Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 23



চন্দ্রকণার রাহা পর্ব-০৪

0

#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪

নিত্তিকা হুট করেই একটা কামড়ে দিলো শাহিয়ানের বুকে। শাহিয়ান তাও ছাড়লো না। নাছোড়বান্দার মতো নিজের বুকের সাথেই মিশিয়ে রাখলো নিত্তিকাকে। নিত্তিকা অনেকটাই অবাক হলো। সে তো কম জোরে কামড় দেয়নি। ধূসর রাঙা টিশার্ট দিয়ে স্পষ্ট রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। নিত্তিকা অবাক দৃষ্টিতে শাহিয়ানের দিকে তাকাতেই মেয়েটা যেন থমকে গেল। লোকটার চোখে পানি চিকচিক করছে। নিত্তিকা মনের মাঝে এবার অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। শাহিয়ানের চোখে চোখ মেলাতে না পেরে মাথা নিচু করে বলল,
“সরি, আপনার…!”

নিত্তিকার কথার মাঝেই হুট করে শাহিয়ান নিত্তিকাকে জড়িয়ে ধরলো। থমকে গেল মেয়েটা। অনুভূতিরা যেন থেমে গেছে এক জায়গায়। সময় থমকে গেছে। থমকে গেছে মনের রাগ। নিত্তিকার কেন যেন মন চাইলো শাহিয়ানকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে পারলো না এক অদশ্য বাঁধা কাজ করলো মনের গহীনে।

হুট করেই ফুঁপিয়ে কান্না করার আওয়াজে উত্তলা হলো ছোট্ট হৃদয়টা। অস্থির কন্ঠে বলল,
“একি আপনি কান্না করছেন কেন?”

শাহিয়ানের কোনো সারা পাওয়া গেল না। নিত্তিকা যেন এতে আরো অস্থির হয়ে পরলো। মনের মাঝে উঁকি দিতে লাগলো হাজারো প্রশ্ন। কি হয়েছে ওনার? সামান্য একটা কামড়ে তো এমন করে কান্না করবে না তাহলে কি! তার বোনের জায়গায় নিশ্চই তাকে মেনে নিতে পারছেনা। হ্যাঁ তা নয় তো কি? নিজের মনে প্রশ্নগুলো দমাতে না পেরে নিত্তিকা বলে উঠলো,
“আপনি যদি চান আমি আপনাকে ছেড়ে দিবো। আসল কথা হচ্ছে, আপনাদের তো আমরা মূলত ধোঁকাই দিয়েছি। কথা ছিলো বড় বোনের সাথে বিয়ে হওয়ার। ফর্সা, সুন্দরী, শিক্ষিতা, ভদ্র মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা হয়ে। এখন নাকি আমার মতো একটা মেয়েকে আপনার বিয়ে করতে হলো। সবাই তো মুখের উপরেই বলে। আপনি আর লুকিয়ে কি করবেন। ছেড়ে দিন আমায়। আমি সইচ্ছায় আপনাকে মুক্তি দিবো।”

নিত্তিকা কথা শেষ হতেই শাহিয়ান নিত্তিকাকে খামচে ধরলো। আকাশী রঙের জামাটা ভেদ করে নখ একদম বসে গিয়েছে হয়তো নরম কোমরে। নিত্তিকা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো। শাহিয়ান এবার মুখ তুলে নিত্তিকা কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলতে লাগলো,
“আমি চেয়েছি তোর কাছে মুক্তি। মনে রাখবি আমৃত্যু পর্যন্ত তুই আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবিনা।আর একবার মুক্তির কথা তোর মুখে শুনলে শেষ করে দিবো সব।”

বলেই নিত্তিকাকে ধাক্কা দিয়ে গটগট পায়ে রুম ছেড়ে চলে গেল শাহিয়ান। নিত্তিকা বিছানায় পড়ে থমকে বসে রইলো। সবটা যেন গোলকধাঁধাঁর মতো লাগছে তার কাছে। যার অন্যতম রহস্যময় চরিত্র শাহিয়ান খন্দকার।

শাহিয়ান যেতেই রুমে ঢুকলো সায়রা। সাথে তার দাদি আছিয়া বেগম। নিত্তিকা ওদের আসতে দেখেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে সালাম দিলো হাসি মুখে। দাদি হাঁটুতে হাত রেখে বিছানায় বসে ইশারায় নিত্তিকাকেও বসতে বললেন। নিত্তিকাও বাধ্য মেয়ের মতো দাদির পাশে বসলো। দাদি নিত্তিকা থুতনিতে হাত রেখে নিত্তিকার মুখটা উঁচু করে ধরে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
“মাশাআল্লাহ তোরে তো দেখতে একদম আমার যুবতী কালের মতো। বাহ বাহ ভালোই হইছে তোর বড়টা পালাইছে। চাঁদের টুকরা যেন ঘরে আইছে।”

নিত্তিকা বেশ অবাক হলো। মহিলাটা কি সুন্দর করে তার প্রশংসা করলো। কোথায় আগে তো সবাই দোষত্রুটি ধরে। তিনি তো তার করলেননা। ভাবতেই মনের মাঝে এক ভালো লাগা কাজ করে গেল নিত্তিকার। সায়রা দাদির কথায় নাকোচ করে বলল,
“দাদি তুমিও না চাঁদের টুকরা আবার কি বলো পূর্ণিমার চাঁদ।”

সায়রার কথায় হেসে দিলেন আছিয়া বেগম। নিত্তিকা লাজুক হাসলো।

নিত্তিকা রিনরিনে গলায় বলে উঠলো,
“দাদি আপনিও অনেক সুন্দর।”

আছিয়া বেগমের হাসিমুখ নিভে গেল। নিত্তিকা ভরকালো। আছিয়া বেগম একটা শ্বাস টেনে বললেন,
“আর বলিসনা তোর দাদাজান ও বেঁচে থাকাকালীন প্রতিটা সময় বলতো তুমি অনেক সুন্দর গো বউ। হ্যাঁ ছিলাম শ্যামলা তাতে কি ওনার কাছে বিশ্বসুন্দরী।”

নিত্তিকা বুঝতে পারলো আছিয়া বেগমের মন খারাপ হয়েছে। নিত্তিকা চুপ হয়ে গেল। আছিয়া বেগম পরক্ষনেই হেসে বললেন,
“আরে তুই মন খারাপ করছিস কেন, বাদ দে এসব। দাদুভাইয়ের সাথে তোকে কিন্তু মানাবে দারুন।”

নিত্তিকা উপরে উপরে হাসলেও মনে মনে বলল,
“মানাবে নাকি ছাই ব্যাটা যে একটা রহস্যের কারখানা। তার সাথে আমাকে জীবনেও মানাবেনা।”

নিত্তিকার ভাবনার মাঝেই শাহানা বেগম রুমে এসে বললেন,
“সায়রা নিত্তিকাকে রেডি কর। কতটা দেড়ি হয়ে গেছে খেয়াল আছে। বেলা এগারোটা বাজে।”

বলেই হাতের সব জিনিস বিছানায় রাখলেন। সায়রা সবটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। নীল রঙের একটা লেহেঙ্গা, সাথে সাদা স্টোনের গহনা।

সায়রা নিত্তিকাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে নিজের কাজ শুরু করে দিলো। সায়রা সব কাজ ভালোভাবে পারে তাই তা লোক আনতে হয়নি। অবশ্য শাহিয়ানই সায়রাকে সাজাতে বলছে।

——————

সায়রা যখন নিত্তিকাকে সাজাতে ব্যস্ত তখনি নিত্তিকার ফোনটা বেজে উঠলো। নিত্তিকা সেদিকে তাকাতেই সায়রা মুচকি হেসে বলল,
“আপি তুমি ফোনে কথা বলো আমি একটু আমার জামা কাপড় গুলো বের করি।”

নিত্তিকা সম্মতি দিতেই সায়রা চলে গেল। নিত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। প্রথমে কেটে দিবে ভাবলেও কি যেন মনে করে রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই থমকে গেল। অপরপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ভেঁসে আসছে। নিত্তিকা হুট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। অস্থির কন্ঠে বলল,
“আপু এই আপু তুই কান্না করছিস কেন? তুই কোথায়? এভাবে কান্না করছিস কেন, কি হয়েছে তোর?”

অপর পাশ থেকে কান্না ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না । এতে যেন নিত্তিকার অস্থিরতা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল।

নিত্তিকাকে এমন করতে দেখে সায়রা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো কি হয়েছে। নিত্তিকা কিছু বলছেনা। হুট করে কলের লাইন কেটে গেল। নিত্তিকা ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। মাথা কাজ করছেনা তার। অজানা আতঙ্কে হাত পা রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে। সায়রা কিছু বুঝতে পারছেনা। নিত্তিকা জোরে জোরে শুধু শ্বাস নিচ্ছে।

সায়রা ছুটে সোজা শাহিয়ানের ঘরে গেল। ছেলেটা কেবলি ফ্রেশ হয়ে পাঞ্জাবী পায়জামা পরেছে। সায়রাকে এমন হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে আসতে দেখে কপাল গুটিয়ে ফেলল সে। সায়রা গড়গড়িয়ে বলতে লাগলো,
“ভাইয়া দেখনা ভাবি কেমন যেন করছে!”

সায়রার বলতে দেড়ি শাহিয়ানের হন্তদন্ত পায়ে রুম থেকে বের হতে দেড়ি হলো না। শাহিয়ান দ্রুত সায়রার রুমে এসে দেখলো নিত্তিকা জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। শাহিয়ান নিত্তিকাকে নিজের বুকের মাঝে আগলে ধরে অস্থির কন্ঠে বলতে লাগলো,
“এই তোমার কি হয়েছে, কোথায় কষ্ট হচ্ছে, বলো আমাকে। আমি আছি তো তোমার পাশে।”

নিত্তিকার কানে যেন বারবার বেজে উঠলো একটা কথা,
“আমি আছি তো তোমার পাশে।”

হুট করেই নিত্তিকা শাহিয়ানকে আকড়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। থমকে গেল শাহিয়ান। যতদিন যাবত মেয়েটাকে দেখছে মেয়েটা যে এভাবে কান্না করতে পারে তা মনে হয়নি। এমনকি জোর করে যে বিয়েটা দেওয়া হলো তখনো চোখে মুখে শুধু রাগ লেপ্টে ছিলো মেয়েটার। তাহলে কি এমন হলো!

শাহিয়ার দুইহাত দিয়ে নিত্তিকা ছোট গোলগাল মুখটাকে উপরে তুলে বলল,
“কি হয়েছে বলো আমাকে?”

নিত্তিকা নাক টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ সে। কান্নার তোপে কথা বলতে পারছেনা মেয়েটা। শাহিয়ান বিষয়টা বুঝতে পেরে শান্ত গলায় বলল,
“রিলাক্স, এত চাপ নিতে হবে না। পানি খাবে?”

নিত্তিকা জবাব দেওয়ার আগেই শাহিয়ান পিছনে ফিরে সায়রাকে ইশারা করলো। সায়রা ভাইয়ের ইশারা পেতেই চটজলদি পানির গ্লাস এনে এগিয়ে দিলো। শাহিয়ান নিজ হাতে গ্লাস নিয়ে নিত্তিকাকে খাইয়ে দিলো। কান্নার কারণে কাজল লেপ্টে একাকার অবস্থা। পানিটুকু শেষ হতেই নিত্তিকার মাথা নিজের বুকে ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো শাহিয়ান। নিত্তিকাও যেন বাচ্চাদের মতো গুটিয়ে গেল তার বুকের মাঝে।

দৃশ্যটা দেখে হুট করেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো সায়রার। কি যেন মনে করে ফোনটা নিয়ে ছবি তুলে ফেলল। আলগোছে সরে পরলো সেখান থেকে নিজের জামা কাপড় নিয়ে। আর চিন্তা নেই। তার ভাই যখন আছে সবটা সামলে নিবে।

বেশ অনেকক্ষন পরেই নিত্তিকা ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
“আপু কল করেছিলো।”

নিত্তিকার কথায় কপাল গুটিয়ে ফেলল শাহিয়ান। নিত্তিকাকে বুকের সাথে জড়িয়েই বসে রইলো। নিত্তিকা একটা সরে আসার চেষ্টা করতেই ছেড়ে দিলো শাহিয়ান। নিত্তিকা শাহিয়ানের দিকে না তাকিয়ে নিচের সাদা চকচকে টাইলসের মেঝে দৃষ্টি রেখে বলল,
“আপু ভালো নেই। নিশ্চই আপু কোনো বিপদে পড়েছে। কান্না করছিলো অনেক কল করে।”

#চলবে

চন্দ্রকণার রাহা পর্ব-০৩

0

#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৩

নিত্তিকা ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,
“তাহলে চলো যাই।”

নিত্তিকা আর সায়রা দুইজন মিলে একসঙ্গে রুম ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে গেল।

শাহানা বেগম নাস্তা বানাচ্ছিলেন। নিত্তিকাকে আসতে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
“শুভ সকাল”

নিত্তিকাও হাসিমুখে বলল,
“শুভ সকাল আন্টি, আমি কি আপনাকে কোনো সাহায্য করবো!”

শাহানা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“আমি তোমার কি হই?”

নিত্তিকা শাহানা বেগমের কথা বুঝতে পেরে মাথা চুলকিয়ে বলল,
“সরি আম্মু।”

শাহানা বেগম আড়চোখে একবার তাকিয়ে বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে এরপর যেন আর ভুল না হয় বলে দিলাম। এখন চা করেছি সেটা তোমার আব্বুকে দিয়ে আসো তো।”

নিত্তিকা পাশ থেকে চায়ের কাপ নিতে যাবে তখনি শাহিয়ানের চাচি মাফুজা বলে উঠলো,
“ভাবি তোমার প্রশংসা না করে পারছিনা। এমন ভাব করছো মনে হয় বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে।”

নিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমিও বাবা কি মানুষ! ছেলেটার বিয়ে হয়নি একদিন হবে তাও ধরে রাখতে পারলে না।”

নিত্তিকা কিছু বলার জন্য এগোবে তখনি পুরুষালি গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো,
“মানুষকে তখনি ধরে রাখা যায় না চাচি। আর জন্ম মৃত্যু বিয়ে সবটাই আল্লাহ ঠিক করে রাখেন। তাই সবটা যে যত তাড়াতাড়ি মেনে নিতে পারবে ততোই তার কাছে ভালো।”

নিত্তিকা কপাল কুচকে তাকাতেই দেখলো প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথাটা বলছে শাহিয়ান। মাফুজা বেগম প্রতিউত্তরে বলে উঠলেন,
“একরাতেই পোলা দেখি বউ পাগলা হয়ে গেছে!”

শাহিয়ান একই ভঙ্গিতেই বলল,
“এখানে বউ পাগলার কিছু হয়নি। সত্যি কথা যা তাই বলেছি। তাছাড়া এতটুকু কথা বললে যদি বউ পাগলা হয় তাহলে তোমার মেয়ের জামাই কি?”

মাফুজা বেগম চিল্লিয়ে বললেন,
“শাহিয়ার তুমি কিন্তু বড্ড বেশি কথা বলছো।”

শাহানা বেগম এবার ওদের থামানোর জন্য বলে উঠলেন,
“আহা ছোট থাম তো তোরা সকাল সকাল কী শুরু করলি। আর শাহি তুই এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে।”

শাহিয়ান মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু কাজ ছিলো, ওটা করে বাকিটা আমার ম্যানেজারকে বুঝিয়ে এসেছি।”

শাহানা বেগম বললেন,
“ওও ভালোই করেছিস। যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আমরা তো নাস্তা করে ফেলেছি তুই, নিত্তিকা আর সায়রা বাকি আছে। তোদের নাস্তা আমি দিচ্ছি যা।”

শাহিয়ান চলে গেল। নিত্তিকাও গেল সায়রার সাথে হামিদুল সাহেবকে চা দিতে। সায়রা যেতে বলল,
“আপি তুমি কি চাচির কথায় মন খারাপ করেছো?”

নিত্তিকা হাসি মুখ নিয়ে বলল,
“আরে না কী মনে করবো।”

সায়রা হেসে বলল,
“তবে আর যাই বলো ভাইয়া কি সুন্দর করে চাচিকে কুপোকাত করে দিলো। একদম যেন সিনেমা চলছিলো। নায়িকার অপমানের জবাব নিলো নায়ক।”

সায়রার কথা শুনে হেসে ফেলল নিত্তিকা। সায়রাও হাসলো।

——————-

রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে শাহিয়ান খাবার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখলো সায়রা আর নিত্তিকা এখনো আসেনি। শাহিয়ান চেয়ার টেনে বসে পরলো। খাবারের প্লেট টেনে খেতে লাগলো। খানিকবাদেই সায়রার সাথে নিত্তিকা খাবার টেবিলের কাছে এলো। ঘড়িতে প্রায় দশটা ছুঁইছুঁই। নিত্তিকা খাবার টেবিলে বসতেই শাহিয়ান নিত্তিকার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“কখন উঠেছো?”

নিত্তিকা কপালেভাঁজ ফেলে বলল,
“কেন শুনে কি করবেন?”

শাহিয়ান ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“সোজা কথা বলতে পারোনা।”

নিত্তিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না পারিনি। আর আপনার মতো মানুষের সাথে আরো পারিনা।”

শাহিয়ান এবার চোখ তুলে নিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার মতো মানুষ মানে!”

নিত্তিকা উত্তর দিলো না। শাহিয়ান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েই রইলো নিত্তিকার দিকে।

সায়রা গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“ভাইয়া ভাবির দিকে পরে তাকিয়ে থাকিস। এখন খা তো তাড়াতাড়ি। একটু পরে তো রেডি হওয়া লাগবে।”

শাহিয়ান বাম হাত দিয়ে সায়রার মাথার পিছনে গাট্টা দিয়ে বলল,
“বেশি কথা না বলে তোর মতো তুই খা। এত বকবক করতে বলেনি কেউ।”

সায়রা মাথা ঘষতে ঘষতে বলল,
“মাথায় মারিস কেন? জানিস না মাথায় মগজ থাকে। লেগে গেলে কি হবে!”

শাহিয়ান স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে উঠলো,
“কিছুই হবে না। ফাউ কথা বাদ দে।”

সায়রা মুখ বাঁকিয়ে খেতে লাগলো।

শাহিয়ান নিজের খাওয়া শেষ করে নিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“রুমে আসো কথা আছে।”

বলেই গটগট পায়ে চলে গেল নিজের রুমের দিকে। নিত্তিকা শাহিয়ান যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজ মনেই বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এ্যাহ রুমে আসো কথা আছে। যেন শশুরবাড়ির আবদার। যাবো না আমি। আমিও দেখবো ব্যাটা তুই কি করিস। বদ ব্যাটা মনে করছে আমি সব ভুলে গেছি। রাতে টুক করে কেমন চুমু খেল। নিজের সম্পত্তি পেয়েছে নাকি আমাকে। যে নিজের যা ইচ্ছে তাই করবে। আমাকে তো চিনে না।”

নিত্তিকা বিড়বিড় করতে করতেই খাবার শেষ করে সায়রার সাথে সায়রার রুমে গেল। সায়রার রুমের সাথেই লাগানো একখানা বারান্দা আছে। যেখান দিয়ে শো শো করে বাতাস আসছে রুমে। নিত্তিকা তার ঘন কালো চুলগুলো খুলে দিলো। সারাদিনে গোসল করার সুযোগ হবেনা ভেবে গোসল করেছিলো কিন্তু ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রাখায় চুলের অনেকটা অংশই ভেঁজা।

সায়রা নিত্তিকার চুল দেখে মুচকি হেসে বলল,
“আপি তোমার চুলগুলো তো অনেক সুন্দর।”

নিত্তিকাও হাসি মুখে বলল,
“ধন্যবাদ, তা তোমার চুল ও তো সুন্দর। বড় রাখোনা কেন?”

সায়রা নিত্তিকার পাশে বসে ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আর বলো না চুল না শুকালেই আমার ঠান্ডা লেগে যায়। তাই আম্মু বলেছে রাখতে হবে না।”

নিত্তিকা সায়রার ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
“থাক মন খারাপ করো না।”

তখনি গমগমে গলায় শাহিয়ান বলে উঠলো,
“তোমাকে আমি আমার রুমে আসতে বলেছিলাম। তুমি এখানে কি করছো?”

নিত্তিকা পিছনে ঘুরে তাকালো না। বিড়বিড় করে বলল,
“যাইনি যখন তখন বুঝে নে আমি যাবোনা। এখানে আবার বলতে আসা লাগবে কেন, আজব তো!”

সায়রা শাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া,আপি তো এখন রেডি হবে। আজকে যে বউভাতে অনুষ্ঠান আছে তুমি কি ভুলে গেছ?”

শাহিয়ান সায়রার কথায় পাত্তা না দিয়ে গটগট পায়ে নিত্তিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সায়রাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রুম থেকে যা তো কিছুক্ষণের জন্য। দাদি এসেছে দেখা কর গিয়ে।”

সায়রা বড় করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আসল কথা বললেই হয়। আমি দরজা পিছন থেকে লাগিয়ে যাচ্ছি।”

বলেই সায়রা চলে গেল। সায়রা দরজা আটকাতেই শাহিয়ান একটানে নিত্তিকার হাত ধরে ওকে দাঁড় করলো। নিত্তিকা ভরকালেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
“কি টানাটানি করছেন? আপনার তো দেখি চরিত্রের সমস্যা আছে মাইয়া মানুষের হাত ধরে টানাটানি করেন।”

শাহিয়ান বাম হাত দিয়ে নিত্তিকার কোমর ধরে নিজের কাছে এনে ডান হাতের তর্জনী নিত্তিকার ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল,
“চুপ, এই মেয়ে এতো কথা কেন বলো তুমি? তুমি যখন চরিত্র নিয়ে টানলেই। তাহলে আর ভালো সেজে কি করবো বলো তো বউ।”

শাহিয়ানের স্পর্শে নিত্তিকার শরীর কাঁপছে রীতিমতো। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
“দেখুন আমাকে এভাবে ধরবেন না। ছাড়ুন আমাকে।”

শাহিয়ান আরো শক্ত করে ধরে বলল,
“যদি না ছাড়ি।”

নিত্তিকা মনে মনে বলল,
“ব্যাটার পেটে পেটে এতো। এবার আমি ব্যাটারে উচিত শিক্ষা দিবো দাঁড়া তুই।”

#চলবে

চন্দ্রকণার রাহা পর্ব-০২

0

#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০২

নিত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে ইউটিউবে গানটা ছেড়েছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে শাহিয়ান বলে উঠলো,
“এই মেয়ে এতো রাতে এগুলো কিহ?”

নিত্তিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“কানা নাকি আপনি?দেখতে পারছেন না কি করছি!”

শাহিয়ানের আর বুঝতে বাকি নেই নিত্তিকা ওকে বিরক্ত করার জন্যই এই কাজ করছে। শাহিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি বন্ধ করবে নাকি বলো!”

নিত্তিকা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি বন্ধ করবো না।”

শাহিয়ান তীক্ষ্ণ চোখে নিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঠিক তো!”

নিত্তিকা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“বললামই তো করবো না।”

শাহিয়ান হুট করেই নিত্তিকার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে পাশের সোফায় ছুড়ে দিলো। নিত্তিকা নাক ফুলিয়ে বলল,
“এটা আপনি কি করলেন?”

শাহিয়ান উত্তর দিলো না। যেন কানে কোনো কথাই যায়নি। শাহিয়ানের এমন ভাব দেখে নিত্তিকা ফুস ফুস করতে করতে উঠে বসে বলল,
“আমার ফোন কেন ছুড়লেন এখন এনে দিন।”

শাহিয়ান হুট করেই উঠে নিত্তিকাকে ধাক্কা দিয়ে দুইহাত বালিশে চেপে ধরে বলল,
“এতরাতে বিরক্ত করার শাস্তি না পেয়ে তুমি তো শান্ত হচ্ছোনা দেখি।”

শাহিয়ান কাছাকাছি থাকায় নিত্তিকার সব তেজ যেন উড়ে গেল। কপালে ভাঁজ পরলো। ঘাড় ঘুরিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল। আবারো শাহিয়ানের লালচে চোখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“আমাকে ছেড়ে দিন।”

শাহিয়ান বাঁকা হেসে বলল,
“নাতো সোনাময়না, আমি চেয়েছিলাম তোমাকে আজকের মতো ছেড়ে দিবো। কিন্তু না আজকে সব করে ফেলি কি বলো!”

নিত্তিকা ঢোক গিলে বলল,
“আপনাকে বাপ্পারাজের দিব্বি কেটে বলছি আমি ননীর মতো কাজ করবো না। মানে আপনি ঘুমান আমি আর কিছু করবো না।”

শাহিয়ান কপালে ভাঁজ ফেললো নিত্তিকা আজগুবি কথায়। পরক্ষনেই আবারো বাঁকা হেসে বলল,
“আজ তোমার বাপ্পারাজও তোমাকে বাঁচাতে পারবেনা।”

নিত্তিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আপনি ঘুমান আপনার মতো। এতো বিরক্তবোধ করলে বিয়ে কেন করেছেন আমায়! আমি কি করতে বলেছিলাম আপনাকে!”

শাহিয়ান ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“আমার ঘুম নেই এখন।”

নিত্তিকা ভ্রুকুচকে বলল,
“কেবলি না ঘুম ধরেছে বলে চিল্লাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই ঘুম চলে গেল। বাহ আজব মানুষ তো আপনি। আপনি তো দেখি গিরগিটির থেকেও তাড়াতাড়ি রঙ থুক্কু কথা পাল্টান।”

শাহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে নিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার ঘুম না আসার কারণ যেহেতু তুমি তখন তুমি এর হিসাব দিবে।”

নিত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“এটার হিসাব তো মিলল না আপনার চোখ আপনার ঘুম। কেন চোখ বুজে ঘুম আসছেনা সেটা অবশ্যই আপনার দোষ।”

শাহিয়ান আর কথা না বলে হুট করেই নিত্তিকা ঠোঁটে চুমু খেল। এতে যেন নিত্তিকার চোখ বেড়িয়ে আসার মতো অবস্থা। নিত্তিকার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেছে। হাত পা যেন নাড়াতে ভুলে গেছে। মস্তিস্ক যেন তার কার্মকান্ড থামিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষন আগেই ঠোঁটে পাওয়া আলতো স্পর্শ যেন ঝড় তুলেছে মনে। সেই ঝড়কে থামানো কথা বললেও কি না বললেও কি সে ঝড় আর থামবে না।

নিত্তিকাকে এমন গোলগোল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাহিয়ান বলল,
“এরপর থেকে আমার সাথে লাগতে আসলে শাস্তি আরো কঠিন হবে বলে দিলাম সুইটহার্ট। আর তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছো তুমি আমার তিন কবুল করা বউ। তাই মাত্রা অতিরিক্ত শাস্তি দিলেও কিছু যাবে আসবে না।”

শাহিয়ানের কথায় নিত্তিকার যেন হুশ ফিরলো। সে কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
“আপনি এটা কি করলেন?”

শাহিয়ান নিজের বালিশে আরাম করে শুয়ে বলল,
“কিছুই করিনি সব তো বাকিই সুইটহার্ট।”

শাহিয়ানের কথায় নিত্তিকার গা জ্বলছে। কিছু বলতে নিবে তার আগেই শাহিয়ান নিত্তিকা টেনে নিজের কাছে আনে। নিত্তিকা প্রথমে থমকালেও পরবর্তীতে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগে। শাহিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“আর একটু নড়াচড়া করলে খবর করে দিবো বলে দিলাম।”

নিত্তিকা চুপ হয়ে গেল। নিত্তিকাকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরেই চোখ বুজলো শাহিয়ান। নিত্তিকা বেশ কিছুক্ষণ যাবত শাহিয়ানের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে ঘুমিয়ে গেল। নিত্তিকার ভারী নিশ্বাস অনুভব হতেই মুচকি হাসলো শাহিয়ান।

পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজ মনেই বলল,
“জীবনটা রহস্যে ঘিরে থাকা বাগিচার মতো। রহস্য উদঘাটন করলেই সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।”

———————

পান চিবোতে চিবোতে রফিক বলে উঠলো,
“আপনি মাইয়া মানুষ হয়ে এই কাম করতে আসছেন?”

সামনে থাকা মেয়েটা বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুলতে খুলতে বলল,
“চাচা আপনি হয়তো মেয়েদের এখনো চিনেননি। মেয়েরা চাইলে সব করতে পারে।”

মেয়েটার কথা শুনে রফিক হেসে বলল,
“মুখের কথায় কেমন বিশ্বাস করি আফা!”

মেয়েটা রহস্যময় হাসি দিয়ে হুট করে জিন্সের পকেট থেকে গান বের করে দূরে গাছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একব্যক্তিকে না দেখেই সুট করে দিলো। রফিক থমকে গেল।

মেয়েটা হেসে বলল,
“এটুকুতে এই অবস্থা হলে হবে রফিক সাহেব। আর কথা বাড়িয়ে কাজে মন দিন। আর গুপ্তচরের মুখ থেকে কথা বের করুন।”

রফিক মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। মেয়েটা বাঁকা হেসে সামনে বাসাটায় ঢুকে পড়লো।

—————————-

সকালের রোদ পর্দা ভেদ করে চোখে আসতেই পিটপিট করে চোখ খুললো নিত্তিকা। নিজেকে অন্য এক জায়গায় দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠলো নিত্তিকা। পরক্ষনেই মনে পড়লো কালই তো তার বিয়ে হলো। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে শাহিয়ানকে কোথাও পেল না। শাহিয়ানকে দেখতে না পেয়ে সস্থির নিশ্বাস ফেলল নিত্তিকা। বিছানা থেকে উঠে সোফার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে। নিত্তিকা মাথা চুলকিয়ে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো সোফায় শাহিয়ানের বোন সায়রা বসে আছে। নিত্তিকা মুচকি হেসে বলল,
“আরে সায়রা যে কি অবস্থা তোমার!”

সায়রা ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
“আচ্ছা আপি আমি এটা ভেবে পাচ্ছিনা বিয়ের পরের দিন মানুষ অফিসে গিয়ে কি করে?”

সায়রা কথা বুঝতে না পেরে কপালে ভাঁজ ফেলে নিত্তিকা বলল,
“মানে!”

সায়রা উঠে এসে নিত্তিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরে তোমার বর তো সকাল সকাল অফিসে চলে গেল।”

নিত্তিকা কুচকে যাওয়া কপাল স্বাভাবিক করে বলল,
“ওও তাই বলো। আমি ভাবলাম কি না কি!”

সায়রা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“আরে আপি তুমি বুঝতে পারছোনা। নিজের বরকে আঁচলে বেঁধে রাখতে। তাছাড়া সে ভেন্টিলেটার দিয়ে পালায়।”

নিত্তিকা চুলমুছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলল,
“আরে বাদ দেও তো তোমার ভাইয়ের কথা। আমি দেড়ি করে উঠে ফেলেছি তাই না। কি ভাববে সবাই, এমনিতেই বিয়েটা যেভাবে হলো।”

সায়রা নিত্তিকা কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আরে আপি কিছুই হয়নি আম্মু তো নাস্তা বানানো শুরু করেছে একটু আগে। আর মেহমানও কেউ নেই। চিল আপি।”

#চলবে

চন্দ্রকণার রাহা পর্ব-০১

0

#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃসূচনা_পর্ব

বাসর ঘরে ঢুকতেই শাহিয়ানের গলায় ছুরি ধরলো নিত্তিকা। শাহিয়ান থমকে গেল। কি হচ্ছে বুঝতে পারছেনা সে। তার সদ্য বিয়ে করা বউ নিত্তিকা। কিন্তু মেয়েটা এতো লম্বা কি করে হলো। এ কথা ভাবতেই নিত্তিকা বলে উঠলো,
“একদম নড়বেন না। নড়লেই গলা কর্তন করে দিবো বলে দিলাম।”

শাহিয়ান আড়চোখে নিচে তাকিয়ে দেখলো একটা ছোট টুলের উপর ভারী লাল টকটকে জামদানি শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহিয়ানের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো।

মুহুর্তের মধ্যেই নিত্তিকার হাত ঘুরিয়ে ছুরিটা নিত্তিকার গলায় ঠেকিয়ে বলল,
“সমস্যা কি?”

নিত্তিকা চোখ ছোট ছোট করে একবার গলা আর একবার হাতের দিকে তাকিয়ে নাকমুখ কুচকে বলল,
“আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে ধরার!”

শাহিয়ান নিত্তিকার হাতের ছুরি কেড়ে নিয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ে ধীর পায়ে ভাবলেশহীন ভাবে এগিয়ে যায়। নিত্তিকা বেশ বিরক্ত হলো শাহিয়ানের আচরণে। ভারী শাড়ি গহনা নিয়ে টুল থেকে নেমে কোমরে হাত রেখে বলল,
“আমি এই বিয়ে মানি না। আর আপনার বউ পালিয়েছে বলে আপনাকে আমার গলায় ঝুলে যেতে হবে। আপু পালিয়েছে তো আপনিও পালিয়ে যেতেন।”

শাহিয়ান বিছানায় বসে কপাল কুচকে নিত্তিকার দিকে তাকাতেই নিত্তিকা আবারো বলে উঠলো,
“আমি না হয় বাবার কথায় রাজি হয়েছি। তাছাড়া উপায় ছিলনা। আর আপনি কি শালি বানাতে গিয়ে বউ বানিয়ে আনলেন। ছেহ।”

শাহিয়ান কটমট করতে করতে বলল,
“চুপ একদম চুপ আর একটা কথা শুনলে..!”

নিত্তিকা শাহিয়ানের কাছে এসে আঙুল তুলে বলল,
“দেখেন আমি এই বিয়ে মানিনা। সো বউয়ের মতো ধমকে আমি চুপ যাবো না। আমি…!”

নিত্তিকা কিছু বলার আগেই শাহিয়ান ওর হাত ধরে একটানে নিত্তিকাকে বিছানায় ফেলে দিলো। নিত্তিকার সেই ছুরি নিত্তিকার গলায় ধরে বলল,
“তিন কবুল বলে বিয়ে করেছি তোকে। কি করার কথা ছিলো কি হয়েছিস সেটা আমার দেখার বিষয় নেই। চুপচাপ থাক তাছাড়া এই ছুরি তোর গলায় বসে দিবো।”

শাহিয়ানের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালো নিত্তিকা। শাহিয়ানের উষ্ণ নিশ্বাস এসে বারি খাচ্ছে নিত্তিকার চোখমুখে। বাম হাতটা এমন জোরে ধরেছে যে পড়নের চুড়িগুলো মনে হয় ভেঙে গেছে। গলায় একটু চাপ দেওয়ায় ব্যথাও পাচ্ছে মেয়েটা। নিত্তিকার দম বন্ধ হয়ে আছে। ভাঙা গলায় বলল,
“ছাড়ুন আমাকে। লাগছে আমার।”

শাহিয়ান নিত্তিকারকে আরো চেপে ধরে বলল,
“যা হয়েছে আমার ইচ্ছেতে হয়েছে আর যা হবে তা আমার ইচ্ছাতেই হবে।”

বলেই নিত্তিকাকে ঝাড়া দিয়ে ছুরিটা নিয়ে রুম থেকে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল শাহিয়ান। এদিকে অবাক হয়ে নিত্তিকা তাকিয়ে রইলো শাহিয়ানের যাওয়ার দিকে। লোকটা কি বলে গেল এসব? মাথায় ঢুকলো না নিত্তিকার। বাম হাতটা চোখের সামনে এনে দেখলো হাতটা একদম লাল হয়ে আছে। নিত্তিকা আস্তে আস্তে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের চুড়িগুলো খুলতে লাগলো। নিজ মনেই বিরবির করতে করতে বলল,
“ব্যাটা বদমাস আমার নরম, সুন্দর হাতটার কি অবস্থা করেছে। আমি দেখে নিবো ওই ব্যাটারে। আমার সাথে লাগা তাই না। তোর জীবন যদি আমি আলুর দম না বানাইছি তাহলে আমার নামও নিত্তিকা আহমেদ না।”

গায়ের গহনা গুলো ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে চুল খুলতে লাগলো নিত্তিকা। এপাশে ওপাশে তাকাতেই শাহিয়ানের একটা ছবি চোখে পড়লো নিত্তিকার। নিত্তিকা কি যেন ভেবে হাসলো।

————-

শাহিয়ান নিজের রুম থেকে বের হয়ে সোজা চলে এলো ছাদে। শীতের রাত হওয়ায় চারপাশে নিরবতা বিরাজ করছে। শীতল বাতাস এসে আছড়ে পড়ছে শাহিয়ানের গায়ে। রাগের তোপে গা কাঁপছে এখনো। হনহন পায়ে ছাদের কাণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাকালো খোলা আকাশের দিকে। পায়জামার পকেট হাতরে সিগারেট আর লাইটার বের করে একটা সিগারেট ধরালো। মনের সুখে সিগারেট টানতে লাগলো।

বেশ কিছুসময় পর রাগে তোপ কমতেই ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। গায়ে গরম কাপড় না থাকায় ঠান্ডা হয়ে আসছে গা, হাত, পা। তবুও একই রকমভাবে দাঁড়িয়ে রইলো শাহিয়ান। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিজ মনেই বিড়বিড় করতে লাগলো।

তার বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো হারিয়ে যেতে লাগলো অজানা গন্তব্যে।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুরির দিকে তাকালো। ছুরিটা বেশি একটা ধারালো না। হয় তো একটু চামড়া ছিলে যাবে এর আঘাতে। আর বোকা মেয়েটা নাকি এই ছুরি দিয়ে তার কর্তণ করবে। ভেবেই হাসলো শাহিয়ান। আবারো মুখে রাগী ভাব ফুটে উঠলো মুহূর্তেই। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“আমার সাথে লাগতে আসা মানুষ কখনোই সুখে থাকতে পারেনা। একদিন তো আমার সামনে তোকে পড়তেই হবে। জাস্ট ওয়েট ওয়াচ বেইবি।”

বলেই জোরে জোরে হাসতে লাগলো।

———–

নিত্তিকা একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হলো ওয়াশরুম থেকে। চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাসায় পড়ে থাকার একটা কুর্তি আর প্লাজু পরেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত একটা বিশ। নিত্তিকা একপলক তাকালো ফুলে সাজানো খাটটার দিকে। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আপু আজ এই জায়গায় তোর থাকার কথা ছিলো। এটা তুই কি করে গেলি! আমি কখনোই তোকে ক্ষমা করতে পারবো না। কখনো না।”

নিত্তিকা পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে ফুলগুলো সরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই হুট করে চোখের সামনে শাহিয়ানের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ভেসে উঠতেই ধপ করে চোখ খুলল নিত্তিকা। চোখ বড় বড় করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ব্যাটা তো দেখি বহুত বদমাস। চোখ বুজেও তো দেখছি শান্তি নেই।”

নিত্তিকার কথার মাঝেই দরজায় খট করে শব্দ হলো। নিত্তিকা চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। শাহিয়ান রুমের ভিতরে ঢুকে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুমের দরজা লাগাতেই নিত্তিকা দপ করে চোখ খুলে ফেলল। পায়ের কাছে থাকা কম্বল দিয়ে গায়ে জড়িয়ে চোখ বুজে আবারো শুয়ে পড়লো। না এখন তার ঘুমানো দরকার। কাল সকালে এই বদজাত ব্যাটাকে সে দেখে নিবে। তাকে বিয়ে করেছে না। মজা তো বুঝিয়েই ছাড়বে।

———–

শাহিয়ান লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে পড়েই বের হলো ওয়াশরুম থেকে। এমনভাব করছে যেন সে ব্যতীত এই রুমে আর কেউ নেই। কাবার্ট থেকে সাদা রঙের ফুলহাতা গেঞ্জি আর টাউজার বের করে পড়ে নিলো। ডিম লাইটের আলোতে সবটাই স্পষ্ট শাহিয়ানের কাছে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আড়চোখে তাকালো বিছানায় কম্বল গায়ে জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা নিত্তিকার দিকে। মুহুর্তেই চোখ সরিয়ে আবারো মন দিলো চুল মোছায়।

শাহিয়ান বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো নিত্তিকা একসাইড করেই শুয়েছে তবে মাঝে একটা কোলবালিশ দেওয়া। শাহিয়ান তীক্ষ্ণচোখ সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজ মনে কি যেন বিড়বিড় করলো। এক্সট্রা একটা কম্বল নিয়ে অন্যপাশ হয়ে শাহিয়ানও শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুতেই চোখে বুজে ফেলল শাহিয়ান।

চোখ বুজতেই কানের কাছে ঝাঁ ঝাঁ করে বেজে উঠলো,
~~ছি ছি ছি রে ননী ছি
ছি-ছি ছি রে ননী ছিরে ছিরে ছি,
ছি ছি ছি রে ননী ছি
ছি-ছি ছি রে ননী ছিরে ছিরে ছি।

সরতে দিনর সান হেইবা-কাজে ফজল নেই রেলু
সরতে দিনর সান হেইবা-কাজে গজল নেই রেলু,
বনজারনী মা’র পাখে যাই নিয়ম করি রেলু,
গলাগলা যাক তোর হেলি বলি কেতে কথা কহি রেলু
মুই গাঁ যাই করি আসলা বেলে
কেন্তা পাছরি দেলু রে ননী ছি ছি ছি,
ছি-ছি ছি রে ননী ছি
ছি ছি ছি রে ননী ছিরে ছিরে ছি~~

গান শুনেই চোখ কপালে উঠলো শাহিয়ানের। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে শাহিয়ান পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো

#চলবে কি?

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২০

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২০
“আসলেই আপনি বিবাহিত! আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না৷”
“তো এখন কি বৌ নিয়ে আপনার সামনে বাসর সারলে তারপর বিশ্বাস করবেন!”
ইরা বিরক্ত নিয়ে বলে, “ছিহহ কেমন ভাষা এসব?”
“আপনার যেমন প্রশ্ন আমার তেমন উত্তর। নিজের রাস্তা মাপুন৷”
“ধন্যবাদ আমাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য।”
“আপনার ধন্যবাদ রোদে শুকিয়ে বৈয়ামে ভরে রেখে দিন, অন্য কাউকে বিরক্ত করার পর আবার কাজে আসবে৷ বাই দা ওয়ে আপনাকে আপনার বাবার জন্য এতোটুকু হেল্প করেছি৷ ড্রাইভার গাড়ি ঘোরাও৷”

ইরা গম্ভীর মুখে গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,এতো এটিটিউড কিসের ভাই! তবে দেখতে হ্যান্ডসাম, ইশশ অবিবাহিত হলে এমন ভাবে পিছু নিতাম বৌ হয়ে তবেই ছাড়তাম।

এমন গায়ে পড়া স্বাভাবের মেয়ে জিয়ানের একদম পছন্দ না। জিয়ান বাসায় এসে ড্রেস খুলে খালি গায়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে ওয়াশরুমে চলে গেলো, শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে জড়িয়ে রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিয়ে, বডি স্প্রে করলো। আয়নায় তাকতেই নিজেকে দেখে বলে,আমি এই পাঁচটা দিনে পাঁচবারও নীলাঞ্জনার কথা ভাবিনি! আচ্ছা নয়না কি আমার মনে কোনভাবে জায়গা করে নিয়েছে? নাকি এসব সাময়িক মোহ ? জিয়ানের ভাবনার ছেদ ঘটলো ফোনের রিংটোনে। সাত পাঁচ না ভেবেই রিসিভ করলো জিয়ান৷

‘নয়নার চোখের সামনে জিয়ানের অর্ধনগ্ন শরীর ভেসে উঠলো৷ নয়না সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো একহাত নিজের বুকের বা’পাশে রাখলো। মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড এখনি বের হয়ে আসবে ভেতর থেকে। এই লোকটা আমাকে মেরেই ফেলবে এভাবে!
জিয়ান টিশার্ট পরতে পরতে বলে,”চোখ বন্ধ করে রেখেছো কেনো? কয়েকদিন আগেই কে যেনো বলেছিলো দেখার মত জিনিস চোখের সামনে থাকলে তো দেখবোই৷ তা এখন চোখ বন্ধ কেনো?”
“আপনার লজ্জা কই?”
“বেচে দিয়েছি,ওসব লজ্জা টজ্জা ছেলেদের মানায় নাকি!”
“লজ্জা কেউ বেচে দিতে পারে! নিজের জন্য একটু তো রেখে দিতে পারতেন৷”
“বেবি এখন চোখ খুলো আমি শার্ট পরেছি।”

নয়না চোখ খুললো কিন্তু জিয়ানের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না।
“কিগো দৃষ্টি নিচে রেখে আমার তোয়ালের ফাঁকফোকর খুঁজছো নাকি?”
‘নয়না এবার বুঝি লজ্জায় মিলিয়েই যাবে৷ খট করে ফোনটা কেটে দিলো।
“ধুর কে বলেছিলো এই প্লেন ড্রাইভারকে এতো হ্যান্ডসাম হতে! চোখ মেললেও এখন প্লেন ড্রাইভার চোখ বন্ধ করলেও প্লেন ড্রাইভার! পরিক্ষার খাতায় কি লিখবো?

‘জিয়ান হাসতে লাগলো। পিচ্চি বৌ তো দারুন উপভোগ্য! কেনো যে প্রেম করে দেবদাস হওয়ার দারপ্রান্তে পৌঁছালাম! থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে নয়নাকে আবার কল করলো। নয়না পিটপিট করে জিয়ানকে দেখছে।

“মিস ষোড়শী বালিকা আপনি পুরোপুরি ভাবে তাকাতে পারেন এখন আপনার কোন ডিস্টার্ব হবে না৷”
“নয়না তাকালো।মনে মনে, ইশশ ব্লু রঙের টিশার্টে এতো হ্যান্ডসাম লাগছে কেনো!কোন মেয়ের দৃষ্টি পরলে তো ক্রাশ খাবে।”
“এভাবে তাকিয়ে কি দেখো?আমি কি তোমার ক্রাশ বিলাল আব্বাসের চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম?”
“নিজেকে কি মনে করেন আপনি? আমি মোটেও আপনাকে দেখছি না। আমি দেখছিলাম আপনার পেছনে থাকা মিরর, কি সুন্দর মিররের ডিজাইনটা! আবার আসলে এটা আমার জন্য নিয়ে আসবেন।”
“আপনি আমার কে?”
“আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী।”
“সত্যি?”
‘ নয়না মাথায় হাত দিলো৷ এসব কি হচ্ছে তার সাথে! জিয়ান ঠোঁট টিপে হাসলো। নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,তুমি কি আদৌও অন্য কোন ছেলের সাথে রিলেশন করতে পারবে?
“পারবো না কেন! একশবার পারবো। আমি কি কম সুন্দর নাকি!”
“তোমাকে অসুন্দর কে বলল?”
“আপনি বলছেন, আমি কি আসলেই অসুন্দরী?”
“এমন ভুল ধারনা পোষণ কইরো না, ময়নার মা৷ তুমি দেখতে ভুতনীর মত।”
”আপনি দেখতে ভুতের মত।”
‘আরেহহ বাহহ ভুত আর ভুতনী দারুন কম্বিনেশন তো!”
“আপনি কি সত্যি কানাডা আছেন? মানে আমাদের সত্যি আর দেখা হওয়ার চান্স নেই!”
“দেখা করতে ইচ্ছে করছে বুঝি? আসলে দোষটা তোমার না দোষটা তোমার বয়সের। কয়েকদিন পর আর আমার কথা মনেও থাকবে না৷”
“আসলেই আপনাকে ভুলে যাবো,এটা কি সম্ভব?”
“অনেক বেশি মিস করছো বুঝি?”
“নয়না আপনাকে মিস করবে কেনো!আপনি আসলেই প্লেন ড্রাইভার নাকি তা দেখার জন্য কল করেছি।”
“ইট’স পাইলট, নট প্লেন ড্রাইভার।”
“আপনার রুমে আপনি একা থাকেন?”
“নাহহ আমার চারটা বৌ আর গোটা কয়েক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে থাকি।”
“সোজা কথা বলা যায় না?”
”সমস্যা কি তোমার সুনয়না? পড়তে না বসে মোবাইল নিয়ে পরে আছো কেনো?”
“সমস্যা কি মানে!সমস্যা হলেন আপনি। সমস্যার মা, সমস্যার বাপ,সমস্যার চৌদ্দগুষ্টি সব আপনি। কোথাকার প্লেন ড্রাইভার আমার মাথাটা খেয়ে ফেলছে!”
“কোথাকার প্লেন ড্রাইভার মানে! আমি জিয়ান রেজা চৌধুরী, ক্যাপ্টেন রেজা চৌধুরী মানে বুঝো? ফার্স্ট আফিসার আমি, সো রেসপেক্ট। আর ফোন রাখো পড়তে বসো আমার কাল ফ্লাইট, সো রেস্ট নিতে হবে। শরীর ফিট রাখতে হয় বেবি।”

নয়না ফোন কেটে দিলো৷ কি পেয়েছে আমাকে! যখন তখন, ‘বাবু, বেবি, বাচ্চা বলবে!সামনে পেলে একদম নাগা মরিচের আচার বানিয়ে রেখে দিতাম।

🌿
জাহিন ব্ল্যাকশার্ট সাথে ব্ল্যাক ব্লেজার পরা,হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ। চুলগুলো স্পাইক করা৷ নিজেকে আয়নায় শেষবারের মত দেখে নিয়ে নিজের সবচেয়ে পছন্দের পারফিউম ‘(ভারসাচি ইরস ফর মেন’)স্প্রে করে নিলো। এটার স্মেল ভিষন পছন্দ জাহিনের। রেডি হয়ে নিচে আসতেই। মিতা বেগম বললেন, রাত ন’টায় তুই এতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?
“আম্মু কি যে বলো না! আমি কি মেয়ে নাকি সাজগোছ করবো! তোমার ছেলেরা এমনিতেই হ্যান্ডসাম।”
“এসব পাম না দিয়ে আসল কথা বলো?”
“আম্মু আজ পার্টি আছে অন্তরের বাসায় একটার মধ্যে বাসায় চলে আসবো।”
“দেখ জাহিন এবার কিন্তু তোর স্থির হতে হবে অনেক হয়েছে এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি।”
“ওকেএএ আম্মিজান ভেবে দেখছি।”
“জাহিন গাড়ি না নিয়ে তার শখের বাইক নিয়ে বের হলো৷”
অন্তরের বোনের বার্থডে অন্তর বারবার রিতুর পিছু পিছু ঘুরছে আর বলছে, একটা বান্ধবী দে তোর। যদি ভাইয়ের জন্য এতোটুকু না করতে পারিস তাহলে কেমন বোন তুই? একটা মেয়ে দে সিঙ্গেল লাইফ আর ভাল্লাগে না কতকাল একা থাকবো বল!
“আমাকে দেখে কি তোমার মেয়ে পাচারকারি মনে হয়!”
“ওকে ভালো কথা শুনলি নাতো? আজকে জাহিনকে আসতে বলেছিলাম তোর বার্থডেতে থাক মানা করে দেই৷”
“জাহিননননন!ও চলে আসছে?”
“চলে আসলেও কি ও তো তোকে পাত্তাও দেয় না৷”
“ভাই তুমি আমাকে এভাবে অপমান করছো! তোমার বন্ধুর যে প্রেমে এলার্জি সেটা দেখছো না৷”
“তোর সবচেয়ে সুন্দরী বান্ধবীর নামটা বল।”
“নাম বলে কি হবে? আসলেই দেখে নিও৷”

মান্নাত ব্ল্যাক আর গোল্ডেন শেডের আনারকলি পরেছে, সাথে হালকা অর্নামেন্টস, চুলগুলো কার্ল করেছে। আয়নায় তাকিয়ে বলে,হায় নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি সবাই তো বেহুশ হয়ে যাবে৷ কালো বোরকা পরে রুম থেকে বের হলো মান্নাত। জামাল সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে খবর দেখতে বিজি। মান্নাত ধীর পায়ে বের হয়ে গেলো৷ বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। গিফটের প্যাকেটটা এমন ভাবে বোরকার উপর রেখেছে দেখে মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্ট মহিলা। রিকশা না পেয়ে হেঁটেই রওনা হলো বেশি দূরে না রিতুর বাসা, হেঁটে গেলে মাত্র বিশ মিনিট লাগবে।

“মান্নাত রিতুর বাসায় ঢুকতেই সবাই বোকার মত তাকে আছে মান্নাতের দিকে।
“অন্তর এসে বলে,আপনি কে খালাম্মা?”
“মান্নাত নরম স্বরে বলে রিতু কোথায়? আমি ওর ফ্রেন্ড।”
‘অন্তর রিতুর রুম দেখিয়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে বলে,এই নয়মাসের বাচ্চা নিয়ে কে বার্থডে পার্টিতে আসে!এখন এখানেই ডেলিভারি হলে পার্টি ছেড়ে মাটি করতে হবে। মান্নাত রিতুর রুমে ঢুকতেই রিতু চিৎকার দিয়ে বলে,কে আপনি?
‘মান্নাত গিফটের প্যাকেট বেডের উপর রেখে বোরকার নেকাব সরিয়ে বলে,আমি?
“রিতু আরেক দফা অবাক হয়!কে আপনি?”
“মান্নাত বোরকা খুলে চুলগুলো ঠিক করে বলে, সাবকি হোশ উড়ানে ওয়ালি মান্নাত হু।”
“আরেহহহ ইয়ার! তোকে চেনাই যাচ্ছে না! দাদিআম্মা থেকে সোজা হটনেসের দোকান! কিভাবে সম্ভব!”
“সেসব বিরাট কাহিনি পরে বলবো,এখন বল সারপ্রাইজ কেমন লাগলো৷”
“হার্ট এটাক হতে হতে হয়নি৷ মান্নাত ইয়ার এতো রূপবতী হয়ে এমন গাইয়া ভুত হয়ে কলেজে কেন আসিস?”
“কলেজে পড়তে যাই রুপ দেখাতে না। এবার বল বাকিরা কোথায়?”
“সব ছাদে। চল আমরাও যাই। জানিস আজ আমার জান্টুসও আসবে পার্টিতে।”
“তোর আবার জান্টুস আসলো কোথা থেকে? তুই না পিউর সিঙ্গেল একদম হট চিলি সসের মত পিউর?”
“জান্টুসকে তো পটাতে পারিনি।”
“ওহহহ এই কেস। এখন চল বাকিদের শক দেই।”
“যারা এসেছে তোকে দেখলে সত্যিই চারশ চল্লিশ ভোল্টের শক খাবে।”

🌿
লাবিব নীলাঞ্জনার কাছে এসে নীলাঞ্জনার ঘাড়ের চুল সরিয়ে কিস করতে লাগলো৷
‘নীলাঞ্জনা সরে দাঁড়ালো।
‘ লাবিব এবার আরো গভীর ভাবে স্পর্শ করতে লাগলো৷
“নীলাঞ্জনা সরে যেয়ে বলে,সব সময় এসব ভালো লাগে না। আমার কি মন নেই? ফিলিংস নেই? তোমার ইচ্ছে করলেই এসব করতে চলে আসো!”
“লাবিব নীলাঞ্জনার চুল মুঠ করে ধরে বলে,বাবা তোকে মেনে নিয়েছে এরজন্য উড়ছিস? আমি ছুড়ে ফেলে দিলে সব পাখা ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়বি৷ আমার তোকে এখন চাই মানে চাই৷ চাহিদা পূরন করবি নয়ত এই দেশে টাকা ছিটালে মেয়ের অভাব হয়না।”

‘নীলাঞ্জনা লাবিবের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো! একটা মানুষ এতো নিচু মাইন্ডের কিভাবে হতে পারে! আমি সত্যিই এই মানুষটাকে ভালোবেসে ছিলাম!
‘লাবিব নীলাঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো৷
‘নীলাঞ্জনার চোখ থেকে বোবা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ যে ভুল সে করেছে তার মাশুল তাকেই দিতে হবে৷ এই মুখ নিয়ে ফিরে যাওয়ার রাস্তা যে বন্ধ! না সমাজ,আর না পরিবার তাকে কেউ আর গ্রহণ করবে না৷
#চলবে
হ্যাপি রিডিং 🥰

বৃষ্টির ছন্দ পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#বৃষ্টির_ছন্দ

পর্ব-৩ ( শেষ পর্ব)

হলুদের অনুষ্ঠানে কী কী হয়েছে সে গল্প শোনানো হচ্ছে দাদীকে। তবে গল্পটি মৃদুল নয় রিধি শোনাচ্ছে। দাদীর ঘরে আজকেও ঘুমাবে তিন্নিকে বলে এসেছে রিধি। হলুদের সাজপোষাকে বসেই হাত নেড়ে জ্বালাতন করা মেয়েগুলির ভার মুখের গল্প বলছে রিধি। দাদী খুব মজা পেয়ে ফোকলা মুখে হাসছে, রিধিও হাসছে। মৃদুল চুপ করে দুজনার কান্ড দেখছে।

দাদী বলে, শাড়ি পাল্টাইবা না রিধি?

– জি দাদী, একবারে গোসল করে ঘুমাবো। গরম লাগছে খুব।

মৃদুল বলে, কিছুক্ষণ পর কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাবে।

-ওহো, তাহলে তো এখনই গোসল সারতে হয়। চট করে উঠে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতে লাগে রিধি।

গতদিনের চেয়ে রিধি আজ বেশ চটপটে। দাদীর সাথে সম্পর্ক জমছে, মৃদুলকে নিয়েও অস্বস্তি নেই যেন। তবু মৃদুল নিজের রুমে চলে আসে রিধির প্রাইভেসির কথা ভেবে।
ঘরে আরেকটা বাথরুম থাকার দরকার ছিল। বাড়তি একটা রুম করাও জরুরি। এতোদিন এসব মাথায় আসেনি, দাদী নাতির সংসারে প্রয়োজনও পড়েনি। আজ মনে হচ্ছে, একটা ড্রইংরুম, অ্যাটাচ বাথসহ দুইটা বেডরুম করা দরকার। রিধি যেন পরবর্তীতে…. কী ভাবছে এসব! চিন্তা পাল্টায় মৃদুল।
রিধি গোসল সেরে বের হলেও মৃদুল আর নিজের রুম হতে বের হয় না। বিদ্যুৎ চলে গেলে চার্জার হাতে আসতে বাধ্য হয়। মৃদু আলোয় ছোট ছোট ভেজা চুলে শ্যামবর্ণের রিধিকে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছিল। ঘরে আইপিএসেরও দরকার আছে ভেবেছিল, এখন মনে হচ্ছে মৃদু আলোয় রিধির যে সৌন্দর্য তা আলোর প্রখরতায় জানা হতো না।

ভোরে দরজা খুলে বাইরে বেরোতে নিলে দেখে বারান্দার চেয়ারে বসে আছে রিধি।

– এতো সকালে উঠলে যে?
রিধি হেসে উত্তর দেয়, সকালে ওঠাই অভ্যাস। চলুন নাস্তা করতে যাই।
কিছু চিন্তা মাথায় উঁকি দেয়, তবে তা ঝেড়ে মৃদুল বলে, হুম চলো।
নাস্তায় কেউ নেই। গতরাতের অনুষ্ঠান রাত অবদি চলায় সবাই ঘুমোচ্ছে। স্বপ্নাখালা নাস্তা বেড়ে দিলে চোখ কচলে তিন্নির মা আসেন। লাজুক হেসে বলেন, আজ উঠতে দেরী হয়ে গেল। এতো কাজ ছিল, সকালে ঘুম ভাঙতেই চায়নি।
রিধি হেসে বলে, না আন্টি, পারলে আরেকটু শুয়ে নিন। আজ বিয়েতে দৌড়ঝাঁপ আরো বেশি হবে। শরীরে শক্তি দরকার।

তিন্নির মা বলেন, তা কী কেউ বুঝবে রে মা? মেয়ে মানুষের এতো ঘুমোলে চলে? তাও আবার আমি কনের মা!

মৃদুল বলে, চাচী তিন্নিরা কেউ ওঠে নি? ওদের নদীর পাশ ঘুরিয়ে আনতাম।

– না রে, সব নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।

রিধিকে জিজ্ঞেস করে মৃদুল, যাবে তুমি?

রিধির আগেই চাচী বলেন, সবাই উঠলে একসাথে যেও।

-না চাচী, আমাকে হাসপাতাল যেতে হবে। তাছাড়া বেলা পড়লে রোদে ঘুরতে ভালো লাগবে না।

রিধি বলে, আমি যেতে চাই, যাবো আন্টি?

এতোশত চিন্তা করতে জানে না সরল মনের তিন্নির মা। মেয়েগুলো কাল চলেই যাবে। যা ঘুরার ঘুরে নিক ভেবে সম্মতি দেন।

আকাশে মেঘ জমছে। সাথে করে ছাতা নিয়ে নেয় মৃদুল। নদীর কিনারে যেতে যেতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। ছাতা খুলে রিধিকে ছাতার নিচে ডাকে। দ্বিধা ছাড়াই রিধি মৃদুলের সাথে চলে। হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে ঘরে ফিরে যাবার কথা না ভেবে ধীরে ধীরে এগোয় দুজন।
মৃদুল মনে মনে চাইছিল তিন্নি বা ওর বান্ধবীরা না থাকুক। শুধু রিধিকেই প্রিয় জায়গাটি দেখানোর ইচ্ছে। দুই দিনের পরিচয়ে কেন এতো আপন মনে হচ্ছে রিধিকে জানা নেই। হয়তো রিধি আন্তরিক বলে।
বৃষ্টি বেড়ে গেলে নদীর কিনার পর্যন্ত আর যাওয়া হয় না। বট গাছের নীচে দুজন আশ্রয় নেয়। বৃষ্টির দাপুটে হাওয়ায় ছাতাটি দোদুল্যমান। তবু ফিরে যাই কথাটা কেউ বলে না।
বর্ষায় টুইটুম্বর নদীতে নৌকা চলছে। কিনারে একটা বরই গাছ তাকে স্বর্ণলতা গ্রাস করেছে। বৃষ্টির প্রবলতায় নদীর ওপার একেবারে ঝাপসা। শীত শীত বাতাসে ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বাকহারা রিধি মুগ্ধ চোখে অবলোকন করে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য।

মৃদুল বলে, এ জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। ছোট থেকেই একা বড় হয়েছি। প্রায়ই এখানে একা বসে বসে সময় কাটাতাম। বলা যায় এই বিশাল আকাশ, খরোস্রোতা নদী, ওই বরইগাছটি আমার বন্ধু।
রিধির দিকে চাইলে দেখে টপ টপ করে জল পড়ছে গাল বেয়ে। চমকে ওঠে মৃদুল। তুমি কাঁদছো কেন রিধি?

ঠোঁটে হাসি মেখে ভেজা চোখে মৃদুলের দিকে তাকায় রিধি। এতো সুন্দর দৃশ্য আমি জীবনেও দেখিনি! এই দৃশ্য আজীবন আমার মনের কুঠুরিতে বন্দি থাকবে। এই মুহূর্ত, বৃষ্টিতে এমন দাঁড়িয়ে থাকা কখনো ভুলবো না আমি। আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দিবো, জানা নেই!

মৃদুল সামনে তাকিয়ে হাসে, রিধিও এই প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে চায়।

রিমঝিম বৃষ্টিতে দুজনার শরীরের পাশাপাশি মন ভেজে একত্রে, নব এক অনুভূতিতে সিক্ত হয় দুজনে। একে অন্যের হাত ছোঁয়া হয় না তবু অদৃশ্য গহীন ছোঁয়ায় আবেশিত হয় মন।

বিয়ের আয়োজন মেঘ কাঁদা মিলিয়ে শেষ হয়। বিশাল আয়োজনেও ঘাটতি চোখে পড়ে বরের মামার। তাই নিয়ে রাগারাগি, মান ভাঙ্গানো আরো কতকিছু। হা হয়ে দেখে রিধিসহ ওর বান্ধবীরা। এতো হট্টগোল শেষে আবার মিলেমিশে খাওয়া দাওয়া, গগন বিদারী কান্না করে কনের নতুন জীবনের যাত্রা। পরিশ্রম শেষে ক্লান্ত ভূঁইয়া পরিবারের সকলে। অন্যদিকে রিধিরা ক্লান্ত নানান নাটকীয়তা দেখে। এক বান্ধবী বলেই বসে সারাজীবন শুনলাম গ্রামের মানুষ সোজাসরল হয়, এ বিয়েতে না আসলে জানতামই না কেবল পান সাজিয়ে দেয়নি এমন অযুহাতে এতোবড়ো ঝগড়া বাঁধতে পারে। তিন্নি হেসে বলে, এমন নাটক গ্রামের সব বিয়েতেই হয়। নইলে তারা ইজ্জতদার নয়, বুঝলি?
হায় রে সরলতা…বলে হেসে ওঠে বান্ধবীরা।

গ্রামের গরলতার প্যাঁচে পড়েছে মৃদুল। মনে শংকা জেগেছিল বারবার তবু পাত্তা দেয়নি। মনের ইচ্ছেটাকে আজ ছাড় দিতে চেয়েছিল, তা-ই সইলো না। বিয়ের অনুষ্ঠানে রিধিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চললো মৃদুল। রিধি ভেবেছে হট্টগোলের কারণে মৃদুল হয়তো ব্যস্ত। নইলে পুরো বেলা কথা বলা দূর চোখাচোখিও হবে না!
মৃদুল মোবাইলে কথা বলছিল, রিধি এগিয়ে গেলে তিন্নির আম্মা পথ আটকে রিধিকে অন্যপাশে নিয়ে যায়। চাপা কণ্ঠে বলে, কিছু মনে করো না রিধি, আজ ভোরে তোমরা নদীর ধারে গিয়েছিলে তা তোমার ছোট চাচীর চোখে ঠেকেছে। মৃদুলকে কটুকথা শুনিয়েছে। আমি এতো প্যাচ বুঝি না মা, তাই তোমাদের বাধাও দেই নি। কিন্তু গ্রামে বদনাম রটলে… তুমি আমাদের মেহমান, তোমার বদনামী মানে আমাদের বদনামী। তুমি বুঝছো তো ? মৃদুল থেকে দূরে থাকো, কাল তো চলেই যাচ্ছো!
রিধির মুখ অন্ধকার হয়ে আসে। তিন্নির মা ওর গালে মুখে হাত বুলিয়ে সরে এলে রিধি তাও মৃদুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। থমথমে মুখে প্রশ্ন করে, আপনি কী ছোট চাচীর কথায় আমাকে এড়িয়ে চলছেন?

মৃদুল একপলক চেয়ে বুঝতে পারে রিধি জেনে গেছে। মুখ গম্ভীর রেখে বলে, আমারই ভুল হয়েছে। তোমাকে একা ওভাবে নিয়ে যাওয়া আমার উচিত হয়নি।

-অন্যরা কী বললো তা আপনি ভয় পান?

– মন চাইলেই তো সব করা উচিত নয়, তাই না?

রিধি আর দাঁড়ায় না সোজা দোতালায় চলে যায়। রিধির চলা যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদুলের সবকিছু শূন্য মনে হয়।
বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কান্না করে রিধি। জীবনের এতো সুন্দর মুহূর্তটি পুরোই মিথ্যে হয়ে গেল! নিজেকে বহুকষ্টে সামলে চোখ মুখ ধুয়ে বের হয়। তিন্নিকে সামনে পেয়ে চোখ নামিয়ে বলে, দাদীর ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসি। আজ এখানেই থাকবো তোদের সাথে।

তিন্নি শুনেছে রিধির সাথে মৃদুল সম্পর্কিত গুঞ্জন। রিধি সেনসেটিভ মেয়ে, ভেঙ্গে পড়লে সর্বনাশ হবে। ঘটনা আর যেন না ছড়ায় তাই বলে, সেটাই ভালো হবে রে..

ব্যাগ গুছিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে অন্ধকার মুখে বিদায় নেয় রিধি। দাদীর অভিজ্ঞ মন ঠিকই আন্দাজ করতে পারে কোথাও জল ঘোলা হয়েছে।

মৃদুল হাসপালাতে ছিল। অসময়ে যাবার দরকার ছিল না, বিয়ে উপলক্ষে আজ ছুটিও নেয়া ছিল। তবু নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে যাওয়া।
মন টেকে নি বেশিক্ষণ, আবার বাড়ি ফিরে। দাদীর কাছে শুনতে পায় রিধি ব্যাগসহ বিদায় নিয়ে গেছে। মন আরো বিক্ষিপ্ত হয়, তিন্নিদের বাড়ির নিচে হাঁটাহাটি করলে রিধি একবারো নিচে নামে না। দোতালায় গিয়েও রিধির দেখা মেলে না। রুমবন্দি হয়ে আছে রিধি।
নিজের উপর রাগ হয় মৃদুলের। কী দরকার ছিল রিধিকে ওমন কিছু বলার। কাল তো চলেই যাচ্ছিল, হাসিমুখেই বিদায় দিতো। কানাঘুষা যা হবার মৃদুলকে নিয়ে হতো। এসব আর নতুন কিছু নয় মৃদুলের জীবনে।
উপায় না পেয়ে তিন্নিকে অনুরোধ করে রিধিকে ডেকে দেবার জন্য।
তিন্নি বুঝতে পারে দুইদিক থেকেই দগ্ধ মন। গ্রামের পরিবেশে সহজ জিনিসকেও জটিল করে দেখা হয়। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারে না তিন্নি। রিধির মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলে, কল করে কথা বলে নাও।
মনের ভেতর ঝড় বইছে, দূরে সরে ব্যস্ত আঙুলে কল দেয় মৃদুল। রিধির কণ্ঠ শুনতেই ভেতরটা যেন শীতল হয়ে পড়ে।
এপাশের নীরবতায় রিধি বোঝে, মানুষটা কে।
সময় কেটে যায় নিঃশব্দে…

-সরি রিধি, আমি বুঝিনি এমন কিছু হবে। ছোট চাচী তোমাকে নিয়ে বাজে কথা বলবে জানলে….

-আমি চাচীর কথায় দুঃখ পাই নি, স্পষ্ট সুরে বলে রিধি।
মৃদুল থামে কিছুক্ষণ আবার বলে, দাদী বলল তুমি ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছো!

-আপনার বদনাম হোক চাই নি।

-আমার বদনাম নিয়ে আমি বিচলিত নই রিধি।
রিধি চুপ করে থাকে।

-একবার নিচে নামবে?

-না।

-খুব দরকার ছিল।

-আমার কাছে যেটা চমৎকার মুহূর্ত আপনার কাছে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত। এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। আপনি ভালো থাকুন। লাইন কেটে দেয় রিধি।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মৃদুল। জীবনে শেষবার কখন চোখের কোণ ভিজেছিল জানা নেই। আজ হঠাৎ চোখ জ্বালা করায় অবাক হয় না। জীবনের ভালো অংশগুলো মৃদুলের পাতে কখনো উঠে নি।

স্বপ্নাখালা দাদীর জন্য খাবার নিয়ে গেলে খাওয়া শেষে ছড়ির খটখট শব্দ তুলে তিন্নিদের ঘরে ঢোকে দাদী। দোতলায় সিড়ি ভেঙে ওঠা কষ্টকর তবু তিনি ওঠেন।
তিন রুম জুড়ে নারীদের আস্তানা। তিন্নির মা, খালা, ছোট চাচী, উনার বোন, মাসহ তিন্নির মামাতো, খালাতো বোনেরাও আছে। দাদীর উপস্থিতিতে নড়েচড়ে বসে সবাই।

তিন্নির মায়ের উদ্দেশ্যে দাদী বলেন, স্বপ্না তো অনেক থাকলো আইজ নিয়া যাই। আমার পা দুইটা মেজমেজ করতেছে, ওর মালিশ দরকার।

স্বপ্নাখালা মোচড় মেরে বলে সারাদিনের খাটাখাটুনি শেষে আবার পা টিপা আমার শইলে দিবো না।

তিন্নির মা বলেন, আজ তো মেহমান আছে আম্মা। আগামীকাল সবাই চইলা যাইবো। আগামীকাল স্বপ্নারে নিয়েন।
-হো, আমি বুড়ি একলা মইরা থাকলেও কারো যায় আসে না। আইজ সারাটা দিন একলা ঘরে আমি। বাঁইচা আছি না মইরা গেছি কেউ একবার চুঁপি দিছো? দরকারে আমার কামের বেটিরেই নিয়া আইছো। দুইবেলা খাবার পাঠাইয়াই দায়িত্ব শেষ!

ছোট চাচী বলেন, বিয়া বাড়িতে একটু ব্যস্ততা থাকেই। কেউ তো বইসা আছিল না।

-তা বইসা নাই, তয় তোমার ভাগেও তেমন কাম পড়ে নাই। তুমি চলো আমার ওখানে, পা টিইপা দিবা।

ছোট চাচী থতমত খেয়ে যায়।

-দুইদিন রিধি মেয়েটা ছিল, রাতে পা পিইপা দিছে দেইখা আরাম করে ঘুমাইছি। নইলে…

তিন্নির মা অবাক সুরে বলেন, আম্মা আপনি মেহমানরে দিয়া পা টিপাইছেন?

-তো কী করমু? এতো গুলো নাতি নকসল একটাও চুপি দিয়া দেখছে বুড়ি দাদী কী করে, কেমন আছে? আমার পেটে পোকা ধরছিল তাই পুলাগুলো বেইমান জন্মাইছে, বেইমানের ঘরের পোলাপান তো আর ভালো মানুষ হইবো না। সবকটাই স্বার্থপর!

ছোট চাচী মুখ বাঁকিয়ে বলে, ঘর ভর্তি মেহমানের সামনে সবসময় তামাশা করেন কেন আপনি?

-অতীত ভুলিনাই ছোট বউ! কে কতটুকু তামাশা করে আমার জানা আছে। এখন কও কে আমার পা টিপতে সাথে যাইবো?
সবাই মুখ বাঁকিয়ে চুপ করে থাকে।

দাদী গলা উঁচিয়ে বলে, কী গো রিধি, দুইদিন পা টিইপাই হাত ভাইঙ্গা গেছে? কোনো সাড়া দেও না কেন?
পাশের রুমে বসা রিধি থ হয়ে আছে দাদীর মিথ্যা কথা শুনে। রিধি একদিনও দাদীর পা টিপে দেয়নি। দাদী কখনো বলেও নি।

দাদী আবার গলা উঁচায়, যাইবা না রিধি?

ওতোশত চিন্তা বাদ দিয়ে তড়িঘড়ি উত্তর দেয়, আসছি দাদী।

রিধির বান্ধবী ফিসফিস করে বলে, তোকে দিয়ে দাদী পা টেপায় প্রতিদিন? কেন যাচ্ছিস?

তিন্নি ঝটপট বলে, রিধি যেতে চাইলে যা, দাদীর মুখের উপরে কারো কথা চলে না।

রিধি তিন্নির দিকে একনজর তাকায়। দুই বান্ধবীর চোখে বোঝাপড়া হয় যেন।

রুম থেকে বেরিয়ে দাদীর হাত ধরে রিধি। মাথায় হাত বুলিয়ে দাদী বলেন, বাবামায়ের ভালো শিক্ষা এইটারেই কয়!
যেতে যেতে রিধি ভাবে, নিশ্চয়ই দাদীকে দিয়ে এসব মৃদুল করিয়েছে। অথচ ঘরে ঢুকে দেখে মৃদুল নেই। অভিমানী হয়ে ওঠা মন কিছু জিজ্ঞেস করতে চায় না।
বিছানায় শুয়ে দাদী বলেন দরজায় সিটকিনি দিয়া দাও রিধি। যুবতী মেয়ে নিয়া খোলা দরজায় ঘুমানো যাইবো না।
কোনো প্রশ্ন করার আগেই দাদী আবার বলেন, মৃদুলের আইতে রাত হইবো। ঘুমাইয়া পড়ো।
দাদীর পাশে বসে পা টিপতে গেলে দাদী পা সরিয়ে বলেন, ব্যাথা গেছে গা। ঘুমাও তুমি।
বিরস বদনে দাদীর পাশে শুয়ে পড়ে রিধি। কী ভেবে এলো, কী হলো!

বিদ্যুৎ চলে যায় কিছুক্ষণ পরেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কান্না আসে। মনের অস্থিরতা নিয়ে কী আর ঘুম আসে!

রাত কয়টা বাজে জানে না। নয়টায় দাদীর সাথে এসেছিল। কতোক্ষণ এভাবে পরে আছে কে জানে। বাইরে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিনের চালে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দে কান ফাঁটার উপক্রম।
হঠাৎ দরজার কড়া নড়ে। রিধির বুক ধক করে ওঠে। দাদী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মোবাইলে আলো জ্বেলে পা টিপে টিপে দরজা খুলতেই দেখে প্রত্যাশিত মানুষটি কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দিনের আলোয় শেষ দেখা অভিমানী রিধিকে মোটেও আশা করেনি মৃদুল। চেয়ে থাকে অপলক আহত দৃষ্টিতে।
রিধি সরে দাঁড়ালে মৃদুলও এগিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে। কাপড় বদলে নিজ বিছানায় বসে কিছু ভাবার আগেই রুমে ঢোকে রিধি। যে মেয়ে মৃদুলের ঘরে একবারো আসার আগ্রহ দেখায় নি সে এমন ঝড়োরাতে মৃদুলের অন্ধকার ঘরে একা দাঁড়িয়ে।

মৃদুল অবাক হয়ে রিধির সামনে এগিয়ে যায়।
-কিছু বলবে?

রিধি চুপ থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, মোমবাতি লাগবে।

কাঁপা হাতে ড্রয়ার খুলে মোমবাতি নিয়ে ফিরে আসে মৃদুল। ভাবে না দেশলাই ছাড়া মোমবাতি নিয়ে কী করবে রিধি।
হাতে মোমবাতি ধরে নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে রিধি। মৃদুলও নড়ে না সামনে থেকে।
খোলা জানালা ভেদ করে বৃষ্টির মাতাল হাওয়া ঘরের সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। রিধির ছোট চুলগুলোও বাতাসে এলোমেলো হচ্ছে। অন্ধকার ঘরে প্রকৃতির আলোয় রিধিকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতেই মনের শান্তি খুঁজে নিচ্ছে মৃদুল।

রিধি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে, কাল সকালে চলে যাচ্ছি।

মৃদুল কথা খুঁজে পায় না, রিধি অপেক্ষা করে চলে।

অন্ধকারে ছোটশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলে মৃদুল বলে
-রিধি শোনো!
থামে রিধি তবে চোখ তুলে তাকায় না।

…. তুমি কি রয়ে যেতে চাও?

কাঁপা ঠোঁটে প্রশ্ন আসে, কিভাবে?

…দাদী বলছিল, তোমার পরিবারের সাথে আলাপ করবে।

-আপনি কী চান?

কিছুসময় থেমে উত্তর আসে, ঘরে ফিরে এলে দরজার ওপাশে রোজ তোমাকে দেখতে চাই।

শান্ত হয় রিধি, ধীরে ধীরে শরীর কাঁপিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

মৃদুল তাকিয়ে থাকে সামনে দাঁড়ানো মায়াবতীর মুখপানে, যে কিনা মৃদুলের হতে চেয়ে হাপিত্যেশ কাঁদছে।

নিস্তব্ধ ঘরে টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দ। আলো আধারীর মাঝে দুজনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা।

..রিধি, দাদী ঘুমোচ্ছে …….. আমি কি তোমার অশ্রুগুলো স্পর্শ করতে পারি?

সমাপ্তি।

ঝিনুক চৌধুরী।

বৃষ্টির ছন্দ পর্ব-০২

0

#বৃষ্টির_ছন্দ

পর্ব ২

সকালের নাস্তায় তিন্নিকে জিজ্ঞেস করে রিধি, মৃদুল ভাই ও দাদী ওরা নাস্তা করতে আসবে না?

-মৃদুল ভাই এখন হসপিটালে থাকার কথা।

-না খেয়ে গেছেন?

-কী জানি, দাদীর সাথে খেয়েছে হয়তো।

-দাদীরা আলাদা ঘরে থাকে কেন? তাদের রান্না কে করে?

-ঘরের পেছনের ঘরটা রান্নাঘর, দেখিসনি? রান্নাঘরে বিছানো চকিতে স্বপ্না খালা থাকে। ওইবাড়ির সকল কাজ তিনিই সামলান। বিয়ে উপলক্ষে মা উনাকে এখানে এনেছে। দাদীকে অনেক অনুরোধ শেষে রাজি করানো গেছে। তাই দাদীর খাবার এখান থেকেই যাচ্ছে।

-কিন্তু বুড়ো বয়সে দাদী এমন আলাদা থাকেন কেন?
– লম্বা কাহিনী। পরে বলবো।

এমন সময় মৃদুল ঘরে ঢোকে। ঢুকতেই রিধির সাথে চোখাচোখি হয়। মৃদুল চোখ সরিয়ে ডাইনিংয়ে বসে।
এখানে খেতে না এলেও হতো। দুইএকদিন খাবারের ব্যবস্থা হাসপাতালে করাই যায়। তবু আধঘন্টার ব্রেক নিয়ে এখানে এলো। দরকার ছিল না, তবুও।
নিরবে খাওয়া শেষে উঠে গেলে রিধি আবার তাকায় মৃদুলের দিকে তবে মৃদুল তাকায় না। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। রিধি শুরু থেকেই দেখছে মৃদুল বেশ গম্ভীর ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলে। গতরাতে দাদী ও রিধির সামনে অনেক গল্প করেছে তাও নয় তবে আন্তরিক ছিল।

বাথরুমে লম্বা লাইন লেগেছে গোসলের জন্যে। হলুদের অনুষ্ঠানে তৈরি হবার তাড়া সবার। পার্লার থেকে দুটো মেয়ে এসেছে সাজাতে। রিধি ও ওর বন্ধুরা নিজেরাই সাজবে বলেছে, মেয়ে দুটো কেবল চুল বেঁধে দেবে। সবাই হালকা বেগুনী শাড়ি পরে লম্বা বেনীতে ফুল জড়াবে। রিধির চুল ছোট বলে টার্সেল লাগাতে হবে। দাদীর ঘর থেকেই গোসল সেরে চুল বাধার জন্য লাইনে পড়ে রিধি।
তিন্নিকে অবসর পেয়ে আবারো প্রশ্ন করে, দাদী ও মৃদুল ভাইয়ের কাহিনী কী বল না?

রিধিকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আম তলায় দাঁড়ায় তিন্নি, জায়গাটা নিরব। গলা নামিয়ে বলে, কারো সাথে শেয়ার করবি না খবরদার।

– ঠিক আছে, বল?

– আমার বড় চাচা মানে মৃদুল ভাইয়ের আব্বা খেয়ালি মনের মানুষ ছিলেন। কাজকাম করতেন না, গান বাজনা, আড্ডবাজি করতেন। দাদা সুন্দরী দেখে বউ আনলেন, তবু চাচার মন ঘরে থাকতো না। মৃদুল ভাইয়ের চার বছর বয়সে বড় চাচা সাপে কাটায় মারা যান। সুন্দরী যুবতী চাচীকে তার পরিবার সাথে করে নিয়ে যায়। একবছর যেতেই বিয়ের ব্যবস্থাও করে। শর্ত ছিল ছেলেকে সাথে নেয়া যাবে না। ততোদিনে দাদা মারা গেছেন। মৃদুলভাই নানাবাড়ীতে একা বড় হচ্ছে শুনে দাদী নিজের কাছে নিয়ে আসেন। শুরু হয় বিপত্তি। সবই আম্মার কাছ থেকে শোনা, জানিসই তো আম্মা কতোটা সোজাসরল। আব্বা ও ছোট চাচা দাদার সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলো। মৃদুল ভাই ফিরে আসায় বড় চাচার ভাগটুকু দিতে তারা আপত্তি জানায়। দাদীর সাথে এ নিয়ে অনেক গন্ডগোল হয়, সালিশ বসে। আব্বা চাচার প্রতাপে সালিশ তাদের পক্ষেই যায়। দাদী তখন স্ত্রী হিসাবে দাদার সম্পত্তির হক চায়। সালিশে সেটা মানা হয়। দাদীর অংশটুকু আলাদা করে দিতে বাধ্য হয় আব্বা ও চাচা। সেই থেকে দাদী রাগ করে ছেলেদের হতে আলাদা থাকেন। মৃদুল ভাইকে আকড়ে ধরে একা হাতে বড় করেছেন। আমরা অনেক ছোট ছিলাম বলে এসব দেরীতে জেনেছি। মৃদুল ভাই পড়ায় ভালো ছিল, আমাদের সাথে খুব একটা মিশতো না, সারাক্ষণ পড়ার টেবিলেই থাকতো। মেধাবী বলে স্কুল কলেজে শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছে, গ্রামের মানুষও বুঝতে পারে উনার সাথে অবিচার হয়েছে।
মৃদুল ভাই নরম মনের মানুষ, আজ পর্যন্ত কাউকে কটু কথা বলেনি। অবহেলা সাথে নিয়েই বড় হয়েছে। শহরে ভালো চাকরী পেয়েও দাদীকে ভালোবেসে এখানে পড়ে আছে। এতো বড়ো ভূইয়া বাড়ি, এতো আত্মীয় স্বজন তবু কেউ তার আপন হয়নি। এ গ্রামে পড়ে থাকার কোনো কারণ নেই উনার।

রিধির চোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়তে থাকে।

তিন্নি বিরক্ত হয়ে বলে, এই এক জ্বালা, কিছু শুনলেই কান্না শুরু। তোকে কিছু বলবোই না। সুখের খবর শুনেও কাঁদিস, দুঃখের গল্প শুনেও কাঁদিস। শোন, দাদী বা মৃদুল ভাইয়ের কাছে এসব তুলিস না খবরদার। আব্বার অন্যায়ের দরুন আমাদের ভাইবোনদের সাথে মৃদুল ভাইয়ের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা ঘুচবার নয়। আমরা উনাকে সম্মান করি কিন্তু উনার গাম্ভীর্যের কারণে ধারে ঘেষার সাহস পাই না। আম্মার স্নেহ মৃদুল ভাই অনুভব করেন। তাই উনার কথা কখনো ফেলেন না। এই যে বিয়েতে ভাইয়ার উপস্থিতি সেটা আম্মার অনুরোধে। নইলে উনার দেখাই পাওয়া যেত না। এবার চোখ মুছে ঘরে চল।

*****
নকল চুলে ফুল পেঁচিয়ে দাদীর ঘরে ফিরে আসে রিধি। সবাই মিলে এক আয়না নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করার কোনো ইচ্ছে নেই। তারচেয়ে দাদীর বাথরুমের আয়না দেখে আরাম করে সাজা ভালো।
দাদী গলা উঁচিয়ে বলে, মৃদুলের ঘরে আয়না আছে, ওখানে যাও।
রিধি আন্তরিকভাবে মানা করে দেয়। শাড়ি ও হালকা সাজে দাদীর সামনে এসে দাঁড়ালে ফোকলা হাসে দাদী।

দরজায় টোকা দেয় মৃদুল। ভরদুপুরে দাদী দরজা বন্ধ কেন বোঝে না।
রিধি দরজা খুলে দিলে মৃদুল রীতিমতো ধাক্কা খায়। একে তো রিধিকে একেবারেই আশা করেনি তার উপর শাড়ি, সাজে পরিপূর্ণ।
হতবিহ্বল চোখে চেয়ে থাকলে রিধি লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়ায়। মৃদুল স্বাভাবিক হয়ে বলে, দেখতে ভালো লাগছে।
ছোট একটি বাক্য, রিধির মন খুশি হয়ে যায়।
দাদীর পাশে বসে জিজ্ঞেস করে মৃদুল, খেয়েছো দাদী?

-হ, তুই?

-হুম।

রিধির সাজা শেষ, দাদী নাতির মাঝে বসে থাকার কোনো কারন নেই তবু বসে বসে টুকটাক গল্প করে রিধি। দাদীরও ভালো লাগে।
গল্পে গল্পে মৃদুলকে জিজ্ঞেস করে, আপনি যাবেন না হলুদে?

ভ্রু তুলে তাকায় মৃদুল। হুম দেখি, হসপিটাল থেকে ডাক না এলে থাকতে পারি।

– দাদী, আপনি যাবেন না?

-যামু একবার, পান্নারে হলুদ মাখায়ে দোয়া দিয়া আমু।

নকল চুলে আরাম পাচ্ছে না রিধি, বার বার ঘাড়ে আঙুল দিয়ে চুলকাচ্ছে। মৃদুল খেয়াল করলেও দাদীর ঘোলা চোখ তা দেখতে পায় না। রিধির কাঁধ-গলা লাল হয়ে উঠেছে।

-নকল চুল লাগানোর দরকার কী ছিল, ন্যাচারাল সাজই তো সুন্দর। বলেই মৃদুলের মনে হয় বলা ঠিক হয়নি, ব্যাপারটা ব্যক্তিগত!
রিধি চুপ করে থাকলে দাদী বলেন, চুল এমন ছোট করে কাটছো কেন? মেয়েদের অলংকার হইলো লম্বা চুল।

রিধির মুখ লাল হয়ে ওঠে।

দাদী নিজেই বিড়বিড় করেন, অবশ্য লম্বা চুলে কী হইবো? যে আটকায় সে লম্বা চুলেও আটকায়, ন্যারা মাথায়ও আটকায়। মৃদুলের মায়ের রূপ আছিল, কোমর সমান লম্বা চুল আছিল তাও জামাইরে আটকাইতে পারেনাই। সবই কপাল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদী।
মৃদুল উঠে নিজের রুমে গিয়ে ফিরে আসে এলার্জির মলম হাতে। রিধির পাশে চুপ করে রেখে আবার নিজের রুমে ফিরে দরজা ভিজিয়ে দেয়।

হলুদ অনুষ্ঠান বিকাল থেকেই শুরু হয়েছে। ছেলেপক্ষের কিছু মুরব্বির সাথে একদল ছেলে মেয়ে ডালা, মিষ্টি হাতে এসেছে।
মৃদুল আসে সন্ধ্যার পর। চাচাতো ভাই গুলো বন্ধুদের নিয়ে তিন্নির বান্ধবীদের সাথে রংঢং করছে। বান্ধবীগুলোও তাল মিলিয়ে সায় দিচ্ছে। গ্রামে বড় হওয়া ছেলেরা ঢাকার কলেজ, ভার্সিটিতে পড়লেও সেখানকার বেড়ে ওঠা মেয়েদের সাথে তাল মেলাতে পারে না। মেয়েগুলোর চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি। তাদের হাসাহাসি, মেলামেশায় ছেলেগুলোর কেবল ঘুম হারামই হবে, মেয়েগুলো ঠিক তেমন ভাবেই ফিরে যাবে যেভাবে এসেছিল। রিধি হয়তো তেমন নয়, খানিক চুপচাপ ধরনের। চঞ্চলতা নেই, কথা কম তবে বোঝার চেষ্টা বেশি। ছেলেরা রিধির সাথে আলাপ চালিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
আনমনেই চোখ ঘুরিয়ে রিধিকে খোঁজে মৃদুল। একপাশের চেয়ারে চুপ করে বসে সবকিছু দেখছে রিধি। মৃদুলের উপস্থিতি চোখে পড়ে নি।

রিধির সাজ বদলেছে। নকল বেনীটি নেই। কাঁধ পর্যন্ত খোলা চুলে সোজা সিঁথি কাটা, তাতে ছোট একটা হলদে গাঁদা ফুল, একই ফুল দুই কানেও। অল্প সাজে মিষ্টি লাগছে। ঠোঁটে হাসি ফোটে মৃদুলের তখনই রিধি তাকায় মৃদুলের দিকে। মৃদল চমকে চোখ সরায়, বিব্রত হয় এমন চেয়ে থাকার জন্য।
মৃদুলকে ঘিরে ধরে ছেলেপক্ষের উঠতি বয়সী কয়েকটি মেয়ে। দুষ্টমী করে কেউ হলুদ ছোঁয়াতে চায়, কেউ মিষ্টি খাওয়াতে চায়। গ্রাম অঞ্চলে এসব স্বাভাবিক।
আমি এখনই আসছি বলে স্থান ফেলে পালায় মৃদুল। রিধির রাগ হয় এমন গায়েপড়া মেয়েদের দেখে।
আচমকা কানের কাছে মৃদুলের কণ্ঠ শোনা যায়। রিধি, দাদীকে সাথে করে আনতে পারবে?
রিধি পাশ ফিরে তাকায়। একেবারে পাশের চেয়ারে কখন এসে বসেছে মৃদুল টের পায়নি রিধি। কথাটি বলেই উঠে যায় মৃদুল।

দাদীকে সাথে করে নিয়ে আসে রিধি। স্বপ্নাখালা আগেই তৈরি করে রেখেছিল, নিজ থেকেই হয়তো আসতো। রিধিকে দেখে ফোকলা হেসে ওর হাত ধরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হোন।
পান্নাকে হলুদ দিয়ে ওর পাশেই বসে থাকে দাদী। ক্যামেরাম্যান পটাপট ছবি তুলতে থাকে।

তিন্নি ও বাকি বান্ধবীরা হৈচৈ করে আনন্দে মেতে আছে। রিধি তাদের পাশে বসলেও চুপ করে মৃদুলকে দেখে। হলুদে সব ছেলেরা টিয়ে রংয়ের পাঞ্জাবী পরেছে। মৃদুল কেবল ভিন্ন তবে সাদা পাঞ্জাবিতে বেশ লাগছে দেখতে। দাদীর গল্প অনুযায়ী বড় চাচী রূপবতী ছিলেন, মৃদুল মায়ের রং পায়নি তবে লাবন্য পেয়েছে। দাঁড়িয়ে একজনের সাথে গল্পে করছে, মানুষটার ভেতরে কত কষ্ট চাপা ভাবতেই মন খারাপ হয় রিধির।
মেয়েগুলো আবার ঘিরে ধরে মৃদুলকে। পান্নার বড় ভাই বলে ছেলেপক্ষকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারে না মৃদুল। বিনা করণে হি হি করে কেলানো বন্ধ হবার নাম নেই। হঠাৎ রিধি তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করে বসে। দাদীর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, তখন থেকে মৃদুল ভাইকে জ্বালাচ্ছে এই মেয়েগুলো।
দাদী কোনো উত্তর দেয় না, কেবল চোখ পাকিয়ে মেয়েগুলোকে দেখে।
মৃদুল হলুদ মাখাতে এলে পান্নার আশেপাশে মেয়েগুলো আবার জড়ো হয়। চামচে মিষ্টি তুলে মৃদুলের দিকে এগিয়ে দিলে বিব্রত হয় মৃদুল। বাকিগুলো অযথাই হাসিতে গড়িয়ে পড়ে।
দাদী হঠাৎ ধমকে উঠে বলেন, এতো রং লাগছে কেন? বিয়ার লাগি নাগর খুঁইজা পাও না, এতো মানুষ থইয়া আমার নাতির পিছে লাগছো কেন?
পরিবেশ হঠাৎ থমথমে হয়ে যায়।
পরিস্থিতি সামলাতে তিন্নির মা ছুটে এসে বলেন, আত্মীয়রা এমন রং তামাশা করেই আম্মা।

-করলে করে, আমার নাতি এসব পছন্দ করে না দেখার পরও বেহায়ার মতো হি হি হি হি করে দাঁত কেলায় কেন? এই মৃদুল আমারে ঘরে নিয়া চল, এসব আহ্লাদ আমার ভালো লাগে না।
মৃদুল ঝটপট দাদীকে নিয়ে সরে গেলে শুরু হয় মেয়ে পক্ষের ক্ষমা চাওয়া।

তিন্নি এসে নিচু গলায় রিধিকে বলে, এরজন্যেই দাদী থেকে সবাই দূরে দূরে থাকে। আনন্দের মুহূর্ত নষ্ট করতে ওস্তাদ।

তিন্নির সাথে রিধিও মন খারাপের ভান ধরে তবে মনে মনে খুশি হয়।

ঝিনুক চৌধুরী।

বৃষ্টির ছন্দ পর্ব-০১

0

#বৃষ্টির_ছন্দ
পর্ব-১

রিধি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে বসে আছে। ওর কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। দূর থেকে মৃদুল খেয়াল করলেও এগিয়ে প্রশ্ন করবে কিনা ভাবে।
বিয়েবাড়ির আয়োজনে লোকসমাগম এমনিতেই বেশি, তা আবার যদি হয় গ্রামের আয়োজন। ঠিক গ্রাম বলা যায় না, উপজেলা শহর। তবে এ এলাকাটি শহর ছেড়ে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে।
বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে তিন বান্ধবীকে সাথে এনেছে তিন্নি। ভার্সিটির ছুটি চলছিল বলে গ্রামের বিয়ে দেখতে বান্ধবীরাও খুশি মনে রাজি হয়ে যায়। এসে দেখে যতটুকু ভেবেছিল তার চেয়েও এলাহি কাণ্ড।
বৈশালী গ্রামের ভূইয়া পরিবার বেশ বিত্তশালী। সিরাজ ভূইয়ার মেজো ছেলে তিন্নির বাবা। বাজারে বিরাট কারবার, প্রাচীর ঘেরা পৈত্রিক সম্পত্তিতে দোতালা বাড়ি। তিন্নির ছোট চাচাও পাকা ব্যবসায়ী, একতালা বাড়ি, দোতালার নির্মাণ কাজ চলছে। ভূইয়া বাড়িতে আজ সাজ সাজ রব। চারিদিকে আলোকসজ্জা, পেন্ডেল টাঙিয়ে রান্নার আয়োজন, জেনারেটরের ব্যবস্থা আরো নানান কিছু। তিন্নি বান্ধবীসমেত এসে পৌঁছেছে গতকাল সন্ধ্যায়। রাতের গীত গাওয়া, খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমিয়ে উঠে ভোর থেকেই নানান আয়োজন দেখায় ব্যস্ত। আজ কনের গোসল দেয়া হচ্ছে। কনের পাশাপাশি নারীরা নিজেদের মাঝেও জলখেলা করছে। রংমেখে পানিতে ভিজে একাকার সকলে। অনেকক্ষণ ধরেই এক কোণে চুপ করে বসে আছে রিধি। কেউ তাকে ডাকছে না, পানি দিয়েও ভেজাচ্ছে না।
ভূঁইয়া বংশের বড় ছেলে মৃদুল। বড় ভাই হিসাবে যদিও বিয়ের দায়দায়িত্ব তার ঘাড়ে কেউ চাপায় নি তবু নিজ উদ্যাগে সহযোগিতা করার চেষ্টা। যখন তখন হাসপাতাল থেকে ডাক এলে আয়োজন ছেড়ে যেতে হবে। উপজেলা সদর হাসপাতালের ডাক্তার সে।
জলখেলায় পুরুষদের থাকা নিষেধ। মৃদুল স্টেজের কাজ বোঝাতে এদিকটায় এলে রিধিকে খেয়াল করে। গতকালের রিধির সাথে আজকের মিল নেই। কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। এগিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি খারাপ লাগছে?
রিধি চোখ তুলে তাকায়, স্মিত হেসে মাথা নাড়ে। গতরাতে পরিচয় পর্বে মৃদুলের সাথে চোখাচোখি হয়েছিল। তিন্নির চাচাতো ভাই ছাড়া মৃদুল সম্মর্কে তেমন ধারণা নেই রিধির।
মৃদুল হাঁটু ভেঙে রিধির পাশে বসে গলা নামিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, শরীর অসুস্থ লাগছে?
রিধি খানিক কুঁকড়ে যায়, লজ্জা আড়াল করে।
মৃদুল উঠে তিন্নিকে খুঁজে বের করে বলে, তোর ওই বান্ধবী কোণায় চুপচাপ বসে আছে কেন? জিজ্ঞেস করলে কিছু বলছে না।
তিন্নি অল্প কথায় উত্তর দেয়, ওর পেট ব্যাথা।
তাই আন্দাজ করেছিল মৃদুল। রিধির কাছে আবার ফিরে এসে ধীর গলায় বলে, তুমি অসুস্থ ফিল করলে ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো।
রিধি নরম গলায় বলে, ঘরে মেহমান ভর্তি… আমি..
-কোনো সাহায্য লাগবে? আমি ডাক্তার , দ্বিধা ঝেড়ে আমাকে শেয়ার করতে পারো।
– ঘণ্টা খানেকের জন্য আমার একটু প্রাইভেসি দরকার। আসলে বিয়ে বাড়িতে এমন চাওয়া অমূলক। রিধির গলা নেমে আসে।
-আচ্ছা দেখছি কী করা যায়।
কিছুক্ষণ পর তিন্নি এসে বলে, তুই দাদীর ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক। মৃদুল ভাইয়া তোকে নিয়ে যাবে।
মৃদুলের পিছে পিছে উঠান পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে ছোট সেমিপাকা ঘরে ওঠে রিধি। খোলা বারান্দার দরজা খুলতেই সামনে বড় ঘর মাঝ বরাবর বিছানা পাতা। ডানপাশে আরেকটি রুম তবে দরজা ভেজানো।
জলচৌকিতে নামাজ পড়ছিলো দাদী। বিছানার এক কোনে বসে রিধি। ভয় হয় দাদী রাগ করে কিনা। শুনেছে, গ্রামের মুরব্বিরা পিরিয়ড হলে নাক কুঁচকে অচ্ছুত করে রাখে।
মৃদুল ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণে আবার ফিরে আসে। দাদীর নামাজ শেষ হলে বলে, দাদী, ও রিধি, তিন্নির বান্ধবী। শরীরটা খারাপ করেছে, ওখানে অনেক হৈচৈ তাই এখানে নিয়ে এলাম। একটু শুয়ে থাকুক।
দাদী রিধির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, দাদীর পাশে শুইবা?
রিধি মাথা নেড়ে সায় দেয়।
-মৃদুল রে, আমারটা তো ছোট। পাশের রুমে…
মৃদুল বিব্রত হয়ে চোখ ইশারা করলে রিধি ঝটপট বলে, আমি এখানেই পারবো দাদী।
-পারবা,? ঠিক আছে শুয়ে পড়ো। খাওয়া দাওয়া হইছে?
-জ্বি দাদী।
মৃদুল জিজ্ঞেস করে, কোনো ঔষধ লাগবে?
-না, নিয়েছি অলরেডি। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবো।
মৃদুল চলে যায় পেছনের একটি ঘরে। রিধি শুয়ে চোখ বন্ধ করে। কেমন বিব্রত পরিস্থিতি হলো! পিরিয়ড ইরেগুলার বলে প্রায়ই ঝামেলায় পড়তে হয়। ব্যবস্থা সাথে নিয়েই এসেছিল কিন্তু শুরুর দিন প্রচন্ড পেট ব্যথা হয়, সেটা আড়াল করার উপায় নেই। দাদীর পাশে কাঁথামুড়ি দিয়ে কুকড়ে থাকে রিধি। ব্যথায় মাঝে মাঝেই কেঁপে ওঠে।
কিছুক্ষণ পর পেছনের রুম থেকে মৃদুল বেরিয়ে আসে হাতে হটওয়াটার ব্যাগ নিয়ে।
দাদী দেখে বলেন, ভালো করছোস, মেয়েটা ব্যথায় কষ্ট পাইতেছে।
মৃদুল কথা না বলে এগিয়ে দিলে রিধি হাত এগিয়ে নেয়। এবার একটু আরাম হবে। মনে মনে এটা খুঁজলেও বলার সাহস হয় নি।
সন্ধ্যার পর তিন্নি আসে দাদীর ঘরে। রিধিকে জিজ্ঞেস করে, এখন কেমন অবস্থা?
– ভালো, ওদিকের কী খবর?
– আড্ডা হচ্ছে, একটু পর খাওয়া তারপর ঘুম। আসল মজাতেই তুই থাকতে পারলি না।
– হুম, তবে পানিতে ভিজাভিজি আমার ভালোও লাগে না।
– এখন খেতে চল। ঘুমানোর আগে আড্ডা হবে।
দাদী বলেন, এই শরীরে নড়াচড়া করার দরকার নাই।
রিধি চুপ করে থাকে। এমন জিনিস হলো জনে জনে সবাই টের পেয়ে গেছে।
তিন্নি বলে, তুই চাইলে আজ দাদীর কাছে থাকতে পারিস। আমার রুমে চারজন এক বিছানায় থাকতে হবে, অবশ্য ফ্লোরিং করা যাবে। চাইলে দাদীর সাথে নিরিবিলি ঘুমাতে পারবি। আমি মাকে জানিয়ে দেবো।
রিধি হাঁফ ছেড়ে বলে, তাহলে এখানেই থাকি রে…. শরীরটা এখনো নড়বড়ে। কাল থেকে নাহয় আনন্দ করবো। আজ একটু ঘুমাই।
– তাই ভালো, রাতে কী আর এমন আড্ডা হবে! খেতে চল।
দাদী বলেন, আজকে আর যাওয়ার দরকার নাই রিধির। আমার সাথে ওর খাবারও পাঠায়ে দাও।
তিন্নি চলে যাচ্ছিল আবার ফিরে বলে, পাশের রুমে মৃদুল ভাইয়া ঘুমায়।
তিন্নির কথার মর্ম বুঝতে পেরে রিধি চমকে ওঠে। মৃদুল ভাই একা থাকেন?
তিন্নি হেসে বলে, একাই তো থাকবে, বিয়ে হয়েছে নাকি!
রিধির মুখ শুকিয়ে যায়, এভাবে পুরুষ মানুষের ঘরে…
স্বাভাবিক করতে তিন্নি বলে, তুই এতো চিন্তা করিস না, দাদীর সাথে আরামে ঘুমা। বিয়ে বাড়িতে এর ওর বাড়িতেই থাকতে হয়। এসব কেউ এতো খেয়াল রাখে না।
– আমার ব্যাগটা লাগবে। আমি আসছি তোর সাথে।
– ওটা মৃদুলের সাথে দিয়া পাঠাও তিন্নি, দাদী বলেন।
রিধির আর কিছু বলার থাকে না।

মৃদুল ওবাড়িতে খাওয়া শেষে রিধির ব্যাগ হাতে ফিরে। রিধির খুব অস্বস্তি হয়। মৃদুল নিজ ঘরে ঢুকতে গেলে দাদী ডেকে বলেন, আজ কী কী হইলো কইলি না তো!
-আসতেছি দাদী, রিধিকে একটু ফ্রেস হতে দাও, সে তো বাইরের জামা পড়ে কখন থেকে শুয়ে আছে।
রিধি খেয়াল করে এই বাড়িতে বাথরুম একটি তাও দাদীর রুমে। মৃদুলকেও একই বাথরুম ব্যবহার করতে হয়।
কিছুসময় পর কারেন্ট চলে যায়। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলে রিধি বেশ চমকায়। বাইরে জেনারেটরের আওয়াজ ভেসে আসছে অথচ এই বাড়ি পুরো অন্ধকার। বাকি দুই বাড়ির চাকচিক্যের সাথে এবাড়ির পরিবেশ কিছুই মেলেনা। মৃদুল মোম হাতে এগিয়ে এলে রিধি মুখ ফসকে বলে ফেলে, আই পি এস নেই?
হালকা হেসে মৃদুল বলে, না নেই, আমাদের দরকারও পড়ে না।
নিজেকে সামলে রিধি বলে, সরি, আমি আসলে না বুঝে…
দাদী বলেন, তোমার প্রশ্ন করা স্বাভাবিক। ভূইয়া বাড়ির জাঁকজমক আমার এ বাড়িতে নাই, প্রশ্ন ওঠারই কথা। আমাদেরও দিন ঘুরবো, মৃদুল এখন ডাক্তার। হেলার দৃষ্টি সইরা মৃদুলরে এখন সবাই তোয়াজ করে। আমার নাতি ঠিকই একদিন সব অন্যায়ের জবাব দিবো।
দাদীর হাতে হালকা চাপ দিয়ে থামিয়ে দেয় মৃদুল। রিধি অবাক হয়ে একবার দাদীকে একবার মৃদুলকে দেখে।
মৃদুল গম্ভীর সুরে বলে, দাদীর বয়স হয়েছে তাই মনে যা আসে তাই বলে। তোমার কেমন লাগলো বিয়ে বাড়ি?
রিদি বুঝতে পারে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছে মৃদুল। সেও সহমত হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টায়।
এ কথা সে কথায় অনেক জানাশোনা হয়। রিধিরা তিন বোন, বাবা মারা গেছে দুবছর হলো। বড় বোন বিবাহিত, দুলাভাই আপন মানুষ। বাবা সরকারি কর্মচারী ছিলেন সেই পেনশনের টাকায় তারা চলছে।
মৃদুল ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে পাশ করে এই উপজেলা হাসপাতালেই পোস্টিং নিয়েছে। দাদীর কাছে বড় হওয়া তাই দাদীর সাথেই এ ঘরে থাকা। এরচেয়ে বেশিকিছু বলতে নারাজ মৃদুল। দাদীকেও বলতে দিতে চায় না।

ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ। মৃদুল ঘর ছেড়ে বের হয় না। রিধি ঘুমোচ্ছে, অপরিচিত পুরুষ ঘুমন্ত মেয়ের ঘরে হাঁটাচলা করা অভদ্রতা দেখায়।
রিধি ও দাদীর গলার আওয়াজ শুনতে পেলে তারপর বের হয়। রিধি তখন দাদীর সাথে গল্প করছিল।
শরীর এখন কেমন জিজ্ঞেস করতে নিয়েও থেমে যায় মৃদুল। কিছু রোগ নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না। শুধু বলে, তোমাকে সতেজ লাগছে। ভালো ঘুম হয়েছে?
রিধি হাসে, আন্তরিক হাসি। মৃদুল একটু অবাক চোখে তাকায়। ঢোলা কুর্তি-পাজামায় কাঁধ পর্যন্ত ছাটা চুলে রিধিকে বাচ্চা মেয়ে লাগছে। চোখ সরিয়ে বেরিয়ে পড়ে মৃদুল।

চলবে।

ঝিনুক চৌধুরী।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-১৯

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৯

জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে নয়না কান্না করছে৷
“এই পিচ্চি এভাবে কান্না করছো কেন!
‘নয়না নাক টেনে বলে,আমার চোখ আমার অশ্রু আমার ইচ্ছে আমি কাঁদবো।
‘এই আঠারো ঘন্টা জার্নি শেষ করে রেস্ট না নিয়ে তোমার কান্না দেখার জন্য কল করিনি।
‘তো কেটে দেন কল।
‘সত্যি কাটবো?
‘আমি তখন চিৎকার করে কাঁদবো।
‘তুমি কি ছিঁচকাঁদুনি।
‘জানেন রাতে আমি কি স্বপ্ন দেখেছি৷
‘চোখের পানি নাকের পানি মুছে জানাও তো লিটল প্রিন্সেস কি স্বপ্ন দেখলে।
‘নয়না ওড়না দিয়ে চোখ মুখ মুছে জিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,আপনি এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে কি করে বলবো!আমার বুঝি লজ্জা করে না?
‘জিয়ান দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে,এবার বলেন মহারানী।
‘দেখলাম আপনি নাকি আমার, ঠোঁটের নেশায়
মাতাল হয়ে গেছেন, আপনারর নেশা কাটাতে আমার ঠোঁট দুটো চাইছেন৷
‘জিয়ান হুট করে নয়নার দিকে তাকালো৷ দুজনের দৃষ্টি মোবাইলের স্কিনের দু’প্রান্তে থেকে স্থীর হলো একে অপরের দৃষ্টিতে।
‘কান্নার ফলে ঠোঁট দুটো হালকা ফুলে উঠে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। নাকটা লালচে হয়ে আছে। জিয়ান অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,এমন ঠোঁট তো আফিমের চেয়ে নেশালো, মাতাল না হয়ে উপায় আছে?
‘নয়না দু’হাতে মুখ ডেকে নিলো ইশশ কি লজ্জা, কি লজ্জা এভাবে এমন স্বপ্ন কেউ কাউকে বলে! কে যানে এই ড্রাইভার কি ভাবছে!
‘লাজুকলতা.. এভাবে মুখ ঢেকে রাখলে তো তোমাকে একদম আদুরে বৌ লাগে৷
‘তো আমি কি বৌ না?
‘তুমি বৌ?তা তোমার বর কই?
‘আমার বর বিদ্যাশে।
‘জিয়ান হেসে ফেললো৷ হাতটা সরাও দেখতে দাও তোমাকে।
‘আমার লজ্জা করছে তো! এভাবে কেউ দেখতে চাইলে লজ্জা করে না বুঝি?
‘তুমি জানো আমার বয়স কত?
‘আপনার বয়স জেনে আমি কি করবো?
‘গুনে গুনে তোমার চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড়।
‘তেরো।
‘এক যুগ বেশি কাটিয়েছি তোমার চেয়ে৷
‘এক যুগ বেশি কাটিয়ে কোন রাজ্য জয় করেছেন শুনি?
‘এখনো শিউর না তবে মনে হচ্ছে কারো মনের রাজ্য খুব তাড়াতাড়ি জয় করে নেবো।
‘নয়না মোবাইলের সামনে এসে বলে,মিস্টার প্লেন ড্রাইভার জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে থাকুন।
‘এই সব বাদ দাও তোমার না এক্সাম পড়ালেখা করছো না কেন।
‘আজকে থেকে করবো৷ আচ্ছা আমার পরিক্ষা সবাই আমাকে কিছু না কিছু দেবে৷ তো আপনি কিছু দিলেন না?
‘এক্সাম থাকলে কিছু দিতে হয়! আর দেইনি কে বলল?
‘এই যে আপনার চোখের সামনে বসা ষোড়শী, রূপবতী বললো।
‘রূপবতী মেয়েরা সহজ ভাবে মিথ্যা বলতে পারে৷
‘আপনাকে আমার মিথ্যাবাদী মনে হয়!
‘আরেহহ স্যরি মজা করে বলেছি৷
‘আমার চোখের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না।
‘রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি?সুন্দর চোখদুটোর নিচে কালসিটে দাগ বসে গেছে।
‘এসব হয়েছে আপনার জন্য মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। যত দোষ প্লেন ড্রাইভার ঘোষ।
‘তোমার চোখের চাহনি কিন্তু সুন্দর ।
‘ তেলের দাম এতো কমে যায় নি!আপনি যেভাবে তেল দিচ্ছেন মনে হচ্ছে তেল ফ্রীতে পাওয়া যায়
‘জিয়ান চৌধুরী কাউকে তেল দেয় না।
‘নয়না কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো।
‘আচ্ছা পিচ্চি এখন রাখি খেয়ে রেস্ট নেবো। আর হ্যা এখন শুধু পড়ালেখায় ফোকাস করো।
‘আমাকে কিছু কেন দিলেননা সেটার উত্তর দিন।
‘আমি এয়ারপোর্টে তখন টাকা সাধলাম নিলে না কেনো?
‘ওটা তো বেডসিটের তাই।
‘এখন কিভাবে দেবো?
‘জানিনা৷
‘আচ্ছা বাবু রাখি। গুড বায় টেক কেয়ার৷
‘জিয়ান কল কেটে দিলো৷
নয়নার মনটা উদাস হয়ে গেলো। মাত্র চল্লিশ মিনিট কথা বললো!
‘রাতে এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন চোখ লেগেছে জানা নেই নয়নার। ঘুম ভেঙেই দেখে জিয়ানের মিসডকল। কল ব্যাক করবে তার আগেই ওপাশ থেকে কল আসে৷ কিন্তু এতোটুকু কথায় তৃষ্ণা তো মিটলো না উল্টো আরো বাড়লো।
🌿নীলাঞ্জনা তালুকদার। ওর বাবার নাম মিজান তালুকদার আর চাচার নাম মাহবুব তালুকদার। তালুকদার বাড়ির বড় মেয়ে নীলাঞ্জনা৷
‘লাবীবের কথা শুনে অবাক হলেন সৈকত সাহেব। মূহুর্তেই শান্ত স্বরে বলে,শিল্পী মেয়েটাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও৷ ওর কি কি লাগে দেখো। নীলাঞ্জনা নাম তোমার?
‘জ্বি।
‘আজকে থেকে আমরাও তোমার আরেক বাবা মা৷
‘নীলাঞ্জনা বেশ অবাক হলো! মূহুর্তেই মানুষ চেঞ্জ হয়ে গেলো!বাপ চাচার টাকা থাকা বুঝি এতো প্রয়োজন?
‘শিল্পী বেগম আর নীলাঞ্জনা চলে যেতেই৷ সৈকত সাহেব বলেন,জীবনে এই প্রথম একটা কাজের মত কাজ করেছিস। আমার ছেলের বৌ কিনা তালুকদার বংশের মেয়ে! এবার এটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের ব্যবসাটা আগে বাড়াতে হবে৷ সোনার ডিম পাড়া হাঁস পেয়েছি আস্তেধীরে কাজে লাগাবো।
‘বাবা ওনারা কি এই বিয়ে মেনে নিবে?
‘মেনে না নিয়ে উপায় আছে? কান টানলে মাথা এমনেই আসে। যাহহহ খাতির যত্ন কর বৌয়ের৷ বৌ তো না যেনো আলাদিনের চেরাগ।
🌿বাসায় ঢুকেই ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে মারলো। রত্না বেগম দৌড়ে এসে বলে কি হয়েছে মান্নাত?
‘চশমাটা ছুড়ে ফেলে বলে,কি হয়নি সেটা বলো?আম্মু আর কতদিন এমন দাদিআম্মা সেজে ঘুরবো? এই ড্রেস চশমা এসব আমার সাথে যায়?
‘আমাকে কেনো বলছিস তোর বাবাকে বল৷
‘বাবা! হিটলার বলো৷ দেখো এসব আর আমাকে দিয়ে হবে না৷ কলেজে কে জোকার সেজে যায়! জানো আজকে কি হয়েছে? দানিশের মত একটা ছেলের সাথে টক্কর হয়েছে। পুরাই আগুন। হিরোর মত এসে আমাকে বাঁচিয়েছে৷
‘চুপ থাক তোর বাবা বাসায়। ছেলের কথা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না৷
‘খেতে দাও কিছু আর শুনো রাতে কিন্তু রিতুর বার্থডে পার্টি সো কোন না শুনবো না৷ আগেই বলে রাখি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরবো কিন্তু।তোমার হিটলার স্বামীকে কিভাবে ম্যানেজ করবে সেটা আমি জানি না৷
‘মেয়ে আর জামাই নিয়ে রত্না বেগম প্যারায় আছেন৷ যেমন পাব ঘাড়ত্যাড়া তেমন মেয়ে। কি দরকার সরকার পক্ষের বিরুদ্ধে কেস নেয়া! এখন নিজের বৌ মেয়েকে ছদ্মবেশে থাকতে হচ্ছে।
‘জামাল সাহেব সৎ পুলিশ অফিসার৷ তবে বর্তমানে সততাও যে বিপদ ডেকে আনে সেটার প্রমান সে নিজেই৷ মন্ত্রীর ছেলেলে গ্রেফতার করেছিলো। কেস তো কোর্ট পর্যন্ত উঠেই নি উল্টো এখন পরিবার নিয়ে ঝুঁকিতে আছেন৷
‘মান্নাত শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,মিস্টার হিরো আমাকে এভাবে দেখলে নিশ্চিত ক্রাশ খেয়ে রাতে ব্রাশ করা ভুলে যেতেন৷ বাট আই লাইক ইউর এটিটিউ। উপসসস মিস্টার হিরো নামটাও তো জানিনা আপনার! হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে শুকাতে বলে,আপনি এই এলাকার তাহলে ছয়মাস কই ছিলেন? একবার ও তো দেখলাম না৷ কোন ব্যাপার না নজর যখন পরেছে আপনাকে খুঁজে ঠিক বের করবোই৷ মান্নাত যা চায় তা নিজের করেই ছাড়ে। ফোনটা হাতে নিয়ে রিতুকে কল করলো।
‘কিরে আজকে নাকি আমাদের সারপ্রাইজ দিবি? তা কখন আসছিস?দাদিআম্মা?
‘সারপ্রাইজ তো দেখবিই সে-সব ছাড় আগে বল তো তোদের এলাকায় কোন ক্রাশ বয় আছে? যাকে দেখলেই ক্রাশ খাওয়া যায়?
‘হ্যা ছিলো চৌধুরী বাড়ির ছেলে আবার পাইলট যেমন দেখতে তেমন এটিটিউট। কিন্তু সে তো কয়েকদিন আগেই বিয়ে করে ফেলেছে।
‘তুই শিউর আর কোন ক্রাশবয় নেই?
‘নাহহ আমার জানামতে নেই।
‘মান্নাত কল কেটে দিয়ে বলে, ধুর ও হয়তো জানেনা৷ আবার মনে মনে বলে, ওদের এলাকা ওতো জানতো থাকলে৷ বিবাহিত ছেলের উপর কিভাবে ক্রাশ খেতে পারি! মনে হচ্ছে এবার ক্রাশ খেয়ে ব্রাশ আমার নিজের করতে হবে। এখন এসব ভাবলে হবে না মান্নাত৷ আজকে সবার হুঁশ উড়িয়ে দিতে হবে তোর৷ ড্রেস সিলেক্ট কর দেখিয়ে দে তোর আসল সুরত।
‘জামাল সাহেব চট্রগ্রাম থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন মাস ছয়েক আগে। চার রুম বিশিষ্ট একতলা বাড়িটা কিনেছেন তিনমাস ধরে৷ এখানে এসে মেয়ে বৌকে সবার নজর থেকে লুকিয়ে রাখছেন যতটা সম্ভব। পৃথিবীতে তার মেয়ে আর বৌ ছাড়া তিন কুলে কেউ নেই৷ এদের আগলে রাখার জন্য সব সেক্রিফাইস করতে রাজি। তার নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে আছে৷ সে মারা গেলে কে দেখে রাখবে তার মেয়ে আর বৌ কে? এসব চিন্তা সব সময় জামাল সাহেবের মাথায় ঘুরতে থাকে।
‘রত্না বেগম এসে বলেন,বলছিলাম কি মেয়েটাতে এখানে এসে একদম ঘর কুনো হয়ে আছে৷ আজ রিতুর বার্থডে যেতে চাচ্ছে?
‘আমি দিয়ে আসবো। আমি নিয়ে আসবো তবেই যাওয়ার পারমিশন পাবে৷
🌿
নয়না সকালের নাস্তা করে এই পর্যন্ত একশবার মোবাইলের কাছে এসেছে। কিন্তু সাহস করে জিয়ানকে কল করেনি৷ মোবাইল হাতে নিয়ে গুগলে সার্চ করলো কোন মানুষকে কিভাবে চিন্তা থেকে বের করা যায়।
‘প্রথমেই লেখা তাকে নিয়ে না ভেবে মনযোগ অন্য দিকে দিতে৷
‘নয়না মোবাইল রেখে বলে,মনোযোগ যদি অন্য দিকে ঘোরাতে পারতাম তাহলে সার্চ করতাম!গুগলের মাথায় কি বুদ্ধি নেই নাকি? এসব কেমন টিপস হলো? এরচেয়ে তো আমার বান্ধবীদের মাথায় বুদ্ধি বেশি। এবার ওদের জিজ্ঞেস করে দেখি।
#চলবে৷
আসসালামু আলাইকুম।গত পর্ব যারা পড়েছেন তারাই এই পর্ব বুঝবেন৷ হুট করে মাঝখান থেকে পড়লে খাপছাড়া লাগবে। গল্পে তিনটা/চারটা কাপলকে হাইলাইট করা হবে তাই মেইন ক্যারেক্টারের পাশাপাশি তাদের ও এটেনশন দিবো। সো ইন্জয়। হ্যাপি রিডিং ❤️

কলঙ্কের দাগ পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

গল্প #কলঙ্কের_দাগ
অন্তিম পর্ব
লেখক #জয়ন্ত_কুমার_জয়

মহুয়াকে অফিসার জিগ্যেস করলো ” ওরা আপনার মেয়েকে শা”রীরিক হ্যারেজ করেনি?তাহলে খু”নের সিদ্ধান্ত নিলেন কেনো? ”

মহুয়া এখনো চুপ করে রইলো।অফিসার কঠিন স্বরে ” কান্না থামান।এসব দেখিয়ে সহানুভূতি পাবেন ভেবেছেন?মহিলা জন্য ভদ্র ভাবে কথা বলতেছি।এখন দেখছি মাথায় উঠে গেছেন,তিনটা মানুষ খু”ন করেছেন।এতোটাও ভোলাভালা নন ”

মহুয়া চোখের জল মুছে ” আমি নিজের জন্য কাঁদছি না।ছোট্ট মেয়েট মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হলো ”

অফিসার হেসে ” ওই মেয়ে আপনার থেকে কি শিখতো? কি করে স্বামী খু”ন করতে হয়?যাইহোক,প্রথম থেকে শুরু করুন ”

মহুয়া বলতে শুরু করলো ” সে রাতে টুকুর বাবা,মজিত আর নওজান বাইরের আমের গাছটায় বসে তাশ খেলছিলো।আমি এ নিয়ে ওনাকে বারণ করেছি,নে”শাগ্রস্ত হয়ে যেন বাড়ির সামনে আসর না বসায় ”

” আপনার স্বামীর পেশা কি?কি কাজ করে? ”

মহুয়া হেসে ” ও মরোদ কাজ করবে কি!জায়গাজমি সব বেঁচে মদ বিড়ি খায়।বিয়ের পর আমার গহনা,মায়ের পক্ষের জমি সব বিক্রি করে দিয়েছে ”

” মেয়ের বিষয়ে আসুন ”

” দেড় মাসের মতো হলো।ও ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে আসলো।মেয়ের জন্য চুরি,লিপস্টিক,সাজগোছের কি কি যেন আনলো।আমি বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করলাম

” এতোকিছু কে দিলো?”

” কে আবার দিবে।মেয়ের জন্য কিনেছি ”

” টাকা কোথায় পেলে ”

” এতো কথা শুনে তোমার কাজ নাই।মাছ এনেছি,পাতলা করে মাছের ঝোল রাঁধো ”

রাতে খাওয়াদাওয়া করলাম।টাকা কোথায় পেলো সে প্রসঙ্গ তুললাম না।নিশ্চয়ই জুয়ার আসরে লাভ হয়েছে।মাঝেমধ্যে ওর জুয়ায় লাভ হয়।

খাওয়াদাওয়ার পর শরীরটা ভারী হয়ে এলো।ঘুমিয়ে পরলাম।তখনও জানতাম না আমার খাবারে ঘুমের কিছু মেশানো ছিলো।ও আমায় ঘুমিয়ে রেখে মেয়ের ঘরে মজিত আর নওজানকে নিয়ে যায়।

আমি তো বিষয়টা ধরতে পারিনি।কল্পণাও করতে পারিনি ওই কাপুরুষ এতো পাষাণ আর নরপিশাচ।পরেরদিন সকালে টুকু আমায় বলছে ওর নাকি বু”কে,কোম”ড়ে ব্যথা করছে।শুরুতে ভাবলাম শোয়ার বেতিক্রম।

তারপর থেকেই ও মেয়ের জন্য অনেককিছু কিনে আনে।নেশার সামগ্রীও বাড়তে লাগলো।আমি বুঝে উঠতে পারলাম না ব্যাপারটা কি।মেয়ের আর আমার শরীর যেন ঠিক থাকে সেজন্য রোজ আধা কেজি করে দুধের ব্যবস্থা করলো।

দু-তিনদিন পরপরই রাতে খাওয়ার পর শরীর কেমন হালকা হয়ে আসে।সারারাত ঘুমাই,পরেরদিনও সারাদিন ঘুম পায়।বহু কষ্টে জেগে থাকি।মেয়েও দু তিনদিন পরপর বলে গায়ে ব্যথা,কেউ তাকে জ”রিয়ে ধরে।একদিন লক্ষ্য করলাম ওর পিঠে আঁচড়ের দাগ।

কেমন সন্দেহ হলো।মনে হতে লাগলো কিছু একটা সমস্যা আছে।এরপর খাওয়া শেষে মেয়েকেও দুধ দিইনা,আমিও খাইনা।টুকুর বাবা বারবার দুধ খেতে জোরাজুরি করতে লাগলো৷

অফিসার এই পর্যায়ে এসব শুনে বললো ” তাহলে বিষয়টা হলো দুধেই ঝামেলা করে আপনাকে আর টুকুকে ঘুম পাড়িয়ে মজিত আর নওজানকে মেয়ের ঘরে ঢুকিয়ে দিতো ”

মহুয়া কাঁদছে।অফিসার বললো ” বিষয়টা ধরলেন কিভাবে? ”

” সেরাতে দুধ খাইনি।ঘুমের ভান ধরে ছিলাম।টুকুর বাবা বারান্দায় বসে আছে।বুঝলাম কিছু একটা ঝামেলা আছেই।মাঝরাতে ও বারান্দায় বসে থাকবে কেনো!একটুপর ফিসফিসানি আওয়াজ পেলাম।এতো রাতে কে এসছে!তারপর মেয়ের ঘরের ছিটকিনি খোলার শব্দ পেলাম।বিষয় কি বুঝতে চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠলাম।মেয়ের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি।দেখলাম দরজার ছিটকিনি খুলে মজিত ঢুকছে।

আমায় দেখে সমীর,মজিত,নওজান তিনজনই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।”

অফিসার বিষণ্ন চাহনিতে ” সমীর তখন কিছু বলেনি? ”

” ও তখন নেশায় ভুত হয়ে ছিলো।কয়েকটা চ”র দিয়েছিলাম গা”লে। ও বলেছিলো ওরা দুজন শুধু মেয়ের শরীর স্প”র্শ করতো।এর বেশী কিছু না ”

অফিসার ” খু”নের কারণ এটাই ”

” হ্যা ”

” একসাথে তিনজনকে মা”রলেন কিকরে ”

” একসাথে মা”রিনি।সমীরকে প্রথমে ওর পাতানো জালেই ফাঁসিয়েছি।ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়েছি।তারপর মাঝরাতে খাদে ফেলেছি।ঢাকনা দেওয়ার সময় ওরা দু’জন দেখে ফেলে।তারপর…”

” আপনার উচিত ছিলো তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া ”

” তাতে তো বেঁচে থাকতো।ওর একটাই শাস্তি,মৃ”ত্যু ”

” ওরা তো একপ্রকার মুক্তি পেয়ে গেলো।আর আপনি!বাকি জীবনটা জেলে কাটাতে হবে ”

———–সমাপ্ত—————–