি।”

ইশতিয়াক একটু ভেবে বললেন, “ওটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। ভেবো না৷ এখন মাথাটা ধরে আছে একেবারে। আমি গোসলটা সেরে আসি।”

ইশতিয়াক গোসল করল, খাওয়াদাওয়া করল, তারপর মাথাব্যথা আর ব্লাড প্রেশারের ঔষধ খেয়ে শুতে এলো। সিমরান তখনো বিয়ের পোশাকে বসে আছে। তাকে প্রথমবার খেয়াল করে ইশতিয়াক অবাক হয়ে বলল, “তুমি এখনো এই পোশাকে কেন?”

সিমরানের কান্না পেয়ে গেল। এতদিন এত রোমান্টিকতা দেখিয়ে সব এখন হাওয়া? ওর চেহারা দেখে ইশতিয়াক কিছুটা আঁচ করতে পারল। সে ওর মুখটা নিজের দু’হাতে তুলে বলল, “তোমাকে চাঁদের মতো লাগছে সিমরান। এত সুন্দর বউ আমার হবে আমি কোনোদিন কল্পনাই করিনি।”

সিমরান ভালোলাগায় কেঁদে ফেলল। ইশতিয়াক যত্ন করে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল, “আরে কাঁদে কেন পাগল মেয়ে! যাও এই ভারী শাড়ি খুলে একটু আরামদায়ক জামাকাপড় পরে এসো। আজকের রাতটা অনেক স্পেশাল হতে যাচ্ছে! এসব শাড়ি গয়নার ঝামেলায় সেটা নষ্ট করতে চাই না।”

সিমরান খুশি মনে উঠে পড়ল। যত দ্রুত পারে মেকআপ তুলে জামা বদলে আরামদায়ক অথচ সুন্দর একটা নাইট ড্রেস পরে নিল৷ এটা ইশতিয়াক নিজে পছন্দ করে কিনেছে। এত সুন্দর লাগছে তাকে জামাটা পরে! ভেতরে চেরি পিংক অন্তর্বাসের ওপর ফিনফিনে একটা গাউন। গাউনটা খোলার জন্য আবার ফিতে খুলতে হবে ছয়টা! ভাবতেই দুষ্টুমি খেলা করে গেল মাথায়।

সিমরান যখন ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন সে অবাক হয়ে দেখল ইশতিয়াক ঘুমিয়ে পড়েছে। নাক ডাকার শব্দ এতদূর পর্যন্ত আসছে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

কাঁটামুকুট পর্ব-০৪

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব-৪

সিমরানের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে তাকে ঘরে আটকে রেখে বেরিয়ে গেলেন মা বাবা দু’জনেই। সিমরান ওদিকে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে। কিন্তু মা বাবার কানে যেন কিছুই ঢুকছে না। তারা ভেবে পাচ্ছেন না যে ভয়ানক গর্তে মেয়ে পড়ে গেছে তা থেকে কেমন করে তাকে টেনে তুলবেন। এত বড় বিপদ তাদের জীবনে ইতিপূর্বে কখনো আসেনি। এ ধরনের বিপদ আসতে পারে বলে কল্পনাও তারা কোনোদিন করেননি। মেয়েটা যদি কোনো অবিবাহিত ছেলে ছোকরার সাথে পালাত, তাহলে ধরে বিয়ে দিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু এবার যে অঘটন ঘটেছে তার কোনো সমাধান কি আদৌ হতে পারে? এসব জানাজানি হলে সমাজে মুখ দেখানো অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে তো কোনো আশাই নেই। চারদিকে যেন অন্ধকার ছেয়ে আসছে।

বাবার সবচেয়ে বেশি রাগ লাগছে ইশতিয়াকের ওপর। তার মেয়েটা তো ছোটো। ওই বুড়ো ভাম কেমন করে এইটুকু মেয়ের ওপর নজর দিতে পারল! এত কুটিল দুশ্চরিত্র লোক কেমন করে হতে পারে! একটাবার ভাবল না মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা! বোকা মেয়েটার মাথা খেয়েছে দামী দামী উপহার দিয়ে।

বাবা কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। রওনা দিলেন অফিসের উদ্দেশ্যে।

আজ অফিসে কাজ করার কোনো ইচ্ছে বা ক্ষমতা তার নেই। তিনি এসেছেন ইশতিয়াক আহমেদের সাথে কথা বলতে। ইশতিয়াকের কেবিনে তিনি যখন ঢুকলেন তখন ইশতিয়াক মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল দেখছে। অনুমতি না নিয়ে কেউ ঢুকে পড়েছে দেখে ভুরু কুঁচকে চাইতেই সিমরানের বাবার রুদ্রমূর্তি দেখে খানিকটা ভড়কে গেল ইশতিয়াক৷ তবুও গলাটা স্বাভাবিক রেখে বলল, “কোনো সমস্যা সারওয়ার সাহেব?”

সিমরানের বাবা দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করে বললেন, “আমার মেয়ের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?”

ইশতিয়াক অবাক হবার ভান করে বলল, “আপনার মেয়ে…ও সিমরান! সুইট একটা মেয়ে। কী হয়েছে ওর?”

“গতরাতে… ” বলতে বলতে থেমে যেতে হলো সারোয়ার সাহেবকে। তাদের দু’জনেরই সিনিয়র স্যার এসেছেন প্রোজেক্টের বিষয়ে কথাবার্তা বলতে। সারোয়ার সাহেবকে দেখে তিনি খানিক অবাক হয়ে বললেন, “সারোয়ার সাহেব, আপনি এভাবে ক্যাজুয়াল ড্রেসে অফিসে চলে এসেছেন যে?”

সারোয়ার সাহেব খেয়াল করলেন তিনি একটা ফতুয়া আর পায়জামা পরেই চলে এসেছেন। কিন্তু এই স্যারকে তো আর কারনটা বলা যাবে না। তিনি বললেন, “স্যার, একটু তাড়াহুড়ো করে ভুলে এসব পরেই চলে এসেছি।”

“আপনাকে ঠিক সুস্থ দেখাচ্ছে না।”

ইশতিয়াক পেছন থেকে বলল, “আমারো তাই মনে হয়৷ ইদানীং উনি একটু বেশিই খাটাখাটুনি করছেন।”

স্যার বললেন, “আজকের দিনটা বরং আপনি ছুটি নিয়ে রেস্ট করুন। কাজ তো অনেকদূর এগিয়েই গেছে।”

“জি স্যার।” বলে বেরিয়ে গেলেন বাবা। তিনি তারপরেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন ইশতিয়াকের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু সুযোগ পেলেন না। ইশতিয়াকের কেবিনে সবসময়ই কেউ না কেউ আসছে, যাচ্ছে কিংবা সে ফোনে ব্যস্ত থাকছে।

অগত্যা সিমরানের বাবা বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরে দেখলেন আরেক কান্ড। সিমরানের মা অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে বসে আছেন। জানা গেল সিমরান নাকি হুমকি দিচ্ছিল দরজা খোলা না হলে সে হারপিক গ/লায় ঢা/লবে। তারপর ম/রলে ম/রবে, বাঁচলে ছাদ থেকে ঝাঁ/প দেবে। এসব হুমকিতে ভয় পেয়ে মা দরজা খুলে দিয়েছিলেন৷ সিমরান বেরিয়ে এসে বিশাল তান্ডব সৃষ্টি করে নিজের মোবাইল খুঁজে বের করেছে। মাকে যা নয় তাই বলেছে। এখন নিজের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে বসে আছে।

সব শুনে বাবা দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন সোফায়। তার এখন কী করণীয় কিছুই মাথায় ঢুকছে না৷

*******

সিমরান মোবাইল হাতে পেয়ে ইশতিয়াককে অনেকবার কল করেছে। ইশতিয়াক ধরেনি। তার ভয় হচ্ছে বাবা অফিসে গিয়ে ইশতিয়াককে কিছু বলেনি তো? নাহলে তো এরকম করার কথা না।

সন্ধ্যার দিকে মা আর বাবা দু’জনেই সিমরানের ঘরে এলেন। রাগ করে নয়, উত্তেজিত হয়ে নয়, বরং খুব সুন্দর করে বোঝালেন, সে যা করেছে বা করছে সেসব কত ভয়ঙ্কর খেলা। এর ফলাফল কতটা মারাত্মক হতে পারে।

কিন্তু সিমরানের মাথায় ঢুকল না এসব কোনো কথা। বাবা মা যতই বোঝান, সিমরান ততই যেন তার কথায় অনড় হয়ে যায়, ভাঙা রেকর্ডের মতো তার গলা থেকে একটাই গান বেজে যাচ্ছে, “আমি ইশতিয়াককে ভালোবাসি, ইশতিয়াক আমাকে ভালোবাসে। সমাজের কথা ভেবে আমরা দু’জন দুজনকে ছাড়তে পারব না। আমাদের বিয়ে দিয়ে দাও, দেখবে আমরা কত সুখে থাকি।”

অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন বোঝাতে পারলেন না তখন বাবার রাগটা আবারও জেঁকে বসল তার ওপর৷ সিমরান তখন বলে চলেছিল, “ইশতিয়াককে ছাড়া অন্য কাউকে আমি আমার লাইফে কল্পনাই করতে পারব না। তোমরাও আমাকে কোনোদিন ওর মতো করে ভালোবাসোনি।”

বাবা তখন উঠে এসে পরপর কয়েকটা চড় মারলেন ওর গালে। আরো হয়তো মারতেন মা যদি না আটকাতেন তাকে। মারা শেষে বাবা নিজেই কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন মেঝেতে। সিমরানের ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে গেছে। সে হাত দিয়ে গাল আর ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে।

মা বাবাকে টেনে নিয়ে গেলেন বাইরে। তারা বেরিয়ে যেতেই সিমরান দরজা আটকে দিল। তখনই ভিডিও কল করল ইশতিয়াককে। এতক্ষণে ইশতিয়াক কল রিসিভ করল। তখন সে অফিস সেরে বাড়ি ফিরছে। গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। হাসিমুখে কলটা রিসিভ করলেও সিমরানকে দেখে তার হাসি মুছে গেল। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সুইটি?”

সিমরানের অভিমানে ঠোঁট উল্টে এলো। ফোঁপাতে ফোপাঁতে সে আজকের ঘটনা বলল। ইশতিয়াকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে বলল, “তুমি আমার সাথে চলে আসবে সিমরান?”

“হ্যাঁ।”

“এখন তোমাকে নিতে গেলে আসবে?”

“হ্যাঁ।”

ইশতিয়াক ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি ঘোরাতে।

এবার সে সিমরানকে বলল, “তোমাকে নিয়ে আসার কোনো লিগ্যাল অধিকার আমার নেই। তাই সবার সামনে নিয়ে আসতে পারব না। তুমি কি পালিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে? আমি তোমাদের বাড়ির সামনেই থাকব।”

“পারব।”

“ওকে। রেডি হয়ে থাকো। আমি এসে তোমাকে মেসেজ করছি।”

সিমরান এক ফাঁকে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরেটা দেখে এলো। মা আর বাবা নিজেদের ঘরে বসে আছেন। ড্রইং রুমের লাইট বন্ধ। ডাইনিংয়ের আলোটা জ্বলছে। সে পানি খাবার বাহানায় ডাইনিংয়ে গিয়ে মূল দরজার ছিটকিনি খুলে রেখে এলো, যাতে সময়মতো চট করে বেরিয়ে যেতে পারে।

ইশতিয়াক এসে যখন মেসেজ করল, তখন বের হতে গিয়ে সিমরান দেখল মা ডাইনিংয়ে বসে আছেন৷ পানি খাচ্ছেন ধীরে ধীরে। সিমরানের ধৈর্যচ্যুতি হতে লাগল। একটা মানুষের এক গ্লাস পানি খেতে কতক্ষণ লাগে?

পানি খাওয়া শেষেও মায়ের কাজ শেষ হলো না। রান্নাঘরে ঢুকে খাবারের বাটি নিয়ে এসে টেবিলে সাজাতে শুরু করলেন। হয়তো সারাদিন কারো কিছু খাওয়া হয়নি বলে খাবার রেডি করছেন৷ সিমরান তক্কে তক্কে রইল। মা যেই না একবার রান্নাঘরে ঢুকলেন, তিনি বের হবার আগেই সে দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা খোলা আর আটকাবার শব্দে মা বেরিয়ে এলেন কী হয়েছে দেখতে। সিমরান প্রাণপণে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। নিচে নেমে এক দৌড়ে সে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। তাকে দেখে দরজা খুলে দিল ইশতিয়াক। সে ভেতরে ঢুকে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ি সামনের গলির মোড়ে হারিয়ে যাবার আগে কাচে প্রতিফলিত হতে দেখা গেল সিমরানের মা বাবার ছবি। তারা এসে দাঁড়িয়েছেন বাড়ির সামনে। এত দূর থেকে তাদের মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না।

******

সিমরান যখন ইশতিয়াকদের আলিশান বাড়িতে পৌঁছুল তখন অনেক রাত। সিমরানের পরনে ঘরে পরার টিশার্ট আর পায়জামা। সে কোনোদিন ভাবেনি এই বেশে ইশতিয়াকের বাড়িতে আসতে হবে তার। ইশতিয়াক তাকে যত্ন করেই বাড়িতে স্বাগত জানাল। ইশতিয়াকের মেয়ে চলে গেছে দু’দিন আগেই। বাড়িতে শুধু আছে ছেলে আর দু’জন কাজের লোক- একটা মেয়ে আর একজন প্রৌঢ়।

ইশতিয়াক কাজের লোকদুটোর সাথে সিমরানের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের ভালোভাবে বলে দিল ওর পরিচর্যা করতে। সিমরানের জামাকাপড় ছিল না। আপাতত ইশতিয়াকের মেয়ের ওয়্যারড্রোব থেকে কিছু জামাকাপড় বের করে দিতে বলল কাজের মেয়েটাকে। এখনকার মতো গেস্টরুমে থাকার বন্দোবস্ত করতে বলল সিমরানের জন্য। আর রাতের জন্য ভালো কিছু রান্না করতে বলে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

সিমরান গেস্টরুমের বাথরুমে আরাম করে গরম পানি দিয়ে গোসল করল। ইশতিয়াকের মেয়ের জামাকাপড় পরতে একটু কেমন যেন লাগছিল, তবে জামাকাপড়গুলো ভালো করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখা আর বেশ আরামদায়ক কাপড় বলে পরে ভালোই লাগল।

রাতে খেতে বসে প্রথম ইশতিয়াকের ছেলে মুশফিকের সাথে পরিচয় হলো সিমরানের। মুশফিক দারুণ স্মার্ট। বাবা বিয়ে করার জন্য একটা মেয়েকে তুলে এনেছে, ঘটনাটা তার যত আশ্চর্য আর বিরক্তিকর লেগেছে, তারচেয়েও বেশি হাস্যকর লেগেছে। সে ভেবেছিল মাঝবয়েসী কোনো মহিলা হবে হয়তো। কিন্তু খাবার টেবিলে সিমরানকে দেখে একটা ধাক্কা খেয়েছে সে। মেয়েটা রীতিমতো মাথা ধরানো সুন্দরী। সে নিজে আজ পর্যন্ত এত সুন্দর মেয়েকে ডেট করতে পারল না, আর বাবা পটিয়ে একেবারে বাড়ি নিয়ে এসেছে! খেতে খেতে আঁড়চোখে সে সিমরানকে দেখেই যেতে লাগল।

এদিকে সিমরানের বাবা গভীর রাতে থানা থেকে বাড়ি ফিরলেন। ডায়েরি করে এসেছেন ইশতিয়াকের নামে। পুলিশ আশ্বাস দিয়েছে তারা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু এই দেশে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে পুলিশ এমন কী বা করতে পারে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

কাঁটামুকুট পর্ব-০৩

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব-৩

পরদিন রিসোর্টে যাবার জন্য ভোরবেলাতেই তৈরি হয়ে বসে রইল সিমরান। সে সুন্দর একটা সালোয়ার কামিজ পরে নিয়েছে। বাড়িতে বলেছে বান্ধবীর জন্মদিন উপলক্ষে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবে সবাই। রাতেও থাকতে পারে। দূরে বাড়ি বলে সকাল সকাল যেতে হচ্ছে। ব্যাগ প্যাক করে নিয়েছে সে। ব্যাগে চমৎকার একটা ওয়েস্টার্ন ড্রেস আছে। হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা কালো কুচকুচে ব্যাকলেস ড্রেসটা সে একটা অনলাইন শপ থেকে কিনেছিল। কিন্তু বাড়িতে দেখানোর বা পরার সাহস হয়নি। এই সুযোগে পরা হয়ে যাবে। অনেক কিছু প্ল্যান করে রেখেছে সে। গতরাত মাথায় পরিকল্পনার আতিশয্যে ঘুমই আসেনি। এই জামার সাথে কেমন হেয়ার স্টাইল হবে, কোন লিপস্টিক দেবে, কোন জুতো পরবে, কোন জুয়েলারি পরবে সব একটা একটা করে ঠিক করেছে সে৷ পায়ে হালকা লোম ছিল। মাঝরাতে ওয়্যাক্সিং করে তুলেছে সব। তার ধারনা তার ঠোঁট একটু পাতলা। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিল লিপ ফিলার করাবে। ইশতিয়াক জানতে পারলে নিশ্চয়ই করিয়ে দেবে। উফ! কী দারুণ হবে! একটু পরেই ইশতিয়াকের আরামদায়ক গাড়িতে লং ড্রাইভে যাওয়া হবে দূর অজানায়। সেখানে সারাদিন ঘোরাঘুরি, পছন্দের ড্রেস পরে ফটোশ্যুট, মজার সব খাবারদাবার খাওয়া… ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে সিমরানের।

কথা ছিল ইশতিয়াক অফিসে গিয়ে কাজকর্ম ম্যানেজ করে সাড়ে দশটার দিকে তাকে নিতে চলে আসবে। কিন্তু এগারোটা বেজে গেল, ইশতিয়াকের ফোন এলো না৷ সিমরান অনেকবার কল করল, কিন্তু কল রিসিভ হলো না। সিমরানের এত কান্না পেতে লাগল! অসহ্য লাগতে লাগল সবকিছু। মা খেতে ডাকায় তার সাথে দুর্ব্যবহার করল। রাগের অনেকটা ঝাড়ল মায়ের ওপর।

ইশিতয়াকের কল এলো বারোটায়৷ খুব দুঃখের স্বরে সে বলল, “মাই ডিয়ার সুইটি, আই অ্যাম সো স্যরি, অফিসে আটকে গেছি। এমনভাবে আটকেছি যে তোমাকে একটা কল করার পর্যন্ত সুযোগ পাচ্ছি না। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টের দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়েছে আচমকা। যাদের এই প্রোজেক্টে কাজ করার কথা ছিল…”

সিমরান কল কেটে দিল। আর শুনতে ইচ্ছে করছে না৷ তাকে এত আশা দিয়ে এখন উনি প্রোজেক্ট নিয়ে পড়ে আছে! এই হলো ভালোবাসার নমুনা! সিমরানের ইচ্ছে হলো ফোনটা ছুঁড়ে মারতে। বহু কষ্টে সে নিজেকে আটকালো। রাগে গা কাঁপছে তার।

মা একটু পর আবারো এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই যাবি না?”

সিমরান চিৎকার করে বলল, “তুমি চাইলে এখনই বেরিয়ে যাই? আমাকে বিদায় করার জন্য তো পাগল হয়ে গেছো!”

“তুই তো বেড়াতে যাবি বলেছিলি।”

“যাব না। তোমার কোনো সমস্যা?”

মা কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। সিমরান ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রইল। একটু পর ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

দুপুরে খেল না সে। অনেক রাতে ক্ষুধায় কাতর হয়ে খেতে গেল। বাবা দেরি করে ফিরেছেন আজ। বাবাও ওর সাথে বসলেন। খেতে খেতে সিমরান প্রশ্ন করল, “তোমাদের অফিসে কিসের প্রোজেক্ট শুরু হয়েছে?”

বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই প্রোজেক্টের কথা জানলি কেমন করে?”

সিমরান কথাটা অত ভেবে জিজ্ঞেস করেনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো বেরিয়ে গেছে। সে সামলে নেবার জন্য বলল, “এত দেরি করে ফিরলে তাই মনে হলো হয়তো নতুন কোনো প্রোজেক্ট…”

“হুম। নতুন প্রোজেক্টে কাজের একটু বেশি চাপ পড়ে গেছে।” কথাটা বলে বাবার মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সিমরানের কোনোভাবেই নতুন প্রোজেক্টের বিষয়ে জানার কথা না। সে এভাবে ইতস্তত করে কথা বলার মেয়েও না। ঘটনা কী? কিসের যেন খটকা লাগছে বুঝতে পারলেন না তিনি।

রাতে ইশতিয়াক অনেকবার কল করল। ধরল না সিমরান। পরদিনও ইশতিয়াকের সাথে যোগাযোগ করল না সে। ইশতিয়াকের কল রিসিভ বা মেসেজ সীন করারও প্রয়োজন মনে করল না। ইশতিয়াকও খুব একটা সময় পেল না। একদিকে অফিসের চাপ, আরেকদিকে মেয়ে দেশে থাকায় তার ভালোই ব্যস্ততা যাচ্ছে।

প্রায় সপ্তাহখানেক যোগাযোগ বন্ধ রইল তাদের। এরপর এক বৃহস্পতিবার রাতে সিমরানদের বাড়িতে একটা পিজ্জা পার্সেলে এলো। ডেলিভারি ম্যানকে বলে দেয়া হয়েছিল যেন সে একটা চিঠিও সাথে পৌঁছে দেয় সিমরানের হাতে। ডেলিভারি ম্যান তাই করল। মা পিজ্জা দেখলেও চিঠিটা দেখতে পেলেন না। ভাবলেন সিমরানই হয়তো অর্ডার করেছে।

চিঠি খুলল সিমরান। তাতে কয়েক লাইন লেখা-

সুইটি,
সেদিনের জন্য অনেক অনেক স্যরি। জানি তোমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করো আমাকে। আগামীকাল আমার সাথে চলো৷ তোমার জন্য গাজীপুরের বেস্ট রিসোর্ট ভাড়া করে রেখেছি৷ এত সুন্দর যে তুমি গেলে পাগল হয়ে যাবে। আমরা সেখানে ঘুরব, খাবো, সুইমিং করবো, আরো অনেক মজা করব। এবার কথার কোনো অন্যথা হবে না। তুমি সকাল আটটায় রেডি থেকো, আমি সাড়ে আটটায় আসবো। না এলে ভীষণ কষ্ট পাবো।
~ তোমার ইশতিয়াক

সিমরানেরও রাগ এতদিনে খানিক পড়ে এসেছিল। ইশতিয়াককে মিস করছিল সে। তাই ওর চিঠি পেলে এবারের মতো রাগ মুলতবি করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। সেই রাতে নিজেই ইশতিয়াককে কল করল। অনেকক্ষণ কথা হলো ওদের। সিমরান সেবার না যেতে পারায় কত কষ্ট পেয়েছে সব বলল৷ ওর ড্রেসটার কথা বলল। ইশতিয়াক কথা দিল, আর কোনোদিন এরকম ঘটনা ঘটবে না।

পরদিন কথামতো ইশতিয়াক চলে এলো। সিমরান তৈরি ছিল। রওনা হয়ে গেল ওরা সিমরানের কল্পনা করা অজানার পথে।

সিমরানকে বহুদিন পর দেখে ইশতিয়াক খুশিতে টগবগ করে ফুটছে যেন। তার চোখেমুখে আনন্দ ঝলসে উঠছে। সিমরান সেটা বুঝতে পারছে। সে একটু আধটু দুষ্টুমি করছে ইশতিয়াকের সাথে। ইশতিয়াক গাড়ি চালাচ্ছে বলে পাল্টা কিছু করতে পারছে না৷ তবে উপভোগ করছে সবটা।

রিসোর্ট দেখে সত্যিই মাথা ঘুরে গেল সিমরানের। এত সুন্দর। ওরা কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাফেরা করে রুমে ঢুকল। এরকম লাক্সারিয়াস রুমে থাকবে ভেবেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল সিমরানের। ঘরের বিশাল জানালা দিয়ে ওপাশে গাছপালা দেখা যাচ্ছে। সাদা ধবধবে বিছানাটা টানটান করে পাতা, দেয়ালের রঙ মাখনের মতো, মেঝেতে নিজের চেহারা দেখা যায়। বাথরুমটা যেন আরো সুন্দর।

ইশতিয়াক জিজ্ঞেস করল, “পছন্দ হয়েছে?”

“খুব!”

“তাহলে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে তারপর ঘুরতে বের হই কী বলো? সকালের খাবার হজম হয়ে গেছে। লাঞ্চেরও একটু দেরি আছে।”

সিমরান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ওকে!” তারপর বলল, “চলো আগে তোমার রুমটা দেখে আসি।”

ইশতিয়াক অবাক হয়ে চাইল সিমরানের দিকে। সিমরানের এই চাহনির অর্থ বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। বুঝতে পারার পর বলে ফেলল সে, “আমরা এক ঘরে থাকব?”

“অসুবিধা হবে?”

“না মানে…”

“সিমরান, ডোন্ট বি সিলি! আজকালকার মেয়ে হয়ে এসব কী বলছো? এখনো এগুলো ম্যাটার করে তোমার কাছে? দুটো মানুষ ভালোবাসলে তারা এক ঘরে থাকতে পারবে না? তাহলে ভালোবাসা কেমন করে থাকলো? তুমি কি নায়িকা শাবানার যুগে বাস করছো নাকি?”

সিমরানের এবার একটু গায়ে লাগল। “শোনো, আমি এমনি বলছিলাম। আগে বলোনি তাই। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“দ্যাটস মাই গার্ল!”

“আচ্ছা এখন সুইমিং পুলে নামা যাবে?”

“খুব যাবে! তবে আমার প্ল্যান ছিল কাল ভোরে নামব। ওই সময় লোকজন কম থাকে। লোকজনের মাঝে সাতার কাটতে ভালো লাগে না।”

“ওহ তোমার বাড়িতে তো পার্সোনাল পুল আছে। পাবলিক পুলে সাতার কাটতে কেন ভালো লাগবে?”

“সেটা কিছুদিন পর তোমারও হয়ে যাবে ডার্লিং।”

সিমরান তার ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল, “শোনো, তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবে? আমি চেঞ্জ করব আর রেডি হব। সারপ্রাইজ পেতে হলে একটু পর আসতে হবে।”

ইশতিয়াক বাধ্য ছেলের মতো বেরিয়ে গেল। সিমরান সুন্দর করে তৈরি হলো৷ ড্রেসটা প্রায় বছরখানেক হলো কিনেছে। সে এক বছরে একটু স্বাস্থ্যবতী হয়েছে৷ ড্রেসটা একেবারে ফিটিং হয়ে লেগে গেছে গায়ের সাথে। সেজন্য বুঝি একটু শর্টও লাগছে৷ হাঁটু বেরিয়ে গেছে। শরীরের প্রতিটা বাঁক স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। চিকন কয়েকটা ফিতে বাদ দিলে পিঠটা খোলা। এরকম জামাকাপড় সে আগে পরেনি। তাই বেশ লজ্জাই লাগছে। বাইরে বের হতে পারবে বলে মনে হলো না তার। চুলগুলো আর বাঁধল না। খুলে রাখল। কিন্তু চুল দিয়ে সামনের অংশ ঢেকে রাখবে নাকি পেছনে সেটা বুঝে উঠতে পারল না।

তবে মনমতো সাজল সে। ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক, চোখে গাঢ় আইশ্যাডো মাখল। দারুণ লাগছে তাকে। বিশাল আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখে নিজেরই প্রশংসা করল সে।

ইশতিয়াক কল করছে, “আসতে পারি?”

“এসো।”

দরজা খুলে দিলে ইশতিয়াক ঢুকল৷ হা হয়ে গেছে তার মুখ। চোখ সরাতে পারছে না সিমরানের দিক থেকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সে দেখে নিল মন ভরে। তারের পায়ে পায়ে সে এগিয়ে এলো সিমরানের দিকে। সিমরান বাঁধা দেবার চেষ্টা করল তাকে। “আমি ছবি তুলব। প্লিজ সাজ নষ্ট করবে না।”

ইশতিয়াক তার কথা কানে তুলল না। ওর সরু কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টানল। ইশতিয়াকের স্পর্শে ক্রমশ পাগল হয়ে যেতে থাকল সিমরান৷ অচেনা এক আনন্দ হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকল তাকে। নেশায় ডুবে গেল সে।

সিমরানের সেদিন আর ফটোশ্যুট হলো না। ঘোরা হলো অল্প একটু। বাকিটা সময় তারা ঘরেই কাটিয়ে দিল। পরদিন ভোরে সাঁতার কাটল তারা। শুধু দু’জনেই। এখানেও দারুণ আনন্দ হলো। এরপর ফিরে এলো তারা। সিমরানকে বাড়িতে দিয়ে ইশতিয়াক চলে গেল অফিসে।

সিমরান বাড়িতে ঢুকে বুঝতে পারল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। বাবা অফিসে যাননি। মায়ের মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে। নিজের ঘরে ঢুকে সে বুঝল মা ঘরে হাত দিয়েছিলেন। ঘর এলোমেলো ছিল, এখন গোছানো।

এদিকে গতকাল সিমরানের ঘর গোছাতে গিয়ে মা ইশতিয়াকের চিঠি পেয়েছেন। বাবা চিঠিটা দেখেই হাতের লেখা চিনতে পেরেছেন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে দুজনেরই। সিমরানের ফোন গতকাল থেকে সুইচড অফ। সে বলে গেছে বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে থাকবে। দু’জনের এক রাতেই চিন্তায় বয়স বেড়ে গেছে।

সিমরান ঘরে ঢোকার একটু পরেই বাবা তার ঘরে ঢুকলেন৷ কোনো কথা না বলে জীবনে প্রথমবারের মতো বাবা তার গালে প্রচন্ড এক চড় বসিয়ে দিলেন। চড় খেয়ে সিমরান জড় পদার্থের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর বাবা রাগে দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

কাঁটামুকুট পর্ব-০২

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব-২

“তোমাকে প্রথমদিন দেখেই আমার এতটা ভালো লেগেছিল যা আমার কোনোদিন কাউকে লাগেনি৷ আমি কখনো জুনিয়রদের বাড়িতে যাই না। তবুও তোমাদের বাড়িতে গেলাম শুধু তোমার জন্য। সেদিন গোল্ডেন জামায় তোমাকে যে কী পরিমাণ সুন্দর লাগছিল তা তুমি নিজেই কল্পনা করতে পারবে না। মনে হচ্ছিল মাটির পৃথিবীতে জান্নাত থেকে একটা হুরপরী নেমে এসে ছোটাছুটি করছে৷ কিন্তু তুমি আমার থেকে এত ছোটো, কেমন করে আমাদের ভেতর কোনো সম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব? আমি ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি বিশ্বাস করো, যৌবনে আমার প্রাক্তন স্ত্রীর জন্যও আমি এতটা পাগল ছিলাম না। আমি ডেস্পারেট হয়ে তোমার ইন্সটাগ্রাম আইডি খুঁজে বের করলাম। তোমার রোজাকার আপলোড করা ছবিগুলো দেখে আমার মাথা আরো এলোমেলো হয়ে যেত। রোজ আমার সকাল শুরু হতো তোমার ছবি দেখে। আমার গ্যালারি ভর্তি তোমার ছবি৷ কিন্তু তোমাকে কোনো মেসেজ দেবার সাহস আমার হতো না।

একদিন তোমার লিপস্টিকের ছবিটা শেয়ার করতে দেখে মনে হলো একটা সুযোগ নেয়াই যায় তোমার সাথে যোগাযোগ করার। আমার কল্পনাতেও ছিল না তুমি এত দ্রুত রাজি হয়ে যাবে। বিশ্বাস করো, তুমি যখন থেকে ‘হ্যাঁ’ বলেছ তখন থেকে আমার মনে হচ্ছে আমি আকাশে উড়ছি। আমার বয়স পঞ্চাশ থেকে কমে পঁচিশ হয়ে গেছে।

আমি এটাও ভেবেছি যে তুমি হয়তো আবেগে পড়ে আমার সাথে একটা নতুন সম্পর্কে এগুতে রাজি হয়েছ৷ কারন তোমার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য একত্রিশ বছর। আবারো ভালো করে ভেবে দেখো সিমরান, আমাদের এই পথটা সহজ হবে না। অনেক বাঁধা আসবে। তোমার পরিবার থেকে রাজি হবে না, হয়তো আমার পরিবার থেকেও অনেক কথা উঠবে। তুমি কি এই বয়সে আদৌ এসব সহ্য করতে পারবে?”

কথাগুলো বলে দম নিল ইশতিয়াক। সে মাথা নিচু করে রেখেছে। আজ ওরা বেশ ভালো একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে এসেছে। আংটি কেনার পর ইশতিয়াকই ধরে এনেছে সিমরানকে।

সিমরান কথাগুলোকে পাত্তা দিল না৷ হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, “যাব পেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যায়া?”

ইশতিয়াক হাসল। “এই কিশোরীর উচ্ছ্বলতা দিয়েই তুমি আমাকে মেরে দিয়েছ সিমরান। খুন করে ফেলেছ।”

সিমরান হাসতে লাগল। বলল, “তুমি এত চিন্তা করবে না তো। যা হবে দেখা যাবে। ভালোবাসলে অত ভাবতে হয় না। বরং সময়টাকে এনজয় করো। আর তোমাকে মোটেও অত বয়ষ্ক লাগে না৷ এই বয়সেও তোমার সাথে আজকালকের ছেলেরা টিকতে পারবে না৷ এত হ্যান্ডসাম আর চার্মিং হয়েও অত ভাবতে হয়?”

“তাই? আমাকে হ্যান্ডসাম লাগে?”

“লাগে মানে! তোমার কী মনে হয় আমি কেন পাগল হয়ে আছি?”

“সেটাই তো ভাবছি।”

“ভাবাভাবির কিছু নেই। যা হবার হয়ে গেছে। এখন আমি পিছিয়ে যেতেটেতে পারব না।”

“বেশ তো! কিন্তু তুমি আমার ব্যাকগ্রাউন্ড তো জানতে চাইবে তাই না?”

“জানিই তো। তোমার বিয়ে হয়েছিল, দশ বছর সংসার করার পর ডিভোর্স হয়ে গেছে। তোমার প্রাক্তন বিয়ে করে এখন ইংল্যান্ডে সেটেলড।”

“একটুকুই জানো?”

“হুম।”

“আমার ছেলেমেয়ের ব্যাপারে জানো না?”

সিমরান একটু থমকালো। এটা তো সে ভাবেনি। সে খানিক সন্দিগ্ধ গলায় বলল, “তোমার ছেলেমেয়ে তোমার সাথে থাকে?”

“ছেলে আমার সাথে থাকে। মেয়ে থাকে তার মায়ের সাথে।”

“তোমার ছেলের বয়স কত?”

“বাইশ।”

সিমরান বিষম খেতে খেতে সামলে নিল। ইশতিয়াকের ছেলে তার চেয়ে তিন বছরের বড়! ইশতিয়াক হেসে বলল, “স্বাভাবিক নিয়মে তুমি আমার পুত্রবধূ হতে পারবে!”

সিমরান কপট রাগ করে ইশতিয়াকের ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল, “এরকম কথা আর কোনোদিন বলবে না।”

ইশতিয়াক ওর হাতটা আলতো করে ধরে নিজের ঠোঁটের সাথে চেপে রাখা আঙুলটায় চুমু খেল। সিমরান কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে নিল। যদিও তার ভীষণ ভালো লেগেছে।

সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে সিমরান যেন আলাদাই একটা জগতে চলে গেল। পুরো পৃথিবী তার কাছে রঙিন মনে হতে লাগল। ইশতিয়াকের সাথে কথা হয় মেসেজে, ভিডিও কলে। এত খুনসুটি করতে পারে লোকটা! উল্টোপাল্টা ফিল্টার লাগিয়ে ভিডিও কলে আসে, জোকস বলে বলে ইচ্ছেমতো হাসায় ওকে। আর ওর বাচ্চামি তো আছেই। ইশতিয়াক ওর পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখিয়েছে সিমরানকে। ওদের পৈতৃক বাড়িটা নতুন করে ডিজাইন করে নিয়েছে ইশতিয়াক৷ চমৎকার ডুপ্লেক্স বাড়ি, সামনে লন, পেছনে সুইমিং পুল। বেডরুমটা অসাধারণ! সিমরানদের পুরো ফ্ল্যাটটা জায়গা হয়ে যাবে ওই বেডরুমের ভেতর। বাথরুমটা ওর ঘরের সমান। বিশাল বাথটাব। ইশতিয়াক বাথটাব দেখিয়ে বলেছিল ওতে একা একা গোসল করে মজা নেই। দু’জন হলে জমে যেত!

ইশতিয়াকের ছেলেকেও ছবিতে দেখেছে সিমরান। বাবার মতোই হ্যান্ডসাম। কিন্তু দেখে মনে হয় এখনো অত ম্যাচিউরিটি আসেনি।

পরের মাসে সিমরানের সাথে দেখা হলে আরেকটা গিফটের প্যাকেট ধরিয়ে দিল ইশতিয়াক। গিফট পেয়ে পেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে সিমরানের। বক্সের সাইজ দেখে সে ভেবেছে হয়তো কোনো জুয়েলারি হবে। কিন্তু বক্সটা খুলে হা হয়ে গেল সে। সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের আইফোন!

সিমরানের বিস্মিত চেহারা দেখে ইশতিয়াক হেসে বলল, “পছন্দ হয়েছে?”

“পছন্দ হয়েছে মানে?” বলে উত্তেজনায় উঠেই পড়ল সিমরান। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ইশতিয়াককে। ইশতিয়াক খানিক অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আরে আরে করো কী? এত মানুষের মাঝে!”

সিমরান তবুও তাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখে তবেই ছাড়ল। জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানলে কেমন করে আমার এটারই দরকার ছিল?”

“তোমাকে বুঝতে পারি বলে। তোমার পুরানো মোবাইলটাতে খুব ভালো ছবি ওঠে না সেটা তো দেখিই। এটুকু না দিলে অন্যায় হতো।”

সিমরান আবেগে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “থ্যাংক ইউ!”

“আই লাভ ইউ সুইটি।”

“আই লাভ ইউ টু হানি।”

সেদিন ওরা একত্রে অনেকগুলো সেলফি তুলল। ফেরার পথে গাড়িতে বসে ইশতিয়াক তার আবদারটা করে বসল, “এতদিনের রিলেশন, আজ কি আমি আমার সুইটিকে একটা কিস করতে পারি?” বলেই সম্মতির অপেক্ষা না করে জড়িয়ে ধরল সিমরানকে। সিমরানের প্রথমটায় কেমন দমবন্ধ করা বিদঘুটে একটা অনুভূতি হচ্ছিল। লোকটার মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। যতই প্রেম করুক, লোকটা তার বাবার বয়সী। তবুও সে নিজেকে ছাড়াতে পারল না৷ তার এক হাত ইশতিয়াকের চুল খামচে ধরেছে, আরেক হাতে ব্র্যান্ড নিউ আইফোন। শেষের দিকটায় অবশ্য ভালোই লাগতে শুরু করল সিমরানের। কিন্তু ততক্ষণে লোকটা তাকে ছেড়ে দিয়েছে। লম্বা চুমু খেতে গিয়ে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছে।

*******

বাড়িতে আইফোন নিয়ে একচোট ঝামেলা হয়ে গেল। মা ওকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, “কোথা থেকে পেলি এটা বল? ইদানীং খুব গিফট পাচ্ছিস, কে দেয় এসব?”

সিমরান কাঠ গলায় বলে, “বন্ধু।”

“কোন বন্ধু? কে বন্ধু? নামটাই তো জানতে চাচ্ছি।”

“আশ্চর্য! তুমি চিনবে নাকি?”

“না চিনলে না চিনব। তুই বল।”

“বলব না।”

“তোর ফোন দে আমাকে।”

“কী করবে?”

“ভাঙব।”

“এত সহজ নাকি? ধরে দেখো একবার। দেখবে আমি কী করি।”

“কী করবি তুই?”

সিমরান চিৎকার করে বলল, “আগুন লাগিয়ে দেব নিজের শরীরে। তারপর তোমরা সুখে থেকো। আমার সুখ তো তোমাদের সহ্য হয় না। আমাকে একটু ভালো দেখলে তো তোমাদের পিত্তি জ্বলে যায় তাই না?”

“একদম গলা চড়াবি না সিমরান। তোর কোন নাগর এসব দেয় তা তো আমি বের করবই।”

“করো না, করো। পারলে সব বের করো। তাও আমার কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে কান নষ্ট করে দিও না। তেমরাই আমার মানসিক শান্তি নষ্ট করে দিচ্ছো। একটু শান্তিতে বাঁচতে দেবে?”

ওর চিৎকার শুনে বাবা চলে এলেন।

“তুমি মায়ের সাথে বেয়াদবি করছ?”

“উচিত কথা বলেছি।”

“ফোন কে গিফট করেছে?”

“বলব না।”

“সিমরান! সুন্দরমতো কথার জবাব দাও।”

“আমি তোমাকে জবাব দিতে বাধ্য নই।”

“বাধ্য নও মানে? তাহলে কাকে জবাব দিতে বাধ্য তুমি? অতিরিক্ত বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো তুমি দিনদিন। কবে যে আমার হাতে মার খাবে তার ঠিক নেই।”

“শোনো বাবা, আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না তুমি। হিসেব করে কথা বলবে।”

বাবা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, “তোমার সাথে আমার হিসেব করে কথা বলতে হবে?”

“হ্যাঁ হবে।” রাগে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিল সিমরান। ইশতিয়াকের নিষেধ না থাকলে সে বলেই দিত, যে বসের আন্ডারে তুমি কাজ করো সে আমাকে মাথায় তুলে রাখে। আমার সাথে অবশ্যই হিসেব করে কথা বলতে হবে।

বাবা আর কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। মাও ওর দিকে বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলেন। সিমরান এবার ইশতিয়াককে ফোন করে কেঁদে ফেলল। “তোমার গিফটের জন্য মা বাবা আমাকে কত কথা শোনালো জানো?”

“থাক, মন খারাপ করে না সুইটি।”

“এখানে আমার আর ভালো লাগে না৷ ওদের শাসনে দমবন্ধ হয়ে আসে।”

“তোমাকে আমি খুব দ্রুত নিয়ে আসব আমার কাছে। আর মাত্র ক’টা দিন যাক।”

“আর ক’টা দিন কেন অপেক্ষা করতে হবে? তোমার এত বড় বাড়িতে আমার একটুও জায়গা হবে না?”

“এত বড় বাড়ির পুরোটাই তোমার হবে আমার রাণী। সমস্যা হলো আমার মেয়ে দেশে এসেছে এক সপ্তাহ হলো। ও কিছুদিন থেকেই চলে যাবে। এই সময়ে এসে সে বাবার বিয়ে মানতে পারবে না। তাই ওর সামনে কিছু করতে চাচ্ছি না। ও চলে গেলে করব। সেখানে ওর মা ওকে সামলে নেবে।”

“ওকে।”

“তোমার মন ভালো করতে চাও?”

“হ্যাঁ।”

“চলো তাহলে কাল কোথাও ঘুরে আসি।”

“কোথায় নিয়ে যাবে?”

“কোনো রিসোর্টে যাই চলো?”

“সত্যিই? আমি আগে কখনো যাইনি।”

“তাহলে তো কালই যেতে হচ্ছে। তুমি এক কাজ করো। জামাকাপড় নিয়ে এসো। বেশি ভালো লাগলে রাতে থেকে যাব। তুমি বাসায় বলে দিও বান্ধবীর বাড়িতে থাকবে।”

“ওটা নিয়ে চিন্তা নেই। আমি ম্যানেজ করে নেব। তুমি ব্যবস্থা করো।”

“ওকে সুইটি। কাল তোমাকে চমৎকার কোনো ড্রেসে দেখতে চাই। যাতে আমার মাথাটা আরেকবার নষ্ট হয়ে যায়।”

“ওকে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু