একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-১০

0
194

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|১০|

জোনাকি’র বাবা মা মারা যাওয়ার মাস দেড়েক পেরিয়েছে৷ জোনাকি এখনো স্বপ্ন নীড়েই আছে। এত বড় বাড়িতে সবাই থাকা স্বত্তেও জোনাকির দম বন্ধ হয়ে আসে। পাশে জল থাকাতেও ভালো লাগে না। মনটা যে ওদের সেই ছোট্ট ফ্ল্যাট’টাতেই পড়ে আছে। কয়েক দিন ধরেই মন পুড়ে যাচ্ছে নিজেদের বাসায় যাওয়ার জন্য। জোনাকি বেশ অনুরোধ করে জল’কে রাজি করায়। জোনাকি আজ ভীষণ খুশি। ও নিজের বাড়িতে যাবে, সেখানে যেভাবে ইচ্ছে থাকবে। হ্যাঁ বাবা মাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে। কিন্তু তাদের স্মৃতি আগলে ধরেই তো থাকতে পারবে। স্বপ্ন নীড়ের কোনো সদস্য রাজি ছিলো না, মত দেয়নি প্রথমে। কিন্তু জোনাকির জেদের কাছে হার মানে। এখন জোনাকি যেহেতু স্বাভাবিক হয়েছে তাই চিন্তা কিছুটা হলেও কমেছে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচে ড্রয়িংরুমে চলে আসে জোনাকি। সাথে জল আসে। কাল দুই বোন মিলে গিয়ে ফ্ল্যাট পরিষ্কার করে এসেছে সাথে সারা মাসের শুকনো বাজার করে রেখে এসেছে। স্ন্যাকস আইটেম’ও আছে বেশ কিছু। কিছু মাছ মাংসে ফ্রিজ ভর্তি করে রেখে এসেছে জল। জোনাকির কোনো বারণ শুনেনি স্বচ্ছ। নিজের হাতেই সব বাজার সদাই করে দিয়েছে এসেছে ও। শুধু শাক-সবজি কিনে রাখেনি। সেগুলো তো আবার নষ্ট হয়ে যাবে। তাই যখন যেটা খাবে জোনাকি কিনেই নিবে। স্বচ্ছ, শাহাদাত, তৈমুর সবাই এই সময়ে অফিসে। আমিনা বেগম জোনাকি’কে নিয়ে সোফায় বসলো৷ এটা সেটা বোঝাচ্ছে। একা ফ্ল্যাটে থাকবে তাই আগেভাগেই সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে বলছে। রাজিয়া আর নিশি কিচেন থেকে বড় দুটো টিফিন বক্স আর এমনি কয়েকটা বক্স হাতে করে নিয়ে আসলো। সেগুলো আলাদা একটা ব্যাগে ভরতে ভরতে রাজিয়া বললো,
–“এখানে বেশ কয়েক আইটেমের খাবার দিয়ে দিচ্ছি, তোমার তিন চারদিন অনায়াসে হয়ে যাবে। সারা দিন পর অফিস থেকে ফিরে যেদিন যেটা ইচ্ছা সেটা ফ্রিজ থেকে নামিয়ে গরম করে খাবে। কয়েকদিন রান্নাবান্নার ঝামেলা একদম নেই।”

–“আমি রান্না জানি তো আন্টি, কষ্ট করে এতকিছু রান্না করে দেওয়ার কোনো দরকার ছিলো না।”

রাজিয়া চোখ পাকিয়ে বলে,
–“কিসের কষ্ট? এইটুকুন রাঁধতে আবার কষ্ট কিসের? মেয়ের জন্যই তো রেঁধেছি।”

রাজিয়ার কথায় জোনাকি আর জলের চোখে অশ্রু জমে। যে রাজিয়া প্রথমদিন জোনাকি’কে এ বাড়িতে থেকে পছন্দ করেনি সেই রাজিয়া জোনাকি’কে আজ মেয়ে বলছে। নিশি বুঝতে পারছে দুই বোন আর একটু হলেই কাঁদবে। তাই প্রসঙ্গ পালটে জল’কে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“জোনাকি’র প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে দিয়েছো তো?”

জল মাথা নাড়ে। সে সময়ে কলিংবেল বেজে উঠে। আফজাল চাচা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। আঁধার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে’ই বললো,
–“জোনাকি’কে আসতে বলো চাচা, আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।”

আফজাল চাচা সম্মতি জানিয়ে ভেতরে এসে বললো,
–“আঁধার বাবা’য় গাড়িতে অপেক্ষা করতাছে। জোনাকি মারে যাইতে কইছে। দেও দেহি তোমার ব্যাগপত্র আমি গাড়িতে রাইখা আহি, ওই রেহানা ওই ব্যাগ দুইডা তুই লইয়া আয়।”

আফজাল চাচা আর রেহানা মিলে সবগুলো ব্যাগপত্র নিয়ে চলে গেলেন। জোনাকির অস্বস্তি হচ্ছে। জোনাকি লক্ষ্য করেছে আঁধার আগের থেকে বেশ নরম হয়েছে জোনাকি’র প্রতি। আর সেজন্যেই যেন ওর অস্বস্তি’টা বেড়েছে। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে একেক সময় তাকিয়ে থাকে লোকটা৷ তৈমুর’ও কেমন আঁধারকে নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলে৷ আঁধার হাসে তখন। অথচ জোনাকির মতে লোকটা’র তখন রেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে রেগে না গিয়ে হাসে কেন? ভেবে পায় না জোনাকি। নিশি বললো,
–“ভাই অপেক্ষা করছে চলো, ও তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

জোনাকি মাথা নাড়িয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। পেছনে পেছনে নিশি, জল, রাজিয়া তিনজনেই আসে ওকে বিদায় দিতে।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ জোনাকি নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছায়। ওখান থেকে মাগরিবের আগে আগে বেরিয়েছিলো, রাস্তায় জ্যাম থাকায় ক্ষানিকটা দেরী হলো আসতে৷ আঁধার সবগুলো ব্যাগ জোনাকির ফ্ল্যাটের সামনে রেখে দিয়ে বললো,
–“এখন আসি, সাবধানে থাকবেন। আর রাতের বেলা কেউ ডোরবেল বাজালে দরজা খুলবেন না একদম। কোনো সমস্যা হলে আমাকে বা বাসায় ফোন দিবেন বুঝলেন?”

জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“দরজা অব্দি এসে ফিরে যাবেন? খারাপ দেখাচ্ছে না? ভেতরে এসে বসুন।”

–“উহুঁ, অন্যদিন আসবো।”

–“বাবা মা বেঁচে থাকলে উনারা যদি বলতো তাহলে এভাবে চলে যেতেন?”

আঁধার চকিত তাকালো জোনাকির দিকে। মেয়েটার চোখে পানি চিকচিক করছে৷ না করার আর উপায় পেলো না। ব্যাগগুলো আবার হাতে তুলে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো। জোনাকি বেশ খুশি হলো। ঝটপট এক মগ কফি করে এনে দিলো আঁধারকে। আঁধার মৃদু হেসে কফির মগ নিয়ে চুমুক দেয়। জোনাকি বললো,
–“আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি ফ্রেস হয়ে আসছি।”

আঁধারের উত্তরের অপেক্ষা করলো না জোনাকি। দৌড়ে চলে গেলো নিজের ঘরে৷ মিনিট দশেক বাদে ফ্রেস হয়ে এসে দেখলো আঁধার বসে ফোন ঘাটছে। জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“রাতের খাবার দেই? একেবারে খেয়ে যান?”

আঁধার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। চট জলদি মাথা নামিয়ে নেয় জোনাকি। আঁধার কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখলো তারপর বললো,
–“বাসায় গিয়েই ডিনার করবো।”

–“খেয়ে গেলে আমি খুশি হবো।”

–“বাসায় গেলে যা খাবো এখানেও তো সেই সেম খাবার’টাই____”

–“আপনি অপেক্ষা করলে আমি অন্য খাবার বানিয়ে দিতে পারি।”

আঁধার ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো। এটাই চাচ্ছিলো ও। মেয়েটা দুর্দান্ত কফি বানায়। রান্না’ও নিশ্চয়ই ভালো করে? মেয়েটার হাতের রান্না খাওয়ার ভীষণ লোভ ওর। জোনাকি ফের বললো,
–“অপেক্ষা করবেন আপনি?”

আঁধার মাথা নাড়ায়। জোনাকি দৌড়ে কিচেনে যায়। কি রান্না করবে ভেবে পায় না। গুটিগুটি পায়ে আবার ড্রয়িংরুমে আসে। ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
–“কি রান্না করবো?”

–“যা ইচ্ছে।”

ফোন চালাতে চালাতে জবাব দেয় আঁধার। জোনাকি প্রশ্ন করে,
–“আপনার পছন্দের খাবার কি?”

–“আপু’র হাতের সবজি খিচুড়ি, ওটা আপু বেশ বানায়।”

নিশি একবার সবজি খিচুড়ি রান্নার সময় জোনাকি পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখেছিলো। তাই ও ভাবলো একবার না’হয় চেষ্টা করে দেখা যাক। জোনাকি ফের কিচেনে আসলো। কিন্তু কোনো সবজি তো নেই, আর এখন ফ্রিজ থেকে মাংস নামালেও সেটা বরফ ছাড়তে বেশ সময় লেগে যাবে। তাই জোনাকি দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে পার্স হাতে নিয়ে আঁধারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“আপনি বসুন, আমি এক্ষুণি আসছি।”

এবারেও আঁধারকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জোনাকি বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। ওদের বাসার সামনে মোড়ের কাছে যে বাজার আছে সেখানেই চলে আসলো। দূরত্ব মাত্র মিনিট তিনেকের। জোনাকি চট জলদি এক চিল মিষ্টি কুমড়ো, মটরশুঁটি, গাজর, ফুলকপি, বেগুন, ধনেপাতা এবং শসা, লেবু, টমেটো কিনে নিলো। সবজির দোকান থেকে বেরিয়ে মাংসের দোকানে গিয়ে দেড় কেজি গরুর মাংস কিনে সেগুলো দোকান থেকে ছোট ছোট পিস করে কাটিয়ে নিলো।

বাজার সদাই নিয়ে বাসায় ঢুকতেই আঁধার রাগী চোখে তাকায় জোনাকির দিকে। গম্ভীর স্বরে বললো,
–“বাজার নেই আমাকে বললেই তো আমি এনে দিতাম, আপনার এভাবে দৌড়ে বাজারে যাওয়ার কি দরকার ছিলো মিস জোনাকি?”

–“আপনি বাজার করতে পারেন? কখনো গিয়েছেন?”

–“যায়নি, তবে আজ যেতাম। সমস্যা কি?”

–“আসলে সবজি ছিলো___”

আঁধার থামিয়ে দিলো জোনাকি’কে৷ বললো,
–“নেক্সট টাইম কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে রাতের বেলা এভাবে বাজারে যাওয়ার জন্য দৌড়াবেন না। আমাদের জানাবেন, আমরা পৌঁছে দেবো।”

জোনাকি চুপচাপ সম্মতি জানায়। তারপর দ্রুত কিচেনে যায় রান্না করার জন্য৷ ঘন্টা দুয়েকের মতো সময় লাগে জোনাকির কাটাকুটি করে রান্না শেষ করতে। সবজি এবং গরুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি এবং বেগুন ভাজা করেছে জোনাকি। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। বাইরে প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছে। জোনাকি দ্রুত সবজি খিচুড়ি, বেগুন ভাজা পাত্রে বেড়ে নিলো তারপর শসা, লেবু, টমেটো পেয়াজ, মরিচ সবকিছু সুন্দর ভাবে কেটে প্লেটে সাজিয়ে সবকিছু টেবিলে নিয়ে রাখলো। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে কোনোমতে হাতমুখে পানি দিয়ে পড়নে জামা পাল্টে আবার ডাইনিংয়ে আসলো। চেয়ার টেনে প্লেট গ্লাস দিয়ে আঁধারকে ডাকলো খেতে। আঁধার চুপচাপ এসে বসলো। জোনাকি নিজেই খাবার বেড়ে দেয় আঁধারের প্লেটে। আঁধার খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে যায়। প্রশ্ন করে,
–“আপনি খাবেন না?”

–“আগে আপনি খেয়ে নিন, আমি পরে___”

–“পরে না, এক্ষুণি বসুন।”

বলে আঁধার নিজেই প্লেট নিয়ে খাবার তুলে দিলো জোনাকির জন্য। জোনাকি বাধ্য মেয়ে। তাই চুপচাপ বসে পড়লো। অতঃপর দুজনে একসাথেই খাওয়া শেষ করলো। সবকিছু গুছিয়ে কিচেনে রাখার সময়’ই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। জোনাকি হাতের কাজ রেখে দ্রুত কিচেনের জানালা বন্ধ করে দৌড়ে যায় রুমের বারান্দা লক করতে৷

টানা দুই ঘন্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় চলার উপায় নেই। ঘড়িতে তখন রাতের সাড়ে এগারোটা বাজে। অথচ বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই। ড্রয়িংরুমের দুই সোফায় দুজনে চুপচাপ বসে আছে। আঁধার চেয়েছিলো বৃষ্টির মাঝেই চলে যেতে, জোনাকি যেতে দেয়নি। বলেছে বৃষ্টি থামলে যেতে। কিন্তু বৃষ্টি’ই তো থামছে না। আঁধার এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
–“বৃষ্টি মনে হয় থামবে না, আসছি আমি। গাড়ি আছে সাথে কোনো সমস্যা হবে না যেতে।”

বাজ পড়ার শব্দ হলো। বৃষ্টি আরো বাড়ছে। সাথে বাজ পড়ছে। ঝড় হচ্ছে বাইরে ভীষণ রকমের। এই ঝড়ের রাতে জোনাকির একা ফ্ল্যাটে থাকতে এবার ভয় ভয় লাগছে। যদি কারেন্ট চলে যায় তখন? জোনাকি মিনমিন করে বললো,
–“আজ যাবেন না, আমার ভয় লাগছে।”

–“আমি থাকলে ভয় লাগবে না?”

আঁধারের প্রশ্নের ধরণটা বুঝতে পারলো জোনাকি। এই মানুষটা’কে নিয়ে ওরকম কোনো ভয় নেই জোনাকির মনে। তাই বললো,
–“উহুঁ, আপনাকে নিয়ে ভয় নেই।”

চলবে~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে