কবরস্থানে একটা করবকে সম্মান জানাচ্ছে মাহফুজ চৌধুরী ও তার পরিবার।
আজ ৫ ই আগস্ট। প্রতিবছর এই দিনে সম্মানিত অনেক ব্যক্তি এসে সম্মান জানায় তবে গত দুই বছর ধরে তেমন কেউ আসে না। শুধু আসে মন্ত্রী ও তার পরিবার।
সকলেই খুব ভক্তির সাথে সম্মান জানাচ্ছে। হঠাৎই বৃষ্টি নামলো। তারপরও সবাই নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে রইলো।
এমন অবস্থা দেখে একটি মেয়ে পিছে ঘুরলো। সাথে সাথে কিছু বডিগার্ড ছাতা নিয়ে এলো।
কালো হুডিসহ মাস্ক পড়া সেই মেয়েটি দুটি ছাতা হাতে নিলো।একটি মন্ত্রীর মাথার ওপর ধরলো এবং অপরটি ছাতাটি ইশারা করে মাহির চৌধুরী অর্থাৎ মন্ত্রীর একমাত্র ছেলেকে ধরতে বললো।মাহির ছাতাটা নিয়ে তার ও তার মায়ের মাথায় উপর ধরলো।এরই মাঝে সম্মান জানানো শেষ হলো। কিছু লোক গাড়ি থেকে ফুল আনতে গেল। তাড়াতাড়ির জন্য ফুল গাড়িতে রেখে চলে এসেছিল।
মাহফুজ চৌধুরী ছাতাটি নিয়ে নিজের ও তার স্ত্রীর মাথায় ধরলো। মাহির একাই ছাতা নিয়ে দাঁড়ালো।
মেয়েটির অ্যাসিস্ট্যান্ট দৌঁড়ে এসে তার ওপর ছাতা ধরলো।কিন্তু মেয়েটি বাকিদের উপর ছাতা ধরতে বললো।
মূলত আজ বৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না তাই ছাতার সংকট।
মাহফুজ চৌধুরী আস্তে ছেলেকে ডাক দিলেন, “তাশরিফ” ( মাহিরের ডাকনাম)
মাহির: জ্বী বাবা ।
মাহফুজ চৌধুরী আস্তে করে বললেন,” তুমি একাই দাঁড়িয়ে আছো। ছাতাটা মিস সিক্রেট এর মাথার উপর ধরো।”
মাহিরও আস্তে বললো যাতে সাংবাদিকরা না শুনে, ” বাবা আমি যদি ছাতাটা ওর মাথায় ধরি তবে সাংবাদিকরা এটাকে তালকে তিল বানাবে। ”
মাহফুজ চৌধুরী : তুমি ছাতা না ধরলেও বানাবে।
মিস সিক্রেট মন খারাপ করে বললো,”বাদ দেন তো আঙ্কেল। ”
কথা না বাড়িয়ে মাহফুজ চৌধুরী কবরে ফুল দিয়ে এলেন। কবরটি একটি মেয়ের কবর।
মেয়েটির নাম তৃষিতা খান সুমি।
মাহফুজ চৌধুরী সকলকে তাড়া দিয়ে বললেন,” সবাই তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে।”
সবাই চলে যাচ্ছে শুধু দাঁড়িয়ে আছে কালো হুডি পড়া মেয়েটি অর্থাৎ মিস সিক্রেট ও তার এসিস্ট্যান্ট।
মাহফুজ চৌধুরী : কি হলো! তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তাড়াতাড়ি আসো। এমনিতেই কাক ভেজা হয়ে গেছো।
মিস সিক্রেট :আঙ্কেল আপনি যান। আমি একটু পর যাবো।
মাহফুজ চৌধুরী : আচ্ছা তবে তাড়াতাড়ি এসো।
মিস সিক্রেট মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই সবাই রওনা দিলো।
মিস সিক্রেট নিচে বসে পড়লো। ইরফান মিস সিক্রেটের গাড়ি থেকে ছাতা আনতে গেলো।
মিস সিক্রেট কান্না করতে করতে বললো,” কি দোষ ছিল আমার! শুধু বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিলাম তার প্রতিদানে এত অপমান !
আপু, আপু। দেখো। আজও ১০ বছর আগের সেই দিনের মতো বৃষ্টি হচ্ছে। খুব মিস করি আপু।কেন চলে গেলে এভাবে! “( আকাশের দিকে তাকিয়ে)
ইরফান এসে ছাতা ধরলো।
চলবে…
#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৪২
বাস যখন যাত্রাবাড়ী পৌঁছেছে রাত চারটা বাজে। নয়না গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জিয়ান আগেই কল করে ড্রাইভারকে আসতে বলেছিলো৷ জিয়ান নয়নাকে কোলে নিয়ে গাড়ী থেকে নামলো।ড্রাইভার কে বলল ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়িতে রাখতে৷ জিয়ান নয়নাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বসলো৷ নয়নার ঘুম ভেঙে গেছে ততক্ষণে, নয়না সরে এসে বলে সারাদিন আপনি এমন চিপকে থাকলে আমার অস্বস্তি হয় দূরে সরে বসুন৷
“জিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,আহা গো ম্যাডাম যখন কোলে করে নিয়ে আসলাম গাড়ি থেকে তখন মনে ছিলো না?”
“আমি কি বলেছি আমাকে কোলে নিতে! ওটাতো আপনার স্বভাব সুযোগ পেলেই চিপকে যান। চিপকু ড্রাইভার ।”
“ড্রাইভার নট, ক্যাপ্টেন রেজা চৌধুরী।”
” ওই একি পাইলট আর ড্রাইভারের মধ্যে আর তেমন কি পার্থক্য!”
“পার্থক্য নেই?”
” নাহহ নেই। আপনি আকাশে ড্রাইভিং করেন তারা রাস্তায় ড্রাইভ করে।”
“এতো ঝগড়ুটে কেন তুমি!”
” আমি ঝগড়ুটে?ঝগড়া তো করতেই পারি না আমি।”
“পারো না?”
‘চুপ করুন আমি ঘুমাবো। বলেই নয়না চোখ বন্ধ করে নিলো।”
“জিয়ান নিজেও গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর ট্রাই করছে।”
“পাঁচ মিনিট ও যেতে পারেনি নয়না ঘুমিয়ে ঢলে পরলো জিয়ানের উপর।”
জিয়ান নয়ার মাথা নিজের কাঁধে নিলো সযত্নে।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। বাসার কাউকে জানানো হয়নি তাদের ফেরার কথা। একবার ভাবলো কল করবে, পরক্ষণেই ঘড়ির টাইম দেখে ভাবলো কাউকে ঘুমে ডিস্টার্ব করবে না৷
****
গাড়ি চৌধুরী ম্যানশনে এসে থামলো। জিয়ান নয়নার মাথা আলতো হাতে সিটের উপর রাখলো। এরপর কোমল কন্ঠে ডাকলো, এই শুনছো উঠো। দু’বার ডাকার পরেও নয়নার মধ্যে কোন হেলদোল নেই৷
জিয়ান একটু জোরে বলল,”আর একবার ডাকবো উঠলে উঠবা না উঠলে সোজা কোলে তুলে নিবো৷”
” নয়না মিটমিটিয়ে তাকালো৷ চুলগুলো হাত খোপা করে নিলো।ওড়নাটা সুন্দর করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে,আমার লজ্জা করছে।”
“আহাগো লাজুকলতা। চোখ বন্ধ করে আমার পিছু পিছু চলে আসো বৌ।”
“এভাবে কেউ শ্বশুর বাড়ি আসে?”
“তো কিভাবে আসে মিসেস চৌধুরী?”
” রিচুয়েল আছে তো।”
“আমার বৌ আমার সম্পদ রিচুয়েল কোন খেতের মুলা!”
” তবুও কেমন কেমন যেনো লাগছে।”
“বুঝেছি তুমি চাইছো আমি তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে যাই।”
“নয়না মাথা নাড়িয়ে না সূচক মন্তব্য জানালো৷”
“জিয়ান নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,হাতে হাত রাখো আর এগিয়ে চলো আমার পথে পথ মিলিয়ে।”
” নয়না হাত বাড়িয়ে দিলো৷”
“মনে রেখো এই হাত কিন্তু এজন্মে আর ছাড়তে পারবে না।”
“নয়না হাত সরিয়ে নিতে চাইলো৷”
“ততক্ষণে জিয়ানের হাতে আবদ্ধ হয়ে আটকে পরেছে নয়নার হাত। জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,আমি যখন হাত ধরেছি এ হাত ছাড়ানোর শক্তি, সাহস কোনটাই তোমার নেই। এবার পা মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলো৷”
” নয়না গুটিগুটি পায়ে চৌধুরী ম্যানশনে প্রবেশ করলো৷
“জাহানারা বেগম ফজরের নামাজ পরে কিচেন এসেছিলেন চা বানাতে পুরো বাড়ির সবাই তখন ঘুমে।”
নয়না জিয়ানের হাত আঁকড়ে ধরে বলে,”আমার মনের মধ্যে কেমন জেনো করছে?”
” কি হয়েছে সুনয়না? ঠিক আছো তুমি?”
“নয়না কিছু বলার আগেই জাহানারা বেগম কিচেন থেকে বের হয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,জিয়ান তুই!”
” জিয়ান বলে,হ্যা আম্মু এসেছি দু’দিন হলো। এবার ফ্লাইট ল্যান্ড করেছিলো চট্রগ্রামে ভাবলাম ওখানেই যখন নেমেছি সুনয়নাকে সাথে করে নিয়ে ফিরি৷”
“জাহানারা বেগম এগিয়ে এসে নয়নার মাথায় হাত রেখে বল,একদম ভালো কাজ করেছিস৷ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হ আমি খাবার পাঠাচ্ছি খেয়ে রেস্ট নিবি৷ আমার বৌমায়ের কোন কষ্ট হয়নি তো?ঠিকঠাক মত নিয়ে এসেছিস তো? তোমাকে কষ্ট দেয়নি মা?”
” নয়না না সূচক মাথা নাড়ালো।”
“যাও নিজের রুমে যাও। এটা তোমারই বাসা এতো ইতস্তত বোধ করতে হবে না।”
” নয়না সামনে এগোতে নিল।
জাহানারা বেগম বললেন, “একটু দাঁড়াও নতুন বৌ বাড়িতে এসেছে তাকে মিষ্টিমুখ করাতে হবে তো৷ তুমি দাঁড়াও আমি ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে আসছি।”
“নয়না আর জিয়ান দাঁড়িয়ে রইলো৷ জাহানারা বেগম মিষ্টি আনতে গেলো৷ জিয়ান বলে,এই যে মিসেস বাটার মাশরুম এই বাড়িটা আপনার সো লজ্জা টজ্জা পাওয়ার দরকার নেই।”
“নয়না নিম্ন স্বরে বলে,মিস্টার প্লেন ড্রাইভার আপনার ডুপ্লিকেট ভার্সন কই? আসলেই আছে তো নাকি মিথ্যে বলেছেন।”
“সে হলো বাউণ্ডুলে ছেলে এই ভোরে তার দর্শন পাবে না৷ বারোটার পরে তোমাকে তার দর্শন করিয়ে দেবো।*
“জাহানারা বেগম কাটা চামচে মিষ্টি তুলে,নয়নাকে খাইয়ে দিলো,সেই মিষ্টির বাকি অর্ধেক জিয়ানকে খাইয়ে দিয়ে বলল, “সারাজীবন নিজেদের সুখ,দুঃখ এভাবে ভাগ করে নিয়ে একে অপরের পরিপূরক হও৷ মনে রেখো তুমি আমার রেজার অর্ধাঙ্গিনী। তুমি ছাড়া রেজা অপূর্ণ। জাহানারা বেগম নিজের গলায় থাকা চেইনটা খুলে নয়নাকে পরাতে নিলো।”
“নয়না বলল,না না এসবের দরকার নেই আন্টি৷”
“দরকার আছে তুমি আমাদের পরিবারের প্রথম পুত্র বধু তোমার সম্মানের দরকার অবশ্যই আছে।আর হ্যা আন্টি না আম্মি/আম্মু ডাকবে আমাকে৷ যাও রুমে যাও।”
” জিয়ান নয়নাকে নিজের রুমে নিয়ে আসলো৷
“নয়না রুমে ঢুকেই শুয়ে পরলো।
” জিয়ান তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে দিকে পা বাড়ালো, যেতে যেতে বলল,ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে তবেই ঘুম সো আমি না আসা পর্যন্ত জিরিয়ে নাও বেব৷”
“এই বেবি, বাবু, বেব এসব ছাড়া আর কোন ডাক নেই আপনার!”
“আছে তো, সুইটহার্ট, রাঙাবৌ, ময়নামতি, আদুরীনি, ডার্লিং, হানি আর আমার মোস্ট ফেবারিট বাটার মাশরুম বলেই চোখ টিপল৷”
“নয়না বিরবির করে কিছু বলল।
” বিরবির করতে থাকেন ম্যাডাম না খেয়ে ঘুমানো যাবে না৷ সো মনে মনে বকতে থাকুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসি ততক্ষণে।”
🌿
রাতে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো মেহনুর। তার মনের মধ্যে চলছে ইভিল প্ল্যান৷ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জিয়ানদের জিম রুমে এসে জিম করছে মেহনুর৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর ছয়টা বাজে সবে মাত্র! মেহনুর আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, মেহনুর শেখ কখনো নিজের জিনিস অন্য কাউকে শেয়ার করে না। যা আমার তা আমার। নিজের জিনিস নিজের কাছে ফেরাতে মেহনূর কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।মেহনুর যা চায় তা যেকোনো মূল্যে নিজের করেই ছাড়ে। মেহনুর পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে গ্লাসের সব পানি পান করে গ্লাসটা ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। সাথে সাথে ঝংকার তুলে গ্লাসটা ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে ছড়িয়ে পরলো৷ মেহনুর জিম রুম থেকে বের হয়ে গেস্ট রুমে চলে আসলো। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
🌿
লতা বেগম নীলাঞ্জনার পাশে বসে বলছেন,”তুই কেন রেজার মত ছেলেকে ছেড়ে দিলি! এমন ছেলে কেউ হাত ছাড়া করে? তোর বাপ চাচাও অপেক্ষা করেনি তুই চলে গিয়েছিস তারা নয়নাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে রেজার গলায়।”
“নীলাঞ্জনা বলল,আম্মু রেজা কিভাবে মেনে নিলো এই বিয়ে! ওর মতো ছেলেকে কেউ ফোর্স করে কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না কোন কিছু। আমি জানি ওকে। তাহলে দোষটা তো ওর ও আছে।”
“দোষ তোর তুই কেন ছাড়লি এমন ছেলেকে? চাঁদ নিজে তোর হাতে ধরা দিয়েছে আর তুই সেই চাঁদকে পায়ে ঠেলে দিয়েছিস! এখন বল কাল রাতে রেজা তোকে কোথা থেকে নিয়ে এসেছে?”
“নীলাঞ্জনা সবটা বলল৷ তারপর বলল,আম্মু আমি শিউর না ওটা জিয়ান নাকি জাহিন।”
“জাহিন আবার কে?”
“জিয়ানের জমজ ভাই। জিয়ান তো পাইলট এই সময় ও কিভাবে দেশে থাকবে? আমার এখন মনে হচ্ছে ও জাহিন ছিলো।”
“চুপ কর এই কথা আর মুখ দিয়ে বের করবি না। যদি রেজা না হয়েও থাকে তুই বলবি ওটা রেজা ছিলো। কাউকে নিজের না করতে পারলে কি হয়েছে সম্মান তো নষ্ট করতে পারবি৷ আমি যেটা বলছি তুই সেটাই বলবি সবার সামনে।”
“কিন্তু বড় আব্বু তো জানে জাহিন আর জিয়ান জমজ ভাই।”
#চলবে
প্লেনে যাওয়ার প্ল্যান থাকলেও শেষ মূহুর্তে জিয়ান আর নয়না বাসে ট্রাভেল করে, নাইট কোচ বেড সিস্টেম। নয়না প্রথমবার অপরিচিত কারো সাথে ট্রাভেলিং করছে। মানুষটা তো তারই, অপরিচিত কি করে হয়! আবার ভাবে,সে যদি এখন আমাকে হ’ত্যা করে গাড়ির নিচে ফেলে দেয় অথবা কারো কাছে বিক্রি করে দেয়!নিজের মনে মনে আকাশ কুসুম চিন্তা ভাবনায় মগ্ন নয়না৷
জিয়ান নয়নার কাছে এসে বলে,”তোমার চেহারায় এতো আতংক কিসের বেব? নয়নাকে নিজের কাছে এনে বলে,তুমি কি এনি চান্স আমাকে ভয় পাচ্ছো জান?”
“নয়না চোখ বাঁকিয়ে বলে,ভয় আর আপনাকে? সুনয়না তালুকদার কাউকে ভয় পায় না।”
“বিগ মিস্টেক মিসেস চৌধুরী আপনার পরিচয় সুনয়না চৌধুরী নট তালুকদার৷ বাবার বাড়িতে অনেক তালুকদারি করেছন এবার হ্যাসবেন্ডের নামের উপর রাজ করবেন।”
“আমাকে আপনি করে বললেই তো আর আপনার বয়স কমে যাবে না মিস্টার প্লেন ড্রাইভার?”
“এতো সুদর্শন একজন এয়ার ক্যাপ্টেন কে ড্রাইভার বলতে তোমার হৃদয় কাপলো না!”
“ড্রাইভারকে ড্রাইভার বলবো না তো কি বলবো! প্লেন ড্রাইভার, প্লেন ড্রাইভার, প্লেন ড্রাইভার।”
“জিয়ান নয়নার মুখ চেপে ধরলো নিজের হাত দিয়ে। এখন কিন্তু মোটেও ভালো হচ্ছে না বৌ। ঠোঁট আরেকবার নড়লেই ঠোঁট কিন্তু দখল করে নেবো আমার ঠোঁট দিয়ে৷ বাসর যদি গাড়িতে সারতে না চাও তাহলে ভুলভাল বকবে না৷”
“নয়না হেসে উঠলো। এই লোকের মুখে বাসর ছাড়া কি আর কোন শব্দ বের হয় না!”
“জিয়ান নয়নাকে নিজের কাঁধে মাথা রাখতে ইশারা করে৷”
“নয়না বলে,বয়েই গেছে আপনার কাঁধে মাথা রাখতে!আম্মু কই আমি আম্মুর কাছে যাবো।”
“তুমি বড় হবা কবে?”
” আমি কি ছোট নাকি?”
“তো কি? নাক টিপলে এখনো ম্যাঁ ম্যাঁ করো।”
“একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না৷”
“জিয়ান নয়নার আঙ্গুল ধরে বলে,তুই ছুঁলি যখন তোরি হলো এই মন।”
“আমি কিন্তু আপনাকে ভালো টালো বাসতে পারবো না।”
“ভালোবাসতে কে বলল? তুমি শুধু আমার ভালোবাসা সমাদরে গ্রহণ করলেই হবে রাঙাবৌ।”
“আমি কারো বৌ টৌ না৷”
“তাহলে তুমি কি?”
“ভবিষ্যত ডাক্টার সুনয়না তালুকদার।”
“জিয়ান নয়নার নাক টেনে বলে,বারবার তালুকদার তালুকদার করবা না তো। ভবিষ্যত ডাক্তার সুনয়না চৌধুরী। নামটার মধ্যে কেমন রাজকীয় ভাইব আছে তাই না বেব।”
“নয়না জিয়ানের কাঁধে মাথা রেখে বলে,জানেন একবার কি হয়েছে?”
“তুমি না জানালে কিভাবে জানবো?”
” আমি এক ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম।”
“কেনো?”
“সে আমাকে টিজ করেছিলো তাই৷ রাস্তা থেকে একটা পাথর উঠিয়ে সোজা ছেলেটার মাথায় মেরে দিয়েছি৷”
“বাহহ তুমি এতো সাহসী!”
“নয়না কনফিডেন্সের সাথে মিথ্যা বলে মনে মনে নিজেকে সাহস দিচ্ছে।”
“জানো আমার প্রপোজ একটা মেয়ে রিজেক্ট করে দিয়েছিলো বলে,তাকে পাহাড় থেকে ধা’ক্বা দিয়ে ফেলে দিয়েছি।”
” নয়না এবার কেঁদেই ফেলল। আমি আম্মুর কাছে যাবো।”
“জিয়ান নয়নার মুখে হাত রেখে বলে একদম চুপ। একটুও কান্নাকাটি করবে না। আর কথায় কথায় ম্যা ম্যা করার স্বভাব কবে যাবে তোমার! এমন আদর দেবো এরপর কথায় কথায় জামাই জামাই করবা৷আমি শুবো তুমি লক্ষী মেয়ের মত আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বা। ঠিক আছে?”
“কিসের ঠিক আছে!এটা তো জোর খাটানো বলে,এখানে ঠিক কি হলো?”
“বৌ আমার, জোরও আমার, ইচ্ছেও আমার সো চুপচাপ এসে বুকের উপর মাথা রাখো।
”
“নয়না মনে মনে বলে,ওটা বুক! নাকি আমাকে বশ করার তাবিজ! ওখানে মাথা রাখলেই আমার কেমন প্রেম প্রেম পায়৷ তখন নিজেকে কেমন উপন্যাসের হিরোইন মনে হয়৷ এই লোক কেনো যে প্লেন ড্রাইভিং ছেড়ে দেশে আসলো! নিশ্চিত আমাকে বশ করতেই এসেছে। নয়না বি কেয়ারফুল কয়দিন পর তোর বয়স সতেরো হয়ে যাবে এতো সহজে বশ হোস না বুদ্বু রানী।”
“তা তোমার জ্বিনের সাথে আলাপ আলোচনা আর কতক্ষণ চলবে?”
“নয়না এক ঝটকায় জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে,জ্বিন! কোথায় জ্বিন? দোয়া দুরুদ পড়েন, জ্বিন তাড়ান প্লিজ আমার ভয় করছে?”
“জিয়ান নয়নার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,যেভাবে আছো ঠিক এভাবেই জড়িয়ে রাখো আমাকে নয়ত জ্বিন চলে আসবে। আর শোন ডিয়ার ওয়াইফি আমি আটদিন আছি আটটা দিন আমার সাথে ঠিক এভাবে চিপকে থাকবে। আমি এক মূহুর্তের জন্য ও তোমাকে মিস করতে চাই না৷ প্রতিটা মূহুর্তে তোমার স্পর্শ অনুভব করতে চাই, বলেই নয়নার কানের লতিতে আলতে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।”
জিয়ান ভাবছে যেখানে জীবন শেষ হয়েছে সেখান থেকে এতো সুন্দর জীবন উপহার পাবো কোনদিন ভাবিনি। মানুষ বলে না আমারা যা প্ল্যান করি তারচেয়ে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য যা প্ল্যান করে রাখে তা সবচেয়ে উত্তম। তুমি আমার জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।
🌿
মিজান তালুকদার খোঁজ নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। আসলেই সেদিন জিয়ান এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে নীলাঞ্জনাকে?
“নীলাঞ্জনা বলল, বাবা আমি ভুল করে হিরে ছেড়ে কাঁচকে বেঁছে নিয়েছিলাম। কাঁচের আঘাতে খন্ড বিখন্ড হয়ে গেছে আমার দেহমন৷ বাবা জিয়ান যদি আমার কাছে ফিরতে চায় তোমরা বাঁধা হবে না তো?”
“মিজান তালুকদার ঠাটিয়ে এক চড় মারলো নীলাঞ্জনার গালে। লজ্জা লাগে না নিজের ছোট বোনের হাসবেন্ডের দিকে নজর দিতে!নিজের জীবন নষ্ট করে এখন আমার ফুলের মত মেয়েটার জীবন নষ্ট করার জন্য উতলা হয়ে গেছিস?” মিজান তালুকদার নীলাঞ্জনার গলা চেপে ধরে বলে,”মেরে ফেলবো তোকে আমি। তোর মত মেয়ে আমার দরকার নেই। দরকার পড়লে তোকে মে’রে জেল খাটবো।”
“সূচনা দরজায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করলো৷”
“লতা বেগম দৌড়ে এসে নীলাঞ্জনাকে মিজান তালুকদারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো৷ পাগল হয়ে গেছো তুমি! আমার মেয়েটাকে মেরে ফেললেই তো তোমাদের রাস্তা সাফ তাই না? আমি বেঁচে থাকতে তা কখনো হতে দেবো না৷”
“মিজান তালুকদার নীলাঞ্জনার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,তোর জন্য যদি সুনয়নার সংসার ভাঙ্গে আগে তোর মা’কে মারবো তারপর তোকে। মনে রাখিস।”
” লতা বেগম কিছু বলাবে তার আগেই মিজান তালুকদার বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন৷
🌿
অন্তর আনমনা হয়ে বসে আছে রাস্তার পাশের টং দোকানে। আজ জাহিনের সাথে সারাদিন কথা হয়নি ছেলেটা করতে কি চাইছে? অন্তর দোকানদারকে বলল, মামা এক কাপ কড়া লিকারের রং চা দাও তো।
“দোকানদার চায়ের কাপ অন্তরের দিকে বাড়িয়ে দিলো৷ হুট করে কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিলো।
“অন্তর রেগে বলে,সমস্যা কি আপনার? আমার জিনিসে হাত দেয়ার সাহস কি করে হলো?”
“তুষি কপাল কুঁচকে বলে,স্যরি ভাইয়া আমার অনেক বেশি চায়ের ক্রেভিং হচ্ছিলো তাই।”
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে টংয়ের দোকানে চা কোন ভদ্র মেয়ে খায় না।”
“একদম ঠিক কথা বলেছেন ভাইয়া আমি তো চরম লেভেলের অভদ্র। এই মাত্র সাতদিন আগে আমার ব্রেকআপ হলো, সে ব্রেকআপ করার আগে এটা বলেছিলো তাই দুই চারটা চড় দিয়ে অভদ্রতার প্রমাণ দিয়ে এসেছি৷” তুষি দোকানদারকে বলল,”মামা দাম কত?”
“দশ টাকা৷”
“তুষি বিশ টাকা দিয়ে বলে,এই ভাইয়াকে এককাপ দিয়েন৷”
“তুষি রিকশা ডেকে উঠে পরলো।”
” অন্তর বলে,এই মেয়ে নামো রিকশা থেকে৷”
“তুষি কানে হেডফোন গুঁজে বলে,মামা চলেন।”
” অন্তর মোবাইল বের করে জাহিন কে কল করে বলে,শা’লা তুই বাসা থেকে বের হ।”
🌿
অনিকেত দু’দিন ধরে বাসা থেকে বের হচ্ছে না৷ হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় লুকিয়ে আছে। সে কিছুতেই সায়নার সামনাসামনি হতে চায় না। অনিকেত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, তোর কপালে আসলে বৌ নেই বুঝলি অনিকেত সারাজীবন তুই সিঙ্গেল মরবি!
#চলবে
ঘরে ঢুকে আমি চমকে গেলাম। সকাল থেকে যে পরিস্থিতি ছিল তাতে আমার ঘর কেউ সাজাবে এটা আমি একেবারেই আশা করিনি। শুধু যে সাজানো তাই নয় অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়েছে। নিশ্চয়ই হাসিবের কাজ, এজন্যই তাহলে অনুষ্ঠানে আসতে দেরি হয়েছে অথচ দেরি হয়েছে বলে ওকে কত কথাই না শোনালাম। একবার কথা প্রসঙ্গে ওকে বলেছিলাম বেলি ফুল অনিমার খুব প্রিয়। পুরোটা ঘরে বেলি ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। ভালো লাগল দেখে।
তাকিয়ে দেখি অনিমা খাটের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। টুকটুকে বউ বলতে যা বোঝায় ওকে মোটেও সেরকম লাগছে নাঃ যদিও ওর পরনে লাল টুকটুকে বেনারসি গা ভর্তি গয়না, মাথায় জড়ির ওড়না। দেখে মনে হচ্ছে ওর ভীষণ রকম অস্বস্তি হচ্ছে। ডিসেম্বরের শীতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। যে ওকে এখানে বসিয়ে গেছে সে ফ্যানটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে যায়নি। আমার অসম্ভব বিরক্ত লাগলো। চারিদিকে তাকিয়ে ওর কোন ব্যাগ দেখতে পেলাম না। আমি নাজমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম
ওর ব্যাগ কোথায়, চেঞ্জ করবে কি দিয়ে?
ব্যাগ নিচে, সবাই খুলে দেখছে ভাবি কি কি নিয়ে এসেছে
আমি বলার মতন কিছু খুঁজে পেলাম না, বাধ্য হয়ে আলমারি খুলে ওর জন্য কেনা শাড়িটা বের করে নাজমা কে দিয়ে বললাম ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। ওরা বেরিয়ে গেলে আমিও গোসল করতে চলে গেলাম। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। যদিও আমাদের আমাদের দিক থেকে কোন আয়োজন ছিল না শুধু অনুষ্ঠানটাতে যাওয়া তবুও এত রকম ঝামেলা গেছে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়॥
প্রত্যেক অনুষ্ঠানেই বোধহয় এমন একজন মানুষ থাকে, যার মান ভাঙাতে ভাঙাতেই পুরো অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না॥ বড় ফুফুকে কেন আগে থেকে সবকিছু জানানো হয়নি তাই তিনি বেকে বসেছিলেন অনুষ্ঠানে থাকবেন না। এ কথা শুনে মা এবং রেহানা ফুপু খুব খুশি হলেও বাবার মাথায় হাত পড়েছে; তার মাতৃতুল্য বড় বোন অনুষ্ঠানে না থাকলে ছেলের বিয়ে কেমন করে হবে। বারবার ফোন করার পরও তিনি আসতে রাজি হচ্ছিলেন না অবশেষে বাবার ওখানে গিয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হয়েছে।
বাড়িতে ঢোকো মাত্রই বড় ফুপু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। অতিথিরা কে কোথায় থাকবে, কোথায় ঘুমাবে, কাদের জন্য কি রান্না হবে সেই সব কিছু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে কামাল ভাই তাঁর বউ তিন বাচ্চা নিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয় কামাল ভাইয়ের শাশুড়ি, তার দুই মেয়ে এবং দুজন কাজের লোকও এসেছে। বড় ফুপুর ভাষ্যমতে বিয়ের বাড়ি অনেক কাজকর্ম থাকবে ওরা সঙ্গে থাকলে উপকার হবে।যদিও তারা দুজন আসা মাত্রই মেহেদি লাগাতে বসে গেছে। কাজ যা করার তা ছোট ফুপু আর মা-ই করছে আর সঙ্গে আমাদের পুরনো কাজের মহিলা। বাড়ি ভর্তি লোকজন বেশিরভাগই এসেছে ঢাকার বাইরে থেকে আজ তারা এখানেই থাকবে। চাচাতো মামাতো ফুফাতো ভাই বোনদের মধ্যেই আমি সবার বড়। ভাই বোনেরা আনন্দে মেতে আছে সবাই কিন্তু দায়িত্ব নেবার মতন কেউ নেই।
বড় ফুফু আসায় একটু সুবিধা হবার কথা ছিল কিন্তু সেটা না হয়ে বরং উল্টোটা হচ্ছে, উনি সঙ্গে করে তার বেয়াইনকে নিয়ে এসেছেন তার আবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, কিছুক্ষণ পর পর খাবার দিতে হচ্ছে। বড় ফুপু রান্নাঘরে গিয়ে নানান রকমের খাবার তৈরি করার নির্দেশ দিচ্ছেন। যেগুলো ইতোমধ্যে রান্না হয়েছে সেগুলো কি করলে আরো ভালো হতে পারত তাই নিয়ে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। মা আগে থেকেই যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে আছে এসব দেখে সেটা চরম মাত্রায় পৌঁছালো।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি অন্যমনস্ক হয়ে থাকার। আজ আমার বিয়ে আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন আমার জীবনের চিরকালের জন্য আসবেই এই বোধটা মনের ভেতর আনার আপ্রান চেষ্টা করছি, কিছুতেই পারছি না। নানান রকমের দুশ্চিন্তা আমাকে পেয়ে বসছে॥ এরকম একটা পরিবেশে অনিমা কিকরে মানিয়ে নেবে এই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। আমি অন্যমনস্ক হয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম হঠাৎ করেই কেউ একজন পেছন থেকে খোঁচা দিয়ে বললো
ঘর সাজানোর কি ঠিক করলি?
পিছন ফিরে দেখলাম হাসিব। হাসিব আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। আমরা দু বছর একসঙ্গে একই কলেজে পড়েছি। এইচ এসসির পর হাসিব ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে আর আমি চিটাগং চলে গেছি। ও এখানেই শহীদুল্লাহ হলে থাকে। গতবার এসে ওর হলেই উঠেছিলাম। আমার আর অনিমার ব্যপারটা ও শুরু থেকেই সব জানে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল
কিরে লজ্জা পাইতেছিস নাকি?
আমি ম্লান হাসলাম, বললাম
আর ঘর সাজানো
ও ফিচেল হাসি হেসে বলল
তোদের না প্রেমের বিয়ে। তোদের আর ঘর সাজানোর কি দরকার? জঙ্গলে রাইখা আসলেও তোরা..
এই মুহূর্তে এইসব রসিকতা শোনার মতন মনের অবস্থা নেই। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
চুপ কর! কি সব ফালতু কথা বলছিস
তোরে দিয়া হবে না। আমি নাজমার সাথে কথা বলতেছি
যা ইচ্ছা কর। আমার কিছু ভালো লাগছেনা
কেন, কি হইছে?
আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে
ফার্স্ট নাইট নিয়ে সবারই টেনশন থাকে। ভেরী ন্যাচারাল। কোন সাজেশন লাগলে বল
ধুর! তোর সঙ্গে কথা বলাই বেকার
আমি বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে এলাম। বাড়ির ভেতর কেমন দম বন্ধ লাগছে। রাস্তায় কিছুক্ষণ এলোমেলো হাঁটলাম। কেবল আড়াইটা বাজে। আমাদের রওনা দেবার কথা সাড়ে সাতটায় এখনো অনেক সময় বাকি আছে। আচ্ছা, অনিমা কি করছে এখন, পার্লারে গেছে কি? একবার ওকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। ওর জন্য কোন উপহার কেনা হয়নি। চট করে একটা কিছু কিনে ফেললে কেমন হয়? কি কিনব বুঝতে পারছি না। টাকাও নেই বিশেষ। ওর জন্য অনেক কিছু কিনতে ইচ্ছা করছে। একটা সময় হয়তো আমার কাছে অনেক টাকা থাকবে, আমি চাইলেই ওকে অনেক কিছু দিতে পারব কিন্তু আজকের দিনটা তো আর ফিরে আসবেনা।
কথাটা মনে হতেই হঠাৎ ভীষণ হাসি পেল। এই ধরনের প্রতিজ্ঞা মনে হয় পৃথিবীর সব ছেলেরাই করে এবং একটা সময় যখন তাদের সামর্থ্য হয় তখন আর আলাদা করে এই কথাটা মনে থাকে না। এই কথাটা আমি বলছি অভিজ্ঞতা থেকে। আমার মনে আছে অষ্টাশির বন্যার সময় আমি খুব ছোট, স্কুলে পড়ি সে সময়ে বাবার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তখন আমাদের এই বাড়িটা ছিল না। আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। অবস্থা এমন ছিল যে বাড়ি ভাড়া দিতে পারতাম না। বাবার অনুরোধে মা তাঁর সমস্ত গহনা বিক্রি করে বাবাকে ব্যবসার জন্য দিয়েছিল। আজও মনে আছে বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিল যখন টাকা হবে মাকে আবার সেই সব গয়না গড়িয়ে দেবে। একসময় বাবার হাতে টাকা এসেছে, আমাদের নতুন বাড়ি করা হয়েছে কিন্তু আলাদা করে বাবা কখনোই মাকে আর সেই গয়নাগুলি গড়িয়ে দেয়নি। মা সংসারে টাকা বাচিয়ে আবার গয়না গড়িয়েছে কিন্তু বাবা তার কথা রাখেনি, কিংবা সেটা প্রয়োজনীয় বোধ করেনি অথবা মনেই রাখিনি।
আমার কেমন মন খারাপ লাগছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটে চলে গেলাম। কি কেনা যায় ওর জন্য বুঝতে পারছি না। ভালো কোন বই দেয়া যায়। এটা বোধহয় ঠিক হবে না। বিশেষ একটা কোন উপহার দিতে ইচ্ছা করছে। আমাদের দিক থেকে ওকে কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি একটা আংটি পর্যন্ত না। রানু ফুপু উপহার হিসেবে একজোড়া আংটি কিনেছে। বিয়ে পড়ানোর পর সেটা পরানো হবে আমাদেরকে। ব্যস অতটুকুই, আর কিছুই না। আমার কিছুই মন মতো হচ্ছে না। ওকে অসম্ভব অসম্ভব সুন্দর কিছু উপহার দিতে ইচ্ছা করছে অথচ আমার সামর্থ্য এত কম। নিজের অক্ষমতায় নিজের উপরই রাগ হলো ভীষণ।
বইয়ের মার্কেটে কতক্ষণ এলোমেলো ঘুরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এদিকটায় কয়েকটা বেকারি তারপর গহনার দোকান। চট করি একটা জিনিস খুব চোখে লেগে গেল। মনে হল এটা বোধহয় ওর জন্যই তৈরি। সে সময় রুপার দাম খুব কম ছিল মাত্র সাড়ে ৭০০ টাকা ভরি। একজোড়া নূপুর নিলাম। এক জোড়া বালা খুব পছন্দ হয়েছিল। বেশ পুরনো আমলের ডিজাইন কিন্তু টাকা না থাকাই নিতে পারলাম না।
বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যা পার করে। ভেবেছিলাম বাড়ির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হবে। ফিরে দেখলাম অবস্থা আগের চেয়ে আরো খারাপ। বড় ফুপু আর মায়ের মধ্যে বোধহয় এক প্রস্থ ঝামেলা হয়ে গেছে। দুজনের মুখই থমথমে। আমি পাত্তা না দিয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। অনিমাদের ওখান থেকে আমার জন্য পোশাক পাঠানোর কথা ছিল। আমি রাজি হইনি। মা আমাকে সঙ্গে দিয়ে শেরওয়ানি কিনতে যেতে চেয়েছিল সেটাও আমার ইচ্ছে করেনি। ছোট মামা একটু জোরাজুরি করার চেষ্টা করেছিল লাভ হয়নি। এর প কেউ আর মাকে বিশেষ একটা ঘাটায়নি। সবাই জানে আমি সবার কথাই শুনি তবে শেষমেষ যেটা আমার ইচ্ছে করে সেটাই করি।
আমি সাধারণ একটা পাঞ্জাবি পরেই অনুষ্ঠানে গেলাম। অনুষ্ঠান সাদামাটা ভাবে হলেও আয়োজন যথেষ্টই ভালো ছিল। ওদের পক্ষ থেকে আমি তেমন কোনো জাঁকজমক দেখতে পেলাম না। সবারই পরনে সাধারণ পোশাক। তাদের পক্ষ থেকে খুব বেশি লোকজনও আসেনি। নিকট আত্মীয় ছাড়া কাউকেই যেমন দেখতে পেলাম না। বাবা বিয়েতে কোন কিছু দিতে না পারলেও ১০০ জন লোক খাওয়াতে হবে এই কথাটা তাদেরকে জানাতেই মোটেও কুন্ঠা বোধ করেননি।
আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। ঢাকায় যেহেতু ওদের কেউ নেই অনুষ্ঠানের পর সমস্ত খাবার আমাদেরকে সঙ্গে করে দিয়ে দেয়া হলো। সেই সব খাবার নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা হুলুস্থুল বেধে গেল। মা বাবা আর বড় ফুপু সবাই তখনই খাবার প্যাকেট করে প্রতিবেশী এবং যে আত্মীয়দের নিমন্ত্রন করতে পারিনি তাদের পৌছে দেবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল। যাকে উপলক্ষ করে এত কিছু তার কথা বোধহয় কারো মনেই রইল না। সহায্য করার মত তেমন কেউ নেই তাই আমাকেও কাজে লাগে হাত লাগাতে হলো। অনিমাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না। বোধহয় ওকে আমার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।
আমি ঘরে যেতে পারলাম রাত বারোটারও পরে। এতক্ষণ পর্যন্ত বেচারী ওই ভাবেই বসেছিল। আমি ওকে নাজমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে গোসলে ঢুকলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করলাম। ঘরে পা রাখতেই চমকে গেলাম। লাল বেনারসি শাড়িতে যাকে টুকটুকে বউ মনে হয়নি আমার কেনা সাধারণ সুতি শাড়িতেই তাকে রাঙা বউ লাগছে। অনিমা খাটের উপর বসে ভেজা চুল ছড়িয়ে। বোধহয় শুকানোর চেষ্টা করছে। ওর যে এত সুন্দর আর লম্বা চুল আগে কখনো লক্ষ্য করিনি তো। আমি এগিয়ে এসো ওর পাশে বসলাম। বললাম
দাও আমি করে দিচ্ছি
ওর চুলগুলোতে হাত দিতেই মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এলো। কেমন বুনো ফুলের মতন একটা গন্ধ। এই গন্ধতেই পেয়েছিলাম যেদিন প্রথম ওকে দেখেছিলাম। আমি ওর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিলাম। এই গন্ধটা আমি আমার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই। গন্ধতো কৌটায় কিংবা বাক্সে করে নিয়ে যাওয়া যায় না, আমি বোধহয় আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। ও আচমকাই আমার দিকে ফিরে ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল। কমেক মুহূর্ত মাত্র। আমি বিস্ময়াবিভূত হয়ে কিছু বুঝে উঠবার আগেই ও মুখ নামিয়ে আমার বুকের মধ্যে মুখ গুজে বলল
থ্যাঙ্ক ইউ মুনির
কি জন্য?
এই যে আমার জন্য এত ঝামেলা করলে, এত কষ্ট করলে
তোমার জন্য করিনি
ও মুখ তুলে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। ওর আয়তাকার বিশাল চোখ গুলো কেমন ছলছল করছে। ও অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল
আমার জন্য না?
আমি দুই হাতের করতলে ওর মুখটা তুলে ধরে বললাম না তোমার জন্য না। যা করেছি সব নিজের জন্য। এই যে দুই হাতে তোমার মুখটা ধরে আছি, এই জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে আমি হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মরে যেতাম।
এক মুহূর্তে সব কেমন বদলে গেল। যে আমি ঠিক করেছিলাম আজ রাতে ওকে একটুও বিরক্ত করবো না, শুধু আমার মনের মধ্যে জমে থাকা সব কথা বলে ওকে বলবো, কিছুতেই নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারলাম না। ও এমন ভাবে আমার কাছে এলো, মনেই হলো না যে আমরা এই প্রথমবার গভীর সান্নিধ্যে এলাম। মনে হল যেন যুগ যুগ ধরে আমরা এভাবেই একে অন্যের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে ছিলাম।
রাত্রির শেষ প্রহরে যখন ও আমার বুকের সঙ্গে মিশে ছিল, আমি আস্তে আস্তে বললাম
সামনে আমাদের খুব খারাপ সময় আসবে অনিমা। আমাদের অনেক ধৈর্য রাখতে হবে। আমি জানি, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি কিন্তু বিশ্বাস করো আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব যেন তোমার কোন কষ্ট না হয়। যে কয়দিন আমারা একসঙ্গে…। ও আমার কথা শেষ হতে দিল না আমার বুকের মধ্যে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল
এখন এসব কঠিন কঠিন কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না
তাহলে কি শুনতে ইচ্ছা করছে?
অন্য কিছু বল
অন্য কি?
সুন্দর, মন ভালো করা কিছু
একটা কবিতা শুনবে?
হু
আচ্ছা শোন
একে একে বানিয়ে তুলব সব, তুমি দেখে নিয়ো।
বাড়িঘর, খেতখামার,
উঠোনে লাউয়ের মাচা, জানলার পাশে
লতানে জুঁইয়ের ঝাড় –
একে একে সমস্ত বানাবো, তুমি
দেখে নিয়ো
দক্ষিণে পুকুর থাকলে ভাল হয়, তুমি বলেছিলে।
অবশ্য থাকবে।
পুকুরে হাঁসের স্নান দেখতে চাও, সে আর এমন
কী বেশী কথা,
সাদা ও বাদামী হাঁস ছেড়ে দেব।
যা চাও সমস্ত হবে,
একই সঙ্গে হয়ত হবে না, কিন্তু
একে-একে হবে।
ভালবাসা থাকলে সব হয়।
দেখো, সব হবে।
যা-কিছু বানানো যায়, আমি সব
দুই হাতে
দিনে-দিনে বানিয়ে তুলব, তুমি দেখে নিয়ো।
কবিতার নাম “তুমি দেখে নিয়ো” লিখেছেন
– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
বিয়ে করবে মানে?
বাবা-মা দুজনেই খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন এর চেয়ে আশ্চর্যজনক কোন কথাই এর আগে জীবনে কখনো শোনেননি। এইরকম কিছু একটা যে হবে আমি আগেই আঁচ করেছিলাম। আমি চাইলে অন্য কাউকে দিয়ে কথাটা বলাতে পারতাম, ইচ্ছে করেই সেটা করিনি। আজ যদি বাবা মায়ের মুখোমুখি হতে না পারি তাহলে আর কোনদিনও পারবো না
আমি ঢাকায় এসে পৌঁছেছি গভীর রাতে। আমাকে দেখে বাবা-মা দুজনেই চমকে গেছেন। সে সময় আর কথা বলার কোন সুযোগ পাইনি, সকালে খাবার টেবিলে কথাটা তুললাম। প্রথমে আমার কথা শুনে বোধহয় তারা কিছুই বুঝতেই পারেননি কারণ আমি কখনও এ ধরনের কোনো অভ্যাস তাদেরকে দেইনি, দেবার অবশ্য প্রয়োজনও বোধ করিনি। মা হরবর করে বললেন
কাকে বিয়ে করতে চাস? কোথায় থাকে, ঢাকায় না চট্টগ্রামে? বিয়ে আবার করে ফেলিস নি তো?
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি থামত। বল, মুনির কি বলছিলে তুমি?
বাবা সাধারণত আমাদের তুমি বলেন না, আজ বলছেন,স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আমার উপর যথেষ্ট রেগে আছেন।
আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে কিছু বললাম না, স্পষ্ট গলায় বললাম
বাবা, আমি একজনকে পছন্দ করি। এখনই তোমাদের জানানোর ইচ্ছা ছিল না কিন্তু ওর বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উনি চাইছেন এই জানুয়ারি মাসেই ওর বিয়ে হয়ে যাক।
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন “উনি চাইলেই তো হবে না, আমাদেরকেও তো পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হবে। এখনো তোমার পড়াশোনা শেষ হয় নাই
মা আবারও আগ বাড়িয়ে বললেন
মেয়ে কোথায় থাকে, মেয়ের বাবা কি করে?
বাবা মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন কিন্তু লাভ হলো না। মায়ের কৌতূহল যেন বাঁধ ভেঙেছে
বাবা সেটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
ওই মেয়ের সাথে তোমার কিভাবে পরিচয়?
ওর নাম অনিমা বাবা, এখানেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, হলে থাকে। আমি জানি কথাটা তোমাদের জন্য খুব শকিং কিন্তু আমার আসলে আর কোন উপায় নেই। ওর বাবার স্ট্রোক করেছে। উনি চান এই জানুয়ারিতে ওর বিয়ে হয়ে যাক। বিয়ের পর আমরা যেরকম হলে আছি সেরকমই থাকবো প্রয়োজন হলে পড়াশোনা শেষ হলে তখন না হয়ে দেখা যাবে।
এইভাবে চুপে চাপে তো বিয়া করা সম্ভব না। আত্মীয়-স্বজনদের তো জানাতে হবে তোমার চাচা ফুফুদের খবর দিতে হবে। কি করা যায় আগে তোমার ছোট চাচার সঙ্গে একটু বুঝ পরামর্শ করে নেই।
বাবা উঠে গেলেন, পিছন পিছন মাও গজগজ করতে করতে বলতে বলতে গেলেন
তোমার মামাদের খবর দেওয়া লাগবে। মেয়ের বাবা কি করে তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে। মেয়ের হলে লোক পাঠাতে হবে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নাজমা কলেজে গেছে। আমার করার মতন তেমন কিছুই নেই। আমি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অনিমা এখানে থাকতে ভালো হতো আজকের দিনটা ওর সঙ্গে কাটানো যেত। গতকালই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে অথচ মনে হচ্ছে কতদিন ওকে দেখি না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আমি নারিন্দা ছোটফুপুর কাছে চলে গেলাম। ছোট ফুপুর সাথে কথা বলে অবাক হলাম। অনিমার ব্যাপারে সবই জানেন। বুঝলাম নাজমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ছোট ফুফু সব শুনে আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে আমার সঙ্গেই থাকবেন। আমি একটু ভরসা পেলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। আমার মনের অস্থিরতা টের পেয়ে ফুপু আমাকে চট করে ছাড়লেন না, দুপুরে ভাত খাইয়ে তবে ছাড়লেন।
ছোট ফুপুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসে এলোমেলো হাঁটলাম। ভালো লাগছে না, ভীষণ অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে ওর হলের সামনে গিয়ে কল দিলে এখনই ও নেমে আসবে। একটুখানি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আমি হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত চলে গেলাম। পুরনো বইয়ের মাঝে গেলে আমি সব সময়ই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি। বই দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল আমার কাছে তো ওদের সিলেটের নাম্বার আছে, একবার কি ফোন করে দেখব।
বেশি চিন্তা করলে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়না, তাই ঝটপটি একটা দোকান থেকে ফোন করে ফেললাম। ভাগ্য অত্যাধিক সুপ্রসন্ন হলে যা হয়, ফোনটা ওই ধরল। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম
অনিমা
ও সঙ্গে সঙ্গে আমার কন্ঠ চিনতে পেরে বলল
তুমি কোথায়? ঢাকায় না চট্টগ্রামে ফিরে গেছো।
ঢাকায়। কাল পরশুর মধ্যেই ফিরে যাব। তুমি কেমন আছো বলো তো
ভালো
সত্যিই ভালো? আমার কেন মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ
মন তো খারাপই। আমার জন্য কত ঝামেলা হচ্ছে তোমার বলতো।পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। এটা আমি চাইনি কখনো।
ও হঠাৎ করে চুপ করে গেল। আমি টের পাচ্ছি ওর নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ, কোন কথা বলছে না, কাঁদছে নিঃশব্দে। আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আমি নরম গলায় বললাম
অনি, কি হয়েছে বলোতো
কিছু না আমি রাখি
আমার কথাটা একবার শোনো
বল
তুমি এত চিন্তা করো না। আমি বাসায় কথা বলেছি, একদিন দুই দিনের মধ্যেই আমি সব জানাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছো
ও কথার জবাব দিল না, শুধু বলল
কেউ একজন আসছে, রাখছি
ও ফোন রেখে দিল। আমার মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এসেছে। আমি পরপর কয়েকবার ফোন দিলাম, কেউ ধরলো না। ওখান থেকে বেরিয়ে কতক্ষণ এলোমেলো হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের ভেতর চলে গেলাম। বাইরে ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন কিন্তু আমার বুকের ভেতর বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনলাম আসরের আযান দিচ্ছে। নিউ মার্কেটের ভেতর একটা মসজিদ আছে আমি আগে জানতাম না। অনেকদিন পর আসরের নামাজ পড়লাম। সাধারণত এই সময় ল্যবে থাকি বলে মসজিদে যাওয়া হয় না। মনের অস্থিরতা অনেকটা কমেল। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম। হঠাত একটা শাড়ির দোকানে চোখ আটকে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে অনভ্যস্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। দোকানে তেমন ভিড় নেই, অল্প বয়সী একজন সেলসম্যান আগ্রহ নিয়ে অনেক শাড়ি দেখালো। একটা টুকটুকে লাল তাঁতের শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। ওকে আমি কখনো শাড়িতে দেখিনি ভীষণ শখ ছিল দেখার, একবার ওকে বলেও ছিলাম। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আমি হলুদ পাড়ের লাল শাড়িটা কিনে ফেললাম। সত্যি সত্যি যদি আমাদের বিয়ে হয় তাহলে এটা ওকে উপহার দেব।
দোকান থেকে বের হতে হতে মাগরিবের আজান হয়ে গেল। আবারও মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারছি না। এতক্ষণ যে অস্থিরতা ছিল মনের মধ্যে হঠাৎ করেই সেটা কেটে গেল। এখানে বসে থেকে যেটা মনে হল যদি পরম করুনাময় চান তাহলে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন।
আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে আবার ওদের বাড়িতে ফোন দিলাম, এবার ফোনটা ধরলে অন্য একজন। আমি তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম না, তবে বুঝলাম এটা ওর বাবা কিংবা জাহেদ সাহেব নন। এর বাইরে আর কে হতে পারে। খুব সম্ভবত রাতুল।আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস না করেই বললাম
অনিমা কি আছে
আপু তো ঘুমাচ্ছে। আপনি কে বলছেন?
আমি সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম
তুমি কি রাতুল?
জি। আপনি কি মুনির ভাই
হ্য। কি অবস্থা বলো তো একটু
অবস্থা ভালো নয় ভাইয়া। আপনার আসা নিয়ে বাড়িতে যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছে। মা আর জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে মামার অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। মামা সম্ভবত আপনাকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন, তাই না?
হ্যাঁ
মা সেটা চাইছে না। তারা চাইছে এখনই বিয়েটা করিয়ে ফেলতে। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠান হবে।
এক মুহূর্তের জন্য আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। আমি কোনমতে বললাম
তারপর কি হয়েছে
মামা ওদের কথায় রাজি হয়নি। আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি মুনির ভাই। এবার যখন মামা অসুস্থ হয়েছিল আমি তার সঙ্গে হাসপাতালে ছিলাম। মামার শরীর ভালো নেই। এই মুহূর্তে যদি মামার কিছু হয়ে যায় তাহলে জাহিদ ভাই আর মাই কিন্তু আপুর লিগ্যাল গার্ডিয়ান। আপনার হাতে বেশি সময় নেই মনে হয়।
আমি হঠাৎ করে কোথা থেকে এতটা মনবল আর আত্মবিশ্বাস পেলাম জানি না, ওকে বললাম
তুমি আমার ফোন নাম্বারটা রাখো রাতুল। কোন কিছু হলে আমাকে জানিয়ো। আমি আগামীকালই একটা ব্যবস্থা করছি। আর ওকে বলো যেন দুশ্চিন্তা না করে আর নিজের খেয়াল রাখে।
রাতুল ছেলেটাকে আমার ভালো লাগলো। ছেলেটা বুদ্ধিমান এবং যথেষ্ট কেয়ারিং। আমি আমার চট্টগ্রামের ফোন নাম্বার আর আমাদের বাড়ির ল্যান্ডলাইনের নাম্বার দিয়ে ফোন রাখলাম। হাতে একেবারেই সময় নেই। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে খুবই দ্রুত।
চলবে…..
অনির
১৩
আমি বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যা পার করে। বাসায় ঢুকে রীতিমতো ধাক্কা লাগলো। ড্রয়িং রুমে অনেক লোকের সমাগম দেখা যাচ্ছে। ছোট চাচা এসেছেন। রাজশাহী থেকে এত দ্রুত কি করে এলেন সেটা একটা বিস্ময়। উনার উল্টো দিকে সোফায় কামাল ভাইকে দেখা যাচ্ছে। মামা বোধহয় কেবলই এসেছেন পাশেই লাগেজ রাখা। আমাকে ঢুকতে দেখে বাবা থমথম কন্ঠে বললেন
– কোথায় ছিলে সারাদিন? সকালবেলা অর্ধেক কথা বলে চলে গেলে । আমরা তো ভাবলাম আমার বউ নিয়ে ফিরবে নাকি
আমি জবাব না দিয়ে কোনার দিকে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসলাম। বোঝা যাচ্ছে আমি আসার আগে সবার মধ্যেই বেশ আলোচনা হয়ে গেছে। ছোটচাচা বয়সে সবার চেয়ে ছোট হলেও সাধারণত শেষ সিদ্ধান্তটা তিনিই নেন বা বলা ভালো তার পরামর্শই শেষ সিদ্ধান্তটা হয়। এই মুহূর্তে তার ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন। সম্ভবত সবাই তাকে নানান রকমের তথ্য দিয়েছে এখন সেই সবকিছুকেই একত্র করে আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। ছটচাচা শুরুটা করলেন এইভাবে
– তোমার কাছ থেকে কিন্তু আমরা এটা আশা করি নাই মুনির। বিয়ে করবে ভালো কথা, তাই বলে পড়াশোনাটা তো শেষ করবা, নাকি ওই মেয়ের বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে?
আমার মেজাজটা খারাপ হল। এরা নিজেদের মত করে গল্প বানিয়ে নিয়েছে এবং সেটাই সবাইকে বলছে। আমি সাধারণত কারো সঙ্গে রাগারাগি করিনা। এটা আমার স্বভাবেই নেই। আমি বললাম
– আমি জানিনা তুমি ঠিক কি শুনেছ, অনিমার সঙ্গে আমার পরিচয় এক বছর আগে। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে, আমার এক ব্যচ জুনিয়র। এই মুহূর্তে তোমাদের জানানোর আমার কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু রিসেন্টলি ওর বাবা স্ট্রোক করেছেন। ওরা …
মা আমার শেষ না হওয়া কথা কেড়ে নিয়ে বলল
তাই ওরা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, বুঝেছ কবির
এবার আমার মেজেজ সত্যি সত্যিই খারাপ হল। আমি বিরক্ত কণ্ঠে বললাম
– কেউ আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়নি। ওরা তো আমাকে চেনেই না। ওর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে ওরা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। ওর ফুপাতো ভাই বিসিএস ক্যডার। মার্চে বিয়ে। আমি ওর বাবাকে অনুরোধ করেছি যেন আমার ব্যপারটা কনসিডার করে। কাজেই বুঝতেই পারছ এখানে চাপ দেয়ার কিছু নাই।
ছোট চাচাকে এবার বেশ চিন্তিত দেখাল। বললেন
তা ওর বাবা কি বলল?
বললেন আমি এখন এত দায়িত্ব নেবার জন্য প্রস্তুত নই। তাঁর মতে আমাদের উচিত সবটা এখেনেই শেষ করে ফেলা।
কামাল ভাই অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলার জন্য ছটফট করছিল এবার আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল
আমার তো মনে হয় উনি ঠিক কথাই বলসে। এখন বিয়া করলে বউকে খাওয়াবে কি?
আমার মেজাজটা এবার প্রচন্ড খারাপ হল। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই ছোট ফুপু বললেন
এই কথা বলা তো তোমার মানায় না কামাল। তুমি তো মেট্রিক ফেল করে পালায়া বিয়া করসিলা। এখন তিন বাচ্চার বাপ, এখনো তো কিছু করো না, বাড়িতে বইসা খাও।
ছোট ফুপু যেন জোকের মুখে লবন দিয়ে দিলেন। কামাল ভাই তিলবিলিয়ে উঠলেন
বাড়িতে বইসা খাই মানে কি? এত বড় বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করা কি কোন কাজ না?
ছোট ফুপুও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়, তেড়ে উঠে বললেন
স্বীকার করো তাহলে যে এত বড় সম্পত্তি। সারাক্ষণ তো খালি গলা শুকাও বলো তোমাদের নাকি যা দেওয়া হয়েছে তাতে চলে না। তা নিজের সম্পত্তি দেখাশোনা করো অন্যেরটার উপর চোখ দিতে যাও কেন?
দেখলেন দেখলেন মামা, কথায় কথায় কথায় খালি আমারে খোটা দেয়। আজকে আপনারা এর একটা বিহিত করবেন।
রেহানা ফুপু এবা্র তেতে উঠে বললেন
ওনারা কি বিহিত করবেন, তারা তো নিজের নিজের অংশ নিয়ে সড়ে পরেছেন। এই কথাটা বোধহয় ছোট চাচার গায়ে লাগলো। উনি বললেন
সড়ে পড়েছি এটা কি ধরনের কথা রানু? তোমাদেরকে বসতবাড়ি ছেড়ে দিয়েছি কয়জন ভাই এমন করে? এখন তোমরা দুজন একটু মানিয়ে নিতে পারছ না এটা কি আমাদের দোষ?
নিজেরা তো ঠিকই আলাদা আলাদা করে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিয়েছ আমাদেরটা এরকম প্যাচ লাগানোর কি দরকার ছিল?
বাবা বেশ বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন
আহ! রানু, কামাল কি শুরু করলি তোরা
কামাল ভাই ও সুযোগ পেয়ে বলল
মামা আমি কিন্তু কিছু শুরু করি নাই। খালা সবসময় এই কামটা করে। বড় মামা আপনি এইটার আজকে একটা বিহিত করেন, সব সময় এই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। কাজও করি আবার কথাও শুনি
ফুপুর গলা এক পাল্লা চড়ল
ও তাই নাকি কাজ করিস? তা কি কাজ করিস শুনি? যা না কাজ করিস তার থেকে তো অন্যের সম্পত্তি ভোগ করতে সময় চলে যায়
ছোটখালা আপনে বড় তাই কিছু বলতেসি না। আম্মা থাকলে বুঝায়া দিত……
কি বুঝায়া দিত শুনি? তোর মাকে ভয় পাই নাকি আমি?
কেমন একটা হট্টগোল বেঁধে গেছে। আমি দিশেহারা বোধ করছি। কোথাকার কথা কোথায় চলে যাচ্ছে। বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা বাজছে। নাজমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরল। তারপর রিসিভার ফোনের পাশে রেখে আমাকে এসে বলল
ভাইয়া তোমার ফোন
কে?
জানিনা
আমার এই মুহূর্তে ফোন ধরে কথা বলে সময় নষ্ট করার এতোটুকুও ইচ্ছা নেই। এই পরিস্থিতি কি করে সামলাবো সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি নাজমা কে বললাম
নাম, ফোন নাম্বার লিখে রাখ, আমি পরে ফোন দিবো
নাম বলেছে রাতুল, বলল আর্জেন্ট
আমি ভীষণভাবে চমকে গেলাম। রাতুলের সঙ্গে আমার বিকেল বেলা কথা হয়েছে তখনই আমি ওকে নাম্বার দিয়ে বলেছি যে, কোন ইমার্জেন্সি হলে যেন আমাকে ফোন করে। তারমানে নিশ্চই কোন সমস্যা হয়েছে? খারাপ কিছু হয়নি তো? আমি ছুটে গিয়ে ফোন ধরলাম। রাতুল আমাকে সালাম দিল বলল
মুনির ভাই
কি অবস্থা রাতুল, সব ঠিক আছে?
না
কি হয়েছে?
যেটা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। মামার শরীরটা খারাপ করেছে। ব্লাড প্রেসার হাই
হাসপাতালে নিতে হবে?
বুঝতে পারছি না ভাইয়া।
রাতুল স্বগোতোক্তির মতন বলল
মা আর ভাইয়া যে কেন এমন শুরু করেছে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না
আমি সামনের দিকে তাকালাম। আমার সামনে মঞ্চস্থ নাটকের দৃশ দেখতে দেখতে ওইদিককার পরিস্থিতি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। জাগতিক বিষয় সম্পত্তির কাছে মানুষের আবেগ, বিবেক, অনুভূতি এমনকি প্রয়োজনও হার মানে॥ জাহিদের সঙ্গে এখন অনিমা্র বিয়েটা হলে ওদের পুরো সম্পত্তি জাহিদের হাতে চলে যাবে। এই কারণে তারা কোনভাবেই অনিমাকে হাতছাড়া করতে চাইছে না
মুনির ভাই আপনি শুনতে পাচ্ছেন? রাতুল তাড়া দিল
আমি ধীরে ধীরে বললাম
আমি বুঝতে পারছি। তুমি চিন্তা করো না আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফোন করব।
আমি ফোন রেখে এগিয়ে গেলাম। তখনো সবার মধ্যে উচ্চস্বরে বাক-বিতণ্ডা চলছে। আমি সাধারণত উচু গলায় কথা বলি না। আজ বলতে বাধ্য হলাম॥ বাবা কে উদ্দেশ্য করে বললাম
বাবা আমি একটু আপনার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই, এখানে মনে হচ্ছে অন্য কোন কিছু নিয়ে আলোচনা চলছে
কথায় কাজ হল কামাল ভাইয়ের তেমন কোন ভাবান্তর না হলেও রানু ফুপু খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন। সকাল থেকে আমি তার ওখানেই ছিলাম। আমি কতটা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি তা উনি খুব ভালো করেই জানেন। রানু ফুপু উঠে এসে আমাকে হাত ধরে টেনে সোফায় বসালেন। বললেন
এসব নিয়ে পরে কথা হবে, আপাতত ওর বিয়ের কথাটা ঠিক হয়ে যাক
ছোট চাচা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন
হ্যাঁ সেটাই ভালো। আমাকে সকালের বাসও ধরতে হবে। তোমার কি বলার আছে বল মুনির।
আমি দম নিয়ে বললাম
অনিমার বাবার শরীর ভালো নেই॥ ওর বড় ফুপু বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। এই মুহূর্তে উনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না
ওর কি আর কোন ভাই বোন নেই? ছোট চাচা জানতে চাইলেন
না, ও একমাত্র সন্তান
আর ওর এই বড় ফুপু কোথায় থাকে?
একই বিল্ডিঙই থেকে, দোতালায়
বাবা মা দুজনেই এই কথা শুনে বেশ অবাক হলেন
আসলে, বাড়িটা অনিমার দাদার দুটো ফ্লোর ওদের আর বাকি দুটো দুই ফুপুর।
একথা শুনে বাবা আর মায়ের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় আমার চোখ এড়ালো না।
বাবা বললেন বাড়িটা যেন কোন এলাকায় বলছিলে
আমি এলাকার নাম বললাম। জায়গাটা সিলেটের শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বাবার মুখভঙ্গি দেখলাম একটু শিথিল হল, তবু কথা শোনাতে ছাড়লেন না। বললেন
তা এখন কি করতে হবে আমাদের?
আপনি ফোনে ওর বাবার সঙ্গে একবার কথা বলুন॥ উনাকে জানান যে আমরা সামনে সপ্তাহে আসতে চাই
সামনের সপ্তাহে?
জি আমরা সিলেটে গিয়ে ওনাদের বাসায় কথা বলব। ছোটচাচা আপনি কি আমাদের সঙ্গে যাবেন?
যেতে তো চাই কিন্তু মনে হয় না এবার পারব। রানু তুমি চলে যাও
রানু ফুপু বলবেন
ঠিক আছে আমি চলে যাব
কামাল ভাই ফট করে বলে বসলেন
আম্মা হয়তো যাইতে পারবে না তবে আমার যাইতে কোন সমস্যা নাই
জবাবটা আমিই দিতাম তবে তার দরকার পড়লো না ফুপু বললেন
– এত মানুষের যাওয়ার দরকার নাই। বেশি মানুষ গেলে বিয়ায় ভাঙানি পরে। ভাইজান আপনি ভাবি আর আমার সঙ্গে আলিফের আব্বা যাক। আপনারা কি বলেন?
প্রস্তাবটা আমার পছন্দ হলো। আলিফের আব্বা মানে ছোট ফুপা। উনি বেশ গোছানো মানুষ, কথাবার্তায় যথেষ্ট সংযত। কামাল ভাই গেলে যে একটা ঝামেলা হত এতে কোন সন্দেহের কোন অবকাশ নেই
সকলেই সম্মত হল। বাবা অনিমার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। দুই পক্ষই জানে যে তাদের মতামতের এখানে বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। পরস্পরের সম্মান রক্ষা করে কথাবার্তা শেষ করাটাই যেন প্রধান লক্ষ্য ছিল। আমার পরীক্ষা এসে গেছে, সামনে সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেকটা সময় নষ্ট হবে এই ব্যাপারটা আমার বাড়ির কেউ না বুঝলেও আশ্চর্যজনকভাবে অনিমার বাবা বুঝলেন, কিংবা হয়ত তার দিক থেকেই কোনরকম তাড়া ছিল॥ উনি আমাদের পরের দিনই আসতে বললেন।
আমাদেরকে ওদের বাড়িতে থাকতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিন্তু বাবা রাজি হলেন না। আমরা হোটেলে উঠলাম। পরদিন তাদের আতিথিয়তা গ্রহণ করে সন্ধ্যা বেলা কথাবার্তা ফাইনাল করেই ফিরে এলাম। বলতে দ্বিধা নেই রানু ফুপু আর ফুপা থাকায় সবকিছু অনেক সহজ হয়েছে, তা না হলে বাবা-মা তাদের অসন্তোষটা লুকিয়ে রাখার কোনরকম চেষ্টাই করেননি বরং বলা ভালো প্রকাশ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন॥
ওদের বাড়িতে মেয়ে বলতে শুধুমাত্র অনিমা আর ওর বড় ফুপু। যেহেতু তাদের সঙ্গে একটা ঝামেলা চলছে কাজেই তাকে আশেপাশে খুব একটা দেখা গেল না। একবার আমাদের সঙ্গে এসে বসলেন তারপর খাওয়া দাওয়ার কথা বলে উঠে চলে গেলেন।
অনিমা ঘরে এলো আরো কিছুক্ষণ পরে, মজার ব্যাপার ওকে ঘরে নিয়ে এলো রাতুল। সেদিন আমি প্রথম ওকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলাম। কমলা রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। মা নেই তাই কেউ একটু সুন্দর করে কুচিগুলো ধরে দেয়নি। যত্ন করে চুল আছড়ে, ঘোমটায় একটা পিন আটকে দেবার কথাও হয়তো কারো মাথায় আসেনি। বারবার মাথা থেকে আঁচল পড়ে যাচ্ছে॥ ওকে দেখে আমার অদ্ভুত রকমের মায়া হল। কোন সাজসজ্জা ছাড়াই ওকে অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগে। আজ হয়ত ইচ্ছে করেই একটু সেজেছে। ঠোঁটে লিপস্টিকের ছোঁয়া, চোখে কাজল সাড়ির সঙ্গে পুরনো দিনের সোনার গয়না॥ বোঝা যায় ওর মায়ের॥ হয়তো মায়ের স্পর্শটুকু কিছুক্ষণের জন্য ধরে রাখতে চাইছিল। হাসান সাহেব মেয়েকে পাশে বসিয়ে বললেন
ও আমার একমাত্র সন্তান আমার যা কিছু আছে সবই ওর। ভাই সাহেব আমরা শুধু চাই ওর পড়াশোনাটা যেন কমপ্লিট হয়
বাবা বললেন
জ্বী ভাই কোন চিন্তা করবেন না। আমরা শিক্ষিত পরিবার।
মা শুধু একবার জিজ্ঞেস করল কি সাবজেক্টে পড়ো
অনিমা মাথা নিচু করেই বলল
জি বাংলায় অনার্স করছি
মা জবাবে কিছু বলল না, তবে তার মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা গেল যে তিনি রীতিমতন অসন্তুষ্ট
সামনের সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক হল। আমার পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু উনি পারছেন না এ কথা বলে অনিবার বাবা বেশ আফসোস করলেন। বললেন তার শরীরের অবস্থা ভালো না॥ কবে কি হয় উনি কিছুই বলতে পারেন না তাই যা করার দ্রুত করে ফেলাই ভালো॥
আমি জানি ঢাকায় ওদের তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই, এত অল্প সময়ে কোন সেন্টার খুঁজে পাওয়াটা খুবই মুশকিল এই নিয়ে রাতুলের সঙ্গে আমার আলাদা একটু আলোচনা হলো ॥ রাতুল আসলেই খুব বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী ছেলে।ঠিক হল অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে ও আর অনিমা ঢাকায় চলে যাবে১। ওর বাবা আসবে বিয়ের একদিন আগে। আমি আর রাতুল মিলে সেন্টার ঠিক করলাম।
এই পর্যায়ে এসে একটা ব্যাপার দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি করে সামাজিকতার সামনে সম্পর্ক এমনকি সাধারণ চক্ষু লজ্জাও তুচ্ছ হয়ে যায়। বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন এই মুহূর্তে কোন অনুষ্ঠান করা, মানে বৌভাত করা তার পক্ষে সম্ভব না। আত্মীয়-স্বজনদের উনি এখন কিছুই বলতে পারবেন না। তাছাড়া প্রস্তুতি দেওয়ার মতন যথেষ্ট সময়ও নেই। শুধুমাত্র বিয়ের অনুষ্ঠানটাই হবে সে ক্ষেত্রেও মেয়েকে আমাদের পক্ষ থেকে কিছুই দেয়া হবে না। মা ও সে কথায় সম্মতি দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সারা জীবন মায়ের কাছে শুনে এসেছি আমার বউকে জন্য তার কত কি দেবার আছে। কত বিশেষ উপহার তোলা আছে, অথচ মা ও এখন বাবার সঙ্গে একমত। জীবনে প্রথমবারের মতন আমি উপার্জনক্ষম নই বলে বড্ড অনুশোচনা হল।
অনিমার বাবা রাজী হলেন না। আমি এক বছর সময় চেয়েছিলাম উনি নানান যুক্তি দিয়ে আমাকে বোঝালেন যে কেন সেটা সম্ভব নয়। আমি তাঁর কোন যুক্তিই ফেলে দিতে পারলাম না। নাস্তা শেষে ড্রয়িং রুমে বসে চা খেতে খেতে উনি বললেন
দেখো মুনির, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি যদি আরেকটু এডভান্স পজিশনে থাকতে, আমি কখনো তোমাকে মানা করতাম না। একটা কথা তুমি চিন্তা করে দেখো, তোমার এখনো অনার্স কমপ্লিট হয়নি, আরো এক বছর বাকি; এরপর মাস্টার্স এবং থিসিস মিলিয়ে আরও এক থেকে দেড় বছর তারও পরে তুমি পি এইচ ডি করতে যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পিএইচডির ব্যাপারে অভিজ্ঞ তাই বলতে পারি পিএইচডির করতে তুমি তোমার ফ্যামিলি নিয়ে যেতে পারবে না, সে পরিমাণ ফান্ডিং অ্যাপ্রুভ হওয়া খুবই বিরল। ধরে নিচ্ছি তুমি একাই যাবে, সেখানে আরো পাঁচ বছর। এই সাত আট বছর আমার মেয়েটার কি হবে। সেটাও মেনে নিতাম যদি আমি সুস্থ থাকতাম। সব কথা আমি অনিমাকে বলি না। এমনিতেই ওর মা চলে যাবার পর মেয়েটা খুব মনমরা হয়ে থাকে। আমার হাতে এতো সময় নেই। আমি ওকে এরকম একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যেতে পারি না।
আপনি কি চাইছেন এই জানুয়ারি মাসেই বিয়ে হোক?
আমার সেই রকমই পরিকল্পনা
যদি জানুয়ারিতেই আমি বিয়েটা করি তাহলে কি আপনি রাজি হবেন?
টেকনিক্যালি আমার রাজি হওয়া উচিত না, কারণ সমস্যাগুলো কিন্তু জানুয়ারিতে বিয়ে হলেও থেকেই যাচ্ছে
আমার সঙ্গে বিয়ে না হলেও তো মাস্টার্স শেষ হওয়া পর্যন্ত ও হলেই থাকবে, তাই না?
সেটাই তো থাকা উচিত
সেই ক্ষেত্রে তো এখনো দুই বছর সময় আছে আপনি যদি চান বিয়েটা জানুয়ারিতেই হবে। আর পি এইচ ডির ব্যাপারে যেটা বলছেন, আমি যদি ওকে নিয়ে যেতে না পারি তাহলে আমি পিএইচডি করবো না দেশেই ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করব
আমি তাকিয়ে দেখলাম ওনাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। তর্জনী দিয়ে নিজের চিবুক ঘষতে ঘষতে বললেন
এখানেও কিন্তু সমস্যা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
কি সমস্যা
আমি নিশ্চিত তুমি তোমার পরিবারের সঙ্গে এখনও কথা বলোনি। উনাদের রাজি না হওয়ার খুব হাই পসিবিলিটি আছে।
এত বিপদের মধ্যেও আমি হেসে ফেললাম, উনার কথাটা একেবারেই ভুল নয়।
উনি নিজেও হাসলেন, বলেনন
দেখলে তো, আমি ঠিকই ধরেছি। সত্যি কথা বলতে তোমার বাবা-মায়ের জায়গায় আমি হলেও খুব বিরক্ত হতাম। তোমার এত চমৎকার রেজাল্্ এত ব্রাইট ফিউচার সামনে, এসব ফেলে এই মুহূর্তে বিয়ে করাটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আমি আপনাকে একটা কথা সত্যি করে বলি?
বল
ভালো রেজাল্ট কিংবা ব্রাইট ফিউচার এর জন্য একটা মিনিমাম মেন্টাল স্ট্যবিলিটির দরকার হয়। এই মুহূর্তে যদি ওর বিয়েটা অন্য জায়গায় হয়ে যায়, আমি হয়তো আর পড়াশোনাই কন্টিনিউ করতে পারবো না।
এবার উনাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। উনি বললেন
তোমরা তো পরস্পরকে চেনো এক বছর ধরে তাই না?
জি
এর মধ্যে কয় বার তোমাদের দেখা হয়েছে?
চার বারের মতন
এত অল্প সময়ে কোন সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমার ধারণা এই সাময়িক আবেগ তোমরা কাটিয়ে উঠতে পারবে
আমি খুব ধীরে ধীরে টের পাচ্ছি যে আমি পরাজিত হচ্ছি, পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে শুধু হাতের তরবারি খসে পড়া বাকি।
আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম
পারতাম, যদি আবেগটা সামরিক হতো।
আমি অনিমার কাছে তোমার ব্যাপারে যতটুকু শুনেছি তুমি খুবই রেস্পন্সিবল এবং প্র্যাকটিকাল একটা ছেলে। আমার মনে হয় একটু চেষ্টা করলেই তুমি তোমার ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে পারবে। সব দিক দিয়ে এটাই ভালো হবে যে তোমরা পরস্পরের সাথে আর যোগাযোগ না করো।
এবার আমার নিজেকে সম্পূর্ণই পরাজিত মনে হল। আক্রমণাত্মক তো দূরে থাক রক্ষণাত্মক অবস্থানেও আমি আর নেই, শুধু শেষ আঘাতটার অপেক্ষা, তারপরে হয়তো হাতের তরবারি খসে পড়ে যাবে আর আমি পুরোপুরিভাবে পরাস্ত হব। এই মুহূর্তে গা ছাড়া দিয়ে ওঠে না দাঁড়ালে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আমি নিজের শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে বললাম
আপনি কিন্তু শুধু আমার কথা ভাবছেন, ওর কথা একবারও ভাবছেন না
হাসান সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত হলো। উনি বললেন
কিরকম
আপনি যদি এখন রাজি না হন তাহলে আমার জীবনে বিশেষ কোন পরিবর্তন আসবে না কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য একজনকে মেনে নেওয়াটা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনি জানেন ও খুব সেনসিটিভ, নরম মনের এবং আবেগপ্রবণ একটা মেয়ে। ওর ফিউচার সিকিউর করতে গিয়ে ওর কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না তো।
উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন
মাত্র চার বার দেখায় ওকে এতখানি জানা, আমাকে বেশ অবাক করছে।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম
আসলে আমরা গত এক বছর ধরে কন্টাক্ট এ আছি। আপনি হয়তো জানেন না আমরা একজন আরেকজনকে চিঠি লিখছি প্রায় বছর খানেক ধরে। মানসিকভাবে আমরা পরস্পরের প্রতি অনেকখানি নির্ভরশীল, এই মুহূর্তে এইরকম একটা পরিস্থিতির জন্য আমাদের দুজনের কেউই প্রস্তুত নই।
হুম
আমি আবারো বললাম
আপনার কাছে আমি একটা অনুরোধ করবো, আমাকে একটু সময় দিন। আমি আমার ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি।
তোমার মনে হয় জানুয়ারিতে বিয়ের ব্যাপারে তোমার ফ্যামিলি রাজী হবে?
জি
তুমি নিশ্চিত? তারা রাজি না হলে কিন্তু আমি কিছুই করতে পারবোনা
আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন, শুধু আমাকে একটা কথা দিন জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত আপনি আমাকে সময় দেবেন। আমি পরীক্ষাটা শেষ করেই আমার ফ্যামিলিকে নিয়ে আসব।
তোমার সামন পরীক্ষা? হাসান সাহেব বেশ অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
জি সামনে্র সপ্তাহ থেকে শুরু হবে
এই অবস্থায় তুমি পড়াশোনা ফেলে এখানে এসেছ?
আমার আর কোন উপায় ছিল না। না এলে আমি পড়াশোনা করতে পারতাম না
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো কিন্তু তারপর আর নয়
ধন্যবাদ আঙ্কেল
আমি উঠে দাঁড়ালাম। উনি অবাক হয়ে বললেন
তুই কোথায় যাচ্ছ ?
আমি আজ আসি। আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। যাবার আগে কি একবার ওর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
হাসান সাহেব হেসে ফেললেন, বললেন
তুমি এত ব্যস্ত কেন, আমি তোমাকে বিকেলের ট্রেনে উঠিয়ে দেবো। তুমি দুপুরে খেয়ে তারপর যাবে।
জি আচ্ছা
তুই তো চা ও খাওনি। বসে, চা টা শেষ কর
আমি কিছু বললাম না তবে বসলামও না। উনি কি ইচ্ছা করেই দেখা করার বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন?
আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন
অনিমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ছাদে চলে যাও। তোমার চা না হয় ওখানে পাঠিয়ে দেবো।
এতটা অবশ্য আমি আশা করিনি। ছাদের সিঁড়িটা আগেই দেখেছিলাম, উঠে গেলাম তবে ছাদের দরজার দাড়িয়ে একটু ধাক্কা লাগলো। অনিমা দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে তার পাশে আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে, শক্তপোক্ত গড়ন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। অনিমা আমার দিকে পিছন ফিরে থাকায় আমাকে দেখতে পায়নি। আমি ওদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছি।
ভদ্রলোক বলছেন
রাতের বাসে ওই ছেলের সঙ্গে এসেছিস শুনে মা একটু আপসেট হয়েছে। তুই একটু কথা বলে নিস
আমি শুধু রাতের বাসে ওর সঙ্গে আসিনি আগের দিন চট্টগ্রামে ওর হলেও গিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাও একসঙ্গে এসেছি
ভদ্রলোক কাধ ঝাকিয়ে বললেন
আমাকে এসব করে কোন লাভ নেই। আমার এই সবে কোন সমস্যা নেই। বিয়ের আগে এমন থাকতেই পারে, আমারও আছে
আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না এ কথা জানার পরও বারবার তুমি একই প্রসঙ্গ কেন তুলছো
কারন তোর আর কোন অপশন নেই। মামা ওই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়েতে কিছুতেই মত দেবে না
বাবা ওর সঙ্গে বিয়েতে মত দেবে কি দেবে না আমি জানিনা তবে আমি তোমার সঙ্গে বিয়েতে মত দেব না
ভদ্রলোক শব্দ করে হাসছেন, তার হাসিটা আমার ভালো লাগছে না, এভাবে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনতেও ভালো লাগছে না। আমি দরজার মৃদু করাঘাত করে বললাম
ভেতরে আসতে পারি?
উনি আমাকে দেখে একটু চমকালেন তবে সেটা সেই ভাবে প্রকাশ করলেন না। কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
আমি জাহিদ। তুমি নিশ্চয়ই মুনির। কিছু মনে করো না তুমি বললাম। তুমি আসলে আমার অনেক জুনিয়র হবে
না কিছু মনে করিনি, ভালো আছেন আপনি?
হ্যাঁ, ভালো আছি। তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না। অনিমার কাছে তোমার কথা শুনেছি তবে তোমাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না যে তুমি এতটা হ্যান্ডসাম। এজন্যই বোধহয় আমিনা তোমার প্রেমে পড়েছে
জাহিদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও হাসছে। আমাদের দৃষ্টি বিনিময়ে কোন কথা না বলেও আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেল। আমাদের এই অব্যক্ত কথোপকথন বোধহয় তার ভালো লাগলো না। তিনি বললেন
তোমরা কথা বলো আমি আসছি।
উনি চলে যাবার পর অনিমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
বাবা কি বললেন
জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন এর মধ্যে আমি বাসায় কথা বলব
তোমার পরীক্ষার আগে অনেক ঝামেলা হয়ে গেল, তাই না
আমি ওর কথার জবাব দিলাম না। ওর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম
সাবধানে থেকো। আমি খুব তাড়াতাড়ি আসবো, তোমাকে নিয়ে যেতে। ততদিন অপেক্ষা কর।
সাড়ে বারোটার বাসে আমি ফিরে এলাম। ওর বাবা নিজেই আমাকে বাসে তুলে দিলেন। ফেরার আগে ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে কেবল একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম। আমি জানতাম ও ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে, বাগান বিলাসের ঝাড়ের আড়ালে একবার দেখলাম ও হাত তুলে চোখ মুছছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যদি ও তখন জানতাম না যে বাড়ি ফেরার পর মন আরো খারাপ হবে।
অনিমার বাবা প্রথমেই আমাকে যে প্রশ্নটা করলেন সেটা হল
তোমার ফিউচার প্ল্যান কি
এই প্রশ্নটার জন্য আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম, যদিও জানি এর উত্তর যেকোনো মেয়ের বাবারই ভালো লাগবে না; কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে উনি বললেন
বাহ! এতো খুব ভালো কথা। মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি; খুবই ভালো পরিকল্পনা। তোমাকে কি টিচিং এ যাওয়ার ইচ্ছা?
জি আঙ্কেল
তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি নিজেও শিক্ষকতা করি।
আমি মনে মনে একটু চমকালাম, তবে সেটা প্রকাশ করলাম না। আমি সত্যিই জানতাম না অনিমার বাবা শিক্ষকতা করছেন। অনিমা কখনো আমাকে বলেনি ওর বাবা কি করেন, আমিও কখনো জিজ্ঞেস করিনি। আজই জানতে পারলাম যে উনি সিলেট সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
আমরা বসেছি বাইরের ঘরে। ওদের বাড়িটা বেশ পুরনো ধাচের, খাবার ঘর এবং বসার ঘর আলাদা আলাদা। পর্দা সরিয়ে কেউ একজন আমাদের খেতে ডাকলো। আমি দরজার দিকে পিছন ফিরে বসায় তাকে দেখতে পেলাম না। হাসান সাহেব বললেন চলো নাস্তা খেতে খেতে কথা বলি
আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি আজ সকাল আটটায়। পুকুর পাড় থেকে আমি ওকে সোজা হিয়ার কাছে নিয়ে যাই। ওকে দেখে হিয়ার উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না । অনিমা একটু অস্বস্তি বোধ করছিল কিন্তু হিয়ার আন্তরিকতার কাছে পরাজিত হলো। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার টিকেট কাটলাম তারপর ইমেইল করে চেয়ারম্যন স্যারকে জানালাম জরুরী প্রয়োজনে ঢাকা যেতে হচ্ছে। কাজ শেষ করে হলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। রাতের খাবার সময় হয়ে গেছে, খেতে ইচ্ছা করছে না। সামনে খুব কঠিন কিছু সময় আসছে। সাধারণত এরকম দুর্যোগময় সময়ে মানুষের পরিবার তাঁর পাশে দাঁড়ায়, তাকে সাপোর্ট করে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ব্যপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত, আমাদের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের পরিবারের।
দুশ্চিন্তায় সারারাত আমার ঘুম হলো না। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম এল, সকালবেলা উঠতেও দেরি হয়ে গেল। নয়টার সময় আমাদের রওনা দেবার কথা। আমি দ্রুত গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লাম। অনিমাকে হল থেকে তুলে নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে গেলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার জার্নি সে সময় বেশ দীর্ঘ ছিল। পুরো পথ ও আমার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলল না। খেতে বললাম যখন খেল ও না ঠিক মতন। হয়তো আমার মতন ও দুশ্চিন্তায় আছে অনেক। হয়তো আমার উপর ভরসা করতে পারছে না। আমি অবশ্য ওকে কোনো ধরনের আশ্বাসও দেইনি, কিছুই বলিনি, শুধু বলেছি আমি ওর বাবার সাথে কথা বলতে চাই।
ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি ওকে ওর হলের সামনে নামিয়ে দিলাম। বললাম
অনেক ধকর গেছে একটু বিশ্রাম নাও। কাল দুপুরে দেখা হবে। দুটোর পরে এসে কল দিব।
আমি তাকিয়ে দেখলাম ও ভিতরে যাচ্ছে না। ওকে কেমন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরাজিত মানুষের মতন মনে হচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কার মতন লাগলো। ও কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, নাকি ভরসা করতে পারছে না। আমি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বললাম
কি হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে?
ও ভাঙ্গা গলায় বলল
তুমি কি বাসায় যাবে এখন?
না, বাসায় যাব না। হলে থাকব আজ, আমার বন্ধুর সঙ্গে। কিছু লাগবে? আমি আসবো আবার রাতে?
তুমি কি সত্যিই সিলেটে যাবে?
হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল
বল
রাতের বাসে আমার সঙ্গে যেতে তোমার কোন সমস্যা আছে?
ও খুব অবাক হয়ে বলল
না, সমস্যা থাকবে কেন?
আমার খুব সকালেই সিলেট পৌঁছাব
সমস্যা নেই
তাহলে কাল রাতের টিকেট কাটছি, রাত দশটার
আচ্ছা দুপুরে আসবে না তাহলে আর?
ওর বলার ধরন দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম
আসবো না কেন? তুমি চাইলে সকাল থেকে এসে বসে থাকব
এতক্ষণ পর ও একটু হাসল। আমি তৃষিতের মতন চেয়ে রইলাম। ওর এই একটুখানি হাসি দেখার জন্য আমি যত কষ্ট করতে হয়, করতে রাজি আছি।
দুপুরে আসবো বললেো আসতে পারলাম না, ঝামেলায় আটকে গেলাম। টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক কাজ ফেলে এসেছি, একটা দিন নষ্ট করা কোনভাবেই সম্ভব না। এখন মোবাইলের যুগে বিষয়গুলো যত সহজ মনে হয় সে সময় ততটা সহজ ছিল না। আমি আসতে পারছি না এই কথাটা ওকে জানাতেও পারিনি। আমি নিশ্চিত ও আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, হয়তো দুপুরের খায়নি, একসঙ্গে খাবে বলে॥ আমার নিজেরও খেতে ইচ্ছা করল না, কাজ মিটিয়ে আমি ব্যাংকে গেলাম, সেখান থেকে নীলক্ষেত। কয়েকটা বই দরকার ছিল সেগুলো নিয়ে ওর হলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
আমাকে দেখে ও আঁতকে উঠলো । বলল
তোমার এই অবস্থা কেন? কোথায় ছিলে সারাদিন?
আমি হাসলাম একটু, টিকেট দুটো ওর হাতে দিয়ে বললাম
একটু ঝামেলা গেছে। এখন সব ঠিক আছে। কোথাও বসবে?
না। তুমি এখন হলে যাবে। গোসল করবে, খাবে তারপর ঘুমাতে যাবে। রাতে একবারে আমাকে এখান থেকে নিয়ে স্টেশনে যাবে। যাও এখন।
আমি আপত্তি করলাম না। আমার আসলেই একটু বিশ্রামের দরকার। শহীদুল্লাহ হলে আমার এক বন্ধু থাকে। ওর ওখানেই কাল ছিলাম। আমি ওখানেই চলে গেলাম।
বাসে ওকে জানালার সামনে বসিয়ে আমি বললাম
আমি কিছু খাবার কিনে নিয়ে আসি
খাবার আমি নিয়ে এসেছি। তুমি শুধু পানি কিনে আন
আমি পানির সঙ্গে আরও কিছু শুকনো খাবার কিনে আনলাম। বাস আজ সময় মতই ছাড়লো। ও আমার দিকে খাবারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল
খাও, সারাদিন নিশ্চয়ই কিছু খাওনি। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বক্সের ভেতর গরম খিচুড়ি ডিম ভাজা, আলু ভর্তা। দুদিন পর মনে হয় এত আরাম করে খেলাম। খিচুড়ি আমার খুব প্রিয় খাবার। ছোট ফুফুর হাতের খিচুড়ি আমি ভীষণ পছন্দ করি। অনেকদিন পর সেই স্বাদটা মনে পড়ে গেল। খেতে খেতে ও বলল
আমার রান্না তো ভালো না, কষ্ট করে খেয়ে ফেলো
তোমার অন্য রান্না তো খাইনি। তবে তোমার খিচুড়ি অসাধারণ
ও লজ্জা পেয়ে একটু হাসলো।
বাসের মধ্যে এখনো ঘুম নেমে আসেনি। আমরা দুজন হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে গল্প করছি। টিভিতে নাটক চলছে॥ আরো ঘন্টাখানেক পর বাসের বাতি বন্ধ হয়ে গেল, টিভি বন্ধ করে গান চালু হলো। ও আমার কাধে মাথা রেখে খুব আস্তে আস্তে বলল
আমার ভীষণ ভয় করছে
আমি ওকে বলতে পারলাম না যে আমার ওর চাইতেও অনেক বেশি ভয় করছে। ওর বাবার কিংবা আমার পরিবারের মুখোমুখি হবার ভয় নয়। সব কিছুকে ছাপিয়ে আমার ভীষণ ভয় করছে এটা ভেবে যে যদি আমি ওকে হারিয়ে ফেলি। আমি ভিষণ আস্তিক ধরনের মানুষ। মনেপ্রানে বিশ্বাস করি যদি সৃষ্টিকর্তা না চান তাহলে আমি কখনই ওকে পাব না। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অন্য হাতে ওর চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে বললাম
চিন্তা করো না সব ঠিক হবে ইনশাল্লাহ।
ওকে কেমন যেন নিশ্চিন্ত মনে হল। ধীরে ধীরে টের পেলাম ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ঘুমাতে পারলাম না। ভয়, অনিশ্চয়তা , দুশ্চিন্তা মিলেমিশে আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো। হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা দ্রুতগামী ট্রাকের আলো হঠাৎ হঠাৎ এসে পড়ছে জানালার কাচ ভেদ করে। সেই ছিটকে পড়া আলোয় ওর মুখটা দেখে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। আমি ওর একটা হাত আমার বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলাম।
বাসের মধ্যে খুব লো ভলিউমে একটা বাংলা গান চলছে। গানের কথা এবং সুর আমার ভারাক্রান্ত হৃদয়কে আরো বিষন্ন করে তুলছিল। যেন এই কথাগুলো
গানের কথা নয় আমার নিজেরই কথা
দিয়েছিলে যা, নিয়ে নিতে পারো
লেখা কবিতা, গাওয়া গান যত,
খুঁজে দেখ না, পাবে না কেউ আমার মত
মুছে দিও না শুধু হৃদয় ক্ষত।
এই পুকুরটা তোমাকে দেখানোর খুব শখ ছিল আমার
ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
আমারও দেখার খুব শখ ছিল
আমরা বসে আছি আমার ক্যাম্পাসের লেকের ধারে। শরৎ শেষ হয়ে হেমন্ত শুরু হয়েছে কেবল। এবার বৃষ্টি ভালো হওয়াতে গাছের পাতায় ধুলোর আস্তরণ নেই। গরম ও অপেক্ষাকৃত কম। দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হতে শুরু করেছে। পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে পুকুরের পানিতে।
আমার রুম থেকে বেরিয়ে ওকে নিয়ে এসেছি আমার ক্যাম্পাসে। ওর সহজ হতে অনেকটা সময় লেগেছে। আমি জানি ও খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। হুট করে সবকিছু বলতে পারবে না, তাই ওকে বাইরে নিয়ে গেছি। নিঃসন্দেহে ও পথে কিছুই খায়নি। ওকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। অগত্যা এখানে নিয়ে এসেছি, যদি কিছু বলে।
এই পুকুরের কথা একবার ওকে লিখেছিলাম চিঠিতে, বলেছিলাম এই পুকুরের জলে তাকিয়ে থাকলে তোমাকে দেখতে পাই। ক্লাসের ফাঁকে আমরা প্রায়ই এখানে এসে বসতাম। সে সময় আমি ওকে দেখিনি। তখন আকাশের মেঘে, পুকুরের জলে রাতের আকাশের তারায় শুধু ওর মুখ খুঁজতাম। আর যখন ওকে দেখলাম আমার সব কল্পনা হারিয়ে গেল; মনে হল মনের মধ্যে যে শূন্যস্থানটা ছিল তা যেন পুরোপুরি ওর মাপেরই। এই কথাটা কোন একটা বইতে পড়েছিলাম।বাস্তবে এমন ভাবে তা সত্যি হতে পারে সে সময় অনুভূব করতে পারিনি।
ও আনমনা হয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম
এবার বলতো সত্যি করে, কি হয়েছে?
ও আমার দিকে তাকালো। আমার বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বোধ হয় ও ভয়ানক কোন কথা বলবে আর আমার জীবনটা পুরোপুরি বদলে যাবে॥
আমি ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ, চট করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করি না। ও একটু দম নিল। বোধ হয় মনে মনে গুছিয়ে নিল কি বলবে। তারপর বলল
একটু পেছন থেকে বলতে হবে তা নাহলে সবটা বোঝানো যাবে না
বলতে থাকো, আই এম এ গুড লিসেনার
ও একটু দম নিয়ে বলা শুরু করল
বাবার অসুস্থতার কথা তো তোমাকে আগেই বলেছি। এবার যে স্ট্রোকটা করেছে এটা সেকেন্ড স্ট্রোক ছিল। এর আগে বাবা আরেকটা স্ট্রোক করেছিল। সেই সময় আমার পরীক্ষা চলছিল বলে কেউ আমাকে জানায়নি। সে সময় অবশ্য জাহিদ ভাই বাসায় ছিলেন। জাহিদ ভাই আমার ফুফাতো ভাই । বড় পুকুর বড় ছেলে।
তোমাকে বলা হয়নি, আমরা যে বাড়িটাতে থাকি এটা আমার দাদার বাড়ি। আমাদের ছোটবেলায় একতলা বাড়ি ছিল। পরবর্তীতে গ্রামের অন্য সব সম্পত্তি বিক্রি করে এই চার তলা বাড়িটা তৈরি করা হয়। দাদাভাই বেঁচে থাকতেই বাবা আমাদের গ্রামের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে এই বাড়িটা চারতলা বানিয়েছেন। দাদাভাই চাইতেন ভাই বোনের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকুক তাই মৃত্যুর আগে এই বাড়িটা আমার দুই ফুফু আর বাবাকে লিখে দিয়ে যান। বাবার কোন ভাই নেই তাই তিন তলা চারতলা নিয়ে আমরা থাকতাম দোতলায় আমার বড় ফুফু থাকে। একতলাটা ছোট ফুফুর নামে। ছোট ফুপু এখানেই থাকে চট্টগ্রামে।
যেটা বলছিলাম, এবার যখন বাবা অসুস্থ হয় তখন রাতুল মানে বড়ফুফুর ছোট ছেলেই সব করেছে। রাতুল আমার সমবয়সী। শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমি যেদিন সিলেটে পৌঁছাই সেদিন জাহিদ ভাইও এসে পৌঁছলো। তারও এক সপ্তাহ পর আমরা বাবাকে বাড়িতে নিয়ে গেলাম।
বাবা শারীরিকভাবে যতটা না, তার চাইতে বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এমনিতেই মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা অসুস্থ থাকতেন। বাড়ি ফেরার পর সব আত্মীয় স্বজনেরা বাবাকে দেখতে আসে। সেসময়য় ছোট ফুফু সেখানে আসে।
এতোটুকু বলে ও একটু থামলো। আমি বললাম
তারপর কি হল? সবাই চাইছে জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়েটা হয়ে যাক?
ও চট করে একবার আমার দিকে তাকালো। বলল
তুমি কি করে বুঝলে?
এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ক্যালকুলেশন। তারপর কি হল বল।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না তাই রাতুলের সঙ্গে কথা বললাম। রাতুলের পরামর্শ মতই জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। জাহিদ ভাই যেটা বলল তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না
কি বলল?
বলল, যেটা হচ্ছে হতে দে। এখন এসব বলে মামাকে আর টেনশনের মধ্যে ফেলিস না
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমি যতদূর জানতাম জাহিদ ভাইয়ের পছন্দের কেউ আছে। আবারো বললাম, জাহিদ ভাই আমি একজনকে ভালোবাসি আমাদের সম্পর্ক প্রায় এক বছরেরও বেশি।
জাহিদ ভাই বলল এটা কোন ব্যাপারই না। বিয়ের আগে এরকম একটা দুইটা সম্পর্ক থাকেই। আমি ওসব নিয়ে পরবর্তীতে তোকে কিছু বলবো না। বড়দের কথা শুনে এতটা ভয় পাইনি কিন্তু….
তোমার এই জাহিদ ভাই কি করেন?
বিসিএস ক্যাডার, রাজশাহীতে পোস্টেড
ও আচ্ছা, তারপর কি হল বল
আমি রাতুলকে দিয়েও তাকে বলালা্ লাভ হলো না। শেষমেশ উপায়ান্তর না দেখে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি। বাবা সব শুনে তোমার ব্যাপারে জানতে চাইলো
তুমি কি বললে
সেটা সত্যি তাঁর সবই বলেছি।
উনি কি বললেন?
অনিমা জবাব দিল না, চুপ করে রইল। আমি একটু হাসলাম। বললাম
উনি রাজি হয়নি তাই তো?
হু
ঠিক কি বলেছেন কোথায় আপত্তি?
বাবার কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে এত দায়িত্ব নেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না তাছাড়া তোমার ফ্যামিলি ও মেনে নেবে না।
বিয়ে কবে?
ও চমকে আমার দিকে তাকালো। বলল
মানে?
মানে, বিয়ের তারিখ কবে ঠিক হয়েছে?
ও খুব আস্তে আস্তে বলল
জানুয়ারিতে। যেদিন সব ঠিক হয় আমি তারপর দিনই ফিরে যাই॥ এসব চিঠি লিখে তোমাকে জানাতে পারতাম কিন্তু আমার একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করছিল। কিছু ভাবতে পারছিলাম না তাই চলে এসেছে
ভালো করেছো। এখন চলো
কোথায় যাব
আজ তারটা তুমি হলে থাকবে হিয়ার সঙ্গে\
হিয়া কে?
আমার ক্লাসমেট। সমস্যা হবে না ও তোমার কথা জানে
আমার কথা ?
হ্যাঁ আমি ওকে দিয়ে তোমার বাড়িতে ফোন করিয়েছিলাম
ও অবাক হয়ে বলল, কবে?
পরশুদিন। এখন চলো তো কাল সকালে রওনা দিতে হবে।
কোথায় রওনা দেব?
ঢাকায়
কাল ঢাকা আর পরশুদিন আমরা সিলেট যাব । আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব।
কি কথা বলবে
এক বছর সময় চাইবো।
তোমার বাসায় জানাবে না ?
এই মুহূর্তে না। এখন ওঠো তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ও আমার একটা হাত ধরে বলল
মুনির
বল
বাবা রাজি হবে না
আমারও সেরকম ধারনা। তবু আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই ; যদি রাজি না হন তাহলে আমি বাসায় কথা বলব।
তুমি এখানে?
আমি ভূত দেখার মতন চমকে উঠলাম। সাধারণত ছুটির দিনে আমি দুপুরের খাবার পর একটু বিশ্রাম নেই। পরীক্ষা এসে গেছে তাই খাওয়া শেষ করে রুমে এসে তৈরি করে নিচ্ছিলাম একটু লাইব্রেরী যাব বলে। দরজার কাছে এসেই যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল বোধহয় স্বপ্ন দেখছি। আমার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অনিমা। মুখে ক্লান্তির ছাপ, চুল এলোমেলো; বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘ যাত্রার ধকল ওকে পেয়ে বসেছে। আমার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ও ফ্যকাসে একটু হাসলো। তারপর বলল
ভেতরে আসতে বলবেনা?
আমি ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলাম। বললাম
তুমি এখানে কেমন করে এলে? একাই এসেছো?
ও চারিদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। মানে একাই এসেছে। আমি আবারও বললাম
ঢাকা থেকে একা এসেছো? আমাকে একবার ফোন করতে পারতে। এভাবে একা একা এখানে আসাটা তোমার একেবারেই উচিত হয়নি। তোমাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দিল কে?
মুহূর্তেই ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ও থমথমে কণ্ঠে বললো
আমি তোমার রুম নাম্বার জানি।
আমি অসম্ভব ঠান্ডা মাথার মানুষ, চট করে বিচলিত হয়ে যাই না; তবুও আমার মাথা কাজ করছিল না। অনেক রকম চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, বারবার মনে হচ্ছিল। কি হতো যদি আমি রুমে না থাকতাম, যদি ও অন্য কারো খপ্পরে পড়ে যেত। কত রকম বিপদ হতে পারতো ঢাকা থেকে এখানে আসার পথে। আমি গম্ভীর গলায় বললাম
তোমার এভাবে রুমে চলে আসাটা উচিত হয়নি, নিচে থেকে ফোন করতে পারতে বা কাউকে পাঠাতে পারতে
আমি ওর নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই বিচলিত ছিলাম যে একবারের জন্যও মনে হলো না যে ওইভাবে ও এখানে ছুটে এসেছে নিশ্চয়ই বড় রকমের কোন সমস্যা হয়েছে। আমার মাথায় তখন অন্য সব দুশ্চিন্তা ঘুরছিল মনে হচ্ছিল যদি কোন বিপদ হতো। আমার কথা শুনে ও কেমন কেঁপে উঠলো,
কাঁধে ব্যাগ তুলে নিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল
ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। তোমাকে একবার দেখতে ইচ্ছা করছিল এজন্য এসেছিলাম। তোমাকে বিপদে ফেলতে আসিনি
তারপর আর এক মুহূর্ত দাড়াল না, দরজার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। আমি ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। ও দরজার কাছে চলে এসেছে। চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। মুখ নামিয়ে রেখেছে তবুও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওর চোখ ভর্তি হয়ে আছে জলে।
ও দরজার কাছে এসে বলল
দরজা ছাড়ো, আমি বের হব
কোথায় যাবে এখন?
ফিরে যাব
এখন কি করে যাবে, এ সময় তো কোন বাস ট্রেন কিছুই নেই
তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি যেভাবে একা এসেছি সেভাবে একাই যেতে পারবো।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি রাগ রে বাবা! একটুখানি কথা বলেছি তাতেই এত অভিমান? আমি কি এমনি এমনি বলেছি ওর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল বলেই তো বললাম। ও দরজার আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে আবারো বলল
দরজা ছাড়ো
এত কাছে থেকে আমি ওকে আগে কখনো দেখিনি। ওর গোলাপী গাল অভিমানে লাল হয়ে আছে, চোখের পাতা ভেজা আর নিচের ঠোঁটটা তির তির করে কাঁপছে। আমি হঠাৎই নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারালাম, দুই হাতে ওকে নিটোল মুখটা তুলে ধরে বললাম
আমাকে দেখতে এসেছ, না দেখেই চলে যাবে?
ও জবাব দিলো না একবার চোখ তুলে চাইল না পর্যন্ত। আমি আর একটু এগিয়ে এসে ও টুল্টুলে মুখটা দু চোখ ভরে দেখতে লাগলাম। চোখের পাতার কাঁপন, অভিমানী ফুলে ওঠা ঠোঁট । আমার ভিতরে কি করে যেন হঠাৎ সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। আমি ওকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলাম।
আচমকা আমার এমন আচরণে ও কেমন একটু কেঁপে উঠল, তবে বাধা দিল না। আমি জীবনে কখনো কোন মেয়ের এত কাছে আসিনি। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে আমি যে এমন কিছু করতে পারি আমার ধারনাতেও ছিল না। যে সময়কার কথা বলছি তখন এটা খুব সাধারণ কোন ঘটনা ছিল না। এই কারণে আমি অনেক সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাঁর চেয়েও বড় যেটা, আমি ওর শরীরে সমর্পণের ভাষা টের পাচ্ছিলাম। ও আমার বুকের কাছে শার্টের অংশটা খামচে ধরেছে এত জোরে যে মনে হচ্ছে ছিড়েই ফেলবে।
আমি কতটা সময় ওর মধ্যে ডুবে ছিলাম নিজেও জানিনা, এক সময় টের পেলাম ওর ভেজা গাল। মুহূর্তেই আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। এটা কি করছি আমি? একটা বন্ধ ঘরে এইভাবে একটা অসহায় মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি। কতটা ভরসা করে ও আমার কাছে এসেছে। কতটা ভালবাসলে, কতটা নির্ভর করলেই এভাবে আসা যায়, আর আমি তার এই প্রতিদান দিচ্ছি। তীব্র অপরাধবোধে আমি কেমন কুঁকড়ে গেলাম। ওকে ছেড়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললাম
অনিমা আই এম সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে।
ও কিছু বলছে না, মুখ নামিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর চোখের ভাষা পড়তে পারছি না। ও কি রেগে আছে নাকি এই মুহূর্তে আমাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করছে। যেটাই হোক না কেন দুটোর কোনটাই নেয়ার মতন ক্ষমতা আমার নেই। আমি আবারো বললাম
অনিমা এদিকে দেখো, একবার তাকাও আমার দিকে। ও মুখ তুলে চাইল। ওর চোখে কি ছিল আমি জানিনা তবে সেই দৃষ্টি দেখে আমি শিউরে উঠলাম। সাহস সঞ্চয় করে বললাম
তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?
ও মুখ নামিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়লো
ভয়ে উৎকন্ঠায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, বারবার মনে হচ্ছে এই বোধহয় ও চোখ তুলে আমার দিকে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকাবে। আমি আবারো বললাম
বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু চাইনি।
ও কোন জবাব দিচ্ছে না। আমি মরিয়া হয়ে বললাম
কিছু একটা বলো প্লিজ
ও আচমকাই দুই হাতে আমার গলার জড়িয়ে ধরে বলল
আমাকে কোনদিন ছেড়ে যেওনা মুনির, কোনদিনও ছেড়ে যেও না
আমার এতক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে জমাট বাধা ভয়, উৎকণ্ঠা, দ্বিধা সব কোথায় উধাও হয়ে গেল নিজেও জানিনা। আমি দুই হাতে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বললাম
কোনদিনও যাবো না, কোনদিন ও না।
আমি টের পাচ্ছি ওর শরীরটা কেপে কেঁপে উঠছে। আমার ঘাড়ে মুখ খুঁজে ও কাঁদছে নিঃশব্দে। আমি বাধা দিলাম না, ওকে কাঁদতে দিলাম; নিশ্চয়ই এতটা পথ ধরে অনেক কষ্ট, অভিমান, যন্ত্রণা বুকে করে নিয়ে এসেছে আমার কাছে। এই চোখের জলের সঙ্গে ধুয়ে মুছে যাক ওর সমস্ত কষ্ট। আমি ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বললাম
কি হয়েছে আমাকে বলবেনা
ও চোখ মুছে সরে দাঁড়ালো। ম্লান একটু হেসে বলল
আমি এখন যাই
কেন ভয় করছে?
ও অবাক দৃষ্টিতে তাকাল, যেন আমার কথার মানে বুঝতে পারেনি। আমি ওর হাত দুটো আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম
আমাকে ভয় করছে?
ও এতক্ষণে আমার কথার মানে বুঝল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছি। ও নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে দিল তারপর খুব আস্তে আস্তে আমার বুকের মধ্যে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করল, ধীরে ধীরে বলল
এখানে আসার আগ পর্যন্ত খুব ভয় করছিল জানো, ভীষণ ভয় করছিল, এখন আর করছে না।
আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমার মতো নগন্য একজন মানুষকে কি এতখানি ভরসা করা উচিত? আমি কি একজন রক্ত মাংসের মানুষ নই? আমার মধ্যে কি কামনা বাসনা বলে কিছু নেই? আমি ওর চিবুকটা তুলে ধরে বললাম
সত্যি?
ও অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর থেমে থেমে বলল
তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি?
ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করে ফিরলে মনের অস্থিরতা কমবে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারব কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টোটা। পড়ায় মন বসে না, ল্যবওয়ার্কের সময় আনমনা হয়ে যাই। চোখ মেলে ওকে দেখতে ইচ্ছে করে আর চোখ বন্ধ করলে ওর নিটোল মুখটা ভেসে ওঠে।
এইভাবে আর কতদিন চলবে জানি না। যেদিন ওর চিঠি আসে সেদিন অসহ্য রকম ভালো লাগার মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে যেদিন আসে না তীব্র অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসে। আমি চিঠিতে ওকে লিখেছিলাম সেকথা। ও বারবার বলেছে লম্বা চিঠি লিখে সময় নষ্ট না করতে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে। প্রয়োজন হলে ও প্রতিদিন চিঠি পাঠাবে। আমি চেষ্টা করেও সেটা করতে পারছি না। চিঠি লিখতে বসলে রাজ্যের কথা মাথায় এসে ভিড় জমায়। আমি চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারি না।
আমার অবস্থা দেখেই কিনা জানিনা ও প্রতিদিন চিঠি পাঠানো শুরু করল। আমার মন তবু শান্ত হলো না, ইচ্ছা করে ও পাশে এসে বসু্ক, অবিরাম কথা বলুক, হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ুক। আমিও সেই হাসি দেখি দুচোখ ভরে।
এর মধ্যে দুটো ঘটনা ঘটলো। দুটো পাবলিকেশনে আমার নাম গেল। চেয়ারম্যান স্যার আমাকে আরো কিছু নতুন কাজে্র দায়িত্ব দিলেন। সবমিলিয়ে ব্যস্ততা এত বেশি যে নিজেকে দেবার মতন সময় টুকুও পাই না।
দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস চলে এলো। ভাবলাম ওর জন্মদিনের একদিন আগেই চলে যাব। ওকে চমকে দেবো, কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল সেটা ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।
এবার আমাকে আসতে দেখে বাড়ির লোকেরা খুব অবাক হলেন। প্রথমত, কদিন আগেই ঘুরে গেছি, তার উপর আবার খবর দিয়ে আসিনি। আমি অবশ্য ইচ্ছা করেই জানিয়ে আসিনি, জানালে হয়তো সবাই আসতে নিষেধ করত। আমি আসার কোন বিশ্বাসযোগ্য কারণ তাদেরকে বলতে পারতাম না। প্রচুর কাজ ফেলে এসেছি তাই বেশি দিন থাকবো না। ওর সঙ্গে একটা সুন্দর দিন কাটানোর আশাতেই চলে এসেছি।
তখন আমার কোন সেল ফোন ছিল না, বাড়িতে একটা ল্যান্ডলাইন ছিল সেটা থেকেই চেষ্টা করলাম অনিমার সঙ্গে যোগাযোগ করার। ফোনে কেউ ওকে দিতে পারল না, বাধ্য হয়ে বিকেল বেলা আমাকে ওর হলে চলে যেতে হল।
চারটা নাগাদ ওর হল এর কাছে পৌঁছে ভিতরে কল পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে করতে মনে হচ্ছিল কি জানি কত হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছি। আমি ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে চারটা বেজে গেছে। আসলেই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। এর আরো অনেকক্ষন পরে ছোটখাটো একটা মেয়ে বেরিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনি কি অনিমা আপুর কাছে এসেছেন?
– হ্যাঁ ওর কাছেই এসেছি, ও কোথায়?
মেয়েটা এমন জুলজুলে চোখে তাকিয়ে রইল যে আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগতে লাগলো। খানিক সময় পর ও বলল
– আপনি কি মুনির ভাই?
– হ্যাঁ আমিই মুনির
– আপনাকে দেখার আমার খুব শখ ছিল। আপনি তাহলে সেই, যার জন্য আপু রাত জেগে জেগে চিঠি লেখে
আমি একটু লজ্জা পেলাম, বললাম
– ও কোথায়, ওকে একটু ডেকে দেবেন প্লিজ
মেয়েটা মন খারাপ করা গলায় বলল
– আপু তো আজ সকালের ট্রেনে সিলেট চলে গেছে। আপনি কি খবর দিয়ে আসেন নি?
– না আসলে ওকে জানিয়ে আসা হয়নি, তবে সিলেটে যাওয়ার ব্যাপারটা জানতাম না। আপনার কাছে কি ওখানকার ফোন নাম্বার আছে কিংবা ঠিকানা?
মেয়েটা মন খারাপ করা গলায় বলল
– না ভাইয়া, থাকলে অবশ্যই দিতাম
– আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ
আমি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলাম। বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল আমি ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে আসার কথাটা জানাইনি ও নিশ্চয়ই আমাকে ওর সিলেট যাওয়ার কথাটা জানিয়েছে চিঠিতে। সেইসব চিঠি নিশ্চয়ই এখন আমার ঘরে টেবিলের উপর পড়ে আছে একা একা। কি জানি কেন হঠাৎ করে চিঠিগুলোর জন্য আমার মন কেমন করে উঠলো, ইচ্ছে হলো এক ছুটে চলে যাই।
আমি আসায় বাড়ির লোকেরা যতটা না অবাক হয়েছিল এত দ্রুত ফিরে যাচ্ছি শুনে অবাক হলে তার থেকেও বেশি।সত্যি বলতে আমার আর থাকতে ইচ্ছা করছিল না। আমি পরদিন সকালেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিলাম। যেদিনটা আমাদের একসঙ্গে স্মরণীয় করে রাখার কথা ছিল সেই পুরো দিনটাই কাটলো আমার ট্রেনে।
আমি হলে পৌঁছালাম সন্ধ্যা পার হয়ে যাবার পর। যা ভেবেছিলাম তাই ওর দুটো চিঠি আমার টেবিলের উপর নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে।
চিঠিগুলো পড়ে আমার ভারাক্রান্ত মন আরো ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। প্রথম চিঠিটা অনেক বড়। চিঠি ভর্তি নানান মন খারাপের কথা লেখা। ও লিখেছে ওর বাবার শরীর ভালো নেই। আরো লিখেছে পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি। পরের চিঠিটা লিখেছে সিলেট থেকে। ওখানকার ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়েছে তবে নিষেধ করেছে চিঠি পাঠাতে কিংবা ফোন করতে। আমি ওর নিষেধ অগ্রাহ্য করেই ফোন করলাম। ঠিক করলাম ও ছাড়া অন্য কেউ যদি ফোন ধরে তাহলে রেখে দেবো। প্রতিবারই ফোন ধরল অন্য কেউ। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমি বাধ্য হয়ে হিয়ার শরণাপন্ন হলাম।
হিয়া আমার ক্লাসমেট। আমাদের ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবে যে কজন আছে তাদের মধ্যে হিয়া অসম্ভব আন্তরিক একটা মেয়ে। আন্তরিক বললে কম বলা হবে, ওর মতো উপস্থিত বুদ্ধি আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। মজার মজার কথা বলে মানুষকে চমকে দিতে ও ভীষণ ভালোবাসে। প্রথম দিকে এই কারণে ওকে সবাই ভুল বুঝলেও পরে সবাই বুঝতে পেরেছে ওর মনটা আসলে খুবই ভালো। হিয়ার বাড়িও ঢাকায়। আমার মত ও এখানে হলে থাকে। আমি কল দিলে ও নেমে এসে ভুরু নাচিয়ে বলল
– কি ব্যাপার? প্রফেসর সাহেব আজকে এখানে যে
প্রফেসর উপাধি আমি পেয়েছিলাম সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরপরই। থার্ড ইয়ারে উঠার পর আরো উন্নতি হয়েছে। এখন সবাই প্রফেসর মুনির না বলে আমাকে ডঃ মুনির বলে ডাকা শুরু করেছে। আমি রাগ করি না, হাসি। মনে মনে ভাবি ওদের এই রসিকতা যেন একদিন সত্যি হয়।
হিয়াকে সবটা বলার পর ওর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটতে একটু সময় লাগলো। তারপর ও যথাসাধ্য চেষ্টা করল আমাকে সাহায্য করতে। বার ফোন করার পরও লাভ হলো না। ওকে পাওয়া গেল না। এরপর হিয়া অন্য পথ ধরল। ওর বান্ধবী সুমি নাম করে যে ফোন ধরল তাঁর কাছ থেকে নানান কথা বের করে নিয়ে আসলো। বেশ কিছু অজানা তথ্য জানলাম যার কোনটাই ভালো লাগলো না। ওর বাবার স্ট্রোক করেছে। এর আগেও একবার মাইল্ড স্ট্রোক করেছিল, এটা দ্বিতীয়বার। বুঝলাম কেন ও ফোন ধরছে না কিংবা চিঠি লিখতে পারছে না। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, এরকম একটা সময়ে আমি ওর পাশে থাকতে পারছি না। ও আমাকে সবসময়ই বলত, ওর মন খারাপ হলে কিংবা কষ্ট হলেও ওর আমার কথা ভীষণ মনে পড়ে। আমার ইচ্ছা হল ছুটে চলে যাই ওর কাছে। ওর হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকি কতক্ষণ। আমার সেই ইচ্ছাটা যে এমন ভাবে পূরণ হবে সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি।