একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১১

0
212

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|১১|

রাতের বারোটা বাজে। ঝড় কমার বদলে বেড়েই যাচ্ছে। জোনাকি আঁধারকে ওর ঘরে শুতে দিয়ে এসে নিজে বাবা মায়ের ঘরে এসেছে। ঘুম আসছে না জোনাকির। বাবা মাকে ছাড়া এই প্রথম এই বাড়িতে একা থাকছে ও। আর চাইলেও যে কখনো বাবা মায়ের সাথে থাকা হবে না। তাদের ছোঁয়া যাবে না। ভাবতেই কান্না পায় ভীষণ জোনাকির। ঘুম আসছে না বিধায় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দেয়ালে টাঙানো বাবা মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলো অপলক। বাইরে ঝড়ের প্রকোপ ক্ষানিকটা কমে আসছে। বারান্দার দরজা খুলে রেখেছে। বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে পড়ছে বারান্দা ছাড়িয়ে ঘরের মধ্যে। বাতাস আসছে ক্ষণে ক্ষণে। জোনাকির খুব ইচ্ছে হলো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে। ইচ্ছেটাকে দমিয়ে না রেখে গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দু’হাতে বারান্দার গ্রিল আকঁড়ে ধরে আকাশের দিকে মুখ করে তাকায়। অপলক তাকিয়ে থাকে মেঘলা, অন্ধকার আকাশের দিকে। বাতাসে খোলা চুল এবং জর্জেটের ফিনফিনে পাতলা গোলাপি উড়না খানা উড়ছে এলোমেলো ভাবে৷ বৃষ্টির ঝাপটা এসে চোখমুখে পড়ছে বার বার। জোনাকি বিরক্ত হচ্ছে না, বরং ভালোই লাগছে ওর।

ইমারজেন্সি কল এসেছে আঁধারের। ফোনটা রিসিভ করে মিনিট দুয়েক কথা বলতেই লাইন কেটে গেলো। আঁধার কান থেকে ফোনটা নামিয়ে দেখে ফোন বন্ধ, অর্থাৎ ফোনের চার্জ শেষ। কথা বলা’টাও জরুরী। আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে জোনাকি যে ঘরে শুয়েছে সেদিকে পা বাড়ায়। দরজায় নক করে বেশ কয়েকবার। কোনো সাড়া শব্দ এলো না ভিতর থেকে। আঁধার দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে উঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। ভাবলো হয়তো ওয়াশরুমে আছে। কিন্তু পরমূহুর্তেই দেখলো ওয়াশরুমের দরজা খোলা। চলে আসতে নেয় আঁধার কি মনে করে যেন আবার ভেতরে পা রাখে। বারান্দায় একটা অবয়ব দেখে এগিয়ে যায় সেদিকে। জোনাকিকে এরুপ রুপে দেখে হৃদ স্পন্দন থেমে যায় আঁধারের। শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে যায় সেদিকে। কাঁপা কাঁপা ভাবে হাত বাড়ায় জোনাকির দিকে। ঠিক সেই মূহুর্তেই জোনাকি পেছন ঘুরে আচমকা আঁধারকে দেখে ভয়ে চিৎকার করতে গেলেই আঁধার দ্রুত মুখ চেপে ধরে জোনাকির। ফিসফিস করে বলে,
–“ইট’স মি ডোন্ট শাউট। এভাবে চেঁচালে আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষ জন উল্টাপাল্টা ভাববে।”

কথাগুলো বলেই জোনাকির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয় আঁধার। জোনাকি ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–“আপনি? শব্দ করে আসবেন না? ভয় পেয়ে গেছিলাম।”

–“দরজায় নক করেছিলাম, আপনি শোনেননি।”

–“কোনো দরকার ছিলো?”

আঁধার আর একবার চোখ বুলালো জোনাকির দিকে। এ বাসায় থাকাটা এই মূহুর্তে ঠিক হবে না। আঁধারের নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। আলতো করে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ফাঁকা ঢোক গিলে আঁধার বললো,
–“ঝড় থেমেছে, এখন আর আপনার একা থাকতে সমস্যা হবে না। বাসায় ফিরে যাচ্ছি আমি। দরজাটা ভালো করে লক করে যান।”

কথাগুলো বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না আঁধার। দ্রুত কদম ফেলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। আঁধার এত দ্রুত কথা গুলো বলে চলে গেলো যে জোনাকি পাল্টা কিছু বলার সু্যোগ পেলো না আর। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দরজা ভালো মতো আটকে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

বাসায় ফিরে এক দন্ড শান্তিতে বসতে পারছে না আঁধার। এলোমেলো লাগছে সবকিছু। আজকেই কি ঝড়টা হওয়ার ছিলো? আজকেই মেয়েটাকে ওভাবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে হলো? হলো তো হলো ওর সামনেই কেন? দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে আঁধার। জোনাকি’কে ছোঁয়ার কোনো অধিকার ওর নেই। খুব শীঘ্রই অধিকার বানাতে হবে। দরজায় নক হলো। আঁধার ভেতরে আসতে বললেই তৈমুর এসে বসলো পাশে। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“শুনলাম জোনাকি’কে ছাড়তে গিয়েছিলে? ঝড় বৃষ্টির রাতেই এভাবে চলে এলে যে? ঝড় বৃষ্টি থামলে___”

–“সে অপেক্ষায় থাকলে অঘটন ঘটে যেতো বোধহয়, তাই আর বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে মন সায় দিলো না।”

তৈমুর সন্দিহান দৃষ্টিতে পরখ করে আঁধারকে। আঁধার ফের বলে,
–“মেয়েটা আমাকে ঘুমের ঘোরে’ও জ্বালাচ্ছে তৈমুর ভাই। কি করা যায় বলুন তো?”

তৈমুর মুচকি হেসে বললো,
–“সব ব্যবস্থা করছি শালাবাবু। এখন ঘুমিয়ে পড়ো, সকালে আবার অফিস আছে তো নাকি?”

আঁধার সম্মতি জানায়। তৈমুর মৃদু হেসে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

জল স্বচ্ছ’কে নিয়ে নিজেদের বাসায় এসেছে। জোনাকি তো পুরো ব্যস্ত স্বচ্ছকে আপ্যায়ন করায়। কি রেখে কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না যেন। কয়েক ধরনের নাস্তা বানিয়ে দুই বোন আর স্বচ্ছ বসলো বিকেলের আড্ডায়। আড্ডার এক ফাঁকে জল জোনাকি’কে প্রশ্ন করলো,
–“তোর কোনো পছন্দ আছে জোনাকি?”

জোনাকি ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“পছন্দ মানে?”

–“মানে কাউকে ভালোবাসো? পছন্দ করো কাউকে?”

স্বচ্ছ’র কথায় কিছু সেকেন্ডের জন্য আঁধারের মুখ খানা ভেসে উঠলো জোনাকির চোখে। পরপরই নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
–“সেরকম কিছু নেই, কেন?”

এবার জল বললো,
–“নাহার আপু ফোন করেছিলো দুই দিন আগে। তোর জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ দেখেছে। হাসান ভাইয়ের চাচাতো ভাইয়ের পরিবার থেকে সম্বন্ধটা এসেছে।”

এইটুকু বলে থামলো জল। জোনাকি অপলক তাকিয়ে আছে। জল এবার স্বচ্ছ’কে দেখিয়ে বললো,
–“তোর ভাইয়া দূর থেকে খোঁজ খবর নিয়েছে ছেলের। সবকিছু পারফেক্ট। এখন তুই যদি সম্মতি দিস তাহলে সন্ধ্যায় আসতে বলবো।”

শুকনো ঢোক গিলে জোনাকি। কি বলবে ও? আঁধারকে ভালো লাগে ওর এটা বলবে? না না এটা কিভাবে বলবে? আঁধারের দিক থেকে সেরকম কিছু নেই। লোকটা উচ্চবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা। তার সবকিছু’ই হাই কোয়ালিটি সম্পন্ন। তার চয়েজ’ও নিশ্চয়ই তার মতোই কোনো মেয়ে’ই হবে। সে তো আর স্বচ্ছ’র মতো বড় ঘরে জন্মেও সাধারণ ভাবে থাকেনি। সবাই তো আর ওর স্বচ্ছ ভাইয়া না। কোথায় এ.আর. গ্রুপের এমডি আঁধার রেজওয়ান আর কোথায় তার পিএ’র পোস্টে চাকরি করা অনাথ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে জোনাকি। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জোনাকি বললো,
–“তোমরা যা ভালো বুঝো, আমার কোনো আপত্তি নেই।”

জল আর স্বচ্ছ বেশ খুশি হলো। বেশ বড় ঘর থেকেই সম্বন্ধ এসেছে। ছেলেটাও খুব ভালো, যদি বিয়েটা হয় তাহলে জোনাকি’কে নিশ্চয়ই খুব সুখেই রাখবে।

পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে জোনাকি। পাত্র, পাত্র’র মা বাবা আর ছোট বোন এসেছে। সাথে নাহার আর হাসান আছে। টি-টেবিলে হরেক রকমের নাস্তা দিয়েছে জল আর নাহার মিলে। সকলেরই ভীষণ পছন্দ হলো জোনাকি’কে। হাসান বললো,
–“কারো কোনো আপত্তি না থাকলে মিহাদ আর জোনাকি’কে আলাদা ভাবে কথা বলতে পাঠাই?”

সকলেই সম্মতি জানালো। যাদের বিয়েটা হবে, তাদেরও তো নিজস্ব কথাবার্তা বলার দরকার আছে। জোনাকি মিহাদ’কে নিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় গেলো। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে মিহাদ নিজেই বললো,
–“আপনার কোনো কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করতে পারেন আমাকে।”

–“কোনো প্রশ্ন নেই আমার।”

নিচু কন্ঠে জবাব দিলো জোনাকি। মিহাদ বললো,
–“আপনাকে আমি মাস ছয়েক আগে হাসান ভাইদের বাসায় দেখেছি তখনই ভালো লেগে যায় আমার। ইচ্ছে ছিলো তখনই কথা বলবো আপনার পরিবারের সাথে। পরে আপনার বড় বোনের বিয়ে হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। ভেবেছি উনার বিয়ে হলেই আপনার বাবার কাছে প্রস্তাব রাখবো আমি। কিন্তু___”

এইটুকু বলে থেমে যায় মিহাদ। ক্ষানিকটা সময় চুপ থেকে ফের বলে,
–“তার মাঝেই এত বড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেলো তোমার সাথে এরমাঝে আর বিয়ের কথা বলতে সাহস পাইনি। তবে হাসান ভাইকে জানিয়ে রেখেছিলাম। সে বলেছে আপনাকে কিছু দিন সময় দিতে। তাই তো আপনি স্বাভাবিক হওয়া অব্দি অপেক্ষায় ছিলাম আমি।”

জোনাকির চোখ ভার হয়ে আসলো। বাবা মার কথা মনে হতেই চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়লো। মিহাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“সে কি আপনি কাঁদছেন কেন? আমি কি আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?”

জোনাকি চোখের পানি মুছে বললো,
–“না না, সেরকম কিছু না। আপনি বলুন।”

–“আপনার এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই তো?”

–“আপুই আর স্বচ্ছ ভাইয়ার আপত্তি না থাকলে আমারও আপত্তি নেই।”

কথাটা বলার সময় গলা কাঁপলো জোনাকির। আঁধারের রাগী মুখ খানা ভেসে উঠলো বারবার। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কথাখানা বলেই ফেললো জোনাকি। মিহাদ হাসলো। বললো,
–“তবে চলুন সবাইকে আমাদের মতামত জানানো যাক।”

বেরিয়ে আসলো দুজনেই। মিহাদ বাবা মায়ের পাশে বসে বললো,
–“আমার কোনো আপত্তি নেই।”

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো জোনাকির দিকে। জোনাকি নিচু কন্ঠে বললো,
–“আপুই আর স্বচ্ছ ভাইয়া যা ভালো বুঝে তাই হবে।”

স্বচ্ছ আর জল জানালো ওদেরও কোনো আপত্তি নেই। মিহাদের মা সাথে করে রিং নিয়েই এসেছিলো। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আংটির বক্স বের করে মিহাদের হাতে দেয়। নাহার জোনাকির হাত এগিয়ে দিতেই মিহাদ জোনাকির অনামিকায় রিং পড়িয়ে দেয়। জল বাবা মায়ের ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে বাবার একটা সোনার আংটি এনে জোনাকির হাতে দেয়। আজকেই আংটি বদলের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় বাবার রেখে যাওয়া আংটি’টাই নিয়ে আসে। জোনাকিও পড়িয়ে দেয় মিহাদের আঙুলে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই বাগদান হয় দুজনের। চোখের পলকেই জোনাকি হয়ে যায় মিহাদের বাগদত্তা।

চলবে~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে