#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২৫
নয়না বাসায় এসে টেনেটুনে হিজাব খুলে সোফায় ছুড়ে মারলো। ইচ্ছে করছে জিয়ানের মাথা চিবিয়ে খেতে, তাহলে হয়ত মেজাজ একটু ঠান্ডা হতো৷ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে গিলছে৷
“জাহানার বেগম হাত থেকে ঠান্ডা পানির বোতল কেড়ে নিয়ে বলে,বাপ চাচাদের মত মাথায় ক্যাড়া উঠেছে? এতো রাগ জেদ ভালো না নয়না৷ কি হয়েছে সেটা আগে বল।”
নয়না জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলে,”আম্মু আমার জন্য ছেলে দেখো আমি বিয়ে করবো।”
“এমন অলুক্ষণে কথা কখনো মুখেও আনবি না!মেয়ে মানুষ হলো সাদা চাদরের মত একটু কিছু হলেই সহজে দাগ লেগে যায়। তাছাড়া রেজা ছেলেটা ভালো সুখেই থাকবি তুই। রুমে যেয়ে ফ্রেশ হ আমি তোর জন্য শরবত করে নিয়ে আসছি।”
“নয়না যেতে যেতে উচ্চ আওয়াজে বলে,বিয়ে কিন্তু আমি করবোই ওই ড্রাইভারের সাথে আমি কিছুতেই থাকবো না৷ শা’লা একটা হিটলার।”
“জাহানারা বেগম মনে মনে বলে,এই মেয়ের কবে বুদ্ধি হবে! পাইলট ছেলেটাকে ড্রাইভার বানিয়ে দিয়েছে!”
“নয়না রুমে এসে পায়চারি করতে লাগলো। নাহহ কিছুতেই সে স্থীর হতে পারছেনা। এভাবে কেউ মিথ্যে বলে? এরজন্যই নীলাঞ্জনা আপি পালিয়ে গেছে। সে পালিয়ে বেঁচে গেছে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে। মোবাইল হাতে উঠিয়ে নিয়ে কল করলো জিয়ানকে। পরপর পরপর কয়েকবার কল করেই যাচ্ছে। ওপাশ থেকে একি কথা বলছে নাম্বার আনরিচেবল! রাগে মোবাইল বেডে ছুড়ে মারলো। ড্রেস নিয়ে সোজা চলে গেলে ওয়াশরুমে। বাথটবে হালকা উষ্ণ পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো। একটু পর পর মাথা বের করে শ্বাস নিচ্ছে।কিছুক্ষণ পর পুরো মাথা বাহিরে বের করে জোড়ে নিশ্বাস নিলো৷ রাগ কিছুটা কমছে। ড্রেস চেঞ্জ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। কোমর ছাড়িয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই চুলগুলো৷ এখন তার বিরক্ত লাগছে চুলগুলোকে। ড্রায়ার থেকে কাঁ’চি বের করলো আজ সে তার সখের চুলগুলো কেটে ফেলবে৷
“জাহানারা বেগম দ্রুত এসে নয়নার হাত থেকে কাঁ’চি নিয়ে বলে,কি হয়েছে তোর?”
“জানিনা আম্মু আমার কিছুই ভালো লাগছে না।”
“এটা শেষ করে রেডি হ। চল আজ তোর জন্য কিছু কেনাকাটা করবো।”
” নাহহ আম্মু আমার ইচ্ছে নেই।”
“তবে বিরিয়ানি রান্না করি।”
“নাহহ আমার খাওয়ার মুড নেই।”
“কি হয়েছে আমার প্রিন্সেসের?”
“নয়না জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,আম্মু আমরা কি পরীক্ষার পর ভ্রমণে যেতে পারি না?”
“অবশ্যই পারি। দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র এই সব কিছুই তো তোর জন্য।”
” আচ্ছা কথা দিচ্ছো কিন্তু।”
“দিলাম কথা৷ এবার তুই রেস্ট নে আমি বিরিয়ানির জন্য গোশত নামিয়ে ভিজিয়ে রাখি৷”
“নয়না চুপচাপ বসলো না, পায়চারি করছে আর জিয়ানকে কল করেই যাচ্ছে। সাথে মনে মনে অগণিত গালি তো দিচ্ছেই।”
🌿
নীলঞ্জনা গেটের বাহিরে এসে বলে,আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে নতুন করে পথ দেখানোর জন্য।
“জীবন অনেক মূল্যবান সে জীবনকে নিজের হাতে হত্যা করলে দ্বিতীয়বার আর ফিরে পাওয়া যায় না৷ আমরা চাইলেই জীবনের ভুলগুলোকে শুধরে নিয়ে জীবনটাকে সাজিয়ে নিতে পারি। যদিও তা সহজ নয় তবে কঠিনও না।”
“জীবনের কিছু ভুল এমন থাকে যা কখনো শুধরে নেয়া যায় না। সেই একটা ভুল সারাজীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়। জীবনটা আসলে আমরা নিজেরাই নষ্ট করি। ছাড়ুন এসব এটা বলুন আপনার নাম কি?”
“আমার নাম আহিয়ান হাসান অন্তর৷”
“নীলাঞ্জনা।”
” কিছু মনে না করলে আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি?”
“মন্দ হয়না৷”
অন্তর ড্রাইভ করছে নীলাঞ্জনা পাশের সিটে বসা৷ অন্তর হঠাৎ বলল, জানিনা কেনো কিন্তু আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে!
“একই শহরের মানুষ হয়তো কোন রাস্তার মোড়ে আমাদের রাস্তা বদলের সময় দেখা হয়েছিলো।”
“আপনি সুইসাইড কেনো করতে যাচ্ছিলেন?”
“যার জন্য সব ছেড়েছি সে আমাকে না আমার দেহটাকে ভালোবেসেছে। আচ্ছা ছেলে মানুষ কেনো বোঝেনা নারীর মন পেলে তার জন্য সে নারী দুনিয়ায় সর্গ সাজিয়ে দিতে পারে৷ অথচ পুরুষের কেবল নারীর দেহের প্রতি মোহ!”
“সব পুরুষ এক না৷ ভালোবাসা এই যুগে বাগান বিলাস ফুলের মত। সবাই তার সৌন্দর্য আটকে গভীর ভাবে এরপর ধীরে ধীরে তা ঝড়ে পরতে থাকে৷ মোহ আর ভালোবাসার মধ্যে মানুষ মোহকেই ভালোবাসা মনে করে সামনে এগিয়ে যায়।”
“এখানেই থামুন আমার বাসা চলে এসেছে৷”
” তালুকদার ম্যানশনের সমানে এসে থামকে দাঁড়ালো নীলাঞ্জনা৷ কোন মুখে দাঁড়াবে সে? তাকে কি ঠাই দিবে পরিবার নাকি দুর দুর করে তাড়িয়ে দিবে?”
“অন্তর পেছন থেকে বলে,সামনের পথ কঠিন হলেও এগিয়ে যাওয়ার পথে পিছু ফেরতে নেই৷ সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।”
“নীলাঞ্জনা বাসায় এসে কলিং বেল দিলো৷”
“জাহানারা বেগম তখন বিরিয়ানি দমে দিচ্ছিলেন৷ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে বলে,এই সময় কে আসলো?”
“সার্ভেন্ট দরজা খুলে দিয়েই চিৎকার করে বলে,বড় আম্মা দেহেন কেডা আইছে?”
“জাহানারা বেগম ছুটে আসলেন ড্রয়িং রুমে। নীলাঞ্জনাকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।
“নীলাঞ্জনা জাহানার বেগমের পায়ের কাছে বসে বলে,বড় আম্মু আমাকে ফিরিয়ে দিও না৷ আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি৷ আমাকে একটু ঠাঁই দেও বড় আম্মু।”
🌿
দীর্ঘ তেরো ঘন্টা জার্নির পরে জিয়ান নিজের রেস্ট রুমে ঢুকে ড্রেস খুলে থ্রি-কোয়াটার পরে শুয়ে পরলো৷ কখন চোখ দুটো লেগে গেছে তার ইয়াত্তা নেই। যখন চোখ খুললো তখন উঠে দেখে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। নিজের মোবাইল ওপেন করতেই চমকে উঠলো জিয়ান। নয়’শ মিসডকল! সাথে শ’খানেক টেক্সট।
“শয়তান ড্রাইভার, লুচ্চা ড্রাইভার, ডেভিল ড্রাইভার, হিটলার ড্রাইভার, মেয়েবাজ ড্রাইভার, আরো কত আজে বাজে টেক্সট। এসব দেখে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না৷সাত পাঁচ না ভেবে কল ব্যাক করলো৷”
” নয়না সাথে সাথে কল রিসিভ করলো। মুখ ফুলিয়ে রেখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।”
“জিয়ান কাশি দিয়ে বলে,আমি কি দেখতে এতোই খারাপ? আমার দিকে তাকানে যায় না?”
“নাহহ যায় না৷ আগে জামা কাপড় পরেন তারপর তাকাতে বলেন, বডি বানিয়েছেন আর ভাবছেন সব মেয়ে আপনার বডি দেখে প্রেমে পরে যাবে!”
“জিয়ান কম্ফোর্টার টেনে গলা অব্দি টেনে তুললো৷ এবার বলো তো বাংলাদেশের নামকরা প্লেবয় কেন বানিয়েছো আমাকে?”
“সোজা কথার সোজা উত্তর দিবেন একটুও বাঁকা উত্তর দিলে আপনার তেরোটা বাজিয়ে ফেলবো৷”
“আচ্ছা একদম বরাবর উত্তর দেবো।”
” আপনি সিগারেট খান?”
“অভ্যাস নেই তবে মাঝে মাঝে খাই৷ আরেহহহ জানো না সিগারেট খেলে বুদ্ধি বাড়ে।”
“বাজে কথা রেখে এটা বলুন সামনের বাটন খোলা রেখে শার্ট পরেন?”
“মাঝে মাঝে দেশে থাকলে পরি গরমের সময়।”
“কচি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেন?”
“জিয়ান এক চোখ টিপে বলে,আগে তো করতাম না এখন করি।”
“জিয়ানের দুষ্টুমি মাখা কথায় আরেকজনে ভুল বুঝে রেগে বোম হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে বেচারা বেখবর। আর কিছু জানতে চান প্রিন্সেস সুনয়না?”
“নয়নার চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। রাগলে নয়নার চোখে অশ্রু টলমল করে, রাগী কন্ঠে বলে,”আমার ইচ্ছে করছে, আপনাকে থেঁতো করে স্যুপ রান্না করে খেতে৷ তবেই যদি আমার মাথা একটু ঠান্ডা হয়।”
“বাহহহ মাস্টার শেফ সুনয়না চৌধুরী মানুষের স্যুপ বানাবে?”
“মানুষের না আপনার স্যুপ বানাবো।”
“তো আমি কি?”
“আপনি ড্রাইভার। বলেই খট করে কল কেটে দিয়ে মোবাইল সুইচড অফ করে দিলো৷ রাগে কি করবে বুঝতে পারছে না৷ কি অসভ্য লোক কচি মেয়েদের ইভটিজিং করে তা আবার বুক ফুলিয়ে বলছে!নির্লজ্জ লোক।”
“জিয়ান ফোনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,এই পাগলি মেয়ের আবার কি হলো? এই নিব্বা বৌকে নিয়ে যদি সংসার করতে হয় আমার অবস্থা বেহাল হয়ে যাবে৷”
জিয়ান উঠে বসলো৷ টেলিফোন কল করে খাবার অর্ডার করলো। নিজে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো৷
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে, এক তালাক, দুই তালাক,একশ তালাক৷ টেক্সট দেখে জিয়ান উচ্চ স্বরে হেসে ফেললো!
🌿
মান্নাত ক্লাস শেষ করে একটা হাওয়াই মিঠা কিনে সেটা খেতে খেতে আসছিলো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা গায়ে জানালার পর্দার মত একটা ড্রেস।মান্নাতের চোখ আটকে গেলে এক বাসার দোতলার বারান্দায়। মান্নাত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গিটার বাজানো ছেলেটার দিকে।
“জাহিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে টুংটাং করে গিটারের সুর তুলছিলো। সেদিন দেখা হয়েছিলো আজও পারিনি কিছুই বলতে যে তোমায়…হঠাৎ রাস্তায় চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে নিজের রুমে চলে গেলো।
“মান্নাত নিজের দিকে তাকিয়ে বলে,হিটলার বাপের জন্য এজন্মে প্রেম হবে না। নিশ্চিত আমাকে পাগল ভেবে চলে গেছে!”
“জাহিন রুমে ঢুকে দেখে, সায়না দাঁড়িয়ে আছে।”
“তোর কি সমস্যা? তুই জানিস না প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের রুমে হুট করে চলে আসা ব্যাড ম্যানারস?”
“জাহিন আই লাভ ইউ।”
“আই লাভ ইউ টু ডিয়ার বনু।”
“এটা ঠিক না জাহিন আমি তোকে ছ্যাইয়ার নজরে দেখি।”
“আমি তোকে বোনের নজরে দেখি। যা সর এখন রুম থেকে বের হ আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে কল করবো৷”
#চলবে
তাকে প্রথম দেখলাম বাসর রাতে। বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় তাকে সে রাতটা আমাদের বাড়িতেই রাখা হলো। আকস্মিক বিয়ে শুধু মনের উপর দিয়ে না, শরীরের উপর দিয়েও ধকল গেছে। শরীরের ধকল বেশি না মনের ধকল বেশি বলতে পারবো না। কিছুই বলতে পারবো না। আমার ইন্দ্রিয়গুলো যেনো অচল হয়ে গেছে। ধকল সইতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙলো ডিমলাইটের আলোয়, মুখের সামনে অচেনা এক পুরুষের মুখ দেখে আমার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভয়ে চোখ নিশ্চয়ই তার নির্দিষ্ট সাইজের থেকেও বড়ো আকার ধারণ করেছে। চিৎকার দেওয়ার কথা মাথায় আসে নি।
আমার এমন বিহ্বল প্রতিক্রিয়া দেখেই বোধহয় মানুষটা তার স্টকে থাকা সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা দিলো। পুরুষ মানুষের হাসি এতো আকর্ষণীয় হয় আমার জানা ছিলো না। আমার সাথে কি হচ্ছে জানা নেই। আমি বিমোহিত হয়ে সেই হাসি দেখলাম। এই লোক তো প্রলয়ঙ্কর! এই হাসি দিয়েই সে শত শত রমণীর হৃদয় নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। কিন্তু আমাকে পারলো না। কারণ আমার হৃদয়কে আগেই কেউ বিভৎসভাবে হত্যা করে ফেলেছে। তবুও কিছু একটা আমাকে চুম্বকের মতো টানলো।
-ভয় পেলে?
পাবো না! মাঝরাতে মুখের সামনে অচেনা একটা পুরুষকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখলে ভয় পাবো না? গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না। আকস্মিক শকটা কাটিয়ে উঠতে পারি নি তখনও। এরমধ্যেই আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সচল করে দিলো সেই সুবাস। সারা তনু মন ছেঁয়ে গেলো সুবাসে। লোকটা কি মাখে গায়ে!
-এতো সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিলে যে চোখ ফেরাতে পারি নি।
পারবেন কিভাবে লজ্জা আছে আপনার? নেই তো। লজ্জা থাকলে মেয়ে দেখতে এসেই নিশ্চয়ই বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যেতেন না৷
-ভীষণ ঘুমকাতুরে তুমি! নামের মান রক্ষা করেছো। বরের অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়লে। বর পছন্দ হয় নি?
– অবশ্য…তুমি তো আমায় দেখোই নি। এতো এতো বাঁধা পেরিয়ে তোমার সামনে এলাম। নিজেকে দেখার সুযোগ করে দিলাম। আর তুমি একটু মাথা উঁচু করে দেখলেও না। এতো অবজ্ঞা! জানো কতো মেয়ে আমার পিছন পিছন ঘুরে?
ঘুরবে না। চেহারা ছবি তো মাশাল্লাহ। মেয়েরা পিছু পিছু তো ঘুরবেই। এতো পিছু পিছু ঘুরা মেয়ে থাকতে আমাকেই লোকটার চোখে পড়লো! আমি তো তাকে কিছুই দিতে পারবো না। নারীর প্রথম ভালোবাসা নাকি তার আত্মার প্রথম স্পর্শ। আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সেই আত্মার। আমি যে আমার আত্মার প্রথম স্পর্শ তাকে দিতে পারবো না। অপাত্রে দান করে সেই আত্মা নষ্ট করে ফেলেছি যে।
আমার ভাবনার মাঝেই সে লাইট জ্বালিয়ে দুপা ভাজ করে আমার ঠিক সামনে বসে পড়ে। সাথে সেই প্রলয়ঙ্কারী হাসি৷
-যাক বিয়ের আগে যখন বর দেখোনি। এখন দেখো।
দেখতো বরটা চলনসই নাকি। চলনসই না হলেও এখন কিছু করার নেই। তোমাকে একবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো। তুমি সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছো। এখন আর সুযোগ নেই। আমাকেই আজীবনের জন্য বয়ে বেড়াতে হবে। আমার আবার দয়ার শরীর৷ তাই তোমাকে একটা সাজেশন দেই। এই বোঝাটা অন্তর দিয়ে টেনো। আই প্রমিস লোকসান হবে না।
সেই শুরু। নাহ লোকসান হয় নি। বলা যায় আমি জীবনে জিতে গেছি। খুব জেতা জিতেছি। মানুষটা আমায় আমূল বদলে দিয়েছে। এতো যত্ন, আগলে রাখায় আমি বিগড়ে গেছি। কতো যে বাজে অভ্যাস গড়িয়েছে আমার। এই যেমন গোছালো আমিটা এখন অগোছালো হয়ে গেছি। কোনো কাজ এখন গুছিয়ে করতে পারি না। আসলে করতেই চাই না। মানুষটা এতো গোছানো; আমার থেকেও গোছানো। তার কোনোকিছু আমার গুছিয়ে দিতে হয় না। উল্টো আমাকেই সে গুছিয়ে দেয়। আমিও জেনেবুঝে অগোছালো থাকি৷ সে খুব যত্নে আমায় গুছিয়ে নেয়। তার এই যত্নে মাখা ভালোবাসাটার জন্য আমি সারাজীবন অগোছালো থাকতে রাজি। ভাবা যায় একটা সময় আমি অগোছালো কারো জন্য মরিয়া ছিলাম। এখন মনে হয় কি জানেন? কাউকে যত্নে ভালোবাসার থেকে, কারো যত্নের ভালোবাসা নিতেই বেশি ভালো লাগা কাজ করে।
লোকটার উপর আমি পুরোপুরি নির্ভর হয়ে গেছি জানেন। তাকে ছাড়া কিচ্ছু করতে পারি না। দরকারই বা কি বলুন? যার নিজস্ব একজন পারফেকশনিস্ট আছে তার অন্যকিছুর দরকার নেই। লোকে বলে-কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়, এতে করে তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। সে লোকে যা বলার বলুক। লোকে তো কতকিছুই বলে। এই মানুষটা আমার অস্তিত্বকে হারিয়ে যেতে দেয় নি। উল্টো যখন আমি আমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিলাম; তখন আমার সেই হারানো অস্তিত্বকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি জীবনে এমন একটা মানুষকে পেয়েছি যার উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। যার উপর দুনিয়ার সব ঝামেলা চাপিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। যতো খারাপ পরিস্থিতিই আসুক; আমি জানি মানুষটা আমার উপর সেসবের কোনো আঁচ লাগতে দিবে না। এমন মানুষকে মনে জায়গা না দিয়ে উপায় আছে বলুন?
আমি নিজেকে পুরোটাই তার কাছে সঁপে দিয়েছি। আমি এখন নিশ্চিন্ত। আমার কতো কতো ইচ্ছে ছিলো। সব ইচ্ছের দায় এখন তার। এই যেমন হুট করে কোনো বৃষ্টিমুখোর দিনে ফিরতি পথে ফোন দিয়ে বলবে- তন্দ্রা আমি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি৷ তুমি একটা শাড়ি পরে জলদি নিচে আসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
আমি পড়িমরি করে গায়ে শাড়ি জড়িয়ে তার ডাকে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি এক শুদ্ধতম সুদর্শন পুরুষ একরাশ শুদ্ধতা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর আরকি। ঝুম বৃষ্টিতে পিচঢালা রাস্তায় তার হাত ধরে পথ পারি দেওয়া।
আমার সব মন খারাপের দিনে আমার পাশে থাকা। যতক্ষণ না আমার মন ভলো হবে আমার কাছ থেকে সরবে না। মন ভালো করতে একটার পর একটা, কিছু না কিছু করতেই থাকবে। হয় হাতে হাত রেখে গল্প করবে, নাহয় গান গাইবে, নাহয় নিজের হাতে রান্না করে আমাকে খাইয়ে দিবে। গমগমে কন্ঠস্বরে যখন গান গায় শুনতে এত্তো ভালো লাগে। অভিমান করলে হাজার উপায়ে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করবে।
আমার সব ইচ্ছে সে পূরণ করছে। আমি কখনো মুখ ফুটে বলি নি। মুখ ফুটে বলার ক্ষমতা যে আমার নেই, জানেনই তো। তার কাছে মুখ ফুটে কিছু বলার প্রয়োজনই পড়ে না। আমার না বলা কথাগুলো কিভাবে কিভাবে যেনো সে বুঝে যায়।
কবে, কখন, কিভাবে জানি না। আমি তার প্রেমে পড়েছি। এই প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারগুলো বোধহয় এমনই। কখন, কিভাবে কার ছায়া মনে জাগে; বলা মুশকিল। শুধু জানি এই মানুষটাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। কিচ্ছু ভালো লাগে না তাকে ছাড়া। মানুষটার দূরত্বে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। তার গমগমে কন্ঠস্বর না শুনলে আমার বড্ডো একা একা লাগে। আর তার সেই অদ্ভুত সুবাস! তার গায়ের সেই অদ্ভুত সুবাস ছাড়া আমার ঘুম আসে না। কেউ যে এতো যত্নের সাথে ভালোবাসতে পারে আমার জানা ছিলো না। এতো যত্নের ভালোবাসাও আমার কপালে ছিলো! আর আমি কিনা শূন্য নীড়ের জন্য হা-হুতাশ করতাম। এখন আর মুনতাজির ভাইকে সেভাবে মনে পড়ে না। পড়ার সুযোগটা কোথায়। মনে যে এখন অন্যকেউ গেড়ে বসে আছে।
“কিন্তু”। তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়। একজন বলেছিলেন না- নারীর হৃদয়ে প্রথম প্রেম সেই দীপশিখা, যা সময়ের ধাক্কাতেও সহজে নিভে না। আমি তার ব্যতিক্রম নাকি! এতো যত্নের মাঝেও মাঝে মাঝে তাকে মনে হয়।
কেউ যদি আমায় এখন প্রশ্ন করে- জীবন নিয়ে তোমার কোনো আফসোস আছে?
আমি বলবো- হ্যা৷ আফসোস আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধ মানুষকে আমার শুদ্ধতম ভালোবাসাটা না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার প্রথম প্রেমের মালাটা তাকে না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার প্রথম অনুভূতিটুকু তার নামে না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার এই আফসোস কোনোদিন যাবে না।
***
বহু বছর পর দেশে এলাম। বিয়ের পর পরই বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম উনার সাথে। মাসখানেক হলো দেশে ফিরেছি। এতদিন শশুর বাড়িতে ছিলাম। আমার শাশুড়ী মারা যাওয়ার পর, শশুর মশাই একা হয়ে গেছেন। সাথে আমার বিধবা ননাশ থাকেন, বাচ্চাকে নিয়ে। অনেক জোর করা হয়েছে উনাদের আমাদের কাছে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার শশুরের এক কথা। যে কটাদিন বেঁচে আছি এখানেই থাকবো। নিজের বাড়িতে, নিজের দেশেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবো। আমার বাবা-মায়েরও বয়স হয়েছে। খুব চিন্তা হয় তাদের নিয়ে। শশুরকে দেখার জন্য লোক থাকলেও তাদের দেখার জন্য কেউ নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। এবার ঠিক করেছি তাদেরও সঙ্গে নিয়ে যা। সবঠিক হয়ে গেছে। প্রসেসিং-এ যেটুকু সময় বাকি।
সময় বহমান। সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই বদলে গেছে। দেখতে দেখতে আমার বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমিও কি আগের মতো আছি? নেই তো। আমি এখন পরিপূর্ণ নারী। কারো বিবাহিতা স্ত্রী। দুই সন্তানের মা। যার দিনরাত যায় স্বামী, সংসার আর দুটো বাচ্চার পিছনে ছুটতে ছুটতে।
বহুদিন পর আজ পুরনো মানুষদের কাছাকাছি এসে পুরনো স্মৃতি নাড়া দিচ্ছে। জিনিয়া, নিভাপু আসায় আজকে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। নিভাপুর মাঝে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। চুলে পাঁক ধরেছে। আমার চিক্কু বেস্টফ্রেন্ড এখন আর চিক্কু নেই। স্বাস্থ্য বেড়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চলতার ছিটেফোঁটাও নেই তার মাঝে। কেমন জানি অসহায়ত্ব তার চোখেমুখে। আঙ্কেল মারা গেছেন, আন্টিও বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছে। এদের মাঝে আমার বড়ো হওয়া। এক থালায় খাওয়া। কতো কতো স্মৃতি এদের সাথে জড়িয়ে। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে গেছে।
সব বদলে গেলেও উনার প্রতি আমার ভালোবাসা আর আমার প্রতি উনার ভালোবাসা বদলায় নি। আমি আজও উনার যত্ন ভালোবাসার জন্য মুখিয়ে থাকি। বিয়ের পর নাকি ভালোবাসা বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বিলীন হয় নি। বরং সময়ের সাথে সাথে নতুন রুপ নিয়েছে। আমার ভালোবাসার দুটি ফুল আমাদের দুই ছেলে মেয়ে। আগে যেই অনুভূতিগুলোতে সিক্ত থাকতাম। এখন সেসব বিলীন প্রায়।
বহু বছর পর মুনতাজির ভাইকেও দেখলাম। নিজেকে মেইনটেইন করেছে ভালো। চোখে চশমা উঠেছে। এখনও বিয়ে করেন নি। কেনো করেন নি। জানি না। জিনিয়াকে জিগ্যেস করেছিলাম। কিন্তু কোনো জবাব পাই নি। আমিও আর ওকে ঘাটি নি। স্বভাব চরিত্র বোধহয় এখনও বদলায় নি। কিছুই যে বদলায় নি তেমন না। এখন আর উচ্চ শব্দে জ্যাজ সং শোনা যায় না৷ তার পরিবর্তে মৃদু আওয়াজের রবীন্দ্র সংগীত ভেসে এসেছে।
এক বিকেলে তার সাথে কথাও হয়ে গেলো টুকটাক। সবাই উপস্থিত ছিলাম। বাচ্চারা ছুটাছুটি করছিলো। তখন তারসাথে দেখা। জানতাম নিজে থেকে এসে কখনো কথা বলবে না। কথা বললে আমাকেই বলতে হবে। সৌজন্যতার খাতিরে। সবার সামনে আসলে কথা না বললে কেমন দেখাবে না? অথচ আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজেই আসলো কথা বলতে।
-কেমন আছো তন্দ্রা?
-মুনতাজির ভাই! ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
বিনিময়ে মলিন হাসি দিয়ে নরম স্বরে খুব সংক্ষেপে জানালো- ভালো।
-বাচ্চা দুটোর বয়স কতো?
– মেয়ের তিন বছর আর ছেলের এক।
-নাম কি?
– সায়রী আর তিহান।
তিহানকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করলো। সায়রীকেও আদর করলো। বেশ অবাক হলাম। বেশ বদলে গেছে। মুনতাজির ভাই আর এতো নম্রতা,ভদ্রতা। বিশ্বাস করা যায়! এই কি সেই দাম্ভিক, বেয়াদব, বাউণ্ডুলে মানুষটা! অবশ্য এখন তো আর আগের বয়স নেই। বেলা তো অনেক গড়ালো। পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কথা সারাক্ষণ আমার মাঝে খচখচ করে, বিয়ে কেনো করেন নি তিনি৷ হয়তো কোনো খেয়ালিপনা থেকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
***
আজকে জিনিয়া চলে যাচ্ছে। দুদিন পর আমিও চলে যাবো। সব গোছগাছ করা শেষ। বাবা মা’ও সঙ্গে যাচ্ছে। এবার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। জিনিয়া যাওয়ার আগে আমাকে একটা ডায়েরি দিয়ে গেছে। খুব অনুরোধ করেছে যেনো পড়ে দেখি।
-তন্দ্রা প্লিজ ডায়েরিটা পড়িস। আমি জানি এটা করা আমার উচিত হচ্ছে না। কিন্তু কথাগুলো তোর জানা উচিত। একটু সময় করে পড়িস। আমাদের ভুল বুঝিস না প্লিজ।
সেই ডায়েরিটা নিয়ে অনেক্ক্ষণ ধরে বসে আছি। জানি না ডায়েরিটা কার, কি আছে এতে। তবে অবচেতন মন কিছু সংকেত দিচ্ছে। মনের সাথে মনের যুদ্ধ চলছে। এক মন বলছে খুলিস না, আরেক মন বলছে খুলেই দেখ না। শেষে খুলেই দেখলাম। আমার অনেক ছবি। ছোটবেলার; বড়বেলার। বিভিন্ন ছোট ছোট চিরকুট, চিঠি, ডায়েরির পাতায় পাতায় লেখা অসংখ্য বাক্য। সব আমায় নিয়ে। হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে।
আমার প্রাণপাখি,
অনেক অভিমান আমার প্রতি তোর তাই না। মনে মনে কি আমায় বকাঝকা করিস। কর। যতো ইচ্ছা কর। কি করবি বল। মানুষটা যে আমি খুব খারাপ। আর তোর জন্য আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। খুব কষ্ট পেয়েছিস বুঝি? আমারও কষ্ট লাগে। তোকে কষ্ট দিতে আমারও কষ্ট লাগে। তার থেকে বেশি কষ্ট লাগে তোকে অন্যকেউ দেখলে। সহ্য করতে পারি না। ইচ্ছে করে দুনিয়ার সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেই। অন্যকেউ তোকে কেনো দেখবে বল। তুই শুধু আমার। তোকে দেখার অধিকার শুধু আমার। অবশ্য তোর দোষেই তুই কষ্ট পাস। নিজের চুলগুলো অন্যকে কেনো দেখাতে হবে বল? খুব শখ না অন্যকে চুল দেখানোর? তোর সবকিছুতে শুধু আমার অধিকার। অন্যকেউ তোকে দেখবে না। ঠিক করেছি আমি। একদম ঠিক করেছি।
আরেক পৃষ্ঠাতে লেখা-
পরাণপাখি,
আজকে সজীবকে মেরেছি। খুব মেরেছি। কতোবড় সাহস বলতো। বলে কিনা তোকে পছন্দ করে। তোর সাথে যেনো স্যাটিং করে দেই। আমার ভিতরে কি হচ্ছিল বুঝতে পারিস?
এমন অসংখ্য কথা লেখা ডায়েরির পাতায় পাতায়। দমবন্ধ হয়ে আসছে। একটা চিঠিও আছে।
তন্দ্রা,
জানি এই চিঠির আজ কোনো মূল্য নেই। তুই পড়বি কিনা জানি না। তবে একটাবার অনুরোধ করবো পড়ার জন্য। নিজের ভিতরের অস্থিরতা, অপরাধবোধ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যেখান থেকে আমি কোনোদিন বের হতে পারবো না।
আমি জানি তোর সঙ্গে অন্যায় করেছি। শুধু তোর সঙ্গে নয়। নিজের সঙ্গেও অন্যায় করেছি। নিজের খামখেয়ালিপনা, নিজের চিন্তাধারায় এতো মগ্ন ছিলাম যে; ঠিক সময়ে তোর মূল্যায়ন করতে পারি নি। তোকে বলতে পারি নি তোকে কতোটা ভালোবাসি।
আর পড়ার ধৈর্য্য হলো না। ভালোবাসতো? মুনতাজির ভাই আমাকে ভালোবাসতো! এখনও বাসে? আমার জন্যই তিনি আজ অবধি বিয়ে করে নি। আমাকে ভালোবাসলে এতো কষ্ট, অবহেলা, অপমান কেনো? যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো অপমান করা যায়? প্রতিটা পাতায় আমার প্রতি তার পাগলামো আবেগের কথা।
শীতের সন্ধ্যা। মফস্বলি এলাকা হওয়ায় শীত জেঁকে বসেছে। এই প্রচন্ড শীতেও আমি কুলকুল করে ঘেমে চলছি। কোনো অজানা আবেগে নাকি রাগে আমার জানা নেই। রাগ হ্যা রাগ।
মাঠে কিছু বাচ্চারা আগুন জ্বালিয়েছিল। ডায়েরিটা সেই আগুনে জ্বালিয়ে দিলাম। বৃথা৷ এসব মিথ্যা, দমবন্ধকর আবেগের এখন কোনো দাম নেই। আমার প্রতি তার এসব আবেগের এখন কোনো দামই নেই। একসময় উপযুক্ত সময় ছিলো, তখন তিনি সবটা হেলাফেলায় নষ্ট করেছে। সে যাই বলুক, তার কাজের পিছনে তিনি হয়তো হাজারটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে। কিন্তু সত্যি তো এটাই; কোনো যুক্তিই আমাকে অপমান করার অধিকার তাকে দেয় না। আমার কিশোরী বয়সের প্রথম অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করার অধিকার তার ছিলো না। সে তো সবই বুঝতো। জানতো। আমিই বোকা। ভেবেছিলাম তিনি হয়তো কিছুই বুঝতেন না। অথচ তিনি আমার সমস্ত অনুভূতি জানা সত্যেও প্রতি পদে পদে আমাকে অপমান করে গেছে। এ কেমন ভালোবাসা! কেউ চুলের প্রশংসা করেছে বলে, চুল কেটে দেওয়া। কেউ পছন্দ করেছে বলে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করা; কেমন ভালোবাসা!
আর যাইহোক। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষকে কখনো কষ্ট দেওয়া যায় না। অপমান করা যায় না। আমার ভালোবাসা পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই তার নেই। তবুও তাকে ভালোবেসেছি। ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না। আমি ভালোবাসতে জানি তাই তারমতো মানুষকেও খুব যত্ন করে ভালোবেসেছিলাম। তাকে ভালোবাসতে পারাটা আমারই কৃতিত্ব ছিলো। মন থেকে ভালোবেসেছিলাম তাকে আর তিনি তা বড়ো নির্মমভাবে পায়ে ঠেলেছেন। ভালোবাসলে সেই মানুষটাকে সম্মান করতে হয়, আগলে রাখতে হয়, কদর করতে হয়। অপমান, অবহেলা, কষ্ট দেওয়ার মাঝে কোনো ভালোবাসা হতে পারে না। তাই এখন এসবের কোনো মূল্যই আমার কাছে নেই। আমি নিজের জীবনে সুখী। প্রকৃতপক্ষেই সুখী। একটা শুদ্ধতম মানুষ পেয়েছি আমি। যে আমাকে সম্মান করে, মূল্যায়ন করে, আগলে রাখে।
জানি না জীবনে এমন কি পূণ্য করেছি যার জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন বিষাক্ত একটা সম্পর্কে জড়ানো থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বাঁচিয়ে পবিত্র একটা পুরুষকে জীবনে এনে, আমার জীবনটা সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে দিয়েছেন। একসময় কাউকে খুব যত্নে ভালোবেসেছিলাম আল্লাহ তায়ালা আমার থেকেও যত্নে ভালোবাসতে পারা মানুষটাকে আমার জন্য পাঠিয়েছে। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। ব্যস। আর কিচ্ছু জানতে চাই না আমি। কিচ্ছু না। আমাকে ফিরতে হবে। প্রকৃত এক প্রেমিক পুরুষ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। যার সাথে বৃদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে। তার বুকে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার ইচ্ছে আমার।
***
-তন্দ্রা এই তন্দ্রা..
– উমম..
-ঘুমাচ্ছ?
– কি অদ্ভুত কথা সায়র! ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে বলছো ঘুমচ্ছি কিনা। এই রাতের বেলা মানুষ আর কি করবে।
মুচকি হেসে মাথা চুলকে বলে,
– ছাঁদে এসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
অগত্যা কি আর করার। মশাইয়ের আদেশে চলে গেলাম ছাঁদে। শীতের রাত। ধোঁয়া উঠা দুটো কাপ নিয়ে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আছে।
-মাঝে মাঝে যে তোমায় কি ভূতে ধরে। এই মাঝরাত্রিরে কনকনে ঠান্ডায় কেউ ছাঁদে আসে?
-আমি আসি।
বলে এককাপ কফি আমার দিকে দিলো। খুব সন্তপর্ণে নিজের চাদরের মাঝে আমায় ঢেকে নিলো। শুধু কি চাদর। এভাবেই লোকটা তার ভালোবাসার মায়ায় আমাকে ঢেকে নিয়েছে।
– কদিন পর চলে যাবো। ভাবলাম আজকের রাতটা একটু অন্যভাবে কাটায়। আপনার সমস্যা আছে রাণীসাহেবা?
-সমস্যা তো নেই। কিন্তু মাঝরাতে তোমার হুটহাট প্ল্যানিং এ আমার হার্ট অ্যাটাক না হলেই হয়।
সায়র জোরে হেসে উঠে। কি সুন্দর হাসি! এই হাসি এমনই অম্লান থাকুক। অম্লান থাকুক আমাদের ভালোবাসাও।
পুনশ্চ: অন্ধকার ছাঁদের ঠান্ডায় হিম ধরা ফ্লোরে পা মেলে বসে আছে কেউ। বুক্ষুভের মতো সিগারেট টানছে আর হাওয়ায় বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ছে। শীতের কুয়াশার মাঝে মিশে যাচ্ছে তা। গাশে পাতলা একটা শার্ট ছাড়া কিছু নেই। এই ঠান্ডায় শরীর জমে হিম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার ভিতরের ঝড় থামছে না। দৃষ্টি তার সামনের ছাঁদে দাঁড়ানো কপোত-কপোতীর দিকে। তাদের নজর এদিকে পড়ে নি। তারা তো নিজেদের ভালোবাসায় ডুবে আছে। শুধু তারই প্রতিটা রাত এভাবে কাটে। আফসোস আর অনুতাপের সাগরে।
এই আফসোস ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার। এই আফসোস, ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসি বলতে না পারার। শুধু কি আফসোস? তার থেকেও অনুতাপে জর্জরিত সে৷ ভালোবাসার মানুষটাকে বুঝতে না পারার অনুতাপ। ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার অনুতাপ। ভালোবাসার মানুষটাকে মূল্যায়ন না করার অনুতাপ। বাবা-মায়ের কথায় ঠিকঠাক প্রতিবাদ না করার অনুতাপ। জীবনে কতোই তো বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়েছে। আরও একটাবার অবাধ্য হলে ওই নারীটা আজ তার একান্ত ব্যক্তিগত হতো। সময়কে হেলাফেলা করার অনুতাপ। এতো এতো অনুতাপ আর আফসোসেই দিন কাটে তার। একবুক হাহাকার নিয়ে কাটে প্রতিটা রাত। সময় থাকতে সঠিক সময় এবং সঠিক মানুষের কদর করতে জানতে হয়।
সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না
তুমি কেন জানলে না
সময় গেলে সাধন হবে না….
আজকে আমাকে দেখতে আসবে। হুট করে জানতে পারলাম; এমন না। কালকে রাতে বাবা এসে জানিয়েছে। বাবা বিদেশে থাকায় আমি যেমন বাবাকে কাছে পাই নি। বাবাও তেমন আমাকে কাছে পায় নি। আর দশটা বাবাদের মতো আমার বাবা আমার বড় হওয়া দেখে নি। আর দশটা বাবা-মেয়ের মতো আমাদের সম্পর্ক নয়। একটা নিরব দূরত্ব বিরাজ করে আমাদের মাঝে। দেশে আসার পর বাবা একটা নিয়ম তৈরি করেছে। প্রতিদিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এক ঘন্টা কেবল আমাদের বাবা-মেয়ের জন্য বরাদ্দ। এতো বছরের কাছে না পাওয়া মিটিয়ে নেওয়ার ছোট্ট একটা চেষ্টা। এই এক ঘন্টা আমরা কথা বলি। যেকোনো বিষয় নিয়ে। এই এক ঘন্টা আমাদের বাবা-মেয়ের মাঝে দুনিয়ার অন্য সব কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমনকি মা’ও। মায়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও আমাদের আলাপের বেশিরভাগই থাকে মাকে নিয়ে। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা শুরু করলেও বিষয়গুলোতে কিভাবে যেনো মা ঢুকে পড়ে। আলাপের সময় সীমা এক ঘন্টা হলেও; কথায় কথায় ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায়। বাবা যে কিভাবে এতো মজার মজার কথা বলে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বাবার সাথে ওই সময় আমিও কিভাবে যেনো বকবক করে চলি। মায়ের গজর গজরে আমাদের সেই আলোচনা পর্ব শেষ হয়।
রোজকার মতো কালকেও বাবা আসে। এদিক ওদিকের কথা বলতে বলতেই জিগ্যেস করে আমার পছন্দের কেউ আছে কিনা। মুহুর্তেই ভেসে উঠে অগোছালো, দাম্ভিক একটা চেহারা। কিছু টুকরো স্মৃতি। কিছু টুকরো ইচ্ছে। বাবার সাথে সব বলা হলেও এটা বলা হয় নি। আজও বলা হলো না যে,
-হ্যা বাবা। পছন্দ করি। একটা বাউন্ডুলে, অগোছালো,দাম্ভিক ছেলেকে পছন্দ করি। খুব পছন্দ করি। খুবববব।
কিন্তু বলা হলো না। তারপর জানলাম আমাকে আজ দেখতে আসবে। আমার আপত্তি আছে কিনা। নাহ নেই। কোনো আপত্তি নেই। সত্যিই নেই। সে আমার জন্য না এটা আমি বহু আগেই মেনে নিয়েছি। তাই কোনো কিছু নিয়েই আমার কোনো আপত্তি নেই। ওই পরিবারের সাথে আমাদের আন্তরিকতা আগের মতোই আছে। জিনিয়া এখনও আমার প্রাণের সখী। নিভাপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মুনতাজির ভাইয়ের সাথে সামনাসামনি দেখা হয় না বহুদিন। তার সাথে সামনাসামনি দেখা না হলেও; আমার লুকিয়ে দেখা এখনো জারি আছে। যদিও আগের মতো এখন আর তার দেখা পাওয়া যায় না। ছুটিছাটায় আর অফিসে যাওয়া আসার সময় দেখা পাওয়া যায়। বাউন্ডুলেটা চাকরি পেয়েছে কিছুদিন হলো। চাকরি পেলেও বাউন্ডুলেপনা এখনও কমে নি। পাশাপাশি রুম হওয়ায় এখনও তার রুম থেকে জ্যাজ সং শুনতে পাই। হ্যাড়ে গলার গান শুনতে পাই। এখন আর আগের মতো ছটফটে ইচ্ছেগুলো মাথাচাড়া দেয় না ঠিক। তবে এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে ভেবে ঘুমোতে যাওয়া হয়। অফিসে যাওয়ার পথে “আম্মু যাই” বলে যখন ‘ধাঙঙঙ’ করে গেট লাগায়। পর্দার আড়াল থেকে তাকে দেখে সকাল শুরু করা হয়। টিপটপ হয়ে অফিসে যায়। কি যে এক পারফিউম লাগায়। না সে পারফিউম লাগায় না। গোসল করে। পুরনো অভ্যাস। সাতদিনে একবার গোসল করুক আর না করুক; পারফিউম দিয়ে গোসল চলবেই। ঘ্রাণটা নাক দিয়ে ঢুকে সোজা মস্তিষ্কে গিয়ে টং করে উঠে। এখনও নিয়ম করে তাকে নিয়ে ভাবা হয়। তবে কোনো কিছুতেই আমার কোনো আপত্তি নেই।
***
বিয়েটা আমার হয়েই গেলো শেষমেষ। বড়োই নাটকীয় ভাবে। দেখতে এসে বিয়ে হয়ে যাওয়া শুনেছি অনেক। আজকে নিজের সাথেই হলো। আজকেই বিয়ে হবে কথাটা জানলাম বিয়ের ঠিক দশ মিনিট আগে। উনারা আসবে বলে মা একটা জামরঙা জামদানী শাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো। জিনিয়া এসে পরিয়ে দিতেও নিয়েছিলো; বাবা এসে না করলো। আমার মেয়ে যেমন থাকে সেভাবেই সামনে যাবে। আমার অবশ্য কোনো আপত্তি ছিলো না। শাড়ি পড়ে সং সেজে তাদের সামনে যেতে হবে। হেঁটে দেখাও, চুল দেখাও, নখ দেখাও, দাঁত দেখাও এসব দেখানোর জন্য ম্যান্টাল প্রিপারেশন নেওয়াই ছিলো। তবে ঘটনা সেরকম ঘটলো না। ঘরভর্তি মানুষের সামনে গিয়ে আমায় দাঁড়াতে হলো না। কয়েকজন মহিলা এসে আমাকে দেখে গেছে। সুন্দর করে বলতে গেলে বলতে হয় কোশল বিনিময় করে গেছে।
আশেপাশের পরিবেশ তখন রমরমা। কিন্তু যার বিয়ে তারই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভোতা এক অনুভূতি ছাড়া কোনো কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না। কিচ্ছু না। বিয়ে হবে শোনার পরেও না। যেনো এটা হওয়ারই ছিলো। আজ এবং এভাবেই হওয়ার কথা ছিলো। আমি যেনো অপেক্ষায় ছিলাম এমন ঘটনার। বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়া নিয়ে কষ্ট ছিলো না। ভালোবাসাকে না পাওয়া নিয়ে কষ্ট ছিলো না। কারো কথাই ভাবছিলাম না। কোন জগতে ছিলাম জানি না।
বাবা-মা প্রথমে কিছুতেই এভাবে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ছেলের বাবা আর মামার কথায় বাবা নিমরাজি হলেও। মা কিছুতেই রাজি না। কোনোভাবেই একমাত্র মেয়ের বিয়ে এভাবে দিবেন না। তার মেয়ে তার কাছে ভারী হয় নি। কলিজা ছেঁড়া ধন তার। বড়ো আদরের সন্তান। একা এক হাতে মানুষ করেছে। এখনই এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে মা কিছুতেই মেনে নিবে না। কিন্তু জানি না ছেলের সাথে আলাদা কি কথা হলো। কথা বলার পর বাবা সানন্দে রাজি আর মা’ও নিমরাজি! আমার অমতে বিয়ে হয় নি। আমি সজ্ঞানে মত দিয়েছি। সজ্ঞান বললেও তখন জ্ঞান ছিলো কি ছিলো না; জানি না। বাবা-মা এসে মাঝখানে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে জিগ্যেস করলো-আম্মু ছেলে পছন্দ হয়েছে?
আমি ছেলে তখনো দেখি নি। সেটা বললাম না। আমার তো কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। তাই মাথা নাড়ালাম। ছেলে ভালো। আমাদের পছন্দ হয়েছে। এভাবে আমাকে বিয়ে দিতে চায় না। এমন অনেক কিছুই বললো। আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। আমার তো কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। মুনতাজির ভাইকে দেখলাম বড়ভাইয়ের মতো বোনের হঠাৎ বিয়েতে খাটাখাটুনি করছে। অফিস থেকে ফিরে কাপড় বদলানোর সময়টাও পায় নি। ইশশ বেচারা। আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই।
একটুপর সেই ছেলে আসলো। ঘরে ঢুকে নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই মৃদুমন্দ বাতাসে একটা সুন্দর সুবাস নাকে এসে ধাক্কা খেলো। আমি দরজা বরাবর খাটে দুই পা ভাঁজ করে বসা। মাথায় সাদা-গোলাপি মিশেলে উড়না। সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে পাশে জিনিয়া বসা। লোকটাকে আসতে দেখেই সে উঠে বারান্দায় চলে গেলো। ছেলে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো- আসসলামু আলাইকুম। আমি জুনায়েদ সারোয়ার সায়র।
-এই বিয়েতে আপনার আপত্তি আছে?
সুবাসটা এবার শুধু নাকে না সারা রুমে ছড়িয়ে গেলো যেনো। কি অদ্ভুত সুন্দর একটা সুবাস। একদম কড়া না আবার খুব হালকাও না। মেয়েদের সুগন্ধির মতো মিষ্টিও না। অদ্ভুত সুন্দর। এমন সুন্দর ঘ্রাণ এজীবনে আমি আগে কখনো অনুভব করি নি। কাল থেকে আজ পর্যন্ত ওই প্রথম কিছু করতে ইচ্ছে হলো। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হলো- আপনার পারফিউমটার নাম কি মশাই। কি সুন্দর সুবাস। নামটা বলুন তো। মুনতাজির ভাইকে কিনে দিবো একটা। ইশশ আবার মুনতাজির।
আমি লোকটার পলিশ করা চকচকে কালো জুতা, কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট দেখলাম। লোমে ভরা দুটো সুঠাম হাত দেখলাম পকেটে গুজা। ভুড়ি নেই। মাথা নিচু করা অবস্থায় শুধু চোখ তুলে যতটুকু দেখা গিয়েছে তটুকুই দেখেছি। মাথা একটু উঁচু করলেই মুখ দেখা যেতো। ইচ্ছে করলো না। গমগমে গলার আওয়াজ শুনলাম। কথা বলার ঢং-টা সুন্দর। যেনো স্কেলে মেপে মেপে কথা বলে। শুনতে ভালো লাগে। নামের পরে একটু সময় নিয়ে প্রশ্ন করেছে। আপত্তি আছে? নাহ। আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। ব্যস হয়ে গেলো বিয়ে।
এখন আমার জীবনে মুনতাজির ভাইয়ের কোনো জায়গা নেই। এখন আর রোজ নিয়ম করে তাকে নিয়ে ভাবতে বসা হবে না। তাকে দেখা হবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখা হবে না। আমার জীবনে তার আর কোনো অধিকার নেই। এতে যে স্বামী নামক মানুষটাকে। ঠকানো হবে।
তবে আফসোস রয়ে গেলো। ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার। বলতে না পারার। আমি ভালোবেসেছিলাম তাকে। সে তো বাসে নি। বাসে নি বলেই আমার বিয়েতে বত্রিশ দাঁত কেলিয়ে ঘুরতে পারছে। থাক। কিছু না পাওয়া, না পাওয়াই থাক। আপনাকে নিয়ে আর লেখবো না মুনতাজির ভাই। আপনাকে নিয়ে লেখা ডায়েরিটা যাওয়ার সময় ফেলে রেখে যাবো। কবুল বলার সাথে সাথেই আমার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। সেখানে আপনার কোনো স্থান নেই। ভালো থাকবেন মুনতাজির ভাই। খুব ভালো থাকবেন।
মুনতাজির ভাই…আমার বুকে কাঁপন ধরানো প্রথম পুরুষ। আমার কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম। কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম হয় বসন্তের প্রথম কুঁড়ির মতো। যাকে নিয়ে কিশোরী মনে প্রথম প্রেমের মাল্য গাঁথা হয়। আমিও প্রথম প্রেমের মালা গেঁথেছিলাম; মুনতাজির ভাইকে নিয়ে। খুবই নিরবে নিভৃতে। তাকে ভেবে ভেবে যে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। তার কোনো হিসেব নেই। প্রথম প্রেমের অনুভূতি হয় অনন্য। অথচ তার প্রেমে পড়ে আমি প্রতিবার মরমে মরেছি। মুনতাজির ভাই আমার সেই আবেগ যার থেকে পাওয়া আঘাতে জর্জরিত হয়ে দুঃখের মহাসাগরে তলিয়ে গেছি। আসলে এ-তো হওয়ারই ছিল। বলা হয় প্রেম যদি সুখের হয়,তবে তা স্বপ্ন। আর যদি কষ্টের হয়,তবে তা বাস্তবতা। আর বাস্তবতা বলেই কষ্ট পেয়েছি। গল্প হলে হয়তো কাহিনিটা অন্যরকম হতো।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। মা হাইস্কুলের শিক্ষিকা; বাবা প্রবাসী। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় খুব আদরে-আহ্লাদে বড় হয়েছি। যদিও বাবা প্রবাসে থাকার দরুণ বাবার আদর খুব একটা পাই নি। মুনতাজির ভাই আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে। ফর্সা,লম্বা, এলোচুলের সুদর্শন এক পুরুষ। আমার স্বপ্ন পুরুষ। তারা তিন ভাই-বোন। নিভা আপু,মুনতাজির ভাই আর জিনিয়া। মুনতাজির ভাইয়ের মা মমতা আন্টি,নামের মতোই মমতাময়ী। আমাকে খুব আদর করেন। ওই পরিবারের সবাই আমাকে খুব পছন্দ করে। স্নেহ করে। একমাত্র আসল মানুষটা ছাড়া। মুনতাজির ভাইয়ের ছোটবোন জিনিয়া আর আমি বেস্টফ্রেন্ড। দুজন দুজনের সব পেটের খবর জানি। ওকে একটা মশা কামড়ালেও এসে আমাকে বলবে- দোস্ত আজ একটা দানব আকৃতির মশা তোর বেস্টুর শরীর থেকে ১লিটার রক্ত খেয়ে নিয়েছে। কি করি বলতো?
-মাত্র ১লিটার! কমই তো জিনি। মশাদেরও তো ক্ষিধে পায় বল। ওদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে।
-হুমম…ঠিকই তো। কিন্তু তোর চিক্কু বেস্টুর শরীর থেকে ১লিটার রক্ত খেয়ে নিলো তা নিয়ে তোর কোনো আফসোস নেই?
-থাকবে না কেনো। অবশ্যই আছে। তুই হলি আমার বুজম ফ্রেন্ড। তোর কষ্টে অবশ্যই আমি কষ্টিতবোধ করছি। তাই আমার শরীর থেকে ১লিটার রক্ত আমি তোকে দিয়ে দিলাম। হুশ.হুশ.ফুশ ল্যামেন জুশ…ছুহ…নে দিয়ে দিলাম।
-আয় তো এবার বুকাবুকি করি।
স্বভাবতই আমি চুপচাপ, শান্তশিষ্ট, লাজুক প্রকৃতির আমি। তবে একমাত্র জিনিয়ার সাথেই আমার ভিন্নরুপ প্রকাশ পায়। দুজন দুজনের পেটের কথা জানলেও মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতির কথা জিনিয়া জানে না। কাউকেই জানানো হয় নি। মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতি সেভাবে কখনো প্রকাশও করা হয় নি। তার প্রতি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা সবটাই ছিলো মনে মনে। কবে কখন কিভাবে মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে জানি না। খালি একসময় খেয়াল করলাম তারজন্য ভাই ভাই ফিলটা আর আসছে না। ‘মুনতাজির ভাই’ না শুধু মুনতাজির বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়। কেউ বিশ্বাস করবেন না, একসময় তাকে আমি দু-চোখে সহ্য করতে পারতাম না। সে ছিলো আমার দুশমন। কিন্তু কি হলো জানি না। হঠাৎ খেয়াল করলাম বদের হাড্ডি, খামখেয়ালি, এলোমেলো মানুষটাকে আমার ভালো লাগছে। একসময়কার তার সব বিরক্তিকর কাজগুলো ভালো লাগছে। এই যে অযথা ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করে চিল্লাচিল্লি করছে এসব আমার ভালো লাগছে। আগে বিরক্ত লাগতো। গোসল করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে গান গাইছে, আমার ভালো লাগছে। ধুমধাম করে হাঁটা আমার ভালো লাগছে। যাওয়া আসার সময় লোহার গেটটা “ধাঙঙঙ” শব্দ করে আটকানোও আমার ভালো লাগছে। অথচ এসব আমার একসময় বিরক্ত লাগতো। ভালো লাগার মতো কিছু না,যে ভালো লাগবে। এগুলোর জন্য কতবার মাকে বলেছি বাসা পাল্টাতে। মা পাল্টায় নি। বাসাটা সেফ আর মমতা আন্টির ভরসায় আমাকে রেখে মা নিশ্চিন্তে স্কুল যেতে পারছে। এখন এই বিরক্তিকর বিষয়গুলোই আমার ভালো লাগা। একরাশ ভালো লাগা।
আমি কান পেতে থাকি মুনতাজির ভাইয়ের অনর্থক চিল্লাচিল্লি শোনার জন্য। ম্যা ম্যা ম্যা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো চিল্লানিতে বিরক্ত হয়ে আন্টি দুরুম-দারুম করে দামড়া ছেলের গায়ে কিল বসিয়ে গজগজ করতে করতে কাজ করছে। এগুলো দেখে ফিক করে হেসে ফেলছি। মানুষটা লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি বেঁয়ে ধক-ধক করে যখন ছাঁদে উঠে, আমার বুকের ভিতরেও তখন ধক-ধক করে উঠে। সে বাইরে গেলে চাতক পাখির মতো তার ফেরার অপেক্ষা করি। “ধাঙঙ” করে গেটের উপর দিয়ে যখন তুফান বয়ে যায় তখন বুঝি সে এসেছে।
বলে না Opposites attract. মানুষটার সবকিছু তুফানের মতো। শান্ত হয়ে কিছু করতেই পারে না। আমি যতটা শান্তশিষ্ট। সে ততোটাই অশান্ত। আমি যতোটা গোছালো,সে ততটাই অগোছালো। আমি নিরব থাকতে পছন্দ করি। তিনি সবসময় লাউড। সুন্দর করে গুছিয়ে সবকাজ করার বেশ সুনাম আছে আমার।
সে যাইহোক। মুনতাজির ভাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা। তার অনুপস্থিতিতে সবার অগোচরে তার ঘরে গিয়ে তার জিনিস ছুয়ে দেখা। তার পড়নের টি-শার্টের ঘ্রাণ নেওয়া আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। তার ঘর থেকে তার একটা টি-শার্ট চুরিও করেছি। কাউকে বলবেন না যেনো। মুনতাজির ভাই জানলে চুন্নি বলে গালাগালি করবে। চুরি করাটা একটু বেশি হয়ে গেছে কি? হলে হোক। মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসাটাও তো বেশি বেশি।
তুমুল এক বৃষ্টিমুখোর দিনে। মানুষটার পছন্দের ল্যাটকা খিচুড়ি আর কষা মাংস নিজের হাতে রান্না করলাম। বাউন্ডুলে নিষ্ঠুরটা বৃষ্টির দিনে এসব খেতে খুব পছন্দ করে। এই যে আমি তার এই ছোট ছোট বিষয়গুলোও নজরে রাখি নিষ্ঠুরটা তাও জানে না। বাউণ্ডুলে নিষ্ঠুরটার সবকিছু আমার নখ দর্পনে। এই যে তার বৃষ্টির ধাঁচ সহ্য হয় না। আমি জানি। জানা তো তারও আছে। কিন্তু সে মানলে তো। দাম্ভিক গোছের রামছাগল বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে বাসায় ফিরলো। আমি সবে রান্না শেষে ঘরে ঢুকছি। ঠিক এই মুহূর্তে তার আগমন। সেই মুহূর্তে একটা ইচ্ছে জাগলো। কি জানেন? ইচ্ছে হলো বিয়ের পর এমনই কোনো বৃষ্টিমুখোর দিনে সদ্য বর্ষায় ভেজা একগুচ্ছ কদম নিয়ে ভিজে ভিজে আসবে। আমি তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো। সে আসতেই শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছিয়ে শাসন করবো। কেনো সে আমার কথা শুনে না। জ্বর এলে তার সেবাযত্ন আমি করতে পারবো না। বিনিময়ে সে হাসবে। আমি তার হাসি দেখে ভিতরে ভিতরে মুগ্ধ হবো। কিন্তু বাইরে কপট অভিমান নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। তখন শুধু একগুচ্ছ কদমে হবে না। বেলিফুলের মালা খোঁপায় গুজে যতক্ষণ না আমার রাগ ভাঙাবে; ততক্ষণ অভিমানীর অভিমান ভাঙবে না৷ কিছু প্রণয়সমর মুহূর্তের পর কিছু ভালোবাসাময় সময় কাটবে দুজনের। আগাগোড়া প্রেমাবৃত একটা সংসার হবে দুজনের। মানুষ আসলে কল্পনাতেই সুখী।
তার ভিজে চুল নিজের আঁচল দিয়ে মোছার অভিলাষ নিজের মাঝে গ্রাস করে নিই। মানুষটাকে নিয়ে এমন অনেক ইচ্ছেই আমার আছে। এই যেমন বৃষ্টিতে ভিজলে উনার জ্বর আসবেই। তবুও উনি জ্বরে ভিজবেই। আমি চাই সে ভিজুক। জ্বর আসুক। আমি নিজের ভালোবাসা দিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে তাকে সারাতে চাই। জ্বরের দিনগুলোতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে চাই “ভালোবাসি মুনতাজির। খুব ভালোবাসি।” তার জন্য কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে রান্না করতে চাই। অগোছালো মানুষ সে। তার অগোছালো রুমটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে গোছাতে চাই। শুধু যে তার জন্যেই ইচ্ছে হয় তা না। তার পরিবারকে নিয়েও আমার অনেক ইচ্ছে আছে। এই যেমন আন্টির খুব চিন্তা তার বাউন্ডুলে ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকে নিয়ে। আমি তার চিন্তা কমাতে চাই। ছেলের চিন্তায় অতিষ্ঠ হয়ে যখন চেঁচামিচি করে তখন ইচ্ছে করে গিয়ে জিগ্যেস করি- আন্টি তোমার অগোছালো ছেলেকে গোছানোর দায়িত্ব আমাকে দিবে?
আগেই বলেছি মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতি কখনো সেভাবে প্রকাশ করি নি। তবুও অবচেতন মনে আশা করতাম কোনোভাবে সে আমার অনুভূতিটুকু বুঝোক। কোনো না কোনোভাবে কেউ আমার অনুভূতিটুকু তাকে বলে দিক। কিন্তু তেমন কিছুই হয় নি। কেউ বুঝে নি। এই না বোঝাটা আমাকে কষ্ট দেয়। তাকে বলতে না পারাটাও আমায় কষ্ট দেয়। মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-এই নিষ্ঠুর মানুষ এতো কষ্ট দেন কেনো বলুন তো? কি হয় আমাকে একটু বুঝলে। আমার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করলে কি আপনি পঁচে যাবেন? আপনার বুঝতে না পারাটা আমায় কষ্ট দেয়। আমার কষ্ট আপনি দেখতে পান না? আপনার এই অবুঝপনার নীরব বিষে ধীরে ধীরে আমার ভালোবাসা মরে যাবে।
জানি না অবুঝপনা আমার ছিলো নাকি তার। কিন্তু কথাগুলো খুব করে বলতে চাইতাম। বলতে তো অনেক কিছুই চাইতাম। চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা বলতে চাইতাম। বলতে চাইতাম- “মুনতাজির ভাই…আপনার হাতটা একটু ধরতে দেবেন? আমি হাত ধরলে আপনি পঁচে যাবেন না। বিশ্বাস করুন একটুও পঁচে যাবেন না। এই একটুখানি আপনার হাত ধরবো। এক চিমটি।” এহেন অসংখ্য কথা বলতে চাইতাম। কিন্তু কিছুই বলতে পারি নি। সব কথা আমার ভিতরেই রয়ে গেছে।
মুনতাজির ভাইকে আমি যতোটা পছন্দ করি। তিনি আমাকে ততোটাই অপছন্দ করেন। আমাকে দেখলেই তার চোখমুখ কুঁচকে যায়। যেনো কোনো অশুচি দেখে ফেলেছে। তাকে আমি যতোটা যত্নে ভালোবেসেছি। তিনি আমাকে ততোটা যত্নেই অবহেলা করেছেন।
– এই ছকিনা তুই আমার সামনে আসবি না। তোকে দেখলেই আমার বমি পায়।
এটা কোনো কথা হলো বলুন তো! আমাকে দেখলেই বমি এসে যাবে এতোটা কুৎসিত আমি মোটেই নই। ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে এমন কথা শুনলে কষ্ট হয় না বলুন! মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি। আমি কি সত্যিই এতোটা কুৎসিত? আমি অসুন্দর হলে কি পাড়ার ছেলেরা আমার পিছে ঘুরঘুর করতো! অসুন্দর হলে এতো এতো প্রপোজাল কেনো পাই! মুনতাজির ভাই বাদে সবাই বলে আমি সুন্দর। সবাই আমার বড়ো বড়ো টানা টানা চোখ আর কোমড় ছাড়ানো ঝরঝরে চুলের প্রশংসা করে। এগুলো কি মানুষটা দেখতে পায় না? আমার মুখে নাকি আল্লাহ তায়ালা অনেক মায়া দিয়েছেন। তাহলে সেই মায়া মুনতাজির ভাইকে কেনো ছুঁতে পারে না?
মাঝে মাঝে রাগ করে মনে মনে বলি যাহ বেয়াদব। বাসলাম না তোকে ভালো। কিন্তু হায়রে মন! মন কি আর কথা শুনে। ঘরে এসে বিছানায় মুখ গুঁজে সেই অসভ্যটার জন্যেই চোখের পানি ফেলি।
-কেনো এতো কষ্ট দেন মুনতাজির ভাই। আপনি কি কিছুই বুঝেন না?
মুনতাজির ভাই এপর্যন্ত আমাকে কতোভাবে যে কষ্ট দিয়েছে; তার ইয়ত্তা নেই। কিছু কিছু সময় তো অতিরিক্ত করে ফেলেন। চুল মেয়েদের খুব শখের। চুলেই মেয়েদের অর্ধেক সৌন্দর্য। আমার চুল মাশাল্লাহ অনেক লম্বা, ঘন আর সুন্দরও বটে। চুল নিয়ে দূর্বলতা আমারও আছে। লম্বা, ঘন চুল সামলানো প্যারাদায়ক হলেও; শখ। আর শখের দাম ষোলআনা। বেশিরভাগ সময় বেণি করে রাখতাম। সেই বেণি ধরে টান দেওয়া মুনতাজির ভাইয়ের অভ্যাস। আগে বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে তিনি বেণি ধরে টান দিলেই একরাশ লজ্জা এসে ভর করতো আমার মাঝে। মনে হতো এই বুঝি আমার হৃদপিন্ড লাফিয়ে বের হয়ে এলো।
একদিন ভেজা চুল ছেড়ে ছাঁদের রেলিং-এ বসে আচার খাচ্ছিলাম। আমার সাথে নিভাপু আর জিনিয়াও ছিল। কোত্থেকে নিষ্ঠুরটা এসে কথা নেই বার্তা নেই, কেঁচি দিয়ে ঘ্যাচ করে একমুঠ চুল কেটে দিলো। কাঁটা চুল নিয়ে সেদিন পাগলের মতো কেঁদেছিলাম। অথচ পাষাণটা এসে একটাবার সরিও বলে নি। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন ভীষণ।
তবুও তার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে নি। জানি না কখন কিভাবে তার প্রতি অনুভূতি জন্মেছে। ওই যে বলে না, ভালোবাসতে কোনো কারণ প্রয়োজন হয় না। আমিও মানুষটাকে অকারণেই ভালোবেসেছি। কোনো প্রতিদানের আশায় ভালোবাসি নি ঠিকই। তবে চেয়েছি সেও আমায় ভালোবাসুক। ভালো না বাসতে পারুক অন্তত আমাকে সম্মান করুক। ভালোবাসার বিনিময়ে তার কাছে অসম্মান আমার কখনোই প্রাপ্য নয়।
কিন্তু মানুষটা আমাকে তাইই দিয়েছে। প্রেমের এক নির্মম অবশ্যম্ভাবী নিয়ম আছে। যাকে ভালোবাসা হয় তার কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাওয়া হয়। আর আমার ভালোবাসা তো ছিল একতরফা। আমাকে তো পেতেই হতো।
একদিন বাসায় তার কিছু বন্ধু আসে। আমি জানতাম না। কাউকে দেখি নি। মা মরিচ আনতে বলায় আন্টির কাছে গিয়েছিলাম মরিচ আনতে। টানা বেলকনি। বেলকনি দিয়েই তাদের কিচেনে যাওয়া যায়। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম আন্টির সাথে তর্কাতর্কি করছে। কেনো আমি যখন তখন তাদের বাসায় যাই। ভাড়াটিয়া ভাড়াটিয়ার মতো কেনো থাকি না। সৌভাগ্য বলবো না দূর্ভাগ্য বলবো জানি না। গ্যাস না থাকায় সেদিন মা বাসার পিছনের মাটির চুলায় রান্না করছিলো। শুনলে কি হতো জানি না। মুনতাজির ভাইয়ের কাছ থেকে অপমান-অবহেলা, কষ্ট অনেক পেয়েছি। কিন্তু সেদিনের কষ্টের পরিমাণ যেনো একটু বেশিই ছিলো। ভাড়াটিয়া! তিনি একটু অহংকারী জানতাম। তার সবকিছু আমার নখ দর্পনে হলেও তার দাম্ভিকতা এই পর্যায়ের জানা ছিলো না। আমরা তার কাছে কেবল ভাড়াটিয়া সেদিনই প্রথম জানলাম। ভাড়াটিয়া বলেই এমন ব্যবহার; সেই কারণ সেদিনই উদ্ধার করলাম। আর এইরকম একটা শিক্ষা আমার পাওনা ছিলো।
তার সব ভালো খারাপ মেনে নিয়েই তাকে ভালো বেসেছিলাম। তার এতো এতো খারাপ ব্যবহারে আমি কষ্ট তো অনেক পেয়েছি। কিন্তু শিক্ষা হয় নি। এবার হয়েছে। আমার লজ্জা-আত্মসম্মানবোধ কম ছিলো বোধহয়। বোধহয় না। সত্যিই কম ছিলো। নাহলে এতকিছু হতোই না। একতরফা ভালোবাসা ধীরে ধীরে আত্মসম্মান কেঁড়ে নেয়। বলা হয় ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না। কিন্তু তার অবহেলা আমার ভালোবাসাকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলেছে। তার অপমান, অবহেলার ঝড় আমার ভালোবাসার ছোট্ট নৌকাটা একেবারে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে।
ওই ঘটনার পর থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিলাম। চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় কেউ আমলে নেয় নি। মুনতাজির ভাইকে নিয়ে আমার সমস্ত জল্পনা-কল্পনাও নিজের মাঝেই ছিলো। তাই কেউ কিচ্ছুটি বুঝতেও পারে নি। মুখচোরা, আহ্লাদি, ভীতু হওয়ার পাশাপাশি আমি বড্ডো অভিমানী।
সেই ঘটনার পর অনেকদিন চলে গেছে। মুনতাজির ভাই আর আমি দুই মেরুর মানুষ। ভুলে কখনো কাছাকাছি এলেও এক হওয়া অসম্ভব। ভবিতব্য আমি মেনে নিয়েছি। পড়ার অযুহাতে ওদের বাসায় যাওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছি। জিনিয়ার সাথেও আগ বাড়িয়ে মিশতে যেতাম না। তবে ওকে কিছু বুঝতে দিতেও নারাজ ছিলাম। আপাত দৃষ্টিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও। আমার আমিটা সেদিনের পর থেকে স্বাভাবিক রইলাম না। সেই আমার আমিটাকে হয়তো আরও গুঁড়ো করা বাকি ছিলো তার।
সেদিন মুনতাজির ভাইয়ের জন্মদিন ছিলো। ততদিনে আমরা মুনতাজির ভাইদের ভাড়াটিয়া থেকে প্রতিবেশী হয়ে গেছি। বাবা বিদেশ থেকে একেবারের জন্য চলে এসেছে। বাবা ফিরে আসার পর আমাদের নিজস্ব বাড়ি হয়েছে। এখন মুনতাজির ভাইয়ের ঠিক পাশের বাড়িটাই আমাদের। আমার। মাঝে মাঝে বাবার সাথে একতলা ছাঁদে গিয়ে যখন সদ্য কাঁচা দালানে পানি দিতাম; নিজের ভিতরেই পৈশাচিক এক আনন্দ অনুভব করতাম। আর ছাঁদে যেদিন মুনতাজির ভাইকে দেখতাম সেদিন তো কথাই নেই। এখন আর আমরা তাদের ভাড়াটিয়া নই।
তো সেদিন জন্মদিন ছিলো তার। আগের আমি হলে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তাকে একনজর দেখার জন্য, একবার উইশ করার জন্য ভিতরে ভিতরে ছটফট করতাম। হাজারটা অযুহাত দাঁড় করাতাম। তবে ওই যে ভবিতব্য আমি মেনে নিয়েছি। ততদিনে নিজের আবেগকেও কন্ট্রোল করা শিখে গেছি। তাই তাকে না দেখেও দিনের পর দিন থাকতে পারতাম। জন্মদিনের দিন নিভাপু, জিনিয়া, তার সব বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে ছাঁদে তারজন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করে। ওরা দুবোন জোর করে আমাকেও নিয়ে যায়। অনেকদিন পর আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়। আমাকে দেখে কেনো জানি কিছুক্ষণ শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। অনেকদিন পর দেখেছে বলেই হয়তো। মনে মনে নিশ্চয় আমাকে অপমান করার পায়তারা করছে। সবশেষে সবাই যখন গিফট খুলে দেখছিলো তখন মুনতাজির ভাই টিটকারী দিয়ে বলে বসে,
– কিরে ছকিনা ফ্রী ফ্রী খেতে এসেছিস। এখন তো খুব বড়লোক হয়ে গেছিস। কিপ্টেমি করে করে রাজপ্রাসাদ তৈরি করে ফেলেছিস। এবার তো থাম।
– মুন একদম বাজে কথা বলবি না। জন্মদিনে কানমলা খাস না।
নিভাপুর কথা তিনি হেসেই উড়িয়ে দিলেন। রাগে আমার শরীর কিড়মিড়িয়ে উঠলো। সবার সামনে এভাবে বলায় কষ্টও পেলাম। শখ করে মায়ের থেকে হাতের কাজ শিখেছিলাম। মায়ের অগোচরে একটু একটু করে যত্ন করে পাঞ্জাবিতে হাতের কাজ করেছিলাম। তার জন্মদিনেই দিবো বলে। পাঞ্জাবিটা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এই কথার পর তা দিলে সস্তা বলে অপমান করবে বলে দেওয়ার সাহস হচ্ছে না। সবার দামী দামী গিফটের ভীরে আমার এতো যত্ন ভালোবাসার জিনিসের মূল্য এই নাকউঁচু মানুষ কোনদিনই দিবে না। একবার ভাবলাম থাক দিবো না। কিন্তু ওই যে সুখে থাকতে ভূতে কিলাচ্ছিলো। তাই দিয়ে দিলাম। সবার নজর তখন আমার গিফটের উপর। নিভাপু অতি উৎসাহী হয়ে পেপারে মোড়ানো গিফট খুলতেই আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এক্ষুণি নিশ্চয়ই গা জ্বালানো কথা বলে আমাকে জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিবে। কিন্তু সবার প্রশংসা শুনে জানে পানি আসে।
কিন্তু মানুষটা যে নিষ্ঠুর, অহংকারী, শুধু ভালোবাসারই অযোগ্য নয় মানুষ হিসেবেও কুৎসিত। সেদিন তারও প্রমাণ দিলো।
-সত্যিই দারুণ হয়েছে। মোড়ের মাথার পাগলা মামার গায়ে দারুণ মানাবে। এগুলো কি আর আমাকে মানায়?
-সত্যিই মুনতাজির ভাই মানায় না। কারো যত্নে গড়া জিনিস আপনার মতো কুৎসিত মানুষের গায়ে মানায় না।
সেদিন প্রথমবারের মতো তার অপমানের এটুকু জবাব দিয়েছিলাম। কতোই আর চুপ থাকা যায় বলুন তো! আর পারি নি। আমার কিশোরী বয়সের আবেগ কিংবা ভালোবাসা যাই বলুন। আমার এতোগুলো বছরের আবেগ-ভালোবাসার এতো নির্মম হত্যা আর মেনে নিতে পারি নি। দরজা বন্ধ করে সেদিন নিরবে কেঁদেছি। পাশাপাশি আমার মনের দরজাও তার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি।
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২৪
জিয়ান প্রপার রেডি হয়ে ঘড়িতে টাইম দেখলো,আরো আধঘন্টা বাকি ফ্লাইটের৷ মোবাইল নিয়ে নয়নাকে ভিডিও কল করলো।
“ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই জিয়ান বুকে হাত দিয়ে বলে,বাব্বাহ আমি ভাবলাম এই মওশুমে টকটকে স্টবেরী কোথা থেকে এলো৷”
“ক্রাশ খেয়েছেন তাইতো? আমি এতোই সুন্দর ক্রাশ খেতে বাধ্য আপনি৷”
“তা শাড়ি পরেছো কেনো?”
“আরেহহ মাথামোটা লোক ঠিক করে দেখুন এটা শাড়ী না। ওড়না। কালারটা জোসসস তাই না?”
“একটু বেশিই জোসসস এতো বেশি জোসস৷ যে কেউ ভুল করে স্টবেরী মনে করে টুপ করে খেয়ে ফেলবে।”
“আমি ভাবছি বিয়েতে ঠিক এই রঙের লেহেঙ্গা পরবো৷”
“বিয়েতে মানে কতবার বিয়ে করতে চাও?”
“মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন আমাদের মধ্যে কি ডিল হয়েছিলো৷ নাকি আমার সৌন্দর্য দেখে মোহ মায়ায় আটকে যাচ্ছেন!”
“জিয়ান নয়নার দিকে সহজ ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে সুন্দরী মেয়েদের আমি বিশ্বাস করি না৷ এরা খুব সহজে ছলনা করতে পারে৷”
“আপনি আসলে মূর্খ। বুঝতে পারছিনা আপনি পাইলট কিভাবে হলেন? এই ব্রেইন নিয়ে তো বিমান ঝাড়ু দেয়ার যোগ্যতা থাকার কথাও না।
” ইউ নো তোমার চেয়ে আমার বয়স বেশি আমার অভিজ্ঞতা বেশি তাই আমি তোমার চেয়ে বেশিই বুঝি।”
“ছাতার মাথা বোঝেন। বেডা মানুষ আসলেই মাথা মোটা! একটা প্রেম করবে ছ্যাকা খাবে৷ তারপর বলবে, মেয়েরা ছলনাময়ী,ধোঁকাবাজ । আপনার প্রেমিকা যখন আপনার নাকের ডগায় বসে আপনার চোখে ধুলো দিচ্ছিলো তখন আপনার এই এত্তো বড় মাথাটা কই ছিলো? এটার মধ্যে কি শুধু শো অফ করার জন্য চুলই আছে নাকি বুদ্ধি বলতেও কিছু আছে?”
“মাইন্ড ইউর ল্যাঙয়েজ। ডোন্ট ক্রোস ইউর লিমিট।”
“রাখেন তো আপনার ইনজেরি৷ শুনেন আমার বুদ্ধিমত এগোলে এবার কিন্তু ট্রু লাভ পেয়ে যাবেন৷”
“নয়না তোমার এইটুকু মাথা তারমধ্যে তোমার চেয়ে লম্মা চুল তার পরেও এতো আজাইরা কথা কিভাবে ভাবো?”
“ও হ্যালো সুনয়না তালুকদার আমার নাম। এইটুকু মাথার মধ্যে আপনার বিশাল মাথার চেয়ে ডাবল ব্রেইন আছে। মাথা বড় হলেই তাতে বুদ্ধি থাকে না৷ ছোট মাথায় বড় বুদ্ধি। মানে বুঝতে পরছেন ছোট মরিচের ঝাল বেশি।”
“এখন তোমার ঝালে ঝলসে যাওয়ার সময় নেই বেব। সুযোগ পেলে একদিন সব ঝাল শুষে নেবো। দেখি কতটা ঝলসে দিতে পারো৷”
“কি বলছেন এসব! সব আমার মথার তেরো হাত উপর দিয়ে গেলো!”
“বাচ্চা মানুষ এসব বুঝবে না। আমার সঙ্গ পেলে তখন আবার এসবে পিএইচডি প্রাপ্ত হয়ে যাবে। জিয়ান এক চোখ টিপে বলে, হানি তখন তো টিচারের মত ভাষণ দিয়েছি তাই এবার বরের মত ট্রিট করলাম কও তো কোনটা ভালো লেগেছে!”
“একটাও না আপনার অভিনয় কাঁচা৷”
“তাই? আসলে আমারও তাই মনে হয়। তবে প্রাকটিক্যালী আমি আবার এসবের মাস্টার বেবি। এখন আমি তোমার কাছে থাকলে তোমার গলার নিচে জ্বলজ্বল করা কালো তিলটার পাশে স্টাম্প দিয়ে দিতাম৷”
“নয়না কিছুটা বিব্রত হলো। লোকটার মুখে কিছু আটকায় না নাকি!”
“লিটল কুইন কি ভাবছো? শুনো চৌদ্দ ঘন্টা ভাবতে থাকো তারপর শুনবো। তবে মনে রেখো তোলা রইলো তোমার প্রাপ্য লাভ বাইট।”
” কন্টাক্ট বিচ্ছিন হলো নয়না। আয়নার সামনে যেয়ে বারবার তিলটা ছুঁয়ে দেখছে আর লজ্জা পাচ্ছে।নিজেই নিজের মাথায় চাপড় মেরে বলে,এসব বাদ দিয়ে এডমিট কার্ড আনতে যা৷ পড়ালেখা কর এই প্লেন ড্রাইভারকে মাথা থেকে বের কর।
নয়না রেডি হয়ে বের হলো৷ স্কুলের গেট দিয়ে ঢোকার আগেই রাস্তার অপজিট সাইডে জিয়ানকে দেখে থমকে গেলো!সাদা শার্ট পরা, তাও বুকের সামনের বাটন খোলা, মনের সুখে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে৷ নয়না রেগেমেগে বোম হয়ে গেলো, একটু বারুদ হলেই জিয়ানকে ছারখার করে দেবে৷ লোকটা আমাকে বোকা বানাচ্ছে! এভাবে ঠকাচ্ছে?আজ তার একদিন কি আমার যতদিন লাগে। গুষ্টির তুষ্টি উদ্ধার করবো আজ৷ আজ বুঝতে পারবে সুনয়না তালুকদার কি চিজ।
নয়না সোজা রাস্ত পার এসে অপর পাশে এসেই শার্টের কলার চেপে ধরে বলে, আপনার সাহস কি করে হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুক খোলা রেখে শার্ট পরে সি’গারেট খাওয়ার!
‘জাহিনের শার্টের কলার চেপে ধরে রাগী কন্ঠে কথাগুলো বলছে,এক ষোড়শী রমনী। পার্পল আর সাদা রঙের মিশ্রণে গাউন পরিহিতা রমনীর চোখে যেনো অগ্নিশিখা।
” আমার শার্ট আমার চিক আমি দেখাবো তাতে আপনার কি?
“আমার কি মানে! অসভ্য লোক আমাকে মিথ্যে বলে এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বখাটেপনা করছেন! একটু লজ্জা নেই আপনার মধ্যে! আমি আপনাকে এতোটা চিপ ভাবিনি৷
‘তুষি এসে বলে,সাইফুল স্যার তোকে ডাকছে কি শুরু করলি! চল তাড়াতাড়ি।
‘নয়না শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে বলে,এখানেই থাকবেন আপনাকে আমি ফিরে এসে দেখে নিচ্ছি৷ আমার সাথে নাটক করা! আপনার নাটক বেটে নাগা মরচি মাখিয়ে আপনাকে না খাইয়েছি তবে আমার নাম পাল্টে রাখবো।
” একটা পিক ক্যাপচার করে গলায় ঝুলিয়ে নিন দেখতে সুবিধা হবে। যত ইচ্ছে তত দেখবেন৷ আর হ্যাঁ নাগা মরচি কিন্তু আমার ভিষণ ফেবারিট ওয়েট করবা খাওয়ার জন্য।
‘নয়না দ্রুত পায়ে স্কুলের ভেতর চলে গেলো৷ রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে চুলগুলো ছিড়ে কুঁচিকুঁচি করে কেঁটে ফেলতে।
“অন্তর বলে,কিরে ভাই তলে তলে এতো দূর? এরজন্যই বলি আমার নায়কের মতো বন্ধু কোন মেয়ের প্রেমে কেন পরে না।
‘ঠিক ধরেছিস রাম ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা। এমন সাহসী মেয়ে পাইনি বলেই এতোদিন প্রেম করিনি৷ জাহিন শার্টের বাটন লাগাতে লাগাতে বলে,তুই চিন্তা কর কোন মেয়ে জাহিন চৌধুরীর কলার ধরে! আমি ইমপ্রেস! উফফ মনে মনে এমন উড়নচণ্ডী মেয়েই তো খুঁজচ্ছিলাম।
” অন্তর কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলে,হতে পারে এই মেয়ে তোকে জিয়ান ভাইয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলছে।
“তোর মাথায় আসলেই কিছু নেই। বলবো যে গোবর নিয়ে ঘুরিস ওইটুকুও নেই তোর মাথায়। আরে নির্বোধ ভাইয়ার পছন্দ ম্যাচিউর সুশীল ভদ্র টাইপ মেয়ে।এমন বাচ্চা আমার ভাই বিয়ে করবে না৷
” তোর প্রেম তো হলো না চল এবার এখান থেকে। নয়ত ওই মেয়ে এসে এবার কি করবে কে জানে৷ মানে মানে কেটে পরি।”
‘আরেহহহহ দ্যা গ্রেট জাহিন চৌধুরী একটা মেয়ের ভয়ে পালাচ্ছে!”
‘চুপ করা শা’লা ভয় না আগ্রহ যাতে বাড়ে আমাকে জানার তাই চলে যাচ্ছি।”
‘শা’লা বলবি না চাইলে সুমুন্দি বলতে পারিস৷”
‘স্যারের রুম থেকে এডমিট কার্ড নিয়ে বের হলো নয়না৷”
তুষি বলে,তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে গুন্ডামী করার সাহস কই পেলি নয়না! দ্যা গ্রেট ভীতু নয়নার এতো সাহস!
“চুপ থাক তুই ওটা হলো ফ্রড। আমাকে কি সুন্দর বলল, তোমার সাথে চৌদ্দ ঘন্টা পর কথা হবে আর এখানে এসে বাচ্চা মেয়েদের সাথে লাইন মারার চেষ্টা করছে! আমার সাথে নাটক করে? আজকে নাটকের গুষ্টিরপিণ্ডি চটকাবো।”
“এটা তোর বর! যাই বলিস দুলাব্রোকে আমার কিন্তু অনেক পছন্দ হয়েছে৷ কি হ্যান্ডসাম দেখতে বল?”
” এটা অপশনাল। এটাকে ডিভোর্স দিয়ে এটার ছোট ভাইকে বিয়ে করবো৷ তারপর প্রতি মূহুর্তে অনুভব করাবো কি হারালো।”
“তাহলে এটাকে আমাকে ড্রপ কর।”
” তোর লজ্জা করে না! এক বেডার কিসটিস খেয়ে আরেক বেডার কাছে যেতে চাস?”
“লজ্জার কি আছে প্রেম হলো পার্মানেন্ট।প্রেমিক হলো ভাতের মত আর ক্রাশ হলো বিরিয়ানি। প্রতিদিন ভাত খেয়ে বোরিং হলে দূর থেকে ক্রাশ খাওয়া যায়।”
” চুপ কর আমার মেজাজ হারাচ্ছি। রিকশা ডাক দ্রুত বাস্তব ফিরবো।”
“তুষি রিক্সা ডেকে নয়না তুলে দিয়ে বলে,আজ দুলাব্রোর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি৷ বেচারা কি যে সহ্য করবে আজ!”
🌿
একটা ছাদের কর্নারে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে লাফ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে নীলাঞ্জনা৷
” আপনি সুইসাইড করতে চাচ্ছেন?” এক মিনিট বলেই একটা চেয়ার এনে বসে পরলো অন্তর৷
‘নীলাঞ্জনা জিঙ্গেসু দৃষ্টিতে তাকালো৷”
“আপনি কি ভেবেছিলেন আপনাকে বাঁচাবো? আরেহহহ না আপনার জীবন আপনি আরামসে শেষ করুন আমি একটু লাইভ দেখি।”
” নীলাঞ্জনা চোখ বন্ধ করে লাফ দেবে ঠিক সেই মূহুর্তে অন্তর বলল ওয়েট। কষ্ট করে একটু বলে সুইসাইড করুন৷ মানে কোন সুখে এই অপকর্ম বেছে নিলেন?”
“আপনাকে বলবো কেনো?”
” তাহলে আমার বাসার ছাদে মরতে আসলেন কেনো মরার জায়গা কি কম পরেছে?”
“নীলাঞ্জনা অসহায় দৃষ্টিতে অন্তরের দিকে তাকালো৷”
” শুনেন যা ভুল করেছেন বা যে আপনার সাথে ভুল করেছে বা যাই হয়ে যাক আত্মহত্যা কোন অপশন না৷ এখান থেকে নামুন আর নিজের বাবা মায়ের কাছে ফিরে যান। মনে রাখবেন, ‘চিরজীবন কেউ পাশে থাকে না৷ কারো অনুপস্থিতিতে নিজের ক্ষতি করার মত ভুল করতে নেই।”
“সকালের আলো ঝলমলে রুমে বসে নীলাঞ্জনা গতকাল রাতের কথা ভেবে নিজেকে সাহস দিলো বাসায় ফিরে যাওয়ার৷ ছেলেটা কত ভালো তাকে নিজের বাসায় আশ্রয় দিলো! পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ বেঁচে আছে বলেই হয়ত জীবনে চলার পথ কিছুটা হলেও সহজ।”
🌿
সানায় তার মামির সাথে রাতের কথা খুলে বলল।
” মিতা বেগম বলেন,এরকম বাচ্চামো করা তোর একদম ঠিক হয়নি।জোড় করে সংসার হয় না। সংসার করার জন্য মনের মিল থাকতে হয়। তুই তো জানিস জাহিন কেমন ও তোকে বোন ছাড়া অন্য কোনভাবে মেনে নেবে না। জানিসই তো একরোখা ছেলেটা আমার।”
“জাহিন এখন কোথায়? রুমেও তো নেই সকাল সকাল কোথায় বের হয়েছে আম্মি?”
” ওর ফেরা আর বের হওয়া কোনটার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। আয় আমরা দুজন নাস্তা সেরে ফেলি।”
পুরোনো স্মৃতির পাতায় ডুবে আছে প্রণীতা। সেই স্মৃতিগুলোই কল্পনার জগতে ঘুরপাক খায়। সে কী ভাবতে পেরেছিল যে সেদিন পার্কে দেখা হওয়া লোকটাকেই সে একদিন মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে? আসলে,আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত নই। যদি হতাম তাহলে হয়তো জীবনটা অনেক সুখের হতো। প্রণীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার জীবনটায় কতকিছু ঘটে গেল। তার বিন্দুমাত্র আঁচ যদি আগে থেকে টের পেতো,তাহলে নিজেকে আর এমন ভালোবাসা নামক অনুভূতিতে জড়াতো না।
ছাদের রেলিং ধরে একাকী দাঁড়িয়ে আছে আহিয়ান। সে নিজের জীবনের হিসেব কষতে ব্যস্ত। সব কষ্ট মেনে নেওয়া যায় কিন্তু আপন মানুষের দেওয়া কষ্ট কখনো মেনে নেওয়া যায় না। তার উপর তিনি যদি হন নিজের আপন বাবা। আহিয়ানের ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে যে সে এমন এক পিতার সন্তান। সে ভাবতে লাগলো জীবনে সে কী পেল! পিতা তাকে হাতের গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়,জীবনে একজনকে ভালোবেসেছিল কিন্তু সেও অন্য একজনের। যাকে বলে মরিচীকার পিছনে ছুটা। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার চোখের কোণে জল। আজ আহিয়ানের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদছে না। কষ্টগুলো বুকের মাঝেই চাপা দিয়ে রেখেছে। সেদিনের ঘটনা…
আহিয়ান বন্দি অবস্থায় ফারাজের নাম শুনে ভীষণ অবাক হলো। তার আর বুঝতে বাকী রইল না যে এই পুরুষটাই প্রণীতার ভালোবাসা। ইসহাক আহিয়ানকে ফারাজের ব্যাপারে সব বলেছিল। সাথে মশলা মিশিয়ে হাবিজাবি অনেক কিছু বলেছে। যার দরুণ ফারাজের সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় তার মনে। সে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফারাজকে বলে,“তার মানে আপনিই আমাকে এখানে তুলে এনেছেন?”
ফারাজ মুচকি হাসে৷ তারপর বন্ধু মিরাভ ও অপর একজনের নাম ধরে ডাক দেয়। ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই তারা এসে হাজির হয়। আহিয়ান মিরাভকে চিনতে না পারলেও সাথে থাকা ছেলেটিকে চিনতে পারে৷ কারণ,এই ছেলেটিই তো তাকে সাহায্যের নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,“বয়স তো বেশি না তোমার। এই বয়সেই এসব কাজে যুক্ত হয়েছো?”
ছেলেটি দাঁত কেলিয়ে হাসে৷ অতঃপর বলে,“আপনি আমার বসের কলিজাকে ভুলে যান,তার পিছু ছেড়ে দিন। তাহলেই আর আপনাকে এসব জালে ফাঁসাব না।”
আহিয়ান অবাক হয়ে তাকায়। তখনই শুনতে পায় ফারাজের কণ্ঠস্বর,“আমার শিষ্যের কিন্তু বুদ্ধি দারুণ। আপনাকে যখন সে নিয়ে আসছিল তখন কৌশলে আপনার নামটা জেনে নেয় ফলে আপনার আসল পরিচয় পেতে আমার সুবিধা হয়।”
তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,“শিষ্য! কীভাবে জানি নামটা জেনেছিলে?”
ছেলেটি তৎক্ষনাৎ বলতে থাকে,“হ্যাঁ,হ্যাঁ! আসলে আমি তো উনাকে বলেছিলাম যে উনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম তাই হুট করেই যদি জিজ্ঞেস করি যে আপনার নাম কী তাহলে তো উনি সন্দেহ করবেন! যে উনাকে চিনি অথচ উনার নাম জানি না৷ তাই আমি এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম,আচ্ছা,আপনার নামটা যেন কী? এই মুহূর্তে ঠিক মাথায় আসছে না। কী যেন নামটা,উফ মনে পড়ছে না কেন!”
আহিয়ান নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার মাথায় কী বুদ্ধি! আজকালকার ছেলে না ওরা? বুদ্ধি তো থাকবেই। ফারাজ বলে,“এই হলো আমার বন্ধু মিরাভ। সে-ই আপনাকে পিছন থেকে মুখে রুমাল চেপে ধরেছিল৷”
এই বলে মিরাভের দিকে তাকিয়ে বলে,“যাহ ব্যাটা! তোকে আজ তোর ইচ্ছেমতো ট্রিট দিবো।”
মিরাভ আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে,“ভালো আছেন?”
আহিয়ান রাগে কটমট করে৷ উত্তপ্ত স্বরে বলে,“আপনাদের এসব ড্রামা দেখার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। আমাকে এখানে কীসের জন্য আনা হয়েছে?”
ফারাজ গম্ভীর স্বরে বলল,“আমার শিষ্য একটু আগে কী বলেছে শুনেননি? আমার কলিজার পিছু ছাড়ুন তো আপনাকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।”
-“আপনার কলিজা মানে?”
-“নাটক করছেন আমার সাথে? আপনি যে আমার ব্যাপারে সব জানেন তা আমার ভালো করেই জানা আছে। ভালোই ভালোই বলছি প্রণীতার পিছু ছেড়ে দিন। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
-“আমি প্রণীতাকে ভালোবাসি। আপনার মতো একজন বিশ্বাসঘাতকের কথায় নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে দিব?”
-“ও তাই? আমি বিশ্বাসঘাতক? আর আপনি যে একজন বিশ্বাসঘাতকের সন্তান? আপনার রক্তে মিশে আছে এক বিশ্বাসঘাতকের রক্ত তার বেলায়?”
আহিয়ানের রাগ বেড়ে যায়। সে হুংকার ছাড়ে,“খবরদার! আমার বাবা বা মায়ের নামে বাজে কথা বলবেন না!”
-“আপনার মা কেমন তা জানা নেই। তবে আপনার বাবা একজন সেরা ক্রি’মি’না’ল। এটাই সত্য। আর আমি সত্য বলতে ভয় পাই না। আপনার নাম শুনেই চিনতে পেরেছিলাম যে আপনি এই ক্রি’মি’না’লে’র সন্তান।”
-“আপনি কীসের ভিত্তিতে আমার বাবাকে ক্রি’মি’না’ল বলছেন? কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”
তারপরই বেরিয়ে এলো প্রমাণ সহ সমস্ত সত্য। চোখের উপর থেকে পর্দা সরে গিয়ে ঝলমল করে উঠল এতোদিনের লুকায়িত কিছু কর্মকাণ্ডের প্রমাণ। আহিয়ানের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে তার বাবা এমন কাজ করতে পারে? এমন নি’কৃ’ষ্ট কাজের সাথে কিনা তার বাবা জড়িত? সে এটাও বুঝতে পারলো প্রণীতার জন্য সে নয় ফারাজ-ই উপযুক্ত। তার ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। তার মতো করে প্রণীতাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না হয়তো সে নিজেও নয়। সে যখন বলেছিল,“আমি তো প্রণীতাকে পার্কে একা রেখে এসেছি। মেয়েটা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
ফারাজ বলেছিল,“সে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না৷ তার সব ব্যবস্থা আমি করেছি।”
তারপর অন্য নাম্বার দিয়ে প্রণীতাকে ম্যাসেজ দেওয়া,বারবার আহিয়ানের বিপদের কথা বলে বাসায় পৌঁছানোর তাগিদ দেওয়া- সবকিছু খুলে বলল সে। এমনকি,প্রণীতা যখন বাসায় যাচ্ছিল তখন সে ও পিছনে একটা গাড়ি করে তার সাথে সাথে যায়, সে ঠিকঠাক যেতে পারল কিনা তা দেখার আশায়।
আহিয়ান ছাদ থেকে নিজের রুমে আসলো। করবে না করবে না ভেবেও প্রণীতাকে ফোন করে বসল। ফোন রিসিভ হতেই সে জিজ্ঞেস করলো,“কেমন আছো,প্রণীতা?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে প্রণীতা কিছুটা বিস্মিত হলো। তবে তা বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,“আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?”
-“আলহামদুলিল্লাহ! আমার উপর কি এখনো রাগ করে আছো?”
-“নাহ! আপনার উপর রাগ করবো কেন? তবে,আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না সেটা শুরুতে বললেই পারতেন।”
আহিয়ান চোখদুটো বন্ধ করে ফেলে। যন্ত্রণা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে তার হৃদয়। সে কী করে বোঝাবে যে সে তাকে কতোটা ভালোবেসেছিল! কিন্তু সে তা বলবে না। ফারাজ প্রণীতাকে ভালোবাসে,প্রণীতাও ফারাজকে ভালোবাসে। এখন হয়তো ঘৃণা করছে কিন্তু সত্যিটা জানার পর আর করবে না। হয়তো আগের চেয়েও তখন ভালোবাসা বাড়বে। আহিয়ান বলল,“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো,প্রণীতা৷ আমার উদ্দেশ্য তেমন নয়। আমি তোমাকে যা বলেছি সব সত্য।”
প্রণীতা অস্থির কণ্ঠে বলল,“আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”
-“আমার কাছে নেই। তবে ফারাজ নিজেই একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ। তুমি তার কাছে যাও। সে তোমায় প্রমাণ সহ সব সত্য বলবে।”
-“আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি আর ফারাজ মিলে আবার আমার জীবনটাকে নষ্ট করতে চাইছেন। আমি আপনাদের বিশ্বাস করি না।”
-“বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে সত্য তুমি বদলাতে পারবে না। তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষই তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছে অথচ সেটা তোমার চোখে পড়ছে না। আর যে তোমায় নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে তার একদিনের দেখানো একটা রূপেই তাকে চিরতরের জন্য ঘৃণা করতে শুরু করলে। একটিবার সত্যতা যাচাই করবে তো? তাকে নির্দোষ প্রমাণের একটা সুযোগ তো দিবে তাই না?”
প্রণীতা চুপ হয়ে গেল। আহিয়ানের কথাগুলো গভীরভাবে তার মস্তিষ্কে গেঁথে বসল। সে কি একটা সুযোগ দিবে? ফারাজ কী বলতে চায় শুনবে? কিছুক্ষণ নীরবতা পালনের পর সে জবাব দিলো,“বেশ,আমি ফারাজকে সুযোগ দিবো। তাকে সব সত্যি বলার সুযোগ দিবো।”
-“শুনে খুশি হলাম। বেস্ট অফ লাক,প্রণীতা।”
এই বলে ফোন কাটল সে। তারপর বলে উঠল,
“পৃথিবীর সবাই ভালো থাকুক
মন দিয়ে করি এই প্রার্থনা
একলা আমি যেমনই থাকি
কেউ তার খোঁজ রাখবে না।”
আহিয়ানের সাথে কথা শেষ হতেই পুনরায় প্রণীতার ফোন বেজে উঠে। প্রণীতা বিরক্ত হলো। কীসের যে ফোন আসা শুরু হয়েছে! সে বিরক্তির সাথে ফোন হাতে নিলো। হাতে নিতেই তার ভ্রু কুঁচকে এলো। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো। আরে,এটা তো সেই নাম্বারটা যে নাম্বার থেকে সেদিন মেসেজ এসেছিল। সে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে। অজানা বিপদের আশংকায় তার মন ছেয়ে যায়। ফোন রিসিভ হতেই ভেসে আসে সেই চেনা কণ্ঠস্বর,“জান! চিনতে পেরেছো আমায়?”
প্রণীতা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। এটা তো ফারাজের কণ্ঠ। তার মানে এটা ফারাজের নাম্বার! আর সেদিন ফারাজ-ই তাহলে আহিয়ানকে আটকে রেখেছিল? কিন্তু কেন? সে কি কোনোভাবে আহিয়ানের সাথে তার বিয়ের কথা জানতে পেরেছে আর তার জন্যই কী….
সে আর ভাবতে পারলো না। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,“আপনি!”
-“প্লিজ জান,আমায় আর আপনি ডেকো না। তোমার মুখে সেই মিষ্টি তুমি ডাকটা শুনতে চাই।”
প্রণীতা কিছুটা হতভম্ব হলো। কী ব্যাপার,ফারাজ কি এসব বলার জন্যই তাকে ফোন দিয়েছে? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য? তার ধ্যান কাটে ফারাজের পরবর্তী কথায়,“শুনতে পারছো,জান? শুনো,তোমাকে একটা এড্রেস ম্যাসেজ করে পাঠাচ্ছি। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই আহিয়ানকে সাথে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হবে। তোমাদের দুজনের জন্য একটা বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।”
-“সারপ্রাইজ?”
-“হ্যাঁ। অবশ্য সারপ্রাইজটা দেখে খুশি হবে না। কিন্তু সত্যিটা তোমায় অবশ্যই জানতে হবে। যদি এই অধমকে শেষবারের মতো একটি সুযোগ দিতে পারো,তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করে এসে পড়ো। কেমন?”
কথাটুকু শেষ করে ফোন কাটল ফারাজ। প্রণীতা কথা বলার আর সুযোগ পেল না। সে পড়েছে দ্বিধায়। এই সত্যি সত্যি শুনতে শুনতে তার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কীসের এতো সত্যি লুকিয়ে? সে বুঝতে পারে না। তার মস্তিষ্ক শূণ্য হয়ে যায়। সে ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়।
__________________________
আহিয়ানকে নিয়ে ফারাজের পাঠানো এড্রেসে উপস্থিত হলো প্রণীতা। তাদের আসতে দেখে ফারাজ আনমনে হাসলো। তবে খারাপও লাগল একটু। নিজেদের জন্মদাতার এরূপ পরিস্থিতি কোন সন্তানই বা সহ্য করতে পারে? ফারাজ তাদের নিয়ে নির্দিষ্ট রুমের দিকে অগ্রসর হয়। রুমে প্রবেশ করা মাত্রই প্রণীতার শরীর কেঁপে উঠে। স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তার সামনেই তার বাবাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সাথে আহিয়ানের বাবাকেও। আহিয়ান কষ্ট পেল তবে অবাক হলো না। কারণ,সে এমন পরিস্থিতির কথা আগে থেকেই ঠাহর করতে পেরেছে। ফারাজ যে এতো সহজে তাদের ছাড়বে না তা সেদিনই সে বুঝতে পেরেছে। ইসহাক ও আহিয়ানের বাবা রহমানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুলিশ। প্রণীতা চিৎকার করে উঠে,“বাবা! তোমার এই অবস্থা কেন? তোমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন?”
ইসহাক মাথা নিচু করে বসে আছে। দুচোখ হতে টুপটুপ করে অশ্রু ঝরছে। প্রণীতা দৌড়ে ইসহাকের কাছে যেতে চাইলে ফারাজ তার হাত টেনে ধরে। বলে,“দাঁড়াও৷ এতদূর এসেছো,সত্যিটা শুনবে না?”
প্রণীতা ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে বলল,“আপনিই আমার বাবাকে এখানে বেঁধে রেখেছেন তাই না? আপনার এতো বড় সাহস যে আপনি আমার বাবার সাথে শেষমেশ শত্রুতা শুরু করেছেন? কী চান আপনি? আমার জীবনের সুখ শেষ করে আপনার শান্তি হয়নি? এখন আমার বাবার পিছনে লেগেছেন?”
ফারাজ স্থির চোখে চেয়ে বলল,“শান্ত হও,প্রণীতা…
প্রণীতা উচ্চস্বরে বলে উঠে,“কীসের শান্ত হব আমি? আপনি একটা ঠকবাজ,প্রতারক,বিশ্বাসঘাতক। আমার জীবনের একটা বাজে অধ্যায় আপনি। আপনি..
-“প্রণীতা!”
ফারাজ ধমকে উঠে।
-“এতোক্ষণ ধরে তুমি কথা বলেছো। এখন আমায় বলতে দাও। এর মাঝে একটা কথাও তুমি বলবে না।”
ফারাজ সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। আহিয়ানকে বিশেষভাবে দেখে। ছেলেটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজের মায়া হলো। তবে কিছুই করার নেই। অন্যায়কে সে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে শুরু করে,“ইসহাক উদ্দিন উরফে আমার হবু শ্বশুরমশাই আর উনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রহমান সাহেব,এই দুজন দীর্ঘদিন যাবৎ অবৈধ কালোবাজারের সাথে যুক্ত। তারা বিদেশের এক মাফিয়া গোষ্ঠীর সাথে চুক্তিবদ্ধ। সেখানে তারা আমাদের দেশের খাদ্যদ্রব্য,ওষুধ এবং বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ পাচার করছে। ফলস্বরূপ,আমাদের দেশের মানুষের কপালে জুটছে নকল ওষুধ,ফরমালিন যুক্ত খাবার এবং খাবারের দাম অগণিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসবের মূলে রয়েছে এরা দুজন। এই অবৈধ ব্যবসাটা প্রথমে শুরু করেন রহমান সাহেব। তিনিই এই কাজে ইসহাক উদ্দীনকে পার্টনার হিসেবে রাখেন এবং টাকার লোভে তিনিও রাজি হয়ে যান। এখন কথা হচ্ছে আমি এতসব জানলাম কী করে?”
এই বলে ফারাজ থামে। ফের বলতে শুরু করে,“আমি আমার বাবার ব্যবসা টুকটাক দেখাশোনা করি ঠিক আছে। কারণ,ভাইয়ার উপর বেশি চাপ পড়ে যায় তাই আমিও একটু সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার পাশাপাশি আমার আরও একটা পরিচয় আছে। সেটা হলো আমি একজন ইন্টিলিজেন্স অফিসার। এই পরিচয়টা আমি গোপন রেখেছিলাম সবার কাছে। তখন,আমাদের সংস্থা থেকেও এই কালোবাজারের সাথে যুক্ত আসামীদেরকে খোঁজার দায়ভার আমাদের একটা দলের উপর দেওয়া হয়েছিল। আমরা খুঁজতে শুরু করলাম৷ এবং ভাগ্য ভালো থাকায় আমিই সর্বপ্রথম তাদের খোঁজ পেলাম। কিন্তু হাতে যথাযথ প্রমাণ না থাকায় কোনো স্টেপ নিতে পারছিলাম না। তখন আমাদের দলের সদস্যরা জানতে পারে তারা বাইরের একটা দেশের মাফিয়া গোষ্ঠীর সাথে চুক্তিবদ্ধ। ব্যস,সেই থেকেই আমার খেলা শুরু।”
-“আপনি মিথ্যা বলছেন। আমার বাবা কখনো এমন কাজ করতেই পারে না। আপনার কথা সব মিথ্যে,সব।”
প্রণীতার কণ্ঠে জেদ। আহিয়ান ফোস করে শ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,“ফারাজ কিছুই মিথ্যা বলছে না। তার কাছে প্রমাণ আছে।”
ফারাজ বলে,“আমার শ্বশুরমশাই বড্ড চালাক ছিলেন। এই এতোসব কিছু আমি জানতে পারি যখন আমার জীবনে প্রণীতার প্রবেশ ঘটে। প্রণীতার বাবাও আমাকে চিনতেন। তিনি একদিন বুঝে ফেলেন যে উনার এসব কারসাজির কথা আমি জেনে গেছি। কিন্তু আমার আসল পরিচয়টা বুঝতে পারেননি। যার ফলে তিনি একদিন আমায় থ্রেট দেন যেন আমি প্রণীতার জীবন থেকে চলে যাই,তাকে যেন ভুলে যাই। আর এই সত্য ফাঁস করলে তিনি নাকি আমাকে আর আস্ত রাখবেন না। তিনি এটা জানতেন না যে আহসান চৌধুরী ফারাজ এসব হুমকিতে ভয় পায় না। আমি সেদিন উনাকে কিছু বলিনি। আর উনিও আবার উনার বন্ধু রহমান সাহেবের ছেলে আহিয়ানের সাথে প্রণীতার বিয়ের কথা ভাবতে থাকেন। কারণ,এতে করে উনাদের মাঝে সম্পর্কের ভিত্তিটা আরও মজবুত হবে। রহমান সাহেব উনাকে বলেন প্রণীতাকে যদি উনার ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে উনি মোটা অঙ্কের টাকা দিবেন। আর সেই লোভে ইসহাক উদ্দীনও রাজি হয়ে যান। এদিকে,রহমান সাহেবের কু’নজর পড়েছিল প্রণীতার উপর। তিনি খারাপ উদ্দেশ্যেই মূলত প্রস্তাবখানা রাখেন। কী তাইনা রহমান সাহেব?”
রহমান মাথা নিচু করে রেখেছে। মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও বের হচ্ছে না। কী বলবেন তিনি? বলার মতো কোনো ভাষা আছে? ফারাজ হাসে। বলে,“একদিকে তখন প্রণীতার চিন্তা অন্যদিকে সেই দেশটিতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা,এই দুইয়ের মাঝে পড়ে নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছিল। আমি চাইলেই প্রণীতাকে সব বলতে পারতাম। কিন্তু নিজের বাবার সম্পর্কে প্রমাণ ছাড়া কথা কি সে বিশ্বাস করবে? তাই বলিনি। তখন আমার বন্ধু মিরাভ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি যখন বাইরের দেশে চলে গেলাম,সে তখন প্রণীতার উপর নজর রাখতো। প্রণীতা কোথায় যাচ্ছে,কী করছে,তার কোনো বিপদ হচ্ছে কিনা সবকিছুর খেয়াল রাখতো। তার উপর আমার বিশ্বাস ছিল প্রচুর। এদিকে আমি বাইরের দেশে এসে বিপদে পড়ি। যে অবস্থা দেখতে পাই তাতে মনে হয় দীর্ঘদিন থেকে তারপর সত্য উদ্ধার করতে হবে৷ তখন আমার মনে চিন্তার উদয় হয়। এতোদিনে যদি প্রণীতার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়? প্রণীতার উপর আমার বিশ্বাস ছিল যে সে আমায় ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করবে না। কিন্তু তবুও ভয় হতো। তখনও মিরাভ আমায় আশ্বাস দেয়। সে বলে,প্রণীতার যদি বিয়ে ঠিকও হয় তাহলে সেই বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব তার। আমি মূলত তার উপর আর আমার আল্লাহর উপর ভরসা করেই মিশনে নেমেছিলাম। আর দেশে ফেরার পর প্রণীতাকে না চেনার ভান করেছিলাম কারণ এতে করে ইসহাক উদ্দীন বুঝেছিলেন আমি হয়তো সত্যিই প্রণীতাকে ভুলে গেছি। তাই তিনি আর আমাকে বিশেষ পাত্তা দেননি। আর উনার এই পাত্তা না দেওয়াটাই আমার কাজে এসেছিল। আমি আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছি।
প্রণীতা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে সব শুনছে।।পুরো জগতটাকেই কেমন বিষাক্ত মনে হচ্ছে। নেতিয়ে আসা শরীরটা পড়ে যেতে চাইলে ফারাজ তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলে। অস্থির কণ্ঠে শুধায়,“প্রণীতা,তুমি ঠিক আছো?”
প্রণীতা কিছু বলে না৷ কোনোরকম দাঁড়ানোর চেষ্টা করে৷ দুচোখভর্তি অশ্রু নিয়ে বলে,“আপনি সব সত্যি বলছেন? আমার বাবা আর রহমান চাচা এতোটা খারাপ?”
ফারাজ অসহায় কণ্ঠে বলে,“আমি জানি,তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাই সত্যি।”
ফারাজ তারপর একটা সিসিটিভি ফুটেজ অন করে। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইসহাক ও রহমান মালামাল গাড়িতে তুলছে। সাথে একটা গুদামও আছে যেখানে তারা সব মাল সংরক্ষণ করে রাখে। এছাড়াও তার কাছে প্রমাণস্বরূপ আছে অবৈধভাবে লেনদেন হওয়া বিশাল অঙ্কের টাকার রেকর্ড,বিদেশে ইসহাক গোপনে একটা একাউন্ট খোলেছিল সেই একাউন্টের তথ্য। সাথে আছে মাফিয়া গোষ্ঠীর লিডার যে কিনা সবকিছু নিজ মুখে স্বীকার করেছে তার একটি ভিডিও ক্লিপ। কারণ,লিডারের সাথে তারা শেষে প্রতারণা করেছিল যার দরুণ তিনি সব স্বীকার করেন। এসবকিছু সংগ্রহ করতে ফারাজের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
প্রণীতা অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটুমুড়ে বসে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“বাবা,ও বাবা! ফারাজ এসব কী বলছে? আমি,আমি জানি এসব মিথ্যা,এসব ওর বানানো৷ আমি জানি তুমি কখনো এসব কাজ করতে পারো না। তুমি বলো না যে তুমি নির্দোষ,একটিবার বলো বাবা!”
ইসহাকের পিতৃজীবনের হয়তো এখানেই ইতি ঘটবে। তিনি আজ ভুগছেন চরম অনুশোচনায়। এইযে সন্তানের চোখের সামনে অপরাধী হওয়াটা যে উনাকে কতোটা কষ্ট দিচ্ছে এটা যদি আগে বুঝতে পারতেন! কিন্তু লোভের বশে তিনি ছিলেন অন্ধ। আহিয়ান তার বাবাকে বিশেষ কিছু বলল না। বাবা ডাকলেন তবুও গেল না। সে সেখান থেকে চলে গেল। অতঃপর আর কী,দুজনকে ধরে নিয়ে গেলেন পুলিশ দল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নয়তো ফাঁসিই হবে তাদের পনিণতি। প্রণীতা চিৎকার করে কাঁদল কিন্তু বাবাকে আর পেল না।
______________________
কেটে গেছে বেশ অনেকদিন। কারো জন্য কারো জীবন আটকে থাকে না। সবাই যার যার মতো দিন অতিবাহিত করছে। প্রণীতার মা হাফিজা ও স্বামীর শোক কাটিয়ে উঠেছেন। আহিয়ানের মা ও তাই। পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়াই প্রযোজ্য। তাদের জন্য কষ্ট পাওয়া সাজে না।
আজ ফারাজ আর প্রণীতার বিয়ে। ইতিমধ্যেই বিয়ে পড়ানো শেষ। তারা এখন স্বামী-স্ত্রী। হাফিজাকে তারা সাথে নিয়ে যাবে। হাফিজা প্রথমে আপত্তি করলেও ফারাজের জোরাজোরিতে রাজি হন। তিনি এখন থেকে মেয়ের সাথেই থাকবেন। আহিয়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সব৷ বিড়বিড় করে বলল,“আমার ভালোবাসার সুখ মানেই আমার সুখ। সে সুখী হলেই আমি সুখী। নাই বা হলো আমার,হোক না সে অন্যকারো। তার মুখে হাসি তো ফুটেছে। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”
বাসর ঘরে ফুল দ্বারা সজ্জিত বিছানায় বসে অপেক্ষা করছে প্রণীতা। বুকের ভিতর দ্রিমদ্রিম আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ দরজা লাগানোর আওয়াজ এলো। না তাকিয়েও বুঝতে পারলো ফারাজ এসেছে। ফারাজ যতোই তার দিকে এগোচ্ছে,তার হৃদকম্পন ততোই বাড়ছে। হাত-পা অনবরত কাঁপছে। ফারাজ বিছানায় এসে তার কাছে বসল। দুহাতে ঘোমটা সরিয়ে কপালে শব্দ করে চুমু খেল। ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল,“আমার বউ!”
প্রণীতা লজ্জায় হাসফাস করে উঠে। মুখ রক্তিমবর্ণ ধারণ করে। সে কিছু বলতে চাইলে ফারাজ তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে,“হুশ! কোনো কথা নয়। আজ আমি কোনো কথা শুনব না৷ অনেক কষ্ট করে পেয়েছি তোমায়। আমার অনেক কষ্টের ফল তুমি। তাই আজ সারারাত শুধু ভালোবাসা চলবে। আমার আদরে তোমার প্রতিটি অঙ্গ সিক্ত হবে।”
ফারাজ যতোই কাছে আসছে প্রণীতার নিঃশ্বাসের পরিমাণ গাঢ় হচ্ছে। ফারাজের তপ্ত শ্বাস তার গায়ে আছড়ে পড়ছে। ফারাজ ধীরে ধীরে প্রণীতার গা হতে সমস্ত গহনা খুলে রাখলো। তারপর তার মাথা ঠেকলো বালিশে। মুহূর্তের মাঝেই প্রণীতার অধরে অধর মেশালো ফারাজ। ধীরে ধীরে সেই চুম্বন ঠোঁট হতে গলায়,গলা হতে সমস্ত দেহে নেমে আসলো। প্রণীতা বিছানার চাদর খামচে ধরে। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সমার্পিত করে তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে যার প্রতিটি স্পর্শে সে সুখ খোঁজে পায়।
ভোরের আলো ফুটেছে এই কিছুক্ষণ হলো। সেই সাথে শুরু হয়েছে পাখিদের কিচিরমিচির। প্রণীতার ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ দেখতে পায়। ফারাজ তাকে শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। যেন ছাড়লেই পালিয়ে যাবে। নিজেদের বস্ত্রবিহীন অবস্থা দেখে লজ্জায় জান যায় যায় অবস্থা তার। একটুতেই সে লজ্জা পায়। তার উপর রাতে যা হলো….
সে আর ভাবতে পারলো না। সে নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে গোসল করলো। গোসল করে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই হুট করে ফারাজ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চুলে নাক ঘষে বলে,“আমাকে ছেড়ে উঠলে কেন?”
-“তো সারাদিন তোমার সাথে শুয়ে থাকব নাকি?”
-“তাই করবে।”
-“অসভ্য একটা!”
-“তোমার জন্য।”
প্রণীতা মুচকি হাসলো। ফারাজ গাঢ় স্বরে ডাকলো,
-“প্রণীতা?”
-“হু।”
-“আমায় আর কখনো ভুল বুঝবে না তো? আর কখনো ছেড়ে যাবে না তো? বিশ্বাস করো,আমি মরে যাব তোমায় ছাড়া।”
প্রণীতা ফারাজের দিকে ঘুরে তার মুখে হাত দিয়ে বলে,“একদম বাজে কথা বলবে না।”
এই বলে সে ফারাজের পায়ে নিজের পা রেখে একটু উঁচু হয়ে কানে কানে বলে,
প্রণীতা রাগে গিজগিজ করছে। কিছুক্ষণ পর পর আড়চোখে ফারাজকে দেখছে। কে বলবে এই সুন্দর চেহারার আড়ালে কতটা ছলনা লুকিয়ে? কিছু কিছু মানুষের বাহ্যিক রূপ যতোটা চোখ ধাঁধানো হয়,ভিতরটা ততোটাই কুৎসিত হয়। এই যেমন তার পাশে থাকা মানুষটা। ফারাজকে দেখে সে প্রথমে কেমন এলোমেলো হয়ে গেছিলো। পরক্ষণেই সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়তেই পুরোনো তেজ ফিরে আসে। একজন বিশ্বাসঘাতকের জন্য কেবল ঘৃণাই প্রযোজ্য,তারা ভালোবাসার ছায়া পাবারও যোগ্য নয়। প্রণীতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। হাতদুটো নিশপিশ করছে। মনটা কেমন অস্থির লাগছে। ফারাজ সবকিছুই খেয়াল করলো। অতঃপর বলল,
-“গরম লাগছে? এসি ছাড়বো?”
প্রণীতা রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফারাজের দিকে। গমগমে গলায় বলল,“গরম না, রাগ লাগছে। আপনার মুখটা দেখতেও ইচ্ছে করছে না।”
-“তো দেখো না। চোখে পট্টি বেঁধে দিবো?”
-“ফা’জ’লা’মো হচ্ছে আমার সাথে? এই আপনার সমস্যাটা কী শুনি? কোন মতলবে আবার আমার কাছে এসেছেন? কী ভেবেছেন সেদিনের এতো অপমানের পরও আমি আপনাকে ভালোবাসবো? আপনার শোকে কেঁদে কেঁদে মরব? তবে কান খুলে শুনে রাখুন,আমি এতোটাও বেহায়া নই। আমি নিজেকে ভালো রাখতে জানি,দুঃখ ভুলে হাসতে জানি। হ্যাঁ,প্রথম প্রথম আমার খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু এখন আর হয় না। আমি আপনাকে ধীরে ধীরে এই মন থেকে মুছে ফেলছি,আপনার বিন্দুমাত্র অস্তিত্বও থাকবে না সেখানে।”
ফারাজের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। বুকের ভিতর ভারী ব্যথায় মুচড়ে উঠলো। চোখের কোণে অশ্রু জমা হলে তা চটজলদি মুছে ফেলে। তারপর ভেঙে আসা গলায় বলে,“তুমি আমাকে যা খুশি তা বলতে পারো। আমি তাতে কিছুই মনে করব না। কারণ,তোমার দৃষ্টিতে আমি একজন প্রতারক,বিশ্বাসঘাতক। তো,এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এইযে বললে তুমি আমাকে মন থেকে মুছে ফেলছো? বিশ্বাস করো ঠিক এই জায়গাটায় গিয়ে কথাটা লাগলো।”
ফারাজ বুকের বাঁ পাশে হাত নিয়ে দেখালো। প্রণীতা হালকা কেঁপে উঠে। কিন্তু তা বুঝতে দেয় না। কঠোরতার আড়ালে চাপা পড়ে যায় তার মনে থাকা সূক্ষ্ম মায়াটুকু। ফারাজ আবারও বলে উঠে,“আমি তোমাকে সব সত্যি বলব। আর আমার বিশ্বাস সত্যিটা জানার পর তুমি আর আমায় ঘৃণা করবে না। আবারও আগের মতো আমায় ভালোবাসবে। তোমার সম্বোধনটা আবারও আপনি থেকে তুমি হবে।”
প্রণীতা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,“কীসের সত্যি বলবেন আপনি? নতুন প্রেমিকার কাছে ছ্যাঁকা খেয়ে এখন আবার আমাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন সেই সত্যি নাকি নিজের বানানো কোনো মনগড়া সত্যি কোনটা?”
-“প্রণীতা! এতোটা অবিশ্বাস করো না আমায়। জাস্ট এতটুকুই বলব,আমি তোমায় ঠকাইনি। যা করেছি সব তোমার ভালোর জন্য করেছি। তোমাকে ভালোবেসে করেছি।”
-“ও,তাই? মাগো, এতো ভালোবাসা আমি কোথায় রাখি! যে ভালোবাসার জন্য আপনি আমায় চিনতেই পারলেন না,বলেছিলেন আমি কাকে না কাকে নিজের ভালোবাসার মানুষ মনে করেছি,এখন বলছেন সব আমায় ভালোবেসে করেছেন? মিথ্যে বলারও একটা লিমিট থাকে মিস্টার ফারাজ!”
আচমকা গাড়ির ব্রেক কষলো ফারাজ। তারপর বলল,“এসে গেছি।”
প্রণীতা তাকিয়ে দেখলো ভার্সিটি পৌঁছে গেছে। সময়ও হয়ে গেছে তাই দ্রুত সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। চলে যেতে উদ্যত হলে ফারাজ পিছন থেকে ডেকে উঠে৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা দুটো থেমে যায় তার। ফারাজ পিছন থেকে বলে উঠে,“আই লাভ ইউ সো মাচ!”
প্রণীতা চোখদুটো বন্ধ করে ফেলে। এই প্রতারকটা আবারও নিজের ভালোবাসার জালে ফাঁসাচ্ছে তাকে। না,এবার আর ভুল করা যাবে না। ভুল করেছে একবারই করেছে,দ্বিতীয়বারের মতো সে আর ফাঁদে পা দিতে চায় না। সে কিছু না বলে দ্রুতপায়ে ভার্সিটির গেইটের দিকে এগিয়ে যায়৷ ক্লাস শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো কিন্তু সেদিকে মন দিতে পারছে না প্রণীতা। বারবার ফারাজের কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। আচ্ছা,কীসের সত্যি বলতে চায় ফারাজ? সে কি একটা সুযোগ দিয়ে দেখবে? যতোই হোক,সেও তো পাগলের মতোই ভালোবাসতো ফারাজকে। তাকে ভুলতে যে কতোটা কষ্ট হচ্ছিল সেটা তো কেবল সে-ই অনুভব করেছে। উপরে উপরে সে যতোই রাগ দেখাক,ভিতরে ভিতরে তারও দহন হয়। সবগুলো ক্লাস তার অন্যমনস্কতায় কাটলো। ছুটি হলে সে ধীর পায়ে গেইট ছেড়ে বের হয়। ওমনি দেখতে পায় গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাজকে। সে অবাক হয়। লোকটা এখন আবার এখানে কী করছে? তাকে দেখতে পেয়ে ফারাজ দ্রুত তার কাছে আসে। নরম সুরে বলো,“চলো,তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই।”
প্রণীতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,“আমি যাব না আপনার সাথে।”
-“না করো না,প্লিজ। আমি তোমার জন্য এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”
-“আপনি আবার কেন আমার পিছু লাগলেন? সবেমাত্রই আপনাকে ভুলতে শুরু করলাম আর তখনি আমার জীবনে শান্তি নষ্ট করতে চলে এলেন?”
-“শান্তি নষ্ট করতে নয়,ভালোবাসতে এসেছি।”
-“যে ভালোবাসা আমায় কষ্ট দেয় সে ভালোবাসার আমার দরকার নেই।”
-“আমাদের মাঝে কত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তাই না প্রণীতা?”
-“দূরত্ব আপনিই তৈরি করেছেন।”
-“কিন্তু দূরত্বের আড়ালে ভালোবাসা ছিল।”
-“আপনার কথা বিশ্বাস করব কেন?”
-“তাহলে এতোদিনেও আমি তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি? এতোটাই খারাপ ভাবো আমায় যে আমাকে একটা সুযোগ দিতেও তোমার মন সায় দিচ্ছে না?”
প্রণীতা নিশ্চুপ হয়ে যায়। অস্থিরতা ফের শুরু হয়। বেহায়া মনটা আবারও ফারাজকে সুযোগ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। কী করবে সে? সত্যিটা কি শুনবে? পরক্ষণেই সেদিনের তার ক্ষতবিক্ষত মনটার কথা মনে পড়ে। নাহ! আর সুযোগ দিবে না সে। কী হবে সুযোগ দিয়ে? সেদিনের কষ্টের,তার চোখের জলের কি কোনো দাম নেই? সে আসলে বুঝতে পারছে না ফারাজ আসলে কী উদ্দেশ্যে তার কাছে এসেছে। যদি সত্যিই ভালোবেসে এসে থাকে তাহলে তাকেও সেই কষ্টটা অনুভব করতে হবে। তাকেও বুঝতে হবে সেদিন একটা মেয়ে কতোটা দুঃখ বুকে চেপে বাড়ি ফিরেছিল। প্রণীতা চোখমুখ শক্ত করে বলল,“দেখুন,আমার আপনার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। আপনার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। সো প্লিজ,আমাকে আর ডিসটার্ব করবেন না। আপনাকে জাস্ট বিরক্তিকর লাগছে।”
ফারাজ অবাক হয়ে বলল,“প্রণীতা!”
এই বলে সে প্রণীতার দিকে এক পা আগায়। তখনি প্রণীতা বলে উঠে,“খবরদার,আমার কাছে আসবেন না। আবারও কোলে নিয়ে নির্লজ্জতার পরিচয় দিবেন না আশা করি। আমাকে আমার মতো যেতে দিন। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। প্রচুর ঘৃণা করি।”
এই বলে প্রণীতা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। যতো দ্রুত সম্ভব সে স্থান ত্যাগ করলো। ফারাজ এবার আর তাকে আটকালো না। সে অসহায় দৃষ্টি মেলে প্রণীতার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। আনমনেই বলে উঠলো,“আমার দেওয়া আঘাতে তুমি বড্ড শক্ত হয়ে গেছো। কিন্তু এই আঘাতের পিছনে কারণটাই তুমি বুঝোনি।”
ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি রুম। খোঁপের মতো ছোট একটি জানালা দিয়ে ভেসে আসছে দিনের হালকা আলো। যা অন্ধকারকে দূর করার বদলে আরও গাঢ় করেছে। সেই রুম জুড়ে পায়চারি করছে ইসহাক। কপালে শখানেক চিন্তার ভাজ। হঠাৎ বিকট শব্দ করে দরজা ভাঙার আওয়াজ হলো। যেন কেউ লা’থি দিয়ে দরজা ভেঙেছে। ইসহাক চমকে উঠে। কে এলো? এই গোপন জায়গার কথা তিনি আর অপর একজন ছাড়া কেউ জানেনা। সামনে তাকাতেই তিনি হাজার ভোল্টেজের শক খেলেন। বিস্ময়ে উনার চক্ষু চড়কগাছ। মুখ হতে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,“ফারাজ,তুমি?”
ফারাজের মুখে ফুটে উঠলো তীর্যক হাসি। সে এক পা এক পা করে ইসহাকের ঠিক সামনে দাঁড়ালো। তারপর বলল,“ভবিষ্যৎ শ্বশুরমশাই,এতোদিন তো অনেক জামাই আদর করলেন! এবার নাহয় একটু শ্বশুর আদর করি?”
রাগে ইসহাকের চোখমুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। সে প্রায় গর্জে উঠলো,“তুই তাহলে এখনো প্রণীতাকে ভুলিসনি?”
ফারাজের চোখমুখও এবার শক্ত হলো। কপালের রগগুলো ফুটে উঠেছে। সে ঠাণ্ডা স্বরে বলল,“এখন কেন আমি পরের জনমেও প্রণীতাকে ভুলব না।”
প্রণীতা ব্যাগপত্র গোছাচ্ছিল ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তখন রুমে প্রবেশ করেন হাফিজা। হাফিজাকে দেখে প্রণীতা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,“মা,আজ ভার্সিটি যাচ্ছি। এসব ঝামেলার জন্য তো এতোদিন ভার্সিটি যেতে পারিনি। বাবা বোধহয় এখন বাসায় নেই। এসে আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো কেমন।”
হাফিজা কেমন নিষ্পলক দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখতে লাগলেন। যেন কিছু অনুমান করার চেষ্টা করছেন। প্রণীতা বোধহয় সে দৃষ্টি বুঝতে পারলো। জিজ্ঞেস করলো একটু অবাক হয়ে,“কী হয়েছে,মা? কিছু বলবে?”
হাফিজা প্রণীতার মাথায় হাত বুলিয়ে বড় নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন,“তুই কি এই বিয়েতে রাজি?”
সহসা মায়ের এরূপ প্রশ্নে প্রণীতা আশ্চর্য হলো। তার মনে পড়লো গতরাতে আহিয়ানের সাথে ফোনে কথা বলার ঘটনা। তার মনে এখন খটকা লাগছে এই ভেবে যে আহিয়ান কি সত্যিই তাকে বিয়ে করতে চায়? যদি চাইতোই তাহলে হঠাৎ ফারাজের কথা কেন তুলল? কেনই বা বলল যে ফারাজ তাকে ঠকায়নি? উনি কীসের ভিত্তিতে বললেন? প্রণীতা এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। মনের জল্পনাকল্পনা বাদ দিয়ে সে বলে,“রাজি না হওয়ার কোনো কারণ আছে,মা?”
-“আমি জানি তুই মন থেকে এই বিয়েতে রাজি নস। অন্তত আমাকে বুঝাতে আসিস না। কারণ,আমি তো মা। মা হয়ে সন্তানের মনের অবস্থা বুঝবো না?”
-“দেখো মা,সত্যি বলছি। ফারাজকে ভুলে যাওয়াটা আমার জন্য কষ্টদায়ক হলেও আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি তাকে মন থেকে মুছে ফেলার। আর এই বিয়েতেও আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আমারও তো সুখে থাকার অধিকার আছে তাই না?”
-“আহিয়ানকে বিয়ে করলে কি তুই সত্যি সুখী হবি?”
-“হওয়ার চেষ্টা করব।”
-“সুখী হওয়া আর হওয়ার চেষ্টা করা এক নয় রে মা। আমি তোর সুখ চাই। তোর বাবা আমাকে অনেক বুঝালেও আমার মন কেন জানি বলছে তুই সত্যিকার অর্থে এই বিয়েতে রাজি নস। তোর মনে এখনও ফারাজের অস্তিত্ব আছে। তাই বলছি,মনের উপর জোর করে কিছু করিস না। দরকার পড়লে আরও সময় নে। তারপর বিয়ের কথা ভাব। তোর বাবাকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার। তবুও মনে অশান্তি রেখে কিছু করিস না।”
প্রণীতা হাসলো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“সময় নিলেই কী হবে মা? যদি আমি ফারাজকে মনে রাখতে চাই তাহলে আজীবনেও তাকে ভুলতে পারব না। তাই তো এখন থেকেই চেষ্টা করছি তাকে ভুলে যাওয়ার। তুমি হয়তো এখন বলতে পারো যে আরও কিছুদিন গেলে আমি তাকে পুরোপুরি ভুলে যাবো কিন্তু না,মা। যতো দিন যাবে একাকীত্ব আমায় গ্রাস করবে। আর এই একাকীত্বই আমাকে মনে করিয়ে দিবে যে আমি একজনকে ভালোবেসে চরমভাবে ঠকে গেছি। তাই আমার জীবনে এমন একজনের দরকার যে আমাকে ফারাজকে ভুলতে সাহায্য করবে। আর সেটা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হওয়া চাই।”
-“গতকাল যে আহিয়ানের সাথে দেখা করলি তারপর তো আর আমাদের কিছু বললি না। ছেলেটা কেমন রে?”
প্রণীতা বিষণ্ণ হাসলো৷ বলল,“ভালো। আমি এখন যাই,মা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
এই বলে প্রণীতা দ্রুত বাসা ত্যাগ করে।হাফিজা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়েটার কষ্টের খুব দ্রুতই সমাপ্তি ঘটুক। মনে মনে এই কামনাই করেন তিনি।
প্রণীতা রাস্তার ধারে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে। পথে রিক্সা,অটো কিছু না পাওয়ায় তাকে হেঁটে যেতে হচ্ছে। মনে মনে সে ভাবতে লাগলো,মাকে তো খুব করে বলে এলো যে জীবনে এমন একজন মানুষ দরকার যে মানুষটা তাকে ফারাজকে ভুলতে সাহায্য করবে,তাকে সুখে রাখবে। কিন্তু আহিয়ান কি সত্যিই তেমন? গতকাল পার্কে মনে হয়েছিল মানুষটা হয়তো সত্যিই তাকে ভালোবাসে কিন্তু রাতে কথা বলার পর থেকে কেমন খটকা লাগছে। তার ক্লান্ত মন এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। ভয় হয়। যদি আবারও ঠকে যায়? তখন কী হবে উপায়? তারও তো একটা জীবন। একজীবনে একজনকে ভালোবেসে এর মূল্য দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয়বারের মতো এমন ভুল আর সে করতে চায় না।
হঠাৎ তার সামনে এসে একটি গাড়ি থামলো। প্রণীতার পা যুগল থেমে যায়। অবাক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো গাড়িটিকে। কেমন চেনা চেনা লাগছে! ও,হ্যাঁ এটা তো ফারাজের গাড়ি। ফারাজের গাড়ি এখানে কী করছে? এসব ভাবনার মাঝেই গাড়ি থেকে নেমে এলো ফারাজ। ফারাজকে দেখে তার বিস্ময়ের মাত্রা তরতর করে বৃদ্ধি পেলো। মনটা যেন থমকে গেল। সেইসাথে বাড়লো এতোদিনের বহুকষ্টে ভুলতে থাকা তীব্র যন্ত্রণা। মানুষটাকে তো সে কতো ঘৃণা করে। তবুও চোখের সামনে দেখে কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? কেন মনের মাঝে উথাল-পাথাল ঢেউয়ের জাগরণ হচ্ছে? প্রণীতা অনুভূতিগুলো চেপে মাথা নিচু করে চলে যেতে চাইলে ফারাজ ডেকে উঠে,“প্রণীতা!”
প্রণীতা না চাইতেও দাঁড়িয়ে যায়। কতদিন পর ফারাজের কণ্ঠে নিজের নাম শুনেছে। এই কণ্ঠে যেন অজস্র মায়া মিশ্রিত। প্রণীতার কাছে যেন সব উলটপালট লাগছে। সে কিছু না বলে ফের হাঁটা ধরে। ওমনি ফারাজ তার একহাত টেনে ধরে। প্রণীতা চমকালো। বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে ফারাজের দিকে তাকায়। ফারাজ তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রণীতা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলো তাকে। মানুষটা আগের চেয়েও যেন অধিক সৌন্দর্যের অধিকারী হয়েছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মাঝেও যেন তাকে বড্ড অগোছালো,খাপছাড়া মনে হচ্ছে। প্রণীতা চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতঃপর চোখ খুলে দম নিয়ে বলে,“হাত ছাড়ুন।”
ফারাজ প্রণীতার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,“ছাড়ার জন্য তো ধরিনি।”
আচমকা প্রণীতার রাগ বহুগুণ বেড়ে গেল। শিরায় শিরায় খেলে গেল এক জ্বলন্ত লাভা। শরীরের প্রতিটি কোষ সেঁটে গেল এক তীব্র উত্তেজনায়। সেইদিনের মুহূর্তটা মাথার মাঝে ঘুরঘুর করছে। সে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। কণ্ঠে বেজে উঠে আক্রোশের তীব্র ধ্বনি,“হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি,মিস্টার ফারাজ?”
ফারাজ অবাক হলো না এতে। যেন সে এরূপ আচরণ সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল। ফারাজ নরম সুরে বলল,“প্রণীতা,গাড়িতে উঠো।”
প্রণীতা হাসলো। হাসিতে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে বিদ্রুপ৷ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,“একটা অপরিচিত মেয়েকে নিজের গাড়িতে তুলবেন? এটা তো আপনার সাথে মানাচ্ছে না।”
-“দেখো,আমি তোমাকে সব বলব। তার আগে গাড়িতে উঠো। ভার্সিটিতে নিশ্চয়ই তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
প্রণীতা হাতঘড়ি দেখলো। সত্যিই আর বেশি সময় নেই। না থাকুক,তাই বলে সে ফারাজের গাড়িতে উঠবে? কখনোই না! সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,“আপনিই আমাকে দেরি করাচ্ছেন। সরুন,আমাকে যেতে দিন।”
প্রণীতা আশ্চর্য হলো। লোকটা আজ তার উপর কীসের অধিকার দেখাচ্ছে? সেদিনের কথাগুলো কি মনে নেই? প্রণীতা পূর্বের চেয়েও দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,“আপনার মতো এমন নি’র্ল’জ্জ,বে’হ’য়া লোক আমি আর দুটো দেখিনি। লজ্জা করেনা আপনার? সেদিন আমাকে এতো অপমান করলেন,আমাকে তো চিনতেই পারলেন না। আর আজ যেচে এসে নিজের গাড়িতে বসতে বলছেন? কী ভেবেছেন আপনি আদেশ করবেন আর আমিও ধেইধেই করে গাড়িতে উঠে পড়ব? শুনুন,আমার আর কিছু না থাকুক আত্মসম্মানবোধ আছে। তাই সেই সম্মানবোধের জন্যই আপনার গাড়িতে নিজের একটা স্পর্শও লাগতে দিব না।”
এই বলে প্রণীতা হাঁটা শুরু করলে ফারাজ চটজলদি তাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। ফারাজের এমন কাণ্ডে প্রণীতা হতভম্ব। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কিছুসংখ্যক মানুষ তাদের দিকেই তাকিয়ে। লোকলজ্জার ভয় তাকে আকড়ে ধরলো। সেই সাথে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো রাগের অগ্নিশিখায়। সে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকলে ফারাজ বলে,“বেশি ছটফট করলে শান্ত করার উপায়ও আমার জানা আছে। তবে লোকজনের সামনে আমি সেই উপায়টা প্রয়োগ করতে চাইছি না। তাই চুপচাপ আমি যা বলছি তা মেনে নাও।”
কথাটুকু শেষ করে ফারাজ দ্রুত পায় নিজ গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। প্রণীতাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ে ড্রাইভিং সিটে। প্রণীতাকে আড়চোখে একবার পরখ করে চটজলদি গাড়ি স্টার্ট দেয়। যেটি চলতে থাকে শো শো বেগে।
প্রণীতা বাড়ি পৌঁছেছে কিছুক্ষণ হলো। আসার পর থেকে একদণ্ড শান্তি মিলছে না মনে। একে, মনের উপর ঝড় চলছে যে ঝড় থামানোর নিদারুণ প্রচেষ্টায় মত্ত সে। অপরদিকে,আহিয়ানের জন্য দুশ্চিন্তা। আহিয়ানের জন্য তার মনে কোনো অনুভূতি এখনো জন্মায়নি। তার মনে উনাকে নিয়ে যতো দুশ্চিন্তা তার সবকিছুর মূলে সে নিজেকেই দায়ী সাব্যস্ত করছে। তার জন্যই আহিয়ান এমন বিপদের মুখে -এটাই তার বিশ্বাস। সে বাবা-মাকে এখনো কিছু জানায়নি। আগে পরিস্থিতি কতদূর তা দেখা জরুরি। সে তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিলো। কীবোর্ডে আঙুলগুলো চালালো অকপটে। অতঃপর সেন্ড করলো ম্যাসেজটি।
-“আমি বাড়ি এসে পৌঁছেছি। এবার উনাকে ছেড়ে দিন।”
মুহূর্তের মাঝেই রিপ্লাই এলো,“বেশ,ছেড়ে দিব।”
প্রণীতার মুখমণ্ডল আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলো। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব লাভ করলো না। সত্যিই ছেড়ে দিবে তো? মনের খচখচানি ভাব দূর করতে সে ফের ম্যাসেজ দিলো,“সত্যি তো?”
-“আমার উপর বিশ্বাস নেই?”
প্রণীতা থমকালো। এই কথাটা সে ফারাজের মুখে শুনেছিল। একবার ফারাজ তার পরিবারের সাথে এক অনুষ্ঠানে যাবে। সেই থেকেই প্রণীতার চিন্তার পাহাড় জমেছে। অনুষ্ঠানে কতো মেয়েরা থাকবে,তারা সেজেগুজে নিজেদের নায়িকা উপস্থাপন করবে। ফারাজ যদি তাদের দিকে নজর দেয়? বা সেই মেয়েরাও যদি ফারাজকে ঘিরে ধরে? কারণ তার ফারাজ দেখতে মাশাল্লাহ। তাই তো তার এতো চিন্তা। প্রণীতা বারবার করে বলছিল,“তুমি কিন্তু কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না। কোনো মেয়ের ধারেকাছেও ঘেষবে না। মেয়েরা তোমার সাথে কথা বলতে চাইলেও তাদের সাথে কথা বলবে না। সর্বোপরি,তুমি মেয়েদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। মনে থাকবে তো?”
ফারাজ সেদিন প্রণীতাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,“মনে থাকবে ম্যাডাম৷ আমার উপর বিশ্বাস নেই?”
-“নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি তোমায়। কিন্তু ভয় হয় যে!”
ফারাজ প্রণীতার কপালে চুমু খায়। নিজের বুকে প্রণীতার মাথা রেখে বলে,“আমার চোখদুটো কেবল তোমায় দেখতে মরিয়া। এই চোখ আর অন্য কোনো নারীকে দেখবে না। তুমি শুধু আমায় বিশ্বাস করো। তোমার বিশ্বাসটুকু সাথে নিয়েই আমি যেতে চাই দূর-দূরান্তরে।”
প্রণীতা অতীত ছেড়ে বর্তমানে ফিরলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে বিদ্রুপের হাসি৷ সে আপনমনে বলে উঠলো,“তোমায় বিশ্বাস করাটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”
প্রণীতা মনে মনে ভাবলো,নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিশ্বাস করেই বাজেভাবে ঠকে গেলাম সেখানে আপনার মতো একজন অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস করাটা নিতান্তই বিলাসিতা নয় কি? সে রিপ্লাই দিলো,“আপনি কে যে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে যাব? আগে বলুন,সত্যি বলছেন কিনা?”
অপর পাশ হতে রিপ্লাই এলো,“আমি যে সত্য বলছি তার প্রমাণ আজই পাবেন।”
প্রণীতা কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করলো। তবুও মনের মাঝে একটা ভয় থেকেই যায়। সে এবার আর বেশি ভাবলো না। উপযুক্ত প্রমাণের অপেক্ষায় নিজেকে সপে দিলো।
দিনের আলো ফুরিয়ে প্রকৃতিতে বিরাজ করছে রাতের আঁধার। বিশাল গগনে জ্বলজ্বল করছে অজস্র তারার মেলা। শো শো করে হিমেল হাওয়া এসে আছড়ে পড়ছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে এরূপ মনোরম পরিবেশ উপভোগ করছে প্রণীতা। তার দেহমন জুড়িয়ে দিচ্ছে এই শীতল হাওয়া। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠে। সে কিছুটা বিরক্ত হয়। বিরক্তির সাথে রুমে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। তারপর ফের বেলকনিতে আসে। সম্পূর্ণ অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রণীতা বলে,“হ্যালো,কে বলছেন?”
-“প্রণীতা,আমি আহিয়ান। আঙ্কেলের কাছ থেকে তোমার নাম্বারটা নিলাম একটা জরুরি কাজের জন্য৷ তুমি কিছু মনে করো না।”
প্রণীতার চিন্তার প্রহরের সমাপ্তি ঘটলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করলো। যাক,আহিয়ানকে তাহলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিজের উপর থেকে একটা ভার যেন সরে গেছে। সে বেশ প্রফুল্লচিত্তে বলল,“আপনি তাহলে ঠিক আছেন? জানেন,আপনার জন্য আমার কতো চিন্তা হচ্ছিল?”
অপরপাশে থাকা মানবটির অভিব্যক্তি ঠাহর করা গেল না। বলল বড়ো বিষণ্ণ সুরে,“আমার জন্য তোমার চিন্তা হয়,প্রণীতা?”
-“হবে না কেন? আজ আমার জন্যই আপনি এতোবড় একটা বিপদের মুখে পড়লেন। আল্লাহ রহম করেছে যে আপনার কিছু হয়নি।”
-“প্রণীতা,আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। জানিনা এই কথাগুলো শোনার পর তোমার অনুভূতি কেমন হবে। কিন্তু এই কথাগুলো শোনা তোমার জন্য খুবই জরুরি।”
-“হ্যাঁ,বলুন না,কী বলবেন।”
আহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুকের মাঝে থাকা কষ্টগুলো পাথরচাপা দিয়ে বলল,“ফারাজ তোমায় ঠকায়নি। সে এখনো তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসে।”
প্রণীতা স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হলো,সে কিছু ভুল শুনেছে। আহিয়ান ফারাজের কথা জানলো কীভাবে? সে তো বলেনি। তাহলে কি বাবা বলেছে? আচ্ছা বেশ,বাবা বলেছে কিন্তু এমন কথার মানে কী? ফারাজ তাকে ঠকায়নি? তাকে তো খুব নির্মমভাবে ঠকিয়েছে। প্রণীতা আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,“আপনি এসব কী বলছেন?”
-“আমি ঠিকই বলছি প্রণীতা। ফারাজ তোমায় ঠকায়নি। শোনো,আমরা চোখে যা দেখি তা সবসময় সত্যি হয় না। তার পিছনেও লুকিয়ে থাকে চরম সত্য। যে সত্য মানতে না পারলেও মানতে হয়। তুমি তো কেবল ফারাজ যা দেখিয়েছে তাই দেখেছো কিন্তু এর আড়ালে যে কতো সত্য লুকিয়ে আছে তার একাংশ সম্পর্কেও তুমি অবগত নও।”
-“আপনি যা বলছেন বুঝে বলছেন? আপনার মাথা ঠিক আছে তো? আর আপনি হঠাৎ ফারাজের কথা তুললেন কেন?”
-“আমার মনে হলো সত্যিটা তোমায় জানানো দরকার৷ কতোদিন একজনের সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা পোষণ করবে? তাই মনের মাঝে থাকা সকল রাগ,দুঃখ দূর করে ফারাজের সাথে সুখী হও।”
প্রণীতার রাগ হলো খুব। একজন বিশ্বাসঘাতককে নিয়ে সে কোনো কথাই শুনতে চায় না। সে বুঝতে পারছে না আহিয়ান হঠাৎ ফারাজের গুণগান গাইছে কেন! যে যেভাবে পারছে তাকে ব্যবহার করছে,তাকে বুঝ দিচ্ছে। কেন সে কি খেলার পুতুল? যে তাকে যা বোঝানো হবে সে তাই বুঝবে? সে কণ্ঠে রাগ ঢেলে বলল,“আপনার বলা শেষ হয়েছে? এবার তাহলে আমারটা শুনুন। আসলে আপনাদের সবাইকেই না আমার চেনা হয়ে গেছে। বিকেলে তো খুব ভালোবাসার কথা বলছিলেন তাহলে এখন কেন এতো ফারাজের গুণগান গাইছেন? ভালোবাসা বুঝি ফুরিয়ে গেছে? তাই একজন বিশ্বাসঘাতককে মেনে নিতে বলছেন? সে যে আমায় ঠকায়নি সেটা আপনিই বা কীভাবে জানলেন? আরে,আপনার যদি আমাকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে না থাকে তাহলে না করবেন। আপনাকে তো কেউ জোর করছে না যে আমাকে বিয়ে করতেই হবে। শুধু শুধু নিজের ব্যক্তিত্বে প্রভাব ফেলবেন না।”
এই বলে প্রণীতা ফোন কে’টে দেয়। আজ তার দুঃখ হচ্ছে না। হচ্ছে প্রচণ্ড রাগ। যে রাগের আগুন নেভানো দায়। পুরুষ মানেই বিশ্বাসঘাতক,ছলনাকারী। সবাই কী সুন্দর তাকে ব্যবহার করছে। যখন যেভাবে পারছে হাতের পুতুলের মতো তাকে নাড়াচ্ছে। রাগে তার চোখদুটো অশ্রুতে টলমল করলো। বিড়বিড় করে বলল,“আমাকে এখন আর কেউ হাতের পুতুলের মতো ব্যবহার করতে পারবেন না। সেই সুযোগই আমি দেব না।”
ফারাজ বাড়িতে ঢুকলো এইমাত্র। তাকে দেখামাত্রই মহিমা চৌধুরী দ্রুত পায়ে তার কাছে আসেন। বললেন বড়ো উদ্বিগ্ন গলায়,“কীরে,তুই সেই কখন বাসা থেকে বের হলি আর মাত্র আসলি? এখন তোর আসার সময় হলো? আমরা কখন থেকে তোর জন্য না খেয়ে বসে আছি। আয় তাড়াতাড়ি খেতে আয়।”
এই বলে মহিমা ছুট লাগান ডাইনিং এর দিকে। ফারাজ কিছু না বলে নিজ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর নিচে এসে ডাইনিং টেবিলে সবার সাথে যোগদান করলো। হোসাইন চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললেন,“ফারাজ,তুমি পরিবারের ছোট ছেলে দেখে এটা ভেবো না যে তোমার তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত আমরা সবসময় মেনে নিব। এইযে তুমি আমার এতোবড় ব্যবসা ছেড়ে বাইরের দেশে চলে গেলে,তাতে তোমার বড়ভাইয়ের উপর কতোটা চাপ পড়েছে জানো তুমি?”
ফারাজের বড় ভাই মেহরাজ বলল,“বাবা,এখন এসব কথা বাদ দাও না। আর আমি কি কখনো বলেছি যে আমার উপর চাপ পড়েছে?”
-“সব কথা মুখে বলতে হয় না। মানুষটাকে দেখেই বুঝা যায় তার পরিস্থিতি। আর আমি তো একজন বাবা। বাবা হয়ে ছেলের অবস্থা বুঝবো না?”
মহিমা বিরক্ত হয়ে বললেন,“খাওয়ার মাঝে এসব কথা বলার কী দরকারটা পড়েছে শুনি? ছেলেটা এতোদূর থেকে আসলো এখন একটু আরামে খেতে দাও তো। বেশি কথা বলবে না।”
ফারাজ এবার মুখ খুলল,“সরি বাবা। সরি ভাইয়া। আমি জানি আমার জন্য তোমরা অনেক চাপে পড়েছো। কিন্তু আমি যে কাজের জন্য গিয়েছিলাম সে কাজটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”
হোসাইন বললেন,“কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুনি?”
-“সময় হোক বাবা। সব জানতে পারবে। আর সেই সময়টাও খুব সন্নিকটে।”
অতঃপর ফারাজের ঠোঁটে ফুটে উঠলো রহস্যময়ী হাসি। মনে মনে বলল,“প্রস্তুত হোন নিজের আগাম শাস্তির জন্য।”
প্রণীতা তরতর করে ঘামছে। সে যে বেশ ঘাবড়ে গেছে তার ছাপ মুখমণ্ডলে স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। কে দিলো এমন ম্যাসেজ? আহিয়ান কোথায় গেছে? উনার কী হবে? প্রণীতার নিজেকে ভারসাম্যহীন মনে হতে লাগলো। সে অস্থিরচিত্তে ভাবতে লাগলো বর্তমান করণীয় সম্পর্কে। সে দ্রুত সেই নাম্বারে ম্যাসেজ দিলো,“কে আপনি?”
কিন্তু দুর্ভাগ্য কোনো রিপ্লাই এলো না। সে আবারও ম্যাসেজ দিলো,“দেখুন,উনার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে কিন্তু ভালো হবে না বলছি।”
এবার রিপ্লাই এলো,“কী করবেন শুনি?”
-“সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি। আপনি কে সেটা বলুন। আর উনাকে কেন মারতে চান?”
-“উনি আমার ব্যক্তিগত সম্পদ চুরি করেছে তাই।”
প্রণীতা অবাক হয়। আহিয়ান চুরি করেছে? আহিয়ানকে দেখে তো তেমন মনে হয়নি। তাকে ভালো,ভদ্র ঘরের ছেলে মনে হয়েছে। তার দ্বারা কী করে চুরি করা সম্ভব? সে দ্রুত আঙুল চালিয়ে টাইপ করলো,“আপনার কথা আমি কেন বিশ্বাস করব? উনি চোর হতেই পারেন না।”
-“খুব বিশ্বাস করেন বুঝি? তা কতদিন হলো উনার সাথে আপনার পরিচয়? আর উনি আপনার কে হয় যে উনার উপর এতো বিশ্বাস?”
প্রণীতা থমকালো। আসলেই তো,আহিয়ানকে তো সে তেমন ভালো করে চেনেই না। যতটুকু চেনে তা সম্পূর্ণ বাবার কাছ থেকেই। হাফিজ প্রায় সময়ই আহিয়ানের গুণগান গাইতো। ছেলেটা দেখতে ভালো,স্বভাব-চরিত্রে ভালো,সবদিক দিয়েই পার্ফেক্ট। সে তো সেই ছোটবেলায় একবার যা দেখেছিল তারপর তো বোধহয় আহিয়ানের মুখটাও দেখেনি সে। কিন্তু তাই বলে সে চুরির মতো এতো জঘন্য একটা কাজ করবে? তার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। প্রণীতা বুদ্ধি খাটিয়ে এবার ম্যাসেজ দিলো,“আপনার ব্যক্তিগত সম্পদটা কী শুনি? উনি আপনার কী এমন চুরি করেছে যে আপনি উনাকে একদম জানে মেরে ফেলতে চান?”
অপর পাশে নিস্তব্ধতা। মিনিট কয়েক পর রিপ্লাই এলো,“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। সম্পদের আগে যেহেতু ব্যক্তিগত ট্যাগ লাগিয়েছি সেহেতু আপনার বুঝা দরকার যে কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই। এখন আপনি আমার কথা শুনে বাড়ি যাবেন কিনা সেটা বলুন।”
প্রণীতার রাগ বাড়লো। রাগান্বিত হয়ে রিপ্লাই দিলো,“আমার বাড়ি ফেরার সাথে উনাকে বাঁচিয়ে রাখার কী সম্পর্ক বুঝলাম না। আর আপনি আমার নাম্বার কীভাবে পেলেন? কে আপনি দয়া করে বলুন।”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে প্রণীতা সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। নাহ! কোথাও তো আহিয়ান নেই। সেই ছেলেটা কোথায় ডেকে নিয়ে গেল? এই বয়সেই এমন ক্রিমিনালের সাথে জড়িত ভাবতেই প্রণীতার গা রিনরিন করে উঠে। নিজের উপর রাগটা তিরতির করে বাড়ছে। সে কেন বলল যেতে! কেন! ইশ! লোকটা এখন কোথায় আছে,কী অবস্থায় আছে কিছুই তো জানতে পারছে না। আজ তার জন্যই এমন হয়েছে। সে যদি তখন না যেতে বলত তাহলে আহিয়ানও যেত না,আর না এমন ঝুঁকির মুখে পড়ত। তার খারাপ লাগছে এটা ভেবেই যে আজ তার জন্য একজন মৃত্যুুর মুখে। আচ্ছা,লোকটা যে বলল তাকে বাড়ি চলে যেতে,বাড়ি চলে গেলেই কি আহিয়ানকে ছেড়ে দিবে? সে তো লোকটার কথা বিশ্বাসও করতে পারছে না। পরে বাড়ি যাওয়ার পরও যদি না ছাড়ে তখন? তখনই তার ফোনে ম্যাসেজ আসে,“কী হলো,কী ভাবছেন? যদি আহিয়ানকে বাঁচাতে চান তাহলে এখন সুরসুর করে বাড়ি যান। নতুবা কী করব বুঝতেই পারছেন। আর হ্যাঁ,কোনোপ্রকার চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। ফল কিন্তু ভালো হবে না।”
প্রণীতা তৎক্ষনাৎ রিপ্লাই দেয়,“আপনাকে আমি কেন বিশ্বাস করব? পরে আমি বাড়ি যাওয়ার পরও যে উনার কোনো ক্ষতি করবেন না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?”
-“আমি আমার কথায় অটল থাকি। কথার খেলাপ করি না। বাকিটা আপনার ইচ্ছে।”
প্রণীতা ভাবলো তাহলে বাড়িই যাওয়া যাক। অন্তত একজনের প্রাণ বাঁচুক। সে চায় না তার জন্য কারও প্রাণ যাক। আজ আহিয়ানের জন্য তার অস্থির লাগছে কাল আহিয়ানের জায়গায় অন্য কেউ হলেও এমন অস্থির ভাবই হতো। সবশেষে,আমরা মানুষ। আর মানুষ মানুষের জন্যে৷ নিজের জন্য কারও ক্ষতি হোক সেটা প্রণীতা কখনোই চায় না। সে একবার ভেবেছিল পুলিশকে ইনফর্ম করবে পরক্ষণেই ভাবলো এতে যদি হিতে বিপরীত হয়?একা একা এমন পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং লোকটার কথা বিশ্বাস করে বাড়ি যাওয়া যাক। এরপরও যদি আহিয়ানকে না ছাড়া হয় তখন সে বাবা-মায়ের সহায়তায় কঠোর পদক্ষেপ নিবে।
নিভু নিভু হলদে আলোয় পূর্ণ একটি বদ্ধ ঘর। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে কেমন একটা ভ্যাপসা ঘ্রাণ। তার মাঝেই একটা কাঠের চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে আহিয়ান। আহিয়ান ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চোখ খুলতেই সবকিছু কেমন ঝাপসা ঠেকলো তার কাছে। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। সে উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না। খেয়াল করে দেখলো তার হাত-পা চেয়ারের সাথে বাঁধা। নিজেকে এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে দেখে ঘাবড়ে গেল সে৷ তখনই তার মনে পড়লো বিকেলের সেই ঘটনা।
আহিয়ান ছেলেটির কথামতো তার দেখানো অনুযায়ী স্থানেই গিয়েছিল। ছেলেটি তাকে একটি জনশূন্য পথে নিয়ে যায়। সে জায়গাটি ছিল একদম সুনশান-নিস্তব্ধ। পার্ক থেকে বেশ কিছুটা দূরে। একটা কাকপক্ষীও নেই যেন। আহিয়ান বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছেলেটিকে বলে,“এখানে আনলে কেন? সাহায্য চাওয়ার জন্য মানুষ এতদূরে নিয়ে আসে? অদ্ভুত!”
ছেলেটি কিছু বলে না। মাথার পিছনে হাত দিয়ে কেবল চারপাশ দেখতে থাকে। আহিয়ান ফের বলে,“আর তুমি আমাকে চিনো কীভাবে বললে না তো? আসতে আসতে কতোবার জিজ্ঞেস করলাম কিছুই তো বললে না। মুখে কুলুপ এঁটেছো নাকি?”
ছেলেটি তখনও নিরুত্তর। ছেলেটির নিরবতা আহিয়ানের রাগ বৃদ্ধি করলো। সে পার্ক থেকে আসতে আসতে কতোবার ছেলেটিকে প্রশ্ন করেছে। অথচ একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেয়নি সে। শুধু একবার ছেলেটি তার নাম জানতে চেয়েছিল। সে ও ভেবেছিল নাম বললে হয়তো প্রশ্নের উত্তর পাবে তাই সে তার নামটা বলে। কিন্তু না তার আশা বিফলেই পতিত হলো৷ আহিয়ান এবার বেশ উচ্চস্বরেই বলে উঠলো,“এই ছেলে তোমার মতলবটা কী শুনি? কীসের জন্য আমাকে এখানে এনেছো? বলো!”
শেষের কথায় প্রায় ধমকে উঠে আহিয়ান। আহিয়ান হঠাৎ খেয়াল করে রাস্তার অপরপাশে একটি কালো গাড়ি রাখা। সে বিষয়টাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। কার না কার গাড়ি থাকতেই পারে। সে বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই পিছন থেকে রুমাল দিয়ে কেউ তার মুখটা চেপে ধরে। ওমনি সে জ্ঞান হারায়। আর জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে এই অবস্থায় আবিষ্কার করে৷ তার তখনই সন্দেহ হয়েছিল ছেলেটিকে। ছেলেটি কোনো ভালো মতলবে আসেনি৷ কেন যে সে তার কথা শুনতে গেল! হঠাৎ আহিয়ান কারো হাঁটার আওয়াজ শুনতে পায়৷ ধুপধাপ আওয়াজ ফেলে কেউ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার নত করে রাখা মুখটা উঁচু হয়। ততক্ষণে কেউ একজন তার সামনে চেয়ার পেতে পায়ের উপর পা রেখে বসে। আহিয়ান চোখদুটো ভালো করে মেলে দেখতে পায় একজন অজ্ঞাত লোককে। কোনোরকম বলার চেষ্টা করে,“আপনি কে?”
এক সেকেন্ড,দুই সেকেন্ড! এরপরই ভেসে আসে একটি ঠাণ্ডা শীতল কণ্ঠস্বর,“আহসান চৌধুরী ফারাজ!”