Wednesday, August 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 178



মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৫

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৫)

অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে অনুভব। এত গুলো বছর ধরে ঘাস পাতা চিবিয়ে এসেছে। অথচ আজ দুটো রোস্ট অকোপটে পেটে চালান করে দিল! অনুভব খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু বাইরের দিকটায় আরাম করে বসেছিল। এদিক দিয়ে মেয়ে বিদায় হয়ে গেছে। ওর সামনে এসে দাঁড়াতেই মিষ্টি এক সুবাস অনুভব হলো। বুক ভরে সেটা গ্রহণ করল সায়রা। অনুভব বলল,”ভালো কথা, ২০০ শ টাকা দাও।”

সায়রা অবাক না হয়ে পারল না। ও বলল,”এক মিনিট ফোনে কথা বলার জন্য ২০০ টাকা চার্জ করছ, আর এখন যে সামনে বসে আছ।”

“দারুণ কথা মনে করালে, ওয়েট সময় কাউন্ট করছি।”

অনুভব ঠিক ই ঘড়ি দেখল। তারপর হেসে বলল,”টাকা বের করো।”

ছেলেটার কথায় ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইল সায়রা। তবে অনুভব ও নাছোড়বান্দা। সায়রা কে টাকা বের করতে হলো। সে ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকা বের করতেই সেটা টান দিয়ে নিয়ে নিল অনুভব। কোনো কথা ছাড়াই পকেটে চালান করে দিয়ে বলল,”রোস্টের স্বাদ ভালো ছিল।”

সায়রা কিছু বলল না। ও অনুভবকে দেখে অবাক হয়।

“এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? প্রেমে পড়লে নাকি?”

“ত্রিশ বছর বয়সী একজন পুরুষ মানুষের মাঝে প্রেমে পড়ার মতন কিছু দেখছি না আমি।”

“ত্রিশ বছর বয়স বলে অপমান করলে?”

“ধরে নিতে পারো।”

“তোমার বয়সের হিসাব আছে?”

সায়রা সরল চোখে তাকাল। তার কিছু বলার নেই। অনুভব এক গাল হেসে বলল,”সায়রা, ঊনত্রিশ বছর বয়সী নারী তুমি। অথচ আমার কাছে অসম্ভব সুন্দরী।”

অনুভবের সরল স্বীকারোক্তি। ছেলেটার চাহনিতে ভালোবাসা মিশে আছে। সায়রার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠল। অনুভব বিদায় জানাতে বলল,”একবার বলে যেতে পারতে,তোমার জন্য জনম জনম অপেক্ষা করতে পারতাম আমি। তবে তুমি অবহেলা করলে। অনেক বেশি কষ্ট দিলে সায়রা। আই হেইট ইউ, হেইট ইউ সায়রা।”

শেষ কথায় সায়রার চোখে জল চলে এল। ওর ভাঙা কণ্ঠটা শোনা গেল।

“আমাকে ঘৃণা করো ঠিক আছে। তবে সেটা বার বার কেন বলো অনুভব? কেন কষ্ট দাও আমায়? আমায় কষ্ট দিয়ে তোমার কষ্ট কী লাঘব হয়?”

অনুভব উত্তর করল না। সায়রার দু চোখ নোনা জল ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেটা যখনই ঘৃণার কথা বলে, তখনই বুকের ভেতরটা তপ্ততায় মেখে যায়। কি এক শোক নামে বুকের ভেতর। কেন এই ছেলেটাকে এত বেশি মনে পড়ে তার?

জ্বরে পড়ল সায়রা। সেদিন রাতেই হাড় কাপুনি দিয়ে জ্বর এল তার। তবে মেয়েটি ডাক্তার দেখাবে না। ঔষধ ও খাবে না। এমনিই থাকবে বলে ঠিক করল। নিজের সেই ছোট্ট ঘরটায় দরজা আটকে বসে রইল। মাহিম সমস্ত সন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে এসেছে। ফিরল রাত এগারোটায়। তখন এসে খবরটি পেল। এসেই পিপির দরজার কাছে নক করল। সায়রা ভেতর থেকে জবাব দিল।

“আমি ঠিক আছি। তোরা বেশি চিন্তা করছিস।”

“আমাকে একটু দেখতে দাও পিপি। আমি একটু দেখি তোমায়।”

“ডাক্তার গিরি দেখাতে হবে না। তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট নে।”

“তাহলে ডাক্তার হয়ে কী লাভ হলো? যদি ঘরের লোকের চিকিৎসা না করতে পারি।”

সায়রা জবাব দিল না। তার কান্না পাচ্ছে শুধু। সে অনবরত কেঁদেই চলেছে। ওর এই কান্নাটা সব থেকে বেশি বুঝতে পারল আমিরা। মেয়েটির সাথে সব থেকে বেশি সময় সে কাটিয়েছে। ছয় বছর আগে ছোট ছিল বিধায় অনেক কিছুই ধরতে পারে নি। তবে এখন, এখন তো সে বড়ো হয়েছে। বিষয় গুলো মনে হলেই ওর বার বার মনে হয় সামথিং ইজ রং। এই চিন্তা থেকেই সে অনুভবকে কল করে বসল। ছেলেটার সাথে অনুষ্ঠানে আজ দেখা হয়েছিল। নাম্বারটি নিয়ে রেখেছে। আমিরার কণ্ঠটি শুনতে পেয়ে হাসল অনুভব।

“কী ব্যাপার, মিষ্টি বন্ধু? এই মাঝ রাতে একেবারে হুট করে কল করলে যে।”

“দুষ্টু বন্ধু, তুমি মিমি কে কী বলেছ?”

“কী বলেছি বলতে?”

“তার খুব জ্বর হয়েছে। কাউকে সামনে যেতে দিচ্ছে না। ঔষধ খাচ্ছে না।”

অনুভব চুপ করে রইল। আমিরা মন খারাপের সুর টেনে বলল,”মিমি কেঁদেছে অবধি।”

“এর সাথে আমার কী সম্পর্ক মিষ্টি বন্ধু?”

“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।”

“সে কী বলেছে, আমার জন্য তার শরীর খারাপ হয়েছে?”

“বলে নি।”

“তাহলে?”

“আমার মনে হয়েছে।”

অনুভব গলার স্বরটি সামান্য কঠিন করে বলল,”তোমার মিমির কাছে আমি এতটাও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই যার ফলে তার জ্বর হবে। বরং সে আমাকে যথেষ্ট অবহেলা করে। তাকে ঔষধ খাওয়াও।”

কলটি কেটে দিল অনুভব। আমিরার মন খারাপ হয়ে গেল। প্রথমত অনুভব না বলে কল কেটে দেওয়ায়। দ্বিতীয়ত অনুভবের অনেক কথাই সে বুঝতে পারে নি।

সায়রার অসুস্থতার কথা শুনে কল না করে থাকতে পারল না অনুভব। তার হৃদয়ে দং শ ন হয়েছে। সেখান থেকে লাল তরল নেমে যাচ্ছে। ও চোখ বন্ধ করে নিজের শ্বাসের গতি ঠিক করল। কল করল। তবে প্রথম বারেই কলটি রিসিভ হলো না। দ্বিতীয় বারে কল রিসিভ হওয়ায় অনুভবের ইচ্ছে হলো কিছু কথা শোনাবে। তবে কান্নায় ভা ঙা কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে কিছু বলতে পারল না। সায়রা ভা ঙা কণ্ঠে নাক টেনে শুধাল,”কল কেন করেছ?”

অনুভব জবাবহীন। জবাব না পেয়ে আরো একবার নাক টানল সায়রা। বার বার নাকে পানি এসে জমছে। কি এক বেদনা!

“সময় কিন্তু যাচ্ছে অনুভব। তুমি কল করেছ, এক মিনিট হতে চলল। আবার ২ শ টাকা চার্জ করে না বসো।”

এবার অনুভবের হাসি পেল। ও নিজের হাসি আটকে বলল,”না চার্জ করব না। আমি ২ শ টাকা চার্জ করায় যেভাবে কান্নাকাটি করে জ্বর বাঁধিয়েছ।”

শেষ কথায় সায়রার সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠল। ও তড়িঘড়ি করে শুধাল,”তুমি কীভাবে জানলে আমার জ্বর হয়েছে?”

স্মিত হেসে অনুভব বলল,”ঘৃণার পরিমাণ বেশি, তাই দৈবক্রমে জেনে গিয়েছি।”

ছেলেটা সব কথায় যেন ঘৃণা টানে। সায়রার কী যে খারাপ লাগল। অনুভব এবার কণ্ঠটা গুমোট করে বলল,”দ্রুত ঔষধ খাও। শেষে আমাকে ফাঁ সি য়ে না দাও।”

সায়রাও কম নয়। সে ও সুন্দর করে জবাব দিতে জানে। তাই তো রস মিশিয়ে বলল,”খাব না। বরং তোমাকে ফাঁ সি য়ে দিব। জেল হবে তোমার, আমাকে ঘৃণা করার অপরাধে।”

মেয়েটির শেষ কথার সাথে অনুভব তাল মিলিয়ে বলল,

“যদি তুমি সঙ্গে থাকো সখী,
রাখো হৃদয় ও গভীরে।
যাবত জীবনেও শোক হবে না,
আমার এই হৃদয় ও মাঝারে।”

জাফরিন ভীষণ রেগে গিয়েছে। মাহিমকে সে বোঝাতে পারছে না এটা সম্ভব নয়। অথচ মাহিম তাকে ছাড়ছে না। এই যে যেমন একটু আগেই তার হাত স্পর্শ করেছে। ছেলেটার এহেন আচরণে ওর রাগ পৌছে গেল সপ্তম আকাশে। চেচিয়ে ওঠল।

“তোমাকে নিষেধ করলাম মাহিম। আমায় স্পর্শ করবে না।”

আহত দৃষ্টিতে তাকাল মাহিম। তার কোনো বাজে উদ্দেশ্য নেই। শুধুমাত্র মেয়েটার হাত সারাজীবনের জন্য চায় সে।

“সরি, আর হবে না। তবে তুমি আমায় কেন ইগ্নোর করছ?”

“সেটা তোমার বোঝা উচিত। আমি তোমায় পছন্দ করি না।”

“অথচ আমার মনে হয় তুমি পছন্দ করবে।”

“ফিউচারের কথা চিন্তা করা বন্ধ করো। এসব কেবল স্বপ্ন।”

“যদি বাস্তব হয়?”

“জোর করতে চাও?”

“না। ভালোবাসতে চাই। অনেক বেশি।”

মাহিমের মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা দারুণ শোনায়। জাফরিন করুণ চোখে তাকায়।

“প্লিজ, এভাবে জ্বালিও না। আমি মাত্র কটা দিন থাকব এখানে।”

“এ কথা বলো না প্লিজ। আমার হৃদয়ে যন্ত্রণা হয়। তোমাকে যদি হৃদয়টা দেখাতে পারতাম, তবে বিশ্বাস করো কেঁপে ওঠতে তুমিও।”

বুকের বাঁ পাশ দেখিয়ে কথাটা বলল মাহিম। ছেলেটার মুখ আঁধারে মিশে গিয়েছে। জাফরিন ফোঁস করে দম ফেলে। তার মাথা কাজ করে না। কে জানে হয় কি হয় ভবিষ্যতে।

চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৪

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৪)

অনুভব হলুদের অনুষ্ঠানে আসে নি। সায়রার মনে হয়েছিল তার জন্যই আসে নি। তবে বিষয়টি তেমন নয়। ছেলেটার কাজ পড়ে গিয়েছিল। তাই আসতে পারে নি। কিন্তু আজ এসেছে। বেশ সেজে এসেছে। তাকে দেখতে রূপকথার রাজকুমারের মতন লাগছে। অধিক লম্বা হওয়ায় আকর্ষণ বেশি পাচ্ছে। সায়রা আজ শাড়ি পরেছে। অনুভব কে দেখে ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইল। ছেলেটা এত বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে কেন! বয়স যেন বাড়ছে না, কমছে!

এদিকে জাফরিন হতাশ। মাহিম ছেলেটা তাকে বিরক্ত করছে। আজ একদম টেনে সবার থেকে আড়ালে নিয়ে এসেছে। এখন দুজনের মুখশ্রীর মাঝে দূরত্ব বেশি নেই। মাহিম এক চিলতে হাসি রাঙিয়ে বলল,”কী সমস্যা তোমার?”

“সমস্যা তো তোমার। মাথা খারাপ কোথাকার।”

ছেলেটাকে ঠেলে বের হতে নিল জাফরিন। তবে পারল না। স্বাভাবিক ভাবেই ওর শক্তি কম। ও অসহায় বোধ করলেই কটমট করে তাকাল।

“এই তেজের জন্যই এত ভালো লাগে।”

“বাদরামো শুরু করেছ? এসবের কোনো মানে হয় মাহিম? আমি এ রকম মজা পছন্দ করি না।”

“তোমার কেন মনে হয় আমি মজা করছি?”

“তুমি সিরিয়াস?”

“হুম।”

পরপর জবাব দিয়েছে মাহিম। ওর আচরণে অনেক কিছুই পরিষ্কার। জাফরিন বুক ভরে সমীরণ টেনে নিল।

“তুমি কী জানো আমি তোমার থেকে এক বছরের বড়ো?”

“জানি।”

“তাহলে এমন কেন করছ?”

“না করার কী আছে?”

“তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।”

“জানোই যখন তবে গ্রহণ কেন করছ না?”

জাফরিন ওকে পাত্তা দিল না। অনেকটা জোর করেই চলে এল। তবে ওর যে ভীষণ মন খারাপ করেছে।

জুঁইকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। সকাল থেকে জুথির কান্না শুরু হয়েছে। এত দিন মেয়ে বিদায়ের জন্য পাগল হয়েছিল আর এখন কান্নাকাটি করে যা তা অবস্থা। ওর এমন অবস্থা দেখে সায়রার খারাপ লাগে। তবে করার কিছু নেই। মেয়েদের যে বিদায় দিতেই হয়। এদিকে মারুফ কিন্তু একদম ই শোক দেখাচ্ছে না। বরং উত্তেজনা নিয়ে কাজ করছে। অথচ সায়রা স্পষ্ট বুঝতে পারে ভাইয়ের হৃদয়টা জ্বলে যাচ্ছে।

“ভাইয়া।”

ব্যস্ত ভঙ্গিতে আগাচ্ছিল মারুফ। সায়রার ডাকে ফিরে এল।

“হ্যাঁ বল।”

“তুমি একটু রেস্ট করো ভাইয়া।”

“রেস্ট কী করব রে। এখন তো রেস্টের সময় নেই। কত কাজ বল।”

সায়রা দু চোখ ভরে ভাইকে দেখতে থাকে। মানুষটার বয়স হয়েছে। সংখ্যায় সায়রার থেকে ১৫ বছরের বড়ো। ৪৪ এ পা দেওয়া মারুফ যেন মাত্র কদিনেই বয়সের ভার অনুভব করছে। অথচ আগে এমনটা মনে হয় নি।

মাহিম পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সায়রা ডেকে বলল,”ভাইয়ার রেস্ট প্রয়োজন। কী কাজ যেন বাকি আছে। একটু দেখ তো।”

মাহিম চলে গেল। মারুফ আর সায়রা নীরবে পথ চলছে। ক্লান্ত হয়ে আছে মুখশ্রী।

“ভাইয়া, মেয়েদের তো বিদায় দিতেই হবে তাই না। মন কে ভা ঙ তে দিও না।”

“ভা ঙ তে দিচ্ছি না রে।”

“সেটা ঠিক আছে। তবে তুমি যে ভেতরে কষ্ট পুষে রাখছ ভাইয়া।”

মারুফের যেন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। দু চোখ টলমল করছে। সায়রার মাথায় হাত রাখল সে।

“মাত্র ২১ বছর বয়সে বাবা হয়েছিলাম। মাহিমকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। তার ঠিক দু বছর পর ই জুঁইয়ের জন্ম। তখন অতটা আবেগ কাজ করে নি। পরিবার টানার চাপে মেয়েটার যত্ন নিতে পারি নি। এখন মনে হচ্ছে বড়ো ভুল হয়ে গেছে। হৃদয়ে ক্ষ ত করে মেয়েটাকে বিদায় দিতে হবে। এ যন্ত্রণা কেমন করে সইব রে বোন? কেমন করে সইব?”

একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মারুফ। ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সায়রা। ভা ঙা কণ্ঠে বলল,”জুঁই অনেক সুখী হবে ভাইয়া। অনেক বেশি সুখী হবে।”

তোড়জোড় চলছে। বর পক্ষকে খাওয়া দাওয়া করানো হবে। সায়রা ভীষণ ব্যস্ত। চারপাশ থেকে ব্যস্ততা ওকে চেপে ধরেছে। ও নিজেই রোস্টের প্লেট তুলে নিল। সামনের টেবিলে সার্ভ করতে লাগল ক্রমাগত। সার্ভ করার এক পর্যায়ে একটি কণ্ঠ শোনা গেল।

“একটা রোস্ট কেন? মেয়ে পক্ষের বুঝি হাত ভারী?”

কণ্ঠটি অনুভবের। সায়রা ব্যস্ততায় তাকে খেয়াল করে নি। ওয়েটার গুলো কোথায় পড়ে আছে কে জানে। বাড়ির মানুষ গুলোকেই সার্ভ করতে হচ্ছে।

“কী হলো? আরেকটা রোস্ট দাও।”

সায়রা রোস্ট দিল। অনুভব ও তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। ছেলেটার আচরণ এত অবাক করে সায়রা কে।

মাহিম ছুটে এসে বলল,”পিপি, সব নবাবের দল বাইরে গিয়ে সিগারেট টানছে।”

“এখন কি সিগারেট টানার সময়। আশ্চর্য লাগে! সবাই কে ডেকে নিয়ে আয়।”

মাহিম ফের ছুটল। ছেলেটার ওপর দিয়ে আজ বিশাল ধকল যাচ্ছে। জাফরিন অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে দেখছে সব। ওর শরীর টানছে না। মাহিম ছেলেটা মস্তিষ্কে ঝামেলা সৃষ্টি করেছে।

আমিরা গিয়ে সুবর্ণের ছবি তুলে এনেছে। সেটাই দু চোখ ভরে দেখছে জুঁই। ছেলেটার সাথে হুট করেই প্রণয় ঘটে গেল। সব কেমন দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। জুঁইয়ের চোখ ছলছল দেখে আমিরা শুধাল,”কান্নাকাটি করে মেকাপ নষ্ট করলে হবে? শেষে তোমার বর পাত্তাই দিবে না।”

ওর কথায় হাসল জুঁই। চোখের জল মুছে নিয়ে বলল,”দিবে, না দিলে মে রে ফেলব না?”

“ভাইয়া খুব ভালো তাই না?”

“হুম, খুব ভালো। আমার ভীষণ যত্ন করে। জানিস, সারাটা জীবন মধ্যবিত্ত হয়ে ভেবেছি স্বামীর সংসারে অনেক বেশি বিলাসিতা করব। তবে শেষমেশ এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়লাম, যে কী না খুব সাধারণ। কিন্তু বিশ্বাস কর, এক চুল ও আপসোস নেই। ও যখন ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে দেখা করতে আসত, তখন আমার মনে হতো পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান মানুষ আমি। বৃষ্টিতে ভিজে এগিয়ে দিত, নিজে ভিজে আমাকে শুকনো রাখত, তখন আমার কান্না পেত। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হতো। একটা মানুষ, যে কী না নিজের সবটুকু ভালোবাসা আমায় দিয়েছে, তাকে না ভালোবেসে পারা যায় বল?”

কথা গুলো বলতে বলতে জুঁইয়ের দু চোখ ভিজে ওঠল। আমিরার চোখে মুখে খুশির মেলা বসেছে। জুঁই আপুর ভালোবাসার কথা শুনে তার ভালো লাগছে। স্মরণ হচ্ছে নিজের পছন্দের ব্যক্তিটি। ইস কতদিন হয় দর্শন হয় না।

অনেকটা তাড়াহুড়োতেই জুঁইয়ের বিয়েটা হয়ে গেল। মেয়ে বিদায় দিতে এসে জুথির অবস্থা প্রাণ যায় যায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে সে। প্রথম দিকে সকলে চোখের পানি ফেললেও, এখন সব অতিরিক্ত লাগছে। এক ঘন্টা ধরে মেয়েকে চেপে ধরে কেঁদে চলেছে জুঁই। মারুফ ও বিরক্ত। শোক তো তার হৃদয়েও আছে। তাই বলে মেয়েকে ধরে রাখলে চলবে? স্ত্রীকে এক প্রকার টেনে সরিয়ে নিলেন তিনি। জুথির অবস্থা ভালো নয়। তাই মেয়ে বিদায়ের দায়িত্ব পড়ল সায়রার ঘাড়ে। ও সমস্ত নিয়ম মেনে মেয়ে বিদায় দিল। জুঁই গাড়ির ভেতর ওঠে বসেছে। দু চোখ ছলছল করছে। সায়রা ওর কাছে এসে কপালে চুম্বন করল। আদুরে হাতে গাল ছুঁয়ে বলল,”দোয়া করি,অনেক বেশি ভালো থাক তুই। তোর সংসারে সমস্ত সুখ এসে পড়ুক।”

পিপির হাত টা জাপটে ধরল জুঁই। ছলছল নয়নে চেয়ে রইল।

“তোমার দোয়া যেন ফলে যায় পিপি। সব যেন ঠিক হয়।”

মাহিমের হৃদয় ভে ঙে যাচ্ছে। দু ভাই বোন পিঠাপিঠি হওয়াতে জীবনের অনেক সুন্দর স্মৃতি রয়েছে। তাই দুঃখটা তার একটু বেশি। সেই দুঃখ আড়াল করতেই দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রমাগত শ্বাস নিচ্ছে। জাফরিন ও এসেছে পিছু পিছু। বিষয়টা একেবারে অনিচ্ছাকৃতভাবে। খেয়াল হওয়ার পর চলে যেতে চাইছিল। তবে মাহিমের কণ্ঠটি শুনতে পেয়ে পা থমকে গেল। মাহিম এগিয়ে এসে জাফরিনের মুখোমুখি হলো। কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই জাপটে ধরল মেয়েটিকে। জাফরিনের সমস্ত শরীর আন্দোলিত হলো। ও চেয়ে ও পারল না ছেলেটাকে নিজের থেকে আলাদা করতে।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩৩

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩৩)

বাড়িতে এত বছর পর বিয়ে। তাই সব রকমের অনুষ্ঠানই করা হবে। আজ মেহেদির অনুষ্ঠান। ছেলে পক্ষ থেকেও কিছু মানুষজন আসবে। পুরো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে বাড়ি থেকে একটু দূরের সেন্টারে। এ রকম অনুষ্ঠানে অনেক দিন পর থাকছে সায়রা। আজ তার মন ভীষণ ফুরফুরে। সে বসে বসে মেহেদির ডালা সাজাচ্ছে। ভিডিও করা হবে। আয়োজন ছোট হোক, তবে স্মৃতিরা তোলা থাক। আমিরা আর জাফরিন ঘুরঘুর করে সব দেখছে। লাইটিং ঠিক আছে কী না। ফুল গুলো তাজা কী না। এসব দেখতে দেখতে নজরে এল কিছু ফুল শুকিয়ে গেছে। আমিরা চেচিয়ে ওঠল,”এখানে শুকনো ফুল দিয়েছ কেন?”

আশেপাশে সবাই ব্যস্ত। আমিরা হতাশ হয়ে বলল,”তুমি থাকো, আমি এই ফুল গুলো সরানোর ব্যবস্থা করি।”

আমিরা চলে গেল। জাফরিন এখন একা। ও একাই চারপাশ ঘুরতে লাগল। সেন্টারের মাঝে ফোয়ারা আছে। সেখান থেকে পানি নামছে ক্রমাগত। জাফরিন সেদিকেই এগোল। ফোয়ারার কাছে এসে পানি স্পর্শ করল। শীতল পানি হাত ছুঁয়ে যেতেই এক চিলতে হাসি এল অধরে।

“একা হাসছ কেন?”

মাহিমের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত করে রইল জাফরিন। এসে থেকে ছেলেটার সাথে ওর বনিবনা হয় না। বার বার ঝগড়া লেগে যায়।

“হাসতে মানা নাকি?”

“রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকলে, অবশ্যই হাসতে মানা।”

“তোমার সমস্যা কী বলো তো?”

“আমার?”

“হুম।”

“কোনো সমস্যা তো নেই।”

“সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকো।”

“তাই? আমি তোমার পেছনে লেগে থাকব কোন দুঃখে।”

“কোন দুঃখে সেটা তো জানি না। তবে তোমায় সুবিধার লাগে না।”

“কেন লাগে না?”

“তোমার দৃষ্টিতে অশ্লীলতা।”

“অশ্লীলতা! তা কীভাবে?”

“কীভাবে সেটা তো তুমি জানো।”

“আমি জানি? আচ্ছা, তাহলে একটু জেনেই নিই।”

কথাটা বলে মাহিম সামনে এগোল। জাফরিন ভীতু মেয়ে নয়। সে ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ও ভেবেছিল এতে করে মাহিম পিছিয়ে যাবে। তবে তেমনটা হলো না। মাহিম বড়ো অসাধ্য এক কাজ করে ফেলল। জাফরিনের নিকটে এসে একদম গালে চুমু খেল। ছেলেটার উষ্ণ ঠোঁট গাল ছুঁয়ে যেতেই জাফরিনের সমস্ত শরীর শিরশির করে ওঠল। জমে গেল বরফের মতন। মাহিম এক চিলতে হাসি রেখে বলল,”এমন অশ্লীল হয়ে যদি চুমু খাওয়া যায়। তবে কেন অশ্লীল হব না?”

সায়রা মেহেদির ডালা নিয়ে বের হচ্ছিল। ওমন সময় দেখতে পেল অনুভব দাঁড়িয়ে। ওর পা থমকে গেল। অনুভব দৃষ্টি ফেরাতেই মেয়েটিকে নজরে ঠেকল। সুন্দর একটি শাড়ি পরেছে সায়রা। উজ্জ্বল ত্বকে মানানসই মেকাপের ছোঁয়া। লিপস্টিক সামান্য ছড়িয়ে গিয়েছে। অনুভব চট করেই কাছে এসে দাঁড়াল। ছেলেটা যেমন লম্বা, তেমনই বলিষ্ঠ। বরাবরের মতই সায়রার মাথাটা অনুভবের বুক বরাবর হলো। এতে করে দুজনের মাঝে বেশ দূরত্বের দেখা মিলল। সায়রার দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। অসহায় লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে। ওর অস্বস্তি আরেকটু বাড়াতে সামান্য ঝুঁকল অনুভব। এতে করে ছেলেটার ত্বকের উষ্ণতা, পারফিউমের ঘ্রাণ স্পষ্ট নাকে এসে ধরা দিচ্ছে। সায়রার বুকের ভেতর ধীম ধীম হলো। ওর সমস্ত দেহ আন্দোলিত হলো। অনুভবের কণ্ঠটা শোনা গেল এবার।

“তুমি আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছ সায়রা। অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছ। আই হেইট ইউ সায়রা। আই হেইট ইউ।”

কথাটা বলেই অনুভব চলে গেল। সায়রার হাতে থাকা ডালা পড়ে গিয়েছে। চোখ দুটো ইষৎ জ্বালা করছে। ঘৃণা পাওয়া কী স্বাভাবিক নয়? তবে দু চোখ বেহায়ার মতন কাঁদছে কেন?

জাফরিন হতভম্ব। মাহিম এটা কী করে গেল! ওর মস্তিষ্ক খালি হয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। আমিরা এসে দেখল অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে জাফরিন।

“এই জাফরিন আপু।”

মেয়েটির বাহু টেনে ধরল আমিরা। জাফরিন তাকাল। দৃষ্টিতে অসহনীয় ব্যথা।

“চলো না আমরা মেহেদি পরে আসি।”

“আমি দিব না রে আমিরা। তুই যা।”

“না, তোমায় যেতে হবে। প্লিজ চলো আপু।”

টেনে জাফরিনকে নিয়ে গেল আমিরা। মেহেদি পরাল। কিন্তু ওর মনোযোগ নেই এখানে। ও বরং চেয়ে রইল গভীর দুটো চোখে। মাহিমের চোখের দৃষ্টি, ঠোঁটের দুষ্টুমি। সব মনে হতেই শিউরে ওঠল শরীর। মেহেদি তখন প্রায় শুকিয়ে এসেছে। মাহিম কে দেখা গেল ফোনে কথা বলছে। আলগোছে ওর সামনে এসে দাঁড়াল জাফরিন। মেয়েটিকে দেখে কল রাখল ও। দৃষ্টি ফিরিয়ে শুধাল,”কী?”

“তখন ওটা কী করলে?”

“চুমু খেয়েছি।”

“এটা ফাজলামি নয় মাহিম।”

“তোমার মনে হয়,আমি ফাজলামি করেছি?”

“তবে?”

“আমি সিরিয়াস হয়েই চুমু খেয়েছি।”

“তোমার মাথা খারাপ?”

“মাথা খারাপ কী না জানি না। তবে তোমাকে না পেলে পাগল হয়ে যাব।”

জাফরিনের ইচ্ছে করল ছেলেটার গালে ঠাস করে দুটো চ ড় বসিয়ে দিতে। এ ছেলে নিজেকে কী মনে করে!

“মাহিম, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো প্লিজ।”

“স্বপ্ন তো ঘুমিয়ে দেখতে নেই জাফরিন। ঘুমিয়ে দেখলে, সেটা বাস্তব হবে কেমন করে?”

জাফরিন বিহ্বলের মতন তাকিয়ে রইল। এদিকে মাহিমের ঠোঁট জোড়া হাসি।

সায়েম গাড়ি বের করল। অনুভব এখনই বের হবে। ও প্রায় ওঠেই যাচ্ছিল, সে সময়েই সুবর্ণ এসে বলল,”স্যার এখনো তো অনুষ্ঠান শেষ হয় নি।”

“আমার একটু তাড়া আছে সুবর্ণ।”

“আপনি বলেছিলেন পুরো সময়টায় থাকবেন।”

“আজ হলো না। অন্য এক সময় হবে।”

সুবর্ণকে আলিঙ্গন করল অনুভব। তারপরই বেরিয়ে পড়ল। সুবর্ণ চেয়ে রইল গাড়িটির পানে। সে খুব সাধারণ ঘরের ছেলে। পড়াশোনা চালানো কষ্টসাধ্য ছিল। তখনই অনুভবের অফিসে চাকরিটা পেল। সে সময় চাকরিটা পেয়ে ওর মনে হয়েছিল পৃথিবী বুঝি স্বর্গ হয়ে গেছে। আসলে সাধারণ মানুষ গুলো এমনই হয়। এদের চাওয়া, পাওয়া খুবই সামান্য।

সায়রার চোখে ঘুম নেই। অনুভবের কথা গুলো খুব বেশি প্রভাবিত করল তাকে। রাগে দুঃখে কাঁদল কতক্ষণ। তারপর ঠিক করল ছেলেটার সাথে সরাসরি কথা বলবে। তাকে কীভাবে কষ্ট দিয়েছে সায়রা? সে কি প্রণয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল? দেখায় নি তো। তাহলে, তাহলে কীসের এত ঘৃণা?

অনুভব মাত্রই শাওয়ার শেষ করল। এসে দেখল ফোন বাজছে। নাম্বারটি পরিচিত না। ও কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গমগমে কণ্ঠে সায়রা বলল,”তোমার সমস্যা কী অনুভব? কেন ঘৃণা করো আমায়? আমার দোষ কী? তোমাকে প্রত্যাখান করাই কি আমার দোষ?”

মেয়েটির কণ্ঠে তেজ রয়েছে। কমে নি। অনুভব একবার হেসে নিল। তারপর আরশির সামনে এসে দাঁড়াল। অত্যন্ত সুপুরুষ লাগছে নিজেকে। মনে মনে সে নিজেই নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো।

“আমি এত সহজে কারো সাথে কথা বলি না সায়রা। আমার মাসিক আয়ের হিসাবে প্রতি মিনিটে ২০০ টাকা করে রোজগার। তোমাকে ৫ মিনিট সময় দিব। অথার্ৎ ১ হাজার টাকা পাওনা থাকবে। যদি রাজি থাকো তাহলে কথা কন্টিনিউ করা যেতে পারে।”

ছেলেটার কথায় আকাশসম বিস্মিত হলো সায়রা। অনুভব শীতল কণ্ঠে বলল,”অলরেডি ১ মিনিট খরচ হয়ে গেছে। ২০০ টাকা পাওনা রইল।”

সায়রার ইচ্ছে করল ছেলেটাকে কিছু খারাপ ভাষায় গালি দিতে। তবে সেটি করল না ও। কল রেখে দিল। তারপর ভাবতে লাগল এই অনুভব আর ছয় বছর আগের অনুভব, ঠিক কতটা পার্থক্য দু সময়ে মাঝে।

কল কেটে দেওয়ায় হেসে ফেলল অনুভব। ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে সে। ও আরশির সামনে এসে নিজের চুল গুলো হাত দিয়ে সেট করে নিল। গায়ে পারফিউম দিয়ে তারপর ঘুমাতে এল। তবে ঘুম হলো না। মেয়েটি তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কল দিয়ে একদমই উচিত করে নি।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩২

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩২)

জুঁইয়ের বিয়ের কেনাকাটা করা হবে। তার জন্য সায়রা কেও যেতে হবে। সায়রা দেশে ফিরে একটু রিল্যাক্স সময় কাটাচ্ছিল। অথচ এরা সেটা হতে দিল না। এক প্রকার জোর করে মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে বসে সায়রা বলল,”তোরা কি বল তো। আমার কি আর সে বয়স আছে নাকি?”

আমিরা প্রতিবাদ করে বলল,”মিমি, সব সময় নিজেকে বুড়ো বোঝাও কেন?”

“তো বুড়ো হয়ে গেছি না?”

“আশ্চর্য! তোমার ঊনত্রিশ মাত্র।”

সায়রা মলিন হাসল। ঊনত্রিশ হয়ে গেছে তার। বিষয়টা ভাবলেই কেমন গা শিউরে ওঠে।

সুনেরাহ দু হাত ভরাট করে ড্রেস কিনেছে। অনুভব শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। একটা মেয়ে কি করে এত ড্রেস কিনতে পারে!

“সুনেরাহ, এবার লেট হয়ে যাচ্ছে। এত ড্রেসে কী হবে?”

“লাগবে না? কী বলো!”

“ঠিক আছে, এবার প্লিজ আসো। আমাদের মিটিং আছে। সায়েম গাড়ি নিয়ে বসে আছে।”

“ওকে, ওকে। আর একটা।”

কথাটা বলেই আরেকটা ড্রেস তুলে নিল সুনেরাহ। অনুভব ব্যাগ গুনে দেখল তেরো টা।

“প্লিজ চলো এবার।”

ওরা বিল পেমেন্ট করছিল। অনুভব বার বার ঘড়ি দেখছে। সুনেরাহ এটা ওটা বলছে। তবে কিছুই কানে যাচ্ছে না তার। ওর মস্তিষ্ক জুড়ে সময়ের খেলা। একটা সেকেন্ড প্রচন্ড দামি ওর কাছে।

সায়রা ব্যাগ গুলো রেখে বলল,”বিলটা রেডি করবেন কাইন্ডলি।”

অনুভব ফোনে মগ্ন ছিল। কণ্ঠটা শুনে নজর ফেরাল। সায়রা ও নজর ঘুরিয়েছিল। দুজনের চোখাচোখি হলো।

“অনুভব, চলো।”

সুনেরাহ খুব সুন্দর ভাবে অনুভবের হাতটি ধরে নিল। সায়রা দ্রুত নজর সরিয়ে বলল,”বিলটা রেডি করুন। আমি আসছি।”

সমস্ত রাস্তা মাথা ব্যথার ছুতোয় চোখ বন্ধ করে রইল সায়রা। অনুভব কে চিনতে তার অসুবিধা হয় নি। ছেলেটার গঠনে অনেক পরিবর্তন এসেছে তবে মানুষটা তো বদলে যায় না। সায়রা এক সেকেন্ডেই চিনে নিয়েছে।

অনুভব কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল। সায়েম গাড়ি ড্রাইভ করছে। সেটা দেখে বলল,”এনি প্রবলেম স্যার? আপনার শরীর খারাপ? মিটিং ক্যানসেল করব?”

“না সায়েম। মিটিং ক্যানসেলের দরকার নেই।”

কথাটা বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল অনুভব। মৃদুমন্দ হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল মুখশ্রী। অনুভব চোখ বন্ধ করল। ভেসে ওঠল অতীতের স্মৃতি।

সায়রার বলা কথা গুলো অনুভবের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলল। মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যানে যেমন কষ্ট পায়। ঠিক তেমনই কষ্ট পায় যখন মানুষটার থেকে ছোট হতে হয়। সায়রা বলেছিল অনুভব অলস একটা ছেলে। তাকে কীভাবে ভরসা করবে। এই বিষয় গুলো ওর ঘুম কেড়ে নিল। ও সব ছেড়ে দিল। নিজের ভেতর জেদ হলো। নিজেকে পরিবর্তন করার প্রয়াসে ছেলেটার মস্তিষ্ক তপ্ত হতে ওঠেছিল। এতটা পরিশ্রম করতে হতো ওর। তবু ও থেমে ছিল না। নিজেকে গড়ার চেষ্টা করছিল। তিন মাসে বেশ পরিবর্তন করে ফেলল নিজেকে। তারপর যখন সায়রার সাথে যোগাযোগ করতে গেল তখন শুনল মেয়েটা দেশে নেই। চলে গিয়েছে। অনুভব তখন পাগলপ্রায়। সায়রা চলে গেল। একবার বলল না তাকে। সুযোগ দিল না কোনো। এই বিষয় গুলো অনুভবের ভেতরে ক্রোধের সৃজন করল। নিজেকে আ ঘা ত করল। তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হলো। নিজেকে বোঝাল। পরিবর্তন করল নিজেকে। সেই হেংলা, অলস অনুভব হয়ে ওঠল ভীষণ পরিশ্রমী, বলিষ্ঠ। গাড়ির ব্রেক ধরায় ধ্যান ফিরল অনুভবের। সায়েম লুকিং গ্লাসে স্যারকে দেখে নিয়ে শুধাল,”স্যার মিটিং ক্যানসেল করি? আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।”

“না সায়েম। ঠিক আছি।”

সায়েম চেয়ে রইল অনুভবের দিকে। ছয় বছরের ও বেশি সময় ধরে মানুষটাকে দেখে আসছে সে। একটু হলেও মন পড়তে পারে।

সুনেরাহ’র সাথে বিজনেস শুরু করেছে অনুভব। মেয়েটার গুণ ওকে মুগ্ধ করে। দুজনের আজ এক মিটিং রয়েছে। ওরা খুব দ্রুত নতুন প্রডাক্ট লঞ্চ করবে। তার জন্য মার্কেটিং টিম করা হবে। কীভাবে কোনটা করবে সেটার জন্যই ছিল আজকের মিটিং। অনুভব পুরো মিটিং ভীষণ মনোযোগে করেছে। যদিও কোথাও কোথাও মনটা থমকে গিয়েছে। তবু সে সর্বোচ্চ চেষ্টায় মিটিং শেষ করল। রুমে এখন সায়েম, অনুভব আর সুনেরাহ। তিনজন ই বসল চেয়ার টেনে। কেউ কোনো কথা বলছে না। সবার এমন অবস্থা দেখে সুনেরাহ বলল,”কফি খাবে?”

অনুভব নাকোচ করতে গিয়েও হ্যাঁ বলে দিল। সায়েম হাসি হাসি মুখে বলল,”তাহলে আমিও খাব।”

“ওকে।”

সুনেরাহ চলে গেল। সায়েম আর অনুভব বসা এখন। এক পর্যায়ে অনুভব বলল,”একটা কথা বলবে সায়েম।”

“জি স্যার।”

“অতীত কেন এত কষ্ট দেয়?”

প্রশ্নে থমকে গেল সায়েম। অনুভবের দিকে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা সমানে ঘামছে।

“কী হয়েছে স্যার? শরীর খারাপ?”

“শরীর খারাপ হলে তো চিন্তা হতো না সায়েম। খারাপ তো মন।”

কথার আগা মাথা সায়েমের বোধগম্য হলো না। সে চেয়ে রইল ভ্যাবলার মতন। ততক্ষণে কফি নিয়ে এসেছে সুনেরাহ।

“হাবুলের মতন না তাকিয়ে ধরো।”

কথাটা সায়েমকে বলল সুনেরাহ। ও প্রায় লাফিয়ে কফি কাপ ধরল। অনুভব বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,”শুনেছি, তুমি কখনো কাউ কে কফি বানিয়ে খাওয়াও না। আজ কেন বানালে?”

“কথাটা ভুল। স্পেশাল মানুষ হলে বানিয়ে খাওয়াতে অসুবিধা নেই।”

কথাটার পৃষ্ঠে আরো কিছু বলতে পারত অনুভব। তবে বলল না। ওর ভালো লাগছে না তেমন। ও কফি কাপ তুলে নিয়ে চুমুক বসাল। তবে সত্য, মনের দ্বন্দ্বে কফির স্বাদ কেমন পানসে লাগছে।

এত এত শপিং করা হয়েছে। সেগুলোই মেলে দেখানো হচ্ছে। এদিকে সায়রার মন ভালো নেই। তার দৃষ্টিতে উদাসীনতা। জুথি সবার জন্য চা নিয়ে এল।

“যে যার কাপ তুলে নে তো।”

সবাইকে এ কথা বলে সায়রার কাপটা তুলে নিল জুথি। পাশে বসে বলল,”তোর মন খারাপ?”

সবাই মনোযোগ দিয়ে জামা কাপড় দেখছে। তাই কথাটা শুনে নি। সায়রা মৃদু সুরে জবাব দিল।

“না ভাবি।”

“তোকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে।”

“তাই?”

“হুম।”

সায়রা চট করেই ফোনটা বের করল। ক্যামেরায় নিজেকে দেখে নিল।

“ঠিক ই আছে ভাবি।”

“না, ঠিক নেই। শপিং থেকে ফিরেই এমন হয়ে গেছিস।”

ও কিছু বলল না। কথা এড়াতে চায়ের কাপ তুলে নিল। চুমুক বসাল।

“চা ভালো হয়েছে। ভাইয়া কোথায়?”

“বাজারে গেল। কাজের চাপ খুব। একা সামাল দিচ্ছে।”

“রাতে লিস্ট করব নে। সবাই মিলে করলে এতটা চাপ হবে না।”

“তুই কথা ঘোরাচ্ছিস?”

“না ভাবি।”

“আমি বুঝতে পারি সায়রা।”

সায়রা আবার চুপ। জুথি ওর কাছে ঘেঁষে বসল।

“কী হয়েছে?”

সায়রার ভেতরটা আনচান করে ওঠল। কেঁপে ওঠল শরীর।

“বল, কী হয়েছে।”

“অনুভব কে দেখলাম ভাবি।”

জুথি চুপ হয়ে গেল। সায়রা ভাঙা কণ্ঠে বলল,”দেশে না এলেই ভালো হতো ভাবি।”

“সব সময় পালিয়ে বাঁচা যায় না সায়রা।”

ও জবাব দিতে পারল না। দুটো চোখ জ্বলতে শুরু করেছে। কলিং বাজায় জুথি চলে গেল। সায়রা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ পরিষ্কার নয়। মেঘ দেখা যাচ্ছে। আর মেঘের বুক ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩১

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩১)

বাংলাদেশের মাটিতে প্ল্যান স্পর্শ করে গেল। সায়রার বুক কেমন হু হু করছে। ও চোখ বন্ধ করে নিজ ভূমিকে অনুভব করল। ছয় বছর কিংবা তার ও কিছু বেশি সময় পর দেশে পা পড়ল তার। এই ছয় বছরে স্মৃতির পাতায় ব্যস্ততার পরিমাণ ই বেশি। লড়াই করে করে সে যে ক্লান্ত। আমিরা ওর বাহু টেনে ধরল।

“মিমি, ওঠে পড়ো।”

সায়রা চট জলদি ওঠে পড়ে। ওদের পেছনের সারিতে সিট পড়েছিল জাফরিনের। আমিরা এবার জাফরিনকে টেনে তুলল। মেয়েটা পুরো ফ্লাইটেই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।

“এসে গেছি?”

“হুম। পুরো ফ্লাইট ঘুমিয়ে পার করলে।”

জাফরিন আড়মোড়া ভেঙে বলল,”বলিস না রে। সব ভুলে বসেছিলাম। তাই তো আগের রাতে ঘুমাই নি। আর এখন ঘুমে ছাড়ছে না।”

“এখন চলো। গাড়িতে আবার ঘুমিও।”

“হুম।”

ওরা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বেরিয়ে পড়ল। সায়রার পা যেন চলছে না। কেমন যেন শক্তিহীন লাগছে।

“মিমি, কী হয়েছে?”

“কিছু না। চল তোরা।”

“এসো তুমি। পিছিয়ে পড়ো বার বার।”

আগে থেকেই মাহিম এয়ারপোর্টের বাইরে অবস্থান করছিল। আমিরাকে দেখতে পেয়ে এক চিলতে হাসি এল অধরে।

“মাহিম ভাইয়া!”

“তুই এত বড়ো হয়ে গেছিস?”

জবাবে লজ্জা এসে ছুঁয়ে গেল আমিরাকে। মাহিম আমিরার মাথায় হাত রেখে বলল,”চেনা যাচ্ছে না।”

“চিনবে কেমন করে? তখন ছিল ১২। আর এখন ১৮।”

“সেটাই। পিপি কোথায়?”

সায়রার কথা জিজ্ঞাসা করতে করতেই জাফরিনের দিকে নজর পড়ল মাহিমের। মেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে!

“বলা হয় নি, ও জাফরিন আপু। ইতালিতে আমাদের সাথে পরিচয় হয়েছে।”

“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে কেন? ঘোড়া নাকি?”

জাফরিনের এত বেশি ঘুম পাচ্ছিল যে শুরুর দিকে চোখ মেলে তাকাতেই পারছিল না। তবে শেষ কথা গুলো শুনল ও। তাই প্রতিবাদ করে বলল‍,”এই ছেলে, কাকে ঘোড়া বলো?”

“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমালে ঘোড়া বলব না?”

জাফরিন ফের কিছু বলার আগেই সায়রা এসে পড়ল। মাহিম এগিয়ে এসে সায়রাকে আলিঙ্গন করল।

“পিপি,কেমন আছ তুমি?”

“ভালো রে। তোদের কী খবর?”

“আর খবর। ছেড়ে গিয়ে তো ভুলেই বসেছিলে।”

সায়রা মলিন হাসল। ওরা আর কথা বাড়াল না। ব্যাগ পত্র গুটিয়ে চলতে লাগল।

অনুভবের গাড়িটা এয়ারপোর্টের পার্কিং এ এসে থামল। আজ তার লন্ডনের ফ্লাইট আছে। ওর সাথে যাচ্ছে সায়েম ও।

“আমরা কী লেট করে ফেলেছি সায়েম?”

“নো স্যার। আমরা সময়ের দু মিনিট পূর্বেই এসেছি।”

“ঠিক আছে। নামো তাহলে।”

অনুভব আর সায়েম গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আকাশে আজ রোদ খেলা করছে। ঝকঝকে তকতকে পরিবেশ। অনুভব চোখে রোদ চশমা লাগাল।

একই পাশে সায়রাদের গাড়িটাও দাঁড় করানো। সায়রা ক্লান্ত শরীরে গাড়ির কাছে আসছে। ঠিক সে সময়েই ফোন কল আসায় উল্টো পাশ ঘুরল অনুভব। সায়রা ওর গাড়িটা ক্রস করে নিজেদের গাড়িতে ওঠে বসল। অনুভবের কথা তখনো শেষ হয় নি। সায়রাদের গাড়ি পার্কিং ছেড়ে বের হবে। হর্ণ পেয়ে একটু পেছনে সরল অনুভব। একবার চাইল গাড়ির পানে। তবে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা মেয়েটির মুখশ্রী দর্শন হলো না ওর।

জুথি অনেক আয়োজন করেছে। সায়রা আর আমিরার সাথে জাফরিন কে দেখে একটু অবাক হলেও ক্রমেই এক গাল হেসে জাফরিনকে আপন করে নিয়েছে। জাফরিন ও খুব মিশুক প্রকৃতির। তবে মাঝে একটি সমস্যা হয়ে গেল। জুথি কে কী বলে ডাকবে জাফরিন সেটাই বুঝতে পারছে না। সায়রাকে সে আপু বলে ডাকে। এদিকে আমিরা তাকে আপু ডাকে। সেই জন্য জুঁই ও আপু ডাকে। ডাকাটাও স্বাভাবিক। ওদের বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি তো নয়। ও একটু সমস্যাতেই পড়ল। মুখ চোখ অন্ধকার। মাহিম গাড়ি পার্ক করে রেখে এসেছে। বসার ঘরে আসতেই দেখল ওর অবস্থা। জুঁই শরবত এনে রাখছে।

“ভাইয়া, শরবত দিব?”

“না। ঘরে যাই আমি।”

জুঁই এক গ্লাস শরবত নিয়ে জাফরিনকে দিল। জাফরিন হেসে শুধাল,”তোমার বিয়ে?”

“হুম আপু।”

“বাহ, অভিনন্দন।”

“থ্যাংক ইউ।”

ওরা দুজন গল্প করছে। সায়রা তখন নিজের ঘরে অবস্থান করছে। ওর ঘরটা নিচ তলায়। অনেক দিন তালাবদ্ধ ছিল। ওরা আসবে বিধায় পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে বিশেষ কোনো পরিবর্তন করা হয় নি কক্ষটির। সব আগের মতন। সায়রার বুক ভারী হয়ে আসছে। বুক শেলফে নজর পড়তেই হৃদয়টা হু হু করে ওঠল। একটি বইয়ে চোখ আটকে গেল ওর। বইটা হাতে নিয়ে দেখল ধুলোয় ভরে গিয়েছে। ও ধীরে ধীরে বইয়ের মলাট থেকে ধুলো সরিয়ে নিল। ভেসে ওঠল “প্রেমানল” নামটি। সহসাই ওর চিত্তে একটা ব্যথা শুরু হলো। মনে পড়ে গেল সেই স্মৃতির কথা। সম্ভবত অনুভব প্রথমবারের মতন রোজগার করে তাকে “প্রেমানল” বইটি কিনে দিয়েছিল।

জাফরিনকে কক্ষ দেখিয়ে দিল জুঁই। এই বাড়িতে মোট ৬ খানা কক্ষ রয়েছে। আমেনার ঘরটিতে এখন আমিরা থাকছে। জুঁই কে যে ঘর দেওয়া হলো তা মূলত গেস্ট রুম হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। ঘরটি আজ ই পরিষ্কার করা দেওয়া হয়েছে।

“কোনো অসুবিধা হলে ডেকে নিও আমায়?”

“ঠিক আছে।”

জুঁই চলে গেল। জাফরিন ঘরটা একটু দেখে নিল। বাড়িটা যে মধ্যবিত্তদের তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। তাতে অবশ্য ওর অসুবিধা নেই। ও তো এত বিলাসিতা এমনিতেও পছন্দ করে না। তাই এখানে ওর অসুবিধা হবে না। ওর চোখে এখনো ঘুম রয়েছে। তবে এর আগে শাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন। ও একটু জিরিয়ে নিয়ে শাওয়ার নিতে গেল। শাওয়ার শেষে যখন বারান্দায় কাপড় মেলতে এল তখনই সমস্ত পরিবেশ অন্ধকারে ভরে গেল। লোডশেডিং হয়েছে। অন্ধকার ভীতি রয়েছে ওর। ও চিৎকার করে ওঠল। ছুটতে লাগল দিক বেদিক। আর মাঝে ধাক্কা খেল কারো সাথে। যার ফলে পড়ে গেল ও।

ফোনের ফ্লাশ জ্বালাতেই মাহিমের মুখশ্রী ভেসে ওঠল। জাফরিন পা ধরে বসে আছে।

“পাগলের মতন ছুটছিলে কেন?”

“আগে ওঠাও আমায়।”

“ওয়েট।”

ফোনটা পাশে রেখে জাফরিনকে টেনে ওঠাল মাহিম। জাফরিনের পা ব্যথা করছে। চলতে পারছে না।

“আমার পা…” বলে আর্তনাদ করে ওঠল জাফরিন। মাহিম চোখ মুখ শক্ত করে বলল,”এই ঘরে থাকতে দিয়েছে তোমায়?”

জাফরিন নিরুত্তর। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মাহিম হেসে বলল,”মেয়ে মানুষের যত ঢং।”

“এই ছেলে। কীসের কী বলছ তুমি?”

“এই সামান্য ব্যথায় কেউ কাঁদে নাকি?”

“এটা সামান্য ব্যথা?”

“তো?”

জাফরিন কিছু বলল না। পা ধরে দেয়ালে ঠেস ধরে রইল। মাহিম পুরো হতাশ। কারেন্ট আসে নি তখনো।

“হাত সরাও।”

নিচু হয়ে কথাটা বলল মাহিম। জাফরিন অবাক হয়ে বলল,”কী করবে? এই আমার পা স্পর্শ করবে না।”

“চুপ করে থাকো।”

এক প্রকার অবজ্ঞা করেই মেয়েটির পা স্পর্শ করল মাহিম। জাফরিন চেচিয়ে ওঠল,”ব্যথা পাব আমি। ব্যথা পাব।”

কে শুনে কার কথা। মাহিম ওর পা ধরে ইষৎ টান দিল। এতে অবশ্য জাফরিন ব্যথা পেল। তবে ওর চেচানো শুনে মনে হচ্ছে কেউ খুব মে রে ছে। ওর এমন চেচানো দেখে মাহিমের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হলো। এই মেয়েটা এত অদ্ভুত কেন? দাঁড়িয়ে ঘুমায়, একটুতেই কেঁদে ফেলে। এখন আবার ব্যথা না পেয়েও চেচামেচি করছে!

“না চেচিয়ে পা নাড়িয়ে দেখো।”

কে শুনে কার কথা। জাফরিন সমানে চেচিয়ে চলেছে। মাহিমের ইচ্ছা করছে মেয়েটির মাথায় ঠাস করে চ ড় বসিয়ে দিতে।

“থামবে তুমি? পা নাড়িয়ে দেখো। ঠিক হয়ে গেছে।”

জাফরিন প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল,”নিজেকে ডাক্তার ভাবো নাকি?”

অন্তিমক্ষণেই জাফরিন অনুভব করল পায়ের ব্যথাটা নেই। সে চলতে পারছে। মাহিম এক গাল হেসে বলল,”ডাক্তার ভাবি না। আমি ডাক্তার ই।”

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-৩০

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (৩০)

অনুভবের প্রতিটা সকাল শুরু হয় জিমে শরীরচর্চার মাধ্যমে। ভারী ডাম্বেল ওঠানামা করছে সে। এদিকে সায়েমের অবস্থা কাহিল। সে একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অনুভব শরীরচর্চা শেষ করে তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছে নিচ্ছে। সায়েম বলল,”আপনার শক্তির কাছে নিজেকে তুচ্ছ লাগে স্যার।”

“তাই?”

“হুম। ভাবতেও অবাক লাগে আপনি এক সময় কেমন হেংলা,পাতলা ছিলেন। আর অলস ও বটে।”

সায়েমের সাথে ওর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই খুব সহজেই কথা গুলো বলে ফেলল ও। অনুভব এক ফালি হেসে বলল,”মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল।”

“সেটাই স্যার। না হলে আমার অত দিনের গার্লফ্রেন্ডটা বিয়ে করে নিতে পারত!”

সায়েমের কথায় দুঃখ মিশে আছে। অনুভব ওর বাহুতে হাত রেখে বলল,”জীবন কারো জন্য থেমে থাকবে না সায়েম। যে ছেড়ে যায় তাকে স্মরণে ও রাখতে নেই।”

“ঠিক। তাকে ঘৃণা করা উচিত।”

এবার অনুভবের মুখশ্রী ইষ‍ৎ কালো হয়ে গেল। তারপর ও বলল,”অনেক বেশি ঘৃণা করা উচিত।”

অনুভব যখন বাসায় ফিরছিল তখন আহনাফ লিফ্টের কাছে দাঁড়িয়ে। পড়াশোনার চাপে কাতর হয়ে গেছে ও। চোখে চশমা ওঠেছে।

“এই যে পড়কুট ছেলে। কী খবর?”

অনুভব কে দেখে আহনাফ স্থিমিত হয়ে গেল। ওর বাহু টেনে ধরল অনুভব।

“কী ব্যাপার। সারাক্ষণ শুধু পড়াশোনাই করিস?”

“পড়াশোনা তো ভালো অনুভব চাচ্চু।”

“ভালো, তবে অতো বেশি পড়া তো ভালো না। দেখেছিস এই বয়সেই তোর চোখে চশমা ওঠে গেছে।”

আহনাফ চুপ করে গেল। লিফ্ট এসে গেছে। ওরা দুজন লিফ্টে ওঠল। অনুভব ফের বলল,”এত না পড়ে একটু অন্য দিকে ফোকাস করলেও তো পারিস।”

“আমার পড়তেই ভালো লাগে। মিস বলেছিল পড়াশোনা করলে অনেক বড়ো হওয়া যায়। বন্ধুরা ও গুরুত্ব দেয়।”

কথাটা শুনে অনুভবের মুখশ্রী বির্বণ হয়ে এল। লিফ্ট ওদের তলায় এসে যাওয়ায় ও চলে গেল। আহনাফ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ও ভেবে পায় না অনুভব চাচ্চু কেন সায়রা মিসের কথা ওঠলেই চুপ হয়ে যায়। তাদের দুজনের বন্ধুত্ব এখনো মনে পড়ে ওর।

জাফরিন এসেছে। সায়রা সাদা ভাত আর ঝাল ঝাল করে মুরগির ঝোল করেছে। ও তৃপ্তি নিয়ে ভাতের লোকমা তুলল। চিবুতে চিবুতে বলল,”জাস্ট ওয়াও। এত দারুণ রান্না জানো তুমি।”

“আরেকটু নাও জাফরিন।”

“হুম দাও।”

জাফরিন ফের খাওয়া শুরু করল। তৃপ্তিতে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমিরা খেতে খেতে বলল,”জাফরিন আপু, তোমার তো গ্রাজুয়েশন শেষ, তুমি কি ইন্ডিয়া যাবে?”

“বলিস না রে, বাবা-মা পাগল করে দিচ্ছে। ছুটিতে যেতে বলে। আমার ইচ্ছা করে না।”

“কেন?”

“গেলেই বিয়ে করতে বলবে।”

“খারাপ কী? তুমি বিয়ে করবে না?”

“না।”

“ওমা! কেন?”

“ভালো লাগে না আমার। আমি চিল লাইফে থাকতে চাই।”

সায়রা খাওয়ার সময় কথা পছন্দ করে না। ও আসায় ওরা চুপ হয়ে গেল। জাফরিন বলল,”আপু তুমিও বসে পড়ো।”

“বসছি। কি নিয়ে কথা বলছিলে তোমরা?”

আমিরা কিছু বলতে চাচ্ছিল। ওর কথা কেড়ে নিয়ে জাফরিন বলল,”ভাবছিলাম বাংলাদেশ গিয়ে একবার ঘুরে আসব।”

“বাহ ভালো তো। কবে যেতে চাও?”

“এখনো ঠিক করি নি।”

সায়রা একটু ভেবে নিয়ে বলল‍,”তাহলে আমাদের সাথে যাবে জাফরিন?”

“মিমি, আমরা বাংলাদেশে যাব?”

“হুম। ভাবি কল করে বলল জুঁই এর বিয়ে।”

“ইস আমি তো কিছুই জানি না।”

“তা জাফরিন, আমাদের সাথে যাবে? তাছাড়া বাংলাদেশে তো তোমার চেনা জানা নেই। কোথায় যাবে, থাকবে।”

জাফরিন বিষয়টা মজা করে বলেছিল। তবে সায়রা বলার পর কেন যেন যেতে ইচ্ছা করছে। তাছাড়া বাবা-মায়ের জন্য দেশে ও যাওয়া যাচ্ছে না। তার থেকে ভালো প্রতিবেশি দেশে ঘুরে আসা যাক। জাফরিন ভাতের লোকমা তুলে বলল,”ঠিক আছে।”

আমিরার তেমন আনন্দ লাগছে না। ওর ইতালিই ভালো লাগে। এই ভালো লাগার পেছনে কারণ ও আছে। এই যে ওর ছোট্ট মনে একজন জায়গা করে নিয়েছে। দেশে গেলে সেই মানুষটার সাথে দেখা হবে না। এ বিষয়টিই ওর মন খারাপ করে দিচ্ছে।

সুনেরাহ বাবার ঘরের দরজায় এসে নক করল। শব্দ পেয়ে ভদ্রলোক বললেন,”এসো।”

“পাপা হুট করে ডাকলে যে?”

“তুমি তো আপডেট দিলে না মামুনি। অনুভবের সাথে দেখা করেছে দু সপ্তাহের ও বেশি।”

সুনেরাহ আমতা আমতা করে বলল,”আসলে পাপা আমি একটু সময় চাই।”

“ওকে তোমার পছন্দ নয়?”

সুনেরাহ চুপ করে রইল। ওর মা এবার বললেন,”তুমি যদি এবার ও বলো পছন্দ না তাহলে আর কিছু বলার নেই। অনুভব লাখে একটা।”

“আই নো মাম্মা।”

“তাহলে সমস্যা কী?”

“আমরা দুজন এখনো নিজেদের ভালো করে জানি না মাম্মা। পরিচয়টা ভালো হোক। তারপর না হয় ডিসিশন নিব।”

ওর মা কিছু একটা বলতেই নিচ্ছিলেন। তবে ওর বাবা বাঁধা দিয়ে বললেন,”ঠিক আছে মামুনি। তুমি যেটা ভালো মনে করো।”

“থ্যাংক ইউ পাপা।”

সুনেরাহ নিজের ঘরে ফিরে অনুভবের একটি ছবি বের করে দেখতে লাগল। ছেলেটার খামতি নজরে আসে না ওর। ওর সব কিছুই ভীষণ সুন্দর। সুনেরাহ দু চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে। কিছু সময় পর ও ভাবল অনুভব কে কল করবে। হলো ও তাই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কিন্তু কল রিসিভ হলেও ওপাশের ব্যক্তিটার কণ্ঠ শুনে ওর মুখ কালো হয়ে গেল।

“আপনি কে?”

সায়েম আমতা আমতা করে বলল‍,”আমি অনুভব স্যারের পি এ।”

“ওনার ফোন কল কেন রিসিভ করেছেন?”

“আসলে ওনি মিটিং এ।”

“তাই বলে রিসিভ করবেন?”

সায়েম তাজ্জব বনে গেল। উত্তর দিতে পারল না। কিছু সেকেন্ডের মাঝেই অনুভব এসে পড়ল। সায়েম ফোন এগিয়ে দিল।

“হ্যালো।”

সেই কণ্ঠস্বর! সুনেরাহ’র ভেতরটা শীতল হয়ে গেল।

“অনুভব, আমাকে চিনতে পারছেন?”

“সুনেরাহ?”

“জি। কী খবর আপনার?”

“ঠিক ঠাক। আমি ভেবেছিলাম কিছু দিনের মধ্যেই আপনার সাথে মিট করব।”

“কবে ফ্রি আছেন? আমি কি আপনার অফিসে আসব?”

“আসতে পারেন। আপনার সাথে ডিটেলস আলোচনা আছে।”

“ঠিক আছে। তার আগে একদিন আমাদের বাসায় আসুন। পাপা বলছিল আপনাকে বাসায় নিয়ে আসতে।”

অনুভব ঘড়িতে টাইম দেখল। রাত এগারোটা বাজে। আজ অনেক গুলো কাজ ছিল। ও বলল,”সময় করে আসব এক দিন। আপনি ফ্রি থাকলে কাল ই চলে আসুন। দ্রুত কাজ গুলো করে রাখতে চাই।”

“ঠিক আছে। তাহলে রাখছি?”

“আচ্ছা। গুড নাইট।”

“গুড নাইট।”

কল রেখে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল সুনেরাহ। ওর ভেতরটায় শত শত প্রজাপতি ডানা মেলে ওড়ে বেড়াচ্ছে। হুট করেই নিজেকে কেমন সুখী সুখী অনুভব হচ্ছে।

এদিকে সায়েমের মুখ গোমড়া। অনুভব সেটা খেয়াল করে বলল,”কী হয়েছে?”

“ম্যাডাম আমাকে বকা দিয়েছে স্যার।”

“কেন?”

“কল রিসিভ করায়।”

“কী বলেছে?”

“বলেছে কেন আপনার কল রিসিভ করেছি।”

“তুমি কী বললে?”

“আমি কিছু বল‍তে পারি নি।”

অনুভব হতাশ হয়ে চেয়ে রইল। শুরুর দিকে সায়েমকে চালাক মনে হতো। অথচ এখন মনে হয় ছেলেটা আস্ত গাধা। এর কারণ আছে অবশ্য। ঐ যে, গার্লফ্রেন্ড হারানোর শোকে ছেলেটার মস্তিষ্কের বুদ্ধি হারিয়েছে। অনুভব বুক ভরে শ্বাস নিল। কাউকে হারিয়ে ফেলার পর মানুষের জীবনে আমুল পরিবর্তন আসে। তার ও এসেছে।

চলবে…
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশ

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-২৯

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৯)

সায়রা শাওয়ার নিয়ে সবে ফিরেছে। ওমনি আমিরা এসে বলল জুথি কল করেছে। এখানে আসার পর থেকে কথা বার্তার পরিমাণ কমে গেছে। এই যে যেমন আজ তাদের দু সপ্তাহ পর কথা হচ্ছে।

“হ্যাঁ ভাবি কেমন আছ?”

“কেমন থাকব বল। ভুলেই তো গেছিস।”

“ভুলি নি গো। সমস্যা হলো সময়। সময় মেলাতে পারি না।”

“থাক আর সাফাই দিতে হবে না।”

সায়রা একটু হেসে বলল,”আচ্ছা বাবা সরি। এখন বলো সবার কী খবর?”

“খবর আর কি হবে। তোর ভাতিজি তো তোর মতন। অবশেষে বিয়ের জন্য রাজি হলো।”

সায়রা সবে মাত্র বিষয়টা খেয়াল করল। দেখতে জুঁই ও বড়ো হয়ে গেল। এখন তার একুশ বছর বয়স।

“ছেলে কী করে ভাবি?”

“আর বলিস না। মেয়ে নিজে পছন্দ করে বসে আছে।”

“ভালোই তো।”

“ভালো না ছাই। ছেলের আহামরি টাকা পয়সা নেই। সাধারণ চাকরি করে।”

“তাতে কী ভাবি? টাকা পয়সা দিয়ে কী সুখ হবে বলো। তার থেকে ভালো ওর ভালো থাকা টা। তুমিই দেখো। তোমার যখন বিয়ে হয় ভাইয়া তখনো স্টুডেন্ট। রোজগার নেই। সময়ের সাথে সাথে সংসার ভরে ওঠেছে। তুমি কী সুখী নও?”

জুথি একটা গভীর নিশ্বাস ছাড়ল। হ্যাঁ সে সুখী। তবে কখনো সখনো মনে হয় জীবনটা আরো সুন্দর হলেও পারত। আসলে মানুষের মন ই খারাপ। এই মন যত পায় তত চায়। সন্তুষ্ট হতে পারে না কিছুতেই। তবু জুথি মনে মনে একবার সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলে নিল।

“শোনো, জুঁই কে কিছু বলবে না। ছেলে ভালো হলেই হয়।”

“সে ঠিক আছে। এখন বল তুই কবে আসবি?”

“আমি?”

“এত অবাক কেন হচ্ছিস?”

“ভাবি আমি তো….”

“শোন সায়রা। তুই যদি না আছিস, তাহলে বিয়ে বন্ধ।”

“এটা কেমন কথা ভাবি?”

“এটাই ভালো কথা। তোকে ছাড়া মেয়ে বিদায় করব না।”

সায়রা মৌন হয়ে গেল। জুথি মন খারাপের সুরে বলল,”এখন তো অনেক কিছু বদ‍লে গেছে সায়রা। এখন তো আসতেই পারিস।”

সায়রা চুপ। সে ও ফিরতে চায়। তবে কখনো সখনো মনটা বড়ো পো ড়া য়।

অনুভব এক মনে খাবার খাচ্ছে। তার খাবার তৈরি করা হয় বিশেষ ভাবে। তেল মসলার পরিমাণ নেই বললেই চলে। সারাক্ষণ সেদ্ধ খাবার গুলো খায়। ছেলের এমন অবস্থা দেখে রুপবান হতাশ হয়। তিনি আজ ছেলের প্রিয় সর্ষে ইলিশ করেছেন। অথচ অনুভব ফিরেও দেখছে না।

“বাবা একটু খেয়ে দেখ না।”

“মা, আমি এসব খাই না।”

“তোর প্রিয় সর্ষে ইলিশ। দেখ একটু খেয়ে।”

রূপবান ছেলের নাকের কাছে খাবারটি ধরলেন। অথচ ছেলে নাক ছিটকে বলল,”প্লিজ জোর কোরো না।”

রূপবানের কান্না পেল। ছেলেটা কী শুরু করেছে। এই সেদ্ধ শাক,পাতা খাওয়া কোনো জীবনের মধ্যে পড়ে? আমিন সাহেব চুপ করে খাচ্ছিলেন। এবার মুখ খুললেন।

“মাঝে মধ্যে এ রকম খাবার খেতেই পারো অনুভব।”

“না, বাবা। এসব আমার ভালো লাগে না।”

“কথা টা তো সত্য নয়। ভালো লাগে। বরং তুমি ইগ্নোর করো। সেটাও বহাল রেখেছ এত বছর ধরে।”

“একটা হলেই হলো। এখন এসব খেতে ইচ্ছে করে না।”

“তোমার যে কী হলো অনুভব।”

“কিছু হয় নি বাবা। আমি একদম ঠিক আছি।”

“সেটা তো দেখতেই পারছি। হেংলা ছেলেটা কেমন বলিষ্ঠ হয়ে গেছে। এত এত দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে। রীতিমতো বাবাকে ধা ক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।”

বাবার কথায় এক চোট হাসল অনুভব। ওর খাওয়া শেষ। টিসু দিয়ে মুখ মুছে বলল,”ঠিক আছে। তোমরা খাও। আমি বের হলাম।”

“শুনে যাও অনুভব।”

অনুভবের হাতে সময় কম। মিটিং রয়েছে। বাবার কথায় দাঁড়াল ও।

“দ্রুত বলো প্লিজ। সময় নেই।”

“বলছি, এত তাড়া কেন?”

“মিটিং আছে।”

“সুনেরাহ কে কেমন লাগল?”

“দারুণ বাবা।”

আমিন সাহেব মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। অনুভব ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল,”ও খুবই কর্মঠ। আমি তো কথা বলেই ঠিক করে ফেলেছি সামনে যে ক্লথের বিজনেস শুরু করব তার মডেল হবে ও।’

ভদ্রলোকের মুখটা চুপসে গেল। তিনি বললেন,”তুমি ওকে মডেল করবে ভেবেছ?”

“হুম। পারফেক্ট যাবে ওর সাথে।”

“তুমি কী পাগল অনুভব?”

“কেন বাবা?”

“ওর সাথে তোমায় ডেটে পাঠিয়েছিলাম। যাতে করে দুজন নিজেদের চিনে নিতে পারো। আর তুমি কী না, বিজনেসের চিন্তা করে এসেছ!”

আমিন সাহেব হতাশ। অনুভবের সময় নেই। ও দ্রুত এসে মা কে জড়িয়ে ধরল। তারপর বিদায় জানিয়ে চলে গেল। এদিকে শুকনো মুখে বসে রইলেন আমিন সাহেব। তার ত্রিশ বছরের ছেলে মাঝে মাঝে তিন বছরের ছেলের মতন আচরণ করে!

জুঁই অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছে। এদিকে সুবর্ণ’র আসার নাম নেই। জুঁই বিরক্ত হয়ে কল করল।

“তুমি কী আসবে না সুবর্ণ?”

“এসে পড়েছি জান। একটু অপেক্ষা করো।”

“তুমি একটা অসহ্য।”

“আই নো। আর এই অসহ্য কেই তুমি ভালোবাসো।”

জুঁই হতাশ হয়ে বসে রইল। এই ছেলে বরাবর ই লেট।

দশ মিনিট পর সুর্বণ কে দেখা গেল। ওর হাতে ফুলের গুচ্ছ। এসেই ফুল গুলো রাখল টেবিলে।

“তোমার প্রিয় অর্কিড।”

“ফুল কেন আনতে গেলে। এসব কত দাম।”

“তাতে কী?”

“আমাদের সংসার গোছাতে হবে সুবর্ণ। আমি তো ভেবে নিয়েছি টিউশনি শুরু করব।”

সুবর্ণ আরাম করে বসল। ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেল। জুঁই ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।

“মন খারাপ করে আছ কেন? বাসায় কিছু বলেছে?”

“উহু। বাসায় কিছু বলে নি। তবে ভেবেছি বিয়েতে তেমন অনুষ্ঠান করব না।”

সুর্বণ হেসে শুধাল,”কেন?”

“টাকা বাঁচাতে হবে না? সামনে আমাদের কত কিছু কেনাকাটা আছে। সংসারের জন্য সব প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে হবে।”

সুর্বণ কথা বলল‍ না। কফি চলে এসেছে। কফি নিয়েও জুঁইয়ের চিন্তার শেষ নেই। ও বলল,”পাঁচশ টাকা দিয়ে এই কফি না খেয়ে আমরা সেভিংস করতে পারতাম বলো।”

সুর্বণ এবার ও চুপ। জুঁই ওর হাতটা আগলে ধরল।

“সুর্বণ আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। প্লিজ কখনো ছেড়ে যেও না।”

“যাব না। তুমি একটু বেশিই চিন্তা করছ।”

“চিন্তা করছি, কারণ আমি একটা সুন্দর সংসার গোছাতে চাই। অনেক কিছু থাকতে হবে না। শুধু আমরা দুজন ভালো থাকলেই হবে।”

জুঁইয়ের বলা কথাটা সুর্বণের বুকে এসে লাগল। মেয়েটা এত বেশি ভালোবাসে ওকে। ও মনে মনে ঠিক করল, শত বাঁধা এলেও মেয়েটিকে ছাড়বে না। কিছুতেই না।

একটা কাজের জন্য ফেসবুকে এসেছিল সায়রা। অনেক দিন পর আসা হলো। ঠিক তখনই ফ্রেন্ড সাজেশনে একটি মুখ ভেসে ওঠল। আইডিটা অনুভবের।

“মিমি কী দেখছ?”

সায়রা চট করেই ফোনটা অফ করে ফেলল। আমিরা খাবার নিয়ে এসেছে।

“কী রে। কী রান্না করেছিস?”

“এটা একটা ইতালিয়ান ডিশ। খুবই মজা হয়েছে। খেয়ে দেখো।”

এক চামচ খাবার তুলে দিল আমিরা। সায়রা খেয়ে দেখল সত্যিই দারুণ।

“ভালো হয়েছে রে।”

“প্রথম ট্রাই করলাম।”

“আচ্ছা শোন, জাফরিন কে একদিন ইনভাইট করতে চাচ্ছি।”

“ওয়াও,এটা তো দারুণ। জাফরিন আপুকে আমার এত ভালো লাগে।”

সায়রা চোখ রাঙিয়ে চাইল। জাফরিনের বয়স চব্বিশ। তাই মেয়েটিকে আপু বলেই সম্বোধন করে আমিরা। এদিকে জাফরিন আবার সায়রাকে আপু কে ডাকে। মোট কথা ওদের সম্বোধনে গোলমাল হয়ে গেছে। সায়রা হতাশ হলো। তারপর বলল,”কবে আসতে বলব?”

“কাল অফ ডে আছে। কাল ই আসতে বলো। ভালো হবে।”

আমিরার চোখে মুখে খুশি খেলা করছে। কত দিন হয় বাড়িতে কেউ আসে না। সব সময় সে আর মিমি।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-২৮

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৮)

সুনেরাহ’র আজ ব্লাইন্ড ডেট রয়েছে। মেয়েটি ভীষণ রূপবতী বলাই চলে। সে নিজেকে যথেষ্ট ফিট করে রাখে। পঁচিশ বছরের এই জীবনে অর্জন ও কম কিছু নয়। তার নিজস্ব মেকাপ ব্র্যান্ড রয়েছে। যার সুনাম পুরো দেশ জুড়ে।

“ম্যাম গাড়ি বের করা হয়েছে।”

সুনেরাহ দারুণ ভাবে নিজের হ্যান্ডব্যাগ টা তুলে নিল। এতে করে পরিচারিকা মেয়েটার চোখ স্থির হয়ে এসেছে। তার ধারণা সুনেরাহ’র মতন ফ্যাশন সচেতন মানুষ বাংলাদেশে খুব কম ই আছে। তার যদি অভিনয়ের দক্ষতা থাকত, তাহলে সিনেমা জগত কাঁপাত।

ব্লাইন্ড ডেট’টা সুনেরাহ’র বাবা অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছেন। অনেকদিন ধরেই তিনি বলছিলেন টপ ক্লাসের একটি ছেলে রয়েছে। অসাধারণ দেখতে। কাজেও সুনাম রয়েছে। সে যেন একবার দেখা করে। বাবার এত রকমের কথা শুনেই সে মূলত রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। সে প্রায় আধা ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে। অথচ ছেলেটার আসার নাম নেই। ও জুস খেতে খেতে ফোনের স্ক্রিনে টাইম দেখছে। আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে। এর বেশি এক মুহুর্ত থাকবে না সে। পাঁচ মিনিট শেষ হতে আর কিছু সেকেন্ড বাকি। সে তার ব্যাগ নিয়ে ওঠে যাচ্ছিল। সে সময়েই লম্বা,চওড়া, ফর্সা ত্বকের মানুষটির দেখা মিলল। চুলের স্টাইল, পারফিউমের ঘ্রাণ, সব অদ্ভুত রকমের সুন্দর। সুনেরাহ বুক ভরে শ্বাস নিল। অনুভব আসার পূর্বে মেয়েটি সম্পর্কে টুকটাক জেনে নিয়েছে। টপ ক্লাসের মডেলিং ও করে থাকে। যা এক নজর দেখেই বুঝে নিল অনুভব।

“সুনেরাহ জামান?”

ছেলেটার মুখ থেকে নিজের নাম শুনে একটু চমকে ওঠল ও। তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না। ওর চমকে যাওয়া মুখশ্রী দেখে হাসল অনুভব।

“আমি অনুভব রহমান।”

“সরি, আমি আসলে বুঝতে পারি নি। চলেই যাচ্ছিলাম।”

অনুভব কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল,”চলে যাচ্ছিলেন?”

“পুরো ৩৫ মিনিট লেট করে এসেছেন।”

অনুভব এতে হেসে ফেলল। বলল,”আই থিংক আপনার ভুল হয়েছে। আপনি আগে চলে এসেছেন।”

সুনেরাহ ভাবল অনুভব বোধহয় মজা করে বলছে। তাই ও কফির অর্ডার করে বলল,”ইটস ওকে আমি কিছু মনে করি নি। কখনো সখনো লেট হয়েই যায়।”

বিপরীতে অনুভব চুপ রইল না। ও বরং ফোন বের করে সুনেরাহ’র দিকে এগিয়ে দিল। স্পষ্ট ৪ টা ৩ বাজে। অনুভব এসেছে কয়েক মিনিট হয়ে গেছে। ও নিজের ফোন বের করে দেখল ৪ টা ৩৮ টা বাজে। কিছু সেকেন্ড পর বিষয়টি খেয়াল হলো। গতরাতে কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ফোনের সময় পরিবর্তন করেছিল। সেটা আর মনে নেই। ও একটু বিব্রত হয়ে বলল,”সরি। আমার ফোনের টাইম পরিবর্তন করা ছিল।”

“ইটস ওকে। কফি এসে গেছে।”

ওয়েটার কফি রেখে বলল তাদের আর কিছু লাগবে কী না। ওরা নাকোচ করতেই চলে গেল। সুনেরাহ’র মাথা হ্যাং হয়ে গেছে। অনুভবের সামনে লজ্জিত হতে হলো। কফি খেতে খেতে অনুভব বলল,”আপনার ব্র্যান্ডের বেশ সুনাম দেখলাম। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই দারুণ সাফল্য। গ্রেট!”

ওর কথায় সুনেরাহ হাসল। বলল,”সব জেনেই এসেছেন দেখছি।”

“সব নয়। আসার পথে রিসার্চ করে এলাম।”

“আমি কিন্তু আপনার বিষয়ে কিছুই জানি না।”

“কেন?”

“ভেবেছি সামনাসামনি জেনে নিব।”

সুনেরাহ ইচ্ছাকৃতভাবে কথা ঘুরিয়েছে। তার আসলে এই ডেটের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ই ছিল না। বাবার জোরাজুরিতে এসেছে। ভেবেই এসেছিল দু মিনিট ছেলেটার সাথে কথা বলে চলে আসবে। বাসায় ফিরে রিজেক্ট করে দিবে। কিন্তু অনুভবকে দেখার পর ওর মস্তিষ্কের চিন্তা বদলে গেছে। ও ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। অনুভব টেবিলে ঠকঠক শব্দ করতেই ওর ধ্যান ফিরল।

“আপনি চিন্তিত?”

“না, না। চিন্তিত নই। আচ্ছা, আপনি সম্পর্কে কিছু বলুন।”

অনুভবের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির দেখা মিলল। সুনেরাহ আড়চোখে দেখল সেটা। ওর কেবলই মনে হলো, কোনো মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়?

সুনেরাহ’র মস্তিষ্ক জ্যাম হয়ে গেছে। সমস্ত রাস্তা অনুভবের কথা ভেবেছে। ছেলের কথা বলার ভঙ্গিমা, চুলের স্টাইল, মুখের গড়ন, ফিট শরীর আর ভীষণ লম্বা। সব ওর মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। ও বাড়ি ফিরে আরো অস্থির বোধ করছে। নিজের এই অস্থিরতা কাটাতে ফেসবুক ঘেটে অনুভবের প্রোফাইল বের করে নিল। খুব কম ই ছবি সেখানে। মনে হচ্ছে আহামরি একটিভ নয়। লাস্ট ছবি পোস্ট করেছে প্রায় আঠারো দিন পূর্বে। প্রোফাইলে যে কটা ছবি আছে সবগুলো দেখে নিল সুনেরাহ। অথচ ওর মন শীতল হলো না। এত এত অস্থির লাগছে ওর।

সায়রা ইতালির একটি স্কুলে চাকরি করছে বেশ কিছু বছর হলো। পাঁচ বছরের ও বেশি সময় ধরে ইতালির রাজধানী রোমে থাকছে সে। শুরুতে অন্য এক শহরে থাকা হলেও কিছু মাস পর ই রোমে চলে আসে। এখানকার ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করেই চাকরিটি নিয়ে নেয়। পড়াশোনা চলাকালীন একটি কফি শপে জব করত। অনেক দিন পর কফিশপটায় এসেছে। ভালো লাগছে। কিছু সময় পর ভেতর থেকে পশ্চিম বঙ্গের একটি মেয়ে এল। সায়রার থেকে কম বয়সী। নাম জাফরিন।

“আপু, এত দিন পর এলে তুমি।”

জাফরিন আর সায়রা উষ্ণ আলিঙ্গন করল। সায়রা আর জাফরিনের পরিচয় এই কফি শপ থেকেই। দুজনে এক সাথেই কফি শপে কাজ শুরু করেছিল। যদিও জাফরিন ওর থেকে বেশ ছোট।

“কী খবর জাফরিন? তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“প্রচন্ড চাপ আপু। পার্ট টাইম জব আর পড়াশোনা চালানো খুবই যন্ত্রণার। বাট স্টিল ভালো করে যাচ্ছি। কজ টাকা এলে সব মন খারাপ ক্লান্তি চলে যায়।”

জাফরিনের কথায় হাসল সায়রা। মেয়েটি মোটেও মধ্যবিত্ত পরিবারের নয়। ইন্ডিয়ায় ওর বাবার বিশাল বিজনেস রয়েছে। অনেক টাকা রোজগার। তবে ওর মনে হয় নিজের টাকা খরচ করায় আলাদা আনন্দ রয়েছে। এই ব্যাপারটাই সায়রা আর জাফরিনের বন্ধনটা দৃঢ় করেছে। জাফরিন আর সায়রা কফি খেতে খেতে গল্প করল। জাফরিন বিল দিতে দিবে না। কিন্তু সায়রাও নাছোড়বান্দা। ও বিল না দিয়ে যাবে না। শেষমেশ জাফরিন কে হার মানতে হলো। তবে ও আর্জি রেখে বলল,”খুব দ্রুত আমি খাওয়াব। আমিরাকেও সাথে নিয়ে আসবে।”

“ঠিক আছে, আনব। তুমি সময় করে একদিন বাসায় এসো। ঝাল ঝাল মুরগি মাংস আর সাদা ভাত খাওয়াব।”

সায়রার কথা শুনেই জাফরিনের ক্ষিধে পেয়ে গেল। পেট জানান দিচ্ছে কত দিন হয় ভাত খাওয়া হয় না। সায়রার হাতে সময় কম। ও জাফরিনকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রোম ভীষণ সুন্দর একটি শহর। অথচ ওর মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। একেই হয়তো নিজ ভূমির প্রতি টান বলা হয়।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশ

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-২৭

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৭)

সময় যাচ্ছে আবার। অনুভবের উদাসীনতাও বাড়ছে। আজকাল ওর ছটফট চোখে লাগার মতন হয়ে গেছে। একটু খানি কথা বলার জন্য মন পাগলামি করে। নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল হয়ে গেছে। এই যে যেমন এখন মধ্যরাতের ও বেশি সময়। সমস্ত কাজ শেষ করে সায়রা ঘুমানোর জন্য এসেছে। অনুভবের কলটি এল তখনই। ও রিসিভ করতেই অনুভবের জ্বলন্ত কণ্ঠ।

“অফলাইন কেন থাকো সব সময়?”

ছেলেটার এহেন কথায় একটু যেন থমকাল সায়রা। এতটা অধিকার বোধ কেন দেখায় অনুভব? ও শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। একই ভাবে শুধাল,”তোমায় কেন বলতে হবে?”

“অবশ্যই বলতে হবে।”

“কেন বলতে হবে? সেটাই তো জানতে চাচ্ছি আমি।”

“কারণ…..’

অনুভব থমকাল। সায়রা ও আজ জ্বলে ওঠেছে। এর পূর্বেও অনুভব অধিকার দেখিয়েছে। কী বোঝাতে চায় ছেলেটা?

“বলো অনুভব, কারণ টা বলো আমায়।”

“কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি।”

শীতল হাওয়া এসে সায়রার সমস্ত দেহ ছুঁয়ে যায়। অনুভব পরপর বলে ওঠে,”আমি তোমায় পছন্দ করি সায়রা। ভালোবেসে ফেলেছি। কবে, কখন জানি না। জানি না আমি।”

সায়রার মাথাটা ফাঁকা লাগছে। এর পূর্বেও অনুভবের আচরণ গুলো ওকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছে। তবু তারপর ই ও পাত্তা না দিয়ে বিষয় গুলো এড়িয়ে গেছে। কিন্তু আজ, আজ কেমন করে এড়িয়ে যাবে সে? অনুভব অপেক্ষা না করেই বলল,”বলো, বলো সায়রা। তুমিও আমায় পছন্দ করো সায়রা। বলো প্লিজ। আনসার মি, সায়রা।”

সায়রা নিরুত্তর। ওর কাছে উত্তরটি দেওয়ার মতন শক্তি নেই। ও কল কেটে দিল। তারপর অনেকবার কল করল অনুভব। তবে সায়রা, সায়রা পাত্তা দিল না। ওর শুধু মনে হলো মাথার ওপর বিশাল সমুদ্রের ঢেউ এসে পড়ল। আর এই সমুদ্রের জলেই হারিয়ে যাচ্ছে ও।

দুদিন আহনাফকে পড়াতে যায় নি। বাড়ি থেকেও বের হয় নি। তবে কতদিন এমনটা চলবে? কতদিন সায়রা অনুভবের মুখোমুখি হবে না। আজ যে ওকে বের হতেই হলো। আর বের হয়েই অনুভবের সামনে পড়তে হলো। অনুভব রিকশা থামিয়েছে। আশপাশটা ফাঁকা। সায়রা নেমে গিয়ে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিল। অনুভবের লম্বা দেহ। সায়রা ওর বুকের সমান ঠেকেছে। মাথা উঁচু করে চাইল ও। দেখল ছেলেটার চোখ মুখ আঁধারে নিমজ্জিত। দুদিনেই যেন কেমন হয়ে গেছে। না ঘুমানোর জন্য?

“কী বলবে?”

সায়রার সরাসরি প্রশ্ন। অনুভব ও বলল,”আমি কিন্তু উত্তরটি পাই নি সায়রা।”

“তোমার বুঝে যাওয়ার কথা।”

“আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

“কী শুনতে চাও?”

সায়রা সরাসরি অনুভবের চোখের দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টি একত্র হয়ে গেল। অনুভব যেন কোনো মতে নিজেকে আটকিয়ে রেখেছে। ওর কান্না পাচ্ছে ভীষণ। সায়রা নিজের মাথাটা ঠান্ডা করল। কেউ কাউকে পছন্দ করতেই পারে। রিজেক্ট করার ও অপশন আছে। সায়রা সেটাই করল। কণ্ঠ নামিয়ে পুনরায় বলল,”আমাদের কিছু হবে না অনুভব।”

“কেন হবে না?”

“আমরা প্রায় সমবয়সী অনুভব।”

“ভুল, আমি তোমার পুরো এক বছর দুই মাসের বড়ো।”

ছেলেটার এহেন কথায় সায়রা যেন জবাব হারিয়ে ফেলল। অনুভব বলল,”বয়স সম্পর্ক তৈরির জন্য ঠিক কতটা ম্যাটার করে সায়রা? বলতে পারবে তুমি?”

সায়রা হতাশা ভরা কণ্ঠে বলে,”এর কোনো ব্যাখা নেই।”

“আমি তোমায় ভালোবাসি সায়রা। তবে কেন কোনো ব্যাখা নেই? ছয়টা মাস আমি প্রতিটা মুহূর্ত তোমায় ভালোবেসেছি। আর তুমি বলছো আমাদের কিছু হবে না। বয়সের তুলনা করছো।”

অনুভবের কথায় সায়রা অবাক হলো না। ও বরং বাস্তবতা ওঠিয়ে বলল,”অনুভব, ছয় বছরের দ্বিপাক্ষিক ভালোবাসা ভেঙেছে। আর তুমি ছয় মাসের একপাক্ষিক ভালোবাসার কথা বলছো?”

বিপরীতে অনুভব ও থেমে নেই। ও নিজের সবটুকু ভালোবাসা দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টায় বলে ওঠল,”সম্পর্ক তৈরির জন্য ছয় বছর কিংবা ছয় মাসের প্রয়োজন হয় না সায়রা। একটি সম্পর্কে তৈরির জন্য, মুগ্ধতা আনার জন্য একটি বিকেল ই যথেষ্ট। শুধুমাত্র এক বিকেল।”

সায়রা যেন খেই হারিয়ে ফেলল। ওর শব্দ ভান্ডার রিক্ত। ভালোবাসা হারানোর পর সায়রা আর কখনোই নিজের জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখে নি। কখনোই না।

সায়রা ঠিক যতটা ম্যাচিউর অনুভব ঠিক ততটাই বিপরীত। একটা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ও যেন পাগল হয়ে গেছে। অথচ সায়রা ভেবে পাচ্ছে না। ও অনুভবের জন্য কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না। শুধু অনুভবই নয় ওর হৃদয়ে আর কোনো অনুভূতিই বেঁচে নেই। এ যেন রিক্ততায় ভরা এক খন্ড হৃদয়ভূমি। অনুভব আজ আবার কল করেছে। ওর নিজের খামতি গুলো নিয়ে প্রশ্ন করেছে। সায়রার মন মানসিকতা হীন নয়। কাউকে বাহ্যিক দিক দিয়ে শুরুতেই বিচার করে না সে। বরং ভেবে দেখলে দেখা যাবে অনুভব অনেকক্ষেত্রে তার থেকে এগিয়ে। ওর কোনো ভাবনাই ছিল না। ও এতটা বিরক্ত হচ্ছিল যে এক পর্যায়ে আচমকাই বলে ওঠল,”শোনো অনুভব, তুমি খুবই অলস একটা ছেলে। উদাসীন থাকো সব সময়। কখনো কিছু নিয়ে সিরিয়াস না। দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় অনেকবার দিয়েছ। তোমার বাবার টাকা পয়সা আছে। কিন্তু এসব তোমার অর্জনের নয়। তুমি বলতে পারো জীবনে কী অর্জন করেছ? আমি কোন ভরসায় তোমার হাতটা ধরব?”

কথা গুলো বলার পর সায়রা নিজেই থমকে গিয়েছিল। কীভাবে কী বলে ফেলল সে। তবে এগুলোকে সংশোধনের চেষ্টাও করল না। ওর খুব খারাপ লাগতে লাগল। কান্না পেল। অনুভব কেন বুঝতে পারছে না, তার জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মতন সাধারণ নয়। কিংবা হবে না।

জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। না সায়রার জন্য থেমেছিল, আর না অনুভবের জন্য। দুজন আজ পৃথিবীর দুটো প্রান্তে বাস করছে। বৃষ্টির ফোঁটায় ঘোর ভাঙে সায়রার। ও চট করে জানালা গুলো বন্ধ করে দেয়। নিজের অতীতে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে কখন সময় পেরিয়ে গেছে ওর খেয়াল ই নেই। ঘড়িতে তখন বিকেল শেষ হতে চলল। আমিরা’র ফেরার সময় হয়েছে। ও চলল নাশতা বানাতে। নাশতা বানানো শেষ হতেই কলিং বেজে ওঠল। আমিরা এসেছে। কিছুটা ভিজে গেছে। সায়রা তোয়ালে এনে মেয়েটার মাথা মুছিয়ে দিল।

“ভিজে কেন এলি?”

“লেট হয়ে যাচ্ছিল তো।”

“ইস, তাই বলে এভাবে ভিজে আসবি। বছরের প্রথম বৃষ্টি। শরীর না খারাপ করে।”

“উফ মিমি, তুমি একটু বেশি বেশি চিন্তা করো।”

“হুম, আমি তো বেশি বেশি চিন্তাই করি। বড়ো হয়ে গেছিস। তাই এখন মিমি বেশি বুঝে।”

সায়রা যেন মন খারাপ করল। আমিরা ওকে জড়িয়ে ধরল। গালে চুমু খেয়ে বলল,”উফ, আমার মিষ্টি মিমি। রাগ করে না। আমি তো ছোট।”

ওর কথায় হেসে ওঠল সায়রা। আমিরাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলল,”আপনি আর ছোট নেই। কিছু দিন পর ই আঠারো তম জন্ম দিন আসতে চলেছে।”

আমিরা সংখ্যাটি হিসেব করল। তারপর মন খারাপ করে বলল,”ইস,কেন যে বড়ো হচ্ছি।”

“থাক, এখন আর এসব চিন্তা করতে হবে না। যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।”

আমিরা চলে গেল। সায়রা ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে হাসল। সময় পেরিয়ে গেছে। হ্যাঁ আরো অর্ধ যুগ পেরিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বাকি মানুষ গুলোর ও জীবন বদলেছে।

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

মুগ্ধতার এক বিকেল পর্ব-২৬

0

#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৬)

সায়রা বাসায় ফিরে জানতে পারল গতকাল বাহাদুর এসেছিল। এসে জামাকাপড় দিয়ে গেছে। ও রেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কল করল।

“কী মনে হয় আপনাদের? আমাদের সাথে তামাশা করেন?”

“ভদ্র ভাবে কথা বলো সায়রা। আমিরা আমার মেয়ে। আমি তার সাথে দেখা করার পূর্ণ অধিকার রাখি।”

“ও তো চায় না আপনার সাথে দেখা করতে।”

“সেটা তো তোমাদের করা ব্রেন ওয়াশের জন্য।”

“আচ্ছা? এত দরদ আপনার? বিয়েটা কেন করলেন? আপার মৃত্যুর পর মেয়েটার ওপর আ ঘা ত কেন করলেন? বের কেন করে দিয়েছিলেন?”

কথা গুলো বলার সময় সায়রা প্রায় চিৎকার করে ওঠল। আমিরা ওর সন্তানের থেকে কম নয়। মেয়েটিকে নোংরা উদ্দেশ্য ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এরা। কল রেখে সায়রা কেঁদে ফেলল। ওর ভয় হয়। ভীষণ ভয় লাগে আজকাল। মনে হয়, আমিরাকে রক্ষা করতে পারবে না ও। কিছুতেই পারবে না।

হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে অনুভব। সায়েম অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারা দিন সে অভুক্ত ছিল। ছেলেটা এত গাঁধা যে সাথে নাকি টাকা নিয়েও যায় নি। অনুভবের মাথা গরম। সেই তপ্ততা নিয়ে সে বার বার এদিক সেদিক করছে। খানিক বাদে আমিন সাহেবের প্রবেশ হলো। তিনি ছেলের সামনে এসে গর্জে পড়লেন না। তবে চোখের ভাষায় নিজের রাগ প্রকাশ করে গেলেন। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল দুর্বলতা আর ভয় থেকে এমনটা হয়েছে। আমিন সাহেব বের হয়ে ছেলেকে বললেন,”বাইরে এসো অনুভব।”

অনুভবের চোখে মুখে অসহায়ত্ত্বের ছায়া। ও যে কীভাবে কাজটা করে ফেলল। তাছাড়া সায়েম যে এমন গাঁধা হবে তা কে জানত?

বাবা ছেলে যেন দুটি পাহাড়। অনুভবের কেয়ারলেস অবস্থা দেখে আমিন সাহেবের রাগ বেড়ে গেল।

“তুমি এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কেন অনুভব? ছেলেটার যদি বড়ো কিছু হয়ে যেত? সাথে নিতে চাও নি ঠিক আছে। তাই বলে এভাবে ফেলে যাবে? অচেনা একটা স্থানে?”

অনুভবের মাত্রই খেয়াল হলো বিষয়টা। সে যে কী এক কাজ করে ফেলেছে তা সত্যিই লজ্জার। ও মাথাটা নামিয়ে বলল,”সরি বাবা।”

“আমাকে নয়, সায়েমকে গিয়ে সরি বলো। তোমাকে বোঝা হয়ে গেল অনুভব। তুমি সত্যিই কোনো কাজের নয়।”

আমিন সাহেব বেরিয়ে গেলেন। অনুভব বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হতাশ হলো। সে নিজেই নিজেকে বোঝাতে পারে না। ও ধীরে স্বস্তে হসপিটালের ভেতরে এল। ডাক্তারের থেকে জেনে নিল কথা বলা যাবে কী না। অনুমতি পেয়ে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করল অনুভব। সায়েম চোখ বন্ধ করে আছে। স্যালাইন চলছে। অনেকটা সময় যাওয়ার পর অনুভব অনুতপ্তের সুর মেলে দিয়ে বলল,”সায়েম, সরি। আমি আসলে বুঝে ওঠতে পারি নি। আর তুমি সাথে টাকা পয়সা রাখবে না?”

সায়েম চোখ মেলে তাকাল। তার বুক ধরফর করছে এখনো। সে আসলে এই দিকে একটু ভীতু। অচেনা পরিবেশে গুলিয়ে ফেলে সব কিছু। মানি ব্যাগ ও যে কখন কীভাবে পড়েছে জানে না। অনুভব বুঝল সায়েমের জবাব দিতে কষ্ট হচ্ছে। ও হাত দিয়ে বাঁধা প্রদান করে বলল,”পরে, এখন আর কিছু বলা লাগবে না। রেস্ট করো।”

পিকনিক শেষ করার পর সাতদিন পেরিয়ে গেছে। এই কয়েকটা দিন অনুভবের সাথে সায়রার দেখা হয় নি। আজ যখন আহনাফকে পড়াতে এল তখন দুজনের দেখা। সায়রা অন্যমনস্ক। হুট করেই ওর দেহের সাথে মাথা ঠুকে গেল। ধ্যান ফিরলে ও বলল,”সরি।”

“এমন উদাসীন ভাবে কোথায় যাচ্ছ?”

সায়রা মৃদু হেসে বলল,”আদালতে যাব।”

“আমিরার বিষয়টা?”

“হুম।”

অনুভব অল্পবিস্তর জানে এই সম্পর্কে। এই যে আমিরার বাবার করা অত্যাচার ও এখন মেয়ের প্রতি অতি দরদ দেখানো এসব সম্পর্কে সে জেনে নিয়েছিল অর্পার থেকে। সায়রাকে প্রশ্ন করতে ওর ইচ্ছা হয় না। মনে হয়, এই বুঝি কোনোভাবে মেয়েটিকে কষ্ট দিয়ে ফেলবে।

আদালতের সামনে রিকশা থামল। ভাড়া দিয়ে যেই না ভেতরে যাবে ওমনি অনুভবের জিরাফ দেহটা দৃশ্যমান হলো। সায়রা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলেছে। আমিরা হাত নাড়িয়ে অনুভবকে হাই জানাচ্ছে। দুজনের মাঝে যে শত্রুতা ভাব ছিল তা স্কুলে গিয়ে মিটিয়ে নিয়েছে অনুভব। এখন আমিরা আর অনুভব বন্ধু।

“তুমি এখানে কী করছ?”

“এলাম।”

“কিন্তু কেন?”

“আমার বন্ধুর জন্য।”

তারপরই আমিরা আর অনুভব হাই ফাই করল। সায়রা মাথা নাচিয়ে বলল,”বাহ, দুজন বন্ধু হয়ে গিয়েছ।”

অনুভব উত্তর না দিয়ে বলল,”কেইসের কতদূর?”

“লং প্রসেস। চলছে কাজ।”

“আসলে ওর বাবার মতলবটা কী?”

ইশারায় ব্যাপারটি থামিয়ে দিল সায়রা। অনুভব বুঝল আমিরার সামনে এ রকম আলোচনা ঠিক হবে না। ও আর প্রশ্ন না করে ভেতরে চলে এল। আদালতের কাজ শুরু হলো। বাহাদুরের চোখ মুখ অন্ধকার। সায়রা এক পলক তাকিয়ে আওড়াল,”নেশাখোর একটা।”

যুক্তির ওপর যুক্তি দিয়ে কেইস চলছে। তবে বাহাদুর সুবিধা করতে পারছে না খুব একটা। তাই ওর পথ আটকে দিয়ে বলল,”সায়রা তুমি খুব বাড়াবাড়ি করলে?”

“বাড়াবাড়ির অনেক কিছুই দেখেন নি বাহাদুর ভাই।”

“ভালোই ভালোই আমিরাকে ছেড়ে দাও।”

“জীবন থাকতে নয়। আপনাদের নোংরা খেলাতে তো কখনোই নয়।”

সায়রা এগিয়ে যাচ্ছিল। বাহাদুর আবার পথ আটকে দিল।

“কী চাও বলো?”

“কী দিতে চাচ্ছেন বলেন?”

সায়রার বিপরীত প্রশ্ন। বাহাদুর মাথা ঠান্ডা করে বলল,”টাকা দরকার? আচ্ছা পেয়ে যাবে।”

সায়রার হাসি পেল। এই লোক গুলো সম্পর্ক মাপে টাকা দিয়ে। ও গলার সুর উঁচু না করেই বলল,”আমি সম্পর্ক বিক্রি করি না বাহাদুর ভাই। আপনি বিগড়ে গিয়েছেন। আমার কষ্ট হচ্ছে আপা আপনাকে ভালোবেসেছিল।”

এই কথায় ইষৎ কেঁপে ওঠল বাহাদুরের দেহ। তবে যখনই বিদঘুটে ঘটনার স্মরণ হলো সে যেন পুরোই বদলে গেল। অশান্ত মেজাজে বলল,”তোমাদের মূল্য দিতে হবে। সবাইকে মূল্য দিতে হবে।”

বাহাদুরের কথায় একটু ও পাত্তা দিল না সায়রা। ও বরং নিজেকে ঠান্ডা করে বেরিয়ে এল। আমিরা আর অনুভব আইসক্রিম খাচ্ছে। সায়রা আসতেই অনুভব থমথমে গলায় বলল,”তোমার জন্য আনি নি। তুমি তো খাবে না।”

সায়রা হেসে ওঠল। ও জানে অনুভব কথাটি দ্বারা কী বুঝিয়েছে। বইমেলায় উপহার না নেওয়ার জন্যই অনুভব কথা গুলো বলেছে। তবে সায়রা মন থেকে চায় অনুভব নামের উদাসীন ছেলেটার জীবনেও কোনো লক্ষ্য আসুক। যার জন্য ভীষণ দায়িত্বশীল আর কর্মঠ হয়ে ওঠবে ছেলেটা। অথচ ও যদি জানত, ওর এই চাওয়াটা সৃষ্টিকর্তা আগেই কবুল করে দিয়েছিল। অনুভব নামক অলস ছেলেটার জীবনেও লক্ষ্য এসেছে। আর এই লক্ষ্যের নাম সায়রা। যার জন্য জনম জনম পাগলামি করতে চাইবে অনুভব। যাকে পাওয়ার জন্য নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে সে। কখনো অভিমানে, কখনো বা ভালোবাসায়। আর এই ভালোবাসার জন্য মানুষ নিজের প্রাণ দিতে ও নিতে উভয়ই পারে। তাহলে
হয়তো কখনোই সায়রা চাইত না অনুভব নামের উদাসীন হেংলা ছেলেটাও ভীষণ দায়িত্বশীল হয়ে উঠুক।

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি