Thursday, August 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2372



নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৪

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৪

লেখিকা: সুলতানা তমা

পরন্ত বিকেল, ছাদের এক কোণে বসে আছি ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে। এখন আমার কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না, আমি একটু একটু করে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। কলিংবেল বাজছে ইচ্ছে হচ্ছে না নিচে গিয়ে দরজা খুলার তাই চুপচাপ বসেই রইলাম।
সেই কখন থেকে কলিংবেল বেজেই চলেছে কিন্তু মেঘ দরজা খুলছে না, জানিনা কি করছে। নিচে নেমে আসলাম দরজা খুলার জন্য।

দরজা খুলে দেখি সবাই চলে এসেছে, সবাইকে দেখে কষ্ট করে একটা শুকনো হাসি দিলাম।
তোহা: নতুন আম্মু। (তোহা হাত বাড়িয়ে আমার কোলে আসলো, ওকে নিয়ে সোফায় এসে বসলাম)
পপি: একি ভাবি টেবিলের উপর খাবারের প্যাকেট তোমরা এখনো দুপুরের খাবার খাওনি?
দাদি: হেরে মেঘ কোথায়?
আমি: রুমেই আছে হয়তো।
মা: রান্না করে খাওনি তাই না?
আমি: রান্না তো পারিনা যা রান্না করি মুখে দেওয়ার মতো না। (আমার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো)
আমি: জোহা আর বাবাকে দেখছি না কোথায় ওরা?
জোহা: এইতো চলে এসেছি। (জোহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম, জোহা চলে এসেছে যখন ওকে নিয়ে এ বাসা থেকে চলে যাবো। আর এখানে থাকতে চাই না)
মা: আমি তাড়াতাড়ি রান্না করে নিচ্ছি এসব বাইরের খাবার আর খেতে হবে না।
তোহা: নতুন আম্মু আব্বু কোথায়? আব্বু জানেনা আমি যে এসেছি?
আমি: না মামুনি জানলে তো তোমার কাছে আসতো। তুমি রুমে চলে যাও ওখানে তোমার আব্বু আছে।
তোহা: তুমিও চলো।
আমি: তুমি একা চলে যাও।
দাদি: মেয়েটা বলছে যখন যা না। (কিভাবে তোমাদের বুঝাই আমি মেঘের সামনে যেতে চাই না, ওকে দেখলে রাগ আরো বেড়ে যাবে আমার)
তোহা: চলো নতুন আম্মু। (তোহা আমার হাতের একটা আঙ্গুল ধরে টানছে তাই বাধ্য হয়ে ওর সাথে রুমের দিকে পা বাড়ালাম)

রুমের দরজা খুলার শব্দ পেয়ে মেঘ আমাদের দিকে তাকালো, বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে। তোহাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলো মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে মেঘের কোলে উঠে বসলো।
মেঘ আর তোহা হাসছে মজা করছে একবারো মেঘ আমার দিকে তাকাচ্ছে না, চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।

আনমনা হয়ে বাগানে হাটছিলাম হঠাৎ বাগানের দোলনায় রুহানকে বসে থাকতে দেখলাম। এগিয়ে আসলাম রুহানের দিকে। আমাকে দেখে মিথ্যে হাসার অভিনয় করলো রুহান।
রুহান: তোমার মন খারাপ?
আমি: নাতো।
রুহান: বেশ বুঝা যাচ্ছে তোমার মন খারাপ।
আমি: (নিশ্চুপ)
রুহান: বাস্তবতা আমাদের এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে না পারছি এই জায়গা থেকে সরে আসতে আর না পারছি…
আমি: আমরা সবাই একটা গোলকধাঁধায় পরে আছি তাই না?
রুহান: হুম।
আমি: পপি ভালোবাসে তোমাকে, তুমি ভালোবাস আমাকে, আমি ভালোবাসি মেঘকে আর মেঘ ভালোবাসে শায়লাকে। হাহাহা কতো সুন্দর…
রুহান: ভাইয়া হয়তো তোমাকে ভালোবাসে না কিন্তু শায়লাকেও ভালোবাসে না।
আমি: বাসে রুহান তোমরা তো জানো না মেঘ আর শায়লা দুদিন পর বিয়ে করছে।
রুহান: মানে কি? এসব তুমি কি বলছ?
আমি: ঠিকি বলছি রুহান, মেঘ আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
রুহান: কি?
আমি: হ্যাঁ ডিভোর্স পেপারটা আমার হাতেই আছে।
রুহান: আমি এক্ষণি গিয়ে বাসার সবাইকে বলবো, ভাইয়া পেয়েছে কি এভাবে তোমাকে নিয়ে খেলবে আ…
আমি: অনেক দায়িত্ববান হয়ে গেছ।
রুহান: তুমিই তো আমার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে। না পারছি এই দায়িত্ব থেকে সরে আসতে না পারছি আঁকড়ে ধরতে।
আমি: মেঘ আমাকে মেনে নিচ্ছে না আমি একটু একটু করে কষ্ট অবহেলা পেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি এইটা দেখে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
রুহান: কষ্ট তো হচ্ছে কিন্তু আমার তো কিছু করার নে…
আমি: ঠিক এভাবে পপিও একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে রুহান। (আমার কথা শুনে রুহান চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো)
আমি: আমাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারছ না অথচ নিজেই অন্য একটি মেয়েকে কষ্ট দিচ্ছ যে কিনা তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।
রুহান: পপি আমাকে ভালোবাসে রোজ রাতে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আমি বুঝতে পারি কিন্তু আমার কি করার আছে আমি তো তোমা…
আমি: ভুলে যাওনা আমাকে, একবার পপির ভালোবাসার উপর ভরসা রেখে নিজেকে সপে দাও ওর কাছে দেখবে সব কেমন ঠিক হয়ে যায়।
রুহান: তোমার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে না অথচ তুমি অন্য একটি মেয়ের কথা ভেবে ওর সংসার টিকাতে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছ এইটা বোধহয় তোমার মতো পাগলী মেয়ের দ্বারাই সম্ভব।
আমি: (মৃদু হাসলাম)
রুহান: আসছি।
আমি: আমার কথাটা শুনে একবার পপিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। (রুহান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল। রুহান পপিকে মেনে নিলে খুব খুশি হতাম, আমার মতো একি আগুনে পুড়ে আর কোনো মেয়ে ছাই হউক সেটা আমি চাই না)

চাঁচি: বাহ্ কি আছে তোমার মধ্যে বলতো আমাকে? (বাসার ভিতর ঢুকতে গিয়ে চাঁচির সাথে ধাক্কা খেলাম, উনার এমন প্রশ্ন শুনে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম)
আমি: মানে?
চাঁচি: এইযে মেঘকে নাচাচ্ছ আবার রুহান আর পপির বিয়ের মিথ্যে নাটক করে রুহানকেও সমানে নাচিয়ে যাচ্ছ।
আমি: ভদ্র ভাবে কথা বলুন শাশুড়ি শাশুড়ির জায়গায় থাকুন নাহলে…
চাঁচি: নাহলে কি করবে হ্যাঁ? বউ হয়ে শাশুড়িকে…
আমি: আরে আজব আপনি এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন?
চাঁচি: আমার ছেলের জন্য তোমাকে বউ করে আনতে চেয়েছিলাম তুমি নিজে তো বউ হলেই না উল্টো আমার শত্রুর মেয়েকে আমার ছেলের বউ করিয়ে দিলে। তুমি আমার ছেলের জীবন নষ্ট করে ফেলেছ তোমাকে তো আমি ছাড়বো না…
মা: কি হয়েছে তোমরা এমন চেঁচামেচি করছ কেন?
চাঁচি: দেখনা…
আমি: এমনি মা আমি তো চাঁচির সাথে মজা করছিলাম।
মা: ওহ! (মা চলে যেতেই চাঁচি আমার দিকে এগিয়ে আসলেন)
আমি: নিজের জায়গাতেই থাকুন আপনাকে থামানোর ওষুধ আমার কাছে আছে।
চাঁচি: মানে?
আমি: ভুলে যাবেন না আব্বুর খুনের সাথে আপনি জড়িত আছেন।
চাঁচি: এ্যাঁ!
আমি: এ্যাঁ না হ্যাঁ। (চাঁচির কানের কাছে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে চলে আসলাম, আসার আগে পিছন ফিরে একবার উনার দিকে তাকালাম উনি ভয়ে চুপসে গেছেন)

এখন চাঁচিকে আটকে রাখার একমাত্র রাস্তা ভয় দেখানো। কিন্তু আমার মাথায় একটা কথা কিছুতেই ঢুকছে না, চাঁচি শত্রুর মেয়ে বললেন কেন? মেঘ আর রুহানদের মধ্যে কি কোনো শত্রুতা আছে? কিন্তু ওদের দেখে তো তা মনে হয় না।
মেঘ: ওহ তুমি এসেছ তোহাকে দেখো আমি একটু আসছি। (রুমে ঢুকতেই মেঘ বসা থেকে উঠতে উঠতে কথাটা বললো)
আমি: কোথায় যাচ্ছ?
মেঘ: তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করোনা এখন যাই বলি বিশ্বাস করবে না তাই না বলাটাই ভালো। (আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেঘ হনহন করে বেরিয়ে গেল)
তোহা: নতুন আম্মু তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: কই নাতো মামুনি।
তোহা: আমি বুঝিতো আমাকে নিয়েই যতো ঝামেলা।
আমি: হ্যাঁ আমার মাম্মা বড় হয়ে গেছে তাই সব বুঝে।
তোহা: হ্যাঁ আমি যদি আকাশের তারা হয়ে যেতাম তাহলে আব্বু আর তোমাকে কাঁদাতে পারতো না।
আমি: এসব কি কথা তোহা? কে শিখিয়েছে এসব? আর কখনো যেন এসব কথা না শুনি।
তোহা: নিজের আম্মু না থাকলে সবাই বকা দেয়। (মেয়েটা মাথা নিচু করে কাঁদছে তাড়াতাড়ি ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আমি বুঝি তোর আম্মু না?
তোহা: তুমি আমার আম্মু বলেই তো আব্বু তোমাকে এতো কষ্ট দেয়। (হায় আল্লাহ্‌ এই ছোট বাচ্চাটাও বুঝে কিন্তু মেঘ বুঝে নাহ। আজ মেঘ আর শায়লার কাজকর্মের জন্য তোহা কষ্ট পেয়ে আকাশের তারা হয়ে যেতে চাইছে ওদের তো আমি ছাড়বো না, আমার কাছে সবার আগে তোহা তারপর অন্য সবকিছু)

তোহাকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো, শায়লার নাম্বার দেখে রিসিভ করলাম না। কিন্তু ও বারবার ফোন দিয়েই যাচ্ছে বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলাম।
আমি: কি হয়েছে?
শায়লা: মেঘ কোথায়?
আমি: বাসায় নেই।
শায়লা: ও তারমানে চলে এসেছে।
আমি: চলে এসেছে মানে?
শায়লা: সবকিছু জানতে হবে কেন তোমাকে?
আমি: বলো বলছি নাহলে…
শায়লা: মেঘ আমার সাথে দেখা করতে আসছে বুঝতে পেরেছ? ঘুমিয়ে পড়ো ওর জন্য অপেক্ষা করো না কারণ আজ মেঘ আমার কাছে থাকবে। আর হ্যাঁ আগামীকাল প্রস্তুত থেকো তোহাকে গিয়ে নিয়ে আসবো।
আমি: তোহাকে আমি দিবো না।
শায়লা: তোহা আমার মেয়ে তাই চাইলেই আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারি অবশ্য তুমি চাইলে তোমাকে দিয়ে দিতে পারি তবে বিনিময়ে তোমার সবকিছু আমার নামে করে দিতে হবে।
আমি: আর যদি না দেই?
শায়লা: তোহাকে নিয়ে আসবো।
আমি: তোহা তোমার মেয়ে তুমি নিতেই পারো কিন্তু এতে তোমার লাভ কি?
শায়লা: তোমার সবকিছু তো এখন তোহার নামেই আছে।
আমি: তোমার কি মনে হয় তুমি একাই চালাকি করতে পারো?
শায়লা: মানে?
আমি: আমি উইল পাল্টে ফেলেছি তোহার নামে আপাতত কোনো সম্পত্তি নেই তাই ওকে নিয়ে তোমার কোনো লাভ নেই বরং ওকে আমার কাছে রাখলে তোমার লাভ হবে, হয়তো বিনিময়ে তোমাকে কিছু দিবো যেহেতু তুমি তোহার আসল মা।
শায়লা: তোকে তো আমি খুন করবো।
আমি: রাখছি তোমার সাথে কথা বলে আমার সময় নষ্ট হচ্ছে।
ফোন রেখে ভাবছি মেঘ কি সত্যি শায়লার সাথে দেখা করতে গেছে? কিন্তু এতো রাতে দেখা করতে যাবে কেন?

রাত বারোটা বাজে ড্রয়িংরুমে বসে আছি মেঘ আসার নাম নেই, আমার ফোনটাও রিসিভ করছে না। তাহলে কি সত্যি মেঘ আজ শায়লার কাছে থাকবে?
দাদী: এখনো এখানে বসে আছিস?
আমি: হু!
দাদী: ঘুমাবি না রাতের খাবারও তো খেলি না।
আমি: মেঘ আসুক।
দাদী: বারোটার উপরে বাজে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবি।
আমি: আর একটু অপেক্ষা করে দেখিনা।
দাদী: দাদুভাইটা বুঝলনা তোকে। (দাদী চলে যেতে চাইলেন একটা হাত ধরে বসার জন্য বললাম)
দাদী: কিছু বলবি?
আমি: একটা কথা জানতে চাই।
দাদী: বল কি…
আমি: মেঘ আর রুহানদের মধ্যে কি কোনো শত্রুতা আছে?
দাদী: হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আমি: কারণ আছে দাদী।
দাদী: নাতো কি শত্রুতা থাকবে? আমার দুই ছেলে সবসময় মিলেমিশে থেকেছে।
আমি: রুহানের আব্বু কিভাবে মারা গেছেন?
দাদী: (নিশ্চুপ)
আমি: বলুন দাদী প্লিজ।
দাদী: একটা এক্সিডেন্টে…
আমি: সত্যি কি এক্সিডেন্ট ছিল নাকি অন্যকিছু?
দাদী: এক্সিডেন্ট ছিল কিন্তু তুই এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আমি: এমনি জানতে ইচ্ছে হলো।
দাদী: তোর মাথায় যে কি ঘুরে বুঝিনা।
দাদী চলে গেলেন চুপচাপ বসে রইলাম। আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো এতোকিছু ভাবতে ভাবতে। চাঁচি পপিকে শত্রুর মেয়ে বললেন অথচ ওদের মধ্যে কোনো শত্রুতাই নেই। হয়তো এমন কোনো ঘটনা আছে যা মেঘরা ভুলে গেলেও চাঁচি ভুলে যাননি উল্টো এই নিয়ে চাঁচি মেঘদের শত্রু ভাবেন কিন্তু কি ঘটনা ছিল সেটা জানবো কিভাবে?

হঠাৎ কোনোকিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল, মেঘের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ড্রয়িংরুমে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। আবারো কিছু ভাঙার শব্দ ভেসে আসলো, আওয়াজ তো আমাদের রুম থেকে আসছে কে ভাঙছে জিনিসপত্র? দৌড়ে উপরের দিকে আসলাম।

মেঘ: সব ভেঙে ফেলবো আমাকে অবিশ্বাস করে সবকিছুতে। (মেঘ রুমের সব জিনিসপত্র ছুড়ে মারছে, ও কখন রুমে আসলো বুঝতেই পারিনি)
আমি: মেঘ কি করছ এসব?
মেঘ: একদম চুপ আমার সাথে কথা বলবে না তুমি।
আমি: পাগল হয়ে গেছ নাকি জিনিসপত্র এভাবে ভাঙছ কেন?
মেঘ: সব ভেঙে ফেলবো।
আমি: মেঘ তোহা কিন্তু ঘুমে ও যদি ভয় পায় বা ওর উপরে কোনো কিছু উড়ে গিয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু…
মেঘ: এইতো পেয়েছি। (ওয়ারড্রব এর উপরে ডিভোর্স পেপার রাখা ছিল মেঘ পেপারটা এনে ছিঁড়ে টুকরোটুকরো করে ফেললো)
আমি: মেঘ হচ্ছে কি এসব?
মেঘ: আমি যা খুশি করবো তুমি বাঁধা দিবে না।
আমি: তুমি ড্রিংক করেছ?
মেঘ: তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারবে আর আমি যন্ত্রণা ভুলার জন্য ড্রিংক করতে পারবো না? বাহ্ অসাধারণ তোমার…
আমি: চুপ করো, বেরিয়ে যাও রুম থেকে।
মেঘ: যাবো না এইটা আমার রুম আমি এই রুমে বসে ড্রিংক করবো।

মেঘ ফ্লোরে বসে ড্রিংক করে যাচ্ছে আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছি, ইচ্ছে হচ্ছে ওকে…
মেঘ: কণা খাবে? (হাসছে আর আমাকে মদের গ্লাস দেখাচ্ছে)
আমি: তুমি না পুরো মাতাল হয়ে গেছ।
মেঘ: কি করবো বল আমার বউ তো আমাকে অবিশ্বাস করে।
আমি: অবিশ্বাস করার মতো কাজ করো কেন? একটু আগে কোথায় ছিলে তুমি?
মেঘ: কোথায় কোথায়…
আমি: শায়লার কাছে ছিলে তাইতো। (বত্রিশটা দাত বের করে হাসি দিলো, ও তো পুরো মাতাল হয়ে গেছে)
মেঘ: তুমি আমাকে আবার অবিশ্বাস করছ আমি তো শায়লার কাছে ছিলাম না আমি ছিলাম… (মেঘ ঢলে পরে যাচ্ছে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরলাম)
আমি: বিছানায় চলো।

মেঘকে এনে বিছানায় শুয়ে দিলাম, জুতো খুলে শার্ট খুলতে গেলাম মেঘ আমাকে জড়িয়ে ধরে ফেললো।
আমি: ছাড়ো তোমার শার্ট খুলতে হবে শার্টে মদ…
মেঘ: শোননা কণা আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি। আমি শায়লার কাছে যাইনি।
আমি: ছিঃ এতো বাজে গন্ধ…
মেঘ: আমি তো এসব ছেড়ে দিয়েছিলাম তোমাকে পেয়ে কিন্তু তুমিই তো এখন আমাকে আবার এই নষ্ট পথে ঠেলে দিচ্ছ।
আমি: তুমি যা করছ এতে তোমাকে সন্দেহ করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
মেঘ: আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাইনা। শায়লা আমার সাইন নকল করে ডিভোর্স পেপারে সাইন বসিয়েছে আমাকে ফাঁসাচ্ছে…
মেঘ আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফেললো, শার্টটা খুলে দিয়ে ওর গায়ে বিছানা টেনে দিলাম তারপর জানালার কাছে চলে আসলাম।

কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে, আব্বু আম্মু আর পড়াশুনা নিয়ে কতো ভালো ছিলাম। আর এখন এতো এতো ঝামেলা এসে জুটেছে আমার ঘাড়ে। কোথায় এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবো তা না আমাকে নিজের স্বামী সংসারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। আর পারছি না আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো। মেঘের দিকে তাকালাম নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে আছে, দেখে বুঝাই যায় না এই মানুষটা আমাকে এতো কষ্ট দেয়। আস্তে আস্তে মেঘের দিকে এগিয়ে আসলাম, ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না মেঘকে বিশ্বাস করবো নাকি অবিশ্বাস…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৩

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৩

লেখিকা: সুলতানা তমা

চোখেমুখে রোদের আলো পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল, আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। মেঘ জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
আমি: হাসছ কেন? (মেঘ আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমার পাশে বসতে বসতে আবারো হাসলো, এবার বেশ জোড়েই হেসে উঠলো)
আমি: আরে আজব এমন পাগলের মতো হাসছ কেন?
মেঘ: আমি তো পাগলই তোমার প্রেমে পাগল আর তাই পাগলের মতো হাসছি।
আমি: ফাজলামি রেখে বলতো। (মেঘ আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো..)
মেঘ: তোমাকে এই অবস্থায় রোদের আলোতে দেখতে বেশ লাগছে ইচ্ছে হচ্ছে আবারো… (মেঘের কথা শুনে নিজের দিকে একবার চোখ বোলালাম ও এখনো হাসছে দেখে লজ্জায় মেঘের বুকে মুখ লুকালাম)
মেঘ: এতো লজ্জা? রাতে এই পরীটার লজ্জা কোথায় ছিল? (মেঘকে ছেড়ে দিয়ে রাতের কথা ভাবতে লাগলাম, মেঘ আমাকে টেনে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো)
মেঘ: রাতের কথা ভাবতে যেওনা তাহলে আরো বেশি লজ্জা পাবে আর লজ্জায় আরো বেশি লাল হয়ে উঠবে তখন কিন্তু আর নিজেকে আটকে রাখতে পারবো না।
আমি: দ্যাত ফাজিল একটা।
মেঘ: উঠে ফ্রেশ হয়ে এসো আমাকে অফিসে যেতে হবে।
আমি: ওকে।

গোসল করে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রুমে এসে ঢুকলাম, মেঘ দুহাতে দুই মগ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কফির মগ দুটু টেবিলে রেখে আমার কাছে এসে তোয়ালেটা কেড়ে নিয়ে গেল।
আমি: এইটা কি হলো?
মেঘ: আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হচ্ছে সকালবেলা বউয়ের চুল থেকে টুপটুপ করে পানি ঝরে পরার দৃশ্য, আর তুমি আমাকে এই সুন্দর দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করতে চাইছ?
আমি: পাগল একটা…
মেঘ: কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নাও আমি নিজে বানিয়েছি যদিও এতোটা ভালো হবে না তাও রাতের খাবারের চেয়ে ভালোই হবে।
কথাটা বলেই মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো, রাতের খাবারের কথা ভেবে আমিও হেসে দিলাম।

আজ একটু অফিসে যাওয়া প্রয়োজন যদিও মেঘ সব সামলাচ্ছে তাও একবার তো ঘুরে আসা দরকার। তাছাড়া শায়লার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে হলে তো আমাকে বেরুতে হবেই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম, মোবাইলটা হাতে নিয়ে পিছন ফিরতেই মেঘের সাথে ধাক্কা খেলাম। মেঘ ইশারায় টাই বাঁধতে বলে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো।
আমি: কতোবার বলবো আমি রোজ টাই বেঁধে দিতে পারবো না তু…
মেঘ: ওকে সমস্যা নেই রোজ আমার টাই বেঁধে দেওয়ার জন্য তোমার একটা সতিন নিয়ে আসবো কেমন?
আমি: সরো যাও বিয়ে করো গিয়ে। (মেঘকে ধাক্কা দিলাম ও আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো)
মেঘ: এতো ভালোবাস কেন?
আমি: চলো তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মেঘ: কণা তুমি কি শুধু অফিসে ঘুরতে যাচ্ছ নাকি অন্য কোনো কাজে…
আমি: হু আর একটা কাজ আছে।
মেঘ: কি কাজ?
আমি: তোমার শায়লার বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।
মেঘ: আবার আমার শায়লা বলেছ তো…
আমি: উফফ মেঘ লাগছে হাত ছাড়ো আমি তো ফাজলামো করেছি।
মেঘ: বলো কিসের প্রমাণ।
আমি: মেঘ আসলে শায়লাই আব্বুকে খুন করিয়েছে।
মেঘ: কি?
আমি: এটাই সত্যি আর আমার মনে হয় এই কাজে শায়লার স্বামী যুক্ত আছে। সেদিন আব্বুকে মেরে ফেলার পর সন্ত্রাসীরা ফোনে একটা কথা বলেছিল “স্যার কাজ শেষ”
একবার ভেবে দেখো মেঘ ওরা স্যার ডাকবে কাকে? শায়লা তো অবশ্যই না তাহলে ওর সাথে অন্য কেউ যুক্ত আছে। আমি যদি ভুল না ভেবে থাকি শায়লার স্বামী আর ও দুজন মিলেই সব করছে।
মেঘ: কিন্তু শায়লা যে বললো ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আমি: উফফ মেঘ তুমি এতো বোকা কেন? শায়লা বলেছে বলে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে? এমনো তো হতে পারে শায়লা আমাদের সামনে এসে সব করছে আর ওর স্বামী আড়ালে থেকে সব করছে।
মেঘ: হুম হতে পারে কিন্তু ওরা এসব করবে কেন?
আমি: সম্পত্তির জন্য মেঘ এইটা বুঝ না কেন? ওরা চাইছে তোহাকে নিয়ে যেতে কারণ তোহাকে নিয়ে গেলে সম্পত্তি শায়লা পাবে আর আমরা যদি তোহাকে না দেই তাহলে ওরা তোহার বিনিময়ে সম্পত্তি চাইবে।
মেঘ: তোহাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
আমি: চিন্তা করোনা আমি সব সামলে নিবো তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।
মেঘ: আমি তো সবসময় তোমার পাশে আছি। (মৃদু হাসলাম, মেঘ আর তোহা আমার জীবনে থাকলে আমি যেকোনো বিপদের মোকাবিলা করতে পারবো)
মেঘ: চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি: হুম চলো।

শায়লা: মেঘ এতো দেরি করে আসলে যে আজ তো আমাদের শপিং…(মেঘ রুমে ঢুকতেই শায়লা বলতে শুরু করেছিল, মেঘের পিছনে আমাকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল)
আমি: কি যেন বলছিলে কি শপিং…
শায়লা: ককই কিকিছু নাতো।
আমি: মেঘ ও তোমার রুমে কি করছে?
মেঘ: আসল…
আমি: ওকে আমি চাকরি দিয়েছি তোমার পাশে বসে থাকার অনুমতি দেইনি।
শায়লা: আসলে আমি একটা ফাইল নিয়ে এসেছিলাম মেঘ ছিল না তাই অপেক্ষা করছিলাম তুমি আসবে ভাবিন…
আমি: মেঘ নয় স্যার আর আমি কে হই ভুলে গেছ?
শায়লা: সরি মেম।
আমি: আজ তোমাকে কাজ করতে হবে না বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও আমি সারাদিন মেঘের সাথে থাকবো।
শায়লা: কি?
আমি: অবাক হওয়ার কি আছে যাও।
শায়লা: ঠিক আছে।
মেঘ: কণা কি করতে চাইছ তুমি শায়লাকে চলে যেতে বললে কেন?
আমি: শান্তিতে কাজ করো আসছি আমি।
মেঘকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে আসলাম।

শায়লাকে তো বিদায় করেছি ওকে ফলো করার জন্য, ও কোথায় যায় কি করে সব আমাকে জানতে হবে।
–মেম আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। (হনহন করে চলে আসছিলাম পিছন থেকে কেউ কথাটা বলে উঠলো, পিছনে তাকিয়ে দেখি একজন কর্মচারী মেয়ে)
আমি: হ্যাঁ বলুন।
–আপনার সাথে আমি অনেক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনার ফোন নাম্বার বা শশুড় বাড়ির ঠিকানা কিছুই নেই আমার কাছে।
আমি: কি হয়েছে বলুন।
–মেম কাদের আপনি কোম্পানির দায়িত্ব দিয়েছেন? শায়লা মেম সারা দিন স্যার এর রুমে থাকে আর…
আমি: আর কি?
–আমি বলতে পারবো না। (মেয়েটা মাথা নিচু করে ফেলেছে তবে কি..)
–স্যার আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন তাই আপনার ভালোর জন্য কথাটা বললাম। কোনো কাজে মেঘ স্যার এর রুমে গেলে শায়লা মেম বকাঝকা করে বলে এতো কাজ করতে হবে না ওই রুমে যেন না যাই।
আমি: হু ঠিক আছে।
–আর মেম ওরা বোধহয় বিয়ের প্ল্যান করছে, গতকাল শুনেছি ওরা বিয়ের শপিং করতে যাবে বলছিল। আর স্যার অফিস রেখে বার বার বাইরে যায়, আমাদের অন্য একজন কর্মচারী দেখেছে স্যার কোনো এক উকিলের কাছে যায় সম্ভবত মেম ডিভো…
আমি: থাক আর বলতে হবে না আসছি আমি।
বেরিয়ে আসলাম সবকিছু কেমন যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে, মেয়েটি এসব কি বললো? তবে কি মেঘ আমার সাথে অভিনয় করছে?

শায়লাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি বেরুনোর আগেই হয়তো চলে গেছে এখন কি করবো? শায়লার ঠিকানা প্রয়োজন আবার ফিরে গেলাম মেঘের কাছে।

মেঘ: ফিরে আসলে যে?
আমি: ইচ্ছে হয়েছে তাই।
মেঘ: রেগে আছ কেন?
আমি: ভাবছি হানিমোনে যাবো।
মেঘ: কি?
আমি: এতে চমকে যাওয়ার কি আছে মনে হচ্ছে হানিমোন শব্দটা এই প্রথম শুনলে।
মেঘ: তা না অনেক কাজ…
আমি: বাইরে কোথাও যাবো এক মাসের জন্য।
মেঘ: এক মাস?
আমি: হ্যাঁ অবাক হচ্ছ কেন?
মেঘ: হানিমোনের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো আমি যাচ্ছি না। (তুমি যাবে কি মেঘ, আমিই তো যাবো না। হানিমোনের কথা বলে আমি তো তোমায় পরীক্ষা করছি দেখি তুমি শায়লার সাথে বিয়ের প্ল্যান করেছ কিনা)
মেঘ: কথা বলছ না কেন? (মেঘের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোফায় এসে বসে পড়লাম। চুপচাপ ভাবছি মেঘ কি সত্যি শায়লাকে বিয়ে করার প্ল্যান করেছে? তাহলে আমার সাথে অভিনয় করছে নাকি?)
মেঘ: কি হয়েছে কি এতো ভাবছ। (মেঘ আমার পাশে বসে আমার একটা হাত ওর হাতের মুঠোয় নিলো তারপর হাতে চুমু খেলো, তাকিয়ে আছি ওর দিকে সত্যি কি ও আমার সাথে অভিনয় করছে)
মেঘ: বলোনা কি হয়েছে তোমাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
আমি: কিছু হয়নি। (মেঘের কাধে মাথা রাখলাম। যদি মেয়েটির কথা সত্যি হয় তাহলে মেঘকে আর কিছু বলা ঠিক হবে না এমনিতে বলে দিয়েছি শায়লা যে আব্বুর খুনি সেটা আমি জানি)
মেঘ: বাসায় চলে যাও কেমন?
আমি: হুম।
মেঘের থেকে বিদায় নিয়ে মেঘের চোখের আড়ালে আবার সেই মেয়েটির কাছে আসলাম।

–মেম কিছু বলবেন?
আমি: শায়লার বাসার ঠিকানা আমার প্রয়োজন দিতে পারবেন?
–ও কখন কোন বাসায় থাকে ঠিক নেই তবে অফিসে যে ঠিকানা দেওয়া আছে সেটা দিতে পারবো।
আমি: ঠিক আছে দিন।
ঠিকানা নিয়ে শায়লার বাসার দিকে রওনা দিলাম।

শায়লা: কতো বড় সাহস আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে ও নাকি মেঘের কাছে থাকবে যত্তোসব। মেঘ তোর কি হয় যে ওর কাছে সারাদিন থাকবি? মেঘ তো দুদিন পর আবারো আমার হয়ে যাবে তখন কি করবি? নেহাত সম্পত্তিটা হাত ছাড়া করতে চাই না তাই সব মুখ বুজে সহ্য করছি নাহলে কণার বাচ্চা কণাকে খুন করে ফেলতাম। (শায়লা জিনিসপত্র ড্রয়িংরুমের চারদিকে ছুড়ে মারছে আর আমাকে বকাবকি করছে। জানালা দিয়ে এসব দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। শায়লার এসব কথায় আমি মোটেও অবাক হচ্ছি না, অবাক তো হচ্ছি শায়লার বাসা বিয়ে বাড়ির মতো সাজানো দেখে। তবে কি সত্যি ওরা বিয়ে করছে? কিন্তু মেঘের স্ত্রী তো আমি, আমাকে ডিভোর্স না দিয়ে কিভাবে সম্ভব?)
শায়লা: এতো গুলো সম্পত্তি কোন পাগলে হাত ছাড়া করতে চায়? আমি তো মেঘকে নিয়ে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবো। ভাগ্যিস কণা তোহাকে মেয়ে ভেবে সব তোহার নামে করে দিয়েছে এবার তোহাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারলেই হয় অবশ্য তোহাকে কণা না দিতে চাইলে আমার কোনো সমস্যা নেই, তোহার বিনিময়ে সব সম্পত্তি দিয়ে দিলেই হবে। (শায়লার কথা শুনে ওকে ঘৃণা করতেও আমার রুচিতে বাধছে, নিজের সন্তানের বিনিময়ে সম্পত্তি চায় ছিঃ এতো খারাপ মানুষ হয়? শায়লার ফোন বেজে উঠলো..)
শায়লা: কোথায় দেখা করবে? (অপর পাশ থেকে কে কথা বলছে কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না)
শায়লা: আসছি। (শায়লা আসছে দেখে সরে গেলাম। মনে হয় না এভাবে কোনো প্রমাণ পাবো একমাত্র রাস্তা এখন রুহানের আম্মু কিন্তু উনাকে তো পুলিশে দিতে পারবো না কি করবো এখন?)

শায়লার পিছন পিছন আবারো আসলাম ও একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকছে দেখে আমিও ঢুকতে গেলাম তখনি পিছন থেকে কে যেন আমার হাত ধরে ফেললো, পিছনে তাকিয়ে মেঘকে দেখে বেশ অবাক হলাম। মেঘ অফিস রেখে এখানে কি করছে তবে কি শায়লা মেঘের সাথেই দেখা করতে আসছে?
মেঘ: বাসায় চলে যাবে বলে এখানে কি করছ?
আমি: অফিস রেখে তুমি এখানে কি করছ?
মেঘ: আআমমি তো…
আমি: তোতলাচ্ছ কেন?
মেঘ: তুমি বাসায় একা তাই অফিসে মন বসছে না আর দুপুর তো হয়ে আসছে তাই খাবার নিতে রেস্টুরেন্টে…
আমি: অফিসের কাছে রেস্টুরেন্ট নেই নাকি যে এতো দূর খাবার নিতে আসতে হলো?
মেঘ: চলো তো বাসায় খালি প্রশ্ন করো।
কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে এসে বসলাম।

মেঘ: কণা রেগে আছ কেন?
আমি: নাতো।
মেঘ: তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ?
আমি: সন্দেহ করার মতো কাজ করেছ নাকি?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: এবার আমাকে সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।
মেঘ: মানে কি করবে?
আমি: শায়লাকে আর ওর সাথে যারা জড়িত আছে সবাইকে জেলে দিবো। (মেঘ কথাটা শুনেই হুট করে গাড়ি থামালো, তাল সামলাতে না পেরে গাড়ির সাথে আমার মাথা লাগলো)
আমি: মেঘ হয়েছে কি এভাবে কেউ গাড়ি থামায়?
মেঘ: সরি, বেশি ব্যথা পেয়েছ?
আমি: কথাটা শুনে এভাবে চমকে উঠলে কেন?
মেঘ: শায়লার সাথে তো চাঁচি জড়িয়ে আছেন আর চাঁচিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে তো বুঝই আমাদের মান সম্মান সব যাবে আর আব্বু…
আমি: ভয় নেই বাবার কোনো ক্ষতি হবে এমন কিছু আমি করবো না।
মেঘ: হু।
মেঘ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি সত্যি কি ও চাঁচিকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে নাকি অন্য কিছু…

এভাবে প্রমাণ জোগাড় করা সম্ভব না এখন একমাত্র রাস্তা চাঁচি। কিন্তু চাঁচিকে তো পুলিশে দিতে পারবো না এইটার বিনিময়ে তো রুহান আর পপির বিয়ে দিয়েছি তাছাড়া বাবাকে কথা দিয়েছি। চাঁচিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে এই খান পরিবারের সম্মান যাবে এই পরিবারের সাথে তো এখন আমারো সম্মান মিশে আছে, উফফফ কিযে করি।
মেঘ: একা একা দাঁড়িয়ে কি ভাবছ? (বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম মেঘ এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো)
মেঘ: কথা বলছ না কেন?
আমি: এমনি।
মেঘ: খিদে লেগেছে তো।
আমি: ফ্রেশ হয়ে এসো আমি খাবার দিচ্ছি।

মেঘ ফ্রেশ হতে চলে গেল আমি রুম থেকে বেরুতে যাবো তখনি মেঘের ফোন থেকে মেসেজটোন বেজে উঠলো। একবার ওর ফোনটা দেখা প্রয়োজন, মেয়েটির কথা কতটুকু সত্যি সেটা অন্তত জানা যাবে। ফোন হাতে নিয়ে দেখি শায়লার মেসেজ।
“বিয়ের কথা যেন কণা জানতে না পারে জানলে কিন্তু ও জামেলা করবে। আর তুমি তো বলেছ একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সবাই মেনে নিবে। ডিভোর্স পেপারে কোনো ভাবে ওকে দিয়ে সাইনটা করিয়ে নিও আমি অপেক্ষায় আছি”
মেসেজ পড়ে বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছি। তারমানে মেয়েটির কথাই সত্যি মেঘ আর শায়লা বিয়ের প্ল্যান করছে এমনকি আমাদের ডিভোর্স এর ব্যবস্থাও ওরা করে ফেলেছে।
মেঘ: কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছ? (মেঘের কথার উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে মেঘের কাগজপত্র খুঁজতে শুরু করলাম)
মেঘ: আরে এভাবে কি খুঁজছ?
আমি: যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেছি। (ফাইলের ভিতর ডিভোর্স পেপার পেয়ে মেঘের সামনে ধরলাম ও হা হয়ে তাকিয়ে আছে)
মেঘ: এইটা…
আমি: এইটা কি মেঘ? তুমি আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য…
মেঘ: অসম্ভব এইটা আমি আনিনি।
আমি: ওহ আমি এনেছি তাহলে।
মেঘ: তুমি আনতে যাবে কেন তুমি তো আমাকে ভালোবাস।
আমি: মেঘ নাটকটা একটু কম করো।
মেঘ: বিশ্বাস করো আমি এই ডিভোর্স পেপার এর ব্যাপারে কিছুই জানিনা, এই পেপার ফাইলের ভিতর আসলো কিভাবে আমি সত্যি জানিনা।
আমি: অনেক হয়েছে মেঘ, আমাকে বললেই পারতে তুমি শায়লাকে বিয়ে করতে চাইছ আমিই নাহয় সব ব্যবস্থা করে দিতাম।
মেঘ: কণা তুমি বিশ্বাস করো এইসব কিছুই আমি জানিনা, শায়লা আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
আমি: পেপারটা আমি নিয়ে গেলাম কাজে লাগতে পারে।
মেঘ: প্লিজ কণা এইটা ছিঁড়ে ফেলো আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মেঘ ফ্লোরে বসে কাঁদছে চুপচাপ পেপারটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আর ডিভোর্স পেপারটার দিকে তাকিয়ে দেখছি মেঘ কতো সুন্দর সাইন করে দিয়েছে। চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ে পেপারটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। মেঘ’কে তো আমি ভালোবাসি তাহলে ও আমার সাথে এমন কেন করছে? আচ্ছা মেঘও তো আমায় ভালোবাসে তাহলে ও এমনটা করতে যাবে কেন? তবে কি আমি যা দেখছি তা ভুল? মেঘ এসব সত্যি করছে নাকি শায়লা মেঘকে বারবার ফাঁসাচ্ছে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১২

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১২

লেখিকা: সুলতানা তমা

চোখ খুলে তাকালাম সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছে, দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সারা শরীর অবশ হয়ে আছে আস্তে আস্তে হাতটা নাড়ালাম। এখন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমি বিছানায় শুয়ে আছি পাশে মেঘ আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আবারো মেঘের দিকে তাকালাম ওর চোখেমুখে ক্লান্তির চাপ সারা রাত ঘুমায়নি মনে হয়। রাতের কথা মনে পড়লো আমি তো বাথরুমে ছিলাম এখানে কিভাবে… মাথাটা একটু তুলে বাথরুমের দিকে তাকালাম, বাথরুমের দরজা ভাঙ্গা তারমানে…
মেঘ: তোমার ঘুম ভেঙ্গেছে? কিছু খাবে সুপ করে আনবো? (মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে এই মানুষটাই রাতে আমার সাথে ঝগড়া করেছে আমাকে থাপ্পড় মেরেছে আর এখন এই মানুষটাই আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করছে)
মেঘ: আর রেগে থেকো না প্লিজ কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমার উপর হাত তুলবো না। (মেঘ আমার দুগালে আলতো করে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো)
আমি: রাগ করিনি।
মেঘ: একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।

মেঘ কিছুক্ষণ পর হাতে সুপ নিয়ে রুমে ঢুকলো, ওর চোখ দুটু লাল হয়ে আছে।
মেঘ: এইটা খেয়ে নাও। (ও নিজেই এসে আমাকে আধশোয়া করে শুয়ে দিলো)
আমি: তুমি কান্না করেছ?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি।
মেঘ: হু খেয়ে নাও।
আমি: খাবো না বলো কাঁদছ কেন?
মেঘ: কাঁদবো নাতো কি করবো? কিছু মনে আছে তোমার রাতে কি করেছ? তুমি বাথরুমে ঢুকে যতোক্ষণ কেঁদেছ ততক্ষণ আমিও দরজার পাশে বসে কেঁদেছি। হঠাৎ করে তোমার কান্না বন্ধ হয়ে যায় তোমাকে অনেক ডেকেছি কিন্তু কোনো সাড়া দাওনি, কতোটা ভয় পেয়েছিলাম আমি জানো তুমি ধারণা করতে পারছ? আমার কান্না শুনে বাসার সবাই চলে এসেছিল তারপর দরজা ভেঙ্গে বাথরুমে ঢুকে দেখি তুমি অজ্ঞান হয়ে পরে আছ। তোমাকে বাথরুমে নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে আমার কেমন লেগেছিল বুঝতে পারছ তুমি? ডক্টর এসেছিল তোমার গায়ে প্রচুর জ্বর ছিল জ্ঞান ফিরছিল না, প্রায় এক ঘন্টা পর তোমার জ্ঞান ফিরে তারপর ডক্টর তোমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখে যায়। সারারাত তো ঘুমিয়েছ দেখেছ আমি কতোটা চটপট করেছি? এই কিছুক্ষণ আগে দুচোখের পাতা এক করেছিলাম। (মেঘের কথাগুলো শুনে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বোবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে)
মেঘ: অবশ্য দোষটা আমারই এতো গুলো থাপ্পড় দেওয়া উচিত হয়নি, আমি কি করবো বলো সবকিছুতে শায়ালাকে টেনে আনো তুমি ভালো লাগে বুঝি। (মেঘ আমার মুখের সামনে সুপ এনে ধরলো চুপচাপ খেয়ে নিলাম)

মেঘ সুপের বাটী টেবিলে রেখে জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে দিল তারপর আমার পাশে এসে আধশোয়া হয়ে শুয়ে রইলো। পাশ ফিরে আমার দিকে একবার তাকালো তারপর একটা হাত বাড়িয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমাকে টেনে নিয়ে ওর বুকে শুয়ে দিলো, চুপচাপ শুয়ে রইলাম ওর বুকে।
মেঘ: এখনো রেগে আছ?
আমি: নাতো।
মেঘ: রাতে কতোটা ভয় পেয়েছিলাম জানো তুমি? সবাই আমাকে খুব বকেছে তোমার গাল লাল দেখে। আমারো অনেক কষ্ট হয়েছে এখনো হচ্ছে এভাবে মারতে চাইনি কিন্তু তুমি…
আমি: বাদ দাওনা এসব। (মেঘকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ও আমার মাথায় চুমু খেলো)
মেঘ: একটু ছাদে যাবে?
আমি: কেন?
মেঘ: চলনা। (মেঘ উঠে আমাকে কোলে তুলে নিলো, দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে রইলাম ওর চোখের দিকে)

মেঘ আমাকে কোলে করে এনে ছাদে নামিয়ে দিলো, ছাদ সাজানো দেখে বেশ অবাক হলাম। মেঘের দিকে তাকাতেই ও আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
মেঘ: বলেছিলাম তো সারপ্রাইজ আছে। আজ আমার বার্থডে আর রাতে এজন্যই তোমাকে শাড়িটা পড়তে বলেছিলাম, ইচ্ছে ছিল এই খোলা আকাশের নিচে তোমার কোলে শুয়ে সারারাত কাটিয়ে দিবো কিন্তু তুমি…
আমি: শায়লাকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি তাছাড়া ও বলেছিল উকিল নাকি বলেছে ও চাইলেই তোহাকে নিয়ে যেতে পারবে। তুমি তো জানো তোহাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না তাই মাথা ঠিক ছিল না। আমি বুঝতে পারিনি আজ তোমার বার্থডে জানলে আ…
মেঘ: এখন তো জানো…
আমি: হ্যাপি বার্থডে তোহার আব্বু।
মেঘ: পাকনা বুড়ি হয়ে গেছ তোহার আব্বু ডাকা হচ্ছে।
আমি: হ্যাঁ আমাকে তোহার আম্মু ডাকবে বুঝেছ?
মেঘ: ভাবছি তোহার একটা পুঁচকে ভাই অথবা বোন হলে কেমন হয়। (মেঘ আমার পেটে দুহাত দিয়ে খেলা করছে, ওর কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম)
মেঘ: লজ্জা পেয়েছ কথা বলছ না যে।
আমি: জানিনা। (ঘুরে গিয়ে মেঘের বুকে মুখ লোকালাম। মেঘ সত্যি আমাকে ভালোবাসে শুধু শায়লাকে এখন আমাদের মাঝখান থেকে সরাতে হবে)
মেঘ: বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: তোহাকে হারানোর ভয়েই আমি শায়লার সাথে কথা বলি, ও চাইলেই তোহাকে নিয়ে যেতে পারে তাই ভয় হয়।
আমি: তোমার সাথে আমার কথা ছিল।
মেঘ: তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন কষ্ট হচ্ছে তোমার?
আমি: নাতো। (সকালের মৃদু বাতাসে শরীর কাঁপছে সত্যি কষ্ট হচ্ছে কিন্তু মেঘকে বুঝতে দিলে হবে না এমনি সারারাত চটপট করেছে)
মেঘ: তোমার কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি রুমে চলো।

মেঘ আমাকে নিয়ে রুমে আসলো তারপর বিছানায় শুয়ে দিলো। এবার মেঘকে সবকিছু বলা প্রয়োজন।
আমি: তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।
মেঘ: ভালোবাসি বলবে তো…
আমি: না আসলে আব্বু…
জোহা: আপু আসবো?
আমি: আয়। (জোহা এসে তোহাকে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল)
তোহা: নতুন আম্মুকে ছাড়া আমি আর কখনো ঘুমাবো না।
আমি: কেন আম্মু?
তোহা: কেন আবার আমার ঘুম আসেনা তাই।
শায়লা: তোকে ছাড়া যে আমারো ঘুম আসেনা মা। (দরজায় শায়লাকে দেখে চমকে উঠলাম আবার এসেছে ও)
শায়লা: ভাবছি তোহাকে নিয়ে চলে যাবো।
আমি: না ওকে নিয়ো না। (তোহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম শায়লা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে)
মেঘ: শায়লা ওখানেই দাঁড়াও, তোমাকে তো বলেছি তুমি যা চাইবে তাই দিবো তাহলে কেন করছ এরকম?
শায়লা: বাহ্ মেঘ বড়লোক বউ পাশে থাকাতে রাতের সব কথা ভুলে গেলে?
মেঘ: মানে?
শায়লা: তুমিই তো রাতে বললে কণাকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে আবার বিয়ে করবে তারপর তোহাকে নিয়ে আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করবো।
আমি: মেঘ ও এসব কি বলছে?
মেঘ: সব মিথ্যে বলছে সারারাত তো আমি তোমার পাশেই বসে ছিলাম আর ওকে আমি এসব বলতে যাবো কেন?
আমি: শায়লা তুমি কিন্তু শর্ত ভুলে যাচ্ছ।
শায়লা: অনেক ভেবে দেখলাম শর্ত গুলো ভুলে যাওয়াই ভালো কারণ আমি যা চাইছি তা আমি এমনিতেই পাবো।
আমি: কি চাইছ তুমি?
শায়লা: সব কথা বলে দিতে নেই। (শায়লা ফিসফিস করে কথাটা বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল। কোথায় পাবো প্রমাণ কবে শায়লাকে জেলে পাঠাবো আর ভালো লাগছে না)
মেঘ: কণা তুমি চিন্তা করো না তোহা তোমার কাছেই থাকবে।
আমি: হুম।

তোহার পাশে শুয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, মেয়েটা চারহাত পা দিয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ ওকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। আমারো বড্ড ভয় হচ্ছে শায়লা যদি সত্যি তোহাকে নিয়ে যায় তখন আমি কি করবো। না না এর আগেই শায়লাকে জেলে দিতে হবে।
মা: বৌমা তোমার শরীর এখন কেমন।
আমি: এইতো মা এখন একটু ভালো।
মা: মেঘ তো জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চেয়েছিল কিন্তু হলো না তাই বলছিলাম কি আজ সন্ধ্যায় একটা পার্টি…
মেঘ: না আম্মু কণা অসুস্থ এ অবস্থায় এসবের প্রয়োজন নেই। (মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে হাত দিয়ে রুমে আসতে বললাম)
মেঘ: কিছু বলবে?
আমি: মা যখন চাইছেন তখন…
মেঘ: বললাম তো এসব কিছু হবে না আগে তুমি সুস্থ হয়ে উঠো আমার আর কিছু চাই না।
আমি: তাই বলে জন্মদিন…
মা: থাক বৌমা ও যখন চাইছে না তাহলে এসব না করাই ভালো। (মা চলে গেলেন মেঘ এসে আমার পাশে বসলো)
আমি: তুমি তো চেয়েছিলে সেলিব্রেট করতে তাহলে মা বলাতে না করলে কেন?
মেঘ: তুমি তো অসুস্থ বাদ দাও।
আমি: তাই বলে…
মেঘ: তুমি সুস্থ হলে পর নাহয় আমার গিফট চেয়ে নিবো। (মেঘের মুখে দুষ্টু হাসি দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালাম)
মেঘ: তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো প্লিজ। (মেঘ চোখ টিপ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, ওর কথার কিছুই বুঝলাম না)

অসুস্থতার মধ্যে দুটু দিন কেটে গেল, এখন পুরোপুরি সুস্থ আছি। আজ যেভাবেই হউক একবার বাইরে যেতে হবে। শায়লার সম্পর্কে সবকিছু জানতে হবে আমাকে। সেদিনের পর শায়লা আর এ বাসায় আসেনি, কোথায় আছে কি প্ল্যান করছে সব জানতে হবে আমাকে। কিন্তু কিভাবে বাইরে যাবো? আব্বুকে বলে যাবো? মেঘকে বললে তো আমাকে একা বের হতে দিবে না তাছাড়া শায়লা যে আব্বুর খুনি একথাটা মেঘকে এখনো বলা হয়নি যখনি বলতে চাই কোনো একটা বাঁধা পড়ে যায়। আজ মেঘকে সবকিছু বলবো তারপর বাসার বাইরে যাবো।
মেঘ: কণা টাই’টা বেঁধে দাওনা… (মেঘ হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর টাই বেঁধে দিতে দিতে বললাম..)
আমি: রোজ রোজ আমি টাই বেঁধে দিতে পারবো না এখন থেকে সকালে তাড়াতাড়ি উঠবে বুঝেছ?
মেঘ: এখন থেকে তো সকালে উঠতে আরো বেশি দেরি হবে।
আমি: তুমি আবার দুষ্টু হাসি হাসছ?
মেঘ: আজ তোমার জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে।
আমি: আবার সারপ্রাইজ?
মেঘ: হ্যাঁ, আসছি।
আমি: আরে কিসের সারপ্রাইজ বলে তো যাও।
মেঘ: অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। (দ্যাত চলে গেল, এই মেঘকে আমি একদম বুঝতে পারিনা)

ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি সবাই রেডি হচ্ছে কোথায় যাবে সবাই?
আমি: মা সবাই মিলে কোথায় যাচ্ছেন?
মা: গ্রামের বাড়ি যাবো।
আমি: সবাই?
দাদী: তুই আর মেঘ থাকবি শুধু।
জোহা: আমি রেডি।
আমি: জোহা তুইও…
জোহা: গ্রাম দেখার লোভ আমি সামলাতে পারছি না আপু।
মা: আসুক না সবাই মিলে ঘুরে আসবো।
দাদী: ওইতো পপি আর রুহান চলে এসেছে। (সিঁড়ির দিকে তাকালাম দুজন একসাথেই নেমে আসছে, রুহানের রাগ কিছুটা কমলেও পপিকে ওর মন মেনে নিতে পারছে না। পপি এতটুকুও ভেঙে পরেনি বরং সবসময় হাসিখুশি থাকে সত্যি মেয়েটা পারেও)
রুহান: দাদী বলছিলাম আমি না গেলে হয় না?
দাদী: নতুন বিয়ে করেছিস বউ নিয়ে ঘুরার সুযোগ পাচ্ছিস আর এখন এসব কথা বলছিস।
চাঁচি: হুহ নতুন বিয়ে নতুন বউ।
আমি: হ্যাঁ ঘুরে এসো সবার সাথে দুজনেরই ভালো লাগবে।
মা: তোহাকে নিয়ে যাবো?
আমি: না না ও আমার কাছেই থাকবে।
তোহা: আমি যাবো দাদুর সাথে।
আব্বু: নিয়ে যাই সবাই তো আছি আমরা সমস্যা হবে না তোমার মেয়ের।
মা: আজ একটু কষ্ট করে রান্না করে নিও মা আসছি আমরা।
সবাই চলে গেল সাথে আমার মেয়েটাকেও নিয়ে গেল, আমি একা হয়ে গেলাম মেঘও অফিসে।

সারাদিন একা একা কাটালাম আর ভালো লাগছে না মেঘও আসছে না এতো রাত হয়ে গেল। রান্নাঘরে রান্না করছিলাম হঠাৎ মনে হলো বাসায় কেউ ঢুকেছে, ভয়ে ভয়ে ড্রয়িংরুমে আসলাম মেঘ চোরের মতো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে।
আমি: এই তুমি চোরের মতো রুমে যাচ্ছ কেন?
মেঘ: তুমি রান্না করছ ভেবে ডিস্টার্ব করলাম না আমার হাতে চাবি ছিল তা…
আমি: তুমি কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে?
মেঘ: নাতো কি লুকাবো?
আমি: হু ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।

মেঘকে খেতে দিয়ে আমিও খেতে বসলাম তখনি আমার ফোন বেজে উঠলো।
মেঘ: আমি যাচ্ছি।
আমি: না তুমি খাওয়া শুরু করো আমি আসছি।

ফোন হাতে নিয়ে দেখি শায়লা এই মেয়ে তো আমাকে জ্বালিয়ে মারছে।
আমি: কি হয়েছে ফোন করেছ কেন?
শায়লা: অনেক ভেবে দেখলাম আমার মেয়ে প্রয়োজন নেই সম্পত্তি প্রয়োজন তাই মেয়েটা তোমাকে দিয়ে সম্পত্তির জন্য ফোন দিলাম।
আমি: তুমি চাইবে আর আমি দিয়ে দিবো এতোই সস্তা? খুব ভালো করে শুনে রাখো তুমি যে আব্বুর খুনি সেটা আমি জেনে গেছি এখন শুধু…
শায়লা: প্রমাণের অপেক্ষা? কিন্তু প্রমাণ তো তুমি পাবে না কারণ আমি প্রমাণ রেখে কোনো কাজ করিনা।
আমি: আমিতো প্রমাণ খুঁজে বের করবোই।
শায়লা: তার আগেই যদি তোহাকে আমি নিয়ে আসি তাহলে তো সব সম্পত্তি আমার।
আমি: হিহিহি তুমি এতো বোকা জানতাম নাতো।
শায়লা: মানে?
আমি: সব কথা বলে দিতে নেই। (ফোনটা কেটে দিলাম। শায়লা আশা নিয়ে বসে আছে ও তো জানেই না নতুন উইল আমি কিভাবে তৈরি করেছি, তোহাকে নিয়ে গেলেও সম্পত্তি ও পাবে না)

মেঘ খাওয়া শেষ করে চুপচাপ বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি: এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ?
মেঘ: হুম তোমার খেতে হবে না রুমে চলো।
আমি: আমার খিদে আছে তো তুমি বললেই হলো নাকি?
মেঘ: তুমি আগে কখনোই কি রান্না করনি?
আমি: কেন রান্না খারাপ হয়েছে?
মেঘ: নাতো অনেক ভালো হয়েছে তুমি নিজেই দেখো আমি কতোটা খেয়েছি। (মেঘ তো সব রান্নাই খেয়েছে সত্যি কিন্তু ওর কথায় কিছুটা খটকা লাগলো। ওর দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে দিলাম)
আমি: ওয়াক থুঃ…
মেঘ: আরে কি হলো নাও পানি খাও।
আমি: এসব রান্না তুমি খেয়েছ কিভাবে?
মেঘ: লবণ একটু বেশি হয়েছে কিন্তু রান্নাটা দারুণ…
আমি: চুপ করো এজন্যই আমাকে খেতে নিষেধ করেছিলে? এতো লবণ তুমি খেয়েছ কিভাবে?
মেঘ: আমার বউটা কষ্ট করে রান্না করেছে আমি না খেলে তো কষ্ট পেতো। (চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে এতো ভালোবাসে আমায়। মেঘ মুচকি হেসে আমার সামনে থেকে প্লেট নিয়ে গেল)
মেঘ: আর খেতে হবে না চলো।
আমি: আরে কি করছ?
মেঘ: বলেছিলাম না জন্মদিনের গিফট ঠিক চেয়ে নিবো। (মেঘ আমাকে কোলে তুলে নিলো কি চাইছে ও কিছুই বুঝতে পারছি না)

মেঘ আমাকে কোলে করে অন্য একটি রুমে নিয়ে আসলো। রুমের অবস্থা দেখে আমি পুরো থ হয়ে গেলাম। ঠিক আমাদের বাসর ঘরের মতো সাজানো দেখে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। একদম সেই সাজ পুরো রুম জোরে নীল সাদা অর্কিড ফুলের ছড়াছড়ি, সাথে জ্বলছে অনেক গুলো ক্যান্ডেল লাইট।
মেঘ: সারপ্রাইজটা কেমন হলো?
আমি: খুব সুন্দর কিন্তু কখন সাজালে এসব?
মেঘ: তুমি রান্না করছিলে সন্ধ্যার সময় এসে সাজিয়েছি বুঝতেও পারনি তুমি।
আমি: কিন্তু এসব কেন?
মেঘ: আজ আমরা আমাদের জীবন নতুন করে শুরু করবো।
আমি: মামাননে?
মেঘ: সব ভুলের অবসান ঘটাবো আজ।
মেঘ আমাকে খাটের উপর শুয়ে দিলো, ওর কাজকর্ম দেখে অবাক হচ্ছি শুধু।
মেঘ: তুমি কখনো আমার মনে এতোটা জায়গা করে নিবে আমি ভাবতেও পারিনি। সব ভুলের জন্য সরি, চলো আজ সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করি।
মেঘ আমার নাকের সাথে ওর নাক ঘষছে। আমার হাত বিছানায় চেপে ধরে আঙ্গুলের বাজে বাজে ওর হাতের আঙ্গুল গুলো আটকে দিলো। মেঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম ও আমার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কেমন যেন নেশা মিশানো ওর চোখ দুটুতে, এই চোখের গভীরতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে পারছি না ওর চোখ দুটুর দিকে, আস্তে আস্তে চোখ বুঝে ফেললাম। মেঘ আমার আরো কাছে চলে আসলো, দুজনের নিঃশ্বাস ভারী খাচ্ছে চোখ খুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। মেঘ আস্তে আস্তে আমার আরো কাছে এসে ওর ঠোঁট দুটু ডুবিয়ে দিলো আমার ঠোঁটের গভীরে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১১

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১১

লেখিকা: সুলতানা তমা

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি সবাই একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো আবার পপির দিকে তাকাচ্ছে। মেঘ হুট করে এসে আমার হাত চেপে ধরলো।
মেঘ: এসব কি হ্যাঁ কি করেছ এইটা? বলছ না কেন? (মেঘের ধমকে ভয়ে চুপসে গেলাম, বাবা এসে মেঘের হাত সরিয়ে দিয়ে আমাকে উনার কাছে নিয়ে আসলেন)
বাবা: বৌমা তুমি হঠাৎ…
আমি: বাবা পপি রুহানকে ছোট থেকে ভালোবাসে তাই আ…
চাঁচি: তাই উনি ওদের বিয়ে দিয়ে মহৎ কাজ করেছেন।
বাবা: তুমি চুপ করতো।
চাঁচি: কেন চুপ করবো বিয়েটা কি ছেলেখেলা? বড়লোকের মেয়ে বলে আমাদের বাড়ির ছেলে মেয়ের জীবন নিয়ে খেলবে নাকি?
বাবা: কণা মা…
আমি: বাবা প্লিজ আপনি বিশ্বাস করুন পপি রুহানকে ভালোবাসে। হ্যাঁ রুহান এখন পাগলামি করছে কিন্তু দেখবেন কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা: পপি তুই রুহানকে ভালোবাসিস?
পপি: (নিশ্চুপ)
আমি: পপি বলে দাও ভালোবাসার কথা লুকিয়ে রাখতে নেই।
মেঘ: কিন্তু রুহান তো পপিকে ভালোবাসে না পপি কি সুখী হবে?
দাদি: নিজের বোনের সুখ খুঁজছিস অথচ নিজেই নিজের বউকে সুখী করছিস না কি অদ্ভুত। (দাদির কথায় মেঘ কেমন করে যেন তাকালো আমার দিকে)
পপি: আমি ঠিক রুহানের ভালোবাসা জয় করে নিবো দেখো তোমরা।
মা: এভাবে সুখী হওয়া যায়না মা।
বাবা: যা হবার হয়েছে এখন শুধু ওদের জন্য দোয়া কর সুখী হয় যেন।
চাঁচি: তুমি মেনে নিলে?
বাবা: হ্যাঁ, না মানার কি আছে ওরা তো ভুল কিছু করেনি ভালোবাসে তাই বিয়ে করেছে।
পপি: আব্বু…(পপি গিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো, যাক বাবা সবাই তো মেনে নিলো)
চাঁচি: আমি এই বিয়ে মানি না।
মা: কেন মানবে না আমার মেয়ে কম কিসে?
চাঁচি: সে কথা নয় আসলে..(এই মহিলাকে থামাতে হবে নাহলে জামেলা বাড়বে। উনার পাশে এসে আস্তে আস্তে বললাম..)
আমি: চুপচাপ মেনে নিন নাহলে দাদিকে বলে দিবো আপনি আমার আর মেঘের ডিভোর্স করানোর জন্য চক্রান্ত করছেন। একবার বলে দিলে কিন্তু দাদি আপনাকে আর রুহানকে ঘাড় ধাক্কা…(উনার রাগি চাহনি দেখে থেমে গেলাম কিন্তু এখন উনি মানতে বাধ্য)
দাদি: এই তোরা কি ফিসফিস করছিস?
আমি: ওই তো দাদী চাঁচিকে বলছিলাম আমাকে একটু হেল্প করতে ওদের বাসরঘর সাজাতে হবে না?
চাঁচি: না আমি…(আবার কথা বলছেন এখন কিন্তু বলেই দিবো। চাঁচি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছেন আর বেলুনের মতো ফুলছেন হিহিহি)
দাদি: হ্যাঁ বাসরঘর সাজাতে হবে তো, কিন্তু মেঘের পছন্দ আমি জানতাম বলে কিভাবে কিভাবে সাজাতে হবে বলে দিয়েছিলাম রুহানের পছন্দ তো জানিনা। (তারমানে সেদিন বাসরঘর মেঘের পছন্দ অনুযায়ী দাদি সাজিয়েছিলেন, মেঘ আর আমার পছন্দে এতো মিল। মেঘের দিকে তাকালাম ও আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন কোনো কিছুর জন্য মেঘ অনুশোচনায় ভোগছে)
দাদি: আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে নিচ্ছি তোরা যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে আর পপিকে জোহার রুমে নিয়ে যা এখন।
জোহা: ঠিক আছে দাদি। (জোহা পপিকে নিয়ে ওর রুমের দিকে চলে গেল, আমিও রুমের দিকে পা বাড়ালাম)

ফ্রেশ হয়ে এসে ফোনটা হাতে নিলাম সন্ধ্যা হয়ে আসছে অনেক কাজ বাকি তার আগে আম্মুকে ফোন করা প্রয়োজন। আম্মুকে ফোন দিতেই রিসিভ করলেন।
আম্মু: আমাকে ভুলে গেলি।
আমি: না আম্মু একটু বিজি ছিলাম তাই…
আম্মু: হয়েছে হয়েছে বড় হয়ে গেছ তো বিজি তো থাকবাই। পড়াশুনা চলছে নাকি শশুড় বাড়িতে লক্ষী বৌমা সেজে বসে আছ? (সত্যি তো পড়াশোনার প্রতি তো একদম সময় দিচ্ছি না)
আম্মু: পরীক্ষা কিন্তু সামনে আমি মনে করিয়ে দিলাম।
আমি: তুমি টেনশন করোনা তো আমি ঠিক সামলে নিবো।
আম্মু: আমার ছোট মেয়েটা এখন বড় হয়ে গেছে এখন সবার সাহস জোগাতে পারে। (হ্যাঁ আম্মু আমি সত্যি অনেক বড় হয়ে গেছি, আব্বুকে হারানোর যন্ত্রণায় রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদি কিন্তু কাউকে বুঝতে দেইনা, মেঘের অবহেলায় আমি একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি কিন্তু কাউকে বুঝতে দেইনা আমি সত্যি অনেক বড় হয়ে গেছি আম্মু। আমি আর তোমার সেই ছোট্ট কণা নেই)
আম্মু: কণা কথা বলছিস না কেন?
আমি: বলতেছি তো আম্মু।
আম্মু: খুনির কোনো খুঁজ পেলি?
আমি: না তবে চিন্তা করোনা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো।
আম্মু: ওহ! (বেশ বুঝতে পারছি আম্মু কাঁদছেন, চুপচাপ ফোনটা কেটে দিলাম)

আম্মুকে ইচ্ছে করেই বলিনি আমি যে খুনী কে জানতে পেরেছি। বললে আম্মু দেশে আসতে চাইতেন তাই…
মেঘ: কণা তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ..(বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম মেঘ আসাতে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম)
মেঘ: তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: নাতো।
মেঘ: মিথ্যে বলোনা কণা প্লিজ।
আমি: আব্বুর কথা মনে পড়ছে তাই।
মেঘ: শুধু কি তাই? (মেঘের চোখের দিকে তাকালাম কিভাবে বুঝাই ওকে, ওর অবহেলা গুলো যে আর নিতে পারছি না আমি)
মেঘ: বলো আমাকে কি হয়েছে? (মেঘ দুহাত দিয়ে আমার দুগালে ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: তোমাকে বলে কি হবে তুমি তো আমাকে বুঝই না। ছাড়ো আমাকে আ…
মেঘ: ছাড়বো না। (মেঘ আমাকে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো, আমিও তো চাই ওর এই বুকে মাথা রেখে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে কিন্তু মেঘ.. একবার আমাকে চায় তো একবার শায়লাকে চায়)
আমি: ছাড়ো বলছি।
মেঘ: চেষ্টা করোনা কারণ আমি না ছাড়লে তুমি কখনো যেতে পারবে না।
আমি: কেন করো আমার সাথে এরকম। (মেঘকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম, ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো)
কতোক্ষণ মেঘ আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল বলতে পারবো না, চোখ বন্ধ করে ওর বুকের সাথে মিশে ছিলাম। আচমকা মেঘ আমাকে ছেড়ে দিলো।
মেঘ: আজ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
আমি: কি সারপ্রাইজ?
মেঘ: পাগলী সারপ্রাইজ আগে থেকে বলে দেয় নাকি। (মেঘ হনহন করে চলে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না কিসের সারপ্রাইজ দিবে)

পপি আর রুহানের বিয়ের খুশিতে মা আজ রাতের জন্য অনেক খাবার রান্না করছেন সাথে আমি মাকে হেল্প করছি।
মা: বৌমা তোমার আর রান্না করতে হবে না শরীরের যা অবস্থা করেছ যাও গোসল করে নাও।
আমি: আগে কখনো রান্না করিনি তো তাই একটু সমস্যা হচ্ছে।
মা: হ্যাঁ গলায় গালে ময়দা লাগানো হাতের কি অবস্থা করেছ পাগলী মেয়ে যাও গোসল করে নাও, মেঘ যদি দেখে ওর বউকে দিয়ে আমি রান্না করিয়ে বউয়ের এই হাল করেছি তাহলে তো রেগে যাবে।
আমি: কেন আমি কি বসে বসে খাওয়ার জন্য এসেছি নাকি? বউরা রান্না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে খাবে এটাই তো নিয়ম। (মা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন)
আমি: কি হলো মা?
মা: একদম লক্ষী বৌমার মতো কথা গুলো বলেছ। একদিন ঠিক এভাবেই মেহমান এসেছিল রান্না করতে রাত হয়ে গিয়েছিল, তোমার মতোই শায়লা টুকটাক কাজ করেছিল। পরে রুমে গিয়ে মেঘের সামনে কান্নাকাটি করে বলেছে বাবার বাড়িতে এর আগে কখনো এতো কাজ করেনি আর আমার ছেলেটা রেগে গিয়ে বাড়ির সবাইকে বকেছিল।
আমি: ভয় নেই মা মেঘ আমাকে এতোটা ভালোবাসে না তাছাড়া আমি এমন কোনো কাজ করবো না যেন আমার জন্য এই পরিবারের কেউ ছোট হয় আর আপনি তো মা।
মা: হয়েছে পাকনা বুড়ি এবার থেকে পড়াশুনোয় মন দাও কাজ করতে হবে না। তোমার মা ফোন করে বলেছেন তোমাকে শাসন করতে।
আমি: আম্মু কখন ফোন করেছিলেন?
মা: সকালবেলায়।
জোহা: আপু নাও তোমার মেয়েকে উফফ এতো দুষ্টু।
তোহা: আমি যাবো না পঁচা মেয়ের কাছে। (তোহার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমার মেয়ে আমার কাছে আসতে চাইছে না উল্টো জোহার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে)
আমি: কেন আমি কি করেছি মামুনি?
তোহা: তুমি আজ একবারো আমাকে কোলে নাওনি। (সত্যি তো এতো জামেলার মধ্যে মেয়েটাকে একটু আদরও করা হয়নি)
আমি: আম্মু ফ্রেশ হয়ে এসেই তোমাকে কোলে নিবো। (রুমের দিকে পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠলো আমিই দরজা খুলতে আসলাম)

দরজা খুলে আগে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত সাড়ে আটটা বাজে আর এখন শায়লা এসেছে এই বাসায়।
আমি: এতো রাতে তুমি?
শায়লা: তোহাকে দেখতে এসেছি মেয়েটার জন্য মন কেমন করছিল।
আমি: তোমার আবার মনও আছে নাকি আর শর্তের কথা ভুলে গিয়েছ নাকি?
শায়লা: ভুলিনি শুধু একবার ওকে দেখে চলে যাবো। (শায়লা আমাকে ঠেলে ভিতরে চলে আসলো)
আমি: শুধু দেখবে কোলে নিতে পারবে না।
জোহা: আপু আমি আছি তো তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
আমি: না আগে ও এ বাসা থেকে বের হবে তারপর আমি রুমে যাবো।
শায়লা: এতো রাতে আমি ফিরে যেতে পারবো না।
মা: মানে তুমি এই বাসায় থাকবে নাকি? (শায়লা কিছু না বলে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে রইলো। এই মেয়ে তোহাকে দেখতে এসেছে এই কথা তো একফোঁটাও সত্য না তাহলে কেন এসেছে ও কি মতলব ওর)
আমি: শায়লা তুমি এক্ষণি বের হও।
শায়লা: উকিলের কাছে গিয়েছিলাম উকিল বলেছে আমি চাইলেই তোহাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে পারবো। (ফল কাটার চাকুটা হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছে আর নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কথা শুনে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো কি বলছে এসব ও? সত্যি কি উকিল এই কথা বলেছে)
শায়লা: কিন্তু আমি তোহাকে নিবো না কারণ তোহা তোমার কাছেই ভালো থাকবে তবে হ্যাঁ তার বিনিময়ে আমাকে কিছু দিতে হবে।
আমি: কি চাও তুমি?
শায়লা: সেটা নাহয় হিসেব করে পরে বলবো। ভয় নেই আমি এখানেই আছি তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো আর হ্যাঁ মেঘকে বলো আমি এসেছি। (মা আমাকে ইশারা দিয়ে রুমে চলে যেতে বললেন চুপচাপ রুমের দিকে চলে আসলাম)

রুমে ঢুকতেই দেখি মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে ওর হাসি দেখে রাগ আরো বেড়ে গেল।
মেঘ: বাব্বাহ্ পরী আজ এতো রেগে আছে কেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: তুমি বোধহয় আর কখনো রান্নাঘরের ধারেকাছে যাওনি।
আমি: এতো বকবক করো নাতো তোমার শায়লা এসেছে ওর কাছে যাও।
মেঘ: শায়লা এই সময়? (ওর কথার উত্তর না দিয়ে গোসল করার জন্য বাতরুমে চলে আসলাম)

গোসল করে রুমে আসতেই বিছানায় চোখ পড়লো বেগুনী রঙের একটা শাড়ি রাখা সাথে ছোট একটা চিরকুট। “শাড়িটা পড়ে নিও” চিরকুট সহ শাড়িটা ছুড়ে ফ্লোরে ফেলে দিলাম। এতো নাটক করে কিভাবে ও ভাবতেই পারছি না।

নিচে আসতেই মেঘ আমার দিকে রাগি চোখে তাকালো। বাহ্ মেঘ আর শায়লা পাশাপাশি বসে আছে কোথায় আমি রাগ দেখাবো উল্টো ও রেগে আছে। মেঘের দিকে আর তাকালাম না মায়ের কাছে রান্নাঘরে চলে গেলাম।
মা: পপি আর রুহান এসেছে?
আমি: হ্যাঁ সবাই আছে ড্রয়িংরুমে।
মা: খাবার গুলো টেবিলে নিয়ে যাও।
আমি: হুম।
মা: বৌমা কি হয়েছে?
আমি: কিছু নাতো।
মা: শায়লা এসেছে বলে মন খারাপ করে রেখেছ?
আমি: মেঘ শায়লাকে ভালোবাসে তাছাড়া এ বাড়িতে ওদের মেয়ে আছে শায়লা তো আসবেই। আমি কে রাগ করার?
মা: জানিতো মেঘের উপর অভিমান করে আছ। (মায়ের কথার কোনো জবাব দিলাম না, অভিমান কার উপর করবো যে আমাকে ভালোই বাসে না)

খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেল, আমি পপিকে নিয়ে রুহানের রুমে আসলাম। পুরো রুম খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দাদী বুড়ো হলেও পছন্দ আছে বলতে হয়। পপিকে খাটে বসিয়ে দিয়ে রুহানের পাশে এসে দাঁড়ালাম রুহান চুপচাপ সোফায় বসে আছে।
আমি: রুহান…
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: ক্ষমা করে দিও আমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইনি কিন্তু এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পপি তোমাকে ভালোবেসে দিনের পর দিন কষ্ট পাচ্ছে তাছাড়া তুমি যা চাইছ তা সম্ভব না তাই এই কাজ করতে হলো। আজ হয়তো পপিকে মেনে নিবে না কিন্তু একদিন ঠিক মেনে নিবে। আর তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে এবার থেকে নাহয় সবটুকু ভালোবাসা পপিকে দেওয়ার চেষ্টা করো।
রুহান: তোমার কথা শেষ হলে আসতে পারো।
পপি: ভাবি কাকে কি বুঝাচ্ছ ও তোমার কথার কিছুই বুঝবে না উল্টো অপমান করবে।
আমি: সমস্যা নেই একটু অপমানিত হলাম নাহয়।
রুহান: আমার মাথা ঠিক নেই তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না প্লিজ তুমি চলে যাও।
আমি: হ্যাঁ চলে যাচ্ছি তোমার কাছে শুধু একটা অনুরোধ আমি যে কষ্টের আগুনে পুড়ছি সে আগুনে পপিকে পুড়তে দিওনা।
চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে আসলাম ওদের রুম থেকে। স্বামী অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসে এইটা নিজ চোখে দেখতে হয় এইটা বোধহয় একটি মেয়ের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট। আমি আর পপি দুজনই এই একি কষ্টে ভুগছি।

রুমে এসে দেখি মেঘ শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে আছে তোহা তো বিছানায় নেই।
আমি: তোহা কোথায়?
মেঘ: জোহা নিয়ে গেল বললো ওর কাছেই থাকবে।
আমি: ওহ।
মেঘ: কোথায় যাচ্ছ?
আমি: তোহার কাছে।
মেঘ: দাঁড়াও বলছি। (মেঘ এসে আমার হাত ধরে ফেললো)
আমি: কি হচ্ছে এসব?
মেঘ: জোহা নিয়ে গেছে এখন তুমি নিয়ে আসতে গেলে জোহা কি ভাববে?
আমি: ঠিক আছে যাবো না হাত ছাড়ো।
মেঘ: খাবে না? তখন তো তোহাকে খাইয়ে দিয়েছ তুমি খাওনি।
আমি: খিদে নেই।
মেঘ: শাড়িটা পড়লে না?
আমি: শায়লা তো পাশের রুমেই আছে ওকে গিয়ে দিয়ে এসো পড়ে দেখাবে তোমাকে। (মেঘ আমার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারলো, গালে হাত দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম)
মেঘ: নিজে গিয়ে তোমার জন্য শাড়ি এনেছি আর তুমি শায়লাকে দিতে বলছ?
আমি: হ্যাঁ বলছি একদম চিৎকার করবা না বলে দিলাম।
মেঘ: কণা তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।
আমি: সীমা তো ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি, ঘরে এক স্ত্রী থাকা অবস্থায় প্রাক্তন স্ত্রীকে বাসায় আসতে দিচ্ছ থাকতে দিচ্ছ আমার সাথেও সময় কাটাচ্ছ শায়লার সাথেও সময় কাটাচ্ছ। পেয়েছ কি তুমি আমাকে যা খুশি করবে আর আমি মেনে নিবো।
মেঘ: আমি শায়লাকে আসতে বলিনি।
আমি: তাহলে ওকে বাসা থেকে বের করে দাওনি কেন নাকি রাতে ওর কাছে…
মেঘ: কণা…(মেঘ আমার দুগালে অনেক গুলো থাপ্পড় বসিয়ে দিলো)
আমি: মেরে ফেলো আমাকে আর পারছি না এসব সহ্য করতে। নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।
মেঘ: চলো আমার সাথে।
আমি: আমার হাত ছাড়ো কোথাও যাবো না আমি। (মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। বাতরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম)
মেঘ: কণা প্লিজ দরজা খুলো উল্টাপাল্টা কিছু করো না। বিশ্বাস করো আমি শায়লাকে ভালোবাসি না আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।

মেঘ এখনো ডাকছে আর দরজায় ধাক্কাচ্ছে ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ভিজতে থাকলাম। এই শাওয়ারের পানিই নাহয় আমার চোখের পানি গুলোকে ধুয়ে দিয়ে যাক। আর পারছি না খুব কষ্ট হচ্ছে আস্তে আস্তে শাওয়ারের নিচে বসে পড়লাম, পাগলের মতো কাঁদছি হয়তো এই কান্না আমার কষ্ট গুলোকে কিছুটা হলেও হালকা করে দিবে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১০

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১০

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘ কপালে হাত দিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, করতে চাইলাম কি আর হলো কি। তাড়াতাড়ি মেঘ’কে ধরে বিছানায় বসালাম।
আমি: সরি আমি এমনটা চাইনি।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: দেখি হাতটা সরাও।
মেঘ: লাগবে না ব্যান্ডেজ করা।
আমি: লাগবে না নাকি আমি করে দিচ্ছি বলে… (মেঘ আমার হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো)
আমি: দিবো না ব্যান্ডেজ করে যাও তোমার শায়লাকে গিয়ে বলো ব্যান্ডেজ করে দিতে।
মেঘ: আবার বলছ।
আমি: একশ একবার বলবো।
মেঘ ব্যান্ডেজ না করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল আমিও বারান্দায় চলে আসলাম। সত্যি আমি এমনটা চাইনি খুব কষ্ট হচ্ছে এখন। মেঘ তাল সামলাতে না পেরে এভাবে পরে গিয়ে এতোটা আঘাত পাবে আমি ভাবতেও পারিনি।
পপি: ভাবি তোহা… একি তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: কোথায় নাতো। (মেঘকে কষ্ট দিয়ে আমিও যে কখন নিজের অজান্তে কেঁদে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি, পপি আসাতে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম)
পপি: ভাইয়ার কপালে কি হয়েছে?
আমি: (নিশ্চুপ)
পপি: তোমরা কি ঝগড়া করেছ?
আমি: হু।
পপি: আরে মন খারাপ করো না এসব দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া কিছু করতে হয়।
আমি: তোমারও তো মন খারাপ।
পপি: এসব বাদ দাও। (হেসে উঠলো পপি, কষ্ট লুকিয়ে রেখে হাসাটা সত্যি খুব যন্ত্রণার। রুহান যে কবে পপির ভালোবাসা বুঝবে)
পপি: আসছি আমি। (পপি তোহাকে রেখে চলে গেল। তোহা রুম থেকে কিছু খেলনা নিয়ে এসে বারান্দায় খেলতে বসে পড়লো)
কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না শায়লা কিভাবে জানলো তোহার নামে সবকিছু দিয়েছি। সেদিন তো আব্বু আর আমি ছাড়া আব্বুর রুমে অন্য কেউ ছিল না যে শুনবে। নাকি রুমের বাইরে থেকে কেউ শুনেছে? মেঘ শুনেনি তো? সেদিন একমাত্র মেঘই তখন আব্বুর রুমের দিকে গিয়েছিল কিন্তু মেঘ শুনলে শায়লাকে বলতে যাবে কেন? তবে কি মেঘ শায়লা দুজন মিলে আমাকে নিয়ে খেলছে? সম্পত্তি পেয়ে গেলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে শায়লাকে মেঘ আবারো বিয়ে করবে এটাই কি ওদের প্ল্যান? উফফফ সবকিছু কেমন যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে।
তোহা: নতুন আম্মু তোমার ফোন। (তোহার ডাকে ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো ও ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ফোনের রিংটোন বাজছিল শুনতেই পাইনি। ফোন হাতে নিয়ে দেখি অচেনা নাম্বার)
আমি: হ্যালো।
–শায়লা বলছি তুমি মেঘকে এভাবে…
আমি: মেঘ কোথায়?
শায়লা: আমার কাছেই আছে।
আমি: আমি ওর মাথায় আঘাত করেছি এবার তুমি ব্যান্ডেজ করে দাও যত্তোসব।
শায়লা: হ্যাঁ দিবো তো, তুমি আর কখনো এমন করবে না বুঝেছ?
আমি: ফোনটা মেঘ’কে দাও। (শায়লা রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা মেঘের হাতে দিলো)
মেঘ: হ্যালো ক…
আমি: এক্ষণি বাসায় এসো।
মেঘ: কণা আমি অফিসে।
কণা: অফিস তোমার নাকি আমার? যা হবে তা আমি বুঝবো তুমি এক্ষণি এসো।
মেঘ: হুম।
মেঘ ফোন রেখে দিলো। সাহস কতো বড় আমি ব্যান্ডেজ করে দিতে চেয়েছি করেনি চলে গেছে শায়লার কাছে। আগে তো শুধু কপাল কেটেছে এখন ওর পুরো মাথা ফাটাবো।

রুহান: আম্মু তুমি এসব কি বলছ আমি কণাকে সত্যি ভালোবাসি। (রুহানের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ রুহানের কথা শুনে থমকে দাঁড়ালাম)
চাঁচি: হ্যাঁ সেটা আমিও জানি তাইতো বলছি তু…
রুহান: তুমি যা করছ তা ঠিক না আম্মু।
চাঁচি: তুই কি কণাকে তোর করে চাস না?
রুহান: হ্যাঁ চাই কিন্তু তাই বলে এভাবে?
চাঁচি: ভালোবাসায় একটু জোড় খাটাতে হয় বুঝেছিস গাধা।
রুহান: কিন্তু…
চাঁচি: তুই একটু পাগলামি কর দেখবি সবাই মেনে নিবে তাছাড়া মেঘ তো কণাকে মেনে নেয়নি তুই চাইলেই মেঘ কণাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।
রুহান: তাতো বুঝলাম কিন্তু তুমি কণাকে আমার বউ বানানোর জন্য এতো…
চাঁচি: এসব তোর এই গোবরের মাথায় ঢুকবে না। যা বলেছি তাই কর। (চাঁচি এদিকেই আসছেন বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি সরে গেলাম, চাঁচি রুহানকে কি করতে বললেন কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। আর আমাকে রুহানের বউ বানিয়ে চাঁচির কি লাভ)
মেঘ: ওহ তুমি এখানে? এতো তাড়াতাড়ি আসতে বললে যে? (এমনিতেই টেনশনে আছি তার উপর মেঘ এর কপালে সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করা দেখে রাগ মাথায় ছড়ে বসলো। ওর শার্টের কলার চেপে ধরে ওকে টেনে রুমে নিয়ে আসলাম)

মেঘ’কে খাটে বসিয়ে টেনে হিছড়ে ওর কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেললাম।
আমি: শায়লাকে দিয়ে ব্যান্ডেজ করানো হয়েছে আমার হাতে ব্যান্ডেজ ভালো লাগে না… (মেঘ আমাকে টান দিয়ে শুয়ে দিলো বিছানায়, আমার উপর শুয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দুচোখের দিকে। মেঘের এমন চাহনি দেখে খুব অসস্থি হচ্ছে)
মেঘ: আল্লাহ্‌ যেন প্রত্যেকটা ছেলের জীবনে এমন গুন্ডি বউ দেন। (মেঘ মিটিমিটি হাসছে ওর কথার অর্থ বুঝতে একটু সময় লাগলেও বুঝে ফেলেছি একটু আগে ওর শার্টের কলার এভাবে ধরাতে এই কথা বলছে, লজ্জা পেয়ে ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেললাম)
মেঘ: মেঘের কণা লজ্জা পেলে যে এতোটা সুন্দর লাগে আগে তো দেখিনি… (মেঘ আমার নাক টেনে দিলো, ও আমার এতোটা কাছে আছে ভাবতেই মনে অন্যরকম এক শিহরণ জেগে উঠলো। আবারো ওর চোখের দিকে তাকালাম)

কতক্ষণ মেঘের চোখের গভীরতায় ডুবে ছিলাম ঠিক বলতে পারবো না, মেঘের এক আঙ্গুল আমার গলায় খেলা করছে বুঝতে পেরে ওকে তাড়াতাড়ি ঠেলে সরিয়ে দিলাম।
মেঘ: এইটা কি হলো?
আমি: শায়লা তোমার কপালে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে কথাটা ভুলে যাইনি। (উঠে চলে আসতে চাইলাম মেঘ আমার কোমরে ধরে টান দিয়ে বসিয়ে দিলো। আমার পিছনে বসে চুলে নাক ঘষতে শুরু করলো)
মেঘ: ব্যান্ডেজটা অফিসে যাওয়ার সময় ফার্মেসি থেকে করিয়েছি, শায়লা আমাকে এতটুকুও স্পর্শ করেনি।
আমি: কথাটা কতটুকু সত্যি?
মেঘ: যতটুকু সত্যি তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা।
আমি: তাহলে তো বিন্দু পরিমাণও সত্যি না কারণ তুমি আমাকে ভালোবাস না।
মেঘ: তাই?
আমি: আরে কি করছ?
মেঘ: কণা আমি তোমাকে আমার করে পেতে চাই। (মেঘ আমার পেটে ওর হাত দিয়ে খেলা করছিল, ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে আমি দূরে এসে বসলাম)
আমি: শায়লাকে যদি চিরতরে তোমার জীবন থেকে সরাতে পারো তবেই আমাকে পাবে নাহলে ভাববো তুমি আমাকে নিয়ে খেলা করছ। (মেঘ চুপচাপ বসে আছে দেখে রুম থেকে বেরুনোর জন্য পা বাড়ালাম পরক্ষণেই মেঘকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, ফিরে আসলাম ওর কাছে)
আমি: আচ্ছা মেঘ শায়লা যে তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইছে ওর স্বামী কোথায়? তুমি তো বলেছিলে শায়লা ওর প্রেমিকের কাছে ফিরে গেছে তাহলে এখন আবার তাকে রেখে তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইছে কেন?
মেঘ: শায়লা তো বললো ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আমি: কেন হলো?
মেঘ: বললো তো সামান্য ঝগড়াঝাঁটি নিয়ে।
আমি: শায়লা বললো আর তুমি বিশ্বাস করে ফেললে? ভেবে দেখেছ ছয় মাসের ছোট বাচ্চাকে ফেলে যে শায়লা চলে গিয়েছিল তার প্রেমিকের কাছে তাদের কেন সামান্য ঝগড়াঝাঁটি থেকে ডিভোর্স হবে? আচ্ছা আদৌ কি ওদের ডিভোর্স হয়েছে নাকি ওরা তোমাকে কোনো কারণে বোকা বানাচ্ছে? (মেঘ চিন্তিত হয়ে বসে আছে, ভাবো মেঘ শায়লা সত্যি তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইছে কিনা। আমার তো মনে হচ্ছে শায়লা কোনো চালাকি করছে। শায়লাকে পরে দেখছি আগে জানতে হবে চাঁচি রুহানকে কি শিখিয়ে দিয়েছে)

ড্রয়িংরুমে এসে দেখি দাদি আর রুহানের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে, দাদি রেগে গিয়ে রুহানকে একটা থাপ্পড় মারলেন। রুহান গালে হাত দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
দাদি: আগেই বলেছিলাম কণাকে ভুলে যা ওকে শান্তিতে সংসার করতে দে।
রুহান: ভাইয়া তো কণাকে ভালোবাসে না তাহলে ডিভোর্স দিতে সমস্যা কোথায়? আমি তো বলেছি কণাকে আমি বিয়ে করার পরও কণা তোহার মা হয়েই থাকবে আমি কিছু বলবো না তাছাড়া তোহা তো আমার মেয়ের মতোই।
দাদি: আবার তুই ডিভোর্স এর কথা বলছিস? তোকে তো আমি এই বাসা থেকেই বের করে দিবো।
রুহান: বাসা থেকে বের করতে হবে না আমি এই পৃথিবী ছেড়েই চলে যাবো আমি সুইসাইড করবো।
আমি: রুহান দাঁড়াও।
দূর রুহান রাগ করে রুমে চলে গেল। তারমানে বেশি বেশি পাগলামি করার কথা চাঁচি রুহানকে বলে দিয়েছে। কিন্তু এতে চাঁচির লাভ কি? চাঁচির প্ল্যান কি?

চাঁচি: তোমাকে আমি বলেছিলাম এই মেয়ের জীবন থেকে মেঘ’কে সরানোর জন্য যা যা করতে হয় তাই করো কিন্তু তুমি কি করছ… (চাঁচির সাথে কথা বলার জন্য উনার রুমের দিকে এসেছিলাম কিন্তু উনি ফোনে কথা বলছেন শুনে রুমের বাইরে থমকে দাঁড়ালাম। ফোনের অপর পাশ থেকে কে কথা বলছে বা কি কথা বলছে কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না তাহলে বুঝবো কিভাবে)
চাঁচি: আমি খুব তাড়াতাড়ি ওদের ডিভোর্স চাই বুঝেছ? তোমার যা করতে হয় করো শুধু মেঘ কণাকে আমি আলাদা দেখতে চাই। (দেখাচ্ছি তোমাকে মেঘ কণা কতোটা আলাদা, আমাকে চিনো নাই তোমার সব প্ল্যানে আমি জল ঢেলে দিবো)
চাঁচি: আচ্ছা তুমি আমাকে একটা কথা বলতো শায়লা, কণার বাবা সবকিছু তোহার নামে উইল করে দিয়েছে এই কথাটা তোমাকে জানিয়ে আমার কি লাভ হলো? তুমি কণার বাবাকে খুন করালে কিন্তু মেঘ’কে তো ফাঁসাতে পারলে না, মেঘ আর কণা তো এখনো একসাথেই আছে। (চাঁচির মুখে কথাগুলো শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, তারমানে আমার ধারণাই ঠিক শায়লা করছে এসব। কিন্তু চাঁচি কিভাবে শায়লাকে হেল্প করছে এতোটা খারাপ উনি আর চাঁচি আব্বু আর আমার কথা শুনলো কিভাবে? তাহলে কি সেদিন রুমের বাইরে চাঁচি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল? উফফ সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে যাচ্ছে)

রুমে এসে চুপচাপ বসে রইলাম, কি করবো এখন আমি চাঁচিকে পুলিশে দিবো?কিন্তু এতে তো এই পরিবারের সম্মান যাবে আর এই পরিবারের সম্মান যাওয়া মানে বাবা আবারো আঘাত পাবেন স্টোকও করতে পারেন। আব্বুকে হারিয়েছি এখন বাবার মতো শশুড়কে হারাতে পারবো না। তাড়াতাড়ি বাবার রুমের দিকে দৌড় দিলাম।

বাবাকে সবকিছু খুলে বললাম, উনি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন।
আমি: এখন কি করবো বাবা?
বাবা: আর যাই করো মা ওকে পুলিশে দিওনা আমার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে।
আমি: হুম আমি উনাকে ক্ষমা করতে পারি একটা শর্তে।
বাবা: কি শর্ত?
আমি: শায়লা যে আব্বুকে খুন করিয়েছে এই সাক্ষী উনাকে দিতে হবে।
বাবা: অপরাধী কি কখনো নিজের অপরাধ স্বীকার করে তাছাড়া শায়লা তো রুহানের মাকেও মেরে ফেলতে পারে।
আমি: আপাতত কোনো সাক্ষী দিতে হবে না আমি প্রমাণ জোগাড় করি তারপর নাহয়…
বাবা: আমি ভাবছি রুহান এসব শুনলে ছেলেটা কতোটা কষ্ট পাবে। নিজের মায়ের সম্পর্কে এমন কথা কোনো সন্তানই শুনতে চায় না। (ওর মায়ের এই একটা ভুলই তো আমি কাজে লাগাবো বাবা, এই ভুলটাই হবে রুহান আর পপিকে এক করার অস্ত্র)
আমি: শায়লার ব্যাপার আমি পরে দেখছি আগে আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো।
বাবা: কি কথা মা?
আমি: যদি কখনো অনেক বড় অন্যায় করে ফেলি আমি তখন কি আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন? (বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলেন)
বাবা: রায়হান কখনো কোনো অন্যায় কাজ করেনি যাই করেছে কারো না কারো ভালোর জন্যই করেছে তাই তোমার উপরেও আমার বিশ্বাস আছে মা, রায়হানের মেয়েও কোনো অন্যায় করবে না যা করবে কারো ভালোর জন্যই করবে। (মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। বাবার শেষ কথাটায় অনেক ভরসা পেলাম। এবার আমি আমার কাজ শুরু করতে পারবো)

রুহানের রুমে আসলাম ও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে, ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম।
আমি: রুহান জানো তো মানুষ সবসময় যা চায় তা কিন্তু পায় না। তবে এইটাও সত্যি যা চেয়েও পাওনি তারচেয়ে ভালো কিছু একদিন ঠিক পাবে। তেমনি তুমি যেমন আমাকে পাওনি বলে কষ্ট পাচ্ছ একদিন ঠিক এমন কেউ তোমার জীবনে আসবে যে আমাকে ভুলিয়ে দিবে তোমার মন থেকে। তার ভালোবাসায় তখন তোমার মনে হবে…
রুহান: আমি তোমার কাছে জ্ঞান চেয়েছি?
আমি: জ্ঞান দিতে আসিনি আমি, এসেছি একটা সত্য কথা জানাতে।
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: কথাটা শুনার পর হয়তো তুমি আমার সব কথা শুনবে।
রুহান: মানে?
আমি: তোমার আম্মু আমার আব্বুর খুনের সাথে জড়িত আছেন এখন তুমি ভাবো নিজের মাকে কিভাবে বাঁচাবে।
রুহান: কি বলছ এসব?
আমি: বিশ্বাস নাহলে তোমার আম্মুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো অবশ্য উনি স্বীকার নাও করতে পারেন, অপরাধী তো নিজের অন্যায় নিজে স্বীকার করে না যতোক্ষণ না পর্যন্ত পুলিশ…
রুহান: আম্মু এতোটা নিচে নামতে পারেন আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
আমি: এটাই সত্যি রুহান, এখন তুমি বলো উনাকে পুলিশে দিবো নাকি…
রুহান: কণা প্লিজ আম্মুকে মাফ করে দাও।
আমি: হুম কিন্তু শর্ত আছে।
রুহান: আমি তোমার সব শর্তে রাজি শুধু আম্মুকে পুলিশে দিওনা। আম্মু জেলে গেলে এই পরিবারের সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে তাছাড়া চাচ্চু আবারো স্টোক…
আমি: বাবার কথা ভেবেই আমি উনাকে মাফ করবো ভেবেছি নাহলে তো…
রুহান: প্লিজ তুমি রেগে যেও না। তুমি যা বলবে তাই আমি শুনবো।
আমি: তাহলে চলো আমার সাথে।
রুহান: কোথায়?
আমি: প্রশ্ন না করলেই ভালো হবে।

রুহান চুপচাপ আমার সাথে আসলো। পপি আর জোহা একটু বাইরে গিয়েছে, ওদের মেসেজ করে কাজী অফিসে আসতে বললাম।
রুহান: ড্রাইভার এদিকে কোথায় যাচ্ছ?
আমি: শপিংমলে।
রুহান: কিন্তু কেন?
আমি: উফফ রুহান তুমি না বড্ড বেশি কথা বলো। (রুহান চুপচাপ বসে রইলো)

একটা বেনারসি আর একটা পাঞ্জাবী আর কিছু গয়নাগাটি কিনলাম।
রুহান: এসব কিসের জন্য?
আমি: আবার কথা বলছ?
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: চলো।

রুহানকে নিয়ে কাজী অফিসে আসলাম, জোহা আর পপি দাঁড়িয়ে আছে। জোহার হাতে বেনারসি আর গয়না গুলো দিলাম।
আমি: পপিকে সাজিয়ে নিয়ে আয়।
পপি: মামামানে?
আমি: যাও আর রুহান এই পাঞ্জাবীটা পড়ে এসো। (এতোক্ষণে রুহান বুঝতে পেরেছে আমি কি করতে চলেছি)
রুহান: কণা কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
আমি: শর্তের কথা ভুলে গেছ?
রুহান: না তবে পপি কখনো আমার ভালোবাসা পাবে না কথাটা মনে রেখো।
আমি: এইটা পপির উপর ছেড়ে দাও ওর ভালোবাসার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, একদিন ঠিক ও তোমার ভালোবাসা জয় করে নিবে। রুহান রাগে গজগজ করতে করতে পাঞ্জাবীটা হাতে নিয়ে চলে গেল।

রুহান আর পপির বিয়েটা দিয়ে দিলাম, জানিনা কতোটা ঠিক কাজ করেছি তবে মনে হচ্ছে একটি মেয়ের এতো বছরের ভালোবাসা আজ সার্থক হয়েছে।
জোহা: আপু বিয়ে তো হয়ে গেল কিন্তু বাসায় গিয়ে কি বলবে?
আমি: আগে বাসায় তো চল।
জোহা: চলো।
সারা রাস্তা রুহান কারো সাথে কোনো কথা বললো না আর পপি তো ভয়ে আছে বাসার সবাই মানবে কিনা তাছাড়া রুহান ওকে কখনো স্ত্রীর মর্যাদা দিবে কিনা।

বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই মা এসে দরজা খুলে দিলেন, রুহানকে বর সাজে আর পপিকে কনে সাজে দেখে উনি হা হয়ে তাকিয়ে আছেন।
আমি: মা নতুন বর বউকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন নাকি?
মা: এসব তুমি কি বলছ?
আমি: ভিতরে এসে বলি? (মা সরে গেলেন ভিতরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম সবাই)
মা: এসব কি বৌমা?
আমি: পপি রুহানকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে তাই ওদের বিয়ে দিলাম।
চাঁচি: বিয়েটা কি তোমার কাছে ছেলেখেলা মনে হয়? (চাঁচি উপর থেকে নেমে আসতে আসতে চিৎকার করে বললেন, উনার চেঁচামেচিতে সবাই ড্রয়িংরুমে আসতে শুরু করলো)
রুহান: চুপ করো মা, শুধুমাত্র তোমার একটা ভুলের জন্য আজ আমায় এই রাস্তা বেছে নিতে হলো।
রুহান মাথার পাগড়ী ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রুমে চলে গেল। আমায় মাফ করে দিও রুহান, পপির ভালোবাসার জন্য তোমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে হলো তবে হ্যাঁ আমার বিশ্বাস একদিন তুমি আমাকে এই কাজের জন্য ধন্যবাদ দিবে। চাঁচি রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে উনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। সবার চোখের আড়ালে উনার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম “কেমন দিলাম চাঁচি শাশুড়ি? মেঘ আর আমাকে আলাদা করে নিজের ছেলের বউ করতে চেয়েছিলেন, দিলাম তো আপনার প্ল্যানে জল ঢেলে”

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৯

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৯

লেখিকা: সুলতানা তমা

তোহা: ছাড়ো আমাকে।
শায়লা: না মা তুমি আমার…
তোহা: ছাড়ো বলছি। (তোহা শায়লার বুকে কিল দিতে শুরু করলো, শায়লা ওকে ছেড়ে দিলো। তোহা দৌড়ে আমার কাছে চলে আসলো, আমার পাশে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে আলতো করে আমার চোখের পানি মুছে দিলো)
তোহা: আর কেঁদো না।
আমি: মামুনি। (তোহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম)
শায়লা: এসব কি হচ্ছে?
পপি: আমরা তোহাকে ভাবির হাতে তুলে দিয়েছি এখন ভাবিই তোহার মা বুঝেছ?
শায়লা: তাহলে আমি কে? তোমাদের কি মনে হয় আমি এসব মেনে নিবো। (শায়লা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তোহাকে কোলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম)
শায়লা: এই মেয়ে শুনো একদম আমার মেয়ের দিকে নজর দিবা না।
তোহা: তুমি পঁচা দূরে যাও বলছি।
শায়লা: তোমার কারণে আমার মেয়ে আমাকে পঁচা বলেছে। তোমাকে… (শায়লা আমাকে থাপ্পড় দিতে আসছিল পিছন থেকে কে যেন ওর হাত ধরে ফেলেছে, পিছনে তাকিয়ে দেখি রুহান। হসপিটাল থেকে সবাই চলে এসেছে)
রুহান: কণার গায়ে হাত দিতে চাইলে হাত ভেঙ্গে ফেলবো। তোমার সাহস হয় কি করে এই বাসায় ঢুকার?
শায়লা: এইটা আমার স্বামীর বাসা।
রুহান: আসছে স্বামীর বাসা বলতে। ডিভোর্স দেওয়ার সময় মনে ছিল না এখন স্বামী বলো কেন লজ্জা করেনা?
শায়লা: না করেনা কারণ আমি মেঘ’কে ভালোবাসি, ফিরে আসতে চাই ওর কাছে।
মা: তুমি বললেই হবে নাকি?
বাবা: শায়লা তোমাকে তো ফোনে আমি বলেছি তুমি তোহাকে ছাড়া যা চাইবে তাই দিবো তার পরও তুমি জামেলা কেন করছ বলতো?
শায়লা: আমি তো আপনাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছি আমার মেঘ কণা দুজনকেই চাই। (এখন বুঝেছি আব্বু কেন তোহাকে নিয়ে এতো টেনশন করছেন। শায়লা আব্বুকে ভয় দেখিয়েছে। ওদের জামেলা আর ভালো লাগছে না, ওদের ঝগড়াঝাঁটির মাঝেই শায়লার চোখের আড়ালে তোহাকে নিয়ে রুমে চলে আসলাম)

মেঘ এখনো মাতালের মতো ঘুমুচ্ছে ইচ্ছে হচ্ছে ওকে…
আমি: মেঘ উঠনা প্লিজ। (মেঘের চোখেমুখে পানির ছিটা দিলাম কিন্তু ও উঠার নাম নেই। আর ও উঠেই বা কি হবে ভালোবাসে তো শায়লাকে)
নিচ থেকে শায়লার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে আমি রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম, করুক ওরা ঝগড়া তোহা আমার কাছে থাকলেই হবে। কিছুক্ষণ পর নিচ থেকে আর কোনো শব্দ ভেসে আসলো না মনে হয় শায়লা চলে গেছে। এবারের মতো তো বাচঁলাম কিন্তু পরে যদি তোহাকে নিয়ে যায় আমি কিভাবে আটকাবো?

তোহাকে আমার পাশে বসিয়ে রাখলাম পুতুল নিয়ে খেলছে ও আর আমি ভাবছি শায়লা হঠাৎ ফিরে আসলো কেন। যে ছয় মাসের ছোট বাচ্চা ফেলে চলে গিয়েছিল আর এতো বছরে তোহাকে নিতে আসেনি সে কি হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া ফিরে এসেছে নাকি কোনো কারণ আছে? কোনো কারণ থাকলে কি সে কারণ?
অনেক ভেবে একটাই কারণ ফেলাম শায়লা হয়তো কোনো ভাবে জানতে পেরেছে তোহার নামে সবকিছু দিয়ে দিয়েছি। উফফফ আগে জানলে এই ভুল করতাম না, তোহাকে কতোটা ভালোবাসি মেঘ’কে এইটা বুঝাতে গিয়ে তোহার জন্য বিপদ ডেকে এনেছি সাথে নিজেরও। আমার তো মনে হচ্ছে এই সম্পত্তির জন্যই আব্বুকে খুন করা হয়েছে, কিন্তু খুন করালো কে?
জোহা: আপু আসবো?
আমি: হুম আয়।
জোহা: ভাইয়া এখনো ঘুমুচ্ছে?
আমি: ড্রিংক করলে যা হয়।
জোহা: আপু আমার এসব জামেলা আর ভালো লাগছে না।
আমি: আমার কি ভালো লাগছে? ভুল তো সব আমি করেছি এখন হারে হারে টের পাচ্ছি।
জোহা: তুমি কি ভুল করলে?
আমি: প্রথম ভুল মেঘ’কে বিয়ে করা দ্বিতীয় ভুল তোহার নামে সবকিছুর উইল করা। আমার তো এখন মনে হচ্ছে আমার ভুলের কারণে আব্বুকে জীবন দিতে হয়েছে।
জোহা: চাচ্চুকে খুন করে খুনির কি লাভ হলো?
আমি: তোহার আঠারো বছর হবার আগে পর্যন্ত সবকিছু আব্বু দেখাশুনা করবেন এটাই উইলে লেখা ছিল, যে খুন করেছে তার লাভ তোহার আঠারো বছর হওয়া পর্যন্ত সবকিছু সে লুটপাট করে খেতে পারবে আর পরে তোহার থেকে সব কেড়ে নিবে।
জোহা: এই লাভ কার হতে পারে এইটা খুঁজো তাহলেই তো খুনি কে জানতে পারবে।
আমি: লাভ এখানে তিনজনের, মেঘ, শায়লা আর রুহান। কিন্তু আমার মনে হয় না মেঘ আর রুহান এমন কাজ করবে।
জোহা: তাহলে শায়লা, এই মহিলা যা খারাপ ওর পক্ষে খুন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আমি: কিন্তু আমি ভাবছি শায়লা আব্বুকে খুন করাবে কেন? সম্পত্তির জন্য? উইল এর কথা তো আমি আর আব্বু ছাড়া কেউ জানতো না তাহলে শায়লা জানলো কিভাবে?
জোহা: জেনেছে আপু কোনোভাবে নাহলে হুট করে মেয়ের জন্য এতো ভালোবাসা দেখাতো না।
আমি: ভুল যেহেতু আমি করেছি শুধরেও নাহয় আমিই নিবো। খুব তাড়াতাড়ি আমি নতুন উইল করবো আর এই উইল এমনভাবে তৈরি করবো না তোহার জন্য বিপদ আসবে না আমার জন্য।
জোহা: তোহার জন্য তুমি এতোকিছু করছ কিন্তু ভাইয়া তো তোমাকে ভালোই বাসে না।
আমি: ও আমাকে কখনো ভালোবাসবে এই কথা তো বিয়ের সময় ছিল না, তোহা আমার কাছে থাকলেই হবে।
জোহা: শুধু তোহাকে নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিবে? ভাইয়া তো শায়লাকে এখনো ভালোবাসে।
আমি: (মৃদু হাসলাম)
জোহা: আপু তুমি হাসছ?
আমি: এছাড়া কি করার আছে?
জোহা: আপু তুমি নিজেকে শক্ত করো প্লিজ।
আমি: হুম।
জোহা কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে থেকে রুমে চলে গেল। সত্যি এখন আমাকে শক্ত হতে হবে তোহাকে তো আমার কাছে রাখবো সাথে আব্বুর খুনি কে খুঁজে বের করবো।

তোহাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মেঘ সারাদিন ঘুমিয়েই কাটালো জানিনা কতোটুক ছাইপাঁশ খেয়েছিল। এমন একজন কে বিয়ে করলাম যার সব ধরণের বাজে অভ্যাস আছে আর শায়লার মতো খারাপ মেয়েকে ভালোও বাসে আবার।
মেঘ: কণা, তোহা কোথায় তোমরা?
আমি: এখানে। (উঠেছে আজ তো ওর সাথে আমি ভালো ভাবেই বুঝাপড়া করবো)
তোহা: নতুন আম্মু আব্বু এতো পঁচা কেন?
আমি: ছিঃ আম্মু এসব বলতে নেই।
তোহা: তাহলে তোমাকে কাঁদায় কেন?
আমি: কোথায় আম্মু কাঁদি নাতো আর কেন কাঁদবো তুমি তো আমার কাছেই আছ।
তোহা: যদি দুষ্টু মেয়েটা আমাকে নিয়ে যায়।
আমি: নিতে দিবো নাতো। (তোহা দুহাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো, ছোট মেয়েটাও ভয় পায় এখন)
মেঘ: কণা?
আমি: কি?
মেঘ: (চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তোহার গালে হাত দিয়ে আদর করতে চাইলো তোহা হাত সরিয়ে দিলো)
তোহা: তোমরা সব পঁচা তোমরা খুব দুষ্টু।
মেঘ: আমার মামুনি এতো রেগে আছে কেন?
আমি: চোখের সামনে বাবার খারাপ অভ্যাস গুলো দেখছে তো তাই।
মেঘ: মানে?
আমি: ড্রিংক করে মাতালের মতো বাসায় ফিরেছ, শায়লা এসে তোহাকে নিয়ে টানাটানি করে গেছে, সবকিছু তো মেয়েটার চোখের সামনেই ঘটছে। তোমার কি মনে হয় এসবের প্রভাব ছোট মেয়েটার উপর পরছে না?
মেঘ: শায়লা এসেছিল?
আমি: অবাক হওয়ার তো কিছু নেই তুমি শায়লাকে ভালোবাস তাই সে অধিকার ফলাতে এসেছিল। শুনো মেঘ যদি আর কখনো ড্রিংক করে বাসায় এসেছ আর তোহা এসব দেখেছে তাহলে কিন্তু আমি তোহাকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে চলে যাবো।
মেঘ: শায়লা চলে গেছে?
আমি: নাহ তোমার জন্য বাসর সাজিয়ে বসে অপেক্ষা করছে যাও ওর কাছে।
মেঘ: এভাবে কথা বলছ কেন?
আমি: তোমার মতো মানুষের সাথে এরচেয়ে ভালোভাবে কথা বলা যায়না।
মেঘ: কি করেছি?
আমি: কিছুনা তুমি তো ধোয়া তুলসী পাতা। এই শুনো তুমি শায়লাকে ফিরিয়ে আনো বা যা খুশি করো তোহাকে যদি আমার থেকে দূরে নেওয়ার চেষ্টাও করেছ তাহলে কিন্তু আমি তোমাদের সবাইকে জেলে দিবো, ভুলে যেওনা বিয়েটা তোহার জন্যই হয়েছে আর সেটা সেদিন যারা উপস্থিত ছিল সবাই জানে।
মেঘ: কণা আ…
আমি: তোমার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার যাওনা যাও তোমার শায়লার কাছে যাও। (মেঘ চুপচাপ রুমে চলে গেল, ওকে এভাবেই শাস্তি দিতে হবে)
মেঘ চলে যেতেই উকিল চাচ্চুকে ফোন দিলাম, সবকিছু ঠিকঠাক করে মেঘ আর শায়লাকে বুঝাবো।
চাচ্চু: হ্যালো কণা।
আমি: হ্যাঁ চাচ্চু কেমন আছ?
চাচ্চু: ভালো তুমি ভালো আছ তো মা।
আমি: হ্যাঁ, চাচ্চু নতুন করে একটা উইল করতে হবে।
চাচ্চু: কদিন আগেই তো তোমার বাবা করলেন।
আমি: আবার নতুন করে করতে হবে।
চাচ্চু: কিন্তু কিছুদিন সময় লাগবে।
আমি: যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি করে দাও আমি তোমার কাছে আসতে পারবো না সবকিছু মেসেজে বলে দিচ্ছি।
চাচ্চু: ঠিক আছে আমি তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করছি।

ফোন রেখে রুমে এসে দেখি মেঘ সোফায় মাথা নুয়ে বসে আছে।
আমি: তোমার শায়লাকে কাল একবার বাসায় আসতে বলো। (মেঘকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তোহাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম)

তোহাকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছি বাবা এসে আমার পাশের চেয়ারটা টান দিয়ে বসলেন, কিছু বলতে চাইছেন মনে হয়।
আমি: বাবা কিছু বলবেন?
বাবা: অপদার্থটা কোথায়?
আমি: (নিশ্চুপ)
বাবা: কতোবার বিয়ের কথা বললাম করলো না, ও নাকি দুনিয়ার সব মেয়েকে ঘৃণা করে। আর এখন নিজের ঘরে এমন ভালো একটা বউ রেখে আবারো সেই ডাইনীর পিছনে ছুটছে।
আমি: বাদ দিন না বাবা এসব।
বাবা: রায়হানের এমন মৃত্যু আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছে জানিনা সামনে আর কি কি হবে।
আমি: কিছু হবে না বাবা আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
বাবা: একটা কথা বলবো মা শায়লার হঠাৎ ফিরে আসাটা আমার ভালো লাগছে না।
আমি: কারণটা আমি খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করবো বাবা আপনি শুধু সকালের অপেক্ষা করুন।
বাবা: সকালে কি করবে?
আমি: যা হয় তাতো দেখতেই পারবেন।

তোহাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি ঘুম আসছে না চটপট করছি শুধু, ওদিকে মেঘও চটপট করছে। মেঘ তোহাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো আমার হাতের উপর ওর হাত পড়তেই হাত সরিয়ে নিলো। পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মেঘ, ডিম লাইটের আলোতে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি সেটা।
মেঘ: কণা..
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কথা বলবে না?
আমি: সকালে বলবো শায়লা যখন সামনে থাকবে।
মেঘ: সবকিছুতে শায়লাকে টানছ কেন?
আমি: কারণ তুমি শায়লাকে ভালোবাস।
মেঘ: আমি শায়লাকে ভালোবাসি না।
আমি: নেশার ঘোরে মানুষ সত্যি কথাই বলে।
মেঘ: মানে?
আমি: ড্রিংক করে এসে তুমি বলেছ তুমি শায়লাকে ভালোবাস এদিকে আমি থাকায় তুমি দুটানায় পরে গেছ।
মেঘ: এসব কখন বললাম এসব মিথ্যে।
আমি: হয়েছে আর একটা কথাও নয়। এখন শুধু সকালের অপেক্ষা করো।
মেঘ: হুম।
মেঘ চুপ হয়ে গেল, চিন্তা করোনা মেঘ তোমাকে আমি এখন থেকে এতো অবহেলা করবো যে তুমি মাতাল অবস্থায় নয় নিজের মুখে সজ্ঞানে স্বীকার করবে কাকে ভালোবাস আমাকে নাকি শায়লাকে।

আজ সকালটা অন্যরকম লাগছে কারণ সবাই একসাথে বসে নাশতা করছে অন্যান্য দিন বাবা থাকেন না কখনো কখনো মেঘ আর রুহানও থাকে না। কলিংবেল এর শব্দ শুনেই সবাই দরজার দিকে তাকালো।
বাবা: নাশতা খাওয়ার বারোটা বেজে গেছে।
দাদি: এই সকালবেলা কে আসলো।
আমি: মেঘ যাও তোমার শায়লা এসেছে ভিতরে নিয়ে এসো।
মেঘ: আমার শায়লা মানে…
মা: এই বজ্জাত মেয়ে আবার আসলো কেন? (মেঘ আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে দরজা খুলতে গেল)
আমি: পপি তোমার আর তোহার নাশতা নিয়ে রুমে চলে যাও তোহাকেও খাইয়ে দিও।
পপি: ঠিক আছে ভাবি।
শায়লা: আমার তোহা কোথায়?
আমি: আরাম করে সোফাটায় বসো আর আমাদেরও শান্তিতে নাশতা করতে দাও।

নাশতা শেষে সবকিছু গুছাতে গুছাতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম…
আমি: বাবা আমি আব্বুর খুনি কে তা জানতে পেরেছি। (আড়চোখে শায়লার দিকে তাকালাম ও চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
জোহা: কি বলছ আপু তাহলে পুলিশে দিচ্ছ না কেন?
আমি: আমার হাতে কিছু প্রমাণ আছে আরো কিছু প্রমাণ ফেলেই পুলিশে ধরিয়ে দিবো। (সত্যি বলতে তো আমার হাতে শায়লার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই যদি থাকতো তাহলে তো ওকে আমি ফাঁসিতে ঝোলাতাম)
বাবা: কণা মা…
আমি: যে কথা বলতে আমি সবাইকে এখানে ডেকেছি তা হলো তোহা আমার কাছে থাকবে ওকে আমার থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলে আমি সবাইকে পুলিশে দিবো।
মা: কি?
আমি: অবাক হওয়ার কিছু নেই আপনারাই তোহার জন্য আমাকে বিয়েতে জোর করেছিলেন এখন ওকে কেড়ে নিবেন আমি চুপচাপ বসে থাকবো এতোটা ভালো মেয়ে আমি নই।
দাদি: একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তুই।
আমি: মেঘ যেহেতু আব্বুর বিশ্বস্ত লোক ছিল সবকিছুর দেখাশুনা ও করবে।
শায়লা: সত্যি? তাহলে আমিও মেঘের সাথে তোমার অফিসে কাজ করবো। (শায়লার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখে সবাই খুব অবাক হলো। আমাকে তো চিনো না শায়লা তোমার সব মতলব আমি ধরে ফেলেছি)
আমি: করতেই পারো তবে প্রতিমাসে আমাকে সবকিছুর হিসেব দিতে হবে আর যদি হিসেবে কোনো গড়মিল থাকে তাহলে মেঘ আর তোমাকে আমি জেলে দিতে দ্বিধা করবো না।
শায়লা: কোনো গড়মিল হবে না। (শায়লা হয়তো ভাবছে অফিস সামলানোর কথা বলে সবকিছু নিয়ে নিবে ও তো আর জানেনা নতুন উইল আমি কিভাবে তৈরি করছি)
আমি: সম্পত্তি তো আর কম না যথেষ্ট সম্পত্তি তাই সবকিছু মেঘ’কে দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে আমি তোহার দায়িত্ব নিচ্ছি। আর মেঘ যেহেতু শায়লাকে এখনো ভালোবাসে তাই ও কখনো আমার আর তোহার ধারেকাছে আসতে পারবে না।
মেঘ: মানে?
আমি: আশা করি আবার বুঝাতে হবে না।
মা: তোমার কথা আমরা সবাই শুনবো কেন?
আমি: জেলে যেতে না চাইলে শুনতে হবে।
বাবা: আমি কণার কথায় রাজি। (বাবা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলেন তারমানে বাবা সব বুঝে ফেলেছেন)
আমি: শায়লা এবার তুমি আসতে পারো।
শায়লা: আমি কাল থেকে তোমার অফিসে জয়েন করছি তো?
আমি: হ্যাঁ।

একে একে সবাই ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেল আমিও চলে আসতে চাইলাম তখনি বাবা পিছন থেকে ডাক দিলেন।
বাবা: বুদ্ধিটা কিন্তু দারুণ।
আমি: (মুচকি হাসলাম)
বাবা: শায়লা সম্পত্তির লোভে তোমার অফিসে কাজ করবে আর ততদিনে তুমি প্রমাণ জোগাড় করে ফেলবে অন্যদিকে তোহার থেকে শায়লাকে দূরে রাখা হবে। মেঘ’কে অবহেলা করছ যেন খুব তাড়াতাড়ি ও বুঝতে পারে কাকে ও ভালোবাসে শায়লাকে নাকি তোমাকে? তাছাড়া মেঘ’কে দিয়েই সম্পত্তি দেখাশোনা করাবে কারণ তোমার সবকিছু তো মেঘেরই। আমার বিশ্বাস মা মেঘ ঠিক তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারবে।
আমি: আমার কাজটা শুধু আপনিই বুঝতে পারলেন মা তো রেগে গেলেন।
বাবা: ওসব ঠিক হয়ে যাবে সবাই একদিন তোমাকে বুঝবে।
মৃদু হেসে রুমে চলে আসলাম।

আমি রুমে আসা মাত্রই মেঘ আমার হাত ধরে টান দিয়ে আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।
আমি: কি হচ্ছে এসব?
মেঘ: আগে তুমি বলো তুমি কি করছ এসব কেন করছ?
আমি: কি করেছি?
মেঘ: সবকিছুর দেখাশোনা নাহয় আমিই করবো কিন্তু তোমার আর তোহার থেকে দূরে থাকবো কেন?
আমি: কারণ তুমি শায়লাকে ভালোবাস। অন্য কাউকে ভালোবাস তারপরও…
মেঘ: কতোবার বলবো আমি শায়লাকে ভালোবাসি না।
আমি: কাকে ভালোবাস?
মেঘ: তোম…
আমি: থেমে গেলে কেন?
মেঘ: আমি তোমাকে ভালোবাসি শুনেছ তুমি।
আমি: বিশ্বাস করি না তাছাড়া আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না।
মেঘ: ভালোবাস না?
আমি: মেঘ লাগছে আমার হাতে।
মেঘ: লাগুক বলো ভালোবাস কিনা।
আমি: আমার মুখ থেকে পরে শুনো আগে নিজেকে প্রশ্ন করো কাকে ভালোবাসে তোমার মন। একবার আমাকে ভালোবাস বলবে আবার শায়লাকে ভালোবাস বলবে আমি তো এসব মেনে নিবো না। তাছাড়া আমি…
মেঘ: চুপ আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
আমি: একবার আমি একবার শায়লা এসব কি মেঘ?
আমি: বললাম তো আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
মেঘ আমার কপালে ওর কপাল ঠেকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের এমন দুরকম রূপ সত্যি আর নিতে পারছি না, ওকে অবহেলা করা প্রয়োজন। অবহেলা থেকেই ও সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝতে পারবে, জোড়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম ওকে তাল সামলাতে না পেরে মেঘ টেবিলের উপর গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। মাথা তুলে মেঘ আমার দিকে তাকাতেই দেখি কপাল কেটে প্রচুর রক্ত পড়ছে।

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৮

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৮

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘ আমার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
মেঘ: দেখতো কণা আমাকে দেখে কি খুনি মনে হয়?
আমি: খুনি কি কখনো গায়ে লিখে বেড়ায় যে আমি খুনি আমি খুনি?
মেঘ: তুমি অযতা আমাকে সন্দেহ করছ যখন সত্যিটা জানতে পারবে তখন নিজেই অনুশোচনায় ভুগবে।
আমি: তোমাকে পুলিশে দেওয়া উচিত তাহলেই সব সত্যি বেরিয়ে আসবে।
মেঘ: কাকে ফোন করছ?
আমি: পুলিশকে।
মেঘ: ফোন দাও বলছি। (মেঘ আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো)
মেঘ: রাগের মাথায় কোনো কাজ করতে নেই কণা পরে পস্তাতে হয়।
কণা: আমি তো ভুল কিছু করছি না।
মেঘ: তুমি ভুলই করছ। চোখের সামনে প্রমাণ দেখেই আমাকে সন্দেহ করছ একবার ভেবে দেখেছ এসবের আড়ালেও কোনো সত্যি থাকতে পারে।
আমি: মানে?
মেঘ: মানে খুব সহজ, এই ফোন থেকে আমার ফোনে কখনো কল আসেনি আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। (মেঘের কথা শুনে ফোনে থাকা মেঘের নাম্বারটা ভালো করে দেখলাম। শুধু ডায়াল লিস্টেই নাম্বারটা আছে তাছাড়া এই নাম্বারে ফোন দিয়ে কখনো কথা বলেনি কল দিয়েই কেটে দিয়েছে কিন্তু এমন ভাবে রেখেছে যেন দেখেই মনে হয় এই ফোন দিয়ে মেঘকে বারবার কল করা হয়েছে। তারমানে যে আসল খুনি সে মেঘকে ফাঁসানোর জন্য ইচ্ছে করেই মেঘের নাম্বারটা ডায়াল লিস্টে রেখে দিয়েছে আর ফোনটাও আমাদের বাসায় ইচ্ছে করেই ফেলে গেছে যেন আমি মেঘকে সন্দেহ করি)
মেঘ: কি হলো কণা?
আমি: তোমাকে ফাঁসানোর জন্যই কেউ এমনটা করেছে।
মেঘ: তাতো আমিও বুঝতে পারছি কিন্তু কে করবে এই কাজ।
আমি: রুহান হবে হয়তো।
মেঘ: মানে? কণা ও আমার ভাই হয়।
আমি: ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে মেঘ, তোমাকে আমার জীবন থেকে সরানোর জন্যই হয়তো রুহান এমন করেছে।
মেঘ: আমি বিশ্বাস করিনা আমার ভাই আর যাই করুক কাউকে খুন করার মতো জঘন্য কাজ করতে পারে না।
আমি: সেটা তো আস্তে আস্তে প্রমাণ হয়েই যাবে।
মেঘ: হ্যাঁ করো প্রমাণ। (মেঘ রাগ দেখিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো)
যতোই রাগ দেখাও মেঘ সত্যিটা তো আমি খুঁজে বের করবোই আর খুনি যদি হয় রুহান তাহলে তো ওকে আমি বুঝিয়ে দিবো ভালোবাসা কি।

দুদিন পর…

আজ আম্মুরা কানাডা চলে যাবে এয়ারপোর্ট এসেছি আম্মুদের সাথে। মধ্যে যে কিভাবে দুটু দিন কেটে গেল। আম্মুকে নিয়ে ভয় হচ্ছে যদি আম্মুকেও আব্বুর মতো… না না আম্মু কানাডা চলে যাওয়াই ভালো। কষ্ট তো হচ্ছে একটাই আব্বুর খুনি কে তা এখনো জানতে পারলাম না।
আম্মু: কণা তোর কোনো অসুবিধা হবে নাতো?
আমি: না আম্মু তুমি নিশ্চিন্তে যাও আর জোহা তো আমার কাছে আছেই।
চাচ্চু: একা বাসায় থাকবি না কিন্তু এখান থেকে সোজা তোর শশুড় বাড়ি চলে যাবি। ভয় হচ্ছে তোকে রেখে যেতে সম্ভব হলে তোকেও নিয়ে যেতাম কিন্তু তোর তো এখন বিয়ে…
আমি: আমাকে নিয়ে টেনশন করো না আম্মুকে দেখে রেখো।
চাঁচিআম্মু: তোর আম্মুর চিন্তা করিস না আমরা আছি তো।
চাচ্চু: আসছি মা।
আম্মু পিছন ফিরে বারবার আমাকে দেখছেন আর চোখের পানি মুচ্ছেন। নিয়তি আমাদের এমন জায়গায় এনে দাঁড় করাবে কখনো ভাবিনি, সত্যি নিয়তি খুব কঠিন।

জোহাকে নিয়ে মেঘদের বাসায় চলে আসলাম, বাসার দরজা খুলা কিন্তু কাউকে তো দেখতে পারছি না।
মেঘ: আশ্চর্য সবাই কোথায়?
আমি: দরজা খুলা অথচ কেউ…
পপি: ও তোমরা চলে এসেছ।
মেঘ: বাসার সবাই কোথায়রে পপি?
পপি: আব্বু অসুস্থ সবাই হসপিটালে আছে।
মেঘ: মানে কি হয়েছে আব্বুর? আমাকে জানালি না কেন?
পপি: আজ সকালে আব্বু হঠাৎ করেই স্ট্রোক করেন, তোমাদের অনেক বার ফোন করেছি কিন্তু দুজনের মোবাইলই বন্ধ। (তাড়াতাড়ি আমার মোবাইল দেখলাম সত্যি বন্ধ হয়ে আছে চার্জ নেই মনে হয়)
মেঘ: সকালে আব্বু স্ট্রোক করেছেন আর আমি এই সন্ধ্যাবেলায় জানতে পারলাম।
আমি: মেঘ কথা না বাড়িয়ে হসপিটালে চলো।
মেঘ: হ্যাঁ চলো।
আমি: জোহা তুই বাসায় থাক পপি আছে আর তোহাকে রেখে দাও পপি।
তোহা: আমি যাবো।
আমি: না মামুনি আম্মু চলে আসবো কিছুক্ষণ পর।
তোহাকে রেখে মেঘ আর আমি বেরিয়ে পড়লাম।

হসপিটালে বাবার কাছে বসে আছি, বাবা ঘুমিয়ে আছেন। সবাই এখানে কিন্তু মেঘ বারবার কেবিনের বাইরে যাচ্ছে আবার ভিতরে আসছে, চটপট করছে শুধু।
মা: কিরে মেঘ কি হয়েছে এমন চটপট করছিস কেন?
মেঘ: কিছুনা আম্মু আসছি একটু। (মেঘ বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি কোথায় গেল এভাবে)
আমি: মা হঠাৎ করে বাবার স্ট্রোক হলো কিভাবে?
মা: বুঝতে পারছি নারে মা।
দাদি: এইতো আহসানুল এর ঘুম ভেঙ্গেছে।
বাবা: কণা তুমি কখন আসলে?
আমি: এইতো কিছুক্ষণ আগে। আপনার কি হয়েছে হঠা…
বাবা: তোমাকে আমি বলতে পারবো না শুধু এইটুকু অনুরোধ তোহাকে তুমি আগলে রেখো।
আমি: তোহা তো আমার কাছেই আছে বাবা ওকে নিয়ে টেনশন করছেন কেন?
বাবা: কারণ আছে মা। (কি এমন হলো হঠাৎ বাবা তোহাকে নিয়ে টেনশন করছেন যার ফলে উনি স্ট্রোক পর্যন্ত করলেন)
দাদি: কণা তোরা বাসায় চলে যা রাতে থাকার প্রয়োজন নেই।
আমি: ঠিক আছে।
মা: মেঘ কোথায় দেখো তো।
আমি: আছে হয়তো বাইরে আমরা আসছি।
মা: ঠিক আছে।

কেবিনের বাইরে তো মেঘ’কে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না গেল কোথায়? হঠাৎ একটু দূরে বারান্দায় চোখ পড়লো, মেঘ একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে। কথা বলছে বললে ভুল হবে মনে তো হচ্ছে কথা কাটাকাটি করছে। কে এই মেয়ে? ওদের কাছে যাবো কিনা ভাবতে ভাবতেই মেঘ আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
মেঘ: চলো।
আমি: হুম।

মেঘ ড্রাইভ করছে বারবার ওকে আড়চোখে দেখছি, খুব টেনশনে আছে মনে হচ্ছে।
আমি: কি হয়েছে?
মেঘ: কিছু নাতো।
আমি: মেয়েটি কে ছিল?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
মেঘ চুপ হয়ে আছে তাই আর কথা বাড়ালাম না।

রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসলাম মেঘকে দেখতে পারছি না, রাতের খাবারো খেলো না। বারান্দার দরজা খুলা দেখে বারান্দার দিকে আসলাম। মেঘ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে সিগারেট ছিল আমাকে দেখেই ফেলে দিলো। ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি।
মেঘ: কণা আমি কখনো তোমার জীবনে যদি না থাকি আমার তোহাকে তুমি দেখে রেখো।
আমি: মানে?
মেঘ: কিছুনা। (মেঘ আমার চুল গুলো মুঠো করে ধরে কপালে চুমু খেলো, ওর এমন আচরণে খুব অবাক হলাম)
মেঘ: তুমি আমাকে ভালোবাস কিন্তু বুঝতে দাওনা কেন?
আমি: কে বললো ভালোবাসি?
মেঘ: বাসো তো আমি জানি কিন্ত আমি…
আমি: আরে কাঁদছ কেন?
মেঘ: একটু চুপ হয়ে আমার বুকের সাথে মিশে থাকো প্লিজ। (মেঘ আবারো আমাকে জড়িয়ে ধরলো, বুঝতেই পারছি না কি হলো ওর। বাবা আর মেঘ দুজনই তোহাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে কেন সেটাও বুঝতে পারছি না)
অনেক্ষণ পর মেঘ আমাকে ছেড়ে দিলো তারপর কোলে তুলে নিলো।
আমি: কি করছ?
মেঘ: আর কখনো তোমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারবো না আজকে একটু ভালোবাসতে দাও।

মেঘ আমাকে এনে বিছানায় শুয়ে দিলো হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, এসব পাগলামি কেন করছে ও?
মেঘ: তোহাকে পপির কাছে দিয়ে আসি…
আমি: এই খবরদার আমার মেয়েকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করোনা।
মেঘ: এতো ভালোবাস কেন তোহাকে?
আমি: প্রত্যেক মা’ই তার সন্তানকে এভাবে ভালোবাসে।
মেঘ: হুহ।
আমি: কি করছ?
মেঘ: বলেছি তো চুপ হয়ে থাকো আজ তোমাকে অনেক ভালোবাসবো।
আমি: কি হয়েছে তোমার হঠা… (মেঘ আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলো। বুঝতে পারছি না ও কি হুশে আছে নাকি নেশাটেশা করেছে)
মেঘ মাতালের মতো আমার ঠোঁট চুষছে ছাড়াতে চাইলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। সত্যি আমি বুঝতে পারছি না মেঘ হঠাৎ করে এমন কেন করছে।

আচমকা মেঘ আমাকে ছেড়ে দিলো তারপর আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলো।
মেঘ: ঘুমিয়ে পড়ো আসছি আমি। (মেঘ মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল)
আমি: আরে এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ? (মেঘের পিছু পিছু বাসার বাইরে আসলাম, ওর কাছে আসার আগেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। কোথায় গেল এতো রাতে কিছুই বুঝতে পারছি না)

সকাল দশটা বাজে মেঘ এখনো বাসায় ফেরেনি। সারারাত চটপট করেছি ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে।
পপি: ভাবি আর কতক্ষণ এভাবে বসে বসে অপেক্ষা করবে?
আমি: কি করবো বলতে পারো?
জোহা: ভাইয়ার কোনো বন্ধুর বাসায় যায়নি তো?
পপি: আমি তো সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ভাইয়া কোথাও নেই। আম্মুকে ফোন করে বলি।
আমি: পাগল হয়েছ আব্বুকে নিয়েই তো সবাই টেনশনে আছে এখন আবার… (কলিংবেল বেজে উঠলো দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। মেঘ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ দুটু লাল হয়ে আছে)
আমি: কোথায় ছিলে তুমি?
মেঘ: সরো। (মেঘ ভিতরে আসতে চাইলো কিন্তু হাটতে পারছে না, মুখ থেকে গন্ধ আসছে তারমানে মেঘ ড্রিংক করেছে)
আমি: তুমি ড্রিংক করেছ?
পপি: ভাইয়া তো এসব ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আবা…
আমি: আগে ড্রিংক করতো মেঘ?
পপি: হ্যাঁ শায়লা ভাবি চলে যাওয়ার পর অনেকদিন এসব ছাইপাঁশ খেয়েছে কিন্তু এখন কেন খেলো বুঝতে পারছি না।
আমি: রুমে চলো।
মেঘকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে আসলাম বেশিই ড্রিংক করেছে হাটতেই পারছে না।

খাটে এনে বসাতেই মেঘ ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো সাথে আমাকেও টান দিয়ে ওর বুকে শুয়ে দিলো।
আমি: ছাড়ো আমাকে কি গন্ধ ছিঃ মেঘ এসব মানুষে খায়? দূর কাকে কি বলছি ও তো নেশার ঘোরে আছে। (মেঘের হাত আমার কোমর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলাম। ওর শার্ট জুতো খুলে দিয়ে ভালোভাবে শুয়ে দিলাম, বিঘোরে ঘুমুচ্ছে ও। উঠে চলে আসতে চাইলাম মেঘ আমার এক হাত ধরে রেখেছে দেখে আবার ওর পাশে বসলাম। কি মায়াবী লাগছে ওর মুখটা, মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব কষ্ট এসে ভর করেছে ওর চোখেমুখে। মদের গন্ধের তোয়াক্কা না করে মেঘের একদম কাছে চলে আসলাম, ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলাম। আমার ফোন বেজে উঠেছে দেখে ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম)

আমি: হ্যালো আম্মু।
আম্মু: কেমন আছিস মা?
আমি: এইতো তুমি ভালো আছ তো?
আম্মু: হ্যাঁ আমাকে নিয়ে তুই টেনশন করিস না। পুলিশ কি কিছু জানিয়েছে?
আমি: নাতো।
আম্মু: কিছু বুঝতে পারছি নারে মা কে আমাদের এতো বড় শত্রু তোর আব্বুকে…
আমি: কেঁদো না আম্মু সব ঠিক হয়ে যাবে আর পুলিশ তো তদন্ত করছে। (রুম থেকে মেঘের কন্ঠ ভেসে আসছে কি যেন আবোলতাবোল বলছে)
আমি: আম্মু আমি তোমাকে পরে ফোন করছি।
আম্মু: ঠিক আছে।

আম্মুর ফোন রেখে রুমে আসলাম। মেঘ চোখ বন্ধ রেখেই নেশার ঘোরে আবোলতাবোল বকছে।
মেঘ: আমি আর পারছি না দুটানায় পরে গেছি আমি। (কি বলছে মেঘ এসব কিসের দুটানা?)
আমি: মেঘ কি হয়েছে তোমার? (মেঘের পাশে বসে ওকে ধাক্কা দিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে শুয়ে দিলো)
মেঘ: আমি শায়লাকে এখনো ভালোবাসি এদিকে কণার প্রতি কেমন যেন অনুভূতি হয় আমার, মেয়েটা খুব লক্ষী মায়া জন্মে গেছে কণার প্রতি। শায়লা ফিরে আসতে চাইছে এখন আমি কি করবো আমি যে দুটানায় পরে গেছি।
মেঘের কথা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। শায়লা ফিরে আসতে চাইছে তারমানে মেঘ তোহা দুজনই আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে, তাহলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে। মেঘ এখনো আবোলতাবোল কি যেন বলে যাচ্ছে ওকে ছেড়ে দিয়ে দূরে এসে দাঁড়ালাম। কি করবো এখন আমি? কাকে নিয়ে বাঁচবো? মেঘ তো এখনো শায়লাকে ভালোবাসে তারমানে মেঘ শায়লাকেই বেছে নিবে, তাহলে আমার কি হবে? হ্যাঁ মেঘ আমার হবে না জেনেও ওকে বিয়ে করেছি কিন্তু তোহা? তোহার জন্যই তো এই বিয়ে, যদি তোহা না থাকে আমার কি হবে? উফফফ আর ভাবতে পারছি না মাথা প্রচুর ঘুরছে, আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসলাম।

টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি নিয়ে এক গ্লাস পানি ডগডগ করে খেলাম। কলিংবেল বাজছে চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে নিজেই এলোমেলো পায়ে দরজা খুলতে আসলাম। দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে আছি একটি মেয়ে এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে খুব চেনা লাগছে মেয়েটিকে। ওহ এইটা তো সেই মেয়ে হসপিটালে মেঘ যে মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি করছিল কিন্তু এই মেয়ে বাসায় এসেছে কেন?
আমি: কাকে চাই?
–মেঘ আর তোহাকে।
আমি: আপনি কে?
–শায়লা হায়দার। (নামটা শুনে যেন আমার নিঃশ্বাস আটকে গেল, এতো তাড়াতাড়ি শায়লা ফিরে আসলো)
শায়লা: মেঘ কোথায় ওকে ডাকো আর তুমি কে? নিশ্চয় কণা।
আমি: হ্যাঁ আমি কণা।
শায়লা: তোমাকে দেখার খুব সখ ছিল। মানুষ এতো বেহায়া হয় জানতাম নাতো।
আমি: মানে?
শায়লা: এইযে মেঘের বউ বাচ্চা আছে জেনেও নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছ।
আমি: শুধু বাচ্চা ছিল বউ না। আর তোমাকেও আমার দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।
শায়লা: কেন?
আমি: যে ছয় মাসের একটি ফুটফুটে বাচ্চা ফেলে অন্য ছেলের হাত ধরে চলে যায় তাকে দেখার ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি?
শায়লা: একদম বাজে কথা বলবে না।
আমি: সত্যি কথা গুলোই তো বললাম।
পপি: ভাবি এভাবে কে বাইরে চিৎকার কর… (পপি শায়লাকে দেখে ভয়ে আতকে উঠলো, পপির কোলে তোহাকে দেখে শায়লা আমাকে ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল)
শায়লা: তোহা মা।
পপি: তোহাকে ছুবে না তুমি বলে দিলাম।
শায়লা: আমার মেয়ে আমি যা খুশি করবো।
পপি: তখন মনে ছিল না এখন কেন ফিরে এসেছ?
শায়লা: কারণ মেঘ আমাকে এখনো ভালোবাসে।
শায়লা তোহাকে পপির কোল থেকে কেড়ে নিজের কাছে নিয়ে গেল। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে চুপ হয়ে এসব দেখছি। কি করবো এখন আমি? তোহা যে শায়লারই মেয়ে আমি জোড় করবো কিভাবে তাছাড়া মেঘ সত্যিই তো শায়লাকে এখনো ভালোবাসে। আমি কোন অধিকারে তোহাকে আমার মেয়ে বলে দাবী করবো? আমি যে তোহাকে ছাড়া সত্যি থাকতে পারবো না। শায়লা তোহাকে কোলে নিয়ে আদর করছে চুমু খাচ্ছে দেখে বুকে ব্যথা অনুভব হলো, দরজার কাছেই ফ্লোরে বসে পড়লাম। চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে, আমি বোধহয় মেঘ তোহা দুজনকেই হারিয়ে ফেললাম…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৭

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৭

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘ: কণা তুমি এসব কি বলছ?
আমি: ঠিকি বলছি তুমিই আব্বুকে খুন করেছ।
মেঘ: আমি কেন স্যারকে খুন করতে যাবো?
আমি: কারণ তুমি এখনি সম্পত্তি নিজের দখলে নিতে চাইছ।
মেঘ: কিসের সম্পত্তি কি বলছ এসব।
আমি: তোহার নামে দিয়েছি সেটা তুমি জানতে পেরেছ আর তাই…
মেঘ: তোহার নামে মানে?
আমি: এখন না জানার ভাণ করছ কেন?
মেঘ: তোমার মাথা ঠিক নেই তাই ভুলভাল বকছ। আমি তোমার আব্বুকে খুন করবো কেন আমি কি এতোটাই খারাপ?
আমি: হ্যাঁ তুমি খারাপ।
মেঘ: কণা কোথায় যাচ্ছ একা যেও না।
দৌড়ে নিচে চলে আসলাম।

গাড়িতে উঠতেই মেঘ পিছু পিছু এসে গাড়িতে উঠলো।
মেঘ: আমি ড্রাইভ করছি সরো।
কণা: আমি একাই যেতে পারবো।
মেঘ: তোমার মাথা ঠিক নেই এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।
আমি: হলে হউক তাতে তোমার কি?
মেঘ: এক থাপ্পড় দিবো চুপ করে বস এখানে।
মেঘের ধমকে চুপচাপ বসে রইলাম, ও আমার হাত ধরে টান দিয়ে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো অন্য হাত দিয়ে ড্রাইভ করছে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে, আস্তে আস্তে চোখ দুটু বুজে আসলো।

চোখেমুখে পানির ছিটা পড়তেই আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম।
মেঘ: কণা আমরা চলে এসেছি ভিতরে চলো।
মেঘ: কণা আস্তে যাও পরে যাবে।
মেঘের কথার পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে ভিতরে চলে আসলাম।

সাদা কাপড়ে মোড়ানো আব্বুর নিথর দেহটা পরে আছে ড্রয়িংরুমে। আব্বুর পায়ের কাছে দফ করে বসে পড়লাম, সাদা কাপড়টায় এখানে সেখানে রক্তের ছাপ লেগে আছে। চারপাশে শুধু কান্নার আওয়াজ, উপরের রুম থেকে আম্মুর চিৎকার ভেসে আসছে। আমার চোখ দিয়ে কান্না আসছে না কেন, আমি পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি কিভাবে?
পুলিশ আঙ্গেল: কণা তুমি ভেঙে পড়ো না মা তুমি এমন করলে আমরা তদন্ত করবো কিভাবে খুনিকে ধরবো কিভাবে?
আমি: আঙ্গেল এই কাজ কে করলো?
পুলিশ: জানিনা মা তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো? (মেঘের দিকে তাকালাম আমি ওর নাম বলে দিতে পারি এই ভয় না পেয়ে উল্টো ও আমার কাছে এসে এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কাধে মাথা রেখে বসে রইলাম)
কণা: না চাচ্চু আপনারা খুঁজে দেখুন।
পুলিশ আঙ্গেল: ঠিক আছে মা। (পুলিশ চলে যেতেই মেঘ আমার একটা হাত ওর হাতের মুঠোয় নিলো)
মেঘ: তুমি যে আমাকে সন্দেহ করছ সেটা পুলিশকে বলনি কেন?
কণা: শুধু সন্দেহের বশে আমি তোমার গায়ে কলঙ্গের দাগ লাগাতে চাই না। পুলিশ তদন্ত করুক তখনি তো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মেঘ: কণা আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি তাই বলে আমি এতোটা খারাপ না যে কোনো মানুষ খুন করবো।
আমি: আগে তো বলেছ প্রয়োজন হলে তুমিও খুন করতে পারো।
মেঘ: রুহান বলেছে তাই বলেছি তোমাকে হারানোর ভয়ে বলেছি। বলেছি বলে আমি স্যারকে খুন করবো ভাবছ কিভাবে? (মেঘের ফোন বেজে উঠলো ও ফোন নিয়ে দূরে চলে গেল। সত্যি বুঝতে পারছি না কাকে আমি সন্দেহ করবো)

আব্বুর থেকে একটু দূরে সোফাটায় বসে আছি আর আব্বুর নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছি।
চাচ্চু: কণা মা। (হঠাৎ চাচ্চুর কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকালাম চাচ্চু চাঁচিআম্মা আর জোহাকে দেখে দৌড়ে ওদের কাছে গেলাম)
আমি: চাচ্চু তোমরা? (ভাই মারা গেছেন আমরা কানাডায় বসে থাকি কিভাবে বল)
জোহা: আপু। (আর বোধহয় কান্না চেপে রাখা সম্ভব না সবার কান্না দেখে জোহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম)
চাঁচিআম্মা: কণা তোর মায়ের কাছে চল।
চাচ্চু: দাড়া কণা।
আমি: বলো চাচ্চু।
চাচ্চু: তোর কি কাউকে সন্দেহ হচ্ছে।
আমি: নাতো কাকে সন্দেহ করবো? আমার মাথায় কিছুই আসছে না।
চাচ্চু: আমি দেখছি তুই ভেঙ্গে পড়িস না তোর মায়ের কাছে যা।
আমি: হুম।

সকাল হয়ে গেছে একটু পর আব্বুকে দাফন করা হবে।সারাটা রাত জোহার কোলে শুয়ে কেঁদে কেঁদেই কাটিয়ে দিয়েছি আর আম্মু তো অজ্ঞান হয়ে পরে আছেন। আমাদের এতো বড় ক্ষতি কে করলো বুঝতেই পারছি না।
রুহান: কণা… (চাঁচিআম্মার কাধে মাথা রেখে বসে ছিলাম, রুহানের ডাকে সামনে তাকালাম)
রুহান: রাতে এভাবে চলে এসেছ বাসার কাউকে কিছু না বলে…
আমি: আমার তোহা কোথায়?
রুহান: আসছে চাঁচির সাথে।
আমি: হুম।
রুহান: কণা প্লিজ তুমি ভেঙ্গে পড়ো না আমরা সবাই তো আছি।
আমি: (নিশ্চুপ)
রুহান: কণা কে করতে পারে এই কাজ কাউকে সন্দেহ হচ্ছে তোমাদের?
আমি: সবাই শুধু এই একি প্রশ্ন করছ আমি জানলে কি এখানে বসে থাকতাম? খুনিকে ধরে এনে নিজের হাতেই তো শাস্তি দিতাম। (আমার চিৎকার শুনে চাচ্চু আর মেঘ দৌড়ে আসলো)
চাচ্চু: মা কি হয়েছে?
আমি: যে আব্বুকে এতো কষ্ট দিয়ে মেরেছে তাকে ধরে এনে দাওনা চাচ্চু, আমি ওকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাই।
চাচ্চু: এভাবে কাঁদিস না তোর কি একা কষ্ট হচ্ছে, আমার হচ্ছে না? আমারো তো ভাই। (চাচ্চু কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন, মেঘ এসে আমার পাশে বসলো। আমি যতোটা কাঁদছি মেঘও কাঁদছে, নাহ মেঘ খুনি হতে পারে না আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি মেঘ আব্বুকে কতোটা ভালোবাসতো)
মেঘ: কণা এভাবে কেঁদো না প্লিজ তোমার কান্না আর সহ্য করতে পারছি না।
তোহা: নতুন আম্মু… (তোহার ডাক শুনে চমকে উঠলাম মেয়েটা দাদুর কোল থেকে নেমেই দৌড়ে আমার কাছে চলে আসলো)
আমি: মামুনি কাঁদে না এভাবে।
তোহা: তুমি কাঁদলে আমিও কাঁদবো। (তোহার আধোআধো কন্ঠে এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই কেঁদে দিলো, বাচ্চা মেয়ে অথচ এতোটা ভালোবাসে আমাকে। মেঘ কখনো তোহাকে আমার থেকে কেড়ে নিলে আমি হয়তো মরেই যাবো)

নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছি বিছানায়, পাশে জোহা, পপি, মা আর চাঁচি বসে আছেন। আব্বুর নিথর দেহটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না কাকে সন্দেহ করবো। মেঘকে সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু মেঘ কেন… আচ্ছা রুহান করেনি তো? হতেই তো পারে মেঘ’কে আমি ভালোবাসি বলে এমনটা করেছে। মেঘ’কে ফাঁসিয়ে দিয়ে আমার জীবন থেকে ওকে সরিয়ে দিলো। উফফ ভেবে পাচ্ছি না কিছু কাকে রেখে কাকে সন্দেহ করবো সত্যি ভেবে পাচ্ছি না। রুহানের কথা ভাবতে ভাবতেই রুহান আমার রুমে আসলো। আব্বুর দাফন কাজ হয়তো শেষ। একবার রুহানের সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
আমি: সবাই একটু বাইরে যাও রুহানের সাথে আমার কথা আছে। (রুহানের মা আর পপি কিছুটা অবাক হলেও বের হয়ে গেল)
রুহান: কি হয়েছে কণা?
আমি: রুহান তুমি কিছু করনি তো।
রুহান: মানে?
আমি: মেঘকে আমার জীবন থেকে সরান…
রুহান: মেঘ আমার ভাই হয় কণা তাছাড়া আমি তোমাকে ভালোবাসি আর ভালোবাসা কখনো খুন করা শিখায় না। হ্যাঁ আমি তোমাকে রাগের মাথায় বলেছিলাম প্রয়োজন হলে খুন করবো তাই বলে সত্যি…
আমি: ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে রুহান।
রুহান: কণা তোমার মাথা ঠিক নেই তাই যাকে সামনে দেখছ তাকেই সন্দেহ করছ।
আমি: বাবার নিথর হয়ে পরে থাকা লাশ দেখা মেয়েটার পক্ষে তো এটাই স্বাভাবিক।
মেঘ: কণা আসবো? (মেঘকে দেখে রুহান বেরিয়ে গেল)
মেঘ: কণা এখন…
আমি: আব্বুকে একা রেখে চলে এসেছ তাই না?
মেঘ: কেঁদো না প্লিজ এটাই তো নিয়ম।
আমি: এখন আমি কাকে আব্বু ডাকবো?
মেঘ: সব ঠিক হয়ে যাবে আর কেঁদো না।
আমি: হ্যাঁ ঠিক হবে কিন্তু আব্বু তো আর ফিরে আসবে না।
মেঘ: হুম। (মেঘ আমার পাশে শুয়ে ওর বাহুডোরে জড়িয়ে নিলো আমাকে। বাচ্চা মেয়ের মতো ওর বুকের সাথে মিশে চুপচাপ শুয়ে রইলাম)

পপি: ভাবি উঠো তোহা কাঁদছে। (পপির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো, মেঘ কখন উঠে চলে গেছে বুঝতে পারিনি। রাত বোধহয় অনেক হয়েছে, অনেক সময় ঘুমিয়েছি)
পপি: তোমাকে ডাকতাম না ভাবি কিন্তু তোহা কাঁদছে খুব তোমার কাছে আসার জন্য।
আমি: হুম দাও ওকে। (তোহাকে এনে আমার বুকের উপর শুয়ে দিলাম, মেয়েটা নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে)
পপি: ভাবি কিছু খেয়ে নাও।
আমি: উঁহু খিদে নেই। (পপি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে গেল। পপি যেতেই তোহা উঠে ওর কোমল হাতে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে)
আমি: কি হয়েছে মামুনি?
তোহা: তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: আমার আব্বু মারা গেছেন তো তাই।
তোহা: মারা যাওয়া কি?
আমি: আকাশের তারা হয়ে গেছেন।
তোহা: আর আসবে না?
আমি: না মামুনি আকাশে চলে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।
তোহা: ওওও। (কিছুক্ষণ থেমে থেকে তোহা আবার প্রশ্ম করলো)
তোহা: আমিও যদি তারা হয়ে যাই তুমি কি কাঁদবে? (তোহার প্রশ্নে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো, কি বলছে এসব তোহা)
আমি: এসব বলতে নেই মা তুই আমার কাছে না থাকলে আমি মরেই যাবো।
মেঘ: ওকে তোমার থেকে কেউ দূরে সরিয়ে নিবে না। (তোহাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম হঠাৎ মেঘ আসলো)
আমি: কোনো একদিন হয়তো এমন পরিস্থিতি আসবে যে তুমি নিজেই ওকে আমার থেকে কেড়ে নিবে।
মেঘ: কথা দিচ্ছি যাই হয়ে যাক তোহাকে তোমার থেকে আলাদা করবো না।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: নিচে যেতে পারবে তোমার চাচ্চু ডাকছেন?
আমি: হুম তোহাকে ঘুম পারিয়ে আসছি।

তোহাকে ঘুম পারিয়ে নিচে আসতেই দেখি মেঘ’দের বাড়ির সবাই চলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বসে আছে।
দাদি: কণা তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আমরা চলে যাচ্ছি।
আমি: এতো রাতে যাওয়ার কি প্রয়োজন সকালে…
মা: না মা আমরা যাই, তোমার যখন ভালো লাগবে যেও ততদিন মেঘ এখানেই থাকবে। তুমি মন খারাপ করে থেকো না।
আমি: হুম।

একে একে সবাই চলে গেল বাসাটা কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। থাকবেই তো বাসার প্রাণ যে আব্বু, আব্বুই তো নেই।
চাচ্চু: কণা আমাদের তো চলে যেতে হবে। দুদিনের বেশি থাকা সম্ভব না বুঝিসই তো ওদিকে…
আমি: আমরা কার কাছে থাকবো?
চাচ্চু: আমি চাইছিলাম ভাবিকে আমাদের সাথে কানাডা নিয়ে যাই, তুই চাইলে তুইও…
আমি: আমি কিভাবে যাবো?
চাচ্চু: ভাবি বাসায় একা থাকবে কিভাবে আমাদের সাথে নিয়ে যাই, তুই যখন বলবি তখনই আবার নিয়ে আসবো।
আমি: তাহলে আমি একা থাকবো কিভাবে?
মেঘ: একা কোথায় কণা আমরা সবাই তো তোমার পাশে আছি।
জোহা: আব্বু আমি আপুর কাছে থাকি?
চাচ্চু: ঠিক আছে।

নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছি পাশে মেঘ আর তোহা ঘুমুচ্ছে। আমার ঘুম আসছে না বারবার আব্বুর চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আব্বু আমাকে কণা মা বলে ডাক দিবেন। ছোটবেলা থেকে আব্বুই আমার প্রথম বন্ধু ছিলেন, সবকিছুতে আব্বু আমাকে সাপোর্ট করেছেন আর আজ আব্বু আমাকে একা করে দিয়ে এভাবে চলে গেলেন। চোখের সামনে বাবার লাশ দেখার মতো নির্মম দৃশ্য আছে কিনা জানিনা খুব কষ্ট হচ্ছে, ভাবতেই পারছি না আর কেউ আমাকে কণা মা বলে ডাক দিবে না। কে এই কাজ করেছে এইটা জানতে পারলে হয়তো কষ্টটা কিছুটা হলেও কম হতো।
আম্মু: কণা জেগে আছিস? (এতো রাতে আম্মুর ডাক শুনে বেশ অবাক হলাম। তাড়াতাড়ি উঠে এসে দরজা খুললাম)
আমি: আম্মু তুমি?
আম্মু: তোকে একটা জিনিস দিতে ভুলে গেছি আমার রুমে চল।
আমি: চলো।

আম্মুর পিছু পিছু আম্মুর রুমে আসলাম। আম্মু ড্রয়ার থেকে একটা ফোন বের করে আনলেন।
আমি: আম্মু কার ফোন এইটা?
আম্মু: সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর ফোনটা আমি ফ্লোরে পেয়েছি, ওদের মধ্যে কারো হবে, হয়তো পকেট থেকে পরে গেছে। (তাড়াতাড়ি আম্মুর থেকে ফোনটা আনলাম অফ হয়ে আছে চার্জ নেই হয়তো)
আমি: আম্মু আমি দেখছি তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।
আম্মু: ঘুম আসছে নারে মা কি থেকে কি হয়ে গেল।
আমি: এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো হবে না আম্মু। জোহা আম্মুকে বিছানায় নিয়ে যাতো।
জোহা: ঠিক আছে।
জোহা আর চাঁচিআম্মা আম্মুর কাছে আছে তাই নিশ্চিন্তে ফোনটা নিয়ে রুমে চলে আসলাম।

ফোনটা চার্জে দিয়ে অপেক্ষা করছি, হয়তো এই ফোন থেকে কিছু পাবো। ফোনটা চার্জে রেখে বিছানায় এসে বসলাম, দেয়ালে রাখা আব্বু আর আমার ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই দুচোখ ভিজে উঠলো। এভাবে আব্বুকে হারিয়ে ফেলতে হবে কখনো ভাবিনি।

রাত প্রায় তিনটা বাজে সোফায় বসে ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি। কল লিস্টে একটি নাম্বার ছাড়া সারা ফোনে আর কিছুই নেই। এই নাম্বারে ফোন দিবো কিনা ভাবতে ভাবতে ফোন দিয়ে দিলাম। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে মেঘের ফোন বেজে উঠলো। অবাক হয়ে মেঘের ফোনটা হাতে নিলাম, এইটা মেঘের নাম্বার কিন্তু সন্ত্রাসীদের কাছে কেন? তবে কি আমার সন্দেহ ঠিক? কিন্তু মেঘের আচরণে তো কিছু বুঝা যায়নি। ফোনের রিংটোনে মেঘের ঘুম ভেঙে গেল, ঘুম ঘুম চোখে ও আমার দিকে তাকালো।
মেঘ: কণা তুমি ঘুমাওনি?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কণা কি হয়েছে আর আমাকে এতো রাতে কে ফোন করেছে?
আমি: নিজেই দেখে নাও। (মেঘের হাতে ফোন দিয়ে আমি আবারো কল করলাম, মেঘ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে)
মেঘ: কি ব্যাপার ওই ফোন থেকে আমাকে ফোন দিচ্ছ কেন আর এই ফোন কার?
আমি: সত্যি তুমি জাননা এই ফোন কার? নাম্বারটা তো তোমার চেনার কথা তাই না?
মেঘ: আশ্চর্য আমি কিভাবে জানবো এই নাম্বার কার।
আমি: মেঘ ন্যাকামো করো না তুমি ভালো করেই জানো এই নাম্বার কার।
মেঘ: কণা তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি: এই ফোন আব্বুকে মারার সময় একজন ভুলে ফেলে গেছে মেঘ আর এই ফোনে শুধু তোমার নাম্বার।
আমার চিৎকার শুনে মেঘ উঠে দাঁড়িয়ে গেল, ও অবাক হয়ে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে।

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৬

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৬

লেখিকা: সুলতানা তমা

এক মাস পর….

মধ্যে একটা মাস কেটে গেল কিন্তু মেঘের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। অবশ্য না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক মেঘ তো আর ইচ্ছে করে বিয়েটা করেনি যে আমাকে মেনে নিবে। তাছাড়া আমি তো এখন আর মেঘের সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করিনা যে মেঘ বুঝবে আমাকে। সেদিনের পর আর কখনো মেঘ’কে বুঝতে দেইনি আমি ওকে কতোটা ভালোবাসি, সেদিনের পর মেঘের সাথে আমার প্রয়োজন ছাড়া কথা হয়নি। মেঘের প্রতি আমার ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই চলেছে জানিনা কিসের জন্য এমন হচ্ছে। আর আ…
রুহান: কণা আসবো? (জানালার কাছে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম রুহানের ডাকে ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, পিছন ফিরে দেখি রুহান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে)
আমি: হ্যাঁ এসো।
রুহান: কলেজে যাবে না?
আমি: এইতো যাবো।
রুহান: আমি ওদিকে যাবো চলো তোমাকে নামিয়ে দেই।
আমি: উঁহু আমি একা যেতে পারবো।
রুহান: পপিকেও ওর কলেজে ছেড়ে দিবো।
আমি: সত্যি?
রুহান: হ্যাঁ চলো।
আমি: তুমি যাও আমি আসছি।
মেঘের জন্য তো নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে পারবো না তাই পড়াশোনাটা আবার শুরু করেছি।

রেডি হয়ে বেরুনোর জন্য পা বাড়াতেই দরজায় মেঘের সাথে ধাক্কা খেলাম।
মেঘ: কলেজে যাচ্ছ?
আমি: হুম।
মেঘ: আমিও তো অফিসে যাচ্ছি চলো তোমাকে নামিয়ে দিবো। (এতোদিন একা একা কলেজে গিয়েছি কখনো তো এই কথা বলেনি আজ হঠাৎ কি হলো)
মেঘ: কি হলো এমন হা হয়ে তাকিয়ে আছ কেন চলো।
আমি: তুমি যাও আমি রুহানের সাথে চলে যাবো।
মেঘ: ওহ। (মেঘ মন খারাপ করে আমাকে পাশ কাটিয়ে রুমের ভিতরে চলে গেল। করুক মন খারাপ আমার কি আমি বেরিয়ে আসলাম)

তোহা: নতুন আম্মু আসবে কখন তুমি?
আমি: ক্লাস শেষ হলেই চলে আসবো মা।
তোহা: তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না প্রমিস করো তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
আমি: প্রমিস করলাম তাড়াতাড়ি চলে আসবো। তুমি দাদুর কাছে থেকো কোনো দুষ্টুমি করো না।
তোহা: উম্মম্মম্মম্মাহ। (তোহা খুশি হলেই আমার নাকে একটা চুমু দেয় এখনো দিলো, মেয়েটার প্রতি দিন দিন মায়া বেড়েই চলেছে বড্ড ভয় হয় মেঘ যদি কখনো তোহাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, আমি হয়তো তখন মরেই যাবো)
তোহা: যাও তুমি পঁচা মেয়ে তুমি আমাকে চুমু দাওনি। (ভাবনার জগতে ডুবে ছিলাম তোহার অভিমানী কথায় হেসে দিলাম। ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম)

পপি আর আমি পিছনে বসে আছি রুহান ড্রাইভ করছে, রুহান যে বারবার আয়নায় আমাকে দেখছে এইটা পপিও লক্ষ করেছে। মেয়েটা মন খারাপ করে বসে আছে, বুঝিনা সত্যিকারের ভালোবাসা গুলো মানুষ বুঝতে চায় না কেন। সবসময় শুধু সত্যিকারের ভালোবাসা দূরে ঠেলে দিয়ে সবাই মরীচিকার পিছনে ছুটে, কেন হয় এমন?
আমি: চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে। (পপির হাতের উপর হাত রেখে বললাম, পপি মৃদু হাসলো। আমি নিজেই তো জানিনা রুহান আদৌ পপির ভালোবাসা বুঝবে কিনা)
আমি: আর একটু সামনেই তো আমি নেমে যাবো অনেকটা পথ দুজন একসাথে যাবে তখন নাহয় ওকে কিছু বলো।
পপি: কি লাভ হবে বলে যে বুঝার সে অল্পতেই বুঝে। তুমি তো ভাইয়াকে ভালোবাস কিন্তু ভাইয়ার সামনে প্রকাশই করো না আমিও নাহয় রুহানকে এভাবেই নীরবে ভালোবেসে যাবো।
আমি: যারা বুঝেও না বুঝার ভাণ করে তাদের নীরবেই ভালোবাসতে হয়।
পপি: হুম।
রুহান: কণা তোমার কলেজে চলে এসেছি।
আমি: হুম।

ক্লাস শেষ করে তাড়াহুড়ো করে কলেজ থেকে বের হলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ, ওদিকে মেয়েটাকে প্রমিস করেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরবো। কলেজ থেকে বেরুতেই দেখি মেঘের গাড়ি, আমাকে দেখেই মেঘ নেমে আসলো।
আমি: তুমি?
মেঘ: চলো।
আমি: তুমি আমাকে নিতে এসেছ?
মেঘ: স্যার ফোন করে বললেন তোমাকে নিয়ে যেন এক্ষণি তোমাদের বাসায় চলে যাই তাই অফিস থেকে সোজা এদিকেই চলে আসলাম।
আমি: আব্বু হঠাৎ…
মেঘ: গাড়িতে বসেই ভাবো নাহয়।
আমি: হু।

সত্যিই গাড়িতে বসে ভাবছি আব্বু হঠাৎ এভাবে এতো তাড়াতাড়ি যেতে বললেন কেন কোনো সমস্যা কিনা কে জানে। একটা ফোন করে কি দেখবো ভাবছি হুট করে মেঘের দিকে নজর পড়লো, ও বারবার আমাকে আড়চোখে দেখছে। কি হলো ওর আবার হঠাৎ করে কে জানে।

বাসার সামনে এসে আমি তো অবাক পুরো বাড়ি সাজানো অনেক মেহমান। গাড়ি থেকে নামতেই আব্বু আম্মুকে দেখতে পেলাম, তোহা আম্মুর কোলে ছিল আমাকে দেখেই দৌড়ে চলে আসলো।
তোহা: এতো দেরি করলে যে।
আমি: কান ধরেছি মামুনি আর হবেনা। (তোহাকে কোলে নিয়ে ভিতরে আসলাম)
আমি: আব্বু আজ কি কোনো অনুষ্ঠান?
আম্মু: দেখেছ আমি বলেছিলাম না আমার মেয়ে ও বাড়িতে ভালো নেই। যে মেয়ে নিজের বার্থডে কখনো ভুলেনি সে মেয়ে কিনা আজ ওর বার্থডে ভুলে গেল, খুব কষ্টে আছে তাই ভুলে গেছে।
আমি: আম্মু তুমি অযতা কাঁদছ আমি ওখানে খুব ভালো আছি আর মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় তাই হয়তো বার্থডে ভুলে গেছি।
আম্মু: হয়েছে আমাকে আর ভুল বুঝাতে হবে না। (আম্মুকে এসে জড়িয়ে ধরলাম, মেঘের দিকে চোখ পড়লো ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে)

আগে জানলে আব্বুকে এসব পার্টির কথা না করতাম এখন আর এসব ভালো লাগে না। দিন দিন কষ্ট আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে আর পারছি না, হুট করে সবকিছু কেমন যেন উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। শাড়ির কুচি ঠিক করছিলাম হঠাৎ দরজায় চোখ পড়লো, মেঘ দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, আজ যেন কুচিগুলো ঠিক হতেই চাচ্ছে না। আমাকে অবাক করে দিয়ে মেঘ এসে আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো, একটা একটা করে খুব যত্ন করে কুচিগুলো ঠিক করে দিলো। আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে।
মেঘ: সাজুগুজু করবে না? সাজলে কিন্তু তোমাকে দারুণ লাগে।
আমি: না চোখে একটু কাজল দিবো ব্যাস।
মেঘ: কাজলটা আমি দিয়ে দেই? (মেঘের এমন কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম ওর দিকে)
মেঘ: ভয় নেই কাজল আমি ভালোভাবে দিয়ে দিতে পারি।
আমি: কখনো কাউকে দিয়ে দিয়েছ? (মেঘ মন খারাপ করে কাজলটা হাতে নিলো। এই প্রশ্ন করা হয়তো আমার ঠিক হয়নি, মেঘ হয়তো শায়লাকে দিয়ে দিতো)
মেঘ: এদিকে তাকাও। (মেঘ আমার একদম কাছে এসে খুব যত্ন করে আমার দুচোখে কাজল দিয়ে দিলো। এই প্রথম মেঘ আমার এতোটা কাছে এসেছে বেশ অবাক হয়েই তাকিয়ে আছি ওর দিকে)
মেঘ: মিষ্টি পরীটা। (মেঘ আমার নাক টেনে দিয়ে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল)

কি ব্যাপার বাসার সবাইকে পার্টিতে দেখছি কিন্তু রুহানকে দেখতে পাচ্ছি না।
মেঘ: কাউকে খুঁজছ?
আমি: হ্যঁ রুহানকে।
মেঘ: ওহ!
আমি: আসেনি রুহান?
মেঘ: জানিনা। (মেঘ রাগে হনহন করে চলে গেল, কি ব্যাপার আজ মেঘ আমার মুখে রুহান নাম শুনলেই রেগে যাচ্ছে বা মন খারাপ করে ফেলছে)

সারাদিন পার্টিতেই কেটে গেল রাত হয়ে গেছে এবার বাসায় ফিরে যেতে হবে, তার আগে আব্বুর সাথে আলাদা কথা বলা প্রয়োজন উইল এর কি করেছেন জানতে হবে।
আব্বু: কণা তোকেও চলে যেতে হবে? থাকনা মা আজকে।
আমি: না আব্বু বাসার সবাই যখন এসেছে ওদের সাথে চলে যাবো। তুমি রুমে এসো তো কথা আছে। (আব্বুকে রুমে নিয়ে আসলাম)
আব্বু: কিছু বলবি?
আমি: উইল এর কি করেছ?
আব্বু: হ্যাঁ তোকে এটাই বলতে চেয়েছিলাম, সবকিছু হয়ে গেছে।
আমি: কিভাবে করলে?
আব্বু: সবকিছু তোহার নামে করে দিয়েছি। তোহার আঠারো বছর পূর্ণ হলে সবকিছু ও পাবে আর আপাতত সবকিছু আমিই দেখাশোনা করবো। তোহার আঠারো বছর পূর্ণ হবার আগে যদি আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে সবকিছু মেঘ দেখাশোনা করবে। তোকে না জানিয়ে একটা কাজ করেছি, এই বাড়িটা শুধু তোর নামে দিয়েছি।
আমি: ঠিক আছে।
মেঘ: কণা যেতে হবে তো। (মেঘ এখানে? এসব শুনেনি তো)
আমি: আসছি।

বাসায় এসে ঢুকতেই আমার ফোনের মেসেজটোন বেজে উঠলো। “ছাদে এসো” আশ্চর্য রাত দশটা বাজে এতো রাতে রুহান আমাকে ছাদে ডাকছে কেন?

তোহা কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে ওকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম, বারান্দা থেকে মেঘের কন্ঠ ভেসে আসলো।মেঘ: বললাম তো যতো টাকা লাগে আমি দিবো আমার শুধু কাজটা হওয়া চাই আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি। (কি কাজের জন্য মেঘ টাকা দিতে চাইছে আর কাকেই বা এতো রাগ দেখাচ্ছে? মেঘের কথায় আর পাত্তা না দিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম)

পুরো ছাদ সাজানো কাঁচা ফুল, মরিচবাতী আর বেলুন দিয়ে, ছাদের মাঝখানে একটা টেবিল আর টেবিলে কেইক রাখা যাতে লিখা “হ্যাপি বার্থডে কণা” তারমানে এসব রুহানের কাজ আর এজন্যই ও আমাকে ছাদে আসতে বলেছে।
রুহান: হ্যাপি বার্থডে কণা। (রুহানের কথায় চমকে উঠে পিছনে তাকালাম, ও হাসছে)
আমি: এসব কি রুহান?
রুহান: আজ তো তোমার বার্থডে।
আমি: হ্যাঁ আর সেটা আব্বু সেলিব্রেট করেছেন।
রুহান: তাতে কি হয়েছে আমি সেলিব্রেট করবো না, আমার কণার বার্থডে বলে কথা।
মেঘ: ওহ তুমি এখানে। (মেঘের কন্ঠ শুনে ছাদের দরজায় তাকালাম ও চারদিকের সাজানো দেখছে)
আমি: হ্যাঁ তুমিও এসো।
মেঘ: না তাড়াতাড়ি রুমে এসো তোমার জন্য খুব বড় একটা সারপ্রাইজ আছে।
আমি: কি সারপ্রাইজ?
মেঘ: রুমে এসো, আসছি। (মেঘ রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল, কি সারপ্রাইজ দিবে মেঘ?)
আমি: রুহান আর কতো বুঝাব তোমাকে।
রুহান: কণা আমি…
আমি: এই ভালোবাসা টুকু পপিকে দাও দেখবে মেয়েটা তোমার জন্য সব ভালোবাসা উজাড় করে দিবে অনেক সুখী হবে তোমরা দুজন।
রুহান: তোমার বার্থডে আজ আর এসব তোমাকে খুশি করার জন্য করেছি তুমি কিনা পপিকে নিয়ে পরে আছ।
আমি: খুশিতো সেদিন হবো যেদিন ঠিক এভাবে পুরো ছাদ সাজিয়ে হাতে একটা রিং নিয়ে ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে পপিকে প্রপোজ করবে।
রুহান: কণা…
আমি: আসছি।
রুহান: একটা কথা শুনে যাও কণা, ভাইয়ার জন্যই তো আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ? তুমি আমাকে মেনে না নিলে আমি ভাইয়াকে খুন করে আমার পথের কাটা দূর করবো, তোমার আর আমার মাঝখানে যে আসবে তাকেই আমি খুন করবো। (রুহানের কথার কোনো জবাব না দিয়ে রুমে চলে আসলাম)

রুমে এসে মেঘ’কে কোথাও দেখতে পেলাম না, রাগ করে আবার কোথাও চলে গেল কিনা কে জানে। ঘুমানোর জন্য বিছানায় আসতেই আমার বালিশের উপর এক জোড়া নূপুর দেখতে পেলাম। বেশ অবাক হয়ে নূপুর জোড়া হাতে নিলাম, কে রাখলো নূপুর দুটু এখানে?
মেঘ: ইচ্ছে ছিল নূপুর দুটু নিজ হাতে তোমার পায়ে পরিয়ে দিবো কিন্তু ছাদের দৃশ্য দেখার পর ইচ্ছেটা মরে গেছে। (অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মেঘের দিকে, সত্যিই এইটা সেই মেঘ তো যে আমাকে কথায় কথায় কষ্ট দিতো)
মেঘ: নূপুর দেখে অবাক হয়েছ তাই না? আজকাল তো সবাই পায়েল দেয় আমি কেন নূপুর দিলাম এটাই ভাবছ তো?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: আমি চেয়েছিলাম তুমি নূপুর দুটু পায়ে দিয়ে.. থাক অন্যদিন বলবো এখন ভালো লাগছে না।
আমি: এটাই সারপ্রাইজ?
মেঘ: উঁহু অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য যে সারপ্রাইজে তুমি একদম চমকে যাবে।
আমি: কি সারপ্রাইজ?
মেঘ: বোকা মেয়ে তো তুমি, আগে থেকে বলে দিলে সারপ্রাইজ আর সারপ্রাইজ থাকে নাকি? সময় হলে ঠিক জানতে পারবে।
আমি: হুম।
মেঘ: রুহানের সাথে এতো মেলামেশা না করলে হয় না?
আমি: মেলামেশা তাও আমি? কখন করলাম? ওকে তো আমি সমানে বুঝিয়ে যাচ্ছি কিন্তু ওর পাগলামি যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। একটু আগে কি বলেছে শুনবে? রুহান আর আমার মাঝখানে যে আসবে তাকেই নাকি ও খুন করবে।
মেঘ: প্রয়োজন হলে খুন আমিও করতে পারি।
আমি: কি বললে?
মেঘ: কোথায় কি?
আমি: তুমি কি যেন আস্তে আস্তে বললে।
মেঘ: কই কি বললাম। (মেঘ আস্তে বললেও আমি স্পষ্ট শুনেছি ওর কথাটা, কি বলছে ও এসব। ওদিকে রুহানও এসব বলছে, কি চাইছে ওরা দুভাই)
মেঘ: নূপুর দুটু কি পরে দেখাবে আমাকে?
আমি: হু।

বিছানায় বসে এক নূপুর পায়ে দিলাম, অন্য নূপুরটা হাতে নিতেই মেঘ আমার পায়ের কাছে এসে বসলো। আমার হাত থেকে নূপুরটা নিয়ে ও নিজ হাতে খুব যত্ন করে আমার পায়ে পরিয়ে দিলো। মুগ্ধ হয়ে দেখছি মেঘ’কে এতো পাল্টে গেল কিভাবে? আজ তো দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই ওকে পরীক্ষা করার জন্য তাহলে আজ মেঘ এসব কেন করছে? তাহলে কি মেঘ আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে…
মেঘ: কি হলো হাসছ যে?
আমি: এমনি। (আজকের এই মেঘ’কে দেখে নিজের অজান্তেই হাসছিলাম হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠাতে হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। এতো রাতে কে ফোন দিল? ফোন হাতে নিয়ে দেখি আম্মু, কোনো বিপদ হলো নাতো? তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করলাম)
আমি: আম্মু…
আম্মু: কণা তোতর আআব্বু…
আমি: কি হয়েছে আব্বুর?
আম্মু: (নিশ্চুপ)
আমি: আম্মু তুমি এভাবে কাঁদছ কেন কি হয়েছে আব্বুর?
আম্মু: তোর আব্বুকে কারা যেন খুন করেছে।
আমি: কি?
আম্মু: একটু আগে কজন সন্ত্রাসী এসে তোর আব্বুকে… (আম্মু হুহু করে কেঁদে দিলো, কি বলছে আম্মু এসব আমি কি সত্যি শুনছি এসব)
আম্মু: এই কাজ কেউ করিয়েছে নাহলে আমাকে খুন করলো না কেন আর তোর আব্বুকে মারার পর একজনের কাছে ফোন আসে, ফোন রিসিভ করে লোকটি বলেছিল “স্যার কাজ শেষ”
হাত কাঁপতে কাঁপতে ফোনটা হাত থেকে পরে গেল, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে আমার।
মেঘ: কণা কি হয়েছে তোমার কে ফোন দিয়েছিল।
আমি: মেঘ আব্বু আব্বু…(মাথা ঘুরিয়ে পরে যাচ্ছিলাম মেঘ ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো আমাকে)
মেঘ: কি হয়েছে স্যার এর?
আমি: খুখুখুন।
মেঘ: হোয়াট?

মেঘের বুকে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি, কান্না পাচ্ছে না আমার পাথর হয়ে গেছি আমি। কে করলো এই কাজ মাথায় আসছে না, কারো সাথে তো আব্বুর শত্রুতা ছিল না তবে কে কর… “স্যার কাজ শেষ” কথাটা কাকে বলেছে সন্ত্রাসীরা কে এই লোক?
আব্বুর শেষ কথাটা মনে পড়ছে “তোহার আঠারো বছর হবার আগে আব্বু মারা গেলে সবকিছুর দেখাশোনা মেঘ করবে” তখন তো মেঘ আমাকে ডাকতে গিয়েছিল হয়তো কথাটা শুনেছে তবে কি মেঘ আব্বুকে… হতে পারে ও এখনি সবকিছুর মালিক হতে চায় তাই আব্বুকে সরিয়ে দিয়েছে। মেঘের একটু আগের কথাগুলো কানের মধ্যে বাজছে “সারপ্রাইজ আছে যে সারপ্রাইজে তুমি চমকে যাবে” তবে কি এটাই মেঘের সারপ্রাইজ? “প্রয়োজন হলে খুন আমিও করতে পারি” “যতো টাকা লাগে আমি দিবো আমার শুধু কাজটা হওয়া চাই আর সেটা যেন খুব তাড়াতাড়ি হয়” মেঘ এর বলা সব কথা গুলোর মানে তো একটাই দাঁড়াচ্ছে, তবে কি সত্যি মেঘ আব্বুকে খুন করেছে?
মেঘ: কি হলো কণা আমাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলে কেন?
আমি: মেঘ তুমি পারলে এই কাজ করতে?
মেঘ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, ওর থেকে দূরে সরে আসলাম। ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে ওকে আমি খুন করে ফেলি…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৫

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৫

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘ’কে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলাম। মেঘ তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গেল চারদিকে চোখ বুলিয়ে ফিরে আসলো আমার কাছে।
মেঘ: ওয়াক থুঃ।
আমি: হু!
মেঘ: অবাক হচ্ছ কেন? তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবেসে এমন করেছি? আর ঠোঁটে এতো গাড়ো করে লিপস্টিক দিতে হয় নাকি যত্তোসব।
আমি: কি বলছ এসব তুমি?
মেঘ: তুমি না সত্যি একটা বোকা মেয়ে, আরে রুমের বাইরে দাদি দাঁড়ানো ছিল তাই একটু অভিনয় করলাম। (বিছানায় বসে পড়লাম চুপচাপ, চোখ দিয়ে একনাগাড়ে পানি পড়ছে। মেঘ এমন করতে পারলো)
মেঘ: দাদি আমার হাতে শাড়িটা দিয়ে বললো উপরে নাকি আসতে পারবে না সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হয় আমি যেন তোমাকে শাড়িটা দিয়ে দেই কিন্তু তখন আমার সন্দেহ হয়। আর আমার সন্দেহটাই সত্যি হয়েছে, দাদি আমাকে পরীক্ষা করার জন্য লুকিয়ে উপরে এসেছিল তাই তো পরীক্ষাটা ভালো করে দিলাম হাহাহা।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কি কণা চৌধুরী হেরে গেলে তো মেঘ এর অভিনয়ের কাছে।
আমি: ভালোবাসা নিয়ে অভিনয় করেছ তো তাই বুঝতে পারিনি তাছাড়া খান পরিবারের ছেলে যে কোনো মেয়ের বিশ্বাস ভালোবাসা নিয়ে এতো নিখুঁত ভাবে অভিনয় করতে পারে সেটা আমার ভাবনায় আসেনি।
মেঘ: ভুলেও কখনো আমার কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করো না।
আমি: তা নাহয় চাইবো না কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে পারি?
মেঘ: হুম বলো।
আমি: আমার দোষটা কোথায়? কেন করছ এসব? কেন কষ্ট দিচ্ছ আমাকে? কেন খেলছ আমার ইমোশন নিয়ে?
মেঘ: সেদিন যদি তুমি বিয়েতে রাজি না হতে তাহলে আজ আমি এতো যন্ত্রণায় পড়তাম না। আর এটাই তোমার সবচেয়ে বড় দোষ। শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি দাদির কাছে সব…
আমি: বিয়েটা কিন্তু আমি তোমার মেয়ের কথা ভেবেই করেছি।
মেঘ: তুমি রাজি নাহলে আমি তোহাকে ঠিক বুঝিয়ে নিতাম।
আমি: ওহ তাই বুঝি? ঠিক আছে আমি নাহয় তোমার থেকে দূরে সরে যাবো।
মেঘ: মানে?
আমি: চলে যাবো তোমাদের ছেড়ে খুশি?
মেঘ: যদি তোমার যাওয়াটা সম্ভব হতো তাহলে আমিই তোমাকে চলে যেতে বলতাম।
আমি: তুমি যেহেতু আমাকে মেনে নেওনি তাহলে তো একদিন আমাকে চলে যেতেই হবে, এভাবে তো সারাটা জীবন কাটানো সম্ভব না আর তোমার মতো মানুষের সাথে তো একদমই না।
মেঘ: এভাবেই থাকতে হবে এইটা জেনেই তো বিয়েটা করেছ আর আমি ভালো নাকি খারাপ সেটা বিচার করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
আমি: তোমার প্রতি আমার সব ধরণের অধিকার আছে বুঝেছ? আর এই অধিকার আমাকে কবুল শব্দটা দিয়েছে।
মেঘ: অধিকার অধিকার বলে কি বুঝাতে চাইছ? তোমার মর্যাদা চাই? আমাকে চাই আমার সঙ্গ চাই তাহলে চলো বিছানায়।
আমি: ছিঃ মেঘ তুমি এতো নিচ।
মেঘ: তোমাদের মেয়েদের সাথে নিচ হওয়াটাই উত্তম কাজ, তোমাদের ভালোবাসলে তোমরা পিছন থেকে চাকু মারতে দিদ্ধা করো না।
আমি: তুমি কিন্তু আবারো শায়লার সাথে সবাইকে গুলিয়ে ফেলছ।
মেঘ: আমার কাছে সব মেয়েই এক।
আমি: দ্যাত তোমার সাথে কথা বলে অযতা সময় নষ্ট হচ্ছে।
মেঘ: কথা বলতে বলেছে কে?
মা: মেঘ তোদের হলো অনেক দেরি হয়ে গেছে তো।
মেঘ: আসছি আম্মু।
মেঘ তোহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল পিছু পিছু আমিও বেরিয়ে আসলাম।

আমাদের বিদায় দিতে ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছে।সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরুনোর জন্য পা বাড়াতেই রুহান ডাক দিলো, উফফ পারিনা আর।
আমি: কি কিছু বলবে?
রুহান: আসবে কখন?
আমি: সেটা তো বাড়ির বড়দের জানার কথা তোমাকে কৈফিয়ত দিতে যাবো কেন?
রুহান: এভাবে কথা বলছ কেন?
আমি: তো কিভাবে বলবো? তুমি কি আমার স্বামী নাকি প্রেমিক যে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবো? অবশ্য তুমি আমার দেবর হয়ে যদি থাকতে তাহলে নাহয় একটু মিষ্টি করে কথা বলতাম। (ইচ্ছে করেই এভাবে কথা গুলো বললাম রুহান যেন আমাকে ভুলে গিয়ে পপির ভালোবাসা বুঝতে পারে)
চাঁচি: আমার ছেলে একটা কথা জানতে চেয়েছে মাত্র আর তুমি ওকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলে।
দাদি: বৌমা তুমি কেমন মা রুহানকে একটু বুঝাতে পারো না, ওর তো বুঝা উচিত কণা এখন সম্পর্কে ওর ভাবি হয়।
মা: আহ থামবে তোমরা? ছেলে মেয়ে দুটু বের হবে এখন আর তোমরা ঝগড়া শুরু করে দিলে।
দাদি: যা তো দাদুভাই তোরা বের হ আর সাবধানে যাস।
মেঘ: হ্যাঁ আসছি।

গাড়িতে উঠে বসলাম, মেঘ আমার দিকে না তাকিয়ে সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতেই বললো…
মেঘ: তুমিও তো কম নাটক করো না দেখছি।
আমি: মানে?
মেঘ: এইযে রুহানের সাথে এতো সুন্দর অভিনয় করছ, খেলছ ওর ভালোবাসা নিয়ে।
আমি: রুহানের ভালোবাসা নিয়ে আমি খেলছি না, ওকে আমি অনেক বুঝিয়েছি তারপরও রুহান পাগলামি করলে আমার কিছু করার নেই।
মেঘ: আমিও তো তোমাকে বুঝাচ্ছি তারপরও শুনছ না কেন? কেন পাগলামি করছ?
আমি: কখন পাগলামি করলাম।
মেঘ: ওইযে…
আমি: হয়েছে আর একটা কথাও শুনতে চাই না।
মেঘ: হুম।

গাড়ি ছুটছে তার গন্তব্যের দিকে, জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছি। অপর জানালা দিয়ে বাবা মেয়ে এইটা ওইটা দেখে হাসছে। কিন্তু আমি ওদের সাথে হাসিতে যোগ দিতে পারছি না, এখনো কান্না থামছে না বারবার মনে হচ্ছে মেঘ আমার ইমোশন নিয়ে খেলা করেছে। একটা মানুষ কতোটা নিচে নামতে পারে আর এই কাজ করতে পারে ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে।

বাসায় এসে গাড়ি থেকে নামতেই মেঘ ডাক দিলো।
আমি: কিছু বলবে?
মেঘ: তোমার বাবা মায়ের সামনে এমন কিছু করো না বা বলো না যাতে উনাদের সন্দেহ হয় আর আমার পরিবারে জানিয়ে দেয়।
আমি: পরিবারের সামনে এতো ভালো সাজার কি আছে যত্তোসব।
মেঘ: আমি মানুষ ভালোই তবে ভালো মানুষের সাথে ভালো আর খারাপ মানুষের সাথে খারাপ।
আমি: তারমানে আমি খারাপ?
আব্বু: কিরে তোরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আমি: এইতো আব্বু আসছি।

আব্বু আম্মুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে রুমে চলে আসলাম, পিছু পিছু মেঘও তোহাকে নিয়ে আসলো।
মেঘ: বাহ্ তোমার রুমটা তো খুব সুন্দর। (মেঘের সাথে কথা বলবো না ভেবে রেখেছি তাই কোনো উত্তর দিলাম না)
মেঘ: ফ্রেশ হব ওয়াশরুম কোনদিকে? (আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, ও চলে যেতেই তোহার কাছে এসে বসলাম। তোহার দুগালে ধরে জিজ্ঞেস করলাম..)
আমি: আম্মু তুমি কার কাছে থাকতে চাও আব্বুর কাছে নাকি আমার কাছে?
তোহা: আমি তো দুজনকেই চাই।
আম্মু: তা আর সম্ভব না মা, আমি আর ফিরে যাবো না। তুমি আমার কাছে থাকো।
তোহা: না আমার আব্বুকেও চাই।
আমি: তাহলে তোমার আব্বুর কাছে চলে যাও।
তোহা: না আমার তোমাকেও চাই। (কান্না আটকাতে পারছি না তোহাকে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। এই মেয়ের জন্য দূরে সরে আসতে পারছি না আবার মেঘের এমন ব্যবহারের পর ওর কাছে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না)
মেঘ: তোহা তুমি কাঁদছ কেন? (মেঘের কথা শুনে তোহাকে ছেড়ে দিলাম, মেয়েটা কাঁদছে তাড়াতাড়ি ওর চোখের পানি মুছে দিলাম)
মেঘ: তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে কাঁদানোর?
আমি: মেয়ে কিন্তু আমারো আর মা কখনো সন্তানকে কাঁদাতে চায় না। তোহা আমাকে হারানোর ভয়ে কাঁদছে।
মেঘ: হুহ মা! (মেঘের ভেংচি যেন বুকের বাম পাশে এসে লাগলো, এতো ভালোবাসি তোহাকে কিন্তু মেঘ আমাকে তোহার মা ভাবতে পারছে না)
মেঘ: এই তুমি এত কাঁদতে পারো কিভাবে?
আমি: যখন ভালোবাসার মানুষ অবহেলা করবে তখন বুঝবে কান্না কিভাবে আসে। (মৃদু হেসে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম)

আম্মু: কিরে ওখানে কেমন আছিস কিছুই তো বললি না, মেঘ তোকে মেনে নিয়েছে তো। (ভাত খাচ্ছিলাম আম্মুর কথায় ভাতের লোকমা আর মুখে দিতে পারলাম না, ভাগ্যিস মেঘ আগেই খেয়ে রুমে চলে গেছে। কিন্তু আম্মুকে কিভাবে বলি মেঘ যে আমাকে মেনে নেয়নি)
আম্মু: বিয়ের দিন মেঘ যা রাগ দেখিয়েছে আমার মনে হয় না মেঘ তোকে মেনে নিবে।
আমি: কি বলছ আম্মু এসব মেঘ তো আমাকে মেনে নিয়েছে আর ও বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ খুব ভালো আমাকে সবাই খুব ভালোবাসে।
আম্মু: মিথ্যে বলছিস নাতো?
আমি: মিমিমিথ্যে কেকেন বলবো? (মায়ের কাছে বোধহয় এতো সহজে মিথ্যে বলা যায় না তাইতো আমার গলা কাঁপছে)
আম্মু: তুই এখন আমার কাছে মিথ্যে বললেও একদিন তোর এসব কথাই সত্যি হবে এই বিশ্বাস তোর উপর আমার আছে।
আমি: হুম।
আব্বু: কণা খেয়ে একটু আমাদের রুমে আসিস তো।
আমি: ঠিক আছে আব্বু।

আব্বু আম্মুর সামনে বসে আছি আব্বুকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে জানিনা কি বলবে।
আব্বু: কণা আমি বলছিলাম সব সম্পত্তির উইলটা নতুন করে করতে।
আমি: ঠিক আছে করো আমাকে জিজ্ঞেস করার কি আছে।
আব্বু: সবকিছু তোর নামে দিয়ে দিতে চাই তোর নামে থাকলেও দেখাশোনা তো মেঘই করবে তাই আমার কোনো টেনশন থাকবে না, মেঘ কিন্তু খুব ভালো ছেলে। (কতোটা ভালো সেটা তো শুধু আমিই জানি, অপদার্থ একটা)
আব্বু: কিরে কথা বলছিস না কেন, কি ভাবছিস?
আমি: আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছ আমি যা বলি মেনে নিবে?
আব্বু: মানবো না কেন বলে দেখ।
আমি: সব কিছু আমি তোহার নামে দিতে চাই। (আমার কথা শুনে আব্বু আম্মু দুজনই একে অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছেন)
আম্মু: কণা তোর মাথা ঠিক আছে তো কি বলছিস এসব?
আমি: আম্মু আমি ভেবে চিন্তেই বলছি আর তোহার নামে থাকলেই তো এখন তোহার হয়ে যাবে না, তোহার আঠারো বছর পূর্ণ হবার পর তোহা পাবে এর আগে সবকিছু মেঘই দেখাশোনা করবে আর আব্বু তো চানই মেঘ সবকিছু দেখাশোনা করুক।
আব্বু: হ্যাঁ চাই তাই বলে তোহা…
আমি: তোহা আমার মেয়ে আর মায়ের সম্পত্তি মেয়েই তো পাবে।
আব্বু: তারপরও আর একবার ভেবে দেখ মা।
আমি: আমার সিদ্ধান্ত আমি তোমাদের জানিয়ে দিয়েছি এখন তোমাদের ইচ্ছা।
আব্বুর রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। সবকিছু তোহাকে দিয়ে দিবো, মেঘকে বুঝিয়ে দিবো তোহাকে আমি কতোটা ভালোবাসি, তোহার জন্য আমি কতোটা ভাবি।

দুদিন পর….

বাসায় ফিরে আসলাম মেঘের খারাপিও শুরু হয়ে গেল। সবার সামনে ভালো স্বামী আর রুমের মধ্যে বদের হাড্ডি একটা।
রুহান: কণা কথা ছিল। (আরেক পাগল এসে জুটেছে)
আমি: কি বলো।
রুহান: তুমি কি আমার কথা শুনবে নাকি আমি পাগলামি শুরু করবো?
আমি: তুমি ভালো ছিলে কবে সবসময় তো মানসিক রোগী হয়েই আছ।
রুহান: বেশি ভালোবাসি তো তাই আমাকে তোমার কাছে মানসিক রোগী মনে হয়।
আমি: এই শুনো আজকে থেকে তুমি আমাকে ভাবি বলে ডাকবে আর এসব ভালোবাসি ভালোবাসি যেন আর না শুনি।
রুহান: কণা প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো।
আমি: হাত ছাড়ো আমার, তোমার সাহস হয় কিভাবে আমার হাত ধরার।
মেঘ: বাহ্ অফিস যাওয়ার সময় রুমে ফষ্টিনষ্টি।
আমি: মেঘ?
মেঘ: চিৎকার করছ কেন? আর রুহান ফষ্টিনষ্টি করার জায়গা কি আমার রুমেই?
রুহান: সরি ভাইয়া। (রুহান বেরিয়ে গেল। গেল তো গেল আমাকে খারাপ সাজিয়ে গেল)
মেঘ: আমার রুমে যেন আর কখনো এসব না দেখি, ফষ্টিনষ্টি করার ইচ্ছা থাকলে বাড়িতে আরো অনেক জায়গা আছে।
আমি: তোমার ভাই তোমার বউয়ের সাথে এমন করে কোথায় তুমি ভাইকে শাসন করবে তা না উল্টো আমাকে কথা শুনাচ্ছ।
মেঘ: কে আমার বউ, তুমি? তোমাকে তো আমি আমার স্ত্রী এর মর্যাদাই দেইনি তাহলে কিভ…
আমি: ব্যাস আর বলতে হবে না, তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে যাও।
মেঘ হনহন করে বেরিয়ে গেল। আর পারছি না সারাক্ষণ শুধু খারাপ ভাষায় কথা বলা, একটু ভালোভাবে কথা বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় নাকি?

রাত অনেক হয়েছে কিন্তু মেঘ ফিরে আসার নাম নেই। সবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছি তখনি কলিংবেল বেজে উঠলো। পপি গিয়ে দরজা খুলে দিতেই মেঘ এসে ঢুকলো, আমার দিকে একনজর তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে রুমে চলে গেল।
মা: কি হলো বলতো এভাবে রেগে চলে গেল কারো সাথে কোনো কথা বলল না।
দাদি: কিরে কণা বসে আছিস কেন রুমে যা, গিয়ে দেখ দাদুভাই রেগে আছে কেন।
আমি: হুম।

আমি: আহহ! (দরজায় আসতেই কি যেন একটা উড়ে এসে আমার কপালে পড়লো, অনেকটা জায়গা কেটেও গেছে। কপালে হাত দিয়েই নিচে তাকালাম, মেঘের জুতা)
মেঘ: সব দোষ ওই মেয়ের আজ তো ওকে আমি…(মেঘ আর একটা জুতা খুলে ছুড়ে দিতে দিতে দরজায় তাকালো, আমাকে দেখতে পেয়েই হনহন করে আমার কাছে আসলো)
মেঘ: এসো আমার সাথে।
আমি: আরে দরজা বন্ধ করছ কেন।
মেঘ: একদম চুপ।
আমি: আরে আস্তে চেঁচাও তোহা ঘুমে।
মেঘ: শুধুমাত্র তোমার জন্য আজ আমাকে সবাই এতো অপমান করল।
আমি: কে অপমান করেছে আর কেনই বা করেছে আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
মেঘ: আজ অফিসে সবাই বলেছে আমি নাকি তোমার বাবার সম্পত্তির লোভে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার জন্য আমি এসব কথা কেন শুনবো?
আমি: এই কথা কে কে বলেছে?
মেঘ: বললে কি হবে? ওদের চাকরি খেয়ে ফেলবে?
আমি: যারা আমার স্বামীকে অপমান করেছে তাদের তো এমনি ছেড়ে দিবো না।
মেঘ: আসছে স্বামী বলতে কে তোর স্বামী? আমি… (আমার হাত ধরে টান দিয়ে ওর দিকে ফিরাতেই আমার কপালের দিকে ওর নজর পড়লো)
মেঘ: তোমার কপাল কেটেছে কিভাবে রক্ত ঝরছে তো।
আমি: ঝরতে দাও এটাই তো শুধু চোখে দেখতে পারছ ভিতরের রক্ত ঝরা তো কখনো দেখতে পারবে না।
মেঘ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, ওর হাতটা আমার কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত কোথাও আলোর রেখা নেই চারপাশ থেকে শুনশান শব্দ ভেসে আসছে শুধু। আমার চোখের পানি তো মেঘ কখনো দেখে না আর এই অন্ধকারে তো একদমই দেখবে না। কথা দিচ্ছি মেঘ
আজকের পর আর কখনো তোমার সামনে আমার ভালোবাসা প্রকাশ করবো না। এখন থেকে নাহয় তোমার চোখের আড়ালে নীরবেই ভালোবেসে যাবো তোমাকে…

চলবে?