#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৭ (পরিসমাপ্তি)
৩০.
এপ্রিলের তপ্ত দুপুরে আমি তখন ফ্যান না ছেড়ে গায়ে কাঁথা দিয়ে শুয়ে আছি। হালকা আওয়াজে দাদুভাই আমার ঘরে ঢুকলেন। আমি কোনোমতে চোখ খুলে তাকে দেখলাম। কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম না। আমি ঘরবন্দী দীর্ঘ এক মাস যাবত। এই এক মাসে ঘটে গেছে অনেককিছু। আমার টিমমেট বাবা হয়ে উঠলেন আচমকা আমার অজানা শত্রু। তিনি শুদ্ধর কথা তো সহ্যই করতে পারলেন না পরিবর্তে তিনি আমাকে আটকে ফেললেন এই চার দেয়ালের মাঝে। কেউ একটু টু শব্দ করার সাহস পেলো না। আমি দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে উঠলাম। ওজন কমেছে নয় কেজি। আমাকে দেখা যাচ্ছে কঙ্কালসার। কে কখন খাইয়ে দিচ্ছে, কি দিয়ে খাওয়াচ্ছে, গোসলের পর কোন কাপড় পরাচ্ছে আমি কিচ্ছু বলতে পারছি না। পাগল বনে যাচ্ছি।
দাদুভাই এসে পাশে বসলেন। গায়ের উপর থেকে কাঁথাখান সরিয়ে আমার দিকে দু’মিনিট চেয়ে রইলেন। তার চোখ থেকে দু’ফোটা পানি পরলো। আমার গায়ের জ্বর চেক করে ভাঙা আওয়াজে বললেন,
‘আমার প্রিয় দাদুভাই, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।’
আমি অবুঝ নয়নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে শুধালাম,
‘আমাকে এই জেলখানা থেকে বের করবে, দাদুভাই?’
দাদুভাইয়ের চোখ থেকে আরো দুই ফোঁটা পানি পরলো। তিনি ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘করবো, সোনা। তুমি উঠো। আজ আমি তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবো। তারপর তোমার ভালোবাসার মানুষের হাতে তুলে দেবো।’
দাদুভাই আমাকে ধরে উঠালেন। আমি তার কাধে মাথা ঠেস দিয়ে বসলাম। আমার গায়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকার মতোও তখন বিন্দুমাত্র শক্তি নেই।
‘বাবা আমাকে আর ভালোবাসে না কেনো, দাদুভাই? বাবা এমন কেনো করলো?’
‘আমার সোনা দাদুভাই, তোমার বাবা এই পৃথিবীর সবথেকে বেশি তোমাকে ভালোবাসে। তোমার এই অবস্থা তোমার বাবাকেও অসুস্থ করে তুলেছে। বাড়িটা মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। সে কাজে যায় না দীর্ঘদিন। তুমি ঘুমিয়ে থাকলে তোমার বাবা সারারাত তোমার পাশে বসে থেকে পাগলের মতো শুধু বলে যায় ‘সরি আম্মু’।’
আমার শরীর’টা কেঁপে উঠলো। অগ্নিপিণ্ডের ন্যায় জ্বলন্ত চোখ থেকে পানি ঝরলো অঝোরে। দাদুভাই আমাকে খাবার খাইয়ে দিলেন। আমি বাধ্য মেয়ের মতো খেলাম। খাওয়ার পর আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। এরপর বললেন,
‘সন্ধ্যার পর শুদ্ধ আসবে। তোমার ব্যাগপত্র আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। তুমি ওর সাথে চলে যেয়ো। কি কি নিবে বলো?’
এই মুহূর্তে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। কোনো কথা বলতে পারলাম না। কেবল নির্বোধের মতো চেয়ে রইলাম। দাদুভাই নিজেই ব্যাগ গুছাতে লাগলেন। উল্টেপাল্টে কি তুললেন কে জানে!
এরপর যখন সন্ধ্যে নামলো গেটের বাইরে এসে দেখলাম শুদ্ধ দাঁড়িয়ে। দাদুভাই আমার সাথে আমার ব্যাগ এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। শুদ্ধ শুকিয়েছেন। দাড়ি বড় হয়েছে আরো অনেকটা। তার গায়ের পাঞ্জাবি এলোমেলো। উদভ্রান্ত চোখের রক্তিম দৃষ্টি। দাদুভাই আমাকে ধরে ধরে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
‘সুখী হও, দাদুভাই। বাবাকে ভুল বুঝো না। তোমার বাবাই শুদ্ধকে ডেকেছেন। তোমাকে শুদ্ধর কাছে তুলে দিচ্ছেন।’
আমার পা দুটো থমকে দাঁড়ালো। আমি পেছন ঘুরে আমার চিরচেনা বাড়িটার দিকে চাইলাম। এই বাড়িতে আমি আর কক্ষনো ফিরবো না। ও বাড়ি এখন আমার জন্য অস্বস্থিকর! দমবন্ধকর! আমি দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার ঘরের বেলকনিতে। তার চোখ ভেজা তা আমি দূর থেকে বুঝতে পারলাম। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
দাদু শুদ্ধর কাছে কাঁপা হাতে ব্যাগ’টা ধরিয়ে দিলেন। এ বাড়ির এতো আদরের মেয়েকে যে কখনো এমন ভাবে বিদায় দিতে হবে তা কে জানতো? দাদুভাই কি জানতো তার আদরের নাতনি’টা সবার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে? তার পরিবার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? তার দুটো কলিজার টুকরোর মধ্যে একজনকে সে কীভাবে বাছাই করতো তার প্রাণপ্রিয় নাতনির জন্য? কীভাবে সে এই নিকৃষ্ট গর্হিত কাজটি করতো? সেই নাতনি যখন আবার অন্য কাউকে মন দিয়ে বসেছে? এ যে ঘোর বিপত্তি! তার থেকে এই ভালো না পছন্দের মানুষের সাথে বহুদূর গিয়ে ভালো থাকুক!তবুও তো তার নাতি দুটোর চোখের সামনে থেকে আড়াল হবে। তাদের শূন্যতা পাবে কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণা পাবে না।
৩১.
ভোরের রাঙা আলোয় পূব দিকের আকাশ’টা ছেয়েছে। তরু এখন ঘুমোতে যাবে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে আড়মোড়া ভাঙলো। অদূরে মস্ত বড় সবুজ পাহাড়ের মাথায় সূর্য সিংহাসন গেড়ে বসেছে। তরুর বাবা তরুকে ডেকে উঠলেন। ভোর ভোর উঠা তার অভ্যাস। তরু বললো,
‘জি বাবা।’
‘নামাজ পড়েছো, আম্মা?’
‘হ্যাঁ বাবা।’
‘ঘুমিয়ে যাও। একটু পর অফিস আছে না?’
তরু মাথা দুলালো। ঘুমাতে গেলো না। বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হেমন্তের মাস! বাতাসে শীত শীত আরাম আবহাওয়া। তরু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। পার হয়ে গেছে চারটি হেমন্ত! তরু দূরে চেয়ে রইলো আনমনে। তারা থাকে শ্রীমঙ্গলে। তরুর চাকরি হয়েছে। চাকরির পোস্টিং সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই নিলো এই দূর্গম, অচেনা অঞ্চলে। বাবা-মা দুজনকে সাথে আনলো। বাবা লোক দেখানো অযুহাতে এলেন ‘ব্যবসার প্রসার করতে হবে।’ সিলেটে তাদের পারিবারিক ব্যবসার ছোট একটা ব্রাঞ্চ খোলা হলো। জীবনটা কেমন অন্যরকম দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌছালো! যা তরু কোনোদিন কল্পনাও করেনি। কখনো ভাবেনি শুদ্ধ’কে ছেড়ে ও বাঁচতে পারবে। তরু কি সত্যি বেঁচে আছে? হ্যাঁ, শ্বাস তো পরছে। কিন্তু তরুর মন’টা কি বেঁচে আছে?
তরু একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শূন্যে। সে সত্যি আর কখনো সে বাড়িতে ফিরেনি। ওই শহরে মা’র পিতৃ সম্পত্তি থেকে পাওয়া একটা ফ্ল্যাট ছিলো। তারা গিয়ে উঠলো সেখানে। তরু সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে এলো এই পাহাড়ে। দাদু মাসের পনেরো দিন নিজের বাড়িতে থাকতেন বাকি পনেরো দিন থাকতেন তরুর কাছে। ফ্ল্যাটে আনাগোনা ছিলো পরিবারের সবার। শুধু ছিলো না শুভ্র, ধ্রুবর।
তরু কতরাত নির্ঘুম কাটায়! কতদিন কাজে অন্যমনস্ক হয়ে পরে! কতসময় পুরোনো স্মৃতি মনে হয়ে আনমনে হেসে উঠে! কেমন আছে শুদ্ধ? কেমন আছে শুভ্রভাই, ধ্রুবভাই? তরুর নেত্র সজল হয়। মৃদু সরে আওড়ায়,
‘ক্ষমা করো, প্রকৃতি। আমি সার্থপর হতে পারিনি। আমার পুরুষ’টি আমাকে সার্থপর হতে দেয়নি।’
তরুর অশ্রু গাল বেয়ে ঠেকলো গলা অবধি। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠলো। সে রাতে তরুর হাত ধরে শুদ্ধ বললো,
‘ক্ষমা করো, অঙ্গনা। সবার মনে দুঃখ দিয়ে তোমাকে নিয়ে সুখী হতে চাইনা। আমার কাছে থাকা অবস্থায় তোমার দুঃখ আমি সইতে পারবো না। তুমি আমাকে ছাড়া দুঃখী হও তবুও সুখী হও। আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচো।’
তরুর চোখের তারায় তখনো কেবল বাবা, দাদুর কান্নারত মুখমণ্ডল। ও শুদ্ধর দিকে অবাক চোখে তাকালো। শুদ্ধ তখন তরুর কপালে তপ্ত চুমু খেলো। হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিলো। নষ্ট ঘড়ি! তরু তখনো বুঝে উঠছে না সারাদিন কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। শুধু জানে ওরা সবাই কষ্ট পাচ্ছে!
‘আমি তোমাকে নষ্ট সময় উপহার দিলাম। যেনো তোমার মূহুর্তগুলো কখনো নতুন করে নষ্ট না হয়।’
তরুর চোখ বেয়ে ধীর গতিতে অবিশ্রান্ত নীর পরলো। এক পা এগিয়ে শুদ্ধকে ঝাপটে ধরলো। শুদ্ধ এই প্রথমবার তরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ফাঁকা আওয়াজে তরু ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো। নাক টানার তীব্র শব্দ নিস্তব্ধ রাস্তায় ঝংকার তুললো। দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যপটের সাক্ষী হয়ে রইলেন দাদুভাই। শুদ্ধ ভাঙা আওয়াজে ধরা গলায় বললো,
‘তরু, তোমাকে কখনো বলা হয়নি…
এ বলে শুদ্ধ থামে সেকেন্ড কয়েক। এরপর তরুর মাথায় পরপর তিনবার চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘আমি তোমায় হেমন্তের মতো ভালোবাসি, প্রিয় তরু। কিংবা তার থেকেও অধিক, যার সাথে কোনোকিছুর তুলনা হয়না। তোমাকে আমার দুঃখ ছাড়া আর কোনো দুঃখ স্পর্শ করার স্পর্ধা না দেখাক।’
তরু মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে তাকালো। চোখের জলে হাত দুটোও ভিজে একাকার। সেই সন্ধ্যে কবে পার হয়ে গেছে তবুও কত জীবন্ত! শুদ্ধর সেই জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি কথাটা তরুর আজীবনের পুঞ্জি। তরু সেই স্মৃতিটুকু আঁকড়ে সারাজীবন অনায়াসে পার করতে পারবে। তরু কান্নার মাঝে মৃদু হাসলো। তার হাতে ধরা সেই ঘড়ি। ঘড়ি’টা বুকের মাঝে চেপে ধরে বিরবির করে আওড়ালো,
‘আপনার থেকে বড় কোনো দুঃখ নেই আমার।’
এরপর মিনিট খানেক পর এই হেমন্তের সকালের শূন্যে হাহাকার করে তরু খুব আক্ষেপ নিয়ে বললো,
‘আপনি আমার হেমন্তের নীড়। হাত বাড়ালেই যদি ছুঁতে পারতাম,
অথচ কী আশ্চর্য! সেই নীড়ে আমি কখনো এক দণ্ড জুড়োতে পারলাম না।’
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৬
২৮.
আজকে সকালটা ভীষণ সুন্দর! সুন্দরের আঁচে দুপুরটাও ভারী চমৎকার হয়ে উঠলো। আমি ভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে দেখলাম শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! পনেরো দিন পর উনার সাথে আমার দেখা। তাও আবার শুদ্ধ নিজে এসেছে। এতো বড় স্বপ্ন আমি কীভাবে দেখছি? এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধকে একটা চিমটি কাটলাম। শুদ্ধ বেশ ভাবসাব নিয়ে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গম্ভীর মুখে বাইকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার চিমটিতে সে খুব বিরক্ত চোখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ধমকে উঠলো,
‘এই মেয়ে, চিমটাচ্ছো কেনো?’
আমি উৎফুল্ল চোখে মুখে উত্তর দিলাম, ‘ভালো লাগছে তাই।’
উনি নিরস মুখে বিরস বদনে বললেন, ‘উঠো।’
আমার মুখটা পাঙ্গাস মাছের মতো হা হয়ে গেলো। আমি এবার নিজের হাতে চিমটি কেটে বললাম,
‘কি বললেন? আপনার বাইকে উঠবো? আমি?’
শুদ্ধ চু আকারে বিরক্তসূচক শব্দ করে বাইকে উঠে চাবি ঘুরালেন। হেলমেট পরতে পরতে আমার হাতে আরেকটা হেলমেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘তাড়াতাড়ি উঠো। আজ তোমাকে আমি মার্ডার করবো।’
তার কথায় আমি কিছু মনে করলাম না। তার হাতে খুন হতে আমি রাজি। হেলমেট পরতে গিয়েও থেমে গেলাম। আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেললো। আহ্লাদী কণ্ঠে বললাম,
‘হেলমেট পরতে পারছি না। একটু পরিয়ে দেন।’
শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চাপলো কিন্তু আমি না দেখার ভান ধরলাম। উনি বললেন,
‘এই জনসম্মুখে চপেটাঘাত খেতে না চাইলে উঠে পরো, মেয়ে।’
‘আচ্ছা উঠছি। তার আগে বলুন আমাকে মার্ডার করতে আপনার কষ্ট হবে না?’
শুদ্ধ উত্তর দিতে চাইলো। কিন্তু তার উত্তর আমার আগে থেকেই জানা। নিশ্চয়ই ধমকে একটা ত্যাড়া জবাব দিবেন। বিধায় আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে মুখটাকে দুঃখী দুঃখী করে বলে উঠলাম,
‘থাক! আমি জানি আপনি অনেক কষ্ট পাবেন। তারপর দেখা যাবে আমাকে খুন করে আপনি নিজেও সুইসাইড করে বসেছেন। আপনার কষ্টে আমি কষ্টিত, শুদ্ধ সাহেব।’
বলে আমি হিহিহি করে দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। শুদ্ধর কাছে আমার হাসি সহ্য হলো না। তিনি রাম ধমক দিয়ে বললেন,
‘এই মেয়ে উঠো, তোমার যন্ত্রণায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। অসহ্য মেয়ে মানুষ একটা!’
আমার মুখটা ফাটা বেলুনের চুপসে গেলো। চুপসানো মুখে বললাম,
‘আমি আপনার সাথে যাবো না।’
শুদ্ধ বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগকে ধাতস্থ করে বললো, ‘ওকে, তবে যা বলার এখানেই বলছি।’
আমি চোরা চোখে আশেপাশে তাকালাম। আমরা দাঁড়িয়ে আছি একদম গেটের সামনে। পোলাপান আসছে যাচ্ছে আর আমাদের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। বেয়াদব ছেলে-মেয়ে। এছাড়াও আমি বুঝতে পেরেছি শুদ্ধ কি বলতে চায়। এইখানে ওসব কথা তিনি আমাকে ধমকে ধমকে বলার পর এই জনসম্মুখে আমার ইজ্জতের যে ফালুদা হবে তা ভেবেই আমার অস্থির লাগলো। আমি গাল ফুলিয়ে তার পেছনে উঠলাম। এই প্রথম আমি তার বাইকের পেছনে উঠলাম। তার কাধে হাত রাখলাম। আমার একবার ইচ্ছে করলো তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু এতো লোকের সামনে নিজেকে বেহায়া প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছে আমার হলো না। তাই জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখলাম।
আমার মেজাজটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। লুকিং গ্লাসে শুদ্ধর দাড়িতে আচ্ছন্ন গালের একাংশ দেখে আমার বুকটা ধকধক করে উঠলো। কাধ থেকে হাত নামিয়ে একবার তার পেটে রাখলাম। তারপর আবার তার কাধে রাখলাম। শুদ্ধ বিরবির করলেন। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম,
‘আমার ভুল। আমার ভুল। আমি পাগল। কোন কুক্ষণে যে এই মেয়েকে সাজা দিতে এসেছিলাম। এখন আমি নিজেই ভুক্তভোগী।’
আমি হাসলাম নিঃশব্দে। কাধ থেকে হাতটা নামিয়ে আবার তার পেটে রাখলাম। শুদ্ধ দাঁত কিড়মিড় করে ডাকলেন,
‘তরু?’
আমি লজ্জা মাখানো হাসি দিয়ে মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘হু…।’
‘আমাকে হাতানো বন্ধ করবে নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো তোমায়?’
আমার লজ্জা মাখানো হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠলো আলাভোলা নাদান ফেস। আমি আনমনে তাকে বললাম,
‘জি?’
সে আর কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ি টান দিলো। আসার পথে হঠাৎ দেখতে পেলাম রাস্তার ওপাশে ধ্রুব ভাই দাঁড়িয়ে। আমার চোখজোড়া থমকে গেলো। ভালোমতো দেখে বুঝলাম ওটা ধ্রুব ভাই-ই। পাশে ধ্রুব ভাইয়ের বাইক। কিন্তু ধ্রুব ভাই কেনো এসেছেন? আমাকে নিতে?
আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। চোখ সরিয়ে লুকিং গ্লাসে শুদ্ধর দিকে চেয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখটা আমার ঝাপসা হয়ে উঠলো। হেলমেটের আড়ালে তা কেউ বুঝলো না।
,
তরু যদি বুঝতো সানগ্লাসের নিচে ওই অপেক্ষয়মান চোখদুটো ওর দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে! যদি বুঝতো ওর জন্য ধ্রুবর মন কাঁদে! যদি বুঝতে পারতো ওর জন্য ধ্রুবর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়! তরু’টা কেনো ধ্রুবর ক্ষেত্রে অবুঝ হলো? কি এমন ক্ষতি হতো ধ্রুবকে একটু ভালোবাসলে? কি বা এমন ক্ষতি হতো যদি ধ্রুব তরুকে না ভালোবাসতো? ধ্রুব বাইকে উঠে বসলো। ধুলো উড়িয়ে রোদ্রের উজ্জ্বল দ্যুতিকে সঙ্গে নিয়ে পথ চললো। সূয্যিমামা আরামসে চলন্ত ধ্রুবর মাথায় তাপ দিতে দিতে বলে গেলো,
‘ওহে সূর্য, জ্ঞান দিও না। তোমার তাপের মাত্রা’টা কমাও। মস্তিষ্ক যে আর তোমার তাপ সহ্য করতে পারছে না। অযাচিত কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে পাছে কিন্তু দোষ দিতে পারবে না।’
২৯.
শুদ্ধর বাইকটা এসে থামলো একটা নির্জন জায়গায়। সামনে নদী। তীরে নৌকা বাধা। শহর থেকে খানিকটা দূরে। এতোটা পথ ঘুরিয়ে এখানে কেনো নিয়ে এলো শুদ্ধ তা আমার মাথায় ঢুকলো না। প্রশ্ন করে বসলাম,
‘আসলেই মার্ডার করবেন?’
শুদ্ধর মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। সে হিমশীতল গলায় প্রশ্ন করে,
‘তুমি আমার বাড়িতে গিয়েছিলে?’
জানতাম! আমি জানতাম এটাই জিজ্ঞেস করবে শুদ্ধ। তাই উত্তর আগেই রেডি করে রেখেছি,
‘হ্যাঁ, আপনার বাবা বললেন, মা আসো, আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরে যাও।’
সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি কাঁপিয়ে ধমক এলো। ধমকের শব্দে আমার কানের ভেতর টা পু পু শব্দ করে উঠলো।
‘থাপড়ে তোমার দাঁত-পাটি সব ফেলে দেবো, বেয়াদব মেয়ে। আরো বলেছো আমি তোমাকে বিয়ে করার নাম করে বিয়ে করিনি? আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি? এই মেয়ে, তোমার সাথে আমার বিয়ের সম্পর্ক?’
নিজেকে ধাতস্থ করে একটু সাহসী হয়ে উঠার চেষ্টা করে বললাম,
‘ভুল কি বলেছি? আপনি আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেননি? ওই রাতে আমাদের ঢাকায় এসে কাজী অফিসে যাওয়ার কথা ছিলো আর আপনি আমায় বাসায় পৌছে দিয়ে চলে গেলেন। তারপর আমাকে কথা দিলেন বছরের প্রথম দিন দেখা করবেন। তাও করেননি। ধোঁকা হলো না এটা?’
শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি চোখ মুখ কুচকে পিছিয়ে গেলাম এক পা। শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু নরম হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
‘তরু, তোমাকে আগেও বলেছি আমার পেছন ছাড়ো।’
‘আপনি আগে আমায় একবার ভালোবাসুন। একবার ভালোবাসি বলুন।’
সানগ্লাস খুলে এক চটকানা মেরে তা নদীর পানিতে ফেলে দিলেন উনি। আমি ভয় পেলাম না। আমি খুবই সাহসী মেয়ে। কিন্তু ভীত হলাম এই ভেবে যদি তিনি বলেন তিনি আমাকে ভালোবাসেন না। তখন? নদীর পানিতে তখন ধীর স্রোত। শীতল বাতাস। রোদ্রের মাঝে তা মন্দ লাগছে না। ওড়না বাতাসে উড়ছে। চুল উড়ে আমার চোখে মুখে ছড়িয়ে পরেছে। শুদ্ধ হঠাৎ এগিয়ে এলো। এসে আমার মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো প্রথমবারের মতোন। তার স্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম। সে বরফ শীতল কণ্ঠে মৃদু আওয়াজে বললো,
‘আমার নিকট এলে অযত্নে পুষ্প মরে যায়।’
আমি স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চাইলাম। সূর্যের আলো নদীর পানিতে রূপোলী ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সেই ঝিলিকে চোখ রাখা দায়। শুদ্ধর নেমে যাওয়া হাতটা খপ করে ধরে বললাম,
‘তাতে কি? আমি পুষ্প নই। তরু! আবার নাহয় আরেকটা পুষ্প’র অবজ্ঞায় জন্ম হলো!’
শুদ্ধ আমার হাতে ধরা তার হাতটার দিকে অনিমেষ চেয়ে হাত’টা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। আমি ছাড়লাম না। আঁকড়ে ধরে কাতর গলায় বলে উঠলাম,
‘আমি একটু আপনার স্পর্শ চাই।’
শুদ্ধ তার মুখটা আমার কানের কাছে এগিয়ে আনলেন। তার ফিসফিসানি স্বর আমার কানে ফসফস ধ্বনি তুললো। সারা শরীর কেঁপে উঠলো তীব্র থেকে তীব্রতর।
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৫
২৬.
শুদ্ধ নতুন বাসায় উঠেছে। বাবা-মাকে নিয়ে আসবে প্রথম মাসের স্যালারি’টা পেয়েই। ডাক্তার দেখিয়ে যদি শুদ্ধর সাথে থাকতে চায় থাকবে নাহলে গ্রামে চলে যাবে। শুদ্ধ ঠিক করেছে শুদ্ধ বিয়ে করে ফেলবে। একটা সুশ্রী, শান্ত-শিষ্ট মেয়ে দেখে শুদ্ধ ওর ঘরের রানী করে নিয়ে আসবে। তৎক্ষণাৎ শুদ্ধর ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। বললো,
‘জানি। কিন্তু আমাকে চাইলে ওকে সব ছেড়ে আসতে হবে যে!’
‘ও আসতে পারলে তোর কি?’
‘আমি চাই না এতো আদরে বাদর হওয়া মেয়েটা শুধু শুদ্ধর আদর নিয়ে বাঁচুক।’
আর কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া গেলো না। একটা বাবুই পাখি বারান্দার ভেন্টিলেটরে বাসা করেছে। শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে বাবুই পাখির বাসা দেখলো। শুদ্ধ সেদিন পাঞ্জাবি পরেছিলো। ইচ্ছে ছিলো তরুর কথা রাখার। কিন্তু রমনায় গিয়ে দূর থেকে ল্যাভেন্ডার শাড়িতে তরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে শুদ্ধ থমকে দাঁড়ালো। এরপর দূর থেকেই কতক্ষণ চেয়ে রইলো কে জানে! চোখ ঘুরিয়ে এদিক সেদিক নজর বুলাতেই হঠাৎ অদূরে সে ধ্রুবর বাইক আবিষ্কার করলো। তরু তখনো শুদ্ধর অপেক্ষায় ছলছল নয়নে মুখ ভার করে বসে।
ও দুই পুরুষের কষ্ট আর বাড়াতে ইচ্ছে করে না শুদ্ধর। অথচ তার রমণীর কষ্ট সে ঠিকই বাড়িয়ে চললো। একবার ভাবলো ফোন করি। আবার কি মনে করে করলো না। থাক না একটুখানি কষ্ট! কিছু অপূর্ণতা শুদ্ধর বুকপকেটেও জমুক। এই যে তার অপেক্ষাময়ী কে সে দূর থেকে ঝাপসা দেখে চলে এলো একি কম কষ্টের? অদেখার চেয়ে দেখেও না দেখে চলে আসা যে ঢের যন্ত্রণার! শুদ্ধ একটা সিগারেট ধরালো। বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে উপহাস্যে অনুচ্চ স্বরে বললো,
‘আমি দেখে নিলে যদি তুমি দুঃখ পাও?
আমি ছুয়ে দিলে যদি তুমি অকালে নষ্ট হয়ে যাও?’
উত্তর আসে না তো। শুদ্ধ নিজেই বলে,
‘আমি তোমায় দূর থেকে ছুঁই। আমি তোমায় দূর থেকে চেয়ে দেখি। সুন্দরতম তুমি আমার জন্য দুর্লভ হয়ে রও। আমি বেদনায় পিষ্ট হয়ে রই। তুমি আরেকটু শুদ্ধময় যাতনার প্রশ্রয় দাও।’
২৭.
চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটাতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাসে অভ্যস্ত হতে হতে এখন এই বদ্ধ বড় ঘরটায় শুদ্ধর হাঁসফাস লাগে। আজ ছুটির দিন। তরুকে না দেখার আজ বায়ান্ন তম দিন। ঘরের তল্পিতল্পা গুছিয়ে বিকেলে শুদ্ধ ছাদের উদ্দেশ্যে গেলো। কে জানতো ছাদে যে এতো বড় চমক অপেক্ষায় ছিলো?
ছাদের চাপানো দরজা পেরিয়ে আসতেই কয়েকজন রমণীর কন্ঠের শোরগোল শুনা গেলো। শুদ্ধ পা এগিয়েও পিছিয়ে নিলো। নারীর উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করলো? কোথাও দু’দন্ড শান্তি নেই শুদ্ধর জন্য? ছাদে এসে চেঁচামেচি করতে হবে কেনো? মেয়ে, তোদের ঘর নেই? শুদ্ধ পেছন ঘুরেছে ওই মূহুর্তে কানে এলো পরিচিত কণ্ঠস্বর। শুদ্ধর পা দুটো থমকে ভ্রু দ্বয় কুচকে গেলো। কণ্ঠের অনুসরণ করে তাকাতেই শুদ্ধর ভ্রু’র সাথে সাথে চোখদ্বয়ও কুচকে গেলো।
তরু বিহ্বল। এতোটাই হতবাক যে অনুভূতিশূন্য। পাশে থাকা বন্ধুদের ধাক্কাতে ওর ঘোর ভাঙলো। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে মৃদুস্বরে বললো,
‘তোরা যা। আমি একটু পর আসছি।’
এরপর কিছু একটা ইশারা করলো। শুদ্ধ দেখলো তিনজন রমণী তরুর ইশারায় যথা আজ্ঞা করে চলে গেলো। তরুর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। মরুভূমির বুকে জল পাওয়ার ন্যায় তৃপ্ত বৃক্ষ সে। তার চোখ দুটো জুড়িয়ে যাচ্ছে। একধ্যানে পলক বিহীন সে শুদ্ধকে দেখে গেলো। কত খুঁজেছে এর মাঝে! শুদ্ধর বাড়িতে ফোন লাগিয়েছে। শুদ্ধর ফেলে দেওয়া সিমে অহরহ বার ফোন দিয়ে গেছে। পুরাতন অফিসে গিয়েছে। কোথাও নেই। শুদ্ধ তরুকে উপেক্ষা করলো না। ছাদের বসার জায়গাতে বসে তরুকে বসতে বললো। তরু বসলো শুদ্ধর মুখোমুখি। শুদ্ধ মৃদু ধমকে বলে,
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৪
২৪.
শুভ্র প্রভাত! ঘড়িতে আট’টা বেজে সাতান্ন মিনিট। পাখির কিচিরমিচির। কুয়াশা আচ্ছন্ন পিচ্ছিল রাস্তা ভেদ করে শুভ্র বাইক নিয়ে শা করে দৌড় দিলো। এইযে একটি সুন্দর সকাল অথচ কত অসুন্দর! এই শুভ্র প্রভাত শুভ্রর বুকের নীল ব্যথা। নীল ব্যথার অধিকারিণী একজন সুন্দর রমণী। এ জীবনে কত রমণী এলো গেলো। কতজন’কে প্রত্যাখ্যান করলো শুভ্র অথচ বেছে বেছে গিয়ে আসক্ত হলো তার উপর যার উপর সবাই আসক্ত। আচ্ছা পৃথিবীতে এতো সুন্দরী থাকতে কেনো সবাই শুভ’র বুকের সেই নীল ব্যথার প্রতি পাগল? ওরা কি জানে না শুভ্র’র নীল ব্যথা যে ‘তরু’। শুভ্র কেনো সবার থেকে গোপন করলো? তার নীল ব্যথা যে বুকে ঘাঁটি গেড়ে নিচ্ছে। তাকে রেখে অন্য পুরুষে মত্ত হয়ে অন্য পুরুষের জন্য রাত-বিরেতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সুদূর চলে যাচ্ছে। কি ভেবেছে শুভ্র টের পায় না? শুভ্র পিছু না গেলে ওতো সুন্দর করে নীল ব্যথা পৌছাতে পারতো? শুভ্রর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুখের ধোঁয়া মিশে গেলো প্রকৃতিতে। ফাঁকা রাস্তায় শুভ্র জোরে বললো,
শুভ্রর বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। চোখ কি খানিক ঝাপসা হলো? নাহ! শুভ্রদের চোখ ঝাপসা হয় না। ওদের দীর্ঘশ্বাসগুলো কান্না। মায়ের কোলে মাথা পেতে করা হাহাকার গুলো ওদের কান্না। এইতো সেদিনকার কথা বাবা সাফ মুখের উপর জানিয়ে দিলেন,
‘এসব চাইল্ডিশ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তোমার জন্য নিশ্চয়ই আমি পরিবার ভাঙবো না। তাছাড়া ইম্পোর্টেন্ড বিষয় তরু তোমাকে ভাই ছাড়া অন্যকিছু হিসেবে পছন্দ করে না। তোমার একতরফা জেদে আমি আমার পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবো না।’
শুভ্রর মাথায় কথাগুলো যেনো বলের মতো বারি খেলো। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ্রর মা স্বামীকে বুঝাতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরে আসলেন। পরিবার’টাকে তো তিনিও খুব ভালোবাসেন। ধ্রুবর মায়ের সাথে তার মিলে না একথা সত্যি। তাদের মাঝে অকারণে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। কিন্তু ধ্রুব কে তিনি নিজের পেটের ছেলে বৈ অন্যকিছু কক্ষনো মনে করেননি। তার এক ছেলের মনকে ভেঙে দিয়ে আরেক ছেলের বউ করে তরুকে কীভাবে আনবেন? বাড়ির সেই অসুস্থ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন? তারপর কেউ কারোর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে? তাই তিনি কোলে রাখা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘বাবা, জীবনটা ছোট। একজীবনে মানুষ সব পায় না। আমি তোমাকে আমার দু’হাত ভর্তি করে তোমার জীবনের সব অপূর্ণতায় পূর্ণ করতে চেয়েছিলাম। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তোমরা দুই ভাই একই মেয়ে তাও নিজের চাচাতো বোন নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছো। একতরফা…
মাকে মাঝপথে থামিয়ে শুভ্র তাচ্ছিল্য গলায় বললো,
‘প্রতিযোগিতা তো জন্ম থেকে, মা। নামে প্রতিযোগিতা। কাজে প্রতিযোগিতা। সবটা শুরু করে এখন এসে সান্ত্বনা দিচ্ছো? ক্যারি অন।’
শুভ্রর মা ছেলের তাচ্ছিল্যময় হাসি দেখলেন না। কিন্তু বুঝতে পারলেন। তার চোখ’টা ভরে উঠলো। এ দেশে কি আর কোনো তরু নেই আমার ছেলেটার জন্য? শুভ্র বোধহয় মায়ের ব্যথা বুঝতে পারলো। মায়ের হাত টেনে উল্টোপাশে চুমু দিয়ে বললো,
‘সরি মা।’ শুভ্রর মা তখন মৃদু আওয়াজে কেঁদে উঠলেন। শুভ্র বললো,
‘তরুরা শুভ্রদের প্রেমে পরলো না কেনো, মা? আমি এ ব্যথা কত জনম সইবো?’
শুভ্র ভ্রু কুচকে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। অফিসে যেতে মন টানছে না। শহর ঘুরবে আজ। ধ্রুবকে সাথে আনার দরকার ছিলো। দুই রিজেক্টেড মাল একসাথে বিরহ উদযাপন করতে পারতো। কি লাভ নিজেদের এড়িয়ে চলে? পাখি যে অন্যের বাসা পছন্দ করে।
তরুর সাথে ধ্রুবর মা খারাপ আচরণ করায় ধ্রুব যেদিন ঘরের জিনিসপত্র ভাঙলো সেদিন দাদুভাই সব নিরবে দর্শন করে গেলেন। একটা টু শব্দ অব্ধি না করে নিজের ঘরে দোর দিলেন। তিনি কি করবেন? তিনি তো কোনোদিন আশংকা করেননি তার বাড়ির ভেতরের এই অবস্থা। কোনদিকে যাবেন তিনি? কার পক্ষ নিবেন? তিনজনই যে তার রত্ন! কলিজা ছেড়া মানিক!
ধ্রুবর হাত কেটে বিচ্ছিরি অবস্থা হলো। রাতে শুভ্রর বাবা এসে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললো,
‘বাবার সাথে কথা বলবে। মনে রেখো, বাবাদের দোষ থাকে না। যত দামী খেলনাই হোক সন্তান চাইলে বাবারা রক্ত বেঁচে তা কিনে নিয়ে আসতে চায়। বাবা হলে পরে বুঝবে।’
তারপর শুভ্র স্নেহার কাছে শুনলো ধ্রুবর বাবার সাথে ধ্রুবর কি নিয়ে যেনো তুমুল ঝগড়া। বাবার সাথে ধ্রুবর ঝগড়া করার জেদ গিয়ে মেঝো কাকী তরুর উপর তুললো। শুভ্রকে আর বলে দিতে হয়নি কি নিয়ে এতো কোন্দল। সে রাতে ধ্রুবর ব্যান্ডেজ বাধা হাত দেখে চু চু করে বলেছিলো,
‘আহারে ধ্রুব! তুই যদি না জন্মাতি।’
ধ্রুব চোরা গলায় বলেছিলো, ‘তাতে তোর কিছু বিশেষ লাভ হতো না।’
‘ইশশ… যদি তরুই না জন্মাতো। কত সুন্দর হতো সব! তরু তুই কেনো জন্মালি?’
শুভ্র জোরে গাড়ি টানলো। এতো জোরে যে যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বাতাসের তীব্রতা শরীরে কাটার মতো হুল ফুটালো। তবু হুশ নেই। বরং চিৎকার করে বললো,
‘ও প্রকৃতি শুনে রাখো,
অপ্রকাশিত শুভ্র’রা বিক্রি করে অব্যক্ত প্রেম, প্রতীক্ষা। কেবল কিনে আনে শুধু এক বুক হতাশা, উপেক্ষা।’
শূন্য রাস্তায় শুভ্রর কথা প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার এসে কানে লাগলো। শুভ্র চমকে উঠলো। হাত কেঁপে উঠলো। বাইক নিয়ে উল্টে পরলো রাস্তায়।
২৫.
বছরের এক তারিখ পরলো। চারিদিকে কী রঙিন রঙিন সজ্জা!কত আমেজ! রাস্তাজুড়ে আলপনা। তরুর মনেও রং লেগেছিলো কেননা আজ শুদ্ধর সাথে দেখা হবে। তরু মন ভরে সাজলো। একটা ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়ি পরলো। রমনায় শুদ্ধর জন্য অপেক্ষা করলো বিকেল পর্যন্ত। কিন্তু শুদ্ধ এলো না! ভিড়ের মাঝে একলা তরু এককোণে এক জায়গায় বসে সারাদিন অপেক্ষা করলো অথচ শুদ্ধ এলো না। এভাবে ধোকা দিলো তরুকে? তরুর চোখ ছাপিয়ে জল এলো। পড়ন্ত বিকেলেই ফিরে এলো।
ফিরে এসেই দেখলো ড্রইংরুমে শুভ্র বসা। প্লাস্টার করা পা টা ছোট টেবিলের উপর রাখা। বড় জেঠু শুভ্র ভাইকে চেকাপ করছেন। শুভ্র ভাই বাইক এক্সিডেন্ট করার পর থেকে বড় জেঠু নিজের কাজে বাড়ি থেকে কম বেরোন। তিনি মনে করেন তার কঠোরতায় শুভ্রর এই অবস্থা। এ বাড়ির ছেলে মেয়েগুলো বড় আদরে মানুষ। বেশি আদরে মানুষ বলেই হয়তো সবার জীবনে এতো কষ্ট! তরুকে দেখে ওর বড় জেঠু বললেন,
‘কিরে মা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো কিছু বলবি?’
তরু জেঠুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কেনো জানি না বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সামনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। তরু মন খুলে সবার সাথে কথা বলতে পারে না। কিন্তু কারোর কোনো আদরে কমতি নেই। কেউ তাকে ব্লেইম করছে না। কেউ বলছে না, ‘আমার ছেলের জীবন’টা নষ্ট করে দিয়েছিস তুই।’ অথচ তরু জানে আদতে শুধু তাদের ছেলেদের নয় এই গোটা পরিবারটাকে নষ্ট করে ফেলেছে তরু। তাই তো যে বাবা তরুর একমাত্র টিম মেম্বার সেই বাবা তরুর সাথে খুব একটা কথা বলেন না। নাম ধরে ডাকেন না। বাড়ি ফিরে তরুর সারাদিনের অভিযোগ গুলো শুনতে তরুর ঘরে আসেন না। তরু জেঠুর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় মিনমিন করে বললো,
‘আ’ম সরি, বড় জেঠু। আই লাভ ইউ।’
জেঠু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। এমন না একথা তরু আজ প্রথম বলেছে। তবুও তরু দৌড়ে চলে আসার সময় স্পষ্ট দেখতে পেলো জেঠুর চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। তরু কাঁদতে কাঁদতে বলে চললো, ‘সব আমার দোষ। সব।’
সত্যি কি তরুর দোষ? নাকি শুভ্রর? নাকি ধ্রুবর? নাকি ভালোবাসার?
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৩
অপেক্ষা করতে করতে ঘটনাটি গিয়ে ঘটলো রাতে। শীতের মাঝে অপ্রিয় ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল সে রাতে। শুদ্ধর মন বড় অস্থির হয়েছিলো। ঘড়ির কাটা যখন রাত ১০ টার ঘরে তখন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘরের দরজায় ধুপধাপ শব্দ হলো। শুদ্ধ ভয় পেলো না তবে বুঝতে পারলো অঘটন’টি ঘটে গিয়েছে। শীতের রাত তারউপর আবার গ্রামের। মরার উপর খারা হয়ে এসেছে এই বৃষ্টি। সব মিলিয়ে গ্রামে একটা সূচ পরলেই যেনো শোনা যাবে। এই সময় এই নিস্তব্ধতা ভেঙে দরজায় অনবরত করাঘাত শুদ্ধকে একটু বিচলিত করলো। বাবা-মা না উঠে যায়!
দরজা খুলতেই শুদ্ধ রাজুকে আবিষ্কার করলো। ছাতা মাথায় রাজু ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো,
‘শুদ্ধ ভাই, তোমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।’
‘আস্তে কথা বল।’
রাজু গলার স্বর নামিয়ে বললো, ‘চলো। একটা মেয়ে আছাড় খেয়ে পরেছে। আমি গিয়েছিলাম ক্ষেতের আইল কাটতে। অসময়ের বৃষ্টি। মেয়েটা এসে পরলো আমার সামনেই। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই কেমন ভূতের মতো তোমার নাম জপছিলো।’
শুদ্ধ বেজায় বিরক্ত হলো। রাজু পড়াশোনা করছে। ক্লাস টেনে পড়ে। খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কলেজে উঠলে ঢাকায় পড়ার ইচ্ছে। সময় পেলেই বাবার কাজে সাহায্যে লেগে পরে।
শুদ্ধ লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরতে পরতে বললো,
‘তুই ছাড়া আর কেউ দেখেনি তো?’
রাজু উত্তর দেয়, ‘না।’
‘খবরদার কাউকে বলবি না।’
রাজু মাথা নাড়ায়। শুদ্ধ মোটা একটা গেঞ্জি পরে উপরে আরেকটা জ্যাকেট পরে। বাইরে মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা। বড় একটা ছাতা নিয়ে তটস্থ, ব্যস্ত পায়ে হাটা দেয়।
২৩.
এই যে আমি রাত-বিরেতে বৃষ্টিতে ভিজে এতো পাগলামো করলাম। বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার জন্য ছুটে এলাম। জুবুথুবু ভিজে তখন আমার গায়ের জ্বর যে তরতর করে বাড়ছে এবং আমার চোখ জ্বলন্তিতে নিভু নিভু হয়ে আসছে তবুও তার প্রতি আমার উৎকন্ঠা, উদ্বেগ আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু আমার এতো অনুভূতির, কষ্টের বিন্দুমাত্র মূল্য না দিয়ে শুকনো খটখটে আওয়াজে কেবল সে শুধু এইটুকু বললো,
‘কেনো এমন করছো?’
তার এইটুকুন প্রশ্নে আমি কোনো কিছু বলার ভাষা পেলাম না। আমার জ্বরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া চোখ দিয়ে কেবল তার দিকে উদাসীন ভাবে তাকালাম। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নির্লজ্জ চোখ উপচে পানি এলো এবং আমার চোখে চোখ রেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তা সে কেবল দেখে গেলো। কষ্টে তখন আমার বুক ফেঁটে যাওয়ার জোগাড়। এতো অপমানের পরও আমি কীভাবে তার কাছে ছুটে আসি? কীভাবে? আমি কি মানুষ? তবুও আমি নিজেকে অমানুষ, একজন বেহায়ার বস্তা, অপমানের বকরি বানিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় তাকে বললাম,
‘ভালোবাসি তো। তাই এমন করি।’
সেই প্রথম! আমি তাকে ভালোবাসি বলেছিলাম! এর আগে আর কক্ষনো বলিনি। সে বুঝেছে। আমি তাকে নানানভাবে বুঝিয়েছি আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু সর্বনিকৃষ্ট বেহায়া আমি আমার নামমাত্র লজ্জার গন্ডিটুকু পার করে কখনো তাকে ভালোবাসি বলতে পারিনি। পাছে আরো বেশি অপমানিত হই! অজ্ঞাত প্রত্যাখান মানা যায় কিন্তু মুখের উপর ভালোবাসার প্রত্যাখান কি করে সহ্য করা যায়? তখন আমি পরবর্তীতে আবার কীভাবে বেহায়া হবো? কীভাবে দ্বিতীয়বার তার কাছে ভালোবাসার আবদার নিয়ে দাড়াবো? যে আমার মুখের উপর বলে দিবে আমি তোমাকে ভালোবাসি না। এ নির্মম, পাষাণ, হৃদয় ভাঙা সত্যের উপর আর কি হতে পারে?
কিন্তু সেদিন আমার হৃদয় ভেঙে সে একবারের জন্যও বলেনি আমি তোমাকে ভালোবাসি না বরং বাকরুদ্ধ নয়নে কেবল চেয়ে থাকলো মিনিট দুয়েক। সে খুব কম অবাক হয়। আমি সবসময় চাই তাকে আশ্চর্য করে দিতে। আচ্ছা, আমার সব চাওয়া পাওয়া কেনো তাকে ঘিরে? আমি কেনো এতো পাগল তার জন্য? আমার থেকে একটু পাগলামি কেনো শুদ্ধতে ট্রান্সফার হয় না? আমার মাথা ঘুরে উঠলো। পা দুটো টলে উঠতেই সে চমকে হালকা হাতে আমার বাহু ধরলো। আমি ভরসায় তার বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম। সে তৎক্ষণাৎ আমার মাথা তুলে দিয়ে কপালে হাত রাখলো। গম্ভীর গলায় বললো,
‘তরু…।’
এটুকু বলতেই আমি তটস্থ পায়ে পিছিয়ে গেলাম। কানে দু হাত চেপে কাঙালের মতো চিৎকার করে উঠলাম,
‘প্লিজ বলবেন না ভালোবাসি না। প্লিজ। দোহাই!’
হ্যাঁ, আমি কাঙাল। শুদ্ধর ভালোবাসার কাঙাল। ঝুম বৃষ্টিতে আমি তখন স্পষ্ট দেখছি শুদ্ধ’র চোখে অসহায়ত্ব। কিসের বেড়াজাল? তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন,
‘তোমার জ্বর, তরু।’
‘হোক জ্বর।’
‘জোরে কথা বলো না। এটা গ্রাম।’
‘আপনি কেনো বলেছিলেন আমি আপনার কাছে হেমন্তের মতো প্রিয়?’
শুদ্ধ ভ্রু কুচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালেন। আমি তার বুকে কিল ঘুষি মেরে উদভ্রান্তের ন্যায় বললাম,
‘কেনো বলেছিলেন? নাহলে তো আমি আপনাকে ভালোবাসতাম না।’
শুদ্ধ আমার দু হাত চেপে ধরে চাপা গলায় ধমকে উঠলো,
‘আস্তে কথা বলতে বলেছি না? ভুলে বলে ফেলেছিলাম। শুনেছো?’
বলেই তার বুকে হামলে পরলাম। সে বাকরুদ্ধ। তার বুক থেকে আমাকে উঠালো না। আবার আমার পিঠে হাত রেখে জড়িয়েও ধরলো না। আমি তার দুটো হাত বারংবার নিয়ে আমার পিঠের উপর রাখলাম। সে হতাশ শ্বাস ফেলে শুধালো,
‘কেনো পাগলামো করছো?’
আমি আবারো উন্মাদের ন্যায় তার বুকে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলাম,
‘আমি বাঁচবো কীভাবে? আপনাকে ছাড়া বাঁচবো না।’
আমার কাঁপুনি দেখে শুদ্ধ একটা হাতে আমায় জড়িয়ে নিলো। মৃদু ধমকে বললো,
‘এই শীতে এভাবে এসেছো কেনো? এটলিস্ট একটা শাল তো গায়ে জড়াবে।’
‘আমি তাকিয়ে থাকতে পারছি না।’
‘পারবে কীভাবে? যে জ্বর বাধিয়েছো!’
বলে শুদ্ধ নিজের জ্যাকেট খুলে তরুর গায়ে পরিয়ে দিলো। তারা একটা বন্ধ দোকানের ছাউনির নিচে এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে। তরু জ্যাকেট’টা পরে ঝড়ের গতিতে আবারো শুদ্ধের বুকে মাথা রাখলো। শুদ্ধ হতভম্ব। তরু বলে,
‘আমায় নিজের থেকে ছাড়াবেন দেখে জ্যাকেট দেওয়ার নাম করলেন, না?’
‘তরু, গ্রো আপ। তুমি নিজের সেন্সে নেই। চলো তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। রাইট নাও।’
তরু মাথা উঠালো। ছিটকে দূরে সরে বললো,
‘কক্ষনো না। আগে আপনি বলুন চিলেকোঠায় ফিরে যাবেন।’
‘সম্ভব নয়।’
‘তাহলে বলুন ভালোবাসেন।’
শুদ্ধ চোখ দুটো মেলে পূর্ণ চোখে তরুর দিকে চাইলো। চার চোখ এক হলো। ওই শুদ্ধ দুই চোখের মায়ায় শুদ্ধ আটকে গেলো। চাপা শ্বাসে ধীর কণ্ঠে বললো,
‘শুনো মেয়ে, ধ্রুবরা তোমার অপেক্ষায়।’
‘আর আমি আপনার প্রতিক্ষায়।’
‘শুভ্ররা তোমায় ভালোবাসে।’
‘অথচ শুদ্ধ’রা আমায় অবহেলা করে।’
‘আর তোমার নির্লজ্জ চিত্ত সেই অবহেলা’কে দিনরাত ভালোবেসে যায়।’
‘এবার আপনি একটু ভালোবাসুন।’
শুদ্ধ এ কথার পেছনে আর কোনো কথাই খুঁজে পেলো না। এগিয়ে এসে আবার কপালে হাত রেখে বললো,
‘জ্বর বাড়ছে। চলো।’
‘কোত্থাও যাবো না। বিয়ে করবো, চলুন।’
‘আগে সেন্সে ফিরো।’
‘আমার সেন্স আছে।’
‘এই বৃষ্টির রাতে কোনো কাজী তোমার জন্য বসে নেই।’
‘আমার সাথে চলুন। এইটা কোনো রাত হলো? ঢাকায় কাজী বসে আছে।’
‘সাট আপ, তরু।’
‘করবো না সাট আপ। কি করবেন? মুখের উপর দরজা তো এখন আর লাগাতে পারবেন না।’
বলে তরু হিহিহি করে হেসে উঠলো। মুখে বললো, ‘আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? এমন অদ্ভুত আচরণ করছি কেনো?’
শুদ্ধ চোখ পাকিয়ে তাকায়। এরপর তিনি আমার হাত ধরলেন। হাত ধরে পাড়ি দিলেন অনেকটা রাস্তা, অনেকটা সময়। পথ মাড়াতে মাড়াতে বৃষ্টির ঝাপটা কমে এলো। পথে আমাকে তিনি খাবার খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালেন। এরপর স্টেশনে এসে আমরা ট্রেন ধরলাম। ঘন্টা খানিক ট্রেনে ঘুমানোর পর আমার জ্বরটা একটু নামলো। কিন্তু সে রাতে আমরা কাজী অফিসে গেলাম না। তিনি আমায় বাড়ি পৌছে দিলেন। তবে কথা দিলেন ১ তারিখ সে আমার সাথে দেখা করবেন। আমি বাড়িতে ঢুকলাম চুপিচুপি। সবাই জানে আমি ঘরে দোর দিয়ে ভেতরে আছি। কিন্তু আমি গেছো ইঁদুর। বিকালেই আমার বারান্দার সামনে একটা মই এনে রেখেছিলাম। বারান্দার রেলিং টপকে মই দিয়ে নেমে সোজা শুদ্ধর কাছে। এই মূহুর্তে আমি আমার কাছে থাকা চাবি দিয়ে আমার ঘরের দরজা খুলে রুমে ঢুকলাম। জ্বরটা ছাড়েনি। আবার যেনো তড়তড় করে বাড়ছে। তবুও গিজার অন করে গোসল করে কাপড়গুলো ধুয়ে দিলাম। তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাক। যাতে আম্মু টের না পায়। শুদ্ধর জ্যাকেট’টা যত্ন করে রেখেছিলাম গোপনে, নিভৃতে। তা আজও আছে যত্নে।
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১২
২০.
আমি কেনো ঘর ছেড়ে বের হচ্ছি না তা নিয়ে দুদিন বাড়িতে অনেক জল্পনা-কল্পনা চললো। ছোট জেঠি ভেবে বসলেন তার ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে আমি ঘরে দোর দিয়েছি কিংবা ট্যুরে গিয়ে কারোর সাথে আমার অনেক বড় ঝামেলা লেগেছে, গোপনে প্রেম করে প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হয়েছি বলেও কেউ কেউ ধারণা করছে এর সাথে মূল বিষয় বস্তুই ছিলো চিলেকোঠার ছেলেটা বিনা নোটিশে চলে গেলো কেনো?
বাড়ির সবাই কতভাবে চেষ্টা করলো আমার মন ভালো করার, আমাকে হাসানোর। ছোট জেঠী আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। সেদিনের তার ব্যবহারের জন্য কত করে সরি বললেন। স্নেহা স্কুল থেকে আসার পথে ১৫ টাকা দিয়ে আমার জন্য গোলাপ কিনে নিয়ে এলো। এসে খাপটে আমায় জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। ফিসফিস করে বললো,
‘আমি কিন্তু সব বুঝি, তরুপু। তুমি শুদ্ধ ভাইয়ের জন্য কাঁদো তাই না? আমারও কান্না পায়।’
আমি স্নেহাকে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। চোখ মুছে উঠতেই এরমাঝে দরাজ গলায় হুঙ্কার দিয়ে প্রবেশ করলেন শুভ্র ভাই,
‘কিরে তোকে নাকি কে কালোজাদু করেছে? ঘুরে টুরে এসে ঘরে দোর দিয়ে পেত্নীদের সাথে বসবাস করিস। খাস টাসও না। ভূত-পেত্নী কি খাওয়ায় তোকে? দেখা তো আমাকে। দেখি গরু থেকে তোর পেত্নীতে প্রমোশন টা কীভাবে হলো।’
আমি মুচকি হাসলাম। ফাইযলামো করতে ইচ্ছে করলো না। কথার উত্তর দিতেও ইচ্ছে করলো না। শুভ্র ভাই আবার বললেন,
‘কিরে খুব ভাব বেড়েছে? কথার উত্তরও দিচ্ছিস না, গরু?’
আমি এবার একটু বেজার হলাম। শুভ্র ভাই আমাকে ব্যাঙ্গ করে তরু থেকে গরু ডাকেন। তার ভাষ্যমতে আমি নিতান্তই গরু জাতের সাথে আমার নামটাও গরু। চরিত্রের সাথে নামের পার্ফেক্ট কম্বিনেশন। আমার মুখ ফুলানোর মাঝে এবার এলেন ধ্রুব ভাই,
‘কিরে তোকে না কবে থেকে আমার জন্য একটা পাত্রী খুঁজতে বলছি? বিয়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি মারা যাচ্ছি আর তুই দরজা-জানালা লাগিয়ে নাকি সুই*সাইডের প্ল্যান করছিস?’
ডাহা মিথ্যা কথা! এরা প্ল্যান করেই এসেছে আমাকে উল্টাপাল্টা কথা বলে জ্বালাবে। আমি ত্যাড়া স্বরে বললাম,
‘তোমাদের কাজ নেই? বাড়িতে কি করছো?’
শুভ্র ভাই আয়েশ করে উত্তর দিলেন, ‘আরে বাড়িতে একটা পেত্নীর আমদানি হয়েছে তিনদিন আগে। ব্যস্ততায় দেখতে আসতে না পেরে অবশেষে আজ ছুটিই নিয়ে ফেললাম।’
ধ্রুব ভাই উত্তর দিলেন, ‘আর আমি তো সিউর ছিলাম আজ তুই সুই*সাইড মাস্ট করবি। তার জন্য সরঞ্জাম আনতে হবে না?’
‘আমার সুই*সাইডের জন্য তুমি সরঞ্জাম আনবে বলে আজ ছুটি নিয়ে নিলে?’
ধ্রুব ভাই হেসে মাথা নাড়ালেন। বস্তুত তিনি হাসেন না। আমি অপলক দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে রাঙানোর জন্য এমন করছেন তারা। কিন্তু আমি রাগছি না। শুভ্র ভাই বললেন,
‘চল তোর দুঃখ তে আমরা একটু দুঃখিত হই।’
ধ্রুব ভাই শুভ্র ভাইয়ের কাধে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে বলেন,
‘কিন্তু দুঃখিত কীভাবে হওয়া যায় রে? একটা কেক কেটে সেলিব্রেশন করে ফেলি?’
স্নেহা বললো, ‘গুড আইডিয়া ভাইয়া সাথে একটু ডেকোরেশন।’
শুভ্র ভাই এক গাল হেসে বললেন, ‘তাই? নে হাই ফাইভ।’
স্নেহা শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই দুজনের সাথেই হাই ফাইভ করলো। আমি তাদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। আমার মন ভালো রাখার জন্য সবার কত প্রচেষ্টা! আমার এতো বড় বাড়ি ভর্তি মানুষ। তবুও আমি শূন্য ওই একজনের জন্য। আমার মানুষগুলোর আমার মুখে হাসি ফুটাবার কত প্রয়াস! অথচ আমি একজনের ঠোঁটে নিজের জন্য হাসি দেখতে মরিয়া। আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি শুদ্ধকে দেখি না তিনদিন! কোনো কিছুতেই মন থেকে তাকে এক সেকেন্ডের জন্য সরাতে পারছি না।
২১.
বিকেলে আমি ছাদে এলাম। মুক্ত বাতাসে ডানা দুটো মেলে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। এরপর একদৃষ্টিতে চিলেকোঠার ঘরের দরজার দিকে চেয়ে রইলাম। চেয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে আমার বোধ হলো,
‘আরে আমি তো অন্য তরু হয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে তো চুটকিতে সমাধান আছে। এভাবে ঘরে দোর দিয়ে থাকলে আমি শুদ্ধকে খুঁজে পাবো কোথায়? উনি তো একটু ওরকমই। আমার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাব।’
আমি শক্ত হয়ে দাড়ালাম। নাহ! মেজাজটা ফুরফুরে করতে হবে। উনাকে বের করা একটা ব্যাপার? আমার বা হাতের তুড়ির কাজ। এখন মাসের শেষের দিক। নতুন বাসায় নিশ্চয় উঠতে পারেনি। তাহলে? কোথায়? তার বাড়িতে? ওও হ্যাঁ। আরে? এটা আমার মাথায় আগে কেনো খেলেনি? ওতো জিনিসপত্র নিয়ে তো সে আর বন্ধুর বাড়ি কিংবা যেখানে সেখানে উঠতে পারবে না। হাহাহা… শুদ্ধ আই এম কামিং বেইবি। বলেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম দাদুর ঘরে।
দাদু এসময় ঘরে থাকে না। তিনি মসজিদে গিয়ে আসর, মাগরিব একসাথে পড়ে আসেন। তবুও আমি লোকচক্ষুর আড়ালে সতর্কতার সহিত ঘরে ঢুকলাম। দাদুর সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কালো ডায়েরি বের করে তা থেকে মেলে ধরলাম। শুদ্ধর আগেও আমাদের চিলেকোঠার ঘরে আরো ব্যাক্তি ছিলেন। দাদু সবার বাড়ির ঠিকানা, নাম্বার রেখে দিতেন। আমি শুদ্ধর ঠিকানা জানি না। ডায়েরি থেকেই দেখে নিলাম। নাম্বার’টা ফোনে টুকে নিলাম। এরপর দৌড়ে আবার ছাদে এলাম। ব্যস্ত কাঁপা হাতে নাম্বারটায় ফোন লাগালাম।
ফোন ধরলেন একজন পুরুষ। নরম সুরে বললেন,
‘কে?’
আমি সালাম দিয়ে বললাম, ‘আমি তরু। শুদ্ধ স্যারের অফিসের কর্মচারী। শুদ্ধ স্যার আছে আংকেল?’
‘হ। ডাইকে দিমু?’
‘না না আংকেল। ডাকতে হবে না। রাখি আংকেল। ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
তরু আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। ধ্রুব ছাদের দরজা থেকে সব দেখলো, শুনলো। এরপর অপলক তরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারা সারা বাড়ির মানুষ তিনদিনে যা করতে পারেনি এক ব্যক্তির শুধুমাত্র নামটুকু এক সেকেন্ডে তা করে ফেললো। কি আশ্চর্য এই ধরণীর নিয়মকান্ড! ধ্রুব হা করে নিঃশ্বাস নিলো। মুখ উপরে তুলে চেয়ে রইলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো ‘তরু, কেনো আমায় ভালোবাসলি না?’ এরপর বিরবির করে বললো সন্তর্পণে,
‘যে তোমার অপেক্ষায় তাকে তুমি ফিরে দেখো না অথচ তুমি যার উপেক্ষায় তার প্রতি তুমি অবুঝ মৃতপ্রায়, অপরাজিতা।’
ধ্রুব চলে গেলো। জানতে পারলো না তরু তাকে দেখে নিয়েছে। তার ওই দীর্ঘশ্বাস, ওই চোখ লুকানোর প্রচেষ্টা তরু দেখেছে। ওই ফিসফিসানি স্বর তরু সব স্পষ্ট শুনেছে। তরু অবুঝ নয়। তার আশেপাশের আবহাওয়া সে বুঝে। শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাইয়ের সাথে বাড়ির ভেতরে কি সমস্যা চলছে কেউ না বললেও সে বুঝতে পারে। সে তো মেয়ে! এতো কাছে থেকেও বুঝবে না? তরু বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালো। নিচু স্বরে বললো,
‘ও আকাশ, আমায় ক্ষমা করো। আমি ওদের ভালোবাসতে পারিনি।’
বলতে বলতে তরুর গলাটা ধরে এলো। চোখটা ছলছল করে উঠলো। এতো সুন্দর, পবিত্র, বিশুদ্ধ ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারার মধ্যেও যে অশান্তি, অপ্রাপ্তি।
২২.
শুদ্ধ ভ্রু কুচকে বসে আছে। সে নিশ্চিত তরু একটা অঘটন ঘটাবে। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার একটুপর শুদ্ধর বাবা ওকে ডেকে বললো,
‘তরু নাম কইরে একটা মাইয়া ফুন দিছিলো।’
শুদ্ধ চমকে উঠলো। না! তরু ফোন দিয়েছিলো সেজন্য নয়। বাবার মুখে তরু নামটা শুনে। শুদ্ধ আচ করতে পেরেছিলো তরু কিছু একটা করবে। এতো ভদ্র মেয়ে সে নয়। তাই তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তরুর মতো মেয়ে তিনদিন ধৈর্য্য ধরে ছিলো এই অনেক। শুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে তরুর অঘটনের অপেক্ষা করতে লাগলো।
#হেমন্তে_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১১
১৮.
সুপ্রিয় পাঠকমন্ডলী,
আমি বহু গবেষণার পর উদঘাটন করেছি আমার দাদু, বাবা এদের শুদ্ধকে অপছন্দ করার পেছনের কারণ মূলত এটাই যে তারা মনে করেন যেকোনো সময় শুদ্ধর সাথে আমার প্রেম ট্রেম হয়ে মহাকান্ড ঘটে যাওয়ার চান্স আছে। সেই মহাকান্ড মানতেই নারাজ আমার বাপ-দাদা।
তাদের এই মনোভাবে আমি কিছু মনে করি না। আমি আবার খুব উদার কি না! সে যাই হোক, বন্ধুরা মিলে ট্যুর প্ল্যান করা হলো রাঙামাটি। একদিনের জন্য। সেটা কোনো প্রবলেম নয়। একদিন তেমন কোনো ব্যাপার নয়। আমি গেলাম মহা আনন্দে। তবে ফিরে আসার পর আমার জন্য যা অপেক্ষা করছিলো তাতে আমার পায়ের তলায় মাটি আর থাকলো কই?
শুদ্ধ চলে গিয়েছেন। তার যাবতীয় সরঞ্জাম, আসবাবপত্র কিচ্ছু নেই। গোটা ধরণী যেনো আমার মাথায় ভেঙে পরলো। আমি নিস্তব্ধ চোখে মেঝেতে বজ্রাহতের ন্যায় বসে পরলাম। না.. চোখ দিয়ে পানি পরছে না তবে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। গলায় কান্না, ব্যাথা উথলে উঠছে। এতোটা ঘৃণার পাত্রী আমি? আমাকে একবার বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না? শেষদেখাও করলেন না? আমার এতো কষ্ট….! মনে হচ্ছে আমি আজ মারা যাবো।
দিন গড়িয়ে যখন ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তখন আচমকা আমার কাধে কারোর হাত পরলো। আমি ওভাবেই বসে চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। এক সেকেন্ডের জন্য আমার মনে হলো শুদ্ধ… শুদ্ধ বোধ হয় এসেছে। কিন্তু নাহ! দাদুভাই!
‘সারাদিন ধরে এ ঘরে বসে আছিস কেনো?’
আমি নিষ্প্রাণ চোখ দুটো মেলে ধরা গলায় বললাম,
‘তোমরা সবাই খুব খুশি হয়েছো না?’
দাদুভাই জবাব দিলেন না। শুধু আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। ওতো চেয়ে আমার মুখে কি গুপ্তধন খুঁজে বেড়ালেন আমি জানি না। অতঃপর এলো পায়ে উঠে আমি চলে এলাম নিজের ঘরে। দরজার সামনে মা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি একটা টু শব্দ না করে ভেতরে ঢুকে পরলাম। কাউকে সহ্য হচ্ছে না আমার। কাউকে না। কোথায় খুঁজবো আমি শুদ্ধকে? সে কোথায় থাকতে পারে? চিন্তায় আমার মাথা ফেটে পরছে। মা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমি তার বুকে মাথা রাখলাম।
‘ওকে সবাই মিলে তাড়িয়ে দিলে কেনো মা?’
মা আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
‘শুদ্ধ নিজে থেকে চলে গেলো যে। আমিও জানতাম না। যাওয়ার আগমুহূর্তে এসে আমার বললো। তোকে বলে যায়নি বলে খুব খারাপ লাগছে? লাগাটাই স্বাভাবিক। কতদিন ধরে ছিলো! ছেলেটা খুব ফ্যামিলি পার্সন।’
আমি উত্তর করতে পারলাম না। আমার চোখ থেকে টপ করে পানি পরলো। আমি বলতে পারলাম না ‘মা, আমার শুধু খারাপ না বরং সাথে খুব কষ্ট হচ্ছে। শূন্যতায় বুকটা মনে হচ্ছে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।’
‘আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি, মা।’
মা সেকেন্ড কতক চুপ থাকলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ বললেন,
‘তুই শুদ্ধকে অনেক পছন্দ করিস?’
এমন প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তবে তেমন আশ্চর্যও হইনি। আবার বলতেও পারলাম না ‘শুধু পছন্দ নয় আমি তাকে খুব ভালোবাসি।’
মা আবার শুধালেন, ‘শুদ্ধ তোকে পছন্দ করে?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না করলাম। মা যেনো শুনে খুব স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। স্বস্তি টা বেরও করলেন,
‘যাক! পছন্দটা ক্ষণিকের! দেখবি না দেখতে দেখতে কেটে গেছে। আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। তোর দাদা, বাবা শুদ্ধকে একদম পছন্দ করে না। শুদ্ধকে নিয়ে আর ভাবিস না তুই। আয় খাইয়ে দেই।’
আমি খেলাম না। মাকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এরপর কি হলো জানি না…. আম্মুর কথাগুলো বারবার আমার কানে বাজলো। কেউ কেনো আমার সাথে শুদ্ধকে দেখতে চায় না? সে হোক! সবাই দেখতে না চাক। পুরো পৃথিবী দেখতে না চাক। শুদ্ধ কেনো চায় না? কেনো? আমি দুনিয়া ভেঙে কেঁদে উঠলাম। রুমে ফ্যান ছেড়ে, ওয়াশরুমের ট্যাপ ছেড়ে আমি হিড়িক দিয়ে কেঁদে উঠলাম। কান্নার বেগ থামাতে না পেরে হাত কামড়ালাম, চুল টেনে ধরলাম, বালিশে মুখ চেপে ধরলাম। কোনো কিছুতেই কাজ হলো না। তারপর দুই দিন আমি ঘর ছেড়ে বেরোলাম না। তা নিয়েও কত কেচ্ছা হলো!
১৯.
ভিটে পাকা ঘর। সামনে ছোট উঠান। পেছনে যতদূর চোখ যায় সবুজ চাষাবাদের ক্ষেত। বাড়ির সূচনায় খড়ের পাল্লা তার পাশেই একটা বড় চাড়ি। চাড়ির দু’পাশে দুটি বড় দামড়া বাধা। শীতল বাতাসের হুল্লোড়। শুদ্ধ এলো কাধে ঘাসের ভার নিয়ে। ঝাঁকা টা উল্টো করে ঘাসগুলো ফেললো চাড়িতে। ক্লান্ত হয়ে পা ভাঁজ হয়ে বসে পরলো ঘরের সামনে। লুঙ্গি হাটু পর্যন্ত বাধা, গায়ে ময়লা শার্ট, মাথায় বাধা গামছা খুলে শরীর ঝাড় দিয়ে তা কাধে ফেললো। অনেকদিন পর কাজ করে শরীর টা ব্যাথা করছে খুব। শুদ্ধ হাত পেছন দিকে নিয়ে কাধ রাউন্ড করে ঘুরিয়ে এক্সারসাইজ করলো। শুদ্ধর মা এসে ছেলেকে পানি দিলেন। পাশে বসে বললেন,
শুদ্ধ পানি খেয়ে প্রাণ ভরে হাসলো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলেই মাথা পেছনে সরিয়ে নিলো।
‘মাথায় ময়লা। শরীরে ময়লা। গোসল করে আসি।’
‘হ, আহই। আমি পানি জাইতে দেই।’
‘না আম্মা লাগবে না। তুমি গরম ভাত বাড়ো। আমি দুই মিনিটে আসছি। একটা শ্যাম্পুর পাতা দিয়ো।’
গোসল সেরে এসে শুদ্ধ গরম ভাত খেলো লাউ শাক দিয়ে সাথে মাসকলাই ডাল। তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে শুদ্ধ মায়ের দিকে চেয়ে একগাল হাসলো।
‘রান্ধন মজা হইছে বাপ?’
‘খুব।’
‘আর যাইবি না ঢাকাত?’
শুদ্ধ মায়ের কথাটা বুঝলো। মূলত সবকিছু নিয়ে বাড়িতে এসে উঠেছে বলেই এই প্রশ্ন। কি আর করবে? আজ মাসের ২৮ তারিখ। নতুন বাসায় উঠতে হবে ১ তারিখ। এর আগে তো আর জিনিসপত্র গুলো নতুন জায়গায় নিতে পারবে না।
‘যাবো মা।’
‘তোর বাপের বুকের ব্যথাখান বাড়ছে।’
শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কি করলো জীবনে? না পারলো বাবা-মাকে সচ্ছলতায় মুড়িয়ে রাখতে না পারলো ভালোবাসার মানুষটাকে আদরে রাখতে। সে মৃদু আওয়াজে জবাব দেয়,
‘জানি আম্মা। তোমার কাশি টাও বেড়েছে। চিন্তা করো না। এবার তোমাদের আমি ঢাকায় নিয়ে যাব। বড় বাসা নিয়েছি। একটা ভালো বেতনের চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। কাল রাত কনফার্ম করেছে। তোমাদের আর কোনো কষ্ট থাকবে না আম্মা।’
শুদ্ধর মা মোলায়েম হাসি দিলেন প্রাণ ভরে।শুদ্ধ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো। তার মায়ের হাসিটা এত্তো সুন্দর!
শুদ্ধ জানে তার মা তার অর্ধেক কথাই বুঝতে পারেননি। তবুও তিনি শুদ্ধকে দোয়া দিয়ে বললেন,
‘না বাপ। ঢাকাত যায়ে থাকবার পামু না। তুই ভালা থাক। অনেক কষ্ট করছস বাপ। নিজের লাইগে কিছু জমাইস।’
‘জমাতে হবে না। আমি সব তোমাদের পিছনে উড়াবো।’
শুদ্ধর মা হাসলেন, ‘পাগলা! বিয়েশাদি করতে হইবো না?’
‘কি জানি! আদেও কপালে আছে কি না।’
বলে শুদ্ধ একটু উদাস চোখে জানালা গড়িয়ে বাইরে তাকালো। সবুজ বিস্তর ধানক্ষেত পেরিয়ে বহুদূর চোখ রাখলো। কেমন আছে তরু? কান্নাকাটি করছে অনেক? একটা ফোন দিয়ে বলে আসলেও পারতো শুদ্ধ। আর কখনো তরুর সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কি আছে? তাহলে সেদিনের মিথ্যার জন্য শুদ্ধ ক্ষমা চাইবে। বলবে,
‘তরু, আমি সেদিন বাসা পেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ওই দিঘির মতো টলটলে আকৃষ্ট দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কি যেনো হলো। আগে কখনো হয়নি। তোমার প্রলুব্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আমাকে মিথ্যার প্রলোভনে পেলো। আমি নিজের অজান্তে মিথ্যে বলে ফেললাম। বলে আমি আফসোস করলাম না। তোমার সেই হাসির জন্য হাজারটা মিথ্যে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, তরু। কিন্তু তোমার সেই হাসি’র মুখোমুখি আমি হতে চাই না। তোমার ওই চোখের দিঘি আমার জন্য সর্বনাশ। তুমি বলো, আমি যাদুকর। কিন্তু তুমি মস্তবড় ঐন্দ্রজালিক, সম্বন্ধীয়, মায়াবিনী। আমার কেনো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে, তরু? আমি যে তোমাকে দেখতে চাই না।’
শুদ্ধর কি একটু কষ্ট হলো? বোধহয় না! কারণ সে কষ্ট বুঝে না। তার বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। সে ঠাওর করতে পারলো না। তরুর পাগলামি বিহীন সে যে নিশ্চল, শূন্য, মৃত তা ভাবতেই চাইলো না। বহুদূর চেয়ে সে ফিসফিস করে বলে উঠলো কেবল,
‘তরু,
তুমি আমার হেমন্তের অগ্রহায়ণের কারণ,
আমার অঘোষিত প্রেমে পরা তোমার বারণ।’
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১০
১৬.
শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই এর বাবাদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো না। ধ্রুব ভাই ছোট জেঠুর সাথে টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা বললেও শুভ্র ভাই টোটালি বড় জেঠুর সাথে কথা বলেন না। এর কারণ অবশ্য আমি জানি না। তবে ইদানীং শুভ্র ভাইয়ের সাথে বড় জেঠীরও মনমালিন্য দেখা গিয়েছে। তারা কথা বলছে কম। জেঠী যখন তখন চোখের পানি ফেলছে। কি যেনো হয়েছে আমাদের বাড়ি’টার মধ্যে!
কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ছোট জেঠী আমার সাথে শীতল আচরণ করছেন দিন দুয়েক থেকে। আমি ডাকলে সাড়া দিচ্ছেন না, ঠিকমতো কথা বলছেন না, আদর করছেন না, আমায় খাবার দিচ্ছেন না। আমি আলাভোলা নাদান বাচ্চা একটা মেয়ে। এদের ঝামেলার মধ্যে আমার সাথে এই আচরণের কারণ আমি মোটেও বুঝতে পারছি না। আর আমি বুঝতে চাইও না। আমার বিশ্বাস সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সকালে শুভ্র ভাই আর আমি একসাথে খেতে বসলাম। ছোট জেঠী শুভ্র ভাইকে খাবার দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। তবুও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে ছোট জেঠীর আচঁল টেনে ধরে বললাম,
‘আমার খিদে পেয়েছে তো, জেঠি। আমাকে খাবার দিবে না?’
জেঠি আমার দিকে সেকেন্ড কয়েক চেয়ে থেকে চলে গেলেন। আমি স্পষ্ট দেখলাম টেবিলের নিচে শুভ্র ভাই হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছে। বস্তুত যত যাই হোক, শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই দুজন আমাকে খুবই স্নেহ করেন, ভীষণ ভালোবাসেন। ওই মূহুর্ত’টায় আমার কান্না পেয়ে গেলো। আমি কি করেছি? এরমাঝে আম্মু এলো আমার আর আব্বুর খাবার নিয়ে। আব্বু নামবে আর মিনিট পাঁচেক পরে। আমি খানিক ধরা গলায় বলেছি,
‘আম্মু আমার না খেতে ইচ্ছে করছে না। নিয়ে যাও।’
আম্মু কিচ্ছু বললেন না। পাশে বসে খাবার মুখের সামনে ধরলেন। তারপর কি হলো জানি না আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। আশেপাশে কাউকে না দেখে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে আম্মুর বুকে মুখ লোকালাম। আমি তো এই বিহেভিয়ার গুলোও অভ্যস্ত না। হঠাৎ কি হচ্ছে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার মা বুঝতে পারছে। শুধু আমার মা না এই বাড়ির সবাই জানে কি হচ্ছে। শুধু আমিই জানি না। আমি নিশ্চিত চিলেকোঠার ঘরের ওই বেয়াদব লোকটাও জানেন। মঈনুল আংকেলও জানেন। শুধু আমাকেই বলা হচ্ছে না।
শুভ্র ভাই পাতের খাবার রেখে থমথমে মুখে বেরিয়ে গেলেন।
১৭.
বাড়ি ফিরে এসে দেখি পরিবেশ থমথমে। আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম। দুয়ার খোলার পর থেকে কোনো কাকপক্ষীও দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কি? তবে তার চেয়েও অবাকের বিষয় হলো নিস্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে মুঠোফোন টা চেচিয়ে জানান দিলো শুভ্র ভাই ফোন করেছে। আমি যারপরনাই হতবাক। বস্তুত শুভ্র ভাই আমাকে সচরাচর তো দূরে থাক কখনোই ফোন দেয় না। তারউপর ফোন ধরে সে বলছে,
‘বাড়ি পৌছেছিস।’
‘হুম।’
‘সোজা ঘরে ঢুকে রেস্ট কর।’
বলেই রেখে দিলো। আজব! এটুকু বলার জন্য ফোন দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো। দরজার সামনে দেখলাম ধ্রুব ভাইয়ের জুতা। সে কি এসেছে? ধ্রুব ভাই তো এসময়ে বাড়িতেই আসে না। নিজের ঘরে এসে দেখলাম স্নেহা চুপচাপ বসে আছে। গালে চোখের পানির একটা ধারা। আমি বিশেষ পাত্তা দিলাম না। তবুও আড়চোখে একটুখানি আহ্লাদ নিয়ে বললাম,
‘কি হয়েছে, বাবু?’
স্নেহা উত্তর দিলো না। আমার সকালের ঘটনা মনে পরলো। ছোট ছোট চোখে চেয়ে বললাম,
‘ছোট জেঠী মেরেছে নাকি?’
স্নেহা মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ভাইয়ার না কি যেনো হয়েছে। মা অনেক কাদলো।’
আমার ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো। স্নেহার কাছাকাছি এসে বললাম,
‘তোর ভাইয়া কি এই মূহুর্তে তার ঘরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেনো?’
‘জানি না। আসার পরেই জিনিসপত্র ভেঙে মার সাথে চিল্লাচিল্লি করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।’
স্নেহার কথা শুনে আমার চোয়াল ঝুলে পরলো। এ বাড়িতে কখন কি হচ্ছে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কাল উড়োভাবে বড় জেঠুর সাথে শুভ্র ভাইয়ের কথা কাটাকাটি শুনলাম। আজ আবার ধ্রুব ভাই? আমি কতক মিনিট বিষয়গুলো নিয়ে ভেবে উঠে দাড়ালাম। বস্তুত আমাকে কোনো কিছু নিয়ে অবগত করার আগ পর্যন্ত আমি সে বিষয় নিয়ে একদমই মাথা ঘামাই না। তবে এ বাড়িতে যে অনেক কিচ্ছু হচ্ছে এবং তা একমাত্র আমিই জানি না এ আমি ঢের বুঝতে পারছি।
ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আমি ছাদে গেলাম। ঘরের ভেতর কেমন ভুতের বাড়ি হয়ে আছে। দমবন্ধ লাগছে। ছাদের রেলিঙে বসে আমি শুভ্র ভাইকে ফোন দিলাম,
‘বল।’
‘সকালের ঘটনা কি তুমি ধ্রুব ভাইকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলে, শুভ্র ভাই?’
‘তুই খেয়েছিস?’
‘না। আমি তো কোনো কাকপক্ষীকে দেখছিই না। যে যার ঘরে দরজায় খিল মেরে আছে।’
‘তুই কোথায়? তোর ঘরে?’
‘না। ছাদে।’
‘রেলিঙে বসে আছিস?’
প্রশ্ন শুনে আমি চট করে রেলিং থেকে নিচে নেমে বললাম,
‘নাহ। আচ্ছা, আমি কি ধ্রুব ভাইয়ের ঘরে যাবো একবার?’
‘একবার কেনো একশবার যাবি। গিয়ে দেখ যদি একটা দুটো জিনিস তোর উপরেও ফিক্কা মারে।’
আমি চোখ উল্টালাম। শুভ্র ভাই কক্ষনো ভালো কথা বলতে পারে না। রাখছি বলে ফোন কেটে নিচে নামতে ধরেও কি মনে করে যেনো চিলেকোঠার ঘরের সামনে এলাম। দরজায় টুকা দিতেই লুঙ্গি পরনে সাদা গেঞ্জি গায়ে ঘুম ঘুম চোখে শুদ্ধ বেরিয়ে খুবই বিরক্তির গলায় বললেন,
‘তোমার কি কোনো কাজ নেই, তরু? ভরদুপুরে পেত্নীর মতো ঘুরাঘুরি করছো কেনো?’
তার এই পোশাক দেখলেই আমি রাঙা হয়ে যাই। তাই এইমুহূর্তেও আমি লজ্জায় চোখ নিচে নামিয়ে শুধালাম,
‘ঘুমাচ্ছিলেন?’
‘চোখটা মাত্রই লেগে এসেছিলো।’
‘সমস্যা নেই। এক আধবার আমার জন্য ঘুম ভাঙলে আর কি হবে?’
‘অনেক কিছু হবে। তুমি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নও।’
‘হতে কতক্ষণ?’
‘তুমি কি যাবে? নাকি তোমার মুখের উপর দরজা লাগাবো আমি?’
‘না একদম না। আমি যাবোও না। আপনি দরজাও লাগাবেন না। একটা কথা বলবো।’
‘বলো।’
‘আমার খিদে পেয়েছে।’
শুদ্ধ পূর্ণচোখে আমার দিকে চাইলো এবার। হালকা আওয়াজে বললো, ‘তুমি এখনো খাওনি?’
‘না।’
‘যাও গিয়ে খেয়ে নেও।’
‘কেউ নেই। সবাই সবার ঘরে।’
‘নিজে নিয়ে খাও।’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনার কাছে খাবো।’
‘তরু, আমি খুবই টায়ার্ড। অযথা কথা না বাড়িয়ে ঘরে যাও।’
‘কিসের টায়ার্ড আপনি? কাজেও তো যাননি। খাওয়াবেন কি না বলুন?’
শুদ্ধ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
‘দোলনায় বসো যাও।’
‘ভেতরে আসি?’
উনি দাঁত চেপে বললেন,
‘ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে তোমাকে ফেলে দেই। যাও মেয়ে।’
আমি বাধ্য মেয়ের মতো দোলনায় বসে পা দুলিয়ে গেলাম। একটুপর শুদ্ধ খাবার নিয়ে এলো। পরনে টাওজার। তাকে দেখে আকি মুখ টানা মারলাম। খাবারে আছে লাল শাক ভাজি, সজনার তরকারি। একটাও আমার খাওয়ার জিনিস না। তবুও আমার প্রিয় পুরুষের হাতের বিষ খেতেও আমি রাজি। আমি একটু আহ্লাদ নিয়ে বললাম,
‘খাইয়ে দেন না।’
উনি এমনভাবে চোখ পাকিয়ে তাকালেন আমার দিকে তা দেখেই আমার আত্মা ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে আবার সুরুৎ করে ফিরে এলো যখন উনি দোলনায় আমার পাশেই বসলেন। আমি খেতে খেতে বললাম,
‘জানেন, আমাদের বাড়িতে না কি জেনো হয়েছে? ধ্রুব ভাই আজকে নাকি জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে।’
শুদ্ধ খুব মনোযোগের সাথে শুনলো। কিন্তু অমনোযোগী হয়ে মৃদু গলায় উত্তর দিলো,
‘তাই?’
‘হ্যা। শুভ্র ভায়েরও জেঠুর সাথে কিছু নিয়ে তর্ক হয়েছে আই এম প্রিটি সিউর। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ওদের ঝগড়া হলেই মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়।’
শুদ্ধ আর কোনো উত্তর করলো না। বহু দূর নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে রইল। শুষ্ক বাতাসে ওর চুল এলো হলো। ফুল হাতা নেভিব্লু রঙের গেঞ্জির হাতা গুটানো। ফর্সা বাহু দুটো রোদে চিকচিক করছে। শুদ্ধ ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আপনমনে খাওয়া তরুর মুখের দিকে এক নিমিত্তে চেয়ে রইলো। হাওয়ায় হাওয়ায় যেনো ভেসে বেড়ালো,
‘যেই শহরে শুভ্র, ধ্রুবরা অবহেলিত। সেই শহরে শুদ্ধরা টিকে যেতে পারবে?’
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৯
১৪.
স্নেহার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা চারজন বাইরে খেতে এসেছি। স্নেহা গিফটের জন্য আমার কান দুটো ঝালাপালা করে দিলেও আমি নিরুত্তর মুখে মেন্যুতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। যদিও চোখ বুলিয়ে লাভ নেই। দেখা গেলো আমি খেতে চাইছি আম আমাকে জোর করে খাওয়ানো হবে জাম। এই জোরাজুরির যাতাকলে পিষ্ট হতে হতে আমি ক্লান্ত। এহেন পরাধীনতা আমি ঘৃণা করি।
ধ্রুব ভাই বসেছেন আমার পাশে। শুভ্রভাই আমার মুখোমুখি। দুজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যে ক্ষণে ক্ষণে উল্টেপাল্টে আমার মুখের উপর স্থির হচ্ছে তা আমি মাথা নিচু করেও বলতে পারি। কিন্তু আমি পণ করেছি কোনোমতেই নিজপছন্দে খাবার অর্ডার দিতে চেয়ে আজ আর অসম্মানিত হবো না। এমনিতেও আমার মন’টা পরে আছে চিলেকোঠার ঘরে। শুদ্ধকে একবার চোখের দেখাও দেখিনি। তারউপর এদের চাহনি আমাকে বিরক্ত করে তুলছে। যেকোনো মূহুর্তে আমি ব্যাগপত্র কাধে তুলে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে পারি। তারপর যা হবে তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নই বলেই আমি উঠে চলে যেতে পারছি না। অবশ্য প্রস্তুত থাকলে আমি তো আসতামই না। শুভ্র ভাই কেশে জিজ্ঞেস করলেন,
‘অর্ডার দিচ্ছিস না কেনো?’
‘খিদে নেই।’
শুভ্র ভাই আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। ধ্রুব ভাই নিশ্চুপ ফোনের দিকে চেয়ে আছে। তার ব্যাপারটাই হচ্ছে এমন, আমার উত্তরই তার উত্তর। আমি নিশ্চিত এই মূহুর্তে আমি যা খেতে চাইতাম সে একটু ভঙ্গি করে মেন্যু উল্টেপাল্টে দেখে আয়েশি ভঙ্গিমায় সেটাই অর্ডার দিতে বলতেন। কিন্তু বাধ সাধতো শুভ্র ভাই। ওই যে সবার উপর নিজের খবরদারি করার অভ্যাস। সবার মতামত উপেক্ষা করে সে নিজ মন মতো অর্ডার করবে। আমার কেমন অসহ্য লাগছে। শরীর চিড়বিড় করে উঠছে। অযথা আমার এই রাগের কারণ আমি বুঝতে পারছি না। শেষে কুলাতে না পেরে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘খাবার পার্সেল করে নিয়ে চলো। বাসায় গিয়ে খাবো।’
শুভ্র ভাই সেকেন্ড কয়েক আমার দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকলেন। আমি ধরেই নিলাম একটা রাম ধমক খেতে চলেছি এবং হলোও তাই। ধমকে উঠলেন তিনি,
‘পার্সেলই করার হলে এখানে এলাম কেনো?’
ধমকের পৃষ্ঠে আমি আর টু শব্দ করলাম না। চোখ খিচে বন্ধ করে রইলাম। ধ্রুব ভাই তখনো ফোনে চোখ গুজে রয়েছে। শুভ্র ভাই ওয়েটার ডেকে খাবার গুলো পার্সেল করে দিতে বললেন এরপর জায়গা থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে বললেন,
‘এদিকে আয়।’
আমি চমকে উঠলাম। হাত ধরায় অস্বস্তি হলো। এই অস্বস্তির সূত্রপাত শুদ্ধ আমার জীবনে আসার পর। শুভ্র ভাই আলতো হাতে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ধ্রুব ভাই এতোক্ষণে ফোন থেকে চোখ সরিয়েছেন।
‘তিনবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নে তো।’
‘কেনো?’
‘এমনি। আমার মনে হচ্ছে তোর ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করছে না যেকোনো সময় মরে টরে যেতে পারিস তুই। নে নে শ্বাস নে।’
শুভ্র ভাইয়ের কথা আমার মানতে ইচ্ছে করলো না। তখন পড়ন্ত বিকেল পেরিয়েছে। সন্ধ্যা ছুই ছুই! আমি আকাশের দিকে তাকালাম। মিনিট কতক নিশ্চুপ মুহূর্ত গড়িয়ে যাওয়ার পর বিমর্ষ কণ্ঠে বললাম,
‘দেখো! কেমন করে মেঘগুলো চলে যায় প্রকাশ্যে তবু সবার বেখেয়ালে।’
শুভ্র ভাই মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। আমি পেছনে ঘুরে কাচ গলিয়ে দেখলাম ধ্রুব ভাই স্নেহার সাথে কথা বলছে এরপর আবার শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। পরপর দুবার দুজনের মুখচ্ছবি, গাম্ভীর্যতা পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হলো আদতে এরা একসাথে বড় হয়েছে, সমবয়সী, যা করে সব একসাথে কিন্তু কোথায় যেনো সম্পর্কের টান পরেছে। কোথায় গিয়ে যেনো শান্ত দ্বন্ধ! ওদের মধ্যে সব মিল কিন্তু খুব অমিল!
আমার ভাবনার মাঝে পার্সেল নিয়ে স্নেহা ধ্রুব ভাই বাইরে বেরিয়ে এলেন। ওদের দুজনের মুখের দিকে আমাকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব ভাই চোখ নাচালেন। সবসময়ের মতো গম্ভীর মুখে প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘কি হয়েছে তোর?’
‘কিছু না।’
আমাদের যাওয়ার মাঝেই বাধা হয়ে শুভ্র শুভ্র বলে চিৎকার করে দৌড়ে এলেন এক ঝাঁক রমনী। শুভ্র ভাই হেসে হেসে রমনীদের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। বললেন,
‘কিরে মাছের বাজার! এখনো একসাথেই ঘুরিস তোরা?’
কথাবার্তায় বুঝলাম তারা খুব ভালো বন্ধু। খুব সম্ভবত তারা তাদের মোমেন্ট ক্যাপচারড করতে বেরিয়েছেন। পাঁচজনের গায়ে একই শাড়ি, একই গয়না, একই সাজ। পেছনে একজন ফটোগ্রাফার গোছের লোক। কথা বলার এক পর্যায়ে রমনীগণ হেসে কুটি কুটি হয়ে শুভ্র ভাই কে ইশারায় কি যেনো বললো। শুভ্র ভাই শুধু মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসলেন। আমার তখন বিরক্তি তুঙ্গে। রমনীগণ আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হতাশ শ্বাস ফেললেন। তাদের এই শ্বাস ফেলে দেখে ধ্রুব ভাইয়ের ভ্রু জোড়াও কুচকে গেলো। আমি তাদের এই হাসিহাসি মুখভঙ্গি থেকে বিশ্রী মুখভঙ্গি হয়ে যাওয়ার কারণ ঠাওর করতে পারলাম না।
বিদায় নিয়ে চলে আসার বেলায় ধ্রুব স্পষ্ট শুনতে পেলো তাদের ফিসফিসানি স্বর,
‘শুভ্রদের ভালোবাসাও উপেক্ষা করা যায়? ও মেয়ে না কংক্রিট?’
১৫.
এখন ডিসেম্বর মাস! শুদ্ধকে দেখার ছুতোয় পড়ন্ত বিকেলে ভারী কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে ফুল গাছ দেখার অযুহাতে ছাদে এসে আমি ভয়াবহ ছ্যাকা খেলাম। শুদ্ধ নেই। তবে ছ্যাকাটি আর ছ্যাকা রইলো না। মিনিট বিশেক পরেই ঘটলো শুদ্ধর আগমন। আমি তার ঘরের সামনে পথ আগলে দাড়ালাম। বুকের মাঝে হাত দুটো ভাঁজ করে গম্ভীর ভান করে বললাম,
‘কোথায় গিয়েছিলেন?’
ভাবটা এই যেনো আমি তার বউ। এই ভেবেই আমার মন রাঙা হলো। শুদ্ধ তার সকল গন্ডি পেরিয়ে আমাকে অবাকতার সাগরে ফেলে মুচকি হাসলেন। বললেন,
‘ছাদের বেঞ্চেতে বসো, তরু। আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসি।’
আশ্চর্যের চরম শিখরে পৌঁছে গেলাম এই মূহুর্তে আমি। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে রইলো। সে চা বানিয়ে নিয়ে এসে আপনাআপনি বললো,
‘বাসা খুঁজতে গিয়েছিলাম।’
এই তবে তার ভালো ব্যবহারের কারন! আমি স্তব্ধ নয়নে বললাম,
‘আপনি এখনো ওখানটায় পরে আছেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি ভুলে গেছেন।’
‘ভুলে যাওয়ার জন্য তো তোমার দাদুকে বলিনি আমি।’
এই পর্যায়ে আমার চোখ ছাপিয়ে জল এলো। ধরা গলায় বললাম,
‘বাসা পেয়েছেন?’
তিনি মিনিট দুয়েক আমার টলমলে চোখের দিকে চেয়ে কি জেনো খুঁজলেন। এরপর ধীরগতিতে মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘না।’
আমার চোখের জল চোখেতেই গায়েব হলো। আমি ভেবে ফেললাম, সে এক পাও নড়তে পারবে না। তার যাওয়া আমি অবশ্যই ঠেকাবো। আমি তাকে এ পর্যন্ত একবারো জিজ্ঞেস করিনি কেনো তিনি চলে যেতে চান। কারণ উত্তরটা আমার জানা। সে নিশ্চয়ই উত্তর দিবে ‘তোমার জন্য’। আমি পা দুলিয়ে দুলিয়ে বললাম,
‘চা’য়ের টেস্ট ভালো। ধ্রুব ভাইয়াও ভালো চা বানাতে পারে। শুভ্র ভাইয়া আবার ওতো ভালো পারে না।’
বললাম ঠিক টেস্ট ভালো কিন্তু আদতে আমি চা মোটেও পছন্দ করি না। তারউপর সেটা যদি হয় রং চা..! শুদ্ধ মুখে কুলুপ এটে শূন্যে দৃষ্টি রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আমি কি বলবো কি বলবো খুঁজে না পেয়ে শুভ্রভাই, ধ্রুব ভাইয়ের গল্প টেনে বসলাম আচম্বিতে।
‘জানেন, ওরা সবসময় একসাথে চলে, উঠে, বসে, খায়, একসাথে সব করে। কিন্তু… এতো কাছে থেকেও ওরা যেনো যোজন যোজন দূরের। ওদের মধ্যকার আচরণ ঠান্ডা। ওদের এরকম অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ আমি বুঝতে পারি না। নাকি পিঠাপিঠি ভাইদের সম্পর্ক এরকমই থাকে?’
শুদ্ধ কোনো উত্তর দিলো না। একটা চাপা শ্বাস বাতাসে মেলে ধরে পকেটে হাত গুজলো। তরুকে বলতে ইচ্ছে করলো না, ‘ওদের সম্পর্কের এই দূরত্বের কারণ একমাত্র তুমি, তরু।’
শুদ্ধর থেকে উত্তর না পেয়ে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। কেমন বিমর্ষ! কি এতো ভাবে সারাদিন? তারপর হুট করে প্রশ্ন করে বসলাম,
‘আপনার সেলারি কত?’
বাস্তবিক যে কাউকে হুট করে বেতন জিজ্ঞেস করলে সে অপ্রস্তুত হয়। কিন্তু শুদ্ধ অপ্রস্তুত হলো না বরং আয়েস করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা’টা দেয়ালের উপর রেখে বললো,
‘৩০ হাজার টাকা।’
‘ওওও…।’
‘হুম। এই স্যালারিতে তোমার ফ্যামিলি আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে না, তরু। বৃথা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা উচিত তোমার।’
‘আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আপনি আমাকে নিবেন কিনা সেটা বলুন। আমার এই স্যালারিতে দিব্যি জীবন কেটে যাবে।’
বলতে বলতেই আমি তার আর আমার চায়ের কাপ উলোটপালোট করলাম। শুদ্ধ কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপটা আবার উলটে নিজের কাপ নিয়ে এক চুমুকে চা শেষ করলেন। আমি আশ্চর্য হলাম। মনে মনে গালিও দিলাম কিন্তু লজ্জা বোধ করলাম না। কারণ তার বেলায় আমি মহা নির্লজ্জ! অতঃপর তিনি আমাকে অতীব গভীর কণ্ঠে শুধালেন,
‘চুমুকে চুমুকে বিষ পাণ করার এতো প্রচেষ্টা কেনো তোমার?’
আমি মুচকি হাসলাম। উঁচু স্বরে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলাম,
‘কারণ আমার বেহায়া হৃদয় খারাপ প্রেমিকের বিষপান নামক অমৃতসুধা পানে চরম তৃষ্ণার্ত!’
‘মেয়ে, আমার কাছে এলে পরে অযত্নলব্ধ হয়ে রবে।’
‘প্রিয় যত্নের পুরুষের কাছে অযত্নের পাত্রী হতে আমি সহস্রবার রাজি।’
‘মনে রেখো, আমি তোমার বাবার চোখে চিলেকোঠার সেই বেয়ারা ছেলে।’
‘তাতে কি? আমার চোখে তো ‘স্বপ্নের পুরুষ!’
শুদ্ধ আর কোনো টু শব্দ না করে চলে গেলেন। চারিদিকে তখন সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব। আমি ক্ষণে ক্ষণে নিঃশব্দে হেসে উঠছি। বহুদিন! বহুদিন পর মনে হচ্ছে আমরা বৈঠকে বসেছিলাম। যে বৈঠক শুদ্ধর প্রতিকূলে আর আমার অনুকূলে। আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম। নাহ! এই লোকটা কি কোনোদিনও আমার প্রেমে পরবে না?
আমি এই এখনকার সময়টাতে এসেও বুঝতে পারিনা তবে ওকথা তিনি আমাকে কেনো বলেছিলেন? কেনো বলেছিলেন আমি তার কাছে হেমন্তের মতো প্রিয়? সেই বাক্য বলার পরেই না আমার কিশোরী মন তার প্রতি ডুবে মরলো? দোষ কি তার নয়? আগ কি সে বাড়ায়নি? এখন কী সুন্দর আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে সম্পূর্ণ’টা এড়িয়ে চলে যান! অসভ্য লোক!
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৭
১১.
শুভ্র ভাই হলেন লাউড এবং রুড। তার কোনো রাখঢাক নেই। তার মুখে যেটা আসবে সেটাই বলবেন। হাই ভোল্টেজের মেজাজের অধিকারী হওয়ায় বাড়ির বড়-ছোট সবাই একরকম তাকে কুর্নিশ করে চলে। তিনি খুবই পরিবারমুখী। তিনি চান তার পরিবার’টাকে সবসময় আগলে রাখতে। পারেন কি পারেন না সেই হিসেবে আমরা যাচ্ছি না। কিন্তু চেষ্টা তো করেন! যাই হোক আমার সমস্যা’টা এখানে না। আমার সমস্যা হলো আমার ব্যাপারে অন্য কারো যেকোনো হস্তক্ষেপ আমার একদম পছন্দ নয়। আমি আবার তার থেকে এক কদম লাউড বেশি কি না! এ সম্পর্কে বাড়িতে কড়া নোটিশ জারি করা রয়েছে তবুও শুভ্র ভাইয়ের এক ডিগ্রি বেশি মাতাব্বরি না করলে পেটের ভাত হজম হবে না।
আজ ড্রয়িংরুমেই আমি রাত ১০ টার দিকে শুভ্র ভাইকে পাকড়াও করে মেজাজ দেখিয়ে বললাম,
‘তোমার সমস্যা কি, শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই মাত্র কাজ থেকে ফিরলেন। তিনি তার সমস্যার কথা তো আমাকে অবগত করলেনই না বরং দিগুণ মেজাজে বললেন,
‘হু গেভ ইউ দ্য ডেয়ার? তুই কোন সাহসে আমার উপর মেজাজ দেখাস? এক থাপ্পরে সব দাঁত ফেলে দিবো।’
আমি থতমত খেয়ে বসলাম। বুঝতে পারলাম না কি করলাম। শুভ্র ভাইয়ার প্রশ্নে কি আর বলবো উল্টে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। বস্তুত, শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই রুড হলেও কখনো কঠিন অভিব্যক্তি নিয়ে আমাকে বকেনি। শুভ্র ভাইয়ের চিৎকারে বড় জেঠি এসে আমায় আগলিয়ে নিলেন। ওই যে আমি এ বাড়ির খুব আদরে বাদর হয়ে যাওয়া মেয়ে! শুভ্র ভাই আর কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আকস্মিক ধমকে আমার কেবল একটু মন খারাপ, বেশি কিছু নয়। দাদুভাই লাঠিতে ঠুকঠুক আওয়াজ তুলে পাশের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে আমার থুতনি ধরে নিচু মাথা উপর দিকে তুলতেই আমি ফিক করে হেসে দিলাম। দাদুভাই তবুও মুখ ভার করে জিজ্ঞাস করলেন,
‘মন খারাপ হয়েছে, দাদুভাই?’
আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম,
‘না দাদুভাই। দেখছো না আমি হাসছি। ওরা তো সবসময় বকে।’
‘না না। সব বকা এক হয় না। ওই বেটা কোথায় লুকালো? কোন সাহসে আমার দাদুভাইয়ের সাথে এমন আচরণ করলো?’
তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে শুভ্র ভাই চিল্লিয়ে উত্তর দিলো,
‘শুভ্র লুকায় না। একজনকে স্যরি বলে দিয়ো, দাদুভাই। আর আমার কাছে এসেও যেনো তার বেয়াদবির জন্য এপোলোজাইস করে যায়।’
আমিও এখান থেকে উচ্চস্বরে গলা ফাটিয়ে বললাম,
‘মরে গেলেও না। দাদুভাই, বলে দাও আমার এই ব্যবহারের যথেষ্ট কারণ ছিলো। তার ওই দুর্ব্যবহারের যথাপোযুক্ত কারন দেখাতে না পারলে স্যরি ইজ নট এক্সেপ্টেবল।’
‘
‘কি হয়েছে, বল?’
এখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। শুভ্র ভাইয়া নিশ্চয়ই মাথাটা ঠান্ডা করে এসেছেন। কিন্তু এই ভ্যাপসা গরমে আমার মাথা যথেষ্ট গরম আছে। আমি বারান্দার বেতের চেয়ারে দুই পা উঠিয়ে ফোনের নোটপ্যাডে শুদ্ধ’র ছবি এড করে তার আজকের সমস্ত কীর্তিকালাপ লিখছিলাম। প্রত্যেকদিনই করি। শুভ্র ভাই এলেন। বসলেন। আমি লেখা শেষ করে তারপর তার দিকে তাকালাম। তিনি ভ্রু কুচকে আমাকে বললেন,
‘তোর টাইপিং বেশি ইম্পোর্টেন্ড?’
‘হ্যাঁ।’
আমার বেপরোয়া উত্তরে শুভ্র ভাই কোনো উত্তর দিলো না। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বারান্দার ফুল গাছ গুলো থেকে একটা অপরাজিতা ফুল ছিড়ে আরেকটা বেতের চেয়ারের উপর রাখলেন। আমি নাকের পাটাতন ফুলিয়ে চাইলাম,
এবার আমি আসল কথা পাতলাম, ‘তুমি এতো রুড কেনো, শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই ভ্রু নাচালেন। বললেন, ‘তোকে ডিস্টার্ব করেছে রুড না হয়ে উপায় আছে।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় আমি বিন্দুমাত্র অবাক হলাম না। এ আমার ধারণাতে ছিলো যে, শুভ্র ভাই এই দেড় ঘন্টা ঘরে বসে ইনভেস্টিগেশন করে বের করে ফেলেছে আমার রাগের কারন। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর করলাম
‘মোটেও না। আমাকে সে ভালোবাসে, ডিস্টার্ব কখনোই করেনি। আমি তোমার কাছে এসে কখনো বিচার দেই নি।’
‘তুই না বললেই কি আমি জানবো না?’
‘তুমি ওর দুই গালে দুইটা করে চারটা থাপ্পড় মেরেছো। তোমার যে দানবের মতো হাত আর ওর ফর্সা গাল দুটোর আকর্ষণ ঘটে আমার উপর ব্লাস্ট হয়েছে।’
‘কেনো? ছেলেটা কি তোকে কিছু বলেছে?’
আমি চু শব্দ করে উঠলাম,
‘আহা! ছেলেটা হলো অতিভদ্র, আলাভোলা। এই বলদ চর খেয়ে আবার আমাকে জেরা করবে এই বুকের পাটা থাকলে তো পাল্টা চর একটা তুমিও খেয়ে আসতে। এমন একটা পেবা মার্কা ছেলেকে তুমি কি করে চারটে থাপ্পড় মারলে সেটাই ভাববার বিষয়। তোমার একটুও মায়া কাজ করলো না?’
‘না করলো না।’
‘ওর মা এসে আমাকে কত অপমান করেছে জানো?’
এই পর্যায়ে এসে শুভ্র ভাই সুর করে শিষ বাজিয়ে বিদ্রুপ করে বললো,
‘মাম্মা’স বয়! কীভাবে অপমান করলো তোকে?’
‘স্টপ বিহেভিং লাইক দ্যাট। যতটা না অপমানিত হয়েছি তার থেকে ছেলেটার জন্য আমার বেশি খারাপ লেগেছে। চর খেয়ে ছেলেটার ভয়ানক জ্বর!’
‘তাই নাকি? আমার হাতে তো ভালো জোর রে, তরু! আয়, একটা খেয়ে দেখ তো কত ডিগ্রি।’
আমি মুখ ভেঙিয়ে বললাম,
‘দানব একটা! ছেলেটার মা আমাকে বলেছে আমি নাকি ভাড়া করে গুন্ডা নিয়ে গিয়ে তার ছেলেকে পিটিয়ে গালের ছাল তুলে ফেলেছি। সে কর্তৃপক্ষকে বিচার দিবে। থানায় যাবে।’
শুভ্র ভাই পাত্তা না দিয়ে প্রাউড ফিল করে বললেন,
‘মরুক গিয়ে! বলিসনি ‘বেশ করেছি?’ তার ছেলে ওতো নাদান হলে আবার মেয়েদের প্রেমপত্র দেয় কীভাবে? আবার লিখে ‘প্রিয়তমা তরু, তুমি আমার প্রেমে না পরলে আমি রাস্তায় শুয়ে থাকবো। নাওয়া, খাওয়া, বাথরুম সব বাদ দিয়ে বসে থাকবো।’ মদনে বাথরুম পর্যন্ত লিখেছে। হোয়াট রাবিশ!’
আমি নিচুস্বরে বললাম,
‘ঠিকই তো লিখেছে। বাথরুমও মানুষের জীবনে আবশ্যক একটা বিষয়। তুমি বাথরুমে যাওয়া ছাড়া কয়দিন বাঁচবে?’
পরমুহূর্তেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,
‘ওয়েট, হোয়াট? আমি না থাকলে তুমি আমার রুম সার্চ করো, শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই দু’কানে দু’হাত চেপে ধরে বললেন,
‘না জেনে আরেকবার চিল্লালে তোর চাপায় আর একটা দাঁতও খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিঠি’টাকে আমি খুঁজিনি চিঠিটাই আমাকে খুঁজে নিয়েছে।’
আমাকে আর বলে দিতে হলো না চিঠিটা কীভাবে শুভ্র ভাইকে খুঁজে পেলো। চিঠির তো আর হাত পা নেই তাই না! শুভ্র ভাইয়ার ওয়ার্নিং কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমি একচোটে উঠে দাঁড়িয়ে আবারো চিল্লিয়ে উঠলাম,
‘স্নেহার বাচ্চা…..!’
স্নেহা আর আমি এক ঘরেই থাকি। কাজেই আমার ডাকে সে মাথা নিচু কিরে বারান্দায় এসে দাড়ালো। শুভ্র ভাই দাঁতে দাঁত চেপে আমার চুল টেনে ধরলো,
‘এই, তোকে আমি বলেছি স্নেহার নাম?’
আমি ব্যথা পেয়ে আরো জোরে চিল্লিয়ে উঠলাম,
‘আমাকে এসব বলে দিতে হয় না। আমি মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারি।’
‘ওরে বাপরে! তা একটা টিয়া পাখি কিনে মাজারের সামনে বসে যা না! দুই চার টাকাও ইনকাম করতে পারবি।’
আমি মুখ টানা মেরে বললাম,
‘হুহ! আমার ক্লাস এতোটাও নিচু নয়। আমাকে একটা উটপাখি কিনে দাও। আমি উটপাখি নিয়ে বসবো।’
স্নেহা বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,
‘হিহিহি। তার থেকে শুভ্র ভাইয়া আর ধ্রুব ভাইয়া কে নিয়ে বসে যাও। একদিনে দুই চার লাখও কামাতে পারবে। যা ড্যাশিং আমার ভাইয়ারা।’
স্নেহার কথায় আমি বমির ভান করলাম সাথে হাত বাড়িয়ে ওর গালে একটা থাপ্পড় দিলাম। বললাম,
‘ডোন্ট শো ইউর ডার্টি টিথ। ক্লোজ ইউর মাউথ।’
স্নেহা থাপ্পড় খেয়ে ঠোঁট ফুলালো। ফলস্বরূপ শুভ্র ভাই আরো জোরে আমার চুল টেনে ধরলেন,
‘তুই আমার বোনের গালে চর মারলি কোন সাহসে?’
আমি ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে বলে উঠলাম,
‘যেই সাহসে তুমি আমার চুল টেনে ধরেছো। আমিও তো তোমার বোন। ওর বেলায় ভালোবাসা আর আমার বেলায় নো নাথিং? শুধু ধমক আর মাইর?’
‘না। তুই আমার বোন নস।’
এই বলে শুভ্র ভাই তার হাত হালকা করলেন। ছাড়া পেয়ে আমি একটানে চুল ছাড়িয়ে হাতখোপা করলাম। ছোট ছোট চুল ললাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেপ্টে গেলো। শুভ্র ভাই খুব মনোযোগ নিয়ে আমার হাতখোপা করা দেখলেন। আমিও তার দিকে আগুন গরম চোখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি। তারপর কেবল-ই প্রশ্ন করতে যাবো, ‘তবে আমি তোমার কি?’ তার আগেই শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,
‘তুই একটা শাকচুন্নি।’
আমি নাকের পাটাতন ফুলিয়ে ফেললাম,
‘আমি কারোর শাক চুরি করিনি।’
স্নেহা আবার পেত্নী মতো হিহিহি করে দাঁত কেলিয়ে উঠলো। আমি ওর দিকে কড়া চোখে তাকালাম। শুভ্র ভাই চলে যেতে যেতে বললেন,
‘এই চুন্নির কাজ শুধু মানুষের হৃদয় চুরি করা। নইলে ওমন আলাভোলা ছেলেটাও তোর প্রেমে মগ্ন হয়? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব পরলো নাকি!’
চলবে
#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৮
১২.
রৌদ্রময় সকাল! আমি বাবার সাথে দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির বড় গেটে। আমার দাদুভাই এর মান্দাতা আমলের গাড়ি’টি হেচকি তুলতে তুলতে এগিয়ে আসছে। আমি খুব কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে বাবার পাশে লক্ষী বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে আছি। হেচকি তুলতে তুলতে আসা গাড়িটির নাম হলো ‘বুলেট’। আমার দাদুর বাবার জীবনদ্দশার গাড়ি এটি। বাপের স্মৃতি মনের বেদনার বেড়ায় ধরে রাখতে চাওয়ায় আর দাদুর একগুঁয়ে স্বভাব এবং ত্যাড়ামির জন্য বাড়ির কেউ আর নতুন গাড়ির নাম মুখ থেকে উচ্চারণ করতে পারলো না। গলা পর্যন্ত এসে তা মৃত হয়ে সবাই ক্লান্তচিত্তে যে যার মতো বাইক কিনে চলাফেরা শুরু করলো। এ নিয়ে আমার দাদুর কোনো আফসোস নেই। তিনি নিত্যদিন সাবান থেকে শুরু করে নিজের থুতু পর্যন্ত দিয়ে গাড়ি ঝকঝকে তকতকে করতে করতে সবাইকে মূর্খের দল বলে গালিগালাজ করেন।
মঈনুল আংকেল খুবই আন্তরিকতার সহিত বললেন,
‘আবদুল, মামনিকে নিয়ে উঠো।’
মঈনুল আংকেল এ বাড়ির কেয়ারটেকার, ড্রাইভার, মালি, দারোয়ান। এক কথায় একের ভেতর সব। বাবা সহ আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। কিন্তু দেখা গেলো আমাদের গলধঃকরন করতে না পেরে বুলেট দুই তিনবার হেচকি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। আমি এবার রাগে হন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,
‘আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাবা। এই নকশা’র সাথে তুমি অফিস যাও। আমি রিক্সা করে চলে গেলাম।’
মঈনুল আংকেল আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার সহিত বললেন,
‘মামনি রাগ করো না। গাড়িটা একটু ধাক্কা দিলেই দেখবে ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে।’
আমার রাগের পারদ আরো বেড়ে গেলো। বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
‘এখন কি আমি গিয়ে ধাক্কা দেবো?’
মঈনুল আংকেল আমাদের পরিবারের একজন। আমার বাপ-চাচার মতোই। তিনি অত্যধিক স্নেহের স্বরে কিছু বলার আগেই সেই স্থানে শুদ্ধ’র দেখা মিললো। ঠোঁট গোল করে শিস বাজাতে বাজাতে হাতে চাবির রিং ঘুরাতে ঘুরাতে তিনি চলছেন। আমি উনাকে দেখেই কি কারণে কে জানে একদম শান্ত হয়ে বসলাম। তখন কারণ না জানলেও এখন এসে বুঝতে পারছি আসলে শুদ্ধ’কে দেখে নয়, বাবা যে শুদ্ধকে একদম পছন্দ করতো না তাই আমি তাকে দেখে কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার শান্ত হওয়ার মাঝেই বাবা শুদ্ধ’কে অদ্ভুত সম্বোধন করে বললেন,
‘এই, চিলেকোঠার বেয়ারা ছেলে। কাম হেয়ার।’
শুদ্ধ এগিয়ে এলেন। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললেন,
শুদ্ধর কথা আমার বাবার সম্ভবত পছন্দ হলো না। আরো পছন্দ হলো না ওর দাঁত কেলিয়ে হাসি’টা। আরে বেটা সালাম পর্যন্ত ঠিক আছে আগ বাড়িয়ে খুচিয়ে তোর এতো কথা বলতে হবে কেনো? এরজন্যই তোকে আমার বাপ দেখতে পারে না তুই বুঝিস না? তরুর মন উত্তর দিলো, ‘আরে এই বেটা তো এইসব ইচ্ছেকরে করে। মহাপাজি লোক।’ বাবা কপালে ভাঁজ ফেলে চুপচাপ নিজ স্থানে বসে রইলেন। আমি গরমে হাঁসফাস করে উঠলাম। মঈনুল আংকেল অতি আন্তরিকতার সহিত বললেন,
‘শুদ্ধ বাবা। একটু সাহায্য করো। তরু মামনির দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
আমার দেরি হচ্ছে কি হচ্ছে না তাতে শুদ্ধ’র যে কোনো মাথা ব্যথা নেই তা আমার শিরা উপশিরা পর্যন্ত জানে। কিন্তু বিধিবাম! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এই ছেলে বুলেটের চেয়েও নকশাবাজ। সে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে আমার বাবাকে আবারো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
‘আংকেল, হেল্প লাগবে? আসলেই লাগবে?’
কথার ভাষ্য দেখো! মনে হচ্ছে ইহজগৎ এ ওর সাহায্য ছাড়া সবাই থমকে থাকবে। আমার বাবা নাক ফুলালেন। আমি তা দেখে সিটের সাথে খিচে বসে রইলাম। আজ যে কি হবে তা আল্লাহ জানেন! বাবার উত্তর দেওয়া না দেখে শুদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে একদিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,
‘আংকেল আপনি এক থেকে পাঁচ গুণুন আর এই চিলেকোঠার বেয়ারা ছেলের শক্তি দেখুন। কীভাবে আপনাকে আর আপনার মেয়েকে নাড়িয়ে দেয়!’
বলেই নিজের মাসেল দেখিয়ে শুদ্ধ পেছনে চলে গেলো। আমার বাবার নাক ফুলে আগের চেয়ে তিনগুণ হলো। যেকোনো সময় ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সত্যি সত্যি পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় গাড়ি স্টার্ট নিলো। মঈনুল আংকেল উইন্ডো দিয়ে মাথা বের করে শুদ্ধকে দুই আঙ্গুল দিয়ে হ্যাটস অফ দেখিয়ে গাড়ি টানলেন।
১৩.
আমার ক্লাস শেষ হলো সাড়ে বারোটায়। বের হয়ে এসে দেখি শুদ্ধ দাঁড়িয়ে। আমি অবাকতার শীর্ষে চলে গেলাম। বোয়াল মাছের মতো মুখটা হা হয়ে গেলো। চোয়াল ঝুলে পরার যোগাড়। শুদ্ধ আমাকে নিতে আমার ভার্সিটি এসেছে? দু’চোখ আমাকে এই দিনও দেখালো? আমি থমথম পায়ে আশ্চর্য নিয়ে তার চোখের সামনে হাজির হয়ে তাকেও আশ্চর্য করে দিয়ে বললাম,
‘ওহ মাই গড! আমি কি দেখছি এসব?’
শুদ্ধ ভ্রু কুচকালো। পাত্তাহীন গলায় বললো,
‘কি দেখছো?’
‘আপনি আমাকে নিতে এসেছেন?’
আমার কথা শুনে শুদ্ধ যেনো আমার থেকে আরো চারগুণ বিস্মিত হলো। দুই গালে হাত রেখে অবাকতার ভঙ্গি করে বললো,
‘ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।’
পরক্ষণেই ধমক দিয়ে বললো,
‘তোমার কি মনে হয় আমার আর কাজ নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি? রোদ মাথায় নিয়ে এখানে তোমাকে নিতে এসেছি?’
অপমানে আর মন চুরমারের শব্দে আমার মুখটা চুপসে গেলো। আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘তাহলে কেনো এসেছেন?’
‘তোমাকে বলতে হবে?’
‘না বললে বুঝবো আমাকে নিতেই এসেছেন। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আই ডোন্ট মাইন্ড! আমার আবার একটু লজ্জা সরম কম।’
এই বলেই আমি তার বাইকের পেছনে চরে বসে তার কাধে হাত রাখলাম। সে সেকেন্ড দশেক সময় নিলো বিষয়টা বুঝতে। এরপর তার কাধ থেকে আমার হাত ঝারি দিয়ে ফেলে ধমকে ধমকে আমার কানের বারোটা বাজিয়ে দিলো,
‘এই ফাজিল মেয়ে। নামো তাড়াতাড়ি। তোমার বাবা নিজের মেয়ে রেখে আমাকে বেয়ারা ছেলে ডাকে কোন আক্কেলে? আজই গিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করবে। আর বলবে এখন থেকে যেনো তোমাকে নির্লজ্জ ডাকে।’
আমি কানের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দুই সেকেন্ড খুচানোর ভান করে হাসিমুখে বললাম,
‘বাবার হয়ে আপনি ডাকুন। আমি কিছুই মনে করবো না।’
উনি দিলেন আমাকে আরেক রাম ধমক,
‘এই মূহুর্তে নামবে তুমি। জলদি। নাহলে একটা আছাড় দেবো। আমি এক থেকে তিন গুনবো। এক……. দুই……….
‘নামছি নামছি। অভদ্র মানুষ একটা!’
‘আমি অভদ্র? নাকি বলা নেই কয়া নেই হুট করে অন্যের বাইক চেপে বসা তুমি অভদ্র?’
‘অন্যের বাইকে তো বসিনি। আমি আপনার বাইকে বসেছি।’
আমার কথার মাঝেই একজন এসে শুদ্ধকে প্রায় হাজার পনেরো টাকা দিয়ে গেলো। টাকা গুণে মানিব্যাগে রেখে শুদ্ধ বললো,
‘একজনের কাছে ধার পাই। সেই টাকা নিতে এসেছিলাম। মাসের এক তারিখ হতে না হতেই তো তোমার দাদু আবার ভাড়া ভাড়া করে আমার মগজ চিবিয়ে খাবে। আজব এক বাড়িতে উঠেছি। রাতদিন বুড়ো থেকে ছুরি সবাই আমার মগজ চিবিয়ে খাচ্ছে। আমার মগজের যে কতই টেস্ট…! উফফ!’
উনার কথায় আমি মুখ টানা মারলাম। শুদ্ধকে পছন্দ করে না বলেই তো দাদু মাসের এক তারিখ হতে না হতেই ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল শুরু করে। পাঁচ তারিখে মধ্যে ভাড়া দেওয়া শুদ্ধর জন্য ফরজ। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘যেই কাজেই আসুন। তাই বলে আপনি এই রাস্তায় আমাকে ধমকে আপনার বাইক থেকে নামিয়ে দেবেন? আমি বসলে কি আপনার গাড়িতে ফোসকা পরবে?’
‘অবশ্যই।’
‘আমি আজ বুঝতে পারছি কেনো আমার বাবা আপনাকে পছন্দ করে না। আপনার কথার ধরনের যে ছিরি!’
‘শুনো মেয়ে, তোমার বাবার পছন্দে অপছন্দে আমার কোনো যায় আসে না।’
‘কিন্তু আমার আসে।’
শুদ্ধ সেকেন্ড কতক থামলো। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার ব্যর্থ শ্বাস ফেলে মলিন স্থির কণ্ঠে বললো,
আমি তার প্রশ্নের উত্তর দেবো তার আগেই হাওয়ায় ভেসে এলো ধ্রুব ভাইয়ের কণ্ঠস্বর,
‘তরু…। এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’
বলে ধ্রুব ভাই নিজের বাইক ছেড়ে নেমে আমার পাশে এসে দাড়ালো। জোরপূর্বক হেসে শুদ্ধর সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো,
‘ভাইয়ের এখানে কি কাজ?’
‘এইতো তেমন কিছুনা। একজনের থেকে টাকা পেতাম সেটাই নিতে এসেছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা।’
ধ্রুব ভাই আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে খপ করে আমার হাতটা ধরলো। আমি চমকে উঠলাম। ধ্রুব ভাইয়ের বোধ হয় এই একটাই কাজ। হাত মুচড়ে ছাড়াতে গেলেই ধ্রুব ভাই ব্যস্ততার সহিত বললেন,
‘আসি তাহলে।’
বলে আমাকে টানতে টানতে বাইকে উঠালেন। অদূরে শুদ্ধ মৃদু হাসলো। বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বিরবির করলো,
‘তোমার অপেক্ষায় তারা অথচ তুমি চেয়ে দেখো না। কাঠবেলী, আমার পেছন ঘুরো না।’