কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার বান্ধবী মিরার কাছে জানতে পারি আহির অন্য আরেকটি মেয়ের সাথে রিলেশনে গেছে কিছুদিন আগে। ওইদিন বাসায় এসে কেন জানি না অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছিল মনে। প্রচুর কেঁদেছিলাম, ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা সময় অন্য ঘর থেকে যখন মা ডাক দিয়েছিল। তখন ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে গিয়েছিলাম। মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল,”এভাবে ঘুরছিস কেন?” এরপর দ্রুত ঘরে চলে এসেছিলাম। তখন বুঝতে পারি নি কেন এমন হচ্ছিল। ভাবলাম হয়তো সে আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল তাই খারাপ লাগছে।আমি সেই কথার সত্যি মিথ্যা যাচাই করি নি যাচাই করতে ইচ্ছে করে নি। তাছাড়া যাচাই করারও উপায় ছিলো না। আমি তো আর তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। এরপরের দিন গুলো স্বাভাবিকভাবেই যেতো। কিন্তু সে যখন সামনে পরতো আবার তখন আমি এলোমেলো হয়ে যেতাম। কষ্ট হতো মনে। এখন ক্লাস নাইন হতে টেইনে উঠে গেলাম। পড়াশোনার চাপ বাড়লো দ্বিগুণভাবে। তাও প্রতিদিন নিয়ম করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তার দেখা পাওয়ার আশায়। মাঝে মাঝে পেতামও তার দর্শন।আমাদের স্কুল ছিল আটতলা ভবনের। উপরের তিনটা তলা ছিল কলেজের ভাইয়া আপুদের জন্য। আমি ছিলাম পঞ্চমতলায়।তখন রোজার মধ্যেও স্কুলে কোচিং ছিল। ৯টা থেকে কোচিং শুরু হলেও আমরা ফ্রেন্ডরা আসতাম আধঘন্টা আগে। পুরো স্কুল রাউন্ড দিতাম। তখন শুধু পুরো স্কুলে আমরাই ছিলাম। ক্লাস রুম সব খালি। ষষ্ঠতলায় আমরা প্রতিদিনই যেতাম। কেননা ওখানের একপাশে কলেজের ভাইয়াদের ক্লাস হলেও। আরেকপাশ ছিলো পুরো ফাঁকা। তাই ক্লাস রুমগুলো অনেকটা ভূতুড়েই মনে হতো আমাদের। তখন কলেজের ভাইয়াদের ক্লাস ছিলো না। তাই আমরা প্রতিদিন সেখানে গিয়ে এখানে কেমন ভূতের মুভি বানানো যায় তাই নিয়ে কতক্ষণ আলোচনা করতাম।একদিন আমি আর ঈষিকা আগে চলে এসেছিলাম। তখন মাত্র স্কুল খুলেছে। আন্টিরা বেঞ্জগুলো পরিষ্কার করছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন আর কারোর দেখা মিললো না। আমরা দুজন তখন হাঁটা দিলাম সেই ভুতুড়ে তলায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমরা যেই না সামনে এগিয়েছি। তখনই দেখলাম একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত একটা ছেলে গিটার হাতে বসে আছে একটা টুলের উপর। এই অসময়ে আমরা দুজন ব্যতিত অন্য কোনো স্টুডেন্ট তো এখানে ছিল না। তার উপর গিটার হাতে পাঞ্জাবি পড়া।যার কারণে ঈষিকা ভূত বলে চিৎকার করে আমাকে রেখেই দৌড় দিলো। আমি তখনও স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। ঈশিকার চিৎকার শুনে ছেলেটি আমার দিকে ঘুরলো। আমি অবাক হলাম। কেননা এটা আহির ছিল। তখনই আরেকটা ভাইয়া সিড়ি দিয়ে উপর থেকে নিচে নামার সময় আমাকে দিলো ঝাড়ি। ঝাড়ি খেয়ে আর এক মুহুত দাড়ালাম না। দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম ওরা একটা প্রোগ্রামের জন্য স্কুলে এসেছে।
এরপর একদিন পড়তে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম। রাস্তার পাশে থাকা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আহির ও তার প্রেয়সীকে ঝগড়া করতে। আমার পাও তখন সেখানে জমে যায়। তখন সে আমাকে দেখে খুব জোড়ে মেইন গেইটের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল৷ আমিও সেইদিন চলে এসেছিল, সাথে জমেছিল তার প্রতি সুপ্ত অভিমান। সময় প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এসএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল, এখন তিন মাস বাড়িতে বসা। সে এখন আর তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় না। তার বন্ধুদের মাঠে খেলতে দেখলেও তাকে দেখি না। মনটা প্রতিনিয়তই বিষন্নতার অন্ধকারে ঢেকে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে যখন বাসা থেকে নিচে কিছু আনার জন্য যেতাম রাস্তায় দেখলেও আমার দিকে তাকতো না সে। কিন্তু আমি তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম। চাইতাম শুধু একটি বার আমার দিকে তাকিয়ে দেখুক। আমি ভালো নেই। যদিও চাওয়াটা ছিল অন্যায়। কিন্তু মন মানতে চাইতো না।
আমি যখন প্রায় বিষন্নতার অন্ধকারে ডুবে গেছি ঠিক তখনই আমার এক কাজিনের বার্থডে পড়লো।পাশাপাশি বিল্ডিংই থাকতাম আমরা। তো আঙ্কেল এসে আমাকে নিয়ে গেল যদিও আমি তখন যেতে চাইছিলাম না। কেননা আম্মুর পায়ের ব্যাথা ছিল। ছাঁদে কাপড় দেওয়ার সময় স্লিপ কেটে পড়ে গিয়েছিল। পায়ের অবস্থা নাজেহাল।তাই আব্বু আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে থাকলো আম্মু কাছে। আমি সেইখানে গিয়ে বসে রইলাম। কাজিনও ছিল ছোট। মাত্র ছয় বছর। তাও কতক্ষণ ওর সাথে গল্প করলাম। ও আবার আমার কাছে সবসময়ই গল্প শুনতে চাইতো। তখন খালামণি এসে বলে,
–“মিহিতা, তুই এখনো রেডি হস নি। ”
এরপর আমি সাজতে না চাইলেও খালামণি হালকা সাজিয়ে দিলো। চোখে কাজল,লিপস্টিক আর হালকা পাউডার। খালামণি চুল বেঁধে দিয়েছিল। এরপর গেস্টরা সবাই আসতে শুরু করলো। আমি আরোও একা হয়ে যেতে লাগলাম। কেননা আমি তেমন কাউকেই চিনতাম না। এরপর আমার মামাতো বোন আসতেই আমার বোরিং ফিল হওয়াটা একটু কমলো। ও আর আমি গেলাম ছাঁদে। সেখানেই সবকিছুর আয়োজন হচ্ছিল। কিন্তু ছাঁদে যেতেই দেখতে পেলাম সেই অপ্রতাশিত ব্যক্তিকে। আহির, সে আকাশী কালারের একটা শার্ট পড়া। হাতা দু’টো ফ্লোড করে কোমড়ে এক হাত দিয়ে, আরেক হাতে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলোকে পিছনের দিকে ঠেলে দিলো। কপালে ঘামের বিন্দু বিন্দু কণা এসে জমা হয়েছে। হঠাৎ তার আর আমার চোখাচোখি হতেই আমি চোখ নামিয়ে ফেলি। এরপর তার পুরো বন্ধুমহলের সাথেই দেখা হয়। যদিও আমি কথা বলি নি। আমি আর মিঠি গিয়ে ছাঁদের একপাশে চেয়ারে গিয়ে বসি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না আহির এখানে কেন,এরপর আমার সেই কাজিনকে অর্থাৎ সাফিনকে নিয়ে আসা হলো কেক কাটাতে। খালামণি আমাকে বললো তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। এরপর কিছুক্ষণ ছবি তুলে অবশেষে কেক কাটা হলো।কিন্তু সাফিন সবাইকে সুন্দরভাবে কেক খাওয়ালেও আমাকে খাওয়ালো তো ঠিকই কিন্তু আমার গালে মাখিয়ে দিয়ে বললো,
উপস্থিত সবাই তখন হেঁসে দিয়েছিল। আমি পড়েছিলাম লজ্জায়। এরপর গালে লেগে থাকা কেকটুকু টিস্যু দিয়ে মোছার সময় একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো আমার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে” কথাটা শুনতেই আহিরের দিকে আমার চোখ গেল। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। তাকে দেখার ইচ্ছে আমার নেই, শুধু শুধু কেন আমি তাকিয়ে থাকবো। আমাকে নিজেকে সামলাতে হবে। এভাবে তো চলতে পারে না।সে তো অন্য কারোর সাথে রিলেশনে আছে। আমি কেন বেহায়া হবো?এরপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব আসে। আমি সোফায় বসে খাচ্ছিলাম আর টিভিতে কার্টুন দেখছিলাম। আমার ফেভারিট কার্টুন রুদ্রা। আমার সাথে অবশ্য সাফিনও ছিলো। তাকেও আমিই খাইয়ে দিচ্ছিলাম। খালামণি আর আঙ্কেল বাকি গেস্টদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। ঘরোয়াভাবে তারা অনুষ্ঠানের কথা বললেও আমার কাছে মোটেও এটা ঘরোয়া মনে হয় নি। আঙ্কেলের অফিসের লোক, আরোও অনেকেই ছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে আহির এসে বসলো একই সোফায়। কিন্তু বেশ খানিকটা দূরেই। বসেই বললো,
–“কি বাচ্চাদের কার্টুন দেখো! অন্যকিছু দাও।
আমি কিছু না বলে টিভির রিমোটটা বাড়িয়ে দেই তার কাছে। আমি চুপচাপ স্বভাবেরই মেয়ে। কারোর সাথে হঠাৎ করে মিশে যেতে বা কথা বলতে আমি পারি না। সেটা কোনো মেয়ে হলেও না তার সাথে হঠাৎ দেখায় আমি মিশতে পারি না। পরিচিত হলেও কিছুটা সময় লাগে। অবশ্য এটা বেস্টফ্রেন্ডের জন্য আলাদা।
এরপর আবার কেটে যায় কিছুদিন। পরীক্ষার রেজাল্টের সময়ও ঘনিয়ে আসতে থাকে। এর মধ্যে মিরা ফোন করে, কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পরই ও শুরু করে। জানো আহির রিবাকে এটা দিয়েছে ওটা দিয়েছে। মিরা ও রিবার বাড়ি ছিলো পাশাপাশি। তারা ফ্রেন্ডও ছিল হয়তো। মিরার এই কথা শুনে আমি বিরক্ত হলাম। কে কাকে কি দিয়েছে তা জেনে আমি কি করবো? কিন্তু প্রকাশ করলাম না। শুধু শুনে গেলাম। কষ্ট হলো ঠিকই তবে সেটা আর কারোর কাছে প্রকাশ করা হলো না। নিজের মধ্যেই মাটি চাপা দিতে হলো।
আজ প্রায় ৭ বছর পর সেই প্রিয় মুখটিকে দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটাকে এক সময় কত লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি হিসেব নেই। তাকে “ভালোবাসি” বলার সাহস আমার ছিলো না তখন। সে ইগনোর করলেও বেহায়া চোখ শুধু তার পানেই তাকিয়ে থাকতো। মনে হতো এই বুঝি সে এসে বলবে “খুব ভালোবাসি তোমায় মিহিতা” কিন্তু বরাবরই আশাহত হতাম।
তার মনে আছে কি না জানি না, তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল শীতকালে। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। বাবার চাকরির জন্য নতুন শহরে এসেছি আমরা। তাই সবই ছিলো নতুন, নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম, বাড়ি হতে কিছুটা দূরে আমার প্রাইভেট পড়ার জন্য একটা ম্যাম ঠিক করা হলো। সেইখানেই প্রতিদিন পড়তে যেতাম। তখন জানুয়ারী মাস শীতটা বেশ ভালো পরিমাণে থাকায় সেই ম্যাম আমাদের বলেছিল সকাল সকাল চলে আসতে। সেই নিয়মেই আমি ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। গায়ে মোটা গোলাপি রঙের সোয়েটার আর মাথায় দুই ঝুঁটি। তখনই একটি ছেলেকে রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি কিছুটা থমকে যাই। এরপর দ্রুত মাথা নিচু করে তার পাশ কাটিয়ে চলে যাই। এভাবে করতে করতে প্রতিদিনই সে এই টাইমে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি তখন অতটাও গুরুত্ব দিতাম না। আস্তে আস্তে স্কুলে আমার বেশ কয়েকটা বান্ধবীও হয়ে গেল আর আমরা সবাই একসাথেই সেই ম্যামের কাছে পড়তাম। বাসাও আমাদের সবার কাছাকাছিই ছিলো। হাসি-মজার মধ্যেই কাটতো আমার দিন গুলো। এত কিছুর মাঝেও আমি তাকে দেখতাম। রাস্তা ঠিক পাশেই চারতলা বিল্ডিং এর ৪র্থ তলায় থাকার কারণে তাকে দেখতে পেতাম সব সময়। সে যখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো। মাঠ বেশি দূরে ছিল না বিধায় আমাদের বাসা থেকে দেখা যেতো। বিকালে যখন সে ও তার বন্ধুরা ফুটবল খেলতে আসতো। আমি তখন তাকিয়ে থাকতাম। এভাবে করতে করতেই আমি এইটে পরীক্ষা দিলাম।পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এলো।তখন সেই ম্যামের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার সময় আমার হাতে মার্ক সিটটাও ছিলো,বাবা তুলে এনেছিল সাথে সাথেই। তখন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তার বন্ধুরা হঠাৎ আমাকে ডাক দিলো। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীর পায়ে গেলাম তাদের সামনে। তার বন্ধুদের মধ্যে একজন আমার মার্ক সিটটা দেখতে চাইলে আমি সেটা তার হাতে দেই। সে মার্ক সিটটা হাতে নিয়ে বলেছিল,
–“বাহ্, আপু অনেক ভালো রেজাল্ট করেছো তো।”
তখন সে হেঁসে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু তার সেই বন্ধুকে বলেছিল আমাকে মার্ক সিটটা ফিরিয়ে দিতে। তার কথা মতো ভাইয়াটা আমাকে মার্ক সিটটা ফিরিয়ে দিলেও তখন বলেছিল,
–“এত ভালো রেজাল্ট করেছো আপু, মিষ্টি খাওয়াবা না।”
তখন আমার কাছে কোনো উত্তর ছিলো না। আমি মার্ক সিটটা নিয়েই দৌড় দিয়েছিলাম। একদম আমার ম্যামের বাড়ির সামনে এসে থেমেছিলাম। প্রচন্ড ভয় কাজ করছিল। কেননা বাবা যদি দেখে নেয় আমি কোনো ছেলের সাথে কথা বলছি তখন।
এরপর ক্লাস নাইন এ উঠলাম। ফ্রেন্ডরা সবাই তখন আলাদা আলাদা হয়ে গেল। স্কুলে কয়েকজন পড়লেও তারা আর সেই ম্যামের কাছে পড়তো না। অন্যান্য কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি হলো। শুধু একজনের সাথেই সেই ম্যামের বাড়িতে দেখা হতো। সে মাঝে মাঝেই আমার বাসায় আসতো আমাকে নিতে। সেই ম্যামের কাছে নতুন একটা মেয়েও এসেছিল। নাম মিরা।তার সাথেও একটা ভালো ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেল আমার। একদিন প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম তার শার্টের কালারের সাথে আমার জামার কালার এক রকম। তার বন্ধুরা সেটা দেখে তাকে এটা বলে ক্ষেপাতে শুরু করেছিল। তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ই আমি সেটা শুনতে পারি। সে কিছুই বলছিল না তখন, শুধু হাসছিল। সেইদিন একটু আগে আগেই পড়তে গিয়েছিলাম আর গিয়ে দেখি আমাদের আগের ব্যাচের পড়া তখনও শেষ হয় নি। তাই আমি আর আমার বান্ধবী বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার মনে পড়লো আমি গণিত খাতা আনতে ভুলে গেছি। দ্রুত ব্যাগ চেক করে দেখলাম সত্যিই আনি নি। তাই ম্যামকে বলে বাসায় খাতা আনতে চললাম আমি আর আমার সেই বান্ধবী আরিয়া। ম্যামের বাসায় যেতে সেই মাঠটা পার হতে হতো সেখানে আহির ও তার বন্ধুরা ফুটবল খেলতো। তার নাম যে আহির সেটা আমি জানতাম না। একদিন তার একজন বন্ধু আহির বলায় সে উত্তর নিয়েছিল। তখন থেকেই এই খবর জানতে পারি। তো বাড়ি আসার পথে সেই মাঠ পার হওয়ার সময় একটা বল এসে থামে আমার পায়ের কাছে। আরেকটু হলেই গায়ে লাগতো। আমি কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই আহিরের একজন বন্ধু বলে উঠলো –
–” আরে ভাবী বলটা এদিকে একটু পাস করো।
আমি সাথে সাথে সেখানে জমে যাই। হাত-পা তখন কাঁপাকাপা শুরু করেছিল। আর আহির মহাশয়কে তার বন্ধু যখন বলেছিল তুই ওকে পছন্দ করিস? তখন সে হেসে চিৎকার করে বলেছিল আমি ওকে ভালোবাসি। এ কথাটা শুনে আমি এক মুহুর্ত দাড়ায় নি সেখানে। আমার সেই বান্ধবীর হাত ধরে দৌড়ে চলে এসেছিলাম। পিছনে ফিরে অবশ্য একবার তাকিয়েছিলাম। তখন সেও আমার দিকে হেঁসে তাকিয়ে ছিল। এরপর শুরু হয় আমার বান্ধবীর ক্ষেপানো। শুধু কিছুক্ষণ পর পরই বলছিল – আমি ওকে ভালোবাসি, আমি ওকে ভালোবাসি। ম্যামের ওখানে গিয়েও ওর সেই এক কথা। এরপর পড়া শেষ করে ওর পিঠে দিয়েছিলাম দু-এক ঘা।এরপরের দিন স্কুলে সিড়ি দিয়ে উঠার সময় দেখলাম আহির আমার আগের সিড়িতে।তার পাশে থাকা একটা ছোট ছেলে বলছে -” ভাই, আপনার ব্যাগটা দেন। আমি নেই।”
তখন আহির বলে–“আমার ব্যাগ না নিয়ে তোর ভাবীর ব্যাগটা নে।আমি গেলে তো পালাবে।”আমি তখন চোখ বড় বড় করে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমাকে তাকাতে দেখে সে শুধু হেঁসে ওই ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলেছিল –“কি হলো যা।” আমি সেইখানেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আহির চলে যাওয়ার পর ক্লাসে যাই। এরপর কেটে যায় অনেকদিন। এর মাঝে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি পড়াশোনায় সামনেই বার্ষিক পরীক্ষা যেভাবেই হোক ভালো করতে হবে। এর মাঝে আহিরকে আর দেখি নি আমি। ভালোয় ভালোয়ই শেষ হয় পরীক্ষাটা।
কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার বান্ধবী মিরার কাছে জানতে পারি আহির অন্য আরেকটি মেয়ের সাথে রিলেশনে গেছে কিছুদিন আগে।
-‘শীত কিংবা গরম ছেলেরা সহজে গোসল করে না। ময়লা জামা কাপড়ের স্তুপ করে রুমের কোণায় কোণায়। গন্ধভরা মোজায় পারফিউম মেরে কাজ চালায়। রুম ঝাড়ু দেয় না। অকারণে রাত জাগে। নেশাভান করে। কথায় কথায় মিথ্যা বলে। হাতে বালা। কানে দুল। গলায় মালা। ছেঁড়া প্যান্ট,চুলে ঝুঁটি। বাহুতে ট্যাটু স্কিকার। একথায় বনমানুষ। আমরা তো মানুষ। আর মানুষ হিসেবে তাদের অধঃপতন সহ্য করতে পারি না। চোখের সামনে কারো ক্ষতি সহ্য করা যায়? যায় না। এজন্যই একটা ছেলেকে বনমানুষ থেকে মানুষ করতে আমরা বিয়ে করি। নয়তো এত ঠ্যাকা পড়ে তাদেরকে বিয়ে করে জীবন কয়লা করতে।’
মেহজাবিনের একথা শুনে ইফতি ভ্রুঁ কুচকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারে না সে। খোঁচা মারা কথা তো বলবেই সঙ্গে আবার আইক্কা ওয়ালা বাঁশও যুক্ত করবে। সে কি সুন্দর মানবতা সমেত যুক্তিটা দেখাল।
মেয়েদের কথা চিন্তা করে কথাগুলো বুঝিয়ে বলল। আর এই মেয়েটা তাকে হাতে হারিকেন আর পেছনে ড্যাস দিয়ে দিলো। ছেলেরা নাকি গোসল করে না, এটা কোনো কথা?
ছেলেটা গোসল না করলে নিউজে নিউজে হেডলাইন হতো। কই হয় নি তো। সে এবার খ্যাপাটে গলায় বলল,
-‘কি বললে, ছেলেরা গোসল করে না?’
-‘কানে কি কম শুনেন? যা বলার বললামই তো একবার।’
-‘বড্ড বেয়াদব তুমি।’
-‘ভালো করে মেপে দেখুন আপনার থেকে কমই আছি।’
-‘তুমি আর কখনো আমার সাথে কথা বলবে না। ভুলেও না। যদি বলো তাহলে তুমি একটা পেঁচা।’
-‘আপনিও বলবেন না। যদি বলেন তাহলে আপনার একটা কান কাটা হনুমান।’
-‘বড়দের সন্মান করা শিখো। আদব কায়দা জানো বলে তো মনে হয় না। সময় আছে শিখো নাও নয়তো বরের মার খেতে খেতে প্রাণ হারাবে।’
-‘হাতের নখগুলো কি সাধে রেখেছি? বরের দুটো মার খেলে একটা খামচি অবশ্যই দিবো।’
একথা শুনে ইফতি বসল না হনহন করে হেঁটে চলে গেল। গা জ্বলানো কথা বলতে পেরে মেহজাবিন হেসে ফেলল। আজ পর্যন্ত অকারণে কারো সাথে ঝগড়া করে নি। বাঁকা কথাও বলে নি। কিন্তু ইফতির সঙ্গে বার বার লেগে যায়। আর কেন জানি ছেলেটা ইচ্ছে করে তাকে খোঁচাতে আসে,ঝগড়া করে,
পরে হারও মানে। যাক এতক্ষণ ইফতি গাম্বাটটাকে উপযুক্ত কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে পেরে মনে শান্তির হাওয়া বইছে।
গাইতে ইচ্ছে করছে, ‘ আহা, কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।’
কিন্তু তার শান্তি বেশিক্ষণ রইল না। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরানোর আগে ঝপাৎ করে কেউ তার গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিলো। গোবর গোলা পানিতে তার বমি পেয়ে গেল। এত সুন্দর জামাটাও নষ্ট করে দিলো এই অসভ্যটা। তার অবস্থা দেখে ইফতি দাঁত বের করে হাসছে।হাসতে হাসতে ঘাসের উপর শুয়ে পড়েছে। এখন শুয়ে শুয়ে
হাত তালি দিচ্ছে আর হাসছে। তার হাসি আর পঁচা গোবরের গন্ধে, মেহজাবিন বমি করে ফেলল। বমি করে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। তার কান্না দেখে জড়ো গেল মানুষজন, তখন
ছুটে এলেন ইফতি আর মেহজাবিনের বাবা-মা। উনারা এই দুটোকে এক হতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এরা আবারও?
এই দুটোকে কি করবেন উনারা? এরা সুযোগ পেলেই একে অপরের পেছনে লাগে। কতক্ষণ বা চোখে চোখে রাখা যায়?বড়দেরকে দেখে ইফতি উঠে বসলেও এখনো হাসছে, তবে মিটমিটিয়ে। মেহজাবিনের অবস্থা দেখে কারো বুঝতে বাকি রইল কি ঘটেছে। তবুও জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে না থাকলেও ইফতির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘ইফতি তোমার গায়ে পানি ঢালল কেন মা? তুমি কি তাকে কিছু বলেছো?’
মেহজাবিন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। সে মনে মনে বিরাট একটা পরিকল্পনা কষে নিলো। তারপর বলল,
-‘আঙ্কেল, আপনার ছেলে গতকাল রাত থেকে আমার পেছনে পড়ে আছে। সে আমাকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। আমি তার প্রস্তাবে নাকচ করেছি তাই এভাবে আমাকে জব্দ করছে।’
মেহজাবিনের কথা শুনে সকলের দৃষ্টি পড়ল ইফতির দিকে।
সে বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেহজাবিনের কথা শুনে সে অবাক হলো না। বরং সে সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বলল,
-‘মেহজাবিন ঠিকই বলেছে। ওকে আমি বিয়ে করব বাবা। তুমি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলো। রাজি করাও। বিয়ের জন্য কাজি ডাকো। যদিও উনারা রাজি না হোন আমি ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। কিন্তু ওকেই বিয়ে করব। আমি আমার বউকে নিয়ে মামার বিয়ের বরযাত্রী হতে চাই। এখন আমি রুমে গেলাম। ঠিক এক ঘন্টা,দ্রুত বিয়ে সাদির ব্যবস্থা করো। যদি না পারো তাহলে আমি ঘুমের ওষুধ খাব, এটাও
কনফার্ম। ঠিক এক ঘন্টা মনে রেখো।’
-‘এটা কেমন কথা? সব সময় হেয়ালি করা ঠিক না। তুমি তাকে বিয়ে করলেও সে তো করবে না। তার ইচ্ছেরও দাম আছে। বুঝলাম জোর করে বিয়ে করবে ঠিক আছে, কিন্তু সংসার? জোর করে কি সংসার করা যায়? জীবন কি ছেলে খেলা?’
-‘ঠিক এক ঘন্টা। বিয়ে কথা যখন উঠলোই বিয়ে না করে আর থামছি না।’
ইফতি শীতল দৃষ্টিতে মেহজাবিনের দিকে তাকাল। যেন চোখ পড়ার যুদ্ধে নেমেছে। মেহজাবিন মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বিয়ের কথাটা বলেছে ইফতিকে বকা খাওয়াতে। কিন্তু এখন দেখি এখানকার সুর বদলে যাচ্ছে। ইফতি রাজি।সে মিথ্যা বলল আর ইফতি মেনে নিলো, কিন্তু কেন? ইফতি কথা বাড়াল না থমথমে মুখে দ্রুত প্রস্থান করল। আর বড়রা পড়ল বিপাকে। ছেলেটা ভীষণ জেদি। যখন বলেছে বিয়ে করবে মানে করবেই। ইফতির কান্ডে ইফতির বাবা মা এখন কি বলবে বুঝতে পারছে না।ছেলেকে বিয়ের কথা বলে বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছেন অথচ আজকর ছেলের কান্ডে পরিস্থিতি গুবলেট করে দিয়েছে। মেহজাবিনের সঙ্গে যেসব কান্ড করেছে, কোন মুখে উনারা বিয়ের প্রস্তাব দিবে। বিয়ের আগেই তো মেয়েকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। বিয়ের পরে কি হবে,আল্লাহ মালুম। ওদিকে মেহজাবিনের বাবা মাও কি বলবে বুঝছে না। উনারা বিব্রত। ছেলেটা দেখতে শুনতে এক রাজপুত্রের মতো। কিন্তু চঞ্চল স্বভাবের। একে মেয়ে জামাই বানানো ঠিক হবে কি না বোধগম্য হচ্ছে না। যদিও ছেলেটার খারাপ চরিত্রের অথবা নেশাখোর মনে হয় নি। এরপরেও…!
গোবরগোলা পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে মেহজাবিন অবাক
তাকিয়ে ছিল। ফুপি তাকে এনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলেন।
ফ্রেশ হতে বলে দ্রুত বেরিয়েও গেলেন। মেহজাবিন পড়েছে মহাবিপদে। ধুর কি বলতে কী বলে ফেলল। এখন যদি সত্যি সত্যিই বিয়ে হয়ে যায় তখন কি হবে?এমন ঝগড়ুটে ছেলের সঙ্গে সারাজীবন থাকবে কিভাবে? ভুল যখন করেছে ভুল শুধরে নেওয়া উত্তম। সে শাওয়ার নিতে নিতে অনেককিছুই ভাবল। তারপর ড্রেস পরে চুল না মুছে গুঁটি গুঁটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে ইফতির রুমে গেল। আশেপাশে তেমন কেউ নেই, সকলে হলুদের আসরে। ইফতির রুম অন্ধকার ঠিকই দরজা হাঁট করে খোলা। সে রুমে ঢুকে উঁকিঝুঁকি দিতেই কে যেন পেছনে থেকে দরজা আঁটকে দিলো। অন্ধকার রুমটা আরো অন্ধকার হয়ে গেল। হঠাৎ সে অনুভব করল একজন
তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশব্দে পড়ছে তার কাঁধে। সে নিজেকে ছাড়াতে গেলে অগন্তুক তাকে শক্ত করে ধরল, তারপর ফিসফিস করে বলল,
-‘সত্যি সত্যি আমার বউ হয়ে যাও, ভীষণ ভালোবাসব।’
-‘ চুলে চুইংগাম লাগানো, গোবর জলে স্নান করানোর মতো ভালোবাসা? লাগবে না আপনার ভালোবাসা। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করতে নিষেধ করুন। আমি মিথ্যা বলেছি, সব দোষ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। আপনি বিয়েটা ক্যান্সেল করুন। একটা মিথ্যার শাস্তি সারাজীবন বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়, প্লিজ।’
-‘এত কথা থাকতে বিয়ের কথাই কেন বললে? আমার তো মনেই ছিল না বিয়ের কথাটা। তুমি বলার পরে স্মরণ হলো।
আর আমার মনটাও সঙ্গে সঙ্গে বলে বসল,,অনেক হলো দূর থেকে দেখা, ফলো করা বিপদে রক্ষা করা, ভালোবাসি না বলেও পাগলের মতো ভালোবাসা, এবার এসবের সমাপ্তি টানা দরকার। এবারের গল্পটুকু নাহয় হোক কাছে আসার গল্প।’
-‘ভুলভাল বুঝিয়ে লাভ নেই। আমি বিয়ে করব না মানে করবই না। আপনি বাইরে চলুন আমি সবার সামনে বলবো, আমি মিথ্যা বলেছি। বিয়ের ব্যবস্থা যেন না করে। এই বিয়ে আপনি জেদের বশে করছেন। তাছাড়া আমিও রাজি নই।’
-‘কেন, রাজি না কেন শুনি? আমি কি খুব বেশি খারাপ?’
-‘জানি না। তবে যে আমাকে সামান্যটুকুও সন্মান দেয় না আমি তাকে বিয়ে করব না।’
-‘বাসে একা একা ঘুমাচ্ছিলেন আমিই তো ডাকালাম। ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমিই তো পাহারা দিচ্ছিলাম। ক্ষুধার চোটে মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গিয়েছিল, আমিই তো হেল্পপারের সাহায্য ভালো রেস্তোরায়
নিয়ে গেলাম। খোলা চুল দিয়ে সারাদিন জ্বালিয়েন একটুও ঘুমাতে পারি নি, আপনি যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন তাই নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলাম। দুষ্টুমি করে চুলে চুইংগাম
র লাগানোর আগে দেখে নিয়েছিলাম এর সমাধান আছে কি না, যখন দেখলাম তখন চুইংগাম লাগিয়েছি। সারারাত বুকে ঘাপটি মেরে, শার্ট আঁকড়ে ধরে তো খুব ঘুমিয়েছিলেন, ঘুম যাতে না ভাঙে তাই একটু নড়তেও পারি নি। পুরো জার্নিতে চোখে চোখে রেখেছি তবুও এই অপবাদ? কেন দুষ্টমির ছলে করা ভালোবাসা দেখা যায় না?’
-‘চেনা নেই, জানা নেই, গতরাতে প্রথম দেখা এর মধ্যে কি না ভালোবাসাও হয়ে গেল? তা হলো, হলো, কই বুঝলাম না তো। আর আমি কারো বুকে টুকে ঘুমায় নি,এসব ডাহা মিথ্যা কথা।’
-‘কাল হয়তো আমাকে প্রথমবার দেখেছো। কিন্তু আমি আট মাস ধরে রোজ তোমাকে ফলো করছি, ভালোবেসে যাচ্ছি।
বিশ্বাস নাহলে তোমার ফুপি মানে আমার মামনিকে নাহয় জিজ্ঞাসা কোরো। মামনিও তোমার সন্ধান দিয়েছে আমাকে।
ভেবেছিলাম আদা মাদা কেউ হবে। দেখার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু ছবি দেখে আমার মন টা তো কাড়লে কাড়লেই আমার ভালো থাকাটুকুকেও কেড়ে নিলো। এখন তুই বিহনে আমি নিঃস্ব। তাই প্লিজ রাজি হয়ে যাও।’
-‘তাহলে শর্ত মানতে হবে, রাজি?’
-‘বলো কি শর্ত?’
-‘আমি অনেক অনেক অনেক ভালোবাসতে হবে।’
-‘বাসলাম।’
-‘মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে?’
-‘করলাম।’
-‘কখনো কাঁদানো যাবে না।’
-‘ভুলেও না।’
-‘আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবে না, কোথাও না।’
-‘যাব না।’
-‘ঠিক আছে, তবে একটা সুযোগ দিলাম। বাইরে গিয়ে বলুন আমি রাজি।’
একথা বলে মেহজাবিন ইফতিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে গেল। ইফতি নিঃশব্দে হাসতে লাগল। এতদিনের অপেক্ষা।
বাগানে চেয়ার পেতে আজমত আলীই দুই পরিবারকে ডেকে বৈঠক বসালেন। সকলে নিশ্চুপ। তখন আজমত আলী গলা পরিষ্কার করে কথা শুরু করলেন।তিনি নাতির বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন মেহজাবিনের বাবার কাছে। জলদি সিদ্ধান্ত নিতে
অনুরোধও জানালেন। সঙ্গে জানালেন ইফতির বায়োডাটা।
ইফতি বিজনেসম্যান। নিজের চেষ্টায় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে।
বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তার নিজস্ব বৃদ্ধাআশ্রম, চাইল্ড কেয়ারসহ রয়েছে। সেখানকার খরচ সেই টানে। ইফতি কিন্তু জেনে শুনে মেহজাবিনকে এত জ্বলায়। তারমানে এই না সে ছ্যাবলামার্কা। বরং ব্যাক্তিত্বের ধার অন্যরকম। সে শুধু তার কাছের মানুষের সঙ্গে এভাবে মিশে, দুষ্টুমি করে, এছাড়া সে পুরো পৃথিবীর কাছে এটিটিউড ওয়ালা। মোদ্দাকথা, ইফতি মেহজাবিনকে ভীষণ ভালোবাসে। শুধু মেহজাবিনের কারণে অফিসের ডিল ক্যান্সেল করে এখানে এসেছে। যে ছেলেটা বছরের পর বছর কেটে গেলেও মামা বাড়িতে পা রাখে না, সে মেহজাবিনের কারণে এত গ্যাদারিংয়ের মধ্যেও এখানে উপস্থিত। যেটা আশ্চর্যের ব্যাপার। মুখ্য কথা, মেহজাবিনের ফুপিই তাদের বিয়ের ঘটকালি শুরু করেছে। এইকথা শুনে
মেহজাবিনের বাবা বোনের দিকে তাকাল। মেহরু মৃদু মাথা নেড়ে বললেন,
-‘ভাইজান রাজি হয়ে যাও। ইফতির সঙ্গে বিয়েটা হলে মেহজাবিনের জীবনে সুখের অভাব হবে না। ছেলেটা খুব ভালোবাসে তোমার মেয়েকে। এর সাক্ষীও আমি। তাছাড়া এই দেখো তোমার মেয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে আমাকে, সেও রাজি।’
এরপর আর কথায় থাকে না। অতঃপর তাদের পরিবারের উপস্থিতিতে কাজি ডেকে বিয়ে পরানো হলো। পাশাপাশি বসিয়ে মিষ্টি মুখ করানো হলো। ইফতির পরণে পাঞ্জাবি আর মেহজাবিনের পরণে ইফতির কিনে আনা লালরঙ্গা শাড়ি।
দু’জনকে কি যে সুন্দর লাগছে। তখন অনুষ্ঠান করার কথা উঠল। ইফতি রাখঢাক না রেখে সরাসরিই জবাব দিলো,
-‘দু’জনকে এক বাসায় রেখে অনুষ্ঠান করলে ঠিক আছে। কিন্তু দু’জনকে আলাদা বাসায় রেখে সপ্তাহের পর সপ্তাহ
অনুষ্ঠানের নামে মানসিক অত্যাচার করা মানব না আমি। যে যা করবা করো তবে বউ নিয়েই বাসায় ফিরব এই বলে দিলাম।’
বেহায়ার মতো কথাটা বলে সে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলো।
মেহজ লজ্জায় লাল হয়ে চুপটি করে বসে আছে। ওদিকে উপস্থিত সকলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। মজা করছে। ইফতি সেদিকে মন দিলো না বরং মেহজাবিন চোখ ভরে দেখে ফিসফিস করে বলল,
-‘ আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, কাজ আছে। ঘুমিও পড়ো না যেন। আর ঘুমালেও আবার গোরব জলে গোসল করাব।’
-‘ফুপি বলল না, অনুষ্ঠানের আগে দু’জনকে আলাদা থাকতে।’
-‘বললেই হবে? আমার বউ আমার সঙ্গে থাকবে, ব্যস। তুমি শুধু তোমার রুমে থেকো ফিরে বাকিটা আমি বুঝে নিবো।’
একথা বলে ইফতি বেরিয়ে গেল। মানুষ বিয়ে করলে নাকি ঘরকুনো হয়। অথচ সে হবে উল্টো টা। সে হবে ভবঘুরে তবে বউকে সঙ্গে নিয়েই। তার এতদিনের ইচ্ছে ছিল দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। বেড়িয়েছেও। কিন্তু মেহজাবিন তার জীবনে আসার পর থেকে সে কোথাও যায় নি। যেতে পারে নি। দম আঁটকে মারা যাবে এমন মনে হতো। কিন্তু আজ থেকে সেই ভয় নেই, বাঁধা নেই, এখন যখন তখন প্রিয় মানুষটাকে সে কাছে পাবে। যেখানেই যাবে সঙ্গী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে নিবে।
এসব ভেবে সে সাজেকের রিসোর্ট বুক করে ফেলল। কাল মামার বিয়ের পরপরই সেও মেহজাবিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। বউ নিয়ে যত শখ আহ্লাদ মনে পুষে রেখেছে সবটা পূরণ করবে। তখনও কি পাগলিটা বলবে, সে ভালোবাসতে জানে না? প্রকাশ করতে পারে না? রাত বাড়ছে। আজিজুল
খোঁড়া পা মেলে দিয়ে বই পড়ছে। বাইরে এতক্ষণ চেঁচামেচি শোনা গেলেও, এখন সবাইই নিশ্চুপ। ঘড়ির কাঁটা একটার ঘরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেহজাবিন ইফতি তারা কেউই বাসা নেই। ইফতি আগে বের হলেও মেহজাবিন কিছুক্ষণ আগেই বাইরে গেছে। আজিজুল তাদেরকে প্রাইভেসি দিতে
ফাইভ স্টার হোটেলের একটা রুমও বুক করেছে। জীবনের বিশেষ একটা দিন তাদের। এজন্য স্পেশালভাবে বাসরঘর সাজিয়েছে। যেটা ইফতি করার জন্য বাইরে যেতে চাচ্ছিল,
কিন্তু সে বুঝতে করতে দেয় নি। তাদের জন্য যতটুকু করা যায় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এদিকে হোটেলের রুমে ঢুকে মেহজাবিন হতবাক। ইফতিও মুগ্ধ হয়ে দেখছে আশপাশ। এত সুন্দর ডেকোরেশন! চোখ ফেরানো দায়। সুগন্ধি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বিছানা।
পুরো রুমে ছোটো ছোটো মোমবাতি জ্বলছে। লাভ বেলুনের ছড়াছড়ি। সাদা বেডশীটের উপর ইংলিশে লেখা ‘ Best Of luck.
ইফতি নিজে ফ্রেশ হয়ে মেহজাবিনকেও ফ্রেশ হতে তাগাদা দিলো। তারপর দু’জনে বেলকণিতে গিয়ে বসল। আজ চাঁদ
উঠেছে। মিটিমিটি আলো ছড়াচ্ছে ধরণীর বুকে। ইফতি টান দিয়ে মেহজাবিনকে মেঝেতে বসিয়ে দিলো। তারপর তার কোলে মাথা রেখে চুল টানতে ইশারা করল। মেহজাবিনও আলতো করে ইফতির মাথার চুল টেনে দিতে লাগল। কারো মুখে কথা নেই। অথচ মনজুড়ে ভালোলাগা। মেহজাবিনের অবাক লাগছে, কারণ সে কখনো কোনো ছেলের এতকাছে
যায় নি। মিশে নি, কথা বলে নি, অথচ ইফতি কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, কত কথা বলছে, তবুও তার অস্বস্ত্বি কাজ করছে না। লজ্জা লাগলে ঠিক তবে ভালোও লাগছে। তখন ইফতি তার মাথাটা ধরে কপালে চুমে এঁকে দিলো। তারপর চোখের পাতায়, গালে, ঠোঁটে। কথা নেই, শব্দহীন পরিবেশ,
মৃদ বাতাসের গুনগুন স্বর, চাঁদের মিটিমিটি হাসি। এভাবেই সময় কাটল। রাতও বাড়ল। বাড়ল ভালোবাসার তীব্রতাও। সেই সঙ্গে সূচনা হলো তাদের সুখ দুঃখে ঘেরা জীবনে কাছে আসার গল্পও
আজমত আলী আজিজুলের সঙ্গে তর্ক না করে হনহন করে চলে গেলেন। রাগে উনার শরীর জ্বলছে। এমন ছেলের জন্ম দেওয়ার জন্য নিজেকেই নিজের থাপ্পড় ইচ্ছে করে। জীবনে কী পাপ করেছিলেন যে, এমন হাড়ে বজ্জাত ছেলের বাবা হলেন একথা উনি ভেবে পান না। এদিকে আজিজুল বাবার দিকে তাকিয়ে নীরবে দাঁত বের করে শরীর কাঁপিয়ে হাসল।
তার কাজ রোজ বাবাকে একবার করে রাগিয়ে দেওয়া। এ যে পরিপূর্ণ তৃপ্তির কাজ। এই তৃপ্তি জগতের অন্য কোথায় পাওয়া যাবে না। এই তৃপ্তি বাবাদের রাগী মুখে বরাদ্দ করা।
তার মতে, সু-স্বাস্থ্যের জন্য যেমন হাসিহাসি জরুরি দেমনি রাগটাও। রাগ করলে মস্তিষ্ক ভালো থাকে। বুদ্ধির ধার বাড়ে।
যদিও একথাটা কেউ তাকে বলে নি তবে তার মনে হয়। মন নিশ্চয়ই ভুল বলবে না। তবে মন সবসময় উল্টাপাল্টা কিছু এটাও ঠিক। মাঝে মাঝে মনের মন রক্ষার্থে উল্টো কিন্তু করা উচিত। সে যেমন করে, বাবাকে রাগিয়ে দেয়। তবে আজকে সকাল সকাল বাবাকে রাগিয়ে দিয়ে ভালোই লাগছে৷ মনটা ফুরফুরে লাগছে। শরীরে চনচনে ভাব এসেছে। দিনটা ভীষণ ভালোই যাবে আশা করা যাবে। এমনিতেই তার দিন ভালো যায়। কারণ তার বাড়িখানা আস্ত একটা বিনোদনের কেন্দ্র।
যেখানে প্রত্যেকটা দিন নিত্য নতুন কাহিনির উৎপত্তি ঘটে।
আজও হয়েছে। আজ করেছে মেজভাবির ভাইয়ের মেয়ে মেহজাবিন আর তার বোনের ছেলে ইফতি। ইফতি টা যেই হাড়ে বজ্জাত যে তার পাল্লায় পড়ে সেই বুঝে। কিন্তু মেয়েটা কম না বোঝাই যাচ্ছে। এদের ঝগড়াটা বেশ ভালোই জমবে।
সে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আরাম কেদারায় বসল। চা খেতে খেতে মারকাট ঝগড়া দেখার মজাই আলাদা। সে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঝগড়া দেখায় মনোনিবেশ করল। ওইদিকে মেহজাবিন শক্তি দিয়ে ইফতির চুল টেনে ধরেছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ইফতির আজ টাকলা হবেই হবে। বাড়ির সদসরা
মেহজাবিনকে চুল ছাড়ার তাগাদা দিচ্ছে। কিন্তু মেহজাবিন চুল ছাড়ছে না বরং চুল টানতে টানতে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। যেন তারই লাগছে। ওদিকে ইফতি নিশ্চুপ। একপর্যায়ে রাগী মেহজাবিনকে থামানো গেল। মেহজাবিনের বাবা মেয়েকে
বসিয়ে পানি খাওয়ালেন এরপর পুনরায় ঘটনাটা জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে মেহজাবিন বলল,
-‘ওই অসভ্যটা আমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছে। ”
একথা শুনে ইফতি চুল ঠিক করে হাসি হাসি মুখেই বলল,
-‘অসভ্য বলার কারণে চুইংগাম লাগিয়েছিলাম। আবারও অসভ্য বললে, এবার কিন্তু ডাবল হয়ে যাবে বলে দিলাম।’
এতক্ষণে উপস্থিত সকলে বুঝল আসল ঘটনা। কিন্ত তারা
কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। তাদের তর্ক-বির্তক চলতে থাকল। মেহজাবিনের মা বাধ্য হয়ে মেয়েকে হড়হড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। দু’ঘা বসিয়ে দিলেন মেয়ের পিঠে।
ছিঃ! ছিঃ! মেহমান বাড়িতে এসে এ কোন অনাসৃষ্টি। লজ্জার কাউকে মুখ দেখানো যাবে? এই বাসার নাতিকে মারতে এই মেয়ে আঁশবটি তুলেছে, এত বড় দুঃসাহস! না, উনি ভাবতেন
মেয়েটাকে মানুষ করতে পেরেছিলেন। এখন দেখছেন ভুল ভাবতেন। মায়ের মার খেয়ে মেহজাবিন কাঁদতে কাঁদতে পা বাড়াতেই ইফতি ডাকল। পকেট থেকে ফোন করে বের ডাটা কানেক্ট করে ইউটিউবে সার্চ দিলো, ‘বড় চুল থেকে চুইংগাম ছাড়ানোর সহজ উপায়।’ ব্যস ভিডিও পেয়ে গেল। তারপর মুখভর্তি হেসে ভিডিওটা তাকে দেখতে বলে শিষ বাজাতে বাজাতে উপরে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল তার নাস্তাটা উপরে পাঠিয়ে দিতে। খেয়ে ঘুমাবে। বাসে ঘুম হয় নি, ঘাড় পিঠ ব্যথায় টনটন করছে। মেহজাবিনের মা ভিডিওটা দেখে চুল থেকে চুইংগাম ছাড়ানোর কাজে লেগে পড়লেন।
তখনকার মতো তাদের ঝগড়াটাও থামল। বাসাটাও শান্ত হলো। তারপর তাদের কাউকেই আর দেখা গেল না। সময় গড়িয়ে দুপুর হলো। তবুও কেউ নিচে নামল। তাদের খাবার উপরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
বিয়ে উপলক্ষে দুপুরের পর থেকেই মেহমানদের আনাগোনা বেড়েছে। হইচই হচ্ছে। ধুম ধাড়াক্কা গান বাজছে। মহিলাগণ সেজে গুজে মেয়েলি কাজগুলো করছে। বাইরে সামিয়ানা টানানোর হচ্ছে। হলুদের স্টেজ হয়ে গেছে। সেখানে বড় বড় করে লেখা হয়েছে ‘ আজিজুল এর হলুদ সন্ধ্যা।’ কেন জানি লেখাটা আজিজুলের পছন্দ হলো না। সে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারপর লেখালো, ‘আজ আজিজুল এর গায়ে হলুদ।’
হলুদ সন্ধ্যা আবার কি জিনিস? যত্তসব, ভুলভাল কথাবার্তা।
বাঙালি সহজ কথা সহজ ভাষায় বলে না, এটাই আফসোস।
অতঃপর আরো কিছু কাজ সেরে সে গেল ফুটবল খেলতে।
সঙ্গে গেল ইফতি। দুই মামা ভাগ্নেকে হাফ পরে খেলতে যেতে দেখে সকলে হাসল। কেউ কেউ বারণ করল। নতুন বরদের যেখানে সেখানে ঘুরতে নেই, এতে নজর লাগে। কিন্তু কে বক শুনে কার কথা? মামা ভাগ্নে গায়ের জোর দেখিয়ে খেলতে গেল ঠিকই, কিন্তু আজিজুল এলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে। তার পা মচকে গেছে। এক পা ফুলে ঢোল। ছেলের কর্মকান্ড দেখে আজমত আলী ইচ্ছে মতোন গালাগাল করলেন। ইফতিকে
কিছু বলার আগে ইফতি বলল,
-‘নানুভাই খবরদার বলছি, আমাকে কিছু বলবে না। আমি তোমার ছেলেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই নি। বরং তোমার ছেলেই আমাকে ধাক্কা মারতে গিয়ে পড়েছে। পড়ার কারণ
তোমার ছেলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বউ আনার আগে তাকে ভিটামিন খাওয়াও।’
-‘তোরা মানুষ হবি না? আর কত জ্বালিয়ে মারবি আমাকে?’
-‘মানুষ হবি না, এই কথার মানে কি? আর কত মানুষ হবো?
তোমার জ্বালিয়ে মারলামই বা কখন? জ্বালিয়ে মারলে কেউ বেঁচে থাকে? কথা বলে? গপগপ করে চিকেন রোল গিলতে পারে? নানুভাই, আমাকে খুঁচিও না নয়তো প্রচার করে দিবো তুমি তোমার প্রাক্তণকে বাদাম কিনে দিয়েছো।’
-‘এই ঘটনার আর কত খোঁটা দিবি? রুবিনাকে বাদাম কিনে দিয়েছিলাম তাও দশ বছর আগে। বেচারি কিডনি রোগে মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। এই কথার ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়েছিস আমার থেকে। বলি আর কত?’
-‘তোমার উপরে আমার প্রচুর রাগ আছে। যতদিন না সেই রাগ কমবে ততদিন তোমার ব্ল্যাকমেইল করে যাবো। দরকার হলে যাকে তাকে তোমার প্রাক্তন বানিয়ে কেস খাওয়াব।’
-‘আজকেই বলবি, আমার উপর এত রাগ কেন তোর? কি করেছি আমি?’
-‘কি করো নি তুমি? তুমি পারতে না ভালো একটা মানুষের সঙ্গে আমার মায়ের বিয়ে দিতে? দিয়েছো? দাও নি,দিয়েছো
বদমেজাজি, খারুস, এক লোকের সঙ্গে। যে আমার মতো ছেলেকে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারে। অবিবেচক মানুষ। ছিঃ! ছিঃ! কি লজ্জা! কি লজ্জা!”
-‘ওহ তুমি তোমার বাবার মার খেয়ে এখানে এসেছো। আর সবাইকে বলে বেড়াচ্ছো অফিসের কাজে এসেছো, ভালো খুবই ভালো। তা মার খেলে কেন? নিশ্চয়ই পূর্ণের কাজবাজ করেছো?’
-‘পূর্নের কাজই বটে। বাবার পি.এ রোজী আছে না? শালি আমাকে দেখলেও ঠোঁট কামড়ায়, বাবাকে দেখলেও ঠোঁট কামড়ায়। তাই তাকে ডেকে বলছিলাম হয় আমাকে সিগ্নাল দিতে নতুবা বাবাকে। বাবা, ছেলে, এক জনকেই ব্যাপারটা বিশ্রী দেখায়। সে এইকথা বাবাকে বলে দিয়েছে। বাবা এসে আমাকে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মেরেছে। পরে জানতে পারলাম, এটা রোজীর পুরনো রোগ। ঠোঁট কামড়ানো রোগের কারণে তার বিয়ে হয় না। লোকে ভুল বুঝে, এজন্য সে বেশিরভাগ সময় মাক্স পরে থাকে। আমিও তো জানতাম না আসল কাহিনি।
জানলে একথা বলতাম না নিশ্চয়ই, বলো বলতাম? তোমার প্রাক্তনের কথা বলেছি? বলি নি তো। তাছাড়া রোজীকে পরে সরি বলেছি। কারণ আমি উপর উপর অভদ্র হলেও ভেতর ভেতর ভদ্র।’
আজমত আলী কথা বললেন না। অনড় হয়ে বসে রইলেন
টুলের উপরে। টুলের এক পা ভাঙা। ভেঙেছেন উনি নিজেই এইদিকে আজিজুলের কোনো বিকার নেই। সে পায়েসের উপরে চেরি দিয়ে তার বউয়ের নাম লিখতে ব্যস্ত। ডাক্তার এসে তার পা প্লিষ্টার করে দিয়ে গেছে। হাঁটা চলা বন্ধ। একথা মেয়ে পক্ষকেও জানানো হয়েছে। মেয়ে পক্ষই আগামীকাল মেয়ে নিয়ে বিয়ে পড়াতে আসবে। যেখানে ছেলেরা মেয়ের বাড়ি যায়, সেখানে মেয়েই আসবে ছেলের বাড়ি। ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করছে সে।
সন্ধ্যার পরপরই হলুদের অনুষ্ঠান হলো। ইফতির বাবা মাও চলে এসেছে। তারা খুবই মিশুক। উনারা মেহজাবিনের মা বাবার সঙ্গে গল্প করছেন। একটুপরে সেখানে সেজে গুঁজে মেহজাবিনকেও দেখা গেল, সে হলুদ রঙা আনাকলি পরে টইটই করে ঘুরছে। ঘুরছে না ঠিক, ফাঁকা জায়গা খুঁজছে। এত গ্যাদারিং ভালো লাগছে না তার খুব মাথা ব্যথা করছে।
তবে হালকা সাজে তাকে চমৎকার দেখাচ্ছে। এদিকে ইফতি আকাশি রঙের টি শার্ট আর কালো জিন্স পরে বসে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজিজুল মিষ্টি খেতে পারে না। খেলে বমি হয়, মাথা ঘুরে। তাই যত মিষ্টি আছে সব ইফতি খাচ্ছে।
কেউ আজিজুলের কপালে হলুদ ছুঁয়ে মিষ্টি খাওয়াতে গেলে ইফতি বলছে,
-‘মামা মিষ্টি খায় না, আমি আ়ছি, আমাকে দিন।’
এরপর পেটপুরে মিষ্টি খেয়ে আজিজুলের পাশ থেকে উঠে গেছে। এমনিতেই গরম। এত চাপ নেওয়া যাবে না। যে বিয়ে করছে সেই নাহয় মজা বুঝুক। সে পকেট দুইহাত পুরে শিষ
বাজাতে বাজাতে হাঁটছে। হঠাৎ তার নজর পড়ল, জারুল গাছের নিচে চেয়ার পেতে বসা মেহজাবিনের দিকে। সে একগাল হেসে সেদিকে এগিয়ে গেল তারপর মেহজাবিনের পাশের চেয়ারে বসে একা একাই বলল,
-‘উফ! এত গরমে কেউ বিয়ে করে?’
মেহজাবিন জবাব দিলো না তাকাল না। মেহজাবিনের পাত্তা না পেয়ে বলল,
-‘ভয় পেয়ে মানুষ স্ট্রোক করে। স্ট্রোক করলে মারাও যায়।
এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেও। আবার শুনছি, মেয়েরা রাতে একা শুতে ভয় পাই। ভূত টূতও নাকি দেখে। ভয়ে কান্নাকাটি করে। তাই আমরা পুরুষ জাতিরাই এই সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব নিয়েছি। ভয় যেহেতু স্ট্রোকেরই কারণ তাই আমরাই মেয়েদেরকে স্ট্রোক থেকে বাঁচাতে মেয়েদের বিয়ে করি। প্রাণ বাঁচায়। নয়তো তাদেরকে বিয়ে করতে আমাদের এত ঠ্যাকা পড়ে নি।’
একথা শুনে মেহজাবিন হাসল। দৃষ্টি তুলে তাকাল। এরপর চমৎকার হেসে বলল,
-‘শীত কিংবা গরম ছেলেরা সহজে গোসল করে না। ময়লা জামা কাপড়ের স্তুপ করে রুমের কোণায় কোণায়। গন্ধভরা মোজায় পারফিউম মেরে কাজ চালায়। রুম ঝাড়ু দেয় না। অকারণে রাত জাগে। নেশাভান করে। কথায় কথায় মিথ্যা বলে। হাতে বালা। কানে দুল। গলায় মালা। ছেঁড়া প্যান্ট,চুলে ঝুঁটি। বাহুতে ট্যাটু স্কিকার। একথায় বনমানুষ। আমরা তো মানুষ। আর মানুষ হিসেবে তাদের অধঃপতন সহ্য করতে পারি না। চোখের সামনে কারো ক্ষতি সহ্য করা যায়? যায় না। এজন্যই একটা ছেলেকে বনমানুষ থেকে মানুষ করতে আমরা বিয়ে করি। নয়তো এত ঠ্যাকা পড়ে তাদেরকে বিয়ে করে জীবন কয়লা করতে।’
একনাগাড়ে পরপর তিনবার ডাকার পর মেহজাবিন ঘুম ঘুম চোখে তাকাল। সদ্য ঘুম থেকে জেগে ঘটনা কিছুই বুঝল না সে। শুধু বুঝল৷ সামনে দাঁড়ানো মানুষটা তাকে ডাকছে,কেন
ডাকছে, কি করণে ডাকছে মস্তিষ্ক বুঝতে চাইছে না। সে ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে আবার সেই ডাক। তবে এবার একটু জোরেই ডেকেছে। সে এবার সোজা হয়ে বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখে বাসের রোগা পাতলা টিনটিনে হেল্পার তাকে ডাকছে।
কি আশ্চর্য! হেল্পার কেন ডাকবে? সিলেটে কী এসে গেছে?
কী সর্বনাশের কথা ঢাকা থেকে সিলেটে এসে গেছে অথচ সে একটুও জাগা পায় নি? সে দ্রুত চোখ ডলে বাইরে তাকাল।
বাস থেমেছে। বিরতি দিয়েছে। বাসের কেউ নেই, সবাই যার যার কাজ সারতে গেছে। পাশের ছেলেটাও নেই। কী অভদ্র, একটা মেয়ে বাসে একা একা ঘুমাচ্ছে আর সে চলে গেছে। অভদ্রতার খাতিরেও তো ডাকতে পারত। সে এমনি এমনি অভদ্রের খেতাব দেয় নি, ছেলেটা চূড়ান্ত লেভেলের অভদ্র।
তখন হেল্পার তার হলুদপাটির দাঁত বের করে বলল,
-‘আফা বেশি সুমায় নাই, শরমের কাজ করার হইলে জলদি যান।’
-‘শরমের কাজ, শরমের কাজ, করছেন কেন? কোন শরমের কাজের কথা বলছেন? আর শরমের কাজ করবই বা কেন? আশ্চর্য তো।’
-‘আগেই রাইগেন না আফা। থামেন,একটুখানি সবুর করেন। আমার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনেন।’
-‘পরিষ্কারভাবে বলুন। ঘুরানো প্যাঁচানো কথা বুঝি না আমি।’
_’এর আগে বাস থামার পর এক বেডিরে কইছিলাম ‘আফা হাগা মুতা করলে যান গা। দুই মিনিটের মধ্যেই বাস ছাইড়া দিবো।’ একথা শুইনা বেডির ফেমিক আমাকে আচ্ছা মতো
পিডাইছিল। আমার কথায় নাকি বেডি শরম পাইছিল। তাই
শরমের কথা শরম বইলা চালায়। হাগা মুতা নাকি নষ্ট ভাষা।
আর নষ্ট ভাষা মাইগোর লগে কইতে হয় না। হেরা নাকি খুব লজ্জা পায়।’
হেল্পারের একথা শুনে মেহজাবিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বলার শব্দ কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। তবে সে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল। হেল্পারের সাহায্যে উপর থেকে লাগেজ নামিয়ে একটা ড্রেস নিয়ে বাস থেকে নামল।এই সুযোগ চেঞ্জ করে নেওয়ার। বাস থেমেছে একটা রেস্তোরার সামনে। নাম
‘খাই খাই।’ এ আবার কেমন আজব নাম? রেস্তোরায় মানুষ খাবার খায় খুবই সুন্দর কথা। তাই বলে নামও রাখবে ‘খাই খাই।’
দুনিয়াটা বড়ই আজব। তারচেয়ে আজব দুনিয়াতে বাস করা মানুষজন। সে বাস থেকে নেমে হেল্পারকে বলল সে না আসা অবধি বাস যেন না ছাড়ে। এক্ষুণি চলে আসবে। বেশি সময় লাগবে না তার।একথা শুনে হেল্পার কথা দিলো জান থাকতে তাকে ছাড়া বাস ছাড়তেই দিবে না সে। হেল্পারের কথা শুনে সে হাসল। কৃতজ্ঞতা জানাল৷ চিন্তামুক্ত হয়ে সে ওয়াশরুমের খোঁজে পা বাড়াল। বাসের মানুষজন হাঁটছে, কেউবা খাচ্ছে, কেউবা হাসিগল্পে মশগুল। সে এক মহিলার থেকে জানতে পারল, মেয়েদের ওয়াশরুম বামদিকে, ছেলেদের ডানদিকে।
সে মেয়েদের ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দেখে ইয়াবড় লাইন। বিরক্ত হলেও সে লাইনে দাঁড়াল। তবে যে লাইনে দাঁড়াল তার পাশের লাইনের ভিড়টা আগে শেষ হলো। সে চট করে লাইন ভঙ্গ করে পাশের ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। এখানে অবস্থা যা তা। সে কোনোমতে শাড়িটা বদলে হালকা পার্পেল কালারের সালোয়ার কামিজ পরে নিলো। দেহে প্রাণ থাকতে সে আর কোনোদিন শাড়ি পরে জার্নি করবে না। বাসেও উঠবে না। এ তার নিজের কাছে নিজেরই প্রমিস। যতটুকু শিক্ষা পাওয়ার পেয়ে গেছে। এই শিক্ষাটুকুই যথেষ্ট তার জন্য। তারপর চোখ মুখসহ হাতে-পায়েও পানি দিয়ে চুলগুলো কোনোমতে বেঁধে কাঁটা গুঁজে নিলো। চুল বাঁধার সময় হাত চ্যাটচ্যাট করলেও তাড়াহুড়োয় তেমন পাত্তা দিলো না।উফ! সালোয়ার কামিজে শাস্তি লাগছে।এতক্ষণ মনে হচ্ছিল তার শরীরে সাপ পেঁচিয়ে আছে। এদিকে, শাড়ি খুলে যাওয়ার ভয়ে পেডিকেটের নাড় এতটা টাইট করে বেঁধেছিল শাড়ির ঘর্ষণে সেখানে লাল হয়ে ছাল উঠে জ্বলতে শুরু করেছে। সেই জ্বলোনির তালে তালে মেজাজও হাই হচ্ছিল৷ না পারছিল সেখানে হাত বুলাতে না পারছিল নাড় ঢিলা করতে। কি একটা অবস্থা! এইদিকে কে
যেন একনাগাড়ে ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কাতে আছে। ওরে বাবারে, থামাথামির নাম নেই। সে কোনোমতে শাড়ি গুছিয়ে বাসের সিটের উপর রেখে এলো। ক্ষুধায় মাথা ঘুরছে। কিছু খাওয়া দরকার। সে সময় দেখে রেস্তোরায় ঢুকে দেখে ভীড় খুব। এককোণের টেবিলে বসে তারই পাশের সিটের অসভ্য ছেলেটা রুটি তরকারি খাচ্ছে। তাও হালুম হালুম করে। যেন জীবনেও খাবার দেখে নি। সে সেখানকার একজনকে ডেকে
জিজ্ঞাসা করল, এখানে কি কি খাবার দাবার পাওয়া যাবে?
মাঝ বয়সী এক লোক কোমরে গামছা বেঁধে অভিজ্ঞ হাতে রুটি বেলেই যাচ্ছে। তিনিই জানাল, অন্য যেইসব আইটেম ছিল সব শেষ। খেতে হলে রুটি তরকারি খেতে হবে।এছাড়া উপায় নেই। অগত্যা মেহজাবিন রুটি তরকারির সঙ্গে ডিম ভাজা দিতে বলে ফাঁকা টেবিল দেখে সেও বসল। গরম গরম রুটি তরকারি পেয়ে ঝটপট খাওয়াও শুরু করল। ছেলেটার খাওয়া শেষে সে বিল মিটিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোলাকোলা খাচ্ছে।কানে ফোন ধরা। সম্ভবত কারো সঙ্গে কথা বলছে৷ সে আর সেদিক তাকাল না দ্রুত খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে বাসের কাছে এসে দাঁড়াল। বার দু’য়েক মিলিয়ে নিলো এটা তারই বাস নাকি। যাওয়ার আগে একটা চিহ্ন’ও রেখেছিল।
তার কাছে বাড়তি শুকনো খাবার আগে তাও কোলাকোলা,
ঝাল চকলেট, চিপস, কিনে বাসে উঠে বসল ৷ সে বসার দুই মিনিট পর হেল্পার এলো। তার সাহায্যে সে পুনরায় লাগেজ নামিয়ে শাড়িটা রেখে দিলো। পরপর তিনবার সাহায্য করায়
সে হেল্পারকে কিনে আনা কোলাকোলাটা উপহার দিলো। কী যে খুশি হলো হেল্পারটা। তারপর সে সবাইকে ডাকল, বাঁশি বাজাল। বাঁশি শুনে সকলে ধীরে ধীরে বাসে উঠে বসল। সব সিট পূর্ণ হতেই আবার চেক দিয়ে বাস ছাড়ল। ঘড়িতে তখন রাত্রি আড়াইটা। ভোর হতে অনেক দেরি। অনেক পথ বাকি। সে স্যান্ডেল খুলে সিটে দু’পা তুলে হাঁটু মুড়ে বসল। আজকে আকাশে চাঁদ নেই। বেহায়া চাঁদ বলাতে রাগ করে চলে গেছে বোধহয়।
এইদিকে ইফতি পাশের সিটে বসে সেই তখন থেকে উশখুশ করছে। মেয়েটার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিলো, তবুও কিছু বলছে না কেন? তার তো লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে দেওয়ার কথা।
তবে কি সে খেয়াল করে নি? তার কি উচিত হবে মেয়েটাকে বলে দেওয়া। বললে কি বা বলবে, ‘এই যে মেয়ে শুনুন আমি আপনার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছিল। আপনি উচিত রাগ করা, রাগ করুন প্লিজ।’
যদি বলেও গণপিটুনি খাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে তো? সম্ভবত না। এরচেয়ে চুপ করে থাকাটাই বোধহয় শ্রেয়।
কিন্তু চুপ থাকলে তো মেয়েটার উপকার হবে না। তার জানা উচিত, তার চুলে চুইংগাম আছে। তাছাড়া প্রতিটা মানুষের অধিকার তার নিজের ব্যাপারে সব কথা সবার আগে জানা।
তাই সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-‘এই যে শুনছেন একটা কথা বলার ছিল। কথাটা জানা
জরুরি।’
মেহজাবিন শুনেও জবাব দিলো না। কাঠ মেরে সেভাবেই বসে রইল। তখন ছেলেটি পুনরায় বলল,
-‘আপনি যখন ড্রেস চেঞ্জ করে খাবার খাচ্ছিলেন তখন আপনার চুলে গোলাপি গোলাপি কিছু একটা দেখেছিলাম।
দূর থেকে মনে হলো চুইংগামের মতো। গোলাপির শাড়ির সাথে চুলে কি গোলাপি চুইংগাম লাগিয়েছেন? এটা কি নতুন ফ্যাশান?’
এবার মেহজাবিন ধড়ফড় করে উঠে চুলের কাঁটা খুলে হাত গলিয়ে দিলে চুলের ভাঁজে। এবং জটের মতো চুইংগামের অস্তিত্বও টের পেল। সে এবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘কে করেছে এটা?’
-‘জ্বি আমিই করেছি। রাগের মাথায় করে ভেবে দেখলাম কাজটা করা ঠিক হয় নি। এজন্য সরি।’
-‘আপনাকে এখন কি করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?’
-‘যা ইচ্ছে করতে পারেন। তবে যেটাই করুন আগে আমার বায়োডাটা জেনে নিন। আমি ইফতি। বয়স আটাশ। বছরের ছয় মাস বাবার ব্যবসা দেখা শোনা করি। বাকি ছয়মাস বনে বাঁদাড়ে ঘুড়ে বেড়ায়। অফিসের কাজে সিলেটে যাচ্ছি, উঠব মামনির বাসায়। নিন এবার দ্রুত আমার শাস্তি ঠিক করুন,
সাতটা রুটি খেয়ে পেট টানটান। যখন তখন ঘুমিয়েও যেতে পারি।’
মেহজাবিন এবারও নিশ্চুপ। ইফতির কোনো কথার জবাবই সে দিলো না। পুনরায় চুল বেঁধে নিয়ে পূর্বের মতো চুপ করে বসে রইল। মন খারাপ হয়ে গেছে। এখন চুল থেকে চুইংগাম ছাড়াবে কিভাবে? দীর্ঘক্ষণ সেভাবে থাকতে থাকতে সে ঘুমে তলিয়ে গেল। মন খারাপের মুহূর্তগুলোতে তার ঘুম আসে। মেয়েটাকে ঘুমাতে দেখে ইফতি খুব অবাকই হলো। এমন অদ্ভুত প্রজাতির মেয়ে এর আগে দেখে নি সে, পেট দেখার কথা বলার রাগে গনগন করছিল। যেন তাকে তুলে আছাড়ই মেরে দিবে। অথচ চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিলো তবুও কিছুই বলল না! কেউ যদি কিছু না বলে তাহলে সে বা কি করতে পারে? অপরাধ করেছে, সেটা স্বীকারও করেছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সেও ঘুমিয়ে গেল।
দীর্ঘ সাত ঘন্টা পর বাস সিলেটে এসে পৌঁছাল। বাইরে তখন ঝকঝকে দিনের আলো। বাস থেমেছে বাস স্ট্যান্ডে। অনেকে নেমে পড়েছে। হইহট্টগোল শুনে ইফতির ঘুম ভাঙল। দুইহাত দুই পাশে ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। ঘাড় পিঠ ব্যথা করছে।
তখন তার খেয়াল হলো পাশের সিটের মেয়েটা নেই। ওমা, মেয়েটা তাকে ডিঙিয়ে কখন চলে গেল? গেল তো গেল বলে গেল না কেন? সে সাতপাঁচ না ভেবে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাস থেমে নামল। তারপর একটা সিএনজি নিয়ে নিয়ে চলে গেল মামনির বাসায়। এদিকে মেহজাবিন ফুপির বাসায় পৌঁছেই কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। কিছুতেই চুইংগাম ছাড়ানো
যাচ্ছে না। যেই দেখছে সেই বলছে চুল কাঁটা ছাড়া উপায় নেই। রাতে লাগানো চুইংগাম সকালে শুকিয়ে আরো খারাপ অবস্থা। মেহজাবিনের মা এখনো বুঝতে পারছে না, মেয়ের চুলে চুইংগাম লাগল কে? তবে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না, এখন কিছু বললেই মেয়েটা ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠবে। না, তিনিও উপায় না পেয়ে চুল কেঁটে ফেলার কথা বললেন। এই কথা শুনে মেহজাবিনের কান্না বেড়ে গেল। তখন সেই মুহূর্তে কেউ একজন বলে উঠল, গুডমনিং এভিওয়ান।’
দুঃচিন্তার মুহূর্তে একথা শুনে সকলে দরজার দিকে তাকাল।
দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে ইফতি দাঁড়িয়ে আছে। মুখভর্তি হাসি। তার আসতে লেটই হয়েছে। মেহমান হিসেবে আসবে ফল মিষ্টি ছাড়া তো আর আসা যায় না। তাই সেগুলো কিনে আসতে আসতে খানিক দেরি হলো। দেরি হলেও সমস্যা হয় নি, মেহমান দের জন্য কেনা ফল খেতে খেতেই এসেছে সে।
কারণ, খালি হাতে কারো বাসায় যাওয়ার ছেলে ইফতি নয়, আবার মেহমানদের জন্য যা কিনবে সবগুলো ভদ্রভাবে সব দিয়ে দেওয়ার ছেলেও সে নয়।’
একটু চালাক না হলে দুনিয়াতে টেকা খুবই মুশকিল। কিন্তু এখানে এসে সে অবাকই হলো। বাসের মেয়েটা এখানে কি করছে? এদিকে তাকে দেখামাত্রই মেহজাবিন রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেল, খুঁজে খুঁজে আঁশবটি নিয়ে ছুটে গেল ইফতির দিকে।অবস্থা বেগতিক দেখে আঁতকে উঠল সকলে। মেহজাবিনের বাবা কোনোমতে মেয়েকে থামালেন, আদুরে ভাবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললেন। এরপর কি হয়েছে জানতে চাইলেন। মেহজাবিন কেঁদে কেটে চোখ মুখ লাল করেছেন। কান্নার চোটে কথা বলতেও পারছে না।
ইফতির খুব মায়া হলো। ইশ! মেয়েটা কিভাবে কাঁদছে। সে হাতের ফল মিষ্টি রেখে বলল,
-‘হয়, হয়, কান্নাকাটি করলে আমারও এইরকম হয়। ভয় নেই এটাই স্বাভাবিক। উনাকে কেউ টিস্যু এনে দাও প্লিজ, নাকভর্তি সর্দির কারণে ঠিকঠাকভাবে অভিযোগ জানাতে পারছে না।
এ কথা বলতে দেরি মেহজাবিনের হামলে পড়তে দেরি হলো না। সে শক্ত করে ইফতির মাথার চুল ধরে, দুই হাত দিয়ে ঠিক বরই গাছ ঝাঁকানোর মতো করে ঝাঁকাচ্ছে। এমনকান্ডে
ইফতি টু শব্দও করতে পারল না। তখন মেহজাবিনের দাদু আজমত আলী বিরবর করে বললেন,
-‘বুনো ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুল, এ কি করে সম্ভব?’
পাশ ফিরে তখন আজিজুল হাই তুলে জবাব দিলো,
-‘নিয়তি বুঝলে, সবই নিয়তি। তোমার কপালে যদি লেখা থাকে তুমি হাগতে হাগতে মারা যাবে, তাহলে এই নিয়তিও কেউ খন্ডাতে পারবে না। আজ হোক অথবা বছর পর তুমি হাগতে হাগতে ক্লান্ত হয়ে যাবে। তারপর পানি শূন্যতায় মারা যাবে।’
-‘বেয়াদব।’
ছোটো ছেলের আজিজুলের কথা শুনে আজমত আলী খুব রেগে গেলেন। ঠিক একারণে আজিজুলের সঙ্গে কথা বলতে চান না তিনি। সবসময়ই ভুলভাল বকে মেজাজ গরম করে। তখন আজিজুল হতাশার শ্বার ফেলে বাবাকে বলল,
-‘হাগার কথা বললাম বলে বেয়াদব হয়ে গেলাম। কেন আব্বা, আপনি কি হাগেন না? হাগা হলো খাঁটি বাংলা শব্দ।
বাংলা ভাষা, বাংলা শব্দ নিয়ে আমাদের এত অহংকার, তাই না? যে শব্দ আমাদের অহংকার সেসব শব্দ ব্যবহার করতে লজ্জা কিসের?’
_’এই যে মিস গোলাপি পেট দেখানো হয়ে গেলে সরে দাঁড়ান, আমি বসব।’
চলন্তবাসে পাশে দাঁড়ানো যুবকের এমন অসভ্য কুটুক্তিতে মেহজাবিন বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। তাকে বলল কী না দেখতে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। যখন দেখল তাকেই বলেছে তখন কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। জবাবে কিছু বলার খৈই হারিয়ে ফেলল। রাগে দুঃখে মেজাজ গরম হয়ে গেল। তাকে পেছনে তাকাতে দেখে যুবকটি বিরক্তিকর দৃষ্টি ছুঁড়ে, মুখে চুইংগাম পুরে পুনরায় বলল,
-‘ওহ হ্যালো আমি আপনাকেই বলেছি। সরুন এবার, এটা আমার সিট।’
ছেলেটার স্পর্ধা দেখে সে সচকিত। নড়লো না, সরলোও না।
কেবল ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার আঠারো বছরের জীবনে এর আগে কখনো এমন নোংরা ইঙ্গিত শোনে নি সে।
তাছাড়া কোনো ছেলের ভাষা এতটা নোংরা হতে পারে জানা ছিল না। কোনো মেয়েকে সন্মান দিতে না’ই পারল, তাই বলে মুখের উপর চটাস করে এই ধরনের কথা বলে বসবে? কোন আক্কেলে বলবে? মেয়েরা কি সস্তা? পেট দেখানো মানে কি?
কখন পেট দেখালো সে? সে কি বাজারি সস্তা মেয়ে যে বাসে উঠে পরপুরুষকে পেট দেখিয়ে বেড়াবে? নেহাৎ আজ শাড়ি পরে বাসে উঠেছে তাও জীবনে প্রথমবার। প্রথমবার শাড়ি পরলে এমন একটু আধটু সবারই হয়। শাড়ির আঁচল ধরলে কুঁচি খুলে যায়, কুঁচি ধরে হাঁটতে গেলে উস্টা খেতে হয়। এই তো জানা কাহিনি, পুরনো ঘটনা। তাছাড়া ভারি ব্যাগটা টেনে উপরে তুলতে গিয়ে এক্সিডেটলি তার শাড়িটা সরে গিয়েছিল বোধহয়। তাই বলে এমন নোংরা ইঙ্গিত ছুঁড়বে?ভাগ্যিস অন্য
সিটের কেউ ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। নয়তো সকলে তার দিকে তাকিয়ে মজা নিতো। নোংরা দৃষ্টি ছুঁড়তো। মেহজাবিন আশপাশ দেখে কঠিন কথায় জবাব দিতে গিয়েও বহুকষ্টে
নিজেকে সামলে নিলো। যতই হোক, সে মেয়ে। তার উপরে একা। এখন যদি কিছু বলতেও যায় তবে এই ছেলেটা লাই পাবে, কথা বাড়াবে, তখন বাসের বাকি সদস্যরাও ব্যাপারটা জেনে যাবে। লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। মনে মনে এই
কথা ভেবে মেহজাবিন কথা বাড়াল না,নীরবে সরে গিয়ে ওর বরাদ্দকৃত জানালার ধাঁরের সিটে বসল। ছেলেটাও কাঁধের ব্যাগ উপরে রেখে সিট হেলিয়ে বসল। পানি খেলো। কানে ব্লু টুথ গুঁজে কার সাথে যেন কিছুক্ষণ কথা বলল, হাসাহাসিও করল, এরপর সিটে মাথা এলিয়ে চোখজোড়া বুজলো। এই সময়টুকু মেহজাবিন দাঁতে দাঁত চেপে কাঠ হয়ে বসে রইল। তার মনে হলো ছেলেটার কলার ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলতে, ‘সরি বল বেয়াদব, এক্ষুণি বল।’
কিন্তু বলতে পারল না। আর পারল না বলে নিজের উপরেই রাগ হলো। রাগে চোটে ভুলেও চোখ তুলে তাকাল না। কথা বলা দূর টু শব্দও করল না। এমনভাবে বসল যেন ছেলেটার সঙ্গে ভুলক্রমেও স্পর্শ না লাগে। এই ছোট্ট জীবনে কতশত ছেলে দেখেছে, ক্রাশ খেয়েছে, কিন্তু এমন অসভ্য ছেলে এর আগে দেখে নি। যার মধ্যে ভদ্রতাজ্ঞানটুকুও নেই। ভাই তো তারও আছে। কই তারা তো এমন নয়। এমনভাবে কাউকে নোংরা ইঙ্গিত করে না। বাজে কথা বলে না। বলবে কিভাবে তার ভাইরা তো এমন নোংরা মানসিকতার নয়। যারা নোংরা মানসিকতার তারাই এসব বলবে। ছিঃ! এখন পাশ বসতেও বিরক্ত লাগছে। তখন সিটে বসার সময় ঢং করে পায়ে পাড়া দেওয়া উচিত ছিল। নয়তো পড়ে যাওয়ার ভাণ করে হাতে নখ বসানো উচিত ছিল। এতে মনের জ্বালা কিছুটা কমলেও কমতে পারতো। ইস! মিস হয়ে গেল। তার স্বভাবটাই এমন সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে না। ঝগড়া করার সময় মেইন পয়েন্ট মনে থাকে না। পরে আবার ঠিকই মনে পড়ে,
কথা বলে না, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে ওর তেমনই অবস্থা।
তখন তার ফোন ভাইব্রেট হলো। স্কিণে মায়ের নাম দেখামাত্র তার রাগের পারদ আরো একডিগ্রী বেড়ে গেল। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল আলাভোলা মায়ের উপর। মায়ের কারণে শাড়ি পরে বাসে উঠেছে। মায়ের কারণে তাকে সিলেট যেতে হচ্ছে। মায়ের কারণে ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কক্সবাজার যেতে পারল না। তাই সব দোষ মায়েরই। ততক্ষণে কল কেটে গিয়ে, পুনরায় কল এসেছে। সে এবার রাগে গজগজ করে কলটা রিসিভ করে বলল,
-‘শাড়ি পরেই আসছি। শুনেছো? হয়েছে শান্তি?’
-‘কি আশ্চর্য, রেগে যাচ্ছিস কেন?’
-‘ রাগ করব কেন? রাগ করা কি আমাকে সাজে? রাগ শুধু তোমাদেরই আছে। আমি আছি হুকুম তামিল করতে। আর কোনো হুকুম স্থগিত আছে, বলো বলো।’
-‘ না নেই, রাস্তাঘাটে রাগ করে না মা। সাবধানে আয়।’
-‘পারব না সাবধানে যেতে। কি ভেবেছো সব তোমার কথা হবে?’
-‘এভাবে কথা বললে আশপাশের মানুষ কি ভাববে? মাথা ঠান্ডা কর মা।’
মেহজাবিন জবাব দিলো না রাগে দুঃখে কল’ই কেটে দিলো।
তার এখন চোখ জ্বালা করছে।কান্না পাচ্ছে। অস্থির লাগছে। কান্নার চোটে দম আঁটকে আসছে। নিজের মাকে মাঝেমধ্যে অচেনা লাগে। সে কান্না আঁটকে দু’হাতে মুখে ঢেকে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। একটু পানিও খেলো। তারপর জানালা খুলতেই এক পাগলাটে বাতাস এসে শরীরে ছুঁয়ে দিলো তার তনুমন। সে চোখে মুখে পানি দিলো। অশান্ত মন শান্ত করতে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিলো। তাতে কাজও হলো। এখন একটু ভালো লাগছে। ভেজা মুখে বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে।
অনেকক্ষণ ধরে ভেজা চুল বেঁধে রাখায় মাথা ব্যথা করছে।
শাওয়ার নিয়ে চুল শুকাতেও পারে নি ওমনি চুল বেঁধে ছুটে এসেছে। ঘুমিয়েছিল আর জাগা পায় নি। ফলে কোনোমতে, বুয়ার সাহায্যে শাড়িটা পরে লাগেজ নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছেছে। এই পাগলাটে বাতাসে বেশিক্ষণ লাগবেও না চুল
শুকিয়ে নিতে। একথা ভেবে সে চুলের কাঁটা সরাতেই ঝপাৎ করে পিঠময় ছড়িয়ে গেল ভেজাচুল। ভুরভুর করে শ্যাম্পুর সুগন্ধ এসে ধাক্কা দিলো নাকে। অবাধ্য বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে চুলগুলো যেন বেপরোয়া রুপ ধারণ করল। সমুদ্রের
উত্তাল ঢেউয়ের মতো বাতাসের প্রবঞ্চনায় উড়তে লাগল।
একেই বুঝি বলে, মুক্তির স্বাধীনতা। মুক্ত মনে, মুক্ত আকাশে একা উড়তে পারার অদম্য সাহসীকতা। বাস চলছে নিজস্ব গতিতে। রাস্তায় কৃত্রিম আলোর সাজসজ্জা। এখনো চলছে মানুষের আনাগোনা। সময় কতই বা হবে, রাত সাড়ে দশটা। তার যাত্রা সিলেটের পথে। বড় ফুপির বাসায়। বড় ফুপির দেবরের বিয়ে। তারা নিমন্ত্রিত। মা বাবা ওখানেই আছে। তার পরীক্ষার কারণে আসতে লেট হয়েছে। যদিও তার আসার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ফুপির ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, মায়ের ঘ্যানঘ্যানি, বাবার চিন্তার অবসাদ ঘটাতে আসতেই হয়েছে।
এখন ভালোই ভালোই ক’দিন থেকে ফিরে আসতে পারলেই হলো।রাতের জার্নি তার ভীষণ পছন্দ। ধুলোবালি নেই, গরম নেই, ভিড়ভাট্টাও কম। এই প্রথমবার একা জার্নি করছে সে। একা জার্নির মজাও আছে। রাতের নিস্তব্ধতা, বেহায়া চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে পথ চলা, রাস্তার দু’ধাঁরে বেড়ে ওঠা বুনো ফুলের গন্ধ, সবকিছুতে এক আলাদা রকম ভালোলাগা কাজ করে। নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে সে কত কী ভাবছে। চিপসের প্যাকেট ছিঁড়ে চিপস্ খেতে খেতে সে রাতের সৌন্দর্যে ডুবে গেছে। তার মন এখন বেশ ফুরফুরে। ভুলে গেছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। পাশে বসা অভদ্র ছেলেটার কথাও। কিন্তু এসব তাকে বেশিক্ষণ ভুলে থাকতে দিলো না। হঠাৎ পাশের সিটের ছেলেটা হাঁচি দিয়ে বিরক্তিকর সুরে বলল,
-‘এই যে মিস গোলাপি আপনার সমস্যাটা কি? আমাকে দেখে স্বামী স্বামী ফিল পাচ্ছেন নাকি? প্রথমে পেট দেখালেন এখন আবার সাপের মতো বড় বড় চুল দিয়ে নাকে সুড়সুড়ি দেওয়াচ্ছেন। এসব কিসের ইঙ্গিত? ক্রাশ খেয়েছেন? বিয়ে করবেন আমাকে? মতলব বুঝি না মনে করেছেন?দেখে তো ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, তা বিহেভিয়ার থার্ডক্লাস মার্কা কেন?’
আবার! আবারও গা জ্বলানো বাজে কথা। তাকে দেখে সে নাকি ক্রাশ খাবে, বিয়ে করবে, একথাও শুনতে হলো। তবে পাগলে কত কী বলে সব কথা কানে নিতে নেই। পাগল তার প্রলাপ আওড়াবেই এটা তো সে জানেই। ছেলেটার একথা শুনে মেহজাবিন রাগল না মুচকি হাসল। হাসির সঙ্গে সঙ্গেই
তার দুইগালে ছোট্ট একটা গর্ত হলো। যাকে বলা হয় টোল।
তাকে হাসতে দেখে ছেলেটা কিছু বলার আগে সে জবাব দিলো,
-‘আমি থার্ডক্লাস তাই আমার বিহেভিয়ারও থার্ডক্লাসমার্কা। তাছাড়া সমস্যা যখন আপনার, সমস্যার সমাধান খোঁজাও বোধহয় আপনারই দায়িত্ব, তাই নয় কি? বাই দ্যা ওয়ে, ভদ্র ঘরের ছেলেরা কাউকে আলতু ফালতু নামে ডাকে না।’
-‘তা আপনার নামটা জানতে পারি? ‘
-‘না, পারেন না। অপরিচিত কাউকে আমি আমার নাম বলতে ইচ্ছুক নই।’
একথা শুনে ছেলেটা ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইল। পেছন ফিরে দেখল, সিট ফাঁকা নেই অগত্যা সেভাবেই বসে রইল।
সুপারভাইজারকে বলেও লাভ হলো না। কেউই তাদের সিট ছাড়তে রাজি নয়। বাসের প্রায় অনেকে ঘুমে তলিয়ে গেছে। কেউ বা পাশের জনের সঙ্গে গল্পে মশগুল। কেউ খাচ্ছে তো কেউ ফোনালাপ ব্যস্ত। যাত্রী ওঠা নামার ব্যাপারও নেই তাই
বাসের ভেতরের লাইটটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ছেলেটা এখন ফোন টিপছে। ফোনের সল্প আলোয় বোঝা গেল তার মুখ থমথম করছে। অপমানিত হয়ে রাগে ফুঁসছে। এমনই হওয়া উচিত। অন্যকে যাতা বলার সময় হুঁশ জ্ঞান থাকে না। বেশ হয়েছে। এবার দেখ কেমন লাগে।
এতক্ষণে মনমতো জবাব দিতে পেরে মেহজাবিন মনে মনে হাসল। তবে চুল বাঁধল না। মন কেমন করা সুগন্ধি মেশানো
চুলগুলো সেভাবেই উড়তে থাকল। ছেলেটাকে জব্দ করতে পেরে সে এদিকে তাকালও না। পাশ ফিরে সিটে মাথা দিয়ে
চোখ বুজে নিলো। ছেলেটার মুখ দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ঠোঁট টিপে নীরবে হাসলও সে। কিন্তু কথায় বলে না কোনো শত্রুকে দূর্বল ভাবতে নেই। পাছে নিজেরই ক্ষতি হয়।এখানে ঠিক তাই ঘটল। ছেলেটাকে জব্দ করেছে ভেবে সে নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে গেল৷ ঘুম গাঢ় হলো। সজাগ থাকার আর প্রয়োজনই বোধ করল না। কিন্তু সজাগ থাকা উচিত ছিল। যদি সজাগ থাকত তাহলে টের পেতো, তার শখের চুলে ছেলেটা খুব যত্ন করে চুইংগাম লাগিয়ে দিচ্ছে। একটা নয়, দুটো নয়, তিনটে চুইংগাম। তার এই কাজে কেউ দেখল না, জানল না, সাক্ষী রইল না। তাই কাজ সেরে ছেলেটা হাত ঝেড়ে বিরবির করে বলল,
-‘পূর্ণের একটা কাজ করলাম, থাক ধন্যবাদ দিতে হবে না।’
আজ আমার আর রাদিফ ভাইয়ের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে। অনেক মান অভিমানের পর আজ অবশেষে দুজন এক হতে যাচ্ছি। ভালোবাসার সার্থকতাই বোধহয় এখানে, আপনার মানুষটার সাথে অনেক রাগ হবে, অভিমান হবে, তার প্রতি অনেক অভিযোগ থাকবে কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে যাওয়া যাবে না। এই জায়গা থেকে আমাদের ভালোবাসা টাও সার্থকতা পেল। রাদিফ ভাইয়ের প্রতি আমার রাগ, অভিমান এরপর দূরত্ব,, অবশেষে দুজন একসাথে।
বড় মা এসে বললো,,
“এখনো সাজ শেষ হয় নি ওদিকে সবাই তুবাকে দেখতে চাচ্ছে। আমি এইজন্যই বলেছিলাম পার্লারের লোকদের আরো আগে পাঠাতে। ”
“আচ্ছা হয়ে গেছে মোটামুটি সাজা। তুমি ওদের কে একটু অপেক্ষা করতে বলো” বলে সাবা আপু তার মেয়ে আয়রা কে নিয়ে বাইরে গেলো।
আয়রা সাবা আপু আর ইরহাম ভাইয়ের এক বছরের মেয়ে। সাবা আপু আর ইরহাম ভাইয়ের রিলেশনের কথা দুই পরিবার কে জানানোর আগেই একদিন হুট করে ছোট ফুফি জেঠু মনির কাছে বললো,,
“ভাইজান, আমি আমার সাবা মেয়েটাকে আমার ঘরের মেয়ে করে নিতে চাই। আমি আগে থেকেই আমার ইরহাম এর জন্য সাবা কে পছন্দ করে রাখছি। এখন তো আমার ইরহাম ভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে জয়েন দিছে। তাই আমি চাচ্ছি ইরহামের সাথে সাবা র বিয়ে দিতে। যদি আপনারা সবাই রাজি…”
“এটা তো খুশির খবর। সাবা যেমন আমাদের মেয়ে। ইরহাম ও আমাদের ছেলে। যথেষ্ট ভদ্র একটা ছেলে। আমার কোনো আপত্তি নেই। এখন বাকিটা আমি সাবার মা বাবার উপর ছেড়ে দিলাম”
আমাকে সাজিয়ে দেওয়া হলে নিচে নিয়ে গেলো রাহা আপু এসে। স্টেজে আগে থেকেই রাদিফ ভাই ছিলো। আমাকে বসিয়ে দেওয়া হলো রাদিফ ভাইয়ের পাশে। একে একে সবাই দেখে যাচ্ছে,, কথা বলে যাচ্ছে আমাদের সাথে। রাদিফ ভাই আমাকে চুপিচুপি বললো,,
“এত সাজার কি আছে!! আমার বউ এমনিতেই সুন্দর। সেটা লোকজন কে ডেকে দেখানোর কি আছে,,বুঝলাম না!!” বলে রাদিফ ভাই অন্য দিকে চাইলো।
“আমি কিছু বললাম না। শুধু একটা হাসি দিলাম। কারণ অভিযোগ শেষ হলেও ওনার প্রতি আমার অভিমান গুলো বোধহয় এখনো শেষ হয় নি”।
__________________
রাদিফ ভাইয়ের বড় মামি আমার সাথে কথা বলছেন না। উনি আমাকে উপেক্ষা করছেন। আমি জানি উনি কেন এমন করছেন আমার সাথে। ওনার মেয়ে সিনথিয়ার জন্য। কিন্তু আমার সাথে এমন করে লাভ কি!! ওনার মেয়ে সিনথিয়া তার প্রাপ্য শাস্তিটুকু পেয়েছে।
কিন্তু আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা। দিনের পর দিন যে মানসিক অশান্তি তে ভুগেছি। হতাশারা যখন আমাকে ঘিরে ধরেছে তখন! সেই সময় গুলো তো আমার জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় স্মৃতি। আমার তো যেন এখনো চোখের সামনে সেই সময়গুলো ভাসছে।
দুই বছর আগে,,
সেইদিন যখন রাদিফ ভাই রাগ করে ছোট ফুফিদের বাসা থেকে চলে আসলো পরে বড় মা আমাকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,
” কি হয়েছে রে তুবা?? রাদিফ অমন রাগ করে বেরিয়ে গেলো কেন?? তোদের মধ্যে কিছু হয়েছে??”
“না বড় মা, কি হবে। আমি জানিনা রাদিফ ভাই অমন রেগে বেরিয়ে গেলেন কেন।” বলে আমি ছোট ফুফি ডাকলো যে সেদিকে গেলাম।
এরপর আমাদের বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এর মধ্যেই রাদিফ ভাই কে অসংখ্য বার বড় মা ফোন দেন। কিন্তু উনি ফোন সুইচড অফ করে রাখেন। রাদিফ ভাই এর রুমের দরজা বন্ধ। তারমানে উনি রুমে আছেন। বড় মা কয়েকবার নক করেছেন কিন্তু উনি দরজা খুলেন নি। বড় মা বুঝলেন হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু আমি কিছু বললাম না। সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। গিয়ে ফ্রেস হয়ে পড়তে বসলাম। কিন্তু পড়ায় কোনো মন বসছেই না।
ওদিকে সিনথিয়া আপু যেন রাদিফ ভাই এর জন্য পাগল হয়ে গেছেন। বার বার নক করছে রাদিফ ভাই এর রুমে। যেন উনি আমার স্বামী না ওনার নিজের স্বামী।
এদিকে রাদিফের রুমে চারপাশে জিনিসপত্র পত্রের ভাংচুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ও নিজেও তুবার এইসব অস্বাভাবিক আচরণের মানে বুঝছে না। কালকে তুবা ঠিক ছিলো। আজকে ওর কি হয়ে গেলো। সিনথিয়া কে আজ উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। তার আগে তুবার সাথে কথা বলতে হবে। রাদিফ হুট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
ও সোজা উদ্ভ্রান্তের মতো তুবার রুমে গেলো।
আমি যখন পড়ছি দেখলাম রাদিফ ভাই এসে আমার টেবিলের পাশে দাড়ালো। এরপর আমার একহাত টেনে আমাকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,
“তুই কি আমাকে পাগল পেয়েছিস??আমাকে যখন যেভাবে পারবি ঐভাবে ব্যবহার করবি। যখন মন চাইবে তখন ভালোবাসবি যখন মন চাইবে তখন ইগনোর করবি। আমাকে তুই পেয়েছিস টা কি। আমি বলে তোর এইসব ন্যা*কামি সহ্য করছি,, অন্য কেউ হলে তো,,,”বলে রেগে উনি চেয়ারে লাথি মারেন।
রাদিফ ভাইয়ের এইভাব হঠাৎ টেনে উঠানোয় হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছি। হাত চেপে ধরে রাখায় যেন আঙুল গুলোর চাপ হাতের মধ্যে ঢেবে আছে। তারউপর ওনার এইসব বাজে ব্যবহার।
আমার মনের মধ্যে যেন কেউ চুরি চালালো। একটা তরতাজা প্রাণীর মধ্যে যেমন চুরি ঢুকালে র*ক্তের বন্যা বয় তেমন যেন আমার হৃদয় থেকে র*ক্ত বইছে। রাদিফ ভাই যে আমার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করতে পারে আমার কল্পনার বাইরে ছিলো।
আমার দুচোখ বেয়ে শুধু পানি পড়ছে। আমি যেন কথা বলতে পারছি না!! আমি কথা বলছিনা দেখে উনি আবারো চিৎকার করে বলে,,
” কি হয়েছে কথা বলছিস না কেন!! আমাকে এখন আর ভালো লাগছে না,, তাই না?? আমি কি এতই খারাপ। আনাস, ইরহাম, তমাল সবার সাথে কথা বলা যায় একমাত্র আমার সাথে কথা বলা যায় না। সিনথিয়া ঠিকই বলে,, আমাকে এখন আর তোর ভালো লাগে না”
রাদিফ ভাই যেন আজকে কি বলছে না বলছে উনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। রাদিফ ভাইয়ের এইসব বাজে কথাগুলা যেন আমি নিতে পারছিনা। আমি শুধু শান্ত স্বরে একটা কথাই বললাম,,
“আমাকে নিয়ে যখন এতই অভিযোগ তাহলে সিনথিয়া আপুকেই বিয়ে করে নিলেই পারতেন”।
রাদিফ ভাইয়ের চিৎকার শুনে নিচ থেকে বড় মা, আম্মু, মেজো মা চলে আসলো। আমি আম্মুকে বললাম,,
” প্লিজ আম্মু, লোকটা কে বলো আমার সামনে থেকে যেন চলে যায়”
____________________রাত দশ’টা
আমি সবাই ডিনার করার আগে খেয়ে রুমে চলে এসেছি। নিচে গিয়ে আম্মুকে বললাম,,
“আম্মু খেতে দাও খিদে পেয়েছে”
যেন সবকিছু স্বাভাবিক। আমি আমার কষ্ট কাওকে দেখাতে চাই না। তাদেরকে বুঝাতে চাই যে আমি সব কিছু ভুলে গেছি। তাদের ছেলের ব্যবহার এ আমি কিছু মনে করিনি।
খেয়ে আমি রুমে চলে এসেছি। এসেই শুয়ে পড়েছি একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে।
সবাই খাবার টেবিলে বসে চুপচাপ খাচ্ছে। শুধু তুবা বাদে। তুবার কথা ওর জেঠু মনি জিজ্ঞেস করলে তুবার আম্মু বলে যে,, ওর নাকি খিদে পেয়েছে তাই খেয়ে নিয়েছে। ওর মা কিন্তু ঠিকই বুঝেছিতুবা ঠিক নেই। সবার চোখ ফাকি দিলেও মায়ের চোখ কি আর ফাঁকি দেওয়া যায়।তাই ওর মা ঠিক করেছে খাবার খেয়ে একবার তুবার রুমে গিয়ে ওর সাথে কথা বলে আসবে।
নীরবতা ভেঙে রাদিফ বলে,,
“বাবা, আমি আজকে চলে যাবো। ভোর চার’টায় আমার ফ্লাইট। দুই ঘন্টা পর আমি বের হয়ে যাবো। এইবার প্লিজ কেউ জানতে চেওনা কেন আজকেই চলে যাচ্ছি!! আমার আর্জেন্ট দরকার পড়ে গেছে তাই চলে যাচ্ছি” বলে ও খাবার শেষ করে উঠে যায়।
খাবার টেবিলে সবাই তো অবাক!! কেউ না বুঝলেও বাড়ির মেয়েরা বুঝেছে কেন রাদিফ চলে যাচ্ছে। সিনথিয়া তো মনে মনে বেশ খুশি। যাহোক ওদের দুজন কে আলাদা করতে পেরেছে। সিনথিয়া রাদিফের পিছন পিছন উঠে গিয়ে ওর রুমে গিয়ে রাদিফ বলতেই
ঠাসস,,করে একটা চড় পড়ে সিনথিয়ার গালে। রাদিফ চিৎকার করে বলে,,
“ফারদার তুই আমার সামনে আর আসবি না। তোকে যদি আর আমার ত্রিসীমানায় দেখি তো তোর এক দিন কি আমার এক দিন,,মাইন্ড ইট”।
রাত আড়াইটা,,
রাদিফের মা কান্না করছে ওকে ধরে। রাদিফ এখন চলে যাচ্ছে। ড্রয়িংরুমে বাড়ির বড়রা সবাই উপস্থিত ছোটরা বাদে। ছোটরা ঘুমোচ্ছে। তুবা কে একবার ওর মেজো আম্মু গিয়ে ডেকে এসেছে কিন্তু ও ঘুম কারণ ও যে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে কেউ তো জানেনা। যদিও সবাই কম বেশি জানে ও জাগনা থাকলেও আসতো না।
রাদিফ গাড়িতে উঠে চিন্তা করছে তুবার কথা। ও কতটা পাষাণ ও একবারও রাদিফ কে আটকালো না। বেশি ভালোবেসেছে বলেই ও এমন করলো!!
এদিকে তুবা সকালে ঘুম থেকে উঠে সকাল দশ’টায়। ও ভেবেছে ওকে আর কেউ ডাকেনি। কিন্তু ও তো জানেনা ওকে কতবার ওর মা আর রিজবি এসে ডেকে গেছে। নিচে গিয়ে দেখে বাড়ির পরিবেশ একেবারে ঠান্ডা। পরে জানতে পারে রাদিফ ভোররাতে চলে গেছে। এই খবর শুনে যেন রাদিফের প্রতি তুবার রাগ, অভিমান, অভিযোগ আরো বেড়ে গেলো।
এরপর থেকে যেন আমার আমির মধ্যে অন্য আমি কে খুজে পেলাম। নিজের সেই আমিটা কে যেন হারিয়ে ফেললাম।
__________________দুই বছর পর
রাদিফ ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বিরস মুখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত আড়াইটা এখন। এই সময় রাদিফ ভাইয়ের আগমন যেন দিবাস্বপ্নের মতো। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে যেন ছাড়লেই আমি কোথাও হারিয়ে যাবো। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি উনি কান্না করছে। ঐদিন যাওয়ার পর থেকে উনি বহুবার চেষ্টা করেছে আমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য।কিন্তু আমি নিজ থেকে অনিচ্ছা দেখিয়েছি। কিন্তু এইভাবে হুট করে এসে যে আমাকে চমকে দেবে এটা যেন অবিশ্বাস্য!!
এরপর অবশেষে অনেক অভিমান অভিযোগের পর আজকে আমাদের বিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পন্ন হলো কিছুক্ষণ আগে। আমি ঘোমটা দিয়ে বসে আছি,,রাদিফ ভাইয়ের জন্য অপেক্ষায় আছি। বুকের মধ্যে ধুকধুক করছে। যেন রাদিফ ভাই আমার জন্য নতুন। আচ্ছা রাদিফ ভাই কি সত্যিই আমাকে এতটা ভালোবাসে?? আমাকে ভালোবাসেই বলেই কি আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে বলেই কি সিনথিয়া আপুকে উনি কিডন্যাপড করেছিলো!! টর্চার করেছিলো!! এরপর সিনথিয়া আপু কে তার ক্রাইম এর জন্য জেলে পাঠানো টাও কি রাদিফ ভাই এর চক্রান্ত ছিলো!!
এত ভাবাভাবির মধ্যে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। আমি নেমে রাদিফ ভাই কে সালাম করলাম। রাদিফ ভাই আমাকে টেনে নিয়ে বুকে নিলেন। বললেন,,
“ফ্রেস হয়ে এসো তুমি। আমি ফ্রেস হবো।”
আমি ফ্রেস হয়ে গোলাপি কালারের একটা শাড়ি পড়ে বের হলাম। রাদিফ ভাই আমাকে বারান্দা থেকে ডাকলেন।আমি যেতেই আমাকে উনি টেনে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন। ফিসফিস করে বললেন,,
“আমাকে তুমি ক্ষমা করেছে তো বউ?? আমি তোমার কাছে সব কিছু জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আমার এই বউ টা কি আমাকে ক্ষমা করেছে??” বলেই উনি আমাকে আরো টাইট করে জড়িয়ে ধরলেন।
“আমার এই সুদর্শন জামাই টা জেনে রাখুক তাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি”
রাদিফ ভাই উনার ঠোঁট দিয়ে আমার ঘাড়ে চুমু খাচ্ছেন। উনি ঘাড়ে মুখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন,,
“মে আই???”
তুবা সম্মতি দিতেই রাদিফ ওকে কোলে নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ওরা দুজন যেন হারিয়ে গেলো ভালোবাসার অতল ঢেউয়ে। অনেক অভিমান এর পর দুটো প্রাণ এক হলো।
___________________এক বছর পর
রাদিফ ওটির সামনে পায়চারি করছে। ভেতর থেকে ভেসে আসবে তাদের মেয়ের কান্নার স্বর এই আশায়। ঠিকি কিছুক্ষণ পরে ভেসে আসলো তাদের মেয়ের কান্না। নার্স এসে তুবার জেঠু মনির কোলে দিলো। রাদিফ তুবার কথা জিজ্ঞেস করতেই নার্স জানালো তুবা ঠিক আছে।
কেবিনে দেওয়ার পর রাদিফ ভেতরে যায় তুবার কাছে। ওর একহাত ধরে ওর কপালে একটা চুমু খেলো।
“তুমি আমার জীবনের একটা অন্যরকম প্রাপ্তি। আমার সুখপাখি,,যার সংস্পর্শে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হই। তোমাকে ভালোবেসে প্রতিটা মুহুর্ত যেন ভালোবাসাময় বিষাদে কেটেছে। আর তুমি হচ্ছো আমার এই সুখময় জীবনের বিষাদীনী,,
” আমার বিষাদীনি”।
দুজনে যখন বাসায় ফিরলাম তখন চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে। রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে শুয়ে পড়লাম। কালকে আবার ফুফিদের বাড়িতে যেতে হবে। সকালে আম্মুর ডাকাডাকি তে ঘুম ভাঙলো। দেরি করে ঘুমানোর ফলে ঘুমের জন্য চোখ মেলতে পারছি না। তবুও উঠতে হলো। ফ্রেস হয়ে নিচে গিয়ে দেখলাম সবাই ব্রেকফাস্ট করছে। সবাই বলতে আব্বুরে জেঠু রা বাদে আর বাকিরা। আব্বুরা অফিস থেকে ফুফিদের বাড়িতে চলে যাবে। বসে বসে ঘুমে ঢুলছি আমি কিন্তু রাদিফ ভাই কে দেখ কিভাবে স্ট্রেইট আছে মনে হয় উনি সারারাত ঘুমিয়ে কিছুক্ষণ আগেই উঠলো। সাবিহার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও জহুরি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চুপিসারে ও আমাকে বললো,,
“কিরে কি ব্যাপার? রাতে ঘুমোস নাই নাকি। ঘুমে ঢুলছিস যে। নাকি রাদিফ ভাই ঘুমোতে দেয় নি” বলে ও দুষ্ট হাসি দিলো।
আমি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমতাআমতা করে বললাম,,
“আরে না। এমনি তে এলার্জির কারণে মনে হয় চোখ লাল হয়ে আছে। কিন্তু তুইও না কি উল্টো পালটা ভাবিস”
তখন বড় মা বললো সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার মতো রেডি হতে শুরু করো। আমি রুমে গিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুম যেন পিছু ছাড়ছেই না।মাত্র চোখ লেগে আসছিলো তখনি সাবিহা আসলো,,
“কিরে!! তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস। রেডি হচ্ছিস না??”
“হবো তো। তুই যা”
উঠে ফ্রেস হয়ে বাইরে আসলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঝাড়ছিলাম। হঠাৎ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাদিফ ভাই কার সাথে যেন ফোনে চিল্লাপাল্লা করছে।চোখমুখ একদম শক্ত করে কথা বলছে। কে বলবে এটা সেই রাদিফ ভাই যাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। রাদিফ ভাই উপরের দিকে যখনি তাকালো আমি দৌড়ে রুমে চলে আসলাম। এসে আলমারি থেকে হালকা নীল রঙের থ্রি পিস বের করে পড়লাম। চুলগুলো খোপা করে কাঠি দিয়ে বাধলাম। হালকা লিপস্টিক আর কাজল লাগিয়ে নিলাম। ব্যাস আমি রেডি।
______________________
নিচে এসে দেখলাম যে যার মতো গাড়িতে উঠে গেছে। আমিও সাবিহার সাথে বসে পড়লাম। সামনে রাদিফ ভাই ড্রাইভ করবে আর পাশে নেকি সিনথিয়া আপু। আমি দেখেও না দেখার ভান করে আছি। ফোন টিপছি বসে বসে। আমাদের বাড়ি থেকে ছোট ফুফিদের বাড়ি প্রায় আধা ঘন্টার পথ। আমি জানি সিনথিয়া আপু আমাকে এসব করবে জালাবার জন্য। কিন্তু লাভ নেই। রাদিফ ভাই আমার স্বামী। তারচেয়ে বড় কথা উনি আমাকে ভালোবাসেন আর আমি ওনাকে। এক্ষেত্রে উনি আমাদের মধ্যে একটা আগাছা মাত্র। তাই এসব করে উনি শুধু নিজের সম্মান কমাচ্ছে।
কাজিন গ্রুপে দেখলাম ইরা একটা ছবি শেয়ার দিলো আনাস ভাইয়ের। উনি ঘর মুছতেছে। আমি আর সাবিহা তো হাসতে হাসতে শেষ।
এদিকে রাদিফ লুকিং গ্লাস এ দেখছে তুবা আর সাবিহা হাসাহাসি করছে। রাদিফ তো ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ছে। তুবা ফোনে কি দেখে এত হাসছে। কই আমার সামনে তো এত হাসি পায় না। মুখে কুলুপ এটে বসে থাকে। কালকে রাতে যখন রাদিফ তুবার গলায় মুখ গুজিয়ে দিলো কাপা স্বরে রাদিফ কে বললো,,
“রাদিফ ভাই, আপনি এই ভাবে থাকলে আমার সুড়সুড়ি পায় আর কেমন কেমন যেন লাগে। প্লিজ এভাবে করবেন না।”
রাদিফ বিরক্ত স্বরে বললো,,
“উপ বিরক্ত করিস না। একটু রোমান্টিক মুডে আসলেই তুই এমন করস। ভাই ভাই ডেকে রোমান্টিক মুডের বারোটা বাজাই দিস। একটু এইভাবে থাক বউ।”
কই তখন তো ও মুখে কুলুপ এটে বসে ছিলো। এখন তো ঠিকি হাসাহাসি করতেছে। নিজের রাগ কমানোর জন্য রাদিফ ধমকের সুরে ওদের কে বললো,,
” তোরা এত হাসাহাসি করছিস কেন?? মনে হয় কানের পর্দা ফেটে যাবে। এরপর এক্সিডেন্ট করলে তোদের দোষ”।
__________________
ছোট ফুফিদের বাসায় গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলাম। বড় ফুফিরা এখনো আসে নি।তমাল ভাই তো একেবারে অগিস শেষে তারপর আসবে। ছোট ফুফি তো আমাদের কে জড়িয়ে ধরে রীতিমতো কান্না শুরু করে দিলো। কতদিন পর আমরা সবাই ছোট ফুফিদের বাড়িতে আসলাম তাই ঊনি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছেন। আনাস ভাই এসে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আমি আর সাবিহা বললাম,,
“আরে ইরা, এটা তোদের বাসার ঘর মুছার সেই ছেলেটা না” বলে দুজনে আনাস ভাইয়ের দিকে তাকালাম।
আনাস ভাই আমাদের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,,
“এসেই দুজন আমার পেছনে লেগে গেছিস। দেখছিস এইখানে একটা সুন্দরী মেয়ে (সিনথিয়া আপুকে মিন করে) বসে আছে ওমনি তোরা আমাকে পচানি শুরু করেছিস। এবার কিন্তু আমি তোদের সিক্রেট গুলো প্রকাশ করে দেবো”।
এদিকে সিনথিয়া আপুকে সুন্দরী বলায় উনি যেন একটু অহংকার বোধ করলো। আর যেভাবে রাদিফ ভাইয়ের সাথে চিপকে আছে যেন আমি আমি না উনি নিজেই রাদিফ ভাইয়ের বউ। আর রাদিফ ভাই ও এইসব সহ্য করছে। উনিও যেইভাবে বসে আছেন মনে হচ্ছে সিনথিয়া আপু ওনার প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী। এই আচরণ গুলো অনেক সহ্য করছি আর না। আজকে রাদিফ ভাই এর সাথে এগুলো নিয়ে বিহিত করতেই হবে। আমার বেলায় ওনার যত শাসন, অধিকারবোধ। এসব ভেবে নিজের মন খারাপ করতে চাই না,, তাই ওনাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। ওরা সবাই গল্প করছে,আমি উঠে কিচেনের দিকে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম আম্মুরা ফুফি কে সাহায্য করছে।ফুফি বারণ করছে কিন্তু ওনারা শুনছে। এ একটা দৃশ্য দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। আমাকে দেখে ছোট ফুফি বললেন,,
” কি মা, ঐখানে কেন দাঁড়িয়ে আছিস?? দেখ না তোর মা দের কান্ড বলছি আসছো তোমরা একটু রেস্ট করো কিন্তু না এসেই কাজে লেগে গেলো”
আমি বললাম, “তোমাদের কে দেখলে কে বলবে ভাবি আর ননদ। তোমাদের এই ভালোবাসা গুলো আমি দারুণ এনজয় করি। ফুফি আমার জন্য বেগুন ভর্তা টা করেছো তো??”
ফিফি বললো হ্যাঁ করেছি। আমার মা টার জন্য। আচ্ছা আমি ইরা কে ডেকে দি। তোরা আমার চাচি শাশুড়ীর বাড়িতে খাবারগুলো দিয়ে আয়। বলে ফুফি ইরা কে ডেকে আনলো। ফুফির চাচি শাশুড়ী এটার তিন ছেলে কোনো মেয়ে নেই। ছেলেরা বউদের নিয়ে আলাদা থাকে মায়ের তেমন খোজ নেয় না। শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠায় ব্যাস এটা।
আমি ইরা আর সাবিহা তিনজন যাচ্ছি দাদু এটার কাছে। ড্রয়িংরুম দিয়ে যেতে ইরা সিনথিয়া আপু কে জিজ্ঞেস করলো,,
“আপু আমরা পাশের বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি যাবে আমাদের সাথে?? বাইরে গেলে ভালো লাগবে।”
“না তোমরা যাও। আমি রাদিফের সাথে এখানে বসে থাকবো। তোমরা যাও। আমার এরকম কারো বাড়িতে যাওয়ার অভ্যাস নেই। একটু অড ফিল করি” বলে আমার দিকে কোনা চোখে চাইলো।
“তুবা, তুই কেন যাচ্ছিস। তোর কি কাজ ওখানে??” রাদিফ ভাই ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখে আমাকে বললো।
আমি শুনেও না শুনার ভান করে ওদের কে বললাম তোরা আয় আমি বাইরে আছি। যেতে যেতে ইরা বললো,,
“এই সিনথিয়া আপু কে আমার একদম ভালো লাগে না। কেমন যেন ভাব নিয়ে থাকে”
_________________
ঐ বাড়ি থেকে এসে দেখলাম বড় ফুফিরা আসছে। গিয়ে বড় ফুফি কে জড়িয়ে ধরলাম। তানিশা আপু, অনামিকা তানহা ওদের সাথেও দেখা করলাম। এরপর সাবা আপু আর তানিশা আপু ওদের মতো গল্প করছে আর আমরা আমরা আমাদের মতো গল্প করছি। এরপর ওদের কে আমি একটা সিক্রেট বললাম,,
“আচ্ছা তোরা খেয়াল করেছিস কিনা জানিনা! কিন্তু আমার মনে হয় সাবা আপু আর ইরহাম ভাই এর মধ্যে কিছু চলছে। একজন আরেকজন এর দিকে কোনা চোখে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসে। কিছুক্ষণ আগেও তোরা ড্রয়িংরুমে খেয়াল করেছিস??”
ইরা বললো, “হ্যাঁ আমারো আগে থেকে এটা মনে হতো। আমাদের বাসায় কোনো সময় কাজিন দের কথা উঠলে সাবা আপুর কথা বলতেই ইরহাম ভাইয়ের মতো গম্ভীর মানুষ ও হেসে উঠে। আমিও তোদের সাথে বলবো বলবো করে বলা হয় নি”।
খাবার টেবিলে খেতে বসে ফুফি শুধু বলছে,,
” এই তুবা তুই রাদিফ এর পাশের চেয়ারে বোস। এখনের জন্য তুই আমার ভাইপোর বউ। ওর পাশে বোস”।
আমি বললাম,, “না ফুফি আমি একগানে আনাস ভাইয়ের পাশে বসি। তুমি তোমার এইসব আবেগি কথা বাদ দাও। আরেকটু পরে যখন খাবো তখন তোমার কথা শুনবো”
তখন সিনথিয়া আপু গিয়ে ওনার পাশের চেয়ারে বসলো। রাদিফ ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি ওনার দিকে তাকাচ্ছি। ওনার এই নাটক অনেক হইছে,, আর না। হঠাৎ করে তমাল ভাই আমাকে আর সাবিহা কে জিজ্ঞেস করলো,,
“এই তুবা, তোরা যে আমাকে কলেজে যাওয়ার সময়ের সমস্যাটার কথা বললি ওটার কি হলো?? ঐ ছেলেটার কোনো খোজ পেলি”
_________________
রাদিফ ভাই আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আছে। ওনার হাতের জন্য বের হতে পারছিনা। অস্থির কন্ঠে আমাকে বললো,,
“কি সমস্যা তোর?? এমন করছিস কেন?? সকাল থ্রকে দেখছি আমাকে ইগ্নোর করে যাচ্ছিস। আর তমাল কোন ছেলের কথা বললো?? কে তোদের ডিস্টার্ব করে? আমাকে তো কখনো বললি নাহ।”
আমি কিছু বলছিনা। শুধু বললাম, ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি।”
“না ছাড়বো না। কি হয়েছে তোর? আমার সাথে কথা বলছিস না কেন। কালকে তো সব ঠিক ছিল,,তাহলে??”
তখন সাবিহা দের আসার আওয়াজ শুনে রাদিফ ছেড়ে দেয় আমাকে। সবাই বসে নিচে গল্প করছি। ফুফিরা, আব্বুরা, আম্মুরা সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে। আর ওনাদের এক একজনের কথা শুনে আমরা রীতিমতো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি। তখন উপর থেকে রাদিফ এসে বললো,,
“আম্মু আমি বাড়িতে চলে যাচ্ছি। তোমরা পরে চলে এসো। আমার আর্জেন্ট দরকার বাড়িতে যাওয়া। ফুফি যাচ্ছি আমি” বলে আমার দিকে একপলক ফিরে চাইলেন। আমি দেখেও অন্য দিকে তাকিয়ে আছি।
আজকে সবাই বাসায় চলে যাবো। রাদিফ ভাই এর মামারা জোরাজোরি করছে আজকে থাকার জন্য। আব্বু আর মেজো চাচ্চু কালকে চলে গেছে। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। সোহা আর সাইমা মন খারাপ করে আছে। আমরা চলে যাচ্ছি যে তারাও চলে যাবে। সিনথিয়া আপু বললো উনিও নাকি আমাদের সাথে আমাদের বাসায় যাবে। সিনথিয়া আপুর আমাদের বাসায় যাওয়ার কথা শুনে রাদিফ ভাই ভ্রু কুচকে বললো,,
“কিরে হঠাৎ আমাদের বাসায় যাওয়ার মতলব তোর?? ঐখানেও কি কোনো পার্টি জোগাড় করেছিস নাকি?? ” বলে রাদিফ ভাই কুটিল হাসি হাসলো।
আর সিনথিয়া আপুও নির্লজ্জের মতো বললো,,
“তোদের সবাই কে মিস করবো বিশেষ করে তোকে। তাই তোদের সাথে যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য”।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। আসার সময় যেভাবে বড় রা এক গাড়িতে ছোট রা আরেক গাড়িতে আসছে সেইভাবেই যাচ্ছি আমরা। আমাদের গাড়ি রাদিফ ভাই ড্রাইভ করবে আর রাদিফ ভাইয়ের পাশের সিটে সিনথিয়া আপু বোসছে ওনার নাকি পেছনে দমবন্ধ লাগে। আমি কিছু বলছিনা নির্বিকার ভাবে ওনার এই নাটক দেখে যাচ্ছি।
এদিকে ড্রাইভিং করার পাশাপাশি রাদিফ শুধু লুকিং গ্লাস এ তুবার দিকে তাকাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে তুবা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন উদাস দৃষ্টিতে সব দেখছে। ছোট ছোট চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। এরপরও তুবার যেন হেলদোল নেই। তুবা কি রাগ করেছে?? নিশ্চয়ই রাগ করেছে আমার সাথে।যেই আমি তুবার মনে নিজের জন্য পজেটিব চিন্তা তৈরি করতে যায় ওমনি একটা না একটা গড়মিল হয়েই যায়।
এগুলোর জন্য তুবা নিশ্চয়ই ভাববে আমাকে নিজে অন্য ছেলের সাথে সহ্য করতে পারে না ঠিকই নিজে অন্য মেয়ে কে নিজের পাশের সিটে বসার অনুমতি দেয়। উপ!! এই সিনথিয়া মেয়েটা আমার বউ কে সবসময় ভুল বুঝাতে যায়। তোকে তো আমি দেখে নেবো।
____________________
বাড়িতে এসে যে যার রুমে চলে গেছে ফ্রেস হতে। আমিও আমার রুমে ফ্রেস হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। জার্নি করে শরীর পুরা ক্লান্ত লাগছে। মানুষের জীবন টা বড়ই অদ্ভুত! যে রাদিফ ভাই কে কখনো নিজের ভাই ব্যতীত অন্য কিছু ভাবার কথা কল্পনায় ও আনি নাই,, সে রাদিফ ভাই এখন আমার স্বামী। যার সাথে কথা বলার সময় হাটু কাপাকাপি হতো,, তার সাথে এখন আমি নির্দ্বিধায় আমার সব অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি। এই ছোট্ট জীবনে কার সাথে কখন কি হয় সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানেনা। রাদিফ ভাই নিজের মুখে না বললেও আমি জানি উনি আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে। এই বোঝার ক্ষমতা অন্তত আমার আছে।
এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানিনা।
সিনথিয়া কে থাকতে দেওয়া হলো রাদিফের বাম পাশের রুমটায়। ওর ডান পাশের রুম হচ্ছে তুবার। রাদিফ ফ্রেস হয়ে এসে অফিসে চলে গেলো। ওর চাচ্চু মানে তুবার বাবা রাদিফ কে ফোন করে বলেছে ও যাতে তাড়াতাড়ি অফিসে আসে। কিছু ক্লাইন্ট আসবে তাই। রাদিফ যখন দেশে ভার্সিটি তে পড়তো তখনো মাঝে মাঝে অফিস যেত। ও এগুলো তে যেমন পরিশ্রমী তেমনি দক্ষ। বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে দেশে এসে সেই অফিস সামলাতে হবে।তাই ওর বাবা, চাচ্চুরা চায় ও যাতে এখন থেকে অফিসে একটু চোখ কান বুলোয়। তাই ফোন পাওয়া মাত্র ফর্মাল কাপড় পড়েই চলে এসেছে অফিসে।
আসার সময় অবশ্য তুবার রুমে চোখ বুলিয়ে এসেছে।
দেখলো তুবা ঘুমোচ্ছে, তাই আর ডাকলো না।
এই মেয়ে আর ঠিক হোয়ার নয়! এত বড় মেয়ে বুঝি দরজা খোলা রেখে ঘুমোয়! আসার সময় রাদিফ দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আসলো।
বিকাল চারটার দিকে রাদিফ অফিস থেকে ফিরে এলো। ওর বাবা আর চাচ্চুরা একেবারে রাতে আসবে। রাদিফ ফ্রেস হয়ে এসে নিচে আসলো। দেখলো সিনথিয়া সহ বাড়ির ছোটরা সবাই ড্রয়িংরুমে গল্প করছে। তখনি মেজো আম্মু ডাকলো রাদিফ কে খাওয়ার জন্য। রাদিফ টেবিলে আসতে ওর মেজো মা কে জিজ্ঞেস করলো,,
“মেজো আম্মু সবাই খেয়েছে??”
“হ্যাঁ খেয়েছে,,তুবা বাদে। ও যে এসে ঘুমিয়ে পড়লো এখনো ওঠেনি। কতবার করে ডাকলাম মেয়েটা উঠলো না। সেই সকালে কি খেয়েছে না খেয়েছে”
“আচ্ছা মেজো মা, তুমি তাহলে খাবার বাড় আমি তুবা কে ডেকে নিয়ে আসছি” বলে রাদিফ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে তুবার রুমে গেলো।
তুবার রুমে যেতে রাদিফ দেখে ও এখনো ঘুমাচ্ছে। রাদিফ আস্তে করে যেয়ে তুবার পাশে বসে। আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে রাদিফ। আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ওর অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। ওর চোখের ঘন পাপড়ি, কপালে আচড়ে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো, গোলাপি ঠোঁট সবমিলিয়ে যেন ওর প্রেয়সী সবার থেকে আলাদা।
রাদিফ আস্তে করে ডাকলো,,
“তাহিয়া, উঠো না। খাবার খেতে চলো”
তুবা ঘুম চোখে বললো,,
“তোমরা সবাই খেয়ে নাও। আমি পরে খাবো” বলে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো।
রাদিফ আস্তে করে বললো,,
“এই বউ, উঠো না। তোমার সাথে খাবো তো। ক্ষিদে পেয়েছে আমার” বলে ওর কপালে চুমু দিলো।
“আহ রাদিফ ভাই আপনি বাস্তবে ও আমাকে জালাচ্ছেন,, এখন স্বপ্নেও জালাচ্ছেন” ঘুমকাতর স্বরে তুবা বললো।
রাদিফ এইবার তুবার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,,
“তুমি যদি এখন না উঠো জান তাহলে কিন্তু আমি এখন তোমাকে অনবরত চুমু খাবো যতক্ষণ না তুমি উঠবা”
এ কথা শুনে তুবার ঘুম যে কোথায় হারিয়ে গেলো। ও এক লাফ দিয়ে উঠে বলে,,
“আপনি এখানে!! এখানে কি করছেন আপনি!?”
“তো, আমার বউয়ের রুমে আমি থাকবো না তো কে থাকবে। এতে এত অবাক হওয়ার কি আছে?? খেতে ডাকতে এসেছি। আজকে নাকি দুপুরে লাঞ্চও করিস নি??”
“আমি লাঞ্চ করি বা না করি তাতে আপনার কি?? আপনি আপনার সিনথিয়া বেবির কাছে যান। ওকে আপনার পাশে বসে খাওয়ান” অভিমানের স্বরে আমি বললাম।
বলে আমি মাথা উঠাতে দেখলাম রাদিফ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রাদিফ ভাইয়ের তাকানো চোখ দেখে আমি তাড়াতাড়ি ওড়না পড়ে নিলাম।
রাদিফ ভাই বাকা হেসে বললো,,
” ইউ আর লুকিং সো হ*ট জান। আর সিনথিয়া কে কেন পাশে বসে খাওয়াবো,,ওতো আমার বোন আর আপনি তো মিসেস রাদিফ “।
” ছিহ! কি নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছেন। বিদেশেও নিশ্চয়ই মেয়েদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকেন!!?” বলে সন্দিহান দৃষ্টিতে রাদিফ ভাই এর দিকে চাইলাম।
দেখলাম রাদিফ ভাই চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বাকা হেসে বললেন,,
“আমি যদি কারো দিকে এইরকম নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকি সেটা হলেন একমাত্র আপনি,,মিসেস রাদিফ”।
রাদিফ ভাই বিস্ময়কর চাহনি তে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,
“সিনথিয়া আবার আমার জানু হলো কখন!!??”
আমি বললাম, “যখন থেকে সিনথিয়া আপনার পাশের সিটে বসা শুরু করলো তখন থেকে”।
” তোরা মেয়েরা পারিস ও বটে!! আচ্ছা দশ মিনিট সময় দিলাম তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিচে আয়। আমিও এখনো খাই নি। আমি টেবিলে অপেক্ষা করছি” বলে রাদিফ ভাই চলে যেতে লাগলেন
আমি যেই বলতে যাবো,, আমি খাবো না ওমনি রাদিফ ভাই টুপ করে গালে একটা চুমু দিয়ে বললেন,,
“বল আর কি বলবি। যত ওয়ার্ড বলবি ততটা চুমু খাবি”।
___________________
নিচে এসে দেখলাম সাবিহা রা সবাই ড্রয়িংরুমে গল্প করছে আর রাদিফ ভাই ডাইনিং এ বসে মোবাইল চাপছে। আমি যেতেই মেজো আম্মু আমাকে ডাকলো খাবার খাওয়ার জন্য। টেবিলে গিয়ে বসতে মেজো আম্মু বললো,,
” নে আমি এবার গেলাম। রাদিফ তোকে তোর বউয়ে বেড়ে এবার খাইয়ে দেবে। বউ থাকতে নিজের কাজে বউকে ডাকবি মা দের কেন ডাকবি। বউদের কে ডাকলে দুজনের ভিতর ভালোবাসা বাড়ে। আমি গেলাম।”
“মেজো মা তুমি আর ভালো মানুষ পেলে না। ওকে খাইয়ে দিতে লাগে দশজন ও আবার আমাকে বেড়ে খাইয়ে দেবে। এরকম কপাল তোমাদের এই নিষ্পাপ ছেলেটার হয় নি” বলে রাদিফ ভাই হতাশার নিশ্বাস ফেললেন।
মেজো মা ও মুচকি হেসে চলে গেলেন। এদিকে আমি চোখ গরম করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। আগুনে ঘি ডালার মতো রাদিফ ভাই বললেন,,
“আসো বউ তোমাকে খাইয়ে দি” বলে একটা শয়তানি হাসি দিলেন।
এদিকে সিনথিয়া তো এইসব দেখে জ্বলছে শুধু। ও মনে মনে বললো,,
“আজ এইখানে আমার থাকার কথা ছিলো। ছোট থেকে যাকে ভালোবেসে আসছি অন্য কারো সাথে তাকে সহ্য করতে পারছিনা। এই তুবা মেয়েটা আমার সব শেষ করে দিলো। ওর জন্য আমি আমার রাদিফ কে হারিয়ে ফেলেছি। ও না থাকলে রাদিফ এইরকম ভাবে আমাকে ভালোবাস তো”।
আড্ডার মাঝখানে সাবা আপু বললো,,
” আহ তুবা মনিটার জন্য আমার খুব মায়া হয়। যাকে সে যমের মতো ভয় পায় তার সাথে পুরা জীবন কাটাতে হবে। মেয়েটা তো দুইদিনেই পাগল হয়ে যাবে” বলে আফসোস করে।
ওর কথা শুনে সাবিহা তো হাসতে হাসতে শেষ। ও মনে মনে বললো,,
“সাবা আপু তোমার জন্যই আমার মায়া হয়। তুমি এত নিষ্পাপ কেন!! তুমি তো জানো না ওরা কিভাবে আমাদের নাকে ডগা দিয়ে কিভাবে চুটিয়ে প্রেম করছে”।
সন্ধ্যা বেলায় সবাই বসে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে। ওদিকে কিচেনে সন্ধ্যার স্ন্যাকস তৈরি হচ্ছে। বাড়ির পুরুষরাও সবাই অফিস থেকে ফিরেছে। হঠাৎ জেঠু মনি বললো,,
” আজকে একটা মজার কান্ড ঘটেছে। তুবার কলেজের ইংরেজি টিচার কি যেন নাম,, সায়ান স্যার উনি আমার কাছে ফোন দিয়েছেন ওনার বড় ভাইয়ের জন্য আমাদের তুবা কে বউ হিসেবে ওনারা চায়”
নিজের বাবার মুখে নিজের বউয়ের জন্য বিয়ের সমন্ধের কথা শুনে রাদিফ ফোন স্ক্রল করা বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে ওকে দেখে মনে হচ্ছে “পৃথিবীর সবচেয়ে বিবাহিত অসহায় পুরুষ হচ্ছে ও নিজেই”।
[নাইস, নেক্সট বাদ দিয়ে গঠনমূলক মন্তব্য করুন ]
চলবে……..
#আমার_বিষাদীনি
#উম্মে_হাফসা
#পর্ব_১৫
ড্রয়িংরুমে সবাই তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আর আমি কাচুমাচু হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছি। যেন আমি কথাটা শুনতে পাই নি। রাদিফ ভাই এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি এখনো শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। নীরবতা ভেঙে জেঠুমনি রাদিফ ভাইকে পিঞ্চ মেরে বললেন,,
“কি আব্বা, আপনার স্ত্রীর বিয়ে দেবেন তো?!”
জেঠুমনির কথা শুনে ড্রয়িংরুমে হাসির রোল পড়ে গেলো। মেজো চাচ্চু জেঠুমনি কে জিজ্ঞেস করলো,,
“আচ্ছা ভাইজান আপনি এরপর তুবার স্যার কে কি বলেছেন!!?”
জেঠুমনি বললো, “আমি আর কি বলবো। বললাম আসলে স্যার দুঃখিত আমার পুত্রবধূকে এখনো বিয়ে দেবো নাহ। আর তুবা মনির স্যার ও আশা করি শকড হয়েছে”।
জেঠুমনির কথা শুনে আরেকদফা হাসির রোল পড়ে গেলো। একমাত্র আমিই হাসতে পারতেছি না। উলটো চোরের মতো বসে আছি। যেন কোনো কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা যদি অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটতো তাহলে নিশ্চিত এতক্ষণে আমি গড়াগড়ি দিয়ে হাসতাম। কিন্তু এখন বিষয় টা ভিন্ন।
আমি কোনো রকমে ঐখান থেকে উঠে চা এককাপ নিয়ে উপরে চলে আসলাম। এসে টেবিলে বসে পড়লাম। এই কয়েকদিন বিয়ের চক্করে পড়ালেখা সব চান্দে উঠছে।
কলেজ খুললে সামনের মাস থেকে ফাইনাল এক্সাম। কেমিস্ট্রি বইটা নিয়ে আগের পড়াগুলো রিভিশন দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পড়ার পর দেখলাম রিজবী আসলো রুমে।
বললাম,,
” কিরে কি খবর নিয়ে আসলি??”
“আমরা সবাই বাইরে হাটতে যাচ্ছি। তুমি যাবে??”
আমি বললাম, “আমরা বলতে কে? কে?” বলে একটু অনুসন্ধান চোখে রিজবীর দিকে তাকালাম।
রিজবী বললো, “আমি, রাদিফ ভাই, সিনথিয়া আপু, সাবা আপু আর তোমার জান্স মানে সাবিহা ও যাচ্ছে। সিনথিয়া আপু বললো ওনার নাকি আসছে থেকে বন্দী বন্দী লাগছে,, তাই রাদিফ ভাই কে বললো ওনাকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু পরে সাবা আপু বললো যে আমরাও যাবো,, রাদিফ ভাই প্রথমে রাজি হয় নি কিন্তু পরে বড় আম্মুরা রাজি করালো। বললো সবাই কে নিয়ে ঘুরে আসতে।”
সিনথিয়া আপুর জন্য সবাই কে নিয়ে রাদিফ ভাই বের হচ্ছে শুনে রাগে মাথা ফেটে পড়লো। যদিও সবকিছু ডিটেইলস এ জানতে চাইছিলাম তবুও রাগে রিজবী কে বললাম,,
“তোকে এত কিছু বলতে বলছি। আমি যাবো নাহ,,আমার পড়া আছে। যা তোর রাদিফ ভাইরে গিয়ে বল সবাই কে নিয়ে ঘুরে আসতে। তোদের তো আবার বন্দী বন্দী লাগছে”।
যদিও আমি এমনিতেই যেতাম না কিন্তু সিনথিয়া আপুর কথা শুনে রাগ টা মাথায় চাপলো। আমি আবার একবার পড়ার মধ্যে ডুবে গেলে পুরাটা শেষ করা অব্দি উঠতে মন চায় নাহ।
যাক উনি,, ওনার সিনথিয়া জান কে নিয়ে ঘুরে আসুক।
আমার কাছে আসবে না,, তখন বুঝিয়ে দেবো এই তুবা কি জিনিস!!
_______________________
এদিকে রাদিফ রা সবাই নিচে অপেক্ষা করছে তুবার জন্য। কিন্তু রিজবী এসে জানালো তুবা নাকি যাবে না। ওর নাকি পড়া আছে। রাদিফ কিন্তু ঠিকই জানে তুবা না গেলেও মনে মনে কিন্তু রাগ ফুসে আছে।
তাই রাদিফ ওদের কে বললো,,
” তোরা বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর আমি আসছি”
সিনথিয়া ঠিকই বুঝেছে রাদিফ তুবার কাছে যাচ্ছে,, তাই ও সবে বলতে যাচ্ছিলো,,
তুবা যখন যাবে না তখন,,,
কিন্তু রাদিফ লাল চোখ দেখে আর কিছু বলার সাহস পায় নি। রাদিফ উপরে গিয়ে তুবার রুমে গেলো। দেখলো তুবা পড়ছে। রাদিফ গিয়ে ওর সামনের চেয়ারে বসলো। তুবা এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে আবার পড়তে রাগলো।
রাদিফ ওর হাতের উপর হাত রেখে বললো,,
“রাগ করেছো বউ?? কি করতাম বলো সিনথিয়া সবার সামনে ঘুরতে যাওয়ার কথা বললো। আম্মুরা সবাই তাই বললো ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে সবাই কে। ও তো এখন আমাদের বাড়ির গেস্ট। ওকে কিছু বলতে পারছিনা তাই।”
আমার হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,,
“এখানে কেন এসেছেন?? আপনি আপনার সিনথিয়া জানুকে নিয়ে ঘুরতে যান। আমি বুঝিনা যেন, সিনথিয়া কে একা নিয়ে তো যেতে পারছে না তাই সবাই কে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে”।
” আহ জানু। উল্টো টা কেন বুঝছো। আমার বউ থাকতে সিনথিয়া কেন আমার জান হতে যাবে। ও হচ্ছে আমার বোন,, কতবার বলবো। আচ্ছা রাগ করে থেকো না বউ। আমার মতো এইরকম অবলা স্বামীর সাথে রাগ করলে জাতি মেনে নেবে না কিন্তু।
আচ্ছা বলো তোমার জন্য কি আসতাম??”
“আপনি আর অবলা!! কিছু নিয়ে আসতে হবে না।সবকিছু আপনার সিনথিয়া জানু আই মিন বোননন কে নিয়ে দিয়েন”।
” উপ তুইও না। নিচে সবাই ওয়েট করছে। আর রাগ করে থাকিয়েন না। এসে নাহয় আদর দিয়ে রাগ ভাঙাবো। এখন হাতে সময় নাই তাই শুধু একটাই চুমু দিয়ে গেলাম” বলে কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে গেলো।
সবাই মিলে হাটতেছে। সিনথিয়া তো শুধু রাদিফ এর পাশ ঘেঁষে হাটছে। ওর গায়ে গা লাগিয়ে হাটার চেষ্টা করছে। রাদিফ একটু দাঁড়িয়ে বললো,,
“এই সিনথিয়া এই রকম গায়ের উপর উঠে যাচ্ছিস কেন?? মেয়ে মানুষ হয়ে মিনিমাম লজ্জা টুকুও নেই তোর কাছে”
আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। সিনথিয়া দারুণ লজ্জা পেয়েছে। এরপর সবাই মিলে বললো আইসক্রিম খাবে। সবাই গেলো আইসক্রিমের স্টলের দিকে। যে যার ফ্লেভার এর আইসক্রিম নিয়ে নিলো।
রাদিফ আইসক্রিম কগায় না কিন্তু তুবার জন্য চকলেট ফ্লেভার আইসক্রিম নিয়ে নিলো। এরপর রাদিফ এর চোখ রাস্তার ওপাশে একটা ফুল বিক্রেতার দিকে আটকে গেলো। রাদিফ ওদের সবাই কে বললো,,
“তোরা এখানে থাক,, আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি” বলে রাস্তার ওপাশে চলে গেলো। ওপাশে গিয়ে রাদিফ তুবার জন্য একটা বেলি ফুলের মালা নিয়ে নিলো।
________________
বাড়িতে এসে রাদিফ ফ্রেস হতে নিজের রুমে গেলো। তুবার রুমে চোখ বুলিয়ে দেখলো ও এখনো পড়ার টেবিলে বসে আছে। ছোট বেলা থেকেই তুবা ভালো স্টুডেন্ট। তাই পড়াশোনার জন্য রাদিফ কে কখনোই তুবাকে শাসন করতে হয় নি।
এদিকে আসার পর থেকে সাবিহার আম্মু ওকে বকাঝকা করছে। তুবা বসে বসে পড়ছে আর এই মেয়ের কোনো চিন্তাই নেই। ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব বলে মেজো আম্মু ওকে বকাঝকা করছে। এমন না সাবিহা একেবারে খারাপ স্টুডেন্ট। ও একটু মোটামুটি ধরনের।
রাদিফ ফ্রেস হয়ে এসে ওর ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো। ও ওর ভার্সিটির প্রজেক্ট গুলো কমপ্লিট করছে।
ডিনার টেবিলে জেঠুমনি বললো কালকে ছোট ফুফির বাসায় সবার দাওয়াত। এইমাত্র আদরে ভাইপো আসার কারণে সবাইকে নিয়ে যেতে বলেছে।
আমি আর সাবিহা তো খুব খুশি। কতদিন পর ছোট ফুফির বাসায় যাবো। আবার সব কাজিন রা একসাথ হবো। শুনলাম বড় ফুফিরা ও আসবে। তারমানে একটা ছোটখাটো গেট টুগেদার হয়ে যাবে।
রাদিফ ভাইয়ের সাথে এখনো কথা বলিনি। আমি রাগ করেছি,, কই আমার রাগ ভাঙাবে তা না করে উল্টো নিজে ভাব ধরে আছে। শুয়ে শুয়ে এগুলো ভাবছিলাম। হঠাৎ ফোন মেসেজ আসলো রাদিফ ভাইয়ের নাম্বার থেকে,,
“তাহিয়া, একটা শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিচে আয়,,কুইক। আমি নিচে অপেক্ষা করছি। আর যদি না আসিস তাহলে তুই যেই অবস্থায় আছিস সেই অবস্থায় কিন্তু আমি কোলে করে উঠিয়ে নিয়ে আসবো। আর আমি যা বলি তা কিন্তু করি”।
আমি আর কি করবো।কতক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে রেডি হচ্ছি। কিন্তু আমি শাড়ি পাবো কই। আলমারি খুজে একটাই পার্পল কালার এর শাড়ি পাইছি।ওটাই পড়ে নিলাম।চুলগুলো কে কোনোরকম হাত খোপা করে নিলাম। নিচে এসে দেখি রাদিফ ভাই সত্যি সত্যি বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে
বাইরে কি স্নিগ্ধ বাতাস। আহ!আকাশে চাঁদের আলো। আর তার সাথে রাদিফ ভাইয়ের কাছ থেকে কি দারুণ একটা পারফিউম এর স্মেল আসছে। বাইক থামিয়ে উনি বললেন নাম। নেমে দেখলাম নদীর পাড়ে নিয়ে আসছে। আর ওখানে একটা ছোট্ট টেবিলে ক্যান্ডেল সাজিয়েছে। তার সাথে একটা কেক। উপরে লেখা ” সরি বউ”।
আমি তো এসব দেখে অবাক। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হলাম জোনাকি দেখে। রাদিফ ভাই পেছেন থেকে জড়িয়ে ধরে খোপার মধ্যে একটা বেলি ফুলের মালা লাগিয়ে দিলেন। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,,
“এই সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ মায়াবতী টা কে আমি অসীম ভালোবাসি”।
রাদিফ ভাই টেনে আমাকে ছাদের একপাশে নিয়ে আসলো। রেগে গিয়ে বললো, “তুই ঐ মহিলার সাথে এত বকবক কেন করছিলি?? মহিলা যখন তোকে সবকিছু জিজ্ঞেস করছে তুই কিছু বুঝিস নি কেন জিজ্ঞেস করছে?? মাথামোটা কোথাকার।
আমি বললাম,, ” আমি কিভাবে জানবো। ওনার কথার উত্তর না দিলে তো বলবে মেয়েটা বেয়াদব। আর আমি ভাবছি এমনিতেই সব জিজ্ঞেস করছে”।
“তাই বলে তুই তোর পুরা জীবন বৃত্তান্ত দিয়ে দিবি।উপ! এই মহিলা গুলোর জন্যই আমার মতো ছেলেরা বিয়ে বাড়িতে নিজের বউয়ের বিয়ের সমন্ধ পায়” বলে রাদিফ ভাই বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার দিকে চাইলেন।
আমি রাদিফ ভাইয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে বললাম,,
“শুধু আমি একটু সাজুগুজু করলেই যত দোষ,, এখন নিজে এইরকম সুদর্শন হয়ে মেয়েদের সামনে ঘুরঘুর করছে”
রাদিফ ভাই বললেন,, “কি হলো?? নিজে নিজে কি বলছিস”??
আমিও বলে ফেললাম,, ” আমি একটু কিছু করলেই আপনার যত আদেশ। এখন যে আপনি একেবারে ফিটফাট হয়ে ঘুরছেন মেয়েরা যে আপনার দিকে তাকাচ্ছে। যত দোষ নন্দ ঘোষ।”
রাদিফ ভাই ভ্রু কুচকে বললেন,,
“কিন্তু যার জন্য এতকিছু তারই তো কোনো খবর নাই। সে তো দিব্যি অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে বসার জন্য প্রস্তুত। ”
আমি মুচকি হেসে অন্য দিকে চাইলাম। দেখলাম এদিকে লামিসা আসতেছে। এসে রাদিফ ভাই এর পাশ ঘেঁষে বললো,,
“চলেন আমরা কিছু ছবি তুলি। আপনাকে আবার কবে সামনাসামনি পাবো। তাই কিছু মেমোরি ক্রিয়েট করতে চলেন আপনার সাথে কিছু ছবি তুলি” বলে রাদিফ ভাইয়ের একহাত টেনে ধরলো।
আমি রাগি দৃষ্টিতে হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার রাগ বুঝতে পেরে রাদিফ ভাই লামিসার হাত টা ঝাটা মেরে ফেলে দিয়ে বললো,,
“আমি এখন ছবি তুলেতে পারবো না লামিসা। একটু ব্যস্ত আছি”।
লামিসা তো আমার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেছে।
রাদিফ তুবাকে বললো,,
” দেখ, দেখে শিখ। ও কোথাকার কে হয়ে আমাকে রাদিফ বলে ডাকে আর আমি তোর হাসবেন্ড হই,,আর তুই আমাকে ডাকিস ভাই!!”
__________________
সব কাজিন রা মিলে একসাথে গ্রুপ ছবি তুলবে। আমি নিচে চলে এসেছি,,ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ আগেই লামিসা এসে আমাকে একগাদা কথা শুনিয়ে গেছে। আমি রাদিফ ভাই এর যোগ্য না,,উনার পেছনে ছ্যাঁচড়ার মতো পড়ে থাকি,,হেনতেন কত কিছু।
ওর কথাগুলো শোনার পর থেকে সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। মন চাচ্ছে এখনি বাসায় চলে যাই। নিজের বাড়িতেই শান্তি,,সেখানে অন্তত এই বিষাক্ত কথাগুলা হজম করতে হতো না। চাইলে আমিও লামিসা কে জবাব দিতে পারতাম,,কিন্তু জানি এগুলা নিয়ে পরে রাহা আপুর অশান্তি হবে।
আমাদের কে দেওয়া রুমে এসে আমি ফ্রেস হয়ে একটা জামা পড়ে নিলাম। বারান্দায় গিয়ে দাড়াতেই শীতল বাতাসে মনটা যেন ভরে গেল। রাদিফ ভাইয়ের নানু বাড়ির বাগান থেকে কি দারুণ বেলি ফুলের গন্ধ আসছে। দেখলাম ফোনে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে আনাস ভাই ম্যাসেজ পাঠিয়েছে,,
“তুবা, রাতুল তো আমাকে পাগল করে ফেলতেছে তোর সাথে কথা বলার জন্য। তুই নাকি ব্লক করে দিয়েছিস। শা*লা কে আমি কতবার বললাম যে তুই বিবাহিত,, এরপরও আমাকে প্রতিনিয়ত কল করেই যাচ্ছে”।
এরপর আমরা দুজন রাতুল ভাই কে হাসাহাসি করতেছি। যেন আমি ভুলেই গেছি কিছুক্ষণ আগে আমার কি ভীষণ মন খারাপ ছিল।
এদিকে,,
রাদিফ তুবা কে খুজছে চারদিকে চোখ বুলিয়ে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। সবাই যেরকম ঝেকে আছে কোথাও যেতেও পারছেনা। সিনথিয়া একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। তাই রাদিফ সেই তখন থেকে সিনথিয়া কে পাত্তাই দিচ্ছে না। ও ডাকলেও যেন রাদিফ শুনতে পারছে না। রাদিফ কয়েকটা ছবি ওদের কাজিন গ্রুপে শেয়ার দিলো যেগুলোতে স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে কিভাবে সিনথিয়া বিভিন্ন ছেলেদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে কিভাবে ওদের থেকে টাকা,ফ্ল্যাট আদায় করতো।
এখনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। ওর শাস্তি আরো বাকি আছে। ও বোধহয় ভুলে গেছে আমি রাদিফ কি কি করতে পারি। আমার বউ এর কানে বিষ ঢালা,,তাই না।
__________________
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নয়’টা বেজে গেছে। আমার সাথে সাবিহা, সাবা আপু ওরা এখনো ঘুমাচ্ছে। আমার মনে হয় কি সাবা আপু আর ইরহাম ভাই এর মধ্যে কিছু চলছে।
ব্যাপারটা সাবিহা কে বলতে হবে। তারপর দুজন মিলে তদন্ত করবো।ফ্রেস হয়ে এসে সাবিহা আর সাবা আপু ডাকছি ঘুম থেকে উঠার জন্য।
তিনজন মিলে নিচে গিয়ে দেখলাম অলরেডি অনেকেই নাস্তা করে ফেলেছে। আমরা গিয়ে টেবিলে বসতেই নাস্তা করতে এলো রাদিফ ভাই আর মিরাজ ভাই। আমি একনজর রাদিফ ভাই এর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললাম। রাদিফ ভাইয়ের মেজো মামি সবাই কে নাস্তা দিলো। আমার এখান থেকে আমি একটা পরোটা আর ডিম পোজ নিলাম। বাকি গুলা রেখে দিলাম। রাদিফ ভাই এর মামি বললো,,
মিরাজ ভাই বললো, “তুমি কি ডায়েট করছো নাকি?? তোমার এই শরীর নিয়ে যদি ডায়েট করো তাহলে আমাদের কি হবে। কোনো ডায়েট করো না,,ভালো মত খাও”।
আমি একটা শুকনো হাসি দিলাম। মেজো মামি বললো,,
” কি হয়েছে তুবা?? শরীর খারাপ? কালকে অনুষ্ঠানে শেষ পর্যন্ত থাকলেও না?”
আমি বললাম, “না মামি আসলে আমি বেশি রাত জাগতে পারি না। না ঘুমালে আমার শরীর খারাপ করে,,তাই চলে এসেছিলাম”।
মিরাজ ভাই বললো, ” তুবা আরেকটু কিছু খেয়ে নাও। এত কম খেলে কিভাবে থাকবে। কিছু ফ্রুটস খেয়ে নাও তাহলে” বলে আমার দিকে ফ্রুটস গুলো এগিয়ে দিলেন।
আমি বললাম, “না ভাইয়া আর কিছু খাবো নাহ। খিদে নেই।” দেখলাম সিনথিয়া আপু এসে রাদিফ ভাই এর পাশের চেয়ারে বসলো। আর রাদিফ ভাই নির্বিকার ভাবে খাচ্ছে। যেই আমি উঠে পড়বো তখনি রাদিফ ভাই গম্ভীর স্বরে বললো,,
“তাহিয়া আরেকটা পরোটা খেয়ে নে। আর যদি না খাস তাহলে প্রেসার লো হবে”।
যেই আমি কিছু বলতে যাবো অমনি রাদিফ ভাই এর সাথে চোখাচোখি হতে বসে পড়লাম আবার। রাদিফ ভাই দেখলাম তার আগের রুপে ফিরে আসছে। যদি খেতে না বসি তাহলে দেখা গেলো সবার সামনে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসবে। মান সম্মানের কথা ভেবে বসে পড়লাম।আর রাদিফ ভাই যেন সিনথিয়া আপু কে দেখেই নি এরকম ভঙ্গিতে খাচ্ছে।
সকালের নাস্তা করে আমরা কয়েকজন মিলে বের হলাম গ্রাম ঘুরতে। আমি, সাবিহা, সাবা আপু, রিজবী, আদিবা, লামিসা আর সিহাব। আদিবা আর সিহাব আমাদের কে সবকিছু দেখাচ্ছে। আমি, সাবিহা আর আদিবা পেছনে হাটছি। এরপর ওরা দুজন আমাদের কে নিয়ে গেলো নদীর ধারে। উপ! কি সুন্দর মনোরম পরিবেশ। লামিসার ন্যাকামি যেন বেড়েই চলেছে। পানি দেখে যেভাবে রিয়েক্ট করছে যেন ও কখনোই পানি দেখেনি।
সাবিহা আমাকে কিছু ছবি তুলে দিচ্ছে। আদিবা আর সিহাব নৌকায় চড়ার কথস বললে ওরা বলে এখন ঘাটে কোথাও নৌকা নেই। কালকে সবাই মিলে আসলে চড়াবে।
সাবার আপু ফোনে রাহা আপু শুধু কল দিচ্ছে। আমরা কোঠায় সেইজন্য। সাবা আপু কল কেটে ভিড়িও কল দিলো রাহা আপু কে। বললো দেখো আমরা নদীর পাড়ে আসছি। উপ রাহা আপু এত সুন্দর তোমার নানুদের গ্রাম। এদিকে দেখো তুবা আর সাবিহা দুজনে সেই কখন থেকে ছবি তুলেই যাচ্ছে,, বলে সাবা পেছনের ক্যামেরা দিলো। রাদিফ তখন রাহার কাছে আসছে তার মেয়েকে তার কাছে দিয়ে যাওয়ার জন্য। এসে দেখলো রাহার ফোনে ভিড়িও কল চলছে। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে তার প্রিয়তমার হাস্যজ্জল মুখ। কানের পাশের চুল গুলো কে গুজে দিয়ে সাবিহা কে ছবি তুলে দিচ্ছে আর হাসছে। একমুহূর্তে রাদিফ এর মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটিকে সে তার বউ হিসেবে পেয়েছে।
___________________
সবাই মিলে এসে গোসল করে নিলাম। কিছুক্ষণ পর আবার কমিউনিটি সেন্টার এ যেতে হবে। আজকে যে বিয়ের দিন। আমরা এসে দেখলাম বাসার প্রায় অর্ধেক সেন্টারে চলে গিয়েছে। আমি একটা মেরুন কালারের গাউন পড়ে নিলাম। তারপর হিজাব পড়ে নিলাম আর উড়না টা সেট করে নিলাম।একটু লিপস্টিক আর কাজল দিলাম।
নিচে এসে দেখলাম আর দুইটা গাড়ি আছে। এগুলা করে ছোট রা যাবে। বড় রা সবাই চলে গেছে। দুইটা গাড়ি ফুল হয়ে গেছে। এখন বাকি আছি আমি, সাবিহা, মিরাজ ভাই আর রাদিফ ভাই। তখন রাদিফ ভাই উনার গাড়ি নিয়ে আসলো। লামিসা যখন দেখলো রাদিফ তার গাড়ি নিয়ে এসেছে তখন ও অন্য গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। ও বললো ও নাকি রাদিফ ভাই এর গাড়িতে যাবে। আমাকে বললো,,
“তুবা তুমি ঐ গাড়িতে চলে যাও”।
রাদিফ ভাই বললো,, ” কেন ও কেন ঐ গাড়িতে যাবে। তুবা আমার গাড়িতে যাবে। তুমি কেন ঐ গাড়ি থেকে নেমে পড়লে??”
লামিসা বললো, “আসলে ঐ গাড়িতে বেশি চাপাচাপি হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে ভালো লাগছে না।”
রাদিফ বললো, “তাহলে তুবা কে যেতে বলছো কেন”।
লামিসা প্রথমে রাদিফ ভাই এর সাথে সামনে বসার জন্য একটু ন্যাকামি করলেও পরে মিরাজ ভাই বসেছে।
সেন্টারে গিয়ে নেমে আমরা ভেতরে যেতেই কে যেনো পেছন থেকে আমার নাম ধরে বললো,,
” আরে তুবা তুমি এইখানে!!”
পেছন ঘুরে দেখলাম রাতুল ভাই! আল্লাহ রাতুল ভাই এইখানে কি করে! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়।
[গঠনমূলক মন্তব্য করুন ]।
চলবে……
#আমার_বিষাদীনি
#উম্মে_হাফসা
#পর্ব_১৩
রাতুল ভাই কে দেখে আমি একটু শুকনো হাসি দিলাম।রাতুল ভাই আমার কাছে এসে বললেন, “কোন পক্ষ তুমি তুবা?” আমি বললাম,, মাহাদ ভাই আমার কাজিন হয়। আর এরাও আমার কাজিন। এটা হচ্ছে আমি কাজিন সাবিহা৷ এটা মিরাজ ভাই আর উনি হচ্ছে রাদিফ ভাই। আমি বললাম,,
“রাদিফ ভাই কে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন। আনাস ভাই বলেছে না আপনাকে। উনি সেইই রাদিফ।” এরপর রাদিফ ভাই কে বললাম,
“ওনি হচ্ছে রাতুল ভাই। আনাস ভাইয়ের বন্ধু। আনাস ভাই এর সাথে র*ক্ত দিতে হসপিটালে গিয়েছিলাম যে ঐ খানেই পরিচয় হয়েছে”।
রাদিফ ভাই ওনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
” হাই আমি ইফতিখার আহমেদ রাদিফ। মাহাদের আই মিন বরের ফুফাতো ভাই আর তুবার হাসবেন্ড ”
“আমি রাতুল।কনে আমার মামাতো বোন হয়। পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো” বলে রাতুল একটা শুকনো হাসি দিলো।
এরপর রাদিফ ভাই বললো,, “আচ্ছা পরে কথা হবে ওদিকে মনে হয় অপেক্ষা করছে” বলে উনি আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
একটা সাইডে গিয়ে আমি দিলাম আনাস ভাই কে ফোন। দিয়ে বললাম,,
আনাস ভাই অবাক হয়ে বলে,, ” কি!! ঐখানেও পৌঁছে গেছে। তুই এক কাজ কর ও যতক্ষণ তোর দৃষ্টিসীমার ভিতরে থাকবে তুই রাদিফ এর সাথে থাকবে। ওকে আমি কত বুঝাবো বল। এখন যদি এইসব রাদিফ শুনে ও আমাকে আস্তই রাখবে না। বলবে সব তোর জন্য হইছে”।
আমি হতাশ হয়ে বললাম,,
“নারে ভাই, আমি তোমার এই ছ্যাঁচড়া বন্ধুর জন্য এত কিছু করতে পারবো না। আমি যতদ্রুত পারি বাসায় চলে যাবো। ভাল্লাগেনা এইসব উটকো ঝামেলা” বলে আমি ফোন কেটে দিলাম।
________________
লামিসা যেইভাবে রাদিফ ভাই এর সাথে চিপকে আছে ঐ রাতুল ব্যাটা কিছুতেই ভাববে না যে, রাদিফ ভাই আমার হাসবেন্ড। আমি আর সাবিহা খেয়ে আর দেরি করি নাই,, বড় মাকে বলে দুজনে মেজো চাচ্চুর সাথে বাসায় চলে আসছি। এসে সাবিহা কে রাতুল ভাইয়ের ব্যাপারে সবকিছু বললাম। সব শুনে সাবিহা বললো, “আরে তুই এইসব কথা সেন্টারে থাকতে বলতি ঐ ব্যাটাকে একটা শিক্ষা দিতাম।”
আমি সাবিহা কে বললাম,, “ধুর বোন এইসব আর ভাল্লাগে না। নিজের বাসায়ই সবথেকে শান্তি। কালকে যেইভাবে হোক আমি বাসায় চলে যাবো। যে থাকবে থাকুক। এইখানে থাকলে এক লামিসা দুই সিনথিয়া আপি দুজনের ন্যাকামি সহ্য করতে হবে। ”
সাবিহা বললো,, “হ্যাঁ বাসায় শান্তি। চলে যাবো কালকে যেভাবে হোক।”
এরপর দুজন ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কালকে রাতে দেরি করে ঘুমানোর কারণে অনেক ঘুম পাচ্ছে তাই দুজনে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এদিকে,,,
রাদিফ চারদিকে তুবাকে খুজছে কিন্তু পাচ্ছে না।গেলো কোথায় এই মেয়ে?? রাদিফ ওর মার কাছে গেলো। বললো,,
“মা তুবা কোথায়?? ওকে দেখছি না যে” চারদিকে চোখ বুলালো।
“আরে তুবা তো বাড়িতে চলে গেছে। ও আর সাবিহা দুজন খেয়ে নিয়ে বললো ওরা বাড়িতে যাবে। তাই আমি তোর মেজো চাচ্চু কে বললাম দিয়ে আসতে।”
আমাকে না বলে চলে গেলো।শরীর খারাপ করছে কিনা কে জানে। এরপর মিরাজ এসে ডেকে নিয়ে গেলো ও কে। এখন মাহাদ কে ওর শালিরা মালা পড়াবে কিন্তু এরা নাকি টাকা ডিমান্ড করছে। মিরাজ তো ওদের সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে। রাদিফ এক সাইডে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ফোন চাপছে। ওর কাছে এগুলা ভালো লাগে না। শুধু শুধু মিরাজ ওকে ডেকে এনেছে।
রাদিফ ফোনে তুবার তুলা ছবি গুলা দেখছে। দেখতে দেখতে ভাবছে,,ইশ এই মেয়েটা এত সুন্দর কেন!! পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যে যেন ও ভরপুর। এইবার অস্ট্রেলিয়ার গিয়ে তো আমি আর শান্তি পাবো না। কে কখন আমার এই নিষ্পাপ বউটার দিকে চোখ তুলে তাকায়। উপ! সুন্দর বউ হলে স্বামীদের সবসময় চিন্তায় থাকতে হয়।
হঠাৎ ঐখানে একটা মেয়ে রাদিফ কে ইশারা করে বললো এইসব সুন্দর বেয়াইদের ভাব যত বেশি তাই আমাদের মতো বেয়াইন দের ডিমান্ড ও তত বেশি। রাদিফ শুনেও না শুনার ভান করে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বউ যদি শুনে ও মেয়েদের সাথে কথা বলেছে নির্ঘাত ওর মাথা ফাটিয়ে দিবে।
______________________
বউ নিয়ে বাসায় আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এদিকে তুবা আর সাবিহা তো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তুবার আম্মু এসে একবার দেখে গেছে। ঘুমাচ্ছে দেখে আর জাগায় নাই। রাদিফ কে নিয়ে ওর মামারা গেছে বাজারে। নতুন বউ কে সবাই দেখতে আসছে। কিছুক্ষণ পর সিনথিয়া বউ কে রুমে নিয়ে যায়। সবাই এখন সন্ধ্যা বেলায় হালকা নাস্তা করছে। তুবা আর সাবিহার খোজ করতে ওর আম্মু জানায় ওরা ঘুমাচ্ছে। আদিবা গিয়ে ওদের ঘুম থেকে তুলে আনে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে দেখে তো দুজনেই অবাক।
ফ্রেস হয়ে নিচে এসে দুজনে নাস্তা করতে বসে। রাদিফ তখন মাত্র বাজার থেকে আসছে। নতুন বউয়ের সাথে তার বোন আর একটা খালাতো বোন আসছে। ইতোমধ্যে তাদের সাথে সাবিহা আর তুবার ভাব হয়ে গেছে। রাদিফ এসে একনজর তুবার দিকে তাকিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। ওখানে গিয়ে ওর নানু আর দাদির সাথে খোশগল্প করতে লাগলো।
নতুন বউয়ের বোন সাইমা আর খালাতো বোন সোহা তুবা আর সাবিহার সাথে গল্প করছে। গল্প করতে করতে ওদের কাজিন দের কথা বলছে। কে কেমন স্বভাবের। রিজবীর কথা বললে সোহা আর সাইমা তো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এরপর আসলো দ্যা গ্রেট রাদিফ এর কথা। রাদিফ কথা বলতে বলতে রাদিফ সিড়ি দিয়ে উঠার সময় তুবা কে বললো,,
“এই তুবা একটু এইদিকে আয় তো। ফ্রেস হয়ে এসে যেন তোকে রুমে পাই” বলে রাদিফ উপরে চলে গেল।
এদিকে সাবিহা আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিল। কিন্তু আমি জানি রাদিফ ভাই আমাকে ডেকেছেন আজকে আসার সময় ওনাকে বলে আসি নাই যে সেজন্য। আমি উঠতে উঠতে সোহা আর সাইমা কে বললাম,,
“যদি বাঘে খাঁচা থেকে বের হয়ে আসতে পারি তাহলে আবার দেখা হবে” বলে উপরে আসলাম।
সোহা আর সাইমা সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো,,
“তোমাদের রাদিফ ভাই মনে হয় একটু বেশিই স্ট্রিট তাই না??”
সাবিহা ভেসে বললো,, “হ্যাঁ। তবে বউয়ের বেলায় এটা একটু বেশিই ”
সোহা আর সাইমা অবাক হয়ে বললো,, কি বউ!!তারমানে তুবা আর রাদিফ ভাই হাসবেন্ড ওয়াইফ!!
আমি এসে রাদিফ ভাই এর রুমে বসে আছি। ওনার ফোন ওপেন করতেই দেখলাম স্ক্রিনে আমার ছবি। আজকে সকালে নদীর পাড়ে তুললাম যে সেখান থেকে একটা। তারমানে ছবিগুলা সাবা আপু বা সাবিহার থেকে নিয়েছেন উনি।
ওনার ফোনের লক তো আমি জানি না। নাহলে দেখে নিতান কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে কিনা। উহু,, নিজের কিছুই আমাকে জানতে দেয় না আর আমার সবকিছুতেই ওনার সমস্যা।
ফ্রেস হয়ে এসে হাত মুখ মুছতে মুছতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,,
“আজকে এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে। আমি তো তোকে আরো কত জায়গায় খুজছি। পরে আম্মু বললো তোরা নাকি চলে এসেছিস” বলে আমার পাশে বসলেন।
আমি বললাম,, “না আসলে শরীর ভালো লাগছিলো না। কালকে রাতে দেরি করে ঘুমানোর ফলে একটু অস্বস্তি লাগছিলো, তাই চলে এলাম” বলে রাতুল ভাইয়ের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম।
রাদিফ ভাই তোয়ালটা বিছানায় ফেলে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন,,
“উফ শান্তি!!আজকে পুরা দিনেও আমি আমার বউকে কাছে পেলাম না। এখানে গেলেও রাদিফ ওখানে গেলেও রাদিফ। সবাই শুধু আমাকে ডাকে। কেউ বুঝে না যে ছেলেটা কয়েকদিনের জন্য আসছে,, বউয়ের সাথে একটু সময় কাটাক। বউয়ের চিন্তায় চিন্তায় ছেলে যে শেষ হয়ে যাচ্ছে কেউ বুঝলোই না” বলে রাদিফ ভাই আমাকে আরো দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরলেন।
আমি হেসে বললাম,, “আহ আপনার জন্য আমার কে যে মায়া হয়!! আপনার উপর সবাই চরমভাবে অন্যায় করছে” বলেই আমি হেসে দিলাম
রাদিফ ভাই বললো,,
“খুব হাসি পাচ্ছে আমার জন্য। তুই যে কতটা নির্দয়!! এখন ঝটপট একটা চুমু খেয়ে ফেল” বলে রাদিফ ভাই ওনার ঠোঁট এগিয়ে দিলেন
আমি অবাক হয়ে বললাম,,
“এখানে হাসাহাসির সাথে চুমুর কি সম্পর্ক!! আমি হাসাহাসি করছি বলে কি এখন চুমু খেতে হবে নাকি”
“না চুমু খাবি আমার এনার্জির জন্য। আমার প্রতি অন্যায় গুলো করার সহ্য ক্ষমতার জন্য তো এনার্জি প্রয়োজন তাই চুমু খাবি” বলতে বলতে উনি নিজেই আমার ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে দিলেন।
________________
উপ দেখেন কত খানি ঠোঁট কেটে গেছে আমার। আপনাকে নিয়ে আর পারি না। যতদিন ভাই ছিলেন ততদিন সভ্য ছিলেন। আর যখন থেকে ভাইয়া থেকে সাইয়্যা হয়েছেন তখন থেকেই শুরু হলো আপনার অসভ্যতামি। আর আমি কিন্তু বলছি কালকে যেভাবেই হোক আমি বাসায় চলে যাবো। আমার আর ভালো লাগছে না।”
“আমি আপনার কাছে আমৃত্যু এমন অসভ্য থাকতে চাই বউজান”