Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1524



এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১৬

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬

সাদ বেশ বাড়াবাড়ি করতে লাগলো। সবকিছু যেন কতোই সহজ। নিজের যখন যা মনে চাইবে তখন ঠিক সেটাই পেতে হবে এমন একটা ভাব।

সালমা বেগম আর রমজান সাহেব মেয়ের কষ্ট আর নিতে পারলেন না। সালমা বেগম বরাবরই সরল-সোজা, নরম প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু এবার তিনিও আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। সাদকে ওনি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখেছে। এর আগে শোভার কলেজের একটা ফাংশানে দেখেছিলেন। ওনাকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো সাদ। মনে মনে ছেলের আদব-কায়দা দেখে সেদিন ওনি খুব পুলকিত হয়েছিলেন। মনে মনে নিজের মেয়ের জন্য এমন সুন্দর-সুদর্শন, ভদ্র, সরকারি চাকুরীওয়ালা ছেলেই চাইছিলেন। কতশত বিয়ের প্রস্তাব আসতো শোভার জন্য। প্রবাসী, ব্যবসায়ী এমন অনেক প্রস্তাব আসতো। সালমা বেগম আর রমজান সাহেব চাইছিলেন না প্রবাসী বা ব্যবসায়ীদের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে। কারণ এই দুটো পেশায় অনেক রিস্ক, যেকোনো সময় লস হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে ওনার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিলো সাদ। কারণ মানুষের বাইরের চেহারাটা আসল নয়, সৌন্দর্য ক্ষণিকের। ভেতরের মানুষটা কেমন সেটাই দেখার বিষয়। যাইহোক, সালমা বেগম এসে সাদের গালে চড় বসিয়ে দিলেন।বললেন,

‘ তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন তোমাকে আমার খুবই ভালো লেগেছিলো। তবে আমি ভুল ছিলাম। তোমার এসব কান্ডকীর্তি দেখার পর মেয়ের মতো আমারও পুরুষ মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। জানো, তোমাদের মতো কিছু পুরুষ আর টিনার মতো কিছু নারীর জন্য এদেশে ভালো নারী-পুরুষেরও কদর নেই। যদিও টিনাকে আমি দেখিনি। কিন্তু এবার এসব বন্ধ করো আর আমার মেয়ের জীবন থেকে চিরতরে চলে যাও আর আমাদের নাতি-নাতনির কাছ থেকেও!’

সাদ বলল,

‘ দেখুন, আপনি আমার মায়ের মতো। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না শুভিকে!’

‘ স্টপ মিস্টার সাদ চৌধুরী। আমার নাম আপনার মুখে শুনতে চাইনা, আমি আপনার শুভি নই। আপনার শুভি সেদিন মরে গিয়েছিলো যেদিন ওর সুসাইড এ্যাটেম্প করার নিউজ পাবার পরেও আপনি আসেননি!’

শোভার কথা শুনে সাদ বলল,

‘ আমি আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি।’

‘ পারবেন কীভাবে! আপনি তখন বর সেজে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন যে।’

‘ শোভা প্লিজ।’

‘ আমার মেয়েকে আর বিরক্ত করো না।’

‘ আন্টি আপনি একবার বললেই শোভা শুনবে।’

‘ কী শুনবে?’

‘ আমি শোভাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।’

সবাই বেশ অবাক হলো। মিলি বলল,

‘ আপনি কোথা থেকে নাটকের রিহার্সাল শিখেছেন? আপনার অভিনয় পাকাপোক্ত নয়, আগে ওটা ভালো করে শিখে আসুন।’

‘ আমি কোনো অভিনয় করছিনা।’

সাইফ শক্ত গলায় বলল,

‘ অবশ্যই এখানে আপনি নাটক করছেন। বিকজ আপনি যদি সত্যিই শোভাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসে থাকতেন তাহলে রাফুবাবাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাইতেন না।’

‘ আপনি চুপ করুন ডাক্তার। আপনার কথা কেউ শুনতে চায়নি। আপনার কোনো রাইট নেই আমাদের ব্যাপারে কথা বলার।’

শোভা হুংকার দিয়ে বলল,

‘ অবশ্যই ওনার হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইট আছে আমার, আমার ফ্যামিলি নিয়ে কথা বলার।’

সাদ রেগে বলল,

‘ কে হয় ওই লোকটা তোমার?’

‘ ওনি আমার ভাই হোন। আপনজন, প্রতিবেশী, প্রিয় মানুষগুলো আমার জন্য যা করেনি, ওনি আমাদের পাশে থেকে এতোদিন আমাদের জন্য অনেককিছুই করেছেন। হাজারবার জন্মগ্রহণ করলেও আপনি মিলি আর ওনার মতো হতে পারবেন না কখনোই!’

‘ তোমার তো আবার ভাই পাতানোর স্বভাব রয়েছে, তাইনা? কীভাবে পটালে তোমরা দুই বান্ধবী ওই ডাক্তারটাকে?’

‘ ইউ বাস্টার্ড! আই উইল কিল ইউ..!’

বলেই সাইফ সাদকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। এমন সময় সাইফের মা-বাবা এসে দেখলো একটা ছেলেকে সাইফ মারছে। ঘটনাটা মিলির মুখ থেকে শুনে ওনি সাদের উদ্দেশ্য বললেন,

‘ দুর্ভাগ্য তোমার মায়ের, যিনি তোমার মতো কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছেন। না জানি সেই বেচারি কত কষ্ট পেয়েছেন জীবনে। সাইফ বাবা ওকে ছেড়ে দাও।’

‘ কিন্তু আম্মু..!’

‘ মারামারি করে কোনো সমাধানে আসা যায়না!’

সাদ কিছু বললো না। যতোই চাচ্ছে মাথা ঠান্ডা রাখতে ততোই গরম হয়ে উঠছে। এই সাইফটাকে ও একদম সহ্য করতে পারেনা। শোভাদের সাথে সাইফের ভালো সম্পর্ককে ওর অনুর্বর মস্তিষ্ক বারবার খারাপ চিন্তার জন্ম দেয়। যদিও সাদ মনেপ্রাণে এগুলো অবিশ্বাস করতে চায়। আসলে যার নিজের ভেতরটাই অপরিষ্কার, তার চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হবেই বা কী করে! সে তো আশেপাশের সবাইকে নিজের মতোই ভাববে।

সাদ সাইফের মাকে ঠান্ডা গলায় বলল,

‘ আন্টি, আপনি বুঝদার ব্যক্তি। আপনি একটু বোঝান শোভাকে, আমি ওর সাথে কিছু বিষয় আলোচনা করতে চাই। একা কথা বলা প্রয়োজন আমাদের।’

শোভা চিল্লিয়ে বলল,

‘ আমি কোনো আলোচনা করতে চাইনা।’

সাইফের মা এগিয়ে এসে শোভাকে বললেন,

‘ যাও!’

‘ আন্টি!’

‘ এভাবে সিনক্রিয়েট না করে দুজনের মাঝে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে ফেলো।’

শোভা অবাক হয়ে বলল,

‘ আন্টি আপনি কী আমাকে ওনার সাথে সমঝোতা করতে বলছেন?’

সাইফের মা মুচকি হেসে বললো,

‘ না মা। এখানে দেখছোনা বাচ্চার সামনে কী বিশ্রি একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে? তার চেয়ে তুমি ঠান্ডা মাথায় সাদের সাথে কথা বলো, দেখো ও কীজন্য এসেছে। তারপর তুমি যা ডিসিশন নেবে সেটাই ফাইনাল।’

শোভা বুঝতে পেরে বললো,

‘ ঠিক আছে। কিন্তু ওনার কোনো অন্যায় আবদার আমি মানবোনা।’

‘ তুমি যা চাও তাই হবে, আমরা আছি তোমার পাশে।’

মায়ের কথায় সাইফ আর মিলিও একমত হলো। রমজান সাহেব শোভাকে বললেন,

‘ ওনি ঠিকই বলেছেন মা, তুমি যাও।’

সাদ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কোনোমতে বুঝিয়েটুঝিয়ে যদি ওদের সম্পর্ক ঠিক করা যায় তাহলে ভালোই। একা কথা বলার আরেকটা কারণ হলো, শোভা বড্ড বেশী আবেগী। এরকম আবেগী মেয়েরা সবসময় কারো মনে আশ্রয় আর একটু ভালোবাসা পেলেই খুশি।

তখন বৃষ্টি কমে গিয়েছে। বাসায় যেহেতু মেহমান আছে, যদিও ওরা এসব ঘটনা জানতে পারেনি কারণ সবাই ঘুমে মগ্ন। তাই শোভা ছাদে চলে এলো। সাদও এলো। রাফুও মায়ের সাথে এলো, মায়ের কোল থেকে নামছেনা, এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছে যেই লোকটা ওকে ধরে নিতে এসেছে সেই-ই ওর আর তুতুলের আব্বু। কিন্তু ওদের আব্বু এরকম চুরি করে ওদের নিয়ে যেতে এসেছে ভেবেই বাবার প্রতি রাফুর একটা বিদ্বেষ তৈরি হলো। তাছাড়া এতোক্ষণ যা যা ঘটছিলো সব ওর সামনে ঘটায় ওর মনে প্রচুর আঘাত পেয়েছে। কারণ ভেবেছিলো ওদের বাবা বুঝি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, কিন্তু না। শ্রেষ্ঠ বাবারা কখনো এরকম জঘন্য কাজ করতে পারেনা। তাই রাফু ঠিক করেছে আর কখনো বাবার কাছে যাবেনা, যেতে চাইবেওনা। তুতুলকেও যেতে দিবেনা এরকম খারাপ একটা মিথ্যুক লোকের সাথে।

ছাদে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো। বৃষ্টিতে ধুয়ে সেগুলো এখন সতেজ হয়ে বাতাসে দুলছে। যেন একটা নতুন জীবন লাভ করেছে। হাসনাহেনার সুবাসে ভুরভুর করছে পুরো ছাদ। অনেকদূর অবধি এই ঘ্রাণ পৌঁছাচ্ছে। রাতজাগা নিশাচর পাখিরা ডানা ঝাপটে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে৷ যতদূর দেখা যায়, ততদূর পর্যন্ত চেয়ে রইলো শোভা। রাতের চট্টগ্রাম খুবই মোহনীয় আর আকর্ষণীয় লাগছে। এতো সুন্দর হওয়ার ছিলো রাতটা? তাও আবার আজই? জীবন এলোমেলো হওয়ার দিনগুলো নাকি বড্ড ঘোলাটে আর বিশ্রি হয়? তাহলে শোভার বেলায় প্রকৃতি এতো সাজে কেন?

কোথায় যেনো পড়েছিলো, ‘তোমরা যেটা নিজের জন্য চাও, সেটা সবসময় তোমাদের জন্য কল্যাণকর না-ও হতে পারে। কিন্তু তোমার জন্য যেটা কল্যাণকর সেটা আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ঠিক সেটাই দেন।’

তাই হয়তো! শোভার জন্য যেটা কল্যাণকর সেটাই তো আল্লাহ তায়ালা করছেন। সাদের সাথে যে সারাজীবন থাকতে হয়নি এর চাইতে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? যে চলে যেতে চায়, তাকে যেতে দেওয়া উচিৎ। কারণ সৃষ্টিকর্তা তোমার জন্য আরো ভালো কিছু রেখেছেন। তাহলে শোভা কেন মনমরা হয়ে থাকবে? যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন! আর আল্লাহ তায়ালা যা নিয়ন্ত্রণ করেন সেটা কখনো অকল্যাণকর হতে পারেনা।

‘ কী বলবেন বলুন। এভাবে চুপ করে থাকার মানেটা
কী?’

‘ কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা।’

‘ হাস্যকর! আপনাকে আমার কাছে অসহ্য লাগছে।’

সাদ আচমকা শোভার হাত ধরে বলে উঠলো,

‘ শোভা আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

শোভার রাগ হলেও সেটা চেপে বললো,

‘ তারপর?’

‘ আমি তোমাকে চাই। আমাদের বাচ্চাদেরও চাই।’

‘ আর কিছু?’

‘ হুম। আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাই।’

‘ এতোদিনে?’

‘ জানি অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতোটাও দেরি হয়নি। চলো না, আমরা আবার এক হয়ে যাই। বাচ্চাদেরও তো বাবা প্রয়োজন।’

‘ তারপর?’

‘ আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।’

‘ কেন? আপনার ফ্যামিলির কী হবে?’

‘ আব্বু তো নেই। আম্মু আছেন, তোমার যদি তাতে কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আমি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবো।’

শোভার গা রি রি করতে লাগলো। ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে উঠলো। মানুষ কতোটা স্বার্থপর হতে পারে তা সাদকে না দেখলে বুঝতে পারতোনা। মাকে পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চায়।

সাদ বলল,

‘ শোভা আমি দুঃখিত। তোমাকে এভাবে অপমান করা আর কষ্ট দেওয়া আমার ইনটেশন ছিলোনা। কিন্তু তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিলো। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’

শোভা চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফু মায়ের কোলে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাবা নামক মানুষটাকে দেখছে আর অবাক হচ্ছে। তুতুলের সাথে এই লোকটার কতো মিল। রাফু মায়ের কোল থেকে নেমে গেলো। বললো,

‘ আসছি আম্মু, ওয়ান মিনিট!’

‘ কী করছো?’

‘ একটা জিনিস দেখাবো!’

‘ কাকে?’

জবাব পাওয়া গেলোনা। রাফু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। রাত প্রায় একটা বেজে বিশ। তুতুল ঘুমাচ্ছিলো। মেয়েটা বড্ড ঘুমাতে ভালোবাসে। রাফু বোনকে ডেকে তুললো। রাফুকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কী?’

‘ আমাদের বাবা এসেছে। তুই চল।’

তুতুল টাস্কি খেলো। নিমিষেই চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেলো। বলল,

‘ কোথায়? এতো রাতে এসেছে? সত্যিই?’

‘ হুম, চল!’

রাফু বোনকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলো। ছাদে এলো তুতুল। মাকে একটা লোকের পাশে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তুতুল রাফুকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ ওনি?’

‘ হুম। জানিস, আমাদের বাবা ভালো না! আমাকে মায়ের কাছ থেকে দূরে করে দেওয়ার জন্য চুরি করতে এসেছিলো। আমাকে মিথ্যা কথাও বলেছে। আম্মু ঠিকই বলতো। এই বাবাটার সাথে কিছুতেই থাকা উচিৎ নয়।’

সাদের চোখ যখন তুতুলের নিষ্পাপ মুখের ওপর পড়লো তখন বড্ড অবাক হয়ে গেলো। হুবহু তার চেহারা। শোভাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কে এই বাচ্চাটা?’

শোভা রাফুর সামনে মিথ্যে বলতে পারলোনা। বললো,

‘ আমার মেয়ে।’

সাদ চমকে বলল,

‘ মানে আমাদের? ওয়েট..টু ইন বেবি! মানে ও আমার মেয়ে! ওহ মাই গড!’

তুতুলকে কোলে তুলে নিয়ে অনেকগুলো চুমু খেলো সাদ। রাফুকেও কাছে টেনে নিলো। শোভার রাগ হলো প্রচন্ড। আদিক্ষেতা সব। আচ্ছা, এটা কী সত্যি হতেব পারতোনা? পারতো কিন্তু সাদ চায়নি। নিজের হাতে সবটা ধ্বংস করেছে ও। যার কোনো ক্ষমা হয়না।

নিজের বাচ্চাদের উপর সাদের আলাদা একটা মায়া এসে ভর করলো। বিশেষ করে তুতুলকে দেখে। নিজের অবয়ব যেনো আরেকটা। একে কোনোমতে ছাড়া যাবেনা। সাদ শোভাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কী ঠিক করলে? আমার কাছে প্লিজ ফিরে এসো।’

‘ আপনি জানেন আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।’

‘ শোভা প্লিজ, তুমি আমার জীবনে ফিরে এসো। আমি তোমার খুব খেয়াল রাখবো!’

সাদের এসব শোভার কাছে বড্ড অসহ্য লাগছে। তাই বলল,

‘ আমি ভেবেচিন্তে জানাবো। কাল সকালে। এখন আপনি আসুন!’

সাদ বলল,

‘ আচ্ছা। তবে আমি চাই উত্তরটা যেনো পজিটিভ হয়। আমি জানি তুমিও সেটাই চাও, কারণ একটা মেয়ে সারাজীবন দুটো বাচ্চা নিয়ে, তাও হাজব্যান্ড ছাড়া চলতে পারেনা!’

শোভা তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো শুধু। ভাবটা এমন যেনো ও শোভাকে দয়া করছে। ডিজগাস্টিং! সাদ রাফু-তুতুলকে খুব করে আদর করলো। দেখে মনে হচ্ছে ও-ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। শোভা জানে, এগুলো সাদের ভন্ডামি মাত্র। যখন যেটা দরকার সেটা হাতিয়ে নিতে চায়। যখন দেখলো ওর পাশে আর কেউ নেই, তখনোই সুড়সুড় করে শোভার কাছে চলে এলো। এখন আবার শোভা আর রাফু-তুতুলকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছে। বোকা, নিজেকে অতি চালাক ভাবাটাই মানুষের সবচেয়ে বড় বোকামি।

সাদ নিজের সাথে ঘটা সবকিছু খুলে বললো। নিজের কষ্টগুলো একটু বাড়িয়ে বাড়িয়েই বললো সাদ, যদি শোভা ওর প্রতি একটু নরম হয় আরকি! সাদের পরিণতি এমন হওয়ারই ছিলো। তারপর বিদায় নিয়ে কাল সকালে আসবে বলে চলে গেলো। শোভার ভিতরে ভিতরে কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নিলো। কারণ আজ যদি সাদের পাশে টিনা নামক মেয়েটা থাকতো তাহলে সাদ কখনোই শোভার কাছে আসতোনা। আর এই দুমুখো রুপ যে সাদ নিতে পারে, সেটাও শোভার জানা হতোনা। যখন যার প্রয়োজন তখনই তাকে ব্যবহার করে টিস্যুর মতো ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়াটাই সাদের কাজ। যেরকম শোভার সাথে করেছে, টিনার সাথেও করেছে। কিন্তু সেখানে টিনার নিজের দোষও ছিলো যা শোভার ছিলোনা।

বাবার ভালোবাসা প্রতিটি সন্তানের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা বলে এমন নয় যে, বাবা ছাড়া কেউ বাঁচেনা। বাঁচে, বাঁচতে হয়। কিছু কিছু প্রিয় জিনিস কখনো পাওয়ার জন্য হয়না। কষ্ট ভোগ করা ভালো কিন্তু আত্মসম্মান কখনোই বিসর্জন দেওয়া উচিৎ নয়। ছোটবেলা থেকে রাফু-তুতুল বাবা ছাড়া কী বড় হচ্ছেনা? ঘাটতি যেটা আছে সেটা থাকুক, ওদেরও তো জীবনের সাথে লড়তে হবে। ছোট থেকেই অত্যন্ত দুর্লভ কিছু জিনিস হারাতে শিখুক, ভবিষ্যতে তাহলে বেশি কষ্ট অনুভব করতে হবেনা। কারণ কষ্ট অনুভব করতে করতে একসময় বড় বড় কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যায়। তখন জীবনটাই পালটে যায়। জীবনে প্রিয় জিনিস হারাতে আর যুদ্ধে হারতে শিখতে হয়। তাহলেই জেতার মজা টের পাওয়া যায়, অনুভব করা যায়। যেটা বেঁচে থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ!

শোভা দুই সন্তানকে এমনভাবেই তৈরি করবে যেন কোনোদিন মেয়েদের দুর্বল বা ভোগ করার বস্তু না ভাবতে পারে। এমনভাবে বড় করবে যাতে মা জাতির প্রতি আজীবন ওদের মনোভাব পজেটিভ থাকে, তবে অবশ্যই টিনার মতো খারাপ মহিলাদেরও যাতে চিনতে পারে সেই শিক্ষাও দেবে। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেও শিখাবে। সর্বোপরি একটা সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে রেখে সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। সেটা শোভা নিজে করবে, না মিলির সাহায্যও নেবেনা। কারণ সাদকে বারবার বিশ্বাস করে শোভা যে ভুল করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত এটা।

বাসার কেউ শোভাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। মিলি কিছুক্ষণ গাইগুই করলো। কিন্তু মিলির আজ বাসর রাত হওয়ায় শোভা ওকে ধমকে ঘরে পাঠালো। নিজেও ফ্রেশ হয়ে রাফুর হাতে ব্যান্ডেজ করে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে দুই ছেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। রাত প্রায় দুটোর দিকে সবাই যার যার ঘরে ঘুমুতে গেলো। অনেকের মতে, মেয়েরা তরল পদার্থের মতো, যেই পাত্রে রাখবে সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে। কিন্তু তারা এটা জানেনা, মেয়েরা তরল পদার্থ নয় বরং কঠিন থেকে কঠিনতর পদার্থ! মেয়েরা একবার কঠিন হলে তাঁকে আর তরলে রুপান্তর করা যাবেনা, কোনোমতেই না।

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়!

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১৫

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

কিছুক্ষণ আগে।

শোভার হাতে থাকা মোমবাতিটা বাতাসে নিভে যায়। রাফুকে টুলের ওপর বসিয়ে দেয়। ও রাফুকে ছেড়ে দেশলাই খুঁজতে থাকে। তারপর আবার মোমবাতিটা জ্বালিয়ে রান্নাঘরের এঁটোবাসন গুলো ধুতে থাকে। কফির জন্য পানি বসায়। ওর প্রতিদিনের অভ্যাস, রাতে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি খায়। তাছাড়া সাদ আছে বাসায়, ভাবতেই ওর প্রচন্ড মনখারাপ হলো। এই যা, বৃষ্টিটা আরেকটু কমলেই ওকে বের করে দেবে বাসা থেকে। ভাবনায় মগ্ন থাকার এই ফাঁকে রাফু ড্রইংরুমে চলে আসে। ওর কৌতূহল হয় সোফায় বসে থাকা লোকটার প্রতি। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রাফু সাদের কাছে আসে। সাদ চোখ বন্ধ করে ছিলো বিধায় রাফুকে দেখতে পায়নি।

রাফু সাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কে আপনি?’

সাদ চোখ খুলে রাফুকে দেখে। দ্রুত নিজের কাছে টেনে নেয়। অদ্ভুত অনুভূতি হয় ওর। রাফুর মায়াভরা মুখটা দেখে ও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। শোভার সাথে প্রচুর মিল চেহারায়। তাহলে এটা কী ওরই ঔরসজাত সন্তান? ওর ছেলে?

সাদ জিজ্ঞেস করে,

‘ আমি সাদ চৌধুরী। তুমি কে?’

‘ আমি আল-রাফি। সবাই রাফু বলে ডাকে।’

‘ বয়স কত তোমার?’

‘ আম্মু বলে পাঁচ।’

‘ কীসে পড়ো?’

‘ বলবো না।’

সাদ হেসে বললো,

‘ আচ্ছা, আচ্ছা।’

‘ আপনি কে বললেন না তো?’

‘ একটু আগে যে মেয়েটা তোমার চুল মুছে দিচ্ছিলো ওনি কে হন তোমার?’

‘ আমার আম্মু।’

‘ তোমার আব্বু নেই?’

‘ আছে।’

‘ কী করে সে?’

‘ জানিনা। আমি কখনো দেখিনি।’

সাদ এবার নিশ্চিত হয় যে রাফু ওরই সন্তান। সে ওকে বুকে আগলে নেয়। তার আগে রাফুর বয়স যাচাই করে নিশ্চিত হয় যে শোভার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে কিনা। কারণ নিয়ন বলেছিলো শোভাকে বিবাহিত লাগে। যদিও সাদের সেরকম মনে হয়নি।

রাফুর প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগলো। সে শুনেছে যারা বাচ্চাদের সাথে বেশি ঘেঁষতে চায়, ওরা ছেলেধরা হয়। তাই রাফু বলল,

‘ আমাকে ছাড়ুন।’

সাদ ওকে ছেড়ে দিয়ে গালে আর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে নিচু গলায় বলল,

‘ আমার ছেলে।’

রাফু শুনতে পেলোনা। ও নিজের গাল মুছতে মুছতে বলল,

‘ আপনি কে হন আমার আম্মুর?’

সাদ কিছুই বলল না। রাফুর দিকেই তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,

‘ তোমার আম্মুর খুব কাছের একজন।’

‘ বুঝিনি।’

‘ মানে খুব গভীর সম্পর্ক আমাদের।’

‘ আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনা আংকেল। আপনার কথাগুলো ভালো না। আপনি কী কোনো চোর-ডাকাত?’

সাদ ধাক্কা খেলো ছেলের কথা শুনে।

রাফু ওর থেকে দূরে সরে যেতে চাইলো। বৃষ্টি কমে গিয়েছে একটু। রাফুর মুখে ভয় ফুটে উঠলো। লোকটা আবার সত্যিই ছেলেধরা নয় তো? রাফুর ভয়ার্ত দৃষ্টি সাদের চোখ এড়ালোনা। চট করেই মাথায় একটা প্ল্যান খেলে গেলো সাদের। ভাবলো, এখন যেহেতু ওর আশেপাশে কেউ নেই, রাফুকে নিয়ে চলে গেলেই তো পারে। বাই চান্স যদি শোভা ওর সাথে যেতে বা থাকতে রাজি না হয় তাহলে তো একূল-ওকূল সবকূলই হারাবে। শোভাও সতর্ক হয়ে যাবে বা অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে এই কাজটা করে ফেলাই বেটার। দুজন সন্তান না হোক, একজনকে নিজের কাছে রাখতে পারলেও অন্তত সাদের বুকটা কিছুটা হালকা হবে। আর শোভা! প্রথম কিছুদিন ছেলেকে ছাড়া থাকতে হয়তো একটু কষ্ট হবে, কান্না করবে৷ তারপর ভুলে যাবে। হুম, প্ল্যানটা বেশ ভালো।

যেই ভাবা সেই কাজ। সাদ রাফুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো। বলল,

‘ এদিকে আসো তো একটু।’

‘ কেন?’

‘ ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।’

‘ তাহলে কেন এসেছেন?’

‘ বন্ধুত্ব করতে।’

‘ কার সঙ্গে?’

‘ তোমার সঙ্গে। আচ্ছা, তোমার আরও একটা ভাই আছে তাইনা?’

‘ না না। বোন।’

‘ নাম কী ওর?’

‘ উম্মে রুফি। সবাই তুতুল বলে ডাকে।’

‘ বাহ! কিউট নেইম।’

এভাবেই রাফুকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, গল্প করে দীর্ঘ পাঁচমিনিট যাবৎ। কৌতুক বলে রাফুকে হাসায়। জাদুকরের মতোই মিশে যায় রাফুর সাথে। বাচ্চাদের ইম্প্রেস করার জন্য একেবারে পারফেক্ট সাদ। রাফুও সহজেই মিশে যায় লোকটার সাথে। এরই সুযোগ কাজে লাগায় সাদ।

‘ রাফুবাবা!’

‘ জ্বি!’

‘ বৃষ্টি ভালো লাগে?’

‘ হুম।’

‘ ভিজবে?’

‘ নাহ।’

‘ কেন?’

‘ আম্মু না করেছে। ছোটআম্মু বকা দেবে।’

‘ কেউ কিছু বলবেনা৷ আমার সাথে চলো।’

রাফু আঁৎকে উঠে বলল,

‘ কোথায়?’

সাদ হেসে বললো,

‘ ছাদে। বৃষ্টিতে ভিজতে হয় বাবা, নইলে তুমি এর মজাই বুঝবেনা। এতো এতো পানি কী আল্লাহ তায়ালা এমনি এমনি ফেলছে? আমাদের জন্যই তো ফেলছে যাতে আমরা আনন্দ করতে পারি। তুমি কী এই আনন্দ উপভোগ করতে চাওনা?’

রাফু গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলো। সাদ যেহেতু বলেছে ওর সাথে ভিজলে মা কিছু বলবেনা, তাহলে নিশ্চয়ই কিছু বলবেনা। ও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘ চাই।’

সাদ মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,

‘ তাহলে দেরি কেন? চলো।’

ওদিকে থালাগুলো ধুয়ে শোভা মুছে রেখে দিলো। কফির পানিটা ফ্লাস্কে ঢেলে নিয়ে পেছনে ফিরে দেখলো রাফু টুলের উপর বসা নেই। টুলটা একটু উঁচু হওয়ায় রাফু নামতে পারেনা সেখান থেকে। এজন্যই শোভা নিশ্চিত মনে কাজ করছিলো। তাহলে নামলো কীভাবে? সাদ! ওহ মাই গড। ভেবেই দৌড়ে করিডোর আর বারান্দা পেরিয়ে ধুপধাপ করে ড্রইংরুমের দিকে ছুট লাগালো শোভা।

হাত থেকে টর্চটা যেন পড়ে যাবে। শরীর কাঁপছে। কেউ তো জানেই না সাদ এখানে, তাহলে এতোক্ষণে ওকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতো সবাই। নাহ, ভুলটা শোভারই। সাদকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া বা বসতে দেওয়াটাই ওর সবচেয়ে বড় ভুল। কীভাবে পারলো এই মস্ত বড় ভুল করতে? এতোটাও নির্বোধ ও হলো কী করে?

একছুটে ড্রইংরুমে এসে শোভা দেখলো সাদ নেই। রাফুকে খুঁজে দেখলো সেও নেই। দরজা হাট করে খোলা, শোভা দ্রুত সিঁড়িঘরে এলো। ভেজা জুতোর কর্দমাক্ত পায়ের ছাপ সিঁড়িতে। দ্রুত নামার চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে। শোভা একপ্রকার দৌড়ে নামলো নিচে। গিয়ে দেখে রাস্তার ওপাশে রাখা একটা গাড়িতে একটা লোক উঠছে। কোলের বাচ্চাটা দেখে শোভা বুঝতে পারলো এটাই সাদ। রাফুকে নিয়ে পালাতে চাইছে!

বৃষ্টির ঝাপটার তোয়াক্কা না করেই শোভা সেদিকে ছুট লাগালো। হুমড়ি খেয়ে পড়লো একবার রাস্তায়। উঠে আবারও ছুট লাগালো এবং সাদকে একটা ধাক্কা মারলো। ফলে রাফু সাদের কোল থেকে আলগা হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। লোহার শিকে লেগে ওর হাত কেটে গেলো, তবে সামান্যই।

আচমকা সাদ হকচকিয়ে উঠলো। টাল সামলে ঘুরে দেখলো শোভা। রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার সরাসরি দুজন দাঁড়িয়ে আছে। সাদ অনেকবছর পর শোভাকে লক্ষ্য করতে পারলো। ভীষণ সুন্দর হয়েছে শোভা, ভীষণ! চোখ ফেরানো দায়। শাড়িতে আর এলোমেলো চুলে বৃষ্টিতে ভেজা শোভাকে যে এই অন্ধকারেও কেমন লাগছিলো সেটার বর্ণনা করার শক্তিটুকু পর্যন্ত পেলোনা সাদ। কষে একটা থাপ্পড় মারলো শোভা ওর গালে। ভাতের হোটেলের ছাউনির নিচে রাফুকে বসিয়ে দিয়ে দোকানের কাছে পড়ে থাকা একটা ছোটখাটো লাঠি এনে সাদের পিঠ বরাবর কয়েকটা বারি মারলো। রাগে শোভা এতোটাই জর্জরিত যে এটা যে রাস্তা ও বেমালুম ভুলে গেলো।

এদিকে সাদের ভাবান্তর নেই। বুঝে গিয়েছে যে প্ল্যান ফ্লপ করেছে। তাই এভাবেই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো শোভার সুন্দর মুখপানে। রাফু যে ব্যথায় কাঁদছে সেদিকেও শোভার হেলদোল নেই। সাদকে ইচ্ছেমতো মেরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো রাস্তায়। তারপর রাফুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলো। একটা কথা পর্যন্ত বললো না শোভা।

সাদ শোভার পেছন পেছন গেলো। ডাকছে, দাঁড়াতে বলছে শোভাকে।

‘ প্লিজ দাঁড়াও, শুভি।’

শোভা দাঁড়ালোনা। দৌড়ে বাসার ভিতর ঢুকে পড়লো। সাদও গেলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শোভাকে প্রায় ধরেই ফেললো সাদ। আঁচলে টান দিবার চেষ্টা করতে লাগলেই শোভা চেঁচামেচি করতে লাগলো। আর মায়ের কোলে রাফু ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে আছে। এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছে যে এই লোকটা একটা ছেলেধরা।

শোভার চেঁচামেচি যখন পৌঁছালো মিলি আর সাইফের কানে, আর তক্ষুণি ওরা ছুটে এলো। এসে সাদকে দেখে ওরা রীতিমতো অবাক হলো। শোভাকে এরকম করতে দেখে দুজনেই ঘাবড়ে গেলো। মিলি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

‘ আপনি এখানে কেন?’

সাদ বলল,

‘ সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে কেন দেবো?’

‘ কারণ আপনার কোনো অধিকার নেই আমার শুভিকে এভাবে হেনস্তা করার!’

‘ আমি কাউকে হেনস্তা করিনি।’

শোভা সাইফের কোলে রাফুকে দিয়ে ধাক্কা দিলো সাদকে। বলল,

‘ তাহলে আমার বাচ্চাকে কেন চুরি করতে এসেছেন?’

মিলি অবাক হয়ে বলল,

‘ মানে?’

শোভা কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনাটা বললো মিলিকে। শুনে মিলি রেগে শোভাকেই চড় মেরে বলল,

‘ কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না, জানার পরেও তুই একে খাতির করে ঘরে ঢুকিয়েছিস? তোর বোধবুদ্ধি কবে হবে? তুই এতো সরল, এতো ভালো কেন? এজন্যই সবাই তোকে ঠকাতে চায়।’

‘ আমি পারিনা মিলি। আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাইনা। কিন্তু ওনি বারবার আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছেন। আমার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে কিছু বলিনি, কিন্তু আমার সন্তানদের দিকে হাত বাড়ালে সেই হাত আমি কেটে রেখে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো। ভালো শুভি যেমন নরম, খারাপ শুভি ঠিক ততোটাই কঠিন। এবার আমি আর কোনো কম্প্রোমাইজ করবোনা, নিজ হাতে শাস্তি দিবো।’

সাদ শোভাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,

‘ ওদের প্রতি তো আমার অধিকার আছে। তা নয় কী?’

‘ নাহ। কোনোদিনই ছিলোনা। আপনি ভুল করছেন। তাছাড়া আপনার নিজের এখন সংসার আছে, নিশ্চয়ই বউ-বাচ্চা, বাবা-মাকে নিয়ে সুখেই আছেন। তাহলে আমার রক্তজল করা বাঁচার প্রেরণাটা বারবার কেন খুন করতে আসেন?’

‘ আমার এখন কেউ নেই শোভা। না হলো ঘর-সংসার, না হতে পেরেছি বাবা। না নিজের বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে পেরেছি। আমার সব এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেলো।’

অট্টহাসিতে মেতে উঠলো মিলি। একেই বোধহয় বলে রিভেঞ্জ অব নেচার বা যেমন কর্ম তেমন ফল। মিলির চোখের কোণে পানি জমে গেলো।

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল-ভ্রান্তি মাফ করবেন। রি-চেইক করিনি।

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১৪

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

‘ রাফু তুমি কিন্তু বড্ড দুষ্ট হচ্ছো।’

রাফু গাল ফুলিয়ে বলল,

‘ আমি দুষ্ট নই।’

‘ তাহলে এরকম ভিজলে কীভাবে?’

রাফু মাথা নিচু করে রইলো। শোভা ধমক দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

‘ বল!’

‘ সাইফ আংকেল।’

শোভা অবাক হয়ে বলল,

‘ কী করেছে?’

‘ ওনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এভাবে বৃষ্টির পানি দিয়ে ছিঁটাছিঁটি করছিলো। আমি ওখানে গেলে আংকেল বলল এটা নাকি অনেক মজার খেলা। বৃষ্টির সাথে খেলা না করলে নাকি জীবন সুন্দর হয়না।’

শোভা ছেলের মুখে পাকাপাকা কথা শুনে মাথায় হাত দিলো। তার শান্ত, ভালো বাচ্চাটা আজকাল বড্ড চটাশ চটাশ কথা বলা শিখেছে। শোভা হেসে তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বলল,

‘ ঠিকই বলেছে। কিন্তু বৃষ্টির সাথে খেলা করতে হয় বড় হলে।’

‘ কত বড়?’

‘ এই ধরো আমার মতো।’

‘ তোমার মতো বড় হতে তো আরও অনেক বছর লাগবে। ততোদিন কী আমি বৃষ্টিতে ভিজবো না?’

‘ ভিজবে, কিন্তু অল্প!’

‘ তুতুল ও ভিজবে?’

‘ হুম। মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে।’

‘ তুমিও!’

শোভা উত্তর দিলোনা। কারণ বৃষ্টিতে ভিজার মন সেদিনই মরে গিয়েছিলো যেদিন ওর রঙিন জীবনটা
সাদ নামক মানুষটার হাতে মরে গিয়েছিলো। হঠাৎ চোখের কোণ মুছে ড্রইংরুমের কর্ণারে রাখা টিস্যু পেপারের বক্সটা আনতে ঘুরলো তখনই ওর চোখ গেলো দরজার দিকে। আবছা আলোয় একটা সুঠামদেহী পুরুষের অবয়ব মেঝেতে লুকোচুরি খেলছে। শোভা ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। দুরু দুরু বুক নিয়ে যেই না সামনে এগুলো, তখনই দেখতে পেলো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে।এবং লোকটা আর কেউ নয় ওর অতিপরিচিত, একসময়ের প্রিয় মানুষ, ভালোবাসার মানুষ, শোভার প্রাক্তন স্বামী সাদ চৌধুরী। পরনের বসন ভেজা। মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু শোভা সে দৃষ্টিকে প্রাধান্য দিল না। কারণ এখন শুধুই তার প্রাক্তন। ওর সাথে কোন সম্পর্ক হবার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই। তারচেয়ে বড় কথা এই লোকটা একটা প্রতারক এইসব ভেবে ভাবতে-ভাবতে শোভা একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখা এক পশলা বৃষ্টি ওর কাছে ভয়ানক হয়ে উঠল। শোভা ভাবনার জগৎে ঢুকে প্রাণপণে চাইছে মুছে যাক এই এক পশলা বৃষ্টি পৃথিবীর বুক থেকে। দীর্ঘ কয়েকটা ক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো।

এই অন্ধকার রাত্রিতে শোভা যখন দরজার সামনে সাদ কে দেখতে পেল তখন সে চমকে উঠলো! মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, একি দেখছে ও? আদৌ সত্যি এটা? নাকি চোখের ভুল! এতোক্ষণ ভেবেছিলো এটা বুঝি হ্যালুসিলেশন। কিন্তু অবয়বটা তো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি সতেজ।

তাহলে কী সত্যি! যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে কেন এসেছে মানুষটা ওর গোছানো জীবনটা তছনছ করতে আবারো? সাদ কী এখনো শান্তি পায়নি শোভার জীবন নষ্ট করে।

সাদ নিজেকে ধাতস্থ করলো। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো,

‘শোভা?’

কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শোভা ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আপনি?’

‘হুম আমি।’

‘আপনি কী সত্যিই এসেছেন?’

‘হুম।’

‘একটা খারাপ মেয়ের কাছে কী দরকারে?’

সাদ বলার ভাষা খুঁজে পেলোনা। ভেজা গায়ে বেশিক্ষণ থাকার ফলে হাঁচি-কাশি দিতে লাগলো। শোভা হাতে থাকা তোয়ালেটা ছুঁড়ে মারলো ওর উপর। মুখে বলল,

‘ মুছে নিন।’

সাদ নিলো তোয়ালেটা। মাথার চুলগুলো মুছে সেভাবেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘ আপনি কী এখন চলে যাবেন? বাইরে যেহেতু আবহাওয়া খারাপ, একটু পরে গেলে ভালো হয়। বসুন।’

‘ আসলে তোমার সাথে আমার খুব প্রয়োজন আছে।’

‘ কী প্রয়োজন?’

‘ বাসায় কী আর কেউ নেই?’

‘ আছে। অনেক মানুষ আছে, ভেতরের ঘরে।’

‘ ওহহ!’

শোভা বলল,

‘ বাসায় অনেক মেহমান আছে। আশা করি আপনি এমন কিছু করবেন না যাতে সিনক্রিয়েট হয়।’

‘ কী হয়েছে বাসায়?’

‘ মিলির বিয়ে।’

‘ মিলি মানে? আমাদের মিলি?’

‘ আমাদের নয়, আমার মিলি।’

সাদ চুপ করে রইলো। এতোক্ষণ শোভা ওর সাথে নম্রভাবেই কথা বলেছে। সাদ চাইছে এভাবেই ওকে শান্ত রাখতে। কারণ ওকে উত্তেজিত করলে পরিস্থিতি উল্টোদিকে চলে যাবে। সাদ সোফায় বসলো। ভেতরের ঘরগুলো থেকে মানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। কারেন্ট এখনো আসেনি, যার ফলে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। আর মোমবাতির আলোয় যতটুকু
দেখা যাচ্ছে তাতে শোভার অবয়ব শুধু ছায়ার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে। ওর চেহারা সাদ দেখতে পাচ্ছেনা, কারণ শোভা আগেই ওর মুখ ঢেকে নিয়েছে। লোকটাকে নিজের মুখ দেখাতে ও চায় না। সাদ বুঝতে পারলো এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

কিন্তু রাফু এতোক্ষণ মাকে একটা অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে দেখে চুপ হয়ে ছিলো। শোভা ওকে নিজের সাথে আগলে রেখেছিলো। ও ভাবতেও পারছেনা সাদ এখানে অবধি পৌঁছে গিয়েছে। বুকের ভেতর ভয়ের বিশাল একটা দেয়াল তৈরি হলেও নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে ও লোকটার সাথে কথা বলছে। পাছে না রাফুকে চিনে ফেলে। এটারই আভাস পাচ্ছিলো কী শোভা? পুরোনো স্মৃতিগুলো একারণেই মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছিলো! এইসব খারাপ স্মৃতি কেন মুছে না ওর জীবন থেকে? অভিশপ্ত অতীতের থেকে যেন পালানোর কোনো পথ নেই।

শোভা রাফুকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো। সাদ একা সোফায় বসে আগের দিনগুলোর কথা ভাবছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। আনন্দও হচ্ছে। আচ্ছা ওর বাচ্চাগুলো কোথায়? এতোক্ষণ তো ওদের কথা মনেই পড়েনি। আরে, শোভা যে বাচ্চাটার মাথা মুছে দিচ্ছিলো ওটাই! ওয়েট ওয়েট…ডিজগাস্টিং। এটা নিশ্চয় ওর সন্তান। এত কাছাকাছি থেকেও সাদ বাচ্চাটার দিকে একবার তাকালো না, ড্যাম ইট! ওর রাগ হতে লাগলো। কিন্তু এখন রাগলে চলবেনা। এখানে যেহেতু এসেছে ড্যাম শিওর বাচ্চাদের নিজের কাছে পাবেই। তাই সাদ রিল্যাক্স হয়ে বসলো। বাইরে এখনো ঝড়ো বৃষ্টি। সাদের বুকে জমে আছে হাজারো মেঘের টুকরো। শোভাকে যদি সবসময় ও কাছে পেতো, চিরদিন যদি একসাথে থাকতে পারে এটাই বোঝাবে ও শোভাকে। ও নিশ্চয়ই রাজি হবে। জানালার দিকে একমনে তাকিয়ে সাদ গুনগুনিয়ে গান ধরলো!

“কেন মেঘ আসে হৃদয়ও আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয়না,
মোহ মেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না
🍁
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না?”

____________________

মিলি বসে আছে সোফায়। সামনে খাটে বসে আছে সাইফ। দুজনেই চুপ। মিলি বসে মোবাইল স্ক্রল করছিলো। সাইফ ভয়কে জয় করে বলল,

‘ মিলি!’

মিলি সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ কী?’

‘ মানে বলতে চাইছিলাম আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন কেন?’

‘ আপনি যে কারণে রাজি, আমিও সেকারণেই।’

‘ বুঝতে পারলাম না।’

‘ আপনার আম্মু খুব করে আমাকে পছন্দ করেছে, আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে নিয়েছে, ওনি খুব করে চায় যাতে আমি আপনাকে বিয়ে করি, শুভিও চায়। আমার সন্তানেরাও মত দিয়েছে আপনাকে বিয়ে করতে। আন্টি-আংকেলরাও চায়। সবচেয়ে বড় কথা আপনার আম্মুর চিন্তাভাবনা আর আমার চিন্তাভাবনা এক, আমাদের মাঝে কোনো ফারাক নেই। আমি এমন একজনকে মা হিসেবে পেয়ে খুবই খুশি। এসব কারণেই আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।’

সাইফ একটু রাগলো। সবার চাওয়া-পাওয়া মিলি দাম দিলো। কিন্তু প্রথম থেকেই যে সাইফ ওকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, ওর জন্য পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছে সেটা কী মিলির কাছে কিছুই নয়? মিলি এতো নিষ্ঠুর? সাইফের জন্য কী ওর মনে একটু জায়গাও নেই? এতগুলো বছরেও সাইফ ওর জীবনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি? মিলিকে বিয়ে করে কী ও কোনো ভুল করেছে!

এসব ভেবেই একপ্রকার রাগের মাথায় সাইফ মিলিকে বলল,

‘ আপনি সবার কথাই বললেন। কিন্তু আমার কথা তো একবার ভাবলেনও না আপনি প্রিয়তা! আমি যে আপনার জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করলাম, সেগুলোর কোনো দাম নেই? দেখুন, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আপনার প্রতীক্ষায় রয়েছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনি কেন বুঝেও না বোঝার ভান করেন? কেন?’

মিলি প্রথমে অবাক হয়ে সাইফের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর দ্বিতীয়বারের মতো থাপ্পড় পড়লো সাইফের গালে। ভেজা চোখ নিয়ে সাইফ মিলির ফিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সাইফের কাছে এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

‘ বিশাল বড় ভাষণ দিতে পারেন, আর এই ছোট্ট কথাটা বলতে পারেন না যে “আমি আপনাকে ভালোবাসি?” এটা বলতেই আপনার পাঁচ বছর খরচ হয়ে গিয়েছে?’

সাইফ অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আপনি ভালোবাসার কথায় বিশ্বাস করেন না বলেই বলিনি।’

‘ তাহলেও বলতে হয়।’

‘ বলতে গেলেই আপনার হাতের থাপ্পড়ের শিকার হতাম। নয় কী?’

‘ হুম। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির হাতে থাপ্পড় খাওয়াও সৌভাগ্যের ব্যাপার।’

সাইফ হাসলো। মিলিকে বলল,

‘ আপনাকে এখন সত্যি সত্যি আমার মনে হচ্ছে।’

‘ তাই নাকি?’

‘ হুম।’

মিলি ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ প্রিয়তা কে?’

‘ আমি যাকে পছন্দ করি সে কল্পিত আপনি!’

মিলি কিছু ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলতে রেডি হচ্ছিলো, কিন্তু তা হলোনা। কারণ বাইরের ঘর থেকে চেঁচামেচি আসছে। শোভার চেঁচামেচি। মিলি বুঝতে পারলো না বৃষ্টিভেজা এই মুহূর্তে, এতো রাতে, শোভা ঘরভর্তি মেহমান রেখে কীভাবে চেঁচামেচি করছে। কিন্তু কিছু একটা না হলে শোভা কখনো এমন করবেনা। সাইফও অবাক হলো। দুজনে নিজেদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে ড্রইংরুমে গেলো। এবং অন্ধকারে টর্চ লাইটের আলোয় যাকে দেখলো সেটার জন্য ওরা কেউই প্রস্তত ছিলো না।

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১৩

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

সাইফের মায়ের সাথে ভেতর ঘরে মিলির কী কথা হলো, সেটা কেউওই জানতে পারলোনা। কিন্তু দীর্ঘ আধঘন্টা পরে যখন ওরা ঘর থেকে বেরুলো তখন শোভা আতংকে অস্থির। মিলি যদি বিয়েতে রাজি না হয়? মিলি একবার না করে দিলে সাইফের মাও রাজি হবেনা বিয়েতে।

শোভা চোখমুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে। সাইফের মা সোফায় বসলো। মিলি দাঁড়িয়ে রইলো শোভার পাশে। সাইফ মায়ের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু মহিলা কিছু বলছেনা। রমজান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,

‘ মিলি বিয়েতে রাজি?’

‘ জি আংকেল।’

মিলির কথায় শোভা অবাক। মেয়েটা এতো সহজে রাজি হয়ে গেলো? কীভাবে সম্ভব! কিন্তু যারপরনাই খুশিও হলো।

রাফু আর তুতুল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। মিলির আঁচল ধরে বললো, ‘তুমি বিয়ে করবে ছোটআম্মু?’

মিলি বললো,

‘ হুম।’

‘ আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?’

মিলি কিছু বললো না।

রাফু বললো,

‘ বিয়ে করে তুমি আমাদের ভুলে যাবে?’

শোভা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, ‘কখনো না।’

‘ তাহলে বিয়ে করবে কেন?’

‘ সবাইকে করতে হয় বাবা।’

‘ তুমিও করেছো?’

শোভা সবার সামনে থতমত খেয়ে গেলো। মিলি বললো, ‘হুম। মাও বিয়ে করেছে।’

‘ বিয়ে করলে কী বর হয়? সাইফ আংকেল কী তোমার বর হবে?’

‘ হুম।’

‘ তাহলে মায়ের বর কোথায়?’

এবার মিলি আর শোভার দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সাইফের মা বিষয়টা বুঝতে পারলেন। তিনি আগে থেকেই সাইফের কাছে শোভা, মিলির সব কথা শুনেছেন। তাই তিনি এবার উঠে রাফুকে কোলে নিলেন। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ তোমার মায়ের বর হলো তোমার আব্বু। আর তুমি জানো তোমার আব্বু মাকে পছন্দ করেনা। তাইতো আম্মু চলে এসেছে।’

‘ পছন্দ না করলে বিয়ে করেছে কেন?’

‘ সেটা তোমার আব্বু জানে।’

রাফু কোল থেকে নেমে গিয়ে মিলির কাছে দাঁড়ালো। তারপর বললো, ‘তুমি বিয়ে করে নাও ছোটআম্মু। সাইফ আংকেল তোমাকে পছন্দ করে, সে আমার আব্বুর মতো নয়।’

মিলি আলতো হাসলো। শোভার চোখে পানি এসে গেলো। তুতুল চুপচাপ মিলিকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু-ভাইবোন শুধু জানে তাঁদের ছোটআম্মু আর তাঁদের সাথে থাকবেনা। বিয়ে হলে সবাই নাকি বরের বাড়ি চলে যায়।

এদিকে সাইফ দারুণ খুশি। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছেনা মিলির দিকে কীভাবে তাকাবে! কোনোদিন তো বলেওনি যে সে মিলিকে ভালোবাসে। আজ হুট করে মেয়ে দেখতে এসে মা বলছে আজ নাকি ওর বিয়ে। বিয়ের কোনো প্রস্তুতিই তো সে নেয়নি!

যেভাবে ছিলো সেভাবেই রাত আটটার দিকে শোভার বাড়িতে সাইফের বাড়ির কিছু মেহমান এলো। সাথে বিয়ের যাবতীয় তৈজসপত্র, প্রসাধনী। শোভা মিলিকে সাজিয়ে দিলো। শোভার নিজের বিয়েটা হয়েছিল একদম সাদামাটা। সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। সাদ তখন সদ্য চাকুরীতে জয়েন করেছে। নববর্ষ উপলক্ষে সাদ শোভাকে একটা সাদা জামদানী উপহার দিয়েছিলো, সাথে সাদা কাচের চুড়ি। চুলে গুঁজেছিলো বেলী ফুলের সুবাস মোড়ানো সাদা মালা। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপগ্লস। এই সাজেই শোভাকে সেদিন অপ্সরা লাগছিলো। সাদ পরেছিলো ওর সাথে মিলিয়ে সাদা পাঞ্জাবি, ওকেও দারুণ দেখাচ্ছিলো। দুজনেই সেদিন জীবন উলটপালট করা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো পরিবারের কাউকে না জানিয়ে। কাজি অফিসে বিয়ে সারার পর সাদ শোভাকে কথা দিয়েছিলো কখনো ছেড়ে যাবেনা। হাহ, কিন্তু আজ এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও কেউ কারো মুখদর্শন পর্যন্ত করেনি। না করতে চায়! সাদ হয়তো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারে, কিন্তু শোভা পারবেনা। কারণ শোভা বলেছিলো সাদ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ শোভার জীবনে আসবেনা কখনোই। আসেনি, কখনোই দ্বিতীয় মানব শোভার জীবনে আসার পথ পায়নি। শোভা সেই সুযোগ দেয়নি। কী এমন ক্ষতি হবে একলা জীবন কাটালে? কিছুই না। হয়তো বাচ্চাগুলো কাউকে বাবা ডাকার সুযোগ পাবেনা, বাবার ভালোবাসা পাবেনা৷ না পাক, সাদের নোংরা ভালোবাসা কখনোই শোভার সন্তানেরা ডিজার্ভ করেনা।

যাইহোক, শোভা মিলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। লাল শাড়ি, চুড়ি, গয়না সব মিলিয়ে পরী পরী ভাব। মিলি এতকিছু পছন্দ করে না। তাই রেগে বললো, ‘কী করছিস শুভি? আমি তো নিজেকেই চিনতে পারছিনা।’

শোভা বললো, ‘বিয়ের দিন মেয়েরা নিজেদের চিনতে পারবেনা, এটাই স্বাভাবিক।’

‘ তাই বুঝি?’

‘ হুম।’

‘ তোর বিয়েতেও তুই নিজেকে চিনতে পারিসনি?’

‘ নাহ। আমি নিজেকে ঠিকই চিনেছিলাম, কারণ সেদিন আমার সাজগোজ ছিলোনা। যেমন ছিলাম, তেমনই। শুধু চুলে বেলীফুলের মালা গুঁজেছিলাম!’

‘ তো আমাকেও সেভাবেই সাজিয়ে দে।’

‘ না।’

‘ কেন?’

শোভা কঠিন গলায় অদ্ভুতভাবে বললো, ‘ জানিস আমি সেদিন সাদা শাড়ি পরেছিলাম। সাদা শাড়ি
মানে জানিস? বিধবাদের রঙ। সেদিন আমাকে বিধবা বউ লাগছিলো৷ তাইতো দেখলি না, আমার বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো। আমিতো বিধবাদের মতোই বাস করছি। তাই আমি তোকে লাল রঙে সাজাচ্ছি। তোর জীবন রঙিন থাকবে সবসময়। তুই খুব ভালো, তুই সুখ ডিজার্ভ করিস। তুই আজীবন আনন্দে কাটা সাইফ ভাইয়ের সাথে। তুই আমার জন্য যা করেছিস, অন্য কেউ হলে কখনোই করতোনা। তুই ঘর-সংসার নিয়ে সুখে থাক, এছাড়া আমি আর কিছুই চাইনা।’

মিলি শোভার গালে হাত রেখে বললো, ‘কাঁদছিস কেন?’

‘ এমনি। পুরোনো কথা আজ খুব মনে পড়ছে।’

‘ এখনো ভুলতে পারিসনি!’

‘ সব অতীত ভোলা সহজ নয়। আর কিছু কিছু অতীত ভুলে যাওয়ারও নয়। এটাই আমাকে আরও সাহসী হতে সাহায্য করে।’

‘ তুই অনেক বড় হবি শুভি।’

‘ তুইও অনেক ভালো থাকবি।’

রাফু গালে হাত দিয়ে বসেছিলো। মিলিকে এতো সাজগোজ করতে দেখে ওর মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো। মিলি কখনোই সাজেনা, রঙিন কাপড়ও পরেনা। কিন্তু ওকে আজ খুশি হতে দেখে দু-ভাইবোন খুব আনন্দ পেলো। রাফু সাইফকে বর সাজতে দেখে বললো,

‘ আমার ছোটআম্মুকে কষ্ট দিবেনা কিন্তু।’

সাইফ হেসে বললো, ‘আচ্ছা।’

‘ বকবেনা কিন্তু!’

‘ বকবোনা।’

‘ ইনজেকশন দিবেনা। তুমি খুব পচা ডাক্তার, সেবার আমাকে যেভাবে ইনজেকশন দিয়েছিলে ছোটআম্মু আমার কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলেছিলো।’

সাইফ বোকার মতো বললো, ‘ইনজেকশন তো অসুস্থ হলে দিতেই হবে।’

‘ না দিবেনা।’

‘ ধরো, তোমার ছোটআম্মুর বেবী হবে! তখন কিন্তু তোমার ছোটআম্মুকে ইনজেকশন নিতেই হবে।’

‘ কেন?’

‘ সুস্থ থাকার জন্য।’

তুতুল মুখটা কালো করে বললো, ‘সব আমার ছোটআম্মুকে কষ্ট দেওয়ার ধান্ধা, তাইনা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। সবাইকে গিয়ে বলবো।’

রাফু আর তুতুল দৌড়ে দৌড়ে মেহমান সবাইকে গিয়ে এই কথাটা বলছে। বলতে বলতে হঠাৎ মিলির কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

‘ জানো ছোটআম্মু, তোমার বরটা তোমাকে নাকি বেবী হবার সময় ইনজেকশন দিবে।’

শোভা চোখ পাকিয়ে তাকালো। মিলি অবাক হয়ে বলল,

‘ কীহ?’

‘ হুম। তোমাকে গুঁতো দিবে বলেছে।’

‘ বেবীর কথা কে বলেছে?’

‘ সাইফ আংকেল।’

মিলি রেগে কিড়মিড় করে শোভাকে বললো,

‘ দেখলি? এইজন্য আমি পুরুষ জাতটাকে দেখতে পারিনা। এখনো বিয়েই হয়নাই, আর এই হাঁদা ডাক্তার বেবী অবধি আগায় গিয়েছে।’

শোভা মুচকি হেসে বললো,

‘ তো আগাবেনা? বয়স কত দেখছিস?’

‘ হাঁদার বয়স ধুইয়া পানি খাবো! আমার কোনো বাচ্চার দরকার নাই। আমার অলরেডি বাচ্চা আছে, তাও দুইটা।’

শোভা মুখ কালো করে বললো,

‘ এইরকম কথা বলবি না। তোরও কিউট বাচ্চা হবে।’

মিলি গম্ভীর মুখে বসে রইলো।

বেশ কিছুক্ষণ পরে কাজি এলো। মিলি আর সাইফের বিয়েটাও হয়ে গেলো ভালোভাবে। মোনাজাত শেষ করার পর খাওয়াদাওয়া হলো। সাইফের মা অনেক ভালো, নিজেই সব কাজে সালমা বেগমকে সাহায্য করলেন। মিলি রাগী চোখে সাইফের দিকে তাকিয়ে আছে, তার কারণ সাইফ বোকার মতো মিলিকে দেখে ঘামছে। আর সবাই নানা লজ্জ্বাজনক কথা বলছে। আজ রাতটা শোভাদের বাড়িতেই থাকার বন্দোবস্ত করা হলো।

বিয়ের পর্ব নির্বিঘ্নে শেষ হওয়ার পর শোভা নিজের ঘরে গেলো। দরজা আটকে বসে রইলো। মনটা বড্ড কেমন কেমন করছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ঘোলাটে হচ্ছেনা কিছুতেই, সব পরিষ্কার। যেন সেদিনের ঘটনা। মিলিটার একটা গতি করে দিতে পেরে শোভার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে দাঁড়ালো জানালার কাছে। অন্ধকার ঘরটাতে শোভার দীর্ঘশ্বাসের শব্দগুলো ভোঁতা হয়ে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি উঠাচ্ছিলো।
কিছুক্ষণ পর শুরু হলো বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি! অসময়ে দুনিয়া উলটপালট করে ধুলো উড়ানো ঠান্ডা বাতাসে পথঘাট ছেয়ে গেলো।

________

রাস্তার পাশের ভাতের হোটেলটায় দীর্ঘ ছয়ঘন্টা যাবৎ বসে আছে সাদ। সাইফের অপেক্ষা করতে করতে রাত দশটা বেজে গেলো। কিন্তু ডাক্তারের পাত্তা নেই। এর মধ্যেই হোটেল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো। সাদ বাইরে এসে দাঁড়ালো। আজ কিছুতেই সাইফকে হাতছাড়া করবেনা সে। নিশ্চিয় কিছু না কিছু সাইফ জানে। হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। রাস্তায় তো আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না।

কিছু একটা ভেবে সাদ পা বাড়ালো ওই বাড়িটার দিকে, যে বাড়িটাতে সাইফ আছে। দোতলায় উঠে দেখে বাড়ির ভেতর থেকে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। সাদ ভেজা সিক্ত গা নিয়ে পা বাড়ালো। ডোরবেলা বাজাতে লাগলো, কিন্তু বাজ পড়ার প্রচন্ড শব্দে সেই আওয়াজ কারো কানে পৌঁচ্ছাছে না। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি কেন নামলো সাদ বুঝতে পারছেনা। এই অসময়ে বৃষ্টিটা না হলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো!

দীর্ঘ পাঁচ মিনিট পর, যখন বর্ষণ আরো জোরে হচ্ছে তখন কেউ একজন ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো। কিন্তু মানুষটাকে সাদ দেখতে পেলোনা। যেই না সাদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে তখনই বিকট শব্দ করে কারেন্ট চলে গেলো। সাদ চমকে উঠলো সেই শব্দে।

নিজেকে ধাতস্থ করে সাহস নিয়েই সাদ ভেতরে ঢুকলো। মাঝারি আকারের ড্রইংরুমে অন্ধকার চোখে সয়ে নিতে সাদের সময় লাগলো, বেমালুম ভুলে গেলো যে পকেটে সেলফোন আছে। দেখলো একটা ছোট ছেলে সোফার উপর দাঁড়িয়ে আছে। মুখচোখ ভেজা। মোমবাতির হলুদ আলোয় একটা মেয়েকে দেখতে পেলো সাদ। খুব চেনা চেহারা। মেয়েটা শাড়ি পরে আছে, খোঁপা করা চুল। বাচ্চা ছেলেটির মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে মেয়েটি, আর বকবক করছে। সাদ চমকে উঠে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সেদিকে!

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১২

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

চট্টগ্রামে এসে সাদ লোক লাগিয়ে এবং নিজের চেষ্টায় তন্নতন্ন করে খুঁজে শোভাকে। দু’দিন কোনো খোঁজই পেলোনা। এভাবে তো কেউ হারিয়ে যেতে পারেনা, নিয়ন তো জানিয়েছে ওরা এখানেই কোথাও আছে। তাহলে কোথায়? সাদ তবুও হাল ছাড়লোনা। এবং সফলতা এসে ধরা দিলো চতুর্থদিন।

সাদ যখন গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ নজরে আসে সাইফকে৷ ডাক্তার সাইফকে হঠাৎ চিনতে না পারলেও একসময় চিনে ফেলে। এর সাথেই তো সাদের মারামারি হয়ে গিয়েছিলো, এরপর থেকেই শোভা উধাও। নিশ্চয়ই এ সব জানে। সাইফ তার মাকে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। সাদ সন্দেহ করলো, সাইফ হয়তো সব জানে। এজন্য সাইফের পিছু নিলো।

সাইফের পাশের সিটে তাঁর মা বসা। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছেন। ওর মা বেশ কড়া হলেও খুবই ভালো। ছেলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? মুখটা এত শুকনো কেন?’

‘ ভাবছি!’

‘ কী?’

‘ মিলি যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়।’

‘ দিলে দিবে।’

‘ আম্মু!’

‘ বিয়েটা ও করবে, তোর ইচ্ছাতে তো আর ওর জীবন চলবেনা৷ তাই না?’

‘ কিন্তু আমি মিলিকে পছন্দ করি।’

‘ তোর পছন্দ ধুয়ে তো ও পানি খাবেনা। ওর নিজস্ব পছন্দের কি দাম নেই?’

‘ অবশ্যই আছে।’

‘ তাহলে ওকে ওর মর্জিতে চলতে দে।’

‘ আমি জানি মিলি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু তুমিও ওর পক্ষেই চলে গেলে।’

‘ আমি একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের মনোভাব বুঝবোনা? এমনটা কি করে বলতে পারিস তুই?’

এমন সময় সাইফের বাবা কথা বলে উঠলেন। বললেন, ‘সাইফ! তুমি শুধু শুধু তোমার মাকে বুঝাচ্ছো৷ মেয়ে যদি না করে দেয়, তাহলে তোমার মাও স্ট্রেট না-ই করে দিবে!’

সাইফের মা চোখ গরম করে স্বামীর দিকে তাকালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘তোমার মতো হাঁদা ডাক্তার হলো কীভাবে বলোতো? ছেলেকেও হাঁদার পরামর্শ দিচ্ছো।’

‘ আমি কোথায় হাঁদা পরামর্শ দিচ্ছি?’

‘ শোনো, মিলি একটা মেয়ে। সে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাজে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে। শুধু পুরুষ মানুষের খারাপ রুপটাই ও দেখেছে। এখন ও যদি বিয়েতে না করে দেয়, সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে আমাদের ওকে জোর করার রাইট নেই।’

‘ তবুও মেয়েটাকে অন্তত বোঝানোর চেষ্টা তো করতে হবে।’

‘ আচ্ছা, গিয়ে দেখি সিচুয়েশন কেমন। তারপর সব ভাবা যাবে।’

তারপর সবাই চুপ করে বসলো। আর কোনো কথা হলোনা। শোভাদের বাসার দিকে গাড়ি এগুতে লাগলো। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। রাস্তাঘাটের কোণায় কোণায় সোডিয়াম বাতির ঝলকানি। পেছনে ফলো করতে করতে আসছে সাদের গাড়ি!
_____

এদিকে মিলিকে যে দেখতে আসছে সেটা শোভা আর ওর মা ছাড়া আর কেউ জানেনা। মিলি সন্ধ্যার নাস্তা বানিয়ে সবাইকে দিলো। রাফু, তুতুল টিভি দেখছে। শোভা এসে বললো, ‘কী করিস মিলি?’

‘ চা বানাই! খাবি?’

‘ না। আজ অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘ কী?’

‘ একটু স্পাইসি খাবার।’

‘ হঠাৎ?’

‘ মন চাইলো আরকি।’

‘ আচ্ছা আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’

‘ তোর বানাতে হবেনা, আমিই বানাবো।’

‘ কেন?’

‘ নিজের হাতে কতোদিন কিছু বানিয়ে খাইনা।’

‘ পাগল!’

শোভা ফ্রিজ থেকে স্লাইস করা মুরগীর মাংস, ডিম, মশলা বের করলো। পোলাওয়ের চাল, মাছ, সবজি বের করে রাখলো। মিলি অবাক হয়ে বললো, ‘স্পাইসি খাবার না বানিয়ে এসভ খাবার বানানোর মানে কি?’

শোভা পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘জর্দা বানাতে পারিস?’

‘ না।’

‘ তুই যা এই বিচ্ছিরি ফতুয়া ছেড়ে একটা ভালো শাড়ি পরে আয়।’

মিলি তব্দা খেয়ে বললো, ‘হটাৎ শাড়ি কেন পরবো?’

‘ আহ! এতো প্রশ্ন করিস কেন? যা বলছি কর না।’

মিলি সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ কী হয়েছে তোর বলতো। এতসব কীসের আয়োজন করছিস?’

‘ তোর জানতে হবেনা।’

‘ না বললে আমিও এক পা নড়বোনা।’

‘ ওকে বলছি।’

‘ বল!’

‘ আজ খুব ইচ্ছে করছে ভালো করে সেজেগুজে ছবি তুলতে, ভালো খাবার খেতে। একটু পর গেস্টও আসবে।’

‘ কীসের গেস্ট? বাসায় কোনো অকেশন আছে বলে তো মনে পড়েনা।’

‘ আসলেই দেখতে পাবি। যা না প্লিজ!’

মিলি ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘শাড়ি পরতেই হবে?’

‘ প্লিজ!’

‘ ওকে!’

মিলি না চাইতেও ঘরে যায়। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে নেয়। শোভার মনে কি চলছে আর কোন গেস্ট আসবে বুঝতে পারলোনা। রাফু আর তুতুল মিওখ গম্ভীর করে বসে আছে। ঝগড়া হয়েছে দুজনের মধ্যে। মিলি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কী হয়েছে?’

‘ দাদাভাই আমার সাথে ঝগড়া করেছে।’

‘ কেন?’

‘ আব্বুর কাছে যাবে বলে। আমি বলেছি আমরা মায়ের সাথেই থাকবো। তাই ঝগড়া করেছে!’

মিলির মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। রাফুটা আজকাল বাবার জন্য কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণ একটা গম্ভীর ভাব। আসলে স্কুলে সবারই তো বাবা আছে, সেজন্য ওর উপর মেন্টালি একটা চাপ পড়েছে।

মিলি রাফুকে বললো,

‘ তুমি কী সত্যিই যেতে চাও?’

‘ আম্মু গেলে, আমিও যাবো।’

‘ কিন্তু আম্মু তো যাবেনা।’

রাফু একটু রেগে বললো, ‘কেন যাবেনা? কী করেছে আব্বু?’

মিলি শান্ত হয়ে রাফুর পাশে বসলো। তারপর বলল,

‘ আচ্ছা, ধরো! তোমার আম্মুকে কেউ মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, সবার সামনে ছোট করেছে, তোমার আম্মুকে মরে যেতে বলেছে, আঘাত দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে, তোমাদেরকে বাজে কথা বলেছে। তুমি কী চাও সেই মানুষের কাছে তোমার আম্মু ফিরে যাক? যে লোকটা তোমাদের বাজে কথা বলেছে, ছুঁড়ে ফেলেছে তুমি কী ওর কাছে যেতে চাইবে?’

রাফু সাথে সাথেই বলে উঠলো,

‘কখনোই না।’

‘ তুমি জানতে চাওনা, তোমার আম্মুকে কে এতো কষ্ট দিয়েছে?’

‘ কে?’

‘ তোমার আব্বু! এখন তোমার আব্বু যদি তোমাদের নিতে আসে, তুমি কি চলে যাবে?’

রাফু এবং তুতুল দুজনেই মাথা নাড়িয়ে না জানালো। মিলি চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে ওদের গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘গুড গার্ল। এভাবেই মায়ের পাশে থেকো। তোমার আম্মু তোমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। তোমরা চলে গেলে মা এবার মরে যাবে!’

‘ আমরা যাবো না!’

ওদের এই কথোপকথন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলো শোভা। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। সব সন্তানদের অধিকার আছে বাবাকে পাশে পাওয়ার। কিন্তু কোনো খারাপ বাবার এই অধিকার নেই! এমন সময় দরজায় বেল বাজলো। শোভা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সাইফ, ওর মা আর বাবাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চোখেমুখে অস্বস্তি! ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও শোভা বেশ বুঝতে পারছে সাইফ চিন্তাগ্রস্ত! শোভা ওদেরকে বসতে দিলো।

‘ তুমি বুঝি শোভা?’

সাইফের মায়ের কথায় শোভা বললো,

‘ আসসালামু আলাইকুম, জ্বি আন্টি।’

‘ ওয়ালাইকুম সালাম, ভালো আছো মা?’

‘ জ্বি। আপনি ভালো?’

‘ খুব ভালো। তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়?’

‘ বাসায়ই আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি।’

শোভা ভেতরে গিয়ে রমজান সাহেব আর সালমা
বেগমকে ওখানে যেতে বললো। সাইফেরা সাথে করে অনেক ফলমূল,মিষ্টি নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে আরো মেহমান আসবে। শোভা রেস্তোরাঁতে খাবার অর্ডার দিলো। এতোজনের রান্না এই মুহূর্তে করা সম্ভব নয়।

মিলি বসার ঘরে মানুষের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে রাফু, তুতুলকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সাইফের পুরো ফ্যামিলিকে দেখে ওর চক্ষু ছানাবড়া। এরাই তাহলে গেস্ট? শোভার দিকে তাকাতেই ও মুচকি হাসি দিলো।

সাইফ মায়ের কানে কানে মিলির কথা বলতেই ওনি মিলর দিকে তাকালেন। মিষ্টি চেহারার সাথে সাদা রঙের জামদানি শাড়িটা বেশ ভালোই মানিয়েছে মিলিকে। ওনি বুদ্ধি করে শোভার কাছে শাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছেন আগেই৷ মিলিকে খুবই দারুণ দেখাচ্ছে। ওনি হাসিমুখে বললেন,

‘ তুমিই মিলি? আসো, আমার পাশে বসো। হবু শ্বাশুড়ির পাশে বসে মিষ্টিমুখ করে নাও মা!’

মিলি চমকে উঠলো। মানে কী? শ্বাশুড়ি? ও অবাক হয়ে শোভার দিকে তাকাতেই শোভা হেসে ফেললো। মিলি রাগী চোখে ওর দিকে তাকালো। সাইফের মা সবকিছুই লক্ষ্য করে মুচকি হাসছেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘ মিলি! আমি তোমার সঙ্গে একা একটু কথা বলতে চাই মা।’

শোভা বললো, ‘আসুন। আমি আপনাদেরকে ঘরে দিয়ে আসছি।’

সাইফের মা আর মিলিকে গেস্টরুমে দিয়ে এলো শোভা। মিলি রেগে আড়ালে শোভার হাতে কয়েকটা চিমটিও কেটেছে। শোভা পাত্তা দেয়নি।।মিলির ঋণ কোনোদিন শোধ করা শোভার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ওর জন্য মিলির জীবনটা নষ্ট হোক, শোভা তা চায়না। আর সাইফের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। আর মিলি যতোই মুখে না বলুক, শোভা বুঝতে পারে মিলির মনেও সাইফের জন্য একটা অনুভূতি, শ্রদ্ধার জায়গা আছে। তাই শোভা সাইফের মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করে খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ওদের দুজনের আজই বিয়ে দিবে। ধুমধামে বিয়ে মিলির কখনোই পছন্দ না। কিন্তু এই কথাটা সাইফ বা মিলি কেউই জানেনা। সবকিছু তৈরি করে রেখেছে শোভা। একটু হলেও যদি মিলির জীবনটা স্বাভাবিক করে দিতে পারে তাহলে শোভা খুব সুখী হবে। না হোক নিজের সংসার, মিলি’টারই হোক!

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১১

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

চৌধুরী বাড়িতে মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যায়না বললেই চলে। রোমেলা সারদিন চুপচাপ বসে থাকেন, মাঝেমাঝে কেঁদে উঠেন। কি থেকে কি হয়ে গেলো। আচ্ছা, ওনার তো কোনো দোষ ছিলোনা। স্বামী সন্তানের পাপের ফল কেন ওনি পাচ্ছেন? শেষ বয়সে এসে এসব দেখে ওনার বাঁচার আর ইচ্ছা হয়না। শোভা! মেয়েটা কোথায়? একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ কি দিবেনা? কতই না কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা! এমন কুলাঙ্গার ছেলে জন্ম না দিলেই ভালো হতো।

‘ আসবো মা?’

সাদের কথায় রোমেলা তাকালো।

‘ আয়।’

সাদ মায়ের বিছানায় এসে বসে। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে।

‘ কী হয়েছে? শোভার কোনো খবর জানিস?’

‘ এখনো পাইনি ঠিকঠাক।’

‘ তুই কি মরার আগে আমাকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিবিনা?’

‘ এমন করে বলছো কেন মা? অবশ্যই পাবো।’

‘ তোর মতো ছেলে যাতে আর কোনো মা জন্ম না দেয়। আমার জীবনটা তুই শেষ করে দিয়েছিস। কত আশা করেছিলাম, তোর থেকে। একটা ভালো মানুষ হবি, ভালো একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবো।’

‘ এসব কথা থাকনা মা।’

‘ না। আমাকে বলতে দে। তুই সবকিছুর জন্য দায়ী। ভালোর সঙ্গে সবসময় ভালো হয়, আর খারাপের সঙ্গে খারাপ। সেজন্য টিনার মতো মেয়ে তোর কপালে ছিলো। আমাদের পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলো।’

বলতে বলতে রোমেলা কেঁদে ফেললো। বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা নেই। রোমেলা জানে, সাদ যদি শোভার পায়ে ধরে ক্ষমা চায় তাহলে ওকে ক্ষমা করে দিলেও কখনো ওর কাছে ফিরবেনা শোভা। আর ইসলাম ও তাই বলে। কারণ ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। তবুও শোভা আর নাতিদের দেখে কিছুটা হলেও রোমেলার দুঃখ ঘুচবে। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে।

সাদ মাথা নিচু করে বসে ছিলো। ওর বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। ভেতরটা ছাই হয়ে গিয়েছে। অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, বিশ্বাসঘাতকতা কখনোই মানুষকে ভালো থাকতে দেয়না। সেও ভালো নেই। পাঁচ পাঁচটা বছর পর সাদ বুঝতে পারলো ওর ভুলগুলো। যার জন্য ও শেষ হয়ে গিয়েছে। ক্ষণিকের সুখের জন্য ও শোভাকে না যতোটা কষ্ট দিয়েছে, সৃষ্টিকর্তা দ্বিগুণ কষ্ট সাদকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সন্তান থেকেও নেই, বাবা ডাক শোনা দূরের কথা। ছেলে না মেয়ে হয়েছে তাও জানেনা। ক্রোধগুলো নিমিষেই পরিণত হলো মায়ার চাদরে। একবার খুঁজে পাক, শোভার পা ধরে বসে থাকবে, গোলামী করবে। তাও যদি শোভার মনে একটু জায়গা করে নিতে পারে!

এমন সময় সাদের মোবাইল বেজে উঠলো। নিয়নের ফোন। সাদ রিসিভ করলো।

‘ হ্যালো।’

‘ সাদ বলছিস?’

‘ হুম।’

‘ তোকে একটা খবর দিতে ফোন করলাম!’

‘ কী খবর?’

‘ আমি চট্টগ্রামে আসছিলাম অফিসের কাজে।’

‘ কিছু দরকার?’

‘ না। আসলে আমি শোভাকে দেখেছি!’

সাদ বিস্মিত গলায় চিৎকার করে বললো, ‘সত্যি? কোথায়? কোথায় দেখেছিস? এক্ষুনি বল!’

নিয়ন বললো, ‘জানিনা।’

‘ মানে?’

‘ আমি আসলে অফিসের কাজে এসেছিলাম। গাড়িতে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা মেয়ে। প্রথমে চিনতে পারিনি, তারপরে মনে পড়লো এটা শোভা। দোকান থেকে কিসব যেন কিনছিলো। পরে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলো ড্রাইভার, আমি আর ওকে দেখিনি। আমি শিওর ওরা চট্টগ্রামেই আছে।’

সাদ খুশি হয়ে বললো, ‘ধন্যবাদ বন্ধু। তোর এই উপকার কোনোদিন ভুলবোনা।’

‘ তুই আসবি?’

‘ আমি একটু পরই রওয়ানা দিচ্ছি!’

‘ এতরাতে আসার দরকার নাই। কাল আসিস, এখন এসে তো কোনো লাভ হবেনা।’

‘ না আমি এক্ষুণি যাবো। কত কষ্টে ওদের খুঁজে পেয়েছি। এবার আর হারাবোনা।’

নিয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘মনে হয়না লাভ হবে। আর যদি শোভা বিয়ে করে ফেলে? তাহলে? দেখেতো বিবাহিত বলেই মনে হলো?’

সাদ ফোন কেটে দিলো। ওর কোনোকিছু ভালো লাগছেনা। নিয়ন কি বললো এটা?

রোমেলা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’

‘ শোভার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।’

‘ কোথায়?’

‘ চট্টগ্রামে। আমি যাবো।’

রোমেলা আনন্দিত গলায় বললো, ‘আমাকেও নিয়ে যাস। মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে যদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা কর‍্তে পারি।’

‘ তুমি তো কিছু করোনি।’

‘ তোদের পাপই যে আমার পাপ। আমিই তোদের আটকাতে পারিনি। আসল পাপ তো আমি করেছি, তাইতো আমার সংসারটা শেষ হয়ে গিয়েছে।’

সাদ কিছু না বলে ঘরে চলে গেলো। সুটকেস গুছিয়ে দারুণ একটা শাওয়ার নিলো। আজ মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। ভালো লাগছে। তবুও বুকের ভেতরে কেমন খচখচ করছে। সাদ পাত্তা না দিয়ে সাউন্ড বক্সে গান লাগালো। “বধূ কোন আলো লাগলো চোখে!”

গানটা সুন্দর! শোভার মতোই। আচ্ছা, শোভা কি সত্যি আরেকটা বিয়ে করে ফেলেছে? এমন হয়? না কিছুতেই হতে পারেনা। সাদ যদি একবার ওর সামনে যেয়ে দাঁড়ায় ভালোবাসার দাবি নিয়ে তাহলে শোভা কখনোই ওকে ফেরাতে পারবেনা। গুনগুনী মন নিয়ে মোবাইল স্ক্রল করে শোভা আর ওর পুরাতন ছবিগুলো দেখতে লাগলো। কত ছোট ছিলো তখন শোভা। তারপর আগামীকালের ট্রেনের টিকিট বুকিং করলো। সারারাত অস্থিরতায়
ঘুমাতে পারলোনা। আর টিনা? ওর সাথে সাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে চারমাস হলো। কারো সংসার ভেঙ্গে কেউ কখনো সুখী হতে পারেনা সেটা আবারও প্রমাণিত হলো।

________

রমজান সাহেব মেয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তা করেন আজকাল। দু’দুটো বাচ্চা নিয়ে সারাজীবন একলা কাটানো খুবই কষ্টের। সারাজীবন তো আর মেয়ের কাছে থাকতে পারবেন না। ইদানীং শরীরটাও ভালো যাচ্ছেনা। শোভা এমনিতেই খুব কষ্ট করে আজকের জায়গায় নিজেকে পৌঁছাতে পেরেছে। আর কষ্ট সইতে পারবেনা। কিন্তু একা একা জীবন কাটানো খুবই কঠিন। একটা গতি করতে পারলে চিন্তাটা কমবে। শাফিন তো বিয়ে করে নিয়েছে বাবামায়ের কথায়। বউ সায়মা’কে নিয়ে আছে বিদেশে! সায়মা খুব ভালো একটা মেয়ে। এমন পুত্রবধূ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। কাজের চাপে পড়ে দেশেও আসতে পারছেনা। কিন্তু তাও রোজ তিনবার ফোন দিয়ে বাড়ির সবার সাথে কথা বলবেই৷ রাফু আর তুতুলকে নিজের সন্তানের মতো দেখে। যাবতীয় খরচ শাফিনই দেয়। সায়মা তো পারলে কলিজাটাই কেটে দেয়। রাফু, তুতুল শাফিনকে ছোটআব্বু, আর সায়মাকে বড়মা বলে ডাকে।

রমজান সাহেব শাফিনের সাথে শোভার বিষয়ে আলোচনাও করেছেন। কিন্তু শাফিন সাফ মানা করে দিয়েছে শোভাকে যাতে বিয়ের কথা বলা না হয়। যদি কখনো নিজের ইচ্ছায় ও বিয়ে করতে চায়, তাহলেই যেন আগায়। শাফিন জানে, শোভা কখনোই বিয়ে করবেনা এবং এই কথা শুনলে খুব কষ্ট পাবে আর নিজেকে বোঝা মনে করবে। যা শাফিন চায়না। বোনকে খুব ভালোবাসে ও।

মা-বাবা, মিলি, সন্তানদের নিয়ে ছিমছাম পরিবার শোভার। ঝামেলাহীন জীবন পার করছে। স্কুলের চাকরিটা খুবই ভালো। বেতনও বেশ ভালো। চলে যাচ্ছে জীবন এভাবেই! বেডরুমের বিছানায়
বসে শোভা এক্সামের খাতা দেখছিলো। এমন সময় রাফু এসে বললো, ‘আম্মু!’

‘ বলো বাবা।’

‘ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’

শোভা চোখ তুলে মিষ্টি করে হাসলো। বললো, ‘তাই?’

‘ হুম।’

‘ হঠাৎ আমাকে তোমার কাছে এমন লাগছে কেন?’

‘ জানিনা।’

‘ তোমার ছোটআম্মু কোথায়?’

‘ বোনকে ঘুম পাড়ায়।’

‘ আচ্ছা। ডিস্টার্ব করোনা।’

‘ হুম।’

বলে রাফু মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়েই রইলো। রাফু শোভার চোখের চশমাটা খুলে হাতে নিলো। শোভা কিছু বললোনা। মনোযোগ খাতার দিকেই। রাফু হঠাৎ শোভাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আম্মু, আমাদের কী আব্বু নেই?’

শোভা চমকে তাকালো। রাফুর নিষ্পাপ চাহনি ওর গায়ে কাঁটা ফুটালো। চুপ করে রইলো। রাফু আবারও বললো, ‘বলোনা আম্মু। আমাদের কী আব্বু নেই?’

শোভা ছেলেকে কাছে টেনে নিলো। শান্ত কন্ঠে বললো, ‘আছে তো। তোমার ছোটআব্বুই তো আব্বু।’

রাফই জেদ করে বললো, ‘ছোটআব্বু আমার মামা হয়। কীভাবে আমার আব্বু লাগবে?’

শোভা রেগে বললো, ‘ওটাই তোমাদের আব্বু।’

‘ তুমি মিথ্যে বলছো। আমাদের স্কুলের সবার আব্বু আছে। আমাদের কেন নেই? আমি ছোটআব্বু চাইনা, আব্বু চাই।’

‘ কেন? ছোটআব্বু তোমার পছন্দ নয়?’

‘ পছন্দ। কিন্তু আসল আব্বু ও চাই আমার।’

‘ দরকার নেই!’

‘ আছে৷ আমি আমার বন্ধুদের বলেছি যে আমাদের আব্বু আছে, একদিন ঠিক আসবে।’

‘ কখনোই আসবেনা।’

‘ আসবে। আসলে আমি আব্বুর সাথে চলে যাবো।’

শোভা ছেলের কথায় বাক্যহারা হয়ে গেলো। চোখ ভিজে এলো। বলে কি এই ছেলে? শোভা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘কিছুতেই যেতে দেবোনা।’

রাফু স্বভাবতই খুব মাতৃভক্ত, শান্ত ছেলে। কিন্তু আজ কী এমন হলো যে ও নিজের আব্বুকে চাচ্ছে? আবার চলে যাবে তাও বলছে? রাফু গাল ফুলিয়ে বললো, ‘যাবো আমি।’

‘ রাফু!’

রাফু মাথা নিচু করে বসে আছে। শোভা বললো, ‘তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে? ছোটআম্মুকে ছাড়া থাকতে পারবে?’

রাফু মাথা নাড়িয়ে না জানালো। শোভা বললো, ‘রাফু! তোমারও আব্বু আছে। কিন্তু সে আমাদের চায়না।’

‘ কেন?’

‘ কারণ আমাদের ওর ভালো লাগেনা।’

‘ কিন্তু আমরা খুব ভালো।’

‘ জানি তোমরা ভালো। কিন্তু সে বুঝতে চায়নি। এজন্য আমি তোমাদের নিয়ে চলে এসেছি। আমাদেরকে খুব কষ্ট দিয়েছে তোমার আব্বু। তুমিই বলো কোনো বাবা কী তার সন্তানদের কষ্ট দেয়?’

‘ কখনোই না।’

‘ এখন বলো তার কাছে কি আমাদেত ফিরে যাওয়া উচিৎ?’

‘ না।’

‘ আমরা সবাই তো তোমাকে কত ভালোবাসি। এখন তোমার বাবা এসে যদি তোমাকে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তুমি?’

রাফু গালে হাত দিয়ে ভাবছে। কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। আচ্ছা, ওর বাবা কেন ওদের চায়না? সবাই বলে ওরা কত মিষ্টিবাচ্চা, ভালোবাচ্চা। তাহলে ওর বাবা কেন ভালোবাচ্চা চায়না? রাফু শুনেছে যারা ভালোদের ভালোবাসেনা, তাদের সাথে খারাপ হয় সবসময়। ভাবছে কি করবে, সত্যিই যদি বাবা আসে তাহলে কি বাবার সাথে চলে যাবে? নাকি মায়ের কাছেই থাকবে! ভাবনা নিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যায় গুটিগুটি পা ফেলে।

শোভা মনে মনে ভয় পায়। জানে সাদ যদি একবার খুঁজে পায় তাহলে বাচ্চাদেরকে ইম্প্রেস করবে কোনো না কোনোভাবে। কারণ সাদ বাচ্চাদের সাথে খুব সহজেই মিশতে পারে। একেবারে জাদুকরের মতো! এমন সময় মোবাইল বেজে উঠে। সাইফের ফোন।

‘ আসসালামু আলাইকুম।’

‘ ওয়ালাইকুম সালাম। শোভা বলছেন?’

‘ জি ভাইয়া। কোনো দরকার?’

‘ হুম। আসলে আমি চট্টগ্রামে বাসায় এসেছি।’

‘ ওহহ। আমাদের বাসায় অবশ্যই আসবেন কিন্তু।’

‘ আসবো। কিন্তু একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম।’

‘ কী কথা?’

‘ আসলে আম্মু আমাকে এখন বিয়ে দিতে চায়। অনেক তো বয়স হলো। কিন্তু!’

শোভা হেসে বললো, ‘কিন্তু আপনি কাউকে পছন্দ করেন। আর সেটা আমার পাগল বান্ধবী মিলি।’

সাইফ লজ্জ্বা পেলো। তারপর বললো, ‘কিন্তু ওনাকে তো আমি সেই কথাটা বলতে বা বোঝাতেই পারছিনা। যা রাগী।’

‘ মিলি বিয়ে করবেনা।’

‘ কেন?’

‘ ও ছেলেদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনা। কতকিছুই তো ঘটে গেলো ওর বোনের সাথে, আমার সাথে। সেজন্যই আরকি।’

‘ সব পুরুষ তো একরকম হয়না।’

‘ জানি। আপনি খুব ভালো, নইলে এতোবছর অপেক্ষা করতেন না। আচ্ছা, আপনি আপনার আম্মুকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসুন। মিলিকে সোজা করার দায়িত্ব আমার।’

‘ আসবো?’

‘ হুম। ঘাড়ত্যাড়ামি করা মেয়েকে ভালোবেসে সোজা করে নিবেন। পারবেন না?’

‘ ওনাকে দেখলেই ভয় লাগে!’

‘ ভয়কে জয় করে নিবেন। আমি আছিতো, ওকে ঠিক রাজি করাবো।’

সাইফ কিছুক্ষণ থেমে বললো, ‘আপনার জীবনটা গুছাবেন না! বাচ্চারা তো বড় হচ্ছে, ওদের তো একটা বাবা চাই!’

শোভা ফোন রেখে দিলো। বুঝতে পারছে না আজ সবাই ওকে পুরোনো কথাগুলো কেন মনে করিয়ে দিচ্ছে। একটা মেয়ে কি এতোই দুর্বল যে নিজে একা বাচ্চাদের নিয়ে বাঁচতে পারবেনা? কে তৈরি করেছে এই নিয়ম? এই নিয়মের বাইরে কেন যাওয়া যাবেনা? বাবা ছাড়া কি সন্তান একা বড় করা যায়না? রাস্তাঘাটে কতশত এতিম বাচ্চারা পড়ে থাকে, কই! প্রকৃতির নিয়মে ওরা তো ঠিকই বেঁচে আছে। শোভা তো আছেই, পারবে সন্তানদের সামলাতে। কেন মানুষ এটা বুঝতে পারছে না?

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। আপনারা নেক্সট না লিখে একলাইনে মতামত জানালেও ভালো হবে। দু’দিন গল্প না দেওয়ার জন্য দুঃখিত। জানি ছোট হয়েছে, দুঃখিত। ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১০

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

সেদিন ছিলো টিনা আর সাদের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী। তবে এসবে সাদের হেলদোল নেই। অফিস থেকে ফিরে এসে বাড়িতে কোথাও টিনাকে খুঁজে পেলোনা। সাদ মায়ের ঘরে যায়। রোমেলা বসে নামাজ পড়ছিলেন। সাদ জিজ্ঞেস করে, ‘টিনা কোথায়?’

রোমেলা চুপ করে থাকে।

‘ তুমি জানো? কোথাও তো ওকে পেলাম না?’

‘ বললে কী বিশ্বাস করবি?’

‘ কী?’

‘ ওই যে, টিনা কোথায়!’

‘ করবোনা কেন?’

‘ কারণ তোরা ভাবতেও পারবিনা ও এমন কাজ করতে পারে।’

‘ ভনিতা না করে বলে ফেলো!’

‘ টিনার যে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে, তুই জানিস?’

সাদ বড্ড অবাক হলো।

‘ মানে?’

‘ টিনা অন্য একটা ছেলেকে পছন্দ করে, তুই ভাবতেও পারবিনা ওই ছেলের সাথে ওর ফিজিক্যাল রিলেশন পর্যন্ত চলে।’

সাদ বড় একটা ধাক্কা খায়। টিনার সাথে অন্য লোকের সম্পর্ক আছে, তাও আবার ফিজিক্যাকি এটাচড? হোয়াট দ্যা? মা এসব কী বলছে? সাদ বিশ্বাস করতেই পারছেনা। কিন্তু মা যখন বলছে তখন বিশ্বাস করাটাই শ্রেয়।

‘ তুমি কী করে জানলে?’

‘ আমিতো আরও অনেক আগেই জেনেছি। তোদের বিয়ের পাঁচমাসের মাথায়ই।’

সাদ অবাক হয়ে বললো, ‘তাহলে এতোদিন বলোনি কেন?’

‘ তোর বাবার সামনে টিনাকে নিয়ে কিছু বলা যায়? তাছাড়া আমি নিজের কানে শুনেছি। ওরা কলেজে পড়াকালীন একপ্রকার কলগার্ল ছিলো, খুবই লুকিয়ে চুরিয়ে এই কান্ড ঘটাতো।’

‘ মা!’

‘ সত্যি বলছি। আমি এতোদিন বলিনি কারণ প্রমাণ ছিলোনা। কিন্তু আজ আছে। নিজের কানে শুনেছি ওরা “স্কাই হোটেলে” উঠবে আজ রাতে। টিনা হয়তো সেখানেই গিয়েছে।’

সাদিদ সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে শুনে ফেললেন। ঘরে ঢুকেই প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় মারলেন স্ত্রীর গালে। পঁয়ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে কখনো রোমেলার গায়ে হাত তুলেননি ওনি। রোমেলার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। সাদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাবার দিকে চেয়ে আছে।

সাদিদ সাহেব হুংকার ছেড়ে বললেন, ‘হচ্ছেটা কী এসব? তুমি টিনার নামে কীসব আজেবাজে কথা বলছো?’

‘ সত্যি বলছি।’

‘ তোমার এসব আজগুবি কথা বন্ধ করো। টিনা হতে পারে একটু অন্যটাইপ মেয়ে কিন্তু শরীর বিকিয়ে দেওয়ার মতো না।’

‘ হাসালে! যে বিয়ের আগেই তার ভার্জিনিটি খুইয়ে বসে আছে তাকে তুমি সাপোর্ট করছো?’

‘ আমি কাউকে সাপোর্ট করছিনা। তুমি জানো ওর বাবা কতটা ডেঞ্জেরাস মানুষ? যদি শুনে তার মেয়ের নামে কুৎসা রটিয়েছো তাহলে আমাদের জেলের ভাত খাওয়াবে।’

‘ ওনার ও তো জানা দরকার মেয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একটা দূষিত, নোংরা মেয়েকে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। অবশ্য আমার ছেলেই তো এসবের যোগ্য, সে তো কবেই ক্যারেক্টারলেস হয়ে গিয়েছে।’

সাদ মায়ের তুচ্ছতাচ্ছিল্য মেনে নিতে পারলোনা। খুব কষ্ট পেলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু টিনার বিষয়টাও দেখতে হচ্ছে ভেবে বাবার সাথে হোটেলে এলো। তখন রাত দশটা। কাউন্টার থেকে রুম নাম্বার খুঁজে খুঁজে পেয়েও গেলো। এবং দেখা গেলো রোমেলার কথাই ঠিক। দরজা খুলতেই দেখা গেলো টিনা আপত্তিকর অবস্থায় ইফতির সাথে। সাদিদ সাহেব বাক্যহারা হয়ে গেলেন। সাদ প্রচন্ড রেগে গেলো৷ এই ক্যারেক্টরলেস মেয়ের জন্য ওর মা বাবার হাতের থাপ্পড় খেলো? সে টেনে হিঁচড়ে হোটেল থেকে নিয়ে এলো টিনাকে।

বাড়ি এসে সাদ প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় মারলো টিনাকে। চিৎকার করে বললো, ‘কী এসব? এতো নিচ তুমি? ছিহ!’

টিনা চুপ করে আছে৷ কান্না করছে। ভাবেনি ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু ধরা যখন পড়েই গেছে তখন আর লাভ কি মিথ্যা বলে!

‘ কয়দিন ধরে চলছে এসব?’

টিনা এবার মুখ খুললো।

‘ বিয়ের আগে থেকেই।’

সাদ ঠাস করে থাপ্পড় মারলো।

টিনার কোনো ভাবান্তর হলোনা। সে বললো, ‘তুমি যা করতে পারো, আমিও তাই পারি!’

‘ মানে?’

‘ বিয়ের আগে তুমিও তো এসব করেছো।’

‘ না। শোভা আমার লিগ্যাল ওয়াইফ ছিলো।’

‘ ওই একই হলো।’

‘ এক হয়নি।’

‘ কেন হয়নি? তুমি ওর সৌন্দর্য উপভোগ করবে বলেই তো বিয়ে করেছিলে, তাইনা? ভালোবেসে তো করোনি। শুধু বৈধতার দোহাই দিয়েছিলে। আর কিছু না। কিন্ত ইফতির সাথে আমার লিগ্যাল সম্পর্ক না থাকলেও আমি ওকে ভালোবাসি।’

সাদ রেগে চিৎকার করলো।

‘ টিনা! তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।’

‘ মোটেই না। এবার যখন সব জেনেই গেছো তবে আমাকে মুক্তি দিয়ে দাও।’

সাদ চমকে উঠলো। আবার! আবার সেই মুক্তির কথা? মানতে পারলোনা সাদ। টিনাকে থাপ্পড় মেরে বললো, ‘পতিতা একটা।’

সাদিদ সাহেবের মুখভঙ্গি দেখার মতো হলো। টিনার বাবা অনেক কড়া। তাঁর মেয়ে হয়ে টিনা এরকম হলো আর সেটা সাদের কপালেই জুটলো? কেন এমন হলো ওনার ছেলের সাথে? এর চেয়ে তো শোভাই ভালো ছিলো। না পূরণ হলো ছেলের বউয়ের শখ, না দেখাতে পারলো নাতি-নাতনিদের মুখ। মাঝখান থেকে সম্মান নিয়ে টানাটানি। এর উপর টিনাকে কিছু বলার অধিকার তাদের স্বামী-স্ত্রীর নেই। কারণ ঘরের সব কাজ রোমেলাকে দিয়ে করায় টিনা, পা পর্যন্ত টিপিয়েছে। কাপড়চোপড় ধোয়া, রান্না করা, ঘর গুছানো, এমনকি গ্লাসে পানিটা পর্যন্ত ঢেলে দেয় রোমেলা। সাদিদ সাহেবের রিটায়ার্ডের পর বাজার করা, ইলেকট্রিক বিল দেওয়াটাও নিজের কর‍তে হয়। যেটা আগে দারোয়ান করতো। অপমান করতেও ছাড়েনি। কয়েকদিন আগে তো ওদেরকে বৃদ্ধাশ্রমেই পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো, ভাগ্যিস হয়নি। এককথায় বৌমা’র সুখ ওদের কপালে জুটেনি। এটা যে শোভার সাথে করা অন্যায়ের ফল, সেটাও এতদিনে বুঝে গিয়েছে। তাও সাদিদ সাহেব কিছু বলেননি টিনাকে। যেমন ইচ্ছা, তেমন চলতে দিয়েছেন। সাদ তো কবেই দেবদাসের রুপ ধারণ করেছে। কোনোমতে অফিসটা করে খালি। আর সারাদিন ভাবনায় মত্ত্ব। এই সুযোগেই টিনা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, যার মুখোশ আজ উন্মোচিত হলো।

শোভার অভিশাপটাই কাল হলো ওদের। চোখের পানিতে মুখ ধুয়েও কুল হচ্ছেনা। আচ্ছা, মেয়েটা কোথায়? একটিবার দেখা হলে ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। ক্ষমা কী করবেনা শোভা? নউকে যে মরেও শান্তি পাবেনা। এসব ভাবাভাবির মাঝেই সাদ আর টিনার ঝগড়া শুরু হলো। সাদিদ সাহেব ভাবনার প্রহর কাটিয়ে ওদেরকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু টিনা বেয়াদবের মতো সাদিদ সাহেবের গালে চড় মারলো। পুরো ঘর স্তব্ধ হয়ে গেলো। কত বড় স্পর্ধা টিনার!

থাপ্পড় মেরেই টিনা ক্ষান্ত হয়নি। রাস্তার কুকুরের সাথে সাদিদ সাহেবের তুলনা করেছেন এবং রেগে ওনার মুখে থু থু ছিটিয়েছেন। সাদ টিনার টুটি চেপে ধরলো। হাতাহাতির এক পর্যায়ে রোমেলার চিৎকারে ওরা থেমে গেলো। সাদিদ সাহেব রোমেলার উপর ঢলে পড়লেন।

অজ্ঞান অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। ভর্তি করাও হলো কারণ অবস্থা ভালো নয় ওনার।করিডোরে সবাই অপেক্ষা করছে, টিনা আসেনি। ডাক্তার কিছুক্ষণ পর এসে সাদিদ সাহেবকে মৃত ঘোষণা করলেন! রোমেলার চিৎকারে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। কে দায়ী ওনার মৃত্যুর জন্য? সাদ? নাকি সাদিদ সাহেব নিজেই? শোভার প্রতি করা অন্যায়ের শাস্তিটা কী কম হয়ে গেলো সাদিদ সাহেবের! সৃষ্টিকর্তা একবেলা ছাড় দিয়েছেন কিন্তু ছেড়ে তো দেননি!

হার্ট-অ্যাটাকে মৃত্যু হয় ওনার। অবশ্য এমনি এমনি তো আর হয়নি। টিনার অত্যাচারে, ওর আসল চরিত্র বেরিয়ে পড়ায় সাদিদ সাহেব আর সইতে পারলেন না। পাপের শাস্তি এমনই হয় হয়তো।

সাদ’দের দোতলা বাড়িটা আজকাল বড়ই নির্জীব হয়ে গিয়েছে। রাতেরবেলা ভুতুড়ে পরিবেশ। নেই কোনো হৈ-হুল্লোড়, চেঁচামেচি। অথচ চারবছর আগেও বাড়িটা কী অন্যরকম ছিলো। সারক্ষণ হাসি-আনন্দে মেতে থাকতো। সাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। তবুও মাটি কামড়ে মাকে ধরে পড়ে আছে এই বাড়িটাতে। এইতো ক’দিন আগে সাদিদ সাহেব পরপাড়ে পাড়ি জমালেন। একা করে রেখে গেলেন স্ত্রী আর একমাত্র পুত্রসন্তানকে। টিনা ক’দিন এ বাড়িতেই ছিলো। মেয়ের কুকীর্তি জেনে ওর বাবা এসে নিয়ে গিয়েছেন। ইফতি মানসম্মানের ভয়ে টিনাকে ছেড়ে দেয়। কারণ এই খবর রীতিমতো সবাই জেনে গিয়েছে। এখন টিনাকে যদি ইফতি বিয়ে করে তাহলে ওর বাবা ওজে ত্যাজ্যপুত্র করবে। সামান্য একটা মেয়ের জন্য ইফতি এরকম করতে পারবেনা,তাও আবার বিবাহিত। বেঁচে থাকলে অনেক সুন্দরীর দেখা পাবে। এসব ভেবেই টিনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং বিদেশে পাড়ি জমায়। অহংকারে জর্জরিত টিনা পরবর্তীতে সাদের সাথেই সংসার করতে চাইলো। সাদ মেনেও নিলোনা, আবার কিছু বললোও না। ক্ষমা করতে পারেনি টিনাকে। একসময় জানা গেলো টিনা কোনোদিন মা হতে পারবেনা। এরপরই টিনার বাবা এসে মেয়ের কান্ড শুনে রেগে যান, মেয়েকেও নিয়ে যান। এভাবেই পথের ধূলিকণার সাথে মিশে গেলো তিন তিনটি মানুষের অস্তিত্ব। বিত্ত-বৈভব, অবহেলা, অহংকার, চাহিদা, চরিত্রহীনতা, পরকীয়া একা করে দিলো মানুষগুলোকে। প্রকৃতির শোধ!

__________

শোভা সকাল সকাল বাচ্চাদের নিয়ে বেরুলো। এই বছরই স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। কীভাবে যে এতগুলো বছর পার হয়ে গিয়েছে তা বুঝতেই পারেনি। তবে দিনদিন শোভা আরও সুন্দর হয়ে উঠছে। এখন সবসময় শাড়ি পড়ে, লম্বা চুলগুলো বিনুনি করে রাখে। দেখতে খুবই স্নিগ্ধ লাগে।

শোভার মা বাচ্চাদের টিফিন রেডি করে দিয়েছে। মিলির হাতে টিফিনের ব্যাগ। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দুজন অফিস যাবে। একটা স্কুলে দুজনেরই চাকরি হয়েছে। পাশাপাশি অনলাইনে একটা বুকশপও চালায় মিলি আর শোভা। রাস্তা পার হতে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। তুতুলের সামনে এসে পড়ে একটা রিকশা, মিলি দ্রুত কোলে নিয়ে সরে পড়ে। রাফু বোনকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘তুই একনো ঠিকমতো চলতে পারিস না বোন। তো ছোটআম্মুর কোলে থাকলেই পারিস!’

তুতুল পিটপিট করে ভাইয়ের দিকে তাকালো। ‘স্যরি দাদাভাই। তুমি আমাকে কোলে নিয়ে পার করে দেবে এরপর থেকে, ওখে?’

‘ না। আমিও তোর মতোই ছোট বাচ্চা।’

তুতুল মিলিকে বললো, ‘ছোটআম্মু! দাদাভাই কী এতোই ছোট যে আমাকে কোলে নিতে পারবেনা?’

মিলি মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করে বললো, ‘হুম। ভাই তো খুব ছোট। তুমি আমার কোলে উঠেই রাস্তা পার হবে, ঠিক আছে?’

‘ আচ্ছা।’

শোভা ছেলেমেয়েদের কান্ডকারখানা দেখে হেসে ফেললো। মিলি চোখ পাকিয়ে বললো, ‘হাসছিস কেন?’

‘ আমার মনে হচ্ছে তুইই ওদের আসল মা। দেখিস না, ওরা আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।’

মিলি হেসে বললো, ‘বাচ্চা তো।’

‘ যা-ই বলিস, তুই ওদের জন্য যা করিস, আমি তা কখনোই করতে পারতাম না।’

কথা বলতে বলতে ওরা স্কুলে এসে গেলো। দুজনকে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে মিলি একগাদা নোটিস দিতে লাগলো। কি খাবে, কিভাবে লিখবে, ব্যাগের কোন পকেটে কি আছে, কার সাথে খেলবে, বাথরুম পেলে কোথায় যাবে, সবার ভদ্রভাবে কথা বলতে, দুজন যাতে দুষ্টুমি না করে সব বুঝিয়ে দিলো। শোভা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। মিলিটা এতো ভালো কেন? এতো বছর হয়ে গেলো অথচ নিজের জীবন নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। জীবনটা তো গোছাতে হবে। এভাবে শোভার জন্য সেক্রিফাইস করতে থাকলে শোভা যে অনেক বেশি ঋণী হয়ে পড়বে।

স্কুলে যাবার পথে শোভা মিলিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘সাইফের সাথে কথা হয়েছে?’

‘ হুম। ওনি পরশু আসবেন চট্টগ্রামে।’

‘ কোনো দরকারে?’

‘ জানিনা। ওই হাঁদাটা বলেছে বিশেষ দরকার আছে।’

‘ এখনো হাঁদা ডাকাটা গেলোনা তোর।’

‘ তাহলে কী বলবো? জানু? প্রাণু?’

‘ জামাই ডাকবি।’

মিলি অবাক হয়ে বললো,’মানে?’

‘ আমার মনে হয় সাইফ ভাই তোকে পছন্দ করে!’

‘ তোকে বলছে?’

‘ না। কিন্তু আচরণেই বোঝা যায়। সবসময় কেমন খোঁজখবর নেয় দেখিস না!’

মিলি মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘খোঁজখবর নিলেই কী বোঝা যায় একজন আমাকে পছন্দ করে? তাছাড়া আমি এসবে বিশ্বাসই করিনা। আমার এসবে ইন্টারেস্ট নাই। যেমন আছি তেমনি ভালো আছি!’

‘ তার মানে তুই চিরকুমারী থাকবি? বিয়ে করবিনা?’

‘ হুম।’

‘ মিলি!’

‘ বল!’

‘ সাইফ ভাই যদি তোর সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলে তুই তাঁকে ফিরিয়ে দিবি?’

‘ ফিরিয়ে দেবো কেন? বাসায় নিয়ে নাস্তা খাওয়াবো। আফটার অল আমাদের পারিবারিক ডাক্তার বলে কথা!’

‘ আমি সেটার কথা বলছিনা। যদি ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসে, তখন?’

মিলি কিছু বললোনা। গভীর চিন্তায় মগ্ন! আচ্ছা, পুরুষ মানুষ এমন হয় কেন? মিলির খুব ইচ্ছে করে ওদের বিশ্বাস করতে, কিন্তু কই? যতবার কাউকে বিশ্বাস বা ভরসা করেছে সবাই তাঁকে ঠকিয়েছে। সাদের মতো মানুষটাও৷ কি রহস্যের বেড়াজালে নিজেকে ঢেকে রেখেছিলো, চিন্তা করে কুল পাওয়া যায়না। সাদ হয়তো সুখেই আছে। যদি সে ভালোই হতো, তাহলে এতোদিনে নিশ্চয়ই শুধরে যেতো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলি শোভাকে নিয়ে স্কুলে পা রাখে। বিশাল বড় গার্লস স্কুল। সরকারি চাকরি। দিন তো ভালোই কাটছে, সবচেয়ে বড় কথা রাফু আর তুতুলকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মিলি ভাবতেও পারেনা। ছোট্ট পুচ্চুগুলো মিলির জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে আছে। যখন ছোটআম্মু বলে ডেকে ওঠে তখন নিজেকে মাতৃরুপে সম্পূর্ণ আবিষ্কার করে। এমন বাচ্চাদের ছেড়ে মিলি কী ঘর বাঁধতে পারবে নাকি! কখনোই না।

চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল-ত্রুটি মাফ করবেন।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৯

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

পরদিন শোভাকে নিয়ে মিলি হসপিটালে যায়। ডাক্তার সাইফের সাথেও দেখা হয়। ড্রেসিং সেরে ওরা খানিকক্ষণ বসে। বাচ্চাদেরকে বাসায় রেখে আসা হয়েছে। সালমা বেগম আর কাজের মহিলা দেখে রাখবেন। এমনিতে বেশি কান্নাকাটি করে না, এটাই ভালো দিক। ক্যান্টিন থেকে হালকা খাবারও খেয়ে নেয়। আসার পথে আবারও সাইফের সাথে দেখা। সাইফ মিলিকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভালো আছেন?’

‘ আজব। একটু আগেই না দেখা করলাম। তখন জিজ্ঞেস করলেন না কেন?’

‘ মনে ছিলো না।’

‘ ভালো। আপনি?’

‘ ইয়ে.. আমিও ভালো।’

‘ আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?’

‘ না মানে বাচ্চাদের দেখেশুনে রাখবেন। কোনো হেল্প লাগলে লজ্জ্বা না পেয়ে আমাকে জানাবেন!’

মিলি বিস্ময় নিয়ে বললো, ‘সাহায্য লাগলে অবশ্যই চাইবো, এখানে লজ্জ্বা পাবার মতো কী আছে?’

‘ না মানে, মেয়েরা একটু লজ্জ্বাবতী হয় তো তাই।’

‘ আমি অন্যসব মেয়েদের মতো নই, ওকে?’

সাইফ থতমত খেয়ে বলে, ‘ওহ আচ্ছা।’

শোভা দুজনের খুনসুটি দেখে হেসে ফেললো। মিলি রেগে বললো, ‘দাঁত কেলাচ্ছিস কেন?’

‘ এমনি।’

তারপর সাইফকে বলে, ‘আসলে ভাইয়া, আমাদের মিলির মাথাটা না একটু খারাপ আছে। সে সবকিছু সহজভাবে নিতে পারেনা।’

সাইফ তাল মিলিয়ে বললো, ‘বুঝতে পেরেছি।’

মিলি চোখ পাকিয়ে তাকালো। বললো, ‘কী বুঝতে পেরেছেন?’

‘ এই যে, আপনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না!’

‘ কে বললো?’

‘ আপনার আচরণ দেখেই বোঝা যায়।’

মিলি গলা নরম করে বললো, ‘মোটেও না।’

শোভা সাইফকে বললো, ‘ভাইয়া, আমি লক্ষ্য করেছি আপনি মিলিকে ভয় পান। কারণটা জানতে পারি?’

সাইফ হাসে। তারপর নিজের মায়ের ঘটনাটা বেশ সাহস নিয়ে বলে। সাইফের মায়ের সাথে নিজের আচরণের মিল খুঁজে পেয়ে মিলি প্রচন্ড লজ্জ্বা পেয়ে যায়। সাইফ চকিতে লক্ষ্য করে মিলিকে। শোভা দুজনের চাহনি লক্ষ্য করে আড়ালে হাসলো। সাইফ নিজের মনেই ভাবে, আজ এতো সহজে এতো কথা বলে ফেলেছে, কী হয়েছে ওর? প্রেমে একেবারে হাবুডুবু অবস্থা। বাতাসেও যেন প্রেম প্রেম গন্ধ। আহা! বিকেলটা আজ এতো সুন্দর কেন? মিলির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু মিলির ভয়ঙ্কর দৃষ্টির দিকে তাকানোর সাহস পেলোনা! “বাতাসে বহিছে প্রেম/নয়নে লাগিলো দোলা!” আহা।

এভাবেই কথা বলতে বলতে বাইরে চলে এলো। এমন সময় সামনে তাকিয়ে শোভা দেখলো সাদ! হঠাৎ সামনে পড়ে যাওয়ায় সাদও দাঁড়িয়ে পড়লো। ওদেরই তো খুঁজছিলো সাদ। এদিকে শোভা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আটমাস পর মানুষটার সাথে দেখা। ওই অমানুষ, বিশ্বাসঘাতকটার সাথে কেন দেখা হলো! শোভা ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে নিলো যার অর্থ সাদ তার কাছে এখন পরপুরুষ, সে সাদের মুখ দেখতে চায়না এবং সাদকেও নিজের চেহারা দেখাবেনা।সাদও বুঝে গেলো। এতোদিন পর দেখা, ভালো করে শোভাকে লক্ষ্যও করতে পারলোনা। কিন্তু একঝলকের দেখায় বুঝতে পারলো শোভা আগের চেয়ে এখন আরও বেশি সুন্দরী হয়েছে। মিলি, সাইফ দুজনই চুপ। পরিস্থিতি কেমন ঘোলাটে। মিলি দাঁতে দাঁত চেপে শোভার হাত ধরে সাইফকে বললো, ‘আমাদের একটা রিকশা ঠিক করে দিন।’

সাইফ বিনয়ের সঙ্গে বললো, ‘চলুন।’

ওরা পা বাড়াতেই সাদ পথ আটলায়। এবার মিলির আগেই শোভা বলে উঠলো, ‘কী চাই?’

সাদ অকপটে বলে উঠলো, ‘ বাচ্চাদেরকে।’

শোভা হেসে ফেললো। ভ্রু নাঁচিয়ে বললো, ‘আমাকে চান না?’

সাদ কি বলবে ভেবে পেলোনা। শোভা বললো, ‘কিন্তু বাচ্চাদের তো আমি দিতে পারিনা।’

‘ কেন?’

‘ সেই প্রশ্নের কৈফিয়ত আমি কোনো অমানুষকে দেবোনা।’

সাদ রেগে বললো, ‘দিতে হবে, আমি ওদের বাবা।’

‘ নো মিস্টার! আপনি হয়তো বাবা নামের অর্থ বা ব্যাখা কিছুই জানেন না। প্লিজ আগে এসব জেনে আসুন।’

‘ তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো শোভা।’

‘ আরে। আমি কোথায় বাড়াবাড়ি করলাম?’

‘ বাদ দাও। এখন বলো আমার বাচ্চাদের দিবে কিনা?’

‘ প্রশ্নই আসেনা। ওদের জন্ম দিয়েছি আমি, আমি ওদের মা। নয়মাস পেটে ধরেছি, নিজে মরতে মরতেও ওদেরকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি কী আপনার কাছে তুলে দিবো বলে? এতোই সোজা? যেন ওরা আপনার কেনা পণ্য?’

সাদ রেগে বললো, ‘হুম পণ্যই!’

শোভা সাদের গালে থাপ্পড় মারলো। বললো, ‘ভবিষ্যতে আপনার এই মুখ কোনোদিন আমাকে দেখাবেন না। ফল ভালো হবেনা।’

সাদ শোভার গলা চেপে ধরে। আচমকা এরকম কান্ডে মিলি এবং সাইফ দুজনেই হতভম্ব হয়ে যায়। মিলি টেনেও সাদকে সরাতে পারছেনা। সাইফ এক ধাক্কায় সাদকে সরিয়ে দেয়। রেগে বললো, ‘আপনার সাহস তো কম না, আপনি শোভার গায়ে হাত তুলেন! আপনার তো জানা উচিৎ আপনাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে এবং বাচ্চাদের অধিকার একমাত্র শোভার আছে। তাহলে আপনার এসব ঝামেলার মানে কী? হোয়াট দ্যা হেল..!’

‘ ওই কু* বাচ্চা। তোকে বলতে হবে? কে তুই?’

সাদের মুখের ভাষা খারাপ করায় শোভা আরও রাগলো। বললো, ‘নিজের পরিচয় তো দিয়ে দিলেন। আর ওনি কে জানতে চান? ওনি আমার ভাই, বুঝছেন?’

‘ এখন তো কত লোককেই ভাই বানাবি। তোর মতো মেয়েরা এমনই হয়।’

মিলি এবার ফুঁসে ওঠে। বললো, ‘তাই বুঝি দুই বিয়ে করেছেন? বাচ্চাদের জারজ বলেছিলেন? আহা! কী ভালো পুরুষ মানুষ আপনি!’

সাদ বললো, ‘তুই চুপ থাক।’

শোভা সাদকে চিৎকার করে বললো, ‘বাজে ভাষা বন্ধ করুন। নইলে দেখবেন আমি কী করতে পারি। এখন কেন আসছেন বাপের অধিকার দেখাতে? যখন আমি, আব্বু, ভাইয়া, মিলি আপনার কাছে অনুরোধ করেছিলাম তখন কোথায় ছিলো এই অধিকারবোধ? এখন মনে পড়লে হাসি পায়, আপনার মতো কীটের জন্য আমি হাত কেটে মর‍তে গিয়েছিলাম। এতগুলো মাস আত্মীয়স্বজনরা আমাকে কী পরিমাণ মানসিক টর্চার করেছেন আপনি জানেন? সবাই বলতো এবং এখনো আমাকে কলঙ্কিনী বলে। আশেপাশের মানুষজন্ এখন আর আমাদের সাথে মিশেনা, বিপদে এগিয়ে আসেনা। সমাজে আমার বাবা মুখ দেখাতে পারেনা আমার জন্য। আমি ভুল করেছিলাম, তাই শাস্তি পাচ্ছি। এতোসব সহ্য করে ওদের দুনিয়ার আলো দেখালাম আর আপনি ফ্রিতে বাচ্চা দাবি কর‍তে আসেন? কেন? কোন দায়িত্ব পালন করেছিলেন আপনি যার বিনিময়ে ওদেরকে আপনার হাতে তুলে দেবো?’

সাদ সব শুনলো। কিন্তু নিজের ভুল স্বীকার করতে রাজি নয়। একপ্রকার হাতাহাতির পর্যায়ে পরিস্থিতি চলে গেলো। সাইফ সাদকে কিল-ঘুষি দিয়েও দমিয়ে রাখতে পারলো না। একসময় হুমকি দিলো বাচ্চাদের চুরি করে হলেও নিয়ে আসবে। আর শোভা যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে মেরে ফেলবে। হুমকি শুনে শোভা সাদকে পায়ের স্যান্ডেল খুলে থাপ্পড় মারলো। তারপর কাঁদতে কাঁদতে মিলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।

বাড়ি এসেই সবাইকে এই ঘটনা খুলে বললো। রমজান সাহেব রিস্ক নিতে চাইলেন না। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এলেন। এই শহরেই আর থাকবেনা ওরা। মিলিও সাথে চললো। ডাক্তার সাইফ ওদেরকে সাহায্য করলেন খুব। শাফিন, মিলি সবকিছু ঠিকঠাক করে রাতে রাতেই বাচ্চাদের নিয়ে শহর ছাড়লো। সাইফও সাথে গেলো, ও এখন ওদের পরিবারের একটা অংশের মতো হয়ে গিয়েছে। কারণ ছোট বাচ্চাদের এতোদূর নিয়ে যাবে, সাথে একজন ডাক্তার থাকলে ভালো।

_____

চট্টগ্রামের এক নতুন পরিবেশে নতুন করে জীবন সাজালো ওরা। সাইফ পরদিন ঢাকায় ফিরে এলো। তবে ওদের সাথে যোগাযোগ আছে ওর। কারণ ওর বাড়িও চট্টগ্রাম । দুই বছর কেটে গেলো, শোভার একটা চাকরিও হয়েছে। বাচ্চারাও একটু একটু করে বড় হচ্ছে। কথা বলা শিখছে। শোভা মনে প্রাণে চায় ওর কালো অতীত ভুলতে, কিন্তু পারেনা। তবে নতুন করে জীবন সাজিয়ে নিয়েছে। ঠিক করেছে আর কোনোদিন বিবাহ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হবেনা। একাই মানুষ করবে সন্তানদের, দেখিয়ে দেবে ওই সাদটাকে। বাবা হয়েও কীভাবে পারলো সন্তানদের মেরে ফেলার কথা বলতে? অমানুষ একটা।

________

সাদ অফিস শেষে পার্কে এসেছে। বেঞ্চে শুয়ে আছে। আজকাল নিজেকে পাগল পাগল লাগে। কিচ্ছু ভালো লাগেনা। রাত-বিরেতে কিলবিল করে উঠে পুরো শরীর। তখন মনে হয় দুনিয়া উলটপালট করে দিতে। এভাবেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো শোভা ওর বাচ্চাদের নিয়ে? একবারের জন্যও দেখতে পারলো না। দুই-দুইটা সন্তান ওর। একজনকে পাবার অধিকারও তো ওর আছে!

সাদের মাথাব্যথা করছে। কোথায় খুঁজবে শোভাকে? এই এতোবড় দেশের কোন কোণায় গিয়ে লুকিয়ে আছে শোভা! সাদের ফোন বেজে উঠলো। বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো ও।

‘ হ্যালো বেবি।’

‘ বলো।’

‘ কোথায় তুমি?’

‘ জানিনা।’

‘ জানিনা মানে?’

‘ আমি জাহান্নামে আছি!’

‘ এভাবে কথা বলছো কেন? তুমি কী আমাকে বাসার কাজের লোক ভেবেছো? ডিসগাস্টিং!’

‘ ফোন রাখো তো।’

‘ আসার সময় আমার জন্য পিৎজা নিয়ে এসো। আজ যা রান্না হয়েছে, গলা দিয়েই নামছে না।’

‘ কেন? কী হয়েছে?’

‘ তোমার আম্মু কিসব রান্না করেছে, মুড়িঘণ্ট, শাকপাতা, এসব কী কেউ খায়?’

‘ আমি খাই, আমার প্রিয় খাবার।’

‘ ইয়াক।’

সাদ বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আটটা। ঠিক সময় টিনার জন্য পিৎজা না নিয়ে গেলে হৈচৈ শুরু করবে। মেয়েটার বড্ড চাহিদা। এদিন এটা, ওদিন সেটা এই করে করে দিন কাটাচ্ছে। সংসারের দিকে কোনো খেয়াল নেই। এরকম মানুষও যে ওর কপালে জুটেছে সাদ ভাবতেও পারেনা। দুই বছরের সংসার জীবনে অশান্তি ছাড়া আর কিছুই পায়নি।

সাথে সাথেই উঠে গেলো। দোকানপাটে খুব বেশি মানুষজন নেই। একটা প্রেস্টিশপ থেকে পিৎজা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো সাদ।

বাড়ি ফিরে দেখে ড্রইংরুমে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখছে টিনা। সাদকে দেখেই দৌড়ে এলো। বললো, ‘এনেছো?’

‘ হুম।’

‘ দাও।’

সাদ পিৎজার বক্সটা ওর হাতে দিলো। টিনা সোফায় বসে আয়েশ করে খাচ্ছে। সাদ ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু মা-বাবাকে কোথাও দেখতে পেলোনা। সাদ টিনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আম্মুরা কই?’

‘ ঘরে!’

‘ ঠিক আছে। তুমি আমার খাবারটা বেড়ে দাও।’

টিনা বললো, ‘খাবার তো আমি ফেলে দিয়েছি।’

‘ ফেলে দিয়েছো মানে?’

‘ মানে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি। এসব কেউ খায় নাকি?’

সাদ অবাক হয়ে গেলো।

‘ এসব শাকপাতা, ডালভাত কোনো খাবার? তোমার মা যে কী! এসব রান্না করে আমাকে বলে খাও। রাগ উঠে গেলো, সব ফেলে দিলাম।’

‘ আম্মুরাও খায়নি?’

‘ জানিনা।’

‘ তাহলে আমি এখন কী খাবো?’

‘ কেন? এই যে পিৎজা! আমাদের জন্যই তো এনেছি।’

‘ আমি এসব খাইনা!’

‘ আরে বেবি। রাগ করো কেন, একদিন খেলে কিছু হবে না।’

‘ বাড়ির সবাই না খেয়ে আছে, আর তুমি আমাকে পিৎজা খেতে বলছো? মাথায় কী সেন্স নাই? বুড়ো মানুষগুলোকে খালি পেটে রেখে এখানে বসে বসে খাচ্ছো।’

টিনা ন্যাকামি করে বললো, ‘কীহ! আমি বসে বসে খাই শুধু। তুমি আমাকে এমন বলতে পারলে?’

‘ হুম পারলাম।’

‘ জানিতো। এখন আরও কতকিছুই বলবে।’

টিনার ভিত্তিহীন কথাবার্তা আর কাজকর্ম রাগ তুলে দেয় সাদকে। না খেয়েই গিয়ে শুয়ে পড়ে ঘরে। টিনা বড্ড বেশিই বেয়াদব। মা-বাবার বয়স হয়েছে এরপরেও টিনা ওদের একটু শান্তিতে থাকতে দেয়নি। কিছু বললেই ন্যাকা কান্না। ওই দুজন মানুষ নাতিনাতনির আশায় পথ চেয়ে বসে আছেন। কোথায় কী!

টিনা রাতে ঘুমুতে এলে সাদ ঠান্ডা মেজাজে জিজ্ঞেস করে, ‘বেবি! একটা কথা বলি?’

‘ বলো।’

‘ চলোনা, আমারা একটা বাচ্চার ট্রাই করি।’

টিনা রেগে বললো, ‘সাদ! তোমার এই ফালতু টপিক প্লিজ বন্ধ করো। এসব ন্যাকামু কথাবার্তা আমার একদম ভালো লাগেনা। লাইফটাকে এঞ্জয়ই করা হয়নি৷ আর তুমি বাচ্চা বাচ্চা করছো।’

সাদ বলে, ‘দেখো আমাদের সাথেই যাদের বিয়ে হয়েছিলো তাদের কত সুন্দর বাচ্চা হয়েছে। আমাদের অফিসেরই নাহিলের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। কি সুন্দর ফুটফুটে, কোলে নিয়ে ঘুরে। আমারও তো ইচ্ছা হয় বাবা ডাক শোনার।’

টিনা পাত্তা দিলোনা। কিছুক্ষণ বকবক করে ঘুমিয়ে পড়লো। সাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ একটা বাচ্চার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে, কিন্তু ওর ইচ্ছে পূরণ হচ্ছেনা। বাবা ডাক শোনার জন্য বুকটা খাঁ খাঁ করে, কিন্তু কোথাও এই মধুরতম শব্দটা ওর কানে বাজেনা। ওর কোলে একটা বাচ্চা শোভা পায়না। শোভা! হ্যাঁ, ওর তো দুটো সন্তান আছে, কোথায় ওরা এখন? কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে! না জানি দেখতে কেমন, কত বড় হয়েছে। আচ্ছা, ওদের কী দাঁত উঠেছে? কামড় দেয়? ছোট্ট হাত-পা নাড়িয়ে হাঁটতে পারে? চোখগুলো কার মতো হয়েছে? নাম কী ওদের? কিচ্ছু জানেনা সাদ, কিচ্ছুনা। চোখের দেখাটা দেখতেও পারেনি। একবার খুঁজে পেলে আর দূরে যেতে দিবেনা ওদের। কিছুতেই না। শোভার কাছ থেকে কেড়ে নিবে ওদের। প্রাণপণে খুঁজে চলেছে ওদের লোক লাগিয়ে।

চলবে।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৮

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

সাদ নামক অমানুষটা শোভার পিছু ছাড়লো না। হসপিটালে যে ক’দিন রাখা হলো সেই ক’দিন নিয়মিত গিয়ে ঝামেলা করে আসতো। ওর এসবে অতিষ্ঠ হয়ে রিলিজ করার একদিন আগেই শোভাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। কারণ সাদের হাত অনেক লম্বা। যদি ওদের কিছু করে বসে? তখন কোনোকিছু করার থাকবেনা। শোভা জাস্ট এসব সহ্য করতে পারছেনা। লোকটা কেন তার জীবন নিয়ে আবারও ছিনিমিনি খেলতে চাইছে? সে কী বুঝতে পারছে না শোভা আর ওকে চায়না! এক বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা দূর অনুভূতিটুকুও নেই। শোভা এখন তাঁর সন্তানদের নিয়ে বাঁচতে চায়।

মিলিও শোভার বাসায় শিফট করেছে। সে নিজ হাতে বাচ্চাদের খাবার বানিয়ে দিচ্ছে, খেয়াল রাখছে। একজনকে ঘুম পাড়িয়ে অন্যজনকে নিয়ে ঘরে হাঁটাহাঁটি করছে। নিজের সন্তান হলে যেরকম করতো, সেভাবেই শোভার বাচ্চাদের দেখে রাখছে।
শোভার মেয়ের হার্টের প্রবলেমটা এখন আর অতোটা নেই৷ ডাক্তার সাইফই সবকিছু দেখেছেন, চিকিৎসা করেছেন। সেদিন এটা জানার জন্যেই মিলি সাইফের কাছে গিয়েছিলো। অশান্ত মনটা বারবার জানিয়ে দিচ্ছিলো এই বুঝি শোভার মেয়েটার কিছু হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এতোটাও কঠিন হননি। সুস্থ রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ।

শোভা একটু একটু হাঁটার চেষ্টা করে। পেটের সেলাইগুলো মোটামুটি শুকিয়ে এসেছে। আজকালের মধ্যে ড্রেসিং কর‍তে যেতে হবে হসপিটালে। মিলি ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ঘরময় পায়চারি করছিলো। তখুনি সালমা বেগম এসে বললেন, ‘কী রে মিলি তুই? এখনো সকালের খাবারটা মুখে দিসনি?’

‘ এই তো যাচ্ছি। পুচ্চুটা ঘুমিয়ে নিক।’

‘ আমার কোলে দে। শিগগির খাবারটা খেয়ে নে মা। নইলে পেটে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হবে!’

‘ তুমি খেয়েছো? শুভি খেয়েছে?’

‘ হুম। তুইই বাকি। যা না মা!’

মিলি সালমা বেগমের তোড়জোড়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ডাইনিংয়ে গেলো। সে সকালে নাস্তা খেতে পারেনা। ভাত আর আলুভাজি মেখে খেতে শুরু করলো। এমন সময়ই ফোন বাজতে লাগলো। সালমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মেয়েটাকে কেউ দু-দন্ড শান্তি দিচ্ছেনা। খেতে বসেছে এখনও ফোন করছে।’

মিলি ফোনটা রিসিভ করলো। ম্যাজিস্ট্রেট রিপার ফোন। মিলির খুব পরিচিত। মিলির কথায়ই শোভার ডিভোর্স পেপারগুলো তিনি রেডি করে রেখেছিলেন। এখন সেইমতোই কাজ চলছে। মিলি খেতে খেতে বললো, ‘বলুন!’

‘ ব্যস্ত নাকি?’

‘ না আপু, খাচ্ছিলাম।’

‘ আচ্ছা, তুমি আমার সাথে দেখা করিও।’

‘ কোনো সমস্যা?’

‘ আরেহ না। জানোই তো এসবে কত ফর্মালিটি আছে। শোভা তো আসতে পারছেনা, ও-ই বললো তোমাকে পাঠাবে। এসে কাগজপত্র গুলো নিয়ে যেতে।’

‘ ওহহ আচ্ছা। আমি আসবো।’

‘ তাহলে বিকেলের দিকে এসো।’

‘ আচ্ছা। রাখি।’

মিলি ফোন রেখে খাওয়ায় মন দিলো। সম্প্রতি ডাক্তার সাইফের সাথে যোগাযোগ রক্ষার খাতিরে মিলি তাঁর সাথে ম্যাসেঞ্জারে কানেক্ট হয়েছে। ওদিকে সাইফ তো সুযোগ পেয়েছে মিলির চোখে নিজেকে সেরা প্রমাণ করার। তাই ম্যাসেজ করলো মিলিকে।

‘ হাই!’

খাওয়ার মাঝখানে ম্যাসেজ আসায় মিলি খুব বিরক্ত হলো। এসব কী? ওই হাঁদা ডাক্তার ওকে কেন হাই পাঠাবে? মিলির সাথে কী ওর “হাই/হ্যালো” করার সম্পর্ক নাকি? বিরক্ত মিলি কাঁচামরিচে কামড় দিয়ে ফোনটা দূরে ঠেলে দিলো। ধীরেসুস্থে খাওয়া সেরে শোভার ঘরে গিয়ে দেখে পুচ্চু-পুঁচকি দুজনেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। শোভা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। বারান্দার দরজা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে, মিলি দরজাটা আটকে দিলো।

ড্রইংরুমে এসে বসলো একটু। রান্নাঘরে সালমা বেগম দুপুরের রান্না করছেন, টুংটাং শব্দ আসছে। কোনো কাজটাজ নেই বলে মিলি ফোনটা হাতে নিলো। সাইফ ইতিমধ্যে আরও একবার “হাই” লিখে পাঠিয়েছে। মিলি রেগে সরাসরি ফোন করলো।

সাইফ এবার একটু বোকা বনে গেলো। ভেবেছিলো চ্যাটের মাধ্যমে ভাব জমাবে। কিন্তু এই তেজী ঘোড়া তো সরাসরি ফোন করে বসলো। ইতস্তত করে ফোন ধরে বললো, ‘জি বলুন।’

মিলি রেগে বললো, ‘আপনি কী আমার দুলাভাই বা বফ লাগেন?’

আপনাআপনি সাইফের ঠোঁট উল্টে গেলো। ভীত গলায় বললো, ‘না।’

‘ তাহলে বারবার “হাই/হ্যালো” পাঠাচ্ছেন কেন?”

‘ তাহলে কী পাঠাবো?’

‘ মুসলমান হিসেবে সালাম বিনিময় করবেন।’

‘ ওহহ আচ্ছা। ঠিক আছে!’

‘ আচ্ছা আপনি কী নকল করে পাশ করেছিলেন? একজন ডাক্তারের তো এই হাল হওয়ার কথা নয়। ডাক্তারদের এটিটিউডই আলাদা থাকে, আর আপনি? দেখলেই মনে হয় মাকাল ফল!’

‘ আ আসলে আমি ওরকমই!’

‘ না। আপনার বাইরেরটা যাই হোক না কেন, মনে মনে আপনি একটা মিচকা শয়তান। আর কিছু বলার আছে আপনার?’

সাইফ অপমানিত বোধ করলো। কোনোমতে বলল, ‘বেবিরা কেমন আছে?’

‘ ভালো।’

‘ আচ্ছা রেখে দিই।’

‘ আল্লাহ হাফেজ।’

ফোন রেখে সাইফ একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো। ও আসলেই বাইরে-ভিতরে দুরকম। ভিতরে ভিতরে মিলিকে ভালোবাসে, বাইরে এমন একটা ভাব যেন প্রেম নামক জিনিসটা ও বুঝেইনা। এই মিলিটা বড্ড ভয়ানক। মুখের উপর এমনসব কথা বলে দেয়, যাতে করে উত্তর দেওয়ার জো পাওয়া যায়না। পরবর্তী প্যাশেন্টেকে ভেতরে ডেকে নিলো সে।

এদিকে সাইফের সাথে কথা শেষ করেই মিলি আবার শোভার ঘরে গেলো। শোভা চুল আঁচড়াচ্ছে। মিলি ধমকে বললো, ‘আমাকে বললে আমি কী বেঁধে দিতাম না?’

শোভা হেসে বললো, ‘তোরা সবাই কী আমাকে কোলে করে রাখবি, পাগল। সব কাজ তোরাই করছিস আর আমি বসে বসে আলুর বস্তা হচ্ছি।’

মিলি চিরুনিটা নিয়ে শোভার চুল আঁচড়ে বিনুনি কাটতে লাগলো। শোভা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বাচ্চাদেরকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মিলিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘শোন না মিলু।’

‘ বল।’

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘ হাজারটা করতে পারিস।’

‘ তুই রাগবি না তো?’

‘ রাগার মতো না বললে অবশ্যই রাগবোনা।’

‘ প্রশ্নটা সাদ আর আমাকে নিয়ে।’

মিলি সহজভাবেই বললো, ‘বল।’

শোভা জিজ্ঞেস করলো, ‘বাচ্চারা কার মতো হয়েছে রে? আমার মতো নাকি সাদের মতো?’

মিলিও বাচ্চাদের দেখলো। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে লাগলো, ‘ছেলেটা পুরো তুই। আর পুচকির চেহারায় সাইদ্দার চেহারার ছাপ আছে, নাকটাও ওনারই মতো। এককথায় মেয়েটা ওই সাইদ্দার কাটিংকুটিং পাইসে।’

শোভা হেসে বললো, ‘আমার ধারণাটা তাহলে ঠিক?’

‘ কীসের ধারণা?’

‘ আমিও পুঁচকির সাথে ওই লোকটার মিল পেয়েছি। তাই তো তোকে জিজ্ঞেস করলাম।’

মিলি শোভাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই এখনো ওনাকে ভালোবাসিস, তাইনা?’

শোভা উত্তর দিলোনা। কিন্তু সত্যিই কী সাদকে ভালোবাসে মনে মনে? না কখনো নয়। ও শুধু ঘৃণা পাবার যোগ্য। যেটা শোভা আজীবন করে যাবে। বললো, ‘আগে বাসতাম। এখন একফোঁটাও না।’

‘ অনেক ভালো। এটাই তো চাই।’

‘ এটাই সত্যি। মেয়েরা যেমন নরম হতে পারে, ততোধিক কঠিনও হতে পারে। আঘাত পেলে মেয়েরা যে পাথরের মতো কঠিন হয়ে বিপদের মোকাবেলা করতে পারে, সেটা আমি জেনে গিয়েছি!’

‘ তোর অনেক ভালো হবে শুভি।’

‘ এজন্য যে তোর কাছে আমি ঋণী!’

‘ মোটেও না। আমি তোর বন্ধু। সেই দায়িত্ব পালন করেছি!’

‘ এরচেয়েও বেশিকিছু করেছিস। নিজের আপন না ভাবলে কেউ কারো জন্য অতোটা লড়াই কর‍তে পারেনা। আজ আমি বেঁচে আছি, বাচ্চারা বেঁচে আছে সবটার ক্রেডিট একমাত্র তোর।’

_________

সাদের এসব কান্ডকীর্তি কেউ জানতে পারেনি। টিনা অতোটা পাত্তাও দেয়নি, সে এখন বাইরে গিয়েছে ইফতির সাথে দেখা করতে। যদিও সবাই জানে শপিংয়ে গিয়েছে। সাদিদ সাহেব বিকেলবেলা হালকা নাস্তা খেয়ে বারান্দায় বসে আছেন। এমন সময় সাদ এলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সাদিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘অফিস যাওনা কেন?’

‘ এমনি।’

‘ এমন করলে তো হবেনা। নিয়মিত অফিস যাবে।’

‘ আব্বু।’

‘ কিছু বলবে?’

‘ হুম!’

‘ কী বিষয়ে?’

‘ শোভার বিষয়ে?’

‘ কে শোভা?’

‘ ভুলে গেলেন? রমজান আঙ্কেলের মেয়ে, আমার প্রথম স্ত্রী শোভা।’

হঠাৎ মনে পড়লো শোভার কথা। একদম ভুলেই গিয়েছিলো। ওদের ডিভোর্সটা বাকি রয়েছে। সাদিদ সাহেব ভাবেন রমজান যতোই শত্রু হোক, মানুষটা ভালো, আত্মসম্মান প্রবল। আর সেই রমজানের মেয়ে কিনা গোপনে সাদকে বিয়ে করলো৷ আবার কার সাথে নষ্টামি করে বাচ্চা পয়দা করে সাদের উপর দোষ চাপায়। নষ্ট হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। অতিরিক্ত আদরে বাঁদর বানিয়ে ফেলেছিলো এখন তো মজা বুঝতেই হবে রমজানকে।

‘ হুম। কী হয়েছে ওর?’

‘ বাচ্চা হয়েছে!’

সাদিদ সাহেব নাক সিঁটকালেন। বললেন, ‘কার বাচ্চা জানা গেছে?’

‘ জি।’

‘ কার?’

‘ আমার।’

সাদের অকপট স্বীকারোক্তিতে সাদিদ সাহেব চমকে উঠলেন। তিনি নিজের দু’কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানে?’

‘ মানে শোভার গর্ভে আর কারোর নয়, আমার অংশ ছিলো।’

‘ সাদ!’

‘ জি আব্বু।’

‘ তাহলে তুমি অস্বীকার করলে কেন?’

‘ কারণ আমি তখন শোভাকে চাইনি। আমি আপনার কাছে ছোট হতে চাইনি। কিন্তু আজ!’

‘ কী আজ? কী এমন হলো যে, তুমি এতোদিন পর আমাকে এসব বলছো?’

‘ শোভা আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে, তার উপর বাচ্চাদের কাস্টাডি সে নিজের নামে করে নিয়েছে।’

‘ বাচ্চাদের মানে?’

‘ আব্বু আমার দুই-দুইটা সন্তান এসেছে পৃথিবীতে। আমি ওদেরকে চাই।’

সাদিদ সাহেব বিষম খেলেন। পুরো বিষয়টা ওনার মাথা উল্টাপাল্টা করে দিলো। ভাবনার শক্তিটুকুও নেই। একসাথে দু-দুজন বংশের প্রদীপ এসেছে অথচ তার অন্তরালে। আর তিনি কিনা এতক্ষণ শোভাকে খারাপ বলছিলেন! তিনি রেগে বললেন, ‘কী বলতে চাও তুমি?’

‘ আমি টিনাকে ছেড়ে দিতে চাই।’

সাদিদ সাহেব কষে থাপ্পড় মারলেন সাদের গালে। রেগে বললেন, ‘তুমি জীবনটাকে খেলনা পেয়েছো? যখন যা ইচ্ছা হবে তুমি তা-ই করছো। এতোই সোজা সবকিছু?’

‘ আব্বু শোভা আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে, আমিও প্রতিশোধ নিতে চাই। আমি ওর কাছ থেকে আমার বাচ্চাদের কেড়ে নিতে চাই।’

সাদিদ সাহেব আবারও থাপ্পড় দিলেন। বললেন, ‘ছিঃ! জারজ সন্তান হিসেবে পরিচয় করিয়ে তুই আবার বড়বড় কথা বলছিস?’

‘ আমার তখন ভুল হয়েছিলো। কিন্তু এখন আমি চাই ওদের।’

‘ চাইলেই তো আর হবেনা। টিনা তোমার বর্তমান স্ত্রী। ওর বাবাকে তো চেনো কীরকম মানুষ। যদি শোনে তোমার আগের স্ত্রী,বাচ্চা আছে তাহলে সোজা জেলে ঢুকাবে আমাদের। সমাজে আমাদের রেপুটেশন কোথায় নামবে ভাবতে পারছো? তার চেয়ে যা হবার হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ থাকো। ভুলেও একথা টিনাকে বলে বসোনা।’

এদিকে সাদ নাছোড়বান্দা। সে যে করেই হোক বাচ্চাদের চায়। হঠাৎ এতো দরদ কোত্থেকে এসেছে সাদিদ সাহেব বুঝতে পারছেন না। ওনার এসব অশান্তি আর ভালো লাগছেনা। বিরক্ত হয়ে সাদকে দুটো থাপ্পড় মেরে তিনি ঘরে চলে গেলেন। সাদ থাপ্পড় খেয়ে আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। ভাবে যে করেই হোক ও বাচ্চাদের নিয়ে আসবে, দরকার হলে শোভাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে চুরি করে নিয়ে আসবে। তবুও ওদের চাই, চাই এবং চাই। সে নিজেও বুঝতে পারছে না এতো পিতৃত্বের অধিকার নিতে ওর কেন মন চাইছে। শুধুই কী প্রতিশোধের নেশায়?

চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৭

0

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

সাদ কথাটা শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে পারছেনা যে ওর সাথে শোভার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। মিলি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘এবার প্লিজ যান। মুক্ত করে দিয়েছে আপনাকে।’

‘ আমি এটা মানিনা।’

মিলি বেশ অবাক হলো। তবুও কিছু বুঝতে না দিয়ে সহজভাবে বললো, ‘তাতে কারো কিছু যায়-আসে না।’

‘ আমি এই ডিভোর্স মানিনা।’

‘ মানেন না? কিন্তু কেন জানতে পারি?’

সাদ উত্তর দেয়না। পেছন থেকে শাফিন জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ডিভোর্স মানেন না? আপনার মতামত কী কেউ জানতে চেয়েছে মিস্টার সাদ চৌধুরী?’

‘ শোভা আমার স্ত্রী!’

‘ কিছুক্ষণ আগ অবধি ছিলো। কিন্তু আপনি এখন আমার বোনের জন্য পরপুরুষ ব্যতীত অন্য কিছুই ন।’

সাদ বলার মতো কিছুই পেলোনা। কিছুক্ষণ গাইগুই করে বললো, ‘কিন্তু ও আমার সন্তানের মা হতে চলেছে।’

মিলি এবার বেশ চটে গেলো। চিৎকার করে বললো, ‘আপনার কোনো সন্তান নেই। যারা এসেছে তারা শুধু এবং শুধুমাত্র আমার শুভির সন্তান!’

সাদ অবাক হয়ে বললো, ‘ এসেছে মানে?’

শাফিন বললো, ‘কিছুনা। আপনি যান এখান থেকে।’

মিলি চলে আসতে নিলে সাদ পথ আটকালো।

‘ অসভ্যের মতো রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

‘ তার আগে বলো কে এসেছে? আর শোভা কোথায়?’

‘ আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই।’

সাদ রেগে গেলো। বললো, ‘না বলা অবিধি আমি তোমাকে যেতে দেবোনা।’

‘ সেদিনের থাপ্পড়ের কথাটা ভুলে গেছেন?’

‘ আই ডোন্ট কেয়ার।’

ডাক্তার সাইফ এতোক্ষণ চুপচাপ দেখছিলো সব। এতক্ষণে যা বুঝার ও বুঝে গিয়েছে। মিলি শোভার পুরো ঘটনাটাই ওকে জানিয়েছে। আর সাদকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে ও শোভার সেই সো কল্ড স্বামী। এতক্ষণ কিছু বলেনি, কিন্তু মিলির সাথে সাদের কথা কাটাকাটির ব্যাপারটাতে সাইফ বেশ রাগলো। ও এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘দেখুন মিস্টার। এটা হসপিটাল। এটা কোনো সিনক্রিয়েট করার জায়গা নয়। আপনি প্লিজ এখান থেকে চলে যান।

সাদ চকিতে তাকালো মিলির দিকে। তারপর সাইফকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘আমি এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে আসিনি। আমি জানতে চাচ্ছি শোভা কোথায়?’

মিলি কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই সাইফ বললো, ‘রিল্যাক্স। মিস শোভা কেবিনে আছেন। ওনার টু-ইন বেবি হয়েছে। বাচ্চারা এবং ওনি সবাই ঠিক আছেন। এবার যান আপনি!’

সাদ আকস্মিক বাবা হওয়ার সংবাদটা নিতে পারলোনা। বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ভাবলো, ‘শোভার শুধুমাত্র একার অধিকার এই বাচ্চাদের উপর নেই। ওর বাচ্চা, ও ওদেরকে নিয়ে যাবে।’

যেই ভাবা সেইমতো কাজ। সাদ বললো, ‘আমার বাচ্চাদের আমি নিয়ে যাবো।’

এই পর্যায়ে শাফিন আর রাগ ধরে রাখতে পারলোনা। কাপুরুষটা কী বলে? বাচ্চাদের নিয়ে যাবে? ওর বাচ্চা? শাফিন তেড়ে এসে ওর কলার চেপে ধরলো। গলার শিরা ফুলে উঠেছে, রাগে কাঁপছে। চিৎকার করে বললো, ‘তোর বাচ্চা? কারা? ওই দুটি বাচ্চা আমার শুভির। তুই কে যে ওদেরকে নিজের বাচ্চা বলতে আসিস? ওরা আমার বাচ্চা, আমি ওদের মামু, আমি ওদের বাপ। ওদের আর কোনো বাপ লাগবে না। শুনলি তুই?’

সাদও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে বললো, ‘ওরা আমার বাচ্চা?’

‘ তোর ওই নোংরা মুখে ওদের পিতৃত্ব দাবি করবিনা হারামজাদা।’

‘ একশোবার করবো। ওদেরকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।’

‘ ওরা তোর বাচ্চা না। তোর সাথে আমার বোনের বিয়ে হয়েছিলো শুধু, ওরা জারজ সন্তান। আর ওদের বাবা কে তা তুই জানিস না। বুঝলি?’

সাদ রেগে শাফিনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। বললো, ‘ওরা আমার সন্তান।’

মিলি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সাইফের কাঁধে হাত রেখে ও হাসতে লাগলো। চোখে পানি এসে পড়েছে হাসার দরুন। অনেক কষ্টে হাসিটা চেপে বললো, ‘তাই নাকি সাদ চৌধুরী?’

রাগী গলায় সাদ বললো, ‘অবশ্যই।’

‘ কিন্তু এর প্রুফ কী?’

সাদ বললো, ‘প্রুফ মানে?’

‘ আরে ইয়ার। সিম্পল কথাটা আপনার মতো চতুর ব্যক্তি বুঝতে পারছে না? আমিতো সহজ বাংলায় ঝেড়ে কাশছি।’

‘ যা বলার ক্লিয়ার বলো। আমি ভনিতা পছন্দ করিনা!’

‘ ওহহ..আই সি! সো মিস্টার সাদ চৌধুরী, আমি আবারও বলছি শুভির বাচ্চারা যে আপনার তার প্রুফ কী? এমন কোনো এভিডেন্স আছে যেগুলোর ভিত্তিতে আপনি বাচ্চাদেরকে নিজের বলে দাবি করতে পারেন?’

সাদ সহজভাবে বললো, ‘শোভাই প্রুফ।’

‘ কিন্তু শোভা যে অন্যকথা বলে।’

‘ কী বলে?’

‘ শুভির বাচ্চার বাবা অন্য কেউ।’

সাদ রেগে বললো, ‘আমি বিশ্বাস করিনা, আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই।’

‘ কিন্তু ও তো চায়না! আর তাছাড়া বাচ্চারা যদি আপনার হয়েও থাকে, তাহলেও আপনি ওদের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারেন না।’

‘ মানে?’

মিলি হাসে। তারপর ব্যাগ থেকে ডিভোর্স পেপারটা বের করে, সাথে আরেকটা পেপারও আছে। সেখানে লেখা বাচ্চাদের উপর সাদের কোনো অধিকার নেই, শুধুই শুভির অধিকার। আপনি ডিভোর্স পেপারের সাথে সাথে চাইল্ড কাস্টাডি পেপারেও সাইন করেছেন। সো মিস্টার, এবার এখান থেকে ফুটুন।

হতভম্ব সাদ এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলোনা। এত বড় একটা ধোঁকা দেওয়া হলো ওকে? সে দু’পা এগিয়ে মিলির হাত থেকে পেপারগুলো কেড়ে নিতে চায়। উদ্দেশ্য ছিঁড়ে ফেলা। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। মিলি কিছুতেই ছাড়ছেনা পেপারগুলো। শাফিন সাদকে ছাড়াতে গেলে সাদ মিলিকে ধাক্কা মারে। টাল সামলাতে না পেরে মিলি পিছলে পড়ে যায়। ভাগ্য ভালো, পেপারগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি। সাইফ দৌড়ে গিয়ে মিলিকে উঠায়। তারপর রেগে সাদকে বলে আপনি এক্ষুনি এখান থেকে যাবেন? নাকি দারোয়ান ডাকবো?

সাদকে শাফিন পেছন থেকে ধরে রেখেছে। সে ফুঁসে উঠে বললো, ‘তোদের যা ইচ্ছা করে নিস। আমি এতো সহজে হাল ছাড়বোনা।’

মিলি এসে ওর গালে থাপ্পড় মারে। বলে, ‘যেদিন নিজের বাচ্চাদের জারজ আখ্যা দিয়েছিলি, শুভির চরিত্রে স্বামী হয়ে দাগ লাগিয়েছিলি সেদিন মনে ছিলোনা? তোকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করতাম আর তুই? তুই শুভির সুসাইডের নিউজ শুনে দেখতেও আসিসনি। মধুর চাকের খোঁজে বেরিয়েছিলি। তোর বাপ আমাদেরকে অপমান করে বের করে দিয়েছিলো, মনে নাই সেদিনের কথা যেদিন শাফিন ভাই, আঙ্কেল তোর কাছে গিয়ে নিজের মেয়ের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলো তখন লাথি মেরে ভাগিয়ে দিয়েছিলি তুই। এই আটমাসে একবার খোঁজ নিয়েছিলি? অথচ নতুন বউ নিয়ে সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসেছিস। ছিঃ! তখন এসবের কথা মনে ছিলোনা?’

মিলি হাঁপাচ্ছে। ডাক্তার সাইফ ওকে ধরে রেখেছে। সাদ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপমানে, লজ্জ্বায় ওর ইচ্ছে করছে মিলিকে লাথি মেরে সরিয়ে দিতে। এবার মনে হচ্ছে বেশ করেছে শোভার সাথে, বেশ করেছে। জোরে বলে উঠলো, ‘বেশ করেছি আমি, যা হয়েছে ও এটারই যোগ্য!’

শাফিন কষে থাপ্পড় মারে। সাইফ সিকিউরিটি ডেকে আনে। সবাই ওকে জোর করে হসপিটাল থেকে বের করে দেয়।

রাগে সাদের গা কাঁপছে। কোনোমতে বাড়ি ফিরে যায়৷ তখন রাত প্রায় দেড়টা। মুন্নি, ডেইজি ওরা গেস্টরুমে শুয়েছে। টিনা ফোনে ইফতির সাথে প্রেমালাপে লিপ্ত। এই অদ্ভুত সময়ে সাদ ঘরে ঢুকেই হাতের কাছে যা পেলো তাই ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো। টিনার শখের পারফিউম ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেলো। চমকে পেছনে ফিরে দেখে রক্তবর্ণ চেহারা নিয়ে সাদ হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ভাঙছে। টিনা ভয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘ কী হয়েছে বেবি?’

সাদ কিছু সহ্য করতে পারছেনা। চিৎকার করে বললো, ‘এক্ষুনি ঘর থেকে বেরুও। আমি একা থাকতে চাই।’

টিনা আর কিছু বলার আগেই সাদ ধমকে উঠলো। ভয়ে টিনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ভাঙাভাঙির এই শব্দ নিচতলায় পৌঁছলোনা। রোমেলা বা সাদিদ সাহেব কেউ-ই শুনতে পেলোনা। টিনা বেরুতেই সাদ ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো। পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে। মিলি! ওই হারামজাদিটা দ্বিতীয়বার ওর গালে থাপ্পড় মারলো, তাও আবার বাইরের মানুষের সামনে? আর কী বলে? ওই শোভার সাথে ওর তালাক হয়ে গেছে, বাচ্চাদের উপর ওর অধিকার নেই? এতবড় অপমান সাদ নিতে পারছেনা।

কিন্তু ও এরকম করছে কেন? শোভা! হা, ওই শোভাকে আজকাল বড্ড মিস করতো। প্রথম যখন শোভাকে দেখে তখনই সাদ ওকে পছন্দ করে, প্রেমে পড়ে যায়। এড়িয়ে যেতে যেতে শোভাও একসময় ওকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু যখন জানতে পারে ওদের দুই পরিবারের মধ্যে জমি নিয়ে পুরোনো শত্রুতা আছে, তখন সাদ চিন্তায় পড়ে যায়। শোভার প্রেমে পড়ার একটাই কারণ, শোভা অপূর্ব সুন্দরী। ওর সেই সৌন্দর্য ভোগ করার উদ্দেশ্যেই মূলত ওর সাথে সাদ প্রেমের অভিনয় করে। কিন্তু যখন নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আদৌ ওর ফ্যামিলি ওদের বিয়ে দেবেনা, বা মানবেনা তখন সাদ মনোবাসনা পূরণের জন্য গোপনে বিয়ে করে নেয় শোভাকে, অবশ্য শোভা গোপন বিয়ে করতে রাজি ছিলোনা।

সাদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কাছে হার মেনে বিয়ে করে। এটাই ওর ভুল। বৈবাহিক সম্পর্কের দোহাই দিয়ে বেশ কয়েকবার ওর আর শোভার মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যখন সাদ জানতে পারে শোভা প্রেগন্যান্ট, তখন নিজের চরিত্রে যাতে কালি না লাগে, বাবার কাছে যাতে ছোট না হয়ে যায় তখন বিয়ের বিষয়টা স্বীকার করলেও বাচ্চাদেরকে জারজ উপাধি দেয়। সাদিদ সাহেব ছেলেকে বিশ্বাস করেন, তাই সাদের কথাও মেনে নেয়।

কিন্তু টিনার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সাদের মাঝেমাঝেই শোভার কথা মনে পড়তো। দুই বউয়ের মাঝে অনেক তফাৎ খুঁজে পায়। ভাবে টিনার সাথে কখনোই সুখে থাকতে পারবেনা। তখন ওর শোভাকে মনে পড়ে, তাইতো আজ ছুটে গিয়েছিলো। কিন্তু মাঝখান থেকে ওই মিলি মেয়েটা বেশ বাড়াবাড়ি শুরু করে দিলো। নাহ,আর কিছু ভাবতে পারছেনা ও। এখন ওর কাউকে চাই, নিজেকে শান্ত করতে কাউকে চাই। দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো সাদ। নিচতলায় নেমে দেখে টিনা সোফায় শুয়ে আছে, মোবাইল টিপছে। সাদ ওকে কোলে তুলে রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। আচমকা টিনা অবাক হয়ে যায়। বলে, ‘আরে কী করছো? নামাও আমায়।’

‘ চুপ। একদম চুপ!’

ধমক খেয়ে টিনা চুপ হয়ে যায়। দু’হাতে সাদের গলা জড়িয়ে ধরে। সাদ রুমে এনে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে টিনাকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর। নিজের রাগগুলো মেটাতে থাকে টিনার উপর।

________

ওদিকে রাতে এতোবড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর রমজান সাহেব বা শোভা কাউকেই ওরা কিছু জানায়নি। সকালবেলা শোভার ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে। হাতে স্যালাইন পুশ করা। নড়াচড়া করতে কষ্ট হচ্ছে। শোভা প্রথম অবাক হয় যখন টু-ইন বেবির খবর দেওয়া হয়, কান্না করে দিয়েছিলো। বাচ্চাদেরকে রাতে মায়ের কাছে দেওয়া হয়নি। সালমা বেগম মেয়ের জন্য নরম খাবার নিয়ে এসেছেন বাড়ি থেকে। চামচ দিয়ে একটু একটু করে ওর মুখে তুলে দিচ্ছেন। এসময় খুশির খবরটা ওকে মিলি দিলো। খুশি খুশি গলায় বললো, ‘হেই শুভি, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে!’

শোভা অবাক হয়ে বলে, ‘কীসের সারপ্রাইজ?’

‘ গেস কর!’

‘ বলনা।’

‘ তার আগে বল, তুই আমাকে কী দিবি?’

শোভা কিছুক্ষণ ভেবে তারপর বলে, ‘ একটা উম্মাহ দেবো তোর গালে।’

মিলি হেসে বললো, ‘বাহ! দারুণ।’

‘ এবার বল, কী সারপ্রাইজ?’

‘ আগে বল কাঁদবিনা।’

শোভা সন্দেহী চোখে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কী এমন সারপ্রাইজ যে আমি কাঁদলেও কাঁদতে পারি?’

মিলি ব্যাগ থেকে পেপারগুলো শোভার হাতে দিয়ে বললো, ‘ নিজেই দেখে নে!’

শোভা একহাতে আস্তে আস্তে কাগজগুলো দেখে। সাদের সাইন করা ডিভোর্স এবং চাইল্ড কাস্টাডি পেপার। না চাইতেও ওর চোখে পানি এসে যায়। মিলি ধমকে বলে, ‘একদম কাঁদবিনা। কত কান্ড ঘটিয়ে কাজটা করেছি জানিস তুই।’

শোভা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘কাল চাইলাম আর আজ তুই আমার কাজটা সফল করে দিলি? কীভাবে করলি?’

‘ পেপার সব আগেই তৈরি করা ছিলো। আমি সন্দেহ করেছিলাম ওই সাইদ্দা বাচ্চাদের উপর অধিকার চাইলেও চাইতে পারে। আর ওই কু* বাচ্চার কোনো ছায়াও আমি তোর বাচ্চাদের উপর পড়তে দেবোনা বলে সব ঠিকঠাক করে রেখেছিলাম। তুই কাল বলতেই আমি হোস্টেল থেকে অজান্তাকে দিয়ে আনিয়ে নিলাম। আর কাকতালীয়ভাবে ওই হারামিটা রাতে তোকে দেখতে এসেছিলো আর আমি কৌশলে সাইনটা করিয়ে নিলাম। ভালো করিনি?’

শোভা ইশারায় মিলিকে কাছে ডাকে। তারপর মিলির গালে একটা উম্মাহ দিয়ে বলে, ‘খুব ভালো করেছিস। ওনার কোনো অধিকার বা ছায়া আমার সন্তানের উপর নেই, থাকতেও পারেনা!’

সালমা বেগম এতোক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন। তিনি বরাবরই নরম মনের মানুষ। মিলি মেয়েটাকে তিনি নিজের মেয়ের মতো দেখেন। শোভার এই দুঃসময়ে মেয়েটা যে কীভাবে ওদের পাশে ছিলো, অন্য কেউ হলে কখনো থাকতোনা, এতো সাহায্যও করতোনা। তিনি মিলিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন। মিলি হেসে বললো, ‘কেঁদোনা তো মণি। এবার আমাদের কত দায়িত্ব বলো তো। সবকিছু ভুলে নতুন করে সব শুরু করতে হবে আমাদের। এ সময় কাঁদলে কী চলে?’

সালমা বেগম আবেগী কন্ঠে বললেন, ‘তুই এবার থেকে আমাদের বাসায় থাকবি। আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা!’

শোভাও জোর গলায় দাবি জানালো যে এবার থেকে মিলি ওদের বাসায় থাকবে। মিলিও রাজি হয়। কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে শোভা জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা ওনি কী বাচ্চাদের দেখেছেন?’

‘ নাহ।’

‘ তাহলে জানলো কীভাবে?’

মিলির মুখটা কালো হয়ে যায়। আশ্চর্য! ওই হৃদপিণ্ডের ডাক্তারটাকে এই কথার জন্য শাস্তি দেওয়া দরকার ছিলো। এই হাঁদারামটা না বললে তো সাদ আরো পরে জানতে পারতো আর কাল রাতে এতো ঝামেলাও হতে পারতোনা। মিলি শক্ত গলায় কিড়মিড় করে বললো, ‘ডাক্তার সাইফ।’

‘ ওই যে হার্টের ডাক্তার? ওনি?’

‘ হুম। দাঁড়া আমি আসছি!’

বলেই মিলি গটগটিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। ডাক্তার সাইফকে খুঁজছে। কিছু প্রশ্ন জানার আছে ওর, একদম ভুলে গিয়েছিলো।

চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।