Friday, June 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 16



অনির পর্ব-০৬

0

ষষ্ঠ পর্ব

যে কদিন আছি প্রতিদিন ওর সঙ্গে দেখা করব ঠিক করলেও সেটা হয়ে উঠলো না। বাড়ি ফিরে দেখলাম তুলকালাম কান্ড। সকালবেলা বড় ফুফু এসেছে। নাজমার কাছে শুনলাম দুপুর নাগাদ নাকি মায়ের সঙ্গে তার তুলকালাম ঝগড়া বেধেছে, তারই সূত্রই ধরে মা ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে নানা বাড়ি চলে গেছে।

সদর দরজার কাছেই বড় ফুপু বোরকা পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা ফিরেছেন কেবলই, উচ্চ স্বরে বাকবিতণ্ডা চলছে। নাজমা দাড়িয়ে আছে কাছেই, যদিও কিছু বলছে না। বাবা বারবার বড় ফুফুকে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন কিন্তু উনি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন এত বড় অপমানের পর আর কিছুতেই এ বাড়িতে থাকবেন না, কিছুতেই না। আমি নাজমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও মিটিমিটি হাসছে। এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা বোঝা গেল। দুপুর বেলা মা বেরিয়েছে, দুপুর থেকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই অপমানবোধ জেগে ওঠেনি ঠিক বাবা আসার আগ মুহূর্তে একেবারে শিরস্ত্রাণ পরে রনমঞ্চে অবতীর্ণ হওয়াটা যে পূর্বপরিকল্পিত তাদের সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

এই ধরনের পারিবারিক কূতনৈতিক মঞ্চ নাটক বরাবরই ভীষণ রকম অসহ্য লাগে তাই আমি পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। তবে সেদিন বুঝতে পারিনি যে অনতিবিলম্বে আমাকেই হতে হবে এই ধরনের মঞ্চ নাটকের প্রধান কুশীলব।

ঘন্টাখানেক পর নাজমা আমার ঘরে এসে বিস্তারিত ঘটনা জানালো। মায়ের সঙ্গে বরাবরই বড় ফুফুর বনিবনা হয় না। যেহেতু উনি বাবার চেয়ে বছর দশকের বড়, মায়ের প্রতি তার আচার আচরণ অতিমাত্রায় কর্তৃত্বপূর্ণ। মা সেটা কখনোই মেনে নিতে পারেন না॥ নাজমা জানালো এবারও তাই হয়েছে, তরকারিতে আলুর সাইজ ছোট না বড় এই নিয়ে শুরু হয়েছিল তারপর কথা গড়াতে গড়াতে অনেক দূর চলে গেছে।

বড় ফুফু বিধবা । যশোরে উনি আমাদের দাদা বাড়িতেই থাকেন ছেলে পুত্রবধূ এবং নাতি নাতনিদের নিয়ে। আমরা কালে ভদ্রে সেখানে যাই। ছোট চাচা রাজশাহীতে থাকে, উনি যান না বললেই চলে। আর হালিমা ফুফু মানে আমার ছোট ফুফুর সঙ্গে তো তার মুখ দেখা দেখিই বন্ধ। যেহেতু দাদা বাড়িতে থাকেন তাই হিসেব মত প্রতি বছর আমারা সব চাচা ফুফুরা সেখানে যাব, আনন্দ হবে হইহুল্লোড় হবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না উনার কারণেই। গ্রামের বাড়ি থেকে যেটুকু আয় হয় তার পুরোটাই উনি ছেলে নিয়ে ভোগ করেন। এ নিয়ে ভাই-বোনদের কোন অভিযোগ নেই কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ভাই-বোনদের বাড়িতে চলে যান। সেখানে যাবার পরেও তাঁর আবদার অভিযোগের শেষ থেকে না। বাড়ীর অবস্থা ভালো নয়, দেয়াল ধ্বসে পড়েছে, মেরামতের জন্য টাকা দরকার, সবকিছু উনাকেই দেখতে হয, বাকিরা কেউ ফিরেও তাকায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকিরা রীতিমতো অতিষ্ঠ, তাই অত্যাচারটা এই বাড়িতেই বেশি হয়।
মাকে অসংখ্যবার ফোন করে ফিরে আসছে অনুরোধ করা হলো কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যতদিন বড় ফুপু আছেন তিনি ফিরে আসবেন না। বাবাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।একদিকে মাতৃতুল্য বড় বোন অন্যদিকে স্ত্রী। অন্য কোন লোক হলে হয়তো এতটা বিচলিত হতেন না কিন্তু আমার বাবা মায়ের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। আমি ছোটবেলা থেকেই বাবাকে দেখেছি শুধু মায়ের হাতে টাকা দিয়েই তার সব দায়িত্ব শেষ। বাকি সব কিছু মাকেই করতে হতো।

আমার নানা বাড়ি কুমিল্লায়। নানা ভাই এখনো বেঁচে আছেন এছাড়াও দুই মামা আছেন তাই মায়ের দাপটই অন্যরকম। রাতের বেলা মা বাড়ি ফিরলেন না। পরদিন সকালের নাস্তার পর আমি আর নাজমা আমার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলাম সেই সময়েই বাবা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলবেন
– তোর মা তো আসতে চাচ্ছে না, কি করি বলতো
নাজমাট ফট করে বলল
– না আসলে নাই, থাকুক কিছুদিন
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। নাজমা বরাবরই মায়ের খুব ন্যাওটা, ওর কাছ থেকে এরকম একটা কথা আমি আশা করিনি। বাবাকে খুব একটা আশ্বস্ত মনে হল না কোনমতে বললেন
– তোর বড় ফুফু সবটা সামলে নেবে বলছিস
– নেবে না কেন, অবশ্যই নেবে। কদিন পর দেখবে কামাল ভাই চলে এসেছে বউ বাচ্চা নিয়ে, তারপর থেকে এখানেই থাকা শুরু করবে। ভাইয়া তো চলেই যাবে আমাকেও মনে হয় হোস্টেলে উঠে যেতে হবে। দেখি আজ কলেজে গেলে হলের সিটের জন্য এপ্লাই করে দেব
বাবা একটুখানি খড়কুটো ধরার আশায় এখানে এসেছিলেন নাজমার কথা শুনে কেমন মুষড়ে পড়লেন। আমতা আমতা করে বললেন
– তাহলে কি করতে বলিস
– বড় ফুপুকে বিদায় করো তাহলেই মা চলে আসবে
– এভাবে মুখের উপর একজনকে কি করে চলে যেতে বলি, বল
– তুমি না পারলে আমাকে বলো আমি বলি
– না না তোর কিছু বলার দরকার নেই, আবার কি থেকে কি ঝামেলা বাঁধে
– তোমার যা ইচ্ছা কর তবে আমার কথা শুনলে এক ঘন্টার মধ্যে বিদায় করতে পারবে
নাজমার বৈষয়িক বুদ্ধি অসাধারণ এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই তাই বলে এতটা আত্মবিশ্বাস ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়
আমি ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম॥ এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম দেড় ঘন্টার মধ্যে বড় ফুফু সত্যি সত্যি ব্যাগ বস্তা গুছিয়ে রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত।

নাজমা কি এমন বুদ্ধি দিয়েছে সেই কথা ওর কাছ থেকে বার করতে আমাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হলো। অবশেষে মেপাল ওয়ালনাট আইসক্রিম খাওয়াবো এই প্রতিশ্রুতি দেবার পর ও জানালো যে, বিশেষ কিছুই করতে হয়নি শুধু বাবাকে বলতে হয়েছে, মা নেই তাই কিছুক্ষণ পর হালিমা ফুপু আমাদের বাড়িতে আসছেন। যতদিন মা না আসছে ততদিন থাকবেন। হালিমা ফুফুকে উনি যমের মতন ভয় পায়। এর কারণটা অবশ্য আমি জানি। আমার দাদা বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি বড় ফুফু ভোগ করছেন॥ দুই ভাই মানে আমার বাবা আর ছোট চাচা তাদের অংশ বিক্রি করে অনেক আগেই নিয়ে গেছেন। ওই টাকা দিয়েই আমাদের এই বাড়ি বানানো হয়েছে বছর দশেক আগে। এখন বসতবাড়ি আর যেটুকু সম্পত্তি আছে তা দুই বোনের। কিন্তু বড় পুকুর তার থেকে কানাকড়ি ও ছাড়তে রাজি নন॥ হালিমা ফুফুর সাথে এই নিয়ে অনেকদিন ধরেই ঝামেলা চলছে। বড় ফুফু পারতপক্ষে তার সামনে পড়তে চান না। এরকম একটা কূটনৈতিক চাল নাজমার মাথায় কি করে এলো তাই ভেবে আমি চমৎকৃত হলাম।

যাইহোক বড় ফুফু চলে যাবার খবর মাকে জানানোর পরেও মা আসতে রাজি হলেন না। মাঝখান থেকে আমার আরো একটা দিন নষ্ট হল। বাবা অফিস কামাই করতে পারবেন না তাই পরদিন আমি আর নাজমা সকালবেলা মাকে আনতে গেলাম। আমি কয়েকবার অনিমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বেচারি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে বসে ছিল। আমি আসবো না সেটাও জানাতে পারিনি ওকে।
মাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল অনেকদিন পর নানা বাড়ি গেছি তাই না খাইয়ে আমাদের কেউ ছাড়লো না॥

পরদিন সকালে আমি আর কোন ঝুঁকি নিলাম না। সকাল সকালই ওর হলের কাছে গিয়ে বসে রইলাম। প্রথম দিনের মতো আজ ভাগ্য সহায় হলো না। নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কল দেবার পরও ওকে পেলাম না। আরো দু বার কল দেবার পর জানা গেল, ও রুমে নেই॥ আমি হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আজ আবহাওয়া খারাপ, ভ্যাপসা গরম। এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমি ওর ডিপার্টমেন্টে চলে গেলাম। সেখানেও ওকে পাওয়া গেল না। ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি লাইব্রেরীতে যদি পাওয়া যায়। আরো ঘন্টাখানেক চেষ্টা করেও ওকে না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হল কেউ আমাকে পেছন থেকে ডাকছে।
পেছন ফিরে দেখলাম ও দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাধে বিশাল ব্যাগ, মাথার চুল এলোমেলো। আমার কাছে এসে হাঁপাতে হাপাতে বলল
– আরেকটু হলে তোমাকে মিস করে ফেলতাম। সব ঠিক আছে তো ? ওর উৎকণ্ঠা দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম
– তোমার এই অবস্থা কেন?
– কালকে একটা পরীক্ষা আছে। এই দুইদিন কিছু পড়া হয়নি
– কেন?
ও এই প্রশ্নের কোন জবাব দিল না, মাথা নিচু করে ফেলল। আমি বললাম
– রিক্সা নেই? তোমার ব্যাগটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে
– আচ্ছা, তোমার তাড়া নেই তো?
– একেবারেই না
– তাহলে একটু হলে যাই? ব্যাটটা রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে নেই
হলের গেটে পৌঁছে আমি রিকশা ছেড়ে দিলাম। ও বলল
– একদম সময় নেব না
– সময় নাও, কেন সমস্যা নেই
আজ ও এলো একটু দেরি করে । পোশাক পাল্টে এসেছে, ভেজা চুলে চিকন আভা। বোঝা গেল, স্নান সেড়ে এসেছে। কাছে এসে বলল
– দুপুরে খাওয়া হয়নি তো তাই না
– না ভেবেছিলাম একসঙ্গে নাস্তা খাব, এখন মনে হচ্ছে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে
আমরা দুজনেরই হেসে ফেললাম। রিক্সা নিয়ে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। আহামরি কিছু না। সাধারণ মানের রেস্তোরা, দুজন দুটো সেট মেনু খেলাম সময় নিয়ে। সে সময় এই বয়সী ছেলেমেয়েদের সময় কাটানোর মতন জায়গা খুব একটা বেশি ছিল না ঢাকা শহরে। কিছুক্ষণ আমরা রিক্সা করে ঘুরলাম তারপর আবার টিএসসি চলে এলাম। গল্প হলো অনেক। সন্ধ্যে নামার আগে আমি বললাম
– আমি কাল ফিরে যাচ্ছি
ও বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল, বলল
– তার মানে আর দেখা হবে না
– দেখা হবে না কেন? আমি তো সেপ্টেম্বরেই আসছি
– তুমি সত্যি সেপ্টেম্বরে আসবে
– কেন তোমার বিশ্বাস হয়না
– তোমার পরীক্ষারা আর দুই মাস থাকবে, তাই জানতে চাইলাম
– পরীক্ষা যেন ভালো হয় সেজন্যই তো আসবো। বল কি চাও তুমি তোমার জন্মদিনের উপহার
– তুমি আসবে সেটাই তো বড় উপহার, আর কি চাইব
– আমি কিছু চাই, দেবে?
– বলো কি চাও
– সেদিন শাড়ি পড়ে এসো। তোমাকে শাড়িতে কেমন লাগে দেখতে ইচ্ছা করছে
শেষ বিকেলের আলোয় আমি দেখলাম লজ্জায় ওর গাল লাল হয়ে গেছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো একবার ছুঁয়ে দিতে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
– আসবে তো
– আসবো
সন্ধ্যে নামার পর আমরা হাটতে হাটতে ওর হলের দিকে চলে গেলাম। ও বলল একটু দাঁড়াও তোমাকে কিছু দেবার আছে। ও ফিরে এসে আমার হাতে একটা ব্যগ তুলে দিয়ে বলল
– এগুলো তোমার জন্য
আমি বাড়ি ফিরে ওর উপহার দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। একটা কারুকার্য করা কাঠের বাক্স, দুটো কলম আর একটা চিঠির প্যড। এর চেয়ে ভালো উপহার আর কিছু হতেই পারত না।

পরদিন ভোরে আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়েই চট্টগ্রাম ফিরে গেলাম। ফেরার পর প্রথমেই কাঠের বাক্সটার মধ্যে ওর সব চিঠিগুলো যত্ন করে গুছিয়ে রাখলাম। আমরা দুজন যখন একসঙ্গে থাকবো, যখন আর আমাদের চিঠি লেখার প্রয়োজন পড়বে না তখন এই বাক্সে আমাদের দুজনের চিঠি গুলোই রেখে দেব। মানুষ যেমন ছবির অ্যালবাম রাখে তাদের বিশেষ মুহূর্ত ধরে রেখে স্মৃতিচারণ করবে বলে, আমরা না হয় ছবির বদলে কথা ধরে রাখলাম। অনেক অনেক বছর পর পুরনো স্মৃতি গুলো আবার ঝালিয়ে নেবার জন্য।

চলবে…….

অনির পর্ব-০৫

0

পঞ্চম পর্ব

আমি ঢাকা পৌছালাম শুক্রবার সকালে। ছুটির দিন বলে সবাই বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে বাবা-মা দুজনেই ভীষণ খুশি হলেন। এভাবে কোন খবর না দিয়ে আমি আগে কখনো আসিনি। বাবার প্রথম কথাই হল এসেছি যখন বেশ কয়েকদিন থেকে যেতে। আমি কিছু বললাম না। সত্যি কথা বলতে আমি শুধু ওর সঙ্গে দেখা করতেই এসেছি। পড়াশুনা এবং রিসার্চ ওয়ার্কের প্রচুর চাপ, তাই বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে ফিরে যাব।

চিঠিতে ওর সঙ্গে সব ঠিক হয়ে আছে। শনিবার সকালে আমরা দেখা করব। প্রথমে ঠিক হয়েছিল আগের জায়গাতেই দেখা করব, পরে আমার মনে হল যে হল থেকে ওই পর্যন্ত আসতে ওর অনেকটা সময় নষ্ট হবে। আমি এতটুকু সময় ও নষ্ট করতে চাই না। এরপর আবার কবে দেখা হয় ঠিক নেই, তাই আমি বললাম সকাল সকাল ওর হলে চলে যাব; কল দিলে যেন নেমে আসে।

প্রথমবার ওর সঙ্গে এভাবে দেখা করছি, মনে হলো কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাই কিন্তু কি কিনব কিছুই বুঝতে পারছি না। এর আগে আমি কখনো কোন মেয়ের জন্য উপহার কিনিনি। নাজমার জন্য অবশ্য কিনেছি তবে সেটা ও আমার ঘাড় ধরে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দে কিনেছে। ওর সঙ্গে একবার এই নিয়ে কথা বলব কিনা ভাবছিলাম ঠিক তখনই ও চায়ের কাপ দিয়ে ঘরে এলো। অন্যান্য বারের মত ও এবার ঝগড়া করল না বরং লক্ষ্য করলাম এবার ওর গলার স্বর অন্যরকম। চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো।

নাজমা আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। ছোট বেলা থেকেই ও অনেক বুদ্ধিমতী তবে এতটা ধুরন্ধর সেটা সেদিনই টের পেলাম। কথা বলতে বলতে একটা সময় যখন আমার মনে হল ও অনেকটা স্বাভাবিক তখন আমি বললাম
– উপহার কেনার জন্য কোন দোকানটা সবচেয়ে ভালো হবে বলতো
– কোন অকেশনের জন্য?
– কোন বিশেষ অকেশন না, এমনি দেখা করতে যাব
– সেভিং জেল দিতে পারো
– ধুর! সেভিং জেল কেন দেব?
– তাহলে মানিব্যাগ
– আরে না, অন্য কিছু বল
– যাকে দেবে তার হাইট কেমন?
আমি একটু সাবধান হলাম। বললাম
এভারেজ
– আড়ং এ অনেক সুন্দর সুন্দর আয়না পাওয়া যায়। আমার মনে হয় দিলে খুশি হবে
– এটা ভালো বলেছিস, আড়ং থেকে একটা আয়না কিনি বরং
– ওকে কি দেখতে অনেক সুন্দর ভাইয়া?
– অনেক
– কি নাম?
– অনিমা
– আমার সঙ্গে কবে পরিচয় করিয়ে দেবে?
এ কথা বলে ও মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আমার নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করলো। আমি বললাম
– কি বললি তুই?
– এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই ভাইয়া। তুমি যখন গতবার ছটফট করে ফিরে গেলে তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কোথায় থাকে চট্টগ্রামে?
– না এখানে ঢাকায়
নাজমা আনন্দে হাততালি দিয়ে দিয়ে উঠল, বলল
– কাল দেখা করবে?
– হ্যাঁ কাল সকালে
– চলো তাহলে তোমাকে গিফট কিনতে হেল্প করি, আমারও কয়েকটা জিনিস কেনার আছে
আমি দীর্ঘশ্বাস কেললাম। এই তাহলে আসল ঘটনা।

আমি আড়ং এ এর আগে ও গেছি তবে এত ঘুরাঘুরি করিনি। ঈদের সময় মেইল সেকশন থেকে পাঞ্জাবি কিনেছি, আজ ঘুরতে গিয়ে ভালই লাগলো। আমি টুকটাক করে অনেক জিনিস কিনে ফেললাম ওর জন্য। ও খুব রুচিশীল এবং সৌখিন ধরনের মেয়ে। নাজমা অবশ্য এটা নাও ওটা নাও করে আমার কানের পোকা মেরে দিতে লাগলো। ঘ্যান ঘ্যান করে নিজের জন্য অনেক কিছু আদায় করল; শুধু কেনাকাটা নয়, কেনাকাটা শেষ হয়ে যাবার পর উপরে নিয়ে গিয়ে ওকে খাওয়াতেও হল। অবশ্য উপরের ফুড কোর্টে গিয়ে খুব ভালো লাগলো। জায়গাটা বেশ সুন্দর, ছিমছাম নিরিবিলি।আমি ঠিক করলাম ওকে নিয়ে এখানেই আসব। নাজমা এক প্লেট ফুচকা শেষ করে লাচ্ছির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো
– ভাইয়া ওকে নিয়ে কিন্তু এখানে এসো। খাওয়া শেষ করে তারপর একেবারে সংসদ ভবনে চলে যাবে।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম
– তুই এত সব খবর কি করে জানিস?
নাজমা গাল ফুলিয়ে বলল
– যা বাবা! যার জন্য করি সেই আমাকে কথা শোনাচ্ছে। এই যে এতগুলো সময় দিলাম তোমাকে, গিফট খুঁজতে হেল্প করলাম আর তুমি এখন আমাকে এগুলো বলছো? এজন্যই কারো জন্য কিছু করতে হয় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হল আমার।

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এত টাকার শপিং করে দিলাম, এখন গপ গপ করে ফুচকা গিলছে তারপরও এত তেজ
আমারে অবস্থা দেখে নাজমা ফিক করে হেসে ফেলল, তারপর বলল
– ওর একটা ছবি দেখাও না ভাইয়া

ঠিক তখনই আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম আমার কাছে ওর কোন ছবি নেই এবং আমি ওকে সেই প্রথমবার ছাড়া আর কখনোই দেখিনি। ওকে আরেকবার দেখার একটা অদম্য ইচ্ছা আমার মধ্যে সারাদিন বিচরণ করলেও ছবি চাইবার ব্যাপারটা কখনো মাথায় আসেনি। এখন মাঝে মাঝে ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে, ভালোবাসা ব্যাপারটা কত হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, এখন প্রিয়জনকে চাইলেই দেখা যায়, ফোন করে কথা বলা যায়। ম্যসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস এপ, আরো কত কি আছে। তখন এতসব ছিল না। আমি জানি না এখন এসব ভালবাসার গভীরতা আরো বাড়িয়েছে কিনা তবে এই যোগাযোগের দূরত্ব আমাদের ভালবাসাকে কমাতে পারেনি এতটুকুও।

কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি উত্তেজনায় সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম এসেছিল ফজরের আগেই ঘুম ভেঙে গেল। অনেকদিন পর বাড়ির কাছের মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম।

আমি ওর হলের কাছে পৌঁছালাম সকাল সাতটারও একটু পরে। এত সকালে কল দেয়া বোধহয় ঠিক হবে না এইভাবে একটু অপেক্ষা করলাম। এর সকালে যায়গাটা বেশ ফাকা, একটা দুইটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে গেট থেকে বের হতে; সম্ভবত এরা আটটার ক্লাস ধরতে যাচ্ছে। আমি হলের পাশে্র কালভার্টটার উপরে বসে রইলাম। আমার মাথার উপর একটা হলুদ কৃষ্ণচূড়া গাছ। সকাল বলে গরম কম।এপ্রিলের শেষ তাই চারিদিকে ঝেপে কৃষ্ণচূড়া আর জারুল ফুটেছে। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। রিকশার সংখ্যা খুবই কম। মাঝে মাঝে লাল রঙের বাসগুলোকে আসতে দেখা যাচ্ছে।

রোদের তীব্রতা এখনো বাড়নি। চারিদিকে এখনো মিষ্টি রোদ। আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। আটটার একটু বেশি বাজে। না, এখনো কল দেবার মতন সময় হয়নি। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। উল্টোদিকে ভাষা ইনস্টিটিউটের বিল্ডিং। অপেক্ষা করতে করতে যখন মনে হল যে এবার উঠে কল দেয়া যায় তখনি লক্ষ্য করলাম কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মুখ তুলে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ওর মুখ ভর্তি হাসি। আগের দিন ওকে দেখেছি বাসন্তী ফুলের মতন আজ পরেছে সাদা আর কমলার মিশেলে সুতির জামা। ওকে দেখতে ভোরের শিউলি ফুলের মতন লাগছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ও আর একটু কাছে এসে বলল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছো?
না ঘন্টাখানেক
ইস! আগে জানলে আরো আগে নেমে আসতাম।
আমি কিছু বললাম না, ওর হাতে উপহারের ব্যগটা তুলে দিয়ে বললাম
এটা তোমার জন্য।
ওর মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো, ও ব্যাগ খুলে দেখলো না। বলল
এটা ভেতরে রেখে আসি, তাহলে আর সারাদিন বয়ে বেড়াতে হবে না।
আচ্ছা
অনিমা ফিরে এলো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। এসেই বলল
খেয়েছো কিছু সকালে
না, চলো একসঙ্গে খাই

আমরা হাঁটতে হাঁটতে কার্জন হলে চলে গেলাম, ওখানেই নাস্তা করলাম , চা খেলাম। এখনকার মতন তখন এত বড় বড় রেস্টুরেন্ট ছিল না, থাকলেও সেগুলো আমাদের মতন স্টুডেন্টদের জন্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল, তাছাড়া তখন আমাদের হাতে হাতে টাকাও থাকতো না॥ অনিমা আমাকে ওর ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরী ঘুরিয়ে দেখালো। আমি কার্জন হল, সাইন্স লাইব্রেরী সবই ঘুরে দেখলাম। একটা সময় এখানে ভর্তি হতে পারিনি বলে আমার খুব আফসোস ছিল, এখন আর নেই। এখন আমি আমার নিজের ক্যম্পাস অসম্ভব ভালোবাসি।

আমরা সারাদিন রিকশা করে ঘুরলাম। ও যে এত কথা বলতে পারে আগে আমার কোন ধারণাই ছিল না। চিঠি পড়ে আমার মনে হতো ও খুব চুপচাপ শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সারাদিন কত গল্প যে করল।একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় আমার মন ছেয়ে যাচ্ছিল। রিক্সায় বসেই আমি ওকে বললাম
আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি
ও সঙ্গেসঙ্গে হাত এগিয়ে দিল। কি দ্বিধাহীন নিঃসঙ্কোচ সেই ভঙ্গি। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। বললাম
কাল আবার দেখা করাবে?
করব
অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে রিক্সায় বসে রইলাম
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। যখন ওকে হলে নামিয়ে দেবার জন্য ফেরার পথ ধরলাম তখন ও খুব আস্তে করে আমাকে ডাকলো
মুনির
হুম
আবার কবে আসবে?
তুমি বলো কবে আসব
ও মাথা নিচু করে খুব আস্তে আস্তে বলল
শীতের ছুটিতে আসবে?
মুখে কিছু না বললেও ওর কন্ঠস্বরে ঝরে পড়া অভিমান আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। বললাম
না, শীতের ছুটির আগেই আসবো
ও মুখ তুলে তাকালো, তারপর বলল
কবে
সেপ্টেম্বারে, তোমার জন্মদিনের সময়
মুহূর্তেও মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল ও চোখ বড় বড় করে বলল
সত্যি!
ওর বলার ধরণ দেখে আমি হেসে ফেললাম
একটা স্বপ্নের মতন দিন কাটিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম। ওর জন্মদিনের দিন যখন আসব তখন এর চেয়েও আরো চমৎকার একটা দিন কাটাবো ভেবেছিলাম কিন্তু সেই দিনটাকে যে এত ভয়ানক হবে সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি।

চলবে……

অনির পর্ব-০৪

0

চতুর্থ পর্ব

নাসিম হল ছেড়ে দিয়েছে। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস নিয়ে গেছে শুধু কতগুলো চিঠির খাম আমার টেবিলের উপর ফেলে গেছে।এর কারণ আমি সেদিন বুঝতে পারিনি তবে চিঠিগুলো পেয়ে মনে হয়েছিল অমূল্য কিছু পেয়েছি॥ আমি চিঠিগুলো যত্ন করে একটা বাক্সে তুলে রাখলাম। আমি অনিমার রুম নাম্বার জানিনা কোন বিল্ডিংয়ে থাকে সেটাও জানি না শুধু জানিও বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে, এমনকি কোন ইয়ারে পড়ে সেটাও জানিনা। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন উপায় আমার ছিল না। খামের উপর প্রেরকের ঠিকানা দেখে খুব নিশ্চিন্ত লাগছিল যদিও জানি ওকে চিঠি লেখার কোন অধিকার আমার নেই।

ওকে আবারো চিঠি লিখতে শুরু করার একটা উপায় করে দেবার জন্যই বোধ হয় পরদিন সোহানা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সোহানা নাসিমের প্রাক্তন প্রেমিকা। বছর খানের আগে যখন নাসিম আমাকে অনুরোধ করেছিল অনিমা কে চিঠি লিখে দেবার জন্য আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সোহানা এসব জানে কিনা তৎক্ষণাৎ ও কোন উত্তর দিতে পারিনি তার দু চারদিন পরে আমার কাছে জানিয়েছিল যে ওদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। ব্রেকআপের পর একটা মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল বলে আমি চিঠি লেখার ব্যাপারটাকে ওকে সাহায্য করেছিলাম।অতীত ভুলতে যদি একটা সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে জড়ায় তাহলে ক্ষতি কি। আশ্চর্যজনকভাবে সোহানার কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে ওদের আদৌ ব্রেকআপ হয়নি। তবে আরও আশ্চর্য হলাম যখন ওর এখানে আসার কারণটা জানতে পারলাম। ও বলল
আমি আসলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি
আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ তোমার সঙ্গে। তোমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছি
অভিনন্দন? কি বিষয়ে বলো তো
শুধু অভিনন্দন বললে ভুল হবে। তোমাকে ধন্যবাদ জানাতেও এসেছি। আমি নাসিমকে ভুল বুঝেছিলাম। আমাকে একজন বলেছিল নাসিম কোন এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে তার সঙ্গে নাকি চিঠি লেখালেখি চলছে।
কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম। ও আবারো শুরু করল বলল
শুনেছিলাম নাসিমের সঙ্গে নিউ ইয়ারের দিন ওই মেয়ের দেখা হবে। ভেবেছিলাম ওকে হাতেনাতে ধরে একটা উচিত শিক্ষা দেব। ওখানে গিয়ে ওকে পেয়েছিলাম তারপর নিজের ভুলটা বুঝতে পারি
কি ভুল
নাসিমি আমাকে দেখালো মেয়েটা আসলে তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দারুন মানিয়েছে কিন্তু তোমাদের দুজনকে

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না একবার শুধু অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলাম
নাসিম কেমন আছে
ভালো আমাকে বলল
এখানে আর ভালো লাগছে না তাই বাড়ি চলে গেছে

সেদিন রাতে আমি প্রথমবারের মতো নিজে থেকে অনিমাকে চিঠি লিখলাম আমি লিখলাম
অনিমা অনিমা
তুমি কি আমার উপর অনেক রেগে আছো? তোমার রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি কিন্তু তোমাকে একটাও মিথ্যা কথা বলিনি। আমি সত্যিই নাসিম না। তবে তোমাকে চিঠি গুলি আমি পাঠাতাম।যদি তুমি সত্যিই আমার উপর রাগ না করে থাকো তাহলে এই চিঠিটা জবাব দিও।

অনিমার চিঠির জবাব এলো তিন দিনের মাথায়। ক্লাস ফাইভ ট্যলেন্টপুলে এ বৃত্তি পাওয়ার পর যেরকম আনন্দ হয়েছিল সেই রকম একটা শিশুসুলভ আনন্দ আমার মন ছেয়ে গেল। অনিমা একটা লম্বা চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে রাগ অনুরাগের কোন কথা নেই। অনেক কথা লিখেছেতার মধ্যে আমার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা মনে হয়েছে সেটা হলো ও লিখেছে “সেদিন তোমার সঙ্গে আমার কোন কথাই হয়নি। আমি শুধু তোমার আঙুলে আঙ্গুল জড়িয়ে রিকশায় বসে ছিলাম; তবে কি জানো, মানুষের মুখের ভাষার মতন প্রতিটা অঙ্গেরও বোধহয় নিজস্ব একটা ভাষা থাকে। সেদিন তোমার সঙ্গে আমার আঙুলে আঙ্গুল জড়িয়ে অনেক কথা হয়ে গেছে। সব কথা বোধহয় মুখ ফুটে বলা যায় না। বলার প্রয়োজনও পড়ে না

আবার শুরু হলো আমাদের পত্র বিনিময়, যদিও ওকে একবার সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা আমি কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। বারবার ইচ্ছা করছিল আবার ওর কাছে যাই একবার একটু ছুঁয়ে দেখি ওকে কিন্তু উপায় ছিল না। নতুন বছরে পড়াশোনার চাপ বেড়েছিল প্রচুর। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালের রেজাল্ট ভালো হওয়াতে চেয়ারম্যান স্যার আমাকে সিনিয়র একজনের সঙ্গে রিসার্চ এর যুক্ত করে দিয়েছিলেন। এই কাজ শেষে যে পাবলিকেশন হবে সেখানে আমার নাম ও যাবে। চেয়ারম্যান স্যারের আমাকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে।

আমি উদয়ন্ত পরিশ্রম করা শুরু করলাম। সকালে ক্লাস, দুপুরে ল্যব ওয়ার্ক আর রিসার্চ এর জন্য কাজ বিকেলে সেমিনারে বসে রেফারেন্স কালেকশন করতে হতো, আবার রাতে ক্লাসের জন্য পড়তে হতো। তখন এখনকার মতন ওয়াইফাই কানেকশন ছিল না, সেমিনার রুমে দুটো কম্পিউটারে ইন্টারনেট কানেকশন ছিল সেখানে রেফারেন্স কালেকশনের কাজ করতে হতো।
এতো ব্যস্ততার মধ্যে যদি কোন কিছু আমাকে প্রশান্তি দিত তবে সে ছিল আনিমার চিঠি গুলো। ওর এক একটা চিঠি আমি হাজার হাজার বার করে পড়তাম। সামনাসামনি কথা বলার ইচ্ছা যে কি করে দমন করেছি সে একমাত্র আমি জানি।
সময় গড়িয়ে গেল আমাদের সম্পর্কের গভীরতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। আমরা ঠিক করলাম সামনের ছুটিতে আমি ঢাকায় এলে তখন দেখা করব।
এরমধ্যে আমার ক্যাম্পাস একদিন নাসিমের সঙ্গে দেখা হলো। আমি ওকে দূর থেকে দেখে একটু হাসলাম। ও জবাবে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে না চেনার ভান করল। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ও আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ওর আর সোহানার সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য সম্ভবত এটাই উত্তম পন্থা। আমি আর কোন ঝামেলায় গেলাম না। ও যদি আমাকে এড়িয়ে গিয়ে ভালো থাকতে পারে তাহলে থাকুক।

দেখতে দেখতে শীত বসন্ত গড়িয়ে গ্রীষ্ম এসে গেল। জুন মাস থেকে আমার মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হবে এরপর আর হয়তো যাওয়া হবে না। একবার ওকে দেখার জন্য আমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম তাই এপ্রিলের শেষ নাগাদ আমি ট্রেনের টিকেট বুক করে ফেললাম। সেভাবে দেখতে গেলে এটাই আমাদের প্রথম দেখা। এর আগে যখন দেখা হয়েছিল আমরা একে অপরের কাছে অচেনা ছিলাম। ঠিক হলো যেদিন আমি পৌঁছাব তার পরের দিন সকালবেলা ওর সঙ্গে দেখা করব। সারাদিন একসঙ্গে ঘুরব। আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে ও সবকিছু প্ল্যান করে রেখেছে। আমি ছোটবেলা থেকে ঢাকাতেই বড় হয়েছি বরং ঢাকা ওর কাছেই নতুন। ও বেড়ে উঠেছে সিলেটে।তবু আমি কিছু বলছি না ওর উত্তেজনা ভালো লাগছে।
এর আগে এবং পরে ও আমি অনেকবার ঢাকায় গেছি। তবে এবারের ঢাকা ভ্রমণটা আমার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

চলবে………

অনির পর্ব-০৩

0

তৃতীয় পর্ব

আমার সময় জ্ঞান সবসময়ই বেশ প্রখর। চারটা বাজার দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম। তখনো দুজনের কেউই এসে পৌঁছায়নি। লেকের পাশের এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। একটা বাঁধানো চত্বর, আশেপাশে কিছু ছোটখাট দোকান। আমার ডানদিকে একজন বসেছে ফুল নিয়ে অন্যদিকে একজন বিশাল আকৃতির ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করছে। এখনকার মতন এত রেস্টুরেন্ট তখন ছিল না। ঝকঝকে বিকেল হলেও রাতের নানান ঘটনার কারণেই বোধহয় পার্কে খুব বেশি কপোত কপোতি দেখা গেল না।
আমার সময় কাটছিল না, বারবার ঘড়ি দেখছিলাম। প্রথমবার দেখা করতে এসেছি বলে আমি ওর জন্য একটা বই নিয়ে এসেছিলাম, সেটাই খুলে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। খুব আহামরি কোন বই না হুমায়ূন আহমেদের “তোমাকে”, আমার ভীষণ প্রিয় একটা বই। পড়তে পড়তেই টের পেলাম কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব মৃদু একটা সুগন্ধ ভেসে এলো, অনেকটা বুনো ফুলের মতন। আমি মুখ তুলে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এত মায়াবী, সারল্যে ভরা মুখ আমি আগে কোনদিন দেখিনি। মেয়েটা খুব সাধারণ পোশাক পরে এসেছে, সাদার উপর হলুদ ফুল তোলা জামা, শীত বলেই বোধহয় একটা বাসন্তী রঙের শাল জড়িয়েছে। ওকে দেখে আমার মনে হল একগুচ্ছ সোনালু ফুল। আমাকে অবাক করে দিয়েও ও হাসিমুখে বলল
– নাসিম ?
আমি বিব্রত মুখে বললাম
– আমি নাসিম নই, নাসিম এক্ষুনি চলে আসবে
– তাহলে তুমি কে?
আমি নাসিমের বন্ধু। আমার নাম মুনির। তুমি নিশ্চয়ই অনিমা। তোমার কথা অনেক শুনেছি নাসিমের কাছে
মেয়েটা কেমন অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। ৪ টা ২০ বাজে। নাসিমটা যে কেন এখনো আসছে না। বললাম
– তুমি বসো। চা খাবে?
আমি পাশের চা ওয়ালাকে ডেকে বললাম
– ভাই বেশি করে লেবু দিয়ে একটা রং চা দেন তো
অনিমা কাপ হাতে নিয়ে বসতে যাবে তখন আমি বললাম
– অনিমা একটু দাড়াও, এখানে বাদামের খোসা পড়ে আছে, তোমার না বাদামে এলার্জি। আমি হাত দিয়ে ঝেড়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলাম। ও বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল
– এই খেলাটা তুমি আর কতক্ষণ খেলবে?
আমি অবাক হয়ে বললাম
– কিসের খেলা?
– তুমি নাসিম না এটা প্রমান করার খেলা
আমার নিজের উপরই বিরক্ত লাগছে। কেন যে এসব বলতে গেলাম। এলার্জির ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস বলেই বলেছিলাম, তা না হলে কোনদিনও বলতাম না। আমি পরাজিত ভঙ্গিতে বললাম
– অনিমা, আমি সত্যিই নাসিম না। আমি আর নাসিম একই রুমে থাকি। ও তোমার ব্যাপারে অনেক গল্প করে সেই থেকেই তোমার ব্যাপারে আমার একটু ধারণা জন্মেছে
– ধারণা?
একথা বলে ও আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আর কিছু বলবো না বলে ঠিক করলাম। যত কথা বলছি ততই জড়িয়ে যাচ্ছি। নাসিমের বাচ্চাটা যে কেন এখনো আসছে না।
অনিমা কিছু বলল না, চুপচাপ চা খেতে লাগল।
একবার ভাবলাম বইটা ওকে দেই, পরমুহূর্তেই মনে হলো, না থাক, এই বইটা নিয়ে চিঠিতে একবার ওর সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছিল, আবার কি থেকে কি বুঝে ফেলে।

বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। আমি বারবার ঘড়ি দেখছি। সাড়ে চারটার বেশি বেজে গেছে এখনো নাসিমের আসার কোন নাম নেই। অনেকক্ষণ পর অনিমা হঠাৎ করে বলল
– আকাশে কি সুন্দর মেঘ দেখেছো
আমি আনমনা হয়ে বললাম হু
– তুমি একবার আমাকে ক্লাউড হান্টিং এর কথা লিখেছিলে মনে আছে? আচ্ছা তুমি কি এখনও ওই পুকুরটার মধ্যে আমাকে দেখতে পাও?
আমি জবাব দিলাম না। অনিমা মন খারাপ করা গলায় বলল
– ঐ পুকুরে আমাকে যেমন দেখতে, আমি কি তেমন না? তার থেকে খারাপ?
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম, ও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম
– অনিমা, আমি নাসিম না
মুহূর্তে ওর চোখ ছল ছল করে উঠলো। ও ভেজা কন্ঠে বলল
– আমাকে কি তোমার এত খারাপ লেগেছে যে তুমি নাসিম এটা স্বীকার করতেও তোমার ইচ্ছা করছে না। আমি তো তোমার কাছে কিছু চাইনি কিন্তু এই মিথ্যা নাটকের তো কোন দরকার নেই। অনিমা উঠে দাঁড়ালো
আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কারণে ওদের প্ল্যানটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার ঘড়ি দেখলাম, পাঁচটা বেজে গেছে। নাসিম এখনো আসছে না। কি যে করি। আমি ওর হাত ধরে বললাম
– আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কাঁদতে হবে না, বসো। উই ক্যন টক আবাউট ইট
অনিমা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল
– তোমার হাতে ওটা কি?
– বই। তোমার জন্য এনেছিলাম। এই বলে আমি বইটা এগিয়ে দিলাম। বইটা হাতে নিয়ে ও উল্টেপাল্টে দেখল। বলল
– তুমি এখনো বলবে তুমি নাসিম না?
আমি অসহায় কন্ঠে বললাম
– আমি আসলেই নাসিম না অনিমা
– আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে এখানে এটা লিখে দাও।
ও বইটা খুলে উৎসর্গের পাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল, সেই সঙ্গে একটা কলমও দিল
আমি লিখলাম “অনিমা অনিমা, আমি সত্যি বলছি আমি নাসিম নই”। বইটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, এবার নিশ্চয়ই ও বিশ্বাস করবে। ও অনেকক্ষণ লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর মুখের মেঘ কেটে গেছে। পুরো মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে। তখন বিকেলের আলোর মরে আসতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলের কমলা রঙয়ের রোদ ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। সেই কনে দেখা আলোয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি দিশেহারা বোধ করলাম।
ও আমার চোখে চোখ রেখে বলল
এখনো স্বীকার করবে না? এই এক বছর ধরে আমি তোমার হাতে লেখা দেখছি, আর আমি চিনতে পারব না।
আমার মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তার মানে ওই বদমাইশের বাচ্চা নাসিম আমার চিঠিগুলো কপি করেনি, যেমন ছিল তেমনি পাঠিয়ে দিয়েছে। আর আমার কোন পথ নেই। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

আমি চলে যাবার জন্য উদ্যত হতেই ও উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল
– চলো।
আমি মোহগ্রস্থের মতন ওর সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। ও আমার হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে পার্কের ছায়া ঘেরা পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। যতবারই ওকে বলার চেষ্টা করেছি যে আমি অন্য কেউ ও কিছুতেই বিশ্বাস করেনি এবং এখন ওকে বিশ্বাস করানোর আর কোনো উপায়ও আমার নেই।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারিদিক সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। বড় রাস্তায় উঠে ও বলল
– চলো রিকশা নেই।
আমি যন্ত্রচালিতের মতন রিকশায় উঠলাম। রিক্সাওয়ালা কোথায় যাব জানতে চাইলে ও বলল
– কোথাও যাবো না, এমনিই চলেন।
রিকশা ধানমন্ডির অলিগলি দিয়ে ঘুরতে লাগলো। তখনকার ধানমন্ডি এখনকার মতন ছিল না, বেশ নিরিবিরি ছায়া ঘেরা একটা পরিবেশ ছিল।সন্ধ্যা নেমেছে বলে রাস্তায় রিক্সার সংখ্যা কম। হঠাৎই একটা স্পিড ব্রেকারে ধাক্কা লাগায় ও আমার হাত আঁকড়ে ধরল। আমি রিক্সাওয়ালাকে বললাম আস্তে চালাতে। রিক্সাওয়ালা গতি স্লথ করলো। অনিমা হাত সরিয়ে নিল না। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে বসে রইল।
আমরা কেউই কোন কথা বলছিলাম না। আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা সময় ও নীরবতা ভেঙে পড়ল
– আমাকে হলে নামিয়ে দিয়ে তুমি চলে যাও।
আমি রোকেয়া হলে সামনে এসে রিক্সা ছেড়ে দিলাম। জায়গাটা অন্ধকার। ওর মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, যাবার আগে ও শুধু খুব আস্তে করে একবার বললো “আসি”। একবার পেছন ফিরেও তাকালো না। ও চলে যাবার পর আমার মনে হল পুরো শহরটা যেন অক্সিজেন শূন্য হয়ে গেছে; নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ, অমুল্য কিছু হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। আমি উদ্ভ্রান্তের মতন হাটতে আরম্ভ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে এলাম। চারিদিকে অনেক আলো ঝলমলে করছে, তবু আমার মনের অন্ধকার দূর হচ্ছে না। আমি বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।

ঢাকায় আমার আর মন টিকছিল না তাই পর দিন সকালের ট্রেনেই চট্টগ্রাম ফিরে গেলাম।

রুমে ঢুকে রীতিমত ধাক্কা খেলাম।

চলবে………।

অনির পর্ব-০২

0

দ্বিতীয় পর্ব

আমি তীব্র অপরাধবোধে দগ্ধ হতে লাগলাম। ওকে আর চিঠি পাঠাবো না বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। নাসিমকে সত্যিকারভাবে জেনে, ও যদি সম্পর্কে জড়াতে চায় তাহলে আমার তো কোন অসুবিধা নেই। আমি ওদের দুজনের মাঝখানে আসতে চাই না; যদিও ওকে একবার দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমি কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। এই চিন্তাটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে নাসিমকে যখন চিঠি না লেখার কথাটা জানালাম তখন ওর চোয়াল ঝুলে পড়ল। ও কাতর গলায় বলল
– দোস্ত, এইভাবে গাছে ওঠাইয়া মই টাইনা নেওয়াটা কি ঠিক।? আর কয়টা মাসের মামলা একটু কোঅপারেট কর
– আর কয় মাস পর কি হবে?
– আমি ওর লগে দেখা করতে যামু। তখন সব বইলা দিমু। তর লগেও আলাপ করায়া দিমু। দেখবি তখন কত হাসবো আমরা সবাই। এইতো আর কয়টা দিন দোস্ত, একটু ওয়েট কর।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সেই অজানা পথে হাঁটার জন্য পা বাড়ালাম, যার কোন গন্তব্য নেই।
আবার শুরু হলো আমাদের পত্র বিনিময়। আমি ধীরে ধীরে লক্ষ্য করছিলাম মেয়েটা নাসিমের মানে আমার প্রতি কেমন যেন মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। ছোট ছোট সমস্যার কথা চিঠিতে লিখত, কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সেটাও জানাত। এরমধ্যে একদিন চিঠির একটা কথা আমাকে খুব নাড়া দিয়ে গেল। ও লিখেছে “আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন তোমাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে, খুব জা্নাতে ইচ্ছা করে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে কিন্তু আমি ফোন করি না। ফোনে তোমাকে কেমন অচেনা লাগে”।

তখন প্রকৃতি হেমন্ত শেষে শীতের আগমনী বার্তা জানান দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন, তার থেকেও বেশি কুয়াশায় ছেয়ে আছে আমার মন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আর এসবের মধ্যে থাকবো না। ফোনে নাসিমের সঙ্গে ওর সম্পর্কের গভীরতা কতখানি আমি জানিনা, নাসিম ওকে কতটা বুঝিয়ে বলতে পারবে সেটাও জানি না, তবে একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছিলাম ও যতটা না জড়িয়ে যাচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি জড়িয়ে যাচ্ছি আমি নিজে। আমার জীবনে অন্য কেউ নেই। যদি থাকত তাহলে হয়তো বিষয়টা অন্যরকম হতো।
আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলে এসেছে। এই অজুহাতে এসব থেকে বেরিয়ে আসবো বলে ঠিক করলাম। আমি ভেবেছিলাম নাসিম এটা জানালে হয়তো ঝামেলা করবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বলল
– সমস্যা নাই আর কয়দিনের তো ব্যাপার।
আমি জোর করে অনিমাকে আমার মাথা থেকে সরিয়ে পরীক্ষায় মন দিলাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ঢাকার ট্রেনের টিকেট কাটলাম; কেন যেন এখানে আর ভালো লাগছিল না। মনে হল একবার বাবা মার সঙ্গে দেখা করে আসি।

ঢাকার উদ্দেশ্যে যেদিন রওনা দেব সেদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম নাসিমও তৈরি হয়ে আমার সঙ্গে যাচ্ছে। আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– তুই কোথায় যাচ্ছিস?
– ঢাকায়
– ঢাকায়। কেন? তোর বাড়ি তো এখানে
– যাই, একটু ডার্লিং এর সঙ্গে সময় কাটাইয়া আসি
– ঢাকায় কোথায় উঠবি? তোর না কেউ নেই ওখানে
– হোটেলে উঠুম। ডার্লিংরেও ডাইকা লমু
আমি কিছু বললাম না ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। নাসিম হাসতে হাসতে বলল
– আরে ফাইজলামি করতাছি দোস্ত। ফাইনাল কিছু তো আর করতে দিব না, এই হালকার উপর ঝাপসা যা পারি আরকি

আমি আর কিছু বললাম না। সত্যি কথা বলতে কি, আমার খুব খারাপ লাগছিল। কেন এত খারাপ লাগছিল নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকা যাচ্ছি প্রায় বছরখানেক পর, এর মধ্যে দুবার বাবা-মা এসে দেখা করে গেছে। বাড়িতে এসে ভীষণ ভালো লাগছিল। আমার পুরনো ঘর, বইয়ের আলমারি, পড়ার টেবিল বারান্দায় রাখা আমার ছোট ছোট গাছগুলো এখনো সেরকমই আছে। আমার ছোট বোন নাজমা এই গাছগুলোর ভীষণ যত্ন নেয়।

আসার পরপরই ওর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঝগড়া হলো। আগে প্রতিদিন ওর সঙ্গে ঝগড়া না করলে আমাদের রাতে ঘুম হতো না। ভেবেছিলাম এতদিন পর দেখা হচ্ছে হয়তো জড়িয়ে ধরে কাঁদবে কিন্তু তা না, আসতে না আসতেই ঝগড়া শুরু করে দিল।
সবাইকে পেয়ে আমার নিভে যাওয়া মনটা ভালো হয়ে গেল। জোর করে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে ওদের দুজনের দেখা হবে, নিশ্চই ওরাও ভালো থাকবে।

ডিসেম্বর মাস শেষ হয়ে এসেছে। নিউ ইয়ার চলে এসেছে। সনটা ১৯৯৯। পুরো একটা মেলিনিয়াম পার হয়ে যাচ্ছে, তাই নিউ ইয়ার নিয়ে সবার উত্তেজনা অন্যরকম এই বছর। আমি বরাবরই একটু লাজুক অন্তরমুখী মানুষ। এসব হৈ হুল্লোড় আমার ভালো লাগেনা, তাই নিউ ইয়ার নিয়ে আমার মধ্যে কোন,বাড়তি উত্তেজনা নেই। এদিকে নাজমা লাফিয়ে আছে থার্টিফার্স্ট নাইটে বাইরে যাবে বলে, বাবার কাছ থেকে অনুমতি পায়নি বলে আমাকে এসে ধরেছে। আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম এই বিষয়ে আমি কিছু করতে পারবো না। এক তারিখে কোন বন্ধুর বাসায় যেতে চাইলে তার জন্য সাহায্য করতে পারি কিন্তু থার্টি ফার্স্টে বাইরে থাকার ব্যাপারে আমি কোন সাহায্য করতে পারব না। নাজমা মন খারাপ করে চলে গেল। আমার একটু খারাপই লেগেছিল তখন কিন্তু এক তারিখ সকাল বেলা উঠে মনে হল ওকে বাইরে যেতে না দিয়ে বেশ ভালো হয়েছে।

ঢাকার টিএসসিতে থার্টিফার্স্ট নাইটে ভাল রকমের ঝামেলা হয়েছে। বাধন নামের এক মেয়েকে নিয়ে নানান কেলেঙ্কারি কথা পত্রিকায় উঠে এসেছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে নানান রকমের ঘটনা ঘটেছে বলেও পত্রপত্রিকায় এসেছে। এক তারিখ সকালে নাজমা আবার এসে আমাকে ধরল। বিকেলবেলা ওর এক বান্ধবীর বাসায় গেট টুগেদার আছে সেখানে পৌছে দিতে হবে।

কিন্তু দুপুরের পর ঘটলো অন্য ঘটনা। ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম সেই সময় নাসিমের ফোন এলো। জানাল আজ বিকেলে ওরা ধানমন্ডি লেকে দেখা করবে। আমি একটু নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। যাক, তার মানে হোটেলে দেখা করার ব্যাপারটা রসিকতা ছিল কিংবা অনিমা রাজি হয়নি।

আমি এসবের মধ্যে আর জড়াতে চাইছিলাম না। এখন তো ওদের মধ্যে সব ঠিকই হয়ে যাবে। সামনাসামনি একজন মানুষের আবেদনই অন্যরকম, এই কটা চিঠি লিখে আর কি এমন সম্পর্ক তৈরি হয়। তাছাড়া নাসিম দেখতে অসম্ভব সুদর্শন ওকে একবার দেখার পর যে কোন মেয়ে ওর প্রেমে পড়তে বাধ্য। কিন্তু নাসিম কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইল না, বলল আমাকে ওর সঙ্গে যেতে হবে। আজই পুরো ব্যাপারটা এসপার ওসপার করে ফেলতে চায় ও। চিঠি লিখতে আমি ওকে একটু সাহায্য করেছি এই ব্যাপারটা বলা পর্যন্তই আমার পার্ট, তারপর আমার যবনিকা পাত। আমারও মনে হল এটাই তো হওয়া উচিত। একটা সম্পর্ক শুরু হলে তার মধ্যে স্বচ্ছতা থাকাটা জরুরি,তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম।

এত বছর পর আসলে আর লুকানোর কিছু নেই, সত্যি কথাটা আপনাদের বলি। ওকে একবার দেখার একটা প্রবল ইচ্ছা আমার মধ্যে ছিল। আমার কল্পনায় ওর একটা রূপ ছিল। আমি মিলিয়ে দেখতে চাইছিলাম আমার কল্পনার সঙ্গে সেটা কতটুকু মেলে। তাই যথাসময়ে আমি নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেলাম।

চলবে………

অনির পর্ব-০১

0

অনির
পর্ব-০১

আমাদের যখন বিয়ে হল তখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র, অবশ্য থার্ড ইয়ার করলে ভুল হবে, কেবল থার্ড ইয়ার থেকে ফাইনাল ইয়ারে উঠেছি। বাবা-মা কেউ আমার বিয়েতে খুশি ছিল না। তাদের খুব স্বপ্ন ছিল আমি অনার্স পাশ করে মাস্টার্স করব, তারপর থিসিস শেষ করে পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাব, সেই সময় তারা দেখে শুনে তাদের পছন্দমত একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন।
ছোটবেলা থেকেই আমি কখনো বাবা-মায়ের অবাধ্য হইনি, কখনো কোনো কিছুতে নিজের মতামত জাহির করিনি। হঠাৎ করেই বিয়ের বেলায় ছাত্র অবস্থানেই তাদের কাছে এসে হুট করে বললাম যে আমি একজনকে বিয়ে করতে চাই, ব্যাপারটা তাদের কাছে রীতিমতো শকিং ছিল। আমি নিজেও কি কোনদিন ভেবেছিলাম যে আমার সঙ্গে এরকম হবে; কিন্তু ওকে দেখার পর সব ওলটপালট হয়ে গেল, অবশ্য দেখার পর বলছি কেন, আমি তো না দেখেই ওর প্রেমে পড়েছিলাম। দেখে প্রেমে পড়েছিল আমার বন্ধু নাসিম। ভিন্ন শহরে থাকার কারণে ওদের প্রেমটা তেমন জমেনি। পরিচিত একজনের বাসায় দেখে ওকে ভালো লেগেছিল নাসিমের তারপর ও ফিরে গেছে ঢাকায় আমি আর নাসিম রয়ে গেছি চট্টগ্রামে। একই হলে একই রুমে থাকতাম।

সময়টা নব্বইয়ের দশক, এখনকার মতন তখন হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকত না। তাই কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। চিঠি লেখাটাই ছিল একমাত্র ভরসা কিন্তু চিঠি লিখতে গেলেই ওর কলম ভেঙ্গে যেত। সে সময়েই চিঠি লেখার জন্য নাসিম আমার শরণাপন্ন হয়েছিল। আমি ওর হয়ে চিঠি লিখে দিতাম নাসিম সেটা কপি করে পাঠাত, আর সেই চিঠি লিখতে লিখতেই কবে যে আমি ওর মধ্যে ডুবে গেলাম নিজেও বুঝতে পারিনি।

ওই দিনটার কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, তখন কেবল শীতের শুরু একদিন রাতে আমি কম্বল গায়ে জড়িয়ে বসে পড়াশোনা করছিলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম নাসিম নিজেও টেবিলে বসে কিছু লেখার চেষ্টা করছে। রাত প্রায় দেড়টার দিকে ও আমার কাছে এসে অনুনয় করে বলল
– দোস্ত একটা হেল্প করবি?
আমি অবাক হয়ে বললাম
– কি?
– একটা প্রেম পত্র লেখসি, একটু চেক কইরা দিবি?
– প্রেমপত্র তো খুব পার্সোনাল জিনিস, এটা তুই আমাকে দিয়ে চেক করাবি? তাছাড়া তোর প্রেমপত্র লেখার দরকার কি? একটু আগেই তো সোহানার সঙ্গে দেখা হলো।
– এইটা সোহানার জন্য না, এইটা অন্য পার্টি
সোহানা নাসিমের গার্ল ফ্রেন্ড। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ওদের প্রেম। যেমন তেমন প্রেম নয় একেবেরে জমজমাট প্রেম। দুজন একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম

– নিজের প্রেম পত্র নিজে চেক কর, আমাকে দেখাতে আসিস না।
এরপর কয়েকদিন নাসিমের সঙ্গে আর কথা হলো না। সপ্তাহখানেক পর নাসিম আমার কাছে এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে জানাল ওর ব্রেকআপ হয়ে গেছে। আরো কয়েকদিন পর নাসিম আবার আমার কাছে এলো প্রেমপত্রের কারেকশন নিয়ে। এবারে আমি আর কিছু বললাম না, মনে হল এমনিতেই বেচারার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। এখন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক, কিন্তু সেই প্রেমপত্র পড়ে আমার কান গরম হয়ে গেল। কানের চেয়েও বেশি গরম হলো মেজাজ। আমি ওকে বললাম
– এই প্রেমপত্র তুই ওই মেয়েকে পাঠাবি?
– হ্যাঁ কেন, কি হইসে? একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?
– একটু না অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে। আমি ওই মেয়ের জায়গায় হলে ট্রেন ভাড়া করে এসে তোকে জুতা দিয়ে পিটাতাম
– এমন তো কিছু লিখিনি। শুধু ব্রে/সি/য়ারের সাইজ জানতে চেয়েছি. এটা কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি ?
– শুধু বাড়াবাড়ি নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এইসব ফালতু বিষয় নিয়ে আমার কাছে আর আসবি না। নিজে যা পারিস কর
এরপর নাসিম দুইদিন আমার পেছনে পড়ে রইল ওর হয়ে চিঠিটা লিখে দেয়ার জন্য। প্রথমে আমি রাজী হলাম না। সময়টা ১৯৯৯ সন, মোবাইলের যুগ তখনো আসেনি তাই চিঠি ছাড়া উপায় নেই। অনেকক্ষণ ঝোলা ঝুলির পর আমি নাসিমের প্রস্তাবে রাজি হলাম।

এভাবে কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে তো আর চিঠি লেখা যায় না তাই আমি সেই মেয়ের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। নাসিম জানাল ওর নাম অনিমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ে। ওখানেই হলে থাকে। নাসিম আরো জানালো অনিমা ওর এক বন্ধুর খালাতো বোন। বন্ধুর বাড়িতেই দাওয়াতে দেখা হয়েছিল, দেখে ভীষণ ভালো লেগেছে তারপর একদিন ফোনে কথা হয়েছে। তখনই বলেছে চিঠি লেখার কথা। নাসিম চিঠি না লিখে নিউ ইয়ারে ওকে একটা ভিষন দামি কার্ড গিফট করেছে। তারই জবাবস্বরূপ অনিমা ওকে এক বিশাল চিঠি লিখে পাঠিয়েছে। সেই চিঠির জবাব এ নাসিমা একটা চিঠি লেখার চেষ্টা করেছে কিন্তু আমার মতে চিঠিটা অত্যন্ত অশ্লীল।

আমি এই জীবনে কোনদিন প্রেম পত্র লিখিনি। প্রেমপত্র তো দূরে থাক কাউকে কোনদিন চিঠিই লিখিনি। আমার বাবা-মা আর ছোট বোন থাকে ঢাকায়। সপ্তাহে দুদিন ফোনে তাদের সঙ্গে কথা হয়। চিঠি লিখে সময় নষ্ট করতে ওনারাই আমাকে মানা করেছেন। তবে চিঠি না লিখলেও আমি প্রচুর বই পড়েছি। বই পড়া ছাড়া আমার অন্য আর কোন শখ নেই। সাহিত্য বিজ্ঞান, ফিকশন, নন-ফিকশন এমন কোন টপিক নেই যেটা আমি পড়িনি। কাজেই চিঠি লিখতে গিয়ে তেমন কোন সমস্যা হলো না। কলম কামড়ে বসে থাকতে হলো না। একবার লেখা শুরু করার পর কি করে যেন লেখাটা চলতেই থাকলো। প্রথম চিঠিতে আমি খুব বেশি কিছু লিখলাম না। ওর কুশল জানতে চাইলাম। এখানকার জীবনের দু একটা গল্প করলাম, কেমন করে আমরা ট্রেনে করে ইউনিভার্সিটিতে যাই, খানিকটা প্রকৃতির বর্ণনা দিলাম। সবমিলিয়ে খারাপ হলো না। শেষ করে আমি নাসিমকে বললাম, এটা যেন কপি করে পাঠিয়ে দেয়।
একটা মজার ব্যাপার হল চিঠিতে কিন্তু প্রেমের কোন আভাস ছিল না, খানিকটা বন্ধুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল; সম্ভবত এই বিষয়টি ওর খুব ভালো লেগেছিল। এটা বুঝতে পারলাম যখন চিঠির জবাব এলো তিন দিনের মাথায়। এবারেও নাসিম আমার শরণাপন্ন হল। আমার লেখা প্রথম চিঠির জবাবে কি লিখেছে সেই কৌতূহলেই চিঠিটা পড়া হলো এবং পড়ার পর জবাব না লেখা পর্যন্ত নাসিম আমাকে ছাড়লো না।

বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর আমি একদিন নাসিমকে জিজ্ঞেস করলাম এতে কোন ওর কি লাভ হচ্ছে। চিঠি আমি লিখে দিচ্ছি জবাব ও পাঠাচ্ছে। নাসিম জানাল ও প্রতি সপ্তাহে দুইবার ওকে ফোন করে। যদিও বেশিরভাগ সময়ই কথা হয় চিঠি সংক্রান্ত, বেশিরভাগ সময়েই কানেকশন ভাল থাকেনা। অনিমা হলের কয়েন ফোন দিয়ে ফোন করে। ওকে বলেছিল দোকান থেকে ফোন করতে কিন্তু ও বলেছে ওর অসুবিধা হয়। দোকানদার হা করে তাকিয়ে থাকে।

শীত গড়িয়ে গ্রীষ্ম চলে এলো। আমার মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হয়েছে।। আমি পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।এ সময় চিঠি লিখে সময় নষ্ট করার মতন সময় আমার নেই। কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পড়ায় মন বসাতে পারছি না। লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন নাসিমকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে ওর আর চিঠি এসেছে কিনা। নাসিম জানালো ফোনে কথা হয়েছে ওর শরীর খারাপ। জ্বর এসেছে কদিন ধরে তাই চিঠি লিখতে পারছে না। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেচারি জ্বরে পড়ে আছে, এ সময় নাসিমের উচিত একটা বড় করে চিঠি লেখা অথচ ও কিছুই করছে না। তখনই মনে পড়লো, ও তো কিছু করতে পারবে না, যা করার করতে হবে আমাকে। আমি নাসিমকে বললাম
– তুই সুন্দর করে একটা চিঠি লেখ। জ্বরের মধ্যে চিঠি পেলে ওর মন ভালো হয়ে যাবে।
আমি জানতাম নাসিম আবারো আমাকে চেপে ধরবে। এবারে আমি মনে মনে প্রস্তুতই ছিলাম। আমি লিখলাম

অনিমা অনিমা
গত চিঠিতে লিখেছো তোমার শরীর খারাপ কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার শুধু শরীর খারাপ নয়, তোমার মনও খারাপ। আমার ধারনা যদি সত্যি হয় তাহলে এখন তুমি চাদর মুড়ি দিয়ে অন্ধকারে টর্চা লাইট জ্বেলে আমার লেখা পড়ছো। বেশি রাত জেগো না, আর অন্ধকারে পড়তে নেই, মাথা ব্যথা করবে, এমনিতেই তোমার মাইগ্রেনের সমস্যা। বাইরের দেশগুলোতে অডিও বুক নামে একটা জিনিস এখন ভীষণ চলছে। বইগুলো কেউ পড়ে শোনায় তোমার কষ্ট করে পড়তে হবে না। তুমি শুধু অডিও চালু করে গল্পটা শুনবে। মজার না?

আমাদের এখানে ভীষণ গরম পড়েছে ঢাকাতেও নিশ্চয়ই তাই, আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হয়। খুব মেঘ করে যখন বৃষ্টি নামে, আমার তখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে। তুমি লিখেছিলে আকাশ যখন মেঘ করে ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায় তখন তোমার আমার কথা মনে পড়ে। আরো লিখেছিলে ঝকঝকে নীল আকাশে অনেক মেঘের মধ্যে যখন আমরা আমাদের প্রিয়জনের মুখ খুঁজি তুমি সে সময় আমাকে দেখতে পাও। সত্যি করে বলতো তুমি কি সত্যিই আমাকে দেখতে পাও? আমি তো সব সময় মেঘের মধ্যে বিশাল বিশাল সব হাতি আর জলহস্তী দেখি, মাঝে মাঝে অবশ্য হাঙরও দেখতে পাই। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে সেই হোঁতকা পেটুক হাঙরের মতন দেখ না। তবে তোমাকে একটা মজার কথা বলি। আমাদের এখানে একটা পুকুর আছে, সেই স্বচ্ছ পুকুরের জলে আমি যখন তাকাই আমি তোমার মুখ দেখতে পাই। আমি তো কখনো তোমাকে দেখিনি তাই কল্পনায় তোমার মুখ দেখি।

পাশে থেকে নাসিম বলল “এটা কি লিখেছিস? আমি তো ওকে দেখেছি”। আমি লিখতে লিখতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, হঠাৎ করে সম্বিত ফিরে পেয়ে ধাতস্থ হয়ে আবার লিখলাম। তোমাকে অবশ্য অনেক আগে দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় “তোমাকে দেখেছি সেই কবে কোন বৃহস্পতিবার তারপর এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না”।

এলেবেলে কথা বলে আর তোমার মাথা ধরিয়ে দেব না। তোমার জন্য একটা বই পাঠাচ্ছি। এই বইটা পড়ো। আমার ভীষণ প্রিয় একটা বই।
আর একটা কথা বলে শেষ করব। আমি জানি বৃষ্টি তোমার ভীষণ প্রিয় তবে এখন বৃষ্টিতে ভিজে আবার ঠান্ডা বাধিও না।। ভালো থেকো, আর দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাকে আবার চিঠি লিখা শুরু করো। তোমার চিঠি না পেলে নিজেকে খুব অসম্পূর্ণ লাগে।

ইতি তোমার নাসিম

লেখা শেষ করে চিঠিটা নাসিমের হাতে দিয়ে বললাম
– একটু বড় হয়ে গেল দোস্ত। কষ্ট করে কপি করে নিস। নাসিম আমার পিঠ চাপড়ে বলল
– দোস্ত তুই যা লেখস না, একদম সুরসুরি উঠায়ে দেওয়ার মতন।
– মানে?
মানে, এই যে দুইবার নামটা লেখস, আরে দোস! কি কমু একদম অ/র্গা/জম হয়ে যাওয়ার মতন
আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এত চমৎকার একটা মেয়ে অথচ কিসের পাল্লায় পড়েছে। এর জন্য কি আমি দায়ী?

চলবে……

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৪০

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪০
জিয়ান নয়নার ঠোঁটের দিকে নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিচ্ছে। তার পরিটা ঘুমিয়ে আছে একদম তার বক্ষপিঞ্জরে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে এমন দৃশ্য দেখে হৃদয় জুড়িয়ে গেলো জিয়ানের৷ ইচ্ছে হলো প্রিয়তমার ওষ্ঠদ্বয়ে আলতো করে আদর মেখে দিতে৷ এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। জিয়ান বিরক্ত নিয়ে উঠে এসে দরজা খুলে দেখে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে৷

জিয়ান শান্ত স্বরে বলল,”দেখুন আমার ওয়াইফ ঘুমাচ্ছে সো ডু নট ডিস্টার্ব। আপনাদের কিছু বলার থাকলে রিসিপশনে ওয়েট করুন আমি আসছি৷”
“এই তুই কাকে এটিটিউট দেখাস! তোর বাপেরা দাঁড়িয়ে আছে। ওটা তোর বৌ নাকি ভাড়া করা মা***গী আমাদের জানা আছে।”

জিয়ান নিজের রাগ সংযাত করতে না পেরে নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দেয় মূহুর্তেই লোকটার নাক দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। জিয়ান দরজা বন্ধ করে বাহিরে এসে বলে,”আমার ওয়াইফের ব্যাপারে একটা বাজে ওয়ার্ড বের করলে আমি সব আইন কানুন ভুলে যাবো৷ আমার ওয়াইফের সম্মান রক্ষা করার জন্য দুই চারটা লা’শ ফেলে দিতেও পিছপা হবো না৷”
“তিনজন পুলিশ জিয়ানের দিকে তেড়ে আসে।”
“পেছন থেকে একজন বলে,স্টপ।”
“পুলিশগুলো পেছনে তাকিয়ে দেখে এসপি স্যার৷সবাই একত্রে সালাম দেয়৷”
“তোমরা নিজেদের ডিউটি না করে ওনাদের ডিস্টার্ব করছো কেনো?”
“স্যার এই লোকটা একটা মেয়ে নিয়ে হোটেলে উঠেছে আবার নিরাপত্তারক্ষীর সাথে মিস বিহেভিয়ার করেছে। এই দেখুন ওর নাক ফাটিয়ে দিয়েছে৷”

জিয়ান বলল,”স্যার আমি ওনাকে বারবার বলেছি আমরা হ্যাসবেন্ড-ওয়াইফ তবুও ওনারা আমার ওয়াইফকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে৷ কোন পুরুষ যার শরীরে রক্ত মাংস আছে সে নিজের ওয়াইফ সম্পর্কে এমন বাজে কথা সহ্য করতে পারে না। আমিও পরিনি। তাই আমি এরজন্য স্যরি বলতে পারবো না৷ কারন কবুল বলার পর থেকে আমার ওয়াইফের জান,মাল, ইজ্জতের হেফাজতের দায়িত্ব আমার৷ যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন এই দুঃসাহস যে করবে সে যেহোক তাকে আমি ছাড়বো না৷”

এসপি সাহেব বললেন,”দুঃখিত আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য। হ্যাসবেন্ড এমন প্রটেক্টটিভ হওয়া উচিৎ। মিস্টার চৌধুরী ইন্জয় ইউওর ট্রিপ।”

জিয়ান দরজা বন্ধ করে রুমে আসলো৷ঘুমন্ত নয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”তুমি বড় হবে কবে? সব ভুলে আমাদের দু’জনের একটা স্বপ্নের সংসার হবে। কিউট কিউট কয়েকটা বাচ্চা হবে। এই দেখো তুমি নিজেই বাচ্চা আবার আমি তোমার থেকে বাচ্চার বাবা হওয়ার আশায় আছি!”
নয়নার লম্বা চুলগুলো একপাশ থেকে ছড়িয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘুমন্ত সিন্ড্রেলা মনে হচ্ছে নয়নাকে। জিয়ান নয়নার রেশমি চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলে, “আমি তোমার হৃদয়ে পৌঁছাতে চাই আমি তোমার হৃদমহলের রাজা হয়ে তোমার হৃদয়ে রাজত্ব করতে চাই। সুখ,দুঃখ, হাসি, আনন্দ জীবনের প্রতিটা মূহুর্তে তোমার সঙ্গ চাই প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী। নয়নাকে দেখতে দেখতে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেলো জিয়ান৷”

সকালের মিষ্টি রোদ জানালার পর্দা গলিয়ে জিয়ানের চোখেমুখে খেলা করছে। মৃদু বাতাসে দোলখাচ্ছে পর্দাগুলো সাথে রোদের ঝলক খেলা করছে চোখেমুখে৷ জিয়ান চোখ খুলে,নিজের পাশ ঘেঁষে শুয়ে থাকা রমনীকে দেখতেই তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি৷ জিয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল আটটা বাজে। জিয়ান দ্রুত উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অফহোয়াইট রংয়ের পাঞ্জাবি সাথে সাদা পাজামা পরলো৷ নিজের পছন্দের পারফিউম লাকসত, দু লাকসত এল এল বারো, ফ্রেশ স্পাইসি স্প্রে করছে। নয়নার এতো কড়া পারফিউমের ঘ্রানে ঘুম ভেঙে গেলো৷ মিটিমিটি করে চোখ খুলে জিয়ানকে পারফিউম স্প্রে করতে দেখে বলে,”পারফিউমের পুকুরে সাতার কেটে এসেছেন!”

জিয়ান নয়নার দিকে এগিয়ে এসে বলে,”সারারাত পারফিউমের গোডাউনকে বুকের মধ্যে রেখেছি তো তাই স্মেল ছড়িয়ে পড়ছে।”
“তা আপনি এতো ফিটফাট হয়ে নায়ক সেজে যাচ্ছেন কই!”
“সোফার উপর দেখো শাড়ি, আর দুই তিনটা ড্রেস আছে যেটা ভালো লাগে পরো। দ্রুত ফ্রেশ হও শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে তো৷”

নয়না ভ্রু কুঁচকে তাকালো, তারপর মিনমিন করে বলল,”এমন সেজেগুজে বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে নিশ্চিত মেয়ে পটানোর ধান্দা।”
“আর মেয়ে পটানোর ধান্দা-টান্দা নেই বেব, তুমি পটে গেলেই হবে। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। একটাই পটছে না আবার অন্য মেয়ে পটাবো! এতো ধৈর্য আর সময় কোনটাই নেই তোমার মানুষটার।”
“জিয়ানের শেষের কথাটুকু নয়নার হৃদয়ে বাড়ি খাচ্ছে,তার মস্তিষ্ক আর হৃদয় জুড়ে বারবার প্রতিধ্বনি হচ্ছে নিজের মানুষ শব্দটা! এই শব্দের ভার এতো কেনো?যেনো হৃদয় দখল করে নিলো!

🌿

জাহানারা বেগম তার ভাইকে বলল, “জামাই প্রথমবার তোমাদের বাসায় আসবে ভাই আমার জামাইয়ের কদরে যেনো কোন কমতি না থাকে৷”

“চিন্তা করিস না দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র বোনঝি-জামাই তার আপ্যায়ন হবে রাজকীয়। তা ওরা এখনো আসছে না কেন?”

বিয়ে বাড়িতে গেট আগেই সাজানো ছিলো সেখানে মেয়েরা ফুলের ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আতিফ সাহেবের বৌয়ের হাতে মিষ্টিজাতীয় খাবারের ট্রে।

জিয়ান গাড়ি থেকে বের হয়ে নয়নাকে বের করে আনলো,নয়নার পরনে রেড মেরুন রঙের একটা ড্রেস। দুজনকে নব বিবাহিতা কাপল লাগছে। মনে হচ্ছে আজ এদের বিয়ের রিসিপশন।
“জিয়ান নয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নয়না জিয়ানের হাতে হাত রাখলো। ছ’ফুট লম্বা একটা মানুষের পাশে নিজেকে ছানাপোনা লাগছে নয়নার। নয়নার চেহারায় অস্বস্তি ফুটে উঠেছে।

জিয়ান ফিসফিস করে বলল,”লম্বা ছেলেরা বাটার মাশরুম বৌ পায় সো ডিয়ার বাটার মাশরুম বি কম্ফোর্টেবল।ঠোঁটের কোনের হাসিটা ফেরত আনেন মিসেস চৌধুরী। ওটা ছাড়া বাটার মাশরুমের রুপ ফুটবে না ঠিকঠাক।”

গেটের সামনে আসতেই জিয়ান নয়নার উপর ফুলের বর্ষণ হতে লাগলো৷ মিষ্টিমুখ করিয়ে জামাইকে ঘরে এনে বসানো হলো। আদনান এসে বলে, “দুলাভাই ইট’স নট ফেয়ার। বিয়ে আমার ফুল এটেনশন পাচ্ছেন আপনি।”

“শালাবাবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, তুমিও পাবা এমন রাজকীয় ট্রিটমেন্ট আর তো মাত্র কিছু সময়।” বাড়ি ভর্তি মানুষ সবার চোখ কপালে এতো সুন্দর জামাই! তো মানুষ ভাগ্য গুণেই পায়! যেমন দেখতে তেমন ব্যবহার।
জিয়ান নয়না একটা রুমের মধ্যে পাশাপাশি বসে আছে৷ বাকি সবাই রেডি হচ্ছে বরযাত্রী যাওয়ার জন্য। জিয়ান হুট করে নয়নার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো৷
“কি হচ্ছে!”
“চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দাও তো খুব ক্লান্ত লাগছে। আসার পরে একটা দিনও রেস্ট করা হয়নি। তোমার পিছু ছুটতে ছুটতে হয়রান হয়ে গেছি বয়স তো কম হয়নি৷”

নয়না বলে,”টেনে সব চুল ছিড়ে ফেলি? আপনার বয়স কত হলো! এই বয়সে আমার মত বৌ পেয়েছেন মাথায় করে রাখা উচিৎ আমাকে আপনার৷”
“তোমার যদি টাকলু জামাই পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে ঠিকাছে। মাথায় না বেব তোমাকে হৃদয়ে রাখবো সুইটু।”
“হোয়াট?”
“শুনো এইজন্মে তোমাকে আর ছড়ছি না। সো মুখ বন্ধ করে কাজে লেগে পড়ো৷ আর হ্যা আজ বিকেলে আমাদের ফ্লাইট আমরা দুজন ঢাকা ব্যাক করবো। এতো কষ্ট করে ছুটি নিয়ে বৌয়ের সাথে প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করার জন্য এসেছি। এই এতো মানুষের মধ্যে বৌকে ঠিকঠাক ভালোবাসাও দিতে পারছিনা৷ সো চুপচাপ আমার সাথে ফিরবে৷ বিয়ে করেছি বৌয়ের সাথে সোহাগ করা হলো না এখনো স্যাড লাইফ!”
“আমি আম্মুকে রেখে যাবো না।”
“ওরেহহহ আমার আম্মু ভক্ত বৌতাহহহ। তোমার আম্মু তিনদিন পর ব্যাক করবে।আমি চলে যাওয়ার পর আম্মুর আঁচলের তলে আবার ঢুকে যেও।”
“সরেন আমি রেডি হবো।বৌ আনতে যেতে হবে না?”
“তুমি তো রেডিই আছো আর কি রেডি হবে?”
“নয়না হুট করে উঠে পরলো জিয়ানের মাথা বেডের উপর পরলো,বৌ তুমি পূর্ন বৌ হবা কবে? এভাবে কেউ বরকে ফেলে উঠে!”

নয়না লাগেজ থেকে লেহেঙ্গা বের করতে করতে বলে,”আমার নাম সুনয়না। সো এতো সুন্দর নাম থাকতে মৌ মাছির মত ভন ভন করবেন না বৌ বৌ করে।” নয়না ওয়াশরুমে দিকে যাচ্ছে।
“ডিয়ার ওয়াইফি তুমি চাইলে এখানেও চেঞ্জ করতে পারো মাইন্ড করবো না।”
“নয়না চোখ রাঙিয়ে বলে অসভ্য লোক।”
“অসভ্য হয়েছি আমি তোমারি প্রেমে।” বলেই চোখ মারলো৷

🌿

মান্নাত এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। চোখভর্তি অশ্রু বুকভর্তি কষ্ট।
“মিস মান্নাত আপনার আয়ারল্যান্ডে কোন সমস্যা হবে না৷ আমার ক্লাস ফ্রেন্ড ফাইজু ওর ফ্যামিলি নিয়ে ওখানে থাকে। আপনি আপাতত ওর বাসায় উঠবেন৷ ও আপনাকে সব রকম সাহায্য করবে৷ আর হ্যা অতিতের কথা ভেবে নিজেকে ছোট ভাববেন না৷ আপনার সাথে যা হয়েছে সে-সব অন্যায় তাই সেখানে আপনার কোন দোষ নেই৷ টেক কেয়ার।”

“মান্নাত মুখ দিয়ে কোন কথা বের করছে না। তার চোখ যেনো শত কথা প্রকাশ করছে।

“রিতু ছুটে এসে মান্নাতকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোর সাথে এতোকিছু হয়ে গেলো আমি কিছুই জানতে পারলাম না! তুই না চাইলে তোকে দেশ ছেড়ে যেতে হবে না। তুই আমার বাসায় আমার সাথে থাকবি।”
“মান্নাত জানে এই দুনিয়া তার জন্য এতো সহজ নয়। একজন মেয়ে যাকে ক্লাস টেইনে থাকতে তিনজন পুরুষ ধ’র্ষ’ণ করেছে সেই মেয়েকে কোন পরিবার ভালো চোখে দেখবে না৷”
“মান্নাত একবার পিছনে ফিরে জাহিনের দিকে তাকালো৷ তার বলতে ইচ্ছে করছে আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন! কিন্তু সে জানে এই অন্যায় আবদার করা যাবে না৷ চোখের জলটুকু মুছে সামনে এগিয়ে গেলো।”

“অন্তর বলল,তুই মেয়েটাকে ইনসাফ না দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছিস কেনো!”

“এই সমাজ এসব জানার পর মেয়েটাকে বেঁচে থাকতে দিবে না। ওই তিন জা’নোয়ারের ডিটেইলস বের কর৷ ওদের আ’সল জায়গা কে’টে লবন মরিচ লা’গিয়ে কুকুরকে খা’ওয়াবো যাতে ভবিষ্যতে কোন মেয়ের সাথে এই ঘৃণ্য কাজ না করতে পারে৷”
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩৯

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩৯
নয়না ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। জিয়ান একটা সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেটের স্মেলে নয়না কাশি শুরু করে দিলো।
জিয়ান নয়নার দিকে ফিরে নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে বলে,”বেবি কি সমস্যা তোমার?”
“নয়নার কাশির মাত্রা বেড়ে গেলো। জিয়ান নিজের হাতে থাকা সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে, সুনয়না অনেক হয়েছে রাগ অভিমান এখন দশ মিনিট মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনবে তুমি।”

‘নয়না চুপ করে রইলো। জিয়ান নয়নার হাত ধরে নিজের কোলে বসলো৷ নয়না উঠে যেতে চাইলে বলে,”একদম নড়বে না। চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মত বসে আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন।”
“আপনার কোন কথা আমি শুনবো না৷ যে পুরুষের একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক থাকে সে কখনো ভালো পুরুষ হতে পারে না। আপনি বলবেন আমি ছোট তাই কম বুঝি? সতেরো বছর হতে আর দু’মাস বাকি। কোনটা ভালো কোনটা খারাপ সে জ্ঞান আমার আছে। আমার বয়সী অনেক মেয়ে যারা সংসার করছে স্বামী সন্তান নিয়ে৷ ভালো খারাপ বোঝার বোধবুদ্ধি আমার আছে।”

জিয়ান নয়নাকে বেডে বসিয়ে নিজে নয়নার সামনে এসে ফ্লোরে বসে নয়নার হাতে হাত রেখে বলে,”আমি জিয়ান রেজা চৌধুরী স্বজ্ঞানে কোনদিন কোন মেয়ের সংস্পর্শে যাইনি৷ তোমার বোনের সাথে আমার রিলেশন ছিলো তবে তাকে আমি হালাল ভাবে পেতে চেয়েছি। কোনদিন কিস আদান প্রদানও হয়নি আমাদের মধ্যে। মাঝে মাঝে তোমার বোন শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি সেটাকেও প্রশ্রয় দেইনি। কারন আমি তাকে পবিত্র ভাবে সারাজীবনের জন্য নিজের অর্ধাঙ্গিনী রুপে চেয়েছিলাম। আমার ছোট বেলা থেকে ইচ্ছে ছিলো পাইলট হবো। বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার ইচ্ছেও প্রবল হতে থাকে৷ পড়ালেখা ছাড়া আর ধ্যান কোনদিন অন্যদিকে যায়নি৷ নীলাঞ্জনাকে আমি ভালোবাসতাম কিন্তু সেটা স্থায়ী করার জন্য টাইমপাস করার ছেলে রেজা না।”

‘নয়নার চোখে অশ্রু টলমল করছে যে কোন সময় টুপ করে ঝরে পড়বে। জিয়ান নিজের হাত দিয়ে নয়নার অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিলো৷
“কাঁদবে না তুমি কাঁদলে আমার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। আমি বেঁচে থাকতে তোমার চোখে পানি দেখতে চাইনা৷”
“নয়না কিছু বলতে চাইছে কিন্তু তার ভেতরে শত শত কথা থাকলেও শব্দ হয়ে তা বের হচ্ছে না।

জিয়ান নয়নার কাঁপতে থাকা ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বলে,”তোমাকে কিছু বলতে হবে না তুমি শোন৷ আমি পাইলট জিয়ান রেজা চৌধুরী। ফার্স্ট ক্যাপ্টেন আমি৷ বাসা থেকে বের হলে আমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তেরো ঘন্টা জার্নি করার পর আমি রেস্ট করি আর নিজেকে ফিট রাখি৷ পাইলটদের নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে হয়৷নিজেকে সুস্থ রাখতে হয় এটাও কাজের মধ্যে পড়ে। এই কয়দিন তুমি কাকতালীয় ভাবে যাকে দেখেছো সে আমি না।”
“নয়না এবার শব্দ করে কেঁদে ফেললো৷”

জিয়ান নয়নাকে জড়িয়ে ধরলো নিজের বাহুতে আগলে নিয়ে বলে,”এই পাগলি এভাবে কাঁদছো কেনো! আমি সত্যি বলছি আমি তোমাকে ঠকাই’নি ওটা তোমার ছোট দেবর আর আমার জমজ ভাই জাহিন ছিলো। যার সাথে তুমি আমাকে গুলিয়ে ফেলে মোবাইলে দিনরাত্রি আমার ক্লাস নিয়েছো৷”
“নয়না কাঁদছে তার কান্না বন্ধ হওয়ার কোন নাম নেই।”

জিয়ান নয়নার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,”এভাবে কান্না করতে থাকলে কিন্তু খুব আদর করবো বৌ।পরে কিন্তু এখানেই বাসর সেরে ফেলবো। তখন কিন্তু আফসোস করবে সারাজীবন, ফুলছাড়া ফুলসজ্জা করার জন্য। মনে রেখো ফুলসজ্জা জীবনে একবারই হয় এরপর সজ্জা হলেও ফুল কিন্তু মিসিং থাকে৷”

নয়নার ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ হাসির রেখে, নয়না বলল,”বাসর ছাড়া কি আপনার আর কোন কথা নেই?” চোখে পানি ঠোঁটে হাসি অদ্ভুত কম্বিনেশন।
“জিয়ান নয়নার দিকে তাকালো,অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে নয়নাকে। জিয়ান বললো,”আটাশ বছর ধরে অপেক্ষা করছি বাসর করার জন্য। তো সারাদিন বাসর বাসর করবো না! জন্মের পর থেকে এখনো বাসর করিনি৷”

‘নয়না জিয়ানের বক্ষে লেপ্টে আছে শান্ত ছানার মত৷ জিয়ান নয়নাকে আগলে নিয়েছে। সেভাবে শুয়ে আছে দুজন৷
“নয়না এখন কিছুটা স্বাভাবিক, জিয়ানকে বলল,আপনার সত্যি জমজ ভাই আছে তো নাকি আমাকে টুপি পরাচ্ছেন?”

“ওরেহহহ বাপরেহহহ দ্যা গ্রেট সুনয়না তালুকদার থুরি মিসেস চৌধুরীকে কেউ টুপি পরাতে পারে! এ সাধ্য কারো আছে?” জিয়ান নিজের মোবাইল বের করে অনেকগুলো পিক দেখালো তার আর জাহিনের।

জিয়ান ঘুরে,নয়নাকে বেডে শুয়ে নয়নার উপরে ঝুঁকে বলে,”তুমি আমাকে আরেকটাবার সুযোগ দিবে? আমি তোমাকে আমার সারাজীবনের জন্য পাশে চাই প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।”

“নয়নার অনূভুতিরা জাগ্রত হচ্ছে এলোমেলো লাগছে নয়নার৷ শ্বাসের উর্ধ্বগতি জিয়ানের কানে আসছে৷ জিয়ান দ্রুত সরে আসলো নয়নার উপর থেকে। গ্লাসে পানি ঢেলে নয়নাকে বসিয়ে বলে,রিলাক্স হও জান কিছু হয়নি সব ঠিক হয়ে যাবে। এই নাও পানি খাও। নয়না জিয়ানকে আঁকড়ে ধরলো জিয়ানের হাতে নখ বসে রক্ত বের হয়ে আসছে৷

“জিয়ান নয়নাকে পানি খাওয়ালো৷ ধীরে ধীরে শ্বাস নাও জান। কিছু হয়নি কিছু হবে না। আমি আছি তোমার পাশে৷”

‘অনেকটা সময় পর নয়না স্বাভাবিক হলো।

“জিয়ান নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ এই শোন তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো চোখ বন্ধ করো৷”

“আম্মু, মামা সবাই আমাকে খুঁজবে পেরেশান হবে আমাকে না পেয়ে।”

“টেনশন করতে হবে না তোমার৷ শ্বাশুড়ি আম্মাকে কল করে বলেছি। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যাবো সোজা।”
“আপনিও যাবেন?”
“তুমি চাওনা আমি যাই?”
“আপনি এমন পাগলামি কাজ করেছেন সবাই ক্ষ্যাপাবে আমাকে।”
“তো পাগলামি করবো না! দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র বৌ তাকে নিয়ে পাগলামি না করলে কাকে নিয়ে করবো? পাশের বাসার ছকিনাকে নিয়ে?”
জিয়ান কথা বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল করলো নয়না চোখ লেগে আসছে৷ আলতো করে নয়নার কপালো ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,”তুমি শুধু আমার শুধুই আমার। আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমাকে উজাড় করে দিয়ে তোমার এই ভয় আমি জয় করে নেবো।”

জিয়ানের খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে,বহু বছর হয়েছে জিয়ান গান গায় না৷ নয়নার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সুর তুলল..

“ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে….

তোমার চুলে হাত বুলাবো,
পূর্ণ চাঁদের তলে …..
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার,
জোসনা পড়ুক কোলে…..

ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে….

আজকে জড়ায় ধরবে,তোমার
মনকে আমার মন….
গাইবে পাখি, গাইবে জোনাক
গাছ গাছালি বন…

এত ভালবাসা গো জান,
রাখিও আঁচলে….
দোলাও তুমি, দুলি আমি
জগত বাড়ি দোলে

ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে….

তোমার চুলে হাত বুলাবো,
পূর্ণ চাঁদের তলে …..
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার,
জোসনা পড়ুক কোলে…..
ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে…..
ভালবাসার নাও ভাসাবো,
ভালবাসি বলে….”

গান শেষ হতে হতে নয়না গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরলো৷ জিয়ান নিজের বক্ষে তার পিচ্চি বৌটাকে সযত্নে আগলে নিয়ে নিজেও তলিয়ে গেলো গভীর নিদ্রায়৷ যেনো বহুকাল পর তার হৃদয় প্রশান্ত হলো!

🌿

সায়না অনিকেতের সামনে দু হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে৷
“এসব কি হচ্ছে মিস সায়না? রাস্তা ছাড়ুন আমার কাজ আছে৷”
“আমি তো রাস্তা ছাড়ার জন্য রাস্তা আগলে দাঁড়াইনি ডাক্তার মশাই। আপনি আমার নাম্বার ব্লক করেছেন কেনো?”
“দেখো আমি বহুবার বলেছি তোমার আমার মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্ভব নয়৷ কখনো আকাশের চাঁদকে জমিনে আসতে দেখেছো?”

“বহুবার দেখেছি আপনি দেখেন নি! শুনুন রসকষহীন ডাক্তার শুধু জানেন কাটাছেঁড়া করতে ভালোবাসা টাসাতো জানেননা, পূর্নিমা রাতে সচ্ছ জলধারায় দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন পূর্নিমার চাঁদ কেমন জমিনে নেমে আসে।”

“এসব ফিল্মি ডায়লগে জীবন চলে না।”

“সায়না অনিকেতের হাতের মধ্যে হাত রেখে বলে,ভালোবাস মানুষ পাশে থাকলে জীবনটা ফিল্মের চেয়েও বহুগুণ ভালো কাটে।”

“হাত ছাড়ুন।”

“কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে আমায়?কবে তুমি বলবে?”

“কেনো করছো এমন! আমি মানুষটা বড্ড ভালোবাসার কাঙাল কেনো আরো বিধ্বস্ত করতে চাইছো? কেনো চাঁদ হয়ে বামনের ঘরে উঁকি দিয়ে লোভ বাড়াচ্ছো? আমি জানি আমার লিমিট তাই আমাকে আমার মত থাকতে দাও।” অনিকেত দ্রুত গতিতে স্থান পরিবর্তন করলো৷

“পালিয়ে আর কতদিন থাকবেন ডাক্তার সাহেব? ফিরে কিন্তু এই আমার আঁচলের তলায় আসতেই হবে। ভালোবাসি আপনাকে ভালোবাসা না নিয়ে ফিরবো না খালি হাতে৷হয় আপনার হবো, না হয় আপনার বাচ্চার মা হবো তবুও আপনার পিছু ছাড়বো না৷”

🌿

মিজান তালুকদার তার ওয়াইফের পাশে বসে আছে৷ দু’জনেই চুপচাপ। মিজান তালুকদার নিরবতা ভেঙে বলল,দেখো মেয়ে ভুল করছে তাই বলে তো মেয়েটাকে মরার জন্য ছেড়ে দেয়া যাবে না। তুমি ওর সাথে রাগ করে না থেকে মেয়েটাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করো।

“তুমি জানো কাল রাতে নীলাঞ্জনাকে বাসায় কে দিয়ে গেছে?”
“অন্তর নামের একটি ছেলে আমাদের এলাকার পরের এলাকায় ওদের বাসা৷”
“রেজা চৌধুরী দিয়ে গেছে৷ কিন্তু বাসায় পাঠিয়েছে ওই ছেলেকে।
“এসব তুমি কি বলছো নাহার! রেজা কোথা থেকে আসবে এখানে?”
“আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না৷ আমি কোনদিন তোমার কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারিনি৷ তুমি বরং দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করো। জানো আমার মেয়েটার জীবন ওই ছেলেটাই নষ্ট করেছে।”

#চলবে

প্রেমময় নিবৃত (ছোট গল্প)

0

#প্রেমময়_নিবৃত
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী

‘গেটের সামনে আসেন তো!’

ফোনের এপাশ থেকে কথাটা শুনে খানিকটা চমকালাম। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে কাচুমাচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসময় গেটের বাইরে আসবো কেনো?’

‘কোনো সমস্যা আছে? ক্লাস তো মনে হয় না আছে! ক্লাস থাকলে তো এসময় কল তুলতেন না। তাহলে?’

আমি কিছু না বলে নিশ্চুপ রইলাম। সত্যিই এখন আমার ক্লাস নেই। ক্লাস নেই বললে ভুলই হবে। মূলত ক্লাস থাকলেও আমি ক্লাসটা করছি নাহ৷ এই ক্লাসটা এতো বিরক্ত লাগে তা বলার মতো নাহ তাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসে বান্ধবীদের সাথে লাইব্রেরিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিন্তু এই সময় উনি হঠাৎ গেটের বাইরে কেনো যেতে বললেন তা বুঝে আসলো নাহ। আমার ভাবনার মাঝেই নিবৃত ফের বললো,

‘কথা বলেন না কেন?’

আমি ছোট্ট করে বললাম, ‘আপনি কি এসেছেন?’

উনি মনে হয় বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে একটু তেতে উঠেই বললেন, ‘আমার আসা না আসা দিয়ে আপনার কি! কয়বার বললাম গেটের বাইরে আসতে!’

উনার কথা শুনে আপনাআপনি মুখটা কুঁচকে গেলো। মনে মনে কয়েকটা বকা দিয়ে বললাম, ‘আসছি!’ নিবৃত খট করেই কল কেটে দিলেন। আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে পরপর আরো কয়েকটা বকা দিয়ে বান্ধবীকে বললাম, ‘তোরা বস! আমি একটু আসি!’

‘কিরে কই যাস!’

‘আসতেছি! বস।’

ব্যাগ আর ফোন নিয়ে দৌড় লাগালাম। মনের মাঝে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিলো। উনি কি সত্যি এসেছে নাকি! ২০৫ কিলোমিটার রাস্তার দূরত্ব আমাদের মাঝে। গুটি গুটি পায়ে গেইটের বাহিরে এসে উনাকে নজরে পড়লো নাহ। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। অনেক মানুষের আনাগোনা থাকলেও নির্দিষ্ট লোকটার দেখা নেই৷ যদিও আমি সিউর ছিলাম না তবুও উনাকে না দেখতে পেয়ে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ন হলাম। মাথা নিচু করে ফোনের দিকে তাকাতেই ফোনটা ভাইব্রেট হতে শুরু করে। নিবৃতের কল দেখে মন খারাপ রেখেই কল রিসিভ করে কানে তুললাম। আমার কোনো শব্দ করার আগেই নিবৃত নিজেই বললেন,

‘ডান পাশে তাকান!’

আমি সাথে সাথেই তাকালাম। সামনেই দুইটা বাইক নিয়ে চারজনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিবৃত্ত ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, ‘এদিকে আসেন!’

আমি ফট করেই বললাম, ‘আপনি কি আমাকে এই বাইকওয়ালাদের কাছে পা’চার করে দিবেন নাকি!’

নিবৃত কটমটিয়ে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘থা’প্রিয়ে আপনার কান গরম করে দেবো। জলদি আসেন!’

এরপরই আবার কল কেটে গেলো। আমি গাল ফুলিয়ে রাস্তার পাশ ঘেঁষে একদমই আস্তে হাটতে শুরু করলাম। এতোটাই আস্তে হাঁটছি যে ২ মিনিটের রাস্তা অন্তত আমার ১০ মিনিট তো লাগবেই। টুং করে ফোনো শব্দ হতেই দেখলাম নিবৃতের টেক্সট। ছোট্ট করে লিখছে,

‘পিঁপড়াও এর থেকে জোড়ে হাঁটে। আমি যদি এগিয়ে যাই তবে কিন্তু মাথায় তুলে আছাড় মা’রবো!’

সাথে সাথেই আমার হাঁটার গতি বেড়ে গেলো অটোমেটিক। এই লোকটাকে যে পরিমাণে ভয় পাই এই ভয়টা যদি নিজের আব্বুকেও পেতাম তবুও বোধহয় জীবনে ভালো কিছু হতো! ২ মিনিটের মাথায় অডিটোরিয়ামের সামনে দাঁড়াতেই উনি বাইক থেকে নেমে এলেন। আমার সামনে এসেই হেলমেট খুলে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে চমৎকার একটা হাসি দিলেন। আমি তো শেষ! ড্যাবড্যাব করে উনার হাসির দিকে তাকাতেই উনার হাসি মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর সুরে বললো,

‘এভাবে দেখার কি আছে?’

মনে মনে ভীষণ করে বকা দিলাম। কোনো উত্তর না দিয়েই মাথা নিচু করে থাকলাম। আমি অন্যসময় প্রচুর কথা বলতে পারলেও এই লোকটার বেলায় চুপচাপ হয়ে যায়। উহু সবসময় না। যখন টেক্সট করি তখন নিজের মতো যতো আজাইরা প্যাচাল আছে সব বলি কিন্তু কলে মেপে মেপে কথা বলি। সেখানে লোকটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই আমার ভয়ে গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে কাচুমাচু করে একপাশে দাঁড়াতেই উনি গলা ছেড়ে পেছনের ছেলে গুলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘দোস্ত তোরা ঘুরে আয়!’

উনার ফ্রেন্ডরা মাথা নাড়িয়ে বাইক নিয়ে ছুটে গেলো। উনি আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললেন, ‘চলেন!’

আমি চমকে উঠে গড়গড় করে বললাম, ‘কোথায় যাবো? আমি কোথাও যাবো নাহ। ক্লাস আছে আমার। গেলাম!’

উল্টো ঘুরে চলে আসতে নিলে উনি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ টেনে ধরলেন। আমার মুখটা নিমিষেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো৷ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই বললেন, ‘ক্লাস করে উদ্ধার করেছেন আমাকে! এখন আমার সাথে চলুন। এটা কিন্তু ইনবক্স না যে আমার হাত এসে আপনাকে থা’প্পড় দিতে পারবে নাহ!’

আমার মুখে পুরোপুরি আঠা লাগিয়ে বন্ধ করে দিলাম। উনি আমার থেকে একটু খানি দূরত্ব রেখে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমাদের কলেজের পাশের ছোট্ট একটা রাস্তা আছে। ওখানে শুধু রিক্সা, সিএনজির চলাচল। উনি আমার সাথে পা মিলিয়ে সেই ছোট্ট রাস্তাতেই হাঁটা লাগালেন। আমি আড়চোখে একবার, দুবার করে কয়েকবার তাকালাম। লোকটা আমার প্রিয় রঙের শার্ট পড়েই এসেছে। আচ্ছা লোকটা একটু বেশিই সুন্দর নাকি! কথাটা মনে হতেই ফট করে আশে পাশে তাকালাম। কয়েকটা মেয়ে সরাসরিই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। বিশেষ করে আমার পাশে হাঁটতে থাকা নিবৃতের দিকে। হুট করেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাতেই দিন দুনিয়া ভুলে ছ্যাত করে উঠে বললাম,

‘আপনাকে আসতে কে বলেছে হ্যাঁ? আর এসেছেন ভালো কথা! এতো সাজগোজ করে কে আসতে বলছে? মাস্ক পড়েননি কেনো?’

এটুকু বলতেই উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মাথার তা’র কি আবার খুলে গেছে? এমনিই বলি আপনার মাথায় সমস্যা আছে!’

আমি ফোঁস করে উঠলাম। উনি আমার ব্যাগ টেনে ধরে হাঁটতে লাগলেন। আমি ফুঁসতে ফুঁসতেই হাঁটতে থাকলাম। উনি বুকপকেট থেকে কৃষ্ণচূড়া নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘আপনার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া!’

আমি হাত বাড়িয়ে ফুল নিলাম। প্রসন্ন চিত্তে হেঁসে উনার দিকে তাকালাম। লোকটা বুঝি আমার পছন্দ-অপছন্দও এতো মনে রাখে! কই কখনো তো বুঝতে দেয় না! আমি উনার শার্টের এক কোণা চেপে ধরতেই উনি তাকালেন আমার দিকে। আমি বায়না করার স্বরে বললাম, ‘এটা হিজাবের ওপর সুন্দর করে গুঁজে দেন!’

‘আমি! আমি এসব পারি না। এনে দিয়েছি নিজে গুঁজে নেন!’

‘দেন না!’

উনি আর কথা বাড়ালেন না। নিঃশব্দে হিজাবের পিন দিয়ে সুন্দর করে গুঁজে দিলেন। আমি ঠোঁট কামড়ে হাসলাম। আশে পাশে অনেক বাগানবিলাসের গাছ আছে। আমি নিঃশব্দেই হাঁটছিলাম আর চারপাশ দেখছিলাম। ছোট রাস্তা পেড়িয়েই বড় রাস্তার মোড়। ভীষণ ভীড়ভাট্টা পেরিয়ে তবেই এখান থেকে যেতে হবে। আমি একবার শুধু নিবৃতের মুখের দিকে তাকালাম। উনি নিজের ফোনটা পকেটে পুড়ে নিয়ে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। ভীড় ঠেলে সুন্দর করেই আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসলেন। খেয়াল করলাম এতো ভীড়ের মাঝেও কারোর সাথে মোটেও ধাক্কা লাগেনি আমার। সবার থেকে আগলে নিয়েই খুব সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে নিবৃত। রোদের ঝাপ্টায় বেশ গরম লাগছিলো। গলাটাও বেশ শুকিয়ে গেছে। উনি হুট করেই আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কোথায় যেনো গেলেন। গরমের তাপে আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। মিনিট খানেক ঘুরতেই উনি ছুটে এলেন। হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে নিজের ফোনে মন দিলেন। মুখে কিছুই বললেন নাহ। আমি নিঃশব্দে হেঁসে পানি পান করলাম৷ দুজনে চুপচাপ হেঁটে ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। বরাবরই ফুলের ওপর আমার অগাধ দুর্বলতা। সেই দুর্বলতা থেকেই পা দুটো আর বাড়াতে মন চাইলো নাহ। নিবৃত নিজেও এগোলেন নাহ। ফুলের দোকান থেকে কতগুলো গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন। কোলাহল পেড়িয়ে দুজনেই লেকের পাড়ে বসলাম। আইসক্রিম নিয়ে ধরিয়ে দিলেন হাতে। জোরেই বললেন,

‘বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়েই বিপদে পড়েছি। আইসক্রিম, চকলেট, হাওয়াই মিঠাই দিয়েই আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।’

আমি চোখ বড় বড় করে তাকাতেই উনি হিজাবের ওপর এলোমেলো হয়ে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া ঠিক করে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘তবুও আমার এই বাচ্চা মেয়ের প্রেমই ভালো। কথায় কথায় ধমক দেওয়া যায়। বাচ্চা মেয়েটা ভয়ে কাচুমাচু করে যখন কথা বলে তখন আমার ভীষণ মজা লাগে। এই যে এখন কৃষ্ণচূড়া গুঁজে বসে আছে! বাচ্চা মেয়েটা কি জানে তাকে কি পরিমাণ স্নিগ্ধ লাগছে!’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। উনি শব্দ করে হেঁসে উঠলেন। এই প্রথম তাকে এভাবে হাসতে দেখে আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাকালাম। উনি এক হাত বুকের বাম পাশে রেখে ঠোঁট কামড়ে বললেন,

‘এভাবে তাকাবেন না কৃষ্ণচূড়া। আমার এখানে লাগে! আপনার এই দৃষ্টিতে আমার ভেতর যে তোলপাড় করে দেয় এটা কি বোঝেন? বুঝবেন কেমন করে? আপনি তো বাচ্চা মেয়ে। আমার হৃদয়ের ব্যাথা আপনি আর বুঝবেন কেমন করে! এই যে মিস কৃষ্ণচূড়া আপনি এতো মায়ায় বাঁধেন কেমন করে?’

প্রথম বারের মতো উনার মুখে প্রেমময় বাক্য শুনে আমি স্তব্ধ। আমি বুঝি লোকটা কি ভীষণ ভালোবাসে আমাকে কিন্তু আজ অব্দি কখনোই ভালোবাসি বলেনি আমাকে। তবে হাজার বার হাজার ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে তার ভালোবাসার গভীরতা। আজকের এই প্রেমময় নিবৃত আমার কাছে ভীষণ নতুন। একদমই ভীষণ! আমি কোনো কথা ছাড়াই হুট করেই উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনার বুকে মাথা রেখে শুনতে থাকলাম একেকটা বিট! আহা শান্তি।

সমাপ্ত..

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-৩৬

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৩৬

“নয়না চোখ বন্ধ রেখেই জিয়ানের শার্ট খামচে ধরলো।
“জিয়ান দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে আসলো৷
” নয়না এখনো চোখ খুলেনি। হৃদযন্ত্রে ধুকপুক আওয়াজ হচ্ছে ।
“এই যে ম্যাডাম চোখ খুলে একবার দৃষ্টি স্থীর করুন৷ সুনয়না তোমার মনকর্ষণ করা আঁখি পল্লব মেলে দাও।
” নয়না পিটপিট করে চোখ খুললো,পূর্ণ চাঁদের আলোতে জিয়ানের চেহারা স্পষ্ট হলো নয়নার দৃষ্টিতে৷ নয়না জোড়ে চিৎকার করলো।
জিয়ান নয়নার মুখের উপর হাত রেখে ফিসফিস করে, বলে কেস খাওয়াতো চাচ্ছো কেনো বৌ!কই তোমার জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পারি দিয়ে আসলাম কিসমিস খাওয়াবা তা’না সোজা কেস খাওয়ানোর ধান্দা?
“নয়না কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু জিয়ান নয়নার মুখ চেপে ধরার কারনে কথা বের হচ্ছে না।
” শোনো বৌ ঝগড়া হ্যাসবেন্ড ওয়াইফের পার্সোনাল ইস্যু সো সেটা পার্সোনালি মিটমাট করে নেই। যদি রাজি থাকো আলতো করে আমার হাতে কামড়ে দাও তোমার মুখ খুলে দিচ্ছি। আর রাজি না থাকলে এভাবে তুলি নিয়ে যাবো তোমাকে।
“নয়না জিয়ানের হাতে দাঁত বসিয়ে বেশ জোড়ে কামড় বসালো কিন্তু কাজ কিছুই হলো না৷ কারন রেজা চৌধুরী কি এতোই বোকা নাকি! হাতের তালুতে কেউ জোড়ে কামড় বসাতে পারে নাকি।
” জিয়ান নয়নাকে কোল থেকে নামি দিলো৷
“নয়নার শরীরে ওড়না নেই সেদিকে তার খেয়াল নেই। কোমড়ে হাত রেখে বলে,আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে কোলে তোলার?
” স্যরি। তোমাকে কোলে তুলে ভুল করেছি তোমাকে তো মাথায় তোলা দরকার ছিলো জানেমান৷
“চুপ একদম চুপ স্যরি! আপনার স্যরির আচার বানিয়ে খিচুড়ির সাথে খেয়ে ফেলুন৷ সুনয়না তালুকদারের কারো সস্তা স্যরি চাইনা৷
” তুমি চাইলে আমি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী স্যরি দিতে পারি।
“ওহহহ আচ্ছা তো কোথায় আপনার দামি স্যরি?
” তারজন্য তোমাকে আমার কাছাকাছি আসতে হবে, চোখে চোখ রেখে একে অপরের বাহুতে অবস্থান করতে হবে,এরপর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে স্যরি বলবো। ব্যাস পৃথিবীর সবচেয়ে দামী স্যরি হয়ে যাবে৷
“ছিহহহহ লুচু লোক, অসভ্য লোক মেয়েদের ইজ্জত লুট করার ভালোই ট্রেনিং জানেন দেখি! তা আজ পর্যন্ত কতজনকে এরকম দামী স্যরি দিয়েছেন?
” তোমার কসম বৌ এই স্যরি এই মূহুর্তে আবিস্কার হয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য। এখনো এই অধম এই স্যরি আর কাউকে নিবেদন করেনি।
“প্লেন ড্রাইভারের বাচ্চা,ধোঁকা বাজ, ইতর,লুচ্চা, লাফাঙ্গা। একদম কথায় কথায় বৌ বৌ করবেন না। আমি পিউর সিঙ্গেল।তবে আগামীকাল বিবাহিতা হয়ে যাবো৷ সো দশ হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়ান। আপনার মত ধোঁকাবাজ প্লেন ড্রাইভার আমার দরকার নেই৷
” জিয়ান নয়নার হাতে টান দিয়ে একদম নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসলো,নয়নার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বলে,তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার জীবনসঙ্গিনী, আমার সুখ, দুঃখের চিরসাথী। আমাকে তুমি এজন্মে তোমার থেকে আর আলাদা করতে পারবে না। আমি মানেই তুমি তোমার অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই আমি। আমি শুধুমাত্র তোমার প্লেন ড্রাইভার। ক্যাপ্টেন রেজা চৌধুরী তা স্বীকার করছে।
“জিয়ান নয়নার এতোটা কাছে যে,নয়নার মুখে জিয়ানের গরম নিশ্বাস আছড়ে পরছে,এলোমেলো লাগছে নয়নার, হৃদয়ে কেমন তুফান বইছে! গলা শুকিয়ে আসছে। হার্টবিট ফাস্ট হচ্ছে। নয়না দু’কদম সরে এসে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো।নিজেকে কিছুটা সহজ করার চেষ্টা করছে। মনে মনে বলে,একদম গলে যাস না নয়ন৷ ভুলে যাস না এ’কদিন সে কি কি করেছে। নয়না নিজের বুকের বামপাশে হাত রেখে নিজের হৃদয়ের উথাল-পাথাল থামানোর চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি হৃদপিণ্ড বাহিরে চলে আসবে!
” জিয়ান নয়নার পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল,আমি তোমাকে ঠকাইনি নয়না তুমি ভুল বুঝেছো আমাকে। যাস্ট একটা কনফিউশান ক্লিয়ার করলেই তুমি বুঝে যাবে।
“নয়নার অবচেতন মন মাত্র আন্দাজ করলো তার সাথে ওড়না নেই। মূহুর্তেই নিজের হাত দুটো জড়িয়ে নিলো। ইতস্তত বোধ করতে লাগলো।
“জিয়ান নয়নার আরো খানিকটা কাছে এসে নয়নার হাত ধরে বলে,তোমার সব লজ্জার মালিক এখন আমি। আমার আর তোমার মাঝে কোন লাজ নেই। তুমি কি জানোনা আমরা আমাদের পোষাক! তোমার সব রুপ আমার জন্য উন্মুক্ত।বলেই নয়নাকে জড়িয়ে ধরলো, নয়নার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।জিয়ান নয়নার অতিরক্তি কাছে আসলেই নয়নার এই সমস্যা দেখা দেয়। জিয়ান নয়নাকে নিজের বক্ষ থেকে সরিয়ে বলে,কি হয়েছে তোমার?এমন করছো কেন পাখি? আমাকে বলো কোথায় কষ্ট হচ্ছে। নয়না কিছুই বলতে পারছে না। নয়নার প্যানিক এট্যাক হয়েছে৷ তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো সেই রাতের দৃশ্যগুলো। ঝাপসা হয়ে আসছে নয়নার চারপাশ।
” জিয়ান বেকুল হয়ে পরলো প্রেয়সী এই অবস্থা দেখে।রাত তখন সারে তিনটা। জিয়ান অনিকেতকে কল করলো,রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না৷ কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে নয়নাকে নিয়ে দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে পরলো৷ততক্ষণে নয়না বেহুশ। বিয়ে বাড়ি অনেক আত্মীয় স্বজনরা এসেছে তাই বাড়ি ভর্তি মানুষ। জিয়ান নয়নাকে নিজের মধ্যে জড়িয়ে নিলো।লোকটা চলে যেতেই নয়নাকে কোলে তুলে আবার জাহানারা বেগমের পাশে শুয়ে দিলো,খানিকক্ষ তাকিয়ে রইলো নয়নার দিকে,আবছা আলোতে মেয়াটাকে আরো স্নিগ্ধ লাগছে! নয়নার কপালে চুমু দিয়ে বের হয়ে আসার সময় দরজা আলতো হাতে চাপিয়ে দিয়ে আসলো৷ নিচে আসতেই ঘটলো এক বিপত্তি। হঠাৎ করে পেছন থেকে একজন জিয়ানকে ডেকে বলে,এই ছেলে কে তুমি? তোমাকে তো এর আগে দেখিনি কখনো?
“জিয়ান শুকনো ঢোক গিলে পকেট থেকে মাক্স বের করে পরে নিলো,এরপর সামনে ফিরে দেখে মধ্য বয়স্ক একজন পুরুষ। জিয়ান নিজেকে ধাতস্ত করে বলে,আমি ডেকোরেশনের লোক।
“লোকটা মেবাইলের আলো জ্বালাচ্ছে এই সুযোগ জিয়ান ফুড়ুৎ।
” আতিফ সাহেব সামনে টচ ধরতেই দেখে সামনে কেউ নেই! সে ভীত হলো! মনে মনে ভাবলাম হয়ত জ্বিন ভুত তাই দ্রুত প্রস্থান করলো৷
🌿মেহনুর খেতে বসেছে
“মিতা বেগম মেহনূরের পাশে বসে যত্ন করে খাবার তুলে দিচ্ছে। জানিস তুই একদম তোর মায়ের মত হয়েছিস৷ সেই চোখ সেই নাক।
” মেহনূরের হাতের লোকমটা আর মুখে উঠলো না৷ ঠুকরে কেঁদে উঠলো মেহনূর।
“মিতা বেগম উঠে এসে নয়নার মাথা তার বুকে চেপে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,চিরজীবন কেউ বেঁচে থাকে না মা৷ তোর এক মা চলে গেছে তাতে কি আমি তো আছি। জানিস সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো এতোকিছু হয়ে গেছে আমার বোনের মত ফ্রেন্ডের সাথে আমি তা জানতেও পারলাম না। তার শেষ সময় তাকে একবার দেখতে পারলাম না৷
” আম্মি আম্মু বারবার তোমাদের কথা বলছিলো কিন্তু আমরা কোনভাবে তোমাদের কন্টাক্ট করতে পারিনি৷
“লাস্ট পাঁচটা বছর তোর মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তোর বাবা পছন্দ করতেন না আমাদের দু’জনের সখ্যতা৷
” বাবা ‘ এই শব্দটা এখন হৃদয়ে কাটার মত বিঁধে। আম্মু যখন মৃত্যুর মুখে তখন সে তার নতুন জীবন সাজাতে ব্যস্ত৷ আমি নিজের ছোট বিজনেস আর চাকরির বেতন দিয়ে লড়ে গেছি আম্মুর জন্য। একসপ্তাহ আগে আম্মুর একটা পুরোনো ডায়েরি খুঁজে পাই সেখানেই তোমার ডিটেইলস পেয়েছি আম্মি।অশান্ত মনটাকে শান্ত করার জন্য ছুটে এসেছি তোমার কাছে৷
“মিতা বেগম মেহনূরে কপালে চুমু দিয়ে বলে,একদম মন খারাপ করবি আমি আছি তোর জন্য। জানিস রেজার বিয়ের ইনভিটেশন দেয়ার জন্য অনেক বার ট্রাই করেও কন্টাক্ট করতে পারিনি৷
” রেজার বিয়ে!
“হ্যা রেজার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। মেয়েটা দারুণ দেখতে তবে বয়স একটু কম। মানিয়ে নিতে পারলেই হয়।
” মেহনুরের গলা যেনো কেউ চেপে ধরেছে সেতো এই আশা নিয়ে এসেছিলো তার মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করবে রেজাকে বিয়ে করে। কিন্তু এটা কি হলো!
#চলবে