ভীত ভীত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মায়া।মুখে হাসি নেই তার।বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে।আরিয়ান ফিরছে না কেনো এখনো!মামা-মামি নিচে ডাইনিং টেবিলে খাওয়া-দাওয়া করছে।বাচ্চাদের নিয়ে সে আর নামেনি।তন্ময় ইতিও নিচে।উপর তলায় শুধু সে আর বাচ্চারা একা।কস্মিককালেও সে ভাবেনি রাহাত তাদের বাসায় আসবে।কিন্তু সে এসেছে।শুধু আসেইনি বর্তমানে সে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে ঠি ক মায়ার মুখোমুখি।যদিও এখন পর্যন্ত সে উল্টা পাল্টা কিছু বলেনি।তবুও মায়ার ভয় লাগছে।রাহাতকে সে বিশ্বাস করতে পারেনা।সেই ঘটনার বছর পেরিয়ে গেলেও ভয়টা কাটেনি তার।প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন একবার মামার বাসায় গিয়েছিলো তখন লাস্ট দেখা হয়েছিলো রাহাতের সাথে।তাও শুধুমাত্র কয়েক মুহুর্তের জন্য।তাদের দেখেই নিজের রুমে চলে গিয়েছিলো রাহাত।পরে আর বের হয়নি।
মায়ার দিকে তাকায়নি রাহাত।কোলে থাকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে খেলছে।মায়া থম ধরে সেদিকে চেয়ে আছে।হঠাৎই নিচু কন্ঠে বলে উঠে রাহাত,
—“আমি কিন্তু আপনাকে এখনো ভালবাসি মায়া।”
চট করে মাথা নামিয়ে ফেলে মায়া।অসস্তি শুরু হয়ে যায় তার।উশখুশ করে।রাহাত কেন আবারো এসব বলছে সে জানেনা।
মায়ার নত মুখের দিকে তাকায় রাহাত।ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত করে ডাকে,
—“মায়া?”
একবার তাকিয়ে আবারো মাথা নামিয়ে ফেলে মায়া।মিনমিন কন্ঠে বলে,
—“দেখুন,আপনি দয়া করে এসব আর বলেননা প্লিজ।”
রাহাত কিছুক্ষন চুপ করে থাকে।মেয়েটা তার কোলেই ঘুমিয়ে গেছে।রাহাত হাসে।মায়াকে সে প্রচন্ডভাবে নিজের করে চায়।হয়তো এই চাওয়াটা অনর্থক,নিষিদ্ধ।তবুও নিজেকে বোঝাতে পারেনা সে।হতে পারে এইটা ভালোবাসা না।তার ক্ষনিকের মোহ,মায়ার অতিরিক্ত রুপের কারণে সে তার প্রতি আকৃষ্ট।যাই হোক না কেন,মায়াকে প্রথম দেখেই তার ভালো লেগেছিলো।সেই ভালোলাগাটা এখনো বিদ্যমান।
মায়া কিছু বললোনা।রাহাত আবারো বলে,
—“আমার খুব করে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে।”
এটুকু বলতেই ভয়ে সিটিয়ে যায় মায়া।চোখ বড় বড় করে রাহাতের দিকে তাকায়।
রাহাত তাড়াহুড়ো করে বলে,
—“আরে না না,আমি সেরকম কিছু করবোনা।আমি জানি আপনি আমার নন।আপনাকে জড়িয়ে ধরার অধিকার নেই আমার।তাছাড়া আপনি কষ্ট পাবেন সেরকম কিছু আমি কখনোই করবোনা।”
একটু শিথিল হয় মায়া।শান্ত কন্ঠে অনুরোধের স্বরে বলে,
—“আপনি প্লিজ এখান থেকে যান।উনি আপনাকে এখানে দেখলে রাগ করবেন।”
রাহাত একটা ফাঁকা ঢোক গিলে।একহাতে মাথা চুলকে বলে,
—“আপনি আমাকে ঘৃণা করেন তাইনা?”
—“নাহ্ ঘৃণা করিনা,তবে ভয় লাগে।”
মায়ার এমন সহজ স্বীকারক্তিতে আরো একবার মুগ্ধ হয় রাহাত।উঠে দাড়ায় সে।মায়া চোখ তুলে তাকাতেই দেখে রাহাত তার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে।ঝট করে অন্যদিকে তাকাতেই রাহাত বলে,
—“আমার অনুভূতিগুলোকে আমি সামলে নিব মায়া।আপনি সুখী হন।আমি নাহয় আমার নিষিদ্ধ প্রণয়টুকু আঁকড়ে ধরে ব্যর্থ প্রেমিক হয়েই থেকে যাব”।
বলে আর একমূহুর্ত অপেক্ষা করেনা রাহাত।হনহন করে বেরিয়ে যায়।মায়া হতভম্ব হয়ে চেয়ে রয়।রাহাতের কথাগুলো মনে মনে আওড়ায়।মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
কষ্ট হলেও কিছু করার নেই তার।আরিয়ানকে ছাড়া আর কাউকে সে কখনোই ভাবতে পারেনা।তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বে শুধু সেই ব্যক্তিটিই আছে।
সিঁড়ির কাছে আসতেই রাহাত লক্ষ করে আরিয়ান দ্রুতপায়ে উপরে উঠছে।নামতে গিয়েও থমকে দাড়ায় সে।আরিয়ান তার দিকে ঝলসানো দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে।
রাহাত ম্লান হেসে বলে,
—“কিছু করিনি ভাইয়া।তোমার বাচ্চাদের দেখতে এসেছিলাম।মাশআল্লাহ খুব সুন্দর ওরা”
বলে চট করে নেমে যায় রাহাত।
আরিয়ান ভ্রু কুচকায়।রাহাতকে কখনো এমন স্বরে কথা বলতে দেখেনি সে।সবসময় একটা রূঢ় কন্ঠে কথা বলে সে।তবে আজকে এমন ভাঙাচোরা কেন তার স্বর?
____________
সারাদিনে রাহাতের ব্যাপারে আর কিছু বলেনি আরিয়ান।মামা-মামি গিয়েছে সন্ধ্যাবেলা।এসে আর শাওয়ার নিতে পারেনি সে।
মাত্র শাওয়ার থেকে বেরিয়ে দেখে মায়া চুল আচরাচ্ছে।বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে খাটের মাঝখানে।
পেছন থেকেই মায়ার পেট জড়িয়ে ধরে আরিয়ান।ঘাড়ে মুখ গুঁজে গভীর অঁধরের স্পর্শ দেয়।ঘাড় কাঁত করে ফেলে মায়া।বলে,
—“আপনার গা ভেজা।আমি ভিজে যাচ্ছিতো।”
—“ভিজুক”।
—“গা মুছে আসেন”।
—“আসেন আমি মুছে দেই”এটাও তো বলতে পারো।”
মায়া দু ঠোঁট চেপে মুখ লটকায়।আরিয়ানের হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে আয়না দিয়ে তাকিয়ে আরিয়ানের মতো করেই বলে,”আসেন আমি মুছিয়ে দেই”।
মাথা ঝুকিয়ে হেসে তাকে ছেড়ে দেয় আরিয়ান।টাওয়ালটা নিজের হাতে নিয়ে বলে,
—“হয়েছে লাগবেনা।…কাবার্ড থেকে একটা টি-শার্ট বের করে দাওতো।”
মায়া মুচকি হেসে টি-শার্ট বের করে হাতে দেয়।আরিয়ান তা পরতে পরতে বলে,
—“রাহাত কি বলেছে তোমাকে?”
মায়া কোন দ্বিধা ছাড়াই সবটা বলে আরিয়ানকে।আরিয়ানের কাছে কোনো জড়তা নেই তার।
আরিয়ান মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনে।রাগ ওঠলেও প্রকাশ করেনা সে।সবটা বলে মায়া বিষন্ন কন্ঠে বলে,
—“মানুষ কেন ভুল মানুষকে ভালোবাসে বলেনতো?খুব খারাপ লেগেছে উনার কথাগুলো শুনে”
আরিয়ান স্নিগ্ধ ভাবে হাসে।মেয়েটা সত্যিই খুব নরম।খুব বেশিই নরম।তাকে হাত ধরে কাছে টেনে নেয় আরিয়ান।মাথায় হাত রেখে বলে,
—“মন খারাপ করেনা,ও হয়তো ঠি ক কাউকে পেয়ে যাবে সঠিক সময় হলে”।
মায়া ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকায়।মৃদু হেসে বলে,
—“আপনি সত্যিই খুব ভালো।ভেবেছিলাম আমাকে বকবেন।কিন্তু বকেননি।”
আরিয়ান কিছু বলার আগেই চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয় ছোট্ট পরীটা।মায়া হতাশ কন্ঠে বলে,
—“যান আপনার বাবাপাগলী মেয়ের কান্না থামান।আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।”
আরিয়ান হেসে এগিয়ে যেয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়।ছেলেটা চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে।
মেয়েকে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ায় আরিয়ান।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
—“কাঁদেনা আম্মুটা,বাবা এসে পরেছিতো।কান্না থামাও।”
বলতে বলতেই কান্না থেমে যায় মেয়েটার।আরো কিছুক্ষন হাটাহাটি করে তাকে ঘুম পারায় আরিয়ান।কপালে চুমু খেয়ে তাকে নিয়ে রুমে যায় সে।অত:পর বুকে নিয়েই শুয়ে পরে।
প্রায় একঘন্টার চেষ্টায় স্বাভাবিকভাবেই ডেলিভারি হলো মায়ার।বাচ্চাদের কান্না শুনতেই একরাশ প্রাণভরা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে।এতোক্ষনের অশ্রুভেজা চোখগুলোতে খেলা করছে এক অনন্যময়ী মাতৃত্বের সুখ।তবে জ্ঞান হারায়নি সে।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে বেডে মাথা এলিয়ে দিতেই আরিয়ান তার দিকে ঝুঁকে গেলো।এই একটা ঘন্টা যে সে কিভাবে পার করেছে!একাধারে বাচ্চা আর স্ত্রীর চিন্তা তার মাথায়।
কপালে অধরের স্পর্শ দিতেই মলিনভাবে হাসলো মায়া।কপাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরতেই মায়া আরিয়ানের বাহুতে হাত রেখে বললো,
—“আপনি কাঁদছেন কেনো?”
আরিয়ান মাথা উঠায়না।আজ পর্যন্ত তার কান্না নিজ চোখে দেখেনি মায়া।শুধু দেখেছে তার লাল লাল চোখগুলো।
সে অবস্থাতেই মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আরিয়ান।ধীর কন্ঠে বলে,
—“তোমার খুব কষ্ট হয়েছে মায়াবতী?”
মায়া উওর দেয়ার আগেই দরজা খুলে প্রবেশ করলো ড.মিতালী আর একজন নার্স।আরিয়ান দ্রুত মাথা উঠিয়ে তাকালো।তাদের কোলে সাদা টাওয়ালে পেঁচানো বাচ্চারা।ড.মিতালী এসে আরিয়ানের কোলে একজনকে দিতে গেলেই সে আৎকে উঠে বললো,
—“না,না আমি নিবোনা।ওরা ব্যাথা পাবে।আমার হাত শক্ত।”
আরিয়ানের কথা শুনে হেসে দিল ড.মিতালী।তার পিছে এসে দাড়িয়েছে ইতি আর তন্ময়।আরিয়ান তন্ময়কে
উদ্দেশ্য করে বললো,
—“তুই কোলে নে।”
আরিয়ান মায়াকে উঠিয়ে বসাতেই ড.মিতালী একজনকে কোলে দিলেন।আরেকজন তখন তন্ময়ের কোলে।ড.মিতালীর ভাষ্যমতে মায়ার কোলেরজন অপরজনের থেকে তিনমিনিটের বড়।বড়জন ছেলে আর ছোটজন হলো মেয়ে।
অদ্ভুত ভাবে বাচ্চাটার দিকে চেয়ে আছে মায়া।তার কোলে তাদের বাচ্চা ভাবতেই অবাক লাগছে।হাত পা নাড়াচ্ছে বাচ্চাটা।মায়া তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।কপালে চুঁমু খেলো।
আরিয়ান মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে।হঠাৎই তন্ময়ের কোলেরজন কেঁদে উঠে।তন্ময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
—“বাবা কোলে নিচ্ছেনা দেখে কাঁদছো প্রিন্সেস?”
উওরে হয়তো আরো জোরে কান্না করে দিলে বাচ্চাটা।তন্ময় এগিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—“ভাই,কোলে নেন।আপনি বাবা।আপনিই কোলে নিচ্ছেননা।আপনার মেয়েটাও কাঁদছে।”
আরিয়ান একবার তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কোলে নিলো তাকে।আশ্চর্যজনকভাবে হলেও বাচ্চাটার কান্না তখনই থেমে গেলো।বাবার বুক ঘেঁষে রইলো সে।আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।একহাতে বুড়ো আঙ্গুল চুষছে বাচ্চাটা আর বড় বড় চোখগুলো ঘুড়িয়ে ঘুরিয়ে আরিয়ানকে দেখছে।
মায়ার ঠোঁটে উজ্জল হাসি।বাবা-মা হওয়ার সুখটা নিজের চোখে দেখছে সে।নিজের বাচ্চা,নিজের একটা অংশকে কোলে নেয়া যে কতটা তৃপ্তিময়!এতো আনন্দ!
_______________
গতকালকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে মায়াকে।শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ মায়া।আর কোন সমস্যা নেই।
বিছানায় বসে একজনকে ফিডিং করাচ্ছে।আরেকজন পাশেই ঘুমিয়ে আছে।ইতি গেছে তার খাওয়ার প্লেটটা নিচে রাখতে।এতক্ষন সেই খাইয়ে দিচ্ছিলো মায়াকে।
জরুরি ফোন আসায় আরিয়ান কানে ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে গেছে একটু আগে।অফিস থেকে ফিরেছে সে সন্ধ্যার দিকে।
মায়া অলস ভঙ্গিতে দুই পা ভাঁজ করে বসে আছে।ঘুম আসছে তার।চোখে প্রচন্ড ঘুম।তবুও বাচ্চাটা কাঁদছিলো দেখে ফিডিং করাচ্ছে।নয়তো কথনই ঘুমিয়ে পরতো।ব্যালকনি থেকেই মায়াকে ঘুমে ঢুলে পরতে দেখে দ্রুত ফোন কেটে পকেটে ঢুকিয়ে রুমে আসলো আরিয়ান।বললো,
—“ঘুম আসছে মায়া?তাহলে ঘুমিয়ে পরো।ওকে আমার কোলে দাও।”
মায়া আবছা চোখে তাকালো।জড়ানো কন্ঠে বললো,
—“ক্ষুধা পেয়েছে ওর।কাঁদছিলো তাই খাওয়াচ্ছি।শেষ হলে ঘুমাবো।”
আরিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো।মায়ার পিছে বসে তার মাথা নিজের বুকে নিয়ে বললো,
—“ঘুমাও তুমি।ওর খাওয়া শেষ হলে আমি শুইয়ে দিবোনে।”।
মায়া মুচকি হেসে চোখটা বন্ধ করলে সাথে সাথে কেঁদে উঠে পাশে রাখা বাচ্চাটা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিকে তাকায় মায়া।ততক্ষনে খাওয়া শেষ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে তার মেয়েটা।
আরিয়ান মায়ার কোল থেকে তাকে নিয়ে নিজের কোলে নেয়।মায়ার জামা ঠি ক করে দিয়ে বলে,
—“তুমি একটু শোও মায়া।”
—“ওর ডাইপার চেন্জ করে দিতে হবে।।ডাইপারের প্যাকেটটা একটু এদিকে দেননা।”
আরিয়ান জোর করে মায়াকে শুইয়ে দেয়।নিজেই ডাইপারের প্যাকেটটা নিয়ে বলে,
—“আমি করে দিচ্ছি।”
—“আপনি পারবেননা।”
আরিয়ান একেবারে মায়ার চোখের দিকে তাকায়।মুচকি হেসে বলে,
—“এতবড় বাচ্চাটাকে সামলাচ্ছি আর এই পুঁচকে গুলোকে পারবোনা?নিশ্চিন্তে ঘুমাও মায়াবতী।”
মায়া আর কথা বাড়ালোনা।চুপ করে শুয়ে পরলো।মাথাটা ব্যাথা করছে তার।খানিকবাদেই সে অনুভব করলো একটা শক্তপক্ত হাত তার মাথা টিপে দিচ্ছে।ঘুমের মধ্য চোখ না খুললেও সে বুঝতে পেরেছে এটা আরিয়ান ছাড়া আর কেও নয়।
“আঁধার” শব্দটার মাঝেই লুকিয়ে আছে কিছু সুপ্ত নিকষ কালো রংহীন অনুভূতি।গোটা জীবনটাই যখন একআকাশ আঁধারে ডুবে যায় তখন একটা ক্ষীণ আলোও সেখানে অনেকটা উজ্জল দেখায়।।রাতের অন্ধকার আকাশের বুকে সেই উজ্জল করা ক্ষীণ আলোটা হলো সন্ধ্যাতারা।
_____________
ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রী।চাঁদের আবছায়া আলোয় এক নিদ্রাচ্ছন্ন মায়াপরী।যার সর্বাঙ্গে বিরাজ করছে সৌন্দর্যের এক অদ্ভুত খেলা।
পাতলা ঠোঁটজোড়ার মাঝখানটায় মৃদু ফাঁক হয়ে আছে।সোজা হয়ে শুয়ে একহাত একপাশে ভাঁজ করে রেখেছে আর আরেকহাত মেলে বাচ্চাদুটোকে বাহুর উপর ঘুম পারিয়ে রেখেছে মায়া।চুপটি করে ঘুমিয়েও আছে দুজনে।
আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।জীবন কতটাই না সুন্দর!তার এই ঘুমন্ত পরীটা জীবনে না আসলেও কি সবকিছু এত স্নিগ্ধ লাগতো?একমূহুর্ত অপেক্ষা না করে সজাগ মস্তিষ্ক উওর দিলো,”নাহ্”,কখনোই নাহ্।”
দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত আরিয়ান সর্বপ্রথম ঠোঁট ছোঁয়ায় মায়ার কপালে।মায়ার গাল থেকে হাত না সরিয়েই বাচ্চাদের কপালে চুমু খায়।তার চুমু খেয়ে ছোট্ট আদুরে মেয়েটা একটু নড়েচড়ে উঠে।বারদুয়েক দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আবারো ঘুমিয়ে পরে।
গালে হিমশীতল হাতের স্পর্শটা অনেকক্ষন যাবতই প্রায় জাগিয়ে তুলছিলো মায়াকে।তবে ঘুমের মাত্রাটা বেশি হওয়ায় চোখ খুলেনি সে।এখন শীতল স্পর্শের সঙ্গে তপ্ত নি:শ্বাসও মুখের উপর আছড়ে পরায় চোখ খুললো সে।তার উপর ঝুঁকে থেকে আধা ইন্চি দুরত্বে অবস্থান করছে আরিয়ান।
হঠাৎই চোখের পলক আটকে যায় মায়ার।আরিয়ানের চোখে ঘোর লাগানো চাহনী।নিমিষেই তাকে লজ্জায় ডুবিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে সেই দৃষ্টিতে।চোখ নামিয়ে ফেলে মায়া।অষ্পষ্ট কন্ঠে বলে,
—“আপনি…”
বাকি শব্দগুলো বের হবার আগেই তার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয় আরিয়ান।চোখ বন্ধ করে ফেলে মায়া।
এখনও আরিয়ান এভাবে স্পর্শ করলে তুমুল লজ্জা লাগে তার।পাশের হাতটার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখেছে আরিয়ান।আর এপাশের হাতে বাচ্চারা শুয়ে আছে আর উপরে আরিয়ান।তথাপি নড়াচড়া করার কোনো সুযোগ নেই।লজ্জা নিবারণের জন্য নখের আচড়ে আরিয়ানের পিঠ ক্ষতবিক্ষত করার উপায়ও নেই।
ধীরগতিতে চুমু খাচ্ছে আরিয়ান।কোন হিংস্রতা নেই সে স্পর্শে আর না আছে কোন তাড়াহুড়ো।
মায়া চোখ বন্ধ করেই রেখেছে।আরিয়ান আস্তে আস্তে তার ঠোঁট ছাড়ে।মোহময় কন্ঠে বলে,
—“মায়াবতী,চোখ খুলো।”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মায়া।চোখ মেলে দৃষ্টি নামিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে।আরিয়ান তার চেপে ধরে রাখা হাতটা ছাড়ে।ঠোঁটের কাছে এনে একআঙ্গুল দিয়ে হাল্কা স্পর্শে তার কামড়ে ধরা ঠোঁটটা ছাড়ায়।
তবে চোখ মেলায়না মায়া ।আরিয়ান আরো কিছুক্ষন বিনা শব্দ ব্যায়ে তার মুখের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
ইতিমধ্যেই মায়ার গালদুটো লালবর্ণ ধারণ করেছে।আরিয়ান তার গলায় হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে স্লাইড করে শীতল গলায় বলে,
—“আমার দিকে তাকাও”।
আরিয়ানের শীতল কন্ঠে কেঁপে উঠে মায়া।চট করে তার চোখের দিকে তাকাতেই চারচোখ এক হয়ে যায়।চোখেচোখেই অনুভূতিদের মিলনমেলা হচ্ছে।দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি থমকে গেছে।থেমে গেছে সময়।আটকে আছে মূহুর্ত।
বেশ কিছুক্ষন কেটে গেলেও আরিয়ান কিছু বলেনা।একদৃষ্টিতে সে মায়ার চোখের দিকে চেয়ে আছে।
মায়াই চোখ নামিয়ে ফেলে।আমতাআমতা করে নিচু গলায় সে বলে,
—“সরুননা।”
আরিয়ান শব্দহীনভাবে হাসে।মায়ার উপর থেকে সরে গিয়ে বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মেয়েকে নিজের কোলে তুলে নেয়।গুটিশুটি হয়ে বাবার সাথে লেপ্টে থাকে সে।
মায়া অকারণেই হাসে।মেয়েটা বাবার খুব আদুরে।ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে নিলেও কাঁদেনা।আবার যতই কান্না করুক না কেন বাবার কোলে গেলে চুপ হয়ে যায় সে।মায়া মিষ্টি হেসে ছেলেকে বুকে টেনে নেয়।ছেলেটা আবার তার কাছে থাকতে বেশি পছন্দ করে।
__________________
মেয়েটা খুব চুপচাপ।তবে ছেলেটা খুব ছটফট করে।সারাক্ষণ হাত-পা নাড়ায়।দেখলেই বোঝা যায় খুব দুষ্ট হবে।
চেহারায়ও একটা চন্চলভাব।আর অপরদিকে মেয়েটাকে সেই যে রাতের বেলা আরিয়ান বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছে এখন অবধি উঠেনি।
—“ওদের নাম কি রাখবেন ভাই?একসপ্তাহ তো হয়ে গেলো।”।
তন্ময়ের প্রশ্নে ফোন থেকে চোখ সরায় আরিয়ান।বুকের ছোট্ট পরীটার মুখ দিয়ে লোল গড়িয়ে পরছে।হাত দিয়ে তা মুছিয়ে দেয় আরিয়ান।মৃদু হেসে বলে,
—“কি নাম রাখবো তন্ময়?তুই বল কিছু।”
তন্ময় হাসে।আরিয়ান সবচেয়ে বেশি কনফিউজস থাকে বাচ্চাদের ব্যাপারে।এমনে কত শত মিটিং ডিল করে একদিনে।একভাবায় ডিসিশন নিয়ে নেয়।আর বাচ্চাদের বিষয়ে কোন ডিসিশন নিতে গেলে, কিছু করার আগে একশবার ভাবে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে মায়া।তার চোখেমুখে পানি।টাওয়াল দিয়ে তা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছে সে।
মোছা শেষে তন্ময়ের দিকে এগিয়ে যায়।দুহাত বারিয়ে বলে,
—“দিন ভাইয়া।আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”।
—“আরে না ভাবি।সমস্যা নেই।আপনি যান নাস্তা খেয়ে নেন।ও থাকুক আমার কোলে।”
—“আপনারা অফিসে যাবেননা?”
আরিয়ান বিছানায় হেলান দিয়েই একটু সোজা হয়ে বসে।মেয়েকে সুন্দরমতো জড়িয়ে নিয়ে বলে,
—“তুমি ব্রেকফাস্ট করে নাও।অফিসের দেরি আছে এখনো।যাও”।
মায়া মাথা নাড়িয়ে বের হতে নিলেই হাতে নাস্তা নিয়ে প্রবেশ করে ইতি।টেবিলে রেখে বলে,
—“আপনার খাবারটা আপু।কষ্ট করে নিচে নামতে হবেনা।”
মায়া মুচকি হেসে বসে পরে।সে খাচ্ছে তখনই তন্ময় বলে,
—“বাচ্চাদের নাম ঠিক করেছেন ভাবি?”
মুখে খাবার নিয়েই তাকায় মায়া।বলে,
—“নাতো ভাইয়া।”তারপর আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,”উনি যা বলবেন তাই রাখবো।”
তন্ময় আবারো হাসে।বলে,
—“ভাই তো নিজেই জানেননা”।
মায়া বোকা হাসে।বাস্তবিকই এ বিষয়ে কিছু ভাবেনি সে।অনেকক্ষন গল্পগুজব করলেও নাম ঠি ক করতে পারলোনা তারা।অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো এ নিয়ে পরে কথা হবে।আপাতত থাক!
________________
বিপত্তি বাঁধে মেয়েকে নিয়ে।আরিয়ান কোল থেকে নামাতেই কান্না জুড়ে দিয়েছে সে।চিৎকার করে কান্না করছে।মায়া হাজার চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছেনা।উপায় না পেয়ে তাকে তাকে আবারো বুকে জড়িয়ে নিল আরিয়ান।কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করতেই কান্না থেমে গেল।শান্ত হয়ে গেলো একদম।
তাকে কোলে নিয়েই মায়ার সাহায্য শার্ট পরলো আরিয়ান।আরিয়ান হাত বাড়িয়ে দিলে তাকে ঘড়ি পরিয়ে দিল মায়া।মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে আস্তে করে বললো,
—“ঘুমিয়েছে?”
আরিয়ান চোখে ইশারায় “হ্যাঁ” বোঝালো।অত:পর যত্ন করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল।মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো আরিয়ান।পাশেই শুয়ে আছে বড় ছেলে।যদিও মাত্র তিন মিনিটের ছোট বড় তবুও ছোট বলেই হয়তো মেয়েটা একটু বেশি আদুরে।
__________________
বিকেলবেলা মামা-মামি এসেছেন বাসায়।তাদের আসার খবর শুনেই দ্রুত বাড়িতে ফিরছে আরিয়ান।কারণ ইতির কাছ থেকে সে শুনেছে তাদের সাথে এসেছে রাহাতও…
নিশুতি রাতের কান্নাগুলো আটকে আছে।মাঝেরাতের নিস্তব্ধতা চিঁড়ে আরিয়ানের বুকের ভেতর চলছে বিধ্বংসী ঝড়।শ্বাস নেয়ার সাহসটুকো পাচ্ছেনা সে।বদ্ধ বদ্ধ লাগছে।নিজের সাথে নিজেকে সামলে নেয়ার নিরন্তর যুদ্ধ করছে।রাতের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে দিনের আলো উঁকি দিচ্ছে গহীন আকাশে।
এই ভোরবেলাই ড.মিতালী কে ফোন করায় ছুটে এসেছেন তিনি।হসপিটালে এখন কোন ডাক্তার নেই বিধায় সেখানে নিয়ে যাওয়াটা বোকামি ছাড়া কিছুইনা।ইতি আর ডক্টর মিতালী প্রায় একঘন্টা যাবত রুমের ভেতর আছে।রুমের বাইরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান।তার পাশেই তন্ময়।
বেশ অনেকক্ষনের নিরবতা ভেঙে তন্ময়ই বললো,
—“ভাবির ব্লিডিং তো থেমে গেছে ভাই।টেনশন নিয়েন না।ভাবি আর বাচ্চারা তিনজনই সুস্থ থাকবে, দেখেন।”
আরিয়ান অসচ্ছ চোখে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
—“মেয়েটা আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল অথচ ওর ব্লিডিং হচ্ছে আমি খেয়ালই করলাম না তন্ময়।দোষটা তো আমারই।”
তন্ময় দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে।আরিয়ানকে বোঝানো তার পক্ষে অসম্ভব।যদিও তার নিজেরও মাথা ঘুরছে।আরিয়ান ডাকার পর মায়ার রক্ত দেখে নিজেও প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়েছিলো।সম্পর্কে মায়া তার ভাবি হলেও বয়সে তার থেকে খুব ছোট।ভাবি হিসেবে যেমন সম্মান করে তেমনই ছোটবোনর মতোই তাকে খুব স্নেহ করে তন্ময়।
তার ভাবনার মাঝেই গেট খুলে বেরিয়ে আসে ড.মিতালী।তার ক্লান্ত চেহারাতে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে আরিয়ানকে বলে,
—“আপনার স্ত্রী সুস্থ আছেন।বাচ্চাদের হার্টবিট ও ঠিক আছে।মূলত যতটা দেখা গেছে ততটা রক্ত বের হয়নি।সুতি কাপড়ে রক্ত ভিজে ছড়িয়ে পরেছিলো তারউপর উনি সাদা জামা পরে ছিলেন তাই মনে হচ্ছিল অনেক ব্লাড।কিন্তু আসলে অতটা ব্লিডিং হয়নি।আর এটা স্বাভাবিক।আপনাকে বললাম না ব্লিডিং হওয়া মানেই মিসক্যারেজ না।আপনার স্ত্রীর বয়সটা একটু কম,ফার্স্ট টাইম প্রেগন্যান্সিতেই টুইন বেবি হবে আর এমনেই উনি একটু নাজুক,আদুরে প্রকৃতির।ইমিউনিটি সিস্টেম একটু লো।একটু ব্লিডিং হয়েছে যদিও আমার ধারণা এটা ব্যাথাহীন ব্লিডিং তবুও দেখেন উনি ঘুমের মধ্যই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন।”
আরিয়ান স্বস্তির হাসি হাসে।এতক্ষন বুকের উপর চেপে থাকা পাথরটা নেমে যায়।
—“রক্তটা কেন বের হলো ডক্টর?ওর কিছু হবোনাতো?”
—“আশা করছি কিছু হবেনা।সাতমাসে যদিও ব্লিডিং হয়না।তবুও উনার হয়েছে।সমস্যা নেই।”এভরি প্রেগন্যান্সি ইজ্ ডিফারেন্ট”।উনি সুস্থ আছেন এটাই খুশির।আমি মেডিসিন লিখে দিয়েছি।কাল থেকে টাইমলি খাওয়াবেন।এখন স্যালাইন চলছে,দূর্বলতা কেটে যাবে।
আর আগামী তিনমাসে উনাকে বেশি লাফালাফি করতে দিবেন না।বেড রেস্টে থাকবে এটাই বেটার হবে।”
—“আচ্ছা ডক্টর।আমি খেয়াল রাখবো।আপনি আজকের রাতটা গেস্টরুমে থেকে যান।সকাল হলে বাসায় পৌছে দিবোনে।”
ড.মিতালী হাসেন।আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
—“সরি বাট আমি থাকতে পারবোনা।আমার মেয়েটা বাসায় একা।আমার ফিরতে হবে।আই হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্টেন্ড।
আরিয়ান আর জোর করে করেনা।ড.মিতালীর স্বামী নেই সে জানে।পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে যার সাথে আরিয়ানের দু চারবার দেখা হয়েছে।বেশ মিষ্টি মেয়েটা।তার কারণে বাচ্চা মেয়েটাকে বাসায় মাঝরাতে একা রেখেই চলে এলো ড.মিতালী ভাবতেই মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো।
_______________
ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করলো আরিয়ান।খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে মায়া।কেউ আসার শব্দে চোখ মেলে তাকালো সে।আরিয়ানকে দেখে সে দূর্বল গলায় বললো,
—“আপনি এতক্ষন কোথায় ছিলেন?সবসময় আমার কাছে কাছে থাকবেন।আপনাকে ছাড়া আমার ভয় করে।”
আরিয়ান দরজা আটকিয়ে মায়ার কাছে এসে বসে।
মায়া ক্ষীণ হেসে ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হাতটা আরিয়ানের হাতের উপর রাখে।
আরিয়ান হুট করে ঝুকে মায়াকে নিজের সাথে লেপ্টে নেয়।তার একহাত মায়ার কোমড় আরেকহাত মায়ার ঘাড়ের পিছে।কয়েক মূহূর্তের মাথায় মায়াকে অসংখ্য চুমু তে ভরিয়ে দিতে থাকে সে।
মায়ার গাল,কপাল,গলা ছেঁয়ে যায় আরিয়ানের তীব্র ভালবাসার স্পর্শে।ভালবাসার ঝড় থেমে যেতেই তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রাখে আরিয়ান।দ্বিতীয়বারের মতোন মায়া তার ঘাড়ে চোখের জলের অস্তিত্ব টের পায়।আলতো করে আরিয়ানের পিঠে হাত রেখে সে বলে,
—“কাঁদছেন কেনো?”
উওরে আরিয়ান আরো বার দুয়েক তার ঘাড়ে ঠোঁট ছুইয়ে ভেঁজা কন্ঠে বলে,
—“মায়াবতী তুমি…।”
আরিয়ান আরো বেশ কিছুক্ষন মায়াকে জড়িয়ে রেখে ছেড়ে দেয়।চোখ লাল হয়ে আছে তার।ঠোঁটগুলো রক্তিম।
স্যালাইন শেষ হলে মায়ার ক্যানেলাটা খুলে দিয়ে তাকে শুইয়ে দেয় আরিয়ান।ঘরের লাইট নিভিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে মাথায় হাত রাখে।
মায়া তখনো সজাগ।ঘরের হাল্কা আলোয় আরিয়ানকে দেখা যাচ্ছে।মায়া তার মাথায় রাখা হাতটা নিজের দুহাতে চেঁপে ধরে বুকের মাঝখানটায় নিয়ে বলে,
—“জানেন,বাবাও না আমাকে খুব ভালোবাসতো।আপনার মতোই পাগলামি করতো।আমার কিছু হলে অস্থির হয়ে উঠতো।আমি শান্ত হতে বললেও শান্ত হতোনা।এতো কঠিন মানুষটাও কেঁদে দিত।ঠিক আপনার মতোই।কিন্তু দেখেন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।আচ্ছা আপনিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”
—“আজেবাজে কথা না বলে ঘুমাও মায়া।তুমি না ঘুমালেতো বাচ্চারাও ঘুমাতে পারেনা।”
বিষন্নতার মাঝেও ফিক করে হেসে দেয় মায়া।হাসিমাখা কন্ঠে বলে,
—“এটা কে বললো আপনাকে?”
—“হয়েছে চুপ করেন।এখন আপনি আর কথা বললে আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো।”
আরিয়ান বোকা হাসে।দুটো বাচ্চার বাবা হবে তাই হয়তো দিন দিন এতো বোকা হয়ে যাচ্ছে সে।
______________
বাগানের নরম ঘাসের উপর হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে মায়া।মুখে নজরকাড়া হাসি নিয়ে খেলে চলেছে জ্যাক আর জেনির সাথে।
ঘাসের মাঝখানেই বসার জায়গা আছে আরিয়ান সেখানেই বসে আছে কিন্তু মায়া বসেনি।তার ওরকম পা ঝুলিয়ে বসতে তার কষ্ট হয়।অনেক বাঁকবিতন্ডতার পর আরিয়ান তাকে বাগানে এনেছে।নয়তো এই তিনমাস যাবত তাকে একদম ঘোরাফিরা করতে দেয়না আরিয়ান।দিলেও সবসময় নিজে সাথে থাকে।
মায়া মিষ্টি করে হেসে তন্ময়ের হাত থেকে চকলেটটা নিতেই আরিয়ান গম্ভীর গলায় বলে,
—“তুই ওকে এত চকলেট কেন দেস তন্ময়?সারাদিন খালি খাবারের বদলে চকলেট চকলেট করে।আর তুই ওকে এনেও দেস”।
আরিয়ানের কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকায় মায়া।ততক্ষনে ঠোঁটের চারপাশে ভরিয়ে চকলেট খেতে শুরু করেছে সে।খেতে খেতেই সে বলে,
—“আপনার কি সমস্যা?”
মায়ার এমন বাচ্চা বাচ্চা চাহনী দেখে না চাইতেও হেসে দেয় আরিয়ান।বলে,
—“আচ্ছা খাও।”
তন্ময় পকেট থেকে আরেকটা চকলেট বের করে দিয়ে মায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
—“ওটা শেষ হলে এটা খেয়েন,আপনারা তিনজন মানুষ একটা চকলেটে হয় নাকি!।”
আরিয়ান ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।দুই বাচ্চার মা হবে এই মেয়ে তবুও তরা বাচ্চামো স্বভাব যায়না।বকা দিলে এখনো বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়।
ডেলিভারির ডেটের আর এক সপ্তাহ বাকি আছে।তিনদিন পর মায়াকে হসপিটালে এডমিট করা হবে।এবার সব ভালোয় ভালোয় হলেই হয়।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে।সারাদিনের ছন্নছাড়া পাখিগুলো নিজ নিজ বাসস্থান ফিরে যাচ্ছে তাদের ক্লান্ত ডানাগুলো ঝাপটে।
বিকেলের মিষ্টি রোদের কিছুটা এখনও চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে।সেই ক্ষীণ আলোই তীর্যক আকারে মায়ার উপর আছড়ে পরেছে।।ঘন কালো চুলগুলোয় সোনালি আভা।ঠোঁটের চারপাশে ভরিয়ে চকলেটের দ্বিতীয় প্যাকেটটা শেষ করছে সে।আরিয়ান তাকে রুমে যেতে বললেও সে জেদ করেই যায়নি।এতদিন পর বাগানে এসেছে,এত তাড়াতাড়ি নাকি সে যাবেনা।জ্যাক আর জেনিও অলস ভঙ্গিতে মায়ার পাশে বসে রয়েছে।এতক্ষণ অবিশ্রামভাবে মায়ার সাথে খেলা করছিলো তারা।
একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো আরিয়ান।ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে মায়ার সামনে একহাঁটু গেড়ে বসলো।মায়ার চকলেট খাওয়া শেষ।হাতে খালি প্যাকেট হাতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে চেয়ে আছে সে।আরিয়ান মায়ার গায়ের ওড়না ঠি ক করে দিয়ে হাতের ইশারায় একজন বডিগার্ডকে ডাকলো।লোকটা মাথা নুইয়ে সামনে এসে দাড়াতেই সে মায়ার হাত থেকে চকলেটের প্যাকেটগুলো নিয়ে লোকটার হাতে দিয়ে বললো,
লোকটা ওদের নিয়ে চলে যেতেই আরিয়ান পকেট থেকে রুমাল বের করলো।পাশের পানির বোতল থেকে রুমালটা ভিজিয়ে আলতো করে মায়ার ঠোঁটের চারিপাশ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“অনেকক্ষন থেকেছো বাগানে।এখন রুমে যেয়ে চুপ করে ঘুমাবা।ঠিকাছে?”
মায়া দুষ্ট হাসলো।আরিয়ান ঠোঁট ক্লিন করে রুমালটা সরাতেই সে হাতে লাগা চকলেট গুলো আবারো চারপাশে লাগিয়ে দিল।
আরিয়ান রাগী দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করতেই সে মিষ্টি হেসে মুখ বাড়িয়ে বললো,
—“মুছিয়ে দিন।তারপর তাড়াতাড়ি রুমে চলেন।প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।”
আরিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো।পুনরায় তার হাত,মুখ মুছে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে উঠালো মায়াকে।
ধীরে ধীরে রুমে নিয়ে বিছানায় বসাতে নিলেই “আহ্”বলে মাঝারি আকারে চিৎকার করে উঠলো মায়া।আরিয়ান তাকে বসিয়ে দিয়ে দ্রুত গলায় বললো,
—“কি হলো?পেইন উঠেছে?”
মায়া পেটে হাত দিয়ে পরপরই আবারো চিৎকার করে উঠলো।দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
—“আপনার বাচ্চারা আমাকে লাথি দিচ্ছে।দুইজন একসাথে শুরু করেছে বোধহয়।”
ঠোঁটের কোঁণে স্বস্তির আভাস দেখা গেলো আরিয়ানের।এটা স্বাভাবিক সে জানে তাই ভয় পেলো না
।ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে জামা উঠিয়ে মায়ার পেটে আলতো চুমু খেয়ে কান লাগিয়ে সে বললো,
—“আপনারা এত ব্যাথা কেন দেন মাকে?বুঝেননা আপনাদের মা যে আপনাদের মতোই বাচ্চা।এত ব্যাথা সে নিতে পারেনা।”
মায়া নিরলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,
—“ওরা কি এসব শুনতে পারছে?”
কিছুক্ষন অতিবাহিত হয়ে গেলেও কিছু দেখতে পাওয়া গেলো না।আরিয়ান মুখ এগিয়ে বললো,
—“লাথি দিচ্ছোনা কেন তোমরা?মা অপেক্ষা করছে তো।…আস্তে দিও নয়তো মা ব্যাথা পাবে”।
সাথেসাথেই লাথি দিলো একজন।মায়া মুখ দিয়ে আর্তনাদ করতে গিয়েও থেমে গেল।কারণ এবারে সেও পায়ের ছাপ দেখেছে।এবারের টা আরো স্পষ্ট।খুশিতে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরলো মায়ার।আরিয়ান মুচকি হেসে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।দুগালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে বললো,
—“এখনই কাঁদছো!আর কদিন পর যখন ওরা তোমার কোলে থাকবে,একসময় আধো আধো স্বরে মা বলে ডাকবে।তখন কি করবে?”
আরিয়ান স্বস্নেহে তার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দেয়।এই স্বৃতিময় প্রহরগুলো খুব সুন্দর।খুব বেশিই সুন্দর।
_________________
ব্যাগ গুছিয়ে নেয়া হয়েছে।মায়ার কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।যদিও ডেলিভারির ডেট আরো তিনদিন পরে।তবুও যাতে কোনরকম সমস্যা না হয় তাই আগে আগেই মায়াকে হসপিটালে এডমিট করে দিতে বলেছে ড.মিতালী।
মায়াকে নিয়ে নিচে নেমে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান।জ্যাক আর জেনি অনবরত চেটে দিচ্ছে মায়াকে।তারাও হয়তো বুঝতে পারছে মায়া কয়েকদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছে।তাদের সাথে দেখা হবেনা।
মায়া হাত উঠতেই তারা আরিয়ানের শরীরে সামনের পা ঠেকিয়ে দুইপায়ে দাড়িয়ে গেলো।মায়ার যেনো তাদের ঝুঁকে আদর না করতে হয় সেজন্য।দুজনের মাথায়ই হাত বুলিয়ে দিলো মায়া।আরিয়ান বললো,
—“এবার যাই?ওদেরকে নিয়ে যাক?”
মায়ার একটু মন খারাপ হলেও সে মুচকি হেসে বললো,
—“আচ্ছা নিয়ে যান।”
তন্ময় বসলো ড্রাইভিং সিটে।ইতি বসেছে পিছনে মায়া আরিয়ানের সাথে।আরিয়ানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে মায়া।আধো ঘুম আধো জাগা সে।কয়েকবারই সে বলেছে তার হাল্কা পেট ব্যাথা করছে।হসপিটালেই যাচ্ছে তাই আর আরিয়ান ড.মিতালী কে ফোন দেয়নি।তন্ময় ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে।কোনরকম ঝাঁকুনিতে যেন মায়ার কোনো সমস্যা না হয়।গাড়ি চুপচাপ।মাঝেমধ্য টুকটাক কথা বলছে তারা।
হঠাৎই হুট করে মাথা উঠিয়ে আরিয়নের বাহু খামছে ধরলো মায়া।চোখগুলো বড় বড় করে আরিয়ানের তাকালো সে।আরিয়ান সোজা হয়ে মায়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
—“মায়া?কি হলো?”
সাথে সাথে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো মায়া।লেবার পেইন উঠেছে তার।ব্যাথায় চোখ মুখ লাল হয়ে এলো।চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কোনরকমে সে বললো,
—“ব্যা..থা…হচ্ছে..খু..ব।”
ঘাবড়ে গেলো আরিয়ান।ডেলিভারির ডেট তো চারদিন পর তবে হঠাৎ করে পেইন উঠলে কেনো?তন্ময় এবার দ্রুত ড্রাইভ করছে।একটু পর পর জোরে চিৎকার করে উঠছে মায়া।পেইনটা ছড়িয়ে পরছে তার।কাঁপছে সে।আরিয়ানের শার্ট ভিজে যাচ্ছে চোখের পানিতে।মায়ার কষ্ট দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারছেনা আরিয়ান।এলোমেলো লাগছে তার।অনবরত মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলছে,
—“একটু সহ্য করো মায়া।একটু সহ্য করো।এইতো পৌছে গেছি।”
মায়া আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো।ঠোঁট কামড়ে বললো,
—“খুব….ক…কষ্ট হচ্ছে আমি…”
মায়া সিক্ত নয়নে তাকিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
মায়ার এতো ভারি শরীর নিয়েও তাকে কোলে তুলে নিলো আরিয়ান।কোনরকমে দৌড়ে ভিতরে নিয়ে যেতেই স্ট্রেচার নিয়ে এলো ওয়ার্ডবয়।ড.মিতালী দৌড়ে এলেন।উনি মায়ার কেবিন ঠি কঠাক করে তাদেরই অপেক্ষা করছিলো।
মায়াক দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে বললো,
—“উনারতো ওয়াটার ব্রেক করছে।ডেলিভারি হবে।দ্রুত ওটিতে শিফ্ট করো।ফাস্ট”
তারপর আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“চিন্তা করবেননা।আপনার স্ত্রীর কিছু হবেনা।”
মায়াকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।আরিয়ান তার সাথেই আছে।একমূহুর্ত একা ছাড়েনি।মায়া শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে।জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সে।হসপিটালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে।
ড.মিতালী চলে এসেছেন।ওটিতে ঢুকানোর ঠি ক আগমূহুর্তে মায়া আধোআধে কন্ঠে বললো,
—“আপনাকে ছাড়া আমি ভেতরে যাবেনা।আমার ভয় লাগে।”
—“মায়া আমি…”।
আরিয়ানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মায়া বললো,
—“আমি কিছু জানিনা।আপনি আমার সাথেই থাকবেন।বললামতো আমার ভয় লাগছে।”
ড.মিতালী একমূহুর্ত তাকালেন।আরিয়ানের সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি বললেন,
—“আসুন।আপনিও ভেতরে আসুন।উনি পারবেননা আপনাকে ছাড়া”
আরিয়ান মায়ার হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেলো।এত ব্যাথা সহ্য করছে এই মেয়ে অথচ তার নাকি আরিয়ানকে ছাড়া ভয় করছে।ও
টিতে ঢুকানো হলো মায়াকে।নরমাল ডেলিভারিই হবে তার।ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে।আরিয়ান শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে।তার চোখদুটো দিয়ে কখন যেন ভিজে গেছে নিজেও টের পায়নি সে।
মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বারবার সে বলছে,
—“আমি আছি মায়া।ভয় পেয়োনা।আমি আছি।”
হাঁড়ভাঙা তুমুল ব্যাথার মাঝেও এই একটা কন্ঠস্বর ক্রমাগত সাহস দিয়ে যাচ্ছে মায়াকে।এই মানুষটা না থাকলে হয়তো এই ব্যাথাতেই মারা যেত সে।জীবনে এরকম একটা মানুষের খুব দরকার।খুব!
বাড়িতে খুশির আমেজ।আরিয়ান নিজে যেয়ে এত এত মিষ্টি নিয়ে এসেছে।খবর শুনেই মামা-মামি এসেছে।তন্ময় তার বাবা-মা কে আনতে গিয়েছে।তবুও মায়ার সাথে একটু আগে ফোনে কথা হয়েছে তার।খুশিতে কথাই বলতে পারছিলোনা সে বারবার বলছিলো”আমি আসছি ম্যাম,তাড়াতাড়িই আসছি”।মায়া বুঝিয়ে শুনিয়ে বলে দিয়েছে যেন ধীরেসুস্থেই বাড়ি ফিরে।তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
মায়া বসে আছে নিজের রুমে।বিছানার সাথে হেলান দিয়ে।তার সামনে বসে আছে ইতি।আর একপাশে বসে আরিয়ানের মামী নানান কথা বলে যাচ্ছে।সব কিছুই প্রেগন্যান্সি বিষয়ক।মায়ার মুখে মুচকি হাসি।একবারের জন্যও বিরক্তবোধ আসেনি তার।বরং মনোযোগ দিয়ে মামীর কথাগুলো শুনছে সে।
—“বুঝলে মা,আরিয়ানের বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা একদম নির্জীব হয়ে গিয়েছিলো।ওইটুকু বাচ্চা খেলতোনা,হাসতোনা,প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতোনা।বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সাথে আরো দুরত্ব হয়ে যায়।তারপর তো এই বাসায়ই একা থাকতে শুরু করে।কম কষ্ট করেনি ও।টাকা পয়সা থাকলে কি হবে?জীবনে মানসিক শান্তিটা কখনোই ছিলোনা।কিন্তু তুমি আসার পর থেকে ওর আচরণের পরিবর্তন গুলা সত্যিই চোখে পরার মতো।আরিয়ানের মুখের হাসিটা যেন সবসময় আজকের মতোই থাকে।তুমি ওকে দেখে রেখো মা।”
ঠিক সেসময়ই আরিয়ান দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
—“ও আমাকে দেখে রাখবে মামি?তুমি একটা ধমক দাও।ভয়ে এখানেই অজ্ঞান হয়ে যাবে।”
আরিয়ানের কথায় শব্দ করে হেসে উঠে ওর মামি।মায়া ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায়।সে একটু ভীতু দেখে আরিয়ান এমনে তার মজা নিলো।শুধু মামি সামনে আছে দেখে কিছু বললোনা।তবে নিজের কথাগুলো তুলে রাখলো।যখন একা পাবে তখন আচ্ছামতো বলবে।
আরিয়ান কাছে এসে দাড়ায়।তার হাতে টুকরা করে আপেল কাঁটা প্লেট।
সে যেয়ে মায়ার পাশে বসে।গায়ের কম্বল ঠি ক করে দিয়ে মায়ার মুখের সামনে আপেলের টুকরা ধরে।মায়া মুখ খুলেনা।আরিয়ান তার ঠোঁটে ঠেকিয়ে ধরতেই কোন কথা না বলে সেটা মুখে তুলে নেয় মায়া।
মামি নি:শব্দে হাসলো।আরিয়ান কখনো নিজেরও এতো খেয়াল রাখেনি।
মায়াকে খাওয়াতে খাওয়াতেই মামির সাথে কথা বলছে আরিয়ান।ইতিমধ্য মামাও এসে পরেছে তাদের রুমে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে।বাইরে গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে।তন্ময়রা এসে পরেছে হয়তো।মামা-মামি চলে গিয়েছে একটু আগে।কাল দুপুরে ইতি-তন্ময়ের বিয়ে পরানো হবে।তখন আবার আসবেন তারা।
আরিয়ান মানা করা সত্তেও নিচে নেমেছে মায়া।তন্ময়ের বাবা-মার সাথে দেখা করার জন্য।
আরিয়ানের হাত ধরে নিচে নামে মায়া।তন্ময়ের বাবা-মা সোফায় বসে আছে।তাদের পাশে ইতি-তন্ময়।
সামনে যেয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় আরিয়ান।তন্ময়ের মা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
—“তোমার বউ তো বহুত সুন্দরী বাবা।শুনলাম পোয়াতি হইসে?
ইতি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।তার খুব খুশির দিন আজকে।এখানকার মানুষ গুলা কতো ভালো।সবাই যদি এমন হতো,তাহলে পৃথিবীটা কতোই না সুন্দর হতো।অথচ রাশেদ চৌধুরির মতো কিছু নিকৃষ্ট মানুষগুলোর জন্য তার বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেছে সে।নয়তো এমন একটা দিনে তারাও তার সাথে থাকতো।
_______________
কেটে গেছে আরো তিনমাস…
সাড়ে চারমাস চলছে মায়ার।পেট ফুলেছে বেশ অনেকটা।হাঁটতে চলতে একটু অসুবিধা হয়।এখন আর থ্রিপিস পরেনা মায়া। সবসময় ঢিলেঢালা ফ্রক পরে থাকে।আরিয়ান যতটা পারে তাকে সময় দেয়।তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে।ছুটি ছাড়াও মাঝেমধ্য যায়না।
॥
রাতবিরাতে উঠে পা ভাঁজ করে সোজা হয়ে বসে আছে মায়া।ঘুম আসছেনা তার।নির্ঘুম চোখদুটোয় কোন ক্লান্তি নেই।তার কোলের উপর একহাত রেখে উপুর হয়ে শুয়ে আছে আরিয়ান।ফর্সা সাদা পিঠ তার চোখের সামনে।মায়া হাত দিয়ে ঝাঁকায়।তপ্ত কন্ঠে বলে,
—“উঠেননা।আমার ঘুম আসছেনা।”
আরিয়ান নিভু নিভু চোখে তাকায়।তারপর আবারো চোখ বন্ধ করে জড়ানো কন্ঠে বলে,
—“মায়া,জান আমার।,,,শুয়ে চোখ বন্ধ করো।ঘুম চলে আসবে।”
তারপর বিরবির করে কি যেন বললো মায়া বুঝতে পারলোনা।ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়ে মায়া।এক সপ্তাহযাবত রাতে ঘুম আসেনা তার।রোজই তার সাথে সারারাত জেগে থাকে আরিয়ান।গল্প করে,ঘুম আনানোর চেষ্টা করে।
সারাদিন পরে পরে ঘুমালেও রাতের বেলা নিশাচর পাখির মতো জেগে থাকে সে।ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো আরিয়ান।বলেছে এটা খুব স্বাভাবিক।এইসময় অনেকের এমন হয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই পাশ থেকে উঠে বসে আরিয়ান।একহাতে চোখ কচলে আরেকহাতে মায়াকে বুকে টেনে নেয়।মায়ার ঠোঁটের কোঁণে মলিন হাসি।দুহাতে আরিয়ানের পিঠ জড়িয়ে ম্ল্রান কন্ঠে সে বলে,
—“আপনাকে খুব বিরক্ত করি তাইনা?”
মায়া মুখ উপরে উচিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকায়।তার মাথার উপরিভাগ ঠেকে আছে আরিয়ানের পেটে।
বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে সে বলে,
—“কেটে ছোট করলে কি সমস্যা?”
আরিয়ান আঙ্গুল দিয়ে তার ঠোঁট ঠি ক করে।মাথা সোজা করে দিয়ে বলে,
—“অনেক সমস্যা।কোন চুল কাটাকাটি চলবে না।”
—“আপনারও তো কষ্ট হয়।”
ততক্ষনে চুলের জট ছাড়িয়ে নিয়েছে আরিয়ান।হাল্কা করে বেণি করে দিয়ে চিরুনিটা পাশের টেবিলে রাখে আরিয়ান।মায়া পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াবে মাত্র তখনই হুট করে তার ঠোঁটে ঠোট মেলায় আরিয়ান।মায়া জমে যায়।আরিয়ান বেশ কিছুক্ষন ঠোঁটের স্বাদ নিয়ে তাকে ছাড়ে।লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে মায়া।আরিয়ান তার গাল গলিয়ে গলার পাশে হাত রাখে।বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে লজ্জায় লাল হওয়া গালদুটোতে স্লাইড করতে করতে বলে,
—“গোটা তুমিটাকে যখন সামলাচ্ছি,তখন তোমার চুলগুলো সামলানো কঠিন কিছু না আমার জন্য।এই চুলগুলো আমার ভীষণ প্রিয় মায়াবতী।ভীষণ ভীষণ প্রিয়।”
________________
মায়ার পেট স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে।সাড়ে চারমাসে সাধারণত এতটা বড় দেখায়না পেট।
মায়াকে দেখে মনে হয় সে ছয় সাত মাসের গর্ভবতী।আরিয়ান বেশ চিন্তিত।এই ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে অফিসের কাজে মন দিতে পারছিলোনা।তাই বিকেলেই ফিরে এসে মায়াকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছে সে।সিটে বসলে মায়ার পেট প্রায় সামনে ঠেকে যায়।চুলে সেই সকালের বেণিই করা।শুধু পরণের জামাটা আসার আগে চেন্জ করে দিয়েছে আরিয়ান।
মায়া জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে।চোখেমুখে ঘুমঘুম ভাব।তবে ঘুমায়নি সে।সজাগ আছে।
আড়চোখে কয়েকমিনিট পরপর আরিয়ানকে দেখছে।আরিয়ানের কপালের সুক্ষ্ণ ভাঁজগুলো স্পষ্টই চোখে পরছে তার।
—“আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন?আমি তো সুস্থই আছি।”
—“সেটাতো আমি জানি।তবুও তোমাদের জন্য চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে পারিনা মায়া।”
—“অবশ্যই।আমার পুঁচকে সাইজের তুলনায় আপনাকে পালোয়ানই মনে হয়।”
এত চিন্তার মাঝেও আরিয়ান হাসে।কি সব যে বলে মায়া!
________________
আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট হাতে মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ড.মিতালী।সামনেই মায়াকে একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আরিয়ান।এই চারমাসে তাদের মাঝে একটা দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে।আরিয়ান সময় অসময়ে তাকে ফোন করে।মায়ার বিভিন্ন সমস্যার কথা জানায়।ড.মিতালী মুগ্ধ না হয়ে পারেনা।কেউ কাওকে এতোটা ভালো কি করে বাসে?
আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টটা টেবিলের উপর রাখে ড.মিতালী।মৃদু হেসে বলে,
—“মর্নিং সিকনেস এর ব্যাপারটা শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো।তবু কনফার্ম না হওয়ায় আমি বলিনি।
কিন্তু রিপোর্টে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,ইউ গাইস আর গোয়িং টু বি পেরেন্টস্ অফ টুইন্স।
আকাশ থমথমে।বৃষ্টি হওয়ার আগাম আভাসের আনাগোনা আকাশজুড়ে।বারকয়েক গুড়ুম গুড়ুম শব্দও কানে এসেছে।ঠান্ডা হাওয়া বইছে।হসপিটালের করিডোর ধরে মায়াকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আরিয়ান।ঠান্ডা বাতাসে গা শিরশির করছে।বাতাসে মায়ার ওড়নার আচঁল দিয়ে টানা ঘোমটা পরে গেছে।কপালের দিকে কিছু চুল বেরিয়ে পরেছে।ঠোঁটগুলো শুষ্ক।ঘন পাঁপড়িগুলো দিয়ে বারবার পলক ফেলছে সে।আরিয়ান একটু থেমে মায়ার ঘোমটা উঠিয়ে দেয়।তার আজকাল খুব ভয় লাগে।বাইরে আসলে মনে হয় সবার নজর লেগে যাবে মায়ার।যদিও এই বিষয়গুলো একেবারেই অযৌক্তিক,অহেতুক।আরিয়ান জানে,তারপরও অবচেতন মন মানতে চায়না।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে একবার আকাশের দিকে তাকায় আরিয়ান।মনে মনে ভাবে,যত দ্রুত সম্ভব বাসায় পৌছাতে হবে।বজ্রপাতের শব্দে বেশ ভয় পায় মেয়েটা।কয়েকদিন আগে বজ্রপাতের শব্দে সারারাত তাকে জাপটে ধরে বসেছিলো।একবিন্দু ঘুমোয়নি।এখন গাড়িতে থাকা অবস্থাতেই যদি বিদ্যুৎ চমকায় তবে মায়াকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।ভাবনার মাঝেই হঠাৎই থমকে দাড়ায় মায়া।হাপাতে হাঁপাতে বলে,
—“একটু দাঁড়ান।অস্থির লাগছে।”
আরিয়ান থামে।একটু দূরে বসার সিট আছে।মায়ার মাথাটা বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে সে বলে,
—“বসবে?”
—“নাহ্,বসলে আবার উঠতে কষ্ট হবে।”
আরিয়ানে স্বস্নেহে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।মায়ার কষ্টটা সে নিতে পারেনা।একদমই পারেনা।
হসপিটালে কত মানুষ!যে যে যার যার ধ্যানে আছে।সবাই ব্যস্ত সবার আপনজন নিয়ে।হঠাৎই একটা কোলাহলে ছেঁয়ে যায় হসিপিটাল।একটু দূরেই গেট।তারা যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখান থেকে সব দেখা যাচ্ছে।কয়েকজন ওয়ার্ডবয় মিলে দ্রুত স্ট্রেচার নিয়ে এগিয়ে আসছে পিছন থেকে।আরিয়ান মায়াকে নিয়ে একটু সরে দাড়ায়।
গেট দিয়ে একজন ভদ্রলোক ঢুকছেন।তার শার্টে হাল্কা রক্ত।কোলে সন্তানসম্ভবা বউ।মহিলা অচেতন।একটু খেয়াল করতেই আরিয়ান লক্ষ্য করলো মহিলার পেছন সাইডের জামা রক্তে ভিজে গেছে।সাথে সাথে মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো আরিয়ান।রক্ত দেখলে আবার প্যানিক হয়ে যাবে মেয়েটা!
ভদ্রলোক তার বউকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো।তাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো।নার্সরা বারবার রক্ত ম্যানেজ করার কথা বলছে।ভদ্রলোকের চেহারা উদ্ভ্রানতের মতো অবস্থা।কোনদিকে কি করবে বুঝতে পারছেনা সে।মহিলাকে নিয়ে গেলে মায়াকে ছেড়ে দেয় আরিয়ান।তার বুক থেকে মুখ তুলে মায়া।
ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে সরল মনে আরিয়ানকে বলে,
—“আপনি রক্ত ম্যানেজ করে দিননা উনাকে।”
আরিয়ান একপলক মায়ার দিকে তাকায়।পরক্ষনেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“আচ্ছা,দেখছি।,,,,তোমার অস্থিরতা কমেছে?গাড়িতে নিয়ে বসাই।তারপর দেখি কি করা যায়।”
মায়া মুচকি হেসে বলে,
—“চলুন”।
খুব সাবধানে মায়াকে গাড়িতে বসায় আরিয়ান।দায়িত্ব এখন আরো বেশি।আগে ছিলো দুইজন এখন তা বেড়ে হয়েছে তিনজন।একদিকে একসাথে দুটো বাচ্চা হওয়ার অগাধ খুশি আরেকদিকে মায়ার জন্য দুশ্চিন্তা।সব মিলিয়ে এক মিশ্রঅনুভূতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আরিয়ান।
গাড়ির গেট লাগিয়ে আবারো ভেতরে যায় আরিয়ান।আধাঘন্টার মধ্য লোকটার বউয়ের জন্য রক্ত ম্যানেজ করে দিয়ে তার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ফিরে আসে।এর মধ্যে অবশ্য তিন-চারবার এসে মায়াকে দেখে গিয়েছে।
গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পরছে।আরিয়ান দ্রুত যেয়ে গাড়িতে বসে।মায়া চোখ-বন্ধ করে আছে।ঘুমিয়ে পরেছে হয়তো।মাথাটা জানালার সাথে ঠেকানো।
আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।মেয়েটার সৌন্দর্য কি দিনদিন বেড়েই চলেছে?মায়া অতিরিক্ত রূপবতী।অন্তত তার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী,আদুরে,মায়াবী রমনী!!
গাড়ি স্টার্ট দিতেই নড়েচড়ে উঠে মায়া।ঘুমের মাঝে মাথা এ কাত করতেই আরিয়ান তা ঠি ক করে নিজের বাহুতে রাখে।একহাতে ধরে রেখে আরেকহাতে গাড়ি ড্রাইভ করে।
এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে আবার মাঝরাতে জেগে উঠে বলবে,”আমার ঘুম আসছেনা,চলেন গল্প করি।”
___________
বৃষ্টিতে ভিজে আছে বাগান।জ্যাক আর জেনিকে ভিতরে নিয়ে আসা হয়েছে।আরিয়ান মায়ার পিছু পিছু ওরাও ঢুকেছে রুমে।আরিয়ান বারণ করেনি।মায়ার খুব আদুরে এরা দুজনই।সে অফিসে গেলে ঘুমব্যাতিত প্রায়শই তাদের সাথে খেলা করে মায়া।
মায়া ফিরতেই ইতি এসে পরেছে।আরিয়ান গেছে শাওয়ার নিতে।মায়ার সাথে ইতিই আছে।অনেকক্ষনের
জন্য মায়াকে একা রুমে রেখে সাধারণত কোথাও যায়না আরিয়ান।
ফ্লোরে কার্পেটের উপর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে জ্যাক আর জেনি।
ইতির মুখে চওড়া হাসি।টুইন্স বেবি হবে খবরটা শুনতেই খুশিতে মনটা লাফাচ্ছে তার।দুটো বাচ্চা একসাথে সারাবাড়িতেই দৌড়াবে।কি সুন্দরই না লাগবে দৃশ্যটা!
তিড়িংবিড়িং করা কন্ঠেই সে বলে,
—“আচ্ছা আপু,ওরা যদি দেখতে একদম একরকম হয় তবে ওদের আলাদা করবেন কি করে?”
মায়া শব্দ করে হাসে।খানিকটা চিন্তা করে বলে,
—“জানিনা ইতি।আগে আসুক তারপর ভেবে দেখবো।তন্ময় ভাইয়া কখন আসবেন?”
—“বললোতো ঘন্টাখানেক লাগবে।ওর তো কথাবার্তার ঠি ক নেই।দেখা যাবে তিনঘন্টা লেট করে বলবে,রাস্তায় জ্যাম ছিলো।তবে আজকে মনে হয়না দেরি হবে।টুইন্সদের কথা শুনেছেতো।দৌড়ে চলে আসবে”
মায়া আবারো খিলখিল করে হাসে।তন্ময়ও কম পাগলামি করেনা।মায়াকে এটা ওটা এনে দেয়।আরিয়ান আইসক্রিম,কোক এসব খেতে মানা করলেও মায়া খেতে চাইলে তন্ময় এনে দেয়।আরিয়ানের সাথে ঝগড়া করে হলেও এনে দেয়।
একবারতো মায়ার জেদে রাত দশটা বাজে মায়াকে নিয়ে আরিয়ানের অফিসে চলে গিয়েছিলো।আরিয়ান ফিরতে দেরি করছিলো বলে মায়া জেদ করছিলো তার অফিসে যাবে তখন তার সাথে না পেরে তখন ই মায়াকে নিয়ে বেরিয়েছিলো তন্ময়।
_______________
আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে মায়া।সাতমাসের ভরা পেট তার।একটু মোটা হয়ে গিয়েছে।মা মা একটা ভাব শরীরে।শরীরটা খুব ভারি ভারি লাগে ইদানীং।পেটে আলতো করে হাত বুলায় সে।হঠাৎই ভাবনা আসে তাকে কি খুব বাজে দেখায়?
একবার আরিয়ানের দিকে তাকায় সে।পাশের সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আরিয়ান।আজকে অফিসে যেতে পারেনি।সকালবেলা তার শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।এত মাসেও খাওয়ার রুচিতে কোন সমস্যা হয়নি মায়ার।কোনরকম গন্ধও লাগেনা।সবই খেতে পারে।বরং তুলনায় অনেক বেশি খাবার খায়।
দুজন বাচ্চা পেটে।ক্ষুধা তো বেশি লাগবেই।সকালে নাস্তার পর তিনবার বমি হয়েছিলো তার।যা খাচ্ছিলো তাই বমি করে দিচ্ছিল।ডক্টরকে বলে আরিয়ান ওষুধ খাওয়ানোর পর কিছুটা ভালো লাগছে এখন।
আয়নার সামনে মায়ার এমন ঘুরাফেরা আর হতাশ চোখের চাহনী দেখেই আরিয়ান মায়ার মনের কথাটা বুঝতে পারে।ড.মিতালী বলেছিলো,এসময় মেয়েটা নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে।মায়াও হয়তো সেরকম কিছুই ভাবছে।
আরিয়ান ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে গিয়ে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে।গালে গাল ঘষে বলে,
—“মায়াবতী,তোমার কি মনে হচ্ছেনা তোমার একটু কম সুন্দর হওয়ার দরকার ছিলো?”
—“ফালতু কথা বলবেন না,,আমি জানি আপনি আমাকে খুশি করার জন্য বলছেন।”
—“এমনটা কেন মনে হলো?”
মায়া এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বললো,
—“আমি খুব মোটা হয়ে গেছি তাইনা?”
আরিয়ান ছোট্ট করে তার গালে ছোট ছোঁয়ায়।বলে,
—“তুমি মোটা হওনি।গোলুমোলু হয়েছো।আমার গোলুমোলু মায়াবতী।আমি কি ভাবছি জানো?”
মায়া উৎসুক কন্ঠে বলে,
—“কি ভাবছেন?”
মায়া ঝামটা মেরে তাকে সরায়।চোখমুখ কুঁচকে বলে,
—“ছিহ্,কিসব বলেন এগুলা!”
_______________
রাতের বেলা ঘুম ভেঙে যায় আরিয়ানের।পাশ থেকে ফোন নিয়ে দেখে রাত বাজে দুইটা পঁয়ত্রিশ।তার একহাত মায়ার পেটের উপর রাখা।সোজা হয়ে ঘুমোচ্ছে মায়া।রোজ মাঝরাতে এসময় মায়ার ঘুম ভাঙে।ক্ষুধা লাগে অথবা ঘুম আসেনা কোন একটা কারণে হলেও ঘুম থেকে উঠে সে।তাই আরিয়ানেরও অভ্যাস হয়ে গেছে এসময় ঘুম থেকে উঠার।কিন্তু আজকে মায়া উঠলোনা কেন?আরিয়ান হাই তুলে উঠে বসে।পাশের ল্যাম্পলাইট জ্বালাতেই ঘর অনেকটা আলোকিত হয়ে যায়।ঝুঁকে গিয়ে মায়ার কপালে চুমু খায় সে।মায়া খুব ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে।ভ্রু কুচকে আসে আরিয়ানের।বারদুয়েক গালে হাল্কা করে থাপ্পড় দেয়।মায়ার কোন হেলদোল নেই।বুকটা প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠে আরিয়ানের।কাঁপা গলায় সে দ্রুত ডাকে,
—“মায়া?মায়া উঠো?মায়াবতী?ক্ষুধা লাগেনি মায়া?শরীর খারাপ লাগছে?”
আর কথা বের হয়না গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।মায়া অচেতন।ঘুমের মাঝে মেয়েটা অচেতন হলো কিকরে?আরিয়ান দ্রুত নিজের গায়ের কম্বল সরায়।জোরে সরানোতে মায়ার গা থেকেও কম্বল সরে যায়।বিছানার দিকে তাকাতেই আৎকে উঠে আরিয়ান।সাদা চাদরে লালরক্ত লেগে আছে।মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়।মায়ার গা থেকে সম্পূর্ণ কম্বল সরিয়ে তাকে একটু কাত করতেই নজরে আসে মায়ার পিছন সাইড রক্তে ভিজে গেছে খানিকটা….
গাড়ি একটা জায়গায় থেমে গেছে ব্যাপারটা বুঝতেই চোখ খুলে মায়া।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাসায় এসে পৌঁছেছে তারা।আরিয়ান নেমে গিয়ে তার পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
মায়া এক পা বাড়িয়ে মুচকি হেসে তার হাত ধরার আগেই তাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খায়।
আরিয়ান দ্রুতহাতে তার কোমড় পেচিয়ে ধরে বলে,
—“হোয়াট হেপেন্ড?খারাপ লাগছে?”
আরিয়ানের কুঁচকানো কপালটা স্বাভাবিক হয়।ভ্রু জোড়া স্হির করে সে মায়াকে সোজা করে দাড় করায়।গাড়ির দরজা আটকে দিয়ে একবার নিজের ফোনে চোখ বুলিয়ে মায়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে।ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছে কয়েকজন।
মায়া সেদিকে একবার তাকায়।অত:পর দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে।যত তারাতারি সম্ভব শাওয়ার নিয়ে নিচে নামবে সে।যদিও সন্ধ্যার দিকেও অফিসে খাবার আনিয়ে দিয়েছিলো আরিয়ান।তবুও প্রচন্ড খুদা পেয়েছে।একদম সহ্য হচ্ছে না।
।।
পাশের রুমের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে আসে আরিয়ান।মায়াও শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে তখন।তার পরণে হাঁটু অবধি সাদা রংয়ের ফ্রক,সাদা পায়জামা,সাদা ওড়না।পরিপূর্ণ সাদা শুভ্রময়ী রুপ।আধভেজা চুলগুলো থেকে ঝড়ঝড় করে পানি পরছে।
চুলে তোয়ালে পেচিয়ে সে আরিয়ানকে দ্রুত বলে,
—“চলুন,খেতে চলুন।”
মায়া বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।পাঁচমিনিট শেষ হলেই আরিয়ান তোয়ালে পাশে রেখে দেয়।চুলগুলো হাত দিয়ে সারা পিঠে সুন্দরমতো ছড়িয়ে দিয়ে বলে,
—“চলো,বাকিটা এমনিই শুকিয়ে যাবে।’
খাবার টেবিলে বসে আছে ইতি,তন্ময়।আরিয়ান,মায়া নিচে নেমে তাদের সাথে বসলে খেতে শুরু করলো তারা।মায়া মাঝেমধ্য এটা ওটা বলছে।তন্ময়কে কোথায় গিয়েছিলো কি করেছে এসব জিজ্ঞেস করছে।তন্ময়ও বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে সুন্দরভাবে সবকিছুর উওর দিচ্ছে।
।
।
খাওয়া দাওয়া শেষ।তন্ময়,ইতি যার যার রুমে চলে গিয়েছে।মায়া আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আচরাচ্ছে।ঘড়িতে বারোটা বেজে যাচ্ছে।ঘুমানোর জন্য আগেই বিছানা গুছিয়ে রেখেছে সে।কানে ফোন নিয়ে একটু আগে ব্যালকনিতে গিয়েছে আরিয়ান।হয়তো জরুরি কোনো ফোন!
হঠাৎই রুমে এসে মায়াকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয় আরিয়ান।হাতের চিরুনিটা ফ্লোরে পরে যায়।
মায়া তার গলা জড়িয়ে ধরে আৎকে উঠে বলে,
—“কি করছেন?”
আরিয়ান উওরে স্মিত হাসে।মায়াকে কোলে নিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।সিড়িঘর অনেকটাই অন্ধকার।মায়াকে কোলে করে ছাদের দিকে উঠতে নিলেই মায়া বিস্মিত কন্ঠে বলে,
—“এতরাতে ছাদে কি করবেন?অন্ধকারে পড়ে যাবোতো।”
আরিয়ান উঠতে উঠতেই বলে,
—“আমার কোল থেকে পড়ে যাবে তুমি?আর আমি তোমাকে পড়ে যেতে দিব?”
বলতে বলতেই ছাদে এসে দাড়ায় তারা।ছাদ অন্ধকার।সুনসান নিরবতা।
মায়াকে কোল থেকে নামাতেই চারিদিকে সোনালী রংয়ের লাইট জ্বলে উঠে।মায়ার উপর আছড়ে পরে কতগুলো গোলাপের পাপড়ি।বিস্ময়ে থমকে যায় মায়া।দুহাতে মুখ চেপে জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।পুরো ছাদ লালগোলাপ দিয়ে সাজানো।একটা কর্নার বেলুন দিয়ে ঘেরা।
আরিযান তাকে বাহু ধরে কাছে টেনে চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুইয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
—“হ্যাপি বার্থডে মায়াবতী”।
মায়া মিষ্টি করে হাসে।তার মনেই ছিলোনা তার জন্মদিনের কথা।মূলত নিজের জন্মদিনটা তার কাছে খুব বেশি অপ্রিয়।কোনোকালেই জন্মদিন পালন করেনি সে।তাই এই দিনটা বিশেষভাবে কখনোই মনে থাকেনা তার।
কারণ এতদিন সে জানতো তার জন্মদিনের দিনই তার মা মারা গিয়েছে।তার বাবাতো তাকে এটাই বলেছিলো যে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে।তাই এ দিনটা তার মায়ের মৃত্যুদিনও বটে।সেজন্যই এ দিনটার উপর বিতৃষ্ণা ছিল তার।বরং জন্মদিনটা অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের চেয়ে একটু মন খারাপেই কাটতো তার।
তবে এখন সে জানে তার মা কে তার বাবা মেরেছে।সে তার জন্মদিনের দিন মারা যায়নি।তার মায়ের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী না।
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে পরে মায়ার।আরিয়ান খুব সন্তর্পনে তার চোখের জলটা মুছিয়ে দিতে বলে,
—“আমি জানি তুমি কখনো এ দিনটা কখনো সেলিব্রেট করোনি।আর তার পিছে ছিলো একটা মিথ্যে কারণ।
যেটা তুমি জানো।তাই,এখন আর মন খারাপ করোনা।বারোটা বেঁজে গেছে।চলো কেক কাটি।”
মায়া নিজেই চোখদুটো ভালো করে মুছে নেয়।হেসে বলে,
—“আপনি এমন কেন?সবসময় মন ভালো করে দেন।”
বেলুন ঘেরা জায়গাটায় কেক কাটার টেবিল রাখা।টেবিলের চারপাশে বেলুন দেয়া।পিছে ফোলা ফোলা বেলুনে ইংলিশ অক্ষরে “Happy Birthday Maya” লেখা।কেকের উপরেও একই লেখা।আরিয়ান তাকে কারো সামনে”মায়াবতী”ডাকেনা।যখন তারা একান্তে থাকে তখনই মায়াবতী ডাকে।তাই হয়তো এখানে “মায়াবতী” লেখেনি।তার কন্ঠ থেকে “মায়াবতী” ডাকটা একমাত্র মায়াই শুনেছে।
মায়া কেক কাটে।সর্বপ্রথম আরিয়ানকে খাইয়ে দেয়।আরিয়ান তখন একহাতে মায়ার এলো চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিচ্ছিলো।মায়ার মুখে উজ্জল হাসি।সে অবস্থাতেই ছবি তুলে তন্ময়।ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যায় একটা স্বৃতি।আশেপাশে সবকিছু লাল রং দিয়ে সাজানো।তার মাঝে সাদা জামা পরিহিত মায়াকে যেন একটা শুভ্রপরী লাগছে।
ইতিকে খাইয়ে তন্ময়কে ডাকে মায়া,
—“তন্ময় ভাইয়া,আসেন।ইতি যাওতো তুমি ছবি তুলে দাও।”
তন্ময় ইতস্তত কন্ঠে বলে,
—” না না ম্যাম।আমাকে খাইয়ে দেয়া লাগবেনা।”
আরিয়ান ধমকে উঠে বলে,
—“কেন?তুই কি পর কেও?আয় জলদি।”
তন্ময় ইতির দিকে ক্যামেরা এগিয়ে দেয়।মায়া মুচকি হেসে এক টুকরো কেক তুলে দেয় তার মুখে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার,জ্যাক আর জেনিও বসে আছে মায়ার পায়ের কাছে।আফটার অল,তারাও পরিবারের একটা অংশ।কিন্তু তাদের কেক খাওয়ানো যাবেনা।কেকের ক্রিমে পেট খারাপ করবে।নয়তো তাদেরও কেক দিতো মায়া।আরিয়ান বারণ করায় আর দেয়নি।
______________
রাত প্রায় ১টা বাজে নিচে নেমেছে তারা।মায়ার চোখেমুখে খুশি ঝিলিক দিচ্ছে।হাত ধুয়ে মাত্র বিছানায় বসেছে।তখনই আরিয়ান কাবার্ড থেকে কিছু বের করে নিয়ে আসে।তার সামনে একহাঁটু গেড়ে বসে মায়ার পায়েল পরানো পা টা টেনে নিজের পায়ের উপর রাখতেই মায়া ভ্রু কুচকে বলে,
—“কি হয়েছে?পায়ে তো কিছু হয়নি।”
আরিয়ান হাতের মুঠো থেকে সেই লাল রুবি পাথরের পায়েলটা বের করে বলে,
—“তোমার জন্মদিনের উপহার।আমি জানি এটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছিল।”
মায়া মূহূর্তেই চুপ হয়ে যায়।এতক্ষনের উজ্জল চেহারাটা নিমিষেই কালো মেঘে ছেঁয়ে যায়।দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে কাতরকন্ঠে সে বলে,
-–-“আমার পায়েলটা খুলবেননা প্লিজ।ওটা বাবা দিয়েছিলো।”
আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।মায়ার পায়জামাটা একটু তুলে পায়েলটার দিকে তাকায়।সাথে পাথরের সুন্দর একটা পায়েল।যেদিন এটা মায়াকে পরিয়ে দিয়েছিলো তখন থেকে আজ অবধি মায়াকে একবারের জন্যও এটা খুলতে দেখেনি সে।এমনকি শাওয়ার শেষে মেয়েটা কাপড় দিয়ে রোজ পায়েলটা মুছে।যেন সেটা ভিজে না থাকে।পায়েলটা যে মায়ার জন্য খুব স্পেশাল সেটাও আরিয়ান জানে।রাশেদ চৌধুরি দিয়েছিলো বলেই হয়তো এটাকে এতো ভালোবাসে মায়া।
দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে আরিয়ান।মায়ার কাতর চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—“এটা আমি কখনোই খুলবোনা মায়াবতী।তোমার বাবার স্বৃতি তোমার থেকে নিয়ে নেয়ার অধিকার আমার নেই।আর থাকলেও আমি সেই অধিকার ফলাবো না।আমি জানি তোমার বাবাকে তুমি কতটা ভালোবাসো।শত হলেও তোমার বাবা।তোমার বাবার প্রতি তোমার ভালোবাসা নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই।তাই এই পায়েলটা খোলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।আমি শুধু এই ভালোবাসাটার সাথেই তোমাকে আমার ভালবাসাটাও পরিয়ে দিতে চাই।মে আই?”
মায়া ছলছল নয়নে তাকায়।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই আরিয়ান ওই পায়েলটার সাথেই লাল পায়েলটা পরিয়ে দেয়।সাদা পাথর আর লাল পাথরটা মিলে অদ্ভুত সুন্দর লাগে পা টা।
আরিয়ান তার পা টা নামিয়ে উঠে গিয়ে মায়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
—“তুমি কি ভেবেছিলে?তোমার বাবার কথা শুনলে আমি রাগ করবো?”
মায়া উপর নিচে মাথা নাড়ায়।আরিয়ান বলে,
—“তোমাকে কখনো শত্রুতার মাঝে টেনে এনেছি আমি?”
মায়া ছোট্ট করে জবাব দেয়,
—“না”।
আরিয়ান হেসে বলে,
—“আমাদের সম্পর্টার মাঝে যাতে কখনো তোমার বাবা আর আমার সম্পর্কটা না আসে।তোমার সাথে আমার ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন।সবকিছু থেকে আলাদা।বুঝেছো?”
—“হু”।
মায়া আর কিছু বলেনা।আরিয়ান তার বাবার মৃত্যুর কারণ এটা সে কখনোই ভাবেনা।সে মানে তার বাবা তার কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে এবং সেটা আরিয়ানের দ্বারা।কিন্তু এসবকিছুর উর্ধে তার ভালবাসা।তার জীবনে সে দুজন মানুষকেই প্রচন্ড ভালোবাসে তারা হলো তার বাবা আর আরিয়ান।কোন কারণে কখনোই এদের ঘৃণা করেনি সে।আর না কখনো করবে।
_______________
গভীর রাত…
ঘুম ভেঙে যায় মায়ার।আরিয়ান তাকে বুকে জাপটে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।মায়া জড়ানো কন্ঠেই তাকে ডাকে,
—“একটু উঠবেন?”
মায়ার প্রথম ডাকেই ঘুম ভেঙে যায় আরিয়ানের।মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ভ্রু কুচকে সে বলে,
—“কি হয়েছে?খারাপ সপ্ন দেখেছো?”
—“উহু”।
—“তবে?ঘুম ভেঙেছে কেন?”
মায়া এবার আরিয়ানের হাত সরিয়ে উঠে বসে।ঘাড় ঘুড়িয়ে আরিয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
—“আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
নিস্তব্ধ রজনী।পুরো বাড়ি অন্ধকার।শুধু আরিয়ানের রুমে লাইট জ্বলছে।
মায়া বসে আছে বিছানার মাঝখানটায়।তার সামনে দুটো প্লেট রাখা।একটায় পাস্তা,আরেকটায় নুডলস্।
পাস্তার প্লেটটা ইতিমধ্যেই খালি।আর নুডুলস এর টায় একটু আছে।সেটাই খাচ্ছে মায়া।
আরিয়ান বসে আছে তার মুখোমুখি সোফায়।তার একহাতে ফোন।তবে তার দৃষ্টি সেদিকে নয় সে চেয়ে আছে মায়ার দিকে।মেয়েটার এতো ক্ষুধা পেয়েছে!রাতেও বলছিলো ক্ষুধা লেগেছে।হঠাৎ এতো ক্ষুধা লাগছে কেনো?আগে তো দু’চামচ খেয়েই বলতো “পেট ভরে গেছে”,”আর খাবোনা”আরো কতোরকম বাহানা।
নাহ,মেয়েটার খাওয়া দাওয়ার দিকে আরো যত্নশীল হতে হবে তাকে।নয়তো কি শুধু শুধুই মাঝরাতে এতো ক্ষুধা থাকে পেটে!
নুডুলসের শেষ চামচটা মুখে দেয়ার আগে মায়া বললো,
—“শেষ কিন্তু।খাবেন একবার?”এর মধ্যে আরো পাঁচ ছয়বার মায়া জিজ্ঞেস করে ফেলেছে তাকে খাওয়ার কথা।প্রতিবারই আরিয়ান মানা করেছে।এবারো মানা করার পর মায়া তেঁতে উঠলো।নুডুলসটা মুখে তুলে চিবাতে চিবাতে বললো,
—“তা খাবেন কেন?এটা খেলেতো আপনার পেট খারাপ হবে!!আপনি একমাস অসুস্থ থাকবেন!।
চুপচাপ ফোনটা রেখে উঠে যায় সে।প্লেট দুটো একসাথে করে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিয়ে মায়াকে পানির গ্লাস দেয়।পানি খাওয়া শেষে হাত দিয়ে ঠোঁট মুছিয়ে দিয়ে বলে,
—“শোও তুমি।আমি আসছি।”
আরিয়ানের পরণে শুধু ধুসর রংয়ের ট্রাওজার।উপরে টি-শার্ট পরেনি সে।গরম পরেছে বেশ।রুমে এসি ছাড়া বিধায় বোঝা যায় না।কিন্তু একটু বাইরে বের হলেই জীবন শেষ।রাতের বেলা হলরুমের এসি বন্ধ ছিলো।একজন সার্ভেন্ট কে মায়ার জন্য খাবার বানাতে বলে একটু বসেছিলো সেখানে।ব্যস!সেখানেই দরদর করে ঘাম ছুটে গেলো।ছোট থেকেই গরম সহ্য হয়না তার!।
ওয়াশরুমে যেয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিতেই দরজায় জোরে জোরে বাড়ি দেয়ার শব্দ হলো।মায়া চাপা স্বরে ডাকছে,”দরজা খুলেন,জলদি।”
আরিয়ান দ্রুত দরজা খুলে দিতেই তাকে সরিয়ে বেসিনের উপর হরহর করে বমি করে দিলো মায়া।
মায়ার হঠাৎ এমন করায় বিচলিত হয়ে পরে আরিয়ান।মুখ উপর করে বমি করছে মায়া।আরিয়ান তার থুবড়ে পরা চুলগুলো একহাতে মুঠ করে ধরে।পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।মেয়েটার এতো শরীর খারাপ সে বুঝতেই পারলোনা!।ততক্ষনে বমি থেমেছে মায়ার।দুহাতের আজলায় পানি নিয়ে কুলি করে মুখে পানি দিয়ে চোখ বন্ধ করে আরিয়ানের বুকে সাইড করে মাথা ঠেকায় সে।আরিয়ান পাশে ঝোলানো টাওয়ালটা হাতে নেয়।সারামুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“বেশি খারাপ লাগছে মায়া?”
মায়া উওর দেয়না।আবারো গা গোলাচ্ছে তার।আরিয়ান টাওয়ালটা জায়গামতো ঝুলিয়ে রাখতেই আবারো বমি করে মায়া।এতক্ষন যা খেয়েছিলো কিছুই হজম হয়নি তার।আরিয়ান এবার নিজেই ট্যাপ ছেড়ে দেয়।চিন্তায় অস্থির লাগছে।মেয়েটা এতো অসুস্থ কখন হলো?ফুড পয়েজন হলো নাকি?নতুবা এতো বমি হচ্ছে কেন?এই ভোরবেলা ডাক্তারইবা পাবে কোথায়?
মায়া তার বুকে মাথা এলিয়ে রেখেছে।আরিয়ান নরম শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
—“রুমে নিয়ে যাবো?নাকি আরো বমি হবে?”
মায়া অস্পষ্ট স্বরে বলে,
—“বমি হবে।কিন্তু আসছেনা।”
আরিয়ান ফাঁকা একটা ঢোক গিলে।বমি আসলেও বমি না করতে পারা যে কতটা কষ্টের তার জ্বর হলে বুঝতে পারে।মায়ার থেকে বেশি অস্থির লাগছে তার।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সে বলে,
—“আচ্ছা,একটু ওয়েট্ করি।হয়ে যাবে।”
পাঁচমিনিট পার হয়ে গেলে দুবার জোরে জোরে কাশি দেয় মায়া।সাথে সাথে মুখভর্তি বমি হয় তার।তৃতীয়বারের মতো মুখ মুছিয়ে দিয়ে আরিয়ান নিরস কন্ঠে বলে,
—“আরো বমি করবে মায়াবতী?”
মায়া দু’পাশে মাথা নাড়ায়।আর বমি হবেনা তার।পেটে যা ছিলো সব বের করে দিয়েছে।তিনবার বমি করে প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।আরিয়ান তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়।পরণের জামা গলার দিকে ভিজে গেছে।লাইট নিভিয়ে মায়ার জামা চেন্জ করে দেয়।ততক্ষনে ঘুমিয়ে পরেছে মায়া।আরিয়ান তার পাশে সুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ক্রমাগত।সারারাতেও একবারও তার মাথা থেকে হাত সরায়না।
আজকাল নিজের কাজে নিজেই অবাক হয় আরিয়ান।আগে নিজে বমি করলেও ঘেন্না হতো।বমির দিকে তাকাতে পারতনা পর্যন্ত।রাস্তাঘাটে কাউকে বমি করতে দেখলেও গা গোলাতো।অথচ আজ মায়ার প্রতি ঘেন্না তো দূর একফোঁটা বিরক্তিও আসেনি তার।বরং মেয়েটার অসুস্থতায় অজানা একটা ভয় কাজ করছিলো।
__________
সকাল সকাল মায়াকে দ্রুত রেডি হতে বলেছে আরিয়ান।তাকে নিয়ে হসপিটালে যাবে।যদিও ঘুম থেকে উঠার পর দূর্বলতার ছিঁটে ফোঁটাও ছিলোনা তার মধ্য।আরামে নাস্তা খেয়ে বাগানে বসে জ্যাক আর জেনির সাথে খেলা করছিলো।তখনই আরিয়ানের কড়া আদেশ।”দ্রুত তৈরি হও,হসপিটালে যাবো”।মায়া মানা করলেও শুনেনি সে।অগত্যা রেডি হতে হচ্ছে।
ক্রিম কালারের থ্রিপিস পরে চুলগুলো হাল্কা করে ঝুটি করে নিলো মায়া।
আরিয়ান বসে বসে কফি খাচ্ছে আর মনোযোগ দিয়ে মোবাইল স্ক্রল করছে।মায়া ওড়নাটা দু’কাধে দিয়ে হাতে সেফটিপিন নিয়ে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“আটকে দিন।”
আরিয়ান পিন হাতে নিয়ে মায়ার দিকে তাকায়।মায়াকে একদম স্বাভাবিক লাগছে এখন।বোঝাই যাচ্ছেনা কাল রাতে এত অসুস্থ ছিল মেয়েটা।
ওড়না আটকে দিতে দিতে সে স্বাভাবিকভাবেই বলে,
—“তোমার পিরিয়ড মিস হয়েছিলোনা লাস্ট মান্থে?”
আরিয়ান ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে উঠে দাড়ায়।সে যা ধারণা করছে তাই যদি ঠিক হয়?হাহ্!হসপিটালে গেলেই বোঝা যাবে।
আজকে আবার তন্ময়ের বাবা,মা আসবে।তারা গ্রামে থাকেন।তন্ময়রে বিয়ে এখানেই হবে তাই আসবেন।
যদিও একয়বছরে হাজারবার আরিয়ান তাদের এখানে থাকার কথা বলেছে।কিন্তু তারা থাকবেনা।গ্রাম ছাড়া নাকি তাদের ভালো লাগেনা।তন্ময় প্রতিমাসে যেয়ে দেখে আসে।তন্ময় শহরে এসেছিলো পড়াশোনার সুবাদে।তারপর এখানেই আরিয়ানের সাথে দেখা সাক্ষাত।কাজকর্মের ভীড়ে আর গ্রামে ফিরেনি সে।
_______________
মায়ার অসুস্থতার লক্ষন গুলা শুনেই ড.মিতালী সর্বপ্রথম মায়াকে যেই কথাটা বলেন তা হলো,
—“আপনি কি প্রেগন্যান্ট?টেস্ট করিয়েছেন?”
ড.মিতালী মুচকি হেসে তার ড্রয়ার থেকে একটা প্রেগন্যান্সি কিট বের করে দেয়।মায়ার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে দিকে ইঙ্গিত করে বলে,
—“আপনি টেস্ট করে আসেন।আমার ধারণা ভুল নাহলে খুব সম্ভবত আপনি কনসিভ করেছেন।”
মায়া আমতা আমতা করে আরিয়ানের দিকে তাকায়।তার মেজাজের গতিবিধি লক্ষ্য করার চেষ্টা করে।ড.মিতালী বলার এক মাইক্রোসেকেন্ড আগেও তার মাথায় প্রেগন্যান্সির বিষয়টা আসেনি।সে আসলেই খুব বোকা।এজন্যইতো আরিয়ান সকালে ওসব বলছিলো।তখনো বিষয়টা মাথায় আসেনি তার।
।
।
স্পষ্ট দুটো লাল দাগ।মায়া কয়েকবার ঢোক গিলে।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
খুশিতে চোখ টলমল করছে তার।ঠোঁট কাঁপছে।চোখের জলটা মুছে সে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বের হলো।
আরিয়ানের মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা যায়।জোড়ে একটা শ্বাস ছেড়ে সে বলে,
—“থ্যাংকস ডক্টর।কিন্তু ওর প্রেগন্যান্সিতে কি কোনো কমপ্লিকেশন আছে?আই মিন,ও তো ছোট এখনো।
রিস্কি হবেনা ব্যাপারটা?”
ড.মিতালী স্মিত হাসে।সাধারণত কাউকে এখবরটা দেয়ার পর প্রথমে সে নিজের সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করে।বলে”আমার বেবি ঠি ক আছেতো?”তারপর আসে স্ত্রীর কথায়।তবে আরিয়ানের ভালবাসা দেখে সে সত্যিই মুগ্ধ।
আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল রেখে হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে টেবিলের উপর রেখে সে বলে,
—“দেখুন মি.আরিয়ান।”মা হওয়া” এই বিষয়টাই খুব সেনসিটিভ।খুব সহজ ব্যাপার এটা নয়।আপনি রেগুলার চেকআপ করাবেন।স্ত্রীর যত্ন নিবেন।বাকিটা আল্লাহর হাতে।
আমি বুঝতে পারছি আপনার কনসার্নটা।আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে আপনি খুবই সিরিয়াস।নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,সাধারণত এমনটা দেখা যায়না।এদিক দিয়ে আপনার স্ত্রী খুব লাকি।”
যাইহোক,আপনার স্ত্রী মেইবি দেড়মাসের অন্ত:সত্তা।তবুও আপনারা টেস্ট করিয়ে নেন।শিওর হওয়ার জন্য।রিপোর্ট আমি দেখে দিবোনে।নো প্রবলেম।”
|
|
গাড়ি চলছে।আরিয়ান ধীরগতিতে ড্রাইভ করছে।কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
মায়া চুপচাপ বসে আড়চোখে আরিয়ানকে পর্যবেক্ষন করছে।আরিয়ানের মেজাজটা ঠি ক বুঝে উঠতে পারছেনা সে।লোকটা কি রেগে আছে?নাকি খুশি হয়েছে?নাকি অন্যকিছু?কিছুই বুঝতে পারছেনা।
সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত,সাবলীল দৃষ্টিতে ড্রাইভ করছে সে।চোখে মুখে কোনো অনুভূতি নেই।
বেশ খানিকক্ষন পর গাড়ি জ্যামে আটকায়।গাড়ির জানালা আটকানো।ভিতরে এসি ছাড়া।তাই আজ আর গরম লাগছেনা দুজনের।
ধৈর্যহারা হয়ে মায়াই জিজ্ঞেস করে,
—“আপনি কি খুশি হননি?”
আরিয়ান শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।ঠোঁটের কোঁণে হাসি ফুটিয়ে একেবারে মায়ার দিকে ঝুকে যায়।বলিষ্ঠ হাতজোড়া মায়ার দু’গালে রেখে কপালে গভীর থেকে গভীরতম উষ্ম ঠোঁটের স্পর্শ দেয়।কয়েকমিনিট কেটে গেলেও ঠোঁট সরায়না সে।মায়া চোখ বন্ধ করে রেখেছে।কপালে চুমু দিলে এতো শান্তি লাগে কেনো?স্নিগ্ধ পবিত্র স্পর্শ।
মায়া অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলতে নিলেই আরিয়ান ঠোঁট সরায়।তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
—“মায়াবতী,আমার এই গোটা জীবনে হাতে গোনা দু’বার শুধু আমি বাস্তবিকভাবে খুশি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।এক যেদিন আমি আমার মা বাবার খুনিকে শাস্তি দিতে পেরেছি।আর দ্বিতীয়ত যেদিন তোমাকে আমি সম্পূর্ণ রুপে নিজের করে পেয়েছি।তাছাড়া খুশি শব্দটা আমার উপভোগ করার সুযোগ হয়নি।আজ তৃতীয়বারের মতো আমি খুশি।একেবারে বাঁধভাঙা খুশি।আমার থেকে খুশি এই পৃথিবীতে কেউ আছে নাকি সন্দেহ আছে।
তবে অতিরিক্ত খুশিতে আমি অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছি।নিজেকে প্রকাশ করতে পারছিনা।
কেমন যেন লাগছে!আমি বাবা হবো ভাবতেও শ্বাস আটকে আসছে।
এটুকু বলতেই থামে আরিয়ান।কাঁধে একফোঁটা পানির অস্তিত্ব অনুভব করে মায়া।থমকে গেছে সে।
বেশি খুশি হলে কি মানুষ কাঁদে?অনুভূতি গুলো কি জলরূপে বেরিয়ে যায়?হয়তো যায়।
আরিয়ান নিজেকে সামলায়।একহাতে মায়ার গলা জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে বলে,
—“আপনার সকল সুখ,ভালবাসা,আবেগ,অনুভূতি শুধু এবং শুধু তোমাকে ঘিরেই হোক মায়াবতী।”
~চলবে~
বি:দ্র-রি-চেক হয়নি।বানান ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।”
মায়া ঠোঁট এলিয়ে ভাবলেশহীনভাবে হাসে।আমতা আমতা করে বলে,
—“আসলে..একটুখানি কেটেছে।বেশিনা”
আরিয়ান তার দিকে রাগী দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে হাত থেকে বাটিটা নিয়ে পাশে রাখে।আলতো স্পর্শে মায়ার হাত ধরতেই “আহ্”বলে আর্তনাদ করে উঠে মায়া।আরিয়ান শীতল কন্ঠে বলে,
—“একটুখানি কেটেছে তাইনা?”
মায়া মুখ লটকালো।যার রাগ ভাঙানোর জন্য এত কষ্ট করে রান্না করলো সে ই নাকি আবারো তার উপর রাগ করছে।
মায়ার কোমড় পেচিয়ে ধরে একপায়ের উরুর উপর বসিয়ে রেখেছে আরিয়ান।তাই স্বাভাবিকভাবেই আরিয়ানের থেকে একটু উঁচু হয়ে আছে সে।
মায়া একটু কাত করে আরিয়ানের কাঁধের উপর মাথা রাখে।কন্ঠে সিক্ততা নিয়ে বলে,
—“আপনি আমার উপর রাগ করছেন কেন?আপনি রাগ করলে আমার মন খারাপ লাগে”।
মায়ার সিক্ত কন্ঠে কিছুটা শিথিল হয় আরিয়ান।তবুও স্বরে গাম্ভীর্য টেনে বলে,
—“রাগ করার মতো কাজ করো কেনো?”
—“ভুলবশত কেটে গেছে।আমিতো ইচ্ছা করে করিনি।তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হঠাৎই কেটে গেলো”।
—“তাড়াহুড়ো করেছো কেন?”
—“কারণ আপনি বলে গিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরবেন।…আমিতো আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য রাঁধতে গিয়েছিলাম কিন্তু দেখেন উল্টা আপনি আরো রাগ করে বসলেন।”
আরিয়ান দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে।এই মেয়ের উপর রাগ ধরে থাকা তার সাধ্যের বাইরে।মায়ার অতিসাধারণ কথাগুলোই তার কাছে শুকনো আবেগে এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রিয়।মেয়েটার মধ্য কিছুতো একটা আছে।
সেই প্রথম দিন থেকে যে সে মায়ামীয় ঘোরে ফেঁসেছে আজ পর্যন্ত তার ঘোর কাটলোনা।বরং বেরে চলেছে দিনকে দিন।মায়া নিজের অতিসরল মন দিয়ে তাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ফেলছে তার মায়াময়ী এক অজানা ঘোরে।
আরিয়ান মায়াকে একটু নিচু করে বসায়।মায়ার মাথাটা বুকে নিয়ে কাঁটা হাতটা নিজ হাতের মুঠোয় রেখে ধীরস্থির কন্ঠে বলে,
—“মায়াবতী,তুমি কি জানো তোমার গায়ে একটু আঘাতের ছোয়াঁই আমার গোটা পৃথিবীটাকে নিকষ কালো বিষাদে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।তবে কেন আমাকে এই বিষাদময় যন্ত্রনাটা দাও?”
মায়া একেবারে চুপ করে যায়।কথার পিঠে এতক্ষন জবাব দিলেও এখন কিছু বলেনা।
আরিয়ানের বুকের হৃদস্পন্দনের আওয়াজটা তার খুব ভালোলাগে।রোজ রাতে যখন আরিয়ান তাকে বুকে নিয়ে ঘুমায় তখন এই আওয়াজটাই তার উপর ম্যাজিকের মতো কাজ করে।সেজন্যই খুব অল্প সময়ের মধ্য ঘুমিয়ে পরে সে।
মায়ার কোন উওর না পেয়ে আরিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।মায়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“মায়াবতী?ঘুমিয়ে পরলে নাকি?”
বলে উঠে যেতে নিলেই তাকে চেপে ধরে আরিয়ান।বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,
—“ওটার থেকে তোমার ঘুম বেশি জরুরি।ঘুমাও।”
—“পাগলামো করেননাতো।ছাড়ুন!!আরিয়ান ছাড়েনা দেখে মায়া মাথা খাটিয়ে বলে,”দেখুন আপনার গা থেকে ঘামের গন্ধ আসছে।জলদি কাপড় বদলে আসেন”।
আরিয়ান বাঁকা হেসে মায়াকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়ায়।জামাকাপড় হাতে নিয়ে মায়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
—“আপনার যে আমার গায়ের পারফিউমের গন্ধটা অনেক বেশি প্রিয় সেটা আমি জানি ম্যাডাম।আমি অফিসে গেলে আপনি যে সেটা সারা রুমে স্প্রে করে রাখেন সেটাও আমার জানা আছে।তাই অযথা ঘামের গন্ধের দোহাই দিয়েন না।”
—“উহু!ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগানো নেই।পারফিউমের বোতল প্রতি সপ্তাহেই খালি হয়ে যায়।একই ব্র্যান্ডের পারফিউম কিনতে কিনতে আমি ক্লান্ত মায়াবতী।”
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে যায় আরিয়ান।মায়া লজ্জামাখা নয়নে চেয়ে থাকে।ইশ্!আরিয়ান না জানি কি ভাবছে।
উফ!!এত লজ্জা সে কই রাখবে?পারফিউমের মতো ছিটিয়ে দিবে নাকি সারাঘরে?
______________
______________
হালুয়ার বাটি সম্পূর্ণ খেয়ে শেষ করেছে আরিয়ান।লজ্জায় বুঁদ হয়ে তার পাশেই বসে আছে মায়া।খালি বাটিটা মায়ার হাতে ধরিয়ে দিতেই মায়া সেটা পাশের টেবিলে রেখে দিলো।আরিয়ান মায়ার নত মুখের দিকে চেয়ে ঠাট্টার ছলে বললো,
—“আর লজ্জা পেয়োনা।প্রতিসপ্তাহে পারফিউম কিনার মতো যথেষ্ট টাকা আমার আছে।কোন সমস্যা নেই!তোমার যত ইচ্ছা ততো স্প্রে করো।”
অতিরিক্ত লজ্জায় মায়া এবার মুখ খুললো।লজ্জামাখা অদ্ভুত এক অভিযোগের স্বরে বললো,
—“হ্যাঁ তো?আপনার গায়ের গন্ধ আমার ভালো লাগে মানে লাগে।আমি সেটা ঘরে দিয়ে রাখি মানে রাখি।আপনি সেটা জানেন তো কি হয়েছে?তাই বলে এভাবে আমাকে লজ্জা দিবেন?,এখন থেকে আরো বেশি করে দিয়ে রাখবো,একদিনেই পুরো বোতল শেষ করে ফেলবো।”
—“আচ্ছা করো শেষ”।
—“করো শেষ মানে?আমি অযথা পারফিউম শেষ করবো আর আপনি বলছেন করো শেষ?”
আরিয়ান তখন পাশ থেকে ল্যাপটপ হাতে নিয়েছে।মায়ার কথার উওরে সে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
—“হুম”।
—“এই কি হলো আপনার?”
আরিয়ান ভ্রু কুচকিয়ে মায়ার মাথার তালুতে হাত রাখে।তালু যথেষ্ট গরম হয়ে আছে।আরিয়ান ল্যাপটপ নামিয়ে মায়াকে কাছে টেনে বুকে নিয়ে বলে,
—“শান্ত হও।আমার কিছু হয়নি।বরং তোমারই মাথা গরম হয়ে গেছে।তখন ঘুমাতে পারোনি বলে বোধহয়।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি,জলদি ঘুমিয়ে পরো।”
কিছু সময় অতিবাহিত হতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় মায়া।আরিয়ান আবারো ল্যাপটপ হাতে নেয়।মায়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,
—“তোমার লজ্জামাখা চেহারার মুগ্ধতায় আমি বারবার আটকে যাই মায়াবতী।সেজন্যইতো সময়,অসময়ে তোমাকে লজ্জায় ফেলি।কিরকম স্বার্থপর আমি দেখেছো?নিজে মুগ্ধ হওয়ার জন্য তোমাকে লজ্জা দেই।”
এমনিভাবেই স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে যেতে থাকে সময়।আরিয়ান মায়ার খুনসুটিতে কেটে যেতে থাকে দিনের পর দিন।সময় গড়ালেও তারা দুজন আটকে থাকে তাদের মধ্যেকার ভালবাসায়।আরিয়ান আবিষ্ট থাকে তার মায়াময় দুনিয়ায়।আর মায়া আরিয়ানের ভালবাসার দুনিয়ায় তার মায়াবতী হয়ে।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে কেটে গেছে কয়েকটি মাস।চৈত্রমাসের মাঝামাঝি সময় তখন।গরম পরেছে বেশ।
প্রখর সূর্যতাপের মধ্যেও গাড়ির জানালা খুলে রেখেছে মায়া।মুখের উপর আছড়ে পরছে তপ্ত রৌদ্ররশ্নিগুলো।তাপের চোটে লাল হয়ে আছে চেহারা।চোখগুলো খানিকটা কুঁচকানো তার।রাস্তার জ্যামে গাড়ি থেমে আছে ঘন্টাখানেক যাবত।গাড়ির স্টেয়ারিংয়ে হাত রেখে সিটে মাথা এলিয়ে রেখেছে আরিয়ান।রৌদ্রের মতো মায়ার মেজাজেও আজকে খুব তেজিভাব।সকাল থেকেই কেমন যেন খিটখিট করছে সে।আরিয়ানের ধারণা মায়ার মুড সুইং হলেও হতে পারে।তাই সেও বেশি কিছু বলেনি।মায়াকে নিয়ে বেরিয়েছে দুপুর একটার দিকে।এখন ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে দুইটা চল্লিশ।এতক্ষনেও শপিংমলে পৌছাতে পারেনি তারা।আগামী শুক্রবার ইতি-তন্ময়ের বিয়ে।সপ্তাহখানেক আগে ইতিকে বিয়ে করার প্রস্তাবটা পেশ করে তন্ময়।মানা করার কোনো কারণ নেই বিধায় সবার সম্মতিতেই বিয়েটা পাকা হয়ে গেছে ওদের।তাদের বিয়েটা হুট করে হলেও সবার বিয়েতো আর হুট করে হয়না।আয়োজন করেই হয়।সেজন্যই কিছু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে।
বেরোনোর খানিকপর থেকেই রোদের মধ্য জানলো খুলে রেখেছে মায়া।ওর নাকি রৌদ্রবিলাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
লাইক সিরিয়াসলি?রৌদ্রবিলাসও কারো করতে মনে চায়?আরিয়ান ভেবে পায়না!মায়ার চিবুকের কাছে ঘাম হচ্ছে।আরিয়ানের নিজেরও শার্ট ভিজে গেছে।মায়া স্থির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।গরম সইতে পেরে আরিয়ান ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে,
—“মায়া জানলাটা লাগিয়ে দাও।এসি ছাড়ি।গরম লাগছেতো!
মায়া জলন্ত দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে ক্ষীপ্ত কন্ঠে ঠোঁট চেপে বলে,
—“হ্যাঁ,আপনারতো গরম লাগবেই।আপনিতো অনেক হট!মেয়েরাতো আপনাকে হট হট বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে।আপনার গরম লাগবেনা তো কি আমার গরম লাগবে?!!
এবার বিষয়টা ধরতে পারে আরিয়ান।এতক্ষন যাবত রোদে পুড়ে ছাই হওয়ার পরও মায়ার জানালা খুলে রাখার কারণটা চট করে ধরে ফেলে সে।
॥॥।।।।
কিছু সময় আগের কথা…
অনেকক্ষন যাবত জ্যামে আটকে ছিলো গাড়ি।প্রথম প্রথম জানালা খোলা থাকায় বাতাস ঢুকলেও তখন আর বাতাসের ছিঁটে ফোঁটাও ছিলনা।একটু স্বস্তির শ্বাস নেয়ার জন্য আরিয়ান যেওনা মুখের মাস্ক খুলেছে
ঠি ক তখনই কোথা থেকে যেনো দুজন মেয়ে দৌড়ে তার জানলার সামনে এসে দাড়ায়।তাদে মধ্য একজন অতি খুশিতে উত্তেজিত হয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
—“মিস্টার আরিয়ান,আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা আপনাকে সামনাসামনি দেখছি।ক্যান আই টেক এ সেলফি উইথ ইউ?”
মেয়েটা দ্রুত ফোন বের করে।চট করে একটা সেলফি তুলে বলে,
—“উফ!ইউ আর টু’মাচ হট।আই হ্যাভ আ বিগ ক্রাশ অন ইউ।”
আরিয়ান এবারো কোন অভিব্যক্তি দেখায়না।আড়চোখে একবার মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখে সে বিস্মিত নয়নে এদিকে তাকিয়ে রয়েছে।ততক্ষনে মেয়েটা আরো কিছু বকবক করে যাচ্ছিলো সে শুনতে পায়নি।জ্যাম তখন একটু ছেড়েছে।আরিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিতে উদ্যত হয়।মুখ ঘুড়িয়ে যখন মেয়েটার দিকে তাকায় তখনও সে বকবক করছে।আরিয়ান হেসে বলে,
—“নাইস টু মিট ইউ মিস!ক্যান আই গো নাও?”
—“জি জি অবশ্যই।অনেক ধন্যবাদ।”
আরিয়ান আর কিছু বলেনা।গ্লাস উঠিয়ে একটু আগাতেই আবারো জ্যামে আটকে যায় গাড়ি।
॥
॥
বর্তমান…
—“আর ইউ জেলাস?”
মায়া চট করে তাকায়।জানলা লাগিয়ে দেয়।নিজেই এসিটা ছেড়ে দিয়ে ঝাঁঝালো ভাবে বলে,
—“অবশ্যই আমি জেলাস।একেবারে জ্বলে পুঁড়ে জেলাস।আমি আপনার বউ,আমি জেলাস হবোনাতো কে জেলাস হবে।জেলাস হওয়ার সম্পুর্ণ অধিকার আছে আমার।আপনার কোন সমস্যা?”
আরিয়ান শব্দ করে হাসে।হাসতে হাসতেই মায়ার গাল টেনে বলে,
—“ইউ আর টু কিউট মায়া।”
মায়া একহাতে গাল ঘষে বলে,
—“ধ্যাত্,ব্যাথা পাইতো।”
______________
শপিংমলের সামনে গাড়ি থামে।আরিয়ান নিজের মাস্ক পরে,চোখে সানগ্লাস পরে মায়ার সিটবেল্ট খুলে দেয়।
নিজে নেমে মায়াকে হাত ধরে নামায়।মায়ার মাথায় ওড়নার আচঁল দিয়ে ঘোমটা টানা।মুখে মাস্ক পরার দরুন তাদের চেনার উপায় নেই।তারা দুজন বের হলে আরিয়ান সাথে কোন বডিগার্ড আনেনা।কখনোই না।
জুয়েলার্সের দোকানে ঢুকেছে তারা।দোকানের বাইরে যথেষ্ট সিকিউরিটি আর দোকানও ফাঁকা।তাই ভেতরে এসেই মাস্ক খুলে ফেলেছে তারা।একপাশে গহনা আবার আরেকপাশে ঘড়ির সেকশনও আছে।
আরিয়ান নিজের জন্য ঘড়ি দেখছে।মায়া দাড়িয়ে আছে পাশেই গহনা পছন্দ করে ইতিমধ্যে রিসিপসনে দিতেও বলে দিয়েছে সে।আরিয়ান একটার পর একটা ঘড়ির ট্রায়াল দিচ্ছে।হাতে পরছে আবার খুলে ফেলছে।নিজের গেট-আপের ব্যাপারে খুব সচেতন আরিয়ান।এই জন্যই তার প্রতি মেয়েরা আকৃষ্ট হয় বেশি।যেমন আজকে ব্ল্যাক প্যান্টের সাথে ওয়াইট শার্ট।হাতে মোটা ডায়েলের ঘড়ি পরা ছিলো।যেটা এখন মায়ার হাতে আছে।
হুট করেই একটা ঘড়ি আটকে যায় হাতে।কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করেও খুলতে পারেনা আরিয়ান।এতক্ষন একজন মেয়ে স্টাফ ঘড়ি বের করে দিচ্ছিলো তাকে।তিনিই মুচকি হেসে বলে,
—“মে আই হেল্প ইউ স্যার?”
মেয়েটার হাতের ছোয়াঁ আরিয়ানের হাতে লাগতেই আপন শক্তিতে জ্বলে উঠে মায়া।নিজের হাতের ঘড়িটা শব্দ করে কাঁচের উপর রাখে।আরিয়ানের হাতটা ঝাপটা মেরে নিজের হাতের মুঠেয় নিয়ে ঘড়ি খোলার চেষ্টা করতে করতে শক্ত কন্ঠে বলে,
—“আপনাদের এখানে ছেলে স্টাফ রাখা উচিত।”
সামনের মেয়েটা একটু থমকায়।আমতাআমতা করে বলে,
—“আসলে ম্যাম,একজন ছেলে স্টাফ আছে।ও আজকে ছুটিতে।তাই আমি ওর হয়ে কাজ করছি।”
মায়া উওর দেয়না।বিরবির করে বলে,
—“আজকেই যেতে হলো ছুটিতে।”
মেয়েটার কানে কথাটা না গেলেও আরিয়ানের কানে ঠি কই যায়।
মেয়েটা আরো কিছু বলতে চেলে সে চোখের ইশারায় মেয়েটাকে চুপ থাকতে বলে।
আরিয়ানের ঘড়ি খুলে দিয়ে মায়া মেয়েটাকে বলে,
—“নিন এটা প্যাক করে দেন।এটাই নিব”।
মেয়েটা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে তাকাতেই আরিয়ান চোখ নামিয়ে সম্মতি দেয়।মেয়েটা মুচকি হেসে ঘড়িটা প্যাক করে।ভদ্রতার হাসি দিয়ে মায়ার সামনে একটা বক্স খুলে বলে,
—“ম্যাম এখানে ইউনিক ডিজাইনের পায়েল আছে।আপনি চাইলে দেখতে পারেন।”
মায়ার মুখটা চুপসে যায়।গলার স্বর নামিয়ে সে বলে,
—“নো থ্যাংকস।”
এরমধ্যই আরিয়ান একটা পায়েল হাতে তুলে নিয়েছে।লাল রুবি পাথরের অদ্ভুত সুন্দর একটা পায়েল।
দেখলেই চোখ আটকে যায় এরকম!আরিয়ান বলে,
—“এটা সুন্দর।তাইনা মায়া?নিবে?”
মায়ার নিজেরও এটা পছন্দ হয়েছে খুব।তবে তার পায়ের পড়ানো পায়েলটা সে খুলতে পারবেনা।তাই অপ্রস্তুত হেসে বলে,
—“খুব সুন্দর।কিন্তু আমার পায়েল আছে।এটা লাগবেনা।”
আরিয়ান তাকে জোড় করেনা।পায়েলটা রেখে দিয়ে মায়ার হাত ধরে বলে,
—“অনেক শপিং বাকি।চলো।”
ঘড়ি আর গহনার ব্যাগগুলো নিতে গেলেই বাঁধে আরেক বিপত্তি।ব্যাগগুলো আরিয়ানের হাতে দেয়ার সময় রিসিপসনের মেয়েটার হাত ছুটে যায়।ব্যাগগুলো যাতে না পরে সেজন্য শক্ত করে আরিয়ান ধরে ফেলে।ভুলবশত মেয়েটার হাতটাও তার মুঠোয় চলে আসে।সেকেন্ডের মাথায় সেটা ছাড়িয়ে নেয় আরিয়ান।মেয়েটা কাঁচুমাচু করে বলে,
—“এক্সট্রিমলি সরি স্যার।”
আরিয়ান”ইটস্ ওকে বলার পরপরই মায়া বলে,
—“আপনারা দুজন ছেলে স্টাফ রাখবেন।বুঝলেন?একজন না আসলেও যাতে অন্যজন তার কাজ করতে পারে।তাহলেই আর অহেতুক এই ঝামেলা গুলা হয়না।”
আরো কিছু বলার আগেই আরিয়ান তার হাত টেনে বেরিয়ে আসে।সব শপিং শেষে গাড়িতে উঠে তারা।
আরিয়ান গাড়ি স্টার্ট দেয়ার আগমূহুর্তে বলে,
—“মায়াবতী,আ’ম অনলি ইওর’।তুমি ছাড়া কেউই আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনা আর না কখনো পারবে।মনে রেখো।”
____________
আরিয়ান তার অফিসের দিকে গাড়ি ঘুরায়।মায়া জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলে,
—“এখন বাসায় যাবেননা?”
—“না,আমার অফিসে একটু কাজ আছে।শেষ করেই ফিরবো।”
—“আর আমি?”
—“তুমিও যাবে আমার সাথে।এনি প্রবলেম?”
—“নাহ্ চলুন।একটু থেমে আবার বলে সে,তন্ময় ভাইয়া,ইতি ওরা ফিরেছে বাসায়?ওদের না কোথায় যাওয়ার কথা ছিলো?”
আরিয়ান বিরবির করে বলে,”ওরাতো কোথাও যায়ই নি।ফিরবে আবার কি?”
তবে মুখে বলে,
—“ফোন করেনি।হয়তো ফিরেনি এখনো।”
বেশ কিছুক্ষণ পরে অফিসে পৌছায় তারা।আরিয়ান এটা ওটা বলে অনেকক্ষন আটকে রাখে মায়াকে।মায়ার একটু খটকা লাগে।আরিয়ান তো কখনো সে সাথে থাকলে এতো বিজি থাকেনা।বরং জলদি কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে।নয়তো মায়াকে বাসায় দিয়েই অফিসে আসে।আজকে সেই সকালে বের হলো আর এখন রাত হয়ে যাচ্ছে তবুও ফিরছেনা।ঘড়ির কাঁটা যখন দশটা ছুঁইছুঁই তখন তাকে নিয়ে বের হয় আরিয়ান।মায়া তখন ক্লান্ত।ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিটে মাথা এলিয়ে দেয় সে।আরিয়ান আরো একটু হেলাফেলা করে।উল্টা রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে অবশেষে এগারোটা বাজে বাড়ির সামনে গাড়ি থামায়।
মায়ার এহেন আচরণে চমকে উঠে আরিয়ান।মনটা “ধক” করে উঠে।মায়া এমন করলে সে কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করবে?
মায়া তার উপর সম্পুর্ণ ভর দিয়ে হেলে পরেছে।আরিয়ান মনে মনে হাসে।মেয়েটা ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে নাকি শুধু ঠোঁট ঠেকিয়ে রেখেছে বুঝতে পারছেনা।এই প্রথম নিজে থেকে তার এতটা কাছে এসেছে মায়া,সে ফিরিয়ে দিবে কিকরে?
আরিয়ান মায়ার একহাত তার ঘাড় থেকে সরিয়ে মাথার পিছের দিকের চুলে রাখে।সাথে সাথে শক্ত করে তার চুলগুলো আকড়ে ধরে মায়া।মায়ার কোমড় টেনে নিজের সাথে ঘনিষ্টভাবে লেপ্টে নেয় আরিয়ান।
দোলনায় মাথা ঠেকে যায়।সে অবস্থাতেই গভীর চুম্বনে লিপ্ত হয় সে।
মিনিট পাঁচেক পরই হাপিয়ে উঠে মায়া।সে সরে যেতে গেলেও আরিয়ান তাকে ছাড়েনা।জাপটে ধরে রাখে।আরো কিছুক্ষন অতিবাহিত হতেই প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠে মায়া।মুখ দিয়ে”উম্”জাতীয় শব্দ করতেই তার ঠোঁট ছেড়ে দেয় আরিয়ান।আরিয়ানের কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয় মায়া।আরিয়ান তার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—“পানি খাবে?বেশি খারাপ লাগছে?”
মায়া উওর দেয়না।ক্লান্ত ভঙ্গিতে আরিয়ানের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে রাখে।আরিয়ান দুষ্টু কন্ঠে বলে,
—“এটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে গেলে।আবার বলছো তোমার আরো আদর চাই।”কিছুটা থামে আরিয়ান।
তারপর সিরিয়াস হয়ে আবার বলতে শুরু করে,”মায়া,তোমার বয়স কম,এট এনি চান্স তুমি যদি কনসিভ করে ফেলো তুমি জানো সেটা কতটা রিস্কি হবে তোমার জন্য?তোমার বয়স বিশ গড়িয়ে একুশে পরবে মাত্র।আই নো,এই বয়সেও মেয়েরা কনসিভ করে।
বাট তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো,আমি হানড্রেড পার্সেন্ট শিওর যে তোমার ওজন আন্ডারওয়েট।
আমি ডক্টর না তবুও এতটুকু জানি যে,তোমার প্রেগন্যান্সিতে অনেক কমপ্লিকেশন থাকবে।এখন কতশত মেয়েরা মারা যাচ্ছে অল্পবয়সে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে।সো আই কান্ট টেক দ্যাট রিস্ক।আমি তোমাকে হারাতে পারবোনা মায়াবতী।”
মায়া মনোযোগ দিয়ে আরিয়ানের কথাগুলো শুনছিলো।সবটা শোনার পর মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে এলো তার।আরিয়ানের প্রত্যেকটা কথা যুক্তিপূর্ণ।তবে আরিয়ান যে এতদূর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে এটা ভেবে ভালোও লাগলো।
তবুও মন খারাপের আভাস তার কন্ঠেও ছেঁয়ে যায়।আরিয়ানের গলায় মুখ লুকিয়ে বিষন্ন কন্ঠে সে বলে,
—“আমার কিছু হবেনা।আপনি আছেন তো।”
—“তুমি বুঝতে পারছোনা মায়া।”
—“আমি বুঝতে চাচ্ছিনা।…আচ্ছা,আপনার কি আমাকে আদর করতে ইচ্ছে হয়না?”
মায়া এবার ছলছল নয়নে কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে তার দিকে তাকায়।আরিয়ান দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে।কাকে এতক্ষন ধরে বুঝালো সে।মেয়েটা মনে হয় নিজের মধ্য নেই আজ।এমনিই মায়াকে এই রুপে দেখে ক্ষণে ক্ষনে শ্বাস আটকে আসছে।বহুকষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে তার উপর মায়ার এই আবদার।
কিছুক্ষণ ভাবে আরিয়ান।মায়া এখনও তার দিকে উওরের আশায় চেয়ে আছে।
আরিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“আমাদের ইসলামিক নীতিতে বিয়ে হয়নি মায়া।কাবিননামায় সাইন করে রেজিস্ট্রি হয়েছে।,,,তুমিই বলো এটা কি উচিত হবে?”
মায়া দুবার পিটপিট করে চোখের পলক ফেলে।ব্যাপারটা বুঝে আসতেই ঠোঁটের কোঁণে মৃদু হাসির রেখা টেনে সে চট করে বলে,
—“তাহলে চলেন,এখন বিয়ে করে ফেলি।”
আরিয়ান নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকায়।পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখে বলে,
—“রাত বাজে বারোটা দশ।এখন বিয়ে করবে তুমি?”
—“হ্যাঁ,তো?”
আরিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে মায়াকে কোল থেকে সরিয়ে উঠে দাড়ায়।এই মেয়েকে আর বুঝিয়ে লাভ নেই।মায়ার উপর সে রাগ ও দেখাতে পারেনা।তাই আর কোন উপায় নেই একে সামাল দেয়ার।
কিন্তু এই রাতের বেলা কাজি পাওয়াটাই ঝামেলা।
মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়েই আরিয়ান মায়ার হাত ধরে রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
—“একটু বসো।আমি আসছি।”
মায়া মাথা দুলিয়ে সাঁয় দিতেই আরিয়ান বেরিয়ে যায়।প্রায় আধাঘন্টা বাদে ফিরে আসে।সাথে তন্ময়,ইতি,কাজি,আর আরেকটা লোক সে হয়তো কাজির সাথে এসেছে।কাজির চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা।
বোঝাই যাচ্ছে গভীর ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে।মায়া ঠোঁট চেপে হাসে।
আরিয়ান ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকায় মায়ার হাসি দেখে।তাকে এত হয়রানি করিয়ে মেয়েটা এখন হাসছে।
তিনবার কবুল বলে বিয়ে হয়ে যায় আরিয়ান-মায়ার।বিয়ের সাক্ষী থাকে ইতি,তন্ময় আর কাজির সাথে আসা লোকটা।বিয়ের সব নিয়ম শেষ।কাজিকে এতরাতে ডেকে এনেছে সেজন্য তার পাওনার চেয়ে একটু বেশি টাকা দিয়ে দেয় আরিয়ান।উনি হাসিমুখে বিদায় নেয়।আরিয়ান ফিরে আসতেই তন্ময় ইতি মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আরিয়ান অগোছালো ভাবে হেসে দরজা আটকে দেয়।কাবার্ড থেকে বিয়ের জন্য ধার্য করা মোহরানার টাকা বের করে মায়ার হাতে দিয়ে বলে,
—“নাও।শান্তি হয়েছে?এখন তুমি সম্পূর্ণরুপে আমার।”
মায়া টাকাগুলো পাশে রাখে।আরিয়ানকে বলে,
—“এখনতো আর কোন বাঁধা নেই।”
আরিয়ান হাসে।মায়ার দু গালে হাত রেখে বলে,
—“আর ইউ শিওর?”
উওরে লাজুক হেসে আরিয়ানের বাহুতে মুখ লুকায় মায়া।মায়ার সম্মতি বুঝতে পেরে হাসে আরিয়ান।এমনটা নয় যে সে মায়াকে কাছে পেতে চাইছিলো না।বরং এতক্ষন নিজের সাথে প্রবল যুদ্ধ করে মায়ার কথা ভেবে নিজেকে সামলে রেখেছিলো।কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়।মায়া যখন তার অধিকার চাইছে তখন তার আর মানা করার স্বাধ্যি নেই।
মায়াকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিল আরিয়ান।মায়া তার গলা জড়িয়ে ধরতেই কাঁচের চুড়িতে রিনঝিন আওয়াজ করে উঠলো।সেই আওয়াজটাও যেন তাদের ভালবাসার পূর্ণতা পাওয়ার আগাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
আরিয়ান তাকে বিছানার মাঝখানে এনে বসিয়ে দেয়।চুড়ি কানেরদুল গুলো খুব সন্তর্পণে খুলে রাখে।
আরিয়ান নিজের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আসে।
ব্যালকনির পর্দা খোলা।ঘরে আসা ক্ষীন চাঁদের আলোয় ভীষণ মোহনীয় লাগছে মায়াকে।
আরিয়ান ধীরপায়ে এগিয়ে যায়।মায়াকে শুইয়ে দিয়ে শাড়ির আচঁল ফেলে দেয়।ব্লাউজের হুক খুলতেই আরিয়ানকে দু’হাতে খামছে ধরে মায়া।অত:পর দুজন হারিয়ে যায় ভালবাসার এক অন্য জগতে।এতদিনের
বহু আকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তে ডুব দেয় দুজনে।মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় তাদের সত্তা,অস্তিত্ব।
________________
সকালে মুখের উপর আলো পরতেই চোখমুখ কুঁচকে এলো আরিয়ানের।চোখ খুলে সর্বপ্রথম মুখের উপর ছড়িয়ে পরা মায়ার চুলগুলো সরায় সে।তার গলার সাইডে মাথা গুঁজে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মায়া।আরিয়ানের একহাত মায়ার উন্মুক্ত পিঠে।কম্বল সরে গেছে উপর থেকে।আরিয়ান একটু উঠে গলা অবধি কম্বল টেনে নেয়।ফ্লোরে পরে আছে মায়ার শাড়ি।
কালরাতের কথা মনে পরতেই তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে আরিয়ানের ঠোঁটে।কি সুন্দর স্নিগ্ধ ছিল প্রতিটি সেকেন্ড।
মায়ার কথাগুলো মনে পরতেই আরো হাসি পায় তার।মেয়েটা যে কি করলো কাল।আরিয়ান কখনোই ভাবেনি মায়া নিজ থেকে তাকে এসব বলবে।মায়ার লজ্জামিশ্রিত কন্ঠের আধো আধো আবদারগুলো কানে বাঁজছে এখনো।
আজ সে ও তার অনুভূতিগুলো পরিপূর্ণ রুপে পুরিপূর্ণতা পেলো।
খানিক বাদেই নড়েচড়ে উঠলো মায়া।যখন বুঝলো সে আরিয়ানের উপরে ভর দিয়ে আছে তৎক্ষনাত ছিঁটকে সরে যেতে নিলেই আরিয়ান তাকে আঁকড়ে ধরে ফেলল।শ্বাস আটকে আরিয়ানের দিকে চাইলে মায়া।
পরপরই প্রচন্ড লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো।আরিয়ানের ঠোঁটের কোঁণে দুষ্টু হাসি।
হঠাৎ উল্টে গিয়ে মায়াকে নিচে নিয়ে তার উপরে ঝুঁকে পরলো সে।মায়া সিটিয়ে গেলো।বুক পর্যন্ত কম্বল টেনে শক্ত হাতে ধরে রাখলো।আরিয়ান তার অপরপাশে একহাত রাখলো।মূলত মায়া যাতে উঠে যেতে না পারে সে ব্যবস্থাই করলো।একআঙ্গুল দিয়ে মায়ার কপাল থেকে গালে স্লাইড করতে করতে বললো,
—“কি হয়েছিলো আপনার কালরাতে?এতটা ডেস্পারেট্ হয়ে গিয়েছিলেন কেন?হুম?”
মায়া বেশ বুঝতে পারছে আরিয়ান ইচ্ছা করে তাকে লজ্জায় ফেলছে।ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সে।কালরাতের নিজের বলা কথা গুলো মনে করলে তার নিজেরই লজ্জা লাগছে আরিয়ানকে আর কি বলবে?
আরিয়ান আবার বলে,
—“নিজের ভয়ংকর সুন্দর রুপ দিয়ে তো ভালোই ঘায়েল করলেন আমাকে।এখন লজ্জা মাখা চাহনী দিয়ে কি পুরোপুরি শেষ করে দিবেন?”
—“ধ্যাত্,সরেনতো।”
—“কেন?কেন?এখন লজ্জা লাগছে তাইনা?কালতো খুব আদর আদর করছিলেন।”
আরিয়ান মুখ নামিয়ে তার গালে চুমু খায়।উপর থেকে সরে গিয়ে বলে,
—“যাও শাওয়ার নিয়ে আসো।”
মায়া দ্রুত ফ্লোর থেকে শাড়ি উঠিয়ে গায়ে পেচিয়ে নিলো।আরিয়ান পাশে থেকে ফোন হাতে নিয়ে কিছু একটা করছে।ততক্ষনে মায়া নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষন পর বেরিয়ে এলো মায়া।তার পরণে হাল্কা গোলাপী রংয়ের থ্রিপিস।গোসলের পর স্নিগ্ধতা যেন আরো বেরে গেছে।আরিয়ান তখন শরীরে টাওয়াল পেচিয়ে বিছানার চাদর চেন্জ করছে।তার মাঝেই ধপ করে বিছানায় বসে পরলো মায়া।আরিয়ানকে কাজ তখন শেষ।পুরাতন চাদরটা লন্ড্রি বিনে রেখে দিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে মায়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,
—“শরীর খারাপ লাগছে?”
মায়া দু চোখ বন্ধ করে রেখেছে।মাথা ব্যাথা করছে,দূর্বল দূর্বল লাগছে তার।আরিয়ানকে বলতেই সে একটু পানি খাইয়ে দিয়ে বালিশে সুইয়ে দিলো মায়াকে।চুল আগে থেকেই মুছে বেরিয়েছে তাই চুল মোছার ঝামেলা নেই।আরিয়ান তার শরীরে কম্বল টেনে দিয়ে বললো,
—“চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো,আমি শাওয়ার নিয়ে এসে কিছু খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে।বলেছিলাম জেদ করোনা।আমার কথাতো শুনলেনা।এখন শরীর খারাপ করলোনা?।”
মায়া গোমরা মুখে আরিয়ানের দিকে তাকাতেই সে বলে,
—“চুপ করে শুয়ে থাকো।আমি এলে,তারপর উঠবে”।
আরিয়ান শাওয়ার নিতে চলে যায়।বিছানায় চুপটি করে শুয়ে থাকে মায়া।বাস্তবিকই তার প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।
তবে অন্যরকম একটা ভালোও লাগছে।কেমন যেন লজ্জা লজ্জা একটা মিশ্র অনুভুতি….
শাওয়ার থেকে বেরিয়ে এসেছে আরিয়ান।মায়া উপুর হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।মাথাটা কাত করে বালিশে রাখা।আরিয়ান কাছে যেয়ে তার মুখের উপরের চুলগুলো সরিয়ে দেয়।মায়া অলস ভঙ্গিতে একটু তাকিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে।
মায়ার এমন দূর্বলতা দেখে আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে সন্ধিহান কন্ঠে বলে,
—“তুমি রাতে ডিনার করেছিলে?”
—“নাহ্”।
আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে উঠে।এজন্যইতো এই মেয়ের এত দূর্বল লাগছে।রাতে খায়নি।তাকে একবার বলেওনি পর্যন্ত।সে মৃদু ধমকের স্বরে বলে,
—“এই উঠোতো তুমি।রাতে খাওনি আর এখন বলছো?জলদি উঠো।”
বলে মায়াকে দুহাতে জড়িয়ে উঠিয়ে বসালো আরিয়ান।খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিতেই মায়া পিটপিট করে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
—“বকছেন কেন?”
আরিয়ান উওর দেয়না।চোখমুখ শক্ত করে মায়ার কপালে গালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর আসছে কিনা।
তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে উঠে দাড়ায় আরিয়ান।হনহন করে বাইরে বেরিয়ে যায়।মায়া চোখ মুখ কুঁচকে
চেয়ে থাকে।কালরাতে তো আরিয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই সে ঘুমিয়ে পরেছিলো।তারপর আর খাওয়ার কথা মনে ছিলনা।
হাতে দুই-প্লেট খাবার নিয়ে ভেতরে ঢুকে আরিয়ান।একহাতে ব্রেকফাস্টে আরেক প্লেট ভর্তি ফল।তার পিছে পিছে ঢুকে ইতি।তার হাতে ফলের জুস।পাশের টেবিলে সবকিছু রেখে ইতি বলে,
—“আমি খাইয়ে দিব স্যার?”
আরিয়ান মায়ার পাশে বসে।প্লেটটা নিজের হাতে নিয়ে নরম কন্ঠে বলে,
—“না তুমি যাও ইতি।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।সমস্যা নেই”।
ইতি মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।অত:পর মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে যায়।আরিয়ান আবারো চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলে।মায়ার মুখের সামনে খাবার ধরতেই মায়া সেটা মুখে তুলে বলে,
—“আপনি রাগ করছেন কেন?আমিতো আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি।”
আরিয়ান মায়ার দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।মুখে কিছু বলেনা।একটু পরপর শুধু খাবার তুলে দেয় মুখে।মায়া বিনাবাক্য খেয়ে নেয় সব।আরিয়ান প্লেট রেখে জুসের গ্লাস হাতে নেয়।এক চুমুক খেতেই মুখ বিকৃতি করে ফেলে মায়া।
—“এটা কি?চিনি দেয়নি নাকি?এতো তেঁতো কেনো?”
আরিয়ান কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনা।আবারো মুখে সামনে গ্লাস ধরতেই মায়া আপত্তি করে বলে,
—“আমি খাবোনা।…আপনি খেয়ে দেখেন,এটা সত্যিই খুব টক।”
আরিয়ান চুপচাপ এক চুমুক মুখে নেয়।স্বাভাবিকভাবেই গিলে ফেলে শান্ত কন্ঠে বলে,
—“টক হলেও এটায় পুষ্টি বেশি।খেতে হবেই।মুখ খুলো”।
মায়া ঠোঁট উল্টিয়ে একবার তাকিয়ে হা করে।এক নি:শ্বাসে তাকে পুরোটা খাইয়ে দেয় আরিয়ান।
খাওয়া শেষে সার্ভেন্ট এসে সব কিছু নিয়ে যায়।
অফিস থেকে ফোন আসায় দ্রুত তৈরি হয় আরিয়ান।এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।
পকেটে ফোন ঢুকিয়ে ড্রয়ার থেকে ওয়ালেট বের করছে তখনই মায়া বিষন্ন কন্ঠে বলে,
—“আপনি আমার উপর রাগ করেছেন?”
আরিয়ান আয়না দিয়ে মায়ার দিকে তাকায়।ওয়ালেটটা পকেটে ঢুকিয়ে বিছানার কাছে এসে দাড়িয়ে ঝুঁকে যেয়ে মায়ার কপালে উষ্ণতার ছোয়াঁ দিয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,
—“অফিস থেকে এসেও যাতে তোমাকে এখানেই দেখি।ঠিক এখানেই।সারা বাড়িতে টইটই করে ঘুরবা না।শরীর এমনেই অসুস্থ তাই রুমেই থাকবা।আমি ইতিকে বলে যাচ্ছি।ও তোমার সাথে থাকবে এখানে।আজ তারাতারিই ফিরবো আমি”
মায়া মনে মনে হাসে।লোকটা তাকে বকাও দিচ্ছে আবার চিল্লাচ্ছেওনা।কি অদ্ভুত শাসনপদ্ধতি!!
হাহ্!এমন শাসন শুনলেও শান্তি পাওয়া যায়।
___________
বিকেলবেলা…
রান্নাঘরে কিচেন এপ্রোন পরে দাড়িয়ে আছে মায়া।তার পাশে চিন্তিত মুখে দাড়িয়ে আছে ইতি।শত মানা সত্তেও তার কথা শুনেনি মায়া।সে নাকি এখন গাজরের হালুয়া বানাবে।এমন না যে সে রান্না পারেনা।সে রান্না পারে।কিন্তু রাশেদ চৌধুরি তাকে রান্নাঘরে যেতে দিতোনা।রাশেদ চৌধুরি যখন বাসায় থাকতোনা তখন মাঝে মাঝে রান্না করতো সে।
ইতির চিন্তা সেখানে নয়।ইতি ভাবছে আরিয়ান যদি শুনে মায়া রান্না ঘরে এসেছিলো তবে কি হবে?
মায়া চুপ করে দাড়িয়ে চুলায় দুধ জাল দিয়ে নাড়ছে।অন্য সার্ভেন্টরা সবাই বাইরে।তা অবশ্য মায়ার নির্দেশেই ।মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
—“গাজর বের করো ইতি।ধুয়ে দাও।তারপর আমি গ্রেট করে নিচ্ছি।”
—“ম্যাম,স্যার কিন্তু রাগ করবে।আপনাকে তো বকবেনা।বকবে আমাকে।”
—“করবেনা রাগ।তুমি বের করতো জলদি।”
অগত্যা কোন উপায় পায়না ইতি।মায়ার সাথে চুপচাপ কাজ করতে থাকে।কিন্তু বিপত্তি বাঁধে গাজর গ্রেট করতে যেয়ে।আরিয়ান জলদি ফিরবে ভেবে তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে হাত কেটে ফেলে মায়া।বেরিয়ে আসে রক্ত।
“আহ্”বলে আর্তনাদ করতেই তার হাত চেপে ধরে ইতি।কলের নিচে দেয়ায় রক্ত অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়।
চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে মায়ার হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয় ইতি।মায়ার ব্লাডফোবিয়া এতো বেশি যে অতটুকু রক্ত দেখেই ঘাম ছুটে গেছে।
—“আপনার আর কিছু করা লাগবেনা।আপনি ঘরে যান।আমি বানিয়ে আনছি।”
—“এই একদম না।আমিই করছি।বেশিক্ষন লাগবেনা।”
মায়ার জেদের কাছে হেরে যায় ইতি।হালুয়া বানিয়ে বাটিতে ঢালতেই আরিয়ানের জুতার শব্দ শোনা যায়।আজকে একটু বেশিই তারাতারি এসেছে আরিয়ান।মায়া বাটিতে চামচ নিতেই আরিয়ানের গলার শব্দ শোনা যায়।মায়াকে ডাকছে সে।
বাটি হাতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মায়া।দ্রুত উপরে উঠতেই আরিয়ানের মুখোমুখি হয় সে।আরিয়ান হন্তদন্ত কন্ঠে বলে,
—“কই ছিলা?তোমাকে না রুমে থাকতে বলেছিলাম।”
মায়া আরিয়ানের হাত ধরে রুমে আসে।আরিয়ানকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এক চামচ হালুয়া মুখে সামনে ধরে উৎসুক কন্ঠে বলে,
—“এটা খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে।”
আরিয়ান মায়ার হাতের বাটিটা খেয়াল করেছে আগেই।ভেবেছিলো,মায়া হয়তো খাচ্ছে ওটা।তাই কিছু বলেনি।
—“কি এটা?তুমি খাচ্ছিলে খাও।আমি খাবোনা।,,,,তার আগে বলো তুমি রুমের বাইরে কেনো গিয়েছিলে?”
“আপনার জন্য”কথাটা শুনতেই সমস্ত রাগ নেমে যায় আরিয়ানের।প্রচন্ড ভালোলাগে।এই ছোট্ট দু’টা শব্দ যে কাওকে এতটা প্রশান্তি দিতে পারে মায়া না থাকলে বুঝতোনা আরিয়ান।মায়া তার মুখের সামনে এখনো খাবার ধরে রেখেছে।আরিয়ান খাবারটা মুখে নেয়।তার পরপরই মায়াকে টেনে কোলের উপর বসায়।
মায়া মুচকি হেসে বলে,
—“ভালো হয়েছে?”
আরিয়ান মৃদু হেসে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
—“তুমি এমন কেন মায়াবতী?তোমার উপর রাগ করে থাকা যায়না কেন?কারণটা বলতো?কি আছে তোমার মধ্য?”
মায়া মুদিত নয়নে চেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে।আরিয়ানের হঠাৎ মায়ার হাতের দিকে নজর পরতেই চোখ বড় বড় করে সে অস্থিরভাবে বলে,
স্বভাবতই ব্রেক কষলো আরিয়ান।গাড়ি থেমে গেলো।আজকাল এই অভ্যাসটা হয়েছে তার।রাগ উঠলে আগে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিত এখন আর তা করেনা।মায়া থাকে সাথে।যদি আ্যক্সিডেন্ট হয়ে যায়,এই ভয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয়।
একটা শুকনো ফাঁকা ঢোক গিললো মায়া।কিন্তু আরিয়ানের বাহু থেকে মাথা উঠালো না।
আরিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“আগে বলোনি কেন?”
—“রাগ করেননি তো গাড়ি থামালেন কেন?স্টার্ট দেন।যেতে যেতে বলি।”
আরিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দেয়।মায়া মুচকি হেসে বলে,
—“আস্তে চালিয়েন হ্যাঁ?জোরে চালালে আমার ভয় করে।”
আরিয়ান সামনের দিকে তাকিয়েই বলে,
—“জানি আমি।,,,বলো এখন।”
মায়া সবটাই খুলে বলে আরিয়ানকে।রাহাত যা যা বলেছিলো সবকিছু।আরিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।ফর্সা চেহারা লাল হয়ে যায়।দাঁতে দাঁত চেপে ড্রাইভিং করতে থাকে।
মায়াও কিছু একটা বলতে যেয়েও বলেনা।চুপচাপ আরিয়ানের একহাত জড়িয়ে ধরে বাহুতে মুখ লুকিয়ে রাখে।
ভেবেছিলো আরিয়ানকে বলবেনা কথাগুলো।কিন্তু না বলেও থাকতে পারলোনা।কেন জানি কথাগুলো লুকাতে ইচ্ছা করছিলোনা।যাক!এখন বলেছে তবেই শান্তি লাগছে।
গাড়ি থামে অপরিচিত একটা জায়গায়।মায়া মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।অনেকটা পার্কের মতো জায়গা।গাছপালা আছে।তবে নির্জন,পার্কে তো মানুষ জন থাকে।ভ্রু কুচকে সে বলে,
—“এটা কোথায়?”
আরিয়ান জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যায়।মায়ার পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে বলে,
—“বের হও।”
আরিয়ানের হাত ধরে বেরিয়ে আসে মায়া।গাড়ির দরজা আটকে দিয়ে সামনে হাঁটা ধরে আরিয়ান।
মায়া চারিদিকে তাকিয়ে বলে,
––”কোথায় যাচ্ছি?”
আরিয়ান উওর না দিলেও সামনে তাকাতেই উওর পেয়ে যায় মায়া।সামনে রাহাত দাড়িয়ে আছে।তার পাশে আরো দুইজন ছেলে।সবার হাতেই সিগারেট।মায়া আরিয়ানের কাছে ঘেঁষে যায়।আরিয়ান কে দেখে বাকি দুইজন ছেলে হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলেও রাহাত ফেলেনা।আরিয়ান সামনে গিয়ে তাদের ইশারা করতেই প্রায় দৌড়ে পালিয়ে যায় ছেলে দুটো।রাহাত তখনো ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।
মায়া হাল্কা কেঁশে উঠতেই সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিঁশে ফেলে রাহাত।আচমকাই আরিয়ান তার গলা চেপে ধরে।গাছের সাথে হেলান দিয়ে ছিলো রাহাত।সেখানেই ঠেষে ধরায় ছুটতে পারে না সে।
—“মায়াকে ভালোবাসিস তাইনা?”
রাহাত উওর দিতে পারেনা।শ্বাস আটকে আসছে তার।চোখ বড় বড় করে ছাড়তে ইশারা করে সে।আরিয়ান গাছের থেকে আলগা করে আবারো পিছে ঠেকিয়ে সজোরে বাড়ি দিয়ে গলা ছাড়ে।কাঁশতে থাকে রাহাত।কাশির থেকে মনে হয় হাল্কা রক্তও বেরিয়ে আসে।আরিয়ান তার গালে ঘুষি মারে।শুকনো পাতার উপর পরে যায় রাহাত।মায়া খিঁচে চোখ বন্ধ করে।রাহাত জড়ানো কন্ঠে বলে,
—“হ্যাঁ,ভালোবাসি।অনেক ভালোবাসি।কি করবে তুমি?”
আরিয়ান পাশ থেকে একটা বড় পাথর হাতে তুলে।মায়ার হাত ছাড়িয়ে রাহাতের সামনে ঝুঁকে পাথরটা মুখ বরাবর ধরে বলে,
—“ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করেছিস তুই।তাই তোর এই মুখটাই রাখবোনা।পাথরের আঘাতে বিভৎস করে দিব।”বলে পাথরটা দিয়ে মুখে বাড়ি দিতে নিলেই মায়া তার বাহু ধরে ফেলে।অস্থির কন্ঠে বলে,
—“আপনি আমাকে প্রমিস করেছিলেন।”
থেমে যায় আরিয়ান।মনে পরে,মায়াকে সে প্রমিস করেছিলো আর কখনো হিংস্র হবেনা।আর পাথর দিয়ে কারো মুখ থেতলে দেয়া হিংস্রতার ই পরিচয়।উঠে দাড়ায় সে।পাথরটা ছুড়ে ফেলে রাহাতের বুকের উপর পা রেখে বলে,
—“শুধু ওর জন্য বেঁচে গেলি আজকে।নয়তো তোকে কথা বলার অবস্থায় রাখতামনা।মাইন্ড ইট্।”
মায়া তার বাহুর শার্ট টেনে বলে,
—“চলুন বাসায় যাই।”
আরিয়ান পা দিয়ে একটা বুকে বাড়ি মেরে মায়ার হাত ধরে উল্টোদিকে ঘুরতেই রাহাত বলে,
—“আমার অনুভূতিগুলো আপনার কাছে একেবারই মূল্যহীন মায়া?”
মায়া দাড়ায়।ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
—“আপনার অনুভূতি গুলো আমার কাছে কখনোই মূল্যবান ছিলোনা তাই মূল্য অমূল্য হিসাবে না যাওয়ার শ্রেয়।,,,এসব অহেতুক অনুভূতি সামলানো শিখা উচিত আপনার।দয়া করে আর বিরক্ত করবেননা প্লিজ।”
বলেই মায়া ঘাড় ঘুড়িয়ে নেয়।রাহাত ম্লান হেসে বলে,
—“আপনি যখন বলেছেন তখন আর কখনোই কিছু করবোনা।কথা দিচ্ছি।”
মায়া কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনা।আরিয়ানের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
_________________
বাসায় ফিরেই শাওয়ার নিতে ঢুকেছে মায়া।আরিয়ান খালি গায়ে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে।একহাত কপালে ঠেকানো।
এর মধ্যই বাধলো বিপত্তি।মাত্র তোয়ালে পেচিয়ে গা ভিজিয়েছে মায়া তখনই আর গরম পানির বের হচ্ছেনা।কয়েকবার সুইচটা চালু-বন্ধ করলো।কিন্তু কোনো লাভ হলোনা।তার উপর সে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে পারেনা।শীত লাগে।কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়।পানিতে হাত দিয়ে দেখে বরফ ঠান্ডা।এভাবে কতক্ষন ভেজা শরীরে দাড়িয়ে থাকা যায়।উপায় না পেয়ে।হাল্কা করে দরজা খুলে মায়া।মুখ বের করে আরিয়ানকে শুয়ে থাকতে দেখে গলা বাড়িয়ে ডাকে,
—“একটু এদিকে আসেননা।”
কপাল থেকে হাত সরায় আরিয়ান।মায়াকে এভাবে দেখে মুখ বের করতে দেখে উঠে বসে বলে,
—“কি হয়েছে?”
—“গরম পানি বের হচ্ছেনা।গিজারে সমস্যা মনে হয়।ঠিক করে দিয়ে যান।”
মায়া বোকা হেসে পিছে দাড়িয়েই খুলে দেয়।দরজা দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে।লজ্জায় লাল হয়ে গেছে গালদুটো।আরিয়ান ভেতরে ঢুকে।সারা ওয়াশরুম জুড়ে মিষ্টি গন্ধ।তীব্রভাবে মায়ার শরীরের মোহনীয় ঘ্রানটা নাকে লাগছে।মায়ার দিকে তাকিয়ে একটা ফাঁকা ঢোক গিলে আরিয়ান।মায়ার চোখে মুখে পানি লাগা।ভেজা চুলগুলো লেপটে আছে।চুল দিয়ে গড়িয়ে পরছে পানি।দরজার পিছে দাড়ানো তবুও সে বুঝতে পারছে মায়ার শরীরে শুধু তোয়ালে পেঁচানো,ফর্সা কাঁধ বেরিয়ে আছে।আরিয়ান দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।গিজারে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ কিছু একটা করে।তারপর মেইন সুইচ বন্ধ করে আবার চালু করে।গিজারের লাইট জ্বলে উঠে।
মায়া ঠোঁট এলিয়ে বলে,
—“ঠিক হয়ে গেছে মনে হয়।”
আরিয়ান তার দিকে তাকায়।এগিয়ে গিয়ে দরজায় হাত রেখে দুষ্টু হেসে বলে,”ঠি ক তো হয়েছেই কিন্তু তুমিতো আমার মাথা নষ্ট করে দিলে মায়াবতী।”বলে মায়ার হাত ছাড়িয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় আরিয়ান।
লজ্জায় দুহাতে টাওয়াল আকড়ে ধরে মায়া।তার টাওয়ালটা হাঁটু অবধিও যায়নি।তার উপর ভেজা শরীর।
আরিয়ানের গায়ে জামা নেই।লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে মায়া।
আরিয়ান তার কোমড়ে হাত রাখতেই কেঁপে উঠে চাপা স্বরে বলে,
—“কি করছেন?বাইরে যান”
আরিয়ান তাকে কোমড় টেনে কাছে আনে।কাঁধ থেকে ভেজা চুল সরিয়ে দিয়ে চার আঙ্গুল দিয়ে গলার সাইডে স্লাইড করে।ঠোঁট কামড়ে ধরে মায়া।আরিয়ান তাকে কোণা থেকে সরিয়ে ঝর্ণার নিচে দাড়া করায়।একহাত দেয়ালে রেখে ঝর্ণা ছেড়ে দেয়।মুহূর্তেই ভিজে যেতে থাকে দুজনে।আরিয়ানের খালি বুকে হাত রাখে মায়া।একহাত কাঁধে আর একহাত বুকে।
চোখের উপর পানি পরায় ঠি কমতো তাকাতে পারছেনা।পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
—“আ..আপনি…
আরিয়ান তার ঠোঁটে হাত রাখে।আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে বলে,
—“তোমার শরীরের গন্ধটায় কেমন যেন একটা মাদকতা আছে মায়াবতী।নিজেকে একদমই আটকাতে পারছিনা।”
বলে মায়ার গালে চুমু খায় আরিয়ান।মুখ নামিয়ে কাঁধে ঠোঁট ডুবায়।মায়া কোনরকম বারণ করেনা।আরিয়ান কাছে আসায় তার ঠোঁট আরিয়ানের খালি বুক স্পর্শ করেছে কয়েকবার।অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে।গরম
পানি পরছে তবুও কেমন একটা কাঁপুনি দিচ্ছে শরীরে।খানিক পরে আরিয়ান মুখ উঠায়।গালে নাক ঘষে ঠোঁটের কোঁণায় ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বলে,
—“জলদি শাওয়ার নিয়ে নাও।বেশিক্ষন ভেজা শরীরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
—“আপনিও তো ভিজে গেছেন।”
—“সমস্যা নেই।রুমে চেন্জ করে নিচ্ছি।”
বলে তাকে ছেড়ে দাড়ায় আরিয়ান।আপাদমস্তক একবার মায়ার সারা শরীরে চোখ বুলায়।মায়া টাওয়াল আকড়ে ধরে দেয়ালের সাথে লেপটে থাকে।আরিয়ানের এভাবে তাকানোয় আরো বেশি লজ্জা লাগে।
আরিয়ান ধরা গলায় বলে,
—“তুমি অনেক সুন্দর মায়াবতী।অনেক বেশি সুন্দর।”বলে এগিয়ে এসে তার গালে হাত রেখে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
মায়া সেভাবেই কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকে।আরিয়ান সুন্দর বলতে কেমন সুন্দর বুঝিয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার।
এগিয়ে গিয়ে দরজাটা আটকে দেয় সে।আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলে।গালের লাল আভাটা মনে হয় আজ সারাদিনেও সরবেনা।
~চলবে~
#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩০(ভালবাসা দিবসের বিশেষ পর্ব)
ভার্সিটির পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত পরশু।টানা পনেরদিনের পরীক্ষা শেষে বেশ ক্লান্ত মায়া।এই কয়দিন রোজ তাকে ভার্সিটি নিয়ে গিয়েছে আরিয়ান।সকালের অফিস বাদ দিয়ে তিনঘন্টা বসে থেকে তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বিকেলবেলা অফিসে গিয়েছে।ফিরতো রাতের বেলা।তবে শত ব্যস্ততার পরেও মায়াকে রোজ রাতে বুকে নিয়ে ঘুমাতে ভুলেনি।ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে সর্ব প্রথম মায়ার কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিতে একদিনও দেরি হয়নি।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিছানায় একা অবস্থায় পেলো মায়া।প্রতিদিন আরিয়ানের বুকেই ঘুম ভাঙে তার।সে যতক্ষন না উঠে ততক্ষণ আরিয়ানের ঘুম ভেঙে গেলেও ও উঠে না।তবে আজকে কই গেলো?
গায়ের কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো মায়া।রুম অন্ধকার করা।সে উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো।অনেকটা বেলা হয়ে গিয়েছে।কাল রাতে খুব মাথা ব্যাথা করছিলো।আরিয়ান বেশ রাত পর্যন্ত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে।শেষে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে মনে নেই।
আড়মোড়া ভেঙে কাবার্ড খুললো সে।ভালো লাগছেনা।শাওয়ার নিলে হয়তো একটু ফ্রেশ লাগবে।জামাকাপড় নেয়ার উদ্দেশ্য কাবার্ড খুলতেই ভ্রু সংকুচিত হয়ে এলো তার।কাবার্ডের একটা কর্ণারে শাড়ি রাখা,সাথে কাঁচের চুরি,কানের দুল,গলার লকেট,সাজগোজের প্রসাধনীসহ সম্পূর্ণ তৈরি হতে মেয়েদের যা যা লাগে সেসব রাখা আছে।কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শাড়িটা হাতে নিল মায়া।বেশ সুন্দর!লাল শাড়িতে লাল সুতা আর স্টোনের কাজ করা তবে কেমন যেন ঝিকমিক করছে শাড়িটা।আলোর রিফলেক্ট পরলে একেবারেই ছোট ছোট পাথর গুলা জলজল করছে।মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো মায়ার।এতসব কিছু কিনলো কখন আরিয়ান আর এখানে রাখলোই বা কখন।শাড়ির ভাঁজ খুলতেই একটা একটা কাগজ নিচে পরে গেল।মায়া শাড়িটা একহাতে ধরে দ্রুত ঝুকে গিয়ে কাগজটা উঠালো।কাগজটা চোখের সামনে মেলতেই চোখ আটকে গেলো লেখা গুলোর মধ্যে,
আমার মায়াবতী,
তোমাকে প্রিয় বলে সম্মোধন করছিনা কারণ তুমি আমার প্রিয়র থেকেও অনেক বেশি কিছু।”প্রিয়” নামক ছোট্ট একটা শব্দে তোমাকে বিশ্লেষণ করার যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনি।তোমাকে”আমার”বলতেই শান্তি লাগে।তুমি শুধুই আমার।সম্পূর্ণই আমার।
সে যাই হোক,জিনিস গুলা খুব শখ করে কিনেছি আমি।এসব কখনোই কিনা হয়নি এই প্রথমবার কিনেছি,জানি তোমার পছন্দ নাও হতে পারে তবুও তোমাকে এগুলা পরতে হবে।এক ঘন্টার জন্য হলেও পরতে হবে।শুধু আমি একনজর মনভরে দেখবো তারপর না হয় খুলে ফেলো সব।
আর যদি একদমি পরতে ইচ্ছে না হয় তবে পরোনা।তোমার উপর রাগ করার স্বাধ্যি নেই আমার।তবে কষ্ট পাবো।সেই কষ্ট লাঘব করার জন্যও আবার সেই তোমাকেই লাগবে।তাই বলছি,পারলে আমার ইচ্ছেটা রেখো।আমার দেয়া রুপে নিজেকে সাজিও।
বি:দ্র:জিনিসগুলো তোমাকে সামনাসামনিই দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু দেয়া হলোনা।অফিসে খুব জরুরি একটা কাজের জন্য বেরিয়ে পরতে হলো।ভেবেছিলাম তোমার ঘুম ভাঙিয়ে তারপর দিব।কিন্তু কি হলো জানো?পাক্কা পঁচিশমিনিট সময় নিয়েও তোমার ঘুমন্ত শরীরে একটা টোঁকা পর্যন্ত দিতে পারলাম না।যদি তুমি জেগে যাও অথচ আমি কিন্তু তোমাকে জাগানোর চেষ্টাই করছিলাম।কি অদ্ভুত তাইনা?
এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো চিঠিটা পরলেও শেষে এসে হেসে ফেললো মায়া।আরিয়ান নিজেকে “আপনি”বলে সম্মোধন করেছে কারণ আজ পর্যন্ত আরিয়ানকে সে “আপনি”ব্যাতিত অন্যকোনো নামে ডাকেনি।নাম ধরেতো কখনোই না।মুখে প্রশস্ত হাসি টেনে চিঠিটা স্বযত্নে ভাঁজ করলো মায়া।পুনরায় কাবার্ডের রেখে দিল।শাড়িটা রেখে বাকি জিনিস গুলা দেখতেই সবচেয়ে বেশি অবাক হলো ব্লাউজ দেখে।শাড়ির সাথে ম্যাচ করা লাল ব্লাউজ তাও আবার একদম ওর মাপ মতো।
চিঠির লাস্টের কথাটা মনে পরতেই তড়িঘড়ি করে বামপাশের ড্রয়ারটা খুললো সে।সাথে সাথেই কতকগুলো মুড়ানো কাগজ তার পায়ের কাছে গড়িয়ে পরলো।হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো মায়া।প্রায় বিশ পচিশটা মুড়ানো কাগজ দিয়ে ড্রয়ের ভরা।মানে আরিয়ান কতবার যে চিঠি লিখেছে আর কেটেছে সেটারই হিসাব।পুনরায় একচোট হেসে নিয়ে কাগজগুলো আবারো ড্রয়েরে ঢুকিয়ে রাখে মায়া।
অত:পর একটা থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
গোসল শেষে চুল শুকাচ্ছে তখনই দরজায় নক করার শব্দ হলো।ইতির কন্ঠ শোনা যাচ্ছে,
—“ম্যাম,আপনি উঠেছেন?”
—“হ্যাঁ ইতি।আসো।
দরজা খুলে প্রবেশ করলো ইতি।তার হাতে খাবারের প্লেট।মায়া তোয়ালেটা কোনোরকম মাথায় পেঁচাতেই
ইতি বললো,
—“আমি চুল মুছে দেই ম্যাম।আপনি খান।স্যার আপনাকে সময়মতো খাইয়ে দিতে বলেছে।”
মায়া মৃদু হেসে বিছানায় বসলো।ইতি মায়ার হাতে প্লেট দিয়ে তার পিছে বসে আস্তে আস্তে মাথা মুছতে লাগলো।
—“আপনি কত লাকি ম্যাম!”
—“কেনো?”
—“এই যে আরিয়ান স্যার আপনাকে এত ভালোবাসেন।কারো ভালোবাসা পাওয়া অনেক সৌভাগ্যর ব্যাপার।”
মায়া লাজুক হেসে মুখে খাবার তুলে নিল।হঠাৎ কিছু একটা মনে পরতেই সে বললো,
—“তুমি শাড়ি পরাতে পারো ইতি?”
ইতি খানিকটা ঝুকে সন্ধিহান কন্ঠে বললো,
—“জি পারি।কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
—“না কিছুনা।চুল মুছো।”
________________
রাত ৯টা
মায়ার হাতে লাল কাঁচের চুরি,স্টোনের লাল কানের দুল,গলায় একটা ছোট্ট লকেট।চোখে শুধু কাজল দেয়া আর গাঢ় লাল লিপস্টিক।যদিও লিপস্টিকটা একটু কেমন যেন লাগছে মায়ার।কখনো এতো গাঢ় কালার লাগায়নি সে।সুন্দর তবে মনে হচ্ছে আরিয়ানের পছন্দ হবেনা।
এখন শুধু শাড়িটা সম্পূর্ণ পরা বাকি।পায়ের কাছে বসে কুচি ঠিক করছে ইতি।তার মুখে দুষ্টু হাসি।একটু পরপরই মায়াকে এটা ওটা বলে চেতাচ্ছে সে।
কুচি গুঁজে দিয়ে আঁচলটা জড়িয়ে দিতেই একদম তৈরি হয়ে গেলো মায়া।
ইতি তার চুলগুলো আঁচরে দিতে দিতে বললো,
—“আরিয়ান স্যারতো এমনিতেই আপনাকে চোখে হারায়।আজকে যে কি হবে?”বলেই ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো।
মায়া চোখগুলো ছোট ছোট করে বললো,
—“তুমি মনে হচ্ছে খুব এক্সপেরিয়েন্সড।”
ইতি জিভ কেটে বললো,
—“ধ্যাত্,কিসব বলছেন?”
—“আর তুমি যে আমাকে এতক্ষণ ধরে চেতাচ্ছ?”
ইতি বোকা হেসে আর কিছু বলেনা।মায়ার চুলগুলো আচড়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।মায়া একবার ঘড়িতে তাকায়।নয়টা বেজে বিশ মিনিট।সাড়ে নয়টা বা দশটার মধ্যই অফিস থেকে ফিরে আরিয়ান।
মায়া ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ায়।এখান থেকে বাড়ির মেইন গেট সম্পূর্ণ দেখা যায়।আরিয়ানের গাড়ি ঢুকলে এখান থেকেই দেখতে পারবে।
বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে গেলেও আরিয়ানের দেখা নেই।মায়া অধৈর্যভাবে কিছুক্ষন পায়চারি করে।ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুইছুই।ক্লান্ত একটা নি:শ্বাস ফেলে ব্যালকনির এককোণে রাখা দোলনায় বসে পরে সে।উদ্বেগ নিয়ে সদর দরজার দিকে চেয়ে থাকে।আরো অনেকক্ষন পার হয়ে যায়।আরিয়ান ফেরেনা।
॥
॥
পৌনে এগারোটার দিকে বাড়িতে ফিরে আরিয়ান।গাড়ি থেকেই দেখতে পায় নিজের রুমের লাইট অফ ব্যালকনিও অন্ধকার।একটা দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে আরিয়ান।মায়া মনেহয় ঘুমিয়ে পরেছে।দ্রুত বেরিয়ে পরণের ব্লেজার খুলতে খুলতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে।রুমে ঢুকে বুঝতে পারে সেখানে কেউ নেই।লাইট বন্ধ।মায়া কি তাহলে ওয়াশরুমে?ব্লেজারটা বিছানায় রেখে লাইট জ্বালায় আরিয়ান।ওয়াশরুমের দরজায় টোঁকা দিয়ে বলে,”মায়া?তুমি ভেতরে?”
উওর আসেনা।দরজার লক ঘুরাতেই খুলে যায় সেটা।নাহ্ ভেতরে নেই মায়া।তবে?ব্যালকনির দরজাও আটকানো।রোজ তো রুমেই থাকে।তবে কি মায়া তার দেয়া জিনিসগুলো দেখে রাগ করলো?মুহুর্তেই নিজের উপর বিরক্তি ছেঁয়ে গেল আরিয়ানের।শুধু শুধু কেন যে ওসব করতে গেলো?তার বোঝা উচিত ছিল মেয়েটা এখনো খুব ছোট।”চাপা কষ্ট নিয়ে তার পাশের রুমের দিকে পা বাড়ালো।সেখানেও মায়াকে না পেয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার।দ্রুত নিজের রুমে এসে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালো।মায়া বাগানে থাকলে ওখান থেকে দেখা যাবে।
ব্যালকনির কাঁচের দরজা খুলতেই থমকে গেলো আরিয়ান।গোল দোলনায় পা ভাজ করে গুটিশুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে মায়া।পরণের শাড়ির আচঁল কাঁধ থেকে পড়ে গেছে।দু হাত কোলের উপর রেখে ঘাড় কাত করে ঘুমিয়ে গিয়েছে সে।
আরিয়ান বেশ কিছুক্ষন সময় মায়ার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকলো।মেয়েটাকি আজ তার জালে তাকেই জব্দ করবে?তাকে পাগল করার প্রতিজ্ঞা করে সাঁজতে বসেছিলো মনে হয়।ঠোঁট কামড়ে মায়ার কাছে এগিয়ে যায় সে।মায়াকে শাড়ি পরলে এতোটা সুন্দর লাগবে আগে জানলে জীবনেও শাড়ি কিনতোনা সে।
মায়ার দিকে ঝুকে গিয়ে তার আচঁলটা কাঁধে উঠিয়ে দেয় আরিয়ান।তার জন্য অপেক্ষাময়ী এক অতি আবেদনময়ী রমনী মায়া।আরিয়ান তার দু গালে হাত রেখে কপালে গভীরভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
গালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শে আর কপালে চিরচেনা অধরের ছোঁয়ায় ঘুমাচ্ছন্ন তন্দ্রা কেটে যায় মায়ার।পিটপিট করে তাকাতেই বুঝে আরিয়ানের চিবুক তার চোখের সামনে।আরিয়ান তখনো তার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে রেখেছে।মায়া ঘুম ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
—“আপনি সত্যিই এসেছেন?নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?”
মায়া নড়েচড়ে উঠে।হাত নাড়ানোয় কাঁচের চুড়ি তে শব্দ হয়।ঘাড় ঠি ক করে সোজা হয়ে বসে চোখ কলাতেই নিলেই আরিয়ান তার হাত ধরে ফেলে বলে,”কাজল ছড়িয়ে যাবে”।
মায়ার ততক্ষনে হুঁশ হয় সে যে সেজেগুজে বসে আছে।লজ্জা লাগলেও মুখে প্রকাশ করেনা।দৃষ্টি নিচে নামিয়ে বলে
—“এত দেরি করলেন কেন?”
আরিয়ান তার দোলনার দু পাশে হাত রেখে আছে।মায়ার কথায় একহাত দিয়ে আবারো মায়ার পরে যাওয়া আচঁল ঠি ক করে দিয়ে বলে,
—“তুমি কি জানো তোমাকে কতটা সুন্দর লাগছে?”
মায়া মুদ্রিত নয়নে আরিয়ানের দিকে তাকায়।মুখের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে চুপ করে থাকে।আরিয়ান উঠে দাড়ায়।ঘরের লাইট নিভিয়ে দরজা লক করে আসে।ব্যালকনির হলুদ বাতিতে লাল শাড়ি পরিহিত মায়াকে দেখে আরো একবার হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠে তার।ততক্ষনে উঠে দাড়িয়েছে মায়া।
আরিয়ান মৃদু হেসে তার কাছে যেয়ে দাড়ায়।পকেট হাতরে একটা বক্স বের করে।বক্সটা খুলে কিছু একটা বের করে মায়ার সামনে একহাঁটু গেড়ে বসে যায়।নিজের হাত বাড়িয়ে মায়াকে ইশারা করে।মায়া জিজ্ঞাসু নয়নে
তাকিয়ে আরিয়ানের হাতের উপর হাত রাখে।আরিয়ান একটা সাদা পাথরের জলজল করা আংটি মায়ার অনামিকা আঙ্গুলে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“আমার মায়াবতীর জন্য ছোট্ট একটা ভালোবাসার প্রতীক।”বলে হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ায় আরিয়ান।
মায়া বিস্মিত নয়নে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।খুশিতে কান্না পাচ্ছে তার।আরিয়ান উঠে দাড়িয়ে মায়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়।ধীর কন্ঠে বলে,
—“এটার জন্যই দেরি হচ্ছিল মায়াবতী।অর্ডার দিয়ে ছিলাম এক সাইজের ওরা বানিয়েছিলো এক সাইজ বেশি।এখন আংটি কাটিয়ে সাইজ মতো করে আনলাম।ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।কিন্তু এতরাতে আর বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছেনা।তোমার উপর চাপ হয়ে যাবে।”
মায়া কিছু উওর দেয়না।আরিয়ানের বুক থেকে মাথা সরাতে ইচ্ছে করছেনা।দু হাত দিয়ে আলতো করে আরিয়ানের পিঠ আকড়ে ধরে।আরিয়ান তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই হাল্কা ফুঁপিয়ে উঠে মায়া।
—“আরে কাঁদছো কেন?কাজল নষ্ট হয়ে যাবে মায়া।”
মায়া চুপ হয়ে যায়।আরিয়ান তাকে বাহু ধরে ছাড়ায়।মায়ার শাড়ি আবারো এলোমেলো হয়ে গেছে।এবার না পেরে আচঁল কাঁধে উঠিয়ে নেয় মায়া।শাড়ির ফাঁক দিয়ে মসৃন কোমড় দৃশ্যমান হয়ে উঠে।আরিয়ান ঠোঁট কামড়ে সেদিকে তাকিয়ে বলে,
—“আমাকে কি মারার প্ল্যান করেছো আজ?”
—“মানে?”
আরিয়ান মায়ার উন্মুক্ত কোমড়ে হাত গলিয়ে দেয়।শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠে মায়া।আরিয়ান একহাত বাড়িয়ে ব্যালকনির লাইট নিভিয়ে দেয়।মায়াকে রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে কাঁধের আচঁল সরিয়ে সেখানে মুখ ডুবিয়ে দেয়।মায়া চোখ বন্ধ করে ফেলে।উষ্ণ আবেগে তাকে ভরিয়ে দিতে থাকে আরিয়ান।
নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে মুখ উঠিয়ে ফেলে।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে মায়াকে ছেড়ে দাড়ায়।
চাঁদের ক্ষীণ আলো এসে পরেছে ব্যালকনিতে।মায়া তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে।আরিয়ান শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে দোলনায় বসে।মায়ার হাত টেনে তার কোলে বসায়।প্রচন্ড লজ্জায় নিয়েই আরিয়ান কাঁধে মাথা রাখে মায়া।আরিয়ান মোহনীয় কন্ঠে বলে,
—“আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ মায়াবতী,এই এত বিশাল কালো আঁধারে ঢাকা আকাশে সবচেয়ে উজ্জল যে তারাটা দেখতে পাচ্ছো না?সেটা হচ্ছে সন্ধ্যাতারা।তেমনি আমার অন্ধকার জীবনের সেই একমাত্র সন্ধ্যাতারাটা হচ্ছে তুমি।”
—“আকাশের সন্ধ্যাতারাটা আমি হলে আপনি কি জানেন?আপনি হলেন ওইযে ওই চাঁদটা।যে কিনা প্রতিনিয়ত আমার জীবনে আলো ছড়াচ্ছেন।”
মায়া চুপ করে থাকে।নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়ে জানালা ঘেঁষে বসে।প্রচন্ড রাগ উঠে আরিয়ানের।
মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।হাতের মুঠি শক্ত করে সে সজোরে স্টেয়ারিংয়ে বাড়ি মারে।মায়া সচকিত দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে তাকায়।ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
—“এরকম করছেন কেনো?ব্যাথা পাবেন তো।”
আরিয়ান রক্তলাল চোখগুলো দিয়ে মায়ার দিকে তাকায়।ভয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে মায়া।
আরিয়ান তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
—“এই ভয়ার্ত চোখগুলো আমাকে কতটা ব্যাথা দিচ্ছে তুমি জানো মায়া?”
মায়া এবারো নিরব।ছুড়ি ঢুকিয়ে দেয়ার মুহুর্তটা মনে আসতেই গা শিড়শিড় করে উঠছে।লোকটার গাল থেকে কিভাবে রক্ত বেরোচ্ছিল।মায়া চোখ বন্ধ করে ফেলে।ভাবে,আরিয়ানের কি একটুও দয়া হলোনা লোকটার উপর?এতটা নির্দয় সে?
পরক্ষনেই চোখ খুলে মায়া।জিজ্ঞেস করে,
—“আপনার কি একটুও দয়া হয়নি লোকটার উপর?”
—“না হয়নি”বলেই গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে পরে আরিয়ান।মায়া হতভম্ব হয়ে যায়।কিছু বলার আগেই আরিয়ান তার পাশের দরজা খুলে তাকে হাত ধরে বের করে।বিকট শব্দ করে গাড়ির দরজা লাগাতেই মায়া আৎকে উঠে বলে,
—“কি করছেন?”
গাড়ি থেমেছে একটা ব্রিজ এর উপর।আরিয়ান মায়াকে টানতে টানতে ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে দাড় করায়।তার দুইপাশে হাত রেখে দৃঢ় গলায় বলে,
—“কেন ভয় পাচ্ছো আমাকে?আর দয়া?আমার কারো উপর দয়া হয়না।আমি নির্দয়,হিংস্র।কিন্তু সেটা ক্ষেত্রবিশেষে।বাকিদের সাথে আমি একরকম।আর তোমার সাথে অন্যরকম।গট ইট?”
মায়া একটা ফাঁকা ঢোঁক গিলে বলে,
—“কেন?কয়টা রুপ আপনার?”
—“মায়া ডোন্ট ডু দিস।রাগাবেনা আমাকে।আমার রাগ সহ্য করার ক্ষমতা তোমার হবেনা।”
—“কি করবেন রেগে গেলে?মেরে ফেলবেন আমাকেও?”
এবার বাঁধ ভেঙে যায় আরিয়ানের।রেলিংয়ে ঘুষি মারতেই হাত ছিলে রক্ত বেরিয়ে আসে।মায়া দ্রুত পাশে তাকিয়ে হাতের রক্ত দেখে জোর করে তার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অস্থিরভাবে বলে,
আরিয়ান ঝামটা মেরে তার হাতদুটো সরায়।দু হাতে শক্ত করে মায়ার কোমড় চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়।হঠাৎ এমন হওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে পরে মায়া।কি হচ্ছে বোঝার পর বার দুয়েক আরিয়ানের বুকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করে।ফলস্বরুপ আরিয়ান তাকে আরো শক্ত করে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে।হাল ছেড়ে দেয় মায়া।হাতদুটো আরিয়ানের বুকের উপর রেখে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।প্রায় দশ মিনিট পর আরিয়ান কিছুটা শিথিল হয়।হাতের বাঁধন ঢিলা করে দেয়।একহাত মায়ার ঘাড়ে রেখে এতক্ষনের রুড ভাবটা ছেড়ে সফ্টলি কিস করতে থাকে।মায়ার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে।আরিয়ান নিজের গালে পানির অস্তিত্ব পেতেই আলতো করে একটা চুমু খেয়ে মায়ার ঠোঁট ছেড়ে দেয়।মায়া ফুঁপিয়ে ওঠে।আরিয়ান একটা শ্বাস নিয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
—“খুব বেশি ভালোবাসি মায়াবতী।তুমি অন্তত আমাকে ভয় পেয়োনা।ঘৃনা করোনা।”
বলে সরে দাড়াতে নিলেই মায়া তার বুকের শার্ট দুহাতে খামছে ধরে।বুকে মাঝখানটায় কপাল ঠেকিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,
—“আমি কি একবারও বলেছি আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি?বলেন?বলেছি একবারও?”
আরিয়ান তাকে স্বস্নেহে জড়িয়ে ধরে।পিঠে হাত রেখে বলে,
—“না বলোনি”।
—“তবে?কেন বারবার বলছেন আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি?”
এবার আরিয়ান উওর দেয়না।মায়া আবারো বলে,
—“আমিতো আপনাকে ভয় পাচ্ছিনা।আমি ভয় পাচ্ছি ভিডিওর সেই হিংস্র,পাষাণ লোকটাকে।আমি হিংস্রতা পছন্দ করিনা।আমি যে খুবই ভীতু সেটা আপনার থেকে ভালো কেও জানেনা।আমি নিতে পারিনা এইসব।কাঁটাছেড়া,রক্তারক্তি দেখলে আমার কলিজা কাঁপে।আমি এরকমই।…আপনি একবার অন্তত আমার কথাটা ভাবতেন।এরকমটা করলেন কেন যা দেখে আমি ভয় পাবো?আমি আপনাকে ভয় পেতে চাইনা।কখনো ভয় পেতে চাইনা।…আপনি না আমাকে ভালোবাসেন।তবে কেন করলেন এমনটা?কেন করলেন?”বলে আরিয়নের বুকে ধরে রাখা শার্ট সজোরে ঝাঁকায় মায়া।
আরিয়ান তার হাতের উপর হাত রাখে।নিজের বুক থেকে সরিয়ে দুই হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বলে,
—“আই প্রমিস,এমনটা আর কখনো হবেনা।তোমার আরিয়ান আর কখনো হিংস্র হবেনা।আই প্রমিস মায়াবতী”।
মায়া একদম শান্ত হয়ে যায়।চোখ নামিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,
—“গাড়িতে চলুন।আপনার হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে।”
আরিয়ান হেসে মায়াকে নিয়ে গাড়িতে বসায়।গাড়ির পেছন থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে নিজেও ঢুকে দরজা আটকে দেয়।মায়ার হাতে বক্সটা দিয়ে মায়ার কোলের উপর হাত রেখে বলে,
—“নাও,ব্যান্ডেজ করে দাও।”
মায়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে ব্যান্ডেজ করতে থাকে।কাজ শেষ হয়ে গেলে সবকিছু আবার সুন্দর করে বক্সের ভিতর ঢুকিয়ে গাড়ির সামনে রেখে দেয়।আরিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছেনা দেখে বলে,
—“আর কতক্ষন বসে থাকবেন এখানে?বাসায় যাবেন না?”
আরিয়ান তার দিকে ঝুঁকে যায়।সেকেন্ডের মধ্য মায়ার ঠোঁটে চুমু খেয়ে আবারো নিজের সিটে বসে বলে,
—-“এই জায়গাটা চিনেছো মায়াবতী?সামনে তাকিয়ে দেখো,ওইযে রাস্তার মোড় দেখা যাচ্ছে,সেখানেই তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো।সেই যে রাতের বেলা তুমি আমাকে আচমকাই জড়িয়ে ধরেছিলে।মনে আছে?”
মাথা মৃদুভাবে মাথা নাড়ায়।সে রাস্তাঘাট এতো চিনেনা।এখন আরিয়ান বলায় বুঝতে পেরেছে এটা ওই জায়গাটাই।আরিয়ান আবার বলে,
—“আবার,এইখানেই প্রথম তোমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছি।এই জায়গাটা খুব স্পেশাল আমাদের জন্য।তাইনা?”
মায়া স্বলজ্জায় আরিয়ানের দিকে তাকায়।পরমূহুর্তে ঠাট্টার ছলে বলে,
—“সারারাত কি এখানেই থাকবেন?”
—“আরে না না।বাসায় যাচ্ছিতো।”বলে গাড়ি স্টার্ট দেয় আরিয়ান।
______________
মায়ার মুখের উপর বই ধরা।আর এক সপ্তাহ বাদে পরীক্ষা তার।সেমিস্টার ড্রপ যাতে না দিতে হয় সেজন্যই বেশ পড়াশোনা করছে সে।
আরিয়ান বসে আছে সোফায়।আরিয়ানের কোলের উপর তার মাথা রাখা।সামনের টেবিলে ল্যাপটপ রেখে কানে হেডফোন দিয়ে ভিডিও কলে জরুরি মিটিং করছে আরিয়ান।তার একহাত রাখা মায়ার চুলের ভাজে।আরেকহাত ল্যাপটপের কী-বোর্ডে।মায়া সোজা হয়ে শুয়ে আছে পুরো সোফা নিয়ে।আরিয়ান এককোণায় চেপে বসেছে।তার উপর তার কোলে মাথা রেখে পড়ছে মায়া।
হঠাৎ মায়া আরিয়ানকে ইশারা করে সে কিছু একটা বলবে।আরিয়ান দ্রুত নিজের মাইক্রোফোন মিউট করে বলে,”হুম বলো’।
—“আপনি চুলে হাত বুলালে আমার ঘুম আসে।তাই বলছি,সেটা বন্ধ করেন।”
আরিয়ান ল্যাপটপের স্ক্রীন থেকে চোখ সরায়না।সেদিকে তাকিয়েই বলে,
—“এরকম খোলা চুলে কোলের উপর শুয়ে থাকলে আমি হাত বুলাবোই।সো,আই কান্ট হেল্প ইউ।”
—“মিটিং কখন শেষ হবে?”
—“অনেকক্ষন পরে শেষ হবে।শুরুই তো হলো এখন।তোমার পড়া শেষ?”
—“না,আমার পড়াও শেষ হবে অনেএএএকক্ষন পরে।”
আরিয়ান ভিডিও অফ করে মায়ার কপালে চুমু খায়।তারপর আবার ভিডিও অন করে মিটিংয়ে মনোযোগ দেয়।
মায়া আর বিরক্ত করেনা।যদিও সে শত চেষ্টা করেও কখনো বিরক্তবোধ করাতে পারেনা আরিয়ানকে।কারণ আরিয়ান কখনো তার উপর বিরক্ত হয়ই না।কেন হয়না?কারণটা সে জানে।খুব ভালো করেই জানে।
ভাবতেই মুচকি হাসি ফুটে উঠে মায়ার ঠোঁটের কোঁণ ঘেঁষে…
অনেকদিন পর ভার্সিটিতে যাচ্ছে মায়া।আজকে পরীক্ষা তাই ভার্সিটি না যেয়ে উপায় নাই।বেশ ফুরফুরে লাগছে মনটা।অবশ্য তার তেমন কোন বন্ধু-বান্ধবী নেই।তবুও সবার সাথে কথা হলে দেখা হলে ভালো লাগে।
আরিয়ান একহাতে ড্রাইভ করছে,আর আরেকহাতের মুঠোয় মায়ার হাত আবদ্ধ করে রেখেছে।
হঠাৎ আরিয়ানের ফোন বেজে উঠে।গাড়ির সামনে ফোন রাখা।আরিয়ান মায়ার হাত ছাড়ে না।বলে,
—“দেখোতো কে কল করেছে।”
মায়া ফোনটা হাতে নেয়।দেখে তন্ময় ফোন দিয়েছে।সে ফোনটা আরিয়ানের দিকে এগিয়ে দেয়,
—“তন্ময় ভাইয়া”।
আরিয়ান গাড়ি বাম দিকে টার্ন করতে করতে বলে,
—“রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দাও”।
মায়া তাই করে।বুঝতে পারছে আরিয়ান তার হাত ছাড়বেনা।সে ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে আরিয়ানের সামনে ধরে।ওপাশ থেকে তন্ময় ব্যস্ত গলায় বলে,
—“হ্যালো,ভাই?”
—“হ্যাঁ,বল।”
—“আপনি আসবেন কখন?”
—“বিকালে।”
—“কিহ্?আজকের মিটিংয়ের কথা ভুলে গেলেন?অনেক ইম্পপর্টেন্টতো।আপনি ছাড়া কিভাবে হবে?”
—“কাম ডাউন,তন্ময়।আমি ভুলিনি।ওদের সাথে কথা হয়েছে আমার।আজকে হবেনা মিটিং।ক্যান্সেল করে দিয়েছি।”
—“ওহ্।সেটা আগে বলবেনতো।আমি টেনশনে শেষ।আপনি কোথায় এখন?”
—“মায়ার ভার্সিটিতে।ওর এক্স্যাম আজকে থেকে।”
—“ওহ্,আচ্ছা।রাখি তাহলে?
—“রাখ।”বলতেই ফোন কেটে যায়।
মায়া ফোনটা আবারো আগের জায়গায় রেখে দেয়।গাড়ি থেমে গেছে তার ভার্সিটির সামনে।আরিয়ান তার সিটবেল্ট খুলে দেয়।গালে হাত রেখে বলে,
—“আমি বাইরেই অপেক্ষা করছি।তুমি যাও।ভয় পেয়োনা।ঠিকাছে?”
—“আপনি শুধু শুধু এই তিনঘন্টা এখানে অপেক্ষা করবেন কেন?পরীক্ষা শেষে নিতে আসলেই তো হয়”।
আরিয়ান মুচকি হেসে মায়ার পাশের দরজার লক খুলে দেয়।কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,
—“তোমাকে এখানে একা রেখে আমার অন্যকাজে মন বসবে না।…যাও”
মায়া ঠোঁটে লজ্জামিশ্রিত হাসি এলিয়ে বেরিয়ে যায়।হাত নেড়ে আরিয়ানকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে চলে যায়।আরিয়ান স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে সিটে মাথা এলিয়ে দেয়।মায়াকে কোথাও একা ছাড়তেই তার ভয় করে।
যেমন এখনও ইচ্ছা করছে মায়ার পাশের সিটে বসে বসে তাকে পাহারা দিতে।যদিও সে বললে এটারো পারমিশন দিয়ে দেয়া হবে কিন্তু তবুও এমনটা করলে মায়া অসস্তিতে পরীক্ষাই দিতে পারবেনা।হাহ্,একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আরিয়ানের।
____________
মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে মায়া।তার পাশে একটা মেয়ে বসেছে।হল এ গার্ড দিচ্ছে একটা
মহিলা টিচার।মায়া অনেকক্ষন ধরেই লক্ষ্য করছে ম্যাডামটা অনেকক্ষন যাবত তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।আবার মাঝে মাঝে নিজের ফোনের দিকে তাকাচ্ছে।অসস্তি হচ্ছে তার।সে তো কোনোরকম দেখাদেখি করছে না তবে এভাবে কি দেখছে ইনি?
কিছুক্ষন পরে ম্যাডামটা হাঁটতে হাঁটতে তার সিটের সামনে এসে দাড়ায়।মায়া চোখ তুলে তাকাতেই তিনি চোখ ছোট ছোট করে চাপা স্বরে বলে,
—“এই মেয়ে,তোমার চেহারাটা আরিয়ান খানের বউয়ের মতো লাগে।তাই না?”
মায়া হকচকিয়ে যায়।থেমে থেমে বলে,
—“জি…জি ম্যাম।”
—“জি মানে?তুমিই উনার বউ?”
মায়া মৃদুভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।মহিলাটা যেন খুশিতে লাফিয়ে উঠে।কিন্তু বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করেনা।উৎসুক কন্ঠে বলে,
—“তুমি একাই এসেছো?মি.আরিয়ান আসেননি?উনার সাথে দেখা করার অনেক ইচ্ছা আমার”
মায়া সরলমনে অকপটে বলে,
—“এসেছে ম্যাডাম,উনি বাইরে অপেক্ষা করছেন।”
—“ওহ্,গ্রেট।তোমার কোনো হেল্প লাগলে আমাকে বলো হ্যাঁ?আমি কিন্তু এই সাবজেক্ট এর ই প্রফেসর।”
মায়া চোখ বড় বড় করে তাকায়।কিসব বলছে এই মহিলা?পরীক্ষায় কেউ কাউকে এভাবে বলে দেয় নাকি?
তবুও উনার মুখের উপর তো কিছু বলা যায় না।তাই নিচু স্বরেই বলে,
—“না ম্যাম,হেল্প লাগবেনা।”
মহিলাটা চলে যেতেই মায়া হাফ ছেড়ে বাঁচে।পাশের মেয়েটাকে সে জিজ্ঞেস করে,
—“উনি মনে হয় নতুন প্রফেসর।তাইনা?”
—“হ্যাঁ,এই সপ্তাহেই জয়েন করেছে।”
মায়া আবারো লেখায় মনোযোগ দিয়ে বিরবির করে বলে,
—“এজন্যইতো এমন অদ্ভুত কথাবার্তা বলছিলো।আজব!।
বেল পরতেই খাতা দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পরে মায়া।চারতলার কর্ণারের রুমে সিট পরেছিলো তার।আরিয়ান অপেক্ষা করছে ভেবে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে সে।দ্বিতীয়তলা পুরোটা খালি।এখানে মনে হয় আজকে কোন পরীক্ষা হয়নি।খালি করিডোর ধরে দ্রুত হাঁটে মায়া।আচমকাই কেউ একজন টান দিয়ে তাকে খালি ক্লাস রুমে নিয়ে যায়।চিৎকার করে উঠে মায়া।এই ফ্লোরে কেউ নেই।বিধায় কারো কানে যায়না তার চিৎকার।জানালা দিয়ে আলো আসছে।আবছা আলোয় রাহাতকে দেখে চমকে উঠে মায়া।রাহাত এখানে কি করছে?তার হাত ছেড়ে দেয় রাহাত।একটু দুরত্ব নিয়ে দাড়ায়।
মায়া গায়ের ওড়না ঠি ক করে ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে,
—“আপনার সমস্যাটা কি?এখানে কি করছেন?দেখুন আপনার কোনো কথা আমি শুনতে চাচ্ছিনা।উনি যেরকমই হোক আমার কোন সমস্যা নেই।অযথা ঝামেলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেননা।”
এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে রাহাতের দিকে তাকায় মায়া।
—“আপনি খুব ভালোবাসেন আরিয়ানকে তাইনা?”
মায়া এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
—“আপনি কি এসব বলার জন্য এখানে এসেছেন?….আমার যেতে হবে,উনি অপেক্ষা করছেন।সরুন প্লিজ”
—“উওরটা দিন।”
মায়া এবার সরাসরি রাহাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“জি।খুব বেশি ভালোবাসি।শুনেছেন?এবার প্লিজ নিজেও যান আর আমাকেও যেতে দিন।”
রাহাত এক কদম এগিয়ে এসে বলে,
—“আমিওতো আপনাকে ভালোবাসি মায়া।”
মায়া থমকে যায়।সে কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পরেনি।কি বলবে বুঝতে পারেনা।রাহাত এগোতে থাকে।
—“দে..দেখুন একদম এগোবেন না।আপনার এসব অহেতুক কথাবার্তা আমার ভালো লাগছেনা।উনি না আপনাকে গুলি করলো ওইদিন,,আপনার হাতে এখনো ব্যান্ডেজ করা তবুও এসব বলার সাহস কেমনে হয়?”
রাহাত তার একপাশের দেয়ালে হাত রেখে বলে,
—“আপনি আমাকে ভয় পান কেন?”
—“কারণ আপনি ভয় পাওয়ার মতোই।”বলে আর একমূহুর্ত সেখানে দাড়ায়না মায়া।রাহাতকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে।পেছন থেকে শুনতে পায় রাহাত বলছে,
—“আরিয়ানকে বলবেননা আমি এখানে এসেছিলাম।ও রেগে যাবে।”
মায়ার কথাগুলো শুনলেও কানে নেয় না।একদৌড়ে নিচে নেমে যায়।
বাইরে বের হতেই আরিয়ানের গাড়ি দেখে এতক্ষনের ভয় কেটে যায়।গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই আরিয়ান দরজা খুলে দিয়ে বলে,
—“আসো ভিতরে আসো।এত দেরি করলে কেন?”
মায়া উওর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে বসে।আরিয়ান পানির বোতল এগিয়ে দিতেই তৃপ্তি নিয়ে পানি খায়।
—“এত দেরি হলো কেন?কোন সমস্যা হয়েছিলো?”
মায়া উওর দেবার আগেই জানালায় টোঁকা পরে।আরিয়ান ভ্রু কুচকে গ্লাস নামায়।একজন মোটামোটি ইয়াং মহিলা দাড়িয়ে আছে।আরিয়ান সানগ্লাস নামিয়ে বলে,
—“কে আপনি?এনি প্রবলেম?”
মায়া চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে,”ইনি পরীক্ষার গার্ডে ছিল।ভার্সিটির প্রফেসর।”
আরিয়ান মায়ার দিকে তাকায় আবার মহিলার দিকে তাকায়।
বলে মহিলাটা তার দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ায়।
আরিয়ান হাত মিলায়না অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বলে,
—“নাইস টু মিট ইউ।”
মহিলাটা হয়তো একটু অপমানিত বোধ করেন।মুখের হাসিটা নিভে না গেলেও একটু কমে যায়।তবু আগের মতোই উৎকন্ঠিত ভাবে সে বলে,
—“আপনার ওয়াইফকে পরীক্ষায় হেল্প করেছি।বুঝলেন?”
আরিয়ান বিস্মিত নয়নে মায়ার দিকে তাকায়।মায়া মাথা দু দিকে নাড়িয়ে বলে,”উনি সাহায্য করতে চেয়েছিলো,আমি নেইনি।”
আরিয়ান চোখে আবারও সানগ্লাস টা পরে মহিলাটাকে বলে,
—-“এস এ প্রফেসর,আপনার অবশ্যই পরীক্ষায় হেল্প করা উচিত না।সেটা আমার ওয়াইফ হোক আর যেই হোক না কেন।আই হোপ আপনি বুঝতে পারছেন।”
মহিলাটা অপমানে দাঁত কেলিয়ে হাসে।সে হয়তো ভেবেছিলো এটা বললে আরিয়ান তার উপর খুশি হবে।কিন্তু হলো উল্টা।
মায়া আরিয়ানের বাহুতে মাথা রাখে।চোখ বন্ধ করে বলে,
—“খুব ভালো”।
বেশ কিছুক্ষন গাড়ি চলে।মায়া হঠাৎ করে বলে উঠে,
—“একটা কথা বলি?রাগ করবেন নাতো?”
—“কখনো রাগ করেছি তোমার উপর?”
—“করেছেন।”
আরিয়ান হাসে।এপর্যন্ত দুইবার মায়ার সাথে চিল্লিয়ে কথা বলেছে সে।তাও পরিস্থিতির চাপে।এমনিতে না।
মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলে,
—“আচ্ছা বলো।রাগ করবোনা।”
প্রায় মিনিটদশেক পর ধীর গতিতে মায়ার গলা থেকে মুখ উঠালো আরিয়ান।চাঁদের স্নিগ্ধ শীতল আলো এসে পরেছে ব্যালকনিতে।আবছা আবেগি আলোর ছোঁয়ায় মায়ার লজ্জারাঙা চেহারার সৌন্দর্য্য যেন হুড়মুড় করে বেড়ে যাচ্ছে।আরিয়ান ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে।চোখ বন্ধ করে মাথা নুইয়ে রেখেছে মায়া।একহাতে আরিয়ানের পিঠে ক্রমাগত নখের আচঁর দিয়ে যাচ্ছিল সে।এখন কিছুটা শিথিল হয়েছে।অবাধ্য খোলা চুলগুলো আবারো ছড়িয়ে পরেছে তার সারামুখে।আরিয়ান কোমড় থেকে একহাত সরিয়ে চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দেয়।ধীরে ধীরে তাকায় মায়া।তবে চোখ তুলে না।পিটপিট করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘনঘন নি:শ্বাস নিচ্ছে সে।পরিবেশ উষ্ম হয়ে উঠছে।আরিয়ান তার ঠোঁটে হাল্কাভাবে আঙ্গুল স্লাইড করে।
মায়া কাঁপছে।আচ্ছা,লজ্জা পেলে কি সবাই কাঁপে?নাকি শুধু মায়াই কাঁপছে?
আরিয়ান ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে মায়ার থুতনি ধরে মুখ তুলে বলে,
—“তাকাবেনা আমার দিকে?রাগ করলে?…আমার ছোয়াঁ তোমার পছন্দ নয় মায়াবতী?”
মায়া চমকায়।আরিয়ান কি তাকে ভুল বুঝলো?সে তড়িঘড়ি করে আরিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“না না তেমনটা না।আমি আসলে…”
—“তুমি আসলে…?”
—“আমার লজ্জা লাগছে”।
আরিয়ান শব্দ করে হেসে উঠে।মায়ার এই সরলমনে বলা সোজা কথাগুলো তার বেশ লাগে!এই কথাগুলোর প্রতি প্রচন্ড ভালোলাগা কাজ করে তার!
হুট করেই মায়াকে কোলে তুলে নেয় আরিয়ান।ঘরে যেয়ে বিছানায় সুইয়ে দেয়।ঘরের লাইট নিভিয়ে গিয়েছিলো মায়া।আরিয়ান যেয়ে তা আবার জ্বেলে দেয়।গায়ের টি-শার্টটা একটানে খুলে ফেলে।মায়া অনুসন্ধানি কন্ঠে বলে,
—“কি করছেন?”
—“আমি কি করছি সেটা বাদ দাও।বরং তুমি কি করেছো তা দেখো।বলেই মায়ার দিকে পিঠ দিয়ে দাড়ালো আরিয়ান।
মায়ার চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়।ফর্সা পিঠ লাল হয়ে গেঁছে।খামছিতে একজায়গায় কেটে পর্যন্ত গেছে।আর বাকি জায়গায় আঁচরে লাল হয়ে আছে শুধু।মায়া কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে বলে,
—“সরি”।
আরিয়ান হেসে বলে,
—“আরে অদ্ভুত!সরি বলছো কেন?প্রেয়সীর নখের আঁচরে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার সৌভাগ্য সবার থাকেনা।সেদিক দিয়ে বলতে গেলে তুমি আমার সেই সৌভাগ্য করে দিলে।বুঝলে?
মায়া উওর দেয়না।অগোছালো ভাবে একটু হাসে।
আরিয়ান কখনোই তাকে কোন কিছুর জন্য দোষারূপ করে না।মানে তার কোন ভুল আরিয়ানের চোখেই পরেনা কখনো।সে কাউকে মেরে ফেললেও মনেহয় আরিয়ান বলবে,”নিশ্চয় লোকটার দোষ ছিলো।একদম
ঠি ক করেছো মেরে”
____________
সকালবেলা রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আরিয়ান।আজ অফিসে যাবেনা সে।মায়াকে নিয়ে এগারোটার দিকে হসপিটালে যেতে হবে।ব্যান্ডেজ খুলে দিবে তাই সে নিজেই যাবে সাথে।
মায়া বিছানায় হেলান দিয়ে বই পরছে।কদিন পর পরীক্ষা তার।এতদিন পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো তাই এখন একটু চাপ নিয়েই পড়ছে।
হঠাৎ আরিয়ানের ফোন বেজে উঠে।মায়া একবার তাকিয়ে আবারো পড়ায় মনোযোগ দেয়।
আরিয়ান ফোন রিসিভ করে।মামা ফোন দিয়েছে।নিশ্চিত বাসায় যাওয়ার কথা বলবে।
আরিয়ান কিছু একটা ভেবে বলে,
—“আচ্ছা,ঠিকাছে।”
—“সত্যি আসবি তো?”
—“আমি কখনো তোমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছি?”
—“আচ্ছা ঠিকাছে।দেরি করিস না।”
আরিয়ান “হুম” বলে ফোন কেটে দেয়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশটা বাজে।চোখ নামিয়ে আবারো কাজে ধ্যান দেয় সে।মায়া কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠে,
—“আপনার মামার ছেলের সাথে কাল ওমন করলেন কেন?মামার সাথে তো ভালো করেই কথা বললেন”
—“ওর সাথে আমার একটু ঝামেলা আছে”
—“কি ঝামেলা?”
—“অনেক প্যাঁচানো বিষয়।তোমার মাথায় ঢুকবেনা।”
—“বলুননা প্লিজ।
আরিয়ান ল্যাপটপটা বন্ধ করে।মায়ার খাবারের প্লেট পাশের টেবিলে রেখে গিয়েছে ইতি।মায়া এখন খাবেনা তাই বলেছে যখন খাবে তাকে যেন ডাক দেয়।আরিয়ান উঠে প্লেটটা হাতে নিয়ে মায়ার পাশে বসে।
মুখের সামনে খাবার তুলে বলে,
—“শুনতে চাচ্ছো,তাই অল্প করে বলছি।
মায়া অকপটে মাথা নাড়ায়।মুখে খাবার নিয়ে বলে,”বলুন।”
আরিয়ান একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বলে,
—“He is such a characterless person.ওর এই স্বভাবের জন্য কখনোই ওর সাথে আমার মিলতো
না।কথা বার্তাও বেশি বলতামনা আমরা।আর ও শুধু শুধুই আমার সাথে ঝামেলা বাঁধাতো।কারণ ও একপ্রকার হিংসা করে আমার সাথে।কেন আমার কম্পানি এত সফল হলো?কেন ওর ক্যারিয়ার আমি সেট করে দেই না?আমার থেকে দুই বছরের ছোট।কিন্তু নিজের স্টাডি নিয়ে একেবারেই সিরিয়াস না।আসলে মামার টাকা আছে তো।তাই এসব বিষয়ে ওর অনেকটা গা ছাড়া ভাব।”
আরিয়ান থামে।মায়া মনোযোগ দিয়ে শুনছে।আরিয়ান আবারো মায়াকে খাইয়ে দিয়ে বলে,
—“এসব নিয়ে ঝামেলা চললেও আসল সমস্যা হয় একবছর আগে।প্রায়ই লেট নাইট পার্টি করতো ও।রাতে ফিরতোনা।তেমনই এক পার্টিতে একটা মেয়েকে ও হ্যারেস করে।মূলত ফিজিক্যালি এ্যাবিউস করে।খুব বাজে ভাবে।
তো মেয়েটা সেইদিন কোনরকম নিজেকে বাঁচিয়ে পুলিশে কেস করতে চাচ্ছিল।সিসি ক্যামেরায় প্রমান থাকা সত্তেও ইউ নো টাকার প্রভাবে আর মামা যেহেতু পুলিশ অফিসার তাই খুব সহজেই রাহাত কে ছাড়িয়ে নেয়।সেসময় আমি মেয়েটাকে সাহায্য করেছিলাম।মামা মামির অনুরোধ করা সত্তেও আমি কেস করি এ্যান্ড ফলস্বরুপ তিনমাস জেল খাটতে হয় রাহাতকে।
।আমার যেটা ঠি ক মনে হয়েছিলো আমি সেটাই করেছি।মামা মামি কষ্ট পেলেও এ নিয়ে আমাকে কড়া কিছু বলেনি।কিন্তু এরপর থেকে রাহাতের সাথে আমার সম্পর্কটা খুব বেশি খারাপ হয়ে যায়।
কথা শেষে জোরে একটা শ্বাস ছাড়ে আরিয়ান।মায়ার খাবারের প্লেট খালি হয়ে গিয়েছে ততক্ষনে।মায়াকে পানি খাইয়ে দিয়ে উঠে যায় সে।মায়া অন্যমনস্ক হয়ে বলে,
—“আপনি এতো ভালো কেন?”
আরিয়ান হাসে।ঝুঁকে গিয়ে মায়ার কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বলে,
—“উঠে পরো।হসপিটালে যেতে হবে।সেখান থেকে আবার মামার বাসায়।”
_____________
হাতের ব্যান্ডেজ খুলে দেয়া হয়েছে মায়ার।হাত নাড়াতেও কোন সমস্যা হচ্ছেনা।তবে কপালের কাঁটাটা এখনো
ঠি ক হয়নি তাই সেখানে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে গাড়িতে বসে আছে তারা।গাড়ি থামে সুন্দর একটা বাসার সামনে।আরিয়ানের মামার বাসা এটা।
গাড়ি থেকে বের হতেই একজন মধ্যবয়স্ক ধাঁচের লোক এগিয়ে আসে।আরিয়ান হাসিমুখে বলে,
—“কেমন আছো মামা?”
এটাই আরিয়ানের মামা বুঝতে পেরে মায়া দ্রুত সালাম দেয় উনাকে।সজীব খান সালামের উওর দিয়ে মায়ার মাথায় হাত রেখে বলে,
—“আসো মা ভেতরে আসো।”
মায়া খুবই মুগ্ধ হয় তার ব্যবহারে।ভেতরে যেতেই একজন মহিলা উপর থেকে নিচে নামে।মায়া বুঝে এটা আরিয়ানের মামি।মায়া সালাম দিতেই সে এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরে সজীব খান কে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“দেখেছো,মেয়েটা কতো সুন্দরী।কি মায়াবী চেহারা।বলেছিলাম না আরিয়ানের পছন্দ আছে।”
মায়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরে।রুপের প্রশংসা শুনতে তার কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।যেটার উপর মানুষের কোন হাতই নেই সেটা নিয়ে এতো প্রশংসা কিসের?
______________
দিনটা ভালোই কাটে মায়ার।আরিয়ানের মামা-মামি খুবই আন্তরিক।তবে একটা জিনিস খুবই অবাক লাগে ।সারাদিনে একবারও রাহাতের ছায়া পর্যন্ত দেখেনি সে।এমনকি খাওয়ার সময়ও সে ছিলোনা।সে তো নিশ্চয় এই বাসায়ই থাকে।মামা-মামি একবার তার কথা বললোনা পর্যন্ত।
তবুও মুখে কিছু বলেনা সে।পাছে আরিয়ান রেগে যায়।
সন্ধ্যাবেলা বাসার বাইরেটা তাকে ঘুরে দেখাচ্ছিলো আরিয়ান।হঠাৎ তার ফোন আসায় সে মায়াকে দাড়া করিয়ে একটু দূরে সরে যায়।মায়া চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।ওপাশের দিকটা অন্ধকার।লাইট জ্বালানো নেই।
হঠাৎ একটা হাত তাকে হেঁচকা টানে ওপাশে নিয়ে যায়….
মায়া চিৎকার দেয়ার আগেই একটা শক্ত হাত তার মুখ চেপে ধরলো।মুখ দিয়ে কোনরকম আওয়াজ করতে পারলোনা সে।ছেলেটা তার পিছে দাড়িয়ে আছে তার উপর চারিদিকে অন্ধকার।হৃদপিন্ডটা তুমুল গতিতে লাফাচ্ছে তার।গলা শুকিয়ে আসছে।ছেলেটা তাকে ওই অবস্থায় ধরেই বাগানের আরো ভেতরে নিয়ে যায়।আরিয়ানের কন্ঠও আর শোনা যাচ্ছেনা।
ছেলেটা তার মুখটা কানের সামনে এনে অনেকটা শীতল কন্ঠে বলে,
মায়া উপর নিচে মাথা নাড়ায়।তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে নোনাজল।কন্ঠটা শুনে সে বুঝতে পেরেছে এটা রাহাত।
মুখ থেকে হাত সরাতেই জোরে জোরে শ্বাস নেয় মায়া।রাহাত তার হাত ছেড়ে দিতেই সে দৌড় দিতে চায় কিন্তু পারেনা।রাহাত তাকে কাছে টেনে নিয়ে একহাতে কোমড় পেচিয়ে ধরে।অসহ্য লাগে মায়ার,রাহাতের স্পর্শ তার সহ্য হচ্ছেনা।সকালে তার সম্পর্কে ওসব শোনার পর এখনতো গা গুলিয়ে যাচ্ছে।
—“যেতে দেন বলছি।এখানে কেন এনেছেন?”
—“আমি জানি আরিয়ান হয়তো আপনাকে আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই বলেছে।এবং আপনি হয়তো একদমই সেফ ফিল করছেন না আমার সাথে।বাট আই প্রমিস,আমি খারাপ কিছু করবোনা আপনার সাথে।আরিয়ান হয়তো চলে আসবে একটু পরেই।আপনাকে শুধু একটা জিনিস দেখানোর জন্য এনেছি।বলেই নিজের ফোন বের করে রাহাত।কিছু একটা খুঁজে বের করে বলে,আপনি জাস্ট এটা একটু দেখুন।”
মায়া তার বাহুতে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।না পেরে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
—“আমি কিছু দেখবোনা।আপনি প্লিজ আপনার হাতটা সরান।যেতে দিন আমাকে।”
রাহাত হাত সরায়না।বরং আরেকটু নিজের সাথে লেপ্টে নিয়ে বলে,
—“কাঁদবেননা প্লিজ।একদম সময় নেই।এটা দেখুন।বলে একটা ভিডিও প্লে করে রাহাত।জার্নালিস্ট জীবনকে মারার ভিডিও।মায়া জলভরা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়।এটা না দেখা ছাড়া উপায় নাই তার।
স্ক্রীনে আরিয়ানকে দেখে অবাক হয় মায়া।আরিয়ানের সামনে আরেকটা লোক।এরপর ভিডিও চলতে থাকে।
আরিয়ানের হাতে ছুড়ি নিয়েছে মাত্র তখনই ফোনটা পরে যায় রাহাতের হাত থেকে।মায়া চমকে পেছনে তাকায়।আরিয়ানকে দেখে কলিজায় পানি আসে তার।এতক্ষন ভিডিওতে দেখা সবকিছু মাথা থেকে ঝড়ে যায়।রাহাতকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় আরিয়ান।মায়াকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।পকেট থেকে বন্দুক বের করে রাহাতের দিকে তাক করে রেখে মায়াকে বলে,
—“এই অসভ্যটা কিছু করেছে তোমাকে?”
মায়া উওর দেয়না।সে আরিয়ানকে জাপটে ধরে কাঁদছে।
আরিয়ান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুইয়ে দেয়।রাহাত মাটিতে পরে আছে।
—“উনার সাথে কিছু করিনি আমি।শুধু তোমার আসল চেহারাটা উনাকে দেখাতে চেয়েছিলাম।এ্যান্ড আই এম অলমোস্ট সাকসেসফুল।যদিও পুরোটা দেখেননি।তবুও”
আরিয়ান তার বাহুতে শুট করে।কঁকিয়ে উঠে রাহাত।
—“জাস্ট শাট আপ!কার আসল চেহারা?..কি দেখাচ্ছিলি তুই ওকে?তোর ওসব মিথ্যা কথা অন্তত মায়া বিশ্বাস করবেনা।আসল কথা হলো,তোর নষ্ট নজর পরেছে মায়ার উপর”
রাহাত হাত চেপে ধরে উঠে দাড়ায়।গড়গড় করে রক্ত পরছে তার হাত থেকে।দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে উঠে,
—“মায়া,আমি আপত্তিকর কিছু করেছি আপনার সাথে?বলুন!”
মায়া দু’পাশে মাথা নাড়ায়।রাহাত তাকে ধরেছিলো ঠি ক কিন্তু তার কথায়ই সে বুঝতে পেরেছে তার কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিলনা।।রাহাতের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে।মায়ার দৃষ্টি নিচের দিকে।রাহাতের হাত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।রক্তে ভয় লাগে তার।
চারপাশে লাইট জ্বলে উঠে।আরিয়ানের মামা-মামি দৌড়ে আসে।রাহাতের হাতের রক্ত দেখে মামি দ্রুত তাকে ধরে।কাঁদতে কাঁদতে আরিয়ানকে বলে,
—“ও কি করেছে বাবা?”
—“সেটা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো মামি।”
রাহাত হাসতে হাসতে মায়াকে দেখিয়ে বলে,
—“উনাকে তোমার ভাগ্নের সত্যিটা দেখাতে চেয়েছিলাম মা।উনি যাকে এতটা বিশ্বাস করে সে যে কতটা ভয়ংকর তাই দেখাচ্ছিলাম।কিন্তু পারলামনা।তবে একদিন দেখাবো অবশ্যই।”
আরিয়ান আবার তার দিকে বন্দুক তাঁক করে।আরিয়ানের মামা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
—“ওকে ছেড়ে দাও আরিয়ান।আর কখনো এমন কিছু হবেনা।আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে।”
আরিয়ান বন্দুক নামায়।রাহাত ঠোঁটে তখনো হাসি।
আরিয়ান জোরে একটা শ্বাস নিয়ে রাগ সংবরণ করে।আর একমুহূর্তও সেখানে না থেকে মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
____________
গাড়ি চলছে নিজস্ব গতিতে।রাস্তা ফাঁকা।তবুও জোরে ড্রাইভ করছেনা আরিয়ান।গাড়ির জানালা খোলা।শীতল বাতাস ঢুকছে।মায়া বাইরে তাকিয়ে আছে।একটা কথাও বলেনি সে।বাইরের অন্ধকারেই সে কিছু একটা
খুঁজে বেরাচ্ছে সে।হঠাৎই সে নিরবতা ভেঙে বলে,
—“একটু শুনবেন?”
আরিয়ান একবার তার দিকে তাকায়।তারপর আবারো ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে বলে,
—“বলো”।
—“আপনি কি করেছিলেন ওই সাংবাদিকটার সাথে?”
আরিয়ান চমকায় না।সে জানে এমন কিছুই হতো।একটু আগেই রাহাত তাকে সেই ভিডিওটা পাঠিয়েছে।সাথে মেসেজে লেখা ছিল,ভিডিওটা কেমন হলো ভাইয়া?”তখনই সে বুঝতে পেরেছিলো রাহাত এটাই দেখিয়েছে মায়াকে।সে চলে আসায় হয়তো পুরোটা দেখাতে পারেনি।
আরিয়ান শান্ত কন্ঠে বলে,
—“তুমি পুরো ভিডিওটা দেখেছিলে?”
—“না”।
আরিয়ান গাড়ি থামায়।পকেট থেকে ফোন বের করে মায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“নাও দেখো।”
মায়া কাঁপা হাতে ফোনটা ধরে।আরিয়ান যখনই ছেলেটার গালে ছুড়ি ঢুকায় তখনই চিৎকার করে উঠে মায়া।
হাত থেকে ফোনটা ফেলে দেয় সে।ভয়ে হাত পা কাঁপছে।মাথা ঘোরাচ্ছে।
আরিয়ান সিটে মাথা এলিয়ে বসে ছিলো।ফোন পরার শব্দে সে তাকায়।মায়া দুহাতে মুখ চেপে রেখেছে।
ক্রমাগত কাঁপছে ।চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট।আরিয়ান কখনো মায়ার চোখে নিজের প্রতি কোন ভয় দেখেনি।আজ দেখছে।সে ধীরগতিতে ফোনটা উঠায়।পকেট রেখে বলে,