Thursday, August 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 177



মেঘের আড়ালে রোদ ২ পর্ব-০৬

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_৬
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

ছোঁয়া হসপিটাল থেকে বের হলো। মহুয়া কে অনেক বার বলেছে মিম কে সাথে দিয়ে দিতে। মেয়েটার একটু রেস্ট প্রয়োজন কিন্তু মিম কিছুতেই মহুয়া কে হসপিটালে একা রেখে কোথাও যাবে না।

মিমের মহুয়ার প্রতি ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হলো ছোঁয়া। সব বিষাদের পরেও মনে একটু শান্তি পেলো কেউ ত আছে আমাদের ভালোবাসে তাদের জন্য আমাদের ভালো থাকতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে।

হসপিটাল থেকে বের হয়ে দেখলো সকাল পাঁচটা বাজে হাঁটা শুরু করলো বাসা বেশি দূরে নয়। একটু সামনে যেতে একটা বাইক আসতে দেখলো, বাইকটা বাতাসের চেয়েও দ্রুত এসে থামলো ছোঁয়ার সামনে।

ছোঁয়া ভ্রু কুঁচকে নিলো। বাইকের ছেলেটাকে চিনতে ভুল হলো না। কিন্তু এই লোক এখন এখানে কেনো.? আবার কি কাহিনী করতে চাচ্ছে.?

নির্জন বাইক থেকে নেমে চুল গুলো পেছনে টেনে নিলো। ছোঁয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ছোঁয়া চোখ মুখ শক্ত করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো।

নির্জন ছোঁয়ার সামনে হাত দিয়ে রাস্তা আঁটকে দাঁড়ালো।
ছোঁয়া নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে এক হাত দিয়ে অন্য হাত খামচে ধরল।

নির্জনঃ কিছু কথা ছিল।
ছোঁয়াঃ আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।
নির্জনঃ ছোঁয়া জেদ না করে বাইকে বস।
ছোঁয়া নির্জনের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।

নির্জন ছোঁয়ার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলো।

নির্জনঃ ছোঁয়া তোর সাথে আমার ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে পাঁচ মিনিট সময় দে।
ছোঁয়া কাধের ব্যাগটা ঠিক করে নির্জনের দিকে ফিরে বলে উঠলো, ‘ ঘরে নতুন বউ রেখে রাস্তায় মেয়েদের পিছু পিছু ছুটতে লজ্জা করছে না! কাকে কি বলি! আপনাদের মতো ছেলেদের লজ্জা আছে নাকি।’

নির্জন হেঁসে বললো,’ এখনো লজ্জাহীন কিছু করিনি তাও লজ্জা নেই বলছিস! আচ্ছা কিছু করেই না হয় লজ্জাহীন হই।’

ছোঁয়া রাগে ফুঁসে ওঠলো।
ছোঁয়াঃ ছিঃ আমার চোখের সামনে থেকে একশো হাত দূরে থাকুন।

নির্জন দুই পা সামনে এসে ছোঁয়ার একদম কাছে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ আজ থেকে ঠিক এতোটাই কাছে থাকবো যতোটা কাছে থাকলে একজনের নিশ্বাসের শব্দ অন্য জন অনুভব করে।

ছোঁয়াঃ নিশ্চয়ই উল্টা পাল্টা কিছু খেয়ে এসেছেন! কি সব বলছেন!.?
নির্জনঃ ছোঁয়া সব ভুলে…..
ছোঁয়াঃ চুপপপপপ!!! বাসায় আপনার বউ অপেক্ষা করছে।
নির্জনঃ বউ!! বউ ত আমার সামনে। আমার হবু বউ.. প্রেমিকা।
ছোঁয়াঃ আপনার লজ্জা হওয়া উচিত। এতোটা নিচ মনমানসিকতা কিভাবে হয় একজন মানুষের! এতো কিছুর পর এইসব বলছেন!.? কেনো আসেন বার বার! আমি ত ভালো আছি, আমাকে আর কিভাবে শেষ করবেন!.? কি করলে আপনার মন শান্ত হবে.?

নির্জনঃ তুই আমার হয়ে যা আমি শান্ত।
ছোঁয়া হাসতে হাসতে বলে উঠলো, ‘ আজ দেখি আপনার ভালোবাসা আকাশ থেকে টপকে পড়ছে! কই ছিলেন সেই দিন.? কোথায় ছিল সেই দিন আপনার ভালোবাসা.? যখন আমার আপনাকে ভীষণ পাশে প্রয়োজন ছিল তখন আপনি পালিয়ে গেলেন আমার জীবন থেকে। আমাকে অস্বীকার করে নতুন কিছুতে জড়িয়ে গেলেন। আমার চোখের সামনে থেকে বহু দূরে থাকুন। ঘৃণা করি আমি আপনাকে আর আপনার বিষাক্ত প্রেম কে। ঘরে বউ বাহিরে প্রেমিকা ঘৃণা করি আপনাদের মতো পুরুষদের, আপনারা সাপের চেয়েও বিষাক্ত। আমাকে আপনার রাস্তার মেয়ে মনে হয়!

নির্জন কিছু বলতে চাইলে ছোঁয়া ওকে চুপ করি দিলো। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,’ আমিও দেখিয়ে দিব ছোঁয়া ভালো থাকতে পারে, নির্জন ছাড়াও ছোঁয়া ভালো থাকতে পারে।খুব জলদি খুশির খবর যাবে’

ছোঁয়া কাঁধের ব্যাগ ঠিক করে হাঁটতে লাগলো। পেছন থেকে তাকিয়ে রইলো নির্জন আজ তার মুখে কোনো কথা নেই। ছোঁয়া ত ভুল কিছু বলেনি। কোথায় ছিল সে.? কেনো মা কে থামায়নি! কেনো ছোঁয়ার পাশে আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়নি.! কেনো সবার সামনে ছোঁয়ার ভালোবাসা তুচ্ছ করে নতুন কাউকে জড়িয়ে ছিল! আজ এইদিনের জন্য দায়ী কে!..??? ওর বাবার খুনে ত ছোঁয়ার হাত ছিল না! নিরুপমা নিজ হাতে ভাইয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্বামী কে খু’ন করে ছিল। তাও আজ তাদের কেনো শাস্তি পেতে হচ্ছে।

________________

সকালে ঘুম থেকে চোখ খুলে তাকালো আলভি। মহুয়া ছেলেকে বুকে জড়িয়ে খাবার খাওয়ালো, মেডিসিন খাইয়ে বসতেই একজন নার্স এসে বললো স্যার আপনাকে উনার ক্যাবিনে ডাকছে।

মহুয়ার ভয়ে ভেতর কেমন করে উঠলো। মিম বোনের ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

মহুয়া ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে আহনাফের ক্যাবিনের ভেতর গেলো।
ভেতরে পা দিতেই থমকে গেলো৷ নাকে এসে ঠেকল তরতাজা বেলীফুলের ঘ্রাণ।

আহনাফ একবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। কি আজব মুখ ডেকে নিলে কি নিজেকে আড়াল করা যায়!.?

মহুয়া কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

আহনাফঃ বসুন।
মহুয়া বসলো।

আহনাফ ল্যাপটপে কাজ করছে, পাক্কা আধাঘন্টা মহুয়া বসে রইলো।
আহনাফ না ওকে কিছু বলছে আর না যেতে বলছে।

আধা ঘণ্টা পর আহনাফ কাজ রেখে মহুয়ার দিকে কিছু কাগজ এগিয়ে দিল।

মহুয়া মনে মনে বিরক্ত হলো, এইসব কাগজ নার্স দিয়েও পাঠিয়ে দেওয়া যেত। এতোক্ষণ শুধু শুধু বসিয়ে রাখলো। সব পেসেন্টের সাথেই কি এমন করে..?

মহুয়া উঠে যেতে নিলে আহনাফ বলে উঠলো, ‘ দাঁড়ান ‘
মহুয়া দাঁড়িয়ে রইলো।
আহনাফঃ আপনার স্বামী কে বলবেন দেখা করতে, এখানে কোথাও আপনার ছেলের বাবার নাম লেখা নেই।
মহুয়া কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো , ‘ ওর বাবার এখানে কি কাজ!.? যতটুকু প্রয়োজন আমি মা হয়ে কি সামলাতে পারছি না.?’
আহনাফ কিছু বলতে চাইলে মহুয়া বলে উঠলো, ‘আমার এখন আসতে হবে আমার ছেলে হয়তো আমাকে খুঁজছে।’

আহনাফ কিছু বললো না।

মহুয়া বের হতে গিয়ে দরজার সাথে ধাক্কা খেলো। কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, ব্যাথাটা একটু বেশিই পেয়েছে।
আহনাফের মহুয়ার আগের কথা মনে পরে গেলো। হসপিটাল আসলেই মহুয়া আহনাফের সামনে পরে যেতো,ধাক্কা খেত।

মহুয়া কপালে হাত দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

আহনাফ অন্য দিকে ফিরে হাসলো। নিজের হাসির উপর নিজেই বিরক্ত হলো। ওকে দেখার পর এতো বছর ধামাচাপা দেওয়া অনুভূতি গুলো আবার জেগে উঠছে এমনটা আহনাফ কখনো চায় না। নিশ্চয়ই বিয়ে করে নতুন সংসার সাজিয়ে নিয়েছে, বাচ্চাও আছে। আচ্ছা ওই বাচ্চাটা কি রেখে ছিল.? নাকি… আর কিছু ভাবতে চায় না আহনাফ। ওই বাচ্চা ত ওর নয় যা ইচ্ছে করুক। তাহলে কি বাচ্চা মাহিনের ছিল.? মাহিন ত তাই বলে ছিল। আমি জানিনা আমার মধ্যে কিসের কমতি ছিল, আমার এতো ভালোবাসার পরও তোমার অন্য কারো সান্নিধ্য লাগলো।

মহুয়া ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত রাখলো। ছেলেটা হয়েছে একদম আহনাফের মতো। একে দেখেও কি আহনাফের কিছু ফিল হয়নি! ছেলের এতো কাছে এসেও কি ছেলের প্রতি টান অনুভব করেনি! একবার ও মনে হয়নি আমার খুব কাছের কেউ, রক্তের টান অনুভব করেনি!…??

ছেলেটা ছোট হলেও সে জেনো মা কে খুব ভালো বুঝে, এই যে মহুয়া কাঁদছে ছোট ছোট হাত দিয়ে মহুয়ার চোখ মুছে দিচ্ছে।

” আপনার ব্যাগ”

আহনাফের কন্ঠ পেতেই মহুয়া দ্রুত ঘোমটা টেনে নিলো।

আহনাফ ভেতরে এসে আলভির গালে হাত রাখলো।

আহনাফঃ কেমন আছো গুড বয়..?
আলভিঃ ভালো, ভালো আঙ্কেল।
আহনাফঃ ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো ত.?
আলভি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো।
আহনাফ আলভির চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে বললো” গুড বয়”

মহুয়া অবাক হলো ওদের কথা শুনে। ভালো আঙ্কেল! এরা কি আগে থেকে একজন অন্য জনকে চিনে.?

আহনাফ আরও কিছু কথা বললো আলভির সাথে। যাওয়ার কথা বলতেই আলভি আহনাফের আঙ্গুল শক্ত করে ধরে রাখলো।

বাচ্চা ছেলে সে ত কিছুই বুঝে না, যার কাছে ভালোবাসা, আদর পায় তাকেই আপন মনে করে। আলভির কাছে এখন আহনাফ ডাক্তার নয়, সে ত ডাক্তার কি বুঝে না সে মনে করছে আহনাফ ওর বন্ধু, ভালো আঙ্কেল।

মহুয়া ছেলেকে বললো আহনাফের আঙ্গুল ছেড়ে দিতে। কিন্তু আলভি কিছুতেই আহনাফ কে ছাড়বে না।

আহনাফ টোল টেনে আলভির পাশে বসলো।

মিম বাহির থেকে এসে আহনাফ কে দেখে আর ভেতরে আসলো না। মিম কে দেখলেই চিনে ফেলবে সেটা ভেবে মিম চলে গেলো।

আহনাফ আলভির সাথে গল্প করছে মহুয়া দাঁড়িয়ে তা দেখছে, হঠাৎ করে ভীষণ রাগ হচ্ছে মহুয়ার। নিজের ছেলের পাশে আহনাফ কে দেখে রাগ হচ্ছে, একদম সহ্য হচ্ছে না , যেই লোক নিজের সন্তান কে অস্বীকার করেছে সেই লোক কেনো আজ আমার সন্তানের পাশে!?

মহুয়া রেগে বললো,’ আমার ছেলে এখন ঘুমাবে! ‘
আহনাফ আলভির দিকে তাকিয়ে বললো,’ ঘুমাবে..?’
আলভিঃ না.. আম্মু আত্তু পর।
আহনাফ মনে মনে হাসলো, মহুয়া বিরক্ত হচ্ছে! রেগে যাচ্ছে এটা জেনো ওকে ভীষণ মজা দিচ্ছে।
আহনাফ মহুয়ার দিকে ফিরে বললো,’ নিজেকে আড়াল করতে চাইলে পুরোপুরি ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়,… মহুয়ার সামনে এসে গলার চেইনটা এক টানে নিজের হাতে নিয়ে নিল।’

মহুয়া সাথে সাথে পাথর হয়ে গেল। কখন গলার চেইনটা দেখা গেলো!.?

আহনাফ চেইনটা নিয়ে সাথে সাথে বের হয়ে গেল। পেছনে পাথর বানিয়ে রেখে গেলো মহুয়াকে। সে জেনো নরতে ভুলে গেলো। এভাবে ধরা পড়বে হয়তো ভাবতে পারেনি।

তিনদিন পর বাড়িতে চলে যাবে, আহনাফের মুখোমুখি আর কখনো হবে না। যেই মানুষ নিজের সন্তান কে অস্বীকার করে, ভালোবাসার মানুষ কে অবিশ্বাস করে আর যাই হোক তার মুখোমুখি হতে চায় না মহুয়া।

______________

শ্রাবণ ঘরে প্রবেশ করে দেখলো মেঘলা কারো সাথে কথা বলছে, শ্রাবণ কে দেখে কল কেটে দিল।

শ্রাবণ মুচকি হেঁসে বললো, ‘ মামির সাথে কথা বললে!.?’
মেঘলাঃ হুম।
শ্রাবণঃ ওরা কেমন আছে..?
মেঘলাঃ ভালো না মহুয়া হসপিটালে এসেছে। আলভির এক্সিডেন্ট হয়েছে।

শ্রাবণ শার্ট খুলতে গিয়ে থমকে গেলো। দ্রুত শার্টের বোতাম লাগিয়ে বললো,’ কোন হসপিটালে.? বেশি কিছু হয়নি ত.? ও ঠিক আছে ত.?’
মেঘলাঃ শান্ত হও।
শ্রাবণঃ এমন খবর শুনে আমি শান্ত কিভাবে থাকি মেঘলা। হসপিটালের নাম বলো।
মেঘলা হসপিটালের নাম বললো। শ্রাবণ কোনো দিকে না তাকিয়ে বের হয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

মেঘলা পেছন থেকে তাকিয়ে দেখলো শ্রাবণ ভয়ে ছটফট করা মুখটা। শ্রাবণ আর মেঘলা সব সময় দূর থেকে খেয়াল রেখেছে মহুয়া আর আলভির। মামির সাথে যোগাযোগ থাকলেও মহুয়া কে বুঝতে দেয়নি। আলভিকে কতোটা ভালোবাসে শ্রাবণ মেঘলা জানে। মানুষ নিজের সন্তান কেও এতোটা ভালোবাসে না শ্রাবণ আলভিকে যতোটা ভালোবাসে। মহুয়া কি রিয়াকশন দিবে এতো বছর পর শ্রাবণ কে দেখে!..?

মেঘলা নিজেও রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলো। আমেনা বেগম মেঘলাকে জিজ্ঞেস করলো এমন অবস্থায় একা একা কোথায় যাচ্ছে.? আমেনা বেগম নিজে ওর সাথে যেতে চাইলো কিন্তু মেঘলা কিভাবে হসপিটালে নিয়ে যাবে! মেঘলা খারাপ লাগছে বলে আবার নিজের রুমে চলে গেলো। আমেনা বেগম চিন্তিত হয়ে মেঘলার পিছু পিছু মেঘলার রুমে গেলো। মেয়েটার আজকাল শরীর একটু বেশিই খারাপ থাকে।

_______________

নির্জন দুই ঘন্টা ছোঁয়ার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার চেচামেচি করলো।

নিরুপমা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে।

ছোঁয়া বারান্দা দিয়ে তাকালো নিচে। রাস্তার মাঝে বসে আছে নির্জন।

ছোঁয়া বাসায় এসে শুনেছিল নির্জনের বিয়ে হয়নি মেয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। তাতে ওর কি! নারী যেমন অসম্ভব ভালোবাসতে জানে ঠিক কষ্ট পেলে তার দ্বিগুন ঘৃণাও করতে পারে, এক বার দুই বার তিন বারের সময় তারা আর ফিরে তাকায় না।

ছোঁয়া দরজা খুলে নিচে নেমে আসলো। নির্জনের সামনে গিয়ে বলে উঠলো, ‘ আপনি কি চাচ্ছেন আমি লোকজন ডাকি.!? আপনার এমন আচরণে আমরা সহ আশেপাশের লোকজন বিরক্ত হচ্ছে! একজন পালিয়ে গেছে আরেকজন খুঁজে নেন এখানে কি!.? আপনার জন্য মনে হচ্ছে আমাদের বাসা ছেড়ে দিতে হবে।ভদ্র ভাবে কথা বলছি দ্বিতীয় বার আপনাকে এই এলাকায় দেখলে আপনার এমন অবস্থা হবে নিজেকে নিজে চিনবেন না। নিজের মায়ের আঁচলের নিচে বসে থাকুন।

নির্জন প্রচুর ড্রিংক করেছে মাতাল অবস্থায় কিছুই বুঝলো না ছোঁয়ার কথার। সে ছোঁয়ার হাত ধরতে চাইলে ছোঁয়া এক ঝটকায় দূরে সরে গেলো। নির্জনের থেকে খুব বাজে গন্ধ আসছে।

নির্জন বিরবির করে কিছু বলছে ছোঁয়া তা শুনার একটুও আগ্রহ দেখালো না। একটা টেক্সি ডেকে বাড়ির ঠিকানা বলে জোর করে নির্জনকে গাড়িতে তুলে দিল।

নির্জন বাসায় হেলতে দুলতে ঢুকলো।
আমেনা বেগম ওকে ধরতে চাইলে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ কাছে আসবে না কেউ’

নিজের রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসলো হালিমা বেগম। ছেলের এই কি অবস্থা! কখনো সিগারেট না স্পর্শ করা ছেলে আজ মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছে!

নির্জন হেলতে দুলতে নিজের রুমে গেলো।

আমেনা বেগম হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,,’ এখন তুই খুশি!.? খুশি হয়েছিস ছেলের এমন অবস্থা দেখে!.? এটাই ত চেয়ে ছিলি।
হালিমা বেগমঃ ভাবি…
আমেনা বেগমঃ চুপপপপ!!

নির্জন রুমে এসে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলো । প্রথমে যদি আজকের মতো বুঝত তাহলে আজ ছোঁয়া ওর থেকে দূরে যেত না। কেনো সেই দিন ও ছোঁয়ার হাত ধরেনি! কেনো ছোঁয়ার পাশে থাকেনি! কেনো সেই সময় ছোঁয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে ছিলো! কেনো মা কে বুঝায় নি! এতে ত নিরুপমা বা ছোঁয়ার কোনো হাত ছিল না। এই আপসোস সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

রাত গভীর বারান্দায় গিটার নিয়ে বসে আছে নির্জন, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো আজকের আকাশে চাঁদ নেই অন্ধকার রাত। চাঁদেরও বুঝি আজ মন ভালো নেই!? চাঁদ ও কি আজ দুঃখ লুকাতে আড়ালে আছে! ??

গিটারে টুংটাং শব্দ তুলল..

” সেই তুমি, কেন এতো অচেনা হলে,
সেই আমি, কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম..?
কেমন করে এত অচেনা হলে তুমি.?
কিভাবে এত বদলে গেছি এই আমি.?
ও বুকেরই সব কষ্ট দু’হাতে সরিয়ে,
চল বদলে যাই..
তুমি কেন বুঝোনা..?
তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়
আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে,
আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে..
তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়…

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মেঘের আড়ালে রোদ ২ পর্ব-০৫

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_৫
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

দুই ঘন্টা পর অপারেশন রুম থেকে বের হয় আহনাফ।

মহুয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল এক পাশে।

আহনাফ কোনো দিকে না তাকিয়ে চলে গেল।

মহুয়ার সামনে এসে একজন ডাক্তার বললো অপারেশন সাকসেসফুল।

দেহে প্রাণ ফিরে পেল। মিম জড়িয়ে ধরলো মহুয়াকে।

রাতে মহুয়া চুপচাপ বসে ছিল আলভির পাশে। মিমের ভীষণ খিদে পেয়েছে মহুয়া মিম কে আলভির পাশে বসিয়ে মহুয়া হসপিটাল থেকে বের হলো।

হসপিটালের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে মোবাইল দেখলো কয়টা বাজে।

সামনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ পেছন থেকে ডেকে উঠলো ” মহুয়া ”

পা সাথে সাথে থেমে গেল মহুয়ার, হৃদপিন্ড ছেদ করে উঠলো।
পেছন ফিরে দেখলো ছোঁয়া তাকিয়ে আছে। ছোঁয়া কে দেখেই মহুয়ার চোখে জল জমা হলো ছোঁয়া ধীর পায়ে মহুয়ার কাছে আসলো। নিজের অজান্তেই ছোঁয়ার হাত মহুয়ার গালে চলে গেলো।
ছোঁয়া মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না একটা চিমটি দাও’

মহুয়া নিজেও স্তব্ধ হয়ে গেছে এখানে ছোঁয়া কে দেখে। সে কি বলবে! কি করবে বুঝতে পারলো না তার আগেই ছোঁয়া ওকে জড়িয়ে ধরলো। মহুয়া চমকে উঠলো।

ছোঁয়া বসে আছে আলভির পাশে। চোখে পানি মুছে আলভির গালে হাত রেখে বললো” ফুপিমণি ”

মহুয়া চুপচাপ তাকিয়ে ছোঁয়া কে দেখছে।

ছোঁয়া আলতু হাতে আলভির মুখে হাত বুলিয়ে মহুয়ার দিকে তাকালো।
মিম নিজেও অবাক হয়েছে ছোঁয়া কে দেখে। এক এক করে সবার সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে।

ছোঁয়াঃ তুমি কোথায় ছিলে মহুয়া.? কতো খুঁজেছি তোমাকে! কোথাও পাইনি।
মহুয়াঃ কেমন আছো.?
ছোঁয়া হাসলো, হেঁসে বললো,’ এই ত বেশ ভালো আছি’..
মহুয়া কিছু বললো না।
ছোঁয়া এসে মহুয়ার পাশে বসে বলে উঠলো, ‘ তোমাকে সবাই অনেক মিস করে। এভাবে হুট করে কি হয়ে ছিল!.? তুমি হারিয়ে গেলে ভাই পাল্টে গেলো.?
মহুয়া কে চুপ দেখে ছোঁয়া বলে উঠলো, ‘ প্লিজ আজ চুপ থেকো না। ‘
মহুয়া নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করেও পারলো না শব্দ করে কান্না করে দিল।
ছোঁয়া জড়িয়ে ধরলো মহুয়া কে। শান্ত করার চেষ্টা করলো। স্বামী কে সামনে দেখেও পালিয়ে বেরিয়েছে, জীবন থেকে প্রতি নিয়ত পালিয়ে বেড়াচ্ছে! কিন্তু কেনো!.?

ছোঁয়া ঘড়ির দিকে তাকালো, ডিউটির টাইম হয়ে গেছে৷
মহুয়া নিজেকে শান্ত করে চুপ করে রইলো।
মিম ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আপনি এখন এখানে.? কেউ অসুস্থ!..?
ছোঁয়াঃ না, আমি এই হসপিটালের ডক্টর।

সময় গড়িয়ে রাত অনেক হলো। নিরুপমা কল দিয়ে জেনে নিলো ছোঁয়া কোথায় আছে.? খেয়েছে কিনা”.?
ছোঁয়া মহুয়ার কথা বলতে চাইলে মহুয়া নিষেধ করলো কাউকে ওর কথা বলতে।
ছোঁয়াঃ প্লিজ মহুয়া সবটা খুলে বলো।

মহুয়া লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলে উঠলো, ‘ বিয়ের পর সব ঠিক চলছিলো, আহনাফ আর আমার মধ্যে ভালোবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু বেশি দিন সেই ভালোবাসা আমার ভাগ্যে সহ্য হলো না, নজর পরলো এক নরপিশাচের। আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মামা যখন ছবি দিয়ে ছিলো তখন সেই ছবি গিয়ে পড়ে ছিল মাহিনের হাতে। প্রথম দেখায় নাকি সে আমার প্রেমে পড়ে তারপর বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়া আমাকে আর খুঁজে পায়নি ও। যখন আবার মিম কে আনতে ওর শশুর বাড়িতে গেলাম সেখানে মাহিন আমাকে সামনাসামনি দেখে সেই পুরনো প্রেম জেগে উঠে। আমার বিয়ের কিছু দিন পর থেকে আমি লক্ষ করি কেউ আমাকে ফলো করে প্রথমে ভাবতাম হয়তো মনের ভুল। একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে ধরে ফেললাম মাহিন কে। জিজ্ঞেস করার পর বললো ওর ফলো করতে ভালো লাগে। কয়েকদিন এভাবে চলে একদিন রাতে আমার কাছে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে, কল রিসিভ করতেই আমাকে ভয় দেখানো হলো, আহনাফ কে ডিভোর্স না দিলে আমার অতীত সম্পর্কে শশুর বাড়িতে সব বলে দেওয়া হবে। আমি সেদিন ভীষণ ভয় পেয়ে ছিলাম, একটা সুন্দর গুছানো সংসার হারানোর ভয়, মায়ের মতো শাশুড়ী হারানোর ভয়, স্বামী হারানোর ভয়। তাও আমি কল কেটে সিম খুলে নিলাম।

তার দুইদিন পর একটা চিঠি আসলো, বেশ অবাক হয়ে ছিলাম এই যুগে এসেও চিঠি!!
চিঠি খুলে দেখলাম সেই একই কথা আহনাফ কে ডিভোর্স দিতে না হলে ওকে শেষ করে দিবে।

আমি ভয় পেলেও তা কাউকে বললাম না।

তারপর তোমার ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হলো। আমি ভীষণ ভাবে ভেঙে পরে ছিলাম। অনেক চেষ্টা করেছি কে সে খুঁজে বের করার কিন্তু পারিনি। আমার মনে তখন আহনাফ কে হারানোর ভয় ঢুকে গিয়ে ছিল।

আহনাফ একটু সুস্থ হতেই আবার একটা গিফট বক্স আসলো সেখানে লেখা ছিল ‘ এই এড্রেসে না আসলে আহনাফ কে একদম শেষ করে দিবে, আস্তে আস্তে চোখের সামনে প্রিয় জনের মৃত্যু দেখতে হবে।” আমি ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

সন্ধ্যার দিকে সেই এড্রেসে গেলাম, হোটেল নাম্বার ৩০৩ এ যেতেই দরজা খুলে গেলো। আমি ভয়ে ভয়ে রুমে প্রবেশ করতেই রুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে ছিলাম। কিন্তু সেই দরজা সারারাত খুলতে পারিনি ভেতরে কেউ ছিল না। আমি ভীষণ অবাক হয়ে ছিলাম শুধু মাত্র রুমে আটকে রাখার জন্য একটা মানুষকে কেনো এতো কিছু করে আনা হলো!.? সকাল হতেই দরজা খুলা পেলাম। কারো দেখা না পেয়ে জলদি হসপিটালে ফিরে আসলাম।

সেই দিনের পর থেকে আহনাফ বদলে গেল। আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো। আমার শরীর অসুস্থ থাকায় নিজেই হসপিটালে গেলাম আহনাফ ভীষণ ব্যস্ত আমার খবর রাখার সময় কোথায়! আমাদের দেখা হতো মাঝে মধ্যে একই বাসায়, একই ছাঁদের নিচে থাকলেও আমাদের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। হসপিটাল থেকে সব টেস্ট করিয়ে বাসায় এসে সব চেয়ে প্রথম খুশির খবরটা আহনাফ কে দিব বলে কাউকে কিছু বললাম না। আহনাফ আসলো রাত ১টায়। আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম তাও ঘুম ভেঙে গেল। আহনাফ কে দেখে খুশিতে সেই খবর বলতেই মুখের রং বদলে গেলো ওর। বেশ রেগে গেলো ঝগড়া শুরু করলো। এক পর্যায়ে বলে উঠলো ” এই বাচ্চা আমার না” আমি সেই দিন নিজের কান আর নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দিন দিন এতোটা দূরত্ব হয়েছে যে আজ আমার সন্তান কে অস্বীকার করছে! শুরু হলো আমাদের ঝগড়া। এতোদিন মেনে নিলেও সেই দিন আহনাফের এই কথা আমাকে ভেতর ভেতর শেষ করে দিয়ে ছিল।

প্রতিদিনের ঝগড়া এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো সম্পর্ক শেষ করায়। তোমার ভাইয়ের ধারনা ওইদিন আমি কারো সাথে হোটেলে.. বলেই মহুয়া কাঁদতে শুরু করলো। কে কি বলেছে আমি জানিনা! আহনাফ কার কথা শুনে ছিল তাও আমি জানতাম না, কি ভিডিও দেখেছিল তাও আমি জানতে চাইনি যেখানে বিশ্বাস শব্দটা নেই সেখানে আমি আর কি বলবো!

আমি নিজের মতো চেষ্টা করলাম সেই লোককে খুঁজে বের করতে। খুঁজে বেরও করলাম কিন্তু তাতে আরও সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। আমি মাহিন কে জিজ্ঞেস করলাম কেনো সে এমন করছে.? এতে ওর লাভ কি.?
মাহিন বলে ছিলো, সব ছেড়ে ওর কাছে চলে আসতে। আমি থাপ্পড় মেরে বলে ছিলাম ওকে আমি ছাড়বো না। দূর থেকে আমাদের এক সাথে দেখে তোমার ভাই ভেবে নিলো অন্য কিছু। বাসায় আসতেই সে আমাকে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিল৷
আমি সবটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু আহনাফ কিছুই শুনতে চাইলো না। আমার মনে হলো সে মুক্তি চাচ্ছে দিয়ে দিলাম মুক্তি।

ছোঁয়াঃ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে ছিলে.?
মহুয়াঃ নাহ্..
ছোঁয়াঃ মাহিন কে ছেড়ে দিয়ে ছিলে.?
মহুয়াঃ নাহ্.. আমি তোমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে মেঘলার সাহায্যে ওর কাছে পৌঁছাই। ওর বুকে ছুরি মেরে ছিলাম, ওর হলো কৈ মাছের প্রাণ তাও বেঁচে গেছে। হসপিটাল থেকে মিথ্যা খুনের আসামী বানিয়ে সারাজীবনের জন্য কারাগারে পাঠিয়ে দিয়ে ছিল মেঘলা। তাও কিভাবে আজ ছাড়া পেয়ে গেলো!!…

ছোঁয়া অবাক হয়ে বললো,’ এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি বুঝতেই পারিনি।’

মহুয়াঃ বাদ দাও যা হয় হয়তো ভালোর জন্যই হয়। আমি আমার ভাগ্য মেনে নিয়েছি আমার ছেলে নিয়ে ভালো আছি। তোমার কি খবর.? বিয়ে করেছো?
ছোঁয়া মুচকি হেসে বললো,’ ভালো পাত্র পেলে করে নিব।’
মহুয়াঃ নির্জন!..
ছোঁয়াঃ আজ ওর বিয়ে..
মহুয়াঃ কি বলছো.? সত্যি.?
ছোঁয়াঃ হুম।
মহুয়াঃ সবাই তোমাদের সম্পর্কের কথা জানতো তারপর ও কিভাবে.?
ছোঁয়া প্রথম থেকে সবটা খুলে বললো মহুয়া কে।

মহুয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে। সবার জীবনে এতো কষ্ট কেনো! কোথাও সুখ নেই..

____________

নির্জন রুমে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। রাত দুইটা বাজে এখন ওকে ছোঁয়ার কাছে যেতে হবে, সব ঠিক করতে হবে, ছোঁয়া কি ওকে মেনে নিবে আর.? এইসব লুকোচুরি শেষ করতে হবে….

আহনাফ হসপিটাল থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় মহুয়াকে দেখেছে। সেই শাড়ি, চোখে চশমা, চুল বিনুনি করা নারীকে দেখে থমকে গিয়ে ছিলো প্রথম দিনের মতো.. এতো বছর পর কেনো.? আবার কেনো ফিরেছে এই শহরে..? এই বার যে আহনাফ কে দেওয়া প্রতিটা কষ্ট আহনাফ ফিরিয়ে দিবে। এমনি এমনি কিছুতেই ছাড়বে না সে মহুয়া কে৷ মহুয়ার জন্য কি অপেক্ষা করছে সে নিজেও কল্পনা করতে পারছে না।

চলবে….
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মেঘের আড়ালে রোদ ২ পর্ব-০৪

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_৪
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

হসপিটালে চিন্তিত হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে মিম ওর পাশেই মহুয়া চুপচাপ বসে আছে, থেমে থেমে শরীর কেঁপে উঠছে মহুয়ার।

আলভি অপারেশন রুমে।

একজন ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই মহুয়া দৌড়ে গিয়ে ডাক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো।
ডাক্তার কিছু সময় মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ দেখুন আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি, আপনার ছেলের এখন ইমার্জেন্সি একটা অপারেশন করাতে হবে আমাদের কারো পক্ষে এই অপারেশন করানো সম্ভব নয়।

মহুয়া শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে।
মিম পাশ থেকে বলে উঠলো, ‘ তাহলে কি অন্য হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে!.?’
ডাক্তারঃ তার প্রয়োজন নেই তিন ঘন্টার ভেতর অপারেশন করাতে হবে একটু পর একজন ডক্টর আসবে আপনারা উনাকে রাজি করাতে পারলে এখানেই অপারেশন হবে। হাতে সময় নেই এখনি ডক্টর চলে আসবে।

ডক্টর চলে যেতে নিলে মিম বলে উঠলো, ‘ ডক্টরের নাম!.?’
ডক্টরঃ ভালো কথা মনে করেছেন ডক্টর আহনাফ চৌধুরী।

নাম শুনতেই বজ্র পাতের মতো তাকালো মহুয়া, ডাক্তার চলে যাচ্ছে মহুয়া কিছু বলতে গিয়েও লক্ষ করলো কথা বের হচ্ছে না। সব কিছু গলায় এসে আটকে গেছে।

মিম বিরবির করে বললো,’ আহনাফ চৌধুরী! মানে আহনাফ ভাই!..? ‘

মহুয়া চুপচাপ সিটে বসে আছে। কি করবে.!? এক তো আলভির চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার উপর আহনাফের মুখোমুখি কিভাবে হবে.?? আহনাফ কি রাজি হবে আলভিকে অপারেশন করাতে!.? এতো বছর পর সামনে দেখলে আহনাফের রিয়াকশন কেমন হবে.! আহনাফ বলে ছিল সে কখনো মহুয়ার এই মুখ দেখতে চায় না। আর কিছু ভাবতে পারছে না মহুয়া।

মিম মহুয়ার কাঁধে হাত রাখলো।

_________________

বিয়ে বাড়ি কয়েক ঘন্টায় একদম মরা বাড়ির মতো হয়ে গেছে। বাড়ি একদম ফাঁকা আত্মীয়স্বজন সবাই চলে গেছে।

নির্জন আঁড়চোখে মা’য়ের দিকে তাকালো। হালিমা বেগম কাঁদছেন।

আজাদ চৌধুরী বিরক্ত হলো ছোট ভাইয়ের বউয়ের বাচ্চামিতে।

নিজেই মেয়ে পছন্দ করলো, নিজেই বিয়ে ঠিক করলো সব কিছু নিজে করে এখন সবাই কে দোষ দিচ্ছে!

হালিমা বেগমঃ আজ যদি বিয়েটা হয়ে যেত আমার ছেলেটার কি হতো.? ও ত আপনাদের কেউ নয় কেনো ওর বউয়ের বিষয় খোঁজ নিবেন।
আমেনা বেগমঃ ছোট কান্না বন্ধ কর বিয়ে ত হয়নি! আর তুই তোর ছেলের জন্য নিশ্চয়ই খারাপ কিছু পছন্দ করবি না সেই জন্য আমরা এতোটা ঘেঁটে দেখিনি।
হালিমা বেগমঃ ঠিক বলেছেন আপা ছেলে ত শুধু আমার আজ ওর আব্বু বেঁচে থাকলে আমার এমন দিন দেখতে হতো না।
আমেনা বেগমঃ তুই এখন ভুল বুঝছিস ছোট আমরা নির্জন কে কখনো পর মনে করিনি। আজকাল ভালো কথায়ও তুই দোষ খুঁজে বেড়াস।

আজাদ চৌধুরীঃ চুপ করো তোমরা যা হয়েছে, হয়েছে এখন সব ভুলে যাও।

নির্জন চুপচাপ ভদ্র বাচ্চার মতো বসে আছে।
দুইতলা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে মেঘলা।
নির্জন একবার মেঘলার দিকে তাকালো মেঘলার মুখের হাসি দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সে বুঝতে বাকি নেই এই সব কিছুর পেছনে কে! প্রথমেই বুঝতে পেরেছে।

ছোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার পর পর কিছু লোক এসে ভাংচুর শুরু করে, লোকগুলো এলিনার বয়ফ্রেন্ড, হালিমা বেগম পুলিশ ডাকতে চাইলে এলিনা নিজেই বলতে শুরু করে জোর করে ওকে বিয়ে দিচ্ছে সে এই বিয়েতে রাজি নয় বলেই বিয়ে বাড়ি থেকে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যায়।

হালিমা বেগম নিজের রুমে যেতে যেতে বলে উঠলো, ‘ আমি আমার ছেলের জন্য রাজকন্যা খুঁজে আনবো।”

নির্জন ক্লান্ত চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে সোফায় মাথা রাখে।

_________

অপারেশন রুমের দিকে তাকিয়ে আছে চোখ থেকে টপটপ করে এখনো পানি পড়ছে। মিম বাড়িতে কথা বলে ফোন রাখলো রাবেয়া বেগম বাড়িতে কান্নাকাটি করছেন৷

একজন নার্স এসে বললো ” স্যার চলে যাবে আপনি কথা বলে দেখুন, আমাদের বড় ডাক্তার বলেছেন কিন্তু স্যার রাজি হচ্ছেন না ”
মিম রেগে বললো,’ উনাদের কাজই হলো মানুষের জীবন বাঁচানো সেখানে উনি রাজি কেনো হচ্ছে না!.?’
~ দেখুন স্যার আগামীকাল দেশে এসেছে আজ প্রয়োজনে হসপিটালে এসেছে কোনো রোগী দেখতে নয়৷
মিমঃ তাই বলে একটা ছোট বাচ্চা উনার সামনে কষ্ট পাচ্ছে।
~ আপনারা কথা বলে দেখুন।

মহুয়া মিম কে চুপ করিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

আহনাফের ক্যাবিনের সামনে গিয়ে মহুয়া ঘোমটা টেনে নিল।
আহনাফ ভেতরে আসতে বললো।

মহুয়া হাত দিয়ে ঘোমটা টেনে চেয়ারে বসলো।
আহনাফ একবারও সামনে তাকালো না ল্যাপটপে চোখ রেখে কফিতে হাত দিল।

মহুয়া ভয়ে ভেতর ভেতর জমে গেলেও বাহিরে একদম স্বাভাবিক থাকলো।

আহনাফ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বললো,’ জ্বি বলুন’

মহুয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আলভির অপারেশনের জন্য বললো।
আহনাফ মহুয়ার এমন কাঁপা কাঁপা এলোমেলো কথা শুনে ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো।

ঘোমটা দিয়ে মুখ ডাকা, হাত টেবিলের উপর।
আহনাফ হাতটার দিকে তাকাতেই বুক ধক করে উঠলো। ভীষণ চেনা মনে হলো হাতটা। আহনাফ আবার মহুয়ার দিকে তাকালো।

মহুয়া আবারও আলভির কথা বললো।

আহনাফ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। কন্ঠটা বেশ পরিচিত। মহুয়া যথেষ্ট চেষ্টা করছে কন্ঠ চেঞ্জ করে কথা বলার।
আহনাফ কে দাড়াতে দেখে মহুয়ার আত্না শুকিয়ে গেলো। আহনাফ কি তাহলে চিনে ফেলেছে.!..?

আহনাফ দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে বলে উঠলো, ‘ আপনি এখন আসুন।’
মহুয়াঃ স্যার আমার..
আহনাফঃ আপনাকে যেতে বলেছি….

মহুয়া চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। বাহিরে গিয়েই চোখের পানি বাঁধ মানছে না দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলো।

ওয়াশরুমে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। এতো বছর পর কি পরীক্ষায় ফেললেন আল্লাহ! একদিকে স্বামী অন্য দিকে ছেলে।

মহুয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মিমের কাছে এসে বললো, ‘ আমাদের বসে থাকলে হবে না চল আলভির জন্য শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তারের কাছে যাব৷ আমার ছেলেকে আমি সুস্থ করে তুলবই ওর কিছু হবে না৷ ও ছাড়া আর আছে কে আমার!..।

মিমঃ তুই কোথায় ছিলি.?
মহুয়াঃ একটু ওয়াশরুমে গিয়ে ছিলাম।
মিমঃ ডাক্তার আহনাফ চৌধুরী রাজি হয়েছে অপারেশন করাতে পাঁচ মিনিট পর শুরু হবে।

মহুয়া অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো মিমের দিকে।

মিমঃ মাহিন…
মহুয়াঃ ওর নামও নিবে না৷ ওই সাইকো জেনো হসপিটালের আশেপাশেও না আসে। এখান থেকে বের হয়ে নেই তারপর ওকে দেখে নিচ্ছি। ওর অনেক অপরাধ সহ্য করেছি আর নয়।

________________

মেঘলা রুমে এসে দেখে শ্রাবণ ওর জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে।
মেঘলাঃ আমি এখন খাব না শ্রাবণ।
শ্রাবণঃ আজ সারাদিন কিছু খাওনি, নিজে না খেলে না খাওও কিন্তু আমার আম্মুটাকে কেনো কষ্ট দিচ্ছ.?
মেঘলাঃ তোমার আম্মু এখন খাবার চাচ্ছে না।
শ্রাবণঃ দেখি..
মেঘলাঃ শ্রাবণ বাচ্চামি বন্ধ করে নিচে যাওও।
শ্রাবণঃ নিচে আমার কোনো কাজ নেই। এখন বলো মিষ্টি কখন খাওয়াচ্ছ।
মেঘলাঃ কিসের মিষ্টি!.?
শ্রাবণঃ কাল রাতে তোমার প্লেন খুব ভালোই কাজ করেছে দিন দিন সিআইডি থেকে ভিলেন হয়ে যাচ্ছ।
মেঘলা অবাক হয়ে বললো, ‘ তুমি সব জানতে!.? ‘
শ্রাবণ ভাব নিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমার বউ কি করছে না করছে আমি জানবো না!.
মেঘলাঃ তুমি রাগ করোনি?
শ্রাবণঃ আমার বউ কখনো ভুল কাজ করতে পারে না নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ ছিল।
মেঘলার চোখ চিকচিক করে উঠলো মানুষটা ওকে এতো বেশি কেনো বিশ্বাস করে! একটা সম্পর্ক টিকে থাকতে হলে হয়তো এমন বিশ্বাস প্রয়োজন, ঠিক এতোটাই বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন গলায় ছুরি ধরার পরও বলবে তুমি আমাকে মারতে পারো না! আজ হয়তো এই বিশ্বাস টুকু আহনাফ মহুয়া কে করলে, মহুয়া ওর থাকতো..

মেঘলা চোখ বন্ধ করে কাল রাতের কথা ভাবলো।

ফাহিম কে কল দিয়ে পাঠিয়ে ছিল কিছু গুন্ডা ভাড়া করতে আর নিজে গিয়ে ছিল এলিনার কাছে। ভয় দেখিয়ে ছিল যদি বিয়ে করে তাহলে ওর সব কুকর্মের ভিডিও ভাইরাল করে দিবে, ভিডিও দেখালো ভয়ে চুপসে গিয়ে ছিল এলিনা। মেঘলা ঠিক যেভাবে বলেছে এলিনা ঠিক সেভাবে আজ অভিনয় করেছে।

শ্রাবণের ডাকে ফিরে তাকালো মেঘলা। শ্রাবণ ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে খাবার মুখের সামনে ধরলো।
মেঘলাঃ তুমি অফিসের কাজ সামলে সারাদিন রাত আমার পেছনে পেছনে ঘুরতে বিরক্ত হও না!.?
শ্রাবণঃ বিয়ের পরও তিনটা বছর পিছে পিছে ঘুরিয়ে ছিলে, একি ছাঁদের নিচে থেকেও হাতটা ধরতে দাওনি এখন এইসব আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এই পিছু ঘুরা মৃত্যুর আগে ছাড়ছি না।
মেঘলা হেঁসে শ্রাবণের গালে কিস করলো।
শ্রাবণঃ তুমি এতো কিপ্টে কেনো বউ!?
মেঘলা এসে শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরলো।

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মেঘের আড়ালে রোদ ২ পর্ব-০৩

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_৩
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল আহনাফ।
আমেনা বেগম বার বার নিষেধ করলেন আজ বাড়ি থেকে বের হতে। বাড়িতে এতোবড় একটা অনুষ্ঠান। হালিমা বেগম ছেলের বিয়েতে কোনো কিছুর কমতি রাখেননি।

আহনাফ মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে দরকারী কাজ আছে বলে বেরিয়ে গেলো। এইসব বিয়েতে ওর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। নিরুপমা বাড়ি থেকে চলে গেছে, কোথায় গেছে.? কেনো গেছে.? কি হয়েছিল.? আহনাফ জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায়নি সবার এক কথা আগে বিয়ে শেষ হোক তারপর বসে এই বিষয় কথা বলবে।

ছোঁয়া ঘোমটা দিয়ে বাসা থেকে বের হতেই নিরুপমা মেয়েকে ডাকলেন৷
ছোঁয়া ভয়ে চুপসে গেলো।
নিরুপমাঃ কোথায় যাচ্ছ..?
ছোঁয়াঃ আম্মু..
নিরুপমাঃ আমি জিজ্ঞেস করছি কোথায় যাচ্ছ.?
ছোঁয়া ভয়ে মাথা নিচু করে নিল। নিরুপমা যা বুঝার বুঝে নিল।
একবার ভালো করে মেয়ের দিকে তাকালো। সাদা সেলোয়ার-কামিজ, চুল বিনুনি করা, চোখে চশমা.. চোখে মুখে কোন সাজ নেই ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে ছোঁয়াকে।
নিরুপমাঃ আমি নিষেধ করে ছিলাম ওই বাড়িতে পা রাখতে।
ছোঁয়াঃ এটাই শেষ আম্মু, আমি ভাবিকে কথা দিয়েছি।
নিরুপমাঃ তাই বলে বিধবা সেজে যাচ্ছ কেনো.?
ছোঁয়াঃ আমার হসপিটালে যেতে হবে আম্মু। ওই বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য যাচ্ছি।
নিরুপমা মেয়েকে আর কিছু বললো না৷, মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে সে এখন একজন ডাক্তার।

ছোঁয়া কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে বের হয়ে গেল। পেছন থেকে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে তাকিয়ে রইলো নিরুপমা, কাছের মানুষ গুলো বদলে গেলে এতো কষ্ট হয় কেনো.? আমরা যাদের আপন ভাবি তারা আমাদের আপন ভাবে না কেনো.? এক জীবনে যন্ত্রণা শেষ হলো না নিরুপমার।শান্তি কোথায়.??? বিশ্বাস আর ভালোবাসার উপর আজকাল বিশ্বাস উঠে গেছে, দিন শেষে সবাই স্বার্থ খুঁজে।

_________________

সকাল থেকেই মিম একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে মহুয়াকে। আজ অফিসে কাজ থাকায় একটু জলদি অফিসে চলে আসতে হয়েছে।

মিম মহুয়ার অফিসের নিচে এসে আবার কল দিল মোবাইল বন্ধ। সেই আটটা থেকে কল দিয়ে যাচ্ছে এখন বাজে এগারোটা।

মিম অফিসের ভেতরে গিয়ে খুঁজ করলো মহুয়ার। ভাগ্য ভালো পেয়েও গেলো।
মহুয়া অবাক হলো মিম কে দেখে।

মিম কে এক সাইডে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি হয়েছে.? অফিসে কেনো এসেছিস.? জানিস ত বস কেমন.?’

মিমের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।
মহুয়া ভয় পেয়ে গেলো।
মহুয়াঃ কি হয়েছে মিম.?
মিম হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করলো।
” আলভি কে সকাল থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ”

কথাটা শুনতেই মুহূর্তে মহুয়ার মুখের রং পাল্টে গেলো।
মহুয়াঃ ভালো করে সব জায়গায় দেখেছিস তুই.?
মিমঃ কোথাও বাকি রাখিনি।

মহুয়া কোনো দিকে না তাকিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো। কোথায় খুজবে প্রথমে.?

খুঁজতে খুঁজতে কোথাও বাকি রাখেনি মহুয়া। বাসায় এসে নিচে বসেই কাঁদতে শুরু করলো।

মোবাইলের টুংটাং শব্দ শুনে মিম হাতে নিল। মেসেজ পড়ে দ্রুত মহুয়ার হাতে দিল।
মহুয়া মেসেজটা দেখেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। বুঝতে বাকি নেই আলভি এখন কোথায়! আলভির কোনো ক্ষতি করবে না ত.?

মহুয়া এড্রেস দেখে বেরিয়ে পড়লো, মহুয়ার পিছু পিছু বের হলো মিমও।

_______________

ছোঁয়া বাড়ির সামনে এসে চারপাশে একবার নজর বোলালো। কি সুন্দর করে পুরো বাড়ির আশপাশ সাজানো হয়েছে, এতো জাঁকজমকের ভেতর ছোঁয়া কে ভীষণ নরমাল দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে।

বাড়ির বাগানে বড় করে আয়োজন করা হয়েছে । ফুল গাছগুলো অর্ধেক নেই, ভীষণ কষ্ট লাগলো ফুলগাছ গুলোর জন্য, ছোঁয়ার খুব প্রিয় ছিল ফুলগাছ গুলো।

স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে নির্জন, এলিনা। এলিনার মুখ থেকে হাসি সরছে না নির্জন পাথরের মতো বসে আছে। ফটোগ্রাফার বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে নির্জনের আচরণে। না হাসলে কি ছবি সুন্দর হয়!.? এই জন্য লোকে বলে পুলিশ মানুষ কসাই এদের মনে ভালোবাসা নেই, আজ বিয়ের দিনেও রোবট সেজে আছে। বিরবির করে ক্যামেরা ম্যান আবার ছবি তুলছে।

ছোঁয়া দূর থেকে হাসলো। হাতের চিরকুটের দিকে তাকিয়ে বললো,’ এটাই আমার দেওয়া শেষ উপহার তারপর আপনি সম্পূর্ণ অন্য কারো। ‘

” অনেক দিন পর দেখা”
ছোঁয়া চমকে পেছন ফিরে তাকালো।
ছেলেটা মিষ্টি হেঁসে বললো,’ অনেক দিন নয়, বছর পর দেখা।’

ছোঁয়া তাকিয়ে বললো ছেলেটার দিকে।
~ চিনতে পারছেন না.?
ছোঁয়াঃ রাফি!!..
রাফিঃ যাক অবশেষে চিনতে ত পেরেছেন।
ছোঁয়া হাসার চেষ্টা করলো।
রাফি ছোঁয়ার দিকে ভালো করে তাকালো, চোখের নিচে কালো দাগ, ফেঁকাসে মুখ, খুব সাধারণ একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। ছোঁয়া ত এমন নয়, কতো চঞ্চল একটা মেয়ে ছিল, এই ছোঁয়া আর আগের ছোঁয়া মধ্যে বিশাল এক তফাত ।

রাফির এভাবে তাকানোতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ছোয়া।
ছোঁয়াঃ আপনি এখানে.?
রাফিঃ কাজিনের বিয়ে, এলিনা আমার খালাতো বোন। আজ থেকে আপনি আমার বেয়াইন।
ছোঁয়া হাসলো। পেছন ফিরে চলে যেতে নিলে রাফি বলে উঠলো, ‘ এখন কি করছো.? তোমার স্বামী কেমন আছে.?’

হাসলো ছোঁয়া, এখনো বিয়ে করেনি আর স্বামী!! তাও পেছন ফিরে বললো,’ ভালো ‘

রাফি তাকিয়ে রইলো ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে। ছোঁয়া কারো সাথে দেখা না করে বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। হসপিটালে যেতে হবে, নিয়ে আসা চিঠিটা রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। মনে মনে বলে উঠলো “লোকে যাহার নাম দিয়াছে প্রেম,
আমি তাহার নাম দিয়াছি বি’ষপান!”
রাস্তার পাশে একটা বিড়াল ছাড়া দেখে হাঁটু গেড়ে বসলো মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো ” মানুষের চেয়েও পশু পাখির ভালোবাসা স্বার্থহীন ”

ছোঁয়া বাড়ি থেকে বের হতেই একদল লোক বাড়িতে প্রবেশ করলো। বিয়ে বাড়ির সব কিছু ভাঙচুর শুরু করলো। হইচই বেঁধে গেলো পুরো বিয়ে বাড়িতে।

ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া চিঠি খুব যত্ন করে কেউ কুড়িয়ে নিল ।

__________________

মহুয়া রাস্তার পাশে তাকিয়ে দেখলো আলভি আইসক্রিম খাচ্ছে বসে।

মহুয়া দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আলভিকে। চোখ থেকে পানি পড়ছে, কতোটা ভয় পেয়ে ছিল ছেলের জন্য। একটুর জন্য মনে হয়ে ছিল পৃথিবীটা বুঝি অন্ধকার হয়ে আসলো।

আলভিও আম্মুকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো।
মহুয়া আলভির সারা মুখে চুমু দিয়ে বুকে টেনে নিল।

আলভি চুপটি করে মায়ের বুকে মাথা রেখে আছে।

মহুয়া চোখের পানি মুছে রেগে তাকালো সামনে।
পকেটে এক হাত দিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে মাহিন।
মহুয়া রেগে আলভিকে সরিয়ে মাহিনের কলার চেপে ধরলো।

রাস্তার মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

মহুয়াঃ তোকে আগেও সাবধান করেছি আমাদের মা ছেলে থেকে দূরে থাকতে, কোন সাহসে আমার ছেলেকে নিয়ে এসেছিস!..

মাহিন হেঁসে তাকিয়ে আছে হিংস্র বাঘিনী মহুয়ার দিকে। মহুয়াকে দেখতে এখন একটা হিংস্র বাঘিনী মনে হচ্ছে।

মাহিনের হাসি শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল মহুয়ার।

মহুয়াঃ আমার থেকে আর কি চাই …? সব কেঁড়ে নিয়েও শান্তি হয়নি তোর!.?
মাহিনঃ তোমাকেই ত পাওয়া হলো না।
মহুয়া মাহিনের কলার চেপে ধরে বলে উঠলো, ‘ এই জীবনে হয়তো কখনো পাওয়া হবে না, অন্যের বউয়ের দিকে তাকানো পুরুষদের আমার ঘৃণা হয়। ‘
মাহিনঃ তুমিও এখন অন্যের বউ নেই, এই জীবনে না পাওয়া হলে পরের জন্ম বলে কিছু থাকলে তখনো আমি তোমার পিছু নিব৷
মহুয়াঃ তোর মতো পুরুষদের দেখলেই ঘৃণা হয়।
মাহিনঃ ঘৃণা থেকে একদিন ভালোবাসা হয়ে যাবে, ভালোবাসায় না রাখলেও ঘৃণায় রেখেছো এটাই অনেক।
মহুয়াঃ সাইকো! তোর মৃত্যু আমার কাছে নিয়ে এসেছে।
মাহিনঃ এর আগেও অনেক বার চেষ্টা করে ছিলে পেরেছো.?
মহুয়া রাগে দুঃখে মাহিনের কলার ছেড়ে দিল।
মহুয়াঃ আমার থেকে আমার স্বামী সংসার সব কেঁড়ে নিয়েছো এখন ত থেমে যাও, না হয় আমি নিজেই শেষ হয়ে যাব!।
মাহিনঃ তোমার স্বামী কতোটুকু বিশ্বাস করত তোমাকে? সে কি একবার তোমার খুজ নিয়েছে.?
মহুয়াঃ আমার স্বামীর বিষয় আর একটা কথাও শুনতে চাই না তোমার মতো পাপীর মুখে। সে তোমার মতো জঘন্য মানুষ নয়। আমি তার বিশ্বাস, ভালোবাসা কে ঠকিয়েছি তোমার জন্য। আমার থেকে যেভাবে আমার সব কেড়ে নিয়েছো ঠিক সেভাবে এক এক করে সব হারাবে তুমিও।
মাহিন হাসলো বিশ্রী হাসি। মহুয়ার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে এক চিৎকারে সবাই পেছন ফিরে তাকালো।

মিম চিৎকার দিয়ে ছুটে গেল রাস্তার পাশে আলভির ছিটকে পড়া শরীরের কাছে।

মহুয়া ছেলের রক্তমাখা হাতটা দেখেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মেঘের আড়ালে রোদ ২ পর্ব-০২

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_২
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

ব্রিজের উপর বসে একের পর এক সিগারেটের টানে ভেতর, ঠোঁট পোড়াচ্ছে নির্জন।

সাজ্জাদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্জনের দিকে।

নির্জনঃ এভাবে আমাকে দেখার কি আছে.? আগে কখনো দেখিসনি..??
সাজ্জাদ নিজেও সিগারেটে টান বসিয়ে ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিলো।
সাজ্জাদঃ কি করছিস তুই..? কেনো করছিস.?
নির্জন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না।
সাজ্জাদ রেগে গেলো।
সাজ্জাদঃ তোর সমস্যা কি.? মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস এখানে নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস! ভালোই যদি বাসিস তাহলে অন্য কেউকে বিয়ে কেনো করছিস.?
নির্জন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠলো, ‘ কে বলেছে ভালোবাসি!.? ও ওই মেয়েদের মতোই যাদের সাথে খেলা করা যায় বিয়ে নয়।টাইম পাস ছিল আর কিছু নয়।’
সাজ্জাদ নির্জনের কলার চেপে ধরলো,’ছিঃ তুই আমার বন্ধু ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা আসছে। ছোঁয়ার সাথে প্রেমের অভিনয় কেনো করেছিস! ওকে কেনো ঠকালি.? তোকে বন্ধু ভাবতেই আমার লজ্জা লাগছে। এমন একটা নিষ্পাপ, পবিত্র ফুলকে কেনো ছুঁড়ে ফেলে দিলি!.? মেয়েটার কথা একটা বার ভাব, সব শেষ করে ফিরে যা। কি সমস্যা খুলে বল। মেয়েটা তো তোর কাছে আসেনি তুই গিয়ে ছিলি। আল্লাহ না করুক এমন একটা দিন,রাত তোর জীবনে না আসুক। এলিনা মেয়েটা কেমন আমি খুব ভালো করেই জানি। বিয়ে করছিস কর আজ এই মুহূর্তে আমাদের বন্ধুত্ব শেষ।

নির্জন সাজ্জাদের হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে ব্রিজ থেকে নেমে বাইকে উঠে বসলো।

সাজ্জাদ পেছন থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ একদিন তুই বুঝবি কি হারিয়েছিস! খুব ভালো করে বুঝবি। তবে সেই দিন কোনো লাভ হবে না। আঘাতে আঘাতে মানুষ পাথর হয়ে যায় চাইলেও সেই পাথরে আর ফুল ফুটানো যায় না। এখনো সময় আছে সব ঠিক করে ফেল।

নির্জন আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখে চশমা পড়ে বাইক নিয়ে এক টানে চোখের আড়ালে চলে গেলো।

_____________

ছোঁয়া এলোমেলো হাতে ডায়েরি খুঁজে বের করলো। কাল থেকে নিজের ভাবা মানুষটা অন্য কারো কিভাবে সহ্য করবে ছোঁয়া! এতো সুন্দর পৃথিবীটা কেমন দমবন্ধকর লাগছে। সুন্দর ভালো একটা পৃষ্ঠা দেখে লেখতে শুরু করলো,

” শেষবার যখন তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম,
“তুমি আমাকে এভাবে ঠকাতে পারো না”।

উত্তরে তুমি বলেছিলে “এরকম বহু মানুষ ঠকে”।
অতঃপর বুঝেছিলাম, ছেড়ে যাওয়াই তোমার উদ্দেশ্য ছিলো। বাকি সবতো নিছক অভিনয় মাত্র..

তুমি আজ এমন ভাবে ভুলে আছো যেনো আমাদের কখনো দেখাই হয়নি, আমি চোখ বন্ধ করলে এখনো তোমাকে দেখতে পাই,যেভাবে তৃষ্ণার্ত ক্লান্ত পথিক বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে দেখে মরীচিকা। আমি বার বার বলে ছিলাম,” আমাকে ভালোবাসতে এসো না।
যেদিন থেকে আমায় ভালোবাসবে, সেদিন থেকে তোমার পৃথিবীতে যুদ্ধ শুরু হবে।”
কিন্তু আজ দেখো তোমার পৃথিবীতে কতো শান্তি আর আমার পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি আমি প্রতি নিয়ত, বেঁচে থাকার যুদ্ধ।

এখন তুমি আমার কাছে এক অপরিসীম হাহাকার, যে হাহাকার সমর্পিত হয়ে রচিত হয়েছে শেষ গল্পের উপসংহার,এদিকে দরজার এপাশে আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে তোমার ফিরবার অপেক্ষায়। ক্যালেন্ডারের কয়েকটা পাতা পিছনে উল্টালেই ভেসে উঠে আমাদের অনড় প্রেমের দৃশ্য।

তোমার বাড়ি থেকে যখন আমাদের মা মেয়েকে অপমান করে বের করে দেয় তোমার মা। আমি শুধু চাতক পাখির মতো চারপাশে তোমাকে খুঁজেছি। যখন বলছিল খুনির মেয়ে আমার ছেলের বউ হতে পারে না তখন আমি তোমার অপেক্ষা করেছি। মৃত মানুষকে আর কিভাবে শাস্তি দেওয়া যায় বলবে!!.?
তুমি এসেছো পাঁচ বছরের লুকোচুরি ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটাতে।

এ শহরে যারা স্বপ্ন দেখে তাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে নিকৃষ্ট একটা সত্তা, খুনির মেয়ের হয়তো স্বপ্ন দেখা সাজে না। তুমি তো সব জানতে!

অথচ আজ সব মিথ্যা অভিযোগ আমার উপর দিয়ে দিলে। আজ খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে ” কখনো ভালোবেসেছ কি..?”

আমি আজ আর কান্না করি না, আমার সকল কান্না জমিয়ে রেখেছি তোমার জন্য, আমি সেদিনের অপেক্ষায় রয়েছি, যেদিন তোমারও ঠিক আমার মত বিষাদে ছেয়ে যাবে মন,আর হৃদয় হবে রক্তাক্ত, সে দিন আমি তোমার জন্য কাঁদবো, তোমায় হারিয়ে ফেলেছি ভেবে কাঁদবো না, আমার বিষাদের একটুকরো তুমি অনুভব করেছো বলে কাঁদবো।
আমার বিষাদের রঙ নীল নয়, নিকষ কালো। ”

ছোঁয়া ডায়েরিটা বন্ধ করে, কলম পাশে রেখে টেবিলের উপর চোখ বন্ধ করে নিল। মানুষটা তার না কখনো তার ছিল না।

____________

মহুয়া নিজের কাজ শেষ করে আলভির পাশে এসে শুয়ে পড়লো।
মিম বই হাতে নিয়ে চশমা ঠেলে মহুয়ার রুমে নক করলো।
মহুয়াঃ দরজা খুলা আছে চলে আয়।
মিম রুমে এসে এদিক ওদিকে তাকালো।
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই মিম দাঁত বের করে হেঁসে বলে উঠলো, ‘ আপা আজ কি হয়েছে জানিস.??’
মহুয়ার কোনো আগ্রহ দেখলো না জানার, তাও মিম চশমা উপরে তুলে আয়েশ করে বিছানায় বসলো।
মহুয়াঃ জলদি বলে বের হ অফিস জেতে হবে সকালে।
মিমঃ আগে শুনবি তো কি হয়েছে। আজ ভার্সিটি থেকে বাসায় এসে দেখি সামনে যেই বাড়িটা আছে না, মাঝে মাঝে ছাঁদে কাঁথা সেলাই করে, পান খেয়ে দাঁত লাল করে রাখে মহিলাটা। তোকে দেখলেই মুখ কালো করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
মহুয়াঃ কি বলবি সেটা বল।
মিম মুচকি হেঁসে বললো, ‘ উনি আজ তোর জন্য বিয়ে নিয়ে এসেছে। ‘
মহুয়া বিরক্ত হলো, বিয়ে নিয়ে এসেছে মানে কি.? আমার একটা চার বছরের বাচ্চা আছে। নাকে নাকফুল হাতে চুড়ি তাও মহিলার সমস্যা কি!.??
মিমঃ তাতে কি! উনার ছেলের নাকি তোকে পছন্দ। মহিলা তো সারা এলাকা বলেছে তোর জামাই নাকি মদ গাঞ্জা খেয়ে রাতে বাড়িতে এসে মারধর করে, কোনো কাজ করে না সেই জন্য তুই ছেড়ে দিয়েছিস। আরেকজন তো এই কথা শুনে বলে উঠলো ” প্রিন্সেস ডায়না ও সুন্দরী ছিল কিন্তু তাও স্বামীকে আঁচলে বাঁধতে পারেনি তুইও ত সুন্দরী ঠিক প্রিন্সেস ডায়নার মতো তাও নাকি স্বামীকে ঠিক করতে পারিসনি৷ প্রিন্সেস ডায়না আর তোর কপাল নাকি একই, সুন্দরী মেয়েদের স্বামী ভালো থাকে না, সংসার হয় না। এইগুলো শুনলে রাগ হয় না বল!.? আমিও দুই চারটা কথা শুনিয়ে দিয়েছি।
মহুয়াঃ ওই মহিলা আমাকে পছন্দ করে না মিম সেটা তুই সহ পুরো পাড়ার লোক জানে। আমরা কারো সাথে তেমন মিশি না যে যা ইচ্ছে বলুক তাতে কান না দিয়ে চুপ থাকবি। একদিন দুইদিন তিন দিনের দিন এমনিতেই রেসপন্স না পেলে চুপ হয়ে যাবে।
মিমঃ উনি তো তোকে হিংসে করে, উনার মেয়ে কুচকুচে কালো আর তুই দেখতে পরীর মতো স্বাভাবিক সব মহিলা, মেয়েরাই হিংসে করবে। মজার বিষয় কি জানিস!!.’
মহুয়াঃ না বললে জানবো কিভাবে।
মিমঃ মহিলা পান খেয়ে দাঁত বের করে সারা পাড়া তোর সৌন্দর্য নিয়ে এটা সেটা বলে বেড়ায়, আর ঘরে বেডির ছেলেই তোর সাথে বিয়ে না দিলে খাবার খাবে না বলে অনশন শুরু করেছে।

বলেই মিম হাসতে শুরু করলো, মিমের সাথে মহুয়াও হাসলো। ছাঁদে উঠলেই ছেলেটাকে দেখা যায় । সে জেনো নোট করে নিয়েছে মহুয়া কখন বাড়ি থেকে বের হয়, কখন ছাঁদে যায়। মিম তো নাম দিয়েছে চার চোখ ওয়ালা গাধা, চশমা ঠেলে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে যদিও এখনো মহুয়ার সাথে কথা হয়নি আজ পাঁচ বছর ধরে দেখে আসছে। ছেলে বোকা টাইপের দেখতেই বুঝা যায়।

মিমঃ আম্মা তো একদম মুখের উপর বলে দিয়েছে আমার মেয়ে রাজি থাকলে আমার আপত্তি নেই তবে মেয়ে রাজি না হলে আমি আগাতে পারবো না৷ সকালেই দেখবি তোর হাতে পায়ে ধরছে।

মহুয়া আলভির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো, ‘ ওকে সাবধানে রাখবি৷ আমি পারলে ওকে আমার সাথে অফিসে নিয়ে যেতাম। জানিসই তো আমাদের বস কেমন!.?আমি কাল অন্য কোথাও আমাকে বদলি করে দেওয়ার জন্য লেটার জমা দিব।
মিমঃ কেনো.?? এখানে আজ পাঁচ বছর ধরে আছি আপু। আবার অন্য কোথাও কেনো.? নিজের শহর ছেড়ে আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা তো কোনো দোষ করিনি তাও কেনো এতোকিছু!!.??
মহুয়াঃ এটা যে আমার পাপের শাস্তি, ভালোবাসার মতো বড় পাপ করে ছিলাম তার শাস্তি। কারো বিশ্বাস ভাঙার শাস্তি। মৃত্যু পর্যন্ত এই শাস্তি আমার পিছু ছাড়বে না।
মিমঃ আহনাফ ভাইকে সবটা বলে দিলে হয়তো…
মহুয়াঃ যা রুমে যা অনেক রাত হয়েছে।
মিম চশমা ঠেলে বই হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

মহুয়া মিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের কোনের পানিটা মুছে নিল। আজ ওর এই পরিস্থিতি ও নিজে তৈরি করেছে। আহনাফের বিশ্বাস ভেঙেছে, লোকটা আজও ওকে এক আকাশ সমান ঘৃণা করে। যেই চোখে ভালোবাসা ছিল সেই চোখে ঘৃণা কিভাবে সহ্য করবে মহুয়া! তাই ত পালিয়ে বেড়াচ্ছে। উনি কি বিয়ে করেছে.? আজ একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মানুষটাকে। মহুয়া কি একবার কল দিবে!.? আজ পাঁচ বছর পর মানুষটির কন্ঠস্বর শুনে নিবে! আজ যার জন্য আকাশ সমান দূরত্ব তাকে কিছুতেই ছাড়বে না মহুয়া। খুব শাস্তি পেতে হবে তোমাকে, নিজ থেকে ফাঁদে পা দিতে চাচ্ছ। আমি নিজ হাতে তোমাকে শাস্তি দিব!! আমার থেকে আমার স্বামীকে কেঁড়ে নেওয়ার শাস্তি। পাঁচ বছর আগের হিসাব সব চুকিয়ে নিব! এই পাঁচ বছরে হারানো সব কিছুর হিসাব ফিরিয়ে দিব, বুঝিয়ে দিব কাছের মানুষ হারানোর যন্ত্রণা!!

_______________

রাত ২টায় বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো আহনাফ।
দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে আমেনা বেগম। চোখে মুখে ছেলেকে দেখার ব্যাকুলতা।ছেলেকে দেখতেই জড়িয়ে ধরে রাখলেন।
আহনাফ এক হাতে মা’কে জড়িয়ে ধরলো। কতো বছর পর বাড়িতে পা রাখতে যাচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো। বাড়িতে আসতেই বুক কেমন ফাঁকা মনে হলো। সবার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।
কেউ ঘুমায়নি, আহনাফ আসছে শুনেই বাড়িতে আনন্দের শেষ নেই তার মধ্যে বাড়ি ভর্তি মেহমান।
আহনাফ এতো মানুষ দেখে কিছুটা অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। সবার সাথে টুকটাক কথা বলে নিজের রুমে চলে গেলো।
আমেনা বেগম ছেলেকে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতে বললো। কেমন শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেনি, নিজের যত্ন নেয়নি। আজ নিজ হাতে খাইয়ে দিবেন ছেলেকে।
শ্রাবণ নিজেও ভীষন খুশি হলো আহনাফ কে দেখে। মেঘলাকে জোর করে ঘুম পারিয়েছে এই সময় রাত জাগলে বাবুর সমস্যা হবে।

নির্জন বাসায় আসলো ৩টার দিকে। বাড়িতে এসে সবাইকে জেগে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,’ আগামীকাল আমার বিয়ে তোমাদের চোখে ঘুম নেই! কি আজব। যার বিয়ে তার খবর নেই বাড়ির মানুষের ঘুম নেই।
আমেনা বেগম রেগে তাকালো নির্জনের দিকে।
নির্জন চুপ হয়ে গেলো। বড় মা ইদানীং নির্জনের সাথে তেমন কথা বলে না। বিয়ের কথা উঠলেই রেগে যান।

নির্জন এক গ্লাস পানি খেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে থমকে যায়, চোখ কচলে আবার তাকায়। না সে ভুল দেখছে না ওর সামনে আহনাফ দাড়িয়ে।তাহলে কি আহনাফ ওর বিয়ের খবর পেয়ে বিয়ের জন্য এসেছে..!!
নির্জন দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আহনাফ কে।
আহনাফ নিজেও বুকে জড়িয়ে ধরলো নির্জন কে।

নির্জন আহনাফের সাথে বসে টুকটাক কথা বলে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য উঠতেই আহনাফ বলে উঠলো, ‘ ফুপিমণি আর ছোঁয়া কোথাও!.? ওদের দেখলাম না ঘুমিয়ে আছে মনে হয়।

আমেনা বেগমের হাত থেমে গেলো। নির্জন পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেলো।

হালিমা বেগম আহনাফের জন্য খাবার টেবিলে সাজিয়ে বলে উঠলো, ‘ খাবার খেতে আসো আহনাফ এইসব বিষয় পরে কথা হবে। আজ এসেছো রেস্ট নাও আস্তে ধীরে সব জানতে পারবে, সবার বিষয় জানতে পারবে।’

আহনাফ কথা বাড়ালো না, রেস্ট নিতে হবে। বাড়িটার দিকে একবার তাকালো। কতো বদলে গেছে বাড়ি। এতো সাজগোজ বাড়িটা দেখতে বিয়ে বাড়ি মনে হচ্ছে, সবাই বেশ ভালো আছে। বাড়িতে কি কারো বিয়ে!.? আহনাফ মাথা না ঘামিয়ে টেবিলের দিকে চলে গেলো। বাড়িতে যা ইচ্ছে হোক আহনাফ যেই কাজের জন্য এসেছে তা শেষ করেই চলে যাবে।

________

নির্জন মায়ের রুমে প্রবেশ করে গুটিশুটি মেরে মায়ের কোলে মাথা রাখলো।

হালিমা বেগম ছেলের মাথায় হাত রাখলেন।

নির্জন ভাঙা কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ আম্মু একবার ভেবে দেখো না, এখানে তো ওর দোষ নেই। তোমাকে সব সময় ভালো রাখতে চেয়েছে। প্লিজ আম্মু এতো পাষাণ হইয়ো না। আমি ওকে ছাড়া বেঁচে থেকেও মৃত হয়ে যাচ্ছি। এমনটা হতে থাকলে আমি শেষ হয়ে যাব। তোমার কসম তুমি ফিরিয়ে নাও। ওকে ফিরিয়ে আনো, এতোটা কঠিন ত তুমি না, তাহলে আজ কেনো হতে চাইছো? এতে তো ওদের দোষ ছিল না। তুমি জানো এলিনা কেমন মেয়ে ওর সাথে সংসার করার চেয়ে আমাকে মেরে ফেলো। আজ আমি তোমার সামনে ভীষণ অসহায় আর এই কঠিন খেলার অভিনয় করতে পারছি না।

হালিমা বেগম চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে।
____________

শ্রাবণ রুমে এসে দেখে মেঘলা কেমন এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে।
শ্রাবণ মেঘলার চুলগুলো সরিয়ে বেঁধে দিল। একটা কাপড় পানিতে ভিজিয়ে এনে মেঘলার হাত, পা, গলা, মুখ আলতো করে মুছে দিল।

মানুষ বলে সময়ের সাথে নাকি ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়। শ্রাবণ ত দিন দিন এই মেয়েটার ভালোবাসায় ডুবে যাচ্ছে যেখান থেকে ফিরে আশা শ্রাবণের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়৷ আমি প্রতিদিন নতুন ভাবে আপনার প্রেমে পড়ি৷ চাইলে এক জনকেই হাজার ভাবে ভালোবাসা যায়। আমি আপনার মাঝেই নিজের সুখ,শান্তি খুঁজে পাই৷ অফিস থেকে এসে আপনার মুখ দেখলেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মেঘলার গরম একটু বেশিই লাগে শরীরে ঠান্ডা পেয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে।

শ্রাবণ মেঘলার কপালে গভীর একটা চুমু দিয়ে বলে উঠলো, ‘ জীবনের শেষ দিনেও আপনাকে আমার পাশে চাই,বৃদ্ধ বয়সে যখন চশমা খুঁজে পাব না আপনি হাতে তুলে দিবেন৷, আর বলবেন তুমি বড্ড মন ভুলা। ‘

চলবে….

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মেঘের আড়ালে রোদ ২ পর্ব-০১

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#সূচনা_পর্ব
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

ভাগ্যের নির্মমতার শিকার একটা মেয়ের জীবনে ঝড়ো হাওয়ার মতো দ্বিতীয় বার এলো প্রেম! ভালোবাসায় রঙিন হয়ে উঠলো তার দুনিয়া। কিন্তু বাস্তবতা যে আরও কঠোর!!.মেয়েটির সেই রঙিন জীবনে নজর পড়লো এক কালো ছায়ার।….

” অফিসে যাবে না!..?”

ছোট বোনের ডাকে ডায়রি থেকে চোখ তুলে পেছনে তাকায় মহুয়া। দ্রুত ডায়েরিটা লুকিয়ে ফেলে।
মিম বড় বোনের চোখে পানি দেখে ব্যস্ত পায়ে কাছে এসে বললো,’ কি হয়েছে তোমার!.? আজ এতোগুলা বছর পর তোমার চোখে পানি। কিছু কি হয়েছে আপু.?’
মহুয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো। মিমের দিকে তাকিয়ে বললো,’ বাবু কই.?’
মিমঃ এখনো ঘুমিয়ে আছে।
মহুয়াঃ ঘুম ভাঙলে ওকে ফ্রেশ করিয়ে তুই ভার্সিটিতে চলে যাস।

মহুয়া ডায়েরিটা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

মিমের মনে হলো তার বোন জেনো ওর কাছ থেকে পালিয়ে গেলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকালো মিম। কখন কার জীবন পাল্টে যায়, ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।

মহুয়া শাড়ির আঁচল ঠিক করে মায়ের রুমে প্রবেশ করলো।

রাবেয়া বেগম নাতিকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছেন৷ মহুয়া ডাকতে গিয়েও ডাকলো না আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে রিক্সার জন্য। কিছু সময় দাঁড়াতেই একটা রিক্সার দেখা পেল। রিক্সায় উঠতেই রিক্সা চলতে শুরু করলো গন্তব্যের দিকে। মহুয়া রাস্তার পাশে চোখ ফেলতেই বুক কেঁপে উঠল, এলোমেলো দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো, আবার তাকালো রাস্তার পাশে বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে একটা যুবক , মহুয়ার রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেল, ইচ্ছে করলো এই চোখ দিয়ে এই যুবকটাকে শেষ করে দিতে, পৃথিবী থেকে বিলীন করে দিতে, আজ ওর পরিস্থিতি ভিন্ন হতো,জীবন সুন্দর হতো যদি না এই কালো ছায়া ওর জীবনে পা না রাখতো। মহুয়া রাগে বিরবির করে বলে উঠলো, ‘ মাহিন!!!’

___________________

ছাঁদের রেলিঙের উপর বসে গিটারের টুংটাং শব্দ তুললো একটি মেয়ে, চুল ছাড়া,এলোমেলো দৃষ্টি আকাশের পানে তাকিয়ে গান ধরলো ” তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম, কি দোষ দিবি তাতে..?
বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই,সকাল দুপুর রাতে..।’

আগুন জ্বেলে পুড়লাম আমি,দিলাম তাতে ঝাঁপ,
তোর আমার প্রেমে ছিলো রে বন্ধু, ছিলো পুরোটাই পাপ।”

চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো হাতে। গান বন্ধ করে হাতের দিকে তাকালো। পাশেই বিয়ের কার্ডটা অবহেলায় পড়ে আছে।

” ছোঁয়া! ”

নিজের নাম কারো মুখে শুনেও ছোঁয়া কোনো রেসপন্স করলো না। সেই আগের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিয়ের কার্ডের দিকে, কি সুন্দর করে ভালোবেসে বানিয়েছে কার্ডটা! আজ এই কার্ডে ওর নাম থাকার কথা! আজ তো ওর হাতে মেহেদীর রঙে রঙিন হওয়ার কথা, আজ তো ওর প্রিয় মানুষটির হলুদে নিজের শরীর ছুঁয়ে যাওয়ার কথা! তাহলে আজ ওর জায়গায় অন্য কেউ কেনো.!?? ছোঁয়ার নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হলো। গিটার হাত থেকে ফেলে রেলিঙের থেকে নিচে তাকালো চার তলা থেকে পড়লে কি সে মুক্তি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে!.? ছোঁয়া আর কিছু ভাবতে পারলো না লাফ দিতে গেলেই কেউ একজন ওর হাত ধরে টান দিয়ে রেলিঙ থেকে নিচে ফালিয়ে দিল।

ছোঁয়া ছাঁদে পড়ে হাতে ব্যথা পেলো।তাও কোনো শব্দ না করে উপরে তাকালো।

মেঘলা রেগে বলে উঠলো, ‘ তোমার সমস্যা কি!!.? ভয় বলতে কি কিছু নেই! আজ যদি কিছু হয়ে যেত.? এটা কেমন পাগলামি ছোঁয়া! তুমি বাচ্চা না।রেলিঙের উপর এভাবে কেউ বসে!..?।

ছোঁয়া চোখের পানি মুছে এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল।

মেঘলা ছোঁয়ার পাশে বসলো।

ছোঁয়া নিজেকে সামলাতে না পেড়ে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে শুরু করলো।
আজ যে ওর মহুয়াকে খুব বেশি প্রয়োজন কোথায় আছে মহুয়া!…? ও কি বেঁচে আছে.?

মেঘলার নিজেরও কান্না পেলো, এই চঞ্চল মেয়েটার জীবন কেনো এমন হলো! ভালোবাসা তো পাপ নয় তবুও কেনো এতো যন্ত্রণা দেয়!.?। এই যে চোখের সামনে প্রিয় মানুষের বিয়ে দেখার চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। এটা যে মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়েও কষ্টের। অথচ বিপরীত মানুষটি কতো আনন্দে আছে নতুন হবু বউ নিয়ে। কথায় বলে না” যেই পুরুষের নাকে লেগে আছে হাজারো নারীর ঘ্রাণ সেই পুরুষ কিভাবে বুঝবে এক নারীর টান।” আজ জেনো নির্জনের মাঝে সেই সব পুরুষদের খুঁজে পেলো মেঘলা।

মেঘলাঃ তোমাকে নিতে এসেছে তোমার মামা মামী নিচে চলো।
ছোঁয়া নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।
মেঘলাঃ লম্বা করে শ্বাস নাও। তুমিও দেখিয়ে দাও তুমি দুর্বল নও। সে পারলে তুমিও পারো প্লিজ ছোঁয়া তোমাকে আর এভাবে দেখতে পারছি না। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি নির্জ….
ছোঁয়াঃ প্লিজ ভাবি ভাগ্য আমার খারাপ আমি কেনো অন্য কাউকে দোষ দিব! সে আমার নয় আমি মেনে নিয়েছি আমার নিয়তি। আমি দুর্বল নয় তার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়ে ছিলাম। তুমি মামা-মামী কে বলো আমি আর আমার আম্মু কাল সকালে আসছি।
মেঘলাঃ তুমি আসবে এটাই অনেক ছোঁয়া নিজেকে শক্ত করো। নিজেকে সময় দাও, নিজের কাজে মন দাও। আজ কতোদিন হসপিটাল যাও না, এভাবে অনিয়ম করলে প্যাশেন্টের কি হবে.?
ছোঁয়া বুঝলো মেঘলা কথা ঘুরিয়ে ওকে এই যন্ত্রণার দুনিয়া কিছু সময়ের জন্য ভুলাতে চাচ্ছে!
ছোঁয়া হাসলো…
মেঘলার ফোন বেজে উঠলো, ফোনে তাকিয়ে দেখে শ্রাবণ কল দিয়েছে।
মেঘলা ফোন কেটে ছোঁয়ার দিকে তাকালো।

ছোঁয়া বসা থেকে উঠে মেঘলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
ছোঁয়াঃ উঠে আসো প্রেগন্যান্ট অবস্থায় রাতে ছাঁদে থাকা ভালো না।
মেঘলা সাত মাসের পেটটা নিয়ে ছোঁয়ার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো।

ছোঁয়া নিচে আসতেই আজাদ চৌধুরী আর আমেনা বেগম কে দেখলো।

নিরুপমা চুপচাপ রান্না করছেন তাদের জন্য।
ছোঁয়াদের নতুন বাসার রুম গুলো ছোট ছোট, দুই রুম একটা ড্রয়িং রুম, একটা কিচেন, একটা বাথরুম। দুই মা মেয়ের এতেই সুন্দর চলে যায়। এই প্রথম আজাদ চৌধুরী এসেছেন বোনের বাড়িতে।

ছোঁয়া মামা-মামী কে সালাম দিয়ে কথা বলে মায়ের কাছে রান্না ঘরে গেলো পিছু পিছু মেঘলাও গেলো।

নিরুপমা মেঘলাকে বকা দিয়ে সোফায় বসালো।এই সময় কোনো কাজ করা ঠিক নয়, সাবধানে চলতে হয়। আমেনা বেগম কেও বকা দিয়ে বললেন,’ কেনো মেঘলাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। ‘

আমেনা বেগমঃ বউমা আমার কথা শুনলে তো আপা। আমি নিষেধ করে ছিলাম তাও ছোঁয়াকে নিতে এসেছে।

নিরুপমার হাত থেকে গেলো। নিজেকে সামলে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো, ‘ বুঝলাম না ভাবি।’

আজাদ চৌধুরীঃ আমরা এসেছি তোকে আর ছোঁয়া মাকে নিতে।
নিরুপমা শক্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ ক্ষমা করবেন ভাই আমার মেয়ে কখনো ওই বাড়িতে পা রাখবে না। আপনারা এসেছেন খুশি হয়েছি। এই বিষয় আর কোনো কথা হোক আমি চাই না।’

আজাদ চৌধুরী কিছু বলতে গেলে আমেনা বেগম চোখের ইশারায় নিষেধ করলেন।

ছোঁয়া রান্নাঘর থেকে মেয়ের সব কথা শুনলো। হঠাৎ করে নরম মনের মা টা আজ কতো কঠিন হয়ে গেছে। ছোঁয়া নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে এমন একজন মা পেয়ে,যে কিনা যে কোনো বিপদে ডাল হয়ে এসে দাঁড়ায় ছোঁয়ার সামনে।

মেঘলার ফোনে আবার কল আসলো শ্রাবণের।
মেঘলাঃ হ্যালো
শ্রাবণঃ………
মেঘলাঃ সত্যি!!..???
শ্রাবণঃ……
মেঘলাঃ ঠিক আছে।

কল কেটে মেঘলা আজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ আব্বু আহনাফ দেশে আসছে।’

আমেনা বেগম নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলেন না। আজ কতোগুলো বছর পর ছেলে আসবে শুনলেন।

আমেনা বেগমঃ তুমি মজা করছো তাই না বউমা!.?
মেঘলাঃ না আম্মু সত্যি বলছি, আজ রাতেই আসছে।
আমেনা বেগম খুশিতে কাদতে শুরু করলেন আজ পাঁচ বছর ছেলেটা রাগ,অভিমান আর এক বুক কষ্ট নিয়ে দেশ ছেড়ে ছিল। এই পাঁচ বছর কারো সাথে এক মিনিটও কথা বলেনি। আমেনা বেগম সাথে সাথে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলেন। নিরুপমাও জোর করলো না থাকতে, আহনাফ আসছে তাই। নিরুপমা খুব যত্ন করে নিজের চোখের পানি আড়াল করে নিলো। যেই বাড়ি থেকে এতো অপমানিত হয়ে বের হতে হয়েছে সেই বাড়িতে আর কখনো তাদের ছায়াও পড়বে না।

_______________

রাত দশটায় বাড়ি ফিরলো মহুয়া সাথে সাথে ছোট একটা বাচ্চা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মহুয়া কে। আদুরে গাল গুলো মহুয়ার কাঁধে রেখে বলে উঠলো, ‘ মাম্মা ডিম আমাতে মেরেতে..’

বাচ্চাটার সকল অভিযোগ শুনলো মহুয়া মন দিয়ে। তারপর কাঁধ থেকে মাথা তুলে গালে পাপ্পি দিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমার আলভি আব্বুকে খালামুনি মেরেছে!? খালামুনিকে ইচ্ছে মতো মেরে দিব আম্মু।’
আলভি বুঝদার বাচ্চার নতো মাথা দুলালো।

পেছনে কোমরে হাত দিয়ে কালি মাখা মুখে দাঁড়িয়ে আছে মিম।এক তো ওকে ডিম বলেছে, ওর এতো সুন্দর নামটাকে ডিম বানিয়ে দিল!! সাথে ও ঘুমিয়ে ছিল এই বিচ্ছু গিয়ে সারামুখে কালি মেখে খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। মিম আয়নায় নিজের মুখ দেখে শুধু রেগে তাকিয়েছে তাতে এই ছেলে মাকে দেখে অভিনয় শুরু করেছে।

আলভি মিমের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে চোখ মারলো তাতে মিমের মুখ হা হয়ে গেলো। এই ছেলে সারাদিন টিভি দেখে বাঁদর হয়ে যাচ্ছে।

মহুয়া মিমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,’ তোর এই অবস্থা কেনো!.?’
মিমঃ তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো।সব তো আমার নামে বিচার দিল, নিজে কি করেছে সেটাও বলুক।

মিমের রাগী ধমকে ভয়ে আলভি মায়ের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো এক চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইলো মিমের দিকে।

______

রাবেয়া বেগম মহুয়ার জন্য খাবার গরম করে ডাকলো।

মহুয়া ফ্রেশ হয়ে আলভিকে নিয়ে টেবিলে বসলো।
মহুয়াঃ তোমরা খেয়েছো।
রাবেয়া বেগমঃ মিম খেয়েছে।
মহুয়াঃ আর তুমি.? মা কতোবার নিষেধ করেছি আমার জন্য অপেক্ষা কর না, আমার আসতে রাত হয়ে যায়।
রাবেয়া বেগমঃ তুই বুঝবি না মায়ের কি টেনশন হয় সন্তানের জন্য। সারাদিন কি খেইলি না খাইলি নতুন শহরে একা এতো রাতে অফিস থেকে একা আসতে হয়।
মহুয়াঃ মা নতুন কোথায় আজ পাঁচ বছর এই শহরে, তোমার এখনো নতুন মনে হয়। আসো বসো আগে খেয়ে নাও।

আলভি চুপচাপ তাকিয়ে দেখছিল।। মা মেয়ের কথা শুনছিল। সে তো কিছুই বুঝে না শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।

মহুয়া খাওয়া শেষ করে রুমে আসলো, মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ।

” কতোদিন এই চার দেওয়াল আমাকে বন্ধি করে রাখবে! তোমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে!,পালিয়ে বেড়ালেই কি বাঁচা যায়! ওই জেল খানায় চার দেওয়াল আমাকে আটকে রাখতে পারেনি ফিরেছি তোমার দরজায়। আমার সন্তানের কাছে”

মহুয়ার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেলো ভয়ে, ঘৃণায় কেঁপে উঠল সারা শরীর। তাহলে কি ও সত্যি দেখেছিল সকালে!! মাহিন ছাড়া পেলো কবে..?আর ওকে খুঁজে পেলো কিভাবে!.? পাঁচ বছর আগের সেই কালো অধ্যায় কি আবার জীবনে আসতে যাচ্ছে!! ? মহুয়া আলভিকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে উঠলো, ‘ এই সন্তান আমার আর…

চলবে…

(যারা সিজন 1 পড়েননি আগে সিজন 1 পড়লে বুঝতে ভালো হবে।.)

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৯ এবং শেষ পর্ব

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৯) [ সমাপ্তি পাতা ]

অনুভবের বলা কথা গুলো একেবারেই বুঝল না সায়রা। ছেলেটা হুট করেই এতটা খোলামেলা হলো কেন? এই ভাবনাটি সেদিন রাতে ঘুমাতে দিল না সায়রাকে। তবে সকাল হতেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল। জুহাদের ছোট ভাই আছে। নাম জাবেদ। ছেলেটা তুখোড় মেধাবী। আর এই মেধার পেছনেই নিজের জীবনের বত্রিশটি বছর শেষ করেছে। অথচ বিয়ের ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহ ছিল না। কিছু দিন হলো সে ঘর মুখী হয়েছে। শুধু ঘরমুখীই নয়, একেবারে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে। আর তার পছন্দের তালিকায় সবার ওপরে সায়রার নামটি ওঠে এসেছে। সবটা বুঝে সায়রার মাথাটা খোলসা হওয়ার উপক্রম। ছেলেটা সব সময় চুপচাপ স্বভাবের ছিল। তাই ওদের তেমন কথাও হয় নি কখনো। দুজন এখন ছাদে অবস্থান করছে। জাবেদকে দেখলেই বোঝা যায় ছেলেটা কতটা নম্র স্বভাবের। এই যে এখন, সায়রার পাশে দাঁড়িয়ে। অথচ চোখ তুলে দেখছে না একবার ও। সময় অনেকটা চলে যাওয়ায় সায়রা বলল,”আপনার সাথে আমার সেভাবে পরিচয় নেই। শুধু জানতাম ভাবির ভাই। যে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই বুঝে না।”

জাবেদ শুরুতেই উত্তর করল না। বরং কিছুটা সময় নিয়ে বলল,”ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলাম। নানান বাঁধা থাকা সত্ত্বেও বার বার প্রমাণ করেছি নিজেকে। পড়াশোনা শেষ করে বি সি এস দিয়েছি। প্রথম বারেই সেরাদের কাতারে ওঠে এসেছি। সব মিলিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় হয়ে ওঠে নি। তাই কখনো আমাদের সেভাবে কথা হয় নি।”

“কিন্তু আমাকেই কেন পছন্দ?”

“পছন্দের জন্য কোনো বিশেষ কারণ থাকতে হয় কি?”

এহেন প্রশ্নের কারণে থমকে যায় সায়রা। বাতাসে তার চুল গুলো ওড়ে যাচ্ছে। জাবেদ ফের বলে,”আমার বোনের ননদ আপনি। সংগত কারণেই আমাদের সেভাবে কথা বার্তা হয় নি। তাই চেনা জানা টা হয়তো কম। তবে আপনাকে আমি অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করেছি।”

“কেমন?”

“বিশেষ ভাবে নয়,তবে আপনার আচরণ গুলো খেয়াল করতাম। চালচলন দেখেছি। সেক্রিফাইজ, কথা বলার ধরন সব কিছু মনে প্রভাব রাখার মতন।”

সায়রার মাথা ব্যথা করছে। ও জাবেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। কথা ঘুরিয়ে বলল,”চলুন নিচে যাই। প্রচণ্ড রোদ আজ।”

সায়রা নিজ ঘরে তো ফিরল তবে শান্তি পাচ্ছে না। বাড়ির সবাই মোটামুটি রাজি। ও বাড়ি থেকেও প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে মাথা কাজ করছে না। কীভাবে সামাল দিবে সব এটাই বুঝতে পারছে না ও। সেদিন পুরো সকালটা নিজ ঘরে পার করল ও। দুপুরের দিকে জুথি এসে দরজায় নক করল। দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল।

“তোর কী শরীর খারাপ লাগছে?”

মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে কথাটা বলল জুথি। সায়রা জবাব না দিয়ে চেয়ে রইল।

“হ্যাঁ রে সায়রা। তোর আবার কী হলো বল তো। সব ঠিক আছে বোন?”

“কিছু হয় নি ভাবি।”

“জাবেদের বিষয়ে ভেবেছিস?”

“আপাতত না।”

“কেন?”

“আমার ভালো লাগছে না কিছু।”

“তুই কি বিয়ে করবি না আর কখনো?”

“জানি না ভাবি। আমার ভালো লাগে না কিছু।”

সায়রা ধপ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। জুথি ওর পায়ের কাছটায় বসল।

“জাবেদ কিন্তু অন্যদের তুলনায় ভীষণ ভালো। নিজের ভাই দেখে প্রশংসা করছি এমন নয়। ওকে ভেতর থেকে চিনলে, না করতে পারবি না।”

সায়রা এবার ও জবাব দিল না। জুথিই বলতে লাগল,”ভাইটা আমার বিয়ে করে নি শুধু তোর জন্য। শুরু থেকেই ওর বিষয় গুলো বুঝতে পারতাম। তবে বলার মতন পরিস্থিতি, সাহস ছিল না। তোর ওপর দিয়ে কম ঝড় তো গেল না। আমিরার নামে প্রপার্টির অংশ থাকায় বাহাদুর ভাই যা যা করলেন…. এই অবধি বলে থামল জুথি। খেয়াল করে দেখল সায়রার তেমন একটা মনোযোগ নেই।

“এই সায়রা।”

ধাক্কা পেয়ে মনোযোগ ফিরল সায়রার। ওঠে বসল। তারপর হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে বলল,”জীবন এত অসহনীয় কেন ভাবি?”

“তুই এখনো সাঈদ কে নিয়ে ভাবিস?”

সাঈদ নামটা শুনে সায়রার ভেতর থেকে কোনো উত্তেজনা এল না। ছেলেটার প্রতি ওর অনুভূতি’রা আর ডানা মেলতে চায় না। সে নিশ্চয়ই বউ, সংসার নিয়ে ভালো আছে। থাকার ই কথা। এত গুলো বছর পার হলো। সায়রার মনে এখন অন্য চিন্তা। ওর মস্তিষ্ক বড়ো দোটানায় ভুগছে। কোনটা ঠিক হবে আর কোনটা ভুল হবে,কিছুই যেন খেয়াল হচ্ছে না।

বিয়েটা সায়রার মতামতের জন্য আটকে গেল। ও সময় চেয়েছে। দেওয়া ও হয়েছে। সবাই আজ বিদায় নিবে। জাবেদের মুখটা শুকনো। চোখে ব্যথা। সায়রার বুকটা হু হু করে ওঠল। ছেলেটার দৃষ্টি অনেক কিছু বোঝাতে চাইল। তবে সায়রা সেসব বুঝেও না বোঝার ভান করে রইল। সবাই যখন চলে গেল, সায়রা এল নিজ ঘরে। এসে ঘুমিয়ে নিল। ঘুম ভাঙল একদম বিকেল চারটায়। মেজাজ তখন অনেকটাই ফুরফুরে। আমিরা এসে চা দিয়ে গেল। তারপর শুধাল,”কোথাও যাবে মিমি?”

“বইয়ের দোকানে।”

“তুমি আবার কবে থেকে বই পড়া শুরু করলে?”

জবাবে কিছুটা হাসির দেখা মিলল সায়রার অধরে। আমিরা মিমির দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে চলে গেল। এই নারীটিকে বোঝা তার কর্ম নয়।

অনুভব তখন নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। বিষণ্নতা মেখে আছে মুখশ্রীতে। ক্ষণে ক্ষণে বুকের ভেতর থেকে তপ্ততা নামছে। ও মন ভরে সমীরণ টেনে নিল। দেখল কলিং বেজে চলেছে। বাসায় আজ কেউ নেই। ও একা। দরজা খুলতেই দেখতে পেল পার্সেল এসেছে। অনুভব ভীষণ অবাক হয়ে পার্সেল রিসিভ করল। রুমে এসে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই। আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। অনুভব চটপট প্যাকেটটা খুলে নিল। দেখল একটি উপন্যাসের বই। আর তার থেকেও বেশি অবাক হলো চিরকুট পেয়ে। চিরকুটে লেখা,’ঋণ শোধ করতে হয় অনুভব। তাই তোমার ঋণ শোধ করতে পাঠালাম।’

অনুভবের চোয়াল ভাঙার উপক্রম। সায়রা তাকে বই পাঠিয়েছে! ঋণ শোধার করার জন্য। ওর চোখ, মুখ আঁধারে ডুবে গেল। তৎক্ষণাৎ কল করল। রিসিভ হলো এক সেকেন্ডেই।

“এ কেমন ঋণ শোধ সায়রা?”

সায়রা এক গাল হেসে বলল,”ঋণ শোধ হওয়ায় খুশি হও নি?”

অনুভব জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। এই মেয়েটাকে বুঝতে পারে না ও।

“এখন রাখছি অনুভব।”

“এমন ভাবে বলছ, যেন পরে আবার কল করবে।”

“কেন, পরে কল করলে খুশি হবে না?”

“তুমি বিয়েটা করে নিবে তাই না?”

পাল্টা প্রশ্ন পেয়ে সায়রা অবাক হলো না। ছেলেটার ভেতরে এখন ঝড় চলছে। সে জেনেছে জাবেদের সাথে সায়রার বিয়ের কথা চলছে।

“এত জেনে কী করবে অনুভব? তার থেকে বরং বই পড়ো। বইমেলা থেকে তুমি আমায় বই কিনে দিয়েছিল। ঋণের বোঝাটা বইতে পারছিলাম না আর।”

ঠিক তারপর ই কল টা কেটে গেল। অনুভব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। সত্যি বলতে ওর কান্না পাচ্ছে। হাউমাউ করে কাঁদতে পারলে ভালো লাগত। এই মেয়েটা এত য ন্ত্র ণা দিল ওকে।

দুদিন পর সায়রার নাম্বার থেকে কল এল। অনুভব তখন উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে একেবারে দেবদাস হয়ে গেল। কলটি রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে সায়রা বলল,”তুমি একদম ই বদলাও নি অনুভব। একদম ই বদলাও নি। বইটা এখনো দেখো নি তাই না?”

অনুভব জবাব দিতে পারল না। এই বইটা দেখানোর জন্য সায়রা এমন কেন করছে? ও প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল। তবে কলটি কেটে গেল। অনুভব দু বার কল করল। তবে সায়রা কেটে দিল। ও বুঝতে পারল, আর কল করে লাভ নেই।

তারপরের দুটো দিন অনুভবের জন্য সবথেকে বেশি চ্যালেঞ্জিং হলো। সে বইটা খুলেছে, দেখেছে। তবে আহামরি কিছু তো বুঝতে পারে নি। আর এই না বুঝতে পেরে ছেলেটার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। সে এখন কফি শপে বসে আছে। আর বই নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে সায়েম। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইটি দেখে বলল,”স্যার, ম্যাডাম আর কোনো ক্লু দেয় নি?”

“না।”

“কোনো ক্লু না?”

“না সায়েম। কোনো ক্লু দেয় নি।”

“ব্যাপারটা জটিল।”

“অনেকবেশি জটিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

অনুভব মাথা চেপে ধরল। কপি আসতেই সায়েম বলল,”স্যার কফি খান। মাথা ঠান্ডা হবে।”

“হট কফিতে মাথা ঠান্ডা হয় সায়েম?”

“উফস,সরি স্যার। আমি কোল্ড কফি আনতে বলি।”

“দরকার নেই।”

অনুভব কফি কাপ তুলে নিল। এক চুমুক দিয়ে বইটার দিকে তাকাল। সায়েম হুট করেই চেচিয়ে ওঠল।

“আমার মাথায় একটা বিষয় এসেছে স্যার।”

“কী?”

“আমার মনে হয় ম্যাডাম আপনাকে তার বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে।”

অনুভব চোখ ছোট করে চাইল। সায়েম বলতে লাগল,”আপনি তো বললেন জাবেদ নামের ছেলেটার সাথে ম্যাডামের বিয়ের কথা চলছে। ম্যাডাম তো অন্যদের থেকে আলাদা। তাই আপনাকে বিয়ের কার্ড না দিয়ে একেবারে বই পাঠিয়েছে। বইয়ের ওপরের অংশটি দেখুন, একটি ছেলে আর মেয়ে বসে আছে। আমি সিওর ম্যাডাম এভাবেই আপনাকে তার বিয়ের দাওয়াত পাঠিয়েছে।”

সায়েমের কথা শুনে অনুভবের ইচ্ছে করল ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। ইদানীং এত বেশি ফানি কথা বার্তা বলে!

“স্যার, আপনি বিশ্বাস করলেন না?”

“তুমি চুপ করো সায়েম। চুপ করো একটু।”

সায়েম চুপ করে রইল। অনুভব ভাবতে লাগল। একটা বই দিয়ে কি এমন বোঝানো যেতে পারে?

সপ্তাহ গেলেও বইয়ের রহস্য উন্মোচন করতে পারল না অনুভব। ছেলেটা যেন শুকাতে শুরু করেছে। তখন বিকেল বেলা। সায়রার নাম্বার থেকে কল এল। অনুভব নিজের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে।

“কোথায় তুমি?”

“ছাদে।”

“নিচে আসো।”

“কেন?”

“আসতে বলেছি। দরকার আছে।”

“বিয়ের দাওয়াত দিবে সায়রা? যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে প্লিজ আমায় যেতে বলো না। আমি কেঁদে ফেলতে পারি।”

সায়রার ইচ্ছে করল অনুভবের কানটা ধরে নিচে নামিয়ে নিতে। এ ছেলে, কেমন কথা বলছে! ও দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,”এখনই নিচে আসবে তুমি। আমি পাশের মাঠে আছি।”

অনুভব মাঠের কাছে আসতেই সায়রাকে দেখতে পেল। মেয়েটা সাদা রঙের পোশাক পরেছে। তাকে শুভ্র পরির মতন লাগছে। ওর খুব কান্না পেল। কেঁদে কেঁদে বলতে ইচ্ছে করল,’শুভ্র পরি কেন তুমি আমার হলে না। একটু আমার হয়েই দেখো না। প্লিজ শুভ্র পরি, একটু ভালোবাসা দাও।’ কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছে অনুভব! ওর আসলেই মাথার ঠিক নেই। সায়রা দেখল বিড়াল পায়ে আসছে অনুভব। চেহারায় মলিনতার দেখা মিলছে। তবে ছেলেটার মধ্যে অন্য রকম সৌন্দর্য তখনো বিরাজমান। অধিক লম্বা হওয়ায় কেমন একটা ফিল হচ্ছে। সায়রা নিজ থেকেই এগিয়ে এল। একদম বরাবর এসে দাঁড়াল। এদিকে অনুভবের চোখ যেন মৃত। কেমন তার দৃষ্টি।

“বইটা দেখেছিলে?”

“কোন বই সায়রা? আমার তো কোনো বইয়ের কথা মনে আসছে না।”

“স্বাভাবিক ভাবে কথা বলো অনুভব। এমন পাগল পাগল ভাব নিও না প্লিজ।”

“আমি আর কখনো স্বাভাবিক হব না। তুমি বিয়ের কার্ড দিবে তো? দাও, নিয়ে যাই আমি। ঘরের মধ্যে বড়ো ফ্রেমে বন্দী করে রাখব।”

সায়রা সত্যিই অবাক হচ্ছে। এই অনুভবকে চিনতে পারছে না। ও ঠোঁট কামড়ে বলল,”বইটা দেখে কী বুঝলে?”

“কী বুঝব?”

“আমার মাথা।”

“সেটা তো তোমার সাথেই আছে। আমাকে তো দেও নি সায়রা। যদি দিতে তাহলে মাথায় তুলে রাখতাম। আমার মাথার থেকেও বেশি ওপরে থাকত তোমার মাথা।”

“উফ অনুভব!”

অনুভবের ভেতর থেকে হতাশা শ্বাস নেমে এল। আকাশ ডেকে ওঠেছে। সায়রা মাথা উঁচু করে তাকাল। যখন তখন বৃষ্টি হতে পারে। দৃষ্টি ফিরিয়ে অনুভবের দিকে চাইল।

“আমার দিকে তাকাও অনুভব।”

“তাকাতে পারব না সায়রা।”

“তাকাও।”

“পারব না। পারবা না তাকাতে। তোমার চোখের দিকে তাকালে আমি নিশ্চিত অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।”

সায়রা থেমে গেল। এ ছেলেকে এখন আসলেই পাগল মনে হচ্ছে। ও আর জোর করল না।

“বইটা দেখে কিছু অনুভব করো নি?”

“এই বইয়ের মধ্যে কী আছে? কেন বার বার বইয়ের কথা বলে যাচ্ছ।”

সায়রা চুপ করে রইল। তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বলল,”তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই অনুভব। কোনো কথা নেই। বইয়ের নামটা দেখেও কিছু বুঝতে পারলে না।”

সায়রা সত্যি সত্যি রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। অনুভব হতাশ। আকাশ ডেকে ওঠছে। দু এক বিন্দু জল এসে পড়ছে চোখে মুখে। বইটার নাম স্মরণ করল অনুভব। ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’। মনে মনে কয়েকবার ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ উচ্চারণ করল ও। একবার, দু বার, তিনবার, এভাবে সাত বার উচ্চারণ করে থেমে গেল। সহসাই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠল। ফট করে চোখ মেলল। বিকট গর্জন করে বৃষ্টি নেমে এল পৃথিবীর বুকে। আর তারপর, তারপর ভিজিয়ে দিল সমস্ত শরীর। অনুভব খেয়াল করল সায়রা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ও এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করল না। ছুটে গেল বাতাসের গতিতে। মাত্রই মাঠ ছাড়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল সায়রা। অনুভবের পায়ের শব্দে ঘুরে তাকাল। বৃষ্টির জলে মেয়েটা ভিজে একাকার হয়ে গেছে। বিকেলের এই হঠাৎ বৃষ্টিতে সায়রার সৌন্দর্য যেন আরো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ভেজা ঠোঁট ভীষণ ভাবে টানছে। অনুভবের অধর প্রসারিত হলো। ছেলেটার এমন দৃষ্টিতে সায়রা বিস্মিত হয়ে পড়ল। এর থেকেও বেশি বিস্মিত হলো অনুভব যখন একদম শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বুকের মাঝে মিশিয়ে নিতে চাইল। স্বাভাবিক ভাবেই সায়রা তখন অনুভূতিহীন। আর অনুভব তখন চিৎকার করে বলল‍,”বইয়ের রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছি সায়রা। পেরেছি আমি। আই লাভ ইউ সায়রা, আই লাভ ইউ। এভাবেই হৃদয়ের গোপনে রেখে দিও প্লিজ। কথা দিলাম, তোমার প্রতিটা বিকেলের মুগ্ধতা হয়ে নামব আমি। বৃষ্টির মতন মিশে যাব। ভালোবাসায় ভালো রাখব। কথা দিলাম সায়রা, কথা দিলাম তোমায়।”

অনুভব ওমন করেই মেয়েটিকে জড়িয়ে রইল। এদিকে সায়রার দু চোখের জলের সাথে বৃষ্টির জল মিশে একাকার হয়। ছেলেটা কি জানে, কত যুদ্ধ করে সায়রা আজ নিজের অনুভূতির কথা জানিয়েছে?

~সমাপ্ত

কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৮

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৮)

“অনুভব, তুমি আমায় এভাবে কল করে জেরা করো কেন বলো তো?”

“এটি পুরো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার সায়রা। আমি কাকে কল করব, না করব এটি নিশ্চয়ই তোমাকে বলব না।”

“সেটি তোমার ব্যক্তিগত তখন হতো যখন তুমি যাকে কল করেছ, সেই ব্যক্তিটা আমি না হতাম।”

কথাটি মন দিয়ে শুনল অনুভব। সায়রা এপাশ থেকে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ছাড়ল।

“কল কেন করেছ?”

“জব কেন ছাড়লে?”

“সেটা তুমি জানো।”

“না, জানি না আমি। বলো জব কেন ছাড়লে?”

“এটি আমার ব্যক্তিগত বিষয়। তোমায় কেন জানাতে হবে?”

অনুভব বুঝল, সায়রা তার কথাটাই ফিরিয়ে দিল। একই ভাবে অনুভব বলল,”বিষয়টা তখন তোমার ব্যক্তিগত হতো, যদি না কোম্পানির সাথে আমি জড়িত থাকতাম।”

“আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিলে?”

“একটু আগে তুমিও সেটা করেছ।”

সায়রা চুপ হয়ে গেল। অনুভব কিছু সময় পূর্বে জেনেছে সায়রা জবটা ছেড়ে দিয়েছে। অথচ মাত্র দু সপ্তাহ হয়েছে সে জয়েন করেছিল।

“সায়রা, আমাকে এতটাই অসহ্য লাগে তোমার?”

“এখানে অসহ্য লাগার কোনো বিষয় নেই অনুভব।”

“তবে?”

“তুমি ইচ্ছে করে জবটা আমার কাছে এনে দিয়েছিলে। তাই না?”

অনুভব কথা বলল না। সায়রা ঠিক ধরেছে। অনুভব ইচ্ছে করেই লোক দিয়ে সায়রার কাছে জবের অফার রেখেছিল। যাতে করে মেয়েটার সান্নিধ্য মিলে। ভালো টাকার অফার দেখে সায়রা ও রাজি হয়ে যায়। অথচ তখনই মাথায় আসে নি, কোনো রকম শর্ত ছাড়া কীভাবে কাউকে জবে নেওয়া হয়। ফোঁস করে দম ফেলল অনুভব। ফোনের এপাশে থাকা নারীটি বলে ওঠল,”সময়টা পেরিয়ে গেছে অনুভব।”

“অথচ আমি সেই ছয় বছর আগেই আটকে আছি।”

কথাটার সাথে কি,ব্যথা মিশে আছে? সায়রার কেন যেন মনে হয় ছেলেটার হৃদয়ে অনেকটা ব্যথা জমে আছে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয়। অথচ সে জীবনে বড়ো ঝড় পেরিয়ে এসেছে। জুথির বাবা বাড়ি থেকে হওয়া অশান্তিটুকু সায়রার জীবনটাই বদলে দিল। জুথির আচরণ ও তখনই কেমন মিইয়ে গিয়েছিল। পারিবারিক অশান্তিতে ঝিমিয়ে গিয়েছিল সকলে। আর তারপর বাহাদুরের আক্রমণ। আমিরাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় সায়রা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে ক্ষত হয়েছিল দেহ। সবটা স্মরণ হলেই সায়রার বুক কেঁপে ওঠে। অনুভবের প্রতি অনুভূতি জন্মানোর সুযোগ ই মিলে নি। তবে এটা সত্য যে চাইলেই ছেলেটার থেকে অনেক রকম সাহায্য নিতে পারত ও। কিন্তু সেটি অন্যায় হতো। সায়রা চায় নি ছেলেটার সাথে ওমন অন্যায় করতে। আর তারপর যখন সুযোগ মিলল, তখনই দেশ ছেড়ে গেল ও। অনেকটা দ্রুত ঘটেছিল সবটা। সেই ছোট্ট সময়টুকু সায়রার জীবনটাই বদলে দিল।

জাফরিনের যাওয়ার সময় হয়েছে। এতদিন থাকল সে। পরিবারটা ওর বড়ো আপন মনে হয়। তবে এক বুক কষ্ট নিয়ে সে বিদায় জানাল। সব থেকে কষ্টের বিষয় হলো কোথাও মাহিমকে দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটা বিদায় বেলায় দেখা দিল না। জাফরিন নিজের কান্না আটকিয়ে রেখেছে। গাড়ি চলছে। দূরত্ব বাড়ছে। জাফরিনের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে গাড়ি এয়ারপোর্টে এসে থামল। ব্যাগ পত্র নিয়ে নামল জাফরিন। আর তারপর এগিয়ে যেতে লাগল। এদিকে মাহিম আগে থেকেই এয়ারপোর্টে অবস্থান করছে। ওর ভেতরটা ভীষণ তপ্ত হয়ে আছে। রাগ, অভিমান থেকে মেয়েটিকে বিদায় জানাবে না ভেবেছিল। তবে পারল না। মেয়েটিকে দেখার লোভ ওকে টেনে নিয়ে এল।

মাহিম কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পা থেমে গেল জাফরিনের। ছেলেটা এগিয়ে এল। বিধ্বস্ত মুখখানি। এ নাকি ডাক্তার! জাফরিনের হাসি পেল। চোখের কান্নাটা দমিয়ে রেখে বলল‍,”তোমাকে পাগল লাগছে মাহিম। ডাক্তার ছেলেকে এভাবে মানায় না।”

“তাতে তোমার কী জাফরিন? তুমি তো পছন্দ করো না আমায়।”

জাফরিন উত্তর না দিয়ে সরল চোখে তাকাল। নিজেকে আটকে রাখতে ব্যর্থ হলো মাহিম। চারপাশের মানুষজনকে অবজ্ঞা করে জড়িয়ে ধরল মেয়েটিকে। উষ্ণতা পেয়ে জাফরিনের গাল বেয়ে এক বিন্দু অশ্রু নেমে গেল। মাহিম ভাঙা গলায় বলল,”অপেক্ষা করব জাফরিন। আমি জানি ফিরবে তুমি। ফিরবে তুমি জাফরিন।”

কি এক দায় থেকেই ছেলেটার পিঠে হাত রাখল জাফরিন। কান্না আটকে বলল,”সময় হয়ে গেছে। যাচ্ছি আমি। নিজের যত্ন নিও ডাক্তার। তোমাকে এমন বিষণ্ন মানাচ্ছে না।”

আর তারপরই চলে গেল জাফরিন। সে দিকে তাকিয়ে থেকে মাহিমের দু চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। হয়তো জাফরিন ফিরবে, কিংবা ফিরবে না। তবু আশায় থাকবে মাহিম। নিজের ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায়।

মাহিম ফিরল একটু রাত করে। সায়রা তখনো ঘুমোয় নি। সে অপেক্ষা করছিল। মাহিমের সাথে চোখাচোখি হলো।

“সাথে চল।”

কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সাথে গেল মাহিম। ওরা ছাদে এসে দাঁড়াল। আকাশ মেঘলা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।

“অনেক বড়ো হয়েছিস মাহিম। সবটা বোঝার মতন বোধ আছে জানি। আমার জীবন সম্পর্কে সবটাই তোর জানা। কত গুলো দুঃখ সয়ে আজও আমি এখানে দাঁড়িয়ে।”

“পিপি, তুমি আমিরার জন্য অনেক কিছু সেক্রিফাইজ করেছ। কিন্তু আমি কার জন্য করব?”

“নিজের জন্য। নিজের জন্য করতে হবে। জাফরিন যদি ফিরে আসে, তবে সবথেকে বেশি খুশি আমি হব। তবে মাহিম, বিপরীত জিনিসটাও ভাবতে হবে। নিজেকে ভে ঙে ফেলা আসলেই ঠিক নয়।”

মাহিম মৌন হয়ে রইল। তার ভেতরটা ক্ষত হচ্ছে শুধু। আলগোছে ওর গাল ছুঁয়ে দিল সায়রা। বয়সের তুলনায় ওর ম্যাচিউরিটি একটু বেশি।

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে কি? করে না বোধহয়। সায়রা নিজের ঘরে শুয়ে ছিল। আজ তাদের বাসায় মেহমান আসবে। এটি সে জানত না। শরীরটা কেমন মেজমেজ করায় ঘরে ছিল। আমিরা এসে দরজায় নক করল।

“মিমি, বসে আছ কেন? বাড়িতে মেহমান এসেছে।”

“কারা এসেছে রে?”

“জুহাদ মামা’রা এসেছে।”

জুহাদের কথাটি শুনে একটুখানি অন্ধকার ছুঁয়ে গেল সায়রার মুখখানি। সে অতীতের কথা স্মরণ করলেই কষ্ট পায়।

“আর কে,কে এসেছে?”

“ওনাদের বাড়ির সবাই এসেছে।”

সায়রা চটপট ওঠে দাঁড়াল। নিজেকে পরিপাটি করে বের হলো। বসার ঘরে তখন নাশতার আয়োজন করা হচ্ছে। জুথি প্রচণ্ড ব্যস্ত। ওর সাথে সাহায্য করতে লাগল সায়রা।

“ভাবি, একটা কথা বলব?”

“জানি কি বলবি। ওসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। এখন সব ঠিক আছে। আমিরার প্রতি তাদের কোনো বাজে মনোভাব ও নেই।”

সায়রা বুঝে নিয়ে কাজে সাহায্য করতে লাগল। বসার ঘরের সবার মুখ হাসিতে ভরে গেছে। সবাইকে বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছে। বিষয়টা সায়রার মনকে প্রশমিত করল।

আজ সবাই থেকে গেল। তাই আড্ডা দিতে দিতে বেশ রাত হয়ে গেছে। সায়রার চোখটায় ঘুম ঘুম ভাব। ও সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজের ঘরে ফিরল। এসে দেখল অনেক গুলো কল। অনুভবের নাম্বার থেকে। অন্য কেউ হলে সায়রা দিন অবধি অপেক্ষা করত। তবে অনুভব হওয়াতে সে চট করেই নাম্বারটি তে কল করল। রিসিভ ও হলো চটপট।

“সায়রা, সায়রা, এত ব্যস্ত তুমি! কল রিসিভ ও করছিলে না।”

অনুভবের কণ্ঠে উদ্বেগ। সায়রা স্থির গলায় বলল,”এভাবে কেন কথা বলছ?”

“তাহলে কীভাবে বলব বলো।”

কথাটা বলে অনুভব যেন বুক ভরে সমীরণ টেনে নিল। তারপর দুঃখের মতন করে বলল,”আমি কখনো সিগারেট খাই নি সায়রা। মদ ছুঁয়েও দেখি নি। তোমার প্রত্যাখ্যান, অবহেলা সব কিছুর পর ও আমি অন্য কোনো নেশায় নিজেকে ডুবাতে পারি নি। তোমার প্রতি আমার যে নেশা,সেটা পৃথিবীর সব নেশাকেও হার মানায় সায়রা। আমার কোনো জোর নেই। তুমি অন্য কারো হয়ে গেলেও আমি বাঁধা দিব না। তবে তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারব না। সায়রা, তোমাকে পাই বা নাই, আজীবন ভালোবাসাই হবে আমার এক মাত্র লক্ষ্য।”

চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৭

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৭)

মুক্ত সমীরণ এসে পূর্ণ হলো কক্ষটি। সায়রা মুগ্ধ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে। সেই গাছে দুটো পাখি বাসা বেঁধেছে। তারা ঘর করছে ভেবেই ওর মন নেচে ওঠল। ইচ্ছে করল দু চোখ ভরে এদের সংসার দেখে নিতে। অথচ নিজের ঘরের খবর নেই। ঊনত্রিশ বছর বয়সী সে এখনো বিয়ের কথা ভাবতে পারে না। কি এক ব্যথা ছেয়ে যায় সমস্ত শরীর জুড়ে।

জাফরিন এসে দরজায় নক করল। তার মন মস্তিষ্ক ইদানীং চলছে না। খুব কান্না পাচ্ছে। সায়রা ওকে দেখে বলল,”কী ব্যাপার জাফরিন? মুখ ওমন শুকনো কেন দেখায়?”

মেয়েটির মুখ দেখেই সায়রার মায়া হলো। ও এগিয়ে এসে বাহুতে হাত রাখল।

“কিছু হয়েছে?”

জাফরিনের সরল দৃষ্টি। চোখ দুটো বোধহয় ইষৎ ছলছল করছে। সায়রা ওকে নিয়ে বসল। তারপর কিছু সময় চেয়ে রইল।

“জাফরিন, তুমি বলো কী হয়েছে। এমন হয়ে আছে কেন মুখখানি?”

জাফরিনের কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। ও জ্বিভের অগ্রভাগ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। দৃষ্টিতে লজ্জা মিশে আছে। যা সায়রা স্পষ্ট অনুভব করতে পারল।

“আমার কিছু ঠিক লাগছে আপু।”

“সেটির কারণ?”

“আসলে…..

বলে থেমে গেল জাফরিন। ঘটনাটা কেমন করে বলবে সে? এটা বলার মতন তো নয়।

“বলো, জাফরিন। কী হয়েছে? এমন চুপ করে থেকো না প্লিজ।”

“মাহিমের বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি।”

সায়রা ইষৎ থমকাল। জাফরিন হুট করে মাহিমের বিষয়ে কেন বলতে চাইছে? ও ভালো মতন কয়েক দিনের ঘটনা স্মরণ করল। দুজনের মাঝে খুব বেশি কথা বার্তা হতে দেখে নি সে। তবে, তবে কী হতে পারে?
এদিকে জাফরিন মাথা নামিয়ে রেখেছে। ও দ্বিধা হচ্ছে। কিছুতেই কিছু বলতে পারছে না। সায়রা তখনো চেয়ে আছে। ও জানতে চাইছে। দ্বিধা কাটিয়ে জাফরিন কিছু বলতেই চাইছিল। সে সময়েই ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল মাহিম। এসেই জাফরিনের হাত স্পর্শ করল।

“আমার সাথে আসো জাফরিন। কথা আছে।”

“ছাড়ো হাত। তোমাকে নিষেধ করেছি।”

“তর্ক করার মতন সময় নয় এখন। প্লিজ আসো।”

তারপর মেয়েটিকে প্রায় টেনেই নিয়ে গেল মাহিম। পুরো ঘটনায় বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল সায়রা। ওর শরীর শিউরে ওঠল।

জাফরিন কেঁদে ফেলল। মাহিম ওর মুখখানি হাতের মাঝে আটকে নিল। আবেগ মিশিয়ে বলল,”ভালোবাসো তুমি। বলো ভালোবাসো।”

জাফরিন মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। কদিনে ছেলেটার প্রতি ওর মায়া হয়ে গেছে। আর এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জাফরিন আহত।

“কথা বলো জাফরিন। কথা বলো প্লিজ।”

“তুমি আমায় মে রে ফেললে মাহিম। মে রে ফেললে আমায়।”

মেয়েটির আরেকটু কাছে এল মাহিম। ওর চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে।

“এমনটা বোলো না প্লিজ। আমি তোমায় যথেষ্ট ভালোবাসি জাফরিন। অনেক বেশি পছন্দ করি তোমায়। আর তুমিও আমায় ভালোবাসো।”

জাফরিনের কান্নার বেগ বাড়তে লাগল। মেয়েটিকে আলিঙ্গন করল মাহিম। যার ফলে জাফরিনের মাথা ঠেকল বুকে।

“জাফরিন,শুধু বলো ভালোবাসো। বিশ্বাস করো,তোমায় কখনো ছাড়ব না। কখনোই না।”

সায়রা ঘটনাটি বেশ বুঝতে পারছিল। তবে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ওর কাজ পড়ে গেল। তাই বের হতে হলো তাকে। আর সবথেকে বিস্মিত হলো মিটিং এ অনুভব কে দেখে। তার থেকে বেশি অবাক করল ছেলেটির ভাব এমন যে ওকে চেনে না অবধি!

সুনেরাহ আর অনুভব খুব দ্রুতই একটি ব্র্যান্ড লঞ্চ করতে যাচ্ছে। সায়রা এখানে আসার পর একটি কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে। সেই কোম্পানির সাথে অনুভব নতুন কিছু করতে চলেছে। মিটিং শুরু হলো। অনুভবের কথা বার্তা দেখে সায়রা অবাক হয়। এই সেই অলস অনুভব! ওর মনে হয় না। কিছুতেই ছেলেটাকে মেলাতে পারে না ও। সায়রা বোধহয় প্রথম বারের মতন নিজের কাজের প্রতি আগ্রহ হারাল। কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না। ব্রেক টাইমে কফি আনতে গেল। কফি তৈরি। কাপটি তুলবে সেই সময়েই খপ করে কাপটি নিয়ে নিল অনুভব। চুমুক দিয়ে বলল,”এত মিষ্টি খাও তুমি!”

“কারণ আমি তোমার তেঁতো নই।”

“আমি তেঁতো?”

“অবশ্যই।”

“কীভাবে?”

“সব ভাবে।”

সায়রা ফের আরেক কাপ কফি বানাতে দিল। অনুভব মেয়েটিকে ভালো মতন দেখে নিয়ে বলল,”তোমার মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে সায়রা।”

ছেলেটার কথায় ভ্রু কুঞ্চিত করে চাইল সায়রা। অনুভব আরেকটু মজা নিতে বলল,”দেখো, তোমার কপালে ভাঁজ পড়েছে। একটা নয়, পুরো দুটো ভাজ। একটু মুটিয়েও গেছ। চোখে মুখে ক্লান্তি দেখা যাচ্ছে। তোমার সত্যিই বয়স হয়েছে সায়রা।”

সায়রার এত রাগ হচ্ছে। এদিকে অনুভব কথা বলত‍ে বলতে ওর মুখের কাছাকাছি চলে এল। দুজনের দৃষ্টি একত্র হলো। অনুভবের চোখে খুশি খেলা করছে। সায়রা দৃষ্টি নামিয়ে বলল,”আমাকে রাগানো চেষ্টা করছ?”

“কেন, রাগ হচ্ছে না তোমার?”

“হচ্ছিল, তবে এখন হচ্ছে না।”

“কেন?”

“তোমার দৃষ্টিতে আমি আমার সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি অনুভব। মুখে এসব বললেও চোখের দৃষ্টি কেমন করে বদলাবে অনুভব?”

“তুমি চোখের দৃষ্টি পড়তে পারো সায়রা?”

সায়রা জবাব দিল না। অনুভব আর তার মাঝে খুব হলে এক ইঞ্চির মতন দূরত্ব।

“কী হলো? উত্তর দিলে না যে।”

“সব কথার উত্তর হয় না।”

অনুভব হাসল। তারপর মেয়েটির মুখশ্রীর দিকে চাইল। এক সেকেন্ডের জন্য কোমল ঠোঁটটা নজরে এল। ও চোখ ঘুরিয়ে নিল।

“তুমি চোখের দৃষ্টি পড়তে পারো না সায়রা। একদমই পারো না।”

সায়রা হয়তো কিছু বলত। তবে সে সময়ই সুনেরাহ’র আগমন হলো। ও এসে বলল,”কফি খাচ্ছ, আমায় কেন ডাকলে না?”

“তুমি ব্যস্ত ছিলে।”

“ও আচ্ছা। আমি কফি বানাতে দেই।”

সুইচ প্রেস করে অনুভবের হাতটি ধরল সুনেরাহ। সায়রার দৃষ্টিতে এল সেটা। ও চোখ ঘুরিয়ে নিল। অনুভব কিন্তু সায়রার দিকেই চেয়ে আছে। মেয়েটার ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করছে। এই মেয়েটা ওর দেখা পৃথিবীর সব থেকে অদ্ভুত প্রাণীর মধ্যে পড়ে।

বের হওয়ার সময় অনুভব আর সায়রার দেখা হলেও কোনো কথা হলো না। দুজন দুদিকে চলে গেল। আজ সারাটা দিন বড়ো বিরক্তিতে কেটেছে সায়রার। ওর ভালো লাগছে না কিছু। নানান চিন্তায় মাথা জ্যাম হয়ে আছে। বাসায় ফিরেই মাহিমের সাথে দেখা হয়ে গেল। মাহিম যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইল। তবে সায়রা আটকে দিয়ে বলল,”কথা আছে। সাথে চল।”

মাহিমকে যেতে হলো। সায়রা নিজের কক্ষে এসে আরাম করে বসল। এত ধকল গেল তার। এদিকে মাহিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ওর মনে হচ্ছে সমস্ত শরীর কাঁপছে। সায়রা আর তার সম্পর্কে বন্ধুত্বের ছোঁয়া আছে। তবু সম্পর্কে অনেকটা বড়ো হয় সায়রা। শ্রদ্ধার জায়গাটা বিশাল।

“কিছু কথা বলব, শুধু হ্যাঁ অথবা না বলবি। ঠিক আছে?”

মাহিম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝাল। সায়রা শুরুতেই শুধাল,”জাফরিনকে পছন্দ করিস? প্রথম দিন থেকেই?”

মাহিম কি বলবে বুঝতে পারছে না। মিথ্যে বলতে পারবে না সে। জাফরিনের প্রতি তার অনুভূতি অস্বীকার করার মতন না।

“কী হলো?”

“পছন্দ করি।”

“জাফরিন?”

“জানি না।”

“কেন?”

“কিছু বলে নি।”

মাহিম চুপ। সায়রা ও তাই। ছেলেটার মুখশ্রী ভালো মতন দেখে নিয়ে সায়রা বলল,”বাসায় বলার মতন সাহস আছে?”

“আছে।”

“যদি না মানে?”

এবার মাহিমের হৃদয় ধক করে ওঠে। ও কিছু সময় চুপ করে থাকে। সায়রা এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারে না। তবে ওঠে এসে মাহিমের বাহুতে স্পর্শ করে। সম্পর্কে সন্তানের মতন হলেও, বয়সে আহামরি পার্থক্য নেই। তাই বন্ধুত্বের ভাব আছে বেশ।

“মাহিম, সম্পর্ক তৈরি যতটা কঠিন, ভাঙা ততটাই সহজ। তাই সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিবি। সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে এমন কোনো আচরণ যেন না হয় যার ফলে অপর পাশের ব্যক্তিটির অসম্মান হয়।”

সায়রার কথাটা বুঝতে পারল মাহিম। মাথা দুলিয়ে বলল‍,”আমি এমন কিছু করব না পিপি। জাফরিনের স্বাধীনতা আছে পুরো।”

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৬

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৬)

জুথির বাবা বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। ওর বড়ো ভাই জুহাদের আবার সন্তান হয়েছে। অনেকদিন ধরেই বাবার বাড়িতে যাওয়া হয় না। তাই এবার বেশ কিছুদিন থাকবে বলে ঠিক করেছে। এদিকে সায়রাও ব্যস্ত। মেয়েটির সময় হচ্ছে না। ও যখন টিউশনি করিয়ে ফিরল তখন সবাই বসার ঘরে বসে আছে। চা পান চলছে। সায়রাকে দেখে বলল,”এসেছিস?”

“হ্যাঁ ভাবি। সবাই কী আলোচনা করছ?”

“জুহাদ ভাইয়ের মেয়ে হয়েছে। সবাইকে যেতে বলেছে।”

আমিরা চা পান করছে। সেই সাথে টিভিতে কার্টুন দেখছে। সায়রা জবাব নিচু রেখে বলল,”ভাবি, এখন কীভাবে যাব?”

“কিছু হবে না। তুই এত ভাবিস না।”

“তবু আমার….”

“আমি বলছি কিছু হবে না।”

অনেক কথার মাঝে সায়রা রাজি হয়ে গেল। পরেরদিন ই জুথির বাবার বাড়িতে গেল ওরা। আয়োজনের কোনো ক্রুটি নেই। তবে এক পর্যায়ে পাশের বাড়ি থেকে একজন বলে ওঠল,”জুহাদের মেয়ের সাথে আমিরার চেহারার বেশ মিল। দেখলে মনে হচ্ছে দু বোন।”

কথাটা একদম পিঞ্চ করে বলা। সায়রার সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠল। জুথি কথা কাটিয়ে বলল,”আরে তেমন কিছুই না। বাবু তো এখনো ছোট। চেহারার মিল বোঝা যায় নাকি।”

কথাটা এখানে থেমে গেলেও জুহাদের বউ রাবেয়া প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলো। সে জুহাদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলল। ঝগড়াটা সামান্য থেকে ভয়াবহ রূপ নিল। রাগে আক্রোশে জুহাদের শক্ত হাতটি রাবেয়ার গাল ছুঁয়ে গেল। হতভম্ব সকলে। সায়রা বিষয়টি মানতে পারল না। ও তৎক্ষণাৎ আমিরাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

জুহাদ মাথা চেপে আছে। ওর মস্তিষ্কের ঠিক নেই। বার বার একই কলঙ্ক শুনে সে বিরক্ত। রাবেয়া কান্নাকাটি করে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। জুহাদ ফোঁস করে দম ফেলে। ওঠে এসে রাবেয়ার পাশে বসে।

“রাবেয়া, আমায় ক্ষমা করো।”

রাবেয়া কাঁদছে। সে মানতে পারে না এসব। জুহাদ ওর হাতটি ধরে।

“মাথার ঠিক ছিল না। তাই ওভাবে থা প্প ড় দিয়ে ফেলেছি।”

ঘর ভরা মানুষের সামনে থা প্প ড় দিয়েছে জুহাদ। স্মরণ হতেই রাবেয়ার সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে। ও আক্রোশ থামাতে পারে না।

“কথা বলবে না তুমি। পুরনো প্রেম এখনো যায় নি। ম রে ও আমায় শান্তি দিচ্ছে না। আমার সংসারটা শেষ করে দিল।”

জুহাদ চুপ করে থাকে। রাবেয়া প্রায়শই এ রকম কথা বলে। ও নিজেকে কত ভাবে যে সামলে রাখে।

“তুমি স্বীকার করো আর না করো, আমি জানি আমিরা তোমার ই মেয়ে। তুমি আর আমেনা সে রাতে…..”

রাবেয়া হু হু করে কেঁদে ওঠে। জুহাদের মুখ র ক্ত হীন হয়ে পড়ে। কলঙ্কের প্রহার আর কত দিন সইবে সে? মৃত্যুর পর ও তো মুক্তি নেই। নতুবা আমেনা কেন ম রে ও কলঙ্কমুক্ত হলো না?

ঘটনার শুরু হয় জুথির বিয়ে থেকে। জুথি আর মারুফ ভালোবেসে বিয়ে করে। তবে সেটি মানতে পারেন না মারুফের বাবা। এর প্রধান কারণ জুথি’রা ছিল খুবই গরিব। তাছাড়া বংশ মর্যাদার দিক থেকেও নিচু। এই কারণেই জুথিকে মেনে নিতে পারেন নি তিনি। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বউ হয়ে আসে জুথি। আর মারুফের বয়সই বা কত? ঊনিশ বিশ। এই ছোট্ট বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করে তারা। দুজনেই পড়াশোনা করছিল। বছর পেরিয়ে গেলেও জুথিকে মানতে পারেন না মারুফের বাবা। এর ই মধ্যে মাহিমের জন্ম হয়। মারুফের বাবা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন তিনি আর খাওয়াতে পারবেন না। মারুফের ওপর তখন দায়িত্ব চড়াও হয়। ছেলেটা পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি শুরু করে। সে যে কি কষ্টের সময়। এরই মধ্যে ঘটে যায় আরেক কান্ড। আমেনার সাথে জুহাদের প্রণয় ঘটে যায়। দুজন একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসলেও পাওয়া হয় না। বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে জুহাদের হাত ধরে পালিয়ে যেতে পারে নি আমেনা। জুহাদ তখন পাগল প্রায়। নিজেকে আ ঘা ত করে হসপিটালেও থাকতে হয়েছে। কত অশান্তি যে চলছিল সে সময়। জুথি নিজের ভাইয়ের অবস্থা দেখে নিজেও বিপদে পড়ে যায়। বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির দ্বন্দ্বে অশান্তি ছেয়ে যায় ওর মস্তিষ্কে। বলা বাহুল্য আমেনার জীবন ও সহজ ছিল না। তবে সত্য হলো সে মানিয়ে নিয়েছিল। বাহাদুরের ভালোবাসা তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল জুহাদ নামের শুদ্ধ মানুষটিকে। ধীরে ধীরে তাদের সংসারে সুখ বর্ষণ ঘটে। আমেনা সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করে এমন সুন্দর সংসার দেওয়ার জন্য। জুহাদ ও মেনে নিতে শিখে। তার ও বিয়ে হয়ে যায়। আমেনা আর জুহাদের কোনো যোগাযোগ ই ছিল না। বেশ কিছু বছর পর এক ঝড়ের সন্ধ্যায় আমেনা আর জুহাদকে অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। জুহাদ এসেছিল বোন আর বোনের সন্তানদের জন্য জামা-কাপড় নিয়ে। তবে তারা সবাই সেদিন কেনাকাটার জন্য বাইরে গিয়েছিল। বিষয়টি সে জানত না। না জানিয়ে এসেছিল। আমেনার শরীর বিশেষ ভালো লাগছিল না। তাই সে যায় নি। ঝড়ের কারণে আটকে যায় জুহাদ। ওদিকে বাড়ির বাকিরাও শপিংমল থেকে ফিরতে পারছিল না। ঝড় ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল। নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। জুহাদ চলে যেতে চেয়েছিল। তবে এমন ঝড়ের মাঝে চলে গেলে তা অমানবিক আচরণ হয়ে যেত। আমেনা বলল থেকে যেতে। জুহাদ ও থেকে গেল। অপেক্ষা করতে লাগল। সব থেকে বড়ো সত্য তারা দুজন দুজনার প্রতি সামান্য দৃষ্টিও দেয় নি। তবে বিপদ যে ঘনিয়ে এসেছিল। প্রতিবেশিদের কেউ একজন দুজনকে এক বাড়িতে দেখে কটাক্ষ করে মন্তব্য করতে লাগল। ধীরে ধীরে সেটা ছড়িয়ে যেতে লাগল। সেটা সহ্য না করতে পেরে মাঝ রাতে, ঝড় বৃষ্টির মাঝেই চলে যায় জুহাদ। ঘটনা এখানেই থেমে গিয়েছিল। তবে বহু বছর পর আমিরা যখন বড়ো হয়ে গেল তখন ঘটনাটিকে খারাপ ভাবে দেখানো হয়। বলা হয় আমিরা নাকি জুহাদের সন্তান! এর কারণ সেই রাতের কিছু সপ্তাহ পর ই জানা যায় আমেনার শরীরে আরেকটি প্রাণ বেড়ে ওঠেছে। এই ঘটনাকে টেনে ধরেই রাবেয়া আর জুহাদের সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। এমন এক পরিস্থিতির জন্ম হয় যার ফলে দুজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিচ্ছেদের। অথচ তাদের দুজনের একটি সন্তান ও রয়েছে। এই সন্তানের দোহাই দিয়েই কোনো মতে টিকে থাকে সম্পর্কটি। এদিকে ঘটনাটি কোনো এক ভাবে বাহাদুরের কানেও পৌছে যায়। তার মা কখনোই আমেনাকে দেখতে পারতেন না। তিনি ঘটনাটি এমন ভাবে সাজান যার ফলে বাহাদুরের ভেতর সন্দেহের বীজ বপন হয়। খবর নিয়ে বাহাদুর জানতে পারে আমেনার সাথে জুহাদের প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। সেই থেকে আমেনার প্রতি তার ভালোবাসা ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়। বাহাদুর মোটেও খারাপ মানুষ নয়। স্বামী হিসেবেও দারুণ। তবে এই সন্দেহ তার চোখে পর্দা ফেলে দেয়। স্ত্রী ও কন্যার প্রতি তার আচরণ হয়ে ওঠে ভয়াবহ। নেশায় ডুবে যায় সে।

সায়রার সমস্ত শরীর কাপুনি দিয়ে জ্বর নেমে গেল। সে ধরমরিয়ে ওঠল। ঘুমের ঘোরে ছয় বছর আগের সেই অতীত দেখেছে সে। ভয়ে আর জ্বরে তার শরীর ঘেমে গিয়েছে। ও দেখল ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে। ফোনের এলার্ম বেজে চলেছে। সেটি বন্ধ করে শ্বাস নিতে থাকল। ধীরে ধীরে শরীর স্বাভাবিক অবস্থান ফিরে পেলে হাত মুখ ধুয়ে নিল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে আরশির সামনে এসে দাঁড়াল। দেখতে লাগল নিজেকে। অনুভবের বলা কথাটার সাথে মিলিয়ে নিল। সে ঊনত্রিশ বছর বয়সী নারী,তবে দেখতে এখনো বেশ সুন্দর। কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি