Saturday, August 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 17



অনির পর্ব-১২+১৩

0

দ্বাদশ পর্ব

বিয়ে করবে মানে?
বাবা-মা দুজনেই খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন এর চেয়ে আশ্চর্যজনক কোন কথাই এর আগে জীবনে কখনো শোনেননি। এইরকম কিছু একটা যে হবে আমি আগেই আঁচ করেছিলাম। আমি চাইলে অন্য কাউকে দিয়ে কথাটা বলাতে পারতাম, ইচ্ছে করেই সেটা করিনি। আজ যদি বাবা মায়ের মুখোমুখি হতে না পারি তাহলে আর কোনদিনও পারবো না

আমি ঢাকায় এসে পৌঁছেছি গভীর রাতে। আমাকে দেখে বাবা-মা দুজনেই চমকে গেছেন। সে সময় আর কথা বলার কোন সুযোগ পাইনি, সকালে খাবার টেবিলে কথাটা তুললাম। প্রথমে আমার কথা শুনে বোধহয় তারা কিছুই বুঝতেই পারেননি কারণ আমি কখনও এ ধরনের কোনো অভ্যাস তাদেরকে দেইনি, দেবার অবশ্য প্রয়োজনও বোধ করিনি। মা হরবর করে বললেন
কাকে বিয়ে করতে চাস? কোথায় থাকে, ঢাকায় না চট্টগ্রামে? বিয়ে আবার করে ফেলিস নি তো?
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি থামত। বল, মুনির কি বলছিলে তুমি?
বাবা সাধারণত আমাদের তুমি বলেন না, আজ বলছেন,স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আমার উপর যথেষ্ট রেগে আছেন।
আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে কিছু বললাম না, স্পষ্ট গলায় বললাম
বাবা, আমি একজনকে পছন্দ করি। এখনই তোমাদের জানানোর ইচ্ছা ছিল না কিন্তু ওর বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উনি চাইছেন এই জানুয়ারি মাসেই ওর বিয়ে হয়ে যাক।

বাবা গম্ভীর গলায় বললেন “উনি চাইলেই তো হবে না, আমাদেরকেও তো পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হবে। এখনো তোমার পড়াশোনা শেষ হয় নাই
মা আবারও আগ বাড়িয়ে বললেন
মেয়ে কোথায় থাকে, মেয়ের বাবা কি করে?
বাবা মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন কিন্তু লাভ হলো না। মায়ের কৌতূহল যেন বাঁধ ভেঙেছে
বাবা সেটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
ওই মেয়ের সাথে তোমার কিভাবে পরিচয়?
ওর নাম অনিমা বাবা, এখানেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, হলে থাকে। আমি জানি কথাটা তোমাদের জন্য খুব শকিং কিন্তু আমার আসলে আর কোন উপায় নেই। ওর বাবার স্ট্রোক করেছে। উনি চান এই জানুয়ারিতে ওর বিয়ে হয়ে যাক। বিয়ের পর আমরা যেরকম হলে আছি সেরকমই থাকবো প্রয়োজন হলে পড়াশোনা শেষ হলে তখন না হয়ে দেখা যাবে।
এইভাবে চুপে চাপে তো বিয়া করা সম্ভব না। আত্মীয়-স্বজনদের তো জানাতে হবে তোমার চাচা ফুফুদের খবর দিতে হবে। কি করা যায় আগে তোমার ছোট চাচার সঙ্গে একটু বুঝ পরামর্শ করে নেই।
বাবা উঠে গেলেন, পিছন পিছন মাও গজগজ করতে করতে বলতে বলতে গেলেন

তোমার মামাদের খবর দেওয়া লাগবে। মেয়ের বাবা কি করে তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে। মেয়ের হলে লোক পাঠাতে হবে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নাজমা কলেজে গেছে। আমার করার মতন তেমন কিছুই নেই। আমি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অনিমা এখানে থাকতে ভালো হতো আজকের দিনটা ওর সঙ্গে কাটানো যেত। গতকালই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে অথচ মনে হচ্ছে কতদিন ওকে দেখি না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আমি নারিন্দা ছোটফুপুর কাছে চলে গেলাম। ছোট ফুপুর সাথে কথা বলে অবাক হলাম। অনিমার ব্যাপারে সবই জানেন। বুঝলাম নাজমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ছোট ফুফু সব শুনে আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে আমার সঙ্গেই থাকবেন। আমি একটু ভরসা পেলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। আমার মনের অস্থিরতা টের পেয়ে ফুপু আমাকে চট করে ছাড়লেন না, দুপুরে ভাত খাইয়ে তবে ছাড়লেন।

ছোট ফুপুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসে এলোমেলো হাঁটলাম। ভালো লাগছে না, ভীষণ অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে ওর হলের সামনে গিয়ে কল দিলে এখনই ও নেমে আসবে। একটুখানি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আমি হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত চলে গেলাম। পুরনো বইয়ের মাঝে গেলে আমি সব সময়ই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি। বই দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল আমার কাছে তো ওদের সিলেটের নাম্বার আছে, একবার কি ফোন করে দেখব।
বেশি চিন্তা করলে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়না, তাই ঝটপটি একটা দোকান থেকে ফোন করে ফেললাম। ভাগ্য অত্যাধিক সুপ্রসন্ন হলে যা হয়, ফোনটা ওই ধরল। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম
অনিমা
ও সঙ্গে সঙ্গে আমার কন্ঠ চিনতে পেরে বলল
তুমি কোথায়? ঢাকায় না চট্টগ্রামে ফিরে গেছো।
ঢাকায়। কাল পরশুর মধ্যেই ফিরে যাব। তুমি কেমন আছো বলো তো
ভালো
সত্যিই ভালো? আমার কেন মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ
মন তো খারাপই। আমার জন্য কত ঝামেলা হচ্ছে তোমার বলতো।পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। এটা আমি চাইনি কখনো।
ও হঠাৎ করে চুপ করে গেল। আমি টের পাচ্ছি ওর নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ, কোন কথা বলছে না, কাঁদছে নিঃশব্দে। আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আমি নরম গলায় বললাম
অনি, কি হয়েছে বলোতো
কিছু না আমি রাখি
আমার কথাটা একবার শোনো
বল
তুমি এত চিন্তা করো না। আমি বাসায় কথা বলেছি, একদিন দুই দিনের মধ্যেই আমি সব জানাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছো
ও কথার জবাব দিল না, শুধু বলল
কেউ একজন আসছে, রাখছি

ও ফোন রেখে দিল। আমার মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এসেছে। আমি পরপর কয়েকবার ফোন দিলাম, কেউ ধরলো না। ওখান থেকে বেরিয়ে কতক্ষণ এলোমেলো হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের ভেতর চলে গেলাম। বাইরে ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন কিন্তু আমার বুকের ভেতর বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনলাম আসরের আযান দিচ্ছে। নিউ মার্কেটের ভেতর একটা মসজিদ আছে আমি আগে জানতাম না। অনেকদিন পর আসরের নামাজ পড়লাম। সাধারণত এই সময় ল্যবে থাকি বলে মসজিদে যাওয়া হয় না। মনের অস্থিরতা অনেকটা কমেল। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম। হঠাত একটা শাড়ির দোকানে চোখ আটকে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে অনভ্যস্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। দোকানে তেমন ভিড় নেই, অল্প বয়সী একজন সেলসম্যান আগ্রহ নিয়ে অনেক শাড়ি দেখালো। একটা টুকটুকে লাল তাঁতের শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। ওকে আমি কখনো শাড়িতে দেখিনি ভীষণ শখ ছিল দেখার, একবার ওকে বলেও ছিলাম। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আমি হলুদ পাড়ের লাল শাড়িটা কিনে ফেললাম। সত্যি সত্যি যদি আমাদের বিয়ে হয় তাহলে এটা ওকে উপহার দেব।

দোকান থেকে বের হতে হতে মাগরিবের আজান হয়ে গেল। আবারও মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারছি না। এতক্ষণ যে অস্থিরতা ছিল মনের মধ্যে হঠাৎ করেই সেটা কেটে গেল। এখানে বসে থেকে যেটা মনে হল যদি পরম করুনাময় চান তাহলে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন।

আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে আবার ওদের বাড়িতে ফোন দিলাম, এবার ফোনটা ধরলে অন্য একজন। আমি তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম না, তবে বুঝলাম এটা ওর বাবা কিংবা জাহেদ সাহেব নন। এর বাইরে আর কে হতে পারে। খুব সম্ভবত রাতুল।আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস না করেই বললাম
অনিমা কি আছে
আপু তো ঘুমাচ্ছে। আপনি কে বলছেন?
আমি সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম
তুমি কি রাতুল?
জি। আপনি কি মুনির ভাই
হ্য। কি অবস্থা বলো তো একটু
অবস্থা ভালো নয় ভাইয়া। আপনার আসা নিয়ে বাড়িতে যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছে। মা আর জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে মামার অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। মামা সম্ভবত আপনাকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন, তাই না?
হ্যাঁ
মা সেটা চাইছে না। তারা চাইছে এখনই বিয়েটা করিয়ে ফেলতে। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠান হবে।
এক মুহূর্তের জন্য আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। আমি কোনমতে বললাম
তারপর কি হয়েছে
মামা ওদের কথায় রাজি হয়নি। আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি মুনির ভাই। এবার যখন মামা অসুস্থ হয়েছিল আমি তার সঙ্গে হাসপাতালে ছিলাম। মামার শরীর ভালো নেই। এই মুহূর্তে যদি মামার কিছু হয়ে যায় তাহলে জাহিদ ভাই আর মাই কিন্তু আপুর লিগ্যাল গার্ডিয়ান। আপনার হাতে বেশি সময় নেই মনে হয়।
আমি হঠাৎ করে কোথা থেকে এতটা মনবল আর আত্মবিশ্বাস পেলাম জানি না, ওকে বললাম
তুমি আমার ফোন নাম্বারটা রাখো রাতুল। কোন কিছু হলে আমাকে জানিয়ো। আমি আগামীকালই একটা ব্যবস্থা করছি। আর ওকে বলো যেন দুশ্চিন্তা না করে আর নিজের খেয়াল রাখে।

রাতুল ছেলেটাকে আমার ভালো লাগলো। ছেলেটা বুদ্ধিমান এবং যথেষ্ট কেয়ারিং। আমি আমার চট্টগ্রামের ফোন নাম্বার আর আমাদের বাড়ির ল্যান্ডলাইনের নাম্বার দিয়ে ফোন রাখলাম। হাতে একেবারেই সময় নেই। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে খুবই দ্রুত।

চলবে…..

অনির

১৩

আমি বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যা পার করে। বাসায় ঢুকে রীতিমতো ধাক্কা লাগলো। ড্রয়িং রুমে অনেক লোকের সমাগম দেখা যাচ্ছে। ছোট চাচা এসেছেন। রাজশাহী থেকে এত দ্রুত কি করে এলেন সেটা একটা বিস্ময়। উনার উল্টো দিকে সোফায় কামাল ভাইকে দেখা যাচ্ছে। মামা বোধহয় কেবলই এসেছেন পাশেই লাগেজ রাখা। আমাকে ঢুকতে দেখে বাবা থমথম কন্ঠে বললেন
– কোথায় ছিলে সারাদিন? সকালবেলা অর্ধেক কথা বলে চলে গেলে । আমরা তো ভাবলাম আমার বউ নিয়ে ফিরবে নাকি

আমি জবাব না দিয়ে কোনার দিকে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসলাম। বোঝা যাচ্ছে আমি আসার আগে সবার মধ্যেই বেশ আলোচনা হয়ে গেছে। ছোটচাচা বয়সে সবার চেয়ে ছোট হলেও সাধারণত শেষ সিদ্ধান্তটা তিনিই নেন বা বলা ভালো তার পরামর্শই শেষ সিদ্ধান্তটা হয়। এই মুহূর্তে তার ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন। সম্ভবত সবাই তাকে নানান রকমের তথ্য দিয়েছে এখন সেই সবকিছুকেই একত্র করে আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। ছটচাচা শুরুটা করলেন এইভাবে
– তোমার কাছ থেকে কিন্তু আমরা এটা আশা করি নাই মুনির। বিয়ে করবে ভালো কথা, তাই বলে পড়াশোনাটা তো শেষ করবা, নাকি ওই মেয়ের বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে?

আমার মেজাজটা খারাপ হল। এরা নিজেদের মত করে গল্প বানিয়ে নিয়েছে এবং সেটাই সবাইকে বলছে। আমি সাধারণত কারো সঙ্গে রাগারাগি করিনা। এটা আমার স্বভাবেই নেই। আমি বললাম

– আমি জানিনা তুমি ঠিক কি শুনেছ, অনিমার সঙ্গে আমার পরিচয় এক বছর আগে। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে, আমার এক ব্যচ জুনিয়র। এই মুহূর্তে তোমাদের জানানোর আমার কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু রিসেন্টলি ওর বাবা স্ট্রোক করেছেন। ওরা …
মা আমার শেষ না হওয়া কথা কেড়ে নিয়ে বলল
তাই ওরা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, বুঝেছ কবির
এবার আমার মেজেজ সত্যি সত্যিই খারাপ হল। আমি বিরক্ত কণ্ঠে বললাম
– কেউ আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়নি। ওরা তো আমাকে চেনেই না। ওর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে ওরা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। ওর ফুপাতো ভাই বিসিএস ক্যডার। মার্চে বিয়ে। আমি ওর বাবাকে অনুরোধ করেছি যেন আমার ব্যপারটা কনসিডার করে। কাজেই বুঝতেই পারছ এখানে চাপ দেয়ার কিছু নাই।

ছোট চাচাকে এবার বেশ চিন্তিত দেখাল। বললেন
তা ওর বাবা কি বলল?
বললেন আমি এখন এত দায়িত্ব নেবার জন্য প্রস্তুত নই। তাঁর মতে আমাদের উচিত সবটা এখেনেই শেষ করে ফেলা।
কামাল ভাই অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলার জন্য ছটফট করছিল এবার আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল
আমার তো মনে হয় উনি ঠিক কথাই বলসে। এখন বিয়া করলে বউকে খাওয়াবে কি?

আমার মেজাজটা এবার প্রচন্ড খারাপ হল। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই ছোট ফুপু বললেন
এই কথা বলা তো তোমার মানায় না কামাল। তুমি তো মেট্রিক ফেল করে পালায়া বিয়া করসিলা। এখন তিন বাচ্চার বাপ, এখনো তো কিছু করো না, বাড়িতে বইসা খাও।
ছোট ফুপু যেন জোকের মুখে লবন দিয়ে দিলেন। কামাল ভাই তিলবিলিয়ে উঠলেন

বাড়িতে বইসা খাই মানে কি? এত বড় বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করা কি কোন কাজ না?
ছোট ফুপুও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়, তেড়ে উঠে বললেন
স্বীকার করো তাহলে যে এত বড় সম্পত্তি। সারাক্ষণ তো খালি গলা শুকাও বলো তোমাদের নাকি যা দেওয়া হয়েছে তাতে চলে না। তা নিজের সম্পত্তি দেখাশোনা করো অন্যেরটার উপর চোখ দিতে যাও কেন?
দেখলেন দেখলেন মামা, কথায় কথায় কথায় খালি আমারে খোটা দেয়। আজকে আপনারা এর একটা বিহিত করবেন।
রেহানা ফুপু এবা্র তেতে উঠে বললেন
ওনারা কি বিহিত করবেন, তারা তো নিজের নিজের অংশ নিয়ে সড়ে পরেছেন। এই কথাটা বোধহয় ছোট চাচার গায়ে লাগলো। উনি বললেন
সড়ে পড়েছি এটা কি ধরনের কথা রানু? তোমাদেরকে বসতবাড়ি ছেড়ে দিয়েছি কয়জন ভাই এমন করে? এখন তোমরা দুজন একটু মানিয়ে নিতে পারছ না এটা কি আমাদের দোষ?

নিজেরা তো ঠিকই আলাদা আলাদা করে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিয়েছ আমাদেরটা এরকম প্যাচ লাগানোর কি দরকার ছিল?
বাবা বেশ বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন
আহ! রানু, কামাল কি শুরু করলি তোরা
কামাল ভাই ও সুযোগ পেয়ে বলল
মামা আমি কিন্তু কিছু শুরু করি নাই। খালা সবসময় এই কামটা করে। বড় মামা আপনি এইটার আজকে একটা বিহিত করেন, সব সময় এই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। কাজও করি আবার কথাও শুনি
ফুপুর গলা এক পাল্লা চড়ল
ও তাই নাকি কাজ করিস? তা কি কাজ করিস শুনি? যা না কাজ করিস তার থেকে তো অন্যের সম্পত্তি ভোগ করতে সময় চলে যায়

ছোটখালা আপনে বড় তাই কিছু বলতেসি না। আম্মা থাকলে বুঝায়া দিত……
কি বুঝায়া দিত শুনি? তোর মাকে ভয় পাই নাকি আমি?

কেমন একটা হট্টগোল বেঁধে গেছে। আমি দিশেহারা বোধ করছি। কোথাকার কথা কোথায় চলে যাচ্ছে। বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা বাজছে। নাজমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরল। তারপর রিসিভার ফোনের পাশে রেখে আমাকে এসে বলল
ভাইয়া তোমার ফোন
কে?
জানিনা
আমার এই মুহূর্তে ফোন ধরে কথা বলে সময় নষ্ট করার এতোটুকুও ইচ্ছা নেই। এই পরিস্থিতি কি করে সামলাবো সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি নাজমা কে বললাম
নাম, ফোন নাম্বার লিখে রাখ, আমি পরে ফোন দিবো
নাম বলেছে রাতুল, বলল আর্জেন্ট
আমি ভীষণভাবে চমকে গেলাম। রাতুলের সঙ্গে আমার বিকেল বেলা কথা হয়েছে তখনই আমি ওকে নাম্বার দিয়ে বলেছি যে, কোন ইমার্জেন্সি হলে যেন আমাকে ফোন করে। তারমানে নিশ্চই কোন সমস্যা হয়েছে? খারাপ কিছু হয়নি তো? আমি ছুটে গিয়ে ফোন ধরলাম। রাতুল আমাকে সালাম দিল বলল
মুনির ভাই
কি অবস্থা রাতুল, সব ঠিক আছে?
না
কি হয়েছে?
যেটা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। মামার শরীরটা খারাপ করেছে। ব্লাড প্রেসার হাই
হাসপাতালে নিতে হবে?
বুঝতে পারছি না ভাইয়া।
রাতুল স্বগোতোক্তির মতন বলল
মা আর ভাইয়া যে কেন এমন শুরু করেছে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না

আমি সামনের দিকে তাকালাম। আমার সামনে মঞ্চস্থ নাটকের দৃশ দেখতে দেখতে ওইদিককার পরিস্থিতি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। জাগতিক বিষয় সম্পত্তির কাছে মানুষের আবেগ, বিবেক, অনুভূতি এমনকি প্রয়োজনও হার মানে॥ জাহিদের সঙ্গে এখন অনিমা্র বিয়েটা হলে ওদের পুরো সম্পত্তি জাহিদের হাতে চলে যাবে। এই কারণে তারা কোনভাবেই অনিমাকে হাতছাড়া করতে চাইছে না

মুনির ভাই আপনি শুনতে পাচ্ছেন? রাতুল তাড়া দিল
আমি ধীরে ধীরে বললাম

আমি বুঝতে পারছি। তুমি চিন্তা করো না আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফোন করব।
আমি ফোন রেখে এগিয়ে গেলাম। তখনো সবার মধ্যে উচ্চস্বরে বাক-বিতণ্ডা চলছে। আমি সাধারণত উচু গলায় কথা বলি না। আজ বলতে বাধ্য হলাম॥ বাবা কে উদ্দেশ্য করে বললাম
বাবা আমি একটু আপনার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই, এখানে মনে হচ্ছে অন্য কোন কিছু নিয়ে আলোচনা চলছে
কথায় কাজ হল কামাল ভাইয়ের তেমন কোন ভাবান্তর না হলেও রানু ফুপু খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন। সকাল থেকে আমি তার ওখানেই ছিলাম। আমি কতটা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি তা উনি খুব ভালো করেই জানেন। রানু ফুপু উঠে এসে আমাকে হাত ধরে টেনে সোফায় বসালেন। বললেন
এসব নিয়ে পরে কথা হবে, আপাতত ওর বিয়ের কথাটা ঠিক হয়ে যাক
ছোট চাচা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন
হ্যাঁ সেটাই ভালো। আমাকে সকালের বাসও ধরতে হবে। তোমার কি বলার আছে বল মুনির।
আমি দম নিয়ে বললাম
অনিমার বাবার শরীর ভালো নেই॥ ওর বড় ফুপু বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। এই মুহূর্তে উনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না
ওর কি আর কোন ভাই বোন নেই? ছোট চাচা জানতে চাইলেন
না, ও একমাত্র সন্তান
আর ওর এই বড় ফুপু কোথায় থাকে?
একই বিল্ডিঙই থেকে, দোতালায়
বাবা মা দুজনেই এই কথা শুনে বেশ অবাক হলেন
আসলে, বাড়িটা অনিমার দাদার দুটো ফ্লোর ওদের আর বাকি দুটো দুই ফুপুর।

একথা শুনে বাবা আর মায়ের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় আমার চোখ এড়ালো না।
বাবা বললেন বাড়িটা যেন কোন এলাকায় বলছিলে
আমি এলাকার নাম বললাম। জায়গাটা সিলেটের শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বাবার মুখভঙ্গি দেখলাম একটু শিথিল হল, তবু কথা শোনাতে ছাড়লেন না। বললেন
তা এখন কি করতে হবে আমাদের?
আপনি ফোনে ওর বাবার সঙ্গে একবার কথা বলুন॥ উনাকে জানান যে আমরা সামনে সপ্তাহে আসতে চাই
সামনের সপ্তাহে?
জি আমরা সিলেটে গিয়ে ওনাদের বাসায় কথা বলব। ছোটচাচা আপনি কি আমাদের সঙ্গে যাবেন?
যেতে তো চাই কিন্তু মনে হয় না এবার পারব। রানু তুমি চলে যাও
রানু ফুপু বলবেন
ঠিক আছে আমি চলে যাব
কামাল ভাই ফট করে বলে বসলেন
আম্মা হয়তো যাইতে পারবে না তবে আমার যাইতে কোন সমস্যা নাই
জবাবটা আমিই দিতাম তবে তার দরকার পড়লো না ফুপু বললেন
– এত মানুষের যাওয়ার দরকার নাই। বেশি মানুষ গেলে বিয়ায় ভাঙানি পরে। ভাইজান আপনি ভাবি আর আমার সঙ্গে আলিফের আব্বা যাক। আপনারা কি বলেন?
প্রস্তাবটা আমার পছন্দ হলো। আলিফের আব্বা মানে ছোট ফুপা। উনি বেশ গোছানো মানুষ, কথাবার্তায় যথেষ্ট সংযত। কামাল ভাই গেলে যে একটা ঝামেলা হত এতে কোন সন্দেহের কোন অবকাশ নেই
সকলেই সম্মত হল। বাবা অনিমার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। দুই পক্ষই জানে যে তাদের মতামতের এখানে বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। পরস্পরের সম্মান রক্ষা করে কথাবার্তা শেষ করাটাই যেন প্রধান লক্ষ্য ছিল। আমার পরীক্ষা এসে গেছে, সামনে সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেকটা সময় নষ্ট হবে এই ব্যাপারটা আমার বাড়ির কেউ না বুঝলেও আশ্চর্যজনকভাবে অনিমার বাবা বুঝলেন, কিংবা হয়ত তার দিক থেকেই কোনরকম তাড়া ছিল॥ উনি আমাদের পরের দিনই আসতে বললেন।

আমাদেরকে ওদের বাড়িতে থাকতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিন্তু বাবা রাজি হলেন না। আমরা হোটেলে উঠলাম। পরদিন তাদের আতিথিয়তা গ্রহণ করে সন্ধ্যা বেলা কথাবার্তা ফাইনাল করেই ফিরে এলাম। বলতে দ্বিধা নেই রানু ফুপু আর ফুপা থাকায় সবকিছু অনেক সহজ হয়েছে, তা না হলে বাবা-মা তাদের অসন্তোষটা লুকিয়ে রাখার কোনরকম চেষ্টাই করেননি বরং বলা ভালো প্রকাশ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন॥

ওদের বাড়িতে মেয়ে বলতে শুধুমাত্র অনিমা আর ওর বড় ফুপু। যেহেতু তাদের সঙ্গে একটা ঝামেলা চলছে কাজেই তাকে আশেপাশে খুব একটা দেখা গেল না। একবার আমাদের সঙ্গে এসে বসলেন তারপর খাওয়া দাওয়ার কথা বলে উঠে চলে গেলেন।

অনিমা ঘরে এলো আরো কিছুক্ষণ পরে, মজার ব্যাপার ওকে ঘরে নিয়ে এলো রাতুল। সেদিন আমি প্রথম ওকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলাম। কমলা রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। মা নেই তাই কেউ একটু সুন্দর করে কুচিগুলো ধরে দেয়নি। যত্ন করে চুল আছড়ে, ঘোমটায় একটা পিন আটকে দেবার কথাও হয়তো কারো মাথায় আসেনি। বারবার মাথা থেকে আঁচল পড়ে যাচ্ছে॥ ওকে দেখে আমার অদ্ভুত রকমের মায়া হল। কোন সাজসজ্জা ছাড়াই ওকে অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগে। আজ হয়ত ইচ্ছে করেই একটু সেজেছে। ঠোঁটে লিপস্টিকের ছোঁয়া, চোখে কাজল সাড়ির সঙ্গে পুরনো দিনের সোনার গয়না॥ বোঝা যায় ওর মায়ের॥ হয়তো মায়ের স্পর্শটুকু কিছুক্ষণের জন্য ধরে রাখতে চাইছিল। হাসান সাহেব মেয়েকে পাশে বসিয়ে বললেন
ও আমার একমাত্র সন্তান আমার যা কিছু আছে সবই ওর। ভাই সাহেব আমরা শুধু চাই ওর পড়াশোনাটা যেন কমপ্লিট হয়
বাবা বললেন
জ্বী ভাই কোন চিন্তা করবেন না। আমরা শিক্ষিত পরিবার।
মা শুধু একবার জিজ্ঞেস করল কি সাবজেক্টে পড়ো
অনিমা মাথা নিচু করেই বলল
জি বাংলায় অনার্স করছি
মা জবাবে কিছু বলল না, তবে তার মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা গেল যে তিনি রীতিমতন অসন্তুষ্ট

সামনের সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক হল। আমার পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু উনি পারছেন না এ কথা বলে অনিবার বাবা বেশ আফসোস করলেন। বললেন তার শরীরের অবস্থা ভালো না॥ কবে কি হয় উনি কিছুই বলতে পারেন না তাই যা করার দ্রুত করে ফেলাই ভালো॥

আমি জানি ঢাকায় ওদের তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই, এত অল্প সময়ে কোন সেন্টার খুঁজে পাওয়াটা খুবই মুশকিল এই নিয়ে রাতুলের সঙ্গে আমার আলাদা একটু আলোচনা হলো ॥ রাতুল আসলেই খুব বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী ছেলে।ঠিক হল অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে ও আর অনিমা ঢাকায় চলে যাবে১। ওর বাবা আসবে বিয়ের একদিন আগে। আমি আর রাতুল মিলে সেন্টার ঠিক করলাম।

এই পর্যায়ে এসে একটা ব্যাপার দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি করে সামাজিকতার সামনে সম্পর্ক এমনকি সাধারণ চক্ষু লজ্জাও তুচ্ছ হয়ে যায়। বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন এই মুহূর্তে কোন অনুষ্ঠান করা, মানে বৌভাত করা তার পক্ষে সম্ভব না। আত্মীয়-স্বজনদের উনি এখন কিছুই বলতে পারবেন না। তাছাড়া প্রস্তুতি দেওয়ার মতন যথেষ্ট সময়ও নেই। শুধুমাত্র বিয়ের অনুষ্ঠানটাই হবে সে ক্ষেত্রেও মেয়েকে আমাদের পক্ষ থেকে কিছুই দেয়া হবে না। মা ও সে কথায় সম্মতি দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সারা জীবন মায়ের কাছে শুনে এসেছি আমার বউকে জন্য তার কত কি দেবার আছে। কত বিশেষ উপহার তোলা আছে, অথচ মা ও এখন বাবার সঙ্গে একমত। জীবনে প্রথমবারের মতন আমি উপার্জনক্ষম নই বলে বড্ড অনুশোচনা হল।

চলবে………

অনির পর্ব-১১

0

অনির

একাদশ পর্ব

অনিমার বাবা রাজী হলেন না। আমি এক বছর সময় চেয়েছিলাম উনি নানান যুক্তি দিয়ে আমাকে বোঝালেন যে কেন সেটা সম্ভব নয়। আমি তাঁর কোন যুক্তিই ফেলে দিতে পারলাম না। নাস্তা শেষে ড্রয়িং রুমে বসে চা খেতে খেতে উনি বললেন

দেখো মুনির, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি যদি আরেকটু এডভান্স পজিশনে থাকতে, আমি কখনো তোমাকে মানা করতাম না। একটা কথা তুমি চিন্তা করে দেখো, তোমার এখনো অনার্স কমপ্লিট হয়নি, আরো এক বছর বাকি; এরপর মাস্টার্স এবং থিসিস মিলিয়ে আরও এক থেকে দেড় বছর তারও পরে তুমি পি এইচ ডি করতে যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পিএইচডির ব্যাপারে অভিজ্ঞ তাই বলতে পারি পিএইচডির করতে তুমি তোমার ফ্যামিলি নিয়ে যেতে পারবে না, সে পরিমাণ ফান্ডিং অ্যাপ্রুভ হওয়া খুবই বিরল। ধরে নিচ্ছি তুমি একাই যাবে, সেখানে আরো পাঁচ বছর। এই সাত আট বছর আমার মেয়েটার কি হবে। সেটাও মেনে নিতাম যদি আমি সুস্থ থাকতাম। সব কথা আমি অনিমাকে বলি না। এমনিতেই ওর মা চলে যাবার পর মেয়েটা খুব মনমরা হয়ে থাকে। আমার হাতে এতো সময় নেই। আমি ওকে এরকম একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যেতে পারি না।

আপনি কি চাইছেন এই জানুয়ারি মাসেই বিয়ে হোক?
আমার সেই রকমই পরিকল্পনা
যদি জানুয়ারিতেই আমি বিয়েটা করি তাহলে কি আপনি রাজি হবেন?
টেকনিক্যালি আমার রাজি হওয়া উচিত না, কারণ সমস্যাগুলো কিন্তু জানুয়ারিতে বিয়ে হলেও থেকেই যাচ্ছে
আমার সঙ্গে বিয়ে না হলেও তো মাস্টার্স শেষ হওয়া পর্যন্ত ও হলেই থাকবে, তাই না?
সেটাই তো থাকা উচিত
সেই ক্ষেত্রে তো এখনো দুই বছর সময় আছে আপনি যদি চান বিয়েটা জানুয়ারিতেই হবে। আর পি এইচ ডির ব্যাপারে যেটা বলছেন, আমি যদি ওকে নিয়ে যেতে না পারি তাহলে আমি পিএইচডি করবো না দেশেই ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করব
আমি তাকিয়ে দেখলাম ওনাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। তর্জনী দিয়ে নিজের চিবুক ঘষতে ঘষতে বললেন
এখানেও কিন্তু সমস্যা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
কি সমস্যা
আমি নিশ্চিত তুমি তোমার পরিবারের সঙ্গে এখনও কথা বলোনি। উনাদের রাজি না হওয়ার খুব হাই পসিবিলিটি আছে।
এত বিপদের মধ্যেও আমি হেসে ফেললাম, উনার কথাটা একেবারেই ভুল নয়।
উনি নিজেও হাসলেন, বলেনন
দেখলে তো, আমি ঠিকই ধরেছি। সত্যি কথা বলতে তোমার বাবা-মায়ের জায়গায় আমি হলেও খুব বিরক্ত হতাম। তোমার এত চমৎকার রেজাল্্‌ এত ব্রাইট ফিউচার সামনে, এসব ফেলে এই মুহূর্তে বিয়ে করাটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আমি আপনাকে একটা কথা সত্যি করে বলি?
বল
ভালো রেজাল্ট কিংবা ব্রাইট ফিউচার এর জন্য একটা মিনিমাম মেন্টাল স্ট্যবিলিটির দরকার হয়। এই মুহূর্তে যদি ওর বিয়েটা অন্য জায়গায় হয়ে যায়, আমি হয়তো আর পড়াশোনাই কন্টিনিউ করতে পারবো না।
এবার উনাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। উনি বললেন
তোমরা তো পরস্পরকে চেনো এক বছর ধরে তাই না?
জি
এর মধ্যে কয় বার তোমাদের দেখা হয়েছে?
চার বারের মতন
এত অল্প সময়ে কোন সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমার ধারণা এই সাময়িক আবেগ তোমরা কাটিয়ে উঠতে পারবে

আমি খুব ধীরে ধীরে টের পাচ্ছি যে আমি পরাজিত হচ্ছি, পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে শুধু হাতের তরবারি খসে পড়া বাকি।
আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম
পারতাম, যদি আবেগটা সামরিক হতো।
আমি অনিমার কাছে তোমার ব্যাপারে যতটুকু শুনেছি তুমি খুবই রেস্পন্সিবল এবং প্র্যাকটিকাল একটা ছেলে। আমার মনে হয় একটু চেষ্টা করলেই তুমি তোমার ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে পারবে। সব দিক দিয়ে এটাই ভালো হবে যে তোমরা পরস্পরের সাথে আর যোগাযোগ না করো।

এবার আমার নিজেকে সম্পূর্ণই পরাজিত মনে হল। আক্রমণাত্মক তো দূরে থাক রক্ষণাত্মক অবস্থানেও আমি আর নেই, শুধু শেষ আঘাতটার অপেক্ষা, তারপরে হয়তো হাতের তরবারি খসে পড়ে যাবে আর আমি পুরোপুরিভাবে পরাস্ত হব। এই মুহূর্তে গা ছাড়া দিয়ে ওঠে না দাঁড়ালে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আমি নিজের শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে বললাম
আপনি কিন্তু শুধু আমার কথা ভাবছেন, ওর কথা একবারও ভাবছেন না
হাসান সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত হলো। উনি বললেন
কিরকম
আপনি যদি এখন রাজি না হন তাহলে আমার জীবনে বিশেষ কোন পরিবর্তন আসবে না কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য একজনকে মেনে নেওয়াটা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনি জানেন ও খুব সেনসিটিভ, নরম মনের এবং আবেগপ্রবণ একটা মেয়ে। ওর ফিউচার সিকিউর করতে গিয়ে ওর কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না তো।
উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন
মাত্র চার বার দেখায় ওকে এতখানি জানা, আমাকে বেশ অবাক করছে।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম
আসলে আমরা গত এক বছর ধরে কন্টাক্ট এ আছি। আপনি হয়তো জানেন না আমরা একজন আরেকজনকে চিঠি লিখছি প্রায় বছর খানেক ধরে। মানসিকভাবে আমরা পরস্পরের প্রতি অনেকখানি নির্ভরশীল, এই মুহূর্তে এইরকম একটা পরিস্থিতির জন্য আমাদের দুজনের কেউই প্রস্তুত নই।
হুম
আমি আবারো বললাম
আপনার কাছে আমি একটা অনুরোধ করবো, আমাকে একটু সময় দিন। আমি আমার ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি।

তোমার মনে হয় জানুয়ারিতে বিয়ের ব্যাপারে তোমার ফ্যামিলি রাজী হবে?

জি
তুমি নিশ্চিত? তারা রাজি না হলে কিন্তু আমি কিছুই করতে পারবোনা
আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন, শুধু আমাকে একটা কথা দিন জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত আপনি আমাকে সময় দেবেন। আমি পরীক্ষাটা শেষ করেই আমার ফ্যামিলিকে নিয়ে আসব।
তোমার সামন পরীক্ষা? হাসান সাহেব বেশ অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
জি সামনে্র সপ্তাহ থেকে শুরু হবে
এই অবস্থায় তুমি পড়াশোনা ফেলে এখানে এসেছ?
আমার আর কোন উপায় ছিল না। না এলে আমি পড়াশোনা করতে পারতাম না
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো কিন্তু তারপর আর নয়
ধন্যবাদ আঙ্কেল
আমি উঠে দাঁড়ালাম। উনি অবাক হয়ে বললেন
তুই কোথায় যাচ্ছ ?
আমি আজ আসি। আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। যাবার আগে কি একবার ওর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
হাসান সাহেব হেসে ফেললেন, বললেন
তুমি এত ব্যস্ত কেন, আমি তোমাকে বিকেলের ট্রেনে উঠিয়ে দেবো। তুমি দুপুরে খেয়ে তারপর যাবে।
জি আচ্ছা
তুই তো চা ও খাওনি। বসে, চা টা শেষ কর
আমি কিছু বললাম না তবে বসলামও না। উনি কি ইচ্ছা করেই দেখা করার বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন?
আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন
অনিমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ছাদে চলে যাও। তোমার চা না হয় ওখানে পাঠিয়ে দেবো।
এতটা অবশ্য আমি আশা করিনি। ছাদের সিঁড়িটা আগেই দেখেছিলাম, উঠে গেলাম তবে ছাদের দরজার দাড়িয়ে একটু ধাক্কা লাগলো। অনিমা দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে তার পাশে আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে, শক্তপোক্ত গড়ন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। অনিমা আমার দিকে পিছন ফিরে থাকায় আমাকে দেখতে পায়নি। আমি ওদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছি।
ভদ্রলোক বলছেন
রাতের বাসে ওই ছেলের সঙ্গে এসেছিস শুনে মা একটু আপসেট হয়েছে। তুই একটু কথা বলে নিস
আমি শুধু রাতের বাসে ওর সঙ্গে আসিনি আগের দিন চট্টগ্রামে ওর হলেও গিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাও একসঙ্গে এসেছি
ভদ্রলোক কাধ ঝাকিয়ে বললেন
আমাকে এসব করে কোন লাভ নেই। আমার এই সবে কোন সমস্যা নেই। বিয়ের আগে এমন থাকতেই পারে, আমারও আছে
আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না এ কথা জানার পরও বারবার তুমি একই প্রসঙ্গ কেন তুলছো
কারন তোর আর কোন অপশন নেই। মামা ওই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়েতে কিছুতেই মত দেবে না
বাবা ওর সঙ্গে বিয়েতে মত দেবে কি দেবে না আমি জানিনা তবে আমি তোমার সঙ্গে বিয়েতে মত দেব না
ভদ্রলোক শব্দ করে হাসছেন, তার হাসিটা আমার ভালো লাগছে না, এভাবে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনতেও ভালো লাগছে না। আমি দরজার মৃদু করাঘাত করে বললাম
ভেতরে আসতে পারি?
উনি আমাকে দেখে একটু চমকালেন তবে সেটা সেই ভাবে প্রকাশ করলেন না। কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
আমি জাহিদ। তুমি নিশ্চয়ই মুনির। কিছু মনে করো না তুমি বললাম। তুমি আসলে আমার অনেক জুনিয়র হবে
না কিছু মনে করিনি, ভালো আছেন আপনি?
হ্যাঁ, ভালো আছি। তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না। অনিমার কাছে তোমার কথা শুনেছি তবে তোমাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না যে তুমি এতটা হ্যান্ডসাম। এজন্যই বোধহয় আমিনা তোমার প্রেমে পড়েছে
জাহিদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও হাসছে। আমাদের দৃষ্টি বিনিময়ে কোন কথা না বলেও আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেল। আমাদের এই অব্যক্ত কথোপকথন বোধহয় তার ভালো লাগলো না। তিনি বললেন
তোমরা কথা বলো আমি আসছি।
উনি চলে যাবার পর অনিমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
বাবা কি বললেন
জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন এর মধ্যে আমি বাসায় কথা বলব
তোমার পরীক্ষার আগে অনেক ঝামেলা হয়ে গেল, তাই না
আমি ওর কথার জবাব দিলাম না। ওর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম
সাবধানে থেকো। আমি খুব তাড়াতাড়ি আসবো, তোমাকে নিয়ে যেতে। ততদিন অপেক্ষা কর।
সাড়ে বারোটার বাসে আমি ফিরে এলাম। ওর বাবা নিজেই আমাকে বাসে তুলে দিলেন। ফেরার আগে ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে কেবল একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম। আমি জানতাম ও ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে, বাগান বিলাসের ঝাড়ের আড়ালে একবার দেখলাম ও হাত তুলে চোখ মুছছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যদি ও তখন জানতাম না যে বাড়ি ফেরার পর মন আরো খারাপ হবে।

চলবে……

অনির পর্ব-১০

0

দশম পর্ব

অনিমার বাবা প্রথমেই আমাকে যে প্রশ্নটা করলেন সেটা হল
তোমার ফিউচার প্ল্যান কি
এই প্রশ্নটার জন্য আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম, যদিও জানি এর উত্তর যেকোনো মেয়ের বাবারই ভালো লাগবে না; কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে উনি বললেন
বাহ! এতো খুব ভালো কথা। মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি; খুবই ভালো পরিকল্পনা। তোমাকে কি টিচিং এ যাওয়ার ইচ্ছা?
জি আঙ্কেল
তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি নিজেও শিক্ষকতা করি।
আমি মনে মনে একটু চমকালাম, তবে সেটা প্রকাশ করলাম না। আমি সত্যিই জানতাম না অনিমার বাবা শিক্ষকতা করছেন। অনিমা কখনো আমাকে বলেনি ওর বাবা কি করেন, আমিও কখনো জিজ্ঞেস করিনি। আজই জানতে পারলাম যে উনি সিলেট সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।

আমরা বসেছি বাইরের ঘরে। ওদের বাড়িটা বেশ পুরনো ধাচের, খাবার ঘর এবং বসার ঘর আলাদা আলাদা। পর্দা সরিয়ে কেউ একজন আমাদের খেতে ডাকলো। আমি দরজার দিকে পিছন ফিরে বসায় তাকে দেখতে পেলাম না। হাসান সাহেব বললেন চলো নাস্তা খেতে খেতে কথা বলি

আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি আজ সকাল আটটায়। পুকুর পাড় থেকে আমি ওকে সোজা হিয়ার কাছে নিয়ে যাই। ওকে দেখে হিয়ার উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না । অনিমা একটু অস্বস্তি বোধ করছিল কিন্তু হিয়ার আন্তরিকতার কাছে পরাজিত হলো। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার টিকেট কাটলাম তারপর ইমেইল করে চেয়ারম্যন স্যারকে জানালাম জরুরী প্রয়োজনে ঢাকা যেতে হচ্ছে। কাজ শেষ করে হলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। রাতের খাবার সময় হয়ে গেছে, খেতে ইচ্ছা করছে না। সামনে খুব কঠিন কিছু সময় আসছে। সাধারণত এরকম দুর্যোগময় সময়ে মানুষের পরিবার তাঁর পাশে দাঁড়ায়, তাকে সাপোর্ট করে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ব্যপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত, আমাদের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের পরিবারের।

দুশ্চিন্তায় সারারাত আমার ঘুম হলো না। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম এল, সকালবেলা উঠতেও দেরি হয়ে গেল। নয়টার সময় আমাদের রওনা দেবার কথা। আমি দ্রুত গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লাম। অনিমাকে হল থেকে তুলে নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে গেলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার জার্নি সে সময় বেশ দীর্ঘ ছিল। পুরো পথ ও আমার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলল না। খেতে বললাম যখন খেল ও না ঠিক মতন। হয়তো আমার মতন ও দুশ্চিন্তায় আছে অনেক। হয়তো আমার উপর ভরসা করতে পারছে না। আমি অবশ্য ওকে কোনো ধরনের আশ্বাসও দেইনি, কিছুই বলিনি, শুধু বলেছি আমি ওর বাবার সাথে কথা বলতে চাই।

ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি ওকে ওর হলের সামনে নামিয়ে দিলাম। বললাম
অনেক ধকর গেছে একটু বিশ্রাম নাও। কাল দুপুরে দেখা হবে। দুটোর পরে এসে কল দিব।
আমি তাকিয়ে দেখলাম ও ভিতরে যাচ্ছে না। ওকে কেমন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরাজিত মানুষের মতন মনে হচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কার মতন লাগলো। ও কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, নাকি ভরসা করতে পারছে না। আমি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বললাম
কি হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে?
ও ভাঙ্গা গলায় বলল
তুমি কি বাসায় যাবে এখন?
না, বাসায় যাব না। হলে থাকব আজ, আমার বন্ধুর সঙ্গে। কিছু লাগবে? আমি আসবো আবার রাতে?
তুমি কি সত্যিই সিলেটে যাবে?
হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল
বল
রাতের বাসে আমার সঙ্গে যেতে তোমার কোন সমস্যা আছে?
ও খুব অবাক হয়ে বলল
না, সমস্যা থাকবে কেন?
আমার খুব সকালেই সিলেট পৌঁছাব
সমস্যা নেই
তাহলে কাল রাতের টিকেট কাটছি, রাত দশটার
আচ্ছা দুপুরে আসবে না তাহলে আর?
ওর বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম
আসবো না কেন? তুমি চাইলে সকাল থেকে এসে বসে থাকব
এতক্ষণ পর ও একটু হাসল। আমি তৃষিতের মতন চেয়ে রইলাম। ওর এই একটুখানি হাসি দেখার জন্য আমি যত কষ্ট করতে হয়, করতে রাজি আছি।

দুপুরে আসবো বললেো আসতে পারলাম না, ঝামেলায় আটকে গেলাম। টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক কাজ ফেলে এসেছি, একটা দিন নষ্ট করা কোনভাবেই সম্ভব না। এখন মোবাইলের যুগে বিষয়গুলো যত সহজ মনে হয় সে সময় ততটা সহজ ছিল না। আমি আসতে পারছি না এই কথাটা ওকে জানাতেও পারিনি। আমি নিশ্চিত ও আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, হয়তো দুপুরের খায়নি, একসঙ্গে খাবে বলে॥ আমার নিজেরও খেতে ইচ্ছা করল না, কাজ মিটিয়ে আমি ব্যাংকে গেলাম, সেখান থেকে নীলক্ষেত। কয়েকটা বই দরকার ছিল সেগুলো নিয়ে ওর হলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

আমাকে দেখে ও আঁতকে উঠলো । বলল
তোমার এই অবস্থা কেন? কোথায় ছিলে সারাদিন?
আমি হাসলাম একটু, টিকেট দুটো ওর হাতে দিয়ে বললাম
একটু ঝামেলা গেছে। এখন সব ঠিক আছে। কোথাও বসবে?
না। তুমি এখন হলে যাবে। গোসল করবে, খাবে তারপর ঘুমাতে যাবে। রাতে একবারে আমাকে এখান থেকে নিয়ে স্টেশনে যাবে। যাও এখন।
আমি আপত্তি করলাম না। আমার আসলেই একটু বিশ্রামের দরকার। শহীদুল্লাহ হলে আমার এক বন্ধু থাকে। ওর ওখানেই কাল ছিলাম। আমি ওখানেই চলে গেলাম।

বাসে ওকে জানালার সামনে বসিয়ে আমি বললাম
আমি কিছু খাবার কিনে নিয়ে আসি
খাবার আমি নিয়ে এসেছি। তুমি শুধু পানি কিনে আন
আমি পানির সঙ্গে আরও কিছু শুকনো খাবার কিনে আনলাম। বাস আজ সময় মতই ছাড়লো। ও আমার দিকে খাবারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল
খাও, সারাদিন নিশ্চয়ই কিছু খাওনি। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বক্সের ভেতর গরম খিচুড়ি ডিম ভাজা, আলু ভর্তা। দুদিন পর মনে হয় এত আরাম করে খেলাম। খিচুড়ি আমার খুব প্রিয় খাবার। ছোট ফুফুর হাতের খিচুড়ি আমি ভীষণ পছন্দ করি। অনেকদিন পর সেই স্বাদটা মনে পড়ে গেল। খেতে খেতে ও বলল
আমার রান্না তো ভালো না, কষ্ট করে খেয়ে ফেলো
তোমার অন্য রান্না তো খাইনি। তবে তোমার খিচুড়ি অসাধারণ
ও লজ্জা পেয়ে একটু হাসলো।

বাসের মধ্যে এখনো ঘুম নেমে আসেনি। আমরা দুজন হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে গল্প করছি। টিভিতে নাটক চলছে॥ আরো ঘন্টাখানেক পর বাসের বাতি বন্ধ হয়ে গেল, টিভি বন্ধ করে গান চালু হলো। ও আমার কাধে মাথা রেখে খুব আস্তে আস্তে বলল
আমার ভীষণ ভয় করছে
আমি ওকে বলতে পারলাম না যে আমার ওর চাইতেও অনেক বেশি ভয় করছে। ওর বাবার কিংবা আমার পরিবারের মুখোমুখি হবার ভয় নয়। সব কিছুকে ছাপিয়ে আমার ভীষণ ভয় করছে এটা ভেবে যে যদি আমি ওকে হারিয়ে ফেলি। আমি ভিষণ আস্তিক ধরনের মানুষ। মনেপ্রানে বিশ্বাস করি যদি সৃষ্টিকর্তা না চান তাহলে আমি কখনই ওকে পাব না। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অন্য হাতে ওর চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে বললাম
চিন্তা করো না সব ঠিক হবে ইনশাল্লাহ।
ওকে কেমন যেন নিশ্চিন্ত মনে হল। ধীরে ধীরে টের পেলাম ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ঘুমাতে পারলাম না। ভয়, অনিশ্চয়তা , দুশ্চিন্তা মিলেমিশে আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো। হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা দ্রুতগামী ট্রাকের আলো হঠাৎ হঠাৎ এসে পড়ছে জানালার কাচ ভেদ করে। সেই ছিটকে পড়া আলোয় ওর মুখটা দেখে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। আমি ওর একটা হাত আমার বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলাম।
বাসের মধ্যে খুব লো ভলিউমে একটা বাংলা গান চলছে। গানের কথা এবং সুর আমার ভারাক্রান্ত হৃদয়কে আরো বিষন্ন করে তুলছিল। যেন এই কথাগুলো
গানের কথা নয় আমার নিজেরই কথা

দিয়েছিলে যা, নিয়ে নিতে পারো
লেখা কবিতা, গাওয়া গান যত,
খুঁজে দেখ না, পাবে না কেউ আমার মত
মুছে দিও না শুধু হৃদয় ক্ষত।

চলবে……

অনির পর্ব-০৯

0

নবম পর্ব

এই পুকুরটা তোমাকে দেখানোর খুব শখ ছিল আমার
ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
আমারও দেখার খুব শখ ছিল
আমরা বসে আছি আমার ক্যাম্পাসের লেকের ধারে। শরৎ শেষ হয়ে হেমন্ত শুরু হয়েছে কেবল। এবার বৃষ্টি ভালো হওয়াতে গাছের পাতায় ধুলোর আস্তরণ নেই। গরম ও অপেক্ষাকৃত কম। দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হতে শুরু করেছে। পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে পুকুরের পানিতে।
আমার রুম থেকে বেরিয়ে ওকে নিয়ে এসেছি আমার ক্যাম্পাসে। ওর সহজ হতে অনেকটা সময় লেগেছে। আমি জানি ও খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। হুট করে সবকিছু বলতে পারবে না, তাই ওকে বাইরে নিয়ে গেছি। নিঃসন্দেহে ও পথে কিছুই খায়নি। ওকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। অগত্যা এখানে নিয়ে এসেছি, যদি কিছু বলে।

এই পুকুরের কথা একবার ওকে লিখেছিলাম চিঠিতে, বলেছিলাম এই পুকুরের জলে তাকিয়ে থাকলে তোমাকে দেখতে পাই। ক্লাসের ফাঁকে আমরা প্রায়ই এখানে এসে বসতাম। সে সময় আমি ওকে দেখিনি। তখন আকাশের মেঘে, পুকুরের জলে রাতের আকাশের তারায় শুধু ওর মুখ খুঁজতাম। আর যখন ওকে দেখলাম আমার সব কল্পনা হারিয়ে গেল; মনে হল মনের মধ্যে যে শূন্যস্থানটা ছিল তা যেন পুরোপুরি ওর মাপেরই। এই কথাটা কোন একটা বইতে পড়েছিলাম।বাস্তবে এমন ভাবে তা সত্যি হতে পারে সে সময় অনুভূব করতে পারিনি।
ও আনমনা হয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম
এবার বলতো সত্যি করে, কি হয়েছে?
ও আমার দিকে তাকালো। আমার বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বোধ হয় ও ভয়ানক কোন কথা বলবে আর আমার জীবনটা পুরোপুরি বদলে যাবে॥
আমি ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ, চট করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করি না। ও একটু দম নিল। বোধ হয় মনে মনে গুছিয়ে নিল কি বলবে। তারপর বলল

একটু পেছন থেকে বলতে হবে তা নাহলে সবটা বোঝানো যাবে না
বলতে থাকো, আই এম এ গুড লিসেনার
ও একটু দম নিয়ে বলা শুরু করল
বাবার অসুস্থতার কথা তো তোমাকে আগেই বলেছি। এবার যে স্ট্রোকটা করেছে এটা সেকেন্ড স্ট্রোক ছিল। এর আগে বাবা আরেকটা স্ট্রোক করেছিল। সেই সময় আমার পরীক্ষা চলছিল বলে কেউ আমাকে জানায়নি। সে সময় অবশ্য জাহিদ ভাই বাসায় ছিলেন। জাহিদ ভাই আমার ফুফাতো ভাই । বড় পুকুর বড় ছেলে।

তোমাকে বলা হয়নি, আমরা যে বাড়িটাতে থাকি এটা আমার দাদার বাড়ি। আমাদের ছোটবেলায় একতলা বাড়ি ছিল। পরবর্তীতে গ্রামের অন্য সব সম্পত্তি বিক্রি করে এই চার তলা বাড়িটা তৈরি করা হয়। দাদাভাই বেঁচে থাকতেই বাবা আমাদের গ্রামের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে এই বাড়িটা চারতলা বানিয়েছেন। দাদাভাই চাইতেন ভাই বোনের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকুক তাই মৃত্যুর আগে এই বাড়িটা আমার দুই ফুফু আর বাবাকে লিখে দিয়ে যান। বাবার কোন ভাই নেই তাই তিন তলা চারতলা নিয়ে আমরা থাকতাম দোতলায় আমার বড় ফুফু থাকে। একতলাটা ছোট ফুফুর নামে। ছোট ফুপু এখানেই থাকে চট্টগ্রামে।
যেটা বলছিলাম, এবার যখন বাবা অসুস্থ হয় তখন রাতুল মানে বড়ফুফুর ছোট ছেলেই সব করেছে। রাতুল আমার সমবয়সী। শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমি যেদিন সিলেটে পৌঁছাই সেদিন জাহিদ ভাইও এসে পৌঁছলো। তারও এক সপ্তাহ পর আমরা বাবাকে বাড়িতে নিয়ে গেলাম।

বাবা শারীরিকভাবে যতটা না, তার চাইতে বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এমনিতেই মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা অসুস্থ থাকতেন। বাড়ি ফেরার পর সব আত্মীয় স্বজনেরা বাবাকে দেখতে আসে। সেসময়য় ছোট ফুফু সেখানে আসে।

এতোটুকু বলে ও একটু থামলো। আমি বললাম

তারপর কি হল? সবাই চাইছে জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়েটা হয়ে যাক?

ও চট করে একবার আমার দিকে তাকালো। বলল
তুমি কি করে বুঝলে?

এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ক্যালকুলেশন। তারপর কি হল বল।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না তাই রাতুলের সঙ্গে কথা বললাম। রাতুলের পরামর্শ মতই জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। জাহিদ ভাই যেটা বলল তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না
কি বলল?
বলল, যেটা হচ্ছে হতে দে। এখন এসব বলে মামাকে আর টেনশনের মধ্যে ফেলিস না
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমি যতদূর জানতাম জাহিদ ভাইয়ের পছন্দের কেউ আছে। আবারো বললাম, জাহিদ ভাই আমি একজনকে ভালোবাসি আমাদের সম্পর্ক প্রায় এক বছরেরও বেশি।
জাহিদ ভাই বলল এটা কোন ব্যাপারই না। বিয়ের আগে এরকম একটা দুইটা সম্পর্ক থাকেই। আমি ওসব নিয়ে পরবর্তীতে তোকে কিছু বলবো না। বড়দের কথা শুনে এতটা ভয় পাইনি কিন্তু….
তোমার এই জাহিদ ভাই কি করেন?
বিসিএস ক্যাডার, রাজশাহীতে পোস্টেড
ও আচ্ছা, তারপর কি হল বল
আমি রাতুলকে দিয়েও তাকে বলালা্‌ লাভ হলো না। শেষমেশ উপায়ান্তর না দেখে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি। বাবা সব শুনে তোমার ব্যাপারে জানতে চাইলো
তুমি কি বললে
সেটা সত্যি তাঁর সবই বলেছি।
উনি কি বললেন?
অনিমা জবাব দিল না, চুপ করে রইল। আমি একটু হাসলাম। বললাম
উনি রাজি হয়নি তাই তো?
হু
ঠিক কি বলেছেন কোথায় আপত্তি?
বাবার কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে এত দায়িত্ব নেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না তাছাড়া তোমার ফ্যামিলি ও মেনে নেবে না।
বিয়ে কবে?
ও চমকে আমার দিকে তাকালো। বলল
মানে?
মানে, বিয়ের তারিখ কবে ঠিক হয়েছে?
ও খুব আস্তে আস্তে বলল
জানুয়ারিতে। যেদিন সব ঠিক হয় আমি তারপর দিনই ফিরে যাই॥ এসব চিঠি লিখে তোমাকে জানাতে পারতাম কিন্তু আমার একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করছিল। কিছু ভাবতে পারছিলাম না তাই চলে এসেছে
ভালো করেছো। এখন চলো
কোথায় যাব
আজ তারটা তুমি হলে থাকবে হিয়ার সঙ্গে\
হিয়া কে?
আমার ক্লাসমেট। সমস্যা হবে না ও তোমার কথা জানে
আমার কথা ?
হ্যাঁ আমি ওকে দিয়ে তোমার বাড়িতে ফোন করিয়েছিলাম
ও অবাক হয়ে বলল, কবে?
পরশুদিন। এখন চলো তো কাল সকালে রওনা দিতে হবে।
কোথায় রওনা দেব?
ঢাকায়
কাল ঢাকা আর পরশুদিন আমরা সিলেট যাব । আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব।
কি কথা বলবে
এক বছর সময় চাইবো।
তোমার বাসায় জানাবে না ?
এই মুহূর্তে না। এখন ওঠো তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ও আমার একটা হাত ধরে বলল
মুনির
বল
বাবা রাজি হবে না
আমারও সেরকম ধারনা। তবু আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই ; যদি রাজি না হন তাহলে আমি বাসায় কথা বলব।

চলবে………

অনির পর্ব-০৮

0

অষ্টম পর্ব

তুমি এখানে?
আমি ভূত দেখার মতন চমকে উঠলাম। সাধারণত ছুটির দিনে আমি দুপুরের খাবার পর একটু বিশ্রাম নেই। পরীক্ষা এসে গেছে তাই খাওয়া শেষ করে রুমে এসে তৈরি করে নিচ্ছিলাম একটু লাইব্রেরী যাব বলে। দরজার কাছে এসেই যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল বোধহয় স্বপ্ন দেখছি। আমার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অনিমা। মুখে ক্লান্তির ছাপ, চুল এলোমেলো; বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘ যাত্রার ধকল ওকে পেয়ে বসেছে। আমার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ও ফ্যকাসে একটু হাসলো। তারপর বলল
ভেতরে আসতে বলবেনা?
আমি ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলাম। বললাম
তুমি এখানে কেমন করে এলে? একাই এসেছো?
ও চারিদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। মানে একাই এসেছে। আমি আবারও বললাম
ঢাকা থেকে একা এসেছো? আমাকে একবার ফোন করতে পারতে। এভাবে একা একা এখানে আসাটা তোমার একেবারেই উচিত হয়নি। তোমাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দিল কে?
মুহূর্তেই ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ও থমথমে কণ্ঠে বললো
আমি তোমার রুম নাম্বার জানি।

আমি অসম্ভব ঠান্ডা মাথার মানুষ, চট করে বিচলিত হয়ে যাই না; তবুও আমার মাথা কাজ করছিল না। অনেক রকম চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, বারবার মনে হচ্ছিল। কি হতো যদি আমি রুমে না থাকতাম, যদি ও অন্য কারো খপ্পরে পড়ে যেত। কত রকম বিপদ হতে পারতো ঢাকা থেকে এখানে আসার পথে। আমি গম্ভীর গলায় বললাম

তোমার এভাবে রুমে চলে আসাটা উচিত হয়নি, নিচে থেকে ফোন করতে পারতে বা কাউকে পাঠাতে পারতে

আমি ওর নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই বিচলিত ছিলাম যে একবারের জন্যও মনে হলো না যে ওইভাবে ও এখানে ছুটে এসেছে নিশ্চয়ই বড় রকমের কোন সমস্যা হয়েছে। আমার মাথায় তখন অন্য সব দুশ্চিন্তা ঘুরছিল মনে হচ্ছিল যদি কোন বিপদ হতো। আমার কথা শুনে ও কেমন কেঁপে উঠলো,

কাঁধে ব্যাগ তুলে নিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল

ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। তোমাকে একবার দেখতে ইচ্ছা করছিল এজন্য এসেছিলাম। তোমাকে বিপদে ফেলতে আসিনি

তারপর আর এক মুহূর্ত দাড়াল না, দরজার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। আমি ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। ও দরজার কাছে চলে এসেছে। চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। মুখ নামিয়ে রেখেছে তবুও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওর চোখ ভর্তি হয়ে আছে জলে।
ও দরজার কাছে এসে বলল
দরজা ছাড়ো, আমি বের হব
কোথায় যাবে এখন?
ফিরে যাব
এখন কি করে যাবে, এ সময় তো কোন বাস ট্রেন কিছুই নেই
তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি যেভাবে একা এসেছি সেভাবে একাই যেতে পারবো।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি রাগ রে বাবা! একটুখানি কথা বলেছি তাতেই এত অভিমান? আমি কি এমনি এমনি বলেছি ওর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল বলেই তো বললাম। ও দরজার আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে আবারো বলল
দরজা ছাড়ো
এত কাছে থেকে আমি ওকে আগে কখনো দেখিনি। ওর গোলাপী গাল অভিমানে লাল হয়ে আছে, চোখের পাতা ভেজা আর নিচের ঠোঁটটা তির তির করে কাঁপছে। আমি হঠাৎই নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারালাম, দুই হাতে ওকে নিটোল মুখটা তুলে ধরে বললাম
আমাকে দেখতে এসেছ, না দেখেই চলে যাবে?
ও জবাব দিলো না একবার চোখ তুলে চাইল না পর্যন্ত। আমি আর একটু এগিয়ে এসে ও টুল্টুলে মুখটা দু চোখ ভরে দেখতে লাগলাম। চোখের পাতার কাঁপন, অভিমানী ফুলে ওঠা ঠোঁট । আমার ভিতরে কি করে যেন হঠাৎ সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। আমি ওকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলাম।

আচমকা আমার এমন আচরণে ও কেমন একটু কেঁপে উঠল, তবে বাধা দিল না। আমি জীবনে কখনো কোন মেয়ের এত কাছে আসিনি। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে আমি যে এমন কিছু করতে পারি আমার ধারনাতেও ছিল না। যে সময়কার কথা বলছি তখন এটা খুব সাধারণ কোন ঘটনা ছিল না। এই কারণে আমি অনেক সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাঁর চেয়েও বড় যেটা, আমি ওর শরীরে সমর্পণের ভাষা টের পাচ্ছিলাম। ও আমার বুকের কাছে শার্টের অংশটা খামচে ধরেছে এত জোরে যে মনে হচ্ছে ছিড়েই ফেলবে।

আমি কতটা সময় ওর মধ্যে ডুবে ছিলাম নিজেও জানিনা, এক সময় টের পেলাম ওর ভেজা গাল। মুহূর্তেই আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। এটা কি করছি আমি? একটা বন্ধ ঘরে এইভাবে একটা অসহায় মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি। কতটা ভরসা করে ও আমার কাছে এসেছে। কতটা ভালবাসলে, কতটা নির্ভর করলেই এভাবে আসা যায়, আর আমি তার এই প্রতিদান দিচ্ছি। তীব্র অপরাধবোধে আমি কেমন কুঁকড়ে গেলাম। ওকে ছেড়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললাম

অনিমা আই এম সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে।
ও কিছু বলছে না, মুখ নামিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর চোখের ভাষা পড়তে পারছি না। ও কি রেগে আছে নাকি এই মুহূর্তে আমাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করছে। যেটাই হোক না কেন দুটোর কোনটাই নেয়ার মতন ক্ষমতা আমার নেই। আমি আবারো বললাম
অনিমা এদিকে দেখো, একবার তাকাও আমার দিকে। ও মুখ তুলে চাইল। ওর চোখে কি ছিল আমি জানিনা তবে সেই দৃষ্টি দেখে আমি শিউরে উঠলাম। সাহস সঞ্চয় করে বললাম
তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?
ও মুখ নামিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়লো
ভয়ে উৎকন্ঠায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, বারবার মনে হচ্ছে এই বোধহয় ও চোখ তুলে আমার দিকে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকাবে। আমি আবারো বললাম
বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু চাইনি।
ও কোন জবাব দিচ্ছে না। আমি মরিয়া হয়ে বললাম
কিছু একটা বলো প্লিজ
ও আচমকাই দুই হাতে আমার গলার জড়িয়ে ধরে বলল
আমাকে কোনদিন ছেড়ে যেওনা মুনির, কোনদিনও ছেড়ে যেও না
আমার এতক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে জমাট বাধা ভয়, উৎকণ্ঠা, দ্বিধা সব কোথায় উধাও হয়ে গেল নিজেও জানিনা। আমি দুই হাতে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বললাম
কোনদিনও যাবো না, কোনদিন ও না।

আমি টের পাচ্ছি ওর শরীরটা কেপে কেঁপে উঠছে। আমার ঘাড়ে মুখ খুঁজে ও কাঁদছে নিঃশব্দে। আমি বাধা দিলাম না, ওকে কাঁদতে দিলাম; নিশ্চয়ই এতটা পথ ধরে অনেক কষ্ট, অভিমান, যন্ত্রণা বুকে করে নিয়ে এসেছে আমার কাছে। এই চোখের জলের সঙ্গে ধুয়ে মুছে যাক ওর সমস্ত কষ্ট। আমি ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বললাম

কি হয়েছে আমাকে বলবেনা
ও চোখ মুছে সরে দাঁড়ালো। ম্লান একটু হেসে বলল
আমি এখন যাই
কেন ভয় করছে?
ও অবাক দৃষ্টিতে তাকাল, যেন আমার কথার মানে বুঝতে পারেনি। আমি ওর হাত দুটো আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম
আমাকে ভয় করছে?
ও এতক্ষণে আমার কথার মানে বুঝল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছি। ও নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে দিল তারপর খুব আস্তে আস্তে আমার বুকের মধ্যে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করল, ধীরে ধীরে বলল
এখানে আসার আগ পর্যন্ত খুব ভয় করছিল জানো, ভীষণ ভয় করছিল, এখন আর করছে না।
আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমার মতো নগন্য একজন মানুষকে কি এতখানি ভরসা করা উচিত? আমি কি একজন রক্ত মাংসের মানুষ নই? আমার মধ্যে কি কামনা বাসনা বলে কিছু নেই? আমি ওর চিবুকটা তুলে ধরে বললাম
সত্যি?
ও অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর থেমে থেমে বলল
তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি?

চলবে………

অনির পর্ব-০৭

0

সপ্তম পর্ব

ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করে ফিরলে মনের অস্থিরতা কমবে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারব কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টোটা। পড়ায় মন বসে না, ল্যবওয়ার্কের সময় আনমনা হয়ে যাই। চোখ মেলে ওকে দেখতে ইচ্ছে করে আর চোখ বন্ধ করলে ওর নিটোল মুখটা ভেসে ওঠে।

এইভাবে আর কতদিন চলবে জানি না। যেদিন ওর চিঠি আসে সেদিন অসহ্য রকম ভালো লাগার মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে যেদিন আসে না তীব্র অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসে। আমি চিঠিতে ওকে লিখেছিলাম সেকথা। ও বারবার বলেছে লম্বা চিঠি লিখে সময় নষ্ট না করতে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে। প্রয়োজন হলে ও প্রতিদিন চিঠি পাঠাবে। আমি চেষ্টা করেও সেটা করতে পারছি না। চিঠি লিখতে বসলে রাজ্যের কথা মাথায় এসে ভিড় জমায়। আমি চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারি না।

আমার অবস্থা দেখেই কিনা জানিনা ও প্রতিদিন চিঠি পাঠানো শুরু করল। আমার মন তবু শান্ত হলো না, ইচ্ছা করে ও পাশে এসে বসু্‌ক, অবিরাম কথা বলুক, হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ুক। আমিও সেই হাসি দেখি দুচোখ ভরে।

এর মধ্যে দুটো ঘটনা ঘটলো। দুটো পাবলিকেশনে আমার নাম গেল। চেয়ারম্যান স্যার আমাকে আরো কিছু নতুন কাজে্র দায়িত্ব দিলেন। সবমিলিয়ে ব্যস্ততা এত বেশি যে নিজেকে দেবার মতন সময় টুকুও পাই না।

দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস চলে এলো। ভাবলাম ওর জন্মদিনের একদিন আগেই চলে যাব। ওকে চমকে দেবো, কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল সেটা ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।

এবার আমাকে আসতে দেখে বাড়ির লোকেরা খুব অবাক হলেন। প্রথমত, কদিন আগেই ঘুরে গেছি, তার উপর আবার খবর দিয়ে আসিনি। আমি অবশ্য ইচ্ছা করেই জানিয়ে আসিনি, জানালে হয়তো সবাই আসতে নিষেধ করত। আমি আসার কোন বিশ্বাসযোগ্য কারণ তাদেরকে বলতে পারতাম না। প্রচুর কাজ ফেলে এসেছি তাই বেশি দিন থাকবো না। ওর সঙ্গে একটা সুন্দর দিন কাটানোর আশাতেই চলে এসেছি।

তখন আমার কোন সেল ফোন ছিল না, বাড়িতে একটা ল্যান্ডলাইন ছিল সেটা থেকেই চেষ্টা করলাম অনিমার সঙ্গে যোগাযোগ করার। ফোনে কেউ ওকে দিতে পারল না, বাধ্য হয়ে বিকেল বেলা আমাকে ওর হলে চলে যেতে হল।

চারটা নাগাদ ওর হল এর কাছে পৌঁছে ভিতরে কল পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে করতে মনে হচ্ছিল কি জানি কত হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছি। আমি ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে চারটা বেজে গেছে। আসলেই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। এর আরো অনেকক্ষন পরে ছোটখাটো একটা মেয়ে বেরিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনি কি অনিমা আপুর কাছে এসেছেন?
– হ্যাঁ ওর কাছেই এসেছি, ও কোথায়?
মেয়েটা এমন জুলজুলে চোখে তাকিয়ে রইল যে আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগতে লাগলো। খানিক সময় পর ও বলল
– আপনি কি মুনির ভাই?
– হ্যাঁ আমিই মুনির
– আপনাকে দেখার আমার খুব শখ ছিল। আপনি তাহলে সেই, যার জন্য আপু রাত জেগে জেগে চিঠি লেখে
আমি একটু লজ্জা পেলাম, বললাম
– ও কোথায়, ওকে একটু ডেকে দেবেন প্লিজ
মেয়েটা মন খারাপ করা গলায় বলল
– আপু তো আজ সকালের ট্রেনে সিলেট চলে গেছে। আপনি কি খবর দিয়ে আসেন নি?
– না আসলে ওকে জানিয়ে আসা হয়নি, তবে সিলেটে যাওয়ার ব্যাপারটা জানতাম না। আপনার কাছে কি ওখানকার ফোন নাম্বার আছে কিংবা ঠিকানা?
মেয়েটা মন খারাপ করা গলায় বলল
– না ভাইয়া, থাকলে অবশ্যই দিতাম
– আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ
আমি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলাম। বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল আমি ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে আসার কথাটা জানাইনি ও নিশ্চয়ই আমাকে ওর সিলেট যাওয়ার কথাটা জানিয়েছে চিঠিতে। সেইসব চিঠি নিশ্চয়ই এখন আমার ঘরে টেবিলের উপর পড়ে আছে একা একা। কি জানি কেন হঠাৎ করে চিঠিগুলোর জন্য আমার মন কেমন করে উঠলো, ইচ্ছে হলো এক ছুটে চলে যাই।

আমি আসায় বাড়ির লোকেরা যতটা না অবাক হয়েছিল এত দ্রুত ফিরে যাচ্ছি শুনে অবাক হলে তার থেকেও বেশি।সত্যি বলতে আমার আর থাকতে ইচ্ছা করছিল না। আমি পরদিন সকালেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিলাম। যেদিনটা আমাদের একসঙ্গে স্মরণীয় করে রাখার কথা ছিল সেই পুরো দিনটাই কাটলো আমার ট্রেনে।
আমি হলে পৌঁছালাম সন্ধ্যা পার হয়ে যাবার পর। যা ভেবেছিলাম তাই ওর দুটো চিঠি আমার টেবিলের উপর নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে।

চিঠিগুলো পড়ে আমার ভারাক্রান্ত মন আরো ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। প্রথম চিঠিটা অনেক বড়। চিঠি ভর্তি নানান মন খারাপের কথা লেখা। ও লিখেছে ওর বাবার শরীর ভালো নেই। আরো লিখেছে পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি। পরের চিঠিটা লিখেছে সিলেট থেকে। ওখানকার ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়েছে তবে নিষেধ করেছে চিঠি পাঠাতে কিংবা ফোন করতে। আমি ওর নিষেধ অগ্রাহ্য করেই ফোন করলাম। ঠিক করলাম ও ছাড়া অন্য কেউ যদি ফোন ধরে তাহলে রেখে দেবো। প্রতিবারই ফোন ধরল অন্য কেউ। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমি বাধ্য হয়ে হিয়ার শরণাপন্ন হলাম।

হিয়া আমার ক্লাসমেট। আমাদের ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবে যে কজন আছে তাদের মধ্যে হিয়া অসম্ভব আন্তরিক একটা মেয়ে। আন্তরিক বললে কম বলা হবে, ওর মতো উপস্থিত বুদ্ধি আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। মজার মজার কথা বলে মানুষকে চমকে দিতে ও ভীষণ ভালোবাসে। প্রথম দিকে এই কারণে ওকে সবাই ভুল বুঝলেও পরে সবাই বুঝতে পেরেছে ওর মনটা আসলে খুবই ভালো। হিয়ার বাড়িও ঢাকায়। আমার মত ও এখানে হলে থাকে। আমি কল দিলে ও নেমে এসে ভুরু নাচিয়ে বলল
– কি ব্যাপার? প্রফেসর সাহেব আজকে এখানে যে
প্রফেসর উপাধি আমি পেয়েছিলাম সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরপরই। থার্ড ইয়ারে উঠার পর আরো উন্নতি হয়েছে। এখন সবাই প্রফেসর মুনির না বলে আমাকে ডঃ মুনির বলে ডাকা শুরু করেছে। আমি রাগ করি না, হাসি। মনে মনে ভাবি ওদের এই রসিকতা যেন একদিন সত্যি হয়।
হিয়াকে সবটা বলার পর ওর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটতে একটু সময় লাগলো। তারপর ও যথাসাধ্য চেষ্টা করল আমাকে সাহায্য করতে। বার ফোন করার পরও লাভ হলো না। ওকে পাওয়া গেল না। এরপর হিয়া অন্য পথ ধরল। ওর বান্ধবী সুমি নাম করে যে ফোন ধরল তাঁর কাছ থেকে নানান কথা বের করে নিয়ে আসলো। বেশ কিছু অজানা তথ্য জানলাম যার কোনটাই ভালো লাগলো না। ওর বাবার স্ট্রোক করেছে। এর আগেও একবার মাইল্ড স্ট্রোক করেছিল, এটা দ্বিতীয়বার। বুঝলাম কেন ও ফোন ধরছে না কিংবা চিঠি লিখতে পারছে না। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, এরকম একটা সময়ে আমি ওর পাশে থাকতে পারছি না। ও আমাকে সবসময়ই বলত, ওর মন খারাপ হলে কিংবা কষ্ট হলেও ওর আমার কথা ভীষণ মনে পড়ে। আমার ইচ্ছা হল ছুটে চলে যাই ওর কাছে। ওর হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকি কতক্ষণ। আমার সেই ইচ্ছাটা যে এমন ভাবে পূরণ হবে সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি।

চলবে………

অনির পর্ব-০৬

0

ষষ্ঠ পর্ব

যে কদিন আছি প্রতিদিন ওর সঙ্গে দেখা করব ঠিক করলেও সেটা হয়ে উঠলো না। বাড়ি ফিরে দেখলাম তুলকালাম কান্ড। সকালবেলা বড় ফুফু এসেছে। নাজমার কাছে শুনলাম দুপুর নাগাদ নাকি মায়ের সঙ্গে তার তুলকালাম ঝগড়া বেধেছে, তারই সূত্রই ধরে মা ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে নানা বাড়ি চলে গেছে।

সদর দরজার কাছেই বড় ফুপু বোরকা পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা ফিরেছেন কেবলই, উচ্চ স্বরে বাকবিতণ্ডা চলছে। নাজমা দাড়িয়ে আছে কাছেই, যদিও কিছু বলছে না। বাবা বারবার বড় ফুফুকে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন কিন্তু উনি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন এত বড় অপমানের পর আর কিছুতেই এ বাড়িতে থাকবেন না, কিছুতেই না। আমি নাজমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও মিটিমিটি হাসছে। এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা বোঝা গেল। দুপুর বেলা মা বেরিয়েছে, দুপুর থেকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই অপমানবোধ জেগে ওঠেনি ঠিক বাবা আসার আগ মুহূর্তে একেবারে শিরস্ত্রাণ পরে রনমঞ্চে অবতীর্ণ হওয়াটা যে পূর্বপরিকল্পিত তাদের সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

এই ধরনের পারিবারিক কূতনৈতিক মঞ্চ নাটক বরাবরই ভীষণ রকম অসহ্য লাগে তাই আমি পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। তবে সেদিন বুঝতে পারিনি যে অনতিবিলম্বে আমাকেই হতে হবে এই ধরনের মঞ্চ নাটকের প্রধান কুশীলব।

ঘন্টাখানেক পর নাজমা আমার ঘরে এসে বিস্তারিত ঘটনা জানালো। মায়ের সঙ্গে বরাবরই বড় ফুফুর বনিবনা হয় না। যেহেতু উনি বাবার চেয়ে বছর দশকের বড়, মায়ের প্রতি তার আচার আচরণ অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপূর্ণ। মা সেটা কখনোই মেনে নিতে পারেন না॥ নাজমা জানালো এবারও তাই হয়েছে, তরকারিতে আলুর সাইজ ছোট না বড় এই নিয়ে শুরু হয়েছিল তারপর কথা গড়াতে গড়াতে অনেক দূর চলে গেছে।

বড় ফুফু বিধবা । যশোরে উনি আমাদের দাদা বাড়িতেই থাকেন ছেলে পুত্রবধূ এবং নাতি নাতনিদের নিয়ে। আমরা কালে ভদ্রে সেখানে যাই। ছোট চাচা রাজশাহীতে থাকে, উনি যান না বললেই চলে। আর হালিমা ফুফু মানে আমার ছোট ফুফুর সঙ্গে তো তার মুখ দেখা দেখিই বন্ধ। যেহেতু দাদা বাড়িতে থাকেন তাই হিসেব মত প্রতি বছর আমারা সব চাচা ফুফুরা সেখানে যাব, আনন্দ হবে হইহুল্লোড় হবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না উনার কারণেই। গ্রামের বাড়ি থেকে যেটুকু আয় হয় তার পুরোটাই উনি ছেলে নিয়ে ভোগ করেন। এ নিয়ে ভাই-বোনদের কোন অভিযোগ নেই কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ভাই-বোনদের বাড়িতে চলে যান। সেখানে যাবার পরেও তাঁর আবদার অভিযোগের শেষ থেকে না। বাড়ীর অবস্থা ভালো নয়, দেয়াল ধ্বসে পড়েছে, মেরামতের জন্য টাকা দরকার, সবকিছু উনাকেই দেখতে হয, বাকিরা কেউ ফিরেও তাকায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকিরা রীতিমতো অতিষ্ঠ, তাই অত্যাচারটা এই বাড়িতেই বেশি হয়।
মাকে অসংখ্যবার ফোন করে ফিরে আসছে অনুরোধ করা হলো কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যতদিন বড় ফুপু আছেন তিনি ফিরে আসবেন না। বাবাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।একদিকে মাতৃতুল্য বড় বোন অন্যদিকে স্ত্রী। অন্য কোন লোক হলে হয়তো এতটা বিচলিত হতেন না কিন্তু আমার বাবা মায়ের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। আমি ছোটবেলা থেকেই বাবাকে দেখেছি শুধু মায়ের হাতে টাকা দিয়েই তার সব দায়িত্ব শেষ। বাকি সব কিছু মাকেই করতে হতো।

আমার নানা বাড়ি কুমিল্লায়। নানা ভাই এখনো বেঁচে আছেন এছাড়াও দুই মামা আছেন তাই মায়ের দাপটই অন্যরকম। রাতের বেলা মা বাড়ি ফিরলেন না। পরদিন সকালের নাস্তার পর আমি আর নাজমা আমার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলাম সেই সময়েই বাবা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলবেন
– তোর মা তো আসতে চাচ্ছে না, কি করি বলতো
নাজমাট ফট করে বলল
– না আসলে নাই, থাকুক কিছুদিন
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। নাজমা বরাবরই মায়ের খুব ন্যাওটা, ওর কাছ থেকে এরকম একটা কথা আমি আশা করিনি। বাবাকে খুব একটা আশ্বস্ত মনে হল না কোনমতে বললেন
– তোর বড় ফুফু সবটা সামলে নেবে বলছিস
– নেবে না কেন, অবশ্যই নেবে। কদিন পর দেখবে কামাল ভাই চলে এসেছে বউ বাচ্চা নিয়ে, তারপর থেকে এখানেই থাকা শুরু করবে। ভাইয়া তো চলেই যাবে আমাকেও মনে হয় হোস্টেলে উঠে যেতে হবে। দেখি আজ কলেজে গেলে হলের সিটের জন্য এপ্লাই করে দেব
বাবা একটুখানি খড়কুটো ধরার আশায় এখানে এসেছিলেন নাজমার কথা শুনে কেমন মুষড়ে পড়লেন। আমতা আমতা করে বললেন
– তাহলে কি করতে বলিস
– বড় ফুপুকে বিদায় করো তাহলেই মা চলে আসবে
– এভাবে মুখের উপর একজনকে কি করে চলে যেতে বলি, বল
– তুমি না পারলে আমাকে বলো আমি বলি
– না না তোর কিছু বলার দরকার নেই, আবার কি থেকে কি ঝামেলা বাঁধে
– তোমার যা ইচ্ছা কর তবে আমার কথা শুনলে এক ঘন্টার মধ্যে বিদায় করতে পারবে
নাজমার বৈষয়িক বুদ্ধি অসাধারণ এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই তাই বলে এতটা আত্মবিশ্বাস ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়
আমি ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম॥ এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম দেড় ঘন্টার মধ্যে বড় ফুফু সত্যি সত্যি ব্যাগ বস্তা গুছিয়ে রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত।

নাজমা কি এমন বুদ্ধি দিয়েছে সেই কথা ওর কাছ থেকে বার করতে আমাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হলো। অবশেষে মেপাল ওয়ালনাট আইসক্রিম খাওয়াবো এই প্রতিশ্রুতি দেবার পর ও জানালো যে, বিশেষ কিছুই করতে হয়নি শুধু বাবাকে বলতে হয়েছে, মা নেই তাই কিছুক্ষণ পর হালিমা ফুপু আমাদের বাড়িতে আসছেন। যতদিন মা না আসছে ততদিন থাকবেন। হালিমা ফুফুকে উনি যমের মতন ভয় পায়। এর কারণটা অবশ্য আমি জানি। আমার দাদা বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি বড় ফুফু ভোগ করছেন॥ দুই ভাই মানে আমার বাবা আর ছোট চাচা তাদের অংশ বিক্রি করে অনেক আগেই নিয়ে গেছেন। ওই টাকা দিয়েই আমাদের এই বাড়ি বানানো হয়েছে বছর দশেক আগে। এখন বসতবাড়ি আর যেটুকু সম্পত্তি আছে তা দুই বোনের। কিন্তু বড় পুকুর তার থেকে কানাকড়ি ও ছাড়তে রাজি নন॥ হালিমা ফুফুর সাথে এই নিয়ে অনেকদিন ধরেই ঝামেলা চলছে। বড় ফুফু পারতপক্ষে তার সামনে পড়তে চান না। এরকম একটা কূটনৈতিক চাল নাজমার মাথায় কি করে এলো তাই ভেবে আমি চমৎকৃত হলাম।

যাইহোক বড় ফুফু চলে যাবার খবর মাকে জানানোর পরেও মা আসতে রাজি হলেন না। মাঝখান থেকে আমার আরো একটা দিন নষ্ট হল। বাবা অফিস কামাই করতে পারবেন না তাই পরদিন আমি আর নাজমা সকালবেলা মাকে আনতে গেলাম। আমি কয়েকবার অনিমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বেচারি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে বসে ছিল। আমি আসবো না সেটাও জানাতে পারিনি ওকে।
মাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল অনেকদিন পর নানা বাড়ি গেছি তাই না খাইয়ে আমাদের কেউ ছাড়লো না॥

পরদিন সকালে আমি আর কোন ঝুঁকি নিলাম না। সকাল সকালই ওর হলের কাছে গিয়ে বসে রইলাম। প্রথম দিনের মতো আজ ভাগ্য সহায় হলো না। নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কল দেবার পরও ওকে পেলাম না। আরো দু বার কল দেবার পর জানা গেল, ও রুমে নেই॥ আমি হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আজ আবহাওয়া খারাপ, ভ্যাপসা গরম। এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমি ওর ডিপার্টমেন্টে চলে গেলাম। সেখানেও ওকে পাওয়া গেল না। ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি লাইব্রেরীতে যদি পাওয়া যায়। আরো ঘন্টাখানেক চেষ্টা করেও ওকে না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হল কেউ আমাকে পেছন থেকে ডাকছে।
পেছন ফিরে দেখলাম ও দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাধে বিশাল ব্যাগ, মাথার চুল এলোমেলো। আমার কাছে এসে হাঁপাতে হাপাতে বলল
– আরেকটু হলে তোমাকে মিস করে ফেলতাম। সব ঠিক আছে তো ? ওর উৎকণ্ঠা দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম
– তোমার এই অবস্থা কেন?
– কালকে একটা পরীক্ষা আছে। এই দুইদিন কিছু পড়া হয়নি
– কেন?
ও এই প্রশ্নের কোন জবাব দিল না, মাথা নিচু করে ফেলল। আমি বললাম
– রিক্সা নেই? তোমার ব্যাগটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে
– আচ্ছা, তোমার তাড়া নেই তো?
– একেবারেই না
– তাহলে একটু হলে যাই? ব্যাটটা রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে নেই
হলের গেটে পৌঁছে আমি রিকশা ছেড়ে দিলাম। ও বলল
– একদম সময় নেব না
– সময় নাও, কেন সমস্যা নেই
আজ ও এলো একটু দেরি করে । পোশাক পাল্টে এসেছে, ভেজা চুলে চিকন আভা। বোঝা গেল, স্নান সেড়ে এসেছে। কাছে এসে বলল
– দুপুরে খাওয়া হয়নি তো তাই না
– না ভেবেছিলাম একসঙ্গে নাস্তা খাব, এখন মনে হচ্ছে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে
আমরা দুজনেরই হেসে ফেললাম। রিক্সা নিয়ে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। আহামরি কিছু না। সাধারণ মানের রেস্তোরা, দুজন দুটো সেট মেনু খেলাম সময় নিয়ে। সে সময় এই বয়সী ছেলেমেয়েদের সময় কাটানোর মতন জায়গা খুব একটা বেশি ছিল না ঢাকা শহরে। কিছুক্ষণ আমরা রিক্সা করে ঘুরলাম তারপর আবার টিএসসি চলে এলাম। গল্প হলো অনেক। সন্ধ্যে নামার আগে আমি বললাম
– আমি কাল ফিরে যাচ্ছি
ও বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল, বলল
– তার মানে আর দেখা হবে না
– দেখা হবে না কেন? আমি তো সেপ্টেম্বরেই আসছি
– তুমি সত্যি সেপ্টেম্বরে আসবে
– কেন তোমার বিশ্বাস হয়না
– তোমার পরীক্ষারা আর দুই মাস থাকবে, তাই জানতে চাইলাম
– পরীক্ষা যেন ভালো হয় সেজন্যই তো আসবো। বল কি চাও তুমি তোমার জন্মদিনের উপহার
– তুমি আসবে সেটাই তো বড় উপহার, আর কি চাইব
– আমি কিছু চাই, দেবে?
– বলো কি চাও
– সেদিন শাড়ি পড়ে এসো। তোমাকে শাড়িতে কেমন লাগে দেখতে ইচ্ছা করছে
শেষ বিকেলের আলোয় আমি দেখলাম লজ্জায় ওর গাল লাল হয়ে গেছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো একবার ছুঁয়ে দিতে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
– আসবে তো
– আসবো
সন্ধ্যে নামার পর আমরা হাটতে হাটতে ওর হলের দিকে চলে গেলাম। ও বলল একটু দাঁড়াও তোমাকে কিছু দেবার আছে। ও ফিরে এসে আমার হাতে একটা ব্যগ তুলে দিয়ে বলল
– এগুলো তোমার জন্য
আমি বাড়ি ফিরে ওর উপহার দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। একটা কারুকার্য করা কাঠের বাক্স, দুটো কলম আর একটা চিঠির প্যড। এর চেয়ে ভালো উপহার আর কিছু হতেই পারত না।

পরদিন ভোরে আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়েই চট্টগ্রাম ফিরে গেলাম। ফেরার পর প্রথমেই কাঠের বাক্সটার মধ্যে ওর সব চিঠিগুলো যত্ন করে গুছিয়ে রাখলাম। আমরা দুজন যখন একসঙ্গে থাকবো, যখন আর আমাদের চিঠি লেখার প্রয়োজন পড়বে না তখন এই বাক্সে আমাদের দুজনের চিঠি গুলোই রেখে দেব। মানুষ যেমন ছবির অ্যালবাম রাখে তাদের বিশেষ মুহূর্ত ধরে রেখে স্মৃতিচারণ করবে বলে, আমরা না হয় ছবির বদলে কথা ধরে রাখলাম। অনেক অনেক বছর পর পুরনো স্মৃতি গুলো আবার ঝালিয়ে নেবার জন্য।

চলবে…….

অনির পর্ব-০৫

0

পঞ্চম পর্ব

আমি ঢাকা পৌছালাম শুক্রবার সকালে। ছুটির দিন বলে সবাই বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে বাবা-মা দুজনেই ভীষণ খুশি হলেন। এভাবে কোন খবর না দিয়ে আমি আগে কখনো আসিনি। বাবার প্রথম কথাই হল এসেছি যখন বেশ কয়েকদিন থেকে যেতে। আমি কিছু বললাম না। সত্যি কথা বলতে আমি শুধু ওর সঙ্গে দেখা করতেই এসেছি। পড়াশুনা এবং রিসার্চ ওয়ার্কের প্রচুর চাপ, তাই বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে ফিরে যাব।

চিঠিতে ওর সঙ্গে সব ঠিক হয়ে আছে। শনিবার সকালে আমরা দেখা করব। প্রথমে ঠিক হয়েছিল আগের জায়গাতেই দেখা করব, পরে আমার মনে হল যে হল থেকে ওই পর্যন্ত আসতে ওর অনেকটা সময় নষ্ট হবে। আমি এতটুকু সময় ও নষ্ট করতে চাই না। এরপর আবার কবে দেখা হয় ঠিক নেই, তাই আমি বললাম সকাল সকাল ওর হলে চলে যাব; কল দিলে যেন নেমে আসে।

প্রথমবার ওর সঙ্গে এভাবে দেখা করছি, মনে হলো কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাই কিন্তু কি কিনব কিছুই বুঝতে পারছি না। এর আগে আমি কখনো কোন মেয়ের জন্য উপহার কিনিনি। নাজমার জন্য অবশ্য কিনেছি তবে সেটা ও আমার ঘাড় ধরে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দে কিনেছে। ওর সঙ্গে একবার এই নিয়ে কথা বলব কিনা ভাবছিলাম ঠিক তখনই ও চায়ের কাপ দিয়ে ঘরে এলো। অন্যান্য বারের মত ও এবার ঝগড়া করল না বরং লক্ষ্য করলাম এবার ওর গলার স্বর অন্যরকম। চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো।

নাজমা আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। ছোট বেলা থেকেই ও অনেক বুদ্ধিমতী তবে এতটা ধুরন্ধর সেটা সেদিনই টের পেলাম। কথা বলতে বলতে একটা সময় যখন আমার মনে হল ও অনেকটা স্বাভাবিক তখন আমি বললাম
– উপহার কেনার জন্য কোন দোকানটা সবচেয়ে ভালো হবে বলতো
– কোন অকেশনের জন্য?
– কোন বিশেষ অকেশন না, এমনি দেখা করতে যাব
– সেভিং জেল দিতে পারো
– ধুর! সেভিং জেল কেন দেব?
– তাহলে মানিব্যাগ
– আরে না, অন্য কিছু বল
– যাকে দেবে তার হাইট কেমন?
আমি একটু সাবধান হলাম। বললাম
এভারেজ
– আড়ং এ অনেক সুন্দর সুন্দর আয়না পাওয়া যায়। আমার মনে হয় দিলে খুশি হবে
– এটা ভালো বলেছিস, আড়ং থেকে একটা আয়না কিনি বরং
– ওকে কি দেখতে অনেক সুন্দর ভাইয়া?
– অনেক
– কি নাম?
– অনিমা
– আমার সঙ্গে কবে পরিচয় করিয়ে দেবে?
এ কথা বলে ও মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আমার নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করলো। আমি বললাম
– কি বললি তুই?
– এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই ভাইয়া। তুমি যখন গতবার ছটফট করে ফিরে গেলে তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কোথায় থাকে চট্টগ্রামে?
– না এখানে ঢাকায়
নাজমা আনন্দে হাততালি দিয়ে দিয়ে উঠল, বলল
– কাল দেখা করবে?
– হ্যাঁ কাল সকালে
– চলো তাহলে তোমাকে গিফট কিনতে হেল্প করি, আমারও কয়েকটা জিনিস কেনার আছে
আমি দীর্ঘশ্বাস কেললাম। এই তাহলে আসল ঘটনা।

আমি আড়ং এ এর আগে ও গেছি তবে এত ঘুরাঘুরি করিনি। ঈদের সময় মেইল সেকশন থেকে পাঞ্জাবি কিনেছি, আজ ঘুরতে গিয়ে ভালই লাগলো। আমি টুকটাক করে অনেক জিনিস কিনে ফেললাম ওর জন্য। ও খুব রুচিশীল এবং সৌখিন ধরনের মেয়ে। নাজমা অবশ্য এটা নাও ওটা নাও করে আমার কানের পোকা মেরে দিতে লাগলো। ঘ্যান ঘ্যান করে নিজের জন্য অনেক কিছু আদায় করল; শুধু কেনাকাটা নয়, কেনাকাটা শেষ হয়ে যাবার পর উপরে নিয়ে গিয়ে ওকে খাওয়াতেও হল। অবশ্য উপরের ফুড কোর্টে গিয়ে খুব ভালো লাগলো। জায়গাটা বেশ সুন্দর, ছিমছাম নিরিবিলি।আমি ঠিক করলাম ওকে নিয়ে এখানেই আসব। নাজমা এক প্লেট ফুচকা শেষ করে লাচ্ছির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো
– ভাইয়া ওকে নিয়ে কিন্তু এখানে এসো। খাওয়া শেষ করে তারপর একেবারে সংসদ ভবনে চলে যাবে।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম
– তুই এত সব খবর কি করে জানিস?
নাজমা গাল ফুলিয়ে বলল
– যা বাবা! যার জন্য করি সেই আমাকে কথা শোনাচ্ছে। এই যে এতগুলো সময় দিলাম তোমাকে, গিফট খুঁজতে হেল্প করলাম আর তুমি এখন আমাকে এগুলো বলছো? এজন্যই কারো জন্য কিছু করতে হয় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হল আমার।

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এত টাকার শপিং করে দিলাম, এখন গপ গপ করে ফুচকা গিলছে তারপরও এত তেজ
আমারে অবস্থা দেখে নাজমা ফিক করে হেসে ফেলল, তারপর বলল
– ওর একটা ছবি দেখাও না ভাইয়া

ঠিক তখনই আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম আমার কাছে ওর কোন ছবি নেই এবং আমি ওকে সেই প্রথমবার ছাড়া আর কখনোই দেখিনি। ওকে আরেকবার দেখার একটা অদম্য ইচ্ছা আমার মধ্যে সারাদিন বিচরণ করলেও ছবি চাইবার ব্যাপারটা কখনো মাথায় আসেনি। এখন মাঝে মাঝে ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে, ভালোবাসা ব্যাপারটা কত হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, এখন প্রিয়জনকে চাইলেই দেখা যায়, ফোন করে কথা বলা যায়। ম্যসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস এপ, আরো কত কি আছে। তখন এতসব ছিল না। আমি জানি না এখন এসব ভালবাসার গভীরতা আরো বাড়িয়েছে কিনা তবে এই যোগাযোগের দূরত্ব আমাদের ভালবাসাকে কমাতে পারেনি এতটুকুও।

কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি উত্তেজনায় সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম এসেছিল ফজরের আগেই ঘুম ভেঙে গেল। অনেকদিন পর বাড়ির কাছের মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম।

আমি ওর হলের কাছে পৌঁছালাম সকাল সাতটারও একটু পরে। এত সকালে কল দেয়া বোধহয় ঠিক হবে না এইভাবে একটু অপেক্ষা করলাম। এর সকালে যায়গাটা বেশ ফাকা, একটা দুইটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে গেট থেকে বের হতে; সম্ভবত এরা আটটার ক্লাস ধরতে যাচ্ছে। আমি হলের পাশে্র কালভার্টটার উপরে বসে রইলাম। আমার মাথার উপর একটা হলুদ কৃষ্ণচূড়া গাছ। সকাল বলে গরম কম।এপ্রিলের শেষ তাই চারিদিকে ঝেপে কৃষ্ণচূড়া আর জারুল ফুটেছে। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। রিকশার সংখ্যা খুবই কম। মাঝে মাঝে লাল রঙের বাসগুলোকে আসতে দেখা যাচ্ছে।

রোদের তীব্রতা এখনো বাড়নি। চারিদিকে এখনো মিষ্টি রোদ। আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। আটটার একটু বেশি বাজে। না, এখনো কল দেবার মতন সময় হয়নি। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। উল্টোদিকে ভাষা ইনস্টিটিউটের বিল্ডিং। অপেক্ষা করতে করতে যখন মনে হল যে এবার উঠে কল দেয়া যায় তখনি লক্ষ্য করলাম কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মুখ তুলে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ওর মুখ ভর্তি হাসি। আগের দিন ওকে দেখেছি বাসন্তী ফুলের মতন আজ পরেছে সাদা আর কমলার মিশেলে সুতির জামা। ওকে দেখতে ভোরের শিউলি ফুলের মতন লাগছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ও আর একটু কাছে এসে বলল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছো?
না ঘন্টাখানেক
ইস! আগে জানলে আরো আগে নেমে আসতাম।
আমি কিছু বললাম না, ওর হাতে উপহারের ব্যগটা তুলে দিয়ে বললাম
এটা তোমার জন্য।
ওর মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো, ও ব্যাগ খুলে দেখলো না। বলল
এটা ভেতরে রেখে আসি, তাহলে আর সারাদিন বয়ে বেড়াতে হবে না।
আচ্ছা
অনিমা ফিরে এলো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। এসেই বলল
খেয়েছো কিছু সকালে
না, চলো একসঙ্গে খাই

আমরা হাঁটতে হাঁটতে কার্জন হলে চলে গেলাম, ওখানেই নাস্তা করলাম , চা খেলাম। এখনকার মতন তখন এত বড় বড় রেস্টুরেন্ট ছিল না, থাকলেও সেগুলো আমাদের মতন স্টুডেন্টদের জন্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল, তাছাড়া তখন আমাদের হাতে হাতে টাকাও থাকতো না॥ অনিমা আমাকে ওর ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরী ঘুরিয়ে দেখালো। আমি কার্জন হল, সাইন্স লাইব্রেরী সবই ঘুরে দেখলাম। একটা সময় এখানে ভর্তি হতে পারিনি বলে আমার খুব আফসোস ছিল, এখন আর নেই। এখন আমি আমার নিজের ক্যম্পাস অসম্ভব ভালোবাসি।

আমরা সারাদিন রিকশা করে ঘুরলাম। ও যে এত কথা বলতে পারে আগে আমার কোন ধারণাই ছিল না। চিঠি পড়ে আমার মনে হতো ও খুব চুপচাপ শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সারাদিন কত গল্প যে করল।একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় আমার মন ছেয়ে যাচ্ছিল। রিক্সায় বসেই আমি ওকে বললাম
আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি
ও সঙ্গেসঙ্গে হাত এগিয়ে দিল। কি দ্বিধাহীন নিঃসঙ্কোচ সেই ভঙ্গি। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। বললাম
কাল আবার দেখা করাবে?
করব
অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে রিক্সায় বসে রইলাম
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। যখন ওকে হলে নামিয়ে দেবার জন্য ফেরার পথ ধরলাম তখন ও খুব আস্তে করে আমাকে ডাকলো
মুনির
হুম
আবার কবে আসবে?
তুমি বলো কবে আসব
ও মাথা নিচু করে খুব আস্তে আস্তে বলল
শীতের ছুটিতে আসবে?
মুখে কিছু না বললেও ওর কন্ঠস্বরে ঝরে পড়া অভিমান আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। বললাম
না, শীতের ছুটির আগেই আসবো
ও মুখ তুলে তাকালো, তারপর বলল
কবে
সেপ্টেম্বারে, তোমার জন্মদিনের সময়
মুহূর্তেও মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল ও চোখ বড় বড় করে বলল
সত্যি!
ওর বলার ধরণ দেখে আমি হেসে ফেললাম
একটা স্বপ্নের মতন দিন কাটিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম। ওর জন্মদিনের দিন যখন আসব তখন এর চেয়েও আরো চমৎকার একটা দিন কাটাবো ভেবেছিলাম কিন্তু সেই দিনটাকে যে এত ভয়ানক হবে সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি।

চলবে……

অনির পর্ব-০৪

0

চতুর্থ পর্ব

নাসিম হল ছেড়ে দিয়েছে। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস নিয়ে গেছে শুধু কতগুলো চিঠির খাম আমার টেবিলের উপর ফেলে গেছে।এর কারণ আমি সেদিন বুঝতে পারিনি তবে চিঠিগুলো পেয়ে মনে হয়েছিল অমূল্য কিছু পেয়েছি॥ আমি চিঠিগুলো যত্ন করে একটা বাক্সে তুলে রাখলাম। আমি অনিমার রুম নাম্বার জানিনা কোন বিল্ডিংয়ে থাকে সেটাও জানি না শুধু জানিও বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে, এমনকি কোন ইয়ারে পড়ে সেটাও জানিনা। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন উপায় আমার ছিল না। খামের উপর প্রেরকের ঠিকানা দেখে খুব নিশ্চিন্ত লাগছিল যদিও জানি ওকে চিঠি লেখার কোন অধিকার আমার নেই।

ওকে আবারো চিঠি লিখতে শুরু করার একটা উপায় করে দেবার জন্যই বোধ হয় পরদিন সোহানা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সোহানা নাসিমের প্রাক্তন প্রেমিকা। বছর খানের আগে যখন নাসিম আমাকে অনুরোধ করেছিল অনিমা কে চিঠি লিখে দেবার জন্য আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সোহানা এসব জানে কিনা তৎক্ষণাৎ ও কোন উত্তর দিতে পারিনি তার দু চারদিন পরে আমার কাছে জানিয়েছিল যে ওদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। ব্রেকআপের পর একটা মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল বলে আমি চিঠি লেখার ব্যাপারটাকে ওকে সাহায্য করেছিলাম।অতীত ভুলতে যদি একটা সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে জড়ায় তাহলে ক্ষতি কি। আশ্চর্যজনকভাবে সোহানার কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে ওদের আদৌ ব্রেকআপ হয়নি। তবে আরও আশ্চর্য হলাম যখন ওর এখানে আসার কারণটা জানতে পারলাম। ও বলল
আমি আসলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি
আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ তোমার সঙ্গে। তোমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছি
অভিনন্দন? কি বিষয়ে বলো তো
শুধু অভিনন্দন বললে ভুল হবে। তোমাকে ধন্যবাদ জানাতেও এসেছি। আমি নাসিমকে ভুল বুঝেছিলাম। আমাকে একজন বলেছিল নাসিম কোন এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে তার সঙ্গে নাকি চিঠি লেখালেখি চলছে।
কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম। ও আবারো শুরু করল বলল
শুনেছিলাম নাসিমের সঙ্গে নিউ ইয়ারের দিন ওই মেয়ের দেখা হবে। ভেবেছিলাম ওকে হাতেনাতে ধরে একটা উচিত শিক্ষা দেব। ওখানে গিয়ে ওকে পেয়েছিলাম তারপর নিজের ভুলটা বুঝতে পারি
কি ভুল
নাসিমি আমাকে দেখালো মেয়েটা আসলে তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দারুন মানিয়েছে কিন্তু তোমাদের দুজনকে

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না একবার শুধু অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলাম
নাসিম কেমন আছে
ভালো আমাকে বলল
এখানে আর ভালো লাগছে না তাই বাড়ি চলে গেছে

সেদিন রাতে আমি প্রথমবারের মতো নিজে থেকে অনিমাকে চিঠি লিখলাম আমি লিখলাম
অনিমা অনিমা
তুমি কি আমার উপর অনেক রেগে আছো? তোমার রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি কিন্তু তোমাকে একটাও মিথ্যা কথা বলিনি। আমি সত্যিই নাসিম না। তবে তোমাকে চিঠি গুলি আমি পাঠাতাম।যদি তুমি সত্যিই আমার উপর রাগ না করে থাকো তাহলে এই চিঠিটা জবাব দিও।

অনিমার চিঠির জবাব এলো তিন দিনের মাথায়। ক্লাস ফাইভ ট্যলেন্টপুলে এ বৃত্তি পাওয়ার পর যেরকম আনন্দ হয়েছিল সেই রকম একটা শিশুসুলভ আনন্দ আমার মন ছেয়ে গেল। অনিমা একটা লম্বা চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে রাগ অনুরাগের কোন কথা নেই। অনেক কথা লিখেছেতার মধ্যে আমার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা মনে হয়েছে সেটা হলো ও লিখেছে “সেদিন তোমার সঙ্গে আমার কোন কথাই হয়নি। আমি শুধু তোমার আঙুলে আঙ্গুল জড়িয়ে রিকশায় বসে ছিলাম; তবে কি জানো, মানুষের মুখের ভাষার মতন প্রতিটা অঙ্গেরও বোধহয় নিজস্ব একটা ভাষা থাকে। সেদিন তোমার সঙ্গে আমার আঙুলে আঙ্গুল জড়িয়ে অনেক কথা হয়ে গেছে। সব কথা বোধহয় মুখ ফুটে বলা যায় না। বলার প্রয়োজনও পড়ে না

আবার শুরু হলো আমাদের পত্র বিনিময়, যদিও ওকে একবার সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা আমি কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। বারবার ইচ্ছা করছিল আবার ওর কাছে যাই একবার একটু ছুঁয়ে দেখি ওকে কিন্তু উপায় ছিল না। নতুন বছরে পড়াশোনার চাপ বেড়েছিল প্রচুর। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালের রেজাল্ট ভালো হওয়াতে চেয়ারম্যান স্যার আমাকে সিনিয়র একজনের সঙ্গে রিসার্চ এর যুক্ত করে দিয়েছিলেন। এই কাজ শেষে যে পাবলিকেশন হবে সেখানে আমার নাম ও যাবে। চেয়ারম্যান স্যারের আমাকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে।

আমি উদয়ন্ত পরিশ্রম করা শুরু করলাম। সকালে ক্লাস, দুপুরে ল্যব ওয়ার্ক আর রিসার্চ এর জন্য কাজ বিকেলে সেমিনারে বসে রেফারেন্স কালেকশন করতে হতো, আবার রাতে ক্লাসের জন্য পড়তে হতো। তখন এখনকার মতন ওয়াইফাই কানেকশন ছিল না, সেমিনার রুমে দুটো কম্পিউটারে ইন্টারনেট কানেকশন ছিল সেখানে রেফারেন্স কালেকশনের কাজ করতে হতো।
এতো ব্যস্ততার মধ্যে যদি কোন কিছু আমাকে প্রশান্তি দিত তবে সে ছিল আনিমার চিঠি গুলো। ওর এক একটা চিঠি আমি হাজার হাজার বার করে পড়তাম। সামনাসামনি কথা বলার ইচ্ছা যে কি করে দমন করেছি সে একমাত্র আমি জানি।
সময় গড়িয়ে গেল আমাদের সম্পর্কের গভীরতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। আমরা ঠিক করলাম সামনের ছুটিতে আমি ঢাকায় এলে তখন দেখা করব।
এরমধ্যে আমার ক্যাম্পাস একদিন নাসিমের সঙ্গে দেখা হলো। আমি ওকে দূর থেকে দেখে একটু হাসলাম। ও জবাবে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে না চেনার ভান করল। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ও আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ওর আর সোহানার সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য সম্ভবত এটাই উত্তম পন্থা। আমি আর কোন ঝামেলায় গেলাম না। ও যদি আমাকে এড়িয়ে গিয়ে ভালো থাকতে পারে তাহলে থাকুক।

দেখতে দেখতে শীত বসন্ত গড়িয়ে গ্রীষ্ম এসে গেল। জুন মাস থেকে আমার মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হবে এরপর আর হয়তো যাওয়া হবে না। একবার ওকে দেখার জন্য আমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম তাই এপ্রিলের শেষ নাগাদ আমি ট্রেনের টিকেট বুক করে ফেললাম। সেভাবে দেখতে গেলে এটাই আমাদের প্রথম দেখা। এর আগে যখন দেখা হয়েছিল আমরা একে অপরের কাছে অচেনা ছিলাম। ঠিক হলো যেদিন আমি পৌঁছাব তার পরের দিন সকালবেলা ওর সঙ্গে দেখা করব। সারাদিন একসঙ্গে ঘুরব। আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে ও সবকিছু প্ল্যান করে রেখেছে। আমি ছোটবেলা থেকে ঢাকাতেই বড় হয়েছি বরং ঢাকা ওর কাছেই নতুন। ও বেড়ে উঠেছে সিলেটে।তবু আমি কিছু বলছি না ওর উত্তেজনা ভালো লাগছে।
এর আগে এবং পরে ও আমি অনেকবার ঢাকায় গেছি। তবে এবারের ঢাকা ভ্রমণটা আমার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

চলবে………

অনির পর্ব-০৩

0

তৃতীয় পর্ব

আমার সময় জ্ঞান সবসময়ই বেশ প্রখর। চারটা বাজার দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম। তখনো দুজনের কেউই এসে পৌঁছায়নি। লেকের পাশের এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। একটা বাঁধানো চত্বর, আশেপাশে কিছু ছোটখাট দোকান। আমার ডানদিকে একজন বসেছে ফুল নিয়ে অন্যদিকে একজন বিশাল আকৃতির ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করছে। এখনকার মতন এত রেস্টুরেন্ট তখন ছিল না। ঝকঝকে বিকেল হলেও রাতের নানান ঘটনার কারণেই বোধহয় পার্কে খুব বেশি কপোত কপোতি দেখা গেল না।
আমার সময় কাটছিল না, বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। প্রথমবার দেখা করতে এসেছি বলে আমি ওর জন্য একটা বই নিয়ে এসেছিলাম, সেটাই খুলে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। খুব আহামরি কোন বই না হুমায়ূন আহমেদের “তোমাকে”, আমার ভীষণ প্রিয় একটা বই। পড়তে পড়তেই টের পেলাম কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব মৃদু একটা সুগন্ধ ভেসে এলো, অনেকটা বুনো ফুলের মতন। আমি মুখ তুলে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এত মায়াবী, সারল্যে ভরা মুখ আমি আগে কোনদিন দেখিনি। মেয়েটা খুব সাধারণ পোশাক পরে এসেছে, সাদার উপর হলুদ ফুল তোলা জামা, শীত বলেই বোধহয় একটা বাসন্তী রঙের শাল জড়িয়েছে। ওকে দেখে আমার মনে হল একগুচ্ছ সোনালু ফুল। আমাকে অবাক করে দিয়েও ও হাসিমুখে বলল
– নাসিম ?
আমি বিব্রত মুখে বললাম
– আমি নাসিম নই, নাসিম এক্ষুনি চলে আসবে
– তাহলে তুমি কে?
আমি নাসিমের বন্ধু। আমার নাম মুনির। তুমি নিশ্চয়ই অনিমা। তোমার কথা অনেক শুনেছি নাসিমের কাছে
মেয়েটা কেমন অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। ৪ টা ২০ বাজে। নাসিমটা যে কেন এখনো আসছে না। বললাম
– তুমি বসো। চা খাবে?
আমি পাশের চা ওয়ালাকে ডেকে বললাম
– ভাই বেশি করে লেবু দিয়ে একটা রং চা দেন তো
অনিমা কাপ হাতে নিয়ে বসতে যাবে তখন আমি বললাম
– অনিমা একটু দাড়াও, এখানে বাদামের খোসা পড়ে আছে, তোমার না বাদামে এলার্জি। আমি হাত দিয়ে ঝেড়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলাম। ও বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল
– এই খেলাটা তুমি আর কতক্ষণ খেলবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম
– কিসের খেলা?
– তুমি নাসিম না এটা প্রমান করার খেলা
আমার নিজের উপরই বিরক্ত লাগছে। কেন যে এসব বলতে গেলাম। এলার্জির ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস বলেই বলেছিলাম, তা না হলে কোনদিনও বলতাম না। আমি পরাজিত ভঙ্গিতে বললাম
– অনিমা, আমি সত্যিই নাসিম না। আমি আর নাসিম একই রুমে থাকি। ও তোমার ব্যাপারে অনেক গল্প করে সেই থেকেই তোমার ব্যাপারে আমার একটু ধারণা জন্মেছে
– ধারণা?
একথা বলে ও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আর কিছু বলবো না বলে ঠিক করলাম। যত কথা বলছি ততই জড়িয়ে যাচ্ছি। নাসিমের বাচ্চাটা যে কেন এখনো আসছে না।
অনিমা কিছু বলল না, চুপচাপ চা খেতে লাগল।
একবার ভাবলাম বইটা ওকে দেই, পরমুহূর্তেই মনে হলো, না থাক, এই বইটা নিয়ে চিঠিতে একবার ওর সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছিল, আবার কি থেকে কি বুঝে ফেলে।

বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। আমি বারবার ঘড়ি দেখছি। সাড়ে চারটার বেশি বেজে গেছে এখনো নাসিমের আসার কোন নাম নেই। অনেকক্ষণ পর অনিমা হঠাৎ করে বলল
– আকাশে কি সুন্দর মেঘ দেখেছো
আমি আনমনা হয়ে বললাম হু
– তুমি একবার আমাকে ক্লাউড হান্টিং এর কথা লিখেছিলে মনে আছে? আচ্ছা তুমি কি এখনও ওই পুকুরটার মধ্যে আমাকে দেখতে পাও?
আমি জবাব দিলাম না। অনিমা মন খারাপ করা গলায় বলল
– ঐ পুকুরে আমাকে যেমন দেখতে, আমি কি তেমন না? তার থেকে খারাপ?
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম, ও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম
– অনিমা, আমি নাসিম না
মুহূর্তে ওর চোখ ছল ছল করে উঠলো। ও ভেজা কন্ঠে বলল
– আমাকে কি তোমার এত খারাপ লেগেছে যে তুমি নাসিম এটা স্বীকার করতেও তোমার ইচ্ছা করছে না। আমি তো তোমার কাছে কিছু চাইনি কিন্তু এই মিথ্যা নাটকের তো কোন দরকার নেই। অনিমা উঠে দাঁড়ালো
আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কারণে ওদের প্ল্যানটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার ঘড়ি দেখলাম, পাঁচটা বেজে গেছে। নাসিম এখনো আসছে না। কি যে করি। আমি ওর হাত ধরে বললাম
– আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কাঁদতে হবে না, বসো। উই ক্যন টক আবাউট ইট
অনিমা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল
– তোমার হাতে ওটা কি?
– বই। তোমার জন্য এনেছিলাম। এই বলে আমি বইটা এগিয়ে দিলাম। বইটা হাতে নিয়ে ও উল্টেপাল্টে দেখল। বলল
– তুমি এখনো বলবে তুমি নাসিম না?
আমি অসহায় কন্ঠে বললাম
– আমি আসলেই নাসিম না অনিমা
– আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে এখানে এটা লিখে দাও।
ও বইটা খুলে উৎসর্গের পাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল, সেই সঙ্গে একটা কলমও দিল
আমি লিখলাম “অনিমা অনিমা, আমি সত্যি বলছি আমি নাসিম নই”। বইটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, এবার নিশ্চয়ই ও বিশ্বাস করবে। ও অনেকক্ষণ লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর মুখের মেঘ কেটে গেছে। পুরো মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে। তখন বিকেলের আলোর মরে আসতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলের কমলা রঙয়ের রোদ ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। সেই কনে দেখা আলোয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি দিশেহারা বোধ করলাম।
ও আমার চোখে চোখ রেখে বলল
এখনো স্বীকার করবে না? এই এক বছর ধরে আমি তোমার হাতে লেখা দেখছি, আর আমি চিনতে পারব না।
আমার মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তার মানে ওই বদমাইশের বাচ্চা নাসিম আমার চিঠিগুলো কপি করেনি, যেমন ছিল তেমনি পাঠিয়ে দিয়েছে। আর আমার কোন পথ নেই। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

আমি চলে যাবার জন্য উদ্যত হতেই ও উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল
– চলো।
আমি মোহগ্রস্থের মতন ওর সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। ও আমার হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে পার্কের ছায়া ঘেরা পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। যতবারই ওকে বলার চেষ্টা করেছি যে আমি অন্য কেউ ও কিছুতেই বিশ্বাস করেনি এবং এখন ওকে বিশ্বাস করানোর আর কোনো উপায়ও আমার নেই।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিক সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। বড় রাস্তায় উঠে ও বলল
– চলো রিকশা নেই।
আমি যন্ত্রচালিতের মতন রিকশায় উঠলাম। রিক্সাওয়ালা কোথায় যাব জানতে চাইলে ও বলল
– কোথাও যাবো না, এমনিই চলেন।
রিকশা ধানমন্ডির অলিগলি দিয়ে ঘুরতে লাগলো। তখনকার ধানমন্ডি এখনকার মতন ছিল না, বেশ নিরিবিরি ছায়া ঘেরা একটা পরিবেশ ছিল।সন্ধ্যা নেমেছে বলে রাস্তায় রিক্সার সংখ্যা কম। হঠাৎই একটা স্পিড ব্রেকারে ধাক্কা লাগায় ও আমার হাত আঁকড়ে ধরল। আমি রিক্সাওয়ালাকে বললাম আস্তে চালাতে। রিক্সাওয়ালা গতি স্লথ করলো। অনিমা হাত সরিয়ে নিল না। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে বসে রইল।
আমরা কেউই কোন কথা বলছিলাম না। আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা সময় ও নীরবতা ভেঙে পড়ল
– আমাকে হলে নামিয়ে দিয়ে তুমি চলে যাও।
আমি রোকেয়া হলে সামনে এসে রিক্সা ছেড়ে দিলাম। জায়গাটা অন্ধকার। ওর মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, যাবার আগে ও শুধু খুব আস্তে করে একবার বললো “আসি”। একবার পেছন ফিরেও তাকালো না। ও চলে যাবার পর আমার মনে হল পুরো শহরটা যেন অক্সিজেন শূন্য হয়ে গেছে; নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ, অমুল্য কিছু হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। আমি উদ্ভ্রান্তের মতন হাটতে আরম্ভ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে এলাম। চারিদিকে অনেক আলো ঝলমলে করছে, তবু আমার মনের অন্ধকার দূর হচ্ছে না। আমি বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।

ঢাকায় আমার আর মন টিকছিল না তাই পর দিন সকালের ট্রেনেই চট্টগ্রাম ফিরে গেলাম।

রুমে ঢুকে রীতিমত ধাক্কা খেলাম।

চলবে………।