Sunday, July 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1485



দেবী তৃতীয় এবং শেষ পর্ব

0

দেবী তৃতীয় এবং শেষ পর্ব

# – হুমায়ূন আহমেদ

🔴 পনেরো 🔴
.
সারাটা পথ নীলু চুপ করে রইল। একবার সে বললো, ‘কী ব্যাপার, এত চুপচাপ যে?’ নীলু তারও জবাব দিল না।তার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে আছে একটা ঘোরের মধ্যে।
‘গান শুনবে? গান দেব?’
নীলু মাথা নাড়ল। সেটা হাঁ কি না, তাও স্পষ্ট হলো না।
‘কী গান শুনবে? কান্ট্রি মিউজিক? কান্ট্রি মিউজিকে কার গান তোমার পছন্দ?’
নীলু জবাব দিল না।
‘আমার ফেবারিট হচ্ছে জন ডেনভার। জন ডেনভারের রকি মাউন্টেন হাই গানটা শুনেছ?’
‘না।’
‘খুব সুন্দর! অপূর্ব মেলোডি!’
সে ক্যাসেট টিপে দিতেই জন ডেনবারের অপূর্ব কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ক্যালিফোর্নিয়া রকি মাউন্টেন হাই।’
‘কেমন লাগছে নীলু?’
‘ভালো।’
‘শুধু ভালো না। বেশ ভালো।’
সেও জন ডেনভারের সঙ্গে গুনগুন করতে লাগল। নীলুর মনে হলো ওর গানের গলাও তো চমৎকার! একবার ইচ্ছা হলো জিজ্ঞেস করে গান জানেন কি না, কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গাড়ি কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে তাও সে লক্ষ্য করছে না। এক বার শুধু ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক জন ভিখিরি এসে ভিক্ষা চাইল। সে ধমকে উঠল কড়া গলায়। তারপর আবার গাড়ি চলল। নীলু ফিসফিস করে বলল, ‘কটা বাজে?’
‘সাতটা পঁয়ত্রিশ। তোমাকে আটটার আগেই পৌঁছে দেব।’
‘আপনার বাড়ি মনে হয় অনেক দূর?’
‘শহর থেকে একটু দূরে বাড়ি করেছি। কোলাহল ভালো লাগে না। ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড কার লেখা জান?’
‘নাহ্।’
‘টমাস হার্ডির। পড়ে দেখবে, চমৎকার! অথচ ট্রাজিডি হচ্ছে, টমাস হার্ডিকেই নোবেল পুরুষ্কার দেয়া হয় নি। তুমি তাঁর কোনো বই পড়েছে?’
‘পড়ে দেখবে। খুব রোমান্টিক ধরনের রাইটিং।’
গাড়ি ছুটে চলছে মিরপুর রোড ধরে। হঠাৎ নীলু বলল, ‘আমার ভালো লাগছে না।’
সে তাকাল নীলুর দিকে। একটি হাত বাড়িয়ে ক্যাসেটের ভল্যুম বাড়িয়ে দিল। গাড়ির গতি কমলো না।
‘আমি বাসায় যাব।’
‘আটটার সময় আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব।’
‘না, আজ আমি কোথাও যাব না। প্লীজ গাড়িটা থামান, আমি নেমে পড়ব।’
‘কেন?’
‘আমার ভালো লাগছে না। প্লীজ।’
সে তাকাল নীলুর দিকে। নীলু শিউরে উঠল। এ কেমন চাউনি! যেন মানুষ নয়, অন্য কিছু।
‘প্লীজ, গাড়িটা একটু থামান।’
‘কোনো রকম ঝামেলা না-করে চুপচাপ বসে থাক। কোনো রকম শব্দ করবে না।’
‘আপনি এ রকম করে কথা বলছেন কেন?’
গাড়ির গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ঝড়ের গতিতে পাশ দিয়ে দুটো ট্রাক গেল। লোকটি তার একটি হাত রাখল নীলুর উরুতে। নীলু শিউরে উঠে দরজার দিকে সরে গেল। লোকটি হাসলো। এ কেমন হাসি!
‘গাড়ি থামান। আমি চিৎকার করব।’
‘কেউ এখন তোমার চিৎকার শুনবে না।’
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’
‘আমি ভয় দেখাচ্ছি না।’
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করে গাড়িতে উঠেছি।’
‘আরো কিছুক্ষণ থাক। বেশিক্ষণ নয়, এসে পড়েছি বলে।’
‘কী করবেন আপনি?’
‘তেমন কিছু না।’
নীলু এক হাতে দরজা খুলতে চেষ্টা করল। লোকটি তাকিয়ে দেখল, কিন্তু বাধা দিল না। দরজা খোলা গেল না। নীলু প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করল, আমাকে বাঁচাও, কিন্তু বলতে পারল না। প্রচুর ঘামতে লাগল। প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হলো।
.
🔴 ষোলো 🔴
.
আনিস এলো রাত সাড়ে আটটায়। ঘর অন্ধকার। কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। রানু বাতিটাতি নিভেয়ে অন্ধকারে বসে আছে। জিতু মিয়া মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়েছে।
‘রানু, কী হয়েছে?’
রানু ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি এত দেরি করলে!’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘নীলুর বড় বিপদ।’
আনিস কিছু বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকাল। রানু থেমে-থেমে বলল, ‘নীলুর খুব বিপদ।’
‘কিসের বিপদ? কী বলছ তুমি?’
রানুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সে গুছিয়ে কিছু বলতে পারছে না।
‘রানু, তুমি শান্ত হয়ে বস। তারপর ধীরেসুস্থে বল-কী হয়েছে নীলুর?’
‘ও একজন খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছে। লোকটা ওকে মেরে ফেলবে।’
রানু ফোঁপাতে লাগল। আনিস কিছুই বুঝতে পারল না। নীলুর বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই তার কথা হয়েছে। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কি, এত দেরি যে?’ যার মেয়ের এত বড় বিপদ, সে এ রকম স্বাভাবিক থাকবে কী করে?
আনিস বলল, ‘ওরা তো কিছু বলল না।’
‘ওরা কিছু জানে না। আমি জানি, বিশ্বাস কর-আমি জানি।’
‘আমাকে কী করতে বল?‘
‘আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘জিনিসটা কি তুমি স্বপ্নে দেখেছে?’
‘না। কিন্তু আমি দেখেছি।’
‘কী দেখেছ?’
‘আমি সেটা তোমাকে বলতে পারব না।’
‘তুমি যদি চাও আমি নিচে গিয়ে ওদের বলতে পারি, কিন্তু ওরা বিশ্বাস করবে না।’
রানু চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। ওর শরীর অল্প-অল্প করে কাঁপছে। আনিস বলল, ‘নাকি মিসির আলি সাহেবের কাছে যাবে? উনি কোনো-একটা বুদ্ধি দিতে পারেন।যাবে?’
রানু কাঁপা গলায় বলল,‘তুমি নিজে কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?’
‘হ্যাঁ, করছি।’
একতলার বারান্দায় বিলু বসেছিল। ওদের নামতে দেখেই বিলু বলল, ‘ভাবী, নীলু আপা এখনো ফিরছে না। বাবা খুব দুশ্চিন্তা করছেন।’
রানু কিছু বলল না।
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভাবী?’
রানু তারও জবাব দিল না। রিকশায় উঠেই সে বলল, ‘আমাকে ধরে রাখ,খুব ভালো লাগছে।’
আনিস তার কোমর জড়িয়ে বসে রইল। রানুর গা শীতল। রানু খুব ঘামছে। জ্বর নেমে গেছে।
.
রানু চোখ বড়-বড় করে বললো, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তাই না?’
মিসির আলি চুপ করে রইলেন।
‘আগে আপনি বলুন-আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?’
‘বিশ্বাসও করছি না, আবার অবিশ্বাসও করছি না। তুমি নিজে যা সত্যি বলে মনে করছ, তা-ই বলছ। তবে আমি এত সহজে কোনো কিছু বিশ্বাস করি না।’
‘কিন্তু যদি সত্যি হয়,তখন?‘
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে কাশতে লাগলেন।
‘বলুন, যদি আমার কথা সত্যি হয়-যদি মেয়েটা মারা যায়?’
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ঠিক এই মুহূর্তে কী করা যায়, তা তো বুঝতে পারছি না। মেয়েটি কোথায় আছে, তা তো তুমি জান না। নাকি জান?’
‘না,জানি না।’
‘ছেলেটির নামধামও জান না?’
‘ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর। আমার এ রকম মনে হচ্ছে।’
‘এই শহরে খুব কম করে হলেও দশ হাজার সুন্দর ছেলে আছে।’
‘আমরা কিছুই করব না?’
‘পুলিশের কাছে গিয়ে বলতে পারি একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে এবং আশঙ্কা করা যাচ্ছে দুষ্ট লোকের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু তাতেও একটা মুশকিল আছে, ২৪ ঘন্টা পার না হলে পুলিশ কাউকে মিসিং পারসন হিসেবে গণ্য করে না।’
‘রানু, তুমি যদি ঐ লোকটির কোনো ঠিকানা কোনোভাবে এনে দিতে পার, তাহলে একটা চেষ্টা চালানো যেতে পারে।’
‘ঠিকানা কোথায় পাব?’
‘তা তো রানু আমি জানি না। যেভাবে খবরটি পেয়েছ, সেইভাবেই যদি পাও।’
রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘যাচ্ছ নাকি?’
‘হ্যাঁ, বসে থেকে কী করব?’
নীলুদের সব ক’টি ঘরে আলো জ্বলছে। রাত প্রায় এগারটা বাজে। নীলুর বাবা পাথরের মূর্তির মতো বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। রানুদের ঢুকতে দেখে এগিয়ে এলেন কিন্তু কিছু বললেন না। রানু মাথা নিচু করে তিনতলায় উঠে গেল। নীলুদের ঘরে ঘনঘন টেলিফোন বাজছে। দুটি গাড়ি এসে থামল। মনে হয় ওঁরা খুঁজতে শুরু করেছেন। পুলিশের কাছে নিশ্চয়ই লোক গিয়েছে। নীলুর বাবা অস্থির ভঙ্গিতে বাগানে হাঁটছেন।
.
*****
.
ছোট্ট একটি ঘর। কিন্তু দু শ’ পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলছে ঘরে। চারদিক ঝলমল করছে। লোকটি একটি চেয়ারে বসে আছে। নীলু লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কারণ লোকটি বসে আছে তার পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাবার কোনো উপায় নেই নীলুর। নাইলনের চিকন দড়ি তার গা কেটে বসে গেছে। চারদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাঝে-মাঝে দূরের রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নীলু থেমে-থেমে বলল, ‘আপনি কি আমাকে মেরে ফেলবেন?’
কেউ কোনো জবাব দিল না।
‘আমি আপনার কোনো ক্ষতি করি নি। কেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? প্লীজ, আমাকে যেতে দিন। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেউ আপনার কথা জানবে না।’
পেছনের চেয়ার একটু নড়ে উঠল। ভারি গলায় লোকটি কথা বলল, ‘কেউ জানলেও আমার কিছু যায়-আসে না।’
‘কেন আপনি এ রকম করছেন?’
‘আমি একজন অসুস্থ মানুষ। মাঝে-মাঝে আমাকে এ রকম করতে হয়।’
‘আপনি কি আমাকে মেরে ফেলবেন?’
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লোকটি হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। নীলু চাপা স্বরে ডাকল, ‘মা, মাগো!’
‘চুপ করে থাক, কথা বলবে না।’
‘কেন এ রকম করছেন আপনি?’
‘আমি একজন অসুস্থ মানুষ। পৃথিবীতে কি অসুস্থ মানুষ থাকে।’
‘আপনি কি আমার মতো আরো অনেক মেয়েকে এইভাবে ফাঁদ পেতে এনেছেন?’
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লোকটি এগিয়ে এসে নীলুর গায়ে হাত রাখল। এই কি সেই ভালোবাসার স্পর্শ? নীলূ ডাকল, ‘মা, মাগো!’
‘চুপ করে থাক।’
‘আপনি মানুষ, না অন্য কিছু?’
‘বেশির ভাগই আমি মানুষ থাকি, মাঝে-মাঝে অন্য রকম হয়ে যাই।’
লোকটি শব্দ করে হাসল। কী কুৎসিত হাসি! ঘরে একটুও বাতাস নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নীলু প্রাণপণে তার একটা হাত ছুটিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। যতই চেষ্টা করছে দড়িগুলো ততই যেন কেটে-কেটে বসে যাচ্ছে।
‘কেন, কেন আপনি এরকম করছেন?’
‘বলেছি তো নীলু! অনেক বার বললাম তোমাকে। আমি অসুস্থ।’
‘কী করছেন অন্যদের?’
লোকটি হেসে উঠল। নীলু কাতর স্বরে বলল, ‘আপনি দয়া করুন, আমি আপনার পায়ে পড়ি। প্লীজ। আমি আপনার কথা কাউকে বলব না।’
‘তা কি হয়?’
‘বিশ্বাস করুন। আমি আমার কথা রাখি। কাউকে আমি আপনার কথা বলব না।’
লোকটি ফিরে যাচ্ছে। নীলু কি বেঁচে যাবে? লোকটি কি তাকে ছেড়ে দেবে? নীলু গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। লোকটি একটি ড্রয়ার খুলল। ঘর অন্ধকার, নীলু কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সে নিশ্চিত জানে, তার হাতে ধারাল কিছু একটা আছে। ক্ষুরজাতীয় কিছু। লোকটি সেটি বাঁ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। আসবে, সে এক সময় এগিয়ে আসবে তার কাছে। খুব কাছে কোথাও রিকশার টুনটুন শোনা গেল। নীলু প্রাণপণে চেঁচাল,‘বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও।’ কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না।
.
🔴 সতেরো 🔴
.
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রানুর অবস্থা খারাপ হতে লাগল। বারবার বলতে লাগল-উফ্, বড্ড গরম লাগছে। আনিস সমস্ত দরজা-জানালা খুলে দিল, ফ্যান ছেড়ে দিল, তবু তার গরম কমল না। রানু কাতর স্বরে বলল, ‘তুমি আমাকে ধরে থাক, আমার বড্ড ভয় লাগছে।’
‘কোনো ভয় নাই রানু।’
‘লোকটি ক্ষুর হাতে বসে আছে। তবু তুমি বলছ ভয় নেই?’
‘এই সব তোমার কল্পনা। এস, তোমার মাথায় একটু পানি দেই?’
‘তুমি কোথায়ও যেতে পারবে না। ঐ লোকটি এখন উঠে দাঁড়িয়েছে। তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে থাক। আরও শক্ত করে ধর।’
আনিস তাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। রানু ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আমি তোমাকে একটি কথা কখনো বলি নি। একবার একজন লোক আমাকে মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল।’
‘রানু, এখন তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। দয়া করে চুপ করে থাক।’
‘না, আমি বলতে চাই।’
‘সকাল হোক। সকাল হলেই শুনব।’
‘মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় একজন-কেউ আমার সঙ্গে থাকে।’
‘রানু, চুপ করে থাক।’
‘না, আমি চুপ করে থাকব না। আমার বলতে ইচ্ছে করছে। যে আমার সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে আমি অনেক বার কথা বলেছি, কিন্তু আজ সে কিছুতেই আসছে না।’
‘তার আসার কোনো দরকার নেই।’
‘তুমি বুঝতে পারছ না, তার আসার খুব দরকার।’
রাত দেড়টার দিকে নিচ থেকে বিলুর কান্না শোনা যেতে লাগল। অনেক লোকজনের ভিড়। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। রানু বলল, ‘বিলু কাঁদছে। বড় খারাপ লাগছে আমার।’
‘রানু, তুমি একটু শুয়ে থাক। আমি জিতুকে ডেকে দিচ্ছি।’
‘তুমি কোথায় যাবে?’
‘আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসব। আমার মোটেই ভালো লাগছে না।’
‘তুমি আমাকে ফেলে রেখে কোথাও যেতে পারবে না।’
রানুর কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। এক সময় বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। আনিস ছুটে গেল ডাক্তার আনতে। বড় রাস্তার মোড়ে একজন ডাক্তারের বাসা আছে। ডাক্তার সাহেবকে পাওয়া গেল না। আনিস ফিরে এসে ঘরে ঢোকবার মুখেই তীব্র ফুলের গন্ধ পেল। ঘরের বাতি নেভানো। কে নিভিয়েছে বাতি? আনিস ঢুকতেই রানু বলল, ‘ও এসেছে।’
‘কে? কে এসেছে?’
‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’
আনিস এগিয়ে এসে রানুর হাত ধরল। গা ভীষণ গরম। রানু বলল, ‘ও নীলুর কাছে যাবে।’
‘রানু, শুয়ে থাক।’
‘উহু, শোব কীভাবে? ও একা যেতে ভয় পাচ্ছে। আমিও যাব ওর সঙ্গে। ও আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।’
বলতে বলতে রানু খিলখিল করে হাসল।
আনিস বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, রহমান সাহেব। ভাই, একটু আসুন, আমার বড় বিপদ।’
রহমান সাহেব ঘরে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে?’
‘আপনি একটু আসুন, আমার স্ত্রী কেমন যেন করছে।’
ভদ্রমহিলা সঙ্গে-সঙ্গে এলেন। এবং ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে বললেন, ‘নূপুরের শব্দ না?’ রানু কিশোরী মেয়ের গলায় খিলখিল করে হাসল।
‘কী হয়েছে ওনার?’
‘আপনি একটু বসুন ওর পাশে। আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।’
আনিস ছুটে বেরিয়ে গেল। ফুলের সৌরভ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। রানু হাসিমুখে বলল, ‘আামার সময় বেশি নেই, ঐ লোকটি এগিয়ে আসছে।’
‘কোন লোক?’
‘আপনি চিনবেন না। না-চেনাই ভালো।’
ভদ্রমহিলা রানুর হাত ধরলেন। উত্তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না।
আনিস ডাক্তার নিয়ে ফেরার আগেই রানু মারা গেল।
.
******
.
ঘর অন্ধকার, কিন্তু চোখে অন্ধকার সয়ে আসছে। আবছামতো সব কিছু দেখা যায়। বাড়িটা কোথায়? কহর থেকে অনেক দূরে কী? কোনো শব্দ নেই। কত রাত এখন? বাড়িতে এখন ওরা কী করছে? বিলু কি ঘুমিয়েছি মশারি ফেলে? না, না-আজ কেউ ঘুমায় নি, আজ সবাই ছোটাছুটি করছে। সবাই খুঁজছে নীলুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা যাবে। বাবা এসে বলবেন-কোনো ভয় নেই মা-মণি।
চেয়ার নড়ার শব্দ হলো। লোকটি কি উঠে দাঁড়িয়েছে? তার হাতে ওটা কী? নীলু মনে-মনে বলল, ‘বাবা, আমি একজন অসুস্থ লোকের হাতে আটকা পড়েছি, আমাকে তোমরা বাঁচাও। আমার আর মোটেও সময় নেই বাবা। তোমাদের খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।’
লোকটি এগিয়ে আসছে। পেছন থেকে খুব ধীর গতিতে এগিয়ে এল সামনে। এখন নীলু আবছাভাবে লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে। কী সুন্দর একটি মুখ! নীলু বিড়বিড় করে বলল, ‘প্লীজ, দয়া করুন।’ লোকটি অদ্ভুত শব্দ করল। এটি হাসির শব্দ? নীলুর গা গোলাচ্ছে। নীলু চিৎ হয়ে থাকা অবস্থাতেই মুখ ভর্তি করে বমি করল।দুঃস্বপ্ন, সমস্তটাই একটা দুঃস্বপ্ন। এক্ষুণি ঘুম ভেঙে যাবে। আর নীলু দেখবে-বিলু বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বুকের ওপর একটা গল্পের বই। এখানে যা ঘটেছে, তা সত্যি হতেই পারে না।
লোকটি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। নীলু চাপা গলায় বলল, ‘আমার গায়ে হাত দেবেন না, প্লীজ।’ লোকটি হেসে উঠছে শব্দ করে। আর ঠিক তখনই নূপুরের শব্দ শোনা গেল। যেন কেউ-একজন ঢুকেছে এ ঘরে।
লোকটি ভারি গলায় বলল, ‘কে, কে ওখানে?’ তার উত্তরে অল্পবয়সী একটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। লোকটি চেচাঁল, ‘কে, কে?’ কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু ঘরের শেষ প্রাস্তের একটা জানালা খুলে ভয়ানক শীতল একটা হাওয়া এসে ঢুকল ঘরে। সে হাওয়ায় ভেসে এল অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ।
নীলুর দেখল, লোকটি ক্রমেই দেয়ালের দিকে সরে যাচ্ছে। এক বার সে চাপা স্বরে বলল, ‘তুমি কে?’ মিষ্টি একটি হাসি শোনা গেল তখন। ফুলের গন্ধ আরো তীব্র হলো। অন্য কোনো ভুবন থেকে ভেসে এল নূপুরের ধ্বনি। লোকটি গা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে! কে, এখানে কে?’ কেউ তার কথার জবাব দিল না। একটি দুষ্টু মেয়ে শুধু হাসতে লাগল। ভীষণ দুষ্টু একটি মেয়ে। তার পায়ে নূপুর। তার গায়ে অপার্থিব এক ফুলের গন্ধ। মেয়েটি এবার দুইহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটির দিকে। লোকটির কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল, ‘এইসব কী? কে, কে?’ তার উত্তরে সমস্ত ঘরময় মিষ্টি খিলখিল হাসি ঝমঝম করতে লাগল। লোকটি চাপা গলায় বলে উঠল, ‘আমাকে বাঁচাও। বাঁচাও।’ দুষ্টু মেয়েটি আবার হাসল, যেন খুব একটা মজার কথা।
.
🔵 পরিশিষ্ট 🔵
.
থার্ড ইয়ারের অনার্সের এই ক্লাসটি মিসির আলি সাহেবকে দেয়া হয়েছে। সাইকোলজি ফিফ্থ পেপার। মিসির আলি সাহেব হাসিমুখে ঢুকলেন। তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। রানু বসে আছে সেকেন্ড বেঞ্চে। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। তিনি মেয়েটির দিকে তাকালেন এবং তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো, মেয়েটির ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে আছে। মিসির আলি কাঁপা গলায় বললেন, ‘তোমার নাম কি?’
মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘আমার নাম নীলু। নীলুফার। রোল নাম্বার থার্টি টু।’
‘আমি একটি মেয়েকে চিনতাম। তুমি দেখতে অবিকল তার মতো।’
নীলুফার শান্ত স্বরে বললো, ‘আমি জানি।’
মিসির আলি সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন। সমস্ত ব্যাপারটি ভুলে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে-করতে বললেন, ‘আমি তোমাদের পড়াব ফিফ্থ পেপার। খুব ইন্টারেস্টিং একটি টপিক-’

রানুর মতো দেখতে মেয়েটি তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। মেয়েটির মুখে মৃদু হাসি।
.
[ বিঃদ্রঃ এই গল্পের দ্বিতীয় পার্ট হচ্ছে নিশিথীনী। তবে নিশীথিনী পড়লেও কিছু রহস্য রহস্যই থেকে যাবে ]

দেবী দ্বিতীয় পর্ব

0

দেবী দ্বিতীয় পর্ব

#দেবী – হুমায়ূন আহমেদ

🔴 নয় 🔴
.
রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘ভেতরে আসবো?’
‘এস রানু, এস।’
‘গল্প করতে এলাম।’
‘খুব ভালো করেছ।’
নীলু উঠে গিয়ে রানুর হাত ধরল। রানু বললো, ‘তুমি কাঁদছিলে নাকি, চোখ ভেজা!’ নীলু কিছু বলল না। রানু বলল, ‘এত কিসের দুঃখ তোমার যে দুপুরবেলায় কাঁদতে হয়?’
‘তোমার বুঝি কোনো দুঃখটুঃখ নেই?’
‘উঁহু আমি খুব সুখী।’
রানু হাসতে লাগল। নীলু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি বলেছিলে, একটা খুব অদ্ভুদ কথা আমাকে বলবে।’
‘বলেছিলাম নাকি?’
‘হ্যাঁ। আজ সেটা বলতে হবে। তারপর আমি আমার একটা অদ্ভুদ কথা বলব।’
রানু হাসতে লাগল।
‘হাসছ কেন রানু?’
‘তোমার অদ্ভুদ কথা আমি জানি, এই জন্যে হাসছি।’
‘কী আবোলতাবোল বলচ! তুমি জানবে কী?’
‘জানি কিন্তু।’
নীলু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘জানলে বল তো।’
‘তোমার এক জন প্রিয় মানুষ তোমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছে। ঠিক না?’
নীলু দীর্ঘ সময় কোনো কথাবার্তা বলল না। রানু বলল, ‘কি ভাই, বলতে পারলাম তো?’
‘হ্যাঁ, পেরেছ।’
‘ও কি বাসায় আসবে?’
‘বলব তোমাকে। তার আগে তুমি বল, তুমি কী করে জানলে? বিলু তোমাকে বলেছে? কিন্তু বিলু তো কিছু জানে ন!’
‘আমাকে কেউ কিছু বলে নি।’
‘তাহলে তুমি জানলে কী করে?’
‘আমি স্বপ্ন দেখেছি।’
‘স্বপ্ন দেখেছি মানে?’
‘নীলু, মাঝে-মাঝে আমি স্বপ্ন দেখি। সেগুলো ঠিক স্বপ্নও নয়। তবে অনেকটা স্বপ্নের মতো। সেগুলো সব সত্যি। গত রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, তুমি একটি চিঠি পেয়ে খুব খুশি। সেই চিঠিতে একটি লাইন লেখা আছে, যার মানে হচ্ছে-তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে বা এই রকম কিছু।’
‘এসব কি তুমি সত্যি-সত্যি বলছ রানু?’
‘হ্যাঁ। কবে তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা হবে?’
‘আজ বিকেলে। আমি নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে একটা সবুজ রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকব। তিনি আমাকে খুঁজে বের করবেন।’
‘বাহ, খুব মজার ব্যপার তো!’
রানু হাসতে লাগল। এক সময় হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘শুধু গল্প-উপন্যাসেই এসব হয়। বাস্তবে এই প্রথম দেখছি। তোমার ভয় করছে না?’
‘ভয় করবে কেন?’
‘তোমার কিন্তু নীলু ভয় করছে। আমি বুঝতে পারছি। বেশ ভয় করছে। করছে না?’
‘নাহ।
রানু ইতস্তত করে বলল, ‘ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পার। আমি দূরে থাকব।’
‘থাক, দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।’
মনে হলো নীলু রানুর কথাবার্ত সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। তার চোখ-মুখ গম্ভীর। রানু বলল, ‘কি, নেবে?’
‘না। আমার একা যাবার কথা, একাই যাব।’
‘আর যদি গিয়ে দেখ, খুব বাজে ধরণের একটা লোক। তখন কী করবে?’
‘বাজে ধরণের লোক মানে?’
‘অথ্যাৎ যদি গিয়ে দেখ দাঁত পড়া, চুল পাকা এক বুড়ো?’
‘তোমার কি সে রকম মনে হচ্ছে?’
রানু মাথা দুলিয়ে হাসল, কিছু বলল না। নীলুকে দেখে মনে হলো রানুর ব্যবহারে সে বেশ বিরক্ত হচ্ছে। দুটো বাজতেই সে বলল, ‘এবার তুমি যাও, আমি সাজগোজ করব।’
‘এখনই? চারটা বাজতে তো দেরি আছে।’
‘তোমার মতো সুন্দরী তো আমি না। আমাকে সময় নিয়ে সাজতে হবে।’
রানু উঠে পড়ল। নীলু সত্যি সাজতে বসল। কিন্তু কী যে হয়েছে তার, চোখে পানি এসে কাজল ধুয়ে যাচ্ছে। আইল্যাশ পরার ইচ্ছা ছিল, একা-একা পরা সম্ভব নয়। অনেক বেছেটেছে শাড়ি পছন্দ করল। সাদার উপর নীলের একটা প্রিন্ট। আগে সে কখনো পরে নি।
‘নীলু মা, কোথাও যাচ্ছ নাকি?’
নীলু তাকিয়ে দেখল-বাবা।
‘কোথায় যাচ্ছ গো মা?’
‘এক জন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তোমার কি চা লাগবে?’
‘হলে ভালো হত। থাক, তুই ব্যস্ত।’
‘চা বানাতে আর কয় মিনিট লাগবে! তুমি বস, আমি বানিয়ে আনছি।’
নীলুর বাবা চেয়ার টেনে নীলুর ঘরেই বসলেন।
‘চা কি চিনি ছাড়া আনব বাবা?’
‘না, এক চামচ চিনি দিস। একটু-আধটু চিনি খেলে কিছু হবে না।’
নীলু চা নিয়ে এসে দেখে বাবা ঝিমুচ্ছেন। ঝিমুনিরও বেশি, প্রায় ঘুমাচ্ছেন বলা চলে। বাবা যেন বড় বেশি দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। বড় মায়া লাগল নীলুর।
‘বাবা, তোমার চা।’
‘কোন বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিস মা?’
নীলু খানিক ইতস্তত করে বলল, ‘তোমাকে আমি পরে বলব বাবা।’
‘সন্ধ্যার আগেই আসবি তো?’
‘হ্যাঁ, বাবা।’
‘গাড়ি নিয়ে যাবি?’
‘না, গাড়ি নেব না।’
‘নিয়ে যা না। ড্রাইভার তো দিন-রাত বসে-বসেই মায়না খায়।’
‘বাবা, আমি গাড়ি নেব না।’
নীলুর সাজ শেষ হলো সাড়ে তিনটায়। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে তার পছন্দই হলো। যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে, সে বেশ রুপসী। তার মায়া-কাড়া দুটি চমৎকার চোখ আছে। কিশোরীদের মতো ছোট ছোট চিবুক। ভালোই তো! এ রকম একটি মেয়েকে পুরুষরা কি ভালোবাসে না? নাকের কাছে মুক্তোর মতো কিছু ঘামের বিন্দু। নীলু তার সবুজ রুমাল দিয়ে সাবধানে ঘাম মুছে ফেলল। তারপর উঠে এল তিনতলায়।
‘রানু, রানু।’
রানু যেন তৈরি হয়েইছিল। সে বেরিয়ে এল সঙ্গে-সঙ্গে।
‘তুমি যাবে বলেছিলে আমার সঙ্গে। চল।’
‘চল।’
রানু তালা লাগাল। নীলু মৃদু স্বরে বলল, ‘তুমি জানতে আমি আসব?’
‘হ্যাঁ, জানতাম।’
সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করল। কারো দেখা পাওয়া গেল না। এক সময় নীলু বলল, ‘এখন চলে যেতে চাও রানু?’
‘আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। তোমার এখনো যেতে ইচ্ছা করছে না।’
‘এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে চল হাঁটি।’
তারা বেশ কয়েক বার নিউ মার্কেট চক্কর দিয়ে ফেলল। কেউ এগিয়ে এসে বলল না, ‘তোমাদের মধ্যে নীলু কে?’
‘রানু, তোমার কি হাঁটতে টায়ার্ড লাগছে?’
‘না।’
‘রানু, তুমি তো অনেক কিছু বুঝতে পার, তাই না?’
‘মাঝে-মাঝে পারি।’
‘লোকটি এসেছে কি না বুঝতে পারছ না?’
‘না নীলু, পারছি না। আমি সব সময় পারি না।’
রানু লক্ষ্য করল, নীলুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে তার সবুজ রুমাল দিয়ে চোখ চেপে ধরল। রানু গাঢ় স্বরে বলল, ‘কাঁদে না নীলু।’
‘কান্না এলে কী করব?’
‘মনটা শক্ত কর ভাই। পৃথিবীটা খুব ভালো জায়গা নয়।’
লোকজন তাকাচ্ছে ওদের দিকে। রানু নীলুর হাত ধরে বাইরে নিয়ে এল। বেশ অস্বস্তিকর অবস্থা।
.
******
.
তার প্রায় চার দিন পর নীলু একটি চিঠি পেল।

প্রিয় নীলু,
ঐদিন তোমাকে দেখলাম। তুমি তো ভারি মিথ্যুক! কেন বললে তুমি দেখতে সুন্দর নও? তোমাকে বর্ষার জলভারে নত আকাশের মতো লাগছিল। আমি ছুটে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার বান্ধবিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছি। কথা ছিল
একা আসবে। তাই নয় কি?
শুধু আমরা দুই জন থাকব। আমাকে দেখে যদি তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে কোনো একটি রেস্টুরেন্টে বসে দুই জনে চা খেতে-খেতে গল্প করবো আর যদি তোমার আমাকে পছন্দ না-হয়, তাহলে তুমি তোমার সবুজ রুমালটি
তোমার হ্যান্ডব্যাগে লুকিয়ে ফেলবে।
তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। আমি মন-খারাপ করব ঠিকই, কিন্তু বিদায় নেব হাসিমুখে, এবং আর কোনো দিনই তুমি আমাকে দেখবে না। তবে নীলু,
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমাকে তুমি অপছন্দ করবে না। এ রকম মনে করার কোনোই কারণ নেই, তবু মনে হচ্ছে। খুব সম্ভব উইশফুল থিংকিং। না মেয়ে?

নীলু চিঠিটি সমস্ত দিনে প্রায় একশ’ বার পড়ল এবং প্রতি বারই তার কাছে নতুন মনে হলো। রাতে সে অদ্ভুদ সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখল-যেন পুরোনো আমলের একটি পালতোলা জাহাজে সে বসে আছে। জাহাজের পালটি গাঢ় সবুজ রঙের। প্রচন্ড বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে জাহাজ ছুটে চলেছে বিদ্যুৎগতিতে। নীলুর একটু ভয়ভয় লাগছে, কারণ জাহাজে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নীলু এক সময় বলল, ‘আমার ভয় লাগছে জাহাজে। আর কেউ কি আছে?’ সঙ্গে-সঙ্গে একটি ভারি পুরুষালি গলা শোনা গেল, ‘ভয় নেই নীলু। আমি আছি।’ স্বপ্ন এত সুন্দর হয়!
নীলুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাকি রাত সে আর ঘুমোতে পারল না। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। বিলু জেগে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে রে আপা?’
‘নীলু ভেজা গলায় বলল, ‘পেট ব্যথা করছে। এখন একটু কম। তুই ঘুমো।’
.
🔴 দশ 🔴
.
অনুফার কাছ থেকে নতুন কিছু জানা গেল না। সেও খুব জোর দিয়ে বলল, রানুর পরনে পায়জামা ছিল এবং মৃত লোকটির পরনেও কাপড় ছিল।
‘আপনি লোকটিকে দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি করে বলছেন কেন? মুরুব্বি মানুষ আপনি। আমি আপনার মেয়ের বয়েসী।’
‘লোকটিকে কেমন দেখলে বল তো!’
‘চাচা, আমার কিছু মনে নেই। সেই সময় আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। পরদিন আমার বিয়ে।’
‘হ্যাঁ, তা আমি জানি। লোকটিকে নদীর পাড়ে পুঁতে রাখা হয়, তাই না?’
‘জ্বি। তারপর অনেক দিন কেউ ওদিকে যেত না। সবাই বলাবলি করত, রাতে কী জানি দেখতে পায়।’
‘কী দেখতে পায়?’
‘ছায়া-ছায়া কী নাকি দেখে। তবে এইসব সত্যি না চাচা। সব মনগড়া।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। ভূতপ্রেত বলতে কিছু নেই।’
মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। গ্রামের কোনো মেয়ে এই চিন্তা করে না। এতটা মুক্তচিন্তা তাদের থাকার কথা নয়। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি পড়াশোনা কত দূর করেছ?’
‘চাচা, আই.এ. পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়েছে। তারপর আর পড়াশোনা হয় নি। গ্রামে বিয়ে হয়েছে তো! পড়াশোনা করার আমার খুব শখ ছিল।’
‘মানুষের সব শখ মেটা উচিত নয়। একটা ডিসস্যাটিসফেকশন থাকা দরকার।’
‘কেন?’
‘তাহলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। সব শখ মিটে গেলে বেঁচে থাকার প্রেরণা নষ্ট হয়ে যায়। যে সব মানুষের শখ মিটে গেছে, তারা খুব অসুখী মানুষ।’
অনুফা চুপ করে রইল। মিসির আলি মৃদু স্বরে বললেন, ‘এবার রানুর কথা বল।’
‘কী কথা জানতে চান?’
‘সব কথা।’
‘ও খুব অদ্ভুদ মেয়ে। ও মানুষের ভবিষ্যত বলতে পারে।’
‘কীভাবে বলে?’
‘তা জানি না, তবে বলতে পারে। একবার কী হয়েছে, শোনেন। আমি আর ও গল্প করছি, সে হঠাৎ গল্প থামিয়ে বলল-কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের বাড়িতে শ্রীপুরের খালারা বেড়াতে আসবেন। আর সত্যি-সত্যি তাঁরা এলেন।’
‘এটা তো এমনিতেও হতে পারে। মানুষ বেড়াতে আসে না?’
‘তা আস্ে কিন্তু শ্রীপুরের খালা পাঁচ বছর পর প্রথম এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের কী-একটা ঝগড়া চলছিল।’
‘ও, তাই নাকি?’
‘জ্বি। আরেক গল্প বলি শোনেন, তখন আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রানুদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছি-না, এটা আপনাকে বলা যাবে না।’
‘বলা যাবে না কেন?’
‘গল্পটা ভালো না।’
‘থাক, তাহলে অন্য গল্প বল।’
অনুফার স্বামীকেও মিসির আলি সাহেবের বেশ লাগল। গোঁয়ারগোবিন্দ ধরনের লোক। স্ত্রীর খুবই অনুগত। সে মিসির আলিকে নিয়ে প্রচুর ঘুরল। লোকটির যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তিও দেখা গেল। মধুপুর থানার ওসি সাহেব ওর কথাতেই পুরোনো ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখলেন যে, একটি মরা লাশ পাওয়ার খবরে এফআইআর করা হয়েছিল। তখন ওসি ছিলেন ব্রজগোপাল হালদার, তাঁর নোটে লেখা-
একটি কলেরায় মৃত মানুষের লাশ (৩০/৩৫) মধুপুরের নিমশাসা গ্রামে পাওয়া যায়। লাশটির পচন ধরিয়া গিয়াছিল। প্রথামিক পরীক্ষার পর আমি লাশটির পুঁতিয়া ফেলিবার নির্দেশ দেই। লাশটির কোনো পরিচয় জানা যায় নাই।
মিসির আলি বললেন, ‘কলেরায় মৃত, এটা বোঝা গেল কী করে?’ ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সেটা আমি কী করে বলব? রিপোর্ট তো আমার লেখা না। ব্রজগোপাল বাবুকে জিজ্ঞেস করেন। তিনি জানবেন।’
তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে?’
‘পুলিশ ডাইরেক্টরেটে খোঁজ করেন। তবে এই সব খোঁজাখুঁজির কোনো অর্থ নেই। দশ বৎসর আগের ঘটনা মনে করে বসে আছেন নাকি? পুলিশকে আপনারা কী মনে করেন বলেন তো?’
‘ঘটনাটি অস্বাভাবিক। সে জন্যই হয়তো তাঁর মনে থাকবে।’ ‘একটা ডেড বডি পাওয়া গেছে পানিতে, এর মধ্যে আপনি অস্বাভাবিক কী দেখলেন? বাংলাদেশে প্রতি দিন কয়টা ডেড বডি পাওয়া যায় জানেন?’
‘জ্বি-না, জানি না।’
‘পুলিশের লাইনে ডেড বডি পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা, বুঝলেন?’
.
মিসির আলি মধুপুরে আরো একদিন থাকলেন। দেখে এলেন, যে জায়গায় লোকটিকে পোঁতা হয়েছিল সেই জায়গা। দেখার মতো কিছু নয়। ঘন কাঁটাবন হয়েছে, যার মনে হচ্ছে এই জায়গাটিকে বেশ কিছু দিন লোকজন ভয়ের চোখে দেখেছেন। হাঁটাচলা বন্ধ করে দিয়েছে নিশ্চয়ই।
মিসির আলি অনেকের সঙ্গেই কথা বললেন-যদি নতুন কিছু পাওয়া যায়। নতুন কোনো তথ্য, যা কাজে লাগবে, কিন্তু কিছুই জানা গেল না। দশ বৎসর দীর্ঘ সময়। এই সময়ে মানুষ অনেক কিছু ভুলে যায়।
মধুপুর থেকে তিনি গেলেন রানুদের আদি বাড়িতে। সেখানে যাবার তাঁর একটি উদ্দেশ্য, খুঁজে দেখা-জালালউদ্দিন নামে কাউকে পাওয়া যায় কি না। এই লোকটিকে পাওয়া খুবই প্রয়োজন।
.
*******
.
আনিস লক্ষ্য করলো, রানু ইদানীং বেশ অস্বাভাবিক। এর প্রধান কারণ বোধহয় বাড়িঅলার দুটি মেয়ে। ওদের সঙ্গে সে বেশ মিলেমিশে আছে। গল্পের বই আনছে। ভালোমন্দ কিছু রান্না হলেই আগ্রহ করে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঅলাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা আনিসের পছন্দ নয়। বাড়িঅলাদের সে সব সময় শত্রুপক্ষ মনে করে। কয়েক বার ভেবেছিল বলবে মেলামেশাটা কমাতে। না বলে ভালোই হয়েছে, এত যদি অসুখটা চাপা পড়ে তো ভালোই।
কাজের একটি ছেলে পাওয়া গেছে-জিতু মিয়া। এই ছেলেটিও রানুকে বেশ ব্যস্ত রাখছে। ছেলেটির বয়স দশ-এগার, তবে মহাবোকা। কোনো কাজই করতে পারে না। করার আগ্রহও নেই। রানু ক্রমাগত বকঝকা করেও কিছু করাতে পারে না। তবে তার সময় বেশ কেটে যায়।
সন্ধ্যাবেলা সে আবার জিতু মিয়াকে নিয়ে পড়াতে বসে। জিতু ঘুমঘুম চোখে পড়ে ‘স্বরে অ স্বরে আ’। এই পড়াটি গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে। জিতু মিয়া কিছুই মনে রাখতে পারছে না, কিন্তু তাতে রানুর উৎসাহে ভাটা পড়েছে না।
আনিস মিয়া একদিন ঠাট্টা করে বলেছে, ‘তুমি দেখি একে বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলছ!’ রানু তাতে বেশ রাগ করেছে। গম্ভীর হয়ে বলেছে, ‘ঠাট্টা করছ কেন? বিদ্যাসাগর তো একদিন হতেও পারে।’
অবশ্য অদূর-ভবিষ্যতে তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ভবিষৎ-বিদ্যাসাগর রোজ রাতেই পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছে এবং রানু প্লেটে খাবার বেড়ে প্রতি রাতেই প্রাণাস্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। এতটা বাড়াবাড়ি আনিসের ভালো লাগে না, কিন্তু সে কিছুই বলে না। থাকুক একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত।
এর মধ্যে একদিন আনিস গিয়েছিল মিসির আলি সাহেবের কাছে। ভদ্রলোক বেশ কিছু দিন ঢাকায় ছিলেন না। সবে ফিরেছেন। তাঁর চোখ হলুদ, গা হলুদ।
আনিস অবাক হয়ে বলেছে, ‘হয়েছে কী আপনার?’
‘জন্ডিস। জন্ডিস বাধিয়ে বসেছি।’
‘বলেন কী!’
‘ইনফেকটাস হেপাটাইটিস। লিভারের অবস্থা কাহিল রে ভাই! আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘আর ভয়টয় পাচ্ছেন না?’
‘জ্বি-না।’
‘খুব ভালো খবর। আমি একটু সুস্থ হলেই যাব আপনার বাসায়।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘আমি কিছু খোঁজখবর পেয়েছি। মনে হয় আপনার স্ত্রীর সমস্যাটি ধরতে পেরেছি।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, একটু ভালো হলেই এনিয়ে কথা বলব।’
রানু মিসির আলি সাহেবের জন্ডিসের খবরে খুবই মন-খারাপ করল।
‘আহা, বেচারা একা-একা কষ্ট করছে।চল এক দিন দেখে আসি। যাবে?’
‘ীঠক আছে, যাব একদিন।’
‘কবে যাবে? কাল যাব?’
‘এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? জন্ডিস যখন হয়েছে, তখন বেশ কিছু দিন থাকবে। এক দিন দেখে এলেই হবে।’
‘আমি এই অসুখরে ভালো অষুধ জানি। অড়হড়ের পাতার রস। সকালবেলা এক গ্লাস করে খেলে তিন দিনে অসুখ সেরে যাবে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আমার দাদা এই অষুধটা দিতেন। তুমি কিছু অড়হড়ের পাতা ঐ লোকটিকে দিয়ে এস না।’
‘ঢাকা শহরে আমি অড়হড়ের পাতা কোথায় পাব? কী যে বল!’
‘খুঁজলেই পাবে। জংলা গাছ সব জায়গায় হয়।’
আনিস যথেষ্ট বিরক্ত হলো। রানুর এই একটা প্রবলেম-কোনো-একটা জিনিস মাথায় ঢুকলে ওটা নিয়েই থাকবে। আনিস বলল, ‘আচ্ছা, দেখি।’
‘দেখাদেখি না,তুমি খুঁজবে । আর শোন, কাল তো তোমার অফিস নেই, চল ওনাকে দেখে আসি।’
‘এত ব্যস্ত কেন? ভদ্রলোক তো আর পালিয়ে যাচ্ছেন না।’
রানু থেমে- থেমে বলল, ‘আমি অন্য একটা কারণে যেতে চাই।’
‘কি কারণ?’
‘ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করার জন্যে মধুপুর গিয়েছিলেন,কী খোঁজ পেলেন জানতে ইচ্ছা করছে।’
‘মধুপুরের খবর পেলে কীভাবে? স্বপ্নে?’
‘না, স্বপ্নটপ্ন না। অনূফা চিঠি দিয়েছে।’
‘কবে চিঠি পেয়েছ?’
‘গতকাল।’
আনিস চুপ করে গেল। রানু তার নিজের চিঠিপত্রের কথা আনিসকে কখনো বলে না। বিয়ের পর রানু তার আত্মীয়স্বজনের যত চিঠিপত্র পেয়েছে তার কোনোটি সে আনিসকে পড়তে দেয় নি। এ নিয়ে আনিসের গোপন ক্ষোভ আছে।
‘কি আমাকে নিয়ে যাবে?’
‘আমি আগে গিয়ে দেখে ভদ্রলোকের অবস্থা কেমন।’
.
🔴 এগারো 🔴
.
মিসির আলিকে পাওয়া গেল না। বাড়িতে তাঁর এক ছোট ভাই ছিল, সে বলল, ‘ভাইয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা বেশি ভালো না। বিলরুবিন নাইন পয়েন্ট ফাইভ। লিভার খুবই ড্যামেজ্ডৃ।

মিসির আলি হাসপাতালে এসেছেন একগাদা বই নিয়ে। তাঁর ধারণা ছিল বই পড়ে সময়টা খুব খারাপ কাটবে না, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। ডাক্তাররা বই পড়তে নিষেধ করেন নি, কিন্তু দেখা গেল বই পড়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই মাথার ভেতর ভোঁতা এক ধরনের যন্ত্রণা হয়। যন্ত্রণা নিয়ে এই বই পড়ে ফেললেন এবং মৃত্যু ব্যাপারটিতে যথেষ্ট উৎসাহ বোধ করতে লাগলেন। তাঁর স্বভাবই হচ্ছে কোনো বিষয় একবার মনে ধরে গেলে সে বিষয়ে সম্পর্কে চূড়ান্ত পড়াশোনা করতে চেষ্টা করেন।
মৃত্যু সাবজেক্টটি তাঁর পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারছেন না। বইপত্র নেই। ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে কিছু থাকার কথা, কিন্তু আনাবেন কাকে দিয়ে? তাঁকে কেউ দেখতে আসছে না। তিনি এমন কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তি নন যে তাঁর অসুস্থতার খবরে মানুষের ঢল নামবে। তা ছাড়া অসুখের খবর তিনি কাউকে জানান নি। হাসপাতালে ভর্তি হবার ইচ্ছাও ছিল না, কিন্তু ঘরে দেখাশোনার লোক নেই। কাজের মেয়েটি তিনি মধুপুর থাকাকালীন বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ভেগে গেছে। এমন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া উপায় কী?
বিকালবেলা তাঁর কাছে কেউ আসে না। সবারই আত্মীয়স্বজন আসে দেখতে, তাঁর কাছে কেউ আসে না। এই সময়টা তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন এবং এখনো মানুষের সঙ্গ পাবার জন্যে তাঁর মন কাঁদে দেখে নিজের কাছেই লজ্জিত বোধ করেন।
আজ সারা দিন মিসির আলির খুব খারাপ কেটেছে। তাঁর রুমমেট ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি সকাল ন’টায় বিনা নোটিসে মারা গেছে। মৃত্যু যে এত দ্রুত মানুষকে ছুঁয়ে দিতে পারে তা তার ধারণাতেও ছিল না। ছেলেটা ভোরবেলায় নাস্তা চেয়েছে, তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তাও বলেছে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আজ কেমন আছ?’
‘আজ বেশ ভালো।’
‘লিভার ব্যাথা করছে না?’
‘নাহ্,তবে তলপেটের দিকে একটা চাপা ব্যাথা আছে।’
‘এটা একটা সায়েন্স ফিকশন-“ফ্রাইভে দি খার্টিস’”। বেশ ভালো বই। তুমি পড়বে?’
‘জ্বি-না। ইংরেজি বই আমার ভালো লাগে না। বাংলা উপন্যাস পড়ি।’
‘কার লেখা ভালো লাগে? এ দেশের-মানে বাংলায়, কার লেখা তোমার পছন্দ?’
‘নিমাই ভট্টাচার্য।’
‘তা নাকি?’
ছেলেটি আর জবাব না দিয়ে কাৎরাতে থাকে। সকাল সাড়ে আটটায় বলল,‘এক জন ডাক্তার পাওয়া যায় কি না দেখবেন?’ তিনি অনেকক্ষণ বোতাম টিপলেন,কেউ এল না। শেষ পর্যন্ত নিজেই গেলেন ডিউটি রুমে। ফিরে এসে দেখেন ছেলেটি মরে পড়ে আছে।
মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না, এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নেই। শেষ বিদায় নেবার সময় কোনো-একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার। নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা-একা চলে যাওয়া যায় না। যাওয়া উচিত নয়। এটা হৃদয়হীন ব্যাপার।
এত দিন যে ছেলেটি ছিল, এখন আর সে নেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তার সমস্ত চিহ্ন এ ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিছানায় নতুন বালিশ ও চাদর দিয়ে গেছে-হয়তো সন্ধ্যার মধ্যে কোনো নতুন পেশেন্ট এসে পড়বে।
মিসির আলি সমস্ত দিন কিছু খেতে পারলেন না। বিকেলের দিকে তাঁর গায়ে বেশ টেম্পারেচার হলো। প্রথম বারের মতো মনে হলো একজন-কেউ তাঁকে দেখতে এলে খারাপ লাগবে না। ভালোই লাগবে। কেউ না এলে এক জন রোগী হলেও আসুক, একা-একা এই কেবিনে রাত কাটানো যাবে না। ঠিক এই সময় ইতস্তত ভঙ্গিতে রানু এসে ঢুকল।
‘আপনি ভালো আছেন?’
‘না, ভালো না। তুমি কোথেকে?’
‘বাসা থেকে।ইস্! আপনার এ কী অবস্থা!’
‘অবস্থা খারাপ ঠিকই।আনিস সাহেব কোথায়?’
‘ও আসে নি, আমি একাই এলাম। ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।’
‘বস তুমি। ঐ চেয়ারটায় বস। ফ্লাস্কে চা আছে। খেতে চাইলে খেতে পার।’
‘উঁহু, চা-টা খাব না। আপনার কাছে একটা খবর জানতে এসেছি।’
‘কোন খবরটি?’
‘মধুপুরে গিয়ে আপনি কী জানলেন?’
‘তেমন কিছু জানতে পারি নি।’
‘তবু যা জেনেছেন তা-ই বলুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে। অনুফা লিখেছে, আপনি নাকি হাজার-হাজার মানুষকে নানা রকম প্রশ্ন করেছেন।’
মিসির আলি হাসলেন।
‘হাসলে হবে না, আমাকে বলতে হবে।’
‘প্রথম যে জিনিসটি জানলাম-সেটি হচ্ছে, তুমি অনেকগুলো ভুল তথ্য দিয়েছ।’
‘ আমি কোনো তথ্য দিই নি।’
‘তুমি নিজে হয়তো জান না সেগুলো ভুল। যেমন পায়জামা খোলার ব্যাপারটি-এ রকম কোনো কিছু ঘটে নি।
রানু চোখ লাল করে বলল, ‘ঘটেছে।’
‘না রানু। এইসব তুমি নিজে ভেবেছ এবং আমার ধারণা এ জাতীয় স্বপ্ন তুমি মাঝে-মাঝে দেখ। দেখ না?’
‘কী রকম স্বপ্নের কথা বলেছেন?’
মিসির আলি কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘তুমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখ না- এক জন নগ্ন মানুষ তোমার কাপড় খোলার চেষ্টা করছে?’
রানু উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে থাকল।
‘বল রানু। জবাব দাও।’
‘হ্যাঁ, দেখি।’
‘কখনো কি ভেবে দেখেছ এ স্বপ্ন কেন দেখ?’
‘না, ভাবি নি।’
‘আমি ভেবিছি এবং কারণটাও খুঁজে বের করেছি। আজ সেটা বলতে চাই না, অন্য একদিন বলব।’
‘না, আপনি আমাকে আজই বলেন।’
‘মিসির আলি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘চা খেতে-খেতে শোন। চায়ে ক্যাফিন আছে। ক্যাফিন তোমার নার্ভগুলোকে অ্যাকটিভ রাখবে।’
রানু চায়ের পেয়ালা নিল, কিন্তু চুমুক দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি ঠান্ডা গলায় বলতে লাগলেন, ‘রানু, তোমাকে নিয়ে এই গল্পটি আমি তৈরি করেছি। তুমি মন দিয়ে শোন। তুমি যখন বেশ ছোট-নয়, দশ বা এগার বছর বয়স, তখন এক জন বয়স্ক লোক তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নির্জন কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। তোমাদের গ্রামে এরকম একটা নির্জন জায়গায় খোঁজে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে জঙ্গলের কাছে একটা ভাঙ্গা বিষ্ণুমন্দির দেখেছি। মনে হয় ঐ জায়গাটাই হবে। কারণ সাপের ভয়ে ওখানে কেউ যেত না। রানু, তুমি কি আমার কথা শুনেছ?’
‘শুনছি।’
‘তারপর সেই বয়স্ক মানুষটি মন্দিরে তোমাকে নিয়ে গেল।’
‘আমাকে কেউ নিয়ে যায় নি। আমি নিজেই গিয়েছিলাম। ঐ মন্দিরে খুব সুন্দর একটি দেবীমূর্তি আছে। আমি ঐ মূর্তি দেখার জন্যে যেতাম।’
‘তারপর কী হয়েছ, বল।’
রানু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তীব্র স্বরে বলল, ‘আমি বলব না, আপনি বলুন।’
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন,‘ঐ লোকটি তখন টেনে তোমার পায়জামা খুলে ফেলল।’
রানুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
‘ঐ লোকটির নাম ছিল জালালউদ্দিন।’
রানু কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, ‘তোমার অসুখ শুরু হলো সেদিন থেকে। তোমার মনের মধ্যে ব্যাপারটি গেঁথে গেল, পরবর্তী সময়ে গোসলের সময় যখন মরা মানুষটি তোমার পায়ে লেগে গেল, তখন তোমার মনে পড়ল মন্দিরের দৃশ্য। বুঝতে পারছ?’
রানু জবাব দিল না।
‘অসুখের মূল কারণটি আলোয় নিয়ে এলেই অসুখ সেরে যায়; এ জন্যেই আমি এটা তোমাকে বললাম। তুমি নিজেও এখন গোড়া থেকে সমস্ত ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করবে। তোমার অসুখ সেরে যাবে।’
রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘আপনি কি ঐ লোকটির সঙ্গে কথা বলেছেন?’
‘বলেছি।’
‘ও কী বলেছে?’
‘তেমন কিছু বলে নি।’
‘না, বলেছে, আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন না। একটা যখন বলেছেন, তখন বাকিটাও বলুন।’
রানু তীব্র চোখে তাকাল। মিসির আলি বললেন, ‘দেখ রানু, আমি খুবই যুক্তিবাদী মানুষ। অলৌকিক কোনো কিছুতে বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি সব কিছুরই একটি ব্যাখা আছে। জালালউদ্দিন যা বলেছে, তাও নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করা যায়।’
‘আপনি জালালউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন না?’
‘না ওর মনে পাপবোধ ছিল। মন্দিরটন্দির নিয়ে মূর্খ মানুষদের মনে অনেক রকম ভয়-ভীতি আছে। তা থেকেই সে একটা হেলুসিনেশন দেখেছে। তুমি নিজে তো কিছু দেখ নি।’
‘না।’
‘তাহলেই হলো। জালালউদ্দিন কী দেখেছে না-দেখেছে, সেটা তার প্রবলেম, তোমার নয়।’
রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু একটা জিনিস কি জানেন? ঐ ঘটনার পর থেকে আমি অসম্ভব সুন্দর হয়ে গেলাম।’
মিসির আলি শব্দ করে হাসলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, ‘সুন্দর তুমি সব সময়ই ছিলে। ঘটানাটি ঘটেছে তোমার বয়ঃসন্ধিতে। বয়ঃসন্ধির পর মেয়েদের রূপ খুলতে শুরু করে। এখানেও তাই হয়েছে।’
‘কিন্তু ঐ দেবীমূর্তিটিকে এর পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।’
‘তুমি কিন্তু খুব ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ রানু। মূর্তিটি চুরি গেছে, কেউ নিয়ে পালিয়ে গেছে, ব্যস।,
‘মূর্তিটি চুরি যায় নি।’
‘তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর না-একটা পাথরের মূর্তি তোমার মধ্যে ঢুকে আছে? কি, কর?’
রানু তীব্র কণ্ঠে বলল, ‘আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলুন, আমাকে কি অনেকটা মূর্তির মতো দেখায় না?’
‘না রানু, মূর্তির মতো দেখাবে কেন? অসম্ভব রূপবতী একটি তরুণী-এর বেশি কিছু না। তোমার মতো রূপবতী মেয়ে এ দেশেই আছে এবং তারা সবাই রক্ত-মাংসের মানুষ।’
রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি বললেন, ‘চলে যাচ্ছ রানু?’
‘হ্যাঁ।’
‘অসুখ সারলে তোমাদের ওখানে একবার যাব।’
‘না, আপনি আসবেন না। আপনার আসার কোনো দরকার নেই।’
রানু ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিসির আলি ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং।’ তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হলো।তিনি ব্যাপরটি ঠিক বুঝতে পারছেন না। যতটা সহজ মনে হয়েছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে না। তিনি মৃত্যু-বিষয়ক বইটি আবার পড়তে শুরু করলেন। সাবজেক্টটি তাঁকে বেশ আকর্ষণ করেছে। ফ্যাসিনেটিং টপিক।
.
🔴 বারো 🔴
.
গভীর রাতে আনিস জেগে উঠল। শুনশান নীরবতা চারদিকে। রানু হাত-পা ছড়িয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো ঘুমোচ্ছে। জানলার আলো এসে পড়েছে তার মুখে। অদ্ভুদ সুন্দর একটি মুখ। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। আনিস ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। বাথরুমে যেতে হবে।
বাথরুমে পানি জমে আছে। পাইপ জ্যাম হয়ে গেছে। বাড়িঅলাকে বলতে হবে। আনিস নোংরা পানি বাঁচিয়ে সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই শুনল ঝুমঝুম করে শব্দ হচ্ছে। নতুন বাজছে যেন। এর মানে কী? মানের ভুল কি? মনের ভুল হবার কথা নয়। বেশ বোঝা যাচ্ছে নূপুর পায়ে দিয়ে ঝমঝম করতে-করতে কেউ-একজন এঘর-ওঘর করছে। শব্দটা অনেকক্ষণ ধরইে হচ্ছে। মনের ভুল হবার কথা নয়।
বাথরুমের দরজা খুলতেই শব্দটা চট করে থেমে গেল। শুধু একটা তীব্র ফুলের গন্ধ আনিসকে অভিভুত করে ফেলল। একটু আগেও তো এ রকম সৌরভ ছিল না।আনিসের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বিস্ময়ের ঘোর অবশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আনিসের মনে পড়ল একতলার বাগানে হাস্নাহেনার প্রকাণ্ড একটা ঝাড় আছে। বাতাসের ঝাপটায় ফুলের গন্ধই উড়ে এসেছে বারান্দায়। আনিস কিছুক্ষণ একা-একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল-নূপুরের শব্দ আবার যদি পাওয়া যায়।
দোতলায় একটা বাচ্চা ছেলে শুধু কাঁদছে। তার মা তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। একটা রিকশা গেল টুনটুন করে। ব্যস, আর কিছু শোনা গেল না।
শোবার ঘরে রানু ঘুমাচ্ছে। মড়ার মতো। জানালা খোলা। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ঘরে। আনিস জানালা বন্ধ করতে গিয়ে শুনল, রান্নাঘর থেকে জিতু মিয়া সাড়াশব্দ দিচ্ছে। কান্না চাপার আওয়াজ।
‘জিতু মিয়া।’
জিতু ফুঁপিয়ে উঠল। আনিস রান্নাঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল। জিতু মশারির ভেতর জুবথবু হয়ে বসে আছে।
‘জিতু, কি হয়েছে রে?’
‘কিছু হয় নাই।’
‘বসে আছিস কেন?’
‘ঘুম আহে না।’
‘স্বপ্ন দেখেছিস?‘
জিতু মাথা নাড়ল।
‘কী স্বপ্ন?’
‘এক জন মাইয়া মানুষ পাকের ঘরে হাঁটতে আছিল।’
‘এই দেখেছিস স্বপ্নে?’
‘স্বপ্নে দেখি নাই। নিজের চোখে দেখলাম।’
‘দূর ব্যাটা, অন্ধকারে তুই মানুষ দেখলি কীভাবে? যা, ঘুমো তুই।’
‘আচ্ছা।’
জিতু শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। আনিস একটি সিগারেট ধরাল। ঘুম চটে গেছে। তাকে এখন দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে হবে। এক পেয়লা চা খেতে পারলে মন্দ হত না। রাত তো বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা। বাকি রাতটা তার জেগেই কাটবে মনে হয়। সিগারেট টানতে ভালো লাগছে না। পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে।
ঘুমের মধ্যে রানু শব্দ করে হাসল। আনিস মৃদু স্বরে ডাকল, ‘এই রানু।’রানু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘কি?’
‘জেগে আছ নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী আশ্চার্য, কখন জাগলে?’
‘অনেকক্ষণ। তুমি বাথরুমে গেলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে।’
‘আমাকে ডাকলে কেন?’
আনিস সিগারেট টানতে লাগল। রানু বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। জানালা বন্ধ করলে কেন?’
‘গরম কোথায়? বেশ ঠাণ্ডা তো!’
‘আমার গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড় না।’
‘এই ঠাণ্ডার মধ্যে ফ্যান ছাড়ব কি, কী যে বল!’
রানু ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুমি যখন বাথরুমে ছিলে তখন কি নূপুরের শব্দ শুনেছ?’
আনিস ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘না তো কেন?’
‘না, এমনি। আমি শুয়ে-শুয়ে শুনছিলাম।’
‘ঘুমাও রানু।’
‘আমার ঘুম আসছে না।’
‘ঘুম না এলে উঠে বস, গল্প করি। চা খাওয়া যেতে পারে, কি বল?’
রানু উঠে বসল, কিন্তু জবাব দিল না। আনিস দেখল রানু কোন ফাঁকে গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে। ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘বড্ড গরম লাগছে। তুমি আমার দিকে তাকিও না, প্লীজ।’
‘এইসব কী রানু? ঘরে একটা বাচ্চা ছেলে আছে।’
‘কী করব, বড্ড গরম লাগছে। তুমি বরং রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে সব অন্ধকার করে দাও।’
‘না, বাতি জ্বালানো থাক।’
‘আনিস দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। রানু বলল, ‘আমাদের গ্রামে একটা মন্দির আছে, তার গল্প এখন শুনব না।’
‘আহ্, মন্দির-ফন্দিরের গল্প এখন শুনব না।’
‘আহ্, শোন না। আমার বলতে ইচ্ছে করছে। আমি যখন খুব ছোট, তখন একা-একা যেতাম সেখানে।’
‘কি মন্দির? কালীমন্দির?’
‘নাহ্, বিষ্ণূমন্দির বলত ওরা।তবে কোনো বিষ্ণূমুর্তি ছিল না। একটি দেবী ছিল। হিন্দুরা বলত রুকমিনী দেবী।’
‘তুমি মন্দিরে যেতে কী জন্যে?’
‘এমনি যেতাম। ছোট বাচ্চা পুতুল খেলে না?’
‘কী করতে সেখানে?’
‘দেবীমূর্তির সাথে গল্পগুজব করতাম। ছেলেমানুষি খেলা আর কি!’
বলতে-বলতে রানু খিলখিল করে হেসে উঠল। আনিস স্পষ্ট শুনল সঙ্গে-সঙ্গে ঝমঝম করে কোথাও নুপুর বাজছে। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ?’
‘কী শুনব?’
‘নূপুরের শব্দ শুনছ না?’
আনিস দৃঢ় স্বরে বলল, ‘না। তুমি ঘুমাও রানু।’
‘আমার ঘুম আসছে না।’
‘শুয়ে থাক। তুমি অসুস্থ।’
‘রানু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি অসুস্থ।’
‘তোমাকে খুব বড় ডাক্তার দেখাব আমি।’
‘আচ্ছা।’
‘এখন শুয়ে থাক।’
রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি ঐ দেবীকে গান গেয়ে শোনাতাম।’
‘ঐ সব অন্য দিন শুনব।’
‘আজ রাতে আমার বলতে ইচ্ছে করছে।’
আনিস এসে রানুর হাত ধরল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আনিস অবাক হয়ে বলর, ‘তোমার গা তো পুড়ে যাচ্ছে!’
‘হুঁ, বড্ড গরম লাগছে। ফ্যানটা ছাড়বে?’
আনিস উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিল। ঘর ভর্তি হয়ে গেল ফুলের গন্ধে। আর তখনি রানু অত্যন্ত নিচু গলায় গুনগুন করে কী যেন গাইতে লাগল। অদ্ভুত অপার্থিব কোনো-একটা সুর-যা এ জগতের কিছু নয়। অন্য কোনো ভূবনের। রান্নাঘর থেকে জিতু ডাকতে লাগল, ‘ও ভাইজান, ভাইজান।’
আনিস রানুকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে গায়ের চাদর টেনে দিল। জিতুকে বলল, এ ঘরে যেন না আসে। তারপর নেমে গেল নিচে, বাড়িঅলার মেয়েটিকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে।
নীলু এল সঙ্গে সঙ্গে। আনিস দেখল রানু শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে। জিতু মিয়া শুধু জেগে আছে। কাঁদছে ব্যাকুল হয়ে। নীলুর সঙ্গে তার বাবাও আসছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘হয়েছেটা কি?’ আনিস ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছি না, কেমন যেন করছে।’
‘কী করছে?‘
আনিস জবাব দিল না। নীলু বলল, ‘বাবা, তুমি শুয়ে থাক গিয়ে, আমি এখানে থাকি। রাত তো বেশি নেই।’ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিচে নেমে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন,‘হাসপাতালে নিতে হলে বলবেন, ড্রাইভারকে ডেকে তুলব।’
‘জি আচ্ছা।’
রানু বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল। একবারও জাগল না। নীলু সারাক্ষণ তার পাশে রইল। আনিসের সঙ্গে তার কথাবার্তা কিছু হলো না। আনিস বসার ঘরের সোফায় বসে ঝিমুতে লাগল।
.
*******
.
মিসির আলি লোকটির ধের্য প্রায় সীমাহীন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি দ্বিতীয় দফায় রানুদের গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে প্রত্নতও্ব বিভাগের এক ভদ্রলোক, জয়নাল সাহেব। উদ্দেশ্য রুকমিনী দেবীর মন্দির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।
জয়নাল সাহেব মন্দির দেখে বিশেষ উল্লসিত হলেন না। তিন শ’ বৎসরের বেশি এর বয়স হবে না। এরকম ভগ্নস্তূপ এ দেশে অসংখ্য আছে। মিসির আলি বললেন, ‘তেমন পুরোনো নয় বলেছেন?’
‘না রে ভাই। ইটের সাইজ দেখলেন বুঝবেন। ভেঙে-টেঙে কী অবস্থা হয়েছে দেখেন!’
‘যত্ন হয় নি। মন্দির যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি হয়তো মারা গেছেন কিংবা তাঁর উৎসাহ মিইয়ে গেছে।’
গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অল্প কিছু তথ্য পাওয়া গেল-পালবাবুদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির। পালরা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরপরই তাদের ভাগ্য-বিপর্যয় শুরু হয়। তিন-চার বছরের মধ্যে পালরা নির্বংশ হয়ে পড়ে। দেবীকে তুষ্ট করার জন্যে তখন এক রাতে কুমারীকন্যাকে অমাবস্যা রাত্রিতে মন্দিরের সামনে বলি দেয়া হয়। দেবীর তুষ্টি হয় না তাতেও। পাথরের মূর্তি এত সহজে বোধহয় তুষ্ট হয় না। তবে গ্রামের মানুষেরা নাকি বলি দেয়া মেয়েটিকে এর পর থেকে গ্রামময় ছুটোছুটি করতে দেখে। ময়মনসিংহ থেকে ইংরেজ পুলিশ সুপার এসে মন্দির তালাবন্ধ করে পালদের দুই ভাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান।
পালরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিল। কাজেই ছাড়া পেয়ে এক সময় আবার গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু মন্দির তালাবন্ধই পড়ে থাকে।
ইতিহাস এইটুকুই। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত মূর্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা গেল না। দুই-এক ঘর নিম্নবর্ণের হিন্দু যারা ছিল, তারা বিশেষ কিছু বলতে পারে না। হরিশ মণ্ডল বলল, ‘বাবু, আমরা কেউ ঐ দিকে যাই না। ঐ মন্দিরে গেলে নির্বংশ হতে হয়, কে যাবে বলেন?’
‘আপনি তো শিক্ষক লোক, এইসব বিশ্বাস করেন?’
‘করি না, কিন্তু যাইও না।’
‘মূর্তিটা আপনি দেখেছেন?’
‘আমি দেখি নাই, তবে আমার জ্যাঠা দেখেছে।’
‘তিনি কি নির্বংশ হয়েছেন?’
‘না তাঁর তিন ছেলে। এক ছেলে নান্দিনা হাইস্কুলের হেড মাস্টার।’
‘মূর্তিটা কেমন ছিল বলতে পারেন?’
‘শ্বেত পাথরের মূর্তি। কৃষ্ণনগেরর কারিগরের তৈরি। একটা হাত ভাঙা ছিল।’
‘মূর্তিটা নাকি হঠাৎ উধাও হয়েছে?’
‘কেউ চুরিটুরি করে নিয়ে বিক্রি করে ফেলেছে। গ্রামে চোরের তো অভাব নাই। এ রকম একটা মূর্তিতে হাজার খানিক টাকা হেসেখেলে আসবে। সাহেবেরা নগদ দাম দিয়ে কিনবে।’
‘আচ্ছা, একটা বাচ্চা মেয়ে যে বলি দেয়া হয়েছিল, সে নাকি অমাবস্যার রাত্রে ঘুরে বেড়ায়?’
‘বলে তো সবাই। চিৎকার করে কাঁদে। আমি শুনি নাই। অনেকে শুনেছে।’
অমাবস্যার জন্যে মিসির আলিকে তিন দিন অপেক্ষা করতে হলো। তিনি অমাবস্যার রাত্রে একটা পাঁচ-ব্যাটারির টর্চ আর একটা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে রইলেন। তিনি কিছুই শুনলেন না। শেয়ালের ডাক শোনা গেল অবশ্যি। শেষ রাত্রের দিকে প্রচণ্ড বাতাস বইতে লাগল। বাতাসে শিষ দেবার মতো শব্দ হলো। সে সব নিতান্তই লৌকিক শব্দ। অন্য জগতের কিছু নয়। রাত শেষ হবার আগে-আগে বর্ষণ শুরু হলো। ছাতা নিয়ে যান নি। মন্দিরের ছাদ ভাঙা। আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। মিসির আলি কাকভেজা হয়ে গেলেন।
ঢাকায় ফিরলেন প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে। ডাক্তার পরীক্ষা করে শুকনো মুখে বললেন, ‘মনে হচ্ছে নিউমোনিয়া। একটা লাংস এফেকটেড, ভোগাবে।’
মিসির আলিকে সত্যি-সত্যি ভোগল। তিনি দীর্ঘ শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন।
.
🔴 তেরো 🔴
.
বইপড়াতে এ সময় লোকজন তেমন থাকে না। আজ যেন আরো নির্জন। নীলু একা-একা কিছুক্ষণ হাঁটল। তার খুব ঘুম হচ্ছে। বারবার সবুজ রুমালটি বের করতে হচ্ছে। চারটা দশ বাজে। চিঠিতে লিখেছে সে চারটার মধ্যেই আসবে, কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নীলু অবশ্যি কারো মূখের দিকে তাকাতেও পারছে না। কাউকে তাকাতে দেখলেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠছে।
নীলু একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। গল্পের বই তার তেমন ভালো লাগে না। ভালো লাগে বিলুর। বিলুর জন্যে একটা কিছু কিনলে হয়. কিন্তু কী কিনবে? সবই হয়তো ওর পড়া। ঐ দিন শীর্ষেন্দুর কী-একটা বইয়ের কথা বলছিল। নামটা মনে নেই।
‘আচ্ছা, আপনাদের কাছে শীর্ষেন্দুর কোনো বই আছে?’
‘জ্বি-না। আমরা বিদেশি বই রাখি না।’
নীলু অন্য একটা ঘরে ঢুকল। শুধু-শুধু দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে একটা কবিতার বই কিনে ফেলল। অপরিচিত কবি, তবে প্রচ্ছদটি সুন্দর। একটি মেয়ের ছবি। সুন্দর ছবি। নামটি সুন্দর-‘প্রেম নেই’। কেমন অদ্ভুত নাম। ‘প্রেম নেই’ আবার কী? প্রেম থাকবে না কেন?’
দাড়িঅলা এক জন রোগা ভদ্রলোক এক রোগা ভদ্রলোক তখন থেকেই তার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটির কাঁধে একটি ব্যাগ। এই কি সে! নীলুর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। নীলু বইয়ের দাম দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল। তার পেছনে ফেরারও সাহস নেই।পেছেনে ফিরলেই সে হয়তো দেখবে বুড়ো দাড়িঅলা গুটিগুটি আসছে।
না, লোকটি আসছে না। নীলুর মনে হলো, ভয়ানক মোটা এবং বেঁটে একজন কে যেন তাকে অনূসরণ করছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না, কিন্তু আসছে তার পিছু পিছু। নীলুর তৃষ্ণা পেয়ে গেল। বড্ড টেনশান। বাড়ি ফিরে গেলে কেমন হয়? কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। নীলু ঘড় িদেখল, পাঁচটা পাঁচ। তার মানে কি যে সে আসবে না? কথা ছিল নীলু থাকবে ঠিক এক ঘন্টা।
সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ভালোই হয়েছে। দেখা না-হওয়াটাই বোধহয় ভালো। দেখা হবার মধ্যে একটা আশাভঙ্গের ব্যাপার আছে। না-দেখার রহস্যময়তাটাই না হয় থাকুক। নীলু ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল।
‘নীলু।’
নীলু দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘একটু দেরি হয়ে গেল। তুমি ভালো আছ নীলু?’
চকচকে লাল টাই-পরা যে ছেলেটি হাসছে,সে কে? লম্বা স্বাস’্যবান একটি তরুণ। ঝলমল করছে। তার লাল টাই উড়ছে। বাতাসে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। সেন্টের গন্ধ। পুরুষ মানুষের গা থেকে আসা সেন্টের গন্ধ নীলুর পছন্দ নয়, কিন্তু আজ এত ভালো লাগছে কেন?
‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বল।’
‘আপনি বলেছিলেন আপনি বুড়ো।’
‘আমরা সবাই কিছু-কিছু মিথ্যা বলি। আমাকে নীলু নামের একটি মেয়ে লিখেছিল, সে দেখতে কুৎসিত।’
লোকটি হাসছে হা হা করে। এত সুন্দর করেও মানুষ হাসতে পারে! নীলুর এক ধরনের কষ্ট হতে লাগল। মনে হতে লাগল সমস্তটাই একটা সুন্দর স্বপ্ন, খুবই ক্ষণস্থায়ী। যেন এক্ষুণি স্বপ্ন ভেঙে যাবে। নীলু দেখবে সে জেগে উঠছে, পাশের বিছানায় বিলু ঘুমাচ্ছে মশারি না-ফেলে, কিন্তু সে রকম কিছু হলো না। ছেলেটি হাসিমুখে বলল, ‘কোথাও বসে এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? খাবে?’
নীলু মাথা নাড়ল-সে খাবে।
‘তুমি কিন্তু সবুজ রুমালটি ব্যাগে ভরে ফেলছ। আমি যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি না।’
নীলু অস্বাভাবিক ব্যস্ত হয়ে রুমাল বের করতে গেল।একটা লিপস্টিক,একটা ছোট চিরুনি,কিছু খুচরো পয়সা গড়িয়ে পড়ল নিচে। ছেলেটি হাসিমুখে সেগুলো কুড়াচ্ছে। নীলু মনে-মনে বলল-যেন এটা স্বপ্ন না হয়। আর স্বপ্ন হলেও যেন স্বপ্নটা অনেকক্ষণ থাকে। নীলুর খুব কান্না পেতে লাগল।
নিউ মার্কেটের ভেতর চা খাওয়ার তেমন ভালো জায়গা নেই। ওরা বলাকা বিল্ডিংয়ের দোতলায় গেল। চমৎকার জায়গা! অন্ধকার-অন্ধকার চারদিক। পরিচ্ছন্ন টেবিল। সুন্দর একটি মিউজিক হচ্ছে।
‘চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে নীলু?‘
‘নাহ্।’
‘এরা ভালো সামুচা করে। সামুচা দিতে বলি? আমার খিদে পেয়েছে। কি, বলব?’
‘বলুন।’
ছেলেটি হাসল। নীলুর খুব ইচ্ছা করছিল, জিজ্ঞেস করে-হাসছ কেন তুমি? আমি কি হাস্যকর কিছু করেছি? কিন্তু নীলু কিছু বলল না। ছেলেটির হাসতে-হাসতে বলল, ‘আসলে আমি বিজ্ঞাপনটা মজা করবার জন্যে দিয়েছিলাম, কেউ জবাব দেবে ভাবি নি।’
‘আমি ছাড়া কেউ কি লিখেছিল?’
‘তা লিখেছে। মনে হচ্ছে এ দেশের মেয়েদের কাজকর্ম বিশেষ নেই।সুযোগ পেলেই ওরা চিঠি লেখে। এই কথা বললাম বলে তুমি আবার রাগ করলে না তো?’
‘নাহ্।’
‘গুড। আমি কিন্তু শুধু তোমার চিঠির জবাব দিয়েছি। অন্য কারোর চিঠির জবাব দিই নি। আমার কথা বিশ্বাস করছ তো?’
‘করছি।’
বেয়ারা চায়ের পট দিয়ে গেল। ছেলেটি বললো, “দাও, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।ঘরে বানাবে মেয়েরা, কিন্তু বাইরে পুরুষেরা-এ-ই নিয়ম।”
নীলু লক্ষ্য করল, ছেলেটি তার কাপে তিন চামচ চিনি দিয়েছে। নীলু একবার লিখেছে সে চায়ে তিন চামচ চিনি খায়। ছেলেটি সেটা মনে রেখেছ। কী আশ্চার্য।
‘চায়ে এত চিনি খাওয়া কিন্তু ভালো না।’
‘নীলু কিছু বলল না।
‘এর পর থেকে চিনি কম খাবে?’
নীলু ঘাড় নাড়ল।
তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইল। নীলু একবার বলল, ‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, উঠি?’
ছেলেটি বলল, ‘আরেকটু বস, আমি বাসায় পৌঁছে দেব, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।’ নীলু আর কিছু বলল না।
‘একটু দেরি হলে তোমাকে আবার বাসায় বকবে না তো?’
‘নাহ্, বকবে না। আমি মাঝে-মাঝে অনেক রাত করে বাসায় ফিরি।’
‘সেটা ঠিক না নীলু। শহর বড় হচ্ছে, ক্রাইম বাড়ছে। ঠিক না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক।’
‘ঐ দিন কী হলো জান-আমার পরিচিত এক মহিলার কোন থেকে টেনে দুল নিয়ে গেছে, রক্তারক্তি কাণ্ড!’
‘আমি গয়নাটয়না পরি না।’
‘না-পরাই উচিত। আচ্ছা নীলু, তুমি কি আজ তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে?’
‘আপনি যদি চান, দেব।’
‘আমি নিশ্চয়ই চাই। তুমি কি চাও?’
‘চাই, বলতে গিয়ে নীলুর চোখ ভিজে উঠল। ছেলেটিকে এখন কত-না পরিচিত মনে হচ্ছে। সে যদি এখন হাত বাড়িয়ে নীলুর হাত স্পর্শ করে, তাহলে কেমন লাগবে নীলুর? ভালোই লাগবে। কিন্তু ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র। সে এমন কিছুই করবে না।
‘নীলু, আমি তোমার জন্যে একটা উপহার এনেছিলাম। কিন্তু তার আগে বল, তুমি কী এনেছ? তুমি বলেছিলে লাল টাই আনবে।ভুলে গেছ, না?’
‘না ভুলব কেন?
‘আমি তোমার জন্যেই লাল টাই পরে এসেছি। যদিও লাল রং আমার পছন্দ নয়। আমার পছন্দ হচ্ছে-নীল।’
‘নীল আমারও পছন্দ।’
‘তবে হালকা নীল, কড়া নীল নয়।’
নীলু এই প্রথম অল্প হাসল। হালকা নীল তার নিজেরও পছন্দ। ছেলেটি হাসতে-হাসতে বলল, ‘আমার সবচে’ অপছন্দ হচ্ছে সবুজ রং। কিন্তু দেখ,আজ সবুজ রংটাও খারাপ লাগছে না।’
তারা উঠে দাঁড়াল সাড়ে আটটায় দিকে। হেঁটে-হেঁটে এল নিউমার্কেটের গেটে। ছোট্ট একটা হোন্ডা সিভিক সেখানে পার্ক করা। ছেলেটি ঘড়ি দেখে বলল, ‘রাত কি বেশি হয়ে গেল নীলু?’
‘না, বেশি হয় নি।’
‘তোমার বাবা দুশ্চিন্তা না-করলে হয়। আমি চাই না আমার জন্যে কেউ বকা খাক। অবশ্যি এক-আধ দিন বকা খেলে কিছু যায়-আসে না, কি বল?’
নীলু হাসল। ছেলেটিও হাসল। মাজির্ত হাসি।
‘সরাসরি বাসায় যাব, নাকি যাবার আগে আইসক্রীম খাবে? ধানমণ্ডিতে একটা ভালো আইসক্রীমের দোকান দিয়েছে।’
‘আজ আর যাব না।’
‘ঠিক আছে, চল বাসায় পৌঁছে দিই।’
ছেলেটি নীলুকে তাদের গেটের কাছে নামিয়ে দিল। নীলুর খুব ইচ্ছে করছিল তাকে বসতে বলে, কিন্তু তার বড্ড লজ্জা করল। বিলু নানান প্রশ্ন শুরু করবে।
.
******
.
‘স্যার, ভেতরে আসব?’
‘এস। কী ব্যাপার?’
মিসির আলি মেয়েটিকে ঠিক চিনতে পারলেন না। তিনি কখনো তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের চিনতে পারেন না।
‘স্যার, আমার নাম নীলু, নীলুফার।’
‘ও, আচ্ছা।’
মিসির আলি পরিচিত ভঙ্গিতে হাসলেন কিন্তু নামটি তাঁর কাছে অপরিচিত লাগছে। এও এক সমস্যা। কারো নাম তিনি মনে রাখতে পারেন না। তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হলো। নাম মনে না করতে পারার একটিই কারণ-মানুষের প্রতি তাঁর আগ্রহ নেই। আগ্রহ থাকলে নাম মনে থাকত।
‘স্যার, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি সেকেন্ড ইয়ারের। এক দিন এসেছিলাম আমরা চার বন্ধু।’
‘ও হ্যাঁ। এসেছিলে তোমরা। মনে পড়েছে। আজ কী ব্যাপার?‘
‘মেয়েটি ইতস্তত করতে লাগল। তার মানে কী? কমবয়েসী মেয়েদের তিনি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেন। তরলমতি মেয়েরা মাঝে-মাঝে অনেক অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে বসে।
‘তোমরা কী ব্যাপার,বল।’
‘স্যার, আমি ঐ ইএসপির টেস্টটা আবার দিতে চাই।’
‘এক বার তো দিয়েছে। আবার কেন?’
মিসির আলি বিস্মিত হলেন। এই মেয়েটির মতিগতি তিনি বুঝতে পারছেন না।
‘স্যার, আমার মনে হয়, একবার পরীক্ষা করলে দেখা যাবে-আমার ইএসপি আছে।’
‘এ রকম হবার কারণ কী?’
মেয়েটি উত্তর না-দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। লক্ষণ ভালো নয়। মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এখন আমি একটু ব্যস্ত আছি। অন্য এক দিন এস।’
মেয়েটি তবুও কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল।
‘তুমি কি অন্য কিছু বলতে চাও?’
‘জ্বি-না স্যার। আমি যাই। স্লামালিকুম।’
মিসির আলি গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। এ মেয়েটিকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। এরা সহজেই একটা ঝামেলা বাধিয়ে দিতে পারে। এ রকম সুযোগ দেয়া ঠিক না।

বারটায় একটা ক্লাস ছিল। মিসির আলি গিয়ে দেখলেন কোনো ছাত্র-ছাত্রী নেই। কোনো স্ট্রাইক হচ্ছে কি? এরকম কিছু শোনেন নি। সামনে হয়তো টার্ম পরীক্ষা আছে। টার্ম পরীক্ষা থাকলে ছাত্ররা দল বেঁধে আসা বন্ধ করে দেয়। মিসির আলি ভ্রকুঁচকে খালি ক্লাসে পাঁচেক বসে রইলেন। গত রাতে অসুস্থ শরীরে এই ক্লাসটির জন্যে পড়াশোনা করেছেন। এ অবস্থা হবে জানলে সকাল-সকাল শুয়ে পড়তে পারতেন। ছাত্রশূণ্য একটি ক্লাসে তিনি খাতাপত্র নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন-হাস্যকর দৃশ্য। অনেকেই করিডোর দিয়ে হাঁটবার সময় তাঁকে কৌতূহলী হয়ে দেখল। পাগলটাগল ভাবছে বোধহয়। মিসির আলি উঠে পড়লেন।
আজকের দিনটিই শুরু হয়েছে খারাপভাবে। একটি কাজও ঠিকমতো হচ্ছে না। মিসির আলি ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। তাঁর কপালের মাঝখানে ব্যাথা শুরু হলো। এই উপসর্গটি নতুন। ব্লাড-প্রেশারট্রেশার হয়েছে বোধহয়। ডাক্তার দেখাতে হবে।
তিনি বাড়ি ফিরলেন তিনটার দিকে। এই অসময়েও বসার ঘরে কে যেন বসে আছে। সমস্ত দিনটিই যে খারাপ যাবে, এটা হচ্ছে তার প্রমাণ। গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা চাইতে কেউ এসেছে নির্ঘাত।
‘কে?’
‘জ্বি, আমি আনিস’
‘আনিস সাহেব, আপনি এই সময়ে! অফিস নেই?’
‘ছুটি নিয়ে এলাম।’
‘ ব্যাপার কী?’
‘রানুর শরীরটা বেশি খারাপ। ভাবলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।’
‘ভালোই করেছেন। বসেন, চা-টা দিয়েছে?’
‘জ্বি, চা খেয়েছি। আপনার ভাই ছিলেন এতক্ষণ।’
‘বসুন, আমি কাপড় ছেড়ে আসি।’
লোকটি জড়সড় হয়ে বসে আছে। মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, তার চোখের নিচে কালি পড়েছে। তার মানে রাতে ঘুমাতে পারছে না। এ রকম হওয়ার কথা নয়। মিসির আলি চিন্তিত মূখে ভেতরে ঢুকলেন। তাঁর ফিরে আসতে অনেক সময় লাগল।
‘এখন বলেন, ব্যাপারটা কী?’
আনিস ইতস্তত করে বলল, ‘ভূতপ্রেত বলে কিছু আছে?’
‘এই কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
আনিস মুখ কালো করে বলল, ‘অনেক রকম কাণ্ডকারখানা হচ্ছে। আমি কনফিউজড হয়ে গেছি।’
‘অথাৎ এখন ভূতপ্রেত বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন?’
আনিস চুপ করে রইল।
‘এর কারণটা বলেন, শুনি।’
‘নানারকম শব্দ হয় ঘরে।’
‘তাই নাকি? আপনি নিজে শোনেন?’
‘জ্বি, শুনি। গন্ধও পাই, ফুলের গন্ধ।’
‘আপনি পান, না আপনার স্ত্রী পান?’
‘রানু প্রথম পায়, তারপর আমি পাই।’
মিসির আলি চুরুট ধরালেন। আনিস বললেন, ‘গত রাতে ঘরের মধ্যে কেউ যেন নূপুর পায়ে হাঁটছিল।’
‘এই নূপুরের শব্দ প্রথমে কে শোনে? আপনার স্ত্রী?’
‘জ্বি।’
‘তারপর আপনাকে বলার পর আপনি শুনতে পান।’
‘জ্বি।’
‘আনিস সাহেব, এটাকে বলা হয় ইনডিউসড অডিটরি হেলুসিনেশন। আপনার মন দুর্বল। আপনার স্ত্রী যখন বলেন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, তখন আপনিও তা শুনতে থাকেন। ব্যাপারটি আপনার মনোজগতে। আসলে কোনো শব্দ হচ্ছে না।’
আনিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি যদি একবার আসলে আমাদের বাসায়, আপনি নিজেও শুনবেন।’
‘না ভাই, আমি শুনব না। আমি খুব শক্ত ধরনের মানুষ। খুবই যুক্তিবাদী লোক আমি।’
‘আপনি আসেন-না এক বার।’
‘ঠিক আছে,যাব।’
‘আমাদের বাড়িঅলার খুব সুন্দর ফুলের বাগান আছে। প্রচুর গোলাপও আছে। বিকেলের দিকে গেলে সেটাও দেখতে পারবেন।’
মিসির আলি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বড় ফুলের বাগান?’
‘জ্বি।’
‘আনিস সাহেব, এমন কি হতে পারে না, বাতাসে নিচের বাগান থেকে ফুলের সৌরভ ভেসে আসে? সেই সৌরভকে আপনি একটি আধ্যাত্মিক রূপ দেন। হতে পারে?’
‘পারে, কিন্তু শব্দটা?’
‘কোনো একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। মস্তিক খুব অদ্ভুত জিনিস, আনিস সাহেব। সে আপনাকে এমন সব জিনিস দেখাতে বা শোনাতে পারে, যার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনি কি উঠছেন?’
‘জ্বি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, যান। আমার নিজেরও মাথা ধরেছে। দুটো পেরাসিটামল খেয়েছি, লাভ হচ্ছে না।জ্বরও আসছে বলে মনে হয়। শরীরটা গেছে। বেশি দিন বাঁচব না।’
.
🔴 চৌদ্দ 🔴
.
পত্রিকা খুলে নীলু অবাক হলো। সেই বিজ্ঞাপনটি আবার ছাপা হয়েছে। কথাগুলো এক। জিপিও বকা্র নাম্বারও ৭৩। শিরোনামটিও আগের মতো-কেউ কি আসবেন?’ এর মানে কী? নীলুর ধারণা ছিল, এই বিজ্ঞাপনটি আর কোনো দিন ছাপা হবে না। এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। নীলুর ইচ্ছা হলো দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদার। সে মুখ কালো করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দায় তার জন্যে একটা বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। মিসির আলি সাহেব দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, ‘এখানে কি আনিস সাহেব থাকেন?’
‘স্যার আপনি? আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘ও ইয়ে, তুমি। আমার ছাত্রী? কোন ইয়ার?’
‘থার্ডইয়ার স্যার। নিলু আমার নাম। নীলুফার।’
‘ও আচ্ছা। নীলুফার-তোমাদের তেতলায় আনিস সাহেব থাকেন নাকি?’
‘জ্বি।’
‘তাঁর কাছে এসেছি। উঠবার রাস্তা কোন দিকে?’
নীলু তাঁকে সঙ্গে করে তিনতলায় নিয়ে গেল।
‘ফেরবার পথে আমাদের বাসা হয়ে যাবেন স্যার। যেতেই হবে।’
‘আচ্ছা, দেখি।’
‘দেখাদেখি না স্যার, আপনি আসবেন।’
আনিস ঘরে ছিল না। রানু তাঁকে নিয়ে বসাল। সে খুবই অবাক হয়েছে। মিসির আলি বললেন, ‘খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে?’
‘আপনি-আপনি করে বলেছেন কেন?’
‘ও আচ্ছা, তুমি-তুমি করে বলতাম, তাই না? ঠিক আছে।এখন বল, আমাকে দেখে অবাক হয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘খুব অবাক হয়েছ?’
‘জ্বি। আপনি আসবেন ভাবতেই পারি নি।’
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘তুমি তো শুনেছি সব কিছু আগে বলে দিতে পার, এটি তো পারার কথা ছিল।’
রানু থেমে-থেমে বলল, ‘আপনি লোকটি বেশ অদ্ভুত!’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আপনার যুক্তিও খুব ভালো, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়।’
‘বিশ্বাস করলেই পার। আনিস সাহেব কখন আসবেন?’
‘এসে পড়বে।’
‘আমাকে একটু চা খাওয়াও। আর শোন, তোমাদের একটা কাজের ছেলে আছে নাকি? ওকে পাঠাও তো আমার কাছে।’
‘ওকে কী জন্যে?’
‘কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।’
মিসির আলি : কি নাম?
জিতু : জিতু মিয়া।
মিসির আলি : দেশ কোথায়?
জিতু : টাঙ্গাইল।
মিসির আলি : শুনলাম দুই-এক দিন আগে তুমি নাকি রাতের বেলা কি-একটা দেখে ভয় পেয়েছ?
জিতু : জ্বি, পাইছি।
মিসির আলি : কী দেখছ?
জিতু : পাকের ঘরে একজন মেয়েমানুষ। হাঁটাচলা করতাছে।
মিসির আলি : সুন্দরী?
জিতু : জ্বি, খুব সুন্দর!
মিসির আলি : রান্নাঘরে তো বাতি জ্বালানো ছিল?
জিতু : জ্বি-না।
মিসির আলি : অন্ধকারে তুমি মানুষ কীভাবে দেখলে?
জিতু : নিশ্চুপ।
মিসির আলি : আমার মনে হয় জিনিসটা তুমি স্বপ্নে দেখছ।
জিতু : নিশ্চুপ।
মিসির আলি : আচ্ছা জিতু মিয়া, তুমি যাও। শোন, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এস আমার জন্যে। ক্যাপস্টান। নাও, টাকাটা নাও।
জিতু মিয়া চলে গেল। রানু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ইউনিভার্সিটির সব মাস্টাররাই কি আপনার মতো বুদ্ধিমান?’
‘না। আমার নিজের বুদ্ধি একটু বেশি। আচ্ছা, এখন যে খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে, এই শব্দটার কথাই কি আনিস সাহেব আমাকে বলেন?’
রানু জবাব দিল না। মিসির আলি কান পেতে শুনলেন।
‘শব্দটা তো বেশ স্পষ্ট। রান্নাঘর থেকে আসছে না?’
‘হুঁ।’
‘এই শব্দটার কথাই আনিস সাহেব বলেন, তাই না?’
‘বোধহয়।আপনি রান্নাঘরে দেখবেন?আপনি যাওয়ামাত্রই শব্দ থেমে যাবে।’
‘শব্দটা বেশির ভাগই রান্নাঘরে হয়?’
‘জ্বি।’
‘ইঁদুর-মরা কিছু বিষ ছড়িয়ে দিও, আর শব্দ হবে না। ওটা ইঁদুরের শব্দ। রান্নাঘরে খাবারের লোভে ঘোরাঘুরি করে। সে জন্যেই শব্দটা বেশি হয় রান্নাঘরে। বুঝলে?’
‘হুঁ।’
‘যুক্তিটা পছন্দ হচ্ছে না মনে হয়।’
‘যুক্তি ভালোই। আরেক কাপ চা খাবেন?’
‘নাহ, এখন উঠব। আনিস সাহেব মনে হয় আজ আর আসবেন না।’
‘না, আপনি আরেকটু বসুন। আপনাকেও একটা গল্প বলব।’
‘আজ আর না, রানু। মাথা ধরেছে।’
‘মাথা ধরলেও আপনাকে শুনতে হবে। বসুন, আমি চা আনছি। প্যারাসিটামল খাবেন?’
‘ঠিক আছে।’
চা আনবার আগেই আনিস এসে পড়ল। তার অফিসে নাকি কী-একটা ঝামেলা হয়েছে। দশ হাজার টাকার একটা চেকের হিসাব গণ্ডগোল। চেকটা ইস্যু হয়েছে আনিসের অফিস থেকে। আনিসের চোখে-মুখে ক্লান্তি। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি বিশ্রামটিশ্রাম করেন। আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। আমি রানুর কাছ থেকে একটা গল্প শুনব।’
‘কী গল্প?’
‘জানি না কী গল্প। ভয়ের কিছু হবে।’
রানু বলল,‘না, ভয়ের না। তুমি গোসলটোসল সেরে এসে চা খাও।’
‘আমি গল্পটা শুনতে পারব না?’
‘নাহ্। সব গল্প সবার জন্যে না।’
আনিসের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। সে কিছু বলল না। ব্যাথরুমে ঢুকে পড়ল। রানু তার গল্প শুরু করল খুব শান্ত গলায়। মিসির আলি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগলেন।
.
[ রানুর দ্বিতীয় গল্প ]
.
আমার তখন মাত্র বিয়ে হয়েছে। সপ্তাহখানেকও হয় নি। সেই সময় এক কাণ্ড হলো।
আমার বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসের ছ’ তারিখে। ঘটনাটা ঘটল শ্রাবণ মাসের চোদ্দ তারিখ।সকালবেলা আমার এক মামাশ্বশুর এসে ওকে নিয়ে গেলেন মাছ মারতে। নৌকায় করে মাছ মারা হবে। নৌকা বড় গাঙ দিয়ে যাবে সোনাপোতার বিলে। বঁড়শি ফেললেই সেখানে বড়-বড় বোয়াল মাছ পাওয়া যায়। বর্ষাকালে বোয়ালের কোনো স্বাদ নেই জানেন তো? কিন্তু সোনাপোতার বোয়ালে বর্ষাকালেই নাকি সবচেয়ে বেশি তেল হয়।
দুপুরের পর থেকেই হঠাৎ করে খুব দিন-খারাপ হলো। বিকেল থেকে বাতাস বইতে লাগল। আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।ও ওরা আর ফেরে না। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল।
আমাদের বাড়িটা হচ্ছে কাঠের। কাঠের দোতলা। আমি একা-একা দোতলায় উঠে গেলাম। দোতলায় কোণার দিকের একটা ঘরে আজেবাজে জিনিস রাখা হয়। স্টোররুমের মতো। কেউ সেখানে যায়টায় না। আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ একটি মেয়ের কথা শুনতে পেলাম। মেয়েটি খুব নিচুস্বরে বলল- সোনাপাতার বিলে ওদের নৌকা ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই ডুবেছে। এটা শোনার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
মিসির আলি বললেন, ‘এইটুকুই গল্প?’
‘হ্যাঁ।’
‘গল্পের কোনো বিশেষত্ব লক্ষ্য করলাম না।’
‘বিশেষত্ব হচ্ছে, সেদিন সন্ধ্যায় ওদের সত্যি-সত্যি নৌকাডুবি হয়েছিল। এর কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?’
‘আছে। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, কাজেই তোমার মনে ছিল অমঙ্গলের আশঙ্কা। অবচেতন মনে ছিল নৌকাডুবির কথা। অবচেতন মনই কথা বলেছে, তোমার সঙ্গে। মানুষের মন খুব বিচিত্র রানু। আমি উঠলাম।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘একতলার নীলু নামের যে মেয়েটি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে, সে আপনার জন্যে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। যাবার সময় ওর সঙ্গে আপনার দেখা হবে।’
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তাতে কি?’
রানু বলল, ‘নীলু এই মুহূর্তে কী ভাবছে তা আমি বলতে পারব।ওকে জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন আমি ঠিকই বলেছি। আমি অনেক কিছুই বলতে পারি।’
‘নীলু কী ভাবছে?’
‘নীলু ভাবছে এক জন অত্যন্ত সুপুরুষ যুবকের কথা।’
‘সেটা তো স্বাভাবিক। এক জন অবিবাহিত যুবতী এক জন সুপুরুষ যুবকের কথাই ভাবে। এটা বলার জন্যে কোনো অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দরকার হয় না, রানু।’
মিসির আলি নেমে গেলেন। নীলু সত্যি-সত্যি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সে খুব অনুরোধ করল যাতে স্যার এক কাপ চা খেয়ে যান, কিন্তু মিসির আলি বসলেন না। তাঁর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।প্যারাসিটামল কাজ করছে না। সারা জীবন তিনি এত অষুধ খেয়েছেন যে অষুধ তাঁর ওপর এখন আর কাজ করে না। খুব খারাপ লক্ষণ।

নীলুর বাবা বারান্দায় বসেছিলেন। নীলুকে বেরুতে দেখে তিনি ডাকলেন,‘নীলু কোথায় যাচ্ছ মা?’
‘একটু বাইরে যাচ্ছি।’
কিন্তু এইটুকু বলতেই নীলুর গলা কেঁপে গেল। গলা লাল হলো। তিনি তা লক্ষ্য করলেন। বিস্মিত গলায় বললেন,‘বাইরে কোথায়?’ নীলু জবাব দিল না।
‘কখন ফিরবে মা?’
‘আটটা বাজার আগেই ফিরব।’
‘গাড়ি নিয়ে যাও।’
‘গাড়ি লাগবে না। তোমার কিছু লাগবে বাবা, চা বানিয়ে দিয়ে যাব?’
‘না, চা লাগবে না। একটু সকাল-সকাল ফিরিস মা। শরীরটা ভালো না।’
‘সকাল-সকালই ফিরব।’
.
বিকেলের আলো নরম হয়ে এসেছে। সব কিছু দেখতে অন্য রকম লাগল নীলুর চোখে। নিউ মার্কেটের পরিচিত ঘরগুলোও যেন অচেনা। যেন ওদের এক ধরনের রহস্যময়তা ঘিরে আছে।
‘কেমন আছ নীলু?’
নীলূ তৎক্ষণাৎ তাকাতে পারল না। তার লজ্জা করতে লাগল। তার ভয় ছিল আজ হয়তো সে আসবে না। প্রিয়জনদের দেখা তো এত সহজে পাওয়া যায় না।
‘আজ তুমি দেরি করে এসেছ। পাঁচ মিনিট দেরি। তোমার তার জন্যে শাস্তি হওয়া দরকার।’
‘কী শাস্তি?’
‘সেটা আমার চা খেতে-খেতে ঠিক করব। খুব চায়ের পিপাসা হয়েছে।’
‘কোথায় চা খাবেন?’
‘এখানে কোথাও। আর শোন নীলু, চা খেতে-খেতে তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। খুব জরুরি কথা।’
‘এখন বলুন। হাঁটতে-হাঁটতে বলুন।’
‘নাহ্। এই কথা হাঁটতে-হাঁটতে বলা যায় না। বলতে হয় মুখোমুখি বসে। চোখের দিকে তাকিয়ে।’
নীলূর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। সে কোনোমতে বলল,‘ঠিক আছে, চলুন কোথাও বসি।’
‘কি বলতে চাই তা কি বুঝতে পারছ?’
‘নাহ্।’
‘বুঝতে পারছ, নীলু। মেয়েরা এইসব জিনিস খুব ভালো বুঝতে পারে।’
নীলুর গা কাঁপতে লাগল। অন্য এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে। অন্য এক ধরনের সুখ। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এখন আর কেউ নেই। চারিদিকে সীমাহীন শূন্যতা। শুধু তারা দুই জন হাঁটছে। হেঁটেই চলছে। কেমন যেন এক ধরনের কষ্টও হচ্ছে বুকের মধ্যে।
ওরা একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল।
‘চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে?’
‘না।’
‘খাও না! কিছু খাও।’
সে বয়কে ডেকে কী যেন বলল। নীলু শুনতে পেল না। কোনো কিছুতেই তার মন বসছে না। সব তার কাছে অস্পষ্ট লাগছে।
‘কি নীলু, কিছু বল। চুপ করে আছ কেন?’
‘কী বলব?’
‘যা ইচ্ছা বল।’
নীলূ ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি ঐ বিজ্ঞাপনটা আবার দিয়েছেন কেন?’
সে হাসল শব্দ করে।
‘দেখেছ বিজ্ঞাপনটা?’
‘হ্যাঁ।’
‘মন-খারাপ হয়েছে?’
‘নীলু কিছু বলল না।
‘বল, মন-খারাপ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
সে আবার শব্দ করে হাসল। তার পর ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি পত্রিকার অফিসে টাকা দিয়ে রেখেছিলাম। কথা ছিল প্রতি মাসে দুই বার করে ছাপাবে। তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর তার আর প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু সেটা বলা হয় নি। আগামী কাল বন্ধ করে দেব। এখন খুশি তো?’
নীলু জবাব দিল না।
‘বল, এখন তুমি খুশি? এইভাবে চুপ করে থাকলে হবে না, কথা বলতে হবে।বল, তুমি খুশি?’
‘হুঁ।’
সে আরেক দফা চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। খানিকক্ষণ দুই জনেই কোনো কথা বলল না। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবী বড় সুন্দর গ্রহ। এতে বেঁচে থাকতে সুখ আছে।
‘নীলু।’
‘হুঁ।’
‘তোমাকে যে কথাটি আমি বলতে চাচ্ছিলাম সেটি বলি?’
‘বলুন।’
‘দেখ নীল, সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও এক সময় একজন অন্যজনকে চিনতে পারে না। আবার এমনও হয়, এক পলকের দেখায় একে অন্যকে চিনে ফেলে। ঠিক না?’
নীলু জবাব দিল না।
‘বল, ঠিক না?’
‘হ্যাঁ।’
তোমাকে প্রথম দিন দেখেই….’
সে চুপ করে গেল। নীলুর চোখে জল এল।
‘নীলু, আজ যদি তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, তাহলে তোমার আপত্তি আছে?’
নীলু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।জবাব দিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে বসেছিল। সে তার চোখের জল তাকে দেখাতে চায় না।
‘বল নীলু, আপত্তি আছে?’
‘আমাকে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘আটটার আগেই আমরা বাড়ি ফিরব। এস উঠি।’
সে নীলুর হাত ধরল। ভালবাসার স্পর্শ, যার জন্যে তরুণীরা সারা জীবন প্রতীক্ষা করে থাকে।
.
*****
.
রানু আজ অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন দিন প্রায় শেষ। আকাশ লালচে হতে শুরু করেছে। সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের বারান্দায় বিলু হাঁটছে একা-একা। রানুর কেমন জানি অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। যেন কোথাও কিছু-একটা অস্বাভাবিকতা আছে, সে ধরতে পারছে না। নিচে থেকে বিলু ডাকল, ‘রানু ভাবী, চা খেলে নেমে এস, চা হচ্ছে।’
‘চা খাব না।’
‘আস না বাবা! ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার বলব। কুইক।’
রানু নেমে গেল। তার মাথায় সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। বমিবমি ভাব হচ্ছে।
বারান্দায় নীলূর বাবাও ছিলেন। ওপর থেকে তাঁকে দেখা যায় নি। তিনি নরম স্বরে বললেন, ‘এখন তুমি কেমন আছ মা?’
‘জ্বি, ভালো।’
‘আমি আনিস সাহেবকে বলেছি বড় একজন ডাক্তার দেখাতে। পিজির একজন প্রফেসর আছেন, আমার আত্মীয়, তাঁকে আমি বলে দেখতে পারি। তুমি আলাপ করো আনিসের সাথে, কেমন?’
‘জ্বি, করব।’
বিলু বলল, ঘরে গিয়ে তুমি চা খাও। তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমরা দুই জন বাগানে বসি।’ ভদ্রলোক চলে গেলেন সঙ্গে-সঙ্গে।
রানু বলল, ‘নীলু কোথায়?‘
‘ওর এক বন্ধুর বাড়ি গেছে।’
বন্ধুর বাড়ি যাওয়া এমন কোনো ব্যাপার নয়, তুব কেন জানি রানুর বুকে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল। ভোঁতা এক ধরনের যন্ত্রণা হতে লাগল মাথায়। বিলু বলল, ‘রানু ভাবী, তোমাকে একটা গোপন কথা বলছি। টপ সিক্রেট, কাউকে বলবে না।’
‘না, বলব না।’
‘ইভেন নীলু আপাকেও নয়। কারণ কথাটা তাকে নিয়েই।’
‘ঠিক আছে, কাউকে বলব না।’
‘ নীলু আপা ডুবে-ডুবে জল খাচ্ছে। আজকে সকালে টের পেয়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। নীলু আপার ট্রাঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি। জনৈক ভদ্রলোক দারুণ সব রোমান্টিক চিঠি লিখেছে নীলু আপাকে। খুব লদকালদকি।’
বিলু হাসল। রানু কিছু বলল না। তার মাথার যন্ত্রণাটা ক্রমেই বাড়ছে।
‘দু একটা চিঠি পড়ে দেখতে চাও?’
‘না, না। অন্যের চিঠি।’
‘আহ্,পড় না, কেউ তা জানতে পারছে না। আমরা ব্যাপারটা টপ সিক্রেট রাখব, তাহলেই তো হলো।’
‘না বিলু, আমি চিঠি পড়ব না।’
‘পড়ব না বললে হবে না। পড়তেই হবে। দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি। যে আলো আছে তাতে দিব্যি পড়তে পারবে।’
বিলু ঘর থেকে চিঠি নিয়ে এল। রানু চিঠিটি হাতে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিলু অবাক হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘না, কিছু হয় নি।’
‘এ রকম করছ কেন?’
‘মাথা ধরছে। বড্ড মাথা ধরছে।’
‘প্যারাসিটামল এনে দেব? তুমি চিঠিটা পড়ে আমাকে বল ভদ্রলোক সম্পর্কে তোমার কী ধারণা।’
রানু চিঠি পড়ল। বিলু বলল,‘বল, তোমার কী মনে হয়?’
রানু কিছু বলল না। এক হাতে মাথার চুল টেনে ধরল।
‘তোমার কী হয়েছে?’
‘বড্ড শরীর খারাপ লাগছে। আমি এখন যাই।’
‘চা খাবে না?’
‘না। বিলু, নীলু কখন ফিরবে-বলে গেছে?’
‘না। সন্ধ্যার আগে-আগেই ফিরবে বোধহয়। তোমার কী শরীর বেশি খারাপ লাগছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা হলে যাও, শুয়ে থাক গিয়ে।’
রানু উপরে উঠে এল। ঘর অন্ধকার। বাতি জ্বালাতে ইচ্ছে হলো না। শুয়ে পড়ল বিছানায়।আনিস আজ ফিরতে দেরি করবে। তার অফিসে কী-সব নাকি ঝামেলা হচ্ছে। রানু ডাকল, ‘জিতু মিয়া।’ কেউ সাড়া দিল না। জিতু কি বাসায় নেই? ‘জিতু-জিতু।’ কোনো উত্তর নেই। জিতু মিয়া ইদানীং বেশ লায়েক হয়েছে। রানু কিছু বলে না বলেই হয়তো বিকেলে খেলতে গিয়ে সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফেরে। বকাঝকা তার গায়ে লাগে না।
রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছে।ইঁদুর। নিশ্চয়ই ইঁদুর। তবু রানু বলল, ‘কে?’ খুটখুট শব্দ থেমে গেল। ইঁদুর ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু সেই গন্ধটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। কড়া ফুলের গন্ধ। রানুর ইচ্ছা হলো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। রানু দুর্বল গলায় ডাকল, ‘জিতু, জিতু মিয়া।’ আর তখন কে-একজন ডাকল, ‘রানু-রানু।’ এই ডাক রানুর চেনা। এই জীবনে সে অনেক বার শুনেছে। তবে এটা কিছু নয়। প্রফেসর সাহেব বলেছেন, ‘অডিটরি হেলুসিনেশন’। আসলেই তাই। এছাড়া আর কিছু নয়।
‘রানু-রানু।’
‘কে? তুমি কে?’
রানুর মনে হলো কেউ-একজন যেন এগিয়ে আসছে। তার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ছোট্ট-ছোট্ট পা নিশ্চয়ই। হালকা শব্দ। পায়ে কি নূপুর আছে? নুপুর বাজছে?
‘রানু।’
রানু চোখ বন্ধ করে ফেলল। এ সব সত্যি নয়, চোখের ভুল। রানু দুর্বল গলায় বলল, ‘তুমি কে?’
‘আমাকে তুমি চিনতে পারছ না?’
‘না।’
কিশোরীর গলায় মৃদু হাসি শোনা গেল।
‘তাকাও রানু। তাকালেই চিনবে।’
‘আমি চিনতে চাই না।’
‘তোমার বন্ধু নীলুর খুব বিপদ, রানু। এক দিন তোমার যে বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল, তার চেয়েও অনেক বড় বিপদ।’
দরজায় ধাক্কা পড়েছে। জিতু এসেছে বোধহয়।রানু তাকাল, কোথাও কেউ নেই। ফুলের গন্ধ কমে আসছে। জিতু মিয়া বাইরে থেকে ডাকল, ‘আম্মা, আম্মা।’ রানু উঠে দরজা খুলল।
‘আপনের কী হইছে?’
‘কিছু হয় নি।’
রানু এসে শুয়ে পড়ল।তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। সে বিছানায় ছটফট করতে লাগল। কখন আসবে আনিস? কখন আসবে?
‘জিতু।’
‘জ্বি।’
‘নিচে গিয়ে দেখে আয় তো-নীলু ফিরেছে নাকি।’
জিতু ফিরে এসে জানাল, এখনও আসে নি।রানু একটি নিশ্বাস ফেলে ঘড়ি দেখলো, আটটা বাজতে চার মিনিট বাকি। কখন আসবে আনিস?

দেবী – হুমায়ূন আহমেদ প্রথম পর্ব

0

প্রথম পর্ব

#দেবী – হুমায়ূন আহমেদ

🔴 এক 🔴
.
মাঝরাতের দিকে রানুর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
তার মনে হলো ছাদে কে যেন হাঁটছে। সাধারণ মানুষের হাঁটা নয়, পা টেনে টেনে হাঁটা। সে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, ‘এই, এই।’ আনিসের ঘুম ভাঙল না। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অল্প-অল্প বাতাস। বাতাসে জামগাছের পাতায় অদ্ভুদ এক রকমের শব্দ উঠছে। রানু আবার ডাকল, ‘এই, একটু ওঠ না। এই।’
‘কী হয়েছে?’
‘কে যেন ছাদে হাঁটছে।’
‘কী যে বল! কে আবার ছাদে হাঁটবে? ঘুমাও তো।’
‘প্লীজ, একটু উঠে বস। আমার বড় ভয় লাগছে।’
আনিস উঠে বসল। প্রবল বর্ষণ শুরু হলো এই সময়। ঝমঝম করে বৃষ্টি। জানালার পর্দা বাতাসে পতপত করে উড়তে লাগল। রানু হঠাৎ দেখল, জানালার শিক ধরে খালিগায়ে একটি রোগামতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটির দুটি হাতই অসম্ভব লম্বা। রানু ফিসফিস করে বলল, ‘ওখানে কে?’
‘কোথায় কে?’
‘ঐ যে জানালায়।’
‘আহ কী যে ঝামেলা কর! নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে।’
‘একটু বাতিটা জ্বালাও না।’
‘রানু তুমি ঘুমোও তো।’
আনিস শোবার উপক্রম করতেই ছাদে বেশ কয়েক বার থপাথপ শব্দ হলো। যেন কেউ-এক জন ছাদে লাফাচ্ছে।
রানু চমকে উঠে বলল, ‘কিসের শব্দ?’
‘বানর। এ জায়গায় বানর আছে। কালই তো দেখলে ছাদে লাফালাফি করছিল।
‘আমার বড় ভয় করছে। একটু উঠে গিয়ে বাতিটা জ্বালাও না। পায়ে পড়ি তোমার।’
আনিস বাতি জ্বালাল। ঘড়িতে বাজে দেড়টা। ছাদে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তবু রানুর ভয় কমল না।
সে কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।
আনিস বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এরকম করছ কেন?’
‘কেন জানি অন্য রকম লাগছে আমার। একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।’
‘কী স্বপ্ন?’
‘দেখলাম আমি যেন….
কথার মাঝখানে হঠাৎ রানু থেমে গেল। কে যেন হাসছে। ভারি গলায় হাসছে। রানু কাঁপা স্বরে বলল, ‘হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছ? কে যেন হাসছে।’
‘কে আবার হাসবে। বানরের শব্দ। কিংবা কেউ হয়তো জেগে উঠেছে দোতলায়।’
আনিস লক্ষ্য করল, রানু খুব ঘামছে। চোখ-মুখ রক্তশূণ্য। বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দেশলাই জ্বালাতে-জ্বালাতে বলল, ‘কী স্বপ্ন দেখেছিলে?’
‘দিনের বেলা বলব।’
‘কী যে সব কুসংস্কার তোমাদের! এখনো ভয় লাগছে?’
‘হ্যাঁ।
‘ভয়টা কিসের? চোর-ডাকাতের, না ভূতের?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে বাতি জ্বালানোই থাক। বাতি জ্বালিয়েই ঘুমাব আজকে। এখন বল দেখি কী স্বপ্ন দেখলে?’
‘দিনের বেলা বলব।’
‘আহ্ বল না! বললেই ভয় কেটে যাবে।’
রানু আনিসের বাঁ হাত শক্ত করে চেপে ধরল। থেমে-থেমে বলল, ‘দেখলাম, একটা ঘরে আমি শুয়ে আছি। একটা বেঁটে লোক এসে ঢুকল। তারপর দেখলাম, সে আমার শাড়ি টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে।’
আনিস শব্দ করে হাসল।
রানু বলল, ‘হাসছ কেন?’
‘হাসব না? এটা কি একটা ভয় পাওয়ার স্বপ্ন?’
‘তুমি তো সবটা শোনো নি।’
‘সবটা শুনতে হবে না। পরে কী হবে তা আমার জানা। তুমি যা দেখেছ তা হচ্ছে একটা সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি। যুবক-যুবতীরা এ রকম স্বপ্ন প্রায়ই দেখে।’
‘আমি দেখি না।’
‘তুমিও দেখ। মনে থাকে না তোমার।’
‘আমি স্বপ্ন খুব কম দেখি। যা দেখি তা সব সময় সত্যি হয়। তোমাকে তো বলেছি অনেক বার।’
আনিস চুপ করে রইল। রানু এই কথাটি প্রায়ই বলে। বিয়ের রাতে প্রথম বার বলেছিল। আনিস সেবারও হেসেছে। রানু অবাক হয়ে বলেছে, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, না?’
‘নাহ।’
‘আমি আমি আপনার গা ছুঁয়ে বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা।’
রানু এমনভাবে বলল, যেন আনিসের বিশ্বাসের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আনিস শেষ পর্যন্ত হাসি মুখে বলল, ‘ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম, এখন দয়া করে আপনি-আপনি বলবে না।’ রানু ফিসফিস করে বলল, ‘আপনার সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে, সেটাও আমি জানতাম।’
‘এটাও স্বপ্নে দেখেছিলে?’
‘হুঁ। দেখলাম, একটি লোক খালিগায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেটের কাছে একটা মস্ত কাটা দাগ। লোকটিকে দেখেই আমার মনে হলো, এর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। আমি তাকে বললাম, কেটেছে কীভাবে? আপনি বললেন, ‘সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম।’
আনিস সে রাতে দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা বলতে পারে নি। তার পেটে কেটা কাটা দাগ সত্যি-সত্যি আছে, এই মেয়েটির সেটি জানার কথা নয়। তবে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে কাটে নি। জামগাছ থেকে পিছলে পড়ে কেটেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়, বলাই বাহুল্য। মাঝে-মাঝে এমন দুই-একটা জিনিস খুব মিলে যায়। তবুও কোথায় যেন একটা ক্ষীণ অস্বস্তি থাকে।
বাইরে বৃষ্টি খুব বাড়ছে। ঝড়টর হবে বোধহয়। শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে জানালায়। একটি কাঁচ ভাঙ্গা। প্রচুর পানি আসছে ভাঙ্গা জানালা দিয়ে, শীত-শীত করছে।
‘রানু চল ঘুমিয়ে পড়ি।’
‘সিগারেট শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
বিছানায় ওঠামাত্র প্রবল শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল। বাতি চলে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। শুধু এ অঞ্চল নয়, সমস্ত ঢাকাই বোধ করি অন্ধকার হয়ে গেল। আনিস বলল, ‘ভয় লাগছে রানু?’
‘হ্যাঁ।
‘আচছা একটা হাসির গল্পটল্প কর। এতে ভয় কমে যায়। বল একটা গল্প।’
‘তুমি বল।’
আনিস দীর্ঘ সময় নিয়ে এক জন পাদ্রী ও তিনটি ইহুদি ও তিনটি মেয়ের গল্প বলল। গল্পের এক পর্যায়ে শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করতে হয়–পাদ্রী তখন কী বলল?
এর উত্তরটি হচ্ছে পাঞ্চ লাইন, কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না রানু। সে কি শুনছে না? আনিস ডাকল, ‘এই রানু, এই!’ রানু কথা বলল না। বাতাসের ঝাপটায় সশব্দে জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল। আনিস বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রানু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি যেও না। খবরদার, যেও না!’
‘কী আশ্চর্য, কেন?’
‘একটা-কিছু জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘কী যে বল!’
‘প্লীজ, প্লীজ।’
রানু কেদে ফেলল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’
‘কীসের গন্ধ?’
‘কর্পূরের গন্ধের মতো গন্ধ।’
এটা কি মনের ভুল? সু্ক্ষ্ম একটা গন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে ঘরে। ঝনঝন করে আরেকটা কাঁচ ভাঙল। রানু বলল, ‘ঐ জিনিসটা হাসছে। শুনতে পাচ্ছ না?’ বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আনিস কিছু শুনতে পেল না।
‘তুমি বস তো। আমি হারিকেন জ্বালাচ্ছি।’
‘না তুমি আমাকে ধরে বসে থাক।’
আনিস অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘তুমি ঐ জানালাটার দিকে আর তাকিও না তো!’ আনিস লক্ষ্য করল, রানু থরথর করে কাঁপছে, ওর গায়ের উত্তাপও বাড়ছে। রানুকে সাহস দেবার জন্যে সে বলল, ‘কোনো দোয়া-টোয়া পড়লে লাভ হবে? আয়াতুল কুর্সি জানি আমি। আয়াতুল কুর্সি পড়ব?’
রানু জবাব দিল না। তার চোখ বড়-বড় হয়ে উঠছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে নাকি? শ্বাস ফেলছে টেনে-টেনে।
‘এই রানু, এই।’
কোনোই সাড়া নেই। আনিস হ্যারিকেন জ্বালাল। রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। ইঁদুর, এতে সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি ভালো লাগছে না। আনিস বারান্দায় এসে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, ও রহমান সাহেব।’ রহমান সাহেব বোধহয় জেগেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন।
‘কী ব্যাপার?’
‘আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।’
আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে হলো সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র কেউ-এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রোগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, ‘রানু।’ রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, ‘কি?’
ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘এখন কেমন অবস্থা?’ রানু অবাক হয়ে বলল, ‘কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?’
রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, ‘তোমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?’
‘ভালো।’
রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘এখন আমি ভালো।’
রহমান সাহেব তবু মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, ‘আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?’
‘সে তো রোজই শুনি। বাঁদরের উৎপাত।’
‘আমিও তাই ভাবছিলাম।’
‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে-দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। নতুন এসেছেন তো! কয়েক দিন যাক টের পাবেন। বাড়িঅলাকে বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।’
‘জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন না কি এক কাপ?’
‘আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই। কোনো অসুবিধা হলে ডাকবেন।’
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, ‘এই রাত-দুপুরে ভদ্রলোককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!’
‘তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই ভদ্র লোককে ডাকলাম।’
‘কী করেছিলাম আমি?’
‘অনেক কান্ড করেছ। এখন তুমি কেমন, সেটা বল।’
‘ভালো।’
‘কী রকম ভালো?
‘বেশ ভালো।’
‘ভয় লাগছে না আর?’
‘নাহ।’
রানু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। সে বেশ সহজ ও স্বাভাবিক। ভয়ের কোনো চিহ্নও নেই চোখে-মুখে। শাড়ি কোমরে জড়িয়ে ঘরের পানি সরাবার ব্যবসা করছে।
‘সকালে যা করার করবে। এখন এসব রাখ তো।’
‘ইস, কী অবস্থা হয়েছে দেখ না!’
‘হোক, এস তো এদিকে।’
রানু হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এল।
‘এখন আর তোমার ভয় লাগছে না?’
‘না।’
‘জানালার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়েছিল বলেছিলে?’
‘এখন কেউ নেই। আর থাকলেও কিছু যায় আসে না।’
আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। হালকা গলায় বলল, ‘এক কাপ চা করতে পারবে?’
‘চা, এত রাতে!’
‘এখন আর ঘুম আসবে না, কর দেখি এক কাপ।’
রানু চা বানাতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ফোটার শব্দ হলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। রানু একা-একা রান্নাঘরে। কে বলবে এই মেয়েটিই অল্প কিছুক্ষণ আগে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল! ছাদে আবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বানর এসেছে নাকি? আনিস উঠে গিয়ে রান্না ঘরে উঁকি দিল। হালকা গলায় বলল, ছাদে বড় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে?’ রানু জবাব দিল না।
আনিস বলল, ‘এই বাড়িটা ছেড়ে দেব।’
‘সস্তায় এ রকম বাড়ি আর পাবে না।’
‘দেখি পাই কি না।’
‘চায়ে চিনি হয়েছে তোমার?’
‘হয়েছে। তুমি নিলে না?’
‘নাহ, রাত-দুপুরে চা খেলে আমার আর ঘুম হবে না।’
রানু হাই তুলল। আনিস বলল, ‘এখন বল তো তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত।’
‘কোন স্বপ্নের কথা?’
‘ঐ যে স্বপ্ন দেখলে! একটা বেঁটে লোক।’
‘কখন আবার এই স্বপ্ন দেখলাম? কী যে তুমি বল!’
আনিস আর কিছু বলল না। চা শেষ করে ঘুমুতে গেল। শীত-শীত করছিল। রানু পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো শুয়েছে। একটি হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে আনিসকে। তার ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়। জানালায় নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে। মানুষের মতোই লাগছে ছায়াটাকে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। মনে হচ্ছে মানুষটি হাত নাড়ছে। ঘরের ভেতর মিষ্টি একটা গন্ধ। মিষ্টি, কিন্তু অচেনা।
আনিস রানুকে কাছে টেনে আনল। রানুর মুখে আলো এসে পড়েছে। কী যে মায়াবতী লাগছে! আনিস ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ’ মাস। আনিস এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। প্রতি রাতেই রানুর মুখ তার কাছে অচেনা লাগে। অপরুপ রুপবতী একটি বালিকার মুখ, যাকে কখনো পুরোপুরি চেনা যায় না। আনিস ডাকল, ‘রানু, রানু।’ কোনো জবাব পাওয়া গেল না। গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন রানু। আনিসের ঘুম এল না। শুয়ে-শুয়ে ঠিক করে ফেলল, রানুকে ভাল একজন সাইকিয়াট্রিস্ট্রের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অফিসের কমলেন্দুবাবু এক ভদ্রলোকের কথা প্রায়ই বলেন, খুব নাকি গুণী লোক। মিসির সাহেব। দেখালে হয় একবার মিসির সাহেবকে।
রানু ঘুমের ঘোরে খিলখিল করে হেসে উঠল। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের হাসি শুনতে ভাললাগে না, গা ছমছম করে।
.
🔴 দুই 🔴
.
ভদ্রলোকের বাড়ি খুঁজে বের করতে অনেক দেরি হলো। কাঁঠালবাগানের এক গলির ভেতর পুরোনো ধাঁচের বাড়ি। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর অসম্ভব রোগা এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, ‘কাকে চান?’
‘মিসির সাহেবকে খুঁজছি।’
‘তাকে কী জন্যে দরকার?’
‘জ্বি, আছে একটা দরকার। আপনি কি মিসির সাহেব?’
‘হ্যাঁ। বলেন, দরকারটা বলেন।’
রাস্তায় দাড়িয়ে সমস্যার কথা বলতে হবে নাকি? আনিস অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিন্তু ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি এ রকম যে, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। আনিস বলল, ‘ভেতরে এসে বলি?’
‘ভেতরে আসবেন? ঠিক আছে আসুন।’
মিসির সাহেব যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ঘন অন্ধকার। তিন-চারটা বেতের চেয়ার ছাড়া আসবাব পত্র কিছু নেই।
‘বসুন আপনি।’
আনিস বসল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ আমার শরীরটা ভালো না। আলসার আছে। ব্যাথা হচ্ছে এখন। তাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন।’
‘আমার স্ত্রীর একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি। আপনার নাম শুনেই এসেছি।’
‘আমার নাম শুনে এসেছেন?’
‘জ্বি।
‘আমার এত নাম ডাক আছে, তা তো জানতাম না! স্পেসিফিক্যালি বলুন তো কার কাছে শুনেছেন?’
আনিস আমতা-আমতা করতে লাগল। ভদ্রলোক অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, ‘বলুন, কে বলল?’
‘আমাদের অফিসের এক ভদ্রলোক। কমলেন্দুবাবু। আপনি নাকি তার বোনের চিকিৎসা করেছিলেন।’
‘ও আচ্ছা,চিনেছি, কমলেন্দু। শোনেন, আমি ডাক্তার না, জানেন তো?’
‘জ্বি স্যার, জানি।’
‘আচ্ছা আগে এক কাপ চা খান, তারপর কথা বলব। রুগীটি কে বললেন?’ আপনার স্ত্রী?’
‘জ্বি।
‘বয়স কত?’
‘ষোল-সতের।’
‘বলেন কী! আপনার বয়স তো মনে হয় চল্লিশের মতো, ঠিক না?’
আনিস শুকনো গলায় বলল, ‘আমার সাঁইত্রিশ।’
‘এমন অল্প বয়সি মেয়েকে বিয়ে করেছেন কেন?’
এটা আবার কেমন প্রশ্ন। আনিসের মনে হলো, কমলেন্দুবাবুর কথা শুনে এখানে আসাটা ঠিক হয় নি। ভদ্রলোকের নিজেরই মনে হয় মাথার ঠিক নেই। একজন অপরিচিত মানুষকে কেউ এ রকম কথা জিজ্ঞে করে?’
‘বলুন বলুন, এ রকম অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করলেন কেন?’
‘হয়ে গেছে আর কি।’
‘বলতে চান না বোঝা যাচ্ছে। ঠিক আছে, বলতে হবে না। চা‘র কথা বলে আসি। চা খেয়ে তারপর শুরু করব।
ভদ্রলোক আনিসকে বাইরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। তারপর আর আসার নামগন্ধ নেই। আট-ন’ বছরের একটি বাচ্চা মেয়েমেয়ে এক কাপ দারুণ মিষ্টি সর-ভাসা চা দিয়ে চলে গেল। তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। দেখতে-দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । আনিস বেশ কয়েকবার কাশল। দুই বার গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘বাসায় কেউ আছেন?’ কোনো সাড়া নেই। কী ঝামেলা!
কমলেন্দুবাবু অবশ্য বারবার বলে দিয়েছেন-এই লোকের কথাবার্তার ঠিকঠিকানা নেই। তবে লোকটা অসাধারণ। আনিসের কাছে অসাধারণ কিছু মনে হয় নি। তবে চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। এইটি অবশ্য প্রথমেই চোখে পড়ে। আর দ্বিতীয় যে জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হচ্ছে তার আঙ্গুল। অস্বাভাবিক লম্বা-লম্বা তার সব ক‘টা আঙ্গুল।
‘এই যে, অকেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।’
‘না, ঠিক আছে।’
‘ঠিক থাকবে কেন? ঠিক না।’
লোকটি এই প্রথম বার হাসল। থেমে-থেমে বলল, ‘আলসার আছে তো, ব্যথায় কাহিল হয়ে শুয়েছিলাম। অমনি ঘুম এসে গেল।’
‘আমি তাহলে অন্য একদিন আসি?’
‘না, এসেছেন যখন বসুন। চা দিয়েছিল?’
‘জ্বি।’
‘বেশ, এখন বলুন কী বলবেন?’
আনিস চুপ করে রইল। এটা এমন একটা ব্যাপার, যা চট করে অপরিচিত কাউকে বলা যায় না। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনার স্ত্রীর মাথার ঠিক নেই, তাই তো?’
‘জ্বি-না স্যার, মাথা ঠিক আছে।’
‘পাগল নন?’
‘জ্বি-না।’
‘তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?’
‘মাঝে-মাঝে সে অস্বাভাবিক আচরণ করে।’
‘কী রকম অস্বাভাবিক?’
‘ভয় পায়। মাঝে-মাঝেই এ রকম হয়।’
‘ভয় পায়? তার মানে কী? কিসের ভয়?’
‘ভূতের ভয়।’
‘ঠিক জানেন ভয়টা ভূতের?’
‘জ্বি-না, ঠিক জানি না। মনে হয় এ রকম।’
ভদ্রলোক একটি চুরুট ধরিয়ে খকখক করে কাশতে-কাশতে বললেন, ‘বর্মা থেকে আমার এক বন্ধু এনছে, অতি বাজে জিনিস।’ আনিস কিছু বলল না। তবে এই ভদ্র লোকের স্টাইলটি তার পছন্দ হলো। ভদ্রলোক অবলীলায় অন্য একটি প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এবং এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আগের কথাবার্তা তাঁর কিছুই মনে নেই।
‘এ রকম চুরুট চার-পাঁচটা খেলে যক্ষ্মা হয়ে যাবে। আপনাকে দেব একটা?’
‘জ্বি-না।’
‘ফেলে দিলে মায়া লাগে বলে খাই। খাওয়ার জিনিস না। অখাদ্য। তবে হাভানা চুরুটগুলি ভালো হয়। হাভানা চুরুট খেয়েছেন কখনো?’
‘জ্বি-না।
‘খুব ভালো। মাঝে-মাঝে আমার এক বন্ধু আমাকে দিয়ে যায়।’
ভদ্রলোক চুরুটে টান দিয়ে আবার ঘর কাঁপিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামতেই বললেন, ‘এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। যথাযথ উত্তর দেবেন।
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘প্রথম প্রশ্ন, আপনার স্ত্রী কি সুন্দরী?’
‘জ্বি।’
‘বেশ সুন্দরী?’
‘জ্বি।’
‘আপনার স্ত্রী কখন ভয় পান-রাতে না দিনে?’
‘সাধারণত রাতে। তবে একবার দুপুরে ভয় পেয়েছিল।’
‘ভয়টা কী রকম সেটা বলেন।’
‘মনে হয় কিছু-একটা দেখে।’
‘সব বার কি একই জিনিস দেখে না একেক বার একেক রকম?’
‘এটা আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘এই সময় তিনি কি কোনো রকম গন্ধ পান?’
‘আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘যখন সুস্থ হয়ে ওঠেন তখন কি তাঁর ভয়ের কথা মনে থাকে?’
‘বেশিরভাগ সময়ই থাকে না, তবে মাঝে-মাঝে থাকে।’
‘আপনার স্ত্রীর স্বাস’্য নিশ্চই খারাপ।’
‘জ্বি।
‘উনি প্রথম কখন ভয় পেয়েছিলেন, বলতে পারেন?’
‘জ্বি-না। তবে খুব ছোটবেলায়।
‘প্রথম ভয়ের ঘটনাটা আমাকে বলুন।’
‘আমি সেটা ঠিক জানি না।’
‘আপনি অনেক কিছুই জানেন না মনে হচ্ছে। আপনার স্ত্রীকে একদিন নিয়ে আসুন।’
আনিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি তাকে আনতে চাই না।’
‘কেন চান না?’
‘সে খুব সেনসিটিভ। সে যদি টের পায় যে, তার অস্বাভাবিকতা নিয়ে আমি লোকজনের সাথেঘ আলাপ করছি, তাহলে খুব মন-খারাপ করবে।’
‘দেখুন ভাই, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা না-বলে কিছুই করা যাবে না। আপনার স্ত্রী অসুস্থ এবং আমার মনে হচ্ছে এই অসুখ দ্রুত বেড়ে যাবে। আপনি তাঁকে নিয়ে আসবেন।’
আনিস উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আপনাকে কত দেব?’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কমলেন্দবাবু কি আপনাকে বলেন নি আমি ফিস নিই না? এই কাজটি আমি শখের খাতিরে করি, বুঝতে পারছেন?’
‘জ্বি পারছি।’
‘তবে আপনি যদি ভালো গোলাপের চারা পান, তাহলে আমাকে দিতে পারেন। আমার গোলাপের খুব শখ। সব মিলিয়ে ত্রিশটি ডিফারেন্ট ভেরাইটির চারা আমার কাছে আছে। একটা আছে দারুন ইন্টারেস্টিং, ঘাসফুলের মতো ছোট সাইজের গোলাপ।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। ওরা বলে মাইক্রো রোজ। হল্যান্ডের গোলাপ। কড়া গন্ধ। দেখবেন?’
‘আরেক দিন দেখব। আজ দেরি হয়ে গেছে, আমার স্ত্রী একা থাকে।’
‘ও, তাই নাকি? শোনেন, একা তাকে রাখবেন না। কখনো যেন মেয়েটি একা না থাকে। এটা খুবই জরুরি।’
রাস্তায় নেমে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। খামোকা সময় নষ্ট। লোকটি তেমন কিছুই জানে না। কমলেন্দুবাবু যে সব আধ্যাত্মিক শক্তিটক্তির কথা বলেছেন, সে সব মনে হয় নেহায়েতই গালগল্প। তবে লোকটির কথাবার্তা বেশ ফোর্সফুল। রানুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এক বার এনে দেখালে হয়। ক্ষতি তো কিছু নেই।
তাছাড়া ভদ্রলোক খুব সম্ভব ফ্যালনাও নন। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির টীচার। একেবারে কিছু না-জেনে তো কেউ মাষ্টারি করে না। কিছু নিশ্চই জানেন। মানুষের চেহারা দেখে কিছু অনুমান করাটাও ঠিক না।
.
🔴 তিন 🔴
.
আনিস অফিসে চলে গেলে রানুর খুব একলা লাগে। কিছুই করার থাকে না। গোছানো আলনা আবার নতুন করে গোছায়। বসার ঘরের বেতের সোফা ঝাড়ন দিয়ে ঝাড়ে। শোবার মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে-মুছতে চকচকে করে ফেলে, তবু সময় কাটে না। এক সময় তেতলার বারান্দায় গিয়ে বসে। এ-বাড়ির ছোট বারান্দাটি তাঁর খুব পছন্দ। গ্রিল দেওয়া বারান্দাটি গোলাকার। এখানে বসে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনেই একটা মেয়েদের স্কুল। টিফিন টাইমে মেয়েগুলোর কান্ডকারখানা দেখতে এমন মজা লাগে! রানু প্রায় সারা দুপুর বারান্দাতেই বসে থাকে। একা-একা ঘরে বসে থাকতে ভারো লাগে না। কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটু যেন ভয়ভয়ও লাগে।
অবশ্য যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে থাকে, তখন ভয়ভয় ভাবটা কমে যায়। বিকেলবেলা বাড়িঅলার মেয়ে ুদটি তাদের ভেতরের দিকের বাগানে বসে মজা করে চা খায়। চা খেতে-খেতে দুইজনেই খুব হাসাহাসি করে। একেক দিন ওদের বাবাও সঙ্গে বসেন, রানুর দেখতে বেশ লাগে।
ছোট মেয়েটির সঙ্গে রানুর কিছু দিন আগে আলাপ হয়েছিল। বেশ মেয়েটি! খুব স্মার্ট। দেখতেও সুন্দর। একদিন দুপুরে রানু বারান্দায় এসে বসেছে, মেয়েটি এসে উপস্থিত। মুখে চাপা হাসি। হাতে কী-একটা বই। এসেই বলল, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।’
‘কি কথা?’
‘আপনি সারাদিন বারান্দায় বসে থাকেন কেন?’
‘সারাদিন কোথায়? দুপুরবেলায় বসি। কিছু করার নেই তো, একা একা লাগে।’
‘তা ঠিক। বসব আপনার এখানে? আজ আমি কলেজে যাই নি। বোটানি প্র্যাকটিক্যাল ছিল আজকে।’
মেয়েটি খুব সহজভাবে বসল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে একগাদা কথা বলল। তারপর যাবার সময় হঠাৎ বলল, ‘আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘কর।’
‘আপনি এত সুন্দর কেন? যে আমার চেয়ে সুন্দরী, তাকে আমার ভালো লাগে না।
রানু কী বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটি হাসতে-হাসতে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি ধারণা, জানেন? তাদের ধারণা, আমি হচ্ছি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। ওদের এক দিন এনে আপনাকে দেখিয়ে দেব।
‘ঠিক আছে, দিও। আরেকটু বস। চা খাবে?’
‘না আমি চা বেশি খাই না। বেশি চা খেলে গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যায়।’
মেয়েটি যেমন হুট করে এসেছিল, তেমনি হুট করে নিচে নেমে গেল। বেশ লাগল রানুর। মালিবাগের বাসাটার মতো নয়। নিঃশ্বাস নেবার জায়গা ছিল না সেখানে। পাশ দিয়ে রাত-দিন রিকশা যাচ্ছে, গাড়ি যাচ্ছে। প্রথম দিনেই আনিসকে বলেছেন, ‘আমার বাড়ি ভাড়া দেবার দরকার নেই। টাকার জন্যেই তো বাড়ি ভাড়া। টাকা যথেষ্ট আছে। তবু দুই ঘর ভাড়াটে রাখি। কারণ এত বড় বাড়িতে মানুষ না-থাকলে ভালো লাগে না। কবরখানা-কবরখানা ভাব চলে আসে। তবে সবাইকে আমি বাড়ি ভাড়া দিই না। আপনাকে দিচ্ছি, কারণ আপনাকে পছন্দ হয়েছে।
ভাড়াও খুব কম। মাত্র ছয় শ’ টাকা। তিন-রুমের এত বড় একটা বাড়ি ছয় শ’ টাকায় পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রানু এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে বাথরুম। বড় ঝকঝকে একটা বাথরুম। বাসাটা রানুর খুব পছন্দ হয়েছিল। আনিস যখন বলল, ‘কি, নেব? পছন্দ হয়?’
‘হয়।’
‘ভালো করে ভেবে বল নেব কি না। দুই দিন পর যদি বল পছন্দ না, তাহলে মুশকিলে পড়ব। মালিবাগের বাসাটা ভালো ছিল। শুধু-শুধু বদলালাম।’
‘এই বাসাটাও ভালো।’
রানু খুব খুশি মনে নতুন বাসা সাজাল। নিজেই পরদা কিনে আনল, সারা রাত জেগে সেলাই করল। তার উৎসাহের সীমা নেই।
‘বুঝলে রানু, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। অন্যদের বাসা যা-েটাবে। একা-একা থাকার অভ্যেসটা ভালো না। যাবে তো?’
‘যাব।’
‘একা থাকলেই মানুষের মধ্যে নানান রকম প্রবলেম দেখা যায়, বুঝলে? সব ভাড়াটেদের সঙ্গে খাতির রাখবে।’
‘ভাড়াটে তো মাত্র এক জন।’
‘ঐ ওনার বাসাতেই যাবে। বাড়িঅলার বাসায়ও যাবে।’
‘আচ্ছা, যাব।’
রানু অবশ্যি যায় নি কোথাও। তাঁর ভালো লাগে না। অন্যদের মতো সে কারো সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে না। অন্যদের সামনে কেমন যেন আড়ষ্ট লাগে। বারান্দার বেতের চেয়ারটাতে বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগে। দুপুরটাই যা কষ্টের। দুপুরটা কেটে গেলেই অন্যরকম একটা শান্তি লাগে। কিন্তু আজকের দুপুরটা দীর্ঘ। কিছুতেই আর কাটছে না। বারান্দায় বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। মেয়েদের স্কুলটাও কী কারনে যেন বন্ধ। চারদিকে চুপচাপ। বড্ড ফাঁকা। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে কেমন হয়?
ঘরের ভেতরটা কেমন যেন অন্য রকম। রানু ভেতরে ঢুকে জানালার পর্দা ফেলে দিল। অনেকখানি অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকার ও চুপচাপ। আর তখন স্পষ্ট গলায় কেউ ডাকল, ‘রানু, রানু।’ কয়েক মূহুর্ত রানু নড়ল না। অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু যে ডেকেছে সে দ্বিতীয়বার আর ডাকল না।
রানুর এ রকম চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে এক জন অশরীরী কেউ তাকে ডেকে ওঠে। অসংখ্যবার শুনেছে এই ডাক। কে সে! কোত্থেকে আসে সে! রানু ফিসফিস করে বলল, ‘কে?’ কোনো জবাব পাওয়া গেল না।
‘কে তুমি?’
জানালার পরদাটা শুধু কাঁপছে। বিকেল হয়ে আসছে। রানু ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের বাগানে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি হাঁটছে। নীলু বোধহয় ওর নাম। এই মেয়েটি তার বোনের মতো নয়। গম্ভীর। কথাবার্তা প্রায়ই বলেই না। তবুও ওকে দেখলেই রানুর মনে হয়-মেয়েটি বড় ভালো। মায়াবতী মেয়ে।
রানু দেখল-বিষণ্ন ভঙ্গিতে মেয়েটি একা-একা বসে আছে। তার ইচ্ছা হল নিচে নেমে ওর সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু সে গেল না।
.
🔴 চার 🔴
.
নীলু দুই বার বিজ্ঞাপনটা পড়ল। বেশ একটা মজার বিজ্ঞাপন।
কেউ কি আসবেন?
আমি এক নিঃসঙ্গ মানুষ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা জীবন-
যাপন করছি। সময় আর কাটে না। আমার দীর্ঘ দিবস ও দীর্ঘ
রজনীর নিঃসঙ্গতা কাটাতে কেউ আমাকে দুই লাইন লিখবেন?
জিপিও বক্স নাম্বার ৭৩
দৈনিক পত্রিকায় এ রকম বিজ্ঞাপন দেবার মানে কী? সাপ্তাহিক কাগজগুলিতে এই সব থাকে; ছেলেছোকরাদের কান্ড। এই লোকটি নিশ্চই ছেলেছোকরা নয়। বুড়ো-হাবড়াদের একজন।
‘বাবা, এইটা পড়েছ?’
নীলু জাহিদ সাহেবের হাতে কাগজটা গুঁজে দিল।
‘বাবা, এই বিজ্ঞাপনটা পড় তো!’
জাহিদ সাহেব নিজেও ভ্রু কুঞ্চিত করে দুই বার পড়লেন। তাঁর মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল বেশ বিরক্ত হয়েছেন।
‘পড়েছ?’
‘হুঁ, পড়লাম।
‘কী মনে হয় বাবা?’
‘কী আবার মনে হবে? কিছুই মনে হয় না। দেশটা রসাতলে যাচ্ছে। খবরের কাগজঅলারা এইসব ছাপে কীভাবে?’
নীলু হাসিমুখে বলল, ‘ছাপাবে না কেন?’
‘দেশটা বিলাত-আমেরিকা নয়, বুঝলি? আর ভালো করে পড়লেই বোঝা যায়, লোকটার একটা বদ মতলব আছে।’
‘কই, আমি তো বদ মতলব কিছু বুঝছি না।’
জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দেখিস, তুই আবার চিঠি লিখে বসবি না।’
নীলু মুখ নিচু করে হাসল।
‘হাসছিস কেন?’
‘এমনি হাসছি।’
‘চিঠি লিখবার কথা ভাবছিস না তো মনে-মনে?’
‘উঁহু।’
নীলু মুখে উঁহু বললেও মনে-মনে ঠিক করে ফেলল, গুছিয়ে একটা চিঠি লিখবে। দেখা যাক না কী হয়। কী লেখে লোকটি।
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সে সত্যি সত্যি একটা চিঠি লিখে ফেলল। মোটামুটি বেশ দীর্ঘ চিঠি।
জনাব,
আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। লিখলাম কয়েক লাইন।
এতে কী আপনার নিঃসঙ্গতা কাটবে? আমার বয়স আঠার।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমরা দু’ বোন। আমার
ছোট বোনটির নাম বিলু। সে হলিক্রস কলেজে পড়ে। আমরা
দু’ বোনই খুব সুন্দরী। এই যা, এটা আপনাকে লেখা ঠিক হল না।
তাই না? নাকি সুন্দরী মেয়েদের চিঠি পেলে আপনার নিঃসঙ্গতা দ্রুত কাটবে?
নীলু চিঠিটি লিখেই তার মনে হলো যে, এ রকম লেখাটা ঠিক হচ্ছে না। চিঠির মধ্যে একটা বড় মিথ্যা আছে। সে সুন্দরী নয়। বিলুর জন্য কথাটা ঠিক, তার জন্যে নয়। নীলু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখল।
জনাব,
আমার নাম নীলু। আমার বয়স কুড়ি। আপনার নিঃসঙ্গতা
কাটাবার জন্যে আপনাকে লিখছি। কিন্তু চিঠিতে কি কারো
নিঃসঙ্গতা কাটে? আপনার বয়স কত, এটা দয়া করে জানাবেন।
নীলু
দ্বিতীয় চিঠিটিও তার পছন্দ হলো না। তার মনে হলো, সে যেন কিছুতেই গুছিয়ে আসল জিনিসটি লিখতে পারছে না। রাতে শুয়ে-শুয়ে তার মনে হলো, হঠাৎ করে সে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন? চিঠি লেখারই-বা কী দরকার?
সে নিজেও কি খুব নিঃসঙ্গ? হয়তো-বা। এ বাড়িতে আর দুটি মাত্র প্রাণী। বিলু আর বাবা। বাবা দিন-রাত নিজের ঘরেই থাকেন। মাসের প্রথম দিকের কয়েকটা দিন বাড়িভাড়ার টাকা আদায়ের জন্যে অল্প যা নড়াচড় করেন। তারপর আবার নিজের ঘরেই বন্দি। আর বিলু তো আছে তার অসংখ্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে। শুধু মেয়ে বন্ধু নয়, তার আবার অনেক ছেলেবন্ধুও আছে।
মহানন্দে আছে বিলু। তবে সে একটু বাড়াবাড়ি করছে। কাল তার কাছে একটি ছেলে এসেছিল, সে রাত আটটা পর্যন্ত ছিল। এ সব ভালো নয। নীলু উঁকি দিয়ে দেখেছে, ছেলেটি ফরফর করে সিগারেট টানছে। হাত নেড়ে-নেড়ে কথা বলছে। আর বীলু হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ছে। ভাত খাওয়ার সময় নীলু কিছু বলবে না বলবে না করেও বলল, ‘ছেলেটা কে রে?’
‘কোন ছেলে?’
‘ঐ যে রাত আটটা পর্যন্ত গল্প করলি?’
‘ও, সে তো রুবির ভাই! মহাচালবাজ। নিজেকে খুব বু্দ্িধমান ভাবে, আসলে মহা গাধা।’
বলতে বলতে খিলখিল করে হাসে বিলু।
‘মহা গাধা হলে এতক্ষণ বসিয়ে রাখলি কেন?’
‘যেতে চাচ্ছিল না তো কী করব?’
বলতে বলতে বীলু আবার হাসল। বীলু এমন মেয়ে, যার উপর কখনো রাগ করা যায় না। নীলু কখনো রাগ করতে পারে না। মাঝে-মাঝে বাবা দুই-একটা কড়া কথা বলেন। তখন বিলু রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। সে এক মহা যন্ত্রনা! একবার রাগ করে সে পুরো দুদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিল। কত সাধাসাধি, কত অনুরোধ! শেষ পর্যন্ত মগবাজারের ছোট মামাকে আনতে হলো। ছোটমামা বিলুর খাতিরের মানুষ। তাঁর সব কথা সে শোনে। তিনি এসে যখন বললেন, ‘দরজা না খুললে মা আমি কিন্তু আর আসব না। এই আমার শেষ আসা-’ তখন দরজা খুলল। এ রকম জেদী মেয়ে।
নীলুর কোনো জেদ-টেদ নেই। কালো এবং অসুন্দরী মেয়েদের জে কখনো থাকে না। এদের জীবন কাটাতে হয় একাকী। নীলু বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করল। ছোটবেলায় বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম আসত, এখন আর আসে না । অনেক রাত পর্যন্ত এপাশ-ওপাশ করতে হয়। পাশের খাটে টেবিল-ল্যাম্প জ্বালিয়ে চোখের ওপর একটা গল্পের বই ধরে আছে বিলু। অনেক রাত পর্যন্ত সে পড়বে। পড়তে-পড়তে হঠাৎ এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে, বাতি নেভাবে না। মশারি ফেলবে না। নীলুকেই উঠে এসে বাতি নেভাতে হবে, মশারি ফেলতে হবে।
‘বিলু ঘুমো, বাতি নেভা।’
‘একটু পরে ঘুমাব।’
‘কী পড়ছিস?’
‘শীর্ষেন্দুর একটা বই। দারুন!’
‘দিনে পড়িস। আলো চোখে লাগছে।’
‘দিনে আমার সময় কোথায়? তুমি ঘুমাও-না!’
নীলু ঘুমাতে পারল না। শুয়ে-শুয়ে তাকিয়ে রইল বিলুর দিকে। দিনে-দিনে কী যে সুন্দর হচ্ছে মেয়েটা! একই বাবা-মার দুই মেয়ে-একজন এত সুন্দর আর অন্যজন অসুন্দর কেন? নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
‘আপা?’
‘কী?’
‘দারুন বই, তুমি পড়ে দেখ।’
‘প্রেমের?’
‘হ্যাঁ। প্রেমের হলেও খুব সিরিয়াস জিনিস। দারুণ!’
‘তাই নাকি?’
‘হুঁ, একজন খুব রুপবতী মেয়ের গল্প।’
‘তোর মতো একজন?’
‘দুর, আমি সুন্দর নাকি? আমাদের তিনতলার ভাড়াটের বৌটির মতো বলতে পার। রানু নাম, দেখেছ।’
‘না তো, খুব সুন্দরী?’
‘ওরে ব্বাপ, দারুণ! হেমা মালিনীর চেয়েও সুন্দরী।’
‘তুই মেয়েটিকে একবার আসতে বলিস তো আমাদের বাড়িতে! দেখব।’
‘বলব। তুমি নিজে একবার গেলেই পার। মেয়েটা ভালো। কথাবার্তায় খুব ভদ্র। ওর বরকে দেখেছ, আনিস সাহেব?’
‘হুঁ।
‘ঐ লোকটা বোকা ধরণের। বোকার মতো কথাবার্তা। আমাকে আপনি-আপনি করে বলে।
‘কলেজে পড়িস, তোকে আপনি বলবে না?’
‘ফ্রক-পরা কাউকে এ রকম এক জন বুড়ো মানুষ আপনি বলবে নাকি?’
‘বুড়ো নাকি?’
‘চল্লিশের ওপর বয়স হবে।’
‘মেয়েটার বয়স কত হবে?’
‘খুব কম। চৌদ-পনের বছর হবে।’
বিলু বাতি নিভিয়ে দিল এবং নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়ল। নীলু জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্ত। কিছুতেই তার ঘুম এল না। ইদানীং তার ঘুম খুব কমে গেছে। রোজই মাঝরাত না হওয়া অবধি ঘুম আসে না।
রানু চুলায় ভাত চড়িয়ে বসার ঘরে এসে দেখে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি ঘরের ভেতর।
‘না জিজ্ঞেস করেই ঢুকে পড়লাম ভাই। আমার নাম নীলু।
‘আসুন, আসুন। আপনাকে আমি চিনি। আপনি বাড়িঅলার বড় মেয়ে। আজ ইউনিভার্সিটিতে যান নি?’
‘উঁহু। আজ ক্লাস নেই। আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। কী করছিলেন?’
‘ভাত রান্না করছি।’
‘চলুন, রান্নাঘরে গিয়ে বসি। বিলুর কাছ থেকে আপনার খুব প্রশংসা শুনি।
বিলুর ধারণা, আপনি হচ্ছেন হেমা মালিনী।
রানু অবাক হয়ে বলল, ‘হেমা মালিনীটি কে?’
‘আছে একজন। সিনেমা করে। সবাই বলে খুব সুন্দর। আমার কাছে সুন্দর লাগে না। চেহারাটা অহঙ্কারী।’
রানু মুখ টিপে হাসতে-হাসতে বলল, ‘সুন্দরী মেয়েরা তো অহঙ্কারীই হয়।’
‘আপনিও অহঙ্কারী?’
রানু হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে আপনি আপনি বলতে পারবেন না। তুমি করে বলতে হবে।
নীলু লক্ষ্য করল মেয়েটি বেশ রোগা কিন্তু সত্যিই রুপসী। সচরাচর দেখা যায় না। চোখ দুটি কপালের দিকে ওঠান বলে-দেবী প্রতিমার চোখের মতো লাগে। সমগ্র চেহারায় খুব সুক্ষ্ম হলেও কোথাও যেন একটি মূর্তি-মূর্তি ভাব আছে।
‘কী দেখছেন?’
‘তোমাকে দেখছি ভাই। তোমার চেহারায় একটা মূর্তি-মূর্তি ভাব আছে।’
রানু মুখ কালো করে ফেলল। নীলু অবাক হয়ে বলল, ‘ও কী! তুমি মনে হয় মন-খারাপ করলে?’
‘না, মন-খারাপ করব কেন?’
‘কিন্তু মুখ কালো করলে কেন? আমি কিন্তু কমপ্লিমেন্ট হিসেবে তোমাকে বলেছি। তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি খুব বেশি দেখি নি। তবে এক বার একটি বিহারি মেয়েকে দেখেছিলাম। আমার ছোটমামার বিয়েতে। অবশ্যি সে মেয়েটি তোমার মতো রোগা ছিল না। ওর স্বাস’্য বেশ ভালো ছিল।
‘আপনি কি একটু চা খাবেন?’
‘তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? তোমার কি মনে হয় আমার বয়স অনেক বেশি?’
‘না, তা মনে হয় না।’
‘তুমিও আমাকে তুমি বলবে। আর তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি মাঝে-মাঝে তোমার কাছে আসব।’
রানু চায়ের কাপ সাজাতে সাজাতে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমাকে মূতি-মূর্তি লাগে, এটা বললে কেন?
নীলু অবাক হয়ে বলল, ‘এমনি বলেছি! টানাটানা চোখ তো, সে জন্যে। তুমি দেখি ভাই রাগ করেছ।’
‘একটা কারণ আছে নীলু। তোমাকে এক দিন আমি সব বলব, তাহলেই বুঝবে। চায়ে কতটুকু চিনি খাও?’
‘তিন চামচ।’
নীলু অনেকক্ষণ বসল, কিন্তু কথাবার্তা আর তেমন জমল না। রানু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। কিছুতেই মন লাগাতে পারছে না। সহজ হতে পারছে না। নীলু বেশ কয়েক বার অন্য প্রসঙ্গ আনতে চেষ্টা করল। ভাসা-ভাসা জবাব দিল রানু। এবং একসময় হালকা স্বরে বলল, ‘আমার একটা অসুখ আছে নীলু।’
‘কী অসুখ?’
‘মাঝে-মাঝে আমি ভয় পাই।’
‘ভয় পাই মানে?’
রানু মাথা নিচু করে বলল, ‘ছোট বেলায় একবার নদীতে গোসল করতে গিয়েছিলাম, তারপর থেকে এরকম হয়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
রানু জবাব দিল না।
‘বল, কী হয়েছে?’
‘অন্য একদিন বলব। আজ তুমি তোমার কথা বল।’
‘আমার তো বলার মতো তেমন কথা নেই।’
‘তোমার বন্ধুদের কথা বল।’
‘আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই। আমি বলতে গেলে একা-একা থাকি। অসুন্দরী মেয়েদের বন্ধুটন্ধু থাকে না।
‘রঙ খারাপ হলে মানুষ অসুন্দর হয় না নীলু।’
‘আমি নিজে কী, সেটা আমি ভালোই জানি।’
নীলু উঠে পড়ল। রানু বলল, ‘আবার আসবে তো?’
‘আসব। তুমি তোমার ভয়ের কথাটথা কি বলছিলে, সেই সব বলবে।’
‘বলব।’
.
*****
.
নীলু পাঠাবে না পাঠাবে না করেও চিঠিটি পাঠিয়ে দিল, কিন্তু তার পরপরই দুশ্চিন্তার সীমা রইল না। কে জানে, বুড়ো-হাবরা লোকটি একদিন হয়তো বাসায় এসে হাজির হবে। দারুণ লজ্জার ব্যাপার হবে সেটা। নিতান্তই ছেলেমানুষি করা হয়েছে। চা-পাঁচদিন নীলুর খুব খারাপ কাটল। দারুণ অস্বস্তি। বুড়োমতো কোনো মানুষকে আসতে দেখলেই চমকে উঠত, এটিই সেই লোক নাকি? যদি সত্যি-সত্যি কেউ এসে পড়ে, তাহলে সে ভেবে রেখেছে বলবে-এই চিঠি তো আমার নয়। অন্য কেউ তামাশা করে এই ঠিকানা দিয়েছে। আমি এ রকম অজানা-অচেনা কাউকে চিঠি লিখি না।
কেউ অবশ্যি এল না। দেখতে-দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। চিঠিরও কোনো উত্তর নেই। লোকটি হয়তো চিঠি পায় নি। ডাকবিভাগের কল্যানে আজকাল তো বেশির ভাগ চিঠিই প্রাপকের হাতে পৌছায় না। এতে ক্ষতি যেমন হয়, লাভও তেমনি হয়। কিংবা হয়তো এমন হয়েছে, ঐ লোকটি অসংখ্য চিঠি পেয়ে পছন্দমতো চিঠিগুলোর উত্তর দিয়েছে। নীলুর তিন লাইনের চিঠি তার পছন্দ হয় নি। সে হয়তো লম্বা-লম্বা চমৎকার চিঠি পেয়েছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কিছু লেখা সব চিঠিতে।
দশ দিনের মাথায় নীলুর কাছে চিঠি এসে পড়ল। খুবই দামী একটা খামে চমৎকার প্যাডের কাগজে চিঠি। গোটা-গোটা হাতের লেখা। কালির রঙ ঘন কালো। মাখন-রাঙা সে কাগজে লেখাগুলো মুক্তার মতো ফুটে আছে। এত সুন্দর হাতের লেখাও মানুষের হয়! চিঠিটি খুবই সংক্ষিপ্ত।
কল্যাণীয়াসু
তোমার চমৎকার চিঠি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। একজন ব্যথিত
মানুষের আবেদনে তুমি সাড়া দিয়েছ-তোমাকে ধন্যবাদ। খুব সামান্য
একটি উপহার পাঠালাম। প্লীজ, নাও।
আহমেদ সাবেত
উপহারটি সামান্য নয়। অত্যন্ত দামী একটি পিওর পারফিউমের শিশি। নীলু ভেবে পেল না, এই লোকটি কি সবাইকে এ রকম একটি উপহার পাঠিয়েছে? যারাই চিঠির জবাব দিয়েছে তারাই পেয়েছে? কিন্তু তাও কি সম্ভব?
নাকি নীলু একাই চিঠির জবাব দিয়েছে? নীলুর বড় লজ্জা করতে লাগল। সে পারফিউমের শিশিটি লুকিয়ে রাখল এবং খুব চেষ্টা করতে লাগল সমস্ত ব্যাপার ভুলে যেতে। সে চিঠিটি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিল জানালা দিয়ে। কেন এমন একটা বাজে ঝামেলায় জড়াল?
কিন্তু দিন সাতেক পর নীল আবার একটি চিঠি লিখল। একটি বেশ দীর্ঘ চিঠি। সেখানে শেষের দিকে লেখা – আপনি কে, কী করেন-কিছুই তো জানা নি। আপনার বিজ্ঞাপনটিও দেখছি না। তার মানে কি এই যে আপনার নিঃসঙ্গতা এখন দূর হয়েছে?
নীলু বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করল চিঠির জবাবের জন্যে, কিন্তু কোনো জবাব এল না। কেন জানি নীলুর বেশ মন-খারাপ হল। আরেকটি চিঠি লেখার ইচ্ছা হতে লাগল, কিন্তু তাও কি হয়? একা-একা সে শুধু চিঠি লিখবে? তার এত কী পড়েছে?
.
🔴 পাঁচ 🔴
.
দুপুর-রাতে আনিসের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়াল অভ্যেসমতো। পাশে কেউ নেই। আনিস ডাকল, ‘রানু, রানু।’ কোনো সাড়া নেই। বাথরুম থেকে একটানা পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বাথরুমে নাকি? আনিস উঁকি দিল বাথরুমে-কেউ নেই। কোথায় গেল! আনিস গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘রানু। বসার ঘর থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দ এল। বসার ঘর অন্ধকার। রানু কি সেখানে একা-একা বসে আছে নাকি?
আনিস বসার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলেই সঙ্গে-সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলল। রানু বসার ঘরে ছোট টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই।
‘এই রানু।’
‘উঁ।
‘কী হয়েছে? তোমার কাপড় কোথায়?’
‘খুলে ফেলেছি। বড্ড গরম লাগছে।’
আনিস এসে রানুর হাত ধরল। হিমশীতল হাত। একটু-একটু যেন কাঁপছে।
‘এস রানু, ঘুমুতে যাই।
‘আমার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।’
‘কাল আমরা একজন ডাক্তারের কাছে যাব, কেমন?’
‘কেন?’
‘তোমার শরীর ভালো না রানু।’
‘আমার শরীর ভালোই আছে।’
‘না, তুমি খুব অসুস্থ। এস আমার সঙ্গে। কাপড় পরে ঘুমুতে এস।
রানু কোনো আপত্তি করল না। সঙ্গে-সঙ্গেই উঠে এল। কাপড় পরল এবং বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় শুয়ে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে রইল আনিস। রানুর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আগে তো এরকম কখনো হয় নি! মিসির আলি-টালি নয়, বড় কোনো ডাক্তারকে দেখানো দরকার।
খুটখুট করে শব্দ হচ্ছে রান্না ঘরে। ইঁদুরের উপদ্রব। তবু কেন জানি শব্দটা অন্য রকম মনে হচ্ছে। যেন কেউ হাঁটছে রান্নাঘরে। থপ্থপ্ শব্দও হলো কয়েক বার। আনিস বলল, ‘কে?’ রান্নাঘরের শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। আনিস বলল, ‘কে? কে?’ মনের ভুল নাকি? আনিস যেন স্পষ্ট শুনল, রান্নাঘর থেকে কেউ-এক জন বলল, ‘আমি।’ স্পষ্ট এবং তিক্ষ্ণ আওয়াজ। মেয়েলি স্বর। নাকি রানুই বলছে ঘুমের ঘোরে? এটাই হয়েছে। রানুরই গলা।
আনিস হাত বাড়িয়ে রানুকে কাছে টানল। রানু বলল, ‘হাতটা সরিয়ে নাও, গরম লাগছে।’ তার মানে কি রানু জেগেছিল এতক্ষণ?
‘রানু।’
‘উঁ।
‘তুমি জেগেছিলে?’
‘হ্যাঁ।
‘আমি যখন বললাম কে কে, তখন কি তুমি বলেছ, আমি?’
রানু চুপ করে রইল। আনিস বলল, ‘বল, বলেছ এ রকম কিছু?’
‘হ্যাঁ বলেছি।’
‘কিন্তু তুমি জবাব দিলে কেন? তোমাকে তো কিছু জিজ্ঞেস করি নি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম রান্নাঘরে কেউ আছে কিনা?’
রানু ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তো রান্নাঘরেই ছিলাম। আমি রান্নাঘর থেকেই জবাব দিয়েছি।’
আনিস চুপ করে গেল। বিছানায় উঠে বসে পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। বাথরুমে গিয়ে বাত জ্বালিয়ে রেখে এল। রান্নাঘরের বাতিও জ্বালিয়ে দিয়ে এল। থাকুক, সারা রাত বাতি জ্বালানো থাকুক।
‘রানু।’
‘কি?’
‘কাল তুমি আমার সঙ্গে একজন ডাক্তারের কাছে যাবে, কেমন?’
‘ঠিক আছে, যাব।’
‘ডাক্তার সাহেব যা-যা জানতে চান, সব বলবে।’
রানু জবাব দিল না। মনে হলো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। শান্ত নির্বিঘ্ন ঘুম কিন্তু রান্নাঘরে আবার শব্দ হচ্ছে। আনিসের মনে হলো স্পষ্ট চুড়ির টুনটুন শব্দ শুনছে। কাঁচের চুড়ির আওয়াজ। আনিস কয়েকবার ডাকল, ‘কে, কে ওখানে?’ কেউ কোনো জবাব দিল না। বাথরুম থেকে একটানা জল পড়ার শব্দ আসছে। বাড়িঅলাকে বলতে হবে কল ঠিক করে দিতে। এক জন কাজের মানুষ রাখতে হবে। পুরুষমানুষ নয়, মেয়েমানুষ-সে রাত-দিন থাকবে। আত্নীয়স্বজন কাউকে এনে রাখলে ভালো হত। কিন্তু আনিসের তেমন কোনো আত্নীয়স্বজন নেই, যারা এখানে এসে থাকবে। আনিসের ঘুম এল শেষরাতের দিকে।
মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে তারা প্রায় দুই ঘন্টা সময় কাটাল। রানু খুব সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করল। এর প্রধান কৃতিত্ব সম্ভবত মিসির সাহেবের। তিনি খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বললেন। এক পর্যায়ে রানু বলল, ‘আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন, আমি আপনার মেয়ের বয়সী।’
‘মেয়ের বয়সী হলে হলে কী, আমার তো মেয়ে নেই। বিয়েই করি নি।’
রানু কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ভদ্রলোক সেটি লক্ষ্য করলেন।
‘তুমি কিছু বলতে চাচ্ছিলে?’
‘জ্বি-না।’
‘কিছু বলতে চাইলে বলতে পার।’
‘না, আমি কিছু বলব না।’
মিসির আলি সাহেব চায়ের ব্যবসা করলেন। চা খেতে-খেতে নিতান্তই সহজ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আনিস সাহেব বলেছিলেন, তুমি যা স্বপ্নে দেখ তা-ই সত্যি হয়।’
‘হুঁ।
‘যা স্বপ্নে দেখ তা-ই হয়?’
‘শুধুর স্বপ্ন না, যা আমার মনে আসে তা-ই হয়।’
‘বল কী!’
‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, না?’
‘বিশ্বাস হবে না কেন? পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুদ ব্যাপার আছে। পৃথিবীটা বড় অদ্ভুদ।’
বলতে-বলতে মিসির আলি ড্রয়ার খুলে চৌকা ধরণের চারটি কার্ড বের করলেন। হাসিমুখে বললেন,‘রানু, এই কার্ডগুলিতে ডিজাইন আঁকা আছে। আমি একেকটি টেবিলের ওপর রাখব, ডিজাইন গুলি থাকবে নিচে। তুমি না দেখে বলার চেষ্টা করবে।’
রানু অবাক হয়ে বলল, ‘না দেখে বলব কীভাবে?’
‘চেষ্টা করে দেখ। পারতেও তো পার। বল দেখি এই কার্ডটিতে কী আঁকা আছে?’
‘কী আশ্চর্য, কী করে বলব?’
‘আন্দাজ কর। যা মনে আসে তা-ই বল।’
‘একটা ক্রস চিহ্ন আছে। ঠিক হয়েছে?
‘তা বলব না। এবার বল এটিতে কী আছে?’
‘খুব ছোট-ছোট সার্কেল।’
‘ক’টি, বলতে পারবে?’
‘মনে হচ্ছে তিনটি। চারটিও হতে পারে।’
মিসির সাহেব কার্ডগুলো ড্রয়ারে রেখে সিগারেট ধরালেন। তাঁকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হতে লাগল। আনিস বলল, ‘ও কি বলতে পেরেছে?’ মিসির সাহেব তার জবাব না-দিয়ে বললেন, ‘রানু, এবার তুমি বল, প্রথম ভয়টা তুমি কীভাবে পেলে। সবকিছু বলবে, কিছুই বাদ দেবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি।’
রানু চুপ করে রইল।
‘তুমি নিশ্চই চাও, অসুখটা সেরে যাক। চাও না?’
‘চাই।’
‘তাহলে বল। কোনোকিছু বাদ দেবে না।’
রানু তাকাল আনিসের দিকে। মিসির আলি বললেন, ‘আনিস সাহেব, আপনি না হয় পাশের ঘরে গিয়ে বসেন। ঐ ঘরে অনেক বইপত্র আছে, বসে-বসে পড়তে থাকুন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কারেন্ট ইস্যুটা আছে, গতকালই এসেছে।’
রানু বলতে শুরু করল। মিসির আলি শুনতে লাগলেন চোখ বন্ধ করে। একটি প্রশ্নও জিজ্ঞেস করলেন না। মাঝখানে একবার শুধু বললেন, ‘পানি খাবে? তৃষ্ণা পেয়েছে?’ রানু মাথা নাড়ল। তিনি পানির জগ এবং গ্লাস নিয়ে এলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘চোখে-মুখে পানি দিয়ে নাও, ভালো লাগবে।’ রানু সে সব কিছুই করল না। শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। কথা বলতে লাগল স্পষ্ট স্বরে।
.
[ রানুর প্রথম গল্প ]
.
আমার বয়স তখন মাত্র এগার-বার বৎসর। আমি মধুপুরে আমার এক চাচার বাড়িতে বেড়াতে গেছি। চাচাতো বোনের বিয়েতে। চাচাতো বোনটির নাম হচেছ অনুফা। খুবই ভালো মেয়ে, কিন্তু চাচা বিয়ে ঠিক করেছেন একটা বাজে ছেলের সঙ্গে। ছেলের প্রচুর জায়গাটায়গা আছে, কিন্তু কিছুই করে না। দেখতেও বাজে, দাঁত উঁচু, মুখে বসন্তের দাগ। দারুণ বেঁটে। অনুফা আপার এই নিয়ে খুব মন-খারাপ। প্রায়ই এই নিয়ে কাঁদে। আমি তাকে সান্ত্বনাটান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমি নিজে একটা বাচ্চা মেয়ে, তাকে কী সান্ত্বনা দেব? তবে আমার সঙ্গে অনুফা আপার খুব ভাব ছিল। আমাকে অনেক গোপন কথাটথা বলত।
যাই হোক, গায়ে হলুদের দিন খুব রঙ খেলা হলো। আমাদের ওদিকে রঙ খেলা হচ্ছে-উঠোনে কাদা ফেলে তাতে গড়াগড়ি খাওয়া। সারা দিন রঙ খেলে কাদা মেখে সবাই ভূত হয়ে গেছি। ঠিক করা হলো সবাই মিলে নদীতে গোসল সেরে আসবে। চাচা অবশ্যি আপত্তি করলেন-মেয়েছেলেরা নদীতে যাবে কী?
চাচার আপত্তি অবশ্যি টিকল না। আমরা মেয়েরা সবাই দল বেঁধে নদীতে গোসল করতে গেলাম। বাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরেই নদী। আমরা প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন মেয়ে, খুব হৈচৈ হচ্ছে। সবাই মিলে মহানন্দে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছি। সেখানেও খুব কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হলো। ঠিক তখন একটা কান্ড হলো, মনে হলো একজন কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছে। নির্ঘাত কেউ তামাশা করছে। আমি হাসতে-হাসতে বললাম-এ্যাই, ভালো হবে না। ছাড় বলছি, ছাড়। কিন্তু যে পা ধরেছে সে ছাড়ল না, হঠাৎ মনে হলো সে টেনে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলতে চেষ্টা করছে। তখন আমি চিৎকার দিলাম। সবাই মনে করল কোনো-তামাশা হচ্ছে। কেউ কাছে এল না, কিন্তু ততক্ষণে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলেছে আর, আর…..।
[এই সময় মিসির সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছি তারপর কী হলো।’]
সবার প্রথম অনুফা আপা ছুটে এসে আমাকে ধরলেন, তারপর অন্যরা ছুটে এল। যে আমার পা জড়িয়ে ধরেছিল, সে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে গভীর জলের দিকে টেনে নিতে লাগল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হবার পর শুনেছি ওরা আমাকে বহু কষ্টে টেনে পাড়ে তুলেছে এবং দেখেছে একটা মরা মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ঐ মরা মানুষটাকে গ্রামের লোকেরা নদীর পাড়ে চাপা মাটি দিয়েছিল। সেইসব কিছুই অবশ্যি আমি দেখি নি, শুনেছি। কারণ আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। চাচা আমার চিকিৎসার জন্যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। সবাই ধরে নিয়েছিল আমি বাঁচব না, কিন্তু বেঁচে গেলাম। এইটুকু আমার প্রথম ভয়ের গল্প।
রানু গল্প শেষ করে পুরো একগ্লাস পানি খেল। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘ঐ লোককে তুমি দেখ নি।?’
‘জ্বি-না।’
মিসির আলি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে নিচু গলায় বললেন, ‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনো একটি জিনিস তুমি আমাকে বল নি। কিছু একটা বাদ দিয়ে গেছ।’
রানু জবাব দিল না।
‘যে জিনিসটা বাদ দিয়েছ, সেটা আমার শোনা দরকার। সেটা কী, বলবে?’
‘অন্য আরেক দিন বলব।’
‘ঠিক আছে, অন্য এক দিন শুনব। তোমাকে আসতে হবে না, আমি গিয়ে শুনে আসব।’
রানু কিছু বলল না। মিসির আলি সাহেব কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে হঠাৎ বললেন, ‘যখন তুমি একা থাক, তখন কি কেউ তোমার সঙ্গে কথা বলে?’
‘হ্যাঁ।’
মিসির আলি খুব উৎসাহ বোধ করলেন।
‘ব্যাপারটা গুছিয়ে বল।’
‘মাঝে-মাঝে কে যেন আমাকে নাম ধরে ডাকে।’
‘পুরুষের গলায়?’
‘জ্বি-না। মেয়েদের গলায়।’
‘শুধু ডাকে, অন্য কিছু বলে না?’
‘জ্বি-না।’
‘এবং যে ডাকে তাকে কখনো দেখা যায় না?’
‘জ্বি-না।
‘এটা প্রথম কখন হয়? অর্থাৎ প্রথম কখন শুনলে? নদীর ব্যাপারটা ঘটার আগেই?’
‘হুঁ।
‘কত দিন আগে?’
‘আমার ঠিক মনে নেই।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ এ পর্যন্তই।’
রানুরা উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি ভারি গলায় বললেন, ‘আবার দেখা হবে।’
রানু কিছু বলল না। আনিস বলল, ‘আমরা তাহলে যাই।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মিসির আলি ওদের রিকসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। ওরা রিকসায় উঠবার সময় তিনি হঠাৎ বললেন, ‘রানু, তোমার পা যে জড়িয়ে ধরেছিল, ওর নাম কী?’
‘ওর নাম জালালউদ্দিন।’
‘কি করে জানলে ওর নাম জালালউদ্দিন?’
রানু তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, পরে কথা হবে।’
রিকসায় ওরা দুই জনে কোনো কথা বলল না। আনিসের এক বার মনে হলো, রানু কাঁদছে। সে সিগারেট ধরিয়ে সহজ স্বরে বলল, ‘ভদ্রলোককে তোমার কেমন লাগল রানু?’
‘ভালো। বেশ ভালো লোক। উনি আসলে কী করেন?’
‘উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পার্ট-টাইম টীচার। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি পড়ান। খুব জ্ঞানী লোক।’
‘ইউনিভার্সিটির টীচাররা এমন রোগা হয়, তা তো জানতাম না! আমার ধারণা ছিল তাঁরা খুব মোটাসোটা হন।’
রানু শব্দ করে হাসল। আনিস বলল, ‘আজ বাইরে খাওয়া-দাওয়া করলে কেমন হয়?’
‘শুধু-শুধু টাকা খরচ।’
‘তোমার গিয়ে রান্না চড়াতে হবে না। চল না, কিছু পয়সা খরচ হোক।’
‘কোথায় খাবে?’
‘আছে আমার একটা চেনা জায়গা। নানরুটি আর কাবাব। কি বল?’
.
🔴 ছয় 🔴
.
মিসির আলি সাহেব দেখলেন তাঁর ঘরের সামনে চারটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো টিউটোরিয়েল ক্লাস আছে নাকি? আজ বুধবার, টিউটোরিয়েল ক্লাস থাকার কথা নয়। তবে কে জানে হয়তো নতুন রুটিন দিয়েছে। তিনি এখনো নোটিস পান নি।
‘এই, তোমাদের কী ব্যাপার?’
মেয়েগুলো জড়সড় হয়ে গেল।
‘কি, তোমাদের সঙ্গে কোনো ক্লাস আছে?’
‘জ্বি-না স্যার।
‘তাহলে কি? কিছু বলবে?’
‘স্যার নোটিস-বোর্ডে আপনি একটা নোটিস দিয়েছিলেন, সেই জন্যে এসেছি।
‘কিসের নোটিস?’
তিনি ভুরু কোঁচকালেন। মেয়েগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
‘কী নোটিস দিয়েছিলাম?’
‘স্যার, আপনি লিখেছেন-কারো এক্সট্রাসেপ্সরি পারসেপশনের ক্ষমতা আছে কি না আপনি পরীক্ষা করে বলে দেবেন।
মিসির আলি সাহেবের সমস্ত ব্যাপারটা মনে পড়ল। মাস দুয়েক আগে এ রকম একটা নোটিস দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এই প্রথম চার জনকে পাওয়া গেল, যারা উৎসাহী এবং সব ক’টি মেয়ে। মেয়েগুলো রোগা। তার মানে কি অকল্টের ব্যাপারে রোগা মেয়েরাই বেশি উৎসাহী? তিনি মনে-মনে একটা নোট তৈরি করলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে হলো বিষয়টি ইন্টারেস্টিং। একটা সার্ভে করা যেতে পারে।
‘এস তোমরা। ঘরে এস। তোমরা তাহলে জানতে চাও তোমাদের ইএসপি আছে কি না?’
মেয়েগুলো কথা বলল না। যেন একটু ভয় পাচ্ছে। মুখ সবারই শুকনো।
‘বস তোমরা। চেয়ারে আরাম করে বস।’
ওরা বসল। মিসির আলি সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। নিচু গলায় বললেন, ‘সব মানুষের মধ্যেই ইএসপি কিছু পরিমাণে থাকে। টেলিপ্যাথির কথাই ধর। তোমাদের নিজেদেরই হয়তো এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। সহজ উদাহরণ হচ্ছে, ধর, এক দিন তোমাদের কারো মনে হলো অমুকের সাথে দেখা হবে। যার সঙ্গে দেখা হবার কথা মনে হচ্ছে, সে কিন্তু এখানে থাকে না। থাকে চিটাগাং। কিন্তু সত্যি-সত্যি দেখা হয়ে গেল। কি, হয় না এ রকম?’
মেয়েগুলো কিছু বলল না। এর মধ্যে এক জন রুমাল দিয়ে কপাল মুছতে লাগল। মেয়েটি ঘামছে। নার্ভাস হয়ে পড়ছে মনে হয়। নিশ্চয়ই ব্ল্যাড-প্রেশার বেড়ে গেছে। মিসি আলি বিস্মিত হলেন। নার্ভাস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই বিষয়ে চর্চা এখনো বিজ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে না। বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই অনুমানের ওপর। তবে আমেরিকায় একটি ইউনিভার্সিটি আছে-ডিউক ইউনিভার্সিটি। ওরা কিছু-কিছু এক্মপেরিমেন্টাল কাজ শুরু করেছে। মুশকিল হচ্ছে, ফলাফল সবসময় রিপ্রডিউসিবল নয়।’
মিসির আলি সাহেব ড্রয়ার খুলে দশটি চৌকো কার্ড টেবিলে বিছালেন। হাসিমুখে বললেন,‘পরীক্ষাটি খুব সহজ। এই কার্ডগুলোতে বিভিন্ন রকম চিহ্ন আছে। যেমন ধর ক্রস, স্কয়ার, ত্রিভুজ, বিন্দু। কোনটিতে কী আছে সেটা অনুমান করতে চেষ্টা করবে। দুই এক বার কাকতালীয়ভাবে মিলে যাবে। তবে ফলাফল যদি স্ট্যাটিসটিক্যালি সিগফিকেন্ট হয়, বুঝতে হবে তোমাদের ইএসপি আছে। এখন এস দেখি, কে প্রথম বলবে? তোমার নাম কী নাম?’
‘নীলুফার।’
‘হ্যাঁ নীলুফার, তুমিই প্রথম চেষ্টা কর। যা মনে আসে তা-ই বল।’
‘আমার কিছু মনে আসছে না।’
‘তাহলে অনুমান করে বল।’
মেয়েটি ঠিকমতো বলতে পারল না। তার সঙ্গীরাও না। মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন,‘নাহ্, তোমাদের কারো কোনো ইএসপি নেই।’ ওরা যেন তাতে খুশিই হলো। মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন,‘আধুনিক মানুষদের এসব না থাকতে নেই। এতে অনেক রকম জটিলতা হয়।’
‘কী জটিলতা?’
‘আছে, আছে।’
‘বলুন না স্যার।’
মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, নীলুফার নামের মেয়েটিই কথা বলছে। স্পষ্ট সতেজ গলা।
‘অন্য আরেক দিন বলব। আজ তোমরা যাও।’
নীলুফার বলল, ‘এমন কিছু কি আছে স্যার, যা করলে ইএসপি হয়?’
‘লোকজন বলে, প্রেমে পড়লেও এই ক্ষমতাটা অসম্ভব বেড়ে যায়। আমি ঠিক জানি না। তোমরা যদি কেউ কখনো প্রেমে পড়, তাহলে এস, পরীক্ষা করে দেখব।’
কথাটা বলেই মিসির আলি অপ্রস্তুত বোধ করলেন। ছাত্রীদের এটা বলা ঠিক হয় নি। কথাবার্তায় তার আরো সাবধান হওয়া উচিত। এ রকম হালকা ভঙ্গিতে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।
‘স্যার, আমরা যাই?’
‘আচ্ছা্ ঠিক আছে, দেখা হবে।’
মিসির আলি নিজের টীচার্স লাউঞ্জে চা খেতে এলেন। বেলা প্রায় তিনটা। লাউঞ্জে লোকজন নেই। পলিটিক্যাল সায়েন্সের রশিদ সাহেব এক কোণায় বসেছিলেন। তিনি অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘মিসির সাহেব, অনেক দিন পর মনে হয় এলেন এদিকে। চা খাবেন?’
‘কে যেন বলছিল, আপনি নাকি ভূতে-ধরা সারাতে পারেন। ঠিক নাকি?’
‘জ্বি-না। আমি ওঝা নই।’
‘রাগ করলেন নাকি? আমি কথার কথা বললাম।’
‘না, রাগ করব কেন?’
‘আচ্ছা মিসির আলি সাহেব, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?’
‘না।’
রশিদ সাহেব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।
‘আত্মা, আত্মায় বিশ্বাস করেন?’
‘না ভাই, আমি একজন নাস্তিক।’
‘আত্মা নেই-এই জিনিসটা কি প্রমাণ করতে পারবেন? কী কী যুক্তি আছে আপনার হাতে?’
মিসির আলি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। রশিদ সাহেব বললেন, ‘আত্মা যে আছে, এর পক্ষে বিজ্ঞানীদের কিছু চমৎকার যুক্তি আছে।’
‘থাকলে তো ভালোই। বিজ্ঞানীরা জড়জগৎ বাদ দিয়ে আত্মাটাত্মা নিয়ে উৎসাহী হলেই কিন্তু ঝামেলা। রশিদ সাহেব, আমার মাথা ধরেছে। এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। কিছু মনে করবেন না।’
মিসির আলি চা না খেয়েই উঠে পড়লেন। তাঁর সত্যি-সত্যি মাথা ধরেছে। প্রচন্ড ব্যথা। বড় রকমের কোনো অসুখের পূর্বলক্ষণ।
.
🔴 সাত 🔴
.
নীলু ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে দেখে তার বিছানার উপর চমৎকার একটি প্যাকেট পড়ে আছে। ব্রাউন কাগজে মোড়া প্যাকেটে গোটা-গোটা করে তার নাম লেখা। নীলুর বুক কেঁপে উঠল, বিলুর চোখে পড়ে নি তো? বিলুর খুব খারাপ অভ্যাস আছে, অন্যের চিঠি খুলে-খুলে পড়বে। হাসাহাসি করবে। নীলু দরজা বন্ধ করেই প্যাকেটটি খুলল। ছোট্ট চিঠি, কিন্তু কী চমৎকার করেই না লেখা:
কল্যাণীয়াসু,
ইচ্ছা করেই তোমাকে আমি কম লিখি। তোমার চিঠি পড়ে-পড়ে খুব
মায়া জন্মে যায়। এ বয়সে আমার মায়া বাড়াতে ইচ্ছা করে না।
মায়া বাড়ালেই কষ্ট পেতে হয়। আরেকটি সামান্য উপহার পাঠালাম।
গ্রহণ করলে খুব খুশি হব।
আহমেদ সাবেত
উপহারটি বড় সুন্দর! নীল রঙের একটি ডায়েরি। অসম্ভব নরম প্লাষ্টিকের কভার, যেখানে ছোট্ট একটি শিশুর ছবি। পাতাগুলো হালকা গোলাপী। প্রতিটি পাতায় সুন্দর-সুন্দর দুই লাইনের কবিতা। ডায়েরিটির প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখাঃ
‘I wish I could be eighteen again’
– A.S.
পড়তে গিয়ে কেন জানি নীলুর চোখে জল এল। এক জন সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মানুষের জন্যে মন কেমন করতে লাগল। লোকটি দেখতে কেমন কে জানে? সুন্দর নয় নিশ্চয়ই। বয়স্ক মানুষ, হয়তো চুলটুল পেকে গেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। মানুষের বয়স হচ্ছে তার মনে। মন যত দিন কাঁচা থাকে, তত দিন মানুষের বয়স বাড়ে না। এই লোকটির মন অসম্ভব নরম। শিশুর মতো নরম। নীলুর মনে হলো এই লোকটি স্বামী হিসেবে অসাধারণ ছিল। তার স্ত্রীকে নিশ্চয়ই সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছে।
নীলু রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল-আপনি এমন কেন? নিজের কথা তো কিছুই লেখেন নি! অথচ আমি আমার সমস্ত কথা লিখে বসে আছি। তবু মনে হয় সব বুঝি লেখা হলো না। অনেক কিছু বুঝি বাকি রয়ে গেল। আপনি আমাকে এত সুন্দর-সুন্দর উপহার দিয়েছেন, কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছুই দিই নি। আমার কিছু-একটা দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আমি তো জানি না আপনি কী পছন্দ করেন। আচ্ছা, আপনি কী টাই পড়েন? তাহলে লাল টকটকে একটা টাই আপনাকে দিতে পারি। জানেন, পুরুষমানুষের এই একটি জিনিস আমি পছন্দ করি। কিন্তু হয়তো আপনি টাই পরেন না, ঢিলেঢালা ধরণের মানুষদের মতো চাদর গায়ে দেন। আপনার সম্পর্কে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। এক দিন আসুন না আমাদের বাসায়, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। জানেন, আমি খুব ভালো চা বানাতে পারি। অন্য কেউ চা বানিয়ে দিলে আমার বাবা খেতে পারেন না। সব সময় আমাকে বানাতে হয়। গত রোববারে কী হলো, জানেন? রাত তিনটেয় বাবা আমাকে ডেকে তুললেন-মা, এক কাপ চা বানা তো, বড্ড চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে।
‘আপা, দরজা বন্ধ করে কী করছ?’
নীল অপ্রস্তুত হয়ে দরজা খুলল। বিলু দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহজনকভাবে তাকাচ্ছে।
‘কী করছিলে?’
‘কিছু করছিলাম না।’
বিলু বিছানায় এসে বসল, ‘আপা,তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।’
‘কী পরিবর্তন?’
‘অস্থির-অস্থির ভাব। লক্ষণ ভালো না আপা। বল তো কী হয়েছে।?’
‘কী আবার হবে? তোর শুধু উল্টোপাল্টা কথা।’
‘কিছু-একটা হয়েছে আপা। আমি জানি।’
‘কী যে বলিস!’
‘আমার কাছে লুকোতে পারবে না আপা। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।’
‘যা ভাগ, পাকামো করিস না।’
বিলু গেল না। কাপড় ছাড়তে-ছাড়তে বলল, ‘রানু আপাকেও বললাম তোমার পরিবর্তনের কথা। তারও ধারণা, তুমি কারো প্রেমে পড়েছ।’
‘হুঁ, আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া প্রেমটা আমার সঙ্গে করবে কে? চেহারার এই তো অবস্থা।’
‘খারাপ অবস্থাটা কী? রঙটা একটু ময়লা। এ ছাড়া আর কি?’
নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
‘নিঃশ্বাস ফেললে কেন আপা? নিজের চেহারা সম্পর্কে তোমার এমন খারাপ ধারণা থাকা উচিত নয়।’
‘উচিত নয় কেন?’
‘সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম প্রবলেম থাকে।’
‘কী প্রবলেম?’
‘রানু আপার মাথা খারাপ-সেটা তুমি জান?’
‘কী বলছিস এসব!’
‘ঠিকই বলছি। আকবরের মা একদিন দুপুরে কি জন্যে যেন গিয়েছিল, শোনে রানু আপা নিজের মনে হাসছে এবং কথা বলছে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। কথাগুলো বলছে আবার দুই রকম গলায়। আকবরের মা প্রথম ভেবেছিল কেউ বোধহয় বেড়াতে এসেছে। শেষে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ নেই।’
‘সত্যি?’
‘হুঁ। রহমান সাহেবের স্ত্রী বললেন, একদিন নাকি আনিস সাহেব গভীর রাতে রহমান সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর স্ত্রীর খুব অসুখ, এই কথা বলে। রহমান সাহেব গিয়ে দেখেন অসুখটসুখ কিচ্ছু নেই, দিব্যি ভালো মানুষ।’
নীলু মৃদু স্বরে বলল, ‘রানুর মতো সুন্দরী হলে আমি পাগল হতেও রাজি।’
বিলু হেসে ফেলল। হাসতে-হাসতে বলল, ‘কথাটা ঠিক বলেছ আপা।’
.
🔴 আট 🔴
.
রানু প্রসঙ্গে পাওয়া সব তথ্য লিখে রাখবার জন্যে মিসির আলি সাহেব মোটা একটা খাতা কিনে এনেছেন। খাতাটির প্রথম পাতায় লেখ-
‘এক জন মানসিক রুগীর পর্যায়ক্রমিক মনোবিশ্লেষণ।’ দ্বিতীয় পাতায় কিছু ব্যক্তিগত তথ্য। যেমন-
নাম : রানু আহমেদ।
বয়স : সতের বৎসর (রুপবতী)।
বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিত। (তের মাস আগে বিয়ে হয়)।
স্বাস্থ্য : রুগ্ন।
ওজন : আশি পাউন্ড।
স্বামী : আনিস আহমেদ। দি জেনিথ ইন্টারন্যাশনালের ডিউটি অফিসার। বয়স ৩৭। স্বাস্থ্য ভালো। তৃতীয় পাতার হেডিংটি হচ্ছে-‘অডিটরি হেলুসিনেশন’। এর নিচে লাল কালি দিয়ে একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা। এই পাতায় অনেক কিছুই লেখা হয়েছে, আবার কাটাকুটি করা হয়েছে। যেন মিসির আলি সাহেব মনস্থির করতে পারছেন না কী লিখবেন। দুটি লাইন শুধু পড়া যায়। লাইন দুটির নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয়া।
‘মেয়েটি অডিটরি হেলুসিনেশন হচেছ: সে একা থাকাকালীন শুনতে পায় কেউ যেন তাকে ডাকছে।’
পরের কয়েকটি পাতায় রানুর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয় লেখা। এ পাতাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, মিসির আলি নামের এই লোকটির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। অতি তুচ্ছ ব্যাপারগুলোও লেখা আছে। যেমন, এক জায়গায় লেখা-মেয়েটি বেশ কয়েকবার শাড়ীর আঁচল টেনেছে। দুই বার শব্দ করে আঙুল ফুটিয়েছে। আমি লক্ষ্য করলাম মেয়েটি পানি খেল মাথা নিচু করে। বেশ খানিকটা নিচু করে। যেন পানি পান করার ব্যাপারটি সে আড়াল করতে চায়।
নদীতে গোসলের গল্পটি লেখা আছে। গল্পের শেষে বেশ কিছু প্রশ্ন করা আছে। যেমন-
– একজন মৃত মানুষ পানিতে ভেসে থাকবে। ডুবে থাকবে না। গল্পে মৃত মানুষটির ডুবে-ডুবে চলার কথা আছে। এ রকম থাকার কথা নয়।
– পাজামা খুলে ফেলার কথা আছে। কিশোরীরা সাধারণত শক্ত গিট দিয়ে পাজামা পরে। গিট খুলতে হলে ফিতা টানতে হবে। ঐ মানুষটি কি ফিতা টেনেছিল, না পাজামাটাই টেনে নামিয়েছে?
– তার আনুমানিক বয়স কত ছিল?
– প্রথম অসুস্থতার সময় কি মেয়েটি ঘুমের মধ্যে কোনো কথাবার্তা বলত? কী বলত?
– মেয়েটি বলল, লোকটির নাম জালাল উদ্দিন। কীভাবে বলল? লোকটির নাম তো জানার কথা নয়। নাকি পরে শুনেছে?
– জালালউদ্দিন-জাতীয় নামের কারো সঙ্গে কি এই মেয়েটির পূর্বপরিচয় ছিল?
প্রশ্ন শেষে তিনটি মন্তব্য লেখা আছে। মন্তব্যগুলো সংক্ষিপ্ত। প্রথম মন্তব্য-মেয়েটি যে ঘটনার কথা বলছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্বিতীয় মন্তব্য- এই ঘটনা অন্য যেসব ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেছে তাদের সঙ্গে প্রথমে আলাপ করতে হবে। দ্বিতীয় মন্তব্যটি লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা ও পাশে লেখা-অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয় মন্তব্য-মেয়েটির অবশ্যই কিছু পরিমাণ এক্সট্রান্সেরি পারসেপশন আছে। সে কার্ডের সব ক’টি চিহ্ন সঠিকভাবে বলতে পেরেছে। আমি এ রকম আগে কখনো দেখি নি। এই বিষয়ে আমার ধারণা হচ্ছে, মানসিকভাবে অসুস্থ রুগীদের এই দিকটি উন্নত হয়ে থাকে। আমি এর আগেও যে ক’টি অসুস্থ মানুষ দেখেছি, তাদের সবার মধ্যেই এই ক্ষমতাটি কিছু পরিমাণে লক্ষ্য করেছি। দি জার্নাল অব প্যারাসাইকোলজির তৃতীয় ভল্যুমে(১৯৭৩) এই প্রসঙ্গে রিভিউ পেপার আছে। অথর জন নান এবং এফ টলম্যান।
.
*******
.
সোহাগী হাইস্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব দারুণ অবাক হলেন। রানুর ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্যে এক ভদ্রলোক এসেছেন-এর মানে কী? অতো দিন আগে কী হয়েছিল, না-হয়েছিল, তা কি এখন আর কারো মনে আছে? আর মনে থাকলেও এইসব ব্যাপার নিয়ে এখন ঘাঁটাঘাঁটি করাটা বোধহয় ঠিক নয়। কিন্তু যে ভদ্রলোক এসেছেন, তাঁকে মুখের ওপর না বলতেও বাধছে। ভদ্রলোক হাজার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক। মানী লোক। তা ছাড়া এত দূর এসেছেন, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। মুখে বলছেন রানু অসুস্থ এবং তিনি রানুর এক জন চিকিৎসক, কিন্তু এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ মাস খানেক আগেই রানুকে তিনি দেখে এসেছেন। কিছুমাত্র অসুস্থ মনে হয় নি। আজ হঠাৎ এমন কি হয়েছে যে ঢাকা থেকে এই ভদ্রলোককে আসতে হলো?
‘রানুর কী হয়েছে বলবেন?’
‘মানসিকভাবে অসুস্থ।’
‘আমি তো সেদিনই তাকে দেখে এলাম।’
‘যখন দেখেছেন তখন হয়তো সুস্থই ছিল।’
‘কী জানতে আপনি, বলেন।’
‘নদীতে গোসলের সময় কী ঘটেছিল, সেটা বলেন?’
‘সে সব কি আর এখন মনে আছ্ে?’
‘ঘটনাটা বেশ সিরিয়াস এবং নিশ্চয়ই আপনাদের মধ্যে বহু বার আলোচিত হয়েছে, কাজেই মনে থাকার কথা। আপনার যা মনে আসে তাই বলেন।’
হেডমাস্টার গম্ভীর স্বরে ঘটনাটা বললেন। রানুর গল্পের সঙ্গে তাঁর গল্পের কোনো অমিল লক্ষ্য করা গেল না। শুধু ভদ্রলোক বললেন, ‘মেয়েরা গোসল করতে গিয়েছিল দুপুরে, সন্ধ্যায় নয়।’
‘পায়জামা খোলার ব্যাপারটি বলেন। পায়জামাটা কি পাওয়া গিয়েছিল?’
‘আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।’
‘রানু বলছিল, নদীতে গোসল করবার সময় সেই মরা মানুষটি তার পায়জামা খুলে ফেলে।’
‘আরে না না, কী বলেন!’
‘ওর পরনে পায়জামা ছিল?’
‘হ্যাঁ, থাকবে না কেন?’
‘আপনার ঠিক মনে আছে তো?’
‘মনে থাকবে না কেন? পরিষ্কার মনে আছে। আপনি অন্য সবাইকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’
‘ঐ মরা মানুষটি সম্পর্কে জানেন?’
‘কিছুই জানি না রে ভাই। থানায় খবর দিয়েছিলাম। থানা হচ্ছে এখান থেকে দশ মাইল। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবসা ভালো ছিল না। থানাঅলারা আসে দুই দিন পরে। লাশ তখন পচে-গলে গিয়েছে। শিয়াল-কুকুর কামড়াকামড়ি করছে। থানাঅলারা এসে আমাদের লাশ পুঁতে ফেলতে বলে। আমরা নদীর ধারেই গর্ত করে পুঁতে ফেলি।
‘আচ্ছা, ঐ লাশটি তো উলঙ্গ ছিল, ঠিক না?’
‘জ্বি-না, ঠিক না। হলুদ রঙের একটা প্যান্ট ছিল আর গায়ে গেঞ্জি ছিল।’
মিসির আলি সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
‘আপনার ঠিক মনে আছে তো ভাই?’
‘আরে, এটা মনে না-থাকার কোনো কারণ আছে? পরিষ্কার মনে আছে।’
‘লাশটি কি বুড়ো মানুষের ছিল?’
‘জ্বি-না, জোয়ান মানুষের লাশ।’
‘আর কিছু মনে পড়ে?’
‘আর তো কিছু নেই মনে পড়ার।’
‘আপনার ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই, অনুফা যার নাম। শুনেছি ওর শ্বশুরবাড়ি কাছেই।’
‘হরিণঘাটায়। আপনি যেতে চান হরিণঘাটা?’
‘জ্বি।’
‘কখন যাবেন?’
‘আজকেই যেতে পারি। কত দূর এখান থেকে?’
‘পনের মাইল। বেবিট্যাক্সি করে যেতে পারেন।’
‘রাতে ফিরে আসতে পারব?’
‘তা পারবেন।’
‘বেশ, তাহলে আপনি আমাকে ঠিকানাটা দিন।’
‘দেব। বাড়িতে চলেন, খাওয়াদাওয়া করেন।’
‘আমি হোটেল থেকে খেয়েদেয়ে এসেছি।’
‘তা কি হয়, অতিথি-মানুষ! আসুন আসুন।’
ভদ্রলোক বাড়িতে নিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু বড়ই গম্ভীর হয়ে রইলেন। মাথার ওপর হঠাৎ এসে পড়া উপদ্রবে তাঁকে বেশ বিরক্ত মনে হলো। ভালো করে কোনো কথাই বললেন না। অকারণে বাড়ির এক জন কামলার ওপর প্রচন্ড হম্বিতম্বি শুরু করলেন।
কিন্তু অনুফার বাড়িতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ঘটল। মেয়েটি আদর-যত্নের একটি মেলা বাধিয়ে ফেলল। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটির স্বামী সন্ধ্যাবেলাতেই জাল নিয়ে পুকুরে নেমে গেছে। অনুফা পরিচিত মানুষের মতো আদুরে গলায় বলল, ‘রাতে ফিরবেন কি-কাল সকালে যাবেন।’ লোকজন মিসির আলিকে দেখতে এল। এরা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ। মেয়েটিও মনে হয় বেশ ক্ষমতা নিয়ে আছে। সবাই তার কথা শুনছে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে তাঁকে গোসলের জন্যে গরম পানি করে দেয়া হলো। একটা বাটিতে নতুন একটা গায়ে মাখার সাবান। মোড়কটি পর্যন্ত ছেড়া হয় নি। বাংলাঘরে নতুন চাদর বিছিয়ে বিছানা করা হলো। মেয়েটির বৃদ্ধ শ্বশুর একটি ফর্সী হুক্কাও এনে দিলেন এবং বারবার বলতে লাগলেন, খবর না-দিয়ে আসার জন্যে ঠিকমতো খাতির-যত্ন করতে না পেরে তিনি বড়ই শরমিন্দা। তবে যদি কালকের দিনটা থাকেন, তবে তিনি হরিণঘাটার বিখ্যাত মাগুর মাছ খাওয়াবেন। খাওয়াতে না-পারলে তিনি বাপের ব্যাটা না-ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিসির আলিরও বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি সত্যি-সত্যি এক দিন থেকে গেলেন। মিসির আলি সাহেব এ রকম কখনো করেন না।

কানামাছি পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

1

#কানামাছি
#পার্টঃ১৭ অন্তিম
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁঝ। তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না রিপোর্টে পজেটিভ লেখা আছে। সাঁঝের মনে হলো এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকলো। তার একটা ছোট্ট বাবু হবে? যে ইহানকে বাবা আর তাকে মা বলে ডাকবে! গুটিগুটি পায়ে ঘরময় হেঁটে বেড়াবে। সাঁঝের চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাঁঝকে সে নিজেই চিনতে পারলো না। খুশিতে নাচতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। নিজের পেটের উপর হাত রাখলো সে।

কয়েকদিন ধরে শরীর খারাপ লাগছিলো। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরে ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়েছিলো। আজ রিপোর্ট হাতে পেয়েছে। আর রিপোর্ট খুলে দেখে প্রেগ্ন্যাসি পজেটিভ। ডাক্তারের কাছে আবার যেতে হবে রিপোর্ট নিয়ে। এই সব কাজ বাড়ির সবার অগোচরে করেছে। ইহান নিজেই অসুস্থ তাই ইহানকে বলে আর বিচলিত করতে চায়নি। আজ সে ভার্সিটিতে যায়নি। ইহান গিয়েছে। তাই রিপোর্ট নিয়ে আসতে আর কোন ঝামেলা হয়নি।
বিকালে ইহান তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। কোন সারপ্রাইজ আছে তার জন্য। ইহান তার জন্য যে সারপ্রাইজ রাখুক না কেন সেও আজ সারপ্রাইজ দিবে। সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ।
সাঁঝের মন খুশিতে ভরে উঠলো। তার মনে হলো এতোদিন সে যে কষ্ট করেছে তা সুখে পরিনত হয়েছে বিয়ের পর থেকে। বিয়ের পরে এতো ভালো একজন জীবনসঙ্গী, একজন মা একজন বাবা আর একজন বোন পেয়েছে। তার জীবনটা একটা সুখের বাগানে পরিনত হয়েছে। ইহান আসার পর থেকে জীবনটা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তুমি কেমন আছো তাহলে সে মন থেকে বলতে পারবে আমি অনেক ভালো আছি। অনেক!

সাঁঝ ড্রয়িংরুমের চলে আসলো। আম্মু টিভি দেখছে আম্মুর পাশে বসে আহ্লাদীর সুরে বলল,

—” আম্মু”

আম্মু টিভি দেখতে দেখতে বলল,

—” হুম বলো”

—” মিষ্টি খাবে?”

আম্মু একটু অবাক হয়ে বলল,

—” এখন মিষ্টি? ”

সাঁঝ হেসে বলল,

—” হ্যা। আমি খাবো। তুমিও খাও আমার সাথে”

—” আচ্ছা”

—” আমি আনছি”

সাঁঝ মিষ্টি নিয়ে আসলো দুজনের জন্য। খেতে তার মনে হলো আজকের মিষ্টিটা বেশিই ভালো। সাঁঝ জিজ্ঞেস বললো,

—” ইশিতার বাসায় আসতে তো দেরী আছে এখনো। নাহলে তিনজন মিলে খেতে পারতাম”

—” হুম কলেজ শেষ করে প্রাইভেট পড়ে তারপর আসবে”

সাঁঝ মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে রুমে চলে আসলো। তার আর তর সইছে না ইহান কখন আসবে? সবার আগে ইহানকেই বলবে। তারপর বাড়ির বাকি সবাইকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো দুপুরই হয়নি। ইহান তো আসবে দুপুরের পরে। সাঁঝ টিভি দেখার চেষ্টা করলো, বই পড়ার চেষ্টা করলো কিন্তু কোনটাতে মন বসলো না। এরপর শাওয়ার নিয়ে এসে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়েও পড়লো।
,
,
,
,
🌿
রেডি হয়ে নিজেকে আয়নায় ভালো ভাবে দেখে নিচ্ছে সব ঠিক আছে কিনা। ইহান তাকে বলেছিলো “তোমাকে লাল গোলাপের মোহে না কাঠগোলাপের শুভ্রতায় মানায়।”
যেহেতু কাঠগোলাপের শুভ্রতায় মানায় তাই কাঠগোলাপের মতো শুভ্র ভাবেই আজ সেজেছে। সাদা শাড়ি পরেছে। এখনও ইহান আসেনি কিন্তু তবুও আগে থেকে রেডি হয়ে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ইহান রুমে এসে তাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। সাঁঝ হেসে জিজ্ঞেস করলো,

—” এসে গেছো? কেমন লাগছে আমাকে বলো?”

ইহান কিছুটা অবাক হয়েই বলল,

—” আসলাম আর তোমাকেও অনেক সুন্দর লাগছে। কিন্তু এভাবে সাজার কারণ?”

সাঁঝ একগাল হেসে বলল,

—” আজ বেড়াতে যাবো না? সেজন্য রেডি হয়েছি”

—” কিন্তু সেটা তো এখন না। বিকালে”

—” হ্যা জানি তো। কিন্তু আমার ইচ্ছা হলো তাই এখনই রেডি হলাম”

—” আচ্ছা”

ইহান শাওয়ারে যেতে যেতে ভাবলো আজ সাঁঝকে বেশিই খুশি লাগছে। বেড়াতে যাওয়ার জন্য এতো বেশি খুশি তো আগে কখনো হয়নি! ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হয়তো আজই শেষ ঘুরতে যাওয়া। সেজন্য না জেনেও সাঁঝ কোনভাবে এতো খুশি হয়েছে।
,
,
,
,
🌿
ইহান একদৃষ্টিতে সাঁঝকে দেখছে। শুনছে সাঁঝের সব কথা। নদীর পাড়ে বসে একদিক থেকে বাতাস লেগে সাঁঝের চুল গুলো উড়ছে। আর নানা রকমের গল্প শোনাচ্ছে। ইহান শুধু শ্রোতার ভূমিকা পালন করছে এখন। সাঁঝের কথা শুনতেও ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ও এভাবেই বলতে থাক। বুকে কিছুটা ব্যথাও অনুভব হচ্ছে। কারণ যখন সে বলতে শুরু করবে তখন সাঁঝ নিশ্চুপ থাকবে। আর কোনদিন কথা বলবে কিনা সেটাও সন্দেহ। সাঁঝের উড়তে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। সাঁঝ তার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” এভাবে কি দেখছো? আমিই কখন থেকে কথা বলে যাচ্ছি আর তুমি চুপচাপ শুনছো। কিছু বলছো না কেন?”

—” তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে। সেজন্য কিছু বলছি না।”

—” আচ্ছা।”

একটু চুপ থাকার পরে সাঁঝ আবার বলল,

—” তুমি না বললে আমার জন্য সারপ্রাইজ রেখেছো? কি সারপ্রাইজ? ”

ইহান আঙ্গুল দিয়ে সাঁঝের পিছন দিকে ইশারা করলো। সাঁঝ ঘুরে দেখলো একটা নৌকা। বেশ সুন্দর করে সাজানো। সাঁঝ একটু খুশি হয়ে বলল,

—” আমাদের জন্য?”

ইহান একটু হেসে বলল,

—” হ্যা আজ বিকালের জন্য এটা আমাদের। আমরা ঘুরবো এই নদীর বুকে”

—” তাহলে চলো”

নৌকায় উঠে সাঁঝ মন জুড়িয়ে গেলো। দুই পাশে সবুজ গাছপালা দেখা যাচ্ছে। আর মাঝে নৌকায় চড়ে ঘুরছে। মৃদু ঢেউ আছে নদীতে। সাঁঝের ইচ্ছা হলো পানিতে পা ডুবিয়ে বসতে। ইহান কে বলল,

—” আমি পা নামায় পানিতে?”

ইহান কড়া সুরে বলল,

—” না তুমি সাঁতার জানোনা। পড়ে গেলে সমস্যা হবে”

সাঁঝ একটু হেসে বলল,

—” তুমি তো জানো। আমি পড়লে তুমিও নেমে যাবে আমাকে বাঁচানোর জন্য। নামায় না প্লিজ! দরকার হলে আমার একহাত তুমি ধরে থাকো”

ইহানকে শেষ পর্যন্ত সাঁঝের কথা মানতেই হলো। সাঁঝ ইহানের একহাত ধরে পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো। নৌকা মাঝে মাঝে দুলছে। আর পা কখনো বেশি ডুবে যাচ্ছে কখনো অল্প। সাঁঝের দারুণ মজা লাগছে। শাড়িও অবশ্য ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা ব্যাপার না।
আর ইহান চোখ ভরে সাঁঝের উচ্ছ্বাস দেখছে। এই উচ্ছ্বাসকে গুড়িয়ে নষ্ট করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। কিন্তু সে সত্যিকে আর লুকিয়ে রাখবে না৷ আজ বলবে সব। যেভাবেই হোক।
,
,
,
,
🌿
নদীর ধারে সাঁঝের মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখে ইহান কিছু বলেনি। কিন্তু এখন বলবে। সাঁঝের দিকে ঘুরে তাকালো। সাঁঝ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ইহান আবার গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।

সাঁঝ ভেবে রেখেছে গাড়ি থেকে নেমে ইহানের কানে কানে বলবে সে বাবা হবে তারপর দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে যাবে। সারাদিন আর ইহানের সামনে আসবে না। একটু মজা তো নেয়ায় যায় এটা নিয়ে। ইহানের মুখের অবস্থা কি হবে ভেবে আনমনে হেসে উঠলো। ইহান ডেকে উঠলো,

—” সাঁঝ শোন”

সাঁঝ ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” বলো”

—” আমার কিছু বলার আছে”

—” বলো আমি শুনছি”

ইহান একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল,

—” সাঁঝ অনিক আমার ভাই”

ইহান সাঁঝের মুখের দিকে তাকালো। যে হাসিটুকু ছিলো সেটা উবে গেল। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ একদম স্থির। দৃষ্টি শান্ত। ইহান আবার বলা শুরু করলো,

—” অনিক বড় চাচার প্রথম সন্তান যার খবর আমি বাবা আর চাচা জানি। অনিক গত কয়েকমাস ধরে আইসিইউ তে ভর্তি আছে। মিশনে ওর গুলি লেগেছিলো সেটা অনিকের ইচ্ছাকৃত ছিলো। অনিক আত্মহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে গুলির সামনে দাঁড়ায়। আর আত্মহত্যার কারণ দুটা ছিলো। প্রথমটা ও তোমাকে অনেক ভালোবাসতো। তোমার ছেড়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি আর দ্বিতীয় একটা অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় যেটা ও নিতে পারিনি। আর ওটা তুমি ভাইরাল করেছিলে”

ইহান একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো,

—” অনিককে আমি ছোট থেকে দেখেছি। ও আমার খুব কাছের। আমি ওর এই অবস্থাকে মেনে নিতে পারিনি। তাই আমি খোঁজ খবর নিয়ে তোমার কথা জানতে পারি। আর ঠিক করি তোমাকেও একটু একটু করে কষ্ট দিবো। ভালোবাসার নাটক করবো আর তারপর তোমাকে ছেড়ে দেবো যেমনটা তুমি করেছিলে। তাই তোমাকে বিয়ে করি। আর তোমার সাথে ভালোবাসার নাটক শুরু করি। তোমাকে বজ্রপাতের সময় বারান্দায় আমি বন্দী করেছিলাম। মানসিকভাবে অসুস্থ করে দেয়ার জন্য।”

ইহান থামলো। সাঁঝ সেই শান্ত দৃষ্টিতে এখনো তাকিয়ে আছে। ইহানের গা শিউরে উঠলো এই দৃষ্টি দেখে।

সাঁঝের মুখে একটু হাসির আভা দেখা দিলো। সাঁঝ বিদ্রুপের সুরে বলল,

—” তার মানে আমি মিথ্যা সুখে বাঁচছিলাম?”

ইহানের চোখের কোনে পানি জমলো৷ বলল,

—” যখন তোমার ডায়েরিটা পড়লাম তখন আমার মনে হলো আমি সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী। আমার মরে যাওয়া উচিত। আর বুঝতে পারলাম আমি…আমি তোমাকে ভালোবাসি”

সাঁঝের হাসি আরেকটু বিস্তৃত হলো। সে বলল,

—” যখন আপনি দেখলেন আমি কোথাও না কোথাও আপনার দিক থেকে ভুল হয়েও ঠিক তখন বুঝলেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”

—” না সাঁঝ আমি তোমাকে আগে থেকেই ভালোবাসি৷ আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার তীব্রতা আমাকে আগেই বাধ্য করেছিলো ভালোবাসতে। কিন্তু তখন মনে হতো আমি আমার ভাইয়ের অপরাধীর জন্য অনুভব করি? নিজেকে ধিক্কার জানাতাম। কিন্তু সত্য জানার পরে আমি বুঝেছি আমি ভুল মানুষকে ভালোবাসিনি”

সাঁঝ শুধু ইহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইহান আবার বলল,

—” এগুলো জানার পরে তুমি কি আমাকে চিরকালের জন্য নিজের জীবন আর স্মৃতি থেকে মুছে ফেলবা না কি করবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার সিদ্ধান্ত। শুধু এটাই বলতে চাই যে আমি তোমাকে……”

হঠাৎ বিক্ষিপ্ত ভাবে তীব্র কিছু শব্দ হলো তারপর সব থেকে গিয়ে অন্ধকার……………

পরেরদিন খবরের কাগজে এক জায়গায় খবর বের হলো মহাসড়কে সন্ধ্যাবেলায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাড়ি গাছের সাথে লেগে এক্সিডেন্ট করেছে। গাড়িতে অবস্থানকারী দুজনের মধ্যে একজন ওখানেই মৃত আর আরেকজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।
,
,
,
,
🌿
ইহান বারান্দায় বসে সূর্য ডোবা দেখছে। সামনে সাঁঝের জামা কাপড় ছড়ানো। সাঁঝের প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্টটা এক কোণে পড়ে আছে। আর কিছু বাচ্চাদের খেলনাও আছে সামনে। হঠাৎ একাই হেসে উঠলো ইহান।
নিজের জীবনের উপর হেসে উঠলো। কি পেলো প্রতিশোধের কানামাছি খেলে? যার জন্য খেলছিলো সে প্রায় নয়-দশ মাস আইসিইউতে থেকে মারা গেলো।
যার সাথে ভুল করে খেলছিলো, তার ভালোবাসা তার জীবনের আলো সাঁঝ, তার সাথে কানামাছি খেলে ধরা ছোয়ার বাইরে চলে গেলো। তার অনাগত সন্তান যার খবর সাঁঝ তাকে দিতোই হয়তো তাকেও হারিয়ে ফেলেছে। সন্তানের খুশির খবরটা অনুভব করতে পারলো না।
নিজের কাজের শাস্তি চেয়েছিলো আল্লাহর কাছে। পেয়েছে এবং পাচ্ছে। কঠিন রূপে পাচ্ছে। একই এক্সিডেন্ট একজন মারা গেলো আরেকজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। সে কেন বেঁচে গেলো? সাঁঝ কেন বাঁচলো না? কেন? সাঁঝ তো তার অপরাধী ছিলো না। তার সন্তান কেন বাঁচলো না? এর থেকে সে নিজেই মরে যেতো সাঁঝ আর তার সন্তানের বদলে! এ কেমন খেলা? যার শুরু তো খুব আগ্রহ নিয়ে করেছিলো কিন্তু শেষ করার সময় সব শেষ করে গেলো।

ইহান ডুকরে কেঁদে উঠলো। একটু আগেই অবশ্য হাসছিলো। এখন কাঁদছে। এখন তার সাথে এমনই হয়। নিজের ভালোবাসার কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চাইতে পারলো না। স্ত্রী আর অনাগত সন্তানকে হারিয়ে আজ সে উন্মাদ…..

“It wasn’t a love story. It was a story of revenge. It was a story of bitterness and hate. And hate always leads people to destruction.”
~Kuhu. (সমাপ্ত)

⛔⛔ কিছু কথাঃ

★ইহান কি পজেটিভ ক্যারেক্টার না নেগেটিভ ক্যারেক্টর?

গল্পের মূল চরিত্র সাঁঝ। সাঁঝের সাপেক্ষে ইহান যখন তার জীবনে আসে তখন একটা নেগেটিভ ক্যারেক্টর হিসেবে আসে। কিন্তু ক্রমেই সে পজেটিভ ক্যারেক্টারে রূপান্তরিত হয়। আর অনিক শুরু থেকেই একটা নেগেটিভ ক্যারেক্টর ছিলো।

★আপু সাঁঝ সারাজীবন কষ্ট করেই গেল?

সাঁঝের জীবনটা কষ্টের ছিলো। ইহান আসার পর থেকে সে সুখে থাকতে শুরু করে। সেটা ইহানের খেলা হোক বা অন্য কারণে সাঁঝ সবকিছু থেকে অজ্ঞ থেকেই সুখটুকু পুরোপুরি ভাবে অনুভব করেছে। ইহান এবং অনিক ভুল ছিলো। তাদের ভুলের শাস্তিও তারা পেয়েছে। তাহলে আপু সাঁঝ কিসের শাস্তি পেয়েছে?
প্রশ্ন আপনাদের কাছে থাকলো সাঁঝও কি পুরোপুরি নির্দোষ ছিলো?

আমি প্রতিটা চরিত্রের ভুলের বিপরীতে শাস্তি আর কষ্টের বিপরীতে সুখ দেয়ার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি সেটা আপনারা ভালো বলতে পারবেন। আমি নিতান্তই একজন নতুন আর ক্ষুদ্র লেখিকা। ভুল ত্রুটি করলে সেগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই জানাবেন কেমন লাগলো। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন। ধন্যবাদ সবাইকে♥️♥️।

কানামাছি পর্ব-১৬

0

#কানামাছি
#পার্টঃ১৬
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
কমলা জামায় রক্তের দাগ লেগে আছে। রক্ত শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারন করেছে কিন্তু সাঁঝের সে দিকে কোন মন নেই। বারবার কানে বাজছে ” তোমাকে লাল গোলাপের মোহে না কাঠগোলাপের শুভ্রতায় মানায়”। এখনও কি সে শুভ্রতায় মুড়িয়ে আছে?
অনেকেই তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। সে নিজেও একবার নিজের দিকে তাকালো। জামায়, ওড়নায় ইহানের রক্ত লেগে আছে। হাসপাতালে আসার সময় ইহান তার কোলেই মাথা রেখে দিয়েছিলো। হঠাৎ সাঁঝের মনে হলো এখন হয়তো তার দায়িত্ব কিছুটা কমেছে।
এক্সিডেন্ট স্পট থেকে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে ইহানকে নিয়ে গিয়েছিলো। সে ড্রাইভিং জানেনা গাড়ি যোগাড় করে যেতে বেশ দেরী হয়ে গেছিলো। কিন্তু ঐ হাসপাতালে বলল মেডিকেলে নিয়ে যেতে। সাঁঝ চিল্লাপাল্লা করেছিলো কেন তখন ভর্তি নিলো না। তারপরে মেডিকেলে আনলো। রক্তের ব্যবস্থা করলো। এখন ইহান অপারেশন থিয়াটারে। কেন যেন মনে হচ্ছে ইহানের কিছু হয়ে যাবে।

এতোক্ষণ ধরে নিজের ভিতরে যত শক্তি ছিলো সবটা নিংড়ে পরিস্থির সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। কাঁদেনি একটুও। ভাঙেনি একদম। চোখ শুকনোই আছে। বাড়িতে খবর দেয়া হয়েছে। আম্মু, আব্বু, ইশিতা হয়তো এখনই চলে আসবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এটা জীবনের তৃতীয় এক্সিডেন্ট। প্রথমটা বাবার ছিলো কিন্তু বাবার সময়ে বাবার পাশে না থেকে সে নিজেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। দ্বিতীয়টা ভাইয়ার। তার অজান্তেই ভাইয়া সব করে ফেলেছিলো। আর তৃতীয়টা ইহানের। নিজের চোখের সামনে সবটা দেখলো। তার জীবনের সব আপনজনরা কেন এভাবে চলে যায়? কেন তাকে সব কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়? কি দোষ তার? কোন উত্তর পেলো না।

পাশে তাকিয়ে দেখলো হন্তদন্ত হয়ে আম্মু, আব্বু, ইশিতা আসছে। আব্বু এসেই জিজ্ঞেস করলো,

—” ইহান কোথায়?”

সাঁঝ উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেলো না। বসে থেকেই বলল,

—” অপারেশন থিয়েটারে”

—” ব্লাড, মেডিসিন, ভর্তি করা সব হয়েছে?”

—” হ্যা আব্বু আমি সব ব্যবস্থা করেছি”

আব্বু সাঁঝের মাথায় রেখে বলল,

—” বিশ্বাস রাখো মা সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি একটু খোঁজ খবর নিয়ে আসি”

আব্বু চলে গেলো। সাঁঝের একপাশে আম্মু আরেক পাশে ইশিতা বসলো। আম্মু সাঁঝকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না করছে। ভেজা কন্ঠে আম্মু বলল,

—” চিন্তা করো না মা। দেখো ইহান ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে। তুমি তো আমার সাহসী মেয়ে। ভেঙে পড়োনা”

সাঁঝ কোন কথা বললো না। তার ভিতরে ঝড় বয়ে গেলেও চোখ থেকে কোন পানি বের হচ্ছে না। সাঁঝের মনে হলো হয়তো তার কান্না করা উচিত। বৃষ্টি আসলে ঝড় থামবে। কিন্তু কান্না করতে পারলো না। আম্মু তাকে জড়িয়ে ধরে নিজেই কান্না করতে থাকলো। ইশিতা বলল,

—” মা শান্ত হও। ভাবী চলো আমার সাথে। হাত মুখ ধুয়ে আসবে। অনেকক্ষণ ধরে আছো”

আম্মুও তাল মেলালো,

—” যাও একটু হাত মুখ ধুয়ে আসো। তোমার জামা আনলে ভালো হতো। এই জামাটা আর কতক্ষণ পরে থাকবে? তাই একটু ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি আছি এখানে।”

সাঁঝ কাঠকাঠ গলায় বলল,

—” না আম্মু আমি থাকি এখানে। পরে যাবো। প্লিজ”

সাঁঝের মনে হতে থাকলো সে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসেও ইহানের হাত ধরে আছে। সে এখান থেকে আড়াল হলেই ইহান হাত ছেড়ে তার চোখের আড়ালে চলে যাবে। তাকে কেউ জোর করলো না।
একটু পরে তার মা আর মায়ের স্বামী আসলো। সাঁঝকে দেখে আঁতকে উঠল। মা বলল,

—” এ কি অবস্থা? ইহান কোথায়?”

আম্মু বলল,

—” অপারেশন হচ্ছে ভিতরে”

মায়ের স্বামী জিজ্ঞেস করলো,

—” ডাক্তার, কেবিন সব ঠিক হয়েছে? আমাকে আগে খবর দিলে হতো। আমার অনেক পরিচিত লোকজন আছে এখানে”

সাঁঝ অত্যাধিক শান্ত গলায় বলল,

—” কেন এসেছেন এখানে? তামাশা করতে?”

সাঁঝের শান্ত গলা শুনে সবাই কেমন যেনো থমকে গেলো। ইশিতে সাঁঝের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। সাঁঝ খেয়াল করলো ইশিতার চোখ লাল হয়ে আছে। চোখের পাশে পানির দাগও বোঝা যাচ্ছে। মানে সেও কান্না করেছে আড়ালে। ইশিতা তার হাত ধরে বলল,

—” চলো ভাবী যাই। একটু ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে আসবে। সেই দুপুরে খেয়েছো। তুমি অসুস্থ হলে কিভাবে হবে বলো তো?”

ইশিতার কথা শুনে সাঁঝে গা গুলিয়ে উঠলো। আসলেই কিছু খাওয়া হয়নি,তার উপর হাসপাতালের পরিবেশে বমি বমি লাগছে। সাঁঝ আর কিছু না বলে ইশিতার সাথে চলে গেলো। হাসপাতালের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই তার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছিলো। সাঁঝ সেগুলোকে পাত্তা দিলো না।

ফিরে আসার পরে দেখলো অপারেশন শেষ। ইহানকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাঁঝ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,

—” ইহান কেমন আছে?”

—” মোটামুটি out of danger. কিন্তু বেশ আঘাত আছে। মেরুদন্ডে আঘাত আছে। সেটা সিরিয়াস না কিন্তু সারতে সময় লাগবে। আর হাত, পা, মাথায় সব জায়গায় আঘাত আছে। মানে এক কথায় সেরে উঠতে সময় লাগবে”

—” এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”

—” আপনারা তো কেবিনের ব্যবস্থা করেছেন। ওখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে”

আব্বু বলে উঠলো,

—” হ্যা আমিই কেবিনের ব্যবস্থা করলাম”

সাঁঝ আবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,

—” জ্ঞান আছে?”

—” না এখনো নেই। আসতে সময় লাগবে”

—” আচ্ছা”

ডাক্তার চলে গেলো। সাঁঝ স্বস্তি পেলো। ইচ্ছা হলো এখনই ইহানের কাছে যেতে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কেবিনে যেতে চাইলে তাকে নার্স ঢুকতে দিলো না। সাঁঝ অবাক হয়ে গেলো। তাকে কেন ঢুকতে দিবে না? এটাতো আইসিইউ না। তাহলে? নার্সের বক্তব্য আইসিইউ না হলেও মানুষ ঢুকলে ইনফেকশনের ঝুকি আছে। আর এখন জ্ঞান নেই। কথাগুলো বলার সময় বারবার সাঁঝের জামার দিকে তাকাচ্ছিলো।
সাঁঝের জামাও না ঢুকতে দেয়ার আরেকটা অন্যতম কারণ। শেষে সবাই বুঝিয়ে সাঁঝকে বাড়িতে পাঠানোর জন্য রাজী করলো। সাথে আম্মুও যাবে। সাঁঝ পারলে দৌড়ে চলে যায়।

বাড়িতে পৌঁছে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে এসে দেখলো আম্মু টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” আম্মু তুমি তো যাবে না তাইনা? আমি গেলাম গাড়ি নিয়ে”

আম্মু তাড়াহুড়ো করে বলল,

—” এই এই এদিকে আসো”

সাঁঝ আম্মুর কাছে গিয়ে বলল,

—” বলো ইহানের জন্য কিছু নিয়ে যেতে হবে? আর্জেন্ট হলে এখনই দাও। নাহলে পরে পাঠিয়ে দিও। আমি যাই”

আম্মু সাঁঝকে জোর করে টেবিলে বসিয়ে দিলো। তারপর বলল,

—” খেয়ে যাবে। একদম না খেয়ে যেতে দিবো না”

—” কিন্তু আম্মু.. ”

সাঁঝ কথা শেষ করতে পারলো না। আম্মু ভাত মেখে মুখে দিয়ে দিলো। অগত্যা সাঁঝকে খেতে হলো। আম্মু বলল,

—” তুমি না খেলে কেমন করে হবে? ইহানের দেখাশোনাও করতে হবে না? তুমি অসুস্থ হলে কিভাবে হবে?”

সাঁঝের চোখের কোনে পানি চলে আসলো। মায়ের স্নেহ! তার মা কেন এমন হলো না? তারপর মনে হলো তার মা এমন না বলেই আরেকটা মা দিয়েছে আল্লাহ। যে এতোটা ভালোবাসে। অল্প কয়েকদিনে এতো আপন করে নিয়েছে। আম্মু জোর করে অনেকটা খাইয়ে দিলো সাঁঝকে। এরপর তাড়াতাড়ি করে চলে আসলো হাসপাতালে।
এবার আসার পরে কেবিনে ঢুকে গেলো। কেউ মানা করলেও সাঁঝ থামতো না। ইহানের জ্ঞান ফেরেনি এখনো। অক্সিজেন লাগানো। আরো কিছু কিছু জিনিস লাগানো আছে। সাঁঝ আস্তে করে ইহানের পাশে বসলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো মুখে কয়েক জায়গায় কেটে গেছে। মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। এতোক্ষণ চোখে কোন পানি না আসলেও এখন চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেলো। ইহানের হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে ফিসফিস করে বলা শুরু করলো,

—” কেন আমার সাথে এমন হয়? সবাই কেন আমাকে একা করে দেয়? যাকে নিজের আপন ভাবি সেই এমন করে। আমি কি দোষ করেছি?”

কিছুক্ষণ পরে কান্না করতে করতেই আবার বলল,

—” আপনার কিছু হয়ে গেলে আমার নিজের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে যেতো। আমি যাকে ভালোবাসতে যাই সেই অনন্তের পথে চলে যায়। কিন্তু আপনাকে যেতে দিবো না আমি”

সাঁঝ ইহানের হাতের উপর আলতো করে কপাল ছোয়ালো। এখন তার কিছুটা শান্তি শান্তি লাগছে।
,
,
,
,
🌿
—” আমি গেলাম ভার্সিটিতে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। কোন সমস্যা হলে বাড়ির কাউকে ডেকো। আর হাঁটতে সমস্যা হলে কিছু ধরে হেঁটো”

সাঁঝ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো। ইহান একটু হেসে বলল,

—” আচ্ছা বাবা আর কত বার এক কথা বলবা? আমার মুখস্ত হয়ে গেছে”

—” তবুও তুমি যাতে ভুলে না যাও”

—” আমি ক্লাস নিতে যাওয়া শুরু করেছি। আর তাও তুমি এই কথা বলছো সাঁঝ? আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছি। এখন চিন্তা কম করো”

সাঁঝ একটা রাগী লুক দিয়ে বলল,

—” হুম। আসছি”

ইহান পিছন থেকে ডেকে বলল,

—” আতিকের থেকে দূরে থেকো”

সাঁঝ একটু হেসে দিলো। মুখে হাসির রেশ টেনে বলল,

—” আমি আর কি দূরে থাকবো? উনিই আমার সামনে আসবে না। বেচারা কত শখ করে আমাকে প্রপোজ করবে বলে সব প্রিপারেশন নিয়ে আসলো। আর তুমি কিনা সুস্থ হয়ে প্রথম দিন যেয়েই তার মন এভাবে ভেঙে দিলে!”

ইহান একটু রেগে বলল,

—” খুব কষ্ট লাগছে না আতিকের জন্য?”

সাঁঝ মুখটা একটু বেজার করে বলল,

—” তা তো লাগছেই। এতো মায়া মমতা ভালোবাসা উনার মনে কি আর বলবো?”

ইহান বিছানা থেকে উঠে কিছুটা দৌড়ে সাঁঝের দিকে যেতে বলল,

—” মায়া, মমতা না?”

সাঁঝ আগেই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আর ইহান জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসতে থাকলো। তারপর সাঁঝের গলায় শুনলো,

—” আম্মু আমি আসছি। তোমার ছেলের দিকে খেয়াল রেখো”

আম্মু বললো,

—” আস্তে যাও। পড়ে যাবে তো!”

সাঁঝ বাইরে চলে গেলো। ইহান আবার বিছানায় এসে বসলো।

গত দুই আড়াই মাস ধরে সাঁঝ তার খেয়াল রাখছে আর বাড়ির লোক সাঁঝের খেয়াল রাখছে। সাঁঝের মধ্যে যে মমতাময়ী আরেকটা রূপ থাকতে পারে সেটা ইহানের ভাবনার বাইরে ছিলো। এক্সিডেন্টের পর থেকে তাকে খাইয়ে দেয়া, ঔষধ খাওয়ানো, হাঁটতে সমস্যা হওয়ার কারণে ধরে ধরে হাঁটতে সাহায্য করা, মাঝরাতে পিঠে ব্যথা হলে গরম সেক দেয়া এই সবগুলোর কোনটাই বাদ দেয় নি। ঔষধের সাইড এফেক্টের জন্য খাবারের রুচি চলে যেতো। তখন সাঁঝ নিজেই বা মাকে বলে নতুন কিছু বানিয়ে আনতো। যে কয়দিন হাসপাতালে ছিলো বাকি সব কিছু বাদ দিয়ে সাঁঝ সবসময় তার সাথে হাসপাতালে ছিলো। এগুলো করার সময় কখনো এতোটুকু বিরক্তির রেশ দেখতে পায়নি সে সাঁঝের ভিতরে।

এই সময়টাতে না চাইতেও তার আর সাঁঝের সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সাঁঝ আপনি থেকে তুমি তে নেমে এসেছে। আর সে নিঃসন্দেহে ভালোবেসে ফেলেছে সাঁঝকে। কিন্তু আবার নিজের মনেই প্রশ্ন আসে একই সাঁঝের কত রূপ? অনিকের সাথে একরকম আর তার সাথে একদম ভিন্ন? এখন সে নিজেই নিজের প্রতিশোধ আর ভালোবাসার মধ্যে ঝুলছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। আর অনিকের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। অনিকের কথা ভাবলেই সাঁঝের উপর বিতৃষ্ণা আছে আসে কিছুটা। এখন ইহান নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ে ব্যস্ত। কি করবে?

কয়েকদিন যাবৎ আবার ক্লাস নেয়া শুরু করেছে। আজ অবশ্য তার ছুটি। তাই আর ভার্সিটিতে যায়নি। ইহান অনিকের লেখা চিঠিগুলো আবার পড়ার জন্য নিজের আলমারিতে খুঁজতে শুরু করলো। চিঠির বক্সটা পেলো না কিন্তু একটা পুরানো ডায়েরি পেলো। ইহান বেশ অবাক হলো। কারণ এটা তার না সাঁঝ এই এতোগুলো মাসে কখনো ডায়েরির কথা বলেনি বা তার সামনে বের করেনি। ইহান ডায়েরিটা হাতে নিয়ে নিজের চিঠিগুলো খুঁজতে থাকলো। চিঠিগুলো পাওয়ার পরে সব নিয়ে বসলো একসাথে।

ডায়েরিটা নিয়ে খুব কৌতুহল হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। ইহান ডায়েরি খুলে প্রথম পেজেই সাঁঝ, সাঁঝের বাবা আর ভাইয়ের একটা ছবি পেলো। বেশ পুরানো ছবি। এরপরের পেজে সাঁঝের ভাইয়ের ছবি। নিচে গুটিগুটি অক্ষরে অনেক কিছু লেখা। ইহান না পড়ে পরের পৃষ্ঠাতে গেলো। অনিকের ছবি আটকানো। ইহান চমকে উঠলো। এর নিচেও অনেক কিছু লেখা। ইহান পড়লো। কিছু বুঝলো আর বাকি বুঝলো না। এরপর পিছনের পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করলো। পড়া শেষে ইহান থম মেরে বসে থাকলো।
সব কিছুই মিথ্যা মনে হতে থাকলো। ডায়েরির কথাগুলো সত্যি হলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষের মধ্যে একজন হবে সে। সাঁঝকে নানা সময়ে নানা ভাবে কষ্ট দিয়েছে। এগুলো সব কিছু একটা মিথ্যার উপর ভিত্তির করে দিয়েছে? ছি! নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে তার।
,
,
,
,
🌿
বই খাতা নিয়ে বসে থেকেও পড়াতে মন বসাতে পারছে না সাঁঝ। ঘুরে ফিরে ভাবনা শুধু ইহানে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। গত বেশ কয়েকদিন ধরে ইহান কেমন যেন হয়ে গেছে। মাঝরাতে উঠে দেখা যায় বারান্দায় বসে আছে। খাওয়া দাওয়া করে না। চোখের নিচেও কিছুটা কালি পড়েছে। হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কারণ ধরতে পারে না। সবচেয়ে বড় বিষয় তার মনে হচ্ছে ইহান তাকে এড়িয়ে চলছে। এখন ইহান রুমে নেই। বারান্দায় আছে। সাঁঝ উঠে বারান্দায় চলে গেলো।
ইহানের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল,

—” কি হয়েছে বলো তো? এমন উদাস লাগে কেন তোমাকে?”

ইহান একটু হেসে বলল,

—” কি হবে? কিছুই হয়নি। তুমি আমাকে নিয়ে বেশি ভাবো এজন্য এরকম মনে হচ্ছে”

—” আমি বেশি ভাবছি না তোমার আসলেই কিছু হয়েছে”

ইহান কোন জবাব দিলো না। একটু পরে ইহান বললো,

—” কাল তোমাকে নিয়ে বাইরে যাবো?”

—” আবার? যদি কিছু হয়?”

ইহান হেসে বলল,

—” আরে কি হবে? প্রতিবার কি এক্সিডেন্ট হবে নাকি?”

সাঁঝ একটু উৎসাহ নিয়ে বলল,

—” তুমি কি আমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করছো?”

—” এই একপ্রকার”

—” আমি এক্সাইটেড”

ইহান সাঁঝের দিকে ঘুরে বলল,

—” এক্সাইটেড পরে হতে পারবা। এখন পড়তে বসো যাও”

শেষের কথাটা টিচারদের মতো বলল। সাঁঝ বলল,

—” যাচ্ছি স্যার”

সাঁঝ চলে গেলে ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হয়তো সাঁঝের সাথে তার শেষ দিন কালকে। কাল সব বলে দিবে। প্রতিনিয়ত একই ছাদের নিচে থেকে গুমড়ে গুমড়ে কষ্ট পাচ্ছে। নিজেকে সাঁঝের অপরাধী মনে হয়। সাঁঝকে একটা মিথ্যা উদ্দেশ্য নিয়ে বিয়ে করেছিলো। ওকে মেন্টালি কষ্ট দিয়েছে! যার জন্য করেছে সে নিজেই একটা অমানুষ। কিভাবে এসব জেনে ভালো থাকবে? আজকাল রাতে ঘুম হয়না। সাঁঝের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। সে তো প্রথম দিকে সাঁঝের সাথে ভালোবাসার নাটক করেছিলো।
কিন্তু সাঁঝের ভালোবাসার তীব্রতা অনেক। যেটা তাকে বাধ্য করেছে ভালোবাসতে। সাঁঝের মতো মেয়ের ভালোবাসার তীব্রতা যতটুকু ঘৃণার তীব্রতাও ততটুকুই তো হবে! হয়তো বেশিই হবে। সাঁঝ হয়তো আর কখনো তাকে মাফ করবে না। তার দিকে ঘুরেও তাকাবে না। নিজের জীবন থেকে ইহান নামটা চিরকালের জন্য মুছে ফেলবে। কিন্তু তাও সে সব সত্যি বলে দিবে কাল। অন্তত নিজের কাছে তো বলতে পারবে যে সাঁঝকে সব সত্যি বলে নতুন করে সব শুরুর প্রচেষ্টা করেছে। বাকিটা তো সাঁঝের হাতে। কিন্তু যখন তার পরিবার থেকে সব জানতে পারবে তখন? মা,বাবা ইশিতাও কি ক্ষমা করবে? না তারাও দূরে ঠেলে দিবে?

অনিক একটা অমানুষ হলেও শেষে যখন সাঁঝ তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো তখন যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিলো ইহানও একই রকম কষ্ট পাচ্ছে। বরং আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটার সাথে করা অন্যায়ের অনুতাপে পুড়ছে।
ইহানের চোখ বেয়ে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। সে বলে উঠলো, “সাঁঝ আমি হয়তো তোমাকে কাল হারিয়ে ফেলবো। তোমার জীবনে আমার নামটা কি কোথাও থাকবে? হয়তো থাকবে না। যদি নিজেকে শেষ করে দিতে পারতাম তাহলে হয়তো সব কিছুর একটা সুষ্ঠ সমাধান হতো। নিজের কাজের শাস্তি পেতাম।” (চলবে)

কানামাছি পর্ব-১৫

0

#কানামাছি
#পার্টঃ১৫
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে সাঁঝের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভার্সিটির মেয়েদের বর্তমান ক্রাশ। ইনি নতুন জয়েন করেছেন লেকচারার হিসেবে আর এসেই মেয়েদের ক্রাশে পরিনত হয়েছে। উনাকে দেখলে মেয়েরা তার পিছনে বলে উঠে, “aww কি কিউট আর হ্যান্ডসাম”
সেই ক্রাশ আতিক স্যার অনেকগুলো টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে সাঁঝের সামনে নার্ভাসভাবে হাসছে।
আর ঘটনার আকস্মিকতায় সাঁঝ থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বলে উঠলো, “ব্যাপারটা কি হলো? এই আতিক স্যার এমন ফুল নিয়ে এসেছে! লক্ষন তো ভালো না ইনার।” সাঁঝ আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। এখন তেমন স্টুডেন্ট নেই। আর অফিসরুমের পাশে গাছতলায় তেমন কেউ না থাকলেও যারা আছে তারাই তাদের দুজনকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। আতিক মৃদু হেসে নার্ভাসভাবে বলল,

—” সাঁঝ এটা তোমার জন্য”

সামনে এগিয়ে দেয়া জিনিস কিভাবে ফিরিয়ে দেবে। সাঁঝ বিব্রত হয়ে ফুলগুলো নিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

—” স্যার কিসের জন্য?”

—” এমনি মানে তোমার মতো ফুলকে আরো কিছু ফুল তো দেয়ায় যায় না?”

—” মানে?”

সাঁঝ অবাক হয়ে গেলো।

আতিক স্যার আবার হেসে বলল,

—” হ্যা মানে তুমি এমনি নম্র, সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে ফুলের মতো! কিন্তু যখন প্রয়োজন আসে তখন কাটার ভূমিকাটাও পালন করো। তুমিও একটা গোলাপের মতোই। তোমাকে গোলাপ দিলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না”

সাঁঝ পারলে নিজের কপাল চাপড়ায়। তিন চারদিন আগে একটা কাজের জন্য যেকোন স্যারের একটা পারমিশন লাগতো। সাঁঝ কাজের লিডার ছিলো। এখন পুরানো কোন স্যারের কাছে গেলে হাজারটা প্রশ্নসহ আরো ঝামেলা করতো। তাই নতুন এই আতিক স্যারের কাছে গিয়েছিলো যাতে সহজেই পারমিশন পেয়ে যায়। তখন কাজ আদায়ের জন্য হেসে হেসে কথা বলেছিলো যার ফলাফল এখন দেখা যাচ্ছে। আর কালকে কয়েকটা ছেলেকে একটু শিক্ষা দিয়েছিলো কারণ ছেলেগুলো খুব পাওয়ার দেখাচ্ছিলো নিজেদের। এখন গ্রুপের মেইন দায়িত্ব বলতে গেলে সাঁঝের উপর। নিশ্চয় আতিক স্যার সেটাও দেখেছে! এজন্য কাটাসহ ফুলের উপাধি পেলো। আতিক স্যার আবার বলল,

—” তোমার ক্লাস শেষ কখন? ক্লাস শেষে ব্যস্ততা না থাকলে কোন কফিশপে বা কোথাও বসে কথা বলা যাবে?

সাঁঝ আশেপাশে তাকালো। এই আতিক স্যার কি বোধবুদ্ধি সব গুলে খেয়েছে নাকি? আশেপাশে যারা আছে তারা সবাই তাকিয়ে দেখছে। অন্য কিছুতে সাঁঝের কিছু যায় আসে না কিন্তু তার আর আতিকের নামে কিছু ভার্সিটিতে কিছু ভেসে বেড়াক এটা সে চায় না। তার উপরে ইহানও এখানেই চাকরি করে। নিশ্চয়ই ইনি জানেন না ইহান তার স্বামী! সাঁঝ জোর করে হেসে বলল,

—” না স্যার আমি ব্যস্ত আছি আমার সময় হবে না।”

—” আচ্ছা তাহলে কোনদিন তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো সবার সাথে দেখা করতে”

সাঁঝ কিছু বলতেই যাবে তখন অফিসের দিক থেকে ইহান তাদের কাছে আসলো। সাঁঝের চোখ ইহানের উপর আটকে গেলো। একটা কফি কালারের শার্ট পড়েছে। দারুণ লাগছে। সকালে দেখেছে ইহানকে। কিন্তু এখন যেন আরো সুন্দর লাগছে। কিছুটা ঘেমে আছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। চুলগুলো এলোমেলো। সব মিলিয়ে চোখ সরাতে পারছে না। হঠাৎ মনে হলো ভার্সিটির মেয়েরা কি ইহানের উপর ক্রাশ খায়নি? জানতে হবে। যারা ইহানের উপর লাইন মারা ট্রাই করছে তাদের ভালো করে খবর নিতে হবে। ইহান আতিক স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” কি ফুলকে ফুল দেয়া হচ্ছে?”

আতিক স্যার মনে হয় একটু অবাক হলো কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। হেসে বলল,

—” হ্যা সাঁঝকে আমার কাছে ফুলের মতোই লাগে। তাই আর কি”

ইহান গোলাপগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,

—” Wow red roses! Good choice”

আতিক স্যার আবার হেসে বলল,

—” Thanks”

সাঁঝ ইহানের মুড বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না। ইহান সাঁঝের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—” ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে নাকি?”

ইহাম সবটা শুনেছে এটা বুঝতে পেরে আতিক স্যার কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো ।সেটা মুখ দেখেই বোঝা গেলো। উনি তাও হেসে বলল,

—” হ্যা ভাবছি একদিন সবাইকে আমার বাসায় দাওয়াত করবো”

ইহান চাপাস্বরে বলল,

—” হ্যা তাতে মেয়েকে আরো ভালো করে দেখেশুনে নেয়া যাবে তাই তো?”

সাঁঝ ইহানের কথা শুনে চোখ গোলগোল করে তাকালো। ইহান চাপাস্বরে বলেছে বিধায় আতিক স্যার বুঝতে পারিনি। সে বলল,

—” সরি আপনি কি বললেন বুঝতে পারলাম না”

—” মানে মিটিং আছে তো। যাবেন না?”

—” হ্যা চলুন”

সাঁঝ এতোক্ষণ ধরে সব কথা শুনার পরে বলল,

—” স্যারেরা আমি আসি। আমার কাজ আছে”

সাঁঝ আর কিছু বলতে না দিয়ে গোলাপগুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিলো। তার আর ইহানের বিয়ের খবর স্টুডেন্টদের মধ্যেই মাত্র কয়েকজন জানে। আর টিচারদের মধ্যে কেউ জানেই না। আতিক স্যারও জানে না। সেজন্য আজ এগুলো বলে গেলো।
,
,
,
🌿
মিটিং শেষ করে ইহান কফি হাতে নিয়ে বাবার ব্যবসার ফাইলের দিকে তাকালো। ভার্সিটিতে এখনো কাজ বাকি বলে বাসায় যেতে পারছে না। তার পাশের চেয়ার আতিক এসে বসলো। তার হাতেও কফি আছে। ইহান একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। এমনিতে তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে প্রচন্ড রকমে। তাও এই আতিকের কারণেই। সাঁঝকে লাল গোলাপ দেয়া হচ্ছে! সাঁঝ গোলাপ ফুলের মতো! আর সাঁঝ যদি ফুল হয়েও থাকে তাহলে সেটা শুধু আর শুধুমাত্র তার। সে দেখবে এই ফুলকে, সাজিয়ে রাখবে, ছবি তুলবে, সুবাস নিবে। অন্য কারোর না এই ফুল! উনি আসছেন মাঝখান থেকে ফুল দিতে!
আতিক জিজ্ঞেস করলো,

—” খুব ব্যস্ত নাকি?”

—” না তেমন না। এই ফাইল চেক করছি”

—” ও। আচ্ছা আপনি তো বেশ কিছুদিন ধরে এখানে আছেন। তো সাঁঝের ব্যাপারে কিছু জানেন?”

ইহান ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি জানবো?”

আতিক ইতস্তত করে বলল,

—” না এই মানে মেয়েটা কেমন তারপর ভার্সিটি ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন এইসব আর কি”

ইহান আবার কাজে মনোযোগ দিতে দিতে বলল,

—” লেখাপড়া তে বেশ ভালো। মানে এক কথায় ভালো স্টুডেন্ট। আর ক্লাস থেকে বাইরে কাজ কারবার বেশি করে। অবশ্য খারাপ কিছু করে না। ভালো কাজই করে। কিন্তু কেন বলুন তো?”

—” আসলে মেয়েটাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। মানে বেশ তেজী মেয়ে। কিন্তু নিজের বিয়ের কথা কিভাবে নিজের মুখে পাত্রীকে বলি? যদি ওর বাসার লোকের সাথে যোগাযোগ করা যেতো তাহলে ভালো হতো। আপনার সাথে আমি একদিন ওকে আসতে দেখেছি। ওর বাসার ব্যাপারে কিছু জানেন? জানলে বলবেন আমি আমার বাসা থেকে প্রস্তাব পাঠাবো”

ইহান বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকলো। কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝছে না। তার কাছে তার বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কথা বলছে? এমন অভিজ্ঞতা কোন মানুষের হয়েছে কিনা সন্দেহ। মুহুর্তে ইহানের রাগ লাগতে শুরু হলো। মানে প্রচন্ড রকমের রাগ। চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা হলো, “শুনুন সাঁঝ আমার বিয়ে করা বউ। ও শুধু আমার। ও আমার আছে আর আমারই থাকবে সবসময়। ওর দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না”

কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছুই বলতে পারলো না। আর একই সময়ে আতিকের ফোন আসায় আতিক উঠে চলে গেলো। আতিক চলে যাওয়ার পরে ইহানের ভিতরে আরেক সত্তা জেগে উঠলো। দ্বিতীয় সত্তা বললো, “তুমি তো ওকে ভেঙে ছেড়ে দিবে”।
প্রথম সত্তা প্রচন্ড ক্রোধে বলল,” কোন ছেড়ে দেয়া টেয়া না। যা ভাঙাচোরা হবে আমার সাথে থেকেই হবে। সাঁঝের ইচ্ছা থাক আর না থাক ও আমার সাথেই থাকবে সারাজীবন। ওর উপর শুধু আমার অধিকার আছে”
ইহান নিজের মাথা চেপে বসলো। বিরক্ত লাগছে। তার লক্ষ্য অন্য কিছু। নিজের লক্ষ্য থেকে সরা যাবে না। ইহানের মনে হলো লম্বা একটা শাওয়ার নেয়ার দরকার। মোবাইলে মেসেজের শব্দ পেয়ে চেক করে দেখলো সাঁঝের মেসেজ এসেছে। “আমার ক্লাস, কাজ শেষ। আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। কখন আসবেন?”
ইহান রিপ্লে করলো, “থাকো আমি আসছি একটু পরে”

নিজের কাজ শেষ করে কাগজপত্র গুছিয়ে ইহান সাঁঝকে খুঁজতে খুঁজতে ক্যান্টিনের দিকে আসার পরে দেখলো সাঁঝ আর আতিক সামনাসামনি বসে হাতে চা নিয়ে কথা বলছে। ইহানের দেখে রাগ হয়ে গেলো। সাঁঝ হঠাৎ হেসে দিলো কথা বলার সময়। এমন কি বলছে যে সাঁঝ হাসবে? দুনিয়ার সবার সাথে সাঁঝ হেসে কথা বলতে পারে শুধু তার সাথে ছাড়া।

ইহান ওদের কাছে না গিয়ে ক্যান্টিন থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো যাতে সাঁঝ তাকে দেখতে পারে। সাঁঝ তাকে দেখতে পেয়ে উঠে তার দিকে আসতে শুরু করে। সে আগে আগে গিয়ে গাড়িতে বসে।

আর এদিকে সাঁঝ ইহানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আতিককে পিছনে রেখে চলে আসলো। সে ইহানের জন্য অপেক্ষা করছিলো ক্যান্টিনে আর কোথা থেকে আতিক স্যার এসে চা খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলো। সাঁঝ মানা করতে পারলো না। আতিক “স্যার” বলে কথা।

সে আসার আগেই ইহান চলে গেলো। সাঁঝের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এতো কি তাড়া ছিলো যে দুমিনিট দাঁড়াতে পারলো না? আজ একটা ছোট খাটো সাজা দিতে হবে ইহানকে। সাঁঝ গাড়িতে এসে বসলো। ইহান তার দিকে মুখ না ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাঁঝ বুঝলো না কি হয়েছে যে এমন মেজাজ দেখাচ্ছে? সে ইহানকে জিজ্ঞেস করবে না কি হয়েছে। কেন জিজ্ঞেস করবে? ইহান গাড়ি চালাতে শুরু করলো।

দুপুর গড়িয়ে বেলা এখন বিকালের দিকে। আকাশের রোদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে। ঝড় বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাতাস এসে লাগছে মুখে। শান্তি লাগছে। সারাদিন এতো গরম ছিলো! বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে। ইহান গাড়িটা বাড়ির দিকে না নিয়ে গিয়ে অন্য দিকে ঘুরালো। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” কোথায় যাচ্ছেন? বাসায় যাবেন না?”

ইহান থমথমে গলায় বলল,

—” কেন আমার সাথে যেতে ভয় করছে?”

সাঁঝের এমন গা জ্বলানো কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তবুও শান্ত স্বরে বলল,

—” সেটা না। এমনি। যেখানে ইচ্ছা চলুন।”

ইহান তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে বলল,

—” যাবে তো?”

—” যাবো না কেন?”

ইহান সামনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আতিক কি বলছিলো?”

—” তেমন কিছু না। এই পড়ালেখা কেমন চলছে এইসব”

ইহান কোন উত্তর দিলো না। সাঁঝ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ইহান শহরের বাইরে এসেছে সাঁঝকে নিয়ে। দুপুরবেলা হোক বা আকাশ মেঘলা সেজন্য হোক যেকোন একটা কারণে রাস্তায় মানুষ নেই। দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে। রাস্তার ধারে সারি সারি উঁচু গাছ লাগানো। গাছগুলো দুপাশ থেকে বেকে এসে রাস্তার উপর ছাউনির মতো তৈরি করেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রাস্তাটা বেশ অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। ইহান একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে দিলো। সে নামলেও সাঁঝ নামলো না।
সাঁঝের পাশে দরজা খুলে বলল,

—” আসো”

সাঁঝ বাইরে এসে দাঁড়ালো। গাড়ির ভিতর থেকে বুঝতে পারেনি রাস্তার একপাশে বড় একটা বিল আছে । তাতে কচুরিপানা আছে। আকাশ মেঘলা হওয়ায় পানিও কালো লাগছে। দারুণ লাগছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরর ইহান বলল,

—” চলো”

—” কোথায়?”

ইহান উত্তর না দিয়ে সাঁঝের হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। সাঁঝের একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো। যে অনুভূতির সাথে সে পরিচিত না। কোন নাম দিয়ে এই অনুভূতিকে সঙ্গায়িত করতে পারলো না। ইহান হাত ধরে একটা গাছের কাছে আনলো। সাঁঝ দেখলো কাঠগোলাপের গাছ। থোকায় থোকায় ফুল ফুটে আছে। সাঁঝ মুগ্ধ হয়ে ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইহান এক ফাকে নিজের ফোন বের করে সাঁঝের অগোচরে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। তারপর ফুল ছিড়ে নিলো।
সাঁঝের পিছনে গিয়ে চুলে ফুল লাগাতে লাগাতে বলল,

—” তোমাকে লাল গোলাপের মোহে না কাঠগোলাপের শুভ্রতায় মানায়”

সাঁঝের ভিতরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো ইহানের কথা শুনে। কিছুটা ভালো লাগাও কাজ করলো।
,
,
,
🌿
বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখছে আর নিজের মেজাজকে ঠান্ডা করার চেষ্টা চালাচ্ছে সাঁঝ। আজ তাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো। দ্বিতীয় ঘুরতে যাওয়া। প্রথমটা ছিলো ভার্সিটি থেকে গাড়িতে করে কাঠগোলাপের গাছের কাছে যাওয়া। আর আজ একমাস পরে অন্য কোথায় যেনো ইহান নিয়ে যাবে বলেছিলো। বিকাল হয়ে গেছে। সে রেডি হয়ে বসে আছে। কিন্তু ইহান এখনো কাজ থেকে বাসায় এসে পৌছায়নি। রুমের ভিতরে কারোর আসার শব্দ শুনে ভিতরে গিয়ে দেখে ইহান এসেছে। তাকে দেখেই বলা শুরু করলো,

—” সরি সরি সরি। দেরী হয়ে গেছে। আসলে বিজনেস মিটিং ছিলো। শেষ হতে লেট হলো”

সাঁঝ কোন উত্তর দিলো না। সে মনে মনে ঠিক করছে ইহানের সাথে কি করা যায়? কোন একদিন ইহানের ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় বাথরুম আটকে বসে থাকবে। তাহলে বুঝবে অপেক্ষা করতে কেমন লাগে!
ইহান শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে কাপড় নিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেলো। একটু পরেই ইহান বাথরুম থেকে বের হয়ে আসলো। সাঁঝের চোখ ইহানের চুলের দিকে গেলো। ঠিকমতো মাথা মোছা হয়নি। চুলে পানি চিকচিক করছে। ইহান তার সামনে এসে বলল,

—” কি হয়েছে বলো তো? মুখ এমন করে রেখেছো কেন?”

সাঁঝ কোন উত্তর দিলো না। ইহান তার দিকে দুই পা এগিয়ে এসে বলল,

—” অন্য কারোর সাথে থাকলে তখন তো হাসতে থাকো। আমার সাথে থাকলে মুখটা এমন করে রাখো কেন?”

সাঁঝ তাও কোন উত্তর দিলো না। ইহান দুই হাত দিয়ে সাঁঝের কোমড় জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি কমতি আছে আমার মধ্যে?”

সাঁঝ ইহানের কাজে আংশিক ভড়কে গেলো। হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,

—” সরি ভুল টাইমে চলে এসেছি। ভাইয়া জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম তুই কি খাবি?”

ইহান সাঁঝকে ছেড়ে দিলো। ইশিতা উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। ইহান বলল,

—” না আমি খেয়ে এসেছি। এখন বের হবো তোর ভাবীকে নিয়ে”

—” আচ্ছা আমি গেলাম”

ইশিতা দৌড়ে চলে গেল। সাঁঝ ইশিতার কান্ডে লজ্জা পেয়ে গেলো। ইহানের সামনে থেকে সরে বারান্দায় চলে আসলো।
,
,
,
🌿
পার্কে এসে সাঁঝের মন ভালো হয়ে গেলো। ইহান লেট করার জন্য যেটুকু রাগ ছিলো সেই রাগ নিয়ে সাঁঝ আবার ভেবে দেখবে বলে ঠিক করেছে। বাথরুম আটকের রাখার শাস্তি দিবে কিনা সেটাও ভেবে দেখবে। ইহান যেখানে এনেছে সেটাকে পুরোপুরি পার্ক বলা যাবেনা। অনেক বড় জায়গা। প্রচুর গাছপালা আছে। নানান রকম ফুলের গাছ। আর বসার জায়গা আছে। পার্কের মধ্যে লেক আছে। টলটলে পানি। লেকের মাঝ দিয়ে আবার ব্রিজ আছে। পায়ে হেটে যাওয়া যায়। দারুণ সুন্দর। কিন্তু সমস্যা হলো এটা বাসা থেকে গাড়িতে আসতে দেড় ঘন্টার পথ। তাই চাইলেই আসা যাবে না।
লেকের মাঝ দিয়ে ব্রিজের উপর হাঁটার সময় সাঁঝ আশেপাশে তাকালো। খুব বেশি মানুষ নেই। দূরে বেঞ্চে নাহলে গাছের নিচে অনেক যুগল বসে আছে। দুই একটা পরিবারও দেখা যাচ্ছে। গল্প করছে। ব্রিজে শুধু সে আর ইহান। ব্রিজের দুপাশে অবশ্য রেলিং দেয়া নেই। বাচ্চাদের জন্য বিপদজনক।
ইহান হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,

—” তুমি সাঁতার জানো?”

—” নাহ”

ইহান হঠাৎ সাঁঝের হাত ধরে পানির দিকে পিঠ বরাবর ঝুকিয়ে দিলো। সব এতো দ্রুত হলো যে সাঁঝ প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো। সে দুই হাত দিয়ে ইহানের হাত ধরলো। ইহান মুখে একটু হাসি ঝুলিয়ে বলল,

—” আমি এখন হাত ছেড়ে দিলে কি হবে?”

সাঁঝ ওইভাবে ঝুলে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে ইহানের মতো একটু বাঁকা হেসে বলল,

—” আমি পড়ে গেলে আপনি তো আছেন বাঁচানোর জন্য”

এরপর সাঁঝ মুহুর্তের মধ্যে ইহানের পায়ের সাথে নিজের পা বাঁধিয়ে ইহানের হাত শক্ত করে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইহানের পিছনে এসে দাঁড়ালো। ইহান অবাক হয়ে গেলো। কারণ ইহানের ধারনার মধ্যেও ছিলো না কেউ ঐরকম অবস্থা থেকে নিজে নিজে সোজা হতে পারবে। সাঁঝ পিছন থেকে বলল,

—” এবার আমি যদি আপনাকে ধাক্কা দিই?”

ইহানের অবাকের রেশ কাটছে না। সে বলল,

—” আমি সাঁতার জানি। সাঁতার জানা মানুষ জ্ঞান থাকা অবস্থায় ডুবে না”

এরপর সাঁঝ ইহানের পাশে চলে আসলো। দুজনে আবার হাঁটা শুরু করলো। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনি ওরকম করলেন কেন?”

—” তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য”

সাঁঝ হাসলো। ইহান আবার বলল,

—” By the way তুমি কিন্তু খুব ট্রিকস জানো”

এবারও সাঁঝ কিছু বললো না।

পার্ক ঘোরা শেষ হলে দুজনে বাইরে চলে আসলো। পার্কের ভিতরে কোন কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাইরে মেইন রাস্তায় আসার পর একটা ফুচকার দোকান আছে। পাশে আরো কয়েকটা স্টল আছে। ফুচকা ইহানের তেমন পছন্দ না হলেও সাঁঝের বেশ ভালো লাগে। তাই ফুচকা খাবে বলে ঠিক করে। কিন্তু ওখানে বেশ ভীড় আর বসার জায়গা নেই। তাই ইহান সাঁঝকে রাস্তার অপর পাশে থাকতে বলে। ফুচকা কিনে নিয়ে এসে গাড়ির সামনে বা ভিতরে বসে খাবে।

ইহান ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। একসময় হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মাঝে চলে যায়। অল্প কিছু গাড়ি যাচ্ছে। তাই হাঁটতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না ইহানের। আর সাঁঝ আশেপাশের গাছগাছালিগুলো দেখছে। সামনে তাকিয়ে দেখলো ইহান এখনো ফোনে কথা বলছে। অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই৷ আর বিপরীত দিক থেকে অল্প গতিতেই একটা ট্রাক প্রায় ইহানের কাছে চলে এসেছে কিন্তু হর্ণ দিচ্ছে না। সাঁঝ চিৎকার দিয়ে বলল,

—” ইহান পিছনে ট্রাক”

ইহান পিছনে ঘুরে সরে আসতে আসতে এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো। ট্রাকটা না থেমে বরং গতি বাড়িয়ে চলে গেলো। আর সাঁঝ দেখলো ইহান রাস্তায় পড়ে আছে। রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে রাস্তা। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-১৪

0

#কানামাছি
#পার্টঃ১৪
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
একটা বাচ্চার ছবি হাতে নিয়ে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করছে সাঁঝ। পুরানো দিনের ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একদিকে ছেড়া ছবিটার। বাচ্চাটাকে কেউ কোলে করে আছে। যে কোলে করে আছে সেও নিতান্তই ছোট কিন্তু তার ছবি নেই। ছিড়ে ফেলা হয়েছে। সাঁঝ বুঝতে পারলো না এটা কার ছবি। আজ ইহানের আলমারি গুছানোর সময় আর নিজের ডায়েরী লুকানোর জায়গা খুঁজতে গিয়ে এটা পেয়েছে। বেশ ভিতরের দিকে ছিলো এটা। সাঁঝ ছবিটা পাশে রেখে দিয়ে আলমারি গোছানোতে মন দিলো। ইহান বাসায় নেই নাহলে ওর কাছেই জিজ্ঞেস করতো। কাজ শেষ হলে ইহানের মায়ের কাছে গেলো। আজকাল সে শাশুড়ীকে আম্মু বলেই ডাকছে। মালিহা বেগম রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলো। সাঁঝ ডাকলো,

—” আম্মু”

—” হুম কিছু বলবা?”

—” কিছু হেল্প করে দিবো?”

—” না হেল্প করতে হবে না। তোমার না ভার্সিটিতে যেতে হবে?”

সাঁঝ ইতস্ততভাবে ছবিটা সামনে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” এই বাচ্চাটাকে?”

মালিহা বেগম হাতের কাজ রেখে ছবিটার দিকে তাকালো ভালো করে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল,

—” জানিনা তো কে এটা! চিনতে পারছি না। কার ছবি? কোথায় পেলে?”

—” আমিও জানিনা এটা কার ছবি।”

—” কোথায় পেলে?”

সাঁঝ বিপদে পড়ে গেলো। কি উত্তর দেবে এখন? যদি বলে ইহানের আলমারিতে তাহলে বিষয়টা ভালো হবে না। এর থেকে একবারে ইহানকে জিজ্ঞেস করলেই ভালো হতো। আমতা আমতা করে বলল,

—” ওই পেলাম আর বাসার বাইরে পড়েছিলো”

মালিহা বেগম আবার কাজে মন দিতে দিতে বলল,

—” বাইরে পড়ে ছিলো তাহলে হবে হয়তো কারোর। কাজের লোক, দাড়োয়ান, ড্রাইভার তাদের কারোর নাহলে উড়ে এসেছে”

—” হ্যা হতে পারে”

—” তুমি রেডি হবা না? যেতে হবে তো! যাও রেডি হয়ে নাও”

—” হুম যাচ্ছি”

সাঁঝ ঘরে চলে আসলো। ইহানকেই জিজ্ঞেস করতে হবে কে এটা। ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ যেতেই মনে হলো তাদের বিয়ের তিনমাস পার হয়ে গেছে এরমধ্যেই। এই কয়েকদিনে ইহান তার ভালো খেয়াল রেখেছে। বারান্দায় আটকে যাওয়ার পরে সে ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিলো যেটা কাটাতে বেশ সময় লেগেছে। ইহান এই সময়ে অনেক খেয়াল রেখেছে। যদিও সাঁঝের এখন মানুষের উপর সন্দেহ হয়। আসলেই তারা খেয়াল রাখে, না শুধু নিজের প্রয়োজন? হঠাৎ দেখা যাবে ইহান তাকে একা করে মাঝ রাস্তার মধ্যে ছেড়ে চলে গেছে । এই সব কিছুর জন্যই সে মানসিকভাবে প্রস্তুত আছে।
,
,
,
🌿
ভার্সিটিতে এসে মাঠে আশিকের দেখা পেলো। অনেক দিন পরে দেখছে। ফাইনাল ইয়ারদের পরীক্ষাসহ নানা ব্যস্ততা চলছে। তাই ওদের দেখা পাওয়া যায় না। সাঁঝকে দেখেই আশিক বলল,

—” কি ম্যাডাম স্যার কই?”

সাঁঝ একটু রাগত্ব স্বরে বলল,

—” কে তোর ম্যাডাম?”

আশিক হাই তুলতে তুলতে বলল,

—” স্যারের বউকে ম্যাডামই বলে”

—” এখন স্যারের বউ পরিচয়টা বড় হয়ে গেলো? আমি যে আগে ফ্রেন্ড সেটা ভুলে গেলি?”

—” আরে না না এমনি বললাম। মজা করছিলাম”

—” হুম। তারপর বল পরীক্ষা কেমন হলো? তোরা চলে গেলে গ্রুপের দায়িত্ব কে নিবে?”

—” নিবে কেউ। তুইও নিতে পারিস। বর লেকচারার আর বউ ভার্সিটিতে মস্তানি করে। ভালো কম্বিনেশন”

আশিক হেসে দিলো। সাথে সাঁঝও হেসে দিলো। বলল,

—” হ্যা ভালোই কম্বিনেশন। স্যারের বউ গুন্ডি! আচ্ছা থাক ক্লাস আছে আমি গেলাম”

—” আচ্ছা”

পর পর দুটা ক্লাস করে ক্যান্টিনে এসে বসার সাথে সাথে ইহানের ফোন আসলো। ফোন তোলার সাথে সাথে ইহান বলল,

—” ৩০২ নাম্বার রুমে আসো এখনই”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কেন?”

—” আসতে বলছি আসো”

সাঁঝ কঠিন স্বরে বলল,

—” আমার কাজ আছে আমি আসতে পারবো না এখন”

ইহান হয়তো কিছুটা বুঝলো তার কথা। বলল,

—” কাজ শেষ হলে এসো।”

সাঁঝ ফোন কেটে দিলো। গ্রুপের কাজ শেষে প্রায় আধা ঘন্টা পরে সাঁঝ ৩০২ নাম্বার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এই রুমে ক্লাস হয়না। দরজাটা একটু টেনে দেওয়া আছে। ভিতরে ঢুকে দেখলো ইহান টেবিলে বসে কাজ করছে। রুমটা অন্ধকার। কেবল একটা জানালা খোলা আছে। সাঁঝ রুমের ভিতরে ঢুকে ইহানের সামনে থাকা হাই বেঞ্চে বসলো। ইহান একবার মাথা তুলে সাঁঝকে দেখে আবার কাজ করতে থাকলো। অনেকক্ষণ কিছু বললো না ইহান। এরপর সাঁঝ বিরক্ত হয়ে বলল,

—” আজব! ডেকেছেন কথা বলবেন না?”

ইহান কিছু বলল না। সাঁঝের মেজাজ খুব গরম হয়ে গেলো। রেগে বলল,

—” আপনি কি কিছু বলবেন না আমি চলে যাবো? আমাকে কি এই আধা অন্ধকার রুমে আপনার সামনে বসে থাকার জন্য ডেকেছেন?”

ইহান নিজের কাজ থামিয়ে হেঁটে সাঁঝের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাঁঝের দিকে ঝুকে চোখের দিকে তাকালো। একদম ঠান্ডা দৃষ্টি। সাঁঝের কিছুটা অস্বস্তি হলো ইহানকে এতো কাছে দেখে। সাথে লজ্জাও পেলো। ইহান ঠান্ডা গলায় বলল,

—” খুব হাসছিলে না তখন মাঠের মধ্যে? এতো কিসের হাসি তোমার?”

সাঁঝের কিছুক্ষণ সময় লাগলো বুঝতে ইহান আসলে কিসের কথা বলছে। তারপর মনে পড়লো আজ মাঠে দাঁড়িয়ে আশিকের সাথে কথা বলছিলো। সে কিছু বলতে যাবে তার আগে ইহান আরেকটু ঝুকে আসলো। এবার ইহানের নিঃশ্বাস সাঁঝের মুখের উপর পড়তে শুরু করলো। ইহান বলল,

—” কৈ অন্য সময় তো এতো হাসতে দেখিনি! আমার সাথে থাকলেও তো মুখ গোমড়া করে থাকো। ও এমন কি বলেছে যে এতো আনন্দ হচ্ছিলো?”

ইহানের কথা, চোখের দৃষ্টি আর এতো কাছে আসা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে ইহানের বুকে কনুই দিয়ে গুতা মারলো। ইহান সরে গেলে সাঁঝ বলল,

—” পেঁচার সাথে থাকলে মুখ পেঁচার মতো হয়েই থাকবে”

ইহান টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে বলল,

—” আমি পেঁচা?”

সাঁঝ বাঁকা হেসে বলল,

—” আমি কখন আপনাকে পেঁচা বললাম? আপনি যদি নিজেকে পেঁচা ভাবেন তাহলে আমার কিছু করার নেই। আর মাঠে যার সাথে কথা বলছিলাম সে আমার বন্ধু আশিক”

—” ভালোই সখ্যতা দেখছি ওর সাথে। প্রায় দুজনকে একসাথে দেখা যায়”

—” স্পেশাল বন্ধু বলে কথা। একসাথে তো দেখা যাবেই! আমাদের পরিচয় অনেক দিনের। এই তিন চার মাসের না”

—” তাতো বটেই। ক্লোজ ফ্রেন্ড বলে কথা!”

সাঁঝ আর কিছু বললো না। ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ব্যাগ থেকে সেই বাচ্চার ছবিটা বের করে ইহানের দিকে ধরে বলল,

—” এটা কে?”

ইহান প্রথমে ছবিটা দেখতে না পেয়ে ভালো করে তাকাতেই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সাঁঝের কিছুটা অবাক লাগলো। কার ছবি এটা যে ইহানের মুখের রঙ এভাবে পরিবর্তন হবে?
ইহান সাঁঝের চোখের দিকে তাকালো। সাঁঝের শান্ত দৃষ্টিতে কৌতুক আর রহস্য খেলা করছে। মনে হচ্ছে ও এটার ব্যাপারে জানে। ইহান কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” তুমি এটা কোথায় পেলে?”

সাঁঝ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

—” আপনার আলমারি গোছানের সময় পেয়েছি”

—” এটা আমার ভা….”

ইহানের কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল,

—” আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছি। উনি জানেন না এটা কে। আপনার কোন কাজিন নাকি? কিন্তু কাজিন হলে আম্মু কেন চিনবে না?”

ইহান সাঁঝের দিকে তাকালো। এই সাঁঝ বজ্রপাতে ভয় পাওয়া ভিতু না সাঁঝ না। তেজী মেয়ে। এই সাঁঝ অনেক কিছু করতে পারে। কোন কথা ধরে অনেক দূর যেতে পারে। সাঁঝ যখন নিজের এই রূপে থাকে তখন তাকে থামানো কঠিন কাজ। ইহান বলল,

—” এটা আমার একটা বন্ধু। ওর ছোটবেলার একটা ছবি আমার কাছে আছে। আর আমার ছোটবেলার একটা ছবি ওর কাছে আছে”

—” ও। কিন্তু একপাশে ছেড়া কেন?”

—” আমি জানিনা। যখন দিয়েছিলো তখন ছেড়াই ছিলো”

—” আপনি জিজ্ঞেস করেননি কেন ছেড়া? মনে হচ্ছে পাশে যে ছিলো সে এই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ছিলো”

—” জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু তেমন কোন উত্তর দেয়নি। পাশে কে কোলে নিয়ে ছিলো সেটা জানিনা”

—” আচ্ছা”

সাঁঝ ইহানের হাতে ছবিটা দিয়ে দিলো। বলল,

—” আমি আসি এখন আমার ক্লাস আছে। তারপর বাসায় যাবো”

—” একাই যাবা নাকি আমি রেখে আসবো?”

—” না আপনাকে যেতে হবে না। আপনার কাজ আছে তো। আমি একাই যেতে পারবো।”

—” সাবধানে যেও”

—” হুম আমি আসি”

রুম থেকে বের হওয়ার সময় সাঁঝের উড়ো ভাবে মনে হলো আচ্ছা বাচ্চাটা কি ইহান? আবার মনে হলো, ইহান কিভাবে হবে? ইহান হলে আম্মু চিনতো না? কি যে ভাবছি সে!
,
,
,
🌿
ইহান সাঁঝের দেয়া ছবিটার দিকে তাকিয়ে নিজের ছোটবেলার কথা মনে করতে শুরু করলো। ছবিটা অনিকের। আর পাশে অনিককে কোলে নিয়ে সে বসে ছিলো। নিজের অংশটুকু কেটে সে বাদ দিয়ে রেখেছে।

অনিক তার চাচাতো ভাই। বড় চাচার প্রথম সন্তান। কিন্তু অনিকের কথা পরিবারের মধ্যে চাচা, সে আর তার বাবা ছাড়া কেউ জানেনা। ইহানের দাদু খুব মেজাজই, রাগচটা আর কড়া মানুষ ছিলেন। তাই উনি বিয়ের আগে ভালোবাসাকে সমর্থন করতেন না। বড় চাচা একজনকে ভালোবাসতো। সেই মেয়েটির সাথে বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিলো না। তাই চাচা লুকিয়ে বিয়ে করে নেয়। তার বাবা বয়সে চাচার থেকে ছোট হলেও বিয়ে আগে হয়েছিলো। তাই তার জন্মও হয়ে গিয়েছে ততদিনে। এরপর ইহানের যখন চার-পাঁচ বছর বয়স তখন অনিকের জন্ম হয়। তখনও চাচার বিয়ের খবর কেউ জানতো না। অনিকের জন্মের সময় অনিকের মা মারা যায়। তখন বড় চাচা ভীষণ বিপদের পড়ে। কাউকে কিছু বলতে পারবে না বিয়ের ব্যাপারে। পরিবার থেকে অনেক ঝামেলায় পড়বে। এবং সম্ভাবনা ছিলো যদি আশেপাশের মানুষ অনিকের কথা জানতে পারে তাহলে অনিকের মায়ের নামে অনেক বাজে কথা বলবে। কারণ সবটাই সবার থেকে লুকানো ছিলো। অনিকের মায়ের পরিবারের দিক থেকেও লুকানো ছিলো সব। আর অনিকের নানার বাসার লোকজন গরিব হওয়ার সেখানে অনিককে রাখা সম্ভব ছিলো না। তখন বড় চাচা অনিককে একটা শিশু নিবাস কেন্দ্রে রাখতো। দিনের বেলাতে গিয়ে অনিকের দেখা শোনা করতো। ছোট বাচ্চার সাথে খেলার জন্য পার্কে ঘোরার নাম করে ইহানকে নিয়ে যেতো। বাড়ির কেউ ইহানের যাওয়া নিয়ে আপত্তি করতো না। ইহান যেয়ে খেলতো অনিকের সাথে। বড় চাচা মানা করে দিয়েছিলো যাতে বাড়ির কাউকে সে কিছু না জানায়।

এরপর দাদু বড় চাচার সাথে রাগারাগি শুরু করে এতোদিনেও বিয়ে না করার জন্য। আর জোরাজুরি করে বড় চাচির সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন অনিককে নিয়ে আরেক সমস্যা হয়। বিয়ের পরে বড় চাচার পক্ষে প্রতিদিন ওখানে গিয়ে খেয়াল রাখা কষ্টকর হয়ে যায়। তাও উনি ইহানকে সাথে নিয়ে যেতো। ইহান খেলা করতো, ঘুম পাড়াতো আর বাকি সব কাজে সাহায্য করতো। সে নিজে অল্প বয়সী হলেও বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতো। এরপর যখন অনিকের বয়স এক বছরের কাছাকাছি তখন শিশু নিবাস কেন্দ্রে এক নিঃসন্তান দম্পতি আসে বাচ্চা এডপ্ট করার জন্য। তারা অনিককে পছন্দ করে। বড় চাচা খোঁজ খবর নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করে এটাই হয়তো ঠিক হবে। অনিককে নিজের সাথে রাখতে পারবে না। হাজারটা প্রশ্ন আসবে অনিকের জন্ম, পরিচয়, মায়ের উপর। এর থেকে অন্য একটা পরিবারে ভালো থাকলে ভালো হবে। অনেক কষ্টে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। অনিককে যারা এডপ্ট করেছিলো তারা ভীষণ ভালো মানুষ। তাই এরপরের আড়াই বছর পর্যন্ত বড় চাচা আর সে অনিকের সাথে দেখা করতে প্রায় প্রতিদিন যেতো। ইহানের স্কুলের পরে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে বা বড় চাচার সাথে থাকার নাম করে ওখানে যেতো। বাড়িতে তেমন কেউ জিজ্ঞেস করতো না কোথায় ছিলো তাই ইহানকে তেমন মিথ্যা বলতে হয়নি।

কিন্তু আড়াই বছর পরে বড় চাচা ঠিক করেন উনি আর অনিককে দেখতে যাবেন না। অনিক বড় হচ্ছে। আর তাছাড়া নতুন মা-বাবাও হয়তো বড় চাচার প্রতিদিন যাওয়া পছন্দ করবে না। কিন্তু ইহান যাওয়া বন্ধ করলো না। অনিককে ছাড়া তার দিন কাটতো না। ওকে একপ্রকার নিজের হাতে খাইয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে, খেলা করেছে। কিভাবে থাকবে? তাই বড় চাচা যাওয়া বন্ধ করলেও ইহান যেতো। চাচা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতো বাড়িতে বলে। আর অনিকের নতুন বাবা-মাও তাকে পছন্দ করতো। নিজেদের বড় ছেলের মতো দেখতো। একটু বড় হওয়ার পরে ইহান নিজেই চলে যেতো। ছোট বেলা থেকেই সে স্বাধীনতা পেয়েছে। তাই অনিকের কাছে যেতে কোন সমস্যা হতো না। অনিক আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো আর তাকে নিজের বড় ভাই বা বিগ ব্রো হিসেবে জানতো।

আজ থেকে সাত-আট বছর আগে যখন ইহান উনিশ-বিশ বছরের ছিলো তখন তার বাবা সবটা জানতে পারে। এবং বড় চাচার সাথে এটা নিয়ে রাগারাগি করে। তার সাথেও রাগারাগি করে কেন যোগাযোগ রেখেছে অনিকের সাথে? যদিও ব্যাপারগুলো শুধু তাদের তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তাও ইহান সেবার বাবার রাগ দেখে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এবং কথা দিয়েছিলো আর অনিকের সাথে কোনপ্রকার যোগাযোগ রাখবে না। সেই থেকে অনিকের সাথে সেভাবে কোন যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ বন্ধ করার কিছু দিনের মধ্যে অনিকরা এই শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। কিন্তু মন কি মানে? তাই ইহান বড় চাচার কাছে ফোন করে অনিকের ব্যাপারে খোঁজ নিতো। যদিও বড় চাচা তেমন কিছু জানতো না। শুধু কেমন আছে, পড়ালেখা করছে, পুলিশের চাকরি পেয়েছে এগুলো অনিকের মায়ের কাছ থেকে জেনেছিলো। সেগুলোই ইহানও জেনে নেয়। এরপর তো সে দেশের বাইরে চলে যায়। আর আসার বেশ কিছুদিন পরে শোনে অনিক আহত মিশনে গিয়ে।

ইহান পুরানো ঘটনাগুলো মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাঁঝ অনিকের অনুভুতির সাথে খেলা করেছে একবছর ধরে। এরপর অনিককে ভেঙে দিয়েছে। সাঁঝের শাস্তিটাও সে একই ভাবে দিবে। সময় ইনভেস্ট করবে সাঁঝের পিছনে। তারপরে ভেঙে ছেড়ে দিবে।
কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই সাঁঝের সাথে কিছু মুহুর্তে, সাঁঝের কিছু ছবি চোখের সামনে চলে আসে। ওর বুকে মাথা রেখে কান্না করা, ভরসা পেয়ে কাঁধে মাথা রাখা, শাড়ি পরে নিজের বউ রূপে দেখা, যখন রেগে যায় সেই তেজী রূপে মুগ্ধ হওয়া , ভেজা চুল যখন বিরক্ত হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মোছে সেই স্নিগ্ধ রূপ দেখে স্নিগ্ধতার পরশ অনুভব করা, “কোথায় ছিলেন আপনি?”এই অভিযোগের সুরসহ সবটা দেখতে আর কানে শুনতে পায়। সাঁঝের সামনে গেলে ভুলে যায় কি উদ্দেশ্য তার। নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হয় সাঁঝ কি করেছে অনিকের সাথে আর সে কি শাস্তি দেয়ার জন্য সাঁঝকে বিয়ে করেছে! কেন বারবার নিজেকে মনে করাতে হয়? (চলবে)

কানামাছি পর্ব-১৩

0

#কানামাছি
#পার্টঃ১৩
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
ইহানের গায়ের উপর ঢলে পড়লো সাঁঝ। বৃষ্টির পানিতে আপাদমস্তক ভিজে গেছে। চোখ বন্ধ করার আগে তার মনে হলো কেউ ধরে নিয়েছে তাকে।

চোখ খুলে নিজেকে ঘরে আবিষ্কার করলো সাঁঝ। মাথাটা ঝিনঝিন করছে। উঠে বসলো। তখনই চোখের সামনে আলোর ঝলকানি দেখতে পেলো। তার মনে হতে থাকলো জোরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। কান চেপে ধরলো। তাও শব্দ কমছে না। বরং ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে মাথার ভিতরে শব্দটা গেথে গিয়ে বারবার প্রতিফলিত হচ্ছে। সাঁঝের মনে হলো কান থেকে এখনই রক্ত বের হতে শুরু করবে। চোখের সামনে ঘরের ভিতরে যেন বজ্রপাত দেখতে পাচ্ছে। যতটা সম্ভব হলো গুটিশুটি মেরে বসলো। এখনই মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে যাবে।

ইহান ঔষধ কিনে নিয়ে ঘরে এসে দেখলো সাঁঝ কান চেপে ধরে বিছানার এক কোণে বসে আছে। এতো তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরেছে বেশ অবাক হলো। সাঁঝ চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ইহান সামনে গিয়ে বলল,

—” সাঁঝ! উঠে পড়লে কেন? শুয়ে পড়ো। ডাক্তার রেস্ট নিতে বলেছে”

সাঁঝ মনে হলো তার কোন কথায় শুনতে পেলো না। ইহান সাঁঝের হাত ধরে ডাকলো,

—” সাঁঝ!”

সাঁঝ চোখ খুলে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” শব্দটা বন্ধ করুন। আমি আর শব্দ নিতে পারছি না। আমি মরে যাবো”

ইহান অবাক হয়ে বলল,

—” কোথায় শব্দ? কোন শব্দ নেই তো”

সাঁঝ কোন জবাব দিলো না। হয়তো তার কথায় শুনতেই পায়নি। ইহান সাঁঝের কান থেকে জোর করে হাত সরিয়ে নিলো।
সাঁঝের মুখে অবর্ননীয় আতঙ্ক দেখা দিলো। সে আরো গুটিশুটি মেরে বসলো। ইহানের কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। ইহান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

—” কোন শব্দ নেই এখানে। আমি আছি শুধু। আমার কাছে আসো”

—” বজ্রপাত আমাকে শেষ করে দিবো”

—” সাঁঝ কোন বজ্রপাত নেই। এখন আকাশ পরিষ্কার”

সাঁঝ একটু শুনলো। ইহানের কথা একটু বিশ্বাস হলো হয়তো। ইহানের দিকে এগিয়ে গেলো। একসময় ইহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না শুরু করলো। ইহান সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও সাঁঝের কান্নার মাত্রা ক্রমাগত বাড়তেই থাকলো। একসময় কান্নাটা চিৎকার দিয়ে কান্নায় পরিণত হলো। মনে হলো ভিতরের সব আর্তনাদ বের হয়ে আসবে। সাঁঝের চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই তাদের রুমে এসে পৌছালো। ইহানের মা এসে সাঁঝ কে কিছু বলতে গেলে ইহান ইশারায় তাদের থামিয়ে দিয়ে ঘর থেকে যেতে বলে। সাঁঝ কান্না করতেই থাকলো। একসময় কান্না করতে করতে ঘুমিয়েও গেলো। হয়তো ঘুমের ঔষধ যেটা দেয়া হয়েছিলো সেটা কাজ করছে। ইহান সাঁঝকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কেন যেন সাঁঝের এই আর্তনাদ তার সহ্য হচ্ছে না!
,
,
,
🌿
মাঝরাতে সাঁঝের ঘুম ভেঙে গেলো। অন্ধকার ঘরে ভয় জাপটে ধরলো। মনে হলো আবার শব্দ হচ্ছে। সাঁঝ ডেকে উঠলো,

—” ইহান”

প্রথমবার সাড়া না পেয়ে সাঁঝ আবার ডাকলো,

—” ইহান উঠুন। আমার ভয় করছে”

ইহান সাঁঝের গলা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলো। লাইট জ্বেলে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি হয়েছে?”

—” আমার ভয় লাগছে”

—” ভয় পেও না। আমি আছি এখানে”

সাঁঝ ইহানের কাঁধে মাথা রাখলো। বলল,

—” আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। বাবা আর ভাইয়ার মতো আমাকে একা করে স্বার্থপরের মতো যাবেন না প্লিজ। মনে রাখবেন একজন মানুষ আপনার পথ চেয়ে বসে আছে”

ইহান কিছু বলল না। সাঁঝ আবার বলতে শুরু করলো,

—” ছোট বেলা থেকে আমি বজ্রপাতে ভয় পাই। তখন শব্দ হলেই দৌড়ে বাবার কাছে চলে যেতাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম। তারপর একদিন বাবা আমাকে একা করে চলে গেলো। এরপর ভয় পেলে ভাইয়ার হাত ধরে বসে থাকতাম। কিন্তু ভাইয়াও চলে গেল আমাকে ছেড়ে। এরপর থেকে বৃষ্টি হলেই আমি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ কানে হেডফোন গুজে বসে থাকতাম। নাহলে দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতাম। আমার ভয়ের কোন সঙ্গী নেই।”

ইহান কাঁধে পানির অস্তিত্ব টের পেলো। সাঁঝ কান্না করছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,

—” আমি আছি। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

—” হুম”

ইহান সাঁঝের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। একসময় সাঁঝ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। ইহান সাঁঝের মুখ পানে তাকিয়ে দেখলো।।
,
,
,
🌿
টেবিলল্যাম্প জ্বেলে ইহান কিছু কাগজ নিয়ে বসে আছে । একবার সাঁঝের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো। ইহানের মনে হয় সাঁঝ ভিতরে ভিতরে একটা নিঃসঙ্গ, অভিমানি, জেদি, ছোট বাচ্চা। যে একটা ভাঙা পরিবার থেকে এসেছে। ভালোবাসা পায়নি তাই অসম্ভব রকমের জেদি। নিজের কষ্টগুলো ঢাকার জন্য মুক্তি পাওয়ার জন্য অন্য মানুষকে আঘাত করে কষ্ট দেয়। অন্যের অনুভূতির সাথে খেলা করে। হয়তো এতে মনে শান্তি পায়।
এই ভীতু, অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকা বাচ্চার একটা হাত দরকার যে তাকে টেনে আলোতে আনবে। যে আলোকে সাঁঝ হয়তো ভয় পায়। সাঁঝের ভিতরের যে সত্তাটা মানুষকে আঘাত করে, একটু একটু করে কষ্ট দিয়ে মারতে পছন্দ করে সেই সত্তাটাকে শেষ করা প্রয়োজন। ইহানের মনে মায়া হলো কিছুটা। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে বলল,
“সাঁঝকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করো। তোমার কিছু উদ্দেশ্য আছে। আর সেই কাজ তোমাকে করতে হবে”

ইহান একটা কাগজ মেলে ধরলো। তাকে লেখা অনিকের শেষ চিঠি। যেদিন অনিকের মিশনে যাওয়ার কথা ছিলো সেদিন লেখা।

বিগ ব্রো,
সাঁঝ আমার সাথে সম্পর্কটা শেষ করে ফেলেছে। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ও অন্য কারোর হয়ে যাবে। আমি কিভাবে নিজের খুশিটা অন্য কোন মানুষের হতে দিবো? আমি ওর কাছে গেলে ও যে নিজেকে শেষ করে দিবে। আমি ওর মৃত্যুর কারণ কখনো কোনদিন কোনভাবেই হতে পারবো না। আমার যে ওকে ছাড়া নিঃশ্বাসটুকু নিতেও কষ্ট হচ্ছে! আমি কিভাবে নিজের খুশি ছাড়া নিজের প্রাণটা ছাড়া বাঁচবো? আদোও কি আমি বাঁচতে পারবো? আমি পারবো না। তুমি ভালো থেকো। খুব ভালো থেকো।
লিটিল

চিঠিটা পড়ে ইহানের সাঁঝের প্রতি মায়াটা কেটে গেলো। সাঁঝ ইচ্ছা করে অনিককে মিথ্যা বলেছে। নাটক করেছে। অনিক কতো মিনতি করেছিলো! সে কল রেকর্ড শুনেছিলো সাঁঝে আর অনিকের কথার। এরপর সাঁঝ একটা মিথ্যা ভয়েস রেকর্ড ছড়িয়ে দেয় যাতে অনিকের নাম ছিলো। সেই ভয়েস রেকর্ডের কোন প্রমান নেই। কিন্তু মুহুর্তের মাঝে যেটা অনিকের জীবনকে একটা বিভীষিকা বানিয়ে তুলেছিলো। এইসব কারণে অনিক ইচ্ছা করে অপারেশনের সময় গুলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার সামনে এটা একটা এক্সিডেন্ট হলেও আসলে এটা একটা আত্মহত্যার প্রচেষ্টা ছিলো।

অনিক তার চাচাতো ভাই হলেও সে নিজে অনিকের বড় হওয়া দেখেছে। বলতে গেলে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। অনিক অনেকটাই তার সন্তানের মতো। অনেকগুলো বছর অনিকের থেকে দূরে ছিলো কিছু প্রতিজ্ঞার কারণে। কিন্তু সন্তানের থেকে দূরে থাকলেও কি ভালোবাসাটা কমে?কমে না। আর অনিকের বর্তমান এই অবস্থার কারণ সাঁঝ। সাঁঝকে তো শাস্তি পেতেই হবে।

ইহান চিঠিটা রেখে তার আর অনিকের ছোটবেলার একটা ছবি বের করলো। কিছুক্ষণ দেখার পর ছবিটা অতি যত্নে সবার চোখের আড়ালে থাকবে এমন একটা জায়গায় রাখলো। যার নাগাল কেউ পাবে না।

সাঁঝের পাশে শুয়ে সাঁঝের মুখের আতঙ্কটা পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। চোখ বন্ধ করলে একদিকে সাঁঝে আর্তচিৎকার আর আরেকদিকে দিনের পর দিন আইসিইউএর বেডে শুয়ে অনিকের মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ের ছবি ভেসে উঠলো। নিজের কাছে মনে হলো দোলাচালে পড়েছে সে! কেন মনে হলো বুঝলো না। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-১১+১২

0

#কানামাছি
#পার্টঃ১১
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
—” অনিক ছাড়ো আমাকে। বাঁচাও কেউ আমাকে। অনিক ছাড়ো। কেউ আছে আশেপাশে?”

সাঁঝের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিক।সাঁঝের গলা চেপে দাঁড়িয়ে আছে অনিক। সাঁঝের মুখ শুকিয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে তীব্র শ্বাসকষ্টে এখনই মারা যাবে। অনিক হিংস্রভাবে বলল,

—” আমারও ঠিক এমনই লাগছিলো সেদিন যেদিন তুমি আমার সাথে সম্পর্কটা ভেঙে দিয়েছিলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো তোমাকে ছাড়া। কিন্তু তুমি তো বিয়ে করে নিলে এই ইহানকে”

সাঁঝ চেষ্টা করেও অনিকের লোহার মতো হাতকে ছাড়াতে পারছে না। মনে সাড়াঁশির মতো চেপে ধরেছে। অনিক আবার বলল,

—” কি ছিলো এই ইহানের মধ্যে যা আমার মধ্যে নেই”

সাঁঝ কোন উত্তর দিতে পারছেনা। অনেকক্ষণ হাসফাস করার পরে অনিকের হাত একটু হালকা হলে জোরে একটা লাত্থি মারলো অনিককে।
হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার শুনে সাঁঝ জেগে বসলো। অন্ধকারে কোন একটা জায়গায় আছে। এখনো মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাঁঝ নিজের মাথা চেপে ধরে বসলো। চিন্তা ভাবনা ধোয়াশার মধ্যে আছে। আ… একটা মৃদু চিৎকারে মাথা একটু পরিষ্কার হলো সাঁঝের। মনে পড়লো কাল তার বিয়ে ছিলো আর সে এখন বাসর রাতে আছে। পাশে তাকিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই দেখলো ইহান নেই। সাঁঝ ডাকলো,

—” ইহান?”

—” আ… আ.. আমি এখানে”

বিছানার ওপাশ থেকে ইহানের আওয়াজ শুনে সাঁঝ টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঝুকে দেখলো ইহান চোখ মুখ কুচকে নিজের কোমড় চেপে নিচে শুয়ে আছে।
সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো

—”আপনি এখানে কিভাবে?”

ইহান বলল,

—” আমি কি দোষ করেছিলাম সাঁঝ? এতো জোরে কিক মেরে ফেলে দিলে কেন নিচে?”

সাঁঝ একটু বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—”ওটা আপনার লেগেছে?”

—” হ্যা তোমার পাশে আমি বাদে আর কেউ ছিলো না তো!”

সাঁঝ মনে মনে বলল,”স্বপ্নে অনিককে মেরে বাস্তবে আপনার লাগলো”
তারপর বলল,

—” আচ্ছা আসুন। খুব বেশি লেগেছে?”

সাঁঝ ইহানকে তুলে বিছানায় বসালো। ইহান বলল,

—” তাও লেগেছে একটু”

—” মুভ বা এই টাইপের কিছু নেই?”

—” হ্যা ওই বেডসাইড টেবিলের নিচের ড্রয়ারে আছে”

সাঁঝ ইহানের কোমড়ে স্প্রে করতে করতে বলল,

—” এজন্য রাতে বলেছিলাম একটা ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার দিই। আপনিই আমাকে বর্ডার দিতে না দিয়ে শুধু একটা বালিশ দিলেন”

ইহান মিনমিনে স্বরে বলল,

—” আমি কি জানতাম নাকি তুমি মাঝরাতে এরকম কিক মারো! জানলে অবশ্যই দিতাম”

সাঁঝ অনুতপ্ত হয়ে বলল,

—” সরি। আমি বুঝতে পারিনি”

—” ঠিক আছে ”

স্প্রে করা হলে সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” ব্যথা কি কমেছে?”

—” বেটার। তুমি চিন্তা করো না। সকালে একটা মেডিসিন নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ঘুমাও। অনেক রাত এখন”

—” I am sorry.”

ইহান একটু রেগে বলল,

—” হয়েছে আর এতো সরি বলো না। মন খারাপও করো না। শুধু বর্ডারটা ঠিক মতো দাও”

সাঁঝ বালিশ দিয়ে তাদের বিছানায় একটা ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার দিলো। যাতে অনিককে মারতে গিয়ে আবার ইহানকে মেরে না দেয়।
,
,
,
🌿
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতের কথা মনে হতেই সাঁঝ লজ্জা পেলো। বাসর রাতে ঘুমের মধ্যে বরকে কিক মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছে। ছি ছি।

সাঁঝ বর্ডারের উপর ভর করে ইহানের দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আছে। ভালো করে ইহানকে পর্যবেক্ষণ শুরু করলো। গায়ের ফর্সা। সরু নাক। গালে চাপদাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। নাকটা কোন কারণে লাল হয়ে আছে। সাঁঝের মনে হলো নাকে হাত দিলে হাতে লাল রঙ লেগে যাবে। ইহানের নাকে হাত দেয়ার ইচ্ছাটাকে দমন করে উঠ পড়লো। একটু পরেই হয়তো ডাকতে আসবে। তাই সে শাওয়ার নিয়ে রেডি আয়নার সামনে দাঁড়ালো।

নিজেকে আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সাঁঝ। কেন জানি আজ নিজেকে অন্যরকম লাগছে তার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। সাঁঝ যদি একবার পিছন দিকে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতো কেউ আলতোভাবে চোখ খুলে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ ইহানের কাছে এসে দেখলো ইহান এখনো ঘুমাচ্ছে। সাঁঝের ইচ্ছা হলো না ডাকার। কোন কাজ না পেয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে আসলো।

বেশ বড় একতালা বাসা ইহানদের। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে ড্রইংরুমে চলে আসলো। এসে তার মনে হলো আসা ঠিক হয়নি। অনেক মহিলা বসে আছে। তাকে কেমন ঘুরে ঘুরে দেখছে! মনে হচ্ছে আগে কখনো মানুষ দেখেনি। সাঁঝের মনে হলো আজকে হয়তো শাড়ি পরা উচিত ছিলো। কিন্তু তার ইচ্ছা হয়নি বলে পরেনি। মালিহা বেগম সাঁঝকে দেখে খুশি হয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে সবার মাঝে বসিয়ে দিলো। তারপর একে একে পরিচয় করিয়ে দিলো। ইহানের দাদী, মামী, ফুফুসহ অনেক মেয়ে আত্মীয় আছে। একজন মহিলা বলে উঠলো,

—” বাহ আজ প্রথম দিনে বউ শাড়ি কেন পরেনি?”

সাঁঝের ইচ্ছা হলো বলতে, “প্রথম দিনে শাড়ি পরতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি?” কিন্তু বলল না। তার শাশুড়ী বলল,

—” না পরলেও তো কোন সমস্যা নেই আপা? থ্রি পিসে ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে তাই এটাই ঠিক আছে”

আর কেউ এই বিষয় নিয়ে কোন কথা না বললেও সাঁঝ বুঝলো সবাই তার শাশুড়ীর কথায় ক্ষুব্ধ। কথা বলতে বলতে ইহানও চলে আসলো। সেও রেডি হয়ে এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে ইহানকে স্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু সাঁঝ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকার পরে বুঝলো কোমড়ে ব্যথা আছে।

ইহান এসে সাঁঝের পাশে বসলে সাঁঝ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনার ব্যথা কমেছে?”

ইহান তার দিকে না তাকিয়েই বলল,

—” হুম”

—” এখনো কি আছে?”

—” আছে একটু। ব্রেকফাস্ট এর পরে মেডিসিন খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

—” আচ্ছা”

ইহান তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

—” তোমার ঘুম হয়েছে? কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?”

—” না সব ঠিক আছে”

তাদেরকে এভাবে কথা বলতে দেখে একজন বৃদ্ধ মহিলা রসিকতার সুরে বলল,

—” কি এতো কথা বলিস বলতো? আমরাও একটু শুনি”

সাঁঝের কিছুটা অস্বস্তি হলো। না জানি কি না কি ভাবছে সবাই! ইহান হেসে বলল,

—” ছোট দাদী তোমার নাতবৌকে জিজ্ঞেস করছিলাম এখানে কেউ জ্বালাচ্ছে না তো!”

কেউ হেসে উঠলো আর কেউ মুখ গোমড়া করে রাখলো। এরপর সবাই নাস্তা করে নিলো। সাঁঝ রেডি হয়ে নিলো বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য। অনুষ্ঠানে সাঁঝের বাসা থেকে অনেকেই এসেছিলো। ফুফু-ফুফা সহ মায়ের পরিবারের সবাই। তার আর ইহানের আজকেই যাওয়ার কথা ছিলো ওই বাড়িতে কিন্তু বৌভাতের অনুষ্ঠানে শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেলো। সাঁঝের বাড়ির লোক চলে গেলেও তারা দুজন গেলো না। কাল আবার সাঁঝের বাসা থেকে কেউ আসবে তাদেরকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

রাতে সাঁঝ ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে যাওয়ার সময় ইহান তাকে জিজ্ঞেস করলো,

—” এখন কোথায় যাচ্ছো?”

—” ড্রয়িংরুমে। আন্টি আর ইশিতার সাথে গল্প করতে”

—” ও আচ্ছা”

—” আপনি কি এখন ঘুমাবেন? ১০.৩০ বাজে মাত্র”

—” না এখন ঘুমাবো না। তুমি যাও”

—” হুম”

ড্রয়িংরুম থেকে সাঁঝের গলার আওয়াজ পাওয়ার পর ইহান ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো।
,
,
,
🌿
বিগ ব্রো,
জানো আজ একটা মেয়েকে দেখলাম। শান্তশিষ্ট মনে হলো অনেক দেখে। মেয়েটাকে দেখে আমার একটা বহমান নদীর মতো মনে হয়েছে।
যে বয়ে চলেছে সময়ের সাথে। দেখতে শান্ত কিন্তু ভিতরে হয়তো অনুভূতির
জোয়ার আছে। জানিনা কেন জানি বারবার ওর কথায় মনে হচ্ছে। তোমার কাছে হয়তো কোন একদিন চিঠিগুলো পৌঁছে যাবে তাই নিজের অনুভুতিগুলো লিখলাম।
লিটিল।
,
,
বিগ ব্রো
জানো আমি তোমাকে যেই মেয়ের কথা বলেছিলাম না? সেই মেয়েটার নাম
আর ও কোথায় পড়ে জানতে পেরেছি। নিজের কাজের সুবাদে কিছু সুবিধা
পাই। সেগুলো ব্যবহার করে জেনেছি। মেয়েটার নাম কি হতে পারে বলো
তো? তোমাকে বলে দিবো? না বলবো না। কোনদিন সামনে আসলে সেদিন
বলবো। শুধু এটুকু বলতে পারি আজও মেয়েটাকে দেখে আমার একই কথা
মনে হয়েছে। মেয়েটার শান্ত, চুপচাপ,আর কিছুটা বিষন্নতার মুখোশের আড়ালে রয়েছে হাজারো না বলা অনুভূতি, শত শত অপ্রকাশিত ইচ্ছে আর স্বপ্ন। আচ্ছা মেয়েটাকে দেখলেই কেন আমার এমন মনে হয়? আমি কি প্রেমে পড়েছি ওর? আর আমার এখন ইচ্ছা হয় সেই অনুভুতিগুলোর গন্তব্য আমি হবো। কেন এই ইচ্ছা হয়? যদি চিঠিটা পৌঁছাতে পারি সেদিন তোমার উত্তর শুনবো।
লিটিল।
,
,
ইহান দ্বিতীয় চিঠিটা পড়ার পরে চিঠির বক্সে রেখে দিলো। বক্সের ভিতরে অনেকগুলো ডাকটিকিটবিহীন খামে চিঠি আছে। পড়া শেষ সবগুলো। তার উদ্দেশ্যেই লেখা। কিন্তু যখন সে চিঠিগুলো হাতে পেয়েছে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আজ আবার এই দুইটা চিঠি বের করে পড়লো কারণ চিঠির প্রেরকের মতো সেও একই রকম অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্রমেই দূর্বলতা তৈরী হচ্ছে। যেটা কাটিয়ে উঠতে হবে। (চলবে)

#কানামাছি
#পার্টঃ১২
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
ভিড়ের মধ্যে একটা লোক ইচ্ছা করে শাড়ির কুচির উপর পা দিয়ে কুচি কিছুটা টেনে ধরে চলে গেলো। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পরে পিছন ঘুরে একবার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসি দিলো। সাঁঝের ইচ্ছা করলো লোকটার দাঁত বরাবর একটু ঘুষি মারতে। দাঁত না পড়লেও অন্তত নড়ে তো যাবে সেটাই মনে শান্তি দিবে।

ব্যর্থভাবে চারিদিকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সাঁঝ। গলা ছেড়ে কান্না করতে ইচ্ছা হচ্ছে। চারিপাশে ভয়াবহ ভিড়। এর মধ্যে সে একপ্রকার হারিয়ে গিয়েছে। লোকেরা যাওয়ার সময় গায়ের সাথে গা লাগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সাঁঝ ডানপিটে মেয়ে হলেও এই ভিড়ের মধ্যে তার সাথে খারাপ কিছু হলে সে কিছুই করতে বা বলতে পারবে না। বরং কিছু বললে মানুষ তার চরিত্রের উপর আঙ্গুল তুলবে। একবার শেষ বারের মতো কুচিটা হাতে ধরে ডান পাশে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফলস্বরূপ মানুষ তার পায়ের উপর, শাড়ির উপর পা দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সাঁঝে ভয় হতে শুরু করলো এখানে তো কত ধরনের মানুষ আছে। এই ভীড়ের মধ্যে খারাপ কোন অভিজ্ঞতা না হয়ে যায়! আবার ভয় হলো শাড়ি সামলাতে পারবে তো?

আকাশের দিকে তাকালো সাঁঝ। সূর্য নিজের পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করছে। ঘামে পিঠ ভিজে একাকার হয়ে গেছে। প্রাণটা যেনো বলছে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।

দুপুরবেলা এই মেলাতে আশার আইডিয়া তারই ছিলো। আজ ফুফা আর মায়ের স্বামী তাদের নিতে এসেছিলো ইহানের বাসায়। সাঁঝ অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলো এই দুজন মানুষকে দেখে। এর থেকে কেউ না আসলে সে আর ইহানই যেতে পারতো। মায়ের স্বামী নিজের গাড়ি এনেছিলো। নিজেই ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে সেই উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠার পরেই মায়ের স্বামী দুটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

—” এই নাও তোমাদের জন্য কিছু গিফট”

সাঁঝ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো। গাড়ির মধ্যে গিফট কে দেয়? সাঁঝ না নেয়ায় ওটা ইহানই নিয়েছিলো। ইহান বলল,

—”Thank you”

মায়ের স্বামী বলল,

—” এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাদের দুজনের জন্য। আগেই দিয়ে দিলাম”

ইহান শুধু প্রতিত্তরে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়েছিলো। এরপর শুরু হলো আরেক ঝামেলা। ফুফা আর সামনে বসেছিলো, পিছনে সে আর ইহান। সামনে বসে ভিউ মিরর দিয়ে ফুফা বারবার সাঁঝের দিকে তাকাচ্ছিলো। সাঁঝ ইহানের পাশে বসে এই বিষয় নিয়ে চরম অস্বস্তিতে পরে। নির্বোধ ফুফা কিছু বুঝেনা বারবার অসহ্যের মতো সাঁঝের দিকে তাকাচ্ছে। সাঁঝ তো ইহানের দিকে তাকাতেই পারছিলো না অস্বস্তিতে। সাঁঝের ইচ্ছা করছিলো তখনই গাড়ি থেকে নেমে যায়। কোনমতে মোটামুটি বাড়ির কাছে আসার পর এই মেলা চোখে পড়ে। বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে। তখন সাঁঝ গাড়ি থামিয়ে ইহানকে বলে,

—” চলুন মেলাতে যাই”

সবাই অবাক হয়েছিলো। ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” এই দুপুর বেলাতে মেলায় গিয়ে কি করবা?”

—” বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করে নিয়ে যাই! বাচ্চারাও আছে”

ইহান অবাক হয়ে বলেছিলো,

—” মেলা থেকে?”

—” মেলা বলে অবজ্ঞা করবেন না। বানিজ্য মেলা। শহরের বড় বড় দোকান থেকে এখানে স্টল দেয়। আর পছন্দ না হলে পরে কিনবো। এখন তো দেখে আসি”

মায়ের স্বামী বলল,

—” না না সাঁঝ কি বলছো? কেনাকাটা করতে হবে না। যদি করতেই হয় পরে করো। এখন বাসায় চলো”

সাঁঝ বিশাল একটা মেকি হাসি দিয়ে বলেছিলো,

—” না না কি বলছেন? জামাই প্রথমবার শশুড়বাড়ি যাচ্ছে কিছু তো দায়িত্ব আছে না?”

সাঁঝের এই দায়িত্বের কথা শুনে ইহান গলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” Are you sure?”

—”100% sure. Let’s go”

তাদের যাওয়ার কথা শুনে ফুফা প্রথমবার মুখ খুলে জিজ্ঞেস করলো,

—” আমরা সবাই যাই? নাহলে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করি? তোমরা ফিরবে কি করে? দুপুরে খাবে না?”

সাঁঝ বলে,

—” না না আমাদের দেরী হবে। আপনারা চলে যান। আমরা সিএনজি বা রিকশায় করে চলে আসবো। গিয়ে খাবো”

এরপর অতি উৎসাহে ইহানকে নিয়ে ফুফার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। আর এই উৎসাহের কারণে ভুলেই গেছে ফেসবুক স্ক্রল করে ফোনটা গাড়িতেই রেখেছে। আসার সময় ফোন আনতে ভুলে গেছে।
মেলার ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট কিনে আনার পরে ইহান জিজ্ঞেস করে,

—” তোমার এই দুপুরবেলাতে মেলায় কেনাকাটা করার আইডিয়াটা কি ঠিক হলো? মানুষ কিন্তু অনেক”

ইহানের কথা উড়িয়ে দিয়ে সাঁঝ বলেছিলো,

—” আরে দুপুরবেলাতেই আসতে হবে। মানুষ কম থাকবে। এই বাইরেই ভিড়।
ভিতরে ঢুকলে দেখবেন ফাকা।”

ভিতরে ঢুকে সাঁঝের ধারনা ভুল প্রমান হলো। মানুষ গিজগিজ করছে। তার উপর জায়গায়টা ছোট মনে হচ্ছে। এবং বালি ফেলা জায়গা। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। ভিতরে ঢুকে সাঁঝ একটু অবাক হয়ে বলেছিলো,

—” এই দুপুরে এতো মানুষ কেন?”

ইহান একটু আশেপাশে তাকানোর পরে বলল,

—” আজ মেলার শেষ দিন। বিকালে শেষ। তাই সবাই তোমার মতো ভেবেছে দুপুরে কে আসবে? এবং এতো ভীড়”

এরপর দুজন মিলে দোকান ঘুরতে থাকলো। ইহান সাঁঝকে বলেছিলো সামনে বা পাশে পাশে হাঁটতে। সাঁঝ না শুনে দোকান ঘুরে হাঁটছিলো। শাড়ি পায়ে বেঁধে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছিলো। ফলস্বরূপ ইহানকে হারিয়ে ফেলেছে। আর এখন এই ভীড়ের মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছেলে তার পায়ের কাছে শাড়িতে পা দিয়ে চেপে ধরলো। একদিকে টান পড়েছে। সাঁঝের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ছেলেটা তার পাশে আসলে সে তার নিজের শরীরের সব ভর ছেলেটার পায়ের উপর দিয়ে পায়ে পাড়া দিলো। ছেলেটা চোখ মুখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে না থেমে চলে গেলো।
সাঁঝের মনে হলো কেউ ইচ্ছে করে তার পিঠে হাত লাগিয়ে চলে গেলো। পিছনে ঘুরেও কাউকে দেখতে পেলো না। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করলো তার। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকলো। হঠাৎ কেউ তার পিঠের সাথে একদম এসে দাঁড়ালে সাঁঝের কান গরম হয়ে যায়। রেগে পিছনে ঘুরে ইহানকে দেখতে পায়। দেখেই কেঁদে দিয়ে বলে,

—” এসেছেন আপনি? কোথায় ছিলেন এতক্ষন?”

—” তোমাকেই খুঁজছিলাম। তখন তো বললাম পাশে পাশে হাঁটো। তা তো হাঁটলে না।”

সাঁঝের যেন প্রাণ ফিরে আসলো। বলল,

—” হাঁটতে পারছি না”

ইহান পিছনে দাঁড়িয়ে সাঁঝের দুই পাশে হাত দিয়ে একটা বলয়ের মতো তৈরী করলো। যাতে কেউ সাঁঝকে ছুতে না পারে। তারপর বলল,

—” কুচি ধরে সাবধানে হাঁটো। কেউ এখন ডিস্টার্ব করবে না”

সাঁঝের মনে হলো এই প্রতিরক্ষা বলয় ভেদ করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারবে না। এমন একটা আশ্রয়েরই যে খুব দরকার ছিলো তার। ইহানই কি তার সেই আশ্র‍য়?
এরপর হেঁটে একপাশে আসার পরে ইহান তাকে আড়াল করে দাঁড়ালো শাড়ি ঠিক করে নেয়ার জন্য। তার অবস্থা দেখে বলল,

—” ঘেমে তো গোসল করে ফেলেছো”

—” হুম”

সাঁঝ ভাবলো ইহান নিশ্চয় এবার মেলায় আসা নিয়ে বকা দিবে বা কিছু বলবে। সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছি ইহান কিছু বললে সেও বলবে। কিন্তু ইহান কিছু বলল না। বরং ফ্যান আছে এমন একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলো। তারপর বাকি শপিং করে ইহান তাকে একপ্রকার নিজের সাথে চেপে ধরে মেলার বাইরে আসলো।

সিএনজিতে করে আসার সময় সাঁঝের মনে হলো কেউ একজনও তার এই জীবনে আসলো যে তার হাতকে শক্ত করে ধরতে পারবে। ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে এই কঠিন পৃথিবীকে একা মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজের উপরে এবং ভিতরে কাঠিন্য চলে এসেছে। এখন তার বিপদকে মোকাবেলা করার মতো না হলেও বিপদের সময় পিছনে এসে পথ আগলে রাখার মতো কেউ তো আছে!
,
,
,
🌿
নিষ্পলক ভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে সাঁঝ। তার ফেক একাউন্টটা হ্যাক হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকদিনের জন্য সেটা একটিভ ছিলো। তারপর বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এর মাঝেই হ্যাক হয়ে গেছে। পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকতে পারছে না গত তিনদিন ধরে চেষ্টা করেও। যে করেছে তাকে অবশ্যই টেকনোলজি নিয়ে এক্সপার্ট হতে হবে। কম্পিউটার, কোডিং, সফটওয়্যার এগুলোতে পারদর্শী হতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো আপনা আপনি। আজ সে হাসপাতালের সেই কেবিনের সামনে আবার গিয়েছিলো। আশা ছিলো হয়তো যাকে অনিক ভাবছিলো তাকে আবার দেখতে পাবে। কিন্তু সেখানে কেউ ছিলো না। ফাকা রুম। হয় রোগীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে না হলে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

সাঁঝ চোখ বন্ধ করলো। প্রচন্ড গরমে অস্বস্তি লাগছে দুপুরবেলা। ইহান বাসায় নেই। অনেক ব্যস্ততা আছে তার। তাই ঐ বাসা থেকে ফিরে দুদিন পর থেকে নিজের কাজে লেগে পড়েছে। আর সাঁঝ ওবাসা থেকে ফিরেছে দুই সপ্তাহ হলো কিন্তু এখনো ভার্সিটিতে যায়নি। যাবে কাল বা পরশু থেকে। চোখ বন্ধ করে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

একসময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো সাঁঝের। ঘুম কেন ভাঙলো সেটা বোঝার চেষ্টা করতেই বাইরে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত বৃষ্টি পড়ছে। তার চোখ ঘড়ির দিকে যেতেই মনে প্রশ্ন আসলো এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি? ইহান কি চলে এসেছে অফিস থেকে?

জোরে বৃষ্টির শব্দ শুনে সাঁঝের খেয়াল হলো আজ অনেক কাপড় ধোয়া হয়েছে। সেগুলো সব বারান্দায় মেলে দেয়া আছে। তড়িঘড়ি করে উঠে কাচের দরজা ঠেলে বারান্দায় গিয়ে দেখলো ঘরের থেকে বোঝা না গেলেও বাইরে প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে বাতাস আর মেঘের ঝলকানি তো আছেই। এতো কাপড় তুলতে সাঁঝ হিমসিম খাচ্ছে। হঠাৎ জোরে মেঘ ডেকে উঠলো। মনে হলো কানে তালা লেগে যাবে। সাঁঝের হাত থেকে কাপড়গুলো পড়ে গেলো। ভয় আকড়ে ধরেছে। তার সব থেকে বড় ভয় এই বজ্রপাত! কোন রকমে কাপড় তুলে পিছনে দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো দরজা বন্ধ। খুলছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেও খুলতে পারলো না।

তখন আবার জোরে বজ্রপাত শুরু হলো। বজ্রপাত একবার শুরু হলে বেশ কিছুক্ষণ থাকে। সাঁঝ কান্না শুরু করে দিলো। এতো শব্দ আর এতো আলো! সাঁঝ দিয়ে ডাকলো,

—” ইহান! ইহান!”

বৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে তার এতো জোরে চিৎকার ঘর পর্যন্ত পৌছাচ্ছে কিনা সন্দেহ! তাই সাঁঝ কান্না করতে করতে চিৎকার দিয়ে ডাকলো,

—” ইহান!”

কাচের দরজায় হাত দিয়ে বাড়ি মারতে শুরু করলো। চিৎকার দিতে গিয়ে মনে হলো গলা ছিড়ে যাবে। আবার ডাকলো,

—” আন্টি,… ইশিতা…..”

আবার জোরে শব্দ হলে বলল,

—” আন্টি… আঙ্কেল…”

সাঁঝের মনে হলো এবার সে জ্ঞান হারাবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে ডাকলো,

—” বাবা… বাবা বাঁচাও। ভাইয়া বাঁচাও আমাকে। ভাইয়া………”

চিৎকার দিতে দিতে সাঁঝ মেঝেতে বসে পড়লো।

ইহান নিজের ঘরের দরজার সাথে হেলান দিয়ে সামনে বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। বারান্দা থেকে তাকে দেখা যাবে না তার উপর পর্দা আছে তাই সাঁঝ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে সাঁঝের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে আর দরজায় বাড়ি মারাটাও দেখতে পাচ্ছে। ইহানের ফোন আসলে ফোনটা তুলে নেয়। জিজ্ঞেস করলো,

—” ডা. সাহেব আমার ভাই মানে অনিকের অবস্থা কি?”

—” একই রকম। কোমায় আছে। উন্নতি বা অবনতি কিছুই হচ্ছে না”

—” আপনারা চেষ্টা চালান। বাকিটা আল্লাহর হাতে।দেখা যাক কি হয়”

ইহান ফোন কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গত প্রায় তিনমাস ধরে অনিকের অবস্থা হয় অবনতি হচ্ছে নাহয় এক জায়গায় থেমে আছে। কিছুক্ষণ পরে ইহান হেঁটে বারান্দার কাছে গেলো। (চলবে)

কানামাছি পর্ব-১০

0

#কানামাছি
#পার্টঃ১০
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
—” নিজের নোংরা নজর ঠিক কর। মেয়েদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করার আগে একবার নিজের এই ভাঙা হাতের দিকে তাকাবি। এবারের মতো ছেড়ে দিয়েছি এরপর আর প্রাণে বাঁচবি না। মাটির দিকে তাকিয়ে চলবি। খুব সাহস না তোর? সাঁঝের পিছনে লাগবি? ওর ক্ষতি করবি? এতোদিন তো ও তোকে শিক্ষা দিয়েই এসেছে। এবার থেকে আমিও আছি ওর সাথে। কিছু বলার আগে ভেবে নিবি এর পরের বার কি হবে!”

সাঁঝ ইহানের গলায় কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়ালো। হাসপাতালে দেখতে এসেছে সবাই নাহিদকে। ইহানও এসেছিলো দেখতে। ইহান ভিতরে নাহিদের সাথে কথা বলার নাম করে ঢুকেছিলো। সাঁঝ ইহানের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তার মানে গত রাতে ইহান নাহিদকে মেরেছে। সাঁঝের কানে একটা কথা বাজতে লাগলো, “সাঁঝের সাথে আমি আছি।”

কেউ আছে তার সাথে। যে তার সাথে তাল মিলাচ্ছে। হঠাৎই সাঁঝের নিজের মায়ের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা জন্মালো। মা জোর না করলে সে হয়তো ইহানের সাথে বিয়ে করার কথাটা ভাবতে পারতো না। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে অন্য দিকে চলে আসলো। এদিকে মানুষ কম। হয়তো সিরিয়াস পেশেন্টরা থাকে। অনেক বড় একটা করিডর। করিডরে যত সামনের দিকে যাচ্ছে কোলাহল, মানুষ তত কমে যাচ্ছে। সাঁঝের একসময় মনে হলো একটা ভৌতিক হাসপাতালে চলে এসেছে। করিডরের শেষ প্রান্তে কোন মানুষ নেই। এমনকি ডাক্তার নার্সও নেই। দুইপাশে কিছু রুম আছে। আর সামনে একটা বড়া জানালা আছে। রাস্তার রোডল্যাম্পের আলো আসছে ওখান থেকে। নিজের গায়ে থাকা কাচা ফুলের গন্ধ বারবার নাকে এসে লাগছে। সাঁঝ গয়নাগুলোর কিছু কিছু খুলে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের হলুদ শাড়ি এখনো পরনে আছে।

নাহিদের মার খাওয়ার ঘটনা কাল রাতে ঘটলে তাকে আজ সকাল থেকে কেউ কিছুই বলেনি। সবাই তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলো। এমনকি ফুফুর মধ্যে কোন হেলদোল দেখতে না পেয়ে সাঁঝ বেশ অবাক হয়েছিলো। তারপর বিকালে সব অনুষ্ঠান শেষে সবাই জানালো নাহিদ হাসপাতালে ভর্তি। ইহানদের বাসাতে বলা হয়েছে নাহিদ এক্সিডেন্ট করেছে। তাই ইহান নাহিদকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু ইহানের আসল উদ্দেশ্য তো নাহিদকে ভয় দেখানো ছিলো।
সাঁঝ আনমনে হেসে উঠলো। ইহান তার জন্য ভাবে!

পিছন দিকে তাকিয়ে তার গা ছমছম করে উঠলো। কেউ নেই সে একা একা দাঁড়িয়ে আছে এই রাতের বেলায়। সে পিছন দিকে আসার সময় দুই পাশে থাকা হাতে গোনা কয়েকটা রুমের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ হলো। সাঁঝ সবগুলোতে উঁকি মেরে মেরে দেখতে থাকলো। সবগুলোই ফাকা। শেষের আগেরটাতে একজন শুয়ে আছে। হাতে পায়ে মাথায় নানা ধরনের যন্ত্র লাগানো। সাঁঝ চোখ সরিয়ে নিলো। দ্বিতীয়বার তাকানোর পরে সাঁঝ চমকে উঠলো। অনিক! সাঁঝের আবছা মনে হলো অনিক শুয়ে আছে। মুখ প্রায় দেখতে পাচ্ছেনা। আরো ভালো করে দেখার জন্য রুমটার কাঁচের জানালা ঘষামাজা শুরু করলো। কিন্তু তাও দেখতে পেলো না ঠিক মতো। হঠাৎ বাজখাঁই গলায় শুনতে পেলো,

—” এখানে কি চায়?”

সাঁঝ চমকে উঠলো। একটু স্থির হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো একজন নার্স তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ বলল,

—” কিছু না এমনি হাঁটতে হাঁটতে এসেছি”

—” এটা হাসপাতাল। সব জায়গায় এমনি হাঁটা যায় না। আর হাঁটতে আসলে কি উঁকি মারতে হয়?”

—” না আসলে এমনি।”

সাঁঝ একটু চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” এই তিনটা রুম কিসের জন্য?”

মহিলাটি থমথমে গলায় বলল,

—” এগুলো আইসিইউ”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আইসিইউ তো ওইদিকে আছে। তাহলে এগুলো কি?”

—” এগুলো স্পেশাল।”

—” আইসিইউ আবার স্পেশাল হয়?”

মহিলাটা বিরক্ত হয়ে বলল,

—” আপনি ডাক্তারও না নার্সও না। এতো প্রশ্ন কেন আপনার? আর এখানে যে উকি মারছেন আপনার কাছে পারমিশন আছে?”

—” না”

—” পারমিশন না থাকলে এখানে আসতে পারবেন না। এখন যান”

সাঁঝ আর কিছু বলতে পারলো না। চলে আসলো। সে লোকটাকে ঠিকমতো দেখতে না পেলেও মোটামুটি শিউর ওটা অনিক। অনিক আইসিইউ তে আছে? কিন্তু মনের মধ্যে আবার খচখচ শুরু হলো অনিক তো? কিভাবে জানবে? আশিককে বললে হয়তো বিরক্ত হবে। সে নিজেও তো কিছু করতে পারবে না। সাঁঝের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। তার কাছে অনিকের ছবি এখনো আছে। আবার জানার ইচ্ছা হচ্ছে অনিকের আসলে কি হয়েছিলো? ও কি ইচ্ছা করে গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিলো কিনা জানতে হবে।

আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মূল হাসপাতালে এসে গেলো। মা, ফুফু ফুফাকে দেখতে পাচ্ছে। ইহানও আশেপাশে আছে কোথাও। একটু পরে ইহানও কোথা থেকে এসে গেলো। তাকে দেখে বলল,

—” তোমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। অনেক ক্লান্ত মনে হয়”

—” হ্যা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে রেস্ট নেয়ার সময় পাইনি।”

—” এখন চলো। নাহিদের বাসা থেকে লোক আসছে। কাল তো বিয়ে সেজন্য তোমার ফুফা,ফুফু থাকতে পারবে না।”

—” আচ্ছা।”

নাহিদের কথা মনে হতে সাঁঝের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ইহানের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” কি?”

—” কিছু না। আপনি অনেক ভালো”

ইহান তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সাঁঝ এতো মিষ্টি স্বরে কখনো কথা বলে না। এরপর ইহান নিজের বাসায় আর সাঁঝ নিজের বাসায় চলে আসলো। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় সেই মানুষটার কথা মনে হচ্ছিলো যাকে দেখে অনিক মনে হয়েছে। খুব অদ্ভুত লাগছিলো দেখতে। একবার মনে হয়েছে অন্য কেউ। আরেকবার মনে হয়েছে ওটা অনিক। সাঁঝ নিজের মাথা চেপে ধরেছে। এই গোলকধাঁধা থেকে বের হতে পারছে না সে!
,
,
,
🌿
গোলাপ দিয়ে সাজানো খাটে বসে আছে সাঁঝ। রুমটা বেশ সুন্দর করে ফুল, মোমবাতি দিয়ে সাজানো। কিন্তু সাঁঝের মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে। একে সারাদিনের শারিরীক ধকল তার উপর মানসিক ধকল!
সকাল থেকে শুধু ধকল যাচ্ছে। এখন রাত বারোটা তাও একটু রেস্ট নিতে পারেনি।
সকালে ইহান আর ওর পরিবারের অল্প কয়েকজন কাজী নিয়ে এসে বিয়ে পড়িয়ে গিয়েছে। তারপর বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। সেখানে ইহান আর তার সব আত্মীয়দের সাথে শুধু কুশল বিনিময় করতে গিয়েই সে হাপিয়ে গেছে। এরপর এই বাসায় চলে আসলো। কিছুক্ষণ সবার সাথে বসে কথা বলে খেয়েদেয়ে এখন বসে আছে ইহানের জন্য।
বিয়ের কবুল বলার মুহুর্তের কথা মনে হতেই সাঁঝ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। তখন মনে হয়েছিলো বাবা আর ভাইয়া থাকলে কত ভালো হতো। একটা শব্দ কবুল তারপর থেকে অন্য একজন মানুষের সাথে জীবনটা একদম জুড়ে যাবে। যদিও ইহানের জন্য কোন অনুভূতি নেই সাঁঝের মনে তাও ইহানের সাথেই সে জুড়ে গিয়েছে।

সাঁঝ রুমটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সবই প্রায় সাদা। ইহানের পছন্দের রঙ সাদা। সাথে বাথরুম আর ট্রান্সপারেন্ট গ্লাস দেয়া বারান্দা আছে। বারান্দার সামনে অবশ্য পর্দা টাঙানো সাদা রঙের। চোখ বুলাতে গিয়ে সাঁঝের চোখ সামনের মিনি সোফাতে গেলো। সেখানে ইহানের বিয়ের শেরওয়ানি আছে। মানে ইহান চেঞ্জ করেছে। সাঁঝ মনে মনে বলল,

—” উনি চেঞ্জ করে ফুরফুরানো মেজাজে ঘুরছেন। আর আমি এতোসব ভারী জামা কাপড় পরে থাকবো? মোটেও না”

সাঁঝ নিজের লাগেজ খুলে কাপড় বের করতে গেলেই ডায়েরিটা চোখে পড়লো। তার কানামাছি ডায়েরি। এটা সাথেই নিয়ে এসেছে। ওখানে রেখে আসার সাহস হয়নি। কারোর সাথে পড়তে দেয়া যাবে না। সাথে দুটো মেমরি কার্ড আর নিজের পুরাতন সিমটাও এনেছে। এগুলো লাগেজের নিচের দিকে রেখে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমের ভিতরে পায়চারী করতে থাকলো। ইহানের শেরওয়ানীর পকেটে একটা কাগজ দেখতে পেয়ে সেটা বের করে নিলো। পারমিশন ছাড়া খুলে দেখবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো সাঁঝ। আবার মনে হলো ইহানের স্ত্রী সে। দেখতেই পারে। কোন সমস্যা নেই।

কাগজটা খুলে দেখলো হসপিটালের বিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার কাছাকাছি বিল। টাকার পরিমাণ দেখে সাঁঝের চোখ কপালে উঠে গেলো। রিলিজ করার কোন কথা লেখা নেই। তারমানে রোগী এখনো ভর্তি অথচ এতো বিল! কিন্তু এতোক্ষণ পরে হাসপাতালের নাম দেখে সাঁঝের খটকা লাগলো। নাহিদ যে হাসপাতালে ভর্তি আছে এটা সেই হাসপাতালের বিল। ইহান ওই হাসপাতালে কার বিল দিলো?

সাঁঝ কাগজটা আবার নিজের জায়গায় রেখে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। নিজের ভিতরে আর রাগ, বিরক্তি এসে ভর করছে। আগুন দেখলে শান্তি লাগবে তাই ধরালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে সাঁঝের মনে হলো ইহান তার জীবনে এসেছে তাকে পাগল বানিয়ে দেয়ার জন্য!
সিগারেটটা একটু একটু করে পুড়ছে আর সাঁঝ একদৃষ্টিতে দেখছে।
একটু পরে ইহান এসে বলল,

—” কি মিসেস কি চলছে?”

সাঁঝ না ঘুরেই বলল,

—” কিছু না”

ইহান সিগারেট নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,

—” বাহ এটাও আছে দেখছি”

সাঁঝ এবার পিছনে ঘুরলো। ইহান ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে এসেছে। তার মানে অনেকক্ষণ আগে রুমে এসেছে। বারান্দায় থাকার কারণে খেয়াল করেনি। সাঁঝ ইহানের চোখের দিকে তাকালো। খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে চোখে।
ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” মন খারাপ নাকি?”

—” না ক্লান্ত লাগছে”

সাঁঝের হাতে হঠাৎ জ্বলতে শুরু করলে সাঁঝ আহ করে নিচে তাকিয়ে দেখলো ইহান তার হাতে সিগারেটটা ধরে আছে। ইহান সাঁঝের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,

—” সরি সরি সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমি ইচ্ছা করে করিনি। পুড়ে গেছে। ইশ খুব ব্যথা হচ্ছে?”

ইহান সিগারেট ফেলে দিয়ে সাঁঝের হাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু ফেলে দেয়ার পরে সেটা সাঁঝের পায়ের উপর পড়লো। পায়ের অনেকখানি পুড়ে গেলো। ইহান নিচু হয়ে বসে সাঁঝের পায়ের উপর থেকে সরিয়ে নিলো।
কেউ তার জন্য এতো ভাবছে এতো ব্যাকুল হচ্ছে দেখে সাঁঝের ভালো লাগলো।
কিন্তু সাঁঝ যদি নিচে তাকিয়ে ইহানকে ভালো ভাবে দেখতো তাহলে ইহানের মুখে একটা হাসির ঝিলিক দেখতে পেতো। (চলবে)