Sunday, July 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1486



কানামাছি পর্ব-০৯

0

#কানামাছি
#পার্টঃ৯
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
হাত-পা ভর্তি মেহেদী দিয়ে সাঁঝ স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। নড়তে পারছে না। এদিকে মশা এসে মনে হচ্ছে এখনই তুলে নিয়ে যাবে। বিরক্তির চরম সীমাতে পৌঁছে গেছে সাঁঝ। গত দুই ঘন্টা ধরে এক ভাবে বসে আছে। নিজের মনে মনেই বলল, ” কে বলে মানুষকে বিয়ে করতে? কে? বিয়ে করবে তার আবার এতো অনুষ্ঠান কেন? মানুষ বিয়েতে মেহেদী কেন পরে? আজব তোহ! এই মূর্তির মতো বসে থেকে মেহেদী পরার কোন মানে হয়?”

সাঁঝ রাগে গজগজ করতে করতে সামনের দিকে তাকালো। অনুষ্ঠান তাকে ঘিরে কিন্তু তার দিকে কারোর নজরই নেই! সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। সামনে ইহানকে হেসে কথা বলতে দেখে বলল নিজের মনে বলল, “এই ভাই সাহেব কে দেখুন! এখানে আমি এভাবে মেহেদী লাগিয়ে স্ট্যাচু হয়ে বসে আছি উনি কি সুন্দর আমার বাড়ির লোকের সাথে কুশল বিনিময় করছে!”

সাঁঝ নিজের হাত পায়ের দিকে তাকালো। বাম হাতে মেহেদী পরার পরে নড়ার কারণে মেহেদী নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে পরিষ্কার করে আবার মেহেদী দিয়েছে। দুই হাত টানটান করে ধরে আছে। এবার অত্যাচার চলছে দুই পায়ের উপর। একবার ইচ্ছা হলো মেহেদী পরানোর মেয়েটাকে বলবে যে আপনি চলে যান। লামিসা, ইশিতা আর ইহানের চাচাতো ভাই রিফাত হলো এই মেহেদী অনুষ্ঠানের নাটের গুরু। কি উনাদের শখ জাগলো গায়ে হলুদের আগের রাতে মেহেদীর অনুষ্ঠান হবে। আর সাথে সাথে সব ব্যবস্থা হয়েও গেলো! এখন নিজেরা কি হাসি খুশি মাঝখান থেকে সে ফেসে গেলো।

সাঁঝ চোখ বন্ধ করে পিছনের দিকে ঝুকলো। পিঠে ব্যথা হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে পারলো কিছু একটা আছে হেলান দেয়ার জন্য। কিন্তু পিছনের দেয়াল তো বেশ দূরে। সাঁঝ চোখ খুললো। দেখলো ইহান নিজের একটা বালিশ সাঁঝের পিঠের নিচে দিয়ে বালিশটা ধরে আছে। সে চোখ খুললে বলল,

—” ব্যথা হচ্ছে না পিঠে?”

—” শুধু পিঠে না হাতে, পায়ে, মাথায় সব জায়গায় ব্যথা হচ্ছে”

ইহান একটু অনুতপ্ত হয়ে বলল,

—” আসলে আজকে এখানে এসে কোন অনুষ্ঠান করার প্ল্যান আমাদের ছিলো না। কিন্তু ইশিতা, রিফাত, আর অন্য কাজিনরা এতো করে জেদ ধরলো আর তোমার বাসা থেকে মেনে নিলো তাই”

—” আচ্ছা”

সাঁঝ হেলান দিয়ে সুবিধা করতে না পেরে মনের অজান্তেই আলতোভাবে ইহানের কাঁধে মাথা রেখে দিলো। সাথে সাথে ঘুমে চোখ বুজে আসলো।

আজ দুপুর অব্দি সে জানতো না সন্ধ্যায় এই অনুষ্ঠান আছে। দুপুরে ঘুমিয়েছিলো। মা আর ফুফু কয়েকবার ডেকে গিয়েছিলো কিন্তু কোন গুরুত্ব দেয়নি। পরে অনেকের গলা শুনে উঠে ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে ইহান দাঁড়িয়ে আছে। আর বাকিরা বসে। তখন ইহান তাকে দেখে হেসে বলেছিলো,

—” ঘুম ঘুম চোখে তোমাকে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। ইচ্ছা হচ্ছে গাল গুলো টেনে দিই”

সাঁঝ কিছু না বলে ভিতরে চলে গিয়েছিলো।
তন্দ্রার মধ্যে সাঁঝ একটা মিষ্টি মিষ্টি সুবাস পেলো। সুবাসটা ক্রমেই কড়া হয়ে নাকে লাগতে শুরু হলো। সাঁঝ বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে দেখলো সে ইহানের কাঁধে মাথা রেখেছে। ঝট করে সরে গিয়ে সামনে তাকালো কেউ দেখেছে কিনা। কেউ দেখেনি। নিজের মেহেদীর দিকে তাকালো। নষ্ট হয়নি। নাহলে আবার দেয়া লাগতো। ইহান বলল,

—” তোমার ঘুম আসছে? অনেক ধকল যাচ্ছে তো। আগে থেকে বলা উচিত ছিলো আমাদের। আসলে আমার ভাইবোনগুলো এমন জেদ ধরলো যে”

ইহানের কথার মাঝেই সাঁঝ বলল,

—” ব্যাপার না। এসব বাচ্চাদের আমি দেখে নিবো। সব গুলোকে ড্রেনের সামনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিবো। তাহলে এদের শিক্ষা হবে 😒”

ইহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসা শুরু করলো। সাঁঝের চোখ ইহানের হাতের মেহেদীর দিকে গেলো। ইহানও মেহেদী পরেছে। কিন্তু শুধু বাম হাতে। তার আর ইহানের হাত মিলে একটা পূর্ণ হার্ট শেপ আঁকা হয়েছে। তার ডান হাতের অর্ধেক হার্টের মধ্যে ইহান লেখা। আর ইহানের হাতের অর্ধেকের মধ্যে লেখা সাঁঝ। দুজনের হাত পাশাপাশি আনলে একটা পূর্ণ হার্ট সহ “সাঁঝইহান = সাঁঝিহান” হয়। ইহানের হাতে কেবল এটুকুই আছে। ইহান হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কিছু খাবে? আনবো?”

সাঁঝ একটু ভেবে বলল,

—” কোল্ড ড্রিংকস”

—” আচ্ছা আমি আনছি”

ইহান চলে গেলে সাঁঝ গলা নামিয়ে মেহেদী যে মেয়েটা পরাচ্ছে তাকে জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনি কি নাস্তা করেছেন?”

মেয়েটা উত্তর দিলো,

—” হ্যা আপু নাস্তা করেছি”

—” আপনার পেমেন্ট করা হয়েছে?”

—” হ্যা”

—” আচ্ছা বাকি যে দুইজন এসেছিলো মেহেদী দিতে উনাদের তো দেখছি না। উনারা কোথায়?”

—” উনারা তো আমার সাথে আসেননি। আমি স্পেশালি শুধু ব্রাইডাল মেহেদী দিই। উনারা চলে গেছেন”

—” আচ্ছা। এবার আপনিও চলে যান”

মেয়েটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” মানে? আপনার মেহেদী দেয়া এখনো শেষ হয়নি। এক পায়ে তো পুরোই বাদ আছে”

সাঁঝ হেসে বলল,

—” নাহ আর দরকার নেই। যা দিয়েছেন সেটাই অনেক। আপনার পেমেন্ট হয়ে গেছে। এবার তো আর কোন সমস্যা নেই”

—” কিন্তু আপু….”

—” আর কোন কিন্তু না আপু। আপনি এখান থেকে ওই যে দরজা ওখান দিয়ে চলে যাবেন। খেয়াল রাখবেন কেউ যেন না দেখে”

সাঁঝের জোরাজুরিতে মেয়েটা চলে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে ইহান এসে জিজ্ঞেস করলো,

—” মেয়েটা কোথায়? মেহেদী দেয়া শেষ? ”

সাঁঝ বিজয়ীর ভঙ্গিতে হেসে বলল,

—” চলে গেছে। উনার কাজ শেষ”

ইহান নিচু হয়ে সাঁঝের পায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,

—” শেষ না বলো তুমি তাড়িয়ে দিয়েছো। এক পায়ে মেহেদী আছে অন্য পায়ে নেই। Weird!”

ইহান হাসতে থাকলো। সাঁঝ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,

—” এক পায়ে পায়েল পরা যদি স্টাইল হয় তাহলে এটা কেন স্টাইল হবে না?”

—” সেটাই। এটা নিউ স্টাইল”

ইহান সাঁঝের সামনে গ্লাস ধরলো। সাঁঝের একটু অস্বস্তি হলো। তারপর একবারে পুরোটুকু খেয়ে নিলো। এরপর ইহান গ্লাস নিয়ে চলে গেলো। আর আসলো না। সাঁঝ সামনের দিকে তাকালো। বেশ মানুষ আছে। তার নিজের অনেক লতানো প্যাচানো ভাইবোন এসেছে যাদের কোনদিন দেখেছে কিনা সন্দেহ। তার এই ভাইবোন আর ইহানের কাজিনরা মিলে একজায়গায় আড্ডা দিচ্ছে। আন্টিরা একজায়গায় বসে গল্প করছে। আর আঙ্কেলরা আরেক জায়গায়। ইহানকে কোথাও দেখতে পেলো না।

সাঁঝ উঠে পড়লো। একা একা বসে থাকার কোন মানে হয়না। সবার সাথে হাই হ্যালো বলে ছাদে হাঁটতে লাগলো। তাদের ছাদটা বেশ বড়। একটু দূরে ফাকা জায়গায় ইহান আর বড় চাচা একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে ওদিকে গেলো। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনলো ইহান বলছে,

—” চাচু তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি তো। আমার উপর বিশ্বাস নেই?”

বড় চাচা মিনমিন করে বলল,

—” আমার কি যাওয়া উচিত ছিলো? সব ম্যানেজ করতে পারবে তো ওরা?”

ইহান চাচার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,

—” বিশ্বাস রাখো আমার উপর। সব ঠিক হবে। আমি ব্যবস্থা করছি। এখন ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমার বিয়ে এঞ্জয় করো”

সাঁঝ চলে আসলো। তার মনে প্রশ্ন জাগলো কি হয়েছে? ইহান কিসের কথা বলছে? বড় চাচাই বা এভাবে কি বলছিলো? অন্য সবাইকে তো ঠিকঠাক লাগছে। শুধু বড় চাচাকেই বিষন্ন লাগছে। সাঁঝ আন্টিদের গ্রুপের দিকে গেলো। ওখানে ইহানের মা, চাচী, বাড়ির ভাড়াটিয়া আন্টিসহ অনেকে আছে।
সাঁঝ যেতেই ইহানের মা বলল,

—” দেখি মেহেদী”

সাঁঝ হাত সামনে নিয়ে দেখালো। ইহানের মা বলল,

—” এখনো শুকায়নি তো। তবুও সুন্দর লাগছে”

ইহানের চাচীও তাল মেলালো। বলল,

— ” আসলেই অনেক সুন্দর লাগছে”

সাঁঝ চাচীকে জিজ্ঞেস করলো,

—” চাচী অনিক কোথায়?”

চাচী জিজ্ঞেস করলো,

—” অনিক কে মা?”

সাঁঝ আমতাআমতা করে বলল,

—” ইহানের চাচাতো ভাই মানে.. আপনার ছেলে”

চাচী হেসে বলল,

—” ওর নাম তো অনিক না। ওর নাম রিফাত। ওই যে ওখানে কথা বলছে”

সাঁঝ একটু হেসে বলল,

—” আসলে নাম ভুলে গিয়েছিলাম। আমি খেয়াল করিনি ওখানে আছে”

—” ব্যাপার না মা”

সাঁঝ আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” চাচী আপনার আর ছেলে মেয়ে নেই?”

চাচী একটু আফসোস করে বলল,

—” না একটাই ছেলে আমার”

—” ও আচ্ছা”

সাঁঝ চলে আসলো ওখান থেকে। ইহানের বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে মৃদু সুরের একটা গান বাজছে। সাথে মানুষের কথার শব্দ তো আছে। সাঁঝের মাথার ভিতর দপদপ করতে শুরু হলো। তাই হেঁটে হেঁটে ছাদের অন্য পাশে চলে আসলো। এদিকে শব্দ আসছে না। বাতাসও আছে। সাঁঝ ইহানের বলা কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে থাকলো। পিছন থেকে কেউ বলল,

—” আরে সাঁঝ যে!”

সাঁঝ পিছন ঘুরে দেখলো নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা ব্লক করে। সাঁঝ বলতে গেলে দেয়ালেফ সাথে আটকে আছে। সাঁঝ বলল,

—” আপনার সাহস দেখছি দিন দিন বেড়েই চলেছে।”

—” তোমার সাথে হিসাব ক্লিয়ার না করে তো যেতে দিতে পারিনা”

—” সেদিন রাতে কি বলেছিলাম ভুলে গেছিস? এটা আমার…”

সাঁঝকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নাহিদ বলল,

—” জানি জানি এটা তোমার এলাকা। কিন্তু আর কতদিন? দুদিন পরই তো চলে যাবা অন্য বাড়িতে। তখন এতো তেজ থাকবে না তোমার। মাথা নিচু করে চলতে হবে। এখন এমন বাঘের মতো গর্জন করছো তখন ভেজা বিড়াল হয়ে থাকতে হবে”

সাঁঝ কঠিন স্বরে বলল,

—” বাঘিনী যে জঙ্গলেই যাক সে বাঘিনীই থাকে। আর সময় আসলে গর্জনও করে। আর বিড়াল জঙ্গলে গেলেও বাঘ হয় না। বিড়ালই থেকে যায়। অবশ্য ইদুরকে বিড়ালের কথা বলাও ভুল। বুঝবে না”

নাহিদ সাঁঝের দিকে এগিয়ে এসে হেসে বলল,

—” এতো যে কথা বলছো তুমি নিজেই এখন মেহেদী পরে বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছো। কি করবে তুমি আমার?”

—” এতো এগিয়ে আসছেন কেন পেছান। আমার রাস্তা ছাড়ুন”

নাহিদ পেছানোর বদলে আরো একপা এগিয়ে আসলো। সাঁঝ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—” আমি নিজের মেহেদী নষ্ট করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু অমানুষদের শিক্ষা দেয়ার জন্য এটা করতেই হবে”

সাঁঝ নাহিদকে মারার জন্য হাত তুললো। লাস্ট মোমেন্টে সাঁঝের হাত ধরে ফেললো। দেখলো ইহান দাঁড়িয়ে আছে। ইহান বলল,

—” ইদুর মেরে নিজের হাতের মেহেদী কেন নষ্ট করবা?”

এরপর ইহান নাহিদের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,

—” আপনার নাম তো নাহিদ না? Lets talk man to man”

ইহান নাহিদকে একপ্রকার ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলো। আর সাঁঝ রাগে ফুসতে থাকলো। একটা শিক্ষা নাহিদকে দেয়াই লাগবে।
,
,
,
🌿
সাঁঝ রাতে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আশিকের ভয়েস মেসেজ এসেছে। সেটা অন করে শুনলো আশিক বলছে,

” সাঁঝ আমি অনিক আর ইহান স্যারের মধ্যে কোন যোগসূত্র খুঁজে পাইনি। দুজনের স্কুল কলেজ আলাদা ছিলো। আর তুই এগুলো নিয়ে ভাবা বন্ধ কর। পরশু তোর বিয়ে সেটাতে মনোযোগ দে”

সাঁঝ এটা শোনার পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর সাকিবকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে ধরে বলল,

—” হ্যা সাঁঝ আপু বলো”

—” ব্যস্ত আছিস?”

—” ব্যস্ত মানে তোমার বিয়ের কাজেই ব্যস্ত”

—” আচ্ছা একটা কাজ করতে হবে”

—” কি কাজ?”

—” ওই নাহিদ আছে না? আমাদের বাসায় থাকে? ওকে শিক্ষা দিতে হবে”

—” নাহিদ মানে রোমেসা আন্টির দেবর তো? কি শিক্ষা?

—” হ্যা ওই নাহিদ। ওর হাত আর পা ভাঙতে হবে। আজ রাতেই। পিছন দিকে যে পুরানা মাঠ আছে ওখানে মারবি।ওকে কিভাবে ওখানে ডাকবি আর কি পরিচয় মানে ডাকাত না ছিনতাইকারী কি সেজে মারবি সেটা তোদের ব্যাপার। আমি জানি তোরা এসব কাজ করিস না কিন্তু এই অমানুষটাকে শিক্ষা দেয়া লাগবে। আর কাজ শেষে আমাকে ফোন দিস”

—” আচ্ছা আপু আমি দেখছি কি করা যায়। এমনিই লোকটার নজর খারাপ। আমি কাজ শেষে ফোন দিবোনে।”

সাঁঝ ফোন রেখে ইহানের কথাগুলো ভাবতে থাকলো। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে দেখে ১ টা বাজে। সাকিব ফোন করেছে। সাঁঝ ফোন তুলে বলল,

—” হ্যা বল কাজ শেষ? ”

—” কাজ শেষ কিন্তু আমরা করিনি।”

—” মানে কে করেছে?”

—”আমি নাহিদকে বললাম যে কাজ আছে আসতে হবে। নাহিদ নিজেই বলল উনি ওই মাঠের দিকে থাকবে। তারপর আমার ছেলেদের নিয়ে গিয়ে দেখলাম তিনজন আগে থেকেই মারছে। আমরা দূর থেকে দেখলাম। তারপর চলে গেলাম। পরে আবার গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে এসেছি। নাহলে আমাদের উপর সন্দেহ করতো। তোমার বাড়িতেও খবর গেছে”

—” আচ্ছা ভালো করেছিস। কিন্তু কারা মেরেছে?”

—” জানিনা আপু। দূর থেকে দেখতে পাইনি। মুখ ঢাকা ছিলো”

—” যেই মারুক ভালো কাজ করেছে। তোরা বিয়ের দিন এসে ভালো করে খাবি কিন্তু”

—” আচ্ছা আপু কবজি ডুবিয়ে খেয়ে আসবো”

সাঁঝ ফোন কেটে দিলো। যেই মারুক নাহিদকে ভালো কাজ করেছে। একটা শান্তির ঘুম দিতে পারবে সে। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-০৮

0

#কানামাছি
#পার্টঃ৮
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
সাঁঝ অনেকক্ষন ধরে চেষ্টা করেও শাড়ির কুঁচিটা ঠিক মতো করতে পারছে না। আজকের শাড়িটা হাত থেকে বারবার পিছলে যাচ্ছে। পাঁচবারের মতো চেষ্টা করে কুঁচি করতে না পেরে শাড়িটা ফেলে দিলো। যেটুকু পরা ছিলো সেটুকু পরে বিছানায় বসে পড়লো।

দরজা খুলে কেউ এসেছে বুঝতে পেরেও পিছনে তাকালো না। নিশ্চয় তার সৎবোন লামিসা এসেছে। তার বিয়ে উপলক্ষে মা আর সৎবোন এই বাড়িতেই আছে। সে মানা করেছিলো কিন্তু মা জোর করে থেকে গেছে। কারণ একসময় এটা তার স্বামীর বাড়ি ছিলো! সাঁঝ অবাক হয় মায়ের স্বামী কেন মানা এই বাড়িতে থাকতে? কেন? তার মা যেমনই হোক এই সৎবোনটা বেশ ভালো। ক্লাস নাইনে পড়ে। তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। সারাদিন লাফালাফি আর বকবক করার এক অশেষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে লামিসা। সারাদিন আপু আপু করে মাথা খায়। আপু তোমাকে এভাবে সাজাবো, আপু তোমাকে এটা পরাবো, আপু তুমি এটা খাও তাহলে স্কিন ভালো হবে, আপু এটা মাখো দেখতে ভালো লাগবে, এতো এক্সাইটমেন্ট মনে হয়ে যেন লামিসা নিজেই বিয়ের কনে। ধমক দিলে মন খারাপ করে চলে যায় কিন্তু কিছুক্ষন পরে এসে আবার শুরু হয়ে যায়।
এখন আবার না জানি কি বলতে এসেছে। সাঁঝ বিরক্তি নিয়ে বলল,

—” লামিসা তুমি যদি নতুন কোন রূপচর্চার টিপস নিয়ে এসে থাকো তাহলে চলে যাও। এখন ভালো লাগছে না তোমার বকবক শুনতে।”

সাঁঝ একটু থেমে আবার বলল,

—” একটু পরেই ইহানরা চলে আসবে। আমি শাড়ির কুচি ঠিক করতে পারছি না। তুমি যদি পারো তাহলে এসে আমার কুচি ধরো”

কোন উত্তর না পাওয়ায় সাঁঝ ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” এটা কি ধরনের বেয়াদবি লামিসা? কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন?”

সাঁঝ পিছনে ঘুরে দেখলো লামিসা না নাহিদ এসেছে তার ঘরে! দেয়াল হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। গায়ে আঁচল থাকলেও কোমড়ের কাছে শাড়ি এলোমেলো হয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সাঁঝ কোনরকমে শাড়িটা গুছিয়ে নিজের হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—” এটা কি ধরনের বেয়াদবি? না বলে আপনি আমার ঘরে কেন ঢুকেছেন? আপনার সাহস তো কম না! এতো কিছুর পরেও আবার এসেছেন?”

নাহিদ কিছু না বলে হায় তুললো। কিন্তু যাওয়ার কোন লক্ষন দেখালো না। বরং আরো আয়েশ করে দাঁড়ালো। নাহিদ ইচ্ছা করে এরকম সময়ে এসেছে। সাঁঝ শাড়ি পরে মারামারি করতে পারবে না তার সাথে। এখন নড়তেও পারবে না। সাঁঝ বলল,

—” বের হন আমার ঘর থেকে। নাহলে মেরে পঙ্গু বানিয়ে দিবো”

নাহিদ হায় তুলতে তুলতে বলল,

—” আগে ওখান থেকে হেঁটে আসো তো আমার কাছে! আমি একটু দেখি তোমাকে চোখ ভরে!”

সাঁঝের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। জোরে চিৎকার দিলো,

—” লামিসা? ফুফু? একটু এখানে আসো তো”

—” আরে এতো জোরে চিল্লাচ্ছো কেন? বিয়ের কনের গলা খারাপ হলে বিষয়টা ভালো হবে না। বাড়ির সবাই ছাদে গেছে। তোমার গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান ওখানে হবে কিনা দেখতে। এই দোতালা থেকে চিৎকার দিলে পাঁচ তালার উপরে শুনতে পাবে না”

সাঁঝ বিপাকে পড়লো। না কুচি ঠিক করতে পারছে, না শাড়িটা ছেড়ে দিতে পারছে আর না নাহিদকে গিয়ে মারতে পারছে। ফোনটাও নাহিদের পিছনে টেবিলের উপর রাখা। কিছুটা সময় পার করার জন্য সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” কেন এসেছেন এখন এই ঘরে?”

নাহিদ দুইপা এগিয়ে দেয়ালের সাথে আবার হেলান দিয়ে বলল,

—” আমার নিজের কিছু ইচ্ছা,আকাঙ্খা আছে সেগুলো পূরণ করতে হবে আর তোমার সাথে তো পুরানো হিসাব বাদ আছে। ওগুলো মেলাতে হবে না?”

সাঁঝ বুঝতে পারলো আজ পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে। জানালা থেকে একটু দূরেই ছিলো সাঁঝ। একটু এগিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দেখলো ইহান নামছে গাড়ি থেকে। একমুহূর্তের জন্য ইহানকে দেখে নিজের ভিতরে একটা প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেলো। মনে হলো ইনাকেই তো দরকার ছিলো। সাঁঝ ডাক দিলো,

—” ইহান”

সাঁঝের রুম রাস্তা থেকে একটু সাইডে হওয়ায় ইহান প্রথমে তাকে খুঁজে না পেলেও এদিক ওদিক তাকানোর পরে জানালার ধারে সাঁঝকে দেখতে পেলো। হাত তুলে বলল,

—” আরে সাঁঝ! আমি ভিতরে আসছি”

ইহানের গলার আওয়াজ নাহিদের কান পর্যন্ত গেলো। নাহিদ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো। সাঁঝ তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ফুফুকে ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলল। সবাই নিচে নেমে আসলে সাঁঝ লামিসাকে ডেকে শাড়ির কুচি ঠিক করে নিলো। বসার ঘরে সবাই আছে। আজ বিয়ের শপিংয়ে যাবে তাই এতো আয়োজন। সাঁঝে কিছুটা বিরক্ত লেগেছে। এতো কেন করতে হবে? কিন্তু ইহান একমাত্র ছেলে তাই ওর পরিবারের সবার অনেক ইচ্ছা ছেলের বিয়েতে আনন্দ করবে।
আজ ইহানে মা আর বোনের সাথে বড় চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাইও এসেছে। ইহানের বড় চাচাকে দেখে সাঁঝের মনে একটু খটকা লাগলো। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে বড় চাচাকে। কিন্তু মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে। আবার গলা শুনে অপরিচিত গলা মনে হলো। সাঁঝ মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় দেখেছে বা কি চেনা চেনা লাগছে।

এরপর সবাই নিচে চলে আসলো। ইহান, সাঁঝ, লামিসা আর ইশিতা একগাড়িতে। আর অন্য গাড়িতে ইহানের মা, বড় চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাই। চাচাতো ভাইয়ের নাম রিফাত। ইহানের সাথে খুব ক্লোজ দেখেই বোঝা যায়। সবসময় দুজন ফুসুরফুসুর করতেই থাকে।
গাড়ি চালাতে চালাতে ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” তুমি কি আজ শুধু শপিংয়ে যাওয়ার জন্য শাড়ি পরেছো না অন্য কোন কাজ আছে?”

সাঁঝ ইহানের দিকে ঘুরে বলল,

—” না আজ ভার্সিটিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টে একটা ছোট প্রোগ্রাম আছে। সেজন্যও পরেছি”

—” প্রোগ্রাম কখন? আমারও তো ক্লাস আছে। তাহলে শপিং শেষ করে একসাথে যেতে পারবো”

—” প্রোগ্রাম তো বিকালে কিন্তু দুপুরে গিয়ে কাজ করতে হবে”

—” আচ্ছা”

সাঁঝ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। একটু পরে ইহান বললো,

—” শাড়ি পরে ভার্সিটিতে যাওয়া ঠিক হবে না”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কেন?”

ইহান সাঁঝের দিকে না তাকিয়ে বলল,

—” তুমি বোধহয় জানো না তোমাকে শাড়ি পরে অনেক সুন্দর লাগে”

হঠাৎ করে সাঁঝ চমকে উঠলো। একটা ভালো লাগার পরশ যেনো তাকে ছুয়ে গেলো। গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে মাঝে মাঝে ইহানের দুই একটা কথায় এমন অনুভূতি হচ্ছে। সাঁঝ বুঝতে পারছে এটা ঠিক হচ্ছে না। নিজেই নিজেকে বলল, “সাঁঝ নিজেকে আটকাও। তোমার কিছু কাজ,কিছু উদ্দেশ্য আছে। সেগুলোর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু না। অন্য কোন জিনিসে এখন মন দিবে না।”
ইহানের দিকে তাকিয়েই নিজের ভাবনার জগতে ডুবে গিয়েছিলো সাঁঝ। হঠাৎ সামনের আয়নায় তাকিয়ে দেখলো ইশিতা আর লামিসা হাসছে। সাঁঝ খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।

মার্কেটে গিয়ে সাঁঝ কোন কিছুতে তেমন মন দিতে পারলো না। ঘুরে ফিরে চোখ শুধু ইহানের চাচার উপর গিয়েই পড়ছে। সাঁঝের চিন্তা ভাবনা উনাকে ঘিরেই ঘুরছে। কেমন যেন একটা বিষন্নতা রয়েছে উনার চেহারার মধ্যে। অনেক ঘোরাঘুরি করে কিছু জিনিস কিনে আর কিছু জিনিসের অর্ডার দিয়ে সাঁঝ আর ইহান চলে আসলো। বাকি যা কেনাকাটা তা বাড়ির লোকজন করবে। ওদের দুজনকেই এখন যেতে হবে ভার্সিটিতে। দুজনে একজায়গায় বসে লাঞ্চ করে ভার্সিটিতে চলে গেলো।
,
,
,
🌿
ভার্সিটিতে নেমে সাঁঝ নিজের মতো ক্লাসের দিকে চললো আর ইহান অফিসরুমে। সাঁঝ ঘড়িতে দেখলো এখনো অনেক সময় আছে প্রোগ্রামের। এতো তাড়াতাড়ি গিয়ে কোন কাজ করা যাবে না। এর মধ্যে নিজের গ্রুপের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে। দুপুরবেলা হওয়ায় মাঠে কেউ নেই। সাঁঝ ক্যান্টিনের দিকে চললো। দূর থেকে দেখতে পেলো তার গ্রুপের সবাই বসে আছে। আরো অনেক ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
সাঁঝ ক্যান্টিনের ভেতরে পা রাখতেই তার গ্রুপের সবাই ঘুরে তাকালো। এমনভাবে সবাই তাকাচ্ছে যেন কোন ভূতকে দেখছে। একটু খেয়াল করে দেখলো শুধু তার গ্রুপই না ক্যান্টিনের মোটামুটি সবাই তাকে ঘুরে দেখছে। সে কাছে আসতেই ইরা বলল,

—” সাঁঝ তুই শাড়ি পরেছিস?”

—” হ্যা কেন?”

দীপ বলল,

—”যেই সাঁঝ নবীনবরণের দিনে শাড়ি পরবে না এটা নিয়ে সব সিনিয়রদের সাথে ঝামেলা করেছে সে আজ কোন উপলক্ষ ছাড়া শাড়ি পরে ভার্সিটিতে এসেছে?”

শাওন বললো,

—” কি ব্যাপার বলতো? আজ পর্যন্ত তো তুই কখনো শাড়ি পরিসনি আজ কি মনে করে?”

সাঁঝ বিরক্ত হয়ে বলল,

—” Guys relax! সামান্য একটা শাড়িই। এমন কিছু না। আজ আমার ডিপার্টমেন্টে প্রোগ্রাম আছে তাই পরেছি”

রুনা বলল,

—” মোটেই সামান্য না। তুই এই শাড়ি পরা নিয়ে ভার্সিটিতে কম ঝামেলা করিসনি। ম্যাডামদের পর্যন্ত বলেছিস। তাই আজ অবাক লাগছে”

সাঁঝ বললো,

—” আমি নিজে যা চাই তাই করতে পছন্দ করি। বাধ্যবাধকতা আমার এতো ভালো লাগে না। আর শাড়ি নিয়ে বাধ্যবাধকতা আমার কাছে খুবই হাস্যকর লেগেছিলো। তাই সেই সময়ে বলেছিলাম যত যাই হোক আমি শাড়ি পরবো না। কিন্তু এখন ইচ্ছা হয়েছে তাই পরেছি।”

আর কেউ কিছু বললো না। সাঁঝ নিজের ব্যাগ থেকে ছয়টা কার্ড বের করলো। ওদের সামনে দিয়ে বলল,

—” নে”

সামি জিজ্ঞেস করলো,

—” কিসের কার্ড?”

—” আমার বিয়ের কার্ড।”

সবাই আবার হা করে তাকালো তার দিকে।।ইরা কোনমতে বলল,

—” সাঁঝ তুই বিয়ে করছিস? কবে?”

সাঁঝ হায় তুলয়ে তুলতে বলল,

—” সামনের শুক্রবার। ছয়দিন পরে। বর হলো তোদের ইহান স্যার। এবার তোরা স্বাভাবিক হয়ে যা। নাহলে আমি উঠে যাবো।”

ওরা কার্ডটা পড়া শুরু করলো। আর কিছুক্ষণ পরে নিজেদের প্ল্যানিংও শুরু হয়ে গেলো কে কি করবে। আর সাঁঝ শুধু বসে ওদের এই কান্ড দেখতে থাকলো। সাঁঝের চোখ হঠাৎ ইহানের উপর পড়লো। দূর থেকে দেখতে পেলো ইহান ফোনে কথা বলছে। সাঁঝ চাপাস্বরে আশিককে ডাকলো। সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত তাই তাদের কথা কেউ শুনছে না। সাঁঝ বলল,

—” একটা কাজ করে দিতে পারবি?”

—” হুম বল”

—” ইহান সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। অনিকের সাথে ইহানের কোন সম্পর্ক আছে কিনা খোঁজ নিবি তো। মানে ক্লাসমেট, বন্ধু বা দুজনের মধ্যে কোন সংযোগ আছে কিনা একটু খোঁজ নিস”

আশিক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

—” ইহান স্যারের সাথে তোর বিয়ে আর তুই উনাকে সন্দেহ করছিস?”

—” আরে না না ইহান অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি ওই অমানুষটার সাথে ইনার কোন যোগাযোগ আছে কিনা? আমি চাইনা অনিকের কোন ছায়া আমাদের জীবনে পড়ুক”

—” আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো”

—” হুম”

সাঁঝ মুখে অনিকের ছায়া না পড়ুক বললেও অনিকের ছায়া পড়লেও তার কিছু যায় আসে না। অনিক আর ইহানের কোন সম্পর্ক আছে কিনা এটা জানা দরকার। যদিও অনিকে চরিত্রের সাথে মিল আছে এমন কিছু দেখেনি ইহানের মধ্যে তাও কেন যেন এটা মনে হচ্ছে। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-০৭

0

#কানামাছি
#পার্টঃ৭
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
—”কি অদ্ভুত না?নিজের প্রাক্তন আর ভবিষ্যতে যে আসবে তার দেয়া উপহার একই হাতে পরা! জীবনটা খুব বিচিত্র”

সাঁঝ কথাটা বলে পশ্চিম আকাশে ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে তাকালো। আকাশে লাল, গোলাপি আভা ছড়িয়ে আছে। কিছু কিছু মেঘের গায়ে গোলাপি আভা লেগে দেখতে হাওয়াই মিঠাই এর মতো লাগছে। সাঁঝে মনে হলো একটা কাঠি নিয়ে গিয়ে একটু মেঘকে কাঠির মাথায় আটকে দিব্যি হাওয়াই মিঠাই হিসেবে খাওয়া যাবে।

আর ইহান সাঁঝের দিকে তাকিয়ে আছে। হালকা বাতাসে চুল উড়ছে। একটা খয়েরী রঙের শাড়ি পরে আছে। সাঁঝকে কেমন যেন নিজের বউ বউ লাগছে! ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” ভালোবাসতে প্রাক্তনকে?”

—” সে বাসতো”

—” তুমি তো বাসতে না। সেটাই যথেষ্ট”

সাঁঝ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনার খারাপ লাগছে না? আমি যে প্রাক্তনের কথা বলছি তার দেয়া উপহার হাতে পরে আছি সেটা নিয়ে?”

ইহান ছাদের রেলিঙে উল্টো হয়ে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে বলল,

—” নাহ খারাপ লাগবে কেন? তোমার ভালোবাসার পুরোটাই তোলা আছে। সেটা হাসিল করে নেয়ার ব্যাপারটা আমার”

—” বাহ এতো confidence?”

—” কেন নয়? তোমার হাতটা দাও তো”

সাঁঝ নিজের হাতটা এগিয়ে দিলো। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলো। একই সাথে অনিকের দেয়া ব্রেসলেট আর আজকে ইহানের মায়ের দেয়া চুড়ি পরে আছে! সে নিজেও জানেনা কি উদ্দেশ্যে অনিকের দেয়া ব্রেসলেটটা পরেছে। যদিও সেই হার্ট শেপটা নেই। সেটা ফেলে দিয়েছে। কিন্তু
তবুও এটা অনিকের দেয়া। হয়ত ইহানকে ভড়কে দেয়ার উদ্দেশ্য এটা পরেছে। মা তাকে ঝামেলা করতে মানা করেছে কিন্তু ইহানকে পরীক্ষা করতে মানা করেনি। বিয়ের আগে বরকে একটু টেস্ট করায় যায়।

ইহান কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্রেসলেটটা খুলতে থাকলো। সাঁঝ কোন প্রতিরোধ করলো না। খোলা হয়ে গেলে বলল,

—” এটা না থাকায় ভালো। অতীতকে অতীতে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাই?”

—” হুম”

ইহান ব্রেসলেটটা ছুড়ে পাঁচ তালার ছাদ থেকে ফেলে দিলো। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” ফেলে দিলেন?”

—” হুম ”

—” আমি মজা করছিলাম। ওটা প্রাক্তনের দেয়া ছিলো না। আমার কোন প্রাক্তনই ছিলো না”

—” জানি”

সাঁঝ এতোক্ষণে অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো,

—” কিভাবে জানেন?”

—” প্রাক্তন থাকবে তার দেয়া উপহারও হাতে পরে থাকবে কিন্তু চোখে মুখে কোন ভালোবাসার আভা দেখা যাবে না এটা তো হতে পারে না। যারা ভালোবেসে হারিয়ে ফেলে তাদের চোখে বেদনা স্পষ্ট থাকে। তোমার চোখে নেই সেটা”

—” বাহ আপনি দেখছি mind reading জানেন”

ইহান সাঁঝের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” হ্যা চোখের দিকে তাকিয়ে পিছনের অনেক কিছুই বলতে পারি আমি”

সাঁঝ চোখ সরিয়ে নিলো। চোখ সরানোর একমূহুর্ত পরে মনে হলো সে কি ভয় পেলো ইহানের কথায়? চোখ দেখে ইহান তার অতীতের অনেক কিছু জেনে যাবে এটার ভয়েই কি চোখ সরিয়ে নিলো? ঠিক করলো আবার তাকাবে। বিয়েটা করছে মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে। এই সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি আশা নেই। ইহান সব জেনে যদি ছেড়েও দেয় তাতেও তার তেমন কিছু যাবে আসবে না। ইহানের প্রতি তার মায়া, মমতা,ভালোবাসা কিছুই নেই। তাই ইহানকে ছাড়তে তার কষ্ট হবে না।

সাঁঝ আবার তাকিয়ে দেখলো ইহান তার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই দৃষ্টিতে কিছুটা মুগ্ধতা আছে হয়তো। সেজন্য সাঁঝ লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেই অবাক হলো সে লজ্জা পাচ্ছে? ভাবা যায়! তারপর আড়চোখে দেখলো ইহান অন্যদিকে তাকিয়েছে। সে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” চোখের দিকে তাকিয়ে সবাইকে খোলা বই ভাববেন না। যাকে খোলা ভাবছেন হতে পারে সেটা রহস্যে ঘেরা ধাঁধায় পরিপূর্ণ একটা বই!”

—” হুম হতে পারে। কিন্তু সব ধাঁধার সমাধান ঠিকই থাকে।”

ইহানের কথার কোন জবাব না দিয়ে সাঁঝ আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,

—” দেখুন ঐ মেঘগুলোকে হাওয়াই-মিঠায়ের মতো লাগছে। ইচ্ছা করছে এনে খেয়ে নিই”

ইহান মেঘের দিকে তাকালো। সাঁঝের কথায় হাসি পেলো কিছুটা। সাঁঝের ভাবনার মধ্যে বাচ্চামী লুকিয়ে আছে অনেকটা। সে বলল,

—” যদি ইচ্ছা হয় তাহলে খেয়ে নেয়া উচিত। ইচ্ছাকে পুষে রাখার কোন মানে হয়না।”

—” কিভাবে?”

—” ওয়েট”

সাঁঝ ইহানের কাজ দেখতে থাকলো। ইহান ছাদে খুঁজে খুঁজে একটা কাঠি বের করলো। তারপর সেটা নিয়ে হাতটা উঁচু করে কাঠিটা ঘুরাতে থাকলো। দূরে থেকে দেখলে মনে হবে মেঘকে কাঠির চারপাশে পেচিয়ে নিচ্ছে। এরপর সাঁঝের সামনে এনে বলল নাও খাও তোমার হাওয়াই মিঠাই। সাঁঝ একটু হেসে সেই অদৃশ্য হাওয়াই মিঠাই খেতে থাকলো।
কারোর কাশির শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখলো ইশিতা দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলো,

—” আসবো?”

সাঁঝ কিছু বলার আগেই ইহান বললো,

—” এই যে পেত্নীর আগমন হয়েছে। এসে যখন পড়েছেন তখন আসেন”

ইশিতা তাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

—” খাওয়া দাওয়া হলো?”

সাঁঝ আর ইহান একে অপরের দিকে তাকালো। ইশিতা আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” তা কি খেলেন যদি আমাকে একটু বলতেন। আমি আসলে কোন খাবার দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু খেতে দেখছি”

ইহান বললো,

—” তোর এতো কিছু দেখতে হবে কেন? খেতে দেয় না বাসায় তোকে?”

ইশিতা একটু রেগে বলল,

—” এই তুই একদম কথা বলবি না। খুব তো আমাকে বিয়ে দিয়ে তাড়াতে চাচ্ছিলি। এখন ভাবী আসছে। দেখি তুই কেমন করে আমাকে তাড়াস। ”

ইহান বাঁকা হেসে বলল,

—” হ্যা তোর ভাবী এসেছে এবার আমরা দুজন মিলে তোর বর খুঁজবো”

ইশিতা এবার মুখ ফোলালো। সাঁঝ সেটা দেখে হেসে বলল,

—” নিচে কি আমাদের ডাকছে?”

—” হ্যা ভাবী এখন ডাকছে”

—” আচ্ছা চলো তাহলে সবাই”

সাঁঝ, ইহান আর ইশিতা সিড়িঘরের কাছে আসার পরে ইহান সাঁঝের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে বলল,

—” শাড়ি পরে নামতে অসুবিধা হবে না তো?”

সাঁঝ কিছুটা অবাক হলো। বাবার পরে এভাবে কতদিন পরে আবার একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কারোর সাহায্য নেয়ার অভ্যাসটা এখন চলে গেছে। সে বলল,

—” না আমি সামলে নিতে পারবো”

ওরা তিনজন মিলে বাসায় চলে আসলো। ড্রয়িংরুমে অনেক মানুষজন বসে আছে। সাঁঝের মা, তার স্বামী, সাঁঝে সৎ ভাই-বোন, ফুফা-ফুফু, ইহানের পরিবার সবাই আছে। তারা আসতেই ইহানের মা একটা উষ্ণ হাসি দিয়ে সাঁঝের হাত ধরে টেনে একটা সোফায় নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। আরেক পাশে ইহান বসলো। ইহানের মা একহাত দিয়ে সাঁঝকে জড়িয়ে ধরে সবার সাথে কথা বলতে থাকলো বিয়ের সব বিষয় নিয়ে।
সাঁঝ উৎসুকভাবে সব দেখছে। বাড়িতে কারোর বিয়ে হলে সবাই কি এতো খুশি হয়? দেখে মনে হচ্ছে সবাই কত খুশি! শুধু তার অনুভূতি শূন্য।
হঠাৎ সাঁঝের মনে হলো বিয়ের কনেদের বিয়ের আলোচনার সময় মাথা নিচু করে বসে লজ্জা পাওয়া উচিত। কিন্তু তার কোন লজ্জাই লাগছে না। বরং সবার কথা আর আয়োজনের ব্যবস্থা শুনে মজা লাগছে। কোন কোন কথার মাঝে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে “এটা এভাবে না করে ওভাবে করলে ভালো হবে”। আফসোস হলো যদি ভাইয়া থাকতো তাহলে ভাইয়ার বিয়েতে নিজে সব ব্যবস্থা করতো!

সামনে চোখ যেতেই দেখলো ইশিতা আর তার সৎবোন লামিসা তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সাঁঝ চোখ কুচকে ওদের দিকে তাকালো। হঠাৎ কি মনে করে একবার পাশে ইহানের দিকে তাকালো। দেখলো ইহান তার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ আবার লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। ইহানকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই ওরা দুজন হাসছিলো। সাঁঝে তার খুব অস্বস্তি লাগতে শুরু হলো। এরপর একে একে তার মা, ফুফু, ইহানের মা সবাই বিষয়টা খেয়াল করলেও ইহানের কোন হুশ নেই। সাঁঝ কটমট করে তাকালো। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি দেখছেন এভাবে?”

—” এই তো একই মানুষের কত রূপ!”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” মানে?”

—” তোমাকে একেক সময় একেক রকম লাগে। মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। ছাদে এক রকম এখানে আরেকরকম। বোঝার চেষ্টা করছি আর কত রূপ আছে”

সবাই তাদের দিকে তাকালে সাঁঝ আর কোন কিছু বললো না। ঠিক হলো আটদিন পরে বিয়ে। আর বিয়ের আগে পরের সব অনুষ্ঠানই হবে। সামনেই ইহানের কাজের ব্যস্ততা আছে অনেক তাই তাড়াতাড়ি করা হচ্ছে। সবাই যাওয়ার সময় সবার আড়ালে ইহান একটা ছোট বক্স সাঁঝের হাতে দিয়ে দিলো।
,
,
,
🌿
জানালার ধারে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে সাঁঝ বসে আছে। ভেজা চুল পিঠ ছড়িয়ে দেয়া। সন্ধ্যার দিকে ইহানরা যাওয়ার পর থেকে কারেন্ট নেই। গরমে অস্থির হয়ে শাওয়ার নিয়ে এখন জানালার ধারে বসে আছে। আজকাল এই বাসায় তার কদর বেড়েছে। তার ফলস্বরূপ এই চা পেয়েছে রাতের বেলায়। ফুফু বেশ খেয়াল রাখে এখন। সে চলে গেলে তো তাদেরই ভালো। তাই খেয়াল রাখে যাতে কোন ঝামেলা করে না বসে।
অল্প কয়েকদিনের মাঝে জীবনে কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাত্র আটদিন পরে তার বিয়ে। সে নিজে কখনো বিয়ের কথা ভাবতেই পারেনা কিন্তু কত তাড়াতাড়ি তার জীবনটা অন্য আরেকজনের সাথে আটকে গেলো। প্রথমে ইহান আসলো তার পরের দিনে মায়ের চাপে পড়ে হ্যা বলে দিলো। সবাই ইহানের খোঁজ নিলো ভালো করে তার পাঁচদিন পরে আজ ইহানের বাসা থেকে এসে তাকে দেখে গেছে। সাথে বিয়ের দিনও ঠিক করে গেছে! সব কত দ্রুত হয়ে গেলো। চোখের নিমিষে জীবন পুরো ঘুরে গেলো।

হালকা বাতাস আসছে এটাই যা শান্তি। নাহলে আবার ঘেমে এককার হয়ে যেতো। আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে অনেক।।চাঁদও আছে কিন্তু সাঁঝের ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে না। ফোনে মেসেজের শব্দ শুনে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আশিকের মেসেজ এসেছে।
সাঁঝ,
অনিকের বাবা-মা দেশে নেই। এক সপ্তাহ আগে বাইরে চলে গেছে। আমি আর কিছু জানতে পারিনি।

মেসেজটা পড়ে সাঁঝ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অনিক এখন একটা ধাঁধার মতো হয়ে গেছে তার কাছে। যাকে সমাধানের কোন ক্লু পাচ্ছে না। সাঁঝ ভাবলো আজই কি ছবিগুলো লিক করে দিবে? তারপর মনে হলো না। সময় আসুক তারপর।

এরপর আবার কি মনে করে নিজের ফেক একাউন্টে আবার ঢোকার চেষ্টা করতে থাকলো। সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করেছিলো এখন আবার ঢুকে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু দুই বার চেষ্টা করেও একসেস করতে পারলো না। অন্ধকারে কাগজে লেখা পাসওয়ার্ড খুঁজে আর ঢুকতে ইচ্ছা হলো না। ফোনটা বিছানায় রেখে হাত সরাতে গেলে একটা কিছুর সাথে হাত লেগে গেলো। জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখলো ইহানের দেয়া সেই বক্স। দেখতে বেশ কিউট বক্সটা।

মোবাইলের লাইট জ্বেলে বক্সটা খুললো। ভিতর থেকে একটা চাবির রিং। তার সাথে কিছু একটা ঝুলে আছে। সাঁঝ লাইটটা ভালো করে নিয়ে দেখলো একটা হার্ট শেপের কিছু। দেখার পরে তার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো। অনিকের দেয়া ব্রেসলেটেও এমন হার্ট শেপ ছিলো। যেটা সাঁঝ ভেঙে ফেলেছিলো। একই রকম! সাঁঝ অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে অনিকের দেয়া সেই হার্ট শেপটা খুঁজে বের করলো। দুটা পাশাপাশি রাখলো। ভালো করে দেখার পরে বুঝলো ইহানের দেয়া রিংটা একটু বড়। আর ওর ভিতরে S.E লেখা। অনিকেরটাতে S.A লেখা। কিন্তু হঠাৎ করে দেখলে দুটাকে একই বলে ভ্রম হয়।

সাঁঝ বাইরে তাকিয়ে ভাবতে থাকলো গত কয়েকদিনে তার চারপাশের অনেক কিছুই অদ্ভুত লাগছে। এখন প্রশ্ন আসলেই অদ্ভুত না তার কাছে অদ্ভুত লাগছে?
(চলবে)

কানামাছি পর্ব-০৬

0

#কানামাছি
#পার্টঃ৬
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
সাঁঝ আংশিক হা করে তাকিয়ে আছে। সামনে ইহান নীল পাঞ্জাবি পরে মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। পাশে একটা কম বয়সী ছেলে বসে আছে। ইহান আর সাঁঝ নিজেদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা ছাড়া আর কেউ রুমে নেই। ইহানের পাশের ছেলেটার কাশির শব্দে ওরা দুজনে হুঁশে ফিরে।
সাঁঝের বাসার লোকজনও অবাক হয়ে গেছে কারণ সাঁঝ পাত্রপক্ষের সামনে এসেই একটা না একটা কান্ড করে বসে। আজ চুপ আছে! রোমেসা বেগম ইহানকে বললেন,

—” এটা হলো মেয়ে। সাঁঝ। তুমি তো সাঁঝকে আগে থেকে চিনেই এসেছো তাই আর তেমন কিছু বললাম না”

ইহান একটু হেসে সাঁঝকে বলল,

—” আসসালামু আলাইকুম। আমি ইহান রহমান। তোমার ভার্সিটির লেকচারার। আমাদের তো আগে দেখা হয়েছে ভার্সিটিতে। আর এটা হলো আমার গার্জিয়ান। আমার মামা আবির”

সাঁঝ আড়চোখে ইহান আর পাশের ছেলেটার দিকে তাকালো। যাকে ইহান মামা বলছে সে নিতান্ত একটা বাচ্চা ছেলে। মনে হচ্ছে ফু দিলেই উড়ে যাবে। ইহান খুব আগ্রহ করে তাকে দেখছে। আর ইহানের দিকে তাকিয়ে সাঁঝের সেদিন ভার্সিটিতে ইহানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। পুরানো কথা মনে হতেই সাঁঝ নিজের ফর্মে ফেরত আসলো। সে হাতের সিগারেটটা মুখে চেপে ধরলো। এটা দেখে সাঁঝের পরিবার ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকলো। একটা ভালো ছেলে নিজে থেকে দেখতে এসেছিলো সাঁঝকে, সাঁঝ তাকেও তাড়াবে। নাহিদ অবশ্য মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলে পালিয়ে গেলে তারই সুবিধা।
সাঁঝ মাঝে মাঝে টান দেয়ার ভাণ করছে আর আড়চোখে ইহানকে দেখছে। মনে মনে গুণতে শুরু করেছে ইহান কতক্ষণে উঠে চলে যাবে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও ইহান উঠে গেলো না। বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝের দম বন্ধ হয়ে বমি বমি লাগা শুরু করলো। সিগারেটের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না সাঁঝের। কিছুটা ভয় হলো সবার মাঝে কি বমি করে দিবে নাকি? তারপর মনে হলো করলে ইহানের গায়েই করবে। তাতে সেদিনের ব্যবহারের একটা শাস্তি হবে। ইহান হঠাৎ সাঁঝকে বলল,

—” Can you share that with me?”

সাঁঝসহ তার পুরো পরিবার হা করে ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এমনকি ইহানের মামাও তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইহান আবার বলল,

—” আমাকে দাও”

সাঁঝ একপ্রকার ঘোরের মধ্যে থেকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। ইহান একটু হেসে সিগারেট নিয়ে নিজের ঠোঁটে চেপে ধরলো। আর বাকি সবাই তার দিকে এমন তাকিয়ে থাকলো যেনো সার্কাস হচ্ছে। ইহান বলল,

—” তাহলে কথা শুরু করি?”

রোমেসা বেগম বলল,

—” হ্যা শুরু করি। তোমার বাবা-মা কেউ আসবে না? আজ আসলো না যে!”

—” হ্যা মা-বাবা কাল আসবে। আসলে আমার মা-বাবা আমার পছন্দে বিশ্বাসী। তাই প্রথমে আমিই আসলাম মামাকে নিয়ে। আমার কিন্তু সাঁঝকে পছন্দ হয়েছে”

তারপর মামার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” মামা তোমার কেমন লাগলো মেয়েকে?”

ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল,

—” হ্যা হ্যা মেয়েকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে ভাগ্নের জন্য”

ইহান একটু হেসে সাঁঝের ফুফুর দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আসলে সাঁঝকে আমার প্রথম দিন ভার্সিটিতে দেখেই ভালো লেগেছিলো। তারপর আজ আবার ভালো লাগলো। আজ coincidentally আমাদের জামার রঙও একই”

রোমেসা বেগম আড়চোখে সাঁঝের দিকে তাকালেন। উনি বুঝতে পারছেন না সাঁঝ এরপর কি করবে? সাঁঝের প্রথম প্ল্যান তো মার খেয়ে গেলো।
সাঁঝ ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইহান নিজেও সিগারেট টানছে না কেবল মুখে ধরেছিলো তার মতো। এখন তো ইহানের মুখ লাল হয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে। সাঁঝের বুঝতে কষ্ট হলো না ইহানও তার মতো সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। ইহান জানালা দিয়ে সিগারেটটা ফেলে পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করলো। তারপর বলল,

—” তাহলে আংটি পরিয়ে দিই? মা আসার আগে দিয়ে দিয়েছে যাতে মেয়ে পছন্দ হলে আমি আংটি পরিয়ে আসি”

রোমেসা বেগম সাঁঝের হাত জোর করে এগিয়ে দিলো। ইহান আংটি পরিয়ে দিলো সাঁঝের হাতে। রোমেসা বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অবশেষে এই মেয়ে বিদায় হবে। উনি হেসে বললেন,

—” নাও মিষ্টি মুখ করো”

এরপর বেশ কিছুক্ষণ খাওয়া দাওয়ার পর্ব চললো। সাঁঝ তব্দা মেরে বসে থাকলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এমন কান্ড ঘটানোর পরেও কেউ তাকে আংটি পরিয়ে দিয়েছে! ভাবা যায়! খাওয়া দাওয়া শেষ হলে ইহানের মামা বলল,

—” আজ তাহলে আসি। কাল আপা আর দুলাভাই এসে বিয়ের তারিখসহ সব ঠিক করে যাবে”

সাঁঝের ফুফা বলল,

—” হ্যা হ্যা। কাল সব বিস্তারিতভাবে ঠিক করে নেবো”

ইহানরা উঠে চলে যাওয়ার সময় ফুফুরা তাদের এগিয়ে দিতে গেলেও সাঁঝ বসে থাকলো। সে ভেবে চলেছে বিয়েটা যদি সত্যি ঠিক হয়ে যায় তাহলে ভাঙবে কিভাবে ? অনিকের শাস্তি সম্পূর্ণ হয়নি। অনিকের খোঁজও বের করতে হবে। তাছাড়া ইহানকেও তেমন পছন্দ হয়নি। সাথে ইহানের আচরণ অনেক সন্দেহজনক। কোন মানুষ কেন একটা সিগারেট খাওয়া উগ্র মেয়েকে নিজের বউ বানিয়ে নিয়ে যাবে? কেন? সাঁঝের ভাবনার মধ্যেই ইহান আবার রুমে আসলো। সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ফোনটা নিতে ভুলে গেছি।”

ফোন নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘুরে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ভালোই হবে। বিয়ের পরে আমরা দুজন একসাথে সিগারেট খাবো”

এরপর চোখ মেরে চলে গেল। সাঁঝ হা করে ইহানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের ঘরে এসে চুড়িগুলো খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো। কাঁচের চুড়িগুলো পড়ে ভেঙে গেলো। ইহানের পরিয়ে দেয়া আংটিটাও ফেলে দিলো। রাগে গা হাত পা কাপছে সাঁঝের। মনে হচ্ছে সব ধ্বংস করে দিক। এভাবে তার প্ল্যান ফেইল হবে ভাবতেও পারেনি। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে! বিয়ে নামক সম্পর্কটার উপরও তার ঘৃণা আছে। আজ বিয়ে করবে। কতশত প্রমিস, স্বপ্ন থাকবে তারপর কাল সে মারা গেলে দুদিন যেতে না যেতে বর অন্য কোথাও বিয়ে করে সুখে থাকবে। এসব মিথ্যা সম্পর্কে জড়ানোর কোন মানে হয়না। সাঁঝের মতে, বিয়ের সম্পর্কটাও তার আর অনিকের সম্পর্কের মতো নাটক, মিথ্যা আর ঠুনকো হয়। সাঁঝ শাড়ি পরেই শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো লম্বা শাওয়ার নিয়ে বাইরে আসলো। এরপর ফুফুর কাছে গেলো কথা বলার জন্য

ফুফুকে আজ খুশি খুশি লাগছে। লাগবে নাইবা কেন? তাকে যে বিদায় করতে পারবে। সাঁঝ উঁচু গলায় বলল,

—” ওই ছেলে নাম্বার দিয়ে গেছে কোন?”

—” হ্যা কেন কথা বলবে?”

—” ফোন করে বলো আমি বিয়েতে রাজী না। তুমি না হলে আমাকে দাও আমি ফোন করছি”

—” কেন পছন্দ না? তুমি এতো কান্ড করার পরেও ছেলে তোমাকে পছন্দ করেছে। আংটি দিয়ে গেছে। তাও তোমার অপছন্দ হওয়ার কারণ কি? বয়স তো কম হলো না তোমার!”

—” ওই ছেলে তোমাদের পছন্দ হয়েছে? অবশ্য তোমাদের রুচি নিয়েই বা কি বলতে পারি? সবার সামনে বসে সিগারেট খায়! একটা নেশাখোর ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিবে?”

রোমেসা বেগম একটু হেসে বললেন,

—” ছেলেটাকে কিছু বলার আগে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখো। তুমি কেমন? নেশাখোর মেয়ের সাথে নেশাখোর ছেলেই যায়।”

সাঁঝ চিৎকার দিয়ে বলল,

—” তুমি মানা করবে না তাই তো? ঠিক আছে। কাল আসলে আমিই মানা করে দিবো”

সাঁঝ নিজের রুমে এসে জোরে দরজা বন্ধ করে দিলো। এই এলাকায় সবাই তাকে গুন্ডি বলে জানে। এটা ইহানের কানে তুলতে হবে। তার এলাকার গ্রুপের যে লিডার সাকিব তাকে ফোন করবে বলে ঠিক করলো। সাকিব তার থেকে ছোট। তার সব কথা মেনেই চলে। সাঁঝ ফোন দিলো। ওপাশে ফোন ধরার পরেই সাঁঝ বললো,

—” সাকিব ব্যস্ত আছিস?”

—” না আপু। বলো”

—” একটা কাজ করতে হবে। একটা ফোন নাম্বার দিচ্ছি। যার নাম্বার তার নাম ইহান। তাকে আমার সম্পর্কে বলবি। যে আমি গুন্ডামি করি। চাঁদাবাজি, টিজ সহ অনেক বাজে কাজ করি। যার জীবনে আমি যাবো তার জীবন ভাজা ভাজা করে দেবো। আমার থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো। তুই চাইলে নিজের পরিচয় দিতে পারিস।”

—” বিয়ে ভাঙতে হবে তো? আচ্ছা আমি বলছি”

—” হুম দেখনা। বিয়েটা ভাঙতে পারলে তোদের কাচ্চি খাওয়াবো”

—” আচ্ছা আপু আমি দেখছি”

সাঁঝ ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকলো। এবার নিশ্চয় ইহান নিজেই বিয়ে ভাঙবে? প্রায় আধা ঘন্টা পরে সাকিবের ফোন আসলো। সাঁঝ অনেক উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কিরে কি বলল?”

—” আপু লোকটা বড্ড ঘাড়ত্যাড়া। আমার বলা কথাগুলো শুনলো। যে তুমি মারধর, চাঁদাবাজি এসব করো। শোনার পরে বলল, সমস্যা নেই। আমার সাঁঝের এই অভ্যাসগুলো আরো পছন্দ হয়েছে। আগে বলেননি কেন? আমার চাকরি না থাকলে চাঁদাবাজির টাকায় তো সংসার চলবে। আর মারধর করতে আমি পারিনা সাঁঝ পারে। ও আমাকে রক্ষা করবে দুষ্ট লোকের হাত থেকে। আর ও হচ্ছে boss lady টাইপের। এমন মেয়েই আমার পছন্দ।”

সাঁঝের মুখটা হা হয়ে গেলো। সাকিব আবার বললো,

—” আরো বলল তোমাদের বিয়েতে যেনো আমি আমার গ্রুপ নিয়ে যাই। ভালো মতো খেয়েদেয়ে আসি।”

—” আচ্ছা আমি রাখছি”

সাঁঝ ফোনটা রেখে শুয়ে পড়লো। মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। একদিকে অনিকের চিন্তা। আহত বাঘ বেশি ভয়ঙ্কর হয়। অনিক সম্পর্ক ভাঙার জন্য তার উপর এটাক করবে না তো? এটাক করলেও সমস্যা নেই তার। নিজের প্রতিশোধ পূরণ করতে পারলেই হলো। কিন্তু অনিক কি আহত না নিহত?
আরেকদিকে এই ইহান। কোথা থেকে টপকে পড়ে তার জীবনে ঝড় আনছে। বিয়ের জন্য একদম পিছে পড়ে গেছে। সাঁঝ দুটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমে তলিয়ে গেলো।

সকালের রোদ চোখে লেগে সাঁঝের ঘুম ভেঙে গেলো। পাশ ফিরে শুয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। সামনেই আশা আফরোজ বসে আছেন। সম্পর্কে ইনি সাঁঝের মা। সাঁঝ একবার ভালো করে তাকালো। যৌবনের সৌন্দর্যের কিছু অংশ এখনো চেহারার মধ্যে বিদ্যমান। চুলে পাক ধরেছে। মিষ্টি কালারের শাড়ি পরে বেশ রাশভারি মনে হচ্ছে। সাঁঝ ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি মনে করে সার্কাসের জোকার কে দেখতে এসেছেন?”

উনি বেশ আহত স্বরে বললেন,

—” মা তার মেয়েকে দেখতে আসতে পারে না?”

সাঁঝ বিদ্রুপ করে বলল,

—” মা! মেয়েকে দেখতে এসেছেন? এতোকাল কোথায় ছিলো এই স্নেহ? কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন সেটা বলেন”

—” মা কখনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসে সন্তানের কাছে?”

—” অন্যরা কি করে জানিনা। কিন্তু আপনি নিজেরটা ছাড়া কিছুই বোঝেন না”

—” এভাবে বলতে পারলে?”

—” ভুল কি বললাম? যাকে এতো ভালোবাসি ভালোবাসি করতেন তার মৃত্যুর দুই বছর পরে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিলেন। নিজেকে মা বলে দাবী করছেন তখন তো ঠিকই নিজের ছেলেমেয়েকে রেখে শশুড় বাড়িতে চলে গেলেন। এখম নিজেকে মা বলছেন!”

—” সাঁঝ একটা মানুষ তার অতীতকে নিয়ে থাকতে পারে না। তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। কি লাভ অতীতকে নিয়ে পড়ে থেকে? আমিও তাই সামনে এগিয়েছি”

সাঁঝ হো হো করে হেসে দিলো। তারপর বলল,

—” নিজের সন্তানরা আপনার কাছে অতীত। তাদেরকে পিছে ফেলে নতুন জীবন শুরু করেছেন। বাহ! নিজেকে মা দাবী করেন আবার! ছেলের মৃত্যুর পরে তো দেখতেও আসলেন না একবার। উনি নাকি মা!”

মা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল,

—” যাক বাদ দাও সেসব আমার জীবনের কথা। আমি তোমার জীবনের কথা শুনতে এসেছি। শুনলাম কাল একজন তোমাকে দেখতে এসেছিলো। ছেলেটা নাকি লেকচারার। ভালো ছেলে । তুমি বিয়ে কেন করতে চাচ্ছো না?”

সাঁঝ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

—” আমার জীবন আমার সিদ্ধান্ত। আমার বিয়ে করার ইচ্ছা নেই। বিয়ের উপর বিশ্বাস নেই। আর বিশ্বাস না থাকার কারণটাও আপনি”

সাঁঝের মা একটু অপেক্ষা করে বলল,

—” সকালে তোমার বাবা উনাদের সাথে কথা বলেছে। উনাদেরকে আমাদের ভালো লেগেছে। তুমি প্রাথমিক ভাবে হ্যা বলে দাও। তাহলে আমরা খোঁজ খবর নেবো আজ উনাদের বাসায় ঘুরে আসবো। আর ছেলে ভালো হলে। তুমি এই বিয়েটা করবে”

—” উনি আপনার স্বামী আমার বাবা নয়। আর এখন কি জোরজবরদস্তি করবেন বিয়ের জন্য?”

আশা বেগম মুখ শক্ত করে বললেন,

—” দরকার হলে করবো। কোন মা নিজের সন্তানের খারাপ চায় না। আমিও চাচ্ছি না। তোমার ভালোই হবে এতে”

—” আমার ভালো চান! আমার ভালো চাইলে যেদিন ভাইয়ার লাশের সামনে বসে কাঁদছিলাম সেদিন আমার পাশে বসে নিজের কাঁধটা এগিয়ে দিতেন যাতে আমি মাথা রেখে কান্না করতে পারি। আপনি চান আর না চান I don’t care। আমি বিয়ে করবো না”

সাঁঝ আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাকে পাশ কাটিয়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবলো রাতে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ঘুমালে সকালটা এতো বাজে হতো না। পিছন থেকে মা বলে উঠলো,

—” আমার ঋণটা শোধ করে দাও তাহলে”

সাঁঝ পিছন ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকালো। মা আবার বলল,

—” ঋণদাতা যদি নিজের ঋণ ফেরত না চায় তাহলে সেটা তার মহানুভবতা হয়। আর ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতার কাছে ঋণ ফেরত চায় তাহলে ঋণগ্রহীতাকে সেটা ফেরত দিতেই হয়”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কিসের ঋণের কথা বলছেন আপনি?”

—” মাতৃত্বের ঋণ। আমি তোমাকে নিজের শরীরের মধ্যে বড় করেছি। জন্ম দিয়েছি। একটা সময় পর্যন্ত পালন করেছি। এটাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঋণ”

সাঁঝ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকলো। একজন মা নিজের সন্তানের কাছে জন্ম দেয়ার, বড় করার প্রতিদান চাচ্ছে? এখন সাঁঝের সব কিছু মজার লাগছে। মানে আর কি বাদ আছে তার জীবনে? সাঁঝ কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করলো,

—” কিভাবে আমি আমার জন্মের ঋণ শোধ করবো?”

—” তুমি এখন হ্যা বলে দিবে। আমরা আজ যাবো ওখানে। আরো খোঁজ খবর নেবো। সব ঠিক থাকলে বিয়েটা তুমি করবে। আর সাহেলের ব্যাপারে কিছু বলবে না। সবাই জানবে ও এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সেই ভিডিওর ব্যাপারে কোন কিছু বলবে না।”

—” আমি না বললে বুঝি জানতে পারবে না? অন্য কেউ তো বলে দিতে পারে”

—” এসব ঘটনা যেমন হুট করে আসে তেমন হুট করে চলে যায়। কারোর মনে নেই। সর্বোচ্চ এটা জানতে পারে পুলিশ নিয়ে কিছু হয়েছিলো। সেটা আমি ম্যানেজ করে নেবো। তুমি এগুলোর মধ্যে একদম থাকবে না। অন্য কাউকে দিয়েও কিছু করাবে না”

—” আর যদি ছেলে ঠিক না থাকে তাহলে ঋণের কি হবে?”

—” ছেলে ঠিক না থাকলে বিয়ে বাতিল। অন্য কোন সম্বন্ধ আসলে সেখানে দেখে শুনে সব ঠিক থাকলে তোমার পছন্দ হলে বিয়ে করবে। আর কথা দাও তুমি নিজে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করবে না। এটাই হবে ঋণ শোধ ।”

সাঁঝ বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

—” ঠিক আছে। Deal done। এরপরে আমার কাছে আর কোনদিন মা হিসেবে আসবেন না। সব ঋণ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর কোন দাবী থাকবে না আপনার। সব শোধ করে দিচ্ছি আমি। আর আমি কথা দিচ্ছি নিজে থেকে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করবো না। এবার উনাদের হ্যা বলে আসুন”

সাঁঝ বাথরুমের দিকে হাঁটা ধরলো। একটু থেমে পিছনে না ঘুরেই জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনি আমার বিয়ে নিয়ে এতো কেন ব্যস্ত হলেন?”

—” মা হিসেবে সন্তানের ভবিষ্যৎ সিকিউর করা আমার দায়িত্ব ”

সাঁঝ একটু হেসে চলে গেলো।
,
,
,
🌿
বিছানায় শুয়ে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সাঁঝ। ফ্যানটা সবসময় ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে। তার জীবনের মতো। ঘুরছে কিন্তু কোন আদি অন্ত নেই। আজ একটা বড় সিদ্ধান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়েছে। তার মন বলছে এবার বিয়েটা হয়েই যাবে। ভার্সিটিতে ইহানের প্রথম দিন ইহানের দিকে তাকানোই ভূল হয়েছে তার।
ফোনের শব্দ পেয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। অপরিচিত নাম্বার। ফোন তুলে বলল,

—” আসসালামু আলাইকুম ”

ওপাশ থেকে একটা ছেলে কণ্ঠে বলল,

—”ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?”

সাঁঝ কণ্ঠ চিনতে পারলো না। কিন্তু শুনতে ভালো লাগছে আওয়াজটা। বলল,

—” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কে?”

—” ইহান। তুমি তো হ্যা বলেই দিয়েছো। আজ তোমার বাসা থেকে আসছে এখানে। তাই জানাশোনার জন্য ফোন দিলাম”

—” ও আচ্ছা”

সাঁঝ অনুভূতিহীনের মতো কথা বলে যাচ্ছে। বলতে হচ্ছে তাই। ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” তোমার পছন্দের রঙ কি?”

—” কালো”

ইহানে হেসে জিজ্ঞেস করলো

—” আমারটা জিজ্ঞেস করবে না?”

—” আপনার পছন্দের রঙ?”

—” সাদা। তোমার পছন্দের খেলা কি? মানে কি খেলতে পছন্দ করতে বা করো? এই মানে দেশি খেলা যেমন, গোল্লাছুট, কানামাছি, বৌ-চুরি এগুলো মধ্যে?”

—” আমার সবই ভালো লাগে। ছোটবেলাতে সবই খেলতাম। আপনার?”

—” কানামাছি আমার খুব ভালো লাগে। আর যদি সেটা একজনের সাথে হয় তাহলে আরো ভালো। একটা মানুষের চোখ বেঁধে খেলিয়ে নেয়াটা বেশ ভালো লাগে। কোন দিকে আছে বা কোন দিক থেকে আঘার আসবে এটা সেই চোখ বাঁধা মানুষটা বুঝে না। বেশ মজার খেলা”

সাঁঝ মৃদু ঝটকা খেলো। ইহানের কথাগুলো তার কাছে অদ্ভুত,পরিচিত আর নিজের ভাবনার মতো ঠেকলো। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-০৫

0

#কানামাছি
#পার্টঃ৫
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
“স্যার আমাকে মেরেন না। স্যার আল্লাহর দোহায় লাগি আর মারবেন না স্যার। আল্লাহর কসম আমি এই কাজ করিনি। বিশ্বাস করেন স্যার। আর মারবেন না”

সাঁঝের কানে কথাগুলো বারবার বাজছে। অনিককে ফোন দেয়ার সময় যেটুকু জড়তা কাজ করছিলো সেটাও এক নিমিষেই কেটে গেলো। ফোন দিলো সাঁজ। রিং হলো কিন্তু অনিক ধরলো না। সাঁঝ বেশ অবাক হলো। কারণ সে ফোন দিয়েছে কিন্তু অনিক ফোন ধরেনি এরকম কখনোই হয় না। সাঁঝ আবার ফোন দিলো। এই ভাবে ১২ বার ফোন দিলো কিন্তু অনিক ফোন ধরলো না। সাঁঝের ঠোঁট গলা সব শুকিয়ে আসছে। কাজের শুরুতেই এভাবে বাধা কেন আসছে?
ঢকঢক করে আধা বোতল পানি খেয়ে নিলো। এরপর শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

তীব্র গরম অনুভূত হওয়ায় সাঁঝ আলতো করে চোখ খুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। কারণ দুপুর শেষ প্রায়। অনিক আবার ওর মিশনে চলে গেলো না তো? সাঁঝ তাড়াতাড়ি উঠে ফোন হাতে নিলো। দেখলো অনিকের মিসড কল উঠে আছে। আর কোন ভাবনা চিন্তা না করে সাঁঝ ফোন দিলো। ফোন ধরে ওপাশ থেকে অনিক বলল,

—” ফোন দিয়েছিলে অনেক বার। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। শুনতে পায়নি”

—” আচ্ছা”

সাঁঝের ভয় লাগছে একটু একটু। অনিক বলল,

—” কি হয়েছে? সব ঠিক আছে? তোমার গলা কেমন যেনো লাগছে!”

—” না.. আমি ঠিক আছি। অনিক তোমাকে কিছু জরুরি কথা বলার আছে”

—” হুম বলো”

সাঁঝ একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

—” অনিক তোমার সাথে আর সম্পর্কটা রাখা সম্ভব না। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে”

অনিক একটু হেসে বলল,

—” আমাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য মজা করছো না?”

সাঁঝ কঠিন গলায় বলল,

—” অনিক আমি মজা করছি না। আমি সিরিয়াস। আমার বিয়ে আজ রাতেই”

অনিক এবার ঘাবড়ে গিয়ে বলল,

—” কি বলছো সাঁঝ? তুমি না বলোনি কেন তোমার বাড়ির লোককে? আজ রাতে বিয়ে মানে? আম.. আমার কথা কেন বলনি তুমি তোমার বাড়ির লোককে?”

অনিকের কথা জড়িয়ে আসছে। সাঁঝ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

—” আমি বলেছিলাম তোমার কথা। কিন্তু ওরা প্রেমকে সমর্থন করে না। আমাকে মেরেছে। আর সবাই আমার চরিত্র নিয়ে অনেক বাজে কথা বলছে। আমার চরিত্রের উপর কালি লাগাচ্ছে।”

—” তোমার চরিত্রে কালি? আমি.. আমি তো এখন আসতে পারবো না। আমার দুই ঘন্টার মধ্যে মিশনের জন্য প্রেজেন্ট হতে হবে। তুমি পালিয়ে আসো সাঁঝ। পালিয়ে আমার বাসায় আসো”

সাঁঝ এবার প্রায় কেঁদে বলল,

—” অনিক ওরা আমাকে আটকে রেখেছে। কোন রকমে ফোন নিয়ে তোমার সাথে কথা বলেছি”

—” আমি আমি তাহলে আমার মা-বাবাকে পাঠায় তোমার ওখানে?”

সাঁঝ কান্নাভাবটা দূর করে অত্যাধিক শান্ত গলায় বলল,

—” অনিক আমার কথা শোন। আমি সব বিষয়গুলো ভেবে দেখেছি এই দুই দিনে। আমার বিয়ে দুই দিন আগে ঠিক হয়েছে। তোমার মা-বাবা আসলে তাদের অপমান করে বের করে দিবে। আর তুমি আসলে আমার মরা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। আমার চরিত্রে কি পরিমান কালি লেগেছে আর লাগাচ্ছে আমিই জানি। আমি পালিয়ে বা তোমার সাথে গেলে আমার পরিবারের উপর, আমার মা-বাবার উপর কাদা লাগাবে এরা। এটাই মধ্যবিত্ত পরিবার অনিক। তুমি আসলে আমার ফুফুদেরকে একঘরে করে দিবে। যতই হোক তারা আমার আপনজন। আমাকে নিজের পরিবারের সম্মান রাখতে বিয়ে করতে হবে। তুমি আসলে যে পরিমান আঘাত আমার উপর আসবে সেটা নেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে তখন মরতে হবে। আমি এতো সহ্য করতে পারছি না।”

অনিক কান্না করে অনুনয় করে বলল,

—” কিন্তু সাঁঝ তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না? আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আমি কিভাবে বাঁচবো?”

—” আমার পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে নিজেকে স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে। হয়তো বিয়ের পরে আমার অনুভূতিগুলো শূন্য হয়ে যাবে। কিন্তু সেই অনুভূতিহীন আমিটাকেই জীবনটা চালিয়ে নিতে হবে অন্য কোন মানুষের সাথে।”

—” সাঁঝ এভাবে আমাকে ছেড়ে যেও না।”

অনিকের কন্ঠে কান্না, কষ্ট, বেদনা স্পষ্ট। যেটা সাঁঝকে প্রশান্তি দিচ্ছে। সাঁঝ থমথমে গলায় বলল,

—” অনিক আমি তোমার সাথে নিজেকেও ছেড়ে যাচ্ছি। আমার আর কিছু করার নেই। দুইটা অনুরোধ আছে। যদি আমার বিয়ের পরেও কোন দিন তোমার সামনে পড়ি তাহলে আমার সামনে এসো না। আমি মরে যাবো তোমাকে দেখলে। নিজের না পাওয়া ভালোবাসা আর মানুষটাকে দেখে। সত্যি সেদিন নিজেকে শেষ করে দিবো। তাই আমি যদি তোমার কাছে মূল্যবান হই তাহলে আমার সামনে এসো না। আর দ্বিতীয় অনুরোধ অন্য কারোর সাথে নিজের জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করো। আমার ভাগের ভালোবাসাটুকুও তাকে দিও। রাখবে আমার অনুরোধ?

সাঁঝ অনিকের কান্নার শব্দ পেলো। অনিক বলল,

—”কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচবো? আমার কি হবে?”

—” তুমি নতুন কারোর সাথে নতুন ভাবে বাঁচবে। তুমি ভালো থাকলে বুঝে নিবে তোমার সাঁঝও ভালো আছে। আজ আমার কাছ থেকে ফোনটা হয়তো নিয়ে নিবে। আর সিমটাও চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। আর তোমার সাঁঝকে পাবে না ফোন করে। রাখছি। ভালো থেকো।”

—” সাঁঝ প্লিজ সাঁঝ”

সাঁঝ ফোনটা কেটে অনিকের নাম্বার ব্লক করে দিলো। কোন মানুষ যতই ক্ষমতাশালী হোক, যতই ঔদ্ধত্যপূর্ণ হোক, যতই উগ্র হোক তার কোন একটা জায়গা প্রচন্ড দূর্বল হয়। সেই দূর্বলতায় আঘাত করলে সে তার ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারেনা। সাঁঝ নিজে অনিকের সেই দূর্বলতা। এক বছর ধরে নিজের ঘৃণার মানুষের সাথে থেকে নিজেকে তার দূর্বলতায় পরিণত করেছে।

সাঁঝ অনিকের সেই অডিও ক্লিপটা একটা নকল পরিচয়ের আড়াল থেকে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে নকল একাউন্ট বন্ধ করে দিলো। যদি এই অডিও ক্লিপটা নিয়ে পুলিশের কাছে বা অনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হতো তাহলে অনিক কোন না কোনভাবে পার পেয়ে যেতো। কিন্তু যখন এটা সে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন কিছু মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, কিছু মানুষ অবিশ্বাস করবে কিন্তু কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না। অনিক যখন বাইরে বের হবে সবাই ঘুরে দেখবে ওকে। কানে কানে কথা বলবে। যারা বিশ্বাস করবে ক্লিপটাকে তারা অনিকের গায়ে কাদা লাগাবে। ভাগ্য ভালো থাকলে পুলিশের নজরে আসলে অনিক সাসপেন্ডও হয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হতে পারে। ডাইরিটা বের করে সাঁঝ কানামাছির পাশে লিখলো “Tit for tat”.

সাঁঝের কানে বারবার তার ভাইয়ের সেই কথাগুলো বাজতে থাকলো। মনে হলো এখনই কান থেকে রক্ত বের হয়ে যাবে। সাঁঝ একবার অডিও ক্লিপটা দেখলো। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে হাজার হাজার মানুষ দেখছে, মন্তব্য করছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাঁঝ ভাবলো অনিক নিশ্চয় যাওয়ার আগে দেখে যাবে! এটা দেখার পরে হয়তো এখনই অনিককে উপরমহল থেকে কিছু বলবে না। হয়তো সে মিশনেও যাবে৷ কিন্তু তারপর? ভেবেই সাঁঝের আনন্দ হলো। সে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো।
,
,
,
🌿
কাল থেকে সাঁঝের মনটা খুব ভালো হয়ে আছে। নিজের কাজে সফল হয়েছে। এখন আরো ভালো কারণ আশিক ফোন দিয়ে বলেছে অনিকের কিছু ছবিও পাওয়া গিয়েছে। এটার সাথেও একই কাজ করবে। বরং আরো ভালো প্রমাণ এটা। মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে। তাই ভাবলো আজ বাড়ির সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। সকালে নাস্তার টেবিলে গিয়ে ফুফুকে ডেকে বলল,

—” ফুফু, গুড মর্নিং ”

রোমেসা বেগম বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন। উনি দুই কদম সরে আসলেন সাঁঝের থেকে। এই মেয়ের লক্ষণ ভালো না। এরপর সাঁঝ বলল,

—” দাও আমি হেল্প করে দিচ্ছি। একদিন না একদিন তো বিয়ে করে শশুড় বাড়ি যেতেই হবে। তখন কাজ না পারলে তোমার নামেই খারাপ কথা বলবে।”

রোমেসা বেগম চুপ থাকায় শ্রেয় মনে করলেন। মেয়েটার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছেন না।তিনি কি না কি বলবেন আর ক্ষেপে উঠবে। তারপর সাঁঝ আবার বলল,

—” আচ্ছা তোমার সাথে একটা ডিল করি। এরপর যেদিন পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে সেদিন আমি নিজে থেকে ওদের সামনে গিয়ে বসবো। বসা পর্যন্ত ডিল। আজ আমার মন অনেক ভালো। ”

রোমেসা বেগম থমথমে গলায় বললেন,

—” মনে থাকে যেনো।”

—” হ্যা থাকবে”

এরপর টেবিলে নাহিদ আর ফুফা আসলে সাঁঝ হাসি মুখে বলল,

—” আসসালামু আলাইকুম ফুফা। আসসালামু আলাইকুম কাকা”

কাকা ডাক শুনে ফুফু আর ফুফা সাঁঝের দিকে অবাক হয়ে তাকালেও কেউ কিছু বললো না। নাহিদ তার দিকে চোখ তুলে তাকালোও না। সাঁঝ জোর করে সবার সাথে বসে নাস্তা করে নিজের ঘরে গিয়ে রেডি হলো।

ভার্সিটিতে এসে প্রায় দৌড়ে সে আশিকের কাছে যাচ্ছিলো। ছবিগুলো নিতে হবে। মাঠের ভিতর দিয়ে দৌড়ানো সময় কারোর সাথে ধাক্কা লেগে সাঁঝ পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়। কাঁধে এতো জোরে লেগেছে মনে হচ্ছে মানুষ না কোন দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগেছে। এতো স্টিল বডি মানুষের হয়? সাঁঝ পিছন ঘুরে কড়া কিছু কথা শোনাতে যাবে তার আগে মানুষটা পিছনে ঘুরলো। লম্বু মানে ইহান স্যারের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। ইহান বিরক্তি নিয়ে বলল,

—” What the hell! কি চোখে দেখো না নাকি? চোখ কি ব্যাগে নিয়ে ঘোর? Rubbish. Disgusting girl”

ইহান আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। সাঁঝের মাথা গরম হয়ে গেলো। যেটুকু কৃতজ্ঞতা ছিলো সেদিনের সাহায্যের জন্য সেটা বিতৃষ্ণায় পরিনত হলো। ঘৃণা চলে আসলো। শুধু ধাক্কা লাগার কারণে এতোগুলো বাজে কথা বলল! মনে মনে ঠিক করলো এর পরের দিন যোগ্য জবাব দেবে ইহানকে এবং আর কোনদিন তার সামনে যাবে না।

মুখ বেজার করে আশিকের কাছে আসলেই আশিক বলল,

—” কি রে মুখ ওমন পেঁচার মতো করে আছিস কেন?”

—” কিছু না এমনি”

আশিক আবার একটা মেমোরি কার্ড হাতে দিয়ে বলল,

—” এই নে এতে ছবি আছে। একটা রাঘববোয়ালের লোকের সাথে টাকা লেনদেনের সময়ের। প্রমাণ সরানোর জন্য টাকা। কিন্তু ছবি অস্পষ্ট ”

—” আচ্ছা চলবে।”

আশিক একটু হেসে বলল,

—” অডিও ক্লিপটা নিয়ে ভালোই খেল দেখালি”

সাঁঝ একটু হাসলো। এরপর ক্লাসে চলে আসলো। তাদের সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার দিন তারিখ দিয়ে দিয়েছে। সামনেই পরীক্ষা।

এরপরের তিন সপ্তাহ সাঁঝ নিজের পড়া আর পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকলো। অন্য কোন দিকে তেমন খোঁজ রাখলো না । তিন সপ্তাহে অনিকের কোন খোঁজ পেলো না। অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছিলো ফোন বন্ধ। সোসাল মিডিয়াতে নেই। মানে পুরাই গায়েব। সেই ইহানের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে ইহানও ভার্সিটিতে আসে না। দুটা মানুষ এক সাথে গায়েব। শেষমেশ সব তথ্যের জন্য আশিককে বলেছিলো। অনিকের খোঁজ বের করতে বলেছিলো। শেষ পরীক্ষার শেষে আশিককে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কোন খোঁজ পেলি?”

আশিক চিন্তিত মুখে বলল,

—” আংশিক। অনিক মাহমুদের লাস্ট মিশনে গুলি লেগেছে। যেরকম শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে অনিক ইচ্ছা করেই বিপরীত পক্ষের গুলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সাথে যারা ছিলো তারা আটকানোর চেষ্টা করেছিলো অনিককে যাতে সামনে না যায়। কিন্তু অনিক কথা শোনেনি। সে বাড়িতে নেই যথাসম্ভব। এখন এরপর সে কি আহত না নিহত না কোন হাসপাতালে আছে সে তথ্য আমি আমার সোর্স দিয়ে পাচ্ছি না।”

সাঁঝ ভ্রু কুচকে বলল,

—” একটু আজব না যে তিন সপ্তাহ আগে গুলি লেগেছে কিন্তু আর কোন খোঁজ নেই!”

—” হ্যা সেটা তো একটু আজবই বটে”

সাঁঝ আশিক আর নিজের গ্রুপকে বিদায় বলে চলে আসে। কয়েকদিন ছুটি পাবে। বাড়িতে গিয়ে এখন একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে ঘুমাবে। অনেক ধকল গেছে পরীক্ষার জন্য।

দুপুরে শুয়ে শুয়ে অনিকের কথা ভাবতে থাকলো। অনিক এই শহরে, নিজের জ্ঞানে আছে এটা না জানা পর্যন্ত সে ছবিগুলোকে লিক করতে পারবে না। অনিকও দেখুক কেমন লাগে নিজের কর্মফল যখন সবার সামনে আসবে। যখন পরিবার পরিজন তার উপর ছি ছি করবে তখন কেমন লাগবে সেটা অনিককে ভোগ করতে হবে।
সাঁঝের হঠাৎ ইহানের কথা মনে হলো। ইহানই বা কোথায় গেলো সেই দিনের পরে? এমন না যে সে দেখেনি ইহানকে, নিজে খোঁজ নিয়ে জেনেছে ইহান তিন সপ্তাহ ধরে ভার্সিটিতে আসে না। কেন সেটা জানতে পারেনি। অফিস রুম থেকে এতো কিছু স্টুডেন্টদের বলে না”

এগুলো ভাবতে ভাবতে সাঁঝ ঘুমিয়ে গেলো। বিকেলে দরজায় জোরে জোরে শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেলো। বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দেখে ফুফু দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ডলতে ডলতে বলল,

—” কি ব্যাপার এতো জোরে দরজায় বাড়ি মারছো কেন? আগুন ধরেছে নাকি?”

রোমেসা বেগম গম্ভীর স্বরে বলল,

—” পাত্রপক্ষ এসেছে। রেডি হয়ে আসো নিজের কথা মতো”

সাঁঝের চোখে যেটুকু ঘুম ছিলো তা উড়ে গেল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আজ হঠাৎ করে আসলো? আগে থেকে বলোনি কেন?”

—” হঠাৎ এসেছে তাই হঠাৎই বললাম। এখন নিজের কথা মতো রেডি হয়ে আসো”

—” কথা যেহেতু দিয়েছি সেই মতো আমি আসবো”

—” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসবে। আর নীল শাড়িটা পড়বে”

—” হুম”

সাঁঝ দরজা বন্ধ করে দিলো। নীল শাড়ি, নীল চুড়ি পরতে পরতে ভাবলো আজ সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়েই পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। ফুফুর সাথে শুধু সামনে যাওয়া পর্যন্ত ডিল হয়েছে। এরপর তার যা করার সে করবে।
যেহেতু তাকে ধরে কেউ পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যায় না নিজেই যেতে হয় তাই সিগারেট হাতে করে নিয়ে যাওয়াটা অনেক সহজ হলো।
ড্রইংরুমে মাথা নিচু করে গিয়ে সোফায় বসে সামনে পাত্রের মুখের দিকে তাকাতেই সাঁঝের চোখ মাথায় উঠে গেলো। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-০৪

0

#কানামাছি
#পার্টঃ৪
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে বসার ঘরে নাহিদ, ফুফু-ফুফাকে দেখে মেজাজ গরম হয়ে গেলো সাঁঝের। সিড়ি থেকে পড়ে গিয়েও বেশি আহত হয়নি দেখছি। একদম পিঠ সোজা করে বসে আছে নাহিদ। হাতে কয়েক জায়গায় ছিলে গিয়েছে এর থেকে বেশি আর কোন আঘাত খুঁজে পেলো না। সবাই তার দিকে দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের ঘরে চলে আসলো। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে যাওয়ার পরে দেখলো ফুফু খাবার রেডি করছে কিন্তু তার প্লেট নেই। এগুলোতে সে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।ফুফুর চোখের আড়ালে পানি খেয়ে আর কিছুটা পানি চেয়ার ফেলে চলে আসলো। ব্যাগের থেকে মেমোরি কার্ডটা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে অনিকের কথা মনে হতেই গা ঘিনঘিন করে উঠলো।
এরপর খাওয়ার টেবিল থেকে নাহিদের আওয়াজ পেলো,

—” ভাবী চেয়ারে পানি কেন? আমার প্যান্ট ভিজে গেলো তো”

—” পানি কিভাবে পড়লো? আমি তো মুছেই দিয়েছি”

সাঁঝ দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলো সবাই তার ঘরের দিকেই তাকিয়ে আছে। এরপর ফুফু বলল,

—” যাও প্যান্ট বদলে আসো”

নাহিদ বিরক্তি নিয়ে বলল,

—” এমনি কোমড়ে ব্যথা তারপর বারবার যাওয়া আসা আর চেঞ্জ এগুলো ভালো লাগে?”

একপ্রকার রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো। সাঁঝ আনমনে কিছুটা হেসে ঘুমিয়ে পড়লো।
ক্ষিদার চোটে ঘুম ভেঙে দেখলো লাইট অন করেই অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে সে। এখন পেটের মধ্যে মনে হচ্ছে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। হাতমুখ ধুয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখলো লাইট অফ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রান্নাঘরে গিয়ে নিজের প্লেটে খাবার বাড়তে শুরু করলো। প্লেটে খাবার নেয়া শেষে পিছনে ঘুরতেই চমকে উঠলো। তার গা ঘেঁষে নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। সাঁঝ দুই পা পিছিয়ে বলল,

—” আরে নাহিদ কাকা আপনি? আপনার না কোমড়ে ব্যথা? যান গিয়ে রেস্ট নেন”

নাহিদ হিংস্রভাবে বলল,

—” আমাকে কাকা ডাকবে না। আমার বয়স এতোটাও বেশি না”

—” তাহলে কি ডাকবো ভাই? আপনাকে ভাই ডেকে ভাই শব্দটাকে আর অপমান করতে পারবো না বুঝলেন”

নাহিদ তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গেলে তার পথ আটকে দুই পা সাঁঝের দিকে এগিয়ে বলল,

—” সাঁঝ আমি সব বুঝতে পারছি সব তুমিই করেছো। ঠিক করোনি তুমি এগুলো করে। আমি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি মেনে নাও। নাহলে পস্তাবে”

সাঁঝ হেসে দিলো। হেসে বলল,

—” জানেন যখন তখন এটা ভালো খবর। ঘরে যেয়ে ওষুধ খেয়ে এখন ঘুমান। আর বিয়ে? তাও আবার আপনার মতো লোকের সাথে?আপনি ভালো কল্পনা করতে পারেন”

নাহিদ সাঁঝের দিকে আরো একপা আগাতে গেলেই সাঁঝ নাহিদের হাতে ছিলে যাওয়া জায়গা চেপে ধরলো। নাহিদ প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে বলল,

—” আ… হ। সাঁঝ ছাড়ো!”

নাহিদ সাঁঝের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। কোমড়ে ব্যথার কারণে বেশি নড়তে পারছে না। সাঁঝ জোরে চেপে ধরে রাখলো। বলল,

—” এবার কাটা ঘায়ে লবণ ধরেছি এরপর মরিচও ধরবো। শোন চিৎকার করিস না। আমি চিৎকার করলে পুরো এলাকে চলে আসবে। আর তোকে বদনাম করতে সময় লাগবে না। এটা আমার এলাকা। আর এলাকার মানুষ আমাকে গুন্ডি বলে ডাকে। আমার সাথে লাগতে আসলে এমন গুন্ডামো করবো যে আর এখানে আসার কথা ভাবতেও পারবি না। মনে থাকে যেনো”

সাঁঝ হাতে আরো যে কয়টা জায়গা কাটা ছিলো সেখানে লবণ ছিটিয়ে দিলো। নাহিদ কোন প্রতিবাদ করতে পারলো না। এরপর বলল,

—” আসি নাহিদ কাকা। ভালো থাকবেন”

সাঁঝ একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলো। খাওয়া শেষে রান্নাঘরে নাহিদকে আর দেখতে পেলো না।
,
,
,
🌿
সেই মেমোরি কার্ডটা নিয়ে বসলো। মোবাইলে মেমোরি কার্ড ঢোকানোর পরে কেবল একটা ফাইল দেখতে পেলো। কানে হেডফোন দিয়ে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনতে থাকলো। প্রথমেই একজন লোকের গলা,

—” অফিসার আমার ছেলেকে ছেড়ে দিন। ও তো কিছু করেনি। ওকে কেন ধরে রেখেছেন?”

এরপর অনিকের গলায় শুনলো,

—” মাদকদ্রব্য পাচারকারী একটা বড় দলের সাথে ধরা পড়েছে ও। আর আপনি বলছেন ছেড়ে দিতে?”

—” ও তো এগুলোর কিছু জানেই না। বরং ওই দলটা ওকে ধরে রেখেছিলো কারণ ও কিছু পাচার করার সময় কিছু জিনিস দেখে ফেলেছিলো তাই”

অনিক হেসে বলল,

—” সেটা তো আমিও জানি ও কিছু করেনি। এমনি ফেসে গেছে।”

লোকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনি সব জেনে ওকে ধরে রেখেছেন কেন? কেস কোর্টে উঠলে ওর ছাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে”

—” হুম সেটাও জানি। এবার আপনি ভালো করে শুনুন আমি প্রস্তাব দিচ্ছি। যদি ওই মাদক পাচারকারী দলটা ধরা নাও পড়তো তাহলেও আপনার নিজের ছেলেকে ওদের থেকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে টাকা খরচ করতে হতো। তাহলে এখন আপনি সেই টাকাটা আমাকে দিন। আমি ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি”

—” মানে আপনাকে টাকা দিতে হবে?”

—” হ্যা। আচ্ছা আপনি কত দিতে পারবেন বলেন? পাঁচ লক্ষ?”

—” আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? আমি দিন আনি দিন খাই। একটাই মাত্র ছেলে। ওকে ছেড়ে দিন”

অনিক একটু গম্ভীর গলায় বলল,

—” দেখুন মশাই এই অনিক মাহমুদ এক কথার মানুষ। আপনি চাচার বয়সী তাই কম করেই বললাম। এখন আপনি ভাবুন। অল্প সময় আছে হাতে। দেখুন কি হয়”

লোকটার আওয়াজ আর শুনতে না পেলো না সাঁঝ। এরপর অনিক বলল,

—” আপনার জন্য চা আনতে বলি। আপনি ভাবুন”

এরপর অনিকই আবার বলল,

—” আরিফ একটা চা নিয়ে আসো তো”

অনেকক্ষণ শুধু পিছনের বিভিন্ন শব্দ অন্যান্য মানুষের শুনতে পেলো। সাঁঝ কিছুটা টেনে দিলো অডিওটা। এরপর আবার শুনতে পেলো অনিকের গলায়,

—” ভেবে দেখুন কি করবেন। আর হ্যা এগুলো বাইরে জানালে আপনার ছেলে যে ওই দলের সদস্য এবং অনেক পাচার করেছে এবং তার অপরাধের আরো রেকর্ড আছে এই রকম চার্জশিট যাবে কোর্টে”

ক্ষীণ গলায় শোনা গেলো

—” জি”

এরপর আর কোন কথা শোনা গেলো না। রাস্তার আওয়াজ, রিকশা ঠিক করা সহ বিভিন্ন শব্দ বেশ অনেকক্ষণ চলার পরে থেমে গেলো অডিও।

সাঁঝ বুঝতে পারলো আশিক কেন এটা কোথাও দিতে চাচ্ছিলো না। এটা শুধু অডিও। অনিক যেরকম মানুষ তাতে এটাকে ভুয়া বা তাকে ফাঁসানো হয়েছে এরকম কিছু বলে কাটিয়ে দিবে। এই অডিও তার বিরুদ্ধে ধোপে টিকবে না। কিন্তু সে নিজে কি করবে সেটা ঠিক করা হয়ে গেছে। আশিক কিছু না করলেও সে অনিককে ছাড়বে না। তাছাড়া অনিকের অনেক বড় একটা দূর্বলতা সাঁঝ নিজেই। মায়া, মোহ বা ভালোবাসা যেটার কারণেই হোক অনিক তার উপর প্রচন্ডভাবে দূর্বল। নিজেকে একবছরে অনিকের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হিসেবে গড়ে তুলেছে। এখন এটাকেই কাজে লাগাবে সে। সাঁঝ মনের শান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে একগাদা মিসড কল আর মেসেজ দেখে বেশ অবাক হলো। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলো তা টের পায়নি। অনিক ফোন দিয়েছিলো। হঠাৎ এতো জরুরি কি প্রয়োজন হলো যে এতো ফোন? সাঁঝ মেসেজ দেখলো। সেখানে লেখা,
সাঁঝ,
আমার আর্জেন্ট একটা কেসের ব্যাপারে বাইরে যেতে হচ্ছে। হঠাৎই খবর পেলাম। তোমাকে ফোন দিয়েছি কিন্তু হয়তো ঘুমাচ্ছো। আমার আসতে আসতে একসপ্তাহ লাগবে হয়তো। আমার জন্য চিন্তা করো না। নিজের খেয়াল রেখো।

মেসেজটা পড়ে সাঁঝের মন একটু খারাপ হয়ে গেলো তার কাজটা পিছিয়ে গেলো। ভাবলো তাহলে এই কয়দিন ভার্সিটি যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো বাইরে এসে নাহিদকে দেখতে না পেয়ে শান্তি পেলো। এরপর ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো।
,
,
,
🌿
ইহান ইন্টারভিউ শেষে ভার্সিটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের ক্যাম্পাস, নিজের টিচার, সবই নিজের কিন্তু তাও ইন্টারভিউ দেয়ার সময় ভয় লাগছিলো। কিন্তু ভালো মতোই দিয়েছে। এবং চাকরিটা যে হবে এই ব্যাপারেও শিউর। কিছু কাগজপত্রে কাজ বাদ আছে। সেগুলো করতে হবে। অফিসে কাগজ রেডি করছে বলে তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সামনে মাঠের ছেলে মেয়েদের আড্ডা দেখে নিজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেও একসময় একই জায়গায় আড্ডা দিতো , ক্লাস ক্লাস করতো, লাইব্রেরিতে ঘুরতো। ভিতর থেকে ডাক পড়ায় সে ভিতরে চলে গেলো।

সাঁঝ ভার্সিটিতে এসে আরেক দফা খুশি হয়ে গেলো। আশিক বললো অনিকের কিছু ছবি যোগাড় করার চেষ্টা চলছে। দেখা যাক হয় কিনা। হলে তো সাঁঝের জন্য দারুণ খবর।
আজ সে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে কয়েকবার অফিস আর ভিসির রুমের আশেপাশে উঁকি মেরেছে কালকের সেই লম্বু ছেলেটা আছে কিনা দেখার জন্য। লম্বু নামটা আনমনেই দিয়ে দিয়েছে। কেন জানি ভার্সিটিতে আসার পরেই ছেলেটার কথা মনে হয়েছে। তাকে আরেকবার দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো। কিন্তু খুঁজে পায়নি। তাই ক্লাস শেষে আবার দূর থেকে অফিসের ওইদিকে দেখে এসেছে। খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে মাঠে একা একাই হাঁটছিলো। আকাশে মেঘ হয়েছে। তার বন্ধুদের কারোর ক্লাস শেষ হয়নি। এখন বাসায় যাবে না অপেক্ষা করবে সেটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে।
হঠাৎ করেই বৃষ্টি নামতে শুরু করলে কোন রকমে দৌড়ে করিডরে গিয়ে উঠে। আরো অনেকেই উঠে এসেছে করিডরে।
অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সাঁঝ হাত বাড়িতে বৃষ্টির পানি নিয়ে একপ্রকার খেলা করতে শুরু করলো। তার বৃষ্টি পছন্দের কিন্তু বজ্রপাতে ভয় পায় অনেক। যখন বাবা আর ভাই ছিলো তখন ভাইয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতো। একা ভিজতে ভয় হয়। আর বজ্রপাত হলে বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ভেজা দূরে থাক বৃষ্টির পানিতে হাত দেয়া হয় না। আকাশ মেঘলা হলেই দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতো।

আজ মনটা খুব ভালো তাই পানিতে হাত দিয়েছে। কিন্তু বিধি বাম! হঠাৎ জোরে মেঘ ডাকতে শুরু করলো। সাথে আছে আলোর ঝলকানি। সাঁঝ ভয় পেয়ে পিছনে সরে আসলো। ভয় আকড়ে ধরেছে। এখানে তো আপন কেউ নেই। কি করবে? আরো একবার জোরে আলোর ঝলকানি আর শব্দ শুনে সাঁঝ ভয়ে আরো পিছিয়ে আসলো। কারোর সাথে ধাক্কা লাগলে দেখলো সেই লম্বু ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁঝের মুখে এতো ভয় দেখে ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” কি হয়েছে? কোন সমস্যা? ”

সাঁঝ কিছু বলবে তার আগেই আবারো বজ্রপাত হলে সে ইহানের শার্টের হাতা খামচে ধরলো। ইহান বুঝে গেলো মেয়েটা শব্দে ভয় পাচ্ছে। একটু হেসে বলল,

—” রিল্যাক্স। ভয় নেই। আমি আছি”

সাঁঝ কোন একটা অজানা কারণে ছেলেটার দৃষ্টি আর কথার মধ্যে অনেক ভরসা পেলো। সে শার্টের হাতা ছেড়ে দিলো। গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ শুনে ইহান বলল,

—” এখানে বেশি শব্দ হচ্ছে। ওই দিকে চলুন”

সাঁঝ কোন কথা না বলে ইহানের পিছন পিছন হাঁটতে থাকলো। যেনো একটু ছেলেটার থেকে একটু পিছিয়ে পড়লেও সে হারিয়ে যাবে। বেশ ভিতরের দিকে সিড়ির কাছে একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালো। এখানেও অনেক মানুষ। এতো মানুষের কথার শব্দে বজ্রপাতের শব্দ বেশি শোনা যাচ্ছে না। তাও ইহান বৃষ্টি থামা পর্যন্ত সাঁঝের সাথে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইহানের মেয়েটাকে একা রেখে যেতে মায়া হচ্ছিলো। বেচারি ভয় পাচ্ছে খুব। বৃষ্টি থেমে গেলে ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” এবার আর সমস্যা আছে?”

—” না”

ইহান তবুও দাঁড়িয়ে থাকলো। সাঁঝে একটু পরে আবার বললো,

—” ধন্যবাদ। আমি আসি”

সাঁঝ আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে আসলো।
মেয়েটা যাওয়ার ইহানের মনে হলো নাম মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করা হলো।

এরপর থেকে প্রতিদিন সাঁঝ ভার্সিটিতে এসে প্রথমে ইহানের খোঁজ করে। দূর থেকে দেখে যায় প্রতিদিন। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে ইহান এখানকার নতুন লেকচারার। ইঞ্জিনিয়ারিং এর। কিন্তু সে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ায় তার সাথে ক্লাস নেই। কোনদিন ইহানের সামনেও পড়ে যায়। তখন খুব অস্বস্তি হয়। কোনরকমে পাশ কাটিয়ে চলে আসে।
,
,
,
🌿
অনিকের যাওয়ার আটদিন পরে সকালে সাঁঝের কাছে অনিকের মেসেজ আসে,
সাঁঝ,
আমি ফেরত এসেছি। কয়েকদিন খুব কাজের প্রেশার গেছে। শারিরীক আর মানসিকভাবে আমি অনেক ক্লান্ত। আজ বিকালে আবার দুই দিনের জন্য একটা অপারেশনে যেতে হবে। নিজের খেয়াল রেখো। সময় পেলে ফোন দিও।

মেসেজটা দেখে সাঁঝ ঠিক করে নিলো আজকে অনিককে একটা পরিণতি দিবে। অনিক মানসিক ভাবে ক্লান্ত যেটা সাঁঝের জন্য সুখবর। সে বড় একটা শ্বাস নিয়ে অনিককে কল দিলো। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-০৩

0

#কানামাছি
#পার্টঃ৩
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
একটা লম্বা, সুদর্শন ছেলেকে ভার্সিটির মাঠে দেখে সাঁঝের চোখ তার দিকে আটকে গেলো। ছেলেটার গায়ে রোদ লেগে মনে হচ্ছে তার গায়ের থেকেই রোদ ঠিকরে পড়ছে। সাঁঝ নিজের চোখ ছেলেটার দিক থেকে সরাতে পারছে না। ফোনে কথা বলতে বলতে ছেলেটা হঠাৎ সাঁঝের দিকে তাকালে ওর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। চোখ সরিয়ে নেয় সাঁঝ। একটু পরে আবার তাকিয়ে দেখে ছেলেটা নেই। সাঁঝ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার গ্রুপ সুপার সেভেনের মেম্বার আশিক, সামি, রুনা, দীপ, ইরা, শাওনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,

—” এই ওটা কে রে?”

আশিক উত্তর দেয়,

—” চিনতে পারছি না তো। নতুন কোন স্টুন্ডেট নাকি?”

দীপ বলে,

—” আরে কোন স্টুডেন্ট না। নাহলে এতো সেজেগুজে আসতো নাকি?”

রুনা বলল,

—”কেউ একজন পিছনে গিয়ে দেখে আয় না কোথায় গেল। তাহলেই তো হয়ে গেলো”

সামি বলল,

—” তোরা থাক আমি গিয়ে দেখে আসছি”

সামি কিছুক্ষণ পরে এসে বলল,

—” প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে ঢুকে গেলো তো। স্যারের রুমে এখন ঢোকা যাবে না”

সাঁঝ বলল,

—” বাদ দে। ভার্সিটির কেউ হলে পরে নিশ্চয় আসবে। তখন জেনে নেয়া যাবে কে”

এরপর সবাই যার যার ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। সবাই আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টের। এখন আশিক আর সাঁঝে বাদে বাকি সবার ক্লাস আছে। সবাই চলে গেলে আশিক বলল,

—” সাঁঝ তুই দাঁড়া। তোর সাথে দরকার আছে। আমি আসছি একটু”

—” আচ্ছা”

সাঁঝ সুপার সেভেন গ্রুপের কথা ভাবতে থাকলো। এই গ্রুপটাই সেই গ্রুপ যেটা বিভিন্ন বাজে কাজ বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। র‍্যাগিং, ইভটিজিং এই টাইপের কাজগুলো। তাদের মধ্যে আশিক,রুনা আর দীপ ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। আর এদের সাথে রাজনৈতিক আর প্রসাশনিক ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সম্পর্ক আছে তাই মোটামুটি সবাই সমীহ করে চলে তাদের গ্রুপকে। মেইন সাতজন তার কিন্তু কাজের সময় আরো ছেলেমেয়ে যোগ দেয়। গ্রুপে যারা জুনিয়র আছে যেমন সাঁঝ, ইরা, শাওন,সামি এরা সিনিয়রদের সম্মান করে। কেউ বলতে পারবে না তারা কোন খারাপ কাজ করেছে। তবুও ভার্সিটিতে তাদের নামে অনেক সময় খারাপ কথা ঘুরে বেড়ায়।
একটু পরে দেখলো আশিক আসছে দুই কাপ চা নিয়ে। আশিকরা সিনিয়র হলেও তুই বলে সম্বোধন করে সবাই একে অপরকে।
আশিক চা হাতে দিয়ে বলল,

—” বস কথা আছে”

—” হুম বল”

—” অনিক মাহমুদের ব্যাপারে কিছু প্রমান চেয়েছিলি।”

—” হুম। কিছু পেলি? খোঁজ নিয়েছিস?”

—” তুই ঠিক বলেছিলি। আমি খোঁজ খবর করিয়েছি। লোকটা দূর্নীতির আস্তানা একদম। ঘুষ তো তার জন্য পানি ভাত। আরো অনেক রেকর্ড আছে। আমি একটা ভয়েস ক্লিপ পেয়েছি”

সাঁঝ চমকে উঠলো। জিজ্ঞেস করলো,

—” কি পেলি? কিভাবে পেলি?”

—” আমার সাথে তো অনেক ধরনের মানুষের পরিচয় আছে। সেখান থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওর বিরুদ্ধে একটা প্রমান পেয়েছি”

তারপর আশিক একটা মেমোরি কার্ড বের করে দিলো। তারপর সাঁঝের হাতে দিয়ে বলল,

—” এটার মধ্যে আছে। এখন এটা তোর”

সাঁঝ বেশ অবাক হয়ে বলল,

—” যদি অনিকের বিরুদ্ধে কোন প্রমান হয় তাহলে তুই আমার কাছে এভাবে দিয়ে দিচ্ছিস কেন? তুই তো চাইলে ওর বিরুদ্ধে একটা স্টেপ নেয়ার চেষ্টা করতে পারিস”

—” তুই শুনলেই বুঝতে পারবি কেন আমি কিছু করছি না। আর তাছাড়া এই অনিকের খোঁজ তুই আমাকে দিয়েছিলি এর সম্পর্কে তুই ইনফরমেশন চেয়েছিলি তাই তোকেই দিলাম। এখানে যা আছে সব কিন্তু সত্যি। কোন ভাওতাবাজি নেই”

—” খরচ হয়েছে কি? হলে আমার থেকে লুকাস না। আমি দিয়ে দিচ্ছি টাকা”

আশিক একটু হেসে বলল,

—” আরে না কোন খরচ হয়নি। একটু ট্রিকস খাটিয়েছি। বাকিটা ভাগ্য”

—” আচ্ছা তোকে অনেক অনেক থ্যাংস। তুই আমার খুব উপকার করলি”

—” আরে না না। আমার বিশ্বাস আছে তুই ভালো কিছুই করবি”

সাঁঝ একটু হেসে বলল,

—” হুম। থাক। আমার ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। দেখি পড়ালেখার কি হাল আমার। আসি”

—” হুম যা”

সাঁঝ মেমোরি কার্ডটা ব্যাগের মধ্যে যত্ন করে রেখে দিলো। ক্লাসে ঢোকার আগে ভাবলো ক্লাস শেষে শুনবে কি আছে এর মধ্যে।
,
,
,
🌿
ইহান নিজের বাড়িতে ঢোকার পরেই মুখে আপনা আপনি একটা হাসি চলে আসলো। অদ্ভুদ শান্তি অনুভব হলো। কতদিন পরে আজ বাসার সবার সাথে দেখা হবে। বাসার কলিংবেল চাপার সাথে সাথে খুলে গেল। সামনে ছোট বোন ইশিতা দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। ইশিতা বলল,

—” এতো দেরী করলি কেন? সেই কখন ল্যান্ড করেছিস। এতোক্ষন লাগে এয়ারপোর্ট থেকে আসতে? ফোনও ধরছিলি না!”

ইহান হেসে বলল,

—”আসলে কি বলতো তো বর খুঁজতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো। কেউ তোকে বিয়ে করতে চায় না যে!”

ইশিতা কয়েকটা কিল মেরে বলল,

—” সবসময় আমার বিয়ের কথা বলিস কেন বলতো? আমাকে তাড়াতে পারলেই যেনো তোর ভালো”

—” ঘাড়ের উপর একটা পেত্নী বসে থাকলে তাকে যত দ্রুত সম্ভব ঘাড় থেকে নামানো উচিত”

ইশিতা ভেঙচি কেটে বলল,

—” যাতে নতুন কেউ ঘাড়ে এসে বসতে পারে তাই তো?”

তারপর সে ইহানের থেকে দূরে গিয়ে বললো,

—” তোর সাথে কথাই নেই যা”

দূর থেকে নিজের দুই ছেলে মেয়ের খুনসুটি দেখে ইহানের মা মালিহা বেগমের চোখে পানি চলে আসলো। দুই বছর পর নিজের ছেলেকে দেখছে। নিজেই যেন ছেলের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা তার ছেলে? এতো সুন্দর? যেমন চেহারা সুন্দর তার থেকেও ব্যবহার, হাসি, কথাগুলো সুন্দর। তার মনে হয় মা হিসেবে সে সার্থক।
ইহান মায়ের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল,

—” মা কেমন আছো?

মালিহা বেগম চোখ মুছে বলল,

—” এখন কেমন আছি না? তখন কত করে মানা করেছিলাম যাস না। কিন্তু তোর তো যেতেই হতো। কতো মনে পড়ে তোর কথা জানিস?”

—” আচ্ছা এবার তো চলে এসেছি। তোমাদের সাথেই থাকবো। আর মনে পড়বে না।”

—”হুম। যা ভিতরে যা তোর বাবার সাথে দেখা করে আয়। বসে আছে তোর জন্য”

ইহান ভিতরে গিয়ে দেখলো বাবা মাহবুব রহমান বসে আছে। তার দিকে জিজ্ঞেস করলো,

—” এতো দেরী হলো যে?”

—” আমি আমার ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম।”

ইহানের বাবা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” হঠাৎ ভার্সিটি কেন?”

—” ভিসি এর সাথে দেখা করতে”

—” কেন?”

—” বাবা আমি আমার ভার্সিটিতে লেকচারার এর জন্য এপ্লাই করেছি। সেটা নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য গিয়েছিলাম। একটা ছোট ইন্টারভিউ আছে। সেটা দেয়া লাগবে”

মাহবুব সাহেব বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কিন্তু তোমার তো আমার কোম্পানিতে জয়েন করার কথা ছিলো। আর তোমার নিজেরও কিছু পরিকল্পনা আছে নিজের কোম্পানি নিয়ে। তাহলে আবার লেকচারার কেন? আর হুট করে ইন্টারভিউ পর্যন্ত সব পৌঁছে গেল কিভাবে?”

—” আমার নিজের কিছু পরিকল্পনা আছে সফটওয়্যার কোম্পানি নিয়ে। কিন্তু সেটা তো একদিনে হবে না। প্রচুর সময়, খাটনি,টাকা, কর্মচারী লাগবে। তোমার ব্যবসা তো অন্য সেক্টরে। এখন আমি পড়াশোনার মধ্যে না থাকলে সব ভুলে ক্রিয়েটিভিটি কমে যাবে। যেটা আমার কোম্পানির জন্য ভালো না। আর তুমি তো জানো কোন স্টুডেন্টের রেজাল্ট ভালো হলে ভার্সিটি থেকেই তাকে জব অফার করা হয়। সেখানে তো আমার দুই বছর বাইরের দেশে লেকচারার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।”

—” আচ্ছা তুমি যেমন ভালো বোঝ। All the best for your upcoming future.”

—”Thank you বাবা”

ইহান বাবার রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে আসলো। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ কর‍তে সেই সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার কথা মনে হলো। মেয়েটার চেহারা বা অন্য কিছু সে দেখেনি তাই মনেও নেই। কিন্তু অবয়বটা মনে হচ্ছে। ইহানের ইচ্ছা হলো মেয়েটাকে কোনদিন সামনে পেলে জিজ্ঞেস করবে কেন সিগারেট খায়।
বেশ কিছুক্ষণ পরে নিচে কোলাহল শুনে নিচে এসে দেখলো বড় চাচা-চাচী এসেছে। কিন্তু চাচাতো ভাইকে দেখলো না। ইহানের একটু মন খারাপ হলো। ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক খুব ভালো। কিন্তু তাও ভাই আসলো না। এরপর সবাই মিলে আড্ডা দিতে বসে গেলো।
,
,
,
🌿
সাঁঝ ক্লাস শেষে বের হওয়ার পরে ভাবলো এখনই অডিও ক্লিপটা শুনবে। তার আর তর সইছিলো না। সে ফোন বের করে মেমোরি কার্ডটা ঢুকাতে যাবে তখন দেখলো অনিকের ফোন এসেছে। সাঁঝের মুখটা বিরক্ততে কুচকে গেলো। আনমনে বলল, এ আবার এখন কেন ফোন দিয়েছে?
ফোন তুলে গলা যথাসম্ভব নরম করে বলল,

—” হ্যালো?”

—” ব্যস্ত আছো?”

—” না তেমন না। তুমি এখন ফোন দিয়েছো? কাজ নেই আজ?”

একটু হেসে অনিক বলল,

—” তেমন কাজ নেই। তোমার কথা মনে হচ্ছে খুব। তাই আবার ফোন দিলাম। কথা না বললেও শুধু লাইনে থাকতেও ভালো লাগে।”

সাঁঝ কিছু বললো না। অনিক আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” বাড়িতে আছো?”

—” না ভার্সিটিতে এসেছি। কেন?”

—” আজ দেখা করবা? আমার খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে তোমাকে। প্লিজ না করো না”

—” আম.. আজ? মানে আচ্ছা৷ কখন?”

—” এখনই আসো। না তুমি ওয়েট করো আমি আসছি তোমাকে নিতে”

সাঁঝ ভয় পেয়ে বলল,

—” না না তার দরকার হবে না। তুমি কোন একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসো আমি আসছি”

অনিক একটু কেয়ার দেখিয়ে বলল,

—” আমি নাহয় আসি?”

—”না তার দরকার হবে না আমিই আসছি”

এরপর সাঁঝ একরাশ বিরক্তি নিয়ে ক্যাফের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। অডিও ক্লিপটা শোনা হলো না। ক্যাফেতে পৌছে দেখলো অনিক একপাশে বসে আছে। গায়ে খয়েরী রঙের শার্ট। সানগ্লাস হাতে নিয়ে ফোনের মধ্যে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে। অন্য কেউ হলে দেখে ক্রাশ খেয়ে যেতো। সাঁঝ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ক্যাফেতে বসা অনেক মেয়েই ঘুরে ঘুরে দেখছে অনিককে। সাঁঝ মনে মনে বলল “আসল রুপ তো জানে না, সেজন্য এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখছে। ”
সাঁঝ সামনে আসতেই তাকে দেখে হেসে বলল,

—” এসে গেছো? বসো”

সাঁঝ একটু কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি ব্যাপার আজ অফিসে যাওনি? ইউনির্ফম নেই যে!”

অনিক হেসে বলল,

—” আরে পুলিশ বলেই কি সবসময় ইউনির্ফম পরতে হবে? আজ তেমন কাজ ছিলো না। তাই এক পাক ঘুরে এসেছি”

—” আচ্ছা”

—” কি খাবে বলো? ক্লান্ত নিশ্চয়। ঠান্ডা, গরম, না ভারী কিছু খাবে?”

—” না না হালকা কিছু হলেই হবে”

খাবার অর্ডার হলে অনিক আবার বলতে শুরু করলো,

—” জানো সাঁঝ আমার প্রায় তোমার কথা মনে হয়। তোমার পরিবারের সবাই মা-বাবা, ভাই সবাই একটা এক্সিডেন্টে মারা গেলো। তুমি তোমার ফুফুর বাসায় থাকো। তারাও খারাপ ব্যবহার করে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে আমার রানী করে নিয়ে যাবো। আমার বাবা-মায়ের মেয়ে হিসেবে নিয়ে যাবো তোমাকে। ভালোবাসার কোন কমতি হবে না ওখানে। তুমি তো এখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ো। অনার্স কমপ্লিট হোক তোমার বাসায় আমি যাবো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

সাঁঝ নিজের মনে বলল, “আমার ভাইয়া এক্সিডেন্টে মারা যায়নি। তুমি মেরেছো ওকে। মিথ্যাটাকে সত্য বলে জানো। আর এটাই মানো তুমি। যখন সত্য সামনে আসবে তখন লুকানোর পথ পাবে না। আরো দুই বছর তুমি ভালো ভাবে থাকো তারপর না বিয়ের প্রস্তাব।” সাঁঝ যথাসম্ভব চেষ্টা করতে থাকলো যাতে মুখে ঘৃণার ভাব প্রকাশ না পায়। অনিক আবার বলল,

—” এরপর আমাদের ছেলেমেয়ে হবে। একটা ছোট পরিবার হবে। যাতে ভালোবাস থাকবে অফুরন্ত ”

সাঁঝের ভিতর ঘৃণার স্রোত বয়ে গেলো। তার আর অনিকের ছেলে মেয়ে! ছি! দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনা।অনিক এবার তার হাত ধরে বলল,

—” আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। আমি জানি তুমি আমার হাত ছেড়ে কখনোই যাবে না। আর আমিও প্রতিজ্ঞা করছি তোমার হাত মাঝপথে ছেড়ে যাবো না। পাশে থাকবো সবসময়”

সাঁঝ চেষ্টা করলো মুখে একটা লাজুক হাসি আনার। এরপর অনিক একটা চিকন ব্রেসলেট তার হাতে পরিয়ে দিলো। যাতে একটা ছোট হার্ট শেপের মধ্যে S.A লেখা। অনিক হেসে বলল,

—” এখন থেকে সবসময় আমার নামের আগে তোমার নাম আসবে”

ব্রেসলেটটা সুন্দর হলেও সাঁঝের কাছে এটা একটা শিকলের মতো লাগছে। সাঁঝ মিষ্টি করে হেসে বলল,

—” থ্যাংকিউ”

খাওয়া শেষ হলে বিল দেয়ার সময় অনেক জোর করে সাঁঝ অনিককে রাজী করিয়ে নিজে বিল দিয়েছে। সে অনিকের ঘুষের হারাম টাকায় খাবে না কখনোই।

রাস্তায় আসার পরে অনিকের একটা ফোন আসলে সে কথা বলতে বলতে কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে থাকলো। পিছন থেকে একটা রিকশার চাকা অনিকের পায়ের জুতায় ঠেকলো। অনিককে আঘাত করার আগেই রিকশাওয়ালা থামিয়ে দিয়েছে। অনিকের কোন ব্যথা লাগেনি। জুতায় একটু ধুলা লেগেছে। সবটা সাঁঝের সামনেই হয়েছে।
অনিক হিংস্র চোখ পিছনে তাকিয়ে রিকশাওয়ালাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে সামনে নিয়ে আসলো। রিকশাওয়ালার শার্টে কলার ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল,

—” এই চোখে দেখিস না? চোখ বন্ধ করে রিকশা চালাস নাকি? ছোটলোক কোথাকার! আমাকে চিনিস? আমি কে জানিস? রিকশা গায়ের মধ্যে যে দিয়ে দিলি জানিস আমি কি করতে পারি? একদম জেলে ঢুকিয়ে দিবো। তোর বউ বাচ্চা না খেয়ে মারা যাবে”

অনিক এগুলো বলতে বলতে ক্রমাগত চড় থাপ্পড় মারতে থাকলো। সাঁঝ অনিকের এমন কাজে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। মানুষজন জড়ো হয়ে গেছে আশেপাশে। সবাই অনিককে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অনিক ছাড়ছে না। শেষে সাঁঝ চিৎকার করে বলল,

—” অনিক ছাড়ো”

সাঁঝের কথা শুনে অনিক ছেড়ে দিয়ে হিংস্র ভাবে রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাঁঝ রিকশাওয়ালার দিকে তাকালো। বেচারা রিকশাওয়ালা গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। হয়তো চোখ ভর্তি পানি। তাই মাথা নিচু করে আছে। উনাকে দেখে সাঁঝেরও ভিতর থেকে কান্না চলে আসলো। মনে হলো এখনই ডুকরে কেঁদে উঠবে। অনিক সাঁঝের হাত ধরে টানতে টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে আসলো। তারপর বলল,

—” এসব লোকদের মাইরের উপর রাখতে হয়। নাহলে মাথায় চড়ে বসে।”

অনিকের কথা শুনে সাঁঝের গা গুলিয়ে আসলো। মনে হলো অনিকের গায়ের উপর বমি করে দিবে। অনিক সাঁঝকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চাচ্ছিলো কিন্তু একটা জরুরি ফোন অনিক আসায় একাই চলে গেল। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-০২

0

#কানামাছি
#পার্টঃ২
#জান্নাতুল কুহু
নাহিদ সাঁঝের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার লোলুপ দৃষ্টিতে দেখে নিল। হঠাৎ সাঁঝের গলার সামনের হাড় আর কাঁধের কাছে চোখ আটকে গেলো। নাহিদের ধারনা মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কোন লাভ নেই। মুখ তো সবাই দেখে। তাই সে সাঁঝের পা থেকে গলা পর্যন্ত আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সাঁঝ বলে উঠলো,

—” যদি স্ক্যান করা হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে রাস্তা ছাড়েন”

নাহিদ এবার সাঁঝের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

—” মাশাল্লাহ সাঁঝ! তুমি অনেক বড় আর সুন্দরী হয়ে গিয়েছো। যৌবন এসেছে তোমার শরীরে। তার তোমার গলার সামনে হাড় দুটা কিন্তু মাশাল্লাহ সেই লাগছে। যাকে বলে আর কি বিউটি বোন”

নাহিদের মুখের চ্যাটচেটে হাসি দেখে সাঁঝের গা ঘিনঘিন করে উঠলো। মাশাল্লাহ কথাটাকে অপবিত্র বানিয়ে দিলো। সে বেশ জোরে জোরে বলল,

—” আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তনির রাজীম”

সাঁঝ নিজের গায়ে আর চারপাশে ফু দিলো। নাহিদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” তুমি হঠাৎ এটা কেন পড়লে?”

—” শয়তানের নজর থেকে বেঁচে থাকার জন্য এই দোয়া পড়ে নাহিদ ভাই। শয়তানের নজর লেগেছে যে আমার”

সাঁঝ মিষ্টি করে হেসে পাশ কাটিয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে আসলো। সকালবেলা এই অসভ্যটাকে দেখে মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়িতে আজ এলাহি কান্ড। ফুফুর চরিত্রহীন দেবর এসেছে বলে কথা! সাঁঝ নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দরজাতে কান পেতে থাকলো। সাথে সাথে দুরুম দুরুম করে শব্দ হতে থাকলো। মনে হলো সিড়ি দিয়ে কোন বস্তা বা ভারী কিছু পড়ে যাচ্ছে। শেষে একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল,

—” ভাইয়া ভাবি বাঁচাও। মরে গেলাম সিড়ি থেকে পড়ে। কোমড় ভেঙে গেল আমার”

সাথে সাথে ফুফুর গলায় শুনতে পেলো,

—” নাহিদ পড়লে কি করে? ইশ লেগেছে খুব? তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ডাকো”

ফুফা বলল,

—” আরে তুই পড়লি কি করে? আমি এম্বুলেন্স ডাকছি”

সাঁঝ দরজার কাছ থেকে সরে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে নিলো। সিড়িতে তেল ফেলতে গিয়ে হাতেও কিছুটা তেল লেগে গেছে। একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এই নাহিদ আর কোন ঝামেলা করতে পারবে না। দরজার দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখে নিলো ছিটিকিনি লাগানো আছে কিনা। নাহলে ফুফা যেকোন সময়ে চলে আসতে পারে। ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে একদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখে ফুফা বিছানায় বসে তার দিকে ঝুকে আছে। সাঁঝ ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করেছিলো,

—” ফুফা আপনি এতো রাতে এখানে?”

—” আসলে তুমি ভয়টয় পাও কিনা তাই দেখতে আসলাম”

—” আমি তো দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলাম আপনি আসলেন কিভাবে?”

—” ভালো করে লাগানো হয়েছিলো না তাই ধাক্কা দিতেই খুলে গেল”

এরপরও ফুফা বসেই ছিলো। তার এই ঘর থেকে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই নেই যেন। সারারাত সাঁঝকে পাহারে দিবে। সাঁঝ বিরক্ত হয়ে বলেছিলো,

—” আমার ভয় করছে না। আপনি যান”

—” যাবো? ভয় পাবে না তো? কোন সমস্যা হলে আমাকে ডেকো। ফুফুকে ডাকার দরকার নেই। তার ঘুম গাঢ় অনেক”

এরপর অনেক অনিচ্ছা নিয়ে ফুফা চলে যায়। তখন রাতে দরজা লাগাতো। এখন দিনেও লাগায়। নাহলে সারাদিন দরজার সামনে ঘুরঘুর করতে থাকে।

সাঁঝ একটা ডাইরি খুললো। প্রথম পাতায় বাবা,ভাইয়া আর সাঁঝের একটা ছবি আছে। এরপর শুধু ভাইয়ার একটা হাস্যোজ্জ্বল ছবি। তারপরের পৃষ্ঠাতে একটা কমবয়সী ছেলের কম ছবি। ছবিতে সেই ছেলেটাও হাসছে। গায়ে পুলিশ ইউনির্ফম। নিচে সাঁঝ লিখেছে অনিক। ছেলেটার নাম অনিক।

এই সেই পুলিশ অফিসার যে তার ভাইয়াকে পুরো মাঠের শত শত ছেলে মেয়ের মাঝে মেরেছিলো। জুতার মালা গলায় দিয়ে হাঁটিয়েছিলো। একে দেখে নিজের ভিতরে জ্বলতে শুরু করেছে। এই লোকটার জন্য তার ভাইয়া সুইসাইড করেছে। রাস্তায় গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। এই লোকটা বিনা অপরাধে তার ভাইয়ে অভিযুক্ত বানিয়েছিলো।
সাঁঝ পৃষ্ঠা উল্টিয়ে সেখানে তার লেখা কিছু জিনিস আবার পড়তে থাকলো। পুলিশ অফিসারটার নাম অনিক মাহমুদ। ইয়াং পুলিশ কিন্তু ঘুষ আর অনিক একসাথে চলে। তার সাথে যারা কাজ করে তারা অনেকেই এটা জানে অনিক ঘুষ খায় কিন্তু অনিক নিজে পুলিশ এবং তার সাথে উপরওয়ালাদের সাথে ভালো সম্পর্ক। তাই কেউ কিছু বলার সুযোগ পায় না।

দেড় বছর আগে ভাইয়াদের ভার্সিটির একটা মেয়ে অভিযোগ করেছিলো সাহেল নামের একটা ছেলে মেয়েটার গায়ে হাত দিয়েছে, আর বাড়ি থেকে তুলে নেয়ার হুমকিও দিয়েছে। অনিকের কাছে অভিযোগ করা হয়েছিলো। কিন্তু সেই সাহেল আর যে সাহেলকে মারা হয়েছিলো তারা এক না। অপরাধী সাহেল বড়লোক বাবার নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলে। অনিক সাহেলের বাবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কেস বন্ধ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু সাহেলের বাবা অন্য কোন সাহেলকে আটক করার প্রস্তাব দিয়েছিলো। তাই অনিক নিজের টার্গেট বানায় নিরপরাধ সাহেলকে। এরপরে ভাইয়ার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা চেয়েছিলো তাতে তার ভাইয়া ধরা পড়বে না। কিন্তু ভাইয়া মানা করে দেয়। ভাইয়া বিষয়টা আমলে নেয় না। কারণ সে নিরপরাধ। একটা পুলিশ তার কি করবে? আর টাকার বিনিময়ে সে কোন ডিল পুলিশের সাথে করবে না।

কিন্তু ভাইয়ার ধারনা ভুল করে দিয়ে অনিক তার জীবনটা বরবাদ করে দেয়। মারার পরে জেলে একরাত থাকতে হয়েছিলো। তারপর ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার সব হয়ে গেছে। বাইরে বের হলেই সবাই ধিক্কার জানাচ্ছে ইভটিজার হিসেবে। ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সবাই ছি ছি করছে। ভাইয়া বাসার বাইরে যেতে পারে না। সবাই ঘুরে ঘুরে তাকায় আর ফিস ফিস করে কথা বলে।

সাঁঝ পড়া থামিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো। পরের পাতা উল্টালো। সেখানে একটা কাগজ আঠা মেরে রাখা। কাগজটাতে ভাইয়ার হাতের লেখা আছে। সেখানে লেখা,
আমি আর পারছিনা এই অপমান নিয়ে বাঁচতে। নিরপরাধ হয়ে আজ আমি সবার চোখে ঘৃণার একজন মানুষ। সবাই আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আজ আমার বোনটাকে যেতে আসতে শুনতে হয় ইভটিজারের বোন। আমি এগুলো নিয়ে আর বেঁচে থাকতে পারবো না। আমার কাছে আর দ্বিতীয় কোন উপায় খোলা নেই।
এটা ছিলো ভাইয়ার নিজের ডায়েরিতে লেখা শেষ কথা। যেদিন লেখা হয়েছে সেদিন ভাইয়ার লাশ পাওয়া যায়।
অনিকের ব্যপারে সব তথ্যগুলো ভাইয়া জোগাড় করেছিলো। সাঁঝ সত্যতা যাচাই করেছে। আর কথাগুলো আসলে ঠিক। অনিকের জন্য তার ভাইয়ের জীবন ধ্বংস হয়ে গেলো।
সাঁঝ পাতা উল্টে লিখলো “কানামাছি”

জানালার বাইরে কোন একটা পাখির ডাক শুনে সাঁঝ বাইরে তাকালো। কিন্তু পাখিটাকে খুঁজে পেলো না। মন উদাস হয়ে উঠলো। তার জীবনটাও অনেক পাল্টে গেছে। এখন তার আড়ালে অনেকেই তাকে মেয়ে গুন্ডা বলে ডাকে। যদিও সে কোন গুন্ডামী করে না। কিন্তু তার কিছু দল আছে। একটা এলাকায় আরেকটা তার ভার্সিটিতে। দলগুলো কোন খারাপ কাজ করে না বরং খারাপ কাজ আটকানোর চেষ্টা করে। তবুও মানুষ গুন্ডার দল বলে। তার সাথে বেশ কিছু মেয়ে আছে। তাদের নামের শেষে গুন্ডা কথাটা লাগেনি। তার নামের শেষে কেন লেগেছে এটার কারণ তার জানা নেই।

ফোনের রিংটোনে ভাবনা থেকে বাইরে আসলো। মুখে বাঁকা হাসি খেলে গেল। অনিক ফোন করেছে। সাঁঝ ফোন ধরার পরে ওপাশ থেকে বলল,

—” সাঁঝ ফোন করেছিলে রাতে? তখন আসলে ব্যস্ত ছিলাম একটা কেস নিয়ে। এখন বলো কেমন আছো?”

—” এই তো ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

—” হুম ভালো আছি। তোমার গলার আওয়াজ এমন কেন মনে হচ্ছে? শরীর খারাপ? বাসায় কিছু বলেছে?”

—” না অনিক তেমন কিছু না”

—” আচ্ছা তোমার সাথে জরুরী কিছু কথা আছে।”

—” হুম বলো”

অনিক কিছুটা থেমে বললো,

—” তোমার আমার সম্পর্ক এক বছর হয়ে গেছে। আমি এটাকে সম্পর্কই বলবো। কারণ আমি তোমার সাথে যেদিন থেকে কথা বলা শুরু করি সেদিন থেকে আমার ভালো লাগে তোমাকে। আমি এই এক বছরের মধ্যে অনেক বারই অনেকভাবে তোমাকে বলেছি যে আমি শুধু তোমাকে পছন্দ করিনা। এর থেকেও বেশি কিছু। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা আমি সত্যি তোমাকে নিজের কল্পনা আর স্বপ্নে সর্বোচ্চ জায়গা দিয়েছি যেটা অন্য কাউকে দেয়া সম্ভব না। এখন এমন হয়েছে যে তোমার সাথে আমার কথা না বললে অস্থির লাগে। তোমার কিছু হলে আমার রাতে ঘুম হয় না। তাই আজ অফিসিয়ালি বলছি সাঁঝ আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেকটা ভালোবাসি। হয়তো অন্য কাউকে এতোটা ভালোবাসতে পারবো না ”

সাঁঝের মুখে একটা হাসি খেলে গেলো। আপন মনেই বলল, অনিক তোমার চোখ বাঁধা শেষ। এবার তোমাকে ভেঙে দেয়া বাকি।

সাঁঝ যথাসম্ভব চেষ্টা করলো নিজের গলায় জড়তা আর লজ্জা আনার। বলল,

—” হুম। ধন্যবাদ”

অনিক একটু হাহাকার করে বলল,

—” ধন্যবাদ? কি ধন্যবাদ? প্রপোজ করলে কেউ ধন্যবাদ বলে?”

—” আর কি বলবো?”

—” আরে বাবা নিজের অনুভূতিটা বলো। আমার প্রতি তোমার কি অনুভূতি? ”

সাঁঝ একটু আমতা আমতা করে বলল,

—” আমারও তোমাকে ভালো লাগে”

অনিক একটু হেসে বলল,

—” লজ্জা পাচ্ছো? আমার না খুব ইচ্ছা হচ্ছে তোমার লজ্জামাখা মুখটাকে দেখতে। জানো আমার খুব ইচ্ছা আমি আর তুমি একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো। জ্যোৎস্না দেখবো। সকালে সূর্য ওঠা দেখবো। আর যখন আমি বলবো ভালোবাসি তখন তোমার লজ্জারাঙা মুখটাও দেখবো।”

—” আমি রাখছি”

—” এখনো লজ্জা পাচ্ছো দেখছি। আচ্ছা আর লজ্জা দিচ্ছি না। পরে কথা বলবো। নিজের খেয়াল রেখো। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো। কিছু লাগলে আমাকে বলো”

—” হুম রাখছি।”

সাঁঝ ফোন কেটে দিলো। তার মিশ্র অনুভুতি হচ্ছে। একদিকে অনিকের প্রোপজ শুনে ভালো লাগছে। তার কাছে ধরা দিয়েছে অনিক। ভালোবাসার কাছে ধরা দিয়েছে। অনিক আসলে তাকে অনেক ভালোবাসে। আর এটাই অনিককে শেষ করে দিবে। আর ভিতরে জ্বলতেও শুরু করেছে ভাইয়ের খুনির কাছ থেকে এসব ভালোবাসার কথা শুনে।
অনিককে তিলে তিলে শেষ করার আরো ব্যবস্থা সাঁঝ করেছে। সেগুলোর কাজে আজ ভার্সিটি যেতে হবে। এমনি সময়ে সে ভার্সিটিতে বেশি যায় না। মাঝে মাঝে পরীক্ষা বা অন্য কাজ থাকলে যায়। রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো কেউ নেই। দেখে খুশি হলো। নাহিদকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে মনে হয়। যা রান্না হয়েছিলো তার থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে সাঁঝ বের হয়ে গেলো।

রাস্তায় যাওয়ার সময় বারবার অনিকের বলা কথাগুলো মনে হচ্ছিলো। লজ্জামাখা মুখ দেখবে। এক বছর ধরে অনিকের সাথে এই নাটক করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বারবার ভাইয়ার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভাসছে। ভাইয়াকে মারার ভিডিও সে দেখছিলো। সেদিন খুব কান্না করেছিলো। কিন্তু এখন দেখলে অনিককে মেরে ফেলার নেশা চাপে মাথায়।

রিকশা থেকে নেমে ভার্সিটি থেকে একটু দূরে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে নিজের বান্ধবীদের জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ এসে পৌছায়নি। সাঁঝ একটা সিগারেট নিয়ে সেটা জ্বালিয়ে একটু সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে আগুনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
,
,
,
🍁
ইহান জার্মানি থেকে আজ দেশে ফিরলো। আজ তার খুশি আর ধরছে না এতোদিন পরে দেশে ফিরে। বাবা-মায়ের সাথে জেদ ধরে একটা ভার্সিটির লেকচারার হিসেবে জার্মানিতে গিয়েছিলো। কিন্তু দুই বছর হতে হতে না হতেই বুঝলো জার্মানি তার জন্য না। কোন আপনজন নেই সেখানে, নিজের মতো কাজ করার স্বাধীনতা পাচ্ছে না, কোন কিছুই ঠিক নেই। তাই চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। এখানে নিজের একটা সফটওয়্যার কোম্পানি দিবে বলে ঠিক করেছে। তবে বাবার সাথে ডিল হয়েছে বাবা তার কোম্পানি দিতে সাহায্য করবে যদি সে বাবার ব্যবসায় জয়েন করে। ডিলটা মেনে নিয়েছে।

গাড়িতে বসে চারিদিক যতো দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে ইহান। নিজের দেশের ট্রাফিক জ্যাম, হকার, শব্দ দূষণ সবই তার ভালো লাগছে। মানে এক কথায় অপূর্ব লাগছে। এক জায়গায় জ্যামে পড়ে গাড়ি আটকে গেলে ইহান জানালা নামিয়ে চোখ ভরে সব দেখতে থাকলো। হঠাৎ একটা মেয়েকে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো। বলে উঠলো,

—” আজকার পশ্চিমা দেশের মতো বাংলাদেশের মেয়েরাও কি রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে নাকি?”

ড্রাইভার কোন উত্তর দিলো না।
ইহানের মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেল এই দৃশ্য দেখে। সে নিজে কত গর্ব করতো যে তার দেশের মেয়েরা অন্য দেশের মেয়েদের মতো না। মদ, সিগারেট এসব খায় না। অনেক শালীন। এই দুই বছরে এতো পরিবর্তন হয়ে গেলো সব? (চলবে)

কানামাছি পর্ব-০১

0

#কানামাছি
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
#পার্টঃ১

পাত্রপক্ষের সামনে শাড়ি, চুড়ি পরে আদর্শ পাত্রী হয়ে এসে সিগারেট ঠোঁটে চেপে তাতে আগুন ধরিয়ে নিলো সাঁঝ। সামনে বসা ভুড়িওয়ালা পাত্র বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো সাঁঝের দিকে। সাঁঝ পাত্রের দিকে তাকিয়ে একবার চোখ মেরে উদাস ভঙ্গিতে জানালার বাইরে তাকালো। মাঝে মাঝে সিগারেটটা নিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরছে। কিন্তু টান দিচ্ছে কিনা সেদিকে কারোর নজর নেই।

কেউ আশা করতে পারেনি সাঁঝ এমন করতে পারে। একটা জামরঙা শাড়ি আর সাথে ম্যাচিং চুড়ি পরে যখন মাথা নিচু করে পাত্রের সামনে এসেছিলো তখন খুব শান্ত মনে হয়েছে সবার। আর মেয়েকে শান্ত দেখে পাত্রের মা হেঁটে দেখাতে বলেছে। সেটাও করেছে। কিন্তু বসার পরেই সাঁঝ সিগারেট জ্বালিয়েছে। পাত্রের মা আর্তচিৎকার দিয়ে বলল,

—”ছি ছি এই মেয়ে সিগারেট খায়? নেশাখোর মেয়েকে দেখতে এসেছি আমার বাবুর জন্য?”

পাত্রের মা মুখ কুঁচকে সাঁঝের ফুফু রোমেসা বেগমের দিকে তাকালো। তারপর হেড়ে গলায় বলল,

—”কেমন মানুষ আপনারা? মেয়েকে কেমনভাবে মানুষ করেছেন? নেশাখোর মেয়েকে মিথ্যা বলে গছিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন আমাদের কাছে? যে মেয়ে সিগারেট খায় সে যে গাঞ্জা খায় না বা নষ্ট মেয়ে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে? কেমন শিক্ষা পেয়েছে মেয়ে?”

রোমেসা বেগম আমতাআমতা করে বললেন,

—”আসলে ও মানে….”

উনার কথা আর আগালো না। উনি চুপ হয়ে গেলেন। সাঁঝ জানালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাত্রের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ইনারা আমাকে কোন শিক্ষা দেয়নি। এটুকু ভুল বলেছেন। বাকি উনাদেরকে যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। আরো বলতে পারেন। সমস্যা নেই ”

রোমেসা বেগম সাঁঝের দিকে কটমট করে তাকালেন। আর সাঁঝের ফুফা তাহের সাহেব কাশতে শুরু করে দিলেন। সাঁঝ নিজের ফুফা-ফুফুর কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা করে পাত্রের দিকে সিগারেট দিয়ে বলল,

—” একটা টান দিবেন নাকি? দিলে নিতে পারেন। আমার সমস্যা নেই। আমার আবার সবকিছুই শেয়ারিংয়ের অভ্যাস আছে বুঝলেন”

সাঁঝ মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। পাত্র অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।আর পাত্রের মা চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকলো সাঁঝের দিকে। বললেন,

—” মেয়ে এরকম আগে জানলে কখনোই আসতাম না। এমনিতে মেয়ের গায়ের রঙ ময়লা তারপর মেয়ের চরিত্রের কথা নাই বা বললাম। ছি ছি এই বাড়িতে থাকতেও অপবিত্র লাগছে”

পাত্রের মা পাত্রকে একপ্রকার টানতে টানতে হনহন করে বের হয়ে গেল। সাঁঝ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেটটা হাতে নিয়েই বাসার ভিতরে গেল। পিছন থেকে হঠাৎ সাঁঝের ফুফু সাঁঝের হাত চেপে ধরলো। এতো জোরে ধরলো যে কাচের চুড়ি ভেঙে সাঁঝের হাত কেটে গেলো। ফুফু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—” বেয়াদপ মেয়ে। ইচ্ছা করে এক চড় মেরে সবগুলো দাঁত ফেলে দিই। আমাদের এতো অসম্মান করছিস তুই!”

—” তোমাদের সম্মানও আছে নাকি? আমার তো জানা ছিলো না। আর আমি বিয়ে করবো না সেটা ভালো করেই জানো। তারপরও সম্বন্ধ আনো কেন? তোমাদের শিক্ষা হয় না? এতোজনকে তো তাড়িয়েছি তাও প্রতিবার বাবার নামে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে ওদের সামনে যেতে বল!”

সাঁঝে হাতের সিগারেটের আগুনটা ফুফুর হাতে লাগিয়ে দিলো। সাথে সাথে রোমেসা বেগম হাত সরিয়ে নিলো। মিষ্টি হেসে সাঁঝ বললো,

—” সরি। ভুলে লেগে গেছে”

সাঁঝ আর কিছু না বলে চলে গেলো নিজের রুমে। হাতের রক্ত পরিষ্কার করে রান্নাঘরে থেকেই নিজের খাবার নিয়ে টেবিলে বসে খেতে লাগলো। রোমেসা বেগমের রাগ উঠে গেলো সাঁঝের এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার দেখে। সে খাবার প্লেটটা সাঁঝের সামনে থেকে তুলে নিলো। কেবল দুই গ্রাস খাবার মুখে নিয়েছিলো সাঁঝ। উনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

—” লজ্জা করে না ফুফুর ঘাড়ের উপর বসে খাচ্ছিস? বিয়ে করে বিদেয় হোস না কেন? নিজের বাপ আর ভাইটাকে কে তো খেয়েছিস। মা অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার পেতেছে। আর মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে।”

সাঁঝ মাথা নিচু রেখে খুব শান্ত স্বরে বলল,

—” আমি তোমাদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি না। তোমরা বরং আমার বাড়িতে বসে বসে গিলছো। এই বাড়ি আমার বাবার ছিলো। আর এখন আমার। তুমি কি মনে করো আমি জানিনা তুমি বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ির শেয়ার ছেড়ে দিয়েছিলে? আমি সব জানি”

রোমেসা বেগমের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

—” অসভ্য মেয়ে। ফুফার উপর বসে খেয়ে আবার বলিস আমরা তোর বাড়িতে আছি? আমা দেবরের বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলাম। তা তো তুই বিয়ে করবি না। নাহিদ কাল আসছে। ওর সাথে আর কোন বেয়াদপি করবি না বলে দিলাম”

—” তোমার ওই চরিত্রহীন দেবর নাহিদের সাথে বিয়ে কেন ওর মুখ আমি দেখতে চাই না। ওই ছেলে তো কথা বলার সময় মুখের দিকে তাকায় না। ওর চোখ সারা শরীরের উপর ঘুরে বেড়ায়। আগের বার আমার হাত ধরেছিলো শুধু সিগারেটের ছ্যাকা দিয়েছিলাম। এবার কিছু করলে হাত একদম গুড়িয়ে দেবো”

রোমেসা বেগম ভয় পেয়ে গেলেন। উনি মুখে হম্বিতম্বি করলে ভিতরে ভিতরে সাঁঝকে ভয় পান। এখন তো মনে হচ্ছে সাঁঝের কথা আর চোখ থেকে আগুন ঝরছে। সাঁঝ আবার বলল,

—” আর বাকি থাকলো তোমার ওই স্বামীর কথা। সে কোন কাজ তো করেই না বরং শশুড় বাড়ির ইনকাম উড়িয়ে বেড়ায়। আমার সব জানা আছে সে কোন কোন জায়গায় কি কি করে বেড়ায়! ভালো চাইলে আমার মুখ খুলিয়ো না”

সাঁঝ একবার আড়চোখে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ফুফার দিকে তাকালো। সে ভয়ে সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে গেলো। এই লোকটাকে দেখলে সাঁঝের ইচ্ছা হয় বাড়ি থেকে বের করে দিতে। নিজের ভাইয়ের মতো ইনার চোখের দৃষ্টি ঠিক নেই। কথা বলার সময় মুখ বাদে জায়গায় চোখ থাকে এই ফুফার। কিন্তু তার বাবা নিজের বোনকে ভীষণ ভালোবাসতো তাই বাবার কথা ভেবে এদের বের করতে পারে না।
খাওয়া শেষ না করেই হাত ধুয়ে ছাদে চলে এলো সে। মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর গ্যাসলাইট। বমি বমিও লাগছে। সাঁঝ সিগারেট খায় না। গন্ধও সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু একটু একটু করে আগুনে পুড়তে দেখলে তার ভিতরটা শান্ত হয়। নিজের ভিতরে শান্তি অনুভব করে। আজ সিগারেট মুখে নিয়েছে। এজন্যই বমি বমি লাগছে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে দূরে রেখে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এভাবে পুড়তে দেখলে মনে হয় যাক তার মতো অন্য আরো জিনিস আছে যেগুলো পোড়ে। নিজের জীবনটা একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না তার কাছে।

বাবা নাম দিয়েছিলো সেমন্তী সাঁঝ। বাবা, মা আর বড় ভাই সাহেলকে নিয়ে ছোট একটা পরিবার ছিলো। মা-বাবার লাভ ম্যারেজ ছিলো। তাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না।কিন্তু একটা ঘটনার পর সব বদলে যেতে থাকে। সাঁঝ যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন একদিন বাবার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলো। নিজে জেদ ধরে ছিলো বেড়াতে না নিয়ে গেলে কান্না করবে। বাবা তাকে খুব ভালোবাসতো। তাই মোটরসাইকেলে করে বেড়াতে গিয়েছিলো। রাতে বেলা ফেরার পথে এক্সিডেন্টে বাবা স্পট ডেড হয়। আর সাঁঝ আহত। যাওয়ার সময় একটাই হেলমেট ছিলো। সেটা বাবা পড়েছিলো। কিন্তু ফেরার পথে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে বাবা তাকে জোর করে পড়তে বলেছিলো হেলমেটটা। আর শেষ সময়ে ধাক্কাও দিয়েছিলো যাতে রাস্তার পাশে গিয়ে পড়ে যায় সে। সাঁঝের মনে হয় বাবা সব জেনে বুঝে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে নিজেকে ঝুকিতে ফেলে দিয়েছিলো।

মা বাবার মৃত্যুর পর একপ্রকার পাথর হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় দেড় সপ্তাহ পরে হাসপাতাল থেকে ফিরে যখন সাঁঝ মাকে সব বলে তখন মায়ের মনে হতে থাকে সব সাঁঝের জন্য হয়েছে। সে না থাকলে তার বাবা এভাবে মারা যেতো না। শুধু মা কেন তার নিজের কাছেও এমন মনে হয়। বাবাকে একবার জড়িয়ে ধরে সরি বলতে পারলে খুব ভাল হতো। মায়ের সাথে তাদের সম্পর্কের দুরত্ব সে সময়ে বাড়তে থাকে। বাবার মৃত্যুর দুই বছর পরে সাঁঝ যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো তখন তার মা এই বাসায় তাদের দুজনকে ফেলে অন্য একজনের সাথে বিয়ে করে নেই। এখন তো নিজের মায়ের উপর ঘৃণা হয়। তাদের নাকি লাভ ম্যারেজ ছিলো! অফুরন্ত ভালোবাসা ছিলো! এজন্য মানুষটা যাওয়ার দুই বছর পরেই আরেকজনকে বিয়ে করে এখন সুখে সংসার করছে। এখন সাঁঝ নিজের মায়ের মুখদর্শনও করে না। তখন ভাইয়া তার একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়। আর ফুফুরা এই বাসায় চলে আসে।

এর দেড় বছর পরে ভাইয়াও তাকে ছেড়ে যায়। সাঁঝ আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করতেই একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। একটা মাঠে একটা ছেলেকে একটা পুলিশ অফিসার বেধড়ক মারছে। আর ছেলেটা কান্না করতে করতে বলছে,

—” স্যার মেরেন না। স্যার আল্লাহর দোহায় লাগি আর মারবেন না। আল্লাহর কসম আমি এই কাজ করিনি। বিশ্বাস করেন স্যার। আর মারবেন না।”

ছেলেটা মাইর সহ্য করতে না পেরে পুলিশ অফিসারটার পায়ের পড়লো। পুলিশ তাকে পা দিয়ে ঠেলে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,

—” সর! আমার পায়ে পড়বি না। ইভটিজিং করিস? হ্যা? মেয়েদের গায়ে হাত দিস? অপহরণ করার হুমকি দিস? বাসায় চিঠি পাঠাস তোর সাথে না গেলে তুলে নিয়ে যাবি?”

পুলিশটা আবার মারতে শুরু করে। গায়ের রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। শার্ট ছিড়ে গেছে ছেলেটার। নাক থেকে রক্ত পড়ছে। কিন্তু ছেলেটা আর প্রতিরোধ করা শক্তি পাচ্ছে না। পুলিশটা একটু থামলে ছেলে ক্ষীণ স্বরে বলল,

—” স্যার আমি এই কাজ করিনি। আমারও বোন আছে। আমি কিভাবে এই কাজ করি?”

পুলিশের অত্যাচার এখানেই শেষ হলো না। ছেলেটার গলায় জুতার মালা পরিয়ে সারা মাঠ ঘোরানো হলো। আশেপাশে শত শত লোকজন শুধু দেখে গেল। কেউ টু শব্দটা পর্যন্ত করলো না। কেউ কেউ মজা নিয়ে দেখতে থাকলো। কেউ ভিডিও করে ছেড়ে দিলো ইন্টারনেটে।
এরপরে সাঁঝের চোখের সামনে আরেকটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। তার ভাই ঘুমিয়ে আছে।হাসপাতালের মর্গে। চিরঘুমে চলে গেছে। সামনে থাকা পুলিশ বলল,

—” এক্সিডেন্ট পেশেন্ট। হাসপাতালে আনার পরে মৃত্যু । আপনি চান না তাই পোস্টমর্টেম হবেনা।”

সাঁঝ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কোন আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না দেহে। এভাবে এক্সিডেন্টে মারা গেল তার ভাই? এটা আদোও এক্সিডেন্ট না আত্মহত্যা?

সাঁঝ চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকালো। কত তারা দেখা যাচ্ছে! আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” ভাইয়া এবার আমি খেলা শুরু করবো। কানামাছি খেলা। চোখ থাকবে বাঁধা। আর কোনদিক থেকে কি হবে চেয়েও বুঝতে পারবে না”

চলবে।

শোষণ – লেখিকাঃ- ফারিয়া তাবাসসুম

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
#গল্পের নামঃ- শোষণ
#লেখিকাঃ- ফারিয়া তাবাসসুম
#পোস্ট নংঃ- ১

বাজান? ও বাজান? বড়লোকগো খাওনের টেবিলে আপেল-কমলা থাহে, তাও তারা খায় না ক্যা?
– তাগো মুখে ওইগুলান বিস্বাদ ঠ্যাকে।
– কী কও তুমি? আপেল, কমলা বিস্বাদ ঠ্যাকবো ক্যান?
– তোর মুখে জৈষ্ঠ্যমাসে আমগো গাছের কাঁঠল বিস্বাদ লাগে না?
– সারাদিনই কাঁঠল খাইতে ভাল্লাগে কি? সকালে কাঁঠল, দুপুরে কাঁঠল। মা তো রাইতেও খাইতে কয়।
– বড়লোকগো কাছে আপেল, কমলাও ওমন। খাইতে খাইতে তাগো মুখে সবই কাঁঠলের মত লাগে।
আট বছর বয়সী গুলুর বাবার উত্তরটা মনে ধরে। সে সিনেমায় বহুবার দেখেছে খাওয়ার টেবিলে হরেক রকম ফল থাকলেও যারা খেতে বসে তারা না খেয়েই উঠে যায়। না খেয়ে উঠে যায় কেন গুলু তা বুঝে না। আরও কত কিছুই বুঝে উঠতে পারে না গুলু। বাবাকে প্রশ্ন করতে থাকে একের পর এক।
– বাজান? তারা যদি নাই খাইব তাইলে টেবিলে ওমন কইরা সাজাইয়া রাখে ক্যান? কত রকম মাছ, মাংসও তো থাহে!
ফজর আলী যে সবসময় গুলুর সবরকম প্রশ্নের যুতসই জবাব দিতে পারে, তা নয়। তখন ধমক দিয়ে বলে, বড় ত্যক্ত করস পোলা! চুপ কইরা না থাকলে কি মাছ আইব?
বর্ষার শুরুতেই জল ঢুকে তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর ডুবে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ছোটো বড়ো নানা রকমের মাছ। গ্রামের কেউ কেউ ঠেলাজাল, বিটে, পলো, আন্টা নিয়ে এসেছে মাছ ধরতে। ফজর আলী এসেছে ধর্মজাল নিয়ে। টেংরা, পুটি যেমন ধরা পড়ছে তেমনি রুই, কাতলাও আটকা পড়ছে কারও কারও জালে। ফজর আলীর জালে এখনও বড় মাছ ধরা পড়েনি। বাড়ি থেকে জাল নিয়ে বের হওয়ার সময় গুলুকে নিয়ে একরকম পালিয়েই এসেছে সে। কেননা ছোটো ছেলে টুনু দেখে ফেললে তাকে রেখে আসার কোনো উপায় ছিল না।
টুনুর বয়স ছয়। পিঠাপিঠি এই দুই ভাই কেউ কাউকে ছাড়া বেশি সময় থাকতে পারে না। তবু মাছ ধরার লোভ সামলাতে না পেরে গুলু টুনুর মায়া ত্যাগ করেই বাবার পিছু নিয়েছে। গুলু ভালো করেই জানে ছোটোর জ্বর, মা তাকে কিছুতেই আসতে দিবে না। ফজর আলী মনে মনে স্ত্রী সালেহার কথা ভাবে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে টুনু গুলুর খোঁজ নিতে নিতে সালেহাকে অস্থির করে তুলেছে।
– বাজান? ও বাজান? মাছে পানির মইধ্যে ঘুমায় কেমনে? তাকাইয়া তাকাইয়া ঘুমায় কি?
ফজর আলী নিজেও জানে না, মাছ কিভাবে ঘুমায় কিংবা আদৌ ঘুমায় কিনা। গুলুর এতশত প্রশ্নের কী জবাব দিবে সে? তার জ্ঞানের পরিধি বড় সীমিত। আকাশের দিকে তাকায় ফজর আলী। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, যে কোন সময় শুরু হতে পারে বর্ষণ। গুলুকে বলে,
– তোরে যে কইলাম বৃষ্টি নামবার পারে। তাও আইলি। এহন নামলে কই যাবি? কই খাড়াবি?
– তুমি কই যাইবা?
– আমি ভিজলে সমস্যা নাই। তুই ভিজলে তো জ্বর আইবো।
গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে বাপের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে গুলু। ফজর আলী কিছু দূরেই একটা ঝোঁপ থেকে মানকচুর পাতা কেটে এনে ছাতার মত করে পুত্রের মাথায় ধরে। বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে টুপটুপ বৃষ্টি পতনের ছন্দ গুলুর কাছে দারুণ এক ব্যাপার। এর মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ মাছ ধরতে আসা মানুষগুলো উল্লসিত হয়ে পড়ে, যে কারও জালে একটা বড় মাছ ধরা পড়লেই।
গুলু মনে মনে কথা গুছিয়ে রাখে। বাড়ি ফিরেই সে টুনুকে মাছ ধরার বিবরণ দিবে, বৃষ্টি শুরু হলে কী করলো সবাই, কার জালে কত বড় মাছ ধরা পড়লো, সেটা নিয়ে কেমন উৎফুল্ল হলো সবাই,
আরও কত কী! কিন্তু গুলুদের জালে একটা বড় মাছ ধরা না পড়লে গল্প কী ঠিক জমবে?
– বাজান? ও বাজান? একটা বড় মাছও কি আইবো না আমগো জালে?
এমন বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ওতটুকু ছেলের একটা বড় মাছের আকাঙ্ক্ষা পিতার বুকেও বিঁধে। একটা বড় মাছ তো আটকা পড়াই উচিত; সকলের জালেই ধরা পড়ছে। কিন্তু অদৃষ্ট কখনোই ফজর আলীর প্রতি সুবিচার করেনি। নিত্য অভাব অনটনের সংসারে ফজর আলীর উদ্বৃত্ত হয়নি কিছুই। কিছু জমাতে পারলেও সেই সম্বল কখনোই টিকেনি তার বরং নানা রকম বিপদ-আপদে জড়িয়ে সঞ্চয়টুকু হারিয়ে আরও বেশি দেনা হয়েছে সে। বছর দশেক আগে ভিটেমাটি পর্যন্ত এ গ্রামেরই তরফদার সাহেবের কাছে গচ্ছিত রেখে টাকা এনে অসুস্থ পিতার চিকিৎসা করেছিল ফজর আলী। তবু বাবাকে ফেরাতে পারেনি সে , আজ অবধি চক্রবৃদ্ধির সুদও!
প্রথম যৌবনে সালেহাকে বিয়ে করে আনার পর তবু হুটহাট দু একটা বড় মাছ কিনে আনার দুঃসাহস দেখিয়েছে সে। এখন আর পারে না। কত রকম হিসাব নিকাশ করে চলতে হয়। ছেলেরা বড় হচ্ছে, স্কুলের মাইনে, বই খাতা পত্র, ঋণের সুদ, চাল ডাল নুন তেল, একটা সংসারে কত কিছুই না লাগে! সামান্য কৃষিকাজে ক’টাকা আর আয় হয়? হিমশিম খেতে হয় ফজর আলীর।
সালেহার কথা বাদ দিলেও দুটো সন্তানের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে না পারার দুঃখ ভেতরে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খায় তাকে।
– বাজান? ও বাজান? জাল তুলবা না?
সম্বিৎ ফিরে পায় ফজর আলী।
বৃষ্টি থেমে গেছে।
কাকভেজা হয়ে বাপ-বেটা দুজনেই বাড়ি ফেরার পথে আনন্দের সীমা নেই। মাছ ধরার শেষের দিকে এসে দুই হাত সাইজের একটা কাতল মাছ ধরা পড়েছে জালে। এত বড় সাইজের মাছ গুলু তার এই জীবনে আগে কখনও দেখেনি। তবে ওত সহজেই পাকড়াও করা যায়নি এ মাছ। মাছটা ধরার সময় মানকচুর পাতা কোথায় ভেসে গেছে সেদিকে খেয়াল ছিল না বাপবেটার। বাকিটা সময় দুজনেই ভিজেছে।
– বাজান? ও বাজান? মাছডা তাইলে টুনুর সমান অইব?
– বাড়ি যাইয়া টুনুর লগে মাপ দিয়া দেখিস।
– মাছডা তো তোমার কোমর ছোঁয় ছোঁয় বাজান।
– হ। কই থাইক্যা যে বানের জলে ভাইস্যা আইছে কেডায় জানে!
– বাজান, মাছের মুড়োডা কইলাম তাইলে আমি খামু?
– খাইস! খাইস!
পরক্ষণেই টুনুর কথা মনে পড়ে গুলুর। দীর্ঘ সময় অনুজকে না দেখতে পেয়ে মায়া হয় টুনুর প্রতি। এ সময়টায় কতই না ভাই ভাই করে খুঁজেছে টুনু! গুলুরও কম মনে পড়েনি ছোটো ভাইয়ের কথা। মাছটা ধরার সময় টুনু পাশে থাকলে কত আনন্দই না পেতো!
– বাজান মাছের মুড়োডা তো বড় অইবো অনেক?
না?
– হ, তা তো অইবোই।
-আধেকখান তাইলে টুনুকে দিবনি।
পুত্রের মুখের দিকে তাকায় ফজর আলী। পিতার এক জীবনে সন্তানদের নিকট এরচেয়ে বেশি আর কী বা চাওয়ার থাকে? খুশি মনে আবার হাঁটা শুরু করে সে।
গ্রামের পথ, বৃষ্টি শেষে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তায় গুলু পা ফেলে মেপে মেপে। তবুও পায়ে পায়ে তাল মেলায় বাবার সাথে। দ্রুত ফেরার তাড়া তারও। টুনুকে এই মাছ না দেখানো অবধি মনে স্বস্তি নেই এতখানি।
– বাজান, আমি আইছিলাম দেইখাই কিন্তু এত বড় মাছ আইছে জালে! তাই না বাজান?
– হ, রে বাপধন। আমার বাপধনের কপাল আছে। আমার মত না আমার বাপধনের….
কথা শেষ হয় না ফজর আলীর।
বিপরীত দিক তরফদার সাহেব তার সাত বছরের নাতনি সুইটিকে নিয়ে এইদিকেই আসে। দেখা হয় পথের ওপর। বৃষ্টি থেমে গেলেও তরফদার সাহেবের লাঠিয়াল জমশেদ ভূস্বামীর মাথা থেকে ছাতা নামায়নি এখনও। প্রথমেই মাছটা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয় সুইটি।
– দাদু! দাদু! কত বড় মাছ!
আ্যঁ, সত্যিই তো! তরফদার সাহেব নিজেও কম অবাক হয় না। এত বড় মাছ সচরাচর চোখে পড়ে না। ফজর আলীকে জিজ্ঞেস করে,
– ফজর! কই থেকে ধরলা মাছটা?
এক মুহূর্তেই দমে যায় ফজর আলী। এত সাধের মাছটা হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মুখে কৃত্রিম হাসি এনে জবাব দেয় ফজর আলী,
– ভাটচান্দা বিলের কাছে থিইক্যা মাতবর সাব।
– ভাটচান্দা বিলে এত বড় মাছ? উঁহু! মাছটা মনে হয় অন্য কোন জায়গা থেকে বানের জলে ভাইসা আইছে।
– তাই অইব মাতবর সাব।
জমশেদের চাটুবৃত্তি স্বভাব। দীর্ঘদিন ধরে তরফদার সাহেবের লাঠিয়াল। কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় খুব ভালো করেই জানে। জমশেদ বলে,
– মাতবর সাব। মাছডা মনে হয় আপামণির পছন্দ অইছে অনেক। ঢাকা থিইক্যা আইছে। শহর বন্দরে তো আর খাঁটি জিনিশ পাওন যায় না!
-আ্যঁ! কস তুই? ফজর এত কষ্ট কইরা ধরছে!
– আবার ধরবনি। কেবল বানের পানি আসা শুরু অইছে। ওর ছাওয়ালকে টেহা পয়সা দিয়া দেইন কিছু।
-আ্যাঁ! কস তুই?
তরফদার সাহেব তার পরনের গেরুয়া রঙের ফতুয়ার পকেট থেকে একশত টাকার দুইখানা নোট গুলুর হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলে, রাখো!ফজর আলীর উদ্দেশে বলে,
-তোমার পোলাকে কিছু কিনে দিও ফজর! পড়ালেখা করাইও ঠিকমতো। পড়ালেখা ছাড়া উপায় নাই। আর শোনো ফজর,সুদের টেকা তো বাকি পড়ছে মেলা। দিন কয়েক হইলো হিসাবের খাতা নিয়া বসি না। আইসো একসময়। ওত চাপ নাই তোমার জন্য, তুমি অইলা আমার আপনা লোক।
জমশেদ রে, নে তাইলে। মাছটা নিয়া আয়।
দাদুমণি খাইব আমার।
ফজর আলী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর চলা শুরু করে আবার। সামনের পথটুকু ঝাপসা মনে হয়। কিছুক্ষণ আগেও যে ফেরায় আনন্দ ছিল মুহূর্তেই সে উৎফুল্লতা হারিয়ে গিয়ে বাড়ির পথে পা যেন আর এগুতে চায় না কিছুতেই। পাশেই সমস্ত উত্তেজেনা বিসর্জন দিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হেঁটে চলে ছোটো গুলুও। এই মুহূর্তে প্রিয় সন্তানের দিকে একটিবার তাকাবার মতো দুঃসাহসও হারিয়ে ফেলে পরাজিত, শোষিত, দলিত এক জনক। বোধকরি ওতটুকু শিশুও বাবার মনের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে। দীর্ঘ সময় নীরব থাকা জনকের হাতের আঙুল ছুঁয়ে কিছু একটা বলে নীরবতা ভাঙা উচিত ভেবেই বলে হয়তো,
-বাজান? তরফদার সাবরা তো ধনী মানুষ।
নিত্য দিন মাছ-মাংস খায়
তাদের মুখে বিস্বাদ ঠ্যাকে না কোনোদিন?