Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 31



কাঁটামুকুট পর্ব-০১

0

#কাঁটামুকুট
পর্ব-১
সুমাইয়া আমান নিতু

গিফট বক্সটা খুলে সিমরান এত অবাক হলো যে অনেকক্ষণ সে নড়তে চড়তে পারল না৷ এটা তাকে কে পাঠালো? যে জিনিটা সে উপহার হিসেবে পেয়েছে তার জন্য বাড়িতে বায়না করে সে তিনদিন ঠিকমতো না খেয়ে না ঘুমিয়ে একপ্রকার অনশনে আছে। বাবার সামর্থ্য নেই, নইলে হয়তো কিনেই দিত। তবুও সে জেদ ধরেছিল, যদি কোনোভাবে পেয়ে যায়। কিন্তু শখের হিসেবে জিনিসটার দাম তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় একটু বেয়াড়া রকমেরই বেশি। তাই সে ভেবেছিল এবারের মতো জেদটা ছেড়েই দেবে। যদিও তার বড্ড বেশিই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল জিনিসটা।

আর এখন তার চোখের সামনে চমৎকার বক্সের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একসেট ব্র্যান্ড নিউ লিপস্টিক সেট। মোট দশটা লিপস্টিক আছে এতে, গুনে দেখল সিমরান। দামী ব্র্যান্ড। স্পেশাল এডিশনে এসেছিল সেটটা, মাত্র কিছুদিনের জন্য। এর একেকটার দাম পাঁচ হাজারেরও বেশি। পুরো সেটটা কিনতে লেগেছে পঞ্চাশ হাজার টাকারও বেশি। তার এক বান্ধবী কিছুদিন আগেই কিনেছিল বক্সটা। তখন থেকে চোখে লেগে আছে ওর। কী সুন্দর একেকটা রঙ! কী সুন্দর টেক্সচার! সিমরানের পুরো মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায় এক লিপস্টিকের বদৌলতে।

কিন্তু….

প্রশ্নটা আবার মাথায় ধাক্কা দেয়। পাঠালো কে এটা? পার্সেলে এসেছে এটা। তার মা বাবা অনলাইনে অর্ডার দিতে অত পারদর্শী নন। তারা জানেনই না কোন পেজ থেকে কিনতে হবে। এটা অন্য কেউ পাঠিয়েছে। বক্সটা উল্টেপাল্টে দেখল সে। ভেতর থেকে একটা ছোট্ট কার্ড বেরিয়ে এলো,

“Dear Simran,
A small present for the most beautiful lady of the town. Happy birthday to you.
~ Ishtiaq Ahmed”

ইশতিয়াক! এই নামের একজনকেই তো চেনে সে। কিন্তু তার সাথে তো এরকম গিফট দেয়ার সম্পর্ক তার নয়। নাহ, অতিরিক্ত ভাবছে সে৷ এ কি তাহলে তার পিছনে ঘুরতে থাকা বড়লোকের কোনো ছেলে? কিন্তু এমন কাউকেই তো সে চেনে না। যারা পেছনে ঘোরে প্রত্যেককেই ভালোমতো চেনে সিমরান। ভাবতে ভাবতেই কল চলে আসে তার মোবাইলে।

ট্রু কলারে ভেসে ওঠে নামটা, ইশতিয়াক আহমেদ! ফোনটা তুলে কাঁপা গলায় বলে সে, “হ..হ্যালো..”

“কেমন আছো সিমরান?”

গলাটা চেনা সিমরানের। চেনা কথার ধরনটাও। যার কথা প্রথমে মনে হয়েছে এই লোক সে-ই! ইশতিয়াক আহমেদ, অফিসে তার বাবার অনেকটাই সিনিয়র। লোকটার সাথে একবারই দেখা হয়েছে সিমরানের। গত মাসে তিনি এসেছিলেন পাশেই একটা পার্টি সেন্টারে কোনো এক বিয়ের দাওয়াতে। সেখানে সিমরানরাও ইনভাইটেড ছিল। অফিসের বসের সাথে আচমকা দেখা হয়ে যাওয়ায় বাবা আর ছাড়েননি। দাওয়াত শেষে নিয়ে এসেছিলেন ওদের ফ্ল্যাটে। সেদিন বাবা আর মায়ের আপ্যায়নের ব্যস্ততার সুযোগে সিমরানের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হয়েছিল তার৷ তিনি এমনিতে বেশ মিশুক প্রকৃতির। সিমরানকে বলেছিলেন তাকে আঙ্কেল না ডাকতে। ওটা ডাকলে নাকি তার নিজেকে বুড়ো বুড়ো মনে হয়। অথচ তিনি মনে মনে এখনো তরুণ। তবে সিমরান চাইলে তাকে নাম ধরে ডাকতে পারে। অত বড় লোকটাকে নাম ধরে ডাকার সাহস সিমরানের হয়নি। সে কিছুই ডাকেনি। সেদিনের পর থেকে লোকটার সাথে তার কোনো যোগাযোগও হয়নি। আজ হঠাৎ এসব…

“শুনছো সিমরান?”

“জি শুনছি।” সম্বিত ফিরল সিমরানের।

“গিফট পছন্দ হয়েছে?”

“হুম। অনেক পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে এটা আমার উইশলিস্টে ছিল? আর আজ আমার জন্মদিন তাই বা জানলেন কেমন করে?”

“কোথা থেকে আর জানব! তোমার ইন্সটাগ্রামেই তো সব আছে। সেদিন এই লিপস্টিক সেটটার ছবি শেয়ার করে লিখেছিলে কেউ ভালোবাসলে এটা গিফট পেতে। আর আজকে জেনেছি সবার উইশ করা দেখে।”

সিমরান অবাক হয়ে বলল, “আপনি আমাকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করেন?”

“ইয়েস মিস। তবে ফলো করি না, শুধু স্টক করি৷ সুন্দরীদের দেখা ছাড়া ইন্সটাগ্রামের আর কাজটা কী বলো?”

“থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার!”

“স্যার? আমি তোমার বাবার স্যার। তোমার নই। আমি তোমার ফ্রেন্ড, ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“এখন এইযে গিফট দিলাম, এর রিটার্ন গিফট কি আমার পাওনা হয়নি?”

“অফকোর্স। কিন্তু আমি আপনাকে এমন কী বা দিতে পারি?”

“এমন কিছুই চাইব যা তুমি দিতে পারবে।”

“কী চান বলুন? সাধ্যের মধ্যে থাকলে আমি অবশ্যই দেব।”

ইশতিয়াক হেসে বললেন, “ওকে! আগামী শনিবার বিকেল পাঁচটায় আমার সাথে এক কাপ কফি খাবে। কফিটা তুমি খাওয়াবে।”

“এটাই?” খুশি হয়ে বলল সিমরান।

“হ্যাঁ এটাই। ও হ্যাঁ, সাথে আজকের লিপস্টিক সেট থেকে সবচেয়ে সুন্দর লিপস্টিকটা লাগিয়ে আসবে।”

“অবশ্যই।” হেসে বলল সিমরান৷

“আর একটা কথা, আমি যে উপহার দিয়েছি এটা প্লিজ তোমার বাবাকে বলো না৷ তাহলে সে বলবে তার মেয়েকে গিফট দিয়ে আমি স্পয়েল করে দিচ্ছি। হাজার হোক তোমার বাবা পুরানো চিন্তাধারার মানুষ। দেখো না বুড়ো হয়ে গেছে। কত বলি একটু আধুনিক হন, তিনি কি আর শোনেন? আমাকেই দেখো, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছি৷ তোমাদের জেনারেশনের মতোই ফ্রেশ আমার চিন্তাভাবনা।”

“হ্যাঁ, বাবাটা একদম ওল্ড ফ্যাশন।” ঠোঁট উল্টে বলল সিমরান।

“আচ্ছা রাখছি তাহলে। দেখা হবে শনিবার।”

“ওকে বাই।”

এমন সময় মা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। লিপস্টিক সেটটা দেখে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, “পেলি কোথায় এটা?”

যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সিমরান জানাল, “ফ্রেন্ড গিফট করেছে।”

মা এগিয়ে এসে লিপস্টিকগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে বললেন, “এগুলো কি সেগুলো যার জন্য..”

“হ্যাঁ।”

“তোর এত দরদী ফ্রেন্ড কবে হলো? এত দামী গিফট দিয়েছে?”

সিমরান বাঁকা হেসে বলল, “সবসময়ই ছিল। শুধু তোমরাই আমার শখের কোনো পাত্তা দাও না৷ তার মানে এটা নয় যে আর কেউ দেবে না।”

মা আর কথা বাড়ালেন না। মেয়েটার সাথে কথা বলা বিপদ। অপমান করে কথা বলা শিখেছে। ছোটোবেলায় শাসন করা হয়নি, এখন এমন সব কথা বলে যে গা পিত্তি জ্বলে যায়, অথচ এখন শাসনের বয়স নেই। ইউনিভার্সিটিতে উঠে গেছে, এই বয়সী মেয়েদের কি কিছু বলা যায়? বলতে গেলে উল্টো তেড়ে আসে। সাথে আছে বায়না আর জেদ। তার ইদানীং নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে।

*******

শনিবার বিকেলে সেজেগুজে বেশ পরিপাটি হয়ে বের হলো সিমরান৷ লাল রঙের টপস আর গাঢ় নীল জিন্স পরেছে। কানে ছোট্ট মুক্তার দুল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাতে ব্রেসলেট। আর্টিফিশিয়াল আইল্যাশ ছাড়া চোখের আর কোনো সাজসজ্জা করেনি। মুখে সামান্য বেইজ মেকআপ করে ব্লাশন লাগিয়ে নিয়েছে। দেখে মনে হয় মেকআপ করেনি। সে অবশ্য এমনিতেই সুন্দর দেখতে। গায়ের রঙ মাখনের মতো। হাসলে গালের একপাশে টোল পড়ে। ওর বান্ধবীরা প্রায় সবাই ওকে হিংসে করে। সেজন্যই বোধহয় নিজেদের টাকাপয়সার গরম ওর সামনে একটু বেশিই দেখায়। ওর বান্ধবীদের মধ্যে একমাত্র সিমরানদের ফিনানশিয়াল অবস্থাই একটু নিচে। বাকিরা দেদারসে টাকা ওড়ায়। তাকে খানিক কটাক্ষও করে। ব্যাপারটা সহ্য হয় না ওর। মনে হয় কোনো জাদুর কাঠি দিয়ে বড়লোক হয়ে যেতে পারত যদি! বড়লোক অনেকে অবশ্য ওকে প্রপোজ করে। তবে সিমরান এখনো মনের মতো কাউকে পায়নি।

এসব ভাবতে ভাবতেই সে পৌঁছে গেল কফিশপে। গিয়ে দেখল ইশতিয়াক আগেই এসে বসে আছেন। ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি৷ চেয়ার টেনে দিলেন ওর জন্য। মুগ্ধ হয়ে গেল সিমরান। এতটা সে আশা করেনি। বসার পর ইশতিয়াক বললেন, “তুমি পনেরো মিনিট লেট।”

সিমরান খানিক বিব্রত হয়ে বলল, “স্যরি, আসলে জ্যাম…”

“জ্যাম ঠেলে তো আমিও এসেছি।” বলেই হেসে ফেলল ইশতিয়াক। “তবে সুন্দরীদের এক্সকিউজ মেনে নেয়াই যায়, কী বলো? কোন কফি খাবে বলো?” মেন্যু কার্ডটা এগিয়ে দিলেন তিনি।

সিমরান মেন্যুটা উল্টো ঠেলে দিল৷ “আপনি সিলেক্ট করুন। আপনার জন্যও, আর আমার জন্যও। আজকের পছন্দটা আপনার ওপর ছেড়ে দিলাম।”

ইশতিয়াক হেসে মেন্যুটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। এই ফাঁকে ভালো করে তাকে দেখল সিমরান৷ অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। চকচকে কালো স্যুটটা চমৎকারভাবে মানিয়ে গিয়েছে তার গায়ের ফর্সা রঙের সাথে। চুলগুলো পুরোপুরি কালো নয়, সাদা আর কালোর মিশেলে। তবে মাথাভর্তি চুল, দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। দাড়িগোঁফ কামানো চেহারায় সামান্যই ভাজ পড়েছে। তবে সেজন্যই বুঝি লোকটাকে আরো বেশি ম্যানলি লাগছে। হাতে রোলেক্স ঘড়ি আর একটা দামী আংটি। পেশিবহুল হাতটা দেখে শরীর নিজের অজান্তেই শিরশির করে উঠল সিমরানের। ইশতিয়াকের শরীর থেকে মোহনীয় ঘ্রাণ আছে। খুব দামী পারফিউম বুঝি!

ততক্ষণে কফি অর্ডার দিয়ে অবসর পেয়েছেন ইশতিয়াক। তিনি নানা বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন। ফ্যাশন, ট্রেন্ড, সিনেমা, ট্রাভেলিং… সব সিমরানের পছন্দের টপিক। এত ভালো লাগল ওর গল্প করে! ওর আশেপাশের ছেলেগুলো যেন কিছুই জানে না। এরা শুধু পড়ে আছে ফেসবুক, রিলস, মিমস নিয়ে। এদের সাথে গল্প করতেও ভালো লাগে না।

কফির সাথে ইশতিয়াক পেস্ট্রি আর চকোলেট চিপস কুকি অর্ডার করেছিল। সেগুলো চলে আসায় সিমরান নিজের মানিব্যাগের কথাটা একটু ভাবল। জমানো সব টাকাই সে নিয়ে এসেছে। তবুও কম পড়লে? এত পশ কফিশপে আগে আসেনি সে। মেন্যুকার্ডটাও দেখেনি। তবে সে নিজের নার্ভাসনেসটা বুঝতে দিল না ইশতিয়াককে। হাসিমুখে খেতে শুরু করল।

খাওয়া শেষে বিলটা ইশতিয়াকই পে করলেন। সিমরান জোর করেছিল, কিন্তু তিনি ওর হাত থেকে ব্যাগটাই টেনে নিয়ে গেছেন। সেখান থেকে বের হয়ে ইশতিয়াক তাকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিলেন৷ ড্রাইভ করলেন নিজেই। সিমরানের মনে হলো চমৎকার একটা ডেট ছিল এটা! যদি আদৌ ডেট হয়ে থাকে তাহলে। লোকটা তাকে এত স্পেশাল ফিল করাচ্ছে কেন? মুখে তো কিছু বলছে না।

বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগটা খুলেই চমকে গেল সে। তার অগোচরে কখন যেন ইশতিয়াক একটা ছোট্ট গিফট বক্স ঢুকিয়ে দিয়েছে ব্যাগের ভেতর। সেটা খুলতেই বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা হীরের আংটি। অসম্ভব সুন্দর কাটিং। সাথে একটা চিরকুট। “রিংটা একসেপ্ট করলে ফোন করবে। নয়তো এটাই আমাদের শেষ দেখা ছিল।”

সিমরানের চোখে পানি চলে এলো। তার পক্ষে কি এটা রিজেক্ট করা সম্ভব? ইশতিয়াক এটা কেমন করে লিখতে পারল? অভিমান হলো তার।

সাথে সাথেই ফোন করল সিমরান। ইশতিয়াক কল ধরতেই সে বলল, “আপনার কেন মনে হলো আমি রিংটা একসেপ্ট করব না?”

ইশতিয়াক বেশ ধীর গলায় বললেন, “তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না সিমরান, শুধুই বন্ধু হিসেবে একসেপ্ট করার কথা বলিনি আমি।”

“আমি অত বোকা নই ইশতিয়াক। আপনি যেভাবে চাইছেন আমি সেভাবেই আপনাকে একসেপ্ট করলাম।”

ইশতিয়াক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেসে বললেন, “ধন্যবাদ।”

“আপনাকে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটা আংটির জন্য। এর রিটার্ন গিফট কিন্তু দিতে পারব না।”

“কেন পারবে না? আমার সাথে আংটির দোকানে গিয়ে একটা চুজ করে দেবে। সেটাই হবে আমায় দেয়া তোমার উপহার।”

“আচ্ছা।”

“কবে যাবে?”

“যেদিন বলবেন।”

“কালই এসো।”

“ওকে।”

“উফ… ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। কতটা সময় তোমাকে না দেখে কাটাতে হবে!”

সিমরান খিলখিল করে হেসে বলল, “আপনি তো টিনএজারদের মতো কথা বলছেন।”

ইশতিয়াক বলল, “প্রেমে পড়লে সবাই টিনএজার হয়ে যায় সুইটি।”

(চলবে)

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৩

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৩
‘পাস্তা খাচ্ছে দুজনে মনোযোগ দিয়ে৷ হুট করে জিয়ান নয়নার মুখের সামনে চামচ ধরলো। নয়না অবাক দৃষ্টিতে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,সামথিং সামথিং?
‘আগে শেষ করে তারপর বলছি।
‘কাটা চামচ থেকে পাস্তাটুকু মুখে নিলো নয়না৷ জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে ইট’স সো টেস্টি! রাঁধুনির রান্নার হাত ভালো৷
‘ওহহ সিরিয়াসলি! তাহলে তো চেখে দেখতে হয়৷
‘নয়না জিয়ানের মুখে খাবার তুলে দিলো৷

‘আসলেই সো ইয়াম্মি! রাঁধুনির রান্নার হাতে চুমু খাওয়া উচিৎ।
‘নয়না হাত বাড়িয়ে দিলো৷

‘জিয়ান নয়নার হাতে চুমু দিলো৷।
‘এই এটা কি হলো!আপনি আমার হাতে ঠোঁট মুছে নিলেন!
‘এতো নরম কোমল তোয়ালে থাকতে মুখটা কই মুছতাম বেবি?
‘কফি ঠান্ডা সরবত করে খাবেন?
‘নাহহ তো। আর ঠান্ডা হলেও সমস্যা নেই তোমার হট মেজাজ মিশিয়ে গরম করে নেবো।
‘নয়না হেসে বলো আপনি দারুন মজার মানুষ তো!
‘আজ পর্যন্ত কেউ বললো না এ কথা। ভাগ্যিস বিয়ে করেছিলাম। বৌ ছাড়া কেউ আপন হয়না৷
‘নয়না পাস্তার খালি প্লেটটা টেবিলে রেখে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,দেখে যাননা আর কয়েকটা দিন।
‘জিয়ান নয়নার কাছে ঘেঁষে বলে,প্রেমে পরে গেছো?
‘প্রেমে পরে গেছি মানে!প্রেমে একদম হাবুডুবু খাচ্ছি। আরেহহ বুদ্বু আপনাকে নিয়ে সাজেক যেতাম।
‘জিয়ান নয়নার আরো কাছে ঘেঁষে বলে,বাহহ সোজা হানিমুনে যাওয়ার প্ল্যান৷

‘নয়না উঠে দাঁড়ালো। ট্রেসিং টেবিলের টুলের উপর দাঁড়িয়ে বলে,আপনার সমস্যা কি!সব কথার ডাবল মিনিং বের করেন! আপনি যে কদিন থাকবেন ততদিন হ্যাসবেন্ড ওয়াইফের রোল প্লে করে মনের সকল উল্টোপাল্টা ইচ্ছে পূরন করে ফেলতে পারতাম।

‘জিয়ান নয়নার কোমড় ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,বাহহ বাচ্চা মেয়েটা সব বোঝে দেখছি৷ তা তোমার মনের উল্টোল্টা ইচ্ছেটা কি?

‘আগে ছাড়ুন আমাকে তারপর বলছি৷

‘উঁহু ছাড়বো না৷

‘জিয়ানের বাহু থেকে ছুটে আসার জন্য জোড়াজুড়ি করতে করতে ঠাসসস করে বেডের উপর পরলো দুজনে৷ নয়না জিয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে৷

‘জিয়ান নয়ান চোখে ফুউউ দিয়ে বলে,বার্বিডল।

‘নয়না চোখে মেলে তাকিয়ে বলে,আমার কোমড় ঠিক আছে? ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখে জিয়ান তার নিচে সে জিয়ানের উপরে৷ জিয়ানের এক হাত তার কোমড়ে৷

‘আমার উপর কাঁঠাল ভেঙ্গে খেলে কোমড় ভাঙ্গবে কি করে?

‘নয়না লাফ দিয়ে উঠে বলে,কি করলেন এটা? আপনার কাজই সব অকাজ করা!

‘অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে কি করলাম?

‘আপনার জন্য সব কফি বেডে পরেছে। আম্মু আমাকে বকবে তো৷

‘জিয়ান উঠে বসে বলে,এই ছাড়ো তো এসব আসো গল্প করি৷ তোমার সাথে থাকা এই চারটা দিন মিস করবো মনে হচ্ছে।

‘ছাড়বো মানে তাড়াতাড়ি বাইশ’শো টাকা দিন।

‘দিয়ে দেবো যাওয়ার আগে৷

‘মনে থাকে জেনো। আর আপনি করবেন আমাকে মিস!মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনার এরোপ্লেনের এয়ারহোস্টসরা আছে না। তাদের দেখলে দিন দুনিয়ায় সব ভুলে যাবেন।

‘বাদ দাও তো সেসব কথা তুমি বরং তোমার কথা বলো,

তোমার কোন পছন্দের মানুষ নেই। আই মিন প্রেমিক নেই?

‘প্রেম আর আমি! সেই ক্লাস প্লে থেকে ছায়ার মত আম্মু আমার পেছনে পেছনে। ইনফেক্ট স্যারের বাসায় পড়তে গেলেও আম্মু সাথে যেতো৷ একটা ছেলে ফ্রেন্ড নেই আর প্রেমিক তো বহুত দূরের কথা!

‘সিরিয়াসলি একা একা কখনো যাওনি স্কুলে বা ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে?

‘এই যে প্লেন ড্রাইভার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিবেন না।

আমি যদি বলি ফুচকা খাবো। আম্মু বলবে ঠিক আছে আমি নিয়ে যাবো। বাহিরে একটু দরকার ছিলো আম্মু।

ঠিক আছে আমার সাথে নিয়ে যাবো। এই এলাকায় আপনি যে জিজ্ঞেস করেন মাহবুব তালুকদারের মেয়ের নাম কি? বেশিরভাগ মানুষ জানবেনা। জানা তো দূর চেনেও না।এলাকার দোকানেও কখনো যাইনি৷ যাইনি মিন যাওয়ার অনুমতি পাইনি। তবে জানেন একবার কি করেছি?

‘ক্লাস এইটে থাকতে নিতেন আর সামন্থার অ আ মুভি দেখে ভাবলাম আমি আর বেঁচে কি করবো! আমার আম্মুও আমার সাথে এমনই করবে।তারচেয়ে সুই’সাইড করে ফেলি।

‘লাইক সিরিয়াসলি! তার মানে আগে থেকেই তোমার স্ক্রু ঢিলা?

‘এই মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনি কি বুঝবেন বন্দি খাঁচার আদুরে পাখির যন্ত্রনা।

‘তারপর শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেলে কি করে? বন্দি খাঁচার আদুরে পাখি।

‘তারপর এই সুন্দর ওয়াশরুমের বাথটবে শুয়ে ফল কটার ছুড়ি দিয়ে আমার এই কোমল হাতের কবজি বরাবর এক টান দেই৷ যখন জ্ঞান ফিরলো ভাবলাম মরে ভূত হয়ে গেছি মেবি। কিন্তু নাহহ চোখ খুলেই দেখি আমার আম্মু আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷

‘তুমি কি পাগল?

‘আরেহহহ ড্রাইভার কিয়া বাত হ্যা একদম ঠিক কথা আমি আসলেই পাগল। জানেননা পাগল ছাড়া দুনিয়ার চলে না৷

‘আমার দুনিয়া চলে যাবে।

‘,কাভি নেহি মনে রেখো বালক তোমাকে ফিরে আমার কাছেই আসতে হবে। তুমি পাগল ছাড়া বেঁচে থাকতে পারো না না না।

‘ওয়াও ইউর এক্টিং স্কিল রিয়েলি নাইস৷ তা অভিনয়ে কবে যোগ দিচ্ছ?

‘হবে না হবে না ওসব অভিনয় টবিনয় আমাকে দ্বারা হবে না৷ কেউ আমার শরীরে টাচ করবে! আমি তো তাকে খু’ন করে ফেলবো৷

‘আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছো কেন?

‘ওই মিস্টার প্লেন ড্রাইভার বেঁচে আছেন শুধু আমার বাবা মায়ের জন্য।

‘কাল চলে যাবো তারপর কি করবা।

‘নাচবো ধুম তা না না ধুম তানা নানা।

‘এই একটু আগে তুমি আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছো।

‘ওটা তো অভিনয় ছিলো৷ আচ্ছা কাল আপনাকে এগিয়ে দিতে যাবো।
‘আমার সাথে আর এগোতে হবে না।। যে পথের গন্তব্য নেই সে পথ ছেড়ে দেয়া ভালো।
‘শুনেন কঠিন কথা যাওয়ার সময় বলতে নেই৷ কঠিন কথা মনে দাগ কাটে৷ যে চলে যাবে তার কথা মনে রাখতে চাই না৷
‘ভুলে যেতে কতটুকু সময় লাগে তোমার।
‘যা আমি মনে রাখতে চাই তা ভুলি না। আপনার রেখে যাওয়া সিম ফেরত নিবেন কবে?
‘সব কিছু ফেরত নিতে নেই কিছু জিনিস অফেরতযোগ্য।
‘ঠিক আপনার দেয়া আঘাতের মত?
‘তোমার বয়স আরেকটু বেশি হলে মন্দ হতো না।
‘তখন কি আপনি আমার আঁচলে বাঁধা পরতেন?
“আঁচলে কি বাঁধা যায় মানুষ?
‘মানুষ তো বাঁধা লাগে না, মন বাঁধতে পারলে মানুষ এমনেই বিনি সুতোয় বাঁধা পরে।
‘হাত বাঁধা যায়, পা বাঁধা যায় মন বাঁধা যায় তা তো শুনিনি!
‘শুনবেন কি করে? ওসব শোনার জিনিস না অনুভব করার জিনিস।
‘মাঝে মাঝে বড্ড পাঁকা পাঁকা কথা বলো তুমি!
‘আঁচল দিলাম বিছাইয়া বইসা লওনা জিরাইয়া। যদি তোমার চায় মনে, পরান রাইখো পরানে।
‘মিষ্টি কণ্ঠ তো তোমার?
‘আপনি কি চেকে দেখেছেন?
‘হুম মাত্রই টেস্ট করলাম।
‘আপনার ফোন নাম্বার দিবেন না?
‘নাম্বার লাগবে?
‘দিলে মন্দ হতো না। মাঝে মাঝে তোমাকে প্লেন ড্রাইভার বলে ক্ষ্যাপানো যেতো।
‘তুমি বলছো আজ! মনে হচ্ছে আমার প্রেমে পরে গেছো?হয় হয় সুদর্শন যুবক দেখলে প্রেম হয়েই যায় ।
‘আপনি আর সুদর্শন? রানবীর কাপুরের মত ফর্সা আর সালমান খানের মত বডি বানালেই কেউ সুদর্শন হয়ে যায় না৷
‘সুদর্শন হতে আর কি কি লাগে?
‘এখন আমার বলার মুড নেই অন্য কোনদিন বলবো।
‘একটা গান শোনাও।
‘গান শোনালে কি দেবেন?
‘আসার সময় তোমার পছন্দের স্টবেরি ফ্লেভারের লিপস্টিক নিয়ে আসবো এক ডজন।
‘আরেহহ বাহহহ এক্ষুনি শোনাচ্ছি। কিন্তু আমাদের তো দেখা হবে না আর তাহলে কিভাবে দেবেন?
‘কুরিয়ার করে পাঠাবো। এবার গান শোনাও৷
“ আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস ।
যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো ”
‘তুমি কি আমার বিরহিণী?
‘জানিনা মন চাইলো তাই এটা গাইলাম।
চলে যাওয়ার মূহুর্তে এতো মিষ্টি সুর শোনানো ঠিক না, কারন তা হৃদয়ে দাগ কাটে।
‘আমার কথা আমাকে ফেরত দিচ্ছেন!

#চলবে

ভুল থেকে ফুল পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_৩(শেষ)

ঘড়ির কাটায় রাত বাজে এগারো টা। আগামীকাল চলে যাব তাই গুছিয়ে নিচ্ছি সব। আয়ান ঘরে ফিরলো। তার সাথে একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলাম। অবাক লাগলেও ভাবলাম হয়তো তার কোন আত্মীয় হবে। শাশুড়ির রুমে ডুকলো মেয়েটাকে নিয়ে। আয়ানকে বলতে শুনলাম, মা এই সে!

আমি ছেলেকে কোলে নিয়ে শাশুড়ির রুমের দরজায় দাড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে ও?
মা ছেলে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। মেয়েটা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে দাড়িয়ে রইল। আমার সন্দেহ বাড়ছে। জোর গলায় বললাম, “কে ও, বলছো না কেন?”

আয়ান কাঠ কন্ঠে বলল, “ওকে বিয়ে করেছি আমি।”

কথাটা শুনামাত্র আমার চারপাশ ঘুরতে লাগলো। শরীর থরথর করে কাঁপছে। ছেলেকে নামিয়ে রেখে দরজা শক্ত করে ধরলাম। শত চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারলাম না। বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললাম। প্রচন্ড রাগে এগিয়ে গেলাম আয়ানের কাছে। তার শার্টের কলার ধরে হেঁচকা টান দিলাম, “তোমার সাহস কি করে হয়, একটা বউ থাকা স্বত্বেও আরেকটা বিয়ে করার? উত্তর দাও?”

আয়ান কিছু না বলে হাত ছাড়িয়ে নিলো। বাচ্চা কান্না করছে, গিয়ে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটাকে কষিয়ে কয়েকটা থা*প্প*ড় দিলাম পরপর। বাজেভাবে বললাম, তুই কেমন মেয়ে? জানতিস না ওর বউ আছে, বাচ্চা আছে। তারপরেও পালিয়ে এসেছিস? দুনিয়ায় কি আর ছেলে ছিলো না বিয়ের জন্য? ফের আবার মারতে গেলে আয়ান এসে সজোরে আমাকে থা*প্প*ড় দিলো এলোপাতাড়ি।

শাশুড়ী বললেন, এসব হচ্ছে কি? ছেলেরা বিয়ে করতেই পারে সমস্যা কি তাতে? তোমাকে তো আর ফেলে দেবে বলেনি।

আমি কি করব কি বলব কিছুই বুঝতে পারলাম না। দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছি শুধু। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকে জড়ো হয়ে গেছে। কেউ কেউ লুকিয়ে আমাকে বলছে, পুলিশে যাও। এই করো ওই করো। কিন্তু আমি ওসব কিছুই ভাবছি না। আমি চাচ্ছি এই মুহুর্তে এই নরক থেকে পালিয়ে যেতে।

সবাই ওদিকে ব্যস্ত। আমি ছেলে কোলে নিয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সাথে কোন ফোন ও নিয়ে আসিনি। আগে আমার বাড়ি যেতে হবে। নয়তো দম আটকে আমি মরেই যাব। এত কিছু সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

তাড়াতাড়ি ভ্যান এ উঠলাম। ভ্যান থেকে নামিয়ে দিলো বাস স্টেশনে। রাত বাড়ছে। মানুষজনের সংখ্যা কম স্টেশনে।খানিক ভয় ভয় ও লাগছে। হঠাৎ কেউ আমার নামে ডাকলো ‘এই রুহি’ বলে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ফুয়াদ।

সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে তুমি এখানে কেন? আর এ কি অবস্থা তোমার? হয়েছে টা কি?”

কিছু বলার মতো অবস্থা না আমার। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে।

“এ কি তুমি কাঁদছো কেন? প্লিজ বলো রুহি, হয়েছে কি? এদিকে এসো বসো এক জায়গায়।”

আমি নড়লাম না। সে হাত ধরতেই চিৎকার করে উঠলাম। “হাত ছাড়ো বলছি।”

“আরে চিৎকার করছো কেন? মানুষ ভাববে কি! ছেলেটা কাঁদছে। আমার কাছে দাও।”

“না। আমার ছেলেকে নিবে না। কাঁদুক। ”

“আরে পাগল তোমার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি না।” এই বলে সে ছেলেকে কোলে নিলো। দোকান থেকে পানি এনে দিয়ে বলল, “পানি খাও। মুখ ধুয়ে নাও। ভালো লাগবে। আর আমাকে বলো কোথায় যাবে?”

বিস্তারিত তাকে বলে বললাম, আমি এখন আমার বাড়ি যাব।

সব শুনে ফুয়াদ বলল, “তোমার এভাবে আসা উচিত হয়নি। ওখানে থেকে তোমার পরিবারকে খবর দেওয়া উচিত ছিলো।”

“তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে আসিনি।। ছেলেকে দাও। আমাকে যেতে হবে।”

“চলো আমি নিয়ে দিচ্ছি।”

আগুন চোখে তাকালাম তার দিকে, “আমি একা যেতে পারব।”

“এত রাতে একা যাওয়া সেফ না। আমি তোমার বাড়ি যাব না। শুধু সাথে যাব। তুমি পৌঁছালেই চলে আসব। অযথা তর্ক করো না। বাচ্চাটার কষ্ট হচ্ছে। ”

কিছু না বলে বাসে উঠলাম।

বাড়ি গিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। খানিক সময় পার হলে সব বললাম। মা-বাবা ভাইসহ সবার একই কথা, শেষ দেখে ছাড়বে আয়ানের। আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম, শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আয়ানকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।

বাবা, ভাই তাই করলেন। টাকা পয়সা সব ঢেলেও আয়ান রেহাই পায়নি। জেল খাটছে কয়দিন। পরে আমারই দয়া হলো, যত হোক সে আমার ছেলের বাবা। বাবাকে মিনতি করে তাকে ছাড়ালাম।

তারপরে শুরু হলো আমার উপর জবরদস্তি। আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নামলেন মা-বাবা। কিন্তু আমি কোনমতে রাজি না। তার কারণ আমার ছেলে। তাকে কখনও একা ছাড়ব না আমি। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় অনেক কথা ও শুনতে হয়েছে পরিবারের সবার। চুপচাপ শুনতাম। কিছু বলতাম না। কান্না পেলে কাঁদতাম। ভাবলাম আর বিয়েই করব না। ছেলেকে নিয়ে এই ছোট্ট জীবন কাটিয়ে দিতে পারব অনায়াসে।

সুখে দুঃখে কেটে গেছে দুই থেকে তিন বছর। এর মধ্যে আমি প্রাইমারিতে জব ও পেয়ে গেলাম। মানসিক অবস্থা ও আগের থেকে ভালো। হুট করে এক সন্ধ্যায় ফুয়াদের আগমন। তাকে দেখে বেশ চমকালাম। এতবছরে তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিলো না। সে কেন, কোনও ছেলের সাথে আর সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। নিজের ইচ্ছে ছিলো না।

ফুয়াদের সাথে দেখি আরও মানুষ। জানতে পারি তার মা ভাই উনারা। আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে আমার পরিবারে। বুঝতে পারলাম না। এত বছর পর সে আবার কেন ফিরলো। তাও বিয়ের জন্য। আমি তাকে আড়ালে ডাকি। নাকোচ করি প্রস্তাব।
জানাই বিয়ে করব না আমি। আর তোমাকে তো কখনই না।

সে বলে, “কেন।”
আমি বলি, “নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না। তাই করব না।”

সে বুঝায়, “সবাইকে এক পাল্লায় মেপো না। আজ তিন চারটে বছর থেকে তোমার পিছনে পড়ে আছি, তুমি কথা না বলা স্বত্বেও। এই যুগে ক’জন এমন করে একবার ভাবো? তারপরেও আমাকে বিশ্বাস করছো না। একবার বিশ্বাস করে দেখতে পারো আমায়। কখনও ভাঙবে না।

জানো রুহি? যেদিন তোমায় প্রথম লাইব্রেরি তে দেখি, এক আকাশ পরিমাণ মুগ্ধতা নিয়ে তোমাকে দেখেছিলাম। এখনও দেখি। জীবনের শেষ অব্দি ও দেখতে চাই। প্লিজ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করো না আমায়।”

“আমার ছেলেকে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না। বাবাহারা সে, মা হারাও করতে চাই না। দরকার হয় আমার সুখ বিসর্জন দেবো।”

সে হাসলো খানিক। বলল, “তুমি সত্যিই পা*গ*ল৷ আমাকে বুঝতে পারো নি। ছেলেটা তোমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। তোমাকে আপন করতে চাই মানে, তোমার আপন সবকিছু আমার ও আপন। আমি যেমন ভালো স্বামী হব তেমনি একজন ভালো বাবা হয়েও দেখাবো। তোমার আমার দুজনের সাথে ছেলে থাকবে।”

“এতদিন কোথায় ছিলে? কোন মেয়ে আসেনি জীবনে?”

“সত্যি বলতে মেয়ে এসেছে। কিন্তু মন বসাতে পারিনি কোথাও। ওভাবে সম্পর্ক ও গড়ে উঠেনি কারও সাথে। মনের ঠিকানা একমাত্র তোমার মাঝে।
আর এতদিন আমি বাহিরে ছিলাম। তোমাকে তো নক করলেই ব্ল*ক করতে তাই আর করিনি। সব খবরাখবর নিতাম তোমার বান্ধবীর থেকে। বলো না বিয়ে করবে আমায়?”

“জানি না। আমার মন সায় দিচ্ছে না।” বলে আমি চলে আসলাম।

আমি দু টানার মধ্যে থাকলেও পরিবারের সবাই রাজি হওয়াতে আমিও হলাম। মা তো বলেই দিয়েছেন, এ বিয়েতে রাজি না হলে আমার আর মুখ দেখবি না। দুদিন পর আমরা মরে গেলে কে তোকে দেখবে। ভাগ্যের লিখন হয়তো তাই ছিলো। আমাদের বিয়ে হলো। এত এত ভালোবাসা, কেয়ারিং দেখে আমি মাঝেমধ্যে অবাক হই। একটা মানুষ এত ভালো হয় কি করে। মন বলে, এইতো মনের মতো কাউকে পেয়েছি।

দেখতে দেখতে বিয়ের সাত বছর হয়ে গেলো। সপরিবারে আমরা লন্ডনে থাকি। ভালোবাসা এক বিন্দু ও কমেনি ফুয়াদের। ছেলের সাথে বন্ডিং ভালো ফুয়াদের। ফুয়াদকে বাবা বলেই ডাকে সে। তাদের যখন একসাথে আড্ডা দিতে দেখি তখন আমার একটা কথাই মনে হয়, মাঝেমাঝে রক্তের সম্পর্ক থেকেও আত্মার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়। ফুয়াদ তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে।

আয়ান তার মা বোন কদিন পরপর কল দেন ছেলের সাথে কথা বলার জন্য। ফুয়াদ নিজে থেকে কথা বলিয়ে দেয়। শুনেছি সেই মেয়েটা আয়ানের সাথে নেই। ডিভোর্স হয়েছে। আর বিয়ে করেনি কাউকে।

মাঝেমধ্যে বুক খানিক হু হু করে উঠে আয়ানের জন্য। প্রথম ভালোবাসা সে। পরমুহূর্তে যখন আবার মনে পড়ে আমার সাথে করা তার অ*ত্যা*চা*র। তখনি ঘৃ*ণা জেগে উঠে।

[সমাপ্ত ]

ভুল থেকে ফুল পর্ব-০২

0

#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_২

সব ঠিকঠাক চলতে লাগল। আয়ান যে আমার অজান্তেই তার পরিবারকে এ বিষয় জানিয়েছে, সেটা আমি জানতাম না। তার মা-বাবা সবার পরামর্শেই সে সালিশ বসিয়েছে। নিজের স্ত্রীকে সবার সামনে এভাবে সালিশ ডেকে অপমান করার বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারছি না। না চাইতেও তার প্রতি খারাপ লাগা আসছে। আমার জন্য আমার মা-বাবার বা সম্মান কোথায়! সে আমার পরিবারের দিকটা ভেবে দেখলে পারতো। এত মিনতি করার পরেও সে কেন এমন কাজ করল! কেন অন্যদের কথা শুনতে গেলো! তার নিজের বিবেক নেই!

উপস্থিত সবার সামনে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “তুমি কি সংসার করতে চাও?”

কোন কথা না বলে আমি হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ালাম।

“যদি করতে চাও তাহলে আজ থেকে ওই ছেলের সাথে কখনও কোনও কথা বলবা না।”

বাধ্য মেয়ের মতো আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে আসলাম নিজের রুমে। জোরে কান্না পাচ্ছে আমার কাঁদতে লাগলাম। মা এসে বললেন, এমনভাবে তোর জন্য আমাদের ছোট হতে হবে কখনও ভাবিনি।

মাকে পুরো বিষয় বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে হলো না আমার। থাকার জন্য ও বললাম না। ফুপিয়ে কাঁদছি। আয়ান হেসে ঘরে ডুকলো। জড়িয়ে ধরলো আমায়।এই প্রথমবার তার জড়িয়ে ধরায় গা গিরগির করতে লাগল। সে বলল, সব ঠিক হয়ে গেছে, আর কোনও ঝামেলা নেই। আমিও তোমায় ক্ষমা করে দিলাম।

একবার বলতে ইচ্ছে হলো, আমি তোমার বউ হই।আমার ভুলগুলো একান্ত তুমি শুধরাবে। তুমি কেন দু’পরিবারে সেটা জানাবে। এতে আমি আর আমার পরিবার অপমানিত হয়েছি। তোমার প্রতিও ঘৃ*ণা আসছে। কিন্তু কিছুই বললাম না। সে বুঝার হলে আগেই বুঝতো।

কয়েকদিন এই বিষয় নিয়ে আমার মন খারাপ থাকলেও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেল। হাসি আনন্দে দিন কাটছে আয়ানের সাথে। ওদিকে ফুয়াদ বিভিন্ন নাম্বার থেকে, বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে, হোয়াটসঅ্যাপ এ নক করে, আমি সাথে সাথে ব্ল*ক দেই। আমি চাই না আবার আমার সংসারে অশান্তি লাগুক।

আমি প্রে*গ*ন্যা*ন্ট হই। মা হতে চলেছি, এই অনুভূতি বলে বুঝানের মতো না। আয়ান আর আমি ভীষণ খুশি। ডেলিভারি হওয়ার দুমাস আগে বাপের বাড়ি চলে যাই। আয়ান প্রথমে রেগুলার খোজ খবর নিলেও আস্তে আস্তে তার মাত্রা কমে আসলো। এমনিতে শরীর ভীষণ খারাপ তার উপর তার এই পরিবর্তন আমাকে গভীর ভাবাচ্ছে। আমি কোনমতে শান্তি পাচ্ছি না। দুই দিনে, তিনদিনে একবার সে আমায় কল করে তাও তিন চার মিনিট কথা বলে শেষ। অভিমান করে আমিও আর কল দেইনা। এই মানসিক অশান্তি ভোগ করতে করতে চলে আসলো আমার ডেলিভারি ডেট। সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চাইলেই আমার দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারতো কিন্তু নেয় নি। শুধু এক দুইবার খোজ নিয়েছে, ব্যাস। আমার ছেলে বাবু হয়েছে। গভীর রাতে বাবুকে বুকে জড়িয়ে ইচ্ছেমতো কাঁদলাম। সে কেনো আসলো না এইজন্য।

একটা সংসার তো আর সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমি দ্রুত তার কাছে ফিরলাম। মানুষটার হয়েছে টা কি তা দেখার জন্য। নজরুলের মতো লম্বা চুল আর উদাস উদাস ভাব দেখে আমার সন্দেহ হলো বেশ। কিন্তু প্রকাশ করিনি কিছু। আমার সাথে ভালোই ব্যবহার করছে। বাবুকে যত্ন করছে। মেয়ে তো আমি, তাই সে শত আঘাত দেওয়ার পরেও একবার ভালো করে কথা বললে সব ভূলে যাই।

সপ্তাহ যেতে না যেতে একদিন তার ফোনের ওয়ালে একটা মেসেজ আসলো হোয়াটসঅ্যাপ এর। স্বাভাবিক মেসেজ না, প্রেমের কথা। আমার দম বন্ধ লাগছিলো এটা দেখে। কিন্তু আয়ানকে বুঝতে দেইনি। তার ফোনের পাসওয়ার্ড চেন্জ ছিলো তাই কৌশলে আগে সেটা জানলাম। সারাদিন অশান্তিতে থেকেছি, রাতে অনেক আগে শুয়ে পড়লেও ঘুমাইনি। ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি। সে যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন রাত তিনটা। তার ফোনটা হাতে নিয়ে চুপিচুপি বারান্দায় গেলাম। ফোন কল, মেসেজ, মেসেন্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু সবকিছুতে একই মেয়ে। ভালোবাসার, প্রেমের, রোমান্টিক আর অ*শ্লী*ল*তার মেসেজে ভরপুর সব বক্স।এসব দেখে বসে পড়লাম আমি। অদ্ভুত কাঁপুনি হচ্ছে পুরো দেহে। কান্নারা দলা বেধে গলায় এসে জড়ো হলো। মুখে কাপড় গুজে চিৎকার করলাম। কবে থেকে এসব শুরু তা খুজতে লাগলাম। সব দেখে বুঝলাম, আমি বাড়ি যাওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই সে রিলেশনে জড়িয়েছে। নিজেকে নিজের কাছে খুব ছোট মনে হলো আমার। আমি এতো আকর্ষণীয় হয়েও তাকে আমাতে আসক্ত করতে পারলাম না।

আয়ান টের পেয়ে উঠে আসলো। কেড়ে নিলো ফোন। কেঁদে কেঁদে বললাম, “এটা কি করলে? আমাদের বাচ্চা আছে এখন! এখন কি এসবের সময়?”
সে ঝটপট উত্তর দিলো, “তুমি প্রেম করতে পারছো, আমি পারব না কেন?”
আমি শকড খেলাম তার কথায়। বললাম, “আমি জাস্ট ক’দিন কথা বলেছি। এত ভালোবাসার আর নোংরামি মেসেজ করিনি। আমি জড়ানোর আগেই ফিরে এসেছি। অনুতপ্ত হয়েছি। মাফ চেয়েছি। আর তুমি! মেসেজ দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েটা তোমার বউয়ের থেকেও বেশি ঘনিষ্ঠ। ”

আয়ান কোন উত্তর দেয় নি। সে অনুতপ্ত ও নয়। আমার মন বলছিলো, এই বোধহয় বলবে, আর এমন হবে না রুহি। মাফ করে দাও। কিন্তু সে বলেনি এমনটা। ব্যাপারটা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। সারারাত কেঁদে কেঁদে কাটালাম। কাউকে বলার ও সাহস নেই। বললে নিজেরই লজ্জা লাগবে। যদি কেউ করুণা করে বলে উঠে, বউ এত সুন্দর হওয়া স্বত্বেও বর আরেক মেয়ের সাথে কথা কয়, ইশ বেচারী!
এই যে এই কথাগুলো আমি মেনে নিতে পারব না। নিজেরে বড্ড ছোট লাগবে।

পরের দিন রাত ১২টায় সে টেক্সট করছে ওই মেয়ের সাথে। আমি গিয়ে পাশে বসি। না চাইতেও চোখের পানি পড়ছে। সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ ও নাই। রাগে, জেদে, কষ্টে রুমে এসে ব্লে*ড নিয়ে নিজের হাত কাটতে গেলাম। কেটে কেটে একদম রক্তের নদী বসিয়ে ফেলব, এমনটা মনোভাব। হুট করে তখন মাথায় আসলো একটা কথা, আমি পাশে বসে কান্না করা স্বত্বেও যে ফিরে তাকায়নি একবার। আমার পুরো শরীর কেটে ফেললেও তার কিছু যাবে আসবে না। আমি উঠে দাড়ালাম। নতুন করে শক্তি পেলাম। ওযু করে তাহাজ্জুদ পড়লাম। কেঁদে কেঁদে দোয়া করলাম। দীর্ঘ সময় মোনাজাত করার পর ভেতরে শান্তি অনুভব করলাম।

তারপর থেকে আমাকে কেমন যেন অন্যচোখে দেখে সে। অল্পস্বল্প ভুল হলে শাশুড়িকে, এমনকি আশেপাশের সবাইকেও বলে। তারা আবার আয়ানকে ফিরতি বলে, বউকে এতছাড় দিতে হয় না। শাষন করতে হয়। আমি এসব শুনি আর আড়ালে গিয়ে চোখের পানি ফেলি। আয়ানকে অনেক বুঝাই। কিন্তু সে ঠিক হয় না। আমি হিসেব খুজি, কি করে একটা মানুষ এভাবে রাতারাতি পরিবর্তন হয় হুট করে। আমার হিসেব মেলে না।

আমার প্রতি তার অবহেলা চরম পর্যায়ে পৌছাচ্ছে। অযথা খুত খুজে। বকে। অপমান করে। বহুদিন অপেক্ষা করেছি, সে ভালো হওয়ার। একটা বাচ্চা আছে এজন্য সব ছাড় দিয়েও থাকতে চেয়েছি। কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। অপারগ হয়ে ভাবলাম, আমার বাচ্চার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। তখন মা-বাবাকে পুরো বিষয়টা জানালাম। বললাম, আমি আর পারছি না। পাগল হয়ে যাব এভাবে থাকলে। আমি আসছি বাড়ি।

সপ্তাহের ভেতর চলে গেলাম বাপের বাড়ি। কিছুদিন যেতেই আয়ান যায়, মিনতি করে নিয়ে আসে। বলে আর করবে না এসব। এভাবে কয়েকবার চলল, আমি যাই আর সে ‘করব না’ বলে নিয়ে আসে। কিছুদিন ভালো যায় তারপর আবার শুরু হয় অশান্তি। খারাপ ব্যবহার করে। আমার সত্যিই খুব ঘৃ*ণা চলে আসল আয়ানের প্রতি। ঠিক করলাম, তার কথায় আর ভুলব না। হাজার মিনতি করলেও ফিরব না। সে আমাকে জ্বালাবে, আবার ছাড়বে ও না। অন্য জায়গায় ফ*ষ্টি*ন*ষ্টি করে বেড়াবে। এবার তাকে চিরতরে মুক্তি দেবো।

চলমান…..!

ভুল থেকে ফুল পর্ব-০১

0

#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_১

শশুরবাড়িতে আজ আমার বিচারের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো ড্রয়িংরুম ভর্তি মানুষজন। দুই পক্ষের লোক উপস্থিত। সালিশ ডেকেছে আমার স্বামী আর তার মা-বাবা। আমার স্বামী আয়ান বসে আছে সোফার উপর। তার মুখে শয়তানি হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার কাছে হাসিটা পৈশাচিক হাসি লাগছে। অনেকক্ষণ কি সব কথাবার্তা হওয়ার পর আমাকে খানিক আগে ডাকা হয়েছে। আমি এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আমার বিশ্বাস করতে এখনও কষ্ট হচ্ছে যে, আমার জন্য এ সালিশ বসেছে আর সেটাও আমার স্বামী করেছে। লজ্জায় ঘৃণায় এখনি আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। মন বলছে, এখনি ফ্লোর দু’ভাগ হয়ে যাক আর আমি গর্তের মধ্যে ডুকে পড়ি।

আজ থেকে প্রায় তিনবছর আগে আয়ানের সাথে আমার বিয়ে হয় পারিবারিক ভাবে। ঠিকঠাক চলছিলো সব কিন্তু বাধা আর মনোমালিন্য তখনি তৈরি হলো, যখন আমি অন্য একজনের সাথে প্রেমে জড়িয়ে যাই। অপর মানুষটির সাথে প্রায় এক মাস কথা বলার পর আয়ান বুঝে যায় ব্যাপারটা আর আজ সেজন্য আমার এই অবস্থা। আমি স্বামী রেখে অন্য একজনের প্রেমে পড়েছি ঠিক। কিন্তু ভুলটা আমার হলেও আমার স্বামী এতে বেশি দোষী। তার কারণেই আমি আবার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছি।

আমি রুহি। দেখতে বেশ সুন্দর, আকর্ষণীয়, মায়াবী আর আবেদনময়ী। বেশিরভাগ ছেলে প্রথম দেখায় আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য। ছোট থেকে আমি আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে আসছি। কিন্তু, ‘তুমি দেখতে বেশ মায়াবী, চোখ ফেরানো দায়’ এই কথাটা হাজারজনের থেকে শুনেও আমার মন ভরতো না, ভালো লাগতো না। মন চাইতো, বিশেষ একজনের থেকে এই কথাটা শুনতে। তারপর হুট করে বিয়ে হলো। আয়ান আসলো আমার লাইফে। আমাদের মধ্যে প্রেম হলো। ভালোবাসা হলো। কিন্তু বিয়ের তিন বছর হতে গেলো, প্রথম প্রথম এক দুইবার সে আমার প্রশংসা করলেও আর করেনি। চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও বলেনি, জানো রুহি? তোমার চোখজোড়া অদ্ভুত সুন্দর! অন্তরঙ্গ মুহুর্ত ছাড়া সে কখনও রোমান্টিক আলাপ ও করেনি। চাঁদনী রাতে হাতে হাত ধরে চাঁদ দেখে গল্প করার কথা থাকলেও আমাদের এমন মুহুর্ত আসেনি। আমি আমার ইচ্ছের কথা বললেও সে নীরব থাকতো। কোনকিছুতে তার ইন্টারেস্ট নেই। যা লাগবে সে তা ঠিক টাইমে এনে দেবে, তার ভালোবাসা এইটুকুতে সীমাবদ্ধ। কেয়ারিং এর বিষয়ে সে জিরো। আমার মন চাইতো, কেউ আমায় ভীষণ যত্নে রাখুক। চোখে হারাক। মন খারাপের দিনগুলোতে আমার পাশে বসুক। আমার মন ভালো করার দায়িত্ব নিক। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি।

আমি তাকে খুব ভালোবাসি। আমার থেকেও বোধহয় বেশি বাসি। কিন্তু তবু হৃদয়ে অশান্তি লাগতো। সে থাকা স্বত্বেও ভেতর বাড়িতে অদ্ভুত শূন্যতা বিরাজ করতো। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। খালি মনে হতো, আমি এখনও পরিপূর্ণ না। আমার মনের মতো কাউকে পাইনি।

লেখাপড়া ছাড়া নিজেকে অচল লাগে। তাই বিয়ের পরেও লেখাপড়া কন্টিনিউ চলছে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। কলেজে অনেকের সাথে পরিচয় হয়। কেউ কেউ যেচে এসে কথা বলে। বিবাহিত শুনার পর মন্তব্য করে, যে আপনাকে পেয়েছে সে খুবই ভাগ্যবান। তাদের থেকে এ কথা শুনলেই আমার মন ভেঙে যায়। মনে হয়, সবাই বলে আমারে যে পাইছে সে ভাগ্যবান কিন্তু আজ অব্দি একবারও সে বলল না, তোমাকে পেয়ে আমি ভাগ্যবান। অচেনা অভিমান আর মন খারাপি ভর করে তখন আমার উপর।

এক বৃষ্টিস্নাত দিনে লাইব্রেরী বসে আছি।হুদাই বইয়ের পাতা উলটপালট করছি। বান্ধবী চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, সামনে তাকিয়ে দেখ লাল টি-শার্ট পরা একটা ছেলে তোকে বারবার দেখছে। আমি আড় চোখে তাকালাম। সত্যিই তো, ছেলেটা একবার বইয়ের পাতায় চোখ বোলায় আর একবার আমার দিকে তাকায়। বেশ বুঝলাম, বইটই পড়ছে না। হুদাই আমাকে দেখার জন্য এই বাহানা করছে।

সেদিনের পর থেকে লাল টি-শার্ট ওয়ালা ছেলেটা কখনও সামনে থেকে আবার কখনও দূর থেকে আমাকে দেখতো। একদিন তো সোজা সামনে এসে গোলাপ নিয়ে বসে পড়লো হাটু গুজে। আমিসহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়ে অতি বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। সে সেসব দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। খালি দেখতে ইচ্ছে করে। না দেখলে মনের উঠান বিষাদে ভরপুর হয়। তুমি কি তোমাকে দেখার সারাজীবন সুযোগ দেবে আমায়? বিনিময়ে আমি ভালোবাসা দেবো। আগলে রাখব। যত্নে রাখব।”

কোন অস্বস্তি ছাড়া স্ট্রংলি ছেলেটা এক নাগাড়ে বলে ফেলল এত কথা। আমি কি বলব না বলব বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু এতটুকুই বলতে পারলাম, “উঠুন আপনি।”

আমার বান্ধবী তাকে বলল, “আপনি ভুল করছেন। হয়তো জানেন না। রুহি বিবাহিত। ”

সে চোখজোড়া বন্ধ করে আবার খুলল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সহজ গলায় বলল, “ভালো লাগার সময় তার কোথাও লেখা ছিলো না যে, সে বিবাহিত। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন যখন তাকে নিয়ে বিভাের থাকতাম, তখনও আমার অনুভূতিরা একবারের জন্য ও জানান দেয়নি যে, মেয়েটা বিবাহিত। ভালো লাগা যখন ভালোবাসায় রুপান্তর হলো, তখনও এই শহরের একটি কাকপক্ষী ও বলেনি সে বিবাহিতা। সবশেষে এখন জানলাম সে বিবাহিতা। এখন তাকে ভুলে যাওয়া, এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

তারপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ফুয়াদ। ইংরেজি ফাইনাল ইয়ারে আছি। এখন তুমিই ডিসিশন নাও আমায় গ্রহন করবে কি না।”

আমি তো স্পেচল্যাস।এক পলক শুধু তাকালাম তার দিকে। তাকাতেই বুক ধুক করে উঠলো। অদ্ভুত সুন্দর ঘন পাপড়িওয়ালা বিশিষ্ট টানাটানা তার চোখ দুটো। মায়ায় কাড়া শ্যামলা বর্ণের চেহারা। বিস্তৃত কপালের উপরে কাটাকাটা করে চুল খাড়া করে রাখা। মনে হচ্ছে কেউ চুলগুলো সোজা করে ধরে রেখেছে উপরে। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললাম। অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে বললাম, “আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“আমি অপেক্ষায় থাকব।” এই বলে সে দ্রুত পায়ে চলে গেলো।
আমার মন খচখচ করতে লাগলো। মস্তিস্কে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো তার সুন্দর কথাগুলো।

ফিরিয়ে দেবার পরেও ফুয়াদ আমাকে দেখতো। আড়াল থেকে আবার সামনে থেকেও। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকতো। তেমনি আরেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুমবৃষ্টির দিনে আমি ভিজে জবুতবু হয়ে কলেজ ডুকছিলাম। সে কোথা থেকে এসে হেঁচকা টান দিয়ে ছাতার ভেতর ডুকিয়ে রাগ ঝাড়লো, “কোথাও দাড়াতে পারতে! জ্বর আসবে তো!”
আমি কোন উত্তর না দিয়ে বাংলা ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় উঠলাম।
দাড়াও আমি আসছি বলে দশ মিনিটের ভেতর একটা ওয়ান পিস, ওড়না আর টাইলস এনে দিয়ে বলল, “চেন্জ করে এসো তাড়াতাড়ি।”
আমি সত্যি তার এসব আচরণে অভিভূত হয়ে যাচ্ছি।

এইভাবে চলতে চলতে তার ভালোবাসা, কেয়ার দেখে আমিও তার প্রেমে পড়ে গেলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতাম। কলেজে এড়িয়ে চলতাম। তার কারণ কম বেশ অনেকে জানে আমি মেরিড।

একদিন সারাবেলা অফলাইন থাকায় সে সিমে মেসেজ করছিলো, “কোথায় তুমি? তুমি জানো না, তুমি ছাড়া সবকিছু আমার বিষাদ লাগে।”
সেই মেসেজটা আায়ান দেখে ফেলে। কথায় আছে না, কোনকিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। আমার বেলায় ও তাই হলো। আয়ান এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমি কাঁপতে লাগলাম। চারপাশ অন্ধকার লাগতে শুরু করলো। আমি কিছু না ভেবে তার পায়ে পড়ে কান্না শুরু করে দিলাম। মিনতি করে বললাম, আমি ভুল করে ফেলেছি। আমার ভুল হয়েছে। আমায় ক্ষমা করে দাও। কখনও আর কারও সাথে কথা বলব না। মনে ভয় লাগতে শুরু হলো, যদি এই কারণে আয়ান আমাকে ছেড়ে দেয়, আমি মানতে পারব না। আমি আমার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসি। তার জন্য আমি হাজারও ফুয়াদকে ছেড়ে দিতে পারব। আয়ানকে সারারাত দিন মিনতি করলাম। কাউকে বলো না প্লিজ। আমি ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম আর তার কারণ এই এইগুলো। তুমি হয় এমন হও, আমাকে কেয়ার করো, আর না পারো করো না। ছোট্ট একটা জীবন, অত কিছ লাগব না আমার। তোমার সাথে থেকেই কাটিয়ে দেবো পুরো জীবন। আয়ানকে স্বাভাবিক দেখালো। বলল, মাফ করলাম। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। তার প্রতি ভালবাসাটাও আরও বাড়ল।

ওদিকে ফুয়াদ ফোন কল মেসেজ দিয়ে পাগল করে দিচ্ছে। সময় করে তার সাথে কথা বললাম। বুজিয়ে বললাম, “তুমি জানো আমি বিবাহিতা আর তা জেনেই আমাকে ভালোবেসেছো। কিন্তু আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবাসিনি। বড়জোর প্রেমে পড়েছি বলতে পারো। তোমার কথার প্রেমে পড়েছি। তুমি খুব সুন্দর আর গুছিয়ে কথা বলো! হয়তো এজন্য! ”

“তাহলে আমার সব অনুভূতি কি তোমার কাছে শুধু কথার খেলা ছিল? আমি তোমাকে ভালোবেসে নিজেকে হারিয়েছি, আর তুমি সেটা শুধু কথার মোহ বলে উড়িয়ে দিচ্ছো?”

“দেখো ফুয়াদ, তোমার জন্য আমার সংসার ভাঙ্গুক এটা কখনও চাইব না। আমায় আর খুজো না প্লিজ। ভুলে যেও। কখনও কথা বলার চেষ্টা করো না।”

“তোমার জন্য যদি আমার সঙ্গে কথা বলা কঠিন হয়, তাহলে চুপ থাকো। কিন্তু মনে রেখো, আমার মন থেকে তোমার জায়গাটা কখনো মুছবে না।”

“তোমার মন থেকে মুছে যাবে কি যাবে না, সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি স্পষ্ট বলতে চাই—তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা আমার নেই।”

ফুয়াদকে ফিরতি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবকিছু থেকে ব্লক করে দিলাম। তাকে দেখলে হয়তো আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এজন্য কলেজ যাওয়া ও সাময়িক অফ করলাম।

আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ পর্দা কেন ফরজ করেছেন। যতই বিবাহিত আর অবিবাহিত হোক না কেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকে। এসে যায়।

চলমান…..!

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১২

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব- ১২
‘এই ছাড়ুন আমাকে৷
‘কোলে বসে আছো ভালো লাগছে না বেবি৷
‘আমাকে ছাড়ুন?
‘আমার প্রতি এতো রাগ?
‘রাগ, অভিমান তার সাথে করা যায় যাকে মানুষ ভালোবাসে। আপনি তো সুনামি যার আছড়ে পড়ার আঘাত কত কাল আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে জানা নেই! আপনার প্রতি রাগ অভিমান বেমানান। আপনার প্রতি থাকবে ক্ষোভ আক্ষেপ।
‘হুট করেই জিয়ান বলে, আই নিড ইউর লিপস যাস্ট টু মিনিট।
‘আমি ইংরেজি বুঝি না৷
‘জিয়ান হাত টান দিয়ে বলে, যে সাহিত্য বোঝে সে এই সামান্য কথা বুঝবে না!
‘যে হাত সারাজীবন ধরে রাখতে পারবেন না সে হাত ধরার সাহস কেনো দেখাচ্ছেন?
‘জিয়ান হাতটা ছেড়ে দিলো৷
‘নয়না দ্রুত বারান্দা থেকে রুমে চলে আসলো।
‘জিয়ান সেভাবেই বসে রইলো। সে হঠাৎ কেনো নয়নার কাছে অমন আবদার করলো! কিন্তু এই মূহুর্তে জিয়ানের মনে হচ্ছে নয়নার ঠোঁটের স্পর্শ তার প্রয়োজন খুব প্রয়োজন কারো উষ্ণ আলিঙ্গন।

নয়না রুমের লাইট অন করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো। নিজের চেহারার দিকে তাকালো। জীবনের মাত্র ষোলতম বছর পার করছে নয়না৷ কত রঙিন স্বপ্ন কত প্ল্যান কত আশা ছিলো ছোট মস্তিষ্কে। একটা দিন একটা আকস্মিক ঘটনা তার জীবনটা মূহুর্তে পাল্টে দিলো! কি হলো এই পাঁচটা দিন তার সাথে? যে হাত আজ পর্যন্ত কেউ সাহস করে স্পর্শ করতে পারেনি! আজ সেই শরীর জুড়ে কারো স্পর্শ লেপ্টে আছে৷ ঠোঁটে হাত দিয়ে কেঁপে উঠলো নয়না। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো বিভৎস সেই রাতের দৃশ্য। কেউ টেনে তার লেহেঙ্গার ওড়না ছুড়ে ফেললো৷ অন্ধকার রাত মোমবাতির টিমটিম আলো আর নানা রকম ফুলের সৌরভ। সে-সব নিছক তাকে আঘাত করার জন্য সাজানো। জোর করে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিলো৷ সে কি যন্ত্রণার। নয়নার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগলো। হঠাৎ কেউ তার কাঁধে হাত রেখে বলে,কি হয়েছে তোমার?

‘নয়না হুট করে উঠে এসে সামনে থাকা মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে, কাঁপতে থাকে৷

‘জিয়ান নয়নাকে আগলে রাখে নিজের বক্ষে। শান্ত স্বরে বলে, কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে কি নিয়ে সমস্যা?

‘নয়না জিয়ান কন্ঠ শুনো চোখ খুলে জিয়ানের মুখের দিকে তাকায়। চিৎকার দিয়ে বলে, দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন আমার সাথে এমন করবেন না? ছেড়েদিন আমাকে।

‘জিয়ান হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে নয়নার দিকে।

নয়না ততক্ষণে জিয়ানের কয়েক হাত ধুরে সরে দাঁড়ায়৷

‘জিয়ান বেড সাইট টেবিলের উপরে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নয়নার সামনে পা বাড়ায়।

‘নয়না আরো দূরে সরে যাচ্ছে আর বলছে,আমাকে ছেড়েদিন।

‘জিয়ান থমকে দাঁড়ালো। নরম স্বরে বলল,কি হয়েছে তোমার সুনয়না৷ ভয় পাচ্ছো কেনো? দেখো আমি তোমাকে ধরিনি। আর এখানে আর কেউ নেই৷ ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই৷।

‘নয়না আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো। মাটিতে লুটিয়ে পরার আগেই জিয়ান নয়নাকে নিজের বাহু বন্ধনে আগলে নিলো। কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজে নয়নার মাথার সামনে বসলো। কি করবে এখন সে? এ বাড়ির কাউকে কিভাবে বলবে।মাথা নিচু করে বসে থেকে মোবাইল নিয়ে তার ফ্রেন্ড অনিকেতকে কল করলো৷ অনিকেত পেশায় একজন ডাক্তার।

‘ভ্রু কুচকে মোবাইলের দিকে তাকালো অনিকেত।এতো রাতে কল করার মত মানুষ অনিকেতের জীবনে নেই! তাহলে কে কল করলো? বিরক্তি নিয়ে মোবাইলের স্কিনে তাকাতেই দেখতে পেলো জ্বলজ্বল করছে রেজা নামটা। অনিকেত কাল বিলম্ব না করে সাথে সাথে রিসিভ করে বলে,কিরে শা’লা এতোদিন পর মনে পরলো? শুনলাম এরমধ্যে বিয়েও সেরে ফেলেছিস?

‘তোর কথা পরে শুনবো আগে আমার কথা শোন..তারপর অনিকেতকে সবটা খুলে বলল৷

‘অনিকেত সব শুনে বলে, সম্ভবত ভাবির প্যানিক আট্যাক হয়েছে৷ এই পরিস্থিতি সাধারণত কয়েক মিনিটের মধ্যে শীর্ষে পৌঁছায়, কিন্তু তখনও তা ভয়াবহ বা অস্বস্তিকর অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। প্যানিক অ্যাটাক সাধারণত অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা নির্দিষ্ট পরিস্থিতি সামাজিক বা কর্মজীবনের চাপ এই ধরনের আক্রমণকে হতে পারে। তুই এক কাজ কর, চোখে মুখে পানির ছিটা দে।জ্ঞান ফিরলে আতঙ্কিত এবং বিচলিত থাকতে পারে।ভাবির পাশে থাক এবং শান্ত থাকার চেষ্টা করবি, ভাবিকে সান্ত্বনা দিবি তাকে অনুভব করাবি যে সে নিরাপদ আছে। মনোযোগ অন্য দিকে নেয়ার চেষ্টা করবি৷ আর কয়েকবার লম্বা শ্বাস প্রশ্বাস নিতে বলবি৷ দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছুই নেই প্রথম প্রথম অনেক মেয়েই এটাকে ভয় পায়।

জিয়ান আর কোন কথা শুনলো না৷ খট করে ফোনটা কেটে দিলো। জিয়ান ভালো করেই জানে এখন অনি উল্টোপাল্টা কথা বলবে।

‘ফোন কেটে দিলো! মানুষ ঠিকি বলে বৌ পেলে মানুষ সব ভুলে যায়। আচ্ছা আমি কবে সব ভুলে যাওয়ার মত বৌ পাবো? বাবা আমার কি বিয়ে হবে না?

‘জিয়ান বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা জগটা থেকে সামান্য পানি নিয়ে নয়নার চোখমুখে ছিটিয়ে দিলো৷

কিছুক্ষণ পর নয়না চোখ খুললো৷ জিয়ান নয়নার মাথা নিজের বক্ষে নিয়ে,নয়নাকে বললো,তুমি তো আমাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিচ্ছেলে?বললেই হতো আজ তোমার বাচ্চাদের মত ঘুমোতে ইচ্ছে করছে তাহলেই আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম।

‘ছাড়ুন আমি বালিশে শোবো।

‘জিয়ান নয়নার মাথা বালিশে রেখে সরে বসলো। এই তুমি জোরে শ্বাস নিতে পারো? এই আমার মত করে?

‘এটা কোন ব্যপার হলো? এই দেখুন বলেই জোরে শ্বাস নিলো।

‘এতো আমার চেয়ে কম হলো৷

‘নয়না আবার শ্বাস নিলো লম্বা শ্বাস। তারপর জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে আপনি সত্যি গান গাইতে পারেন?

‘নাহহ, পারি না আমি গান গাইলে তোমার এলাকার সব লোক লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হবে। এতো বাজে কন্ঠ আমার।

‘নয়না উচ্চ স্বরে হেসে বলে,এতো বাজে কন্ঠ আপনার?

‘হুম খুব বাজে একবার কি হয়েছিলো জানো?

‘নিশ্চিত আপনার গান শুনে কুকুর তাড়া করে ছিলো আপনাকে!

‘নয়না উঠে বসলো। এই একটা হেল্প করেন আমার গয়না গুলো খুলতে সাহায্য করেন।

‘জিয়ান নয়নার গহনা খুলতে সাহায্য করলো৷ নয়না উঠে দাঁড়ালো। ড্রয়ার থেকে ড্রেস বের করে বলে,আমি চেঞ্জ করে আসি আপনিও চেঞ্জ করুন৷

‘আমি তো কিছু নিয়ে আসিনি?

‘আপনার শ্বশুর আব্বা আপনার জন্য ড্রেস কিনে রেখেছে ওই যে চারটা শপিং ব্যাগ দেখছেন তাতে আপনার প্রয়োজনীয় কাপড় পেয়ে যাবেন।

‘নয়না ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার পর জিয়ান ব্যাগ খুলে অবাক, টিশার্ট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট,তোয়ালে শার্ট, ব্লেজার সব আছে এতে! একটা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বের করে পরে নিলো। নয়নার রুমটার দিকে নজর গেলো। পুরো রুম জুড়ে হোয়াইট আর পিংক কালারের ফার্নিচার। রুমের রংটা হালকা পার্পল। বলতেই হয় নয়না খুব আদুরে মেয়ে। তাইতো প্রিন্সেসের মত রুপটা সাজানো। হঠাৎ চোখ পরলো দেয়ালে টাঙানো একটা পেইন্টিংয়ের দিকে৷ অবাক হয়ে বলে এটা এখানে কি করছে?

‘নয়না ওশারুম থেকে বের হয়ে বলে,আমার রুমটা খুব সুন্দর তাই না? সব কেবিনেট আমার মন মত করে বানানো।

‘হুম খুব সুন্দর। তবে তোমার চেয়ে..

‘কি আমার চেয়ে?

‘তোমার চেয়ে কম।

‘এই পাস্তা খাবেন? আমার খুব খিদে পাচ্ছে এই রাত আর সাথে পাস্তা আর কফি যাস্ট জমে যাবে।

‘তুমি পারো?

‘ইয়েস মিস্টার ড্রাইভার।

‘নট ড্রাইভার ইট’স পাইলট।

‘একি তো।

‘কখনো রাত জেগে উপন্যাস পড়েছেন?

‘নাহহ আমার এসব পড়ার সময় হয়নি। সাকালে ভার্সিটি দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত পাইলট হওয়ার জার্নি এভাবেই কেটেছে দিন।

‘এরজন্য আপনার মধ্যে কোন রসকষ নেই। উপন্যাসের নায়ক চরিত্রগুলো হয় কল্পনার পুরুষের মত। তাদের রাগ তাদের আগলে রাখা, তাদের অ্যাটিটিউড সব কিছুই সুপার সে উপার৷ আর ভালোবাসা? তাতো বলার ভাষা রাখে না।

‘তোমার উপন্যাস নিয়ে গবেষণা শেষ হলে পাস্তা আর কফি বানিয়ে আনো।

‘এই যে মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। আমার পিছু পিছু আসেন।

‘তোমার বাসার কেউ দেখে ফেললে?

‘দেখে ফেললে কি? আমরা কি চোর নাকি? জিয়ানের হাত ধরে বলে চলেন তো।

‘রান্নাঘরে এসে নয়না, চুলায় পানি বসালো, তাতে সয়াবিন তেল, আর লবন দিলো।

‘জিয়ান জীবনে প্রথমবার কিচেনে ঢুকেছে৷ অবাক হয়ে বলে,সাদা পানিতে তেল আর নুন কেনো দিলে?

‘ওরেহহহ ড্রাইভার সারাজীবন বইয়ের পাতায় ডুবে থাকলে জানবেন কি করে? চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন আর দেখুন ঘরোয়া স্টাইলে সহজ ভাবে কিভাবে পাস্তা রান্না করতে হয়।

‘পানি ফুটে উঠলে নয়না গ্যাস কমিয়ে তাতে পাস্তা দিলো। এরপর ফ্রিজ থেকে টমেটো, ক্যাপসিকাম, ধনিয়াপাতা, সয়াসস, টমেটো সস, কাঁচা মরিচ বের করে আনলো। একে একে পেয়াজ, টমেটো, ক্যাপসিকাম কুচি করে নিলো৷ ততক্ষণে পাস্তা সেদ্ধ হয়ে গেছে। পাস্তা ছাকনীতে দিয়ে চুলায় প্যান বসিয়ে একে একে সব দিয়ে নাড়া চাড়া করে এরপর ডিম দিলো ডিমটা হয়ে এলে পাস্তা ঢেলে দিলো৷ নামানোর আগে ধনিয়া পাতা দিয়ে নামিয়ে নিলো৷ হিটারে পানি গরম করে, তাতে গুঁড়া দুধ, কফি পাউডার দিয়ে মিক্সড করে নিলো৷

‘জিয়ান এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে রান্না দেখছিলো৷ এবার বলল,আমি ব্ল্যাক কফি পান করি। সুগার আর মিল্ক পাউডার এভোয়েট করি।

‘আয়হায় কি বলেন! যারা ব্ল্যাক কফি পান করে তারা তো বিষ পান করলেও মরবে না৷

‘হোয়াট?

‘আমার মাথা! চলুন।

‘জিয়ান হাঁটা শুরু করলো৷

‘আরেহহহ ওই মিস্টার ড্রাইভার এতোসব আমি একা রুমে নিয়ে যাবো কি করে?কফি মগ আপনি নিন পাস্তার প্লেট আমি নিচ্ছি।

#চলবে

তিনি আমার সৎ মা পর্ব -৮(শেষ পর্ব)

0

তিনি_আমার_সৎমা
পর্বঃ৮ (শেষ পর্ব)
মিথিলা জামান নিভা

“নীরার মা মা*রা গেলো কীভাবে আফজাল?”
আমি দম আটকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি যেনো নিঃশ্বাস ছাড়লেই কেউ টের পেয়ে যাবে।
“মা মা মানে? জানো না তুমি রাত্রি আত্মহ*ত্যা করেছে?”
“ভয় পাচ্ছো কেনো আফজাল? হ্যা আমি জানি, কিন্তু তোমার মুখ থেকে একটু শুনি। কেনো আত্মহ*ত্যা করলো সে?”
“কেনো করেছে সে আমি কি জানি। মহিলা মানুষ, শেষের দিকে পাগল হয়ে গিয়েছিলো। আর পাগলে কি না করে।”
“আচ্ছা তাই নাকি? তবে আমি যতোদূর জানি, রাত্রি তো তার পরের দিনই তোমার আর তোমার ওই অসভ্য বন্ধু হাশেম ভাইয়ের মুখোশ টেনে ছিঁ*ড়ে দিতে যাচ্ছিলো। এর আগ পর্যন্ত তার কাছে কোনো প্রমাণ ছিলো না। তাই তোমাদের কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। তোমরা জেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছো। কিন্তু সেদিন সে এমন কিছু প্রমাণ হাতে পেয়েছিলো যার দ্বারা তোমাদের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি হতে পারতো। এতোদিন সে সব মুখ বুজে সহ্য করলো বাচ্চা দুইটার জন্য আর যখনই সে হাতে প্রমাণ পেলো তখনই সে আত্মহ*ত্যা করলো? এটা কি সত্যিই আত্মহ*ত্যা নাকি সুপরিকল্পিত মাথার হ*ত্যা?”
আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। এসব সে কি শুনছি আমি হঠাৎ করে? আমার কেনো জানি মনে হলো আমার এই মা ও হয়তো কোনো বিপদে পড়তে চলেছে, কারণ আফজাল লোকটা অত্যন্ত ধুরন্ধর। ও ওর স্বার্থের জন্য পারে না এমন কোনো কাজ নেই। আমি এখন কি করবো?
“কি বলছো এসব তুমি? রাত্রি এসব করেছে? আমি কিছু জানতাম না তো। আহা রে!”
একটু শব্দ করে হাসলো মা। এরপর বেশ চড়া গলায় বললো,”ও তাই নাকি? তুমি কিছুই জানতে না? কিন্তু তোমার মা তো জানতো। তাকে রাত্রি সবকিছু বলেছিলো। আচ্ছা এমন কি হয়েছিলো যে, তোমার মা তোমাকে জানিয়ে দেয় রাত্রির প্লান? তোমাকে ওকে থামাতে বলে আর তুমি চিরদিনের জন্য ওকে থামিয়ে দিলে?”
মা একটু থামলেন কথাটা শেষ করে। ওপাশ থেকে পিনপতন নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। আমার হাত পা অসাড় হয়ে গিয়েছে। হাতড়ে হাতড়ে চেয়ার ধরে দাঁড়াই। নাহলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো মনে হচ্ছে।
“এরমধ্যে আমার মা কেও টেনে এনেছো রুনা? আচ্ছা শুনলাম তো সব। আর কিছু বলার আছে তোমার? বলে বিদায় হও, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“সবার ঘুম হারাম করে দিয়ে এতো শান্তির ঘুম তো তোমাকে ঘুমাতে দিবো না আফজাল সাহেব। তোমার আর তোমার মায়ের সব কীর্তি আমি ফাঁ*স করে দিবো।”
“কি করবে তুমি? কি করার ক্ষমতা আছে তোমার? তুমি রাত্রির মতো সুন্দরীও নও যে ওর সাথে যা করতে পারছি তোমার সাথেও পারবো। তোমাকে তো আমি ডিভোর্স দিয়ে এই বাড়ি ছাড়া করবো। নীরার কাছ থেকে সব সম্পত্তি হাতাবো। এরপর ওর মায়ের সাথে যা হয়েছে ওর সাথেও তাই হবে। আর বাড়াবাড়ি করলে ওর মায়ের মতো অবস্থা হবে।”
“রাত্রিকে কীভাবে মা*রলে আফজাল?”
“ওয়েল, সব যখন জেনেই গিয়েছো তখন বলতে কি সমস্যা। এমনিও তোমার কী বা করার ক্ষমতা আছে? কোনো প্রমাণ তো দেখাতে পারবে না। হ্যা আমি আর আমার মা মিলে রাত্রিকে মে*রেছি। রাত্রি বেশি চালাকি করতে গিয়েছিলো। দিনের পর দিন চুপ করে থাকার নাটক করে সব প্রমাণ যোগাড় করে। তাই তো ওকে থামিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। সেদিন রাতে নীরা আর রনি ঘুমিয়ে গেলে রাত্রিকে মা ডেকে আনেন ভালো কথা বলে। এরপর ওকে মে’রে ফেলে ফ্যানে ঝুলিয়ে দিই আমরা, যাতে করে এটা আত্মহ*ত্যা মনে হয়। আর হলো ও তাই। কেউ বুঝতে পারলো না। আমি আর মা কান্নার নাটক করে পোস্টম*র্টেম করতে বাধা দিই। ব্যস, কাহিনি শেষ। শুনলে সব? আর কিছু বলতে চাও? তোমাকে এই বাড়ি থেকে খুব তাড়াতাড়ি দূর করে দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো। নীরা বোকা, একটু রাগী কিন্তু ভীষণ বোকা। তার মনে তোমার জন্য সন্দেহের সৃষ্টি করবো, ও নিজেই চাইবে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে।”
আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। এতোদিন আফজাল লোকটার জন্য আমার একরাশ ঘৃণা ছিলো। আমি জানতাম যে, ওর জন্য আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আজ আমি কি শুনলাম? ও আমার মা কে মে*রে ফেলেছে? আর দাদী? দাদী কীভাবে এই কাজ করলো? আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। না না দাদী কীভাবে এই কাজ করবে? উনি তো অনেক ভালোবাসতেন আমার মা কে। কিন্তু নিজের কানকে অবিশ্বাস করবো কীভাবে?
“কে এই বাড়ি থেকে দূর হয় সে তো সময় বলবে আফজাল সাহেব। তোমার সময় হয়েছে তোমার বন্ধুর কাছে চলে যাওয়ার। সাথে তোমার মাকেও নিয়ে যাবে। এরপর তোমাদের শাস্তি নির্ধারণ করবে উচ্চ আদালত।”
ঘর কাঁপিয়ে হাসলো আফজাল। হাসির শব্দে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেলো। আমার এখন ইচ্ছা করছে ছুটে যেয়ে ওকে শেষ করে ফেলি। কিন্তু এখন আমাকে ওর হাত থেকে এই মা কে বাঁচাতে হবে। ও একটা খু*নী, ও সব কিছু করতে পারে। কিন্তু এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে আমি এখন ঢুকবো কীভাবে?

“কি করবে তুমি? কিচ্ছু করার ক্ষমতা তোমার নেই। সব খবর নিয়েই তো দেখছি এই বাড়ি এসেছো। তবে কি তুমি রাত্রির আত্মা? মেয়েকে বাঁচাতে নতুন রূপে এসেছো?”
ঘর কাঁপিয়ে হাসলো আবারও আফজাল। মনে হচ্ছে মায়ের কথায় খুব মজা পাচ্ছে সে।
“তাই নাকি? কিচ্ছু প্রমাণ নেই আমার কাছে? এইযে টেপ রেকর্ডার। এতোক্ষণ তুমি যা যা বলছো সব এখানে রেকর্ড করা আছে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ। আগামীকাল সকাল পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করো। এরপর কাল সকালে কোথায় তোমরা যাও সেটা পুলিশ ঠিক করবে।”
আমি চমকে উঠে তাকালাম। মা এটা কি করলো? যদি সত্যিই এই সে সব রেকর্ড করে, সেটা এখন কেনো জানালো আফজালকে? বদ্ধ ঘরের মধ্যে তার কি বিপদ আসতে পারে এটা কি সে বুঝতে পারছে? না না, যেভাবে হোক মা কে বাঁচাতে হবে আমার।
“এটা কি রুনা? ওটা আমাকে দিয়ে দাও বলছি। এতো চালাক তুমি? রেকর্ড করছো আমার কথা? ওটা আমাকে দিয়ে দাও বলছি।” আফজালের গলায় ভীতি। মনে হয় ভাবতে পারেনি মা এমন কাজ করতে পারে।
“এতোদিন আমার কাছে অন্য প্রমাণ ছিলো তোমার বিরুদ্ধে। সেই প্রমাণ যা দিয়ে রাত্রি তোমাকে ফাঁ*সাতে চেয়েছিলো। কিন্তু এই বাড়ি আসার পর আমার অন্য চিন্তা মাথায় আসে। এতো প্রমাণ যোগাড় করার পরেও সে কেনো তার বাচ্চাদের ফেলে রেখে আত্মহ*ত্যা করলো? সন্দেহ এখন সত্যতে পরিণত হলো। সব তো নিজের মুখেই স্বীকার করলে।”
“কে তুমি রুনা? তুমি কীভাবে রাত্রির প্রমাণ পেয়েছো?”
“আমি রাত্রির বান্ধবী। সেই ছোটবেলা থেকে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ত্ব। ও আমার কাছে শুধু বান্ধবীই ছিলো না, ও ছিলো আমার একটা অংশ। তোমার এই কুৎসিত চেহারা ও দেখার আগ পর্যন্ত ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো। আস্তে আস্তে তুমি ওর কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিলে, ওকে ঘরবন্দী করে দিলে। অনেকদিন ওর সাথে কথা না হওয়ায় আমার একটু দুশ্চিন্তা হয়। আমি আমার বাসার কাজের বুয়াকে পাঠাই এই বাড়ি। ও কাজ করতে আসতো আর রাত্রির কাছ থেকে সব কথা সংগ্রহ করে আমাকে জানাতো। যেদিন রাত্রি মা*রা যায় তার আগের দিন ও আমাকে সব জানায় চিঠিতে। আমি কথা দিই ওকে আমি সবরকম সাহায্য করবো। কিন্তু তার পরের দিনই শুনলাম ও আর নেই।”
ওপাশটা চুপচাপ। আমি পাগলের মতো এদিক ওদিক ছটফট করছি। এইটুকু জীবনে আমি আর কতো কিছু সহ্য করবো? আমার মা এতো কষ্ট করে পৃথিবী ছেড়েছে? আমি কেনো কিছু করতে পারলাম না মায়ের জন্য? তবে কি এই মা কে ও আমি বাঁচাতে পারবো এই নরপশুটার হাত থেকে?
“সেদিন রাতেই মনে হয় রাত্রি টের পেয়ে গিয়েছিলো কি হতে চলেছে ওর সাথে। মনে হয় সবটাই ধারণা করতে পেরেছিলো। তাই রাতেই ও সব প্রমাণ সহ আমার নামে একটা চিঠি লিখে চিলেকোঠার ঘরে রেখে আসে। যেখান থেকে বুয়া সব সংগ্রহ করতো আগেই। সেদিনও রাত্রি মারা যাবার পর ওসব এনে বুয়া আমার কাছে দেয়।”
“ওহ তুমি প্লান করেই এ বাড়ি এসেছো তাহলে?”
“তা বলতে পারো। রাত্রি একদিন আমার জীবন বাঁচিয়েছিলো। সেদিন আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম আমার জীবনের বিনিময়েও যদি হয় আমি ওকে সাহায্য করবো। কিন্তু আফসোস ওকে তো সাহায্য করতে পারলাম না। তবে ওর কলিজার টুকরো মেয়েটাকে আমি বাঁচাবো। যেভাবেই হোক আমি বাঁচাবো ওকে। এই নোংরা লোকগুলোর হাত থেকে ওকে বাঁচাবো আমি।”
“তুমি কি চাও রুনা? তুমি যা চাও তোমাকে আমি তাই দিবো। নীরার কাছ থেকে সব সম্পত্তি হাতানোর পর তোমাকে আমি অর্ধেক সম্পত্তি দিবো। কেউ কিচ্ছু জানবে না। তোমার কোনো ধারণাই নেই ওর নামে কতো কোটি টাকার সম্পত্তি আছে। তুমি সব পাবে। তুমি কি ভেবেছো আমি জেলে চলে গেলে নীরা তোমাকে কানাকড়ি কিছু দেবে? নিজের জীবনটা কেনো নষ্ট করবে একটা এতিম মেয়ের জন্য? ভাবো রুনা ভাবো।”
আমি নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছি। মা কি সিদ্ধান্ত নেবে? তবে কি মা কে আফজাল সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে? মা কি তাতে রাজি হবে? আর মা আমার মায়ের বান্ধবী। এতো কাছের বান্ধবী যে, নিজের জীবন বিপন্ন করে শুধুমাত্র আমাকে বাঁচাতে এখানে এসেছে?
“সম্পত্তির লোভ আমি কোনোদিন করিনা আফজাল। আমার কোনোদিন সন্তান হবে না তাই আমার প্রথম স্বামী আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এখানে এসে আমি সন্তান পেয়েছি। নীরা আর রনিকে পেয়েছি। আর কিচ্ছু চাইনা আমার।”
“কিন্তু আমার যে চাই রুনা। তুমি কি ভেবেছো সবকিছু এতোটাই সোজা? তুমি কি টেপ রেকর্ডারটা আমাকে দিয়ে দেবে নাকি এই ঘরেই নিজেকে শেষ করে দেবে যেটা রাত্রির সাথে হয়েছে?”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি করবে আফজাল? মা কে মে*রে ফেলবে? ওর দ্বারা কিচ্ছু অসম্ভব না। না না এভাবে বসে থাকা যাবে না। কিছু একটা আমাকে এখন করতেই হবে। আমি এদিক ওদিক করছি মা কে বাঁচানোর জন্য।
“ছাড়ো বলছি আফজাল আমাকে। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।”
“চিৎকার করো। কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না। দোতলা থেকে চিৎকার নিচতলায় যাবে না। কোনো কাজের লোক আসবে না। মা ও কিছু করবে না। আর নীরা? ওর কিচ্ছু করার নেই।”
ভিতর থেকে ধ্বস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমি কাকে ডেকে আনবো? আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না। আমি কোনো কিছু না ভেবেই জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো ভিতরের দৃশ্য দেখে।

মায়ের গলা আফজাল এক হাত দিয়ে টি*পে ধরে রেখেছে আরেক হাত দিয়ে টেপ রেকর্ডারটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মা নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু আফজালের মতো একজন শক্তপোক্ত লোকের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানো কি সহজ কথা? কিন্তু কোনোভাবেই মা টেপ রেকর্ডার টা হাতছাড়া করছে না। আমি চিৎকার করে ডাকতে গেলাম মা কে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম এখন আমি চিৎকার করলে আমাকেও এখানে বন্দী করে ফেলবে। দুইজনকেই মেরে ফেলবে। কেউ কাউকে বাঁচাতে পারবো না। তাই বাইরে থেকেই আমাকে যা করার তাই করতে হবে। কিন্তু কীভাবে কি করবো? ওদিকে মা ছটফট করছে বাঁচার জন্য।
“এটা দিয়ে দে রুনা। বাঁচতে চাস তো দিয়ে দে।”
মা কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বলতে পারে না। মায়ের ফর্সামুখ বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে পড়তে থাকে। অস্থির হয়ে যাই আমি মা কে বাঁচাতে।
আমি অস্থির হয়ে এদিকে ওদিকে তাকাই। হঠাৎ আমার চোখ যায় পাশেই ইনডোর প্লান্টের মাটির উপর রাখা পাথরের টুকরোর দিকে। এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে আমার ঠোঁটে। আল্লাহ সঠিক সময়ে সঠিক জিনিস হাতের কাছে এনে দেন। দৌড়ে যেয়ে বেশ কয়েক টুকরো পাথর তুলে নিই হাতে। আবার ফিরে আসি জানালার কাছে। মায়ের অবস্থা তখন করুণ, কিন্তু কোনোভাবেই টেপ রেকর্ডারটা হাতছাড়া করেননি এখনো। আমি আর দেরি করলাম না। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে হাতের পাথরগুলো ছু*ড়তে লাগলাম আফজাল নামক নরপশুটার দিকে।

বেশ কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ হয়না। ওদিকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন। কেউ ভাবতে পারেনি আমি এখানে আসবো। কপাল ফে*টে গলগল করে র*ক্ত পড়ছে আফজালের। সে মায়ের গলা ছেড়ে দিয়ে কপালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে ভয় আর রাগ। বাঁধন আলগা হতেই মা খকখক করে কাশতে শুরু করলো।
আমি চিৎকার করে বললাম,”মা বেরিয়ে আসো। এক্ষুনি বেরিয়ে আসো। নাহলে ও শেষ করে দিবে তোমাকে।”
মা আর এক মুহুর্তও দেরি করলো না। দরজা খুলতে গেলেই আফজাল আবারও চে*পে ধরতে গেলো তাকে। মা এবার তার সর্বশক্তি দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। বেরিয়েই বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। আমি ছুটে যেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরলো এরপর দুই গালে আমাকে অজস্র চুমু দেওয়া শুরু করলো।
মা উপরের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলো,” রাত্রিরে, তুই আমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়ে গিয়েছিস। আমার মেয়ে, আমাকে আজ বাঁচিয়েছে। আমার আর কিচ্ছু চাইনা, কিচ্ছু না।”
আমি মা কে শক্ত করে চেপে ধরে রাখলাম। যেনো ছেড়ে দিলেই মা চলে যাবে। ওদিকে আফজাল জোরে জোরে শব্দ করছে দরজায়,”এই কে আছিস, খোল দরজা খোল। শেষ করে দিবো সবাইকে।”
তার চিৎকার এতোক্ষণে কানে যায় দাদীর। মহিলা ছুটে এসেছে ছেলেকে বাঁচাতে। দরজার সামনে আমার মায়ের রণমুর্তি দেখে ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যায় সে, হয়তো বুঝতে পেরেছে তাদের সময় শেষ। আমি লাল টকটকে চোখে তাকাই তার দিকে। আজ এই মহিলার জন্য আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এতোদিন ভালো মানুষের মুখোশ পরে আমাদের সামনে ঘুরছিলো। আমি ছুটে যেয়ে উনার ঘর থেকে রনিকে তুলে কোলে নিয়ে আসি। এদের কাউকে আর বিশ্বাস করিনা আমি।

হাশেম আর আফজালের মায়ের দুইজনের বারো বছর করে সশ্রম কারা*দণ্ড হয়েছে আর আফজালের হয়েছে মৃ*ত্যুদণ্ড। কোর্টে চিৎকার করে কাঁদছে ও। আমার কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সেই কান্না দেখে। আজ এতোদিনের করা অপরাধের শাস্তি ও পাবে। আমি একবার উপরের দিকে তাকাই আর একবার আমার মায়ের দিকে তাকাই। আজ সত্যি সত্যি আমার মনে হচ্ছে আমার মা-ই নতুন রূপে আমার কাছে এসেছে আমাকে বাঁচাতে। মা মিটিমিটি করে হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে ডাকলো মা আমাকে। আমি তার বুকে যেয়ে ঝাপিয়ে পড়ি। না তিনি আমার সৎমা না, তিনি আমার মা, আমার নিজের মা।

(সমাপ্ত)

তিনি আমার সৎ মা পর্ব-৭

0

তিনি_আমার_সৎমা
পর্বঃ৭
মিথিলা জামান নিভা

বসার ঘরের পরিবেশ থমথমে। কারো মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। দাদী তো হতভম্ব হয়ে আফজাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছেন যেনো শুনতেই পারেননি কি বলেছে সে। চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গিয়েছেন। আমার হৃৎপিণ্ডটা ধক ধক করছে। এক মা কে হারিয়েছি আমি৷ যাকে পেয়েছি তাকে আপন করে নেওয়া শুরু করেছি মাত্রই। এখন কি তিনিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন? না না তা কীভাবে হবে? এটা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। শুধু তার মধ্যেই কোনো বিকার নেই। মিটমিট করে হাসছেন যেনো মনে হলো। যেনো আগেই জানতেন তিনি আফজাল সাহেব এই কথা বলবেন।
শান্তস্বরে মা বললেন,”আমার অপরাধ?”
বেশ ভারিক্কি গলায় আফজাল সাহেব বললো,”তোমার অবৈধ সম্পর্ক আছে অন্য পুরুষের সাথে। সে সাক্ষীও আছে আমার কাছে। এই বাড়িতে তুমি এসেছো নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে, ওর নরম মনের সুযোগ নিয়ে ওর এতো সম্পত্তি হাতাতে। এসব সাক্ষী আমার কাছে আছে।”
আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। কি বলছে কি লোকটা এসব? না না এটা কোনোদিন সম্ভব নয়। মায়ের মতো মানুষ কোনোদিন এমন হতে পারে না। যেভাবে সে আমার জীবন বাঁচিয়েছে একমাত্র মায়ের মমতা ছাড়া এটা কোনোদিন সম্ভব না। আর সে কিনা আমার দূর্বলতার সুযোগ নিতে আমার সম্পত্তি গ্রাস করবে? কোনোদিন সম্ভব নয় এটা।
দাদী বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এতোদিন তিনি কোনো কথা বলতে পারেন নি এই লোকটার ভয়ে। আজ যেনো একটু সাহস পেয়েছেন উনি। মনে হয় নতুন মায়ের সাহসিকতায় সবাই সাহসী হয়ে উঠেছে।
“আফজাল, ভুলে যেও না আমি এখনো বেঁচে আছি। তুমি আমাকে মা বলে কোনো সম্মান করোনা। আমার সামনে রাত্রির সাথে যা করেছো, আমি কিচ্ছু করতে পারিনি। রুনাকে তুমি বিয়ে করে এনেছো। মাত্র কিছু মাস হয়েছে বিয়ের। এরমধ্যে সে বাড়ির রূপটাই পালটে ফেলেছে। নীরা আর রনিকে তাদের মায়ের অভাব বুঝতে দিচ্ছে না। তুমি বললে আর আমরা বিশ্বাস করে নিবো সব?”
আফজাল সাহেব কিছু বলতে যাবে তার আগেই মা বললেন,”মা থাক না। ওকে বলতে দিন। দেখি আমার বিরুদ্ধে কি কি প্রমাণ আছে ওর কাছে। আমিও একটু দেখতে চাই কতোটা বাড়তে পারে ও।”
এবার একটু তেতে যায় আফজাল সাহেব।
“ও তাই? এসব কিছু বানানো? বেশ কোর্টেই কেস উঠুক। ওখানেই সাক্ষী আসবে, প্রমাণ হবে৷ তোমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো আমি।”
এবার মা একটু হাসলেন। হঠাৎ হাসি থামিয়ে লোকটার চোখের দিকে তাকালেন একদৃষ্টিতে। আফজাল সাহেব চোখ নামিয়ে নিলেন।
“সাক্ষী? প্রমাণ? কোর্ট? আচ্ছা আফজাল, তো এতোদিন কই ছিলো তোমার প্রমাণ? গতকাল তোমার ক্রাইম পার্টনারকে জেলে যেতে হয়েছে আমার জন্য। আর আজই তুমি প্রমাণ যোগাড় করে ফেললে? একরাতেই সব সাক্ষীরা এসে তোমাকে বলেছে আমার অবৈধ সম্পর্ক আছে? আমি নীরার সম্পত্তির জন্য এই বাড়ি এসেছি?”
এবার একটু তোতলাতে শুরু করলো আফজাল সাহেব।
“প্রমাণ অনেক আগেই পেয়েছি। তোমাকে সুযোগ দিচ্ছিলাম তুমি ভালো হও কিনা। কিন্তু না, তুমি নীরাকে উষ্কাচ্ছো আমার বিরুদ্ধে। যাতে ওর বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠো তুমি। আর ওর আঠারো বছর হওয়ার পরপরই ওর কাছ থেকে সব সম্পত্তি নিতে পারো। এসবই তোমার প্লান। তুমি এই বাড়িতে আসার আগেই সব প্লান করে এসেছো। সব জেনেশুনে এসেছো এখানে। আমাকে ফাঁ*সিয়ে বিয়ে করে তোমার রাস্তা ক্লিয়ার করেছো।”
আমি এতোক্ষণ কোনো কথা বলিনি। চুপ করে ওদের কথা শুনছিলাম। কিন্তু আর থাকতে পারলাম না। একটা ছোট্ট মাথা আর কতো চাপ নেবে? আমিও তো একটা মানুষ। কেনো আমার জীবনটা বাকি দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হলো না? কেনো আমি বাবা মাকে নিয়ে সুখে থাকতে পারলাম না?
চিৎকার করে উঠলাম আমি।
“এনাফ। আর কতো নাটক করবেন সবাই আমার সামনে? আমি আর নিতে পারছি না। আমার মুক্তি দরকার এগুলো থেকে। এক সম্পত্তির জন্য এতোকিছু। আমার মা কে চলে যেতে হলো পৃথিবী থেকে। চাই না এই সম্পত্তি আমার। নিয়ে নিন সব আমার কাছ থেকে। আমাকে শুধু একটু শান্তি দিন। আর কিচ্ছু চাইনা আমি আপনাদের কাছে, কিচ্ছু না।”
এই বলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লাম আমি। দাদী আর মা দুইজন ছুটে এলেন আমাকে ধরার জন্য। আমি ওদের হাত সরিয়ে দিলাম আমার শরীর থেকে।
মা একটু অবাক হয়ে বললেন,”তুমিও কি আমাকে সন্দেহ করছো নীরা? তুমিও মনে করো যে, আমি সম্পত্তির জন্য এখানে এসেছি? তোমার মা হয়ে উঠতে চাচ্ছি। শুধুমাত্র তোমার সম্পত্তির জন্য?”
“আমার মনে হওয়া না হওয়াতে কিচ্ছু আসে যায়না মা। এই পৃথিবীতে একজনই আমার আপন ছিলো। আমার মা। সেই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আমার মাকে আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি তোমার মধ্যে। আমি জানিনা কি হবে আমার সাথে। আমি এখন কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা।”
সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু আফজাল সাহেবের মুখে হাসি। মনে হচ্ছে সে সফল তার কাজে।
“নীরা।”
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। তার অসহায় মুখটা দেখে আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আমি কোনোভাবে বিশ্বাস করতে চাচ্ছি না স্বার্থের জন্য উনি এমন করতে পারেন।
“মা, আমি একটু শান্তি চাই। এই বাড়িটা নরক হয়ে উঠেছে আমার কাছে। আমাকে এমন কোথাও নিয়ে চলো যেখানে আমার একটু শান্তি হয়।”
“তুমি কেনো যাবে? যে এই বাড়িটা নরক করে তুলেছে সে চলে যাবে। উনি প্রমাণ দিবে বলেছে তো? দিক প্রমাণ, আমিও দিবো। দেখি কে জেতে কে হারে।”
চোখ বড় বড় হয়ে যায় আফজাল সাহেবের। আমতা আমতা করে বলে,”প্রমাণ? কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”
“জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ। তোমার ভালোবাসার বন্ধু,তোমার আজীবন ক্রাইম পার্টনার মিস্টার হাশেমের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো, দেখা যাবে কি হয়।”
আমি আর বসতে পারলাম না। একছুটে উঠে এসে নিজের ঘরে এসে বসলাম। মাও এলেন আমার পিছু পিছু।
আমাকে বসে থাকতে দেখে আমার মাথায় এসে হাত বুলিয়ে দেন। আমি ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। এরপর ছোট্ট করে একটা হাসি দিয়ে বলি,”আমার বিশ্বাসটা যেনো আর ভেঙে না যায় মা। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা।”
মা আমাকে দুইহাত দিয়ে চেপে বুকে টেনে নিলেন। তার প্রতিটা নিঃশ্বাস আমাকে জানান দিচ্ছে তিনি অসৎ হতে পারেন না।

বেশকিছু দিন স্কুলে যাওয়া হয়নি। পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। তাই আজ যেতেই হবে। মা টিফিন বানিয়ে দেবে। বাড়ির বানানো টিফিন খেয়ে বেশ অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। আমি রেডি হচ্ছি আর মা টিফিন বানাচ্ছে।
“নাও নীরা৷ তোমার টিফিন।”
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলাম। ঘামে ভিজে গিয়েছে রান্নাঘরে যেয়ে। কি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। আমি জড়িয়ে ধরি তাকে।
“নীরা আজ তুমি স্কুল থেকে ফিরলে আমরা এক জায়গায় ঘুরতে যাবো।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। অনেকদিন স্কুলের বাইরে আর কোথাও যাইনা আমি। মায়ের এই বাড়ি ছেড়ে বেরোনো নিষিদ্ধ ছিলো। আফজাল সাহেব ও কোনোদিন বের হননি আমাদের নিয়ে। তাই ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে আনন্দে ভরে ওঠে মনটা।
“সত্যি মা? কোথায় যাবো আমরা?”
“দেখি কোথায় যাওয়া যায়। তবে আর কাউকে নিবো না। শুধু তুমি আর আমি। তোমার ছুটির পর আমি স্কুল গেটে দাঁড়াবো। ওখান থেকে নিয়ে যাবো তোমাকে।”
আমি ভীষণ খুশি হই। ঘুরতে যাওয়া যে কতো আনন্দের, সেই আনন্দ তো ভুলতেই বসেছিলাম। আমি মায়ের কপালে একটা চুমু এঁকে বেরিয়ে যাই।
ক্লাস শেষ হওয়ার সাথেই খুশিতে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসি আমি। একটু ভয় ভয়ও করে। আফজাল সাহেব যে ধুরন্ধর মানুষ, মা কে আসতে দেয় কিনা কে জানে।
তবে গেটের বাইরে মা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুশ্চিন্তা দূর হয় আমার। আমাকে দেখে মা হাত নাড়ে, আমিও হাত নাড়াই।
মা ইশারা করে একটা রিকশাতে উঠতে।
“মা কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“নিউ মার্কেট।”
“হঠাৎ নিউ মার্কেট কেনো মা?”
“আজ সারাদিন শপিং করবো আমরা। অনেক মজা হবে।”
শপিং করতে কার না ভালো লাগে। আজ তো খুশি আর খুশি।
অনেক অনেক শপিং করলাম আমরা। বলতে গেলে সব আমারই কেনাকাটা। মা তেমন কিছু কিনলো না। রনি আর দাদীর জন্যও নেওয়া হলো।
“মা এতো যে কেনাকাটা করলাম, কারণটা কি?”
“কেনো নীরা? কেনাকাটা করতে কি কোনো উপলক্ষ লাগবেই?”
“না তবুও। কিন্তু আমার সব টাকা তো আফজাল সাহেবের কাছে। দিলো সে তোমাকে এতো টাকা?”
“তার দেওয়া লাগবে কেনো? এগুলো সব আমার নিজের জমানো টাকাতে কেনা।”
“এতো টাকা তুমি খরচ করলে আমার জন্য?”
“বাহ রে! আমার মেয়ের জন্মদিন সামনে আর আমি একটু কেনাকাটা করবো না?”
আমি তো আরো একপ্রস্থ অবাক হলাম। তবে কি এসব আমার জন্মদিনের জন্য? ভুলেই তো বসেছিলাম প্রায় জন্মদিনের কথা। মা ঠিকই মনে করে রেখে দিয়েছে।
“আমার জন্মদিন তোমার মনে আছে মা?”
“মেয়ের জন্মদিন মায়ের মনে থাকবে না তো কার থাকবে?”
খুশিতে চোখে পানি চলে আসে আমার। এতো আনন্দ লাগছে কেনো আজ আমার?
“তবে নীরা। এখন কিন্তু তোমাকে আরো বেশি শক্ত হতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করার।”
“কি বলছো মা এসব? আমি এগুলো কেনো করতে যাবো?”
“আঠারো বছর বয়স হচ্ছে তোমার।আঠারো বছর হলেই সব সম্পত্তি তোমার নামে চলে আসবে। তখন আফজাল সাহেব সহ আরো অনেকের নজর পড়বে এদিকে। তোমাকে সব বুঝে নিতে হবে। আগলে রাখতে হবে।”
আমি ভয়ে ঢোক চাপলাম। এসব কীভাবে করে। এই ব্যবসাবাণিজ্য কিছুই তো বুঝিনা আমি।
“তুমি কোথায় থাকবে মা? তুমি এসব দেখো। আমি তো এগুলো পারিনা।”
ম্লান হাসলো মা। মায়ের মিষ্টি মুখে এমব হাসি মানায় না। আমার একটু কষ্ট লাগলো দেখে।
“তা কি করে হয় নীরা? আফজাল সাহেবের স্ত্রী হয়েই ওই বাড়ি গিয়েছি আমি। সে যদি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয় কীভাবে ওখানে থাকবো আমি?”
“আমার মা হয়ে থাকবে। ওই বাড়ি আমার। আমি ঠিক করবো ওখানে কে থাকবে না থাকবে। একবার মা কে হারিয়েছি আমি, আর হারাতে পারবো না।”
“তা হয়না মা। আফজাল ওই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না, যতদিন বাড়ি তোমার কাছে আছে। কারণ ও কোর্ট থেকে যেভাবে হোক তোমার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আনবে। আর ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরে কীভাবে ওই মানুষের সাথে একই বাড়িতে থাকবো আমি নীরা মা?”
” তাহলে বরং এসব কিছু আমার আঠারো বছর হওয়ার পর আমি তোমাকে লিখে দিবো। তাহলে তো এসব কিছু তোমার হয়ে যাবে। আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তুমি।”
চমকে উঠে মা তাকালো আমার দিকে। আমি মিষ্টি করে হাসলাম তার দিকে তাকিয়ে। রিকশাতে বসেই মা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি মায়ের কাঁধে মাথা রাখলাম। কি ভীষণ শান্তি আর ভরসার জায়গা। বুঝতে পারলাম মা কাঁদছে। ফিসফিস করে বললো,”অনেক বড় হও মা, অনেক বড় হও।”

সেদিন রাতে হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আফজাল সাহেবের সাথে ঝামেলা হওয়ার পর থেকে মা আমার সাথেই ঘুমায়। আমি মা কে জড়িয়ে ধরে ঘুম দিই, অনেক ভালো লাগে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় অনেকক্ষণ বুঝতে পারিনা কয়টা বাজে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে দেখি ঘড়িতে সময় রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু আমার পাশে মা নেই। এতো রাতে মা গেলো কোথায়?
আমি উঠে যেয়ে ওয়াশরুম দেখলাম, ওখানে নেই। ডায়নিং, ড্রয়িং সব জায়গার লাইট অফ। একটু দুশ্চিন্তা হলো আমার। কারণ আফজাল নামক লোকটাকে একটুও ভরসা করিনা আমি।
আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে হাঁটতে লাগলাম আমি। মনে হলো একবার মা কে ডাকি চিৎকার করে। পরে মনে হলো থাক কি দরকার। বাকিদের ঘুম ভেঙে যাবে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম আফজাল সাহেবের ঘরের লাইট জ্বলছে। এতোরাতে লোকটা লাইট জ্বালিয়ে কি করে? আমি আস্তে আস্তে হেঁটে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম৷
এবং তখনই অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমার মায়ের স্যান্ডেলজোড়া ঘরের বাইরে।
মানে মা এই ঘরে? তারা দুইজন এখনো বৈধ সম্পর্কে আছে। এভাবে স্বামী স্ত্রীর ঘরের সামনে এসে আড়ি পাতা মোটেই ভালো কথা না। কিন্তু সমস্যাটা সেখানেই। দুইজন দুইজনকে দেখতে পর্যন্ত পারে না এখন। ডিভোর্সের কথা পর্যন্ত উঠেছে।এতোরাতে দরজা বন্ধ অথচ লাইট জ্বালিয়ে কি কথা তাদের? একটু উশখুশ করতে থাকি আমি। ভিতরের কথা শোনা কি ঠিক হবে নাকি হবে না?
একবার ভাবলাম থাক চলে যাই। হয়তো নিজেদের মধ্যে সব ঠিক করে নিচ্ছে তারা। তাহলে তো ভালোই হয়। মা এখানেই থাকবে, কোথাও যাবে না আমাকে ছেড়ে।
চলেই আসছিলাম ফিরে। হঠাৎ করেই মায়ের একটা কথা শুনে থমকে দাঁড়াই আমি। আমার হাতপা কেঁপে উঠলো থরথর করে। আমি কি ঠিক শুনলাম?

আর এক পার্ট আছে,, সবাই ফলো দিয়ে রাখুন,,, সকালে দিয়ে দিবো

তিনি আমার সৎ মা পর্ব-৬

0

তিনি_আমার_সৎমা
পর্বঃ৬
মিথিলা জামান নিভা

আমি বুঝতে পারলাম আমার শক্তি কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। নিস্তেজ হয়ে পড়ছি আমি। বার বার চোখের সামনে রুনা আন্টির মুখটা ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবো আমি। লোকটাও তার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। ঠিক এমন সময় আমার মনে হলো বাইরে ভীষণ শোরগোল। কার কণ্ঠ বুঝতে পারছি না। হাশেম লোকটাও দেখলাম একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে কিন্তু তার বাঁধন এখনো শক্ত। আমার সামনে আমার পুরো দুনিয়া টলছে। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহুর্তে আমি দেখলাম কেউ একজন দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়েছে তার হাতে একটা শা’বল। ঘরে ঢুকেই শা’বলটা ফেলে দিয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন আমার নাম ধরে। আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আমি ঝাপসা চোখে দেখলাম যেনো আমার মা দাঁড়িয়ে আছে। সেই তার আগুন ঝরানো চোখ। আমি এবার পুরোপুরি জ্ঞান হারালাম। আমার আর কিচ্ছু মনে নেই।

কতক্ষণ আমি অজ্ঞান ছিলাম আমি জানিনা। অজ্ঞান অবস্থাতেই আমি একটা কল্পনার মধ্যে ঢুকে পড়ি। আমার নিজের মা আমাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে চাচ্ছে আর আমি না ঘুমিয়ে শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছি।
“কি রে পাগলি? ঘুমাবি না? কি দেখছিস ওভাবে ঘুরে ঘুরে?”
“তোমাকে দেখছি মা।”
“পরে দেখবি মা কে। এখন ঘুমা তো সোনা।”
“না মা আমি ঘুমাবো না। আমি ঘুমালেই তুমি আবার আমাকে এই নরকে একা রেখে চলে যাবে। কতোদিন তোমাকে দু’চোখ ভরে দেখিনা। একটু দেখতে দাও না মা তোমাকে। একটু তৃষ্ণা মেটাই।”
মা খুব সুন্দর করে হাসলো। আমি অবাক নয়নে সেই হাসি দেখলাম। হাসির দমকে মায়ের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কি অপরূপ সেই দৃশ্য। আমি মা কে আরো শক্ত করে চেপে ধরতে চাই। মায়ের গায়ের গন্ধে শান্তিতে জানটা ভরে ওঠে আমার। এ যেনো স্বর্গীয় এক সুখ।
হঠাৎ চারপাশ কেমন কালো হয়ে আসলো। একটা হালকা ধোঁয়াতে ভরে গেলো পরিবেশটা। আমার খুব ভয় করতে লাগলো। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,”ও মা, মা তুমি কই? আমার খুব ভয় করছে মা। কই গেলে তুমি?”
“এইতো আমি। তোর কাছেই আছি আমি। দেখতে পাচ্ছিস না?”
আমি মা কে কোথাও দেখতে পেলাম না। তেষ্টায় আমার গলা কাঠ হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে শেষবারের মতো আমি চিৎকার করে উঠলাম,”মা গো, মা।”
ঠিক তখনই আমার হুঁশ ফিরে আসে। আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে আমি কোথায় আছি মনে করতে। কি হয়েছিলো আমার?
মাথা যন্ত্রণার জন্য একা ঘরে শুয়ে থাকা। হঠাৎ কারো স্পর্শে ঘুম ভেঙে যাওয়া, দরজা বন্ধ। হাশেম? হ্যা ওই পিশাচটা…..
এটুকু ভাবতেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠে বসি। আমার সারা শরীর ঘামে জবজব করছে। তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত।
আমাকে ওভাবে দেখেই রুনা আন্টি ছুটে আসলেন আমার কাছে। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন দুই হাতে। উনি ফোঁপাচ্ছেন।
“এইতো আমার মা, আমি এইযে। কিচ্ছু হয়নি তোমার। আমি চলে এসেছি তো তার আগেই। এইতো আমি এখানে। কোনো ভয় নেই তোমার মা।”
তার গায়ের গন্ধটা এতো পরিচিত লাগছে আমার। মনে হচ্ছে কতো জনম জনম ধরে গন্ধটা আমার শরীরের সাথে লেপ্টে ছিলো। আমি উনাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরলাম। ফোঁপানোর জন্য কথা বলতে পারছি না। কোনোরকমে একটু স্বাভাবিক হয়ে বললাম,”মা, তুমি এসেছো মা? জানো ওই পশুটা আমার ক্ষতি…..”
মুখ চেপে ধরলেন উনি আমার। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,”তোর কোনো ক্ষতি আমি ওকে করতে দিই নি। আয় আমার সাথে। আমার হাত ধরে আয় আস্তে আস্তে।”
“কোথায়?”
“আগে আয় তারপর দেখবি।”
আমি উনার হাতটা শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলাম উনার সাথে। আমার শরীর বেশ দূর্বল, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।

উনি আমাকে হাত ধরে বসার ঘরে আনলেন। বসার ঘরে যে দৃশ্য আমি দেখলাম তা দেখার জন্য প্রস্তুত আমি ছিলাম না। আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। রুনা আন্টির হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। আমার সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে।
হাশেম অসভ্যটাকে শক্ত রশির সাহায্যে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু বাঁধন এতো শক্ত যে নড়াচড়াও করতে পারছে না সে। পাশেই আফজাল সাহেব কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। রুনা আন্টিকে দেখে সে বললো,”রুনা, বাড়াবাড়ি করো না। তোমার কোনো আইডিয়া নেই কার সাথে কি করছো তুমি। উনাকে চিনো তুমি? ছেড়ে দাও উনাকে। হ্যা মানছি উনি ভুল করেছেন। তাই বলে এসব কি কথা রুনা? ছেড়ে দাও উনাকে প্লিজ।”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম রুনা আন্টির দিকে। কি হচ্ছে এসব কিছুই বুঝতে পারছি না। রুনা আন্টি কেনো বেঁধে রেখেছে উনাকে? কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।
রুনা আন্টি যেনো আফজাল সাহেবের কোনো কথা শুনতেই পায়নি। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,” নীরা মা, পা থেকে স্যান্ডেলটা খুলে নে তো।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে, কিছুই বুঝতে পারলাম না উনার কথা। আফজাল সাহেবের মুখ বিস্ময়ে ঝুলে গেছে। আর হাশেমের কথা তো না বলাই ভালো। অসভ্যের মুখ আরো কদাকার লাগছে।
“কি বললাম নীরা? শুনতে পাস নি? স্যান্ডেল খুলে হাতে নে।”
আমি কিছু না বুঝেই যা করতে বললো করলাম। এবার উনি আমাকে বললো,”এবার আয় আমার সাথে।”
আমি উনাকে ফলো করছি, উনি এগিয়ে যাচ্ছে ওই পিশাচটার দিকে।
যখন আমরা প্রায় কাছাকাছি ওই লোকটার তখন রুনা আন্টি আমার দিকে ফিরে বললো,”নে নীরা। এবার এই স্যান্ডেলটা দিয়ে ইচ্ছামতো মার এই জানোয়ারটাকে। আমি আছি তোর সাথে। মার ওকে নীরা, মার।”
বসার ঘরে হঠাৎ পিনপতন নীরবতা। হাশেম হা করে তাকিয়ে আছে রুনা আন্টির দিকে। আফজাল সাহেব ছুটে এসে বললো,”এই রুনা, আর ইউ ক্রেজি? কি বলছো তুমি? তোমার কোনো ধারণা আছে কি বলছো তুমি? নীরা, স্যান্ডেল ফেলে দাও হাত থেকে।”
“ডোন্ট শাউট মিস্টার আফজাল। আমি আমার মেয়েকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা শেখাবো। ওর মায়ের মতো অবস্থা যেনো ওর না হয়। অপরাধী কে জানার দরকার নাই আমার, সে অপরাধ করেছে, শাস্তি তাকে পেতে হবে। নীরা দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? এতোদিনের যতো রাগ এই লোকটার উপর মিটিয়ে নে।”
আমার শরীর কাঁপছে থরথর করে। বুঝতে পারছি না কি করবো আমি। যতোই রাগ থাকুক আমার, আমি একটা মশাও মারতে পারিনা, এতো নরম মন আমার।
আমার অবস্থা দেখে রুনা আন্টি বললো,”এই লোকটার জন্য তোর মা তোকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। দিনের পর দিন এ তোর মায়ের উপর অত্যা’চার করেছে। আজ তোর সাথেও তাই করতে চেয়েছিলো। তুই চাস না ওকে শাস্তি দিতে?”
হঠাৎ আমার মুখের সামনে আমার মায়ের করুণ মুখটা ভেসে উঠলো। কষ্টে হাউমাউ করে কাঁদছে আমার মা। এই লোকটার জন্য। আচমকা আমার শরীরে কোথা থেকে অনেকটা শক্তি এসে ভর করলো। পেছন থেকে আফজাল সাহেব চিল্লাচ্ছে,”না নীরা না।”
আমি কারো কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না আর। আমার মুখের সামনে শুধু আমার মায়ের মুখ। আমি চোখ বন্ধ করে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলাম ওকে আমার স্যান্ডেল দিয়ে। হিতাহিত কোনো জ্ঞান নেই আমার। পাগল হয়ে গিয়েছি আমি আজকে। পিছন থেকে আফজাল লোকটা এসে আমাকে বাঁধা দিতে চাইলে রুনা আন্টি উনাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।
হঠাৎ আমার মাথায় কি হলো আমি জানিনা। স্যান্ডেল ফেলে দিলাম আমি। এক দৌড়ে যেয়ে আমাদের ভারী পিতলের ফুলদানিটা তুলে নিলাম। আমার চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে তখন। বাস্তবিক কোনো জ্ঞান নেই আমার। আমি ছুটে যেতে থাকলাম ওই নরকের কীটটার দিকে।
হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরলেন রুনা আন্টি।
“আমাকে ছাড়ুন বলছি। শেষ করে ফেলবো ওকে আমি আজকে। ওর জন্য আমার সাজানো গোছানো জীবনটা শেষ হয়ে গেলো। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। ওকে আমি শেষ করে দিবো।”
আমি চিৎকার করছি আর কাঁপছি। রুনা আন্টি আমার হাত থেকে ফুলদানিটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো।
“শান্ত হও, নীরা। শান্ত হও। ওর বাকি বিচার করবে আইন, আদালত। ওর যেনো সর্বোচ্চ শাস্তি হয় সেই কাজ আমি করবো। তুমি এই কাজ করো না।”
হঠাৎ আমি নিস্তেজ হয়ে যাই। উনাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠি আমি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করি আমি।
“কিচ্ছু হবে না ওই বিচারে, কিচ্ছু না। আমার মা অনেক চেষ্টা করেছে পারেনি। ওর ক্ষমতা আছে, যেভাবেই হোক ও বের হয়ে চলে আসবেই। ওর বিচার হবে না।”
“বিচার হবে। প্রমাণ আছে আমার কাছে সব। এবার বিচার হবেই। আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি। তুমি শান্ত হও।”
“কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে রুনা?”
“জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ মিস্টার আফজাল। তুমি নিজের চিন্তা করো তুমি কীভাবে বাঁচবে। কারণ তোমার শাস্তি হবে অন্যভাবে। প্রস্তুত থাকো তার জন্য।”
“রুনা।”
“চিৎকার করবে না। আওয়াজ নিচে।আমি রাত্রি নই, আমি রুনা। আমাকে এভাবে ভয় দেখাতে পারবে না তুমি।”

ঘণ্টা খানিকের মধ্যে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় হাশেমকে। আমার শারীরিক অবনতির জন্য থানায় যেয়ে লিখিত অভিযোগ করা সম্ভব না হলেও বাড়ি থেকেই ডায়েরি করা হয়েছে। যাওয়ার আগে আমার চোখ পড়ে ওই হাশেমের দিকে। আমার দেওয়া মারে ওর চেহারার অবস্থা নাজেহাল। এখান থেকে সেখান থেকে র*ক্ত পড়ছে। আমি একটু ভয়ে কেঁপে উঠি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে। ওই চোখে যেনো আমার উপর আগুন চাপা দেওয়া রাগ। ছাড়া পেলেই আমাকে শেষ করে দিবে এমন। রুনা আন্টি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেন,”কিচ্ছু হবে না তোমার, আমি আছি তো। ভয় পেয়ো না।”
আমি অবাক চোখে তাকাই উনার দিকে। সেই মুখের আদলে আমি মাতৃস্নেহ দেখতে পাই শিরায় শিরায়।

আমি আমার খাটে বসে আছি বালিশে হেলান দিয়ে। আমার পাশে বসে আছেন রুনা আন্টি। এতোক্ষণ দাদী ছিলেন। আমি উনাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। উনার উপর দিয়েও কম ধকল যায়নি।
আমি আস্তে করে বললাম,”আপনি কি ঘরের লাইটটা একটু অফ করে দিবেন? একটা কথা বলার আছে আমার।”
মিষ্টি করে হাসলেন রুনা আন্টি।
“কি এমন কথা নীরা? যা লাইট জ্বালিয়ে বলা যায়না। লজ্জার কথা নাকি?”
আমি মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললাম,”হুম।”
“কি ব্যাপার বলো তো? প্রেমেট্রেমে পড়েছো নাকি?”
লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেলো। উনি হাসতে হাসতে যেয়ে লাইট অফ করে আসলেন।
“বলো কি বলবে?”
“আমি কি আপনার হাতটা একটু ধরতে পারি?”
লাইট অফ থাকা সত্ত্বেও আমি বুঝলাম উনি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আস্তে করে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন উনি।
আমি হাতটা ধরলাম। নরম ঠান্ডা একটা হাত।
হঠাৎ উনি হাতের উপর উষ্ণ পানির ছোঁয়ায় চমকে উঠলেন।
“কি ব্যাপার নীরা? কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো আবার তুমি? তোমার কোনো ক্ষতি তো হয়নি। ওই বদমাশটা এখন জেলের মধ্যে। আর খুব তাড়াতাড়ি ওর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। আমি বলছি দেখো তুমি। এভাবে কেঁদে নিজেকে সহ আমাকে দূর্বল করে দিবে না।”
“আমি কি আপনাকে মা বলে ডাকবো একবার?”
প্রায় মিনিট দুইয়ের মতো কেউ কোনো কথা বললাম না। হালকা কেঁপে উঠলেন উনি শুধু।
কাঁপা কাঁপা গলায় উনি বললেন,”হু বলো।”
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,”মা মা গো ও মা।”
আঁকড়ে ধরলাম উনাকে। উনিও পরম মমতায় আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার শুকনো মরুভূমিতে এতোদিন পর প্রবল বৃষ্টির দেখা দিলো।
সেদিন রাতে মা আমাকে বুকে জড়িয়েই ঘুমালেন। অনেকদিন পর অনেক শান্তির ঘুম হলো আমার। ছোট বাচ্চাদের মতো উনাকে জড়িয়ে ঘুমালাম আমি।

পরদিন সকাল হতে না হতেই আফজাল সাহেবের হাঁকডাকে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। মা কে কোথাও দেখলাম না। মনে হয় আগেই উঠে গিয়েছেন। বসার ঘর থেকে আফজাল সাহেবের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আমার বুকটা একটু কেঁপে উঠলো। আবার কি হলো? তবে কি হাশেম ছাড়া পেয়ে গেছে? অজানা আশঙ্কায় অস্থির হয়ে গেলাম আমি। ছুটে চলে আসলাম বসার ঘরে।
দরজার বাইরে থেকে শুনলাম মা বলছে,”কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো। মেয়ের ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়ে গেছে। ওকে নাস্তা বানিয়ে দিতে হবে।”
“আরে রাখো মেয়ে। মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি। কে মেয়ে? কার মেয়ে? ওর সাথে কিসের সম্পর্ক তোমার?”
“চিৎকার করো না। মা মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে আবার আলাদা কি সম্পর্ক থাকবে?”
“যাও তোমার মেয়েকেও ডাকো। এখন যা বলবো সবাইকে শুনতে হবে তা।”
মা কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আমি পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। একটা সোফায় দাদীও বসে আছেন শূন্যের দিকে দৃষ্টি মেলে।
“এইযে এসেছেন আমাদের মালকিন। তা ম্যাডাম যদি কৃপা হয় একটু বসবেন? একটা কথা জানানোর ছিলো সবাইকে।”
আফজাল লোকটার টিটকারির কথা শুনে গা জ্বলে গেলো আমার। আমি মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম।
আফজাল সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,”কোনোরকম ভণিতায় আমি যেতে চাইনা। রুনা, তোমাকে অনেকবার আমি বলছি, তুমি আমার স্ত্রী। এই বাড়িতে আমি তোমাকে এনেছি। আমার কথামতো তোমাকে চলতে হবে। কিন্তু আফসোস। আমি জানিনা তোমার উদ্দেশ্য কি। তুমি আসার পর থেকেই এই বাপ মা মরা মেয়ে ওহ দুঃখিত আমাদের মালকিনের উপর বেশিই দরদ দেখাচ্ছো। আর গতকাল যা করলে তাতো সবাই দেখলো। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকে। আম্মা আপনিও শুনবেন আশা করি।”
আমি চোখ সরু করে তাকালাম উনার দিকে। কথা কোনদিকে নিতে চাচ্ছে উনি? মা কে দেখলাম নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেনো উনি জানেনই কি সিদ্ধান্ত হবে।
দাদী শান্ত স্বরে বললেন,”কি সিদ্ধান্ত আফজাল?”
“আমি রুনাকে ডিভোর্স দিতে চাই।”

৭ পার্ট বইপোকা 👈 এই পেইজে দুপুর ১২ টাই দিবো,, তাই আমার ওই পেইজে ফলো দিয়ে আসুন গিয়ে 😘🌸

চলবে,,,,

তিনি আমার সৎ মা পর্ব-৫

0

তিনি_আমার_সৎমা
পর্বঃ৫
মিথিলা জামান নিভা

“নীরা আসবো?”
আমি চমকে উঠলাম কণ্ঠস্বরটা শুনে। সেদিনের পর থেকে আমি ওই লোকটার মুখোমুখি হইনা। আমরা যে একই ছাদের নিচে বাস করছি এটা ভাবতেও আমার ঘৃণা লাগে মাঝে মাঝে। এই লোকটার জন্য, হ্যা শুধুমাত্র এই পি’শাচটার জন্য আমার মায়ের ফুলের মতো জীবনটা এভাবে চলে গেলো। এই লোকটা আমার কাছে একটা নরকের কীট ছাড়া আর কিছুই না। এখন আমার কাছে কি চায় ও?
আমি কোনো কথা না বলে নিজের বইতে মনোযোগী হই। লোকটা আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই আমার রুমে ঢুকে যায়। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে রাগে।
“কি ব্যাপার নীরা? আমার সাথে কথা বলো না কেনো তুমি বেশ কিছুদিন যাবৎ?”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,”আপনার সাথে কথা বলার কোনো রুচি আমার নেই মিস্টার আফজাল সাহেব।”
আমি লোকটা দিকে তাকাইনি, না তাকালেও আমি বুঝতে পারছি লোকটা হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“এসব কি বলছো নীরা? আমি তোমার বাবা। বাবার সাথে এভাবে কেউ কথা বলে?”
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি আমি। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠে বলি,”বাবা? লজ্জা করে না আপনার নিজেকে আমার বাবা বলে পরিচয় দিতে? মেয়েকে একটা পরপুরুষের হাতে তুলে দেওয়ার সময় কোথায় ছিলো আপনার পিতৃত্ব আফজাল সাহেব? আপনি দয়া করে আমার সামনে থেকে চলে যান। আপনার ছায়া দেখতেও ঘৃণা করছে আমার।”
“নীরা, বিহ্যাব ইওরসেল্ফ। তুমি মনে হয় ভুলে যাচ্ছো কার সাথে কথা বলছো তুমি।”
“চোখ রাঙাবেন না আফজাল সাহেব। এই চোখ রাঙানোকে অনেক ভয় পেয়েছি একটা সময়ে। পুরো একটা রাত আমাকে বাথরুমে অন্ধকারে আটকে রেখেছেন সাথে আমার মাকেও আটকে রেখেছেন অন্যঘরে যাতে সে আমাকে বাঁচাতে না পারে। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম আমি, কাঁদতাম চিৎকার করে। তবুও আপনার মন গলেনি। দাদীকে ভয় দেখিয়ে বন্দী বানিয়ে রেখেছেন। দেখতে আমাদের সুখী মনে হলেও আমরা ছিলাম আপনার হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু না, আর পারবেন না। লেবু বেশি নিংড়ালে তেতো হয়ে যায়। আপনি সম্পর্কটা তেতো করে ফেলেছেন। আর আমি ভয় পাইনা আপনাকে।”
লোকটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বিস্ময়ে হতভম্ব সে। হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হয় বিশ্বাস করতে পারছে না, যে নীরাকে চিরকাল ভয় দেখিয়ে পুতুল বানিয়ে রেখেছে সেই নীরা আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ অনেক হিংস্র হয়ে যেতে পারে এটা তাকে বুঝতে হবে।
“নীরা, তুমি আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার সাথে এভাবে কথা বলছো? তুমি কি জানো তোমাকে আমি এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি? তখন কই যেয়ে দাঁড়াবে তুমি? একবারও ভেবে দেখেছো?”
উনার কথায় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসলাম আমি। আমার হাসি দেখে আরো একপ্রস্থ অবাক হলেন উনি।
“ও তাই নাকি আফজাল সাহেব? আপনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন? কিন্তু তার আগে তো আমিই আপনাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি।”
“মা মা মানে? কি বলছো কি তুমি?”
“এই বাড়িসহ আরো যে যে সম্পত্তি আমার আছে সব আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। কিচ্ছু যেনো বাদ না থাকে। এসব কিছুর একমাত্র মালিক আমি, আপনি নন। আমার আসল বাবা এগুলো আমার জন্য রেখে গেছেন। তাই আমি যদি চাই আপনাকেই এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি।”

সারাঘরে পিনপতন নীরবতা। লোকটার মুখ ঝুলে গেছে হতভম্ব হয়ে। সে এখনো জানে না আমি সেদিনই সব সত্যির মুখোমুখি হয়ে গিয়েছি।
“তোমাকে এসব কে বলেছে? ওই বুড়িটা?”
“কেনো? দাদী যদি বলেও থাকেন তো আপনি কি করবেন? তাকে আর কোনো ভয় আপনি দেখাতে পারবেন না। কারণ এই বাড়িটা আমার। আমার বাড়িতে আমি যা বলবো তাই হবে। আর কারো কোনো কথা শোনা হবে না।”
আমার এই কথা শুনে পিশাচের মতো একটা হাসি হাসে লোকটা। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাই সে হাসির দিকে। আবার কি চাল দিতে চাচ্ছে ও?
“নীরা, তোমার বয়স যেনো কতো?”
আমি কোনো কথা না বলে তাকাই উনার দিকে। কি বলতে চাচ্ছে ও বুঝতে পারছি না।
“শোনো, স্কুলে তোমার দুই বছর গ্যাপ গেছে সংসারের বিভিন্ন অশান্তির জন্য। তোমার মা ছিলো বোকা, সে বিভিন্ন ঝামেলা করতো। যার ফলে তোমার এই অবস্থা। তো যাই হোক, এখনো কিন্তু তোমার বয়স আঠারো হয়নি। তোমার বয়স এখন সতেরো বছর দশ মাস। তার মানে আঠারো বছর হতে তোমার এখনো দুই মাস বাকি। বয়স আঠারো না হওয়া পর্যন্ত তুমি এই সম্পত্তির কিছুই পাবে না। সে পর্যন্ত তোমার রক্ষনাবেক্ষন এর দায়িত্ব আমার। এটা তোমার মায়েরই স্বাক্ষর করা রয়েছে দলিলে। তুমি চাইলে দেখাতেও পারি। দুই মাস কিন্তু অনেকটা সময়। অনেক কিছু হতে পারে দুই মাসে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,”মানে? কি হতে পারে এই দুইমাসে?”
“অনেক কিছুই হতে পারে। এই যেমন ধরো তুমি স্বেচ্ছায় তোমার নামের সব সম্পত্তি আমার নাম লিখেও দিতে পারো, তাইনা?”
এই বলে লোকটা বিশ্রী করে হাসলো। আমার বুক কেঁপে উঠলো। এই লোকটা কি করতে চাচ্ছে আমার সাথে?
“তাই ভালোয় ভালোয় বলছি আমার কথামতো চলো। আখেরে তোমারই লাভ হবে। তা না হলে….”
“তা না হলে কি আফজাল? কি করবে তুমি আমার মেয়ের সাথে?”
রুনা আন্টি এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়। আমার বুকে একটু সাহস ফিরে আসে। উনার মুখে মিটিমিটি হাসি। সবসময় একটা রহস্যের হাসি দেন উনি। আমি বুঝতে পারিনা সেই হাসিটাকে ভালোমতো।
“তোমার মেয়ে? হাসালে রুনা। সবাই যখন জেনেই গিয়েছো বলতে তো দ্বিধা নেই। নীরার সাথে বস্তুত কোনো সম্পর্ক নেই তোমার। এমনকি এই বাড়ির কারো সাথেই ওর কোনো সম্পর্ক নেই।” তাচ্ছিল্যের হাসি লোকটার মুখে।
“হুম সে তো হবেই। কারণ ও এই বাড়ির মালকিন। আর আমরা ওর বাড়িতে আছি।”
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আফজাল সাহেবের। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”এখনো নয়। আরো দুইমাস পর থেকে। এই দুই মাসে কেউ মালকিন থেকে আশ্রিতা হয়েও যেতে পারে। কে বলতে পারে।”
“আবার কেউ চিরতরে এই বাড়ি থেকে বিদায়ও হয়ে যেতে পারে। কে বলতে পারে।”
“বাহ! মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি দেখতে পাচ্ছি। তুমি আমার স্ত্রী। আমি যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে তুমি। নাহয় তোমার অবস্থাও খারাপ হবে।”
“আমি রাত্রি নই আফজাল। আমি রুনা। আমাকে ওই লাল চোখ দেখিয়ে তোমার গোলামী করাতে পারবে না।”
এই প্রথম আমি রুনা আন্টির চোখে আগুন দেখলাম। এই আগুন আমার মায়ের চোখেও আমি দেখেছি। কিন্তু সেই আগুন এই লোকটা ছাইচাপা দিয়ে শেষ করে দিয়েছিলো। রুনা আন্টির সাথেও এমন কিছু করবে না তো? কিন্তু উনি বা আমার জন্য নিজের জীবনকে এভাবে ঝুঁকিতে তুলছেন? কি লাভ উনার? কি উদ্দেশ্য উনার? এই লোকটা কে বিয়েই বা কেনো করেছেন উনি এতকিছু জেনেও? এইসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতেই হবে।

কিছুদিন গেলো এভাবেই। রুনা আন্টির সাথে আমার সম্পর্ক কিছুটা ভালোর দিকে। আমার অনেকরকম বদঅভ্যাস উনার জন্য পরিবর্তন হয়েছে। আমি এখন নিয়মিত পড়াশোনা করছি। বাইরের খাবার এখন খাইনা বললেই চলে। একদম রুটিনমাফিক জীবন চালাচ্ছি আমি। মাঝে অবাক হয়ে উনার দিকে তাকাই। বড্ড আপন লাগে উনাকে। মনে হয় কতো জনম জনম ধরে উনাকে চিনি আমি। উনার মধ্যে মা কে খোঁজার চেষ্টা করি আমি। কোনো মিল পাইনা তেমন। আমার মা ছিলেন লম্বা,চিকন আর উনি ছোটখাটো, গোলগাল। তেমন কোনো মিল দুইজনের মধ্যে পাইনা আমি। কিন্তু সবকিছুর বাইরে যেয়েও উনার মধ্যে মাকে খোঁজার চেষ্টা আমার চলতেই থাকে। কখনো তার হাসিটা, কখনো তার কপট রাগ দেখানো। আমার অবচেতন মন যেনো ভেবেই নিয়েছে উনিই আমার মা। হয়তো নতুন রূপে ফিরে এসেছেন আমার কাছে। অনেকবার চেয়েছি উনার রহস্য উদঘাটন করার। বারবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরেছি। এখন সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। হয়তো রহস্য উদঘাটন করার পর জানবো উনি আমার কিছুই নন। কি দরকার? আমার অবচেতন মন ভেবে নিক না উনাকে আমার মা হিসেবে। ক্ষতি কি? কিন্তু জীবন কোনো রূপকথা তো নয়। রূপকথায় হয়তো রাজকন্যার কাছে তার মা নতুন রূপে ফিরে আসে। কিন্তু সত্যিকার জীবনে এমনটা হয়না। এখানে যারা একবার চলে যায়, একেবারেই চলে যায়। তারা আর ফিরে আসে না।

এরইমধ্যে আমার জীবনে আবারও একটি দুর্ঘটনা ঘটতে গেলো। যা আমার সাজানো গোছানো জীবনটাকে আরো একপ্রস্থ এলোমেলো করে দিলো।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি লাইট অফ করে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। রুনা আন্টি গিয়েছেন পাশের ওষুধের দোকানে আমার জন্য ওষুধ আনতে। সাথে গিয়েছে আমার ছোট ভাই রনি। দাদী গিয়েছেন ছাদে। সন্ধ্যার পর তার ছাদে একটু হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে উঠে বসি আমি। এখন আবার কে এসেছে? রুনা আন্টির কাছে তো চাবি আছে। সে নিশ্চয়ই কলিংবেল দিবে না। এখন ঘরে শুধু আমি আর আফজাল সাহেব। কে আসবে এই অসময়ে? এমনিতে আমাদের বাড়িতে বাইরের কেউ তেমন আসে না। ওই লোকটাই আসলে চায়না কেউ আসুক। আসলেই যে ওর কীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে।
আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না। পুনরায় এসে শুয়ে পড়লাম। ক্লোস্টোফোবিয়া থাকার কারণে আমি কখনো ঘরের দরজা আটকাতে পারিনা। সবসময় খোলাই থাকে তাই।
চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। হঠাৎ আমার পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসতে চাই আমি। স্পর্শটা অপরিচিত। আমরা মেয়েরা খুব ভালো করে বুঝতে পারি কোন স্পর্শের কি মানে। হঠাৎ দেখলাম ঘর অন্ধকার। এতোক্ষণ দরজা খোলা থাকার কারণে আমার ঘর অন্ধকার হলেও পাশের ঘরের আলো আসছিলো। এখন এতো অন্ধকার কেনো? কে দরজা দিয়েছে? আমি চিৎকার করে দাদীকে ডাকতে গেলে একটা শক্ত হাত আমার মুখে চেপে ধরলো। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো।

হঠাৎ দরজার বাইরে ঠকঠক শব্দ শুনলাম। আফজাল সাহেব বাইরে থেকে চিৎকার করছে,”হাশেম ভাই। আপনি নীরার ঘরের দরজা কেনো দিয়েছেন? কখন গেলেন আপনি ওর ঘরে? ও বদ্ধ দরজার ভিতর থাকতে পারে না। দরজা খুলুন আপনি। দয়া করে ওর কোনো ক্ষতি করবেন না এখন হাশেম ভাই। দরজা খুলুন প্লিজ।”
আমি ছটফট করছি বদমাশটার বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। নরকের কীটটার পৈশাচিক হাসি শুনতে পাচ্ছি আমি। কিন্তু আফজাল সাহেব আমাকে বাঁচাতে কেনো চাচ্ছে এখন?
আমি চিৎকার করে রুনা আন্টিকে ডাকতে চাচ্ছি। কোথায় মা তুমি?

6 পার্ট টা বইপোকা 👈এই পেইজে দিতে হবে,,,, তাই যারা ৬ পার্ট পড়তে ইচ্ছুক তারা ডুকে ফলো দিয়ে আসুন গিয়ে, ঘুম থেকে উঠে দেখবেন পোস্ট,,, নীল লেখাই চাপ দিয়ে ফলো দিয়ে আসুন

চলবে