Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1525



এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৬

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

রাত বারোটায় শোভাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই চিন্তিতমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অবস্থা খুব খারাপ নয়, কিন্তু ডেইট যেহেতু দুদিন আগে ছিলো তখন ঠিকঠাক কিছু বলা যাচ্ছেনা। শোভার চোখের কোণে জমে থাকা পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। বাবাহীন সন্তান হিসেবে সমাজে পরিচয় পাবে ওর সন্তান। আচ্ছা, ছেলে হবে নাকি মেয়ে? কার মতো দেখতে হবে? সাদ নাকি শোভার মতো? শোভার ভাবনার গতি এখানে এসে স্থির হলো। চোখ দুটো আস্তেধীরে বুজে এলো। মানুষের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে আশেপাশে। কথাও শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু সব অস্পষ্ট।

করিডোরে সবাই বসে আছে। মিলি করিডোর পেরিয়ে একটু বাঁক নিতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো। বিপরীত দিকে থাকা ব্যক্তির হাত থেকে ফোন ছিঁটকে পড়ে ডিসপ্লে ড্যাম হয়ে গেলো। ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে মিলি দেখলো সেদিনের ওই হাঁদা ডাক্তার সাইফ ওর দিকে চেয়ে আছে। বললো, ‘এই যে মিস চাশমিশ, চোখে দেখতে পান না?’

‘ এই প্রশ্ন আমিও করতে পারি।’

‘ পারেন না। কারণ আপনি আমাকে ধাক্কা মেরেছেন।’

‘ মোটেও আমি ধাক্কা দিইনি।

‘ তাহলে কী আমি ভূতের সাথে ধাক্কা খেয়েছি? আই মিন আপনিই সেই ভূত!’

‘ দেখুন বাজে কথা বলবেন না।’

‘ একশোবার বলবো। জানেন এই ফোনটার দাম কত? ধারণা আছে আপনার?’

মিলি বললো, ‘আমি এর দাম শুনে কী করবো? ওকে ওকে..আপনি আবার এই ফোনের দাম আমার থেকে চাইবেন নাকি? আপনি তো মিয়া ধরিবাজ!’

‘ হোয়াট দ্যা ধরিবাজ। একদম ওসব ডাকবেন না।’

‘ তাহলে কী বাপ্পারাজ বলবো?’

‘ আমার নাম আছে। সেই নামে ডাকবেন।’

‘ সরেন তো মিয়া!’

‘ সরবোনা। আপনি ধাক্কা মেরে আমার ফোন ভেঙ্গে দিয়েছেন তাও কিছু মনে করিনি, অন্তত স্যরি তো বলবেন।’

‘ যে সে মানুষকে মিলি স্যরি বলে না। আর এখানে দোষ আমার একার নয়। আমি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলাম, আর আপনি? আপনার চোখদুটো কী আকাশে রেখে হাঁটছিলেন? মোবাইলে এতো কী দেখেন যে হাঁটতে হাঁটতে, ঘুমুতে ঘুমুতে, খেতে খেতেও ওই যন্ত্রে চেয়ে থাকেন?’

ডাক্তার সাইফ বোকা বনে গেলো। দোষ এখানে তাঁরও আছে। সে তো পারতো ধাক্কা এড়াতে। একটু সাবধানে হাঁটলেই তার সাধের মোবাইলটা বেঁচে যেতো। পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার ফোনটার অবস্থা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মিলি ফ্লোর থেকে তুলে ফোনটা ওর হাতে দিয়ে চলে গেলো। ওর হুঁশ ফিরতেই ভাবলো ধুর! মেয়েটার সাথে একটু সমীহ করে কথা বলা উচিৎ ছিলো। ডেঞ্জেরাস পার্সনদের সাথে ভাব জমাতে পারলে নিজেরই লাভ। অবশ্য ডাক্তার সাইফ এজন্য ভাব জমাতে চাচ্ছেন না। সে চাচ্ছে মিলিকে আরও ভালোভাবে জানতে, বুঝতে। অনেকদিন পরে দেখা ওর সাথে। এ সুযোগে নিজেকে একটু স্মার্ট দেখানোর সুযোগ এসেছিলো যেটা নিজের হাতেই নষ্ট করেছে।

আচ্ছা, মিলি নামক মেয়েটা কী জানে, সে ইতিমধ্যে সাইফের জীবনের অন্যতম একটা স্থানে বসবাস করছে? সেই স্থানটা শুধু একজনকেই দেওয়া যায়। মন নামক জিনিসটা কারো সাথে ভাগ করা যায়না। সাইফ শুধু মিলি নামক ফুলটির সাথেই ভাগ করতে চায়, ওর সাথে যৌবন কাটাতে চায়, ওর হাত ধরেই বুড়ো হতে চায়। আচ্ছা মিলি কী এসব শুনলে হাসবে? মেয়েটাকে কখনো সামনে থেকে হাসতে দেখেনি সাইফ। হাসলে নিশ্চয়ই ওকে মোনালিসার মতো সুন্দর দেখায়!

_____

চৌধুরী বাড়ি!

সাদ’দের পরিবারের সবাই খুব মিশুক হলেও টিনা মোটেও সেরকম নয়। সে সহজেই সবার সাথে কথাবার্তা বলেনা। নিজের একটা আলাদা উদ্ধতস্বভাব আছে, যার কারণে ওকে কেউ ঘাটায় না। সাদের সাথে একান্তে কিছুসময় কাটিয়ে নিজের মনটা ফুরফুরে করে নিলো। তার বন্ধুরাও এসে খাবার-দাবার সেরে নিয়েছে। কয়েকজন বিদায় নিলেও টিনা মুন্নি, ডেইজিকে থেকে যেতে বললো। ওদের স্বভাবও টিনার মতোই। কলেজ জীবনে ছিলো একপ্রকার কলগার্ল, টিনাও মাঝে মাঝে এসব করতো। তবে সেটা সবার অজানা। মুন্নি আর ডেইজিই শুধু জানে। ওদের তিনজনের আত্মার সম্পর্ক। বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান হলেও ওরা কাউকেই এসব বুঝতে দেয়নি।
ঘরে তিন বান্ধবী বসে গল্প করছে। সাদ নেই ঘরে।

রোমেলা রুমে এসে কিছু নাস্তা দিয়ে গেলো।মুন্নি কয়েকটা আঙুর মুখে পুরে দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, বেইব! তুই আজকে এতো সাজলি কেন?”

টিনা একটা ফিকে হাসি দিয়ে বললো, ‘কই সাজলাম?’

‘ মানে? এই যে তুই শাড়ি পড়লি,ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালি এটা সাজ না?’

‘ ওহহ। এমনি।’

‘ এমন বুইড়া সেজে থাকতে তোর ভাল্লাগে?’

‘ সাদ পছন্দ করে।’

ডেইজি অবাক হয়ে বলল, ‘ কী বলস। তোর জামাই কী গেঁয়ো রে।’

‘ কী আর করবো বল। কপালে জুটলো এমন। তবে ওকে খুশি রাখতে পারলে আমারই লাভ!’

‘ কেমন লাভ?’

‘ ওসব আমিই বুঝবো।’

‘ তাহলে কী আমরা কচি খোকা? যে কিছু বুঝমু না?’

মুন্নি ডেইজিকে বললো, ‘তোরে বলতে হইবো নাকি সব কথা। আমাদের টিনা বেইব সব বুঝে।’

ডেইজি টিনার গাঁ ঘেঁষে এসে বসলো। ওর হাতটা ধরে বললো, ‘প্লিজ তুই বলবি আমারে? আজকাল তোর ভাবসাব আমার কাছে ভালো ঠেকছে না।’

টিনা মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বললো, ‘আমি এতো আজাইরা না।’

‘ অন্যদিকে ফিরা আছিস কেন?আমার চোখের দিকে তাকাইয়া বল!’

‘ যা তো।’

‘ প্রমিজ দোস্ত। কাউরে কমুনা।’

টিনা ওদের দিকে ফিরলো। তারপর বললো, ‘প্রমিজ?’

‘ হুম।’

‘ তাহলে শোন। ইফতিরে চিনস তো?’

‘ ওই ইফতি? যে তোর বয়ফ্রেন্ড ছিলো?’

‘ হুম।’

‘ তোদের না ব্রেকাপ হয়েছিলো।’

‘ সে আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে। তুই জানিস ওকে আমি কত পছন্দ করি? একদম হিরো টাইপ। দেখলেই বুক কাঁপে।’

মুন্নি ফোড়ন কেটে বললো, ‘আমরা তো আর জানিনা ও দেখতে কেমন। তুমি তো ওর সাথে দশবার শুইছো, এজন্য হিরো বলতাছো। আমার কাছে কেমন মাকাল ফল লাগে।’

টিনা ধমক দিয়ে বললো, ‘আস্তে বল। শুনবে কেউ।’

‘ কেউ শুনবেনা। তারপর বল।’

‘ সাদের উপর থেকে আমার ইন্টারেস্ট উঠে যাচ্ছে। ভাবছি কী করা যায়। তাই তোদের ইনভাইট করে নিয়ে এলাম। তোরা একটা পরামর্শ দে।’

‘ কেন? ইন্টারেস্ট উঠে যাচ্ছে কেন?’

টিনা চোখমুখ কুঁচকে বললো, ‘ওই ব্যাটা সারাদিন অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে আবারও অফিসের কাজ করে। আর রাতে শুরু করে শরীর নিয়ে খেলা। কোথাও যাওয়ার কথা বললেই বলে আজ না কাল। জীবনে কোনো আনন্দ নাই, বুঝলি।’

‘ বিয়ের তো পাঁচমাস মাত্র হলো। তুই কী চাস?’

‘ সাদের সাথে থাকতাম যদি জীবনে আনন্দ থাকতো৷ কিন্তু এটাই ওর মাঝে নাই।’

‘ মানে ছেড়ে দিতে চাস?’

‘ হুম।’

‘ তোর উচিৎ কয়েকটা বছর অপেক্ষা করা। এরপর কোনো রিজন থাকলে ছেড়ে দিস। কিন্তু এক্ষুনি যদি এসব ছাড়াছাড়ির কথা বলিস তোর বাবা কী করবে ভাবতে পারিস? জ্যান্ত কবর দিবে তোরে।’

টিনার মুখটা কালো হয়ে গেলো। ওর বাবা ভীষণ কড়া। মেয়ে যে এমন কুকীর্তি করে রেখেছেন এসব কিছুই তিনি জানেন না। তিনি বিয়ে ভাঙ্গাও সাপোর্ট করেন না। সামান্য কারণে যদি সাদকে সে ছেড়ে দেয়, তাহলে মেয়েকে ত্যাজ্য করতে ওনার বুক কাঁপবেনা। হতাশ হলো টিনা।

‘ সাদ তোকে টাকাপয়সা দেয়না?’

‘ দিবেনা কেন। বেতনের কিছুটা নিজে রেখে বাকিটা আমাকেই দেয়।’

‘ তাহলে সমস্যা কই। এসব সামান্য কারণে ছেড়ে দিস না। পরে পস্তাবি। তাছাড়া ইফতির কোনো ঠিক নাই। সে কখন আসবে, কখন যাবে বলতে পারবিনা। তখন নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারবি৷ এর চেয়ে ক’টা বছর যাক।’

টিনা ডেইজির কথায় সায় জানায়। এমন সময় ঘরে ঢুকে সাদ। তিনজনে চুপ হয়ে যায়। সাদ ইতস্তত করে বললো, ‘ওহহ। থাকুন।’

তারপর ড্রয়ার থেকে ওয়ালেটটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মুন্নি হেসে বললো, ‘বর দেখি বউকে চোখে হারায়।’

টিনা বলে, ‘বউটা সুন্দরী হলে যা হয় আরকি।’

তিনজনেই হাসি-তামাশায় মেতে ওঠে। এসব ঘটনা আর কেউ জানতে না পারলেও রোমেলার কানে পৌঁছলো। তিনি ভাবতেও পারছেন না টিনা বিয়ের আগেই তাদ সতীত্ব আরেকজনকে বিলিয়ে দিয়েছে, আর এখন সাদকে ছেড়ে দেওয়ার পায়তারা করছে। তিনি এই কথাটা কাউকে জানালেন না। দেখা যাক কী হয়। তাছাড়া প্রমাণ ছাড়া এসব কথা তাঁর স্বামী-ছেলে কেউওই বিশ্বাস করবেনা। তিনি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন। এভাবেই খোদাতায়ালা ওনাদের শাস্তি দিচ্ছেন।

____

শোভার একটি মেয়ে আর একটা ছেলে হয়েছে। ছোট্ট শরীর দুটো তোয়ালেতে মুড়ানো। মিলি খুশিতে কান্না করে দিয়েছে। কেউ ভাবেইনি শুভির দুটো সন্তান আসতে চলেছে। আল্ট্রা করানোর সময় ওদেরকে জানানো হয়নি। সেসব চুলোয় যাক, সবাই সুস্থ আছে এটাই বেশি। শোভার জ্ঞান এখনো হয়নি। বাচ্চাদের এখনো অভিভাবকদের কাছে দেওয়া হয়নি। অবর্জাভেশন রুমের বাইরে থেকে দেখানো হয়েছে। ফুটফুটে দুটো বাচ্চা দেখে রমজান সাহেবও কেঁদে দিলেন। কী ভীষণ কষ্ট সহ্য করে বাচ্চাগুলোকে দুনিয়ার আলো দেখালো শোভা।

ডাক্তার সাইফ হার্টের ডাক্তার হলেও চাইল্ড জোনগুলোতে আসেন, ওদের দেখেন। চিকিৎসা করেন। এর মধ্যে জানা গেলো শোভার মেয়ের হার্টে একটু সমস্যা হচ্ছে। সাময়িক সমস্যা, তবে ঠিকঠাক মতো যত্ন না নিলে ক্ষতি হবে। মিলি এ খবর শুনে কাঁদতে কাঁদতে সাইফের কেবিনে ঢুকে পড়লো। অনুনয় করে বললো, ‘প্লিজ বাচ্চাটাকে বাঁচাবেন। আমার শুভি এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারবেনা। প্লিজ আপনি দেখুন।’

ডাক্তার সাইফের বুক চিনচিনে ব্যথা করতে লাগলো মিলির চোখে পানি দেখে। গলা শুকিয়ে এলো। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বললো, ‘মিস মিলি, রিল্যাক্স। এটা কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। সাময়িক সমস্যা। আমি অলরেডি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে!’

‘ সত্যিই?’

‘ জি।’

মিলি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। ডাক্তার সাইফ পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। মিলি খেলোনা। বললো, ‘জানেন কত কষ্টের ফল এরা? আমার শুভি কী কী সাফার করেছে। এখন যদি এদেরই কিছু হয়ে যায়, তাহলে ও আর বাঁঁচবেই না।’

‘ খুব ভালোবাসেন শুভিকে?’

‘ জি। আমার এই দুনিয়াতে ও ছাড়া কেউ নেই।’

‘ মানে? ওনি আপনার বোন হন?’

‘ না। আমার বান্ধবী কম বোন বেশি।’

‘ আপনার ফ্যামিলিতে কেউ নেই?’

‘ না। আমি একাই বেঁচে আছি। শুধু শুভির জন্য, শুভিটার কিছু হয়ে গেলে, আমিও আর বাঁচবোনা।’

সাইফ অবাক হয়। অথচ শোভা আর মিলি দুজনকে বোন ভেবেছিলো। বান্ধবীর জন্য কাউকে এমন করতে কখনো দেখেনি সে। এমন বান্ধবী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যে সুখেও পাশে থাকবে, দুঃখের সঙ্গীও হবে। মিলিকে এই মুহূর্তে আরও বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে ওর। কিন্তু মুখ ফুটে বললো, ‘ আপনার শুভি এবং ওনার বাচ্চাদের কিছু হবেনা। আমি আছি তো।’

মিলি চুপচাপ বসে রইলো। অনেকদিন পরে ও কাঁদলো। মনটা খুব ভার লাগছে।

_____

সাদের বন্ধু নিয়ন। সে ফোন করে সাদকে জানিয়েছে শোভা হাসপাতালে। নিয়নের বোন ড্যাফোডিল হসপিটালে ভর্তি, অ্যাপেন্ডিক্স এর ব্যথা। শোভার সাথে সাদের সম্পর্ক কয়েকমাস আগেই জেনেছিলো, আজ যখন শোভাকে ওটিতে নিয়ে যেতে দেখে তখনই ওর সাদের কথা মনে হয় আর তৎক্ষনাৎ ফোন লাগায়।

সাদ নিজেকে আর আটকাতে পারলোনা। এবার অন্তত যাওয়া উচিৎ শোভাকে একপলক দেখার জন্য ভেবে সে এই গভীর রাতেই বেরিয়ে এসেছে। টিনাকে ফোন করে জানিয়েছে ফিরতে লেইট হবে। ড্যাফোডিলে পৌঁছানোর পরে সোজা নিয়নের কাছে গেলো। নিয়ন ওকে শোভার ওখানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো। করিডোরে বসে আছে শাফিন। বোনকে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। এমন সময় সাদকে দেখতে পেয়ে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। সাদ এগিয়ে গিয়ে অপরাধী গলায় শাফিনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘স শ শোভার কী হয়েছে?’

শাফিন রাগ দমন করলো। হসপিটালে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায়না। ওখানে গুরুতর অনেক প্যাশেন্টরা আছে, তাঁদের সমস্যা হবে। ঠান্ডা গলায় বললো, ‘কিছুনা, পেটব্যথা।’

‘ এখন কেমন আছে?’

‘ ভালো। ঔষধ দেওয়া হয়েছে।’

‘ ইয়ে ওর সাথে দেখা করা যাবে?’

পেছন থেকে মিলি বলে উঠলো, ‘যাবেনা। ও ঘুমুচ্ছে।’

মিলিকে দেখেই সাদ বিষম খায়। মিলির পাশে ডাক্তার সাইফ। মিলি বললো, ‘যাইহোক আপনি এতো রাতে এখানে?’

‘ ওই এমনি। শুভিকে দেখতে এসেছিলাম!’

মিলি রেগে বললো, ‘শুভি যদি বলেন আর একবার, আমি আমি আপনার অবস্থা খারাপ করে দেবো!’

সাদ চুপ করে মাথা নিচু করে। মিলি বলে, ‘যাইহোক, দেখা হয়ে সুবিধাই হলো।’

সাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মিলি হাতের ফাইলগুলো সাইফের হাতে দিয়ে হ্যান্ডব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে। তারপর এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নিন এখানে একটা সাইন করে দিন।’

সাদ অবাক হয়ে বললো, ‘কীসের সাইন?’

‘ বারে! প্যাশেন্ট ম্যারিড। তো হসপিটালের সব ফর্মালিটিতে নিশ্চয়ই তার ভাইয়ের সাইন থাকবেনা! তাঁর স্বামীকেই সাইন দিতে হবে।’

সাইফ অবাক হয় মিলির কথা শুনে। এসব ফর্মালিটি তো শাফিনই করেছে। তাহলে ও কোন ফর্মালিটির কথা বলছে? যাইহোক, অনেকক্ষণ ইতস্তত করে সাদ সাইন করে দিলো। শোভার স্বামী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে কেমন আনইজি লাগছে। কিন্তু আজ কী এমন হলো যে, ওর নিজেকে শোভার স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেলো? সাদ ভেবে পেলোনা। বুকটা খাঁ খাঁ করছে, কিছু হারিয়ে ফেলছে মনে হচ্ছে।

সাইন শেষ হওয়ার পর মিলি কাগজ কেড়ে নিলো। তারপর হাসিমুখে বললো, ‘কংগ্রাচুলেশন। মিস্টার সাদ চৌধুরী আর শোভার ডিভোর্স কমপ্লিট!’

সাদের মাথা ঘুরে উঠলো কথাটা শুনে। পায়ের তলার মাটিও সরে গেলো। কী বলছে মিলি? ওর আর ওর শুভির ডিভোর্স হয়ে গেলো মানে?

চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৫

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে:ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

সময় খুব দ্রুত বদলায়। জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায়, সেখান থেকেই সামনে পথচলার শক্তিটুকু অর্জন করে নিতে হয়। নইলে এ জগতে টিকে থাকা আর সূর্যে গিয়ে বসবাস করা একই কথা। এতো অবাস্তব কিছু আর দ্বিতীয়টি নেই। শোভাও নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে, সামনে মাসেই একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। আশা করা যায় চাকরিটা হয়ে যাবে, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এর মাঝেই ঘটে গেলো আরেক কান্ড! সকালবেলা বাথরুমে পিছলে পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা পেলো পেটে।

তাড়াতাড়ি করে নিয়ে আসা হলো হসপিটালে। চেক আপ করে ডাক্তার শোভাকে এডমিট হয়ে যেতে বললো, কারণ ডেলিভারির ডেইট দুদিন আগেই ছিলো। ডাক্তারের এমন কথায় রমজান সাহেব খুব ভয় পেয়ে গেলো। অবশেষে এডমিট করানো হলো শোভাকে। আপাতত স্যালাইন লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বারোটার দিকে অপারেশন। সিজার করতে হবে।

সালমা বেগম বাসায় গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এলেন। মিলিও এলো। সে শোভাকে বোনের মতো এতোটা দিন আগলিয়ে রেখেছে, সাহস জুগিয়েছে। মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় শোভা জিজ্ঞেস করলো, ‘মানুষটার সাথে তোর যোগাযোগ আছে রে মিলি?’

মিলি অবাক হয়ে বলে, ‘কোন মানুষটা?’

‘ সাদ!’

মিলি রাগলেও কিছু প্রকাশ করলো না। বলল, ‘ যোগাযোগ নেই।’

‘ কোনো খবর জানিস?’

‘ শুনেছি বউ সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসেছে। ইন্সট্রাতে ছবি আপ দিয়েছিলো, কে যেন আমাকে দেখিয়েছিলো। বউ নিয়ে সুখেই আছে।’

‘ ওহহ!’

‘ হুম।’

‘ মিলি?’

‘ বল!’

‘ আমার বাচ্চাটা কাকে বাবা ডাকবে?’

মিলি থমকায়। বলে, ‘তুই নিজেই ওর মা, নিজেই ওর বাবা।’

‘ লোকটা আমার সাথে কেন এমন প্রতারণা করলো বলতে পারিস? আমি কী খুব খারাপ ছিলাম?’

‘ তুই কেন খারাপ হবি? খারাপ তো সে, আর তার ভাগ্য!’

‘ তাহলে লোকটা আমাকে এখনো কেন ডিভোর্স দেয়নি?’

‘ হয়তো ভুলে গিয়েছে যে সে একটা বিয়ে করেছিলো, তার একটা বউ আছে।’

‘ মিলি!’

‘ হুম!’

‘ এমন একটা ব্যবস্থা কর যাতে ডিভোর্সটা হয়ে যায়। আমার অসহ্য লাগছে।’

মিলি আশ্বস্ত করে শোভাকে যে ডিভোর্সটা হবেই। পাঁচমাসেও কী ওদের সময় হয়নি এটা শেষ করার? যত্তসব! শোভা ঘুমিয়ে পড়েছে, সেদিকে তাকিয়ে মিলি ভাবে কেন শুভিকে এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে। ভালোবাসা কী শুধু কষ্ট দিতেই জানে? মিলি জানে, শুভি সাদকে এখনো পাগলের মতো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসাটা বিষাদে ছেয়ে আছে। এতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। সেদিনের শুভিটার আজ বাচ্চা হবে। একটা প্রিন্স নয়তো প্রিন্সেস আসবে। কোথায় পাবে বাচ্চাটা তাঁর বাবাকে? জন্মের আগেই বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে গেলো, এমন দিনও দেখতে হলো ওর!

ঘুমন্ত শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে মিলির মায়া হয়। মনে পড়ে তার বড় বোন ঝিলি’র কথা, সেও শোভার মতো এমন ভুল করে। যার ফল গুনতে হয় মিলির পুরো পরিবারকে। সমাজের মানুষের কাদা ছিঁটাছিঁটিতে ওর বোনটা গলায় ফাঁস দিয়ে সুসাইড করে। মেয়ের এসব দেখে মিলির বাবাও সেদিন হার্ট-অ্যাটাকে দুনিয়া ছাড়ে। স্বামী-সন্তানের এমন নির্মম মৃত্যু দেখে বিকারগস্ত হয়ে পড়ে মিলির মাও। ছয়মাস পর মা-ও ছেড়ে চলে যায় মিলিকে। এতিম হয়ে পড়ে মিলি। সেই থেকেই ঘেন্না এসে পড়ে মানুষের প্রতি। হোস্টেলে উঠার পরে অহরহ এসব কাহিনী দেখে মিলির রক্ত টগবগ করে ফুটতো। এমন ভুলভাল কাজে মেয়েরাও যে সায় জানায় সেটাও দেখেছে মিলি। এতসব সহ্য করে আজ এতো কঠিন মিলি। বুকের ভেতর চেপে রাখা কষ্টটা সে কাউকে জানায়নি, শুধু শুভি ছাড়া। একটা পরিবার ধ্বংস করার জন্য কিছু অমানুষ, আর সমাজই যথেষ্ট। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে শুভিও এমন কাহিনীর শিকার, অবশেষে সেই কাহিনীরও ইতি ঘটতে চলেছে ডিভোর্সের মাধ্যমে।

_____

সাদ অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র! ক্লান্ত শরীরটা নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক’দিন যাবৎ বেশ চাপ পড়েছে অফিসে। হানিমুনে একমাস কাটিয়ে এসে সে যে কী ভুল করেছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এতোদিন থাকতো না, কিন্তু টিনার জেদ। সে একমাস না থেকে কিছুতেই ফিরবেনা, অগত্যা থাকতেই হলো।

টিনা গ্লাসে পানি ঢেলে সাদের দিকে এগিয়ে ধরলো। সাদ উঠে বসলো। ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখলো। টিনা অভিযোগের সুরে বললো, ‘কতদিন হয়ে গেলো বাইরে যাইনা।’

সাদ বলে, ‘কেন? কী হয়েছে বউটার?’

‘ উফফ,, এসব কী বলো তুমি?’

‘ কী বললাম?’

‘ বউ বলবেনা, নাম ধরে বলবে।’

‘ তুমি তো আমার বউই!’

‘ জানি। কিন্তু বউ ডাকটা গেঁয়ো, ব্যাপারটা কেমন ব্যাকডেটেড।’

‘ ওহহ, আচ্ছা।’

সাদ ভাবনায় পাড়ি দেয়। শোভার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সাদ যখন ওকে “আমার বউ” বলে ডেকেছিলো শোভা লজ্জ্বায় মাথা তুলে তাকায়ইনি। বউ বললেই মেয়েটার গাল লাল হয়ে যেতো, মিষ্টি দেখাতো খুব। সবসময় নরম গলায় ওর সাথে কথা বলতো, সাদ যা বলতো তা-ই করতো। কখনো বলেনি নিজের শখ-আহ্লাদের কথা। অথচ টিনার শখ আহ্লাদ পূরণ করতে করতে আজকাল নিজের শখগুলোর কথা সে ভুলেই গিয়েছে। কী তফাৎ নিজের দুই বউয়ের মাঝে।

টিনা সাদের বুকে মাথা রেখে বলে, ‘চলোনা আজ ডিনারে যাই,কতদিন যাইনা!’

ভাবনা থেকে ফিরে আসে সাদ। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাসায় এসেও দুদন্ড শান্তি নেই। গত পরশুই টিনাকে নিয়ে বেরিয়েছে। শপিং সেরে ডিনার সেরে এসেছে। যেনতেন ডিনার নয়। একদম রাজকীয় ভোজ ছিলো। সেটাই টিনার কাছে অনেকদিন মনে হচ্ছে? বলে কী মেয়ে!

‘ এ্যাই, কিছু বলছোনা কেন?’

‘ আমি খুব কান্ত।’

টিনা মুখ ফুলিয়ে বললো, ‘ কিছুই তো করোনি, অফিসেই তো ছিলে। তাহলে ক্লান্ত হলে কী করে? এই তুমি আবার অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাওনাতো?’

সাদ অবাক হয়ে বললো, ‘মানে?’

‘ তোমার আরেকটা বউ আছেনা? ওর কাছেই নিশ্চয়ই যাও?’

‘ কী বলছো তুমি?’

‘ ঠিকই বলছি। ওর তো বাচ্চা হবার কথা ছিলো, তুমি কী আবার ওই বাচ্চার কাছে যাও নাকি?’

সাদের মগজে কথাটা ঠোক্কর খায়। আরে, সে তো বাবা হতে চলেছিলো। পরমুহূর্তেই সেসব ভুলে টিনাকে বাহুডোরে আগলে নেয়। কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বলে, ‘এতো সুন্দরী বউ থাকতে অন্য কারো কাছে কেন যাবো?’

টিনা ওর বুকে কিল দিয়ে বলে, ‘ওই মেয়েটাও নাকি সুন্দরী ছিলো, তাও তো ফেলে চলে এলে।’

সাদ আহত হয়। তবুও টিনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে, ‘আমার তো তোমাকেই চাই।’

টিনা হাসে। বলে, ‘জানিতো বাবুমশাই। এবার বলো ডিনারে যাচ্ছি কিনা।’

সাদ ক্লান্ত গলায় বললো, ‘কাল যাই?’

‘ না আজ।’

‘ উহু, এখন শুধু তোমাকে চাই।’

বলে টিনার ওষ্ঠজোড়া দখল করে নেয় সাদ। কেমন অদ্ভুত লাগে। একসময় শোভার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে কতই না কসরত কর‍তে হতো ওকে। আজ! আজ শোভাও নেই, আর বাঁধাও নেই। সুখেই তো আছে ও, খুব সুখে। টিনা ওকে সুখেই রেখেছে, তবে শারীরিকভাবে। মনটা তো কবেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছে অন্য কারো চিন্তায়, অন্য কারো ভাবনায়।

_______

সাদিদ সাহেব ইজি চেয়ারে বসে চোখবুঁজে আছেন। মাথাটা বড্ড ধরেছে। গরম একমগ কফি হলে ভালো লাগতো। তিনি রোমেলাকে ডাক দেন। রোমেলা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন, হাতে মশলা লেগে আছে। কপালের ঘাম মুছার ব্যর্থ চেষ্টা কর‍তে করতে জিজ্ঞেস করেন, ‘ডাকছো কেন?’

‘ কফি দাও!’

‘ কফি তো বানাইনি।’

‘ মানে? তুমি জানোনা সন্ধ্যায় আমি কফি খাই?’

‘ মনে ছিলোনা।’

‘ ভুলে গেলে কীভাবে? রান্নাঘরেই তো ছিলে?’

‘ টিনা তার বান্ধবীদের দাওয়াত করেছে। রাতের এতোসব আয়োজন আমাকে একা কর‍তে হচ্ছে। বিকাল থেকে একাই সব করছি। আমার তো দশটা হাত নেই যে সবদিক সামলাবো।’

‘ কেন? টিনা কই? রান্না করবেনা সে?’

‘ কোনোদিন দেখেছো নিজের খাবারটা নিয়ে খেতে? বিয়ের পাঁচমাসে একদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেছো?’

‘ না!’

‘ তাহলে আশা করো কীভাবে সে রান্না করবে?’

সাদিদ সাহেব রেগে যান। বাড়ির বৌ কী সামান্য কাজও করতে পারেনা নাকি? রোমেলা এই বয়সে একা একা দশজনের রান্না করতে পারবে নাকি! কাজের বুয়াও আর আসেনা, ছেলে বিয়ে করিয়েছে কী এই দিন দেখার জন্য! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কোথায় টিনা?’

‘ সে ঘরে। সাদ এসেছে অফিস থেকে।’

‘ আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি!’

রোমেলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। সাদিদ সাহেব উঠে রওনা দিলো সাদের ঘরের দিকে। ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি টোকা দিতে গিয়ে থমকে যান। দুজন হাসাহাসি করছে। সাদ কিছু একটা বলছে, আর টিনা জোরে জোরে হাসছে। ঘরের ভেতর কী হচ্ছে তার আভাস পেয়ে তিনি লজ্জ্বা পেয়ে যান। উল্টো ঘুরে নিজের ঘরেই ফিরে আসেন।

ভাগ্য! ছেলে-ছেলের বউ থাকতে আজ তাঁর বউকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। এটি প্রকৃতির প্রতিশোধের শুরু।

______
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৪

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে:ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

শোভার জ্ঞান ফিরেছে সকালে। রমজান সাহেব বিরস মুখে মেয়ের হাত ধরে বসে আছেন, সালমা বেগম মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। সবাই-ই চুপ, কেউ কথা বলছেনা। শাফিন ঔষধ কিনতে বাইরে গেছে, জানেনা বোনের জ্ঞান ফিরেছে। মিলি খবরটা নার্সের কাছ থেকে জেনে কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। হাতটা নিশপিশ করছে।

কেবিনে ঢুকেই সরাসরি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো শোভার গালে। শোভার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি বেয়ে পড়লো। মাথা নিচু করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। রমজান সাহেব, সালমা বেগম অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে আছেন।

‘ লজ্জ্বা করছেনা? একটুও লজ্জ্বা করছেনা তোর শুভি? তুই এতো নির্লজ্জ, বেহায়া কবে হলি?’

শোভা চুপ।

‘ এখন চুপ করে আছিস কেন? কথা বল, কথা বল!’

শোভা মাথাটা আরো নিচু করলো। কান্না করছে।

মিলি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলো। তারপর শোভার পেটের উপর হাত রেখে বললো, ‘এর কথাটাও তুই একবার ভাবলি না শুভি? তুই কী রে?’

শোভা অবাক হয়ে বললো, ‘ কী হয়েছে?’

‘ তোর বাচ্চাটা মরে গেছে।’

‘ কী বলছিস তুই?’

‘ এটাই তো চাইছিলি তুই, সফলও হয়েছিস।’

‘ মিলি!’

‘ একদম চুপ।’

শোভা জোরে জোরে কান্না শুরু করেছে। মিলির বিরক্ত লাগছে। ও এসব আর নিতে পারছেনা। এ কী মেয়ে? কী ধাতু দিয়ে তৈরি এই মেয়ে? নারীশক্তির ছিঁটেফোঁটা এই মেয়ের মধ্যে নূন্যতম মাত্রায়ও নেই।

‘ শুভি প্লিজ তোর ন্যাকামি বাদ দে।’

‘ ত ততুই কী বলছিস? আ আমারর ববাচ্চাটা নেই?’

‘ না নেই। কারণ তুই খুন করেছিস!’

শোভা পাগল হয়ে উঠলো। বিকারগ্রস্ত রোগীর মতো বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও ক কী বলছে মা?’

রমজান সাহেব এবং সালমা বেগম দুজনেই চুপ। তারা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শোভা সিট থেকে উঠে যেতে চাইলে মিলি ওকে আটকায়। শোভা মিলিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বু আম্মু কথা বলছেনা কেন?’

মিলি অকপটে বলে উঠলো, ‘কারণ ওরাও মরে গেছে। আর কে মেরেছে জানিস? তুই! তুই মেয়ে, মা, নারী হিসেবে কলঙ্ক। আর ওদের কাছে কী জানতে চাইছিস, ওরা তো মৃত।’

শোভা কানে হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো, ‘চুপ কর প্লিজ।’

মিলি রেগে অগ্নিমূর্তি হয়। বলে, ‘এখন এতো খারাপ লাগছে কেন শুভি? সুসাইড করতে যাওয়ার আগে এই মানুষগুলোর কথা একবারও ভেবে দেখেছিস? বল তোর জন্য কী না সহ্য করেছে ওরা? তোকে ছোট থেকে আদর দিয়ে বড় করেছে, খাইয়েছে, পড়ালেখা শিখিয়েছে, যা চেয়েছিস তাই দিয়েছে, হোস্টেলে যেতে চেয়েছিস তাও দিয়েছে, সব তোকে ভালোবেসে করেছে। কিন্তু বিনিময়ে? বিনিময়ে কী পেয়েছে ওরা? তুই ওদের না জানিয়ে সাদ চৌধুরীর সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিস, বিয়ে করেছিস, বাচ্চা পয়দা করেছিস, ভাইকে কষ্ট দিয়েছিস, তোর জন্য তোর বাবা সাদ নামক অমানুষটার কাছে গিয়ে হাত-পায়ে ধরেছে, সাদিদ চৌধুরীর কাছে লাঞ্চিত হয়েছে, সমাজের কাছেও ছোট হয়েছে, ওদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছিস তুই।’

শোভা চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছে। মিলি যেগুলো বলেছে সব ঠিক।

‘ এরপরেও যে তোকে ওরা লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেয়নি সেটাই বেশি৷ কিন্তু নাহ, তুই তো লোভী, অকৃতজ্ঞ! তুই ওই সাদ নামক কু* বাচ্চার জন্য হাত কেটে বাংলা সিনেমা দেখাইছিস ওদের। সারারাত টেনশনে রাখছিস! শাফিন ভাই নাওয়া-খাওয়া ভুলে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর তোর জামাই? সে? সে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ের গাড়িতে করে বউ আনতে যাচ্ছে। হাহ, তুই মৃত্যুপথযাত্রী শুনেও এলোনা। যা না এখন! দেখি কত ভালোবাসা দুইজনের। যে তোরে ভালোই বাসেনা তার জন্য তুই নিজের জান দিতে যাচ্ছিলি, ব্যাপারটা নাটকীয় হয়ে গেলোনা শুভি?’

শোভা অবাক হয়। সে ভেবেছিলো সাদ নিশ্চয়ই ওর কাছে ছুটে আসবে। অন্তত ওর মৃত্যুর খবরটা শুনে। কিন্তু কী হলো? সাদ এলোই না, বিয়ে করতে যাচ্ছে? ইশ, কী বোকা শুভি। ওর তো আগেই ভাবা উচিত ছিলো যে নিজের সন্তানকে অস্বীকার কর‍তে পারে, তার দ্বারা সব করা সম্ভব। এতো বোকা কেন ও? বাবা-মা, ভাইয়ের ছায়া থাকা স্বত্ত্বেও আবেগের বশে ওই অমানুষের জন্য মরতে বসেছিলো? ছিহ ছিহ। নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে। মাঝখান থেকে ওর.. ওর বাচ্চাটাকে হারালো, মনে পড়তেই ঘর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পেটে হাত দিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমার বাচ্চা! আমি ভুল করেছি, ক্ষমা করে দিস মাকে!’

অনেকক্ষণ কাঁদার পর মিলির হাতের ছোঁয়া পেলো মাথায়। মিলি মিষ্টি হেসে বললো, ‘ও ঠিক আছে।’

কথাটা যেন অলৌকিক। যেন কোনো বার্তা শুনছে বাতাসে। শোভা আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে তাকায় বাবা-মায়ের দিকে। ওরা মাথা নাড়িয়ে জানায় বাচ্চা ঠিক আছে। শোভা খুশিতে মিলিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। মিলি ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘যার জন্য এমন করেছিস সে একদিন নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে। তুই তোর বাচ্চার খেয়াল রাখ আর লক্ষ্যে এগিয়ে যা। পাশে তো সৃষ্টিকর্তা আছে, আমরা আছি। তুই সাদ অমানুষটাকে দেখিয়ে দে তুই বেঁচে আছিস, ভালোভাবে আছিস, সুখে আছিস। তোর জীবনে লোকটার প্রয়োজন নেই, তুই দামী, হীরের চেয়েও দামী। যা পেয়েও হারালো সাদ চৌধুরী।’

শোভা চোখ মুছলো। জীবনের মানেটা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে। শাফিন ফিরে এসে বোনকে দেখে সে কী কান্না! শোভা আশ্বস্ত করেছে এরকম আর করবেনা, দেখিয়ে দেবে সাদকে ও নিজের পরিচয়ে, নিজের সন্তানকে বড় করেছে। একাই পারবে নিজেকে সামলাতে!’

এতোক্ষণ পুরো দৃশ্যটা দেখেছে ডাক্তার সাইফ। এ যেন অবিশ্বাস্য। মিলি নামক মেয়েটা খুবই ডেঞ্জেরাস বুঝতে পারছে। তবে খুব নরম মনের সেটাও বুঝে গেছে। মেয়েদের এমনই হওয়া উচিৎ। নয়তো বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হতে হবে। সে মনে মনে পুলকিত হয়, কাল রাতের থাপ্পড়ের কথাটা মনে পড়তেই হেসে ওঠে। গালে হাত বুলায়। থাপ্পড়টাকে ওর মিষ্টি মনে হচ্ছে। ওর মা-ও এমনই বাঘিনী টাইপ মহিলা। মিলি আর মায়ের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল খোঁজে পায় সাইফ। তাঁর নানাকে যখন কোনো হসপিটালে এডমিট করতে চাইছিলোনা, তখন ওর মা মালিনীও ডাক্তার জুবায়েরের গালে থাপ্পড় মারে, পরবর্তীতে তাঁর মায়ের সাথেই নাকি ডাক্তার জুবায়েরের বিয়ে হয় এবং বর্তমানে সাইফের বাবা-ই জুবায়ের। বাবা তাঁর মাকে খুব ভয় পায়। সাইফও পায়। তবে আজকের ঘটনা মনে পড়তেই মাকে ফোন করে জানাতে ইচ্ছা করছে। বলতে ইচ্ছা করছে, ‘বাঘিনীকে আমি পেয়ে গেছি, মা শুনছো?’

_____

একটু আগেই চৌধুরী ভবনে পা রেখেছে নতুন বউ। আনন্দে হইহই রব চারদিকে। সবার মুখে মুখে এক কথা , বউ খুব সুন্দরী। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনায় মুড়ানো৷ তবে মনমেজাজ সোনার মতো হলেই হলো।

সাদ ড্রইংরুমে টিনার পাশে বসে ছবি তুলছে। মেহমানরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। সাদিদ সাহেব খুব খুশি। মনের মতো ছেলের বউ পেয়েছেন। হাসি নেই রোমেলার মুখে। তাঁর ছেলে একটা বউ রেখে কীভাবে পারলো অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে? এই শিক্ষা কোথায় পেলো? মা হিসেবে নিজেকে খুব ছোট, হীন, কীট মনে হচ্ছে। কিছু কর‍্তে পারেনি শোভার জন্য। অথচ সে দাদী হতে চলেছে। আর টিনার মতো অহংকারী মেয়ে এনে তাঁর ছেলে যে কী বড় ভুল করেছে সেদিন আর কিছুই করার থাকবেনা। সব জেনেও রোমেলা বেগম চুপ। সংসারে তার কোনো কথার কোনো দাম নেই। তিনি চুপচাপ সব সহ্য করছেন।

তিনি সাদিদ সাহেবকে একপাশে ডেকে বললেন, ‘কাজটা কী করলে তুমি?’

‘ কীসের কাজ?’

‘ মেয়েটাকে ঠকালে!’

‘ কোন মেয়ে?’

‘ ভুলে গেলে?’

‘ পরিষ্কার কথা বলো।’

‘ শোভা। সাদের বউ!’

সাদিদ সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কে বউ। ও একটা ভুল করেছিলো, শুধরেও নিয়েছে।’

‘ এমন পাপ আল্লাহ সহ্য করবেনা।’

‘ চুপ করোতো।’

‘ চুপই ছিলাম, আর পারলান না!’

‘ কী বলতে চাও তুমি?’

‘ বলতে চাই তোমরা অন্যায় করেছো।’

‘ সাদের কিন্তু বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে।’

‘ ভালো তো। টিকতে পারলে হয়। এই মেয়ে আমাদের সংসার বাঁচালে হয়। শেষ বয়সে না আমাদের আবার ঝামেলা মনে করে ভিক্ষুকের মতো তাড়িয়ে দেয়।’

সাদিদ সাহেব বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন। তারপর চলে গেলেন। কিন্তু কথাটা মনে ঢুকে গেছে। টিনা এমনিতেও অন্য ধাঁচের মেয়ে। মানিয়ে না নিতে পারলে ওদের কপালে দুঃখ আছে। হঠাৎ কেমন অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন তিনি। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলেন না। কৃত্রিম হাসির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলো অনুশোচনার ছোট্ট ছোট্ট কণাগুলো। মনকে মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগলো।

টিনা ছবি তুলতে তুলতে বিরক্ত। সে সাদকে বলে, ‘প্লিজ আমাকে ঘরে নিয়ে যাও।’

‘ ঠিক আছে, চলো।’

‘ চলো মানে? নতুন বউ আমি। কোলে করে ঘরে নিয়ে যাও!’

‘ এভাবে?’

‘ হুম।’

‘ কিন্তু?’

‘ কীসের কিন্তু?’

‘ এতো লোকজনের মধ্যে দিয়ে?

‘ নয়তো কীভাবে?’

সাদ আর কথা না বাড়িয়ে টিনাকে পাজাকোলা করে তুলে নিলো। হাঁটা ধরলো ঘরের উদ্দেশ্যে। যে ঘরটাকে কোলে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছিলো শোভাকে, সেই ঘরে আজ অন্য কেউ, অন্য মানুষ সংসার করার উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছে।

কিছু গঠনমূলক মন্তব্য পেতে পারি কী? গল্পটা নিয়ে আমি কনফিউজড।

চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৩

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

মিলি শুধু এটুকুই জানালো। আর কিছু বলার প্র‍্য়োজন মনে করলোনা। একসময় সাদ’কে ও নিজের বড় ভাইয়ের জায়গায় বসিয়েছিলো। খুব সম্মান করতো। কিন্তু এখন ওর আফসোস হয়। নিজে এতো বিচক্ষণ হয়েও কী করে মানুষরুপী জানোয়ারটাকে চিনতে পারলোনা। নিজের প্রিয় বান্ধবীকে ওই বিষাক্ত কীটের থেকে দূরে রাখতে পারলোনা। আজ নিজের জীবনের সাথে লড়াই করছে শোভা, শুধু এই কাপুরুষের জন্য।

শোভাও এতো দুর্বল হয়ে পড়লো কেন মিলি বুঝতে পারছেনা। মেয়েটা নিজেই বলেছিলো সাদ’কে উচিৎ শাস্তি দিবে। কিন্তু সাদের বিয়ের কথা শুনে কেন নিজেকে আটকাতে পারলোনা? কেন গেলো সুসাইড করতে? আজকের যুগে এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। মেয়েরা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে। এতো করে বোঝানোর পরেও যদি কেউ ভুল পথে পা বাড়ায় তাহলে আর কী-ই বা করার থাকতে পারে?

ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায় মিলির। কপালের শিরা ভেসে উঠে। ইচ্ছে হয় এক কোপে এসব নরপুরুষদের বলি দিতে। কান্নাটা কষ্টের নয়, রাগের। রাগ হলে মিলির চোখে পানি আসে। কিছু করতে পারছেনা এটা ও মানতে পারছেনা। ইচ্ছে হচ্ছে দুনিয়া উলটপালট করে দিতে। বুক থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস! জীবন বড়ই কঠিন। যেখানে বাঁচার আশায় মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে, সেখানে সবকিছু পেয়েও শুভির মতো নরম মনের মেয়ে কেন যায় সুসাইড করতে? তাও ওই সাদ নামক জানোয়ারটার জন্য? সেতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে। ছিঃ! ঘেন্না হচ্ছে মিলির, শোভা আর সাদ দুজনের উপরই। তবে আলাদা কারণে। সাদকে ঘেন্না হচ্ছে চরিত্রহীনতার জন্য, শোভাকে ঘেন্না করার একমাত্র কারণ ওই সাদের জন্য মরতে যাওয়া।

এইতো আজকে রাতের ঘটনা। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।

শোভার পাঁচমাস চলছে। সাদের সাথে দেখা নেই তিনমাস। সেদিনের পর দুজন দুজনের চেহারা মাড়ায়নি। কথাও হয়নি। সব স্বাভাবিক চলছিলো। শোভা মনমরা থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়েছিলো মূলত মিলির প্রাণান্তকর চেষ্টায়। ডিভোর্স লেটার এখনো পায়নি, সময় লাগবে। তাই এখনো তারা স্বামী-স্ত্রী। শাফিন বোনকে আগলিয়ে রাখছে।

কিন্তু রাতে হঠাৎ শাহানা ফোন করে জানালো সাদের আজ হলুদ। ব্যস! শুভি উদ্বিগ্ন হয়ে গেলো। কাউকে কিছু না বলে ঘরে গিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেললো। শাফিন রাতে শোভার ঘরে উঁকি দিতে গিয়ে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রক্তে বিছানা ভেসে গেছে। তাড়াতাড়ি বাসার সবাইকে ঘুম থেকে তুললো। শোভার মায়ের কান্নায় আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠলো। রমজান সাহেব ভাবতে পারেননি তাঁর মেয়ে এমন কিছু করবে। শাফিন উপায় না পেয়ে মিলিকে ফোন করলে মিলি দ্রুত হসপিটাল নিয়ে আসতে বলে। নিজেও হোস্টেল থেকে চলে আসে।

আসার পথেই কথা হয় সাদ চৌধুরী নামক মানুষটার সাথে। খবরটা জানিয়ে দিলো। আচ্ছা, ওই অমানুষটা কী এই খবর শুনে খুশি হয়েছে? হওয়ারই কথা।

মিলি পৌঁছে দেখে ডাক্তার শোভাকে এডমিট করতে চাচ্ছেনা। পুলিশ কেইস, হ্যানত্যান বলে ঝামেলা করছে। এমনিতেই মিলির রাগ বেশি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ইয়াং ডাক্তার সাইফের গালে চড় বসিয়ে দিলো। চিৎকার করে বললো, ‘এক্ষুনি যদি শুভির চিকিৎসার ব্যবস্থা না করেন আপনাকে আমি খুন করবো।’

ডাক্তার সাইফ হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এতো মানুষের সামনে একটা মেয়ে তাঁর গালে চড় মেরেছে ভেবে সে হতভম্ব। এই অপমান সহ্য করতে পারছেনা, মিলির টুটি চেপে ধরতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু মানসম্মানের ভয়ে পারছেনা।

যে মেয়ে একবার থাপ্পড় মারতে পারে, সে দ্বিতীয়বারও মারতে পারে ভেবে সাইফ আর কথা বাড়ালোনা। এদিকে নীরবতা সহ্য হচ্ছেনা মিলির। সে হুট করে সাইফের কলার চেপে ধরে বললো, ‘শুভির যদি কিছু হয় হারামি, তোরে আমি বলি দিবো।’

ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দেয় সাইফ। রাগে গা কেঁপে উঠে। তেড়ে এসে মিলির হাত চেপে ধরলো। তারপর সাথে থাকা ডাক্তাদের বললো, ‘ আপনারা মেয়েটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।’

অন্যান্য ডাক্তাররা মিলির ভয়ে মাথা নাড়িয়ে শোভাকে নিয়ে গেলো। শাফিন সব ফর্মালিটি পূরণে ব্যস্ত। রমজান সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে শোভার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

ডাক্তার সাইফ! হার্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ড্যাফোডিল হসপিটালের অন্যতম ভালো একজন ডাক্তার। দু’মাস হলো নতুন জয়েন করেছে, চারদিকে নাম হয়ে গিয়েছে। সবাই ওকে খুব সমীহ করে চলে। অথচ মিলি ওর উপর হাত তোলার দুঃসাহস করেছে। সাইফের তীক্ষ্ণ ভয়ানক দৃষ্টি দেখে অবাক হলোনা মিলি। ডাক্তারদের তো এমনই মানায়। সাইফ হুংকার ছেড়ে বললো, ‘ হু আর ইউ মিস? আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কোথায় পেলেন?’

‘ আমার সাহসের কথা আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা। ডাক্তার হয়েছেন সেই দায়িত্ব পালন করুন।’

‘ সেটাই পালন করছিলাম।’

‘ রিয়েলি? আপনি মৃত্যুর মুখে আমার শুভিকে ফেলে রেখে ডাক্তারের দায়িত্ব পালন করছিলেন? গ্রেট!’

‘ শুনুন! আমরা ডাক্তার আমাদেরও কিছু নিয়ম মেইনটেইন করতে হয়। সুসাইড এ্যাটেম্প করতে চেয়েছে আপনার রোগী, আর এটা পুলিশকে জানানো আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কেননা, এটা খুনের চেষ্টাও হতে পারে।’

‘ রাখুন আপনার এসব নিয়ম। একটা মানুষ মরার পথে, আর আসছেন নিয়ম দেখাতে।’

‘ শুনুন আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।’

‘ বাড়াবাড়ি আমি করেছি? তো বেশ করেছি। আচ্ছা আপনারা ডাক্তাররা কী মানুষকে সেবা দিবেন বলে ডাক্তার হয়েছেন? নাকি টাকা কামাতে?’

‘ অবশ্যই সেবাধর্ম পালন করতে।’

‘ এতোক্ষণে পয়েন্টে এলেন। তাহলে মনুষ্যসেবা না করে আইনিসেবা নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন? সে দায় আইনের। আমার বা আপনার নয়। হোক সেটা খুন বা সুসাইড কেস। ডাক্তারদের একমাত্র কাজ রোগীকে সারিয়ে তোলা। আর আপনার মতো বিজ্ঞ লোক এই ভুলটা করেছেন সো থাপ্পড় খেতেই হবে। মার না খেলে কী কিছু মনে থাকে? ছোটবেলায় দেখতেন না পড়া না পারলে বা ভুল করলে শিক্ষকরা মেরে শিখাতো! আমিও আপনাকে একটা শিক্ষা দিলাম, কখনোই ভুলবেন না। ওকে?’

সাইফের মাথার উপর দিয়ে কথাগুলো যাচ্ছে। তাঁর মনে হচ্ছে এই কথাগুলো সার্জারির চেয়েও বেশি কঠিন। সে বুঝতে পারছেনা। মিলি হুংকার ছেড়ে বললো, ‘আমার হাত ছাড়বেন মিস্টার? নাকি পেটে লাথি খাবেন?’

সাইফ ভয়ে হাত ছেড়ে দিলো। মেয়ে তো নয়, যেন বাঘিনী। মেরে দিলেও দিতে পারে লাথি। গতকালই ওর পেটের অসুখ সেরেছে, আজ আর কোনো রিস্ক নিতে চায়না। শেষে দেখা যাবে লাথি খেয়ে আর কোনোদিন পেটব্যথা সারতেই চাইবেনা। এই মেয়ের সাথে কথা বলার চেয়ে একঘন্টায় তিনটে সার্জারী করা অনেক সোজা।

মিলি করিডোরে চিন্তিত মুখে বসে রইলো। এলোই না সাদ? শুভির এতো বড় বিপদ শুনেও তার মন গললো না? পুরুষ জাতি কী এমন? নাকি কাপুরুষ জাতি বলে এদের! শিট..শুভি…শিট। এর জন্য মর‍তে চাইছিস, এর জন্য! ভুল তুই ভুল শুভি। এ ভালোবাসার দায়িত্ব যেমন পালন করতে পারেনি, স্বামী হিসেবে কিঞ্চিৎ দায়িত্বও পালন করতে পারেনি।

_________

ওদিকে সাইফ বিছানায় শুয়েও শান্তি পাচ্ছেনা। শোভার কথাটাও মিলি পুরোপুরি বললো না। কিন্তু কিছু একটা যে হয়েছে বেশ বুঝতে পারছে। ধুর! ওই মেয়ের চিন্তা করে কী হবে, সেতো নিজের জীবন গোছাতে চলেছে। তাও, পিছুটান বড় খারাপ জিনিস। জানে সে বাবা হতে চলেছে। কিন্তু চায়না এইসব। ডিভোর্সটা হয়ে গেলে ওদিকে আর ফিরেও তাকাবেনা সাদ। টিনার সাথে আনন্দে জীবন কাটাতে চায় সে, বাবা-মাও এটাই চায়। বাবা-মায়ের খুশিতেই সাদ খুশি।

এই মুহূর্তে কারো সাথে ওর চিন্তাগুলো শেয়ার করা দরকার। কার সাথে করবে? টিনার সাথে? হুম করাই যায়, টিনা ওর আর শোভার ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। সাদ’ই বলেছে। যার সাথে বিয়ে হবে তাকে সবটা জানালো দরকার বলেই জানিয়েছে। চায় না কোনো মিথ্যে থাকুক দুজনের ভেতর। সব শুনে টিনা মেনে নিয়েছে, পাশে দাঁড়িয়েছে সাদের। পাত্তাই দেয়নি, এমন ভুল নাকি হয়ই! অনেক ভেবে সাদ ফোন লাগালো টিনাকে।

‘ হ্যালো।’

‘ বলো জান।’

‘ কী করো।’

‘ কিছুনা, তুমি?’

‘ শুয়ে পড়েছি, ঘুম আসছেনা।’

‘ তাই বুঝি আমার কথা মনে পড়েছে।’

‘ বলতে পারো।’

‘ আচ্ছা, আমিও তোমার কথাই ভাবছিলাম।’

‘ কেন?’

‘ বারে! তুমি আমার হবু বর, কাল আমাদের বিয়ে! তারপর সারাজীবন একসাথে থাকবো।’

‘ ওহহ!’

‘ তুমি খুশি না সাদ?’

‘ খুশি!’

‘ তবে আমার কেন মনে হয় তুমি খুব আপসেট?’

‘ জানোই তো। আমি ওই ব্যাপারটা ভুলতে পারছিনা।’

‘ ভুলার চেষ্টা করো।’

‘ অন্তত ডিভোর্সটা হয়ে গেলে আমি রিল্যাক্স হতে পারতাম।’

‘ হয়ে যাবে। তাছাড়া শোভা মেয়েটিও তো চায় ডিভোর্স হোক।’

‘ আমি কিছু ভুল করছিনা তো?’

‘ না। ওই মেয়েকে বিয়ে করাটাই তোমার ভুল, ডিভোর্স একদম ঠিক সিদ্ধান্ত।’

‘ বলছো!’

‘ হুম জান।’

সাদ চুপ করে রয়েছে। টিনা বললো, ‘আচ্ছা এসব কথা বাদ। আমাদের বিয়ের পরবর্তী প্ল্যান বলো।’

‘ আমি কী বলবো। তুমিই করো।’

টিনা বললো, ‘হুম। আমি ঠিক করেছি হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাবো। আর শুনো বাড়ির কাজ করতে আমি পারিনা, ওসব করবোনা।’

‘ তাহলে কে করবে?’

‘ কাজের লোক রেখে দেবো!’

‘ আচ্ছা!’

‘ বেবি তাড়াতাড়ি নিবোনা, দুই-তিন বছর পর নেবো।’

‘ কেন? আমার আব্বু তো নাতি-নাতনির আশায়ই বিয়ে করাচ্ছে!’

টিনা বিরক্ত হলো। বললো, ‘ধুর বাদ দাও। ওনি চাইলেই তো আর হবেনা। আমারও একটা মতামত আছে, তাইনা।’

‘ ঠিক আছে।’

‘ তোমার কী প্ল্যান সাদ?’

সাদ ভাবে কী তার প্ল্যান। এসব কথা তো শুধু শোভাকেই বলেছিলো সে। শোভা অক্ষরে অক্ষরে সাদের প্রতিটি কথা মেনেছে। শোভা চেয়েছিলো স্বামীর বাড়ির প্রতিটি মানুষ তাঁর আপন, সবাইকে আগলে রেখে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ওদের সেবা করবে। নিজ হাতে রান্না করবে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা থাকবে ওর। সাদ অফিস থেকে ফিরলে ওকে লেবুর শরবত এগিয়ে দেবে, যা সাদের খুব পছন্দ। ছোট্ট সংসারে নিজের জন্য কিছুই চাইনি শোভা। অথচ টিনার সাথে শোভার কত পার্থক্য। দুজনের ভাবনা চিন্তা সম্পূর্ণ আলাদা। টিনার সাথে কেন ভালো থাকবে কী সাদ? শোভাকে কী বোকাটাই না বানালো। মেয়েটাকে কিছু বললেই কেঁদে দিতো বাচ্চাদের মতো। সেই মেয়েই আজ মা হতে চলেছে। ছোট্ট শোভার কোলজুড়ে থাকবে ছোট্ট সাদ! মনে মনে এটাই চাইছে নাকি ও?

চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০২

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

প্রেগন্যান্সির এই ঘটনা আর লুকিয়ে রাখা গেলোনা। এই খবর মিলি শোভার বাড়িতে জানালো। বাড়ির সবাই যখন জানতে পারলো ওদের শত্রুতা যাদের সাথে, সেই সাদিদ চৌধুরীর ছেলে সাদের বাচ্চা শোভার গর্ভে তখন তারা একপ্রকার মিঁইয়ে গেলো। রাগে, দুঃখে শাফিনের চোখে পানি এসে গেলো। বড় ভাই হয়েও শাফিন শোভাকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো।

‘ হারামজাদি, তোকে এজন্য বাসার বাইরে পাঠানো হয়েছিলো? এসব বেলাল্লাপনা করতে? তোর একটু লজ্জ্বাও করলোনা? অবৈধ সন্তান পেটে ধরেছিস ছিঃ!’

‘ চুপ করো ভাইয়া। ও অবৈধ নয়, আমাদের বিয়ে হয়েছে!’

শাফিন বোনের মুখে একথা শুনে বাক্যহারা হয়ে গেলো। বললো, ‘কী বলছিস তুই? বিয়ে করেছিস মানে?’

‘ মানে আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার বাচ্চা অবৈধ নয়।’

শাফিন আর শোভা। দুজনে পিঠাপিঠি প্রায়। ভাইবোনের সম্পর্ক কেমন হতে হয় তা এই দুজনকে দেখেই বোঝা যায়। স্কুল-কলেজে পড়াকালীন দু’ভাইবোনের মাঝে কোনো গোপনীয়তা ছিলোনা। সারাদিন কী কী হয়েছে, কোথায় গিয়েছে, কোন ছেলেটা কী বলেছে দুজন দুজনকে শেয়ার করতো। অথচ আজ! শাফিনের আদরের ছোট্ট বোনটা নাকি ওকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। সম্পর্ক কী এমন? দূরে গেলে নাকি সম্পর্ক মজবুত হতো, কিন্তু কই? ওদের মাঝখানে যে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। কী করবে শাফিন? যে বোনটা চুপচাপ, হাসিখুশি ছিলো। প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাস করতোনা। যাকে দিনের পর দিন আগলে রেখেছে সেই বোন যে ওকে না জানিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত এবং সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছে, বড় ভাই হয়েও শাফিন আটকাতে পারেনি। বিবেকবান বোনটাও আর সবার মতো আবেগী হয়ে গেলো।

এদিকে সালমা বেগম আর রমজান সাহেব নিশ্চুপ। ওদের মন ভেঙ্গে দিয়েছে শোভা। এতো বড় ভুল করার আগে শোভার কী একবারও ওদের মুখটা মনে পড়েনি? একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি? ভালোবাসায় কী এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো যে সামনের পৃথিবীটা সে দেখতে পায়নি? দুজন শোভাকে কিছু বলতেও পারেননি। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে রমজান সাহেব সাদের সাথে দেখা করলেন। অনেক কাকুতিমিনতি করলেন, কিন্তু সাদ আবারও একই কথা বলে রমজান সাহেবকে ফিরিয়ে দিলো।

শোভা এবার আর কিছু ভাবতে পারলোনা। মিলি প্রচন্ড রেগে গেলো। সে শোভাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে এলো সাদদের বাড়িতে। দারোয়ান প্রথমে ঢুকতে দিতে চাইছিলো না। মিলি তাকে ধাক্কা মেরে শোভাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। ড্রইংরুমের সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন সাদিদ চৌধুরী। অচেনা দুটো মেয়েকে দেখে তিনি উঠে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কে তোমরা?’

‘ আমি মিলি আর ও শোভা।’

‘ তোমাদের চিনি বলেতো মনে পড়েনা।’

‘ আপনার সাথে আমাদের পরিচয় নেই!’

‘ কী দরকার এখানে? কারো সাথে দেখা কর‍তে এসেছো?’

‘ জি।’

‘ কাকে চাই?’

‘ সাদ ভাইকে!’

‘ সাদ তো ঘরে ঘুমুচ্ছে।’

মিলি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ‘একটা মেয়ের সর্বনাশ করে সে এখন ঘুমাচ্ছে? বাহ, বাহ!’

সাদিদ সাহেব বললেন, ‘মানে?’

‘ আপনার ছেলেকে ডাকুন, সে এলেই ক্লিয়ার হবে সব।’

‘ কিন্তু করেছেটা কী সে?’

‘ আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন না।’

‘ মিনুর মা, যাও তো। সাদকে ডেকে নিয়ে আসো।’ বুয়াকে বললেন সাদিদ সাহেব। মেয়ে দুটো কী বলছে ওনি বুঝতে পারছেন না। নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। সামনেই সাদের বিয়ে, এইসময় যদি মেয়েলি ব্যাপারস্যাপার ঘটিয়ে থাকে তাহলে সমাজে ওনার উঁচু মাথা হেঁট হয়ে যাবে। পায়ে পায়ে সাদের মা রোমেলাও এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন, বুঝতে পারছেন না।

শোভা আর মিলি সোফায় বসে রইলো। শোভার মাথা নিচু। চোখের নিচে কালি পড়েছে। উস্কুখুস্কু এলোমেলো চুল কপালের কাছে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে সাদ এলো। ওদেরকে খেয়াল না করেই জিজ্ঞেস করলো, ‘আব্বু তুমি ডেকেছো?’

‘ হুম।’

‘ কিছু হয়েছে?’

‘ সেটা তুমিই ভালো বলতে পারবে!’

সাদ বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। চোখগুলো এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে যখন সোফায় থাকা মেয়ে দুটোর উপর পড়লো, ঘটনা বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না। একী হাল তার শোভার? মেয়েটাকে মৃত মনে হচ্ছে।

সাদিদ সাহেব কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ দুটো মেয়েকে তুমি চেনো?’

‘ জি আব্বু।’

‘ কী হয় তোমার?’

‘ আমার বন্ধু।’

শোভা এবার মুখ খুললো। ‘ সত্যি কথাটা বলছেন না কেন?’

সাদিদ সাহেব বললেন, ‘কীসের সত্যি?’

‘ আমি আপনার ছেলের সন্তানের মা হতে চলেছি। ওনি আমায় বিয়ে করেছেন।’

সাদ চুপ। সাদিদ সাহেব এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। মুহূর্তেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বলছে কী এই মেয়ে?

তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘এসব কী বলছে ও?’

সাদ অকপটে বলে উঠলো, ‘সব সত্য নয়। মিথ্যা। আমি ওকে বিয়ে করেছি ঠিক, বাচ্চা আমার নয়।’

ঘরে যেন বজ্রপাত হলো। মিলি প্রচন্ড রেগে সাদের গালে থাপ্পড় মারলো। থাপ্পড়ের সেই শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। শোভা বিস্মিত, কুন্ঠিত। সাদ নিজের বাচ্চাকে স্বীকার করছেনা? এই দিনও দেখতে হচ্ছে ওকে? এর চেয়ে মরে যাওয়াটাও বেশ শান্তির।

সাদ গালে হাত দিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। পারলে কাঁচা গিলে খাবে। মিলি চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘সাদ ভাই! আপনি এতো পাল্টে গেলেন কখন? আমার দেখা সেরা মানুষদের মধ্যে আপনি একজন। আর সেই আপনি নিজের সন্তানকে অস্বীকার করছেন?’

সাদ আবারও অস্বীকার করলো। ‘ ও আমার বাচ্চা নয়। যদি হতোই তাহলে আমি অস্বীকার করতাম না।’

‘ বাহ, খুব ভালো! আপনি যে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শয়তান সেটা আজ বুঝতে পারছি।’

‘ মুখ সামলে কথা বলো। তোমার বান্ধবী কার না কার বাচ্চার মা হতে চলেছে, বিয়ে করেছি বলে এখন আমার উপর চাপাতে চাইছে? ভালোই শিখলে।’

শোভা ধরা গলায় বলে উঠলো, ‘সত্যিই তো। বাচ্চার বাবা আপনি নন। আমার সন্তানের বাবার নাম সাদ চৌধুরী, যিনি আমাকে ভালোবাসতেন। আর আপনি তো সাদ নন, একটা মানুষরুপি জানোয়ার। আপনি কীভাবে কারো বাবা হতে পারেন। ছিঃ!’

সাদিদ সাহেব এবার কথা বলে উঠলেন। বললেন, ‘দেখো আমার ছেলের ক’দিন পর বিয়ে। তোমরা এসব নাটক অন্য কোথাও গিয়ে দেখাও। হোস্টেলে থাকো, তোমাদের আর কে বিশ্বাস করবে। মানছি আমার ছেলে বিয়ে করেছে, কিন্তু তুমি যেটা করেছো এরপর পুত্রবধূ হিসেবে তোমায় মেনে নেওয়া যায়না। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো, যত টাকা চাও ততোই দেবো। এবার যাও এখান থেকে।’

শোভা যেন এই কথাটা শোনার অপেক্ষাই করছিলো। বললো, ‘থাক আঙ্কেল। শত্রুর মেয়েকে টাকা দিতে হবেনা। কিন্তু সাদ চৌধুরী এটাও মনে রাখবেন, যে মেয়ে অল্পতেই কাঁদতে পারে সেই মেয়ে কঠোর আঘাতে বাঁচতেও পারে। আমি তো আমার সন্তানকে দেখেই রাখবো। কোনোদিন না এমন হয় যে, আপনি আমার কাছে ফিরে আসতে চাইবেন। ভালো থাকবেন।’

‘ শত্রুর মেয়ে মানে?’

‘ আমার আব্বুর নাম রমজান।’

সাদিদ সাহেব বাঁকা হেসে বললেন, ‘বাপ যেমন , মেয়েও তেমন। একেবারে উচিৎ শিক্ষা হয়েছে!’

‘ শিক্ষা তো খোদাতায়ালা দিবে আপনাদের। এই অন্যায় করার জন্য।’

‘ বাপের মতোই পটরপটর কথা বলতে শিখেছো!’

‘ নাহ। আপনার ছেলের আঘাতে মুখ দিয়ে এমনিই কথা আসছে।’

‘ ভালো। আঘাত পেয়ে শক্ত হওয়া ভালো।’

‘ উল্টো আঘাত সহ্য করতে পারবেন তো আংকেল?’

সাদিদ সাহেব রেগে গেলেন। বললেন, ‘বেরুও এখান থেকে!’

মিলি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। এবার ফিরে আসার পথে হাতের কাছে থাকা ফুলদানিটা সাদের মাথায় ছুঁড়ে মারলো। এরকম অমানুষদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। কাপুরুষ সাদ তখন মাথা নিচু করে ভালো মানুষ সেজে দাঁড়িয়ে ছিলো। শোভা মিলিকে টেনে নিয়ে চলে এলো। ছিঃ ছিঃ! এমন মানুষকে কীভাবে বিশ্বাস করেছিলো সে?

_______

সেদিনের পর সাদের সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করলো শোভা। রমজান সাহেব সাদিদ চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাইলো, শোভা দিলোনা। হোস্টেল ছেড়ে চলে এলো বাসায়। প্রথম প্রথম কিছুদিন নিজেকে ঘরে আটকে রাখলো। একবার ভেবেছিলো মরে যাবে, এসময়টাতে পুরোপুরি ওর পাশে থেকেছে মিলি। মাঝে মাঝে মনে হয় মিলি বুঝি শোভাকে বাঁচার রাস্তা দেখিয়েছে। পুরোদমে পড়াশোনায় সাহায্য করলো শাফিন। বোনের উপর চাপা রাগ থাকলেও প্রকাশ করেনা।

এদিকে সাদের আজ গায়ে হলুদ। ধুকধাম আয়োজন। ওর মনটা কু গাইছে। কেন এরকম লাগছে বুঝতে পারছেনা। বিয়ে হচ্ছে বড়লোক বাড়ির মেয়ের সাথে। তাও এমন লাগার কারণটা বুঝতে পারছেনা। খবরটা এলো মাঝরাতে, যখন ও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোবাইল বেজে উঠলো।

‘ হ্যালো, কে বলছেন?’

‘ আমি মিলি।’

‘ কোন মিলি?’

‘ থাপ্পড়ের কথাটা ভুলে গেলেন?’

‘ তুমি? কেন ফোন করেছো?’

‘ গায়ে হলুদ বেশ ভালো কাটলো তাইনা?’

‘ এসব জানতে ফোন করেছো?’

‘ হুম। তবে একটা গুডনিউজও আছে।’

‘ কীসের নিউজ?’

‘ এই যে! আপনি নতুন জীবনে পা রাখতে চলেছেন আর অন্যদিকে একজন দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চলেছে!’

‘ বুঝলাম না।’

‘ বোঝার কথাও না। মাথায় কিছু আছে নাকি মানুষ ঠকানো ছাড়া!’

‘ স্পষ্ট করে বলো!’

‘ আমাদের শুভি! শুভি বোধহয় আর বাঁঁচবেনা, মরে যাবে।’

বুক কেঁপে উঠলো। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে লাগলেও সাদ সামলে নিলো। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে শোভার?’

চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০১

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#পর্ব:১
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া

প্রেগ্ন্যাসি কিট দেখেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো শোভা। কারণ ফলাফল পজিটিভ। হোস্টেলের অন্যান্য মেয়েরা দৌড়ে এসে ধরলো ওকে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিলো। বেশ খানিকক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলো। সবাই জেঁকে ধরলো কী এমন হয়েছে যার জন্য অজ্ঞান হয়েছে? শোভা কাউকে কিছু বললোনা। কাউকে বলার মতো মুখই নেই ওর। কী। বলবে যে ও মা হতে চলেছে? না এমনটা কখনো কাউকে বলতে পারবেনা।

শোভার অবস্থা দেখে ওর খুব কাছের বান্ধবী মিলি সবাইকে চলে যেতে বললো। সবাই চলে গেলে মিলি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে রে শুভি? বলনা!’

শোভা কেঁদে উঠলো বাচ্চাদের মতো। মিলিকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আমি মা হতে চলেছি মিলি!’

‘ কীহহ?’

‘ হুম।’

‘ ক কার সাথে…!’

‘ সাদ!’

‘ শুভি তুই এসব কী বলছিস? সাদ মানে আমাদের সাদ ভাইয়া?’

‘ হুম।’

‘ ওনাকে তো কখনো এমন মনে হয়নি? এই শুভি বলনা এসব মিথ্যা? দেখ আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।’

‘ সত্যি? দু’মাস যাবৎ পিরিয়ড বন্ধ। সন্দেহবশত কীট এনে টেস্ট করালাম, এখন পজেটিভ ফলাফল। বল আমি এখন কী করবো?’

‘ ভাবছি আমি।’

মিলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বললো, ‘ভাইয়াকে জানিয়েছিস?’

শোভা মাথা নাড়ালো। মিলি চেঁচিয়ে বললো, ‘তাহলে জানা যে তুই ওনার সন্তানের মা হতে চলেছিস!’

‘ ওনাকে আমি কী করে বলবো। আমার সাহস নেই এই কথা বলার।’

মিলি রেগে গেলো। ‘কেন? এসব করার আগে মনে ছিলো না? এটা তো অবৈধ প্রেমের ফসল..!’

শোভা মিলির দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এই অপবাদ দিস না প্লিজ!’

‘ আমি না হয় দেবোনা। সমাজ কী আর চুপ করে থাকবে? তুই এটা কী করলি?’

‘ আমায় মাফ করে দে প্লিজ!’

‘ আমার মাফ করা না করায় কিছু আসে যাবেনা। বাচ্চার বাবাকে বল এখন সে কী করবে! নাকি অন্যদের মতো বেঁকে বসবে। আর তোদের দুজনের পাপের ফলে এই নিষ্পাপ ভ্রুণের জায়গা হবে কোনো ডাস্টবিনে। যেখানে কুকুর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে!’

শোভা মাথা নিচু করে কাঁদছে। মিলির প্রচুর রাগ হচ্ছে। এই আলাভোলা মেয়েটাও কিনা আজ সবচেয়ে ভয়ংকর ভুলের ফাঁদে পা দিলো। আর সাদ ভাই? ওনি? ছিহ! মিলির ইচ্ছা করছে শোভাকে কুচিকুচি করে কাটতে। রাগটা সামলে ধমকে সাদকে ফোন কর‍তে বললো। কিন্তু শোভা ফোন না করে হাতে নিয়ে বসে রইলো। মাঝে মাঝে হিঁচকি তুলে কাঁদছে। এসব ন্যাকামি দেখে মিলির আরও রাগ হচ্ছে। আগে মনে ছিলো না এসব করলে ফল কী হয়! এখন এসব করার মানে কী!

শোভা অনেক ভেবেচিন্তে ফোন হাতে নিলো। ডায়াল করলো সাদে’র নাম্বারে।

________

অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রজেক্ট নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত সাদ। প্রচন্ড গরমে ক্লান্ত শরীর নিয়ে মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে এসে বসলো সে। মনটা কেমন খচখচ করছে, ঢকঢক করে বরফ গলা ঠান্ডা পানি গিলে নিলো। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসতেই মোবাইলটা বেজে উঠলো ওর। নামটা দেখে মুচকি হেসে কল রিসিভ করলো। ‘হুম বলো!’

‘ আ আপনি কোথায়?’

‘ অফিসে। কেন?’

‘ দরকার ছিলো।’

‘ আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতে নাকি? শোনো এসবের কোনো দরকার নেই।’

‘ না সেজন্য নয়!’

‘ তাহলে?’

‘ একটা কথা বলার ছিলো!’

‘ বলে ফেলো সুন্দরী।’

শোভার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বললো, ‘ আ আমি প্রেগন্যান্ট!’

সাদ শব্দ করে হাসলো। বললো, ‘ দুপুরবেলা এসব মজা না করলেই নয়?’

‘ সত্যি বলছি। আমি আপনার সন্তানের মা হতে চলেছি।’

সাদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কী করবে এখন সে? শোভাকে বললো, ‘ফোন রাখো!’

শোভা অবাক হয়ে বললো, ‘ মানে? আপনি কিছু বলুন।’

‘ আমি কী বলবো?’

‘ আমি এখন কী করবো?’

‘ সেটা তোমার ব্যাপার। তুমি মা, তুমি বাচ্চা রাখবে নাকি রাখবেনা সেটা একান্তই তোমার উপর ডিপেন্ড করছে।’

‘ সাদ! আপনি বাচ্চার বাবা।’

‘ হুম। আমি তো অস্বীকার করিনি।’

‘ আবার স্বীকারও তো করছেন না।’

‘ তুমি জানো কেন স্বীকার করছিনা।’

‘ এসব রাখুন। বলুন কী করবো। আপনার মতামতের উপর সবকিছু ডিপেন্ড করছে!’

‘ তাহলে শোনো। বাচ্চা যদি রাখতে চাও, তাহলে নো প্রবলেম। আমি ওর সমস্ত খরচ দেবো। আর যদি না রাখতে চাও সেটা সম্পূর্ণ তোমার উপর নির্ভর করছে। তাতেও আমি হ্যাঁ।’

‘ আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না সাদ!’

‘ না বোঝার মতো কিছু বলিনি। বাচ্চার সমস্ত খরচ আমার, বাট..কখনো আমার ফ্যামিলির সামনে ওর পরিচয় দেওয়া যাবেনা!’

শোভা বজ্রাহত হলো। মানেটা ও খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। ফোন রেখে দিলো। মিলি জানতে চাইলো কী হয়েছে। শোভা কিছু বললোনা। মুখ ঢেকে বিছানায় শুয়ে রইলো। মিলির আর কিছু বোঝার বাকি রইলোনা। যা ভেবেছিলো তাই, সাদ মেনে নেয়নি। সাদ এরকম কাপুরষ হবে মিলি ভাবতেও পারছেনা। বুক থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হোস্টেলে থাকার বদৌলতে এরকম অনেক কেস দেখেছে মিলি। ফলাফল ওই সিটি হসপিটালের পেছনের ডাস্টবিনে ছোট ছোট নিষ্পাপ শরীরগুলো, যেগুলো কুকুর খুবলে খুবলে খায়। ভালোবাসার নামে এসব অনাচার আজ মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে। ক্ষণিকের আনন্দ আর জৈবিক চাহিদা মেটাতে মানুষ কত ভুল পথে পা বাড়ায় সেগুলো দেখে মিলি আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেনা। এসব অনাচার কখন সমাজ থেকে উঠে যাবে তা জানেনা মিলি।

_____

শোভা! মধ্যবিত্ত বাবামায়ের মেজো সন্তান। খুব বড়লোক না হলেও বেশ বড়লোকই। এমনিতে ভালো মেয়ে। বাসায় থেকে পড়াশোনা ঠিকমতো হয়না বলে কলেজের হোস্টেলে থাকে। তাদেরই কলেজের সিনিয়র ছাত্র সাদ চৌধুরী। পড়াশোনা শেষ করে এখন সরকারি চাকরি করছে। মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক , হাসিখুশি ছেলেটা প্রথম দেখায়ই প্রেমে পড়ে শোভার। অমন সুন্দর মেয়ে দেখে তার মাথা ঘুরে যায়। অথচ কেউ টেরই পায়নি এসব। শোভার প্রতি সবসময় আলাদা কেয়ার দেখাতো, একদিন মনের কথা প্রকাশ করে শোভার কাছে। শোভা প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাসী না বলে সাদের কাছ থেকে দূরে থাকে। কিন্তু সাদের পাগলামি দেখে অন্যান্য মেয়েদের মতো শোভাও একসময় স্বীকার করে যে, সে সাদকে ভালোবাসে। একদিন জানতে পারে ওদের দুই পরিবারের মাঝে যুগ যুগ ধরে শত্রুতা লেগে আছে। দুজন দুজনকে হারানোর ভয়ে বিয়ে করে নেয় কাউকে না জানিয়েই, যার ফলে আজ শোভা গর্ভে ধারণ করছে সাদের সন্তান। এসব কথা ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানেনা। এমনকি মিলিও নয়!

এসব ভেবে শোভা চিন্তা করে কীভাবে বাবামাকে মুখ দেখাবে, অনাগত সন্তানের পরিণতি কী? সাদ তো একপ্রকার বিশ্বাসঘাতকাই করলো। টাকা দিয়ে কী বাবার ভালোবাসা কেনা যায়? তাহলে সাদ কেন বললো এই সন্তানের খরচ ও দেবে, কিন্তু পরিচয় দিতে পারবেনা? এই বিশ্বাস নিয়ে সারাজীবনের জন্য বাঁধা পড়েছিলো বিয়ে নামক বন্ধনে? ছিহ সাদ! ধিক্কার আপনাকে।

চলবে..ইনশাআল্লাহ! ভিনদেশি তারা শেষ হতে চললো বলে, তাই শুরু করা।

চলবে।

সোনার সংসার পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

1

#সোনার সংসার
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#অন্তিম পর্ব

বাবার সামনে অপরাধীর মত বসে আছি।বাবা সবটা জেনে গেছে যে আমি এখানে এসেছি।পাশেই আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই বসে আছে,শরীফও আছে কিন্তু তার কোন ভাবান্তর নেই।

“তুমি কী এতকিছুর পরও এখানে থাকতে চাও,নাকি আমার সাথে বাড়িতে ফিরবে?”

“ফিরব চিরদিনের মত এ বাড়ি থেকে চলে যাব কিন্তু তার আগে আমার কিছু প্রশ্নের উওর চাই।”

শরীফের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললাম,আমি আবারও বলে উঠলাম,,,

“একটা সম্পর্কে কী বাচ্চা হওয়াটা খুবই জরুরি?ভালবাসার কী সেখানে কোন মূল্যই নেই?তিন বছর প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম আমরা।আমার পরিবার পরিজন সব ছেড়ে তোমাকে আপন করে নিয়েছিলাম।আর তুমি শুধু একটা বাচ্চার জন্য আমাকে এ বাড়ি থেকে সরিয়ে দিলে!”

শরীফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে,তার পাশেই শয়তানি হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার শ্বাশুড়ি।হঠাৎ আমার শ্বশুর মশাই বলে উঠলেন,,,

“শরীফ যে তোমাকে বৃহত্তর কোন স্বার্থে এ বাড়ি থেকে সরিয়েছে সেটা তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।আর আমার মতে বাচ্চা না হওয়াটা কোন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি নয়,ভালবাসাটাই একটা সম্পর্কের মূল বিটা।যদি ভালবাসার কোন দাম না থাকত তবে পৃথিবীতে এত সংসার ভেঙ্গে যেত না বাচ্চা থাকা স্বত্বেও।”

“তুমি চুপ করো ত,এত জ্ঞান দিতে কে বলেছে তোমাকে?অপয়াটা বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে এতেই শুক্কুর আলহামদুলিল্লাহ।” (শরীফের মা)

“মা,সাদিয়াকে একদম অপয়া বলবে না।সাদিয়া অপয়া নয়।আর সাদিয়া এ বাড়ি থেকে কোথাও যাবে না।” (সজীব)

“অপয়াকে অপয়া বলব না ত কী বলব?এই মেয়ে এই সংসারে আসার পর থেকে একটা না একটা দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।আমার ছেলেটা বাবার সুখ পাবে না,ত এমন মেয়েকে কেন আমি আমার বাড়িতে রাখব?”

“মা একদম চুপ করো,এতক্ষণ তুমি অনেক কথা বলেছো কিন্তু আর মানতে পারছি না।অপয়া যদি কেউ হয়ে থাকে তবে সেটা তুমি!”(শরীফ)

শরীফের কথা শুনে সবাই অবাক,মাকে কেউ এভাবে বলে।শরীফের মার চোখে পানি টলমল করছে কিন্তু শরীফ সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠল,,,

” এতক্ষণ ভেবেছি চুপ করে থাকব,আমি মুখ খুললে আমার মায়ের ক্ষতি।কিন্তু তুমি ত মা না একটা রাক্ষসী যে নিজের ছেলের বাবা হওয়ার সুখ কেড়ে নিয়েছো।একটা মা হয়ে আরেকটা মেয়ের মা হওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছো।”

“তুমি এসব কী বলছো আমার মা হওয়ার ক্ষমতা তোমার মা কেড়ে নিয়েছে মানে কী?”

“হে হে তোমার মা হওয়ার ক্ষমতা আমার মা নষ্ট করে দিয়েছে।আর তোমাকেও জানে মেরে ফেলতে চেয়েছে।আমি সবটা জানতে পারি যখন আমার মা আর চাচি মিলে তোমাকে ঐ বন্ধ ঘরে বন্ধি রেখেছিল তখন।তোমাকে মেরে ফেলার যড়যন্ত্র করছিল তারা,আমি ওদের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সবটা শুনতে পাই।যে আমার মা আর চাচি মিলে তোমার মা হওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে।তাই সেদিন রাতে তোমাকে আমি এ বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলি তোমার গাড়ে ইনজেকশন পুস করে।আর তোমাকে হসপিটালে রেখে আসি,তোমার মাকে সবটা জানাই যাতে উনি তোমাকে নিজের কাছে রাখতে পারে।কারন তুমি তোমার বাবার বাড়িতেই সেফ থাকবে।এখন হয়ত তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে আমি হসপিটালে না রেখে তোমাকে তোমার বাড়িতেই ত পৌঁছে দিতে পারতাম কিন্তু সেটা কেন করি নি?তার পিছনের কারন হল তোমার বাবা,কারন তোমার বাবা আমার সাথে তোমাকে দেখে ফেললে কখনও মেনে নিত না।আর তোমাকে সেফলি রাখতেও পারতাম না।তাই আমি তোমার মার সাথে যোগাযোগ করে তোমাকে হসপিটালে রেখে আসি।আর তোমার সমস্ত খবর তোমার মার থেকে নিতাম আমি।”

শরীফ কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল কিন্তু তারপরও শরীফ নিজেকে শক্ত রেখে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে থামে।সবার চোখে রাগ+পানি,কারন কোন মা যে এতটা নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে জানা ছিল না।শরীফ আবারও বলে উঠে,,,

“আমার মা আমার ভালো না চাইতেই পারে কিন্তু আমি আমার মাকে ভালবাসি।তাই মাকে কিছু বলব না আমি,আমার ভালবাসাকে মা মেনে নিতে পারে নি।তাই আমি আমার ভালবাসার মানুষটার হাত ধরে আজ এক বছর পর আবারও চলে যাব।মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এতদিন কিছু বলতে পারি নি কিন্তু আজ আর পারছি না,চলো আমার সাথে।”

কথাটা বলেই শরীফ আর কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে আমার হাত ধরে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে সেদিন কেউ আমাদের থামাতে পারে নি।

ছয় মাস পর,,,

জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছি আমি,দৃষ্টি আমার বাইরে খেলা করা কয়েকজন বাচ্চার উপরে।তখন শরীফ আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলে উঠল,,,

“আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা কী ভুল কোন সিদ্ধান্ত?”

“একদমই নয়,এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।আমি মা হতে পারব না,আর তুমিও বাবা হতে পারবে না।আর এখানের বাচ্চা গুলোরও কোন বাবা মা নেই।এখান থেকে যদি একটা বাচ্চাকে মা-বাবার স্নেহ,ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারি তবে আল্লাহ তায়া’লা আমাদের উপর খুশিই হবে।”

আমার কথাশুনে শরীফ আমাকে তার বুকে আগলে ধরে।সেদিন আমরা বেরিয়ে আসার পর আর কারো সাথে কোন যোগাযোগ করি নি।শরীফকেও ক্ষমা করে দিয়েছি আমি,কারন শরীফ যা করেছে সেটা ত ভুল কিছু করে নি।যা করেছে সবটা আমার ভালোর জন্যই করেছে।আর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা বাচ্চা দত্তক নিব।আমার সংসারটা সোনার সংসারে পরিনত করব নতুন করে।

আমার মা হওয়ার ক্ষমতা হয়ত নষ্ট করা হয়েছে কিন্তু এমন হাজারও মেয়ে আছে যারা মা হতে পারে না বলে তাদের সোনার সংসার ভেঙ্গে যায়।তারা তখন কিছু করতে পারে না কারন তারা তাদের স্বামীকে সন্তান সুখ দিতে পারবে না বলে নিজেকে সরিয়ে ফেলে চুপচাপ।
এই একই সমস্যা যখন কোন পুরুষের হয় তখন এমন কিছুই হয় না।তখন মেয়েদের নানা ভাবে বুঝানো হয় তারা যাতে মানিয়ে নেয়।তেমনটা কী ছেলেরা মানিয়ে নিতে পারে না?
একটা মেয়ে যখন মা হতে পারবে না জেনে ডিপ্রেশনে ভুগে তখন কী তার স্বামীর কর্তব্য নয় তার পাশে থেকে তাকে সুস্থ করে তোলা,নাকি তার দায়িত্ব পিতৃ সুখ পাওয়ার জন্য আরেকটা বিয়ে করা?
বাচ্চা ত আল্লার দান জিনিস,আল্লা না চাইলে ত কিছু করার নেই।কিন্তু এই একই যুক্তি মেয়েদের ক্ষেত্রে কতভাগ খাটে যতটা ছেলেদের ক্ষেত্রে খাটে?
মেয়ের সমস্যা থাকলে আরেকটা বিয়ে করো সেই মেয়ে তোমাকে বাচ্চা দিবে।বিয়ে হয় কী শুধু বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্যই,যে বাচ্চা না হলে বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে?
মেয়েরা কী কোন বাজারে বিক্রি করা আলু,পেয়াজ,পটল,যতক্ষন এসব ভালো থাকবে ততক্ষণ দাম থাকবে আর নষ্ট হলেই ফেলে দিবে।তেমন কী বাচ্চা হলেই মেয়েটার দাম থাকবে,আর বাচ্চা জন্ম দিতে না পারলে নষ্ট জিনিস যেমন ফেলা দেয়া হয় তেমন ফেলে দিবে?অহরহ দেখতে পাচ্ছি মেয়ের মা হওয়ার ক্ষমতা না থাকলেই ডিভোর্স।আর ছেলের বাবা হওয়ার ক্ষমতা না থাকলে নানা রকম যুক্তি দেয়া হয়।সম্পর্কে বাচ্চা না হওয়াটা কোন সমস্যা না যদি সে সম্পর্কে ভালবাসার জায়গাটা খাটি আর শক্তপোক্ত হয়।বাচ্চা হওয়াটাই যদি সম্পর্ক মজবুত করার চাবিকাঠি হত তবে এত সংসার ভাঙ্গত না বাচ্চা থাকার পরও।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,সমাপ্ত,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

(একদম কাঁচা হাতের লেখা আমার,তাই সবটা গুছিয়ে লিখতে পারি নি,,,গল্পটা বাস্তব আর কল্পনা মিশ্রত।কিন্তু আমার যেটা মনে হয় সেটাই গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরলাম।জানিনা কতটা সফল হয়েছি,ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।যাই হোক সবাই ভালো থাকবেন,আর জানাবেন গল্পটা কেমন হয়েছে সবাইকে ধন্যবাদ আর অনেক অনেক ভালবাসা রইল।

আল্লাহ হাফেজ🥰)

সোনার সংসার পর্ব-১৫

0

সোনার সংসার
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#পর্বঃ১৫

বসন্ত প্রায় শেষের দিকে,এই বসন্ত কালে সকল গাছ নতুন সাজে সজ্জিত হয়।এই বসন্তটা খুব পছন্দের আমার,এমনই এক বসন্তের বিকালে শরীফের সাথে আমার দেখা হয়েছিল।কতই না সুন্দর ছিল সে দিনটা,হয়ত আজকের বিকালটাও সেদিনের মত সুন্দর হত কিন্তু কিছু বিষাদময় স্মৃতির জন্য সেটা সম্ভব হচ্ছে না।আশেপাশে কিছু মানুষ রূপি নিকৃষ্ট মানুষের জন্য আজকের দিনটা একটু বেশিই বিষাদময় লাগছে।ব্যালকনিতে বসে এসবই ভাবছি,কখন আমার পাশে সজীব ভাই আর ভাবি এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাই নি।আমাকে এভাবে ভাবতে দেখে ভাবি বলে উঠল,,,

“কী গো এত মন দিয়ে কী ভাবছো হুম?”

ভাবির কথায় আমার ধ্যান ভাঙ্গে,আমি তাকিয়ে দেখি ভাইয়া,আর স্বর্নাকে কোলে নিয়ে ভাবি দাড়িয়ে আছে।আমি বসা থেকে উঠে স্বর্নাকে নিজের কোলে নিয়ে একটা চুমু দিয়ে ভাবিকে বলে উঠলাম,,,

“কার কথা আর ভাবব বলো,তোমার ঐ খবিশ,হিটলার দেওরের কথাই ভাবছি।”

আমার কথা শুনে ভাবি হেঁসে ফেলল কিন্তু সজীব ভাইয়ার মুখে এখনও কোন হাসি নেই।আমি সেটা দেখে বড় ভাইয়াকে বলে উঠলাম,,,

“ভাইয়া আপনার কী মন খারাপ?”

“না বোন আমার মন খারাপ না,তোমাকে কিছু জানানোর ছিল তাই আসা।”

“জি ভাইয়া বলুন না কী বলতে চান!”

“তুমি প্লিজ কথাগুলো মন,মস্তিষ্ক দুটো দিয়েই বিবেচনা করো,হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিও না তুমি।”

“ভাইয়া আপনি এভাবে কেন বলছেন?খারাপ কিছু কী হয়েছে?”

“তুমি কথাটা শুনলেই বুঝতে পারবে।কারন তোমাকে সবটা জানালে তোমার সামনে এগোতে আরো সুবিধা হবে।”(ভাবি)

” ভাইয়া প্লিজ কথাটা বলুন,আপনারা যেভাবে বলছেন তাতে আমার জানার আগ্রহটা বেড়েই চলেছে।প্লিজ বলুন কী হয়েছে,এভাবে না বলে সবটা খুলে বলুন আমাকে।”

“তোমার কী মনে প্রশ্ন জাগে না সেদিনের কথা,যেদিন রাতে শরীফের বিয়ে ছিল আর সেই রাতে তোমার সাথে কী হয়েছে?আর তুমি হসপিটালে কীভাবে পৌঁছালে!”

সজীব ভাইয়ার কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে বোকাদের তালিকায় ফেলতে ইচ্ছে করল।এই কথাটা আমার মাথা থেকে একদম বেরিয়েই গিয়েছিল,সেদিন শরীফ আমার রুমে এসেছিল তারপর কী হয়েছিল?আর আমি হসপিটালে কীভাবে পৌঁছালাম,আর মা-বাবাও কীভাবে খবর পেলো আমি হসপিটালে।তবে কী সেদিন শরীফই সবটা করেছে?এত বড় একটা কথা কীভাবে আমার মনে হয় নি।আমাকে গভীর চিন্তায় মত্ত দেখে সজীব ভাইয়া আবারও বলে উঠল,,,

“নিজেকে এত প্রেশার দিও না,আমি বলছি তোমাকে সেদিন কী হয়েছিল আর কীভাবে তুমি হসপিটালে পৌঁছালে?”

সজীব ভাইয়ার কথা শুনে আমি ভাইয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলে ভাইয়া বলে উঠে,,,

“সেদিন রাতে শরীফ তোমাকে সবার আড়ালে সরিয়ে ফেলেছিল এ বাড়ি থেকে।আর হসপিটালে ভর্তি করিয়ে তোমার মাকে খবর শরীফই দিয়েছিল।”

ভাইয়ার কথা শুনে আমি একটুও অবাক হই নি কারন ঘটনাটা এমনই যে এমনটা ঘটতে পারে তা একটু খুঁটিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে।তাই আমি হালকা হেঁসে বললাম,,,

“এই কথা,আমি ভাবলাম কী না কী!”

“সাদিয়া আমার কথা কিন্তু এখনও শেষ হয় নি,এখনও আসল কথাটাই শোন নি তুমি।”

“আসল কথা মানে?”

“আসল কথা এটাই হল যে তোমার মা শরীফকে সাহায্য করেছে তোমাকে তোমার বাবার বাড়িতে পাঠাতে।”

ভাইয়ার কথায় ৪২০ ভোল্টেজ শক খেলাম,মা সাহায্য করেছে মানে কী?

“মা সাহায্য করেছে মানে কী বলছেন এসব।মা বাবার সাথে ত তখন আমারই কোন যোগাযোগ ছিল না তবে শরীফ কীভাবে কী করল?”

“যোগাযোগ ছিল না বলে যে যোগাযোগ করা যাবে না সেটা কিন্তু নয়।সেদিন আমি তোমাকে আর হৃদয় কে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তোমার ভাবিকে হসপিটাল থেকে আনতে গিয়েছিলাম সেদিনই আমি সবটা জানতে পারি কারন সেখানে আমার এক বন্ধু ডাক্তার,অর কাছেই আমি এসব জানতে পারি।আমি আর কিছু জানি না,এখন সমস্ত সত্যিটা বের করার দায়িত্ব তোমার।যাই করো একটু ভেবে চিন্তা করে করো।”

ভাইয়ার কথায় মাথার মধ্যে সব গন্ডগোল লেগে যাচ্ছে,এত রহস্য রাখছে না ইচ্ছে করতাছে লেখিকাকে পিডাইতে😤।

________________________________

ঘরের মধ্যে পাইচারি করে চলেছি অনবরত,মাথা কাজ করছে না একদমই।কীভাবে আমি সমস্ত রহস্য ভেদ করব?এসব ভাবছি তখন চোখ পড়ে পানির বোতলের দিকে,সেটা দেখে মাথায় শয়তানি বুদ্ধিরা ভর করে।আমি একটা শয়তানি হাসি দিয়ে নাচতে নাচতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

শরীফ অফিস থেকে ফিরে এসে রুমে গিয়ে দেখে ঘরে সাদিয়া নেই।সেটা দেখে শরীফ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল,এই মেয়েটা এখন আশেপাশে থাকা মানেই পুরা কাল বৈশাখী ঝড় তুলে ছাড়বে।কিন্তু শরীফকে ভুল প্রমানিত করে সাদিয়া হুট করে শরীফের সামনে চলে আসে,শরীফ ছিটকে কিছুটা দূরে চলে যায়।আর সাদিয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠে,শরীফ নিজেকে সামলে সাদিয়ার দিকে তাকায়।অনেকদিন পর সাদিয়াকে এভাবে হাসতে দেখল,বুকের ভিতর যেন প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।সাদিয়া হাসতে হাসতেই বলে উঠে,,,

“কী ভেবেছেন জনাব,আমি ঘরে নেই আর আপনাকে জ্বালানোর মত মেয়েটা নেই তাই না।এত সহজে ছাড়ছি না আপনাকে।”

বলেই আবার খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে সাদিয়া,শরীফ এবার রেগে বলে উঠল,,,

“আবারো ফাজলামো করছো আমার সাথে!কাল থেকে অফিসেই থাকব আর বাড়িতে ফিরব না।বাড়িতে ফিরলেই শুরু হয়ে যায় ভাঙ্গা টেপ রেকর্ডার।”

“সে তুমি যাই বলো,আমার কোন সমস্যা নেই।তোমাকে জ্বালানোর জন্য অফিসে পৌঁছাতেও আমার দুই মিনিট লাগবে না।এখন নাও ত এই শরবতটা খেয়ে ফেলো,তবে আজ রাতে আর তোমাকে জ্বালাব না।”

শরীফ সন্দেহ করে তাকায় সাদিয়ার দিকে,কিন্তু পরক্ষণে শরীফ কিছু একটা ভেবে সাদিয়ার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রেখে সাদিয়াকে টেনে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।সাদিয়া রাগে ফুঁসছে,,,

“ধন্যবাদ এত সুন্দর ওফার দেয়ার জন্য,আজ সারারাত নিশ্চিন্তে ঘুমাব।আর শরবতে যে গন্ডগোল করেছো সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার।”

সাদিয়া শরীফের কথা শুনে পুরো অবাক,,,

“বেটায় বুঝল কেমনে?দেৎ একটা কাজও ঠিকঠাক করতে পারি না।এখন এই বজ্জাত বেটার পেট থেকে কথা কীভাবে বের করব।আর আমি রাতে থাকব কোথায়,ভাল্লাগেনা।”

#চলবে…

(রিচেক করি নি,ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

সোনার সংসার পর্ব-১৪

0

#সোনার সংসার
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#পর্বঃ১৪

শরীফ আমার ফোন হাতে নিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে আপেল চিবুচ্ছি।আমাকে কিছু বলতে না দেখে শরীফ ফোনটা আছার মেরে দুই টুকরো করে ফেলল।আমি চমকে শরীফের দিকে তাকাই,আর অস্থির হয়ে বলে উঠি,,,

“হায় হায় আমার কলিজাটা ভেঙ্গে দুই টুকরা হইয়া গেলো গো।এখন আমি কেমনে বাচমু গো,ও খোদা গো আমার এত বড় সর্বনাশ কেন করলা গো।”

বলেই ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলাম,আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে শরীফ তার রাগ ভুলে আমার কাছে এসে বলে উঠল,,,

“কলিজা ভেঙ্গে গেছে মানে?কী বলছো এসব তুমি!তোমার শরীর খারাপ লাগছে নাকী?আর বাঁচবে না মানে কেমন কথা এটা।তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো,আর নয়ত চলো এখনই ডাক্তার দেখাব তোমাকে।”

কথাটা বলে শরীফ আমার হাতটা ধরে টান দিলে আমি হাত ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছে ফ্লোর থেকে ফোনটা তুলে শরীফকে যাওয়ার জন্য ইশারা করলাম।শরীফ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।তারপরই সন্দেহ নিয়ে বলে উঠল,,,

“তুমি হসপিটালে যাবে কিন্তু এই ভাঙ্গা ফোনটা সাথে কেন নিলে?তুমি কোন ভাবে আমাকে বোকা বানাও নি ত?”

“আজিব ত বোকা কেন বানাব?আর ফোনটা সাথে না নিলে ডাক্তার দেখাব কী করে?”

“ফোনের সাথে তোমার ডাক্তার দেখানোর কী সম্পর্ক?”

“ফোনকেই ত ডাক্তার দেখাব😊।”

“মানেহ😤!”

“মানেটা ত খুব সহজ,আমার কলিজাটা ভেঙ্গে গেছে আর তুমিই ত বললা ডাক্তার দেখাবে।তাই ত ফোনটা নিলাম ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য।ফোনটা না নিলে ডাক্তার দেখাব কাকে?”

“সদিয়য়য়য়য়য়য়া👿”

আমি শরীফের ধমকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম,তখন আবার শরীফ রেগে বলে উঠল,,,

“ফোনকে কলিজা বলে আমাকে বোকা বানানো,দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা তোমাকে।দুইদিন ধরে খালি দেখছি তোমাকে,কিছু বলছি না বলে ফাইজলামির সীমা দিন দিন বেরেই চলেছে।”

“এক মিনিট,এক মিনিট ব্রেক মারো,নয়ত এক্সিডেন্ট করবে।আর আমার কথা শোন কান,নাক,চোখ সব খুলে নয়ত আবারও ব্লাস্ট হবে রাগে।আমি কোন ফাইজলামি করতাছি না।ফোন আমার কলিজা তাই কলিজা বলেছি।কারন নিজে পড়ে গেলে ততটা কষ্ট লাগে না যতটা না আমার ফোন পড়ে গেলে কষ্ট লাগে।একদম কলিজায় গিয়ে লাগে,আর সেখানে ত তুমি আমার ফোনটা দুই টুকরা করে ফেললে।আমার কলিজা ত ভেঙ্গেই গেছে,এখন যদি তুমি সেটা না বুঝো তবে ত তুমি বোকাই,শুধু বোকা না তার সাথে ডাবল বোকা হবে।”

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথাটা বললাম,তারপর শরীফের দিকে তাকিয়ে দেখি বেটা আরো চেতছে🤭।শরীফ এবার আর কিছু না বলে আমাকে টেনে হিছড়ে ছাদে নিয়ে এলো,আর এনেই ছাদের একদম কিনারায় নিয়ে দাড় করাল।এমন ভাবে দাড় করাল যে শরীফ আমার হাতটা ছেড়ে দিলেই পড়ে যাব।আমি শরীফের হাতটা শক্ত করে আকড়ে ধরলাম,সেটা দেখে শরীফ রেগে বলে উঠল,,,

“ছাড়ো আমাকে একদম ধরবে না,এখনই তোমাকে এখান থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলব।ফাজলামি করো আমার সাথে হে!”

“আল্লা গো আল্লা কী কও এইসব আমাকে মেরে ফেললে ত তুমি বিধবা হয়ে যাবে।প্লিজ তোমার এত বড় ক্ষতি কইরো না,তোমার সাথে সাথে ত তোমার হবু পোলাপানও এতিম হয়ে যাইব।আমি আর ফাজলামো করব না এবারের মত ছেড়ে দেও।”

“এই মাইয়া এত কথা কেমনে শিখল খোদা?আমাকে পাগল করে ছাড়বে একদম,ফেলে ত দিব না কিন্তু রাগ না হলে,ভয় না দেখালে কাজের কাজ কিছু হবে না।আর এই মাইয়াও চুপ করবে না।আমার কানের তেরোটা বাজাইয়া ছাড়ব।” (মনে মনে শরীফ বলল)

“ছাড়ব তবে একটা শর্ত আছে,রাজি থাকলে বলো নয়ত ধাক্কা দিয়ে সত্যি সত্যি ফেলে দিব।”

“আল্লা না না এমন কইরো না আমি রাজি সব শর্তে রাজি।কিন্তু তার আগে আমাকে এখান থেকে উঠাও প্লিজ।”

“এখন আমি যা জানতে চাইব সবটা বলবা কোন ফাজলামো না করে আর যা বলব সব মেনে নিবা ঠিক আছে।”

“আগে ত এখান থেকে উঠি তারপর তোরে কেমনে টাইড দিতে হয় আমার ভালো করেই জানা আছে।”

মনে মনে কথাটা বলে তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে উওর দিলাম সব মানব।শরীফ আমাকে আর কিছু না বলে সরে এসে আমাকে ছাদের মাঝখানে নিয়ে এলো।আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম,তখন শরীফ তার হাত গুজে বলে উঠল,,,

“ছেলেটা কে যার সাথে ফোনে কথা বলছিলে তখন?”

“ওটা ত আমার ফ্রেন্ড।”

“ছেলের সাথে কীসের বন্ধুত্ত,আর বন্ধুকে মিস ইউ বলার কী মানে?”

“আরে ছেলে মেয়ের সমান অধিকার কথাটা কী জানো না তুমি?ছেলে মেয়ে সবাই বন্ধু হতে পারে এটাও ত একটা অধিকার তাই না।আর বন্ধুত্ত করতে পারব বন্ধুকে মিস করলে মিস ইউ বলতে পারব না নাকি?”

মজা করতে গিয়ে কী থেকে কী বলতাছি নিজেও জানি না,শুধু জানি এই রাক্ষসটার হাত থেকে বাঁচতে হবে।

“না পারবে না,আজ থেকে ছেলেদের সাথে কথা বলা যাবে না,কোন ছেলে ফ্রেন্ড থাকবে না আজ থেকে।”

“এহহ বললেই হল থাকবে না।থাকবে ছেলে বন্ধু একটা কেন হাজারটা থাকবে তাতে তোমার কী?তোমার কী জ্বলে,হিংসা লাগে নাকি গো?”

“চুপ একদম চুপ,আর একটা কথা বলবা ত খুব খারাপ হয়ে যাবে।যেটা বলেছি সেটা করবা খালি বেশি কথা।”

“তুই চুপ কর,শালা খাটাশ,খবিশ,হিটলার কোথাকার।তুই অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারবি,তোর মেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড থাকতে পারবে আর আমার ছেলে ফ্রেন্ড বানাতে পারব না।তোর কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে।”

শরীফ আমার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে আছে,শরীফ ভাবতেই পারে নি আমি এভাবে বলব।আমি উত্তেজিত হয়ে এতগুলো কথা বলে এখন ভাবছি কী বলে ফেললাম এসব।তাই চুপচাপ কিছু না বলে কেটে পড়লাম।আজ হাওয়া গরম আজ আর সামনে যাওয়া যাবে না,তাই আমি টাটা বায় বায় হয়ে যাই।
কিন্তু ফোনটা ভেঙ্গে ফেলছে সেটা ভেবেই ভিতরটা কেঁপে উঠল গো,তখন কোন দুঃখে যে বজ্জাতটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আলামিনের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে গেলাম।যার ফল আমার ফোন এখন নিশ্চিন্তে ঘুমিং,আমি এখন ফোন মিস করিং😭।

____________________________________

সাদিয়ার বাবা তার ভাই আশরাফুলের কাছে ফোন দেয়।সেটা দেখে আশরাফুল ইসলাম কিছুটা গাবড়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে ফোনটা তুলে আর বলে উঠে,,,

“কেমন আছো ভাইয়া?”

“ভাইয়ের খবর রাখিস তুই,বাতিজীকে পেয়ে ত ভাইকে ভুলেই গেছিস।আমার মেয়েটাও হয়েছে তেমন চাচ্চুকে পেয়ে মা,বাবা,ভাইদেরকেও ভুলে গেছে।”

“ভাইয়া যে কী বলো ভুলব কেন?একটু বিজি ছিলাম তাই খবর নিতে পারি নি।”

“আচ্ছা সেটা না হয় বুঝলাম এখন আমার মেয়েটাকে একটু দে ত আরাফাত,ফরহাদ কথা বলবে।”

“আআসলে ভাইয়া সাদিয়া ত একটু বাইরে গেছে,ও আসলে কথা বলিয়ে দিব নে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে,এখন রাখি তবে।”

“আচ্ছা ভাইয়া।”

ফোনটা রেখে আশরাফুল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর বিড়বিড় করে বলে উঠে,,,

“কতদিন যে এভাবে মিথ্যা বলে চলতে হবে,কবে এই সব লুকোচুরি শেষ হবে।”

কথাটা বলেই তিনি সাদিয়ার নাম্বারে কল দেয়।সাদিয়া ফোন ধরছে না তাই একটা ম্যাসেজ করে দেয় যাতে সাদিয়া ফোন হাতে পেলেই উনাকে কল বেক করে।

#চলবে,,,,

সোনার সংসার পর্ব-১৩

0

#সোনার সংসার
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#পর্বঃ১৩

রাতে ডিনার করার জন্য নিচে এসে দেখি সবাই খেতে বসে গেছে,বড় ভাবি খাবার সার্ভ করছে।সবাই আছে কিন্তু আমার হিটলার জামাইটা নাই।আমি কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে আামর শ্বাশুড়ি আম্মার পাশে বসে পড়লাম।আমাকে দেখে আমার শ্বশুর,চাচা শ্বশুর,ছোট দেওর অমিত,আর নিলুফা আপু সবাই যেন ভূত দেখার মত অবাক হয়েছে।কিন্তু অরা সবাই খুব খুশিই হয়েছে আমাকে ফিরে আসতে দেখে,সেটা সবার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছি।কিন্তু শ্বাশুড়ি আম্মার ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।আমি কাউকে কিছু না বলে আমার শ্বাশুড়ি আম্মা আর চাচি শ্বাশুড়ির দিকে তাকালাম।কীভাবে রাগে ফুঁসছে, ভেবেছে আগের মত সব কাজ করে মুখের সামনে খাবার রাখব।এভাবে যে খাওয়ার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ব সেটা বুঝতে পারে নি।আমার বেশ মজাই লাগছে ওদের এমন চেহারা দেখে।হঠাৎ আমার চাচি শ্বাশুড়ি বলে উঠল,,,

“বাড়ির বউ হয়ে কীভাবে বসে আছে দেখো!লজ্জা সরম বলতে কিছু নেই এই মেয়ের।”

“Same too you.”

আমার এমন কথা শুনে সবার চোখ বের হওয়ার উপক্রম।আমার শ্বাশুড়ি আম্মু রেগে বলে উঠল,,,

“এই মেয়ে তুমি ছোটর সাথে কীভাবে কথা বলছো হে!”

“আপনাকে বলি নি বলে কী আপনার খারাপ লাগছে শ্বাশুড়ি আম্মা,,,ডোন্ট মাইন্ড আপনাকেও বলছি,আপনারাও ত বাড়ির বউ আপনারা কীভাবে চুপচাপ বসে খাচ্ছেন?এবার নিশ্চয়ই ঠিক আছে তাই না শ্বাশুড়ি আম্মু!”

আমি খাবার বেরে নিজের প্লেটে নিতে নিতে কথাটা বললাম,আমার কথায় শ্বশুর আব্বা আর অমিত ফিক করে হেঁসে ফেলল।শ্বাশুড়ি আম্মা কটমট চোখে শ্বশুর আব্বার দিকে তাকাতেই উনি চুপ করে গেলেন।এবার শ্বাশুড়ি আম্মা আমাকে রেগে বলে উঠল,,,

“তোমার মত মেয়ে আমার জীবনে দেখি নি।এমন নির্লজ্জ না হলে কীভাবে এত কিছুর পরও কোন দ্বিধা ছাড়া সবার সাথে খেতে বসেছে দেখো।আমি হলে জীবনেও পারতাম না।”

“আমি ত আপনি না,আর না আপনি আমি।”

“সাদিয়া চুপ করে খাও,কিছু বলো না।” (নিলুফা আপু)

“আমি ত চুপ করেই ছিলাম আপু,কিন্তু তোমার মা আর জেঠিমা ত চুপ থাকতে দিচ্ছে না।ননস্টপ ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়েই চলেছে,এক পা কবরে চলে গেছে তারপরও বুড়িদের তেজ কমছে না।”

“এই মেয়ে মুখ সাম,,,

আর কিছু বলতে পারল না আমার শ্বাশুড়ি আম্মা তার আগেই মুখে একটা আস্ত ডিম দিয়ে দিয়েছি।ডিমটা মুখে নিয়েই উনি আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।আমি মুচকি হেঁসে উনার কয়টা পিক তুলে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আমার খাবারটা নিয়ে উপরে চলে এলাম।আর ঐদিকে শ্বাশুড়ি আম্মা কী করছে নিশ্চয়ই জানেন?

_______________________________

সাদিয়ার কাহিনী এতক্ষণ উপর থেকে সবই শরীফ দেখেছে।আর মুচকি মুচকি হাসছে,সে কিছুটা নিশ্চিন্ত এখন সাদিয়াকে নিয়ে,যে সাদিয়া এখন আর আগের মত দুর্বল নেই।কিন্তু সাদিয়াকে উপরে আসতে দেখে শরীফ দৌড়ে রুমে চলে গেলো।

আমি খাবার নিয়ে রুমে ডুকে দেখি শরীফ ঘরে নেই।আশেপাশে তাকিয়ে দেখি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ।তাই কিছু না বলে খাবারটা বেডে রেখে তার পাশেই আমি পা ঝুলিয়ে বসে পরলাম।উদ্দেশ্য হল শরীফ আসলে একসাথে খাব।আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শরীফ আসল,আমি সেটা দেখে মুচকি হাসলাম।শরীফ আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে বারান্দায় চলে যাচ্ছিল আমি দৌড়ে শরীফের টিশার্টের কলার পিছন থেকে ধরে টানছি।সেটা দেখে শরীফ রেগে বলে উঠল,,,

“What is this?কী করছো এসব,ছাড়ো আমাকে।”

“ভাবটা কম লও,আর বসো খাব আমি।”

“আমি খাব না,ছাড়ো আমাকে।”

আমি শরীফকে এবার বিছানায় বসিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে বললাম,,,

“জানি আমনে যে খাইতেন না,আর আমি ত আমনেরে কইও নাই যে খান কিংবা আপনি না খেলে আমি খাব না।”

আমার কথায় শরীফ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো,আমি সেটা দেখে শরীফের আড়ালে মুচকি হাসলাম।তারপর শরীফের কোলে বসে পড়লাম আর খাবারের প্লেটটা শরীফের হাতে দিয়ে বললাম,,,

“খাইয়ে দেও আমাকে।”

আমার কাজে আর কথায় শরীফ খুব অবাক হয়েছে সেটা অর ফেস দেখেই বুঝা যাচ্ছে।শরীফ অবাক হয়েই বলে উঠল,,,

“মানেহ কী?”

“মানে হল তুমি আমাকে খাইয়ে দিবা।নিজের হাতে খাইতে আলসেমি লাগতাছে🥱।”

“নামো আমার কোল থেকে,আর আমাকে কী তোমার নিজের মাইনে করা চাকর মনে হচ্ছে যে যা বলবে তাই করব।”

“জি নট,তোমাকে আমার মাইনে করা চাকর ভাবতে বয়েই গেছে।তুমি ত আমার কাগজে,কলমে সই করা
পার্মানেন্টলি হাব্বি।”

কথাটা বলে শরীফের গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে দিলাম।শরীফ সেটা দেখে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে।

“এসব অবাক হওয়ার হলে আমাকে খাইয়ে দিয়ে অবাক হইয়ো তখন বাঁধা দিব না।এখন চুপচাপ আমাকে খাইয়ে দেও নয়ত খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

“এই মেয়েটা কী শুরু করল আল্লাহ,এমন করলে ত আমি অর উপর একদম রাগ করে থাকার অভিনয় করতে পারব না।কিন্তু আমার ত এখন নরম হলে চলবে না,আমার এখন যতটা সম্ভব সাদিয়ার সাথে খারাপ আচরন করতে হবে।যাতে এখান থেকে চলে যায়,নয়ত সাদিয়ার বিপদ।” (শরীফ মনে মনে)

শরীফ মনে মনে এসব বলে সাদিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে শক্ত গলায় বলে উঠল,,,

“কী ভেবেছো তুমি নিজেকে?তুমি যা বলবে আমি তাই করব,যদি এমনটা ভেবেই থাকো তবে ভুল ভাবছো।এ বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে এখন আবার ফিরে এসে নাটক করছো।”

আমি ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে গিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলাম।কারন এই কান্নাই আমার হাতিয়ার শরীফকে দিয়ে কাজটা করানোর ভেবেই কান্নার আওয়াজটা বাড়িয়ে দিলাম,আমার কান্না দেখে শরীফ হকচকিয়ে গিয়ে আমার কাছে ছুটে এসে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,,,

“কোথায় লেগেছে তোমার,বলো আমাকে।দেখি কোথায় ব্যাথা পেয়েছো।”

“হাঁটুতে ব্যাথা পেয়েছি।”

বলেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলাম।আমার কথা শুনে শরীফ আবারও বলে উঠল,,,

“তুমি একটু বসো আমি আসছি,এক্ষুনি ব্যাথা সেরে যাবে।”

“না তুমি যাবে না,আর ব্যাথা কমানোর জন্য কোথাও যেতে হবে না।আমাকে তুমি খাইয়ে দিলেই ব্যাথা কমে যাবে।”

আমার কথা শুনে শরীফ চোখ কটমট করে তাকাল,আমি ইনোসেন্ট ফেস করে শরীফের দিকে তাকালাম।তারপর আমাকে কিছু না বলেই শরীফ আমাকে কোলে করে বিছানায় বসিয়ে দিল,আমি শুধু ভাবার চেষ্টা করছি কী করতে চাইছে।তারপর হঠাৎ ইয়া বড় একটা ভাতের ধলা মুখে পুরে দিলো।সব রাগ এই ভাত আমার মুখে দিয়ে শোধ করল বজ্জাতটা।অনেক কষ্টে ভাতের ধলাটা শেষ করলাম তারপর যেই না মুখে পানি দিব তখন শরীফ আমার মুখ চেপে ধরে আবারও বড় ভাতের ধলা মুখে দিয়ে দিলো।আমার এবার সত্যি কান্না করার মত অবস্থা হয়েছে।

#চলবে..