Sunday, July 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1487



ভাস্কর – লেখা-ইসরাত

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১

ভাস্কর
লেখা-ইসরাত
মাস শেষ হতে আরও আঠারো দিন বাকি। কিন্তু ব্যাগের ভিতর থাকা গভর্নর সাহেবের সাইন দেয়া কাগজগুলো সে কথা বলছে না। তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে টেনেটুনে আর এক সপ্তাহ এরা আমাকে পার করতে পারবে। এরপর? চিন্তার ছাপ মুখেও পড়েছিল বোধহয়। প্রিয় বান্ধবীর নজর এড়ালো না সেটা। পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী রে, মুখটা যে একেবারে আমসি বানিয়ে রেখেছিস।কী হয়েছে?” সোমা, আমার আত্মার বন্ধু, ওর কাছে আমার কিছুই গোপন নয়। বেশি কিছু বলতে হলো না। টাকা-পয়সার ব্যাপার, বলতেই বুঝে গেল। কিছুক্ষণ মুখটা শুকনো করে রাখল। তারপর কী মনে হতেই মুখটা আলোয় উদ্ভাসিত করে বলল, “এই, তোর একটা ব্যবস্থা হতে পারে, চল আমার সাথে।”

আমি যূথিকা, সবাই ডাকে যূথি। নিম্নবিত্ত কেরানি বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। চতুর্থ সন্তানরা বেশিরভাগ পরিবারেই অবহেলিত হয়, না বড়, না মেজ, না সেজ, না ছোটো। পরিবারে তাদের কোনো অবস্থানই থাকে না। আমার ক্ষেত্রে এ ধারার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। তার কারণ হচ্ছে, আমি অসম্ভব রূপবতী, আমার অন্য ভাইবোনরা দেখতে মোটামুটি ভালো হলেও আ্রমার আশেপাশে কেউই লাগে না। তাই আমার মা-বাবা সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকেন। আমরা থাকি সরকারি চতুর্থ শ্রেনীর স্টাফ কোয়ার্টারে। ফুল সুবাস ছড়ালে ভ্রমরের আনাগোণা থাকবেই, আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আজ চিঠি, তো কাল ফুল, বিয়ের প্রস্তাব তো লেগেই থাকছে ফি সপ্তাহে। একবার তো একজন হাতের রগ কেটে মরতে বসেছিল আমার জন্য। তবে মা আর ভাই বোনদের কড়া নজর এড়িয়ে আমার এদিক-ওদিক যাবার সুযোগ ঘটেনি তেমন।
ভাগ্যক্রমে আমি ছাত্রী হিসেবেও খুব ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা বিভাগে পড়ছি। আমার অন্য ভাইবোনরা স্কুল জীবন থেকেই টুকটাক টিউশনি করালেও আমাকে তার অনুমতি দেয়া হয়নি,কারণ ওই যে, আমি রূপবতী কন্যা। বাড়ি বাড়ি যেতে হবে, রূপে যদি কলঙ্ক লেগে যায়! ফলে হাতখরচার জন্য হা-ভাতের মতো বড় আপা না হয়, ভাইয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এদিকে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আমার চাহিদা বেড়েছে, বন্ধুদের সাথে খাওয়া-আড্ডা, প্রসাধনের সামগ্রী – এগুলোর জন্য কিছু বরাদ্দ রাখতে হয়। তাই বাড়তি আয়ের একটা উপায় খুঁজছিলাম। সোমার সাথে কথা হচ্ছিল মলচত্বরে বসে। একটা সিঙ্গারা খেয়ে চা নিলাম একটা। সোমা এর মধ্যে তাড়া লাগাল, “তাড়াতাড়ি কর তো, তোকে একজনের কাছে নিয়ে যাব।”
হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে ডাকসুর কাছে চলে এলাম। ছেলেদের একটা দল বসে আছে, আড্ডা চলছে জম্পেশ। সোমা এগিয়ে গিয়ে একজনকে হাত নাড়ল, ঝাঁকড়া চুলের ভাসা ভাসা স্বপ্নালু চোখের একটা ছেলে, একটু একটু বাচ্চা বাচ্চা দেখতে, নাকের বাম পাশে একটা গভীর কাটা দাগ। আড্ডা ছেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো সে। পরিচয় করিয়ে দিল সোমা, মুসাব্বির বাম ছেলেটার। মার্কেটিং এ বিবিএ করছে৷ পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর থেকে আমার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে সে। ছেলেদের এই মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমি অভ্যস্ত, তাই বিব্রত হলাম না। সোমা বলল, “আমার এই বান্ধবীকে তো দেখছ। রায়হান স্যারের মডেল হিসেবে কেমন হবে বলো তো?”
মুসাব্বির আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দারুণ! অপূর্ব! স্যারের ছবির উপযুক্ত মডেলই বটে!” আমি প্রত্যুত্তরে হাসলাম। ছেলেটা বেশ সরল, আচরণে কোনো লুকোছাপা নেই। তবে সোমার কথা শুনে অবাক হলাম, কীসের মডেল হওয়ার কথা বলছে ও? আম্মা জানলে মাটিতে পুঁতে দিবে একদম। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। সোমা আমার মনের অবস্থা বুঝে বলল, ” আরে বিখ্যাত আর্টিস্ট রায়হান ইমতিয়াজ স্যারের নাম শুনিসনি?” শিল্পসাহিত্যের জ্ঞানে আমি একটু পিছিয়ে আছি, মাথা নেড়ে না বললাম। এবার ছেলেটা হতাশ হয়ে বলল, “রায়হান স্যার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর। জীবনের একটা বড় অংশ ফ্রান্স আর ইতালিতে কাটিয়েছেন। এখন দেশে এসেছেন৷ শুনেছি কয়েক বছর থাকবেন, দেশের সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করবেন। আমি নিজে তার একটি ছবির মডেল হয়েছি।” এবার বুঝলাম, হালে পত্রিকাগুলোতে সদ্য ফ্রান্সফেরত এক চিত্রশিল্পীকে নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। মুসাব্বিরের কথায় কিছুটা মনে পড়ল। কিন্তু আমি ছবির মডেল হব? কী না কী আঁকবে? কেমন ছবি? ন্যুড ছবি আঁকে নাকি আবার? শঙ্কিত হয়ে সদ্য পরিচিত মুসাব্বিরকে করেই ফেললাম প্রশ্নগুলো। মুসাব্বির হেসে বলল, “আমার তো প্রোট্রেট করেছে। তোমাকে যদি এমন কিছু করতে বলে যেটাতে তুমি কম্ফোর্টেবল নও, না করে দিবে। স্যার এত দারুণ ভদ্রলোক, তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই।” মুসাব্বিরের আশ্বাস পেয়েও আমার মন থেকে ভয় দূর হলো না। রায়হান ইমতিয়াজ তো অপরিচিতই,মুসাব্বিরকেও তো চিনি বা ঠিকমতো। সোমা কতটা চিনে, তাও জানি না।শেষে কোনো বিপদে পড়ব না তো? তারপরও প্রস্তাবটা নাকচ করলাম না, কারণটা সেটা নিঃসন্দেহে লোভনীয়। একটা সিটিং-এ পাঁচ হাজার টাকা। মাসে একবার করলেই আমার পুরো মাসের খরচ উঠে যাবে। মুসাব্বিরের ফোন নাম্বারটা নিয়ে আসলাম, বললাম, ভেবেচিন্তে জানাব।

পরের কয়েকদিন শুধু রায়হান ইমতিয়াজের খবর সংগ্রহ করলাম। পরিচ্ছন্ন ইমেজ, তেমন কোনো দুর্নাম নেই। মেয়েঘটিত কাহিনি কিছু আছে বটে৷ কিন্তু তা উভয়পক্ষীয়। আমি মুসাব্বিরকে হ্যাঁ বলে দিলাম। আগামী মঙ্গলবার বিকালে যযাওয়া ঠিক হলো। নিজের নিরাপত্তার জন্য সাথে করে মরিচের গুঁড়ার স্প্রে বানিয়ে নিয়ে যাব ঠিক করলাম। উল্টা পাল্টা কিছু দেখলেই অস্ত্রের সদ্ব্যবহার করব।বাসায় আম্মাকে জানালাম, বাড়তি ক্লাস হবে।

মঙ্গলবার ক্লাস সেরে সোমার বাসায় চলে গেলাম। পরণের জামাটা পাল্টে সোমার একটা জামা পরলাম৷ সুন্দর ফ্লোরাল প্রিন্টের একটা কুর্তি। হালকা সেজে নিলাম। সোমা আমার দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল, ‘কোথায় তুই রাজকন্যা হবি, আল্লাহ তোকে পাঠাল গরিব ঘরে। দেখ, কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তোকে।” কথা সত্য, কিন্তু শত দারিদ্র্য সত্ত্বেও আমার পরিবারকে আমি ভালোবাসি, জীবনের কঠিন বাস্তবতার আঁচ থেকে তারা সর্বতোভাবেই আমাকে আগলে রেখেছেন। অন্য কেউ এ কথা বললে ফুঁসে উঠতাম নির্ঘাত, তবে সোমার ব্যাপার ভিন্ন। ও আমাকে ছোটো করার উদ্দেশ্যে বলেনি। সে তো আমার আত্মারই একটা অংশ। সোমা নিজেই আমাকে রায়হান ইমতিয়াজের বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। গুলশান-১ এ একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির সামনের দেয়াল দেখেই বুঝা যায় এখানে কোনো শিল্পীর বাস। তিনটায় আসার কথা আমার, উবার চালক রাস্তা ভুল করে সময় নষ্ট করায় পাঁচ মিনিট দেরি হলো পৌঁছাতে। মুসাব্বির বলে দিয়েছিল বাড়ির প্রধান ফটকের সাথে একটা কলিংবেল থাকবে। খুঁজে নিয়ে সেটা বাজালাম। সাথে সাথেই ছোটো দরজাটা খুলে গেল। একা একা দরজা খুলে যাওয়ায় একটু ভড়কে গেলেও বুঝলাম ভিতর থেকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় দরজা খোলা হয়েছে। প্রথমে আমি ঢুকলাম, সোমাও ঢুকতে যাবে, এমন সময় দরজা বন্ধ হয়ে গেল দুম করে। অল্পের জন্য সোমার হাতে চাপা লাগেনি।।ভীষণ চমকে গেলাম। ঠিক তখনই একটা ফোন এলো আমার মোবাইলে। নাম্বারটা মুসাব্বির দিয়ে রেখেছিল আগেই। রিসিভ করতেই একটা ভরাট পুরুষালি কণ্ঠ শুনতে পেলাম, “তোমার বন্ধুকে চলে যেতে বলো যূথিকা। আমার স্টুডিওতে মডেল ছাড়া কারো প্রবেশ নিষেধ। সোমাটা ওদিকে আমার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে৷ বেচারি ভয় পেয়েছে। ভয় কি আমিও কম পেয়েছি? কিন্তু ফোনে সেই কণ্ঠ শুনে সম্মোহিতের মতো আমার সকল ভয় যেন কেটে গেছে। কী আধিপত্য তার কণ্ঠে! সোমার ডাকে সাড়া দিয়ে ওকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম চলে যেতে। আমি সেশন শেষে উবার নিয়ে চলে যাব৷ পাঁচ হাজার টাকা পাচ্ছি, উবার পাঠাও তো চড়াই যায় এখন। ইট বিছানো হাঁটা পথের উপর দাঁড়িয়ে আছি। পথটা শেষ হয়েছে শ্বেত শুভ্র একটা দোতলা বাড়ির দরজায়। পথের দুপাশে লন। কিছু গাছ আছে। তবে লনের নিয়মিত পরিচর্যা হয় না মনে হয়, ঘাসগুলো এলোমেলো অসমান হয়ে আছে। বাড়ির সামনে এসে বেল খুঁজছিলাম, পরে দেখলাম দরজাটা ভেজানোই আছে।আস্তে করে ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। ঘরটিকে বসার ঘর কম, গ্যালারি বেশি বলা যায়। একটা সোফার উপর বসে আছেন সৌম্যদর্শন মাঝবয়েসী এক পুরুষ। তাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণার সুবাদে মুখটা চেনাই ছিল, কিন্তু সামনাসামনি দেখে মুগ্ধ হলাম। অসম্ভব সুপুরুষ ভদ্রলোক, সৃষ্টিকর্তা মনে হয় এঁর কোনোকিছুরই কমতি রাখেনি। হ্যাঁ, রেখেছেন, তিনি পরিবারহীন। ইতালিতে থাকার সময় তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান। একেবারে শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিলেন যেন মহিলা। কিছুতেই তার খোঁজ মিলেনি। রায়হান সাহেব অনেকদিন পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই তার কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়নি তারা। স্ত্রী আর অনাগত সন্তানকে হারিয়ে কয়েক বছর সব রকমের শিল্পচর্চা থেকে দূরে রেখেছিলেন নিজেকে। এরপরই ফ্রান্সে পাড়ি জমান। সেখানে আবার নিজের ঘুমন্ত শিল্পীসত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলেন।

উনি একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। আমি ঘরে ঢুকতেই ম্যাগাজিনটা টেবিলের উপর রাখলেন। এরপর আমার দিকে না তাকিয়েই দরজাটা লাগিয়ে দিতে বললেন। আমি দরজা বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। রায়হান ধীরপায়ে আমার কাছে এলেন। খুব কাছে, এতটা কাছে যে তার নিঃশ্বাস আমার মুখের উপর পড়ছিল। তিনি খুব কাছ থেকে গভীর মনোযোগের সাথে আমাকে পরখ করতে লাগলেন, ঠিক যেমন কোনো জহুরি স্বর্ণ পরীক্ষা করে তেমনি। আমার অস্বস্তি লাগায় চোখ নামিয়ে রেখেছিলাম। উনি আমার থুতনি ধরে আমার মুখ উপরে তুলে ধরলেন। চোখে চোখ রেখে তাকাতে হলো বাধ্য হয়ে। কী জাদুকরী দৃষ্টি! তার কণ্ঠের চেয়েও বেশি সম্মোহনী! আমি আমার আশেপাশে, অতীত- বর্তমানে কী আছে, সব ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম আমি নিম্নবিত্ত বাবার মেয়ে, ভুলে গেলাম টাকার জন্য ছবির মডেল হতে এসেছি, ভুলে গেলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত পরপুরুষের সাথে আমি একা, নিরাপত্তাহীন। মনে রইল শুধু এই ভয়ংকর সর্বনাশা দুইটি চোখ। সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠল আমার, মনে হলো এখনই জ্ঞান হারাব। জাদুকর তার চোখ সরিয়ে নিলেন। আমার মনের ভিতর উঠা তুফান যেন উনি টের পেয়েছিলেন। তাই নজর সরিয়ে নিলেও একহাতে ধরে রাখলেন আমায়। ধীরে ধীরে সোফায় এনে বসালেন। একটা গ্লাস এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি কোনো দ্বিধা না করে গ্লাসের সম্পূর্ণ তরল শেষ করে ফেললাম এক চুমুকেই। তরলটা পানি ছিল না, শরবতও না, কোনো ফলের জুস হবে বোধ হয়। অদ্ভুত মিষ্টি মিষ্টি, আবার নোনতা ভাবও আছে খানিকটা। খুব ভালো লাগল আমার। আরেক গ্লাস খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে আর চাইলাম না। একটু আগের ঘটনা নিয়ে বেশ বিব্রত লাগছে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি আমার সমস্তটা পড়ে ফেলেছেন। উনি আমাকে বললেন, “তুমি যে ছবি আঁকার জন্য পারফেক্ট একটা সাব্জেক্ট, তুমি জানো?” মাথা নেড়ে না বললাম। উনি বলতে লাগলেন, আমার ক্যারিয়ারে এমন সাব্জেক্ট খুব কম পেয়েছি। তোমার চেহারার প্রতিটি ফিচার একদম নিখুঁত। আমি খুব লাকি যে তোমাকে পেয়েছি। আমি প্রশংসায় একেবারে গলে যেতে লাগলাম৷ যদিও এই প্রশংসায় আমার কোনো কৃতিত্ব নেই।

রায়হান সাহেব আমাকে বসিয়ে রেখে ভিতরে উনার স্টুডিওতে গেলেন। সব তৈরি করে আমাকে নিয়ে যাবেন। আমি ঘরটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। বসার ঘরটার চারপাশে রায়হান সাহেবের আঁকা ছবি, সত্যিই ভদ্রলোক প্রতিভাবান। কী পোট্রের্ট, কী প্রাকৃতিক দৃশ্য, কী স্টিল পেইন্টিং- সব ক্ষেত্রেই তিনি পারদর্শী। কিছু ছবি দেখে তো আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। তুলির আঁচড়ে এত নিখুঁত রঙের খেলা কী আদৌ সম্ভব? এ কয়দিন উনাকে নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে ছবি আঁকা সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছি। এমন গুণী শিল্পী আমার ছবি আঁকবেন, ভাবতেই শিহরিত হলাম।

হঠাৎ ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে উঠলাম। রায়হান সাহেব এসে গেছেন! আমার চমকে যাওয়া খেয়াল করে বললেন, “সরি। কিন্তু আমার কোনো দোষ নেই। তুমিই এমন মগ্ন হয়ে ছিলে।” অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে বললাম, “হওয়ারই কথা, এত অসাধারণ আপনার হাতের কাজ।” উনি হেসে বললেন, ” এগুলো কিছুই না। আমার হাতের আসল কাজ তুমি দেখবে আরও পরে। এখন চলো।” বলে আমার বাম হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলেন তিনি। তার হাতের ছোঁয়ায় আবার সম্মোহিত হওয়ার পালা আমার৷ ভিতরে ভিতরে খুব অবাক হচ্ছি। আমার প্রতি পুরুষের আকর্ষণে আমি অভ্যস্ত। কিন্তু আমি এই এতখানি বয়স পর্যন্ত এভাবে কারোর প্রতি আকর্ষণ বোধ করিনি। মনে হচ্ছে কোনো এক মন্ত্রজালে আষ্টেপৃষ্টে বাধা পড়ে যাচ্ছি।

কাজের সময় উনি অন্য মানুষ। অখণ্ড মনোযোগের সাথে তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসটাকে রাঙিয়ে যাচ্ছেন। কখনও আমাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন, এদিকে তাকাও, মুখটা ত্রিশ ডিগ্রি কোণে ঘুরাও। না বুঝলে নিজেই এগিয়ে এসে আমার মুখটাকে কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে নিয়ে আসছেন। আমার মধ্যে কী শয়তান ভর করেছে জানি না, ইচ্ছা করেই নির্দেশনা বুঝছিলাম না, যেন উনি এগিয়ে এসে ঠিক করে দেন। বারবার উনার স্পর্শ পাবার লোভে কাতর হয়ে যাচ্ছিলাম। আবার পরক্ষণেই নিজের ভাবনাকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। ছি ছি! এতটা অধঃপতন হলো কী করে আমার! আম্মা বলেন হাদীসে আছে, দু’জন বিনা সম্পর্কের নারী-পুরুষ একসাথে নির্জনে থাকলে তৃতীয় সঙ্গী হয় শয়তান। এখানে আমরা ছাড়াও মনে হয় শয়তান উপস্থিত আছে। আর এই কাজ করব না বাবা! দরকার নেই এত টাকার। যত যাই হোক, আব্বা-আম্মা আমাকে ঘৃণা করবেন, এমন কিছু আমি করতে পারব না।

কোথা দিয়ে যে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। উনি হাত ধুয়ে এসে কিচেন থেকে দুইটা স্যান্ডউইচ নিয়ে এলেন। স্যান্ডউইচটা বেশ মজার। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার রান্না কি আপনি নিজেই করেন?
উত্তরে হ্যাঁসূচক জবাব এলো। বললাম, “আপনার হাতটাকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা উচিত। আপনার রান্নার হাতও চমৎকার।” প্রশংসা সহাস্যে গ্রহণ করে রায়হান বললেন, ” আমার আসল প্রতিভার সাথে তো তোমার পরিচয় ঘটেইনি এখনও। চলো দেখাই তোমাকে।”
সাথে সাথেই চেয়ার থেকে উঠে বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন। কিন্তু তার আগে আমার ছবিটা দেখি।”
“ছবির কাজ এখনও অনেক বাকি। ফিনিশিং টাচ দিব আজকে রাতে। পরের বার যখন আসবে, তখন দেখো।”

মনটা খারাপ হলো কিঞ্চিৎ। বললাম, “স্যার, আমি আর আসব না। আসলে বাসায় জানাইনি। আর এ ধরণের কাজ আব্বা আম্মা কিছুতেই পছন্দ করবেন না।”
ভুল দেখলাম কিনা জানি না, মনে হলো উনার চোখ দুটো ধ্বক করে জ্বলে উঠল।
বিড়বিড় করে বললেন, “তাহলে তো আজকেই….”
“কিছু বললেন স্যার? আজকেই মানে? ঠিক বুঝলাম না।”
উনি মাথা নেড়ে বললেন, “না, কিছু না। চলো আমার ভাস্কর্যের স্টুডিওতে নিয়ে যাই তোমাকে।” আবার আমার হাত ধরলেন। আচ্ছা, একটা আলতো স্পর্শে এমনভাবে কারো সমস্ত স্নায়ু দুর্বল করে দেয়া যায়?

পাশের ঘরটাই ভাস্কর্যের স্টুডিও। আমি আমার সারাজীবনে বোধহয় এতটা চমকাইনি কখনও। ঘরটায় ঢুকতেই মনে হলো সহস্র চোখ আমার দিকে ভীত, আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেয়ালজুড়ে শেল্ফ, তাতে প্রায় গোটা পঁচিশেক কাদামাটির ভাস্কর্য, শুধু মাথা আর গলা। রায়হান ইমতিয়াজকে নিয়ে পড়াশোনার সময় ইন্টারনেট থেকে জেনেছিলাম এগুলোকে বলা হয় পোট্রেট বাস্ট । নিখুঁত হাতে বানানোরর পর তাদেরকে রঙ করা হয়েছে। এই ভাস্কর্যগুলোই তখন হয়ে উঠেছে শিল্পীর ক্যানভাস। এত জীবন্ত, মুখের রঙ, চোখের দৃষ্টি, চুলের বিন্যাস! এও কি সম্ভব! নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম, “অপূর্ব!অদ্ভুত!” উনি কখন আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। খুব কাছ থেকে উনার কণ্ঠ শুনলাম, “তোমার ভালো লেগেছে?” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললাম, “অবশ্যই! ভালো লাগবে না মানে! এমন দারুণ কিছু যে আমি আমার এ দু’চোখ দিয়ে দেখব, এ আমার কল্পনার বাইরে ছিল।” এবার উনি একটা হাত আমার কাঁধের উপর জড়িয়ে ধরলেন। ধীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “জানো যূথি, এ আমার বহু সাধনার ফসল। কত দেশে, কত জায়গায় আমি যাযাবরের মতো ঘুরে বেরিয়েছি এ বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার জন্য। তোমার চোখের মুগ্ধতা দেখে বুঝতে পারছি আমি সফল হয়েছি।” আমি এমনভাবে উনার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলাম, যেন কতদিনের চেনাজানা তার সাথে আমার! জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু আপনার এসব ভাস্কর্য আপনি এক্সিবিশনে দেন না? কোথাও তো এগুলোর কথা পাইনি আমি।”
“এই শিল্প শুধু আমার জন্য, পৃথিবীর আর কারো জন্য নয়। এই শিল্পকে প্রত্যক্ষ করা একমাত্র জীবন্ত চোখ দুটি আমার হবে।” চমকে উঠে উনার কাঁধ থেকে মাথা উঠালাম। কী বলছেন উনি!
উনি যেন সেটা খেয়ালই করলেন না। আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, “তুমি আমার ভাস্কর্যের মডেল হবে? প্লিজ না করো না। তোমার চেয়ে পারফেক্ট ফেস আমি আর পাইনি, পাবোও না।”

না করার শক্তি কী আমার আছে? কিন্তু হঠাৎ একটা বিষয় মনে করে মূর্তিগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। এগুলোর মধ্যে একটা মিল আছে। সবগুলো চেহারাতেই একটা ভয়, তীব্র ভয়, যেন সব হারানোর আতঙ্কে তাদের আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। এত নিখুঁত অভিব্যক্তি কীভাবে সম্ভব? এরা কী অভিনেতা? কৌতুহল চাপিয়ে না রেখে জিজ্ঞেস করলাম রায়হান সাহেবকে। আমার প্রশ্নের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন, বললেন, “এই অভিব্যক্তিগুলো আসল, অভিনয় নয়, তাই এত নিখুঁত, এত জীবন্ত।” প্রশ্ন ছুঁড়লাম, “কিন্তু কীভাবে সম্ভব?” “সত্যিকারের ভয়ের মুখোমুখি হলে সবই সম্ভব।” “তার মানে?”
জবাবে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন এলো, “মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় কী বলো তো?”

একটু চিন্তা করে বললাম, “মৃত্যু?”

মাথা ঝাঁকালেন রায়হান, বললেন, “তুমি বুদ্ধিমতী।একদম ঠিক বলেছ। এই মডেলরা সত্যিকারের মৃত্যুভয়ের মুখোমুখি হয়েছে বললেই এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে চেহারায়।”
এবার একটু ভয় পেলাম বৈকি! সত্যিকারের মৃত্যুভয়! সেটা কী করে সৃষ্টি করেন উনি? হঠাৎ একটা ভাস্কর্যের দিকে চোখ আটকে গেল। ঝাঁকড়া চুল, ভাসা ভাসা চোখে সীমাহীন বিস্ময় আর আতঙ্ক, পাতলা ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে যেন বাঁচার আকুতি করতে চাইছে। চেহারাটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে। নাকের পাশটায় একটা কাটা দাগ। এরকম আর কার দেখেছি? হঠাৎই মনে পড়ল গল্পটা, সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল কাঁটার ঝোপে। মুসাব্বির! মুসাব্বিরের আবক্ষ মূর্তি! চকিতে রায়হান সাহেবের দিকে তাকালাম। উনার দৃষ্টি আমার দিকেই নিবদ্ধ ছিল।বললেন, “চিনেছ?” মুসাব্বিরের সাথে এ কয়দিনে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। আমার দিক থেকে বন্ধুত্বই, মুসাব্বির কী ভাবছে, জানি না। কিন্তু গত চার দিন ধরে তার কোনো পাত্তা নেই। এখানে আসার আগেও কয়েকবার ফ্যন করেছি ওকে, আমি, সোমা দুজনেই, বারবারই সুইউচড অফ বলছে ফোনটা।

উনি একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। বেশ কিছু নিউজ কাটিং, নিখোঁজ সংবাদের। আমার বিস্ময়ের পাল্লা কেবল ভারিই হচ্ছিল। নিখোঁজ অনেক ব্যক্তির চেহারার সাথে কিছু ভাস্কর্যের অদ্ভুত মিল! এ কীসের মধ্যে এসে পড়লাম আমি! আতঙ্কে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল যেন।

রায়হান বলতে শুরু করলেন, “আমার এই বাড়িটা প্রায় পাঁচ একর জমি নিয়ে তৈরি, জানো? বাড়ির পিছনে অনেক জায়গা, অনেক। দুইটা কুকুর আছে আমার, মারাত্মক হিংস্র। যেদিন আমি ভাস্কর্য বানাই, সেদিন তাদের একজনকে খাবার দেয়া হয় না সারাদিন। খুব ক্ষুধার্ত থাকে ওরা, আর প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ। ক্ষুধার্ত কুকুরকে ভয় পাবে না তুমি?” বলে একটা মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন। “আই যে এই ছেলেটা, খাবার ডেলিভারি দিতে এসেছিল। খুব ভয় পেয়েছিল, হা হা হা!” গগণবিদারী হাসিতে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এ কি মানুষের হাসি?

আরেকটা আবক্ষ মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন তিনি। ওটা দেখিয়ে বললেন, “আমার লনটা দেখেছ না আসার সময়। ঘাসগুলো কাটা হচ্ছে না বেশ কিছুদিন। হবেই বা কী করে? মালী সাহেব তো ঘাপটি মেরে এখানে বসে আছেন।”

রায়হানের কথা তখনও শেষ হয়নি, “আমার কুকুরগুলোকে যে রাখে, হায়দার, সেও কিন্তু অনেক ভয়ংকর। শুনেছি এককালে মানুষ খুন করত টাকার বিনিময়ে। খুন, ধর্ষণের কয়েকটি মামলা আছে ওর নামে। ওকেও তো ভয় পাবে তুমি, পাবে না, যূথি? তবে হায়দারের দিন শেষ বুঝেছ? বড্ড বেশি জেনে গিয়েছে যে। মালীটার লাশ পুঁতে ফেলার পর থেকে একটু অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। তবে ওর ভয়-ডর কম। ওকে অন্য কিছুর ভয় দেখাতে হবে। কীসের ভয় দেখানো যায়, বলো তো?”

আমার কাছে এসে পড়লেন রায়হান। আমার গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “এত সুন্দর তুমি যূথিকা, কীসে ভয় তোমার বলো? কুকুর, ঠাণ্ডা মাথার খুনি, নাকি এই সুন্দর মুখটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়? কীসে যূথি, বলো আমাকে?” আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়ার চেষ্টা করছিলাম, মাথা ঠিক রাখতে পারছি্লাম না, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। আচমকা আমার গলা চেপে ধরলেন রায়হান৷ কতক্ষণ, দশ সেকেন্ড, ত্রিশ সেকেন্ড, নাকি দুই মিনিট,আমি জানি না, শুধু জানি,মৃত্যু অনেক কাছে ছিল। অক্সিজেনের জন্য হাঁসফাস করতে করতে যে মুহূর্তে মনে হলো হাল ছেড়ে দিব, তখন হঠাৎ আমার হাত লেগে একটা ভাস্কর্য পড়ে গেল। নিমিষেই রায়হানের এক অসামান্য সৃষ্টি খণ্ড বিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। গলার চেপে থাকা হাতের বাঁধনও শিথিল হলো। উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম দু’চোখে ক্রোধ ঠিকরে পড়ছে। যেন এক্ষুণি আমাকে এই ভাস্কর্যের মতো টুকরো টুকরো করে ফেলবেন। আমার মনে হলো বাঁচতে হবে, আমাকে, যে কোনো মূল্যে বাঁচতে হবে, এই বোধ অস্থির করে তুলল আমাকে । মরিয়া হয়ে হাতের ধাক্কায় বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য ফেলে দিলাম। একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনবদ্য সব সৃষ্টি। আমাকে আটকাতে আসা রায়হান ইমতিয়াজকে লক্ষ করেও কয়েকটা ভাস্কর্য ছুঁড়ে মারলাম। একটা কপাল ঘেঁষে গেল, রায়হান হাত চেপে ধরে সেখানে। কিছুক্ষণ পর হাত সরাতেই দেখলাম রক্ত! রায়হানের মুখে যন্ত্রণা, ক্রোধ- সব আবেগের সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তির খেলা দেখতে পাচ্ছিলাম। পিপার স্প্রের কথা মনে পড়ল, কিন্তু ব্যাগটা তো বসার ঘরেই রেখে এসেছি। কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। রায়হানের প্রশ্নটা মনে পড়ল, সত্যিই তো, আমি কীসে ভয় পাব? ভয়ংকর হিংস্র দুই কুকুর, নাকি ঠাণ্ডা মাথার খুনি নাকি এই বিকৃত মস্তিষ্কের প্রতিভাবান খুনিকে? দরজার বাইরে থেকে পায়ের আওয়াজ আসছে। সাথে জান্তব একটা গোঙানি, যেন শিকারের গন্ধ পেয়েছে ক্ষুধার্ত শিকারী। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শেষ ভাস্কর্যটা আমি হাতে তুলে নিলাম। দৌড়ে দরজার কাছে চলে এলাম। রায়হানের চোখেমুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। আমি দরজার আড়ালে থেকে দরজাটা খুলে দিলাম। ঘরে প্রবেশ করল চারপেয়ে একটা জন্তু আর হায়দার, যে এককালে ভাড়াটে খুনি ছিল। হায়দারকে মনে হয় নির্দেশনা দেয়া ছিল দরজা খুলতেই কুকুরটাকে ছেড়ে দিতে। হায়দার ঘরে ঢুকতেই আমি দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে স্টুডিওর বাইরে চলে এলাম। হায়দার চকিতে পিছন ফিরে তাকাল। কিন্তু আমাকে তাড়া করবে না মালিককে বাঁচাবে, তা বোধহয় ঠিক করতে পারছিল না। নাকি মালী নিখোঁজ হওয়ার পর সে বুঝতে পেরেছিল এরপর তার পালা? তা জানি না, তবে এটুকু জানি, সেদিন হায়দার চাইলে আমাকে সহজেই আটকাতে পারত। রায়হান দরজার বরাবরই দাঁড়িয়ে ছিল। কুকুরটা তার দিকে ক্ষীপ্রগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে রায়হানের চোখে-মুখে যে অভিব্যক্তির দেখা পেলাম আমি, তা ভয়ের, নিখাদ মৃত্যুভয়ের, অভিনয়ের লেশমাত্র সেখানে নেই।

গোপন_ভালোবাসা❤️ মুমুর্ষিরা_শাহরীন

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
গোপন_ভালোবাসা❤️
মুমুর্ষিরা_শাহরীন
#রোমান্টিক
দু ঘন্টা আগে আমার বিয়ে হয়েছে। বাসররাতে ছড়ানো ছিটানো ফুলগুঞ্জা বিছানায় বসে অপেক্ষা করছি তার জন্য। বুকে উথাল-পাথাল ঢেউ। না জানি কি হয়?
এই প্রথম দেখা হবে। হ্যা, আগেও হয়েছিলো কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে একটা ঘরে একা আমি আর সে এভাবে তো আর হয় নি। হয়েছে জনা সমাগমস্থলে। সবার সামনে। আমি বোধ হয় একবার চোখের পলক দেখেছি মাত্র। মাশাল্লাহ স্বামী আমার বেশ সুদর্শন, এক ঝলক দেখেই বুঝেছি।

আমার হাত পা কাঁপছে। কি হবে? কীভাবে কথা শুরু করবো? তাকে সালাম করবো কীভাবে? সে আমার সাথে কি কথা বলবে? কীভাবে কি করবে? আজ ই কি সব হবে? ভেতর বাহির শরীর সব কি আজ পরিচিত হয়ে যাবে? না কি সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে আগে মন পরিচিত হবে? কি জানি কি হয়? আচ্ছা আমি তার চোখে চোখ রাখবো কীভাবে? লজ্জা করবে না!

হাতে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে টকটকে লাল পাপড়িগুলো নির্দয় ভাবে একটার পর একটা ছিড়ে ফেলছিলাম। মনে উৎকন্ঠার ঢেউ। কাপছে বুক ভয়ে, উত্তেজনায়।
অতঃপর অপেক্ষার অবসান কাটিয়ে আমার বুকটাকে ধক করে কাপিয়ে প্রবেশ করলো আমার সদ্য বিবাহ করা স্বামী। পড়নে ক্রিম কালার শেরওয়ানি, মেরুন কালার চুরিদার, মাথায় মেরুন কালার সাথে ক্রিম কালার মিশ্রনে পাগড়ি। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। ঘেমে নেয়ে একাকার সে।

আমি মাথা নিচে নামালাম। উঠে গিয়ে তাকে সালাম করলাম। সে ক্লান্ত কন্ঠে বলল, ‘এখনো জেগে আছো? আচ্ছা এসব শাড়ি কাপড় খুলে এসো, যাও।’

আমি চমকে গেলাম। এ কি অবস্থা! দেখা হতেই এই বিশ্রী প্রস্তাব। সে তো আমার স্বামী। আরো অনেক সময় পরে আছে। আর সে এখনি এসব…ছি!

আমার ভাবনার মাঝেই আমার স্বামী আমাকে অনেকবার ডেকেছে। এবার না পেরে আমার বাহুতে ধরে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল,

‘প্রমা… এই প্রমা।’

আমি চকিতেই তাকালাম তার দিকে। এরপর নিচু গলায় ঘৃণার সহীত বললাম, ‘কি?’

‘যাও। এসব শাড়ি খুলে কোনো পাতলা থ্রি-পিস পরে এসো। যা গরম!’

আমি অবাক হয়ে গেলাম। ঠোঁটদুটো কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেলো। এই লোকে এতোক্ষন থেকে এই কথা বলছিলো? আমি হেসে দিলাম। এরপর কিছু বলতে যাবো। কিন্তু মনে হলো উনাকে আমি ডাকবো কি বলে? প্রশ্নটা করেই ফেললাম,

‘আচ্ছা আপনাকে আমি কি বলে ডাকবো? মানে স্বামী স্বামী বা ওগো ওগো করে তো আর ডাকা যায় না।’

সে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ‘তাহলে আর কি! জান জান বলে ডেকো।’

কি খারাপ! আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, ‘নাম কি আপনার?’

সে হায়হায় করে বলল, ‘আল্লাহ স্বামীর নাম ধরে ডাকবে? তুমি জানো আমি তোমার কত বড়? প্রায় দু-তিন বছরের বড় হবো।’

আমি চোখ তুলে একবার তাকালাম। সাথে অবাক হলাম দু-তিন বছর একটা বড় হলো না কি? আমি মিনমিনে গলায় বললাম, ‘তা বলি নি। আপনার নামটা বলুন। আমি আপনার নাম ধরে ডাকবো না। শুনবো। বিয়ের ওতো ভেজালের মধ্যে নাম শুনার দিকে খেয়াল ছিলো না।’

‘আমার ডাক নাম প্রথম। পুরো নাম মুসাদ্দেক হাসান প্রথম।’

‘ওহ…’

‘শুয়ে পড়ো তাহলে। ভয়ের কিছু নেই। আজ কিছু হবে না।’

আমি মাথা নিচু করে শাড়ি বদলাতে গেলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমার খুব খুশি লাগছিলো। মানুষটা কি সত্যি এতোটা ভালো? না কি শুধু আমার কাছেই ভালো লাগছে?

জামা কাপড় পালটে দুজনে দু রাকাআত নফল নামাজ পড়ে শুতে গেলাম। একটা পাতলা শাড়ি আমার গায়ে। আমি বেশ দূরত্ব রেখেই শুয়েছি তার থেকে। হঠাৎ সে আমাকে হেচকা টান দিলো। আমি হুমড়ি খেয়ে পরলাম তার বুকের উপর। ভয় পেয়ে গেলাম। আজ তো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। তার মানে মানুষটা যা দেখায় সে আসলে তা নয়। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো।

প্রথম আমার পিঠে এক হাত রাখলো। বলতে নেই, আমার ভেতর মৃদুমন্দ কাপন সৃষ্টি হলো। ভালো লাগলো। চোখ নির্বিঘ্নে নিজ দায়িত্বে বন্ধ হয়ে গেলো। আমি বলতে শুনলাম। প্রথম বলছে আমার কানে ফিসফিস করে,

‘আমি কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছি। আর তুমি পাতলা শাড়ি পরে এসেছো? তার উপর এত্তো বড় গলার ব্লাউজ। পিঠের অনেকাংশই তো দৃশ্যমান। কি চাইছো বলো তো তুমি?’

আমি চট করে চোখ খুললাম। তার চোখের সাথে আমার চোখ মিলে গেলো। এরপর কিছুক্ষন দমবন্ধকর পরিস্থিতি। আমি লজ্জা পেলাম। সরে আসতে চাইলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু তার শক্তির সাথে পেলাম না। সে আমাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। বলল,

‘আজ থেকে আমার বুকেই তোমার স্থান।’

সত্যি কথা, সে সময় আমার চোখ থেকে আপনা আপনি দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমার ভাগ্যে আল্লাহ এতো ভালো একজন স্বামী রেখেছিলো? প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাজে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম, ‘হে আল্লাহ, আমি বাবা মার অবাধ্য হবো না। কিন্তু আমার মনের মতোই কাউকে যেনো আমি পাই।’ আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। দিয়েছে আমাকে একজন ভালো স্বামী।

আমি তার বুকে শুয়ে থাকলাম। আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়লো তার বুকের উপর। সে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে প্রমা কাদছো কেনো?’

নাক টেনে তাকে আরো শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আল্লাহ এতো ভালো স্বামী দিলো তাই কাদছিলাম।’

প্রথম আমার কপালে চুমু দিলো। এই প্রথম কোনো ছেলের এতো কাছের স্পর্শ আমার শরীরে লাগলো। কেপে উঠলো পুরো শরীর। আমি তার নীল গেঞ্জির গলার দিকে ফাকা স্থান থেকে বের হওয়া বুকের লোম গুলো খুটছি। সে আমার গালে চট করে চুমু দিলো। আমার শরীর ক্রমশ অসাড় হয়ে এলো। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেতে শুরু করলো। একসময় আমি তার বুকের মাঝে আলতো করে একটা চুমু একে দিলাম। সে আমাকে নিজের সাথে পিষিয়ে ধরলো। মিশে গেলাম তাহাতে আমি।

_______________________________

আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আমার কোল আলো করে আসতে চলেছে আমার আর উনার সন্তান। ঠিক যতটা না আমার উৎফুল্লতা তার থেকে দ্বিগুন বেশি উনার।

আমি তার বুকের উপর শুয়ে ছিলাম৷ সে আমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে গম্ভীর সুরে বলল, ‘একটা কথা বলার ছিলো।’

‘বলুন।’

‘আগেই বলার উচিত ছিলো। কিন্তু আজ বলছি। কারন মনে হচ্ছে এখন বলার উচিত।’

আমার বুক কেপে উঠলো। কি এমন কথা! সে তার ফোন মেলে ধরলো আমার চোখের সামনে। আমি ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটা হয়তো নাইন বা টেন হবে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম! কারন ছবিটা আমার বোনের। আমার বড় বোন। যে বড় বোন বিদেশে বর নিয়ে সেটেল। আমার ভয় লাগতে শুরু করলো। হঠাৎ আপুর ছবি উনার ফোনে কেনো? কাপা কাপা গলায় প্রশ্ন করলাম,

‘আপুর ছবি আপনার কাছে কেনো?’

উনি মুখটা অনেক গম্ভীর বানিয়ে ফেললেন। আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যেতে শুরু করলো। এখন মনে হচ্ছে পেট ও ব্যাথা করছে। তিনি বলতে শুরু করলেন,

‘তোমার আপু আর আমি ব্যাচমেট। স্কুল কলেজ আমরা একসাথেই পড়েছি। কিন্তু ভারসিটিতে আলাদা। আমরা যখন কলেজে পড়তাম তখন আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার। তখন তুমি বোধ হয় নাইনে পড়ো। তুমি না কি কারোর সামনে আসো না। বাইরেও মুখ ঢেকে চলাফেরা করো। মানে পর্দা করো। বিষয়টা আমার কাছে খুব ই ভালো লাগলো। আমি একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। ওয়াশরুমে যেতে হতো তোমাদের রান্না ঘর পার করে। তো যখন ওয়াশরুম থেকে ফিরছিলাম দেখলাম রান্না ঘরে একটা ছিপছিপে গড়নের একদম সাধারণ মেয়ে। থ্রি পিস পরে মাথায় সুতির উড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চা ঢালছে।
বিশ্বাস করো, দৃশ্যটা আমার বুকে গিয়ে লাগলো। ওই চায়ের গরম ধোয়ায়…. তোমার ফর্সা লাল মুখশ্রী দেখে আমি এলোমেলো হয়ে গেলাম। কিন্তু তোমার অতি সাধারণ চলা ফেরা দেখে ভেবেছিলাম তুমি বোধ হয় ওই বাড়ির কাজের লোক।’

এইটুকু বলে প্রথম দাত দিয়ে জিহ্বা কাটলো। আমি ফুসে উঠলাম। জ্বলন্ত খড়ির মতো পুড়তে পুড়তে বললাম, ‘তারপর?’

সে বেশ আয়েশ করে বসে বলল, ‘তারপর? তারপর আমি তোমার আপুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘রান্নাঘরে একটা মেয়ে দেখলাম অনেক সুন্দর। তোদের বাড়ির কাজের লোকগুলোও এতো সুন্দর কেনো রে?’
তোমার আপু বড় বড় চোখ করে তাকালো আমার দিকে। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আমাদের বাড়িতে তো কোনো মেয়ে কাজের লোক নেই। শুধু রহিম চাচাই আছেন।’
আমি বললাম, ‘আয়হায়! কি বলি তাহলে কাকে দেখলাম নীলটে রঙের জামা পরে সুতির উড়না মাথায় দেওয়া।’
সে একটু ভেবে হায়হায় করে উত্তর দিলো, ‘হাইরে! তুই তো আমার বোনরে দেখে ফেলছোস। এটা যদি আমার বোন প্রমা জানতে পারে তাহলে আমার আর কোনো ফ্রেন্ড রে বাড়িতে ঢুকতে দিবো না।’

আমার মুখ তখন উজ্জ্বল বাতির নেয় ঝিলিক দিচ্ছিলো। সাথে ভালো লাগছিলো তোমার সেই সাধামাটা চলন দেখে। মনের স্থানে সেই তোমাকে কবেই জায়গা দিয়ে দিলাম। সেই থেকে তোমার পিছু নিতাম। খোঁজ খবর রাখতাম। তোমার জন্যই তোমার আপুর সাথে যোগাযোগ রাখতাম। পড়াশোনা শেষ করে একটা সময় আমি তোমার আপুকে সব বললাম। তোমার আপুর তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তোমার আপু আমাকে বলল তোমার বাবাকে পটাতে। তোমাকে পটিয়ে কোনো লাভ হবে না। কারন তোমার বাবা মা যার সাথে বিয়ে দিবে তুমি তাকেই বিয়ে করবে। ব্যস, আমি তোমার বাবাকে পটানো শুরু করলাম। তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। আমার ফ্রেন্ড কয়েকজনরে কাজে লাগালাম। যারা তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমার নামে ভিষণ ভালো ভালো বক্তব্য দিয়েছে। ব্যস, তোমার বাবাও পটে গেলো। আর পটবে নাই বা কেনো। হ্যান্ডসাম, গুড লুকিং, ব্রাইট একটা ছেলে আমি। ভালো জব করি। পটবে না আবার..।’

এই জায়গায় প্রথম একটু ভাব নিয়ে বলল খানিকটা কলার উঁচিয়ে। আমি গালে হাত দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে আমাকে নিজের সাথে ঝাপটে ধরে বলল, ‘তারপর আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। এখন তুমি আমার বাচ্চার মা হতে চলেছো।’

বিস্ময় নিয়ে বললাম, ‘এতো কিছু? সেই নাইন থেকে আপনি আমাকে ভালোবাসেন? মানে? এতোদিন জানান নি কেনো হ্যা? বিয়ের পরেও তো জানাতে পারতেন।’

প্রথম মুচকি হেসে আমার নাক টেনে বলল, ‘এই যে এখন জানিয়ে দিলাম। পিচ্চি একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। আর সেই মেয়ে এখন আমার বাচ্চার মা হবে।’

এরপর সে আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেশ সন্তুষ্টি নিয়ে বলল, “আমার গোপন ভালোবাসা। আমার অপ্রকাশিত ভালোবাসা। আমার বাচ্চার মা টা রেহ….।”

আমিও তাকে ঝাপটে ধরে বললাম, “আমার প্রকাশিত ভালোবাসা।”

সে হাসলো। আমিও হাসলাম। এরপর মুখ কুচকে বললাম, ‘আহা! আস্তে ধরুন না! পেটে ব্যাথা পাই তো।’

সে ‘উপসস স্যরি স্যরি বলে’ আমাকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে পেটের উপর একটা চুমু দিলো। কি সুন্দর সেই দৃশ্য! এমন সুন্দর মুহুর্তের একটা ছবির অভাববোধ করছি আমি এই মুহুর্তে। ইশশ…কি কিউট আমার জামাইটা! আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া!

সমাপ্ত❤️

গল্পের নাম:মুক্তির আলো – লেখিকা:ফাইজা হাবীব নীবুলা

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
গল্পের নাম:মুক্তির আলো
লেখিকা:ফাইজা হাবীব নীবুলা
জনরা:সামাজিক
★সাল ১৯২৪, ১৪ই এপ্রিল,বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ।

সুখী মাঠের আল দিয়ে দৌড়ে আসছে বাড়ির দিকে।গুরুর কাছে সকালে ধর্মীয় পাঠ লাভের পর প্রতিদিন বন্ধুদের সাথে গ্রামবাসীর গাছপালার উপর হামলা চালাতে ব্যস্ত থাকলে আজ সে দৌড়ে যাচ্ছে মায়ের কাছে।বৈশাখী মেলার আয়োজনে পুরো গ্রাম যেন আজ নতুন বউয়ের মতো সেজেগুজে তৈরী।নতুন ধানের পায়েশের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশের বাতাস।সুখী তাই আরও তাড়াতাড়ি পা চালাতে শুরু করলো।বাড়িতে ফিরে মনের সব উচ্ছ্বাসগুলো যেন এক নিমিষেই কেউ এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল।পুরো গ্রাম যেখানে উৎসব মানাতে ব্যস্ত সেখানে তাদের বাড়িটা যেন বিধবাবেশে দাঁড়িয়ে আছে।মা অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির কাজ করে চলেছে।আর আব্বাজীও তার হিসাবের খাতা নিয়ে সবসময়ের মতো ব্যস্ত।মা কে দেখেই সুখী দৌড়ে গেল,গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, মা আজ বৈশাখের আনন্দ আমরা করব না।মেলায় নানা রকম জিনিসের পসড়া বসেছে।আমরা মেলায় যাব কখন?
ছেলের কথা শুনে রত্না দেবীর হাত থেমে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে নির্বিকার চিত্তে বললো, আমরা আজ মেলায় যাব না!বৈশাখীর আনন্দ আমাদের জন্য না।কিন্তু সুখী মায়ের কথা মানলে তো।জিদ করতে লাগলো অনবরত।পুত্রের আর মায়ের বৎসা দেখে হিসাবের খাতা থেকে চোখ উঠিয়ে দেখলেন সুমেন্দার সিং, মায়ের পাঁচ আঙুলের দাগ তার কলিজার টুকরার গালে বসে গেছে।ছেলেকে মেরে মা প্রস্থান করলেও ছেলে চোখভরা টলটলে জল নিয়ে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।
পুত্রকে দ্রুত বুকে টেনে নিলেন সুমেন্দার সিং,যে পুত্রের গায়ে কখনো ফুলের টোকা ও দেন নি তারা স্বামী স্ত্রী দুজন, সেই পুত্রর গালে লাল হয়ে থাকা পাঁচ আঙুলের দাগ তাকে বরই ব্যথিত করলো।পুত্রের মন ভালো করার জন্য পুত্রকে কাঁধে নিয়ে মেলার দিকে চললেন সুমেন্দার সিং।মেলা থেকে নানারকম মিঠাই কিনে দিয়েছেন পুত্রকে,চড়িয়েছেন নাগরদোলায় চড়িয়েছেন,দুই হাত ভর্তি করে খেলনা কিনে দিয়েছেন কিন্তু বাড়ি আসার আগে পুত্রের কাছে এক ওয়াদা চেয়েছেন।আর যেন কোনোদিন মায়ের কাছে বৈশাখী পালনের জিদ না করে,আর যেন বৈশাখী পালনের জন্য রাগ না করে সুখী।পিচ্চি সুখী বাবার কাছে ওয়াদা করে ঘুমিয়ে গেছে পথিমধ্যেই।সেই রাতে সুমেন্দার রত্নাদেবীর শয়নকক্ষে প্রথমবারের মতো পদার্পণ করে।বাইরের উত্তাল বৈশাখী ঝড়ের মধ্যে তাদের মধ্যে বিনিময় হওয়া শব্দগুলো দাফন হয়ে যায়।

★সাল ১৯৪০, ১৪ই এপ্রিল, বাংলা বর্ষের প্রথম দিন
অন্য সবার জন্য এ দিনটি অনেক আনন্দের হলেও সুখীর জন্য তা গতানুগতিক।ভারত মাতার সুযোগ্য সন্তান সে,ইংরেজরা গদি ছাড়বে বলে! গান্ধীজির ডাকে সারা দেশ উত্তাল।হিন্দু, মুসলমান,ধনী, গরিব,শিখ, বৌদ্ধ সবাই দলমত নির্বিশেষে একযোগে ইংরেজদের ভারত ছাড়ে বদ্ধ পরিকর।আর এখন তার কি বসে থাকার সময় আছে।আন্দোলন বেগবান করতে দেশের মা বোনেরা নিজেদের অর্থ গয়না আজাদীর মশালে আহুতি দিয়ে এর শিখা আর ও প্রজ্জ্বলিত করছে।তার মাও ব্যাতিক্রম নয়।রুপিয়া দিয়ে রত্নাদেবী নিজের কাজে ব্যস্ত হলেও সুখী খেয়াল করলো, আলমারী থেকে কিছু চিঠি আর একটা ছবি ডায়েরি থেকে গড়িয়ে পড়লো।
রুপিয়া গুলো পকেটে ভরে চিঠিগুলো গুছাতে বসলে কৌতুহল বশত তাতে চোখ বুলিয়ে স্থবির হয়ে বসে রইলো সুখী।

★সাল ১৯৪৮,১৪ই এপ্রিল, বাংলা নববর্ষ,১লা বৈশাখ

“আজ অনেক দিন পর ডায়েরি লিখছি।এই প্রথম আমাদের পরিবারে ১লা বৈশাখ পালন হবে।পহেলা বৈশাখ নিয়ে মায়ের এত বিতৃষ্ণার কারণ জানার পর আমারও আর ইচ্ছে করে নি মায়ের ক্ষতকে আরো দগদগে করে দিতে।পহেলা বৈশাখ নিয়ে মায়ের কষ্টের মূল কারণ পেয়েছিলাম চিঠিগুলোর ভেতরে।১৯১৯ সালে বৈশাখীর দিন মায়ের বিয়ে হবার কথা ছিল, কিন্তু জালিওয়ানবাগের সেই ভয়াবহ হত্যাকান্ড মাকে সধবা হবার আগেই বিধবা লাশে পরিণত করেছিল।সেদিন মা তার প্রেমাস্পদ আর হবু সন্তানের পিতার পাশাপাশি বড় ভাইস্বরূপ বন্ধুকেও হারিয়েছিল।একদিকে শোক আরেকদিকে লোকলজ্জ্বার ভয়।দুই বিপদে যখন মা দিশেহারা তখন আব্বুজী এসেছিল মায়ের জীবনে।বিগ্রেডিয়ার ডায়ার সেদিন কোন কারণ ছাড়াই নিরপরাধ মানুষগুলোর দিকে গুলি চালিয়েছিল।সমাবেশ আর তীর্থ যাত্রীদের মাঝে আমার পিতাও মারা গিয়েছিল।রাজনৈতিক সচেতন মানুষ তাই স্টেজের খুব কাছেই ছিল।গুলির প্রথম ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছিল,তার সাথেই হারিয়েছিল আমার মায়ের হাসি।কারফিউ এর জন্য সেই ময়দানে পড়ে থাকা লাশগুলোর দাহ সংস্কারের জন্য কেউ এগুতে পারে নি। সেই থেকে হয়েছিল অভিশপ্ত পহেলা বৈশাখ আমার মায়ের জন্য।সত্য জানতে পেরে সেই না দেখা পিতার জন্য যতটুকু কষ্ট লাগছিলো,তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছিলাম মায়ের এই নির্বাক কষ্ট দেখে।মায়ের কষ্ট উপশমের জন্যই আরো দুর্বার বেগে আজাদীর লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ি।আজ দেশ স্বাধীন,মা ও স্বাধীন তার ভেতরের কষ্টগুলো।মুক্তি পেয়েছে মা তার বন্দীত্ব থেকে।”
এতটুকু লিখে ডায়েরি বন্ধ করে সুখী আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ,মা রত্নাদেবী আর কন্যা রাণীর খুনসুটি দেখছে দু চোখ ভরে।সুমেন্দার ও বারান্দায় বসে দাদী নাতনীর এ চমৎকার সময় উপভোগ করছে আর সুখীর বউ ১লা বৈশাখ পালনের সমস্ত যোগাড় যন্ত্র করছে।

গল্পের নাম: আমার ছেলে Misk Al Maruf

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
গল্পের নাম: আমার ছেলে
Misk Al Maruf

পার্কের বেঞ্চে বসা অবস্থায় আকস্মাৎ সাত বছর বয়সী একটি ছেলে আমার পাশে এসে বসলো। আমি ছেলেটির দিকে একনজর তাকিয়ে ওর ভাব ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করলাম। দেখে মনে হলো ওর আবাসস্থলটা এই পথেঘাটেই হবে হয়তো কিন্তু ওর চেহারায় আলাদা একটা মায়াবী ভাব আছে। হয়তো এসব শিশুদের মায়াবী ভাবটা আমার চোখেই ধরা পরে কেননা গত পনেরো বছর অপেক্ষা করার পরও আমার বাবা হবার স্বপ্নটা এখনো ধোয়াশাই রয়ে গেল। সমস্যাটা আসলে আমার নয় বরং আমার স্ত্রী মিমির। একটি সন্তানের আশায় কতবার যে ডাক্তার আর কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছি তাঁর কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ফলাফল সেই শূণ্যই রয়ে গেল। আমার স্ত্রী একটি সন্তানের আশায় নিজেকে দোষী ভেবে প্রতিদিন রাতেই নিজেকে একান্তে নিয়ে কান্না করে। প্রথম প্রথম আমি মিমিকে অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে যথেষ্ট সান্ত্বনা দিলেও এখন আর ওকে সান্ত্বনা দেইনা। কারণ আমার ধারণা কান্না করলে মেয়েরা নিজের মনে জমে থাকা সমস্ত আক্ষেপ আর কষ্টকে প্রশমিত করতে পারে। হঠাৎই ছেলেটি আমাকে অনেকটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-আঙ্কেল, সকাল থেকে কিছু খাইনি যদি আমাকে কিছু খাবার কিনে দিতেন তাহলে খুব ভালো হতো।
ছেলেটির এহেন কথায় আমি কিছুটা অবাক হলাম কেননা সচরাচর কোনো পিতৃমাতৃহীন রাস্তার ছেলেগুলো এতোটা সাবলীল আর ভদ্রভাবে কারো নিকট কিছু চায়না বরং তাঁরা অনেকটা জোরপূর্বক পথচারীদের জামা আকড়ে ধরে সাহায্য চায়। ছেলেটির এরকম অসহায় অনুরোধ দেখে আমারও বেশ মায়া হলো তাই ওর কাছে ঘেঁসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আসলেই কিছু খাওনি?
পুনরায় অনেকটা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-না আঙ্কেল।
ওর ঐ মায়ামাখা মুখোবয়ব দেখে আমার একটুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো না যে ও আসলেই সত্য বলছে। তাই ওকে নিয়ে পার্কের বাহিরে থাকা একটি ছোটখাঁটো রেষ্টুরেন্টে বসে পরলাম। একটি টেবিলে বসতেই একজন ওয়েটার আমাদের দিকে এগিয়ে এসে পরক্ষণেই ছেলেটির দিকে তাকালো আর মুহূর্তেই ওয়েটার টির কপালখানি ক্ষানিকটা কুঁচকে গেলো বোধহয়। কারণ তাঁদের মতো একটি নামিদামী রেষ্টুরেন্টে এরকম একটি রাস্তার ছেলের উপস্থিতি কখনোই কাম্য নয়। তবুও ওর সাথে আমাকে দেখে তেমন কিছু বলার সাহস পেলোনা। আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-কী খাবে?
আমার কথা শুনে ও বললো,
-আঙ্কেল কিছু মনে না করলে মেন্যুটা আমাকে দিন আমি বলে দিচ্ছি।
-এখানেতো সব ইংরেজিতে লেখা আছে তুমি বুঝবেতো?
-হ্যাঁ আঙ্কেল বুঝবো।
আমি পুনরায় অবাক হলাম ওর কথা শুনে। তবুও ওর দিকে মেন্যুটা এগিয়ে দিলাম অনেকটা কৌতুহলের বসেই ঠিক এটা জানার জন্য যে ও আসলে আমাকে কী উত্তর দেয়। বেশ কিছুক্ষণ মেন্যুটা এদিক ওদিক উল্টানোর পর ছেলেটি আমার দিকে মেন্যুটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
-আঙ্কেল এগারো নম্বরের ফ্রাইড রাইস এন্ড এগটা অর্ডার করতে পারেন। এটার দাম সবগুলোর থেকে কম আছে।
আমি ওর কথা শুনে স্বভাবতই ওর দিকে কিছুক্ষণ অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম। একটি সাত বছরের বাচ্চা ছেলে কীভাবে এতোটা সাবলীল ভঙ্গিতে ইংরেজিতে লিখে রাখা খাবারের নাম আমাকে বলতে পারলো? আমার এই ভাবনায় ছেদ ঘটালো ওয়েটার। আমি বাস্তবে ফিরে ওয়েটারের দিকে একনজর তাকিয়ে পরক্ষণেই ছেলেটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম এবং বললাম,
-তুমি কম দামীটাই কেন পছন্দ করতে গেলে বলোতো?
-আঙ্কেল ওটাতেই আমার হবে। আর তাছাড়া আমি আপনার কাছে শুধু সামান্য কিছু খাবার চেয়েছিলাম নিজের ক্ষুধা মেটানোর জন্য কিন্তু আপনি আমাকে তাঁর থেকেও বড় জায়গাতে নিয়ে এসেছেন। আঙ্কেল আমার শুধু পেট ভরলেই চলবে আমি এর থেকে দামী খাবার চাইনা। আপনি আমাকে খাবার খাওয়াচ্ছেন এটাই অনেক, আমি চাইনা আপনার বেশি টাকা খরচ হোক।
ছেলেটির একনাগাড়ে কথাগুলো শুনে আমার চোখটা কোনো এক অজানা আনন্দে যেন ঝাপসা হয়ে এলো। একটা বাচ্চা ছেলে কতটা ভালো বুদ্ধিসম্পন্ন হলে এই ধরণের মনমানসিকতা নিয়ে কথা বলতে পারে? অথচ ওর মতো এরকম মানসিকতা আমাদের তেরো চৌদ্দ বছরেও তৈরি হয়নি। আমি ক্ষানিকটা খুশি হয়েই এগারো নম্বরের সাথে আরো তিনটা আইটেম অর্ডার করলাম। খাবারগুলো সামনে আসতেই ছেলেটি কীরকম যেন খেতে ইতঃস্তত ফিল করছিলো। ওর এহেন কান্ডে আমি বললাম,
-কী হলো? খাওয়া শুরু করো।
ও যেন আমার এই কথাটির জন্যই অপেক্ষা করছিলো। ওর খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে মনে হলো কয়েকদিন ধরে বোধহয় পেটে কিছু পরেনি এবং কতকাল ধরে যেন এসব খাবার ও মুখেও নেয়নি। আমি ওর খাবার খাওয়ার স্টাইল দেখে একনয়নে ওর নিষ্পাপ মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবতে লাগলাম প্রভু যদি আমাকে ওর মতোই একটি ছেলে দিতো তাহলে আমার আর মিমির কখনোই সুখের সীমা থাকতো না কিন্তু প্রভু তো আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে কোনো দিনই তাকালেন না। কিছুক্ষণ খাওয়ার অন্তর ছেলেটি আমার দিকে একনজর তাকিয়ে বেশ লজ্জা পেলো বোধহয়।
-আঙ্কেল আপনিও খান।
আমি ওর কথায় ক্ষানিকটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
-আমার পেট ভরা আছে। এগুলো সব তোমার জন্যই। তুমি পেট ভরে খাও।
আমার কথা শুনে ছেলেটি আর কিছু বললোনা। কিন্তু আমার তখনো ওর পরিবার সম্পর্কে সবকিছু জানার চরম আগ্রহ মনে উঁকি দিচ্ছিলো।
.
রেষ্টুরেন্টের বিল দিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে আবার সেই পূর্বের পার্কের সেই বেঞ্চটিতে বসে পরলাম।
-আচ্ছা তোমার নামটাইতো জানা হলোনা।
-জ্বী আংকেল আমার নাম মুনিম। এটা আমার আম্মু রেখেছিলেন।
-ও। আচ্ছা তোমার বাবা মা কোথায় থাকে? আর তুমি এভাবে রাস্তাতেই বা থাকো কেন?
আমার কথাটি শুনে মুনিমের মুখখানিতে ক্ষানিকটা বিষাদের ছায়া ভর করলো বোধহয়। পরক্ষণেই বলে উঠলো,
-আমার আম্মু মারা গেছে আঙ্কেল। আর আমার আব্বুকে আমি কখনো দেখিনি। জানেন? আমার আম্মু সবসময় আমাকে বলতো কখনো কারো সাথে ঝগড়া করবিনা আর সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবি। আমার অনেক পড়ালেখা করার ইচ্ছা ছিলো এমনকি আমি একটি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ালেখা করতাম কিন্তু আম্মু মারা যাবার পর স্কুলের বেতন দিতে না পারায় আমাকে তাঁরা বের করে দেয়। কেউ আমাকে ভালোবাসেনা আঙ্কেল আর কেউ আমাকে খাবারও দিতে চায়না।
এই বলেই মুনিম নিজের ডান হাত দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরে কান্না করে দিলো। ওর এরকম আবেগমাখা কথা শুনে আমার চোখদুটোও ক্ষানিকটা ভিজে এলো। আসলেইতো কেউ ওদের মতো ছেলেদেরকে ভালোবাসে না।
এভাবেই চলে যায় বেশকিছুদিন আর আমিও প্রতিদিন মুনিমের জন্য পার্কে বিভিন্ন খাবার নিয়ে চলে আসি।
.
আমাকে মূলত রাজশাহীতে অফিস থেকে পাঠানো হয়েছিলো কর্পোরেট শাখা পরিদর্শনের জন্য। আর বেশিদিন হয়তো এখানে থাকা হবেনা কারণ এখানের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হতে চলেছে। আমার স্ত্রী মিমিকে আমি ফোনে প্রায়শই মুনিমের কথা বলি। আমার মুখে ছেলেটির এতো গুণগান শুনে স্বভাবতই মিমি মুনিমকে দেখার বায়না ধরে। আমিও আর না করিনি বরং সেদিন যখন মিমির সাথে ভিডিও কলে মুনিমের আলাপ করিয়ে দিলাম তখন ওদের কথোপকথন শুনে আমার মনে হচ্ছিলো মুনিম কোনো বাহিরের ছেলে নয় বরং ও মিমিরই জন্মগত কোনো সন্তান। আমি তখন বেশ খুশি হলেও হৃদয়ের গহীনে রক্ত ক্ষরণ হয়েছিলো এই ভেবে যে,
-আমিতো মুনিমকে কখনো নিজের সাথে নিয়ে যেতে পারবোনা কারণ ওকে নিয়ে গেলে সমাজের মানুষগুলো কটু মন্তব্যের তীর ছুড়তেও পিছপা হবেনা কখনো।
আমি জানতাম মিমির মনেও ঠিক এই কথাটিই ইলেক্ট্রনের ন্যায় ছোটাছুটি করতো তাই সেও মুখফুটে আমাকে কখনো বলেনি মুনিমকে সাথে নিয়ে আসতে।
গত দুদিন কর্পোরেট অফিসে কাজের চাপে আমি একদমই দেখা করতে পারিনি মুনিমের সাথে। এই দুদিন মিমি আমাকে ফোন দিয়ে বেশ করেই বলতো মুনিমের সাথে দেখা করতে যেতে কিন্তু সেভাবে ফ্রি সময়টা করে উঠতে পারিনি। বিকালে হঠাৎই আমার বাসার কেয়ারটেকার এর কল আসলো। কলটি রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে জানালো মিমি নাকি রাস্তা থেকে হেঁটে যাবার সময় এ্যাক্সিডেন্ট করেছে এমনকি হাসপাতালে নিয়ে আসার পরও জ্ঞান ফিরছে না। এই খবর শোনামাত্রই আমি আর একমুহূর্ত দেরী করিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে। কারণ দুনিয়ার যত কিছুই হয়ে যাক না কেন মিমিকে ছাড়া আমার আকাশটা বায়ুমন্ডলহীন এক নিকষ কালো অন্ধকারে রূপ নেয়। আমি বাসে ওঠার পর থেকে কিছুক্ষণ পরপরই কেয়ারটেকার জসিমকে কল দিয়ে জানার চেষ্টা করছিলাম মিমির জ্ঞান ফিরেছে কীনা। কিন্তু বরাবরই যখন ওর মুখে নাবোধক শব্দ শুনছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো আমার হৃদয়ের অর্ধেকটা কেউ বোধহয় কেঁটে আলাদা করে দিচ্ছে। হঠাৎই অপরপাশ থেকে জসিমের কল পেয়ে হুড়মুড়িয়ে কলটি রিসিভ করতেই সে বলে উঠে,
-ভাইজান! আফার জ্ঞান ফিরছে। আপনের সাথে কথা কইবো।
এই বলেই সে মিমির দিকে কলটি এগিয়ে দিতেই আমি বললাম,
-মিমি, তুমি ঠিক আছোতো? শরীর কী খুব খারাপ লাগছে? আমি চলে আসছি আর কিছুক্ষণের মধ্যে।
মিমি অনেকটা ভাঙ্গা গলায় আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো,
-তোমার সাথে মুনিম আসছেতো?
মিমির এই প্রশ্ন শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই আমি চোখে ক্ষানিকটা অশ্রু আর মুখে কিছুটা হাসি নিয়ে বললাম,
-হ্যাঁ মুনিম আমার সাথেই আছে।
এই বলেই কলটি কেঁটে দিয়ে দ্রুত বাসের হেলপারকে বললাম,
-ভাই আমাকে আবার রাজশাহীতে ব্যাক করতে হবে আমাকে এখানে নামিয়ে দিন।
.
পার্কে উপস্থিত হতেই দেখতে পাই আমি আর মুনিম যেই বেঞ্চটাতে বসে গল্প করতাম সেই বেঞ্চেই ও অনেকটা অসহায় আর নিষ্পাপ বাচ্চার ন্যায় ঘুমিয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে ওর কপালে ক্ষানিকটা স্পর্শ করতেই ও জেগে উঠলো। আমাকে দেখেই মুনিম বলে উঠলো,
-আঙ্কেল, আপনি এই দুদিন কোথায় ছিলেন? জানেন? এই দুদিন আমি আপনার অপেক্ষায় এখানেই বসে ছিলাম আর রাতেও এখানেই ঘুমিয়েছি।
ওর কথা শুনে আমি নিজের অশ্রুবাধ আটকাতে না পেরে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-তোমাকে আর কখনোই অপেক্ষা করতে হবেনা, বাবা। আর তোমাকে কখনো একাও থাকতে হবেনা। তোমাকে আমি একেবারের জন্যই নিয়ে যেতে এসেছি। তোমার মা তোমাকে দেখতে চায়, তিনি তোমার অপেক্ষায় আছে।…..
.
(সমাপ্ত)

গল্প-আমি কি? -লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

0

#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
গল্প-আমি কি?
#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১

আজ আকাশটা কালো রং ধারণ করেছে।বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।দৃষ্টি আমার আকাশের দিকে।কিন্তু মন আমার কোন ভাবনায় আছে কে জানে।মহিনের মৃত্যুর আজ ছয়দিন চলছে।মহিন আমার স্বামী।এই তো বছর খানেক আগে আমাদের বিয়ে হয়।আমরা ক্লাসমেট। অনার্স কমপ্লিট করার পর পরিবারের সম্মতিতেই আমাদের বিয়েটা হয়।বাঘ হরিণকে হঠাৎ ধাওয়া করলে যেমন চমকে যায় এমন চমকে গেলাম আমি বজ্রপাতের শব্দে।অবশ্য আলোর ঝলকানিটা প্রথমে আমার মুখে লেগেছিল। খেয়াল করিনি।ধ্যানে মগ্ন যে!

-সুমনা।

আম্মার ডাকে পিছনে ফিরলাম আমি।ছেলের শোকে মহিলাটা অর্ধেক হয়ে গেছেন।চোখের নিচে কালো দাগ,চোয়াল গুলো ডেবে গেছে। আহারে স্বামীহীন এই একমাত্র ছেলেটাই তো তার ভরসা ছিল।

-জ্বি,আম্মা।
-জানালার পাশ থেকে সরে দাঁড়া। দিন ডাকছে।
-আম্মা।আকাশটাও মনে হয় আমার দুঃখে কাদঁবে।

আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম আমি।আম্মাও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিলেন।বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। প্রকৃতিও আজ আমার দুঃখে দুঃখী।

রাত ১২ টা বেজে ৫০ মিনিট।আম্মার পাশে শুয়ে আছি।মহিন মারা যাওয়ার পর থেকে আম্মার সাথেই ঘুমাই আমি।মহিনের লাশটা আমি আজো ভুলতে পারিনা।কি বিভৎস! চোখের সামনে ভাসে ছিন্ন মাথা,কত শত ক্ষত চিহ্ন! না,আর ভাবতে পারছিনা আমি।

মহিনের সাথে গত ছয়মাস ধরে আমার একটা বিষয়ে ঝামেলা চলছে। একটা ছেলেকে আমি রোজ রাতে স্বপ্ন দেখি।আমার ভাই শাওনের মতো।যে আমাকে বলে, “বুবু,ভাইয়া ভালো না রে।দেখনা আমাকে অন্ধকারে ফেলিয়ে গেছে”। আমরা এক ভাই এক বোন ছিলাম।শাওন আমার ছোট ভাই।হঠাৎ করে একদিন তার এক্সিডেন্ট হয়।আমার কলিজাটা মারা যায়।বাবার অঢেল সম্পত্তি আমাকে আর মহিনকে দিয়ে দেন। মূলত শাওনের ভাগটাই মহিন পায়।এই যে এখন যে ছয়তালা বাড়িটাতে আমরা আছি তাও তো আমার বাবার। মহিনের মোবাইলটা হাতে নিলাম।চলে এলাম বারান্দায়। শেষ বারের মতো প্লে করলাম রেকর্ডটা।

” তুমি। এই এসব কি করছো।জানপাখি মাথাটা ঠান্ডা করো।আমরা বসে কথা বলি।এই না প্লিজ আমাকে ছেড়ে দও।”

ঐখানে উপস্থিত ব্যাক্তিটির হাসির শব্দ ভাজছে।হা হা হা।

“ঠিক এইভাবে তো আমার ভাইটাও বাঁচার জন্য আকুতি মিনুতি করেছিল। ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার আগে ভাবলেনা একবারো।মা হারা ভাইটাকে সন্তানের মতো মানুষ করেছি আমি।”

মেয়েলি কন্ঠের মেয়েটার আর্তনাদ শোনা গেল।মনে হয় কেউ আচমকা আঘাত করেছে।

আবার মহিনের আওয়াজ, “তোর ভাইটারে তো শেষ করলাম এবার তুই শেষ হবি।”

কতক্ষণ নিরবতা।আচমকা আবার মহিনের আর্তনাদ। বাচাঁর আর্তনাদ।

ডিলিট করে দিলাম রেকর্ডটা।আম্মা ডাকছেন সুমনা সুমনা করে।চলে গেলাম ভিতরে। আম্মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলাম।মা হারা আমি অনেক আদর পেয়েছি আমার এই আম্মার কাছে।আজ একটা শান্তির ঘুম আসবে।মহিনের খুনটা একটা রহস্য।আমি করেছি কি?হঠাৎই অবচেতন মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে।

(সমাপ্ত)…

অনিন্দিতা : লেখিকা আনিকা রাইশা হৃদি

0

অনিন্দিতা
লেখিকা__আনিকা_রাইশা_হৃদি
#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১

২০০৬ সাল। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি একমাস হলো।ছোট থেকেই স্বপ্ন ডাক্তার হবো।ময়মনসিংহ শহরের ছোট একটি গ্রামে বসবাস আমার।এখানে থাকলে আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে বলে মনে হয় না।তাই বাবা পাঠিয়ে দিলেন ঢাকা।ছোট একটি গ্রামের মেয়ে আমি।আমাদের গ্রামের পরিবেশ ছিলো শান্ত, নির্জন।পাশদিয়ে বয়ে চলতো অবিরাম ব্রাহ্মপুত্র নদ।চারপাশে ধানক্ষেত, পাখির কলকাকলি। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যেতাম দূর, বহুদূর।রাতে ঝিঁঝিপোকার ডাক একটানা ভাঙা রেকর্ডারের মতো বাজতো।মাঝে আবার একটা কোলাব্যাঙও তাদের তাল দিতো।বলতো তোরা একা নেইরে আমিও আছি।নদীর পাড়ে বসে থাকতাম। যখন বক আসতো দৌড়ে যেতাম।তবে সাদা সাদা বকের দল উড়ে যেতো প্রাণপণে। শাপলা ফুল,কলমি ফুলের প্রতি লোভটা ছিল বরাবরই বেশি।সবার উঠার আগে সকালে উঠে গিয়ে নিয়ে আসতাম।ঐ যে নয়তো ওরা বেশি নিয়ে নিতো তো!

সেই আমি ঢাকা এসে যেন অকুল পাথারে পড়লাম।চারপাশে কোলাহল,ধূঁয়া, কাকের ডাক।এযেন পুরোই বিপরীত চিত্র। নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।মেসে থাকতাম।মেস থেকে কোচিং।কোচিং থেকে মেস আর পড়াশোনা এই আমার জীবন। মেসের মেয়েদের সাথে আমার তেমন সখ্যতা ছিলনা।মেয়েগুলো অতি আধুনিক ছিল। একদিন কোচিং থেকে এসে শুনলাম আমার রুমমেট চলে গেছে।নতুন একজন এসেছে।আমি আর রুমানা থাকতাম এক রুমে।মেয়েটা হ্যাংলাপাতলা রোগা গড়নের ছিল।তবে অতি আধুনিক। নতুন যে মেয়েটা এসেছে তার নাম অনিন্দিতা। হলদে সাদা গায়ের রং, মাঝারি উচ্চতা।আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়েছিল মেয়েটি।আমিও একটা হাসি ফেরত দিয়েছিলাম। আমার মতোই মেয়েটি কোচিং করতে ঢাকা এসেছে। অবাক হলাম তার বাড়িও নাকি ময়মনসিংহের মগটুলা।মানে আমরা একই গ্রামের।যাই হোক মেয়েটি খুব ভালো।তবে মেয়েটিকে আমার কেমন জানি রহস্যময়ী লাগতো।তার কিছু কার্যকলাপ এমন ছিল হাসতে হাসতে হঠাৎ নিরব হয়ে যেত।মাঝরাতে উঠে কান্না করতো।আমি ভাবতাম তার হয়তো অনেক দুঃখ। ইতিমধ্যে একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখি অনি আমার পাশে নেই।ও আমি তাকে অনি বলে ডাকতাম।আর ও আমাকে তিলোত্তমা না ডেকে তিলো ডাকতো।অনি দেখি উদাসমনে জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালাম।তার দৃষ্টি বাইরে।তবে বাইরে কুটকুটে আঁধার ছাড়া আমি আর কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না।থেকে থেকে হুতুম পেঁচা ডাকছে।অনেকটা অবাক হয়েছিলাম ঢাকার মতো শহরে হুতুম পেঁচার ডাক শুনে। অনি হঠাৎই বলে উঠলো,

-জীবনের মায়া বড়ো মায়া।এই মায়া কাটানো বড়ই মুশকিল। জীবন এক বড় জটলা। যতো এর রহস্য কাটাতে চাই ততো জড়িয়ে যাই।

এটা বলে হাসতে হাসতে আবার নিরব হয়ে গেল অনি।তার এই অদ্ভুত রূপ আমি যতোবার দেখতাম ততোবারই অবাক হতাম।এর মধ্যে এইচএসসির রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। তুলনামূলক ভালোই হয়েছে রেজাল্ট। ভাবলাম একবার বাড়ি যাবো কতদিন বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়না।এর মধ্যে একটা জিনিস কিছুদিন যাবত খেয়াল করলাম বিশেষ করে অনি আসার পর মেসের সবাই আমার দিকে কেমন করে তাকায়।আমাকে দেখলে কানাঘুষা করে।আমি অবশ্য বিশেষ পাত্তা দিতাম না।বাড়ি যাওয়ার দিন তো মেসের ইনচার্জ বলেই বসলেন আমি নাকি একা একাই কথা বলি।আমি যেন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাই নয়তো কোনো হুজুর। আমি অনেকটা হতভম্বের ন্যায় বাড়ি ফিরে আসলাম।চিরচেনা গ্রাম আমার।বাতাসে একটা চেনা গন্ধ। নদীর ছলছল আওয়াজ,সাদা বকের সারি।আহা সে কি দৃশ্য!সবুজ ধানক্ষেত গুলো দেখে চোখটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল।নিজের মাটির গন্ধ পেয়ে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এসেছে চোখ থেকে।বাড়িতে যাওয়ার পর বিকালে আম্মা যা বললো তা শোনার জন্য মোটেও আমি প্রস্তুত ছিলাম না।মগটুলা গ্রামের এক মেয়েকে নাকি কিছুদিন আগে দুইটা ছেলে মিলে ধর্ষণ করে জঙ্গলে ফেলে রেখে গিয়েছিল মৃত অবস্থায় । মেয়েটার নাম অনিন্দিতা। ছেলে গুলো আমাদের পাশের বাড়ির। তবে তাদের কোনো শাস্তি হয়নি।ঐ যে টাকা,ক্ষমতা। কেমন জানি ভয়,কষ্ট,রাগ মিলিত এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। মাঝরাত। চারিদিকে আজ ঝিঁঝিপোকারা ডাকছেনা। তারাও কি শোক পালন করছে?কুলো ব্যাঙটাও চুপ। আমি জানালার পাশে শুয়ে আছি।দুচোখে ঘুম নেই আমার।বাইরে চাঁদ উঠেছে। আলো ছড়াচ্ছে সর্বত্র। এমন সময় একটা দমকা হাওয়া কাঠের জানালাটাকে নাড়িয়ে দিলো।আমি অনেকটা হকচকিয়ে উঠলাম।এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে।আমি দরজাটা খুলে দিলাম।দেখি অনি দাড়িয়ে আছে।পড়নে তার সাদা শাড়ি।চাঁদের আলোয় খুবই স্নিগ্ধ লাগছে তাকে।সে এগিয়ে চললো সামনে।আমিও তার পিছনে যেতে লাগলাম।কখন যেন আমাদের পুকুর পেরিয়ে বাঁশবাগানে ঢুকে পরেছি নিজেই খেয়াল করিনি।আমি ছিলাম নির্বিকার। না কোনো ভয় না কোনো শঙ্কা। অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিলাম। বাঁশবাগানের শেষ মাথায় গিয়ে দেখি দুইটা লাশ পড়ে আছে।ঐ ছেলে দুইটার লাশ।কি বিভৎস! আমি ভয়ে ভয়ে অনির দিকে তাকালাম। অনি বললো,

-আমার সাথে যা হয়েছে তা আর কারো সাথে যেন না হয় সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।এদের নজরে তুই ছিলি পরবর্তী শিকার।ঢাকাও গিয়েছিল। এখন তুই নিরাপদ। আমি এদের শেষ করে দিয়েছি।

এই বলে সে চলে গেল আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। এক সময় মিলিয়ে গেল।আর আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। খুন কে করেছিল? অনি না আমি।

(সমাপ্ত)

হটাৎ এক বৃষ্টির দিনে পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ২১ #নওরীনের_জামাই
#নবনী_নীলা
আমাকে এতো পরিমাণে খাবার খাওয়ানো হচ্ছে যে নিজেকে আমার জলহস্তী মনে হচ্ছে। খেতে পারছি না জোর করে খাওয়াচ্ছে। এই নিয়ে অভির সাথে ঝগড়া শুরু করলাম।

” আমি বললাম না খাবো না। একটু আগে খেয়েছি তো।”, কাদো কাদো করে বললাম।

” একটু আগে মানে? দুঘন্টা আগে খেয়েছো এখন এই গ্লাস দুধ তুমি শেষ করবে।”,রাগী গলায় বললো অভি।

” আমার খিদে নেই। উফফ এমন করবেন না।”, ভ্রু কুঁচকে বললাম।

” তোমার খিদে না থাকতে পারে কিন্তু আমার বাচ্চার তো খিদে পেয়েছে। তোমার জন্য কি সে না খেয়ে থাকবে?”,বলেই গ্লাস হাতে আমার পাশে বসে পড়লো।

” আপনার বাচ্চা মানে?”,রেগে বললাম

” তোমার বাচ্চা হলে তুমি চুপ চাপ খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।”,বলে গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

আমি বিরক্তি সহকারে গ্লাস হাতে নিয়ে বললাম,” ছেলেরা কেনো যে প্রেগনেন্ট হয় না! হলে আপনাকে আমি বুঝাতাম।”

” ছেলেদের মধ্যে মেয়েদের মতো এতো সহ্য ক্ষমতা নেই। মেয়েরা যা সহ্য করে একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনতে একটা ছেলের পক্ষে এতো পেইন সহ্য করা অসম্ভব। ছেলেরা শুধু শক্তিতে এগিয়ে।”

” হয়েছে হয়েছে, এতো ভালো সাজতে হবে না।”, বলে মুখ ভেংচি কেটে গ্লাসটা শেষ করলাম।

অভি আমার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

এভাবে আদর যত্নে দেখতে দেখতে এক মাস, দুইমাস, তিন মাস, ছয় মাস কিছুদিন হলো নয় মাসে পা দিয়েছি। নিজেকে দেখে আমি নিজেও অবাক আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছি। পেট কতটুকু বড় হয়েছে সেটা দেখছি, আচ্ছা বেবী কি করছে বসে আছে নাকি ঘুমিয়ে আছে?অভী পিছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

“আচ্ছা বেবির কি নাম দিব?”, আমি অভির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই অভি আমার ঠোটে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,” হুম আমি ভেবেছি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না।” তারপর আমাকে এনে খাটে বসলো।

” আমিও অনেক নাম পড়েছি কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না।”, অভি আমার গাল হাত দিয়ে ধরে বললো,” আচ্ছা বেবী আসুক তারপর চিন্তা করবো, ঘুমাও এবার।”

” তাহলে আপনাকেও ঘুমাতে হবে।”, বললাম আমি। রাত সবে সরে এগারোটা ঘুম কি এখন আসবে? শুধু শুধু শুয়ে থাকা। একদিন শুয়ে থাকুক বুঝবে মজা। অভি না মুলুক কোনো কথা না বলে বলো,” আচ্ছা ঠিক আছে।”

উফফ জ্বালা! ভালো লাগে না শুয়ে থাকতে। অভি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এখন ভাল্লাগছে। আচ্ছা বাচ্চা কার মতো হবে? আমার মতো নাকি অভির মত হবে, বাচ্চার নাম এইসব ভেবে আমাদের সময় যাচ্ছে।

সেদিন খুব বৃষ্টি ছিলো হটাৎ বৃষ্টি। বৃষ্টি সাথে করে নাকি আনন্দ নিয়ে আসে। আনন্দ কিনা নওরীন জানে না,লেবার পেইন উঠেছে তার।
বেশি রাত হয়নি রাত তখন ১১টা।
অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অভি হুড়োহুড়ি করে গাড়ি বের করলো।
ব্যাথায় নওরীন হাটতে পর্যন্ত পারছেনা। নওরীনকে কোলে করে নিচে নিয়ে আসলো। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় জ্যাম, ব্যাথায় নওরীন চিৎকার করছে।
অভি কিছুক্ষণ জ্যাম ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করলো। নওরীনের হাত ধরে তাকে ভরসা দিলো। কিন্তু জ্যাম কমছে না।
অভি নওরীনকে রেখে বেরিয়ে গিয়ে যে ট্রাফিক পুলিশের সাথে কথা বলে কিছু বেবস্থা করবে অভি সেটাও পারছে না।
অভির নিজেকে অসহায় লাগছে। নওরীনের এমন সময় সে কিছুই করতে পারছে না। হাসপাতলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত বারোটা। নওরীনের শরীর নিস্তেজ হয়ে গেছে।
হাসপাতলে যাওয়ার পর নওরীনকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।

বাড়িতে ফোন করা হয়েছে অভির বোন, দুলাভাই আর নওরীনের বাবা মা আসছে। অভি অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে বসে আছে। অভির ভয় হচ্ছে, কিসের ভয় অভি জানে না। বৃষ্টি আরো জোরে শুরু হয়েছে। বৃষ্টির শব্দে এখণ অভির ভয়টা বাড়ছে। সময় যেনো কিছুতেই যেতে চাইছে না। অভি উঠে পায়চারি শুরু করেছে। অপারেশন থিয়েটার থেকে অনেক্ষন পর ডক্টর বেরিয়ে বললেন,” আপনি কি অভি আহমেদ? পেশেন্ট এর হাসবেন্ড?”

অভি ভয়াথ চেহারায় হা সূচক মাথা নাড়ল।
“congratulations আপনাদের একটা সুন্দর মেয়ে হয়েছে।”
অভির বুক থেকে যেনো ভার নেমে গেছে।কিন্তু পরক্ষনেই ডক্টর বললো,” তবে আপনার ওয়াইফের অনেক ব্লিডিং হয়েছে। আমাদের AB+ রক্তের খুব দরকার। Other wise”, বলে অভির কাধে হাত রাখলেন। অভির বুকটা কেঁপে উঠলো। অভির জানা মতে তার ফ্যামিলির সবার B+ রক্ত। এতো রাতে কোথায় সে রক্ত খুঁজবে।
অভি ছুটতে লাগলো পাগলের মতন,নিজের মেয়েকেও দেখলো না।

_____________________

রাত এখন সাড়ে বারোটা অভির কাছে ফ্ল্যাটের এক্সট্রা চাবি থাকায় সে কলিং বেল বাজলো না। হয়তো ওরা ঘুমিয়েছে, অভির প্রতিদিন এমন দেরি হচ্ছে। অভি অফিসের ব্যাগ সোফার পাশে গিয়ে রেখে নিজের রুমে এলো। আরিন কি ঘুমিয়ে আছে? দেখার জন্য রুমে এলো। অরিন নামটা নওরীনের রাখা। অভি তখন বলেছিলো এতো নাম থাকতে অরিন কেনো রাখবে?

এর পিছনে নওরীনের যুক্তি ছিল সে অভির অ আর নওরীনের রিন নিয়ে অরিন রেখেছে। অরিনের বয়স দুই বছর হলো।প্রতিদিন দেরি করে আসায় দেখা যায় অরিন ঘুমিয়ে গেছে। আজ বিপরীত হয়েছে অরিন জেগে আছে নিজের মনে খেলা করছে নিজের হাত দিয়ে।কিন্তু আজ নওরীন ঘুমিয়ে পরেছে।

সেদিন রাতের পর থেকে অভি ইমন নামের ছেলেটার কাছে ঋণী হয়ে আছে।
হাসপাতলে যখন রক্তের জন্যে ছুটাছুটি করেও রক্ত পায়নি তখন ইমনের সাথে দেখা ইমনের সাথে অভি কোনো কথা বলে নি।
যখন শেষমেশ রক্ত জোগাড় হয় ততক্ষনে দেরি হয়ে যায়। অভী যখন ব্যার্থ হয়ে চোখের পানি আটকে রাখতে পরছিলো না তখন নার্স বলে ইমন নামে এক ছেলে নওরীনকে রক্ত দিয়েছিলো।
ইমন হয়তো জানত নওরীনের প্রেগনেন্সির কথা অভিকে দেখে হয়তো তার বুঝতে বাকি রইলো না। ইমনকে ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগ অভি পায় নি। তারপর ইমন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। অভি যোগাযোগের চেষ্টা করে কিন্তু পায় না ইমনকে।

কি জানি কেনো হটাৎ সেই বৃষ্টির রাতে ফেরেস্তার মতন এসে অভির জীবনের আলোটুকু নিভতে দেয়নি ইমন। এই আলোটা হয়তো সে নিজের জন্যই জ্বালিয়েছে নিজের ভালোবাসার জন্য কিন্তু তাও অভি ঋণী রয়ে গেল।

অভি কাছে গিয়ে অরিনের খেলা দেখছে, মেয়েটা খুব শান্ত নওরীন তাকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে কিন্তু সে মায়ের ঘুম না ভাগিয়ে নিজের মনে খেলছে।অভিকে দেখে বাবা বলে উঠলো অরিন। বাবার সাথে তার দেখা হয় খুব কম। অফিসের কাজে ফিরতে রাত হয় আবার সকালে তাড়াতাড়ি যেতে হয়। অভি নওরীনের গায়ে কাথা তুলে দিয়ে ইশারায় অরিনকে চুপ করতে বললো। তারপর নওরীনের ঘুম না ভাঙিয়ে অরিনকে কোলে তুলে নিলো। বাবা মেয়ে অনেক্ষন খেললো। অরিন চোখ বন্ধ করে আবার খুলে খুলে অভিকে দেখে হাসতে থাকে তারপর আবার চোখ বন্ধ করে।

অভি মুগ্ধ হয়ে অরিনের খেলা দেখছে। খেলতে খেলতে অভির কোলে অরিন ঘুমিয়ে পড়েছে। অভি অরিনকে নওরীনের পাশে শুইয়ে দিলো। অভি মুগ্ধ হয়ে নিজের বউ আর মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

অভি সাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে দেখে নওরীনের ঘুম ভেঙেছে সে খাবার টেবিলে বসে অভির জন্যে অপেক্ষা করছে। নওরীনের মাঝে মাচুরিটি এসেছে সে এখন আর নিজেকে বিপদে ফেলে না কারন সে জানে তার বিপদ মানে অভি আর অরিনের বিপদ। তবে নওরীনের বাচ্চামিগুলো অভী মিস করে। খাওয়া শেষ করে অভি রুমে গিয়ে বসে নওরীনের দিকে তাকিয়ে আছে।

নওরীন বললো,” আপনি ঘুমাবেন না?”
অভি না সূচক মাথা নাড়ল। নওরীন চিন্তিত হয়ে বললো,” কেনো? মাথা ব্যাথা করছে?”

অভি ইশারায় নওরীনকে নিজের কাছে ডাকলো। নওরীন এসে পাশে বসতে নিলো অভি নওরীনের হাত ধরে টেনে নিজের কোলে বসালো।

” আরে আপনি কি করছেন? অরিন ঘুমিয়ে আছে না। উঠে পড়লে?”, নওরীন বিস্ময় নিয়ে বললো।

অভি নওরীনের বাধা চুল খুলে দিয়ে বললো,” উঠবে না, কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছে। এটা না তোমার জায়গা ছিলো এখন বুঝি আর আমার কোলে বসতে ইচ্ছে করে না?”

নওরীন হেসে বললো,” আপনার তো কোলে খেলার মতন মেয়ে আছে, ভুলে যাবেন না। আর জনাব আপনার কাছে সময় আছে আমার জন্য?”

” ঠিক আছে মানছি আমি busy but সময় না দিলে সময় আদায় করে নিতে পারো না?”

” কি হয়েছে আপনার? ঠিক আছে?”নওরীন অবাক হয় বললো অভির কথায় সে হতবাক।

অভি নওরীনের প্রশ্ন উপেক্ষা করে বললো,” তুমি আমাকে ওই নামে ডাকো না কেনো? আমি মিস করি।”

নওরীন কিছুক্ষণ হতভম্বের মতন তাকিয়ে থেকে মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,” কোনটা নওরীনের জামাই? এখন ওই নামে ডাকলে অরিনও পরে বাবা না ডেকে বলবে নওরীনের জামাই। কেমন হবে ভাবুন।”

” ওর সামনে ডাকতে বলেছে কে?”, অভির কথায় নওরীনের অভিকে কিউট লাগছে কিন্তু যদিও অভির সাথে কিউট শব্দটা যায় না।

নওরীন অভির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো,” আচ্ছা নওরীনের জামাই এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। কালকে অফিসে আছে না।”

অভি নওরীনকে কোলে তুলে নিলো। নওরীন অবাক হয় বললো,” কি করছেন?”
অভি বললো,” কাল আমি অফিসে যাবো না।”
” কেনো? আর আমাকে কোলে নিয়েছেন কেনো?”, বলে শেষ না করতে অভি নওরীনকে চুপ করতে বলে নইলে অরিনের ঘুম ভেঙে যাবে। নওরীন চুপ করে অভির কোলে থেকে অভির কান্ড দেখছে। অভি নওরীনকে নিয়ে অন্য রুমে এসে নওরীনকে শুইয়ে দিলো। অভি কি করতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে নওরীন লাফ মেরে উঠে বসলো।

” কি করেছেন? মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?অরিন একা ওই রুমে।”,বলতেই অভি নওরীনের কাছে আসতে লাগলো।তারপর বললো,” অরিন ঘুমচ্ছে। আমার মেয়ে যথেষ্ট ভদ্র সে তার বাবা মায়ের রোমান্সে বাধা দিবে না।”

” আপনি এইগুলো কি বলছেন? লজ্জা করছে না?”, নওরীন মুখ ঘুড়িয়ে বললো।

” না একদম না। লজ্জা যে করছে না সেটা এক্ষুণি বুঝবে।”,বলে অভি নওরীনের মুখ হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নওরীনের ঠোঁটে কিস করলো।

[ সমাপ্ত ]

হটাৎ এক বৃষ্টির দিনে পর্ব-১৯+২০

0

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ১৯ #বেচারা_অভি
#নবনী_নীলা
আমি অভিকে ডাকলাম,
” নওরীনের জামাই ও নওরীনের জামাই।”আমার ডাকে এবার অভী চমকালো না। সে বুঝতে পেরেছে এটা আমি।

অভী ফোন হাতে আমার দিকে এলো,” কি হয়েছে কিছু লাগবে?”প্রশ্ন করতেই আমি দরজার ওপাশ থেকে মুখ বের করে হা সূচক মাথা নেড়ে বললাম,” আমাকে আপনার একটা শার্ট আর ট্রাউজার দেন।”

অভী ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,” কেনো? আমার শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে তুমি কি করবে?”

এমনেই এনার উপর মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আবার এতো প্রশ্ন, আমি বললাম,” আপনার শার্ট আর ট্রাউজার দিয়ে আমি বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে উড়াবো। এতো প্রশ্ন করবেন না তাড়াতাড়ি দিন।”

অভি মুখ ভার করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,” আগে বলবে না হলে আমি দিবো না।”

” দিবেন না মানে দিতেই হবে। আমাকে যে তুলে আনলেন এবার আমি কি পড়বো আমার জামা কাপড় কিছু এনেছেন?”, দরজার ওপাশ থেকে মুখ বের করে বলে আবার মুখ ঢুকিয়ে নিলাম।

” তার মানে কি তুমি তোমার সব জামা কাপড় নিয়ে চলে গেছো? তুমি জামা কাপড় নিয়ে গেছো, তোমার দোষ এখন জামা কাপড় ছাড়া থাকো। Stupid.”, বলে নিজের জামা কাপড় খুঁজতে লাগলো অভি।

” শুধু দুটো জামা চেয়েছি বলে এতো কথা শুনলেন।লাগবে না আপনার জামা আমি এই ভেজা জামা কাপড় পড়ে থাকতে পারবো।”, বলতে বলতে অভি জামা এনে আমার দরজার কাছে ধরে,” এই নেও।”

আমি বললাম,” না নিবো না। লাগবে না আমার।”

” নওরীন তুমি কি চাও আমি ভিতরে আসি? চুপ চাপ এইগুলো পরে বেরিয়ে এসো।”, অভির কথা আমি হাত বাড়িয়ে কাপড় নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।

কিন্তু এটা কি! অভি আমাকে একটা কালো রঙের শার্ট আর একটা প্যান্ট দিয়েছে কিন্তু প্যান্টটা শর্ট ট্রাউজার মনে হচ্ছে। প্যান্টটা আমার হাঁটু আর গোড়ালির মাঝা মাঝি হয়েছে। শার্টের হাতা কোনো রকম ভাজ করে রাখলাম। নিজেকে আমার গোপাল ভাঁড়ের মতন লাগছে খালি ওনার মাথা বড়ো আর মোটা আমারটা স্বাভাবিক।

আমাকে দেখে অভি নিজের হাসি চাপানোর চেষ্টা করছে। ওনার জন্য আমার এমন অবস্থা উনি আবার হাসে। আমি রেগে বললাম,”একদম হাসবেন না। আপনার জন্য হয়েছে সব।”

” শিক্ষা হওয়া উচিত তোমার। Stupid”, বলে অভি নিজের ল্যাপটপ খুলে কাজ করছে।

আমি কিচেনে গেলাম,গিয়ে দেখি পোড়া ছাই গুলো। আমি সেগুলো পরিষ্কার করতে লাগলাম অথৈ নিজেও জানে না সে কি হারিয়েছে।আচ্ছা অথৈ যখন আগে থেকেই জানত নিজের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়েছিল অন্য ছেলের সাথে, তারপরও অভির সাথে সম্পর্ক রাখলো কেনো? অথৈ মেয়েটা একসাথে দুইটা ছেলেকে চিট করেছে।

আম্মু বলেছিলো সব জানতে পেরে অথৈয়ের ফিয়ান্সে বিয়ে ভেঙে দেয় এবং অভিকে থ্রেড দিয়ে যায়। অথৈ যে অভিকে চীট করছিল সেদিন অথৈয়ের ফিয়েন্স থেকে অভি জানতে পারে।

ড্রয়ারে থাকা এই ছবি, অংটি এইগুলো দেখে তো আমি মনে করেছিলাম অভি এখনও অথৈকে ভালোবাসে তাই এগুলো রেখে দিয়েছে। তাই ওদের মাঝে ফিরতে চাইনি।
ডাইনিটা এতো শয়তান আমার জানা ছিলো না। আমি এতো বলদ কেনো? ছাই গুলো তুলে ডাস্টবিনে ফেলতেই দেখি অভি এসে দাঁড়িয়ে আছে।

” কি করছো তুমি?”

” আপনি যে অকাজ করে ঘর নষ্ট করেছেন সেটাই পরিষ্কার করছি।”, সিঙ্কে হাত ধুতে ধুতে বললাম।

” Don’t you think এটা তোমার করা উচিৎ ছিলো?”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল অভি।

” আপনি এতো যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন দেখে কিছু করিনি।’,একটু খোঁচা মেরে বললাম।

” এইগুলো যে আমার কাছে ছিলো আমার নিজেরই জানা ছিলো না।Now just end the topic here।”, বলে গ্লাসে পানি ঢাললো অভি।

” আচ্ছা আমি এইগুলো পরে কতক্ষণ থাকবো?”

–” কেনো খারাপ না তো ছোটখাটো একটা অপুষ্টিতে ভোগা পান্ডা লাগছে।”, বলে অভি ঠোঁট চেপে হাসলো।

আমি তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে খাবার ওভেনে গরম করতে দিলাম।আমার কিছু রান্না করতে হয়নি অভি বাহির থেকে খাবার অর্ডার করেছে।
আমাকে পান্ডা বললো কেনো?আমি কি মোটা হয়ে গেছি! নাকি মজা করে বললো। আমি ভাবতে লাগলাম আমার হুশ ফিরল আমার ঘাড়ে অভির ঠোঁটের স্পর্শে। এর জন্য দেখি খোপা করেও শান্তি নেই।

আমি পিছনে ফিরে অভির বুকে একটা ঘুষি মেরে বললাম,” কি করছেন আপনি ? সরুন গিয়ে চুপ চাপ খাবার টেবিলে বসুন।”

অভি মাথা কাত করে বললো,” ওকে ম্যাডাম।”

বাহ্ কি উন্নতি। একবার বলায় কাজ হয়েছে। কি সুন্দর গিয়ে চুপ চাপ বসে পড়লো।আমি খাবার অভির সামনে বেড়ে দিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসলাম অভি খাচ্ছে না বসে আছে।

” কি ব্যাপার আপনি খাচ্ছেন না কেনো?”, আমি প্রশ্ন করলাম।

অভি আমাকে নিজের হাত দেখিয়ে বললো,”খাইয়ে দেও।”

“খাইয়ে দিবো মানে? দাড়ান চামচ এনে দিচ্ছি,” বলে আমি উঠে যেতেই অভি হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বললো,” স্বামীর সেবা করলে সাওয়াব হয়। আর আমার হাতের এ অবস্থা তোমার জন্য হয়েছে , আমি কেনো চামচ দিয়ে খাবো?”

আমি যেনো বলেছি ওনাকে দেওয়ালে ঘুষি মেরে হাত ছিলতে।আমি আর কিছু বললাম না। আমাকে খাইয়ে দিতে হচ্ছে। অভি এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, আমি তাকাতেও পারছি না। এতো মনযোগ দিয়ে কি দেখছে।

” আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”, বললাম আমি।

” আমার ইচ্ছে।”,অভির উত্তরে আমি বললাম,” আপনি হয় চোখ বন্ধ করুন নইলে অন্য দিকে তাকান। আমি নয়তো আপনাকে খাইয়ে দিবো না।” বলে আমি সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

অভি মুখ কাত করে আমার দিকে ঘুরিয়ে বলে,” কেনো তোমার কি লজ্জা লাগছে? কান দেখি লাল হয়ে আছে।”

আমি কিছু বললাম না, না সূচক মাথা নাড়লাম। আরে লজ্জা পেলে আমার কান লাল হয় উনি এটাও যানে।

অভি মাথা সোজা করে বললো,” বউ বিয়ে করেছি নাকি লজ্জাবতী গাছ। কিস করতে পারিনা চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, তাকিয়ে থাকতে পারিনা কান লাল হয়ে যায়। এতো মহা মুশকিল।” বলে ঠোঁট টিপে হাসছে।

অভির কথায় আমি উঠে চলে যেতে নেই। অভী আমাকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে বললো,” এতো লজ্জা পেলে আমি বাবা হবো কি করে?শেষমেশ ফুফুর হুজুরের ওষুধ নিতে হবে, তাই না।”

অভির কোথায় আমি লজ্জায় হাসি ঠোঁট কামড়ে আটকে অভির কাধে মুখ লুকিয়ে ফেললাম। অভি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও হাসছে।

—-
খাওয়া শেষে অভি নিজের রুমে কি জানি করছে এখন রাত সাড়ে বারোটা আমি সোফায় বসে মুভি দেখছিলাম। অভি কাজ শেষে ড্রইং রুমে এসে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” তোমার আবার শুরু হয়ে গেছে?”

আমি অভিকে বললাম,” বসুন না। এই মুভিটা অনেক সুন্দর।”

অভি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে আমার হাত ধরে আমাকে উঠতে বললো,” নওরীন উঠো। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবে এসো।”

” না, না প্লীজ আরেকটু বাকি আছে। একটু পর শেষ। শেষ পর্যন্ত না দেখলে আমার রাতে ঘুম আসবে না।”, রিকোয়েস্ট করে অভিকে আমার পাশে বসলাম। অভি বিরক্তির চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

” তোমার ঐ আগের ড্রামা দেখা শেষ? এটা আবার কি?”,বলে অভি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো।

” আরে টার্কিশ ড্রামা ঐটা তো অনেক জোস। কিন্তু ভালো জিনিস অল্প অল্প করে দেখতে হয়। একসাথে সব দেখলে শেষ হয়ে যাবে তাই মাঝে মাঝে দেখি। এইটার নাম “our time” এটাও অনেক সুন্দর”, বললাম আমি।

আমার কর্ম কাণ্ডে অভি বিরক্ত নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।ছবি শেষ হলো কিছুক্ষণ পর অভি নওরীনের দিকে তাকিয়ে দেখে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পরছে।

অভি অবাক হয়ে নওরীনের কাছে এলো,” হ্যাপি এন্ডিং হয়েছে তুমি আবার কান্না করছো কেনো?”

নওরীন ফুফাতে ফুফাতে বললো,” আপনি কি করে বুঝবেন প্রথম থেকে আপনি কি দেখেছেন?”

অসহায়ের মতো অভি না সূচক মাথা নাড়ল।

নওরীন বললো,” জানেন ছেলেটা অনেক ভালো স্টুডেন্ট ছিল কিন্তু ওর বেস্ট ফ্রেন্ড পানিতে ডুবে মারা যায় ওর সামনে আর ও চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারে না তাই নিজেকে দোষীভাবে।তাই ছেলেটা পড়া লেখা ছেরে গুন্ডা টাইপ হয়ে যায়। ছেলেটা একদিন একটা লেটার পায় একটা মেয়ে থেকে তারপর ছেলেটার অ্যাকসিডেন্ট হয়।
তাই যেই মেয়েটা লেটার দিয়েছে ওই মেয়েকে খুজে বের করে। মেয়েটা ছিলো খুব বোকা। মেয়েটাকে বুলি করতে করতে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ছেলেটাও ভালো হয়ে উঠে।
ওরা ভালোবেসে ফেলে কিন্তু বলে না।
মেয়েটার জন্মদিনের দিন ওর প্রিয় সিঙ্গার এর ফটোস্টান্ড নিয়ে ওকে সারপ্রাইজ দিতে যায় গুন্ডারা ওকে মারে কিন্তু মেয়েটাকে প্রমিজ করায় ছেলেটা মার সহ্য করে তারপর জানেন কি হয়?”বলে নওরীন কাদতেঁ লাগলো।

অভি ভ্রু কুঁচকে বললো,” ছেলেটা মরে যায়?”

” না…., তারপর ছেলেটার ব্রেইনে একটা সমস্যা হয়।”,নওরীনের কথার মাঝে অভি মজা করে বললো,” আচ্ছা সব ভুলে যায় মাথায় বাড়ি খেয়ে? টেম্পোরারি মেমোরি লস?”

” না…, আপনি শুনুন তারপর ছেলেটাকে বিদেশে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করতে হয় যাওয়ার আগে ছেলেটা একটা টেপে নিজের কিছু কথা রেকর্ড করে রেখে যায়। সেখানে ছেলেটা বলে (মেয়েটার নাম ট্রুলী থাকে) ট্রুলি তুমি যদি আমাকে মিস করো তাহলে ঐ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো কারণ আমিও ওই একি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি।”,বলে নিজের চোখের পানি মুছতে লাগলো।

” What! ছেড়ে চলে গিয়ে বলছে মিস করলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকো কারণ আমিও তাকিয়ে আছি। How lame!”, বলেই বুঝতে পারলো এইটা বলা ঠিক হয়নি।
নওরীন বিস্ময় নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে আছে।অভী নওরীনকে তুলে দারকরে টিভি বন্ধ করে বললো,”I mean technically lame but the line has emotion.” নিজের মুখে কোনোদিন এইগুলো বলবে অভি নিজেও ভাবেনি।

নওরীন কান্না করছে না এখন কিন্তু বললো,” জানেন পরে ওদের দেখা হয়।”

অভি হাই তুলতে তুলতে বললো,”চলো ঘুমাতে যাই ঘুমাতে ঘুমাতে শুনবো।”
অভির কথায় নওরীন হেসে বললো আচ্ছা। যাক মেয়েটা হেসেছে এইটাই অনেক অভির জন্য।

[ চলবে ]

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ২০ #মেরুন_রঙের_শাড়ি
#নবনী_নীলা
কয়েকদিন হলো কিছুই খেতে পারছি না।খেলেই বমি করে দেই। অর্পা আপু কিছুদিন ছিলেন আমাদের সাথে এদিকে একটা কাজে কিছুদিন থাকতে হয়েছিলো আজ আপু চলে যাবেন। আমার এমন অবস্থার কথা আমি অভিকে বলিনি তবে আপু জানে।

যাওয়ার আগে আপু আমাকে বললেন,” নওরীন শুনো,তুমি টেস্ট করিয়ে ফেলো। I hope good news are coming।”

আপুর কথায় আমার মনেও সন্দেহ হচ্ছে। তাই আমি সত্যি সত্যি টেস্ট করিয়ে নিলাম। প্রথমে দোকান থেকে প্রেগনেন্সি কিট আনলাম সেগুলোয় পজিটিভ এসেছে। কিন্তু এইগুলো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এখন কাউকে বলা যাবে না অভিকেও না। কালকে একবার ডক্টরের কাছে যেতে হবে।
আমি স্বাভাবিক ভাবে ওয়াশরুম থেকে বের হলাম কিন্তু মুখের হাসি লুকাতে পারছি। যদি আমি এখনও বিশ্বাস করিনি তবুও ভাবতে ভালো লাগছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি অনেক আদর নিয়ে নিজের পেটে হাত রাখলাম।

“তোমার কি পেট ব্যাথা করছে?”, অভির কথায় চমকে আমি হাত নামিয়ে না সূচক মাথা
নাড়লাম।

” তোমার চোখে মুখে এতো উচ্ছাস কিসের? “, খাটে বসে এক হাতে ফোন ধরে বললো।
আমি অভির পাশে গিয়ে বসলাম আর বললাম,”আজ একটা কান্ড ঘটেছে।”

অভি ল্যাপটপ অন করতে করতে বলল,” কি হয়েছে?”

মায়ের বাসা থেকে আমি আমার পুরনো সব বই নিয়ে এসেছিলাম। আজ সকালে সেগুলো ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে একটা বই চোখে পড়ে বইটা ইমনের দেওয়া 1st ইয়ার এ আমার জন্মদিনে দিয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদের লেখা বইটার নাম,” মৃন্ময়ীর মন ভালো নেই।” এই বই আমার পড়া হয়নি।

এনে যে কোথায় রেখেছিলাম মনেও ছিল না। আমি আগ্রহ নিয়ে বইটা খুললাম। খুলতে গিয়ে বই থেকে একটা কাগজ পড়লো কাগজ খুলে দেখি একটা চিঠি। চিঠি বললে ভুল হবে প্রেমপত্র। ইমন যে আমাকে ভালোবাসতো ওর আচরণে সেটা কখনোই বুঝতে দেয় নি। চিঠি পরে আমি নিজেও কিছুক্ষণ অবাক ছিলাম। ভালই হয়েছে আগে দেখিনি তাহলে হয়তো অভি আমার জীবনে আসতো না। হয়তো আমার সাথে অভির ভাগ্য জুড়ে ছিলো বলেও চিঠিটা আমি পাইনি।
খুব সুন্দর করে লেখা চিঠি যে মেয়ে পড়বে সে না দেখেই প্রেমে পড়ে যাবে। অভিকে সেটার কথাই বলবো।

” জানেন আজকে আমি আমার জীবনের প্রথম প্রেম পত্র পেয়েছি।”, আমার কথা শুনে অভি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।এটাই তো দেখতে চাই।

অভি বিস্ময় কাটিয়ে বললো,” মানে?”যদিও এখনও অভির চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।

আমি বললাম,” পুরনো বই খাতা ঘটতে গিয়ে পেয়েছি।”

” তা কে লিখেছে?”, গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলো অভি।

” ইমন।”,আমার কথায় অভি তাকিয়ে আছে।আমি বললাম,” অবাক হয়েছেন না? আমিও হয়েছি।”

অভি গম্ভীর গলায় বললো,” কোথায় সেই চিঠি?”
আমি বললাম,” যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তবে আপনি চাইলে শেষ লেখাটা বলতে পারি।বলবো?”

অভী মুখ ভার করে আছে বুঝতে চাচ্ছে এইসবে অভির কিছু যায় আসে না কিন্তু আমি ঠিক বুঝেছি অভি আমার যেই ডাইরি পড়েছিল সেখানে এক পাতায় আমি লিখেছিলাম;

“ভালোবাসি কথাটা সবাই মুখে বলে, আজকাল তার ও প্রয়োজন নেই সোসায়াল মিডিয়া আছে আরো আধুনিক। আমার বন্ধুরা বলে আমি প্রেম করিনা কেনো? আমি বলেছি যদি কেউ আমাকে চিঠি লিখে ভালবাসা প্রকাশ করে সেদিন প্রেম করবো।”

অভি সেটা পরেছে তাই তার মুখ আরো শুকিয়ে গেছে।অভিকে আরেকটু রাগিয়ে দেই। আমি অভিকে চিঠির শেষের কিছু লাইন বলতে চাইলাম অভি শুনতে চাইল না সে রেগে আছে।

” নওরীন আমাকে কাজ করতে দেও। এইগুলো পরে শুনা যাবে।”,বলে ল্যাপটপে কি করছে। হাতের কাছে পেলে হয়তো চিঠি কুচি কুচি করে রাগ কমতো।

আমি বললাম,” ল্যাপটপ সরান কোল থেকে।”
গম্ভীর মুখে বললো,” কেনো?”

” আপনি সারাদিন ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে থাকেন কেনো? ওটা আমার জায়গা, আমি বসবো। ল্যাপটপ কেও দেখি আমার সতীন বনিয়ে ফেলেছেন।”

বলে আমি ল্যাপটপ নিয়ে দূরে রেখে এসে অভির কোলে বসে পড়লাম। অভি হাত ভাজ করে বসে আছে। বেচারার রাগ হচ্ছে কিন্তু রাগ দেখাতেও পারছে না।
শেষে আর রাগ ধরে না রাখতে পেরে বললো,” যাও যত্ন করে রাখা প্রথম প্রেমপত্র পরো। আমাকে কি দরকার? আমাকে কাজ করতে দেও।”

আমি অভির হাতের ভাজ খোলার চেষ্টা আছি। শক্ত করে বসে আছে। প্রচন্ড রেগে গেছে মনে হয়।” আপনাকেই আমার দরকার। হাত খুলুন না। এতো জেলাস হলে কি করে হবে?”বললাম।

” আমি যেনো ইমনের সঙ্গে তোমাকে আর না দেখি। ওর সাথে তুমি কথা বলবে না ফোনেও না।”,দেখে মনে হচ্ছে রেগে এক্কেবারে শেষ।

আমি কিছু বললাম না। রাগ ভাঙ্গাবো কিভাবে সেটাই বুঝতে পারছি না।” আরে জামাই রাগ করেন কেনো? এতো রাগ স্বাস্থের জন্য ভালো না।”

” নওরীন আমি কিন্তু মজার মুডে নেই।”,বলে অন্যদিকে তাকালো অভী।

আমি অনেক কষ্টে হাতের ভাজ খুলে অভির বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।কিন্তু অভির রাগ কমেছে বলে মনে হয় না।আমাকে জড়িয়ে ধরলো না। আমি মুখ তুলে অভির দিকে তাকালাম। রাগ করে আছে কেনো ভাল্লাগছে না। যদিও আমি নিজেই রাগিয়েছি। আমি অভির দিকে তাকিয়ে আছি। হাত দিয়ে অভির চোখ থেকে চশমা খুলে পাশের টেবিলে রাখলাম। অভি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।
অভিকে চমকে দিয়ে আমি অভির গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম। পুরো ঘটনাটা ঘটলো একটা ঘোরের মাঝে।আমি বুঝতে পেরে চোখ বড় বড় করে ফেলি।কিছু বুঝতে না পেরে উঠে যেতেই অভি আমার কোমর জড়িয়ে আমাকে কাছে নিয়ে এলো। নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছি কি আর করার? অভি একহাত দিয়ে আমার গাল স্পর্শ করে আমাকে গভীরভাবে কিস করল।অন্য হাতে আমার জামার পিঠের চেইন খুলে দিতেই আমার শরীর বরফ হয়ে গেল।

___________________

আমি আজ ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেছি, চেকআপ করে তিনি বলেছেন আমি প্রেগনেন্ট। এ কেমন আনন্দ আমি জানি না। অভিকে সারপ্রাইজ দিবো।খবর শুনে নিশ্চই সে অনেক খুশি হবে। আমি বাসায় এসে খুব সুন্দর করে সব কিছু ঘুছিয়ে রাখলাম। অনেক সময় নিয়ে গোসল করলাম। বার বার শুধু আলট্রাসোগ্রামটা দেখছি কত ছোট, এক মাস হয়েছে মাত্র।
আমি কাউকে বলিনি সবার আগে অভিকে বলবো। কিন্তু সে কখন আসবে?

আমি ড্রয়ার খুলে সেই মেরুন রঙের শাড়িটা বের করে পড়লাম। অভির দেওয়া প্রথম শাড়ি অন্য সব শাড়ি পড়েছি কিন্তু এটা পড়িনি ইচ্ছে ছিলো খুব আনন্দের একটা দিনে এটা পড়বো।
আজকের চেয়ে আনন্দের দিন আমার জীবনে নেই।

অভি এলো রাত ৮টায় প্রতিদিন ৭টায় আসে কিন্তু আজ একটু দেরি হয়েছে।নওরীন সেজে বসে আছে। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে নওরীন একটা কাপড়ের টুকরা এনে দরজা অল্প খুলে অভির দিকে কাপড়ের টুকরা বাড়িয়ে দিল। নওরীন মুখ বের করলো না। অভি নওরীনের কাণ্ডে এখন আর অবাক হয় না, সব স্বাভাবিক মনে হয়। উল্টা পাল্টা কাজ না করলে অস্বাভাবিক লাগে।

অভি ভ্রু কুঁচকে বললো,” কি এটা?”
নওরীন ভিতর থেকে বললো,” এটা চোখে বাধুন।”
অভি কিছু বুঝতে না পেরে বললো,” কেনো? চোখে বাঁধবো কেনো?”
” আহা ! বাঁধতে বলেছি বাধুন।”, নওরীনের কথায় উপায় না পেয়ে অভি কাপড় দিয়ে নিজের চোখ বাধল নইলে হয়তো ভিতরেই যেতে দিবে না।
অভি চোখ বেধে বললো,” হুম , করেছি।”
নওরীন দরজা পুরো খুললো।তারপর প্রথমে অভি ঠিক করে চোখ বেধেছে কিনা দেখে অভিকে ভিতরে আনল।

“নওরীন কি শুরু করলে তুমি?”, ন্ওরিন অভিকে চুপ করে থাকতে বলে হাত ধরে টেনে করিডোরে নিয়ে গিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিল। অভী অবাক হয়েছে কারণ করিডর খুব সুন্দর করে সাজানো বিভিন্ন রঙের বাতি জ্বলছে তার মাঝে এক সারিতে কিছু মোমবাতি অপূর্ব লাগছে। অভি নওরীনের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ মেরুন রঙের শাড়িটাতে অসাধারণ লাগছে তাকে। অভি হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” আজকে কি কিছু স্পেশাল?”

” শুধু স্পেশাল না অনেক স্পেশাল।”,বলে নওরীন একটা টেডি বিয়ার অভির কোলে দিলো।

অভি টেডি বিয়ারের দিকে তাঁকিয়ে বললো,” এটা কি?”

” বলবো না।”, নওরীন চলে যেতেই অভি নওরীনকে জড়িয়ে কাছে নিয়ে এলো।

” মনে হচ্ছে তুমি অনেক খুশি। কি হয়েছে ? বলো।”, অভির প্রশ্নে নওরীন বললো,”কেউ আসবে।”

অভি অবাক হয়ে বললো,” কে আসবে ? এখন আসবে?”

” না, নয় দশ মাস পর আসবে।”, নওরীনের কথায় অভি বুঝলো না সে বললো,” মানে।”

নওরীন টেডি বিয়ার কে দেখিয়ে হাসলো। অভি চোখ বড় করে ফেললো বিস্ময়,আনন্দ সব একসাথে তার চেহারায় ফুটে উঠেছে অভি বললো,” Are you pregnant?”

নওরীন হা সূচক মাথা নাড়ল। অভি খুশিতে নওরীনকে কোলে তুলে নিলো। কিছুক্ষণ পর বললো,” I’m going to be a dad! I can’t believe.”

অভির খুশী দেখে নওরীন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কতো সুন্দর একটা সময়ের মধ্যে দিয়েই না তারা যাচ্ছে।

[ চলবে ]

হটাৎ এক বৃষ্টির দিনে পর্ব-১৬+১৭+১৮

0

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ১৬ #ভালোবাসায়_দূরত্ব
#নবনী_নীলা
“উঠো এবার নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেও।”অভির কথায় আমি বিস্ময় নিয়ে তাকালাম।”আমি কেনো ব্যাগ গোছাবো? ব্যাগ গুছিয়ে আমি করবোটা কি? ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবো?”,ভ্রু কুঁচকে বললাম আমি।

“তোমাকে তোমার মার কাছে রেখে আসবো। আমি না আসা পর্যন্ত তুমি সেখানেই থাকবে।”

একটুর জন্য ভেবেছিলাম আমাকে সঙ্গে নিয়ে
যাবে তাই ব্যাগ গুছাতে বললো কিন্তু না আমাকে নাকি মার কাছে রেখে আসবে।
আমি কেনো মার কাছে থাকতে যাবো?আমি কি বাচ্চা একা একা থাকতে পারবো না।

” না আমি মার কাছে যাবো না। “, হাত ছাড়িয়ে বললাম।

” ঠিক আছে তাহলে আমি মাকে বলে দিচ্ছি মা এসে এ কয়েকদিন তোমার সাথে থাকবে।”,বলে অভি নিজের সুটকেসের দিকে গেলো।

” আম্মুকে কেনো বলবেন ? উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন জার্নি করলে। আমি একা থাকতে পারবো আপনার এতো ভাবতে হবে না।”, অভি কিছু বলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো।

আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখি ইমন এসে হাজির। এখন সকাল ১১ বাজে এমন সময় ইমনের এখানে আসার কারণ কি? আমি ইমনকে ভিতরে আসতে বললাম। ইমন এসে সোফায় বসলো। কে এসেছে সেটা দেখতে রুমের বাহিরে এসে ইমনকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো।

আমি অভির দিকে তাকিয়ে বললাম,” আমার ফ্রেন্ড ইমন।”

অভির মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে, এখানে গোমড়া মুখ বানানোর কারণ ঠিক বুঝলাম না। ইমন উঠে গিয়ে অভির সাথে হ্যান্ডশেক করলো।অভি থমথমে গলায় কথা বলে রুমে চলে গেল। আমার ফ্রেন্ড কোথায় ভালো করে কথা বলবে তা না উনি ঢং করছেন। আমি ইমনের সামনের সোফায় বসলাম।

” তুই আমার বাসার ঠিকানা পেলি কোথায়?”, আমি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম।

– “অবাক হয়েছিস তাই না? তোকে আমি অনেকবার ফোন করলাম কিন্তু তুই তো মঙ্গল গ্রহে ফোন ফেলে রাখিস।”

-” আমি জানি না! ফোনের কথা মাঝে মাঝে ভুলেই যাই।”

–” আচ্ছা যে কারণে আসা। আজকে কতো তারিখ আজকে অ্যাসাইনমেন্টের ডেট। আজকেও নিশ্চয় তোর মনে নেই। ”

–” আয় হায় ! আমার কি হবে ?আমি এবার কি করবো? আমি কিচ্ছু লিখি নাই। একটা পেজ লিখেছিলাম শুধু। এবার কি হবে আমার ইমন?”

–” তুই এটা করবি আমার জানা ছিলো তাই রচনার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এসেছি। দেরি করিস না যতোটুকু লিখেছিস আমাকে দিয়ে দে।”

-” ওই টুকু দিয়ে তুই কি করবি?”

-” আমি বাকিটা কমপ্লিট করে জমা দিবো।”

-” কিন্তু হাতের লেখা?”

-” তোর হাতের লেখা আমার চেনা আমি পারবো। তাড়াতাড়ি কর যা।”

-” তুই এত ভালো কেনো?”

-” নওরীন যা নিয়ে আয় আমার আবার ভার্সিটিতে গিয়ে এইগুলো লিখে জমা দিতে হবে। টাইম waste করিস না।”

আমি দৌড়ে রুমে গিয়ে সব নিয়ে আসলাম। আসার সময় অভির রুমের সামনে ছায়া দেখতে পাই অভি কি আড়ালে দাড়িয়ে কথা শুনছে আমাদের? ধুরো শুনক, আমি গিয়ে ইমনকে লেখাগুলো দিয়েই সে উঠে চলে যেতে চাইলো। আমি জোর করলাম কিন্তু তার ক্লাস আছে অন্যদিন এসে গল্প করবে বলে চলে গেলো।আমি দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরে দেখি অভি হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে।

মুখ গম্ভীর করে বললো,” নওরীন তোমাকে না আমি বললাম ব্যাগ গুছিয়ে নিতে।”

” আমি না বললাম, আমি যাবো না। যন্ত্রণা করবেন না।”, বিরক্ত হয়ে বললাম।

” তোমার কি মনে হয় এরপরও আমি তোমাকে একা এ ফ্ল্যাটে রেখে যাবো। তুমি তোমার মায়ের কাছে যাবে এটাই ফাইনাল।”

” আমি যাবো না, মা খালি পতিসেবা মুকুল বাণী দেয় আমার ভালো লাগে না। আমি যাবো না।”,বলে চুপ করে সোফায় বসে পড়লাম।

অভি ভ্রু কুচকে বললো,” কি সেবা?”

” পতিসেবা, স্বামীকে কিভাবে যত্ন করতে হয়, হেন তেন হাবি জাবি কথা।”ঠোঁট উল্টে বললাম।

” ঐগুলা শেখার জন্য আরো আগে সেখানে যাওয়া উচিৎ। “,বলে নিজেই আমার ব্যাগ গুছাতে লাগলেন।

আমার মা কি যে বলে উফফ। সেইগুলো শুনলে ইচ্ছে করে কান দুইটা খুলে হাতে নিয়ে বসে থাকি। এই লোকটাকে আমাকে নিয়েই যাবে বলে মনে হচ্ছে।

আমি গোসল করে বের হয়ে দেখি অভি আমার ব্যাগ পুরো গুছিয়ে ফেলেছে। নিজে যাচ্ছে যাবে আমাকে পাঠানোর কি দরকার। আমি অভির সামনে গিয়ে চুলের পানি ঝরাচ্চি ইচ্ছে করে তার গায়ে পানি ছিটিয়ে দিলাম। অভি আড় চোখে তাকিয়ে গায়ের পানি মুছে শাওয়ার এ চলে গেলো। দুপুরে খাবার সময়ে আমাকে একগাদা উপদেশ দিয়ে দিলেন। বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না, উল্টা পাল্টা কিছু করবে না।

অবশেষে বিরক্তিকর ভাষণ শেষ হয়েছে। এখন বিকেল আমি বারান্দায় বসে আছি একটুপর আমাকে মায়ের বাসায় রেখে আসবে অভি। মন খারাপ লাগছে।

আমি গাড়ীতে এসে বসেছি, অভি ব্যাগগুলো গাড়ীতে ভরে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। সবসময়ের মতন আমার সিটবেল্ট লাগিয়ে দিলো।

তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,” আমি ড্রাইভারকে বলে দিবো সে তোমায় ভার্সিটিতে আনা নেওয়া করবে, রিক্সা করে যাওয়ার প্রয়োজন নেই তোমার।”

” ড্রাইভার এই নামক পদে চাকরিপ্রাপ্ত কাউকে আমি তো দেখলাম না। গাড়িতো আপনি চালান।”, বিস্ময় নিয়ে বললাম।

” তা বাকি গাড়িগুলো কে দেখে?”

” ও আচ্ছা।”,বলে আমি জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাল্লাগছে না কিছুই না। ওনার সাথে এই ব্যাপারে ঝগড়া করা দরকার কিন্তু করতে ইচ্ছে করছে না কিছুক্ষণ পরই চলে যাবে।

আমাকে নামিয়ে দিয়েই অভি এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হবে। অফিসের গাড়িকে আসতে না করেছে অভি। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো। গাড়ী গ্যারেজে ঢুকিয়ে অভি আমার দিকে তাকালো। আমি সাবলীল ভাবে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম।

অভি গাড়ী থেকে নেমে আমার ব্যাগ দারওয়ানের কাছে দিলো। দারোয়ান ওপরে নিয়ে গেলো ব্যাগ। আমি অভির দিকে তাকিয়ে আছি কি বলবো বুঝতে পারছি না অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে।

আমি বললাম,” মায়ের সাথে দেখা করবেন না?”

অভি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,” না, আমার ৮টার ভিতরে পৌঁছাতে হবে। এখন না গেলে দেরি হয়ে যাবে।”

আমি কিছু বললাম না তাকিয়ে রইলাম কিছক্ষন তারপর চোখ নামিয়ে নিলাম।
অভি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে একটু ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
” take care, হুম? আমি কল করবো গিয়ে।”

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গাড়ীতে উঠলেন।আমি ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকালাম।

[চলবে]

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ১৭ #জমে_থাকা_অভিমান
#নবনী_নীলা
“আমি যাবো না।”, বলে নওরীন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষণ্ণতায় তার চেহারার ভরে গেছে।
অভি প্রচন্ড রেগে বললো,” যাবে না মানে কি? আমি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে এসেছি আর তুমি বলছো যাবে না।”
ঘরে নওরীনের মা আর রচনা দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিলো।
নওরীনের মা নিচু স্বরে বললো,”থাক বাবা ও যখন যেতে চাইছে না থাকুক কিছুদিন। এমনেই মেয়েটার শরীর ভালো না।”

” শরীর ভালো না মানে? কি হয়েছে ওর? আবার জ্বর বাধিয়েছো?”,অভি তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করে নওরীনের দিকে গেলো।
নওরীন অভির দিকে তাকালো না।
নওরীন একটু দূরে সরে গেলো। নওরীনের আচরণের এমন পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না অভি।

রচনা নওরীনকে ধরে ওর বিছনায় বসিয়ে দিয়ে অভিকে বললো,” অভিদা তুমি একটু আমার সাথে এসো।”বলে রচনা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

অভি কিছুক্ষণ নওরীনের দিকে তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

রচনা অভিকে নওরীনদের বারান্দায় বসতে বললো। অভি হতাশভাবে বসে। রচনা অভির সামনের চেয়ারে বসে।

— কথাগুলো কিভাবে বলবো আমি বুঝতে পারছি না। বিষয়টা তোমাদের ব্যাক্তিগত বাপার। কিন্তু আমার মনে হলো তোমাকে এইগুলো জানানো দরকার নওরীন হয়ত কখনো বলবেনা।

— আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ও আমার দিকে তাকাচ্ছে পর্যন্ত না। কি করেছি আমি?

— আচ্ছা তোমাকে বলছি। তোমার যাওয়ার দুদিন পর নওরীন ফ্ল্যাটে ফিরে যায়। ওর ভালো লাগছিলো না এখানে।

— ফ্ল্যাটে ফিরে যায়!

— হুম সেদিন বেলী ফুল কিনতে নওরীন ফুলের দোকানে যায়। সেখানে অথৈর সাথে নওরীনের দেখা হয়। As always অথৈ ওকে কথা শুনায়।

— এই কারণে ও আমার উপর রাগ করেছে?আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
[ অভি একটা নিশ্বাস ফেলে।]

— নাহ্ সামান্য কারণে রাগ করার মেয়ে নওরীন না। তোমার খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্পে রাখার টেবিলের ৩নম্বর ড্রয়ার। সেখানে কি আছে তোমার মনে পড়ে?

অভি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একহাত দিয়ে মাথা ধরে বসলো। রচনা অভির উত্তরের আশায় অভির দিকে তাকিয়ে রইল।

— নওরীন সেগুলো দেখেছে?[বলে অভি একটা নিশ্বাস ফেলে]

— নিজে থেকে দেখেনি। অথৈ মেয়েটা নওরীনকে বলেছে নওরীন চেষ্টা করলেও তোমার জীবনে অথৈয়ের জায়গা নিতে পারবেনা। তোমার জীবনে নাকি অথৈয়ের জায়গাটা অনেক special কতটা special তার প্রমাণ স্বরূপ সে নওরীনকে তোমার টেবিল ল্যাম্পের ৩নম্বর ড্রয়ার চেক করতে বলেছে। শুধু তাই না ড্রয়ারের চাবি যে তোমার গাড়ির চাবির সাথে থাকে সেটাও সে বলেছে।

কথাগুলো শুনার পর অভি নিজেও চমকে গেছে। কি বলবে সে নিজেও যানে না।

— সেখানে কি ছিলো আমি জানি না। তোমার আর অথৈয়ের মেমোরি ছিলো হয়তো। তুমি আমাকে বলো একটা মেয়ে যাকে বিয়ের আগে তুমি বলেছ তুমি মেয়েটার বন্ধুর থেকে বেশি কিছু হতে পারবে না। তুমি তোমার অতীতকে ভুলতে পারোনি।
এবার বিয়ের পর ধীরে ধীরে তোমার ভালোবাসো পেয়ে মেয়েটা যদি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চায় তখন তাকে যদি তাকে প্রতিমুহূর্তে বুঝানো হয় সে তোমার আর তোমার এক্স এর জীবনে থার্ড পারসন। কে সহ্য করতে পারবে বলো।
If I was in this situation I would never tolerate this. নওরীন এইসব বিষয়ে কাউকে কিছু বলেনি, এসবের পর বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এসেছে। জ্বর বাধিয়েছে, দুইদিন ১০২ এর উপর জ্বর ছিলো। কিছুই খাচ্ছিল না অনেক কষ্টে পেট থেকে কথা বের করেছি।

অভি এখনও চুপ করে আছে।

— “তোমার যে কোনো ভুল নেই তানা। নিজের ভুলটা খুজে বের করো। সব বললাম বাকিটা তুমি কি করবে বুঝে নেও।” বলে রচনা উঠে চলে গেলো।

অভি বারান্দায় চুপ করে বসে রইল। অভি নিজের ভুল খুজে পেয়েছে। অভি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে নওরীনের রুমে গেলো নওরীন পা তুলে হাঁটুতে মাথা নামিয়ে বসে আছে। অভি রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। নওরীন মাথা উচু করে দেখে অবাক হয়ে বিছনা থেকে নেমে আসে।

“আপনি দরজা বন্ধ করলেন কেনো?, বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো।
অভি কিছু না বলে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে নওরীনের দিকে এগিয়ে আসছে। নওরীন একটা ঢোক গিলে পিছনে তাকালো,পিছনে দেওয়াল।
অভি নওরীনের সামনে এসে দাড়ালো।

অভি কোমল গলায় বললো,” আমার সাথে চলো।” নওরীন অন্য দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়ল।

” কিন্ত কেনো? এতদিন দূরে ছিলাম তোমার থেকে দূরে থাকাটা যে এতটা কঠিন কাজ সেটা আগে জানা ছিল না। তুমি ফোন ধরাও বন্ধ করে দিয়েছিলে।”, বলে দেওয়ালে একটা হাত রেখে ঝুঁকে আসতেই নওরীন নিজের মুখের সামনে দুই হাত ধরে মুখ আড়াল করে।

” হাত সড়াও।”,বলে মুখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখলো হালকা জ্বর আছে।

অভি বিরক্ত স্বরে বলল,” মন খারাপ হলে বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস তোমার কবে বলদলাবে?।”

অভির কথায় নওরীন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

” আমি তো কথা বন্ধ করার মতো কিছুই এখনও করিনি! কথা বন্ধ কেনো তোমার?”,বলে আরেকটা হাত দেওয়ালে রেখে নওরীনের চোখের দিকে তাকালো। অভির ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি দেখে নওরীন ঠোঁট চেপে মুখের ভিতরে নিয়ে গেলো।

অভি নওরীনের কানের পাশের চুল সরিয়ে বললো,” এবার বলো তুমি আমার সাথে যাবে কি যাবে না?”

নওরীন না সূচক মাথা নাড়ল।

” তোমার কাছে দুটো অপশন আছে হয় তুমি নিজে নিজে আমার সাথে আসবে নইলে তোমাকে জোড় করে নিয়ে যাবো।”

নওরীন রাগী স্বরে বলল,” বললাম তো যাবো না।”

” যাবো না কথাটা তো তোমার অপশনে নেই। তোমাকে এই অপশন আমি দেই নি। এবার বলো আমার হাত ধরে যাবে নাকি কোলে করে নিয়ে যাবো?”,বলে শার্টের হাত ভাজ করতে লাগলো।

” আরে কি আজব! বললাম না যাবো না। একদম জোর করবেন না।”বলে চলে যেতে নিলো।

” হুম বুঝেছি তোমার আমার কোলে উঠার শখ হয়েছে।”,বলে নওরীনের হাত ধরে কাছে নিয়ে এলো।

[ চলবে ]

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ১৮ #You_are_the_source_of_my_happiness
#নবনী_নীলা
” হুম বুঝেছি তোমার আমার কোলে উঠার শখ হয়েছে।”,বলে অভি আমার টেনে হাত ধরে কাছে নিয়ে এলো। আমাকে কি সত্যি জোর করে নিয়ে যাবে?

ওই ফ্ল্যাটে আমার যেতেই ইচ্ছে করছে না। আরো কোথায় কোথায় কি লুকানো আছে কে জানে। অভি কি একটা চিন্তা করে আমার হাত ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এখন কি মত বদলালো নাকি!

অভি কিছুক্ষণ পরেই রুমে এসে বললো,” বেবস্থা করে এসেছি।”

” বেবস্থা করে এসেছেন মানে কি?”, ভ্রু কুঁচকে বললাম।অভি নিজের জামার হাতা ভাজ করা আছে কিনা দেখে বললো,” আমার শাশুরির বেবস্থা করলাম।”

” কি বলেন এইগুলা। আমার মা কোথায়?”,বলে মা মা বলে ডাকতে লাগলাম।

অভি আমার কাছে আসে আমার মুখের সামনে হাত দিয়ে আমার চিৎকার বন্ধ করে বললো,”কিছু করিনি, চুপ করো। রচনা তোমার মাকে ছাদে নিয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে যাবো। শাশুড়ির সামনে কোলে নিয়ে যাওয়াটা ভালো দেখাবে না।”

” আপনি কি আমাকে কিডন্যাপ করবেন!আমি তো একবার বলেই দিয়েছি আমি যাবো না। আপনি চলে যান।”, আমার কথা শেষ না হতেই রচনা রুমে ঢুকে পড়ল।

” অভিদা আমি আন্টিকে নিয়ে ছাদে গেলাম।”,বলে রচনা চলে গেলো।

” চলো “,বলে অভি সত্যি সত্যি আমাকে কোলে নিলো। আমি আমার মাকে ডাকলাম কিন্তু মাকে রচনা ছাদে নিয়ে গেছে আমি চিৎকার করতে গেলাম কিন্তু চিৎকার করলে পাড়া প্রতিবেশী এভাবে জামাইয়ের কোলে দেখলে লজ্জা। এনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

এমনেই দারোয়ান আংকেল এভাবে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। এইগুলার কোনো মানে হয়? অভি আমাকে গাড়ীতে বসিয়ে নিজেও বসলো। আমি ঠোঁট উল্টে বসে আছি।আমি সারা রাস্তায় কথা বললাম না।

আমি গাড়ী থেকে নামতে চাইলাম না অভি আমার হাত ধরে টেনে বের করলো। আমাকে বাধ্য হয়ে আসতে হয় নইলে আবার কোলে নিয়ে বসবে। অ্যাপার্টমেন্ট এর লোকেরা দেখলে সেটা মোটেও ভালো হবে না।

ফ্ল্যাটে ঢুকতেই আমার ড্রয়ারে থাকা জিনিসগুলোর কথা মনে পড়লো।আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার থাকতে ইচ্ছে হলো না।

” কি হয়েছে তোমার?”,বলে আমার হাত ধরতে এলে আমি আমার হাত সরিয়ে নিলাম।

অভি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার হাত শক্ত করে ধরে আমাকে রুম নিয়ে এলো। রুমে এসে ড্রয়ার থেকে সেগুলো বের করে আমার কাছে এলো। এইগুলো নিয়ে আমার কাছে আসছে কেনো? আমার কান্না পাচ্ছে।

অভি আমার সামনে সেগুলো ধরে বললো,” তোমার আমাকে একবার প্রশ্ন করা উচিৎ ছিলো, রাইট? এইগুলার জন্য তুমি আমার সাথে আসতে চাইছিলে না? একটু বিশ্বাস করতে আমাকে।”

আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি কিছু বললাম না। আমার কিছু না বলায় অভি রেগে গেছে,” নওরীন তুমি কথা বলছো না কেনো? আমার দিকে তাকাও।” আমি তাকালাম না।

“I can’t tolerate this ignorance. নওরীন stop this. Don’t make me angry. I need to end this.”, বলে অভি আমার একপাশের দেওয়ালে হাত দিয়ে আমার দিকে ঝুকে এলো। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার এইগুলো ভালো লাগছে না।

হটাৎ অভি নিজের আরেক হাত দিয়ে দেওয়ালে জোড়ে ঘুষি মারলো।
শব্দে আমি চমকে উঠে অভির হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি হাত ছিলে গেছে। অভি চোখ মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না আমি রেগে বললাম,” আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কি করলেন এটা।”,বলে অভির হাত ধরতে নেই অভি নিজের হাত সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

আমি অভির পিছনে গেলাম অভি কিচেনে গিয়ে ম্যাচের কাঠি দিয়ে ড্রয়ারে থাকা সমস্ত জিনিস পুড়িয়ে দিলো। আমি বাধা দিতে গেলাম কিন্তু লাভ হলো না। মুহূর্তে আগুন লেগে সব কিছু ছাই হয়ে গেলো। আমি আগুন নিভাতে গেলাম অভি আমার হাত ধরে আমাকে আটকালো। চোখের সামনে সব কিছু ছাই হতে লাগলো।

” আপনি কি করছেন ? ঘরে আগুন লাগে যাবে, ছাড়ুন আগুন নিভাতে হবে।”, বলে আমি হাত ছাড়াতে চাইলাম অভি ছাড়লো না। কিছুক্ষণ পর সব পুড়িয়ে দিয়ে আগুন নিজে নিজে নিভে গেলো।

এই কিছুক্ষনের মধ্যে কি হলো আমি কিছুই বুঝতে পরলাম না। আগুন নিভার সাথে সাথে অভি আমার হাত ছেরে দিলো। আমি রেগে বললাম,” আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কি করলেন এইটা।”

“এই কাজটা আমার আরো আগে করা উচিত ছিলো। আমার জীবনে অথৈ আর অথৈ সংক্রান্ত কোনোকিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। অথৈ আমার অতীত, আমার জীবনে এখন শুধু তোমার অধিকার আছে। You’re the source of my happiness কিন্তু তুমি সেটা কোনোদিন বুঝতেও চাও নি। আর কিভাবে বললে তুমি বুঝবে?”, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভি কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলো।

আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আমি কেনো এমন না বুঝে অভিকে কষ্ট দিলাম। আমার জন্য নিজের হাতের কি অবস্থা করলেন।সব হয়েছে ওই ডাইনিটার জন্য একবার যদি সামনে পাই আমি মেরেই ফেলবো। আমি এখণ অভির মুখোমুখি হবো কি করে? আমার উপর রেগে আছে।

আমি হাতে তুলা আর ব্যান্ডেজ নিয়ে অভিকে খুঁজতে রুমে এলাম সে রুমে নেই। কোথায় গেলো? আমি করিডোরে গেলাম অভি ফ্লোরে ডানপা হাঁটু ভাজ করে তার উপর ডানহাত রেখে বসে আছে। কাছে গিয়ে কি বলবো? আমি এতো ভয় পাচ্ছি কেনো? আমার জামাই আমি কাছে যাবো না তো কে যাবে ?

আমি গিয়ে অভির পাশে বসলাম। অভি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আমাকে ইগনোর করছে কতো বড় সাহস! আমিও দেখি কিভাবে ইগনোর করে। আমি তুলাতে ওষুধ নিয়ে অভির হাত ধরতেই সে বললো,” এসবের প্রয়োজন নেই।” হাত সড়িয়ে নিলো।

উনি আমাকে দূরে সরাতে চায়? এখন অধিকার বোধ বেড়ে দশগুণ হয়েছে আমার।
আমি অভির কোলে উঠে বসে পড়লাম। গন্ডগোল আমি করেছি ঠিক আমাকেই করতে হবে। আমি এমন কাণ্ড করবো অভি বুঝেনি, সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অভির চোখে ক্লান্তির ছাপ আজকে আমার জন্য বেচারার উপর দিয়ে কতো কিছু না গেলো।

আমি অভির গলার পিছনে দুই হাত রেখে নিচু স্বরে বললাম,” সরি আমি আর কোনোদিন এমন করবো না।”

অভি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে, মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। এটা কি হলো ? এতো সুন্দর করে রোমান্টিক ভাবে সরি বললাম উনি উল্টে ভাব নিচ্ছেন। কোথায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে it’s ok। এমন বেরসিক আমি আমার জীবনেও দেখি নি।

আমি রেগে বললাম,”আমি এতো সুন্দর করে রোমান্টিক ভাবে সরি বললাম আপনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন কেনো?” অভি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

এভাবে মান ইজ্জত ডুবিয়ে কারো কোলে বসে থাকার কোনো মানে আছে?কোনো মানে নেই। ধুরো উঠে গিয়ে ফ্লোরে বসি আর জীবনেও এনার কোলে উঠবো না।

উঠে যেতেই অভি আমার আমার কোমড় আর এক হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। কোমড়ের পাশের কাপড় সরে যাওয়ায় আমার শরীর কেপে উঠলো। অভি বললো,”ওটা বুঝি রোমান্টিক ভাবে সরি বলা ছিলো?”

” আমি জানি না।আপনার হাত দিন, ওষুধ লাগবো”, গাল ফুলিয়ে বললাম।

” হাত দিবো না তুমি আমাকে অনেক suffar করিয়েছো। আমি এতো সহজে ভুলবো না। আমি এতটুকুতে মানছি না।”, বলে অভি অন্য দিকে তাকালো।

” মানে! কি করতে হবে?”, না বুঝে বললাম।

অভি ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। এনার মতলব ভালো না। কি করতে চাচ্ছে? কোলে বসে মস্ত বড় ভুল করেছি। আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,” কি করতে চাচ্ছেন আপনি!”

” করলেই বুঝতে পারবে।”,বলেই আমার ঠোটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। আমি নড়াচড়া করতে পারলাম না আমার শরীর বরফ হয়ে গেছে।আমি আর পারছি না অভিকে সরিয়ে দিয়ে আমি সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম।

“আর কতক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকবে?অভি ওর হাতটা আমার সামনে রেখে বললো,” আমার হাতে কি করবে,শেষ করো।”

আমি চোখ খুলে অভির হাতে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। হাতের দিকে তাকিয়েও লজ্জা লাগছে কি অদ্ভুত ব্যাপার!

আমার সাথে কোনো কাপড় নেই এই লোকটা আমাকে এভাবে নিয়ে আসছে কোনো কাপড় অনে নাই এবার আমি কি পড়বো? রাগ করে সব কিছু নিয়ে গেছিলাম এখানে কিছুই নেই আমার। এদিকে আমি গোসল করে বসে আছি কাপড় আনার প্রয়োজনবোধ করিনি। কাপড় না নিয়ে আমি এলাম কেনো লজ্জায় মাথা হ্যাং হয়ে গেছে।

আমি এমন কেনো? এবার আমি করবো কি? অভিকে ডাকবো ধুরো ওনাকে ডেকে কি হবে? উল্টে আরো বিপদ হয়। কিন্তু ভেজা জামা কাপড় নিয়ে কি করবো?

আমি দরজা খুলে দেখার চেষ্টা করলাম অভি রুমে আছে কিনা? উনি ফোনে কথা বলছেন।আমি কথা শেষ হবার অপেক্ষা করলাম। এইতো শেষ হয়েছে।

আমি অভিকে ডাকলাম,” নওরীনের জামাই, ও নওরীনের জামাই।”

[ চলবে ]

হটাৎ এক বৃষ্টির দিনে পর্ব-১৪+১৫

0

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ১৪ #খুনসুটি
#নবনী_নীলা
“আরে আরে আস্তে! আপনি দেখছি আমার পা ভেঙ্গে ফেলবেন? আপনার এতো নিষ্ঠুর হৃদয় কেনো?”, ব্যাথায় কাদতেঁ কাদতেঁ বলল নওরীন।

” একদম চুপ করে থাকো। একটা কথাও বলবেনা। মই বেয়ে উপরে উঠার সময় এইসব মনে ছিল না?”, অভির ধমকে নওরীন মুখ ফুলিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে আছে।

নওরীন মই বেয়ে গাছে উঠতে গেছিলো। অভির কাজিন তুলি আর নুহাশের সঙ্গে নওরীন নিজের গাছে উঠার নিজ্জা টেকনিক দেখাতে গিয়ে মই থেকেই পরে পা মচকে ফেলেছে।
পা বেশি মচকে নি কিন্তু নওরীনের চিৎকারে বাকিদের অবস্থা দেখার মতন ছিলো। নওরীনকে এখন রুমে এনে, অভি পা নাড়াচরা করে দেখছে serious কিছু কিনা? এতেও নওরীন যা করছে তাতে অভি চুপ করে নিজের রাগ কমাচ্ছে।

নুহাশ আর তুলি ভয় পেলেও প্রভাত অনেক মজা পেয়েছে। সে চুপ করে মামা মামীর পাশে বসে আছে। মামীর কান্ডকারখানায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় প্রভাত।

অভি নওরীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
” ইনজেকশন লাগবে। এভাবে কিছু হবে না।”

নওরীন চোখ বড় বড় করে বলল,” একদম ফালতু কথা বলবেন না একটু পড়েছি কিসের ইনজেকশন। ভয় দেখাবেন না আমাকে।”

” তুমি যা শুরু করেছ প্রাথমিক চিকিৎসা বলে যেটা আছে সেটাতেই তুমি এমন চিৎকার করছো। ইনজেকশন মেরে অজ্ঞান না করে কিছুই করা যাবে না। বসো আমি ডক্টর আংকেল কে ফোন করছি।”,বলে অভি ফোন হাতে নিল। অভি ভালো করে জানে কিভাবে নওরীনকে সামলাতে হয়।

নওরীন অভির হাত থেকে ফোন কেরে নিয়ে ভয়ার্থ গলায় বলে,” আমি আর চিৎকার করবো না। ফোন দিয়েন না প্লীজ।”

” ফোন এই দিকে দেও। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। তুমি চিৎকার করবে এতে আমার কোনো প্রকার সন্দেহ নেই।”,ফোন নিতে কাছে আসায় নওরীন ফোন লুকিয়ে বলে,” সত্যি চিৎকার করবো না। প্লিজ প্লিজ।”

প্রভাত পাশে বসে মুখ টিপে হাসছে।

অভি বললো,” মুখে হাত দেও।”নওরীন চুপচাপ কোনো প্রশ্ন না করে মুখে হাত দিল।অভি নওরীনের পায়ের কাছে হাঁটু গুঁজে বসলো। একবার নওরীন দিয়ে তাকিয়ে যেই দিকে মচকে গেছে উল্টো দিকে জোড়ে ঘোরালো। একটু শব্দ হলো।

নওরীন অভির কাধে হাত রেখেছিলো ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে বিছানার চাদর আর অভির শার্ট শক্ত করে ধরে চিৎকার থামলো। অভি একটা খামচি কাটার মতো অনুভব করলো।অভি নিজের কাধের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে নওরীনের দিকে তাকালো সে চিৎকার করেনি কিন্তু চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি পড়ছে।

প্রভাত বললো,”মামীর পা ঠিক হয়েগেছে?”

অভি হা সূচক মাথা নাড়ল। নওরীন পা নাড়াচারা করে দেখে সত্যি পা ঠিক হয়েছে । নওরীন খুশি হয়ে গেলো। অভি নিজের কাধে নওরীনের আঁচড়ে দেওয়া জায়গা ডলতে ডলতে উঠে দাড়ালো। নওরীন যে এই কাণ্ড করেছে তা সে নিজেও জানে না।

প্রভাত বললো,” চলো তাহলে আমাদের নিনজা টেকনিক দেখাও।”

অভি ভ্রু কুঁচকে বললো,” কিসের টেকনিক?”
প্রভাত এক গাল হাসি আর উচ্ছাস নিয়ে বললো,” গাছে উঠার নিনজা টেকনিক।’

অভি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নওরীনের দিকে তাকালো। নওরীন ইশারায় প্রভাতকে চুপ করতে বলে।

” যাও গিয়ে নিনজা টেকনিক দেখাও। আমি নিয়ে যাবো নাকি যেতে পারবে।”, রাগী গলায় বললো অভি।
আরো বললো,” যে নিজেই মই থেকে পড়ে পা ভেঙে বসে আছে সে কি শিখাবে? প্রভাত রুমে যাও তুমি। কিছু মানুষ এমনেই লাফায় তাদের কথা বিশ্বাস করতে হয় না।”

অভির কথায় প্রভাত হা সূচক মাথা নেড়ে মিট মিট হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নওরীনের ইচ্ছে করছে এতো এত কথা শুনাতে কিন্তু কোনটা আগে বলবে সেটাই বুঝতে পারছেনা।

অভি রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,” আকাশে কিভাবে উড়ে সেটার নিনজা টেকনিক জানো?”

” একদম আমাকে খোটা মেরে কথা বলবেন না।আমি এমনেই বলিনি। আমি গাছে উঠতে পারি। অনেক ছোট বেলায় একবার উঠেছিলাম মই বেয়ে গাছে।”, প্রতিবাদী ভঙ্গিতে বলল নওরীন।

“চেয়ার দিয়ে ট্রাই করনি? করা উচিৎ ছিল তো। তুমি দড়ি দিয়ে করতে পারতে গাছের উচু ডালে দড়ি বেধে তারপর দড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে লাইক বাঁদরের মতন।”,কথা শেষ করে অভি ওয়াসরুমে চলে গেলো।

নওরীন এখন মনের সুখে রাগ ঝাড়ছে।নওরীন ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে বলতে শুরু করে,” আমি তো তাও জীবনে একবার গাছে উঠেছি। আপনি কখনো উঠেছেন? আপনি কি করে জানবেন গাছে উঠার মহত্ব?
আপনার কি মনে হয় আমি বকা, বাচ্চা কিছু বুঝি না? আপনার না জ্বলে আমাকে দেখে। আমি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াই আপনি তো এইগুলো করতে পারেন না। এইগুলো করলে আপনি যেই ভাব নিয়ে থাকেন তা তো থাকবেনা।
আপনি হলেন অভি আহমেদ একটা ভাব নিয়ে থাকতে হবে না? আমাকে পেয়েছেন অসহায় কিছু বলি না তাই আমাকে এভাবে অপমান করেন।আমার প্রতিভায় আপনার হিংসে হয়।”

নওরীন ওয়াশরুমের দরজায় হেলান দিয়ে আপন মনে কথা বলছে।নওরীন নিজে নিজে বলে আবার হাসছে মুচকি মুচকি।তারপর আবার বললো,” আমার আনন্দ তো আপনি দেখতে পারেন না। আমারও সময় আসবে আমিও তখন আপনাকে দেখাবো নওরীন কি জিনিস।”

তখনই নওরীন পিছনে হেলে পড়ে গেলো কারন অভি দরজা খুলে দিয়েছে। নওরীন পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়। অভি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে অভির গায়ে শার্ট নেই।

অভির রাগী মুখ দেখে নওরীনের গলা শুকিয়ে গেছে। সে হাসি দিয়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলো কিন্তু অভি বললো,” কি বলছিলে এতক্ষন?”

নওরীন একটু দূরে এসে বলে ,” কিছু না”

“তোমার প্রতিভায় নাকি আমার হিংসে হয়! seriously? তোমার এসব উল্টা পাল্টা প্রতিভা তুমি তোমার কাছে রাখো।”, অভি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল।

নওরীন বুঝেছে এখন চুপ করে থাকা তার জন্যই ভালো। এতক্ষন আজে বাজে কি বলেছে সেটা তার নিজের ও জানা নেই। নওরীন পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

নীচে নামতেই দেখা হলো তার শাশুড়ির সাথে তিনি বললেন,” তোমার পায়ের কি অবস্থায়?”
নওরীন বললো,” এখন ঠিক আছে।”

” ঠিক থাকলেও দৌড় দৌড়ি করো না। রেস্ট নেও, নীচে নেমেছ কেনো?”

নওরীন কিছু বলতে পারছেনা কারন কোন মিথ্যে কথাটা সত্যি বলে মনে হবে সেটাই সে বুঝতে পারছেনা।

এমন সময়ে নুহাশ এলো। নুহাশ কলেজে পড়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। অবশ্য এই পরিবারে ব্রিলিয়ান্ট মানুষের অভাব নেই। তারা জ্বীনগত ভাবে ব্রিলিয়ান্ট হওয়ার ট্রেনিং পেয়ে পৃথিবীতে আসে। নুহাশ ছেলেটা নওরীনকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে।

নুহাশ বলে,” একি তোমার না পায়ে অনেক ব্যাথা ছিলো। ব্যাথায় চিৎকার করছিলে এখন দাড়িয়ে আছো কিভাবে?”

” নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।”,বলেই হাসতে হাসতে নওরীনের শাশুড়ি নিজের রুমে যায়।

নওরীন বিরক্তি চোখে নুহাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্রিলিয়ান্ট মানুষরা আধ পাগল টাইপ হয় সেটা নওরীন নুহাশ আর অভিকে দেখে জেনেছে।

নওরীন রুমে এসে দেখে অভি নিজের কাধে ক্রিম জাতীয় কিছু লাগাবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা।
অভি শার্টের বোতাম খোলা আর এক পাশের কাধ দিয়ে একটু খোলা। নওরীন রুমে এসে অভির কাছে গেলো। অভি ঠিক কি করছে সেটা তার জানা দরকার। নওরীন কাছে গিয়ে খেয়াল করলো অভির কাধে আঁচড়কাটা দাগ।

নওরীন বেস্ত হয়ে বললো,” কি হয়েছে দেখি” বলে অভির কাধের শার্টটা একটু সরালো।

নওরীন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,” আপনাকে কি বিড়াল খামচে দিয়েছে? দাগ হয়ে আছে।”

অভি একটু হেসে বললো,” বিড়াল না বাঁদর।”

” বাঁদর! কিন্তু এখানে আসার পর থেকে কোনো বাঁদর চোখে পড়লো না তো আমার!”, বিস্ময় নিয়ে বলল নওরীন।

” তোমার বুঝা লাগবে না। তুমি আমাকে এই ক্রিম লাগাতে হেল্প করো।”,বলে নওরীনের হাতে ক্রিমটা দিয়ে দিল।

” আচ্ছা,আপনি এসে বিছনায় বসুন।”
অভি গিয়ে বিছনায় বসলো নওরীন ক্রিম খুব সাবধানে, দেখে লাগাতে লাগলো। হটাৎ বানরের ব্যপারটা তার মাথায় এলো।

” আপনি কি কোনো ভাবে বাঁদর বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন?”, বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো নওরীন।
তুমুল কান্ড লাগাবে সেটা নওরীনের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে।

[চলবে]

#গল্পের_নাম #হটাৎ_এক_বৃষ্টির_দিনে
#পর্বঃ১৫ #তোমার_কি_আমাকে_মনে_পড়বে?
#নবনী_নীলা
” আপনি কি কোনো ভাবে বাঁদর বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন?”বিস্ময় নিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম। অভি হাসছে, আমি কি মজার কিছু বললাম যে উনি এভাবে হাসছে।

বাঁদরতো আমাকেই বলে আমি আবার কবে এই কুকর্ম করলাম?সকালে শার্ট খামচে ধরেছিলাম তখন কোনো ভাবে কি নখ লেগে এমন হয়েছে? ব্যাপারটায় খারাপ লাগছে মাঝে মাঝে কি যে করি আমি নিজেও বুঝি না।

অভি হটাৎ আমার হাত ধরে আমাকে সামনে নিয়ে এলো। আমি অভির সামনে বসলাম। আমি দুঃখিত স্বরে বললাম,” আমি ইচ্ছে করে করিনি ভুল করে হয়েগেছে sorry।”

অভি অবাক হয়ে বলে,” বাহ্ এতো ভালো মেয়ে হয়ে গেলে কি করে? নিজে নিজেই sorry বলছো।” আমি চুপ করে রইলাম। অভি আমাকে সামনে ফিরিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মাথা গিয়ে ঠেকেছে অভির বুকে।

আমি “আপনি….” বলতে গেলাম অভি আমার মুখের সামনে হাত দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে বলল,” চুপ করে থাকো, উল্টা পাল্টা কথা বলে আমার মুড নষ্ট করো না।”

আমি কিছু বলার আগে আমার ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিলো। অভির স্পর্শ এখন ভালো লাগতে শুরু হয়েছে।যদিও নিজেকে এখনও শ্বাসকষ্টের রোগী মনে হয়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয়।

” কালকে সকালে আমরা চলে যাচ্ছি।”,বলে অভি আমার দিকে তাকালো।আমি ঘাড় কাত করে অভির মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম,”কেনো? হটাৎ করে কালকেই যেতে হবে কেনো? আমরা থাকি আরো কিছু দিন।” বলে তাকিয়ে রইলাম।

” আমার কিছুদিনের জন্য জাপানে যাওয়া লাগবে অফিসের কাজে, কালকে সন্ধায় আমার ফ্লাইট।”,বলেই শুকনো মুখ করে আমার দিকে তাকালো।

আমি কি বলবো কি বুঝলাম না। আমি কিছু না বলে ঘাড় সোজা করে সামনে তাকালাম। কালকে সন্ধায় ফ্লাইট আর উনি আমাকে এখন বলছে! আমাকে এর আগে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। আমাকে এখন বলতে এসেছে।

অভি আরো বললো,” I know আমার তোমাকে আগেই জানানো উচিৎ ছিলো। আমি আসলে তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তোমার পাসপোর্ট করার অনেক ট্রাই করেছি but কমপক্ষে ৫, ৬দিন লাগবে আর আমার হাতে সময় কম ছিল।”

আমি একটা নিশ্বাস ছেরে দিয়ে বললাম,”হুম বুঝেছি।”

আমি আমাকে ওর বুক থেকে সরিয়ে আমাকে ওর সামনে বসিয়ে দিল। হটাৎ আবার কি হলো? কি সুন্দর জড়িয়ে ধরে ছিলো হটাৎ করে কি হয় এর। আমি ভ্রু কুচকে অভির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

অভি বলল,” আমি কি তোমাকে বায়োলজি পড়াচ্ছি? হুম বুঝেছি এইটা কেমন কথা।”

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,” একদম বায়োলজির নাম নিবেন না অসহ্য একটা সাবজেক্ট। আমি এইটাকে দেখতেই পারি না।”

” তোমার আমার মধ্যে কেমিস্ট্রি বলতে কিছু নেই, ফিজিক্স এর কথা তো বাদ। বাকি আছে বায়োলজি এইটাও বাদ দিলে কিভাবে হবে।”

অভি সাবলীল ভাবে তাকিয়ে আছে। সত্যি বলতে অভির কথার কিছুই আমি বুঝিনি। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে রইলাম তারপর বললাম,
” কয়দিনের জন্য যাবেন?”

” ৬, ৭দিন লাগতে পারে অথবা তার বেশি।”বলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি “ও আচ্ছা” ছাড়া কিছু বলতে পারলাম না। এতো দিন থাকবে সেটা আমি ভাবিনি। আমার চেহারায় যেন ঘন মেঘ বাসা করেছে। বৃষ্টি নামবে বলে। আমি করিডোরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

” তোমার কি মন খারাপ হয়েছে?”,অভি আদর মিশানো গলায় বলল।

নিজের অজান্তেই আমি হা সূচক মাথা নাড়লাম। অভী ডান হাত দিয়ে আমার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো,” কেনো? তোমার কেনো মন খারাপ হয়েছে? তোমার তো খুশি হবার কথা না? যা ইচ্ছে করতে পারবে।”

আসলেই তো আমার কেনো এতো খারাপ লাগছে। উনি না থাকলে আরো ভালো লাগার কথা। বকা, রাগ, ঝাড়ি শুনতে হবে না। কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে। কান্না আটকে রাখতে গিয়ে গলায় ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।

তাও অনেক কষ্টে বললাম,” আমি কি বলেছি আমার আপনার জন্য মন খারাপ হয়েছে? আমি জাপানে যেতে পারবো না এই জন্য মন খারাপ হয়েছে।”

আমার গলা দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না। যেকোনো সময়ে চোখ দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বে।আমি চাই না অভি সেটা দেখুক।আমি উঠে যেতেই অভি আমার হাত ধরে টেনে নিজের কোলে বসালো।

অনেক কিছু বলতে চাই কিন্তু গলায় চাপ পড়ায় কিছু বলতে পারছি না। অভি আমার কোমরের পাশে দুই হাত জড়িয়ে বললো,” তোমার কি আমার কথা মনে পড়বে ?”

এই কথাটা বলার কি খুব প্রয়োজন ছিল। এই কথা শুনে আমার চোখ থেকে টপ টপ পানি পড়তে শুরু হলো। আমি মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে না সূচক মাথা নেড়ে বললাম,” আমি জাপানে যেতে চাই।”

অভি আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,” হুম বুঝেছি তুমি জাপানে যেতে পারছো না তাই কান্না পাচ্ছে। আচ্ছা কান্না থামাও নেক্সট টাইম তোমাকে নিয়ে যাবো।”

_________________

সকাল সকাল গাড়ি করে ফ্ল্যাটে ফিরে আসলাম আমরা। সারা রাস্তায় আমি চুপ করেছিলাম। অভি বিভিন্নভাবে আমার সাথে কথা বলতে এসেছে আমি কথা বলিনি।

অভির ফ্লাইট সন্ধ্যায় অফিস থেকে গাড়ি তাকে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবে।অভি নিজের ব্যাগ গুছাতে বেস্ত।
আমি মুখ কালো করে বিছানায় বসে অভির সুটকেস গুছানো দেখছি। আমি সত্যি যেতে চাই। আমি একা একা এতো দিন কিভাবে থাকবো? এই লোকটাকে না জ্বালাতন করলে ভালো লাগে না।

” তোমার জাপানে যেতে না পারার শোক এখনও কাটেনি?”, নিজের সুট গুছাতে গুছাতে বললেন।

ওনার কি সত্যি মনে হচ্ছে আমি জাপানে যাওয়ার জন্য এমন মন খারাপ করে বসে আছি। কালকের কান্নাটা সেটাও কি জাপানে যাওয়ার জন্য কেঁদেছি? আমার জামাইটা এমন কেনো ? কিছুই দেখি বুঝে না। আচ্ছা মেনে নিলাম জামাইটা আনরোমান্টিক কিন্তু বুদ্ধি শুদ্ধি কিছুই নেই।

আমি আড় চোখে তাকালাম। অভী মিট মিট করে হাসছে।অভি আবার বললো,” তুমি জাপানে যেতে চাও কেনো?”

কান্ড দেখো লোকটার মনটা ভালো নেই অথচ উনি আমার মেজাজটাও খারাপ করছেন। উনি তো বেশ আনন্দেই আছে মনে হচ্ছে।

” হ্যা ছোটোবেলায় খুব ইচ্ছে ছিলো নবিতাকে বিয়ে করবো। তাই যেতে চাচ্ছি।”,আমি রেগে বললাম।

” নবিতা! তোমার ওই বলোদটাকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো? বলদের তো বলোদকেই ভালো লাগবে। “, বলতে বলতে উঠে এলো।

” আপনি একেবারে খুব বুদ্ধিমান তাই না? পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মানুষ হলো অভি আহমেদ।”,আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম।

অভি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে বলে,” উঠো এবার নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেও।”

[ চলবে ]