Saturday, June 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 22



দূরত্বের আড়ালে পর্ব-০৩

0

#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন

নিজ বাড়িতে পা রাখা মাত্রই একজোড়া হাত আগলে নেয় ফারাজকে। ফারাজের বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হলো না এই হাতজোড়ার মালিক কে৷ সে হেসে নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,“মা,কেমন আছো?”

ফারাজের মা মহিমা চৌধুরী বলেন,“তোকে ছাড়া ভালো থাকি কীভাবে বাপ? কেন সেদিন আমাদের ছেড়ে এভাবে চলে গেলি? কোনো কারণ ছাড়া কেউ এভাবে চলে যায়? আমাদের তোকে ছাড়া থাকতে কতো কষ্ট হচ্ছিল জানিস?”

ফারাজ মায়ের বাঁধন ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর মনে মনে আওড়ালো,“যার জন্য এই দেশ ছেড়েছিলাম,তাকেই যে কষ্ট দিয়ে এলাম।”

মহিমা ফের বললেন,“কীরে,কথা বলছিস না কেন?”

-“মা,তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিবো। এখন আমার একটু রেস্টের প্রয়োজন। আর হ্যাঁ,আমি এখন কিছু খাব না। বাইরে মিরাভের সাথে খেয়ে এসেছি। তার সাথে ঘুরতে গিয়েই বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হলো। যাই হোক,আমি এখন ঘরে গেলাম।”

কথা শেষ করে ফারাজ দ্রুত পায়ে নিজ ঘরের দিকে এগোলো। সে আগে থেকেই অবগত ছিল যে বাড়িতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তাকে একগাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আপাদত সে কিছুই খোলাসা করতে চাচ্ছে না। গুটিটা আরেকটু সাজিয়ে নিক,তারপরই দেখা যাবে আসল খেলা। ভাগ্যিস,মা বাদে বাড়িতে এখন আর কেউ ছিল না। নাহলে প্রশ্ন শুনতে শুনতেই তার কানের বারোটা বাজতো।

মহিমা ছেলের যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। উনার কেন জানি মন বলছে,ফারাজ ভালো নেই। তার মাঝে অনেক কষ্ট আছে,দুঃখ আছে। মায়ের মন তো,সন্তানের চোখমুখ দেখেই বুঝে ফেলেন তার অন্তরের খবর। এইযে,এতোক্ষণ হাসিমুখে কথা বলল? সে হাসিটাও যেন বিষাদের হাসি। ভিতর থেকে টেনে হিঁচড়ে আনা এক টুকরো হাসি। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজকাল নিজের সন্তানকে বুঝতে পারাটাও কেমন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফারাজ নিজ রুমে এসে বিছানায় বসল। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে তার। মনের অজান্তেই চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। যতোবার প্রণীতার কথা ভাবে ততোবারই মনে হয় কে যেন তার বুকে আঘাত করছে। পরক্ষণেই একজনের কথা ভাবতেই তার চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে,“আপনার খেলা শেষ। এবার আমার খেলা শুরু।”

প্রণীতার বাবা-মা বেশ অবাক হলেন মেয়ের থেকে ইতিবাচক উত্তর পাওয়ায়। উনারা ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো কেঁদেকেটে ভাসাবে,নতুবা তাদের উপর অভিমান করবে,রাগ করবে। কিন্তু তার একটাও যখন ঘটলো না তারা যেন তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাই হোক,মেয়েটা রাজি হলো তো। মেয়ের সুখেই তাদের সুখ। উনাদের বিশ্বাস আহিয়ানের সাথে প্রণীতা সুখী হবে। ছেলেটা দেখতে শুনতে যেমন ভালো তেমনই বেশ অর্থের মালিক। কোনোদিক দিয়ে তাদের মেয়েকে অপূর্ণ রাখবে না। ইসহাক যখন আহিয়ানের সাথে প্রণীতার বিয়ের কথা তুলল তখন হাফিজার খানিক ভয় হয়েছিল এই ভেবে যে ছেলেটা কি তার মেয়েকে ভালো রাখতে পারবে? সত্যিকার অর্থে ভালোবাসবে তো? নাকি ফারাজের মতোই ধোঁকা দিয়ে চলে যাবে? কিন্তু ইসহাকের আশ্বাসে উনার ভীতি কিছুটা হ্রাস পায়। ইসহাক বোঝান,ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো। প্রণীতা আগলে রাখবে সে।

মাঝে একদিন কাটে। ইসহাক চাচ্ছেন,প্রণীতা খুব দ্রুত তার জীবনে মুভ অন করুক। আর কোনো কষ্টের ছায়া তার জীবনে না পড়ুক। আর এর জন্য একমাত্র মাধ্যম হলো আহিয়ানের সাথে যতদ্রুত সম্ভব বিয়ে দেওয়া। সকালে নাস্তা খেতে বসলে ইসহাক বলেন,“প্রণীতা,তোকে একটা কথা বলতাম। রাগ করবি না তো?”

প্রণীতা খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,“বলো।”

-“আহিয়ান তোর সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল। মানে,বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদেরও তো একটা মতের বিষয় থাকে। তুই এই বিয়েতে রাজি কিনা সে জানতে চাচ্ছিল। আর তাই সে তোর পছন্দের কোনো জায়গায় দেখা করার কথা বলেছে। তুই দেখা করবি?”

-“আশ্চর্য! আমি তো তোমাদেরকে বলেছিই যে আমি এই বিয়েতে রাজি। তাহলে আবার দেখা কেন করতে হবে?”

-“আমিও তাকে ফোনে এ কথা বলেছি। কিন্তু সে তোর মুখ থেকে কথাটা শুনতে চাচ্ছে। আর এমনিতেও ছেলেটার সাথে দেখা করলে সমস্যা কোথায়? দুইদিন পর যাকে বিয়ে করবি তার সাথে একদিন দেখা করতেই পারিস। তাহলে তুইও বুঝতে পারবি ছেলেটা কেমন।”

প্রণীতার কাছে এই বিয়ের ব্যাপারটা বিষের মতো অসহ্য লাগে। কিন্তু জেদের বশে সে আজ সব মেনে নিয়েছে। সে কাউকে দেখিয়ে দিতে চায় তাকে ছাড়াও প্রণীতা থাকতে পারে। প্রণীতা গম্ভীর স্বরে বলল,“বেশ,আমি দেখা করব।”

ইসহাক খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,“সত্যি? তাহলে শোন,আজ বিকেল ৩টায় তোর পছন্দের কোনো জায়গায় দেখা করিস। তো,তুই কোথায় দেখা করতে চাচ্ছিস?”

প্রণীতা মনমরা হয়ে জবাব দিলো,“আমার আর পছন্দের জায়গা! উনাকে বলে দাও উনি যেখানে বলবেন আমি সেখানেই দেখা করব।”

মেয়ের মন খারাপটুকু হাফিজার কলিজায় গিয়ে লাগল। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন প্রণীতা সম্পূর্ণরূপে ফারাজকে ভুলতে পারেনি। নাহলে একটাদিন কেটে গেলো মেয়েটার মুখে হাসি নেই,উচ্ছ্বাস নেই,চপলতা নেই। আগের সেই বাড়ি মাতিয়ে রাখা প্রণীতা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু না ভুলতে পারলেই বা কী? বিয়ে তো একদিন না একদিন করতে হতোই। তার চেয়ে বরং এখনই একজন বিশ্বস্ত লোকের হাতর তুলে দিতে পারলেই শান্তি। যে কিনা প্রণীতাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে।

ইসহাক জানালেন আহিয়ান তার সাথে শিশুপার্কে দেখা করতে চায়। শিশুপার্ক নাম শুনতেই প্রণীতার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। এই পার্কেই ফারাজের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ,এই পার্কেই প্রথম প্রেম নিবেদন,মনের আদান-প্রদান। তার সবচেয়ে প্রিয় একটি স্থান হলো শিশুপার্ক। এখন কিনা সেই পার্কেই অপর একজনের সাথে তার দেখা করতে হবে? একসময় তাকে বিয়েও করতে হবে? তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে কাঁদে না। কেন কাঁদবে? কার জন্য কাঁদবে? যে তাকে কষ্ট দিয়ে সুখে আছে তার জন্য? কক্ষনও না। কিন্তু সে জানতেও পারলো না সেই মানুষটা তার চেয়েও দ্বিগুণ কষ্ট সহ্য করছে,তার মনের ব্যথাটুকু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

চলবে……

দূরত্বের আড়ালে পর্ব-০২

0

#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_২
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন

বাড়ি ফেরার পর থেকে অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে প্রণীতা। যন্ত্রণার অনলে তার হৃদয় পুড়ে ছারখার হচ্ছে। একটা মানুষকে ভালোবেসে সে আর কতো কষ্ট পাবে? আর কতো তীব্র বেদনা মনে পুষবে? আজ বাবা-মায়ের সাথে বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছিল মন ভালো রাখার উদ্দেশ্যে। অথচ ভাগ্যের কী অদ্ভুত লীলা! তাকে ফিরতে হলো একটি চূর্ণবিচূর্ণ মন নিয়ে,রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে।

সহসা সে মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব করলো। এই স্পর্শটা তার খুব চেনা,খুবই মমতাময়ী একটি স্পর্শ। সে বালিশ থেকে মাথা তুলে মুখ ঘুরিয়ে অস্ফুটস্বরে ডাকলো,“মা!”

হাফিজা কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে ভাঙা গলায় বললেন,“আসার পর থেকে কিচ্ছু খাসনি। এবার একটু খেয়ে নে।”

প্রণীতা হাফিজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর মায়ের বুকে মাথা রেখে বলতে থাকে,“খেতে মন চাচ্ছে না,মা। আমার গলা দিয়ে যে এখন এক বিন্দু খাবারও নামবে না।”

-“একজনকে মনে করে আর কতো কষ্ট পাবি তুই? আমাকে বোঝা তো? ছেলেটাকে তুই এতো ভালোবাসলি কিন্তু বিনিময়ে কী পেলি? অবহেলা,কষ্ট,বেদনা এসব ছাড়া তুই কিছু পেয়েছিস? তিনবছর আগে যখন বাইরের দেশে গেলো তখনও তোকে কিছু জানায়নি,তোর সাথে এই তিনবছরে একটা বারের জন্যও যোগাযোগ করেনি। আর এখন যখন দেশে ফিরলো তখন তোকে চিনলোই না। তাহলে তুই-ই বল এই ছেলে তোকে আদৌ ভালোবেসেছিল? তোর মনে হয়না ছেলেটা তোর সাথে বিশ্বামঘাতকতা করেছে?”

প্রণীতা নিশ্চুপ। সে খুব মনোযোগের সহিত মায়ের কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু এটা বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে যে ফারাজ তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেনি। সেই তিনবছর আগে ফারাজের চোখ দেখে তা মনে হয়নি। মনে হয়নি সেই চোখদুটোতে ভালোবাসার বদলে বিশ্বাসঘাতকতা ছিল। ফারাজের বলা এক একটি প্রেমময় কথা,সেই আবেগঘন মুহূর্তগুলো যে মিথ্যা হবে তা তো সে কখনো কল্পনাতেও আনেনি। প্রণীতার মাঝে যা ছিল তার সবটুকুই ছিল বিশ্বাস,ভরসা আর ভালোবাসা। এই অনুভূতিগুলোকে আকড়ে ধরেই সে তিনটি বছর কাটিয়েছে। প্রতিটা ক্ষণ কেটেছে তার ফারাজের অপেক্ষায়। মনে হলো মানুষটা এই বুঝি তার কাছে চলে এলো,তাকে এসে জড়িয়ে ধরে বুকে আগলে নিলো। কিন্তু সেই যখন ফিরলো তখন তার প্রেমিক পুরুষের জীবনে তার আর কোনো অস্তিত্ব থাকলো না। হাফিজা প্রণীতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,“আয়,খেয়ে নে।”

-“মা,এখন খাবো না। আমাকে একটু তোমার বুকে থাকতে দাও।”

-“দেখ,তুই যদি এখনো সেই ছেলেটাকে মনে করে কষ্ট পাস,আর ফলস্বরূপ নিজেকে না খেয়ে,না ঘুমিয়ে খালি কেঁদে কেঁদে কষ্ট দিস তাহলে তুই আমার আর তোর বাবার মরা মুখ দেখবি। এখন তুই ভেবে দেখ তোর জীবনে কার গুরুত্ব বেশি।”

-“মা! এসব কী বলছো তুমি?”

প্রণীতা আশ্চর্যের সহিত মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে। চোখেমুখে অঢেল বেদনার ছাপ। হাফিজা নিজের থেকে প্রণীতাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কঠোর গলায় বললেন,“তোর বাবারও একই কথা। তুই আর এখন ছোট নস যে তোর ভালোমন্দ বুঝার বয়স হয়নি। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। বিবেক দিয়ে ভাবতে শিখ।”

শেষ কথাটায় দাঁড়ি টেনে তিনি রুম ত্যাগ করেন। তিনি এতো চড়াও হয়ে কথাগুলো বলতে চাননি কিন্তু এছাড়াও যে কোনো উপায় নেই। চোখের সামনে মেয়েটা না খেয়ে আছে,কষ্টে গুমরে মরছে। একজন মা হয়ে কীভাবে সন্তানের এই কষ্ট সহ্য করবেন তিনি? একটামাত্র মেয়ে উনার,হীরের মানিক সে। সেই হীরের মানিকের বিন্দুমাত্র কষ্টও যে তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রার্থনা করলেন,“হে আমার রব,আমার মেয়েটার জীবনের সমস্ত দুঃখ,কষ্ট তুমি দূর করে দাও। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে,আর কতো কষ্ট পাবে সে? তাকে তুমি সুখের ঠিকানা দেখাও। সমস্ত বেদনা তুমি দূর করে দাও।”

প্রণীতা ফের বালিশে মুখ গুঁজে দিল। কান্নারত কণ্ঠে বলল,“মা,তুমি এভাবে বলতে পারলে আমায়? আমার কষ্টটা একটু বোঝার চেষ্টা করলে না?”

একসময় প্রণীতা এই অবস্থায় নিদ্রার দেশে পাড়ি জমায়। মানসিক অবসাদগ্রস্ততার সাথে শারীরিকভাবেও সে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেল টেরই পেলো না সে। এভাবে কাটল কিছুক্ষণ। মাঝে ইসহাক,হাফিজা খাওয়ার জন্য ডাকতে এলে মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আর ডাকেননি।

-“যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছে,
দুঃখের পরই সুখ আসে।
কষ্ট তোমার কেউ নাই বা বুঝুক,
আল্লাহ কিন্তু ঠিকই বুঝে।”

কেমন একটা ধোঁয়াশাময় পরিবেশ। অস্পষ্টতায় মিইয়ে যাচ্ছে সব। চারিদিকের প্রশান্তিময় হাওয়ায় জুড়াচ্ছে দেহমন। অকস্মাৎ একটি অপরিচিত কণ্ঠে ভেসে আসে উপরোক্ত বাক্যগুলো। প্রণীতা এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই মানুষটিকে খোঁজার প্রয়াস চালায়। তখনই সে দেখতে পায় সামনের দিকে এই ধোঁয়াশায় কেউ ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে,আর বাক্যগুলোর পুনরাবৃত্তি করছে। প্রণীতা তৎক্ষনাৎ লোকটির পিছু নেয়। যতোই সামনের দিকে সে পা বাড়াচ্ছে,ততোই যেন লোকটি ধোঁয়াশায় হারিয়ে যাচ্ছে। লোকটির আবছা অবয়ব ব্যতীত সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শেষে সে চিৎকার করে বলল,“কে আপনি?”

প্রণীতা ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে। শরীর তরতর করে ঘামছে। তার মানে সে এতোক্ষণ স্বপ্নে বিভোর ছিল। মাথায় এখনো লোকটির বলা সেই চারটি লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে বাক্যগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। নাহলে হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখার কী মানে? সে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে। অতঃপর ভাবতে থাকে,আমাদের দুঃখ আল্লাহ ব্যতীত কেই বা ভালো বুঝতে পারে? আমরা যখন একাকীত্বে ভুগি তখন তো মহান পাক রাব্বুল আলামিনই হয় আমাদের সাথী। তিনি সর্বদায় আমাদের সাথে আছেন,থাকবেন। সে ভাবলো,এই উছিলায় দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা যাক। ভাবনা অনুযায়ী বিছানা ছেড়ে সে ওযু করে আসে। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
নামাজ আদায় করার পর এখন কেমন শান্তি শান্তি লাগছে তার। স্বপ্নে শোনা সেই চারটি বাক্যের মর্মার্থ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো সে। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। এমনটা নয় যে,প্রণীতার কেউ নেই। তার তো বাবা আছে,মা আছে তবুও জীবনে কেমন একটা শূণ্যতা তৈরি হয়েছিল,মনে হয়েছিল জীবনে কী যেন নেই। তবে এখন আর তেমন লাগছে না। আল্লাহ তো আছে। এতোক্ষণ পর্যন্ত চিন্তাভাবনায় নিজেকে শেষ করার যে কৌশলগুলো রপ্ত করেছিল সেগুলো এখন আবর্জনার মতো মাথা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। একজন বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার মূল্যবান জীবন নষ্ট করবে সে? এটা কখনোই সম্ভব নয়। বাবা,ঠিকই বলেছে বিশ্বাসঘাতককে মনে করে সে আর কষ্ট পাবে না। সে ও দেখিয়ে দিবে ফারাজকে ছাড়া প্রণীতা ভালো থাকতে পারে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে উঠলো,“তুমি আমার নাম ভুলে গেলে আমি পুরো তুমিটাকেই ভুলে যাবো। আর যদি আমায় সম্পূর্ণরূপেই ভুলে যাও তাহলে আমার জীবনে তোমারও কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।”

এটুকু বলে থামলো সে। মনের কষ্ট ছাপিয়ে ভালোবাসার সাথেই যুদ্ধ করতে হবে। খুব কষ্ট হবে,কলিজা ছিঁড়ে যাবে তবুও সে ফারাজকে ভুলার চেষ্টা করবে। সে ফের বলল,“তুমি এতোদিন আমার নরম সত্তাটাই দেখলে যেটা ভালোবাসা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল কিন্তু এখন দেখবে তোমার প্রতি এক আকাশসম ঘৃণায় পরিপূর্ণ একটি নতুন সত্তা।”

প্রণীতা কিছুক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ সে বাবা-মার ফিসফিসিয়ে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পায়। তন্মধ্যে কিছুকথা তার কানের কাছে এসে বারি খায়।

-“আমার মনে হয়,এখন মেয়েটাকে এসব বলা ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ আগেও আমি গিয়ে ওর যা অবস্থা দেখলাম তাতে মনে হয় না সে কোনোদিন ওই ছেলেকে ভুলতে পারবে।”

-“কিন্তু এভাবে সে আর কতোদিন থাকবে? আমি বাবা হয়ে ওর এমন কষ্ট আর সহ্য করতে পারব না। চলো,এখন।”

-“বলছি কি আর কয়েকটাদিন যাক…

-“চুপ করো তুমি। এখন চলো। গিয়ে দেখি ঘুম থেকে উঠেছে কিনা।”

মিনিট কয়েকের মাঝেই তারা রুমে প্রবেশ করে। প্রণীতাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে তারা যেন খুশিই হলো। প্রণীতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে তাদেন। কী বলতে চাইছে তারা? ইসহাক হাসিমুখে এগিয়ে এসে প্রণীতার মাথায় হাত বুলান। স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বলেন,“ঘুম থেকে উঠে পড়েছিস,মা? বোস এখানে।”

প্রণীতা বিছানায় বসলো। তার একপাশে বসে ইসহাক অপরপাশে হাফিজা। ইসহাক কিছুক্ষণ চুপ থেকে গলা ঝেড়ে বলতে লাগল,“দেখ মা,মানুষ মাত্রই ভুল। আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। জীবনে ছোটবড় অনেক ভুলই করে থাকি আমরা। তেমনই ধরে নে,ফারাজকে ভালোবাসা তোর জীবনের একটা ভুল। তো এখন সেই ভুলটাকে শুধরে নেওয়াটাই উত্তম কাজ তাই না বল?”

প্রণীতা কিছু না বলে মাথা নাড়ায়। সেদিক চেয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে হাসেন তিনি। তারপর কিছুটা রয়েসয়ে বললেন,“জানি না তুই এখন বিষয়টাকে কীভাবে নিবি কিন্তু তোর ভালোর জন্যই বলছি,তুই ফারাজকে ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে সব শুরু কর। তোর পুরো জীবনটাই তো পড়ে রয়েছে। তোরও তো একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। আর কতোদিন ওই বিশ্বাসঘাতককে মনে করে কষ্ট পাবি? তাই বলছি কি,আমরা না তোর জন্য একজন ছেলেকে পছন্দ করেছি। না,মানে তুই চাইলে ছেলেটার সাথে আগে দেখা করে কথা বলতে পারিস। ওইযে তোর রহমান চাচা আছে না? তার ছেলে আহিয়ান। ছেলেটা না বড্ড ভালো। তাকে বিয়ে করলে তুই সুখী হবি,মা।”

এই বলে ইসহাক দম ছাড়লেন। এখন শুধু মেয়ের প্রতিক্রিয়া দেখার পালা। হাফিজা বললেন,“মা,তুই কি রাজি? দেখ তোকে আমরা জোর করছি না। তোর ইচ্ছে অনুযায়ী সব হবে। তুই চাইলে সময় নিতে পারিস।”

প্রণীতা এতোক্ষণে মূল বিষয় বুঝতে সক্ষম হলো। তার মা-বাবা তাহলে এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিল? মা-বাবার দিক থেকে চিন্তা করলে বিষয়টাই যৌক্তিকতা আছে। কোনো বাবা-মা তার সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সন্তান কীভাবে সুখে থাকবে সেই ভাবনায় মত্ত থাকে। তার বাবা-মাও তো তার সুখের কথাই ভাবছে। সে কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে। তারপর তাদেরকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠে,“আমি রাজি।”

চলবে……..

দূরত্বের আড়ালে পর্ব-০১

0

#সূচনা_পর্ব
#দূরত্বের_আড়ালে
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন

দীর্ঘ তিনবছর পর প্রিয় মানুষকে চক্ষু সম্মুখে দেখে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন মনে হলো প্রণীতার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই একই অনুভূতি,একই টান। হৃদকম্পন শুরু হলো ফের। সে আর একমুহূর্তও দেরি করলো না। দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরলো পুরুষটির বুক। বুকে মাথা রেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলতে লাগল,“আমি জানতাম,আপনি ফিরে আসবেন! আমি জানতাম! কারণ,আপনিও যে আমায় ভালোবাসেন আর নিজের ভালোবাসা ছেড়ে কেউ কি দূরে থাকতে পারে? পারে না তো! তাকে তো ফিরতেই হয় তার প্রিয় মানুষের কাছে।”

-“এক্সকিউজ মি! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি যাকে ভেবে এই কথাগুলো বলছেন আমি সেই ব্যক্তি নই। আপনি হয়তো গুলিয়ে ফেলছেন সব।”

এইতো সেই চিরচেনা কণ্ঠ! চিরচেনা সুর! কিন্তু মুখের বুলি ভিন্ন! প্রণীতা অবাক দৃষ্টিতে বুক থেকে মাথা তুলে। জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন হালকা করে। সামনে থাকা পুরুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েকপল। নাহ! সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে চিনতে ভুল করবে? এ কখনো হতে পারে? তার ভালোবাসা এতোটাও দুর্বল ছিল না যে সে যাকে তাকে দেখে নিজের ভালোবাসার মানুষ মনে করবে। সে চোখের জল মুছে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল,“তুমি আমাকে চিনতে পারছো না,ফারাজ? আমি প্রণীতা,তোমার ভালোবাসা।”

সামনে থাকা লোকটি ভ্রু কুঁচকালো। নিশ্চিত হতে শুধালো,“প্রণীতা? হু আর ইউ? আমি কি আপনাকে চিনি?”

প্রণীতা হতভম্ব দৃষ্টি মেলে পরখ করতে থাকে ফারাজকে। এসব কী বলছে সে? তাকে চিনতে পারছে না? সে একটু হেসে বলতে লাগল,“জানি,তুমি আমার সাথে মজা করছো,ফারাজ। দেখো,আমার সাথে একদম মজা করবে না। আমি এই ধরণের মজা পছন্দ করি না। তুমি জানো,তুমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমার কী অবস্থা হয়েছিল? আমি কতো কেঁদেছি,কত না খেয়ে থেকেছি,কতো নির্ঘুম রাত্রি কাটিয়েছি,তোমার কোনো ধারণা আছে?”

ফারাজ গম্ভীর স্বরে বলল,“দেখুন,আপনি কীভাবে আমার নাম জানেন আমি সে বিষয়ে অবগত নই। আর না আপনি কীভাবে দিনরাত কাটিয়েছেন সেসব শুনতে ইচ্ছুক। সো,প্লিজ আপনি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ান। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।”

-“ফারাজ! তুমি কি ভুলে গেলে আমায়? তোমার মনে নেই তোমার কাছে আমি এক বুক ভালোবাসা নিয়ে এসেছিলাম? তুমিও তো আমার ভালোবাসা গ্রহণ করেছিলে? তাহলে আজ কেন এমন করছো?”

ফারাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে হাজির হয় প্রণীতার বাবা-মা। প্রণীতার মা হাফিজা বেগম বললেন,“তুই এখানে কী করছিস? তোকে এদিকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা শেষ!”

প্রণীতা কান্নারত কণ্ঠে বলল,“মা,দেখো না,ফারাজ আমায় চিনতে পারছে না। সে আমায় ভুলে গেছে। সে আমার ভালোবাসা ভুলে গেছে।”

প্রণীতার বাবা ইসহাক উদ্দীন ফারাজের দিকে চেয়ে বললেন,“আরে,এটা তো ফারাজ!”

তারপর ফারাজের দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে একহাত রেখে বললেন,“কেমন আছো,বাবা? অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো।”

ফারাজ স্থিরকণ্ঠে জবাব দিলো,“জি,ভালো। তবে আপনারা আমায় চেনেন কীভাবে সেটাই বুঝতে পারছি না!”

ইসহাক অবাক হলো। পরক্ষণেই বলল,“আমাদের তুমি না-ই চিনতে পারো। সেই কবে না কবে একবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু প্রণীতাকে তো তোমার ভালো করেই চেনার কথা কারণ তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। তাকেও কি চিনতে পারছো না?”

ফারাজ প্রণীতার দিকে এক পলক তাকায়। মুহূর্তের মাঝেই দৃষ্টি সরিয়ে বলল,“না,চিনতে পারছি না। আমি কাউকেই চিনতে পারছি না। আপনারা প্লিজ সরুন। আমায় যেতে দিন। কাকে না কাকে এই মেয়ে ভালোবাসে আর ভাবছে আমিই তার সেই ভালোবাসার মানুষ। আশ্চর্য!”

প্রণীতা ফারাজের কলার শক্ত করে চেপে ধরে। কান্নারত মুখশ্রীতে স্থান নিয়েছে ক্রোধের পাহাড়। রাগে চোখদুটো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,“নাটক করছো আমার সাথে? নাটক? বুঝতে পেরেছি,বাইরের দেশে গিয়ে নতুন কাউকে পেয়ে গেছো তাই এখন আর আমাকে চিনতে পারছো না? তাই না? ছি! এতোটা অধঃপতন হয়েছে তোমার? নিজের ভালোবাসাকে ভুলে গেলে?”

ফারাজ গম্ভীর মুখে তার কলার হতে প্রণীতার হাতদুটো সরায়। অতঃপর প্রণীতার চোখের দিকে চোখ রেখে শীতল কণ্ঠে বলল,“মেয়ে মানুষ বলে ছেড়ে দিলাম। ছেলে হলে এতোক্ষণে নিজের আসল রূপটা দেখাতাম।”

এই বলে প্রণীতার সাইড কে’টে সে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রণীতা তার একহাত টেনে ধরে। আজ আর অশ্রুরা বাঁধ মানছে না। মানবেই বা কীভাবে? যার অপেক্ষায় এই তিনটা বছর সে কাটিয়েছে,যাকে মনে করে সে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে,যার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে সে সুখ খুঁজার চেষ্টা করেছে,আজ সেই মানুষটা তার সামনে। অথচ তাকে চিনতে পারছে না। অস্বীকার করছে তার এতোদিনের হৃদয়ে বোনা ভালোবাসাকে। এ দহন সে কীভাবে সহ্য করবে? প্রণীতা কাঁদতে কাঁদতে বলে,“দোহাই লাগে তোমার। এভাবে আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া তিনটা বছর কাটিয়েছি,আর পারব না। আর পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে। তোমায় বড্ড ভালোবাসি,ফারাজ। আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিও না।”

ফারাজ তপ্ত চোখে চেয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,“ব্যস,অনেক হয়েছে এসব মেলোড্রামা! এতোক্ষণ ধরে ভালো ব্যবহার করছিলাম দেখে একদম মাথায় চড়ে বসেছেন দেখা যায়! লোক হাসানোর খুব শখ আপনার তাই না? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন আমি না আপনাকে চিনি আর না আপনাকে ভালোবাসি। দয়া করে কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট করবেন না।”

ইসহাক ফারাজের দিকে তেড়ে গিয়ে বললেন,“তোমার এত্তো বড়ো সাহস? তুমি আমার মেয়েকে অপমান করছো? কী দোষ ওর? তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল এটাই তার দোষ? ঠিক আছে,এই দোষ কীভাবে উপড়ে ফেলতে হয় তা অনেক ভালো করেই এই ইসহাক উদ্দীন জানে। শুধু একটা কথা মনে রেখো,আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়ে তুমি একদমই ভালো করোনি। কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো সুখী হতে পারে না ঠিক তেমনই তুমিও পারবে না।”

অতঃপর তিনি প্রণীতার হাত ধরে বললেন,“চল,মা। এই বিশ্বাসঘাতকের জন্য একদম চোখের জল ফেলবি না। যার কাছে তোর ভালোবাসার মূল্য নেই তার জন্য তুই কেন কাঁদবি? তোর চোখের জলের মূল্য নেই? একদম কাঁদবি না। চল,এখান থেকে।”

প্রণীতা ফারাজের দিকে চেয়ে বলতে লাগল,“না,বাবা। আমি ফারাজকে ভালোবাসি। আমি ওকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আমার ফারাজের কাছে যাবো।”

ইসহাক উদ্দীন,হাফিজা বেগম দুজন প্রণীতার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলেন। প্রণীতা চিৎকার করে বলতে লাগল,“ফারাজ,আমি তোমাকে ভালোবাসি। দেখো না,তারা আমায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। তুমি একটিবার এসে আমায় আটকাও,একটিবার এসে বলো তুমি আমায় ভালোবাসো। ফারাজ,আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো? আমায় এতো বড় শাস্তি দিও না তুমি।”

প্রণীতার এরূপ শত অনুরোধ,শত আকুতি মিনতি যেন পাষাণ পুরুষটির হৃদয়ের একাংশও টলাতে পারছে না। কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রণীতাকে নিয়ে এতোক্ষণে তার বাবা-মা সে স্থান ত্যাগ করেছে। প্রণীতা এখন দৃষ্টিসীমার বাইরে। ফারাজ অনুভব করলো তার চোখে জল। সে চোখের জল মুছে বলল,“আমায় মাফ করো,প্রণীতা। মাঝে মাঝে ভালোবাসার ভালোর জন্যও দূরে চলে যেতে হয়। ঠিক ততোটাই দূরে যতোটা দূরে গেলে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমিও ঠিক ততোটাই দূরে গিয়েছিলাম কিন্তু এখন সময় এসেছে কাছে আসার। আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও দেখবে তোমার ফারাজ তোমার কাছেই ফিরে এসেছে।”

ফারাজ এলোমেলো পায়ে সামনের পথ ধরে হাঁটছে। সে এখন নিজের মাঝে নেই। তার কানে বাজছে প্রণীতার বলা প্রতিটা কথা,প্রতিটা আর্তনাদ। মেয়েটা তাকে ভালোবেসে কতো কষ্ট পেল,সেও পাষাণের মতো কষ্ট দিল। কিন্তু এছাড়া যে আর উপায় ছিল না তার। সুখ পেতে হলে দুঃখকে করতে হয় জয়। সেই দুঃখকে জয় করতে গেলে সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় কষ্ট,বেদনা। তবেই না জীবনে সুখের আলো ফুটবে, সুখপাখিরা ডানা মেলে উড়বে।

ফারাজ আজই দেশে ফিরলো। পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা করার কথা ছিল। তাই বন্ধুর ঠিকানা অনুযায়ী সেই পথে এসে গাড়ি থামায়। দীর্ঘক্ষণ পেরিয়ে গেলেও তার আসার কোনো নামগন্ধ নেই বিধায় সে গাড়ি ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। আর তখনই তার বুকে এসে ঝাঁপটে পড়ে প্রণীতা। ব্যস,মনে হলো হৃদপিণ্ডে কেউ ধারালো ছুড়ি ধারা আঘাত করেছে,হৃদপিণ্ডটাকে দুভাগ করে ফেলেছে যখন দেখলো প্রণীতা কান্না করছে। যার কষ্টে সে দ্বিগুণ কষ্ট পায় তার সাথে কড়া কণ্ঠে কথা বলা যে কতোটা কষ্টদায়ক,কতোটা বেদনাদায়ক সেটা যদি কেউ বুঝতো! ফারাজ সহজে কাঁদে না। কিন্তু আজ কাঁদছে। চোখ হতে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে সে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে পিছু ফিরে তাকায়। যাক,এতোক্ষণ ধরে যার অপেক্ষা করছিল অবশেষে তিনি হাজির হলেন। মিরাভ বিস্মিত কণ্ঠে বলল,“দোস্ত,তুই কাঁদছিলি?”

ফারাজ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,“কোথায় কাঁদছিলাম? বাদ দে,বল তোর কী অবস্থা? কতোদিন পর দেখা হলো তোর সাথে।”

মিরাভ সে কথার জবাব না দিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,“সত্যি করে বল,তুই প্রণীতার জন্য কাঁদছিলি তাই না?”

ফারাজ জবাব দিলো না। তার নিরবতা বুঝিয়ে দিলো সব। মিরাভ সেদিক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ধীর কণ্ঠে বলল,“আর কতো কষ্ট দিবি মেয়েটাকে? সত্যিটা বলে দে এবার।”

-“সময় হোক।”

-“তোর সময় আর কবে হবে? দেখিস আবার এমন সময়ে বলিস না যখন মেয়েটা আর তোর থাকবে না। হয়ে যাবে অন্যকারো বউ।”

ফারাজ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকায়। মিরাভের দুই কাঁধ ঝাকিয়ে বলে,“এমন কথা বলার সাহস করিস না,মিরাভ। প্রণীতা আমার,শুধুই আমার। ওকে আমি আর কারো হতে দিবো না। তাকে এই ফারাজ চৌধুরীর হয়েই থাকতে হবে চিরকাল।”

চলবে…….

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২৩

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২৩

“আমি ফ্লাইটের উদ্দেশ্য বের হচ্ছি৷ তোমার সাথে আবার কথা হবে তেরো ঘন্টা পর। মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করবে৷ সব মানুষ তোমাকে ছেড়ে গেলেও তোমার শিক্ষা তোমাকে কখনো একা ছাড়বে না। কলমের জোর থাকলে কারো কাছে মাথা নত করতে হয় না৷কলম তোমাকে সম্মানের সাথে বাঁচতে সাহায্য করবে৷ সো মনোযোগ দিয়ে পড়বা।”
‘নয়না হাসা শুরু করলো।
“এভাবে বোকার মত হাসছো কেন! আমি কি জোক্স বলেছি?”
“স্যরি বাট নট স্যরি। আমাদের আলতাফ স্যারের মত মোটিভেশনাল কথাবার্তা বলছেন তাই হাসছি৷ আপনি আমার অফিসিয়াল হোন বা আনঅফিসিয়ালি হোন বর তাই তো! ভবিষ্যতে আলাদা হয়ে যাবো সেটা ভিন্ন । তাই বলে কাজে যাওয়ার সময় বৌকে লেকচার দিবেন! বৌ হলো আদর করার জিনিস। সব সময় আদরে সোহাগে রাখতে হয়।”
“এসব তোমাকে কে বলল!উপন্যাস পড়ে পড়ে মাথাটা অল্প বয়সে খারাপ করছো?”
“রেগে যাচ্ছেন কেনো? এসব আমাকে নানুমনি বলেছে৷ জানেন নানুমনি নাকি নানাভাইকে অনেক নাকানিচুবানি খাওয়াতো। বেচারা নানাভাই নানুমনির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে কত কিছুই না করেছে৷”
“নয়না আমি সিরিয়াস”
“আপনি সিরিয়া কেন হবেন আপনি তো আমার কানাডা৷ শুনুন বৌয়ের কথা শুনে চলতে হয় তাহলে ঘর বাহির দু’টোই ঠিক থাকে।”
“তো এখন কি প্রফেশনাল বরের মত বিহেভিয়ার করবো?”
“এখন কি সেটাও আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে মিস্টার প্লেন ড্রাইভার! আকাশে উড়াতে পারেন আর বৌয়ের সাথে প্রেম করতে পারেননা!”
“এই বেবি কাম।”
” আর কত কাছে আসবো বেবি?”
“একদম আমার ঠোঁটের কাছে বেবি। তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে ডার্লিং।”
” উফফ বাবু! লজ্জা লাগছে তো।”
“আসো না জান।”
“এইতো এসেছি তোমার ঠিক কাছে, এতোটা কাছে যতটা কাছে আসলে একে অপরের নিঃস্বাস মিলিত হয়ে যায়।”
“বেব এবার মনে করো আমি তোমার নিঃস্বাস বন্ধ করে দিচ্ছি দু’হাতে কলার চেপে ধরে।”
‘ইট’স নট ফেয়ার মিস্টার প্লেন ড্রাইভার! মিষ্টি দেয়ার কথা বলে, জান নেয়ার ভয় দেখাচ্ছেন! আনরোমান্টিকের বস্তা।”
“কিসমিস খাওয়ার তো দেখছি খুব সখ?”
“আপনি জানেন তুষির বফ তুষিকে বলে,ওর ঠোঁটের কাছে পৃথিবীর সব মিষ্টতা ফিঁকে। আর আপনি তো মিয়া ফ্রীতে আমার মিষ্টি টেস্ট করে গেছেন৷ আপনার নামে কেস করা উচিৎ থানায়।”
“মামলা হইলে পরে দেইখা নেবো থানায়। নয়না বয়স কতটুকু তোমার! এসব বাদ দিয়ে পড়ো৷ মাথায় সারাক্ষণ দুষ্টু বুদ্ধি।”
“আমার ঠিক ততটুকু বয়স যতটুকু বয়স হলে প্রেম করা যায়।”নয়না মোবাইলের সামনে এগিয়ে এসে বলে,এই দেখুন আমার ঠোঁট এতো সুন্দর ঠোঁটে কে চুমু না খেতে চাইবে হু?
“কিস লাগবেই তোমার হানি?”
“নাহহ লাগবে না স্যার৷ প্লিজ জয়েন ইউর ডিউটি।”
” জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,গুডবাই হানি। আবার কথা হবে চৌদ্দঘন্টা পর৷ ফ্লাই কিস দিয়ে বলে,টেক কেয়ার সুইটহার্ট।”
“কন্টাক্ট বিচ্ছিন হয়ে গেলো৷ নয়না সেভাবেই বসে আছে৷ মনে মনে বলে,এইলোক এমন রসহীন কেন?আরেহহ একটা মেয়ে তোকে পছন্দ করে আর তুই টিচারের মত বিহেভিয়ার করিস! তোর মাথায় কি ঘিলু নেই? আমার টিচারের অভাব! উঠে এসে আয়নায় দাঁড়িয়ে বলে,আমি বেশি সুন্দর নাকি তার প্লেনের এয়ারহোস্টসরা বেশি সুন্দর? এই লোকের চরিত্র ঠিক আছে তো নাকি? নয়না নিজের রুম থেকে বাহিরে আসলো৷”
‘সূচনা বলে,”এই তুই এই বাড়ি থেকে যাচ্ছিস না কেন ময়না?”
“তুই নিজের বাসা ফেলে সারাক্ষণ আমাদের বাসায় কি করিস?”
“চুপ কর টয়না এটা আমার বড় আব্বুর বাসা৷ বড় আব্বুকে বিচার দেবো কিন্তু।”
“নয়না মুখে ভেংচি কেটে কিচেনে গেলো৷ কফি বিটার নিয়ে কফি বিট করছে৷”
“জাহানারা বেগম নয়নার সামনে এসে বলে,এভাবে রাগ করতে নেই নয়না৷ এখন থেকে উনিও তোমার আরেক মা৷ শোন ওনাকে খুব ভালো মনের মনে হয়েছে৷ নিজের মনে করবে।”
“নয়না কফি মগে দুধ ঢালতে ঢালতে বলে,তাই বলে তুমি আমাকে এবাড়ির মেহমান বানিয়ে দেবে! এটা আমার বাড়ি আছে, ছিলো, ভবিষ্যতেও থাকবে৷ মনে রাখবেন মিসেস মাহবুব তালুকদার আমি সুনয়না তালুকদার, তালুকদার বাড়ি মানে আমার নিজের বাড়ি।”
“নিজের মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ওরে পাগলি মেয়ে ওটাতো কথার কথা বলেছি।”

🌿

মান্নাত বাসায় ফিরে বারবার জাহিনের ভিডিওটা দেখছে৷ আর নিজেই লজ্জা পাচ্ছে! ইশশ আমি তো আপনাকে ভালোবাসি আপনি আমাকে ভালোবাসবেন তো!
” জাহিন বাসায় ফিরে গিটার নিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে গান গাইছে৷ তখন রাত বাজে তিনটে৷ হঠাৎ গেটের বাহিরে গাড়ির হর্ন শুনতে পেয়ে বাহিরে খেয়াল করলো৷ মনে মনে বলে এতো রাতে কে আসলো! গিটার রেখে নিচে নেমে আসে।

“অনিকেত বলে,আপনি কাজটা মোটেও ঠিক করেননি! একটা ছেলে কতটা স্বপ্ন নিয়ে বৌ নিতে এসেছিলো তাকে এভাবে ফাঁকি দিলেন! এতো নিষ্ঠুরতা কেনো কেনো?”
“এতো কথা কেন বলেন আপনি? আর কি সারাক্ষণ বৌ বৌ করেই যাচ্ছেন? যারা এতো বৌ বৌ করে তাদের কপালে বৌ জুটে না৷”
“প্লিজ এভাবে বলবেন না, এসব কথা শুনলে বুকে ব্যথা করে। নিজের হার্ট তো নিজে সার্জারী করতে পারবো না।”
“সায়না বলে,এই নিন ঠিকানা মুখ বন্ধ করে চুপচাপ ড্রাইভ করুন।”
“ললনা বলোনা, কার প্রেমে তুমি বাড়ি ছাড়া হলে?”
“সেটা আপনাকে কেন বলবো?”
” আমি তোমাকে হেল্প করতে পারব।আমার ফ্রেন্ড রেজার বাসা এটা আমি ভালো করেই চিনি এই ঠিকানা৷”
“আপনি রেজা ভাইয়ের বন্ধু! আরেহহ বাহহহহ নাম কি আপনার?”
” অনিকেত।”
“এরজন্যই আপনাকে পরিচিত লাগছিলো৷ আমি জাহিনের প্রেমে ফেরারি।”
” রেজার ছোট ভাই?”
“হুম। ব্যাডারে আমি পছন্দ করি কিন্তু ব্যাডা আমারে পাত্তা দেয়না।”
” যে পাত্তা দেয় না তার জন্য ঘর ছাড়া উচিৎ হয়নি। বরং যে পাত্তা দিয়ে নিতে এসেছিলো তার সাথে যাওয়া উচিৎ ছিলো৷”
“চুপ করেন পৌঁছে গেছি।”
” সায়না গাড়ি থেকে নামলো।”
“অনিকেত বলল,আমরা সব সময় ভুল মানুষকে প্রায়োরিটি দিতে যেয়ে নিজেদের সেল্ফ রেসপেক্ট কমিয়ে ফেলি। যাকে আমরা ভালোবাসি তারচেয়ে তাকেই আপন করে নেয়া ভালো যে আমাদের ভালোবাসে। অথচ আমরা তার পেছনে নিজের সবটুকু আবেগ, অনূভুতি, ভালোবাসা বিসর্জন দেই!”
“সায়না এক পলক স্থীর করলো। মনে মনে বলল,ছেলেটা দেখতে তো খারাপ না। এই যে মিস্টার বৌ পাগলা, ধন্যবাদ।”
“জাহিন গেটের সামনে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,যেখান থেকে এসেছিস সেখানে ব্যাক কর।”
“তোমাকে বিয়ে না করে এই বাড়ি ছাড়বো না৷ বিয়ের জন্য অনশনে বসবো জাহিন ভাই।”
“লজ্জা করে না ডাকিস ভাইয়া বানাতে চাস ছ্যাইয়া?”
“মুখে বলি ভাইয়া মনে মনে বলে জান্টুস।”
“অনিকেত গাড়ি থেকে বের হয়ে জাহিনকে বলে,হেই লিটল ব্রো কি অবস্থা?”
” জাহিন অনিকেতের সাথে হাত মিলিয়ে বলে,আপনি এতো রাতে এই পাগলের সাথে?”
“রাস্তায় গুন্ডীগিরি করে এখানে নিয়ে এসেছে। ভাই সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করে নাও বৌ না থাকলে জীবনে আর কিছু নাই।”
” জাহিন হেসে বলে ভেতরে আসো৷”
“সায়না, জাহিন, অনিকেত বাসায় প্রবেশ করলো।”
🌿

নীলাঞ্জনা সকাল থেকে এদিক ওদিক ঘুরছে৷ তার সম্বল বলতে পাঁচশ টাকা আছে হাতে৷ সারাদিন পর সন্ধায় একটা ছাউনির নিচে বসলো। কি করবো কোথায় যাবো? এ জীবন এতো বিষাক্ত না হলেও পারতো! আমার কাছে তো মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই৷ কোন মুখে পরিবারের সামনে দাঁড়াবো? আমি যে নিজের হাতে সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি। রাস্তায় থাকলে রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে আমাকে খুবলে খাবে মানুষ নামের পশুরা। আমি বেঁচে থেকে কি করবো!মরে যাবো, আমি মরেই যাবো। আমার কোন অধিকার নেই বেঁচে থাকার৷ রাত একটা পর্যন্ত এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো৷ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বসে পরলো গেটের সামনে৷ চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিলো৷ চোখের সামনে ভেসে উঠলো জিয়ানের মুখশ্রী। কি নির্মম ভাবে আমি তোমাকে প্রতিনিয়ত ঠকিয়েছি! মনে পরলো পুরোনো স্মৃতি… জিয়ান নিজের ব্লেজার নীলাঞ্জনার কাঁধে পড়িয়ে দিয়ে বলছে, নীলাঞ্জনা আমার স্লিভলেস ব্লাউজ পছন্দ না কতবার বলেছি এসব পরে বের হবে না?

“তোমার সব কিছুতেই শাসন বারন আমার একদম পছন্দ না৷ বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। এই যুগে এসেও সেই দাদার আমলের মানুষের মত বিহেভিয়ার কেনো করো রেজা? আমার শরীর আমার ইচ্ছে আমি কতটুকু দেখাবো৷ বলেই ব্লেজার ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে আসলো”, নীলাঞ্জনার চোখ থেকে অঝোর ধারায় বর্ষণ হতে লাগলো৷ কি হারিয়েছে সে এখন অনুভব করছে। কিন্তু এখন যে আর ফিরবে না সে।
চোখের কার্নিশ বেয়ে বোবা অশ্রু গুলো মুছে নিতে নিতে বলে,”তুমি ছিলে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়, আর এখন আমি সেই অধ্যায়ের শূন্যতায় ডুবে আছি। তোমার চলে যাওয়া আমার ভেতরে যে শূন্যতা রেখে গেছে, তা কখনো পূর্ণ হবে না। কিন্তু জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসি—এ অনুভূতি আমার মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবে, আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত!!আমি ভুল করেছি রেজা। এই ভুলের মাশুল হয়ত আমার জীবনের বিনিময়ে দিতে হবে! আমি বুঝতে পারিনি স্বর্ন খুঁজতে যেয়ে হিরে হারিয়ে ফেলছি! আমার তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলে আমার জীবনটা হয়ত আবার প্রান ফিরে পেতো৷ অথচ এজন্মে আর তোমার বক্ষে মাথা রাখার অধিকার আমার নেই। ইচ্ছে করছে সমাজের নিয়ম ভেঙে বেহায়া হয়ে তোমার বক্ষে ঝাপিয়ে পরে,চিৎকার করে কান্না করি৷

#চলবে

অচেনা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

অচেনা
শেষ পর্ব,

বড় ভাবীকে ঘিরে পরবর্তী চার থেকে পাঁচ ঘন্টা ,বাড়ির সদস্য এবং পাড়া প্রতিবেশীর বুকভাঙা আহাজারি চলতে থাকলো… তারপর হঠাৎ সবাই কেমন ক্লান্ত হয়ে গেল।
দুঃখ কষ্টের তীব্রতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আস্তে আস্তে ভোঁতা হয়ে আসে । সহনশীল হয়ে আসে। তখন সেই যন্ত্রণা প্রকাশ করার চেয়ে বুকের মধ্যে পুষে রাখতেই আরাম লাগে।

পাড়া-প্রতিবেশীরা একজন আরেকজনের সাথে হাজারো রকমের তর্ক বিতর্ক, পরামর্শ, উপদেশ, ঘটনার কারণ এবং তাঁর সম্ভাব্য ভয়াবহ সব ফলাফল আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে করে ক্ষান্ত হয়ে গেল । কেউ কেউ এরমধ্যেই বিদায় নিয়েছে, কেউ কেউ যাচ্ছি, যাই করছে।

আব্বার এই বয়সে ,এর চেয়ে বেশি সময় ধরে বিলাপ করার মতো শারীরিক শক্তি নেই।
ভাবী ডাইনিং টেবিলে সেই ঠায় বসে আছে। কেউ কেউ ভাবীকে কাঁদানোর চেষ্টা করেছে,, কিন্তু লাভ হয়নি। যেন এ বাড়িতে কি ঘটছে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ভাবী।
আমার ভীষণ ইচ্ছা করছিল, ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদি, ,, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার মনের ইচ্ছা মনেই থেকে যায়।

কেউ একজন ফোনে ছোট ভাইয়াকে খবরটা দিয়েছে, ছোট ভাইয়া আর ভাবী এসেছিলেন।বড় ভাইয়া লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে,তার নতুন বউয়ের জন্য খাবার নিতে রুম থেকে বের হয়েছিলেন…ছোট ভাইয়া আর ভাবীকে দেখতে পেয়ে,,বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে তাদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করলেন।

“ও তোদের খুব অসুবিধা হয়ে গেল তাই না, আকবর? বসে বসে আমার সব সম্পদ পাবি বলে স্বপ্ন দেখেছিলি…. আমার ছেলে হলে তো তোদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি… আমার ভালো কবে চাইসিলি তোরা? খুব জ্বলে তাই না? আমার ছেলে হবে শুনে? কে খবর দিলো তোদের এখানে মাতব্বরি করার জন্য?। তোদের ফন্দি আমি বুঝি, ..বড় ভাবীর জন্য তোদের কত দরদ আমার সব জানা আছে।আসল কথা তো অন্যখানে… এক কনা সম্পত্তি পাবি না আমার, মনে রাখিস….ইত্যাদি ইত্যাদি ।”
“তোদের” শব্দটা দিয়ে,বড় ভাইয়া আমাকে সহ বোঝালো কিনা জানিনা…

আর এতো লাভ ক্ষতি বোঝেন বড় ভাইয়া!! চারটা পরীর মতো মেয়ের কোন অস্তিত্ব নেই ভাইয়ার কাছে? এতো অন্ধকার এই মানুষটার মনে?

ছোট ভাইয়া এইসব শুনে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। ছোট ভাবী অবশ্য আরো কিছুক্ষণ রয়ে গেল।
আব্বার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল… সম্ভবত আব্বা এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না,যে তার নয়নের মনি আলমগীর — এমন একটা কাজ করতে পারে।ছোট ভাবী আব্বাকে বেশ জোর করে একটু খাইয়েছে…,
তারপর ঘুমাতে যাওয়ার জন্য অনেক জোর করলো , কিন্তু আব্বার এক কথা… আলমগীর আর রুকুর সাথে কথা না বলে ,আব্বা বিছানায় যাবেন না।

ছোট ভাবীকে আমার খারাপ লাগে না। যদিও বেশিদিন এই বাড়িতে থাকা হয়নি তার, তবু বড় ভাবীর প্রতি তার ভালোবাসা আন্দাজ করতে পারি। ভালোবাসা আর ঘৃনা দুটোরই একটা গন্ধ আছে। কোনো রকম কথাবার্তা না হলেও ,কে আপনাকে ভালোবাসে আর কে আপনাকে ঘৃনা করে ,সেটা কেমন যেন টের পাওয়া যায়।

ছোট ভাবী আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে.. এ বাড়ির চার মেয়েকে নিজের সাথে নিয়ে যাবার কথা বললো।

আমি ছোট ভাবীর সিদ্ধান্তে সায় দিলাম মাথা নেড়ে।
সত্যি এটা খুব ভালো হবে।

এদিকে ছোট ভাইয়া রাগ করে,বাড়ির বাইরে গাড়িতে বসে ভাবীর জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের গাড়িতে সবার জায়গা হবে না।তাই বাড়ির আরেকটা গাড়ি নিয়ে আমিও গেলাম সবাইকে নামিয়ে দিতে। ড্রাইভারকে দিয়েই পাঠিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু বড় ভাবীর স্হির মুখটা দেখে আর বাড়িভর্তি লোকজনের মন্তব্যে আমার কেমন দম বন্ধ লাগছিলো।

সবাইকে নামিয়ে দিয়ে যখন ফিরছি তখন ড্রাইভার , সিরাজের মুখে অনেক গল্প জানতে পারলাম।

সিরাজ এই বাড়িতে এসেছে মাত্র কয়েকমাস হলো। আগে তার চাচা মতি মিয়া,আমাদের অনেক বছরের পুরনো এবং বিশ্বস্ত ড্রাইভার ছিল। উনার অনেক বয়স হয়েছে বলে তার‌ই অনুরোধে ,ভাতিজা সিরাজকে রাখা হয়েছে। সিরাজের বয়স একদম কম, কথা বললেই বোঝা যায় সে বেশ চটপটে এবং বুদ্ধিমান ছেলে।বড় ভাবীকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে সিরাজ। সত্যি বলতে এ বাড়িতে যত লোক কাজ করে, আশ্রয় পায় সবাই বড় ভাবীকে অনেক ভালোবাসে এবং সম্মান করে।বড় ভাবীর প্রতি আনুগত্য থেকেই সিরাজ গত কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভাইয়ার ঢাকার কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ করে ,নতুন ব‌উ সম্পর্কিত সব খবর বের করে ফেলেছে। নতুন ব‌উ এর নাম জেরিন।সে ভাইয়ার ম্যানেজার এর বোন।এই বয়সে এসে,,সুন্দরী এই মেয়েকে বিয়ে করতে ভাইয়া বিশ লক্ষ টাকার গয়না দিয়েছে, সাথে পঁচিশ লক্ষ টাকার কাবিন পরিশোধ করেছে, এবং আরো কিছু সম্পত্তি বা ব্যবসার শেয়ার লিখে দেয়ার কথা রয়েছে। হানিমুন করতে দুজন মিলে থাইল্যান্ডেও গিয়েছিল।
এই মেয়েটির সাথে কয়েক বছর ধরে ভাইয়ার সম্পর্ক । ঢাকার বাড়িটি এই মেয়ের নামে কেনা হয়েছে।

এইসব শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। নিজেকে দারুন নির্বোধ মনে হচ্ছিল। চোখের সামনে এতো কিছু ঘটে গেলো আর আমি একটুও টের পেলাম না।

জন্মের পরপরই মা’কে হারিয়েছি তো, তাই আমি ভালোবাসা আর স্নেহের কাঙাল। টাকা পয়সা, বিষয় সম্পদ আমাকে এতটুকু আকৃষ্ট করে না।তাই এগুলো নিয়ে মাথাই ঘামাই না আমি।ন‌ইলে আট নয় মাস আগে, বড় ভাইয়া যখন ভাবীর ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়েছিল তখন একটু খোঁজ নিতে পারতাম।

বড় ভাইয়া ইচ্ছে করেই ভাবীর একাউন্ট খালি করেছেন, যেন ভাবী টাকার জোরে কোথাও যেতে না পারেন ।মন থেকে মানুক আর না মানুক,এ বাড়িতে থেকেই যেন বড় ভাবী সবার সেবা যত্ন করেন এটাই ভাইয়ার প্ল্যান।

বড় ভাবীর বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। দুই ভাইয়ের কেউই সচ্ছল নন,। চার মেয়েকে নিয়ে বড় ভাবীর শেষ জীবন তাহলে এই অপমানের মধ্যে কাটবে?

বাড়িতে ফিরে বাকি লোকজনদের বুঝিয়ে বিদায় করলাম।
তারপর বড় ভাবীর সামনে এসে দাঁড়ালাম…

ভাবী আমার দিকে তাকালেন না,,,একবার‌ও না।

মনে হলো ভাবীর কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন।
আমি নিজের ঘরে ঢুকে গেলাম।হঠাৎ দেখি বড় ভাইয়া পিছনে…
শেষ কবে বড় ভাইয়া আমার ঘরে এসেছিলেন.. আমার সাথে কথা বলতে.. মনে পড়ে না।
আমি বললাম,”আব্বা আপনার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে অনেকক্ষন যাবৎ, আপনি একটু আব্বার ঘরে যান।”
বড় ভাইয়া খুব একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

“জাহাঙ্গীর, রুকু কে একটু ম্যানেজ কর তুই।বোকা মানুষ তো,,, কি থেকে কি করে ফেলে…ওর খাওয়া পড়ার কোন সমস্যা তো হবে না… যেমন ছিল তেমনই থাকবে… বাড়িতে একজন সদস্য বাড়লো আর কি…তোর নতুন ভাবীর এখন একটু যত্ন দরকার। রুকু একটু ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াবে এই তো… একটু প্র্যাকটিক্যালি চিন্তা করে দেখ… আমি তো…”

প্রচন্ড রাগে আমার মনে হচ্ছিল , ঘুষি মেরে বড় ভাইয়ার নাক মুখ ফাটিয়ে দিই।

তার চোখে মুখে কোন অপরাধবোধ নেই, নেই বড় ভাবীর প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা। মনে হয় যেন খাওয়া পড়াটাই বড় ভাবীর একমাত্র প্রাপ্য, এরজন্য‌ই বড় ভাবী এই পরিবারটা কে এইভাবে আগলে রেখেছিল।

ভাইয়ার পিশাচের মতো মুখের দিকে তাকিয়ে,,আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম কি করবো।

পাঁচ বছর পর…..

সন্তানের অধিকার খাটিয়ে বড় ভাবীকে সেদিন আমার সঙ্গে আসতে রাজি করিয়েছিলাম। সাথে আব্বা। মেয়েরাও কেউ থাকতে চায় নি বাবার সাথে। সেদিন ওই বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছিল আমার বড় ভাবী, ভাইয়ার দেয়া যেকোনো জিনিস নিতে ঘৃনা হচ্ছিল তাঁর । বড় ভাইয়া কাউকে আটকানোর চেষ্টা করে নি ভালোবেসে,,ক্ষমা চেয়ে… বরং ভাবীর গায়ে হাত তুলেছিল,এক মনিবের মতোন।

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সামান্য যা কিছু আমার ছিল, তাই দিয়ে পার্টনারশিপে আমি আর বড়ভাবী একটা ছোট ব্যবসা শুরু করেছি। আমার মূলধন আর বড়ভাবীর শ্রম।

পরিশ্রমী ভাবীর ব্যবসা দাড় করাতে সময় লাগেনি। আমিও ছিলাম পাশে, বড় ভাবীর কাছে যে আমার অনেক ঋন।

বড় মেয়ের তো পড়া শেষের পথে ছিল‌ই । ছোট ভাইয়ার সামান্য সাহায্যে সেটা পুরোপুরি শেষ হয়েছিল।ভাবী নিজের রোজগার করা টাকায় সেই ঋন শোধ করতে পেরেছেন।
মেজো মেয়ে নিজ যোগ্যতায় সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
পরের দুইজনও আশা করছি এবছর ভালো জায়গায় চান্স পাবে।
আমিও বিয়ে করে সংসারী হয়েছি। আমাদের সবার মাঝে বাবাও ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সত্যি বলতে, আমরা সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচছি। সবকিছু এতো সহজ নয় তো॥

আর বড় ভাইয়া?
বড় ভাইয়ার সুন্দরী বউ, তার কাছ থেকে টাকা পয়সা যতটুকু সম্ভব নিয়ে ..উধাও হয়ে গিয়েছে ম্যানেজারের সাথে।যাকে ভাই বানিয়ে বড় ভাইয়াকে বিয়ে করেছিল। যতটুকু শুনেছি ঐ বাচ্চাটা ম্যানেজারের, ভাইয়ার নয়। সারা জীবন এতো হিসেবে দক্ষ ভাই, শেষ সময়ে গড়মিল করে ফেললেন।
সেই শোকে, ..যন্ত্রণায় ,ভাইয়া শয্যাশায়ী।
সাথে অযত্ন,,,,হায়..! জলপাই তেল দিয়ে খাবার বানিয়ে দেয়ার কেউ তো নেই আর।
যার দুই দুইটা মেয়ে ডাক্তার, সে এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে,একা ঘরে নিজের সাথেই নিজের জীবনের হিসাব করে। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে, ওদের নিয়ে বড় ভাইয়াকে একটু দেখে আসি কিন্তু ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ইচ্ছা দমন করে রাখি।

বড় ভাবী কখনো ভাইয়ার প্রসংগে একটা কথাও বলে না। বাড়িতে বড় ভাইয়া কে নিয়ে কথা হলে, সেখান থেকে সরে যান ভাবী। এতোটা নিয়ন্ত্রণ নিজের উপর কারো থাকতে পারে, চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস হয়না।

বড় ভাবী সব দিক থেকেই জয়ী,
তবু ভাবীর মুখে মাঝে মাঝেই, ভীষণ ভাবে প্রতারিত হবার কেমন একটা বিষন্নতা ছুঁয়ে থাকে। অবশ্য সেদিনের পর,,,তার চোখে আজ‌ও একফোঁটা অশ্রু দেখিনি আমি।
শক্ত খোলসে মোড়ানো,এই ভাবী যেন আমার বড্ড অচেনা।

অচেনা,
রুচিরা
Ruchira Sultana

(সমাপ্ত)

অচেনা পর্ব-০১

0

অচেনা (প্রথম পর্ব)
রুচিরা

মাস ছয়েক ধরে লক্ষ্য করছি,বড় ভাইয়া যেদিন রাতে বাড়ি ফিরে সেদিন ভাবি লিপস্টিক , কাজল ,পাউডার দিয়ে সেজেগুজে টেবিলে খাবার সাজিয়ে, ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করে । ভাইয়ার জন্য সেজেছে বলে ভাবীর মুখে একরাশ লজ্জা ঘিরে থাকে ।লজ্জায় ভাবি তার মাথার ঘোমটা কারনে অকারণে বারবার টানতে থাকে,, ঘোমটার টানে ভাবির চুল অনেক বেশি এলোমেলো হয়ে যায় ।ভাবিকে খুব অচেনা দেখায় তখন।

ব্যাপারটা এমন নয় যে ,বড় ভাইয়া ছয়মাস কিংবা এক বছর পর পর বাড়ি আসে ।বড় ভাইয়া প্রতি সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসে ।তাছাড়া ভাইয়া যে খুব দূরে থাকে তাও না, যে বাড়িটাতে এখন আমরা থাকি সেটা নারায়ণগঞ্জে…এটা ছাড়াও আমাদের আরো বাড়ি আছে এই শহরেই।ভাইয়া আগে এখানে থেকেই সব ব্যবসা করত ।এখন ভাইয়ার ব্যবসা অনেক অনেক বড় হয়েছে,, সেজন্যই ঢাকায় থাকতে হয় । নিজের ব্যবসার সবকিছুই ভাইয়া নিজে দেখাশোনা করে। আমাকে বা ছোট ভাইয়াকে ব্যবসা থেকে বেশ দূরেই রাখে। ব্যবসা দেখাশোনার সুবিধার্থে ঢাকায় একটা বাড়িও কিনেছে ইতিমধ্যে থাকার জন্য।বিদেশেও যাচ্ছে আজকাল দেখছি।

যাই হোক, বড় ভাবীর প্রসঙ্গে আসি।সকাল থেকে ভাইয়া আর বাড়ির বাকি সবার জন্য রান্না করে করে ভাবী ক্লান্ত হয়ে যায়। ভাইয়া আর বাকি সবাইকে এক না করার কারণ হলো এই বাড়িতে দুই রকমের রান্না হয়। বাড়ির সব সদস্যদের জন্য একরকম আর ভাইয়ার জন্য আরেকরকম।বাসায় সবাই যত‌ই ভাবীকে বলে, কাজের লোক তো আছে কয়েকটা…তারাও তো রান্না করতে পারে …. কিন্তু ভাবি খুব বেশ একটা রাগ আর লজ্জা মিশিয়ে বলতে থাকে,,, “জানোই তো তোমাদের ভাই আমার রান্না ছাড়া খেতেই পারে না… আর বাবার কতো বয়স হয়েছে, তার কি এখন কাজের লোকের রান্না মুখে রুচে? বাচ্চারাও তো আমার হাতের রান্না খেতে চায়,, এখন কি করা? কষ্ট করে করি “… মনে হবে যেন রান্নার জন্য ভাবীর খুব কষ্ট হয় …কিন্তু সত্যি এটাই যে ভাবি নিজের খুশিতেই এইসব রান্নাবান্না করে।
শুধু তাই নয়,,আমার এই মহান ভাবী প্রতিদিন ভাইয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে রান্না করে ঢাকায় পাঠান।ড্রাইভারকে দিয়ে দুপুর বারোটার আগে ভাইয়ার জন্য সব রান্না করে পাঠানো হয়।
এর পেছনে ভাবীর একনিষ্ঠ ভালোবাসা ছাড়া আরও একটা কারণ আছে। সেটা হল কয়েক বছর আগে ভাইয়ার হঠাৎ করে খুব শরীর খারাপ হয় ।বড় ভাইয়ার বয়স পঞ্চান্ন, অসুখ বিসুখে ভোগার মোক্ষম বয়স এটা। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় হার্টে ব্লক আছে । শুনে ভাবি একেবারে অস্থির হয়ে পড়ে। আল্লাহর রহমতে বড় ভাইয়া ভাবীর চার মেয়ে। একজনের‌ও বিয়ে হয়নি, বড় মেয়ে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ছে,, এরপরের জন এইচএসসি দিবে আর তারপর দুটো জমজ মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে।এই অবস্থায় ভাইয়ার ভালো মন্দ কিছু হলে মেয়েদের নিয়ে ভাবী কোথায় যাবে? অনেক ডাক্তার, ওষুধ চলার পর শেষ পর্যন্ত ,,ভাবী ভাইয়ের জন্য কিটো ডায়েট নামে এক ডায়েট শুরু করেছে ।সেই রান্নার যোগান করতে করতে ভাবির দিন পার হয়ে যায় ।

তবে বলা যায় …ভাইয়া এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ ।বেশ ফিট লাগে ভাইয়াকে আজকাল ।কিছুদিন আগেই থাইল্যান্ডে গিয়ে সমস্ত চেক আপ করে এসেছে। সব রিপোর্ট ভালো, আর রিপোর্ট ভালো এসেছে শুনে মহা আনন্দে ভাবী এই ডায়েট আরো কড়া ভাবে চালু রেখেছে।

আমার ভাবী শুধু যে আগ্রহ নিয়ে রান্না করে তাই না,,, বাড়ির সমস্ত সাংসারিক কাজে ভাবী ভীষণ দক্ষ। এই বাড়িতে ভাবী আসার কিছুদিন পর আমার জন্ম হয়। সন্তান জন্মের জন্য আম্মার বয়সটা উপযুক্ত ছিল না। আমার জন্মের চারদিন পর আম্মা মারা যান। কয়েকদিনের এই ছোট্ট আমাকে নিয়ে সবার দুশ্চিন্তার সীমা ছিল না। আত্মীয়-স্বজন সবাই আব্বাকে আবার বিয়ে করার জন্য নানাভাবে চাপ দিয়েছিল। কিন্তু আব্বার অগাধ আস্থা ছিল বড় ভাবীর উপর। ভাবী
কে ডেকে নিয়ে আব্বা বলেছিল,” রুকু মা,তুই আমার একমাত্র ভরসা মা ..আমার ছোট্ট জাহাঙ্গীরকে তুই দেখবি তো?”
আম্মা শখ করে মোগল সম্রাটদের নামে আমাদের তিন ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন। আলমগীর,আকবর আর আমি জাহাঙ্গীর।আর ভাবীর নাম রোকেয়া, আদর করে আব্বা রুকু ডাকেন।
আব্বার কথায় সেই যে ভাবী আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল,, এরপর আর কখনো আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। আমি একটু বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত ভাবী নিজের সন্তান নেওয়ার কথা চিন্তা করেননি। আমাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছেন ঠিক আমার মায়ের মতো করে।বড় ভাইয়া কোন এক অজানা কারণে আমাকে পছন্দ করেননা, খুব একটা কথাও বলেন না….হয়তো আমাকে আম্মার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন।আর ছোট ভাইয়া ঝগড়া করে ব্যবসা বুঝে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন বহু আগে।তাই নিজের সংসারের পাশাপাশি বৃদ্ধ শশুর আর মা হারা দেবরকে ভাবীই আগলে রাখেন। এজন্যই ভাবীর জন্য আমার অগাধ মায়া ,,ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।সব করতে পারি আমি, এই মানুষটার জন্য।

আজ‌ও বড় ভাইয়া বাড়ি আসবে বলে সেজেগুজে অপেক্ষা করছিল ভাবী। সংসারের বাকি সব কাজ যতটা দক্ষতার সাথে করে, নিজের সাজের বিষয়ে ততটাই কাঁচা আমার ভাবী। নিজের প্রতি সবসময় বড্ড উদাসীন।তা না হলে লিপস্টিক সবসময় ভাবীর দাঁতে লেগে যায়, কাজলটাও ঠিক ঠাক দিতে পারে না। পাউডার কেমন ভেসে ভেসে থাকে।আর চুলের কথাতো বলেছি…বারবার ঘোমটার টানে চুলটা একদম অগোছালো হয়ে যায়। মিষ্টি মুখের ভাবীকে বড় অচেনা লাগে। একবার দুবার নয়, যতবার সাজে এমন‌ই হয়।

আমার খুব ইচ্ছা করে বলতে যে “ভাবী তুমি সাজটা ধূয়ে ফেলো” কিন্তু ভাবী হয়তো কষ্ট পাবে ,আরো বেশি লজ্জা পাবে… এই ভেবে আর বলিনা ।

কলিং বেলের শব্দে ভাবী দৌড়ে দরজা খুলে দিল।

বড় ভাইয়ার সাথে একটা মেয়ে, দেখতে বেশ সুন্দরী, চেহারার মধ্যে কেমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব।

বড় ভাইয়া মেয়েটাকে হাত ধরে ভিতরে এনে বসিয়ে দিলো।

ভাইয়ার সাথে মেহমান দেখে ভাবী আরো ব্যস্ত হয়ে গেলো।

___মেহমান নিয়ে আসবেন, আগে ফোন করে একটু জানাবেন না ? এখন তো ঘরের রান্না দিয়েই মেহমান খাওয়াতে হবে। আপনার কবে একটু বুদ্ধি হবে, বলেন তো?
__ভাবী লিপস্টিক লাগানো দাঁত বের করে হেসে হেসে ভাইয়াকে অভিযোগ করছে।
__ভাইয়া কিছু না বলে আব্বার ঘরে ঢুকে গেল, আর এরপর যা শুনলাম তাতে আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম।
বড় ভাইয়ার হাবভাব আর মেয়েটার সাথে ভাইয়ার আচরণ দেখে আমার প্রথমেই একটু খটকা লাগছিল কিন্তু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে নিজের বড় মেয়ের কাছাকাছি বয়সী কোন মেয়েকে এই বয়সে বিয়ে করে বাড়িতে এনে তুলতে পারে।

বড় ভাইয়ার ভাষ্যমতে,ভাবীর উপর তার কোন অভিযোগ নেই, তবে চার চারজন মেয়ের বাবা হয়ে ভাইয়া থাকতে চায় না। এতো বড় ব্যবসা ভাইয়ার, ছেলে না হলে এই সম্পদ ভাইদের কাছে যাবে।এতো কষ্টের সম্পদ রক্ষা করার জন্যই ভাইয়া বিয়ে করেছেন। তার নতুন ব‌উটি এখন সন্তান সম্ভবা এবং ডাক্তার বলেছে ছেলে সন্তান আছে ভাইয়ার নতুন ব‌উএর গর্ভে। এখন তার সেবা যত্ন দরকার।তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছেন যেন বড় ভাবী ঠিক মতো যত্ন করে খাওয়াতে পারে।
বাড়ির সব মানুষ আচমকা এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। জানিনা কি এক অদৃশ্য মাধ্যমে আধা ঘন্টার মধ্যে গোটা পাড়ায় খবরটা জানাজানি হয়ে গেলো। আমাদের সাজানো সুখের বাড়িটা মরা বাড়ির মতো হাহাকার করতে শুরু করলো।
____সারাজীবন এই সংসারে দাসীর মত খেটে ভাবীর কপালে এই জুটলো শেষমেশ !এই আহাজারি সব পাড়া প্রতিবেশীর মুখে।

পাড়া প্রতিবেশীর কাছে ভাবীর যথেষ্ট সুনাম। তাদের তোপের মুখে ভাইয়ার সুন্দরী, সন্তান সম্ভবা নতুন ব‌উ অসুস্থ বোধ করছিল, তাই ভাইয়া কোলে করে নতুন ব‌উ কে নিয়ে বেডরুমে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ হার্টের সমস্যা আছে বলে, পাঁচ কেজির ব্যাগ উঠাতেও দেয় না ভাবী, ভাইয়া কে।
এইসব দেখে…
এই বৃদ্ধ বয়সে, শিশুর মতো কাঁদছেন আব্বা, তার চার নাতনি কে জড়িয়ে ধরে।
বাড়ির কাজের লোকগুলো পর্যন্ত বিলাপ করছে…
শুধু একজন এবাড়িতে কাঁদছে না, বড় ভাবী…

ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভয় হলো আমার।এক টেবিল ভর্তি খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। ভাবীর মুখে কেমন একটা অদ্ভুত হাসি যেন,, চোখদুটো বড্ড স্হির , অশ্রুহীন।
কারো এরকম চেহারা , আমি কখনো দেখিনি আগে…

চলবে…..

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২২

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২২
“জিয়ান নয়নার কোমড় ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো, নয়নার এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে৷ ”
“নয়না চোখ বন্ধ করে নিলো,এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে লজ্জা করে তো!”
“জিয়ান নয়নার চোখে ফুউউ দিয়ে বলে,তোমার লজ্জা আমার কাছে বিসর্জন দাও। আমি তোমাকে পুরোপুরি আমার দখলে নিতে চাই?”
“নয়না সরে যেতে চাইলো৷ কেমন এলোমেলো লাগছে তার, বুকের ভেতর কেউ তবলা বাজাচ্ছে! আশ্চর্য মানুষটা সামনে আসলেই এভাবে হৃদপিণ্ড বের হয়ে আসতে চায় কেনো৷”
‘”জিয়ান নয়নার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বলে,তুমি বড্ড মোহনীয়। তোমার ঠোঁট দুটো যেনো কালো জাদু জানে! বারবার আমাকে টানে৷”
“নয়না জিয়ানের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে বলে,ছাড়ুন আমাকে৷”
“জিয়ান ধীরে ধীরে নয়নার ঠোঁটের দিকে নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিতে নিতে বলে,এতো কাছে এসে ছাড়া যায় বলো?আমি এই ঠোঁটের সুধা পান করে তবেই ছাড়বো৷”
“নয়না আর কিছু বলতে পারলো না, তার আগেই জিয়ান নয়নার ঠোঁট দুটো দখল করে নিলো।”
“নয়না হুট করে জিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে গেলো৷”
“প্লিজ ডোন্ট লিভ, আই নিড ইউর লিপস।”
“নয়না হাসছে কি মনোমুগ্ধকর সে হাসি!”
“জিয়ান দ্রুত উঠে বসলো,সামনে তাকিয়ে দেখে পর্দা নড়ছে। রুম জুড়ে কি ভিষণ শূন্যতা বিরাজ করছে। সাইড টেবিল থেকে ওয়াটারপট নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করলো। অস্বস্তি হচ্ছে!নয়না নেই? নয়না এখানে কিভাবে আসবে? তারমানে স্বপ্ন ছিলো? ঘড়ি বের করে টাইম দেখলো। এখনো আরো দু’ঘন্টা রাত বাকি। বারান্দায় এসে ইজি চেয়ারে বসবে ভেবে বাহিরে আসলো। পুরো বারান্দা সাদা বরফে ঢাকা৷ দরজা বন্ধ করে রুমে চলে আসলো৷ নিজের ব্যাগ থেকে নয়নার বুকসেল্ফ থেকে চুরি করে আনা বইটা বের করলো৷ তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে,বইয়ের নামটা ঠিক পছন্দ হলো না জিয়ানের! মনে মনে ভাবলো নিশ্চিত বিরহের গল্প নাহহ এখন তার বিরহ বিলাস করার ইচ্ছে নেই৷ আবার শুয়ে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো৷
🌿

নয়না বারান্দায় বসে পড়ছিলো। হঠাৎ খেয়াল করলো তাদের বাসায় একটা প্রাইভেট কার ঢুকছে৷ সূচনা এসে বলে,এবার তোকে নিয়ে যাবে দেখিস৷ তারপর সবার আদর আমি একা খাবো।
“এই তোকে না কতবার বলেছি আমাকে তুই করে বলবি না৷”
“বলবো তোকে আমি তুই করে বলবো৷ নয়না, টয়না গান কেউ কয় না৷”
“সূচনা তোকে আমি ছাড়বো না। বলে নয়না সূচনার পেছনে ছুটতে লাগে।”
“হঠাৎ থমকে যেয়ে বলে, আপনি? নয়না নিজের দিকে তাকিয়ে একছুটে নিজের রুমে চলে গেলো৷ নয়না প্লাজু আর টিশার্ট পরা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,ছিহহহ নয়না ছিহহহ শ্বাশুড়ির সামনে মানসম্মান হারালি!দ্রুত একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ড্রেস চেঞ্জ করে, জিয়ানকে কল করে৷ সাথে সাথে ওপাশ থেকে রিসিভ।
“মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনি ভারী বজ্জাত তো! একবার বলবেন তো নকল শ্বাশুড়ি ধুর মানে আপনার মা আমাদের বাসায় আসছে৷”
“ডার্লিং আমি তো নিজেও জানিনা৷ তো তুমি তার সাথে কথা না বলে আমাকে কেন কল করছো!”
“বাসায় তো কাজের বেটি রহিমা সেজে থাকি, সে অবস্থায় শ্বাশুড়ির সামনে যাওয়া যায়?”
“এখন নায়িকা ক্যাটরিনা সেজে দ্রুত যাও৷”
“নয়না কল কেটে দিয়ে মাথায় সুন্দর করে ওড়না দিয়ে বসার রুমে গেলো৷ নিলুফা বেগমকে সালাম দিলো, আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
‘নিলুফা বেগম নয়নার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন৷ তাড়াহুড়ো করে জামা উল্টো পরে আসছে৷ নয়নাকে ডেকে নিজের পাশে বসালেন৷ জাহানারা বেগম নয়নার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করছেন৷ কিন্তু নয়না কিছুই বুঝতে পারছে না৷
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
“ভালো আছি। তোমাকে নিতে এসেছি যাবে তো আমার সাথে?”
“নয়না চুপ করে রইলো। জিয়ান যাওয়ার সময় বলে গেছে পরিক্ষা শেষ না হতে এ বাসা ছেড়ে যেতে মানা৷”
“কি হলো বলো?”
“জাহানারা বেগম বললেন ও কি বলবে আপা!আমি চাইছিলাম পরিক্ষা শেষ করে পাঠাতে। আপনাদের আপত্তি না থাকলে থাকুক৷”
‘”আচ্ছা ঠিক আছে। তবে পরিক্ষার পর কিন্তু আমাদের বাড়ির লক্ষী আমরা নিয়ে যাবো।”
“এখন তো মেয়ে আপনাদেরই আমাদের বাসার তো কয়েকদিনের মেহমান।*
“নয়না ফট করে বলে,ফেললো থাকবো না তোমাদের বাসায় মেহমান কি একমাস থাকে নাকি! বলেই গাল ফুলিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো৷ মায়ের কথায় রাগ হয়েছে ভিষন!”
“নয়না চলে যেতেই জাহানারা বেগম বলেন,কিছু মনে করবেন না আপা, মেয়েটার বয়স কম তো তাই। আস্তেধীরে বুঝে যাবে সব৷”
‘নাহহ আমি কিছু মনে করিনি। বড্ড মিষ্টি আপনার মেয়েটা৷
“সুচনা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,তুমি কে গো?”
“জাহানারা বেগম বলেন,সূচনা এভাবে কেউ কথা বলে?উনি তোমার আন্টি সালাম করো।”
‘সূচনা দৌঁড়ে নিজের বাসায় চলে গেলো৷
“আমার ছোট জা’য়ের মেয়ে।”
“নীলাঞ্জনার বোন?”
“হ্যা।”
“নয়না রুমে এসে পায়চারি করতে লাগলো, এমা! জামা তো উল্টো! শ্বাশুড়ি সামনে সম্মান আর থাকলোই না!
🌿

অনিকেত হসপিটাল থেকে বের হয়েছে রাত এগারোটায়৷ আজ তার একটা ওটি ছিলো৷ বের হয়ে রেস্টুরেন্টে রাতের ডিনার সেরে লং ড্রাইভে বের হয়েছে, নিজেই ড্রাইভিং করছে আর গানের তালে মাথা নাড়াচ্ছে৷ একা জীবনে অনিকেতের সঙ্গী বলতে তিন বন্ধু ছাড়া কেউ নেই। হঠাৎ কোথা থেকে এক মেয়ে এসে গাড়ির সামনে পরলো,অনিকেত দ্রুত হার্ড ব্রেক করলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে বলে,”মরার জন্য আমার গাড়ি পেলেন? আমার এইটুকু জীবন এখনো বিয়ে করিনি,বৌকে আদর করিনি একটা প্রেমও করিনি আমাকে কেনো ফাঁসাচ্ছেন!”
“হ্যালো মিস্টার আমি মরতে এসেছি সেটা কখন বললাম?”
“তো আমার গাড়ি নিচে কি হাডুডু খেলতে এসেছেন?”
“নাহহ চার ছক্কা খেলতে এসেছি, খেলবেন আমার সাথে?”
“মেয়েদের সাথে ব্যাটে বলে ঠিক ম্যাচ করবে না৷ সো আমার রাস্তা ছাড়ুন।”
“আমি বৌ খুঁজতে ব্যস্ত, আহারে আহারে কোথায় পাবো তাহারে? যে রাখিবে আমারে তাহার আঁচলের তলে!”
“সায়না লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে বলে,একদম চুপ করুন মাথায় সমস্যা আছে নাকি আপনার! ওয়েট আপনাকে চেনাচেনা লাগছে কোথায় দেখেছি বলেন তো?
‘আমার আপনাকে চেনা চেনা লাগছে না৷ সো টাটা৷
“আপনি আমাকে ফেলে চলে গেলে চিৎকার করে মানুষ জড়ো করে গণধোলাই খাইয়ে হাত পা ভেঙে দেবো।”
“এই না না এই কাজ করবেন না প্লিজ আমি এখনো বিয়ে করিনি৷”
“তাহলে আমাকে একটু হেল্প করুন। গাড়িতে আসুন বলছি৷”
“ছিহহহ আপনি যা ভাবছেন আমি ওই টাইপের ছেলে না৷ আমি আমার লজ্জার হেফাজত করছি বৌয়ের জন্য প্লিজ টাকা লাগলে নিন আমার ইজ্জতে হাত দিবেন না।”
‘চুপ একদম চুপ! আমাকে দেখে আপনার ওরকম মেয়ে মনে হয়? আমি একজনকে ভালোবাসি কিন্তু আমার পরিবার মিথ্যে বলে আমাকে অন্য কারো কাছে বিয়ে দিতে চাইছে তাই বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি৷ আপনি আমাকে আমার প্রেমিকের বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিন৷
‘অনিকেত বুকে হাত দিয়ে বলে,আহহহ বুকে বড্ড ব্যথা পেলুম। আমার হবু বৌটা যে কেনো আমার কাছে আসছে না!
‘আমাকে হেল্প করুন আপনাকে একটা হাফ মেন্টাল বৌ খুঁজে দেবো।
‘আসুন গাড়িতে বসে আমাকে ঠিকানা দিন৷
🌿
লাবিব ঘুম থেকে উঠে দেখে নীলাঞ্জনা তার পাশে নেই! ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসেও নীলাঞ্জনাকে দেখতে পেলো না!
‘আম্মু নীলাঞ্জনাকে দেখেছো?
‘নাহহ সকাল থেকে তো একবারও আমার নজরে পরেনি।
‘লাবীব পুরো বাসায় খুঁজেও পেলো না নীলাঞ্জনাকে৷ গেটের সামনে এসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই দারোয়ান বলল, ম্যাডাম তো খুব ভোরেই বের হয়ে গেছেন৷
‘বের হয়ে গেছে মানে! কোথায় গেছে?
‘তা তো জানি না স্যার।
‘লাবীব নিজের মোবাইল বের করে নীলাঞ্জনাকে কল করলো, নিজেই বলে উঠলো উফফ সিট। মোবাইল তো আমি ভেঙে ফেলেছি!
🌿জাহিন ম্যারিনকো নিয়ে ব্যস্ত এতো মেয়ে তাদের দিকে কোন নজর নেই জাহিনের৷ মেয়েদের তার এক্সট্রা প্যারা মনে হয়! একবার তার মায়ের সাথে শপিংয়ে যেয়ে বুঝেছে বিয়ে শাদী তার কম্য নয়৷
‘মান্নাত ইন্জয় করছিলো বেশ, এতোদিন পর নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে।
‘অন্তর জাহিনের সামনে এসে বলে,এতোগুলা মেয়ে চোখেন সামনে অথচ আমারা সিঙ্গেল এমন কেন! ভাই আমারা কি একটা মেয়ে পাবো না!
‘চুপ কর তোর জন্য পার্টি ক্যানসেল করে এখানে এসে বোরিং হচ্ছি।
‘এক কাজ কর তুই তো খুব ভালো গাইতে পারিস আমি গিটার এনে রেখেছি একটা গান শুনিয়ে সবাইকে ঘায়েল করে দে।
‘যাহহহ এনাউন্সমেন্ট কর আমি গাইবো৷
‘ অন্তর এনাউন্সমেন্ট করতেই সবাই স্থীর হলো৷ সবার দৃষ্টি পরলো হ্যান্ডসাম এক ছেলের উপর যার হাতে গিটার৷ পরনে ব্ল্যাক শার্ট ব্ল্যাক ব্লেজার। স্পাইক করা চুল, হাতে শোভা পাচ্ছে ব্র্যান্ডের ওয়াচ। জাহিন গাওয়া শুরু করলো,
Milgaye jo chora chori
Hui masti thodi thodi
Bas pyaar ka naam na lena
I hate love storys

Koi aas paas ho
Samjhe jo dil ki baat ko
Soche na aaj yaar voh
Kal ki baatein
Pal do pal ka saath ho
Phir na haaton mein haath ho
Bhule naa yaad aayein
Phir beeti raatein
Aankho se kehke yeh
Sapnaa gaya hai
Subha ko jaage toh
Raasta naya

Milgaye jo chora chori
Hui masti thodi thodi
Bas pyaar ka naam na lena
I hate love storys
সবাই গানের তালে নাচচ্ছে। মান্নাত ব্যস্ত ভিডিও করতে।
জাহিন এই প্রথমবার দৃষ্টি দিলো মান্নাতের উপর৷
‘মান্নাতের সেদিকে খেয়াল নেই মান্নাত ব্যস্ত ভিডিও করতে৷ হঠাৎ ভিডিও থামিয়ে দৃষ্টি স্থীর করলো৷ প্রথম বারের মত চার চোখ এক হলো।

#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২১

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২১
“আপনি দেখতে অনেক সুন্দর, আপনার হ্যাসবেন্ড অনেক লাকি।”
“মান্নাত ভ্রু কুঁচকে বলে,ইস কিউজ মি! আপনার আমাকে দেখে বিবাহিতা মনে হচ্ছে?”
“স্যরি আপনার বয়ফ্রেন্ড লাকি।”
“আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই।”
“অন্তর একটু দূরে সরে বলে,এটাই জানার ছিলো বিউটিফুল লেডি।”
“মান্নাত খেয়াল করতেই দেখে এটাতো সেই ছেলেটা যে তাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে! মনে মনে বলে,আমাকে চিনতে পারেনি! চিনতে পারার কথাও না৷”
“অন্তর আর একটু সামনে এসে বলে,ভালো করে দেখে নিন আমি কিন্তু পিউর সিঙ্গেল।”
“আপনার ফ্লার্টিং স্কিল একদম জঘন্য। এভাবে ট্রাই করলে আগামী বছরও সিঙ্গেল থাকবেন। মান্নাত সরে আসলো৷ রিতুর কাছে এসে বলে,এই রিতু ওই ছেলেটা কে রে?
“এটা আমার ভাই৷ পছন্দ হয়েছে তোর? পছন্দ হলে বল তোর সেটিং করিয়ে দেই। ”
“চুপ কর। তুই কেক কাটবি কখন? আর কেউ আসার বাকি আছে?”
“হুম ভাইয়ার স্পেশাল ফ্রেন্ড জাহিন চৌধুরী আসলেই কেক কাটবো৷”

মান্নাত ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য নিচে আসছিলো, হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে বলে কে আছো বাঁচাও আমাকে৷ জাহিন দ্রুত মান্নাতের মুখ চেপে ধরে বলে,হোয়াই?
“মান্নাত চোখ বন্ধ করে উমমম উমম করছে।”
“জাহিন আস্তে করে বলল,হাত সরালে চিৎকার দেবে নাতো?”
“মান্নাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো৷”
“জাহিন নিজের হাত মান্নাতের মুখের উপর থেকে সরিয়ে নিলো৷ সিঁড়ির লাইট অফ সম্ভবত কারেন্ট চলে গেছে তাই কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।
“মান্নাত ভয়ে ভয়ে বলে,এটাকে সরান প্লিজ আমি বেড়াল ভয় পাই।”
“ম্যারিনো এদিকে আসো বাচ্চা৷ কাম বেবি কাম কাম।”
‘ম্যারিনো চুপটি করে জিহানের কাছে চলে গেলো। অন্ধকারে ম্যারিনোর চোখ দেখে ভয় পেয়েছিল মান্নাত। মান্নাত সাইড ঘেঁষে চলে যেতে নিলে তার ওড়নায় টান খায়। পেছনে না তাকিয়ে বলে,একদম অসভ্যতা করার চেষ্টা করবেন না আমি কিন্তু চিৎকার করে মানুষ জড়ো করবো।

“ও হ্যালো জাহিন চৌধুরী কোন মেয়েকে পাত্তা দেয় না। উল্টো মেয়েরা তার জন্য পাগল।”

ততক্ষণে কারেন্ট চলে এসেছে। মান্নাত সামনে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জাহিনের দিকে। উফফ ব্ল্যাক ব্লেজার, কি হ্যান্ডসাম লাগছে।
এরমধ্যেই ম্যারিনো মিউ মিউ করতে লাগলো। মান্নাত তাকিয়ে দেখে ম্যারিনোর পায়ের নিচে তার ওড়না। মান্নাত চট করে জাহিনের পেছনে দাঁড়িয়ে জাহিনের ব্লেজার আঁকড়ে ধরে বলে,প্লিজ ওকে তাড়িয়ে দিন৷

“ও আমার সঙ্গী ম্যারিনো। কোথাও ভ্রমণে গেলে ওকে ছাড়ি না আর আপনি বলছেন ওকে তাড়িয়ে দিতে? জাহিন ম্যারিনোকে কোলে তুলে নিয়ে সামনে হাটা শুরু করলো।”
“মান্নাত বুকে হাত রেখে বলে, আমি তোমার প্রেমে ডুবে যাচ্ছি। ঠিক যেভাবে চায়ের কাপে ডুবে যায় বিস্কিট! সেই বিস্কিট যেভাবে বিলিন হয়ে যায় আমিও ঠিক সেভাবেই তোমাতে বিলিন হতো চাই, এরপর শত চেষ্টা করেও আমাকে কেউ তোমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।কিন্তু তোমার বিড়াল এটাকে কিভাবে মেন নিবো!

🌿

নয়না পড়তে বসেছে বেশ কিছু সময় মনোযোগ দিয়ে পড়লো। এরপর মোবাইল নিয়ে তার ফ্রেন্ড তুষিকে কল করলো। ওপাশ থেকে আসলো, দ্যা নাম্বার ইজ বিজি নাউ৷ পরপর বেশ কয়েকবার কল করলো। সেম অবস্থা! এই মেয়ে রাত এগারোটায় কার সাথে এতো কথা বলতে ব্যস্ত?
নয়না ফোন নিয়ে ভাবলো জিয়ানকে কল করবে কিন্তু এই রাতে কল করলে নিশ্চিত এই লোক বলবে, কতবার বলবো আমাকে কল না করে পড়তে বসো? আমাকে ডিস্টার্ব করবে না আমার কাল ফ্লাইট আছে। নয়না আবার বসলো ম্যাথ নিয়ে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো৷ বা’হাত দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে বলে,তোর এতো রাতে কিসের পিরিত! তুষি ভুসি তোরে একদম ভাসিয়ে দেবো৷ পিরিত এক্সামের পর করতে পারবি না! এরপরে এক্সাম হলে যদি বলিস,নয়না আমাকে একটু দেখা শুধু পাস নাম্বার উঠিয়ে দে। তাহলে তোর বয়ফ্রেন্ডের কোলে নিয়ে ফেলবো তোকে৷

“এরজন্যই বলি তুমি এতো সাড়ে আঠারো হলে কি করে?”
“নয়না ফোনটা সামনে নিয়ে এসে বলে,আপনি?নাম্বারে কিভাবে কল করলেন?”
“ও হ্যালো নাম্বারে কল করা যায় না সেটা কে বলল?তোমার ডাটা অফ তাই নাম্বারে কল করলাম।”
“আগে এটা বলুন সাড়ে আঠারো কেন বললেন আমাকে?”
“তোমার এজের মেয়েরা প্রেমও করে!”
“আমার এজের মেয়েরা বাচ্চা পয়দা করে সংসারও করে।”
“লাইনে আসো, বলেই জিয়ান কল কেটে দিলো। ঘুম থেকে উঠে ভাবলো নয়নাকে একটা কল করা দরকার। কল করতে যেয়ে দেখে ডাটা অফ তাই নাম্বারে কল করলো৷
‘নয়না টিশার্ট আর প্লাজু পরা চুলগুলো সব এলোমেলো। একটা ওড়না প্যাচিয়ে ডাটা অন করলো।
“জিয়ান কল রিসিভ করে কফি মগে চুমুক দিতে দিতে বলে,এতো সময় লাগে ডাটা অন করতে?”
“নয়না চুপ করে রইলো৷”
“জিয়ান ভালো করে নয়নার দিকে লক্ষ্য করলো।এভাবে নয়নাকে আরো সুন্দর লাগছে৷ বলা যায় নয়না ন্যাচারাল বিউটি। এমন প্যাঁচার মত মুখ করে বসে আছো কেন?”
“আমার না পড়ালেখা ভাল্লাগে না। এতো পড়ে হবে টা কি আপনি বলুন তো? এরচেয়ে বিয়ে করে সন্তান আর সংসার করা সহজ৷ বাবা মা বোঝে না৷”
“জিয়ান হেসে বলে,ওরে বুড়িরে বয়স এখনো ষোল পার করতে পারলো না সন্তান, সংসারো চলে গেছে।”
“আপনার বয়স কত সেটা জানেন তো নাকি! নিজে বুইড়া আর কচি আমপাতার মত মেয়েকে বুড়ি বলে!শুনুন আমি যখন আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হবো কত সিনিয়ররা লাইন মারবে। আর আপনার তখন চুল পেঁকে যাবে।”
“মোটেই না তখন মেয়েরা আমাকে আরো বেশি পাত্তা দেবে। দেখো না ইদানীং মেয়েদের সুগার ড্যাডি পছন্দ।”
‘আচ্ছা প্রেমে পড়ার প্রথম ডেফিনেশন কি?”
‘প্রেমে পড়ার আবার ডেফিনেশন থাকে?”
“প্রেম, মোহ, ভালোবাসা এই তিনটা ভিন্ন জিনিস আপনাকে বুঝতে হবে আপনি কোন স্তরে আছেন।”
“বেশ ইন্টারেস্টিং কথা বললে তো! আচ্ছা আমাকে বোঝাও তো এই তিনটার ভিন্নতা৷”
“মোহ” সাময়িক আকর্ষণ আপনি কারো রুপের মোহে আটকে পড়তে পারেন অথবা কথার মোহে অথবা তার ব্যাক্তিত্বের মোহে। তবে মোহ একদিন ঠিক কেটে যায়।”
“তারপর,”
“প্রেম হলো সবচেয়ে সুন্দর অনূভুতি। প্রেমে পড়ার মূহুর্তগুলো রঙিন ফানুসের মত। আপনি এমন ভাবে প্রেম উপভোগ করবেন মনে হবে জীবনে প্রেম ছাড়া সব কিছু পানসে৷ প্রেমে না পড়লে মানুষ হয়ত জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে পারে না।”
“ইমপ্রেসিভ! এরপর ভালোবাসার ব্যখ্যাটা কি?”
“ভালোবাসা হলো বিরহ৷”
“বিরহ কেনো?”
“যখন আমরা প্রেমে পড়ি তা খুব কম সময় স্থায়ী হয়।তবে আপনি যদি কাউকে একবার মন থেকে ভালোবাসেন তাকে কখনো ভুলতে পারবেন না, ঘৃনা করতে পারবেন না, অবহেলা করতে পারবেন না। সে আপনাকে সর্বোচ্চ কষ্ট দেয়ার পরেও আপনি বারবার তার কাছে ফিরে যাবেন৷ বিচ্ছেদ হলেও সে আমৃত্যু আপনার হৃদয়ে থেকে যাবে৷ আপনি চাইলেও তার চিহ্ন মুছে দিতে পারবেন না। ভালোবাসার পূর্নতা না পেলে আজীবন মেয়াদি বিরহ নিয়ে বাঁচতে হবে আপনাকে।”
“আরেহহ বাহহহ তা তুমি প্রেম ভালোবাসায় পিএইচডি প্রাপ্ত মনে হচ্ছে!”
“আমার এইটুকু জীবনে তেমন কোন ফ্রেন্ড নেই, বাহিরের জগত আমি চিনিনা। আমার সঙ্গী বলতে বই আর আম্মু।”
“তুমি এই তিনটার কোনটায় পড়েছো এখন পর্যন্ত?”
“হুম মোহে আটকেছি বিলাল আব্বাস খানের৷ প্রেম আর ভালোবাসা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর করবো।”
“তোমাকে যতটা বাচ্চা ভেবেছি তুমি ততটা বাচ্চা নও। খুব গভীর চিন্তা ভাবনা তোমার৷ আমি সত্যি ইমপ্রেস হচ্ছি তোমার সাথে যত কথা বলছি ততই তোমাকে নতুন মনে হচ্ছে।”
“বেচারা কফিকে শাস্তি কেনো দিলেন?”
‘মানে? ”
“ও বেচারকে তো একটু পর ছুড়ে ফেলে দিবেন। শুনুন ভালোবাসলে যত্ন করতে হয়৷ যত্নে রত্ন মিলে।”
“জিয়ান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নয়নার দিকে৷ মেয়েটা এতোটুকু বয়সে এতো গভীর চিন্তাভাবনা কি করে পোষণ করে!”
“এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না মিস্টার ড্রাইভার।”
“নট ড্রাইভার ইট’স পাইলট।”
“ওহি ওহি। আচ্ছা আপনি কোন আকাশে উড়েন?আমার রাত কাটে, দিন কাটে আকাশের পানে চেয়ে! সে খবর কি একবারও রাখেন? নিষ্ঠুর প্লেন ড্রাইভার একবার নিচে তাকালেও পারেন!”
“আহাগো ময়নার মা’নিচে তাকালে বুঝি তোমাকে দেখা যাবে?তোমার আমার আকাশ তো ভিন্ন। এক আকাশের নিচে হলেও ট্রাই করতাম দূরবীন দিয়ে তোমাকে দেখার৷”
“আকাশ কখনো ভিন্ন হয়না মিস্টার প্লেন ড্রাইভার। আমরা একি আকাশের নিচে তবে ভিন্ন ছাদের তলায়৷ দেশ ভিন্ন হতে পারে আকাশ কিন্তু একটাই।”
“জিয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,তোমাদের দেশে তো এখন একটা বাজে! ইশশ সময় নষ্ট করলাম তোমার! রাতে খেয়েছো সুনয়না?”
“হুম বিরিয়ানি খেয়েছি৷”
“গুড বেবি। এবার ঘুমিয়ে পরো লক্ষি বাচ্চার মত। বলেই কল কেটে দিলো৷”
“নয়নার ভিষণ রাগ হচ্ছে! এই লোকটা এমন কেন? কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুম করে কল কেটে দেয়ার বেরাম আছে নাকি!আজাইরা লোক মনচায় দেই দুইটা কিল৷”
🌿

নীলাঞ্জনার চোখের পাতা এক হচ্ছে না।ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়েছে। হলদে রংয়ের একটা শাড়ী পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ল্যামপোস্টের আধো আলো তার শাড়ীতে পরতেই নিজের দৃষ্টি স্থীর করলো শাড়ির উপর, হুট করে হৃদয় কেঁপে উঠলো! চোখ থেকে নামলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। এই শাড়িটা জিয়ান থাকে বসন্ত উৎসবে গিফট করেছিলো। আমার হয়তো তোমাকেই ভালোবাসা উচিৎ ছিলো ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফুলের মত জীবনটা নিজের হাতে ধ্বংস করে দিলাম! তুমি আমাকে ভুলে গেছো?তুমি না বলতে আমি কাঁদলে বা আমার মন খারাপ থাকলে তোমার মনে পৌঁছে যায় সে সংবাদ? আমার এতো কষ্ট তোমার হৃদয় স্পর্শ করেনি? তোমায় খুব সহজে পেয়েছিলাম তো তাই অবহেলায় হারিয়ে ফেলেছি৷ বুঝতেই পারিনি হিরে ছেড়ে কাঁচের টুকরো হৃদয়ে জায়গা দিয়েছি! কাঁচতো বিঁধবেই, রক্তাক্ত হবে হৃদয়। আমি তোমার কাছে কোন মুখে ক্ষমা চাইবো? একবার তোমার মুখোমুখি হতে চাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোনো স্মৃতি ভাবছে আর নিরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছো। দৃষ্টি রেখেছে শূন্য আকাশের পানে৷ যেখানে ছেয়ে আছে শুভ্র কুয়াশা৷

#চলবে

চন্দ্রকণার রাহা পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৬(অন্তিম পর্ব)

নিত্তিকা কিছুটা দমে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“আপু ছিলো ওই মেয়েটা তাই না।”

মিষ্টি হাসলো। চাপা হাসি, যা অগোচরেই রয়ে গেল। নিত্তিকা বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল,
“আপু আপনার কাছে আছে তাই না। শাহিয়ান, উনি সবটা জেনেই এই কাজটা করেছিলো। কিন্তু আপাকে বিয়ে করার কারণটা কি?আর আপুর সাথে আপনারা কি করবেন?”

মিষ্টি দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট আকরে ধরে বলল,
“বেশিকিছু করবোনা। কারণ আমি এতোটাও পাষান না। দুইদিন পর বাড়িতে দিয়ে আসবো তোমার বোনকে। যেহেতু লোক জানাজানি হয়ে গেছে সেহেতু তোমার বোনের বিয়ে আর হচ্ছে না। আর হতে নিলেও আমি হতে দিবো না। ওকে আমি ক্ষণে ক্ষণে একাকিত্ব অনুভব করাবো। ওকে বুঝতে হবে একা হয়ে যাওয়ার কষ্টটা কতটুকু। আর শাহিয়ানের কথা বলছো ও তো তোমার বোনকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু..!”

মিষ্টি থেমে যেতেই নিত্তিকা বলে উঠলো,
“কিন্তু কি আপু, থেমে গেলেন কেন?”

মিষ্টি নিত্তিকার অস্থিরতা দেখে হাসলো। চেয়ার থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সকালের রক্তিম আভায় সূর্যকে যেন এক রহস্যময় চরিত্র লাগছে। মিষ্টি সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“জানো তো ভালোবাসা মানুষকে অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। সবাই কিন্তু ভালোবাসতে পারেনা। যারা পারে তারা বেশিরভাগই কষ্ট পায়। যেমন দেখ না আমি। তবে ভাগবান বা ভাগ্যবতী তারা যারা ভালোবাসা পায়। আমার মনে হয় ভালোবাসা পেলে তাকে আকড়ে ধরতে হয়। মনে অতল গহ্বরে যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে হয় সেই মানুষটাকে। এই যে এতটা সময় চাঁদের কণা কেমন জ্বল জ্বল করছিলো আকাশ জুরে। আর এখনি আকাশে সূর্য তার দাপট দেখাতে শুরু করেছে। সূর্যের দাপট বেশি থাকলেও আমরা কিন্তু ওই চিকন চাঁদের কোণাটাকেই বেশি পছন্দ করি। কারণ সে স্নিগ্ধ। তেমনি ভালোবাসাও এক স্নিগ্ধ অনুভূতি। যাকে অনুভব করতে হয়।”

মিষ্টি চুপ হয়ে গেল। নিত্তিকাও চুপ হয়ে গেল। এতটা সময় সে খুব মনোযোগ দিয়ে মিষ্টির কথাগুলো শুনছিলো। কথাগুলো যেন তাকে অনুভব করাচ্ছে। একটা মানুষ এত ভালো করে কথা বলতে পারে। কিন্তু আজ তার বোনের জন্যই মানুষটার ভালোবাসার মানুষ চলে গেছে। যাকে ফিরিয়ে আনা কখনোই সম্ভব না। ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো নিত্তিকার। নিত্তিকা সহজে কান্না করে না। তবে কেন তার সাথে এমন হচ্ছে। কথায় কথায় কেন এতো কান্না পাচ্ছে। সে কি ছিচকাদুনি হয়ে গেল। না না এ হতে পারে। ভাবতে ভাবতেই কান্না করে দিলো বেচারি। তখনি শাহিয়ানের কন্ঠ ভেসে এলো,
“এই মেয়ে তুমি কাঁদছো কেন?”

নিত্তিকা ঝট করে উল্টো করে শাহিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। মিষ্টি হাসলো। মিষ্টি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে পুনরায় তাকালো সূর্যের দিকে।

নিত্তিকা নাক টেনে বলল,
“আমি কি দিন দিন ছিচকাদুনি হয়ে যাচ্ছি বলুন না। আমার শুধু কান্না পায়।”

নিত্তিকার এমন কথায় কিছুটা ভরকালো শাহিয়ান। রাত জেগে মেয়েটা কি পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি। শাহিয়ান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তুমি কি ঠিক আছো?”

নিত্তিকা এবার শাহিয়ানের বুক থেকে মুখ তুলে ওরে চোখে চোখ রাখলো। শাহিয়ান এতটা সময় ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। নিত্তিকা চোখে চোখ রেখেই বলল,
“আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন শাহিয়ান?”

শাহিয়ান চমকে উঠলো নিত্তিকার বলা কথা। মিষ্টির তো এসব বলার কথা ছিলো না। তাহলে কি মেয়েটা বলে দিয়েছে? শাহিয়ানের চোখ মুখে প্রশ্নবোধক ভাব দেখে নিত্তিকার আর বুঝতে বাকি নেই। নিত্তিকা মুচকি হেসে বলে উঠলো,
“মিষ্টি আপু আমাকে বলেনি কিছু। চিন্তা করবেনা। তবে আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।”

শাহিয়ান কপাল গুটিয়ে বলল,
“কি বুঝেছো?”

নিত্তিকা কিছু না বলে শাহিয়ানকে ছেড়ে চলে যেতে নিলে শাহিয়ান ওর কোমর পেঁচিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
“বললে না তো কি বুঝেছো?”

নিত্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ঘোড়ার আন্ডা।”

শাহিয়ান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“একদম তেড়ামি করবে না। মিষ্টি কি তোমাকে….!”

নিত্তিকা শাহিয়ানের কথার মাঝেই বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
“আমি কি বললাম শুনতে পেলেননা। আপনি যা বলতে বলেছেন তাই বলেছে। বাড়তি কিছু বলেনি। আমাকে দেখলে কি আপনার অবুঝ মনে হয়।”

শাহিয়ান মনে মনে হাসলেও প্রকাশ না করে বলল,
“তা কি কি বুঝেন আপনি?”

নিত্তিকা দুইহাত দিয়ে শাহিয়ানের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
“পরে বলবো এখন ছাড়ুন তো।”

শাহিয়ান কোলে তুলে নিলো নিত্তিকাকে। নিত্তিকা ভরকে গেলেও তীক্ষ্ণ চোখে শাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই আপনি এগুলো কি করছেন?”

শাহিয়ান ভাবলেশহীন ভাবে রুমে আসতে আসতে বলল,
“সব যখন বুঝেই গিয়েছো। তখন আরো ভালো করে না হয় বুঝিয়ে দেই সব।”

——————-

কেটে গেছে দুটো দিন। মিষ্টি নিজ দায়িত্বে নিত্তিকার বড় বোনকে তার বাড়িতে দিয়ে এসেছে। নিজে ফিরেছে তার বাসায়। শাহিয়ান আর নিত্তিকার সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। শাহিয়ান মুখে ভালোবাসি না বললেও তার সকল কাজকর্মে ঠিকিই প্রকাশ পায় সে কতটা ভালোবাসে নিত্তিকাকে।

নিত্তিকা আর শাহিয়ান একসাথে বসে আছে বারান্দায়। আকাশে অর্ধেক চাঁদ উঠেছে। নিত্তিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসার পথ কোনদিকে বলুন তো!”

শাহিয়ান মুচকি হেসে বলল,
“চন্দ্রকণার রাহার দিকে। যেই দিন আমি আজীবন তোমার হাত ধরে এগিয়ে যেতে যাই। থাকবে তো পাশে।”

নিত্তিকা মুচকি হেসে তাকালো শাহিয়ানের দিকে। চোখাচোখি হতেই বলল,
“জানেন তো আমি সত্যিই ভাগ্যবাতী।”

শাহিয়ান নিত্তিকার কাধের একপাশ ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
“আমিও ভাগ্যবান।”

#সমাপ্ত

চন্দ্রকণার রাহা পর্ব-০৫

0

#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৫

শাহিয়ান হুট করেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“আজ রাতে তোমাকে কিছু কথা বলবো। আশা করছি তোমার সমস্যার সমাধান সেখানেই হবে।”

নিত্তিকা ভ্রুকুচকে তাকালো শাহিয়ানের দিকে। শাহিয়ান তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
“নিজেকে ঠিক করে নেও। মেহমান আসতে শুরু করছে।”

বলেই শাহিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবী ঝাড়া দিলো। নিত্তিকা কিছুটা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো।

———————

রাতের প্রায় শেষভাগ হতে চলল। শাহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার কাণিশ ঘেঁষে। নিত্তিকা বসে আছে চেয়ারে। শাহিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি আর কখনো তোমার বড় বোনের কল রিসিভ করবেনা।”

নিত্তিকা ভ্রুকুচকে বলল,
“কেন!”

শাহিয়ান ফোন হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে কল দিয়ে ফোনটা নিত্তিকার হাতে ধড়িয়ে বলল,
“আমি কাল থেকে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি বেশ ক্লান্ত লাগছে। সব কাহিনী কলের অপরপাশের জন তোমাকে বলে দিবে। নো টেনশন বেইবি। রেডি ফর এ টুইস্ট সুইটহার্ট।”

বলেই ভাবলেশহীন ভাবে রুমে চলে গেল। নিত্তিকা অবাক হয়ে ফোন কানে নিতেই একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো,
“ভালো আছো তো নিত্তিকা!”

নিত্তিকা কপাল কুচকে বলল,
“কে আপনি?”

মেয়েটা আরামে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর দু পা তুলে বলল,
“আমি মিষ্টি, তুমি আমাকে চিনবেনা সুইটি। তারচেয়ে বরং তুমি আমার কথা গুলো মন দিয়ে শোনো। ওও আর একটা কথা, কথার মাঝে কথা বলবেনা। ঠিক আছে?”

নিত্তিকা দ্বিমত করবে ভেবেও বলল,
“আচ্ছা”

মিষ্টি বলতে লাগলো,
“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো শাহিয়ানের বড় ভাই সারোয়ার। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি দুইজন। মাস্টার্স এর শেষের দিকে সারোয়ার একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। মেয়েটা সদ্য অনার্সে উঠেছিলো। মেয়েটাই সারোয়ারের পিছু ঘুরতো। পরে একসময় সারোয়ার মেনে নেয়।”

মিষ্টি খানিকটা দম নিলো। সমস্ত কিছু যেন সে নিজের চোখের সামনে দেখছে। কথাগুলো দলা পাকিয়ে গেছে। শাহিয়ান বললেই পারতো নিত্তিকাকে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“জানো তো কবি বলেছে ছেলে মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারেনা। প্রথমে আমি এটা বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিলো কথাটা আমি মানতে শুরু করেছিলাম জানো। কারণ…!”

মিষ্টির কথার মাঝেই নিত্তিকা বলে উঠলো,
“আপনি খুব ভালোবাসতেন ভাইয়াকে তাইনা।”

মিষ্টি হাসলো নিত্তিকার কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“একতরফা ভালোবাসা ভিষণ কষ্টকর। যে করে সেই বুঝে। দিন যাচ্ছিলো সারোয়ার মেয়েটার উপর দুর্বল হয়ে পরছিলো। মেয়েটা পড়াশোনা থেকে শুরু করে নোট করে দেওয়া সবটাই করতো। সপ্তাহে সপ্তাহে সপিং, রেস্টুরেন্ট সবটাই হয়েছে। মেয়েটা কিছু বলার আগেই সারোয়ার সবটা করতো। জানো তো আমার সামনে যখন এসব বলতো তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো।তবুও হাসিমুখে সবটা মেনে নিয়েছিলাম। ভালোবাসা তার ভালোবাসার কাছে ভালো ছিলো আর কি চাই বলো। আমি চলে গিয়েছিলাম বিদেশে। পরবর্তীতে সারোয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও হয়ে উঠেনি। দুই বছর পর ফিরে এসে শুনি সারোয়ার মারা গেছে।”

মিষ্টির কথা আটকে গেল। নিত্তিকাও থমকে গেল। মিষ্টি কান্না করে দিয়েছে। নিত্তিকা অস্থির কন্ঠে বলল,
“আপু শান্ত থাকুন প্লিজ। আর ভাইয়া কি ভাবে মারা গেল কিছু জানতে পেরেছিলেন। আর ওই মেয়েটা, ওই মেয়েটার কি খবর!”

মিষ্টি নাক টেনে এক গ্লাস পানি খেলো। হুট করেই হেসে বলল,
“ওই মেয়ে আর কি বিন্দাস ছিলো।”

নিত্তিকা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“মানে!”

মিষ্টি আবারো বলতে লাগলো,
“মেয়েটাই সারোয়ারের খুনি।”

নিত্তিকা অবাক হয়ে হা হয়ে রইলো বেশ খানিকক্ষণ। কি বলবে বুঝতে পারলো না। মিষ্টির কথাগুলো যেন কানে বাজছে রীতিমত। মেয়েটা কি বলছে এসব?

মিষ্টি তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“মেয়েটা শুধু খেলেছে সারোয়ারকে নিয়ে। যখনি সারোয়ার বিয়ের কথা বলে তখনি মেয়েটা সারোয়ারকে ইগনোর করতে শুরু করে। সারোয়ার জোর করায় সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সে। সারোয়ার পাগল প্রায় হয়ে উঠেছিলো। মানসিক ভাবে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গেছিলো ও। এতো মানসিক চাপ নিতে না পেরে আত্ম*হত্যা করে ও।”

মিষ্টি কান্না করছে। নিত্তিকার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। আচ্ছা খুব কি ক্ষতি হতো যদি মিষ্টি সারোয়ারকে পেতো।নিত্তিকার মাথার ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। মিষ্টির শেষ কথাগুলো তার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো বারবার,
“মেয়েটাই সারোয়ারের খুনি!”

তার আঙুল শক্ত হয়ে এঁটে গেল ফোনে। গলার স্বর কাঁপছে থরথর করে।তবু নিজেকে সামলে বলল,
“আপনি নিশ্চিত? মানে… এটা কি প্রমাণিত?”

মিষ্টি একটু হাসল, বিষাদমাখা তিক্ত হাসি।
“প্রমাণ? সমাজ কি কখনো মানসিক অত্যাচারকে খুনের পর্যায়ে ফেলে? আত্ম*হত্যা প্ররোচনা তো শুধু কাগজে-কলমে লেখা আইন। বাস্তবে এসবের বিচার হয় না, নিত্তিকা।”

নিত্তিকা মুখটা ছোট হয়ে গেল। আসলেই তো আত্ম*হত্যার কি কোনো বিচার আছে।

মিষ্টি কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন নিজের ভেতরের ক্ষতচিহ্নগুলোকে সামলাচ্ছে। তারপর ধীর গলায় বলল,
“মেয়েটার নাম বলার দরকার নেই, নিত্তিকা। নাম জেনে কী হবে? সে তো দিব্যি ভালো আছে, সুখে আছে, অন্য কারও জীবনে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ সারোয়ার? সে তো আর নেই। শুধু একটা নাম শুনে কী লাভ বলো?”

নিত্তিকা কোনো উত্তর দিল না। ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে যেতে ধরে ফেলল। বুকের ভেতর কেমন একটা শূন্যতা লাগছিল।

মিষ্টি আবার বলল,
“আমি জানি, তুমি ভাবছো যে এই গল্পটা শোনানোর মানে কী, তাই তো? শাহিয়ান কেন চেয়েছিল তুমি এসব জানো? কারণ সে চায় না, তুমি ওর ভাইয়ের মতো একই ভুল করো। শাহিয়ান কারও ওপর অন্ধবিশ্বাস করতে শেখেনি, বিশেষ করে যাদের সে একবার বুঝে ফেলেছে।”

নিত্তিকার ঠোঁট শুকিয়ে এলো। ও ধীরে ধীরে বলল,
“আপু তুমি কি বলতে চাইছো, আমার জীবনেও এমন কিছু হতে পারে?”

মিষ্টি হাসল, তিক্ত এক হাসি,
“আমি কিছু বলছি না। শুধু বলছি, সবকিছু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস কোরো না, নিত্তিকা। বিশ্বাসটা যখন ভাঙে, তখন শুধু হৃদয় নয়, পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়ে।”

নিত্তিকা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। ফোনের ওপাশ থেকে আসা মিষ্টির নিশ্বাস কেমন ভারী শোনাচ্ছে।

#চলবে