Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1860



অনুভূতি পর্ব ১১

0

অনুভূতি
পর্ব ১১
মিশু মনি
.
১৭.
– “সকাল নয়টা অব্দি বাসর রাত থাকে?”
ভাবির এমন রসিকতা শুনে মুখ টিপে হাসলো অরণ্য। হেসে হেসে বললো, “তাও তো কম হয়ে গেলো, আমি ভেবেছিলাম টানা দুদিন দরজা খুলবো না।”
বলেই শব্দ করে হাসল। ভাবিও হাসলো। কিন্তু এরকম কথা শুনে বুকটা চিনচিন করে উঠলো দুপুরের। ভালো লাগছে না এরকম কিছু শুনতে। নিতান্তই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হয়েছে ওকে। তারমানে এই নয় যে, আর সবার মত করে তাকেও এরকম রসিকতা শুনতে হবে। কিন্তু কিছুই করার নেই। শুনতেই হবে তাকে। কেউ তো আর জানেনা তার ভেতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
ভাবি রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করার চেষ্টা করল দুপুরের সাথে। কিন্তু দুপুরের মুখে কিছুতেই হাসি আসেনা। উনি তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলে যেতে বলে চলে গেলেন রুম থেকে। অরণ্য এসে দুপুরের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোনো সমস্যা?”
– “না।”
– “একটু সহজ হও আমার সাথে। বলো কি হইছে তোমার?”
দুপুর চোখ তুলে তাকালো। চোখাচোখি হতেই বুকটা কেমন যেন করে উঠলো ওর। অরণ্য’র চোখে কি যেন একটা আছে। সেই চোখের দিকে তাকালে খুন হয়ে যাবে যেকোনো মেয়েই। দুপুর তাকাতে পারলো না আর। চোখ নামিয়ে নিলো।
কিন্তু অরণ্য এগিয়ে এসে দুপুরের মুখটা আলতো করে ধরে একদম কাছে চলে এলো। দুপুর কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বুকের ধুকপুকুনি টা বেড়েই যাচ্ছে ওর। অরণ্য আলতো করে একটা চুমু একে দিলো দুপুরের কপালে। দুপুরের বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। অনেক কষ্টেও চেপে রাখতে পারলো না। চোখে একটু পানি চলে এলো। অরণ্য দুপুরের মুখটা তুলে বলল, “তোমাকে আমার করে নিলাম। এখন থেকে তুমি শুধুই আমার। আর আমিও শুধুই তোমার। কাজেই নিজেকে আমার থেকে আলাদা ভেবোনা। যা কিছু ভেতরে চেপে রেখেছো, আমাকে বলে হালকা হতে পারো। ”
দুপুর চোখ বন্ধ করেই রইলো। খুলতে পারলো না কিছুতেই। অরণ্য বলল, “তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসো, সবাই ওয়েট করছে আমাদের জন্য।”
কথাটা বলেই অরণ্য বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। কপালের যে জায়গাটায় অরণ্য চুমু একে দিয়েছে, সেখানে একবার হাত রাখলো দুপুর। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। এখন তো এই অধিকার শুধুই অরণ্য’র, সে দোষের কিছুই করেনি। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে অন্যকারো জন্য। অরণ্য কে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী ভাবলে ভূল হবেনা, তবে কষ্টটা যে অন্য কোথাও। নিখিলকে কিছুতেই ভূলতে পারছে না দুপুর। বারবার ওর কথা ভেবে কান্না আসতে চাইছে, কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর।
তাড়াতাড়ি নাস্তার টেবিলে চলে এলো ও। নাস্তা খেতে খেতে অরণ্য ওর বাবাকে বললো, “আব্বু আমি কালই দুপুরকে নিয়ে একবার সিলেট থেকে ঘুরে আসতে চাই। বাংলোয় কথা বলে দাও।”
বাবা একবার চোখ তুলে তাকালেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। মাথা নেড়ে খাবার খেতে লাগলেন। অরণ্য বলল, “আব্বু আমি কিছু বলেছি। আমার অফিসের ছুটি মাত্র কয়েকদিন। এর ফাঁকেই একবার ঘুরে আসতে চাই। বাসায় দুপুরের কোনো কাজ নেই। আজ বৌভাত হয়ে গেলে কালই চলে যাবো।”
সবাই খাওয়ার মাঝে একবার তাকালেন অরণ্য ও দুপুরের দিকে। দুপুর লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। ওর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। তবুও নাড়াচাড়া করতে হচ্ছে। অরণ্য বউকে নিয়ে বিয়ের পরদিন ই ঘুরতে যেতে চাইছে! একটুও কি লজ্জা লাগছে না বলতে?
অরণ্য আবারো বললো, “আব্বু, কিছু বলছো না কেন?”
– “যাবি ঘুরতে। বারণ তো আর করবো না। কয়দিনের জন্য যেতে চাস?”
– “দুদিন তিনরাত।”
– “চা বাগানের ভিতরে থেকে কি করবি? বউ নিয়ে যাচ্ছিস হোটেলে ওঠ। নূরজাহান গ্রান্ডে কথা বলে দেখ।”
অরণ্য উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “থ্যাংকস আব্বু। আমি এক্ষুণি কথা বলে দেখছি রুম বুক করা যায় কিনা। আর তোমরা খেয়ে নাও, আমি খুশির ঠেলায় আর খেতেই পারবো না।”
অরণ্য উঠে রুমের দিকে চলে গেলো। দুপুর একবার তাকালো ওর চলে যাওয়ার দিকে। ছেলেটা প্রচণ্ড রকমের খুশি হয়েছে। উত্তেজনায় চোখে পানি চলে এসেছে ওর। কিন্তু এরকম আচরণ সাধারণত কেউ করেনা, খাওয়ার মাঝখানে উঠে যাওয়াটা তো ঠিক না। খাবার শেষ করে যেতে পারতো।
দুপুরের শ্বাশুরি মা বললেন, “তুমি কিছু মনে করোনা মা। ও একটু এমন ই। পাগলাটে ছেলে আমার।”
দুপুর এমনিতেই খেতে পারছিলো না, এখন আরো পারছে না। মনটা কেমন কেমন যেন করছে। বেড়াতে গেলে প্রত্যেকটা মুহুর্ত অরণ্য ওর সাথে সাথেই থাকবে, অনেক কষ্ট হচ্ছে ভাবলে। একজনকে মন থেকে সরিয়ে আরেকজনকে জায়গা করে দেয়াটা সত্যিই খুব কষ্টের।
কোনোমতে খাওয়া শেষ করে রুমে আসতেই অরণ্য বললো, “রাগ করছো দুপুর?”
– “না, রাগ করবো কেন?”
– “ভাবছো কেমন নির্লজ্জের মতন বললাম কালকেই বেড়াতে যেতে চাই? আসলে আমি তোমার জন্যই ওটা বলেছি। আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, কিছুতেই সহজ হতে পারছো না। তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরে এলে ভালো লাগবে তোমার।”
দুপুর কিছুই বললো না। কিন্তু অবাক হলো বেশ। আস্তে করে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে রইলো জানালার পাশে। অরণ্য এসে দুপুরের পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু কেউই কোনো কথা বললো না। এভাবে সময় পেড়িয়ে যেতে লাগলো। অরণ্য ভাবছে কিভাবে মেয়েটার মনটাকে একটু ভালো করা যায়? আর দুপুর ভাবছে, জীবন এত অদ্ভুত কেন!
১৮.
মিশু রৌদ্রময়ীর সাথে গল্প করার অনেক চেষ্টা করেও পারলো না। মেয়েটা কিছুতেই মুখ খুলতে চায়না। শুধু সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে, গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। মিশু একবার রোদের হাত ধরে আলতো করে চেপে ধরলো। বললো, “আমাকে তোমার বোন ভাবতে পারো। মনে যা আছে বলে ফেলতে পারতে, হালকা লাগতো অনেক।”
দুপুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছুই বললো না। এমনকি চোখ ও খুললো না। মিশু উঠে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। একটু পরেই মেঘালয় চলে এলো। এসে হাসতে হাসতে বললো, “ম্যাম সরি, হাঁসের গোশত পাওয়া গেলো না।”
মিশু হেসে ফেললো ওর সরি বলার ধরণ দেখে। বললো, “থাক, হাসের গোশত এখন খেতেও চাইনা। আপাতত ওই নতুন বউয়ের মুখ থেকে দুটো শব্দ বের করতে চাই। অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। কি করি বলুন তো?”
মেঘালয় একবার রোদের দিকে তাকিয়ে মিশুকে বললো, “আমার মনেহয় মেয়েটা সুইসাইড করার জন্য এসেছিলো। কিন্তু সেটা পারেনি, হয়ত মরার মত সাহস ছিলোনা। তাই ট্রেনে উঠেই বসে আছে। এখন কোথায় যাবে তাও জানেনা।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হতেও পারে। নাও হতে পারে, অন্য কোনো কষ্ট আছে মেয়েটার।”
– “এখন কি তাকে নিয়েই ভাব্বে? তোমার না খিদে পেয়েছে? খাবেনা?”
– “হুম চলুন। আচ্ছা আপনার বন্ধু আমাকে ভাবি ডাকলো কেন?”
মেঘালয় হেসে বললো, “সে তোমাকে আমার বউ ভেবেছে।”
বউ কথাটা শুনতে কেন যেন অনেক ভালো লাগলো মিশুর। মুখ টিপে হাসলো ও। তারপর খাবার বগিতে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।
চলন্ত ট্রেনে হাটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো মিশু। টাল সামলাতে পারছে না, মেঘালয় ওর হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মিশুর মনটা বেশ উৎফুল্ল। মেঘালয়কে খুব আপন মনেহচ্ছে ওর। বারবার মেঘালয় ওর হাত ধরছে, এই ব্যাপার টাকেও অনেক ভালো লাগছে!
খাবার খেতে খেতে অনেক বকবক করলো মিশু। রোদের জন্য কিছু নাস্তা ও চা নিয়ে আবারো নিজেদের সিটে ফিরে এলো। মিশু নিজেই গিয়ে রোদকে নাস্তা ও চা দিয়ে শুধু বললো, “খেয়ে নাও।”
কথাটা বলেই নিজের জায়গায় ফিরে আসলো। রোদ অনেক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর চায়ে চুমুক দিতে লাগলো। ওকে খেতে আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে মিশুর। আর মিশুর আনন্দ দেখে বড্ড ভালো লাগছে মেঘালয়ের।
মিশু হঠাৎ বললো, “আচ্ছা আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
– “আপাতত গন্তব্যস্থান জানা নেই।”
– “আচ্ছা তাহলে ভোরের ট্রেনে আবারো ঢাকায় ফিরে আসবো?”
– “হুম তা করা যায়। টানা এতক্ষণ জার্নি করতে খারাপ লাগবে না?”
– “আরে নাহ, আমার জার্নিতে কোনো সমস্যা নেই। আমার মন খারাপ লাগছে ওই মেয়েটার জন্য।”
– “মিশু, প্লিজ এত মন খারাপ করোনা। ওকে ওর মত থাকতে দাও, অনেক চেষ্টা করেও একটা কথা বের করতে পেরেছো? পারোনি। অযথা কষ্ট দেয়ার দরকার নেই।”
– “আমিতো কষ্টটা কমাতে চাইছিলাম।”
– “কেউ যদি কমাতে না চায়, তুমি জোর করে কমাবা?”
মিশু আর কিছু বললো না। মুখ বাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাতাসে চুল উড়তে শুরু করেছে। ঘুম এসে যাচ্ছে ওর। কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না, আবারো যদি মেঘালয়ের কাঁধে ঢলে পড়ে তাহলে লজ্জা লাগবে ভীষণ। এরচেয়ে বরং জেগে থাকাই ভালো।
জেগে থাকতে চেয়েও বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারলো না। আস্তে আস্তে ঘুম এসে গেলো চোখে। কিছুক্ষণ পরেই গাড় ঘুমে তলিয়ে গেলো মিশু। মাথাটা আস্তে করে মেঘালয়ের কাঁধের উপর এসে পড়লো। মেঘালয় মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক ভাবে। ধীরেধীরে মিশুর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে ওর।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ১০

0

“অনুভূতি”
পর্ব ১০
লিখা: মিশু মনি
.
১৫.
মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে। হাওয়ায় চুল উড়ছে মিশুর। মাঝেমাঝে চুল উড়ে এসে মেঘালয়ের মুখের উপর পড়ছে। মনটা কেমন কেমন যেন করছে মেঘালয়ের। জীবনে প্রথমবার কেউ এভাবে ওর কাঁধে মাথা রেখেছে। মিশুই প্রথম সেদিন রাতে ওর পিঠে মাথা রেখেছিল, আজ কাঁধে। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মেয়ে ধীরেধীরে কিভাবে যেন বড্ড কাছে এসে যাচ্ছে, আপন হয়ে যাচ্ছে। অন্যরকম কোনো ব্যাপার যে ঘটছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না মেঘালয়ের। সামনে থেকে একজন যাত্রী ছবি তুলে নিলো ওদের দুজনের। মেঘালয়ের অন্যদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ই নেই।
একবার আড়চোখে মিশুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে বুকটা কেমন যেন করে উঠলো ওর। চোখ বুজে ভাবতে লাগলো, কি অদ্ভুত ব্যাপার! এরকম কখনো হয়না ওর সাথে। ইদানীং কিসব কান্ড যে ঘটে বুঝতে পারেনা ও। রাতে ঘুমালেই স্বপ্নে একটা মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েটা খোলাচুলে হেঁটে যায় সমুদ্রের তীর ঘেষে। বিশাল ঢেউ এসে ওর উপর দিয়ে আছড়ে পড়ে তীরে। ভয় হয় মেঘালয়ের। এই বুঝি মেয়েটাকে সমুদ্র তার ভিতরে টেনে নিয়েছে। কিন্তু ঢেউ নেমে যেতেই আবারো দেখা যায় মেয়েটি দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। ওর মুখ স্পষ্ট বুঝতে পারেনা মেঘালয়। শুধু চুলগুলো দেখতে পারে, কত চেনা সেই চুল আর চুলের গন্ধ!
চমকে উঠলো মেঘালয়। স্বপ্নে তো চুলের গন্ধ বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু কারো চুলের গন্ধ যে নাকে লাগছে! চোখ মেলে দেখলো মিশুর এক গোছা চুল উড়ে এসে মুখের উপর পড়েছে। সেই গন্ধই নাকে লাগছিলো। মিশু যে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে স্বপ্নের কথা ভাবতে গিয়ে সেটা ভূলেই গিয়েছিলো ও। আরেকবার মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেঘালয়। মিশু গভীর ঘুমে মগ্ন যেন কত রাত ভালোমত ঘুমায় না মেয়েটা! বড্ড মায়া লাগছে ওর জন্য।
একজন যাত্রী এসে মেঘালয় ও মিশুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো, “আরে মেঘ না?”
মেঘালয় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো, “হিরণ ভাই? আমাদের ভার্সিটির বড় ভাই ছিলেন?”
– “হ্যা হ্যা।”
খুশিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে হিরণ। মেঘালয় হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে যেতেই মিশুর মাথাটা ওর বুকে ঢলে পড়ে যেতে লাগলো। হাত দিয়ে মিশুকে ধরে ফেললো ও।
হিরণ হেসে বললো, “ইটস ওকে। তোমার গার্ল ফ্রেন্ড?”
প্রশ্নটা করেই হিরণ হাসলো। মেঘলয় কি বলবে বুঝতে না পেরে মিশুর দিকে তাকালো। সত্যিই কি বলা উচিৎ বুঝতে পারছে না। ওর বোনকে তো হিরণ চেনে। কাজিন বললে উলটা পালটা কিছু ভেবে বসবে। কিছু বলার আগেই হিরণ বললো,, “আমি ওই যে ওই সিটে বসেছি।”
মিশুর ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো একজন লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মেঘালয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আর তারই সামনে ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলো ও? ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মিশু।
হিরণ মিশুকে বলল, “কি ভাবি,ঘুম হলো?”
মিশু আচমকা ভাবি শব্দটা শুনে ভড়কে গেলো। সে কি মিশুকে মেঘালয়ের বউ ভেবেছে নাকি? ওর মত বাচ্চা মেয়েটাকে বউ বউ লাগে? আজকালকার লোকজনের আইডিয়া দেখলে হাসি পায়।
মিশু মনেমনে এসব ভাবছে। এদিকে সে যে মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রাখলে এটা ভাবাটাই স্বাভাবিক সেটা ওর মাথাতেও এলো না। বড্ড সরল একটা মেয়ে।
হিরণ গিয়ে তিনকাপ চা নিয়ে এসে দিলো। চায়ে চুমুক দিয়ে মিশু বললো, “আমার না খিদে পেয়েছে।”
হিরণ তাকালো মিশুর দিকে। বাচ্চা স্বভাবের মেয়ে কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয় হাসি চেপে রেখে বললো, “আচ্ছা বসো, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
– “চা শেষ করে যান।”
– “কি খাবা বলো?”
মিশু একটু ভেবে বলল, “আপনি কি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে খাবার আনতে যাবেন?”
মেঘালয় হেসে বলল, “গাড়ির ভিতরেই রেস্টুরেন্ট আছে। আমি অর্ডার দিয়ে আসি। ভাত খাবে? মুরগির মাংস দিয়ে?”
– “আমি হাসের গোশত দিয়ে ভাত খাবো। ঝাল ঝাল করে যেন রান্না করে।”
মেঘালয় এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। মেয়েটা এখনো বোধহয় ঘুমের ঘোরেই আছে। ঘুম জড়ানো গলায় এভাবে কিছু বললে একদিকে ভালো লাগে, অন্যদিকে হাসি পায়। হিরণ ভাইও রীতিমত অবাক হয়ে চেয়ে আছেন।
মেঘালয় বলল, “আমি দেখছি পাওয়া যায় কিনা। না পাওয়া গেলে ঢাকায় গিয়ে হাস কিনে ঝাল ঝাল করে রান্না করে খাওয়াবো।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো। চা শেষ করে কাপ নিয়ে হিরণের সাথে কোথায় যেন আড়াল হয়ে গেলো। মিশু উঠে গিয়ে রৌদ্রময়ীর পাশে বসলো। নতুন বউটাকে খুব মনমরা দেখাচ্ছে। একটু গল্প করা যাক, যদি বউটার মনটা ভালো হয়!
১৬.
আজ বৌভাত।
ঘুম থেকে উঠতে বড্ড দেরি হয়ে গেলো দুপুরের। উঠে আড়মোড়া ভেঙে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। নতুন বউ সাধারণত এত বেলা অব্দি ঘুমায় না। বাসার লোকজন কি যে ভাবছে কে জানে!
তাড়াহুড়ো করে উঠে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হুরমুর করে পড়ে গেলো দুপুর। অরণ্য ঘরেই ছিলো। ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে দুপুরের পাশে বসে বলল, “আরে পড়ে গেলে কিভাবে? ব্যথা পেয়েছো?”
দুপুর মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বলল, “না। আমি ঠিক আছি।”
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো দুপুর। অরণ্য অবাক হয়ে খেয়াল করলো দুপুরের চোখ লাল হয়ে আছে, একদম ফুলে গেছে চোখ দুটো। রাত্রে সে কান্না করেছে বুঝতে অসুবিধা হলো না অরণ্য’র। কিন্তু কান্না করার মত কোনো কারণ কি ছিলো?
উৎসুক চোখে দুপুরের দিকে তাকিয়ে রইলো অরণ্য। দুপুর বাথরুমের দিকে চলে গেলো। অরণ্য বিছানার উপর বসে বসে ভাবতে লাগলো। মেয়েটাকে হুট করে বিয়ে দিয়ে দেয়ায় কষ্ট পেয়েছে বোধহয়। আগে যেভাবে কথা বলতো, বিয়ের পর আর সেভাবে বলতে পারছে না।
দুপুর গোসল করে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো কোনো কল এসেছে কিনা। রোজ সকালে নিখিলের ফোনকলে ঘুম ভাঙত ওর। ছেলেটা বড্ড খেয়াল রাখতো দুপুরের। আজ সে কেমন আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে দুপুরের।
অরণ্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেয়ে আছে দুপুরের দিকে। দুপুর ঠিকমত চুল ও মুছতে পারেনা। চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। চুলের পানিতে জামা ভিজে যাচ্ছে,মেঝেতেও টপটপ করছে পানি। অরণ্য তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে এসে দুপুরের পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “একটু চুলও মুছতে পারোনা ঠিকমত? একটু নিজের খেয়াল রাখা কবে শিখবে বলোতো?”
চমকে উঠলো দুপুর। অরণ্য এমন ভাবে বলছে, ওর কথার সাথে কণ্ঠের আবেশ মিশে একদম অন্যরকম সুন্দর শোনাচ্ছে। যে কারো ভালো লাগতো শুনলে। দুপুর কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের পাপড়ি ও নড়ল না ওর। অরণ্য তোয়ালে দিয়ে ভালোভাবে চুল মুছিয়ে দিতে লাগলো দুপুরের। এরকম যত্ন পেয়ে আবেশে চোখ বুজে ফেললো দুপুর। অরণ্য খুব মনোযোগ সহকারে দুপুরের চুল মুছে দিচ্ছে। এই কাজটা করতে অরণ্য’র সে খুবই ভালো লাগছে সেটা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মুখে প্রসন্ন হাসি।
চুল মুছে দেয়ার পর অরণ্য বললো, “একি হাল করেছো নিজের? মাত্র একদিনেই এই অবস্থা? শোনো, আমার রুমে থাকতে হলে এরকম মনমরা হয়ে থাকা যাবেনা। বুঝলে?”
দুপুর চুপ করে রইলো। মনমরা হয়ে থাকলে কি সে রুম থেকে বের করে দিবে? যদি দিতো তাহলে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকতো ও। কিন্তু বের করে দেয়ার পথটা এতটা সহজ না। আর বের হওয়ার জন্য সে এ বাড়িতে আসেও নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো দুপুর।
অরণ্য বললো, “মুখে ক্রিম ব্যবহার করো তুমি?”
দুপুর এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে মাথা ঝাঁকাল। অরণ্য আয়নার সামনে রাখা ক্রিমের দিকে তাকিয়ে বললো, “ফেয়ার এন্ড লাভলী মেনস ক্রিমে হবে তোমার?”
এরকম আজগুবি প্রশ্নের উত্তরে কেমন রিয়েকশন দেয়া দরকার বুঝতে পারলো না দুপুর। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। অরণ্য মুখ টিপে হেসে বললো, “ওহ সরি। তুমি উইমেন্স ভূলেই গিয়েছিলাম। দেখেছো তোমার বরটা কেমন আত্মভোলা? তার বউ মেন নাকি ওমেন সেটাই মনে রাখতে পারেনা আর বউয়ের কেয়ার কিভাবে নিবে বলোতো?”
নিতান্তই বাচ্চাদের মত করে নরম কণ্ঠে কথাগুলো বললো অরণ্য। দুপুরের ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির আভাস ফুটে উঠলো। সেটুকু বুঝতে পেরে ভালো লাগলো অরণ্য’র। আসলে দুপুরকে একটু হাসানোর জন্যই এভাবে বলছে ও। আরেকটু চেষ্টা করতে হবে।
অরণ্য বললো, “এরকম খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছো যে? পা পুরনো হয়ে ভেঙে যাবে বাবা।”
দুপুর একবার তাকালো অরণ্য’র দিকে। চোখে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, “পা কিভাবে পুরনো হয় আবার?”
অরণ্য বললো, “কি ভাবছো? পা কিভাবে পুরনো হয় তাইতো? দেখো বিদ্যুতের খুটি পুরনো হয়ে গেলে ভেঙে যায়। যায়না?”
দুপুর এবার কথা না বলে পারলো না, “আমাকে আপনার বিদ্যুতের খুঁটি মনে হচ্ছে কোন দুঃখে?”
– “নাহ, তোমাকে বিদ্যুতের খাম্বা মনে হওয়ার কোনো কারণ ই নেই। তুমি মোটেও লম্বা নও,তুমি তো শর্ট।”
– “আমি শর্ট?”
– “আমার তুলনায় অনেক শর্ট। আমার পাশে তুমি দাঁড়ালে মনে হয় বিদ্যুতের খুটির পাশে বনমানুষ দাঁড়িয়ে।”
কথাটা শুনে ক্ষেপে গেলো দুপুর -“কিহ! এভাবে বলা হচ্ছে? আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে খাটো মনেহয় আপনার শুনি?”
অরণ্য আপাদমস্তক তাকিয়ে বললো, “সবদিক থেকেই। যে পরিমাণ শর্ট তুমি, না জানি আমার বাচ্চাকাচ্চাদের তেলাপোকার বাচ্চা মনে হয় কিনা।”
এবারে আরো ক্ষেপে গেলো দুপুর। রেগে বললো, “আমাকে বিয়ে করতে কে বলেছে আপনাকে? কেন করলেন?”
– “একি! দুপুরবেলা ক্ষেপে গেছে দেখছি। আরে বাবা আমি তোমাকে একটু সহজ হওয়ার জন্য কথাগুলো বললাম। বুঝোনা তুমি?”
দুপুর মাথা নিচু করে ফেললো। সত্যিই তো! মাত্র দুটো কথা বলেই অনেকটা স্বাভাবিক লাগছিলো নিজেকে। মনটাও ভালো হতে শুরু করেছিলাও। মুহুর্তের জন্য নিখিলকে ভূলে গিয়েছিলো ও।
অরণ্য বললো, “তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে আপসেট? দুপুর?”
দুপুর দুদিকে মাথা নাড়ালো।
– “বাবা মায়ের জন্য খারাপ লাগছে? নাকি বোনের জন্য?”
– “না।”
– “হঠাৎ বিয়ে দিয়ে দেয়ায় তুমি কষ্ট পেয়েছো?”
– “না।”
– “তাহলে?”
দুপুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিভাবে বলবে ওকে যে ওর নিখিলের জন্য বুকটা হাহাকার করছে? রৌদ্রময়ী তো পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে, বাবা মা তো দুপুরের সাথে অরণ্য’র বিয়ে দিয়ে বেঁচেছে, অরণ্য ও একজনের পরিবর্তে আরেকজন কে পেয়ে বেঁচেছে, আর দুপুর? দুপুরের ভেতরে কি পরিমাণ ঝড় চলছে কে বুঝবে সেটা? কাউকে বলাও যায়না, সহ্য করাও যায়না। কি নিদারুণ যন্ত্রণা সে শুধু দুপুর ই জানে।
এমন সময় অরণ্য’র ছোট বোনের গলা শুনতে পাওয়া গেলো, “এই ভাইয়া, ভাবি তোরা উঠবি না? দশটা বাজে তো।”
অরণ্য উঠে দরজা খুলতে চলতে গেলো। নিরবে বসে রইলো দুপুর। আজ তাকে কেউ ভাবি বলে ডাকছে! অথচ গতকাল ই তো তার জীবন টা অন্যরকম ছিলো। মাত্র কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে যায়! জীবন অদ্ভুত!
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৯

0

অনুভূতি
পর্ব ৯
মিশু মনি
.
১৩.
বাসর ঘরে ফুলের উপর পা তুলে বসে আছে দুপুর।
আজ এই বিছানায় রোদের বসে থাকার কথা ছিলো। মাত্র কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে এখন এখানে দুপুর বসে আছে। রোদ কোথায় কি অবস্থায় আছে কে জানে, কিন্তু দুপুর ও নিখিল দুজনের ভিতরে একটু আগেই সর্বোচ্চ মাত্রার ঝড় বয়ে গেছে। যার রেশটা এখনো রয়ে গেছে। আনমনা হয়ে বসে বসে এই আকস্মিক ঝড়ের কথা ভাবছে দুপুর। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বোঝা গেলো না।
দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো অরণ্য। ওকে বেশ উজ্জ্বল আর হাসিখুশি দেখাচ্ছে যেন বিয়েটা দুপুরের সাথেই হবার কথা ছিলো। এগিয়ে এসে দুপুরকে বললো, “ওভাবে চেয়ে আছো যে?”
দুপুর চোখ নামিয়ে নিলো। অরণ্য মাথা থেকে পাগড়ি খুলে রেখে আস্তে আস্তে বিছানার কাছে এসে দুপুরের পাশে বসলো। দুপুর খুব অপ্রস্তুত বোধ করছে। আজকে দিনেও অরণ্য কে দুলাভাই বলে ডেকেছিলো ও। এখন তারই সাথে বাসর হচ্ছে! আর নিখিল? ডুকরে কান্না পেয়ে গেলো দুপুরের।
অরণ্য জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো দুপুর? রোদের জন্য মন কেমন করছে?”
দুপুর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বললো। অরণ্য বললো, “যা হবার তা তো হয়েই গেছে। সে নিজের লাইফ নিজেই বেছে নিয়েছে। আমাদের কারো কথা সে ভাবেনি। আমরা কেন তাকে ভেবে অযথা কষ্ট পাবো বলোতো? আমাদের এখন একটা নতুন লাইফ শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের উচিৎ নিজেদের জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়া।”
দুপুর মাথা নিচু করে রইলো। যদি ওর জীবনে নিখিল বলতে কেউ না থাকতো, তাহলে হয়ত এটা মেনে নিয়ে খুব সুখী হতে পারতো। অরণ্য নিঃসন্দেহে একজন ভালো ছেলে, স্বামী হিসেবেও অনেক ভালো। এরকম একজনের সাথে অনায়াসে সুখী হওয়া যায়। কিন্তু দুপুরের সবটুকু ভালোবাসা যে নিখিলের জন্যই ছিলো। এখন নিখিলকে ভূলে গিয়ে আবার নতুন করে অরণ্যকে ভালোবাসতে অনেক কষ্ট হবে। সবকিছু মেনে নেয়া সহজ হলেও, সুখী হওয়া সহজ নয়। কিছুতেই সুখী হতে পারবে না দুপুর।
অরণ্য আস্তে করে ঘোমটা টা সরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো দুপুরের দিকে। দুপুর কে আজ একটু বেশিই অপূর্ব লাগছে! ও যে এতটা সুন্দর সেটা আগে বোঝা যায়নি। আলতো করে দুপুরের ডান গালটা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো অরণ্য। দুপুর চোখ বন্ধ করে ফেললো। ওর এখন খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। নিখিল নিশ্চয়ই এখন কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছে। নিখিলকে ওরকম দুঃখ দিয়ে কিভাবে ভালো থাকবে দুপুর? নিখিল তো আসতে চেয়েছিলো দুপুরের বাবার কাছে, কিন্তু দুপুর ই নিষেধ করে দিয়েছে। কেন করলো এটা? দুপুরের নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এই বাসর ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে। কিন্তু কিইবা করার আছে। নিজের ইচ্ছায় সে এ বিয়েতে মত দিয়েছে। একবার না বললে বাবা কখনোই বিয়ে দিতো না। কিন্তু বাবার সম্মানের কথা ভেবে এটা করতে হয়েছে ওকে। কি করবে এখন ও?
দুপুরের চোখ বেয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
অরণ্য বললো, “দুপুর… কাঁদছো কেন? বাসার কথা মনে করে?”
দুপুর কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অরণ্য বললো, “তোমার কি টায়ার্ড লাগছে? ঘুমাতে চাও?”
প্রশ্নটা শুনে অনেক অবাক হয়ে গেলো দুপুর। মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।
অরণ্য বললো, “আচ্ছা তুমি তাহলে ঘুমাও।”
চমকে ওর দিকে তাকালো দুপুর। বাসর ঘরে ছেলেরা সাধারণত খুব চেষ্টা করে বউকে ঘুমাতে না দেয়ার জন্য। আর অরণ্য ঘুমাতে বলছে! সত্যিই একবার মুগ্ধ হতেই হলো। দুপুর কোনো কথা না বলে আস্তে করে শুয়ে পড়লো। অরণ্য এসে বরের সাজ পোশাক বদলে টিশার্ট পড়ে ঘুমাতে গেলো।
দুপুরের কিছুতেই ঘুম আসছে না।একবার নিখিলের কণ্ঠটা না শুনলে ওর ঘুম আসবে না। কিন্তু এখন কিভাবে ওকে ফোন দেবে ও? সেটা যে আর হয়না। ওই অধিকার টা আর নেই।
অনেক চেষ্টা করেও আর পারলো না দুপুর। একবার নিখিলের কণ্ঠটা ওকে শুনতে ই হবে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টা নিয়ে নিখিলকে কল দিলো। প্রথম বার রিং হতেই রিসিভ করলো নিখিল। কিন্তু রিসিভ করে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বললো। কিন্তু দুপুর চুপ করে ওর ভয়েস টা শুনে যেতে লাগলো। ভেতরে ভেতরে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবুও শান্ত হয়ে শুনতে লাগলো ওর কণ্ঠ।
নিখিল বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ও ভেবেছে দুপুরের হয়ত বিয়েটা হয়নি। একটু আশার আলো দেখতে যাচ্ছিলো। এভাবে ওকে কষ্ট দেয়া যায়না। দুপুর আস্তে করে উঠে বাথরুমে চলে এলো। এসে টেক্সট পাঠালো নিখিলের নাম্বারে, “ami bashor ghore shuye achi Nikhil. tomar kontho ta shunte icche korchilo tai phone dilam. amk maf kore dio.”
মেসেজ টা দেখে যতটা কষ্ট পাওয়া সম্ভব তারচেয়ে বেশি পেলো নিখিল। সে বাসর ঘরে শুয়ে আছে অন্য একটা ছেলের সাথে আর সেটা মেসেজ করে পাঠিয়েছে? এরচেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?
দুপুর মুখ ধুয়ে আবারো রুমে চলে আসলো। মনে মনে থ্যাংকস জানাচ্ছে অরণ্যকে। সে ঘুমাতে না দিলে আরো বেশি কষ্ট হতো দুপুরের। ও বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুধু কেঁদেই যেতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেললো একদম।
১৪.
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “তোমার এখন কি ইচ্ছে করছে?”
– “আপনার গান শুনতে।” নিঃসংকোচে উত্তর দিলো মিশু।
মেঘালয় হেসে বললো, “এই ট্রেনে গান শুনবা? লোকজন কি বলবে?”
– “ফিসফিস করে শোনান। খুব আস্তে আস্তে।”
– “এসএমএস করে পাঠাই তাহলে।”
বলেই হাসলো। মিশুও হাসতে যাচ্ছিলো কিন্তু হাসতে পারলো না। তার আগেই মেঘালয়ের আচরণে অবাক হয়ে গেলো। মেঘালয় একদম মিশুর কানের কাছে এসে গাইতে আরম্ভ করলো,
“এ জীবনে যারে চেয়েছি…
আজ আমি তারে পেয়েছি…
তুমি আমার সেই তুমি আমার…
মিশুর কানের উপর মেঘালয়ের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। সেইসাথে ওর মায়াবী কণ্ঠে এই গান শুনে মিশুর শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।
– “তুমি ছিলেনা, ছিলোনা আশা…
তোমায় পেয়ে আশা বেঁধেছে বাসা….”
মিশু একটু মাথাটা ঘোরাতেই মেঘালয়ের সাথে চোখাচোখি হলো। একদম কাছ থেকে দেখলো মেঘালয়ের চোখ দুটো। চোখাচোখি হতেই কেমন যেন লাগলো বুঝে উঠতে পারলো না ও।
মেঘালয় হেসে হেসে গান গেয়ে শুনাচ্ছে। গান থামাতেই মিশু বললো, “আরো শুনবো।”
মেঘালয় আবারো আরেকটা গান শুনাতে আরম্ভ করলো। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যাচ্ছিলো মিশুর। আস্তে করে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। মেঘালয় গান থামালো না। মিশু ওর গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো। মাথাটা ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয় আস্তে করে ওর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর নিয়ে নিলো। মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে আরামে ঘুম দিলো মিশু।
বারবার মিশুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাচ্ছে মেঘালয়। বড্ড মায়াবী লাগছে দেখতে। আসলে সেই প্রথম দিনেই তো মিশু এক নামহীন মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে ওকে। সেই মায়ার কোনো নাম হয়ত নেই। যে মায়ার টানে প্রতিদিন বারবার ছুটে যেতো ওর দোকানে। শুধুমাত্র একটা বার দেখার জন্য,কথা বলার জন্য। আর মিশুর জন্য কিছু করার ইচ্ছেটাও খুব পেয়ে বসেছিলো মেঘালয় কে। আস্তে আস্তে ওর প্রতি দূর্বলতা তৈরী হচ্ছে। কিন্তু সেটা বুঝতে পারছে না মেঘালয়।
জানালা দিয়ে মিষ্টি বাতাস আসছে। কোথায় যাচ্ছে কেউই জানেনা। খুলনার টিকেট কাটা হয়েছে। এখন যেখানে খুশি নেমে যাওয়া যায়। নয়ত খুলনা অব্দিও যাওয়া যেতে পারে। মেঘালয় আবারো তাকালো মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে।
চলবে…

অনুভূতি পর্ব ৮

0

অনুভূতি
পর্ব ৮
মিশু মনি
.
১১.
শিকদার সাহেবের মেজো মেয়ে রৌদ্রময়ীর আজ বিয়ে।
পুরো বাড়িতে বিয়ের আনন্দের বন্যা বইছে। এত হাসাহাসি আর এত আনন্দের ফোয়ারা অনেক দিন দেখেননি শিকদার সাহেব। মেয়েটাকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পেরে বুকটা অনেক শান্তি শান্তি লাগছে। স্ত্রীকে বারবার ডেকে ডেকে বলছেন, “ওগো নিধির মা, দেখবা আমাগো রোদ অনেক ভালা থাকবো।”
– “হ, আমার ও তাই মনেঅয়। আমাগো রোদ অনেক ভাগ্য কইরা জন্মাইছিলো তাইনা?”
– “তুমি তো ওর মা, তুমিই কইবার পারো সেইটা।”
– “ধুর, আমারে এইভাবে কইবেন না তো। আমার শরম করে।”
– “হ, করবো ই তো। নিজে যখন কইলা, তখন শরম লাগে নাই?”
শিকদার সাহেবের স্ত্রী লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেলেন। এমন সময় শোনা গেলো অনেক আনন্দধ্বনি আর চেঁচামেচি, বর এসেছে, বর এসেছে।
শিকদার সাহেব ও ওনার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পাত্রপক্ষ কে বরণ করতে ছুটলেন। রৌদ্রময়ী’র ঘরে বসে থাকা সবাই ছুটে গেলো বরকে দেখতে। পুরো বাড়িতে যেন শুধু হাসির কল্লোলধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে।
পাত্রকে দেখে রোদের ছোটবোন দুপুর খুশিতে গদগদ হয়ে ঘরের দিকে ছুটছে। আপুকে জলদি জলদি বলতে হবে আজ অরণ্য ভাইয়াকে কি দারুণ দেখাচ্ছে! উফফ এত্ত সুন্দর আর কিউট লাগছে আজ দুলাভাইকে! কিজানি বিয়ের সাজে বুঝি সবাইকেই দারুণ লাগে। আজ রোদ আপুকেও দারুণ দেখাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে দেখলো রৌদ্রময়ী নেই। বোধহয় ওয়াশরুমে গেছে। অনেক্ষণ বিছনায় বসে পা দুলাতে লাগলো দুপুর। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেছে। এখনো আপুর দেখা নেই,কোথায় যে গেলো মেয়েটা। একটু পরেই বিয়ে পড়ানো হবে আর সে বাথরুমে গিয়ে বসে আছে। নিশ্চয় ই কাঁদছে। পাগলি একটা।
আপনমনে এসব ভাবছিলো দুপুর। সে সময়ে হঠাৎ ফোনের মেসেজ টোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বুকটা ছলাৎ করে উঠলো। রোদ আপুর মেসেজ, “dupur, ami basa theke paliye jacchi. baba ma k bolis amk maf kore dite. ar kichu bolte parchi na. amr jonno kew tension koris na. babar dike kheyal rakhis.”
মেসেজ টা সিন করেই চোখ ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইলো দুপুরের। বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগলো। আপু এই কাজটা কেন করলো? কখনোই তো ওকে দেখে কিচ্ছু বোঝা যায়নি। আজ এই কাজের কারণ টা কি? আপু কেন এমন করলো? আপুরে, বাবার সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিলি তুই!
কয়েকবার কল ব্যাক করে দেখলো নাম্বার বন্ধ। কিছুতেই রোদের সাথে এখন যোগাযোগ করা সম্ভব না। এবার কি হবে! বাবাকে কিভাবে বলবে এ কথা! পুরো গ্রামের লোক জানে রৌদ্রময়ী কত ভালো একটা মেয়ে। আর আজ এভাবে বাবাকে অপদস্থ হতে হবে সবার সামনে!
চুপচাপ বসে কাঁদতে লাগলো দুপুর। ধীরেধীরে সবাই ঘরে এসে রোদকে খুঁজতে আরম্ভ করে দিলো। দুপুরকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে ও চেপে গেলো। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আর মুখ বন্ধ করে থাকা যায়না। ও মাকে জড়িয়ে ধরে বলেই দিলো কথাটা।
মা কথাটা শুনে কয়েকমুহুর্ত নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। কথাটা দুঃস্বপ্নের মত কানে বাজছে। কিভাবে স্বামীকে বোঝাবেন উনি!
দুই মা মেয়ে মিলে আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কথা বলছিলেন। আর কেউ যেন শুনতে না পায়। কিন্তু দু একজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। গ্রামের লোকদের মুখ সামলানো দায়। এবার যে কি তুলকালাম কান্ড হবে কে জানে! বুকটা ধুকপুক করে উঠলো দুপুরের।
শিকদার সাহবকে ডেকে নিয়ে এসে দুপুর বললো, “আব্বা একটা বিপদ ঘইট্যা গ্যাছে।”
শিকদার সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। আসন্ন বিপদের শংকা স্পষ্ট হয়ে উঠলো চেহারায়। দুপুর আস্তে আস্তে কথাটা বুঝিয়ে বললো বাবাকে। বাবা সব শুনে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলেন। দুপুর কান্নায় ভেঙে পড়েছে। বাবার একটা সম্মান আছে এ এলাকায়। সব আপু নষ্ট করে দিলো। কেন করলো এরকম টা?
খুব বেশি সময় সবকিছু শান্ত রাখা গেলো না। বাধ্য হয়ে শিকদার সাহেব বেয়াইকে ডেকে কথাটা বললেন। সব শুনে বেয়াই নিশ্চুপ হয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। বড় কিছু বলে অপমান করার ইচ্ছে তার নেই। তার মেয়ে এই কাজটা করলে তিনি চুপ করেই থাকতেন, অযথা শিকদার সাহেবকে অপমান করার কোনো মানে হয়না।
ঘটনা বুঝতে পেরে অরণ্য এসে জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে আব্বু?”
অরণ্য’র বাবা কথাটা বলতেই কিছু না ভেবেই অরণ্য উত্তর দিলো, “আব্বু এখনো কথাটা কেউ জানেনা। শুধু আমরাই চার পাঁচজন জানি। এখন ই কিছু একটা উপায় বের করতে হবে।”
– “কিসের উপায়?”
অরণ্য এক মুহুর্ত চুপ থেকে বললো, “আব্বু,আমি দুপুরকে বিয়ে করে ফেলি। তাহলে আমাদের উভয়ের সম্মান ই বেচে যাবে। আর লোকজন কে বলবে, আমিই দুপুরকে বিয়ে করতে চেয়েছি। তাই রোদ কষ্ট পেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আর দুপুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দাও আমাকে। আর একটু দেরি হলেই লোকজন নানা কথা বলবে আব্বু।”
অরণ্য’র মুখে এমন প্রস্তাব শুনে চমকে উঠলেন শিকদার সাহেব। ছেলেটা সম্মানের কথা ভেবে এভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! সিদ্ধান্ত টা খারাপ নয়। এখন অরণ্য’র বাবা যদি রাজি হোন আরকি। উনি অসহায় ভাবে বেয়াইয়ের দিকে তাকালেন। অরণ্য নিজেও বাবার হাত ধরে বললো, “সবকিছু পরে ভেবো আব্বু। আমি জানি তুমি রোদকে অনেক পছন্দ করতে। এখন এতকিছু ভাবার সময় নেই। আমি নিজেও জানিনা রোদ এ কাজটা কেন করলো! কখনোই কিছু বুঝতে পারিনি ওকে দেখে।”
অরণ্য বাবাকে অনেক বোঝানোর পর বাবা রাজি হলেন। শিকদার সাহেব বেয়াইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন প্রায়। ছুটে এসে দুপুরকে বললেন কথাটা। কিন্তু এখন নিজেকেই বিয়ে করতে হবে শুনে মাথায় বাজ পড়লো দুপুরের! বাবার সম্মানের প্রশ্ন। রোদ আপু পালিয়ে গিয়ে যে অসম্মানিতে ফেলে দিতে যাচ্ছে, সেটা সামলানোর জন্যই বিয়েটা করতে হবে ওকে। কিন্তু দুপুরের সবকিছু জুড়েই যে নিখিল। ছেলেটাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে ও। নিখিলকে কিভাবে কষ্ট দেবে ও? এদিকে এখান না বলে দিলে বাবার অপমান হবে, সেইসাথে অপমানিত হবেন অরণ্য ভাইয়া আর ওর বাবাও। কারণ ওনারা নিজে থেকে এই প্রস্তাব দিয়েছেন শিকদার সাহেবের সম্মান বাঁচানোর জন্য। এখন কি করবে দুপুর!
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে, “আমি রাজি আব্বা” কথাটা বলেই ছুট লাগালো একটা। এক ছুটে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানার উপর ধপ করে পড়ে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
অনেক্ষণ নিরবে কাঁদার পর ফোনটা নিয়ে নিখিলকে কল দিলো। নিখিল রিসিভ করেই বললো, “এতক্ষণে সময় হলো তাইনা? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি মহারানীর কলের জন্য।”
ডুকরে কেঁদে উঠলো দুপুর। নিখিল স্তব হয়ে বলল, “কি হয়েছে দুপুর? আপু চলে যাচ্ছে বলে কাঁদছো?”
দুপুর আরো কিছুক্ষণ কেঁদে বলল, “হ্যা। কিন্তু শুধু চলে যায়নি, আমাকে তোমার থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে নিখিল।”
নিখিল একেবারেই স্তব্ধ! কিছুই বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে বললো, “মানে!”
কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু খুলে বললো দুপুর। নিখিল বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছে। সব শোনার পর মনেহচ্ছে ওর কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে।
দুপুর বলল,”আমি কি করবো নিখিল? বলো তুমি?”
– “আমি এসে তোমার বাবার পায়ে ধরে তোমাকে চাই?”
– “আমার খুশির জন্য হয়ত বাবা তোমার হাতে তুলে দিতে চাইবে। কিন্তু সবার সম্মানের কথা ভেবে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে নিখিল। আমি কি করবো এখন তুমিই বলো। প্লিজ নিখিল বলো। আমাকে খুন করে যাও তুমি। আমি পারছি না ভাবতে।”
নিখিল অনেক্ষণ চুপ থেকে বলল, “বিয়ে করে নাও।বাবার সম্মান রক্ষা করো।”
– “নিখিল! তুমি বাঁঁচবা কিভাবে?”
– “ভাগ্যে তুমি ছিলেনা। এটা ভেবেই বাঁচতে হবে আমাকে। ভালো থেকো দুপুর।”
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিলো নিখিল। দুপুরের মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। বাবাকে দুপুর এতটাই ভালোবাসে যে বাবার সম্মানের কথা ভেবে বিয়েটা করতেই হবে। আর নিখিলকে হারিয়ে ফেলতে হবে রোদের জন্য। আপু এত বড় সর্বনাশ টা কেন করলো? কি দোষ ছিলো দুপুরের?
মা এসে ডাকাডাকি করে দরজা খুলতে বাধ্য করলেন। পাত্রপক্ষ বসে আছে, কাজি বসে আছে এসব বলে দুপুরকে বউয়ের সাজে সাজালেন। দুপুরের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মায়ের চোখেও জল বাঁধ মানছে না। দুই মা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুপুরকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করালেন।
১২.
মেঘালয় একজন পুলিশ কে ডেকে নিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠেছি তাই টিকেট করার সময় পাইনি। আমাদের দুটো টিকেট দিলে ভালো হতো।”
পুলিশ জানালেন, “এই কম্পার্টমেন্টে সিট ফাঁকা নেই। সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। প্রথম শ্রেণির বগিতে অনেক সিট ফাঁকা আছে। সেখানে চাইলে বসতে পারেন।”
– “পরের স্টেশনে নেমে তাহলে ওখানে যাবো। আপনি একটু দেখিয়ে দেবেন প্লিজ।”
– “শিওর মিস্টার মেঘালয়। আপনাদের সেবার জন্যই আমরা নিয়োজিত।”
– “থ্যাংকস ভাইয়া।”
পুলিশ টি হেসে মেঘালয়কে আপাতত একটা সিটে বসতে বলে চলে গেলেন অন্যদিকে। মেঘালয় এসে মিশুর সামনে বসে পড়লো। মিশু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো মিশু?”
– “সারপ্রাইজড আমি।”
– “আমি ধন্য।”
– “তাই নাকি! কেন?”
– “আপনি সারপ্রাইজড হয়েছেন বলে। কেন হয়েছেন?”
– “আমি সারপ্রাইজড হলে আপনি ধন্য হবেন সেজন্য।”
মেঘালয় হেসে উঠলো। মিশুও মুচকি হাসলো। এরপর অনেক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। মিশু আশেপাশে তাকিয়ে ট্রেনের ভেতরের পরিবেশ উপভোগ করছে। মেঘালয় বারবার তাকাচ্ছে মিশুর মুগ্ধ চোখের দিকে। এই মেয়েটা যা দেখে, তাতেই মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ হবার জন্যই বোধহয় জন্ম হয়েছে ওর!
রাত বেড়ে যাচ্ছে। ট্রেনের যাত্রীগণ ঘুমে ঢলে পড়ছেন একেকজন। দেখতে দেখতে পরের স্টেশনে এসে ট্রেন থামলো। এই বগি থেকে নেমে প্রথম শ্রেনীর একটা বগিতে এসে উঠলো মেঘালয়। মিশুকেও সাথে আসতে হয়েছে। পাশাপাশি দুটো সিট নিয়ে টিকেট কাটলো। তারপর বসে পড়ল নিজেদের সিটে।
মিশু জানালার পাশে বসতে পেরে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। কি যে আনন্দ হচ্ছে ওর। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা সিটে একটা সুন্দর বেনারসি পড়া লাল টুকটুকে বউ বসে আছে! কি মিষ্টি দেখতে। মিশু মেঘলয়কে বললো, “আমার ওই বউটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। একটু যাই?”
মেঘালয় হেসে বললো, “আচ্ছা যাও।”
মিশু উঠে গিয়ে মেয়েটির পাশে বসে বললো, “কিগো বিয়ের কনে, নাম কি গো তোমার?”
– “রৌদ্রময়ী।”
– “বাহ! নামটাও যেমন মিষ্টি, দেখতেও তেমন মিষ্টি। বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছো বুঝি?”
রোদ কিছু বললো না। মিশু ওর পাশে বসে হাত দুটো ধরে বলল, “সরি এমন প্রশ্ন করার জন্য। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো।”
রোদ মৃদু স্বরে বললো, “হুম পালাচ্ছি বাসা থেকে।”
– “প্রিয়জনের কাছে যাচ্ছো বুঝি?”
চমকে উঠলো রৌদ্রময়ী। কি করে যাবে সে? তার তো কোনো প্রিয়জন ই নেই!
মিশু বলল, “নাকি জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলো?”
– “থাক না প্লিজ। আমি এসব নিয়ে এখন কথা বলতে আরাম পাচ্ছিনা।”
– “ওহ আচ্ছা। ঠিকাছে আপুটা। তাহলে একটু ঘুমিয়ে নাও, খুব টায়ার্ড মনেহচ্ছে তোমাকে।”
মিশু উঠে গিয়ে নিজের সিটে বসলো। মেঘালয় বললো, “কথা হলো?”
– “হ্যা, মেয়েটার বোধহয় অনেক কষ্ট।”
– “হুম। কষ্ট না হলে কি কেউ এভাবে পালায়?”
মিশু এক পলক মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বাইরে তাকালো। জানালা দিয়ে সুন্দর বাতাস আসছে, মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠছে, আহ! কি শান্তি!
চলবে…

অনুভূতি পর্ব ৭

0

অনুভূতি
পর্ব ৭
মিশু মনি
.
১০.
গভীর রাত।
রেলস্টেশনের ওভারব্রিজ দিয়ে হাঁটছে মেঘালয়। মাঝেমাঝেই এই কাজগুলো করে ও। হুটহাট করে বেড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে, তারপর যেদিকে ইচ্ছে হয় হাঁটা শুরু করে। রাতের পরিবেশ বড্ড বেশি রোমাঞ্চিত করে মেঘালয়কে। রাতের মধ্যে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। রাতে সবকিছুই কেমন যেন রহস্যময় হয়ে ধরা দেয়।
ওভারব্রিজ এর উপরে অনেক লোকজন শুয়ে আছে, কিছু বাচ্চা একেবারে খালি গায়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এদের দেখলেই মনটা কেমন যেন করে উঠে। কত অসহায় এরা! মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে এগিয়ে গিয়ে একটা বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে দিতে। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়,সে রাতে খেয়েছে কিনা? এরা দুবেলা ঠিকমত খেতেও পারেনা।
এসব ভাবতে ভাবতে মেঘালয় ওভারব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ টা দেখছে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলো সিঁড়ির নীচের ধাপগুলোর দিকে একটা মেয়ে বসে আছে। মাথায় ওড়না দেয়া। পিছন দিকটা দেখে কেমন চেনাচেনা লাগছে। এরকম ওড়না কারো দেখেছিলো ও। কিন্তু এই মাঝরাতে সে স্টেশনে বসে থাকবে কেন? ভেবেই পেলো না মেঘালয়।
কৌতুহলে ভরা চোখ নিয়ে ধীরেধীরে নেমে এলো নীচে। সিঁড়ির নীচের ধাপগুলোর কাছাকাছি এসেই বুঝতে পারলো এটা আর কেউ নয়, এটা সেই বাচ্চা স্বভাবের মিশু নামের মেয়েটা। মেঘালয় বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। পিছনে মেঘলয় এসে দাঁড়িয়েছে মিশু সেটা খেয়াল করেনি। মেয়েটা সামনে ই চেয়ে আছে আর গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে।
মেঘালয় এগিয়ে এসে সিঁড়িতে মিশুর পাশে বসে পড়লো। মিশু এক পলক ওর দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। মেঘালয়ের চোখেও বিস্ময়! এত রাতে এই মেয়েটা রেলস্টেশনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, কত রকমের বিপদ ঘটতেও পারে। কিন্তু সে নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে। ভাবতেই অবাক লাগে!
মিশু বললো, “আপনি খুব সুন্দর করে গান গাইতে পারেন।”
– “সেটা আমিও জানি। এত রাতে তুমি এখানে কেন?”
– “এত রাত আর কোথায় হলো? সবেমাত্র রাত সাড়ে এগারো টা।”
– “এটা কি সন্ধ্যাবেলা মনেহচ্ছে? তুমি এখানে কেন?”
– “আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ওদেরকেই ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলাম।”
– “সেকি! তোমার আম্মুও অসুস্থ! কি হয়েছে ওনার?”
– “কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর আম্মুর জণ্ডিসের দিকেও যাচ্ছিলো। তাই গ্রামে যেতে চাচ্ছিলো।”
– “চলে গেছেন ওনারা?”
– “হ্যা, ওদেরকে বিদায় দিয়ে আমি এখানে বসে আছি। আমার আর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।”
– “তোমার মায়ের সাথে আর কে আছেন?”
– “ছোটবোন।”
– “আচ্ছা বেশ।”
মেঘলয়ের চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়েছে। মিশুর দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মুখ দিব্যি হাসিহাসি। মেঘালয় জিজ্ঞাস করলো, “তোমার খারাপ লাগছে না?”
– “একটু লেগেছিলো। মানিয়ে নিয়েছি।”
– “কি বলে মানিয়ে নাও নিজেকে?”
– “এইযে স্টেশনে কত কত লোক এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে, বাচ্চাদের গায়ে জামাও নেই। কি করুণ চেহারা ওদের, ঠিকমত খেতেও পারেনা। আমি শুধু নিজের দিকে তাকাই আর ভাবি, ওদের চেয়ে আমিতো কত্ত ভালো আছি। তাহলে কেন সামান্য কিছু দুঃখে মন খারাপ করে বসে থাকবো”
মেঘালয় মিশুর এই উক্তিতে একেবারে অবাক হয়ে গেলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মিশুর দিকে। ছোট্ট একটা মেয়ে, অথচ কত গভীর চিন্তা ভাবনা! এরকম কেন এই মেয়েটা! সত্যিই অদ্ভুত!
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কোথাও যাচ্ছেন?”
– “না, আমি মাঝেমাঝে এরকম বাইরে বের হয়ে হাঁটি। রাত আমাকে মোহিত করে তার সৌন্দর্য দিয়ে।”
– “আমার ও রাত প্রিয় অনেক। রাত কত স্তব্ধ, কত নির্জন, কত রহস্যময় তাইনা?”
– “হুম। এ জন্যই রাতকে আমার ও এত বেশি ভালো লাগে। এনিওয়ে মিশু, মুখটা খুব শুকনা শুকনা লাগছে। বসো, চা নিয়ে আসি।”
মেঘালয় উঠে গিয়ে দুকাপ চা নিয়ে এসে আবারো মিশুর পাশে বসে পড়লো। মিশু মুগ্ধ হচ্ছে এটা ভেবেই যে, এরকম বড় একজন মানুষ এত অনায়াসে, এত নিঃসংকোচে কিভাবে মিশতে পারেন! বড্ড মুগ্ধ হতে ইচ্ছে করে।
মেঘালয় চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। মিশু চা নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। মেঘালয় বললো, “কি ভাবছো মিশু?”
মিশু রেললাইনের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। যাত্রীরা ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে। কেউ কেউ নামছে, কেউ উঠছে। কত সুন্দর একটা দৃশ্য! মিশুর ও খুব ইচ্ছে করছে একবার ট্রেনে উঠে লম্বা একটা জার্নি দিতে। কিন্তু সকালেই অফিস আছে, আবারো সকাল দশটা থেকে রাত দশটা অব্দি ডিউটি। জীবন টাকে নিজের মত করে উপভোগ করার কোনো সুযোগ ই যে নেই।
মেঘালয় জানতে চাইলো কি হয়েছে? মিশু জবাব দিলো, “আমার খুব ট্রেন জার্নি করতে ইচ্ছে করছে।”
– “কোথাও ঘুরে আসো ট্রেনে করে।”
– “কিন্তু আমার লাইফটা তো ব্যস্ততায় ঢাকা। ঢাকা শহরের ব্যস্ততায় ঢাকা হলে কি অবস্থা হয় জানেন ই তো। সকালে ডিউটি আছে।”
– “আমি তো তোমাকে একটা অফিসের এড্রেস দিয়েছি। সেখানে চাকরী কনফার্ম। তুমি শুধু গিয়ে ইন্টার্ভিউ দিয়ে, এপোয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে আসবে।”
মিশু একবার তাকালো মেঘালয়ের দিকে। এটার কথা ওর মনেই ছিলোনা। বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর চোখ। চোখের মণি ঝিকমিক করে উঠলো।
মিশু বলল, “আজ তো বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। আমি তাহলে আজই ট্রেনে করে কোথাও ঘুরে আসি।”
মেঘালয় হেসে বললো, “আচ্ছা যাও। হুটহাট করে কোথাও যাওয়ার মজাই আলাদা।”
মিশু এক চুমুকে সবটুকু চা শেষ করে দ্রুত উঠে পড়লো। তারপর এগিয়ে গেলো ট্রেনের দিকে। মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়েছে। মিশু একবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “যাই ঘুরে আসি। ট্রেন যেখানে যাবে, সেখানেই যাবো।”
মেঘালয় হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। মিশু ছুটে গিয়ে টেনে উঠে পড়লো। ব্যাপার টা চমকানোর মতই ছিলো। এত রাতে একা একটা মেয়ে স্টেশনে একা একা গালে হাত দিয়ে বসে আছে, আবার ইচ্ছে হতেই ছুটে গিয়ে ট্রেনে উঠলো। এমন মেয়েও এ পৃথিবীতে আছে! ভারী অদ্ভুত!
মিশু ট্রেনে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। টিকেট কাটা হয়নি,কাজেই সিট পাওয়ার প্রশ্নও আসেনা। গাড়িতে প্রচণ্ড রকমের ভিড়। সকলেই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য যে যার সিটে বসে পড়লেই গাড়িটা ফাঁকাফাঁকা লাগবে। মিশু চুপচাপ একটা সিটের উপরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মেঘালয়কে দেখতে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ওকে দেখা যাচ্ছেনা।
গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে চলতে আরম্ভ করে দিয়েছে। মিশু দরজার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলো মেঘালয় ও ছুটে এসে গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পড়লো। মিশু এগিয়ে এসে বিস্ময়ের ঘোরেই বললো,”এভাবে ছুটে এলেন যে! আপনার ও বুঝি ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে করছে?”
– “হুম, হঠাৎ ই ইচ্ছে করে বসলো। আর আমার কিছু ইচ্ছে হলে আমি সেটা করেই ফেলি।”
মিশু হেসে বললো, “আমিও খানিকটা এরকম পাগলী পাগলী। যখন যা ইচ্ছে হয়,কিছু না ভেবেই করে ফেলি। জানেন, একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রাইভেটে যাচ্ছিলাম। সাথে ছিলো আমার চারজন বন্ধু। রাস্তার পাশেই রেলওয়ে স্টেশন। কিন্তু আমরা যেখানে আছি,সেখান থেকে গিয়ে ট্রেনে উঠতে চাইলে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট দৌড়াতে হবে। তবুও সম্ভব কিনা সন্দেহ। তো, আমার এক বন্ধু আমাকে বললো, “ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দিবে। এখন ছুটে গিয়ে উঠা সম্ভব?” আমি উত্তরে বললাম, “হ্যা সম্ভব।” এরপর দু একটা কথায় রীতিমত ওরা আমাকে চ্যালেঞ্জ জানালো। আমি আর কিছুই না ভেবে ছুটা আরম্ভ করে দিলাম। উসাইন বোল্টের মত গতিতে দৌড়েছি বোধহয় কারণ আমি দ্রুতই স্টেশনে পৌছে গেলাম।কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে সেটা চলতেও আরম্ভ করেছে। আমি অনেক দ্রুত দৌড়াচ্ছিলাম। লোকজন শুধু চেঁচাচ্ছিল আমাকে দেখে। কেউ কেউ বলছিল,এই মেয়ে ট্রেনে উঠতে পারবে না। পড়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি সব কথাবার্তা। ট্রেনে খুব জোড়েই ছেড়ে দিয়েছে। আমি চলন্ত ট্রেনে গিয়ে উঠে পড়লাম। কি যে থ্রিলিং ছিলো ব্যাপার টা!”
কথা শেষ করতে করতেই মিশু রীতিমত হাঁফাচ্ছিলো। মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। মনেমনে ভাবছে, “আমার মতই পাগলাটে স্বভাবের মেয়েটা। এমন রিস্কি কাজও কেউ করে!”
মিশু হাসছে আর বারবার মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছে। মেঘালয় বললো, “কোথায় যাবে এখন?”
– “ট্রেন যতদূর নিয়ে যাবে।”
– “আচ্ছা বেশ। আজ বোধহয় খুব টাকা পয়সা নিয়ে বেড়িয়েছো?
মিশু মুখ বাঁকা করে হেসে বললো, “না। মানে আজ বেতন পেয়েছি তো।”
– “আচ্ছা। আজ তোমার অফিসে আমি যেতেও পারিনি, ক্লাস শেষে ফ্রেন্ডরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আজ কিছু কেনাকাটা করা হয়নি। সে যাই হোক, এখন চলো বসে পড়ি।”
– “টিকেট তো কাটিনি। কোথায় বসবো?”
মেঘালয় আশেপাশে তাকিয়ে একটা সিট দেখিয়ে দিয়ে বললো, “আপাতত এখানে বসো। এরপর দেখি কি করা যায়।”
মিশু একবার মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে সিটে গিয়ে বসলো। এই লোকটা সত্যিই একটু অন্যরকম! যাক, ট্রেন জার্নিটাও তবে বেশ অন্যরকম হবে!
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৬

0

অনুভূতি
পর্ব ৬
মিশু মনি
.
৮.
মিশু চোখ মুছতেও ভূলে গেছে। তাক লেগে হা করে চেয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয় অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে।
এবারে বলল, “কাঁদার মত কিছু ঘটেছে কি?”
– “সরি। আসলে সাধারণত এমনটা তো হয়না।”
মেঘালয় মুখ টিপে হেসে বলল,”আমি একটু অসাধারণ তো তাই আরকি। নাও খাও এবারে।”
মেঘালয়ের তাড়া দেখে মিশু একটু একটু করে খেতে আরম্ভ করলো। ওর এখন বেশ ভয় ভয় লাগছে।মেঘালয় কেমন রহস্যময় ভাবে হাসি দিচ্ছে। এই হাসিতে কিছু লুকিয়ে নেই তো? বড়লোকের ছেলেদের কত কত পরিকল্পনা থাকে! কিন্তু মেঘালয় তো সেরকম নয়। তবুও ওর হাসি দেখে ভয় হচ্ছে মিশুর। এভাবে হাসছে কেন ছেলেটা?
মেঘালয় মিশুর কান্না দেখে হাসছে। আর ওর চাহনী টাই কেমন রহস্যজনক! মিশু অযথাই ভূল বুঝছে ওকে। কিন্তু সে কথা কে বোঝাবে মিশুকে? মিশু তো ভয়েই অস্থির হয়ে বারবার তাকাচ্ছে মেঘালয়ের বাঁকা ঠোঁটের দিকে।
মেঘালয় বললো, “ম্যাম কি কিছু ভাবছেন?”
– “আমি মনের কথা চেপে রাখতে পারিনা।একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না তো?”
– “না, বলো।”
– “আসলে বলছি যে, আপনি এরকম একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিলেন আবার আমাকে নিয়ে ট্যুরে যেতে চাইছেন। আমার না খুব ভয় করছে। আপনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই তো?”
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর টাইপ অবস্থা। মিশুর জন্য এতকিছু করার পরও সে ভাবছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা? আসলে মেয়েরা বোধহয় এমনই। ওরা সবকিছু ছেড়ে দিতে পারে কিন্তু সন্দেহ ছেড়ে দিতে পারেনা।সন্দেহ এদের রক্তের সাথে মিশে আছে।
মিশু বললো, “আপনি কি রাগ করলেন?”
– “না,আমি বড্ড আনন্দ পাচ্ছি। এভাবে কৃতিত্ব দিলে কি রাগ করা যায়?”
– “না মানে আমি এভাবে বলতে চাইনি। মাথায় হুট করে আসলো তাই। সরি।”
– “গভীর রাতে একা পেয়েও যে আপনাকে সম্মানের সহিত ফার্মেসি তে নিয়ে গেলো, বাপের ঘুম ভাঙিয়ে বিকাশে টাকা নিয়ে ওষুধ নিয়ে দিলো, আবার বাসায় পৌছে দিলো, সে এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করে আপনাকে নিয়ে অন্য কোনো উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করবে? আজব!”
মিশু খুব লজ্জা পেয়ে গেলো মেঘালয়ের কথা শুনে। সত্যিই তো! এত কিছুর পরও কেন যে মিশু সন্দেহ প্রবণ হয়ে পড়লো নিজেও বুঝতে পারছে না।
মিশু বললো, “আমি দুঃখিত। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে এসব ভেবে বলিনি কথাটা। আমি না একটু এরকম ই।”
মিশুর অসহায় মুখ দেখে হাসি পেলো মেঘালয়ের। হেসে বলল,”ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আমাদের সাথে ট্যুরে যেতে হবেনা। আমিই একটু বেশী বেশী বলে ফেলেছি বোধহয়। অফিসের ঠিকানা দিচ্ছি,চাইলে চাকরীতে জয়েন করতে পারো। আমার বাবার নিশ্চয় ই কোনো উদ্দেশ্য নেই।”
মিশু বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো মেঘালয়ের কথা শুনে। মাথা নিচু করে ফেলল। ওর কান্না পেয়ে যাচ্ছে। আসলে একটু বেশিই ইমোশনাল এই মেয়েটা। কথায় কথায় কান্না আসে ওর। কেউ কঠিন করে কিছু বললেই চোখে পানি এসে যায়।
মেঘালয় মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে আবারো মুখ টিপে হাসলো। মেয়েটাকে নিয়ে দারুণ মুশকিলে পড়া গেলো তো। কিছু বললেও সে সহ্য করেনা, আবার না বললেও পারা যায়না কিছুতেই। মাথাটা ঝাঁকিয়ে মেঘালয়, উঠে এসে মিশুর পাশে বসতে বসতে বলল,”আচ্ছা ঠিকাছে বাচ্চা মেয়েটা। মন খারাপ করোনা কেমন? তুমি যা চাইবে, তাই হবে। এবার খেয়ে নাও।”
মিশু চুপচাপ খেতে আরম্ভ করে দিলো। টুকটুক করে খাবার মুখে দিতে দিতে বারবার আড়চোখে মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছিলো। ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো। একটু রহস্যময় হলেও খুব উদার মনের। পর্বতারোহী রা বুঝি এমন ই হয়!
মেঘালয় উঠেই গিয়ে ফোনে কথা বলে আসলো। মিশুর খাওয়া ততক্ষণে হয়ে গেছে। মেঘালয় এসে সামনে বসলো। মিশু খেয়েদেয়ে চুপচাপ চেয়ে আছে মেঝের দিকে।
মেঘালয় আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। মিশুও পিছুপিছু এলো। কেউ কোনো কথা বলছে না। মেঘালয় যেদিকে যাচ্ছে,মিশুও পিছুপিছু যাচ্ছে ওর। একটা চেম্বারে নিয়ে এসে মেঘালয় মিশুকে বসতে বসলো। এটা যে ডাক্তারের চেম্বার সেটা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলোনা মিশুর। কিন্তু অসুখ টা আবার কার? মেঘালয় কি অসুস্থ?
একটু পরে মিশুর বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো যখন ডাক্তার এসে ওকেই নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। তাহলে এই হচ্ছে আসল ব্যাপার! সামান্য শরীর খারাপের কথা শুনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে। অদ্ভুত মানুষ একটা!
ডাক্তার জানালেন অনেক আগে থেকেই মিশুর শরীরে জ্বর বইছে। শরীর অনেক দূর্বল আর অপুষ্টিতে ভুগছে। একটু পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে, আর কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। ওষুধ গুলো ফার্মেসি থেকে কিনে নিয়ে মেঘালয় মিশুর হাতে দিয়ে বললো, “এইগুলা নিয়ম করে খাবেন ম্যাডাম। অসুস্থ শরীরে অফিসে কাজ করবেন কি করে?”
মিশুর মুখে কোনো কথা নেই। ও বিস্ময়ের ঘোরে শুধু বারকয়েক বিড়বিড় করলো। মেঘালয় এগিয়ে এসে রাস্তায় সিএনজি দাড় করালো। তারপর মিশুকে তাতে উঠতে বললো। মিশু অবাক করা চোখে ওর দিকে চেয়ে থেকে গাড়িতে চেপে বসলো। মেঘালয় ওর পাশেই বসে পড়লো।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “তোমার বোনের শরীর কেমন এখন?”
-“মোটামুটি সুস্থ। ওষুধ খেলেই ও ঠিক হয়ে যায়।”
– “ওহ আচ্ছা। তুমিও ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে যাবা।”
– “আচ্ছা। এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
– “আমরা নেভারল্যান্ডে যাচ্ছি।”
মিশু ফিক করে হেসে ফেললো, “সিএনজি তে করে নেদারল্যান্ড? বাহ! আজকালকার সিএনজি বুঝি ফ্লাইং করে?”
মিশুর হাসি দেখে মেঘালয় ও হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, “নেদারল্যান্ড নয় মিশু, নেভারল্যান্ড।”
মিশু ভ্রু কুঁচকে বললো, “নেভারল্যান্ড! সেটা আবার কোথায়? ”
মেঘালয় মুখ টিপে হাসলো। হা করে চেয়ে থাকা মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে ও বললো, “নেভার ল্যান্ড মিরপুরে অবস্থিত ম্যাম।”
-“জীবনেও নাম শুনিনি আমি। কি আছে সেখানে? প্লেন উড়াউড়ি করে নাকি?”
– “আজব প্রশ্ন! প্লেন উড়াউড়ি কেন করবে? সেখানে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি না বললা খুব বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে?”
মিশু লজ্জা পেয়ে গেলো খুব। লাজুক স্বরে বলল, “ও আচ্ছা। সেখানে কি কি আছে? পার্ক?”
– “নদী, নৌকা, রেস্টুরেন্ট আর সবুজে ঘেরা একটু প্রকৃতি। মজার ব্যাপার কি জানো? প্লেনের উড়াউড়ি না থাকলেও সেখানে ময়ূরপঙ্খী আছে।”
মিশু অবাক হয়ে বললো,”ঢাকার ভিতরে এমন প্লেস আছে! আমিতো জানতাম না। ময়ূরপঙ্খি আছে! উফফ তাড়াতাড়ি চলুন না প্লিজ।”
– “সিএনজি কি আমি চালাচ্ছি?”
মিশু আবারো লজ্জা পেয়ে গেলো। মুচকি হাসলো এবার ও। মেঘালয়ের খুব আনন্দ হচ্ছে। মেয়েটির এই আনন্দিত মুখটাই দেখার জন্য ওকে সীতাকুণ্ড ট্যুরের প্লানটা জানিয়েছিলো। সামান্য কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনলেই মেয়েটি বড্ড আনন্দিত হয়ে ওঠে। পাগলী একটা! এই ফুটফুটে মেয়েটাকে কি ওইরকম বন্দি দশায় মানায়? এ জন্যই বড্ড মন কেমন করছিলো মেঘালয়ের।
মেঘালয় বলল,”ওটা মূলত একটা রেস্টুরেন্ট। তবে শ্যুটিং স্পট। পরিবেশ টা অনেক সুন্দর করেছে। আর রেস্টুরেন্ট এ চাইনিজ,থাই থেকে শুরু করে দেশী খাবার দাবার ও পাওয়া যায়।”
মিশু অবাক হয়ে বলল,”আপনি যে বললেন ময়ূরপঙ্খী? রেস্টুরেন্ট এর ভিতরে নৌকা চলে?”
মেঘালয় এবারে হো হো করে হেসে উঠলো। আচ্ছা পাগলি মেয়ে তো। রেস্টুরেন্ট এর ভিতরে নৌকা কখনো চলে নাকি? বরং অনেক সময় নৌকার উপরেই রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠে। কিন্তু নেভার ল্যান্ড তো কয়েক একর জমির উপরে তৈরী। রেস্টুরেন্ট একদিকে আছে। এটা বুঝতেও কষ্ট হচ্ছে ওর?
মেঘালয়ের উত্তর শুনে মিশু লজ্জা পেয়ে বলল,”আমি একটু এমন ই। কিচ্ছু বুঝিনা। তবে একবার বললে আর ভূলিনা।”
মেঘালয় হাসল। এই বাচ্চা স্বভাব টাই দেখার অপেক্ষায় ছিলো ও এতদিন! মেয়েটি বড্ড মায়াবী, শুধু মায়ায় জড়িয়ে ফেলে!
মিশু সিএনজির ভিতর থেকেই বাইরে টা দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। মেঘালয় বললো,”তোমার কি সবকিছু দেখতে খুব ভালো লাগে?”
– “হ্যা লাগে। খুউউব লাগে। কিন্তু দেখার সুযোগ পাইনা তো। সারাক্ষণ অফিসে বন্দি থাকতে হয়। আর এখন এই দেখুন সিএনজি থেকে কিচ্ছু দেখা যায় না।”
মিশুর ছেলেমানুষি কণ্ঠ শুনে আবারো হাসি পেলো মেঘালয়ের। ও মনে মনে ভাবলো, এখন থেকে বাইক নিয়ে বের হতে হবে। তাহলে ঘুরাঘুরি করে খুব আনন্দ পাবে মেয়েটা।
মিশুর পরিবারের অবস্থা শুনতে শুনতে অনেক দূর চলে এলো ওরা। মেঘালয় সিএনজি থেকে নেমে রিক্সা নিলো। এবার মিশুর মুখটা উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। রিক্সা থেকে সবকিছু বেশ সুন্দর দেখা যায়! একদম বাচ্চাদের মত লাফিয়ে উঠছে আনন্দে।
নেভারল্যান্ডে ঢোকার আগেই মিশুর খুশি আর দেখে কে? রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য দেখে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে ও। রাস্তাগুলো এত সুন্দর কেন! নদীও দেখা যাচ্ছে। মিশু আনন্দে লাফাচ্ছে।
চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখানোর পর মিশুকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট এ এসে বসলো মেঘালয়। খাবারের মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার করতে বলল মিশুকে। মিশু কি অর্ডার করলো নিজেও জানেনা। খাবার চলে আসতেই হা করে চেয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। এই খাবার জীবনেও দেখেনি ও। কিভাবে খেতে হয় তাও জানেনা। মেঘালয় কাঠি ও কাটা চামচ দিয়ে ওকে শিখিয়ে দিলো কিভাবে খাবার টা খেতে হবে।
মিশু মেঘালয়ের দেখাদেখি খাবার খাচ্ছে। এখন একটু একটু খেতে পারছে। কিন্তু খাবারের স্বাদ বেশী সুন্দর না,শুধু নামেই সুন্দর। এজন্যই বিদেশী খাবার গুলো ভালো লাগেনা ওর। খাবার খেতে খেতে রেস্টুরেন্ট এর পরিবেশ উপভোগ করছিলো মিশু। বেশ উন্নত আর সুন্দর, সাজানো গোছানো পরিবেশ। চারদিক টা অনেক সুন্দর বলতে হবে। মেঘালয় দারুণ একটা সারপ্রাইজ দিলো আজ ওকে।
কিন্তু ময়ূরপঙ্খী তে ওঠা হলোনা। অল্প ক’জন যাত্রী নিয়ে ময়ূরপঙ্খী যাত্রা করেনা। যাত্রী পূর্ণ হলে তবেই নৌকা ছাড়ে। মিশুর খুব মন খারাপ হয়ে গেলো এটা শুনে। মেঘালয় ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আরেকদিন নিয়ে আসবো এখানে।
অনেকবার বলার পর একটু মন ভালো হলো মিশুর। পুরোটা বিকেল জায়গাটায় ঘুরাঘুরি করে বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো ওরা। এর মধ্যে টুকটাক কথা হয়েছে দুজনাতে সেটা শুধুমাত্র পড়াশুনা, ছেলেবেলা এসব নিয়েই। লোকাল বাসে করে রওনা দিলো ওরা। মিশু জানালার পাশে বসে বাইরে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে রোজ মিশুকে এভাবে বাইরে ঘুরতে নিয়ে বের হতে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?
৯.
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ইয়ারফোনে গান শুনছিলো মিশু। পুরনো দিনের কিছু গান। শুনতে শুনতে একটা গল্পের বই পড়ছিলো। একটা গান শেষ হওয়ার পর আরেকটা গান আসতেই বেশ চমকালো মিশু! গানটা পুরনো দিনের হলেও তার সুর এত মধুর আর মায়ায় জড়ানো! কিছুক্ষণ পড়া বন্ধ করে গান শুনতে লাগলো। শিল্পী গান গাইতে আরম্ভ করার পর একদম চোখে জল এসে যাওয়ার মত অবস্থা হলো। এত মায়া দিয়ে গান গাইছে সে! কণ্ঠে যেন জাদু আছে। কিন্তু কে এই শিল্পী? ওনার গান তো আগে কখনো শোনা হয়নি। এত ভালো গান গায়, অথচ তার গান আগে শোনা হয়নি!
মিশু অবাক হয়ে প্লে লিস্টে ঢুকলো। গানের ডিটেইলস দেখে ভিরমি খেয়ে গেলো একবার। শিল্পীর নাম দেখে কয়েক মুহুর্ত চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো, “Meghaloy Ahmed”
এলবামের ছবিতেও মেঘালয়ের ছবি দেয়া। প্রথম টায় স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিলো মিশুর। এই ছবির ছেলেটার সাথে তো আজকেই সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে ও। তার গান প্লে লিস্টে বাজছে আবার এত মধুর কণ্ঠ! সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে যেন! এটা কিভাবে সম্ভব? মেঘালয় কি গান গায়? এটা তো মিশু জানতো না।
আজ কিছু গান ডাউনলোড করেছে মিশু। এ গানটাও আজকেই ডাউনলোড করা। কিন্তু মিশু তখন জানতো না মেঘালয়ের গাওয়া গানও আছে এতে! আর মেঘালয় তো আরোহী হিসেবেই পরিচিত, সে আবার গান গায় কবে থেকে?
তৎক্ষণাৎ ফেসবুকে ঢুকে গেলো মিশু। মেঘালয়ের নাম দিয়ে সার্চ দিয়ে ওর পেইজে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর দেখতে পেলো সত্যিই মেঘালয় মাঝেমাঝে গান গায়। রেডিও তে গাওয়া গান এটা! রেডিও তে গেয়ে রেকর্ডিং করে আপলোড দিয়ে দিয়েছে। দেখার পর অজান্তেই কেঁদে ফেললো মিশু।
বেশ কিছুক্ষণ অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো। ছেলেটা পর্বতারোহী, মাঝেমাঝে গানও গায়। মোটামুটি জনপ্রিয় একজন মানুষ। অথচ এত আপনজন দের মত মিশেছেন যেন মিশু ওনার বন্ধু! রোজ রোজ মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করা, রাতে ওষুধ কিনে দেয়া, বিকাশে টাকা নেয়া, বাইকে তোলা, আবার আজ ডাক্তার দেখানো, স্টার কাবাবে খাওয়াদাওয়া, নেভারল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়া সবকিছু স্বপ্নের মত মনেহচ্ছে। এসব শুধুমাত্র স্বপ্নেই সম্ভব। বাস্তবেও সম্ভব সেটা ভাবাই যায়না!
মিশু বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে হেডফোনে মেঘালয়ের গানটা ফুল ভলিউম দিয়ে বারবার শুনতে লাগলো। কেন যে কাঁদছে সেটা ও নিজেও জানেনা। গানে মেঘালয়ের মায়াবী সুরের টান শুনে আরো কান্না বেড়ে যাচ্ছে মিশুর।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৫

0

অনুভূতি
পর্ব ৫
মিশু মনি
.
৮.
সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলো মেঘালয়ের। ঘুম থেকে উঠে বিছানার উপর বসলো। মনে পড়ে গেলো স্বপ্নের কথা। আজ রাতেও একটা স্বপ্ন দেখেছে ও। আগের দুদিনের মতই তবে আজকে একটু ভিন্নতা ছিলো। আজ দেখলো, মেয়েটি খুব কাঁদছে, তার চোখের জলে সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে। জল দিয়েই সমুদ্র! এত কাঁদছিল কেন মেয়েটা! বারবার কাঁদছে আর মেঘালয়ের দিকে তাকাচ্ছে। যেন খুব করে চাইছে মেঘালয় ওর চোখ মুছে দিক। তারপর আবার উঠে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটা শুরু করেছে। একই স্বপ্ন পরপর তিনদিন দেখার মানেটা বুঝতে পারছে না ও।
মেঘালয় গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো। যখন কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না, তখন উঠে দাঁড়ালো। বাইরে যাওয়া যাক। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে পোশাক বদলে বাইরে বেড়িয়ে পড়লো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল সারে দশটা। এখন ওর কোনো কাজ নেই। কি করা যায় তাহলে? কোথাও যেতেও ইচ্ছে করছে না। মনটা কেমন যেন হয়ে আছে। খুব বিক্ষিপ্ত লাগছে। হঠাৎ মনে পড়লো একবার সুপার শপে যাওয়া যায়। মিশুর বোনের শরীর কেমন হলো সেটাও জেনে নেয়া দরকার আর কিছু কেনাকাটা ও সেরে ফেলতে হবে। শপে ঢুকতেই মিশুর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশু খুব মায়াবী গড়নের একটা হাসি দিলো।
মেঘালয় এগিয়ে গিয়ে বলল, “ছোটবোনের শরীর কেমন এখন?”
– “ওষুধ খেয়েই অনেক টা সুস্থ হয়ে গেছে। এখন বেশ ভালো আছে। আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো আমি।”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “বেশ। এখন কিছু কেনাকাটা করা দরকার। পিংক ল্যাকমি লিপস্টিক আর লাল ম্যাট লিপস্টিক দিন তো।”
মিশু ওর কথামত লিপস্টিক নিয়ে এসে রাখলো। মেঘালয় প্যানকেক ও দিতে বললো একটা।আর কোনো কিছুর নাম ওর মনে নেই। তাই রোদেলার নাম্বারে ফোন দিয়ে শুনে নিলো সানস্ক্রিন কোন ব্রান্ডের নিতে হবে? জিনিস গুলো প্যাকেটে নিয়ে বিল মিটিয়ে বাইরে চলে এলো মেঘালয়। আজ দশ মিনিটেই কেনাকাটা হয়ে গেলো! কিন্তু মিশুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব যে ইচ্ছে হয়। ওর সাথে কথা বলতেও মন টানে। কিন্তু এভাবে তো আর কারণ ছাড়া কথাও বলা যায়না।
মেঘালয় আরেকবার ভিতরে ঢুকে মিশুকে গিয়ে বলল, “আপনার ছুটি কি বার থাকে?”
– “আমাদের কোনো ছুটি নেই। মাসে চারদিন ছুটি নিতে পারি কিন্তু আমি নেইনা।”
মেঘালয়ের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মাত্র সাত হাজার টাকার জন্য ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। তাও আবার সাপ্তাহিক কোনো ছুটিও নেই! সূর্যের আলো দেখার সুযোগ টাও বোধহয় পায়না সে। ওর জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করতেই হবে।
বাইরে এসে কয়েকজন কে কল দিয়ে খোজ খবর নিলো কোথাও সেরকম সুযোগ আছে কিনা। কিন্তু কেউই সেরকম বলতে পারলো না। ভার্সিটিতে না গিয়ে সোজা ওর বাবার অফিসে চলে আসলো মেঘালয়। ওর মুখ থেকে মিশুর অবস্থার কথা শুনে বাবা কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। এখন কোনো লোক অফিসে নিয়োগ দেয়া হচ্ছেনা, তাছাড়া গ্রাজুয়েট ছাড়া কাউকে নেয়ার সুযোগ ও নেই। মিশু তো সবেমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলো, ওকে কি চাকরী দেবেন উনি! কিন্তু মেঘালয়ের অনুরোধ রাখলে ছেলেটা অনেক খুশি হবে। অনেক ভেবেচিন্তে বাবা বললেন, “আমার একজন অফিসের কাজে সহযোগিতা করার জন্য কাউকে দরকার। এসিস্ট্যান্ট এর চাকরী দিলে পারবে সে?”
– “পারবে আব্বু। শুধু কাজের চাপ একটু কম দিও। আর বাচ্চামেয়ে তো, একটু মানিয়ে নিও তুমি।”
বাবা হেসে বললেন, “আচ্ছা সে দেখা যাবে। বেতন কিন্তু বারো হাজার দিবো।”
– “ওর জন্য এটাই অনেক আব্বু। মাত্র সাত হাজার টাকায় ১২ ঘন্টা ডিউটি করে ও।”
– “আচ্ছা, এখানে ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা অব্দি থাকলেই হবে।”
মেঘালয় খুশিতে ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরলো। সবসময় আব্বু ওর ইচ্ছে গুলো পূরণ করে দেন। এখন মিশুকে এই খুশির কথাটা জানাতে হবে।
মেঘালয় শপিং ব্যাগটা আব্বুর কাছে দিয়ে আবারো সুপার শপে চলে গেলো। কিন্তু গিয়ে দেখল মিশু নেই। ঘন্টা খানেক আগেই তো এখানে ছিলো মেয়েটা! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ও মিশুকে পাওয়া গেলো না। মন খারাপ করে বেড়িয়ে এলো ও। মিশুর বোন বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই মিশু বাসায় চলে গেছে হয়ত। দোকানে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে কি যে ভাবে! কিছু জিজ্ঞেস করাও যায়না।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর ওর ইচ্ছে করলো একবার মিশুর বাসায় চলে যেতে। এই ভালো খবর টা ওকে জানাতেই হবে তো। আর সে চাইলে কালই জয়েন করতে পারে এটাও ওকে বলা দরকার। কিন্তু মেয়েটা বাসায় গেছে কিনা সেটাও তো জানেনা মেঘালয়। আজ কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিছুই ভালো লাগছে না।।এর কারণটাও ধরা যাচ্ছেনা। বোধহয় সেই স্বপ্নটা!
পায়ে হেঁটে অনেকদূর আসার পর মেঘালয় দেখতে পেলো রাস্তার পাশে মিশু দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। খুবই মলিন মুখ আর বিষন্ন দেখাচ্ছে। যেন কোনো কঠিন অসুখ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ও। মেঘালয়ের ডাক শুনে চকিতে ফিরে তাকালো মিশু।
মেঘালয় বলল, “এখানে কেন তুমি? ডিউটি ছেড়ে এখানে কি করছো? আমি গিয়ে তোমাকে পেলাম না।”
– “শরীর টা ভালো লাগছিলো না। তাই ছুটি নিলাম আজ। এর আগে কখনো ছুটি নেইনি। আপনার কথা শোনার পর নিতে ইচ্ছে করলো।”
– “কোথায় যাবে এখন?”
– “জানিনা, আমার খুব ঘুরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোথায় যাবো একা একা,আর হাতও খালি একদম। তাই রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করছি।”
– “আর আমি ছটফট করছি।”
– “কেন?”
– “তোমাকে দোকানে গিয়ে খুঁজলাম। একটা ভালো খবর দেয়ার আছে।”
– “বলুন।”
মেঘালয় বলল, “ভালো খবর এভাবে দেয়া যাবে না। এক জায়গায় যেতে হবে।”
মিশু অবাক হয়ে বলল, “ভালো খবর দিতে চাইলে এক জায়গায় গিয়ে দিতে হবে?”
– “হ্যা, ভালো খবর ভালো জায়গায় দিতে হয়।”
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “চলুন তাহলে।”
মেঘালয় ওকে নিয়ে লোকাল বাসে উঠে পড়লো। বাসায় গাড়ি থাকা সত্ত্বেও গাড়ি নিয়ে বের হয়না ও। সাধারণ মানুষ দের মত চলাফেরা করতেই ভালো লাগে। বাসে উঠতেই কিছুক্ষণ পর দুইটা সিট ফাঁকা হয়ে গেলো। জানালার পাশের সিটে বসলো মিশু। মেঘালয় ওর পাশেই বসলো। মিশু উৎসুক চোখে বাইরে তাকাচ্ছে আর অবাক হচ্ছে কিছু না কিছু দেখে। ওর মনটা ভালো হয়ে গেছে। ইস! হাসলে কত সুন্দর দেখায় মেয়েটাকে! ও বোধহয় জার্নি খুব ভালোবাসে। ইচ্ছে করছে ওকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে। মেয়েটা যাই দেখবে শুধু অবাক হবে, ভালো লাগবে খুব।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই মাথা চুলকে ভাবতে লাগলো মেঘালয়। বেশ কয়েকদিন ধরেই বন্ধুরা বলছিল কোথাও ট্যুরে যাওয়ার কথা। দশ বারো জন বন্ধু বান্ধবী গেলে মিশুকে বললে সেও যেতে পারে। ট্রাভেলিং করতে কে না ভালোবাসে?
মেঘালয় বলল, “আচ্ছা মিশু তুমি ট্রাভেলিং ভালোবাসো?”
– “হ্যা খুব ভালোবাসি। কেন?”
– “আমরা দশ জন বন্ধু বান্ধবী মিলে ট্যুরে যাচ্ছি।তুমি কি যাবা আমাদের সাথে? গেলে তোমার মনটা ভালো হয়ে যাবে।”
মিশু বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল, “হ্যা আমি যাবো। অবশ্যই যাবো। কবে যাবেন?”
ওর খুশি দেখে মন ভরে গেলো মেঘালয়ের। হেসে বলল, “খুব শীঘ্রই যাচ্ছি। প্রিপারেশন নাও।”
এবার মিশুর মুখে মেঘ নেমে এলো। মুখটা কালো করে বলল, “না থাক যাবো না।”
– “কেন?”
– “আমার টাকা নেই এখন হাতে।”
– “আমার কাছে ধার নিও,এসে ফেরত দিয়ে দিও।”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে বলল, “এমনি তেই আপনি দুই হাজার টাকা পাবেন আমার কাছ থেকে।”
– “ধুর বাদ দাও তো। তুমি যাচ্ছো। আমি আমার বন্ধুদের কনফার্ম করে দিচ্ছি।”
মিশুর মনটা আনন্দে ভরে গেলো। কিন্তু চাকরী তে তো তিনদিন ছুটি নিতে হবে তাহলে। ছুটি নিলে মাস শেষে বোনাস টা আর পাওয়া যাবেনা। সেটাও চিন্তা হচ্ছে,ঘুরতে যেতেও ইচ্ছে করছে। কি করা যায় ভাবতে লাগলো ও। হঠাৎ ও খেয়াল করলো, মেঘালয় যে সিটে বসেছে তার সামনের সিটের পিছনে হাত রেখেছে। হাত ঘেমে গেছে বেশ। কিন্তু হাতে এত সুন্দর ঘনঘন লোম! ঘর্মাক্ত হাতটাকেই মনেহচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য!
মেঘালয়ের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর মিশুর চোখ চলে গেলো মেঘালয়ের কপালে। কপাল টাও ঘেমে গেছে। কপালের দিকের চুলগুলো দেখেও কেমন যেন ফিল কাজ করছে ভেতরে। মনেহচ্ছে মেঘালয়ের সমস্ত শরীরেই এমন সৌন্দর্য! এমন বাহ্যিক জিনিস গুলো দেখেও এত ভালো লাগছে কেন বুঝতে পারছে না মিশু।
মেঘালয় মিশুকে বাস থেকে নামতে বললে নেমে পড়লো ও। তারপর দেখল পিছনে স্টার কাবাব রেস্টুরেন্ট! এই রেস্টুরেন্টটা নাকি মোহম্মদপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত গুলোর একটি। এখানে কেন নিয়ে এলো মেঘালয়!
মিশু মেঘালয়কে অনুসরণ করে ভিতরে গিয়ে বসলো। মেঘালয় ওর বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলে এসে খাবার অর্ডার করলো। মিশু চুপচাপ বসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।
মেঘালয় এসে বসতে বসতে বলল, “আমরা আগামী পরশু যাচ্ছি। দুদিনের ট্যুর।”
মিশু অবাক হয়ে বলল, “পরশু! একটা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে না?”
– “দেরি করা যাবেনা। এসেই তোমাকে আবার চাকরী তে জয়েন করতে হবে।”
– “মানে!”
মেঘালয় খুব সুন্দর ভাবে মিশুকে বুঝিয়ে বলল চাকরীর ব্যাপার টা। সব শুনে মিশুর চোখে পানি এসে গেছে। অচেনা একটা মানুষ ওকে নিয়ে এত কিছু ভেবেছে! কত উপকার করলো মানুষ টা, আবার ট্যুরেও নিয়ে যেতে চাইছে। দেবদূত হয়ে এসেছেন উনি!
মিশুর মুগ্ধ চাহনি খুব ভালো লাগলো মেঘালয়ের। মেয়েটা খুশি হলেও সুন্দর লাগে, মুগ্ধ হলে আরো বেশি সুন্দর লাগে! এখন থেকে বেশী বেশী সারপ্রাইজ দিয়ে ওকে মুগ্ধ করে দিতে হবে! তাহলে অন্তত এই সুন্দর চাহনি টা উপভোগ করা যাবে।
খাবার চলে এলো কিন্তু মিশু কিছুই খেতে পারলো না। ওর সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে! কাল থেকে আর মার্কে টে ডিউটি তে যেতে হবেনা। বিকেলে একটা সিভি নিয়ে মেঘালয়ের বাবার অফিসে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করতে হবে। ট্যুর থেকে ঘুরে এসে তারপর চাকরী তে জয়েন!
মিশুর গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। অন্য কোনো লোক হলে মিশুর এত ভালো লাগত না। ট্যুরে যেতে বললেও সে যেতো না। কিন্তু মেঘালয়ের মানবতা, বিবেকবোধ, সম্মানবোধ সবকিছু এত বেশী সুন্দর যে, ওকে সন্দেহ করলে অন্যায় হয়ে যাবে। ছেলেটা দেবতাসুলভ একদম!
মিশু কাঁদছে আর মেঘালয় মুখ টিপে হাসছে। এই মুগ্ধ কান্নাটাও অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওর। এত সুন্দর করে কেউ কাঁদতে পারে! জানা ছিলোনা মেঘালয়ের। আজ মিশুর নতুন নতুন রূপ ধরা দিচ্ছে ওর কাছে।
চলবে..

অনুভূতি ৪র্থ পর্ব

0

অনুভূতি
৪র্থ পর্ব
মিশু মনি
.
৭.
একটা মেয়ে খুব কাছ থেকে তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। মেয়েটির মুখটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। মেঘালয় কে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে সে। ডাকতে ডাকতে সে সমুদ্রের তীরে গিয়ে দাঁড়ালো। আবারো উত্তাল ঢেউ এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম।
লাফিয়ে উঠে বিছানার উপর বসে পড়লো মেঘালয়। গত রাতেও এরকম একটা স্বপ্ন ও দেখেছে। মেয়েটির মুখটা স্বপ্নে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়না। কিন্তু এটুকু অনুভূত হয় যে, মেয়েটি অনেক করুণ ও মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এর অর্থ কি? ওর অবচেতন মন কি কাউকে নিয়ে এভাবে ভাবছে? যে খুব ভয়াবহ বিপদের দিকে যাচ্ছে আর হাত বাড়িয়ে ডাকছে মেঘালয় কে?
একমনে বসে বসে চিন্তা করতে লাগলো ও। কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। যত বান্ধবী আছে, সবাই তো বেশ ভালো আছে। দিব্যি এনজয় করে সবসময়। এরকম মায়াবী দুঃখিনী কেউ তো বন্ধুত্বের তালিকায় নেই। একবার ভাবলো, ধুর, সব স্বপ্নের মানে হয় নাকি? স্বপ্ন তো স্বপ্নই। কিন্তু অবচেতন মন যা ভাবে, সেটাই স্বপ্নে এসে ধরা দেয় এই যুক্তিটা তো ফেলে দেয়া যায় না। অনেক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো মেঘালয়। আর ঘুম আসছে না। এমনি তে অনেক কল্পনাপ্রবণ আর প্রখর অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ মেঘালয়। আর স্বপ্নে কাউকে দেখলে জেগে ওঠার পর তাকে খুব আপন মনে হয়। বারবার তার কথা মনে পড়ে। কিন্তু তার মুখটা তো স্পষ্ট নয়।
মেঘালয় উঠে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে গিটার হাতে নিয়ে বেলকুনিতে এসে বসলো। তারপর টুংটাং করে সুর তোলার চেষ্টা করলো।
একটু পর গেয়ে উঠলো,
“তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার…
যত দূরে সরে যাও রবে আমার…
স্তব্ধ সময় টাকে ধরে রেখে, স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার…
কেন আজ এত একা আমি? আলো হয়ে দূরে তুমি….
আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না…
চাঁদের আলো তুমি কখনো……”
এ পর্যন্ত গেয়ে হঠাৎ থমকে গেলো মেঘালয়। বেলকুনি থেকে দেখতে পেলো রাস্তা দিয়ে একটা মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। মেয়েটি দেখতে একদম মিশুর মত। মিশু ই মনে হলো। হ্যালুসিনেশন নয়তো? কিন্তু গিটারের শব্দ যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা হ্যালুসিনেশন নয়। খুবই দ্রুত হাঁটছে মেয়েটা। মিশু হোক আর যে ই হোক,নিশ্চয় ই কোনো বিপদে পড়েছে। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে এভাবে। একবার দেখা উচিৎ বিষয়টা।
গিটার রেখে এক ছুটে বেড়িয়ে আসলো মেঘালয়। লিফটে উঠেও মনে হচ্ছে লিফট একদম ধীরে চলছে। তিনতলা থেকে নামতেও যেন অনন্তকাল চলে যাচ্ছে!
নিচে নেমে ছুটে রাস্তায় এসে দেখলো মেয়েটিকে আর দেখা যাচ্ছেনা। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো মেঘালয়ের। এটা হ্যালুসিনেশন নয়,নিজের চোখে দেখেছে ও। মেয়েটি কোনদিকে ঢুকে গেলো কে জানে। ফিরে এসে বাইকটা নিয়ে স্টার্ট দিলো ও। কিছুদূর এগিয়ে এসেই মেয়েটিকে দেখা গেলো। অনেক দ্রুত ছুটে এসেছে মেয়েটা, প্রায় মেইনরোডের কাছে চলে এসেছে। মেঘালয় গিয়ে ওর সামনে বাইক দাড় করালো।
মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো একদম। এটা তো সত্যিই মিশু! খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে মিশুকে। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। ও অবাক হয়ে বলল, এত রাতে তুমি এভাবে কোথায় যাচ্ছো?
মিশু হন্তদন্ত হয়ে বলল, “আমার ছোট বোনটা আলসারের পেশেন্ট। হঠাৎ ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ফার্মেসী তে যাচ্ছি।”
– “এভাবে একা বের হয়েছো ভয় করেনা? নিজেই সুস্থ শরীরে বাসায় নাও ফিরতে পারো। বোনের সুস্থতা পরে।”
– “কেন? রাস্তার অমানুষ নামক পুরুষ রা আমাকে ছিড়ে ছিড়ে খাবে?”
প্রশ্নটা মিশুর মুখ থেকে শুনে ধাক্কা লাগলো বুকে। কঠিন একটা সত্য মেয়েটি অনায়াসে বলে ফেলেছে।
মেঘালয় বলল, “সেটাও আমাদের দেশে সম্ভব।”
মিশু বললো, “আমার বাসায় কেউ নেই আর। এই শহরে আমার এমন আপনজন ও কেউ নেই যে এখন ওষুধ এনে দিবে। তাই আমাকে ই যেতে হবে। ছোট বোনটা বুক চেপে ধরে কাঁতরাচ্ছে, সহ্য করতে পারছিলাম না। যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছে।”
মেঘালয় বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল, “বাইকে ওঠো।”
একবার বলামাত্র ই মিশু বাইকে গিয়ে উঠলো। এখন এতকিছু ভাবার সময় নেই। তাছাড়া এই দুদিনে মেঘালয় কে যতটা চিনেছে ও, এরকম মানুষ থাকলে কিছুটা ভরসা করা যেতেই পারে। মেঘালয় জোরে বাইক ছেড়ে দিয়ে বলল, “ওষুধ খেলেই কি সুস্থ হবে? নাকি হসপিটালে নিতে হবে?”
– “ওষুধ খেলেই অনেক টা সুস্থ হয়ে ওঠে। আসলে অনেক দিন ধরে সুস্থই ছিলো। মাঝেমাঝে হঠাৎ ব্যথা ওঠে ওর। প্রচুর ভাজাপোড়া খায় আর পানি কম খায় তো।”
– “এটা ঠিক রাখার দায়িত্ব কিন্তু তোমার ই।”
– “হুম,কিন্তু আমিতো বাসায় থাকিনা সারাদিন। মেয়েটা কথা না শুনলে কি করবো বলুন?”
মেঘালয় খুব দ্রুত বাইক নিয়ে ফার্মেসির সামনে এসে দাঁড়ালো। মিশু দোকানে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আবার কি যেন ভেবে অর্ধেক ওষুধ ফেরত দিলো। দূর থেকে দেখলো মেঘালয়। তারপর বাইক রেখে দোকানের সামনে এসে মিশুকে জিজ্ঞেস করলো, “কি সমস্যা?”
মিশু আমতা আমতা করে বলল, “না মানে অল্প করে নিচ্ছি। পরে আবার নিয়ে যাবো।”
– “আবার কোনো এক রাতে এভাবে ছুটতে ছুটতে আসবে? তোমরা পারোও বটে।”
মিশু মেঘালয়ের চোখে চোখ রেখে বেশ রাগী গলায় বলল, “এভাবে বিদ্রুপ করছেন কেন? আমার কাছে টাকা নেই আর।”
মেঘালয় লজ্জা পেয়ে গেলো। আসলেই এভাবে বিদ্রুপের সুরে বলাটা উচিৎ হয়নি। সমস্যাটা বোঝা উচিৎ ছিলো। মেঘালয় দোকানদার কে বলল, “ভাইয়া, বিকাশে পে করে দিই?”
দোকানদার বললেন, “জি ভাইয়া দিন।”
– “বিকাশ নাম্বার টা দিন।”
দোকানদার নাম্বার বলতে গেলে মেঘালয় পকেটে হাত দিতে গিয়ে দেখলো প্যান্টে তো পকেট ই নেই। আসলে ও তো রাতে মোবাইল, ওয়ালেট, টাকা পয়সা সব বের করে রেখে একটা কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি শার্ট পড়ে ঘুমিয়েছিলো। এখন কি হবে?
মিশু অবাক হয়ে চেয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। নিরুপায় হয়ে গেলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষের চেহারা যেমন হয়,মেঘালয়কে ঠিক তেমনি দেখাচ্ছে এখন। মিশুর মায়া লাগছে মেঘালয়ের জন্য। মনেহচ্ছে মেঘালয়ের বোনের জন্য ওষুধ নিতে এসেছে, আর মিশু ওর সাথে বেড়াতে এসেছে। মিশু চুপচাপ চেয়ে আছে ওর দিকে।
মেঘালয় দোকানদারের ফোনটা নিয়ে ওর আব্বুকে কল দিয়ে বলল,”আব্বু এক্ষুনি এই নাম্বারে ২ হাজার টাকা সেন্ড করো তো।”
ওপাশে কি বলল বোঝা গেলো না। মেঘালয় হাসতে হাসতে বলল, “সরি রোমান্টিক সিনে ডিস্টার্ব করার জন্য।”
মিশু বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো একইসাথে দারুণ অবাক ও হলো। ফোন দিয়ে আব্বু বলে ডাকলো অথচ এটা কি বললো ও! আব্বুকে কি এভাবে বলা যায়? লজ্জা লাগেনা? ছি ছি… ছেলেটা ভারী দুষ্টু তো!
মেঘালয় ফোনটা দোকানদার কে দিয়ে মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,”কি দেখো?”
মিশু বলল,”এত টাকা দিতে বললেন কেন?”
– “বেশী করে ওষুধ নিয়ে যাও।”
মিশু হা করে চেয়ে রইলো অনেক্ষণ। মেঘালয় মানুষ নাকি দেবদূত! এমন মানুষ ও আছে এখনো দুনিয়ায়! আসলে পর্বতারোহী রা বুঝি সত্যিই খুব ভালো হয়!
দোকানদার জানালেন টাকা এসে গেছে। মিশু ওষুধ নিলো অনেকগুলো। মায়ের প্রেশারের ওষুধ ও নিলো। মেঘালয় ততক্ষণে গিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়েছে। মিশু গিয়ে বাইকের পিছনে উঠে পড়লো।
মেঘালয় মনে মনে ভাবলো, “জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ে আমার বাইকের পিছনে উঠেছে। রোদেলাকেও কখনো কলেজে রেখে আসিনি। মিশু নামের মেয়েটাই উদ্বোধন করে দিলো!”
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা পর্বতারোহী রা এত ভালো হয় কেন?”
– “কে বলেছে?”
– “আমার মনেহয়।”
– “কতজন পর্বতারোহী কে দেখেছো?”
মিশু একটু থেমে বলল, “দুবার এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিত কে আমি বেশ ভালো করেই চিনি। ওনার সাথে অনেকবার কথা হয়েছে আমার। আমার লাইফে এত ভালো মানুষ আমি কখনো দেখিনি।”
মেঘালয় অবাক হয়ে বলল,”সিরিয়াসলি! মুহিত ভাইয়ের সাথে কথা বলেছো তুমি! সত্যিই ওনার সাথে কারো তুলনা চলেনা। কত ভালো একজন মানুষ। আর আমাদের দেশটাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে অনেক অবদান রাখছেন। প্রতিদিন অসংখ্য ছেলেমেয়ে অনুপ্রাণিত হয় ওনার কথায়।”
– “সেজন্যই বললাম। পর্বতারোহীরা এত অনুপ্রেরণার উৎস হয় কি করে?”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,”আসলে পর্বতারোহণ মানে কিন্তু মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়া। প্রতি পদে পদে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকে। মূলত মৃত্যুকে অত কাছে থেকে দেখেন বলেই ওনারা অনুপ্রেরণা দিতে সবচেয়ে বেশী দক্ষ। এভারেস্ট এর যত উপরে উঠবা, দেখবা শুধু লাশ আর লাশ। এসব দেখে কেমন লাগে ভাবতে পারো? যেখানে নিজের মৃত্যুও যেকোনো মুহুর্তে হতে পারে।”
মিশু ভয়ে শিহরিত হয়ে বললো, “এত রিস্ক নিয়ে আপনি কেন যান?”
মেঘালয় হেসে বলল,”আমিতো মাত্র কয়েকবার গিয়েছি শুধুমাত্র বেইসক্যাম্পের জন্য। প্রথমবার অভিযানে গিয়ে একটা মোটামুটি উচ্চতম পর্বত জয় করে ফেললাম আর রাতারাতি বিখ্যাত ও হয়ে গেলাম। কিন্তু শুধুমাত্র কৌতুহল বশত আর ভালোলাগার টানেই আমি আরোহণ করেছি। বিখ্যাত হওয়ার জন্য নয়।”
মিশু হেসে বললো, “সেটা আমি জানি। তবে অত রিস্ক নিয়ে যাওয়ার কি দরকার?”
– “সেজন্যই আম্মু আর যেতে দেয়না। আমিতো চেয়েছিলাম একবার এভারেস্ট অভিযানে যাবো। কিন্তু আম্মু রাজি নয়। আমার বড় ভাইয়ের নাম ছিলো হিমালয়। সে পাহাড় থেকে খাদে পড়ে মারা গেছে।”
মিশু আঁৎকে উঠলো, “সেকি! আপনার ভাই এভাবে… তবুও আপনি অভিযানে যান?”
মেঘালয় বেশ সহজ গলাতেই বলল, “আমার আব্বুর নাম আকাশ। উনি আকাশের মতই বিশাল স্বপ্ন দেখেন। ছোটবেলা থেকেই আব্বু পাহাড়ে বেড়ে উঠেছে। তাই পাহাড় প্রীতি অনেক ওনার। ছেলেদের নামও রেখেছেন পাহাড় পর্বতের নামে। আব্বু চেয়েছিলেন তার ছেলেও তার মত ট্রেকার হবে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে নিজেকে অনেক সমৃদ্ধ মনেহয়। সেই সুখটুকু উনি আমাদের দিতে চেয়েছিলেন। বড় ভাইয়ার নাম রেখেছিলেন হিমালয় আর আমার নাম মেঘালয়। কিন্তু বিদেশে একবার পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে হিমালয় ওপারে চলে গেছে। আমি তখন খুবই ছোট। গভীর খাদে পড়ে গেছে ভাইয়া, ওর লাশটাও আমরা উদ্ধার করতে পারিনি।”
মিশুর কান্না পেয়ে যাচ্ছে মেঘালয়ের কথা শুনে। ও অজান্তেই মেঘালয়ের কোমরে হাত রেখে শক্ত করে ধরলো পেছন থেকে। কি ভয়ংকর কথা! এতবড় দূর্ঘটনার পরও মেঘালয় পাহাড়ে যায়,পর্বতারোহণে যায়!
মেঘালয় বললো, “আব্বু আমাকে বলেছিল, হিমালয়ে সবচেয়ে উচ্চতম ১৪ টি পর্বত আছে, এর যেকোনো একটি যদি জয় করতে পারিস তাহলে আমার কষ্টটা কমবে। আব্বুর কথা রাখার জন্যই আমি আরোহণে গিয়েছিলাম। আমার এখন পর্বত ছাড়া ভালো লাগেনা কিন্তু আম্মু যেতে দেয় না। একটা মাত্র আদরের ছেলেকে হারাতে চায়না আর।”
মিশু আরো শক্ত করে ধরে মেঘালয়ের পিঠে মাথা রেখে বললো, “আপনার আম্মুই ঠিক বলেছেন। আর যাওয়ার দরকার নেই। আপনার আব্বুর ইচ্ছে তো পূর্ণ হয়েছে।”
মিশুর কথাটা ভালো মত শুনতে পেলো না মেঘালয়। ওর সেদিকে মনোযোগ নেই। মিশু এভাবে জাপটে ধরে পিঠে মাথা রেখেছে, তাতে কেমন যেন অন্যরকম অনুভূত হচ্ছে! বেশ ভালো লাগছে আর মনেহচ্ছে এভাবেই থাক। এরকম অনুভূতি প্রথমবার হচ্ছে ওর।
নিজের বাসার সামনে এসে মেঘালয় বলল, “আমার বাড়ি এটাই। এখানেই দেখতে পেয়েছি তোমাকে। তা এখন কোনদিকে যাবো ম্যাম? ”
মিশুর এতক্ষণে হুশ হলো। সাথে বেশ লজ্জা লাগলো। ওরকম ভয়ংকর মৃত্যুর কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিলো মিশুর। আবেগে কখন এভাবে ওকে ধরে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি। সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল, “আমি একাই যেতে পারবো। আপনি বাসায় যান।”
মেঘালয় বলল, “বাসায় রেখে আসি। পর্বতের চেয়েও বেশী রিস্ক শহরের অলিগলিতে বুঝলে? পর্বতকে ভালোবাসলে সহজে মৃত্যু আসেনা, দূর্ঘটনা ছাড়া। কিন্তু তুমি যতই দেশপ্রেমী হও, দেশের কিছু নরপশু তোমার উপর পশুত্ব ফলাবেই।”
মিশু আর কিছু বললো না। এটা বেশ ভালোই জানে ও। প্রতি পদে পদে এরকম পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। চুপচাপ রাস্তা দেখিয়ে দিলো।
মেঘালয়ের খুব ইচ্ছে করছিলো মিশু যদি আরেকবার পিঠের উপর মাথাটা রাখতো। কিন্তু সেটা ঠিক না। তাই ইচ্ছেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। মিশুর কথামত এগোতে লাগলো বাইক নিয়ে। কিছুদূর আসার পর হঠাৎ রাস্তায় পূর্ব ও সায়ানের সাথে দেখা। ওরা মেঘালয়কে দেখে থামতে বললো। মেঘালয় থামার পর সায়ান বলল, “পিছনে ভাবি নাকি রে?”
মিশু লজ্জা পেয়ে সরে বসলো একটু। কিন্তু পূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রাতেই তো মেয়েটাকে সুপার শপ থেকে রিক্সায় তুলে দিয়েছিলো ওরা। সে এখন মেঘালয়ের বাইকে কি করছে! আজব ব্যাপার! কোনো রহস্য আছে মনেহচ্ছে।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো “এতরাতে তোরা কোথা থেকে আসলি?”
পূর্ব বলল, “বিড়ি খাইতে গেছিলাম।”
– “বিড়ি নাকি গঞ্জিকা হুম?”
– “আমি গঞ্জিকা টানিনা সেটা ভালো করেই জানিস।”
– “ওকে, কাল কথা হবে। এই মেয়েটার খুব বিপদ। আগে ওকে রেখে আসি।”
পূর্ব ও সায়ান অবাক চোখে তাকালো। মেঘালয় আবারো বাইক স্টার্ট দিলো। মিশু জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা গঞ্জিকা কি জিনিস?”
মেঘালয় হেসে বললো, “গাঁজা। খাবা নাকি?”
-“ছি, মরলেও না।”
মেঘালয় শব্দ করে হাসলো। মিশুর দেখানো পথ অনুযায়ী পৌছে গেলো এসে। মেঘালয়ের বাসা থেকে বাইকে পাঁচ ছয় মিনিটের পথ। মেঘালয় বাসার সামনে মিশুকে নামিয়ে দিয়ে বললো, “বোনের দিকে খেয়াল রাখবেন।”
– “আচ্ছা। আপনাকে…”
মিশুকে থামিয়ে দিয়ে মেঘালয় বলল, “বাংলা সিনেমার ডায়ালগ ঝাড়বা না তো। বাসায় গিয়ে বোনকে ওষুধ খাওয়াও।”
মিশু একবার মেঘালয়ের চোখে চোখ রেখে ভিতরের দিকে পা বাড়ালো। মাথার ওড়না টা ঠিক করতে করতে ভিতরে ঢুকে গেলো। একতলা বাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে মেঘালয় বাইক স্টার্ট দিলো।
চলবে..

অনুভূতি ৩য় পর্ব

0

অনুভূতি
৩য় পর্ব
মিশু মনি
.
৫.
বাইরে আসতেই মেঘালয় দেখতে পেলো একটা ছোট্ট মেয়ে পা চেপে ধরে রাস্তায় পড়ে আছে। পা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
আশেপাশের কেউ মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেও না। মেঘালয় ছুটে গিয়ে বাচ্চাটির সামনে বসে ওর পায়ের দিকে তাকালো। কোথাও লেগে কেটে গেছে মনেহচ্ছে। মেয়েটি ভয় পেয়ে কাঁদছে। মেঘালয় বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা ইভা সুপার শপের ভিতরে ঢুকে পড়লো। দোকানের কর্মচারীরা হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেঘালয়ের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ও একদম চেনা মানুষ দের মত মিশুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ফাস্ট এইড বক্স থাকলে দিন তো।”
মিশু দ্রুত ড্রয়ার থেকে বক্স বের করে মেঘালয়ের হাতে দিলো। ও সেটা নিয়ে খুব যত্ন সহকারে পায়ের কাটা অংশটুকু পরিষ্কার করে দিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। বাচ্চাটি কেঁদে ফেললো যন্ত্রণায়। মিশু এসে বুকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটিকে। তারপর টুলের উপর বসে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসলো আর মেঘালয় বাচ্চাটির পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে দিতে লাগলো।
মিশুর বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। এত সুন্দর মনের একজন মানুষ! কত্ত বড়লোক অথচ এরকম ময়লা কাপড়ের একটা বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামাচ্ছিলো! কতটা মহান হলে এটা করা যায়! আসলে কিছু কিছু মানুষ সত্যিই তাদের ব্যক্তিত্ব দিয়েই সবার থেকে আলাদা হয়। মানবতা আর বিবেকবোধ টা অনেক প্রখর হয় তাদের। মেঘালয় তাদেরই একজন।
মেঘালয় খুব যত্নে ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়ার পর মিশুকে বলল, “সরি, ফ্লোরে একটু ব্লাড আর স্যাভলন পড়েছে।”
– “আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
– “থ্যাংকস মিশু। আপনি কি এখনি লাঞ্চের জন্য বের হবেন?”
– “হ্যা, কেন?”
– “আমরা রেস্টুরেন্ট এ আছি, একটু তাড়াতাড়ি আসবেন।”
মেঘালয় দ্রুত উঠে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো দরজার দিকে। দোকানের সব কর্মচারীও বেশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। রাস্তায় কত লোকজন, কই কেউ তো নিজের কাজ ফেলে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়নি। বিবেক নাড়া দিলেও কিছু করার থাকেনা হয়ত, সবাই গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হন। বাচ্চাটির সাড়া গায়ে অনেক ময়লা। ইচ্ছেকৃত ভাবে ময়লা ছোঁয়ার মানসিকতা সবার থাকেনা, শুধুমাত্র মেঘালয় দেরই থাকে! মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্লোরটা পরিষ্কার করে ফেললো।
তারপর লাঞ্চ করার জন্য রেস্টুরেন্ট এ চলে আসলো। এসে দেখলো মেঘালয় সামনে দুই প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে বসে আছে। ওর পাশেই ছোট্ট মেয়েটি।
মিশু এগিয়ে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসতে বসতে মেয়েটিকে বলল, “এখনো ব্যথা পাচ্ছো সোনামণি?”
বাচ্চাটি দুদিকে মাথা নাড়লো। তারমানে ব্যথা পাচ্ছেনা। মেঘালয় মিশুকে বলল,”হাত ধুয়ে আসুন।”
তারপর এক প্লেট বিরিয়ানি মিশুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,”এটা আপনি আর এই খুকুমণি টা খাবেন। ওকে তুলে খাইয়ে দিন একটু। আমি তুলে খাওয়াতে পারিনা।”
মিশু এখন এতটাই অবাক হয়ে গেলো যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। মেঘালয় নতুন নতুন রুপে ধরা দিচ্ছে ওর কাছে। এত বিস্ময় ও কি করে লুকাবে? কত সুন্দর একজন মানুষ!
মেঘালয়ের হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেলো বোধহয়। ও ব্যস্ত হয়ে বললো, “ওহ শিট”
বলেই উঠে দ্রুত ছুটে বেড়িয়ে গেলো। মিশু উৎসুক চোখে চেয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো। মেঘালয় ফিরে এলো একটু পরেই। মুখটা খুব কালো করে ফেলেছে। কি হলো ওর হঠাৎ!
মেঘালয় এসে বসতেই মিশু জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
– “আমি শপিং ব্যাগটা মনেহয় রাস্তায় ফেলে রেখে ওকে নিয়ে দোকানে ঢুকেছিলাম। ওকে কোলে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় আমার হাতে কিছু ছিলোনা। তারমানে ওটা রাস্তায় ই ফেলে রেখে গেছিলাম।”
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “পেলেন না?”
– “না…”
মিশু কি বলবে বুঝতে পারলো না। এটাই কি মানুষের মানবতা! হায়রে, একটা অসহায় বাচ্চার কান্না দেখেও কেউ এগিয়ে আসেনি,অথচ ব্যাগটা দশ মিনিটেই কেউ না কেউ পেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। দুটো সানগ্লাস ই অনেক দামী ছিলো।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “প্রথম গ্লাসটার মত সেইম কোনো সানগ্লাস কি আরো আছে?”
– “হ্যা আছে।”
– “আমাকে নিতে হবে। ওটা চোখে দেয়া অবস্থায় একজন কে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো।”
মিশুর খুবই মন খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনে। আহারে! বেচারা বোধহয় প্রিয়জনের জন্য কিনেছিলো সানগ্লাস টা। সেটা হারিয়ে ফেললো। মনেহয় মেয়েটিকে খুব ভালোবাসেন উনি। সত্যিই ওনার প্রিয়জন অনেক ভাগ্যবতী। যার এমন একজন মনের মানুষ আছে। কত উদার আর সুন্দর একজন মানুষ! ইস! আমার জীবনে যদি এরকম কেউ আসতো!
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গরীবের সব স্বপ্ন দেখা মানায় না। থাক ওসব, বাচ্চাটিকে বিরিয়ানি তুলে খাওয়াতে হবে। মিশু উঠে হাত ধুয়ে এসে বাচ্চাটিকে খাওয়াতে লাগলো। মেঘালয়ের অনুরোধে নিজেও মুখে দিতে লাগলো।
মেঘালয় বলল, “মিশু আপনার বাসায় কে কে আছেন?”
– “মা আর ছোট বোন।”
– “ওনাদের দেখাশোনা আপনাকেই করতে হয়?”
– “হ্যা।”
– “কম্পিউটার জানেন আপনি?”
– “না।”
– “ও আচ্ছা। আপনি খাচ্ছেন না কেন? খান।”
মিশু আবারো একবার মুখে দিলো। ছোট্ট বাচ্চাটি আর কাঁদছে না। খাবার খাচ্ছে আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। মিশুও আস্তে আস্তে মুখে দিচ্ছে। এমন সময় দুজন ছেলে এসে মেঘালয় কে দেখে বলল, “আরে মেঘালয় ভাই না?”
মেঘালয় উৎফুল্ল হয়ে বলল, “জি ভাই।”
– “আরে ব্রাদার আমিতো আপনার বিশাল সাইজের ফ্যান। সিলিং সমান মাগার সিলিং ফ্যান নই কিন্তু।”
মেঘালয় হো হো করে হেসে বলল, “তাই নাকি! ব্রাদার বসেন, একসাথে খাই।”
ছেলেটি একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “না ভাই। আপনি খান। আমরা পাশের টায় বসছি। তো বস, একটা সেলফি নেই?”
– “শিওর।”
ছেলে দুটি মেঘালয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুললো। নিশ্চয় ই এটা ফেসবুকে আপলোড দিবে। এটা এখন একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। মিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। সবাই কত্ত সম্মান করে ওনাকে। আর উনি কত সুন্দর সহজ ভাবে মিশে যান সব শ্রেণির মানুষের সাথে!
মেঘালয় তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বলল, “আমি এই পিচ্চিকে ওর বাসায় রেখে তারপর বাসায় ফিরবো। আপনি ওই সানগ্লাসের মতই দুটো সানগ্লাস খুঁজে রেখে দেবেন। বিকেলে এসে নিয়ে যাবো।”
মিশু মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
মেঘালয় পিচ্চিটাকে কোলে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। ওর সেই ফ্যান দুইজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাস্তার দিকে। মেঘালয়ের কোলে এরকম বস্তির একটা বাচ্চা দেখে ওরা খুবই অবাক হয়ে গেছে।
৬.
ঘুম ভাঙার পর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সাত টা বাজে। অবাক হয়ে কয়েকবার চোখ পিটপিট করলো মেঘালয়। সকাল সাতটা! গত রাতে কখন ঘুমিয়েছে ও? কিছুই মনে পড়ছে না তো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে আরেকবার তাকালো। এখন 7PM তারমানে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এবার মনে পড়েছে। বিকেলে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে একটা ফ্রেশ ঘুম দিয়েছিলো ও। অনেক্ষণ ঘুমিয়েছে, এবার বাইরে যেতে হবে।
উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার টেবিলে বসে আম্মুকে ডেকে বললো, “এক কাপ চা দিও তো আম্মু।”
তারপর টোস্ট নিয়ে কামড়াতে শুরু করে দিলো। আম্মু চা নিয়ে এসে সামনে রেখে বললো, “আমার শ্যাম্পু এনেছিস?”
– “কিসের শ্যাম্পু?”
– “এরই মধ্যে ভূলে গেলি? ভালো তো।”
মেঘালয়ের মনে পড়ে গেলো। আম্মু শ্যাম্পু আনতে বলেছিলো। আর রোদেলার এক ইয়া বড় লিস্ট ছিলো শপিং এর। মিশুকে বলেছিলো বিকেলে সানগ্লাস নিতে যাবে কিন্তু ঘুমের কারণে যাওয়া হয়নি। এখন একবার গিয়ে নিয়ে আসা দরকার।
আম্মু বলল, “কি রে কি হলো তোর আবার?”
মেঘালয় চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, “আম্মু তোমাদের ম্যারেজ ডে যেন কবে?”
– “হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
– “বলো না কবে?”
– “এইতো ১২ ই ভাদ্র।”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে। এবার তোমাকে একটা শাড়ি গিফট করবো।”
আম্মু হেসে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা। এখন যাই, রান্না বসাবো। তুই কি বেরোবি?”
– “হুম, তোমার শ্যাম্পু আনতে যাবো।”
আম্মু হেসে রান্নাঘরের দিকে গেলো। মেঘালয় চা শেষ করে বাইরে বেড়িয়ে আসলো।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সাড়ে নয়টা বেজে গেলো। দুইবন্ধু একসাথে বাসার দিকে ফেরার সময় এগোরার সামনে এসেই মিশুর কথা মনে পড়ে গেলো। সানগ্লাস টা আর আম্মুর জন্য শ্যাম্পু নিতে হবে। এখন তো প্রায় দশটা,দোকান বন্ধ হয়ে গেলো কিনা কে জানে!
মেঘালয় রিক্সা ঘুরিয়ে ইভা সুপার শপে চলে এলো। ওর বন্ধু পূর্বও সাথে এসেছে।
মার্কেটে ঢুকতেই মিশু অবাক হয়ে তাকালো। এগিয়ে এসে বলল, “আর দুই মিনিট পরে এলেই তো দোকান বন্ধ পেতেন।”
– “হুম, ভাগ্য ভালো ছিলো। দিন সানগ্লাস টা।”
পূর্ব অবাক হয়ে বলল, “তুই শুধুমাত্র সানগ্লাসের জন্য রিক্সা ঘুরালি? রাত্রিবেলা কি সানগ্লাস পড়বি নাকি? কাল নেয়া যেত না?”
মেঘালয় হেসে বলল, “সানগ্লাস পড়ে পূর্ণিমা দেখবো।”
মিশু সানগ্লাস নিয়ে এসে বলল, “এই নিন। আরো কিছু লাগবে?”
– “মুন গ্লাস পাওয়া যায়না?”
মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,”মানে?”
– “সানগ্লাস আছে মুনগ্লাস নেই?”
মিশু হেসে বলল, “জোৎস্না উপভোগ করার জন্য কোনো গ্লাস লাগেনা।”
পূর্ব বলল, “বাহ! দারুণ বলেছেন তো!”
মিশু মুচকি হাসলো। পূর্ব একটা টুথব্রাশ কিনে নিলো আর মেঘালয় একটা শ্যাম্পুর বোতল নিলো। তারপর বিল মিটিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসলো। মিশুও আসলো ওদেরই পিছুপিছু। মেঘালয় পিছনে মিশুকে দেখতে পেয়ে বলল, “ডিউটি শেষ?”
– “হ্যা শেষ।”
– “বাসা কতদূর?”
– “রিক্সাভাড়া ত্রিশ টাকা নেয়।”
মিশু ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়িয়েই রইলো ওদের পাশে। মেঘালয় ভাবছে ওর কি করা উচিৎ? ওদের রিক্সাটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ই আছে,সেটায় মিশুকে পাঠিয়ে দেয়া উচিত না? তারপর পূর্বকে বলল, “দোস্ত আয় আজ আমরা হেঁটে বাসায় ফিরি।”
– “হেঁটে যাবি? আচ্ছা চল।”
মেঘালয় রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সাথে ত্রিশ টাকা দিয়ে বলল, “মামা ওনাকে বাসায় রেখে আসেন তো।”
তারপর মিশুকে বলল, ” এটাতেই বাসায় চলে যান।”
মিশু বিস্ময়ে কোনো কথাই বলতে পারলো না। ছেলেটাকে যতই দেখছে, ওর বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে! বিবেকবোধ থাকলে এরকম ই থাকা উচিৎ। তারপর হাসিমুখে মেঘালয় কে ধন্যবাদ জানিয়ে রিক্সায় গিয়ে উঠলো। কারণ ততক্ষণে মেঘালয় ও পূর্ব রাস্তায় নেমে গেছে হাঁটার জন্য। না বললেও হয়ত লাভ হবেনা। রিক্সা ছেড়ে দেয়ার পর কিছুদূর এসে একবার মাথা ঘুরিয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকালো মিশু। এই রাতে হেড লাইটের আলোয় দূর থেকে খুবই অপূর্ব দেখাচ্ছে মেঘালয় কে!
চলবে..

অনুভূতি ২য় পর্ব

1

অনুভূতি
২য় পর্ব
মিশু মনি
.
৩.
ড্রয়িংরুমে বসে আব্বু আম্মুর পায়ে আলতা দিয়ে দিচ্ছে। মায়ের মুখটা খুবই উচ্ছল। দেখে মনে হচ্ছে যেন ষোল সতের বছরের তরুণী।
হঠাৎ আম্মু চেঁচিয়ে উঠে বললো, “একদম ছ্যারাব্যারা করে দিলা। তুমি আসলেই কোনো কাজের না।”
আব্বু বললো,”ত্রিশ বছর ধরে দিয়ে দিচ্ছি আর আজ এই বদনাম?”
আম্মু মুখটা বাঁকা করে বললো, “ইস! ত্রিশ বছর ধরে দিয়ে দিচ্ছেন। কক্ষনো ভালো মত দিয়ে দিতে পেরেছো?”
– “দেখো বৃষ্টি, অযথা এরকম তর্ক কিন্তু ভালো লাগেনা। তুমি সেটা ভালো করেই জানো। আমি সব কাজেই পারদর্শী।”
– “এহ,চাম নাই কুত্তার বাঘা নাম।”
– “আমাকে কুত্তা বললা?”
– “কুত্তাকে কি বাঘ বলা উচিৎ নাকি?”
– “বৃষ্টি ভালো হচ্ছেনা কিন্তু।”
মেঘালয় দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো এরকম কান্ড। এখন ওকে গিয়েই বাবা মায়ের মাঝে ঢুকে যেতে হবে নয়ত ওদের ঝগড়া চলতেই থাকবে অনেক্ষণ। নিতান্তই ছেলেমানুষি ঝগড়া। আসলে বাবা মা দুজনে একসাথে পড়তেন বলে সম্পর্ক টা আজো বন্ধুত্বের মতই আছে।
মেঘালয় বলল,”মে আই কাম ইন মিস্টার এন্ড মিসেস আকাশ?”
বাবা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,”নো।”
মেঘালয় থতমত খেয়ে গেলো। আম্মু আবার বলল,”মেঘালয় আয় বাবা। দ্যাখ তোর আব্বু কি শুরু করেছে আমার সাথে।”
বাবা বলল,”কে কি শুরু করেছে সেটা ভালো করেই জানো।”
মা ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আবার শুরু করে দিলা? তুমি আসলেই একটা…..”
– “থামলে কেন বলো? ছেলের সামনে বলতে লজ্জা লাগছে? তোমার আবার লজ্জা আছে নাকি?”
মা রেগে বলল,”এরকম গায়ে পড়ে ঝগড়া করা লোক জীবনেও দেখিনি। ত্রিশ বছর ধরে জ্বালিয়ে মারছে।”
মেঘালয় কাছে গিয়ে বলল, “আম্মু থামো তো। একটু কথা বলি আমরা?”
আম্মু গলার স্বরটা যথাসম্ভব ঠাণ্ডা করে বলল, “হ্যা বল।”
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি কিছু লাগবে?”
– “বাব্বাহ! আমার আবার কি লাগবে?”
– “না মানে এমনকিছু কি লাগবে যেটা এনে দিলে তোমার উপকার হবে?”
মা মুখ টিপে হেসে বলল, “সিস্টেমে বিয়ের কথা বলছিস নাকি বাবা মেঘ?”
– “উহ মা তুমিও না। আমি জানতে চাচ্ছি কোনো কসমেটিক্স প্রোডাক্ট লাগবে কিনা?”
মা বেশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে হয়ত। মেঘালয় ভ্যাবাগঙ্গারামের মত চেয়ে আছে মায়ের দিকে।
আব্বু বলল, “আজকাল কি গার্ল ফ্রেন্ড এর জন্য শপিং টপিং করা হয় নাকি?”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে ঠোট উলটে বলল, “সেরকম না আব্বু। আসলে একজন দোকানদারের সাথে খুব খাতির হয়েছে আমার। তার দোকানে কিছু কেনাকাটা করলে বিশেষ ছাড় দিয়ে দিবে। সেখানেই যাবো। আম্মুর কিছু লাগলে বলো?”
আম্মু একটু ভেবে বলল, “আমার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ লাগবে।”
আব্বু মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো, “তুমি বউ দিয়ে কি করবে বৃষ্টি? তোমার জন্য তো স্বামী দরকার।”
মা ভয়াবহ ক্ষেপে গেলো। আসলে আব্বু এমনসব রসিকতা করে সবসময়, একইসাথে হাসিও পায়,আবার রাগও পায়।
মেঘালয় বলল, “বউ সময় হলেই আনবো আম্মিজান। এখন বলেন আপনার কিছু লাগবে কিনা?”
– “একটা শ্যাম্পু নিয়ে আসিস। আর কিচ্ছু লাগবে না এখন।”
– “ওকে,তুমি রোদেলা কে জিজ্ঞেস করে দেখিও তো ওর কিছু লাগবে কিনা।”
– “আচ্ছা ঠিকাছে।”
মেঘালয় উঠে নিজের রুমে চলে এলো। শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে ঘুরাঘুরি করতে লাগলো।
৪.
সকালবেলা ঘুম ভাংলো একটু দেরীতে।
রোদেলা বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে সমানতালে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় বিরক্ত হয়ে চোখ মেললো -“এই এত সকাল সকাল চেঁচাচ্ছিস কেন?”
– “ভাইয়া, সাড়ে নয়টা বাজে। আমি ক্লাসে যাচ্ছি।”
– “যা তো আমাকে বলার কি আছে?”
– “তুই নাকি জানতে চেয়েছিস আমার কিছু লাগবে কিনা?”
– “হুম, বল।”
– “এইযে লিস্ট করেছি, এইগুলা এনে দিস।”
মেঘালয় বিছানায় ওপাশ ফিরে শুয়ে বলল, “টেবিলের উপর রেখে যা।”
রোদেলা লিস্ট টা টেবিলের উপর রেখে বেড়িয়ে গেলো। আরো কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করলো মেঘালয়। আজ খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না সেটা। স্বপ্নটা মনে করতে চাইলে আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার। ও দুচোখ বুজে কোলবালিশ টা বুকে চেপে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
মিনিট বিশেক ঘুমানোর পর ঘুম ভেঙে গেলো। এখন স্বপ্নটা মনে পড়েছে। একটা মেয়ে শাড়ি পড়ে সমুদ্রের তীর ঘেষে হেঁটে চলেছে। পিঠ জুড়ে লম্বা মৃদু কোঁকড়ানো চুল। শাড়ির আঁচল টা উড়ছে। মেয়েটি একদম তীর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ এসে হঠাৎ মেয়েটির খুব কাছ ঘেষে চলে গেলো। আৎকে উঠলো মেঘালয়। ভেবেছিলো সমুদ্র ভিতরে টেনে নিয়েছে মেয়েটিকে। কিন্তু না, মেয়েটি দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। আবারো উত্তাল ঢেউ এসে মেয়েটিকে গ্রাস করার জন্য অনেক দূর উপরে উঠে গেলো। মেঘালয়ের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এবারে মেয়েটি ভেসে গেছে। কিন্তু না, ঢেউ নেমে যেতেই দেখা গেলো মেয়েটি তীর ঘেষেই হেঁটে চলেছে!
স্বপ্নটা দেখার পর মেয়েটির জন্য মন কেমন করতে লাগলো। সেই স্বপ্নকুমারীর মুখ দেখা হয়নি। কিন্তু স্বপ্নটা দেখার পর কেমন যেন মায়া মায়া লাগছে। মেঘালয় বুঝতে পারেনা ওর অনুভূতির মাত্রাটা এতটা তীব্র আর প্রখর কেন? স্বপ্নেও কেমন মন খারাপ লাগছিলো। কেন যে এমন হয়! কেন যে এই স্বপ্ন দেখলো? ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো ও।
বাইরে বের হওয়ার সময় টেবিলের উপর রাখা লিস্ট টা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলালো। লিস্ট দেখেই মাথা ঘুরে যাওয়ার মত অবস্থা। লিস্ট টা ছিলো এরকম-
* সানস্ক্রিন, (ব্রান্ডের নাম আমাকে ফোন দিয়ে শুনিস)
* প্যানকেক (সাদা)
* লাল ম্যাট লিপস্টিক
* পিংক লিপস্টিক (ল্যাকমি)
* ব্লাশ
* আইশ্যাডো
* আইলানার
* ব্রেসলেট (তিনটা)
* সানগ্লাস
* ব্লাক নেইলপলিশ
এভাবে লিস্ট টা বাড়তেই থাকবে। প্রায় গোটাবিশেক জিনিসের নাম লিখা এতে। দেখেই মেঘালয়ের আক্কেলগুড়ুম হওয়ার জোগাড়। লিপস্টিক আর নেইলপলিশ ছাড়া আর একটা নাম ও কখনো শোনেনি ও। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। এইসব জিনিসের কাজ কি? রোদেলা তো সেরকম সাজগোজ করেনা। তাহলে কি হবে এসব দিয়ে?
ও রোদেলার নাম্বারে কল দিলো। ফোন রিসিভ করতেই বলল, “তোর কি সিরিয়াসলি এসব লাগবে? তোকে তো কখনো সেভাবে সাজতে দেখিনা।”
– “মাঝেমাঝে বিয়েতে গেলে, ফ্রেন্ড দের বার্থডে, পার্টি শার্টিতে একটু লাগে আরকি। তুই জানতে চেয়েছিস, আমি বলেছি। আনবি কি আনবি না তোর ব্যাপার। রাখলাম।”
রোদেলা ফোন রেখে দিয়েছে। মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “মেয়েরা পারেও বাবাহ! অবশ্য ভালোই হলো। প্রতিদিন দুটো করে জিনিস কিনতে গেলেও অন্তত দশ দিন মার্কেটে যেতে হবে। ব্যাপার টা মন্দ হবেনা। মিশু নামের মেয়েটির জন্য যদি কোনো চাকরীর ব্যবস্থা করা যেতো, কত যে ভালো লাগতো!
বাসা থেকে বেড়িয়ে সোজা ভার্সিটি তে গেলো মেঘালয়। ক্লাস শেষ করে বন্ধুবান্ধব মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো। তারপর বাসায় ফেরার সময় সুপার শপে গিয়ে ঢুকলো।
মিশুর সাথে চোখাচোখি হতেই দুজনের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস দেখা গেলো। মেঘালয় কাছে যেতেই মিশু বলল, “ওয়েলকাম স্যার।”
– “এরকম রোবটিক্স স্টাইলে আমার সাথে কথা বলবেন না।”
মিশু থমকে গেলো কথাটা শুনে। রোবটিক্স স্টাইল আবার কেমন? কিন্তু কাস্টমার যা খুশি বলতে পারে, কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না বোধহয়। যাই হোক, সব কথা নিয়ে ভাবতে হয়না।
মিশু বলল, ” কিছু লাগবে?”
– “একটা ভালো মানের প্যানকেক দিন তো। যেন খেতে খুব সুস্বাদু হয়।”
মিশু মুখ টিপে হেসে বলল, “আপনি প্যান কেক খান?”
– “কখনো খাইনি। তবে আজ খেয়ে দেখবো যদি ভালো লাগে তাহলে পরে আরো খাবো।”
মিশু কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারছে না। কি বলবে তাও বুঝতে পারছে না। ও উঠে গিয়ে কয়েকটা প্যান কেক হাতে করে নিয়ে এসে মেঘালয়ের সামনে রাখলো। মেঘালয় হা করে একবার সেগুলোর দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার মিশুর দিকে তাকাচ্ছে! মিশুর বেশ মজা লাগছে ব্যাপার টা।
মেঘালয় হা বন্ধ করে বলল, “এটা তো কাইন্ড অফ ফেস পাউডার মনেহচ্ছে।”
– “জি স্যার।”
– “সেকি! আমিতো ভেবেছিলাম কোনো কেক টেক হবে।”
মিশু এবার আর কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারছিলো না। পিছন ফিরে নিঃশব্দে হেসে ফেললো। তারপর মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেক তো আমাদের এখানে বিক্রি হয়না।”
মেঘালয় প্রচুর লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জায় হাসি পাচ্ছে ওর। হেসে বলল, “সেটা আমি ও জানতাম। তো একজন বান্ধবী কে জিজ্ঞেস করলাম সুপারে প্যানকেক পাওয়া যায় কিনা। ও বলেছে যাবে।”
– “প্যানকেক পাওয়া যায় কিন্তু খাবার কেক নয়।”
– “বোকা বনে চলে গেলাম।”
মেঘালয়ের মুখের ভঙ্গি দেখে মিশুর আবারো হাসি পেলো। ও অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, “এটা নিতে পারেন, অনেক ভালো হবে।”
মেঘালয় সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, “এত কষ্ট করে হাসি আটকে রাখার কি আছে? হাসি পেলে হাসবেন।”
– “কাস্টমার দের কোনো কাজ বা কথায় হাসলে তাকে বিদ্রুপ করা হয়।”
– “তাই নাকি! জানতাম না তো।”
মেঘালয় মিশুর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। মিশু মেঝের দিকে চেয়ে আছে। অনেক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর মিশু বলল, “আপনি এটা নিন, খুব ভালো হবে।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “দিন। আর ওইখান থেকে সবচেয়ে ভালো সানগ্লাস নিয়ে আসুন তো একটা।”
মিশু গিয়ে চারটা সানগ্লাস নিয়ে আসলো। মেঘালয় অবাক হয়ে খেয়াল করলো চারটাই বেশ সুন্দর! মেয়েটার রুচিবোধ অনেক উন্নত তো! একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি পড়ে দেখান তো দেখি কেমন লাগে।”
মিশু সানগ্লাস টা চোখে দিলো। ওর মুখের গড়নের সাথে দারুণ ম্যাচ করেছে গ্লাসটা। মেঘালয় কয়েক মুহুর্ত চোখ সরাতে পারলো না। সানগ্লাসে একদম অন্যরকম লাগছে ওকে! মেঘালয় ভাবলো কখনো ওর চাকরীর ব্যবস্থা করতে পারলে, মাঝেমাঝে যাবে ওর অফিসে। লাঞ্চে ওকে সামনে বসিয়ে কাচ্চিবিরিয়ানি খাওয়াবে। আর পুরোটা সময় ওকে এরকমই একটা সানগ্লাস চোখে দিয়ে থাকতে বলবে।
মিশু বলল, “এটাই নিন।”
মেঘালয় আরেকটা সানগ্লাস তুলে দিয়ে বলল, “এই দুইটাই দিন।”
– “দুইটাই তো একইরকম প্রায়। অন্য আরেকটা…”
মেঘালয় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এই দুইটাই দিন। আলাদা আলাদা দুজন মানুষের জন্য নিবো।”
মিশু ঘাড় বাঁকিয়ে আচ্ছা বলে প্যাকেটে তুলে দিলো। মেঘালয় এটা মিশুর জন্যই কিনেছে। কিন্তু সেটা তো আর বলা যায়না। কেন কিনেছে তাও জানেনা মেঘালয়। তবে এটুকু বিশ্বাস আছে যে, মিশুর চাকরীর ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। আর তখন একদিনের জন্য হলেও এটা ওকে পড়তেই হবে।
মিশু বলল,”আরো কিছু লাগবে?”
– “আজ আর কিছু নেবো না। আবার কাল আসবো।”
কথাটা শুনেই চমকে উঠলো মিশু। শেষের বাক্যটা আর প্রত্যেকটা শব্দের উচ্চারণ এতটাই মধুর লাগলো শুনতে! মনে হলো কথাটা ওকেই উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, “কাল আবার আসবো।” যেন ওর জন্যই আসতে হবে, ও যেন অপেক্ষা করে বসে থাকে। পরক্ষণেই মাথাটা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল মিশু। ওনার কেনাকাটা করার প্রয়োজনে উনি আসতেই পারেন। অন্যকিছু ভাবা যাবে না।
মেঘালয় হেসে প্যাকেট টা নিয়ে সামনে চলে গেলো। বসের সাথে কিছুক্ষণ কি যেন কথা বললো। মিশু বারবার তাকাতে লাগলো সেদিকে। বস হেসে হেসে কথা বলছেন। মেঘালয়ের মুখেও হাসি। বিল পরিশোধ করে মেঘালয় একবার মিশুর দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই মিশু অন্যদিকে চোখ ঘুরালো। মেঘালয় মিষ্টি হেসে বেড়িয়ে এলো মার্কেট থেকে।
চলবে..