Thursday, July 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 25



অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৭

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৭

‘নয়না বারবার মোবাইলটার দিকে তাকাচ্ছে।নাহহ একটা কল ও আসেনি! এই লোকটা এমন রসকষহীন কেন!আরেহহ ভাই তোর প্রেমিকা পালিয়ে গেছে তাতে কি হইছে! দুনিয়ায় মেয়ের অভাব পরছে! আমার মত সুন্দরী একজনকে ভালোবাসলেই তো লেটা চুকে যায়। কত নিষ্ঠুর হলে একবারও কল না করে। নাহহ নয়না স্থীর হতে পারছে না৷ পায়চারি করছে সারা রুম জুড়ে। রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসলো। চোখ গেলো পশ্চিম কর্নারে চোখের সামনে ভেসে উঠলো জিয়ানের প্রতিচ্ছবি! এই তো মনে হচ্ছে তার অস্থিরতা দেখে লোকটা মুচকি হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। দ্রুত ছুটে গেলো চেয়ারের সামনে, একদম দাঁত ফেলে দেবো এভাবে হাসলে।
‘আশ্চর্য সামনে কেউ নেই! লোকটা থাকলে ঠিক বলতো ফেলো দাও দেখি তারপর খপকরে তাকে কোলে নিয়ে নিতো? উফফ এসব আর ভাবতে পারছে না নয়না৷ দ্রুত পায়ে বারান্দা থেকে বের হয়ে আসলো৷ রুমেও স্বস্তি পাচ্ছে না৷ রুম থেকে বের হয়ে টিভি অন করলো,সেখানে গান বাজচ্ছে, সখী তোরা প্রেম করিও না পিরিত ভালা না…
চ্যানেল পাল্টে চলেছে কোথাও স্থীর হতে পারছে৷ বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে বলে,মহা মুশকিলে পরলাম তো!এই প্লেন ড্রাইভারতো কিছুতেই আমার মস্তিষ্ক আর হৃদয় থেকে সরছেই না।
‘আপিতা তুমি কার সাথে কথা ও।
‘নয়না সূচনার দিকে তাকিয়ে বলে,নট আপিতা ইট’স আপি।
‘ওকে পাপিতা।
‘তুই এতো বিচ্ছু কেন সূচনা? আমার মুড ভালো নেই সর এখান থেকে।
‘সূচনা হুট করে নয়নার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে বলে,তোর মুড দিয়ে আমি কি করবোরে আপিতা। আমি কার্টুন দেখবো সর তুই।
‘তোকে না কতবার বলছি আমাকে তুই করে বলবি না আর আপিতা বলবি না!
‘আপিতা, তুই আপিতা, তুই আপিতা।
‘চুপ করবি!
‘করবো না চুপ তুই করবি! চিনিস আবার বাবাকে?
‘নয়না সূচনার কান টেনে দিয়ে বলে,তুই মুচনা মুচনা।বলেই নিজের মায়ের রুমে চলে গেলো৷
‘সূচনা কাঁপাল কুঁচকে বলে,আমার সাথে এমন করেছিস দেখিস তোর সাথে কি করি আপিতা।
‘রুমে এসেই জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,আম্মু আমার ভালো লাগছে না৷
‘জাহানারা বেগম নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,বাহিরে যাবি? চল আমরা ফুচকা খেয়ে আসি।
“,নয়না আনন্দিত হয়ে বলে সত্যি!
‘হুম সত্যি।
‘নয়নার তবুও মন ভালো হচ্ছে না। ওই লোকটা কল করবে কখন! একটা কল কি করা যেতো না! আরেহহ মানুষের জন্য একটু মায়া তো থাকবে! কি নিষ্ঠার মানব লোকটা!
‘কিরে মা এখন কি ভাবছিস? আমাকে বল।
‘কিছু না আম্মু।
‘কিছু না হলেই ভালো। এখন মাথা থেকে সব ভাবনা বাদ দিয়ে দিবি৷ একমাত্র পড়া ছাড়া। সামনে পরিক্ষা সেটাতে ফোকাস করতে হবে। শ্বশুর বাড়ির লোকদের কাছে নয়ত লজ্জায় পরতে হবে।
‘নয়না চট করে উঠে বসলো, জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,আম্মু আমার আরেকবার বিয়ে দিলে কেমন ছেলের কাছে দিবে? এবার বিয়েতে বর কি আমি চুজ করতে পারবো?
‘মেয়ের এমন বোকার মত প্রশ্ন শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন৷
এসব তুই কি বলছিস? তোকে আবার বিয়ে কেন দেবো!বিবাহিতা মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়ে কোন দুঃখে দিতে যাবো!তাছাড়া জামাই আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। যেমন দেখতে তেমন কি অমায়িক তার ব্যবহার।
‘দেখতে রানবীর কাপুড়ে হলেই হয়!একদম ভালো না৷ এখনো একটা কল করলো না আমাকে! কেমন পাষাণ হৃদয়েে মানুষ! এমন মানুষ আমার মোটেই পছন্দ না৷
‘আরেহহ বোকা মেয়ে প্লেনে থাকলে কল কি করে করবে! ল্যান্ড করলে তারপর তোকে কল করতে পারবে৷ এখন তো ফোন এরোপ্লেন মুডে আছে। নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন।
‘নয়নার মন পুত হলো না কথাটা৷ কল করেনি সেটা মানলাম আমার শেষ কথাটাও তো শুনলো না!আস্তা হিটলার ড্রাইভার। আর একবার সামনে আসুন আপনাকে আমি উগান্ডা ভ্রমন করিয়ে আনবো।
‘এতো ভাবা বাদ দে। যা রেডি হয়ে আয়, ফুচকা খেয়ে আসি। আর হ্যা কাল থেকে কিন্তু স্যাররা আসা শুরু করবে পড়াতে। পরিক্ষার মাত্র সতেরোদিন বাকি।
‘তুমি না বলছিলা বিয়ে হলে আর পড়তে হবে না৷ তাহলে আর পড়বো না৷ আমার পড়াশোনা এখন বর, টিচার হলো শ্বশুর বাড়ির মানুষ, সংসার হলো ক্লাস রুম।
‘পরিক্ষা না দিলে জামাই মানুষদের কি বলবে, আমার বৌ আন্ডার মেট্রিক? জামাইয়ের যোগ্য হতে হবে না? উল্টোপাল্টা কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
‘🌿জিয়ান চোখ বন্ধ করলেই নয়নার নিষ্পাপ মুখশ্রী ভেসে উঠে চোখের সামনে। শেষ চাহনি তার চোখের আকুলতা। চোখ খুলে ফেলে জিয়ান৷ ঘুম আসছে না তার৷ ইশশ কেনো যে তোমার কথাটা শুনলাম না! আচ্ছা এই পাঁচদিনে মেয়েটার প্রতি কেমন টান অনুভব করছি৷ আমার কি বৌ হিসেবে সুনয়নাকে মেনে নেয়া উচিৎ?
‘এই যে মিস্টার হ্যান্ডসাম।
‘হঠাৎ এমন সম্বোধনে জিয়ান পাশ ফিরে তাকালো৷ জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে?
‘আমি ইরা।
‘জিয়ান ভ্রু কুচকে আবার নিজের ধ্যানে মগ্ন হলো৷
‘ ও হ্যালো পাত্তা দিচ্ছি বলে ভাব নিচ্ছেন! আমি ইরা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আর তাছাড়া আমরা কানাডার সিটিজেন। ছেলেদের লাইন লেগে যায় আমার পিছনে কিন্তু আমি কাউকে পাত্তা দেইনা৷
‘জিয়ান কানের মধ্যে ইয়ারফোন গুঁজে নিলো৷
‘আপনি এমন একটা ভাব নিচ্ছেন মনে হচ্ছে আপনি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে! আমার ভয় হচ্ছে তাই আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম৷ এতো এটিটিউট কিসের আপনার! চেহারা আর বডি থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না৷
‘জিয়ান আস্তে করে, বলল, আমি মানুষ না দানব, পিচাশ টাইপ দানব। আমি আমার বৌয়ের বিরহে বিলীন হয়ে যাচ্ছি তাই দয়া করে আমার বৌয়ের কল্পনায় বা’হাত ঢোকাবেন না৷
‘ছিহহহ আপনার বিহেভিয়ার এমন কেনো! আপনি দেখতে যতটা সুন্দর ব্যবহার ততটাই বাজে। সো কন্টিনিউ। ইরা ভেবেছিলো সুদর্শন এক যুবকের সাথে তার সিট পরেছে প্লেন জার্নিটা তার ভালোই কাটবে সতেরো ঘন্টার দীর্ঘ জার্নি কথা বলার মত একজন পাশে থাকলে একটু সহজ হতো৷ অদ্ভুত লোকটা।
‘জিয়ান মেজাজ হারাচ্ছে!বিরক্ত হচ্ছে নিজের উপর। ইচ্ছে করছে এখন এক দৌঁড় নয়নার কাছে যেয়ে নয়নাকে জড়িয়ে ধরতে। কপালে চুমু দিয়ে বলতে, বলো তুমি কি বলতে চাও তোমার কথা না শুনে কোথাও যাচ্ছি না৷ নয়নার প্রতি সে অন্যায় করেছে একে একে কতগুলো অন্যায় করে বসেছে বাচ্চা মেয়েটার প্রতি। বাচ্চা মেয়ে শব্দটা মনে আসতেই হেসে দিলো জিয়ান৷ নয়না এখন সামনে থাকলে নিশ্চিত কোমড়ে হাত রেখে বলতো, আমি মোটেও বাচ্চা মেয়ে না। আমি ষোড়শী বালিকা৷ আর কয়েকদিন পর কলেজে ভর্তি হবো৷
‘ইরা জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,লোকটার কি মাথায় সমস্যা আছে! একা একা পাগলের মত হাসছে?
🌿 মিজান তালুকদার মাহবুব তালুকদারের সামনে বসা।
‘কিছু বলবি?
‘ভাইজান আমি নীলাঞ্জনার খোঁজ পেয়েছি কিন্তু আমার মন পোড়ে তবুও আমার বিবেক তার দিকে ফিরতে দিচ্ছে না৷ আইরিন নীলাঞ্জনার জন্য কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
‘দেখ মিজান। ভুল করলে সেটা ধরে তো আর বসে থাকা যাবে না৷ যে ভুল করে তার ফল সেই ভোগ করে৷ এমন একটা ছেলেকে ছেড়ে ও যে ভুল করেছে একদিন ও নিজেই আফসোস করবে। তুইতো দেখেছিস রেজাকে কি সুদর্শন আর কর্মঠ ছেলে৷ নিজের মেয়েকে তো আমরা পর করে দিতে পারি না। তবে তুই আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধর ও নিজেই আসবে৷ আমরা সখ করে সমুদ্র ভ্রমণে যাই, হুট করে পঁচা সমুকে পা কাঁটলে তবেই টের পাই, সাবধানে চলাচল করতে হতো! অতি আবেগে আমরা ভুল করে বসি। ও পঁচা সুমুকে পা’ কেটে দগ্ধ হয়ে ঘরের মেয়ে ঘরেই ফিরে আসবে। চিন্তা করিস না৷
‘বিয়েটা টিকবে না বলছো?
‘আমি ছেলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে যা বুঝেছি টেকার সম্ভবনা খুব কম৷ যদি টিকে যায় তাহলে তো ভালোই৷ আইরিনকে সামলা। বড় মেয়ের শোকে ছোট মেয়েটাকে অযত্ন যেনো না করে৷ যে চলে যায় সে স্বার্থপর। স্বার্থপর মানুষের জন্য ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দিতে হয় কারন এমন মানুষ ভালোবাসার কদর বুঝে না৷ কি না করেছি আমরা নীলাঞ্জনার জন্য! আমাদের সম্মানের কথা একটাবারও ভাবলো না! বাবা, মায়ের,পরিবারের ভালোবাসা সম্মানের চেয়ে নিজের ভালো থাকাটা বেছে নিলো!
🌿এক ছেলে চলে গেছে আরেক ছেলে আসতেছে৷ ছেলের রুম গুছিয়ে রাখলো নিজের হাতে। কিচেনে এসে নানারকম খাবার রান্না করলো ছেলের পছন্দের। ছেলেটা তো বাসায় তেমন থাকেই না। সারাক্ষণ তার মাথায় থাকে বাউণ্ডুলেপানা৷ কোন দেশ রেখে কোন দেশে ভ্রমন করবে সেই তাড়না। রেজা রাগি তবে মা’ভক্ত। জাহিন একরোখা তার মন মর্জি বোঝা মুশকিল৷
‘দীর্ঘ আটমাস পর দেশের মাটিতে পা’রাখলো জাহিন চৌধুরী। চৌধুরী বংশের ছোট নবাব৷ এশ কালার শার্ট, শার্টের হাতা ফোল্ড করা। কালো চশমা পরা,এক হাতে লাগেজ অন্য হাতে ব্লেজার। হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে এয়ারপোর্টের গেট দিয়ে বের হচ্ছে।

#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৬
আমার বর হ্যাসবেন্ড প্লিজ তার সাথে দেখা করতে দিন৷
‘ম্যাম আপনার বর তো হ্যাসবেন্ড হবেই। বাংলাতে বর,ইংরেজিতে হ্যাসবেন্ড৷
‘আরেহহহ আমার বর ড্রাইভার।
‘ম্যাম অযথা আমাদের সময় নষ্ট করবেন না৷ আপনার বর হ্যাসবেন্ড হোক বা ড্রাইভার আমরা আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবো না৷
‘জাহানারা বেগম বললেন এসব কি ভুলভাল বলছিস তুই?
‘আমার কি দোষ বলো আম্মু?এই লোক আমার মাথা খারাপ করে রেখেছে।
‘স্যরি ভাইয়া। আসলে বলতে চেয়েছিলাম আমার হ্যাসবেন্ড পাইলট। সে ফাস্ট অফিসার৷ আইমিন ক্যাপ্টেন। ওনার কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রেখে গেছেন ভুলবশত প্লিজ হেল্প করুন এগুলো তাকে পৌঁছে দিতে।
‘কোন দেশে যাবে আপনার হ্যাসবেন্ড?
‘কানাডা৷
‘ওয়েট ম্যাম। দেড় হাজার টাকা দিন।
‘ নয়না কিছু বলতে নিলে,জাহানারা বেগম নয়নার হাত টেনে ধরে। নিজের ব্যগ থেকে টাকা বের করে দেন৷
‘লোকটা একটা টোকেন দিয়ে বলে,রুম নাম্বার দশে চলে যান৷ তারা আপনাকে হেল্প করবে। ধন্যবাদ ম্যাম।
‘নয়না রুম নাম্বার খুঁজতে লাগলো হঠাৎ করে চিৎকার করে ডেকে উঠলো, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার…..
‘অনিকেতের সাথে পুরো রাস্তা হাসিঠাট্টা করতে করতে এয়ারপোর্টে চলে আসে দু’জনেই।
‘অনিকেত জিয়ানের ব্যাগ নামিয়ে এনে বলে,তুই আমার বন্ধু এটা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ভাই।
‘তোর বিশ্বাস করতে হবে না।
‘ভাবির কোন বান্ধবী নাই দোস্ত?
‘এখন এসব বলার সময় শা’লা।
‘বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে সময় টময় হিসেব করতে নেই। যদি পেয়ে যাই মনমতো কন্যা বিয়ে করে বনবাসে যাবো।
‘,জিয়ান হেসে বলে, বিয়ে করে বনবাসে কোন দুঃখে যাবি?
‘বৌ কে নিয়ে যাবো। জানিস তো আমি আবার প্রকৃতি লাভার
বিয়ের একবছর টানা হানিমুন করবো এক দেশের জঙ্গল থেকে আরেক দেশের জঙ্গলে।
‘হানিমুন তো ভালো কথা তোর হাড্ডি অবশিষ্ট থাকলে তবেই না এক জঙ্গল ভ্রমণ শেষ করে আরেক জঙ্গলে যাবি!চুপ কর আর চল।
‘হাঁট ছিলো দুজনে। এমন সময় অনিকেত আবার বলে উঠলো,ভাই তোর বুকে ব্যথা করছে না? এতো সুন্দরী বৌ রেখে তুই কোন বুকের পাঠা নিয়া ফ্লাই করতে চলে আসলি? বৌটাকে সাথে করে নিয়ে আসলে একটা দুইটা চুম্মা খাইতি,জড়ায়া টরায়া ধরতি!বৌ কান্না করতো তুই বলতি কেঁদো না সাথী আমার, আমি তোমার আছি তোমারই থাকবো, ফিরে ফিরে তোমারই কাছে আসবো।
‘চুপ করবি!নয়তো তোর সাথে এখানেই বিদায়।
‘আচ্ছা ভাবির কোন বোন নেই?
‘আছে একটা তোর মাথার চুল সব টেনে ছিড়ে ফেলবে৷ তবে তোর জন্য ওই একপিস যথেষ্ট।
‘তো করিস না আর দেরি নাম্বার দে তাড়াতাড়ি।
‘তুই আসলেই ডাক্তার?
‘হসপিটাল আর ক্লিনিকে আমি ডাক্তার। বাহিরে আমি রোমিও কিন্তু আমার জুলিয়েটের খবর নাই৷
‘ওর বয়স আট তবে তোরে নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারবে৷
‘একটা হৃদয় কয়বার ভেঙে দিবি বন্ধু!পাষান বন্ধু। কথা বলছিলো আর হাঁট ছিলো৷ হটাৎ কানে আসলো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। হুট করে পা’থামিয়ে দিয়ে সামনে চোখ বোলালো৷ নাহহ নেই তো!তাহলে কি আমি ইমাজিন করছি!ভাবনার ভেদ করে আবার কানে আসলো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। পেছনে ঘুরে তাকাতেই চোখ পরলো নয়নার দিকে,এক প্রকার ছুটে আসছে সে৷জিয়ান যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা৷ নিজের দু’হাত প্রসারিত করে দিয়ে বলে, নয়না। সব মানুষ তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। হুট করে দেখলে সবাই ভাববে কোন সিনেমার শুটিং চলছে এখানে,নায়ক নায়িকার জন্য দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে, আর নায়িকা দৌড়ে নায়কের কাছে আসছে!
‘অনিকেত ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,এটা তো ভাবি?তুই বললি অস্থায়ী এখন দেখি অন্য সিন? অনিকেতের কথা জেনো জিয়ানের কর্নে পৌঁছায়নি। সে তাকিয়ে আছে নয়নার দিকে।
‘নয়না জিয়ানের সামনে এসে থামলো, জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
‘জিয়ান নিজের প্রসারিত হাত দুটো সরিয়ে নিলো।আচ্ছা সে কি চাইছিলো নয়না তাকে জড়িয়ে ধরুক! কেনো তার মন এটা চাইলো?যাকে আপন করতে পারবো না তাকে কেনো বক্ষ টানছে? কেনো মনে হচ্ছে এইভাবে ছুটে এসে আমার বক্ষে আঁছড়ে পরুক!
‘প্লেন ড্রাইভার আপনি লোকটা মোটেও সুবিধার নন। রাতেই বললেন,নাম্বার লাগবে? নাম্বার না দিয়ে চলে যাচ্ছেন?
‘সিরিয়াসলি সুনয়না তুমি একটা নাম্বারের জন্য এভাবে ছুটে এসেছো? তোমার মাথার স্ক্রু আছে নাকি পরে গেছে৷
‘চুপ করুন সব সময় জটিল জটিল কথা! এতো কষ্ট করে এসেছি কই কোলে নিবে চুমু খাবে তা-না উল্টো বকড় বকড় করছেন?
‘পাবলিক প্লেসে তোমাকে কোলে নিয়ে চুমু খাবো?তুমি এটা চাইছো? তুমি চাইলে আমার কোন সমস্যা নেই।
‘অনিকেত কাশি দিয়ে বলে,ভাই তুই থাম আমার বুকে ব্যথা উঠতেছে।
‘আপনি এখানে কি করছেন! দ্রুত হসপিটালে যান। অসুস্থ মানুষ এয়ারপোর্টে না হসপিটালে থাকে।
‘নয়না ও আমার বন্ধু অনিকেত। ও পেশায় ডাক্তার কার্ডিওলজিস্ট। মজা করে বলেছে। এবার বলো কেনো এসেছো?
‘বাসায় বসে আপনার বিরহে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম৷ তাই ভাবলাম পাগল না হয়ে আপনাকে কয়েকটা কিসমিস দিয়ে যাই।
‘এখানে কেনো বেবি? খোলা ময়দানে প্রেম জমে নাকি? প্রেম জমে আড়ালে।
‘আহারে মিস্টার রোমিও। এই নিন আপনার কিসমিস।
‘ধন্যবাদ প্রিয়া।
‘ওয়েলকাম প্রিয়।
‘জিয়ান ওয়ালেট থেকে তিনহাজার টাকা বের করে নয়নার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, বেড সিটের দাম৷ আমি আবার এতো উদার না।
‘নয়না জিয়ানের জিন্সের পকেটে টাকাটা ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,দাগ চলে গেছে তাই টাকা লাগবে না৷
‘তোমার সাথে কে এসেছে?
‘আম্মু এসেছে।
‘উনি কোথায়?
‘বসে আছে।
‘আচ্ছা আমার হাতে একদম সময় নেই। আমি আসি৷
‘শুনুন
‘বলো।
‘এভাবে বলো, বললে কি বলবে হু! মনে হচ্ছে আমার উপর এক্ষুনি পাহাড় ছুড়ে মারবেন৷
‘সুনয়না এখন মজা করার সময় না।
‘অনিকেত হেসে বলে,এতো কিউট একটা বচ্চা বৌয়ের মিষ্টি কথা তোর ভালো লাগছে না!
‘আপনি হার্টের ডাক্তার তাইতো?এককাজ করতে পারবেন?
‘কি কাজ লিটল ভাবি।
‘এই ড্রাইভার হার্টের সার্জারী করে সব বদ রাগ জেদগুলো বের করে দিবেন৷
‘অনিকেত জিয়ানের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে সরে গেলো।
‘আপনি এভাবে চোখ রাঙিয়ে ডাক্তার বাবুকে সরিয়ে দিলেন কেন? আমি তো আপনার চোখ রাঙানোকে ভয় পাই না৷
‘নয়নার কথার উত্তর না দিয়ে নয়নার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজের নাম্বার সেভ করে দিলো৷ ফোনটা নয়নার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,পড়ালেখা করো ক্যারিয়ার গড়ো।
‘আমার পড়ালেখায় হলো বিয়ে আর ক্যারিয়ার হলো সংসার।
এতো কষ্ট করে পড়ালেখা না করে বরের সাথে ঝামেলা করবো। উল্টোপাল্টা কাজ করে শ্বাশুড়ির বকা খাবো৷ এই হলো আমার মূল ক্যারিয়ার৷ জামাই ইনকাম করবে আমি তার মাথায় চড়ে দুনিয়া ভ্রমণ করবো৷
‘এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হও। আমার হাতে সময় নেই।
‘আহা আমার কথাটা তো শুনবেন।
‘এখন বাচ্চামো করার সময় না সুনয়না।
‘আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।
জিয়ান কিছু বলবে তার আগেই এনাউন্সমেন্ট হলো, প্রিয় যাত্রীরা Ac. 87 টরন্টোগামী ফ্লাইটের যাত্রীদের গেইট নাম্বার ২২ এর দিকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
‘জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,কিছু কথা না বলা থাকুক। কথাটা শেষ করেই দ্রুত সামনের দিকে পা’ বাড়ালো।
জিয়ানের ইচ্ছে করছে নয়নার কথাটা শুনতে কিন্তু তার গন্তব্য সামনে এই মূহুর্তে পিছু ফেরা সম্ভব না। তাছাড়া সময় একদম কম।
‘নয়না এক ভাবেই তাকিয়ে আছে জিয়ানের চলে যাওয়ার দিকে। মনে মনে বলছে,আমার কথাটা শুনলেন না! কথার ভাজে কথা জমতে থাকুক৷ আপনি ভালো থাকুন সব সময়। নয়না ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলো যতক্ষণ জিয়ানকে দেখা যাচ্ছিলো।
‘জাহানারা বেগম এসে নয়নার হাত ধরে বলে,ওতে কাজে যাচ্ছে এটাই ওর পেশা। ফিরে চল। সময় হলে আবার তোর কাছেই আসবে।
‘জিয়ান প্লেনে নিজের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে,নিজের মোবাইল বের করে নয়নার আজকে সকালে লুকিয়ে তোলা পিকটার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার চাওয়াটা আমি পূরন করতে পারলাম না।
আমার জীবন তোমার নামে বিলীন করতে পারলাম না,
ধীরে ধীরে জ্বলছি,আগুনকে হৃদয় থেকে নেভাতে পারছি না!
‘বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সাথে। নিজেকে কখন ক্ষমা করতে পারবো না। “তুমি সদ্য ফোটা কলি আমি ঝড়ে যাওয়া ফুল, কিভাবে খুঁজবো তোমাতে কুল!
‘ভিষন ভিষণ অভিমান জমলো নয়নার৷ তার কথাটা না শুনে চলে গেলো! লোকটা একটুও ভালো না৷ আজ থেকে তার নাম নিষ্ঠুর প্লেন ড্রাইভার। মনে মনে বকবক করতে ব্যস্ত নয়না। জাহানারা বেগম বললেন, এতো কি ভাবছিস?এসব ভাবনা বাদ দিয়ে এবার বইখাতার চিন্তা কর।এখন রেজাল্ট খারাপ হলে শ্বশুর বাড়ির মানুষ ও তোকে পঁচাবে।
🌿
লাবিব বাসায় এসে ঢুকতেই। সৈকত সাহেব (লাবিবের বাবা) বলেন,তুই আমার বাসায় কেনো এসেছিস?
‘বাবা স্যরি।কিন্তু দোষটা আমার একার না৷ আমি তোমাদের বলেছিলাম তোমরা রাজি হওনি তাই এই পথ বেঁছে নিতে হলো।
‘সৈকত সাহেব লাবিবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,তা তোমার বাবা মা তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে? বড়লোক ছেলে পেয়েই গলায় ঝুলে পরলে? কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যায় শুনি!
নীলাঞ্জনা নিচের দিকে তাকিয়ে নিরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কত আদরের মেয়ে ছিলো সে। মুখ ফুটে বলার আগেই সব হাজির হয়ে যেতো।এতো বিলাসী জীবন ছিলো তার৷ আজ তার একটা ভুল তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে!
‘শিল্পি বেগম এসে বলে,(লাবিবের মা) মেয়েটার কি দোষ বলো? তোমার ছেলে প্রশ্রয় দিয়েছে বলেই না এসেছে সব ছেড়ে।
‘একদম চুপ করো তুমি। আমি কি ফিডার খাওয়া বাচ্চা? মেয়েরা সায় না দিলে কোন ছেলের সাহস হয়! আমি নিশ্চিত কোন নিম্ন পরিবারের মেয়ে এরজন্য লোভে পরে আমার ছেলেকে রুপের জ্বালে ফাঁসিয়েছে। এই মেয়ে বংশ পরিচয় কি তোমার? তা আদৌও বংশ পরিচয় আছে তো নাকি ছাপড়ি?
#চলবে

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

1

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তূজা

সমাপ্তি পর্ব.

ইরাজকে জোর করেও সারাদিনে কিছু খাওয়ানো যায়নি। মেঘালয়াকে বেডে শিফ্ট করা হলেও পুরোপুরি হুশে নেই মেঘালয়া। বলা যায়, অবচেতনায় লুপ্তপ্রায় পড়ে আছে মেয়েটা। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি একাধারে বসে ছিল ইরাজ মেঘালয়ার মেঘালয়ার পাশে মেঘালয়ার হাতটা ধরে। ব্লাড প্রেশার এখনও পুরোপুরি কন্ট্রোলে নেই— ১২০/১৫০ চলছে। তবে ঝুঁকিমুক্ত বলা চলে। আনতারা খানম মেঘালয়াকে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। ইরাজ বেরিয়ে এলে হেলাল সাহেব আবারও গিয়ে বসলেন নিঃশব্দে মেয়ের শিয়রে।

ইরাজ রোবটের মতো কৃত্রিম পায়ে হেঁটে হাসপাতালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। শরীরে জড়ানো সেই গতকাল রাতের একটা জীর্ণ শার্ট। সারাদিনের অভুক্ত অবস্থায় মুখটা বড্ড শুকনো লাগছে তার। যে কেউ দেখলে অবাক হবে–এই কী সেই ইরাজ! সবসময় গুছিয়ে চলা ইরাজকে আজ বড়ো অগোছালো লাগছে। বারবার ইরাজকে ওই অর্ধ-বিকশিত কচি মুখটা চোখের স্মৃতি দংশন করছে। কেমন এক দুর্বিসহ যন্ত্রণা একাধারে খুঁচিয়ে যাচ্ছে ইরাজকে। আবার মেঘালয়ার ওই র ক্তশূন্য অচেতন মুখ!

ইরাজ রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনল। দিয়াশলাই চেয়ে নিলো দোকানদারের কাছ থেকে। সিগারেটে টান দিতে গিয়ে মনে পড়ে, মেঘালয়া আর বাচ্চার কোন ক্ষতি হবে বলে ইরাজ ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিল। চোখটা শক্ত করে বন্ধ করে নিয়ে লম্বা এক শ্বাস টেনে নেয়। যা সাথে সাথে শ্বাসে মিশে ফুসফুসে প্রবেশ করল একপাঁজা নিকোটিনের ধূম্র। আকাশের দিকে চাইল মুখ তুলে। আকাশে চাঁদ নেই। হতে পারে অমানিশা লেগেছে অথবা মেঘ জমেছে ঘটা করে। আকাশটাকে আজ ইরাজের নিজেরই প্রতিচ্ছবি মনে হলো। আশ্চর্যজনক ভাবে স্বাভাবিক ক্ষুধাটুকু এখনও হানা দেয়নি ইরাজকে। মস্তিষ্কে ব্যথার ক্ষরণ শুরু হলে বোধহয় গোটা শরীরের উদ্দীপনাও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।

পর-পর বেশ কয়েকটা সিগারেট অন্ধকারচ্ছন্ন ওই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একসাথে টানল ইরাজ। প্যাকেট অর্ধেক। বুকটা জ্বলছে এবার। পানির পিপাসা অনুভব করল। তবে পানি পান করার কোনরূপ চেষ্টা না করে আবার ছুটল হাসপাতালের ভেতরে। মেঘালয়ার ওই বিবর্ণ মুখটা খুব জালাচ্ছে ইরাজকে। দূরে থাকতে চাইছে ইরাজ–যাতে ওই মুখে চেয়ে যন্ত্রণা দ্বিগুণ অনুভূত না হয়। অথচ দূরে থাকার ফলে যেন তা দ্বিগুন বরং কয়েকগুণ বেশি অনুভূত হচ্ছে। দরজাটা হালকা আলগা করে দেখল মেঘালয়াকে। পাশেই হেলাল সাহেব পরিশ্রান্ত মুখে বসে আছেন মেঘালয়ার দিকে পলকহীন চেয়ে। ইরাজ চলে এলো। বাবা-মেয়ের ভাবাবেগে দখলদারী করার ইচ্ছে হলো না। ইরাজ তো একালে মায়ায় পড়েছে মেঘালয়ার। অথচ এই লোকটা নিশ্চয়ই মেঘালয়ার জন্মেই আগেই আটকে গিয়েছিল ওই মেয়েতে! যেমনটা ইরাজ আটকেছিল নিজের সন্তানের মায়ায়। সে মায়া বড়ো জটিল, সে এক জাল বটে। যা ইরাজকে গ্রাস করেছিল ওই ছোট্ট শরীরের অধিকারী পুচকি শিশুটাকে চক্ষে না দেখেই।

ইরাজ দ্রুত এসে বসল বেঞ্চের ওপর। কথাগুলো ভাবতেই বুকটা মুচরে উঠেছে। শরীরটাও দুর্বল লাগল। বেঞ্চে বসতেই পাশে বসে থাকা আনতারা ছেলের মাথাটা নিজের কাধের সাথে আগলে নিলেন। অপর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “এত ভেঙে পরিস না, আব্বা! মেঘা ঠিক আছে, আল্লাহ দিলে আমার আবার নাতি হবে।ʼʼ

ইরাজের প্রতিক্রিয়াহীন মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরালেন। বললেন, “তোর ছেলের জন্য নিজেকে যতভাবে পারা যায় কষ্ট দিচ্ছিস, সারাদিন না খেয়ে আছিস। কেন, তুই আমার ছেলে না? তুই একদিন বাপ হয়েছিস, আমি আঠাশ বছর মা হয়েছি। এবার বল, কার বেশি পুড়ছে সন্তানের জন্য– সন্তানের অবস্থা দেখে?ʼʼ

ইরাজ সেই শেষবার কথা বলেছিল সকালে। এরপর থেকে বোবা হয়ে গেছে সাথে যেন ঠসাও। মায়ের এমন অভিযোগী কথা শুনে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ঢোক গিলল। আস্তে করে বেঞ্চের ওপর পা তুলে আনতারা কোলে মাথা রেখে পা দুটো জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ইরাজের চেয়ে তুলনামূলক বেঞ্চটা বেজায় ছোটো। তবুও বাচ্চা ছেলের মতো পা-দুটো গুটিয়ে নিষ্প্রাণের ন্যায় পড়ে রইল ইরাজ মায়ের কোলে।


রাত দেড়টাও পেরিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা। হাসপাতালটা সারাদিনের তুলনায় বেশ শান্ত। ইরাজ কেবিনের চাপানো দরজাটা খুলে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল মেঘালয়ার বেডের পাশে। মেঘালয়া ঘুমিয়ে আছে। ইরাজ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ একদৃষ্টে মেঘালয়ার মুখের দিকে। এই মেয়েটার খাতিরে ইরাজ নিজের পিতৃত্বকে হাজার জনম ত্যাগ করতে পারবে; হঠাৎ-ই এমন মনে হলো ইরাজের। এই মেয়েটার এই অসুস্থ মুখটার আড়ালে গেলেই কেবল সন্তানের কচি মুখটা পীড়া দিচ্ছে ইরাজকে। এই মেয়ে নজরে বন্দি হতেই কেবল মস্তিষ্ক প্রতিবাদ করে উঠছে, সব পেছনে ফেলে এই মেয়েটাকে সাথে নিয়ে কিছুদিন বাঁচার আছে ইরাজের।

আস্তে করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে গাঢ় এক চুমু দিলো ইরাজ মেঘালয়ার কপালে। অতঃপর মেঘালয়ার ঠোঁটের কিনারায়। একহাতে মেঘালয়ার কাতর মুখখানি ও অপর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চেয়ারে বসল, মেঘালয়ার বাঁ হাতে স্যালাইন চলছে। ক্যানোলা ঢুকানো শিরাটা খানিক ফুলে আছে। ইরাজ আলগোছে মেঘালয়ার হাতটা জড়িয়ে নেয় নিজের হাতের মাঝে। ফুলে থাকা শিরাটার ওপর বৃদ্ধা আঙুলি দিয়ে কয়েকবার স্পর্শ করল। ভেজা এক ঢোক গিয়ে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। হাতটা ছেড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে অগ্রসর হয়। আকস্মিক ইরাজের হাতটা চেপে ধরা হয় পেছন থেকে।

ইরাজ ঘুরে তাকাল পেছনে। মেঘালয়ার চোখ বন্ধ, অথচ চোখের কিনারা দিয়ে তরল গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে, ঠোঁট নিচে থুতনির ওপরে কম্পন উঠেছে। ক্যানোলা লাগানো হাতটা দিয়েই ইরাজের হাতখানা মেঘালয়া আরও শক্ত করে চেপে ধরল। ইরাজ চোখটা বুজে নিয়ে ধপ করে আবার বসে পড়ে চেয়ারটায়। মেঘালয়া হাসছে, চোখের টলমল পানিকে উপেক্ষা করেই পাগলি মেয়েটা হাসছে।

মেঘালয়ার মুখের ওই কাতর হাসি! ইরাজের কলিজা ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইল! বোকা মেঘ বুঝছে না তা! নাহ! আজও বুঝছে না। এ মেয়ে ইরাজকে কোনদিনই বুঝবে না। ক্ষণে ক্ষণে শুধু কলিজা ঝলসাবে ছেলেটার! ইরাজের লাল চোখদুটো, এলোমেলো চুল! মেঘালয়ার দৃষ্টি ইরাজের ওপর স্থির। আজ বোধহয় প্রথমবার এমন খামোশ দৃষ্টিতে দুজন দুজনার চোখে চেয়েছে! মেঘালয়ার কাত হয়ে থাকা মাথাটা বালিশে লেপ্টানো। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়ল সাদা বালিশের ওপর। মেঘালয়া ঠোঁটটা আরও খানিকটা প্রসার করে চেয়ে দেখে ইরাজের ধ্বংসপ্রাপ্ত চেহারাটা। সর্বস্বান্ত ইরাজের চোখটা চেয়ে আছে মেঘালয়ার ঠোঁটের হাসির দিকে। মেঘালয়া ইরাজের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“আপনি ঠিকই বলতেন, ইরাজ! মেঘ অপদার্থ, জঘন্যতম অপদার্থ— যে নিজের ওপর রাখা কাছের মানুষগুলোর আশাগুলোকে কেবল আশা ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণায় বদলে দিতে পারে। দেখুন না, আব্বু আশা রেখেছিল,মেঘা অনেক বড়ো হবে, মেঘা সবসময় তার বাবার আদুরে মেয়ে হয়েই থাকবে। দেখেছেন কী করেছি আমি? ইরাজ আমায় পর্বতের মতো অটল ভালোবাসায় আগলে রেখে আশা রেখেছিল, আমি বুঝব তাকে কোন একদিন। দেখেছেন আমি কী করেছি? এবার আপনারা সকলে আশা রেখেছেন, একটা পুচকু আসবে,আমি আনব তাকে। দেখেছেন কী ..

প্রথমবার মেঘালয়া নাম ধরে ডেকেছে ইরাজকে। কেন! সবকিছু নির্বিশেষে ইরাজ এক অদ্ভুত কম্পন পের পায় নিজের বুকে।

চেপে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। চোখের মণিতে ভাসমান ছলছলে জলটুকু চোখের পাতার চাপে বেড়িয়ে এসে পাপড়ি ভেজায় বোধহয় এবার। মেঘালয়ার হাতখানা সেও এবার শক্ত করে চেপে ধরে। নাকটা কেঁপে উঠল ইরাজের। মুখের চোয়াল শক্ত করে গালটা হা করে চোখ খুলে তাকায়। মেঘালয়ার কথা শেষ হয় না। মেঘালয়া আরেকটু হেসে দেয়। চোখে ভরে থাকা এক দলা জল তার গড়িয়ে যায় কপালের পাশ বেয়ে। ইরাজ ডানহাতের তর্জনী আঙুল টা চেপে ধরে বুকের মাঝখানে শক্ত কাঠামোর ওপর শক্ত করে। চেপে ধরে একটু নাড়ল আঙুলটা। নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে তার বারবার। মেঘালয়া একদৃষ্টে ইরাজের দিকে চেয়ে আবার বলতে শুরু করে,

“জানেন, ইরাজ! ক’দিন হলো জটিল এক অনুভূতি জ্বালাতন করতো আমায়। ঘুম হতো না একদম। এ অনুভূতির সঙ্গে একদম পরিচিত নই আমি। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। যাতে মিশে আছে, হারানোর ভয়, তার পাশে এক-জীবন থেকে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা আর তার সঙ্গে মিশে যাওয়ার এলোমেলো পাগলামি।ʼʼ

এটুকু বলে আবার হাসে মেঘালয়া। আবার বলে, “অথচ আগে কখনও এমন অনুভূতি জাগে নি। এই অনুভূতিটা কার প্রতি এসেছে জানেন?ʼʼ

ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে মেঘালয়া। সজল চোখে চেয়ে বলে, “যে পুরুষটাকে তার রুক্ষ, এলোমেলো আচরণের জন্য অপছন্দের তালিকার শীর্ষে রেখেছিলাম। অথচ কবে কবে যেন, তার ঘাঁড় ত্যাড়ামির মায়ায় আঁটকেছি। কবে থেকে যেন তাকে পুষতে শুরু করেছি নিজের গভীরে।ʼʼ

মেঘালয়ার চোখটা ভরে উঠেছে। কথাগুলো মেঘালয়া থেমে থেমে দুর্বল স্বরে, ক্ষীণ আওয়াজে বলছে। ইরাজ কেবল মলিন হাসল।

“তাবির আমায় বলেছিল, আমি আব্বুর চালিত পুতুল। বোকা মেঘ! সেকালে এত মূর্খ ছিলাম, ঘৃনা আমারও জাগে আপনার মতই মেঘের ওপর। এই দেখুন, ক’দিন আগে হুট করে বুঝতে পেরেছি, তাবির আব্বুর নাম কোরে আমার অপছন্দের পুরুষের কথা বলেছে বারবার। সহজ অঙ্ক– আব্বু তো আমায় কোনদিন শাসন করেনি! আব্বু আমায় বেঁধে রেখেছিল না কখনও, আব্বু ধমকায় নি, আব্বু আটকায় নি। আমার আব্বু তো আমার সঙ্গে প্রথম চোটপাট করেছিল, তার মুখ ডুবিয়ে ফেরার পর। আব্বুর কাছে আমি ছিলাম দেবী। যাকে আব্বু পূজা করেছে সকাল-দুপুর।ʼʼ

ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল মেঘালয়া, “অথচ এই সরল অঙ্ক মেলাতে পারিনি সেদিন। ইরাজের সব কথা মিলে যায় আজকাল আমার কাছে— মেঘ, অঙ্কে জঘন্য কাঁচা। তাই-তো ইঞ্জিনিয়ারিং ওর কোনকালেই পছন্দ না। ইরাজ চরম অপছন্দের পুরুষ বরাবরই আমার। কারণ, আমায় বেঁধে রেখেছিল ইরাজ, সব-সময় শ্বাস আটকে নজরে রেখেছে ইরাজ, কোনদিন সাজতে দেয়নি, বাইরে বের হতে দেয়নি, একসাথে চললে, এতো বড়ো মেয়ে হয়ে গিয়েছিলাম, রাস্তাটা হাত ধরে পার করে দিতো ইরাজ। তার কড়া নজরে অতিষ্ট ছিলাম চিরদিন। তার জন্য আর পাঁচটা মেয়ের মতো অবাধে চলতে পারি নি। সব মিলিয়ে আমি তো তার পুতুল ছিলাম, আব্বুর না। অথচ এই হিসেব এই-তো ক’দিন আগে মিলেছে। ইরাজের মতে, ন্যাকা আমি,এজন্য এসব ছোট্ট ব্যাপারগুলোকে ভুল বুঝে জীবনটা সিনেম্যাটিক করে তুলেছি। তার মত আবার ফেলার মতো হয়না।ʼʼ

নিজের ওপর তাচ্ছিল্য হাসে মেঘালয়া, চোখে জল। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় মেঘালয়া। ইরাজ অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হেসে ফেলে নিঃশব্দে। তার বুকের উঠা-নামা, আর ভারী নিঃশ্বাস মেঘালয়ার চেয়েও অস্বাভাবিক লাগে। মেঘালয়া একটু নড়ে-চড়ে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ একভাবে শুয়ে থেকে এক-ঘেয়েমি ধরে গিয়েছে। ইরাজ আতঙ্কিত হয়ে উঠল তাৎক্ষণিক। চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। মেঘালয়া শান্ত হয়ে শুয়ে চেয়ে রয় কেমন করে যেন চিন্তিত ইরাজের দিকে। সেকেন্ড কয়েক পর ইরাজের চোখের দিকে তাকায়। চোখের মণিতে সূক্ষ্ম শিরাগুলোয় র ক্ত জমে চোখদুটোকে লাল দেখাচ্ছে। বারবার ঢোক গিলছে ইরাজ। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে! অথচ নীরবতায় জড়িয়ে সে যেন বুকের ব্যথাগুলোকে অনুভব করতে ব্যস্ত। মেঘালয়া নিভু-নিভু স্বরে বলতে শুরু করে,

“সেদিন গাড়ির ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দুধারের দোকানপাটের ব্যানার দেখে বুঝলাম, আমরা চট্রগ্রাম পৌঁছেছি। বড্ড হাঁসফাঁস লাগছিল কেন জানি। আমি সন্তষ্ট হতে পারছিলাম না, অথচ গেছি আমি নিজেই।ʼʼ

হেসে ওঠে মেঘালয়া, “একটা অজানা ভয় কাজ করছিল। ভয়টা কী জানেন? ইরাজের ভয়। মনের কোণে না চাইতেও অজান্তেই একটা বদরাগী মুখ এসে জ্বালাতন করছিল, এই হয়ত সামনে এসে দাঁড়াবে, চটাং করে থাপ্পর মারবে।এরপর কী হবে, আল্লাহ জানে! সে যে কেমন অস্থিরতা! ওই যে ছোটো থেকে ঢুকে যাওয়া এক ভয়! জায়েজ শাসন! আমি তাবিরকে বলেছিলাম, ‘বিয়ে কোথায়
করবে?ʼ বলল, ‘এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আপাতত হোটেলে থাকব, সকালে যা হয় হবে।ʼ কথাটা পছন্দ হয়নি আমার। হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকেও দরজাটা খোলা রেখেছিলাম। অস্থিরতা! দরজা বন্ধ করব! ভাবতেই গা শিউরে উঠছিল। আব্বু বা ইরাজ কারও হাতে পড়লে আমার রুহু বের করে নেবে। অথচ মাথায় এটা আসতে চাইছিল না, আমি না পালিয়ে এসেছি, প্রেমিকে সাথে এসেছি, তাদের নাগালের বাইরে। চারদিকে চোরের মতো তাকিতুকি করেছি— আল্লাহ জানে ক্যাকটাসটা কোথায়, দেখে ফেললে আমার কী হবে, এভাবে এত রাতে বাইরে এসেছি জানলে কী বিশ্রী ঝাড়ি শুনতে হবে… যেন আমি যশোরেই আছি। এক মুহুর্তের জন্যও মাথায় এটা সেট হয়নি– আমি দূরে আছি, আমার আশেপাশে ইরাজ নেই।ʼʼ

মেঘালয়া এ পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমি আসলেই কারও ছায়াতলে বন্দি এক কচি পাখি। জোশের বশে যাহোক করে তো ফেলেছি, অথচ…
কিছুক্ষণ পর হোটেলের মেনেজার আসল সাথে কয়েকজন অপরিচিত লোক। এসেই তাবিরের গলায় ছুরি ধরে। তাদের ডিমান্ড আমাকে তাদের হাতে তুলে দিলে তাবিরের রেহাই।ʼʼ

মেঘালয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু থামল না। এটুকু বলে মৃদূ গা কাঁপিয়ে শব্দহীন হাসি হাসল। আস্তে করে হাসিটুকু মিলিয়ে শান্ত হয়ে যায় মুখটা, চোখ ঘোলা দেখায় তার। বলে, “তখন আব্বুর কথা মনে পড়েনি। কেন জানি না। তখন কেবল মনে মনে কল্পনা করে উঠেছিলাম, আমার ক্যাকটাস এসে এখানে দাঁড়ালে এ দুনিয়ার সবটুকু বিপদ আমার পাশ কেটে বেরিয়ে যাবে। আমি আজও জানি না, সেদিন কেন ওই অপছন্দের তিক্ত পুরুষটা সেখানে বাস্তবে পৌঁছানোর আগেও কল্পনায় আমি তাকে বহুবার সেখানে আমায় আগলে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। যে-জন্য পুরো সময় একদম শান্ত, নিশ্চিন্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি নিশ্চিত, ইরাজ আসবে, থাপ্পড় মারবে আমায়, বাজে ভাষায় বকবে, কটুক্তি করবে, আর তারপর? আমি নিরাপদ, এই এত বড়ো দুনিয়াতে সকল অনিষ্ট থেকে আমি নিরাপদ। সব বিপদ মিটে যাবে সে এসে দাঁড়ালেই। আজব, তাই-না! এই-তো ক’দিন আগে এ হিসেবগুলো আমি মেলাতে গিয়েও আমার মাথা গুলিয়েছে।ʼʼ

মেঘালয়ার কান্নারত মুখের দিকে চেয়ে ইরাজ ঠোঁট এলিয়ে ক্লান্ত হাসল। মেঘালয়া বলল, “ওই বদমাশ লোকটা কোনদিন ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করেনি আমায়, আমার দিকে বিরক্তি ছাড়া অন্য নজরে তাকায়নি, মিষ্টি করে কথা বলেনি। সে যেমন নিজের ভালো থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আমায়, তেমনই দুনিয়ার খারাপগুলো থেকে। এ ব্যপারটা কিছুদিন আগেই মিলিয়েছি আমি।ʼʼ

মেঘালয়ার কণ্ঠস্বর ভেঙে আসে। ঠোঁটটা বোধহয় বেঁকে এলো এবার কান্নার তরে। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল অশ্রুবৃষ্টির জল গালের পাশ বয়ে। ঠোঁট ভেঙে হেসে ওঠে মেঘালয়া। যা দেখতে কান্নার মতো লাগে। আসলে মেঘালয়া বোধহয় কাঁদলই, সাথে হাসল। ইরাজ নিচের দিকে ঝুঁকে বসল এবার একটু। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। মেঘালয়ার কান্না এবার আর থামবে না। তাই কান্না জরানো ভাঙা কণ্ঠেই বলে,

“নিজের অজান্তেই ইরাজ নামক আমার স্বাধীনতার করাগার যে আমার অভ্যাস ও দৈনন্দিন চলনে পরিণত হয়েছিল–তা উপলদ্ধি করার সুযোগ হয়নি। আত্মনির্ভশীলতাহীন হয়ে পড়েছি আমি বহুবছর আগ থেকে। আমার অবলম্বন হয়ে উঠেছে ইরাজ। অথচ ইরাজের আচরণ বরাবর বিভ্রান্ত করতো আমায়। এত শাসন, বারণ লোকটার সাথে আমার দূরত্বই সৃষ্টি করেছে দিন-দিন। যেকোন মুসিবতে সমাধান হিসেবে তাকে আশা করলেও, তাকে পছন্দ করা হয়ে ওঠেনি। সেদিন সেই অন্ধকার রাতেও ইরাজকেই পাশে চেয়েছিলাম।ʼʼ

মেঘালয়া এবার কান্নামিশ্রিত স্বরে যেন অভিযোগ করে
ওঠে, “কী করব তাছাড়া? ছোটো বেলা থেকে তার হাতের পুতুলের মতো নাচিয়েছে, বলতে গেলে তার জন্যই সেদিন বলি হতে ওতদূর গেছি, সে আসবে না? আব্বুর বন্ধুর ছেলে, পার্টনারের ছেলে সে। সেরকম ভাবে থেকেছে নাকি? আমার জীবনটাকে হাতের মুঠোয় মুড়ে রেখেছিল। তাতে তার কঠোরতা আমার বদভ্যাস হয়ে উঠলে, সেটা আমার দোষ? তার শাসনের মায়ায় পড়ে গেলে, সেটা আমার দোষ? তার ওপর নির্ভরশীল হলে, সেটাও আমার দোষ? অথচ লোকটার ব্যবহার জঘন্য। চরম অসভ্য লোকটা, নমনীয়তার আকাল আছে তার মাঝে। আর সেজন্য তাকে আমার পছন্দ না। কোনকালেই পছন্দ না। করবও না পছন্দ, ওরকম রসকসহীন ক্যাকটাস মার্কা লোককে পছন্দ করার প্রশ্নই ওঠে না। তার চালচলন, কথাবার্তা, আচরণ সবকিছু কাঁটায় ভরা। সেজন্য তার মাঝে এতবছর আটকে থেকেও কোনদিন নিজের অনুভূতি বুঝতে সক্ষম হইনি আমি। লোকটা তারও শাস্তি দিয়েছে আমায়। আই ব্লাডি হেইট হিম।ʼʼ

ইরাজ হেসে ফেলল হঠাৎ-ই নিঃশব্দে। মাথাটা খানিক ঝুঁকিয়ে তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল কপালে রেখে নিঃশব্দে হাসে ইরাজ। মেঘালয়ার চোখের পানি শুকিয়ে গালে লেপ্টে আছে। শেষের কথাগুলোয় কপট আক্রোশ মিশে ছিল। মেঘালয়ার ঠোঁট ভেঙে আসে আবার, “আপনি কেমন? আপনার প্রতি কোন একরকম অনুভূতি কেন আসে না আমার? সবসময় মিশ্র কিছু অনুভব করি আপনাকে নিয়ে। একটু সহজ হলেও পারেন..ʼʼ

“এখন বিশ্রাম প্রয়োজন তোর, এসব ভারী ভাবনা পরেও ভাবতে পারবি।ʼʼ

ইরাজের কথাটা পছন্দ হলো না মেঘালয়ার। বলল, “আর আপনি?ʼʼ

“হু, আমি কী?ʼʼ

“আপনি কী করবেন?ʼʼ

“কী করতে বলছিস?ʼʼ

মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে দুর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করে, “যা করতে বলব, করবেন?ʼʼ

ইরাজ মুখে জবাব দিলো না, কেবল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেঘালয়া বলল, “থাকুন আমার কাছে।ʼʼ

“আমি আছি, তুই ঘুমা।ʼʼ

মেঘালয়ার কাছে কথাটা বিশেষ এক অনুভূতি হয়ে মস্তিষ্কে সারা জাগায়। “আমি আছি।ʼʼ ইরাজ আছে। মেঘালয়ার বুকটা শান্ত হয়ে ওঠে। ইরাজের হাতের আঙুলগুলোর মাঝে সন্তর্পণে নিজের আঙুল ঢুকায়। চোখটা বুজে দীর্ঘ করে এক শ্বাস টেনে নিলো। ইরাজ চেয়ে রইল মেঘালয়ার অচঞ্চল মুখটার দিকে।

“খান নি কেন?ʼʼ

মেঘালয়ার ক্ষীণ স্বরে বলা কথাটায় ইরাজ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল মেঘালয়ার দিকে। কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে করে বলল, “খেয়েছি।ʼʼ

“আপনাকে জানতে জানতে আটকে গেছি আপনার মাঝে। নিজের ব্যপারে আমার কাছে মিথ্যা বলা বোকামি হবে আপনার।ʼʼ

ইরাজ চোখটা সরু করে বলে, “এত জানিস আমায়?ʼʼ

এই ছেলেটা এক ঝটকায় নিজের বাহ্যিক রূপে এসে যায়। এই কিছুক্ষণ আগে বিষাদে পরেপূর্ণ ছিল চেহারাটা হুট করে আবার নিজের ত্যাড়ামিতে ফিরে এসেছে। বলল, “পুরোটা নয়, তবে প্রায় পুরোটা।ʼʼ

ইরাজ সামান্য ঠোঁট প্রসার করে হাসল। বড়ো ক্লান্ত লাগল দেখতে সেই হাসি। মেঘালয়া আচমকা প্রশ্ন করে, “আপনি কেমন?ʼʼ

ইরাজ ভাবলেশহীন ভাবে ঠোঁট উল্টায়, সাথে কাধ ঝাঁকাল যেন সেও নিশ্চিত নয় এ ব্যপারে, “ধরে নে, আমি কিছুটা চাঁদ। আমার গুপ্ত নরম অনুভূতি, আলো। তাতে আলোকিত হয়ে ধন্য হবে আমার ভালোবাসা পাওয়া মানুষগুলো। আবার আমার ত্যাগের তপ্ততা সূর্যরশ্মির মতো প্রখর অগ্নিশোধিত। আর সূর্য যখন চাঁদের বারবার থাকে; চাঁদের সেই অবস্থা হলো ঘোর অমানিশা। আমি নামক ‘অমানিশায় সেই তুই’! যাকে পেয়ে হারিয়ে, ত্যাগের প্রখরতায় ডুবেছি, ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে চাঁদটা অমানিশার আড়ালে।ʼʼ

ইরাজ থামল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরল। আবার বলল, “তবে অমানিশা তো সারামাস থাকে না, মেঘ! যেমনটা তোর বিরহ আমার জীবনে মাসের কয়েকটা দিন করেই রয়, আবার বাঁকা চাঁদ উঠে ক’দিন পরে তা পূর্ণিমায় রূপ নেয়। তবে আমার জোৎস্না বিলাসের সুযোগ নেই। আমি তো মেঘে মগ্ন, পূর্ণিমার ওপর মেঘের ঘনঘটায় আমার আকাশটা অমানিশার মতোই তিমিরে ছেঁয়ে থাকে চিরকাল।ʼʼ

-সমাপ্ত

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২৮

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৮.

মেঘালয়াকে ওটিতে শিফ্ট করা হয়েছে বেলা ন’টার দিকে। শারমিন আরা নিজে এসেছিলেন না-দাবী দলিলে সিগনেচার নিতে। ইরাজকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বারান্দায় বেঞ্চের ওপর বসানো হয়েছে। তখন থেকে জড় পদার্থের মতো পড়ে আছে। মেঘালয়াকে ওটিতে নেওয়ার সময় কেবল চেয়ে ছিল মেঘালয়ার বেডের নিচের র ক্তে লাল হয়ে ওঠা বেডশিটের দিকে। এ অবস্থায় ইরাজের কাছে এমন কিছু নিয়ে যাওয়া মোটেই সমাচীন মনে করলেন না শারমিন আরা। তাই গেলেন হেলাল সাহেবের কাছে। হেলাল সাহেব কাগজটির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে মাথাটা এলিয়ে দেয় পেছনের দেয়ালের সাথে। বাবার হাতে এরা মেয়ের জীবনের না-দাবী সই করাতে এসেছে! আচ্ছা ডাক্তাররা এমন পাষাণ নাকি প্রকৃতি বর্বর! যে মেয়েকে নিজের জান-মাল দিয়ে একটু একটু করে পালন করে তুলেছেন, সেই মেয়ের নাকি জানের দাবী ছাড়তে হবে বাবার! ওহ! প্রকৃতি সঙ্গে মিলেমিশে তকদীরের নির্দয়তা!একদৃষ্টে কয়েক মুহূর্ত দলিলের দিকে চেয়ে থেকে নিভু চোখে ইরাজের দিকে ইশারা করে পরিশ্রান্ত কণ্ঠে বললেন, “ওই পাগলের কাছে যান। ওই পাগল আমার মেঘার জীবনের দাবী ছাড়লে তবে তা জায়েজ হবে।ʼʼ

আসলেই তো! যে ছেলে কিছুদিন বাঁচার দাবী নিয়ে ওই মেয়েকে চেয়েছে, তার মানে ও মেয়ের দাবী, চাহিদা তো ইগজগতে সম্পূর্ন ওই পাগলার। হেলাল সাহেবের এতসবের মাঝে বুকে প্রশান্তি লাগে, তার অবর্তমানে তার মা-হারা পাগলি মেয়েটা খারাপ থাকবে না এই পাগলার কাছে।

শারমিন আরার বুক কাঁপছে দুরু-দুরু। এ অবশ্য আশ্চর্যজনক বটে! ডাক্তারদের আবার বুক কাঁপে নাকি! কাঁপে। এই-যে আজ কাঁপছে। ইরাজ চোখ তুলে তাকাল ওই কাগজটার দিকে। সবটুকু ঘৃনা তার গিয়ে ওই কাগজের ওপর পতিত হলো। এই কাগজ হলো সেই বাঁধা, মেঘকে হারালে কোন প্রতিশোধ নিতে না পারার বাঁধা! মেঘকে ত্যাগের দলিল। বুকে কলিজা-ছিদ্রক সূঁচাল ব্যথা! নড়বড়ে হাতে কাগজটা নেয়, তা নিজের জড়িয়ে বসা হাঁটুতে রেখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত খানিক। কাগজটার ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতো এক দানা পানি ঠাস করে পড়ে তা কাগজের শোষনে একটু ছড়িয়ে যায় কাগজটার ওপর। কাগজটার অভিশাপ ধুয়ে যাক– বুক চিরে বের হওয়া এই একফোঁটা তরলের সঃস্পর্শে। কাগজে উল্লেখিত কেঁড়ে নেওয়ার বয়ানে জড়িয়ে থাকা পাপগুলো কলঙ্ক ঝরিয়ে নিক না-হয়! কলমটা নিয়ে সই করে দেয়। সইটা খুব দ্রুত এবরো-থেবরোভাবে করে ইরাজ। সই করতে যত দেরী হবে, মেঘালয়ার সার্জারীর সময় পেছাবে।

শারমিন আরা নার্সের হাত থেকে ওটির ড্রেসটা নিয়ে তা পড়তে পড়তে ঢুকে গেলেন ওটিরুমে। ইরাজ নির্বিকার চেয়ে রইল কেবল সেদিকে। ওটির দরজাটা বন্ধ হয়ে দরজার ওপরে লাল লাইটটি জ্বলে ওঠে। ইরাজ চোখটা নামিয়ে নেয়। ওই মেয়েটাকে নাকি ইরাজ ত্যাগ করেছিল। হেসে উঠল ইরাজ ভাবতেই। যে মেয়েটাকে ছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাসে চাপ সৃষ্টি হয়, সেই মেয়েটাকে নাকি ত্যাগ করেছিল ইরাজ! আচ্ছা! ইরাজ তো এমন ছিল না। এতকিছুর পরেও ইরাজের ভেঙে পড়া কেউ দেখেনি। কেউ দেখেনি, ইরাজকে কাঁদতে, ইরাজের ছটফটানি। অথচ আজ ইরাজ কিছুই মানছে না। সবকিছুকে এড়িয়ে সে এমনভাবে কেন ওই মেয়েটার জন্য তড়পাচ্ছে! এ মায়া জন্মেছিল ইরাজের ভেতরে সেই কত বছর আগে। অথচ কোনদিন তা বাইরে আসেনি, অথচ এ-ক’দিনে এমন হলো কী! ইরাজ এত জাহির হয়ে উঠল কবে? পুনরায় কবে এভাবে থেমে গেছে মেঘালয়ার মাঝে? ইরাজ চিরদিন মেঘালয়ার কাছে নিজেকে লুকিয়েছে, সবশেষে মেঘালয়ার ভুলের পর তো ইরাজ শপথ করেছিল, ত্যাগ করেছিল ওই মেয়েকে। এ ভালোবাসার অনুভূতি বড্ড বেলেহাজ! কিছুই মানে না যে! কিছুই মনে রাখে না! এই-তো ক’দিন আগে ইরাজ মেঘালয়ার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে, তাকিয়ে দেখেনি, ঠিকমতো কথা বলেনি, মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। অথচ তারপরের ক’দিনে আস্তে আস্তে হলোটা কী! আবার জড়িয়ে পড়েছে ইরাজ!

তবে এবার কেন জানি ইরাজের মনে হয়, এ জড়িয়ে পড়াটা সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের! যে জড়িয়ে পড়ায় ইরাজের নিজস্ব সত্তা গুম হয়ে গেছে। নিজের চারিত্রিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, এ জড়িয়ে পড়ায় লুকোনো যায়নি আর অনুভূতি। বরং বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেছে ইরাজ না চাইতেও। আগে মেঘালয়া ইরাজের আকাঙ্ক্ষা ছিল, মায়া ছিল। আজ যে মেঘালয়া ইরাজের অর্ধাঙ্গিনী! এই হালাল সম্পর্কের সুতোর টানে ইরাজের চাপা স্বভাবের আল-বিদা হয়ে গেছে।

ইরাজ আবার হাসে মৃদূ! দৃষ্টি তার আটকানো ওটি রুমের দরজায়। মুখ নাড়িয়ে বিরবির করে ওঠে, “মেঘ! যাসনা কেমন! আমি আর কিছুদিন ভিজতে চাই তোর ঝরানো বৃষ্টিতে। শোন, শোন আমার কথা, তোকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটব, কিছুদিন আগে শখ জেগেছিল। তখন বলিনি, তবে কাল রাতে বললাম, তুই যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলি না। সুস্থ হ, নিয়ে বের হবো। তুই চাইলে ফুসকাও কিনে দেব। তবে সেটা আমার আড়ালে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে মুখ করে খাবি। রাস্তার ছেলেদের কার কেমন নজর কে জানে! মেয়েদের একটু ঢেকে-ঢুকে চলা ভালো। যশোরে মেলা বসছে সপ্তাহখানেক পর, ওখানেও নিয়ে যাব তুই চাইলে। তুই যাসনা, মেঘ! একা একা তো আজীবন ঘুরলাম। বহুত হয়েছে। আজকাল ভাল্লাগেনা একা। তুই চলে গেলে, একা আর আমার যাওয়া হবে না। ভাবলাম, তুই ভার্সিটিতে ভর্তি হবি, তারপর আমার কাছে রাতে পড়তে বসবি। ধমকে ধমকে পড়াব। সে তুই যা-ই বল, আমার ওসব মিনমিনে প্রমবাণী আসে না। আমি ধমকেই পড়াব। আসলে, অভ্যাস তো! তোর সাথে ধমকে কথা বলার অভ্যাসটাই যখন বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সেটাকে ভালোবাসা বলেছি আমি। চিরদিন ওভাবে ধমকাতে তোকে আমার খাচায় আটকাতে চেয়েছি। চাইলেও অন্যরকম করে বলতে পারিনা। বলতে গেলে মনে হয়, তোর সাথে কথা বলছিনা। ভাবলাম, প্রতিদিন তোকে বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে আসব, ভার্সিটিতে। আগে তো প্যানপ্যান বহুত করেছিস, তোর বাপ ধরত আমায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। তোর বাপ কিন্তু সেই শুরুর থেকেই আমার প্রেমেই পড়েছে, তুই না পড়লেও। হেলাল আকবরের জামাই আমি সেই বহুকাল আগ থেকে। তখন বের হতে চাইলে ধমকে ঘরে পাঠিয়েছি। এখন না-হয় ভার্সিটি যাওয়ার বদৌলতে বাইকের পেছনে ঘুরতে পারতি! সব-ই তোর চাহিদা। দেখ কী করবি! তুই থেকে গেলে এসবের সাথে আরও বহুত কিছু পাবি। আর চলে গেলে আর কী! ইরাজ একা আর কী-ই বা করবে! যাসনা মেঘ! কেমন! চল কিছুদিন একসাথে রাস্তায় হাঁটি।ʼʼ

মেঘালয়া কী শুনল কথাগুলো! পাগল ইরাজের পাগলাটে প্রলাপ শুনল না বোধহয় মেয়েটা! না পাওয়া যন্ত্রণা তো সময়ে আবর্তনের সাথে সাথে উপশম হয়ে যায়। তখন হারিয়ে যাওয়া বস্তুটাকে নিজের অনুভূতির বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয় মানুষ একটা সময়! সময় ধৈর্য্য দেয়, যা আমার ছিলই না, তা নিয়ে আর কতদিন আহাজারী, আকাঙ্ক্ষা সব পুরো হওয়ার নয়। অথচ আকাঙ্ক্ষা থেকে যে জিনিস নিজের প্রাপ্তিতে এসে কিছুদিন বিচরণ করে, পেয়ে যাওয়ার খুশিতে ডুবিয়ে তারপর শূন্যে মিলিয়ে যায়, সেখানে মন-মস্তিষ্কের চাপটা যে অসহ্য লাগে বড়োই! যে চাপটা ইরাজকে ক্ষণে-ক্ষণে বিষাক্ত তীরের আঘাতের ন্যায় খোঁচাচ্ছে। রক্তাক্ত করে তুলছে ভেতরটাকে।


প্রায় দেড় ঘন্টা পর শারমিন আরা সহ তার সহকারী ডাক্তারটি বেরিয়ে এলো ওটি রুম থেকে। ইরাজ কেবল নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকাল একবার শারমিন আরার দিকে। কোনরকম নড়চড় দেখা গেল না তার মাঝে। দৌঁড়ে গেলেন হেলাল সাহেব, পেছনে ইমতিয়াজ সাহেব ও আনতারা খানম। অথচ শারমিন আরার দৃষ্টি আটকে আছে, নিষ্প্রভ, নিস্তেজ ইরাজের দিকে। তিনি ওটির পোশাকটি খুলে কনুইতে রেখে হেলাল সাহেবের দিকে তাকালেন। তার মুখটা করুণ, বড়ো অসহায় লাগল, আজ এক মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে শারমিন আরার। তিনি মুখে কিছু না বলে বরং সকলকে উপেক্ষা করে এসে বসলেন ইরাজের পাশটায়। গ্লাভসটা এখনও হাতেই রয়েছে তার। তখনই একটি নার্স বেরিয়ে এলো ছোটো-খাটো এক ট্রলি ঠেলে। ইরাজ তাকায় না সেদিকে। শারমিন আরা ইরাজের পাশে মাথাটা ইরাজের মতোই ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন। আস্তে করে নিরুত্তেজ গলায় বললেন, “রাজ! মেঘার মিসক্যারেজ হয়েছে।ʼʼ

ইরাজ মোটেই অবাক হলো না। কোন কথাও বলল না। যেন তার খুব ভালো করে জানা কোন বিষয় তাকে আবার জানানো হলো। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় ইরাজ, মনে হলো, হঠাৎ-ই রোধ হয়ে যাওয়া শ্বাসটুকু ইরাজ ভারী বুক থেকে আস্তে করে মুক্ত করে দিল।

ট্রলিতে অপরিপক্ক ছোট্ট এক নিথর-দেহ পড়ে আছে। শরীরে এখনও সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো সেজে ওঠেনি। তবে মানুষের আকৃতি এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে, সদ্য জন্মানো শিশু, মাখনের ন্যায় ক্রিম সদৃশ এক আস্তরণে ঢেকে আছে শরীরের ত্বক। চোখের পাতা ও ভ্রু গজিয়েছে হালকা করে।

আনতারা খানম হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। হেলাল সাহেব পুরুষ মানুষ তো! তার চোখে পানি থাকতে আছে, তবে চিৎকার করে বুকের আর্তনাদগুলোকে বোধহয় প্রকাশটুকু করতে নেই তার। ইমতিয়াজ সাহেব সরে আসলেন সেখান থেকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখটা মুছে নিলেন। আনতারা খানম বেসামাল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। মেঘালয়ার যে কাঁদার মতো নিজের মা নেই, তাই বোধহয় সেই আহাজারীটুকু মিলিয়ে আনতারা আজ ওই মা হারা অনাথ মেয়েটার জন্য নিজে কেঁদে ভাসাচ্ছেন। ইমতিয়াজ সাহেব গিয়ে ধরলেন আনতরাকে। তাকে সরানো যায় না।
ধরতে যায় বাচ্চাকে, তখনই ইমতিয়াজ সাহেব জোর করে ধরে দূরে নিয়ে এলেন আনতারাকে। তিনি বুঝলেন, আনতারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ মুহুর্তে। একটা নয়, সে যে এভাবে চারটা সন্তানের নিথর দেহ দেখেছে। আজ তার জন্য ছেলের সন্তানের সেই একই অবস্থা দেখা মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করল খুব খারাপ ভাবে। মেঘালয়ার কথা ভেবে আনতারা আরও পাগল হয়ে ওঠেন। দৌঁড়ে যেতে চান ওটি রুমের দিকে। তিনিও এভাবেই পড়ে থেকেছেন হাসপাতালের বেডে, তার সন্তানকে চিরদিনের মতো নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার বুক থেকে। আজ মেঘালয়াও কী দেখবে না সন্তানের মুখ?
ইমতিয়াজ সাহেব আনতারাকে দেখে নিজেও বড্ড ভেঙে পড়লেন। আনতারাকে নিয়ে ইরাজের পাশে বসে পড়লেন। শারমিন আরা উঠে যায় ফ্রেস হতে।

হেলাল সাহেব বসে পড়ে ওভাবেই মেঝেতে। লোকসমাগম বেড়েছে চারদিকে। সকলে তাকিয়ে দেখছে একটা মেয়ের দরদী কয়েকজন মানব-মানবীর বিদ্ধস্ত দৃশ্য। হেলাল সাহেবের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল, প্রায় ষোল বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনের কথা। এভাবেই তার ছোট্ট ছেলেকে এনে তার সম্মুখে রাখা হয়েছিল, কিছুক্ষণ বাদে তার স্ত্রীকেও। সেদিন মেঘালয়া কাঁদেনি। কেবল আনতারার হাতটা ধরে পিছেপিছে ঘুরেছিল চারদিকে। বুকটা পুড়ছে হেলাল সাহেবের। সর্বহারার মতো পড়ে রইলেন তিনি ধুলোমাখা মেঝেতে।

কারও অবস্থাই স্বাভাবিক নয়। শারমিন আরা যেন আজ আর ডিউটিতে নয়, ব্যক্তিগত কোন শোকে জড়িয়ে রয়েছেন। কোনমতো ফ্রেস হয়ে এসে ইরাজকে ধরে উঠালেন। আস্তে আস্তে করে নিয়ে গেলেন ট্রলির কাছে। ইরাজের শরীরটা বেজায় ভারী লাগল শারমিন আরার। ইরাজ শারিরীকভাবে নিজের ভার ছেড়ে দিয়ে প্রাণহীনের মতো হাঁটছে।

নাকের পাটা ফুলিয়ে, চোয়াল মাড়িতে চেপে শক্ত করে চোখের পাতা বুজে নেয় ইরাজ। টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল দাঁড়ি-গোফের গাল বেয়ে। ছেলে সন্তান হয়েছে মেঘালয়ার। মেঘালয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। ইরাজ হাসার চেষ্টা করে। এই-তো মেঘালয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে, ইরাজ হেরে গেছে—মেয়ে হয়নি। ইরাজ বরাবর ওই পুচকি মেয়ের কাছে হারবেই! জিতবে ওই মেয়ে। পাগলাটে হাসিতে ইরাজকে উন্মাদের মতো লাগে। শারমিন আরা ইরাজের বাহু চেপে ধরে তাকিয়ে রয় ইরাজের বুক চিরে বেরিয়ে আসা পাগলা হাসির দিকে।

বাবার সামনে সন্তানের প্রাণহীন, শ্বাসহীন, নিশ্চল দেহ! হায়! ইরাজের ভেতরে জান নেই; হঠাৎ-ই এমন মনে হলো শারমিন আরার। ইরাজের শরীর আরও ভারী হয়ে ওঠে। এই ছেলে কী পাথরের তৈরী! ভেতরে যে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে, সবটা মাড়ি আটকে ভেতরে চেপে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। ইরাজের ভেতরের এই অগ্নিকাণ্ড হয়ত শারমিন আরাও টের পেতেন না, যদি-না ইরাজকে ধরে দাঁড়াতেন। এ ছেলের উদ্দীপনা গুলো বড়োই চাপা, একটু বেশিই চাপা। ছোটো-ছোটো বিষয়ে কেমন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অথচ যখন কলিজা ছিন্নভিন্ন করা ব্যথা তাকে ক্ষয় করছে, তখন কেমন অলৌলিক ক্ষমতার জোরে যেন লুকিয়ে রেখেছে নিজের যন্ত্রণাগুলো।
ইরাজ যে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে, অথচ তার মুখে হাসি, সে একদম বরফ-শীতল শান্ত। এখন অবধি একটা কথাও বলেনি ইরাজ। শারমিন আরা দ্রুত ইরাজকে সরিয়ে এনে বসালেন বেঞ্চিতে। ইরাজের মেনটাল-কন্ডিশন যে হেভি-প্রেশার ইফেক্টেড হয়ে পড়ছে তা বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শারমিন আরা।

ইরাজ বেঞ্চিতে বসে আবার মাথাটা এলিয়ে দেয় দেয়ালের সঙ্গে।

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২৬+২৭

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৬.

বিয়েতে যেহেতু কিছু করা হয়নি, অতএব হেলাল সাহেব চেয়েছিলেন, মেঘালয়ার গর্ভবস্থায় আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়াবেন সঙ্গে দোয়াও নেওয়া হবে মেঘালয়ার জন্য। ইরাজ অমত করেছে এতে। সে আপাতত কোনরকম ঝামেলা চায়না। সবকিছু সুষ্ঠভাবে মিটে গেলে বহুত অনুষ্ঠান করা যাবে; এটাই তার মতামত এবং সিদ্ধান্ত।

হেলাল সাহেব রোজই এসে মেয়েকে দেখে যান। তার পায়ে সুতো নেই। আজও এসেছিলেন, ঘন্টাখানেকের মতো মেঘালয়ার সঙ্গে কাটিয়ে চলে গেলেন নিজের কাজের ব্যস্ততায়। তার পর-পরই হঠাৎ-ই মেঘালয়া উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কোনকিছুতেই শান্তি লাগছে না। আশেপাশের সবকিছু অসহ্য লাগছে। পাঁচ-মাস চলছে তার গর্ভাবস্থার। খুব বেশি না হলেও পেট বুঝা যায় এখন তার। পায়ের ফোলা কমছে না। ওভাবেই মনমরা হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। খানিকবাদে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকল ইরাজ।

মেঘালয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দ্রুত কপাল, গলায় হাত রাখল। এলোমেলো চোখে দেখে নিল মেঘালয়াকে। ব্যস্ত হাতে বিছানার ওপর থেকে ওড়নাটা তুলে মেঘালয়ার গায়ে জড়িয়ে দেয় ভালোভাবে। মাথায় ওড়না তুলে দিয়ে, ওড়না ভেদ করে আসা এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে ওড়নার ভেতরে রেখে আবারও ওড়নাটা ভালোভাবে টেনে দিল। শান্ত নজরে তাকাল একবার মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার মুখটা ভার। এটা অবশ্য আজকাল সবসময়ের পরিচিত দৃশ্য। ইরাজকে কেন জানি সহ্য করতে পারে না মেঘালয়া। কেন তা অবশ্য জানে না ঠিকঠাক, ইরাজ! সর্বক্ষণ ওমন মুখটা ভার করেই থাকে মেঘালয়া। বিশেষ করে ইরাজ কাছে আসলে। মেঘালয়ার ভারী মুখটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচে তাকাল ইরাজ। বলল, “ডাক্তার এসেছে, প্রেশার চেইক করবে।ʼʼ

বেরিয়ে গেল কথাটা বলেই। মেঘালয়া এবার তাকায় ইরাজের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার মাথা নত করে বসল। ইরাজ যা-ই করে, সবটাই তার সন্তানের জন্য নিশ্চয়ই! এটা বোঝে মেঘালয়া। ইরাজের এত চিন্তা, ছটফটানি সবটাই নিজের সন্তানকে কেন্দ্র করে!

ডাক্তার বলতে, বড়ো কোন বিশেষ ডিগ্রিধারী ডাক্তার নয়। প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান সম্পন্ন ডাক্তারকে এনেছে ইরাজ, প্রেশার চেইক করার জন্য। মেঘালয়া ভ্রু কুঞ্চন করল, তার তো প্রেশার নেই! ডাক্তার তার হাতের কব্জির কাছে মৃদূ চেপে ধরে প্রথমে পালস-রেট অনুমান করল। পরে প্রেশার মেপে স্ফিগমেনোমিটার নামিয়ে, স্টেথোস্কোপ লাগাল মেঘালয়ার বুকের ওপরে। সেটাও নামিয়ে নীরবে বের হয়ে গেল রুম থেকে। পেছনে যায় ইরাজ। মেঘালয়া চেয়ে রইল সেদিকে।

কিছুক্ষণ বাদে ইরাজ রুমে আসে। বিক্ষিপ্ত লাগছে দেখতে। মেঘালয়া সে-সবে তোয়াক্কা না করে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “কী হয়েছে? ব্লা ড-প্রশার হাই? কী লুকোচ্ছেন?ʼʼ

“কি লুকোবো? চল ডাক্তারের কাছে যাব।ʼʼ

“আমার কী হয়েছে, সেটা আমি শুনব না?ʼʼ

ইরাজ অজ্ঞাত কারনেই জ্বলে উঠল যেন ধপ করে। হাতে থাকা ফোনটা সজোরে ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। মাথার দু-পাশের চুল টেনে ধরল। জোরে জোরে শ্বাস নিল কিছুক্ষণ। মেঘালয়া বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে রয় নাম না জানা কারনে হুটহাট উত্তেজিত হয়ে পড়া ইরাজের দিকে। কী থেকে কী হয়— আজকাল দুজনেই বড্ড উত্তেজিত থাকে সবসময়। তবে ইরাজ যে ছটফটানির মাঝে আছে, এটা চোখে গাঁথার মতো। কিছুটা সময় নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসল ইরাজ। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে গা আওলে বসে পরিশ্রান্ত শ্বাস ফেলল কয়েকটা। আগুন নিভে যাওয়ার পর যেমন বাতাসের দমকায় মৃদূ প্রজ্জ্বলিত-নিভু আকারে তাপ ছড়ায়, ইরাজের গলাটা তেমন নিভু আগুনের মতো শান্ত-অটল শুনাল, “চল বের হই।ʼʼ


মৃদূমন্দ এসির হাওয়ার মাঝেও ইরাজকে দেখতে অশান্ত, পরিশ্রান্ত লাগছে। মুখটা শুকনো, চোখে-মুখে কাতরতা। মাথাটা হালকা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। তাকে কিছুক্ষণ পরখ করে দেখলেন ড. শারমিন আরা। দুষ্টু, ছন্নছাড়া, বেপরোয়া এই ছেলেটা কেমন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন স্বামী ও অনাগত সন্তানের উদ্বিগ্ন বাবা হয়ে উঠেছে! পুরুষ বোধহয় এমনই! যারা একসময় সবকিছুর বাঁধন ছেড়ে, প্রাবহমান স্রোতের মতন তাণ্ডব ছড়িয়ে বেড়ায়, তো সেই পুরুষই সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠে এক নারীর অবলম্বন, সবটুকু ভরসার জায়গা, কচি হাতগুলোর বেড়ে ওঠার কারিগর। থেমে যায় পুরুষ, রাস্তা বদলে ভিন্ন ধরণে পথ চলতে শুরু করে আপনচিত্তেই।

কিছুক্ষণ ওভাবেই বিবর্ণ ইরাজকে অবলোকন করে, শান্ত স্বরে বললেন, “তুমি এভাবে ডিস্ট্র্যাক্ট হয়ে পড়লে চলবে কী! যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, সেটার কারন হবে— তোমার এই মনোবলের অভাব, রাজ!ʼʼ

ইরাজ অসভ্যের মতো বলে ওঠে, “আপনি এতদিনে কী এমন করেছেন, ম্যাম! যাতে আমি মনোবল পাব বা শান্ত, নিশ্চিন্ত থাকব? দিন-দিন কনডিশন খারাপ হচ্ছে। তার ওপর নাকি কোন ওষুধ দেওয়া যাবে না। কী করছেন, কী করতে চাইছেন আপনি? যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? কী এমন হয়েছে, পরিকল্পনা কী আপনার?ʼʼ

কথাগুলো বলেই উত্তেজিত শ্বাস ফেলল ইরাজ। ঘাঁড় ঝাঁকাল কয়েকবার। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। শারমিন আরা বললেন, “মূর্খের মতো কথা বলছো তুমি। উত্তেজনা কখনও কোন সমস্যার সমাধান নয়, শিক্ষিত ছেলে তুমি। অথচ এ অবস্থায় নিজের বিচক্ষনতা হারিয়ে বসেছ। এখন সবচেয়ে জরুরী তোমার নিজেকে সামাল দেওয়া। কী করতে বলছ তুমি আমায়, বলো?ʼʼ

ইরাজ করুণ চোখে তাকায়। হঠাৎ-ই ঠান্ডা জলের মতো অভিব্যাক্তিতে প্রায় অনুরোধ করে বলে ওঠে, “ম্যাম! কোনভাবে ওষুধ খাইয়ে বা অন্য কোন উপায় নেই ব্লা ড- প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখার? ম্যাম, আমার বাচ্চা..

“রিল্যাক্স রাজ! শোনো আমার কথা। তুমি যতটা সহজভাবে ভাবছ, তা কেবলই উত্তেজনার বশে। সেভাবে আমি ভাবতে পারি না। আমাকে ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত নিতেও বহুদিক বিবেচনা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় সব-ধরণের প্রেশার কন্ট্রোল মেডিসিন সেবন করার নয়। এতে বরং হিতে বিপরীত হবে। যে আশঙ্কা আমি করছি, তা আরও নিশ্চিত হবে। আমি আমার মতো যথাসাধ্য চেষ্টা করব। মেঘালয়ার এই কন্ডিশনটাকে বলা হয়— জেসটেশনাল হাইপারটেনশন। এই ঘটনা ঘটে— পরিবারে কারও এমনটা থাকলে বা পঁচিশ বছরের কম বয়সে গর্ভধারণে এমন হয়ে থাকে। আর তাছাড়া প্রথম গর্ভধারণে ব্লা ড-প্রেশারে গড়মিল প্রায় নারীরই দেখা যায়। তবে ঝুঁকি কমানো যায়, রাজ! বি পজেটিভ।ʼʼ

ইরাজ ব্যাকুল হয়ে উঠল, “সকলেই তো সন্তান জন্ম দিচ্ছে। তাহলে মেঘেরই কেন এমন হচ্ছে, ম্যাম!ʼʼ

শারমিন আরা মৃদূ হাসলেন। পূর্নদৃষ্টি মেলে তাকালেন আকুল হয়ে চেয়ে থাকা ইরাজের দিকে। ইরাজকে সে আগেও বহুবার দেখেছে। পূর্ব-পরিচিত ইরাজ ছিল বেপরোয়া,দাম্ভিক, আর বাঁকানো হাড়ে তৈরী। অথচ এই ইরাজকে তার সাথে কিছুদিন মেলাতে পারেন না তিনি। অশান্ত ইরাজকে আশ্বস্ত করতে শান্ত স্বরে বললেন, “রাজ! তোমার ক্ষিপ্রতা জায়েজ! বাবা তো তুমি! কিন্ত কী বলো তো! সবকিছুর ওপরে লাঠি ঘুরছে সৃষ্টিকর্তার— এটা অস্বীকার করতে পারবে? আমি ডাক্তার; মানছি, তবে তিনি যদি আমার চিকিৎসায় শেফা না দেন তবে আমি কী করে তকদিরে পরিবর্তন আনতে পারি? তুমি তো অবুঝ নও, রাজ! আল্লাহর ফয়সালা এবং আমার চেষ্টা; হতে পারে ভালো কিছুই হলো। ভরসা রাখো।ʼʼ


সম্প্রতি শরীরের অবনতি চোখে পড়ার মতো মেঘালয়ার। পা আরও ফুলে উঠেছে, সঙ্গে মাথা ব্যথার তীব্রতা সময়ের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যেন! রাত এগারোটার মতো। ইরাজ মেঘালয়াকে খাইয়ে নিজে খেতে বসেছে।মেঘালয়ার পা মেলে দিয়ে বসা বিছানার ওপরে। ইরাজ খেতে খেতে হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করল, “মেঘ! ঘুরতে যাবি?ʼʼ

এমন একটা সময় মেঘালয়া এ কথা শুনে অবাক হলো। এটা অবশ্য ইরাজের পুরোনো অভ্যাস— রাত করে রাস্তায় বিনা গন্তব্যে হাঁটতে বেরোনো। আগেও হল থেকে বাড়ি ফিরলে রাতে এভাবে হাঁটতে হাঁটতে কখনও কখনও মেঘালয়াদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। হাতে থাকত মেঘালয়ার পছন্দের কোন খাবার অথবা মেয়েদের কিছু ব্যবহার্য সামগ্রী। হেলাল সাহবে খুব খুশি হতেন অবশ্য ইরাজের এমন অদ্ভুত সময়ে অদ্ভুত আগমনে। সকলেরই জানা, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ইরাজ কমই করে। তাই তার এমন রাতবিরাত মেহমান হয়ে আগমন স্বাভাবিক এবং সারপ্রাইজিং বটে। আহ্লাদি মেঘালয়া ইরাজের সঙ্গে ঘুরতে যেতে বায়না করত। তবে আব্বুর কাছে, ইরাজের কাছে বলার সাহস ছিল না মোটেই। হেলাল সাহেব বললেও ইরাজ নিয়ে যেত না। কখনও কখনও মেঘালয়াকে ধমকে জিজ্ঞেস করত, “কেন এ-সময় ঘুরতে যেতে হবে? কিছু লাগলে বল, এনে দিয়ে যাচ্ছি।ʼʼ

আবার কখনও কখনও ধমকাতে ধমকাতে নিয়ে গিয়ে ফুসকা, চটপটি কিছু কিনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিত। নিজের সঙ্গে মেঘালয়াকে কখনোই ইরাজ একাকী রাখতে চায়নি। এমনটা কেন, তা জানে না কেউ-ই। জানে ওই ত্যাড়া ইরাজ। সে যেখানে মেঘালয়াকে সকল বিপদ ও অনিষ্টর হাত থেকে জোরপূর্বক হলেও বাঁচিয়ে রেখেছে, সেখানে ইরাজও তো মেঘালয়ার প্রেমে পড়েছিল, হতে পারত— ইরাজই মেঘালয়ার জন্য অপ্রস্তুত-বোধের কারন হয়ে উঠল কখনও। এছাড়াও, নিজের অনুভূতিকে কাবুকে রাখতেও, ইরাজের মেঘালয়ার সঙ্গে ঘেষতে আপত্তি ছিল।তার ধরণা ছিল, এভাবে অবাধে চলাফেরা করলে, সে আরও বেসামাল হয়ে যাবে। পরিশেষে, ইরাজের তো হাড় বাঁকা! সে যে সুষ্ঠ, স্বাভাবিক আচরণ ও চিন্তা করবে না; এটাই বরং স্বাভাবিক তার জন্য। মেঘালয়াকে দু মিনিটের মাঝে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, নিজে রাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে শেষরাতে বাড়ি পৌঁছেছে।

আজ সেই ইরাজ মেঘালয়াকে সঙ্গে নিতে চাইছে। ঘুরতে যেতে চাইছে। ব্যাপারটা আজব এক অনুভূতি জাগায় মেঘালয়ার মাঝে। ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকায় সে ইরাজের দিকে। বুকটা ধুক করে ওঠে। দেখতে কেমন প্রাণহীন লাগছে সবসময় সাহেব বেশে চলাচল করা ইরাজকে। চোখ বসে গেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বহুরাতের ঘুম-শূন্যতার সুবাদে এই হাল। জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ এ কথা কেন?ʼʼ

“তোকে নিয়ে একটু ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হলো, আর কী!ʼʼ

ইরাজের মুখে আজ এমন একটা কথা এমন অদ্ভুত আবদারের সুরে মেঘালয়ার বুকের কোথাও একটা খালি খালি লাগল আচমকা। হাঁসফাঁস লাগল খুব। দ্রুত বলে উঠল, “কেন, খুব শীঘ্রই হারিয়ে যাবেন আপনি?ʼʼ

প্লেটের ওপর ইরাজের হাতটা থেমে যায় আচমকা। চোখ তুলে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। চট করে ঠোঁট প্রসার করে মলিন হেসে উঠল ইরাজ। ওভাবেই বলল, “যে হারায় সে বলে হারায় না, মেঘ! হারিয়ে যাওয়ার পূর্বে খবর পাওয়া যায় না। খবর যা পাওয়া যায়, তা ঘটে না। খবর যতদিন পাওয়া যায় যতদিন, ততদিন কেউ হারায় না।ʼʼ

মেঘালয়া কেবল চেয়ে রইল ইরাজের সজল চোখদুটোর দিকে। সে মুহূর্তে ইরাজ ঝুঁকে বসে খানিকটা। মেঘালয়ার কেন জানি, আরও কিছুক্ষণ দেখতে ইচ্ছে হলো ইরাজের ভগ্ন-সিক্ত চোখদুটো। সে-ও একটু ঘাঁড় বাঁকিয়ে মাথা নিচু করল ইরাজের চোখদুটো দেখার লোভে। ইরাজ খাবার শেষ না করেই অনীহার সাথে হাতটা ধুয়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে আস্তে করে ড্রয়ার খুলল। ভরা সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার হাতে তুলে নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। মেঘালয়া তা দেখে মুখ-চোখ জড়িয়ে বলে উঠল, “আপনি আবার সিগারেট খেতে যাচ্ছেন? খাবেন না সিগারেট, শুনুন আমার কথা? আমি কিন্ত..

ইরাজের কানে আদৌ কথাগুলো গিয়েছে বলে মনে হলো না। সে আপন মনে মৃদূ হেলেদুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। মেঘালয়া মুখটা গম্ভীর করে বসে রয় ওভাবেই। ইরাজ খুব বেশি মানসিক কষ্টে না থাকলে রাতে ধূমপান করে না; তা অজানা নয় মেঘালয়ার। তাহলে কী হয়েছে ইরাজের? মনটা আবার বিষিয়ে উঠল মেঘালয়ার। ইরাজকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়, অথচ সর্বক্ষণ চোখে-মুখে স্পষ্ট ব্যথা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

শেষরাতের দিকে মেঘালয়ার ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে জ্বলে থাকা মৃদূ আলোতে এমনিতেই ঝাপসা লাগছে চোখ নাকি সে দেখছে ঝাপসা; তা ঠাহর করতে পারল না। জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করল। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে যেন, আর বেশিক্ষণ এ শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা চলতে পারবেনা, থেমে যাবে বলে মনে হলো মেঘালয়ার। ধীরে-ধীরে চোখের সামনে অন্ধকার নামতে শুরু করল যেন। শ্বাসের গতি আরও বাড়ল মেঘালয়ার। তবুও যেন রোধ হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। আরও খানিকটা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে মেঘালয়া। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল ইরাজ। শ্বাসরোধ মেঘালয়ার হয়ে আসলেও, প্রাণটা যেন ইরাজের বেড়িয়ে যেতে নিয়েছিল– এভাবে ব্যাকুল হয়ে পড়ল মুহূর্তের মাঝে। মেঘালয়াকে ধরে দ্রুত বসায়। শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলল কেবল, মুখে কিছু বলতে পারল না কিছুক্ষণ। ভাষা মেলাতে পারে না ইরাজ। চোখ-মুখ বিষ্ফোরিত তার। পর্বতের ন্যায় অটল ইরাজ যেন আজ এলোমেলো ঝরনার ন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে, পাহাড়ের ঢালুতে। একহাতে মেঘালয়াকে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আপাতত টেবিল-ল্যাম্প জ্বালাল। তাতে মেঘালয়া যেন অসহ্য হয়ে উঠল আরও। হাত চোখের সম্মুখে রেখে আলোকে রুখতে চেষ্টা করল। মেঘালয়ার দিকে তাকাতেই ইরাজের হৃদস্পন্দন থেমে রইল কয়েকটা। অতঃপর দ্রিম-দ্রিম করে বাজতে থাকল আবার।

মেঘালয়ার নাক থেকে র ক্ত বয়ে ঠোঁট পার করে থুতনিতে এসে ঠেকেছে। মেঘালয়া কয়েকবার বমি করার লক্ষ্যে ‘ওয়াক’ এর মতো করে ওঠে। অতঃপর করেও ফেলল শেষে। এক-সময় পেট চেপে ধরে কেঁদে ওঠে। অসহ্য ব্যথায় কাতর হয়ে ছটফটানির মাত্রা বাড়ল ক্রমশ মেঘালয়ার। নাক দিয়ে র ক্ত পড়ছে, সঙ্গে চোখটা আরও ঝাপসা হয়ে এলো ধীরে-ধীরে।

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৭. (প্রথমাংশ)

রাতের শেষ প্রহর পেরিয়ে ভোর হতে চলল। খুব বেশি সময় বাকি নেই ফজরের আজান পড়তে। কোথাও কোথাও দূর মসজিদ থেকে ভেসেও আসছে আজানের ধ্বনি। রাত আধার কেটে আলোর ছটা তো প্রকাশ পাবে শীঘ্রই; সেই সাথে যেন ইরাজের ছটফটানি সম-হারে বাড়ছে। পাবলিক হাসপাতাল হওয়ায় লোক সমাগম তুলনামূলক কম। ইরাজ বারান্দায় একাধারে ছটফটে পায়ে পায়চারী করছে। পাশেই এক বেঞ্চে ভেঙে পড়া হেলাল সাহেবকে ধরে বিষণ্ন মুখে বসে রয়েছেন ইমতিয়াজ সাহেব। ইরাজ একা অস্থির নয়। আজ বড়ো আশ্চর্যজনক দৃশ্য হিসেবে চোখে পড়ার মতো ব্যপার হলো— আনতারা খানম যেন সমানতালে অস্থির ইরাজের সঙ্গে সঙ্গে। তার চোখ-মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। বারবার এগিয়ে যাচ্ছেন অবজারভেশন রুমের দ্বারের দিকে। আবার হতাশ হয়ে ফিরে আসছেন।

মেঘালয়া নাক-মুখে র ক্ত উঠে এসেছিল সঙ্গে অস্বাভাবিক পেটের ব্যথা। রাত সাড়ে তিনটার সময় নিয়ে আসা হয়েছে হাসপাতালে। তখনই মেঘালয়াকে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে অবজারভেশন রুমে। তখন থেকে ইরাজের এই অশান্ত, এলোমেলো চলন চালু আছে। চোখ-মুখ র ক্ত শূন্য, উদ্দীপনাহীন লাগছে। চেহারাটা ভাঙা, বসে যাওয়া। শারমিন আরা আজ রাতে ডিউটিতে ছিলেন না। তাকে ইরাজ ফোন করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তিনি এখনও এসে পৌঁছান নি। ইরাজের মাথা আরও গরম হয়ে উঠল।

ফজরের আজান শোনা যায়। ইরাজ একবার ভাবনা-পীড়িত দৃষ্টিতে তাকাল সেই কেবিনের দিকে– যেখানে মেঘালয়াকে অবজার্ভ করা হচ্ছে। অতঃপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল মসজিদের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই নজরে এলো শারমিন আরা নামলেন নিজস্ব গাড়ি থেকে। ইরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে দাঁড়াল এক পুরুষ। ইরাজ এগিয়ে গিয়ে দাঁত খিঁচে বলল, “ম্যাম! আপনার বিবেক ঘুনপোকায় খেয়েছে? মেঘের কিছু হলে আপনাকে আমি..

শারমিন আরা ইরাজের বাহুতে হাত রেখে সজল চোখে তাকায় ইরাজের বিক্ষুব্ধ চোখের দিকে। ইরাজ নিভে গেল একটু, থামল। শারমিন আরা ডিভোর্সী-নারী। এই শেষ রাতে একজন নারীর পক্ষে পথ পেরিয়ে হাসপাতালে আসা সহজ তো মোটেই নয়। যে ছেলেটি তাকে নামিয়ে দিতে এসেছে, শারমিন আরার ছোটো ভাই শান্ত। সেও পরিচিত ইরাজের। শারমিন আরা বললেন, “কুল, রাজ!ʼʼ

ইরাজ চলে যায় নামাজের উদ্দেশ্যে। শারমিন আরা দ্রুত প্রবেশ করলেন ভেতরে।


সকাল সাড়ে ছয়টা বাজতে চলল। ইরাজ মন্থর পায়ে প্রাণহীনের ন্যায় দরজা খুলে প্রবেশ করল কেবিনে। চোখের কাতরতা আর বুকের ধুকপুকানিতে ইরাজ বিদ্ধস্ত যানবাহনের মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে যেন! গিয়ে বসতেই শারমিন আরা বলতে শুরু করলেন,
“রাজ! আমি তো তোমাকে প্রেগন্যান্সির সেই শুরুতেই বলেছিলাম, মেঘালয়ার প্রি-একলাম্পসিয়া দেখা দিতে পারে। কারন প্রথম থেকে ওর ব্লাড-প্রাশার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আর যা ধারণা করেছিলাম, তা ঘটে গেছে। এখন..

কথা শেষ করতে দেয়না ইরাজ। বলে ওঠে, “এখন কী অবস্থা, ম্যাম!ʼʼ

শারমিন আরা ইতস্তত করলেন। এই ছেলের যা মেজাজ। না জানি কথাটা শুনে কিভাবে নেবে। তবুও বলতে শুরু করলেন, “মেঘালয়ার ব্লাড-প্রেশার অনিয়ন্ত্রণে। মাঝেমধ্যেই খিঁচুনি হচ্ছে। নাক-মুখে রক্ত আসছে। আর বাচ্চার গঠন সুষ্ঠুভাবে হয়নি।ʼʼ

কোনদিন কোন রোগীর কন্ডিশন জানাতে ডাক্তার হিসেবে এমন দ্বিধা কাজ করেনি তার, অথচ ইরাজের সামনে ব্যাপারটা খুলতে মুখে বাঁধছে যেন। থেমে থেমে বললেন কথাগুলো শারমিন আরা। ইরাজ শান্ত নজরে তাকিয়ে বলল, “ভনিতা না করে খুলে বলুন, এখন কী করা যায়। কী হয়েছে?ʼʼ

চরম অসভ্যের মতো শোনাল ইরাজের কথা। শারমিন আরা একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “তোমার বাচ্চা বাঁচার সম্ভাবনা টেন-পার্সেন্ট। আর যেহেতু প্রি একলাম্পসিয়া শুরু হয়েছে, প্রসবের সময় খিঁচুনি উঠবে প্রায় নিশ্চিত। আর তখন বাচ্চা ও মা দুজনের লাইফ-রিস্ক রয়েছে। যদি কোনভাবে কেউ একজন বেঁচেও যায়, সে মেঘালয়া হলে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়বে। আর বাচ্চা প্রতিবন্ধী হতে পারে। কারণ, বাচ্চার বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়নি। মেঘালয়া গর্ভধারণের শুরু থেকে শারীরিকভাবে ফিট ছিল না। আর… মেঘালয়ার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। আ’ম সিওর তোমারটা পজেটিভ। বাচ্চার বর্ধণ ও শারীরিট পরিপক্কতায় বাঁধা হয়েছে ব্যাপারটি, সঙ্গে মেঘালয়ার শারীরিক কন্ডিশনকে আরও বিগড়েছে।ʼʼ

ইরাজের বুকটা কেঁপে উঠল বোধহয়! মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল, তবুও অটল চাহনিতে জিজ্ঞেস করল, “কেন এসব হচ্ছে?ʼʼ

“হতে পারে পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে এমন। বংশগতি বোঝো তো! হার্ট ফেইলিওর বা উচ্চ রক্তচাপ রোগ গুলো বংশগতির ধারায় প্রবাহিত হওয়ার মতো ম র ন ঘা তি রোগ।ʼʼ

এই কথাটুকুর পরিপেক্ষিতে ইরাজের মাথায় হুট করে এলো, মেঘালয়ার আম্মুও মেঘালয়ার ছোটো ভাইয়ের প্রসবের সময় খিঁচুনিতে মা-ছেলে দুজনেই মারা গিয়েছিল। এ-কথা এতদিন মাথায়ই আসে নি ইরাজের। শারমিন আরা বলতে লাগলেন,

“প্রথম গর্ভধারণে প্রেশারটা অনিয়ন্ত্রিত হতে বেশির ভাগ নারীরই দেখা যায়। মেঘালয়া পঁচিশ বছরের কম সময়ে গর্ভাধারণ করেছে, এখানেও এ অবস্থা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যায়। আর তাছাড়া তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো, পরিবারে আর কারও হাইপারটেনশন আছে কিনা!ʼʼ

মেঘালয়ার গোটা পরিবারটাই হাইপারটেনশনের রোগী। হেলাল সাহেবের হাই-প্রেশার আছে, মেঘালয়ার মা তো জীবনটাই দিয়ে গেলেন। এ-কথা মাথায় আসতেই ইরাজ উদ্ভ্রান্তের মতো বলে ওঠে, “আমার বাচ্চা লাগবে না। আপনি মেঘালয়াকে ঠিক করুন। বাচ্চা দরকার নেই তো, ম্যাম! আমার জন্যই হয়েছে সব। আমিই করেছি এসব। মেঘের গর্ভধারণে আমি শালা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম। বুঝেই উঠতে পারিনি আমার এক খুশির জন্য আমার জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বনকে কোরবানী করতে হবে। শালা, বোকা ইরাজ! জীবনে তোর হারানোর শেষ নেই। আর তার কারণগুলো তুই নিজেই।ʼʼ

পাগলের মতো ছটফট করতে করতে এসব প্রলাপ বকতে শুরু করল ইরাজ। উঠে দাঁড়াল, কেবিন থেকে বেরিয়ে একদৌঁড়ে গেল মেঘালয়ার কেবিনের দিকে। ওয়ার্ডবয় ওর উত্তেজনা দেখে বাঁধা দিতে আসলে এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। মেঘালয়া প্রায় অচেতন পড়ে আছে বেডে। ইরাজ গিয়ে দাঁড়াল মেঘালয়ার বেডের পাশে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল মেঘালয়ার অচঞ্চল, অর্ধবোজা চোখের দিকে। মেঘালয়ার হাতটা মৃদূ নড়ে ওঠে। ইরাজ তা চেপে ধরে বসে পড়ল চেয়ারে। মেঘালয়ার মুখে কাতর হাসি। মলিন চোখদুটো চেয়ে আছে ইরাজের দিকে, মুখে হাসি লেপ্টে আছে তার। ইরাজের বুকের ভেতর সূঁচাল ব্যথা অনূভূত হয়। হৃদযন্ত্রটা লাফিয়ে উঠল ধকধক করে। চোখ লাল হয়ে উঠল। নির্নিমেষ চেয়ে রইল মেঘালয়ার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে। কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা বুঝে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষারত রয় ইরাজ।

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৭ (বর্ধিতাংশ).

“আমার বাচ্চা ঠিক আছে?ʼʼ

মেঘালয়ার ক্ষীণ স্বরে বলা কথাটা ইরাজকে কঠিন এক ধাক্কা মারে। তা হয়ত বোঝা গেল না তার উদ্দীপনাহীন চেহারায় তাকিয়ে। কোন জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ইরাজ মেঘালয়ার শুকনো মুখটার দিকে। ওই মুখটাকে সজীব দেখতে ইরাজ এরকম হাজার বাচ্চার মায়া ত্যাগ করবে নির্দ্বিধায়; তা হয়ত জানবে কেউ কোনদিন! হঠাৎ-ই এমন কিছু বলে ওঠে ইরাজের ভেতরে আন্দোলিত মস্তিষ্কটা। একটা ঢোক গিলল ইরাজ। ইরাজের এই পরিশ্রান্ত, কাতর চাহনি! মেঘালয়ার ভেতরে ঝড় তুলছে। অথচ মেয়েটার শরীর সায় দিচ্ছে না। মেঘালয়ার চোখের কোণায় জলের ফোঁটা চিকচিক করে ওঠে। আস্তে করে বলল, “ডাক্তার যাই বলুক,আমার বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে নিন। পাঁচটা মাস ধরে ধারণ করেছি ওকে, হারাতে পারব না..ʼʼ

ইরাজ দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠল বোধহয়, “আর আমি যে তোকে ছয়- সাতটা বছর ধরে ধারণ করে আসছি! খু ন করে ফেলব একদম! আবেগ দেখাচ্ছিস? শালা, স্বার্থপর রে! সব স্বার্থপর! এই এই, এই মেঘ, এই! তোদের আমাকে পাথর মনে হয়? আমি শিলাখন্ড? আমার মায়া নেই, হারানোর ভয় নেই, আমার ব্যথা লাগে না, তাই না?ʼʼ

টপ করে আরেক ফোঁটা জল ছিটকে পড়ে ইরাজ নামক কঠিন ছেলের চোখের কোণ পেরিয়ে। মেঘালয়া বিভ্রান্ত হয়ে চেয়ে রয় সেদিকে! তার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থামল, আবার শুরু হলো ধুকপুক করে। ইরাজকে পাগলের মতো লাগছে। যেন তার শরীরে জলন্ত কয়লার সেঁক দেওয়ার হচ্ছে, ওভাবে ছটফট করতে থাকল ইরাজ। আকষ্মিক ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসল ইরাজের বিক্ষুব্ধতা। শীতল চোখে চেয়ে শান্ত আওয়াজে প্রশ্ন করে, “আমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে হয় না তোর, তাই না? এজন্য চলে যেতেও ভয় নেই।ʼʼ

আবার ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠল। মেঘালয়ার হাতটা ঝারা মেরে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিদ্ধস্ত পাগলাটে ভাবে বলতে থাকে,

“আরে তোরা তো পারিস, বাল। ইরাজ পারে না। ইরাজ বারবার আটকে পড়ে একই জালে। শালা ইরাজ ভয় পায়, ইরাজরা সবকিছুর ওপরে তোদের মতো মেঘেদের নিজের সাথে চেপে ধরে ক’দিন বাঁচতে চায়! ইরাজ হারাতে চায় না, কিন্তু তোদের হারিয়ে যেতে কত আয়োজন!ʼʼ

চিৎকার শুনে শারমিন আরা এসে দাঁড়ালেন কেবিনে। ইরাজের বাহুতে হাত রাখতেই ছিটকে সরিয়ে দেয় ইরাজ হাতটা। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মেঘালয়ার দিকে চেয়ে।
মেঘালয়া ফুঁপিয়ে উঠল, হাতটা প্রসারিত করল ইরাজের দিকে। শব্দ করে শ্বাস নিল। ইরাজের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে মুহূর্তের মাঝে। দৌঁড়ে গিয়ে মেঘালয়ার হাতটা চেপে ধরে। আচমকা মেঘালয়া ক্যানোলা লাগানো হাতটা ব্যথা লাগা সত্ত্বেও তুলে ইরাজের শার্টের কলার চেপে ধরে মৃদূ টান দেয়। ইরাজ আরও খানিক ঝুঁকে যায় মেঘালয়ার দিকে। ইরাজের চোখের স্থির চাহনি। অথচ মেঘালয়ার চোখ কাঁপছে। চোখে টলমলে পানি, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকায় তা ছিটকে পড়ছে মুখের চারদিকে। ইরাজের চোখের দিকে চোখ রেখে ভাঙা স্বরে বলে, “এসব কেন বলছেন? আমি দেখেছিলাম ইরাজের চোখে বাবা হবার আনন্দটুকু।ʼʼ

পরস্পরের মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া দুটো রুহুর বিচ্ছেদের পূর্বক্ষণ বোধহয় এমনই বিপর্যস্ত হয়! এমনই গুমোট যন্ত্রণারা বোধহয় ধোঁয়ার কুণ্ডলি হয়ে বাতাসে বিষাদ ছড়ায়! কেবিনে যে শারমিন আরা দাঁড়ানো তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই এক সম্ভাব্য বিদায়ী পথযাত্রী ও আরেক বিদ্ধস্ত, সর্বস্বান্ত পুরুষ! ইরাজ মলিন হাসল, “মেঘ! তুই বোকা, অন্ধ নাকি স্বার্থপর? সবসময়ই স্বার্থপর! ইরাজের বাপ হওয়ার আনন্দটুকু না দেখে বরং ইরাজকে দেখলে আজ তোর বুক কাঁপতো হয়ত চলে যাওয়ার কথা ভাবলে। বাপ হওয়ার আনন্দের কথা ভাবছিস? আমি ভাবছি, কেউ আমায় রেখে চলে যাবে, অথচ তার সাথে থাকার ছিল আমার, সে অনুযায়ী আমার তো পরপারের নেশা ধরে যাবে রে, মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া ডুকরে কেঁদে ওঠে, বুক চেপে ধরে হাঁপানীর মতো করে শ্বাস নেয়। থেমে থেমে বলে, “আমার কিছু হবে না। আপনি..

ইরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল আবার, ইরাজের ধমক গর্জনের মতো শোনায়, “আমি কী? কী করব আমি? তোর বাচ্চা সাথে নিয়ে সরাজীবন তোর মুখটা মনে করতে করতে জীবন পার করব? পাগলে ** আমায়? ইরাজের এত খারাপ দিন আসেনি, বাল। ইরাজ সবসময় সুখী ছিল, থাকবে। তোর ওসব ঝোলা টেনে নিয়ে বেড়ানোর মধ্যে নেই ইরাজ..

আনতারা খানম এলেন সেখানে। দৃশ্যটা তার বুকের ভেতরে নাড়িয়ে তোলে। তার ছেলের কী হবে— এই মেয়েটার সঙ্গে খারাপ কিছু হলে! ইরাজকে টেনে একটু পিছিয়ে নিয়ে গেলেন। ইরাজের বুকের উঠা-নামা আর সর্বস্বান্ত চোখের চাহনি! আনতারা করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের দিকে। গিয়ে মেঘালয়ার পাশে বসে অর্ধসিক্ত চোখে চেয়ে মেঘালয়ার মাথা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ইরাজ সরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। শারমিন আরা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। কপট রাগ দেখিয়ে ধমকে বললেন, “রাজ! এ কেমন অসভ্যের মতো আচরণ? ব্যাড-টেমপার হলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? আমরা দেখব কী করা যায়! তুমি শান্ত হও।ʼʼ

ইরাজ মুখটা বিকৃত করে উগ্র হয়ে তাকাল শারমিন আরার দিকে, “কী দেখবেন? হেলাল আকবরের মেয়ের আমাকে ছেড়ে পালানোর অনুষ্ঠান দেখবেন? রিপোর্ট দেখিনি আমি? আমি নাহয় বোকা শালা, মূর্খ তো না! প্রেশার ১৮০/১৩০। দুইশো ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? হেলাল আকবরের মেয়ের র ক্তে মাখা থেমে যাওয়া দেহ থেকে বাচ্চা বের করে ইরাজের হাত দেবেন? পরিকল্পনা কী আপনার?ʼʼ

ইরাজকে উন্মাদের মতো লাগে। এক একটা প্রশ্নে কেবিন কেঁপে উঠছে। হেলাল সাহেব এগিয়ে আসে, পেছনে ইমতিয়াজ সাহেব। ছেলেকে বাঁধা দিলেন না। ক্লান্ত চোখে চেয়ে দেখলেন ছেলেকে। ইরাজ আবার পাগলের মতো করতে শুরু করে, ম্যাম! কখন সার্জারী শুরু হবে? জলদি করুন তো!ʼʼ

পাগলের মতো মাথা দুলিয়ে, হাত নাড়ায়, “যান যান, ব্যবস্থা করুন। এখানে দাড়িয়ে থাকবেন না। যান তো, বাল!সময় যাচ্ছে শুধুশুধু।ʼʼ

ডাক্তার কেবিনে প্রবেশ করে। ইরাজকে বলল,এভাবে এবোর্শোন করানো অনৈতিক। আপনি ধৈর্য্য ধরুন। সবে পাঁচ-মাস শেষের দিকে।

ইরাজ বকে ওঠে, “এ শালা ডাক্তাররা তো আইনের লোকের থেকে বড়ো বা** হয়ে গেছে। রিপোর্ট লিখাতে গেলে আগে আঘাত দেখাতে হয়। আঘাত পাওয়ার আগে ব্যবস্থা নেই! তো মরলে তারপর প্রমাণ হাতে নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন? শালা তোর ডাক্তারীর ..

এগিয়ে যায় ইরাজ ডাক্তারের দিকে তেড়ে। ইরাজের বিশ্বাস, এভাবে এই আবেগী কথোপকথনের মাঝে খারাপ কিছু ঘটবে মেঘালয়ার সঙ্গে। ও মোটেই আলাপ বাড়াতে চায় না। হেলাল সাহেব এসে ইরাজকে সামলাতে চেষ্টা করে। ইরাজ অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে ওঠে ডাক্তারটিকে। পুরো কেবিনে এলোমেলো এক অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়।

অথচ শারমিন আরা স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। এরকম কত কেইস প্রতিনিয়ত হেন্ড্যল করতে হয়। অথচ এতটা অস্থির লাগে নি কখনও ভেতরে। আসলে ইরাজের মতো জটিলতম অনুভূতিতে মাখা, পাগল পুরুষের দেখা পায়নি যে! যার কথার মর্ম উদ্ধার করতে গেলে সে কথার মাঝে ডুবে যেতে হয়। হুট করে শারমিন আরা নিজ মনেই নিজের ভাগ্যের ওপর হেসে উঠলেন। এক মেয়ে মৃ ত্যুপথযাত্রী। তার অর্ধাঙ্গ যেন খোদার কাছ থেকেও মেয়েটাকে ছিনিয়ে আনতে যুদ্ধ করতে চায়! সে নিজেও তো নারী, তবে সে জীবিত থাকতে কেন তাকে স্বামী নামক পুরুষটা কাছে রাখেনি এভাবে ধরে! পুরুষ বৈচিত্র জাত। একই জাতের মাঝে কতরকম বিভেদ! তবে ইরাজ যেন একটু বেশিই ব্যতিক্রম সত্তার। যার সবকিছুতে ভাবার বা বোঝার মতো কিছু লুকায়িত।

মেঘালয়া হঠাৎ-ই কেঁদে ওঠে। অতঃপর আস্তে করে চোখটা উল্টে ঝাপসা চোখে চোখটা বুজে নেয়। আনতারা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, “আল্লাহ!ʼʼ

ইরাজের বিশ্বাস বাস্তবে রূপ নিল বোধহয়! ইরাজ ধপ করে নিভে যায়। শান্ত হয়ে উঠল একদম! শরীরের ভর ছেড়ে দাঁড়াল। হেললা সাহেব ইরাজকে ছেড়ে চমকিত হয়ে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার ব্লিডিং শুরু হয়েছে। শারমিন আরা সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড়ে গেলেন সেদিকে। মেঘালয়ার কব্জিতে হাত রাখলেন। কয়েক মিলি সেকেন্ড পালস রেট না পেয়ে ডাক্তারী ভুলে একজন সাধারণ মানুষের মতো তার কলিজাটাও ছলাৎ করে ওঠে। কেন! হয়ত ওই-যে এগিয়ে না এসে বরং প্রাণহীনের ন্যায় পিছিয়ে গিয়ে উদ্ভ্রান্ত নজরে তাকিয়ে থাকা তেজী পুরুষটার কথা ভেবে? আবার পেলেন পালস রেট। তবে খুবই ধীর গতিতে চলছে তা। রক্তক্ষরণ চলছে, মেঘালয়া অচেতন। তিনি তাকালেন ডাক্তারটির দিকে। চোখের ইশারায় কথা বিনিময় হয় এক মুহূর্ত। জরুরী ভিত্তিতে সার্জারীতে নিতে ডাক্তারটা বেরিয়ে যায় হন্তদন্ত পায়ে ব্যবস্থাপনার কাজে।

ইরাজ এগিয়ে এলো না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আড়চোখে চেয়ে রইল মেঘালয়া জ্ঞানহীন মুখটার দিকে। রোবটের মতো সেই দৃষ্টি। যাতে উদ্বেগ, উদ্দীপনা, মানসিক কোন অনুভূতি দেখা গেল না। কেবল ভরাট, সজল চোখে চেয়ে রয় ইরাজ। তার পাপ-পূণ্যের ঘড়া পূর্ন হয়েছে। সে তার সমস্ত সম্পদ হারিয়ে সর্বস্বান্ত আজ। তার কাছে হারানোর মতো কিছু নেই যেখানে, তার মানে সে-ই তো সিকান্দার। সে বাদশাহ। আজ সব হিসেব মিলে গেছে যেন তার জীবনের। আর চাওয়া-পাওয়ার নেই কিছু। সব পেয়েছে সে। সব আজ তার হয়েছে। নির্বিকার, অনুভূতিহীন চাহনিকে চোখের পাতার ঝাপটায় ঢেকে ফেলে আস্তে করে চোখটা বুজে নিল ইরাজ।

ওভাবেই শান্ত হয়ে বসে পড়লেন আরেকটা মানুষ। মেয়ের জন্মদাতা। যাদের জন্য ত্যাগ নিতকর্ম মাত্র। এই-যে মেয়ের বাবা তিনি, তাই তো আজ হারানোর যন্ত্রণায় তার কাতর হওয়া চলবে না। তার অভিযোগ করার নেই। তার বিলাপ করার নেই। সে কেবল সইবে, দেখবে, আর বুকটা চেপে ধরে মাটিতে পড়ে রইবে। মেয়েদের জীবন যদি ত্যাগের আরেক রূপ হয়, তবে সেই মেয়ের জনক হয়ে তার কতখানি ত্যাগী হতে হবে তা বেশ বুঝেছেন হেলাল সাহেব। তাই তিনি আজ চেঁচাবেন না, আহাজারী করবেন না শুধু দেখবেন। তবে সবশেষে তার নিজেকে বড়ো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহীতা হিসেবে নিজের প্রতি গর্ব করতে খুব ইচ্ছে হলো, তিনি তার পাগলিকে ভুল পুরুষের হাতে দেননি। এ-ই তো মেয়ের বাবা জীবনের সার্থকতা!

আনতারা খানম বসে রইলেন ওভাবেই। মেঘালয়ার প্রতি নিজের ক্ষোভগুলো ভাঙতে শুরু করেছিল, ধীরে-ধীরে ইরাজের জীবনের খুশি ফিরতে দেখে। তিনি তো কখনও মেঘাকে খারাপ চোখে দেখতে চাননি! অথচ ছেলের বুকের হাহাকারের সামনে সব তুচ্ছ। যে মেয়েটা ছেলেকে এতো কষ্ট দিয়েছে, তাকে মেনে নিতে মা হিসেবে বুকে বেঁধেছে বারবার। আবার যখন সেই মেয়েই ছেলের জীবনের সুখগুলো একটু একটু করে ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছে, তখন মায়ের অভিমান টিকে নাকি? ইরাজের ভালো থাকার কারণ যেখানে মেঘালয়া— সেখানে মেঘালয়াকে ভালো রাখা তো আনতারার মাতৃত্যের কর্তব্য। যেদিন শুনলেন, মেঘালয়া গর্ভবতী, এ এক অনবদ্য খুশি ছিল তার জন্য।

অথচ এই-যে মেঘালয়ার গর্ভকালীন অসুস্থতা তাকে প্রতিক্ষণে পুড়াচ্ছে! এভাবেই তিনি চারটা সন্তানকে হারিয়েছেন। কেউ গর্ভপাতে, তো কেউ জন্মের পর। তবেই তো ইরাজ একা আজ! মায়ের কাছে সন্তানের নিথর শরীর! কাল রাত থেকে সেই সকল পুরোনো যন্ত্রণাগুলো তার ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। তিনি এত বছর পর মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে প্রতিবার সেই যন্ত্রণা তাজা অনুভব করছেন। তার পাগল ছেলে, তার ছেলের র ক্তে গড়া তারই একাংশ মেঘালয়া বয়ে চলেছে ভেতরে। আর সয়ে বেড়াচ্ছে, অতুলনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। বহুবছর আগের মাতৃত্য হারানোর চটা পড়া যন্ত্রণাগুলো আজ আবার তাজা হয়ে উঠেছে মেঘালয়াকে দেখে। ঝরঝর করে বেয়ে পড়ল গুমোট যন্ত্রণা গুলো জলের ধারায়।

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২৩+২৪+২৫

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৩.

বিকেলে বৃষ্টি হওয়ার ফলে পরিবেশটা স্যাতস্যাতে হয়ে আছে। তবুও এক সজীবতা জুরে আছে চাঁদহীন আকাশ ও গাছের সবুজ পাতায়। মেঘালয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে ভেজা প্রকৃতি। কিছুক্ষণ আগে গোসল করায় চুলগুলো ভেজা। ছড়িয়ে দেয়া পিঠে। মৃদূমন্দ বাতাসে উড়ছে তা। আজকাল তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অল্পতেই হাপিয়ে ওঠে। মাথাটা ঝিমঝিম করে, কখনও কখনও চারদিক অন্ধকার হয়ে ঘুরে ওঠে মাথা।

এডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছে ইরাজ তাকে। প্রথম কিছুদিন নিয়মিত ক্লাস করলেও ক’দিন শরীরের এমন দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে আর নিয়মিত কোচিংয়েও যাওয়া হয় না। তবে পড়ালেখা যথাসম্ভব, খুব বেশিই করছে মেঘালয়া। সঙ্গে ইরাজ আছে দিন রাত পড়তে বসার তাগাদা দেয়ার জন্য। মেঘালয়ার কাছে জীবনটা আবারও রঙিন লাগতে শুরু করেছে। ইরাজের ঘাঁড় ত্যাড়ামির কাছে দিন দিন তার দুর্বলতা কেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে! ইরাজকে হারানোর কথা ভাবলেও বুক মুচড়ে ওঠে। ইরাজকে নতুনভাবে চিনছে, জানছে। ইরাজের ছায়াতলে মেঘালয়া আজকাল আবারও বড়ো আহ্লাদি হয়ে উঠেছে যেন!

ভেবেই মুচকি হাসল। ইরাজের ত্যাড়া কথা, বেপরোয়া চলন, রাগী মেজাজ আবার অদ্ভুত এক শীতলতা, কখনও কখনও যত্নশীল মন-মাতানো এক প্রেমিক হয়ে উঠতে ইরাজের জুরি নেই। সেখানে আর কোন পুরুষকে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। খুব অনুতাপ হয় মাঝেমধ্যে মেঘালয়ার— এই পাগল ছেলেটাকে ঠুকরে সে নিজের সিদ্ধান্তে চলতে গিয়েছিল! হাহ! নিজের ওপর তাচ্ছিল্য করে ওঠে। কিছুদিনের মাঝে তাদের সম্পর্ক, ইরাজের চালচলন, মেঘালয়ার মনের অবস্থা; সবকিছুতেই অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে।

বারান্দা থেকে রুমে চলে এলো। দাঁড়িয়ে থাকতে শরীর সায় দিচ্ছে না। গতকাল হেলাল সাহেব এসেছিলেন মেয়েকে দেখতে। সঙ্গে এনেছিলেন মেঘালয়ার পছন্দসই বহু খাবার। দুপুরে খাওয়া হয়নি তার। খাওয়ার কথা ভাবলেও বমি ঠেলে আসছে। এখন ভাবল, কিছু খাবে। অথচ রুচিতে আসল না। এতক্ষণের ফুরফুরে মনটা হুট করে বিষন্ন হয়ে পড়ল। আর কিছুই ভালো লাগছে না তার আশেপাশের। দেহে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে।

সাড়ে নয়টার দিকে ইরাজ এলো। তার এই আজব পরিবর্তন। আজকাল বাড়ি ফিরতে দশটাও বাজে না তার। রুমে ঢুকেই প্রথম মেঘালয়ার দিকে নজর গেল। বিষন্ন চিত্তে মনমরা হয়ে বসে আছে সোফার কাছে মেঝেতে। চঞ্চল পায়ে হেঁটে গিয়ে বসল মেঘালয়ার সম্মুখে। একহাত মেঘালয়ার কপালে ঠেকিয়ে অপর হাতে হালকা বন্ধনে জড়িয়ে নিল মেঘালয়াকে। অশান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“এভাবে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে, কেমন লাগছে? এবার ইচ্ছে কী করছে জানিস? ঠাস করে একটা চড় মেরে দাঁতগুলো নড়িয়ে দেই। কতদিন ধরে বলছি, চল ডাক্তারের কাছে। মাতব্বর হয়ে গেছিস?ʼʼ

মেঘালয়া চোখ তুলে তাকাল এতক্ষণে ইরাজের দিকে। একটু নড়েচড়ে বসে ইরাজের শার্টের বোতামগুলো আলগা করতে লাগল। ইরাজ ভ্রু কুঁচকে তা দেখছে কেবল। মেঘালয়া শান্তস্বরে বলল আস্তে করে, “এখন আপাতত ফ্রেস হয়ে আসুন। আর সবকিছুতে উত্তেজিত হতে নেই।ʼʼ

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “জ্ঞান দিচ্ছিস, পুচকি মেয়ে!ʼʼ

মেঘালয়া শার্টটা খুলে তা হাতের কনুইতে রেখে, চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, “সে আপনি যতই হাত-পা ওয়ালা লম্বা, বয়সে বড়ো হন না কেন, মেনে তো চলতে হবে আপনাকে এই পুচকির কথাই!ʼʼ

ইরাজ কপালটা জড়িয়ে ঘাঁড় বাঁকাল, সন্তর্পণে সামান্য হাসল। উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল, “আম্মা কোথায় রে? আর তোর হয়েছে কী সে ব্যাপারে তুই খেয়াল করবি নাকি আমাকে করতে হবে? আমি করলে কিন্ত ওভার হয়ে যাবে, তুই নিতে পারবি না।ʼʼ

বলে হাতটা বাড়িয়ে দিল মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়া ইরাজের হাতটা চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল টলমলে পায়ে। ক্ষীণ স্বরে বলল, “মামনি বোনের বাড়ি গিয়েছে। আমি খাবার দিচ্ছি চলুন।ʼʼ

ইরাজ ক্ষেপা নজরে তাকাল এবার। একহাতে জড়িয়ে নিল মেঘালয়াকে। মুখ ভেঙচিয়ে বলল, “আমি খাবার দিচ্ছি চলুন!ʼʼ

এরপর ধমকে বলল, “চল ডাক্তারের কাছে। শরীরে তো মশার অতখানি জোরও নেই। এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে তোর বাপ আবার আমার বদনাম করে বেড়াবে?ʼʼ

“এছাড়া, আপনার কিছু না?ʼʼ—বিছানায় বসে বলল কথাটা মেঘালয়া।

ইরাজ ওকে বসিয়ে দিয়ে টান হয়ে দাঁড়াল। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা খুলে মেঘালয়ার কোলে ছুড়ে মারল। একটু ঝুঁকে দাঁড়াল মেঘালয়ার দিকে। নিচু আওয়াজে বলল, “আমি বউহারা হয়ে যাব। এর চেয়ে চিন্তার আর কী আছে?ʼʼ

মেঘালয়া নাক ফুলিয়ে চেয়ে রইল দুষ্ট হাসি ছড়িয়ে থাকা ঠোঁটের দিকে। হঠাৎ ইরাজ সিরিয়াস হয়ে বলল, “মেঘ! আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। ‘না’ বললে, কানটা গরম হয়ে যাবে।ʼʼ

বলেই বাথরুমের দিকে চলে গেল ইরাজ। মেঘালয়া সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিক্ষিত মেয়ে সে। শরীরের অবস্থা সম্বন্ধে যথেষ্ট বুঝ ও ধারণা রয়েছে তার। এই বদমেজাজি, একরোখা লোককে কী করে বোঝাবে সেসব!

ইরাজ বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল, মেঘালয়া খাবার নিয়ে বসে আছে। মাথা গরম হয়ে উঠল। ভারী পায়ে হেঁটে গিয়ে বলল, “আমার কথায় মন লাগে না তোর? শরীরের দিকে মনোযোগ দিতে ব্যাথা পাস? বললাম না ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি আজ ফাইনাল! সিঁড়ি ভেঙে নেমে খাবার আনতে চলে গিয়েছিস! এত কর্তব্যপরা..

মেঘালয়া ইরাজের হাত টেনে ধরে বসাল সামনে। যথাসম্ভব তেজী গলায় বলল, “আর একটাও কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নিন। আমার শরীরের ব্যাপারে আমি বুঝি না? এসেছে আমার খেয়াল রাখতে।ʼʼ

মুখের সামনে খাবার ধরল ইরাজের। ইরাজ ভ্রুত কুঁচকে চেয়ে আছে; সবে মাত্র সে তার বউয়ে ধমক খেল। এবং সেই ধমকের আঁছড়ে এবার খাবারটুকুও খেল চুপচাপ। আজকাল মেঘালয়ার কাছে মাঝেমধ্যেই সে এমন ধমক, ধামকি-ধুমকি পায়। এবং চুপচাপ মেনেও নেয়। বউয়ের সামনে নাকি বাহাদুরী চলে না; ইরাজ এ কথা টের পাচ্ছে আজকাল খুব।

মেঘালয়া ইরাজকে খাইয়ে নিজেও সামান্য কিছু খেয়ে নিল। খাবারির প্লেটটা আর রেখে আসার ব্যাপারে শরীর সায় দিল না। বেড-সাইড টেবিলের ওপরে রেখে ওমনি বসে রইল কিছুক্ষণ। এর মাঝে ইরাজ আস্তে করে উঠে যাচ্ছে তার নিত্যকর্মে। মেঘালয়ার দিকে চোখ যেতেই দেখল, সে চোখ ছোটো ছোটো করে চেয়ে আছে। সাফাই গাওয়ার সুরে বলে উঠল,

“আরে, দেখ সারাদিন একটাও টান দেইনি। এখনও না দিলে রাগ করবে তো? একটাই তো, বেশি না। দেখ এ প্যাকেটে আছেও আর একটাই।ʼʼ

“বউয়ের চেয়ে সিগারেটের রাগের প্রাধান্য বেশি?ʼʼ

ইরাজ আস্তে করে বসল বিছানায়। কপট রাগে সিগারেটের প্যাকেটটা ছুড়ে দিল মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “একদম তাই। কারন যখন বউ ছিল না, সিগারেট ছিল সাথে। এখনও যদি বউ ভাগে, সিগারেট কিন্ত ছেড়ে যাবে না আমায়! বউয়ের আগে সিগারেট এসেছে আমার জীবনে। আমি নতুন কাউকে পেয়ে ওর সাথে বেইমানী করতে পারব না। আফটার অল, আ’ম লয়াল!ʼʼ

মেঘালয়া অতিষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। পেটের মধ্যে গুলিয়ে আসছে। আচমকা মাথাটা ঘুরে আসল, পেটের সবকিছু যেন বেরিয়ে আসবে এখনই। মেঘালয়া দ্রুত পায়ে নেমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। বমির করার উপক্রম হলে মুখ চেপে ধরল হাত দ্বারা। ইরাজ দৌড়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। ধরে দাঁড় করাল, মেঘালয়া তো শান্ত, অথচ ইরাজ অস্থির হয়ে উঠেছে মুহূর্তের মাঝে। বাথরুমে গিয়ে ওকে দাঁড় করিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ বমির ভাব হলেও বমি হলো না। ইরাজ ওকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়ে, প্রস্তত হতে অগ্রসর হয় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য। মেঘালয়া হাত চেপে ধরল। পাশে বসল ইরাজ, উত্তেজিত হয়ে কিছু বলার আগেই মেঘালয়া বলে,

“এখন ভালো লাগছে। যদি যেতেই হয় কাল সকালে যাব। এখন দরজা লাগিয়ে দিন, আর এসির টেমপারেচার কমান একটু, গরম লাগছে। তারপর ভদ্রলোকের মতো এসে শুয়ে পড়ুন।ʼʼ

ইরাজ কপাল কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “মেঘ! তোর ভাবসাব কিন্ত ভালো না।ʼʼ


সকালে টুকটাক বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। পরিবেশটাও ঠান্ডা। মেঘালয়ার ঘুম ভাঙল নয়টার দিকে। অথচ পাশে তাকিয়ে দেখল, ইরাজ নেই। শরীরটা ওর বহুরূপী হয়ে উঠেছে। এখন বলা চলে, তুলনামূলক ভালো লাগছে। আস্তে করে উঠে, বাথরুমে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে বের হয়ে মুখটা মুছলোও না। তোয়ালে ইরাজ কোথায় ছুরে ফেলে গেছে আল্লাহ পাক জানে। এরকম অগোছালো হয় পুরুষ মানুষ, তা অজানা ছিল মেঘালয়া। আব্বুকে সফসময় পরিপাটি দেখেছে সে। অথচ ইরাজ! নিজেকে পরিপাটি রাখলেও তার অভ্যাস বাজে রকমের এলোমেলো। বাইরে থেকে এসে শার্ট খুলে এক প্রান্তে ছুড়ে মারে তো প্যান্ট খুলে অপর প্রান্তে। সেভাবেই এখন তোয়ালে কোথায় রেখেছে, তা খোঁজার ইচ্ছেটুকু হলো না মেঘালয়ার।

নরম পায়ে হেঁটে নেমে এলো বসার রুমে। ইমতিয়াজ সাহেব সোফায় বসে সকাল সকাল টিভি ছেড়ে খবরের চ্যানেল চালু করে রেখছেন। অথচ নজর তার খবরের কাগজে। খবর যখন কাগজেই পড়বে, তাহলে টিভিতে খবরের চ্যানেল চালিয়ে রাখার মানেটা কী? তার চেয়ে বড়ো কথা টিভিটাই চালু করে রাখার মানে কী? মেঘালয়ার মেজাজ আজকাল চরম খিটখিটে। আর এই খিটখিটে মেজাজেই কথাগুলো ভেবে ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেল সোফার দিকে।

“বাবাই, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে, বেশি করে বুদ্ধি বাড়ার ওষুধ খাবে।ʼʼ

মেঘালয়ার কথায় ইমতিয়াজ সাহেব থমকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, অতঃপর ফিক করে হেসে ফেললেন। মেঘালয়া তা দেখে কপালটা আরও জড়িয়ে ফেলল।

“হাসছ কেন? জোকস বলেছি?ʼʼ— কথাটা বলেই রিমোটটা হাতে নিয়ে চট করে টিভিটা বন্ধ করে দিল। ইমতিয়াজ সাহেব কৃত্রিম গম্ভীর স্বরে বললেন, “এখনই বাড়ির খরচে সাশ্রয় শুরু করেছিস? ক’দিন পর তো সোফায় বসার ভাড়া আদায় করবি!ʼʼ

মেঘালয়া থমথমে মুখে বলল, “এটা কোন কথা?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়ার এই খিটখিটে রূপে বেশ মজা পাচ্ছেন। মনেমনে হাসলেন, মুখে সিরিয়াস হয়ে বললেন, “তোর শরীর নাকি ভালো যাচ্ছে না, কী হয়েছে মেঘা!ʼʼ

মেঘালয়া সোফায় বসে বলল, “এ খবর কী কাগজে ছাপা হয়েছে নাকি টিভিতে দেখাচ্ছে?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব বললেন, “দুটোর কোনটাই না, বরং রাজের মুখে ঘোষিত হয়েছে। আর বুঝলাম, তোর শারীরিক না বরং মেজাজ খিটখিটের রোগ হয়েছে।ʼʼ

মেঘালয়া অতিষ্ট হয়ে বলে ওঠে, “উফফ,বাবাই!ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব ঢং করে বললেন, “আ’ম হেয়ার, মাই প্রিন্সেস!ʼʼ

মেঘালয়া হেসে ফেলল এবার, “তোমার ক্যাকটাস, থুক্কু ক্যাকটাস আমার। তোমার বাঁদর কই?ʼʼ

“আস্তে বল। আজ বাঁদরের হাতে আমাদের পেট।ʼʼ

“মানে! রান্না করছে? করতে জানে তোমার..

কথা পুরো না করে উঠে গেল রান্নাঘরের দিকে। ইরাজ রান্না করছে। ঘেমে কাহিল অবস্থা তার। চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। মুখটা মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর। ওভাবেই রান্না করছে দাঁড়িয়ে। ঘর্মাক্ত, বিরক্ত, রান্নায় ব্যস্ত ইরাজকে দেখে কোথাও একটা নরম অনুভূতি উঁকি দিল মেঘালয়ার মাঝে। যুবতী মেঘালয়ার সামনে দাঁড়ানো ওই ঘামে সিক্তদেহী পুরুষ কেমন আকর্ষণীয় ঠেকল তার কাছে। আস্তে করে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আমায় ডাকতেন, অমি সাহায্য করতাম। একা এভাবে হেনস্তা হওয়ার কী দরকার?ʼʼ

ইরাজ হাত ধুতে ধুতে বলল, “হুম ডাকতাম। তোর বাপে যে ননীর পুতুল মানুষ করে ঘাঁড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে, তাকে ডাকতাম রান্নার মতো কাজে। রান্না করেছিস জীবনে? খালি তো খেয়েছিস পায়ে পা তুলে। আর তার ওপর শরীর খারাপ, যা এখান থেকে। এখানে গরম, গিয়ে আব্বুর কাছে বস।ʼʼ

মেঘালয়া চোখ-মুখ জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি খোঁটা দিচ্ছেন আমায়? একদিন আপনার চেয়ে ভালো রাধুনী হয়ে দেখাব… ওয়েট ওয়েট, আপনি রান্না জানেন? জানেন তো, কীভাবে জানেন?ʼʼ

ইরাজ ঘুরে দাঁড়াল, মেঘালয়ার মুখে মৃদূ একটা থাপড়া মেরে বলল, “তোর মতো ন্যাকারাণী আর আহ্লাদি ছিলাম নাকি আমি? হলে থেকে পড়ালেখা করেছি।ʼʼ

মেঘালয়া মুখে হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে খোঁচা দিয়ে বলল, “হলে আপনি রান্না করতেন? নাকি অন্যকে ভয় দেখিয়ে তাদের দিয়ে রান্না করিয়ে নিয়ে গিলতেন! আপনি যে উন্নত জাতের কাঁটাভরা ক্যাকটাস!ʼʼ

ইরাজ সরু চোখে তাকাল, “চড় খেয়ে ফর্সা গালটায় ছাপ বসাতে না চাইলে ভাগ এখান থেকে।ʼʼ

মেঘালয়া মুখ বাঁকাল, “কোন ইচ্ছে নেই আপনার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ঝগড়া করার। দরকারে এসেছি।ʼʼ

ইরাজ রান্নায় খুন্তি নাড়তে নাড়তে বলল, “বলে ফেল।ʼʼ

মেঘালয়া একটু কাছে এসে দাঁড়াল, ফিসফিস করে বলল, “বাড়ি ফেরার সময় মনে করে একটা প্রেগন্যান্সি কিট আনবেন।ʼʼ

ইরাজকে থমকানোর সুযোগটুকু দিল না মেঘালয়া। বের হয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। ইরাজ কেবল বিষ্ময়ে থমকে, ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া বুকের ধুকপুকানির সাথে স্থির দাঁড়িয়ে রইল মেঘালয়ার যাওয়ার পথে নজর মেলে।

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তূজা

২৪.

দুপুরের বেলা গড়িয়ে যায়। ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে বসে থেকে মেঘালয়ার বিরক্তি চরমে পৌঁছেছে। তবুও ইরাজের দেখা নেই। এদিক ওদিক তাকিতুকি করে, তো একবার উঠে দাঁড়ায় আবার বসে। যে কেবিনে ঢুকেছে ইরাজ, সেদিকে তাকিয়ে থাকে আশা নিয়ে— এই বুঝি ইরাজ বেরিয়ে এলো। কেবিনের দরজার ওপরের নেমপ্লেটে লেখা,
‘শারমিন আরা (গাইনি এন্ড অবস)’

সকালে ইরাজকে কিট আনার কথাটা বলার পর থেকে আর এক নতুন ইরাজ আবিষ্কৃত হয় মেঘালয়ার কাছে। পাগল ইরাজ। যার আচরণ একদম পাগলাটে ধরণের। মেঘালয়া শুনেছিল খুশিতে মানুষ পাগল হয়। বিশ্বাসযোগ্য ছিল না কথাটা তার কাছে। অথচ আজ সে দৃঢ় বিশ্বাসী, ইরাজকে দেখে। কিসের কিট, কিসের কী? মেঘালয়াকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে গাইনি ডাক্তারের কাছে। কোনরকম ত্রুটি সে হতে দেবে না। ব্লা ড ও ইউরিন টেস্টের রিপোর্টে প্রেগন্যান্সি পজেটিভ দেখার পর থেকে ইরাজের পাগলামী বেড়েছে বহুগুনে। তখন মেঘালয়া ভাবতে বসেছিল, সন্তানের আগমনীতে বাবারা বুঝি এমনই পাগল হয়ে ওঠে? তাহলে তার আব্বুও নিশ্চয়ই এমন পাগল হয়ে উঠেছিল? হেলাল সাহেবের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

কোনরকম ছটফটানি করতে দিচ্ছে না ইরাজ, ধরে বসাচ্ছে, ধরে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, তার দৌড়া-দৌড়ি দেখে খুব সহজেই বলা যায়— ইরাজ ম্যারাথনেই বোধহয় নেমেছে আজ। সেই রিপোর্ট নিয়েই ডাক্তার সাহেবা ইরাজকে কেবিনে ডেকেছিলেন। মেঘালয়া যেতে পিছু নিলে, ইরাজ নেয়নি। ইরাজকে নাকি একা ডাকা হয়েছে। তখন থেকে বসে মেয়েটা তেতো হয়ে উঠল।

আরও কিছুক্ষণ সময় পার করে ইরাজ বের হয় কেবিন থেকে। হাতে তার রিপোর্ট। মেঘালয়া ইরাজের দিকে তাকাতেই তার বোধগম্য হলো— ইরাজকে দেখতে যেন অখুশি লাগছে। কোন কিছুতে উদ্বিগ্ন সে। কিছুক্ষণ আগের চঞ্চল, চটপটে উল্লাসিত মুখটা শুকনো লাগে। মেঘালয়ার দিকে চোখ পড়তেই কৃত্রিম এক হাসি মুখে টানল। মেঘালয়া ভ্রুজোড়া কুঁচকে নেয়। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে, সব ঠিক আছে? কী বলল ডাক্তার?ʼʼ

ইরাজ হাসিমুখে জবাব দেয়, “বিশেষ কিছু না। বলল, এখন থেকে পুচকি বউয়ের সাথে আমাকে জ্বালানোর জন্য আরেক পুচকি আসছে। আমার শরীরে এক্সট্রা এনার্জি লোড করে রাখতে বলল।ʼʼ

মেঘালয়া নাক ফুলিয়ে তাকালে, ইরাজ আবারও হেসে ওঠে।


মেঘালয়ার যত্নের ত্রুটি নেই। হেলাল সাহেব বোঝাই করা জিনিস নিয়ে এসে দেখে গেছেন মেয়েকে। কল্যান প্রার্থনা করেছেন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। ইমতিয়াজ সাহেবের খুশি উতলে পড়া দুধের মতো দিগ্বিদিক গড়িয়ে পড়ছে। আনতারা খানম স্বাভাবিক। তবে তার মাঝে পরিবর্তন যা লক্ষ করা যায় তা হলো, তিনি নিঃশব্দে মেঘালয়ার যত্ন নিতে ভোলেন না। সময়মতো মেঘালয়া খাবার খেতে না গেলে খাবার ওপরে পাঠিয়ে দেন, এটা ওটা তৈরী করে রাখেন, গর্ভাবস্থায় একটা মেয়ের যেমন যত্নের প্রয়োজন সবটাই মেঘালয়া পায়, বরং বেশিই পায়। তবে তিনি কথা বলেন না মুখ খুলে। বরং নিরবতা বজায় আছে।

মেঘালয়ার শরীর একটু-আধটু মোটা দেখতে লাগে অবশ্য আজকাল। খুব বেশি না হলেও শরীরে তুলনামূলক পরিবর্তন এসেছে সামান্য।

রাত দশটার মতো বাজে। অথচ ইরাজ বাড়ি আসেনি এখনও। বারান্দার সোফাতে হেলান দিয়ে বসে একমনে চেয়ে আছে মেঘালয়া আকাশের দিকে। আজকাল কিছুসময় ইরাজ কাছে না থাকলে বুকটা খাঁ-খাঁ করে বড়ো। খালি-খালি লাগে নিজেকে। এক অজানা ভয়ে
হাত-পা শিউরে ওঠে। যেমনটা এখন হচ্ছে। মনটা ভীষনভাবে কেবল চাইছে, ইরাজ এসে প্রতিদিনের মতো গা ঘেঁষে বসে কোন ত্যাড়া কথা বলুক, মনটা শীতলতায় ছেঁয়ে যাক। আগে তো এমন হতো না? মোটেও অপেক্ষা করত না মেঘালয়া ওই বদমেজাজি, ঘাঁড় ত্যাড়া ইরাজের। তবে আজ কেন এত অস্থির লাগে ইরাজের দুরত্বে! সে জানে না, হয়ত জানে তবে প্রকাশ করে না। সে জানতে চায়না, বুঝতেও চায়না। কেবল ইরাজকে হারাতে
চায় না— এটুকুই যথেষ্ট! আকাশ দেখতেও ভালো লাগল না। শরীর তো খারাপ, তার সঙ্গে মিশে যায় ক্রমশ মন খারাপগুলো। বড্ড খারাপ অনুভূতি এসে জেকে ধরল মেঘালয়াকে। আসছে না কেন, ক্যাকটাসটা?

আস্তে করে উঠে দাঁড়াল হেঁটে রুমে আসার জন্য। অথচ মাথাটা চক্কর কেটে উঠল। ঝাপসা হয়ে এলো চোখদুটো। সঙ্গে সঙ্গে সোফার হাতল চেপে ধরে বসে পড়ল। আম্মুর চেহারাটা মেঘালয়ার সেভাবে মনে পড়ে না। তবুও মাঝেমধ্যে যখন সেই নারীটির শূন্যতা অনুভব হয়, মেঘালয়ার বুকে আগুন জ্বলে ওঠে। মেঘালয়া নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এখন এভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলে খারাপ কিছু হতে পারে। সে দেখেছে ইরাজের পাগলামী, সে বুঝেছে আব্বু ও বাবাইয়ের চোখে নাতি আসার আনন্দটুকু। নিজের জন্য না হোক, এই মানুষগুলোর জন্য হলেও তাকে এবং সেই ছোট্ট পুচকির সুস্থ থাকা চাই। আম্মু নেই তো কী হয়েছে? ইরাজ আছে তো?

মেঘালয়া অবাক হয় নিজের ভাবনায় আগে এমন সময় আব্বুর কথা মাথায় আসত। আজ ইরাজের কথা ভেবে ফেলেছে সে। চোখটা বুজে মাথাটা সোফার সঙ্গে এলিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে ফেলল মেঘালয়া। ইরাজ আসলেই নেশালো, ছেলেটা পাগল। যাকে বাহ্যিকভাবে দেখতে কত কঠিন, পাষাণ আর বদমেজাজি মনে হয়। মেঘালয়া সেসব ভেদ করে এক পাগলকে পেয়েছে, যে ইরাজের মতোই দেখতে। তবে সবার দেখা ইরাজের চেয়ে একদম আলাদা।

“মেঘ! মেঘ, কোথায় তুই। মেঘ!ʼʼ

হন্তদন্ত, অস্থিরতার মাঝে এই পুরুষের ডাক। মেঘালয়ার বুকটা শান্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই প্রতিরাতে এসে ডেকে ঘর মাথায় তুলে ফেলে, যেন— সে কোন মহামূল্যবান আমানত রেখে বাইরে গিয়েছিল, জান হাতে নিয়ে ফিরেছে তা ফিরিয়ে নিতে। মেঘালয়া ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয়। তাতে ইরাজের উত্তেজনা বাড়ল শতগুন। দৌড়ে বারান্দায় এসে পাশে বসে মুখটা হাতের আজলায় তুলে এলোমেলো স্বরে বলল, “এখানে এভাবে বসে আছিস কেন? কেমন লাগছে, কী হয়েছে? এই মেঘ! ঠিক আছিস তুই?ʼʼ

মেঘালয়ার কথা বলার সুযোগ নেই। মেঘালয়া আস্তে করে নিজের মুখে ঠেকিয়ে রাখা ইরাজের হাতের ওপরে হাত রাখল। বলল, “সবসময় এত উত্তেজিত না হলে হয়না? আমি প্রথম মেয়ে নই, যে গর্ভবতী। সকলেরই এ সময় আসে, চলে যায়। এত অস্থির হলে আপনারই যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে!ʼʼ

“সবারটা জানি না। আমার বউ তো প্রথম গর্ভবতী, আমি প্রথমবার বাপ হব। তুই নিজের খেয়াল রাখবি নয়ত তোর ঘটে শনি আছে।ʼʼ

মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “তার মানে এসব কেবল তার জন্য, আমার জন্য না?ʼʼ

ইরাজ জবাব না দিয়ে চট করে মেঘালয়াকে পাঁজাকোলে করে তুলে ফেলল। মেঘালয়া থমকে যায়, সঙ্গে লজ্জায় চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে নিল।

রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিল। মেঘালয়া শক্ত মুখে প্রশ্ন করে, “এত দেরী হলো কেন আসতে?ʼʼ

ইরাজ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে হেঁটে সোফার কাছে গেল। মেঘালয়া তা অনুসরণ করে সেদিকে তাকায়। প্রকান্ড বোঝাই করা এক ব্যাগ। কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল। ইরাজ তা এনে বিছানায় রেখে পাশে বসে চুলে হাত চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেঘালয়া ব্যাগ থেকে এক এক করে সব নামাতে লাগল।

বাচ্ছাদের যাবতীয় খেলনা দিয়ে ব্যাগ ভরা। সব বের করে বিছানায় রেখে বিষ্মিত চোখে চেয়ে রইল কেবল। এ ছেলের পাগলামী দিন দিন বাড়ছে কেবল। ব্যাগ এখনও খালি হয়নি। দেখল সেখানে, আচার, চাটনি, খোলা তেঁতুল আর কিছু ওষুধ। মেঘালয়া অবাক চোখে তাকায় ইরাজের দিকে। ইরাজ স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ভ্রু নাচায়। মেঘালয়া বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় একটা। বলে, “সবে দু-মাস চলছে। এখন এসবের..

ইরাজ কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, “যাতে আমার মেয়ে এসে খেলনার জন্য অপেক্ষা না করতে হয়। তখন কিনতে যাব, কতগুলো কিনব? এখন থেকে কিনতে থাকলে অনেক জমবে।ʼʼ

কেমন বাচ্ছা মানুষের মতো কথা ইরাজের। মেঘালয়া হতভম্ব হয়ে চেয় রয় ইরাজের দিকে। আজকাল ইরাজের আচরণ কেমন বোকা-বোকা পাগলাটে লাগে। ভারসাম্যহীন এমন আচরণ ও কথা ইরাজ মাঝেমধ্যেই বলে। এই সেই মানুষ যে কিনা ত্যাগী, বদমেজাজি, বেপরোয়া ইরাজ! আসলেই! মেঘালয়া অভিভূত নজরে চেয়ে ধীরকণ্ঠে প্রশ্ন করল,

“এত সুখী আপনি বাবা হতে পেরে, কই কখনও তো বলেন নি আমায়? সেভাবে কোন ইঙ্গিত পাইনি আমি আপনার কাছে। আমি নিজে কনসিভ করেছিলাম। কেন জানিনা। তবে কোন ধরণের কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহারে মন সায় দেয়নি। আমি যদি কনসিভ না করতাম, আপনি বলতেন করতে?ʼʼ

ইরাজের মুখভঙ্গি হঠাৎ-ই পাল্টে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল দুর্বোধ্য এক চিলতে হাসি। ওভাবেই বলল,

“কখনোই না। বরং তোকে মুক্ত করে দিতাম। কেবল সংসারে থাকতে বিতৃষ্ণা থাকলেই একটা নারী তার গর্ভাবস্থাকে ত্যাগ করতে পারে। কেবল স্বামীর প্রতি মন না টিকলে তার সন্তানের প্রতি মায়া হারায়। নয়ত কোনক্রমেই সম্ভব নয় কোন নারীর দ্বারা, যে সে তার মা হওয়ার সুযোগকে এড়িয়ে চলে। যেমনটা তুই পারিস নি। এতকিছুর পরেও পারিস নি নিজের নারীত্বের সাধটুকু খোয়াতে। সেদিন প্রমাণিত হয়েছিল, তুই আমার। তোকে পেয়েছি আমি অবশেষে। তোকে জড়িয়ে নিতে আর বাঁধা নেই। তোর পায়ে জড়িয়ে থাকা সুতোটা খুলে দিতাম নিমেষেই, যদি আমার র ক্ত নিজের মধ্যে ধারণ করতে অনীহা দেখাতি সেদিন। জোর করে তোকে হাসিল করার হলে বহু আগে কেঁড়ে নিতাম তোকে তোর কাছ থেকে। ইরাজকে ত্যাগের খেলায় হারানোর সাধ্য কারও নেই, মেঘ!
ইরাজ তো নিজের কলিজাটুকু নিজ হাতে ছিঁড়ে ফেলে বেঁচে থাকার শক্তি রাখে। তুই আমার না হলে নাহয় সেভাবেই বেঁচে থাকতাম।ʼʼ

মেঘালয়ার চোখের কোণে বোধহয় চিকচিক করে উঠল এতক্ষণে, নাকটা লালচে হয়ে উঠল। ইরাজ কিঞ্চিত হাসল তা দেখে। এগিয়ে এসে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরল মেঘালয়াকে বুকের মাঝে। মেঘালয়ার কান্নার বহর বেড়ে যায় এবার। ইরাজ শক্ত করে চেপে ধরে মেঘালয়াকে। কপালের ওপরে একটা গাঢ় চুমু দিয়ে মেঘালয়ার মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। অদ্ভূত স্বরে বলল,

“তোর মাঝে নিজেকে সেই প্রথমজীবনে লুটিয়ে দিয়েছিলাম। আজও সে অধিকারবোধ আর মায়া কাটানো সম্ভব হয়নি। আমি গোটাটাই অসম্পূর্ণ তোকে ছাড়া। আমায় খালি করে দূরে যাস না আর, ভেতরে আর জায়গা নেই যন্ত্রণা চাপানোর। আমার বুকের ঝরে যাওয়া র ক্তা ক্ত হাহাকারের মূল্যে কেনা তুই, তোকে হারালে এবার ক্ষয় হয়ে যাব আমি।ʼʼ

মেঘালয়া হিচকি তুলে শব্দ করে কেঁদে ফেলল এবার। বুকে ভাঙচুর শুরু হয়েছে। সে ভাঙচুরে মিশে আছে, অনুতাপ, প্রশান্তি, হারানোর ভয় আরও বহু জটিল অনুভূতি!

চলবে..

[ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করবেন।]

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৫.

মেঘালয়ার শরীরের অবনতি চোখে পড়ার মতো আজকাল। শরীর বেশ ফুলে উঠেছে, বিশেষ করে পা দুটো। মাথার ব্যথাও কিছুসময় তীব্র থাকে। অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে, রেগে যায়। খাওয়া দাওয়া ছেড়েই দিয়েছে প্রায়।

গতকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে ছুটেছিল ইরাজ। যখন ডাক্তারের কেবিনে যাওয়া হয়, মেঘালয়াকে বাইরে রাখা হয়। এটা অবশ্য মেঘালয়ার জন্য বিরক্তিকর। তবে কোন ওষুধ দেওয়া হয়নি। ইরাজের যত্ন-আত্তি আর আনতারা খানমের নীরব স্নেহে ভালোই আছে মেঘালয়া। তবুও যেন ইরাজের উদ্বেগের সাগরে বাঁধ ভেঙেছে।
রাতের ঘুমটা একেবারে নেই বললেই চলে মেয়েটার। সে যে একা নির্ঘুম রজনী কাটায়, তা নয়। বরং সে একটু-আধটু ঘুমিয়ে গেলেও জেগে থাকে ইরাজ। বসে কেবল অটল চাহনিতে চেয়ে থাকে মেঘালয়ার মুখের দিকে। এ-প্রাপ্তিতে নজর না লাগুক ইরাজের।

সকালে মেঘালয়ার ঘুম ভেঙে গেলেও ইরাজ ঘুমে অচেতন। শেষ রাতের দিকে শুয়েছে। যেহেতু এসি চলছে, মেঘালয়া পাতলা চাদরটা ইরাজের গায়ে তুলে দেয়। এসি অফ করলেও জেগে উঠবে ইরাজ। মেঘালয়া আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। সে বুঝে পায়না, এত অসুস্থ হয়ে পড়ছে কেন দিন-দিন। আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যেতে অগ্রসর হলে আবারও মাথা ঘুরে উঠল, সঙ্গে পেটে মোচর দিয়ে বমি ঠেলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল মেঝেতে। জোরে জোরে শ্বাস নিল কয়েকটা। তাতেই যেন ইরাজের কলিজার পানি ছুটে যায় ঘুমন্ত অবস্থাতেই। হন্তদন্ত উঠে এসে মেঘালয়ার পাশে বসে পড়ে। ওকে একহাতে ধরে বুকের সঙ্গে আগলে নেয়। মেঘালয়ার চেয়েও জোরে জোরে শ্বাস নেয় ইরাজ। কিছুক্ষণ পর একটু শান্ত হয়ে মেঝেতে ঠেসে বসে ধপ করে। মেঘালয়া মাথাটা বুক থেকে তুলে অপর হাত থাপ্পর মারার ভঙ্গিতে এগিয়ে নিয়ে কঠিন স্বরে বলল,

“মারব এক থাপ্পর? বলেছি না একা মাতব্বরি করতে যাবি না। আমাকে ডাকতে বলেছিলাম না?ʼʼ— শেষের কথাটা ধমকে বলে ইরাজ।

“কী এমন হয়েছে? এ সময় এরকম একটু হওয়াই বরং স্বাভাবিক।ʼʼ

মেঘালয়ার কথায় ইরাজ আরও ক্ষেপে উঠল, “বেশি বুঝতে শিখেছিস?ʼʼ

মেঘালয়া ইরাজের রাগকে উপেক্ষা করে বলল, “বুঝব না? বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি। না বুঝলে বাচ্চাকে বুঝাব কী?ʼʼ

ইরাজ গাল ফুলিয়ে একটা শ্বাস নিলো। নিজের ক্রোধকে সামলে নিল যেন। ইরাজকে দেখতে খুব উদ্বিগ্ন লাগছে। অসুস্থ মেঘালয়া, স্বাভাবিক অসুস্থতা তার। এ-সময় শতভাগ সুস্থ কোন নারীই থাকে না। তবুও ইরাজের চিন্তা বিরামহীন।

দুপুরে মেঘালয়াকে গোসল করিয়ে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দেয় ইরাজ। সকালে মেয়েটা কিছু খায়নি। বমি করে ভাসিয়েছে। আনতারা খানম এলেন খাবার হাতে। ইরাজ মাথা নত করে চুলে হাত গুজে, কপালের দুপাশের চুল মুষ্ঠিবদ্ধ করে চেপে ধরে বসে আছে পাশেই। মেঘালয়া চুলের পানি ঝারছে আস্তে আস্তে। তিনি এসে খাবারটা টি-টেবিলের ওপর রেখে দ্রুত পায়ে গিয়ে ইরাজের পাশে বসলেন। ইরাজের মাথার একপাশে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “মাথা ধরেছে? কফি খাবি?ʼʼ

ইরাজ দুদিকে ঘাঁড় নেড়ে মুখ তুলে তাকায়। ক্লান্ত চেহারা, চোখ-মুখ বসে গেছে ছেলেটার। আনতারার ভালো লাগল না ছেলের এমন রূপ দেখে। তিনি জানেন, ইরাজ এখন মেঘালয়াকে খাওয়াতে বসবে। শান্ত স্বরে বললেন, “আমি খাইয়ে দিচ্ছি, মেঘাকে। যা গোসল সেরে আয়।ʼʼ

ইরাজ নীরবে উঠে দাঁড়ায়। মেঘালয়ার দিকে শান্ত নজরে তাকায় একবার। মেঘালয়া চুলে জড়ানো তোয়ালেটা খুলে ইরাজের হাতে দেয়। ইরাজ চলে যায় বাথরুমে। আনতারা খানম খাবারের লোকমা তুলে ধরে মেঘালয়ার সামনে। মেঘালয়ার মাঝে মিশ্র এক অনুভূতি হলো— খারাপ লাগা, ভালো লাগা, চাপা কষ্ট, সংকোচ, বিষ্ময়। সাথে আবারও আম্মুর অভাববোধটা পীড়া দিতে শুরু করল ভেতরে। কান্নাগুলো জড়িয়ে আসে ভেতরে, নাকটা সামান্য লাল হয়ে উঠল খাবারটুকু মুখে নিয়ে। আগের মেঘালয়া হলে নিশ্চিত কেঁদে উঠে আনতারাকে ‘মামনি, মামনি’ বলে জড়িয়ে ধরত। তবে সেই মেঘালয়ার দিন ফুরিয়েছে, সে বিনষ্ট হয়ে সম্মুখে উঠে এসেছে আরেক মেঘালয়া। যে বাস্তবতা ও আঘাতগুলোকে খুব যতনে কোলে পিঠে বয়ে নিয়ে বাঁচতে শিখেছে। আনতারার প্রতি তার ক্ষোভ বা রাগ নেই। তবুও আজকাল চাইলেও আগের মতো আহ্লাদি আর সহজ হয়ে উঠতে পারে না তার সঙ্গে মেঘালয়া। সে একসময় বুঝেছিল, মা তো মা-ই। যা তার নেই। মায়ের মতো বলতে যা বোঝায়, তারা স্বার্থে টান লাগলে রূপ বদলে অচেনা হতে একদম সময় নেয় না।

কঠিন চিত্তে ভেতরকে সামলে ওপরে স্বাভাবিক ভাবে খাবারটুকু শেষ করল। আনতারা খানমও বিশেষ কথা বললেন না। খাওয়ানো শেষ করে বেরিয়ে গেলেন। এর মাঝে দু-একবার অবশ্য পানি খাবে কিনা– এ কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন মেঘালয়াকে। মেঘালয়া কেবল ঘাঁড় নেড়েছে।

ইরাজ গোসল সেরে বের হতে হতে যোহরের আজান শেষ হয়ে যায়। শুক্রবার, জুমার দিন। এমনিতেই তাড়াতাড়ি আজান দেয়। মেঘালয়া তুলনামূলক সুস্থতা বোধ করছে এখন আপাতত। তার শরীর নিয়ে সে নিজেই বিভ্রান্ত। কখন কেমন লাগে, ভালো থাকতে খারাপ হয়ে যায়, বোঝা যায় না। তবে এখন ঠিকঠাকই লাগছে বেশ। ইরাজ মাথা মুছতে মুছতে এসে মেঘালয়ার সামনে দাঁড়ায়। শরীরটা যেমন-তেমন, মেঘালয়ার পা ফুলে উঠেছে বেশ। সঙ্গে মেয়েটা মাঝেমধ্যেই শ্বাস-প্রশ্বাস জোরে নেয়। দেখলেই বোঝা যায়, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তবে তা বুঝতে না দেবার কি নিদারুণ প্রচেষ্টা মেঘালয়ার। ইরাজ এটা ধরতে পেরেছে এতদিনে, মেঘালয়ার যখন শরীর খারাপ লাগে, মুখটা হাসি হাসি রাখার চেষ্টা করে মেঘালয়া, ঘন ঘন হাসে, বেশ চঞ্চলতা দেখাতে চেষ্টা করে। ইরাজ মনে মনে এটা ভেবে হতাশ হয়, পাগলি মেয়ে! ইরাজের সম্মুখে নিজেকে লুকানোর কি বৃথা চেষ্টা! অথচ ইরাজ কিনা মুখস্ত করে রেখেছে বহু আগেই ওই বোকা, পুচকি মেঘালয়াকে।

আচমকা হালকা হাসল ইরাজ, তোয়ালেটা মৃদূ ভাবে ছুঁড়ে মারল মেঘালয়ার মুখের ওপর। মেঘালয়া কটমট করে তাকায়। এ কেমন অগোছালো ব্যাটাছেলে! কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই! ইরাজ তা দেখেও পরোয়া না করে বলে,

“চাবি-টাবি কোথায় রাখিস? যবে থেকে এসেছিস, রুমের স্ট্রাকচারই বদলে ফেলেছিস একদম! এবার একটা পাঞ্জাবী বের করে দে। আয়রন কোথায় রেখেছিস?ʼʼ

মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “পাঞ্জাবী?ʼʼ

“হু, আজ জুমার দিন তো!ʼʼ

মেঘালয়ার অবাক কণ্ঠস্বর, “নামায পড়তে যাবেন? আপনি?ʼʼ

ইরাজ গোমরা মুখে তাকাল, মেঘালয়ার কথা শুনে বলল, “উহ, তোকে পরিয়ে দেব। জুমার নামাযটা সেরে আসবি।ʼʼ

মেঘালয়া চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় ইরাজের দিকে। ইরাজ মুখ ফুলিয়ে একটা শ্বাস ফেলল। এগিয়ে এসে ধপ করে বসল মেঘালয়ার কাছে। সাফাই গাওয়ার মতো করে বলল, “আরেহ! তুই উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করবি, আর আমি উত্তর দিলেই দোষ?ʼʼ

মেঘালয়া নাক ফুলিয়ে বলে, “ইউ নো হোয়াট! আপনার জিহ্বায় সমস্যা আছে। সেখানে সোজা কথা বের হওয়ার ক্যাপাসিটিই নেই। আর জিহবার কি দোষ, যেখানে ঘাঁড়টাই জন্মের ত্যাড়া?ʼʼ

মেঘালয়াকে রেগে যেতে দেখে আকষ্মিক সামান্য হেসে ফেলল ইরাজ। বলল, “তুই যে এখন আমায় টিজ করলি? কেন আমি নামায পড়তে যেতে পারি না? সৃষ্টিকর্তা সব কেড়ে নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। যদিও, এত খুশি কতদিন সইবে ইরাজের কপালে, তা জানি না। তবে শুকরিয়া আদায় না করে যাই কোথায়? সঙ্গে আমার মেয়ের সুস্থতা কামনাও করে আসি এইসাথে।ʼʼ

মেঘালয়া বলে ওঠে, “মেয়ে কেন? ছেলেও হতে পারে। আর তাছাড়া ছেলে হলে আমি খুশি হব।ʼʼ

ইরাজ গম্ভীর হয়ে তাকাল। বলল, “তা কেন?ʼʼ

মেঘালয়ার মুখে মৃদূ মলিন হাসি ফুটে ওঠে, “আমার মেয়েও যদি আমার মতোই ভুল করে বসে জীবনে? ওর জীবনও নিশ্চয়ই আমার মতো দুর্বিসহ হয়ে উঠবে? ছেলেরা ভুল করে না। করলেও তাদের মেয়েদের মতো মূল্য দিতে হয় না। আর যদি এমন হয়, আম্মুর মতো আমিও…

ইরাজ থাবা দিয়ে ধরে মেঘালয়াকে। মেঘালয়া চমকে উঠে তাকায় ইরাজের দিকে। বিক্ষুব্ধ ইরাজকে দেখে ঢোক গিলল একটা। অশান্ত ইরাজ আচমকাই শান্ত নদীর মতো স্রোতহীন বহমান হয়ে উঠল যেন। মেঘালয়ার গালে হাত রাখল। নিভু স্বরে বলল, “ছেলে হলে হতে পারে না কি, সে ইরাজের মতো কোন এক মেঘকে ভালোবেসে ফেলার মতো ভুল করে বসল?ʼʼ

মেঘালয়া আস্তে করে ইরাজের বুকে মাথা রাখে। জড়ানো কণ্ঠে বলে, “আল্লাহর সিদ্ধান্তে খুশি আমি। জীবনের ওপর আর কোন অভিযোগ নেই আমার।ʼʼ

ইরাজ এক ঝটকায় নিজের অভিব্যাক্তি ও প্রসঙ্গ দুটোই বদলে ফেলে, “ভালোই পেকে গেছিস? নিয়মিত হরলিকস খাচ্ছিস নাকি? ক’দিন আগেও তো হাত ধরে রাস্তা পার করতাম। আজকাল আমায় তোর জ্ঞান নিতে হচ্ছে! সবই কপাল!ʼʼ

মেঘালয়া ইরাজকে মৃদূ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে মুখ ভেঙ্চি কাটে। ইরাজ চট করে মেঘালয়ার মুখটা দু আঙুলে চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরাল। ঠোঁটের হাসি সরল না তার, ওভাবেই চিবিয়ে বলল, “তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন?ʼʼ

মেঘালয়া দাঁত শক্ত করে কপাল জড়িয়ে তাকিয়ে আছে। ইরাজ আবার বলে, “এত সাহস কোথায় পাচ্ছিস? এদিকে তাকা, তুই তো খুব সাহসী হয়ে উঠেছিস, চোখে চোখ রাখ এবার।ʼʼ

মেঘালয়া ওভাবেই মুচকি হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টি নত করে ফেলল। ইরাজ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেঘালয়া উঠে যেতে উদ্যেত হলে ইরাজ চেপে ধরল। বলল, “আমি বের করে নিচ্ছি, চাবি কোথায় রেখেছিস?ʼʼ

মেঘালয়া শুনল না। জোর করেই উঠতে যায়। ইরাজের মেজাজ বিগড়ে যায় নিমেষেই। মেঘালয়ার হাতটা চেপে ধরে টেনে বসায় মেঘালয়াকে। চোখ-মুখে ক্ষুব্ধ ভাব স্পষ্ট। মেঘালয়া অবাক হয়, ইরাজের এমন বহুরূপী আচরণে। এই একরকম তো চোখের পলকে পাল্টে অমানুষের পরিণত হয় ইরাজ। ইরাজ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তোকে নিষেধ করেছি না বেশি লাফালাফি করতে? আমায় কথায় মন লাগে না তোর? বলেছি সবসময় নিজের খেয়াল রেখে চলবি। খুব সাবধানে থাকবি। শরীরে একটু এদিক সেদিক যেন না হয়। আমার বাচ্চার কিছু হয়ে গেলে তোকে কি করব, আমি নিজেও জানি না।ʼʼ

মেঘালয়া বিষ্মিত নয়নে থমকে চমকে একাকার হয়ে চেয়ে রইল কেবল। সহসা ভেতরে একটা কথা খেলে গেল, তার কোন মূল্য নেই ইরাজের কাছে। সবটাই কী তাহলে বাচ্চার জন্য! মেঘালয়ার জন্য কিছুই না। আজও মেঘালয়া কেবল ইরাজের কাছে অপ্রয়োজনীয় এক ত্যাগকৃত বস্তু মাত্র! এ সময় একটু আধটু অসুস্থ তো সকলেই হয়। তাই বসে এত শ্বাসরোধী সাবধানতা কেন? আজকাল ইরাজের বহুমুখী আচরণে মেঘালয়া মাঝেমধ্যেই এই ধারণা করে বসে, ইরাজ মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। মানসিকতা সুস্থ নয় ইরাজের।

নিজেই ভাবনায় নিজেই পেচিয়ে যায় মেঘালয়া। ইরাজ কেন এমন অদ্ভুত! মাঝেমধ্যেই কি হয়ে যায় ইরাজের? এত এত রূপ দেখেছে ইরাজের সে প্রেগন্যান্সির পর থেকে। কখনও বিষন্ন, কখনও খুব আবেগী, কখনও পাগল, কখনও অমানুষের মতো বদমেজাজ আবার কখনও স্বাভাবিক ইরাজ। কী চলছে তার জীবনে? কী ঘটছে! সবকিছু ঠিক আছে? ইরাজ বেরিয়ে যায় নামাযের উদ্দেশ্যে। মেঘালয়া সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা।

চলবে..

[ ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করবেন।]

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২০+২১+২২

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২০.

শুক্রবার দিন। বাড়িতে ইমতিয়াজ সাহেবের এক ব্যাবসায়ীক ক্ষেত্রের পরিচিত লোকের পরিবার আসছে। এরকম মাঝেমধ্যেই অনেকেই আসে। আনতারা খানম বহু দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে শেষমেষ উপস্থিত হলেন মেঘালয়ার রুমের সম্মুখে। মেঘালয়া আনতারা খানমকে দেখে বিশেষ কোন খারাপ ভালো কিছুই প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আজকাল ভয় হয় খুব, সেই সঙ্গে পুরোনো ব্যথা! না জানি কি কথা শুনাতে এসেছে! আনতারা খানম নিরস, গোমরা মুখেই কোন শিরনাম ছাড়াই বললেন,

“গোসল করে একটা শাড়ি পরে নিও। মেহমান আসছে।ʼʼ

মেঘালয়া কিছু বলল না। আনতারা খানম চলে গেলেন। যেহেতু ইরাজের বিয়েতে ঘটা করে অনুষ্ঠান করা হয়নি। আর তাছাড়াও মেঘালয়া বাড়ির বউ। এ এক ঐতিহ্যও বটে, বাড়ির বউ শাড়ি পরবে।

মেঘালয়া অনিচ্ছা সত্তেও শাড়ি বের করতে আলমারী খুলল। শাড়ি আছেই মোটে তিনটা। একটা বিয়ের শাড়ি, সেটা অবশ্য খুব বেশি ভারী সাজের নয়। ইচ্ছে করলে এমনিতেও পড়া যায়। তবুও মেঘালয়া বাকি দুটোর মাঝে দেখল। একটা সেদিন পড়ে গিয়েছিল। এই দুটো শাড়ি মেঘালয়ার আগে কেনা। সে ফুফাতো বোনের বিয়েতে এবং কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে কিনেছিল। সেটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকল।

ইরাজ হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করল। সে আজ সকাল সকাল বেরিয়েছিল কোথাও। মেঘালয়া একবার তাকাল। বড়ো অস্থির আর অগোছালো লাগছে দেখতে ইরাজকে। ঘর্মাক্ত শরীর, এলোমেলো চুল। চমকপ্রদ ভাবে নজরে এলো, ইরাজের হাতের সদ্য হওয়া ক্ষতটি। মেঘালয়া উঠে দাঁড়াল। ইরাজ ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজছে। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করল, “কী খুঁজছেন? হাত কাটল কী করে?ʼʼ

ইরাজ কেবল প্রথম প্রশ্নেরই জবাব দিল, “স্যাভলন কোথায় রেখেছিস?ʼʼ

“আপনি বসুন, আমি দিচ্ছি।ʼʼ

“ঘরের জিনিস উল্টোপাল্টা করতে বলে কে তোকে?ʼʼ

মেঘালয়া ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ খুলে উপরের তাক থেকে স্যাভলন বের করতে করতে বলল, “ঘর উল্টোপাল্টা করার দায়টা একচ্যুয়ালি আপনার। হাতের ব্যাথায় মাথা ঠিক নেই, আমার কথা বলে ফেলেছেন। আমি তো কেবল ঘরের পরিচর্যা করি। সবকিছু তার সঠিক জায়গায় গুছিয়ে রাখি।ʼʼ

মেঘালয়ার শীতল জবাবে ইরাজ মুখ ভার করে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। তুলো নেই ঘরে, মেঘালয়া টিস্যুবক্স থেকে কয়েক টুকরো টিস্যু নিয়ে এসে ইরাজের পাশে বসল। ইরাজ খপ করে কেঁড়ে নিল এন্টিসেপটিক এর বোতলটা। বলল, “বহু জ্ঞানের বাণী শুনিয়েছিস। এবার গিয়ে আমার খাবারের ব্যবস্থা কর।ʼʼ

“প্রাথমিক চিকিৎসা আগে দিই। তারপর খাবার।ʼʼ

“না, তোর চিকিৎসা লাগবে না। দেখা যাচ্ছে তোর হাত পড়ে এখানে জীবাণু ইনফ্যাকশন হয়ে গেল।ʼʼ

মেঘালয়ার এ কথায় রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও কেন জানি ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল। ইরাজের হাত থেকে স্যাভলনের বোতল নিয়ে তাতে টিস্যু ভেজাল। ইরাজের হাত ধরতে কেমন দ্বিধা হচ্ছে। যদি হাত ছিটকে নেয়, বা কটুক্তি করে? মেঘালয়া মিনমিন করে বলল, “হাতটা দিন।ʼʼ

মেঘালয়ার ভাবনাকে মিথ্যা করে ইরাজ বিরক্ত মুখে হাত এগিয়ে দিল। স্যাভলন ক্ষততে লাগাতেই ইরাজের বদলে মেঘালয়া মুখ কুঁচকে নিলো। ইরাজ তা দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, “এক প্রাণ-দুই দেহ হয়ে গেল নাকি তোর আমার? আমার বদলে তুই কাঁদছিস কেন?ʼʼ

মেঘালয়া মনে মনে কপাল চাপড়াল। সে নাকি কাঁদছে, আল্লাহ! কী মুসিবত ত্যাড়া লোকের সাথে চলা!

মেঘালয়া এতক্ষণে জিজ্ঞেস করল, “কী করে কাটল হাত?ʼʼ

“তোর পুরোনো আশিককে আজ এ বাজারে পেয়েছিলাম।ʼʼ

মেঘালয়া দ্রুত মাথা উঁচিয়ে তাকাল, “মারপিট করে এসেছেন আপনি?ʼʼ

“মারপিট করব কী উপলক্ষ্যে?ʼʼ

মেঘালয়া চোখের পাতা ঝাপটাল কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বলল, “তারপর?ʼʼ

“তারপর এগিয়ে গেলাম। কানে কানে একটা তরতাজা খবর দিয়ে এসেছি।ʼʼ

মেঘালয়া প্রশ্নাত্মক নজরে ভ্রু কুঁচকে রইল। ইরাজ কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে মেঘালয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, “বলেছি, প্রেম তো তুই করেছিস, বাসর রাতের বেনিফিটটুকু কিন্ত আমিই গিলেছি। আমি ব্যাবসায়ী মানুষ তো, লসের পক্ষে নেই।ʼʼ

মেঘালয়া এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেল। কিছু মুহূর্ত পার হতেই যেন জ্ঞান ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করে নিলো। আচমকা হাসি এসে জড়ো হলো ঠোঁটের কোণে। তবে ভাবনায় কিছু আসতেই কপাল কুঁচকে তাকাল, “আর তারপর মেরেছেন?ʼʼ

“উফফ! তার জন্য তোর এই দরদ! মানুষের পিরিত দেখতেও ভালো লাগে। শালা, আমরাই কী ছিঁড়লাম জীবনে!ʼʼ

মেঘালয়া কটমটিয়ে চেয়ে ক্ষতর স্থানে চেপে ধরল। ইরাজ মৃদূ চিৎকার করে উঠল, “খান্নাস!ʼʼ

“আমি শুধু জানতে চাইছি কাটল কী করে?ʼʼ

“বাড়িতে ঢোকার সময় আম্মা একটা দা আর নারিকেল দিল শরীরচর্চা করার জন্য। শালার, নারকেল এত সফ্ট, আর দা’তে নেই ধার। ছুটে এসে হাতে লেগেছে। দা’য়ে অন্তত তোর মুখের মতো ধার থাকলেও এই ঘটনা ঘটত
না।ʼʼ

মেঘালয়া ভাবল, এলো নিজের ত্যাড়ামির জোরে শক্ত পোক্ত নারকেধকেও সফ্ট বানিয়ে ছেড়েছে। কোনহাতে দা ধরেছিল, ডানহাতে কী করে লাগল। বলল, “তা ভালো। তবে যদি আপনার মুখের মতো ধার থাকতো— না জানি হাতটাই কেটে পড়ে যেত।ʼʼ

ইরাজ হাত ছাড়িয়ে নিলো, গম্ভীর মুখে তাকাল। উঠে চলে যেতে অগ্রসর হলো। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে, “খাবার কী রুমে এনে দেব?ʼʼ

“খাব না। বাইক ধুয়ে আসি, বাপ অপেক্ষা করছে।ʼʼ

“খাওয়ার চেয়ে জরুরী?ʼʼ

“আপাতত।ʼʼ

নিচে নামতেই আনতারা খানম গালি ঝারলেন কয়েকটা। দামড়া ছেলেকে খাওয়ার জন্য তাড়তে হয়। ইরাজের শরীর অবধিও বোধহয় পৌঁছাল না কথাগুলো। ডেটলের সুরক্ষা আছে তার চারপাশে, মানুষের কথার পরিপেক্ষিতে। নির্লিপ্ত হেঁটে হেলেদুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। ইমতিয়াজ সাহেব অপেক্ষারত সেখানে। গাড়ি ধোয়া দিবস আজ বাপ ছেলের। তার হাত কেটেছে তা জানেন না আনতারা। ডানহাতে ক্লান্তি আসায় বামহাতে চেষ্টা করতে গিয়েই এই আকামটা হয়েছে। বামহাতে এমনিতেই স্বাভাবিকই জোর কম। নারকেলে কোঁ প দিতে গিয়ে ব্যালেন্স ছুটে গিয়ে ডানহাতে লেগেছে। তারপর বাঁকি নারকেল গুলো ইমতিয়াজ সাহেব ভেঙেছেন, ইরাজকে পাঠিয়েছেন সেবা নিতে। সেই নারকেল দিয়ে আনতারা বানাবেন মিষ্টি জাতীয় কোন খাবার।

মেঘালয়া শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। এ বাড়িতে থাকলে যে-কেউ অলস হয়ে উঠবে। আগে তিনজন, এখন চারজনের পরিবার। সারাদিনে বাড়তি কোন কাজ নেই। এবং যা আছে আনতারা ও আয়েশা করে ফেলে। আনতারা মেঘালয়াকে ডাকেন না কোন কাজে। সে সারাদিন রুমের মাঝে পড়ে থাকে।

গোসল শেষে মেঘালয়া চুল ঝারতে ঝারতে বের হলো। পরনে তার আসমানী ও সাদার মিশ্রনে সজ্জিত একটি শাড়ি। কলেজের পোশাকটাও এ দুই রঙা ছিল বলে, সকলে এই রঙা শাড়ি কিনেছিল বিদায় অনুষ্ঠানে। মেঘালয়া এ সুযোগ পেয়েছিল কারন— তার থেকে ইরাজ তখন বহু দূরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।

ইরাজ রুমে ঢুকেই মেঘালয়াকে ওমন অর্ধজড়ানো শাড়িতে ভেজা চুলগুলো আনমনে তোয়ালেতে ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসতে দেখল। তড়াক করে পুরুষ হৃদয় থমকে যায় যেন! পা উঠল না ইরাজের। শাড়ির কুচি অবধি ঠিক থাকলেও ওপরে কোনরকম শাড়ির আচলটা চিকন করে বুকের মাঝ দিয়ে কাঁধে তুলে রাখা। আচমকাই ইরাজের মনে হলো, মেঘের শরীরে মেঘবরণ শাড়ি। না না, ঝড়ো মেঘ নয়; বরং শরতের আকাশে নীল-আসমানী ও সাদার জড়াজড়িতে ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ! মেঘালয়াকে ইরাজ আজই প্রথম, প্রথমবারের মতো এভাবে দেখল।

ইরাজ ঠিকমতো আগেও কোনদিন মেঘালয়ার দিকে তাকাত না। তার অনুভূতির সঙ্গে তার আচরণ মেলে নি কোনদিন। সে সংকোচই কাটিয়ে উঠতে পারত না। মনে হতো মেঘালয়াতে আটকে সে বড়ো অবাঞ্ছিত কাজ করে বসেছে। মনকে সংযত না করতে পারলেও, নিজের আচরণ ও নজরকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল সে কষে। যখন মেয়েটার মায়ায় পড়েছিল ইরাজ, অধিকার হানা দিয়েছিল এই মেয়ের জন্য— তখন মেঘালয়া চৌদ্দ বছরের কিশোরী। খুব ছোটো না হলেও যুবতী ছিল না সে। যাকে ইরাজ সর্বদা রক্ষা করেছে, তার প্রতি অধিকার না জেগে যেত কোথায়?

আজ সেই মেঘালয়া তার বউ রূপে, তার ঘরে, এমন নারীবেশে দাঁড়িয়ে। পুরুষ মনে ধাক্কা লাগল কোথাও একটা। তবে কতক্ষণ, তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যে অসীমের মতোই। দ্রুত নজর ফিরিয়ে নিয়ে চারদিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টি ফেলল। মেঘালয়া ইরাজকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ইরাজের শরীর ভেজা। হাতে পায়ে ময়লা লেগে আছে। রেগে উঠল মেঘালয়া,

“এভাবে রুমে ঢুকেছেন? সবে সবকিছু পরিষ্কার করে গোসলে ঢুকেছি। বেক্কল ব্যাটাছেলে।ʼʼ

ইরাজ গম্ভীর কণ্ঠে ভার মুখে শুধাল, “শাড়ি কেন পরেছিস?ʼʼ

মেঘালয়া তাকাল ইরাজের এমন রাশভারী গলা শুনে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজের দিকে খেয়াল দিতেই লজ্জায় ভেঙে পড়ল মেঘালয়া। তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নিল শরীরে। তারপর আড় আড়ষ্টতায় বুদ হয়ে মৃদূ স্বরে জবাব দিল, “মামনি বলেছে।ʼʼ

ইরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “কোন দুঃখে?ʼʼ

“বাড়িতে মেহমান আসার দুঃখে।ʼʼ

“মেহমান আসলে শাড়ি পরতে হয়; কোন বলদের হাতে, কোন কিতাবে ছাপা হয়েছে এই বাণী?ʼʼ

মেঘালয়া প্রতিবাদ করে ওঠে, “আপনার মতো পানসে তো আর না লোকে। অন্তত আমি তো মোটেই না। ওয়েট ওয়েট.. নিজে তো বাইরে বের হওয়ার সময় সাহেব সেজে বের হন। ছোটোবেলার থেকে অত্যাচার করে যাচ্ছেন, এটা করতে পারবা, সেটা করা যাবে না..

কথা ফুরোলো না। ইরাজের গম্ভীর মুখের দিকে চোখ যেতেই থেমে গেল মেঘালয়া। ইরাজ তীর্যক দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে মেঘালয়ার চোখের দিকে। মেঘালয়া এলোমেলো হয়ে উঠল। সে ইরাজের সম্মুখে আবারও অভিযোগ করে উঠেছে, যদিও কথাগুলো সে জটিল কিছু ভেবে বলেনি। কিন্ত ইরাজ তো বাঁকা! ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল, “এরপর?ʼʼ

মেঘালয়া মাথা নত করে নিলো। ইরাজ আবার বলল, “কন্টিনিউ! আর কী কী করেছি, বল? আমারও মনে নেই অত, বল শুনে মনে করি।ʼʼ

মেঘালয়া মুখ খোলার আগেই ইরাজ হনহন করে বাথরুমের দিকে চলে গেল। মেঘালয়া হতাশ এক শ্বাস ফেলল।

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২১.

অতিথিদের বিদায় দিতে সন্ধ্যা হলো। তারা আজই দেখল ইরাজের বউকে। মেঘালয়ার জন্য কিছু উপহারও এনেছে বটে, তবে সেটা খুলে দেখার অবকাশ পায়নি মেঘালয়া। ইরাজ সেই সকাল থেকে এখনও অভুক্ত। আনতারা খানম নিজের ব্যস্ততায় সারাদিনে ব্যাপারটি খেয়াল না করলেও, এবার চিৎকার করা শুরু করলেন। তবে সেটার অধিকাংশ দোষটাই বেঁকে গিয়ে পড়ছে মেঘালয়ার উপর। সে তার স্বামীর যত্ন নেয় না! মেঘালয়া শুনেও কোন জবাব দিল না।
কেবল টেবিল থেকে খাবার বেড়ে নিয়ে উপরে চলে গেল। সে জানে, ইরাজ কেন খায়নি। হাতের ক্ষত ডানহাতের তালু জুরে। সেখানে চামচ দিয়ে খাওয়ারও উপায় নেই। আনতারা খানম জানেন না এ বিষয়ে। ইরাজ বিশেষ প্রয়োজন মনে করেনি তাকে জানানোর। শুধু শুধু উত্তেজিত হয়ে পড়বে।

মেঘালয়া রুমে এসে দেখল, ইরাজ রুমে নেই। খাবারের প্লেটটি টেবিলের উপরে রেখে, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল ইরাজের পেছনে। মেঘালয়া অবিশ্বাস্য নজরে তাকায়— ইরাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে কেবল। হাতে সিগারেট নেই। কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করল যেন! ইরাজকে সিগারেট খেতে দেখলে সে নিজের ভেতরে অদ্ভুত এক চাপ অনুভব করে আজকাল। মেঘালয়া মৃদূ স্বরে ডেকে বলল, “খাবার এনেছি।ʼʼ

“রেখে দে। পরে খেয়ে নেব।ʼʼ

“উহু, এক্ষুনি।ʼʼ

ইরাজ দেহ সামনে রেখে কেবল ঘাঁড়টা ঘুরিয়ে তাকাল, “বাধ্যতামূলক?ʼʼ

“অনেকটা তাই-ই।ʼʼ

ইরাজ, এর পরিবর্তে কোন কঠিন কথা না বলে বরং নিজের অপারগতা প্রকাশ করল, “হাতে খেতে পারব না, আম্মা খাইয়ে দিলে খাচ্ছি, রেখে দে।ʼʼ

মেঘালয়া বিষ্মিত হয়। সে ইরাজকে খাওয়ার বাধ্যতা দিয়েছে, অথচ তার পরিপেক্ষিতে ইরাজের এমন শান্ত উত্তরে মেঘালয়া ভড়কে গেল। সে যা বলতে চাইছে, তা মুখে এসেও আটকে যাচ্ছে বারবার। সংকোচবোধটুকু কাটিয়ে উঠতে পারছে না মেঘালয়া। একসময় ইতস্তত করতে করতে বলে ফেলল, “আমি খাইয়ে দিই, যদি আপনার আপত্তি না থাকে!ʼʼ

ইরাজ কিছুটা সময় নিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। কিছু না বলে বরং নিঃশব্দে রুমে গিয়ে সোফার উপরে বসল খাবারের সম্মুখে।

মেঘালয়া খাবার তুলে মৃদূ কাঁপা হাতে ইরাজের সম্মুখে ধরে। তার ছোট্ট হাতের ছোটো এক লোকমা খাবার ইরাজ মুখে তুলে নেয়। মেঘালয়ার হাত তো কাঁপছে মৃদূ, তবে তার বুকের কম্পনে সে যে আন্দোলিত হয়ে উঠছে প্রতিক্ষণে, তা কী বুঝল সামনের অভিমানী, ত্যাগী পুরুষটি! অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে ক্রমশ ভেতরটা মেঘালয়ার। ইরাজ নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় খেয়ে যাচ্ছে। মেঘালয়ার নিরব ছটফটানি হয়ত তার বুঝি দৃষ্টিগোচর হয়নি? মেঘালয়ার মস্তিষ্কের সংবেদনশীল জায়গাগুলো বিভিন্ন রকম বার্তা জানিয়ে যায় তাকে— সামনে বসে থাকা এই পুরুষটি তার স্বামী এবং তারই গালে আজ সে খাবার তুলে দিচ্ছে নিজ হাতে। চোখটা বুজে ফেলল। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে তর ক্রমশ। আগে ইরাজের সম্মুখে আসলে এমন হতো না। তবে আজকাল হয়! আড়ষ্টতা হানা দেয় বড্ড।

“এক প্লেট খাবার কী সারারাত ধরে খাওয়ানোর পরিকল্পনা আছে, তোর? দিচ্ছিস মিনিট বিশেক পর পর এক লোকমা! বেশি করে দে, পাখির আহার করাচ্ছে যেন!ʼʼ

ইরাজের বিরক্ত হয়ে দেওয়া ধমকে মেঘালয়া চোখ তুলে তাকাল। আবার সঙ্গে সঙ্গে নজর নত করে যথাসম্ভব বড়ো এক লোকমা তুলে ইরাজের সামনে ধরলে ইরাজ তা নেয়। তার কাঁপা হাতে দেওয়া খাবারের অনেকটা ঠোঁটের আশেপাশে লেগে গেছে ইরাজের। তা দেখে এক অদ্ভুত কাজ করে বসল মেঘালয়া। চট করে শাড়ির আচলটা তুলে ইরাজের মুখটা মুছিয়ে দিল।

ইরাজ শান্ত নজর মেলে তাকালে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মেঘালয়ার নিজের কর্ম মনে পড়ে বড্ড অপ্রস্তত হয়ে উঠল। ইরাজের ওই দৃষ্টি যা বলছে, তাতে আরও ছটফটিয়ে উঠল মেঘালয়া। ইরাজের দৃষ্টিতে স্পষ্ট আক্রোশ। যেন ডেকে বলছে, আজ এভাবে যত্ন করছিস আমার, এক সময় মরণসম যন্ত্রণা দিয়েছিস এই তুই-ই, মেঘ!

মেঘালয়ার আস্তে করে মাথাটা নত করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছেন?ʼʼ

ইরাজ ওর নত মুখটার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে জবাব দেয়, “ভাবছি না।ʼʼ

“অতীতে ডুব দিয়েছেন!ʼʼ

“না চাইতেও।ʼʼ

“ভুলে যাওয়াও তো যায়!ʼʼ

“চেষ্টা করিনি কখনও।ʼʼ

“পুষে রেখেছেন কেন?ʼʼ

“ভুলে গিয়ে কী হবে?ʼʼ

মেঘালয়া চোখ তুলে তাকাল। আর বসে থাকা সম্ভব হলো না তার। বাকি খানিকটা খাবার সহ প্লেট নিয়েই উঠে চলে গেল রুমের বাইরে। ইরাজ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মেঘালয়ার চঞ্চল পায়ে উঠে চলে যাওয়ার পানে। ইরাজের সেই নজরে মিশে আছে— অল্প প্রাপ্তির আনন্দ, অজানা তৃপ্তি, এক অদম্য দৈহিক চাহিদা আর খানিকটা বিষাদ!


ঘড়িতে রাত বারোটা। বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে মেঘালয়া ইরাজকে ডাকার উদ্দেশ্যে ইরাজের দিকে তাকাল। দেখল— ইরাজ হাতের ক্ষতর দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বসে আছে। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “ব্যাথা করছে হাতে?ʼʼ

ইরাজ তাকাল, “হু।ʼʼ

মেঘালয়া হেঁটে গিয়ে বসল পাশে। চট করে ইরাজের হাতটা ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ইরাজ চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার সেসবে তোয়াক্কা নেই। সে বরং ইরাজের হাতের ক্ষততে মনোযোগী। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “দা’তে কেটেছে বুঝতে পারছেন? মরিচা থাকলে সমস্যা হতে পারে। আমি দেখছি কোন ব্যথার ওষুধ আছে কি-না রুমে!ʼʼ

বলেই উঠতে উদ্যেত হলো মেঘালয়া। ইরাজ হাত চেপে ধরে মৃদূ টান দিলে অগত্যা ধপ করে বসে পড়ে। ইরাজ ভারী আওয়াজে বলে উঠল, “তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন! বাদ দে। এসব যত্ন-ফত্ন সইবে না আমার নষ্ট শরীরে।ʼʼ

মেঘালয়া ইরাজের দুর্বোধ্য চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনার নষ্ট হওয়ার কারন যদি আমি হই, তবে তা সারিয়ে তুলতে আমার বিকল্প নেই।ʼʼ

ইরাজ হাসল, “সারিয়ে তোলার চেষ্টা কেন? সহানুভূতি?ʼʼ

“আপনি অবুঝ!ʼʼ

“হু, যেমন তুই ছিলি।ʼʼ

“শাস্তি দিচ্ছেন?ʼʼ

“উহু, আরেকবার নিজেকে দুর্বল করতে চাইছি না।ʼʼ

হুট করে মেঘালয়া বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। ইরাজের কলারের প্রান্ত চেপে ধরে ইরাজকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। অস্থির স্বরে বলে উঠল, “এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী প্রমাণ করতে চান? আপনি ব্যর্থ প্রেমিক? আর আপনার অপরাধী আমি? এত অভিমান? এত ত্যাগ? সকল পুরুষই কী এমন অভিমানী হয়? কিসের ক্ষোভ পুষে রেখেছেন নিজের মাঝে? যেখানে আজও অন্যের দ্বারা পাওয়া আমার খানিকটা আঘাত সহ্য করতে পারেন না, সেখানে নিজে কেন আক্রোশ আর অভিযোগ পালছেন আমার জন্য? কী করেছি আমি?ʼʼ

মেঘালয়ার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল এ পর্যায়ে। আরও অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারল না। ইরাজ অদ্ভুত কণ্ঠে আস্তে করে বলল, “তুই নিজের ওপর থেকে আমার অধিকার কেড়ে নিয়েছিস। তুই আমার সত্তাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিস। তুই নিজের মনে অন্য কারও কলঙ্ক ছেপেছিস, হোক সেটা সত্য বা মিথ্যা। তুই আমায় গলা কাটা কবুতরের মতো ছটফট করিয়েছিস রাতের পর রাত।তোকে দেখলে আজ কেবল যন্ত্রণা অনুভূত হয়। মিশ্র এক যন্ত্রণা! তা কেমন যন্ত্রণা, আমি আজকাল নিজেও বুঝতে পারি না। কোন কিছুর হাহাকার, নিদারুন শূন্যতার যন্ত্রণা।ʼʼ

মেঘালয়ার চোখ চিকচিক করে উঠল। কম্পিত স্বরে জোর দিয়ে বলল, “তাহলে তো আমার শাস্তি কোনদিন শেষ হবে না নিশ্চয়ই! অথচ আমি আর নিতে পারছি না, এক মুহূর্তও না। আপনি থাকুন আপনার অভিযোগ আর যন্ত্রণা গুলোকে আঁকড়ে ধরে, আমি নিজেকে নিয়ে একাই চলার রাস্তা দেখি।ʼʼ

বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় মেঘালয়া। উত্তেজিত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে অগ্রসর হয়। পেছন থেকে ইরাজ উঠে গিয়ে খপ করে মেঘালয়া চুলে মুঠি চেপে ধরল। ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে। চোখ লাল হয়ে আছে ইরাজের। মুখের কাঠামো শক্ত। মেঘালয়া চোখ বুঁজে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। শ্বাসগুলো স্রোতের মতো তেড়ে এসে ধাক্কা খায় ইরাজের বুকে। দাঁতের মাড়ি চেপে বলল ইরাজ, “বিছানায় যা।ʼʼ

মেঘালয়া বিষ্মিত হলো হঠাৎ-ই এমন কথায়। রুষ্ঠ নজরে তাকাল ইরাজের দিকে, “বিছানায়? কেন? ঘৃনা লাগবে না আপনার? অপনার তো আমার স্পর্শেও গা পুড়ে যায়? ছাড়ুন, নয়ত হাতটাও জ্বলে যাবে।ʼʼ

মেঘালয়া ছাড়া পেতে ছটফটিয়ে উঠল। ইরাজ আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে বলল, “কথা কম বল। যা বললাম, কর। জবরদস্তি করলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না।ʼʼ

মেঘালয়া খানিক অবাক হয়ে বলল, “জবরদস্তি মানে?ʼʼ

ইরাজ চোখ রাঙিয়ে উঠল, “ছটফট না করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়।ʼʼ

মেঘালয়া নাকের পাটা ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে বলে উঠল, “কোন প্রয়োজন হবে না তার। এতদিন যেমন সোফায় থাকতে পেরেছি, আজ বিশেষ কোন সমস্যা হতো না থাকতে। তবে আমি আর এ রুমেই থাকতে ইচ্ছুক নই। তাই সোফা হোক বা বিছানা; যায় আসে না।ʼʼ

ইরাজ চোখ বুজে শ্বাস ফেলল কয়েকটা ঘন ঘন। অতঃপর চোখ খুলে মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “একবার যখন আমার নামের সঙ্গে জড়িয়েছে তোর জীবন, এবার ভালো থাক বা শাস্তিতে; আমাকে এড়িয়ে চলার সাধ্য তোর নেই। সে সুযোগ ইরাজ তোকে কোনদিন দেবে না।ʼʼ

“তবে কী প্রতি মুহূর্তে আপনি এভাবে শাস্তি দেবেন আমায়, আর আমি সয়ে যাব?ʼʼ

ইরাজ আস্তে করে সামান্য ঝুঁকে মেঘালয়ার কাধ অবধি মুখ নামিয়ে নিয়ে এলো। মেঘালয়ার ঘাঁড়ে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা চুলের মাঝে নাক ঘষে নিভু স্বরে বলল, “আমি যদি শাস্তি দেই, তোকে অবশ্যই সইতে হবে। এবং সয়ে এখানেই থাকতে হবে।ʼʼ

মেঘালয়ার কানে কথাটা পৌঁছেছে কি-না কে জানে! সে বরং বিষ্ময় ও আড়ষ্টতায় একাকার হয়ে টান হয়ে দাঁড়াল। শিউরে উঠল পুরো শরীর। আস্তে করে কেবল বলল, “থাকব না আপনার সাথে। থাকুন আপনি আপনার..

কথা শেষ করতে দিল না ইরাজ। ঘাঁড় থেকে মুখ তুলে বড়ো দুহাতের আজলায় মেঘালয়ার ব্যথিত মুখটা তুলে নিল। হাতের কাটায় ছোঁয়া লাগাতে নাক কুঁচকে ফেলল। সেই হাতটা আলতো করে শাড়ির ফাঁক গলিয়ে কোমড়ের দিকে পেটে রাখল। মেঘালয়া চোখ জোড়া চেপে বুজে নেয়। ভারী শ্বাস ওঠা-নামা করে বুকে। ইরাজ ওভাবেই বামহাতের তর্জনী আঙুল চেপে ধরল মেঘালয়ার ঠোঁটে। নিমেষেই মিইয়ে যায় মেঘালয়া। ইরাজ আবারও বলে উঠল, “বিছানায় যাবি, নাকি তুলে নিয়ে যাব?ʼʼ

মেঘালয়ার কিছু বলতে চায়। ইরাজ আরও খানিকটা চেপে ধরল আঙুলটা। দাঁত চেপে মৃদূ আওয়াজে বলল, “চুপ! তোর পুরুষ মনে হয় না, আমাকে? তুই শাড়ি পরে ঢং করে ঘুরে বেড়াবি আমার সামনে, গালে তুলে খাইয়ে দিবি পাশে বসে, আবার দরদ দেখাতে আসবি.. আমি কী নিজের মস্তিষ্ককে বেধে রাখব দড়ি দিয়ে? কে বলেছিল শাড়ি পরতে তোকে? বেসামাল হয়ে গেছি, এবার সামলা আমায়! নাকি এ দ্বায়ভার আর কারও ওপর চাপাব?ʼʼ

মেঘালয়া কথাটা বুঝতে পেরে নাক ছিটকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বিরবির করে বলে ওঠে, “ছিহঃ অশ্লীল!ʼʼ

ইরাজের মুখে দুষ্ট হাসি ফুটে ওঠে। ওভাবেই পেছাতে পেছাতে নিয়ে গিয়ে মেঘালয়াকে বিছানার সঙ্গে ঠেকাল। মেঘালয়ার চোখে-মুখে ভীতি। বাঁধা দিতে গিয়ে, তবুও বাঁধা দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে ইরাজ যে কথা বলেছে, তাতে কোন স্ত্রী-ই হাজার ভয় বা কষ্ট হলেও নিজের স্বামীকে বাঁধা দেবে না!

মেঘালয়া বিছানাতে অর্ধশোয়া। ইরাজ মেঘালয়ার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, “যেকোন ভাবে যখন বউ হয়েছিস! আমি অস্থির হলে শান্ত করার দায়িত্বটুকু তো তোকেই নিতে হবে। গেট রেডি!ʼʼ

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২২.

বেলা নয়টার এলার্ম সেট করেছিল ইরাজ। এলার্ম বাজতেই মুখটা বিকৃত করে বাজে ভাষায় বকে উঠল। দ্রুত এলার্ম অফ করে দিল। তখনই নজরে এলো তার বুকের কাছে মাথা রেখে বাচ্ছা মেয়ের মতো ঘুমিয়ে আছে মেঘালয়া। অপলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ মেঘালয়ার ঘুমন্ত চেহারার দিকে। রাতে কেঁদেছিল মেয়েটা। জিদ, অভিমান, ছটফটানি; কোনকিছুতেই বাঁধা দিতে পারেনি ইরাজকে। ওভাবেই কাঁদতে কাঁদতে শেষ রাতের দিকে ইরাজের ধমকে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গতকাল রাতের ঘটনা ভেবে মিশ্র এক অনুভূতি ভিড় করল ইরাজের মাঝে। হঠাৎ মাথায় এলো, সে বোধহয় আবারও এই মেয়েটির ওপর পিছলে যাচ্ছে। যাচ্ছে বলতে গেছে! মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে ভিতরে এক অদম্য টান অনুভব করল। এই মেয়েতে সে তার জীবন-যৌবনের শুরুতে মজেছে। আর কোনদিন অন্য পথে চলতে সাহস পায়নি। যে অমানিশার এক রাতে মেয়েটিকে ত্যাগ করেছিল সে, সেই মেয়েটির সঙ্গেই হালাল সম্পর্কে কয়েক অমানিশা কেটে গেল। কাল কিনা আসলেই নিজের করে পেয়েছে! আন্দোলিত হয়ে উঠল ইরাজ। তার হাতটা এখনও মেঘালয়ার ছোট্ট শরীরটা জড়িয়ে ধরে আছে। চেয়ে থাকতে থাকতে আচমকাই মেঘালয়ার ঠোঁটের কিনারায় আলতো এক চুমু খেল।

আস্তে করে চাদর সরিয়ে উঠে যেতে চাইলেও পারল না। মেঘালয়া নড়েচড়ে উঠল, শেষমেষ চোখ খুলে তাকাল। ইরাজকে ওমন লোভী নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল অভিমানে। ইরাজ তা দেখে সামান্য হাসল। মেঘালয়ার মুখে স্পষ্ট অভিমান। সেদিকে তাকিয়ে উঠে বাথরুমের দিকে চলে গেল ইরাজ।

মেঘালয়া উঠে আধশোয়া হয়ে বসল। চুপ করে বসে রইল মুখটা কঠিন করে। তার মনে বহু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। ইরাজের আচরণ অদ্ভুত, বরাবরই অদ্ভুত! এই ভালো তো, আবার খারাপ!

কিছুক্ষণ পর ইরাজ বের হলো একেবারে গোসল করে। সে এত সকালে সচরাচর ঘুম থেকে জাগে না, তবে আজ জরুরী কাজে অগত্যা জাগতে হয়েছে। ভেজা চুলে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। আয়নাতে দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ার গোমরা মুখটা। তোয়ালেটা ঘাঁড়ে ঝুলিয়ে মেঘালয়ার পাশে এসে বসল। মুখটা শুকনো লাগছে মেয়েটার। ইরাজের ভেতরে কোথাও একটা অনুতাপ কাজ করল যেন। সামনে বসে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল মেঘালয়ার নত মুখের দিকে।

নত করে রাখা মাথাটা দু আঙুলে উঁচু করে উপরে তুলে ধরল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?ʼʼ

উত্তর দিল না মেঘালয়া। গা’টা শিউরে উঠল মেঘালয়ার। হয়ত মেঘালয়া ইরাজের স্পর্শকে ভয় পাচ্ছে! মেঘালয়া হয়ত ইরাজের সংস্পর্শে আতঙ্কিত! তা ভাবতেই ইরাজ নিজের হাতটা সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল। একটু সরে বসল সন্তর্পণে। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে ভীষন। এভাবে যখন এতদিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, তাহলে কাল রাতে ওভাবে অধিকার আদায় করতে যাওয়াটা বড্ড ঘৃন্য লাগল ইরাজের আছে। তার মাঝে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আর ত্যাগী মানসিকতা রয়েছে। তবে আজ এমন কাজ করে ফেলার মানে কী? নিজেকে কষে কয়েকটা বিশ্রী গালি দিল মনে মনে। সে কোনদিন নিজের জন্য মেঘালয়ার চোখে এমন আড়ষ্টতা আর ভীতি দেখতে চায়নি। বিধায়, মেঘালয়াকে কোনদিন বুঝতে দিয়েছিল না নিজের সেই গাঢ় অনুভূতির কথা। লজ্জিত লাগল নিজেকে বড্ড! মুখটা ভারী করে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে বলবি তো?ʼʼ

জোরে শ্বাস নিয়ে আবার শান্তভাবে বলল, “কাল খুব খারাপ কিছু করে ফেলেছি? মেঘ! আব.. আমি সরি। দেখ কাল একটু রেগে গিয়েছিলাম, হয়ত একটু রুড আচরণ করে ফেলেছি..ʼʼ

মেঘালয়া মাথা তুলে তাকাল। তার চোখে ছলছল পানি। ইরাজ অস্থির হয়ে উঠল এবার, “বাড়ি যেতে চাস? আচ্ছা, আচ্ছা আমি দিয়ে আসব। তোর থাকতে হবে না আমার সঙ্গে। কান্না থামা, ফ্রেস হ। তুই যা চাস তাই হবে। প্লিজ কাদিস না.. শোন.. দেখ..

মেঘালয়া এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। ইরাজ হতভম্ব হয়ে যায়। গতরাতে বাড়ি যেতে চেয়েছিল মেয়েটা, সে জোর করে ধরে রেখেছে। ইরাজের ধারণা— এ থেকেই অভিমান জমেছে হয়ত। ইরাজের কথা শেষ করতে দিল না, হঠাৎ-ই মেঘালয়া বিক্ষিপ্ত ঢেউয়ের মতো লুটিয়ে পড়ল ইরাজের বুকে। ইরাজ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল এতে। থমকানো এক ঢোক গিলল। আবেশে চোখটা বুজে ফেলল আস্তে করে। মেঘালয়া ফুঁপিয়ে কাঁদছে ইরাজকে জড়িয়ে ধরে। ওর মাথাটা ইরাজের কাধের কাছে বুকের ওপরে ঠেকে আছে। ইরাজকে অবাক করে দিয়ে আরও ঠেসে জড়িয়ে ধরল এবার। যেন ইরাজের বুকের মাঝে ঢুকে যেতে চায় মেয়েটা। অস্থির চিত্তে ইরাজের পিঠ খামচে ধরল। যতটা পারছে ইরাজকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে মেঘালয়া। তার এই অশান্ত আচরণ যেন বলে যায়— কোথায় যাব আমি? আমি তো থাকতে চাই, এই বুকে, এই দেহের সংস্পর্শে, এই দেহের মালিককে কেন্দ্র করে বাঁচতে চাই এক জনম।

হাতদুটো ইরাজের বাহুর নিচ থেকে বের করে এবার ইরাজের গলাটা জড়িয়ে ধরল মেঘালয়া। মাথাটা ইরাজের কাধে চেপে ধরল। বাঁধভাঙা নদীর মতো শান্ত হয়ে উঠেছে মেঘালয়া।

ইরাজ যেন থেমে গেছে মেঘালয়ার আচরণে। তার ভেতরে তোলপাড় চলছে, মেঘালয়ার এই অস্থিরতা তাকেও এলোমেলো করে ফেলল মুহূর্তে। মেঘালয়ার কান্নাজড়িত অভিযোগ ভেসে এলো, “কোথায় যাব আমি? কার কাছে যাব? আব্বু আপনার ভরসায় এখানে পাঠিয়ে দিল। আপনি আব্বুর কাছে রেখে আসতে চাইছেন। আমি খুব ভারী বোঝা হয়ে গেছি সকলের কাছে? কেউ বইতে চাইছে না আমায়! আমার জন্য জায়গা হয়না কারও কাছে? কাল সারারাত রেখে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল আমাকে নিজের কাছে? এখন চাহিদা মিটেছে, আমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছি? কাল কেন ধরে রাখলেন! বিয়ের পর স্বামীর ঘর নাকি মেয়েদের আপন হয়, আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। তাহলে..

আর বলতে পারল না মেঘালয়া। আবারও ডুকরে উঠল। জন্মের বেপরোয়া আর ছন্নছাড়া ইরাজের আজ হাতটা কেঁপে উঠল মেঘালয়ার মাথায় হাত রাখতে। বুকের মাঝে শীতল ঢেউ তাণ্ডব শুরু করেছে যেন! কাঁপা হাতে আস্তে করে মেঘালয়াকে জড়িয়ে নিলো দু’হাতে। যেন জনমানব শূন্য পানি বাতাসহীন এলাকায় আটকে যাওয়া কোন পথিক তার হাজারো ছটফটানির শেষে এবার পথ খুঁজে পেয়েছে। পিপাসায় মৃতপ্রায় ব্যাক্তি গভীর অরণ্যে এক ছোট্ট ঝিরি ঝরনার সন্ধান পেয়েছে। ইরাজের ভিতরটাও ঠিক এমনই আকুল হয়ে উঠল মেঘালয়ার আচরণ ও স্বীকারক্তিতে।

শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলল বুকে লেপ্টে থাকা মেয়েটাকে। জলন্ত ইটের ভাটায় যেন আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো এক টকরো মেঘ ভেঙে বর্ষা নেমে এলো ইরাজের বুকে। ইরাজের এতদিনের খাঁ খাঁ মরুময় তপ্ত বুকটা সজীব হয়ে উঠল মুহুর্তেই। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের বহু সাধনা ও বুকের তিক্ত যন্ত্রণায় কেনা মেঘকে।

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১৯

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৯.

সপ্তাখানেক কেটে গেছে। এর মাঝে মেঘালয়ার ভেতরে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন এসেছে। মাঝেমধ্যে তাকে দেখতে টুকটাক খুশি লাগে, আবার বসে যায় মগ্ন হয়ে কিছু ভাবতে।

ইরাজের কিছু কাজ পড়েছে রাজশাহীতে। সে কাল সকাল সকাল রওনা হয়ে যাবে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। বারান্দার সিঙ্গেল সোফাটির ওপর বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কিছু কাজে ব্যস্ত সে। মেঘালয়া এই রাত করে রুমের সাফ সাফাইয়ের কাজে লেগেছে। বিছানাটা পরিপাটি করে গুছিয়ে সোফার এলোমেলো কুশন গুলো ঠিক করে রাখতে শুরু করল। সে সময় দরজায় টোকা পড়ল। মেঘালয়া তাকাল সেদিকে। এ রুমে তো কেউ আসে না। আনতারা খানম তো মোটেই না, তাহলে কি বাবাই এসেছে? দ্রুত গলা উঁচিয়ে বলে উঠল, “আরে নব ঘুরিয়ে ঢুকে পড়ো। আবার অনুমতি চাইছো?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়ার কথায় হাসলেন। এসে বসলেন বিছানার ওপরে। মেঘালয়া এগিয়ে গিয়ে পাশে বসতে বসতে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে বাবাই? গরীবের বাড়ি হাতির কদম পড়ল যে!ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব শব্দ করে হাসলেন এবার। বললেন, “তাহলে তুই গরীব, আর আমি হাতি?ʼʼ

“আমি গরীব ঠিক আছে, তবে তুমি হাতি নও।ʼʼ

“তবে বললি যে!ʼʼ

“আরে কথার কথা ছিল। এখন বলো কী ব্যাপার?ʼʼ

“ব্যাপার তো সাংঘাতিক রে!ʼʼ

“বাবাই, শুধু শুধু সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে জলদি বলো কি হয়েছে।ʼʼ

“তুই, কাল ইরাজের সঙ্গে যাচ্ছিস।ʼʼ

“বাবাই, তোমার প্রেসার বেড়েছে নাকি? একটু পানি ঢালব মাথায়?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, “আমার প্রেসার লো।ʼʼ

“তুমি তোমার ওই ঘাঁড় ত্যাড়া ছেলের সাথে আমায় যেতে বলছো? রাস্তায় মেরে গুম করে দিয়ে, এসে বলবে, আমি হারিয়ে গেছি।ʼʼ

“কিছুই বলবে না। তুই তৈরী থাকবি।ʼʼ

“না বাবাই, তুমি অন্য যেকোন কিছু বলো মেনে নিচ্ছি। এটা বাদ।ʼʼ

“সব বাদে এটা।ʼʼ বলেই উঠে দাঁড়ালেন ইমতিয়াজ সাহেব।

মেঘালয়াও দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি দিন দিন নাছোড়বান্দা হয়ে যাচ্ছ, বাবাই!ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব সামনে এগোতে এগোতে বললেন, “আগেও ছিলাম।ʼʼ মেঘালয়াকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন এক প্রকার পালিয়ে। মেঘালয়ার যে যাওয়ার মত নেই তা না। সে আগে পরেই ভ্রমন প্রিয়। তবে সমস্যা হলো, যার সাথে যাবে তাকে নিয়ে। সে তো একটা, রাক্ষস!


সকালে ইরাজকে ডেকে তুললেন ইমতিয়াজ সাহেব। মেঘালয়া তখন গোসল নিচ্ছে বাথরুমে। ইরাজ জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে, ড্যাড! তুমি এখানে কেন?ʼʼ

“মুখ সামলে কথা বল, রাজ! বাড়ি আমার, তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস আমি এখানে কেন?ʼʼ

বাবার কথায় যে রস ছিল তা বুঝতে ভুল হয়না ইরাজের। ভ্রু কুঁচকে বলল, “মনে রঙ লেগেছে নাকি তোমার, ড্যাড!ʼʼ

“এই এসব ড্যাড, ফ্যাড ডাকবি না তো। যতসব ঢং। আমাদের বাপদের আমরা ‘আব্বাʼ বলে ডাকতাম।ʼʼ

ইরাজ চোখ উল্টে, হা করে নিঃশ্বাস নিলো। বলল, “বলো কী সমস্যা?ʼʼ

“মেঘালয়া যাবে তোর সাথে?ʼʼ

“আব্বু! তোমার শরীর খারাপ নাকি?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মুখ থমথমে করে বললেন, “এমনিতে তো দেখছি দুজনের মিল ভালো। অথচ বাস্তবে নেই কেন?ʼʼ

তারপর বুঝানোর মতো বললেন, “দেখ, মেয়েটা রেজাল্ট নিয়ে এখনও বিষন্ন। তোর তো অল্প কিছুক্ষণের কাজ। সঙ্গে গেলে একটু ঘুরে আসলে, মন ভালো থাকবে। হেলালের আমানত মেঘা। আমাদের তো দায়িত্ব ওকে ভালো রাখা।ʼʼ

ইরাজ উঠে দাঁড়াল। বলল, “সকাল সকাল নীতির বাণী না শুনিয়ে, নিজের কাজে মনোযোগ দাও তো, ড্যাড। আহা কী জ্ঞানের কথা! যেন আমরা কেঁদে-কেটে আমানতটা কোলে করে তুলে এনেছি!ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব কপট রাগী মুখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। এ কি ছেলে তিনি পয়দা করেছেন!


ইরাজ বসার রুমে বসে বিশ মিনিটের মতো অপেক্ষারত। মেঘালয়া তৈরী হচ্ছে। ইমতিয়াজ সাহেব নরম কথায় ভিজিয়ে বসিয়ে রেখেছেন ইরাজকে।

প্রায় আধাঘন্টার মাথায় নেমে আসল মেঘালয়া। ইরাজের চোখ সিঁড়িতে যেতেই দৃষ্টি থেমে গেল সেদিকে। ভ্রুটা সামান্য কুঞ্চিত করে চেয়ে রইল। মেঘালয়া মেজান্টা ও আকাশী রঙের মিশ্রণে সাজানো একটি জামদানী কাতান শাড়ি পড়ে নেমে এসে দাঁড়াল নিচে। মাথাটা ঝুঁকিয়ে শাড়ির কুচি ধরে নেমেছে সিঁড়ি দিয়ে। নিচে নেমে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে চাইল। ইমতিয়াজ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনে আওড়ালেন, “মাশা-আল্লাহ!ʼʼ

ইরাজের ভ্রুর সাথে সাথে এবার কপাল জড়িয়ে এলো। বেশ ভালোই মেকাআপ করেছে মেঘালয়া। খুব বেশি না হলেও, কমও বলা যায় না! মাঝারী চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দেওয়া। মেঘালয়ার চুলগুলো সামান্য কুঁকড়ানো। তা খুব একটা সেভাবে যেহেতু বোঝা যায় না— দেখতে খুব আকর্ষনীয় লাগে। থ্রি কোয়ার্টার হাতার মেজেন্টা রঙা ব্লাউজের ওপর আকাশী শাড়ির আচল পড়ে আছে। হালকা গহনা, সাথে টুকটাক সাজ। খুব স্নিগ্ধ লাগছে মেঘালয়াকে দেখতে। ওকে দেখে ইরাজ আর নজর ফেরায় নি। বুকের ভেতরে কোথাও একটা লাফালাফি লক্ষ্য করছে সে। আজ মেঘালয়াকে একদম তার পরিচিত ছোট্রো কিশোরী লাগছে না। যুবতী নারী, শাড়িতে! পুরুষ টিকবে কী করে! ইরাজ মেঘালয়াকে আজ যেন প্রথমবার এমনকি বাবার সম্মুখে দাড়িয়ে এভাবে খুঁতিয়ে দেখল। আচমকা নজর আটকা পড়ল মেঘালয়ার বুকের ওপরে ফর্সা গলায়। সেখানে চিকন এক পেন্ডেন্ট ঝুলছে। শাড়ির আচল গিয়েছে গলার খানিক নিচের অংশকে পেচিয়ে। কি যেন হয়ে গেল ইরাজের। দ্রুত চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। এলোমেলো চোখে তাকাল চারদিকে।

মেঘালয়া বরাবরই একটু সাজগোজের দিকে আগ্রহী ছিল। যেটা ইরাজের জন্য করতে পারত না আগেও। স্কুলের ফাংশন অথবা কোথাও যাওয়ার সময়েও ইরাজের কটুক্তির ভয়ে সাজতে পারত না মেঘালয়া। আজও সেই ইরাজই তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ ইরাজের অবশ্য তার প্রতি আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবুও ইরাজই তো!

ইরাজ মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে দাড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, “আমার সুন্নতে খৎনার অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস? এমন মূর্তি সেজেছিস কেন!ʼʼ

এমন একটা কথায় মেঘালয়া খিঁচে চোখ বুজে ফেলল। ইমতিয়াজ সাহেব জিহ্বা কামড়ে ধরলেন। এই ছেলের কী কোনদিন মতিগতি ভালো হবে না! মেঘালয়া কিছু সময় পর চোখ তুলে ইমতিয়াজ সাহেবের দিকে করুণ মুখে তাকাল। তিনি ঘাড় নাড়িয়ে আশ্বাস দিলেন। ইরাজ ভারী পায়ে বেরিয়ে গেল বাইরের দিকে।

মনে মনে আওড়াল, আমি যেভাবে আটকে গেছিলাম, রাস্তার লোকজনও সেভাবেই দেখবে! ভাবনাটা মাথায় আসতেই আবারও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওভাবেই গিয়ে গাড়িতে বসল।

মেঘালয়ার ইমতিয়াজ সাহেবের কাছে এসে মুখ ফুলিয়ে বলল, “এই ক্যাকটাসের সাথে তুমি আমায় পাঠাচ্ছ, বাবাই! আল্লাহ জানে আজ ঘটে কী আছে?ʼʼ

ওভাবেই গটগটে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যেতে যেতে কপট ক্ষোভ ঝারল, “ছোটো বেলা থেকে জালাচ্ছে। কোন কিছুতেই শান্তি দিল না!ʼʼ

আনতারা খানম ইচ্ছে করে রান্নাঘরে বসে ছিলেন এতক্ষণ। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নির্বাক চেয়ে রইলেন মেঘালয়া হেঁটে অগ্রসর হওয়ার দিকে।

গাড়িতে মৃদূমন্দ বাতাসে মেঘালয়ার ঝিম ধরে যায়। চোখটা বুজে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে। ইরাজ ড্রাইভ করতে করতে মেঘালয়ার কোন সারা শব্দ না পেয়ে একবার তাকাল।

আবারও সেই এলোমেলো অনুভূতি। আটকে গেল মেঘালয়া গলায়। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দেওয়া মেঘালয়া। বড্ড আদুরে লাগছে মেঘালয়াকে দেখতে। তড়াক করে নজর সরিয়ে সামনে তাকাল ইরাজ! স্টিয়ারিং থেকে এক হাত সরিয়ে হা করে হাতটা মুখে চেপে ধরে ঘাম মোছার মতো করে নাড়ল। জোরে জোরে শ্বাস নিলো ইরাজ। এই অনুভূতির সাথে ইরাজ কোনদিন আবারও পরিচিত হতে চায়নি। এখনও চাইছে না। তবে মস্তিষ্ক যেন এর ঘোর বিরোধে নেমেছে। এতদিন মেঘালয়াকে দেখেছে, এক ঘরে থেকেছে। তবে কোনদিন মেঘালয়ার প্রতি এমন অনুভূতিদের সারা পায়নি সে। বরং মেঘালয়াকে দেখলেই বুকের ব্যথারা নড়ে চড়ে উঠত। আজ অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করল ইরাজ নিজের মাঝে! যা সে বুঝেও বুঝতে চায় না, অনুভব করেও চায় সে অনুভূতিকে মিথ্যা প্রমান করতে।


নদীর ঘোলাটে পানি, বালিময় সেই নদীর তীর। আশেপাশে লোকজনের সমাগম যথেষ্ট। বিকেলের কয়েক দণ্ড পেরিয়েছে। সূর্য সেই নদীর দিগন্তেই যেন নিজেকে নদীর পানির আড়ালে লুকোতে ব্যস্ত।

মেঘালয়া গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। রাজশাহী জেলার পদ্মার পাড়। ইরাজের কাজ শেষ হয়েছে পাঁচ মিনিটে। এক ক্লাইন্টের সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপারটা মেটাতে এসেছিল ইরাজ। মেঘালয়া ভেবেছিল এবার হয়ত ফিরে যাওয়ার পালা। রাস্তাঘাট তো তার চেনা নয়। একসময় ইরাজ এসে গাড়ি থামাল এই নদীর পাড়ে। মেঘালয়া সব ভুলে অভিভূত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল নদীর পানিতে চিকচিক করা অস্তমিত সূর্যরশ্মির দিকে। প্রতিটি ঢেউয়ে ঢেউয়ে সূর্যের আলো, স্রোতের বাঁকে বাঁকে কমলা-লাল প্রভা।

আস্তে আস্তে হেঁটে সে পানির দিকে এগিয়ে যায়। উঁচু হিলের চোখা প্রান্তটি বালুর মাঝে গেঁড়ে যাচ্ছে, হাঁটার তালে আবার উঠে আসছে। দারুন উপভোগ্য লাগছে ব্যাপারটা মেঘালয়ার কাছে। নদীর দিক থেকে তেড়ে আসা বাতাস মেঘালয়ার লম্বা শাড়ির আচল পতাকার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। সাথে চুলের বেপরোয়া জ্বালাতনকেও এই মুহূর্তে মেঘালয়া চরম উপভোগ করছে।

নদীর এই অসামান্য রূপ দেখে, নদীকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় ওর, ‘তুমি এত স্নিগ্ধ আর সুন্দর কেন? তোমার কী কোন বিষাদ নেই? তোমার যে কোন বাঁধা নেই! এত রুপ, এত মাধুর্য আর প্রবাহমান জলরাশির অহংকারে নিশ্চয়ই তুমি সর্বদিকে সমৃদ্ধ! একটু ধুয়ে দেবে আমার আমার বিষাদগুলো, তোমার বুকে খেলে বেড়ানো ওই টলমলে জলে?ʼ

আচমকা নিজের পাশটা ফাঁকা লাগল। বেরিয়ে এলো চট করে নদীর মুগ্ধতা থেকে। হন্য হয়ে চারদিকে তাকাতেই দেখল পেছন থেকে ইরাজ হেলেদুলে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। হাতের দিকে তাকিয়ে মেঘালয়া বিষ্মিত চোখে চেয়ে রয়। ততক্ষণে ইরাজ এসে কাছে দাঁড়াল। মেঘালয়া একদৃষ্টে চেয়ে আছে ইরাজের হাতে থাকা আকাশী আর গোলাপি রঙা রেশমী চুড়ির দিকে।

ইরাজ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “হাত এগিয়ে দে।ʼʼ

মেঘালয়া ঠিক ঠাহর করতে পারেনি কথাটা। সে বিষ্ময় কাটাতে ব্যস্ত। ইরাজ হুট করে মেঘালয়ার বাঁ হাত চেপে ধরে নিজের দিকে আনল। বাঁ হাতের ওপর শাড়ির আঁচল মেলে আছে। তা খানিকটা তুলে, দু রঙের চুড়িগুলো খুব যত্নে রঙ মিলিয়ে সাজাতে থাকল। মেঘালয়ার বিষ্ময় কাটার বদলে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে এবার। চুড়িগুলো মেলাতে মেলাতে গম্ভীর স্বরে বলল ইরাজ, “শাড়ি পড়েছিস গায়ে, আর হাতটা বিধবা বানিয়ে রেখেছিস?ʼʼ

এরকম একটা কথাও কেউ এমন ভারী কণ্ঠে বলে! তবুও শুনতে অদ্ভুত লাগল মেঘালয়ার। একটু মুখ বিকৃত করে উঠল। মুখে অস্পষ্ট স্বরে একটু আর্তনাদ করে উঠল। চুড়িগুলো হাতে পরিয়ে দিল ইরাজ। চুড়ির মাপ পারফেক্ট, যে জন্য হাতে ঢুকাতে গিয়ে একটু ব্যথা পেয়েছে মেঘালয়া।

ইরাজ বলল, “তোর শাড়ির এই রঙটা কী? একটু গাঢ় বেশি। এমন রঙা চুড়ি পেলাম না। এই হালকা গোলাপিটাই ছিল।ʼʼ

মেঘালয়া অস্পষ্ট উচ্চারণ করে, “মেজান্টা!ʼʼ এরপর আনমনে হাত ঝাঁকিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে দুর্বোধ্য মিটিমিটি হাসি। অতিরিক্তই সুন্দর বলে মনে হলো চুড়িগুলো! আসলেই চুড়ি সুন্দর, নাকি চুড়িগুলোর পাওয়ার অনুভূতিটা জটিলতম সুন্দর! মেঘালয়া জানে না! ইরাজ ওকে ছেড়ে ততক্ষণে নদীর কিনারায় গিয়ে হাত পকেটে গুজে দাঁড়িয়েছে। তখনই চোখে পড়ল মেঘালয়ার, একটি ছোট্রো ছেলে চুড়ি ভর্তি আলনা নিয়ে এদিক সেদিক নদীর পাড়েই ঘুরছে। তার চোখে পড়েনি আগে। তবে ইরাজ দেখল কখন? আর কিনতেই বা গেল কখন!

মেঘালয়া সেদিক থেকে নজর ঘুরিয়ে ইরাজের দিকে তাকায়। পেছন থেকে দেখল টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নজর নিবদ্ধ নদীর শেষে ওই দিগন্তের ধোঁয়াশায়। চোখ কুঁচকে নিচের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে ফেলল। আবার সামলে নিলো নিজেকে। ইরাজের পাশে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়াল।

কিছুক্ষণ পর ইরাজ নদীর বুকে নজর আটকে, হঠাৎ মুখ খুলল। অদ্ভুত অভিব্যাক্তিতে স্বগতক্তি করল, “বুঝলি মেঘ! জীবনটা এই প্রবাহমান নদীর মতো। যে স্রোত হারিয়ে যায় নদীর ধারাবাহিকতায়, তা ফিরে আসে না আর! নদী সেই শূন্যতার হাহাকারে আবারও ফুলে ফেঁপে ওঠে। তর্জন গর্জন করে দু কূল ভাসায়। নদীর এই আর্তনাদকে লোক সাধারণত জলোচ্ছাসের নাম দেয়।ʼʼ

মেঘালয়া চমকে ওঠে। সে না কিছুক্ষণ আগে নদীকে সর্বোচ্চ সুখী আর সুন্দর বলে গেল! এই স্নিগ্ধ নদীরও হাহাকার আছে! সেই পানিতে তার সমস্ত বিষাদ ধুয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে নদীকে মেঘালয়া। নদীর টলমলে পানির দিকে আবিষ্ট নজরে চেয়ে নেশাগ্রস্থের মতো জিজ্ঞেস করল, “আর যে স্রোতগুলো নদীর মাঝে, নদীর বুকে থেকে যায়, তারা কী নদীর আপন?ʼʼ

ইরাজ হাসল মনেহয় একটু! মেঘালয়া নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে মৃদূমন্দ ঢেউ এসে কিছু কিছু বালু ধুয়ে নিয়ে মিশিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্যে।

“আপন বলতে কী বুঝিস তুই?ʼʼ

মেঘালয়া মৃদূ হেসে জবাব দিল, “বুঝিনা।ʼʼ

ইরাজও একই ভাবে বলে, “আমিও।ʼʼ

সন্ধ্যা নামবে প্রকৃতিতে খুব শীঘ্রই। ইরাজ মেঘালয়াকে তাড়া দিল, “চল হাঁটি।ʼʼ

মেঘালয়া ইরাজের আগে হাঁটছে। শাড়ির আঁচল বড়ো হওয়ায় তা মাটি ছুঁয়ে মেঘালয়ার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে ইরাজ কপাল কুঁচকে, চট করে আঁচলটা হাতে তুলে নিলো।

আকাশী রঙা শাড়িতে শোভা পাচ্ছে এক যুবতী, সে হাঁটছে সম্মুখে, তার পেছনে তারই শাড়ির আঁচল তুলে ধরে এগিয়ে চলেছে বিরক্তিতে বুদ হয়ে ওঠা এক পুরুষ। এ দৃশ্য মনে হয় সেখানে উপস্থিত সকলেই বেশ আগ্রহের সঙ্গে উপভোগ করল। ইরাজ ধমকে উঠল, “নদীর পাড় ঝাড়ু দেওয়ার টেন্ডার নিয়েছিস? শাড়ির আঁচল ঠিক রাখতে পারিস না, শাড়ি পড়তে বলেছিল কে?ʼʼ

মেঘালয়া ছোটো ছোটো চোখ করে পেছনে ফিরে আঁচলটা নিলো ইরাজের হাত থেকে। মুখে ভেঙচি কাটল গোপনে।

মাগরিবের আজানের পর সন্ধ্যার চাদরে ঢাকা পড়া নদীর কিনারা যেন সেজে উঠল আরেক রূপে। মেঘালয়া ফুসকা, ঝালমুড়ি, কুলফি মালাই, এরকম বহুকিছু খাওয়ার পরে খেল আবার কামরাঙা মাখা। তাতে ঠোঁট মুখ লাল করে ফেলেছে ঝালে। খাওয়ার সময় ঝাল লেগেছিল বটে, তবে তাতে পরোয়া করার সময় কোথায় মেঘালয়ার। ইরাজ শুধু ভ্রু কুঁচকে দেখছে তা। শেষে খাওয়া থামানোর পর সব ঝাল এসে হানা দিল যেন এবার। মেঘালয়া ঘেমে উঠেছে। ছটফট করতে করতে ইরাজকে বলল, “পানি এনে দিন, পানি খাব। মুখ জ্বলে যাচ্ছে।ʼʼ

ইরাজ এবার বেশ আরাম করে বসল চেয়ারে হেলান দিয়ে। রিল্যাক্স মুডে আছে সে খুব মেঘালয়ার হাল দেখ। সেভাবেই বলল, “মুখ না জ্বললে এনে দিতাম। একটু উপভোগ কর ঝালটা।ʼʼ

মেঘালয়া কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল, “ক্যাকটাস! দিন টাকা দিন, আমি কিনে আনছি পানি।ʼʼ

ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে ধরে, “হুমম! টাকা আমি দেব, পানি কিনে আনবি তুই? তুই টাকা দে, পানি আমি কিনে আনছি।ʼʼ

মেঘালয়ার ঠোঁট জ্বলছে, ঠিকমতো ঝগড়াটা করতে পারছে না ঠিক। তবুও নাক ফুলিয়ে,গম্ভীর মুখে বলল, “আচ্ছা! তো আপনার মানিব্যাগ ফাঁকা? জেনে কষ্ট হলো। আগে বলবেন তো! একটু কম খেতাম।ʼʼ

ইরাজ চোখটা চারদিকে ঘুরিয়ে আবার দৃষ্টিপাত করল মেঘালয়ার দিকে। একটু এগিয়ে বসে মেঘালয়ার দিকে ঝুঁকে আস্তে করে শান্ত কণ্ঠে বলল, “এই পাবলিক প্লেসে থাপ্পড় খেলে কেমন লাগবে তোর?ʼʼ

মেঘালয়াও ইরাজের মতো করেই বলল, “সে এক মোহনীয় অনুভূতি!ʼʼ

এমন পরিস্থিতিতে এরকম একটা পাল্টি খাওয়া কথায় ইরাজ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। মুখটা গম্ভীর করে উঠে পড়ল চেয়ার থেকে।

মেঘালয়া নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। তারা অবশ্য এখনও কিছু বলে নি। মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এখানে সামনে এসে এভাবে দাঁড়ানোর কারন কি? ছেলেদুটোর মাঝে একজন জিজ্ঞেস করল, “একাই নাকি? কেউ আসেনি সাথে?ʼʼ

ইরাজ এসে পাশে দাঁড়াল। হাতে পানির বোতল। মেঘালয়ার অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইরাজের বাহু জাপটে ধরে, গা ঘেষে দাঁড়াল। যেন বিনা বাক্যে বুঝিয়ে দিল, ‘উহু, একা আসিনি। আমার ক্যাকটাস এসেছে আমার সঙ্গে!ʼ

ছেলেগুলো মেঘালয়ার বয়সেরই। এদিকে ইরাজ তো জলজ্যন্ত পুরুষ। সন্ধ্যার আধো আলোতে স্পষ্ট ইরাজের জলন্ত চোখ আর শীতল চেহারা খানা। দুজন আস্তে করে কেটে পড়ল। মেঘালয়া চেয়ে রইল সেদিকে। কয়েক মুহূর্ত পার হলে আচমকা নিজের দিকে খেয়াল যেতেই ঝাড়া দিয়ে হাত বের করে এনে দুরে ছিটকে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে ফেলল। সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হলো, মনে হলো মেঘালয়ার চেয়ে ইরাজ বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে ঘটনাটিতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে এদিক ওদিক অগোছালো দৃষ্টি ফেলছে। তড়িঘড়ি মেঘালয়ার হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

মেঘালয়া বোতল হাতে ধরে হঠাৎ-ই ভাবে, ইরাজ কী লজ্জা পেয়েছে! ছেলে মানুষের আবার এসব ছোটোখাটো বিষয়ে লজ্জা? তবে ইরাজ এমনই। সে জানে, আগেও ইরাজ কোনদিন তার দিকে আকর্ষন অনুভব করেছে, এমন কিছু তার আচরণে প্রকাশ পায়নি। ইরাজের মুখের সেই অপ্রস্তুত ভাব মনে পড়তেই মাথাটা নত করে নিয়ে ফিক করে ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল মেঘালয়া। কপালে হাত ঠেকিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেলল।

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১৮

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৮.

ইরাজ যেদিন মেঘালয়ার মুখে এমন অনীহার বাণী শুনেছিল, তাকে আর বেশি করে বোঝাতে হয়নি যে, মেঘালয়া তার প্রতি বিরক্ত। আর তাবির যে মেঘালয়াকে পুরোদমে ফাঁসিয়ে ফেলেছে; এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নেই। সেদিন ইরাজের ছটফটানি কেবল, ওই চাঁদহীন অমানিশায় ঢাকা খোলা আসমানের তারা’রা হয়ত নিরবে চেয়ে চেয়ে দেখেছিল। তারপর থেকে ইরাজ নিজেকে থামাতে সিগারেট অবধি থেমে থাকেনি। সব রকমের নেশায় ডুবিয়ে ফেলেছে নিজেকে। মাঝেমধ্যে নিজেকে শান্ত করতে, ড্রাগসের ব্যবহারও বাদ রাখেনি।

ছোটবেলা থেকে ইরাজ, মেঘালয়াকে বাবার বন্ধুর মেয়ে হিসেবেই দেখে এসেছে। তবে তাদের মাঝে বয়সের দুরত্বটা ছিল বেশ খানিকটা। যে কারনে মেঘালয়া যখন কেবল তার বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে, ইরাজ তখন একুশ বছরের তাগড়া যুবক। এখানে ইরাজের মাঝে এই অনুভূতিটা জাগার পেছনে দু পরিবারের অভিভাবকদের ভূমিকাও ছিল অল্প সল্প। হেলাল সাহেব ইরাজকে অতিমাত্রায় ভরসা করতেন। ছোটো থেকেই ইরাজ চরম বেপরোয়া স্বভাবের। আর এই স্বভাবটাই তাকে করেছিল সকলের কাছে অনন্য। তাকে কোনদিন সেচ্ছায় মেঘালয়ার আশেপাশে ঘেষতে দেখা যায়নি। যেন তার গায়ে চুলকানী হয়, এভাবে দূরত্ব বজায় রেখেছে সর্বক্ষণ। ইরাজের এই অনন্য স্বভাবের প্রতিই বোধহয়, হেলাল সাহেব গলে গেলেন। তিনি অবাধে মেঘালয়াকে ইরাজের ওপর ছেড়ে দিতেন। ইরাজ সেই ভরসার দাম রেখেছে সুদে আসলে। বরং তাকে ডেকেও পাওয়া যেত না মাঝেমধ্যে। যেন চরম বিরক্ত সে মেঘালয়াকে সঙ্গে নিয়ে চলতে। তবে চলতে চলতে, নিজের দায়িত্বের বাইরে কবে যে যূবক ইরাজের মনে মেঘালয়ার জন্য নরম অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল।

এখান থেকেই ওই কিশোরী মেঘালয়ার প্রতি আলাদা এক টান জন্মাতে শুরু করল, ইরাজের। এরপর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে জেলা ছাড়লেও, যখনই আসতো, মেঘালয়াকে শাসিয়ে রেখে যেতে ভুলত না। দিন দিন অভ্যাস এবং এই টানটা কবে যেন অধিকারবোধ, আর অধিকারবোধ থেকে ভালোবাসার মতো জটিল অনুভূতিতে পরিবর্তিত হয়ে গেল। তবুও ঘাঁড় ত্যাড়া ইরাজ মেঘালয়ার সম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করেনি কোনদিন। তার স্বভাব আচরণে পরিবর্তন আসেনি। সে যে খিটখিটে; সেই খিটখিটে মেজাজেরই রয়ে গেল।

এতে মেঘালয়ার সাথে তার সম্পর্কটা কখনও মধুর হয়ে ওঠেনি বরং শাসনের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এটা হয়ত মেঘালয়ার মনে হয়েছে বরাবর। কিন্ত ইরাজ যে মেঘালয়াকে সর্বদা জোর জবরদস্তিতে রেখেছে, এমন নয়। শুধু এই অসভ্য দুনিয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। মেঘালয়ার কোন ইচ্ছে সরাসরি পূরণ না করলেও, অপূর্ণ থাকতে দেয় নি। ইরাজের এই শাসনের পেছনের তীব্র অধিকারবোধকে আর আগলে রাখার ব্যাপারটি হয়ত মেঘালয়া কোনদিন ধরতে পারেনি!

সবশেষে বাজি! ইরাজের ওই সরল মেঘালয়ার প্রতি এতটাই বিশ্বাস ছিল, সে এত চতুর হয়েও এভাবে ভাবতে পারে নি যে, মেঘালয়া তাবিরকে সুযোগ দেবে তাকে নিয়ে খেলার। তা তো দিয়েছিল, তবুও ইরাজ মেঘালয়ার প্রতি নিজের দৃষ্টি সরায় নি, নিজের মতো করে প্রতিক্ষণে চেষ্টা করেছে মেঘালয়াকে আগলে রাখার। এতে তাবিরের বড়ো অসুবিধা হতো। সে মেঘালয়াকে যেভাবে চাইত, সেভাবে পরিচালনা করতে পারত না। তখনই তাকে নানান উষ্কানিমূলক কথা বলতে থাকে। কাজেও দিল তা। ইরাজ মেঘালয়ার অবহেলায় ঘৃনায় সরে আসল। সারাক্ষণ মনটা মেঘালয়ার কাছে পড়ে থাকলেও, দেহটাকে সে বেঁধে রেখেছিল নেশার দড়িতে। আনতারা খানম ছেলের অধঃপতন দেখেছেন কিছু কিছু। তবে তিনি আবিষ্কার করতে পারেন নি কারনটা। ইরাজকে বুঝতে পারা, সেও এক অভিযানই বটে!

যেদিন ইরাজের কাছে হেলাল সাহেবের অসহায় কল এলো, মেঘালয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না! সেদিন ইরাজ মেঘালয়াকে চিরতরে ত্যাগ করেছিল! তবে তার ত্যাগও বড়ো রহস্যময়। যাকে সে ঘৃনার সাথে ত্যাগ করল চিরতরে, কাটিয়ে ফেলল নাকি সব মায়া! তার জন্য ছুটতে তার এক মুহূর্ত ভাবতে হয়নি। শোনা মাত্র সে যশোর থেকে চট্রগ্রাম পাড়ি দিয়েছে। হুশে ছিল না এ খবর শোনার পর ইরাজ! ওই তাবির খারাপ কিছু করে না বসে মেঘালয়াকে নিয়ে। এই ভাবনাতে উন্মাদের মতো ছুটেছে সে সেদিন তার ত্যাগকৃত মেঘের রক্ষার্থে!

এই তার ত্যাগ! এই তার ঘৃনা!

দিনের পর দিন ইরাজ নিজেকে ধ্বংস করেছে, পুড়েছে, আঘাতে জর্জরিত হয়ে ডুবে থেকেছে রাতভর নেশায়। সকালে সূর্য উঠলে, দিনের আলোয় আবার ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়েছে, নিজের বেপরোয়া রূপে। তার রূপান্তর বড়ো জটিল। যার সত্যতা আবিষ্কার করা যায়নি কোনদিন।

এ সবটাই মেঘালয়ার কাছে অজানা ইতিহাসের পাতায় রচিত সত্য। যা তার বোকা মস্তিষ্ক কোনদিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। হয়েছে কি হয়নি কে জানে! হলেও হয়ত ইরাজ তা স্থায়ী হতে দেয় নি। কারন, তার আচরণ তো সেই বেপরোয়াই রয়ে গেছিল। কখনও কখনও যদি ইরাজের প্রতি খানিকটা মনোযোগ এসেছে মেঘালয়ার, তো পরক্ষণেই ইরাজের ত্যাড়ামির নিচে চাপা পড়েছে সেই মনোযোগটুক।

এতসবের পরেও ইরাজ বারবার চেয়েছে, মেঘালয়াকে এসব থেকে বের করে আনতে। কিন্ত, ওই যে অধিকার হারানোর যন্ত্রনা! যেখানে তাকে আগলে রাখার অধিকারটুকু মেঘালয়া নিজে কেঁড়ে নিয়েছে! সেখানে কোন মুখে সে গিয়ে আবার দাঁড়াবে মেঘালয়ার সম্মুখে! তাছাড়াও ইরাজ কখনও ভবনায় আনতে পারেনি, মেঘালয়ার পালানোর মতো এমন জঘন্য পদক্ষেপ নিয়ে নেবে। সে নিজেকে বারবার প্রস্তত করত, মেঘালয়াকে গিয়ে তাবিরের ব্যাপারে বলার। কিন্ত সামনে এসে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে যেত, মেঘালয়ার বলা সেই অবজ্ঞাসূচক কথাগুলো আর বাজিতে জিতে যাওয়ায় বিশ্রী হাসিতে মগ্ন তাবিরের মুখটা। ইরাজের বিশ্বাস আর ভরসা যেখানে মেঘালয়া পায়ে পিষে সামনে এগিয়ে চলেছে, সেখানে ইরাজ কি করে মেঘালয়ার সম্মুখীন হতে পারে আবারও। তবুও যদি ইরাজের আন্দাজ থাকত, তাবিরের পরিকল্পনা এত জঘন্য পর্যায়ে নেমে গিয়েছে, সে সব সংকোচ কাটিয়ে তার মেঘকে বাঁচিয়ে নিত। যেখানে তাবির শর্তে জিতে গিয়েছে; ইরাজ ভেবেছিল এখানেই শেষ। হয়ত সে নিজেই এবার খেলা শেষ করবে। কিন্ত, তাবির এখানেই থামেনি।

তাবিরকে শাসাতে আবারও সে গোপনে গিয়েছিল, তাবিরের কাছে। তাবিরের কাছে শুনে এসেছে, মেঘালয়া নাকি পাগল তার জন্য। তাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। তার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছে।

এরপর আর কি বলার থাকে? এ কথা বিশ্বাস করার ভিত্তিটুকুও মেঘালয়াই দিয়েছিল ইরাজকে; যেদিন সে ইরাজকে তার পিছু করতে নিষেধ করেছে। ইরাজ এ সময় পাগলের মতো উঠেছিল পুরো। তার নিজের ভালোবাসায় অন্যের অধিকার! তার কোন ভূমিকা নেই তার মেঘের জীবনে। যে মেঘকে সে নিজের সবটুকু মনোযোগে আবদ্ধ করে রেখেছিল এতকাল, সেই মেঘ তাকে নিজের আশেপাশে ঠায় দিতেও নারাজ! ইরাজ কেঁদেছে; অপমানে, দুঃখে, মন ভাঙার যন্ত্রনায়, অধিকার হারানোর ব্যর্থতায়, আত্মমর্যাদাবোধে লাগা তীব্র আঘাতে, সবশেষে মেঘকে ভুলতে চেয়ে, ভুলতে না পারার অপারগতায়। সেদিন ইরাজকে শান্ত করার শক্তি অতিমাত্রার, তীব্র অ্যালকোহলেরও ছিল না। সবশেষে সে ত্যাগ করেছিল তার মেঘকে। সে কেমন ত্যাগ, তার বর্ননা নেই, নেই কোন সরূপ।

এসব মেঘালয়া কোনদিন জানতে পারবে না। ইরাজ জানতে দেবে না। সে নিজেকে লুকিয়ে চলে, সে নিজের দুর্বলতা গুলোকে খুব সন্তর্পণে দাফন করেছে তার বেপরোয়া চলনের চাদরের তলে।


ভাবনাগুলো মেঘালয়াকে এই ধারণায় পৌঁছাতে সাহায্য করল; আজ দুপুরে আব্বু বলেছিল, সে ভুলের চেয়ে বোকামি বেশি করেছে। অতীতের এই বিশ্লেষনে মেঘালয়াও যেন তাই খুঁজে পেল। আব্বু তাকে ভাবতে বলেছিল বোকামিগুলো। মেঘালয়ার মনে হলো, এগুলোই তার বোকামি। সে ইরাজকে দূরে সরিয়েছে যেখানে, তার ধ্বংসের শুরু ঠিক সেখান থেকেই। এতদিনে এভাবে ভাবার মতো মানসিকতা কাজ করেনি তার মাঝে। আজ ভেবে, সবকিছু এলোমেলো লাগে বড্ড।

ভাবনায় মশগুল মেঘালয়া সম্বিত ফিরে পেল ভারী গলার আওয়াজে, “রুমে যা।ʼʼ

ইরাজের আচমকা উপস্থিতিতে মেঘালয়া একটু চমকে উঠল, তবে তা প্রকাশিত হলো না। ইরাজ এসে দাঁড়াল পাশে। মেঘালয়া একবার তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজ সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে চাঁদ নেই। মেঘে ছেয়ে আছে, সাথে মৃদূমন্দ বাতাস। মেঘালয়াকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে বিরক্ত হলো ইরাজ, “দাঁড়িয়ে গিলছিস কথা? রুমে যেতে বলেছি।ʼʼ

মেঘালয়া জবাব দিল, “এখানে ভালো লাগছে।ʼʼ

ইরাজের কণ্ঠ এবার একটু সিরিয়াস শোনাল, “তোর ভালো-খারাপ লাগার অনুভূতি জানতে চাইনি। এখান থেকে যেতে বলেছি।ʼʼ

মেঘালয়া এবার বেশ জিদের সাথেই বলল, “যাব না।ʼʼ

ভেবেছিল ইরাজ এ নিয়েও চোটপাট করবে হয়ত। অথচ ইরাজ আর কিছুই বলল না। সিগারেট জ্বালাতে উদ্যেত হলো। সিগারেটের ধোঁয়াতে এমনিতেও দাঁড়াবে না মেঘালয়া। মেঘালয়া তবুও দাঁড়িয়ে রয় চুপচাপ। কিছু সময় দুজনেরই নিরবতার পর মেঘালয়া অভিযোগের স্বরে বলল, “আপনি সব জানতেন। আমার জীবনটা আপনার কাছে একটা বাজি ধরার বস্ত মনে হয়েছিল? সব জেনে বুঝেও কোনদিন আমায় জানাতে আসেন নি। এটাকে ভালোবাসা বলবেন আপনি?ʼʼ

ইরাজের গায়ে সহ্য হলো না যেন মেঘালয়ার কথাগুলো। দাঁতের মাড়ি পিষে জবাব দিল, “তোর এসব বা লে র প্রশ্নের জবাব দিতে এখানে এসে দাঁড়াই নি আমি। আর কে বলেছে তোকে এটাকে ভালোবাসা বলছি? আমি বলেছি কোনদিন? নাকি আর কেউ বলেছে? ভালোবাসা! হাহ! এই শব্দটাকে মৃত্যুর চেয়েও বেশি ঘৃনা করি আমি, সেখানে তা ভেতরে পুষে রাখার প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ

মেঘালয়ার কাছে ইরাজের বলা কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য লাগল না মোটেই। আজকাল ইরাজকে বুঝতে চেষ্টা করে মেঘালয়া। কিছুটা বুঝতে সক্ষমও হয়। ইরাজের চোখের ছটফটানিগুলোতে মাঝেমধ্যেই নজর দেয় সে। সেখানে শুধুই বিষাদ নজরে আসে মেঘালয়ার। আজকাল সকলকে ছাপিয়ে নিজেকে ঘৃনা করতে ইচ্ছে করে। সকলে তাকে যে আদরে আগলে রেখেছিল, তা সে তুচ্ছজ্ঞান করে যে সিদ্ধান্তগুলোই নিয়েছে, সবগুলোতেই তাকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। তার আজকের পরিণতি কেবলই মাত্র তার আবেগী বয়সের করা ভুল, এবং বোকামির ফল।

এক সময় সকলেই নিজের করে আসা ভুলগুলোকে উপলব্ধি তো করে, তবে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, যখন আর কোন লাভ হয়না। সে সমাজের চোখে সম্মান হারিয়েছে, ইরাজকে অজান্তেই নরক যন্ত্রনা দিয়ে ফেলেছে, নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করেছে, তাবিরের মতো অমানুষকে বিশ্বাস করার মতো নিকৃষ্টতম বোকামি করেছে, তার বদলে আবার তাকেই পুড়তে হয়েছে জলন্ত আগুনে। আজ তা বুঝতে পারলেও লাভের লাভ কিছুই নেই। আজকের পরীক্ষার ফলাফল তাকে আবারও একবার উপলব্ধি করাল, সে নিজের কতবড়ো ক্ষতি করে বসেছে। এবং সেই সকল মানুষকে ঘৃনা করেছে, যারা হয়ত সত্যিই তার আপনজন, তারা তার ভালোর জন্য সবটা লুটিয়ে দিতে প্রস্তত। তাদের যে আচরণ গুলো মেঘালয়ার কাছে বিষের মতো ঠেকত, সেই আচরণে আটকে থাকলে আজ তার পরিণতি এমন হতো না মোটেই।

মেঘালয়ার চুলগুলো হাত খোপা করা ছিল। বাতাসের তরে তা খুলে পিঠে ছড়িয়ে পড়ল। তাতে কোন সমীহ দেখাল না মেঘালয়া। ইরাজকে প্রশ্ন করল আবারও, “ভালোবাসা কি ফুরিয়ে যায় কখনও? কাউকে ভালোবাসলে ঘৃনা করা যায়?ʼʼ

ইরাজ মৃদূ হেসে ফেলল। অন্ধকারে তা দৃষ্টিগোচর হয় না মেঘালয়ার। সিগারেটটা ঠোঁটের ভাজ থেকে নামিয়ে হাতে ধরে জবাব দিল ইরাজ, “ভালোবাসা বড়ো নাজুক, স্পর্শকাতর আর মসৃণ অনুভূতি। তার ওপর অবেহেলা এবং অধিকারহীনতার মতো ধারাল অনুভূতি দ্বারা আঘাত করা হলে, ভালোবাসার সেই মসৃণ অনুভূতি প্রথমত ক্ষত-বিক্ষত হয়, র ক্তা ক্ত হয়, যার ফলে বুকে অসহ্য ব্যথার সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য সময়ের সাথে সাথে সে ব্যথা তুলনামূলক কমে আসে, সয়ে যায়! তবে ভালোবাসার অনুভূতিটা বদলে এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম হয়। যাকে ঘৃনা তো বলা যা না, তবে সে অনুভূতিতে আগের মতো মায়া, টান আর নেশা থাকে না। আঘাতগুলো জড়ো হয়ে এক কঠিন দেয়ালের রূপ নেয়, যে দেয়াল টপকে নরম অনুভূতিরা উঁকি দিতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। সে দেয়ালকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে খুব।ʼʼ

মেঘালয়া অভিভূত হয়ে শুনল ইরাজের মুখে ভালোবাসার এমন ঘাত-প্রতিঘাতী সংজ্ঞা। ইরাজকে বরাবর নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করে যাচ্ছে মেঘালয়া। আজ যেমন এই ইরাজ মিলছে না তার পরিচিত ইরাজের সঙ্গে! মেঘালয়া খুব বুঝল, ইরাজের বলা কথাগুলো কোন বইয়ের পাতা থেকে সংগৃহীত বাক্যমালা নয়। ইরাজে বুক চিরে বেরিয়ে আসা, চাপা আত্মচিৎকার ঝরে পড়ল প্রতিটি শব্দের পরতে পরতে!

চলবে..

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১৭

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৭.

রেজাল্ট শিট হাতে নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে মেঘালয়া সেদিকে। কিছুক্ষণ আগে ইরাজ মার্কশিট তুলে এনে হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকেছে হাত-মুখ ধুতে। মেঘালয়াকে দেখতে কেমন প্রাণহীন, জড়ো পদার্থের মতো লাগছে। যেন ভেতরে অনুভূতির বড়ো অভাব। মাথাটা ঝুঁকিয়ে চেয়ে আছে রেজাল্ট শিটটির দিকে। ইরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মেঘালয়াকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ডাকল, “মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়ার পক্ষ থেকে জবাব নেই। অনিমেষ চেয়ে আছে সেই কাগজটির পানে। ইরাজ পা ফেলে বেরিয়ে যেতে অগ্রসর হয়ে আবার পা ঘুরিয়ে বিরক্ত হয়ে এসে বসল সোফার সামনে থাকা কাউচের ওপর। তখনই মেঘালয়ার চোখ থেকে টুপ করে একফোটা পানি সেই কাগজে পড়ে। ইরাজের ভেতরে আচমকা যেন এই দৃশ্য এক অদ্ভুত ধাক্কা মারল। মুচরে উঠল ভেতরে। কেঁড়ে নেওয়ার মতো কাগজটি হাত থেকে নিয়ে নিলো। মেঘালয়া ছেড়ে দেয় আস্তে করে। ইরাজ দেখেই এসেছে রেজাল্ট, আবারও কৃত্রিম ব্যস্ততা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কাগজটি। অতঃপর নিজের স্বভাবসুলভ কঠিন ভাব ধরে রাখতে মৃদূ ধমক দেওয়ার মতো করে বলল,

“মেয়ে মানুষ ঢং ছাড়া আর কিছু জানেনা? এমন ভাব করছিস যেন, সাড়ে চার সাবজেক্টে ফেইল। ৪.৯৪ জিপিএ তে পাশ করেছিস। এভাবে শোক পালনের কি আছে?ʼʼ

মেঘালয়া এবার মুখ তুলে চাইল। ইরাজের বুকটা আবারও ধুক করে ওঠে। মেঘালয়ার চির পরিচিত চঞ্চল চোখদুটো আজ বিষাদের জলে টলমলে। গাল গড়িয়ে পানি বেয়ে পড়ল এবার। ভাঙা গলায় বাচ্ছাদের মতো অভিযোগ করে নিজের বিরুদ্ধেই মেঘালয়া, “A+ তো আসেনি। আব্বুর সামনে এবার দাড়াব কি করে?ʼʼ

কান্নায় ভেঙে পড়ল মেঘালয়া। ইরাজের কেমন অস্থির লাগছে। চেয়েও আজ আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না মেঘালয়ার থেকে। ইরাজের কি যেন হয়ে গেল। হুট করে উঠে এসে মেঘালয়ার পাশে বসল। নরম স্বরে বলল, “পাগলি! তুই তো গুচ্ছতে পড়তে চাস। আর এস এস সি এর জিপিএ ফাইভ আছে তো। অনায়েসে চান্স হয়ে যাবে।ʼʼ

মেঘালয়ার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। ইরাজের এমন কণ্ঠস্বর তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল। চোখ মেলে তাকাল ইরাজের দিকে। থুতনির কাছে প্রতিক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। ইরাজ সেদিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসল মৃদূ। অতঃপর বলল, “আঙ্কেল আসছে। বাপের সামনে এভাবে যাবি? আর তোর বাপ তোর অবস্থা দেখে আমাকে কেলিয়ে যাবে।ʼʼ

মেঘালয়া চমকে উঠে, আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ল। আব্বু আসছে, না জানি রেজাল্ট দেখে কত কষ্ট পাবে! আব্বুর সামনে যাবে কি করে মেঘালয়া! তা বুঝে ইরাজ আশ্বস্ত করে বলে, “রিল্যাক্স! তোর বাপ জানে। আমি তাকে সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলাম মার্কশিট তুলতে। চরম খুশি সে, মিষ্টি নিয়ে যখন তখন এসে পৌঁছাবে। তাড়াতাড়ি মুখে-চোখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেস হ।ʼʼ

মেঘালয়া উঠল না। থম মেরে বসে রইল। ইরাজ মার্কশিটের দিকে চেয়ে বলল, “কি ভাবছিস?ʼʼ

মেঘালয়া শুনতে পায়নি বোধহয়। ইরাজ আবারও কিছু বলতে যাবে, তখনই মেঘালয়া জবাব দেয়, “আমি বড়ো ভুল করে ফেলেছি জীবনে। নিজের কাছে নিজের ক্ষমা নেই। সকলে কি করে মেনে নেবে আমায়?ʼʼ— ব্যর্থতা প্রকাশ পায় মেঘালয়ার কথায়।

ইরাজ বুক ফুলিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। নিচের দিকে একটু ঝুঁকে বসে, হাতের কাগজটি সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল, নিজের হাতঘড়ি চাপা দিয়ে। এরপর বলল,

“এরকম ভুল তোর বয়সে সকলেই করে। তবে তুই ঠিক ভুল করিসনি, করেছিস বোকামি। যেখানে কোন অনুভূতি নেই, সেখানে রিলেশনশিপে চলে গেলি? শখ করে? নিতান্তই নির্বোধ তুই, যে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারে না। শুধুমাত্র নিজেকে প্রমান করতে, জটিল কোন মায়া, অনুভূতি ছাড়াই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলি?ʼʼ— ইরাজের কথায় অস্পষ্ট তাচ্ছিল্য।

মেঘালয়া আজ আবারও অবাক হয় ইরাজের পাল্টি খাওয়া আচরণে। এভাবে তো কোনদিন বুঝিয়ে বলেনি, করেছে শুধু তিরস্কার। হঠাৎ-ই কিছু মনে পড়তেই এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে মলিন হাসল, “আর আপনি সবটা জানা সত্ত্বেও তা চলতে দিলেন!ʼʼ

ইরাজ কোন জবাব দিল না। আচমকা এ কথায় তার মুখটা কেমন কঠিন হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল। মেঘালয়াকে আবারও তাড়া দিল, “নিজেকে সামলে ফ্রেস হয়ে আয়।ʼʼ


হেলাল সাহেব এলেন দুপুরের দিকে। তার দুহাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট। আজ তিনি ইমতিয়াজ সাহেবের বাড়ি বন্ধু হিসেবে নয়, এসেছেন বেয়ান হিসেবে । এটা ভেবে যেমন উত্তেজনা কাজ করছে, তেমন একটু অপ্রস্তুত বোধও ঘিরে ধরছে তাকে। আর তা প্রায় সম্পূর্ণটাই আনতারা খানমকে ঘিরেই বোধহয়। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময় একটু সংকোচ কাজ করল। আবার আজব অনুভূতিও হচ্ছে, তিনি তার ছোট্রো পরীর শশুরবাড়ি এসেছেন। এই তো কিছুদিন আগেও মেঘালয়া আব্বুর হাত ধরে শুক্রবার হলেই সন্ধ্যার পর ফুসকা খেতে যেত। রাত-বিরাত আবদার করত, “চলো কোথাও বসে আইসক্রিম খেয়ে আসি, আব্বু! এবার আবার না কোরো না যেন! চলো যাই।ʼʼ

তিনি নিয়ে যেতে না পারলে, ইরাজকে কল করতেন। ইরাজকে রাজী করাতে আবার আরেক খাটুনি হতো। ইরাজ তো জন্মের ঘাঁড় ত্যাড়া।

এসব ভাবতে ভাবতে ঢুকলেন ভেতরে। প্রথমেই দেখা হলো আনতারা খামনের সঙ্গে। ওখানেই বুকটা একটু ধুক করে উঠল, হেলাল সাহেবের। তবুও সাহস করে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আসসালামুআলাইকুম, ভাবীজান! কেমন আছেন?ʼʼ

আনতারা খানম নিরস মুখে কেবল সালামের জবাবই দিলেন, এরপর নিজেকে কাজে মস্ত ব্যস্ত দেখানোর চেষ্টা করলেন। মেঘালয়া বোধহয় শুনেছে আব্বুর কণ্ঠস্বর। লাফিয়ে নেমে আসল সিঁড়ি বেয়ে। একদৌড়ে এসে আব্বুর বুকে। হেলাল সাহেব কোনমতো মিষ্টির প্যাকেট নামিয়ে রেখে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। এতক্ষণ মেঘালয়ার আব্বুকে নিয়ে বহু সংকোচ থাকলেও, এতদিন পর আব্বুকে এত কাছে পেয়ে সেসব ভুলে বসল একদম। ইমতিয়াজ সাহেব অফিসে এখন। মেঘালয়া টেনে নিয়ে গিয়ে আব্বুকে বসার ঘরের সোফাতে বসাল। হেলাল সাহেব মেয়ের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছেন কিছু। এক পর্যায়ে মনে হলো, মেঘালয়া খারাপ নেই। তবে বাবার চোখ তো, মেঘালয়ার চোখের নিচের বসে যাওয়া অংশ বহু কথা বলে যায় বাবার কানে কানে।

বেশ কিছুক্ষণ পর কথায় কথায় মেঘালয়া আব্বুর কাছে আক্ষেপ প্রকাশ করে, “আব্বু! আমি ভুল করেছি, প্রতিনিয়ত তার শাস্তিও পাচ্ছি। আজ দেখো না আমার রেজাল্টের হাল। তবুও বলো তো, ভুলটা কি এতটাও বড়ো ছিল, যতটা মাশুল আমি দিয়েছি?ʼʼ

হেলাল সাহেব তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে। আজকাল সেই ছোট্রো মেঘালয়া বেশ ভারী ভারী কথা বলতে শিখেছে। হেলাল সাহেব ছোট্রো একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “ভুল কম, বোকামি বেশি করেছ তুমি।ʼʼ

মেঘালয়া ঘাঁড় নাড়ল, “হুম, আজ উনিও তাই বলল।ʼʼ

মেয়ের কথায় হাসলেন হেলাল সাহেব। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে, “বোকামিটা কি ছিল আব্বু!ʼʼ

“তুই নিজেই বুঝবি, মেঘা! বোঝার চেষ্টা করলে।ʼʼ

আব্বুর গলাটা বড়ো আদুরে লাগল এবার। মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল আব্বুর হাসি হাসি মুখের দিকে।


রাত এগারোটার দিকে রুমে আসল মেঘালয়া। আব্বুকে বিদায় দিয়ে তবে ফিরেছে রুমে। সারাটাদিন আব্বুকে কাছে পেয়ে যতটা ফুরফুরে লাগছিল মেজাজটা, এখন ঠিক ততটাই বিষন্নতা আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরছে ওকে। সন্ধ্যার দিকে ইমতিয়াজ সাহেব বাড়ি ফিরেছেন, তখন থেকে আলোচনা চলেছে, সবার মাঝে। একান্তে আর আলাপ করার সুযোগ পায়নি মেঘালয়া। আনতারা খানম পুরোটা দিন কেবল নিজের দ্বায়ভার পালন করেছেন, বেশি একটুও কিছু না। রাতের খাবার সকলে মিলে একসঙ্গে খেয়ে, তারপর হেলাল সাহেবকে পৌছে দিতে গেছে ইরাজ। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে বাইরে। আজ মেঘালয়া ভেতরটা হালকা হয়েছে এটা বুঝে, যে আব্বুর আর কোন ক্ষোভ নেই তার প্রতি।

সে মুখ-চোখে হালকা পানি ছিটিয়ে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। মস্তিষ্ক ভাবার জন্য একান্ত সময় পেয়ে, প্রথমেই ভাবনায় নিয়ে এলো, রেজাল্টের কথা। ভারী নিঃশ্বাস ফেলল মেঘালয়া। দিন শেষে মানতেই হবে, বাপ তো বাপই। বাপ-মায়ের বাঁধা নিষেধ সাময়িকভাবে খারাপ লাগার হলেও, তা একদিন এটা প্রমান করে ছাড়ে, বা-মা কখনও সন্তানের খারাপের জন্য কিছু করে না। তারা গুরুজন, তাদের চিন্তা-ভাবনা সর্বদা অগ্রগামী। তারা অবশ্যই সন্তানের চেয়ে ভালো বোঝেন জীবন সম্বন্ধে! মেঘালয়াও আজ বোঝে, সে যতদিন আব্বুর ছায়াতলে ছিল, সে জীবনের সেরা সময় কাটিয়েছে। যখনই নিজে সিদ্ধান্ত নিতে সচেষ্ট হয়েছে, জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরু ঠিক ওখান থেকেই।

আচমকা ইরাজের কথা মাথায় এলো। অতীতের ভাবনায় মজে গেল সে।

ইরাজ কখনও তাকে সেভাবে বুঝতে দেয়নি তার ভেতরে লুকানো অনুভূতি। তবে আব্বুর পরেই মেঘালয়াকে আগলে রাখার জায়গা ইরাজের শাসনই তো ছিল! তখন ইরাজকে বড়ো বিরক্ত লাগত মেঘালয়ার। সবকিছুতে বাঁধা! এটা করবি না, সেটা করতে পারবি না, ওখানে যাবি না, এভাবে চলতে হবে। ইরাজকে নিজের চারপাশে কারাগারের শিকলের মতো লাগত।

ইরাজ মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফিরে আসল বাড়িতে। এসে, টুকটাক বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দিল। তার কোনকালেই ইন্টারেস্ট নেই চাকরির প্রতি। যেখানে নিজের বাপের ব্যবসা আছে, চাকরির প্রয়োজন মোটেই নেই। তখন মেঘালয়া সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এসময় ইরাজ নিয়ম করে, মেঘালয়ার কলেজে যাতায়াত করত। চোখে-চোখে রাখা, বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, পরিচিত গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া, কখনও কখনও নিজে না উপস্থিত হতে পারলে লোক পাঠাত। এই ব্যাপারগুলো চরম বিরক্ত লাগলেও মেঘালয়া আব্বুর জন্য, আর ইরাজকে ভয় পাওয়ার কারনে চুপচাপ মেনে নিত।

কিন্ত মেনে নেয় নি আর এক পর্যায়ে। যখন তাবিরের প্রপোজাল সে এক্সেপ্ট করল, তারপর থেকে ইরাজের এই চোখে চোখে রাখার ব্যাপারটা মেঘালয়ার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। একদিন সাহস করে ইরাজকে বলেই দিয়েছিল,

“আপনি আর আসবেন না আমার কলেজে। আমি অনাথ নই। আমার আব্বু স্বয়ং জীবিত। আপনি এভাবে আমার পেছনে বডিগার্ডের মতো লেগে থাকেন, তা নিয়ে পুরো কলেজে আমাকে বেবী গার্ল, ম্যানিকুইন, বার্বিডল বিভিন্ন নামে ক্ষেপানো হয়। আমি ছোটো বাচ্ছা নই আর, চলতে পারি একা।ʼʼ

আসলে তাকে কেউ ক্ষেপাতো না, বরং তাবির এরকম বিভিন্নভাবে মেঘালয়াকে ভড়কেছে। ইরাজকে স্বপ্নেও আর এরপর থেকে কোনদিন কলেজের আশেপাশে দেখতে পাওয়া যায়নি। এমনকি তারপর একেবারে দেখাও হয়েছিল সেই চট্রগ্রামে। এর মাঝে আর ইরাজ কোনদিন মেঘালয়ার সম্মুখে আসেনি।

মেঘালয়া আব্বুর কাছেও এসে অভিযোগ করেছিল ঠিক একইভাবে। মেঘালয়ার আদুরে মুখের কথা হেলাল সাহেব ফেলতে পারেন নি। তিনি কল্পনাতেও আনেন নি তার অগোচরে এমন কিছু ঘটিয়ে চলেছে মেঘালয়া। এরপর থেকে মেঘালয়া একাই যাতায়াত করত। তাবিরের কাছে নিজেকে স্বাধীন প্রমান করতে, সমাজের আর সব মেয়েদের মতো চাল-চলন আয়ত্ব করে ফেলেছিল প্রায়।

চলবে..

error: ©<b>গল্পপোকা ডট কম</b>