Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 248



একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০৪

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|৪|

–“আমার অফিসে জয়েন করার আগে আপনি কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করেছিলেন। আর সেখানে স্পষ্ট লিখা ছিলো, এক বছরের আগে কাজ ছাড়তে পারবেন না আপনি। যদি রিজাইন করেন তো সেক্ষেত্রে আমি আইনি পদক্ষেপ নেবো।”

আঁধারের কথায় জোনাকি ছলছলে চোখে তাকালো। সেদিকে আঁধারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অতঃপর জোনাকির কোনো কথা না শুনেই গটগট করে সেখান থেকে চলে যায় সে। জোনাকি বেশ কিছুক্ষণ সেখানে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

সাড়ে আটটার মতো বাজে। এলোমেলো পায়ে রাস্তায় হাঁটছে জোনাকি। ওর সবকিছু অসহ্য লাগছে। বিশেষ করে এই আঁধার রেজওয়ান নামের মানুষ’টাকে। ওর জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে ফেলছে একেবারে। একটা বছর যে কবে শেষ হবে।

–“আপুই খেতে দে তাড়াতাড়ি, পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।”

খাবার টেবিলে বসে উক্ত কথাটি বললো জোনাকি। জল দ্রুত হাতে কিচেনে খাবার গরম করে প্লেটে সাজাতে সাজাতেই বললো,
–“এই তো হয়ে গেছে, আর একটু।”

জোনাকি টেবিলে কুনইয়ে ভর দিয়ে গালে হাত রেখে বসে আছে। ঘড়ির কাটায় বিকাল চারটা বেজে নয় মিনিট। জল দুই প্লেটে সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে এনে রাখলো টেবিলে। দুই প্লেটে খাবার দেখে জোনাকি ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“আপুই তুই আজও না খেয়ে বসে আছিস?”

জল চেয়ার টেনে বসে মুচকি হেসে বললো,
–“অফিস জয়েন করেছিস পর থেকে তো আর এক সঙ্গে দুপুরের খাবারটা খাওয়া হয়না। বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার দুটো দিন যেহেতু একসাথে খাওয়ার সময় থাকে তাহলে কেন সেই সময়টা হাতছাড়া করবো?”

এ ব্যাপারে আর কিছু বললো না জোনাকি। ও জানে এ বিষয়ে যতই বারণ করা হোক, জল সে বারণ শুনবে না। জোনাকি খাবার প্লেট টেনে নিজের সামনে নিয়ে বললো,
–“আমার ফেভারিট চিংড়ি ভূনা। বাহ! আজকের খাবারটা একদম জমে যাবে।”

নিজের কেবিনে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে জোনাকি। আঁধারের বাড়িতে সেদিনকার সেই ঘটনার আজকে সতেরো দিন চলে। সেদিনের পর থেকে আঁধার আর কোনোরুপ বাজে ব্যবহার করেনি, আর একগাদা কাজ বা ফাইল দিয়েও বসিয়ে রাখেনি। পর্যাপ্ত পরিমানের কাজ’ই দেয় জোনাকিকে। এই যে এখন যেমন কাজ নেই তাই চুপচাপ বসে আছে। আবার যখন আঁধারের ডাক পড়বে তখনই হুড়মুড়িয়ে তার কেবিনে যেতে হবে। এভাবেই চলছে সবকিছু।

–“জোনাকি আসবো?”

মাথা তুলে দরজার দিকে তাকায় জোনাকি। নিলয় দাঁড়িয়ে আছে। ও এই অফিসেই কাজ করে। জোনাকির সাথে মোটামুটি ভালোই সম্পর্ক। জোনাকি একগাল হেসে বললো,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন না।”

নিলয় হেসে কেবিনে প্রবেশ করে। চেয়ার টেনে বসে বলে,
–“ঝিমাচ্ছো যে? কাজবাজ নেই কোনো? চা কফি কিছু দিতে বলি?”

–“চা হলে মন্দ হয় না।”

নিলয় একজন স্টাফকে ডেকে দুই কাপ চা দিয়ে যেতে বললো। চা দিয়ে যেতেই শুরু হলো দুজনের টুকটাক আড্ডা। আড্ডার ফাঁকে নিলয় ছেলেটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে জোনাকিকে। জোনাকির সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। ও নিজের মতো চা খাচ্ছে আর নিলয়ের কথা শুনছে। মাঝে প্রয়োজন পড়লে হু হা করছে।

এতক্ষণ এ সবকিছুই নিজের কেবিন থেকে দেখছিলো আঁধার। এবারে আর নিতে পারলো না। সাথে সাথেই ফোন করলো। জোনাকি ফোন তুলতেই আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“মিস জোনাকি এটা আপনাদের আড্ডার জায়গা না। আড্ডা দিতে হলে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে তারপর দিন, কাজের এখানে কাজ বাদ দিয়ে এরকম হাসি আড্ডা চলবে না।”

জোনাকি মিনমিন করে বললো,
–“আমার তো আপাতত কোনো কাজ নেই স্যার, কি করবো আমি?”

–“এক্ষুনি আমার কেবিনে আসুন, এক সেকেন্ডও যাতে লেট না হয়।”

কথাটা বলেই খট করে লাইন কেটে দেয় আঁধার। জোনাকি হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আপনার সাথে পড়ে কথা হবে, স্যার ডেকেছেন আমাকে।”

কথাটা বলেই একরকম ছুটে গেলো সে। জোনাকি যেতেই আঁধার বললো,
–“বসুন।”

ভয়ে ভয়ে বসলো জোনাকি। আঁধার দুইটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই দুটো এখানে বসেই চেক করে দেখাবেন আমাকে।”

জোনাকি মাথা নাড়িয়ে ফাইল দেখায় মনোযোগ দেয়। আঁধার চেয়ারে হেলান দিয়ে সেদিকে ক্ষানিকটা সময় তাকিয়ে থেকে উঠে যায়। তারপর নিজেই দুই মগ কফি বানিয়ে একটা জোনাকির সামনে রাখে। জোনাকি অপ্রস্তুত ভাবে তাকায়। এরকম কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কল্পনা’ও করেনি আঁধার রেজওয়ান কখনো নিজে কফি বানিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিবে। আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“ফাইল দেখতে দেখতেই কফিটা শেষ করুন, তাহলে আর ঝিমুনি ভাবটা থাকবে না। ফলে ফাইল দেখাতেও কোনো ভুল হবে না।”

কথাটা বলেই সে নিজের মগ নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মনোযোগ সহকারে দৃষ্টি রাখে ঢাকার ব্যস্ত নগরীর দিকে।

জোনাকি কিছুক্ষণ কফির দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটা নিজে ব্ল্যাক কফি চিনি ছাড়া খেলেও ওর জন্য দুধ চিনি সহকারেই কফিটা বানিয়েছে। অতঃপর এক চুমুক কফি নিতেই বুঝলো, না লোকটা মুখে তেঁতো তেঁতো কথা বললেও কফিটা বেশ ভালোই বানায়।

হসপিটাল থেকে সবেই বেরিয়েছেন রাজিয়া। তার খুব কাছের বান্ধবী হসপিটালে ভর্তি, তাকে দেখতেই এসেছিলেন রাজিয়া। এখন বাসায় ফিরবেন। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বেশ ক’বার ড্রাইভারকে কল করলেন। শেষ বার ড্রাইভার কল তুলে বললো,
–“ম্যাডাম, আমি স্বচ্ছ ভাইকে ফোন করে বলছি আপনাকে নিয়ে আসতে। গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে, গ্যারেজে আছি আমি, ঠিক করতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে।”

–“তার প্রয়োজন নেই, আমি ট্যাক্সি ডেকে চলে যাচ্ছি।”

লাইন কেটে দিলো রাজিয়া৷ তিনি জানেন স্বচ্ছ এই মূহুর্তে নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে, তাই আর ছেলের ঝামেলা বাড়াতে চাইলেন না তিনি। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ট্যাক্সি না পেয়ে এবার উনি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলেন। এক কিনার দিয়েই হাঁটছিলেন তিনি হুট করেই একজনের সাথে ধাক্কা লেগে কিছুটা রাস্তায় চলে যান। সেই মূহুর্তেই একটা বাস ধেয়ে আসে এদিকে। আচমকা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন তিনি। হঠাৎই কেউ একজন উনার হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনেন। রাজিয়া বেঁচে গেলেও সেই ব্যক্তিটি একটা রিকশার সাথে বাড়ি খেয়ে তার কনুইটা বিচ্ছিরি ভাবে কেটে যায়। রাজিয়া দ্রুত পায়ে মেয়েটিকে ধরে এক সাইডে নিয়ে আসে। মেয়েটির কনুই থেকে রক্ত বেরোচ্ছে ততক্ষণে। রাজিয়া ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
–“ইশ্! আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তুমি রক্তাক্ত হলে। নাম কি তোমার মা?”

মেয়েটা একবার নিজের কেটে যাওয়া কনুইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“জ্বি জল, আমার নাম জল।”

–“রক্ত এভাবে থামবে না মনে হচ্ছে, পাশেই হসপিটাল চলো আমার সাথে।”

জল যেতে না চাইলেও রাজিয়া ওকে একপ্রকার জোর করেই হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানে কনুইয় ড্রেসিং করিয়ে ব্যান্ডেজ করালো। ততক্ষণে স্বচ্ছ চলে এসেছে সেখানে। রাজিয়া নিজেই ফোন করে ছেলেকে ডেকেছেন, মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। ট্যাক্সির জন্য কতক্ষণ আর অপেক্ষা করবে? তাই ডেকে নিলেন ছেলেকে। স্বচ্ছ হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে রাজিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে তার দুই বাহু চেপে ধরে বললো,
–“তুমি ঠিক আছো মা? তোমার লাগেনি তো কোথাও?”

–“আমার কিচ্ছু হয়নি বাবা, আমার জন্য জলের কনুইটা বিচ্ছিরি ভাবে কেটে গিয়েছে।”

স্বচ্ছ জলের দিকে তাকাতেই থমকালো। এটা তো সেই মেয়েটা যে ওকে ভুলবশত ভিজিয়ে দিয়েছিলো। জল’ও বেশ অবাক’ই হয়েছে স্বচ্ছকে দেখে। সেদিনের ঘটনার জন্য লজ্জায় মাথা নুয়ালো সে। স্বচ্ছ জলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জল, আমার মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য। অবশ্য ধন্যবাদেও এটা কম হয়ে যায়। আর আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত আমাদের জন্য আপনার হাত কেটে গেছে।”

জল ধীর স্বরে জবাব দেয়,
–“এখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, একজন মানুষ হিসেবে একজন মানুষকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছি জাস্ট এতটুকুই।”

স্বচ্ছ আর কিছু বললো না। রাজিয়া জলকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো,
–“বসো মা।”

–“আমি চলে যেতে পারবো আন্টি। সমস্যা হবে না কোনো।”

–“আহা বসো না, তোমাকে এভাবে একা ছাড়তে পারি না আমি। তার উপর আমার জন্যই তোমার এই অবস্থা।”

অগ্যতা গাড়িতে বসতেই হলো জলের। পাশে রাজিয়া’ও বসেছে। স্বচ্ছ সিটবেল্ট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রাজিয়া জলের পরিবার সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব কিছু জিজ্ঞেস করছে। জল’ও হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছে সবকিছুর। সেই হাসিমাখা মুখটাকেই লুকিয়ে চুড়িয়ে বারবার লুকিং গ্লাসে দেখছে স্বচ্ছ।

রাত আটটা বাজে। অফিসের সব কাজ শেষ। কেবিনের সবকিছু গোছগাছ করে বেরোতে জোনাকির সামান্য দেরি হয়ে গেলো। লিফটের কাছে এসে দেখলো দরজা বন্ধ হয়ে আসছে। হুড়মুড়িয়ে লিফটে ঢুকেই একজনের শক্তপোক্ত বুকের সাথে বেশ জোরেসোরেই একটা ধাক্কা খেলো জোনাকি। ততক্ষণে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ধাক্কা খেয়ে আবার পেছনে লিফটের দরজার সাথে বাড়ি খেতে গেলেই আঁধার জোনাকির বাহু চেপে ধরে। জোনাকি ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখে আঁধারের মুখটা। শেষ পর্যন্ত এই লোকটার সাথেই ধাক্কা খেতে হলো ওর? এখন নিশ্চয়ই কয়েকটা কড়া কড়া কথা শুনিয় দিবে। এই ভেবে জোনাকি নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো কথাগুলো হজম করতে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে আঁধার কিছুই বললো না। জোনাকির বাহু ধরে টেনে সোজা ভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
–“নেক্সট টাইম যেন আপনাকে এভাবে ছোটাছুটি করতে না দেখি আমি। আপনি এখন আর বাচ্চ নন, সবকিছুতে এত হুড়োহুড়ি কেন আপনার?”

জোনাকি মাথা নিচু করে বললো,
–“স্যরি স্যার, আর এমন হবে না।”

তারপর পিনপতন নিরবতা। লিফটে এই মূহুর্তে ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ’ই নেই। নিচতলায় এসে লিফট থামতেই আঁধার হনহনিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো। এবার আর জোনাকি বের হবার জন্য তাড়াহুড়ো করেনি, ধীরে সুস্থেই বেরিয়েছে। পাছে লোকটা যদি আবার কিছু বলে? যদি ধমকায় সেই ভয়ে।

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০৩

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|৩|

বিশাল বড় দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো জোনাকি। অফিস থেকে আঁধার রেজওয়ান এর বাসার এড্রেস নিয়ে তারপর এসেছে এখানে। দরজার একপাশে ডোরবেল এর উপরে বাসার নেমপ্লেটে ″স্বপ্ন নীড়″ লিখা। নামটার উপর একবার হাত বুলিয়ে দিলো জোনাকি। মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বললো,
–“স্বপ্ন নীড়, বেশ সুন্দর তো নামটা।”

জোনাকি ডোরবেল বাজাতে নিচ্ছিলো এমন সময় কেউ একজন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। জোনাকি লোকটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলো। দেখে মনে হচ্ছে এ বাসাতেই থাকে। হেল্পিং হ্যান্ড হতে পারে। লোকটা জোনাকি’কে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেডা আপনে, কারে চাই?”

–“আঁধার স্যার বাড়িতে আছেন চাচা? আমি উনার অফিস থেকে এসেছি।”

লোকটা কিছু বলার আগেই ভিতর থেকে একজন মেয়েলি কন্ঠে বললো,
–“আফজাল চাচা, কে এসেছে?”

কথাটা বলতে বলতেই একটা ফর্সা করে লম্বা মেয়ে এসে দাঁড়ালো আফজালের পাশে। আফজাল বললো,
–“আঁধার বাবার অফিস থেকে আইছে মামণি।”

মেয়েটা একগাল হেসে বললো,
–“আচ্ছা তুমি বাজারে যাও, আমি ওকে ভাইয়ের ঘরটা দেখিয়ে দিবো।”

আফজাল সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। মেয়েটা জোনাকি’কে ভিতরে আসতে বললো। জোনাকি গুটিগুটি পায়ে ভিতরে ঢুকে থ হয়ে গেলো। বাইরে থেকে বাসাটা যত সুন্দর ভিতরে তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। মেয়েটা জোনাকি’কে সোফায় বসিয়ে বললো,
–“আমি নিশি, তোমার বস আঁধার রেজওয়ান ওর বড় বোন। তোমার নাম কি?”

–“জো্ জোনাকি।”

নিশি একগাল হেসে বললো,
–“বাহ! তোমার মতো তোমার নামটাও বেশ সুন্দর। তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”

–“না আসলে একটু নার্ভাস আপু।”

–“ভাইকে ভয় পাও?”

–“সারাক্ষণ তো রেগে বোম হয়েই থাকে উনি। নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে।”

জোনাকি’র এহেন কথা শুনে নিশি শব্দ করে হাসলো। নিশির হাসি দেখে জোনাকি মুচকি হাসলো। হঠাৎই দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেলো জোনাকি’র, আটটা পেরিয়ে গেছে। জোনাকি একলাফে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
–“আল্লাহ! আটটা দুই বাজে। স্যার আমাকে ঠিক আটটায় ফাইলগুলো দিতে বলেছিলো।”

–“ভয় পেও না, দু মিনিট এদিক ওদিক হলে কিচ্ছু হবে না। উপরে বাম দিকের তিন নাম্বার ঘরটাই ভাইয়ের। তুমি গিয়ে ফাইল দিয়ে আসো।”

জোনাকি সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়লো। এক প্রকার দৌড়ে গেলো আঁধারের ঘরে দিকে। নিশি হাসলো। ওর ভাইটাও না সবার সাথেই রাগ দেখায়। নিশ্চয় বলেছে আটটার এদিক ওদিক হলে খবর আছে, তাই তো মেয়েটা এরকম ভয় পেয়ে আছে। জোনাকি দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
–“আসবো স্যার?”

–“কাম।”

জোনাকি গিয়ে দেখলো আঁধার সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। জোনাকি ফাইলগুলো এগিয়ে দিলো আঁধার এর দিকে। আঁধার ফাইলগুলো নিয়ে বললো,
–“ইউ আর টু মিনিট লেট।”

–“আ্ আসলে স্যার নিচে নিশি ম্যামের সাথে কথা বলতে বলতে___”

–“ইট’স নট মাই কনসার্ন। পানিশমেন্ট তো পেতেই হবে মিস জোনাকি।”

জোনাকি মাথা নিচু করে নিলো। আঁধার ফাইল চেক করতে করতে বললো,
–“আজ অফিসে না আমার বাসায় ডিউটি করবেন আপনি।”

আঁধারের কথায় কপাল কুঁচকে ফেললো জোনাকি। বিস্ময় নিয়ে বললো,
–“মানে?”

–“মানে খুব সহজ, আমি আজ অফিস যাচ্ছি না। সো, আপনি এখানে আমার সামনে বসে অফিসের কাজ করবেন। কিছু পেন্ডিং জমা হয়ে আছে, সেগুলো টাইপ করে প্রিন্ট আউট করবেন।”

কথাটা বলে আঁধার ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে পেন্ডিংগুলো বুঝিয়ে দিলো। জোনাকি ভেবেছিলো দুই/একটা পেন্ডিং জমা থাকতে পারে৷ কিন্তু এখানে তো অসংখ্য পেন্ডিং জমা হয়ে আছে। এতগুলো পেন্ডিং একা হাতে টাইপিং করে প্রিন্ট আউট করতে গেলে রাত হয়ে যাবে। কি করে করবে এসব? জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“কিন্তু স্যার এখানে তো অনেক___”

–“নো সাউন্ড, কাজটা আপনাকেই করতে হবে। আফটার অল, ইউ আর মাই পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট। দিস ইজ অল ইউ হ্যাভ টু ডু।”

–“এতগুলো পেন্ডিং আমি একা কি করে করবো স্যার?”

–“সবে তো শুরু, পিকচার আভি বাকি হ্যায় মিস জোনাকি।”

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো আঁধার। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো জোনাকি। কোন অলক্ষুণে যে এই আঁধার রেজওয়ান এর কোম্পানিতেই ওর চাকরিটা হলো। ও কালই রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিবে। মনে মনে ঠিক করে কাজে মন দিলো জোনাকি।

আঁধারকে ব্রেকফাস্টের জন্য ডাকতে ওর ঘরে এলো নিশি। এসেই দেখলো জোনাকি খুব মন দিয়ে টাইপ করে যাচ্ছে। নিশি এগিয়ে গিয়ে বিছানার এক কোনে বসে বললো,
–“তুমি ভাইয়ের ঘরে বসে কাজ করছো? আর আমি ভেবেছিলাম চলে গেছো বোধহয়।”

–“যাওয়ারই তো কথা ছিলো ম্যাম, কিন্তু স্যার একগাদা পেন্ডিং ধরিয়ে দিয়ে বললো টাইপিং করে প্রিন্ট আউট করতে। এতগুলো পেন্ডিং আমার মতো মেয়ে একা শেষ করতে পারে বলুন?”

নিশি চোখ ছোট ছোট করে বললো,
–“এ তো ভারী অন্যায়, ভাই তোমাকে এতগুলো কাজ ধরিয়ে দিয়ে মোটেও ঠিক করেনি। ওকে বকে দিবো আমি।”

–“না না ম্যাম একদম না। পরে আঁধার স্যার আবার রেগে বোম হয়ে আমাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে।”

জোনাকি’র কথা বলার ভঙ্গি দেখে নিশি শব্দ করে হেসে দিলো৷ জোনাকি কাজে মন দিলো। নিশি হাসি থামিয়ে বললো,
–“তুমি আমাকে ম্যাম না বলে আপু ডাকতে পারো।”

জোনাকি সম্মতি জানালো। এমন সময় ওদের বাসায় কাজ করে রেহানা, ও এলো সেখানে৷ নিশিকে বললো,
–“নিশি আপা দাদীজান নাস্তার জন্য ডাকছে।”

–“তুমি যাও আমি আসছি।”

রেহানা মাথা নেড়ে চলে গেলো। নিশি জোনাকি’র হাত ধরে বললো,
–“পরে কাজ করবে, এখন নাস্তা করবে আমাদের সাথে চলো।”

–“না না নিশিপু আমি___”

–“অনেক সকালে এসেছো, অত সকালে নিশ্চয়ই খেয়ে আসোনি, এবার চলো তো।”

জোনাকি’র কোনো কথা না শুনেই নিশি ওকে নিয়ে ডাইনিংয়ে চলে গেলো। ডাইনিংয়ে গিয়ে নিশি সকলের সাথে জোনাকি’র পরিচয় করিয়ে দিলো। আঁধার আর নিশি আপন ভাই বোন। ওদের মা-বাবা বেঁচে নেই। ওরা দুজন বাদে এ বাড়িতে আরো পাঁচ জন মানুষ আছে। আঁধারের দাদু আমিনা বেগম, এবং কাকা-কাকিমা, শাহাদাত রেজওয়ান এবং উনার স্ত্রী রাজিয়া এবং তাদের একমাত্র ছেলে স্বচ্ছ রেজওয়ান। এবং আঁধারের ফুপ্পির ছেলে রিশাদ। এতবড় বাড়িতে মাত্র সাতজন লোক থাকে ভেবে অবাক হলো জোনাকি। সবার সাথে পরিচিত হয়ে বেশ ভালো লাগলো জোনাকি’র। তবে আঁধারের কাকিমা জোনাকি’কে ঠিক একটা পছন্দ করেনি যা উনার চোখমুখ দেখে স্পষ্ট।

একসাথে সকলে নাস্তা শুরু করেছে। এমন সময় আঁধার এসে চেয়ার টেনে বসলো। জোনাকি’কে এখানে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আপনি কাজ রেখে এখানে কি করছেন?”

আঁধারের ধমকে জোনাকি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। আঁধারের দাদু আমিনা বেগম জোনাকি’কে বসতে বলে আঁধারকে বললো,
–“এসব কি হচ্ছে আঁধার? এমন ব্যবহার করছো কেন মেয়েটার সাথে?”

–“উনাকে এখানে কাজের জন্য আসতে বলা হয়েছে দাদু।”

নিশি রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
–“তুই না দিনে দিনে কেমন জানি হয়ে যাচ্ছিস ভাই। ও এখানে আসতে চায়নি, আমিই জোরে করে এনেছি।”

আঁধার খেতে খেতে বললো,
–“নাস্তা শেষ করে দ্রুত কাজে হাত লাগান।”

জোনাকি সম্মতি জানালো। আঁধার নাস্তা শেষ করে চলে গেলো। জোনাকি’ও দ্রুত নাস্তা শেষ করে দৌড়ে আঁধারের ঘরে চলে গেলো। হঠাৎই পা স্লিপ করে পড়ে যেতে নিলেই আঁধার দুহাতে আগলে নেয়। ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে জোনাকি। নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত আঁধারের থেকে সরে দাঁড়ায়৷ আমতা আমতা করে বললো,
–“স্যরি স্যার আ্ আসলে___”

–“দেখে শুনেও চলতে পারেন না নাকি ছেলে দেখলেই গাঁয়ে পড়ার স্বভাব? অবশ্য আপনাদের মতো মেয়েরা বড় ঘরের ছেলে দেখলে গাঁয়ে তো পড়বেই।”

–“আমি ইচ্ছে করে___”

–“কাজ শেষ করুন এক্ষুনি।”

ধমকের স্বরে কথাটা বলে আঁধার ফাইল নিয়ে বসলো। জোনাকি’র চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। চোখের জল মুছে আবারো টাইপিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু চোখের জল বাঁধ মানছে না। জোনাকি’কে কাঁদতে দেখে আঁধার থমকে গেলো। মেয়েটাকে কি বেশিই হার্ট করছে ও? ঘুরেফিরে জোনাকি’র দিকে গিয়েই দৃষ্টি আটকাচ্ছে আঁধারের। জোনাকি কিছুক্ষণ বাদে বাদেই বা হাতের উল্টো-পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছছে৷ বিষয়টা খারাপ লাগলো আঁধারের কাছে৷ ওর সাথে সামান্য উঁচু গলায় কথা বলার জন্য কম কাজের প্রেশারে রাখেনি তো মেয়েটাকে। ইচ্ছে করে অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো জোনাকি’কে দিয়ে করাচ্ছে শুধুমাত্র আঁধারের সাথে উঁচু স্বরে কথা বলার জন্য। আঁধারের কেন জানি মনে হচ্ছে ও এসব ঠিক করছে না। অন্যায় করছে মেয়েটার সাথে। উঠে দাঁড়ালো আঁধার৷ হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

আট-টা নাগাদ জোনাকি কাজ শেষ করে স্বস্তির শ্বাস নিলো। চলেই যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছু একটা ভেবে আবারো বসে পড়লো টাইপিং মেশিনের সামনে। রেজিগনেশন লেটার টাইপ করে প্রিন্ট আউট করে নিলো। আঁধার ঘরে নেই। সকালে বের হয়ে যাওয়ার পর দুপুরের দিকে এসে শাওয়ার নিয়ে আবারো চলে যায়। জোনাকি নিজের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো। নিশির সাথে দেখা হলে জোনাকি জিজ্ঞেস করলো,
–“স্যার কোথায়?”

–“ভাই? ও তো পুল সাইডে আছে। কোনো দরকার? দাঁড়াও ডেকে দিচ্ছি আমি।”

–“না না তার দরকার নেই। আপনি আমাকে দেখিয়ে দিন আমি চলে যাচ্ছি।”

নিশি জোনাকি’কে পুল সাইড দেখিয়ে দিয়ে আমিনা বেগমের ঘরে চলে গেলো। জোনাকি পুল সাইডে গিয়ে দেখলো আঁধার ফুলের গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছে। এই লোকটাকে এখন দেখলে কে বলবে এই মানুষটা রাগচটা, নির্দয় একজন মানুষ? জোনাকি আঁধারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আঁধার অপলক কিছুক্ষণ জোনাকি’র দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
–“কাজ শেষ?”

জোনাকি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আঁধার আগের মতোই গম্ভীর গলায় বললো,
–“তাহলে আসতে পারেন এখন।”

জোনাকি রেজিগনেশন লেটারটা আঁধারের দিকে এগিয়ে দিতেই আঁধার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“আ্ আমার রেজিগনেশন লেটার এটা৷ আমি আর আপ্ আপনার অফিসে কাজ করবো না।”

জোনাকি’র কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আঁধারের। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“রিজন?”

–“অফিসের শুরুর দিন থেকে দেখে আসছি, আপনি আমাকে একদমই পছন্দ করেন না। আপনার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলার জন্যই আমাকে আপনার পায়ের তলায় রাখার জন্য এই চাকরিটা দিয়েছেন। নয়তো প্রথমে তো বেরই করে দিয়েছিলেন। তবুও চাকরিটা আমার প্রয়োজন ছিলো বলে আমি করেছি, করতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে মানুষ বলে মনেই করেননি। একের পর এক অপ্রয়োজনীয় পেন্ডিং টাইপিং করে প্রিন্ট আউট করিয়েছেন আমাকে দিয়ে। বহু বছর আগের অপ্রয়োজনীয় ফাইল নতুন করে চেক করিয়েছেন আমায় দিয়ে অথচ সেগুলো কোনো কাজেই লাগবে না। আর সব থেকে বড় কথা আজ আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আপনি। এরপরেও আপনার অফিসে কাজ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। অন্য কোথাও কাজ করবো তবুও আপনার অফিসে আর একদিনও নয়। আমারও সেল্ফ রেসপেক্ট আছে। তাই এই চাকরিটা আর করছি না আমি।”

আঁধার রেজিগনেশন লেটার’টা হাতে নিয়ে মুচড়ে ছুড়ে মারলো। জোনাকি ভয়ে ভয়ে বললো,
–“দে্ দেখুন ওটা ফেলে দিলেই হলো না। আমি কাজ করবো না যখন বলেছি তাহলে করবো না।”

কথাটা বলে জোনাকি চলে যেতে নিলেই আঁধার জোনাকি’র হাত চেপে ধরে। একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এতক্ষণ আপনি বলেছেন আমি শুনেছি। এইবার আমি বলবো আপনি শুনবেন।”

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০২

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|২|

ঠিক ন’টা বেজে পঁচিশ মিনিটে অফিসে ঢুকলো জোনাকি। একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই এসেছে। প্রথম দিনই লেট করতে চায় না ও। এমন কি কোনো দিনই লেট করতে চায় না। নয়তো আবার ওই বদমেজাজি, রাগী দ্যা গ্রেট এ. আর. ধমকাবে৷ যা জোনাকি একদমই চায় না। সোহেলের থেকে কাজ বুঝে নিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে সবে মাত্র বসেছে জোনাকি। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। চমকে যায় জোনাকি। দ্রুত হাতে টেলিফোন তুলতেই ওপাশ থেকে আঁধার বললো,
–“মিস জোনাকি? ফার্স্ট ডে অফিসে এসে আমার সাথে দেখা না করেই কেবিনে গিয়ে রিল্যাক্স মুডে বসে আছেন? কাম টু মাই কেবিন, ইমিডিয়েটলি।”

–“ই্ ইয়েস স্যার।”

লাইন কেটে গেলো। লোকটা দেখলো কি করে ও অফিসে এসে নিজের কেবিনে বসে আছে? এই ভেবে আশেপাশে চোখ বুলাতেই দেখলো আঁধার আর জোনাকির কেবিনের মাঝ বরাবর দেয়ালের বদলে কাঁচ দেওয়া। যার ফলে আঁধার নিজের কেবিনে বসেই অনায়াসে জোনাকি’কে দেখতে পারছে। চোখমুখ কুঁচকে ফেললো জোনাকি। ইতিমধ্যে আবারো টেলিফোন বেজে উঠলো। জোনাকি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। আঁধারের কেবিনের দরজা খুলে উঁকি দিয়ে বললো,
–“মে আই কাম ইন স্যার?”

আঁধার ল্যাপটপ দেখতে দেখতেই বললো,
–“কাম।”

জোনাকি ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছে মিনিট পাঁচেক হবে। অথচ আঁধারের কিছু বলার নাম গন্ধ নেই। সে নিজের মতো ল্যাপটপ চালাতে ব্যস্ত। জোনাকি বিরক্ত হচ্ছে ভীষণ, শেষে না পেরে বললো,
–“কেন ডেকেছিলেন?”

আঁধার ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
–“হু ইজ দ্যা বস, ইউ অর মি?”

জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“আ্ আপনি।”

আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“সো হুয়াই আর ইউ আস্কিং মি?”

জোনাকি মাথা নিচু করে বললো,
–“স্যরি স্যার।”

আঁধার আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে বললো,
–“কফি নিয়ে আসুন আমার জন্য।”

কফি আনার কথা শুনে জোনাকি কপাল কুঁচকে ফেললো। ধীর কন্ঠে বললো,
–“স্যরি স্যার, আমি আপনার পিএ’র পোস্টে আছি। কফি আনা নেওয়ার পোস্টে আমি নিযুক্ত নই।”

ঠাস করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো আঁধার। টেবিলে দুহাতের ভর দিয়ে জোনাকির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“পিএ মানে বুঝেন আপনি? পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট। সো, আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে আপনার। নাউ গো এন্ড গেট দ্যা কফি।”

জোনাকি সম্মতি জানিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেলো কেবিন থেকে। আঁধার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে জোনাকির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমিও দেখি মিস জোনাকি, আমার অফিসে ক’দিন টিকতে পারেন আপনি।”

মিনিট দশেক বাদে জোনাকি কফি নিয়ে আঁধারের কেবিনে আসলো। কফির মগ এগিয়ে দিলো আঁধারের দিকে। আঁধার কফির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“এটা ব্ল্যাক কফি?”

–“আ্ আপনি তো বলে দেননি কোন ক্ কফি___”

–“ব্ল্যাক কফি নিয়ে আসুন উইদাউট সুগার।”

জোনাকি বুঝতে পারলো লোকটা ইচ্ছে করে ওকে দিয়ে এভাবে খাটাচ্ছে৷ কাল ওরকম কথা শুনানোর জন্যই লোকটা ওকে অফিসে রেখেছে হেনস্তা করার জন্য। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেলো জোনাকি, কেননা চাকরিটা ওর সত্যিই দরকার। জোনাকি সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।

একগাদা ফাইলের স্তুপ নিয়ে নিজের কেবিনে বসে আছে জোনাকি। আঁধার ওকে এত্ত এত্ত পুরোনো ফাইল ধরিয়ে দিয়েছে। অফিস টাইমের ভিতর সবগুলো ফাইলের ডিটেইলস নতুন করে নাকি চাই ওর। বসে বসে এসব ফাইল চেক করছে আর মনে মনে হাজারটা গালি দিচ্ছে আঁধারকে৷ ফাইল দেখতে দেখতে রাত আটটা বেজে গেলো। একে একে সবাই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে৷ আর জোনাকি এখনো ফাইল দেখায় ব্যস্ত। অবশেষে সাড়ে আটটা নাগাদ জোনাকির কাজ শেষ হয়। ক্লান্ত পায়ে আঁধারের কেবিনে প্রবেশ করলো জোনাকি। আঁধার জোনাকি’কে দেখে বললো,
–“আ’ম ওয়েটিং ফর ইউ। এ ক’টা ফাইল দেখতে এত সময় লাগে আপনার?”

জোনাকি কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিলো। আঁধার সবগুলো ফাইলে চোখ বুলিয়ে বললো,
–“প্রথমদিন বলে ছাড় পেলেন, নেক্সট টাইম কোনো হেরফের চলবে না। টাইমের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। নাউ ইউ ক্যান গো।”

জোনাকি চলে যেতে নিলেই আঁধার বললো,
–“ওয়েট এ মিনিট।”

জোনাকি আবার পেছন ফিরে তাকায়। আঁধার আবার একটা ফাইল জোনাকির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–“আই ওয়ান্ট দ্যা ডিটেইলস অফ দিস ফাইলস টুমরো।”

জোনাকি মেকি হেসে বললো,
–“ওকে স্যার।”

কথাটা বলেই আঁধারের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো জোনাকি। যাক বাবা একটা মাত্র ফাইল”ই দিয়েছে এটা কাল ঠিক সময় মতো জমা করে দিবে। ভেবে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো জোনাকি। ভেবেছিলো আরো একগাদা ফাইল ধরিয়ে দিবে কিন্তু না। একটু হলেও বোধহয় মায়া দয়া আছে মনে।

এর মাঝে সপ্তাহ খানেক সময় কেটেছে। আঁধার নানান ভাবে জোনাকি’কে হেনস্তা করেছে। কাজের প্রেশারে দম নিতে পারেনা একদম। কাজ শেষ হতে না হতেই আবার এক গাদা কাজ ধরিয়ে দেয়। হাঁপিয়ে উঠেছে জোনাকি। ও জানে আঁধার ইচ্ছে করে এরকম ব্যবহার করে ওর সাথে।

আজ অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে নয়টা বেজে গেছে। আজকেও প্রচুর খাটিয়েছে ওই রাগী রাক্ষসটা। একটু এদিক ওদিক হলেই অযথাই জোনাকি’র উপর চিৎকার চেঁচামেচি করে। হম্বিতম্বি শুরু করে দেয় একেবারে। আজকেও একগাদা ফাইল দিয়েছে সেগুলো রাতের মধ্যে চেক করে কাল সবগুলো ফাইলের ডিটেইলস দেওয়া লাগবে আঁধারকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে জোনাকি। রিকশা পাচ্ছে না এই মূহুর্তে। তাই ভাবলো দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটা যাক, সামনে রিকশা পেলেই সেটা করে চলে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আঁধার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে দেখলো জোনাকি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। অবাক হলো আঁধার। বিড়বিড় করে বললো,
–“আশ্চর্য, এই রাতে মেয়েটা হেঁটে হেঁটে ফিরবে নাকি বাসায়?”

এই ভেবে গাড়ি স্টার্ট দিলো। জোনাকি অনেকটা হেঁটেও কোনো রিকশা না পেয়ে রাস্তার ধারে বসে পড়লো। ক্লান্ত লাগছে বড্ড। মাথাটাও ঘুরাচ্ছে। আঁধার ওর সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে বললো,
–“গাড়িতে এসে বসুন, আমি বাসায় ছেড়ে দিবো।”

জোনাকি অবাক চোখে তাকালো আঁধারের দিকে। আঁধার কেমন দৃষ্টিতে যেন দেখছে ওকে। জোনাকি’কে আগের মতোই বসে থাকতে দেখে বললো,
–“আর ইউ ওকে? শরীর ঠিক আছে আপনার?”

–“হ্যাঁ, আপনি চলে যান, আমি যেতে পারবো।”

–“সিট কোয়াইটলি ইন দ্যা কার, আই উইল ড্রপ ইউ এট হোম।”

জোনাকি কিছু বলতে চাইলে আঁধার ধমকের স্বরে বললো,
–“আই সেইড, সিট ইন দ্যা কার।”

জোনাকি আর কিছু বলার সাহস পেলো না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। আঁধার বললো,
–“সিট বেল্ট লাগিয়ে বসুন।”

জোনাকি সিট বেল্ট নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করেও ঠিকঠাক ভাবে সিট বেল্ট লাগাতে সক্ষম হলো না। আঁধার এতক্ষণ বিরক্তি চোখে জোনাকির কাজ দেখছিলো। আঁধার জোনাকি’র দিকে ঝুঁকে গেলে জোনাকি একদম পিছিয়ে গাড়ির জানালার সাথে লেগে বসে বললো,
–“কি করছেন? আপনি এগোচ্ছেন কেন এভাবে?”

আঁধার ধমক দিয়ে বললো,
–“জাস্ট শাট ইউ’র মাউথ।”

জোনাকি ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ হয়ে গেলো। আঁধার জোনাকি’র সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে সরে আসলো। অতঃপর মনোযোগ দিলো গাড়ি চালানোতে।

জোনাকি রাতভর ফাইল চেক করে ঘুমিয়েছে দু ঘন্টাও হয়নি। এর মাঝেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। আচমকা কানের কাছে ফোন বেজে উঠায় লাফিয়ে উঠে বসলো জোনাকি। বালিশের পাশে ফোন বাজতে দেখে বুকে হাত দিয়ে শ্বাস ছাড়লো। একটু হলেই জানটা বেরিয়ে যেতো বোধহয়। বেশ ভয় পেয়ে গেছে। ফোন হাতে তুলে নিলো ওপাশের মানুষটাকে আচ্ছা মতো ঝারবে বলে। জোনাকি কিছু বলে উঠার আগেই ওপাশ থেকে শক্ত পুরুষালি কন্ঠে কেউ হুংকার ছেড়ে বললো,
–“ফোন ধরছিলেন না কেন ইডিয়ট? একটা ফোন ধরতে এত সময় লাগে আপনার?”

জোনাকি মেজাজ হারিয়ে ফেললো। কে ফোন করেছে না জেনে/বুঝেই দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বললো,
–“এই কে আপনি? সাতসকালে ফোন দিয়ে আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন? একে তো ওই বদমেজাজি, রাগী রাক্ষস লোকটার জন্য সারারাত বসে বসে কাজ করতে হয়েছে তার উপর আবার আপনি এখন আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন। সামান্য কান্ড জ্ঞান নেই আপনার? এত সকাল সকাল কোন প্রেমালাপ করার জন্য ফোন দিয়েছেন আমায়? ফোন রাখুন, আমায় আসে ধমকাতে, সাহস কত বড়।”

এতক্ষণ যাবত দাঁতে দাঁত চেপে জোনাকি’র এসব কথাগুলো শুনছিলো আঁধার। জোনাকি’র এসকল কথায় রেগে বাঘ হয়ে আছে ও। জোনাকি’কে হাতের কাছে পেলেই যেন কাঁচা চিবিয়ে খাবে। এরকম একটা লুকে আছে এই মূহুর্তে। আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আটটার মাঝে আমার বাসায় দেখতে চাই আপনাকে। সাথে ফাইলগুলোও যাতে থাকে৷ আটটা মানে আটটা’ই। এক সেকেন্ডও এদিক ওদিকে হলে___”

ভয় পেয়ে গেলো জোনাকি। লোকটা কি আঁধার? ও কি ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে? আজ অব্দি জোনাকি’র সাথে এই টোনে কেউ কথা বলেনি। একমাত্র আঁধার রেজওয়ান’ই জোনাকির’র সাথে এরকম টোনে কথা বলে। জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“ক্ কে বল্ বলছেন?”

–“আঁধার রেজওয়ান।”

কেঁপে উঠলো জোনাকি। ইশ্ উনার কাছেই উনার নিন্দে করে গেলো জোনাকি? এবার কি হবে ওর? জোনাকি কাঁপা স্বরে বললো,
–“স্য্ স্যরি স্যার আমি আসলে___”

–“এইট এ-এম, মাথায় থাকে যেনো।”

কথাটা বলে আঁধার লাইন কাটতে গেলেই জোনাকি দ্রুত বললো,
–“এক মিনিট স্যার, আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়? আমি তো আপনাকে নাম্বার___”

–“এতবড় একটা কোম্পানি চালাই। আর তাছাড়া আপনি আমার অফিসে চাকরি করেন মিস জোনাকি, আপনার নাম্বার পাওয়া এতটা’ও টাফ ব্যাপার না।”

কথাটা বলেই খট করে লাইন কেটে দিলো আঁধার। জোনাকি ভাবতে বসলো আঁধার কি করে পেলো ওর নাম্বার। পরমূহুর্তে মনে পড়লো অফিসে চাকরির জন্য এপ্লাই করার সময় পেপারে নিজের নাম্বারটাও দিয়েছে৷ আর ওরা তো ওকে নাম্বারে ফোন করেই ডেকেছিলো ইন্টারভিউ’র জন্য। এ. আর. গ্রুপে কাজ করে ও। আর এই কোম্পানির সকল এমপ্লয়িদের ডিটেইলস’ই আছে আঁধার রেজওয়ান এর কাছে। সুতরাং নাম্বার পাওয়াটা কোনো ব্যাপারই না। একদম ইজি এটা। নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজের উপরই বেশ রেগে গেলো জোনাকি।

দ্রুত রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জোনাকি। জোনাকি’কে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে দেখে জল এসে বললো,
–“এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস তাড়াহুড়ো করে?”

–“আপুই, আঁধার স্যারের বাড়ি যেতে হবে এই ফাইলগুলো দিতে। হাতে সময় নেই একদম। আমি আসছি। মাকে বলে দিস।”

জল আর কিছু বলে উঠার আগেই জোনাকি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। এই মেয়েটার না সব কিছুতে বড্ড তাড়াহুড়ো। জোনাকি’র মা ওর বাবাকে ধরে এনে সোফায় বসালো। জল’কে বললো,
–“জোনাকি কোথায় গেলো এভাবে তাড়াহুড়ো করে?”

–“ওর অফিসের এমডির বাড়িতে। কি ইমপোর্টেন্স ফাইল নাকি ছিলো ওর কাছে সেগুলো দিতেই।”

–“নাস্তা করে গেলো না মেয়েটা?”

জল দুই কাপ চা ওর বাবা-মাকে দিয়ে বললো,
–“তোমার মেয়ে কোনো কথা শুনলে তো।”

ব্যালকোনিতে রাখা ফুলের টবগুলোতে পানি দিচ্ছিলো জল। জলে’র হাত ফসকে পানির মগটা নিচে পড়ে যায়। জল দ্রুত রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে ঝুঁকতেই দেখলো নিচে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো। পানিগুলো ছেলেটার উপর পড়ায় ছেলেটা ভিজে যায় অনেকটা। ফোন কান থেকে নামিয়ে বললো,
–“হোয়াট রাবিস।”

কথাটা বলে উপরে তাকাতেই দেখতে পেলো জল দুহাতে নিজের মুখ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত চোখ। ঘনঘন চোখের পলক ফেলছে জল। এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলো ছেলেটা৷ জল মুখ থেকে হাত সরিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
–“স্যরি আমি আসলে ইচ্ছে করে করিনি।”

ছেলেটা কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একজন লোক বললো,
–“মিস্টার স্বচ্ছ?”

জল এর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো স্বচ্ছ। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“ইয়েস।”

–“স্যরি অপেক্ষা করানোর জন্য। এই যে আপনার ফাইলটা।”

–“থ্যাংকিউ মিস্টার মেহতা।”

–“এ-কি আপনি তো একেবারে ভিজে গেছেন এভাবে ভিজলেন কি করে?”

স্বচ্ছ আরেকবার তাকালো ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে থাকা জলের দিকে। জল অবশ্য তখন ব্যস্ত পাখিকে খাবার খাওয়াতে৷ স্বচ্ছ চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
–“এক্সিডেন্টলি ভিজে গেছি। আচ্ছা আসছি মিস্টার মেহতা, আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলে প্রজেক্টের ব্যাপারে কনফার্ম করবো আপনাকে।”

চলবে~

একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০১

0

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|সূচনা পর্ব|

–“জোনাকি, এই জোনাকি উঠ না বোন, অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে তো।”

–“উঁহু, আর একটু ঘুমাতে দে আপুই।”

কথাটা বলেই পাশ ফিরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো জোনাকি। জল, জোনাকির গায়ে থেকে কাঁথা টেনে সরিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই আজ না তোর চাকরির ইন্টারভিউ আছে? কখন যাবি তুই? ইন্টারভিউ শেষ হলে?”

ইন্টারভিউ’র কথা শুনে জোনাকি লাফিয়ে উঠলো শোয়া থেকে। পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো ফ্রেশ হতে। জল সেদিকে ক্ষানিক সময় তাকিয়ে থেকে বিছানা গোছাতে শুরু করলো। মিনিট দশেক বাদেই জোনাকি দরজা হালকা খুলে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
–“আপুই আমার চুড়িদারটা দে না, আনতে ভুলে গেছি।”

জল তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়ারড্রব থেকে একটা হালকা গোলাপি রঙের চুড়িদার এগিয়ে দিলো জোনাকির দিকে। জোনাকি জামা নিয়ে আবারো শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। জল রুম থেকে বেড়িয়ে দেখলো ওর মা টেবিলে খাবার দিয়ে দিয়েছেন। জোনাকি ছুঁটে এলো বাইরে, দ্রুত কন্ঠে বললো,
–“মা, আপুই আসছি দোয়া করো এবার যাতে চাকরিটা পেয়ে যাই।”

–“আরে কিছু তো খেয়ে যা।”

–“এখন খাওয়ার সময় নেই মা, আমি সময় করে খেয়ে নিবো চিন্তা করো না তোমরা।”

কথাটা বলেই একপ্রকার দৌড়ে বেরিয়ে গেলো জোনাকি। রাস্তায় এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। একটা খালি রিকশাও পাচ্ছে না৷ মেজাজ খারাপ হচ্ছে জোনাকির। আজকে একে তো লেট হয়ে গেছে তার উপর রিকশা পাচ্ছে না। আর একটু লেট হলে এবারের চাকরিটাও হাত ফসকে বেরিয়ে যাবে। হঠাৎ করেই এত জোরে একটা গাড়ি গেলো সামনে দিয়ে একটুর জন্য রাস্তার ধারে জমে থাকা বৃষ্টির কাদা পানিগুলো ছিঁটে এসে জোনাকির জামা পুরোপুরি নষ্ট হলো না। ঠিক সময়ে সরে দাঁড়িয়েছিলো, তবে শেষ রক্ষা হয়নি। কিছুটা পানি এসে জোনাকির জামার নিচের অংশে লাগে। জোনাকি মেজাজ হারিয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“এই যে মিস্টার কানা নাকি আপনি? দেখেশুনে গাড়ি চালাতে পারেন না?”

জোনাকির কথা শুনে গাড়ি ব্রেক কষলো আঁধার। গাড়িটা পিছিয়ে এনে জোনাকির সামনে থামালো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে জোনাকির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“হোয়াট ননসেন্স? কি বললেন একটু আগে? কানা? আর আমি?”

–“তো নয়তো কি? কানা বলবো না তো কি বলবো আপনাকে? এভাবে অন্ধের মতো গাড়ি চালালে রাস্তাঘাটে কানা উপাধি তো নিশ্চয়ই পাবেন।”

আঁধার রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“হোয়াট রাবিশ? আপনার কি আমাকে দেখে অন্ধ মনে হচ্ছে?”

জোনাকি এক নজর চোখ বুলালো আঁধারের দিকে। তারপর বললো,
–“এরকম কালো সানগ্লাস চোখে পড়ে গাড়ি চালালে আর চোখে দেখবেন কি করে যে রাস্তার ধারে কাদা পানি ছিলো।”

–“ইউ___”

জোনাকি একটা খালি রিকশা পেয়ে দ্রুত সেটাতে উঠে পড়লো৷ এদিকে আঁধারকে এভাবে ইগনোর করে চলে যাওয়াতে শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো জোনাকির যাওয়ার দিকে। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। এই অব্দি কেউ আঁধারের সাথে এভাবে কথা বলার সাহস করেনি। আর এই অচেনা মেয়েটা আঁধারকে এতগুলো কথা শুনিয়ে গেলো?

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিলো জোনাকি। ও এখন পাঁচ তালা বিশিষ্ট একটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটাই হচ্ছে এ. আর. গ্রুপের বিল্ডিং। নিচের তিনটে তালা এ. আর. গ্রুপের হোটেল, চার তালায় অফিস এবং পাঁচ তালা এবং ছাদে বিশাল বড় রেস্তোরাঁ। দুদিন আগে এ. আর. এর পিএর পোস্টের জন্যই এপ্লাই করেছিলো জোনাকি। আর আজই ইন্টারভিউ’র জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। এই চাকরিটা জোনাকির ভীষণ দরকার। ওর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ হয়ে কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। যদিওবা পেনশনের টাকা পাচ্ছেন, কিন্তু সেগুলো দিয়ে আর কতদিন? তাই জোনাকির ইচ্ছে ও নিজে কিছু করবে পরিবারের জন্য। এসব ভাবতে ভাবতেই ভিতরে ঢুকছিলো জোনাকি। এমন সময় কারো শক্তপোক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে ক্ষানিকটা পিছিয়ে যায় জোনাকি। যেহেতু জোনাকি অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিলো তাই ও দ্রুত কন্ঠ বললো,
–“স্যরি স্যরি, আমি আসলে__”

কথাগুলো বলে সামনে তাকিয়ে আঁধারকে দেখতে পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো জোনাকি। জোনাকি’কে আবারো দেখেই আঁধারের রাগ তড়তড় করে বেড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“ব্লাইন্ড পিপলস।”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে ফেললো৷ ওর কথাটাই লোকটা ওকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ও তো তাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্যরি বলেছে কিন্তু লোকটা কি করলো? এই ভেবে জোনাকি তেড়ে যেতেই আঁধার হনহনিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে। জোনাকি রিসিপশনের মেয়েটির থেকে জেনে নিলো অফিস ফোর্থ ফ্লোরে। তাই ও লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো। আঁধারও সেসময়ে লিফটেই ছিলো। জোনাকি সেদিকে যেতে দেখে লিফটের বাটন চেপে দিলো। জোনাকি দৌড়ে গিয়েও লিফটে উঠতে পারলো না। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। ইন্টারভিউ টাইম শুরু হতে আর পাঁচ মিনিট বাকী। জোনাকি এখন লিফটের জন্য অপেক্ষা করলে আর ইন্টারভিউ দিতে হবে না। তাই সিড়ি বেয়েই দৌড়ে দৌড়ে চার তালায় উঠতে লাগলো।

–“মে আই কাম ইন স্যার।”

–“কাম ইন।”

জোনাকি নিজের সার্টিফিকেট দেখতে দেখতে কেবিনে প্রবেশ করলো৷ এমডির চেয়ারে আঁধারকে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হলো জোনাকি। ক্ষানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
–“আপনি?”

আঁধার একটা ফাইল চেইক করছিলো। চোখ তুলে তাকিয়ে জোনাকি’কে দেখে রাগ হলো। আজকের দিনটাই খারাপ। ঘুরেফিরে এই মেয়েটার সাথে ওর দেখা হচ্ছে আর ঝগড়া হচ্ছে। আঁধার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“ইয়েস আই এম আঁধার রেজওয়ান। ওনার অফ এ. আর. গ্রুপ।”

জোনাকি আর কিছু বললো না। আঁধার আবারো ফাইল দেখায় মনোযোগ দিলো। নিচ দিকে তাকিয়েই জোনাকির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। জোনাকি কাঁপা কাঁপা হাতে ওর সার্টিফিকেটগুলো দিয়ে দিলো আঁধারের কাছে। আঁধার বেশ ভালো করেই দেখলো সার্টিফিকেট গুলো। তারপর বললো,
–“তো মিস জোনাকি, এই চাকরিটা কেন চাই আপনার?”

আঁধারের এমন প্রশ্নে মেজাজ খারাপ হলো জোনাকির। তেজী স্বরে বললো,
–“চাকরি দিয়ে মানুষ কি করে?”

এরকম বাঁকা উত্তর শুনে সার্টিফিকেট থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো আঁধার। দাঁড়িয়ে টেবিলে একটা থাবা মেরে বললো,
–“কুয়েশ্চন করেছি আন্সার দিবেন, পালটা কুয়েশ্চন করতে বলিনি।”

আঁধার এমন রিয়্যাক্ট করায় জোনাকি ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। আঁধার সার্টিফিকেট জোনাকির দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই পোস্ট আপনার জন্য না, আপনি আসতে পারেন।”

মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো জোনাকির। একে তো ইন্টারভিউ’র জন্য ডেকে ইন্টারভিউ নিচ্ছে না, উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করছে, রাগ দেখাচ্ছে তার উপর আবার বলছে এই পোস্ট আপনার জন্য না। আজকের দিনটাই খারাপ জোনাকির। কোন অলক্ষুণে যে এই আঁধার রেজওয়ান এর সাথে সকাল সকাল দেখা হলো ভেবে পায় না ও। বদ, রাগী রাক্ষস একটা লোক। মনে মনে আরো অনেক কিছু বলেই বকাঝকা করলো আঁধারকে। তারপর আঁধারের হাত থেকে নিজের সার্টিফিকেটগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে বললো,
–“আপনার মতো বদ লোকের অফিসে আমিও চাকরি করবো না, হুহ।”

কথাটা বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো জোনাকি। আঁধার জোনাকির যাওয়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এই মেয়ের সাহস হলো কি করে আমাকে বদ লোক বলার? একে তো সায়েস্তা করতেই হবে।”

কথাগুলো বিড়বিড় করে বলে কাউকে ফোন লাগালো। ফোন রিসিভ হতেই আঁধার বললো,
–“হ্যাঁ সোহেল? একটু আগে আমার কেবিন থেকে যে মেয়েটা বেরিয়ে গেলো ওকে এক্ষুনি আমার কেবিনে পাঠাও।”

–“স্যার মিস জোনাকি তো লিফটে উঠে গেছেন।”

–“নিচে রিসিপশনে ফোন করে জানিয়ে দাও।”

–“ওকে স্যার।”

খট করে লাইন কেটে দিলো আঁধার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলো জোনাকির সাহসের কথা।

লিফট থেকে বেরিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছে জোনাকি। এই চাকরিটাও হলো না। খুব শীঘ্রই একটা চাকরি জোগার করতে হবে। পরিবারের হাল ধরতে হবে তো। বাবার পেনশনের টাকায় তো আর বেশিদিন যাবেও না। অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রিসিপশন থেকে একটা মেয়ে এসে বললো,
–“আপনি জোনাকি?”

–“হ্যাঁ, কেন?”

–“স্যার আপনাকে ইমিডিয়েটলি উনার কেবিনে ডেকেছেন।”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। অস্ফুটস্বরে বললো,
–“স্যার আমায় ডেকেছেন___”

–“হ্যাঁ, আঁধার স্যার এক্ষুনি ডেকেছেন আপনাকে। উনি কিন্তু আবার লেট করা একদমই পছন্দ করেন না।”

কথাটা বলেই মেয়েটা চলে গেলো৷ জোনাকি ভাবলো যাবে না আর। পরমূহুর্তেই আবার ভাবলো যদি চাকরিটা দেওয়ার জন্য ডাকে? ওর তো চাকরিটা দরকার। এই ভেবে জোনাকি আবারো আঁধারের কেবিনের যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

–“তো মিস জোনাকি চাকরিটা চাই আপনার?”

আঁধারের কথায় জোনাকি বিরক্তি চোখে তাকালো আঁধারের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন? চাকরিটা চাই বলেই ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। সামান্য এইটুকু কমনসেন্স নেই আপনার? আর এত বড় অফিস সামলাচ্ছেন, ভাবার বিষয়।”

–“হোয়াট ননসেন্স।”

–“কেন ডেকেছেন সরাসরি বলেন, নয়তো আমি চললাম, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার কাছে নেই।”

–“চাকরিটা হবে, তবে কিছু কান্ডিশন আছে আমার।”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি?”

–“লেইটে অফিসে ঢোকা যাবে না, ঠিক সাড়ে নয়টা’র মধ্যে অফিস থাকা লাগবে, কাজে হেরফের চলবে না____”

এরকম আরো শর্ত জুড়ে দিলো আঁধার৷ জোনাকি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
–“আমি রাজি।”

আঁধার একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“সাইন করুন এখানে।”

জোনাকি কিছু না ভেবেই সাইন করে দিলো। আঁধার পেপারটা নিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
–“সো মিস জোনাকি, ইউ উইল জয়েন দ্যা অফিস ফ্রম টুমরো। ইউ ক্যান গো নাউ।”

জোনাকি সম্মতি জানিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। আজ ও ভীষণ খুশি, ফাইনালি একটা চাকরি যোগার করতে পেরেছে৷ এবার সব ভালো হবে। মনে মনে এসব ভেবে প্রশান্তির হাসি হাসলো জোনাকি।

অন্যদিকে আঁধার জোনাকির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
–“আঁধার রেজওয়ান এর মুখে মুখে কথা বলা? আঁধার রেজওয়ান’কে অন্ধ বলা, আঁধার রেজওয়ান এর সাথে উঁচু গলায় কথা বলার ফল আপনি কাল থেকে হারে হারে টের পাবেন মিস জোনাকি। বি রেডি।”

চলবে~

তবুও মনে রেখো পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#তবুও_মনে_রেখো। [০৭]

১৯,
পিকনিক স্পটে রাহনাফদের বাড়ির ছোট বড় সকলেই উপস্থিত। বড়রা একপাশে বসে গল্প করছে। ছোটরা মিলে রান্না করছে আর গল্প করছে। আলিহান ও রাহনাফ দুজনেই রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে। মৌ তাদের সাহায্য করছে, রাহি আর মেহেরকে দেওয়া হয়েছে খাবার সাজানের কাজে। মেহের কাজ করছে কম ভাবছে বেশী। রাহি অনেক্ষন যাবৎ লক্ষ করছে মেহেরের অন্যমনস্কতা কিন্তু কিছু বলছে না।

রান্নার কাজ শেষ হলে সবাই ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর একসাথে বসে গল্প আড্ডায় খাওয়া শেষ করে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সবাই গল্প করতে থাকে রাহনাফ তখন একটা জরুলি কাজে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। এই সুযোগে মেহের আলিহান আর মৌকে বলে,
” তোমাদের একটা কথা জিগ্যেস করি?”
আলিহান মেহেরে দিকে তাকিয়ে বলে,
” ইয়েস শালি সাহেবা।”
” এমন কোন জিনিস যেটা খেতে মিষ্টিও না টকও না ঝালও না আবার তেতোও না।”
মেহেরের কথা শুনে আলিহান মৌয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবে। মৌ ভ্রু কুঁচকে আলিহানের দিকে তাকায়। আলিহান প্রশ্ন করে,
“এই জিনিসটা কে খেতে চেয়েছে আমার ভাই।”
“হুম। বলোনা কি এমন জিনিস।”
আলিহান শুকনো কাশি দিয়ে বলল,
” তোমার বোনকে জিগ্যেস করো এটা আবার তোমার বোন খেতে খুব পারদর্শী।”
মৌ বোকা বোকা চোখে আলিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি আবার কি খেতে,, অমনি চমকে উঠে মৌ বলল,
” এটা তুই বুঝতে পারিসনাই মেহু।”
“তোরা কিসের কথা বলছিস।”
মৌ মেহেরের মাথায় চাপড় মেরে বলল,
“চুমু, চুমুর কথা বলছে রাহনাফ।”
“চুমু,, লজ্জা মাথা নুইয়ে নিলো মেহের। তারপর উঠে অন্য দিকে চলে যায়। মৌ বলে,
“আরে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
আলিহান বলে,
“ওকে যেতে দাও। ওদিক আমার ভাই খাবারটা খাওয়ার জন্যে ছটফট করছে।”
আলিহানের শেষ কথা শুনে মেহেরের লজ্জারাঙা মুখে হাসি ফুটে উঠে।

সবার থেকে আড়ালে গিয়ে মেহের রাহনাফকে কল করে। প্রথমবার রিং হওয়ার পরেও কল রিসিভ করেনা রাহনাফ। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সাথে সাথে কল রিসিভ হলো। মেহের বলল,
“কোথায় আপনি?”
” আমার রুমে। কেন বলতো?”
” আপনার খাবারের সন্ধান পেয়ে গেছি।”
“বলতো কি?”
“আগে এখানে আসেন।”
“কেন খাওয়াবে নাকি?”
“যাদি বলি হ্যাঁ।”
“সবার সামনেই।
“এই না না। হবে না।”
” তাহলে আমার রুমে চলে আসো। আমার কাজ ও আর,,,
মেহের কল কেটে দেয়। লজ্জায় তার বুকের ভেতরটা উঠানামা করছে। দুহাতে মোবাইল চেপে ধরলো। এখন লজ্জা পেয়ে কি হবে। সে যা করেছে তার জন্যে তো শাস্তি তাকে পেতেই হবে। লম্বাশ্বাস নিয়ে চলে যায় রাহনাফের কাছে।

হ্যারির সাথে কথা বলে কল ডিসকানেক্ট করে ল্যাপটপ রেখে ওয়াশরুমে যায় রাহনাফ। কিছুক্ষণ পর মেহের আসে রাহনাফের রুমে। এই নিয়ে তৃতীয় বার সে এই রুমে।হাসিমুখে রুমের চারদিকটা দেখতে থাকে সে।ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। মেহের বুঝতে পারলো রাহনাফ এই মুহূর্তে ওয়াশরুমে আছে তাই খুব মনোযোগ দিয়ে রুমে চারদিকে দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকায় মেহের। সাদা টাওয়াল গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসছে রহনাফ। শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। মাথার চুলগুলো ভিজে লেপ্টে আছে কপালের সাথে সেখান থেকে পানি পড়ছে তার মুখে। মেহের নিষ্পলক তাকিয়ে রইল রাহনাফের উন্মুক্ত শরীরের দিকে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মেহেরকে দেখে হাসি ফুটে উঠে রাহনাফের মুখে। মেহেরকে তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো দুপা এগিয়ে মেহেরের কারো কাছে যায়। মেহের তখনো রাহনাফের দিকে তাকিয়ে। মেহেরকে নিজের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাহনাফ মৃদু হেসে মেহেরের দিকে ঝুকে ওর মুখে ফু’দিয়ে কপালে পরে থাকা চুলগুলো উড়িয়ে দেয়। চমকে উঠে মেহের। দ্রুত উল্টোদিকে ঘুরে চোখ বন্ধকরে নেয়। রাহনাফ স্মিত হেসে বিছানায় থাকা টাওজার পরে নেয়। ট্রিশার্ট গায়ে গলিয়ে নিতেই বলে,
“এখন এদিকে ঘুরেন মেডাম।”
মেহের চোখ খুলে পিছনে ঘুরে রাহনাফকে দেখে মৃদু হাসে। রাহনাফ কয়েকপা এগিয়ে এসে মেহেরের কোমড় জড়িয়ে ধরে,
” তখন ওভাবে হা করে কি দেখছিলে?”
“কই কিছুনা তো। আমি কিছু দেখেনি তো।”
“কিছুই দেখনি?”
“না তো।”
“আচ্ছা।
“হুম।”
রাহনাফ মেহেরকে ছেড়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করে বলে,
” কফি বানতে পারো?”
মেহের মাথা নিচু করে জবাব দেয়, “না।”

রাহনাফ মেহেরের দিকে একপলক তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। মেহের চলে যায় বারান্দায়। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ হাতে দুকাপ কফি নিয়ে রুমে আসে। রুমের ভিতর মেহেরকে দেখতে না পেয়ে রাহনাফ বারান্দায় চলে যায়। মেহের তখন একমনে আকাশ দেখছিলো। বিকালের নরম রোদ এসে পরছে মেহেরের মুখে যার কারনে ঝলঝল করছে মেহেরের মুখখানা। রাহনাফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মেহেরের মুখের দিকে। মেহের আকাশের দিকেই তাকিয়ে বলল,
” এভাবে তাকিয়ে থাকবেননা রাহনাফ।”
” কেন?”
কফির মগ বাড়িয়ে দেয় রাহনাফ। মেহের মগ হাতে নিয়ে বলে,
” ওমন চোখে তাকাবেন না দয়াকরে। ওই চোখ যে আমার হৃদয় কে ঝলসে দেয়।”
রাহনাফ হাসে। মেহেরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
” মানুষ নাকি একবারই প্রেমে পড়ে, এটা সত্য হতে পারেনা। কারন আমি যতবার তোমার দিকে তাকায় ততবারই তোমার প্রেমে পড়ি মেহুরানি।”

১৯,
সময়ের সাথে সাথে জীবনও যেন নেই থেমে, সময় যেন জীবনের স্পন্দন। সময় চলে তার নির্দিষ্ট গতিতে ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডে ।কারো জীবন হয়তো চলে অবহেলায় সময়ের সাথে।আবার কারো চলে তীব্র সচেতনতায়।

বড় বড় সাফল্যের অপরিহার্য চাওয়া হল কাজে একাগ্রতা ও এককভাবে সবকিছু পরিচালনা করা। প্রফেসর খাইরুল মামুন হক ছোটবেলা থেকেই একটা স্বপ্ন দেখেছেন সেই স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলেছেন অবিরাম। তবে সাফল্য পাওয়ার আগেই তাকে হোচট খেয়ে পড়ে যেতে হয়েছে তবে তিনি থেমে থাকেননি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তার নির্দেশেই রাহনাফ একটা ল্যাব তৈরী করছে। যেখানে তিনি আবার রিসার্চ শুরু করবেন। পুরো বিশ্বকে দিবেন এক নতুন চমক। না এবার আর তিনি কোন ভুল করবেন না। এবার ল্যাবে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে থাকছে রাহনাফ অপরদিকে নাসায় একই গবেষণা চলছে। সেখানে কাজ করছেন হ্যারি হাওয়েল মেন্ডেলিনা ও ঋতুরাজ বর্মা। এরা সবাই এক সময় প্রফেসর খাইরুল মামুন হকের প্রিয় স্টুডেন্ট ছিল এবার তাদের দিয়েই তিনি রিসার্চ করাবেন। এদের নিয়ে টিম গঠন করার পিছনে খায়রুল মামুনের আরো একটা কারণ আছে। রিসার্চ এর মাঝপথে যদি তার কিছু একটা হয় কিংবা তিনি মারা যান তাহলে যেন তারা এই গবেষণাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং পুরোপুরি সাফল্য পায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেন পুরোপুরি দূষণমুক্ত করতে পারে। তার তৈরি করা এই নিউক্লিয়ার মডিফায়ার ট্রী যেদিন পৃথিবীর বুকে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠবে তখন পৃথিবী সত্যিই এক বিস্ময়কর জিনিস দেখবে। গাড়িতে বসে এসব ভাবছিলেন খাইরুল মামুন। সবাই মিলে আজ গ্রামে যাচ্ছেন যেখানে সৈয়দা মাহবুবা আরো দিন তিনেক আগে থেকেই আছেন। তিনি তার গ্রামে একটা এনজিও তৈরি করেছে যেখানে অসহায় মহিলাদের আত্মউন্নয়নের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সৈয়দা মাহবুবা এখন গ্রামেই থাকেন। গ্রামে থেকে তিনি তার এনজিওর কাজ সম্পন্ন করলেন। আগামি কাল এনজিও উদ্বোধন করা হবে। তাই সবাই মিলে গ্রামে যাচ্ছেন। গাড়ির পিছনের সিটে বসে আকাশ পাতাল ভেবে চলেছেন খাইরুল মামুন, রুপা তার কাধে মাথা রেখে এক হাত জড়িয়ে দুচোখ বন্ধ করে রেখেছে। ড্রাইভ করছে রাহনাফ, পাশের সিটে বসে আছে মেহের। মেহের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখছে। রাহনাফ ড্রাইভ করার ফাঁকেফাঁকে আড় চোখে দেখছে মেহেরকে। অপর গাড়িতে আলিহান ড্রাইভ করছে ওর পাশের সিটে বসে মৌ ঘুমাচ্ছে পিছে বসে আছে রাহি আরুশি আর আরুশির ভাই আয়ান। মাসখানেক হলো আরুশির পুরো পরিবার দেশে ফিরছে। তাদের দেশে ফিরে আসার কারন আয়ান। আয়ানের সাথে রাহির বিয়ের কথা চলছে। ছোট বেলা থেকেই তাদের বিয়ে কথা পাকা হয়ে আছে। রাহি কানে হেডফোন গুঁজে সিটে হেলান দিয়ে রবিন্দ্রনাথের “যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই ভাটে” গান শুনছে। আরুশি আর আয়ান কিছু নিয়ে কথা বলছে।

রবিনকে রুমে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে নিজের রুমে আসলেন সৈয়দা মাহবুবা। মেডিকেল রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুমে যান ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে আবার রবিনের মেডিকেল রিপোর্ট দেখতে থাকেন। হাত কাঁপছে সৈয়দা মাহবুবার। ছোট বেলার বন্ধু রবিন যে সব সময় তার পাশে থেকেছে সেই বন্ধুটা এমন মরণপণ রোগ বাধিয়েছে টেরও পাননি সৈয়দা মাহবুবা। বেশ কয়েকদিন হলো সৈয়দা মাহবুবা রবিনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসছে। রবিনের শরীরের অবস্থা দিন দিন আরো জটিল হচ্ছে তাইতো আজ তাকে নিয়ে জেলা সদর হসপিটালে গিয়েছিলেন। সেখানেই এক ডক্টর রবিনের হাতের নাড়ি টিপে চোখ উল্টে দেখে একজন অঙ্কলজিস্ট বিশেষজ্ঞ দেখানোর কথা বলে। সৈয়দা মাহবুবা রবিনকে নিয়ে একজন বিশেষজ্ঞর সাথে দেখা করেন। তিনি কিছু টেষ্ট দেন যেগুলো থেকে ঠিক করা হয় রবিনের আসলে কোন রোগ হয়েছে। কম্পিত হাতে কাগজগুলো গুছিয়ে আলমারিতে রাখেন সৈয়দা মাহবুবা। তারপর খাইরুল মামুনকে কল করেন,
” কোথায় আছিস তোরা? আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?”
” এইতো আর পনেরো মিনিট।”
” সবাই ঠিক আছে? মৌ তো গাড়িতে উঠলেই অসুস্থ হয়ে পরে।”
” মৌ আমাদের গাড়িতে না। আলিহানের সাথে আছে।”
” সাবধানে আয় রাখাছি।”
” আচ্ছা।”

কল কেটে রান্নাঘরে যান সৈয়দা মাহবুবা। এক কাপ রং চা করে আবার নিজের রুমে আসেন। কাল থেকে তার এনজিও চালু হবে। কত কাজ বাকি। এখনো অনেকের নাম রেজিস্টার করা হয়নি। সৈয়দা মাহবুবা রেজিস্টারের খাতা নিয়ে বিছানায় বসেন। এমন সময় বড় সাহেব আসেন তার রুমে। বড় সাহেবকে দেখে সৈয়দা মাহবুবা একগাল হেসে বলেন,
“বাবা আপনি? আসুন আসুন।”
বড় সাহেব রুমে এসে সৈয়দা মাহবুবার পাশে বসেন।
বলেন,
” কাজ করছিস?”
” হ্যাঁ বাবা। আপনি কিছু বলবেন?”
” নারে মা। খাইরুলদের সাথেই শহরে ফিরে যাবি?”
” হ্যাঁ। ওখানে তো আমার একটা চাকরি আছে। এবছরটা করবো তারপর একেবারে চলে আসবো।”
“এখন কার উপর এনজিও র দায়িত্ব দিতে চাস?”
” বড় ভাই আর ভাবি সামলাবেন।”
” তোর যেটা ভালো মনে হয় সেটাই কর।”
সৈয়দা মাহবুবা বড় সাহেবের দিকে তাকান। বড় সাহেব দৃষ্টি নিচু করে বলেন,
” আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। আমি তোর জিবনটা গুছিয়ে দিতে পারলাম না।”
” এসব কেন বলছেন বাবা?”
” নওশাদ যে এমন প্রতারণা করবে সেটা আমি ভাবতেও পারিনাই।”
” সেটা আমার ভুল ছিলো বাবা। নওশাদকে আমি পছন্দ করেছিলাম আপনি শুধু আমার পছন্দের মূল্যায়ন করেছেন।”
” বাবা হিসাবে আমার উচিৎ ছিলো তোর জন্যে একজন সঠিক জিবনসাথী বেছে নেওয়া।”
“এটা আমার ভাগ্য বাবা আপনার কোন ভূল নেই।”
বড় সাহেবের বলতে ইচ্ছে করলো,
“আমার ভুল আছেরে মা। তুই না হয় ভালোবাসায় অন্ধ ছিলি আমি তো ছিলাম না। তাহলে আমি এত বড় ভুল কি করে করলাম।”
মুখে কিছুই বলতে পারলেন না শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সৈয়দা মাহবুবার মুখের দিকে।”

খাইরুল মামুন যখন বাড়িতে পৌঁছায় ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে ধরণীর বুকে। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ধরনী ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে নিকষ কালো অন্ধকারে। যেন কালো রংয়ে গহনায় মুড়ে নিয়েছে নিজেকে। বাড়িতে এসে সবাই যে যার রুমে চলে যায়।এতটা রাস্তা জার্নি করে সকলে ক্লান্ত।

রাতের খাবার খাওয়ার পর সব ছোটরা মিলে উঠোনে বসে গল্প জুড়ে দেয়। আলিহান সেখানে আয়ানের সাথে রেদওয়ানের পরিচয় করিয়ে দেয় রাহির হবু বড় হিসাবে। রাহির হবু বর কথা শুনে কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে থাকে রেদওয়ান। তারপর প্রশ্ন করে,
“রাহির হবু বর মানে?”
আরুশি বলে,
“আপনি দেখছি বাংলা বুঝতে পারেন না।”
” মানে!”
“রাহি ওয়িল মেরি মাই ব্রাদার, বুঝলেন।”
” কবে ঠিক হলো?” আড় চোখে রাহির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রিদওয়ান। মৌ বলল,
“ওদের বিয়ে ছোটবেলা থেকেই ঠিকঠাক।
” আচ্ছা, জানা ছিল না আমার।”
রাহির দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রেদওয়ান বলল ”
“তোমরা কথা বলো আমি আসছি।”
এই বলে সেখান থেকে চলে যায় রেদওয়ান। রেদওয়ান চলে যাওয়ার পর রাহি মনে মনে বলে,
“আমার বিয়ে হয়ে যাবে এটা মানতে পারছেন না তাই চলে যাচ্ছেন তাইনা রেদওয়ান। আমিও মানতে পারছি না। শুধু একবার মুখে বলুন না, আপনি আমাকে ভালোবাসেন আমি সব ঠিক দিবো।”

রেদওয়ান এর চলে যাওয়ার পর রাহি ঘুমের অজুহাতে এখান থেকে চলে আসে।

ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে রেদওয়ান। মাথায় এখনো বেজে চলেছে আলীহানের বলা রাহির হবু বর কথাটা। রাগে চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে রেদওয়ানের। বিয়ে! কিছুদিন পর বিয়ে! আগে থেকে সব ঠিকঠাক আর রেদওয়ান কিচ্ছু জানতে পারলো না। এমন একটা মেয়েকে নিজের মন দিয়ে বসলো।মনে মনে সব ভাবতে দেয়ালে জোরে ঘুসি মারে যার ফলে হাত কেটে যায়। সেখান থেকে সামান্য রক্তও পড়ে। জোছনার আলো রেদোয়ানের কেটে যাওয়া হাতটা দেখতে পেলনা রাহি। ধীর পায়ে রেদওয়ানের পাশে দাঁড়ালো।বলল,
“পালিয়ে এলেন।”
রেদওয়ান আকাশের দিকেই দৃষ্টি রেখে বলল,
“পালাবো কেন?আমি কি চোর নাকি ডাকাত যে পালাবো। ”
“সেটাই। তাহলে চলে এলেন যে।
“এমনি। ”
“আমাকে ভালোবাসেন?”
“না।”
“মিথ্যে বলছেন?”
” তাহলে সত্যিটা তুমি বলো?”
” আপনি আমাকে ভালবাসেন। ”
” বললাম তো না।”
“তাহলে আইয়ানকেই বিয়ে করবো।”
“এমনটাই তো হওয়ার কথা।”
“আপনি খুব জঘন্য একটা মানুষ।ঠিক আপনার শরীরের এই পোশাকের রঙের মত বিষাক্ত। সত্যি বিষাক্ত লাগছে আমার আপনাকে।”
“হুম জানি সেটা। আসক্ত হওয়ার জন্য তো আয়ান আছেই।”
রেদওয়ানের উপর অভিমান করে রাহি ছাদ থেকে চলে যায়। রেদওয়ান হাতে থাকা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা নিচে ফেলে দেয়। ধোয়াগুলো উপরে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“যদি হাড়িয়ে যাই কোন অজানায়,
দেখিতে না পাও আমায় তোমার ছায়ায়।
বিষণ্ণ মনে আকাশপানে চেয়ে, ভাবছো আমি কোথায়?
তবুও মনে রেখো আমি আছি তোমার অন্তরায়।”
আমি ভালোবেসে যাব তোমায় অমলিন
তোমার স্মৃতি সুগন্ধি হয়ে থাকবে আমার সাথে চিরদিন।

সমাপ্তি

#মাহফুজা আফরিন শিখা।

তবুও মনে রেখো পর্ব-০৬

0

#তবুও_মনে_রেখো।[০৬]

১৬,
রাহনাফরা দেশে ফিরেছে সপ্তাহখানেক হলো। খাইরুল মামুন এখন মোটামুটি সুস্থ। বড় সাহেব ঠিক করেছেন তার এবং রুপার বিয়ে দিবেন। তাই তিনি সকলকে গ্রামে ডেকেছেন। সবাই এখন গ্রামে উপস্থিত আগামীকাল তাদের বিয়ে। বিয়েটা যেহেতু ঘরোয়া ভাবেই সম্পন্ন হবে তাই কাউকে দাওয়াত করা হয়নি। ঘরের লোক রুপার পরিবার আর শহর থেকে এসেছে রাহনাফ আলীহান ও রাহি। মৌ আর সৈয়দা মাহবুবা মিলে রবিনের বাড়িতে যান।রবিনের শরীরটাও ঠিক যাচ্ছে না আজকাল। আগের মত বলবান সে নেই, শরীর শুকিয়ে গেছে মুখে অরুচি ধরেছে খাবার খেতে পারে না সে। জন্মদাতা পিতার এমন অবস্থা দেখে কষ্টে বুক ফেটে যাই মৌয়ের। কান্না লুকাতে শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরে মৌ। সৈয়দা মাহবুবা মৌকে সামলে বাড়ি নিয়ে আসেন আর রবিনকে বলেন এবার সে যেন ঠিক একটা ডক্টর দেখিয়ে নেয়।

উঠোনে গল্পের আসর জমিয়েছে মেহেররা। খাওয়া-দাওয়ার জন্য আছে পেঁয়াজ কাচা মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখানো সিঙ্গারা ও কোকাকোলা। রাহি কোকাকোলার গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,

“এমন বিয়ে বাড়ি আমি আগে কোথাও দেখিনি ইয়ার। বিয়ে বাড়ি না যেন কোন মৃত্যুপুরীতে আছি সবাই শোক দিবস পালন করছে।”

মৌ বলল,
“গ্রামে বেশিরভাগ বাড়িতে এমন করেই বিয়ে হয়। আসলে শহরে বাবুদের মত গ্রামের মানুষের অত টাকা-পয়সা নেই তো তাই তারা ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। যদিও গ্রামে এখন নগরের সভ্যতা এসে গেছে মানুষ আগের মত নেই সবাই এখন হাসি আনন্দ হইচই এই সবই পছন্দ করে। তবুও মামা আর খালার তো বয়স হয়েছে তাই নানাজান চাচ্ছে না যে তাদের বিয়েতে এত হইহুল্লোর করতে। নানাজান আমাদের গ্রামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি আর একটা কিছু হলেই গ্রামবাসিরা তাকে নিয়ে সমালোচনা করে। নানাজান চাচ্ছেন না এই মুহূর্তে কোন সমালোচনার মুখে পড়তে।”

আলীহান তার আদেক খাওয়া সিঙ্গারাটা মুখে পুরে নিল। আড় চোখে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মামা আর আন্টির জন্য বাসর ঘরটা সাজাবো তো নাকি সেটাও হবে না সমালোচনার ভয়ে।”
” এখানে আবার সমালোচনা আসলো কোথা থেকে?” প্রশ্ন করলো মেহের।
আলিহান হাসিমুখে জবাব দিলো,
” না মানে তোমাদের গ্রামের মানুষ বলতেই পারে বুড়ো বয়সে বিয়ে করছে এতে আবার বাসরঘর সাজাতে হবে কেন?”
” এটা তুমি একদম ঠিক বলছো ভাইয়া।”
মেহের অনেকক্ষণ যাবৎ লক্ষ্য করছে রাহনাফ মুড়ি মাখানো খাচ্ছে আর কিছু ভেবে চলেছে। তারা সবাই মিলে এত কথা বলছে আর রাহনাফ কিছুই বলছে না। কৌতুহলী দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকালো মেহের রাহনাফ তখনো ভাবনায় বিভোর। মেহের প্রশ্ন করল
“রাহনাফ আপনি কিছু বলছেন না যে?”
রাহনাফ মুখে মুড়ি পুড়ে বলল,
“এটা বেস্ট ছিল।”
“কোনটা? “প্রশ্ন করল মেহের।
“এই যে মুড়ি মাখানোটা।” হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলল রাহনাফ।
কিছুক্ষণ পর তাদের গল্পের আসরে যুক্ত হল রেদওয়ান। রেদওয়ানকে দেখে রাহি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। প্রথম দর্শনে যেকোনো ব্যক্তি রেদওয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। আসলে তার পরনে জামাকাপড়ই সবাইকে আকর্ষিত করে তাকিয়ে থাকতে। রেদওয়ানের পরনে ইয়োলো কালারের ট্রাউজার ও টি শার্ট। গলায় লম্বা একটা মালা সাথে গিটারের লকেট লাগানো। মাথায় কোঁকড়ানো চুল এক কানে দুল। রাহি কেবলার মত তাকিয়ে আছে রেদওয়ানের দিকে। রেদওয়ান মাথার চুলকে হেসে বলল,
“সরি আমি মনে হয় লেট করে ফেললাম।”
আলীহান হেসে বলল,
” না না শালাবাবু ঠিক আছে। খুব বেশী লেট হয়নি।”
মৌ বলল,
“কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”
” চাচ্চুকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম।”
রাহি সবার দিকে এক নজর তাকালো। তারপর মৌকে জিগ্যেস করলো,
” এই জন্ডিসটা তোমার কে হয় ভাবি?”
রাহির প্রশ্ন শুনে সকলে কৌতূহলী হয়ে তাকালো তার দিকে। রেদওয়ান কপাল কুঁচকে বলল,
” জন্ডিস মানে? কে জন্ডিস?”
রাহি মুখ বাকিয়ে বলল,
“জন্ডিস মানে বুঝেন না। এইচবিএসএজি চিনেন? নাক সিটকিয়ে বলল, গেটআপ দেখে তো জন্ডিস ছাড়া অন্যকিছু মনে হচ্ছে না।”
রেদওয়ান মুখ গোজ করে বসে রইলো। সবাই মিলে অনেকটা সময় কাটিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। মেহের আর মৌ সৈয়দা মাহবুবার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করে। আলিহান রাহি রেদওয়ান গ্রাম দেখতে যায় আর রাহনাফ যায় খাইরুল মামুনের ঘরে। খাইরুল মামুন বিছানায় গম্ভীর হয়ে বসে কিছু ভাবছেন। বিছানার একপাশে খবরেরকাগজ তার উপর খাইরুল মামুনের চসমা। রাহনাফের বুঝতে অসুবিধা হলোনা তিনি খবরেরকাগজ পড়েই কিছু ভাবতে বসেছেন। দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাহনাফ বলল,
” স্যার, আপনি কি ব্যাস্ত?”
খাইরুল মামুন রাহনাফকে দেখে হাসার চেষ্টা করে বললে,
” রাহনাফ যে, এসো এসো।”
ভিতরে ঢুকে বিছানায় এক পাশে খাইরুল মামুনের বরাবর বসে রাহনাফ। বলে,
” আপনার অসম্পন্ন কাজটাকে নিয়ে ভাবছেন।”
” হ্যাঁ, ভাবছিলাম। আমার স্বপ্নটা মনেহয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক্যার্থবার্ট কেন এমনটা করলো সেও তো আমাদের টিমের একজন ছিলো।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন খাইরুল মামুন। বললেন, সেদিন যদি ক্যার্থবার্ট এমনটা না করতো তাহলে,,
রাহনাফ খাইরুল মামুনের শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অতঃপর বলল,

” স্টিফেন হকিং এর কথা মনে আছে। বিশ্বের সেরা পদার্থবিদের মধ্যে তিনি একজন। ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণবিবরের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি এবং মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং থিওরির ব্যাপারে তার অবদান চির স্মরণীয় হয়ে আছে। খুব অল্প বয়সে জটিল অসুখে পঙ্গু হয়ে গেলেও তার গবেষণা থেমে থাকেনি পঙ্গুত্বকে জয় করে চালিয়ে গেছেন বিজ্ঞানের জগতে তার অগ্রযাত্রা। হকিংয়ের অসুখটির নাম মোটর নিউরন ডিজিজ যার অন্য নাম amyotrophic lateral sclerosis (ALS)। এই অসুখটি হলে মস্তিষ্কের যেসব নিউরন বা স্নায়ুকোষ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা মাংসপেশীর নাড়াচাড়া নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে ফলে রোগীর দেহের বিভিন্ন অংশ আস্তে আস্তে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। শুরুতে হাঁটাচলা সমস্যা হয় আস্তে আস্তে পঙ্গু হয়ে যায় রোগী। আর শেষে নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা ও চলে যায়। ভয়াবহ এই রোগটির কোনো কারণ জানা নেই আর কোন চিকিৎসাও নেই। আর এই রোগ যাদের হয় তারা খুব বেশি হলে দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই মারা যায়। এই সংবাদটি জানার পর মুষড়ে পড়লেন হকিং। এত গবেষণা এত কাজ অথচ বাচবেন খুব অল্প কয়দিন। ডাক্তাররা রায় দিলেন উনি আর দু’বছর বড়জোর বাঁচবেন তাই পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলেন তারা।কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান হল হকিং এর জান প্রাণ এছাড়া কোনভাবেই বাঁচবেন না তিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যতদিন বাঁচবেন কাজ করে যাবেন। শিক্ষাগুরুর ডেনিস শিয়ামা উৎসাহ দিলেন । ছড়ি কিংবা ক্রাচ হাতে কষ্ট করে গবেষণা চালাতে লাগলেন। পরে অবশ্য সুখবর পেলেন। তার অসুখটি অন্যান্য এএলএস রোগীর মত দ্রুত দেহে নানা অংশে ছড়াচ্ছে না। ফলে পুরো দেহ অবশ হয়ে যেতে অনেকদিন লাগতে পারে। হকিং যেন দ্বিতীয় জীবন হাতে পেলেন কষ্ট করে হলেও বিপুল উদ্যমে গবেষণা করে ১৯৬৬ সালে শেষ করলেন তার পিএইচডি। থিসিসের জন্য পেলেন অ্যাডামস প্রাইজ।
“তুৃমি কি বলতে চাইছো রাহনাফ? ”
“সেটা আপনি বুঝেছেন স্যার।”
“সেটা কি করে সম্ভব?”
“সম্ভব। সবই সম্ভব। আপনার ইচ্ছে আছে মেধা আছে এখন পরিকল্পনা করুন। পরিকল্পনাই ভবিষ্যৎ কে বর্তমানে নিয়ে আসে। ভাবুন স্যার ভাবুন। জেমস টি ম্যাকরের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে আছে।”
“কোনটা?”
” একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনার ক্ষমতা কতটুকু, সেটি কোন ব্যাপার নয়। আপনি যা কিছু করেছেন, তার চাইতেও বেশি কিছু করার সক্ষমতা রয়েছে আপনার।”

যেটা ঘটেছে সেটা আমরা কেউ পাল্টাতে পারবোনা তাই আপনার উচিৎ অতীত নিয়ে না ভেবে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা। স্যার আপনি আমাদের দেশে একটা ল্যাব তৈরী করে নতুন করে আবার সবটা শুরু করেন। আপনার বেষ্টটা দিন দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। এখনো কিচ্ছু শেষ হয়নি অনেকটা সময় আছে আপনার হাতে। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। জীবনে বিশ্বাসটাই সব। বিশ্বাসেই সম্পর্ক চলে,বিশ্বাসেই জীবন চলে,বিশ্বাসেই পৃথিবীও চলছে।”

খাইরুল মামুন মন দিয়ে রাহনাফের কথা শুনলেন। বললেন,
” আমি আবার নতুন করে সবটা শুরু করতে চাই। আমাকে পারতেই হবে। উন্নত বিশ্বের জন্যে আমার এ সাফল্যটা খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশে গ্রাম অঞ্চলে সবুল শ্যামল প্রকৃতি দেখা গেলেও শহরে এগুলো বিলুপ্তপ্রায়। ইংল্যান্ড দেখেছি আর্টিফিশিয়াল কালচারাল’র মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা হয়। বাতাশে অক্সিজেন নেই বলে বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবহার করা হয়। আমাকে আমার রিসার্চ কমপ্লিট করতেই হবে। রাহনাফ আই নিড ইউর হেল্প।”

গ্রামে আসার পর থেকেই মেহেরকে এড়িয়ে চলছে রাহনাফ। মেহের অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করলেও হ্যা না ছাড়া তেমন কিছু বলে নি রাহনাফ। রাগ হয়েছে মেহেরের। রাগে অভিমানে সেও রাহনাফের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। খাইরুল মামুন ও রুপার বিয়ের সম্পন্ন হলে সবাই মিলে গল্পের আসর জমায়। রাহি আর মেহের দুজনে মিলে সবার জন্যে চা নিয়ে আসে। রাহি সবাইকে চা দিলেও মেহের রাহনাফের হাতে চায়ের কাপ দেয়। রাহনাফ চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ঝালে মুখ কুঁচকে সেটা ফেলে দেয়। এই দৃশ্য দেখে মেহের খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। মনে মনে বলে, আমাকে এড়িয়ে চলা তাইনা এবার বুঝো মজা।” মেহেরের হাসি দেখে রাগ হয় রাহনাফের। রাগে সে ঝাল চা সবটা এক চুমুকে খেয়ে ফেলে। এই ঘটনায় হতবম্ব সবাই। মেহর শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে রইলো রাহনাফ লাল হয়ে যাওয়া থমথমে মুখের দিকে।

১৭,
মাঝরাত থেকে মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। পাচটার পর থেকে বৃষ্টির বেগ কমলেও আকাশের মুখ ভারী। সারে পাঁচটার এর্লামে ঘুম ভাংলো আলিহানের। ঘুম ভেঙে নিজের বুকের মাঝে উদ্ধার করলো মৌকে। ছোট বিড়াল ছানার মতো গুটিশুটি পাকিয়ে মৌ আলিহানকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। আলিহান মৌয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“একিই, মনহারিণী যে প্রাণহরণ করতে চলেছেন।আর কিছুক্ষণ আমার উপর এভাবে শুয়ে থাকলে আমি চাপা পড়ে এক্কেবারে শেষ। ”
এই বলে আলিহান মৌয়ের মাথার এলোমেলো চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙ্গে মৌয়ের। চোখ খুলে আলিহানকে দেখতে পেয়ে মৃদু হেসে আরো জাপটে ধরে সে আলীহানকে। আলীহানের বুকে নাক ঘষে বলে,
“কটা বাজে?”
“এইতো ছয়টা হবে আর কি।”
“আজ অফিস আছে তোমার? ”
“না আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি বাড়িতে একটা ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে। ”
“বাড়িতে আবার তোমার কি কাজ?”
“তোমার বোন এমন একটা কান্ড করেছে আমার ভাইটার মুড অফ। এবার সেটাই ঠিক করতে হবে।”
“রাহনাফ এখনো রেগে আছে মেহেরের উপর!”
” সেতো আছেই দেখো না সারাদিন কেমন থমথমে মুখে ঘুরে বেড়ায় দেখে মনে হয় বউ মরছে শালার।”
আলীহান মৌকে ছেড়ে উঠে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে কাউকে এসএমএস করে। মৌ বসে চুলে খোপা করতে করতে বলে,
“কি করবে ভাবছো কিছু?”
“সব ভাবা হয়ে গেছে। এবাররর শুধু দুটোকে এক করতে হবে। যে করেই হোক মেহেরকে রাহনাফের রাগ ভাঙাতে হবে।”
” মেহেরের যা রাগ উল্টো মেহের রাগ না করলেই হলো।”
” এই এটা তুমি একদম ঠিক বলছো।”
মৌ ওয়াশরুমে চলে গেলে আলিহান রাহিকে এসএমএস করে বলে রুমে আসতে। রাহি আসতেই দুজনে আজকে সারাদিনের প্ল্যান শুরু করে দেয়।

সকাল আটটা বাজে ত্রিশ মিনিট। রাহনাফরা সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত নেই শুধু আলীহান। কিছুক্ষণ পর আলিহান ডাইনিং রুমে উপস্থিত হলো তবে আজ সে অফিসে যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়ে আসেনি। বাড়িতে যেভাবে থাকে সেই ভাবে আসছে। পরনে শুধুমাত্র একটা ট্রাউজার আর ট্রিশার্ট। আলিহানকে দেখে রাহনাফ প্রশ্ন করলো,
” আজ অফিস নেই তোর।”
আলিহান চেয়ার টেনে বসে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” মা খাবার দাও। খুব ক্ষিধে পেয়েছে।”
রাহনাফ জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে ভ্রুতে সামান্য ভাজ ফেলে তাকিয়ে রইলো আলিহানের দিকে। আলিহান কোনদিকে না তাকিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে পুরে বলে,
” আমরা একটা পিকনিকের আয়োজন করতে চাচ্ছি।
রাহনাফ এক নিঃশ্বাসে জুস গলঃকরন করে বলল,
” আমরা মানে কারা? আমি তো কিছু জানিনা।”
” তোকে জানানো হয়নি। রাহি জানে তাইনা রাহি। ”
রাহি উপর নিজ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। আরমান হাসান বললেন,
” কোথায় পিকনিক করতে চাচ্ছো তোমরা?”
” আমাদের বাড়ির পিছনে যে বাগানটা আছে সেখানেই আয়োজন করি।”
” আচ্ছা বেশ তাহলে আমরাও থাকছি তোমাদের সাথে।”
আলিহান আড় চোখে রাহনাফকে একনজর দেখে নিয়ে বলল,
” তুইও আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েনি।”
” লাঞ্চের পর নিবো।”
” আমাদের কত কাজ আর তুই কিনা বিকালে আসবি। অফিসে যেতে হবে না আমাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবি।”
আরহাম হাসান বললেন,
” একদিনেরই তো ব্যাপার। ছুটি নিয়ে নাও রাহনাফ।”
অবশেষে রাহনাফকে রাজি হতেই হলো ছুটি নেওয়ার জন্যে। তখন রাহি বলল,
“আচ্ছা মেহের আপুকে আসতে বললে কেমন হয়?”
মেহেরের কথা শুনতেই রাহনাফের হাত থেমে যায়। আড় চোখে সবাইকে দেখে খাবারে মনোযোগ দেয় তখন রাহনাফের মা বলে,
” এটা তো ভালো কথা। আচ্ছা রাহনাফ তুমি খাওয়া শেষ করে মেহেরকে গিয়ে নিয়ে আসবে।”
” আমি! আমি কেন?”
” মেহের তোমার হবু স্ত্রী। তুমি যাবেনা তো কে যাবে?”
” হবু স্ত্রী না ছাই।” দাঁত চিবিয়ে বলল রাহনাফ। মৌ বলল,
” আমি তাহলে মেহেরকে কল করে বলে রেডি হয়ে থাকতে।”

১৮,
“এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো” রাহনাফের কাঁধে হাত রেখে পুরনো দিনের উত্তম সুচিত্রার এভারগ্রীন গানটা কেবল গুনগুন করে গায় ছিল মেহের এমন সময় রাহনাফের বাইকটা যায় নষ্ট হয়ে। গাড়িটা দু তিনবার ম্যানুয়াল স্টার্ট দিলেও বাইক আর চলে না। রাহনাফ ভ্রু কুঁচকে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“একটু নামতো বিগড়ে গেছে মনে হচ্ছে।”
মেহের বোকা বোকা চোখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বিগড়ে গেছে?”
রাহনাফ বিরক্ত মুখে উত্তর দিল
“তোমার মাথা। দেখতে পারছ না গাড়ি বিগড়ে গেছে।”
মেহের মুখ কুঁচ করে বাইক থেকে নেমে বলল,
” বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারলে শুধু শুধু আপনার ধমক খাওয়ার জন্য তো আর বলতাম না।”
এই কথা বলে মেহের অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মনে মনে বলল,
“এখন একটু বেশি বেশি করছে।। হ্যাঁ মানছি আমি ওকে ঝাল খেয়েছিলাম তার জন্য তো সরিও বলছি তাও দেখো মুখটা এমন করে রেখেছে যেন ঝাল নয় বিষ খাইয়ে ছিলাম ওকে। মুখটা যেন মেঘলা আকাশের মতই গুমরা গুমোট, এমন মুখ দেখেই তো গাড়িটা বিগড়ে গেছে।”
রাহনাফ পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে বলল,
” আলিহানকে কল করছি তোমাকে নিয়ে যাবে ”
মেহের রাহনাফের সাথে একটু সময় কাটানোর জন্যে বলল,
“আমি যাব না। আপনাকে এমন একাকি রাস্তায় বিপদের মুখে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।”
রাহনাফ সরু চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিইই, বিপদ? কিসের বিপদ? আমি কোন মেয়ে নাকি যে ফাঁকা রাস্তায় আমার কোন বিপদ হবে।”
“এই শুনুন ফাঁকা রাস্তায় ছেলেদেরও বিপদ হয় বুঝলেন তো। আর আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। পিকনিক স্পটে যেতে হলে দুজন এক সাথেই যাব না হলে না।”
মেহেরে এই কথা শুনে রাহনাফের শত রাগের মাঝেও মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সেই হাসি মেহের দেখতে পেলো না। মনে মনে বলল,
“তাও স্বীকার করবে না আমার সাথে থাকতে চায়। আচ্ছা বেড়ে পাকা মেয়ে তো। তবে আমিও নরম হবোনা। সেদিন কি হাল হয়ছিলো আমার। ঝালের চোটে ঠান্ডা পানি খেয়ে খেয়ে সর্দি ধরে গেলো ভুলবো আমি সে কথা। এর ঠিক শোধ না তুলে আমিও শান্ত হবো না।”

এই কথা ভাবতে ভাবতে আলিহানকে কল করলো রাহনাফ। আলিহানকে গাড়ি নিয়ে আসতে বললে সে বলে ব্যাস্ত আছে আসতে পারবেনা। রাহনাফের লোকেশন বলার পর সে জানায় সামনেই একটা গ্যারেজ আছে সেখান থেকে বাইক সাড়িয়ে তারপর ফিরে আসতে। আলিহানের সাথে কথা বলে রাহনাফ বাইক ঠেলে সামনে এগোতে থাকে আর মেহের তার পিছে।

আলিহান কথা বলা শেষ করে মোবাইল হাতে নিয়ে মিটমিটে হাসতে থাকে। মৌ আর রাহি আলিহানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মৌ উঠে গিয়ে আলিহানের সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত গুজে বলে,
” কার কল ছিলো? হাসছো কেন এভাবে?”
” আমার ভাইটার ফোন ছিলো গো গিন্নী। বাইক খারাপ হয়ে গেছে দুজনে এখন একাকি নির্জন রাস্তায় বুঝলে।
ভালোই সুযোগ হয়েছে ওদের এবার দুজনের মান অভিমান মিটিয়ে নিক।”

গ্যারেজে বাইক রেখে মেহেরকে নিয়ে একটা কফিশপে যায় রাহনাফ। মেহের কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
” সরি, সেদিন প্রাঙ্ক করার জন্যে।”
” মানছো তাহলে সেদিন প্রাঙ্ক করেছিলে?”
“হুম।”
“কেন করেছিলে?”
“এমনি।”
“এমনি এমনি কিছু হয় নাকি? সবকিছুরই কোন না কোন কারন থাকে। বলো কেন করেছিলে?”
মেহের মনে বলল,
” এমন প্রশ্ন করছে যেব আমি কোন ক্রিমিনাল আর ওনি পুলিশ। এখন যদি বলি আপনি আমাকে ইম্পরট্যান্ট দেননাই তাই ঝাল খাইয়েছিলাম তাহলে না জানি আর কত প্রশ্ন করবে।” রাহনাফের দিকে অসহায় মু করে তাকিয়ে ডুক গিলে বলল,
“রাগে করেছিলাম।
রাহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হোয়াট? রাগে? কেন আমি তোমাকে রাগানোর মতো কি করেছিলাম।”
“কেন রাগ হবে না আমার। মামাকে নিয়ে আসার পর থেকে আমাকে পাত্তাই দেননা। আগে রোজ রাতে কল করতেন এখন সেটাও করেননা। আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলেন রাগ হবেনা আমার।”
” এই ছোট্ট কারনে এত রাগ।”
“এটা ছোট্ট কারন?”
“তা নয়তো কি? মেহের আমি কিছুদিন ব্যাস্ত ছিলাম স্যারের অনেক কাজ ছিলো যেগুলো আমাকে করতে হয়েছে সাথে আমার অফিসের কাজ তাই তোমাকে সময় দিতে পারিনি। এর কারনে এত রাগ?”
” হুম। সরি বলছি তো। এখন আর আমার উপর রেগে নেই তো?”
” আমার রাগ এত সহজে কমবে না। আমি এর শোধ নিয়ে ছাড়বো।”
“কি শাস্তি দিবেন বলুন। কান ধরে উঠবোস করবো। না হলে আপনিও আমাকে ঝাল খাইয়ে দিন।”
” না না তা হয় নাকি। হতেই তো পারে তুমি আমার থেকে ঝাল বেশী খাও তখন তোমাকে খাল খাইয়ে আমার লাভটা কি শুনি। ”
“তাহলে,,,
“ভাবো ভাবো বড় তো কম হওনি। বড়দের মতো করে ভাবো।”
মেহের কিছুক্ষণ ভাবার পর চমকে উঠে বলল,
” মিষ্টি খাবেন। আমি আপনাকে অনেক মিষ্টি খাওয়াবো। সেদিন ঝাল খাইয়েছিলাম আজ মিষ্টি খাওয়াবো।”
রাহনাফ মাথা নেড়ে বলল,
“সুগারে ভয় আছে ওই জিনিস খাওয়া যাবেনা অন্য কিছু ভাবো।”
মেহের ঠোট উল্টে মাথা চুলকে বলল,
” তাহলে টক কিছু?”
” এসিডিটির ভয় আছে।”
“তাহলে নোনতা,,,,
” ওরে বাবা নুন মানে বিষ। হাই প্রেশার ধরাবে নাকি।”
মেহের বিরক্ত মুখে বলল,
” রোগের ডিপি একটা।
এমন সময় গ্যারেজ থেকে কল আসলো রাহনাফের বাইক ঠিক হয়ে গেছে। রাহনাফ কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে মেহের দিকে মুখটা বাড়িয়ে বলল,
” ভাবো মেহুরানি ভাবো। বড়দের মতো করে ভাবো।”
এই কথা বলে কফির বিল দিয়ে বেড়িয়ে যায় কফিশপ থেকে আর মেহের ভাবুক হয়ে তার পিছে যায়।

চলবে,,,,,,
#মাহফুজা আফরিন শিখা।

তবুও মনে রেখো পর্ব-০৫

0

#তবুও_মনে_রেখো। [০৫]

১৩,
ফোর’ডি মডেলের সুপার কম্পিটারের সামনে চোখ বন্ধকরে বসে আছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ও গবেষক ডঃ খাইরুল মামুন হক। তার দুপাশে চেয়ারে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছেন প্রফেসর উইলিয়াম স্টোরাব এবং আর্থ্যার কারশ্যাম। প্রায় দশ মিনিট পর চোখ খুলে দেখতে পেলেন সুপার কম্পিটারের সিস্ক্রোনিজেসন নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্ট। এক মিনিটের কাজে দশ মিনিট সময় লাগলে কার না বিরক্তি লাগে। সিস্ক্রোনাস ক্যানসেল করে দিয়ে ল্যাব থেকে চলে গেলেন প্রফেসর খাইরুল মামুন হক। যাওয়ার আগে ল্যাবে থাকা এনএম ট্রির পাতা আলতো করে ছুইয়ে দিলেন। লজ্জাবতী গাছের পাতার মতো বন্ধ হয়ে গেলো গাছটার সব পাতাগুলো আর পাতাগুলোর উপর থেকে যে সহস্র জোনাকির মতো আলোগুলো এতক্ষণ পুরো ল্যাবকে আলোকিত করে রেখেছিলো তা বন্ধ হয়ে গেলো। ল্যাব থেকে বেড়িয়ে রিসার্চ টিমের প্রধান ক্যার্থবাট বার্নাপকে কল করলেন।যাতে কালকের মধ্যে ওই নিউক্লিয়ার ট্রির কৃতিম বীজ তৈরী করার কাজ শুরু করে দেয়। প্রথমে এক হাজার বীজ তৈরী হলেই হবে। আর্টিফিশিয়াল শেড কালচারাল মিডিয়ামে বীজ তৈরী হতে সময় লাগবে বড়জোর দুইদিন।

পরেরদিন সকাল দশটায় ল্যাবে আসেন খাইরুল মামুন। ক্যার্থবাট বার্নাপ তখনো কাজ করছিলেন। খাইরুল মামুন কম্পিটারের সামনে বসে ক্যার্থবাট বার্নাপকে সুধায়,
” হাউ ফেয়ার দ্যা ওয়ার্ক অফ মেইকিং শীডস্ প্রোগ্রেস? ”
ক্যার্থবাট বার্নাপ একটা প্ল্যান্ট নিয়ে কাজ করছিলেন খাইরুল মামুনের কথা শুনে তিনি চমকে উঠেন। একটু ইতস্তত করে বলেন
” ইট উইল বি ডান এট দ্যা রাইট টাইম স্যার।”
“সো দিস মানডে দ্যা শীডস্ ক্যান বি সেন্ট টু নাসা?”
” ইয়েস স্যার।”
খাইরুল মামুন তার এনএম ট্রির সামনে গিয়ে একমনে তাকিয়ে রইলেন গাছটার দিকে। তার স্বপ্ন এতদিনের পরিশ্রম সব এবার সত্যি হতে চলেছে।”

সেদিন সারাদিন ল্যাবে কাটিয়ে দিলেন। নিজের এপার্টমেন্টে ফিরে রুপাকে কল করলেন। পর পর কয়েকবার রিং হওয়ার পরেও কল রিসিভ করলো না রুপা। লাষ্ট কবে রুপার সাথে মন খুলে কথা বলেছে মনে পরে না খাইরুল মামুনের। মাঝে মাঝে নিজের প্রতি রাগ হয় তার। রুপা কোন রকম এক্সপেকটেশন ছাড়াই তাকে ভালোবেসে গেছে বিনিময়ে কি পেয়েছে মেয়েটা। তিনি তো রুপাকে কিছুই দিতে পারেনি। শুধু কয়েকটা মিথ্যে আশ্বাস আর একটা সুখের স্বপ্ন দেখানো ছাড়া। মিথ্যে আশ্বাস? নিজেকেই প্রশ্ন করে খাইরুল মামুন। আসলে কি সে রুপাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছে? পরক্ষনেই নিজের মনকে বুঝায় সে মিথ্যে আশ্বাস কেন দিবে? তিনিও তো ভালোবাসেন রুপাকে। তাইতো নিজের জীবনে অন্য কোন নারীকে জড়াননি তিনি।যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ইংল্যান্ড আসলো তখন কত মেমসাহেব তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। কত নারী তাকে একবার কাছে পেতে চেয়েছে তাদের সবার প্রপোজাল তিনি রিজেক্ট করেছেন শুধু মাত্র রুপার জন্যে। রুপার প্রতি অন্যায় করা হবে ভেবে কখনো কোন মেয়ের দিকে গভীর দৃষ্টি দেননি। অথচ রুপার সাথে তার সম্পর্কটাই কেমন নড়বড়ে হয়েগেছে আজকাল। খেলাঘরের মতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও কল করলেন রুপার নাম্বারে এবারও রিসিভ হলো না। মনে অনেক প্রশ্ন আর মাথায় চিন্তা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেন খাইরুল মামুন।

পাঁচদিন পর,
পরিকল্পনা মাফিক নাসার কিছু বিজ্ঞানি মিলে বীজগুলো পৃথীবিতে রোপন করে। এবং সেখান থেকে ছোট ছোট চারা গাছ জন্ম নেয়। খাইরুল মামুনের কোন বিশ্রাম নেই। স্যাটেলাইটের লাইভ ফুটেজে চোখ রেখে সবটা দেখছেন তিনি। তবে কাল থেকে তার মনে কেমন একটা খটকা লাগছে, ফোরডি মডেলের সুপার কম্পিউটারে গাছগুলোর বৃদ্ধি যে রকম দেখেছিলেন স্যাটেলাইটের লাইভ ফুটেজের গাছগুলোর থ্রিউরিক্যাল মডেলের প্রায় দ্বিগুণ। প্রথমে ভাবলেন, হয়তো কম্পিউটার ভুল এসেছিল তাই কোন পাত্তা দিলেন না। কিন্তু তার আশংকা সত্যি হলো তখন যখন নাসা থেকে একটা মেইল আসলো। সেখানে লেখা ছিলো, গাছগুলো বৃদ্ধির হার থ্রিউরিক্যাল মডেলের দ্বিগুন হয়েগেছে যদি এগুলো না থামানো যায় তাহলে এক সময় এই গাছগুলো দিয়ে পুরো বিশ্ব ঢেকে যাবে।” চিন্তায় পরে যান খাইরুল মামুন। কম্পিউটারের নিজের রিসার্চের সমস্ত তথ্য দেখতে থাকেন।এমন সময় অট্ট হাসিতে ফেটে উঠো পুরো ল্যাব। ক্যার্থবাট বার্নাপ বুকে হাত দিয়ে আট্ট হাসিতে মেতে উঠছে। উইলিয়াম স্টোরাব ও আর্থ্যার ক্যারশাম তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। প্রফেসর খাইরুল মামুন একদিকে অস্থির হয়ে উঠছেন আর রিসার্চ টিমের প্রধান এনি হাসছেন! পাগল হলেন নাকি! খাইরুল মামুন বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” হোয়ায় আর ইউ লাবয়িং? কেন্নট সি দ্যা প্রবলেম? ”
ক্যার্থবাট বার্নাপ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে খাইরু মামুনের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
” হোয়ায় আর ইউ সো রেস্টলেস স্যার? ট্রিস্ গ্রোয়িং টেনফোল্ড!”
ক্যার্থবাট বার্নাপের কথা শুনে শান্ত হয়ে গেলেন খাইরুল মামুন। স্তব্ধ হয়ে বসে শূন্য দৃষ্টিতে ক্যার্থবাটের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” হাউ ডিড ইউ নো?!
” আই ইউল নো ইভরিথিং, সাইন্টিস্ট।”
” হাউ?”
ক্যার্থবাট বার্নাপ হাসলেন। খাইরুল মামুনের দিকে শক্ত দৃষ্টি রাখলেন। অতঃপর শান্ত সুরে বললেন,
“দেয়ার অয়াজ নাথিং রোং উইথ ইউর প্রোগ্রাম।”
” হোয়ায় দিস প্রবলেম?”
“আই ডিড।”
” হোয়াট ডিড ইউ ডো?”
” আই এডেড টুয়েলভ মালিছিয়াস ক্রোমোজোম।”
ক্যার্থবাট বার্নাপের কথা শুনে খাইরুল মামুন অবাক হয়ে যান। আর অগোচরে বার্নাপ এতকিছু করে ফেলেছে ভাবতেই পারছেন না তিনি। অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,
” হাউ? ”
“দ্যা ডে ইউর ওয়ার্ক ইজ ডান।”
” আই উইল নট লিভ ইউ।” খাইরুল মামুন তেড়ে আসেন ক্যার্থবাট বার্নাপের দিকে তখন উইলিয়াম স্টোরাব এবং আর্থ্যার কারশ্যাম তার দুই হাত ধরে তাকে আটকিয়ে দেন। ক্যার্থবাট বার্নাপ তার ঢিলেঢালা প্যান্টের পকেট করে একটা বন্দুক বের করে সেটা খাইরুল মামুনের কপাল বরাবর তাক করে বলে,
” ডন্ট গেট এক্সসাইটেড, সাইন্টিস্ট।ইউ উইল ডাই, নট মি। দেন আই উইল বি দ্যা গ্রেটেস্ট সাইন্টিস্ট ইন দ্যা ওয়ার্ড।”
” ইউ ক্যান্নট ডো’ইট।”
” আই ক্যান ডো ইভরিথিং, ইউ উইল’সি।”
ক্যার্থবাট বার্নাপ ট্রিগার চাপবে এমন সময় খাইরুল মামুনের কম্পিটারে মেইল টোন বেজে উঠে। সবাই কম্পিটারের দিকে তাকায়। খাইরুল মামুন মেইল দেখেন। নাসা থেকে মেইল এসেছে সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে,

” প্রফেসর খাইরুল মামুন হক, প্লিজ টেক এ্যনি এমিডিয়েট স্টেপ। দ্যা হাইড এন্ড গ্রোথ্ রেয়্ট অফ ইউর নিউক্লিয়াস মডিফাইয়ার ট্রি ইজ ভেরী মাচ বিয়ন্ড। ইউর এন্টিসিপেশন ইন ভেরী হাউআ্যার দেয়ার ফোরেস্ট্ আর বিকামিং টুইস ইন সাইজ। দেস্ ট্রিজ আর অলসো প্রোডিউসিং টক্সইক রেডিওকটিভ আইসোটোপ অফ ভ্যারিয়াস গ্যাস্ ইন্সটেন্স অফ অক্সিজেন।”

সকলের দৃষ্টি তখন কম্পিউটারের দিকে। ক্যার্থবাট বার্নাপের হাতের বন্দুক তখনো খাইরুল মামুনের কপাল বরাবর তাক করা তবে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ কম্পিউটারের স্কিনে। খাইরুল মামুন তার এই অন্যমনস্কতার সুযোগ নিলেন। ল্যাব থেকে বের হওয়ার জন্যে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই ক্যার্থবাট বার্নাপের দৃষ্টি পরে তার সাথে সাথে তার হাতের বন্দুক গর্জে উঠে। গুলিটা খাইরুল মামুনকে ভেদ করে গিয়ে লাগলো সুপার কম্পিউটারের কলিং ইউনিট এর একটা লিকুইড নাইট্রোজেন এর সিলিন্ডারে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘরটা অক্সিজেন শূন্য হয়ে পুরো নাইট্রোজেনে ভরে গেলো আর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সময় নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় তৈরী হলো এক শ্বাসরোধকারী নাইট্রাস অক্সাইড। নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের কারনে অজ্ঞান হয়ে গেলো ল্যাবে থাকা চারজন সাইন্টিস্ট। বেজে উঠলো সাইরেন। অন্যান্য ল্যাব থেকে গবেষকরা ছুটে এলেন।

১৪,
অনেকদিন পর ছাদে আসে মেহের। রুপা মেহেরের আগেই ছাদে এসেছে। পরন্তু বিকালের কোমল রোদের তাপে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ লাগছে রুপার। অস্তগামী সূর্যটা লাল আভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে ধূসর রঙের আকাশে। অন্নের সন্ধানের বেড়িয়ে পরা পাখিগুলো কুলায় ফিরে যাচ্ছে। ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ত মানুষ তাদের ব্যাস্ততা কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে নীরে। আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে রুপা ভাবছে তার খাইরুল ভাইয়ের কথা। কতদিন হলো রুপাকে কল করেনা তার খাইরুল ভাই। এদিকে রুপার মনে অভীমানের মেঘ জমে সেটা বৃষ্টির ধারার মতো বয়তে শুরু করছে। ধূসর রঙের আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো খাইরুল ভাই।”
রুপার মন কাঁদে খাইরুল ভাইয়ের জন্যে। যে মানুষটার অপেক্ষায় নিজের কৈশোর যৌবন সব কাটিয়ে দিলো সেই মানুষটাকে সেদিন কত কথা শুনিয়ে দিলো। রাগে নাকি অভিমানে বলেছিলো জানেনা রুপা। তবে আজকাল মানুষটাকে বড্ড কাছে পেতে মন চায়। মনে হয় সে থাকুক না আমার পাশে আমার ছায়া হয়ে। অপেক্ষায় তো সারাটা জিবন কাটিয়ে দিলাম এবার না হয় সে কাছে আসুক পাশে থাকুক। কোন এক শ্রাবনের ধারায় দু কাপ চায়ে আমাদের আলাপ হোক। চাঁদনী রাতে জোস্ন্যার আলোয় গায়ে মেখে দুজন দুজনকে ভালোবাসুক, রাতে তার বুকের বা পাশটা আমার ঘুমানোর বালিশ হোক। ঘুম থেকে উঠে তার ঘুমন্ত মুখটা দেখে সকাল শুরু হোক। দিন শেষে তার হাসি মুখটা দেখে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হোক। খুব করে মন তাকে কাছে পেতে চায়। রেলিং দু হাতে চেপে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুপা। মেহের ছাদে এসে রুপাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে আসে। রুপার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠে রুপা। পানিতে টলমল করা চোখদুটো বন্ধকরে বড় করে শ্বাস নেয়। সরাসরি মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,
” কখন আসলি?”
” মাত্র আসলাম। তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? মন খারাপ নাকি তোমার?”
” মন খারাপ কেন হবে? তুই হঠাৎ ছাদে আসলি যে?”
” তোমাকেই খুজছিলাম।”
” কেন কি হয়েছে?”
“মা গ্রামে একটা এনজিও খুলার কথা বলছিলো সেটা নিয়েই কথা বলতে এলাম।”
“এনজিও! কিসের এনজিও। আপা তো আমাকে কিছু বলেনাই।”
” কখন বলবে তোমাকে। সারাদিন স্কুলে কাটিয়ে যতক্ষণ বাড়িতে থাকো ততক্ষণ তোমার বিরহ পালন করতেই যায়।”
“দিন দিন ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস।”
“আচ্ছা শুননা, বলছি বাংলাদেশ ন্যাশনাল পোর্টাল এর নাম নিশ্চয় শুনেছো। মা চাইছে এর একটা শাখা আমাদের গ্রামে তৈরী করতে।”
” বাংলাদেশ ন্যাশনাল পোর্টাল মানে ওই মহিলাদের,,,
“হ্যাঁ, অনগ্রসর, অবহেলিত, বেকার মহিলাদের আত্ম-কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থা দর্জ্জিবিজ্ঞান, এমব্রয়ডারী, ব্লক-বাটিক, চামড়াজাত শিল্প এবং খাদ্য প্রস্ত্তত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। মানব সম্পদ উন্নয়ন, আত্ম-কর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আর্থ- সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সংস্থার ৬৪টি জেলা ও ৫০টি উপজেলা শাখার মাধ্যমে ০৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। এগুলো হলো: নগর ভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প, জেলা ভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প। এ সকল প্রকল্পের মাধ্যমে শহর অঞ্চলের দরিদ্র, বেকার, অসহায়, বিত্তহীন মহিলাদের সেলাই ও এমব্রয়ডারী, ব্লক-বাটিক এন্ড স্ক্রীন প্রিন্ট, নকশী কাঁথা ও কাটিং, পোল্ট্রি উন্নয়ন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন ও সংরক্ষণ, চামড়াজাত দ্রব্য তৈরী, সাবান ও মোমবাতি তৈরী, বাইন্ডিং ও প্যাকেজিং, মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, হাউস কিপিং কম্পিউটার, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন, বিউটিফিকেশন, ক্যাটারিং ট্রেডে কারিগরী ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বর্ণিত প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে ১৬১৫০০ মহিলাকে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
” এমনটা হলে তো ভালোই হয়।”
“হ্যাঁ, এবার নিচে চলো।”
মেহের আর রুপা দুজনেই ছাদ থেকে নেমে যায়। ড্রায়িংরুমে আসতেই সৈয়দা মাহবুবার থমথমে মুখটা দেখে মেহেরের পা থেমে যায়। রুপা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ঠোঁটে নকল হাসে ফুটিয়ে বলে,
“কিগো আপা শরীর খারাপ লাগছে তোমার। মুখটা এত থমথমে হয়ে আছে কেন?”
সৈয়দা মাহবুবা কিছু বলেন না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টিভির স্ক্রিনের দিকে। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে তার। ক্ষনিকের মধ্যে হাতের রিমোটটা নিচে পড়ে সেটা ভেঙে গেল। চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। মায়ের এমন অবস্থা দেখে মেহের দৌড়ে তার কাছে এলো। রুপা আরো কিছু বলবে তখনই তার চোখ যায় টিভির স্কিনে। সময় সংবাদ নিউজ চ্যানেলের লাইভ রিপোর্টিং চলছে। স্কিনে ভেসে উঠছে কিছু আহত মানুষের দেহ তাদের কারোর যে জ্ঞান নাই এটাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। নিচে ভেসে উঠেছে শিরোনাম।টিভির স্কিনের ছবি আর শিরোনাম দেখে রুপা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। ধপ করে বসে পড়ে সে সুফায়। বিড়বিড়য়ে বলে, খাইরুল ভাই খাইরুল ভাই। ” রুপার কথা শুনে মেহের টিভির স্কিনে ভেসে উঠা শিরোনাম টুকু পড়তে থাকে,

“অক্সফোর্ডশায়ারের বায়োটেকনোলজি ল্যাবে বিস্ফোরণ। আহত অবস্থায় সকলকে উদ্ধার করা হয়েছে তার মধ্যে একজন বাঙালি একজন আফ্রিকান ও দুইজন ইংল্যান্ডের অধিবাসী।”

মেহের নিচ থেকে রিমোট তুলে সেটা ঠিক করে ব্যাটারি লাগিয়ে নিল তারপর চ্যানেল ঘুরিয়ে দিল অন্য একটা নিউজ চ্যানেলে সেখানেও একই রিপোর্টিং চলছে “আন্তর্জাতিক সংবাদ।”তারপর আরো একটা চ্যানেলে ঘুরিয়ে দিল সেখানে নিচে শিরোনামে দেখতে পেলো, “প্রফেসর খায়রুল মামুন হক ও তার সহকারীরা নাসায় নিউক্লিয়ার মডিফায়ার ট্রির গ্রোথের যে ইনফরমেশন দিয়ে ছিলো প্রাকৃতিক বায়ুমণ্ডলে সেগুলো প্রপারলি কাজ করছেনা। পৃথীবি এক বিরাট ধ্বংসের মুখে পরতে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এই কঠিন বিপদ থেকে পৃথীবিকে বাঁচাতে প্রফেসর খাইরুল মামুন হক ও তার সহকারীদের প্রয়োজন যারা এখন আহত অবস্থায় পরে আছেন ইংল্যান্ডের হসপিটালে। ”

কম্পিউটার কিংবা অন্য কোন যন্ত্রের মাধ্যমে ডেটাকে একস্থান হতে অন্য স্থানে কিংবা এক ডিভাইস হতে অন্য ডিভাইসে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া হচ্ছে ডেটা কমিউনিকেশন। কাজেই কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে এক স্থান হতে অন্যস্থানে নির্ভরযোগ্যভাবে ডেটা বা উপাত্ত আদানপ্রদান সম্ভব। ডেটা কমিউনিকেশন ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকে যোগাযোগ প্রযুক্তি বা কমিউনিকেশন টেকনোলজি বলা হয়। বর্তমানে এমন কোন ক্ষেত্র পাওয়া যাবে না যেখানে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। মানুষের জীবনে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রাপ্তি সহজতর করার লক্ষ্যে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তথ্য প্রযুক্তির বিবর্তনের পাশাপাশি যোগাযোগ প্রযুক্তিরও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এক সময় রেডিও ব্যবহার করে মানুষ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করত, পরবর্তীতে টেলিভিশন, টেলিগ্রাফ, টেলিপ্রিন্টার, ফ্যাক্স, টেলিটেক্সট, টেলিফোন, মোবাইল ইত্যাদি চালু হয়েছে। মানুষের তথ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। মানুষ এখন যখন যেখানে প্রয়োজন তখন সেখানে সঠিক তথ্য পেতে চায়। যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র তথ্য প্রযুক্তি মানুষের এই চাহিদার যোগান দিতে পারবে না। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি উভয়ের উন্নয়নের ফলে মানুষের এই চাহিদা পূরণ হচ্ছে।এক কথায় বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের খবরা খবর মুহূর্তের মধ্যে আমাদের হাতে পৌঁছে যায়। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ার শহরের বায়োটেকনোলজি ল্যাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বিশ্বকে এক আতঙ্কের মুখে ফেলে দিয়েছে।

ঘটনাটা জানার পর মৌ ছুটে আসে সৈয়দা মাহবুবার বাড়ি। সৈয়দা মাহবুবা অবস্থা শোচনীয় ভাইয়ের কথার চিন্তা করে শরীর অসুস্থ হয়ে গেছে তার। রুপার শরীরটাও ভালো লাগছেনা। সবাই মিলে সৈয়দা মাহবুবাকে নিয়ে হসপিটালে যায়। সৈয়দা মাহবুবা কে ইমারজেন্সিকে নিয়ে যাওয়া হলে ডক্টররা জানায় তিনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন। হসপিটালে ভর্তি করা হয় তাকে। রুপা নিজেকে সামলে বোনের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তার মনের ভিতরে যে ঝড় উঠেছে বাহির থেকে দেখে সেটা বুঝার উপায় নেই।

সন্ধ্যা নাগাত আলিহান ও তার পরিবার আসে হসপিটালে। রাহনাফ হসপিটালে আসে সন্ধ্যার পরে। ডক্টরের থেকে সৈয়দা মাহবুবার অবস্থা জেনে নিয়ে করিডোরে বসে। আলিহান রাহনাফকে বলে,
” তোর বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে? মামার অবস্থা এখন কেমন?”

সবাই রাহনাফের দিকে তাকায়। রাহনাফ একনজর মেহেরের শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যারি এখন হসপিটালেই আছে। স্যারের অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি এখনো পর্যন্ত। ল্যাবে যারা ছিলো তাদের কারো ঞ্জান ফিরেনি।”
খাইরুল মামুনের পাশে এখন পরিবারের কউকে দরকার। জ্ঞান ফিরার পর তাকে সামলানোর জন্যে তার পাশে আপন কাউকে দরকার। কিন্তু কে যাবে এই মুহূর্তে সুদূর যুক্তরাজ্যে। সৈয়দা মাহবুবা অসুস্থ। সৈয়দা মাহবুবা আর রুপা ছাড়া ওদের পরিবারের কারো পাসপোর্ট নেই। তাই ঠিক করা হলো রাহনাফ আর রুপা দুজনেই যাবে খাইরুল মামুনের কাছে।

রুপার শরীর খারাপ থাকার কারনে মৌ রুপাকে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। হসপিটালে থাকে শুধু মেহের। সৈয়দা মাহবুবাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। মেহের মায়ের শিয়রের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুচোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝড়ছে তার। এই মানুষটাকে শত কঠিন বিপদে নিজের মনকে শক্তকরে বিপদের মোকাবেলা করতে দেখেছে কখনো ভেঙে পরেনি। একা হাতে ঘরে বাইরে সবটা সামলেছে। আর আজ সে হসপিটালের বেডে এমন নিথর হয়ে পরে আছে। সৈয়দা মাহবুবার এমন অবস্থা দেখে কষ্ট হচ্ছে মেহেরের। চোখের জল মুছে সৈয়দা মাহবুবার কপালে অধোর ছুঁইয়ে দেয়। বলে,
” তোমাকে এমন নিথর হয়ে শুয়ে থাকা মানায় না মা, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো। এখনো তোমার অনেক কিছু করার বাকি আছে মা।”
কেবিন থেকে বেরিয়ে মৌকে কল করে রুপার কথা জেনে নেয়। তখনি দেখতে পায় রাহনাফ দুকাপ চা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেহের ভ্রু কিঞ্চিৎ ভাজ করে বলে,
” আপনি এখানে? বাড়ি যাননি?”
রাহনাফ মেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসে। ডানহাতটা মেহেরের দিকে বাড়িয়ে দিলে মেহের চায়ের কাপটা হাতে নেয়। রাহনাফ বলে,
” গিয়েছিলাম তো। কিছু দরকারি জিনিসপাতি নিয়ে আবার চলে আসলাম।”
রাহনাফ তার কাধে থাকা ব্যাগটা চেয়ারের উপর রেখে আবার বলে,
” আন্টির কি অবস্থা এখন?”
মেহের চায়ের চুমুক দিয়ে বলে,
“ঘুমাচ্ছে এখন।”
” আচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর রাহনাফের সেলফোনটা বেজে উঠে। রাহনাফ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম্বার দেখে নেয়। তারপর মেহেরের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে একটু দূরে একাকি জায়গায় চলে যায় কথা বলার জন্যে। কল রিসিভ করে রাহনাফ প্রশ্ন করে,
” হোয়াট ইজ দ্যা সিচুয়েশন নাও হ্যারি?”
” নো ওয়ান রেগিয়েন্ড কনসেসনেস। সেইম সিচুয়েশন।”
” ওকে। ইউ কিপ গিভিন আপডেট ফ্রম দ্যা হসপিটাল।আই উইল কাম ভেরি সুন।”
“ইয়াহ।”
কল কেটে মেহেরের সামনে এসে দাড়ায় রাহনাফ। মেহের প্রশ্ন করে,
” কে ছিলো?”
” হ্যারি, হ্যারি হওয়েল আমার ফ্রেন্ড। মামাকে যে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে ও সেখানে আছে ওর থেকেই মামার খবর নিচ্ছি।”
” ওহ্। মামা কেমন আছে এখন।”
” আগের মতোই জ্ঞানহীন। আচ্ছা শুনো কাল সকালের ফ্লাইটে আমরা ইংল্যান্ড যাচ্ছি। টিকেট কাটা হয়েগেছে। ভোরে রওনা দিবো।
রাহনাফের কথা শুনে মেহের অবাক হয়। বলে,
” কখন করলে এতকিছু?”
” হসপিটাল থেকে যাওয়ার পর। ইমার্জেন্সি টিকেট বুক করেছি। রুপা আন্টিকে নিয়ে ভোরে রওনা দিবো।”
মেহের কিছু বলতে যাচ্ছিলো রাহনাফ মেহেরের অধোরে আঙ্গুল ঠেকিয়ে থামিয়ে দেয়। দুপা এগিয়ে আর কাছে এসে দাঁড়ায় রাহনাফ। বলে,
” নো মোর ওয়ার্ড্স। এবার একটু শান্ত হয়ে বসতো।”
মেহের মুখরা ঘুরিয়ে নেয়। বলে,
” আমি শান্তই আছি। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছো? ”
” মেইল করেছি।”
“আচ্ছা।”
“মেহের,,
” হু
রাহনাফ মেহেরের শুকনো মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বলল,
” সাবধানে থেকো এবার আমি আসছি গুছগাছ করতে হবে।”

১৫,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে নাসার প্রধান সেনাপতি স্টিভ জুর্কজিক জরুরী মিটিং ডাকলো। এনএম ট্রির ঘন জঙ্গল থেকে কি করে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায় এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা একের পর এক মতামত ব্যক্ত করতে শুরু করল। মিটিং শেষ হলো সিদ্ধান্ত নেওয়া হল অটোমিক মিসাইল এর সাহায্যে কয়েক কিমি পর্যন্ত লম্বা ঘন জঙ্গলকে ছাইয়ে পরিনিত করা হবে। তিন ঘন্টা পর শুরু হল অটোমিক মিসাইল। যার ফলে ফল হল আরও খারাপ। পরিস্থিতি এখন আরো বেগতিক। এনএম ট্রি তার ক্ষমতাবলে আটোমিক মিসাইল এর রেডিও একটিভ এলিমেন্ট এর শক্তি শোষন করে হয়ে উঠলো আরো ভয়ংকর। এমএম ট্রি বৃদ্ধি পেতে লাগলো আর পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভরে উঠতে লাগলো বিভিন্ন গ্যাসের আইসোটোপ এ। তবে এখন উপায়? নাসার প্রধান সেনাপতি স্টিভ জুর্কজিক আবার জরুরী মিটিং ডাকলো। নাসাতে আবার জরুরী মিটিং বসলো। না না এই ভয়ংকর বিপদ থেকে মুক্তি পেতে প্রফেসর খাইরুল মামুন হক তার সহকারীদেরই দরকার। তবে তারা যে এখনো হসপিটালে জ্ঞানহীন অবস্থায় আছেন তাহলে এখন উপায় কি? সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রফেসর খাইরুল মামুন হক ও তার সহকারি কারোর জ্ঞান না ফিরছে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

প্রফেসর খাইরুল মামুনের জ্ঞান ফিরে আরো চারদিন পর ততক্ষণে রাহনাফ ও রুপা দুজনেই পৌঁছে গেছে ইংল্যান্ডে। উইলিয়াম স্টেরাব আর্থার ক্যারশাম ও ক্যার্থবার্ট বার্নাপের জ্ঞান ফিরেছে অনেক আগে। উইলিয়াম স্টোরাবের বয়ান অনুসারে ক্যার্থবার্ট বার্নাপকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ও তাদের দুজনকে লন্ডনের হসপিটালে শিফট করা হয়েছে। প্রফেসর খাইরুল মামুন হকের অবস্থা খুব বেশি ভালো না হওয়ায় তাকে অক্সফোর্ডশায়ারে রাখা হয়েছে। তার জ্ঞান ফিরেছে ঠিক তবে তিনি কথা বলতে পারছেন না। ডক্টর বলেছে তার পুরোপুরি সুস্থ হতে মাস খানেক লাগবে। এক মাস অনেক সময় এতদিন নাসার বিজ্ঞানীরা তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারবেনা। না হলে পুরো পৃথীবি নিউক্লিয়ার মডিফায়ার ট্রির নিচে চাপা পরে যাবো। ঠিক করা হলো প্রফেসরকে এভাবেই কাজ করতে হবে। কিন্তু কিন্তু কি করে? অনেক ভেবে শেষে একটা উপায় বের করা হলো। নরম্যান ভিনসেন্ট পিলের কথাটাই সমাধান বের করে দিলো তিনি বলেছেন ” মানুষের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ব্যাপার হলো -যখন শারীরিক ও মানসিক প্রতিটি সম্পদকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বিস্ময়করভাবে বেড়ে যায়।

প্রফেসর খাইরুল মামুন হক রাহনাফকে বলে দিলেন তার রিসার্চের সব ডকুমেন্ট কোথায় আছে। রাহনাফ সেগুলো নিয়ে মেইল করে দিলো নাসায়। আর নাসার বিজ্ঞানীরা এই সব কাজ করার জন্যে একটা রোবট নিয়ে নেন। রোবটকে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হলো। রোবট তার ম্যকানিক্যাল গতির জোরে তিন মাসের কাজ করে ফেললেন মাত্র তিন ঘন্টায়। বানানো হলো একটা ভাইরাস। যাকে মডিফায়ার করা ওই নিউক্লিয়ার ট্রির নেই। এই ভাইরাস গাছগুলোকে তো মেরে ফেলবে তার সাথে তাদের দেহ পচিয়ে পরিনিত করবে মাটিতে। ভাইরাসের ক্রোমোজোমের ডিএনএর কেমিক্যাল ফর্মুলা আর স্ট্রাকচার নাসার বিজ্ঞানীদের দেখানো হলে তারা ভাইরাসটা তৈরি করে ছড়িয়ে দিতে লাগলো। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এখন গাছগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা।

চলবে,,,,,,
#মাহফুজা আফরিন শিখা।

তবুও মনে রেখো পর্ব-০৪

0

#তবুও_মনে_রেখো।[০৪]

৯,
গ্রীন ভিলেজ রেস্টুরেন্ট এর সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছে রাহনাফ। পরনে তার হোয়াইট জিন্স আর ব্লু পাঞ্জাবি হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার প্রিয়তমার। প্রায় কুড়ি মিনিট পর একটা রিক্সায় করে মেহেরকে আসতে দেখা গেল। রহনাফ এগিয়ে যায় সেই দিকে। রাহনাফ রিক্সার কাছাকাছি আসতেই মেহের রিক্সা থামাতে বলে। রিক্সা থেমে যায়। রাহনাফ মেহেরের হাতে ফুলগুলো দিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় মেহেরের দিকে। মেহের রাহনাফের হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। রাহনাফের হাতে হাত রেখে রিক্সা থেকে নামে মেহের। মেহেরকে ছেড়ে রিক্সার বাড়া দেয় রাহনাফ। মেহের তখন অবাক হয়ে তাকায় রাহনাফের দিকে। রিক্সা চলে যেতেই রাহনাফ মেহেরকে বলে,
” চলুন ভিতরে যাই।”
মেহের মাথা নাড়ালো। অতঃপর দুজনে ভিতরে গিয়ে বসলো। ওয়েটার ডেকে খাবার অর্ডার করা হলো। তারপর দুজনে চুপচাপ বসে রইলো। রাহনাফ আড় চোখে মেহেরকে দেখে মুগ্ধ। মনে মনে বলল,
“প্রেয়সীর রূপের আগুন ঢাকার জন্য হলেও কালো শাড়ির আবরন প্রয়োজন।‌ না হলে প্রেমিক হৃদয় দহনে পুড়ে যাবে।‌”
রাহনাফের দেওয়া ফুলগুলো নাড়াচাড়া করে মেহের। রাহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আপনার লাল গোলাপ পছন্দ?”
” হ্যাঁ। কেন?”
” আমার কিন্তু কালো গোলাপ পছন্দ।”
” কালো আমার বরাবরই অপছন্দ। তবে আজ ভালো লাগছে।”
মেহের পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রাহনাফের দিকে। রাহনাফ মৃদু হেসে মাথা চুলকালো।

মেহের সেদিন বাড়ি ফিরে সোজা রুপা রুমে যায়। রুপা তখন বিছানায় বসে ডাইরির পাতায় কলমের আচড় আটছিলো। মেহেরকে দেখে একগাল হাসে রুপা ডাইরি রেখে বলে,
” খুব সুন্দর লাগছে তোকে মেহু।”
মেহের রুপার পাশে গিয়ে বসে। বলে,
” মামাকে মিছ করছো?”
” না।” অকপটে জবাব দেয় রুপা।”
” তাহলে ডাইরিতে কি লেখছিলে এতক্ষণ?”
” সে সব তো একান্ত আমার মনের অনুভূতি।”
“তোমার সব অনুভূতি তো মামাকে ঘিরেই।”

রুপা কিছু বলল না। এটা সত্যি যে তার সব অনুভূতিই তার খাইরুল ভাইকে নিয়ে। যখন থেকে রুপা বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই খাইরুলকে নিয়ে তার এই অনুভূতি। খাইরুলের অনুপস্থিতিতেই এই অনুভূতিগুলো বেড়ে উঠেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে প্রথম যেদিন খাইরুলের প্রতি অনুভূতি বুঝতে পারলো তখনি এগুলো পিষিয়ে মেরে ফেলা উচিৎ ছিলো তাহলে হয়তো এতটা কষ্ট তাকে পেতে হতো না। না চাইতেও আজ মন হিসাব কষে এত এত ভালোবাসার পরেও মন কি পেলো শুধু মাত্র অপেক্ষা ছাড়া। কষ্ট হয় রুপার। মনে হয় কেউ হৃদয়টাকে ছুড়ির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করছে আর সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বুকের ভিতরটায় কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নেয় রুপা। অধরে ফুটায় নকল হাসি। ডানহাতে মেহেরের গাল টেনে বলে,
” কেমন কাটলো প্রথম ডেট? ”
“ডেট!” এটা ডেট ছিলো? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মেহের।
রুপা হাসে। বলে,
” এত অবাক হচ্ছিস কেন? একটা সাধারণ ডেট নিয়ে।”
বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে যাওয় ডেটে যাওয়া এসব নিয়ে কোনদিনও মাথা ঘামায়নি মেহের। তবে মৌকে দেখেছে আলিহানের সাথে যখন প্রথম ডেটএ গেলো তখন যে কতটা এক্সসাইটেড ছিলো ফিরে এসে কতশত গল্প বলেছে তাদের প্রথম ডেট নিয়ে। তবে মেহেরের প্রথম ডেট এমন হবে এটা কি কখনো ভেবেছিলো সে। রুপার দিকে অসহায় মুখ করে বলল,
” এই সাধারণ ডেটটাই আমার জিবনে প্রথমবার খালা।”
” কেমন কাটলো তোর প্রথম ডেট?” রুপার ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলো মৌ। রুপা আর মেহের দুজনে মৌয়ের দিকে তাকায়। মৌ দরজায় হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেই একগাল হাসে মৌ। রুমের ভিতরে এসে মেহেরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” বলনা বল কেমন দেখলি রাহনাফকে?”
মাথা নিচু করে নেয় মেহের। মৌ মেহেরকে ছেড়ে রুপার পাশে গিয়ে বসে। রুপা মেহেরের হাত ধরে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় মেহেরের মুখের দিকে। বলে,
” কিসের ভয় পাচ্ছিস মেহু।”
আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় মেহের। রুপা মেহেরের দুইগালে হাত রেখে বলে,
” কাঁদছিস কেন মেহু। রাহনাফ তোকে কিছু বলেছে? বল আমাকে।”
মেহের অশ্রুসিক্ত নয়নে রুপার দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি খালা। আমার এতদিনের কঠোর মন ক্ষনিকের মধ্যেই দুর্বল হয়ে গেলো। প্রেম ভালোবাসা বিয়ে থেকে দূরে থাকবো বলে জিবনে কোনদিন কোন ছেলের সাথে মিশি নাই। এখনো পর্যন্ত আমার কোন ছেলে বন্ধু নাই। সেই স্কুল জিবন থেকে বাশার আমার পিছু ঘুরছে। কলেজে যাওয়ার সময় গলির মোরে ছেলেরা আমার অপেক্ষা করতো কোনদিন কাউকে পাত্তা দেইনি অথচ মাত্র কয়েকদিনের চেনা একটা ছেলের প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম।”
” কার কথা বলছিস তুই? কোন ছেলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিস? ” প্রশ্ন করলো মৌ।
মেহের চোখ বন্ধ করলো। চোখের কোল বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। দুঠোট কামড়ে ধরে অস্ফুটভাবে উচ্চারিত করলো সেই নাম,
” রাহনাফ।”
রুপা আর মৌ দুজনেই হাসলো। তাদের হাসির ঝলকে মুখরিত হলো পুরো রুম। সেই হাসির শব্দ শুনে সৈয়দা মাহবুবাও চলে এলেন রুপার ঘরের সামনে। দরজায় হেলান দিয়ে দৃষ্টি রাখলেন মেহেরের মুখের দিকে। রুপা বলল,
” বেশ তো। এখন দুর্বল কিছুদিন পর ভালোবাসবি।”
” ভালোবাসতে যে বড্ড ভয় হয় আমার।”
” কিসের এত ভয় তোর?”
মেহের চোখ তুলে তাকালো রুপার দিকে। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রুপার বুকটা ধুক করে উঠলো। তার চোখের ভাষা স্পষ্ট। মেহেরের কেন এত ভয় বুঝতে অসুবিধা হলো না রুপার। চোখ বন্ধকরে নেয় রুপা। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মেহেরের চোখে চোখ রেখে বলল,
” সব ছেলেরা এক হয়না মেহু। দুলাভাইয়ের সাথে সবার তুলনা করিস না। ভালোবাসা অনেক শক্তিশালী একটা শব্দ। এখানে না কোন কম্পিটিশন চলে আর না কম্পায়ার। বিশ্বাস সম্মান দায়িত্ব কর্তব্য দিয়ে ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। ভালোবাসা যদি নাই থাকতো তাহলে চারিদিকে এত এত ভালোবাসার মানুষ থাকতো না। এমনও প্রেমিকযুগল আছে যারা সব সুখের বিনিময়ে শুধু প্রিয় মানুষটাকে কাছে যায়। আপাকেই দেখনা, দুলাভাই চলে গেছে কত বছর হলো আপাকি কারো সাথে ঘর বাধতে পেরেছে। পারেনাই। কেন জানিস? কারন আপা দুলাভাইকে সত্যি ভালোবাসেছিলো। আজও তাকে ভালোবাসে তাই নতুন করে কারো সাথে ঘর বাধতে পারেনি। ভালোবাসায় কোন এক্সপেকটেশন রাখতে নেই। শুধু নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসো। মন প্রান উজার করে ভালোবাসো। সে তোমাকে নাইবা ভালোবাসলো। পৃথীবির সব পথে গন্তব্য থাকে না সব অংকের পূর্ণ সংখ্যার উত্তর থাকেনা।

মৌ আর মেহের দুজনেই অবাক হয়ে রুপার কথা শুনলো। রুপার চোখও জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুপা তারপর বলল,

“ভালোবাসার মতো সুন্দর অনুভূতি আর একটাও নেই। অথচ দেখো, ভালোবেসেই মানুষ নিঃস্ব হয়েছে, ভালোবেসেই মানুষ আত্মসম্মান হারিয়েছে, ভালোবেসেই মানুষ প্রতারিত হয়েছে, ভালোবেসেই মানুষ সব থেকে বেশি একা হয়েছে। ভালোবাসা জীবনে যা দেয়,তার থেকে অনেক বেশি নেয়। তারপরেও মানুষ ভালোবাসে,কাছে আসে, এক সাথে থাকে, ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও তার স্মৃতি নিয়ে বাঁচে। মানুষ সব থেকে বেশি নির্লজ্জ হয়েছে ভালোবেসেই। তারপরেও কিন্তু মানুষ ভালোবেসেই বাঁচার রাস্তা খোঁজে। ”

সৈয়দা মাহবুবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছেন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে নওশাদের মুখ। মনে পড়ছে নওশাদের সাথে কাটানো মুহূর্ত। মুখে যতই বলুক নওশাদকে তিনি ভুলে গেছেন তাকে ছাড়া ভালো আছেন আসলে কি সৈয়দা মাহবুবা ভুলতে পেরেছেন নওশাদকে। হোক ভালোবাসা কিংবা ঘৃনার জন্যে মনে তো পড়ে নওশাদকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাতের উল্টোপিঠে চোখের জল মুছেন সৈয়দা মাহবুবা। ধীর পায়ে চলে যান সেখান থেকে।

আমাদের মেয়েদের কত শত ইচ্ছা যে মনের গহ্বরে চাপা পড়ে থাকে তার হিসাব নেই। আমরা অভিমান করেও অনেক সময় তা প্রকাশিত হতে দিইনা। এমনকি নিজেরাই নিজেদের মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখি। একসময় সবশেষ হয়ে যায়, তখন নিরুপায় হয়ে আবার নিজেদের মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে নিজেদের দুঃখ ভোলার নাটক করি। কিন্তু প্রতিবাদ করে সঠিক সময়ে নিজেদের মনের ইচ্ছাগুলো প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি না সমাজ আত্মীয় পরিজনের চাপে।মৌ মেহেরের চোখের জল মুছে বলে,
” কাঁদিস না বোন। হয়তো এটা হওয়ারই ছিলো। রাহনাফের সাথে তুই খুব ভালো থাকবি দেখেনিস।”

মেহের ভেবেছিল রাহনাফের প্রতি তার দুর্বলতা ক্ষনিকের। তাই যতটা সম্ভব নিজেকে রাহনাফের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতো। তবে রাহনাফের কেয়ার দায়িত্ববোধ মেহেরকে বাধ্যকরে ভালোবাসতে। এখন রোজ রাতে নিয়মকরে তাদের কথা হয়। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও যাওয়া হয়। চাঁদনী রাতে কিংবা বৃষ্টিভেজা দুপুরে তাদের কথার ফুয়ারা যেন শেষই হয়না।

১০,
রাত এগারোটা।পুরো শহর ঘুমে নিস্তব্ধ। সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত ব্যাস্ত শহর। ফাঁকা রাস্তায় মাঝে মাঝে দুএকটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। আকাশে রুটির মতো গোলাকার চাঁদ তাকে ঘিরে হাজারো তারার মেলা। বারান্দায় বসে অফিসের কাজ করছে রাহনাফ। কোলের উপর ল্যাপটপ সামনেই সেন্টার টেবিলে মোবাইল মাউস আর এক কাপ কফি। একমনে ল্যাপটপে কিছু টাইপিং করছে রাহনাফ । চাঁদের জোৎস্নায় রাহনাফের মুখটা আরো সিগ্ধ লাগছে। বামহাতে কফির মগ ধরে দুই ঠোঁটে মাঝে বসিয়ে দিলো। কফির মগে চুমুক দিয়ে সেটা আবার সেন্টার টেবিলে রাখলো। ল্যাপটপে দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ল্যাপটপ বন্ধকরে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো। টাওজারের পকেটে দুহাত রেখে তাকিয়ে রইলো তারাভরা আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সেন্টার টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে কল করলো মেহেরের নাম্বারে। দুইবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করলো মেহের। বলল,
” সরি, একটু ব্যাস্ত ছিলাম।”
” কি করছো?”
” একটা স্পিচ তৈরী করছিলাম।”
” আচ্ছা, তাহলে পরে কল করছি।”
” না না। আমার শেষ হয়েছে। ”
” ও আচ্ছা ।”
এরপর দুজনেই নিরব। শুধু একে অপরকে অনুভব করায় ব্যাস্ত। কিছুক্ষণ পর রাহনাফ বলল,
” কাল কি আমাদের দেখা হচ্ছে।”
” না হচ্ছে না।”
” কেন?” চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস নিলো রাহনাফ।
” ভার্সিটিতে যেতে হবে তারপর ডিবেট ক্লাবে বিকালের দিকে মাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যেতে হবে। মোট কথা কাল দেখা হচ্ছে না।”
” আমার কথাটা একটু ভাবুন লেখিকা সাহেবা। আপনার ভালোবাসার অভাবে শুকিয়ে রুক্ষ মরুভূমি হয়ে যাচ্ছি আমি সে খবর কি রাখেন।”
রাহনাফের কথা শুনে মেহের হাসলো। রাহনাফ যেন চোখের সামনে মেহেরের হাসিমুখটা দেখতে পেলো। ডানহাতটা বুকের বা পাশে রেখে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বলল,
” এভাবে হাসবেন না লেখিকা সাহেবা। আমি যে খুন হয়ে যাবো।”
শব্দকরে হাসলো মেহের। বলল,
” আচ্ছা তাই বুঝি।”
” হ্যাঁ তাই।

রাহনাফ ও আলিহানের বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিলো ওদের দুই ভাইয়ের বিয়ে একসাথে দিবেন কিন্তু এতে বাধ সাধে মেহের। এই মুহূর্তে সে কিছুতেই বিয়ের জন্যে প্রস্তুত নয়। তাই আলিহান ও মৌয়ের বিয়ের দিন রাহনাফ আর মেহেরের রেজিট্রি করে রাখা হলো। মেহেরের পড়াশুনা শেষ হলে ওদের বিয়েটা সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি পাবে। মৌ বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। এবাড়িতে এখন শুধু সৈয়দা মাহবুবা রুপা আর মেহের। মেহের এখন পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত সময় পাড় করছে মাঝে মাঝে দু একটা ছোট গল্প লেখে পাঠিয়ে দেয় বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের ফেসবুক পেইজে সেগুলো আবার নিউজ পেপারে ছাপা হয়। রুপার জিবনটা সেই আগের নিয়মেই চলছে। বাড়ি কলেজ আর অপেক্ষা। তার এই অপেক্ষার অবসান কবে ঘুচবে জানে না। তবে কিছুদিন আগে খাইরুল ভাই ফোন করে ছিলেন রুপাকে। সেদিন তিনি বড্ড খুশি ছিলেন। তার গলার স্বরে যেমন উৎফুল্লতা ছিলো তেমনি ছিলো আকুলতা। আকুল কন্ঠে সেদিন বলেছিলেন,
” অনেক তো অপেক্ষা করলি রুপা। আর মাত্র দুটো মাস অপেক্ষা কর তারপরেই আমি ফিরে আসবো।”
রুপা সেদিন কোন কথা বলেনি। খাইরুল মামুনের কথা শুনছিলো আর নিরবে চোখের জল ফেলছিলো। তার সাজানো স্বপ্ন গুলো মুঠোবন্ধি বালির মতো ঝড়ে পড়েছিলো সেই স্বপ্নগুলো আবার ধুলিঝড়ের মতো ফিরে আসছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না রুপার। রুপার ভারি নিশ্বাসের শব্দ শুনে খাইরুল মামুন বলেছিলেন,

” কাঁদিস না রুপা। আজ আমার খুব খুশির দিন। এতদিন ধরে যে এনএম ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছিলাম আজ সেটা নাসায় পাড়িয়েছি। নাসার বিজ্ঞানীরা সেগুলোর বিভিন্ন পরিক্ষা করার পর পৃথীবির উপর এপ্ল্যাই করবে। তারপরেই আমার সাকসেস। বিজ্ঞানীদের নামের তালিকায় আমার নামটাও দেখা যাবে। আমার এই সাকসেসের দিনে তুই কাঁদবি। তুই কাঁদলে আমার বুকটা যে ভারি হয়ে উঠেরে রুপা। ”

সেদিনই ছিলো রুপাকে দেওয়া খাইরুল মামুনের শেষ কল। আজ প্রায় দু সপ্তাহ হলো রুপা তার খাইরুল ভাইয়ের কোন খবর জানেনা। গায়ের কম্বল সড়িয়ে উঠে বসলো রুপা। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। প্রতিটা সকাল জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাটিয়ে শুরু হয় ব্যাস্ত জীবনের আরও একটি নতুন দিন। ঋতু বিশেষে সকালের পরিবেশটা হয় ভিন্ন। শীতের সকাল বললেই প্রকৃতির রূপের এক অন্য চিত্র ভেসে উঠে আমাদের কল্পনায়।হেমন্তের অন্তে শীতের কোমল ছোয়া লাগে সর্বত্র। পৌষ, মাঘ মাসে কয়েকদিনের জন্য শীতের প্রবল প্রকোপ পড়ে, আর সেটার টের পায় আমরা শীতের সকালে। শীতের সকাল থাকে শীত এবং কুয়াশার চাদরে ঢাকা। সবকিছু খুব ঘোলা দেখায়। ঘাস ভেজা থাকে শিশিরে। সূর্য উঠলে শিশির ফোঁটা মুক্তোর মতো ঝরঝরে হয়। প্রাণীগুলিও অসহায় হয়ে পড়ে। তারা নিজেকে ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখে এবং বাইরের ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা। গায়ে চাদর জড়িয়ে দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখলো রুপা। এখনো সূর্যিমামার দেখা নাই। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুরো শহর।

১১,
বেলকনি ছেড়ে নিজের রুমে আসলেন সৈয়দা মাহবুবা। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে তার। সারারাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিয়েছেন রাতটা। রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারনে শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন সৈয়দা মাহবুবা। চোখদুটো বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরনো দিনের কথা। টাংগাইল শহরের দক্ষিণে এক মাধ্য গ্রামে থাকতো মাহবুবারা। ভৌগলিক অবস্থানের দিকে থেকে বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ। এই দেশের অভ্যন্তরের ছোট্ট একটি শহর টাংগাইল। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য টাংগাইলকে এক বিশেষ ঐশ্বর্য দান করেছে। উত্তর ও পূর্বে প্রাচীন লালমাটির উঁচু ভূমির ধ্যানমগ্ন পাহাড়। তার মধ্যে নানা উপজাতি লোকের বিচিত্র জীবন যাপন, গজারী, গামার, কড়ি, মেহগনি বৃক্ষরাজির সারি অনন্তকাল যাবত নামাজের জামায়াতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে সমতল ভূমি, তার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ছোট ছোট আঁকা বাঁকা নদী। পশ্চিমদিকে দুরন্ত যৌবনা বিশাল যমুনা নদী। নদীর মধ্যে মধ্যে অসংখ্য নতুন নতুন চর। চর তো নয় যেনো দুধের সর। সেখানে কূলে কূলে শিশুদের খেলা ঘরের মতো নিত্য নতুন ঘরবাড়ি নতুন জীবন। এ যেনো প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে বিজয়ী মানুষের উড্ডীন রাঙা পতাকা। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে একটা ছোট্ট গ্রাম এই গ্রামেই অবস্থিত একটা জমিদার বাড়ি। সময়ানুক্রমিক ও বংশপরম্পরায় এখনো টিকে আছে এই জমিদার বাড়ি। তবে এতে ছোঁয়া পেয়েছে আধুনিকতার। সেই সাথে পেয়েছে নগরের ছোঁয়া। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই এখানে গড়ে উঠেছে স্কুল কলেজ হসপিটাল মসজিদ মন্দির। এখানকার তাঁতের শাড়ি দেশ বিদেশে সনামধন্য। জমিদার বাড়ির কর্তা গ্রাম বাসির কাছে বড়বাবু আর কর্তাগিন্নি রানিমা। বড় বাবু আর রাণীমার চার সন্তান। এক মেয়ে আর তিন ছেলে। তিন ছেলের পর যখন কন্যা সন্তানের জন্ম হলো বড় সাহেব আদর করে তার নাম রাখলেন মাহবুবা। নামের মতোই অতি প্রিয় আদরে ছিলো মাহবুবা তার কাছে। মাহবুবার জন্মের পর সাতদিন জমিদার বাড়িতে খাওয়া দাওয়াত আয়োজন চলল। গ্রামের যত গরীব দুঃখী ছিলো বড় সাহেব তাদের সকলকে নতুন জামা কাপড় কিনে দিলেন। জমিদার বাড়িতে আয়োজন করা হলো যাত্রা পালা বিভিন্ন ধরনের নাটক ও সার্কেস খেলার। পুরো গ্রাম জুড়ে আনন্দে মেতে উঠেছিলো। বড় বাবুর খুব আদরের মেয়ে ছিলো মাহবুবা। স্কুলে পড়ার সময় শাকিলা ও রবিনের সাথে বন্ধুত্ব হয় তার। তাদের বন্ধুত্বটা ছিলো অন্তরের। তিনটি দেহে একটি প্রাণ। বন্ধুদের সাথে হাসি আনন্দ হৈ হৈল্লুর করে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠে মাহবুবা। কুমারী মাহবুবা একদিন বন্ধুদের সাথে মেলায় যায় পাশের গ্রামে। সেদিন সেই মেলায় এক সুদর্শন যুবককে প্রথম দেখায় নিজের মন দিয়ে বসে মাহবুবা। ধীরে ধীরে প্রণয়ের বাধা পরে দুজনে। তাদের এই প্রণয় থেকে পরিণয়ে পরিণত হতে বেশী সময় লাগে না। বড় বাবুর আদরের কন্যা ছিলো মাহবুবা তাই বড় বাবু তাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়। নওশাদের নামে নিজের দুটো কাপড়ের দোকান লিখে দেন তারপর ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে হাড়ি পাতিল সব দিয়ে দেন মাহবুবার শ্বশুর ঘরে। বড়বাবু যখন মাহবুবাকে শ্বশুর ঘরে পাঠালেন তখন মনে হলো কেউ বুকের ভিতর থেকে হৃদপিন্ডটা বের করে নিয়েছে। তবে কে জানতো বিয়ের চার বছরের মাথায় মাহবুবা আবার তার কাছেই ফিরে আসবে। আসলে মানুষ অতি সহজে যে জিনিসগুলো পেয়ে যায় সেগুলোর প্রতি মানুষের গুরুত্ব কম থাকে। সুখেই কাটছিলো মাহবুবা আর নওশাদের বিবাহিত জিবন। মাহবুবা যেদিন জানতে পারলো তার গর্ভে একটা প্রাণ আছে তার শরীরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে একটা ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে সেদিন শহর থেকে নওশাদের এক বন্ধু আসে তার নতুন বিবাহিত বউকে নিয়ে। সেদিনই বোধহয় মাহবুবার প্রতি নওশাদের অবহেলার বীজ রোপন হয়েছিলো। অবহেলা থেকেই জন্ম নেয় অভিমানের তারপর বিচ্ছেদ। নওশাদের এই অবহেলার মাহবুবার মনে একটু একটু করে অভিমানের পাহাড় তৈরী করে। একটা সময় তাদের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব তৈরী হয়। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলতো না। তারপর একদিন হঠাৎ করেই সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। নওশাদ তার বন্ধুর বউয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। খবরটা শুনার পর মাহবুবা স্তব্ধ পাথর হয়ে যা। কত চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তুতা ফিরে আসেনি নওশাদ তার কাছে। তার কিছুদিন পর মাহবুবা তার নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। পরিবারের কেউ কিছু না বললেও সমাজের মানুষ তাকে নিয়ে নানা কথা রটিয়েছে। অপমান করেছে লাঞ্ছনা দিয়েছে। সকলের সব অপবাদ সহ্য করে নিয়েছে মাহবুবা। মেহেরের জন্মের পর নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারপর একদিন মেহের আর মৌকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরের বুকে। মেহেরের জন্ম থেকে শহরের আসার প্রতিটা সময়ে মাহবুবার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন বড়বাবু। কখনো আর্থিক অনটনে পরতে হয়নি। সচ্ছলভাবে দুই মেয়েকে নিয়ে কাটিয়েছেন জিবন তবুও মাঝে মাঝে মন গভীরের থেকে কেউ যেন বলে উঠে ‘ নওশাদ’ যদি পাশে থাকতো। পরক্ষনেই নিজের মনকে ধমকে দেন। এতকিছুর পরেও কি করে তিনি নওশাদের সঙ্গ পাওয়ার ইচ্ছা করেন। দুচোখের কোল গড়িয়ে অশ্রু পড়তে লাগতো। নাক টেনে লম্বাশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন

“ভালোবাসার বিপরীতে সব সময় ঘৃণা থাকে না,থাকে অবহেলা।এই অবহেলাতেই মানুষ মরে‌। ধ্বংস হয়ে যায়।”

চলবে,,,,,,
#মাহফুজা আফরিন শিখা

তবুও মনে রেখো পর্ব-০৩

0

#তবুও_মনে_রেখো।[০৩]

৬,
চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছে রাহনাফ। হাতে একটা ফাইল যার ভিতরে ওর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমান। মানে সার্টিফিকেট। এই নিয়ে চারটা ইন্টার্ভিউ দেওয়া হলো। ডানহাতে গলার টাইটা একটু আলগা করে নিলো। আজকের আবহাওয়া বেশ থমথমে। আকাশে রোদের দেখা না থাকলেও গরম পড়েছে বেশ ভালোই। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে লম্বাশ্বাস নিলো রাহনাফ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় বিশ মিনিট অতিবাহিত
হওয়ার পরেও কোন রিক্সা পেল না। তাই ধীর পায়ে হাটতে লাগলো। কিছুদূর আসার পরেই পরিচিত একটা মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পরে রাহনাফ। মৃদু হেসে এগিয়ে গেলো তার কাছে।

ডিবেট ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। ছোটবেলা থেকেই যেকোন ডিবেটে অংশগ্রহণ করে সে। জিতেছে অনেক পুরষ্কার। পেয়েছে জাতীয় খ্যাতি। তাই ক্লাবে যে কোন ডিবেট প্রতিযোগীতার আগে তার ডাক পরে। আজও এসেছিলো তার জন্যেই। সামনেই জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতা তাই ক্লাব থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখতে লাগলো মেহের। তখন তার চোখ আটকে যায় রাহনাফের দিকে। রাহনাফ হাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। রাহনাফ মেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“হাই। কেমন আছেন? ”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
“এই তো ভালো। এখানে কি করছেন?”
“ক্লাবে আসছিলাম। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে আসলাম।”
“আচ্ছা” মেহের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো রিক্সা আসছে কি না। রাহনাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার মেহেরের দিকে তাকালো। আসলে এখন কি বলা উচিৎ সেটা বুঝতে পারছেনা সে। তবে কথা যে তাকে বলতেই হবে। এতদিন পর মেয়েটার দেখা পেয়েছে কিছু বলবেনা এমন হতে পারেনা। এই মুখটা একপলক দেখার জন্যে দিনরাত ছটফট করে তার মন। এত সহজে তাকে যেতে দেওয়া যাবে না। মেহেরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়। রাহনাফকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহের বলল,
“কি দেখছেন?
“আপনাকে?”
অবাক হলো মেহের। বলল,
” আজ কি প্রথম দেখছেন?”
” আপনাকে যখনই দেখি নতুন লাগে।”
“আচ্ছা।
“হ্যাঁ। চলুন সামনে হাটি এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো।
“হ্যাঁ চলুন। দুজনে পাশাপাশি হাটতে লাগলো। রাহনাফ বলল,
” গতকাল ভোরের আলো পত্রিকায় আপনার লেখা গল্প পড়ছিলো রাহি। আপনি কি লেখালেখি করেন?”
“একটু আকটু।”
“বই বের হয়েছে আপনার?”
“না । তবে খুব তাড়াতাড়ি হবে। ”
“একটা কথা রাখবেন লেখিকা সাহেবা?”
“বলেন।”
“আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা না হয় আমায় দিবেন।”
“এখনো বই নিয়ে ভাবিনি আর আপনি অটোগ্রাফ চাইছেন?”
“আমি তো বইতে আপনার অটোগ্রাফ চাইনি।
“তাহলে কোথায়?”
রাহনাফের খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো,
“আপনার প্রথম অটোগ্রাফটা আমাদের কাবিননামায় চাই লেখিকা সাহেবা।” কিন্তু মুখে বলতে পারলোনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো শুধু। মেহের তার হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো।মানুষটার হাসি সত্যিই অনেক সুন্দর। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মেহের। সামনের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসলো। ছেলেটা একটু বেশীই সুন্দর। আড়চোখে আপাদমস্তক দেখতে লাগলো মেহের।রাহনাফের পুরো মুখটা ঘামে একাকার। কিছু চুল কপালে লেপ্টে আছে। দাঁড়িগুলো ছোট ছোট করে কাটা। গালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। মেহেরে দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্যে স্থির হয়ে রইলো রাহনাফের গালের দিকটায়। মনে মনে বলল,”ছেলেটার সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো।” মুখে বলল,
” আজ একটু বেশীই গরম।”
“বেশীক্ষণ থাকবে না। মনে হচ্ছে এখনি বৃষ্টি নামবে।”
কিছুক্ষণ পর জোরে হওয়া বইতে শুরু করলো সাথে ঝিরঝিরি বৃষ্টি। রাহনাফ আর মেহের একটা দোকানে আশ্রয় নিলো। ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করলো। ইলশেগুঁড়ি থেকে মুশলধারায়। মেহের হাত বাড়িয়ে দিলো বৃষ্টি বিলাশ করতে। বৃষ্টির পানি পরছে মেহেরের হাতে। মেহেরের চোখ মুখে খুশির ঝিলিক। রাহনাফ সেইদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দেখতে লাগলো বৃষ্টিবিলাশী এই রমণীকে। মনের ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠলো,
“শহর জুড়ে বৃষ্টি নামুক।তুমি খুঁজে নিও ঠাই।প্রতিটি বৃষ্টির কণায় লেখা থাকুক, শেষ অবধি তোমাকে চাই।”

৭,
প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ ফোর ডি মডেলের সুপার কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন প্রফেসর খাইরুল মামুন। গভীর মনোযোগ সহকারে কম্পিটারের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। শুধু একটা সংকেত। একটা সংকেত পেলেই তার লক্ষটা আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তার এতদিনের স্বপ্ন আজ প্রায় পূরণ হতে যাচ্ছে। এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তাকে পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। নিজ দেশ, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে পরে আছে ইংরেজদের দেশে। আজ প্রায় ত্রিশ বছরের কাছাকাছি হবে ভাটির দেশে পা রাখেনি। আসলে দেশে ফিরার সময়টা হয়ে উঠেনি। এবার তার লক্ষে পৌঁছালে ফিরে যাবে নিজ দেশে।

পৃথিবী বদলে গেছে অনেক। অনেক এগিয়ে গেছে বিজ্ঞানও। গ্রাম বলতে এখন আর সবুজ শ্যামল ফিরোজা রুপালি দৃশ্য মেলেনা। শহর আর নগর সভ্যতায় ধ্বংশ হচ্ছে সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। শস্যশ্যামল মাঠ ঘাটে আজ তৈরী হচ্ছে বড় বড় কারখানা। যেখানে আর্টিফিশিয়াল কালচার মিডিয়ামে মানুষের খাবারের জন্যে শস্য উৎপাদন করা হয়। যাতে থাকে সেই পরিমান নিউট্রিসেন্স যা একজন মানুষের প্রয়োজন তার বাড়তি একটুও না। কলকারখানার ধোয়া বাতাশে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার কারনে রোগ জিবানুর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার অন্যতম কারন হলো প্রয়োজনীয় পরিমান অরন্যের অভাব। কার্বনডাইঅক্সাইড থেকে অক্সিজেন এ রুপান্তর করার জন্যে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের পাওয়ার প্ল্যান্ট আবিষ্কার করছে। যা সূর্যের আলো আর বাতাশ থেকে কার্বনডাইঅক্সাইড শোষন করে প্রচুর পরিমানে অক্সিজেন দেয়। এই পাওয়ার প্ল্যান্ট বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে তবুও এতে যেন আমরা প্রয়োজনীয় পরিমান অক্সিজেন পাচ্ছি না। এজন্যে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এমন একটা আবিষ্কারের কথা বলেন যা অসম্ভব কে সম্ভব করবে। যা দিয়ে পৃথীবির পুরো বায়ু মন্ডলকেই পাল্টে দেওয়া যাবে।

প্রফেসর খাইরুল মামুন হক প্রায় তেইশ বছর যাবৎ যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছেন তা হলো এনএম ট্রি। Nucleus Modifier tree. যেই গাছ তার ক্ষমতা বলে পরমানুর নিউক্লিয়াস বিভাজন করে পদার্থের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের যে সিংহভাগ কার্বনডাইঅক্সাইড আছে তাকে শোষন করে অক্সিজেন বানিয়ে নিতে পারবে ওই গাছ। অবশিষ্ট কার্বনকে নিউক্লিয়াস বিভাজন ঘটিয়ে পরিণত করবে হাইড্রোজেন এ, যা থেকে পরিণত হবে পানি। শুধু তাই নয়, এই গাছগুলোর উচ্চতা রাখা হবে হাফ কিমি। ফলে এই ধরনের গাছ থেকে পৃথিবীর ধূলিঝড় থেকেও আড়াল পাওয়া যাবে।

রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ। প্রফেসর খাইরুল মামুন তার কম্পিটারে শেষমেশ এনএম ট্রির ডিএন এ বিটা ভার্সনের নয়শত সাতাত্তরটা বাগ ফিস্কিং করার কাজে সবে মাত্র শেষ করে ফেললেন। তার সুপার কম্পিটারের ফোর ডি মডেলে সুন্দর ভাবে দেখাচ্ছে কিভাবে সময়সাপেক্ষে বেড়ে উঠবে গাছটা। না আর কোন ভুল নেই।চার হাজার তিনশত আটাশিটা ক্রোমোজোম তাতে আরো কয়েকলাখ জিন সব নির্ভুল। এবার ঘুৃমাতে যাওয়ার পালা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন খাইরুল মামুন। লম্বা হাই তুলে ল্যাব থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

ঘুমানোর জন্যে চোখ দুটি বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক মায়াবিনীর মুখ। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন,

” শূন্যতা একদিন পূর্নতা পাবে ইনশাআল্লাহ। শুধু সময়ের অপেক্ষা”

উঠে বসলেন খাইরুল মামুন। সেন্টার টেবিল থেকে মোবাই নিয়ে কল দিলেন তার প্রিয়সীর নাম্বারে। দুই বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো।
“কেমন আছিস রুপা?”
অতি প্রিয় সেই গম্ভীর কন্ঠটা শুনে চোখ বন্ধকরে ফেলল রুপা। চোখের কোল বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করেই রুপা বলে,
“খাইরুল ভাই।”
বুকের বা পাশটায় তীক্ষ্ণ এক ব্যাথা অনুভব করলেন খাইরুল মামুন। দীর্ঘ সময় নিয়ে বললেন,
“রুপা।”
দুজনের বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলো। মনে তাদের হাজারো কথার ফুয়ারা কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছেনা। শুধু একে অপরকে অনুভব করায় ব্যস্ত তারা। মৌনতা ভেঙে খাইরুল মামুন বললেন,
“কি করছিস রুপা?”
” তোমার ফেরার অপেক্ষা করছি খাইরুল ভাই।”
কথাটা খাইরুল মামুনের বুকে আঘাত করলো। চোখ বন্ধ করলেন তিনি। বললেন,
” আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যাস। তোর এই অপেক্ষার অবসান ঘুচবে তবে।”
” অবশেষে তুমি ফিরবে?”
” ফিরতে তো আমাকে হবেই রুপা।”
” আর কতদিন অপেক্ষায় প্রহর কাটাবো আমি।”
” এইবার বসন্তে ফিরবো যে।”
” এই বসন্তে।” বলেই মৃদু হাসলো রুপা। হাসলেন খাইরুল মামুনও। রুপার হাসি মুখটা কল্পনা করলেন তিনি। বললেন
“হাসছিস রুপা।”
রুপা কিছু বললো না। এই চৌত্রিশ বছর বয়সে এসেও সে টিন এজ আরদের মতো লজ্জার মাথা নুইয়ে নিলো। চোখ মুখে লজ্জার লাভা ফুটে উঠলো। খাইরুল মামুন যেন তার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে ভারি খুশি হলেন। মৃদু হেসে বললেন,
“একি রুপা তুই লজ্জা পাচ্ছিস?”
“খাইরুল ভাই।”
“বিয়ের পরও কি আমায় ভাই ডাকবি?”
“তোমাকে বোধহয় আর বিয়ে করা হবেনা খাইরুল ভাই?”
“এটা কেমন কথা বলছিস রুপা?
” ভুল বললাম কি?”
” আমার দেশে ফিরার একমাত্র কারন তুই।”
“এমন কথা বলো না,যার জন্য নিজেকে আফসোস করতে হয়। মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারে, শুধু নিতে পারে না কথার ভার, ভুলতে পারে না কথার মার। ছোট্ট একটা কথার মারেই তো কত মানুষ জীবন থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। তোমাকে ভালোবেসে দুই যুগ ধরে অপেক্ষ করছি খাইরুল ভাই। বিয়ের জন্যে তো আমৃত্যু অপেক্ষা করতে হবে। তুমি দেখে নিও খাইরুল ভাই, তোমার আর দেশে ফিরে আসা হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, যদি অন্তর থেকে কাউকে ভালোবাসো তাহলে বেদনা প্রাপ্তি নিশ্চিত।” এই ভালোবাসার সম্পর্কটা ঠিক দাঁড়িপাল্লার মতো। দুদিককে সমান সমান ভার না চাপালে ব্যালেন্স যেমন সমান থাকে না, তেমনি জীবনের দাঁড়িপাল্লাতো দুজনের প্রচেষ্টা আন্তরিক এবং সৎ হতে হবে না হলে ব্যালেন্স ঠিক থাকবে না। এই কারণেই সঙ্গী বা সঙ্গিনী সৎ এবং আন্তরিক না হলে আঘাতপ্রাপ্তি এবং দুর্ঘটনা ঘটা নিশ্চিত। বিশ্বাস শব্দটা খুব ছোট হলেও বাস্তবে খুব ভারী। তাই সঠিক মানুষকে বিশ্বাস না করলে জীবনে প্রতি পদে বিনা অপরাধে চরম আঘাত সহ্য করতে হয়।শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ হলো হৃদয় যেখানে স্থান পাওয়ার অধিকার সকলের থাকে না। আমি তোমাকে আমার হৃদয়ে স্থান দিয়েছি খাইরুল ভাই তাই হয়তো আমার অপেক্ষার প্রহর এত ভারী।”
“তুই কি বলতে চাইছিস, আমি তোকে তোর মতো করে ভালোবাসিনি।”
“হয়তো, আবার হয়তো না। তুমি সবসময় নিজেকে গুরুত্ব দিয়েছো। তাইতো এই আটাশ বছরে একবারের জন্যেও দেশে ফিরোনি। সবসময় বলে এসেছে আমার রিসার্চটা শেষ হলেই চলে আসবো। যেটা আজও শেষ হলো না। আচ্ছা খাইরুল ভাই তোমার গবেষণা শেষ হবে তো।”
খাইরুল মামুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” নিজেকে নিঃশেষ করে কাউকে কিছু দিতে নেই। নিজের জন্যে কিছু রাখতে হয়। তোকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছি নিজের বলতে আছে শুধু এই স্বপ্নটা। এটা না থাকলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবরে রুপা।”
“আমি খুব বোকা বুঝলে খাইরুল ভাই। নিজের মূল্য নিজেকেই দিতে হয়। অন্যকেউ দিবে এমনটা আশা করাই বৃথা।”
” রাগ করছিস। ভালোবাসার জমিতে ভালোবাসাই চাষ হোক। অবহেলা নয়, ভালোবাসা থাক।”
অঝর ধারায় জল পড়তে লাগলো রুপার চোখ থেকে। কল কেটে মোবাইল বিছানার উপর রেখে বালিশের নিচ থেকে ডাইরি বের করলো। ডাইরিতে হাত বুলিয়ে চোখের পানি মুছে কলমের আচর কটলো,
“অভিমানী মন করে অকারণ,
আশায় এই প্রতীক্ষা।
বুঝবে একজন
তার অভিমান।
ঘুচে যাবে সব অপেক্ষা।
সময় বড় নিষ্ঠুর
সুযোগ দেয় না ভরপুর,
করে নির্মম প্রহার;
অভিমান জমে গিয়ে
প্রস্তরে রূপান্তরিত হয়ে;
আঁচড় কাটাই হয় দুষ্কর।
কত অব্যক্ত যন্ত্রণা
কত স্বপ্ন হারিয়ে যায় সময় কালে।
বোকা মন শুধু খুঁজে ফিরে তবু,
কেউ একজন আসবে বলে।
যদি আর না ফিরে আসো
আমায় তবুও মনে রেখো।”

৮,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর ওই আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে মেহের। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির ছিটা এসে পড়ছে মেহেরের চোখমুখে। সেদিকে হুস নেই তার। আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে ভাবছে এটা কি আধো হওয়ার ছিলো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। আজ সকালে আলিহানের বাড়ি থেকে মৌয়ের জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। সেখানে রাহনাফ ও তার বাবা মাও ছিলো। মূলত আলিহান আর রাহনাফরা যৌথ পরিবার।যেহেতু আলিহান আর মৌ একে অপরকে পছন্দ করে তাই কোন কথা কিংবা চাওয়া পাওয়ার বিষয়টা উঠে নি। বিয়ের দিন তারিখ সবই ঠিক হয়। আনন্দে মেতে উঠে মেহের। মৌকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“শেষ পর্যন্ত তুই ও তোর ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাবি। আর মাত্র কয়েকটা দিন।”
মৌ লজ্জায় মাথা নিচু করে মৃদু হাসে। আলিহান সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।তার মুখেও হাসির রেখা। রাহনাফ এবাড়িতে আসার পর থেকেই মেহেরকে দেখছিলো। মেহেরের উপর থেকে তার চোখ যেন সরছিলোই না। এই ব্যাপারটা খেয়াল করে রাহনাফের বাবা আরমান হাসান। তিনি সৈয়দা মাহবুবাকে বলেন,
“আমার কিছু বলার আছে।”
সৈয়দা মাহবুবা আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন,
“হ্যাঁ বলুন।”
আরমান হাসান একবার মেহেরের দিকে তাকান তারপর রাহনাফের কাধে হাত রেখে বলেন,
” ছেলে হিসাবে আমাদের দুটো ছেলেই রত্ন। আলিহান যেহেতু আপনার বড় মেয়েকে পছন্দ করেছে এই ব্যাপারে আমাদের পরিবারের কোন দ্বিমত নেই। তবে আমাদের এই ছেলের জন্যে আপনার ছোট মেয়েকে চাচ্ছি।”
আরমান হাসানের কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকায়। মেহের ও রাহনাফ একে অপরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আরমান হাসান যে এমন একটা প্রস্তাব দিবে সেটা কেউই ভাবতে পারেনি। রাহি হেসে বলে,
” ভাইয়ার সাথে মেহের আপুর দারুন মানাবে।”

রাহনাফ রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে মেহেরের দিকে তাকায়। মেহেরের চোখমুখে বিরক্তি। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৈয়দা মাহবুবার দিকে। হয়তো সৈয়দা মাহবুবার মতামত জানতে চায়ছে সে। রাহনাফ আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” বাবা, এসব তুমি কি বলছো। আমরা এখানে আলিহানের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছি আমার জন্যে নয়।”
আরমান হাসান রাহনাফের কাধে রাখা হাতটা পিঠে নামিয়ে নেন। রাহনাফের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন,
” কেন তোর এতে আপত্তি আছে? দেখ মেহেরকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই তোর আপত্তি থাকলেও শুনবোনা।”
রাহনাফ কোন জবাব দেয়না না নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার বাবার মুখের দিকে। রাহনাফের মা বলেন,
” মেহেরকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। আপা আপনি না করবেন। আমার ছেলেটা খুব দায়িত্ববান। আপনার মেয়েকে যত্নে রাখবে।”
সৈয়দা মাহবুবা একবার মেহেরের দিকে তাকালেন। মেহের তখন ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরের চোখে চোখ পড়তেন মুচকি হাসলেন সৈয়দা মাহবুবা। তারপর আরমান হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আপনাদের দুটো ছেলেকেই আমার বেশ পছন্দ। মেহেরের সাথে রাহনাফের বিয়েটা হলে মন্দ হয়না।”
সৈয়দা মাহবুবা কথা শুনে সকলে বেশ খুশি হলেন শুধু মাত্র মেহের ছাড়া। মৌ দুহাত তুলে বলল আমিন। আলিহান একহাতে রাহনাফকে জড়িয়ে ধরলো। রাহনাফের দৃষ্টি তখন অপর পাশে বসে থাকা রমণীর দিকে। মেহের চোখ ছোট ছোট করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার মায়ের এই সিদ্ধান্তে খুশি নয় সে। রাহনাফের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্ট আরো গাঢ় করলো।

মাথায় শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে ভাবনার ছেদ ঘটে মেহেরের। কোনদিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো কে হতে পারে। বুঝবেই না কেন? ছোট থেকে এই একটা হাতই তো তাকে আগলে রেখেছে। সুখের সঙ্গী আর বিপদে ঢাল হয়ে পাশে থেকেছে। গাঢ় অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে মেহের বলল,
“এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে মা?”
সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
” রাহনাফ খুব ভালো ছেলে। তোকে অনেক ভালো রাখবে।”
” কিন্তু আমি যে তার সাথে থাকার চেয়ে তোমার সাথে বেশী ভালো থাকবো মা।”
সৈয়দা মাহবুবা হাসেন। বলেন,
” স্বামির যত্ন পেলে আমায় ভুলে যাবি।”
মায়ের কথা শুনে মেহেরের রাগ হয়। গলার স্বর শক্ত করে বলে,
” কেন সবসময় শুধু অন্যের কথা ভাবো বলতো। একবার কি নিজের জন্যে ভাবতে পারোনা। মৌয়ের বিয়ে হলে এ বাড়ি ছেলে চলে যাবে। মামা ফিরে এলে রুপা খালাও চলে যাবে। আমাকেও বিয়ে দিয়ে তাড়াতে চাও। তোমার কি হবে তখন? একা একা কি করে থাকবে তুমি মা। এখন বলোনা যে, সবাই যেভাবে থাকে সেই ভাবেই থাকবে। তোমার সাথে সবার তুলনা হয়না মা। সবার জীবনে জীবন সঙ্গী আছে তোমার নেই। যৌবনে যে পুরুষ ভালোবেসে আদর করে বুকে আগলে রাখে বৃদ্ধ বয়সে সে হয় বেচে থাকার শক্তি, অবলম্বন। একে অপরের কষ্টের ভাগিদার হয় তারা। আচ্ছা মা জিবন নিয়ে তোমার আফসোস হয়না?”
মেহেরের কথা শুনে দুচোখ সিক্ত হয়ে উঠে সৈয়দা মাহবুবার। তিনি জানতেন ঠিক এই কারনেই মেহের বিয়ে করতে রাজি হবে না। কিন্তু তা কি করে হয়। বিয়ে তো মেহেরকে করতেই হবে। রাহনাফের চেয়ে ভালো ছেলে বোধহয় মেহেরের জন্যে আর পাবেনা । সৈয়দা মাহবুবা বলেন,
” আমার জিবন থেকে আমি যা পেয়েছি তাতেই খুশি। তোর মতো একটা মেয়ে পেয়েছি যে আমার সব সময় খেয়াল রাখে এটা কি আমার কম বড় পাওয়া বল।”
মেহের সৈয়দা মাহবুবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” তোমার মতো করে তোমার খেয়াল রাখতে পারি কই? প্লিজ মা বিয়েটা ভেঙে দাও।”
“এটা হয়না মা। এমনটা বলিস না। আমাকে তোর কাছে অপরাধী করে দিস না। এখন যা ঘুমা। আর হ্যাঁ কাল কিন্তু রাহনাফের সাথে দেখা করতে যাবি।”
“মা,,,
“আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। আমার সিদ্ধান্ত বদল হবে না। বিয়ের জন্যে তৈরী হয়ে যা।”
সৈয়দা মাহবুবা নিজের ঘরে চলে যান। মেহের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অন্ধকারছন্ন বৃষ্টিভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,
“আমরা সবাই সার্থপর মা। কেউ নিজেকে ভালো রাখতে সার্থপর হয় আর কেউ আপনজনদের ভালো রাখতে স্বার্থপর হয়। তবে সত্যি এটাই আমরা সবাই স্বার্থপর।

পরেরদিন বিকালবেলা, মেহের বারান্দায় বসে আনা ফ্রাঙ্কের ডাইরি বই পড়ছে। বইয়ের পাতায় তার এতটাই মনোযোগ যে সেই কখন মৌ তাকে এক কাপ চা দিয়েছে যেটা এখন ঠাণ্ডা হয়ে শরবতে পরিণত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত চায়ের কাপে এক চুমুক ও দেওয়া হয়নি। একমনে বই পড়ছে। মাঝে মাঝে নিজেকে আনার সাথে তুলনা করছে। ইহুদীদের প্রতি তৈরী করা এডলফ হিটলারের নিয়ম কানুন ওর তাদের উপর হওয়ার হিটলারের অত্যাচারের কথা যতবার পড়ছে ততবারই হিটলারের প্রতি ঘৃনায় মনটা ভরে উঠছে। আনার জন্যে কষ্ট হয় খুব। ফুটফুটে সুন্দর চঞ্চল একটা মেয়ের কি করুন পরিণতিই না হয়েছিলো। কষ্টে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে।নিজের মনকে শক্ত করে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দেয় মেহের।

মৌ এসে মেহেরের সামনে থেকে বইটা ছিনিয়ে নেয়। মেহেরের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় মৌয়ের উপর রাগ হয় মেহেরের। মৌয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন কিছু বলবে তার আগেই মৌ বলে উঠে,
“আম্মু তোকে ডাকছে।”
“কি দরকার।”
“সেটা গেলেই দেখতে পারবি।” মিটিমিটি হাসে মৌ।
” হাসছিস কেন?”
” এমনি, এখন চল তো চল আম্মু অপেক্ষা করছে।”
মেহের আর মৌ সৈয়দা মাহবুবার রুমে যায়। মেহেরকে দেখে সৈয়দা মাহবুবা বললেন,
” আয় বস এখানে।” মেহের বিছানায় বসলো। সৈয়দা মাহবুবা আলমারি থেকে একটা কালো শাড়ি বের করে মৌয়ের হাতে দিয়ে মেহেরকে বললেন,
” গ্রীন ভিলেজ রেস্টুরেন্টে রাহনাফ তোর জন্যে অপেক্ষা করবে। মৌ এই শাড়িটা ওকে পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি তো।বাসায় তো সারাক্ষণ খালাম্মা সেজে থাকে। আজ একটু সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি।”
মৌ হেসে বলে,
” তুমি একদম চিন্তা করোনা আম্মু। এমন সুন্দর করে সাজিয়ে দিবো যে আমার দেবরটা চোখই ফেরাতে পারবেনা।”
মেহের কড়া চোখে মৌয়ের দিকে তাকালে মৌ বলে,
” দেখছো আম্মু কেমন করে তাকাচ্ছে।”
সৈয়দা মাহবুবা হাসলেন। মেহেরের গালে হাত বুলিয়ে বললেন,
” তোরা যা এখান থেকে। মৌ ওকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি। রাহনাফ আসলো বলে।”
মৌ বলল,
” রাহনাফ কি বাড়িতে আসবে?”
” না রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করবে।”
সৈয়দা মাহবুবা মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় বসেন। মৌ আর মেহের চলে যায়। রুমে এসে বিছানায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নেয় মেহের। মৌ মেহেরের কাধে হাত রাখে। মেহের বলে,
” এই রাহনাফকে আমি ছাড়াবোনা।”
” ছাড়তে বলছে কে? ভালোবাসার শিকলে বেধে ফেল।”
মৌ হাসে আর বলে। মেহের কড়া চোখে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
” খুব মজা লাগছে তাইনা।”
“একদম। এখন উঠতো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
মেহের উঠে দাঁড়ায়। তারপর রেডি হয়।
পরনে কালো শাড়ি আর খোলা চুল। দুহাত ভর্তি কালো চুড়ি কানে ঝুমকো চোখে গাঢ় কাজল। দেখতে অপরুপ লাগছে মেহেরকে। মৌ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আজ তো রাহনাফ তোর প্রেমে পড়বেই পড়বে।”

চলবে,,,,,,
মাহফুজা আফরিন শিখা।

তবুও মনে রেখো পর্ব-০২

0

#তবুও_মনে_রেখো। [০২]

৪,
ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে ঘুম ভাঙে মৌয়ের। অলসতা কাটিয়ে উঠে বসে সে। কাধে হাত রেখে মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে নেয়। পাশে তাকাতেই মেহেরের ঘুমন্ত মুখখানা দেখতে পায়। একহাত বালিশে অন্যহাত পেটের উপর রেখে ঘুমাচ্ছে। মেহেরের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মৌ। কতটা নিষ্পাপ আর আদুরে লাগছে তাকে। মৃদু হেসে মেহেরের গাল টিপে দিলো। ঘুমের ঘোরেই নাক চোখ কুচকালো মেহের। হাত সড়িয়ে নিলো মৌ। কাল সারারাত ঘুম হয়নি তার। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটেছে তার রাত। চারদিন হলো তারা গ্রামে এসেছে। সেদিন নানার অসুস্থতার কথা শুনে সকলে গ্রামে ছুটে আসে। গতকাল আলিহানের সাথে কথা হয়েছে তার। এভাবে না জানিয়ে আসার জন্যে তার উপর বেশ রেগে আছে আলিহান। ঠিকমতো কথাও বলে নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়লো মেহের। চারিদিকে তখন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। সোনার রবি দেখা যাচ্ছে পূব আকাশে। পাখিরা দল বেধে গান গেয়ে উড়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। মৌ উঠোনে এসে দাঁড়ালো। অনেক জায়গা জুড়ে বিভিন্ন সবজি গাছ লাগানো আছে তাতে আবার হরেক রকম সবজি ঝুলছে। প্রশান্তিতে ভরে গেলো মন। শহরে এমন দৃশ্য দেখাই যায়না। যদিও কেউ কেউ ছাদে সবজির চাষ করে। তবে শহুরে মানুষ ছাদে সবজির চেয়ে ফুলের চাষ করতে বেশী পছন্দ করে। মৌ পুরো বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো এমন সময় পিছন থেকে মামি বললেন,
” এত সকাল সকাল বাগানে কি করস মৌ।”
” কিছু না মামি। এমনি ঘুরে দেখছিলাম।” মৃদু হেসে জবাব দিলো মৌ।”
” সেই যে শহরে গেলি আর তোর দেখা পাওন গেলো না। রবিন মাঝে মাঝে আইসা আমাদের উপর চেঁচামেচি করতো। তোর ঠিকানা চাইতো।”
মামির কথা শুনে মৌ’য়ের হাসি মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলে। মৌ বলল,
” আমার ঠিকানা দিয়ে সে কি করবে?”
” তোরে ফিরিয়া আনবার চাইতো। ওর নাকি তোরে ছাড়া ভালো লাগে না এখন। একা একা কার ভালো লাগে?”
মৌয়ের ভালো লাগছিলো না এসব কথা শুনতে। সে মামিকে বলল,
” যখন কাছে থাকতে চেয়েছিলাম তখন কেন দূরে সড়িয়ে দিলো? তখন সে আমার কথা ভাবেনি।”

কথা শেষ করে উল্টোদিকে রাস্তায় হাটতে থাকে মৌ। পুরোনাম সামিরা জান্নাত মৌ। এটাই ওর গ্রাম। এখানে জন্ম এখানেই শৈশব কাটিয়েছে সে। মৌয়ের মা শাকিলা আর মাহবুবা ছেলেবেলার বন্ধু। শাকিলা আর রবিন একে অপরকে ভালোবেসে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে। বছর তিন যেতেই সন্তানসম্ভবনা হয় শাকিলা। শাকিলা বয়স তখন কত? ষোলো কিংবা সতেরো। গর্ভঅবস্থায় নানা জটিলতা দেখা দেয় তার। ডক্টর তাকে গর্ভপাত করাতে বলে না হলে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি আছে। রবিন রাজি হলেও রাজি হয়না শাকিলা। সে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবে জেদ করে বসে। এটা নিয়ে অনেক ঝামেলাও হয় শাকিলা আর রবিনের মাঝে। তাদের এই ঝামেলার ইতি ঘটে মৌয়ের জন্মের সময় শাকিলার মৃত্যু দিয়ে। সদ্য জন্ম নেওয়া মৌ তার বাবার কাছে হয়ে উঠে মায়ের খুনি। মুখও দেখেনি রবিন তার নবজাতক সন্তানের। শাকিলাকে হাড়িয়ে রবিন হয়ে উঠে পাগল প্রেমিক। দিনের বেলা রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখতো কারো সাথে কথা বলতো না আর রাতভর মদ খেয়ে কখনো পরে থাকতো রাস্তার ধারে আবার কখনো তাকে পাওয়া যেতো শাকিলার কবরের পাশে। তখন সেই নবজাত শিশু মৌকে মাহবুবা আর নওশাদ বুকে টেনে নেয়। তাকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করতে থাকে। তার দুবছর পর মাহবুবা সন্তানসম্ভবনা হয়ে পরে। সেই অবস্থায় নওশাদও তাকে ছেড়ে চলে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় মাহবুবার জিবন। বাড়ির এক কোনে অনাদরে অযত্নে বড় হতে থাকে মৌ। মৌ এর বয়স যখন ছয় বছর তখন সে তার বাবার কাছে চলে যায়। রবিনের তখনো মেয়ের উপর থেকে রাগ পরেনি। সে কারনে অকারনে মৌয়ের গায়ে হাত তুলতো। ঠিকমতো খেতে দিতনা।তাই ফিরে আসে মাহবুবার কাছে মৌ। তারপর একদিন মাহবুবা তাকে আর মেহেরকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরের বুকে। সেখানে সে সৈয়দা মাহবুবার সন্তান হিসাবে বড় হয়ে উঠে। ভালোই কাটছিলো তাদের শহুরে জিবন। সৈয়দা মাহবুবা যখন চাকরি জয়েন করলো তখন তাদের দেখা শুনার জন্যে একজন মাধ্যবয়স্ক মহিলাকে রাখা হলো। কারন দুটো বাচ্চা বাড়িতে একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। সারাদিন খেলাদুলা আর খুনসুটিতে কেটে যাচ্ছিল তাদের সময়। সময় প্রবাহমান, সে বদলায়। কারো জন্যে থেমে থাকেনা। বড় হতে লাগলো মৌ আর মেহের একে অপরের বোন, বন্ধু হয়ে। একদিন হঠাৎ করেই রুপা ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির হয় সৈয়দা মাহবুবার বাড়ি। সৈয়দা মাহবুবা তখন মৌ আর মেহেরকে পাড়াচ্ছিলেন। রুপাকে দেখে মেহের আর মৌ যেমন খুশি হয়েছে তেমনি অবাক হয়েছিলেন সৈয়দা মাহবুবা। তিনি ওদের দুজনকে নিজেদের ঘরে যেতে বললে ওরা চলে যায়। রুপা সৈয়দা মাহবুবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
” তোমার এই চোট্ট বাড়িটায় আমার আশ্রয় হবে না আপা? ”
সৈয়দা মাহবুবা অবাক হয়নি। সে রুপাকে একনজর দেখে বললেন,
” বাড়িতে ফিরে যায় রুপা। এটা তোর পাগলামির বয়স নয়।”
” আমি আর ওই বাড়িতে যাবো না আপা।”
” কেন যাবিনা।”
” সবাই আমাকে বিয়ের জন্যে জোর করছে কিন্তু তারা জানেনা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। খাইরুল ভাইকে আমি কথা দিয়েছি আপা। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো না।”
” খাইরুল কি তোকে কথা দিয়েছে?
” না। সে শুধু জানতে চেয়েছে, আমি অপেক্ষা করতে পারবো কি না।”
” কতদিন?”
“বলেনি।”
“তাহলে কার জন্যে অপেক্ষা করবি তুই রুপা। কিসের উপর ভরসা করে থাকবি তুই?”
” আমার ভালোবাসার উপর। সে কোন দিন ফিরে না আসলেও আমি অপেক্ষা করবো। ভলোবাসি তাকে। আপা, দেখো আমার এই প্রতিক্ষাই তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
সৈয়দা মাহবুবা কিছুক্ষণ রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কতটা বিশ্বাস ভরসা নিজের ভালোবাসার উপর। অথচ কোনদিন হাতে হাত রেখে হাটেনি একাকি নির্জন রাস্তায়, ঘুরেনি কোনদিন বসে হুডখোলা রিক্সায়। চোখে চোখ রেখে কখনো বলা হয়নি ভালোবাসি প্রিয় তোমায়। তবুও কতটা বিশ্বাস করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সৈয়দা মাহবুবা।

__________________
মেহেরের ঘুম ভাঙে মুঠোফোনের শব্দে। বিছানা হাতরে মোবাইল হাতে নিয়ে স্কিনে তাকায়। স্কিনের উপর জ্বলজ্বল করছে মামু নামটা। ঘুম ছুটে যায় মেহেরের। অধরে ফুটে হাসি। কল রিসিভ করে অভিমানী সুরে বলে,
” এতদিনে আমার কথা মনে পরলো তোমার মামা?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
“তুমি তো সমসময়ই ব্যস্ত থাকো।”
“হ্যাঁরে পাগলি। কেমন আছিস বল?”
” ভালো আছি মামা। তুমি দেশে আসবে না? প্লিজ মামা ফিরে এসো। রুপা খালা আজও তোমার অপেক্ষায় দিনগুনে।”
ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন খাইরুল মামুন। বলেন,
” রুপাকে বলে দিস, সে যেন আমার জন্যে আর অপেক্ষা না করে।”
“কেন করবে না মামা? তুমি কি তাহলে আর আসবেনা?”
“জানিনা।”

খাইরুল মামুনের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় মেহের। মেহেরের খুব কষ্ট হয়। কষ্টে চোখে জল আসে। মামা তাহলে আসবে না। রুপা খালা কি তাহলে সারাজীবন শুধু অপেক্ষা করেই যাবে। বুকের ভিতরে ভিষন যন্ত্রণা অনুভব করে মেহের। রুপা খালাকে সে কি বলবে? মামা আর কখনো ফিরে আসবে না তুমি বিয়ে করে নাও। না। এটা বলতে পারবেনা মেহের। আগে যখন মামা বলতো সে খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবে তখন দৌড়ে গিয়ে রুপাখালার গলা জড়িয়ে বলতো মামার দেশে আসার কথা। রুপা খালা লজ্জা পেতো তখন। লজ্জায় মুখ ঢাকতো দুহাতে। মেহের তাকিয়ে থাকতো রুপা খালার মুখের দিকে। লজ্জা পেলে তাকে কত সুন্দর দেখায়। দেখতে খুব ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে মেহের, মামাকে তো ফিরে আসতেই হবে না হলে রুপা খালার কি হবে? তাকে কে বিয়ে করবে। রুপা খালার কথা ভাবলে তার কষ্ট হয় খুব। মেহের বলে
” পরিবারের থেকেও কি তোমার কাজ বেশী আপন মামা?”
“এটা আমার স্বপ্ন।”
“আর রুপা খালা?”
” আমার ভালো থাকার কারন।”
“তাহলে সব ছেড়ে চলে আসছো না কেন?”
” আমার হাত পা যে বাধা। স্বপ্ন ছুতে ন। পারলে মরেই যাবো হয়তো। এত সময় পরিশ্রম অপেক্ষ আশা আকাঙ্ক্ষা সব বিফলে যাবে।পারবোনা আমি।”
” কেন পারবেনা মামা?”
” যে স্বপ্ন পূরণ করতে পাড়ি দিয়েছি হাজার মাইল সেটা অপূর্ণ রাখি কি করে?”
“স্বপ্ন, এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে এতগুলো বছর পারিবার পরিজন এমনকি নিজের একান্ত প্রিয় মানুষটার থেকে দূরে আছো তুমি। তুমি ভালো আছো তো মামা?”
“হ্যাঁ, ভালো আছি।”
“কিভাবে? এই তো বললে তোমার ভালো থাকার কারন রুপা খালা। সে তো আমার কাছে নেই।”
“আমি হাজার মাইল দূরে থেকেও জানি রুপা আমার। তাহলে আমার ভালো না থাকার কারন আছে কি?”
জবাব দিতে পারলো না মেহের। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল রুপা আসছে। মেহের রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“খালা এসো। বসো আমার পাশে।”
রুপা মেহেরের পাশে গিয়ে বসলো। জিগ্যেস করলো,
” কার সাথে কথা বলিস?
“মামা, তুমি কথা বলবে? এই নাও। মোবাইল রুপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমরা কথা বল আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।” রুপাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহের ওয়াশরুমে চলে যায়। এদিকে রুপা মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নির্বিকার বসে থাকে। রাগ হয় মেহেরের উপর। কি দরকার ছিলো ওকে মোবাইল ধরিয়ে দেওয়ার। লম্বা শ্বাস নিয়ে মোবাইল কানের কাছে ধরে বলে,
“হ্যালো।”
” কেমন আছিস রুপা?”
“তুমি যেমনটা রেখছো?”
” কেন এত অপেক্ষা করছিস?”
“সেদিন কি বলেছিলে মনে আছে তোমার?”
“সেদিনের কথা ধরে আজও বসে আছিস?”
“কেন থাকবো না।”
“তখন আবেগের বসে অনেক কথাই বলেছি। এখন আর কোন আবেগ নেই। তুই বিয়ে করে নি রুপা।”
“লোকে হাসবে।”
“কেন?”
“আমার বয়স কতো জানো? চৌত্রিশ বছর। এই বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসলে লোকে হাসবে।”
“যদি আমি কখনো তোর সামনে এসে দাঁড়াই তাহলে আমাকে বিয়ে করবি রুপা। নাকি লোক লজ্জায় ভয়ে পালিয়ে যাবি?”
” তোমার মতো বুড়োকে আমি বিয়ে করবোনা।”
“তাহলে অপেক্ষা করছিস কেন?”
” জানিনা।”
“বিয়ে করেনি রুপা। আমার জন্যে অপেক্ষা করিসনা। আমি শূন্যহাতে ফিরবো না।”
“তুমি পূর্ণতা পাও খাইরুল ভাই। আর আমাকে পূর্ণতা দাও। তোমার অর্ধাঙ্গিনী রুপে আমায় পূর্ণতা দাও খাইরুল ভাই।

৫,
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোয়া উড়াচ্ছে রাহনাফ। দু আঙুলের মাঝে সিগারেট নিয়ে ফুঁকছে আর মুখের ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছে উপরের দিকে। উপরের উঠতে গিয়ে অন্ধকারের মিলিয়ে যাচ্ছে সে ধোয়া। আজকের আকাশটা একটু বেশীই কালো। ঘন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত আকাশ। আকাশে আজ চাঁদের দেখা নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা নিচে ফেলে দিলো। দুচোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। মেহের। হ্যাঁ, এই মেহেরকেই সে দেখেছিলো প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এর ল্যাপটপে। দিনটা ছিলো রবিবার। ইউনিভার্সিটি অফ বাসাতেও কোন কাজ নেই তাই সে প্রফেসর খাইরুল মামুন হক এর ল্যাবে যায়। রাহনাফ ছিলো তার প্রিয় ছাত্র তার উপর বাঙালি এজন্য বোধহয় স্যার তাকে একটু বেশীই পছন্দ করতেন। স্যারের ল্যাবে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছে রাহনাফ। সেদিন গিয়েছিলো খাইরুল স্যার যে নিউক্লিয়ার গাছ নিয়ে গবেষণা করছেন সেটা সম্পর্কে জানতে। রাহনাফ যখন ল্যাবে পৌঁছালো তখন খাইরুল স্যার তার ফাইভ জি কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু করছিলেন আর তার পাশেই তার পুরনো ল্যাপটপের স্কিনে দেখা যাচ্ছিলো একটা মেয়ের ছবি। একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখতে পেল তখন ভিডিও কনফারেন্স চলছিল। স্যার কাজ করছিলেন আর মেয়েটা দেখছিলো। রাহনাফ প্রথমে ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো তাদের ডিপার্টমেন্টের কোন স্টুডেন্ট হবে। সে সেখানেই দাড়িয়ে দেখছিলো মেয়েটাকে। এমন মায়াবিনী মুখ ছিলো মেয়েটার যে রাহনাফ শুধু মেয়েটাকেই দেখে যাচ্ছিলো। পরে তাদের কথোপকথন থেকে বুঝতে পারলো মেয়েটা বাংলাদেশের। আর সে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট নয়। সে তো বিজ্ঞানই পছন্দ করেনা। তার পছন্দ ইতিহাস। সেদিন সেই এক ঝলক দেখার পর মেয়েটা তার মনের গভীরে এমনভাবে ভালোলাগার বীজ বপন করেছে যে রাহনাফ ইংল্যান্ড ছেলে ভাটির দেশে চলে আসে। তবে রাহনাফ কি জানতো এত সহজে তার দেখা পাবে? সেদিন আলিহানের সাথে ওর হবু শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মেহেরকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলো। স্যার বলেছিলেন, মেহের তার একমাত্র ভাগ্নি তাহলে মৌ? মৌ কে? বেশী ভাবতে পারলোনা রাহনাফ। গভীর ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাহনাফ বলে,

“ভালোবাসি, বাগানের ঝরে যাওয়া ফুল। ভালোবাসি,
মেঘলা নদীর কুল। ভালোবাসি, উড়ন্ত এক ঝাক পাখি।
ভালোবাসি, তোমার ওই দুই নয়নের আখি।”

রাহনাফের ভাবনার মাঝেই বেলকনিতে আসলো আলিহান। আলিহান রাহনাফের কাধে হাত রেখে জিগ্যেস করলো,
” পাগল প্রেমিক। মেয়েটার কথা ভাবছিস?”
“হ্যাঁ।”
আলিহান রাহনাফের কাধ থেকে হাত সরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। বুকের উপর হাত ভাজ করে বলল,
” সারাক্ষণ শুধু মেয়েটার কথা ভাবেই যাবি। মেয়েটার খোঁজ করবিনা।”
“না।”
“যার জন্যে সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে চলে আসলি তার খোঁজ করবি না। আচ্ছা তোর মাথায় চলছে টা কি?”
” আমার ভালোবাসার টানে সে নিজেই ছুটে আসবে।”
” ও আচ্ছা তাই নাকি। তা সে কবে আসবে শুনি?”
“তুই তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নি তাহলেই তোর আমার রাস্তা ক্লিয়ার।”
“তাহলে আমি তোর পথের কাটা।”
” হুম।”
আলিহান রেগে যায় রাহনাফের কথায়। সে রেগে জিগ্যেস করে,
” মেয়েটা কে শুনি?”
“তোর শালিকা।”
“শালিকা মানে! মেহের।” আশ্চর্য শুনায় আলিহানের কণ্ঠস্বর।
“হ্যাঁ, মেহের। এত অবাক হচ্ছিস কেন?”

রাহনাফ বেলকনি ছেড়ে রুমে চলে আসে। আলিহান সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু একটা মনে পরতেই সে রুমে চলে আসে।রাহনাফ তখন ওয়াশরুমে ছিলো। আলিহান বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। রাহনাফ ওয়াশরুমে থেকে চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে থাকা আলিহানকে একপলক দেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিছানা থেকে আলিহান বলে,
” মৌ একবার বলেছিলে ওদের মামা ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”
” হ্যাঁ ওদের মামাই প্রফেসর খাইরুল মামুন হক।”
“তুই তো বলেছিলে প্রফেসরের একমাত্র ভাগ্নির প্রেমে পরেছিস।”
“এখানে আসার আগ পর্যন্ত আমিও সেটাই জানতাম।”
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে টিশার্ট ঝাড়া দেয় আলিহান। রাহনাফের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
” প্রেমে পরার মতো আর কোন মেয়ে পাইলি না। শেষ পর্যন্ত আমার শালিকার প্রেমেই পরতে হলো। যাই হোক আমি যাই ঘুম পাচ্ছে।”
রাহনাফ আলিহানের দিকে ঘুরে বলে,
“আজকের রাতটা এখানে থাক। ছোট বেলার মতো একসাথে ঘুমাই দুই ভাই।”
“ওকে।” জাম্প দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে আলিহান। রাহনাফ মৃদু হেসে লাইট বন্ধকরে আলিহানের পাশে শুয়ে পরে।

সকালবেলা আফিয়া বেগমের ডাকে ঘুম ভাঙে রাহনাফের। দুহাতে চোখ কচলে উঠে বসে। আফিয়া বেগম কফির মগ সেন্টার টেবিলে রেখে রাহনাফের পাশে গিয়ে বসলেন। আদুরে হাতে রাহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করেন,
“ঘুম কেমন হয়েছে?”
রাহনাফ মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে,
“ভালো।”
আফিয়া বেগম রাহনাফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
” তোর বাবা একটা মেয়ে দেখছে তোর জন্যে। আমরা সবাই মেয়েটার ছবি দেখেছি ভারি মিষ্টি মেয়ে। আমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে। এবার তোর পছন্দ হলেই কথা বলবো। আমরা চাই আলিহান আর তোর বিয়েটা একদিনেই হোক।”
রাহনাফ উঠে বসলো। মায়ের মুখোমুখি বসে বলল,
” আগে চাকরির খোঁজ করি তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে।”
” চাকরি পরেও পাওয়া যাবে।”
“তা যাবে কিন্তু বিয়ে করে বউকে খাওয়াবো কি?”
“আমাদের কি কোন অভাব আছে যে তুই বউকে খাওয়ানোর কথা ভাবছিস।”
“তা নেই তবে যখন কনে পক্ষের লোক প্রশ্ন করবে ছেলে কি করে কখন কি বলবে, ছেলে শিক্ষিত বেকার। বাবার ঘাড়ে বসে খায়।”
“তোর সাথে তর্কে পারবো না কখনোই।”
“তর্ক না এটা যুক্তি।
“হয়ছে হয়ছে। উঠে দাঁড়ান আফিয়া বেগম। বলেন,
“ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আয় সবাই অপেক্ষা করছে এক সাথে নাস্তা করবি।”

চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।