Saturday, July 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1513



অপ্রিয় সে পর্ব-১৩

0

#অপ্রিয় সে
#সানজিদা সন্ধি
#পর্বঃ১৩

আরিয়ানকে বেধড়ক মারধর করছেন রিয়াজুল করিম। রিমু একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে আর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মেঝেতে খোঁচাচ্ছে।
রূপম সোফায় বসে আপেলে কামড় দিচ্ছে। বাসার কেউ কিছু বুঝতে পারছেনা। সবাই শুধু চুপচাপ কী হচ্ছে তা দেখা নিয়েই ব্যাস্ত।

রিয়াজুল করিম আরিয়ানকে মারতে মারতে বললেন, ” তা এটা নিয়ে কজন মেয়ে কে টার্গেট করলে বাবা? ”

আরিয়ান কী বলবে বুঝতে পারছিলো না। চুপচাপ সে মার খেতে লাগলো।

রিয়াজুল করিম বললেন, ” এই আরিয়ান তার বাবার পলিটিকাল পাওয়ার ইউস করে অসংখ্য মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি করেছে। সে যখন দশম শ্রেণির ছাত্র তখন থেকে রিমুকে ফলো করতো। রিমু তখন ক্লাস সেভেনে। এই কথা আমার কানে আসে। আরিয়ান রূপমের পাশের স্কুলে পড়তো বলে আমি রূপমকে বলেছিলাম এই ছেলের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। কারণ আমার মেয়ের পিছনে কেউ চিপকে লেগে থাকুক এটা আমি কখনোই চাইতাম না । রূপম খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে আরিয়ান একজন পলিটিকাল লিডারের ছেলে। খোঁজখবর আমিও নিতে পারতাম কিন্তু ভেবেছিলাম রূপমও যেহেতু আরিয়ানের ইয়ার মেট তাই রূপম খোঁজখবর নিলেই ভালো হবে। রিমু ছোট থেকে মারাত্মক সুন্দরী হওয়ায় আরিয়ানের নজর পড়ে রিমুর উপর। কিন্তু সবসময় ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় আরিয়ান কখনো সুযোগ পায়নি রিমুকে নিজের প্রেমের ফাঁদে ফেলার।

তবে রিমুর পিছু ছাড়েনি সে। রিমুকে ফলো করার পাশাপাশি সে অন্য মেয়েদের সাথেও সম্পর্কে থাকতো। তাদের সাথে কয়েকমাস সম্পর্ক রেখেই ছেড়ে দিতো। শারীরিক সম্পর্কও ছিলো তার অনেকের সাথে। ইদানীং সুযোগ বুঝে রিমুকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু যেই ছেলে এতগুলো মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি করতে পারে সে কী আসলেও রিমুকে ভালোবাসে?

সবটা শুনে সবাই থমকে গিয়েছে। রিমুর চোখ দিয়ে অবাধ্য নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সে কিছু ভাবতেই পারছেনা। তার সাথেই কেন এমন হয় বারবার?

এদিকে আরিয়ানের বাবা মা পুলিশকে ফোন করার জন্য উদ্যত হতেই রূপম বলে ফোনটা তাহলে আপনিই করুন। নিজের ছেলের জন্য নিয়েই পুলিশ আনুন। আরিয়ানের বহু কুকীর্তির প্রমাণ অনেক সযত্নে রেখেছি আমি। যাদের সাথে আরিয়ান অন্যায় করেছে তারা আরিয়ানের চেয়ে অনেক কম পাওয়ারফুল। আর বাকি যেসব গার্লফ্রেণ্ডদের সাথে কুকাজ করেছে সবারই সম্মতি ছিলো। ক্ষমতার দাপট ওই মেয়েগুলোর ছিলোনা তাই তারা আরিয়ানের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নিতে পারেনি। কিন্তু এবার আমি নেবো।

পরিস্থিতি নিজের বিপক্ষে দেখে আরিয়ান তার বাবা মা কে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। সবাই সবার কাজে লেগে পড়ে।

রিমু উপরে নিজের ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। কী হবে ভেবেছিলো আর কী হলো। রিমু মনে মনে বলতে থাকে, ” আল্লাহ এতো কষ্ট কেন দিচ্ছে আমাকে। সুখ জিনিসটা কী আমার কপালে নেই? বিয়ে করে এই জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম অথচ কী হয়ে গেলো। আসলে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ব্যাতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না। খানিক আগেই তো সবটা ঠিকঠাক ছিলো। রিয়াজুল করিম বাসায় এসে বললেন, ” রিমুকে যারা দেখতে এসেছে তাদের সঙ্গে ইমিডিয়েটলি কথা বলতে চায় তিনি। সেই অনুয়ায়ী আরিয়ানকে ফোন করে রিমু বলে, ” বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আসলে আপনারা যখন আমাকে দেখতে এসেছিলেন তখন আমার বাবা বাসায় ছিলেন না। তিনি আপনাদের সাথে কিছু জরুরি কথা বলতে চান। আমি জানি আপনারা সবাই ভীষণ ব্যাস্ত মানুষ। তারপরও যদি একটু সময় দিতেন। ”

রিমুর ফোন পেয়ে উচ্ছসিত আরিয়ান চলে আসে রিমুদের বাসায়। আরিয়ান আসার পরপরই রিয়াজুল করিম এক কথায় দু কথায় রহস্যময়ী হাসি হেসে জিজ্ঞেস করেন বাবা তোমার চরিত্র ঠিক আছে তো?

এ ধরনের প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যায় আরিয়ান। সাথে প্রচন্ড রকম বিব্রতও হয়। সে বলে দায়সারা একটা হাসি দিয়ে বলে জি আঙ্কেল। আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।

আর এই কথা শুনেই রেগে গিয়ে ইচ্ছে মতো আরিয়ানকে পিটাতে থাকে রিয়াজুল করিম।
তারপরই এলোমেলো হয়ে যায় সব।

রিমু তার ফোন হাতে নিয়ে সাদিয়াকে ফোন দেয়। এমন পরিস্থিতিতে কী করা ভালো হবে সাদিয়া তা খুব সহজেই বলতে পারবে। এই মেয়েটা অনেক বেশি বুদ্ধিমতী, স্মার্ট আর এক্সট্রোভার্ট৷ সব সমস্যার সমাধান যেন তারই কাছে। রিমু সবার উপকার করে, আগলে রাখে। কিন্তু সে ততটা চালাক চতুর নয় সাদিয়ার মতো। রিমু সবার জীবনের সমস্যা সমাধান করতে পারলেও নিজের জীবনের সমস্যায় ডুবে থাকে। আর এই সমস্যা থেকে উদ্ধারের জন্য ভালো পরামর্শ দাতা সাদিয়াই হতে পারে।

রিমুর কাছে সবটা শুনে সাদিয়া রেগে যায় রিমুর প্রতি। সে বলতে থাকে, ” তুইও গতানুগতিক ধারার চিন্তা নিজের ভেতরে পোষণ করিস রিমু! এটা ভীষণ হতাশাজনক।
বিয়ে করেই কেন মুক্তির পথ বেছে নিতে হবে? বিয়ে করলেই যে তুই মুক্তি পাবি এটা বলছিস কী করে? এমনও তো হতে পারে এক জেলখানা থেকে অন্য জেলখানায় ঢুকে পড়লি? তখন কীসে মুক্তি খুঁজবি? আমার কথা মন দিয়ে শোন রিমু! নিজের মুক্তির উপায় নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। তুই নিজের পায়ে দাঁড়া। নিজের আইডেন্টিটি তৈরি কর। আর বিয়ের মাধ্যমে মুক্তি এসব আজাইরা চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেল৷ তোকে নিয়ে কী যে করবো আমি। ”

সাদিয়ার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো রিমু। প্রচন্ড গরমে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে রইলো।

রূপম বাইরে থেকে কড়া নাড়ছে রিমুর দরজায়। রিমু ভেতরে আসার অনুমতি দিলো।

রূপম ভেতরে এসে বললো, ” কী রে রিমু? মুখটা ওরকম পেঁচির মতো করে রেখেছিস কেন? আরিয়ানকে বুঝে মনে ধরে গিয়েছিলো
ইশ রে! প্রেম না করেই ছ্যাঁকা খেলি!”

রূপমের কথা অন্য রকম লাগছে রিমুর কাছে। রূপম কখনো এতো বেশি ফ্রি হয়নি রিমুর সাথে। তবে আজ কেন যেন বন্ধুর মতো আচরণ করছে। রিমু কিছু বুঝলোনা।

রূপম আবার বললো, ” দ্যাখ যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। তোর যদি ওই লুচুটার সাথে বিয়ে হতো তাহলে কী হতো ভাবতো। না জানি শরীরে কোন রোগ বাঁধিয়ে বসতি। ইউ নো না কি বুঝাচ্ছি আমি? উ উ ( এক ভ্রু উচিয়ে) ”

রিমু শুরুতে না বুঝলেও পরে যখন বুঝলো তখন ভীষণ লজ্জা পেলো। বালিশে মুখ গুঁজে সে হেসে ফেললো। তারপর বললো, ” রূপম ভাই আপনি যান! ”
রূপম বললো কী বললি? আমি তোর জান?

রিমু রেগে বললো, আমি কখন বলেছি আপনি আমার জান? আমি বলেছি এখন থেকে চলে যেতে!

রূপম বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললো, ইশ আমি আরো ভাবলাম তুই আমাকে তোর জান বললি। আচ্ছা চলে যেতে বলছিস চলে যাচ্ছি। কিন্তু আবার ফিরে আসবো।

রিমু বুঝছেনা তার সাথে ঠিক কী হচ্ছে! রূপম তার সাথে এমন আচরণ করবে এটা তো অবিশ্বাস্য। আর এতো ফ্রি হয়ে তো অসম্ভবই।

রিমুর কিছু ভাবতে ইচ্ছে হলোনা। সে এসি অন করে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

ঋষি সাদিয়ার নম্বরে ভয়ে ভয়ে ফোন করলো। না জানি এই মেয়ে কখন কী রিয়্যাক্ট করে। ঋষি সাদিয়াকে বললো, ” আপনি আজ রূপমদের বাসায় আসবেন। কিনা প্রয়োজন ছিলো।”

সাদিয়া খানিকটা রেগে বললো আমি আপনার কথায় কেন রূপম ভাইদের বাড়িতে যাবো? আর তার জন্য কেন যাবো? ওই বাড়িতে যাওয়ার কারণ তো রিমু। সে যখন আমাকে যেতে বলেনি তাহলে কেন আমি যাবো?”

সাদিয়া একনাগাড়ে অনেকগুলো কথা বললো। ঋষি তাকে থামিয়ে যতটা শর্টকাটে সবটা বলা যায় বললো।

সাদিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো। এতো কিছু হতে পারে তা সাদিয়ার ধারণাতীত। তার মনে এখন একটাই ভয় সে রিমুকে এতো জ্ঞান দিলো সেই যদি এখন রিমুকে প্রপোজ করতে রূপমকে সাহায্য করে তবে কীভাবে সেটা নেবে রিমু?

চলবে,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-১২

0

#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ১২

রূপম ফোন করেছে থেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কান্নার কারণে সে ঠিকমতো একটা কথাও বলতে পারেনি এই অবধি। তৃপ্তি চুপ করে আছে। কারণ এখন সে সান্ত্বনা সূচক একটা কথাও যদি বলে তাহলে রূপম আরো বেশি কান্না করবে।

তৃপ্তি জানে রূপমকে কীভাবে শান্ত করতে হয়। তৃপ্তি কথা ঘোরালো। খানিকটা রাগান্বিত স্বরেই বললো, ” এতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিস না তো। আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে। এমন চলতে থাকলে ফোন কেটে দিবো। আর তুই তো জানিসই ফোন কাটলে আমি ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাবো। চার পাঁচ ঘন্টার মধ্যে উঠবো না। তাই ফ্যাচর ফ্যাচর বাদ দিয়ে সোজা সাপটা বল কী হয়েছে।”

তৃপ্তির ধমক শুনেও রূপম কাঁদছে। তৃপ্তির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এই ছেলেটা এভাবে কাঁদে কেন? রূপম খানিকটা পরে একাই চুপ হয়ে গেলো। তারপর বললো, ” আমি কী করলাম তৃপ্তি? নিজের দোষে রিমুকে হারাতে বসেছি। আজকে বাসায় আরিয়ান এসেছে। তুই তো চিনিস ওকে। শুধু আরিয়ান নয় ওর মা বাবাও এসেছে। রিমু আরিয়ানকে আসতে বলেছে। বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। রিমুর হাবভাব আমার মোটেই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে এবার ও হারিয়ে যাবে চিরতরে আমার জীবন থেকে। ”

তৃপ্তি বললো, ” চিন্তা করিসনা! রিমু তোরই থাকবে। ”

তৃপ্তির স্বান্তনা বাণী শুনে রূপমের কান্নার বেগ বাড়তে থাকলো। কান্নারত অবস্থাতেই সে বলছে, ” আমি নিজের দোষেই রিমুকে হারাতে বসেছি। মেয়েটা কে তো কম কষ্ট দেইনি এ জীবনে। আমার জন্য সে সবকিছু হারিয়েছে। কিন্তু আমি কী করতাম বল তৃপ্তি? রিমুর সাথে ইচ্ছে করে খারাপ ব্যাবহার করতাম যাতে ও আমাকে ঘৃণা করে আমার থেকে দূরে থাকে। কিন্তু সে তো তা করতো না। তুই তো জানিস আমি কী প্রচন্ডরকম দূর্বল রিমুর প্রতি। আমি ড্যাম শিওর ওর ভালোবাসা পেলে আমি মরেই যাবো। তাই ঘৃণাই চাইতাম। কিন্তু যখন বুঝলাম মরে গেলেও রিমুর ভালেবাসাই চাই আমার তখন যে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে রে। সব শেষ। রিমু এখন ঘৃণা করে আমাকে। যেটা আমি আগে চাইতাম। কিন্তু এখন যখন চাচ্ছি সে আমাকে ভালোবাসুক তখনই সে আমাকে ঘৃণা করছে। অবশ্য অস্বাভাবিক নয় সেটা! ”

তৃপ্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ” তুই সব শেষ করে দিয়েছিস রূপম। তোর কারণে একটা মেয়ে সবার ভালোবাসা হারিয়েছে। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছে। আমি শিওর রিমুর যায়গায় আমি হলে তোকে কখনোই ক্ষমা করতাম না। আমি এই বিষয়টা বুঝিনা রূপম। যেখানে মানুষ তার ভালোবাসাকে আগলে রাখে। তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যায় তখন তুই কেন রিমুকে তোর থেকে দূরে রাখতে চাইতি? কেন রূপম? কেন? ”

রূপমের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তবুও সে তৃপ্তিকে বললো, ” তৃপ্তি তুই আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের হলেও তোকে একটা বিষয় জানাইনি আমি। আমি রায়হান খান আর শিহাব খানের পালিত পুত্র। অর্থাৎ তারা আমাকে এডাপ্ট করে নেন। এটা আমি জানতে পারি মা অর্থাৎ রায়হান খানের ডায়েরী থেকে। তবে বাড়ির কেউ কখনো এই বিষয় নিয়ে টু শব্দটিও করেননি। আমার মা রায়হান খান নিঃসন্তান ছিলেন। দীর্ঘদিন তার সন্তান না হওয়ায় মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে তার মানসিক সমস্যা শুরু হয়। তিনি নানান ডাক্তার কবিরাজের কাছে রেগুলার যাওয়া আসা শুরু করতেন। একপর্যায়ে তার অবস্থা অতিরিক্ত খারাপ হলে সবাই আমাকে তার জন্য এনে দেয়। তখন আমি দুই কিংবা তিন মাসের শিশু। আমি মায়ের কোলে আসার পরপরই রিংকি আসে মায়ের পেটে। মা সত্যিকার অর্থেই মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেন রিংকি আসার মাধ্যম। তবে আমাকে আর রিংকিকে সামলাতে মায়ের হিমশিম খেতে হতো। সে সময়ে রিমুর মা অর্থ্যাৎ খালামনিও নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি আমাকে তার কাছে নিয়ে যান।তার কাছে মানুষ হতে থাকি। হয়তোবা অ্যাডাপ্ট বলেই সবাই করুণা করতো অনেক বেশি যা ভালোবাসা হিসেবে সবাই ভাবতো আর নয়তো তারা শুদ্ধতম ভালোবাসায় আমাকে বড় করেছে। তুই বল যেখানে আমি পালিত ছেলে সেখানে রিমু এই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। তার সাথে কী আমায় মানায়? তাই আমি দূরে থাকতে চাইতাম। তবে এটা সত্যি রিমুর জীবনের সব আনন্দ আমার জন্য নষ্ট হয়েছে। সে কোনকিছুরই স্বাদ পায়নি আমার জন্য। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েও যদি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই তারপরও পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে কি না সন্দেহ। আর আমার সবচেয়ে বড় ফল্ট হলো আমি আমার ভালোবাসা কখনো ভালো ভাবে প্রকাশ করতে পারিনি। সবসময় সেটা রাগ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

আমি সবকিছু পেয়েও একা বোধ করি রে। এই অনুভূতিটা আমার জন্য অনেক জঘন্য।

তৃপ্তির চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। নিজের সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর জীবনে যে এমন কিছু থাকতে পারে তা ধারণারও বাইরে ছিলো তার। তৃপ্তি কথা ঘোরাতে বললো, ” আমার কেন জানি মনে হয় তুই কখনো রিমুকে ভালোই বাসিস নি। ভালোবাসলে কী এতো কষ্ট দেওয়া যায় কাউকে? ”

রূপমের ভাবভঙ্গি মুহুর্তেই পাল্টে গেলো। হেসে ফেললো সে। মৃদু হেসে বললো, ” সাত কান্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার পিতা! ” তোর কাছেই এটা আশা করা যায় তৃপ্তি । বললাম তো আমার ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করতে পারিনি।

তৃপ্তি এতক্ষণ এটাই চাচ্ছিলো রূপম যেন খানিকটা স্বাভাবিক হয়।

রূপম খানিকটা রহস্যময়ী হাসি হেসে বললো, ” আচ্ছা তৃপ্তি তোর কী মনে হয়? আমার জীবনকে কষ্ট দিয়ে আমি ঠিক থাকতাম? নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে শেষ করে দিয়েছি। ওকে যতটা কষ্ট দিতাম তার হাজার গুণ নিজেকে ফিরিয়ে দিয়েছি। এসব বাদ দেই। কী করবো বল এখন? ”

তৃপ্তি বললো, ” সরাসরি প্রপোজ কর রিমুকে। জানি অনেক কথা শোনাবে তোকে। কিন্তু ধৈর্য ধরে হ্যান্ডেল কর সবটা। নয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন কিছুই করার থাকবে না তোর। সময় থাকতে সেটাকে কাজে লাগা। ”

রূপম ভরসা পেলো তৃপ্তির কথা শুনে। রূপমের মাঝে মাঝে ভীষণ লাকি মনে হয় নিজেকে। তৃপ্তি, ঋষির মতো বন্ধু বান্ধব পেয়েছে সে। যাদের কারণে রূপম অনুপ্রেরণা পায়।

বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে সাদিয়া ডাটা অন করলো। সাথে সাথে মেসেঞ্জারে টুংটাং বেশ কিছু মেসেজ আসলো। ঋষি চৌধুরী নামক আইডি থেকে মেসেজ রিকুয়েষ্ট এসেছে। মেসেজের রিপ্লাই দেওয়ার আগে সাদিয়া ঋষির আইডিতে ঢুকলো। চেক করে দেখলো এটা ঋষি চৌধুরীরই আইডি। সাদিয়া রিপ্লাই দিলো। অমনি শুরু হলো ঋষির ফ্ল্যাটিং। সে আবার বললো, ” একবারো খোঁজ নিলেন না মিস সাদিয়া? আমার কোমড়টার ব্যাথা বেড়েছে। ”

সাদিয়া ঋষির উপর শুরু থেকেই কেন জানি ভীষণ বিরক্ত। আজকে বিরক্তি আরো বেড়েছে। রিমুর বিষয় নিয়ে সাদিয়ার মন মেজাজ খারাপ আছে। তারউপর আবার ঋষি। রিমু রেগে গিয়ে একটা মেসেজ দিলো, ” আপনি না সেলেব্রিটি? এতো আজাইরা সময় পান কীভাবে? ”

ঋষি বললো, ” নিজের জীবনকে সময় না দিলে কাকে দিবো? ”

সাদিয়ার কথা বাড়াতে আর ইচ্ছে হলোনা। সে ডাটা অফ করে শুয়ে পড়লো। ভাবলো রিমুকে ফোন দিবে একবার। কী ভেবে যেন দিলোনা।

রিয়াজুল করিম বাসায় এসে রিমুকে দেখতে আসা ছেলের বিষয়ে খোঁজ নিয়েই ভীষণ রেগে গেলেন। বাড়ির সবাইকে ডেকে পাঠালেন। রূপম তার নিজের রুমে আছে। ঋষিকে ফোন দিলো সে। রিমুকে প্রপোজ করবে কি না জানতে চাইলো। ঋষি সরাসরি বললো প্রপোজ করে দে। রূপম সেই অনুয়ায়ী প্ল্যান সাজাতে লাগলো।

রিয়াজুল করিম নিজে রূপমের ঘরে এসেছেন। আস্তে করে তিনি রূপমকে ডাকলেন। বাবা একটু বের হবি? তোর সাথে আরিয়ানকে নিয়ে কথা ছিলো।

রূপম মুচকি হেসে বললো, উফ চাচ্চু! আমাদের বাড়ির জামাইকে অনেক খাতির করতে হবে বলো?

রিয়াজুল করিম বললেন তা তো অবশ্যই। তুই আয় বাইরে।

চলবে,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-১১

0

#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ১১

সবাই রিমুর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কারণ সে একটা ছেলেকে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলেছে। রূপম আর রিমুর বিয়ের মধ্যে হাজার ঝামেলা নিয়ে সবার মন যখন বিক্ষিপ্ত তখন কোথা থেকে যেন একটা ছেলে তার পরিবার নিয়ে এসেছে রিমুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। ইতিমধ্যে ছেলের পরিবার রিমুকে দেখতে চাচ্ছে। বাসার সবাই শিষ্টাচার বজায় রাখতে গিয়ে কিছু বলতেও পারছে না। নয়তো সবার মন-মানসিকতা যে পরিমান খারাপ হয়ে আছে তাতে নিশ্চয়ই একটা সিন ক্রিয়েট হতো।

রূপম সবকিছু থেকে বেশ কয়েকবার দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে দেখতে পেলো ড্রইংরুমে অতিথি এসেছে। কিন্তু কারা এসেছে বুঝতে পারলোনা। তাদের কাছে যেতেই রূপমের মাথায় বোধহয় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সে আরিয়ানের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। তারপর রূপমের বাবা মায়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলে জানতে পারলো তারা রিমুকে দেখতে এসেছে। কথাটা শোনার পরপরই রূপম উঠে গিয়ে রিমুর দরজায় ঠকঠক করতে থাকে। বলে, ” কী রে! তোকে তো দেখতে এসেছে! আমার সাথে তো বিয়েটা করলি না। এখন অন্যখানে করে নে। যাইহোক এবার বিয়েতে কিন্তু ঝামেলা করিসনা৷ অবশেষে তোর বিয়ে হচ্ছে কী বল! ”

রূপমের বাহিরে থেকে বলা কথাগুলো এ টু জেড রিমু স্পষ্টভাবে শুনতে পেলো। সে ভেবে পাচ্ছে না যার সাথে কালকেই বিয়ের কথা ছিলো রূপমের সেই মেয়েকেই আজ অন্য কেউ দেখতে এসেছে আর রূপম কীভাবে এভাবে কথা বলতে পারছে? মিনিমাম খারাপ লাগা টুকু নেই? তবে যাই হোক বিষয়টা রিমুর জন্য ভালোই হয়েছে। রিমু কোনোভাবেই চায়না রূপম বিন্দুমাত্র ঝামেলা করুক।

তাই ভেতর থেকে রিমু জবাব দিলো, ” না না এবার আর বিয়েতে ঝামেলা করবো না। এবার বিয়েতে ঝামেলা করলে আপনাদেরকে মুক্তি দিবো কীভাবে বলুন? ঠিকঠাকমতো সব কিছু হলে খুব শীঘ্রই আপনাদেরকে চিরমুক্তি দিয়ে এই বাড়ির বাহিরে পা রাখবো। আর ফিরবো না ইনশাআল্লাহ। ”

রূপম হেসে বললো, ” যাক আপদ তাহলে এবার পারমানেন্টলি বিদায় হবি। আলহামদুলিল্লাহ। রেডি হয়ে বাহিরে আয়! আমিও একটু বাজিয়ে দেখি তোর হবু বরকে।”

রিমু কোনো জবাব দিলো না আর। রূপম কয়েকমিনিট কোনো উত্তর না পেয়ে চলে গেলো।

রিমু একটা লাল রঙের শাড়ি পড়েছে। রিমু যদিও খুব একটা পছন্দ করে না রঙটা। লাল রঙের কিছু পড়লে দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। এইজন্য সে এড়িয়েই চলে। কিছুক্ষণের জন্য তার মনে হলো বাড়ির কাউকে না জানিয়ে এরকম আচরণ করা ঠিক হয়নি তার। মনে মনে খানিকটা অনুতপ্ত হলো। তারপর ভাবলো সে এ বাড়িতে থাকা একটা অপ্রয়োজনীয় বস্তু। যার কোনোকিছুই অপর কাউকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা রাখেনা। রিমুর এই ধরনের আচরণও কাউকে আহামরি প্রভাবিত করবে বলে মনে হয় না। তাই সে নির্দ্বিধায় রেডি হয়ে নিলো। এই বাড়ি থেকে চলে যেতে পারলেই সে একপ্রকার মুক্তি পাবে।

রিমু ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমের দিকে এগোতে ওমনিই কোথা থেকে যেন রূপম আকাশ ফুঁড়ে পাতালে এলো। রূপমের মুখোমুখি হয়েই রিমুর বিরক্ত লাগলো।

রূপম চেহারার মধ্যে একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব এনে বললো, ” তুই যে কী! আমি বুঝিনা। তুই কী চাচ্ছিস তোকে এই ভয়ানক রূপে দেখে পাত্রপক্ষ পালিয়ে যাক। কী পড়েছিস এটা? ক্যাটক্যাটে রঙ। একদম ফালতু লাগছে তোকে। যা চেঞ্জ করে আয়। রিমু রূপমের কথাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে সিরিয়াস হয়ে বললো, ” আমাকে দেখতে বাজে লাগছে ভালো কথা। আমি যেমন অবস্থাতেই থাকি না কেন যে আমাকে মন থেকে ভালোবাসে সে আমাকে গ্রহণ করে নেবে সেই অবস্থাতেই। আর আমাকে কেমন লাগছে সেটা আপনার বিচার করার প্রয়োজন নেই। যাদের ভালো লাগা দরকার তাদের ভালো লাগলেই হবে।

রূপম অপমানিত বোধ করলো। এ কী শুরু করেছে রিমু? তার সাথে কথায় কথায় এরকম আচরণের মানে কোথায়? কিছুক্ষণের জন্য কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ হলো রিমুর ভেতর।

রিমু নিচে গেলো। তার মাথায় কাপড় দেওয়া। বাড়ির প্রত্যেকে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে আছে। তাদেরকে না জানিয়ে রিমু এই ধরনের কিছু করতে পারে তা সবার কল্পনাতীত। তবে কী রিমুর কাছে কারো দামই নেই? আরিয়ানের বাবা মা রিমুকে কাছে ডেকে নিলেন। তারা সবটাই জানেন রিমুর বিষয়ে। আরিয়ান তাকে একতরফা ভালোবাসে আর তারা যে আজ রিমুকে দেখতে আসবে এটা বাড়ির কেউ জানে না। এদের সবার মধ্যে রায়হান খানকেই মনে হলো একটু খুশি। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন সেই তথাকথিত কথাগুলো, ” আমাদের মেয়ে কিন্তু ভারী লক্ষ্মী। আপনাদের ছেলেকে সুখেই রাখবে।

রূপম শকুনের দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে চেয়েই রয়েছে। আরিয়ানের দেখে মনে হচ্ছে তার চেয়ে কেউ সুখে নেই। রূপম আরিয়ানের কাছে গিয়ে তার কাঁধে শক্ত করে চাপড় দিয়ে তার কানেকানে কী যেন বললো, ” হুট করেই রিমুর চোখ আরিয়ান আর রূপমের দিকে গেলো। তাদের দিকে চোখ যেতেই রিমু দেখলো দুজনের মুখেই উপচে পড়া হাসি। যেন হাসির প্রতিযোগিতা লেগেছে। কে কার চেয়ে বেশি হাসতে পারে। ”

রিমুর মনে হলো আরিয়ান কোনোভাবে রূপমের কাছের কেউ নয়তো। যদি হয়ই তাহলে রিমুর পেছনে সে পড়েছে কেন। এই রূপম আসলে চাচ্ছে টা কী? সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। রিমু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজ ভীষণ কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দেবে সে৷ একটা মানুষ আর কতই বা সহ্য করে।

রিয়াজুল করিম বাসায় নেই৷ তাই তার অনুপস্থিতিতে বিয়ের কথা অসম্পূর্ণ রাখলো সবাই। রিমু আর আরিয়ানকে আলাদা ভাবে কিছু বলার জন্য পাঠাতে চাইলেন আরিয়ানের বাবা মা। প্রস্তাবটা শুনেই আরিয়ানের মুখের হাসি হাসি ভাব যেন আরো কয়েক শত গুণ বেড়ে গেলো। রিমু চাচ্ছিলো না আলাদা ভাবে কথা বলতে আরিয়ানের সাথে কিন্তু সবাই আছে ভেবে সে কথা বলতে গেলো। কথার শুরুতেই রিমু বললো, ” আপনি রূপম ভাইয়ার কাছের কেউ তাইনা? আপনারা আমার সাথে পেয়েছেন টা কী? আপনাদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি? জবাব দিন একটু।”

আরিয়ান রিমুর জেরা শুনে বোকা বনে গেলো। সে সালাম দিলো রিমুকে। কাল সালাম নিয়ে যেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছিলো সে আজ পড়তে চায়না। সালাম দিয়ে আরিয়ান বললো, ” আমি আসলে তোমার কথা বুঝতে পারছি না। আমি তোমাকে আগেই অবগত করেছি রূপম আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে অনেক ব্ল্যাকমেল করেছে। তবে তোমার কেন মনে হলো রূপম আমার কাছের কেউ?

রিমুর কোনো এক অদ্ভুত কারণে মেজাজ ভীষণ বিগড়ে গেলো। সে খানিকটা উগ্র গলাতেই বললো, ” তাহলে দুজনে কথা বলার সময় এতো হাসছিলেন কেন?”

আরিয়ান এবার কোনো জবাব দিতে পারলো না। যেন কেউ তার মুখের মধ্যে কুলুপ এঁটে দিয়েছে। এবার রিমু সম্পূর্নভাবে শিওর হলো নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। নিত্যদিনের একই বিষয় নিয়ে রিমু ভীষণ বিরক্ত। রোজ রোজ কার ভালো লাগে এই একই কাহিনী?
রিমু আর কথা বলতে চাইলো না আরিয়ানের সঙ্গে। পরে কথা বলবে বলে সবার সামনে এলো সে। এদিকে আরিয়ান আশাহত হলো। আজ প্রথম বার সুন্দর ভাবে রিমুর সাথে কথা বলার সুযোগ ছিলো আরিয়ানের। কিন্তু রূপমের কারণে সেটাও হলো না।

রূপমের বাসা থেকে অনেক রাতে আসায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি তৃপ্তি। তাই সে এখন অবধি ঘুমাচ্ছে। ফোনে রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো তৃপ্তির। স্ক্রিনে রূপমের নাম দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো তৃপ্তি। ইচ্ছে মতো কয়েকটা গালি দিয়ে নিলো। কিন্তু রূপমের কান্নার শব্দ শুনে সে মুহুর্তই চুপ হয়ে বললো। রূপম আবার? রূপম নিজেকে কোনোভাবেই সামলাতে পারলো না। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। এদিকে তৃপ্তি হয়ে গেলো হতবিহ্বল। তারও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে প্রিয় বন্ধুর অবস্থা দেখে। কিন্তু কী-বা করার আছে তার।

চলবে,,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-১০

0

#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ১০

আরিয়ান নামের একটা ছেলে তাকে একের পর এক মেসেজ আর ফোন দিয়ে যাচ্ছে। রিমু আরিয়ানকে খুব ভালো করে চেনে। সে যখন ক্লাস সেভেনে পড়তো তখন থেকে এই আরিয়ান তার পেছনে আঠার মতো লেগে আছে। রিমুকে না হলেও হাজার বারের মতো প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে। তবে কখনো রিমুর থেকে আশানরূপ উত্তর মেলেনি তার। বারবার প্রত্যাখিত হয়েও রিমুর পিছু ছাড়ার যেন নাম-গন্ধই নেই তার।

রিমু নজরকাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই অসংখ্য প্রেম প্রস্তাব পেয়ে এসেছে। কত শত ছেলে তার পেছনে পাগলের মতো ঘুরেছে। তার প্রত্যাখান পেয়ে যে কতজনের মন ভেঙেছে তার হিসাব নেই। তথাকথিত প্রেম প্রস্তাবে ভরপুর রিমুর জীবন। সবার থেকেই সে একটা কথা শুনেছে, ” ভালোবাসি।” তবে রিমু প্রচন্ডভাবে অনুভব করেছে কেউ তাকে ভালোবাসেনি। কারণ প্রত্যেকের কারণেই সে মানসিক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। সবাই তার রূপের মোহে ক্ষনিকের জন্য রিমুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। রিমুর কানে অনেক সময় এমন কথাও এসেছে যেই ছেলেটা কয়েকদিন আগেও তাকে পাওয়ার জন্য পাগলামি করতো সেই ছেলেটাই প্রত্যাখিত হওয়ার পরে সবাইকে বলেছে রিমু না কি ভালো নয়। সবকথা রিমুর কানে এসেছে। রিমু শুধু মুচকি একটা হাসি দিয়ে চুপচাপ থাকতো। ভালোবাসি কথাটা সবাই বলতে পারে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে কজন? যদিওবা সবাই সমান নয়। ভালো, খারাপ সবকিছুতেই আছে।

রিমু ভার্সিটিতে ওঠার পর পরই কোনো এক অজ্ঞান কারণে আরিয়ান হুট করেই হারিয়ে যায়। আবার আজই সে পাগলের মতো একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে রিমুকে। রিমু ফোনটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময়ই আরিয়ান মেসেজ লিখলো, ” প্লিজ রিমু ফোনটা ধরো। আমি আরিয়ান। তোমার ভীষণ চেনা! ”

খুব জটিল কিছু ভেবে রিমু কল ব্যাক করলো। সাথে সাথে আরিয়ান বলতে লাগলো, ” প্লিজ রিমু যাই হোক না কেন তুমি রূপমকে বিয়ে করো না। আরিয়ানের গলার স্বরে তীব্র অস্থিরতা টের পেলো রিমু। এই কথার প্রতিত্তোরে সে কিছু না বলে সালাম দিলো আরিয়ানকে। সালামের জবাব দিয়ে সে একটু লজ্জিত বোধ করলো। এমন পাগলামি শুরু করেছিলো যে সালাম বিনিময় করতেও ভুলে গিয়েছিলো।

সালাম নেওয়ার পরে বেশ কিছুক্ষন আরিয়ানকে চুপ করে থাকতে দেখে রিমু বললো, ” আমি কী কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? আর আপনি এতদিন পরে হুট করে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। ”

আরিয়ান ভেবেছিলো, ” ফোন ধরে রিমু হয়তো ভীষণ কড়া কথা শোনাবে তাকে। ” কিন্তু আরিয়ান তো জানেই না রিমু ভীষণ রেগে না গেলে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। রিমু খুব কমই রেগে যায় কারো প্রতি। মানুষকে সে সহজে ঘৃণাও করতে পারে না। কিন্তু একবার যার উপর থেকে তার মন উঠে যায় পরবর্তীতে তাকে আপন করে নিতে অনেক সময় লাগে রিমুর।

আরিয়ানকে চুপ করে থাকতে দেখে রিমু আবার বলে ওঠে, ” কী হয়েছে বলবেন কী?”

আরিয়ান এক নিঃশ্বাসে বলতে শুরু করলো, ” দ্যাখো রিমু আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা তুমি জানো। আমি তোমাকে বিয়ে করবো। আমি এবং শুধুই আমি। অন্য কেউ নয়। তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো রিমু। আমাকে আর মেরে ফেলোনা। ”

রিমু মনযোগ দিয়ে সবটা শুনে বললো, ” দেখুন জন্ম, মৃত্যু কিংবা বিয়ে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক
পূর্ব নির্ধারিত। তিনি যা চান সেটাই হবে। তবে আপনার অবগতির জন্য আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে রূপম খানকে আমি বিয়ে করবোনা।

আরিয়ান যেন শান্তির প্রশ্বাস ফেললো। অতি উত্তেজনায় আরিয়ান আরেকটা কাজ করে বসলো। সে বললো, ” তোমার থেকে কতদিন দূরে থাকতে হয়েছে। তোমাকে ছেড়ে থাকার দিনগুলো আমার জন্য ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু কী করবো বলো! নয়তো রূপম খান আমার লেখাপড়ায় বাঁধা দিতো। ”

আরিয়ানের কথা রিমু কিছুই বুঝলো না। সে বললো রূপম খান কী করেছে? আর তার জন্য কেনই বা আপনার আমার কাছ থেকে দূরে যেতে হয়েছে?

আরিয়ান ভারী গলায় বললো, ” রূপম আমাকে থ্রেট দিয়েছিলো যেন তোমার আশেপাশে না আসি। নয়তো সে আমাকে মেরে ফেলবে। তাই এতদিন তোমার থেকে দূরে থেকে লেখাপড়াটা কমপ্লিট করছিলাম। কিন্তু যেদিন তোমার আর রূপম খানের বিয়ের বিষয়টা আমি নিউজপেপারে দেখেছিলাম সেদিন মনে হচ্ছিলো কেউ যেন আমার কলিজায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছিলো। কী করবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ তোমার সাথে দেখা করতে তোমার বাড়ির সামনে যাই। বিষয়টা রূপম জেনে ফেলে কোনোভাবে। সে আমাকে আবার থ্রেট দেয়। আমি বাসায় এসে কয়েকঘন্টা পাগলের মতো কেঁদেছি শুধু। তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবো ভেবে। আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছি যেন তোমাদের বিয়েটা বন্ধ হয়। দেখো আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। এবার আর ভয় পাবোনা। তোমাকে সম্পূর্ণ আমার করে নিবো। যা হয় হোক।

রূপম আরিয়ানকে থ্রেট দিয়েছিল এই বিষয়টা কেন জানি আষাঢ়ে গল্প মনে হচ্ছে রিমুর কাছে। রূপম কেন আরিয়ানকে রিমুর কাছ থেকে দূরে থাকতে থ্রেট দিবে? এতে কিইবা লাভ আছে তার। কিন্তু আরিয়ানের গলা শুনে রিমুর মনে হচ্ছে সে যা বলছে তা সত্যি। রিমুর মন আর মাথার ভেতরে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব বেজে গেলো। মন বলছে আরিয়ান সত্যি বলছে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে আরিয়ান মিথ্যা বলছে। রূপম কেন তাকে থ্রেট দিবে? অবশেষে মনের কথাকে সায় দিয়ে রিমু আরিয়ানকে সরাসরি বললো, ” আমাকে যদি পেতে চান তবে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিন। ” কথাটা বলার সময় রিমু বুঝলো তার শরীরের শক্তি হয়তোবা নিঃশেষ হয়ে আসছে। এদিকে আরিয়ান খুশিতে পাগলপ্রায়। সে পরদিনই আসবে বলে জানিয়ে দেয়।

এ কথা শুনেই রিমু কল কেটে ফোন অফ করে রাখে। তার মাথায় হঠাৎই আবার একটা প্রশ্ন আসে। মন জিজ্ঞেস করছে, ” রূপম তোর কে?” রূপম রিমুর কী হয় রিমু বোধহয় নিজেও জানেওনা। সব সম্পর্কের উর্ধে গিয়ে রিমু নিজেকে জবাব দিলো, ” রূপম ভাই আমার ‘অপ্রিয় সে ‘। আর কেউ নয়।”

রিমুর সুইসাইড এটেম্প্ট নেওয়ার বিষয়টি ঋষি সবাইকে জানিয়ে দেয়। সবাই হুড়মুড় করে রিমুর ঘরে আসতে থাকে। এতজনকে একসাথে দেখে রিমু ভাবতে থাকে সে আবার কী দোষ করলো। কিন্তু খানিক পরেই এ চিন্তা তার মাথা থেকে বের হয়ে যায়। সবাই এসেছে রিমুর প্রতি তাদের ভালোবাসা জাহির করতে। রিমু সবার আচরণে ভীষণ ভড়কে যায়। সবার হলোটা কী! এত ভালোবাসা কেন দেখাচ্ছে সবাই?

রেহনুমা বেগম এসে রিমুর হাত দুটো চেপে বলে, ” ঋষির কাছে শুনলাম তুই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলি রিমু। এটা কী করে করতে পারলি? একবারো ভাবলি না তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা বাঁচবো কীভাবে? ”

রিমু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, ” এ কেমন আজব ব্যাপার মা! বেঁচে থাকতে যাকে কখনো গুরত্ব দাওনি সে মরে গেলে তোমাদের তো একটুও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এসব কথা বলে তোমরা কী অপমান করছো না আমাকে? এতো ভালোবাসা কেন জানি না নিতে পারছিনা। আর ভয় পেওনা তো। আমি তো মরিনি। মরলেও বা কী হতো! শুনো মা। বেঁচে থাকতে মানুষের কদর করতে হয় যেন সে বেঁচে থাকার আশা খুঁজে পায়। মরার পরে হা হুতাশ করে লাভ নেই। আর আমরা ভীষণ আজব জাতী বুঝলে? বেঁচে থাকতে মানুষের কদর করিনা। অথচ মরে গেলে আমাদের কতো শোক পালন। এসব আমার লোক দেখানোই লাগে।

রেহনুমা বেগম সহ সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। রিমুর বলা প্রতিটা কথা তাদেরকে ক্ষত বিক্ষত করছে। রিমু বড্ড বেশিই অবহেলিত হয়েছে। সবাই সেটা বুঝতেও পারছে। তবে রিমুর মনে যে বাজে প্রভাব পড়েছে তার কোন প্রায়শ্চিত্ত করলে কাটবে জানে না কেউ। রেহনুমা বেগমের সাথে কথা শেষ করেই রিমু বললো, ” আমি সম্পূর্ণ সুস্থ সবল আছি। আমাকে নিয়ে এতো বেশি ভাবতে হবে না। আমাকে একা থাকতে দাও।

সবাই ঘর থেকে চলে যেতে উদ্যত হলো। সবার অনেক কথা বলার ছিলো রিমুর সাথে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। এতকিছুর পরও রিমুর অবচেতন মন একবার বোধহয় রূপমের দেখা পেতে চেয়েছিলো। কিন্তু রূপম তো আসলো না।

চলবে,,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-০৯

0

#-অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#-পর্বঃ৯

সিলিং ফ্যানটাকে আজ বড্ড বেশি আপন মনে হচ্ছে রিমুর। ছোট থেকে অবহেলা যেন তার নিত্যসঙ্গী। রিমুর জীবনে অনেক মানুষ এসেছে আবার চলেও গিয়েছে। অসংখ্য প্রিয় বস্তু তার কাছে এসেছে আবার নষ্টও হয়েছে । এগুলোর কোনোটার স্থায়িত্বই অবহেলার মতো দীর্ঘমেয়াদি নয়। সেই ছোটবেলা থেকে অবহেলা ওই যে তাকে আপন করে নিলো! আজ অবধি ছাড়লো না। সে বোধহয় রিমুর মায়ায় পড়ে গিয়েছে। আজীবনের সঙ্গি হতে চায় তার। তাই এতো কাল ধরে আগলে রাখছে তাকে।

গলায় থাকা জর্জেটের ওড়নাটা ফ্যানের সঙ্গে পেঁচিয়ে গলায় দিলো রিমু। তার পা এখন খাটের ওপরে থাকা একটা টুলের ওপর।

প্রেস কনফারেন্স শেষে ঘরে এসে হাঁপ ছাড়লো রূপম। সবাই তাকে এমন ভাবে চেপে ধরেছিলো যে মনে হচ্ছিলো সে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে। জীবনে প্রথমবার এমন পরিস্থিতিতে পড়ে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত । এতকিছু যার কারণে হয়েছে তার মতামত নেওয়ার জন্য যখন মিডিয়ার লোকেরা রূপমকে ফোর্স করছিলো তখন মিশ্র অনুভূতিতে সে স্তব্ধ পাথর। তবে একটা জিনিস তার মাথায় ঢুকছেনা। একটা রাত সবকিছু কী করে চেঞ্জ করে দিতে পারে?

কিছু কিছু মানুষের মানসিকতায় নির্দিষ্ট কিছু জিনিস বা আচরণের প্রতি রাগ বা বিরক্তি বোধ থাকে। তার মধ্যে রূপমের যে বিষয়টা বিরক্ত লাগে সেটা হচ্ছে কলার ধরা। রিমু যেদিন রূপমের কলার চেপে ধরেছিলো সেদিন তার রাগ হয়েছিলো। রিমুর থেকে এই ধরনের আচরণ তো অকল্পনীয় তার কাছে। সেই রিমুই কলার চেপে ধরে যখন রূপমের উপর জোর গলায় কথা বলেছিলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলো রূপম।

তবে চিরকুটটা রূপমই দিয়েছিলো রিমুকে। এটা তার বাম হাতের লেখা। সে দুই হাতেই লিখতে পারে। এবং বিষয়টা সে ছাড়া কেউই জানে না। যেটার ফায়দা সে তুলেছে। সে রেগে না গেলে হয়তোবা স্বীকার করতো৷ যা হবার হয়ে গিয়েছে ভেবে সে এসি ছেড়ে দিয়ে ধরাম করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

বাহিরে রৌদ্রের ঝাঁজে চোখ মেলে তাকাতেও সমস্যা হচ্ছে সাদিয়ার। সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাতে নিলেই চোখে আলো এসে পড়ছে তার। আজকের দিনটা তার জন্য ভীষণ গুরত্বপূর্ণ। রিমু যে শেষ অবধি তার ভুলটা শুধরে নিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে শুরু করছে এটা তার জন্য ভীষণ প্রশান্তির বিষয়।

কিছু মানুষ থাকে তারা যেখানেই যাক না কেন সবার সমস্যা সমাধান করে দেয়। অথচ তাদের নিজের জীবনই সমস্যায় ভরপুর। সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেয়। সবার প্রচন্ড খেয়াল রাখে অথচ মানুষ তার থেকে শুধু ভালোবাসা আর যত্ন নিয়েই যায়। বিনিময়ে তাকে খুব কম ভালোবাসা দেয়। সাদিয়ার জীবনে এই রকম মানুষটা হলো রিমু। যেদিন থেকে রিমু আর সাদিয়ার বন্ধুত্ব হয়েছে সেই দিন থেকে রিমু তার সবটুকু দিয়ে সাদিয়াকে আগলে রেখেছে। রিমু সাদিয়ার জন্য যা যা করেছে সেটা সাদিয়া কখনোই ভুলতে পারবেনা। পক্ষান্তরে সাদিয়া কখনো রিমুর কোনো কাজে আসতে পারেনি। তবে সাদিয়া যে রিমুকে ভালোবাসে এটা সে নিশ্চিত।
পেছন থেকে কারো ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো সাদিয়া । ঋষি ডাকছে তাকে। সাদিয়া ঋষির দিকে তাকাতেই বাচ্চাদের মতো মুখ করে খানিকটা অভিযোগের সুরেই ঋষি বললো, ” আপনি তো ভীষণ পাষন্ড! আমাকে ফেলে দিয়ে কোমড় ভেঙে দিলেন অথচ একবারো খোঁজ নিলেন না? ”

রিমুর কথা ভাবার মুহুর্তে ঋষির আগমন আর অহেতুক বাড়িয়ে কথা বলায় রিমু চোখ মুখ কুঁচকে বললো, ” এ কেমন বিচার! এই তো আপনি দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন। কোমড় ভাঙলো নিশ্চয়ই এখন আমার সামনে না থেকে আপনাকে হসপিটালে থাকতে হতো। অ্যাম আই রাইট মিস্টার ঋষি চৌধুরী? ”

ঋষি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সে বুঝলো এই মেয়ের মাঝে কিছু তো স্পেশাল আছেই। অন্য কোনো মেয়ে হলে ঋষি চৌধুরী তার সাথে কথা বলছে ভেবেই সারারাত ঘুমাতে পারতো না আর সাদিয়া তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। বিষয়টা ঋষিকে আকর্ষিত করে তুললো সাদিয়ার প্রতি।

সাদিয়া আগের মতোই ভ্রু কুঁচকে বললো, ” আপনি এখান থেকে যান তো মশাই! না জানি কখন কোন রিপোর্টার কি নিউজ করে দেয়।”

ঋষি আর কিছু বলার আগে সাদিয়াই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

রিমুর হাত কাঁপছে। সবকিছু একে একে মনে পড়ছে তার। সে ভাবছে কীভাবে মানুষ পারে একটা মানুষকে এতো যন্ত্রণা দিতে যাতে সে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে চায়? শেষবার সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়ে যেই সে গলায় ফাঁস দিতে যাবে অমনিই কোথায় থেকে যেন ঋষি চলে এলো। রিমুর ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। নিজের মন মানসিকতার উপর এতোটাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে রিমু যে ঘরের দরজা না আটকেই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলো। ঋষি রিমুকে ধরে টুল থেকে নামানোর পরপরই প্রচন্ড রেগে থাপ্পড় মারতে গিয়েও থেমে গেলো। নিজেকে শান্ত করে আস্তে সে বললো, ” সরি!”

রিমুর এখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে কয়েক সেকেন্ডর জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলো। হুস ফিরেছে তার৷ একটু আগেই অভিমান , রাগ, জেদের কারণে সে কী জঘন্য পাপটাই না করতে যাচ্ছিলো৷ আল্লাহর হুকুমে ঠিক সময়ে ঋষি চলে এসেছিলো। নয়তো কী যে হতো।

ঋষি রিমুর দিকে তাকিয়ে বললো, ” এসব কী রিমু? আপনার মতো মেয়ে কী করে এই ধরনের কাজের দিকে ধাবিত হওয়ার কথা ভাবতে পারে? আপনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন? এটা কতটা জঘন্যতম পাপ আপনি জানেন না? আমি আপনার সম্পর্কে এতদিন যা যা শুনেছি সবটাই কী তাহলে ভুল? শুনেন! আমি রূপম, আপনাদের পরিবার সম্পর্কে কমবেশি অনেক কিছুই জানি। যতটুকু শুনেছি রূপম আপনাকে অনেক যন্ত্রণা দেয়। সে নিজেই স্বীকার করেছে। আপনি সব সহ্য করেও শক্ত থাকতেন। কখনো নিজের ক্ষতি করার কথা ভাবেননি। তাহলে এখন যখন নিজের কথা ভাবার পথে চলেছেন তখন কেন এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন? এতো সাহস কে দিয়েছে আপনাকে?”

রিমু কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তবে এতটুকু এই মুহুর্তে তার মাথায় আছে সে যা করতে যাচ্ছিলো সেই স্টেপ নেওয়ার কথা ভাবাও মহাপাপ হয়েছে তার। জীবনটা তো সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সেরা একটা উপহার। আল্লাহর আমানত। তবে সে কী করে পারলো এসব ভাবতে?

নিম্ন সুরে রিমু বললো, ” ভাইয়া কেউ যখন নিজের জীবনের উপর ভীষণ বিরক্ত হয় তখনই সে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। যাইহোক
যেটা বলছিলাম আমি ভুল করতে যাচ্ছিলাম। আপনি সেখান থেকে বের হতে সাহায্য করলেন তার জন্য ধন্যবাদ।

ঋষি ঘর থেকে চলে গেলো। তবে রিমু ভেঙে পড়লো একেবারে। জায়নামাজ বিছিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

আত্মহত্যার প্রবণতা কমবেশি অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। যারা নিজের জীবনের উপর হতাশ, বিরক্ত মানুষেরাই এমন করে। কিন্তু আত্মহত্যা কখনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। এতে হয়তো পৃথিবীর সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব কিন্তু পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আল্লাহ লিখে রেখেছেন। আত্মহত্যা যারা করে তাদের পরিবারের মানসিক অবস্থা খারাপ হয়। আশেপাশের মানুষজনের কথা তো আছেই।
সেজদারত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লো রিমু। আল্লাহর কাছে বারবার সে চাইছে আল্লাহ যেন তাকে ধৈর্য ধরার শক্তি দেন। রিমুর মনে একটা প্রশ্ন প্রায়ই জাগে। আল্লাহ কেন তাকে এতো বেশি কষ্ট প্রদান করেন। পরে সে নিজেই নিজেকে উত্তর দেয় আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা করেন। এটা ভেবেই সে একটু প্রশান্তি পায় মনে। হুট করে রিমুর ফোনে ক্রমাগত মেসেজের শব্দ আর অসংখ্য ফোনকল আসতে থাকে। রিমু উঠে ফোনটা হাতে নেয়। ফোনের ওপারে থাকা মানুষটার মেসেজ দেখে রিমুর মনে হচ্ছে মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।

চলবে,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-০৮

0

#-অপ্রিয় সে
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্বঃ৮

রূপম কল্পনাও করতে পারেনি তার সাথে এমন কিছু হবে বা রিমু এমন কিছু করবে। তবে মানুষ সবসময় যা ভাবে তা আসলে হয়না৷ রূপম রিমুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবছে একরাতের মধ্যে রিমুটা কতখানি বদলে গেলো। শান্তশিষ্ট, অভিমানী, কষ্ট পুষে রাখা মেয়েটা হয়ে গেলো একদম রাগী,বদমেজাজি আর প্রতিবাদী মেয়ে।

রিমু বোধহয় রূপমের মনের কথা বুঝতে পারলো। সে ভারী গলায় বললো, ” রূপম ভাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সবাই ঘুরে দাঁড়ায়। আমার দেয়ালে পিঠ আগেই ঠেকে গিয়েছিলো কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানো ভীষণ প্রয়োজন।

রূপম হকচকিয়ে গেলো । আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য দিন। না জানি কতকিছু সহ্য করতে হবে তাকে। তবে কিছু করারও নেই। সে ঠিক করলো কোনোমতে ফ্রেশ হয়েই প্রেসের সামনে যাবে। কারণ যা হওয়ার তা হবেই। ভাগ্যে যা নির্ধারিত আছে তা কেউ ঠ্যাকাতে পারবে না। তাই যা হওয়ার আগেই হোক৷

রিমুর আর ভালো লাগছিলো না রূপমের ঘরে থাকতে। সে চলে যেতে উদ্যত হলেই রূপম তার হাত ধরে হেঁচকা টানে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। রিমু প্রথম কয়েক সেকেন্ড স্তম্ভিত হয়ে রইলো। কারণ রূপম তাকে কখনো এভাবে স্পর্শ করেনি। রিমুর মনে হলো তার যেন প্রচন্ড রকমের জ্বর আসছে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে রূপমকে ধাক্কা দিলো সে। বেকায়দায় ধাক্কা খেয়ে খাটে গিয়ে পড়লো সে। রূপম এবার কিছু বলতে যাবে তখনই একপ্রকার চিৎকার করে রিমু বলতে লাগলো, ” আপনার সাহস হয় কী করে আমার গায়ে স্পর্শ করার? কোন সাহসে হাত ধরে বুকের কাছে নিলেন? আমি কি আপনার বিবাহিত স্ত্রী না কি যে আমাকে এভাবে স্পর্শ করার অধিকার রয়েছে আপনার? ”

রূপমও রেগে গিয়ে বললো, ” আগে বোধহয় তোকে স্পর্শ করিনি? এতো ওভার রিয়্যাক্টের কী আছে? ”

রিমু তার কন্ঠস্বর দ্বিগুণ করে বললো ওভার রিয়্যাক্ট মানে? আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন অথচ আমি কিছু বলবো না? শোনেন অনধিকার চর্চা করতে আসবেন না খবরদার। কাজিন কাজিনের মতো থাকুন। আমার কারো স্পর্শ সহ্য হয়না। আর কী যেন বললেন! আগেও স্পর্শ করেছেন তবে তা একান্তই স্বাভাবিক ভাবে বা আমাকে প্রহার করার উদ্দেশ্য। তবে আজকে যেটা করলেন সেটাতে আমি একদমই ভালো ফিল করিনি । নেক্সট টাইম এই ধরনের আচরণ করলে আমি কিন্তু খারাপ হতে বাধ্য হবো৷ আশা করি নিজের সীমা অতিক্রম করবেন না। ”

রূপম এবার হতাশ হয়ে গেলো। ভালো লাগছে না কিছু তার। কেউ কখনো তার সাথে এই ধরনের আচরণ করেনি। তবে অন্য কেউ হলেও মানতে পারতো রূপম৷ কেন যেন রিমুর থেকে এই ধরনের আচরণ সে সহ্যই করতে পারছেনা। কোথাও একটা ভীষণ অপমানিত বোধ করছে সে আর কোথাও যেন অসহায় বোধ করছে।

রিমু রাগে ফোসফাস করতে করতে চলে গেলো। রূপম ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।

রূপমের চারপাশে এখন অসংখ্য ক্যামেরা। সাংবাদিকদের অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সে অসহায় বোধ করছে। রূপমের কাছে ক্যামেরা, সাংবাদিক, হাজার মানুষের ভীড় কোনো বিষয়ই নয়। এসব হ্যান্ডেল করে সে অভ্যস্ত। তবে আজকের বিষয়টা সম্পূর্ণ অন্যরকম। রিমু যে কাজটা করেছে তাতে রূপমের দিকে আঙ্গুল ওঠা খুব স্বাভাবিক। সবার মনে প্রশ্ন আসাটাও স্বাভাবিক যে কোনো ঘাপলা না থাকলে কী কেউ বিয়ে ভাঙে? আর সেটা বিয়ের দিন সকালেই?

সাংবাদিকদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,” স্যার আপনি বিয়েটা খুব একটা জমকালো ভাবে আয়োজন করেননি যতটা হওয়া উচিত ছিলো। কাছের মানুষজন আর বাহিরের সামান্য কিছু মানুষ নিয়েই আয়েজন করেছিলেন। এর কী বিশেষ কোনো কারণ আছে? ম্যাম কী আগে থেকেই বিয়েতে নাখোশ ছিলো? বা এই বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা? স্যার প্লিজ অ্যানসার দিন। ম্যাম আজকে কেন বিয়ে ভেঙে দিলো? ”

রূপম কোনো উত্তর দিতে পারলোনা। কী বলবে সে? কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সে বললো, ” বিষয়টা একান্তই পারিবারিক। আমাদের মধ্যে কিছু মিসঅ্যান্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। খুব শীঘ্রই রিমুকে আমার স্ত্রী রূপে দেখবেন ইনশাআল্লাহ। ইনশাআল্লাহ বলার মধ্যে সবাই ভীষণ অদ্ভুত একটা জোর পেলো সবাই। ”

সাংবাদিকদের কাজই হচ্ছে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তথ্য বের করা। তাই তারা একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে থাকলো। রূপম ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। মেজাজ খুইয়ে যাচ্ছে তার। জীবনে প্রথমবার এরকম অপমান, লাঞ্ছনা এবং অবাঞ্ছিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার। তার ভেতরটা জলে পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু প্রকাশ করতে পারছেনা। হাসিমুখে সবটা সামলাতে হচ্ছে তাকে। মানুষের জীবন একেক সময় একেক পরিস্থিতিতে দাঁড় করায় তাকে। কখনো ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে গেলেও হাসিমুখে থাকতে হয়। আসলে এই হাসির আড়ালে কষ্ট লুকানোর অনুভূতিটা জঘন্য।

রিমুর আজকে ভেতর থেকে ভীষণ ভালো অনুভূত হচ্ছে। কানে হেডফোন খুঁজে সে গানে মত্ত হলো।

টুপ টাপ গুপ চুপ চাপ
টুপ টাপ খুব চুপ চাপ
আমি জানি একা নদী
অভিমানী তার চোখ
সাবধানে থাকি যদি
কথা নয় নাই হোক
পারিনা, ছাড়িনা (২)
পারিনা তার নাম
এ বোবা ঠোঁটে থাক
ঘুম ঘুম মৌসুম
ঘুম সুম এ মর্সুম
আমি জড়িয়ে থাকি যাতা
গায়ে লেগে ডাক নাম
বাজে ছড়িয়ে ফেলি যাতা
মুঠোর বাদাম
পারিনা, ছাড়িনা
পারিনা তার নাম
এ বোবা ঠোঁটে থাক।

গানটা শুনলেই অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে রিমুর। ভীষণ ভালো লাগে তার। অরিজিৎ এর গলায় যাদু আছে। মানুষকে আকর্ষিত করার জন্য যথেষ্ট। কানে হেডফোন থাকায় বাহিরের জগতে মন ছিলোনা৷ এদিকে তার মা রেহনুমা বেগম তাকে সমানে ডেকেই চলছেন। একপর্যায়ে তিনি রিমুর কান থেকে হেডফোন খুলে সেটাকে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন। রিমুর প্রচন্ড রাগ উঠলো। কিছু সে চুপ করে রইলো। হাজার হোক মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার কিছুতেই সে করতে চায়না। তবে তার যে পরিমাণ রাগ উঠছে তাতে সে হয়তো আজকে একটা অকাজ করেই বসবে।
রেহনুমা বেগম স্থির গলায় বললেন, “রিমু তুই না কি রূপমকে ধাক্কা দিয়েছিস? ”
কথা বাড়ানোর ইচ্ছে না থাকায় রিমু ছোট্ট করে জবাব দিলো ” হু।”

রেহনুমা বেগম একপ্রকার তেড়ে এলো তার দিকে। রিমু আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। আবারো চেঁচিয়ে উঠলো। বললো, ” তোমাদের গুণধর ছেলের প্রেস কনফারেন্স শেষ হলো বুঝি? তা কী কী ফেস করলো সে? এতো এতো প্রশ্নের জাঁতাকল আর সন্দেহের তীরের স্বাদ কেমন ছিলো? বাই ওয়ে তোমাদের ছেলের তো মেয়েলি স্বভাব। কোনো কথা পেটে চেপে রাখতে পারেনা। তা কেন ধাক্কা দিয়েছি সেটা নিশ্চয়ই বলেছে?

রেহনুমা বেগম বললো, ” না সে বলেনি!”

রিমু হেসে বললো মা ঘর থেকে বের হয়ে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।
রেহনুমা বেগম বললেন, ” ভালোই বেয়াদব হয়েছিস ভালোই। মায়ের সাথে কেমন আচরণ করতে হয় ভুলে গিয়েছিস?”

রিমুর সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় সে নিজেই নিজেকে আঘাত করলো রুমে থাকা একটা লাঠি দিয়ে। রেহনুমা বেগম কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। রিমুর আচরণ দেখে রেহনুমা বেগম অত্যাধিক কষ্ট পেয়েছেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্তানের বাজে আচরণ দেখলে সব বাবা মা আঘাত পায়। রেহনুমা বেগম ঘর থেকে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলেন আর রিমু ধরাম করে দরজা বন্ধ করে নিজেকে আঘাত করতে লাগলো। সে নিজের জীবনের উপর বিরক্ত। ভীষণ রকম বিরক্ত। একপর্যায়ে তার নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়ার ইচ্ছে হলো। একদৃষ্টিতে সে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-০৭

0

#_অপ্রিয় সে
#-সানিজিদা সন্ধি
#পর্ব-৭

সারা দিন পরিশ্রম আর রাত জাগার কারণে ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে এলো রূপমের। রিমুর সাথে ঝামেলা হওয়ায় তার মেজাজও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।

বেলা এগারোটা। রূপম ঘুম থেকে জেগেই শুনতে পেলো সারা বাড়িতে অত্যাধিক রকমের হট্টগোল। বিয়ে বাড়িতে হট্টগোল থাকা অতিব স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এই চেঁচামেচি ঠিক অন্য রকমের।

রূপম তার ফোনটা হাতে নিয়ে ডাটা অন করতেই ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার থেকে আসা হাজার হাজার নোটিফিকেশনের ঝড়ে তাজ্জব বনে গেলো। সাথে রয়েছে হাজার হাজার মেসেজ।

রূপম দেশের নামকরা গায়ক। হাজার হাজার ফ্যান ফলোয়ার তার। দেশ বিদেশে গান গেয়ে নাম কুড়িয়েছে সে। তার ফোনে প্রতিদিন অনেক নোটিফিকেশন আসেই৷ যেদিন থেকে তার বিয়ের অ্যানাউন্সমেন্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেদিন থেকেই নারী ফ্যান ফলোয়ারদের হাজার হাজার হৃদয় বিদারক মেসেজ পেয়েছে সে। সবাই অভিনন্দনও জানিয়েছে। তবে আজকের বিষয়টা ভিন্ন।

রূপম ডাটা অন করতেই চাপ লেগে একটা মেসেজ ওপেন হয়ে যায় তার।

মেসেজটা ঠিক এরকম ছিলো, ” যাক অবশেষে কেউ রূপম খানকে রিজেক্ট করলো। আমি তো ভেবেছিলাম সবাই তার জন্য পাগল। কিন্তু এতো দেখি অন্য কাহিনি। বাই দা ওয়ে রূপম খান। রিজেকশন পাওয়ার পর থেকে কেন জানি মিডিয়ার সামনে আসছেন না আপনি? অপমানিত হয়েছেন বুঝি? আহারে। দুঃখ লাগছে আপনার জন্য। যাইহোক এখন হবু বউ চলে যাওয়ার কষ্টে কাঁদতে থাকুন। টিস্যু লাগলে বলবেন। মেয়েটার সাহস আছে বলতে হয়।”

রূপম কিচ্ছু বুঝলোনা বিষয়টা। কাছের মানুষজনেরাও অসংখ্য মেসেজ পাঠিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার এক অনলাইন সংবাদ পড়ে রূপম সবটা বুঝতে পারলো। সেখানে বড় বড় করে হেডলাইন লেখা, ” দেশের বিশিষ্ট গায়ক রূপম খান তার হবু বউয়ের কাছ থেকে প্রত্যাখিত হয়ে হয়েছেন!”

হেডলাইন দেখেই পিলে চমকে উঠলো রূপমের। বিস্তারিত নিউজে বলা হয়েছে, ” বেশ কয়েকদিন ধরেই বিয়ের আমেজে মেতেছেন এদেশের জনপ্রিয় গায়ক রূপম খান। খুব একটা ধুমধামের সঙ্গে না হলেও বেশ নজরকাড়া ভাবেই তার বিয়ের এক একটা অনুষ্ঠান সুন্দভাবে পালিত হচ্ছিলো। রূপম খান কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মিডিয়া থেকে নিজের বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ খানিকটা দূরেই রেখেছেন। তবে গমন মাধ্যম গুলো যে একেবারেই সরব নন তেমনটা নয়। আজ রূপম খানের বিয়ের দিন। সব ঠিকঠাক থাকলে হয়তো তিনি আজ নতুন জীবনে পা রাখতেন। তবে আজ সকালে রূপম খানের হবু বউ রাদিয়া হাসনাত রিমু তার পরিবারের সবাইকে জানান তিনি বিয়ে করবেননা। সেখানে উপস্থিত এক সাংবাদিককের উপস্থিতিতে তিনি সরাসরি বলেন, ” আমি রূপম খানকে বিয়ে করবোনা। ” খবরটা বাতাসের মতোই ছড়িয়ে পড়ে। গনমাধ্যমের কর্মীরা তাকে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার এবং এমন পরিস্থিতিতে এসে এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু জানাননি। রাদিয়া হাসনাত রিমুর এই বক্তব্যের কারণ জানতে তার পরিবার এবং রূপম খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পাওয়া যায়নি। কেউই কিছু বলছেন না। রূপম খানকে সকাল থেকে বের হতে দেখা যায়নি। তাঁর পরিবারের একজন জানায় তিনি অসুস্থ রয়েছেন এবং তাকে যেন কোনোভাবেই বিরক্ত করা না হয়। বর্তমানে রূপম খানের বিয়ের বিষয়ে নানারকম সমালোচনা, জল্পনা কল্পনা চলছে। ”

আর কিছু পড়তে পারলোনা রূপম। তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। রিমু এমন কিছু করতে পারে এটা মাথাতেও আসেনি রূপমের। রিমু আগে থেকেই বিয়ের জন্য নারাজ ছিলো এটা সবার জানা। তবে সে যে জনসম্মুখে নিজের এই মতামত প্রকাশ করছে সেটা যেন বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না রূপমের। এখন হাজার হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, তাকে নিয়ে নানানরকম আলোচনা, সমালোচনায় সয়লাব হয়ে যাবে গণমাধ্যম। আর সেসব ফেস করতে হবে ভেবেই জ্বর চলে আসলো রূপমের। সে কন্ট্রোভার্সিতে খুবই কমই জড়িয়েছে। চারদিকে তার শুধু সুনাম আর সুনাম। এসব কিছু কীভাবে হ্যান্ডেল করবে ভাবতেই কেমন যেন একটা যন্ত্রণা হলো রূপমের। ঠিক মাথার অগ্রভাগে। রূপম এখন ঘর থেকে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ঋষিকে ফোন করে সবটা সামলাতে বললো। ঋষি রূপমের খুব কাছের হওয়ায় সবটাই জানা তার রূপমের জীবন সম্পর্কে। ঋষিকে ফোনে সবটা বুঝিয়েই রিমুকে ফোন দিলো রূপম। রিমু রূপমের নম্বর দেখে প্রথমে ধরলোনা। কিন্তু রূপম ক্রমাগত ফোন দিলেই চলেছে। না পেরে রিমু ফোনটা তুলে সালাম দিলো।

রূপম সালামের জবাব দিয়েই বললো, ” তুই এই মুহুর্তে আমার রুমে আসবি। আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা। ”

রিমু প্রথমে ভাবলো সে যাবে না। কারণ এই মুহুর্তে রূপমের মুখোমুখি হওয়ার কোনোরকমই ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু তারপর কী ভেবে যেন রূপমের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

দরজার নক পড়তেই রূপম বললো, ” কে?”

রিমু জবাব দিলো,” আমি। ”

দরজা খুলেই হ্যাঁচকা টানে রিমুকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়ালের সাথে তার হাত চেপে ধরলো। রিমুর হাতে চুড়ি থাকায় সেগুলো ঘষা লেগে সে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো।

রূপম খুব ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, ” তুই এটা কী করলি রিমু?”

সবটা বোঝার পরেও রিমু বললো, ” কী করেছি আমি? জানি না তো। আপনিই বলেন। ”

রূপম একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, “সাহস বাড়ার সাথে সাথে অভিনয় করাও শিখে গিয়েছিস ভালোই। আমি তোকে স্ট্রেট ফরোয়ার্ড মেয়ে হিসেবে চিনতাম। কিন্তু এখন দেখছি তুই ভালোই ভান করতে পারিস। এমন মুহুর্তে আমি কোন বিষয় নিয়ে তোকে জিজ্ঞেস করবো এটা বুঝতে নিশ্চয়ই বিজ্ঞানী হতে হবে না? আর কাল রাত থেকে কী আপনি আপনি করে যাচ্ছিস? খারাপ লাগছে তো আমার। তুমি করেই বল। যতো যাই হোক এমনটা শুনে অভ্যস্ত নই তো তাই। ”

রিমু বিদ্রুপাত্মক মুখের ভঙ্গি করে বললো, ” কাল রাতে যা করলেন তারপর কেন জানি! থাক। এবার মেইন পয়েন্টে আসি। আমার মনে হয় এতোক্ষণে আপনি পুরোপুরি জেনে গিয়েছেন আমি কী করেছি। আমি আপনার সাথে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠিক হওয়া বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। আমি কিন্তু কাউকে অনুরোধ করিনি। আমি নিজের অধিকার ফলিয়েছি। আমি খুব ভালো করে জানি আপনার সাথে আমার কখনোই বনবে না। তাই বিয়ে ভাঙলাম। ”

রূপম এইবার রেগে গেলো। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সে বললো, ” এখন এই মুহুর্তেই কেন তোর অধিকার বোধ জন্ম নিলো? আগে নিতে পারেনি? তাহলেই তো আমাকে এতো ঝামেলা ফেস করতে হতো না।”

রিমু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,” আগেই অধিকার বোধটা জন্ম নিতো যদি নিজেকে নিয়ে একটুখানি ভাবতাম। আর আগে নিজেকে নিয়ে ভাবিনি মানে এখনো যে ভাববো না বা ভাবনা আসবে না সেটা ভাবলেন কীভাবে? আর বোধদয় মানুষের যেকোনো সময়েই আসতে পারে। আমার এখন এসেছে। সাহস বেড়েছে তাই অতীতের অপমান লাঞ্ছনাকে পুঁজি করে ভবিষ্যতে ভালো থাকার একটা দুয়ার খুলে দিলাম। একটা বিষয় জানেন রূপম ভাই? মানুষের জীবন বড্ড বেশি অদ্ভুত। অনেক সময় হাজার আঘাত পেলেও তারা নিজেকে শক্ত করে গড়ে তোলে না আর অনেক সময় ছোট কিছু আঘাত মানুষকে পাথর বানিয়ে দেয়। কালকে রাতে হয়তো আপনি যা করেছেন তা অত্যাধিক রেগে গিয়ে। তবে চিরকুট নিয়ে যেই মিথ্যাচারটা করেছেন সেটা আমাকে প্রচন্ড আঘাত করেছে।”

ঘুম থেকে ওঠার পরপরই রূপম যেসব দেখছে তাতে গতকালের ঘটনা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। সে আবারো রিমুকে সরি বললো। তবে রিমু নাছোরবান্দা। সে কথার মারপ্যাঁচে বারবার রূপমকে মনে করিয়ে দিতে লাগলো কাল রাতে সে কী অন্যায়টা করেছি। রূপম হাঁপিয়ে গেলো৷ সাথে ভীষণ ক্রোধে ফেটে পড়লো।

চলবে,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-০৬

0

#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ৬
বাসার সবাই রিয়াজুল করিমের ঘরে মিটিং বসিয়েছে। রূপম আর রিমুর ঝামেলা দেখতে দেখতে হতাশ তারা। এখন মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি না করলেও হতো।

রূপমের বাবা শিহাব খান বলে উঠলো, ” রূপমের সাথে সবারই কথা বলা উচিত। সে বোধহয় এবার সমস্ত লিমিট ক্রস করে ফেলেছে।”

রায়হান খান বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, ” রূপমের এরকম বেয়াদব হওয়ার পিছনের দোষটা আসলে কী তার একার? আমাদের দোষ সিংহভাগ। যখন কেউ অন্যায় করে তখন যদি সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তবে সে সেই অন্যায়কে ন্যায় বলে জ্ঞান করে। এতে তার দোষের চেয়ে আশেপাশের মানুষগুলোর দোষই বেশি। এতদিন সব অন্যায়ে সবাই সায় দিতে দিতে তাকে চরম বেয়াদব বানিয়ে ফেলেছি। এখন সে লাগামহীন হয়ে গিয়েছে। কিছু করার নেই। এখন এসব বলে লাভ আছে? ”

শিহাব খান সহ সবার মাথাই নিচু হয়ে গিয়েছে। তারপরও তিনি বললেন, ” আল্লাহ কখন কাকে হেদায়েত দান করবেন সেটা তো কেউ জানে না বলো? আমার আজ ভীষণ খারাপ লাগছে। ”

রায়হান খান হনহনিয়ে উঠে বেড়িয়ে গেলেন। আশেপাশে এদিক ওদিক রিমুকে খুঁজলেন। তাকে কোথাও না পেয়ে ছাঁদে গেলেন। রিমু দুহাটু একসাথে ভাজ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। ছাঁদ থেকে ততক্ষণে সবাই নেমে এসেছে। রিমুর কাছে সাদিয়া আসতে চাইলেও রিমু তাকে একা থাকতে দিতে বলে সবাইকে চলে যেতে বলেছে।

রায়হান খান এগিয়ে রিমুর মাথায় হাত রাখলেন। রিমু মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন রায়হান খান। সে চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পরে মুখ খুলে বললো। আচ্ছা খালামনি! ধরো আজ আমার সাথে যেটা হচ্ছে সেটা যদি তোমার মেয়ের সাথে আমার ভাই করতো তবে কী তোমরা মেনে নিতে? এককথায় জবাব দিবে কিন্তু। রায়হান খান মাথা নিচু করে বললেন, ” কখনোই না। ”

রিমু স্ব শব্দে হেসে একটা বললো, ” তাহলে আমার বাবা তার নিজের মেয়ের চেয়ে ভাইয়ের ছেলে আর আমার মা তার নিজের মেয়ের চেয়ে বোনের ছেলেকে এতো বেশি মাথায় তুলেছে কেন? ”

রায়হান খান বললেন, ” তোর বাবা শিহাবের ছোট! আর তোর মা আমার ছোট। রিয়াজ তোর মাকে বিয়ে করার পরপরই তোর মায়ের রোগব্যাধি ছাড়েই না। দীর্ঘদিন তোর মায়ের বাচ্চাও হয়নি। তারপর পৃথিবী আলো করে তোর জন্ম হলো। জন্মের সময়টায় তোর দাদু তোর বাবাকে বা তোর অন্যান্য চাচারা কেউই সাহায্য করে নি। কারণ তোর বাবা সম্পত্তি নিয়ে তোর দাদুর সাথে কথা-কাটাকাটি করে। সেসময় রিয়াজকে সাহায্য করে শিহাব। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে করতে তোর বাবা মা কত যে কেঁদেছে। আসলে তুই হওয়ার আগে তো তোর মায়ের কোনো বাচ্চা ছিলোনা। আর রূপম তখন তোর মায়ের কোল আলো করে ছিলো। তাই টানটা হয়তো একটু বেশিই। রূপমের পিঠাপিঠি রিংকি হওয়ায় রূপম তোর মা বাবার কাছেই বেশি থাকতো। ”

রিমুর এসব জানা কথা। তবে আজ যতটা গভীরভাবে জেনেছে ততটাও নয়। তারপরে সে বললো, ” তা নাহয় বুঝলাম। তবে আমার কী মনে হয় জানো? না তোমরা কেউ আমাকে ভালোবেসেছো আর না রূপম ভাইকে। যদি রূপম ভাইকে ভালোইবাসতে তবে তাকে ভালো পথে যেতে উদ্ভুদ্ধ করতে। আমি মানলাম সে শুধু আমার সাথেই খারাপ ব্যাবহার করে । কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো সে কেন এমন করবে? কী অধিকার আছে তার একটা মেয়ের সাথে এরকম বাজে আচরণ করার? ”

খালা মনি আমি চুপচাপ সব মেনে নেই বলে এটা ভেবোনা আমার ঘৃণা লাগে না এসব আচরণ থেকে। আর আমার আত্মসম্মান নেই। রূপম ভাই তোমাদের প্রিয় আর আমার বড় হওয়ায় কখনো তাকে অপমান করিনি। কারণ আমি জানি একজনের প্রিয় মানুষ যতই খারাপ হোক না কেন। সেই মানুষটার দূর্ণাম সহ্য করা কষ্টকর। তোমাদের কখনো কষ্ট দিতে চাইনি। তবে এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল ছিলাম। কে যেন বলেছিলো, ” মাইয়া মানুষ পানির মতো হবি। যিহানো ধরাইবো সেইহানেই যেন ধরতে পারিস!” জানো তো কথাটা এখন অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। মেয়েদের শক্ত হতে হয়। পাথর খন্ডের মতো। আগুনের মতো।

রেহনুমা বেগম আড়ালে খালা ভাগ্নির কথা মন দিয়ে শুনলেন। তার ভীষণ অপমানিত বোধ হচ্ছে। বাচ্চামেয়েটার কিছু কথা কেন জানি বুকে এসে লাগলো। নিজে যখন ভুল প্রমানিত হয় তখন আঘাতটা সোজা বুকেই লাগে।

কথা বলতে বলতে রিমুর গলা শুকিয়ে এলো। তারপরেও সে থামলো না। বললো, ” আচ্ছা তুমি চাচী আম্মুরা, আম্মু তোমরা তো মেয়ে। একটা মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে অপমান হতে দেখতে তোমাদের খারাপ লাগতো না? আসলে মানুষ যখন চোখে পট্টি লাগিয়ে ঘোরে তখন তাদের চোখে বোধহয় অন্যায় চোখে পড়ে না। এখানে মেয়ে ছেলে ফ্যাক্ট নয়। অবশ্য একটা কথা আমি বহু শুনেছি। মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হয়।

আচ্ছা খালা মনি আমি এখন উঠি। ভোর হতে চললো প্রায়। নামাজ পড়বো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মায়ের সাথে চোখাচোখি হলে রিমুর। আস্তে করে গলা নামিয়ে সে বললো, ” মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত! ” তাই কখনো তোমাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে চাইনি মা। তবে এটাও খেয়াল রেখো বেহেশত কিন্তু শুধুই সুখের আশ্রয়। যেখানে কোনো কষ্ট নেই। দোযখের অনুভূতি দিওনা।

রূপম ঘরের এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। রিমু রূপমের ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো। রিমুকে দেখে রূপম ডাকলো, ” এই রিমু শোন! ”
রিমু ব্যাটারি চালিত পুতুলের মতো গেলো রূপমের কাছে। রূপম বললো, ” রাগের মাথায় কী থেকে কী করে ফেলেছি। আই অ্যাম সরি! রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না ”

রিমু চুপ করে রইলো। রিমুকে চুপ থেকে রূপম বললো ভাব বাড়লো? যেই সরি বললাম ওমনি ভাব বাড়লো?

রিমু কঠোর গলায় বললো, ” আপনার সরি বলায় বা না বলায় আমার কিছু যায় আসে না। হু আর ইউ? আপনাকে এতো পাত্তা দেওয়ার সময় আছে না কি আমার কাছে? ”

রিমুর কাঠিন্যতা দেখে রূপম খানিক ভড়কালো । তবুও বললো, ” বেয়াদবি করিস না রিমু। ফল ভালো হবে না। ” রিমু ওই আগের মতোই বললো, ” কী করবেন আপনি? গায়ে হাত তুলবেন? কটু কথা শোনাবেন? কটু কথায় কান দেওয়ার মতো মেয়ে আমি নই। কারণ কুকুড়ের কাজই হচ্ছে ঘেউঘেউ করা। সেবস মনে রেখে চললে হবে না কি? আর গায়ে হাত দিলে আইনি ব্যাবস্থা নেবো। অনেক সহ্য করেছি আর নয়। ভরা বাড়িতে, বাহিরের ভেতরের মানুষের সামনে অপমান হতে কেমন লাগে যদি বুঝতেন কখনো! ”

রিমু আর দাঁড়ালো না। বাহিরে একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আজানের ধ্বনিতে চারিদিকে শান্তির প্রবাশ ছড়িয়ে পড়ছে। রিমু ঘরে এসে দরজা আটকে দিলো। এতদিন তার ধারণা ছিলো কেউ তাকে আগলায় না তবে সে আর নিজেকে আগলে কী করবে? তবে আজকের রাতটা তাকে শিখিয়েছে আগে নিজেকে ভালোবাসতে হয়। নয়তো অন্যদের ভালোবাসাও সম্ভব নয়। নিজের জন্য বাঁচতে হয়। আর বর্তমান দুনিয়ায় কেউ কারো জন্য লড়াই করে না। যার যার লড়াই তাকে একাই করতে হয়। মাঝে মাঝে জীবনে কেউ কেউ আসে পাশে এসে শক্ত করে হাত ধরে সাহস জোগাতে। অনুপ্রেরণা দিতে। রিমু ঠিক করলো আর নয় অপমান। এবার থেকে কেউ কিছু বলতে আসলেই পাল্টা জবাব দিবে সে। দিতেই হবে। নিজেকে ভালোবাসা যে ভীষণ জরুরি।

চলবে,,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-০৫

0

#- অপ্রিয় সে
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্বঃ৫

রিমু কোনোরকমে ঘরের দরজা খুলে রূপমের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। বিয়ে বাড়ি হওয়ায় রাতের বেলা শুনশান নিরবতার বদলে রয়েছে এক অন্যরকম কোলাহল। বাচ্চারা যেন আজ মুক্ত, স্বাধীন। বাড়ির বড়রা জীবনের নানা পর্যায় নিয়ে গল্পের আসর জমিয়েছে । আর কিশোর, কিশোরী, যুবক যুবতীরা আড্ডায় মেতেছে। ঘরের মধ্যে রূপমকে দেখতে না পেয়ে রিমু সারা বাড়িতে খুঁজতে লাগলো তাকে। তার মাথা এখন কোনোভাবেই কাজ করছেনা। হাত পা কাঁপছে। মাথা ঘুরে যেন মুহুর্তের মধ্যেই পড়ে যাবে এমন একটা অবস্থা।

ছাঁদের উপর থেকে গান বাজনা আর সবার চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। সাদিয়া সবসময় জোরে কথাই বলেই অভ্যস্ত। বন্ধুমহলে নাম নাম দেওয়া হয়েছে ফাটা বাঁশ। আরো রাত হওয়ায় সাদিয়ার কন্ঠস্বর গমগম করছে। সাদিয়ার আওয়াজ ছাঁদ থেকে আসছে শুনেই দৌড়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো রিমু। দৌড়াতে গিয়ে বা পায়ে ভালো রকমের আঘাত পেলো সে। এখন পা চালানোর শক্তিও তার নেই। রেলিং ধরে ধরে ছাঁদে পৌঁছুতেই রিমুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।

ছাঁদের মধ্যে থাকা দোলনায় আরামসে বসে আছে রূপম। আর তার হাত এক হাত জড়িয়ে ধরে পাশেই বসে আছে তৃপ্তি।

তৃপ্তি রূপমের বেস্ট ফ্রেন্ড৷ ভীষণ মিশুকে আর মিষ্টভাষী মেয়ে । তবে রিমু বুঝতে পারছে না ওরকম ভয়ঙ্কর চিরকুট দিয়ে রূপম কী করে এতো স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে।

রিমু দৌড়ে গিয়ে রূপমের কলার চেপে ধরে তাকে দাঁড় করালো। রিমুর আচরণে সবাই স্তম্ভিত।

রিমু চিৎকার করে বললো, ” আপনার সমস্যা কোথায় রূপম খান? আমি আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছি? আমার মা বাবা বা অন্যকেউ আমাকে বিয়ের করার প্রস্তাব দিয়েছে আপনাকে? আমার জানামতে এমন কিছু কেউই করে নি। কদিন আগে আপনি নিজে এসে আমাকে বিয়ে করবেন বলে পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন। আপনার ইচ্ছার সম্মান রক্ষার্থে আমাকে আমার ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হলো। আর সেই আপনি কেন এখন আমাকে বিয়ে করতে চাননা? আমি আমার জীবনকে কী সার্কাসের স্টেজ পেয়েছেন? এখন যদি আপনি বিয়ে করতে না চান তাহলে সবাই মেনে নিবে। তবে আমি যে অপমানিত হবো এটা একবারো ভেবেছেন? সবাই বলবে নিশ্চয়ই মেয়ের বিশাল কোনো দোষ পেয়েছে রূপম। নয়তো কী আর বিয়ে ভাঙে? আপনাকে তো আবার পীর মানে সবাই। তাই আপনার দোষ কেউ দেখতেই পারবে না।”

রিমু যখনই রূপমের কাছে এসে তার কলার ধরেছে তখনই পুরো ছাঁদে নেমে এসেছে পিনপতন নিরবতা। নিস্তব্ধতার মধ্যে রিমুর জোরে জোরে চিৎকার করে বলে ওঠা কথাগুলো নিচে থাকা বড়দের কানেও স্পষ্টভাবে পৌঁছে গেলো। সবাই হতবিহ্বল। কী বলছে এসব রিমু? রূপম কী সত্যিই এমন কিছু চিরকুটে লিখেছে? নিচ থেকে সবাই ছাঁদে আসতে লাগলো।

হুট করে এসে রূপমকে আপনি করে সম্মোধন করা আর জীবনে দ্বিতীয় বারের কেউ তার কলারে হাত দেওয়াতে রূপমের মিশ্র অনুভূতি হতে লাগলো। রিমু সবসময় রূপমকে তুমি করে সম্বোধন করে এসেছে। তাদের মধ্যে হাজার ঝামেলা হলেও তুমিই বলেছে। সেই রিমু আজ আপনি বলে ডেকেছে। মাঝে মাঝে এই “তুমি”, “আপনি” বা “তুই ” বলে সম্বোধন পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। বলে দেয় মানুষের মনের অবস্থা আর অপর পাশের মানুষের প্রতি সম্মান।

রূপম কিছু কিছু বিষয় একেবারেই সহ্য করতে পারে না। এরমধ্যে অন্যতম হলো কেউ তার কলার ধরার সাহস দেখাবে বা ভুলক্রমে ধরে ফেলবে। ইন্টারে থাকাকালীন রূপমের বন্ধু মজার ছলে তার কলার ধরেছিলো। সেদিন রূপম কিছু বিবেচনা না করেই তাকে ইচ্ছে মতো পিটিয়েছিলো। স্কুলে এটা নিয়ে গার্জিয়ান কলও হয়। রূপমদের বাড়ির সবাই জানে রূপমের পছন্দ অপছন্দ। তার অপছন্দের কিছুই তারা করে না। সেদিনের পর থেকেই সবাই জানে রূপমের এই বিষয়টা। বন্ধুদের মধ্যে কেউ মজার ছলেও এটা করার সাহস দেখায়নি আর। আজ দ্বিতীয় বারের মতো রূপমের কলারে হাত পড়েছে। আর সেটা দিয়েছে রিমু। যেই রিমু যমের মতো ভয় পায় তাকে।

রিমুর অত্যাধিক দুঃসাহস দেখে রূপম নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারলল রিমুকে। রিমু একপ্রকার ছিটকেই পড়লো। ততক্ষণে সবাই হাজির। রায়হান খান দৌড়ে এসে রিমুকে ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রূপমের দিকে তাকালো। রূপম দোলনায় শেকল ধরে সেটাকে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে উপরে উঠিয়ে তারপর ছাঁদে পড়ে থাকা একটা লাঠি হাতে নিলো। রায়হান খানকে সরে যেতে বলে, রিমুর গায়ের দিকে এগোলো রূপম। সবাই বুঝলো অবস্থা ভীষণ বেগতিক। সাজ্জাদ এসে রূপমকে আটকালো।

রূপম রেগে অস্থির হয়ে বললো,” এই মেয়ের সাহস হয় কীভাবে আমার কপাল চেপে ধরে আমার মুখের উপর কথা বলার? কলিজা বড় হয়ে গেছে তার তাইনা? কার আশকারাতে এতো বাড় বেড়েছে সে?”

রিমু ভয়ে রায়হান খানের পেছনে রইলো। রেহনুমা বেগম এসে রূপমের সামনে দাঁড় করালো রিমুকে। তারপর বলতে লাগলো, ” এতো বড় বেয়াদবি তুই কী করে করতে পারলি রিমু?”

রিমুর ডুকরে কান্না আসছে। কী যেন একটা বলতে চাচ্ছে সে। কিন্তু গলার কাছে কান্নারা এতো দলা পাকিয়েছে যে তার মুখ থেকে কথাই আসছে না। কাঁপা কাঁপা গলায় রিমুর বেশ জোরেই বললো, “সরি!”

রিমুর কান্না মিশ্রিত গলা শুনে রূপমের রাগ যেন বেড়ে গেলো। এখন নাটক করছিস? আমাকে অপমান করে এখন নাটক করছিস বলেই সাজ্জাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো।

পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে নেই বুঝতে পেরে রূপন, রিমু দুজনকে নিয়েই বসলো সবাই। এরপর রিমুকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে, ” রিমু গায়ে হলুদের সময় থেকে এই অবধি হওয়া সব ঘটনা বললো। স্বভাবত কেউই বিশ্বাস না করে রূপমকে বললো রূপম এসব কী সত্যি?

রূপম পুরোপুরি ভাবে অস্বীকার করে বললো, ” আমি কেন ওকে চিরকুট দিয়ে এসব বলতে যাবো? আমার কী অন্য কোনো কাজ নেই যে এসব আজাইরা কাজ করে বেড়াবো?” রিমু মিথ্যা বলছে।

রিমু হাতের মধ্যে থাকা চিরকুট সবাইকে দেখিয়ে বললো, ” তাহলে এটা কোথা থেকে আসলো আমার কাছে? ”

রূপম ছোঁ মেরে রিমুর হাত থেকে চিরকুটটা নিলো। তারপর অট্টহাসি দিয়ে বললো, ” তুই যে মিথ্যা বলছিস এটা তো স্পষ্টই। মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে আমার সাথে গেম খেলতে আসছিস? এই হাতের লেখা আমার নয়।”

রিমুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সবাই চিরকুটটা দেখে বললো রিমু এটা তো রূপমের হ্যান্ডরাইটিং নয়। তবে মিথ্যা বলার কী প্রয়োজন ছিলো? আর এমন হাঙ্গামা করেই বা কী লাভ হলো তোর? শুধুশুধু সবাইকে পেরেশানি করালি।

প্রশ্নগুলো রিমুকে করা হলেও উত্তরগুলো যেন রূপমের সব জানা। সে চটপটে বললো, ” ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তো। তাই এরকম নাটক করলো। যাতে আমি রেগে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে। কী ! ঠিক বলছি না রিমু?

রূপম সহ সবার কথা বুঝতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রিমুর। এটা রূপমের হ্যান্ডরাইটিং না হলে কার? রিমুর স্পষ্ট মনে আছে চিরকুটটা রূপমই দিয়েছিলো। এখানে কোনো রকম ভুল নেই। চিরকুটটা নিজের হাতে আরেকবার নিয়েই ভীষণ আফসোস হলো রিমুর। নানান প্রেশারে রূপমের হাতের লেখা চিনতে তার ভুল হলো কী করে? এটা নাহয় রূপমের হাতের লেখা নয় তবে সে যে রিমুকে চিরকুট দিয়েছে এটা স্বীকার না করে কেন এতো মিথ্যাচার করছে। রিমুকে ইচ্ছে মতো কথা শুনিয়ে সবাই নিচে চলে যায়। ছাঁদে থাকা বাকিদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়েছে। লজ্জায় অপমানে রিমুর অবস্থা নাজেহাল। আল্লাহর কাছে মনে মনে একটা কথাই সে বললো, ” হে আল্লাহ! কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছো আমাকে?”

চলবে,,,,,

অপ্রিয় সে পর্ব-০৪

0

#-অপ্রিয় সে
#-সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ৪

রিমুকে চুমু দেওয়ার সময়কার মুহূর্তটা সাজ্জাদের ফোনের ক্যামেরা বন্দি হয়ে গেলো। অন্ধকারে সবাই যখন আলোর সন্ধানে ব্যাস্ত তখন হলুদের স্টেজে থাকা টিমটিমে আলোয় ছবিটা তুলে নিয়েছে সাজ্জাদ।সে বোধহয় সারাক্ষণ রিমু আর রূপমের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সাজ্জাদ আস্তে করে রূপমের পাশে গিয়ে বললো,” রূপম ভাইয়া মুহূর্তটা ভীষণ সুন্দর লেগেছে আমার কাছে। তাই ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম। ” রূপম খানিকটা বিব্রতই হলো। তখনই সাথে সাথে কারেন্ট চলে এলো। রূপম ছবিটা দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সাজ্জাদের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে রিমুকে ছবিটা দেখালো। রূপম ভালোই জানে সে এটা দেখে রাগে গজগজ করবে আর ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করবে। রূপম বুঝতে পারে না এই রিমুকে জ্বালাতে পারলে তার এতো শান্তি লাগে কেন।

রিমুকে চুমু দেওয়ার সময় রিমুর গালের হলুদ রূপমের ঠোঁটে লেগে যায়। পাশ থেকে সাদিয়ার নজর রূপমের ঠোঁটের দিকে যেতেই সে সবার সামনেই বলে ওঠে,” রূপম ভাইয়া তোমার ঠোঁটে হলুদ এলো কী করে? তুমি বুঝি কিছু খেতে না পেরে হলুদই খেয়েছো? তোমাকে তো এখনো হলুদ ছোঁয়ানো হয়নি আর তুমি নিষেধ করেছো বলে কেউ ছোঁয়াবেও না।” রূপম হকচকিয়ে গেলো।

সাজ্জাদ চেঁচিয়ে বললো, ” আরে রিমুর গাল থেকে ঠোঁটে হলুদ ট্রান্সফার হয়েছে। ছবিও তুলেছি। সাজ্জাদ রিমুর হাত থেকে ফোন নিয়ে সবাইকে দেখালো ছবি। ততক্ষণে সেই ছবি প্রায় সবার দেখা শেষ। সাজ্জাদের কাহিনী দেখে রিমু মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আর কমবেশি সবাই রূপমকে এসে ক্ষেপাচ্ছে। রূপম সবার সাথেই ভীষণ ফ্রি। একমাত্র রিমুকেই সে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করার চিন্তায় মত্ত থাকে।

সাজ্জাদ রিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো সে প্রচন্ড অভিমান করেছে। সাজ্জাদ ভাবলো বোধহয় এসব করে রিমুকে কষ্ট না দিলেও পারতো। কিন্তু পুরো বিষয়টা ঝোঁকের মাথায় হয়ে গিয়েছে। সে রিমুকে সরি বলতে যাবে তখনই ঋষি এসে রূপমকে গান গাইতে বললো। রিমু আরো বেশি বিরক্ত হলো এসবে। রূপম গান গাওয়ার জন্য সানন্দেই রাজি হয়ে গেলো।

রিমুকে ঘিরে সবাই গোল হয়েছে বসেছে। রূপমের হাতে গিটার।

কী নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে (২)

আমি যে মাতাল হাওয়ারই মতো হয়ে
যেতে যেতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে( ২)

কী করি ভেবে যে মরি বলবে কী লোকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।

পালাতে পারিনি আমি যে দিশা হারা
দুটি চোখ যেন আমায় দিচ্ছে পাহারা

ধরা পড়ে গেছি আমি নিজেরই কাছে
জানিনা তোমার মনেও কী এতো প্রেম আছে

সত্যি যদি হয় বলুক যা বলছে নিন্দুকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।

গিটারের অনবদঢ় সুর আর রূপমের মাতাল করা গান সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। রিমুর এই গানটা প্রচন্ড রকমের প্রিয়। যেদিন ঝোঁক ওঠে সেদিন যে কতবার সে শোনে তার কোনো হিসাব নেই। নিজের অজান্তেই রূপমের সাথে তাল মিলিয়ে গাইতে লাগলো রিমু৷ সে এখন নিজের মাঝেই নেই। রূপম সহ বাকি সবাই অবাক হলো। অবাক বলতে প্রচন্ড রকমের অবাক। যারা কখনো রিমুকে গুনগুন করে গাইতেও শোনেনি তাদেরই চোখের সামনে আজ রিমু গলা ছেড়ে গাইছে। একদম প্রফেশনাল সিঙ্গারের মতো।

ঋষি আর সাদিয়া মুখোমুখি বসেছে। সাদিয়া অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছে ঋষি চৌধুরী যেন তাকে একধ্যানে দেখছে। মুখোমুখি বসায় একে অপরের সাথে চোখাচোখিও হয়েছে তাদের বেশ কয়েকবার। সাদিয়ার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ভীষণ রকমের। কেউ কারো দিকে যদি একধ্যানে তাকিয়ে থাকে আর সেই মানুষটা যদি বুঝতে পারে তাকে কেউ দেখছে তবে অস্বস্তি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সাদিয়া মাথা নিচু করেই আছে। একপর্যায়ে সে হুট করে সামনের দিকে তাকাতেই সে দেখলো ঋষি তাকিয়েই আছে। এবার চোখাচোখি হতেই ঋষি চোখ টিপে দিলো। রূপম আর রিমুর অনবদ্য রোমান্টিক গানের মধ্যেই চোখটিপ। সাদিয়া রাগ হলেও সে চুপ করে বসে রইলো। নিজেকে বোঝালো এটা বিয়ে বাড়ি৷ এরকম ছোটখাটো ঘটনা ঘটতেই পারে।

কিন্তু পরপরই সাদিয়ার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে ঋষির সামন থেকে সরে এসে ঋষির পেছনে বসলো। তারপর একটু ঋষির কানে কানে বললো, ” এক্সকিউজ মি! আপনি কী একটু উঠতে পারবেন? ঋষি কিছু বুঝলো না। এখানে এসেই সাদিয়াকে ভীষণ মনে ধরেছে তার। কিছু না বুঝলেও সাদিয়ার কথাতে সে উঠে দাঁড়ালো। তার পর পরই সাদিয়া তাকে বসতে বসলো। ঋষি কিছু না ভেবেই বসে পড়লো। তবে চেয়ারে নয়। সোজা মাটিতে। হুট করে এমনটা হওয়ায় কোমড়ে ভালো রকমেরই ব্যাথা পেলো সে। সবাই গানে এতো বেশি ব্যাস্ত যে কারো চোখ এদিকে আসলোই না। ঋষি তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়ালো। হাজার হলেও প্রেসটিজের বিষয়। তারপর পিছন ফিরে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। সাদিয়া সেখান থেকে উঠে রিমুর কাছে যাবে কিন্তু ঋষি সাদিয়ার হাত চেপে ধরে তাকে পাশে বসালো।

সাদিয়া রেগে গেলো। মিনমিন করে বলতে লাগলো চোখ টিপ দেওয়ার ফলাফল স্বরূপ মাটিতে পড়তে হলো। এখনো অসভ্যতামি কমলো না?

ঋষি ব্যাথা নিয়েও মুচকি হেসে বললো, ” কী করবো বলো সুন্দরী! তোমাকে যে ভীষণ মনে ধরেছে। তাই তো চোখ টিপ দিয়েছি। তুমি এমন করতে পারলে আমার সাথে? কোমড়টা যদি ভাঙতো কী হতো বলোতো? তোমাকেই তো সেবাযত্ন করতে হতো। ”

সাদিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” আপনার তো বড্ড বেশি সাহস। এতবড় সেলিব্রিটি হয়ে ছ্যাঁচড়ামি করতে লজ্জা করে না?”

ঋষির ব্যাথা বাড়তে লাগলো, ” তাই সেখানেই চুপ করে সাদিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বসে রইলো। ” এখন তার তর্ক করতে ভালো লাগছে না।
নিজের যায়গায় এসে সাদিয়া ভাবতে লাগলো
মিডিয়া, ফটোগ্রাফারস সবাই রূপম আর রিমুকে কভার করতে গিয়ে আরেক সেলিব্রিটির অসাধারণ কাহিনি মিস করে ফেললো। এটা যদি কারো ক্যামেরায় বন্দি হতো তাহলে নিশ্চয়ই একটা মুখরোচক নিউজ হতো। হেডলাইনটা এমন হলে কেমন হতো?

” বিয়েবাড়ির এক সুন্দরীকে চোখ টিপ দেওয়ার অপরাধে সেই সুন্দরী বিশিষ্ট গায়ক ঋষি চৌধুরীকে ধপাস করে ফেলে দিয়েছেন।”

কথাটা ভেবেই ফিক করে হেসে দিলো সাদিয়া।তবে তার কিঞ্চিৎ অনুশোচনাও হলো। এভাবে ফেলে না দিলেও পারতো। ব্যাথা নিশ্চয়ই অনেক পেয়েছে।

ততক্ষণে রূপম আর রিমুর গান গাওয়া শেষ। হাততালিতে মুখরিত চারিপাশ। রিমু লজ্জায় মাথা অর্ধনমিত করে ফেললো। সে এটা কী করলো ভেবে পেলো না। এরকম বোকামি কেউ করে না কি? রিমুর আফসোস হলো এটা ভেবে যে সে এখনো নিজেকে আয়ত্তে রাখলেও আজ কী করে এই ধরনের কাজ করলো। হইহট্টগোলের মাঝখানে রিমুর কিছু সময়ের জন্য মনে হলো রূপম বোধহয় তাকে উদ্দেশ্য করেই গানটা গেয়েছে। কিন্তু তারপরই নিজের বোকাবোকা চিন্তার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানালো সে। রূপম গাইবে গান তাও আবার রিমুর জন্য। এ যে ব্যাঙের সর্দি হওয়ার মতো ঘটনা।

রিমুকে কখনোই গান গাইতে শোনেনি রূপম। তবে আজ রিমুর কন্ঠ নিঃসৃত গান শুনে সে চমকে গেলো। রিমু এমনিতে মিষ্টভাষী মেয়ে। কিন্তু তার গানের গলা যে এতো সুন্দর হতে পারে সেটা কখনো মাথাতেই আসেনি রূপমের।

রিমু হট্টগোল থেকে বাঁচতে শরীর খারাপের কথা বলে নিজের রুমে চলে এলো। তারপর নিজের হাতে মুঠোয় বন্দি করা চিরকুটটা তার পড়ার টেবিলের মধ্যে থাকা একটা বইয়ের ভেতরে রেখে ফ্রেশ হতে গেলো। ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। সারাদিনের ক্লান্তিতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। ভেতর থেকে দরজা আটকানো ছিলো।

রাত একটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো রিমুর। তৎক্ষনাৎ তার চিরকুটের কথা মনে পড়লো। তড়িঘড়ি উঠে বইয়ের ভেতর থেকে চিরকুট বের করেই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সেখানে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা। ” সাদা পেত্নী আমি তোকে বিয়ে করতে পারবোনা। ইতি রূপম!”

রূপমের সাথে বিয়ে হবে না ভেবে ভীষণ খুশি হওয়া উচিত রিমুর। কিন্তু সে খুশি হতে পারছেনা। এক বোবা কান্না তাকে চেপে ধরলো। তার হাত পা কাঁপছে সমানে। এভাবে রিমুকে হেনস্তার মধ্যে ফেলার মানেটা কী?

চলবে,,,