Sunday, August 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 248



তুমিময় প্রাপ্তি পর্ব-০১

0

#তুমিময়_প্রাপ্তি
#পর্ব_১ (সূচনা পর্ব)
#মেহরিন_রিম

_মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস কি করে হয় আপনার? আপনি জানেন,আমি চাইলে এক্ষুনি এখানে পুলিশ ডাকতে পারি।
পিঠে গিটার ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বললো সদ্য সতেরো তে পা দেওয়া ইশা।
আদৃত সরু চোখে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনছিল। একবার ইশার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে তার দিকে কিছুটা এগোতে লাগলো।
ইশার সামনে এসে স্বাভাবিকভাবে বললো,
_ডাকো।

ইশা এতক্ষন উপরে উপরে নিজের সাহসিকতা বজায় রাখলেও এবার যেন কিছুটা ভয় পেলো। একটা শুকনো ঢোক গিললো সে, তবে এই ভয়টা প্রকাশ করলে চলবে না। ইশাকে চুপ থাকতে দেখে আদৃত আবারো বললো,
_কি হলো,ডাকো কাকে ডাকবে। আমিও দেখি তোমার কত ক্ষমতা।

ইশা এবার আদৃত এর সামনে আঙুল নাচিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা ছেলে ‘জা…ন’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে আসে সেখানে। ইশার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার সামনে গিয়ে কাঁদোকাঁদো ভাব নিয়ে বলে,
_জান তুমি ঠিক আছো তো! জানো আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম। একটু ঝগড়াই নাহয় করেছি, কিন্তু তার জন্য তুমি এমন একটা কাজ করতে যাবে!

ওদের দুজনের কথা যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ইশার। আদৃত এর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সে বুকে হাত গুজে গম্ভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশা এবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
_এই মেয়ে,এসব কি বলছো তোমরা?

মেয়েটা মাথা নিচু করে পাশে থাকা ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল,
_আসলে ও আমার বয়ফ্রেন্ড। ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল বলেই আমি রাগ করে আশেপাশের না দেখেই রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটছিলাম। আরেকটু হলে তো গাড়িটা আমার উপর দিয়েই চলে যেতো। এই ভাইয়াই (আদৃত এর দিকে দেখিয়ে) তো আমাকে বাঁচালো। তাইতো রেগে গিয়ে একটা চ*ড় মে*রে*ছিলো। কিন্তু তুমিতো আমার কথা না শুনিয়ে ভাইয়াকে এতকিছু বলতে লাগলে।

ছেলেটা এবার আদৃত এর দিকে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালো,অত:পর মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। এদিকে ইশার তো মন চাচ্ছে ছুটে পালিয়ে যেতে, কেন যে নিজের সাহসিকতার পরিচয় দিতে এসেছিল। মনেমনে নিজেকেই কয়েকশত গা*লি দিচ্ছে সে। আদৃত একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
_কী? ডাকবে না পুলিশ?

ইশা একটা মেকি হাসি দিয়ে আদৃত এর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
_আসলে আমি না বুঝতে পারিনি, কিছু মনে করবেন না হ্যা।
ইশা কথাটা বলতেই তার পাশে মোহনা উপস্থিত হয়। ইশার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,
_কিরে,তুই এখানে কি করছিস? আমিতো তোকে ওদিকে…
আদৃত এর দিকে চোখ পড়তেই থেমে যায় মোহনা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে,
_আদৃত মেহরাজ!

আদৃত অনিচ্ছাকৃত মুচকি হাসি দেয়। মোহনা এবার ভীষণ খুশি হয়ে আদৃত এর সাথে হাত মেলাতে মেলাতে বলে,
_আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান ভাইয়া, আপনার গান যে আমার এত্ত ভালোলাগে। একটা সেলফি,প্লিজ ভাইয়া..

কথাটা বলেই আদৃত এর সাথে সেলফি তুলতে লাগল মোহনা। অন্যদিকে তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ইশা। মনে মনে বলল,
_ইনি সেই আদৃত! তুই এনাকে চিনতে পারলি না ইশা? না না, যে করেই হোক এনার সাথে একটা সেলফি তুলতেই হবে। একটু ভাব, এই ছবি পোস্ট দিতে পারলে কত্তগুলো লাইক পড়বে…

মোহনার সেলফি তোলা শেষ হতেই ইশা আদৃত এর কাছে গিয়ে হালকা হেসে বলে,
_সো সরি, আসলে আমি না প্রচুর গান শুনি কিন্তু সিঙ্গার দের দেখা হয়না। এখন আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে একটা সেলফি তুলতে পারি।

আদৃত ইশার কথা শুনে বোকা বোনে চলে গেলো। ভ্রু কুচকে বলল,
_হোয়াট?

ইশা এবার জিভে কামড় দিয়ে বলল,
_সরি সরি, মানে আপনার আপত্তি না থাকলে আমি কি আপনার সাথে একটা সেলফি তুলতে পারি?

কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই আদৃত এর চোখ যায় সামনের দিকে। সেখান থেকে একদল মেয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কপালে হাত চলে যায় আদৃত এর। মুখ থেকে “শিট” উচ্চারণ করে দ্রুত নিজের হেলমেট পড়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় আদৃত।
ইশা পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলো মেয়েগুলো হতাশ হয়ে আবারো ফিরে যাচ্ছে। মোহনা নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগলো,
_যাহ,চলে গেলো! ফোন নম্বরটাও তো নিতে পারলাম না।

_তুই ওনার ফোন নম্বর দিয়ে কি করবি!

_আরে ধুর,তুই কি কিছুই বুঝিস না নাকি? ফোন করে একটু পটাতাম ওনাকে।

_হ্যা,তোর জন্য তো উনি অঢেল সময় নিয়ে বসে আছে।

মোহনা ভেংচি কেটে বলল,
_সে নাহয় বাদ দিলাম। কিন্তু তোর ওনার সঙ্গে কি করে দেখা হলো?

ইশা নিজের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে একনজর তাকিয়ে বলল,
_এইরে, ভীষণ দেড়ি হয়ে গেলো। চল যেতে যেতে বলছি।
কথাটা বলে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো দুজন। মোহনার বাসা ইশার বাসার কাছে হওয়ায় তারা একসাথেই যায়।

____
সবেমাত্র প্রোগ্রাম এর ভেনু তে এসে পৌঁছেছে আদৃত। তাকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই সায়ান তার সামনে এসে বলে,
_কটা বাজে দেখেছিস? তোর মতো পাংচুয়াল মানুষের তো এত দেড়ি হওয়ার কথা নয়। কিছু হয়েছে নাকি?

আদৃত নিজের হেলমেট টা খুলতে খুলতে মুখে বিরক্তির আভা ফুটিয়ে বলল,
_আর বলিস না, একটা ইডিয়ট..
থেমে গেলো আদৃত, এখন ঐ মেয়ের কথা বললে যে বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
_কি হলো বল।

আদৃত সায়ান এর দিকে তাকিয়ে তাড়া দিয়ে বলল,
_পড়ে বলব,এমনিতেই অনেক লেইট হয়ে গেছে।
কথাটা বলেই আদৃত ভিতরে যেতে লাগল,সায়ান ও তার পিছন পিছন স্টেজ এর দিকে গেলো।

___
বাড়ির সদর দরজা সামান্য খুলে ভিতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে ইশা। দেখতে পেলো তার মা রুকসানা পারভিন রান্নাঘরে কাজ করছেন। ইশা বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোরের মতো ভিতরে প্রবেশ করলো যেন তার মা টের না পায়।
কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। রুকসানা পারভিন ইশাকে ঢুকতে দেখেই রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে বলতে লাগলেন,
_মহারাণীর এখন আসার সময় হলো? আর একটু দেড়ি করতেন। এই মেয়ের নাকি কদিন বাদে এসএসসি পরীক্ষা।

ইশা এবার রুকসানার কাছে এসে পিছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
_আরে আম্মু, এত রাগ করোনা তো। বেশি রাগলে তোমার চুলগুলো এই কম বয়সেই পেকে যাবে বুঝেছো?

_আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবেনা তোর। এমনিতেও দুদিন পর তোর বিয়ে দিলে শাশুড়ি হয়ে যাবো আমি।
ইশা ফিক করে হেসে বলল,
_আমাকে তুমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতেই পারবে না।

তাদের কথার মাঝেই বাড়িতে প্রবেশ করলো ফাইজা। ইশার চাচাতো বোন সে, নিজের বাড়ি থেকে ভার্সিটি অনেক দূড়ে হওয়ায় সে এখানেই থাকে।
ফাইজা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
_কি ব্যাপার,কার বিয়ের কথা হচ্ছে শুনি।

রুকসানা কিছু বলার আগেই ইশা গিয়ে ফাইজার হাত ধরে বলে,
_আপু ঘরে চলো তো। জানো আজকে অনেক কিছু হয়েছে।

_আরে যাবো তো..একটু দাড়া।

কোনো কথাই শুনলো না ইশা। হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো ফাইজা কে। তারপর সব ঘটনা তাকে বলতে লাগলো। সবটা শুনে ফাইজা বলল,
_হুম বুঝলাম। কিন্তু তুই ওনাকে সরি বলিস নি?

_না তো। আচ্ছা ওনার কথা বাদ দাও,এবার অন্য কথা শোনো।

_জি বলেন আম্মা..

ইশা কিছুটা সাহসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে বলল,
_আমি ভেবেছি,কালকে নিরব ভাইয়াকে প্রপোজটা করেই দেবো।

ফাইজা কিছুক্ষন চুপ থেকে হঠাৎ হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
_সে তো তুই আরো কতদিন আগে থেকেই করছিস।

_হেসোনা তো আপু,আমি এবার সিরিয়াস।

_তুই মেয়ে হয়ে একটা ছেলেকে প্রপোজ করবি?

_হ্যা অবশ্যই। তুমি শুধু দেখতে থাকো,এই ইশা কি করে..

#চলবে

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|অন্তিম পর্ব|

টকটকে লাল এবং সাদা গোলাপের সংমিশ্রণে আঁধারের পুরো ঘরটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সুন্দর ভাবে সাজানো সেই কক্ষটি’র বিছানার ঠিক মাঝ খানটায় বসে আছে জোনাকি। আজ থেকে আরো একজন মানুষের আনাগোনা বাড়বে এই ঘরে। যে ঘর শুধুমাত্র আঁধার রেজওয়ান এর অধীনে ছিলো, যার অনুমতি ছাড়া এই ঘরে কেউ উপস্থিত হতো না, সেই ঘরের আরো একজন মালিক আজ থেকে জোনাকি।

ঘন্টা খানেক ধরে একা এই ঘরে বসে আছে জোনাকি। সেই যে সবাই বসিয়ে রেখেছে আর কারো আসার নাম নেই। বসে থাকতে থাকতে যেন কোমড় ধরে যাচ্ছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেয়াল ঘড়ি খুঁজলো। সময় দেখলো রাতের সাড়ে বারোটা বাজে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। চেঞ্জ করা’ও দরকার। জোনাকি উঠে দাঁড়ায়। পুরো ঘরে কোথাও ওর লাগেজটা দেখতে পাচ্ছে না। ঘরের মাঝখানে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মূহুর্তে খট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। পরমূহুর্তে দরজা লাগানোর শব্দ’টাও কানে আসে। পায়ের শব্দ যতটা নিকটে এগিয়ে আসছে জোনাকির বুকের ধুকপুকানির শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। শাড়ি খামচে ধরলো। খুব কাছে এসে দাঁড়ায় আঁধার। জোনাকির বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। থমথমে গলায় প্রশ্ন আঁধারের,
–“রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?”

চকিত আঁধারের দিকে তাকায় জোনাকি। মানুষটা তুমি করে বললো ওকে? এটা কি ভুল শুনলো? উঁহু ভুল শোনেনি তো, ঠিকই তো শুনেছে মনে হলো। আঁধার ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,
–“ওভাবে তাকাচ্ছো কেন? ঠিকই শুনেছো, তুমি করেই বলেছি।”

জোনাকি দ্রুত দৃষ্টি সরালো। আঁধার আর একটু কাছে গিয়ে বললো,
–“আগে থেকেই ইচ্ছে ছিলো, নিজের বিয়ে করা বউ ব্যাতিত অন্য কোনো মেয়েকে তুমি করে বলবো না। আর এখন তো তুমি আমার বিয়ে করা বউ।”

–“আপুই আমার লাগেজ আনেনি? চেঞ্জ করবো আমি।”

আঁধার জোনাকির দুই বাহু ধরে বিছানায় বসিয়ে বললো,
–“তার আগে তোমাকে ভালোভাবে বউ সাজে একটু দেখি আমি?”

গলা শুকিয়ে আসছে জোনাকির। লোকটার এরকম কথাবার্তায় অভ্যস্ত না ও তাই কেমন কেমন লাগছে। তার উপর আবার লোকটা এখন ওর স্বামী। আজকে ওদের ফার্স্ট নাইট আরো নার্ভাস হয়ে আছে ও। চুপচাপ অন্যদিকে মুখ করে বসে রইলো জোনাকি। আঁধার দুই আঙুলের সাহায্যে জোনাকির থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
–“আঁধারের জীবনে জোনাকি হয়ে আসার তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা, উঁহু #একগুচ্ছ_ভালোবাসা। এক আকাশ সম পরিমান ভালোবাসা, আমার জীবনের যত ভালোবাসা আছে সেসকল ভালোবাসা তোমার।”

লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় জোনাকি। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। বুক ঢিপঢিপ করছে। লোকটা এরকম কথা’ও কি বলতে পারে? আঁধার বুঝলো মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। তাই প্রসঙ্গ পালটে বললো,
–“আলমারির ডান পাশের ডোর খুললেই ওখানে তোমার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেয়ে যাবে।”

জোনাকি দু দন্ড বসলো না। দ্রুত উঠে গেলো আলমারি খুলতে। আলমারি খুলেই হা হয়ে গেলো ও। আলমারির এই পার্ট মেয়েদের শাড়ি জামা দিয়ে ভর্তি। কিন্তু একটাও জোনাকির আগের জামা না। জোনাকি সরু চোখে তাকালো আঁধারের দিকে। আঁধার মুচকি হেসে উঠে আসে। বেছে বেছে কালো রঙের একটা শাড়ি জোনাকির হাতে দিয়ে বললো,
–“আজকে সন্ধ্যায়’ই সব কিনে আলমারি লোড করেছি।”

–“চুড়িদারও আছে দেখছি, মাপ জানলেন কি করে?”

আঁধার আগাগোড়া জোনাকিকে দেখে বললো,
–“তোমার যা বডি, মাপ জানা এতটাও টাফ ছিলো না আমার জন্য। চোখের অনুমান___”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
–“কি?”

আঁধার মুচকি হাসলো। বললো,
–“রিল্যাক্স ম্যাডাম, জলের থেকে জেনেছি আমি।”

জোনাকি শান্ত হলো। তারপর দ্রুত চলে গেলো ফ্রেস হতে। ফ্রেস হয়ে দুজনে একসাথে নামায আদায় করে। আঁধার দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে, সোনার লকেট সহ চেন পড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে একটা বক্সে গোল্ডের চিকন চুড়ি, দুটো রিং, আর সিম্পল একজোড়া দুল আছে সবসময় পড়ে থাকার জন্য। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পড়ে বের হবা।”

জোনাকি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। জোনাকি আঙুলে শাড়ির আঁচল পেচাচ্ছে বারবার। ওর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। গভীর রাত, পুরো ঘরে ওরা দুজন ব্যাতীত অন্যকেউ নেই। তাছাড়া সম্পর্ক বদলেছে দুজনের। বস পিএ, বেয়াই বেয়ান থেকে এখন স্বামী স্ত্রী দুজনে। জোনাকি বিছানায় উঠে বসলো। খাটের যে পাশ দেয়ালের সাথে লাগানো সে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আঁধার ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“শুয়ে পড়লে?”

–“আ্ আমি, না, আসলে কি করবো তাহলে? ঘুম আ্ আসছে আমার।”

আঁধার জোনাকির দিকে ঝুঁকে গিয়ে বললো,
–“তোমার কি আইডিয়া? আজকে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ার জন্য ঘরটা এভাবে সাজিয়েছে সবাই? আজকের রাতটা কি ঘুমানোর?”

জোনাকি সারা ঘরে চোখ বুলালো। গোলাপের সুঘ্রাণ এখনো নাকে এসে বারি খাচ্ছে। জোনাকি সব দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সরাসরি আঁধারের দিকে তাকালো। আঁধারের চোখ দেখেই বুক ধক করে উঠে জোনাকির। চোখের মধ্যে ব্যাকুলতা স্পষ্ট। তবুও জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“তাহলে কিসের?”

আঁধার জোনাকির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“জোনাকি’কে আঁধারের সম্পূর্ণ রুপে নিজের করে নেওয়ার রাত, ভালোবাসাকে ভালোবাসার রাত।”

কথাগুলো বলেই জোনাকির কপালের একপাশে গাঢ় চুমু খায় আঁধার। পবিত্র স্নিগ্ধ ভালোবাসাময় স্পর্শ পেয়ে জোনাকির হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়। চোখ খুলে রাখা যেন দায় হয়ে পড়ে।

খুব ভোরবেলা নিজেকে আঁধারের বাহুডোরে ক্ষানিকটা এলোমেলো অবস্থায় দেখে লজ্জায় হাঁসফাঁস করে জোনাকি। রাতের কথা মাথায় আসতে লজ্জা যেন আরো বেড়ে যায়। দূর থেকে আজানের ধ্বনি কানে আসছে। জোনাকি আঁধারের থেকে নিজেকে ছাঁড়ালো বহু কষ্টে। গোসল সেরে একেবারে পরিপাটি হয়ে এসে আঁধারকে ডাকতে লাগলো। কয়েক ডাকেই ঘুম ভাঙে আঁধারের। জোনাকিকে একটানে নিজের বুকের উপর ফেলে কপালে চুমু খায়। তারপর গালে চুমু দিয়ে বলে,
–“এত সকালে ডাকছো কেন? আদর লাগবে?”

আঁধারের কথা শুনে লজ্জায় জোনাকির গলা দিয়ে যেন শব্দ বের হচ্ছে না কোনো। আঁধার ফের ভ্রু নাচালো। জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“জ্বি না, উঠুন। ফজরের আজান দিচ্ছে নামাজ পড়বো একসাথে।”

আঁধার আর কোনো কথা ব্যয় না করে উঠে দাঁড়ালো। জোনাকির ঠোঁটে আলতো চুমু এঁকে এগিয়ে গেলো শাওয়ার নেওয়ার জন্য। ওয়াশরুমেই ফ্রেস হওয়ার পর পড়ার জন্য টি-শার্ট টাওজার আগেই দিয়ে রেখেছে জোনাকি।

নামায আদায় করে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে আঁধার। ডাকে জোনাকি’কেও। জোনাকি কাছে যায় না আর। বলে,
–“আপনি ঘুমান, আমি কিচেনে যাচ্ছি।”

কথাটা বলে দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। আঁধার সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মেয়েটা পালালো ওর থেকে। মিহাদের সাথে একদিন দেখা করতে হবে, লোকটা না চাইলে জোনাকি ওর হতো না।

কিচেনে এসে একা একাই রান্নার জোগাড় করতে শুরু করে জোনাকি। এ বাড়ির মোটামুটি সবার পছন্দের খাবার সম্পর্কে ধারণা আছে ওর। তাই সুবিধা’ই হলো সকালের নাস্তা বানাতে। নাস্তা বানানোর শেষ পর্যায়ে রেহানা রান্নাঘরে এসে বললো,
–“আয় হায় বড় ভাবী আপনে রান্না ঘরে ক্যান আইছেন? দাদীজান আর নিশি আপা আমারে দেখলে কথা হুনাইবো। সরেন দেহি আমারে নাস্তা বানাইতে দ্যান।”

–“আর একটু বাকী আছে তাহলেই তো শেষ, আপনি বরং এঁটো বাসনগুলো একটু ধুয়ে দিন, অনেক কিছু নোংরা করে ফেলেছি আমি নাস্তা বানাতে এসে।”

রেহানা সম্মতি জানিয়ে বাসন ধোয়ায় মনোযোগ দেয়। আমিনা বেগম রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
–“বড় নাতবউ? তুমি এখানে কেন? রেহানা? নাতবউ রান্না করতেছে কেন?”

জোনাকি চুলো বন্ধ করে আমিনা বেগমের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
–“আমিই এসেছি দাদু, রেহানা আপা আমাকে বারণ করেছিলো বারবার।”

–“ঘরে যাও তুমি, নতুন বিয়ে হইছে এখন আমার দাদুভাইকে সময় দিবে বেশি বেশি রান্নাঘরে আসার প্রয়োজন নেই। রান্না করার সময় অনেক পড়ে আছে, বিয়ের পর এই যে নতুন এই সময়টা যাচ্ছে এটা আর আসবে না ফিরে।”

–“টেবিলে নাস্তা দিয়ে তারপর___”

–“কাল সবাই অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে নয়টার আগে তো কেউ উঠবেই না, বাড়ির ছেলেদের অফিস বন্ধ আজ। কোনো চিন্তা নাই, যে যখন উঠবে নাস্তা করে নিবে। তুমি গিয়ে ঘুমাও কেউ ডাকবে না তোমাদের। রাত্রে তো ঘুম হয় নাই ভালো করে, আঁধার দাদু ভাই ঘুমাতে দেয় নাই নিশ্চয়ই?”

শেষ কথাগুলো আমিনা বেগম নিচু স্বরে রসিকতা করেই বললো। জোনাকি লজ্জা পেয়ে মাথা নামায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের দিকে।

ঘরের দরজা আটকে আবার বিছানায় গিয়ে আঁধারের পাশে শুয়ে পড়লো জোনাকি। আঁধার ঘুমিয়েছে ভেবে জোনাকি কাঁপা হাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আঁধারকে। সেই মূহুতেই আঁধার জোনাকির দিকে ঘুরে শক্ত করে বুকে আগলে নেয়। নাকে নাক ঘঁষে বললো,
–“এতক্ষণে আসলে? অপেক্ষা করছিলাম।”

–“অপেক্ষা কেন? আমি তো না’ও আসতে পারতাম।”

–“আমি জানতাম বাসার যে-ই তোমাকে দেখবে সেই ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিবে। তাই তো অপেক্ষা করছিলাম।”

জোনাকি কিছু বললো না। আঁধার বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“মিহাদকে বিয়ে করার তো খুব ইচ্ছে ছিলো, তাহলে সেই ছেলে বিয়ে ভাঙলো যে?”

জোনাকি গোমড়ামুখে সবটা বলে আঁধারকে। সব শুনে আঁধার বলে,
–“কিছু কথা বলবো, রেগে যাবে না তো?”

জোনাকি সরাসরি আঁধারের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“কি কথা?”

–“মিহাদের সাথে দেখা করেছিলাম আমি।”

জোনাকি সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
–“কি বলেছেন ওকে?”

–“বেশি কিছু না, শুধু বলেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো, এখন আমার উপর রাগ করেই ওর সাথে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছো। আমারও তোমাকে ছাড়া একদমই চলবে না, তাই মিহাদ যেন এই বিয়েটা না করে।”

–“আপনিইই____”

আঁধার আর কিছু বলতে না দিয়ে জোনাকি’কে নিজের সাথে জাপ্টে নিয়ে বললো,
–“সব কথা পরে হবে। রাতে ঘুমাইনি ভালো ভাবে, এখন ঘুমাবো। তুমিও ঘুমাবে, চোখ বন্ধ করো।”

মনে মনে মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করলো জোনাকি। লোকটা আসলেই পাগল। বড্ড বেশিই ভালোবাসে ওকে। শেষমেশ একটা গোমড়ামুখোকে ভালোবেসেছিলো ও। জোনাকি নিজেও তো চাইতো এই গোমড়ামুখো মানুষটাই যেন ওকে ভালোবাসে, ওর হয়। উপরওয়ালা ওদের দুজনের মনের কথা’ই শুনেছে। ওদের ভালোবাসাকে কবুল করেছে। এখন বাকীটা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতে চায় দুজনে একসাথে। ব্যাস! আর কি লাগে এক জীবনে?

|সমাপ্ত|

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১৪

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|১৪|

বিছানা ঘেঁষে ফ্লোরে হাটুতে মুখ গুজে কাঁদছে জোনাকি। এমন হলো কেন ওর জীবনটা? বাবা মাকে হারালো, যাকে ভালোবেসেছে তাকে ভুলে অন্য একজনের বাগদত্তা হলো। এখন সে মানুষটা বলছে এই বিয়েটা করা সম্ভব না? জীবন কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো ভীষণ। কিন্তু চিৎকার করতে পারলো না। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে শুধু। আঁধারকে বলবে সব? আঁধার তো চায় ওকে। এসব ভেবে ফোন হাতে নিলো। পরক্ষণেই মনে হলো এ কয়দিন আঁধার ওকে রিকুয়েষ্ট করেছে, বুঝিয়েছে কিন্তু ও বোঝেনি। বিয়ে ভাঙেনি। এখন মিহাদের থেকে রিজেক্ট হয়ে আঁধারের কাছে ফিরলে হাসির পাত্র হবে না সবার কাছে? ফোনটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিলো জোনাকি। কাউকে দরকার নেই। যেখানে নিজের বাবা মা একা করে ছেড়ে গেছে সেখানে পরের ছেলের কোনো দরকার নাই। কথাগুলো ভেবে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। রাতের রান্না বসাতে হবে। সকালে খেয়েছিলো, দুপুরে রেস্তোরাঁ থেকে ফিরে আর খাওয়ার রুচি হয়নি যার কারণে রান্না’ও করা হয়নি।

ফ্রিজে কালকের রান্না করা মাংসের তরকারি ওভাবেই পড়ে আছে, কাল দুপুরে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছিলো, রাতেও খায়নি বিধায় তরকারিটা ধরা’ই ছিলো। মাংস এবং সেই সাথে কিছু আচার দিয়েই শর্টকাটে আচারি খিচুড়ি রান্না করে ফেললো জোনাকি। আজ রাত এবং কাল সকালে খেয়েও ঢেড় বেশি হবে এই খিচুড়ি। চাল মাপার সময় অন্যমনস্ক থাকায় পরিমানের চেয়েও বেশি পরিমান চাল ডাল দিয়ে ফেলেছিলো, রান্নার সময় পানি দিতে গিয়ে চাল দেখে মাথায় হাত জোনাকির। সেসময়ে আর কিছু করার ছিলো না তাই রান্না করে ফেলে। সবকিছু গোছগাছ করে, খিচুড়ি আর শসা লেবু কেটে টেবিলে রাখলো। সাথে রাখলো আচারের বয়াম। খেতে ইচ্ছে হলে খাবে৷ ধোয়া উঠা গরম গরম খিচুড়ি প্লেটে বেড়ে এক লোকমা মুখে দিতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। কে হতে পারে এ সময়ে জানা নেই জোনাকির। খাবার চিবুতে চিবুতে এঁটো হাতেই উঠে গেলো দরজা খুলতে। ওপাশে আঁধারকে দেখতে পেয়ে ক্ষানিকটা চমকে উঠে জোনাকি। এই মূহুর্তে এই লোকটাকে তো ও কল্পনাতেও আশা করেনি। আঁধার ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“এভাবে হা করে তাকিয়ে আছেন কেন? ভিতরে যেতে বলবেন না?”

জোনাকি লজ্জা পেয়ে গেলো। দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। নিচু কন্ঠে বলে,
–“হ্যাঁ ভেতরে আসুন।”

আঁধার ভিতরে গিয়ে সোফায় বসে। জোনাকি দরজা আটকাতে গেলে আঁদবার সেদিকে না তাকিয়েই বলে,
–“দরজা খোলা রাখুন, স্বপ্ন নীড়ের সকল সদস্যরা আসছে।”

এবার ভ্রু কুঁচকে আসে জোনাকির। বিস্মিত স্বরে বলে,
–“সবাই আসছে?”

–“হ্যাঁ সবাই।”

–“আপুই স্বচ্ছ ভাইয়া কেউ তো কিছু বললো না আমাকে।”

–“প্রি প্ল্যান ছিলো না। তাই জানায়নি।”

জোনাকি কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আঁধার জোনাকির এঁটো হাতের দিকে তাকিয়ে ফের বললো,
–“আপনি বোধহয় খেতে বসেছিলেন? খাওয়া শেষ করুন আগে।”

–“আপনিও আসু____”

আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“খেয়ে নিন, পরে কিন্তু কাহ্বার সুযোগ না’ও পেতে পারেন।”

আঁধারের কোনো কথার’ই আগামাথা বুঝতে পারছে না জোনাকি। তাই সেসব কথার অর্থ খুঁজতে না গিয়ে পুনরায় টেবিলে গিয়ে বসলো জোনাকি। দুই লোকমা খেতেই সবাই এসে হাজির হয়। দরজা থেকেই স্বচ্ছ বলে,
–“আচারি খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে এসে বারি খাচ্ছে মনে হয়? ঠিক সময়েই আসলাম তাহলে।”

জোনাকি ফের খাওয়া বাদ দিয়ে দরজার কাছে যায় সবাইকে ভেতরে আনতে। সবাইকে সালাম জানিয়ে ভিতরে এসে বসতে বলে। তৈমুর আঁধারের পাশে বসে বললো,
–“কি শালা বাবু? দেরী সহ্য হচ্ছে না? আগে ভাগে এসেই বসে আছো দেখছি।”

–“আমি ঠিক টাইমে এসেছি, তোমরা লেট করেছো।”

তৈমুর আর কিছু বললো না। স্বচ্ছ চেয়ার টেনে টেবিলে বসলো। খিচুড়ির ঘ্রাণ নিয়ে বললো,
–“তোমার হাতের আচারি খিচুড়ি জোশ হয় জোনাকি। সার্ভ করো ফাস্ট, হবে তো আমাদের?”

জোনাকি হেসে মাথা নাড়ায়। স্বচ্ছ আঁধার আর তৈমুরকে ডাকে খাওয়ার জন্য। আঁদজার যেতে না চাইলে তৈমুর জোর করে নিয়ে টেবিলে বসায়। জল প্লেট নিয়ে আসে কিচেন থেকে। জোনাকি প্লেটে খিচুড়ি তুলে তিনজনের সামনে দেয়। জল শাহাদাত রেজওয়ানকে বলে,
–“বাবা আপনাকেও দেই?”

–“না মা, আমি এক ক্লাইন্টের সাথে বাইরে থেকেই ডিনার করে নিয়েছি।”

জল আমিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করেন, তিনিও খাবেন না জানায়। জোনাকি এবার আর একটা প্লেটে খিচুড়ি তুলে রাজিয়াকে দেন খাওয়ার জন্য। রাজিয়াও হাসিমুখে প্লেট নিয়ে টেবিলে বসে পড়ে। এবার রইলো জোনাকির প্লেট। জোনাকি আরো কিছু খিচুড়ি তুলে নিয়ে আমিনা বেগমের কাছে গিয়ে জোর করে দুও লোকমা খাইয়ে দেন উনাকে। তারপর একে একে নিশি আর জল’কে খাওয়ায়। সবাই অল্প সল্প করেই ভাগাভাগি করে খেয়ে নেয় খিচুড়ি।জোনাকির হাতের আচারি খিচুড়ি স্বচ্ছ আর জল বাদে বাকী সবাই প্রথম খেলো। সবার এত্ত এত্ত প্রসংশায় লজ্জা পায় জোনাকি।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। জোনাকি সবার জন্য চা কফি করে আনলো। যার যেটা পছন্দ তার হাতে সেটাই তুলে দিলো ও। সকলের এখানে আসার কারণ’টা জোনাকির কাছে এখনো অস্পষ্ট। জোনাকি জল’কে টেনে নিয়ে কিচেনে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,
–“জানিয়ে আসবি না আপুই? আমি আগে থেকে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে রাখতাম।”

–“কিচ্ছু করতে হবে না তোর, সব ঠিক সময়ে হয়ে যাবে।”

–“হঠাৎ করে না জানিয়েই এভাবে আসলি কোনো কারণ আছে?”

জল একপাশ থেকে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“হ্যাঁ তা তো একটা কারণ আছেই। একটু অপেক্ষা কর সব বুঝতে পারবি।”

জল চলে গেলো সবার কাছে। স্বচ্ছকে কিছু বলতেই স্বচ্ছ আর তৈমুর বেরিয়ে গেলো। জোনাকি নিশির পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর নিশির ফোন বেজে উঠে। নিশি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তৈমুর বলে,
–“রওয়ানা দিয়েছি আমরা, রেডি করো ওকে।”

–“আচ্ছা।”

নিশি ফোন পাশে রেখে জলকে ইশারা করে। জল জোনাকিকে নিয়ে নিজের ঘরে যায়। নিশিও যায় সাথে। নিশির হাতে বেশ ক’টা শপিং ব্যাগ। ঘরে গিয়ে নিশি ব্যাগ থেকে শাড়ি পড়ার প্রয়োজনীয় জিনিস বের করে জোনাকির হাতের দিয়ে বললো,
–“পড়ে এসো।”

–“কিন্তু কেন? এসব পড়বো কেন? তোমরা কেউ কিছু ক্লিয়ার করছো না কেন আমার কাছে?”

–“আগে পড়ে এসো তারপর বলছি।”

জোনাকি মনে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। মিনিট পাঁচেক বাদে বের হতেই নিশি আর জল দুজনে মিলে জোনাকিকে সিঁদুর লাল রঙের জামদানি শাড়ি পড়িয়ে দেয়। খোপায় টকটকে লাল গোলাপ গেঁথে দেয় বেশ কয়েকটা। হাত ভর্তি চুড়ি, গলায় কানে মাথায় গোল্ড অর্নামেন্টস। জোনাকি অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিলো সবকিছু। পরিশেষে লাল দোপাট্টা দিয়ে দেয় জোনাকির মাথায়। জোনকি বিস্ময় নিয়ে নিজেকে দেখছে আয়নায়। একদম বউ বউ লাগছে। নিশি জোনাকি’কে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“বউ বউ লাগছে না?”

জোনাকি মাথা নাড়ায়। নিশি ফের বলে,
–“এখন তো শুধু বউ বউ লাগছে, আর কিছু মূহুর্ত পরেই আঁধার রেজওয়ান এর বউ লাগবে। মিস জোনাকি থেকে মিসেস আঁধার রেজওয়ান হবে।”

জোনাকি স্তব্ধ হয়। কি শুনলো ও এটা? সত্যি কিনা আবার জিজ্ঞেস করতেই নিশি হেসে বললো,
–“হ্যাঁ আমাদের স্বপ্ন নীড়ের বড় নাতবউ হবে তুমি।”

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১৩

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|১৩|

স্বপ্ন নীড়ের সকল সদস্য’রা ভাবুক মুখে সোফায় বসে আছে। আঁধারের বলে যাওয়া কথাগুলো ভীষণ ভাবাচ্ছে সকলকে। বিয়ের আসর থেকে যদি সত্যি সত্যিই জোনাকিকে তুলে এনে বিয়ে করে তখন কি মান সম্মান কিছু অবশিষ্ট থাকবে? সেটাই ভাবছে সকলে। সে সময়ে লাগেজ টেনে ভেতরে ঢুকলো তৈমুর। অফিস থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে। সেখান থেকেই সবে ফিরলো। সবাইকে এমন ভার মুখে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
–“কি ব্যাপার? সবাই এরকম বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে রেখেছো কেন?”

নিশি উঠে তৈমুরের সামনে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে ক্ষানিক আগে ঘটে যাওয়া সকল তান্ডবের কথা জানালো। সব শুনে তৈমুরের মাথায় হাত। ইশ্! কি বিচ্ছিরি কান্ড। ও তো খুব শীঘ্রই আঁধার আর জোনাকির বিয়ের কথা বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু জরুরী কাজে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায় আর বলে যেতে পারেনি কাউকে। তৈমুর আমতা আমতা করে বললো,
–“বড় শালাবাবু কোথায় এখন?”

–“নিজের ঘরেই আছে দরজা বন্ধ করে।”

রাজিয়ার কথায় তৈমুর বললো,
–“আসলে আমারই ভুল, আমি ভেবেছিলাম ওদের বিয়ের কথা বলবো কিন্তু তাড়াহুড়ো করে গ্রামে চলে যাওয়াতে___যাই হোক সেসব কথা বাদ, আগে জোনাকির বিয়ে ভাঙতে হবে নয়তো আঁধার বাবুর রাগ এত সহজে গলে পানি হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না।”

–“মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে নাতজামাই। জোনাকির বিয়ে ভাঙলে লোকে ওকে নিয়ে চারটে কথা বলবে। ওর মৃত বাবা মা তুলেও কথা হবে আমি চাই না আমার নাতির জন্য এরকম কিছু হোক।”

আমিনা বেগমের কথা শেষ হতেই স্বচ্ছ বললো,
–“কিন্তু দাদু, ভাইয়া যদি জোনাকিকে তুলে এনে বিয়ে করে তখন কি করবে? তখন মান সম্মান থাকবে তো?”

জল আফসোসের স্বরে বললো,
–“ইশ্! ভাইয়া যদি আগে বলতো তাহলে আজ এমন কিছু হতো না। জোনাকি’কেও আমার থেকে দূরে যেতে হতো না। কিন্তু এখন তো___”

–“এখনো আহামরি তেমন কোনো দেরী হয়নি জল। জোনাকি এ বাড়ির বউ হয়েই আসবে। এটা আমার না আমাদের আঁধার বাবুর কথা। সে যেহেতু একবার বলেছে তাহলে হান্ড্রেড পার্সেন্ট জোনাকিকে বিয়ে করেই ছাড়বে। সুতরাং সে আরো বাড়াবাড়ি রকমের রেগে যাওয়ার আগে আমাদের উচিত জোনাকির বিয়ে ভাঙা।”

তৈমুরের কথায় নিশি সহমত জানিয়ে বললো,
–“আমিও এটাই চাচ্ছি। আমার ভাইয়ের খুশি সবার আগে।”

আমিনা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“আর জোনাকির? ও রাজি হবে কিনা আঁধারকে বিয়ে করতে, ও সুখি হবে কিনা আঁধারের সাথে এটা ভাবছো না কেউ?”

ক্ষানিক সময় ভাবলো সকলে। তারপর বললো,
–“সে দেখা যাবে। আগে একদিক তো ম্যানেজ করি।”

আজকে জোনাকি’কে অফিস নামিয়ে দিতে মিহাদ এসেছে। এ.আর. গ্রুপের সামনে এসে মিহাদ গাড়ি থামাতেই জোনাকি নেমে যায়। মিহাদ’ও বেরিয়ে আসে। একই সময়ে আঁধারের গাড়ি ঢুকে। গাড়ি পার্ক করে একবার রাগান্বিত চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় সে। জোনাকি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। মিহাদের থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত নিজেও চলে যায় অফিসে।

নিজের কেবিনে বসে মনে মনে দুয়া দুরুদ পড়ছে জোনাকি। লোকটা না জানি কখন ওকে ডেকে পাঠায়। ভাবতে না ভাবতেই জোনাকির ডাক পড়লো আঁধারের কেবিনে। শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে যায় সেদিকে। কেবিনের দরজা খোলা’ই ছিলো। জোনাকি ভেতরে যেতেই আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“দরজা লক করুন মিস জোনাকি।”

–“মা্ মানে? দরজা ল্ লক করবো কেন?”

–“যা বলেছি চুপচাপ তাই করুন, নয়তো এখানে এখন যা যা হবে পুরো অফিস দেখবে সেগুলো।”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে আঁধার। ওদিকে ভয়ে জোনাকির অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। কি বলে লোকটা? কি করতে চাইছে সে?জোনাকি কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে আঁধার এসে জোনাকির হাত চেপে ধরে। একহাতে শক্ত করে জোনাকির কবজি ধরে রেখে অন্যহাতে দরজা লক করে। শান্ত চোখে জোনাকির দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলে,
–“কিছুদিন আগে আপনিই বলেছিলেন আমাকে নিয়ে আপনার ভয় নেই। সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে ফাঁকা একটা ফ্ল্যাটে শুধু আপনি আর আমি ছিলাম। তখন ভয় কাজ করেনি আর আজকে অফিস ভর্তি লোকজনের সামনে ভয় পাচ্ছেন আপনি আমাকে নিয়ে। অন্য পুরুষের বাগদত্তা হতে না হতেই আঁধার রেজওয়ানের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেলো? ভয় পেতে শুরু করলেন তাকে?”

কি জবাব দিবে ভেবে পেলো না জোনাকি। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো। আঁধার জোনাকি’কে টেনে নিজের কাছে এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমি বলেছিলাম এই বিয়ে হবে না। তারপরেও আপনি ওই ছেলের সাথে মেলামেশা করছেন কেন? সে কেন আপনাকে অফিসে ড্রপ করতে আসে মিস জোনাকি?”

–“আমি তার বাগদত্তা, কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে হবে আমাদের। তার এইটুকুন অধিকারবোধ নিশ্চয়ই আছে আমার উপর? সে পারে আমাকে অফিসে ড্রপ করতে আসতে। আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তাহলে আপনি কেন রেগে যাচ্ছেন?”

আঁধার জোনাকির দুই গাল চেপে ধরে মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“আমি রেগে যাচ্ছি কারণ আপনার পাশে অন্য পুরুষের আনাগোনা সহ্য হয় না আমার। আপনার চারিপাশে শুধু মাত্র আমিই বিচরণ করবো। আপনি কেবলই আমার মিস জোনাকি।”

প্রথম কথাগুলো রাগের স্বরে বললেও শেষ কথাগুলো অত্যান্ত নরম স্বরে বললো আঁধার। নিশ্চুপ হয়ে যায় জোনাকি। আঁধার ফের বলে,
–“আপনি এই বিয়েটা করবেন না মিস জোনাকি। না করে দিন সবাইকে। আমি আপনাকে অনেক ভালো রাখবো, আই প্রমিসড ইউ।”

চোখ বন্ধ করে ফেললো জোনাকি। ওর কি যেন একটা হলো। ইচ্ছে করলো আঁধারকে বলতে,
–“আপনি আমার প্রথম অনুভূতি আঁধার স্যার। আপনার হাত ধরেই আমার এই নতুন অজানা অনুভূতির জগতে পদচারণ করা।”

মনে মনে কথা গুলো বললেও মুখে কথাগুলো বলতে পারে না জোনাকি। চোখ মেলে তাকায়। চোখমুখ যথাসাধ্য শক্ত করে কাটকাট কন্ঠে বলে,
–“এটা আর সম্ভব না আঁধার স্যার, আপনি বড্ড দেরী করে ফেলেছেন। আপনাকে খুশি করতে গিয়ে আর একটা নিরপরাধ ছেলেকে এতটা কষ্ট দিতে পারি না আমি।”

কথাগুলো বলে আঁধারের কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায় জোনাকি। বেরিয়ে যেতে নিলেই আঁধার পেছন থেকে বলে,
–“মানছেন না তো? ঠিক আছে। আমিও দেখি আপনি আমি আঁধার রেজওয়ান ছাড়া অন্য একজন পুরুষকে কবুল বলে নিজের স্বামী হিসেবে মানেন কিভাবে।”

কথাটা শোনার পর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না জোনাকি। দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় সে।

একটা ক্যাফেতে বসে আছে মিহাদ আর জোনাকি। মিহাদ’ই ডেকেছে আজ৷ মিহাদের চোখমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। পাশাপাশি লোকটাকে বেশ ভাবুক’ও মনে হচ্ছে। নিরবতা ভেঙে জোনাকি নিজেই বললো,
–“কেন ডেকেছেন? কিছু বলছেন না যে?”

–“আসলে জোনাকি কিভাবে বলবো তোমাকে কথাটা___”

–“কিছু হয়েছে? আপনার পরিবারের সকলে ঠিক আছে?”

–“হ্যাঁ সেসব ঠিক আছে। কথাটা আসলে অন্য___”

–“কি কথা? আপনি নির্ভয়ে বলুন।”

–“আমার বাবা মা এখন চাচ্ছে আমি আমার চাচাতো বোন রিয়াকে বিয়ে করি।”

থমকালো জোনাকি। কয়েকদিন বাদেই বিয়ে আর এই লোক আজকে এসব বলছে? জোনাকি কোনোমতে বললো,
–“সব তো ঠিক ছিলো তাহলে হঠাৎ করে___”

–“কিছুই ঠিক ছিলো না জোনাকি। বাবা শুরু থেকেই রাজি ছিলো না। সেদিন এক প্রকার জোর করেই উনাকে এনেছিলাম তোমাদের বাসায়। তার উপর তোমার সাথে এনগেজমেন্ট হওয়ার পর বাসায় ফিরে দেখি রিয়া কান্নাকাটি করছে। ও আমাকে ভালোবাসে। অনেক আগে থেকেই। আমিই পাত্তা দেইনি কখনো। সেদিন আমার হাতে পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করে। মানতে চায়নি আমি। এক পর্যায়ে ও সুইসাইড করতে যায়। দুদিন হসপিটালে ভর্তি ছিলো, এই যাত্রায় বেঁচে গেছে। কিন্তু মেয়েটার পাগলামি কমছে না, দিনকে দিন বেড়েই চলছে। এখন বাবা তো আরো চাইছে না আমি রিয়াকে রেখে তোমাকে বিয়েটা করি, মা’ও আমতা আমতা করছে। আমি আসলে___”

সবকিছু শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জোনাকি। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“আপনি কি চান সেটা বলুন?”

–“আমি আসলে___আমার তোমাকে ভীষণ পছন্দ, ওদিকে রিয়াটা’ও পাগলামি করছে আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।”

–“বুঝাবুঝির কিছু নেই, আপনি রিয়াকে বিয়ে করুন। এনগেজমেন্টের কথা শুনেই সে সুইসাইড করতে গিয়েছিলো, বিয়ে হলে তো নির্ঘাত বাঁচানো যাবে না তাকে। জান বাঁচানো ফরজ। আপনি উনাকেই বিয়ে করুন, আমাদের বাসার দিকটা আমি ম্যানেজ করবো।”

কথাগুলো বলে আর এক দন্ড দাঁড়ালো না জোনাকি। পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো ক্যাফে থেকে। মিহাদ নিষ্প্রাণ চোখে নিজের পছন্দের মানুষটাকে দূরে মিলিয়ে যেতে দেখলো শুধু।

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১২

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|১২|

জোনাকি অফিসে এসে বসতেই আঁধারের ডাক পড়লো। গুটিগুটি পায়ে আঁধারের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে জোনাকি। লোকটার দিকে তাকাবে কি করে ও? তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথমই যে কাউকে ভালো লেগেছিলো ওর। ভালো লেগেছে বললে বোধহয় ভুল হবে, ভালো লাগার থেকেও বেশি কিছু অনুভব হয় লোকটার প্রতি। অজানা একটা টান অনুভব করে জোনাকি। আচ্ছা আঁধার যখন জানবে জোনাকি অন্য একজনের বাগদত্তা তখন কেমন রিয়্যাকশন দিবে আঁধার? ককংগ্রাচুলেশনস জানাবে? নাকি গোমড়ামুখো লোকটা শুভকামনা জানাতেও কার্পণ্য করবে? ভাবছে জোনাকি। সেই মূহুর্তে ভেতর থেকে রাশভারি কন্ঠে আঁধার বলে,
–“দরজার বাইরে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন মিস জোনাকি? কাজে ডেকেছি আপনাকে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য না।”

জোনাকির ভাবুক মুখটা মূহুর্তেই রঙ বদলে ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। লোকটা এরকম কেন? নরম ভাবে কথা বললে কি জাত যায়? বিয়েটা হোক একবার তারপর আর এই অফিসে চাকরি করা তো দূরে থাক, লোকটা ছায়া’ও মারাবে না আর। মনে মনে ভেবে নিলো জোনাকি। বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে জোনাকি। আঁধার দরজার দিকেই তাকানো। জোনাকি ধীর পায়ে হেঁটে টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই আঁধার বসতে বলে। জোনাকি চেয়ার টেনে বসে। আঁধার প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“এতক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিলেন?”

–“উম___কিছু না।”

আঁধার আর ঘাটালো না। কয়েকটা ফাইল জোনাকির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“অফিস ছুটির আগে সবগুলো ফাইল ঠিকঠাক মতো চাই আমার।”

জোনাকি সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“যেতে বলেছি আমি?”

–“নাহ।”

–“তাহলে চলে যাচ্ছেন কেন? বসুন।”

জোনাকি চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লো। অযথাই বেশ কিছুক্ষণ জোনাকি’কে বসিয়ে রাখলো। ল্যাপটপে কাজ করলো, আবার মাঝে সাঝে আড়চোখে দেখলো জোনাকি’কে। তারপর বললো,
–“এবার আসতে পারেন আপনি।”

আঁধারের কথা’টা বলতে দেরী হলেও জোনাকির চট করে দাঁড়িয়ে আঁধারের কেবিন ছাড়তে মোটেও দেরী হলো না।

অফিসে কিছু ফাইল চেক করছিলো জোনাকি। ঘন্টা খানেক আগেই আঁধার তিনটা ফাইল ধরিয়ে দিয়েছে দেখার জন্য। অগ্যতা বসে বসে সেগুলো দেখতে হচ্ছে ওকে। সেসময়ে কেবিনে আসে নিলয়। জোনাকি ফাইল বন্ধ করে সৌজন্য হেসে বললো,
–“বসুন।”

নিলয় চেয়ার টেনে বসলো। বললো,
–“অনেক দিন পর তোমাকে স্বাভাবিক দেখে ভালো লাগছে।”

প্রত্যুত্তরে এবারেও হাসলো জোনাকি। নিলয় আমতা আমতা করে বললো,
–“তোমার অভিবাবক কে বর্তমানে?”

–“আমার আপুই আর স্বচ্ছ ভাইয়া।”

–“আমাদের স্বচ্ছ স্যার?”

–“জ্বি উনি আমার আপুই’র বর।”

–“আচ্ছা আচ্ছা।”

বেশ কিছুক্ষণ আবার দুজনেই চুপ। জোনাকি ফের ফাইল দেখায় মনোযোগ দেয়। নিলয় বলে,
–“আমি উনাদের সাথে কথা বলতে চাইছিলাম জোনাকি।”

জোনাকি প্রশ্ন চোখে তাকায়। নিলয় ফের বলে,
–“আসলে আমার তোমাকে পছন্দ হয়েছে, তাই বিয়ের____”

পুরো কথা বলতে দিলো না জোনাকি। তার আগেই থামিয়ে দিয়ে নিজের বা হাতের অনামিকা আঙুল দেখিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই যে আংটি’টা দেখছেন? এটা আমার বাগদানের আংটি।”

কথাটা শুনেই নিলয়ের মুখ ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। কোনমতে প্রশ্ন করে,
–“কবে হলো?”

–“গত পরশু।”

নিলয় আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। কেবিন থেকে বের হতেই আঁধারকে দেখে সালাম দিয়ে দ্রুত নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে পড়ে। আঁধার সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আঁধার একটা ফাইল নিতে এসেছিলো জোনাকির কেবিনে। দরজার বাইরে থেকেই নিলয় আর জোনাকির সব কথা শুনতে পায় সে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। জাস্ট তিনটে দিন কাজের জন্য ঢাকার বাইরে ছিলো আর এর মাঝেই এই ঘটনা ঘটে গেলো? তৈমুর আটকাতে পারেনি এনগেজমেন্ট’টা? সোজা নিজের কেবিনে চলে যায় আঁধার। সোহেলকে ফোন করে নিজের কেবিনে ডাকে আঁধার। সোহেল আসতেই আঁধার বললো,
–“অফিস ফাঁকা করো ইমিডিয়েটলি, অফিসে শুধুমাত্র আমি আর মিস জোনাকি ছাড়া যেন থার্ড পারসন না থাকে।”

–“স্যার হঠাৎ করে___”

–“আজকে হাফডে করে সবার ছুটি, আর কোনো সমস্যা?”

সোহেল মাথা নাড়িয়ে না জানায়। ঘড়িতে দেখে সাড়ে বারোটা। একটু পরই লাঞ্চ টাইম। সোহেল কেবিন থেকে বেরিয়ে সবাইকে কথাটা জানিয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুরো অফিস ফাঁকা হয়ে যায়। জোনাকি নিজের ডেস্কে সবকিছু গোছগাছ করে বের হতে গেলেই আঁধার খপ করে জোনাকির হাত ধরে ফেলে। জোনাকি’কে টেনে নিজের কেবিনে নিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। জোনাকি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আঁধার জোনাকির সামনে দাঁড়িয়ে ওর বা হাতটা টেনে উপরে তুলে অনামিকা আঙুলের আংটি’টা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–“কিসের রিং এটা?”

–“এনগেজমেন্টের।”

আঁধার জোনাকির দুই বাহু চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,
–“অন্যের পড়িয়ে দেওয়া রিং নিজের আঙুলে নেওয়ার আগে অন্তত আমাকে একবার বলতে পারতেন। আপনার এনগেজমেন্ট হয়েছে দুই দিন হলো, আর আপনি আমাকে এর মাঝে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না?”

জোনাকির সহজ স্বীকারোক্তি,
–“নাহ।”

–“কেন?”

–“কে আপনি? আমার এনগেজমেন্ট এর কথা আমি আপনাকে জানাবো কেন?”

ক্ষানিক সময়ের জন্য চুপ হয়ে যায় আঁধার। তারপর জিজ্ঞেস করে,
–“আপনি এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন মিস জোনাকি?”

–“হ্যাঁ। খুব শীগ্রই বিয়ের আয়োজন___”

–“তবে শুনে রাখুন, হবে না এই বিয়ে।”

জোনাকি চকিত তাকায় আঁধারের দিকে। আঁধার জোনাকির দুই বাহু চেপে ধরে নিজের অনেকটা নিকটে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমার আপনাকে লাগবে মিস জোনাকি। আমি ব্যাতীত অন্য কোনো পুরুষ আপনার হবে না। আমি ব্যাতীত অন্য কোনো পুরুষের জন্য আপনি কবুল বলবেন না, আপনি শুধু মাত্র আমার জন্য হালাল হবেন, অন্য কোনো পুরুষের জন্য আপনি কেবলই হারাম।”

কথাগুলো বলে হনহনিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যায় আঁধার৷ জোনাকি সেদিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। লোকটা কি ওকে থ্রেট দিয়ে গেলো? সেটাই ভাবছে জোনাকি। এটা ভেবে খুব খুশি লাগছে যে লোকটা ওকে চায়। আবার পরমূহুর্তেই মুখটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো এটা ভেবে যে ও এখন মিহাদ নামের একজন পুরুষের বাগদত্তা।

ড্রয়িংরুমের সবকিছু ভাংচুর করছে আঁধার। বাসার সকলে এক জায়গায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দিন পর আঁধারকে এভাবে রেগে যেতে দেখছে সকলে। আর এই রাগের কারণ সকলের কাছেই অজানা। এই মূহুর্তে নিশি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি আঁধারকে শান্ত করতে পারবে না। নিশি এগিয়ে গেলো সেদিকে। আঁধারের হাত থেকে ফুলদানি’টা ছাড়িয়ে নিয়ে টি-টেবিলের উপর রাখলো। তারপর প্রশ্ন করলো,
–“কি পাগলামি শুরু করেছিস ভাই? এত রেগে আছিস কেন সেটা তো বলবি আগে।”

আঁধার নিজের রাগ সামলে নিয়ে বললো,
–“জোনাকির এনগেজমেন্ট হয়েছে কথাটা সবাই জানে?”

–“হ্যাঁ সে তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু কেন ভাই?”

–“কবে থেকে জানিস তোরা?”

–“শুরু থেকেই তো সব জা____”

আঁধার রেগে সামনে থাকা টি-টেবিল টা লাথি মেরে উলটে দিয়ে চিৎকার করে বললো,
–“সবাই সবকিছু জানে, তাহলে আমাকে কেন জানানো হয়নি?”

নিশি মৃদু হেসে বললো,
–“আচ্ছা, তাহলে তুই সবার শেষে জেনেছিস বলে রাগ করছিস? আসলে তুই কাজের জন্য বাইরে ছিলি তো তাই আর ভেবেছিলাম তুই কাজ থেকে ফিরলেই গুড নিউজ’টা জানাবো তোকে।”

–“গুড নিউজ মাই ফুট।”

এবারেও হুংকার ছেড়ে কথাটা বললো আঁধার। বাসার সবাই ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আঁধারের দিকে। আমিনা বেগম এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। রাগান্বিত স্বরে বললেন,
–“তোমার সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গায় আঁধার দাদুভাই? জোনাকির বিয়ের খবর সবার শেষে শুনেছো এখানে? নাকি অন্য কোনো কারণ?”

–“আমার ওকে লাগবে, অ্যাট অ্যানি কস্ট। কিভাবে ওকে এনে দিবে, বা ওই মিহাদের সঙ্গে কিভাবে ওর এনগেজমেন্ট ভাঙবে দ্যাট’স নান মাই কানসার্ন। আর যদি তোমরা এনগেজমেন্ট ভাঙতে না পারো, তাহলে হলুদের দিন রাতে হলেও ওকে তুলে এনে বিয়ে করবো আমি। সবাই ভালো করে মগজে ঢুকিয়ে রেখো।”

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে নিজের ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দেয়। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সকলে। জল একদম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনে।

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১১

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|১১|

রাতের বারোটা বাজে। ঝড় কমার বদলে বেড়েই যাচ্ছে। জোনাকি আঁধারকে ওর ঘরে শুতে দিয়ে এসে নিজে বাবা মায়ের ঘরে এসেছে। ঘুম আসছে না জোনাকির। বাবা মাকে ছাড়া এই প্রথম এই বাড়িতে একা থাকছে ও। আর চাইলেও যে কখনো বাবা মায়ের সাথে থাকা হবে না। তাদের ছোঁয়া যাবে না। ভাবতেই কান্না পায় ভীষণ জোনাকির। ঘুম আসছে না বিধায় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দেয়ালে টাঙানো বাবা মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলো অপলক। বাইরে ঝড়ের প্রকোপ ক্ষানিকটা কমে আসছে। বারান্দার দরজা খুলে রেখেছে। বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে পড়ছে বারান্দা ছাড়িয়ে ঘরের মধ্যে। বাতাস আসছে ক্ষণে ক্ষণে। জোনাকির খুব ইচ্ছে হলো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে। ইচ্ছেটাকে দমিয়ে না রেখে গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দু’হাতে বারান্দার গ্রিল আকঁড়ে ধরে আকাশের দিকে মুখ করে তাকায়। অপলক তাকিয়ে থাকে মেঘলা, অন্ধকার আকাশের দিকে। বাতাসে খোলা চুল এবং জর্জেটের ফিনফিনে পাতলা গোলাপি উড়না খানা উড়ছে এলোমেলো ভাবে৷ বৃষ্টির ঝাপটা এসে চোখমুখে পড়ছে বার বার। জোনাকি বিরক্ত হচ্ছে না, বরং ভালোই লাগছে ওর।

ইমারজেন্সি কল এসেছে আঁধারের। ফোনটা রিসিভ করে মিনিট দুয়েক কথা বলতেই লাইন কেটে গেলো। আঁধার কান থেকে ফোনটা নামিয়ে দেখে ফোন বন্ধ, অর্থাৎ ফোনের চার্জ শেষ। কথা বলা’টাও জরুরী। আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে জোনাকি যে ঘরে শুয়েছে সেদিকে পা বাড়ায়। দরজায় নক করে বেশ কয়েকবার। কোনো সাড়া শব্দ এলো না ভিতর থেকে। আঁধার দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে উঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। ভাবলো হয়তো ওয়াশরুমে আছে। কিন্তু পরমূহুর্তেই দেখলো ওয়াশরুমের দরজা খোলা। চলে আসতে নেয় আঁধার কি মনে করে যেন আবার ভেতরে পা রাখে। বারান্দায় একটা অবয়ব দেখে এগিয়ে যায় সেদিকে। জোনাকিকে এরুপ রুপে দেখে হৃদ স্পন্দন থেমে যায় আঁধারের। শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে যায় সেদিকে। কাঁপা কাঁপা ভাবে হাত বাড়ায় জোনাকির দিকে। ঠিক সেই মূহুর্তেই জোনাকি পেছন ঘুরে আচমকা আঁধারকে দেখে ভয়ে চিৎকার করতে গেলেই আঁধার দ্রুত মুখ চেপে ধরে জোনাকির। ফিসফিস করে বলে,
–“ইট’স মি ডোন্ট শাউট। এভাবে চেঁচালে আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষ জন উল্টাপাল্টা ভাববে।”

কথাগুলো বলেই জোনাকির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয় আঁধার। জোনাকি ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–“আপনি? শব্দ করে আসবেন না? ভয় পেয়ে গেছিলাম।”

–“দরজায় নক করেছিলাম, আপনি শোনেননি।”

–“কোনো দরকার ছিলো?”

আঁধার আর একবার চোখ বুলালো জোনাকির দিকে। এ বাসায় থাকাটা এই মূহুর্তে ঠিক হবে না। আঁধারের নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। আলতো করে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ফাঁকা ঢোক গিলে আঁধার বললো,
–“ঝড় থেমেছে, এখন আর আপনার একা থাকতে সমস্যা হবে না। বাসায় ফিরে যাচ্ছি আমি। দরজাটা ভালো করে লক করে যান।”

কথাগুলো বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না আঁধার। দ্রুত কদম ফেলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। আঁধার এত দ্রুত কথা গুলো বলে চলে গেলো যে জোনাকি পাল্টা কিছু বলার সু্যোগ পেলো না আর। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দরজা ভালো মতো আটকে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

বাসায় ফিরে এক দন্ড শান্তিতে বসতে পারছে না আঁধার। এলোমেলো লাগছে সবকিছু। আজকেই কি ঝড়টা হওয়ার ছিলো? আজকেই মেয়েটাকে ওভাবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে হলো? হলো তো হলো ওর সামনেই কেন? দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে আঁধার। জোনাকি’কে ছোঁয়ার কোনো অধিকার ওর নেই। খুব শীঘ্রই অধিকার বানাতে হবে। দরজায় নক হলো। আঁধার ভেতরে আসতে বললেই তৈমুর এসে বসলো পাশে। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“শুনলাম জোনাকি’কে ছাড়তে গিয়েছিলে? ঝড় বৃষ্টির রাতেই এভাবে চলে এলে যে? ঝড় বৃষ্টি থামলে___”

–“সে অপেক্ষায় থাকলে অঘটন ঘটে যেতো বোধহয়, তাই আর বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে মন সায় দিলো না।”

তৈমুর সন্দিহান দৃষ্টিতে পরখ করে আঁধারকে। আঁধার ফের বলে,
–“মেয়েটা আমাকে ঘুমের ঘোরে’ও জ্বালাচ্ছে তৈমুর ভাই। কি করা যায় বলুন তো?”

তৈমুর মুচকি হেসে বললো,
–“সব ব্যবস্থা করছি শালাবাবু। এখন ঘুমিয়ে পড়ো, সকালে আবার অফিস আছে তো নাকি?”

আঁধার সম্মতি জানায়। তৈমুর মৃদু হেসে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

জল স্বচ্ছ’কে নিয়ে নিজেদের বাসায় এসেছে। জোনাকি তো পুরো ব্যস্ত স্বচ্ছকে আপ্যায়ন করায়। কি রেখে কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না যেন। কয়েক ধরনের নাস্তা বানিয়ে দুই বোন আর স্বচ্ছ বসলো বিকেলের আড্ডায়। আড্ডার এক ফাঁকে জল জোনাকি’কে প্রশ্ন করলো,
–“তোর কোনো পছন্দ আছে জোনাকি?”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“পছন্দ মানে?”

–“মানে কাউকে ভালোবাসো? পছন্দ করো কাউকে?”

স্বচ্ছ’র কথায় কিছু সেকেন্ডের জন্য আঁধারের মুখ খানা ভেসে উঠলো জোনাকির চোখে। পরপরই নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
–“সেরকম কিছু নেই, কেন?”

এবার জল বললো,
–“নাহার আপু ফোন করেছিলো দুই দিন আগে। তোর জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ দেখেছে। হাসান ভাইয়ের চাচাতো ভাইয়ের পরিবার থেকে সম্বন্ধটা এসেছে।”

এইটুকু বলে থামলো জল। জোনাকি অপলক তাকিয়ে আছে। জল এবার স্বচ্ছ’কে দেখিয়ে বললো,
–“তোর ভাইয়া দূর থেকে খোঁজ খবর নিয়েছে ছেলের। সবকিছু পারফেক্ট। এখন তুই যদি সম্মতি দিস তাহলে সন্ধ্যায় আসতে বলবো।”

শুকনো ঢোক গিলে জোনাকি। কি বলবে ও? আঁধারকে ভালো লাগে ওর এটা বলবে? না না এটা কিভাবে বলবে? আঁধারের দিক থেকে সেরকম কিছু নেই। লোকটা উচ্চবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা। তার সবকিছু’ই হাই কোয়ালিটি সম্পন্ন। তার চয়েজ’ও নিশ্চয়ই তার মতোই কোনো মেয়ে’ই হবে। সে তো আর স্বচ্ছ’র মতো বড় ঘরে জন্মেও সাধারণ ভাবে থাকেনি। সবাই তো আর ওর স্বচ্ছ ভাইয়া না। কোথায় এ.আর. গ্রুপের এমডি আঁধার রেজওয়ান আর কোথায় তার পিএ’র পোস্টে চাকরি করা অনাথ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে জোনাকি। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জোনাকি বললো,
–“তোমরা যা ভালো বুঝো, আমার কোনো আপত্তি নেই।”

জল আর স্বচ্ছ বেশ খুশি হলো। বেশ বড় ঘর থেকেই সম্বন্ধ এসেছে। ছেলেটাও খুব ভালো, যদি বিয়েটা হয় তাহলে জোনাকি’কে নিশ্চয়ই খুব সুখেই রাখবে।

পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে জোনাকি। পাত্র, পাত্র’র মা বাবা আর ছোট বোন এসেছে। সাথে নাহার আর হাসান আছে। টি-টেবিলে হরেক রকমের নাস্তা দিয়েছে জল আর নাহার মিলে। সকলেরই ভীষণ পছন্দ হলো জোনাকি’কে। হাসান বললো,
–“কারো কোনো আপত্তি না থাকলে মিহাদ আর জোনাকি’কে আলাদা ভাবে কথা বলতে পাঠাই?”

সকলেই সম্মতি জানালো। যাদের বিয়েটা হবে, তাদেরও তো নিজস্ব কথাবার্তা বলার দরকার আছে। জোনাকি মিহাদ’কে নিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় গেলো। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে মিহাদ নিজেই বললো,
–“আপনার কোনো কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করতে পারেন আমাকে।”

–“কোনো প্রশ্ন নেই আমার।”

নিচু কন্ঠে জবাব দিলো জোনাকি। মিহাদ বললো,
–“আপনাকে আমি মাস ছয়েক আগে হাসান ভাইদের বাসায় দেখেছি তখনই ভালো লেগে যায় আমার। ইচ্ছে ছিলো তখনই কথা বলবো আপনার পরিবারের সাথে। পরে আপনার বড় বোনের বিয়ে হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। ভেবেছি উনার বিয়ে হলেই আপনার বাবার কাছে প্রস্তাব রাখবো আমি। কিন্তু___”

এইটুকু বলে থেমে যায় মিহাদ। ক্ষানিকটা সময় চুপ থেকে ফের বলে,
–“তার মাঝেই এত বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেলো তোমার সাথে এরমাঝে আর বিয়ের কথা বলতে সাহস পাইনি। তবে হাসান ভাইকে জানিয়ে রেখেছিলাম। সে বলেছে আপনাকে কিছু দিন সময় দিতে। তাই তো আপনি স্বাভাবিক হওয়া অব্দি অপেক্ষায় ছিলাম আমি।”

জোনাকির চোখ ভার হয়ে আসলো। বাবা মার কথা মনে হতেই চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়লো। মিহাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“সে কি আপনি কাঁদছেন কেন? আমি কি আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?”

জোনাকি চোখের পানি মুছে বললো,
–“না না, সেরকম কিছু না। আপনি বলুন।”

–“আপনার এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই তো?”

–“আপুই আর স্বচ্ছ ভাইয়ার আপত্তি না থাকলে আমারও আপত্তি নেই।”

কথাটা বলার সময় গলা কাঁপলো জোনাকির। আঁধারের রাগী মুখ খানা ভেসে উঠলো বারবার। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কথাখানা বলেই ফেললো জোনাকি। মিহাদ হাসলো। বললো,
–“তবে চলুন সবাইকে আমাদের মতামত জানানো যাক।”

বেরিয়ে আসলো দুজনেই। মিহাদ বাবা মায়ের পাশে বসে বললো,
–“আমার কোনো আপত্তি নেই।”

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো জোনাকির দিকে। জোনাকি নিচু কন্ঠে বললো,
–“আপুই আর স্বচ্ছ ভাইয়া যা ভালো বুঝে তাই হবে।”

স্বচ্ছ আর জল জানালো ওদেরও কোনো আপত্তি নেই। মিহাদের মা সাথে করে রিং নিয়েই এসেছিলো। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আংটির বক্স বের করে মিহাদের হাতে দেয়। নাহার জোনাকির হাত এগিয়ে দিতেই মিহাদ জোনাকির অনামিকায় রিং পড়িয়ে দেয়। জল বাবা মায়ের ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে বাবার একটা সোনার আংটি এনে জোনাকির হাতে দেয়। আজকেই আংটি বদলের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় বাবার রেখে যাওয়া আংটি’টাই নিয়ে আসে। জোনাকিও পড়িয়ে দেয় মিহাদের আঙুলে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই বাগদান হয় দুজনের। চোখের পলকেই জোনাকি হয়ে যায় মিহাদের বাগদত্তা।

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১০

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|১০|

জোনাকি’র বাবা মা মারা যাওয়ার মাস দেড়েক পেরিয়েছে৷ জোনাকি এখনো স্বপ্ন নীড়েই আছে। এত বড় বাড়িতে সবাই থাকা স্বত্তেও জোনাকির দম বন্ধ হয়ে আসে। পাশে জল থাকাতেও ভালো লাগে না। মনটা যে ওদের সেই ছোট্ট ফ্ল্যাট’টাতেই পড়ে আছে। কয়েক দিন ধরেই মন পুড়ে যাচ্ছে নিজেদের বাসায় যাওয়ার জন্য। জোনাকি বেশ অনুরোধ করে জল’কে রাজি করায়। জোনাকি আজ ভীষণ খুশি। ও নিজের বাড়িতে যাবে, সেখানে যেভাবে ইচ্ছে থাকবে। হ্যাঁ বাবা মাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে। কিন্তু তাদের স্মৃতি আগলে ধরেই তো থাকতে পারবে। স্বপ্ন নীড়ের কোনো সদস্য রাজি ছিলো না, মত দেয়নি প্রথমে। কিন্তু জোনাকির জেদের কাছে হার মানে। এখন জোনাকি যেহেতু স্বাভাবিক হয়েছে তাই চিন্তা কিছুটা হলেও কমেছে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচে ড্রয়িংরুমে চলে আসে জোনাকি। সাথে জল আসে। কাল দুই বোন মিলে গিয়ে ফ্ল্যাট পরিষ্কার করে এসেছে সাথে সারা মাসের শুকনো বাজার করে রেখে এসেছে। স্ন্যাকস আইটেম’ও আছে বেশ কিছু। কিছু মাছ মাংসে ফ্রিজ ভর্তি করে রেখে এসেছে জল। জোনাকির কোনো বারণ শুনেনি স্বচ্ছ। নিজের হাতেই সব বাজার সদাই করে দিয়েছে এসেছে ও। শুধু শাক-সবজি কিনে রাখেনি। সেগুলো তো আবার নষ্ট হয়ে যাবে। তাই যখন যেটা খাবে জোনাকি কিনেই নিবে। স্বচ্ছ, শাহাদাত, তৈমুর সবাই এই সময়ে অফিসে। আমিনা বেগম জোনাকি’কে নিয়ে সোফায় বসলো৷ এটা সেটা বোঝাচ্ছে। একা ফ্ল্যাটে থাকবে তাই আগেভাগেই সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে বলছে। রাজিয়া আর নিশি কিচেন থেকে বড় দুটো টিফিন বক্স আর এমনি কয়েকটা বক্স হাতে করে নিয়ে আসলো। সেগুলো আলাদা একটা ব্যাগে ভরতে ভরতে রাজিয়া বললো,
–“এখানে বেশ কয়েক আইটেমের খাবার দিয়ে দিচ্ছি, তোমার তিন চারদিন অনায়াসে হয়ে যাবে। সারা দিন পর অফিস থেকে ফিরে যেদিন যেটা ইচ্ছা সেটা ফ্রিজ থেকে নামিয়ে গরম করে খাবে। কয়েকদিন রান্নাবান্নার ঝামেলা একদম নেই।”

–“আমি রান্না জানি তো আন্টি, কষ্ট করে এতকিছু রান্না করে দেওয়ার কোনো দরকার ছিলো না।”

রাজিয়া চোখ পাকিয়ে বলে,
–“কিসের কষ্ট? এইটুকুন রাঁধতে আবার কষ্ট কিসের? মেয়ের জন্যই তো রেঁধেছি।”

রাজিয়ার কথায় জোনাকি আর জলের চোখে অশ্রু জমে। যে রাজিয়া প্রথমদিন জোনাকি’কে এ বাড়িতে থেকে পছন্দ করেনি সেই রাজিয়া জোনাকি’কে আজ মেয়ে বলছে। নিশি বুঝতে পারছে দুই বোন আর একটু হলেই কাঁদবে। তাই প্রসঙ্গ পালটে জল’কে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“জোনাকি’র প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে দিয়েছো তো?”

জল মাথা নাড়ে। সে সময়ে কলিংবেল বেজে উঠে। আফজাল চাচা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। আঁধার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে’ই বললো,
–“জোনাকি’কে আসতে বলো চাচা, আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।”

আফজাল চাচা সম্মতি জানিয়ে ভেতরে এসে বললো,
–“আঁধার বাবা’য় গাড়িতে অপেক্ষা করতাছে। জোনাকি মারে যাইতে কইছে। দেও দেহি তোমার ব্যাগপত্র আমি গাড়িতে রাইখা আহি, ওই রেহানা ওই ব্যাগ দুইডা তুই লইয়া আয়।”

আফজাল চাচা আর রেহানা মিলে সবগুলো ব্যাগপত্র নিয়ে চলে গেলেন। জোনাকির অস্বস্তি হচ্ছে। জোনাকি লক্ষ্য করেছে আঁধার আগের থেকে বেশ নরম হয়েছে জোনাকি’র প্রতি। আর সেজন্যেই যেন ওর অস্বস্তি’টা বেড়েছে। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে একেক সময় তাকিয়ে থাকে লোকটা৷ তৈমুর’ও কেমন আঁধারকে নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলে৷ আঁধার হাসে তখন। অথচ জোনাকির মতে লোকটা’র তখন রেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে রেগে না গিয়ে হাসে কেন? ভেবে পায় না জোনাকি। নিশি বললো,
–“ভাই অপেক্ষা করছে চলো, ও তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

জোনাকি মাথা নাড়িয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। পেছনে পেছনে নিশি, জল, রাজিয়া তিনজনেই আসে ওকে বিদায় দিতে।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ জোনাকি নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছায়। ওখান থেকে মাগরিবের আগে আগে বেরিয়েছিলো, রাস্তায় জ্যাম থাকায় ক্ষানিকটা দেরী হলো আসতে৷ আঁধার সবগুলো ব্যাগ জোনাকির ফ্ল্যাটের সামনে রেখে দিয়ে বললো,
–“এখন আসি, সাবধানে থাকবেন। আর রাতের বেলা কেউ ডোরবেল বাজালে দরজা খুলবেন না একদম। কোনো সমস্যা হলে আমাকে বা বাসায় ফোন দিবেন বুঝলেন?”

জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“দরজা অব্দি এসে ফিরে যাবেন? খারাপ দেখাচ্ছে না? ভেতরে এসে বসুন।”

–“উহুঁ, অন্যদিন আসবো।”

–“বাবা মা বেঁচে থাকলে উনারা যদি বলতো তাহলে এভাবে চলে যেতেন?”

আঁধার চকিত তাকালো জোনাকির দিকে। মেয়েটার চোখে পানি চিকচিক করছে৷ না করার আর উপায় পেলো না। ব্যাগগুলো আবার হাতে তুলে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো। জোনাকি বেশ খুশি হলো। ঝটপট এক মগ কফি করে এনে দিলো আঁধারকে। আঁধার মৃদু হেসে কফির মগ নিয়ে চুমুক দেয়। জোনাকি বললো,
–“আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি ফ্রেস হয়ে আসছি।”

আঁধারের উত্তরের অপেক্ষা করলো না জোনাকি। দৌড়ে চলে গেলো নিজের ঘরে৷ মিনিট দশেক বাদে ফ্রেস হয়ে এসে দেখলো আঁধার বসে ফোন ঘাটছে। জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“রাতের খাবার দেই? একেবারে খেয়ে যান?”

আঁধার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। চট জলদি মাথা নামিয়ে নেয় জোনাকি। আঁধার কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখলো তারপর বললো,
–“বাসায় গিয়েই ডিনার করবো।”

–“খেয়ে গেলে আমি খুশি হবো।”

–“বাসায় গেলে যা খাবো এখানেও তো সেই সেম খাবার’টাই____”

–“আপনি অপেক্ষা করলে আমি অন্য খাবার বানিয়ে দিতে পারি।”

আঁধার ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো। এটাই চাচ্ছিলো ও। মেয়েটা দুর্দান্ত কফি বানায়। রান্না’ও নিশ্চয়ই ভালো করে? মেয়েটার হাতের রান্না খাওয়ার ভীষণ লোভ ওর। জোনাকি ফের বললো,
–“অপেক্ষা করবেন আপনি?”

আঁধার মাথা নাড়ায়। জোনাকি দৌড়ে কিচেনে যায়। কি রান্না করবে ভেবে পায় না। গুটিগুটি পায়ে আবার ড্রয়িংরুমে আসে। ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
–“কি রান্না করবো?”

–“যা ইচ্ছে।”

ফোন চালাতে চালাতে জবাব দেয় আঁধার। জোনাকি প্রশ্ন করে,
–“আপনার পছন্দের খাবার কি?”

–“আপু’র হাতের সবজি খিচুড়ি, ওটা আপু বেশ বানায়।”

নিশি একবার সবজি খিচুড়ি রান্নার সময় জোনাকি পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখেছিলো। তাই ও ভাবলো একবার না’হয় চেষ্টা করে দেখা যাক। জোনাকি ফের কিচেনে আসলো। কিন্তু কোনো সবজি তো নেই, আর এখন ফ্রিজ থেকে মাংস নামালেও সেটা বরফ ছাড়তে বেশ সময় লেগে যাবে। তাই জোনাকি দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে পার্স হাতে নিয়ে আঁধারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আপনি বসুন, আমি এক্ষুণি আসছি।”

এবারেও আঁধারকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জোনাকি বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। ওদের বাসার সামনে মোড়ের কাছে যে বাজার আছে সেখানেই চলে আসলো। দূরত্ব মাত্র মিনিট তিনেকের। জোনাকি চট জলদি এক চিল মিষ্টি কুমড়ো, মটরশুঁটি, গাজর, ফুলকপি, বেগুন, ধনেপাতা এবং শসা, লেবু, টমেটো কিনে নিলো। সবজির দোকান থেকে বেরিয়ে মাংসের দোকানে গিয়ে দেড় কেজি গরুর মাংস কিনে সেগুলো দোকান থেকে ছোট ছোট পিস করে কাটিয়ে নিলো।

বাজার সদাই নিয়ে বাসায় ঢুকতেই আঁধার রাগী চোখে তাকায় জোনাকির দিকে। গম্ভীর স্বরে বললো,
–“বাজার নেই আমাকে বললেই তো আমি এনে দিতাম, আপনার এভাবে দৌড়ে বাজারে যাওয়ার কি দরকার ছিলো মিস জোনাকি?”

–“আপনি বাজার করতে পারেন? কখনো গিয়েছেন?”

–“যায়নি, তবে আজ যেতাম। সমস্যা কি?”

–“আসলে সবজি ছিলো___”

আঁধার থামিয়ে দিলো জোনাকি’কে৷ বললো,
–“নেক্সট টাইম কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে রাতের বেলা এভাবে বাজারে যাওয়ার জন্য দৌড়াবেন না। আমাদের জানাবেন, আমরা পৌঁছে দেবো।”

জোনাকি চুপচাপ সম্মতি জানায়। তারপর দ্রুত কিচেনে যায় রান্না করার জন্য৷ ঘন্টা দুয়েকের মতো সময় লাগে জোনাকির কাটাকুটি করে রান্না শেষ করতে। সবজি এবং গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি এবং বেগুন ভাজা করেছে জোনাকি। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। বাইরে প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছে। জোনাকি দ্রুত সবজি খিচুড়ি, বেগুন ভাজা পাত্রে বেড়ে নিলো তারপর শসা, লেবু, টমেটো পেয়াজ, মরিচ সবকিছু সুন্দর ভাবে কেটে প্লেটে সাজিয়ে সবকিছু টেবিলে নিয়ে রাখলো। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে কোনোমতে হাতমুখে পানি দিয়ে পড়নে জামা পাল্টে আবার ডাইনিংয়ে আসলো। চেয়ার টেনে প্লেট গ্লাস দিয়ে আঁধারকে ডাকলো খেতে। আঁধার চুপচাপ এসে বসলো। জোনাকি নিজেই খাবার বেড়ে দেয় আঁধারের প্লেটে। আঁধার খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে যায়। প্রশ্ন করে,
–“আপনি খাবেন না?”

–“আগে আপনি খেয়ে নিন, আমি পরে___”

–“পরে না, এক্ষুণি বসুন।”

বলে আঁধার নিজেই প্লেট নিয়ে খাবার তুলে দিলো জোনাকির জন্য। জোনাকি বাধ্য মেয়ে। তাই চুপচাপ বসে পড়লো। অতঃপর দুজনে একসাথেই খাওয়া শেষ করলো। সবকিছু গুছিয়ে কিচেনে রাখার সময়’ই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। জোনাকি হাতের কাজ রেখে দ্রুত কিচেনের জানালা বন্ধ করে দৌড়ে যায় রুমের বারান্দা লক করতে৷

টানা দুই ঘন্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় চলার উপায় নেই। ঘড়িতে তখন রাতের সাড়ে এগারোটা বাজে। অথচ বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই। ড্রয়িংরুমের দুই সোফায় দুজনে চুপচাপ বসে আছে। আঁধার চেয়েছিলো বৃষ্টির মাঝেই চলে যেতে, জোনাকি যেতে দেয়নি। বলেছে বৃষ্টি থামলে যেতে। কিন্তু বৃষ্টি’ই তো থামছে না। আঁধার এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
–“বৃষ্টি মনে হয় থামবে না, আসছি আমি। গাড়ি আছে সাথে কোনো সমস্যা হবে না যেতে।”

বাজ পড়ার শব্দ হলো। বৃষ্টি আরো বাড়ছে। সাথে বাজ পড়ছে। ঝড় হচ্ছে বাইরে ভীষণ রকমের। এই ঝড়ের রাতে জোনাকির একা ফ্ল্যাটে থাকতে এবার ভয় ভয় লাগছে। যদি কারেন্ট চলে যায় তখন? জোনাকি মিনমিন করে বললো,
–“আজ যাবেন না, আমার ভয় লাগছে।”

–“আমি থাকলে ভয় লাগবে না?”

আঁধারের প্রশ্নের ধরণটা বুঝতে পারলো জোনাকি। এই মানুষটা’কে নিয়ে ওরকম কোনো ভয় নেই জোনাকির মনে। তাই বললো,
–“উহুঁ, আপনাকে নিয়ে ভয় নেই।”

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০৯

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|৯|

প্রচন্ড জ্বরে কাবু জোনাকি। দুদিন হলো অফিস কামাই যাচ্ছে৷ জল আর স্বচ্ছ কালকেই এ বাসা থেকে ঘুরে গিয়েছে। আনিসুজ্জামান’কে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার ডেট আজকে। অথচ জোনাকি বিছানা থেকে উঠতে পারছে না ক্লান্ত শরীর নিয়ে। জ্বর এখন কিছুটা কম থাকলেও শরীর এখনো দূর্বল। জাহানারা বেশ কিছুক্ষণ বসে জোনাকির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। জ্বর হালকা হয়ে এসেছে অনেকটা। জাহানারা বললো,
–“আজকে তো তোর বাবা’কে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার কথা ছিলো, তুই তো অসুস্থ আজ___”

–“তুমি বাবা’কে নিয়ে যাও। আমার সমস্যা হবে না।”

–“তোকে একা রেখে__”

–“জ্বর নেই তো, তুমি যাও।”

জাহানারা আর দ্বিমত করলো না। আনিসুজ্জামান’কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। জোনাকি ভালো করে দরজা লক করে আবার বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘন্টা তিনেক বাদে জাহানারা’র নাম্বারে ফোন করে খোঁজ নেয় জোনাকি। বারো নাম্বার সিরিয়ালে আছে, এখন দশ চলছে।

তীব্র রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় জোনাকি’র। মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন লোক বললো,
–“হ্যালো? হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছেন? আপনি কি জোনাকি বলছেন? একজন ভদ্রলোক, এবং মহিলা এক্সিডেন্ট করেছে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে, ফোন’টা উনাদের থেকে পেয়েছি, আপনি কি উনার পরিচিত? কাইন্ডলি উনাদের পরিবারকে খবরটা জানিয়ে দিবেন।”

মূহুর্তেই ঘুম ছুঁটে যায় জোনাকির। শোয়া থেকে উঠে বসে। দু’হাতে চোখ কচলে ভালো করে নাম্বার’টা দেখে৷ আনিসুজ্জামানের নাম্বার। সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করে জোনাকির। ততক্ষণে ফোনের ওপাশের ব্যক্তি হ্যালো হ্যালো করছেন। জোনাকি কাঁপা-কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
–“কোন হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে?”

–“আপনি কে হোন উনাদের?”

জোনাকি কান্নারত স্বরে বললো,
–“মেয়ে।”

লোকটা সময় না নিয়ে দ্রুত হসপিটালের নাম বলে ফোন রেখে দেন। জোনাকির অবস্থা পাগলপ্রায়। কি করবে? কাকে বলবে? ভাবতে ভাবতেই কয়েক সেকেন্ড গড়ালো। বিছানার কাছ থেকে উড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ফোন আর পার্স নিয়ে ফ্ল্যাট তালা মেরে নিচে নেমে যায় দ্রুত।

আধ ঘন্টার মাঝেই হসপিটালে পৌঁছে বাবার নাম্বারে ফোন দেয় জোনাকি। সেই লোকটা ফোন রিসিভ করে থার্ড ফ্লোরে অটি’র সামনে যেতে বললেন। জোনাকি লিফটের কথা বেমালুম ভুলে সিড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে উঠে। গায়ে তখনো হালকা জ্বর থাকায় কয়েক সিড়ি উঠতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু থেমে থাকে না ও। অটি’র সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা এবং পুরুষ এগিয়ে আসে জোনাকির দিকে। মহিলাটা প্রশ্ন করেন,
–“তুমি জোনাকি?”

–“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার, আমার বাবা মা কোথায়? ওরা ঠিক আছে?”

পুরুষ’টি বলেন,
–“তোমার বাবার অপারেশন চলছে, আর___”

–“আর মা? মা কোথায় আমার?”

মহিলা’টা জোনাকি’কে একপাশ থেকে আগলে নিয়ে বলে,
–“শান্ত হও মা, তোমার মা বেঁচে নেই। স্পট ডেথ।”

পুরো দুনিয়া’টা অন্ধকার হয়ে এলো জোনাকির। জাহানারা নেই কথাটা মাথায় আসতেই মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মহিলাটা বুকের সাথে আগলে নিলেন ওকে। প্রশ্ন করলেন,
–“তোমার বাড়িতে আর কেউ নেই মা? তুমি একাই?”

এই মূহুর্তে এসে জোনাকি’র জলের কথা মনে হলো। ফোন বের করে ডায়াল করে জলের নাম্বারে। একবার, দু’বার, তিনবার। জল ফোন তুললো না। এরপর ট্রাই করলো স্বচ্ছ’র নাম্বারে। স্বচ্ছ’র ফোন বন্ধ। জোনাকির এই মূহুর্তে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আঁধারের কথা মাথায় আসতেই দ্রুত আঁধারের নাম্বারে ডায়াল করে। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ হয় ফোন। জোনাকি কেঁদেই যাচ্ছে। কাঁদার ফলে কথা বলতে পারছে না। আঁধার অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
–“জোনাকি আর ইউ ওকে? জ্বর সেরেছে তোমার? বেশি শরীর খারাপ লাগছে? কাঁদছো কেন?”

–“আমার মা___”

–“আন্টি? কি হয়েছে আন্টির? ঠিক আছে উনি?”

–“আর নেই।”

স্তব্ধ হয়ে যায় আঁধার। জোনাকির থেকে ঠিকানা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। স্বচ্ছ’র ফোন বন্ধ আর জল ফোন তুলছে না দেখে বাসার নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দেয় ও।

আনিসুজ্জামান’ও মারা যায়। বাঁচানো যায়নি তাকে। একই সাথে বাবা মা দুজনকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে যায় জোনাকি। অতিরিক্ত কান্নার ফলে মাথা যন্ত্রণা করছে। শরীরে জ্বরটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হসপিটালের করিডোরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে একধ্যানে তাকিয়ে আছে জোনাকি৷ কিছু মূহুর্ত বাদেই হাজির হলো আঁধার। দৌড়ে জোনাকির সামনে গিয়ে বসলো। জোনাকির দুই গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
–“আংকেলের কি অবস্থা জোনাকি? উনি ঠিক আছে? আর আন্টি___”

–“আমি অনাথ হয়ে গেলাম স্যার। একই সঙ্গে বাবা মা দুজনেই আমাকে চিরতরে একা করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো।”

কথাটা বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে জোনাকি। আঁধারের বুক ভারী হয়ে আসলো। বাবা মা না থাকার যন্ত্রণা আঁধার খুব ভালো করেই জানে। কাঁদতে কাঁদতে আঁধারের বুকে ঢলে পড়ে জ্ঞান হারায় জোনাকি।

মৃতদেহ বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। হসপিটালের সব ফর্মালিটি আঁধার নিজেই ফিল আপ করেছে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্নীয় স্বজনে জোনাকিদের ছোট্ট বাসা’টা গিজগিজ করছে। জোনাকির সকল আত্নীয় স্বজন ঢাকাতেই থাকে। তাই আর আনিসুজ্জামান এবং জাহানারার মৃতদেহ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়নি। কান্নাকাটির রোল পড়েছে। জোনাকির চাচা ফুপু, মামা খালারা প্রলাপ করে কাঁদছে।

জলের পাগলামি বাড়ছে। ওকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। বারবার মৃতদেহ ধরে কাঁদতে যায়। নিশি আর রাজিয়া ধরে রেখেছে ওকে। রাজিয়া বুকের সাথে আগলে রেখে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে কি কোনো বোঝ আসে? যার বাবা-মা না থাকে সে-ই তো বোঝে বাবা মা না থাকার কি কষ্ট।

দাফন করার জন্য মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। যাওয়ার আগে জল আর জোনাকির কান্নায় কেঁদেছে সেখানকার প্রতিটি মানুষ। দুই বোন যেন বাবা-মাকে কিছুতেই যেতে দিবে না। ওভাবেই রেখে দিবে নিজের কাছে। চাইলেই কি আর তাদের রাখা যায়? নিয়মানুসারে আল্লাহ তা’আলার ডাকে সাড়া দিয়েছেন দুজন। তাদের ধরে রাখার সাধ্যি যে আর কারো নাই। আনিসুজ্জামান এবং জাহানারার লাশ নিয়ে যায় দাফন করার জন্য।

জলকে সামলাচ্ছে রাজিয়া আর নাহার। ওদিকে জোনাকি বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে। শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে একটুখানি হয়ে আছে। জোনাকির পাশে রিমু আর মিতু আছে।

জোনাকির বাবা মায়ের মৃত্যুর আজ চারদিন। তিনদিনের দিনই মিলাদ পড়িয়ে গরীব অসহায়দের খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসা এতিমখানায়ও খাবার পাঠানো হয়েছে। জোনাকি ওর বাবা-মায়ের ঘরে বসে তাদের ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদছে৷ বাবা মাকে ভীষণ মিস করছে ও। জল এসে পাশে বসলো। ও এখন নিজেকে সামলে নিয়েছে ক্ষানিকটা। জোনাকির জন্য’ই। জল যদি এখন জোনাকির সামনে কান্নাকাটি করে তাহলে জোনাকি’কে কে সামলাবে? জোনাকির যে এই দুনিয়াতে এখন ও ছাড়া আর কেউ নেই। এই চিন্তা করেই নিজেকে শক্ত করেছে জল। তবুও আড়ালে আবডালে ঠিকই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে বাবা মায়ের জন্য। জোনাকি ছবি’টা বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জল কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“কাঁদিস না জোনাকি। কত বোঝাবো বল? এভাবে কাঁদলে যে বাবা মা’ও কষ্ট পাবে৷ ওরা তো আমাদের সবসময় হাসিখুশি দেখতে চেয়েছে এখন আমরা যদি কেঁদে বুক ভাসাই তাহলে ওরা শান্তি পাবে? হয়তো শারীরিক ভাবে আমাদের কাছে নেই কিন্তু আত্নীক ভাবে তো আমাদের কাছেই আছে বল? মিশে আছে তো আমাদের আত্নার সাথে৷”

–“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আপুই, আমাকে একা করে কেন চলে গেলো বাবা মা? আমাকেও তো সাথে নিতে পারতো বল? আমি কিভাবে থাকবো ওদের ছাড়া?”

জল বোন’কে বুকে জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নিশি আর রাজিয়া ঘরে আসে সে সময়ে দুই বোনকে কাঁদতে দেখে কাছে এগিয়ে যায় ওরা। রাজিয়া জল’কে কঠোর স্বরে বলে,
–“তোমাকে না বলেছি একদম কাঁদবে না? তুমি কাঁদলে জোনাকি’কে কে সামলাবে?”

শ্বাশুড়ির মৃদু ধমকে জল কান্না থামায়। রাজিয়া জোনাকির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–“কেঁদো না, আল্লাহ’র কাছে দোয়া করো যাতে উনারা জান্নাতবাসী হয়। আর তুমি একা কে বলেছে? জল, তোমার বড় বোন আছে না? আমরা সবাই আছি না? আমরা সবাই তো তোমার কাছেরই। নিজেকে একদম একা ভাববে না।”

জোনাকি তখনো ফুঁপাচ্ছে। নিশি জোনাকির মাথায় হাত রেখে বললো,
–“এখন রেডি হও তো, আজ থেকে তুমি আমাদের সাথে স্বপ্ন-নীড়েই থাকবে৷”

–“আমি এ বাসাতেই থাকবো। এখানে আমার বাবা মায়ের অজস্র স্মৃতি আছে। সেগুলো ছেড়ে যেতে পারবো না আমি।”

–“তুই একা থাকতে পারবি না জোনাকি। তুই আমার সাথেই থাকবি। তোকে একা রাখবো না আমি।”

–“প্লিজ আপুই, আমি যাবো না। বাবা মায়ের এই শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকু আগলেই বাঁচতে চাই আমি। এইটুকু থেকে দূরে সরাস না আমাকে।”

–“বাসা’টা তোমাদেরই থাকবে। যখন ইচ্ছে হবে এসে দুই বোন ঘুরে যাবে সমস্যা নেই তো।”

রাজিয়ার কথায় নিশি আর জল সম্মতি জানায়। স্বচ্ছ ঘরে প্রবেশ করে তখন। জোনাকি’কে এখনো ওভাবে বসে থাকতে দেখে বললো,
–“কি ব্যাপার এখনো রেডি হওনি?”

জোনাকি স্বচ্ছকে বললো,
–“ভাইয়া সবাইকে বোঝান না, আমি যাবো না। আমি আমাদের বাড়িতেই থাকবো, আমার কোনো সমস্যা হবে না।”

–“সে কি কথা জোনাকি? তুমি ভাবলে কি করে তোমাকে একা ফেলে আমরা চলে যাবো? জলদি রেড হও, কয়েকদিন পর আবার আমরা সবাই মিলে এসে এই বাড়ি থেকে ঘুরে যাবো।”

সবার এত এত অনুরোধ আর ফেলতে পারে না জোনাকি। জল জোনাকি দুইজনে মিলে জোনাকির সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে নেয়। তারপর সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়ে স্বপ্ননীড়ের উদ্দেশ্যে।

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০৮

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|৮|

–“কি হলো? ধোয়াও আঁধারের হাত।”

কথাটা বলেই তৈমুর ঠোঁট কামড়ে হাসে। আঁধার তখনো জোনাকির দিকে তাকানো। জোনাকি শক্ত কন্ঠে বলে,
–“এখানে বর স্বচ্ছ ভাইয়া, আমরা তার হাত ধুইয়েই টাকা নেবো।”

–“আঁধারের হাত ধোয়ালে তিনগুন পাবে বললামই তো। নয়তো এক টাকা’ও না। আমরা নিজেরাই নিজেদের হাত ধুয়ে নিতে পারি।”

জোনাকি স্বচ্ছ’র হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
–“লাগবে না টাকা।”

জোনাকি চলে যাওয়ার জন্য দুই কদম বাড়াতেই রিমু বলে,
–“আমি ধুইয়ে দিচ্ছি হাত।”

থেমে যায় জোনাকি। রিমু কি সত্যি সত্যিই ধুয়ে দিবে হাত? স্পর্শ করবে আঁধারকে? পেছন ফিরে আবার তাকায় জোনাকি। তৈমুর মৃদু হাসে জোনাকির চাহনি দেখে। তারপর বলে,
–“উঁহু, এই চান্স শুধু জোনাকির।”

রিমু বিরক্ত হলো। যে হাত ধোয়াতে চায় না তাকে দিয়ে জোর করে কেন ধোয়াবে? ও নিজে তো চাচ্ছে ধুইয়ে দিতে, তাহলে ওকে ধোয়াতে দিবে না কেন? আশ্চর্য! মিতু এবার জোনাকি’কে জোর করতে থাকে হাত ধোয়ানোর জন্য। নাহলে একটা টাকা’ও পাবে না ওরা। মিতু’র রিকুয়েষ্ট ফেলতে পারে না জোনাকি। ফের আঁধারের মুখোমুখি গিয়ে বসে। তারপর বলে,
–“দেখি আপনার কোর্টের হাতা উপরে তুলুন।”

আঁধার বাধ্য ছেলের মতো নিজের ডান হাতের কোর্টের হাতা টেনে উপরে তোলে। জোনাকি আশ্চর্য হয়ে তাকায়। কিছুক্ষণ আগে রিমু হাত ধোয়াতে যাওয়ার সময় তো উঠে চলে যাচ্ছিলো, তাহলে জোনাকির বেলা যাচ্ছে না কেন? উলটো জোনাকি কোর্টের হাতা তুলতে বলতেই সাথে সাথে হাতা তুলে ফেলে। রিমু দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। ব্যাপারটা ওর নিজের’ও নজর এড়ায়নি। তৈমুর তো প্রথম থেকেই মজা নিচ্ছে। জোনাকি কোনো কথা না বলে চুপচাপ আঁধারের হাতে সাবান মাখিয়ে ধুইয়ে দেয়। রিমু স্বচ্ছর হাত ধুইয়ে দেয়। মিতু বলে,
–“এবার আমাদের টাকা?”

তৈমুর পকেট থেকে টাকা বের করে জোনাকির হাতে দেয়। জোনাকি টাকা নিয়ে চলে আসতে নিলেই শাড়ির আঁচলে টান বাজে। পেছন ফিরে তাকায় জোনাকি। আঁধার জোনাকির শাড়ির আঁচল টেনে তা দিয়ে হাত মুছে বললো,
–“হাত মোছাতে ভুলে গিয়েছিলে।”

কথাটা বলে আঁধার নিজেই সেখান থেকে উঠে চলে যায়। আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে রয় জোনাকি, মুচকি হাসে তৈমুর। অন্যদিকে রাগে ফেঁটে পড়ে রিমু।

বিদায়ের বেলা ঘনিয়ে আসতেই বুক ভার হয়ে আসে জলের। জোনাকি তো অন্যঘরে বসে সে কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে। জল’কে নিয়ে যাওয়ার পালা এবারে। রিমু নাহার ওরা জল’কে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। আনিসুজ্জামান মেয়েকে শাহাদাত এবং স্বচ্ছ’র হাতে তুলে দেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাবার কান্নায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না জল। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। নাহার ভেতরের ঘর থেকে জাহানারাকে জলের কাছে নিয়ে আসে। বাবাকে ছেড়ে এবার মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জল। অনেক সময় চলে যাওয়ার পরেও জোনাকি’কে না দেখে এদিকে সেদিক খুঁজতে থাকে। রাফিন বলে,
–“তোমাদের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে ও, আসবে না।”

জল এলোমেলো পায়ে সে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় দাঁড়িয়ে বেশ ক’বার ডাকে। কোনো সাড়া দেয় না জোনাকি। জল এবার দরজা ধাক্কা দিয়ে বলে,
–“বের হবি না জোনাকি? চলে যাচ্ছি তো আমি, আর আগের মতো ফিরবো না এ বাড়িতে। সবসময় অতিথি হয়ে আসতে হবে। দেখ জোনাকি কাঁদছি আমি, এখনো দরজা খুলবি না তুই?”

জোনাকির কোনো সাড়া নেই। নাহার জল’কে নিয়ে চলে আসার জন্য ঘুরতেই খট করে দরজা খুলার শব্দ হয়। জল পেছনে ঘুরার আগেই জোনাকি পেছন থেকে ওকে জাপ্টে ধরে শব্দ করে কাঁদে। বলে,
–“তুই যাস না আপুই, আমার রাতে ঘুম হবে না তো। তুই জানিস না আমার একা ঘরে ঘুমাতে ভয় লাগে? আমি কাকে নিয়ে ঘুমাবো? ভয় পেলে কে আমাকে সাহস দিবে? প্লিজ আপুই তুই যাস না আমাকে ছেড়ে।”

জল কাঁদছে, কাঁদার ফলে কিছু বলতে পারছে না। এদিকে রাত হয়ে আসছে। এবার ওকে নিয়ে যাবার পালা। নিশি এসে আগলে ধরে জলকে। চলে যেতে চায় বাসা থেকে। জোনাকি সেখানেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকে। সিড়ি অব্দি যেতেই জ্ঞান হারায় জল। তৈমুর ইশারা করতেই স্বচ্ছ জল’কে কোলে তুলে নিয়ে নেমে যায় সিড়ি দিয়ে। জাহানারা এবং আনিসুজ্জামান দুজনেই গাড়ি অব্দি এসে মেয়েকে বিদায় দেয়।

ফুলে সজ্জিত কক্ষে বসে বসে ঘুমে ঢলছে জল। এ ঘরে ওকে বসিয়ে দিয়ে গেছে ঘন্টা দুই হবে। পুরো ঘরে মোমবাতি’র আলোয় আলোকিত। ফুলের গন্ধ মো মো করছে ঘরটা। এদিকে ঘুমে তাকাতে পারছে না জল। একপর্যায়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে।

জল ঘুমানোরও পাক্কা চল্লিশ মিনিট পর দরজা খুলে ঘরে ঢুকে স্বচ্ছ। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে বিছানার কাছে। দেখতে পায় জল ঘুমাচ্ছে, চোখমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। স্বচ্ছ’র ইচ্ছে করলো না জল’কে জাগাতে। তাই নিঃশব্দে নিজে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। নিরবে বিছানায় উঠে জলের দিলে ঝুঁকে দেখতে লাগলো অপলক। চোখমুখে গরম নিঃশ্বাস পড়ায় ঘুম ভেঙে যায় জলের। মুখের সামনে স্বচ্ছ’কে ঝুঁকে থাকতে দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে। অপ্রস্তুত হয়ে যায় স্বচ্ছ। জল আমতা আমতা করে বলে,
–“স্যরি আসলে ঘুম, ঘুম পাচ্ছিলো।”

স্বচ্ছ প্রথমেই কিছু না বলে পকেট থেকে চেন বের করে পড়িয়ে দেয় জলের গলায়। তারপর বলে,
–“সমস্যা নেই, ঘুমাও। তোমাকে দেখেই তো ক্লান্ত মনে হচ্ছে।”

জল ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
–“ঘুমাবো?”

–“হ্যাঁ শুয়ে পড়ো।”

জল আবার গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। শরীর কাঁপছে ওর। স্বচ্ছ নিজেও জলের পাশে শুয়ে জল’কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
–“এতদিন কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়েছি, এখন আস্তো একটা বউ আছে তাই রোজ বউকে জড়িয়েই ঘুমাবো।”

কথাটা বলে আলতো করে চুমু খায় জলের কপালে। লোকটার স্পর্শে কাঁপুনি শুরু হয় জলের। কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে ঠোঁটে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুমু খেয়ে জাপ্টে ধরে শুয়ে পড়ে। তারপর আবার চোখ খুলে বলে,
–“আজ ক্লান্ত তুমি, তাই আজকের দিনটা ছাড় দিলাম। এরপর আর নো ছাড়াছাড়ি। আজ রাতটা ঘুমাও কাল থেকে অনলি ভালোবাসা-বাসি।”

হাতে গোলাপি রঙের জর্জেট ওড়নার এক টুকরো ছেঁড়া অংশ নিয়ে বসে আছে আঁধার৷ জোনাকির ওড়নার অংশ এটা৷ কাল জোনাকি’কে নিয়ে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলো ও। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে লেট হওয়াতে নিজেই জোনাকি’কে বাসায় পৌঁছে দেয়। কেননা ওর তাড়া ছিলো বাসায় যাওয়ার। জলের হলুদ যে। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে এই অংশটা গাড়ির দরজার সাথে আটকা পড়ে ছিঁড়ে যায়। সেখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে এটা। খুবই তুচ্ছ একটা জিনিস, কিন্তু আঁধারের কাছে বেশ মূল্যবান মনে হচ্ছে। খুব যত্নে রেখেছে এই একদিন। হুট করেই আঁধারের মনে পড়ে গেলো আজ বিকেলের ঘটনা। জোনাকির আঁচল টেনে হাত মোছাটা যেন দূর্দান্ত একটা মোমেন্ট ছিলো আঁধারের কাছে। মেয়েটা যখন ভয় ভয় চেহারা নিয়ে তাকায় ওর দিকে, তখন মেয়েটার ওই ভয়ার্ত চেহারায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে আঁধারের। মনে হয় অনন্তকাল এই মেয়েটার মায়ায় পড়ে কাটিয়ে দিতে পারবে ও। আঁধারের এসকল ভাবনার মাঝেই ওর পাশে এসে বসে তৈমুর। আঁধার দ্রুত ওড়নার অংশটা হাতের মুঠোয় বন্দী করে ফেলে। তা দেখে তৈমুর নিঃশব্দে হাসে। আঁধার বলে,
–“কিছু বলবে তৈমুর ভাই?”

–“রাত তো অনেক হয়েছে শালাবাবু, এখনো না ঘুমিয়ে সুইমিংপুলে বসে বসে কি এত ভাবছো?”

–“এমনি বসে আছি।”

–“স্বচ্ছ তোমার ছোট ভাই, অথচ দেখো সে ছক্কা মেরে দিয়েছে। এই মূহুর্তে বউ নিয়ে বাসর ঘরে আছে। আর তুমি বড় ভাই হয়ে একটা মেয়ের ওড়নার ছেঁড়া অংশ হাতে করে সেই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছো?”

প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না আঁধার। তৈমুর ফের বলে,
–“মিস করে গেলে শালাবাবু, আজকে বিয়েতে মত দিলে তুমিও এখন বউ নিয়ে বাসর ঘরে থাকতে, অন্য মেয়ের চিন্তা ভাবনা মস্তিষ্কে নিয়ে সুইমিংপুলে বসে থাকতে না।”

–“সেরকম কিছু না।”

–“কেমন কিছু তাহলে?”

উত্তর করলো না আঁধার। তৈমুর ঠোঁট কামড়ে হাসে। আঁধার এই মূহুর্তে কিছু একটা বলবে সেটা সিয়র তৈমুর। তাই তো চুপচাপ পাশে বসে রইলো। কিছু মিনিট গড়াতেই আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“আই থিংক, আই ওয়ান্ট হার।”

কথাটা বলে আর এক মূহুর্ত বসে থাকলো না আঁধার। হনহনিয়ে চলে যায়। তৈমুর সেখানে বসেই আঁধারের চলে যাওয়া দেখে। মৃদু হাসলো তৈমুর। এই দুজনের জুটি হলে ভালোই মানাবে বলে মনে করলো তৈমুর। আঁধার জোনাকি’কে তো পাশাপাশি কাছাকাছি বেশ লাগে ওর।

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০৭

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|৭|

হলুদের মোটামুটি সব আয়োজন শেষ। জোনাকির দুই চাচাতো ভাই বোন রিমু, রাফিন, ফুপাতো বোন নাহার এবং তার স্বামী হাসান এবং খালাতো ভাই আশিক এবং মামাতো বোন মিতুই এদিকের হলুদের সব আয়োজন করেছে। নাহার আর আশিক জলের’ও বড়। রিমু জল সমবয়সী এবং রাফিন জোনাকি একই বয়সের, ওদের থেকে বছর দুয়েকের ছোট মিতু।

তাড়াহুড়ো করে কাঁচা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে বের হলো জোনাকি। ওর আজ অফিস থেকে আসতে আসতে লেট হয়েছে অনেকটা। আজ হাফ ডে, সবার তাড়াতাড়ি ছুটি হলেও জোনাকি’কে ছেড়েছে দেরী করে। জোনাকি’কে সাথে নিয়ে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলো মূলত সেখানেই দেরী হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে না। ক্লাইন্টের জন্য ক্ষানিকটা অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ওদের। জোনাকি চলে আসতে চেয়েছিলো আঁধারের দৃষ্টি দেখে আর কিছু বলার সাহস পায়নি।

জোনাকি বের হতে হতেই দেখা গেলো সিড়ি দিয়ে উঠছে স্বপ্ন নীড়ের সদস্যরা। নিশি, তৈমুর, রিশাদ এবং আরো দুই চারটা অপরিচিত মুখ। হলুদের ডালা নিয়ে এসেছে উনারা। আশিক এবং হাসান ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের খাতির আপ্যায়ন করতে। জোনাকি সিড়ির দিকে আরো একবার উঁকিঝুঁকি মারলো। আঁধার আসেনি? আসেনি বোধহয়। জোনাকি পাংশুটে মুখে দরজার কাছ থেকে সরে এলো। লোকটার ধমকি ধামকি যেন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে ওর। কখনো কখনো খুব বেশি খারাপ লাগে, আবার কখনো একটু আধটু ভালো’ও লাগে।

ড্রয়িংরুমের মধ্যেই ছোটখাটো ভাবে হলুদের জায়গা বানিয়েছে। জোনাকি ওরা কয়েকজন মিলে জলকে সেখানে এনে বসালো। স্বচ্ছ’র বাড়ি থেকে দেওয়া শাড়ি গয়না পড়ানো হয়েছে ওকে। তৈমুর আর নিশি দুজনে একসাথে গিয়ে দুইপাশে বসলো জলকে হলুদ ছোঁয়াতে। নিশি রিশাদের কাছে হলুদের বাটিটা চাইলে রিশাদ ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে,
–“ইশ! আপু আমি তো ভুলে গেছি।”

নিশি চোখ রাঙিয়ে তাকায়। তৈমুর নিশিকে বললো,
–“চিন্তা করো না, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলে তৈমুর ওঠে যায়। দরজার কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলো সিড়ি ভেঙে এই ফ্ল্যাটের দিকেই আসছে আঁধার। হাতে হলুদের বাটি। তৈমুর স্বস্তির শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায় আঁধারের দিকে। আঁধারের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–“যাক বাঁচালে তুমি, আমি এক্ষুনি আবার হলুদের জন্য বাসায় যাচ্ছিলাম।”

আঁধার মৃদু হাসলো। তৈমুর আঁধারকে নিয়ে বাসায় ঢুকে বললো,
–“তোমার যে ভাইকে এত বলেও আনতে পারোনি সে ভাই এখন হলুদের বাটি নিয়ে চলে এসেছে নিশি।”

নিশি উঠে আঁধারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“বেশ ভালো করেছিস তুই এসে। একেবারে জলকে হলুদ লাগিয়ে যাবি।”

–“ও আমার ছোট ভাইয়ের বউ আপু।”

এরইমাঝে আনিসুজ্জামান এসে আঁধারকে বললো,
–“তুমি তো মাত্রই আসলে, সোফায় বসো বাবা।”

আঁধার মাথা নেড়ে বসলো। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে ভিতরের রুমের দিকেও উঁকিঝুঁকি মারলো। ফলাফল শূণ্য। পকেট থেকে ফোন বের করে তাতে মনোযোগ দেয় আঁধার। তখনই রিমু আর জোনাকি ট্রে ভরে কয়েক ধরনের নাস্তা এনে টি-টেবিলে রাখলো। আঁধার ফোন থেকে মনোযোগ সরাতেই দৃষ্টি আটকালো শাড়ি পরিহিতা জোনাকির দিকে। তৈমুর পাশে বসে গলা ঝাড়তেই আঁধার দৃষ্টি সরিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দেয়। জোনাকি আর রিমু খালি ট্রে গুলো নিয়ে কিচেনে যায়। যাওয়ার পথে রিমু জিজ্ঞেস করে,
–“ছেলেটা কে রে? জলের দেবর?”

জোনাকি ট্রে গুলো জায়গামতো রেখে বললো,
–“জ্বি না, ভাসুর।”

–“ওহ তার মানে তো বিবাহিত।”

–“আজ্ঞে না, উনি এখনো আনম্যারিড তকমা গলায় ঝুলিয়ে ছোট ভাইকে বিয়ে করাচ্ছে।”

–“কাহিনী কি? জানিস কিছু?”

–“নাহ।”

কথাটা বলেই ছোট পাতিলে করে পানি বসালো চুলোয়। রিমুর মনোযোগ তখন আঁধারের দিকে। ছেলেটাকে ভালো লেগেছে ওর। জলের বিয়েটা হোক তারপর ওর থেকে নাম্বার’টা নিতে হবে। মনে মনে ভাবলো রিমু।

রিমু নাস্তার প্লেট গুলি নিয়ে আসলো আঁধারের সামনে থেকে। লোকটা তো কিছুই খেলো না। কথা বলার চেষ্টা করেছিলো সেটাও বলেনি। রিমু সেগুলো কেবিনেটের উপর রেখে বললো,
–“লোকটা তো একটা নাস্তাও মুখে তুলেনি, ডায়েট টায়েট করে নাকি?”

জোনাকি কফি বানাতে বানাতে বললো,
–“কি জানি আপু, জানি না তো। তবে কফি দিলে সেটা খাবে নিশ্চয়ই, সারাদিনে তো দেখি ওই তেঁতো তেঁতো কফি’ই সাবাড় করছে মগের উপর মগ।”

কথাগুলো বলে জোনাকি একটা মগে কফি নিয়ে নিলো। রিমু ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“তুই জানিস কেমনে?”

–“উনি আমার বস আপু, আর আমি অসহায় বালিকা ওই রাগচটা গোমড়ামুখো মানুষটার পিএ অর্থাৎ পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট।”

কথাটা বলেই প্রস্থান করলো জোনাকি। রিমুর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। জোনাকি’র থেকেই তো তাহলে নাম্বার নেওয়া যাবে এই ভেবে।

তৈমুর আর নিশি জলকে হলুদ লাগিয়ে আঁধারের পাশে বসে আছে। জোনাকি আঁধারের দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“আপনার কফি।”

আঁধার এক পলক তাকিয়ে কফির মগটা নিয়ে নিলো। সেদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো তৈমুর। নিশিকে ইশারা করলো ওদের দুজনকে দেখতে। নিশি খেয়াল করলো দুজনকেই। প্রথমদিনের থেকে আজ অনেক পরিবর্তন দুজনের মাঝেই। যাক আঁধার যে এখন আর মেয়েটার সাথে রুড বিহেভিয়ার করে না এটাই অনেক। তৈমুর রসিকতা করে বললো,
–“বেয়াইন? আপনার এ বিয়াইয়ের জন্য কি স্পেশাল ট্রিট? না মানে সে কফি পাচ্ছে আমরা পেলাম না, সম্পর্কে বেয়াই বেয়াইন তো আমরা’ও।”

জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“না আসলে, স্যার তো কিছুই মুখে তুলেনি তাই আরকি___”

–“হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি, তোমার স্যারের জন্য স্পেশাল ট্রিট তোমার তরফ থেকে।”

জোনাকি লজ্জা পেলো। আগ বাড়িয়ে কফি দেওয়াটা কি ভুল করলো? সবাই কি উল্টাপাল্টা ভাবছে? তৈমুর আঁধারকে আলতো ভাবে ধাক্কা দিয়ে বললো,
–“কি শালাবাবু কিছু চলছে নাকি?”

আঁধার ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার। মুখে কিছু বললো না, চুপচাপ কফি খাচ্ছে। নিশি তৈমুরকে বললো,
–“আহহা! মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছো কেন এভাবে? ভাইয়ের সাথে যারা থাকে তারা সবাই জানে ভাই কফি পছন্দ করে, দিনে পাঁচ ছয় বার কফি লাগে ওর। জোনাকি তো ওর পিএ, ও দেখেছে ভাইকে কফি খেতে তাই দিয়েছে। তুমি মেয়েটাকে ভড়কে দিচ্ছো তো একেবারে।”

নিশি ফের জোনাকিকে বললো,
–“কিছু মনে করো না, ও আসলে মজা করছিলো তোমার সাথে।”

–“না না ঠিক আছে, আপনারা বসুন আমি কফি নিয়ে আসছি।”

জোনাকি কিচেনের দিকে পা বাড়াতে গেলেই তৈমুর বলে,
–“আমরা আবার তোমার স্যারের মতো কফি পছন্দ করি না, আমাদের চা হলেই ভালো হয়।”

জোনাকি যেতে যেতে মাথা নাড়ালো। তৈমুর নিশির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“কি বুঝলে? কিছু হওয়ার চান্স আছে এদের মাঝে?”

নিশি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
–“হলেও হতে পারে, হলে খারাপ হবে না।”

পার্লার থেকে সেজে সবেই বাড়ি ফিরলো জল। সাথে রিমু গিয়েছিলো। রিমু জল’কে নিয়ে ওদের ঘরে বসালো। ক্ষানিক বাদেই স্বচ্ছ’র পরিবারের সকলে চলে আসবে। জল একপলক আয়নায় দেখলো নিজেকে। অনেক দামী শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে সে। শাড়িটা দেখতে বেশ সুন্দর। যে-ই পছন্দ করেছে তার পছন্দ বেশ ভালো। এরইমধ্যে শোনা গেলো স্বচ্ছ’রা চলে এসেছে। রিমু মিতু নাহার ওরা সকলে গেট ধরতে চলে গেলো। জলের পাশে বসে রইলো শুধু জোনাকি। ওর ভালো লাগছে না। একপাশ থেকে জলকে জাপ্টে ধরে বসে আছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভীষণ রকমের কষ্ট হচ্ছে। জলকে তো আর আগের মতো করে পাবে না। কে প্রতিদিন ঘুম থেকে তুলে জোর করে নাস্তা খাইয়ে তারপর অফিস পাঠাবে? কে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল অব্দি বসে থাকবে জোনাকির অপেক্ষায় একসাথে দুপুরের খাওয়ার জন্য? কে প্রতি শুক্রবারে বেলা দশটা অব্দি না খেয়ে জোনাকির জন্য বসে থাকবে? কাকে জড়িয়ে ঘুমাবে জোনাকি? হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। কাঁদতে চাইছে না কিন্তু কান্নাটা আটকেও রাখতে পারছে না। বোনের কান্না দেখে জল’ও নিজেকে সামলাতে পারলো না।

ক্ষানিক বাদেই নিশি রিমু আর মিতুর সাথে ঘরে এসে দেখে দুই বোনে কাঁদছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। রিমু দ্রুত এগিয়ে যায় দুজনকেই শান্ত করে। জল নিশিকে দেখে সালাম দেয়। জোনাকি তখনো থেমে থেমে নাক টানছে। নিশি মুচকি হেসে জলের পাশে বসলো। হাতে কয়েকটা গহনার বাক্স। নিশি একে একে বাক্স গুলো থেকে সব গহনা বের করে জল’কে পড়িয়ে দেয়। রিমু, নাহার, মিতু ওরা অবাক চোখে দেখে। কোনো গহনার কমতি নেই। নাকের টানা নোলকটা অব্দি সোনা দিয়ে গড়ানো। নাহারের বিয়েতেও সোনার গহনা দিয়েই সাজিয়ে নিয়েছে। হাতে কানে গলায় মাথায় সব গহনা দিয়েছে কিন্তু জলের মত এত গহনা না। ওরা বেশ খুশি হলো মেয়েটা বেশ ভালো ঘরেই যাচ্ছে। আল্লাহ স্বামী সংসার নিয়ে ভালো রাখুক, এটাই তো সকলের চাওয়া।

রিমু মিতু একপ্রকার জোর করেই জোনাকিকে সাথে করে নিয়ে গেলো। নিশি আর নাহার আছে জলের কাছে। স্বচ্ছ’র খাওয়া শেষ, এবার হাত ধোয়ানোর পালা। হাত ধুইয়ে টাকা আদায় করতে হবে তো। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই জোনাকির সবার আগে নজর গেলো আঁধারের দিকে। ফুল ব্ল্যাক গেট আপে বেশ ভালোই লাগছে তাকে দেখতে। আঁধার সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় জোনাকি। রিমু মিতু ওদের সাথে চলে যায় স্বচ্ছ’র কাছে হাত ধোয়াতে। স্বচ্ছ’র হাত ধোয়ানোর সময় এক প্রকার হইচই শুরু হয়ে গেছে। শোরগোলের শব্দ অনুসরণ করতেই আঁধারের দৃষ্টি পড়ে জোনাকির দিকে। কালো শাড়িতে মেয়েটাকে মনোমুগ্ধকর লাগছে দেখতে। আঁধার এক ভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরায়।

স্বচ্ছ’র হাতে সাবান মাখিয়ে হাত ধরে বসে আছে জোনাকি। টাকা না দেওয়া অব্দি হাত ধুইয়ে দিবে না। এখন তৈমুর আর রিশাদের দাবী ওদের হাত’ও ধুইয়ে দিতে হবে নয়তো ওরা টাকা দিবে না। জোনাকি বললো,
–“অবশ্যই ধুইয়ে দেবো, তবে টাকার পরিমান ডাবল হতে হবে।”

কথাটা বলেই জোনাকি রিমু আর মিতুকে ইশারা করতেই ওরা দুজনে তৈমুর আর রিশাদের হাতে সাবান মাখানো শুরু করলো। ওরা যে সত্যি সত্যি হাত ধোয়াবে ভাবেনি তৈমুর বা রিশাদ। তাই আচমকা হাতে সাবান মাখানোতে ভড়কে যায় ওরা। তৈমুর বলে,
–“হাত না ধোয়ালে টাকা দেবো কি করে? আগে হত ধুইয়ে দেও তারপর টাকা দিচ্ছি।”

রিমু তৈমুরের হাতে পানি ঢেলে দিলো। তৈমুর ভালো করে হাত কচলে ধুইয়ে টিস্যু দিয়ে মুছে নেয়। রিশাদ বলে,
–“আমার হাত?”

মিতু বলে,
–“আপনি বসে থাকুন, টাকা না দেওয়া অব্দি আপনার হাত ধোয়া হবে না।”

তৈমুর সেখান থেকে উঠে গিয়ে আঁধারকে সাথে করে নিয়ে আসে। স্বচ্ছ’র পাশে বসায় ওকে। তারপর জোনাকিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“আঁধারের হাত ধোয়ালে তোমাদের যা ডিমান্ড তার তিনগুন পাবে।”

আঁধার জোনাকি’র চোখাচোখি হলো একবার। এই সামান্য সময়ের চোখাচোখিটাও তৈমুরের নজর এড়ালো না। জোনাকি বললো,
–“আমাদের ডিমান্ড অনুযায়ী দিলেই হবে, তিনগুন লাগবে না।”

রিমু যেন সুযোগ পেলো আঁধারকে স্পর্শ করার। ও বললো,
–“অবশ্যই তিনগুন লাগবে, আমি ধোয়াচ্ছি হাত।”

বলে আঁধারের দিকে গেলেই আঁধার উঠে যেতে নেয়। তৈমুর বসতে বললে আঁধার চোখ রাঙিয়ে তাকায়। তৈমুর মৃদু হেসে বলে,
–“জোনাকি যদি ধুইয়ে দেয় তাহলেই টাকা তিনগুন হবে তাছাড়া না।”

জোনাকি আড়চোখে আরো একবার তাকায় আঁধারের দিকে। আঁধার এবার সরাসরি দৃষ্টি ফেলেই তাকিয়েছে জোনাকির পানে।

চলবে~