Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 24



কলঙ্কের দাগ পর্ব-০৫

0

গল্প #কলঙ্কের_দাগ [কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
পর্ব=৫
লেখক #জয়ন্ত_কুমার_জয়

অফিসার বললো টয়লেট হাউজে কোনো লা”শ পাওয়া যায়নি।অথচ মহুয়া নিজ হাতে তিনটা লা”শ সেখানে ফেলেছে।এটা কিভাবে সম্ভব?

মহুয়ার মুখ হা করে গেলো।এটা কি করে সম্ভব,সে নিজে হাত পা বেঁধে তিনজনকেই খাদে ফেলেছে।ওরা কি সেখান থেকে পালিয়েছে? সেটা কিভাবে সম্ভব?মহুয়া ঢাকা দেওয়ার পরও ১০ মিনিট সেখানে বসে ছিলো।লা”শ পাওয়া যায়নি এটা কিভাবে হতে পারে!

মহুয়া সে রাতের দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করলো।যখন য় মহুয়া আকুতির স্বরে ওদের পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো ” কাউরে বইলেন না,আপনের পায়ে ধরি ”

মজিত ” পা ছাড় মা*,ঘরের বউ হইয়া ভাতাররে মা”ইরা ফালাইছোস “।কথাটা বলে মহুয়াকে লাথি মে”রে সরিয়ে দিলো।

মহুয়া মাটিতেই পরে রইলো।মজিত ফিসফিস করে নওজানের সাথে কি যেন বললো।একটুপর নওজান বললো

” যাহ,কাউরে কমু না।কিন্তু শর্ত ”

মহুয়া চোখের জল মুছে ” কি শর্ত? ”

” তোর মাইয়ার সাথে কয়দিন যা করছি,অহন থাইক্কা প্রতিদিন করুম।হেতে ট্যাহা দিমু না ”

মজিত বললো ” মেয়ের থাইকা তুই বেশী আগুন।মা মাইয়া একসাথে অল্প কিছু দিমুনি যা।যদি রাজি থাকোস ক ”

মহুয়া চোখের জল মুছলো।রোবটের মতো দাঁড়িয়ে বললো ” আমি রাজি ”

মহুয়ায় কথায় দুজনের চোখে মুখে পৈশাচিক আনন্দ।নওজান বললো ” তয় দেরি ক্যান,আইজ থাইকাই শুরু।মা”ল খাইয়া হিট আইছে, চল ঘরে চল ”

মহুয়া ঘরে গেলো।মজিত নওজান বোতলের শেষটুকু এক ঢোকে খেয়ে বিশ্রী শব্দে ঠেকুর তুললো।নেশা ধরেছে,শরীর হেলেদুলে যাচ্ছে।দরজার কপাট ধরে মজিত দাঁড়াতেই গ”লা বরাবর ছু”রির কো!প,সঙ্গে সঙ্গে গোঙ্গানির মতো শব্দ করতে লাগলো মজিত।এই অবস্থা দেখে নওজান পালাবে তারআগেই মহুয়া দৌড়ে তার পিঠে ছু”রি বসিয়ে দিলো।পিঠে আ”ঘাতে যখন শরীর ভাজ করলো তখন বু!ক বরাবর ছু”রিটা বসিয়ে দিলো মহুয়া।

মুহুর্তেই রক্তে ভেসে গেলো আঙ্গিনা।মজিত শেষবারের মতো হাত পা ছটফটিয়ে চির শান্তিতে ঘুমিয়ে পরলো।সমীরকে যেভাবে টেনে খাদে নিয়ে গিয়েছিলো তাদের দুজনকেও সেভাবে মাটি কাঁদা করে বস্তার উপর রেখে টেনে নিয়ে গেলো।ফেললো খাদে!এরলম জখ”ম হওয়ার পরও সেখান থেকে বেঁচে পালানো অসম্ভব।তার উপর ঢাকনা ছিলো কংক্রিটের।

অফিসারের ডাকে মহুয়ার হুশ ফিরলো৷ ” ম্যাডাম,কি ভাবছেন? ”

মহুয়া শুকনো ঠোক দিয়ে ” ন…না ক..কিছুনা ”

” আপনি ধরা পরে গেলেন ”

মহুয়া চুপ করে রইলো।অফিসার বললো ” জানতে চাননা কিভাবে বুঝলাম ওরা খাদে? ”

” কিভাবে ”

” আমি জানিনা।আপনিই জানিয়ে দিলেন।সন্দেহ করেছিলাম ওরা দুজন এখান থেকেই নিখোঁজ হয়েছে।আর আশেপাশের বাড়িতে খবর নিয়ে জানলাম সমীরের সাথে আপনার সম্পর্কটা কয়েকমাস থেকে ভালো যাচ্ছে না।রোজ গভীর রাতে ওরা আপনার কান্নার শব্দ পায়।দুজন নিখোঁজ,তারউপর আপনি মিথ্যা বলেছেন,সন্দেহ প্রবল হলো।তারপর ভাবলাম যদি খু”ন আপনিই করেন তাহলে বেশিদূর লা”শ টেনে নিয়ে যাওয়ার শ”ক্তি আপনার নেই।কাছেই কোথাও লুকানো আছে।টয়লেট হাউজের খাদটায় লুকাতে পারেন,এমনটা অনুমান করেছিলাম।আপনাকে বুঝলাম অনুমান সঠিক ”

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।মহুয়া চোখে আঁচল টেনে কাঁদছে।অফিসার দুজন সহকারীকে বললো ” কর্পোরেশন থেকে লোক আনুন ”

” গণ্ডগ্রামে কর্পোরেশন কই পাবেন স্যার।মেথর নিয়া আসি ”

” আনো ”

মহুয়া আঙ্গিনায় বসে পরলো।অফিসার ফোন বের করে কি যেন বললো।অতঃপর মহুয়াকে ” আপনার নিকটস্থ আত্নীয় আছে?আপনাকে থানায় যেতে হবে। আত্মীয়র ঠিকানা দিন তাদের কাছে রেখে আসার ব্যবস্থা করবো ”

মহুয়া ভাইকে কল দিলো।২য় বার রিং হয়ে কল ধরে ” ইন্টারেস্টিং একটা বই পড়ছিলাম।এতদিন পর কল দিলি।টুকু কেমন আছে? ”

মহুয়া অশ্রুসিক্ত কন্ঠে “দাদা টুকুকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি।একটু দেখে রেখো ”

কথাটা বলে কল কা”টলো।বাইরে পুলিশের গাড়ি।মহুয়া গাড়িতে বসলো।গ্রামের লোকজনে ভর্তি চারপাশ।সোরগোল পরে গেলো মহুয়া খু”ন করেছে।গ্রামের লোকেরা এমন উৎসাহ নিয়ে দেখছে যেন খু”ন করা একটা উৎসব।সবাই মাতামাতি সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে।

থানায় স্বীকারোক্তি নেওয়া হচ্ছে।মহুয়ার সামনে দুজন আইনের লোক।একজন আরেকজনকে বলে উঠলো

” হাউ কুড সি ডু ড্যাট!ওনাকে দেখে কে বলবে এতো ভয়ঙ্কর কাজটা করতে পারে!লুক এট হার আই,হরিণী চোখ ”

অন্যজন বললো ” হরিণী না।বাঘিনী চোখ।তিনটা মানুষ টপকে দিছে ”

মহুয়া নিলির্প্ত স্বরে ” ওরা মানুষ ছিলো না ”

এই পর্যায়ে ডিউটিরত অফিসার এলো।হাতে চায়ের কাপ।সাথে আরেকজন চা এনে টেবিলে রাখলো।

অফিসার ” চা খান ”

মহুয়া চায়ে চুমুক দিলো।তার সহজ ভঙ্গি।অফিসার ” প্রথম থেকে শুরু করুন।এই পর্যন্ত আমরা তদন্ত করেই এসছি।কাজেই আমাদের অবজারভেশন পাওয়ার সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন নিশ্চয়ই।আপনি সত্য মিথ্যা যাই বলবেন আমরা তদন্ত করে সত্যিটা বের করবো।মিথ্যা বলে হয়রানি করাবেন না।সত্য বলবেন।আমি জানি ওরা খারাপ মানুষ,যতসম্ভব শাস্তি কমানোর চেষ্টা করবো ”

মহুয়া চা শেষ করলো।বলতে শুরু করলো ” ৬টা ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিলো গ্লাসে ”

” উহু,আরো প্রথম থেকে।মাস খানেক থেকে আপনাদের মধ্যে কিসের ঝামেলা চলছিলো ”

” মেয়েকে নিয়ে ”

” পাড়ার মাতাল লোকজনদের দিয়ে মেয়ের শরীর ব্যবসা? ”

মহুয়া চোখের জল মুছলো।তার শরীর কাঁপছে।অফিসার চোখ মুখ শক্ত করে ” কে”সটার জন্য আমার সব জানা প্রয়োজন।মা হয়ে বিষয়টা বলা খুবই অপ্রীতিকর বুঝতে পারছি।তবুও,, ওরা আপনার মেসের সাথে রাত কাটাতো? ”

মহুয়া চুপচাপ কাঁদছে।অফিসার ” ওরা টুকুর সাথে শারী”রিক সম্পর্কে লিপ্ত হতো?যা সত্যি তাই বলুন ”

মহুয়া বললো ” না ”

” না?তারমানে সে”ক্সুয়াল হ্যারেজ করেনি?তাহলে খু”নের সিদ্ধান্ত নিলেন কেনো? ”

মহুয়া এখনো চুপ করে রইলো।

চলবে?

কলঙ্কের দাগ পর্ব-০৪

0

গল্প #কলঙ্কের_দাগ [কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
পর্ব=৪
লেখক #জয়ন্ত_কুমার_জয়

দুপুরের দিক বাড়িতে পুলিশ অফিসার হাজির।ভয়ে মহুয়ার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেলো।অফিসার নির্লিপ্ত স্বরে বললো…

” আপনার কথা হিসেবে আপনার স্বামী,সমীর গত চারদিন আগে শহরে গেছে।অথচ তৃতীয়দিন রাতে সে তার মেয়েকে সাজগোছের সামগ্রী কিনে দিয়েছে।কোন দৈববলে এটা সম্ভব বলতে পারেন মিসেস মহুয়া? ”

মহুয়া আমতা আমতা করে বললো ” ওসব উনি দেননি ”

অফিসার হেসে ” তাই? আপনার মেয়ে তাহলে মিথ্যা বলছে? ”

” ও মিথ্যা বলেনি।আমিই ওকে বলেছি এসব তোমার বাবা কিনে দিয়েছে।সেজন্য বলেছে ”

” আপনার স্বামী না কিনলে কে কিনে দিয়েছে সেসব? ”

” আমি জানিনা।দরজার কাছে রাখা ছিলো ”

” দরজার কাছে রেখে গেলো,আপনি টের পেলেন না? ”

” না ”

” আচ্ছা।গ্লাসটা ফেরত দিতে এলাম।নিন ”

অফিসার গ্লাস এগিয়ে দিলো।মহুয়া কম্পিত হাতে গ্লাসটা নিলো।অফিসার বললো

” আপনার রাতে ঘুম হয়না? ”

মহুয়া বুঝলো অফিসার গ্লাসের অবশিষ্ট অংশ থেকে বেড় করেছে দুধে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিলো।মহুয়া বললো

” টুকুর বাবা খায় ”

” গ্রামের লোকজন যতটুকু বললো,আপনার স্বামী রোজ নেশা করেন।নেশাক্তদের তো ঘুমের ওষুধ প্রয়োজন পরে না ”

” আসলে মাতলামি যখন বেড়ে যায় তখন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিই।ঘরে ছোট মেয়ে আছে।মাতলামি বেড়ে গেলে গায়ে হাত তোলে ”

” আপনি অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।আসি,শীঘ্রই আবার দেখা হবে ”

” গ্লাসটা নিয়ে গিয়েছিলেন কেনো জানতে পারি? ”

অফিসার মৃদু হেসে ” ডিজাইনটা পছন্দ হয়েছিলো।বউকে দেখিয়ে এনেছি। ”

কথাটা বলে সে দুকদম হেঁটে আবার দাঁড়িয়ে বললো ” আপনি কখনো ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন? ”

মহুয়া ভ্রু কুঁচকে বললো ” না ”

” খেলে কি হয় জানেন? ”

” কি হয়? ”

” ব্রেইন সার্প হয়।পাশেই তিনটা মানুষ খু”ন হয় তবুও টের পাওয়া যায় না ”

অফিসার চলে গেলো।মহুয়ার চোখ মুখ দিয়ে গরম ভাব বের হতে লাগলো।সে কি ধরা পরেছে?ধরা পরলে পুলিশ দেরি কেনো করছে? তারমানে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে!

সমীরের দেওয়া সাজগোছ,জামাকাপড়ের বিষয়টা মহুয়া মিথ্যা বললেও প্রকৃত পক্ষে সত্যিই বলেছে।কারন মহুয়া জানে ওসব তার স্বামী সমীর কিনে আনেনি৷কিনে দিয়েছে নোংরা মানসিকতার মানুষ মজিত আর নওজান।কিনে দেওয়ার কারণও আছে।ভয়ঙ্কর কারণ।এই কারণেই তাদের পৃথিবীতে ঠাঁই দেয়নি মহুয়া।

মহুয়া টুকুর কাছে গেলো।মেয়েটা ঘুমাচ্ছে।আজ ছুটির দিন।কি নিষ্পাপ মুখ।টুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই টুকু জেগে উঠলো।মহুয়াকে জড়িয়ে ধরলো।মহুয়া বললো

” টুকু ”

” উু ”

” মাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না? ”

” উঁহু ”

” খুব শীঘ্রই তোমার মাকে সবাই খারাপ ভাববে।এতে আমার কোনো আফসোস নাই।আমি যা করেছি একদম ঠিক করেছি।তুমি একদিন মাকে নিয়ে গর্ব করবে ”

টুকু ঘুমজরিত স্বরে বললো ” উু ”

মহুয়া দেখলো টুকুর চোখ বন্ধ,ঘুমিয়ে পড়েছে।কপালে চু”মু দিয়ে বিছানায় শোয়ালো।

বিকেলে টুকুকে নিয়ে গেলো বাজারে।টুকুর পছন্দের মাছ কিনলো।সময় কম,মহুয়ার ইচ্ছে জেলে যাওয়ার আগে মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াবে।

বাজার করে বাসার সামনে আসতেই টুকু ভয়ে মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো।হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত স্বরে বললো

” মা আমাদের বাড়িতে পুলিশের গাড়ি কেনো? ”

মহুয়া হেসে বললো ” কি করে বলবো? চলো গিয়ে দেখি ”

আঙ্গিনায় অফিসার চেয়ারে বসে আছে।তার সাথে বেশ কয়েকজন পুলিশ সাথে স্যুট পরিহিত তিনজন দাঁড়িয়ে।মহুয়াকে দেখে অফিসার বললো

” ম্যাডাম আপনাকে বিরক্ত করতে চলে এলাম ”

মহুয়া রান্নাঘরে বাজার রাখলো।টুকুকে ঘরে যেতে বললো।অফিসারকে বললো

” বিরক্ত কেনো করবেন! চা করি? চা খান ”

” চা খাবো না।একটা তথ্য দিতে এলাম ”

” কি? ”

” আপনি ঠিকই বলেছেন।ওইরাতে আপনার স্বামী না,অন্যকেউ কিনে দিয়েছিলো।জানতে চান কে? ”

” কে? ”

” নওজান আর মজিত।এ গ্রামে একটা দোকানেই এসব পাওয়া যায়।দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওরা কিনেছে ”

” ও আচ্ছা ”

” মজার ব্যাপার হলো ওরা প্রায়ই সেখান থেকে চকলেট,সাজার জিনিস কিনতো।কিন্তু ওদের দু’জনারই ছেলে সন্তান।মেয়েদের জিনিস কেনো কিনতো বলুন তো? আপনার মেয়েকে দিতে? ”

মহুয়া চুপ করে রইলো।অফিসার বললো ” আপনার স্বামীর সাথে তাদের মিল ছিলো।সেজন্যই বোধহয় দিতো৷এখন আসল কথায় আসি ”

” হু ”

” যে রাত থেকে মজিত,নওজান নিখোঁজ সে রাতে ওরা আপনার বাসায় এসছিলো।দুধের গ্লাস সমীরের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।সে হিসেবে সমীরও সেরাতে বাড়িতে ছিলো ”

মহুয়ার শরীর কাঁপতে লাগলো।নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।অফিসার বললো ” মিথ্যা বলার কারণ? ”

” আ..আমি ঝামেলায় জড়াতে চাইনি ”

” সব থেকে অবাক হওয়ার বিষয়টা এখন বলবো ”

” কি? ”

” টয়লেটের মল জমা হওয়ার খাদে আমরা কোনো লা”শ পাইনি ”

মহুয়ার মুখ হা করে গেলো।এটা কি করে সম্ভব,সে নিজে হাত পা বেঁধে তিনজনকেই খাদে ফেলেছে।ওরা কি সেখান থেকে পালিয়েছে? সেটা কিভাবে সম্ভব?মহুয়া ঢাকা দেওয়ার পরও ১০ মিনিট সেখানে বসে ছিলো।লা”শ পাওয়া যায়নি এটা কিভাবে হতে পারে!

কলঙ্কের দাগ পর্ব-০৩

0

গল্প #কলঙ্কের_দাগ [কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
লেখক #জয়ন্ত_কুমার_জয়
পর্ব=৩

মহুয়া স্বামীর হাত পা বেঁধে খাদে ফেললো।পেছন ফিরে দেখলো দুজন দাঁড়িয়ে!একজন বললো ” মানুষটারে মা”ইরা ফালাইলেন? ”

মহুয়ার সারা শরীর কাঁপছে।ঘামে গা মাখামাখি।চাদর মুড়ি দেওয়া দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে।মহুয়ার পায়ের তল থেকে মাটি সরে গেলো।এরা কখন থেকে তার উপর নজর রাখছিলো? ওরা কি দেখেছে মহুয়া সমীরের হাত পা বেঁধে খাদে ফেলেছে?

তাদের হাতে টর্চের সামান্য আলো।সেই আলোয় একজনের মুখ দেখা গেলো।মাঝবয়সী,চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর,ওনার নাম মজিত।নেশা করে পুকুরপাড়ে শুয়ে থাকে।অন্যজন নওজান,মজিতের ডান হাত।একসাথে চোরাচালানের কাজ করে।মহুয়ার স্বর যেন আঁটকে গেছে।কিছুই বলতে পারছে না।

মজিত বললো ” মাইয়া মানুষের এতো সাহস! ”

নওজান বললো ” পালা,পালা,এইহানে থাকোন যাইবো না।গেরামের লোকজনরে খবর দে ”

মহুয়া আকুতির স্বরে ওদের পা জড়িয়ে ধরে ” কাউরে বইলেন না,আপনের পায়ে ধরি ”

” পা ছাড় মা*,ঘরের বউ হইয়া ভাতাররে মা”ইরা ফালাইছোস “।কথাটা বলে মহুয়াকে লাথি মে”রে সরিয়ে দিলো।

তারপর কেটে গেলো দুইদিন।তিনদিনের দিন গ্রামে সোরগোল পরে গেলো।মজিত,নওজানকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।মহুয়া সকালে ভাত রেঁধেছে।আঙ্গিনায় বসে লাউশাক কুটছে।এমন সময় সুরাজির মা এলো।আঙ্গিনায় গালভর্তি পানের পিক ফেলে বললো

” ঘটনা হুনছোস? ”

মহুয়া আগ্রহ ভঙ্গিতে বললো ” কি? ”

” মজিত আর নওজানরে নাকি খুইজ্জা পাওন যাওচে না ”

” দেখো নেশা করে কোন পুকুর পাড়ে পরে আছে ”

” কোত্থাও নাই।হেগো বউঝিরা হায়রে কান্দান!তোগো বাড়িত নাকি আইছিলো,সমীরের লগে কতা কইতে।তুই কিছু জানোস? ”

মহুয়ার চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে গেলো।যশসম্ভব নিজেকে সামলে ” কই না তো ”

” সমীররে কইতে হইবো।সমীর কই?ওরেও তো দেখিনা, দোকানেও আহে না ”

মহিলার পানের দোকান।সমীরের আড্ডা সেখানেই।মহুয়া বললো ” কাজে গেছে,শহরে ”

এমন সময় মজিতের বউ ছুটে এলো।হাউমাউ করে কেঁদে ” আপা আপনের ভাইরে দেখছেন? সমীর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আইছিলো,আর ফিরেনাই ”

” ওনারা তো এখানে আসেনি ”

” সমীর ভাই কই?উনি কইতে পারবো ”

” উনি শহরে গেছেন।কাইন্দো না,ঘরে যাও।ঠিক ফিরবে ”

মহুয়া সতর্কতায় দুজনকেই বিদায় দিলো।ঠান্ডা এক গ্লাস জল খেলো।হাত পা কাঁপছে।মেয়ে স্কুল থেকে ফিরেছে।ভয় ভয় চোখে বললো

” মা,মা,পুলিশের গাড়ি ”

মহুয়া চোখ বড়বড় করে বললো ” পু…পুলিশ! কোথায়? ”

” নওজান চাচার বাড়িতে।নওজান চাচা নাকি হারায় গেছে।এখন আমায় কে চকলেট, জামা কিনে দিবে।বাবাও তো নাই।মা বাবা কোথায় গেছে? ”

মহুয়া মেয়েকে ডেকে নীচু স্বরে বললো ” তোমার বাবা শহরে গেছে।আচ্ছা মা,পুলিশের কথা কিছু শুনেছো? ”

” না। আমি তো ভয়ে দৌড়ে এসছি ”

” আচ্ছা হাত মুখ ধোঁও।আমি ভাত দিচ্ছি ”

বিকেলের দিক মহুয়া তিনজন পুলিশের সামনে বসা।প্রধান একজন,বাকি দুজন কনস্টেবল।মেইন যিনি,টেবিলে রাখা গ্লাসটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।গ্লাসের চারপাশে পিঁপড়া।পিঁপড়ার দল মেঝে বেয়ে গ্লাসের মধ্যে ঘুরপাক পাচ্ছে।মেইন পুলিশ অফিসার বললো

” আপনার স্বামী কোথায়? ”

মহুয়া প্রানপণ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে।স্বর তবুও এলোমেলো। বললো ” উনি একটু শহরে গেছেন ”

” কবে গেছে? ”

” চারদিন আগে ”

মহুয়া মিথ্যা বললো।তিনদিন আগে বললে পুলিশ ভাবতো মজিত,নওজান সমীরের সাথে দেখা করতে এসেছিলো।তখন সন্দেহ বাড়বে।মহুয়া খুব কৌশলে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।কোনোরকম সন্দেহ হতে দেওয়া যাবে না।পুলিশ বললো ” তিনদিন আগে মজিত আর নওজান আপনার স্বামীর সাথে দেখা করতে এসেছিলো? ”

” ওনারা তো আসেননি।তাছারা সমীর শহরে,দেখা করবে কি করে ”

” তাও ঠিক। আপনার মেয়ে কোথায়? ”

” ওই ঘরে,সাজগোছ করছে ”

” মেয়ে সাজগোছ পছন্দ করে নাকি? ”

” হ্যা ”

” যাদের পাওয়া যাচ্ছে না তারা খারাপ মানুষ। পুলিশের চাকরি নিয়ে বিপদে পরেছি,খারাপ মানুষকে খুঁজতে হয়।তার উপর নে”শাক্ত।কে জানে নেশা করে কোথায় চলে গেছে!ওদের জন্য আপনাকে বিরক্ত করতে চলে এলাম।কিছু মনে করবেন না।চা খাওয়াতে পারেন? ”

” অবশ্যই ”

মহুয়া ঘর থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে গেলো।আতঙ্কে তার শরীর গুলিয়ে উঠছে।কলপাড়ে গিয়ে হাতে মুখে জল দিলো।চা বানিয়ে ঘরে যেতেই দেখলো পুলিশের কেউই নেই৷

মহুয়ার শরীরে কারেন্ট খেলে গেলো!চট করে তাকালো টেবিলে।সেখানে ঘুমের ওষুধ মেশানো দুধের গ্লাসটা রাখা ছিলো।অন্যসব প্রমান লুকাতে গিয়ে গ্লাসটার দিকে তার খেয়ালই ছিলো না৷তন্নতন্ন করে গ্লাসটা খুঁজলো।কোথাও নেই।তবে কি পুলিশ সেটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে!

মহুয়া মেঝেতে বসে পরলো।গ্লাসে সমীরের হাতের ছাপ আছে।হাতের ছাপ দেখে কি বেড় করা যায় ছাপটা কতদিন আগের? যদি বেড় করা যায় তাহলে মহুয়া নিশ্চিত ফেঁসে যাবে।মেয়ল ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে মাকে দেখে

” মা কি হয়েছে তোমার? ”

” কি..কিছু না ”

” পুলিশ আঙ্কেল এসছিলো,আমার সাথে গল্প করে চলে গেছে ”

” আচ্ছা টুকু,ওদের হাতে কোনো গ্লাস ছিলো? ”

” দেখিনি তো ”

” ওরা তোমায় কিছু বলেছে? ”

” হ্যা।বলেছে আমি দেখতে নাকি অনেক সুন্দর ”

” আচ্ছা এখন পড়তে বসো যাও ”

সারারাত কাটলো মহুয়া ঘুমাতে পারলো না।বিছানায় শুয়ে এপাশওপাশ করলো শুধু।পরেরদিন পুলিশ বাড়িতে উপস্থিত…

” আপনার কথা হিসেবে সমীর গত চারদিন আগে শহরে গেছে।অথচ তৃতীয়দিন রাতে সে তার মেয়েকে সাজগোছের সামগ্রী কিনে দিয়েছে।কোন দৈববলে এটা সম্ভব বলতে পারেন মিসেস মহুয়া? ”

চলবে?

কলঙ্কের দাগ পর্ব-০২

0

গল্প #কলঙ্কের_দাগ
পর্ব=২
লেখক #জয়ন্ত_কুমার_জয়

মহুয়া বিছানার নিচ থেকে লুকায়িত ছু”রিটা বের করলো।টুকু আজ বাবার র”ক্তে র”ক্তস্নান করবে।

রাত বাজে দুইটা।গ্রামের সবাই নিশুতি।টুকু ঘুমাচ্ছে,আজকের পর থেকে সে সারাজীবন আরামের ঘুম ঘুমাতে পারবে।ঘুমের মাঝে কেউ তার শরীর স্পর্শ করবে না।লজ্জাকাতর স্থানে হাত বুলাবে না।

খু”ন করার এটাই উপযুক্ত সময়।ঘুমের ট্যাবলেটের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই কাজ করেছে।সমীর মুখ হা করে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত।

মহুয়া কলপাড়ে গেলো।হাড়ির কালি তোলার জন্য একটা ঝষা পাথর আছে,সেটা দিয়ে ছু”রিটার ধার তিক্ষ্ণ করলো।ভয় লাগছে,জীবনের প্রথম মানুষ খু”ন করবে সে।ঘুমের ঘোরে গ”লায় ছু!রি বসিয়ে দিলে কি সে জেগে উঠবে?নাকি চেঁচিয়ে উঠবে? চেঁচালে সমস্যা।আশেপাশের লোকজন চলো আসবে।গ্রামের মানুষের খুব কানখাড়া।সামান্য শব্দে এরা জেগে ওঠে।শুধু জেগে উঠেই এরা শান্ত হয়না।খুঁজে বেড় করে শব্দের উৎস কি।মহুয়া রান্নাঘরে গেলো।কড়া লিকারে এককাপ চা খেয়ে আগে নিজেকে শান্ত করতে হবে।

আড়াইটা বাজে।সমীর ম”রার মতো ঘুমাচ্ছে।মহুয়া শাড়ির পার ছিঁড়লো।শক্ত করে সমীরের হাত,পা বাঁধলো।গ”লায় ছু”রি চালানোর সময় দাপাদাপি করবে,হাত পা বাঁধা থাকলে সুবিধা।

ঘরে মা”রা যাবে না।র”ক্তে ভেসে যাবে।তাছাড়া লা”শ নিয়ে সমস্যায় পরতে হবে৷খু”নের থেকেও বেশি কঠিন লা”শ লুকানো।মাটির মেঝেতে মহুয়া জগের জল ফেলে মাটি পিচ্ছিল করলো।ঠিক করলো বাড়ির পেছনে টয়লেটের মল জমা হওয়ার জন্য যে খাদ আছে,লা”শ সেখানে ফেলে রাখবে।পঁচে গেলেও গন্ধ বাইরে বের হবে না।

পেছনের খাদ পর্যন্ত যাওয়ার পুরো যায়গাটা মহুয়া জল ফেলে পিচ্ছিল করলো।এঁটেল মাটি হওয়ায় বেশ পিচ্ছিল হলো।এরপর একটা প্লাস্টিকের বস্তা ঘরের মেঝেতে ফেলে সমীরের ঘুমকাতুরে শরীরকে টেনে নিচে ফেললো।

সমীর চোখ কিঞ্চিৎ মেলে উু জাতীয় শব্দ করলো।কিন্তু জেগে উঠলো না।মহুয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো।তারপর পিচ্চিল অংশ দিয়ে টেনে নিয়ে গেলো খাদের কাছে।সেখানে যাওয়ার পর খু”নের প্লান বদলালো।যথেষ্ট গভীর এই খাদ।হাত পা বাঁধা কাউকে ফেললে সে এমনেও বাঁচবে না।তার উপর সমীর ঘুমের ওষুধ খেয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় আছে৷গ”লায় ছু”রিঘাতের সিদ্ধান্ত পাল্টালো।

খাদের উপর কংক্রিটের ঢাকনা।চারপাশে সিমেন্টের পাতলা আস্তরণ দিয়ে ঢাকা।মহুয়া ছু”রির মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে প্লাস্টার তুললো।অতঃপর ঢাকনা খুলতেই মলের গন্ধ হঠাৎ মহুয়ার নাকে লাগতেই শরীর গুলিয়ে উঠলো।হরহর করে বমি করলো খাদের ঢাকনার উপর।

কলপাড়ে গিয়ে চোখে মুখে জলের ছিঁটে দিলো। একটা কাপড়ে সমীরের মুখ শক্ত করে বাঁধলো।প্রথমে কোম”ড় থেকে পায়ের অংশটা খাদের দিকে ঠেলে দিলে,অতঃপর হাত টেনে দিতেই ধপ করে শব্দ হলো।সমীর মলমূত্রের খাদে!

মহুয়া দ্রুত ঢাকনা লাগিয়ে দিলো।কান পেতে রইলো।ভেতর থেকে তোলপাড় শব্দ ভেসে আসছে৷মিনিট খানেক এরকম শব্দ করে সব শান্ত হয়ে গেলো।

মহুয়ার সারা শরীর কাঁপছে।ঘামে গা মাখামাখি।বড় একটা শ্বাস ফেলে পেছনে তাকালো।চাদর মুড়ি দেওয়া দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে।মহুয়ার পায়ের তল থেকে মাটি সরে গেলো।এরা কখন থেকে তার উপর নজর রাখছিলো? ওরা কি দেখেছে মহুয়া সমীরের হাত পা বেঁধে খাদে ফেলেছে?

মহুয়া আতঙ্কে পাথর হয়ে রইলো।চাদর মুড়ি দেওয়া একজন বলে উঠলো ” মানুষটারে মা”ইরা ফালাইলেন? ”

চলবে?

কলঙ্কের দাগ পর্ব-০১

0

গল্প #কলঙ্কের_দাগ
[এই গল্প কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]
পর্ব-১
লেখক #জয়ন্ত_কুমার_জয়

মহুয়া আজ রাতে স্বামীকে খু”ন করবে ঠিক করেছে।খু”নটা নিজে না,করাবে ১২ বয়সী মেয়েকে দিয়ে।রাতে মেয়েকে ডেকে….

” টুকু এদিকে এসো তো মা ”

টুকু কাছে এলো।মহুয়া বললো ” কাল রাতে তোমার বাবা খুব মন খারাপ করেছে ”

টুকু করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ” বাবা মন খারাপ করেছে?কেনো? ”

” তুমি ওনাকে একটুও ভালোবাসো না ”

টুকু দুঃখী মুখ করে বললো ” মিথ্যা কথা।আমি বাবাকে অনেক ভালোবাসি।বাবা খুব ভালো,আমায় চকলেট কিনে দেয় ”

” তুমি বাবার খেয়াল রাখো না।তাই বাবা অভিমান করেছে ”

” খেয়াল রাখি তো ”

” বাবা বাইরে থেকে আসলে তাকে দুধের গ্লাস এগিয়ে দাও? ”

” না ”

” এই নিয়ে বাবা অভিমান করেছে।আজ বাবা ফিরলে তুমি নিজের হাতে দুধ খাইয়ে দিবে।ঠিক আছে? ”

” আচ্ছা ”

রাত বাজে ৯টা।সমীর বাসায় ফিরলো দুটো বেলুন সঙ্গে মেয়ের সাজগোছের জন্য পাউডার,স্নো,লিপস্টিক আরো কতকিছু।ঘরে এসেই মেয়ের হাতে সাজগোছের জিনিস দিয়ে আদুরে গ”লায় বললো

” মামনি,এখন চট করে হাতমুখ ধুয়ে সাজুগুজু করো দেখি কেমন লাগে।তোমার জন্য তিন রঙ্গের লিপস্টিক নিয়ে এসছি,এই দেখো ”

লিপস্টিক দেখে টুকু আনন্দে সমীরের গলা জ”ড়িয়ে ধরলো।আদুরে স্বরে বললো ” আমার বাবা সবথেকে ভালো ”

” এই দেখো তোমার জন্য শাড়ি,ব্লা”উজ ও এনেছি।হাত মুখ ধুয়ে এসো,আমি নিজ হাতে সাজিয়ে দিবো ”

টুকু হাতমুখ ধুয়ে এলো।সমীর আগ্রহ করে সাজিয়ে দিলো।দরজার আড়াল থেকে মহুয়া সেসব দেখছে।টুকু যেই মহুয়ার দিকে তাকিয়েছে মহুয়া চোখের ইশারায় ডাকলো।টুকু বাবাকে বললো ” বাবা আমি ঘর থেকে আসি ”

এটা বলে টুকু মায়ের কাছে এলো।মা গ্লাসে দুধ মেয়ের হাতে দিলো।টুকু গাল ভর্তি হাসি নিয়ে মাকে বললো

” আমি খাইয়ে দিবো তাহলে বাবা আমার সাথে অভিমান করতে পারবে না।তাই না মা? ”

” হু ”

টুকু দুধের গ্লাস বাবার কাছে এনে ” বাবা দেখো আমি কি নিয়ে এসছি ”

” এখন দুধ!”

” আমি খাইয়ে দিবো ”

” আচ্ছা দাও।তুমিই তো খাইয়ে দিবে ”

মহুয়া দরজার আড়ালে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে দেখছে।তার পুরো শরীর ঘামছে।এইতো লোকটা গ্লাসে চু”মুক দিলো।দুধের সাথে ৬টা ঘুমের ট্যাবলেট মেশানো আছে।

মহুয়া বিছানার নিচ থেকে লুকায়িত ছু”রিটা বের করলো।টুকু আজ বাবার র”ক্তে র”ক্তস্নান করবে।

চলবে…??

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৮

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৮
” সুন্দরী একা একা কোথায় চললে?
ভরদুপুরে কলেজ থেকে ফিরছিলো মান্নাত। দুপুরের টাইমে এই রাস্তাটা ফাঁকা থাকে। থ্রিপিসের ওড়নাটা টেনে আরেকটু ঠিক করে হাঁটতে লাগলো ধীর পায়ে৷
‘একটা ছেলে সামনে এসে বলে,আরেহহহ বাহহহ চাশমিশ চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
‘মান্নাত নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলে প্লিজ আমাকে যেতে দিন।
‘ছেলেটা সামনে থেকে সরে বলে,যাও বেবিডল।
‘কিছুটা এগোতেই মান্নাতের ওড়না ধরে ফেলে৷ মান্নাত কিছু বলবে তার আগেই একটা কালো রঙের গাড়ি এসে ব্রেক করে তাদের সামনে। গাড়ি থেকে একটা ছেলে বের হয়েই ছেলেগুলোকে মারধর করতে থাকে। বখাটেদের মধ্যে একজন জাহিনের হাতে ছুড়ি দিয়ে পো’চ দেয়। যার ফলে জাহিনের হাত বেশ খানিকটা কেটে যায়।

“এই অন্তর, এদের খোঁজ বের কর তো আমার এলাকায় বসে ইভটিজিং? ওরা হয়তো জানেনা এটা সিংহের গুহা। এখানে শিকারি ভুল করে ঢুকে পড়লেই খালাস।
‘কথা বলার মধ্যে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা ওড়না ছেঁড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু নতুন কাপড় ছেড়া কি এতোটা সহজ!মেয়েদের মাথায় আসলেই কি ঘিলু কিছুটা কম থাকে নাকি? জাহিন শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,মিস চার চোখ, আপনার কি মনে হয় এটা কোন সিনেমার শুটিং!
‘মান্নাত ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকায়। লম্বা, ফর্সা , কালো শার্ট, কালো প্যান্ট কি মারাত্মক সুদর্শন যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! এই ছেলে সত্যি কি এই দেশের নাকি পাকিস্তানি?
‘জাহিন শিশ বাজিয়ে বলে,মিস চারচোখ এর আগে কোন ছেলে দেখেননি নাকি? আর শুনুন এটা কোন সিনেমা নয় যে আপনার ওড়না ছিড়ে আমার হাত বেঁধে দিবেন৷ মাথায় কোন বুদ্ধিসুদ্বি নেই নাকি! এই ভরদুপুরে এই রাস্তায় একা একা কোন ঘাস কাটতে এসেছেন?

‘আপনার হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে।
‘জাহিন আর কোন কথার উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো৷ অন্তরকে বললো, মেয়েটা বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আয়। আজকে রাতে কিন্তু পার্টি হবে মাম্মা।
‘অন্তর মান্নাত কে বললো,নাম কি আপনার?
‘মান্নাত
‘ কোন কলেজ?
‘মান্নাত চুপ করে রইলো।
‘যাতে খালাম্মা আর তালে ব্রিলিয়ান্ট! নিশ্চিত আপনি ক্লাস টপার? এরজন্যই সালার বস্তার মত ড্রেস আর চারচোখ। এতো পড়ে কি হবে?
‘ডাক্তার হবো৷
‘বাসা কই তোমার।
‘সামনের গলিতে৷
‘এমন মিন মিন করে কথা বলো কেন! এভাবে কথা বললে একটাও রোগীও পাবে না৷
‘তোমার বাবা কি করে?
‘ এসিপি।
‘ওহহ চোরদের সরদার? তা এতো কালো টাকা থাকার পরেও তোমার এ হাল কেনো?
‘ মান্নাত চুপ করে রইলো৷
‘তোমার বাসা চলে এসেছে বাসায় ঢুকে উদ্ধার করো মামুনি। অন্তর গেটের সামনে নেইম-প্লেট পড়লো। এসিপি জামাল সরদার।
‘মান্নাত চলে গেলো।
‘কি মেয়েরে বাবা একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলো না!
🌿 মিতা বেগম সেই কখন থেকে জাহিনের অপেক্ষায় আছে। জাহিন গেট দিয়ে ঢুকতেই তার চোখ গেলো জাহিনের হাতের ক্ষতস্থানে। সার্ভেন্টকে বললো, তাড়াতাড়ি ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসো৷

“এসেই মা’রপিট শুরু করে দিয়েছিস!তুই ম্যাচিউর হবি কবে বাবু!
‘তুমিই বলো আম্মু সিংহের সামনে শিকারী চলে আসলে সে কি শিকার ছেড়ে চলে আসে?
‘অতো সব আমি বুঝি না এসব মারামারি করার বয়স তোর নেই।এবার তোকে বিয়ে করিয়ে দেবো।
‘আম্মু এইসব ঝামেলায় আমি নেই৷ বাইদা ওয়ে আমার ভাবি কই?ভাবির জন্য গিফট নিয়ে এসেছি। দেবর ভাবি মিলে তোমার ছেলের চান্দী ফুটো করে দেবো৷

‘মিতা বেগম জাহিনের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলে,এই ‘বিয়ে টিকবে নাকি কে জানে! তুই ফ্রেশ হয়ে আয় তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দিবো।
‘ইট’স নট ফেয়ার আম্মু!ভাবির সাথে দেখা হলো না! আমি ফ্রেশ হয়ে আসি এরপর তোমার ছেলেকে ধরবো।

🌿জিয়ান নয়নার আর তার রিসেশনের ভিডিও দেখে এতোটাই তাতে ডুবে গেছে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সুনয়না “তোমার নামটা বোধহয় তোমার সরল চোখদুটো দেখেই রাখা হয়েছে! কি আছে তোমার ওই নিষ্পাপ চাহনিতে?আমি কেনো বারবার তোমার আঁখি পল্লবে হারিয়ে যাচ্ছি?
‘এই আপনার আসল রুপ!
‘ইরার কথা শুনে জিয়ানের ধ্যান ভাঙ্গলো। ইরার দিকে তাকিয়ে বলে সমস্যা কি আপনার! বারবার আমার আর আমার বৌয়ের মাঝখানে আসছেন কেনো?
‘আমাকে বোকা মনে হয়? আমি জানি আমার চোখ সুন্দর সবাই অনেক প্রশংসা করে তাই বলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার চোখ দেখবেন।
‘হোয়াট!এরকম দিবা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন।জায়িন চৌধুরীর রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি আপনাকে নোটিশ করবে! আমার দৃষ্টি এক্সপেন্সিভ সে যেখানে সেখানে তার দৃষ্টি স্থীর করে না৷ বলেই পায়ের উপর পা তুলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো৷
‘ইরা বেশ অবাক হলো! একটা ছেলের এতো এটিটিউট?তার পাশে বসা সুন্দরী মেয়ে তাকে নিজে যেচে এটেনশন দিতে চাইছে এরপরে ও ইগনোর করছে! ইরা হুট করে জিয়ান এর হাতের উপর হাত রাখলো।
‘ জিয়ান দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,ডোন্ট টাচ,কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ।
‘প্লিজ এমন করবেন না। আমার খুব ভয় পাচ্ছে আপনার হাতটা একটু ধরতে দিন৷
‘সমস্যা কি আপনার! একা ট্রাভেল করতে এতো সমস্যা তাহলে একা ট্রাভেল করতে কে বলেছে! আমার বৌ খুব ডেঞ্জারাস সে যদি জানে আমাকে কেউ টাচ করেছে তাহলে তার হাত কে’টে দেবে। সাথে আমারটাও। নিজের হাতের প্রতি মায়া দয়া থাকলে এমন ক্রাইম করার চিন্তা করবেন না।
‘মানবতার খাতিরে একটু হেল্প করুন প্লিজ৷
‘জিয়ান নিজের ল্যাপটপ ব্যাগ রাখলো। এখানে হাত রাখুন শক্ত করে ধরে রাখুন।
‘এখানে হাত রাখা আর সিটের হ্যান্ডেলে হাত রাখার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? মানুষ ভয় পেলে একটু সহনশীল আচরণ করতে হয়।
‘এরচেয়ে সহনশীল হওয়া আমার জন্য সম্ভব না। সো ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
🌿
আম্মু আট ঘন্টা হয়ে গেছে আর কতঘন্টা লাগবে?
‘নয়না আমি যতদুর জানি আঠারো /বিশ ঘন্টা লাগে। তুই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যা উঠে দেখবি জামাই নিজে থেকে তোকে কল করেছে।
‘নয়না জাহানারা বেগমের কোল থেকে মাথা উঠিয়ে নিয়ে বসে পরলো। নাহহ এখানে ভালো লাগছে না আমি নিজের রুমে শোবো। বলে নিজের রুমে চলে আসলো৷ জিয়ানের টিশার্ট নিজের গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পরলো৷ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ট্রাই করছে। সবে মাত্র তন্দ্রা ভাব এসেছে৷ হঠাৎ মনে হলো কারো গরম নিশ্বাস তার মুখে পরছে, ঘুমঘুম চোখ খুলেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনি!
‘জিয়ান নয়নার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বলে একদম চুপ একটুও কথা বলবে না। তোমার ঠোঁটের নেশায় আমি মাতাল হয়ে গেছি আমার নেশা কাটাতে তোমার ঠোঁট দুটো চাই।
‘নয়না ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো, আওয়াজ করে ডাকলো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনি কোথায়? বেড সাইড সুইচ দিয়ে লাইট অন করলো। নাহহহ কোথায় তার অস্তিত্ব নেই৷ জিয়ানের শার্টটা গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,এ কোন রোগে আমাকে আক্রান্ত করে গেলেন!আমি যে আপনার সাথে কথা বলার তৃষ্ণায় কাতরাচ্ছি! একবার আপনার কন্ঠ শুনিয়ে আমার তৃষ্ণা মিটিয়ে দিন। কথা বলার তৃষ্ণা যে বড্ড বাজে তৃষ্ণা।
🌿
এয়ারপোর্ট থেকে অনিকেত সোজা চলে আসলো হাফ মিঙ্গেল নাহিদের বাসায়৷ কোন মেয়েই আজ পর্যন্ত তার মনের ধারে কাছে যেতে পারলো না৷ মনের সাইড ঘেঁষে সব মেয়ে বের হয়ে যায়! মনে বিয়ে করতে না পারার পাহাড় সমান দুঃখ নিয়ে ধপ করে বসলো সোফায়। কোন ভুমিকা ছাড়াই নাহিদকে জিজ্ঞেস করলো, তোর বৌ যে তুই ওয়াশরুমে দুই মিনিট লেট করলেও সন্দেহ করে!এতো প্যারা দেয় কথায় কথায় সন্দেহ তোর বিরক্ত লাগে না?
‘সন্দেহ করে এটা ভালো তাতে আমি বুঝতে পারি। কিন্তু সন্দেহ না করলে বরং আমার বিরক্ত লাগতো টেনশন হতো৷
‘মাথার তার কি আছে না গেছে?
‘ এখনো একটু আছে কবুল বলার পর ততটুকু ও থাকবে নাকি গ্যারান্টি দিতে পারছি না৷
‘এ কেমন ভালোবাসা!
‘না করেছিস বিয়ে আর না করেছিস জীবনে প্রেম তুই এডি বুঝবি না। ও সন্দেহ করে আমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে তাই। ভালোবাসা ফেইক হলে আমি উগান্ডা গেলেও সন্দেহ করতো না৷
‘উপসসস বড্ড ব্যথা পেলুম বুকে। এজন্মে বিয়ে কি জুটবে আমার কপালে! একটা বৌ নাই এই যন্ত্রণায় কাতর হয়ে যাচ্ছি।
‘নাহিদ হেসে বলে,তুই কাতরাতে থাক। তা হসপিটালে না যেয়ে আমার বাড়িতে কি?
‘আমরা চারজন দুইটা উইকেট পরে গেছে, আরেকটা আউড হওয়ার দারপ্রান্তে, শা’লার আমার উইকেটের পতন কবে হবে! জীবনে লাবিবের মত হতে পারলেই জীবন সুন্দর, ওই শা’লা বন্ধুর প্রেমিকা নিয়া ভাগছে আর আমি বন্ধুর বৌ নিয়া ভাগতাম। ব্যাস মেয়ে খোঁজার ঝামেলা চুকে যেতো।
‘লাবিব কাজটা ঠিক করে নাই।এতো কিছুর পরেও প্লেবয় রয়ে গেছে ওর এক্স সুমাইয়ার সাথে এখনো চ্যাট করে।
‘তুই কেমতে জানলি?
‘আমার হবুর ফ্রেন্ড সুমাইয়া।
‘ভাই তোর বৌটাকে দেখে রাখ আবার তোরটা নিয়ে টানাটানি না শুরু করে?
‘অন্যের টানাটানিতে যে হাত ছেড়ে দেবে তাকে চাই না। ভালোই হইছে রেজার সাথে নীলাঞ্জনার বিয়ে হয়নি৷ তুই বল,মেয়েটাও তো ভালো না? ভালো হলে নিজের প্রেমিকের ফ্রেন্ডের সাথে টু টাইমিং করে!যেমন বারো… মাইয়া তেমন তেরো,, জামাই পাইছে।
‘সে যাহোক আমার বুকে ব্যথা কমানোর ট্রাই করো বাবু।
‘শা’লা তোর কি আমাকে গে মনে হয়!
‘,চুপকর লুচ্চা। আমি কইছি চা- কফির কথা। আমার এ ইজ্জত শুধু মাত্র আমার ভবিষ্যত বৌয়ের জন্য সংরক্ষিত।

#চলবে।
আসসালামু আলাইকুম।নতুন কিছু ক্যারেক্টার যুক্ত হয়েছে। কেমন লাগছে জানাবেন৷

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৭

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৭

‘নয়না বারবার মোবাইলটার দিকে তাকাচ্ছে।নাহহ একটা কল ও আসেনি! এই লোকটা এমন রসকষহীন কেন!আরেহহ ভাই তোর প্রেমিকা পালিয়ে গেছে তাতে কি হইছে! দুনিয়ায় মেয়ের অভাব পরছে! আমার মত সুন্দরী একজনকে ভালোবাসলেই তো লেটা চুকে যায়। কত নিষ্ঠুর হলে একবারও কল না করে। নাহহ নয়না স্থীর হতে পারছে না৷ পায়চারি করছে সারা রুম জুড়ে। রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসলো। চোখ গেলো পশ্চিম কর্নারে চোখের সামনে ভেসে উঠলো জিয়ানের প্রতিচ্ছবি! এই তো মনে হচ্ছে তার অস্থিরতা দেখে লোকটা মুচকি হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। দ্রুত ছুটে গেলো চেয়ারের সামনে, একদম দাঁত ফেলে দেবো এভাবে হাসলে।
‘আশ্চর্য সামনে কেউ নেই! লোকটা থাকলে ঠিক বলতো ফেলো দাও দেখি তারপর খপকরে তাকে কোলে নিয়ে নিতো? উফফ এসব আর ভাবতে পারছে না নয়না৷ দ্রুত পায়ে বারান্দা থেকে বের হয়ে আসলো৷ রুমেও স্বস্তি পাচ্ছে না৷ রুম থেকে বের হয়ে টিভি অন করলো,সেখানে গান বাজচ্ছে, সখী তোরা প্রেম করিও না পিরিত ভালা না…
চ্যানেল পাল্টে চলেছে কোথাও স্থীর হতে পারছে৷ বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে বলে,মহা মুশকিলে পরলাম তো!এই প্লেন ড্রাইভারতো কিছুতেই আমার মস্তিষ্ক আর হৃদয় থেকে সরছেই না।
‘আপিতা তুমি কার সাথে কথা ও।
‘নয়না সূচনার দিকে তাকিয়ে বলে,নট আপিতা ইট’স আপি।
‘ওকে পাপিতা।
‘তুই এতো বিচ্ছু কেন সূচনা? আমার মুড ভালো নেই সর এখান থেকে।
‘সূচনা হুট করে নয়নার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে বলে,তোর মুড দিয়ে আমি কি করবোরে আপিতা। আমি কার্টুন দেখবো সর তুই।
‘তোকে না কতবার বলছি আমাকে তুই করে বলবি না আর আপিতা বলবি না!
‘আপিতা, তুই আপিতা, তুই আপিতা।
‘চুপ করবি!
‘করবো না চুপ তুই করবি! চিনিস আবার বাবাকে?
‘নয়না সূচনার কান টেনে দিয়ে বলে,তুই মুচনা মুচনা।বলেই নিজের মায়ের রুমে চলে গেলো৷
‘সূচনা কাঁপাল কুঁচকে বলে,আমার সাথে এমন করেছিস দেখিস তোর সাথে কি করি আপিতা।
‘রুমে এসেই জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,আম্মু আমার ভালো লাগছে না৷
‘জাহানারা বেগম নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,বাহিরে যাবি? চল আমরা ফুচকা খেয়ে আসি।
“,নয়না আনন্দিত হয়ে বলে সত্যি!
‘হুম সত্যি।
‘নয়নার তবুও মন ভালো হচ্ছে না। ওই লোকটা কল করবে কখন! একটা কল কি করা যেতো না! আরেহহ মানুষের জন্য একটু মায়া তো থাকবে! কি নিষ্ঠার মানব লোকটা!
‘কিরে মা এখন কি ভাবছিস? আমাকে বল।
‘কিছু না আম্মু।
‘কিছু না হলেই ভালো। এখন মাথা থেকে সব ভাবনা বাদ দিয়ে দিবি৷ একমাত্র পড়া ছাড়া। সামনে পরিক্ষা সেটাতে ফোকাস করতে হবে। শ্বশুর বাড়ির লোকদের কাছে নয়ত লজ্জায় পরতে হবে।
‘নয়না চট করে উঠে বসলো, জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,আম্মু আমার আরেকবার বিয়ে দিলে কেমন ছেলের কাছে দিবে? এবার বিয়েতে বর কি আমি চুজ করতে পারবো?
‘মেয়ের এমন বোকার মত প্রশ্ন শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন৷
এসব তুই কি বলছিস? তোকে আবার বিয়ে কেন দেবো!বিবাহিতা মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়ে কোন দুঃখে দিতে যাবো!তাছাড়া জামাই আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। যেমন দেখতে তেমন কি অমায়িক তার ব্যবহার।
‘দেখতে রানবীর কাপুড়ে হলেই হয়!একদম ভালো না৷ এখনো একটা কল করলো না আমাকে! কেমন পাষাণ হৃদয়েে মানুষ! এমন মানুষ আমার মোটেই পছন্দ না৷
‘আরেহহ বোকা মেয়ে প্লেনে থাকলে কল কি করে করবে! ল্যান্ড করলে তারপর তোকে কল করতে পারবে৷ এখন তো ফোন এরোপ্লেন মুডে আছে। নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন।
‘নয়নার মন পুত হলো না কথাটা৷ কল করেনি সেটা মানলাম আমার শেষ কথাটাও তো শুনলো না!আস্তা হিটলার ড্রাইভার। আর একবার সামনে আসুন আপনাকে আমি উগান্ডা ভ্রমন করিয়ে আনবো।
‘এতো ভাবা বাদ দে। যা রেডি হয়ে আয়, ফুচকা খেয়ে আসি। আর হ্যা কাল থেকে কিন্তু স্যাররা আসা শুরু করবে পড়াতে। পরিক্ষার মাত্র সতেরোদিন বাকি।
‘তুমি না বলছিলা বিয়ে হলে আর পড়তে হবে না৷ তাহলে আর পড়বো না৷ আমার পড়াশোনা এখন বর, টিচার হলো শ্বশুর বাড়ির মানুষ, সংসার হলো ক্লাস রুম।
‘পরিক্ষা না দিলে জামাই মানুষদের কি বলবে, আমার বৌ আন্ডার মেট্রিক? জামাইয়ের যোগ্য হতে হবে না? উল্টোপাল্টা কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
‘🌿জিয়ান চোখ বন্ধ করলেই নয়নার নিষ্পাপ মুখশ্রী ভেসে উঠে চোখের সামনে। শেষ চাহনি তার চোখের আকুলতা। চোখ খুলে ফেলে জিয়ান৷ ঘুম আসছে না তার৷ ইশশ কেনো যে তোমার কথাটা শুনলাম না! আচ্ছা এই পাঁচদিনে মেয়েটার প্রতি কেমন টান অনুভব করছি৷ আমার কি বৌ হিসেবে সুনয়নাকে মেনে নেয়া উচিৎ?
‘এই যে মিস্টার হ্যান্ডসাম।
‘হঠাৎ এমন সম্বোধনে জিয়ান পাশ ফিরে তাকালো৷ জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে?
‘আমি ইরা।
‘জিয়ান ভ্রু কুচকে আবার নিজের ধ্যানে মগ্ন হলো৷
‘ ও হ্যালো পাত্তা দিচ্ছি বলে ভাব নিচ্ছেন! আমি ইরা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আর তাছাড়া আমরা কানাডার সিটিজেন। ছেলেদের লাইন লেগে যায় আমার পিছনে কিন্তু আমি কাউকে পাত্তা দেইনা৷
‘জিয়ান কানের মধ্যে ইয়ারফোন গুঁজে নিলো৷
‘আপনি এমন একটা ভাব নিচ্ছেন মনে হচ্ছে আপনি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে! আমার ভয় হচ্ছে তাই আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম৷ এতো এটিটিউট কিসের আপনার! চেহারা আর বডি থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না৷
‘জিয়ান আস্তে করে, বলল, আমি মানুষ না দানব, পিচাশ টাইপ দানব। আমি আমার বৌয়ের বিরহে বিলীন হয়ে যাচ্ছি তাই দয়া করে আমার বৌয়ের কল্পনায় বা’হাত ঢোকাবেন না৷
‘ছিহহহ আপনার বিহেভিয়ার এমন কেনো! আপনি দেখতে যতটা সুন্দর ব্যবহার ততটাই বাজে। সো কন্টিনিউ। ইরা ভেবেছিলো সুদর্শন এক যুবকের সাথে তার সিট পরেছে প্লেন জার্নিটা তার ভালোই কাটবে সতেরো ঘন্টার দীর্ঘ জার্নি কথা বলার মত একজন পাশে থাকলে একটু সহজ হতো৷ অদ্ভুত লোকটা।
‘জিয়ান মেজাজ হারাচ্ছে!বিরক্ত হচ্ছে নিজের উপর। ইচ্ছে করছে এখন এক দৌঁড় নয়নার কাছে যেয়ে নয়নাকে জড়িয়ে ধরতে। কপালে চুমু দিয়ে বলতে, বলো তুমি কি বলতে চাও তোমার কথা না শুনে কোথাও যাচ্ছি না৷ নয়নার প্রতি সে অন্যায় করেছে একে একে কতগুলো অন্যায় করে বসেছে বাচ্চা মেয়েটার প্রতি। বাচ্চা মেয়ে শব্দটা মনে আসতেই হেসে দিলো জিয়ান৷ নয়না এখন সামনে থাকলে নিশ্চিত কোমড়ে হাত রেখে বলতো, আমি মোটেও বাচ্চা মেয়ে না। আমি ষোড়শী বালিকা৷ আর কয়েকদিন পর কলেজে ভর্তি হবো৷
‘ইরা জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,লোকটার কি মাথায় সমস্যা আছে! একা একা পাগলের মত হাসছে?
🌿 মিজান তালুকদার মাহবুব তালুকদারের সামনে বসা।
‘কিছু বলবি?
‘ভাইজান আমি নীলাঞ্জনার খোঁজ পেয়েছি কিন্তু আমার মন পোড়ে তবুও আমার বিবেক তার দিকে ফিরতে দিচ্ছে না৷ আইরিন নীলাঞ্জনার জন্য কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
‘দেখ মিজান। ভুল করলে সেটা ধরে তো আর বসে থাকা যাবে না৷ যে ভুল করে তার ফল সেই ভোগ করে৷ এমন একটা ছেলেকে ছেড়ে ও যে ভুল করেছে একদিন ও নিজেই আফসোস করবে। তুইতো দেখেছিস রেজাকে কি সুদর্শন আর কর্মঠ ছেলে৷ নিজের মেয়েকে তো আমরা পর করে দিতে পারি না। তবে তুই আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধর ও নিজেই আসবে৷ আমরা সখ করে সমুদ্র ভ্রমণে যাই, হুট করে পঁচা সমুকে পা কাঁটলে তবেই টের পাই, সাবধানে চলাচল করতে হতো! অতি আবেগে আমরা ভুল করে বসি। ও পঁচা সুমুকে পা’ কেটে দগ্ধ হয়ে ঘরের মেয়ে ঘরেই ফিরে আসবে। চিন্তা করিস না৷
‘বিয়েটা টিকবে না বলছো?
‘আমি ছেলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে যা বুঝেছি টেকার সম্ভবনা খুব কম৷ যদি টিকে যায় তাহলে তো ভালোই৷ আইরিনকে সামলা। বড় মেয়ের শোকে ছোট মেয়েটাকে অযত্ন যেনো না করে৷ যে চলে যায় সে স্বার্থপর। স্বার্থপর মানুষের জন্য ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দিতে হয় কারন এমন মানুষ ভালোবাসার কদর বুঝে না৷ কি না করেছি আমরা নীলাঞ্জনার জন্য! আমাদের সম্মানের কথা একটাবারও ভাবলো না! বাবা, মায়ের,পরিবারের ভালোবাসা সম্মানের চেয়ে নিজের ভালো থাকাটা বেছে নিলো!
🌿এক ছেলে চলে গেছে আরেক ছেলে আসতেছে৷ ছেলের রুম গুছিয়ে রাখলো নিজের হাতে। কিচেনে এসে নানারকম খাবার রান্না করলো ছেলের পছন্দের। ছেলেটা তো বাসায় তেমন থাকেই না। সারাক্ষণ তার মাথায় থাকে বাউণ্ডুলেপানা৷ কোন দেশ রেখে কোন দেশে ভ্রমন করবে সেই তাড়না। রেজা রাগি তবে মা’ভক্ত। জাহিন একরোখা তার মন মর্জি বোঝা মুশকিল৷
‘দীর্ঘ আটমাস পর দেশের মাটিতে পা’রাখলো জাহিন চৌধুরী। চৌধুরী বংশের ছোট নবাব৷ এশ কালার শার্ট, শার্টের হাতা ফোল্ড করা। কালো চশমা পরা,এক হাতে লাগেজ অন্য হাতে ব্লেজার। হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে এয়ারপোর্টের গেট দিয়ে বের হচ্ছে।

#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৬
আমার বর হ্যাসবেন্ড প্লিজ তার সাথে দেখা করতে দিন৷
‘ম্যাম আপনার বর তো হ্যাসবেন্ড হবেই। বাংলাতে বর,ইংরেজিতে হ্যাসবেন্ড৷
‘আরেহহহ আমার বর ড্রাইভার।
‘ম্যাম অযথা আমাদের সময় নষ্ট করবেন না৷ আপনার বর হ্যাসবেন্ড হোক বা ড্রাইভার আমরা আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবো না৷
‘জাহানারা বেগম বললেন এসব কি ভুলভাল বলছিস তুই?
‘আমার কি দোষ বলো আম্মু?এই লোক আমার মাথা খারাপ করে রেখেছে।
‘স্যরি ভাইয়া। আসলে বলতে চেয়েছিলাম আমার হ্যাসবেন্ড পাইলট। সে ফাস্ট অফিসার৷ আইমিন ক্যাপ্টেন। ওনার কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রেখে গেছেন ভুলবশত প্লিজ হেল্প করুন এগুলো তাকে পৌঁছে দিতে।
‘কোন দেশে যাবে আপনার হ্যাসবেন্ড?
‘কানাডা৷
‘ওয়েট ম্যাম। দেড় হাজার টাকা দিন।
‘ নয়না কিছু বলতে নিলে,জাহানারা বেগম নয়নার হাত টেনে ধরে। নিজের ব্যগ থেকে টাকা বের করে দেন৷
‘লোকটা একটা টোকেন দিয়ে বলে,রুম নাম্বার দশে চলে যান৷ তারা আপনাকে হেল্প করবে। ধন্যবাদ ম্যাম।
‘নয়না রুম নাম্বার খুঁজতে লাগলো হঠাৎ করে চিৎকার করে ডেকে উঠলো, মিস্টার প্লেন ড্রাইভার…..
‘অনিকেতের সাথে পুরো রাস্তা হাসিঠাট্টা করতে করতে এয়ারপোর্টে চলে আসে দু’জনেই।
‘অনিকেত জিয়ানের ব্যাগ নামিয়ে এনে বলে,তুই আমার বন্ধু এটা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ভাই।
‘তোর বিশ্বাস করতে হবে না।
‘ভাবির কোন বান্ধবী নাই দোস্ত?
‘এখন এসব বলার সময় শা’লা।
‘বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে সময় টময় হিসেব করতে নেই। যদি পেয়ে যাই মনমতো কন্যা বিয়ে করে বনবাসে যাবো।
‘,জিয়ান হেসে বলে, বিয়ে করে বনবাসে কোন দুঃখে যাবি?
‘বৌ কে নিয়ে যাবো। জানিস তো আমি আবার প্রকৃতি লাভার
বিয়ের একবছর টানা হানিমুন করবো এক দেশের জঙ্গল থেকে আরেক দেশের জঙ্গলে।
‘হানিমুন তো ভালো কথা তোর হাড্ডি অবশিষ্ট থাকলে তবেই না এক জঙ্গল ভ্রমণ শেষ করে আরেক জঙ্গলে যাবি!চুপ কর আর চল।
‘হাঁট ছিলো দুজনে। এমন সময় অনিকেত আবার বলে উঠলো,ভাই তোর বুকে ব্যথা করছে না? এতো সুন্দরী বৌ রেখে তুই কোন বুকের পাঠা নিয়া ফ্লাই করতে চলে আসলি? বৌটাকে সাথে করে নিয়ে আসলে একটা দুইটা চুম্মা খাইতি,জড়ায়া টরায়া ধরতি!বৌ কান্না করতো তুই বলতি কেঁদো না সাথী আমার, আমি তোমার আছি তোমারই থাকবো, ফিরে ফিরে তোমারই কাছে আসবো।
‘চুপ করবি!নয়তো তোর সাথে এখানেই বিদায়।
‘আচ্ছা ভাবির কোন বোন নেই?
‘আছে একটা তোর মাথার চুল সব টেনে ছিড়ে ফেলবে৷ তবে তোর জন্য ওই একপিস যথেষ্ট।
‘তো করিস না আর দেরি নাম্বার দে তাড়াতাড়ি।
‘তুই আসলেই ডাক্তার?
‘হসপিটাল আর ক্লিনিকে আমি ডাক্তার। বাহিরে আমি রোমিও কিন্তু আমার জুলিয়েটের খবর নাই৷
‘ওর বয়স আট তবে তোরে নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারবে৷
‘একটা হৃদয় কয়বার ভেঙে দিবি বন্ধু!পাষান বন্ধু। কথা বলছিলো আর হাঁট ছিলো৷ হটাৎ কানে আসলো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। হুট করে পা’থামিয়ে দিয়ে সামনে চোখ বোলালো৷ নাহহ নেই তো!তাহলে কি আমি ইমাজিন করছি!ভাবনার ভেদ করে আবার কানে আসলো মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। পেছনে ঘুরে তাকাতেই চোখ পরলো নয়নার দিকে,এক প্রকার ছুটে আসছে সে৷জিয়ান যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা৷ নিজের দু’হাত প্রসারিত করে দিয়ে বলে, নয়না। সব মানুষ তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। হুট করে দেখলে সবাই ভাববে কোন সিনেমার শুটিং চলছে এখানে,নায়ক নায়িকার জন্য দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে, আর নায়িকা দৌড়ে নায়কের কাছে আসছে!
‘অনিকেত ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,এটা তো ভাবি?তুই বললি অস্থায়ী এখন দেখি অন্য সিন? অনিকেতের কথা জেনো জিয়ানের কর্নে পৌঁছায়নি। সে তাকিয়ে আছে নয়নার দিকে।
‘নয়না জিয়ানের সামনে এসে থামলো, জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
‘জিয়ান নিজের প্রসারিত হাত দুটো সরিয়ে নিলো।আচ্ছা সে কি চাইছিলো নয়না তাকে জড়িয়ে ধরুক! কেনো তার মন এটা চাইলো?যাকে আপন করতে পারবো না তাকে কেনো বক্ষ টানছে? কেনো মনে হচ্ছে এইভাবে ছুটে এসে আমার বক্ষে আঁছড়ে পরুক!
‘প্লেন ড্রাইভার আপনি লোকটা মোটেও সুবিধার নন। রাতেই বললেন,নাম্বার লাগবে? নাম্বার না দিয়ে চলে যাচ্ছেন?
‘সিরিয়াসলি সুনয়না তুমি একটা নাম্বারের জন্য এভাবে ছুটে এসেছো? তোমার মাথার স্ক্রু আছে নাকি পরে গেছে৷
‘চুপ করুন সব সময় জটিল জটিল কথা! এতো কষ্ট করে এসেছি কই কোলে নিবে চুমু খাবে তা-না উল্টো বকড় বকড় করছেন?
‘পাবলিক প্লেসে তোমাকে কোলে নিয়ে চুমু খাবো?তুমি এটা চাইছো? তুমি চাইলে আমার কোন সমস্যা নেই।
‘অনিকেত কাশি দিয়ে বলে,ভাই তুই থাম আমার বুকে ব্যথা উঠতেছে।
‘আপনি এখানে কি করছেন! দ্রুত হসপিটালে যান। অসুস্থ মানুষ এয়ারপোর্টে না হসপিটালে থাকে।
‘নয়না ও আমার বন্ধু অনিকেত। ও পেশায় ডাক্তার কার্ডিওলজিস্ট। মজা করে বলেছে। এবার বলো কেনো এসেছো?
‘বাসায় বসে আপনার বিরহে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম৷ তাই ভাবলাম পাগল না হয়ে আপনাকে কয়েকটা কিসমিস দিয়ে যাই।
‘এখানে কেনো বেবি? খোলা ময়দানে প্রেম জমে নাকি? প্রেম জমে আড়ালে।
‘আহারে মিস্টার রোমিও। এই নিন আপনার কিসমিস।
‘ধন্যবাদ প্রিয়া।
‘ওয়েলকাম প্রিয়।
‘জিয়ান ওয়ালেট থেকে তিনহাজার টাকা বের করে নয়নার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, বেড সিটের দাম৷ আমি আবার এতো উদার না।
‘নয়না জিয়ানের জিন্সের পকেটে টাকাটা ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,দাগ চলে গেছে তাই টাকা লাগবে না৷
‘তোমার সাথে কে এসেছে?
‘আম্মু এসেছে।
‘উনি কোথায়?
‘বসে আছে।
‘আচ্ছা আমার হাতে একদম সময় নেই। আমি আসি৷
‘শুনুন
‘বলো।
‘এভাবে বলো, বললে কি বলবে হু! মনে হচ্ছে আমার উপর এক্ষুনি পাহাড় ছুড়ে মারবেন৷
‘সুনয়না এখন মজা করার সময় না।
‘অনিকেত হেসে বলে,এতো কিউট একটা বচ্চা বৌয়ের মিষ্টি কথা তোর ভালো লাগছে না!
‘আপনি হার্টের ডাক্তার তাইতো?এককাজ করতে পারবেন?
‘কি কাজ লিটল ভাবি।
‘এই ড্রাইভার হার্টের সার্জারী করে সব বদ রাগ জেদগুলো বের করে দিবেন৷
‘অনিকেত জিয়ানের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে সরে গেলো।
‘আপনি এভাবে চোখ রাঙিয়ে ডাক্তার বাবুকে সরিয়ে দিলেন কেন? আমি তো আপনার চোখ রাঙানোকে ভয় পাই না৷
‘নয়নার কথার উত্তর না দিয়ে নয়নার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজের নাম্বার সেভ করে দিলো৷ ফোনটা নয়নার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,পড়ালেখা করো ক্যারিয়ার গড়ো।
‘আমার পড়ালেখায় হলো বিয়ে আর ক্যারিয়ার হলো সংসার।
এতো কষ্ট করে পড়ালেখা না করে বরের সাথে ঝামেলা করবো। উল্টোপাল্টা কাজ করে শ্বাশুড়ির বকা খাবো৷ এই হলো আমার মূল ক্যারিয়ার৷ জামাই ইনকাম করবে আমি তার মাথায় চড়ে দুনিয়া ভ্রমণ করবো৷
‘এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হও। আমার হাতে সময় নেই।
‘আহা আমার কথাটা তো শুনবেন।
‘এখন বাচ্চামো করার সময় না সুনয়না।
‘আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।
জিয়ান কিছু বলবে তার আগেই এনাউন্সমেন্ট হলো, প্রিয় যাত্রীরা Ac. 87 টরন্টোগামী ফ্লাইটের যাত্রীদের গেইট নাম্বার ২২ এর দিকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
‘জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,কিছু কথা না বলা থাকুক। কথাটা শেষ করেই দ্রুত সামনের দিকে পা’ বাড়ালো।
জিয়ানের ইচ্ছে করছে নয়নার কথাটা শুনতে কিন্তু তার গন্তব্য সামনে এই মূহুর্তে পিছু ফেরা সম্ভব না। তাছাড়া সময় একদম কম।
‘নয়না এক ভাবেই তাকিয়ে আছে জিয়ানের চলে যাওয়ার দিকে। মনে মনে বলছে,আমার কথাটা শুনলেন না! কথার ভাজে কথা জমতে থাকুক৷ আপনি ভালো থাকুন সব সময়। নয়না ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলো যতক্ষণ জিয়ানকে দেখা যাচ্ছিলো।
‘জাহানারা বেগম এসে নয়নার হাত ধরে বলে,ওতে কাজে যাচ্ছে এটাই ওর পেশা। ফিরে চল। সময় হলে আবার তোর কাছেই আসবে।
‘জিয়ান প্লেনে নিজের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে,নিজের মোবাইল বের করে নয়নার আজকে সকালে লুকিয়ে তোলা পিকটার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার চাওয়াটা আমি পূরন করতে পারলাম না।
আমার জীবন তোমার নামে বিলীন করতে পারলাম না,
ধীরে ধীরে জ্বলছি,আগুনকে হৃদয় থেকে নেভাতে পারছি না!
‘বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সাথে। নিজেকে কখন ক্ষমা করতে পারবো না। “তুমি সদ্য ফোটা কলি আমি ঝড়ে যাওয়া ফুল, কিভাবে খুঁজবো তোমাতে কুল!
‘ভিষন ভিষণ অভিমান জমলো নয়নার৷ তার কথাটা না শুনে চলে গেলো! লোকটা একটুও ভালো না৷ আজ থেকে তার নাম নিষ্ঠুর প্লেন ড্রাইভার। মনে মনে বকবক করতে ব্যস্ত নয়না। জাহানারা বেগম বললেন, এতো কি ভাবছিস?এসব ভাবনা বাদ দিয়ে এবার বইখাতার চিন্তা কর।এখন রেজাল্ট খারাপ হলে শ্বশুর বাড়ির মানুষ ও তোকে পঁচাবে।
🌿
লাবিব বাসায় এসে ঢুকতেই। সৈকত সাহেব (লাবিবের বাবা) বলেন,তুই আমার বাসায় কেনো এসেছিস?
‘বাবা স্যরি।কিন্তু দোষটা আমার একার না৷ আমি তোমাদের বলেছিলাম তোমরা রাজি হওনি তাই এই পথ বেঁছে নিতে হলো।
‘সৈকত সাহেব লাবিবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,তা তোমার বাবা মা তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে? বড়লোক ছেলে পেয়েই গলায় ঝুলে পরলে? কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যায় শুনি!
নীলাঞ্জনা নিচের দিকে তাকিয়ে নিরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কত আদরের মেয়ে ছিলো সে। মুখ ফুটে বলার আগেই সব হাজির হয়ে যেতো।এতো বিলাসী জীবন ছিলো তার৷ আজ তার একটা ভুল তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে!
‘শিল্পি বেগম এসে বলে,(লাবিবের মা) মেয়েটার কি দোষ বলো? তোমার ছেলে প্রশ্রয় দিয়েছে বলেই না এসেছে সব ছেড়ে।
‘একদম চুপ করো তুমি। আমি কি ফিডার খাওয়া বাচ্চা? মেয়েরা সায় না দিলে কোন ছেলের সাহস হয়! আমি নিশ্চিত কোন নিম্ন পরিবারের মেয়ে এরজন্য লোভে পরে আমার ছেলেকে রুপের জ্বালে ফাঁসিয়েছে। এই মেয়ে বংশ পরিচয় কি তোমার? তা আদৌও বংশ পরিচয় আছে তো নাকি ছাপড়ি?
#চলবে

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

1

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তূজা

সমাপ্তি পর্ব.

ইরাজকে জোর করেও সারাদিনে কিছু খাওয়ানো যায়নি। মেঘালয়াকে বেডে শিফ্ট করা হলেও পুরোপুরি হুশে নেই মেঘালয়া। বলা যায়, অবচেতনায় লুপ্তপ্রায় পড়ে আছে মেয়েটা। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি একাধারে বসে ছিল ইরাজ মেঘালয়ার মেঘালয়ার পাশে মেঘালয়ার হাতটা ধরে। ব্লাড প্রেশার এখনও পুরোপুরি কন্ট্রোলে নেই— ১২০/১৫০ চলছে। তবে ঝুঁকিমুক্ত বলা চলে। আনতারা খানম মেঘালয়াকে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। ইরাজ বেরিয়ে এলে হেলাল সাহেব আবারও গিয়ে বসলেন নিঃশব্দে মেয়ের শিয়রে।

ইরাজ রোবটের মতো কৃত্রিম পায়ে হেঁটে হাসপাতালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। শরীরে জড়ানো সেই গতকাল রাতের একটা জীর্ণ শার্ট। সারাদিনের অভুক্ত অবস্থায় মুখটা বড্ড শুকনো লাগছে তার। যে কেউ দেখলে অবাক হবে–এই কী সেই ইরাজ! সবসময় গুছিয়ে চলা ইরাজকে আজ বড়ো অগোছালো লাগছে। বারবার ইরাজকে ওই অর্ধ-বিকশিত কচি মুখটা চোখের স্মৃতি দংশন করছে। কেমন এক দুর্বিসহ যন্ত্রণা একাধারে খুঁচিয়ে যাচ্ছে ইরাজকে। আবার মেঘালয়ার ওই র ক্তশূন্য অচেতন মুখ!

ইরাজ রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনল। দিয়াশলাই চেয়ে নিলো দোকানদারের কাছ থেকে। সিগারেটে টান দিতে গিয়ে মনে পড়ে, মেঘালয়া আর বাচ্চার কোন ক্ষতি হবে বলে ইরাজ ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিল। চোখটা শক্ত করে বন্ধ করে নিয়ে লম্বা এক শ্বাস টেনে নেয়। যা সাথে সাথে শ্বাসে মিশে ফুসফুসে প্রবেশ করল একপাঁজা নিকোটিনের ধূম্র। আকাশের দিকে চাইল মুখ তুলে। আকাশে চাঁদ নেই। হতে পারে অমানিশা লেগেছে অথবা মেঘ জমেছে ঘটা করে। আকাশটাকে আজ ইরাজের নিজেরই প্রতিচ্ছবি মনে হলো। আশ্চর্যজনক ভাবে স্বাভাবিক ক্ষুধাটুকু এখনও হানা দেয়নি ইরাজকে। মস্তিষ্কে ব্যথার ক্ষরণ শুরু হলে বোধহয় গোটা শরীরের উদ্দীপনাও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।

পর-পর বেশ কয়েকটা সিগারেট অন্ধকারচ্ছন্ন ওই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একসাথে টানল ইরাজ। প্যাকেট অর্ধেক। বুকটা জ্বলছে এবার। পানির পিপাসা অনুভব করল। তবে পানি পান করার কোনরূপ চেষ্টা না করে আবার ছুটল হাসপাতালের ভেতরে। মেঘালয়ার ওই বিবর্ণ মুখটা খুব জালাচ্ছে ইরাজকে। দূরে থাকতে চাইছে ইরাজ–যাতে ওই মুখে চেয়ে যন্ত্রণা দ্বিগুণ অনুভূত না হয়। অথচ দূরে থাকার ফলে যেন তা দ্বিগুন বরং কয়েকগুণ বেশি অনুভূত হচ্ছে। দরজাটা হালকা আলগা করে দেখল মেঘালয়াকে। পাশেই হেলাল সাহেব পরিশ্রান্ত মুখে বসে আছেন মেঘালয়ার দিকে পলকহীন চেয়ে। ইরাজ চলে এলো। বাবা-মেয়ের ভাবাবেগে দখলদারী করার ইচ্ছে হলো না। ইরাজ তো একালে মায়ায় পড়েছে মেঘালয়ার। অথচ এই লোকটা নিশ্চয়ই মেঘালয়ার জন্মেই আগেই আটকে গিয়েছিল ওই মেয়েতে! যেমনটা ইরাজ আটকেছিল নিজের সন্তানের মায়ায়। সে মায়া বড়ো জটিল, সে এক জাল বটে। যা ইরাজকে গ্রাস করেছিল ওই ছোট্ট শরীরের অধিকারী পুচকি শিশুটাকে চক্ষে না দেখেই।

ইরাজ দ্রুত এসে বসল বেঞ্চের ওপর। কথাগুলো ভাবতেই বুকটা মুচরে উঠেছে। শরীরটাও দুর্বল লাগল। বেঞ্চে বসতেই পাশে বসে থাকা আনতারা ছেলের মাথাটা নিজের কাধের সাথে আগলে নিলেন। অপর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “এত ভেঙে পরিস না, আব্বা! মেঘা ঠিক আছে, আল্লাহ দিলে আমার আবার নাতি হবে।ʼʼ

ইরাজের প্রতিক্রিয়াহীন মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরালেন। বললেন, “তোর ছেলের জন্য নিজেকে যতভাবে পারা যায় কষ্ট দিচ্ছিস, সারাদিন না খেয়ে আছিস। কেন, তুই আমার ছেলে না? তুই একদিন বাপ হয়েছিস, আমি আঠাশ বছর মা হয়েছি। এবার বল, কার বেশি পুড়ছে সন্তানের জন্য– সন্তানের অবস্থা দেখে?ʼʼ

ইরাজ সেই শেষবার কথা বলেছিল সকালে। এরপর থেকে বোবা হয়ে গেছে সাথে যেন ঠসাও। মায়ের এমন অভিযোগী কথা শুনে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ঢোক গিলল। আস্তে করে বেঞ্চের ওপর পা তুলে আনতারা কোলে মাথা রেখে পা দুটো জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ইরাজের চেয়ে তুলনামূলক বেঞ্চটা বেজায় ছোটো। তবুও বাচ্চা ছেলের মতো পা-দুটো গুটিয়ে নিষ্প্রাণের ন্যায় পড়ে রইল ইরাজ মায়ের কোলে।


রাত দেড়টাও পেরিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা। হাসপাতালটা সারাদিনের তুলনায় বেশ শান্ত। ইরাজ কেবিনের চাপানো দরজাটা খুলে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল মেঘালয়ার বেডের পাশে। মেঘালয়া ঘুমিয়ে আছে। ইরাজ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ একদৃষ্টে মেঘালয়ার মুখের দিকে। এই মেয়েটার খাতিরে ইরাজ নিজের পিতৃত্বকে হাজার জনম ত্যাগ করতে পারবে; হঠাৎ-ই এমন মনে হলো ইরাজের। এই মেয়েটার এই অসুস্থ মুখটার আড়ালে গেলেই কেবল সন্তানের কচি মুখটা পীড়া দিচ্ছে ইরাজকে। এই মেয়ে নজরে বন্দি হতেই কেবল মস্তিষ্ক প্রতিবাদ করে উঠছে, সব পেছনে ফেলে এই মেয়েটাকে সাথে নিয়ে কিছুদিন বাঁচার আছে ইরাজের।

আস্তে করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে গাঢ় এক চুমু দিলো ইরাজ মেঘালয়ার কপালে। অতঃপর মেঘালয়ার ঠোঁটের কিনারায়। একহাতে মেঘালয়ার কাতর মুখখানি ও অপর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চেয়ারে বসল, মেঘালয়ার বাঁ হাতে স্যালাইন চলছে। ক্যানোলা ঢুকানো শিরাটা খানিক ফুলে আছে। ইরাজ আলগোছে মেঘালয়ার হাতটা জড়িয়ে নেয় নিজের হাতের মাঝে। ফুলে থাকা শিরাটার ওপর বৃদ্ধা আঙুলি দিয়ে কয়েকবার স্পর্শ করল। ভেজা এক ঢোক গিয়ে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। হাতটা ছেড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে অগ্রসর হয়। আকস্মিক ইরাজের হাতটা চেপে ধরা হয় পেছন থেকে।

ইরাজ ঘুরে তাকাল পেছনে। মেঘালয়ার চোখ বন্ধ, অথচ চোখের কিনারা দিয়ে তরল গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে, ঠোঁট নিচে থুতনির ওপরে কম্পন উঠেছে। ক্যানোলা লাগানো হাতটা দিয়েই ইরাজের হাতখানা মেঘালয়া আরও শক্ত করে চেপে ধরল। ইরাজ চোখটা বুজে নিয়ে ধপ করে আবার বসে পড়ে চেয়ারটায়। মেঘালয়া হাসছে, চোখের টলমল পানিকে উপেক্ষা করেই পাগলি মেয়েটা হাসছে।

মেঘালয়ার মুখের ওই কাতর হাসি! ইরাজের কলিজা ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইল! বোকা মেঘ বুঝছে না তা! নাহ! আজও বুঝছে না। এ মেয়ে ইরাজকে কোনদিনই বুঝবে না। ক্ষণে ক্ষণে শুধু কলিজা ঝলসাবে ছেলেটার! ইরাজের লাল চোখদুটো, এলোমেলো চুল! মেঘালয়ার দৃষ্টি ইরাজের ওপর স্থির। আজ বোধহয় প্রথমবার এমন খামোশ দৃষ্টিতে দুজন দুজনার চোখে চেয়েছে! মেঘালয়ার কাত হয়ে থাকা মাথাটা বালিশে লেপ্টানো। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়ল সাদা বালিশের ওপর। মেঘালয়া ঠোঁটটা আরও খানিকটা প্রসার করে চেয়ে দেখে ইরাজের ধ্বংসপ্রাপ্ত চেহারাটা। সর্বস্বান্ত ইরাজের চোখটা চেয়ে আছে মেঘালয়ার ঠোঁটের হাসির দিকে। মেঘালয়া ইরাজের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“আপনি ঠিকই বলতেন, ইরাজ! মেঘ অপদার্থ, জঘন্যতম অপদার্থ— যে নিজের ওপর রাখা কাছের মানুষগুলোর আশাগুলোকে কেবল আশা ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণায় বদলে দিতে পারে। দেখুন না, আব্বু আশা রেখেছিল,মেঘা অনেক বড়ো হবে, মেঘা সবসময় তার বাবার আদুরে মেয়ে হয়েই থাকবে। দেখেছেন কী করেছি আমি? ইরাজ আমায় পর্বতের মতো অটল ভালোবাসায় আগলে রেখে আশা রেখেছিল, আমি বুঝব তাকে কোন একদিন। দেখেছেন আমি কী করেছি? এবার আপনারা সকলে আশা রেখেছেন, একটা পুচকু আসবে,আমি আনব তাকে। দেখেছেন কী ..

প্রথমবার মেঘালয়া নাম ধরে ডেকেছে ইরাজকে। কেন! সবকিছু নির্বিশেষে ইরাজ এক অদ্ভুত কম্পন পের পায় নিজের বুকে।

চেপে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। চোখের মণিতে ভাসমান ছলছলে জলটুকু চোখের পাতার চাপে বেড়িয়ে এসে পাপড়ি ভেজায় বোধহয় এবার। মেঘালয়ার হাতখানা সেও এবার শক্ত করে চেপে ধরে। নাকটা কেঁপে উঠল ইরাজের। মুখের চোয়াল শক্ত করে গালটা হা করে চোখ খুলে তাকায়। মেঘালয়ার কথা শেষ হয় না। মেঘালয়া আরেকটু হেসে দেয়। চোখে ভরে থাকা এক দলা জল তার গড়িয়ে যায় কপালের পাশ বেয়ে। ইরাজ ডানহাতের তর্জনী আঙুল টা চেপে ধরে বুকের মাঝখানে শক্ত কাঠামোর ওপর শক্ত করে। চেপে ধরে একটু নাড়ল আঙুলটা। নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে তার বারবার। মেঘালয়া একদৃষ্টে ইরাজের দিকে চেয়ে আবার বলতে শুরু করে,

“জানেন, ইরাজ! ক’দিন হলো জটিল এক অনুভূতি জ্বালাতন করতো আমায়। ঘুম হতো না একদম। এ অনুভূতির সঙ্গে একদম পরিচিত নই আমি। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। যাতে মিশে আছে, হারানোর ভয়, তার পাশে এক-জীবন থেকে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা আর তার সঙ্গে মিশে যাওয়ার এলোমেলো পাগলামি।ʼʼ

এটুকু বলে আবার হাসে মেঘালয়া। আবার বলে, “অথচ আগে কখনও এমন অনুভূতি জাগে নি। এই অনুভূতিটা কার প্রতি এসেছে জানেন?ʼʼ

ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে মেঘালয়া। সজল চোখে চেয়ে বলে, “যে পুরুষটাকে তার রুক্ষ, এলোমেলো আচরণের জন্য অপছন্দের তালিকার শীর্ষে রেখেছিলাম। অথচ কবে কবে যেন, তার ঘাঁড় ত্যাড়ামির মায়ায় আঁটকেছি। কবে থেকে যেন তাকে পুষতে শুরু করেছি নিজের গভীরে।ʼʼ

মেঘালয়ার চোখটা ভরে উঠেছে। কথাগুলো মেঘালয়া থেমে থেমে দুর্বল স্বরে, ক্ষীণ আওয়াজে বলছে। ইরাজ কেবল মলিন হাসল।

“তাবির আমায় বলেছিল, আমি আব্বুর চালিত পুতুল। বোকা মেঘ! সেকালে এত মূর্খ ছিলাম, ঘৃনা আমারও জাগে আপনার মতই মেঘের ওপর। এই দেখুন, ক’দিন আগে হুট করে বুঝতে পেরেছি, তাবির আব্বুর নাম কোরে আমার অপছন্দের পুরুষের কথা বলেছে বারবার। সহজ অঙ্ক– আব্বু তো আমায় কোনদিন শাসন করেনি! আব্বু আমায় বেঁধে রেখেছিল না কখনও, আব্বু ধমকায় নি, আব্বু আটকায় নি। আমার আব্বু তো আমার সঙ্গে প্রথম চোটপাট করেছিল, তার মুখ ডুবিয়ে ফেরার পর। আব্বুর কাছে আমি ছিলাম দেবী। যাকে আব্বু পূজা করেছে সকাল-দুপুর।ʼʼ

ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল মেঘালয়া, “অথচ এই সরল অঙ্ক মেলাতে পারিনি সেদিন। ইরাজের সব কথা মিলে যায় আজকাল আমার কাছে— মেঘ, অঙ্কে জঘন্য কাঁচা। তাই-তো ইঞ্জিনিয়ারিং ওর কোনকালেই পছন্দ না। ইরাজ চরম অপছন্দের পুরুষ বরাবরই আমার। কারণ, আমায় বেঁধে রেখেছিল ইরাজ, সব-সময় শ্বাস আটকে নজরে রেখেছে ইরাজ, কোনদিন সাজতে দেয়নি, বাইরে বের হতে দেয়নি, একসাথে চললে, এতো বড়ো মেয়ে হয়ে গিয়েছিলাম, রাস্তাটা হাত ধরে পার করে দিতো ইরাজ। তার কড়া নজরে অতিষ্ট ছিলাম চিরদিন। তার জন্য আর পাঁচটা মেয়ের মতো অবাধে চলতে পারি নি। সব মিলিয়ে আমি তো তার পুতুল ছিলাম, আব্বুর না। অথচ এই হিসেব এই-তো ক’দিন আগে মিলেছে। ইরাজের মতে, ন্যাকা আমি,এজন্য এসব ছোট্ট ব্যাপারগুলোকে ভুল বুঝে জীবনটা সিনেম্যাটিক করে তুলেছি। তার মত আবার ফেলার মতো হয়না।ʼʼ

নিজের ওপর তাচ্ছিল্য হাসে মেঘালয়া, চোখে জল। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় মেঘালয়া। ইরাজ অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হেসে ফেলে নিঃশব্দে। তার বুকের উঠা-নামা, আর ভারী নিঃশ্বাস মেঘালয়ার চেয়েও অস্বাভাবিক লাগে। মেঘালয়া একটু নড়ে-চড়ে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ একভাবে শুয়ে থেকে এক-ঘেয়েমি ধরে গিয়েছে। ইরাজ আতঙ্কিত হয়ে উঠল তাৎক্ষণিক। চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। মেঘালয়া শান্ত হয়ে শুয়ে চেয়ে রয় কেমন করে যেন চিন্তিত ইরাজের দিকে। সেকেন্ড কয়েক পর ইরাজের চোখের দিকে তাকায়। চোখের মণিতে সূক্ষ্ম শিরাগুলোয় র ক্ত জমে চোখদুটোকে লাল দেখাচ্ছে। বারবার ঢোক গিলছে ইরাজ। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে! অথচ নীরবতায় জড়িয়ে সে যেন বুকের ব্যথাগুলোকে অনুভব করতে ব্যস্ত। মেঘালয়া নিভু-নিভু স্বরে বলতে শুরু করে,

“সেদিন গাড়ির ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দুধারের দোকানপাটের ব্যানার দেখে বুঝলাম, আমরা চট্রগ্রাম পৌঁছেছি। বড্ড হাঁসফাঁস লাগছিল কেন জানি। আমি সন্তষ্ট হতে পারছিলাম না, অথচ গেছি আমি নিজেই।ʼʼ

হেসে ওঠে মেঘালয়া, “একটা অজানা ভয় কাজ করছিল। ভয়টা কী জানেন? ইরাজের ভয়। মনের কোণে না চাইতেও অজান্তেই একটা বদরাগী মুখ এসে জ্বালাতন করছিল, এই হয়ত সামনে এসে দাঁড়াবে, চটাং করে থাপ্পর মারবে।এরপর কী হবে, আল্লাহ জানে! সে যে কেমন অস্থিরতা! ওই যে ছোটো থেকে ঢুকে যাওয়া এক ভয়! জায়েজ শাসন! আমি তাবিরকে বলেছিলাম, ‘বিয়ে কোথায়
করবে?ʼ বলল, ‘এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আপাতত হোটেলে থাকব, সকালে যা হয় হবে।ʼ কথাটা পছন্দ হয়নি আমার। হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকেও দরজাটা খোলা রেখেছিলাম। অস্থিরতা! দরজা বন্ধ করব! ভাবতেই গা শিউরে উঠছিল। আব্বু বা ইরাজ কারও হাতে পড়লে আমার রুহু বের করে নেবে। অথচ মাথায় এটা আসতে চাইছিল না, আমি না পালিয়ে এসেছি, প্রেমিকে সাথে এসেছি, তাদের নাগালের বাইরে। চারদিকে চোরের মতো তাকিতুকি করেছি— আল্লাহ জানে ক্যাকটাসটা কোথায়, দেখে ফেললে আমার কী হবে, এভাবে এত রাতে বাইরে এসেছি জানলে কী বিশ্রী ঝাড়ি শুনতে হবে… যেন আমি যশোরেই আছি। এক মুহুর্তের জন্যও মাথায় এটা সেট হয়নি– আমি দূরে আছি, আমার আশেপাশে ইরাজ নেই।ʼʼ

মেঘালয়া এ পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমি আসলেই কারও ছায়াতলে বন্দি এক কচি পাখি। জোশের বশে যাহোক করে তো ফেলেছি, অথচ…
কিছুক্ষণ পর হোটেলের মেনেজার আসল সাথে কয়েকজন অপরিচিত লোক। এসেই তাবিরের গলায় ছুরি ধরে। তাদের ডিমান্ড আমাকে তাদের হাতে তুলে দিলে তাবিরের রেহাই।ʼʼ

মেঘালয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু থামল না। এটুকু বলে মৃদূ গা কাঁপিয়ে শব্দহীন হাসি হাসল। আস্তে করে হাসিটুকু মিলিয়ে শান্ত হয়ে যায় মুখটা, চোখ ঘোলা দেখায় তার। বলে, “তখন আব্বুর কথা মনে পড়েনি। কেন জানি না। তখন কেবল মনে মনে কল্পনা করে উঠেছিলাম, আমার ক্যাকটাস এসে এখানে দাঁড়ালে এ দুনিয়ার সবটুকু বিপদ আমার পাশ কেটে বেরিয়ে যাবে। আমি আজও জানি না, সেদিন কেন ওই অপছন্দের তিক্ত পুরুষটা সেখানে বাস্তবে পৌঁছানোর আগেও কল্পনায় আমি তাকে বহুবার সেখানে আমায় আগলে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। যে-জন্য পুরো সময় একদম শান্ত, নিশ্চিন্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি নিশ্চিত, ইরাজ আসবে, থাপ্পড় মারবে আমায়, বাজে ভাষায় বকবে, কটুক্তি করবে, আর তারপর? আমি নিরাপদ, এই এত বড়ো দুনিয়াতে সকল অনিষ্ট থেকে আমি নিরাপদ। সব বিপদ মিটে যাবে সে এসে দাঁড়ালেই। আজব, তাই-না! এই-তো ক’দিন আগে এ হিসেবগুলো আমি মেলাতে গিয়েও আমার মাথা গুলিয়েছে।ʼʼ

মেঘালয়ার কান্নারত মুখের দিকে চেয়ে ইরাজ ঠোঁট এলিয়ে ক্লান্ত হাসল। মেঘালয়া বলল, “ওই বদমাশ লোকটা কোনদিন ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করেনি আমায়, আমার দিকে বিরক্তি ছাড়া অন্য নজরে তাকায়নি, মিষ্টি করে কথা বলেনি। সে যেমন নিজের ভালো থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আমায়, তেমনই দুনিয়ার খারাপগুলো থেকে। এ ব্যপারটা কিছুদিন আগেই মিলিয়েছি আমি।ʼʼ

মেঘালয়ার কণ্ঠস্বর ভেঙে আসে। ঠোঁটটা বোধহয় বেঁকে এলো এবার কান্নার তরে। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল অশ্রুবৃষ্টির জল গালের পাশ বয়ে। ঠোঁট ভেঙে হেসে ওঠে মেঘালয়া। যা দেখতে কান্নার মতো লাগে। আসলে মেঘালয়া বোধহয় কাঁদলই, সাথে হাসল। ইরাজ নিচের দিকে ঝুঁকে বসল এবার একটু। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। মেঘালয়ার কান্না এবার আর থামবে না। তাই কান্না জরানো ভাঙা কণ্ঠেই বলে,

“নিজের অজান্তেই ইরাজ নামক আমার স্বাধীনতার করাগার যে আমার অভ্যাস ও দৈনন্দিন চলনে পরিণত হয়েছিল–তা উপলদ্ধি করার সুযোগ হয়নি। আত্মনির্ভশীলতাহীন হয়ে পড়েছি আমি বহুবছর আগ থেকে। আমার অবলম্বন হয়ে উঠেছে ইরাজ। অথচ ইরাজের আচরণ বরাবর বিভ্রান্ত করতো আমায়। এত শাসন, বারণ লোকটার সাথে আমার দূরত্বই সৃষ্টি করেছে দিন-দিন। যেকোন মুসিবতে সমাধান হিসেবে তাকে আশা করলেও, তাকে পছন্দ করা হয়ে ওঠেনি। সেদিন সেই অন্ধকার রাতেও ইরাজকেই পাশে চেয়েছিলাম।ʼʼ

মেঘালয়া এবার কান্নামিশ্রিত স্বরে যেন অভিযোগ করে
ওঠে, “কী করব তাছাড়া? ছোটো বেলা থেকে তার হাতের পুতুলের মতো নাচিয়েছে, বলতে গেলে তার জন্যই সেদিন বলি হতে ওতদূর গেছি, সে আসবে না? আব্বুর বন্ধুর ছেলে, পার্টনারের ছেলে সে। সেরকম ভাবে থেকেছে নাকি? আমার জীবনটাকে হাতের মুঠোয় মুড়ে রেখেছিল। তাতে তার কঠোরতা আমার বদভ্যাস হয়ে উঠলে, সেটা আমার দোষ? তার শাসনের মায়ায় পড়ে গেলে, সেটা আমার দোষ? তার ওপর নির্ভরশীল হলে, সেটাও আমার দোষ? অথচ লোকটার ব্যবহার জঘন্য। চরম অসভ্য লোকটা, নমনীয়তার আকাল আছে তার মাঝে। আর সেজন্য তাকে আমার পছন্দ না। কোনকালেই পছন্দ না। করবও না পছন্দ, ওরকম রসকসহীন ক্যাকটাস মার্কা লোককে পছন্দ করার প্রশ্নই ওঠে না। তার চালচলন, কথাবার্তা, আচরণ সবকিছু কাঁটায় ভরা। সেজন্য তার মাঝে এতবছর আটকে থেকেও কোনদিন নিজের অনুভূতি বুঝতে সক্ষম হইনি আমি। লোকটা তারও শাস্তি দিয়েছে আমায়। আই ব্লাডি হেইট হিম।ʼʼ

ইরাজ হেসে ফেলল হঠাৎ-ই নিঃশব্দে। মাথাটা খানিক ঝুঁকিয়ে তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল কপালে রেখে নিঃশব্দে হাসে ইরাজ। মেঘালয়ার চোখের পানি শুকিয়ে গালে লেপ্টে আছে। শেষের কথাগুলোয় কপট আক্রোশ মিশে ছিল। মেঘালয়ার ঠোঁট ভেঙে আসে আবার, “আপনি কেমন? আপনার প্রতি কোন একরকম অনুভূতি কেন আসে না আমার? সবসময় মিশ্র কিছু অনুভব করি আপনাকে নিয়ে। একটু সহজ হলেও পারেন..ʼʼ

“এখন বিশ্রাম প্রয়োজন তোর, এসব ভারী ভাবনা পরেও ভাবতে পারবি।ʼʼ

ইরাজের কথাটা পছন্দ হলো না মেঘালয়ার। বলল, “আর আপনি?ʼʼ

“হু, আমি কী?ʼʼ

“আপনি কী করবেন?ʼʼ

“কী করতে বলছিস?ʼʼ

মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে দুর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করে, “যা করতে বলব, করবেন?ʼʼ

ইরাজ মুখে জবাব দিলো না, কেবল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেঘালয়া বলল, “থাকুন আমার কাছে।ʼʼ

“আমি আছি, তুই ঘুমা।ʼʼ

মেঘালয়ার কাছে কথাটা বিশেষ এক অনুভূতি হয়ে মস্তিষ্কে সারা জাগায়। “আমি আছি।ʼʼ ইরাজ আছে। মেঘালয়ার বুকটা শান্ত হয়ে ওঠে। ইরাজের হাতের আঙুলগুলোর মাঝে সন্তর্পণে নিজের আঙুল ঢুকায়। চোখটা বুজে দীর্ঘ করে এক শ্বাস টেনে নিলো। ইরাজ চেয়ে রইল মেঘালয়ার অচঞ্চল মুখটার দিকে।

“খান নি কেন?ʼʼ

মেঘালয়ার ক্ষীণ স্বরে বলা কথাটায় ইরাজ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল মেঘালয়ার দিকে। কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে করে বলল, “খেয়েছি।ʼʼ

“আপনাকে জানতে জানতে আটকে গেছি আপনার মাঝে। নিজের ব্যপারে আমার কাছে মিথ্যা বলা বোকামি হবে আপনার।ʼʼ

ইরাজ চোখটা সরু করে বলে, “এত জানিস আমায়?ʼʼ

এই ছেলেটা এক ঝটকায় নিজের বাহ্যিক রূপে এসে যায়। এই কিছুক্ষণ আগে বিষাদে পরেপূর্ণ ছিল চেহারাটা হুট করে আবার নিজের ত্যাড়ামিতে ফিরে এসেছে। বলল, “পুরোটা নয়, তবে প্রায় পুরোটা।ʼʼ

ইরাজ সামান্য ঠোঁট প্রসার করে হাসল। বড়ো ক্লান্ত লাগল দেখতে সেই হাসি। মেঘালয়া আচমকা প্রশ্ন করে, “আপনি কেমন?ʼʼ

ইরাজ ভাবলেশহীন ভাবে ঠোঁট উল্টায়, সাথে কাধ ঝাঁকাল যেন সেও নিশ্চিত নয় এ ব্যপারে, “ধরে নে, আমি কিছুটা চাঁদ। আমার গুপ্ত নরম অনুভূতি, আলো। তাতে আলোকিত হয়ে ধন্য হবে আমার ভালোবাসা পাওয়া মানুষগুলো। আবার আমার ত্যাগের তপ্ততা সূর্যরশ্মির মতো প্রখর অগ্নিশোধিত। আর সূর্য যখন চাঁদের বারবার থাকে; চাঁদের সেই অবস্থা হলো ঘোর অমানিশা। আমি নামক ‘অমানিশায় সেই তুই’! যাকে পেয়ে হারিয়ে, ত্যাগের প্রখরতায় ডুবেছি, ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে চাঁদটা অমানিশার আড়ালে।ʼʼ

ইরাজ থামল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরল। আবার বলল, “তবে অমানিশা তো সারামাস থাকে না, মেঘ! যেমনটা তোর বিরহ আমার জীবনে মাসের কয়েকটা দিন করেই রয়, আবার বাঁকা চাঁদ উঠে ক’দিন পরে তা পূর্ণিমায় রূপ নেয়। তবে আমার জোৎস্না বিলাসের সুযোগ নেই। আমি তো মেঘে মগ্ন, পূর্ণিমার ওপর মেঘের ঘনঘটায় আমার আকাশটা অমানিশার মতোই তিমিরে ছেঁয়ে থাকে চিরকাল।ʼʼ

-সমাপ্ত

অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২৮

0

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৮.

মেঘালয়াকে ওটিতে শিফ্ট করা হয়েছে বেলা ন’টার দিকে। শারমিন আরা নিজে এসেছিলেন না-দাবী দলিলে সিগনেচার নিতে। ইরাজকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বারান্দায় বেঞ্চের ওপর বসানো হয়েছে। তখন থেকে জড় পদার্থের মতো পড়ে আছে। মেঘালয়াকে ওটিতে নেওয়ার সময় কেবল চেয়ে ছিল মেঘালয়ার বেডের নিচের র ক্তে লাল হয়ে ওঠা বেডশিটের দিকে। এ অবস্থায় ইরাজের কাছে এমন কিছু নিয়ে যাওয়া মোটেই সমাচীন মনে করলেন না শারমিন আরা। তাই গেলেন হেলাল সাহেবের কাছে। হেলাল সাহেব কাগজটির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে মাথাটা এলিয়ে দেয় পেছনের দেয়ালের সাথে। বাবার হাতে এরা মেয়ের জীবনের না-দাবী সই করাতে এসেছে! আচ্ছা ডাক্তাররা এমন পাষাণ নাকি প্রকৃতি বর্বর! যে মেয়েকে নিজের জান-মাল দিয়ে একটু একটু করে পালন করে তুলেছেন, সেই মেয়ের নাকি জানের দাবী ছাড়তে হবে বাবার! ওহ! প্রকৃতি সঙ্গে মিলেমিশে তকদীরের নির্দয়তা!একদৃষ্টে কয়েক মুহূর্ত দলিলের দিকে চেয়ে থেকে নিভু চোখে ইরাজের দিকে ইশারা করে পরিশ্রান্ত কণ্ঠে বললেন, “ওই পাগলের কাছে যান। ওই পাগল আমার মেঘার জীবনের দাবী ছাড়লে তবে তা জায়েজ হবে।ʼʼ

আসলেই তো! যে ছেলে কিছুদিন বাঁচার দাবী নিয়ে ওই মেয়েকে চেয়েছে, তার মানে ও মেয়ের দাবী, চাহিদা তো ইগজগতে সম্পূর্ন ওই পাগলার। হেলাল সাহেবের এতসবের মাঝে বুকে প্রশান্তি লাগে, তার অবর্তমানে তার মা-হারা পাগলি মেয়েটা খারাপ থাকবে না এই পাগলার কাছে।

শারমিন আরার বুক কাঁপছে দুরু-দুরু। এ অবশ্য আশ্চর্যজনক বটে! ডাক্তারদের আবার বুক কাঁপে নাকি! কাঁপে। এই-যে আজ কাঁপছে। ইরাজ চোখ তুলে তাকাল ওই কাগজটার দিকে। সবটুকু ঘৃনা তার গিয়ে ওই কাগজের ওপর পতিত হলো। এই কাগজ হলো সেই বাঁধা, মেঘকে হারালে কোন প্রতিশোধ নিতে না পারার বাঁধা! মেঘকে ত্যাগের দলিল। বুকে কলিজা-ছিদ্রক সূঁচাল ব্যথা! নড়বড়ে হাতে কাগজটা নেয়, তা নিজের জড়িয়ে বসা হাঁটুতে রেখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত খানিক। কাগজটার ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতো এক দানা পানি ঠাস করে পড়ে তা কাগজের শোষনে একটু ছড়িয়ে যায় কাগজটার ওপর। কাগজটার অভিশাপ ধুয়ে যাক– বুক চিরে বের হওয়া এই একফোঁটা তরলের সঃস্পর্শে। কাগজে উল্লেখিত কেঁড়ে নেওয়ার বয়ানে জড়িয়ে থাকা পাপগুলো কলঙ্ক ঝরিয়ে নিক না-হয়! কলমটা নিয়ে সই করে দেয়। সইটা খুব দ্রুত এবরো-থেবরোভাবে করে ইরাজ। সই করতে যত দেরী হবে, মেঘালয়ার সার্জারীর সময় পেছাবে।

শারমিন আরা নার্সের হাত থেকে ওটির ড্রেসটা নিয়ে তা পড়তে পড়তে ঢুকে গেলেন ওটিরুমে। ইরাজ নির্বিকার চেয়ে রইল কেবল সেদিকে। ওটির দরজাটা বন্ধ হয়ে দরজার ওপরে লাল লাইটটি জ্বলে ওঠে। ইরাজ চোখটা নামিয়ে নেয়। ওই মেয়েটাকে নাকি ইরাজ ত্যাগ করেছিল। হেসে উঠল ইরাজ ভাবতেই। যে মেয়েটাকে ছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাসে চাপ সৃষ্টি হয়, সেই মেয়েটাকে নাকি ত্যাগ করেছিল ইরাজ! আচ্ছা! ইরাজ তো এমন ছিল না। এতকিছুর পরেও ইরাজের ভেঙে পড়া কেউ দেখেনি। কেউ দেখেনি, ইরাজকে কাঁদতে, ইরাজের ছটফটানি। অথচ আজ ইরাজ কিছুই মানছে না। সবকিছুকে এড়িয়ে সে এমনভাবে কেন ওই মেয়েটার জন্য তড়পাচ্ছে! এ মায়া জন্মেছিল ইরাজের ভেতরে সেই কত বছর আগে। অথচ কোনদিন তা বাইরে আসেনি, অথচ এ-ক’দিনে এমন হলো কী! ইরাজ এত জাহির হয়ে উঠল কবে? পুনরায় কবে এভাবে থেমে গেছে মেঘালয়ার মাঝে? ইরাজ চিরদিন মেঘালয়ার কাছে নিজেকে লুকিয়েছে, সবশেষে মেঘালয়ার ভুলের পর তো ইরাজ শপথ করেছিল, ত্যাগ করেছিল ওই মেয়েকে। এ ভালোবাসার অনুভূতি বড্ড বেলেহাজ! কিছুই মানে না যে! কিছুই মনে রাখে না! এই-তো ক’দিন আগে ইরাজ মেঘালয়ার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে, তাকিয়ে দেখেনি, ঠিকমতো কথা বলেনি, মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। অথচ তারপরের ক’দিনে আস্তে আস্তে হলোটা কী! আবার জড়িয়ে পড়েছে ইরাজ!

তবে এবার কেন জানি ইরাজের মনে হয়, এ জড়িয়ে পড়াটা সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের! যে জড়িয়ে পড়ায় ইরাজের নিজস্ব সত্তা গুম হয়ে গেছে। নিজের চারিত্রিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, এ জড়িয়ে পড়ায় লুকোনো যায়নি আর অনুভূতি। বরং বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেছে ইরাজ না চাইতেও। আগে মেঘালয়া ইরাজের আকাঙ্ক্ষা ছিল, মায়া ছিল। আজ যে মেঘালয়া ইরাজের অর্ধাঙ্গিনী! এই হালাল সম্পর্কের সুতোর টানে ইরাজের চাপা স্বভাবের আল-বিদা হয়ে গেছে।

ইরাজ আবার হাসে মৃদূ! দৃষ্টি তার আটকানো ওটি রুমের দরজায়। মুখ নাড়িয়ে বিরবির করে ওঠে, “মেঘ! যাসনা কেমন! আমি আর কিছুদিন ভিজতে চাই তোর ঝরানো বৃষ্টিতে। শোন, শোন আমার কথা, তোকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটব, কিছুদিন আগে শখ জেগেছিল। তখন বলিনি, তবে কাল রাতে বললাম, তুই যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলি না। সুস্থ হ, নিয়ে বের হবো। তুই চাইলে ফুসকাও কিনে দেব। তবে সেটা আমার আড়ালে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে মুখ করে খাবি। রাস্তার ছেলেদের কার কেমন নজর কে জানে! মেয়েদের একটু ঢেকে-ঢুকে চলা ভালো। যশোরে মেলা বসছে সপ্তাহখানেক পর, ওখানেও নিয়ে যাব তুই চাইলে। তুই যাসনা, মেঘ! একা একা তো আজীবন ঘুরলাম। বহুত হয়েছে। আজকাল ভাল্লাগেনা একা। তুই চলে গেলে, একা আর আমার যাওয়া হবে না। ভাবলাম, তুই ভার্সিটিতে ভর্তি হবি, তারপর আমার কাছে রাতে পড়তে বসবি। ধমকে ধমকে পড়াব। সে তুই যা-ই বল, আমার ওসব মিনমিনে প্রমবাণী আসে না। আমি ধমকেই পড়াব। আসলে, অভ্যাস তো! তোর সাথে ধমকে কথা বলার অভ্যাসটাই যখন বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সেটাকে ভালোবাসা বলেছি আমি। চিরদিন ওভাবে ধমকাতে তোকে আমার খাচায় আটকাতে চেয়েছি। চাইলেও অন্যরকম করে বলতে পারিনা। বলতে গেলে মনে হয়, তোর সাথে কথা বলছিনা। ভাবলাম, প্রতিদিন তোকে বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে আসব, ভার্সিটিতে। আগে তো প্যানপ্যান বহুত করেছিস, তোর বাপ ধরত আমায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। তোর বাপ কিন্তু সেই শুরুর থেকেই আমার প্রেমেই পড়েছে, তুই না পড়লেও। হেলাল আকবরের জামাই আমি সেই বহুকাল আগ থেকে। তখন বের হতে চাইলে ধমকে ঘরে পাঠিয়েছি। এখন না-হয় ভার্সিটি যাওয়ার বদৌলতে বাইকের পেছনে ঘুরতে পারতি! সব-ই তোর চাহিদা। দেখ কী করবি! তুই থেকে গেলে এসবের সাথে আরও বহুত কিছু পাবি। আর চলে গেলে আর কী! ইরাজ একা আর কী-ই বা করবে! যাসনা মেঘ! কেমন! চল কিছুদিন একসাথে রাস্তায় হাঁটি।ʼʼ

মেঘালয়া কী শুনল কথাগুলো! পাগল ইরাজের পাগলাটে প্রলাপ শুনল না বোধহয় মেয়েটা! না পাওয়া যন্ত্রণা তো সময়ে আবর্তনের সাথে সাথে উপশম হয়ে যায়। তখন হারিয়ে যাওয়া বস্তুটাকে নিজের অনুভূতির বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয় মানুষ একটা সময়! সময় ধৈর্য্য দেয়, যা আমার ছিলই না, তা নিয়ে আর কতদিন আহাজারী, আকাঙ্ক্ষা সব পুরো হওয়ার নয়। অথচ আকাঙ্ক্ষা থেকে যে জিনিস নিজের প্রাপ্তিতে এসে কিছুদিন বিচরণ করে, পেয়ে যাওয়ার খুশিতে ডুবিয়ে তারপর শূন্যে মিলিয়ে যায়, সেখানে মন-মস্তিষ্কের চাপটা যে অসহ্য লাগে বড়োই! যে চাপটা ইরাজকে ক্ষণে-ক্ষণে বিষাক্ত তীরের আঘাতের ন্যায় খোঁচাচ্ছে। রক্তাক্ত করে তুলছে ভেতরটাকে।


প্রায় দেড় ঘন্টা পর শারমিন আরা সহ তার সহকারী ডাক্তারটি বেরিয়ে এলো ওটি রুম থেকে। ইরাজ কেবল নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকাল একবার শারমিন আরার দিকে। কোনরকম নড়চড় দেখা গেল না তার মাঝে। দৌঁড়ে গেলেন হেলাল সাহেব, পেছনে ইমতিয়াজ সাহেব ও আনতারা খানম। অথচ শারমিন আরার দৃষ্টি আটকে আছে, নিষ্প্রভ, নিস্তেজ ইরাজের দিকে। তিনি ওটির পোশাকটি খুলে কনুইতে রেখে হেলাল সাহেবের দিকে তাকালেন। তার মুখটা করুণ, বড়ো অসহায় লাগল, আজ এক মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে শারমিন আরার। তিনি মুখে কিছু না বলে বরং সকলকে উপেক্ষা করে এসে বসলেন ইরাজের পাশটায়। গ্লাভসটা এখনও হাতেই রয়েছে তার। তখনই একটি নার্স বেরিয়ে এলো ছোটো-খাটো এক ট্রলি ঠেলে। ইরাজ তাকায় না সেদিকে। শারমিন আরা ইরাজের পাশে মাথাটা ইরাজের মতোই ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন। আস্তে করে নিরুত্তেজ গলায় বললেন, “রাজ! মেঘার মিসক্যারেজ হয়েছে।ʼʼ

ইরাজ মোটেই অবাক হলো না। কোন কথাও বলল না। যেন তার খুব ভালো করে জানা কোন বিষয় তাকে আবার জানানো হলো। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় ইরাজ, মনে হলো, হঠাৎ-ই রোধ হয়ে যাওয়া শ্বাসটুকু ইরাজ ভারী বুক থেকে আস্তে করে মুক্ত করে দিল।

ট্রলিতে অপরিপক্ক ছোট্ট এক নিথর-দেহ পড়ে আছে। শরীরে এখনও সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো সেজে ওঠেনি। তবে মানুষের আকৃতি এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে, সদ্য জন্মানো শিশু, মাখনের ন্যায় ক্রিম সদৃশ এক আস্তরণে ঢেকে আছে শরীরের ত্বক। চোখের পাতা ও ভ্রু গজিয়েছে হালকা করে।

আনতারা খানম হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। হেলাল সাহেব পুরুষ মানুষ তো! তার চোখে পানি থাকতে আছে, তবে চিৎকার করে বুকের আর্তনাদগুলোকে বোধহয় প্রকাশটুকু করতে নেই তার। ইমতিয়াজ সাহেব সরে আসলেন সেখান থেকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখটা মুছে নিলেন। আনতারা খানম বেসামাল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। মেঘালয়ার যে কাঁদার মতো নিজের মা নেই, তাই বোধহয় সেই আহাজারীটুকু মিলিয়ে আনতারা আজ ওই মা হারা অনাথ মেয়েটার জন্য নিজে কেঁদে ভাসাচ্ছেন। ইমতিয়াজ সাহেব গিয়ে ধরলেন আনতরাকে। তাকে সরানো যায় না।
ধরতে যায় বাচ্চাকে, তখনই ইমতিয়াজ সাহেব জোর করে ধরে দূরে নিয়ে এলেন আনতারাকে। তিনি বুঝলেন, আনতারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এ মুহুর্তে। একটা নয়, সে যে এভাবে চারটা সন্তানের নিথর দেহ দেখেছে। আজ তার জন্য ছেলের সন্তানের সেই একই অবস্থা দেখা মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করল খুব খারাপ ভাবে। মেঘালয়ার কথা ভেবে আনতারা আরও পাগল হয়ে ওঠেন। দৌঁড়ে যেতে চান ওটি রুমের দিকে। তিনিও এভাবেই পড়ে থেকেছেন হাসপাতালের বেডে, তার সন্তানকে চিরদিনের মতো নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার বুক থেকে। আজ মেঘালয়াও কী দেখবে না সন্তানের মুখ?
ইমতিয়াজ সাহেব আনতারাকে দেখে নিজেও বড্ড ভেঙে পড়লেন। আনতারাকে নিয়ে ইরাজের পাশে বসে পড়লেন। শারমিন আরা উঠে যায় ফ্রেস হতে।

হেলাল সাহেব বসে পড়ে ওভাবেই মেঝেতে। লোকসমাগম বেড়েছে চারদিকে। সকলে তাকিয়ে দেখছে একটা মেয়ের দরদী কয়েকজন মানব-মানবীর বিদ্ধস্ত দৃশ্য। হেলাল সাহেবের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল, প্রায় ষোল বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনের কথা। এভাবেই তার ছোট্ট ছেলেকে এনে তার সম্মুখে রাখা হয়েছিল, কিছুক্ষণ বাদে তার স্ত্রীকেও। সেদিন মেঘালয়া কাঁদেনি। কেবল আনতারার হাতটা ধরে পিছেপিছে ঘুরেছিল চারদিকে। বুকটা পুড়ছে হেলাল সাহেবের। সর্বহারার মতো পড়ে রইলেন তিনি ধুলোমাখা মেঝেতে।

কারও অবস্থাই স্বাভাবিক নয়। শারমিন আরা যেন আজ আর ডিউটিতে নয়, ব্যক্তিগত কোন শোকে জড়িয়ে রয়েছেন। কোনমতো ফ্রেস হয়ে এসে ইরাজকে ধরে উঠালেন। আস্তে আস্তে করে নিয়ে গেলেন ট্রলির কাছে। ইরাজের শরীরটা বেজায় ভারী লাগল শারমিন আরার। ইরাজ শারিরীকভাবে নিজের ভার ছেড়ে দিয়ে প্রাণহীনের মতো হাঁটছে।

নাকের পাটা ফুলিয়ে, চোয়াল মাড়িতে চেপে শক্ত করে চোখের পাতা বুজে নেয় ইরাজ। টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল দাঁড়ি-গোফের গাল বেয়ে। ছেলে সন্তান হয়েছে মেঘালয়ার। মেঘালয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। ইরাজ হাসার চেষ্টা করে। এই-তো মেঘালয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে, ইরাজ হেরে গেছে—মেয়ে হয়নি। ইরাজ বরাবর ওই পুচকি মেয়ের কাছে হারবেই! জিতবে ওই মেয়ে। পাগলাটে হাসিতে ইরাজকে উন্মাদের মতো লাগে। শারমিন আরা ইরাজের বাহু চেপে ধরে তাকিয়ে রয় ইরাজের বুক চিরে বেরিয়ে আসা পাগলা হাসির দিকে।

বাবার সামনে সন্তানের প্রাণহীন, শ্বাসহীন, নিশ্চল দেহ! হায়! ইরাজের ভেতরে জান নেই; হঠাৎ-ই এমন মনে হলো শারমিন আরার। ইরাজের শরীর আরও ভারী হয়ে ওঠে। এই ছেলে কী পাথরের তৈরী! ভেতরে যে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে, সবটা মাড়ি আটকে ভেতরে চেপে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। ইরাজের ভেতরের এই অগ্নিকাণ্ড হয়ত শারমিন আরাও টের পেতেন না, যদি-না ইরাজকে ধরে দাঁড়াতেন। এ ছেলের উদ্দীপনা গুলো বড়োই চাপা, একটু বেশিই চাপা। ছোটো-ছোটো বিষয়ে কেমন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অথচ যখন কলিজা ছিন্নভিন্ন করা ব্যথা তাকে ক্ষয় করছে, তখন কেমন অলৌলিক ক্ষমতার জোরে যেন লুকিয়ে রেখেছে নিজের যন্ত্রণাগুলো।
ইরাজ যে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে, অথচ তার মুখে হাসি, সে একদম বরফ-শীতল শান্ত। এখন অবধি একটা কথাও বলেনি ইরাজ। শারমিন আরা দ্রুত ইরাজকে সরিয়ে এনে বসালেন বেঞ্চিতে। ইরাজের মেনটাল-কন্ডিশন যে হেভি-প্রেশার ইফেক্টেড হয়ে পড়ছে তা বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শারমিন আরা।

ইরাজ বেঞ্চিতে বসে আবার মাথাটা এলিয়ে দেয় দেয়ালের সঙ্গে।

চলবে..