অনুভূতি ৩য় পর্ব

0
2278

অনুভূতি
৩য় পর্ব
মিশু মনি
.
৫.
বাইরে আসতেই মেঘালয় দেখতে পেলো একটা ছোট্ট মেয়ে পা চেপে ধরে রাস্তায় পড়ে আছে। পা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
আশেপাশের কেউ মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেও না। মেঘালয় ছুটে গিয়ে বাচ্চাটির সামনে বসে ওর পায়ের দিকে তাকালো। কোথাও লেগে কেটে গেছে মনেহচ্ছে। মেয়েটি ভয় পেয়ে কাঁদছে। মেঘালয় বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা ইভা সুপার শপের ভিতরে ঢুকে পড়লো। দোকানের কর্মচারীরা হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেঘালয়ের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ও একদম চেনা মানুষ দের মত মিশুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ফাস্ট এইড বক্স থাকলে দিন তো।”
মিশু দ্রুত ড্রয়ার থেকে বক্স বের করে মেঘালয়ের হাতে দিলো। ও সেটা নিয়ে খুব যত্ন সহকারে পায়ের কাটা অংশটুকু পরিষ্কার করে দিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। বাচ্চাটি কেঁদে ফেললো যন্ত্রণায়। মিশু এসে বুকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটিকে। তারপর টুলের উপর বসে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসলো আর মেঘালয় বাচ্চাটির পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে দিতে লাগলো।
মিশুর বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। এত সুন্দর মনের একজন মানুষ! কত্ত বড়লোক অথচ এরকম ময়লা কাপড়ের একটা বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামাচ্ছিলো! কতটা মহান হলে এটা করা যায়! আসলে কিছু কিছু মানুষ সত্যিই তাদের ব্যক্তিত্ব দিয়েই সবার থেকে আলাদা হয়। মানবতা আর বিবেকবোধ টা অনেক প্রখর হয় তাদের। মেঘালয় তাদেরই একজন।
মেঘালয় খুব যত্নে ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়ার পর মিশুকে বলল, “সরি, ফ্লোরে একটু ব্লাড আর স্যাভলন পড়েছে।”
– “আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
– “থ্যাংকস মিশু। আপনি কি এখনি লাঞ্চের জন্য বের হবেন?”
– “হ্যা, কেন?”
– “আমরা রেস্টুরেন্ট এ আছি, একটু তাড়াতাড়ি আসবেন।”
মেঘালয় দ্রুত উঠে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো দরজার দিকে। দোকানের সব কর্মচারীও বেশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। রাস্তায় কত লোকজন, কই কেউ তো নিজের কাজ ফেলে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়নি। বিবেক নাড়া দিলেও কিছু করার থাকেনা হয়ত, সবাই গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হন। বাচ্চাটির সাড়া গায়ে অনেক ময়লা। ইচ্ছেকৃত ভাবে ময়লা ছোঁয়ার মানসিকতা সবার থাকেনা, শুধুমাত্র মেঘালয় দেরই থাকে! মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্লোরটা পরিষ্কার করে ফেললো।
তারপর লাঞ্চ করার জন্য রেস্টুরেন্ট এ চলে আসলো। এসে দেখলো মেঘালয় সামনে দুই প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে বসে আছে। ওর পাশেই ছোট্ট মেয়েটি।
মিশু এগিয়ে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসতে বসতে মেয়েটিকে বলল, “এখনো ব্যথা পাচ্ছো সোনামণি?”
বাচ্চাটি দুদিকে মাথা নাড়লো। তারমানে ব্যথা পাচ্ছেনা। মেঘালয় মিশুকে বলল,”হাত ধুয়ে আসুন।”
তারপর এক প্লেট বিরিয়ানি মিশুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,”এটা আপনি আর এই খুকুমণি টা খাবেন। ওকে তুলে খাইয়ে দিন একটু। আমি তুলে খাওয়াতে পারিনা।”
মিশু এখন এতটাই অবাক হয়ে গেলো যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। মেঘালয় নতুন নতুন রুপে ধরা দিচ্ছে ওর কাছে। এত বিস্ময় ও কি করে লুকাবে? কত সুন্দর একজন মানুষ!
মেঘালয়ের হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেলো বোধহয়। ও ব্যস্ত হয়ে বললো, “ওহ শিট”
বলেই উঠে দ্রুত ছুটে বেড়িয়ে গেলো। মিশু উৎসুক চোখে চেয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো। মেঘালয় ফিরে এলো একটু পরেই। মুখটা খুব কালো করে ফেলেছে। কি হলো ওর হঠাৎ!
মেঘালয় এসে বসতেই মিশু জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
– “আমি শপিং ব্যাগটা মনেহয় রাস্তায় ফেলে রেখে ওকে নিয়ে দোকানে ঢুকেছিলাম। ওকে কোলে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় আমার হাতে কিছু ছিলোনা। তারমানে ওটা রাস্তায় ই ফেলে রেখে গেছিলাম।”
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “পেলেন না?”
– “না…”
মিশু কি বলবে বুঝতে পারলো না। এটাই কি মানুষের মানবতা! হায়রে, একটা অসহায় বাচ্চার কান্না দেখেও কেউ এগিয়ে আসেনি,অথচ ব্যাগটা দশ মিনিটেই কেউ না কেউ পেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। দুটো সানগ্লাস ই অনেক দামী ছিলো।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “প্রথম গ্লাসটার মত সেইম কোনো সানগ্লাস কি আরো আছে?”
– “হ্যা আছে।”
– “আমাকে নিতে হবে। ওটা চোখে দেয়া অবস্থায় একজন কে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো।”
মিশুর খুবই মন খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনে। আহারে! বেচারা বোধহয় প্রিয়জনের জন্য কিনেছিলো সানগ্লাস টা। সেটা হারিয়ে ফেললো। মনেহয় মেয়েটিকে খুব ভালোবাসেন উনি। সত্যিই ওনার প্রিয়জন অনেক ভাগ্যবতী। যার এমন একজন মনের মানুষ আছে। কত উদার আর সুন্দর একজন মানুষ! ইস! আমার জীবনে যদি এরকম কেউ আসতো!
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গরীবের সব স্বপ্ন দেখা মানায় না। থাক ওসব, বাচ্চাটিকে বিরিয়ানি তুলে খাওয়াতে হবে। মিশু উঠে হাত ধুয়ে এসে বাচ্চাটিকে খাওয়াতে লাগলো। মেঘালয়ের অনুরোধে নিজেও মুখে দিতে লাগলো।
মেঘালয় বলল, “মিশু আপনার বাসায় কে কে আছেন?”
– “মা আর ছোট বোন।”
– “ওনাদের দেখাশোনা আপনাকেই করতে হয়?”
– “হ্যা।”
– “কম্পিউটার জানেন আপনি?”
– “না।”
– “ও আচ্ছা। আপনি খাচ্ছেন না কেন? খান।”
মিশু আবারো একবার মুখে দিলো। ছোট্ট বাচ্চাটি আর কাঁদছে না। খাবার খাচ্ছে আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। মিশুও আস্তে আস্তে মুখে দিচ্ছে। এমন সময় দুজন ছেলে এসে মেঘালয় কে দেখে বলল, “আরে মেঘালয় ভাই না?”
মেঘালয় উৎফুল্ল হয়ে বলল, “জি ভাই।”
– “আরে ব্রাদার আমিতো আপনার বিশাল সাইজের ফ্যান। সিলিং সমান মাগার সিলিং ফ্যান নই কিন্তু।”
মেঘালয় হো হো করে হেসে বলল, “তাই নাকি! ব্রাদার বসেন, একসাথে খাই।”
ছেলেটি একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “না ভাই। আপনি খান। আমরা পাশের টায় বসছি। তো বস, একটা সেলফি নেই?”
– “শিওর।”
ছেলে দুটি মেঘালয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুললো। নিশ্চয় ই এটা ফেসবুকে আপলোড দিবে। এটা এখন একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। মিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। সবাই কত্ত সম্মান করে ওনাকে। আর উনি কত সুন্দর সহজ ভাবে মিশে যান সব শ্রেণির মানুষের সাথে!
মেঘালয় তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বলল, “আমি এই পিচ্চিকে ওর বাসায় রেখে তারপর বাসায় ফিরবো। আপনি ওই সানগ্লাসের মতই দুটো সানগ্লাস খুঁজে রেখে দেবেন। বিকেলে এসে নিয়ে যাবো।”
মিশু মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
মেঘালয় পিচ্চিটাকে কোলে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। ওর সেই ফ্যান দুইজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাস্তার দিকে। মেঘালয়ের কোলে এরকম বস্তির একটা বাচ্চা দেখে ওরা খুবই অবাক হয়ে গেছে।
৬.
ঘুম ভাঙার পর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো সাত টা বাজে। অবাক হয়ে কয়েকবার চোখ পিটপিট করলো মেঘালয়। সকাল সাতটা! গত রাতে কখন ঘুমিয়েছে ও? কিছুই মনে পড়ছে না তো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে আরেকবার তাকালো। এখন 7PM তারমানে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এবার মনে পড়েছে। বিকেলে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে একটা ফ্রেশ ঘুম দিয়েছিলো ও। অনেক্ষণ ঘুমিয়েছে, এবার বাইরে যেতে হবে।
উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার টেবিলে বসে আম্মুকে ডেকে বললো, “এক কাপ চা দিও তো আম্মু।”
তারপর টোস্ট নিয়ে কামড়াতে শুরু করে দিলো। আম্মু চা নিয়ে এসে সামনে রেখে বললো, “আমার শ্যাম্পু এনেছিস?”
– “কিসের শ্যাম্পু?”
– “এরই মধ্যে ভূলে গেলি? ভালো তো।”
মেঘালয়ের মনে পড়ে গেলো। আম্মু শ্যাম্পু আনতে বলেছিলো। আর রোদেলার এক ইয়া বড় লিস্ট ছিলো শপিং এর। মিশুকে বলেছিলো বিকেলে সানগ্লাস নিতে যাবে কিন্তু ঘুমের কারণে যাওয়া হয়নি। এখন একবার গিয়ে নিয়ে আসা দরকার।
আম্মু বলল, “কি রে কি হলো তোর আবার?”
মেঘালয় চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, “আম্মু তোমাদের ম্যারেজ ডে যেন কবে?”
– “হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
– “বলো না কবে?”
– “এইতো ১২ ই ভাদ্র।”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে। এবার তোমাকে একটা শাড়ি গিফট করবো।”
আম্মু হেসে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা। এখন যাই, রান্না বসাবো। তুই কি বেরোবি?”
– “হুম, তোমার শ্যাম্পু আনতে যাবো।”
আম্মু হেসে রান্নাঘরের দিকে গেলো। মেঘালয় চা শেষ করে বাইরে বেড়িয়ে আসলো।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সাড়ে নয়টা বেজে গেলো। দুইবন্ধু একসাথে বাসার দিকে ফেরার সময় এগোরার সামনে এসেই মিশুর কথা মনে পড়ে গেলো। সানগ্লাস টা আর আম্মুর জন্য শ্যাম্পু নিতে হবে। এখন তো প্রায় দশটা,দোকান বন্ধ হয়ে গেলো কিনা কে জানে!
মেঘালয় রিক্সা ঘুরিয়ে ইভা সুপার শপে চলে এলো। ওর বন্ধু পূর্বও সাথে এসেছে।
মার্কেটে ঢুকতেই মিশু অবাক হয়ে তাকালো। এগিয়ে এসে বলল, “আর দুই মিনিট পরে এলেই তো দোকান বন্ধ পেতেন।”
– “হুম, ভাগ্য ভালো ছিলো। দিন সানগ্লাস টা।”
পূর্ব অবাক হয়ে বলল, “তুই শুধুমাত্র সানগ্লাসের জন্য রিক্সা ঘুরালি? রাত্রিবেলা কি সানগ্লাস পড়বি নাকি? কাল নেয়া যেত না?”
মেঘালয় হেসে বলল, “সানগ্লাস পড়ে পূর্ণিমা দেখবো।”
মিশু সানগ্লাস নিয়ে এসে বলল, “এই নিন। আরো কিছু লাগবে?”
– “মুন গ্লাস পাওয়া যায়না?”
মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,”মানে?”
– “সানগ্লাস আছে মুনগ্লাস নেই?”
মিশু হেসে বলল, “জোৎস্না উপভোগ করার জন্য কোনো গ্লাস লাগেনা।”
পূর্ব বলল, “বাহ! দারুণ বলেছেন তো!”
মিশু মুচকি হাসলো। পূর্ব একটা টুথব্রাশ কিনে নিলো আর মেঘালয় একটা শ্যাম্পুর বোতল নিলো। তারপর বিল মিটিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসলো। মিশুও আসলো ওদেরই পিছুপিছু। মেঘালয় পিছনে মিশুকে দেখতে পেয়ে বলল, “ডিউটি শেষ?”
– “হ্যা শেষ।”
– “বাসা কতদূর?”
– “রিক্সাভাড়া ত্রিশ টাকা নেয়।”
মিশু ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়িয়েই রইলো ওদের পাশে। মেঘালয় ভাবছে ওর কি করা উচিৎ? ওদের রিক্সাটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ই আছে,সেটায় মিশুকে পাঠিয়ে দেয়া উচিত না? তারপর পূর্বকে বলল, “দোস্ত আয় আজ আমরা হেঁটে বাসায় ফিরি।”
– “হেঁটে যাবি? আচ্ছা চল।”
মেঘালয় রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সাথে ত্রিশ টাকা দিয়ে বলল, “মামা ওনাকে বাসায় রেখে আসেন তো।”
তারপর মিশুকে বলল, ” এটাতেই বাসায় চলে যান।”
মিশু বিস্ময়ে কোনো কথাই বলতে পারলো না। ছেলেটাকে যতই দেখছে, ওর বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে! বিবেকবোধ থাকলে এরকম ই থাকা উচিৎ। তারপর হাসিমুখে মেঘালয় কে ধন্যবাদ জানিয়ে রিক্সায় গিয়ে উঠলো। কারণ ততক্ষণে মেঘালয় ও পূর্ব রাস্তায় নেমে গেছে হাঁটার জন্য। না বললেও হয়ত লাভ হবেনা। রিক্সা ছেড়ে দেয়ার পর কিছুদূর এসে একবার মাথা ঘুরিয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকালো মিশু। এই রাতে হেড লাইটের আলোয় দূর থেকে খুবই অপূর্ব দেখাচ্ছে মেঘালয় কে!
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে