Friday, June 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 17



অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩৫

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩৫
প্রতিবার দেশে ফেরার সময় জিয়ান এক্সাইটেড থাকে তবে এবার যেনো তার চেহারায় আলাদা রকমের আনন্দ দোল খাচ্ছে। সিটে বসে মনে মনে বলে,সুইটহার্ট এবার ফেরার সময় আমি একা ফিরবো না তোমাকে নিয়ে ফিরবো। আর কয়েকঘন্টা তারপর তোমার সব অভিমান মুছে দেবো রাঙাবৌ। জিয়ানের ভাবনার ছেদ ঘটে পাশের সিটের কারো কান্নার আওয়াজে। জিয়ান একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করবে আবার কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করলো না৷
“পাশের সিটে বসে থাকা মেয়েটা মাথা তুলে তাকাতেই,জিয়ান বলে,আবার আপনি!”
“ইরার কোন হেলদোল নেই সে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে চোখ থেকে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে।”
“এভরিথিং ইজ অলরাইট মিস?”
“ইরা নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো যার মা দুনিয়ায় ছেড়ে চলে গেছে তার সবকিছু অলরাইট কি করে হয়?”
“সো স্যাড। কিন্তু মানুষের জীবন তো চিরস্থায়ী নয়, তাই না? আমরা জন্মের পরেই জানি আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত।”
“আপনি জানেন আমার মম লাইফে কিছু পায়নি। না ঘর,না সংসার, না ওই লোকটার পরিচয়। ধ্বংস করে দেবো তাকে আমি। আমি এখানে আর আমার মা কফিনে৷”
“কোন লোকটা? আর আপনার বাবা কোথায়?”
” বাবা শব্দটাকে ঘৃণা করি আমি। আমার মম সারাজীবন তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছে সে আমার মমকে জাস্ট টিস্যু পেপারের মত ইউজ করেছে।”
“আপনার বাবার সাথে কথা হয়েছে মনে হয়নি ভদ্রলোক এমন হতে পারে।”
” ওটা আমার বাবা না। আমার আঙ্কেল। ছোট খালামনির হ্যাসবেন্ড। বাবা নামক মানুষটাতো আমার মমকে সারাটা জীবন ঠকিয়ে এসেছে। আচ্ছা স্ত্রীর পরিচয় যদি নাই দিতে পারবে তাহলে সেই স্ত্রীর সাথে রাত কাটাতে লজ্জা লাগলো না! তার শরীরে যদি এতোই কারেন্ট পতিতালয়ে না যেয়ে আমার মমকে কেনো ব্যবহার করলো? জবাব চাই আমার, আমি ওই লোকটাকে খু’ন করে তবেই শান্ত হবো।”
“জিয়ান পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনাকে শান্তনা দেবার মত ভাষা আমার জানা নেই। তবুও বলবো একটু শান্ত হোন, ঠান্ডা মাথায় কাজ করুন৷ আল্লাহ তায়ালা আপনার মমকে জান্নাতবাসী করুক।”

পুরো জার্নিতে আর তেমন কোন কথা হলোনা। পুরোটা পথ মেয়েটা শুধু কেঁদেছে। জিয়ান আগ বাড়িয়ে আর কথা বাড়ায়নি কারন সব মানুষ সিমপ্যাথি পছন্দ করে না৷

🌿

নয়না রাগে গজগজ করতে করতে গাড়িতে এসে বসেছে৷ তার মোটেও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তার মা জোর করে নিয়ে যাচ্ছে।
“জাহানারা বেগম নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বললেন চেহারার নকশা ঠিক করো। বাপ বেটি এক রকম হয়েছো। কোথাও যাওয়ার নাম শুনলেই কপালে বজ্রপাত পড়ে! তা আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয় না?”
“তো তোমার ভাতিজার বিয়ে তুমি যাও না, আমাকে কেন টানছো?”
“তোমাকে বড় মামি কত আদর করে আর তুমি এভাবে বলছো!”
“আম্মু, আম্মি ছাড়া আর কিছুই আমার মনমত না ওই বাড়িতে। তাছাড়া আলিফ ভাইয়াও তো আসবে। বাবা জানলে কি হবে?”
” আলিফ যথেষ্ট ভদ্র ছেলে আমার তো ভয় তোমাকে নিয়ে। কি উল্টোপাল্টা কান্ড ঘটিয়ে বসো কে জানে!”
“তো আমাকে নিচ্ছো কেনো? নামিয়ে দিয়ে যাও।”
“শোন জামাইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কোন উল্টোপাল্টা কথা বলবে না৷ ভালো ভালো কথা বলবে৷ জামাইকে নিয়ে একদম ভুলভাল কিছু বলে,আমার নাক কাটাবে না৷”
“তোমার জামাইকে নিয়ে আমি কোন দুঃখে কথা বলবো৷ ওই ব্যাডা চিটার।”
” চুপ একদম বেশি কথা বললে,মুখে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে দিবো।”
“নয়নার ইচ্ছে করছে জিয়ানের চুলগুলো ধরে ইচ্ছেমত টানতে। গোছানো চুলগুলো টেনেটুনে ছিড়ে নষ্ট ভষ্ট করে দিতে। ইচ্ছেমত কামড় দিয়ে রক্ত বের করে আনতে। শা”লা আমার সাথে বাটপারি করে!বিয়ে করেছে আমাকে ঘরে তুলে এনেছে আরেক মেয়েকে!এই বেডা মানুষ, কবরে গেলেও আরেকটা বিয়ে করার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করবে না৷ শা”লা একবার আসি শুধু চট্টগ্রাম থেকে তোকে বোঝাবো সুনয়না তালুকদার কি চিজ!
“জাহানারা বেগম একটা কোণ আইসক্রিম নয়নার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,অন্যের ছেলের গুষ্টি উদ্ধার না করে,আইসক্রিম খেয়ে বংশগত বদ মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করো৷”
“আমাদের বংশ নিয়ে এতোই যখন সমস্যা কে বলেছিলো এই বংশে আসতে?”
“আমি আসিনি আমাকে নিয়ে এসেছে।”
“এবার এসে বলবো ফেরত দিয়ে আসতে।”
“চুপ করো একদম। সবাই জানে তুমি ভদ্র সো নিজের ইমেজ নষ্ট করবে না। আর হ্যা চুলের দিকে খেয়াল রাখবে এই চুল তো আমার যত্নে গড়া।”
” নয়না গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো, মনে মনে ভাবলো ইশশ লেখকের লেখা চরিত্রের মত কেউ আমার জীবনে আসলে কত ভালো হতো! সে আমার চুল দেখে কবিতা আবিষ্কার করে ফেলতো। চোখ দেখে বলতো,”শোন কাজল চোখের মেয়ে আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে, (সাদাত হোসাইন) তা’না কপালে জুটেছে এক চিটার, বাটপার শা’লা হনুমান।”

🌿

জাহিন এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে মেহনুরের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন বলল,হ্যালো?
“জাহিন সামনে তাকিয়ে দেখে কালো স্যুট পরা এক নারী। ফর্সা মুখশ্রীতে কালো চশমাটা যেনো ফুটে উঠেছে। মেয়েটি হাত ঘড়ির দিকে টাইম দেখে বলে,এই ড্রাইভার আমার ব্যাগগুলো গাড়িতে নিয়ে রাখো৷ আর হ্যা গাড়ি স্লো চালাবে।

” জাহিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,আমাকে দেখে আপনার ড্রাইভার মনে হচ্ছে! চোখ আছে তো চশমার আড়ালে?”
“মেহনুর কথার উত্তর না দিয়ে বলে,আমার হাতে সময় নেই আপনাকে জাজ করার দ্রুত যেতে হবে আমাকে।”
” অন্তর হেসে বলে,বাহহহ ভাই এতো মেয়েদের ক্রাশ থেকে সোজা গাড়ির ড্রাইভার বানিয়ে দিলো!বিদেশি ম্যাম তো, তাই হয়তো।”
“চুপ কর বেশি কথা না বলে,ব্যাগ তুলতে সাহায্য কর।বাসায় যেয়ে একে দেখে নিচ্ছি৷ ছোট বেলায় ম্যা ম্যা করতে করতে পিছু পিছু ঘুরতো এখন ভাব নিচ্ছে! দুই দিনের বৈরাগী ভাত কে বলে রাইস!”
” মেহনুর গাড়ির পেছনের সিটে বসলো।তার এমন এক ভাব যেনো আশেপাশে কেউ নেই৷ মোবাইল স্ক্রল করতে ব্যস্ত সে।”
“গাড়ি এসে থামলো চৌধুরি ম্যানশন। মেহনুর ছুটে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই আম্মি বলে জড়িয়ে ধরলো মিতা বেগম কে৷”
” মিতা বেগম মেহনুরকে জড়িয়ে ধরে বলে,কেমন আছিস? আমার বাঁদরটা তোকে বিরক্ত করেনিতো?”
“তোমার বাঁদর মানে আম্মি?”
” জাহিনকে পাঠিয়েছিলাম তোকে আনতে।”
“আমি তো ভেবেছি রেজা! তাই একটু মজাও নিয়েছি।”
“রেজা তো দেশে নেই। আচ্ছা এখন রুমে যা ফ্রেশ হয়ে আয়, আজ সব তোর পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। আর হ্যা এখন থেকে কিন্তু সেলোয়ার-কামিজ পরতে হবে। আমি তোর জন্য কিছু সেলোয়ার-কামিজ বানিয়ে আলমারিতে রেখে দিয়েছি৷”
“বাবা কেমন আছে?”
“সে আছে ভালো। সে ভালো আছে বলেই তো আমরা ভালো আছি।”
“মেহনুর সার্ভেন্টকে সাথে নিয়ে নিজের রুমে আসলো।দীর্ঘ চব্বিশ বছর পর নিজের দেশে পার্মানেন্ট ভাবে ফিরে এসেছে মেহনুর। রুমে এসে বেডে বসে বলে,রেজা এবার তুই আমাকে ভালোবাসবি তো?আমি তোর অর্ধাঙ্গিনী হয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই।

” জাহিন রেগে মেগে আগুন, বাসায় ঢুকে সোজা কিচেনে আসলো,আম্মু তোমার বান্ধবীর মেয়ের কত বড় সাহস আমাকে ড্রাইভার বলে!দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম জাহিন চৌধুরিকে! ওরে একবার পাই তারপর বোঝাবো ড্রাইভার কিয়া চিজ।
“আসছে আমার মোস্ট হ্যান্ডসাম! হ্যান্ডসাম হলে এই বয়সেও তুই একা থাকতি?এতো দিনে দুই চারটা বাচ্চার বাপ থাকতি। নিজেকে আয়নায় দেখ।”
” আম্মু তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো।”
“বিয়ে করতে রাজি হলে সম্মান করবো।”
” এই অহংকারী মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে করবো না৷ জাহিন চৌধুরীর সাথে ভাব নেয়!”

🌿

জিয়ান দেশে ফিরে নয়নাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য সোজা তালুকদার বাড়িতে গেলো,সেখানে যেতেই সূচনা বলে,তুই এই বাসায় কি করিস? তোকে না সেদিন দেখলাম মেয়েদের গান শোনাতে?
“ওরে দাদিআম্মা আমার। তা তোমার সাগরেদ কই?”
” তুই কি টয়নার কথা বলছিস.?
“টয়না তো আম্মুর সাথে বিয়ে করতে গেছে চট্রগ্রাম।”
জিয়ান দ্রুত উঠে এসে দারোয়ানেে কাছ থেকে ফুল ঠিকানা নিয়ে সোজা চলে গেলো এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে চাটার্ড বিমানে সোজা চট্টগ্রাম চলে আসলো।
“নয়নাদের আসতে আসতে অনেক রাত হয়েছে৷ দো’তলা বাসা তবে সিঁড়ি হচ্ছে বাহিরের সাইডে। নয়না তার মায়ের সাথে দোতলায় ঘুমিয়ে আছে।
নয়না তার মায়ের পাশে ঘুমিয়ে আছে,এমন সময় অনুভব করলো কেউ তার মুখ চেপে ধরেছে৷ ভয়ে চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু আওয়াজ বের হচ্ছে না মুখ থেকে। কেউ সেভাবেই নয়নাকে কোলে তুলে নিলো৷ অন্ধকার রুমে আবছায়ার মত একটা ছায়ামূর্তি নয়না ভয়ে কাঁপতে লাগলো,কেউ কানে কানে ফিসফিস করে বলল,এক পুরুষের স্পর্শেই কাঁপা-কাঁপি অবস্থা আবার নাকি বিয়ে করবে শখ কত ম্যাডামের!
“এই কন্ঠ নয়নার চেনা৷ যেনো,যুগ যুগ ধরে পরিচিত কোন কন্ঠস্বর।”

#চলবে।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩৪

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩৪

নয়নার আজকে শেষ এক্সাম ছিলো। হল থেকে বের হয়েছে ঘন্টা খানেক আগে, সবার সাথে শেষবারের মত দেখা করতে গিয়ে কান্না করে দিয়েছে নয়না।সবার চোখেই অশ্রু স্কুল লাইফের দশটা বছর একসাথে কাটানোর পর এই হল থেকে বের হয়ে এরপর কার গন্তব্য কোথায় হবে কারোর জানা নেই। জীবনের স্রোতে চেনা মুখগুলোর সাথে আর কখনো কোন বাঁকে দেখা হবে কিনা তাও জানা নেই! স্কুল লাইফ হয়তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়৷ এরপরের জীবন কি এতো মধুর হয়!
নয়না তুষির হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।
“তুষি কাঁদছে।
“এই তুষি তুই কাঁদছিস কেনো?তুই কিন্তু হারিয়ে যেতে পারবি না।শোন আমরা একি কলেজে ভর্তি হবো৷ তোর বাসা তো আমার বাসা থেকে মাত্র আধঘন্টার দূরত্ব। তুই কাঁদছিস কেন?”
“তুষি নয়নাকে জড়িয়ে ধরলো। তুষির মনে কিছু একটা চলছে। কিছু কথা বলতে যেয়েও তুষি তা শব্দ রুপে মুখ থেকে বের করতে ব্যর্থ হলো৷”
“তুষির বাচ্চা ভুষি বেশি ঢং করলে তোকে কিন্তু ময়না ফুপির ছেলের বৌ করে ফেলবো৷”
“তুষি মেকি হেসে বলে,নয়না একটা কথা বলবো?”
“একটা? এক হাজারটা বল ভুষি।”
“বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন, তুই হেলায় খেলায় সেটা নষ্ট করিস না। চেষ্টা কর ভাইয়ার সাথে সবকিছু স্বাভাবিক করে নিতে৷ তোর আমাদের ক্লাসের নিতুর কথা মনে আছে?”
“কোন নিতু?”
“ওই যে ওর বাবা ভ্যান চালাতো? অসচ্ছলতার কারনে ওর বাবা ওকে ক্লাস এইটে থাকতে বিয়ে দিয়ে দেয়৷ ওই নিতুর দুইটা ছেলে,মেয়ে। তুই তো ওর চেয়ে বড়। দেখ নয়ন জীবন এতো সহজ না৷ মেয়েদের জীবন তো আরো বেশি কঠিন।”
” তুই এতো গভীর কথা কবে শিখলি! আগে তো আমাকে বলতি উপন্যাস পড়ে পড়ে আমি দাদিআম্মাদের মত জ্ঞান দেই। হঠাৎ তোর কি হলো তুষি?”
“নয়না তুই জানিস বয়স আমাদের কোনদিন বড় করতে পারে না। আমরা তো বড় হই বাস্তব জীবনে হোঁচট খেলে। তখন দেখা যায় ষোল বছর বয়সের ভারও অনেক বেশি মনে হয়।”
“চুপ কর আর আউল ফাউল কথা শুনবো না৷ চোখ বন্ধ কর।”
“তুষি চোখ বন্ধ করতেই নয়না তুষির হাতে একটা ব্রেসলেট পরিয়ে দিলো৷”
” তুষি নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলে,তোকে খুব মিস করবো রে নয়ন৷ নয়ন মনে রাখিস চিরজীবন কেউ পাশে থাকে না। কেউ চলে গেলে ভেঙে পরবি না৷ জীবনে মানুষ আসবে যাবে। আপন মানুষ ও হারাতে হয় আমাদের। ভালো থাকিস নয়ন।”
“নয়নার মনটা কেমন বিষিয়ে উঠলো৷ তুষির কথাগুলো এতো ভারি ছিলো যে নয়নার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। নয়না তুষি বলে ডাকলো৷
” তুষি পিছু না ফিরে দ্রুত চলে গেলো। নয়না গাড়িতে উঠে বসলো তার মন খারাপ ভিষণ মন খারাপ। তুষিরও কি মন খারাপ ছিলো? আচ্ছা আজ তুষার ভাইয়া তুষির সাথে দেখা করতে কেনো আসলো না! তুষির কি তুষার ভাইয়ার সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে! কিন্তু তুষি তো কিছু হলেই আমাকে সবটা বলে৷ আজ এমন অন্য রকম তুষি হলো কি করে? বাসায় এসে ফাইল রেখে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চিৎকার বলে, আম্মু পানি। মোবাইলটা টেবিলে রেখে গিয়েছিলো অলসতা কাটিয়ে উঠে মোবাইল আনলো নিজের রুম থেকে ।
ডাটা অন করে তুষিকে কল করলো৷ ওপাশ থেকে বলছে নাম্বার সুইচড অফ। এরমধ্যেই জিয়ানের কল আসলো, নয়নার এমনিতেই মুড অফ তারওপর জিয়ানের কল দেখে আরো রেগে বোম হয়ে গেলো৷ রিসিভ করে বলে,মেয়েদের লাইনে দেখলেই বুঝি কল করতে ইচ্ছে করে? সারাক্ষণ কি এসবই করেন?
“জিয়ান হেসে বলে,তা মেজাজ এতো হট কেন? এক্সাম ভালো হয়েছে তো রাঙাবৌ?”
“ডোন্ট কল মি বৌ। অনলি সুনয়না৷”
“আরেহহহ বাহহহহ বৌ দেখি ইংরেজিও পারে! আসো বৌ আইসা পরো আমার মনের ঠিকানায়। ধুর কানাডায়।”
“দেখুন আমি একদম মজা করার মুডে নেই। ফোনটা রাখুন আর কখনো কল করবেন না। কলেজে ভর্তি হয়ে কোন নামকরা ভার্সিটির সিনিয়র ছেলেকে বিয়ে করে নেবো।”
“আরেহহহহ বাহহহ শখ তো কম না বাবুটার। তা ম্যাডাম আপনার কয়বার বিয়ে করতে মনচায়?”
“একদম বাজে বকবেন না। আপনার সাথে আমি কোন সম্পর্ক রাখবো না আমি আরেকটা বিয়ে করবো।”
“ছিহহহ ছিহহহ ছিরে ননী ছিহহহ ছিহ রে ছিহহ।এসব বলাও পাপ সুইটু। তুমি জিয়ান রেজা চৌধুরী ওয়াইফ। যতদিন জীবিত আছো তুমি মিসেস চৌধুরী হয়েই বাঁচবা বেব।”
” চুপ একদম চুপ আমার জীবন আমি ডিসাইড করবো আমি কিভাবে বাঁচবো। আমি আরেকটা বিয়ে করবো মানে করবোই।”
“বুঝছি ময়নার মা ভদ্র ভাষায় কইলে তুমি শুনবা না৷”
“ভদ্র অভদ্র আপনার কোন ভাষাই আমি শুনবো না, বিয়ে আমি আরেকটা করবোই।”
“এহনো নাক টিপলে শ্লেষ্মা পড়বে আইছে আবার বিয়ে করবো! ছেমড়ির শখ তো কম না!”
“জিয়ানের কথা শুনে নয়না দাঁতে দাঁত চেপে বলে,একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না।আমি ষোল বছরের হট গার্ল!”
“ছেমড়ি কয় কি! মাথায় ঘীলু আছে নাকি খালি খোলস?এহনো দুধের দাঁত পরে নাই আইছে হটগার্ল!”
“ছেমড়ি আবার কি শব্দ!”
” আমগো দেশের জাতীয় শব্দ বেবি। আমাগো দেশের বুলি তোমগো দেশের গালি।”
“নয়না রাগে ফোন কেটে দিলো। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে।
জাহানারা বেগম এসে বলে,”কে মরছে? গরুর মত হাম্মা হাম্মা করছিস কেন?”
“আম্মু আমি বিয়ে করবো আম্মু। আমাকে ভালো একটা সুদর্শন ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। তুমি না দিলে আমি নিজেই খুঁজে নিবো।”
“এক চড় মেরে চাপার দাঁত সব ফেলে দেবো৷ যাহহ রুমে গিয়ে ব্যাগ গোছা,সন্ধ্যায় বের হবো চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে। একটা কথাও মুখ থেকে বের করবি সাথে সাথে মাইর পরবে৷”
“নয়না ধুপধাপ পা ফেলে রুমে চলে আসলো, কত্তবড় সাহস আমারে ছেমড়ি কয়, শ্বশুরের ছেলের বাচ্চা তোরে খালি সামনে পাই তোর কিমা বানিয়ে স্বামী কাবাব যদি না বানিয়েছি তাহলে আমার নাম। বলেই চুপ হয়ে গেলো। ধুর ভাল্লাগে না মায়েরা সব সময় খালি বাহাদুরি দেখায়!”
” জিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। কতবছর পর কারো সাথে এইভাবে কথা বলল!বৌটা নিজে আধপাগল আমাকে পুরো পাগল করে ছাড়বে। যত রাগ করার করে নাও রাঙা বৌ খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে তোমার সাথে। সব অভিমান ভেঙে দেবো ভালোবাসা দিয়ে৷ পিচ্চি একটা সুইট কিউট বৌ আমার। আজ রাতের ফ্লাইটে ফিরছি আমি সুইটহার্ট। সি ইউ সুন।

🌿

নীলাঞ্জনার পুরো শরীর জুড়ে কালসিটে দাগ। চুলগুলো কেটে ফেলেছে নিজেই৷
“লাবিবের বাাবা এসে বসলো,নীলাঞ্জনার পাশে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,জানোই তো ছেলেটা আমার বদমেজাজি ওর কথা শুনে চলবে তো৷
” নীলাঞ্জনা কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে রইলো৷ সে এখানে ফিরে এসেছিলো তার অনাগত সন্তানের জন্য। সে চায়নি সন্তানকে বাবা হারা করতে৷
“লাবিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে। ইচ্ছে করছে নীলাঞ্জনাকে শেষ করে ফেলতে। এতো নাটক সাজিয়ে ফাঁদে ফেললো। কিন্তু কোন টোপ গিলছে না! সোনার ডিম পারা হাঁস যদি ডিম’ই না দেয় তাহলে তাকে রেখে কি করবো!

🌿

জাহিন তার ফেভারিট খাবার হাঁসের মাংশ আর ভুনা খিচুড়ি খাচ্ছে মনযোগ দিয়ে।
মিতা বেগম জাহিনের পাশে বসে বলে,”তুই কি আমাদের একটা কথাও শুনবি না?”
“আম্মু পছন্দের খাবার খাচ্ছি খেতে দাও তো মনমত।”
“আজ মেহনুর দেশে ফিরবে। তুই ওকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করবি।”
“জাহিন মনে মনে বলে,এক আপদ বিদায় করতে পারিনি এখনো আরেক আপদ এসে হাজির হচ্ছে!”
“কিরে কিছু বল?”
“মেহনুর আমাদের বাসায় কেন আসবে আম্মু!ওর দাদা বাড়িতে যেতে বলো।”
” জাহিন!”
“ওকে পিক করবো। কিন্তু বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না কিন্তু।”
” তুই বিয়ে করবি কি? তোর মত বাউণ্ডুলে ছেলেকে মেহনুরের মত বিয়ে করতে রাজি হবে নাকি? তোর বাবা চায় কারন যেমন দেখতে তেমন তার শিক্ষা।বিজনেস নিয়ে পড়ালেখা করেছে ওদের ব্যবসা এখন ও একা চালায়। তোর মত গুন্ডাগীরি করে এমন ছেলে ও মেয়ে বিয়ে করবে কোন দুঃখে!”
“জাহিন ধীরে ধীরে খাচ্ছে। কারন মিতা বেগম সরলেই প্লেট ফুল করে মান্নাতের জন্য খাবার নিয়ে যাবে৷
” মান্নাত কিছুতেই বলতে চাইছে না তার কালো অতীত। কিন্তু অতীত তো তার পিছু ছাড়ছে না! সেই জঘন্য অতীত কিভাবে রিভিল করবো আমি!
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩৩

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩৩
জিয়ান মোবাইলের স্কিনে এক ষোড়শী কন্যার হাসোজ্জল মুখশ্রীর পানে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ মনে মনে আওড়ালো মেয়েটার চোখদুটো আসলেই সুন্দর। এতো সুন্দর দুটি চোখের অধিকারীনির জন্য সুনয়না নামটা হয়ত পৃথিবীতে এসেছিলো। মায়াবী চোখের অধিকার তুমি,আমার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে হেসে ফেললো। প্রেমে পরলে ম্যাচিউর পুরুষ ও বোকা বোকা কর্মকাণ্ড করে বসে!আর সেখানে তো বাচ্চা একটা মেয়ে! সে তো করবেই নিব্বিগিরি। কিছুক্ষণ পূর্বের কথা….. জিয়ান ফ্লাইট ক্যানসেল হওয়ায় সে মিটিং বোর্ড থেকে বের হয়ে চেয়ারে বসতেই তার ফোনে জাহিনের হোয়াটসঅ্যাপ একাউন্ট থেকে কল আসে৷ জিয়ান রিসিভ করে বলে,কি ব্রো হঠাৎ স্বরণ করার কারন?
“জাহিন বলল,তোমাকে কল দিতে কি আমার কারন লাগবে!
“তা লাগবেনা কিন্তু তুই তো দরকার ছাড়া কল করিস না৷
” আমি প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে চেহারা পরিবর্তন করে ফেলবো।
“কি বলছিস এসব! মাথা ঠিক আছে? নাকি ছাইপাস খেয়েছিস?
” আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আমি ওসব খাই না। মাঝে মাঝে সুখটান দেই এই যা বদঅভ্যেস।
“বাবার হাতে ঝাড় খেয়েছিস? এবার কাহিনি কি?
” ওসব বাদ দাও ওতো পুরনো কথা নতুন কাহিনি শোন।
“আচ্ছা শুনছি বল।
” তোমার বৌয়ের নাম কি?
“সুনয়না তালুকদার। কেন?
” বৌ তোমারে ঝাড়ে নাই?
“আর বলিস না বাচ্চা মানুষ মুড কখন কি হয় বোঝা মুশকিল। কিন্তু এসব কথা কেনো?
” তোমার বৌ আমাকে তুমি ভেবে সেই ঝাড়া ঝেড়েছে৷ আর গতকাল তো। যা হয়েছে এরপর তোমার কাছে ডিভোর্স চায়নি?
“জিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,তোর সাথে ওর দেখা হয়েছে? এরপর কি হলো?
” জাহিন সবটা খুলে বলল,
“জিয়ান হেসে বলে,তুই তাড়াতাড়ি চেহারা বদল কর৷ নয়ত দেখা যাবে বৌ বদল হয়ে যাবে৷
” জাহিন বলে,তুমি এই বাচ্চা মাইয়া বিয়া করবা আমি তো আমার কল্পনায় এ কল্পনা করি নাই।
“চুপ থাক ওই বাচ্চা মেয়ে তোর ভাবি। সম্মান দিয়া কথা বলবি।
” সম্মানিত বাচ্চা মেয়ে সুনয়না তালুকদার আমার ভাবি।
“জিয়ান হেসে বলে,আচ্ছা এখন রাখি। আগুনে একটু পানি ঢেলে আসি। নয়ত সে আগুনে আরেকজন আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে। জাহিনের কল কেটে নয়নাকে কল করে, যদিও পুরো কথা বলার সময় হয়নি। তবে অভিমানী নয়নাকে জিয়ানের কেনো যেনো খুব ভালো লাগছে।
” জিয়ান নয়নার হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পাঠালো… ” ভালোবাসকে ততক্ষণ ভালোবেসো না
যতক্ষণ ভালোবাসা তোমাকে ভালো না বাসে।
যখন ভালোবাসা তোমাকে ভালোবাসবে
তখন ভালোবাসাকে এতো ভালোবাসো,
তোমার ভালোবাসা যেনো অন্য কাউকে ভালোবাসতে না পারে। এরপর আরেকটা টেক্সট পাঠালো,ভালোবাসা ভালো থাকে ভালোবাসার যত্নে, ভালোবাসাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয়।
“নয়না প্রায় চারঘন্টা একটানা পড়লো৷
” জাহানারা বেগম নয়নার সামনে এক গ্লাস দুধ একটা সেদ্ধ ডিম চার পাঁচটা খেজুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷
“আম্মু আমি কিছুতেই খাবো না৷ এখন আমার একদম খাওয়ার মুড নেই।
” কেউ মুডের জন্য খায় না৷ খাবার খেতে হয় স্বাস্থ্যের জন্য।
“নয়না জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,আম্মু আমি খাবো তবে আমার একটা কথা রাখবে?
” আগে খেয়ে নাও তারপর বলো,
“নয়না খাবারটা শেষ করে বলে,আমি কিন্তু আবার বিয়ে করবো। এটা তোমাকে মানতেই হবে। কে একজন আসলো বিয়ে করলো এমন বিয়ে মানি না৷
” এসব কথা ভাবতে বলেছে কে?এসব কথা বাদ দিয়ে পড়ালেখা করো। আর একটা এক্সাম আছে এটা শেষ হলেই আমরা চট্রগ্রাম যাবো।
“আম্মু বিয়ে কিন্তু আরেকটা করবোই আমি। ওই ব্যাডার সাথে যাবে না কিছুতেই না।
” তোমার বিয়ে হয়ে গেছে আর তাছাড়া তুমি নিজেই শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল তোমাকে দ্রুত পাঠিয়ে দেবো তোমার বাসায়।
“এটাই আমার বাসা আমি এখানেই থাকবো।
” দেখা যাবে। এবার একটু ঘুমাও মাথা ঠান্ডা থাকবে৷ জাহানারা বেগম চলে যেতেই নয়না নিজের ফোন সুইচ অন করলো। ডাটা কানেক্টেড হতেই দ্যা হিটলার ড্রাইভার দিয়ে সেভ করা নাম্বার থেকে টেক্সট। নয়না মনোযোগ দিয়ে লেখাটা পড়লো। তারপর হাসির রিয়াকশন দিলো। এরপর লিখলো,ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসার খিচুড়ি রান্না করে ভালোবাসা দিয়ে ভালোবেসে খেয়ে নিন৷
“জিয়ান তখন এক্টিভ ছিলো,নয়নার রিপ্লাই দেখে বলে,ছেমড়ি আস্তা বিটলা। চারআনা মাথায় ষোলআনা দুষ্টমিতে ভর্তি। জিয়ান রিপ্লাই করলো,ও আমার ভালোবাসা, আসো তোমাকে ভালোবেসে খিচুড়ি রান্না করে ভালোবাসায় সিক্ত করে ভালোবেসে খেয়ে নেই।
” নয়না রাগী ইমোজি দিয়ে বলে,আজ নয়না গতকাল নীলাঞ্জনা এরপর কে হবে আপনার ভালোবাসা খিচুড়ি?
“জিয়ান হা হা রিয়েক্ট দিয়ে বলে,একবার আসি তোমাকে ভালোবেসে চাটনি বানিয়ে খেয়ে বুঝিয়ে দেবো এরপর মরন পর্যন্ত আমার ভালোবাসা তুমি।
” আইছে আমার রসের কথা নিয়ে! ওসব শুকনো কথায় নয়না গলে না৷
“তো নয়নার জন্য কি ভেজা কথা লাগবে?লিটল বেবি ওসব ভেজা কথা নিতে পারবে তো তুমি?
” আপনার শুকনো কথা ভেজা কথা সব একটা গ্লাসে ঢেলে খেয়ে নিন৷ কোনটাতেই নয়না গলবে না।
“আমি ছুঁয়ে দিলে পরে অকালেই যাবে ঝড়ে, গলে যাবে যে বরফ গলে না৷
” নয়না লিখলো,কারো একদিন হবেন কারো এক রাত হবেন এর বেশি কারো রুচি হবে না৷
“জিয়ান সেন্টি ইমোজি দিয়ে বলে,বুঝেছি বৌটাকে ছুঁয়ে দিয়ে বোঝাতে হবে একবার তার হলে আমি আর কারো হবো না।
“নয়না রিপ্লাই করলো,বেডা মানুষ এক্সও চায় নেক্সট ও চায় আবার প্রেজেন্ট ও ঠিক রাখে!এরপর সাথে সাথে ডাটা অফ করে দিলো। নয়না উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার লম্মা চুলগুলো চিরুনি করতে করতে বলে,হেই সুনয়না তুমি সিন্ড্রেলা। তোমার রাজকুমার অবশ্যই আসবে আর তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। শা’লার ড্রাইভার তুই সারাজীবন গলা বেচেই খাবি। তোর কপালে তো সিন্ড্রেলা জুটবে না৷
” জিয়ান নয়নার টেক্সটের দিকে তাকিয়ে হাসলো,মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ হলো,সে চাইছিলো,নয়না তাকে রেগে একবার বলুক মিস্টার প্লেন ড্রাইভার,আপনি একটুও ভালো না৷ শতশত রাগ অভিমান করুক তবুও কেনো যেনো নয়নার এই প্লেন ড্রাইভার ডাকটা ভিষণ মিস করছে জিয়ান। অথচ এই ডাকটা এক সময় সবচেয়ে বিরক্ত কর ছিলো! ভালোবাসলে প্রেমিকার বিরক্তিকর কথাও কত মধুর মনে হয়!
🌿লাবিব নীলাঞ্জনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে,নীলাঞ্জনা ভেবেছিলো এবার সবকিছু নরলাম হয়ে গেছে। লাবিব নিজেকর শুধরে নিয়েছে,এই কয়েকদিন এ বাড়ির সবাই তার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে।
“লাবীব নীলাঞ্জনার হাত আঁকড়ে ধরে বল,নীলু আমাদের ব্যবসায় বিশাল বড় এক লস হয়েছে। মনে হচ্ছে আমাদের এ বাসাটা বিক্রি করে দিতে হবে।
” নীলাঞ্জনা বলল,ব্যবসায় ভালো খারাপ উভয় সময় আসে৷ এসব কোন ব্যাপার না। আমরা সবাই মিলেমিশে ঠিক করে নেবো আবার।
“লাবিব মনে মনে রাগ হলো,সে ভেবেছিলো নীলাঞ্জনা বলবে,আমার বাসা থেকে সাহায্য আনবো। লাবীব আবার ডাকলো নীলু, তুমি চাইলে কিন্তু আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে এক তুড়িতে।
” কি বলো? কিভাবে?
“মাত্র পঁচিশ লাখ টাকা৷ তোমার বাবা চাচাদের হাতের ময়লা তুমি একবার তাদের সাথে কথা বলে দেখো।
“নীলাঞ্জনা নিজের হাত সরিয়ে আনলো,রাগ দেখিয়ে বলল,দরকার পরলে তোমার সাথে রাস্তায় থাকবো তবুও ওই বাড়ি থেকে কোন সাহায্য আনবো না।
” লাবিব উঠে বসলো,তার চেহারার রাগ স্পষ্ট, নিজের রাগ সংযাত করে বলল,দেখো তুমি ওই বাড়ির মেয়ে তুমি আমাদের বিপদে এতোটুকুও হেল্প করতে পারবে না৷
“নীলাঞ্জনা উঠে দাঁড়ালো,লাবিবের দিকে তাকিয়ে বলে,আমার দ্বারা এসব সম্ভব না। তুমি আর যা বলো আমি করবো কিন্তু কিছুতেই ওই বাসায় টাকার কথা বলতে পারবো না।
” তোর ওই বাসায় টাকার কথা বলতে হবে না,চল হোটেলে তোর শরীর বেচে টাকা কামাবো।।
🌿জাহিন মান্নাতের সামনে বসে আছে, মান্নাত মাথা নিচু করে বসে আছে৷
“জাহিন স্বান্ত স্বরে বলল,সত্যিটা তোমাকেই বলতে হবে? তাই চুপ করে না থেকে সত্য বলো।আর আমি চাইছি না তোমাকে এদেশে রাখতে, তোমার সব কাগজ পত্র ঠিক করতে দিয়েছি তোমাকে বাহিরে দেশে সেটেল্ড করে দিবো৷ সেখানে নিরাপদ থকতে পারবে৷ তার আগে বলে,আজান ছেলেটার সাথে তোমাদের পরিবারের কি সম্পর্ক? দেখো তুমি আমাদের সঠিক তথ্য না দিলে আমরা তোমাতে কোন রকম সাহায্য করতে পারবো না৷
” অন্তর বলল,দেখ জাহিন আমার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা আমাদের কাছ থেকে বড় কোন সত্যি কথা গোপন করছে। তুই আমাকে অনুমতি দিলে,ওকে আমি পুলিশের হেফাজতে দিয়ে আসবো। অন্তর কথা শেষ করার আগেই জাহিন বলল,এদিকে কেউ আসছে মনে হচ্ছে, এই মেয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে লুকিয়ে পরো।
“মান্নাত ওয়াশরুমে লুকিয়ে পরলো, সে এখন এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে! তার যে এই জঘন্য সত্যি প্রকাশ করার সাহস নেই!আচ্ছা এমন ভয়াবহ কালো অতীত কেনো আবার ফিরে আসছে! কেনো এই অধ্যায় জীবন থেকে মুছে যাচ্ছে না!
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩২

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩২
নয়না পড়ার টেবিলে বইখুলে বসে আছে কিন্তু একটা শব্দ ও পড়তে পাড়ছে না!তার মস্তিষ্ক জুড়ে জিয়ানের কথাগুলো বাসা বেঁধেছে। নয়না ফোন নিয়ে তুষিকে কল করলো।
“ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী পড়ার সময় আমাকে কল করলো!এটা তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!
” চুপ থাক আমার ভালো লাগছে না৷ পড়ায় মন বসছে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে তুষি।
“তুষি হেসে বলে,বান্ধবী আমার প্রেমে মজেছে। ওহো পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়েনা।
” তুষি র বাচ্চা ভুষি তোরে আমি..
“আরেহহ ইয়ার মজা করছি রেগে যাচ্ছিস কেনো?এটা বলো দুলাব্রোর সাথে সব কিছু ঠিকঠাক আছে?
” তুই কি এই বা’লের কথা ছাড়া অন্য কথা বলবি! নাহলে কল কেটে দিবো।
“বুঝলাম তোর মুড এহন গরম তেলের মত আমি যে কথাই বলবো পানির ছিটার মত তুই ছ্যাত করে উঠবি।
” আমাকে পড়তে হবে বল পড়ায় মনোযোগ কি করে আনবো?
“তুই মনে করো এই মূহুর্তে পড়ালেখা ছাড়া দুনিয়া কোন কিছু তোর জন্য ইম্পর্ট্যান্ট না। পৃথিবীতে শুধু তুই আর তোর পড়ালেখা ছাড়া কিছু নেই৷ এটা মাইন্ডে সেট কর আর মনের দরজায় তালা দিয়ে মেধা খাটিয়ে পড়।
” তুষী।
“নয়নার কন্ঠে কাতরতা, তুই ঠিক আছিস নয়না৷ কি হয়েছে আমাকে বল। এতো বিধ্বস্ত কেন শোনাচ্ছে তোর কন্ঠ?
” নয়না বলল,আমার জীবনটা এমন হলো কেন? মনে হচ্ছে সাজানো গোছানো জীবনা হঠাৎ সুনামি এসে ধ্বংস করে দিয়েছি।
“তুই একটু বেশিই ভাবছিস। দেখ বিয়ে ভাগ্যের ব্যাপার। তুই তো নিজেও জানতি না তোর এভাবে বিয়ে হবে বা এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে। কিন্তু যা হয়ছে সেটা ধরে বসে থাকলে তো হবে না। বর্তমানে প্রাক্তন থাকাটা স্বাভাবিক। বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে বিয়ের আগে রিলেশন করে। কারোটা সফল হয় কারোটা হয় না। দুলাব্রোর প্রাক্তন তোর আপন চাচাতো বোন।এটা তোন জন্য মেনে নেয়া সহজ না। তবে তুই আর দুলাব্রো ঠিক থাকলে অতীত তোদের সামনের জীবনে কোন বাঁধা হবে না।
” নয়না নিজের মনের কথা বলতে চেয়ে বলতে পারছে না। মানুষ নিজের দুঃখ, কষ্টের কথা কখনো প্রকাশ করতে পারে না। চাইলেও তা শব্দ হয়ে বের হয়না ভেতর থেকে৷ দুঃখগুলোকে চাপিয়ে রাখে হৃদয়ে। হৃদয় দুঃখের ভার না সইতে পেরে মনে মেঘ জমাই চোখে বর্ষণ হয়৷ এই দুঃখের কোন সঙ্গী নেই। নয়না ফোন কেটে আবার চেষ্টা করছে পড়ার। ফোনটা আবার সশব্দে বেজে উঠলো নয়না ফোনটা কানে ধরলে, ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো আই লাভ ইউ ডিয়ার রাঙা বৌ। এইটুকু মাথাতে এতো এতো টেনশন না নিয়ে পড়ালেখা করো। তোমার প্লেন ড্রাইভার শুধু তোমার।
জিয়ানের কথা শুনে নয়না অবাক হলো! একটা মানুষ এতো রুপ কিভাবে দেখায়!”আপনি আমার সাথে নাটক করছেন কেনো!নয়নার কথায় স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠেছে।
” জিয়ান মুচকি হেসে বলে, এসব কি বলো বেব!তোমার সাথে নাটক করবো কেন? তোমার সাথে তো সিনেমা করবো।
” একদম ফাউল কথা বলে মগজ খাবেন না৷
“ধুর বাবু আমি মগজ কেন খাবো! খেলে তো পুরো তুমিটাকে
খাবো।
” অসভ্য লোক।
“অনলি সুনয়নার জন্য আমি অসভ্য থাকতে চাই।
” এসব করে কি পান আপনি?
“আমি তো পান খাইনি বেবি।
” মেজাজ খারাপ করবেন না।
“কি যে বলো,পিচ্চি একটা ফুলের মত বৌ আমার তার মেজাজ খারাপ করার দুঃসাহস আমার আছে?
” মিস্টার চৌধুরী প্লিজ এমন দুমুখো আচরণ বন্ধ করুন৷ কেন আমাকে এভাবে ধোঁকা দিচ্ছেন?
“মিসেস চৌধুরী আজ এই মূহুর্তে থেকে ক্যাপ্টেন জিয়ান রেজা চৌধুরী শুধু আপনার ব্যাক্তিগত প্রপার্টি। আপনার হৃদয়ের দামে আমি নিজেকে বিক্রি করতে চাই আপনার কাছে৷
” নয়না খট করে কল কেটে দিয়ে মোবাইল সুইচড অফ করে পড়ায় মনোযোগ দিলো। বিরক্ত লাগছে এসব তার৷ বাসায় আরেক মেয়ে আর ফোনে প্রেম!
“জিয়ান মুচকি হেসে বলে,আগে কখনো ফ্লাইট ক্যানসেল হলে বিরক্ত লাগতো। আজ শান্তি লাগছে! ডিয়ার ওয়াইফি তুমি শুধু ক্যাপ্টেন জিয়ান রেজা চৌধুরীর। তোমার রাগকে ভালোবাসার ছোঁয়ায় গলিয়ে দেবো৷ যাস্ট ওয়েট এন্ড সি।
🌿নাজিম চৌধুরী জাহিনের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে মারলো।
” বাবা কি হচ্ছে এসব!
“তোমাকে আমি কতবার বলেছি আমাদের ব্যবসায় জয়েন করো? এখন আবার পক্ষে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি একা সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। এরপরেও তুমি কোন সাহস সিক্রেট গোয়েন্দা সংস্থায় যোগ দিয়েছো? প্রথমে র‍্যাপ হতে চাইলে আমি মানা করলাম আর এখন এসব?
” বাবা আমার কি কোন চয়েস থাকতে পারে না! রেজা তো পাইল ওকে কিছু বলছো না কেনো!
“রেজা আর তোমার জন্ম একদিন তবে গ্রহ নক্ষত্র সব ভিন্ন। নিজেকে রেজার সাথে তুলনা করো?
” আমি শুধু আমার প্যাশন বেছে নিয়েছে কোন ক্রাইম করিনি৷
“তোমার জন্য আমার ছেলের উপর বিন্দু পরিমাণ আঁচ আসলে আমি ভুলে যাবো তুমিও আমার সন্তান।
” এতে আমার কি দোষ বলো?আমরা জমজ এটা আমার অন্যায়! তাহলে লন্ডন যেয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে চেহারা বদল করে ফেলবো নিজের।
“তোমার এসব ফাউল কথা আমার সামনে চলবে না। সামনের সপ্তাহে মেহনুর আসবে ওর সাথে তোমার বিয়ে ফিক্সড করেছি। আমি আর কোন কথা শুনতে চাইনা।
” ভাইয়া যা করে তোমরা সব সময় সাপোর্ট করো তো আমার বেলায় কি সমস্যা!
“জিয়ান আজ পর্যন্ত একটা ভুল করেছে সেটা হলো প্রেম।এছাড়া ও কোন ভুল করে না৷ ভদ্রতা, সভ্যতা সব আছে ওর মধ্যে। আর তোমার মধ্যে কি আছে? রাস্তার ছেলেদের মত মারামারি, বুকখোলা শার্ট, মাঝে মাঝে হাতে সিগারেট ও দেখা যায়। তুমি তো এটাও ভুলে যাও তুমি চৌধুরী পরিবারের সন্তান!ছোট বেলা থেকে তোমার আর রেজার সেম চেহারার অনেক এডভান্টেজ নিয়েছো। এখন তুমি ছোট না৷ এসব গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে অফিস জয়েন করো৷ নাজিম সাথে নিজের রুমে চলে গেলেন।
” জাহিন মিতা বেগমের কাছে এসে বলে,এসবের মানে কি আম্মু!আমি কি ছোট বাচ্চা আমাকে যা বলবে তাই করতে হবে!
“ছোট বাচ্চা না তাইতো বিয়ে ঠিক করেছি৷ মেহনুর ভালো মেয়ে। তাই না বলার কোন অপশন নেই তোমার কাছে৷ আর যদি ভাবো বাহিরের দেশে যাবে৷ তোমার বাবা তোমার ভিসা সহ যাবতীয় সব কার্ড সিস করে দিয়েছে। বড় হয়েছো ম্যাচিউর হও৷
” ভাইয়া একটা টুনি মেয়েকে বিয়ে করলো সেটা ভুল না?
“তোমার ভাইয়া কি করলো সেটা না দেখে আজ পর্যন্ত তুমি কি কি অঘটন ঘটিয়েছো সে-সব দেখো।
” রাগে জাহিনের ইচ্ছে করছে, সব কিছু ভেঙে চুরমার করে ফেলতে৷ কিন্তু সে সাহস তার নেই আর সে শিক্ষা ও নেই৷ বাবা,মায়ের সাথে বেয়াদবি করার দুঃসাহস তার নেই৷ তাই নিজের রাগ সংবরণ করে রুমে চলে আসলো। এসেই বক্সিং ব্যাগে পাঞ্চ মারতে লাগলো।
🌿অনিকেত সায়না সামনাসামনি বসে আছে, সায়না অনিকেতের হাতের উপর হাত রেখে বলে,আমার কি মনে হয় জানেন৷ আমি শুধু আপনার।
“অনিকেত দ্রুত হাস সরিয়ে নিয়ে বলে,দেখো তুমি আমার বন্ধুর বোন নয়ত ঠাটিয়ে দুটো চর মারতাম।তুমি আমার চেয়ে বেটার কাউকে ডিজার্ভ করো। আমি সাধারণ একজন মানুষ অতি সাধারণ। যার নিজের পিতৃ পরিচয় নেই। আমি আমার টাইট কাউকে বিয়ে করবো। যাকে বিয়ে করার জন্য আমার নিজেকে ছোট মনে হবে না৷
“আমাকে বিয়ে করলে আপনাকে ছোট কেন হতে হবে!
” কারন আমি অনাথ। তোমার বাসায় গেলে সবার আগে আমার বংশ পরিচয় জিজ্ঞেস করবে। আমি কোথায় পাবো বংশ পরিচয়?
“আমি বলবো, আমি আপনাকে ভালোবাসি এটাই আপনার পরিচয়।
” পাগলামো করো না। জীবন এতো সহজ না৷ সমাজে তোমাদের অনেক নাম ডাক নিজের সম্মান আমার জন্য নষ্ট করবে না।
“আপনি আমাকে বিয়ে করবেন এটাই শেষ কথা করবেন মানে করতেই হবে৷ ভুলে গেছেন আপনার ঠোঁট কিন্তু আমি স্পর্শ করে ফেলেছি তাই আপনি আর কোন মেয়ের হতে পারবেন না। আর একবার না না করলে,পুরো শরীরে টাচ করে দেবো কিন্তু তখন বৌ পাবেন আর এজন্মে!
” অনিকেত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সায়নার দিকে,মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি কিন্তু আমার মত ছেলের কাছে ওর বাবা মা কিছুতেই দিবে না৷ সমাজে বংশ পরিচয় না লাগলেও পিতৃ পরিচয় লাগে। আমার কাছে তো কোনটাই নেই! সেবর যখন মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কত ছোট করেছিল তারা আমাকে। আচ্ছা অনাথ হওয়াটা কি দোষের? আমি জানিনা কে আমাকে জন্ম দিয়েছে! সেখানে আমার দোষটা কোথায়?
“সায়না তুরি বাজিয়ে বলে,এই যে মিস্টার কোন ভাবনার সাগরে ডুবে গেলেন? কোন মেয়ে হলে কিন্তু তাকে আমি মে’রেই ফেলবো৷
#চলবে।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩১

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩১
নয়না বাসায় এসে ফাইল রেখে সোফায় বসলো৷
“জাহানারা বেগম এসে বলে,কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে খুঁজতে তোমার চাচ্চু বের হয়েছে। আর কিছু সময় দেরি করলে,তোমার বাবা তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে ফেলতো৷ কথা বলছো না কেন!
” শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলাম।”
“মানে!”
“শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলাম বললাম তো আম্মু৷ সেই কবে শ্বশুর বাড়ি দেখেছি তারপর কতদিন দেখি না এরজন্য দেখতে গিয়েছিলাম শ্বশুর বাড়ি কেমন৷”
“নয়না তোর কাছে এসব হাসি তামাশা মনে হচ্ছে! ওনারা কি ভাবলো তুই এভাবে চলে গেলি? তারা নিশ্চয়ই ভাবছে মেয়ে বয়সের চেয়ে বেশি পাঁকা!”
“নীলাঞ্জনা নয়নার দিকে ঠান্ডা একগ্লাস জুস বাড়িয়ে দিয়ে বলে,তুই এখনো ছেলে মানুষি ছাড়তে পারলি না! যদিও আন্টি খুব মিশুক মানুষ তবুও তোর এভাবে ওই বাড়িতে যাওয়া উচিৎ হয়নি নয়না।”
“আমার শ্বশুর বাড়ি আমার ইচ্ছে আমি কিভাবে যাবো না যাবো সেটা আমার ব্যাক্তিগত বিষয়।”

জাহানারা বেগম রেগে বলেন,”এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো। বেয়াদব মেয়ে বড়দের মুখে মুখে কথা বলে! যা নিজের রুমে যেয়ে ড্রেস চেঞ্জ কর৷ আর তিনটা এক্সাম বাকি তো? দুই তারিখ এক্সাম শেষ এরপর তোকে পার্মানেন্ট ভাবে রেখে আসবো ওই বাড়িতে৷ ভেবেছিলাম আরো কিছুদিন রাখবো নিজের কাছে কিন্তু তুই তো পাগল হয়ে গেছিস শ্বশুর বাড়ির জন্য। তোকে সেখানেই রেখে আসবো । তখন বুঝবি শ্বশুর বাড়ি কত মধুর৷”
“নয়না ধুপধাপ করে পা ফেলে রুমে চলে এসে দ্রিম করে দরজা বন্ধ করে দিলো৷ রাগে ইচ্ছে করছে লম্বা চুলগুলো কেটে কুটিকুটি করে ফেলতে৷ আলমারি থেকে গতকালকের গিফটগুলো বের করলো৷ দ্রুত তা আনবক্সিং করতে শুরু করলো। অনেকগুলো হেয়ার প্রডাক্ট, মেকাপ প্রডাক্ট, চকোলেট,পার্পল কালারের একটা সুন্দর গাউন । আন নূর পেজ থেকে এসব এসেছে কিন্তু পাঠিয়েছে কে!সব কিছু তন্নতন্ন করে ঘাটতে লাগলো, একটা কার্ড পেলো সেখানে লেখা, রাঙা বৌ রাঙিয়ে দিও আমার শূন্য হৃদয়। অপর পাশে লেখা,
“আমার একটা আকাশ হোক, সেই আকাশ জুড়ে তোমার ভালোবাসার চাঁদ উঠুক,
আমার একটা নদী হোক,
সে নদীতে তোমার ভালোবাসার ঢেউ হোক।
আমার একটা সন্ধ্যা হোক,সেই সন্ধ্যা জুড়ে তোমায় নিয়ে গল্প হোক৷”

“নয়না কার্ডটি ছিড়ে চার টুকরো করে ফেললো৷ মোবাইল নিয়ে সার্চ করে পেজটা খুঁজে বের করলো, দুদিন আগের পোস্টে নয়নার চোখ আটকে গেলো,সূদুর কানাডা থেকে এক ভাইয়া তার প্রিয়তমার রাগ ভাঙ্গাতে এই সারপ্রাইজ গিফটটা পাঠিয়েছে। আপুটি কত ভাগ্যবতী৷ এভাবেই তাদের ভালোবাসা যুগ যুগ বেঁচে থাকুক।
” নয়না পেজের ইনবক্সে নক করলো, আমার একটা ইনফরমেশন দরকার ছিলো৷ কাইন্ডলি আমাকে একটৃু হেল্প করুন৷
“নয়না বুঝতে পারছে না৷ জিয়ান কেন তার সাথে এরকম দুমুখো আচরণ করছে? মোবাইল অন করার সাথে সাথে অগণিত টেক্সট আর মিসডকলের নোটিফিকেশন এসেছে জিয়ানের কন্টাক্ট থেকে৷
নয়নার মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেলো,জানালার উড়তে থাকা পর্দার দিকে তাকিয়ে বলে,ছেলে মানুষ কি কখনো এক নারীতে আসক্ত হতে পারে না! এই উড়তে থাকা পর্দার মত তারাও কি উড়তে থাকে এক নারী থেকে আরেক নারীর মনে?
” জিয়ান তৈরি হচ্ছিলো ফ্লাইটের জন্য। ফার্স্ট ক্যাপ্টেন সে। সব কিছু পরিদর্শন করে সবে মাত্র জুসসস মুখে দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে নয়নাকে এক্টিভ দেখা যাচ্ছে৷ মনটা হটাৎ ফুরফুরে হয়ে গেলো জিয়ানের। সাথে সাথে টেক্সট করলো,হেই লিটল প্রিন্সেস।
“নয়না টেক্সটের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো৷ একটু পরেই নয়নার ফোনটা বেজে উঠলো৷ রিসিভ করে কানের ধরতেই ওপাশ থেকে বলল, প্লিজ এই মুহূর্তে ঝগড়া করো না৷ জিয়ানের কন্ঠে করুনার স্বর।
“আপনার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই আমার৷”
” করুনা করে হলেও একবার ভিডিও কল করো৷ আমি তোমাকে একটা বার দেখতে চাই কতগুলো দিন তোমাকে দেখি না৷ তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় হৃদয় মরুভূমি হয়ে আছে!”

নয়না তাচ্ছিল্য হেসে বলে,”এমন ভাবে বলছেন যেনো আমাদের শত জনমের প্রেম! আপনার মিথ্যে কথায় আমার মন ভিজবে না৷ ফোন রাখুন আর কখনো আমাকে কল করবেন না৷ আমার দেখা জঘন্য পুরুষ আপনি। ঘৃণা করি আপনাকে।”
“আর দশ মিনিট পরে আমার ফ্লাইট দোয়া করে এ জীবনে তোমাকে যেনো এই জঘন্য পুরুষের মুখদর্শন করতে না হয়।”

নয়না নিম্ন স্বরে বলে,
“তোমার সাথে কথা না বলতে পারার যন্ত্রণায় আমার তীব্র জ্বর আসুক, তবুও তুমি এসো না আর কথা নিয়ে।
যে কথার আঘাতে হৃদয় হত্যা করেছো, সে কথার মোহ আমায় আর না টানুক।”

জিয়ান চুপ করে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
” কোন স্মৃতি, কোন কথা, বা কোন লুকোনো অনুভূতি তুমি।
আমার নিশ্বাস , আমার বিশ্বাস আমার চিন্তা জুড়ে তোমার বিচরণ।
আমার দৃষ্টি সিমানার আড়ালে থেকেও
হৃদয়ের সবচেয়ে কাছে তুমি!”

লাইন বিচ্ছিন্ন হলো৷ নয়না সেভাবেই বসে আছে৷ বারবার জিয়ানের কথাগুলো তার কানে বাড়ি খাচ্ছে। একটা মানুষ ক্ষনে ক্ষনে এভাবে পরিবর্তন কি করে হতে পারে! অন্য নারীর সঙ্গ দিচ্ছে আবার আমাকেও প্রেমকাব্য শোনাচ্ছে! ভালোবাসা বোধহয় বইয়ের পাতায় হয়, বাস্তবে এর কোন অস্তিত্ব হয়ত নেই। আমরা ভালোবাসা বলতে শুধু শূন্যতা পাই!

🌿

অন্তর হেসেই যাচ্ছে। তার হাসি কিছুতেই থামছে না।
“তুই তোর দাঁত ঠিক রাখতে চাইলে হাসি বন্ধ কর শা’লা। আমি এই মুখ কই লুকাবো!”
“কই আর লুকাবি রাস্তায় কোন মেয়ে পাস নাকি দেখ তার আঁচলের তলায় মুখটা লুকিয়ে ফেল৷”
“সুমুন্দির পুত উল্টোপাল্টা বকলে,তোরে এহন আরব আলির ডোবার পানি খাওয়াবো।”
“অন্তর জাহিনের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে সরে বলে, আমি তোর সুমুন্দি এহনো বিয়ে করে নাই তাই তোর সুমুন্দির কোন পুত নাই।
“এহন আমি কেম্নে ভাবির সামনে দাঁড়াবো?”
“আমার কথা শোন,মনোযোগ দিয়া শুনবি কইলাম, সোজা বসুন্ধরা সিটিতে যা ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি কিন, পারফিউম তো আছেই, ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে গোসল করবি, এরপর পাঞ্জাবি পরে,পারফিউম মাখবি পুরা শরীরে, এপর চুলগুলো স্পাইক করে সোজা ভাবির সামনে দাঁড়াবি তারপর কবি হেই লিটল ভাবি আমি আপনার হ্যাসবেন্ডের মত দেখতে কিন্তু আপনার হ্যাসবেন্ড না৷”
” চুপ কর শা’লা৷ ওই মাইয়া এমনেই আমারে ভাই মনে কইরা এতোদিনে মনে হয় ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করে তার পিন্ডি চটকে ফেলছে। মেয়ে যেই ডেঞ্জারাস!”
“হ সহজ সরল রেজা ভাইয়ের ডেঞ্জারাস বৌ। আমি ভাবতাছি অন্য কথা।”
“ভাবাভাবি বাদ দিয়া সোজাসাপটা ক।”
” বিয়ের পর তোরা এক বাসায় থাকিস না। তোদের কন্ঠ, শরীরের গঠন সব সেম টু সেম৷ দেহা যাইবো বৌ বদল হইয়া গেছে।”
“জাহিন অন্তরের কলার চেপে বলে,তুই এইসব ফাউল চিন্তা করলি ক্যান এহন তোরে আমি চাটনি বানিয়ে খিচুড়ি দিয়া খাবো।”
” তুই আমারে ছাড় চল আমরা একটা রেস্টুরেন্টে থেকে খিচুড়ি খেয়ে আসি৷ আর কেসটার তদন্তের কাজও শুরু করতে হবে।”
“হুম আমাদের হাতে এখন প্রমান নেই সবার আগে প্রমান সংগ্রহ করতে হবে।”

🌿
নীলাঞ্জনা বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করছে৷ মনে মনে বলে,আমি আসলে কারো ভালোবাসা ডিজার্ভ করি না৷
এমন সময় জাহানারা বেগম এসে বলে,নীলু তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ি এসেছেন ড্রয়িং রুমে আয় তো।
” মাহবুব তালুকদার, মিজান তালুকদার এক সোফায় তার ঠিক সামনের সোফায় সৈকত সাহেব ও শিল্পী বেগম বসে আছেন৷
সৈকত সাহেব কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “আজকালকার ছেলে মেয়েরা একটু কিছু হলেই ডিভোর্স পর্যন্ত চলে আসে!এরা সম্পর্ক বোঝেই না৷”
মাহবুব তালুকদার গম্ভীর কন্ঠে বলল,”আমরা আমাদের মেয়েকে আর আপনাদের বাসায় পাঠাবো না৷ আমাদের মেয়ে ভুল করেছে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে আমরা এতেই খুশি।”
“বেয়াই সাহেব এটা কোন কথা হলো! বিবাহিতা মেয়ে। সে আপনার বাড়ির মেয়ে আমার বাড়ির সম্মান৷ একটাই ছেলে আমাদের। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে মেয়েকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন৷”
“আমার মেয়ে যখন ফিরে এসেছে আপনাদের কাছে আর ফিরবে না৷”

নীলাঞ্জনা হুট করে এসেই বলে,”আমি যাবো আপনাদের সাথে। এই কয়দিনে আমি বুঝে গেছি বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি ছাড়া আর কোন স্থান নেই। আপনারা বসুন আমি রেডি হয়ে আসছি।”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩০

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩০
এক্সাম শেষ করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে নয়না৷ প্রখর রোদের তাপ মনে হচ্ছে ঝলসে দিতে চাইছে প্রকৃতিকে। নয়না গেটের বাহিরে এসে একটা স্ট্রবেরী কোন আইসক্রিম কিনে খেতে ব্যস্ত৷ আর মাত্র তিনটা এক্সাম বাকি। নয়না আইসক্রিম খেতে খেতে ভাবতে লাগলো। দু’টো মানুষ একি সময় দুই প্রান্তে কি করে থাকতে পারে? আমার স্বপ্ন সত্যি নাকি আমার বাস্তবতা? যদি ভিন্ন মানুষ হয়ে থাকে তাহলে কন্ঠ কিভাবে এক হয়! আমি জানিনা কেন আপনি আমার সাথে মাইন্ড গেমস খেলছেন! এসব করে কি লাভ হচ্ছে আপনার? নয়না গাড়ি আসার আগেই রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসলো৷ উদ্দেশ্য চৌধুরী বাড়ি। মনে মনে বলে,আপনার সত্যি আমি উদঘাটন করেই ছাড়বো৷ নয়না গেটের সামনে এসে নামলো৷ ব্যাগ থেকে ভাড়া পরিশোধ করে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। দারোয়ান এক মিনিটের জন্য ও নড়ছে না! তাকে তো যে কোন উপায়ে ঢুকতে হবেই! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দারোয়ান সরলো, নয়না টুপ করে ভেতরে ঢুকে পরলো আস্তে আস্তে মেইন দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাত দিতেই বুঝে গেলো দরজা খোলা নয়না ভেতরে ঢুকলো।
হঠাৎ মুখোমুখি হলো এক সার্ভেন্টের৷ নয়নাকে দেখে বলে,”বৌমনি আপনি!বড় ম্যাডাম তো আজ বাসায় নেই৷”
“নয়না নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,কখন আসবে?”
” সে বিষয়ে আমরা কিছু জানিনা৷”
“আচ্ছা আমি রুমে যেয়ে কল করে জিজ্ঞেস করে নেবো৷”
” আপনার জন্য কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কিছু দেবো?”
“লেমনজুস।” বলেই নয়না দ্রুত পায়ে জিয়ানের রুমে চলে আসলো। রুমটা দেখে মনে হচ্ছে এখানে কেউ ছিলো৷ ভালো ভাবে পরখ করতেই সেখানে মেয়েদের ওড়না আবিস্কার করলো, নয়নার ছোট হৃদয়টা মুচড়ে উঠলো। চোখের জল মুছে নিলে হাতের উল্টো পিঠে।হঠাৎ খেয়াল করলো ওয়াশরুম থেকে কেউ বের হচ্ছে। নয়না দ্রুত পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পরলো। নয়না তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে খেয়াল করেনি পর্দা সাদা কালার ওপাশ থেকে খেয়াল করলেই বোঝা যায় এখানে কেউ আছে।
“নিজের হ্যসবেন্ডের রুমে অন্য একজন নারীর উপস্থিতি নয়নার ছোট হৃদয়টাকে গুড়িয়ে দিচ্ছে৷ মানুষটা তাকে কত যত্ন করেই না ঠকাচ্ছে! আমার সাথে একসপ্তাহ কথা না বলায় যে মানুষটার সামান্য হাঁচি পর্যন্ত আসেনি, সে আমাকে ভালোবাসে এটা কিভাবে মেনে নিলাম আমি! আমি আসলেই বোকা, বোকাদের মানুষ সহজে ঠকাতে পারে, টুপটুপ করে ঝরতে থাকলে নীল নদের পানি।
🌿

মান্নাত খুব ক্লান্ত। রাতের শেষ প্রহরে জাহিন থাকে ফেরেশতা রুপে উদ্ধার করেছে বলতে গেলে। মাথা চেপে ধরে কান্না করছে মান্নাত। জীবন তার সাথে এ’কোন খেলা খেলছে!
গত রাত….
রাত যত গভীর হচ্ছিলো মান্নাতের মনে হচ্ছিলো মৃত্যু ততই নিকটে। লোকগুলো ঘরের কোনা কোনা খুঁজে বেরাচ্ছে ইঁদুরগুলো পা কেটে রক্ত বের করে ফেলছে!
হঠাৎ বাহিরে শোরগোল শোনা গেলো। বাসার ভেতরের লোকগুলোও হয়ত বের হয়ে যাচ্ছে। কোন শব্দ আসছে না কানে। সাহস করে নয়না বেরিয়ে আসলো। ধীর পায়ে দরজার কাছে এসে চিৎকার করলো বাঁচাও কেউ আছো৷
পেছন থেকে কেউ তার মুখ চেপে ধরলো। ছুড়ি বসিয়ে দিলো কাঁধ বরাবর। গল গল করে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো৷ মান্নাতের বেঁচে থাকার শেষ আশা টুকুও ফুরিয়ে এলো বুঝি?হঠাৎ কেউ গর্জন করে বললো,কে রে তুই ধস্তাধস্তির আওয়াজ কানে আসছে৷ ধীরে ধীরে সে আওয়াজ বন্ধ হয়ে আসছে,ঢলে পরছে মান্নাত। মাটিতে পরার আগেই জাহিন তুলে নিলো কোলে। মোবাইলের টর্চের আলোয় চেহারা দেখে বেশ অবাক হলো। অন্তর বাসার ভেতর টর্চ জ্বালিয়ে ঘুরে এসে বলে,বাসায় কেউ নেই দেখে মনে হচ্ছে এখানে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে যেখানে আমরা চোরকে ছাড়িনা সেখানে এতো বড় ঘটনা কিভাবে সম্ভব!
এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে আগে মেয়েটাকে সুস্থ করতে হবে। মান্নাতকে বাসায় নিয়ে এসে জিয়ানের রুমে রাখলো।
অনিকেতকে কল করে ডাকলো, অনিকেত প্রাথমিক চিকিৎসা ও বেন্ডেজ করে দিয়ে গেলো৷ কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করলো। এরপর যে যার মত নিজেদের রুমে চলে গেছে৷ মান্নাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখ মেলে সামনে তাকাতেই সাদা পর্দার আড়ালে নারীমূর্তি দেখে বলে কে ওখানে?
‘নয়না বাহিরে এসে বলে,তোর জম। তোর সাহস কি করে হয় আমার হ্যসবেন্ডের রুমে আসার? আজকে হয় তোকে মারবো নয়তো ওই ছেমড়ারে মারবো।
” মান্নাত অবাক হয়ে বলে?রিলাক্স আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না? আপনি কে আর আপনার হ্যাসবেন্ডই বা কে?
“নয়না মোবাইল বের করে বলে,চোখ খুলে ভালো ভাবে দেখ এটা আমার হ্যাসবেন্ড।
” আপনার মাথা ঠিক আছে? এ আপনার হ্যাসবেন্ড কি করে হয়!ও তো আমার বয়ফ্রেন্ড।
“বয়ফ্রেন্ড! লজ্জা লাগে না বিবাহত ছেলের গলার ঝুলতে! আমি কি কম সুন্দরী? আমার মত সুন্দরী বৌ রেখে কিসের প্রেম? আজকে আমি তোকে মেরেই ফেলবো। বলেই মান্নাতের গলা টিপে ধরতে নিলো৷
” জাহিন এসে বলে,আপনি কে?
“নয়না সামনের দিকে ঘুরে বলে,আপনার যম।
” জাহিন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,তা মিস যম আপনি আমার বাসায় এসে আমার গেস্টকে কেনো আঘাত করছেন?
“নয়না নিজের রাগ সংযাত করতে না পেরে, জাহিনের দিকে পারফিউমের বোতল ছুড়ে মারতে লাগলো। আজকে আপনাকে মেরেই ফেলবো। আমাকে ঠকানো! এতো সাহস? সুনয়না তালুকদারকে ঠকাবে?
” জাহিন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বলে,মিন ধানিলঙ্কা আপনার নিশ্চিত কোথায়ও ভুল হচ্ছে ।
নয়না রুম থেকে বের হতে হতে বলে,আপনাকে আমি ডিভোর্স দেবো৷ আপনার নামে মেয়ে ঠকানোর মামলা করবো৷ নয়না গটগট করে বের হয়ে গেলো৷
“জাহিন মান্নাতকে বলল,স্যরি আমি বুঝতে পারছিনা এসব কি হচ্ছে। আপনি রেস্ট নিন আমি দেখছি। জাহিন নিচে এসে দেখে নয়না নেই।
” জাহিন সোফায় বসে ভাবছে কোন ভাবে এই মেয়ে আমার ভাবি নয়ত!না না এটা হতেই পারে না! ভাইয়া এমন বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করবে?
“সার্ভেন্ট ট্রেতে করে লেমনজুস নিয়ে কিচেন থেকে বের হলো।
” জাহিন বলল,লেমনজুস কার জন্য?
“বৌমনির জন্য।
” বৌমনি আবার কে?
“আপনার বড় ভাইয়ের বৌ। কিছুক্ষণ আগেই এসেছে।
” জাহিন অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেলো! এটাও কি সম্ভব! জাহিন জুসের গ্লাসটা নিয়ে ঠকঠক করে পান করে বলে,সে চলে গেছে। জাহিন অন্তরে কল করে,
“অন্তর রিসিভ করে কানে ধরতেই. ওপাশ থেকে জাহিন বলে,সুমুন্দি স্যাড গান লাগা জীবনের দ্বিতীয় ক্রাশ আমার নিজের ভাবি! এই দুঃখে বুড়িগঙ্গার কালো জলে স্নান কইরা আহি চল সুমুন্দি।
“অন্তর নিজের হাসি চেপে রেখে বলে,তাইলে এহন কোন গানডা বাজামু মামা, চাচা হেনা কোথায়? এই ভার্সন চলবে?প্রেমের সমাধি ভেঙ্গে মনের শিকল ছিড়ে ক্রাশ যায় উড়ে যায়।
” রাখ শা’লা তাত্তাড়ি বাইক নিয়া আয় বুড়িগঙ্গা কালা পানিতে ডুব দিয়া হৃদয়ের সুদ্ধি করণ করমু। ছিহহহ শেষ পর্যন্ত ভাবির উপরে ক্রাশ! এই চোখ আমি কেম্নে রাখমু! পেস্টিজ পাঞ্চার কইরা দিলো মাইয়াডায়। ধুর ভাবিজ্বি।
🌿
জিয়ানের আবেদন মঞ্জুর হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগলো। অবশেষে সে ছুটি পেলে পাঁচদিনের আগামী মাসের তিন তারিখ তার ফ্লাইট। কতবার যে কল করেছে নয়নাকে ফোন সুইচড অফ। মনে মনে কয় ছেমড়ির এমন রাগ! মনে হয় পাঁচফুট হাইটের দশফুট রাগ! এইবার আহি তোমারে খাঁচায় বন্দি কইরা রাখমু রাঙা বৌ। গুন গুন করছে, সোনা বৌ শুনছ নি গো,সোনা বৌ শুনছোনি, নিতে আইলে নাইওর যাইবা নি? জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে আজ কানাডার শহর জুড়ে চকচকে রোদ৷ এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না৷ জিয়ান যেখানে থাকে বেশিরভাগ সময় এখানটাতে তুষারপাত হয়। ছুটি মঞ্জুর হওয়ায় মনের মধ্যে কেমন একটা দোল দিচ্ছে জিয়ানের। মনে মনে বলে,ওরে মন কথা শোন,এতো দ্রুত গতিতে এগোস না। হোচট খেলে ভেঙে পড়বি এবার কিন্তু আর গড়তেই পারবি না নিজেকে।
🌿
অনিকেতের সাথে সায়নার সেদিনের পর আর কোন যোগাযোগ হয়নি৷ আজ সকালে হঠাৎ সায়না উপস্থিত সোজা অনিকেতের হসপিটালে৷
“অনিকেতে গম্ভীর কন্ঠে বলে,আপনি আবার এখানে?
” আপনি কোন কচুর হার্ট সার্জন? একটা মেয়ে আপনার ঠোঁটের দফারফা করে দিলো,এরপরেও আপনার হার্ট সুস্থ! এমন পঁচা হার্ট কোন মানুষের থাকতে পারে?”
“অনিকেত ভিষণ লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ করলো না, আপনার কি লজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি? কোন যুগে আসলাম আমি? কোথায় ছেলেরা মেয়েদের ইভটিজিং করতো আর এখন মেয়েরা ছেলেদের ইভটিজিং করে৷”
“কাজি অফিসে চলুন আর সমস্যার সমাধান করে ফেলুন৷ রোজ রোজ ইভটিজিং সহ্য করার চেয়ে বিয়ে করা বেটার অপশন কিন্তু। মিস্টার হার্ট সার্জন আপনি রাজি থাকলে আমি হসপিটালে কাজি নিয়ে হাজির হতেও রাজি আছি৷”
” চুপ করুন আমার সহকর্মীরা শুনে ফেলবে।”
“চুপ করবো এক শর্তে”
” কিসের শর্ত বলে,বিদেয় হোন।”
“বিকেল পাঁচটায় বকুলতলা কফিশপে দেখা করবেন।”
” পাঁচটায় আমার চেম্বার আছে।”
“তাহলে রাত ন’টায়।”
” আচ্ছা ঠিক আছে পাঁচটায় আসবো। এবার যান৷”
“আসার সময় ফুল নিয়ে আসবেন সাথে রেশমি কাচের চুড়ি ও হ্যা একটা ডাক্তারি বাজে রাইটিংয়ের চিরকুট। না আনলে কিন্তু সবার সামনেই কিসটিস করে বসবো।”
#চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৭ (পরিসমাপ্তি)
৩০.
এপ্রিলের তপ্ত দুপুরে আমি তখন ফ্যান না ছেড়ে গায়ে কাঁথা দিয়ে শুয়ে আছি। হালকা আওয়াজে দাদুভাই আমার ঘরে ঢুকলেন। আমি কোনোমতে চোখ খুলে তাকে দেখলাম। কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম না। আমি ঘরবন্দী দীর্ঘ এক মাস যাবত। এই এক মাসে ঘটে গেছে অনেককিছু। আমার টিমমেট বাবা হয়ে উঠলেন আচমকা আমার অজানা শত্রু। তিনি শুদ্ধর কথা তো সহ্যই করতে পারলেন না পরিবর্তে তিনি আমাকে আটকে ফেললেন এই চার দেয়ালের মাঝে। কেউ একটু টু শব্দ করার সাহস পেলো না। আমি দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে উঠলাম। ওজন কমেছে নয় কেজি। আমাকে দেখা যাচ্ছে কঙ্কালসার। কে কখন খাইয়ে দিচ্ছে, কি দিয়ে খাওয়াচ্ছে, গোসলের পর কোন কাপড় পরাচ্ছে আমি কিচ্ছু বলতে পারছি না। পাগল বনে যাচ্ছি।
দাদুভাই এসে পাশে বসলেন। গায়ের উপর থেকে কাঁথাখান সরিয়ে আমার দিকে দু’মিনিট চেয়ে রইলেন। তার চোখ থেকে দু’ফোটা পানি পরলো। আমার গায়ের জ্বর চেক করে ভাঙা আওয়াজে বললেন,

‘আমার প্রিয় দাদুভাই, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।’

আমি অবুঝ নয়নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে শুধালাম,

‘আমাকে এই জেলখানা থেকে বের করবে, দাদুভাই?’

দাদুভাইয়ের চোখ থেকে আরো দুই ফোঁটা পানি পরলো। তিনি ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে বললেন,

‘করবো, সোনা। তুমি উঠো। আজ আমি তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবো। তারপর তোমার ভালোবাসার মানুষের হাতে তুলে দেবো।’

দাদুভাই আমাকে ধরে উঠালেন। আমি তার কাধে মাথা ঠেস দিয়ে বসলাম। আমার গায়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকার মতোও তখন বিন্দুমাত্র শক্তি নেই।

‘বাবা আমাকে আর ভালোবাসে না কেনো, দাদুভাই? বাবা এমন কেনো করলো?’

‘আমার সোনা দাদুভাই, তোমার বাবা এই পৃথিবীর সবথেকে বেশি তোমাকে ভালোবাসে। তোমার এই অবস্থা তোমার বাবাকেও অসুস্থ করে তুলেছে। বাড়িটা মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। সে কাজে যায় না দীর্ঘদিন। তুমি ঘুমিয়ে থাকলে তোমার বাবা সারারাত তোমার পাশে বসে থেকে পাগলের মতো শুধু বলে যায় ‘সরি আম্মু’।’

আমার শরীর’টা কেঁপে উঠলো। অগ্নিপিণ্ডের ন্যায় জ্বলন্ত চোখ থেকে পানি ঝরলো অঝোরে। দাদুভাই আমাকে খাবার খাইয়ে দিলেন। আমি বাধ্য মেয়ের মতো খেলাম। খাওয়ার পর আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। এরপর বললেন,

‘সন্ধ্যার পর শুদ্ধ আসবে। তোমার ব্যাগপত্র আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। তুমি ওর সাথে চলে যেয়ো। কি কি নিবে বলো?’

এই মুহূর্তে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কোনো কথা বলতে পারলাম না। কেবল নির্বোধের মতো চেয়ে রইলাম। দাদুভাই নিজেই ব্যাগ গুছাতে লাগলেন। উল্টেপাল্টে কি তুললেন কে জানে!

এরপর যখন সন্ধ্যে নামলো গেটের বাইরে এসে দেখলাম শুদ্ধ দাঁড়িয়ে। দাদুভাই আমার সাথে আমার ব্যাগ এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। শুদ্ধ শুকিয়েছেন। দাড়ি বড় হয়েছে আরো অনেকটা। তার গায়ের পাঞ্জাবি এলোমেলো। উদভ্রান্ত চোখের রক্তিম দৃষ্টি। দাদুভাই আমাকে ধরে ধরে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,

‘সুখী হও, দাদুভাই। বাবাকে ভুল বুঝো না। তোমার বাবাই শুদ্ধকে ডেকেছেন। তোমাকে শুদ্ধর কাছে তুলে দিচ্ছেন।’

আমার পা দুটো থমকে দাঁড়ালো। আমি পেছন ঘুরে আমার চিরচেনা বাড়িটার দিকে চাইলাম। এই বাড়িতে আমি আর কক্ষনো ফিরবো না। ও বাড়ি এখন আমার জন্য অস্বস্থিকর! দমবন্ধকর! আমি দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার ঘরের বেলকনিতে। তার চোখ ভেজা তা আমি দূর থেকে বুঝতে পারলাম। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

দাদু শুদ্ধর কাছে কাঁপা হাতে ব্যাগ’টা ধরিয়ে দিলেন। এ বাড়ির এতো আদরের মেয়েকে যে কখনো এমন ভাবে বিদায় দিতে হবে তা কে জানতো? দাদুভাই কি জানতো তার আদরের নাতনি’টা সবার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে? তার পরিবার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? তার দুটো কলিজার টুকরোর মধ্যে একজনকে সে কীভাবে বাছাই করতো তার প্রাণপ্রিয় নাতনির জন্য? কীভাবে সে এই নিকৃষ্ট গর্হিত কাজটি করতো? সেই নাতনি যখন আবার অন্য কাউকে মন দিয়ে বসেছে? এ যে ঘোর বিপত্তি! তার থেকে এই ভালো না পছন্দের মানুষের সাথে বহুদূর গিয়ে ভালো থাকুক!তবুও তো তার নাতি দুটোর চোখের সামনে থেকে আড়াল হবে। তাদের শূন্যতা পাবে কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণা পাবে না।

৩১.
ভোরের রাঙা আলোয় পূব দিকের আকাশ’টা ছেয়েছে। তরু এখন ঘুমোতে যাবে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে আড়মোড়া ভাঙলো। অদূরে মস্ত বড় সবুজ পাহাড়ের মাথায় সূর্য সিংহাসন গেড়ে বসেছে। তরুর বাবা তরুকে ডেকে উঠলেন। ভোর ভোর উঠা তার অভ্যাস। তরু বললো,

‘জি বাবা।’

‘নামাজ পড়েছো, আম্মা?’

‘হ্যাঁ বাবা।’

‘ঘুমিয়ে যাও। একটু পর অফিস আছে না?’

তরু মাথা দুলালো। ঘুমাতে গেলো না। বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হেমন্তের মাস! বাতাসে শীত শীত আরাম আবহাওয়া। তরু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। পার হয়ে গেছে চারটি হেমন্ত! তরু দূরে চেয়ে রইলো আনমনে। তারা থাকে শ্রীমঙ্গলে। তরুর চাকরি হয়েছে। চাকরির পোস্টিং সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই নিলো এই দূর্গম, অচেনা অঞ্চলে। বাবা-মা দুজনকে সাথে আনলো। বাবা লোক দেখানো অযুহাতে এলেন ‘ব্যবসার প্রসার করতে হবে।’ সিলেটে তাদের পারিবারিক ব্যবসার ছোট একটা ব্রাঞ্চ খোলা হলো। জীবনটা কেমন অন্যরকম দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌছালো! যা তরু কোনোদিন কল্পনাও করেনি। কখনো ভাবেনি শুদ্ধ’কে ছেড়ে ও বাঁচতে পারবে। তরু কি সত্যি বেঁচে আছে? হ্যাঁ, শ্বাস তো পরছে। কিন্তু তরুর মন’টা কি বেঁচে আছে?

তরু একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শূন্যে। সে সত্যি আর কখনো সে বাড়িতে ফিরেনি। ওই শহরে মা’র পিতৃ সম্পত্তি থেকে পাওয়া একটা ফ্ল্যাট ছিলো। তারা গিয়ে উঠলো সেখানে। তরু সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে এলো এই পাহাড়ে। দাদু মাসের পনেরো দিন নিজের বাড়িতে থাকতেন বাকি পনেরো দিন থাকতেন তরুর কাছে। ফ্ল্যাটে আনাগোনা ছিলো পরিবারের সবার। শুধু ছিলো না শুভ্র, ধ্রুবর।

তরু কতরাত নির্ঘুম কাটায়! কতদিন কাজে অন্যমনস্ক হয়ে পরে! কতসময় পুরোনো স্মৃতি মনে হয়ে আনমনে হেসে উঠে! কেমন আছে শুদ্ধ? কেমন আছে শুভ্রভাই, ধ্রুবভাই? তরুর নেত্র সজল হয়। মৃদু সরে আওড়ায়,

‘ক্ষমা করো, প্রকৃতি। আমি সার্থপর হতে পারিনি। আমার পুরুষ’টি আমাকে সার্থপর হতে দেয়নি।’

তরুর অশ্রু গাল বেয়ে ঠেকলো গলা অবধি। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠলো। সে রাতে তরুর হাত ধরে শুদ্ধ বললো,

‘ক্ষমা করো, অঙ্গনা। সবার মনে দুঃখ দিয়ে তোমাকে নিয়ে সুখী হতে চাইনা। আমার কাছে থাকা অবস্থায় তোমার দুঃখ আমি সইতে পারবো না। তুমি আমাকে ছাড়া দুঃখী হও তবুও সুখী হও। আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচো।’

তরুর চোখের তারায় তখনো কেবল বাবা, দাদুর কান্নারত মুখমণ্ডল। ও শুদ্ধর দিকে অবাক চোখে তাকালো। শুদ্ধ তখন তরুর কপালে তপ্ত চুমু খেলো। হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিলো। নষ্ট ঘড়ি! তরু তখনো বুঝে উঠছে না সারাদিন কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। শুধু জানে ওরা সবাই কষ্ট পাচ্ছে!

‘আমি তোমাকে নষ্ট সময় উপহার দিলাম। যেনো তোমার মূহুর্তগুলো কখনো নতুন করে নষ্ট না হয়।’

তরুর চোখ বেয়ে ধীর গতিতে অবিশ্রান্ত নীর পরলো। এক পা এগিয়ে শুদ্ধকে ঝাপটে ধরলো। শুদ্ধ এই প্রথমবার তরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ফাঁকা আওয়াজে তরু ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো। নাক টানার তীব্র শব্দ নিস্তব্ধ রাস্তায় ঝংকার তুললো। দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যপটের সাক্ষী হয়ে রইলেন দাদুভাই। শুদ্ধ ভাঙা আওয়াজে ধরা গলায় বললো,

‘তরু, তোমাকে কখনো বলা হয়নি…

এ বলে শুদ্ধ থামে সেকেন্ড কয়েক। এরপর তরুর মাথায় পরপর তিনবার চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘আমি তোমায় হেমন্তের মতো ভালোবাসি, প্রিয় তরু। কিংবা তার থেকেও অধিক, যার সাথে কোনোকিছুর তুলনা হয়না। তোমাকে আমার দুঃখ ছাড়া আর কোনো দুঃখ স্পর্শ করার স্পর্ধা না দেখাক।’

তরু মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে তাকালো। চোখের জলে হাত দুটোও ভিজে একাকার। সেই সন্ধ্যে কবে পার হয়ে গেছে তবুও কত জীবন্ত! শুদ্ধর সেই জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি কথাটা তরুর আজীবনের পুঞ্জি। তরু সেই স্মৃতিটুকু আঁকড়ে সারাজীবন অনায়াসে পার করতে পারবে। তরু কান্নার মাঝে মৃদু হাসলো। তার হাতে ধরা সেই ঘড়ি। ঘড়ি’টা বুকের মাঝে চেপে ধরে বিরবির করে আওড়ালো,

‘আপনার থেকে বড় কোনো দুঃখ নেই আমার।’

এরপর মিনিট খানেক পর এই হেমন্তের সকালের শূন্যে হাহাকার করে তরু খুব আক্ষেপ নিয়ে বললো,

‘আপনি আমার হেমন্তের নীড়। হাত বাড়ালেই যদি ছুঁতে পারতাম,
অথচ কী আশ্চর্য! সেই নীড়ে আমি কখনো এক দণ্ড জুড়োতে পারলাম না।’

‘সমাপ্ত’

হেমন্তের নীড় পর্ব-১৬

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৬
২৮.
আজকে সকালটা ভীষণ সুন্দর! সুন্দরের আঁচে দুপুরটাও ভারী চমৎকার হয়ে উঠলো। আমি ভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে দেখলাম শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! পনেরো দিন পর উনার সাথে আমার দেখা। তাও আবার শুদ্ধ নিজে এসেছে। এতো বড় স্বপ্ন আমি কীভাবে দেখছি? এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধকে একটা চিমটি কাটলাম। শুদ্ধ বেশ ভাবসাব নিয়ে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গম্ভীর মুখে বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার চিমটিতে সে খুব বিরক্ত চোখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ধমকে উঠলো,

‘এই মেয়ে, চিমটাচ্ছো কেনো?’

আমি উৎফুল্ল চোখে মুখে উত্তর দিলাম, ‘ভালো লাগছে তাই।’

উনি নিরস মুখে বিরস বদনে বললেন, ‘উঠো।’

আমার মুখটা পাঙ্গাস মাছের মতো হা হয়ে গেলো। আমি এবার নিজের হাতে চিমটি কেটে বললাম,

‘কি বললেন? আপনার বাইকে উঠবো? আমি?’

শুদ্ধ চু আকারে বিরক্তসূচক শব্দ করে বাইকে উঠে চাবি ঘুরালেন। হেলমেট পরতে পরতে আমার হাতে আরেকটা হেলমেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তাড়াতাড়ি উঠো। আজ তোমাকে আমি মার্ডার করবো।’

তার কথায় আমি কিছু মনে করলাম না। তার হাতে খুন হতে আমি রাজি। হেলমেট পরতে গিয়েও থেমে গেলাম। আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেললো। আহ্লাদী কণ্ঠে বললাম,

‘হেলমেট পরতে পারছি না। একটু পরিয়ে দেন।’

শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চাপলো কিন্তু আমি না দেখার ভান ধরলাম। উনি বললেন,

‘এই জনসম্মুখে চপেটাঘাত খেতে না চাইলে উঠে পরো, মেয়ে।’

‘আচ্ছা উঠছি। তার আগে বলুন আমাকে মার্ডার করতে আপনার কষ্ট হবে না?’

শুদ্ধ উত্তর দিতে চাইলো। কিন্তু তার উত্তর আমার আগে থেকেই জানা। নিশ্চয়ই ধমকে একটা ত্যাড়া জবাব দিবেন। বিধায় আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে মুখটাকে দুঃখী দুঃখী করে বলে উঠলাম,

‘থাক! আমি জানি আপনি অনেক কষ্ট পাবেন। তারপর দেখা যাবে আমাকে খুন করে আপনি নিজেও সুইসাইড করে বসেছেন। আপনার কষ্টে আমি কষ্টিত, শুদ্ধ সাহেব।’

বলে আমি হিহিহি করে দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। শুদ্ধর কাছে আমার হাসি সহ্য হলো না। তিনি রাম ধমক দিয়ে বললেন,

‘এই মেয়ে উঠো, তোমার যন্ত্রণায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। অসহ্য মেয়ে মানুষ একটা!’

আমার মুখটা ফাটা বেলুনের চুপসে গেলো। চুপসানো মুখে বললাম,

‘আমি আপনার সাথে যাবো না।’

শুদ্ধ বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগকে ধাতস্থ করে বললো, ‘ওকে, তবে যা বলার এখানেই বলছি।’

আমি চোরা চোখে আশেপাশে তাকালাম। আমরা দাঁড়িয়ে আছি একদম গেটের সামনে। পোলাপান আসছে যাচ্ছে আর আমাদের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। বেয়াদব ছেলে-মেয়ে। এছাড়াও আমি বুঝতে পেরেছি শুদ্ধ কি বলতে চায়। এইখানে ওসব কথা তিনি আমাকে ধমকে ধমকে বলার পর এই জনসম্মুখে আমার ইজ্জতের যে ফালুদা হবে তা ভেবেই আমার অস্থির লাগলো। আমি গাল ফুলিয়ে তার পেছনে উঠলাম। এই প্রথম আমি তার বাইকের পেছনে উঠলাম। তার কাধে হাত রাখলাম। আমার একবার ইচ্ছে করলো তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু এতো লোকের সামনে নিজেকে বেহায়া প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছে আমার হলো না। তাই জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখলাম।

আমার মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। লুকিং গ্লাসে শুদ্ধর দাড়িতে আচ্ছন্ন গালের একাংশ দেখে আমার বুকটা ধকধক করে উঠলো। কাধ থেকে হাত নামিয়ে একবার তার পেটে রাখলাম। তারপর আবার তার কাধে রাখলাম। শুদ্ধ বিরবির করলেন। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম,

‘আমার ভুল। আমার ভুল। আমি পাগল। কোন কুক্ষণে যে এই মেয়েকে সাজা দিতে এসেছিলাম। এখন আমি নিজেই ভুক্তভোগী।’

আমি হাসলাম নিঃশব্দে। কাধ থেকে হাতটা নামিয়ে আবার তার পেটে রাখলাম। শুদ্ধ দাঁত কিড়মিড় করে ডাকলেন,

‘তরু?’

আমি লজ্জা মাখানো হাসি দিয়ে মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘হু…।’

‘আমাকে হাতানো বন্ধ করবে নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো তোমায়?’

আমার লজ্জা মাখানো হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠলো আলাভোলা নাদান ফেস। আমি আনমনে তাকে বললাম,
‘জি?’

সে আর কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ি টান দিলো। আসার পথে হঠাৎ দেখতে পেলাম রাস্তার ওপাশে ধ্রুব ভাই দাঁড়িয়ে। আমার চোখজোড়া থমকে গেলো। ভালোমতো দেখে বুঝলাম ওটা ধ্রুব ভাই-ই। পাশে ধ্রুব ভাইয়ের বাইক। কিন্তু ধ্রুব ভাই কেনো এসেছেন? আমাকে নিতে?

আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। চোখ সরিয়ে লুকিং গ্লাসে শুদ্ধর দিকে চেয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখটা আমার ঝাপসা হয়ে উঠলো। হেলমেটের আড়ালে তা কেউ বুঝলো না।

,
তরু যদি বুঝতো সানগ্লাসের নিচে ওই অপেক্ষয়মান চোখদুটো ওর দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে! যদি বুঝতো ওর জন্য ধ্রুবর মন কাঁদে! যদি বুঝতে পারতো ওর জন্য ধ্রুবর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়! তরু’টা কেনো ধ্রুবর ক্ষেত্রে অবুঝ হলো? কি এমন ক্ষতি হতো ধ্রুবকে একটু ভালোবাসলে? কি বা এমন ক্ষতি হতো যদি ধ্রুব তরুকে না ভালোবাসতো? ধ্রুব বাইকে উঠে বসলো। ধুলো উড়িয়ে রোদ্রের উজ্জ্বল দ্যুতিকে সঙ্গে নিয়ে পথ চললো। সূয্যিমামা আরামসে চলন্ত ধ্রুবর মাথায় তাপ দিতে দিতে বলে গেলো,

‘অবহেলায় রাখা বাগ্মী শুদ্ধ’রা জিতে যায়, হেরে যাওয়ার যাতাকলে নিষ্পেষিত হয় অঘোষিত ধ্রুবরা।’

ধ্রুব উত্তর করে,

‘ওহে সূর্য, জ্ঞান দিও না। তোমার তাপের মাত্রা’টা কমাও। মস্তিষ্ক যে আর তোমার তাপ সহ্য করতে পারছে না। অযাচিত কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে পাছে কিন্তু দোষ দিতে পারবে না।’

২৯.
শুদ্ধর বাইকটা এসে থামলো একটা নির্জন জায়গায়। সামনে নদী। তীরে নৌকা বাধা। শহর থেকে খানিকটা দূরে। এতোটা পথ ঘুরিয়ে এখানে কেনো নিয়ে এলো শুদ্ধ তা আমার মাথায় ঢুকলো না। প্রশ্ন করে বসলাম,

‘আসলেই মার্ডার করবেন?’

শুদ্ধর মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। সে হিমশীতল গলায় প্রশ্ন করে,

‘তুমি আমার বাড়িতে গিয়েছিলে?’

জানতাম! আমি জানতাম এটাই জিজ্ঞেস করবে শুদ্ধ। তাই উত্তর আগেই রেডি করে রেখেছি,

‘হ্যাঁ, আপনার বাবা বললেন, মা আসো, আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরে যাও।’

সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি কাঁপিয়ে ধমক এলো। ধমকের শব্দে আমার কানের ভেতর টা পু পু শব্দ করে উঠলো।

‘থাপড়ে তোমার দাঁত-পাটি সব ফেলে দেবো, বেয়াদব মেয়ে। আরো বলেছো আমি তোমাকে বিয়ে করার নাম করে বিয়ে করিনি? আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি? এই মেয়ে, তোমার সাথে আমার বিয়ের সম্পর্ক?’

নিজেকে ধাতস্থ করে একটু সাহসী হয়ে উঠার চেষ্টা করে বললাম,

‘ভুল কি বলেছি? আপনি আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেননি? ওই রাতে আমাদের ঢাকায় এসে কাজী অফিসে যাওয়ার কথা ছিলো আর আপনি আমায় বাসায় পৌছে দিয়ে চলে গেলেন। তারপর আমাকে কথা দিলেন বছরের প্রথম দিন দেখা করবেন। তাও করেননি। ধোঁকা হলো না এটা?’

শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি চোখ মুখ কুচকে পিছিয়ে গেলাম এক পা। শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু নরম হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

‘তরু, তোমাকে আগেও বলেছি আমার পেছন ছাড়ো।’

‘আপনি আগে আমায় একবার ভালোবাসুন। একবার ভালোবাসি বলুন।’

সানগ্লাস খুলে এক চটকানা মেরে তা নদীর পানিতে ফেলে দিলেন উনি। আমি ভয় পেলাম না। আমি খুবই সাহসী মেয়ে। কিন্তু ভীত হলাম এই ভেবে যদি তিনি বলেন তিনি আমাকে ভালোবাসেন না। তখন? নদীর পানিতে তখন ধীর স্রোত। শীতল বাতাস। রোদ্রের মাঝে তা মন্দ লাগছে না। ওড়না বাতাসে উড়ছে। চুল উড়ে আমার চোখে মুখে ছড়িয়ে পরেছে। শুদ্ধ হঠাৎ এগিয়ে এলো। এসে আমার মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো প্রথমবারের মতোন। তার স্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম। সে বরফ শীতল কণ্ঠে মৃদু আওয়াজে বললো,

‘আমার নিকট এলে অযত্নে পুষ্প মরে যায়।’

আমি স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলাম। সূর্যের আলো নদীর পানিতে রূপোলী ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সেই ঝিলিকে চোখ রাখা দায়। শুদ্ধর নেমে যাওয়া হাতটা খপ করে ধরে বললাম,

‘তাতে কি? আমি পুষ্প নই। তরু! আবার নাহয় আরেকটা পুষ্প’র অবজ্ঞায় জন্ম হলো!’

শুদ্ধ আমার হাতে ধরা তার হাতটার দিকে অনিমেষ চেয়ে হাত’টা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। আমি ছাড়লাম না। আঁকড়ে ধরে কাতর গলায় বলে উঠলাম,

‘আমি একটু আপনার স্পর্শ চাই।’

শুদ্ধ তার মুখটা আমার কানের কাছে এগিয়ে আনলেন। তার ফিসফিসানি স্বর আমার কানে ফসফস ধ্বনি তুললো। সারা শরীর কেঁপে উঠলো তীব্র থেকে তীব্রতর।

‘আমার স্পর্শে তোমার অঙ্গ কলংকে ঝলসে যাবে। অশুদ্ধতা লেপ্টে যাবে রন্ধে।’

আমার চোখ জ্বলে উঠে। জ্বলন্ত চোখ দুটো তার চোখে নিবদ্ধ করে ধীর স্বরে বললাম,

‘অথচ আপনি শুদ্ধ।’

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-১৫

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৫
২৬.
শুদ্ধ নতুন বাসায় উঠেছে। বাবা-মাকে নিয়ে আসবে প্রথম মাসের স্যালারি’টা পেয়েই। ডাক্তার দেখিয়ে যদি শুদ্ধর সাথে থাকতে চায় থাকবে নাহলে গ্রামে চলে যাবে। শুদ্ধ ঠিক করেছে শুদ্ধ বিয়ে করে ফেলবে। একটা সুশ্রী, শান্ত-শিষ্ট মেয়ে দেখে শুদ্ধ ওর ঘরের রানী করে নিয়ে আসবে। তৎক্ষণাৎ শুদ্ধর ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। বললো,

‘বটে? তরুর মতো দস্যি মেয়ে ছাড়া শুদ্ধর চলবে?’

শুদ্ধ আপনমনে উত্তর করে, ‘খুব চলবে।’

‘চললে কেনো মেয়েটাকে দেখতে গেলি?’

‘দেখতে গিয়েছি। দেখা তো দেইনি।’

‘কথা দিয়ে তুই কথা রাখতে জানিস না।’

শুদ্ধ বারান্দার খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে শূন্যে দৃষ্টি রাখলো। মিনিট কতক চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বললো,

‘জানি। কিন্তু আমাকে চাইলে ওকে সব ছেড়ে আসতে হবে যে!’

‘ও আসতে পারলে তোর কি?’

‘আমি চাই না এতো আদরে বাদর হওয়া মেয়েটা শুধু শুদ্ধর আদর নিয়ে বাঁচুক।’

আর কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া গেলো না। একটা বাবুই পাখি বারান্দার ভেন্টিলেটরে বাসা করেছে। শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে বাবুই পাখির বাসা দেখলো। শুদ্ধ সেদিন পাঞ্জাবি পরেছিলো। ইচ্ছে ছিলো তরুর কথা রাখার। কিন্তু রমনায় গিয়ে দূর থেকে ল্যাভেন্ডার শাড়িতে তরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে শুদ্ধ থমকে দাঁড়ালো। এরপর দূর থেকেই কতক্ষণ চেয়ে রইলো কে জানে! চোখ ঘুরিয়ে এদিক সেদিক নজর বুলাতেই হঠাৎ অদূরে সে ধ্রুবর বাইক আবিষ্কার করলো। তরু তখনো শুদ্ধর অপেক্ষায় ছলছল নয়নে মুখ ভার করে বসে।
ও দুই পুরুষের কষ্ট আর বাড়াতে ইচ্ছে করে না শুদ্ধর। অথচ তার রমণীর কষ্ট সে ঠিকই বাড়িয়ে চললো। একবার ভাবলো ফোন করি। আবার কি মনে করে করলো না। থাক না একটুখানি কষ্ট! কিছু অপূর্ণতা শুদ্ধর বুকপকেটেও জমুক। এই যে তার অপেক্ষাময়ী কে সে দূর থেকে ঝাপসা দেখে চলে এলো একি কম কষ্টের? অদেখার চেয়ে দেখেও না দেখে চলে আসা যে ঢের যন্ত্রণার! শুদ্ধ একটা সিগারেট ধরালো। বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে উপহাস্যে অনুচ্চ স্বরে বললো,

‘আমি দেখে নিলে যদি তুমি দুঃখ পাও?
আমি ছুয়ে দিলে যদি তুমি অকালে নষ্ট হয়ে যাও?’

উত্তর আসে না তো। শুদ্ধ নিজেই বলে,

‘আমি তোমায় দূর থেকে ছুঁই। আমি তোমায় দূর থেকে চেয়ে দেখি। সুন্দরতম তুমি আমার জন্য দুর্লভ হয়ে রও। আমি বেদনায় পিষ্ট হয়ে রই। তুমি আরেকটু শুদ্ধময় যাতনার প্রশ্রয় দাও।’

২৭.
চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটাতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাসে অভ্যস্ত হতে হতে এখন এই বদ্ধ বড় ঘরটায় শুদ্ধর হাঁসফাস লাগে। আজ ছুটির দিন। তরুকে না দেখার আজ বায়ান্ন তম দিন। ঘরের তল্পিতল্পা গুছিয়ে বিকেলে শুদ্ধ ছাদের উদ্দেশ্যে গেলো। কে জানতো ছাদে যে এতো বড় চমক অপেক্ষায় ছিলো?

ছাদের চাপানো দরজা পেরিয়ে আসতেই কয়েকজন রমণীর কন্ঠের শোরগোল শুনা গেলো। শুদ্ধ পা এগিয়েও পিছিয়ে নিলো। নারীর উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করলো? কোথাও দু’দন্ড শান্তি নেই শুদ্ধর জন্য? ছাদে এসে চেঁচামেচি করতে হবে কেনো? মেয়ে, তোদের ঘর নেই? শুদ্ধ পেছন ঘুরেছে ওই মূহুর্তে কানে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর। শুদ্ধর পা দুটো থমকে ভ্রু দ্বয় কুচকে গেলো। কণ্ঠের অনুসরণ করে তাকাতেই শুদ্ধর ভ্রু’র সাথে সাথে চোখদ্বয়ও কুচকে গেলো।

তরু বিহ্বল। এতোটাই হতবাক যে অনুভূতিশূন্য। পাশে থাকা বন্ধুদের ধাক্কাতে ওর ঘোর ভাঙলো। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে বললো,

‘তোরা যা। আমি একটু পর আসছি।’

এরপর কিছু একটা ইশারা করলো। শুদ্ধ দেখলো তিনজন রমণী তরুর ইশারায় যথা আজ্ঞা করে চলে গেলো। তরুর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। মরুভূমির বুকে জল পাওয়ার ন্যায় তৃপ্ত বৃক্ষ সে। তার চোখ দুটো জুড়িয়ে যাচ্ছে। একধ্যানে পলক বিহীন সে শুদ্ধকে দেখে গেলো। কত খুঁজেছে এর মাঝে! শুদ্ধর বাড়িতে ফোন লাগিয়েছে। শুদ্ধর ফেলে দেওয়া সিমে অহরহ বার ফোন দিয়ে গেছে। পুরাতন অফিসে গিয়েছে। কোথাও নেই। শুদ্ধ তরুকে উপেক্ষা করলো না। ছাদের বসার জায়গাতে বসে তরুকে বসতে বললো। তরু বসলো শুদ্ধর মুখোমুখি। শুদ্ধ মৃদু ধমকে বলে,

‘এই মেয়ে, পলক ফেলো।’

তরু ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। বললো,

‘আরেকবার ধমক দিন। কতদিন ধমক খাই না! দেখুন কেমন শুকিয়ে গেছি আমি!’

শুদ্ধ এবার পরিপূর্ণ চোখে তাকালো। তরুর গায়ে সাদা, কালো শাড়ি। ওর বাকি বান্ধবীদের গায়েও তাই ছিলো। হয়তো গ্রুপ ফটো তুলছিলো। শুদ্ধ আরো দেখলো মন দিয়ে। তরু শুকিয়েছে বটে! তবে খুব ফর্সা হয়েছে। আগের চেয়ে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নাকি এই পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলোয় শুদ্ধর কাছেই পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যময়ী সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে?

শুদ্ধ চোখ সরালো। অপ্রস্তুত কেশে বললো,

‘এখানে তোমার কোনো বান্ধবী থাকে?’

তরু হেসে মাথা নাড়ায়,

‘আপনার বাড়িওয়ালার মেয়ে আমার বান্ধবী। আগে প্রায়ই আসা হতো। লাস্ট দুই-তিন মাস ধরে আপনার বিরহে আসা হলো না। ভাগ্যিস আপনি বেছে বেছে এ বাড়িতে উঠেছেন।’

শুদ্ধ কপাল কুচকে বলে, ‘বেছে বেছে উঠিনি।’

তরু আবার হাসে মৃদুমন্দ। এ হাসি মন খারাপের। শুদ্ধ চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। দিনের আলোটা মরে যাচ্ছে। গোধূলির সোনালি আলোয় শুদ্ধ অনেকক্ষণ পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমায় মন খারাপে মানায় না, তরু।’

এসময়ে তরুর গলাটা ধরে এলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,

‘এলেন না কেনো? আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একা!’

শুদ্ধর বুকে সূচের মতো বিধলো ‘একা’ শব্দটি। সে নিচুস্বরে বললো,

‘আমি জানি, তরু। আমি গিয়েছিলাম।’

তরুর অভিমানী স্বর, ‘তবে দেখা দিলেন না কেনো?’

শুদ্ধ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কয়েক মুহূর্ত কেটে যাবার পর বললো,

‘তোমার জন্য অনেকে অপেক্ষায়, তরু। এক শুদ্ধ না এলে তোমার এতো যায় কীসে?’

‘অনেকজনের অপেক্ষা তো আমার দরকার নেই, শুদ্ধ। আমি যে কেবল আপনার অপেক্ষায়।’

তরু বোধ হয় শুদ্ধর সামনে এই প্রথম শুদ্ধর নাম ধরে ডাকলো। শুদ্ধ আজ কথা বলতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে থমকাচ্ছে। তার থমকানোর মাঝে তরু আকুতি করে উঠলো,

‘আমি আপনাকে একটু ছুঁই? আপনার হাত’টা একবার ধরি, শুদ্ধ?’

বাতাস থমকে গেলো। সে সাথে আবারো থমকে দাঁড়ালো শুদ্ধ। থমকে গেলো শুদ্ধর হৃদয়। সে কয়েক সেকেন্ড পর ফিসফিস করে বললো,

‘এই নষ্ট মানব’কে ছুঁতে চাইলে নিশ্চিত তোমার মরণ।’

তরু চোখ বন্ধ করলো। সাথে সাথে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে গেলো গলা অবধি। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,

‘হোক না মরণ তাতে কি?’

তরুর গলা কেঁপে উঠলো। সেকেন্ড কয়েক থেমে বললো,

‘আমি বিরল রাঙা হালতি,
হেমন্তের নীড় খুঁজতে এসেছি।’

বাতাসে শুদ্ধর চুল উড়ছে। উড়ে যেতে চাইছে মনের উপর পর্দাটা। শুদ্ধর আকড়ে ধরলো। কণ্ঠ কঠিন করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে বলে চললো,

‘হৃদয় ব্যথা কিন্তু সাড়ে না, মেয়ে। আফসোসের দানা সেথায় লেগে আজীবন অমসৃণ হয়ে রবে।’

‘আপনাকে না পাওয়ার থেকে পেয়ে হৃদয় ব্যথা হওয়া ভালো।’

শুদ্ধ বড় করে শ্বাস নিলো। সূর্য ডুবছে। লাল-কমলা আলোয় পশ্চিমের আকাশ ছেয়ে গিয়েছে। অদূরে চেয়ে সে বললো,

‘তুমি এতো শুকিয়েছো কেনো, তরু?’

তরু ধীরে জবাব দেয়, ‘উত্তর’টা তো আপনি জানেন।’

‘জানি। কিন্তু আমি চাই উত্তর’টা তুমি বদলাও।’

‘কেনো চান?’

তরুর মুখটা থেকে হলুদ সোনালি দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বাতাসে শাড়ির আঁচল খানি উড়ে যাচ্ছে। সাদা-কালো মিশেলে চুড়ির টুংটাং শব্দ সেথায় ছন্দ ছড়াচ্ছে। প্রেমের ছন্দ! শুদ্ধ ঠোঁটের কোণে অনিচ্ছার হাসি টেনে বললো,

‘কারণ আমি চাই না আমাকে পেয়ে তুমি বাকিসব কিছু হারাও। তুমি অনেক আদরের তরু। এক ব্যথা সইতে পারছো না। সহস্র ব্যথা কীভাবে বইবে?’

তরু কিছু বলতে চায়। শুদ্ধ ওকে থামিয়ে আবারো বলে,

‘আমি না থাকলে তোমার একটা কষ্ট। আমি থাকলে তোমার হাজারটা কষ্ট, তরু। সেই কষ্ট তখন আমি সইবো কেমন করে?’

তরু স্নিগ্ধ হাসি দেয়। কী ভীষণ সুন্দর দেখায় তখন তাকে!

‘কেনো? আমার কষ্টে আপনার কষ্ট হয়?’

‘তোমার জায়গায় যে কেউ থাকলেই হতো। ইউ আর নট স্পেশাল।’

সূর্য ডুবে গিয়েছে। তরু ঠোঁট প্রসারিত করে আবারো হেসে উঠলো। আজ তো তার হাসিরই দিন। কতদিন সে হাসে না। তরু একদম ফিসফিসিয়ে বললো,

‘মিথ্যে কথা! আমি আপনার কাছে মূল্যবান! তাই তো আপনি আমার সুদূরপ্রসারী দুঃখ নিয়ে ভাবেন।’

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-১৪

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৪
২৪.
শুভ্র প্রভাত! ঘড়িতে আট’টা বেজে সাতান্ন মিনিট। পাখির কিচিরমিচির। কুয়াশা আচ্ছন্ন পিচ্ছিল রাস্তা ভেদ করে শুভ্র বাইক নিয়ে শা করে দৌড় দিলো। এইযে একটি সুন্দর সকাল অথচ কত অসুন্দর! এই শুভ্র প্রভাত শুভ্রর বুকের নীল ব্যথা। নীল ব্যথার অধিকারিণী একজন সুন্দর রমণী। এ জীবনে কত রমণী এলো গেলো। কতজন’কে প্রত্যাখ্যান করলো শুভ্র অথচ বেছে বেছে গিয়ে আসক্ত হলো তার উপর যার উপর সবাই আসক্ত। আচ্ছা পৃথিবীতে এতো সুন্দরী থাকতে কেনো সবাই শুভ’র বুকের সেই নীল ব্যথার প্রতি পাগল? ওরা কি জানে না শুভ্র’র নীল ব্যথা যে ‘তরু’। শুভ্র কেনো সবার থেকে গোপন করলো? তার নীল ব্যথা যে বুকে ঘাঁটি গেড়ে নিচ্ছে। তাকে রেখে অন্য পুরুষে মত্ত হয়ে অন্য পুরুষের জন্য রাত-বিরেতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সুদূর চলে যাচ্ছে। কি ভেবেছে শুভ্র টের পায় না? শুভ্র পিছু না গেলে ওতো সুন্দর করে নীল ব্যথা পৌছাতে পারতো? শুভ্রর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুখের ধোঁয়া মিশে গেলো প্রকৃতিতে। ফাঁকা রাস্তায় শুভ্র জোরে বললো,

‘নীল ব্যথা, তবুও তুমি ভালো থাকো! আর শুভ্র’র বুকের বাম পাশের যন্ত্রটার নীল ব্যথা হয়ে থাকো।’

শুভ্রর বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। চোখ কি খানিক ঝাপসা হলো? নাহ! শুভ্রদের চোখ ঝাপসা হয় না। ওদের দীর্ঘশ্বাসগুলো কান্না। মায়ের কোলে মাথা পেতে করা হাহাকার গুলো ওদের কান্না। এইতো সেদিনকার কথা বাবা সাফ মুখের উপর জানিয়ে দিলেন,

‘এসব চাইল্ডিশ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তোমার জন্য নিশ্চয়ই আমি পরিবার ভাঙবো না। তাছাড়া ইম্পোর্টেন্ড বিষয় তরু তোমাকে ভাই ছাড়া অন্যকিছু হিসেবে পছন্দ করে না। তোমার একতরফা জেদে আমি আমার পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবো না।’

শুভ্রর মাথায় কথাগুলো যেনো বলের মতো বারি খেলো। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ্রর মা স্বামীকে বুঝাতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরে আসলেন। পরিবার’টাকে তো তিনিও খুব ভালোবাসেন। ধ্রুবর মায়ের সাথে তার মিলে না একথা সত্যি। তাদের মাঝে অকারণে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। কিন্তু ধ্রুব কে তিনি নিজের পেটের ছেলে বৈ অন্যকিছু কক্ষনো মনে করেননি। তার এক ছেলের মনকে ভেঙে দিয়ে আরেক ছেলের বউ করে তরুকে কীভাবে আনবেন? বাড়ির সেই অসুস্থ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন? তারপর কেউ কারোর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে? তাই তিনি কোলে রাখা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘বাবা, জীবনটা ছোট। একজীবনে মানুষ সব পায় না। আমি তোমাকে আমার দু’হাত ভর্তি করে তোমার জীবনের সব অপূর্ণতায় পূর্ণ করতে চেয়েছিলাম। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তোমরা দুই ভাই একই মেয়ে তাও নিজের চাচাতো বোন নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছো। একতরফা…

মাকে মাঝপথে থামিয়ে শুভ্র তাচ্ছিল্য গলায় বললো,

‘প্রতিযোগিতা তো জন্ম থেকে, মা। নামে প্রতিযোগিতা। কাজে প্রতিযোগিতা। সবটা শুরু করে এখন এসে সান্ত্বনা দিচ্ছো? ক্যারি অন।’

শুভ্রর মা ছেলের তাচ্ছিল্যময় হাসি দেখলেন না। কিন্তু বুঝতে পারলেন। তার চোখ’টা ভরে উঠলো। এ দেশে কি আর কোনো তরু নেই আমার ছেলেটার জন্য? শুভ্র বোধহয় মায়ের ব্যথা বুঝতে পারলো। মায়ের হাত টেনে উল্টোপাশে চুমু দিয়ে বললো,
‘সরি মা।’ শুভ্রর মা তখন মৃদু আওয়াজে কেঁদে উঠলেন। শুভ্র বললো,

‘তরুরা শুভ্রদের প্রেমে পরলো না কেনো, মা? আমি এ ব্যথা কত জনম সইবো?’

শুভ্র ভ্রু কুচকে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। অফিসে যেতে মন টানছে না। শহর ঘুরবে আজ। ধ্রুবকে সাথে আনার দরকার ছিলো। দুই রিজেক্টেড মাল একসাথে বিরহ উদযাপন করতে পারতো। কি লাভ নিজেদের এড়িয়ে চলে? পাখি যে অন্যের বাসা পছন্দ করে।

তরুর সাথে ধ্রুবর মা খারাপ আচরণ করায় ধ্রুব যেদিন ঘরের জিনিসপত্র ভাঙলো সেদিন দাদুভাই সব নিরবে দর্শন করে গেলেন। একটা টু শব্দ অব্ধি না করে নিজের ঘরে দোর দিলেন। তিনি কি করবেন? তিনি তো কোনোদিন আশংকা করেননি তার বাড়ির ভেতরের এই অবস্থা। কোনদিকে যাবেন তিনি? কার পক্ষ নিবেন? তিনজনই যে তার রত্ন! কলিজা ছেড়া মানিক!
ধ্রুবর হাত কেটে বিচ্ছিরি অবস্থা হলো। রাতে শুভ্রর বাবা এসে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললো,

‘বাবার সাথে কথা বলবে। মনে রেখো, বাবাদের দোষ থাকে না। যত দামী খেলনাই হোক সন্তান চাইলে বাবারা রক্ত বেঁচে তা কিনে নিয়ে আসতে চায়। বাবা হলে পরে বুঝবে।’

তারপর শুভ্র স্নেহার কাছে শুনলো ধ্রুবর বাবার সাথে ধ্রুবর কি নিয়ে যেনো তুমুল ঝগড়া। বাবার সাথে ধ্রুবর ঝগড়া করার জেদ গিয়ে মেঝো কাকী তরুর উপর তুললো। শুভ্রকে আর বলে দিতে হয়নি কি নিয়ে এতো কোন্দল। সে রাতে ধ্রুবর ব্যান্ডেজ বাধা হাত দেখে চু চু করে বলেছিলো,

‘আহারে ধ্রুব! তুই যদি না জন্মাতি।’

ধ্রুব চোরা গলায় বলেছিলো, ‘তাতে তোর কিছু বিশেষ লাভ হতো না।’

শুভ্র বড় করে মুখবন্দি বায়ু বাতাসে ছেড়ে দিলো। হালকা আওয়াজে বললো,

‘ইশশ… যদি তরুই না জন্মাতো। কত সুন্দর হতো সব! তরু তুই কেনো জন্মালি?’

শুভ্র জোরে গাড়ি টানলো। এতো জোরে যে যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বাতাসের তীব্রতা শরীরে কাটার মতো হুল ফুটালো। তবু হুশ নেই। বরং চিৎকার করে বললো,

‘ও প্রকৃতি শুনে রাখো,
অপ্রকাশিত শুভ্র’রা বিক্রি করে অব্যক্ত প্রেম, প্রতীক্ষা। কেবল কিনে আনে শুধু এক বুক হতাশা, উপেক্ষা।’

শূন্য রাস্তায় শুভ্রর কথা প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার এসে কানে লাগলো। শুভ্র চমকে উঠলো। হাত কেঁপে উঠলো। বাইক নিয়ে উল্টে পরলো রাস্তায়।

২৫.
বছরের এক তারিখ পরলো। চারিদিকে কী রঙিন রঙিন সজ্জা!কত আমেজ! রাস্তাজুড়ে আলপনা। তরুর মনেও রং লেগেছিলো কেননা আজ শুদ্ধর সাথে দেখা হবে। তরু মন ভরে সাজলো। একটা ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়ি পরলো। রমনায় শুদ্ধর জন্য অপেক্ষা করলো বিকেল পর্যন্ত। কিন্তু শুদ্ধ এলো না! ভিড়ের মাঝে একলা তরু এককোণে এক জায়গায় বসে সারাদিন অপেক্ষা করলো অথচ শুদ্ধ এলো না। এভাবে ধোকা দিলো তরুকে? তরুর চোখ ছাপিয়ে জল এলো। পড়ন্ত বিকেলেই ফিরে এলো।
ফিরে এসেই দেখলো ড্রইংরুমে শুভ্র বসা। প্লাস্টার করা পা টা ছোট টেবিলের উপর রাখা। বড় জেঠু শুভ্র ভাইকে চেকাপ করছেন। শুভ্র ভাই বাইক এক্সিডেন্ট করার পর থেকে বড় জেঠু নিজের কাজে বাড়ি থেকে কম বেরোন। তিনি মনে করেন তার কঠোরতায় শুভ্রর এই অবস্থা। এ বাড়ির ছেলে মেয়েগুলো বড় আদরে মানুষ। বেশি আদরে মানুষ বলেই হয়তো সবার জীবনে এতো কষ্ট! তরুকে দেখে ওর বড় জেঠু বললেন,

‘কিরে মা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো কিছু বলবি?’

তরু জেঠুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কেনো জানি না বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সামনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। তরু মন খুলে সবার সাথে কথা বলতে পারে না। কিন্তু কারোর কোনো আদরে কমতি নেই। কেউ তাকে ব্লেইম করছে না। কেউ বলছে না, ‘আমার ছেলের জীবন’টা নষ্ট করে দিয়েছিস তুই।’ অথচ তরু জানে আদতে শুধু তাদের ছেলেদের নয় এই গোটা পরিবারটাকে নষ্ট করে ফেলেছে তরু। তাই তো যে বাবা তরুর একমাত্র টিম মেম্বার সেই বাবা তরুর সাথে খুব একটা কথা বলেন না। নাম ধরে ডাকেন না। বাড়ি ফিরে তরুর সারাদিনের অভিযোগ গুলো শুনতে তরুর ঘরে আসেন না। তরু জেঠুর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় মিনমিন করে বললো,

‘আ’ম সরি, বড় জেঠু। আই লাভ ইউ।’

জেঠু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। এমন না একথা তরু আজ প্রথম বলেছে। তবুও তরু দৌড়ে চলে আসার সময় স্পষ্ট দেখতে পেলো জেঠুর চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। তরু কাঁদতে কাঁদতে বলে চললো, ‘সব আমার দোষ। সব।’

সত্যি কি তরুর দোষ? নাকি শুভ্রর? নাকি ধ্রুবর? নাকি ভালোবাসার?

চলবে