Sunday, June 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1471



নীরবে ভালোবাসা পর্ব-০৫

0

গল্প:#নীরবে_ভালোবাসা
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০৫

সেখানে আরো কিছুক্ষণ থাকায় যে আমার কাল হবে সেটা তো তখন বুঝি নাই!

আপনারাও বুঝেন নাই?আমি বলছি!

ফ্ল্যাশব্যাক,
তখন সৈকতের কথায় থেকে গেলাম।একটু পর এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে আছাড় খেলাম। কারণটা ইট,ইটে বেঁধে পড়ে গিয়েছি। অন্ধকারে দেখতে পায় নি। পড়েছি তো পড়েছি আর শব্দও সেই জোরে হয়েছে।আমার তো এখন ভয় হচ্ছে চাচা যদি এসে আমাদের দুজনকে দেখে তাহলে কি ভাববে?
আমার ভয়টাই সত্যি হলো! আমি পড়ে যাওয়ায় সৈকত এসে আমাকে উঠালো। আমি এখন দাড়াতেই পারছি না।
পা মচকে গেছে মনে হয়!
আমি সৈকতকে বললাম সে যেন সাইডে গিয়ে লুকায় কিন্তু সে আমাকে উঠাতে ব্যস্ত!
আর এই দৃশ্য টায় চাচা এসে দেখে ফেলল।

প্রথমে আমাকে ঘরে নেওয়া হলো। সেখানে বসিয়ে চাচী তেল গরম করতে গেল আর বাকি সবাই গম্ভীর মুখে বসে রইল। আমার এখন ভয় হচ্ছে! চাচা যদি একবার আব্বুকে এসব বিষয় বলে দেয় তাহলে আমার সব স্বাধীনতা শেষ! একদম বিয়ে দিয়ে ছাড়বে!

চাচা সৈকতকে নিজের সামনা সামনি বসতে বললেন।সবার কোলাহলে সবাই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে।
রাত তখন সাড়ে এগারোটা।
আপুর শশুর শাশুড়ি একসাথে সাইডের সোফায় বসে আছে।আপু আমাকে তেল মালিশ করে দিল তারপর আমি যখন এইসব ভাবতে ব্যাস্ত তখনই পা মচকিয়ে দিল। প্রথমে একটু ব্যাথা পেলাম কিন্তু আসল ব্যাথাটা দূর হলো।আমি বাইরে যেতে গেলে আপু আমাকে ইশারায় দরজার পাশে দাঁড়াতে বললো আর নিজেও তেলটা রেখে আমার পাশে দাড়ালো।

“কি করছিলে তোমরা ছাদে?”

“জ্বি আসলে..

“কি হলো বলো?”

“জ্বী আমি ওর ওড়না দিতে গেছিলাম।”

চাচা বিস্ফোরিত নয়নে সবার দিকে তাকিয়ে আবার সৈকতকে জিজ্ঞাসা করলেন “এগুলো সবার সামনে বলতে লজ্জা করে না?”

সৈকত সাথে সাথে উত্তর দিল “এগুলো কি বলছেন আঙ্কেল?সাকিরের রুমে আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য শার্ট খুলে রেখেছিলাম আর সেটা নিয়ে আসার সময় ওখানে যেটা ওড়না ছিল সেটা শার্টের সাথে চলে এসেছিল তাই দিতে..

“চুপ করো! ইয়ার্কি পেয়েছ আমাদের সাথে?যা বলবা বিশ্বাস করে নিব?সামান্য ওড়না দিতে গেলে রাত বিরাতে ছাদে যাওয়া লাগে?মানহাকে দিলেই তো সে লাবণ্যকে দিয়ে দিত”

চাচা আরেকটু থেমে আপুদের ঘরের দিকে তাকালেন আর আমাকে দেখতে পেয়েই ডাকলেন।আমি একবার আপুর দিকে তাকালাম,সে আমাকে যেতে বলছে। আমিও এগিয়ে গেলাম সেইদিকে।চাচা সহজে রাগেন না।সবসময় লাগামহীন কথা বলেন কিন্তু রেগে গেলে ‌রক্ষা নাই।

“হ্যাঁরে লাবণ্য! তুই তো একবার তোর বাবার কথাটা ভাবতে পারতি, তোর এইসব করতে লজ্জা করল না?”

আমি চুপচাপ শুনলাম।চাচা আবার বললেন”পড়াশোনার বয়সে এগুলো করা হচ্ছে?দাড়া তোর আব্বুকে বলে তোর বিয়ের ব্যাবস্থা করছি!”
আমি এবার চুপ থাকতে পারলাম না।দৌড়িয়ে চাচার কাছে গিয়ে বললাম”যাই করো চাচা আব্বুকে বলোনা! আব্বু ভেঙে পড়বে আমার উপর বিশ্বাস করবে না।প্লিজ!”

“বিয়ে তো তোর আমি দিয়েই ছাড়ব তোর!তা তোর আব্বুকে এসব বিষয় জানিয়েই হোক আর না জানিয়েই”

সব শুনে আপুর শশুর মশাই মুখ খুললেন”দেখেন বেয়াই,আমি আমার ছেলের কৃতকর্মের জন্য ভীষণ দুঃখীত আর মেয়েটারও যেহেতু বিয়ে দিয়েই দিচ্ছেন তাহলে বলছি কি দুজনের বিয়ে দিয়ে দেই।”

এই কথা শুনে চাচা যেন একটু শান্ত হলেন তারপর বললেন”আমি রাজি! শুধু একটু সময় প্রয়োজন।আর লাবণ্য? তুই বলছিলিস না তোর আব্বুকে কিছু না বলতে?বলবনা কিন্তু এই বিয়ে তোকে করতেই হবে।সারা পৃথিবীর কাছে এটা হবে এরেন্জ ম্যারেজ কিন্তু আসল সত্যটা আমাদের মাঝেই থাকল।”

এই বলে চাচা সবাইকে ঘুমাতে বলে চলে গেলেন। সৈকতের আম্মু আমার কাছে এসে বললেন তিনি নাকি আমাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন আর নিজের ছেলের জন্যই এমন মেয়ে চাইছিলেন তাই হয়ত আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নিয়েছেন আর আমার মত মেয়ে না দিয়ে ডাইরেক্ট আমাকেই দিয়েছেন।আর আমার যদি কোন কথা সৈকতের সাথে থাকে তাহলে যেন আমি বলে নি।
এই সব বলেই উনি চলে গেলেন।

চাচি আমার দিকে উদাসীন তাকিয়ে ঘরে চলে গেলেন। তিনি হয়ত আমার থেকে এটা আশা করেন নি। এখন ডাইনিংয়ে শুধু আমি সৈকত আর আপু রইলাম।

আপুও আমার কাঁধে হাত রেখে ঘরে চলে গেল।আমি সৈকতের দিকে তাকালাম। তার চোখ দেখে আমি কিছুই বুঝলাম না।

“সৈকত! আপনার কি মত এই বিষয়ে?”

“আমাদের মত এখানে কোন কাজেই আসবেনা লাবণ্য! আপনার বা আমার কোন কথায় তারা বিশ্বাস করে নাই তাহলে মত দিয়ে কি হবে? আপনার কথা শুনে সরে আসলে আজ এই অবস্থা হত না। আপনার বা আমার জীবন আজ এই পরিস্থিতিতে থাকতো না।”

এবার আমি সৈকতের চোখের দিকে অনুতাপ দেখতে পেলাম। সৈকত চলে যেতে নিলেই আমি তার হাতটা ধরে ফেললাম,সে হাতের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালো আমি আরো একটা হাত দিয়ে তার হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম”রাজি হয়ে যান সৈকত! নিজেকে দোষ দিবেন না। হয়তো নিয়তি এটাই চাইছিল আর নিয়তির লেখা তো কেউ পাল্টাতে পারে না,তাই না?”

“হুম”

সৈকত চলে গেল। আমিও ঘরে এসে চোখ বন্ধ করলাম।আমি এই বিয়েতে রাজি আছি।সৈকতের সাথে যদি পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক করত তাহলে আমি খুশি হয়েই বিয়েটা করতাম কারণ সৈকত ভালো ছেলে।
কিন্তু দুঃখ একটাই সেটা হচ্ছে চাচা আমাদের উপর অপবাদ দিয়ে বিয়েটা চাপিয়ে দিচ্ছেন। আবার বলেছেন পড়ালেখাও পুরোপুরি অফ করতে হবে নয়ত তিনি আব্বুকে সত্যটা বলে দিবেন।যদিও সেটা সত্যি নয়!

চলবে…

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

নীরবে ভালোবাসা পর্ব-০৪

0

গল্প:#নীরবে_ভালোবাসা
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০৪

সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেকটা লেট হয়ে গেল। মানে আমি সবসময় যে দেরিতে উঠি তা কিন্তু না।
আমার ভার্সিটি যেতেই ১০ মিনিট লাগে(বলে রাখা ভাল মানহা আপুদের বাড়ির একটু দূরে ভার্সিটি)।তাই নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে ওড়না টা শুধু মাথায় পেঁচিয়ে দৌড় দিলাম।
সৈকত যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আমি তো ভুলেই গেছি।
ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকতে যাবো তখনই আমার হাতে কেউ টান মারল সেটা হচ্ছে মানহা আপু। সৈকত ওদের গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
বুঝিনা!আপুদের বাড়ি থেকে ভার্সিটি আসতে দুই মিনিটও লাগে না সেখানে গাড়ি এনে ফুটানি দেখানোর কি আছে?

তোমরা কথা বলো আমি ওই বেন্ঞিটাতে বসি।বলে আপু চলে গেল।
দাড়িয়ে রইলাম আমি আর সৈকত।
সৈকত কি বলবে বুঝতে পারছে না হয়তো,কিন্তু ওর জন্য দাড়ায় থাকতে গেলে তো আমার দেরি হয়ে যাবে তাই আমি বললাম-
“কিছু বলেন!”

“আসলে আমি আমার কাজের জন্য ভীষণ দুঃখিত।আমি না জেনেই আপনাকে অনেক কথা বলেছি যেগুলা আমার জানা উচিৎ ছিল।
সৈকত এতক্ষণ মাথা নিচু করে কথা বলছিল তারপর মাথা উচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “আমাকে ক্ষমা করবেন,I am really sorry”

সৈকত আমার দিকে তাকাতেই আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম “it’s ok”

সৈকত আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো
“আপনার ঘাড়ের তিলটা সত্যি আকর্ষণীয়!”

আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম তারপর চোখ ছোট ছোট করে বললাম ‍”এখন তো সত্যিই মানহানির মামালা দিতে মন চাচ্ছে!”
আমার কথা শুনে সৈকত হো হো করে হেসে দিল। তার হাসি সত্যিই আকর্ষণীয়!

“ভালো কথা বলেন তো আপনি!” বলল সৈকত তারপর আবার বললো,”আপনার একটা..
তার আগেই ওর ফোনে একটা কল আসলো। কথাবার্তায় বোঝায় যায় অফিসের ফোন এসছে।কল কেটে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল”আজ আপনার আপুর বাসায় আসবেন। আপনার একটা জিনিস আমার কাছে আছে”
আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই সে গাড়িতে করে চলে গেল।ও চলে যাওয়ার পরে আপু এসে বললো”কি?সব মিটেছে”

আমি হ্যাঁ‌ বললাম আর বললাম আজ তোমাদের বাসায় যাব। অনেক কথা আছে!
_______________
আমি আজ যাব বলে আপু তার শশুর শাশুড়কেও বাসায় যেতে দেয়নি।

আমি যাওয়ার পরে আপুর সাথে অনেক কথা বললাম।সবটাই সৈকতকে ঘিরে।
এই যেমন, দুলাভাই আর সৈকত নাকি এক বছরের ছোট বড়। এলাকার সবাই নাকি ওনাদের টুইন ব্রাদার্স নামে চেনে।যদিও চেহারা আলাদা অনেকটা।
দুলাভাইয়ের জব পাওয়ার পরে তিনিই নাকি সৈকতকে জব দিয়েছেন তাদের অফিসে।
সৈকত সন্ধ্যায় বা বিকেলে বাসায় ফিরবে। ততক্ষন আমি কি করব?যদিও বিকেল হতে বেশি সময় নেই।
সিদ্ধান্ত নিলাম এই সময়টা ছাদে কাটাব।
ফেসবুকে ঢুকেই অনেকটা সময় পার করে দিলাম। একটু পর আপু আসল।সবাই মিলে নাস্তা করলাম। দুলাভাই আর সৈকত বাদে। কারণ তারা অফিসে।
দুলাভাই আর সৈকত ফিরল একদম সন্ধ্যার পরে।আপু তাদের ফ্রেশ হতে বলে তাদের টেবিলে ডাকল। তাদের জন্য আলাদা করে নাস্তা রাখা হয়েছিল।
আমি সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম। সৈকতের নাস্তা খাওয়া হলে সে তার পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। চারিদিক দেখেই মেরেছে অবশ্য। চিরকুট টা সোজা আমার কোলে এসে পড়ল।আমি তার দিকে হা করে তাকালাম।সে আমাকে মুখের ইশারায় পড়তে বলল।
আমি চুপচাপ টিভিটা অফ করে চিরকুট টা হাতে মুঠো করে নিলাম।তারপর একটু সাইডে এসে চিরকুট টা খুললাম। সেখানে লিখা আছে-
“জানি ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছ যে আমার কাছে তোমার এমন কি জিনিস আছে?সেটা বলব কিন্তু তার জন্য তোমায় আজ রাত ১১ টার সময় ছাদে আসতে হবে”

ব্যাস! এইটুকুই?
কি এমন আছে? দেখায় তো কালকে হলো! নাকি সে আমাকে আগে থেকে চিনে?উফ!দেখা যাবে।
______________
রাতে ডিনার করে আপুর সাথে আপুর রুমে ঘুমাতে গেলাম। দুলাভাই আর সৈকত একরুমে ঘুমাবে।
আপুর সাথে রাজ্যর গল্প করলাম কিন্তু মন তো এখানে নেই।১০ টার দিকে আপু ঘুমিয়ে গেল। আপুর রাত জাগার অভ্যাস নেই।
১০:৫০ এই ছাদে পৌঁছালাম।I think সৈকত আর আমি ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে গেছে।
ছাদে গিয়েই দেখলাম সৈকত আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে।আমি গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালাম।সে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। চারিদিকে মৃদু বাতাস বইছে।
সে চোখ বন্ধ করেই বলল”এসেছ?”

“হুম”

“এত বিশ্বাস?মাত্র একদিনের পরিচিত ছেলে বলল আর চলে এলে?”

কি করবেন?

সৈকত আমার দুই পাশের রেলিংয়ে ভর করে আমার দিকে একটু ঝুঁকে বলল “অনেক কিছুই তো করতে পারি তাই না? আমিও তো একটা ছেলে right?”

আমি ওর বুকে হাত দিয়ে আমার থেকে একটু দূরে সরালাম কারণ আমার অস্বস্তি হচ্ছিল তারপর হাত ভাঁজ করে বললাম “যদি করার হতো তাহলে বন্ধ ঘরেই করতে পারতেন,এভাবে খোলামেলা ডাকতেন না”

সৈকত রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল”বেশ intelligent মেয়ে তো তুমি!”

“ওসব বাদ দেন আর কি বলতে ডেকেছেন সেটা বলেন”

“কেন?অন্যকোথাও যাবা?”

“আরে,,আপনি আমার চাচাকে চিনেন না! মানুষ একটু জোরে হাটলেও তিনি জেগে যান”

“আচ্ছা এই নাও, তোমার আমানত”

“এটা তো আমার এক্সট্রা ওড়নাটা!আপনি কোথায় পেলেন?”

“বিছানা‌ থেকে শার্ট নেওয়ার সময় শার্টের সাথে চলে গেছিল।”

“আচ্ছা!আজ আসি?”

“আরেকটু থাকা যায় না?”

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

নীরবে ভালোবাসা পর্ব-০৩

0

গল্প:#নীরবে_ভালোবাসা
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০৩

ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম বিকাল হয়ে গেছে। কেন ঘুমিয়েছিলাম ভাবতেই আবার সৈকতের কথাটা মনে পড়ে গেল।
মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে। ওখান থেকে গোসল করে বেরিয়েছিলাম আর এখানে এসেই শুয়ে পড়েছি।ভেজা চুলে শুয়ে পড়ার জন্য মাথা ব্যথা করছে আর চুলও ভেজা আছে এখনো।
দরজা লাগিয়ে শুয়েছিলাম। কিন্তু আমার ওড়না কই?
ঘুমালে যে ওড়না কোথায় হারিয়ে যায়!সব খুঁজে খুঁজে দেখছি একদম বিছানার শেষ প্রান্তে কম্বলের নিচে ঢুকে আছে।আমি গরমের সময়ও হালকা পাতলা একটা কম্বল রাখি। মাঝেমাঝে বৃষ্টি হলে টুপ করে গায়ে দিয়ে দেই।ওড়নাটা গায়ে দিয়ে আম্মুর রুমে গেলাম।
সেখানে হেয়ার ড্রায়ার আছে।এট ফার্স্ট চুল শুকাব। আমাকে দেখে আম্মু উঠে নাস্তা বানাতে চলে গেল। যেহেতু বিকাল হয়ে গেছে একটু পর আম্মু এমনিতেও বানাতো।
নাস্তা খেয়ে মাথা ব্যথার ওষুধ খেলাম।আর শুয়া যাবে না শুইলেই মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।ঘরে এসে জানালার কাঁচ টা সরালাম,একটু প্রকৃতি দেখি। হঠাৎ একটা সুন্দর পাখি একটু দূরের ডালে বসল।আমি আবার সবকিছুর ফটো তুলতে ভালবাসি।এইটাও মিস করব না!
ফোনটা হাতে নিতেই দেখি মানহা আপুর অনেক কল। আমি চলে এসেছি শুনে কষ্ট পেয়েছে হয়ত!কিংবা সৈকত সব বলে দিয়েছে হয়ত।

একবার কি কল করব? করেই দেখি।
যা অপমানিত হওয়ার তাতো হয়েইছি কিন্তু আপু আমাকে বেশি কিছু বলতে পারবে না তা আমি জানি।

দুইবার রিং হওয়ার পর একটা ছেলে ওপাশ থেকে হ্যালো বললো,তো আমি ভাবলাম সেটা দুলাভাই। তাই আমি বললাম”দুলাভাই বলছেন?আমি লাবণ্য।আপু ফোন দিয়েছিল আমায় একটু দেওয়া যাবে?”

ওপাশ থেকে সৈকতের কন্ঠ স্বর আসতেই আমি ফোনটা কেটে দিলাম।সে আমাকে কি জানি বলছিল”আমি সৈকত! আপনার সাথে…”
তারপর আমি কেটে দিয়েছি। আবার যদি অপমান করত!নাহ ফোনই করব না আর।
ফোনটা অফ করে পড়তে বসলাম। রাত আটটায় উঠে ডিনার করে শুয়ে গেলাম।না না ঘুমাবো না, আমি তাড়াতাড়ি শুধু শুই ঘুমাই না।

একটু পর কে জানি দরজায় টোকা দিল।আমি উঠে দরজা খুলে দেখলাম আব্বু।আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে আব্বুকে ভিতরে আসতে বললাম।আমি বললাম”কোন দরকার আছে আব্বু?না মানে এই সময়?”

আব্বু বললেন”ফোন কোথায় তোমার?”

আমি টেবিলের দিকে একবার তাকিয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললাম”ওইতো আব্বু টেবিলের উপর, কেন?”

আব্বু বললেন”ফোন বন্ধ থাকে কেন?মানহা তোমায় ফোন দিয়ে পায়নি বলে আমায় ফোন দিয়েছিল। বিকালে কি করছিলে?সবসময় তোমার ফোন অফ থাকবে নাহয় সাইলেন্ট কেন?..

“হয়েছে আব্বু!আমি বিকেলে ঘুমাচ্ছিলাম।আর পড়তে বসেছিলাম বলে ফোন অফ করে রেখেছিলাম। এখন তুমি যাও আমি ফোন দিচ্ছি।”

আব্বু আমার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার বিড়বিড় করে আমাকে বকতে বকতে চলে গেল।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম।

এবার আমি শুধু দোয়া করছি যেন আপুই ধরে। এবার তিনবার রিং হওয়ার পর আপু ধরল।

“এত দেরী কেন?কি করছিলা?”

“ঐ,,ইয়ে মানে..”

আমি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম”রোমান্স?”

আপু “ধুর” বলল আর আমি হো হো করে হেসে দিলাম।
তারপর আমি কথা ঘুরানোর জন্য বললাম কেন ফোন করছিলে

“তোর কোন পরিক্ষা নেই তাই না?”

এই কথা শুনেই বুঝলাম সৈকত আপুকে সব সত্যি বলে দিয়েছে। কেন করল‌‌ সে এমন? আমাদের দুজনের মাঝেই রাখতে পারতো কথাগুলো।এখন সত্যিটা যেহেতু আপু জেনেই গিয়েছে সেহেতু নতুন করে মিথ্যা বললে আবার মিথ্যাবাদীও হয়ে যাব।তাই বললাম-

“হ্যাঁ!”

“সৈকত তোকে ভুল বুঝলো তবুও নিরবে সহ্য করলি?”

“জবাব দেওয়ার মত পরিস্থিতিতে ছিলাম না।সে আমাকে কিছু বলারই সুযোগ দেয়নি।”

“দোষটা যেহেতু কারোরই না তাহলে চলে গেলি কেন?”

“তার দিকে তাকানোর সাহস ছিল না।”

“সে তোর কাছে ক্ষমা চায় তাই আমি ওকে তোর সাথে কাল দেখা করিয়ে দিব।”

“না না আমি তার দিকে তাকাতেও পারবো না!তুমি বরং ওকে বলে দিয়ো আমি ক্ষমা করেছি।”

“না পারার কি আছে? সে তোর সাথে কথা বলতে চায়।বাদ দে! বিকালে কি করছিলি?”

*ঘুমাচ্ছিলাম”

“আবার কল দিয়েছিলি শুনলাম”

“হুম, কিন্তু তোমার ফোন ঐ সৈকতের কাছে কি করছিল?”

“সৈকত নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনেক লজ্জিত ছিল।আমার মাথা খেয়ে ফেলতেছিল।তাই তো তোকে কলও করেছিলাম কিন্তু তুই ফোন তুলিস নি।আর টেনশনে ওর মাথা ব্যথা হয়ে গেছিল তাই চা বানাতে গেছিলাম। কিন্তু ফোন তো আর রান্নাঘরে নিয়ে যাব না তাই সে ধরেছিল।”

এরপর কিছু টুকিটাকি কথা বলে আমি ফোন রাখলাম।
আপু একদম পাকা কথার মেয়ে। সে যখন বলেছে দেখা করাবে মানে করাবেই। কলঙ্ক সরলো কিন্তু টেনশন উঠলো।
মানুষতো নিজের হাসবেন্ডের সামনেও কাপড় ছাড়া আসতে লজ্জা পায় আর আমি?
সে তো আমার আদৌ কেউ ছিল না, কোন মুখে দাড়াব?

চলবে…

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

নীরবে ভালোবাসা পর্ব-০২

0

গল্প:#নীরবে_ভালোবাসা
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০২

তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে অন্য একটা জামার সাথে হিজাবটা বেঁধে নিলাম।ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে লাগলাম।সবাই সবার কাজে ব্যাস্ত তাই কেউ আমাকে খেয়াল করল না। বিশেষ করে সৈকত।সে আমাকে দেখেও ইগনোর করল। মনে হলো যেন এখনি কেঁদে ফেলব তবুও নিরবে বাড়ি থেকে বের হলাম। চাচার সাথে কে জানি ছিল আমি চিনলাম না।চাচা জিজ্ঞাসা করল আমি কোথায় যাচ্ছি?

আমি বললাম আমার কাল পরিক্ষা আমার যেতে হবে।আমি শুধু আপুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
চাচা আবার পড়াশোনা নিয়ে বেশ সিরিয়াস তাই বললো ভালোভাবে পড়তে।

বাসায় এসে কলিং বেল চাপতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে অবাক হলো কারণ আমি বলেছিলাম থাকব কিন্তু চলে এলাম। আম্মুকেও পরিক্ষার কথা বলে ম্যানেজ করলাম আর বললাম মাথা ব্যথা করছে তাই আমি ঘুমোতে চাই। আম্মুও কিছু বলল না।

ঐদিকে,
চাচী আপুকে আমার কথা জিজ্ঞেস করছে যে,আমি কোথায়?
আসার পরই আপু রান্নাঘরে ছিল তারপর গোসল করতে চলে গেছিল তাই সে বলল সে আমার খবর জানে না।
চাচী আপুকে বললেন, তিনি নাকি আমাকে সাকির ভাইয়ার রুমে ফ্রেশ হতে বলেছিলেন তারপর কি সে রুমেই আছে?
চাচীর কথা শুনে আপু ঢোক গিলল কারণ সেই সৈকতকে সাকির ভাইয়ার রুমে পাঠিয়েছিল ফ্রেশ হতে।

আমাকে খোঁজার নাম করে আপু চাচীর কাছ থেকে সরে এলো।
সে সর্বপ্রথম সৈকতের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল”তুমি কি লাবণ্যকে দেখেছ?”

“লাবণ্য কে ভাবি?”

“আমার বোন, তোমার গাড়ির পাশে মেবি তুমি ওর সাথে কথা বলছিলে সেই মেয়েটা!”

“সেই চরিত্রহীন মেয়েটা তোমার বোন হয়?”তাচ্ছিল্যের সাথে বলল সৈকত

মানহা চমকে বললো”এভাবে কেন বলছ সৈকত?”

কারণ….

এর আগেই মানহার আম্মু লাবণ্য কে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ি মাথায় করে ফেলেছে। তিনি চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে লাবণ্যর নাম ধরে ডাকছেন।তার চিল্লাচিল্লিতে সবাই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়।
চাচা জিজ্ঞাসা করেন এভাবে চেচানোর কারন কি?

চাচী বলেন”লাবণ্যকে সাকিরের রুমে ফ্রেশ হতে বলেছিলাম কিন্তু তারপর কোথায় চলে গেল?”

চাচা নিজেকে শান্ত করে বললেন”তাই বলো!আমি তো ভাবলাম কি না কি! লাবণ্যতো বাসায় চলে গেছে!আমার সাথে দেখা হয়েছিল বলছিল তার নাকি পরিক্ষা আছে সে শুধু মানহার সাথে দেখা করতে এসেছিলো।”

সৈকতের এবার নিজেকে গালি দিতে মন চাচ্ছে,সে সত্যটা না জেনেই মেয়েটাকে এত কথা শুনালো।”ভাবি যেমন আমাকে সাকিরের রুমে ফ্রেশ হতে বলেছিলো তেমনি ভাবির আম্মু ঐ মেয়েটাকে বলছিলো।Oh shit! আর আমি না জেনেই তাকে চরিত্রহীন বলেছি।I think ও কষ্ট পেয়ে চলে গেছে কোন পরিক্ষা ছিল না।এ বিষয়ে আমার ভাবির সাথে আলোচনা করা উচিৎ”মনে মনে ভেবে রাখল সৈকত।

সবাই খেয়েদেয়ে যে যার রুমে চলে গেল।মানহার মনটা ভালো নেই। এতদিন পর মেয়েটা এসেছিল কিন্তু ঠিক মত সময়ই কাটাতে পারলো না।
অনেক ভেবে চিন্তে সৈকত মানহার ঘরের সামনে এসে নক করল। সৈকতের ভাই সাগর এসে দরজা খুলে দিল।আর ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল”কি চাই?”

“ভাবিকে”

“কেন?”

“তুই বুঝবিনা ভাই ডাকনা!”

“তোর বড় হই,বুঝবনা মানে?”

“আবে সালা ১ বছরের বড় হয়ে এত ভাব নেস কেন?”

“কি হয়েছে?”জিজ্ঞেস করল মানহা

“ভাবি!একটা হেল্প চাই প্লিজ! বাইরে আসো”

“কি এমন হেল্প যা তোর ভাইকে বলা যায় না”

“আহা শুনিই না!”বলল মানহা

সাগর ভেংচি কেটে ঘরে চলে গেল।
সৈকত মানহাকে নিয়ে ছাদে এসে ঘরে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বললো। বলার সময় ওর অবশ্য একটু লজ্জা লাগছিল কারন ব্যাপারটা মেয়েলি।
সব শুনে মানহা হতাশ হয়ে বলল”তো,এখন তুমি কি চাচ্ছ?”
“ক্ষমা!ক্ষমা চাই”

“মনে হয় না পাবে কারণ একজন ভালো মেয়ের চরিত্রই সব আর তুমি সেখানেই আঘাত করেছ”

“তবুও!আমি তো জানি আমি কেমন আচরণ করেছি। যতক্ষণ আমি তার কাছে ক্ষমা না চাচ্ছি আমি নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে থেকে যাব।প্লিজ! একবার দেখা করায় দাও”

“ওদের বাসায় গেলে তো তোমাদের আলাদা কথা বলিয়ে দিতে পারব না,তাই কাল পর্যন্ত তোমার ওয়েট করতে হবে।সে এমনিতে বাসা থেকে বের হয় না।তাই কাল যখন সে ভার্সিটির জন্য বের হবে তখন কথা বলিয়ে দেব but ততক্ষন পর্যন্ত wait করতে হবে”
এই বলেই মানহা নিচে নেমে আসলো।

চলবে….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

নীরবে ভালোবাসা পর্ব-০১

0

গল্প:#নীরবে_ভালোবাসা
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০১

আজ আমি আমার চাচাদের বাসায় যাব। আমাদের বাসা থেকে মাত্র ১০ মিনিট দূরত্বে।কি যে খুশি লাগছে!তার কারন হচ্ছে আমার চাচাতো বোন মানহা আপু।তার এক মাস হলো বিয়ে হয়েছে।আর আজ সে দ্বিতীয় বারের মতো বাসায় আসছে। প্রথমবার যখন সে এসেছিল তখন আমার জ্বর হয়েছিল আর আমি বিছানা থেকে উঠতেও পারছিলাম না তাই যাওয়া হয়নি।সে নাকি আমাকে দেখতে এসেছিল কিন্তু আমি নাকি ঘুমাচ্ছিলাম তাই আর ডাকেনি।

প্রথমে আমার পরিচয় দিয়ে দেই। আমার নাম হচ্ছে ফারিহা তাসনিম লাবণ্য।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ভার্সিটি তে উঠলাম এক বছরও হয়নি এরই মধ্যে বিয়ের প্রোপোজাল আসা শুরু হয়ে গেছে।যেই ঘুরতে আসে সেই আমাকে তার ছেলের বৌ করতে চায় যদি তার ছেলে থাকে আর কি। এজন্যে মেহমান আসলে আমি ঘর থেকেই বের হই না নাহয় বাসায়ই থাকি না। বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছি ইদানিং। যাইহোক, আমার নিজের কোন ভাই বোন না থাকায় মানহা আপুকে অনেক ভালোবাসি।সে আমার থেকে দুই বছরের বড়।তাকে একদম নিজের বোনের মত আর মানহা আপুর ভাই মানে আমার চাচাতো ভাই সাকিরকেও অনেক ভালোবাসি।সে মানহা আপুর এক বছরের ছোট আর আমার এক বছরের বড়।

এমনিতেই সে আমার সাথে বেজির মত লেগে থাকে সবসময়।এত বিরক্ত করে! কিন্তু যখন অন্য ছেলে আমাকে বিরক্ত করে তখন তার খবর করে ছাড়ে। আমার চাচাতো ভাইয়েরা এলাকার সিনিয়র তাই তাদের বোনকে কেউ বিরক্ত করুক এটা তারা মেনে নিবে না।

আব্বু আমাকে মানহা আপুদের বাসার সামনে নামিয়ে অফিস যাবে।মাত্র একদিন থাকব বলেছি তাও আম্মু একগাদা টিপস আর কাপড় দিয়ে দিয়েছে।যদিও কিছু লাগলে বা ভুলে গেলে আমি ১০ মিনিট হেঁটে গিয়ে নিয়ে আসতে পারব।
মানহা আপুদের বাসার সামনে ফাঁকা জায়গা আছে কিন্তু বাগান করে না কেউ। আমাদের বাসার সামনে থাকলে আমি নিশ্চিত করতাম।
বাড়ির সামনে দুইটা গাড়ি আছে।জানি,আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক ধনী কিন্তু তাই বলে কি আপু আর দুলাভাই দুই গাড়িতে এসেছে নাকি?
না না,অন্যকেও ওতো আসতে পারে!
হাঁটতে হাঁটতে একটা গাড়ির সামনে আসতেই গাড়ির দরজা হঠাৎ খুলে গেল আর আমার সাথে এক ধাক্কা লাগল।আর সেই সুবাদে একটা সুন্দর আছাড় খেলাম। হাতে তো সেই ব্যাথা পেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা সুদর্শন ছেলে নামল। চেহারা অনেকটা দুলাভাইয়ের মত। তাকে দেখে তো সেই ক্রাশ খেয়েছি আর হাতের ব্যাথাও ভুলে গেছি।

“এই! মিস?ব্যাথা পেয়েছেন?”

হঠাৎ তার ডাকে হুঁশ ফিরল।আমি যেন তার মধ্যেই ডুবে গেছিলাম।আমি বললাম”হ্যাঁ!একটু পেয়েছি ব্যাপার না”

সে বলল”I am extremely sorry,আমি আসলে খেয়াল করি নাই”

“It’s ok.By the way আপনি কে?”

“আমি? সৈকত আর আপনি?”

আমি..

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই মানহা আপু ঐ ছেলেটা মানে সৈকতের নাম ধরে ডাক দিল আর সে আমাকে”Excuse me”বলে চলে গেল।আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার জামা ঝাড়তে লাগলাম।
আমার কারো সাথেই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার অভ্যাস নেই। সেখানে সৈকতের তো কোন দোষই ছিল না।আমি গাড়ির পিছন দিয়ে আসছিলাম। সেখানে লুকিং গ্লাস ছাড়া তো আমায় দেখায় যাবে না।
দেখলাম মানহা আপু সামনে এগিয়ে আসছে‌। আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল”ধুলো কিভাবে লাগল?আর আসলিই বা কখন?”
আমি বললাম স্লিপ খেয়ে পড়ে গেছিলাম।

মিথ্যা বললাম কারন এতবড় ইতিহাস বলতে বলতেই আমি শেষ হয়ে যাব।
মানহা আপু আমাকে ভিতরে আসতে বলল।আমি বললাম”তোমরা একাই এসেছ?”

“না!আমি আর তোর দুলাভাই এক গাড়িতে আর আমার শ্বশুর শাশুড়ি আর সৈকত এক গাড়িতে”

এবার গাড়ির বিষয়টা বুঝলাম।মানহা আপু আর দুলাভাইকে প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য ওরা অন্য গাড়িতে এসেছে।

বাড়ির মধ্যে যেতেই চাচী আপুকে রান্নাঘরের দিকে ডাক দিল তাই সে চলে গেল। আমার এখন ফ্রেশ হওয়া লাগবে কিন্তু ফ্রেশ হব কার রুমে?যেই রুমে আমি আসলে থাকতাম সেটা মনে হয় আপুর শ্বশুর শাশুড়িকে দেওয়া হয়েছে। আপুর রুমে যাওয়া যাবেনা কারণ সেখানে দুলাভাই আছে আর সবাই জার্নি করে এসেছে তাই সবার গোসল করতে হবে।আমারও করতে হবে কারণ আমার জামা কাপড় সুন্দর ভাবে নোংরা হয়ে গেছে।এসবই ভাবছিলাম তখনই চাচী ডাক দিয়ে নাস্তা করতে বলল। কিন্তু আমি বললাম আমার প্রথমে গোসল করা লাগবে।
চাচী বললো করে নিতে কিন্তু করব টা কোন রুমে?
চাচী তো জানে আমার এত মেহমান পছন্দ না আর আমার অসুবিধা বুঝতে পেরে চাচী বললো সাকির ভাইয়ার রুমে ফ্রেশ হতে। ভাইয়া নাকি ক্রিকেট খেলতে গেছে।তার ম্যাচ আছে যা একদম দুপুরের পর শেষ হবে।আমি এই কথা শুনে চাচীকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেই আবার ছেড়ে দিয়ে দিলাম দৌড় কারণ অলরেডি আমার গা চুলকানি শুরু হয়ে গেছে।

ঘরে এসেই দরজা লাগাই ফেললাম।ফ্যান অন করে হিজাব পিনগুলো খুলতে লাগলাম। হিজাব খুলা শেষে গায়ে যে এক্সট্রা ওড়না ছিল সেটাও নামায় ফেললাম।কাছেই এসেছি তাই শুধু হিজাব নিয়েছি বোরখা না। গায়ে একদম ঘাম হয়েগেছে।যদি গোসল করতে হয় তাহলে এগুলোকে প্রথমে শুকাতে হবে নাহলে আবার ঠান্ডা লেগে যাবে। গায়ের লং ড্রেস টাও খুলে দিলাম এখন গায়ে শুধু একটা হাতকাটা কামিজ।জামা আর ওড়না গুলো আলনায় মেলে দিয়ে বিছানায় আয়েশ করে চোখ বন্ধ করে বসলাম।তখনই মনে হলো দরজা খুলার শব্দ হলো চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম সৈকত বাথরুম থেকে বের হলো। আমার চোখ কপালে উঠে গেল। কারণ দুইটা,প্রথমত ওকে দেখে আমার পা আপনা আপনি ফ্রিজ হয়ে গেছে আর দ্বিতীয়ত তার বডি থেকে যে পানি ঝরছে তাতে ওকে আরো কিলার লাগছে ওকে।
ও আমাকে এখনো খেয়াল করে নি কারণ ও মাথা মুছতে ব্যাস্ত।আমি দ্রুত উল্টা ঘুরে গেলাম।ড্রেস নিয়ে যে শুধু গায়ের সামনে ধরব তারও উপায় নেই কারণ আলনাটাও সৈকতের ঐদিকে।
হঠাৎ সৈকত আমার দিকে তাকালো মানে আমার পিঠের দিকে। যেহেতু আমি উল্টা ঘুরে ছিলাম তাই।
আমি শুধু মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে বললাম”চিল্লাবেন না প্লিজ!”

সৈকত বললো”এই আপনি এই অবস্থায় এখানে কেন?রেপ এর মামলা দিতে চাচ্ছেন নাকি?”

“না আসলে আমি গোসল করতে এসেছিলাম কিন্তু…”

“যদি গোসল করতেই আসেন তাহলে এভাবে বাথরুমের সামনে জামা কাপড় ছাড়া দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাথরুমে টোকা পর্যন্ত দেন নি!দিলে তো বুঝতে পারতেন ভিতরে কেউ আছে কিনা? যখন প্রথম বার দেখলাম তখনতো বেশ ভদ্র মনে হলো কিন্তু আপনি তো একটা চরিত্রহীন আর আপনার মত চরিত্রহীন মেয়ের জন্যই যারা আসল ভুক্তভোগী তারা ন্যয় পায় না যত্তসব!”

এই বলেই সৈকত বিছানার উপর থেকে তার শার্ট টা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমাকে আমার মুখের কথাটুকুও বলতে দিল না আবার আমাকে চরিত্রহীনও বললো।তার দিক দিয়ে হয়ত সে ঠিক বলেছে কিন্তু সত্য না জেনে আমাকে চরিত্রহীন বললো?এটা কি ঠিক?
ঘরের দরজাটা লাগিয়েই আমি চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। চরিত্রই মানুষের সব আর আজ এই চরিত্র নিয়েই একটা অপরিচিত ছেলের কাছে এতকিছু শুনতে হলো?
নাহ! ভেবেছিলাম একদিন থাকব কিন্তু যতবার ওর দিকে আমার চোখ পড়বে ততবারই নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাব।আমারই উচিৎ ছিল কেউ রুমে আছে কিনা চেক করা।

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

একটা পরীর গল্প পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#শেষ_পর্ব

সকালে ঘুম ভাঙতেই সর্বপ্রথম আমি পাশে শুয়ে থাকা অভীকের দিকে তাকাই। আর যেটা দেখি সেটা দেখার জন্য আমার চোখ কিংবা মন কোনোটাই প্রস্তুত ছিলো না। কোথাও কেউ নেই! ভয়ে হুরমুরিয়ে উঠে পড়ি আমি। ডানে, বামে, ঘরের আনাচে কানাচে শতখুজেও কোনো মানুষের হদিশ মিললো না। এবার নিজের দিকে তাকালাম। না জামাকাপড় তো ঠিকই আছে, তবে গায়ে একটু ব্যাথা আছে। হয়তো জ্বরের কারনে। কিন্তু এতো বড় এবং বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম আমি? আমি বাইরে বেড়িয়ে আসি, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। উঠানে একটা কুকুর ঘুমিয়ে আছে তার দুটো বাচ্চা নিয়ে। আমি ওযু করে দ্রুত নামায পড়ে নিলাম।হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। আমি চমকে ফোনের দিকে তাকাই, ফোন চালু করা? তাহলে আমি রাতে ফোন চালু করেছিলাম। যদি ফোন চালু করে থাকি! আর এটা সত্য হয় তাহলে অভীকের আসাটা কি?

কার সাথে ঘুমিয়েছি রাতে? অভীক ছাড়া! অন্য কারোর তো ঘরে আসার কথা না, আর থাকারও কথা না কারন চাচারা সারা রাত জেগেই পুকুরে মাছ ধরেছেন, কেউ আসলে ওনারা নিশ্চই জানবেন। আমি বাইরে গিয়ে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম।

– ” চাচা তোমাদের জামাই..”

চাচা দ্রুততার সঙ্গে উত্তর দিলেন।
– ” হ আইছে তো। তুই ওঠনের আগেই দ্যাখলাম ও উইঠ্যা রাস্তার ওইপারে যাইতাছে। আমি জিগাইলাম কই যাও বাবা, কয় কাজ আছে বিলের ওইহানে তাই যায়। ”

আমি এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। যাক এটা তো সত্য যে উনি এসেছেন। কিন্তু বিলের ওখানে কেন গিয়েছেন? এমন যে আজ প্রথম হয়েছে তা না, প্রতিবারই দেখেছি ওনাকে ঘুরতে এসে ওখানে যেতে। কি করতে যান ওখানে? আমি নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে ধীর পায়ে অগ্রসর হলাম সেই দিকে। হিম শীতল ঠান্ডা হাওয়ায় গা শিরশির করে উঠছে, বোধ হয় জ্বরটা আবার এসেছে। বিলের পাশেই একটা ছোট ব্রিজ। আমি ব্রিজের ওপর দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার চোখ যায় ব্রিজের নিচে, অভীক একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ক্ষনিকের জন্য পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসলো চোখের পানিতে। মেয়েটা অভীককে ছেড়ে পাশে দাড়াতেই দেখলাম লিজাকে। অভীকের বন্ধু লিজা যে এই গ্রামেই থাকে, আমাদের বাড়িতেও আসতো আগে আমার বড় আপুর সাথে। আমার পা টলে আসে। অভীক তখনই উপরে তাকায় আর আমাকে দেখতে পেয়ে চমকে যায়। আমি কিছু না বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। অভীক পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলো আমাকে, কিন্তু সে ডাক আমার কানে এসে পৌঁছালো না। ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মিষ্টি তখন আমার ঘরেই ছিলো।আমাকে খুজতে এসেছিলো, আমি না থাকায় ও আমার ফোনে গেইম খেলছিলো।

– ” মিষ্টি, দীপ্তির কাছে যাও তো সোনা। ”

আমার কথা শুনে মিষ্টি অবাক হয়ে তাকালো। স্বাভাবিক! এই প্রথম ওকে আমি নিজের ঘর থেকে বাইরে যেতে বলেছি তার ওপর নিজের গলার স্বরের এরূপ পরিবর্তন, কান্নায় ভেজা রুদ্ধস্বর। মিষ্টি একনজর আমার দিকে তাকিয়ে বাইরে চলে গেলো। আমিও খিল দিয়ে দিলাম ঘরে। অভীক এসে দরজায় কড়া নাড়লো।

– ” পরী দরজা খোল। ”

আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আমার চেহারা একদম স্বাভাবিক। অভীক ক্রোধান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– ” ওখানে গিয়েছিলি কেন? ”

– ” আপনি আসুন আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি। কি খাবেন আপনি? ”

– ” আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছি এই জ্বর নিয়ে কেন গিয়েছিলি ওখানে? কিসের জন্য? ”

– ” আপনাকে দেখতে। চাচা বললো আপনি ওখানে গিয়েছেন তাই। আমি আসছি। ”

– ” আমাকে দেখতে গিয়েছিলি, তো চলে আসলি কেন?তোকে ডাকলাম তখন উত্তর দিসনি কেন? ”

– ” ইচ্ছে করেনি তাই। তাছাড়া আপনারা তখন কথা বলছিলেন সেজন্য বিরক্ত করিনি। আচ্ছা আপনাদের কথা বলা শেষ হয়েছে? নাকি আরও কিছু বাকি আছে? বাকি থাকলে আজ রাতে যেতে পারেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিবো। ”

কথাটা অভীকের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই অভীক সজোরে চর মারলেন আমার গালে। আমি গালে হাত দিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। মুচকি হেসে বললাম।
– ” খেতে আসুন। ”
– ” খাটের ওপর গিয়ে বস। তোর পা দিয়ে রক্ত পড়ছে।”
– ” আমার অভ্যাস আছে। ”
– ” পরী আমার কথার অবাধ্য হোস না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। তোর কপালে কিন্তু বহুত দুর্ভগ আছে। ”
– ” আগে কি ছিলো না? ছিলো তো!”

অভীক আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি হাতের ইশরায় ওনাকে বাঁধা দিলাম।
– ” আমার কাছে আসবেন না দয়া করে। এখন আমার নিজেরও একটু সময়ের প্রয়োজন এই ঘটনা মেনে নেওয়ার জন্য। ”

অভীক তবুও আমার কথা শুনলেন না। হাতের কব্জি চেপে ধরলেন খুব জোরে। আমি ব্যাথায় কুকড়ে উঠলাম তবুও ছাড়লেন না। আমায় খাটে বসিয়ে উনি পায়ের ধারে বসলেন। পা উঁচু করে দেখলেন কি হয়েছে। এরপর নিজের ব্যাগ এনে সেখান থেকে তুলো আর স্যাভলোন বের করলেন, বড়ইগাছের কাটা ফুটে আছে।অভীক প্রথমে হাত দিয়ে চেষ্টা করলো কাটা বের করার কিন্তু যখন ব্যর্থ হলো তখন সরাসরি মুখ দিয়ে বসলো পায়ে, ময়লা লেগে থাকা পায়ে এভাবে মুখ দেওয়ার আমি বিব্রত হয়ে পা সড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু উনি দু-হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছেন পা। কাটা বের করে, ছিলে যাওয়া অংশ টুকু তুলো দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে বললেন।

– ” পরী একটা সত্য কথা বলবি? ভেবেচিন্তে উত্তর দিবি। তোর এই একটা উত্তর আমার জীবনের অনেক অগোছালো অধ্যায় গুছিয়ে দিবে, অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে, অনেক সমস্যান সমাধান করবে। ”

আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালাম অভীকের দিকে। অভীক আমার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

– ” ভালোবাসিস আমাকে? ”

আমি অভীকের কথা তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি দিয়ে মাথা নত করলাম। ওনার জীবনের সমস্যা আর কি হতে পারে? আমি ছাড়া! ওনার জীবনটা হুট করে অগোছালো কে করেছে? আমি ছাড়া! ওনার অনেক প্রশ্নের মাঝে একটা প্রশ্ন তো এটাও ” আমার জীবন কেন নষ্ট করলি? ” তাছাড়া এটাও তো ঠিক যে উনি আমার থেকে ভালো কাউকে আশা করেছিলেন। আর আমার জীবনের কালো অধ্যায়টাও না জেনে আমাকে নিজের জীবনে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এনেছিলেন। সব ভেবে আমি স্মিত হেসে উত্তর দিলাম।

– ” না। ”
উত্তর শুনে অভীক সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন।
– ” ভেবে বলছিস? ”
– ” হ্যাঁ। ”
– ” আরেকটু ভাব, ভাবার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোকে। ”
– ” ভেবেই বলেছি। আর ভাবার প্রয়োজন নেই। ”
– ” বিয়েটা ভেঙে দিতে চাস? ”
– ” সবাই যা বলবে সেটা করবো।”
– ” নিজস্ব মতামত? ”
– ” নেই। ”
– ” তো এমন গম্ভির মুখে বসে আছিস কেন? ”
– ” তো কি ষোলো পাটি দাঁত বের করে হে হে করবো? ”
– ” মাঝে মাঝে তো তাও করতে পারিস! তোর কালো মুখ দেখলেই সেইদিনটা খারাপ যায় আমার।”
– ” তাহলে না দেখার ব্যবস্থা করে ফেলুন। ”
– ” খুব বাড় বেড়েছে তোর। আমার মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছিস। ”
– ” আমি বরাবরই এমন। আগে নিভৃতে ছিলাম ”
– ” তো হঠাৎ প্রকাশিত হলো কোন আমোদে? ”
– ” আপনার রাসলীলা দেখার আমোদে।”
– ” বাহ। অতি উত্তম উত্তর। ”
– ” হুম। ”
– ” লিজা আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। ”
– ” তো? ”
– ” এবার ঠাটিয়ে দিবো এক চর। মনোযোগ দিয়ে শোন কি বলেছি। ”

ওনার ধমক শুনে আমি এবার খেয়াল করলাম ওনার কথা। এতক্ষণ শুধু হু হা বলে উত্তর দিয়েছি, কোনো প্রশ্নই সেভাবে শুনিনি, সব প্রশ্নই আংশিক শুনেছি। উনি আবারও বললেন,

– ” লিজা আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। আমার বোনের মতো। ওদের সম্পর্ক বাড়ি থেকে কেউ মেনে নিচ্ছে না।তাই কাঁদছিলো তাছাড়া আমার বন্ধুও ছিলো ওখানে, লিজাকে আমায় দেখে রাখতে বলে ও পালিয়েছে।”

– ” কোন বন্ধু? ”

– ” তোর বড়ফুফুর ছেলে রিয়াদ। ”

ওনার কথা শুনে আমি থমথমে গলায় বললাম।
– “মিথ্যা কথা। আমার ভাই’য়ের কথা আমি জানি না। আপনি জানেন? এসব বানোয়াট।”

– ” কি বললি? ”
– ” যেটা শুনলেন সেটাই বলেছি। আপনি যে সত্য বলছেন তার প্রমাণ কি? ”

অভীক আমার সামনে ভাইয়াকে ফোন করলো।
– ” হ্যালো রিয়াদ? ”
– ” হ্যাঁ বল। লিজা কি খুব কাঁদছিলো? ওকে শান্ত হতে বল। আমি সবটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। আর তোকে বলেছিলাম না? মামাকে বলতে।”
– ” আব্বু রাজি হয়েছে ফুফুকে বোঝানোর জন্য। চিন্তা করিস না তুই। আর লিজা এখন স্বাভাবিক আছে।”
– ” যাক বাঁচালি। তুই না থাকলে আমাদের সম্পর্কটা টিকতো না এভাবে, কবেই ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। ”

অভীক ফোনটা কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বসে বসে নখে নখ ঘসছি।
– ” শুনলি? ”
– ” তো এসব আমাকে শুনিয়ে কি লাভ? আমি কে হই আপনার? যে আমাকে এসব বলছেন।”
– ” এখন কি কাবিননামা বের করে দেখাতে হবে সম্পর্কের হিসাব? ”
– ” এসব করে কি বোঝাচ্ছেন? ভালোবাসেন আমাকে? আমার সম্পর্কে সবটা জানেন? যদি ভালোবাসতেন তাহলে এই তিনবছর দূরে ছিলেন কেন? যোগাযোগ করেননি কেন? ওদেশে যে আর কোনো বউ নেই তার গ্যারান্টি কি? ”
– ” গ্যারান্টি তোর বাপ। তোর বাপের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। যা। ”

আমি থতমত খেয়ে প্রশ্ন করি,
– ” মানে? ”
– ” মানে তোর বাপই তো ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়েছিলো। তাই তোর সব উত্তর উনি দিবেন। আমি তোর এই ফালতু মগজে বুদ্ধির চাষ করতে পারবো না।”
– “করার প্রয়োজনও নেই।”
– ” শোন আজ বিকালে তোদের “একটা পরীর গল্প ” শোনাবো। তুই সশরীরে ওখানে উপস্থিত থাকবি নাহলে কিন্তু মার একটাও নিচে পড়বে না। ”
– ” আমি শুনবো না। ”
– ” শোনার প্রয়োজন নেই। শুধু আমার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে থাকবি। নো মোর ওয়ার্ড। ”

বিকালে আসর বসানো হলো বাড়ির পেছনের বাগানে। অনা, দীপ্তি কিছু ফল এবং মিষ্টি এনে রেখেছে মাদুরের ওপর। মিষ্টি তেতুল মাখা, আর বড়ই মাখা আনছে। আমি গিয়ে চুপচাপ দেখতে লাগলাম সবটা। বেশ ভালোই আয়োজন করেছে। হঠাৎ অভীক এবং রিয়াদ কয়েকডজন খাবার প্যাকেট নিয়ে হাজির। অর্ধেকটা রিয়াদ এখানে আনছে, বাকিটা অভীক আম্মুর কাছে দিয়ে আসলো। কি এমন গল্প শোনাবে যে এমন এলাহি কান্ড করা হয়েছে।সবাই গোল হয়ে বসলো মাদুরে। অভীক মৃদু হেসে বলতে শুরু করলো,

– “একটা পরীর গল্প ” বলতে আসলে তেমন কিছু নেই। শুধু কিছু বোকা মানুষের মনোযোগ পাওয়ার জন্য এই চতুরতা। তবে যেটুকু বলা যায় সেটুকুই বলি, ”

আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন উনি। ওনার হেয়ালি দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। অভীক আমার দিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করলো।

– ” সে ছিলো আনন্দপরী।
উল্লাসই যেন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী
সে গান গাইতো নিভৃতে,
আড়ালে, সবার অগোচারে।
সারাদিন ব্যস্ত থাকতো নিজের দুষ্টুমিতে।
দিন যায়, দিন আসে!
পরীর গানের কথা রটে।
ঘরে, বাহিরে সব খানে পরীর নাম ডাক,
পরী শুধু গানকে বলে, তুই আমার সঙ্গে থাক।
পরী, অবুঝ মনের অধিকারী!
বিশ্বাস, শব্দের সঙ্গে তার অতি বাড়াবাড়ি!
দিবালোকে পরীকে দেখে মুগ্ধ হয়! এক শয়তান
কিন্তু পরীর রক্ষাকবচ দেখে!
সে হয়ে গেলো সাবধান
সুরবিদ্যার তরে সে আসে পরীর পানে
তিমিরে সে পরীর দিকে! হাত বাড়ালো সন্তর্পণে
কালো হাতের অন্তরালে পরী ছটফটায়
এই বু্ঝি ছোট্ট পরী ভয়ে জ্ঞান হারায়।

এপর্যন্ত শুনেই আমি ঘামতে শুরু করি।হুবহু আমার মিল রেখে কিভাবে ছন্দ বাঁধছেন উনি? তবে কি উনি সবটা জানেন? সেই নরপশুটার কথাও? যে আমাকে!

– ” পরী থাকে সুরক্ষিত নিজ প্রাসাদে,
কয় না কথা, একলা থাকে অতি নিরবে।
দূর থেকে এক রাজপুত্র!
এলো পরী দেখার ছলে
পরীর রূপে মুগ্ধ হলো,
পরীকে বাঁধলো নিজের জালে।
পরীর অন্তরালে সে ভালোবাসে তাকে
পরীই থাকে অগোচরে, এই কথার উন্মেষে
নিভৃতে যতনে সে পরীকে রাখে দূরে
পরী যেন এই কথা টের না পায় ঘুনাকখরে
অবশেষে সে বাঁধা পড়লো পরীর অভিমানে
ফিরতে হলো সুদূর থেকে! তাকে পরীর টানে।
বিচ্ছেদের এই মিলনতিথির সময় ক্ষণকাল
পরী নিজেই জানে না যে, তার মনের হাল চাল

এটুকু বলেই থেমে গেলেন উনি। সবাই গল্প শোনায় এতোটাই মগ্ন যে গল্প থামার সাথে সাথে ওরা চিৎকার দিয়ে উঠলো।

– ” তারপর? ”

অভীক স্মিত হেসে উত্তর দিলো।
– ” পরী জানে। কাহিনি এখানেই শেষ। এবার সবাই গিয়ে খেয়ে নে। খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

আমি ঘরে চলে আসি। অভীকও পিছু পিছু আসে। অভীক ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো।আজ ও ওর পরীর সব প্রশ্নের উত্তর দেবে । আমি খাটের ওপর বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার পানে।অভীক এসে আমার কোলে মাথা গুজে শুয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায়, আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

– ” আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর পাবি তুই। ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বেড়াতে গিয়ে, অশান্ত হয়েছি তোর থেকে দূরে থেকে থেকে। আমি চাই তোকে কাছে পেতে, তোর কাছে থাকতে, তোকে আগলে রাখতে।”

আমি সরু চোখে তাকালাম অভিকের মুখের পানে। ব্যাপারটা ‘ভুতের মুখে রাম নাম ‘ এর মতো। এটাও অভীকের বিশেষ কোনো চাল আমাকে জব্দ করার সুতরাং আমি ওর কথার জালে আর ফাঁসবো না।কিছুতেই না। অভিক নিজ থেকেই বলে উঠলো,

– ” তোকে যেদিন প্রথম দেখি! কয়লার কালির আবরণে ঢেকে থাকা শুভ্র মুখশ্রী! তখন থেকেই আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিলো। আমি তখন জানতাম তোর গানের স্যার তোর সাথে খারাপ আচরণ করেছে, তোকে গান শেখানোর নাম করে, তোর এবং বাকি সবার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এক বর্ষনের বিকালে এসে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলো তোকে। ”

আমি চমকে তাকালাম অভীকের দিকে। অভীক স্বাভাবিক কন্ঠেই বলতে থাকে।

– ” মূলত তোকে দেখার জন্যই এসেছিলাম আমরা। সেই দূর্ঘটনার পর থেকে তুই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলি, তোর গান তোর থেকে দূরে চলে গিয়েছিলো, একা থাকতিস, দীপ্তি ছাড়া তেমন কারোর সাথে মিশতিস না, এমনকি তখন বুঝতিসও না যে তোর সাথে ঠিক কি হয়েছিলো, তোর শুধু মনে ছিলো সেই বিশ্রি স্পর্শ আর হাসিটুকু। আমি তোকে কথা বলানোর অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু তুই তোর মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতিস না। তাই তোকে জ্বালাতন করতাম। আর তুই ভেবে বসেছিস আমি তোকে অপছন্দ করি! তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। কিন্তু যেদিন তোর বিয়ের কথা শুনলাম সেদিন আমার অবস্থা কেমন হয়েছিলো তোকে বোঝাতে পারবো না আমি। আমার মনে হতে লাগলো আমার আমিটা আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, পাগলের মতে কেঁদেছি সেদিন রাতে। মিষ্টির পরে তোর জন্য কেঁদেছি দেখে আব্বুও রাজি হয়ে যায় আমার সাথে তোর বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শর্ত দিয়েছিলো যতদিন না তুই ঠিক হবি, বড় হবি ততদিন তোর সাথে জোরাজুরি করতে কিংবা তোর কাছে যেতে পারবো না আমি। আমি তখন তোকে পাওয়ার জন্য সবকিছুতে হ্যাঁ বলে দেই। পরেরদিন সবার আগে আমি আর রিয়াদ তোর বর চুরি করার প্লানিং করি, কারন তোর বরকে সামনে রাখলে আমি কখনই তোকে বিয়ে করতে পারতাম না। যে পাওয়ারফুল চেয়ারম্যান তোদের, মোটা,কালো, ভুড়িওয়ালা ”

আমি রাগি চোখে তাকাতেই অভিক মূল কথায় আসে,

– ” যদি রহমতকে না সড়াতাম তাহলে তোর আব্বুর সব জমি ওদের দখলে চলে যেতো। বহুকাল আগে তোর মূর্খ দাদা কোন কাগজে টিপসই দিয়েছিলো তার ফল এটা। যাই হোক তো নির্বিঘ্নে বিয়েটা কাটাতেই আব্বু সেই শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলো। এখন তুই বল বিয়ে করেছি কি আলাদা থাকার জন্য? একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে বিবাহিত হয়েও সিঙ্গেল থাকবো? যখন এগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিলো তখন ইন্ডিয়া থেকে আমাকে একটা রেকর্ডিং কম্পানি লেটার পাঠায়, আমি ওদের আমার কিছু গানের রেকর্ডিং দিয়েছিলাম সেটা সিলেক্ট হয়েছিলো। তাই চলে গিয়েছিলাম। এবার আসি তোর হামযার কথায়, হামযা তোকে না আমার মিষ্টিকে ভালোবাসে, বলা যায় আমি ওকে একপ্রকার ভাড়া করেছিলাম তোর মন পরীক্ষা করার জন্য। ওই যে আজকাল কার লোকের ধারনা আছে না ‘ স্বামী বিদেশ ‘ বউ দেশে কি করে না করে ”

আমি রাগে ওনার মাথা কোল থেকে নামিয়ে সড়ে বসলাম। খচ্চর এবার উঠে বসলো, আমার দিকে তাকিয়ে আমতা সুরে বললো,

– ” আরে ভাই এতো রাগ করার কি আছে? আমি তো একটু খানি, যাস্ট চেক করছিলাম। তোর তো প্রাউড ফিল করা উচিত আমার মতো এমন একটা জামাই পেয়ে। নাহলে তো ওই রহমত ব্যাটার ঘরেই গিয়ে পড়তে হতো, সতীনের সাথে চুলাচুলি করতে হতো, আমি তোকে বাঁচিয়ে। একপ্রকার তোকে উদ্ধার করেছি, সেই হিসাবে আমার প্রতি তোর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত পরী। এমনে মুখ ভেঙচাস না। ”

আমি মাথা নত করে বসে আছি। তার মানে উনি সেই নরপশুটার কথা জানে যে আমাকে.. এজন্যই গতকাল রাতে জিজ্ঞেস করেছেন, ওনার স্পর্শে আমার খারাপ লাগছে কিনা। কিন্তু উনি দূরে থেকে আমার সাথে এতোগুলো অন্যায় করলো! আমি যে ওনার অনুপস্থিতিতে এতো কষ্ট পেয়েছি তার কি হবে? অভীক নিজের দু’হাতে আমার গালে চেপে ধরলো।

– ” তাছাড়া আরও একটা কারন ছিলো আমার ওদেশে যাওয়ার, আমি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমার মিষ্টির মতো যে শিশুগুলো অবুঝ, সরল, তাদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু এদের নিয়েই কাজ করে তাই এইসুযোগে ওর সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে ফেললাম। ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে গতবছর। আর কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হবে কাজগুলো। ”

– ” ভালো। ”

– ” শুধু ভালো? আর কিছু বলবি না? তোর জন্য এতোকিছু করে ফেললাম কি শুধু ‘ভালো’ শব্দ শোনার জন্য? ”

আমি এবার ভীষন চটে গেলাম। মনের সব রাগ মেটানোর সময় এসেছে। আমাকে সবার সামনে যে হারে উনি অপমান করেছেন, মেরেছেন তার শোধ তোলার সময় এসেছে। তাছাড়া উনি আমার অতিত জেনে আমাকে আপন করেছেন সুতরাং আজ, এই মুহূর্ত থেকে আমার আর কোনো দায় নেই। আমি মুখে গাম্ভীর্য ভাব এনে কঠোর গলায় বললাম।

– ” তাহলে কি চাচ্ছেন? ”

– ” গতকাল রাতে যেটা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু হয়নি সেটার জন্য অনুমতি চাচ্ছি। তোর অনুমতি ছাড়া অভীক তার মনোরথে ব্যর্থ।”

– ” আমাকে এতোদিন মেরেছেন, চুল ধরে টেনেছেন,কটু কথা বলেছেন, কাইল্যা-গাইয়্যা বলেছেন, খোঁটা দিয়েছেন ইভেন বিয়ের পর সদ্যবিবাহিত বউকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন, আপনার কারনে রহমতের মুখ থেকে আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে আমায়। ”

অভীক ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে।
– ” তো? ”

আমি ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।
– ” সুতরাং নতুন জীবন শুরু করার আগে, পেছনের সবকিছু ভুলে যাওয়া উচিত।”

অভীক খুশিমনে মাথা নাড়লো। আমি এবার ওনার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললাম।
– ” কিন্তু আমি এগুলো তখনই ভুলবো যখন আপনি সবার সামনে আমার সেই ‘ চৌদ্দগুষ্টি ‘ যাদের নিয়েও খোঁটা দিয়েছেন। সেই চৌদ্দগুষ্টির সামনে আমায় প্রণয়ের কথা বলবেন। প্রস্তাব দিবেন আমার হাত সারাজীবন ধরে রাখার। তারপর যা হবার হবে। ”

আমার কথাগুলো শুনে অভীকের প্রতিক্রিয়া কেমন সেটা বোঝা গেলো না। আমি খুব ভালো করেই জানি আব্বু আম্মুর সামনে উনি কখনই আমাকে প্রপোজ করবেন না। কারন উনি সবার সামনে খুবই নম্র, ভদ্র, এবং অবুঝ যুবক সেজে থাকেন। আমি উঠানে গিয়ে সবাইকে একত্রিত করে গল্পের আসর জুড়ে দিলাম। অনেক বছর পর নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। সবার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারছি। অভীকের গিটার নিয়ে খেলছে মিষ্টি। অভীকও এসে আমার পাশে বসলেন। আমি ভাবলেশহীন হয়ে বললাম,

– ” রাত হতে কিন্তু বেশি দেরি নেই। সুতরাং প্রপোজ’টা দ্রুত করে ফেললেই আপনার জন্য ভালো। নাহলে আমাকে কেন? আমার নখের ছোঁয়াও যাতে আপনি না পান সেই ব্যবস্থা আমি নিজদায়িত্বে করিবো। ”

– ” তোকে সব জানিয়েই ভুল করেছি আমি। না জানালে তুই আগের পরী হয়েই থাকতি, তবে তোর মগজে বোধ হয় এবার সত্যিই বুদ্ধির চাষ করতে হবে। এমন হাম্বা মার্কা বউ কোনো কাজের না। তবে আমারও একটা শর্ত আছে। আমি যদি তোকে প্রপোজ করতে পারি তাহলে, তুই’ও যে আমাকে ভালোবাসিস সেটা তোকে, আমায় গানে গানে জানাতে হবে। ”

– ” গাইবো। এবং বুদ্ধি নিয়ে যা ইচ্ছা বলুন কিন্তু প্রপোজ আপনাকে করতেই হবে। ”

– ” আমি কি বলেছি করবো না? এই মিষ্টি গিটারটা দে তো। ”

অভীক গিটার নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলেন। আমি সরু চোখে তাকিয়ে ওনার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছি।

– ” একটা পরীর গল্প,লেখা অল্প অল্প
তার পাখনাতে ভর করে
খেলে মেঘ আর রোদ্দুরে
তার রংধনু বাসায় রঙিন স্বপ্ন সাজায়
মনের চিলেকোঠায়
দুটো শালিক ঝগড়া বাঁধায়
ও যে ঝগড়া নয় শালিকের!
গোপন ভালোবাসা
মুখ ফুটে বলবি কবে!
বুক বেঁধেছি আশায়।( ২ )

শুনছে না মন তবলায়
অস্ফুট থাকা এই মন
ভালোবাসায় এই সজ্জায়
তবু শুনছে না, কিছু বলছে না,
কেন বুঝছে না,
আমি ভালোবাসি তাকে ”

ওনার গান শুনে আমি পুরো ‘থ’। ব্যাটা কত্তবড় খাঁটাশ। গান দিয়ে প্রপোজ করছে! কেউ টেরও পাচ্ছে না। সবাই আরামসে গান শুনছে আর উপভোগ করছে। আমি ওনার দিকে তাকাতেই উনি সন্তর্পণে সবার আড়ালে চোখ মারলেন আমাকে। এই খচ্চরের সাথে কখনো বুদ্ধিতে কিংবা তর্কে জিততে পারিনি আর কোনো দিন পারবও না, ব্যাটা ধূর্ত শয়তান। যাক উনি যখন প্রপোজ করেছেন তখন ওনার শর্ত মোতাবেক আমাকেও গাইতে হবে। কতদিন পর গাইবো, কি জানি কেমন হবে। ওদিকে অভীক গিটার বাজাতে বাজাতে আমার দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ভাবলাম গেয়েই ফেলি যা আছে কপালে,

– “দুচোখ জুড়ে বৃষ্টি, একি অনাসৃষ্টি
ঝরছে প্রেম টুপটাপ,
তবু ঠোট দুটো এই চুপচাপ
তবু শুনছে না, কিছু বলছে না,
কেন বুঝছে না,
আমি ভালোবাসি তাকে
ও যে ঝগড়া নয় শালিকের!
গোপন ভালোবাসা
মুখ ফুটে বলবি কবে!
বুক বেঁধেছি আশায় ”

আমাকে ১১বছর পর গান গাইতে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে অভীকের দিকে তাকায়, অদ্ভুত আমি গেয়েছি তার ক্রেডিটও কি এই খাঁটাশটা পাবে? ওদিকে খাঁটাশ ব্যাটা আমার দিকে অদ্ভুতভাবে আড়চোখে তাকাচ্ছে।আমি উঠে আসতে চাইলে উনি আমার হাত চেপে ধরেন।

– ” পরী! ”

ওনার ডাকের উত্তরে আমি মৃদু হাসলাম। ওনার মুখের পানে চেয়ে দেখলাম খুশিতে ওনার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। হারিকেনের আলোতেই অস্ফুট যেটুকু দেখা সম্ভব। আমাকে পাশে বসিয়ে উনি আমার কোমর চেপে ওনার সাথে মিশিয়ে নিলেন। ওনার এহানো কান্ডে আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বাড়ির সবাই আছে এখানে সবার মধ্যে ওনার এমন কাজ! কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে। আমি ওনার হাত সরানোর চেষ্টা করতেই উনি আমার হাতও চেপে ধরলেন। এরপর আমার কানের কাছে ঠোট এনে কোমলকন্ঠে বললেন

– ” উফ এতো নড়িস কেন? দেখ রাতে কিন্তু একদম নড়বি না। যদি আমি আমার কাজে ডিস্টার্ব ফিল করি তো আগামী তিনদিন তুই কারোর সামনে যাওয়ার মতো চেহারায় থাকবি না। অভীকের স্পর্শের প্রকাশ সারা শরীরে গাঢ়ভাবে সিল করে দিবো।”

সবার অগোচারে ওনার এমন বাক্য আমার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আমার সারা শরীর শিহরিত হতে শুরু করে।কান গরম হয়ে উঠেছে, সেই সঙ্গে লজ্জায় চেহারায় ফুটে উঠেছে রক্তিম আভা।

সমাপ্ত।

একটা পরীর গল্প পর্ব-০৭

0

#একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#পর্ব_০৭

পরদিন আম্মুকে সব বলতেই উনি ঠোট টিপে হাসতে শুরু করলেন। আরে, আমি কি কোনো কৌতুক বলেছি? আমি জোর করলাম কোনো বুদ্ধি দেওয়ার জন্য। কিন্তু উনি সরাসরি বললেন।

– ” সমস্যা কি? অভীক তো তোকে বউ বলে মানে না। এই তো দেড়মাস পরেই ও ফিরবে। তখন তোর সাথে ওর ডিভোর্স করিয়ে দিয়ে এই হামযার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিবো। সব খরচ আমার। এমনিতেও ছেলেটা দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ। তোকে খুব ভালো রাখবে দেখিস। ”

আম্মুর কথা শুনে আমার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। শাশুড়ি হয়ে কি উপদেশ দিচ্ছেন? অন্য শাশুড়ি হলে নির্ঘাত বলতো ‘ পরপুরুষের সঙ্গে ঢুলাঢুলি করো? এই জন্য তোমার পেছনে টাকা খরচ করে তোমাকে পড়াচ্ছি? আমাদের মান সম্মান নষ্ট করার তালে মেতে উঠেছিস? ‘ আর ইনি কি বলে? ডিভোর্স করিয়ে নাকি বিয়েও দেবে। আমি নির্লিপ্ত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম।আসলেই তো অভীক আমাকে পছন্দ করে না। যদি সামান্যটুকুও করতো তবে কি এই তিন বছরে একটা কল বা ম্যাসেজ দিতো না? একবার আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না? আমি মলিন মুখে আম্মুকে প্রশ্ন করলাম,

– ” তাহলে হামযা’কে কি বলবো? ”

– ” বলবি আমি ওকে বাড়ি আসতে বলেছি। আর ও একা কেন? তোর সব বন্ধুদেরও আসতে বলিস। সবার সঙ্গে ঘটা করে পরিচয় হয়ে যাবে।”

– ” আচ্ছা। ”

আমি কলেজে এসে আম্মুর কথা বলতেই ও খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় মাঠের মাঝখানে। সবার সামনে আমাকে টেনে নিলো নিজের আলিঙ্গনে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।সবকিছু এতো দ্রুততার সঙ্গে হলো যে আমি প্রতিক্রিয়া দিতেই ভুলে গিয়েছি। সবাই হাত উঁচু করে তালি দিচ্ছে। কয়েকজন শীসও দিয়ে ফেলেছে। আমিই শুধু বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি হামযার দিকে। হামযা বললো একমাস পর ওর বাবা ফিরবে সৌদি থেকে তখন ওরা একসাথেই আসবে আমাদের বাড়ি। আমি ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বাড়ি চলে আসলাম। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। এমন পরিস্থিতিতে পরে ভীষন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। তাছাড়া অভীক যদি ফিরে এসে এসব শোনে তাহলে ও কি ভাববে? আমি কি উত্তর দিবো ওকে? এমনিতেই ও আমাকে পছন্দ করে না তারওপর এই হামযা। বাথরুমে শাওয়ার নিলাম ঘন্টাখানেকের মতো। আব্বুকে বললাম আমায় কিছুদিনের জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। আমার মন খারাপ লাগছে। আব্বু আমার কথা শুনে, মিষ্টি আর আমাকে একসাথে গ্রামে পাঠিয়ে দিলো। গ্রামের মাটিতে পা রাখতেই একটা সতেজ অনুভূতিতে শিউরে উঠলাম আমি। চারিদিকে বকুলফুলের মোহময় ঘ্রাণ, শীতল স্নিগ্ধ নদীর তীর, সপসপে কাঁদামাটি, হয়তো মুষলধারায় বৃষ্টি হয়েছিলো। মিষ্টিকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই লম্বা একটা ঘুম দিলাম।দীপ্তি স্কুলে।

বিকালে সবার সাথে আড্ডায় মেতে উঠি। ফোন বন্ধ করে রেখেছি গতকাল থেকেই। মিষ্টির ফোন দিয়ে কথা বলেছি সবার সাথে। রাস্তার ধার ঘেসে হেটে চলেছি এমন সময় রহমত সাহেব এসে আমার সামনে হাজির। আমি তাকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে পা বাড়াতেই উনি আমার হাত ধরে বসলেন। পুরোনো অনুভূতিগুলো আবার ঝেঁকে ধরলো আমাকে। সারা শরীর এই বিশ্রী স্পর্শে ঘিনঘিন করছে। উনি বেশ শক্ত করেই চেপে ধরে আছেন আমার হাতটা। হাতটা মোচড়াতে মোচড়াতে দাঁত বের করে হেসে বললেন।

– ” আমারে রাইখ্যা ওই শহরের পোলারে বিয়া করছো পরী! আমার কম ছিলো কি? আমি কি কম সমত্ত ছিলাম? তোমারে সুখ দিবার পারতাম না? ওই পোলা কি দিসে তোমারে? বিয়া কইরা তো চইল্লায় গেছে! দুইরাত খালি কাটাইতে পারছো। আমি এখনও তোমারে বিয়া করবার চাই, ওরে ছাইড়া আসতে পারলে আইসো। ”

ওনার এমন বচনভঙ্গি আর হাতে ব্যাথার অনুভূতিতে আমার মাথা ঘুরে আসলো।দীপ্তি ততক্ষনে আব্বুকে ডেকে নিয়ে এসেছে। উনি আমার হাত ছাড়তেই আমি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি। যখন জ্ঞান ফেরে তখন রাত দশটা প্রায়। টানা পাঁচ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম আমি!ঘর অন্ধকার দেখে আমি আর উঠলাম না। শুধু শুধু সবাইকে এতো রাতে বিরক্ত করে কি লাভ?

মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যে টের পেলাম কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। তার ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার মুখের ওপর। ভয়ে আতংকে বিছানার চাঁদর চেপে ধরি আমি। চোখ খোলার সাহস হচ্ছে না। আমার পা যুগল তার পায়ে ভাজে পড়ে ব্যাথায় ছটফট করছে। সেই সঙ্গে নাকে ভেসে আসছে অভীকের গায়ের মধুর ঝাঝালো ঘ্রাণ। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? অভীক তো ইন্ডিয়াতে। আর এদেশে আসবে দেড়মাস পর। চোখ না খুলেই মনকে বোঝালাম যে আমি অভীককে স্বপ্নে দেখছি। কিন্তু হাত-পা নড়ছে না কেন? অস্বস্তিতে চোখ মেলে তাকাই আমি। অন্ধকারে ঠিক বোঝা না গেলেও কেউ যে আমাকে চেপে ধরে ঘুমাচ্ছে তা সজ্ঞানে টের পেলাম। মস্তিষ্কে ভীষন চাপ অনুভূত হতেই মুখ দিয়ে একপ্রকার গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসলো। সে তার মুখ আমার ঘাড়ের কাছে এনে গলার ভাজে গুজে দিলো। এইমুহূর্তে আমার গলা থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।অসার হয়ে আসছে সমস্ত শরীর। ঠিক তখনই অভীকের দরদমাখা কন্ঠ শুনতে পেলাম।

– ” উফ পরী ঘুমাতে দে আমাকে। আমি টায়ার্ড। ”

কন্ঠটি শুনতেই আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। তার মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো নয়নযুগল।ছটফট করছে ভেতরটা, কাছের মানুষটা এভাবে হুট করে ফিরে আসার আনন্দ বলে বোঝানো সম্ভব নয়, আমি পাশে হাতরে দেখলাম ফোন আছে কিনা। হাতে ফোনের ছোঁয়া লাগতেই বন্ধ ফোনটা চালু করলাম। ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে অভীকের মুখের দিকে তাকাতেই দেখি অভীক রাগি চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আচমকা এমন চাহুনি দেখে হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো।।ভয়ে রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছি।অভীক আমাকে কাঁপতে দেখে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালায়। এরপর আমার পাশে এসে বসে আমার কপালে হাত রাখে।

– ” জ্বর এসেছে দেখছি। তুই বস আমি ঔষধ আর খাবার নিয়ে আসছি। ”

অভীক খাবার এনে খাইয়ে দিলো আমাকে। আমি নির্নিমেষ চাহুনিতে তাকিয়ে আছি তার পানে। ঔষধ খাইয়ে আমাকে সযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিলো অভীক।

– ” কষ্ট হচ্ছে? ”

আমি কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে আছি। চোখ দিয়ে গলগল করে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। অভীক তার হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিলো। আমি এই নতুন অভীককে দেখে বিষ্মিত। অভীক তো এমন ছিলো না। আমি যাকে চিনতাম সে তো কথায় কথায় আমাকে অপমান করতো, খোঁটা দিতো।কিন্তু এই অভীক!

– ” কেমন লাগছে বলছিস না কেন? এটা কোন ধরনের বেয়াদবি পরী? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো আমি। ”

আমি অস্ফুট কন্ঠে জবাব দিলাম।
– ” আপনি সত্যিই এসেছেন? ”

– ” না। আমার ভুত এসেছে। আগে তুই ভুত ছিলি একা, অভীক এসে আজ দিলো দেখা। ”

আমি ওনার ছন্দ দেখে ভড়কে গিয়ে ওনার দিকে তাকাই। উনি আমার গাল চেপে ধরলেন একহাতে। অন্যহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরেছেন। ক্ষিপ্ত সুরে বললেন,

– ” এভাবেই হামযা তোকে ওর প্রণয় প্রস্তাব দিতো তাইনা? কবিতার সুরে, প্রেমের আলাপে? তোর সাহস হলো কিভাবে আমার অনুপস্থিতিতে ওর কাছে যাওয়ার? বল কি করে হলো এই সাহস? ”

– ” আমি। ”

– ” আমার কি দোষ ছিলো পরী? কি দোষ? যার জন্য, যাদের জন্য এতোকিছু করলাম তারাই আমাকে বুঝলো না, আমায় পর করে দিলো। ”

কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন অভীক। আমার গাল থেকে হাত সড়িয়ে নিয়ে, পরক্ষনেই আবার হাত দিয়ে আলতো ছুঁয়ে দিলো। আমি তার স্পর্শে, আবেশে চোখ বুজে নিলাম। উনি লাইট বন্ধ করে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু বরাবরের মতো দূরত্ব রেখে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম ওনার দিকে। কিন্তু অবশ হয়ে যাওয়া হাত কিছুতেই নড়ছে না।

– ” অভীক। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। ”

আমার কথা তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই উনি হুরমুরিয়ে ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। হাতে, কপালে, হাত রেখে রেখে দেখছেন আর জিজ্ঞেস করছেন

– ” কোথায় কষ্ট হচ্ছে? বল আমাকে। মাথা ব্যাথা করছে? টিপে দিবো আমি? ”

– ” আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন? আলতো করে। আপনার হৃদয়ের খুব কাছে যেতে চাই আমি। ”

অভীক আমার দিকে এগিয়ে এসে সন্তর্পণে আমার মাথা নিজের বুকের ওপর রাখলেন। ওনার সারা শরীর ঘেমে ভিজে আছে, ওনার বুকে মাথা রাখতেই টের পেলাম ওনার হৃদস্পন্দন, স্পন্দনের গতি স্বাভাবিকের থেকে বেশি। ওনার হাতদুটো আমার পিঠে ঠেকানো থাকায় ওনার কম্পিত হাতের শিহরণ টের পাচ্ছি আমি।

– ” রহমত তোকে কি বলেছে পরী? ”

রহমতের নাম শুনতেই আমি মাথা তুলে ওনার দিকে তাকাই। জানালার ফাঁক দিয়ে যৎসামান্য আলো আসায় অস্পষ্টভাবে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। উনি আমার চুলের মাঝে নিজের হাত ঢুকিয়ে বিলি কেটে দিতে লাগলেন।

– ” বল। ”

– ” আমাকে উনি এখনও ওনার বউ বানাতে চান। তাই বলছিলো। ”

– ” খারাপ লাগছে না তো আমার স্পর্শে? ”

আমি চমকে তাকালাম ওনার দিকে। উনি ঠিক কি বলতে বা বোঝাতে চাইলেন বোধগম্য হলো না আমার।উনিও কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন,

– ” হামযাকে মানা করে দিলেই পারতি। শুধু শুধু রাগ করে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে বসেছিস। এখন ভুগছে কে? ”

– ” ঘুমাবো আমি। ”

– ” তো ঘুমা। আমি কি তোর ঘুমকে ধরে রেখেছি? নাকি কেড়ে নিয়েছি? তুই’ই তো আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছিস। হাতির বাচ্চা। ”

আমি ভাবলাম হয়তো ওনার কষ্ট হচ্ছে আমার মাথার ভারে। তাই সড়ে আসতে লাগলাম। কিন্তু উনি হ্যাচকা টানে, আবারও আমাকে জড়িয়ে নিলেন নিজের আলিঙ্গনে।

– ” সড়তে বলেছি আমি? বড্ড বেশি বুঝিস তুই পরী। একদম আমার কথা শুনিস না। ”

আমি ঠোট উল্টিয়ে বললাম।
– ” সব কথাই তো শুনি। সব অপমান, খোঁটাও সহ্য করি। শুধু আপনাকে.. কিন্তু আপনিই তো কখনও আমাকে ভালোইবাসেন নি। শুধু খোঁটা দিয়েই এসেছেন, আমি কালো ভুত, হাতি, ভাঙাচোরা । সবই শুনেছি, তাহলে বলুন আমি আপনার কোন কথাটা শুনিনি ? ”

– ” ওগো পরী, ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে।
কখনও বলার সুযোগ দিয়েছো কি আমাকে?
আড়ালে আবডালে যখন চেয়েছি তোমার পানে,
লুকিয়েছো নিজেকে এক গোলকধাঁধার আবরণে।
শুনেছো কখনও এই হৃদয়ের ধুকধুকানি?
টের পেয়েছো আমার হাড়ে, হাড়ে কাঁপুনি?
তোমার জন্য আমার এই ছটফটানি?
জানতে চেয়েছো? আমার আনন্দ?
যেটা আজও তোমাতে সীমাবদ্ধ
কখনও শুনতে চেয়েছো আমার মনের কথা?
আসতে চেয়েছো আমার হৃদয়ের সংস্পর্শে?
চাওনি, আবার এখন বলছো,
‘ আমি আপনার কোন কথাটা শুনিনি? ‘

ওনার মু্খ থেকে কবিতা আবৃতি শুনে আমি হতভম্ব। উনি আমাকে ভালোবাসেন? এটা যেন নিজের কানকে নিজেই বিশ্বাস করাতে পারছি না। উনি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন? নাকি এখনও স্বপ্ন দেখছি আমি। আমার প্রশ্নের জবাবে উনি যে কবিতায় ছন্দে সেটা আমাকেই ফিরিয়ে দিবেন এটা আমার কল্পনাতীত। উনি আবারও আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলেন।

– ” আমার উত্তর কোথায় পরী? ”

– ” আমি আপনার হতে চাই, শুধু আপনার। একান্তই আপনার। ”

অভীক মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আবদ্ধ করে নিলেন নিজের ভালোবাসার আবরণে, আজ বাঁধা নেই তাহাতে মিলিত হওয়ার।আজ ‘আমি’ এবং ‘ তুমি ‘ শব্দদুটির মিলনে সৃষ্টি হবে নতুন সম্পর্ক যেখানে সবকিছুই আমাদের, সবখানে থাকবে আমরা।

চলবে?

একটা পরীর গল্প পর্ব-০৬

0

#একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#পর্ব_০৬

খোজ নিয়ে জানতে পারি মিষ্টি বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো কিছু ভাবতে, বলতে, বা করতে পারে না ও। তবে ওর একটা ভালো গুণ হলো ও খুব সহজে সবাইকে ভালোবাসতে পারে, বিশ্বাস করে। আর সবথেকে বেশি ভালোবাসে ওর ভাইয়াকে। অভীকও তেমনই ওর কাছে সবার আগে মিষ্টি তারপর বাকি সবাই। এতোবছরের পরিচয় আমাদের অথচ আমি এটা জানি না ভেবে ভীষন লজ্জা লাগছিলো আমার। কিন্তু এখানেও আমার কোনো দোষ নেই, দোষ সব অভীকের। বাড়ি আসলে আমাকে এমনভাবে বিরক্ত করতো যে আমি দম ফেলবারও সময়টুকু অবধি পেতাম না।

সারাদিন বাড়ি ফিরলেন না উনি। রাতে এসেই ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। ওনার রেকর্ডিং আছে, দেশের বাইরে যেতে হবে। কথাটা শুনে আমার পা যেন আর নড়ছিলো না। নির্নিমেষ চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি দড়জার আড়ালে দাড়িয়ে। আম্মু এসে বকাবকি শুরু করে দিলেন। বিয়ের পরেরদিনই কিসের রেকর্ডিং, যাওয়া যাবে না, এই সেই। কিন্তু উনি শুনলেন না কারোর কথা।চলে গেলেন।

কিছুদিন পর আমি চলে আসি ওনাদের বাড়ি, আমার শশুড়বাড়ি। সারাটাদিন মিষ্টির সাথে থাকি। ওর সঙ্গে খেলি, খাই, ঘুমাই। কিন্তু কেন জানি না ওনাকে বড্ড মিস করি, ওনার কথাগুলোকে মিস করি। আজ বুঝতে পারছি ওনার ওই কথাগুলো আমার জন্য কতটা মধুর ছিলো। কাছে থেকে যেটা অনুভব করিনি দূরে এসে সেটা অনুভব করছি।

আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলো এভাবেই। এ বাড়ি থেকেই পরীক্ষা দিয়েছি। দুমাস পর কলেজের এডমিশন। আব্বু বলেছেন এখানকার একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবেন। সবার বচন অনুসারে, দেখতে দেখতে দুটো বছর যে কখন কেটে গেলো কেউ বুঝতে পারলো না! অথচ আমার কাছে প্রতিটা সেকেন্ড এক একটা যুগের মতো কেটেছে। অভীক ইন্ডিয়াতেই একটা কলেজেই নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। আর একবছর পর ওনার পড়ার পাঠ চুকবে! এবং উনি ফিরে আসবেন এদেশে। এ ক’বছরে উনি একবারও আমার সঙ্গে কথা বলতে চাননি। আমিও মুখ ফুটে কিছু বলিনি। এখানে সবাই আমাকে আব্বু আম্মুর মেয়ে বলেই জানেন। আব্বু মানা করেছিলো অভীকের বউ’য়ের পরিচয় দিতে। কেন মানা করেছিলো সেটা আজ অবধি জানি না আমি। মিষ্টি আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। আমাকে ছাড়া ওর কোনো কাজই হয় না। আগে ভাবতাম দীপ্তি ছাড়া আমাকে কেউ বোঝে না কিন্তু আজ আনন্দিত হই এটা ভেবে যে মিষ্টি দীপ্তির থেকেও আমাকে বেশি ভালো করে বুঝতে পারে।

চেয়ারম্যানের ছেলে রহমত সাহেব, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার কথাও পরে জানতে পেরেছিলাম। সে নাকি আমাদের বাড়ির শরবত খেয়ে পেট খারাপের জন্য বাথরুমে ঢোকে। এরপর তার আর কিছু মনে নেই। দুদিন পর বিকালে ওনাকে আলের পাড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ বা কারা বেধরম পিটিয়েছে তাকে। ব্যাপারটা কিছুটা রহস্যে ঢাকা পড়ে আছে। কিছু প্রশ্ন আছে তাকে ঘিরে, ১. কারা নিয়ে গিয়েছিলো তাকে? ২. কেন নিয়ে গিয়েছিলো? ৩. আমার বিয়ে ভেঙে তাদের কি লাভ?

কলেজের প্রথমদিন আজ। আব্বুর সঙ্গে এসেছি আমি। মিষ্টিও এসেছে আমাদের সাথে। আমাকে আর মিষ্টিকে ফুচকার দোকানে, ফুচকা খেতে বলে আব্বুর তার কিছু পরিচিত স্যারদের সঙ্গে কথা বলতে যান। মিষ্টি ফুচকা খেতে খেতে হঠাৎ ভীষম খেলো। আমি পানির বোতল এগিয়ে দিলাম ওর দিকে। ও পানি খেয়ে আমাকে মিষ্টি করে বললো ‘ থ্যাংকইউ আপু ‘। মিষ্টি এখন আর আমাকে ভাবি বলে ডাকে না। এটাও আব্বুর সিদ্ধান্ত। অভীকজড়িত সকল শব্দ, সবার বলা বন্ধ। কিছুক্ষণ পরে শিপুল নামে একটা ছেলে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। আমাদের পূর্বপরিচিত সে। আব্বুদের বাড়ির সামনের বাড়িটাতেই ওরা থাকে। এর বেশি কিছু জানি না আমি। শিপুল এগিয়ে এসে ‘ হাই ‘ বলতেই মিষ্টি ‘হ্যালো’ বলে চুপ হয়ে যায়। আমাকেও ইশারায় চুপ থাকতে বলে। মিষ্টির এমন আচরণে হতবাক হয়ে যাই আমি। শিপুল আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো।

– ” তুমি কি এই কলেজে ভর্তি হয়েছো পরী? ”

মিষ্টি চট করে উত্তর দিলো।
– ” হ্যাঁ কেন? ”

শিপুল মৃদু হেসে এক প্যাকেট চকলেট এগিয়ে দেয় মিষ্টির দিকে। মিষ্টি মুখ কালো করে বলে উঠলো।

– ” আমি কিংবা আপু যার তার দেওয়া চকলেট খাইনা। কোন মলতবে চকলেট দিচ্ছেন কে জানে? ”

মিষ্টির এমন বাক্যে ভড়কে গেলাম আমি। উনি হয়তো ভালো ভেবেই বাচ্চা মেয়েকে চকলেট দিচ্ছেন কিন্তু মিষ্টি এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করছে? আমাকেও কিছু বলতে দিচ্ছে না। শিপুল আমার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে আসতেই মিষ্টি চেচিয়ে ওঠে।

– ” এই আপনি আমার আপুর দিকে যাচ্ছেন কেন? দূরে যান, যান বলছি। নাহলে কিন্তু আমি চিৎকার দিবো। ”

শিপুল রেগে মিষ্টির দিকে তাকায়। আমি এবার মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরলাম। মিষ্টি কেঁদে ফেলেছে। তবুও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে।

– ” তুমি শুধু আমার সাথে খেলবে আপু, আমার সাথে কথা বলবে, আমি শুধু তোমার বন্ধু হবো। ”

আমি মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে শিপুলের দিকে তাকালাম। সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললাম।

– ” কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। ও ভাবছে আমার অন্যকারোর সাথে বন্ধুত্ব হলে ওর থেকে দূরে চলে যাবো আমি। ভয়ে আপনার সাথে এমন আচরণ করে ফেলেছে। দুঃখিত। ”

উনি নিজেকে স্বাভাবিক করে ” আচ্ছা ” বলে চলে গেলেন। আমি মিষ্টির চোখ মুছিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

– ” তুমি এমন কেন করলে মিষ্টি? দেখ তো লোকটা কি ভাবলো। বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে হয়না সোনা। ঠিক আছে? ”

এরপর মিষ্টি যেটা বললো সেটা শুনে চমকে গেলাম আমি। ও বললো,

– ” তো কি বলবো? জানো ও তোমাকে ছাদে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে। চুঁমু দেয় এভাবে ( ফ্লাইং কিসের ভঙ্গি দেখিয়ে বললো )। তারপর সেদিন আমরা বৃষ্টিতে ভিজছিলাম ও খারাপভাবে তোমাকে দেখছিলো। আমি বুঝেছি! আমার ভালো লাগেনি ওকে। তুমি ওর সাথে কথা বলবে না। ও ভালো ছেলে না। খারাপ ছেলে, পঁচা ছেলে।”

আমি মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে চুঁমু খেলাম। আমার মিষ্টি বড় হচ্ছে, সব বুঝতে শিখছে। ও আর আগের মতো কথা বলবে না। স্বাভাবিক হবে আমাদের মতো। কলেজ থেকে ফিরে কথাটা আমি আম্মুকে বলি।আব্বু এটা শুনেই রেগেমেগে উঠে দাড়ান। এখুনি গিয়ে নাকি শিপুলদের বাড়িওয়ালাকে এগুলো বলবেন। কিন্তু আম্মু বাধা দিলেন। আমি আব্বুকে বুঝিয়ে বলি মিষ্টির কথা। আব্বু রাজি হলেন আবারও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য।

পরদিন মিষ্টিকে দেখিয়ে আনি আমরা। ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়েছেন আর বলেছেন ওকে উৎসাহ দিতে সকল ভালো কাজে। ওকে টুকটাক করে সমস্ত কিছু শেখাতে। ওর যত্ন নিতে! তাহলে মিষ্টি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবে।বাড়িতে এসে আব্বু অভীককে জানায় সবটা। অভীকও কথার পিঠে কয়েকটা কথা বলে রেখে দিলো ফোন। রাতে ঘুমানোর সময় মিষ্টি হঠাৎ যেন কোথা থেকে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি কিঞ্চিত ভয় পেয়ে গিয়েছি ঘটনার আকস্মিকতায়।

– ” আপু তুমি প্রতিদিন রাতে কেন কাঁদো? ”

ওর কথা শুনে আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মিষ্টি আবার বললো।

– ” তুমি ভাইয়ার জন্য কষ্ট পাও? জানো আমিও কষ্ট পাই। ভাইয়া আমার সাথেও ঠিক করে কথা বলে না। ফোন দেয় অনেকদিন পরপর। কিন্তু আমি তো কাঁদি না। তুমি কেন কাঁদো? ”

আমি ওর প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দিবো বুঝে উঠতে পারলাম না। মিষ্টি উত্তরের অপেক্ষা না করে আমার হাত টানতে টানতে বিছানায় নিয়ে যায়। আমাদের দুজনের ফোন বের করে গেইম দেখতে থাকে। আমি নির্লিপ্ত নয়নে চেয়ে আছি জানালার অপরপাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টের বাতিটায়। মিষ্টি ঘুমিয়ে যেতেই আমি জানালার পাশে এসে দাড়াই, আকাশপানে তাকিয়ে তার কাছে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, এই আশায় যে,যদি এই নীলাভ আকাশ,চাঁদের জোৎস্না তার কাছে পৌছে দেয় আমার এই জড়ো করা অভিমানের বার্তা। গাল ফুলিয়ে বলতে আরম্ভ করলাম।

★★ তুমি কি জানো রাত যত গভীর হয়,
তোমার শূন্যতা আমাকে ততই কুড়ে কুড়ে খায়।
তুমি কি জানো তোমার শেষ স্বৃতিটুকুর কথা.?
যে স্বৃতিগুলো বার বার জাগিয়ে দেয় আমার হৃদয়ের পুরাতন ব্যাথা।
তুমি কি জানো তোমার বাজানো সেই গিটারের সুর?
যেটা আমাকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছে বহুদূর।
তুমি কি জানো তোমার কথা মনে পড়লে কি করি আমি?
রাত জেগে জানালার পাশে দাড়িয়ে একলা তারা গুনি।
তুমি কি জানো কতটা ভালোবাসি তোমায়?
যতটা ভালোবাসলে নিজের অস্তিত্ব তোমাতে মিশে যায়। ★★


আজ একাই কলেজে যাবো আমি। সকাল সকাল উঠে সব গুছিয়ে রেখেছি। এবার মিষ্টিকে ডেকে ওকে খাইয়ে দিয়ে, নিজে খেয়ে বেড়িয়ে পড়বো। কিছুটা শঙ্কিত আমি! প্রথম দিন! কলেজের কিছু চিনি না, জানি না। কিভাবে মানিয়ে নিবো? ওখানের ছাত্রছাত্রীরা কেমন? এতো কিছু ভাবতে ভাবতে রিক্সা ডেকে চড়ে বসলাম রিক্সায়। ফাঁকা রাস্তা। চায়ের স্টলে মানুষের আড্ডা, দু একজন কাধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। আমি কলেজে এসে নিজের ক্লাসে চলে আসি। কয়েকজন আগে থেকেই বসেছিলো। আমি চার নম্বর বেঞ্চে বসে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছছি ওরনার এক কোনা উঠিয়ে। হঠাৎ আমার পাশে একটা মেয়ে ব্যাগ রাখে। হেসে বলে।

– ” হাই আমি আরোহী। ”

– ” আমি পরী। ”

দেখলাম আরোহী নামের মেয়েটা খুব চঞ্চল। সহজে সবার সাথে মিশে যায়। প্রচন্ড কথা বলে। ওর বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে। আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। কিন্তু সবথেকে মজার বিষয় ওর বয়ফ্রেন্ডকে ‘ভাই’ এর পরিচয় দিয়েছে। সেটা শুনে একটা ছেলে প্রচন্ড শয়তানি শুরু করে, বুঝলাম বন্ধুমহলে এই ছেলেটাই সবথেকে বেশি মিশুকে, আড্ডাবাজ, ব্রিলিয়ান্ট এবং শয়তানের নানা।ওর নাম হামযা। সবার সাথে আমারও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। হামযা প্রায়ই আমাকে পড়া বুঝিয়ে দেয়। কলেজে না গেলে ফোন করে খোজখবর নেয়।

একদিন রাস্তায় কিছু ছেলে আমাকে বিরক্ত করছিলো ওরা দেখতে পেয়ে ছেলেগুলোকে কি মারটাই না মারলো। আরোহী আমায় ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো।

– ” ছেড়ে দে। ওরা ওমনই। আর হামযা’টাতো একটু বেশিই। তোর গায়ে হাত টাত দিয়েছে নাকি? ”

– ” না শুধু মুখেই। ”

– ” ভাগ্য ভালো দেয়নি। নাহলে ওদের হাত ভেঙে দিতো হামযা। দেখছিস না তোকে সামান্য টিজ করায় কতটা রেগে গেলো। যদি হাত দিতো তাহলে তো! মনে কর শেষ।”

আমি সেদিন আরোহীর কথা বুঝতে পারিনি। সবটা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম। বেশকিছুদিন ধরে হামযা আমাকে ফোন দিচ্ছে। মানে কিছুক্ষণ পরপরই ফোন দিচ্ছে। ফোন রিসিভ করলেই কবিতা বলে শোনাচ্ছে। ও ঠিক কেমন মানে কোন জাতের পাগল সেটা বুঝতে ব্যর্থ হলাম। ফোন রিসিভ করতেই হামযা বলে উঠলো।

– ” শুষ্ক কলিজায় ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলে পরী। সাধে কি আর বলি তোমায় ছাড়া থাকতে পারি না আমি।”

আমি মজার ছলেই বলি।
– ” ইউ বান্দর। সারাদিন কানের কাছে করিস ঘ্যানর ঘ্যানর ”

– ” মন আমার বড়ই পিপাসা, শুনিবার তারে তোমার মুখের ভাষা। প্রিয়, কথা বলো ক্ষনিকের জন্যে, তোমার তরে বৈরাগী মন ঘুরতে পারে অরণ্যে। ”

আমি বিরক্ত হলাম ওর এমন ছন্দে।সারাদিন এমন বানিয়ে বানিয়ে হাবিজাবি বলে, আর আমার কানের দফারফা করে ছাড়ে।

– ” ফোন দিছিস ক্যান? ”

– ” কাল লাল রংয়ের একটা জামা পড়ে আসিস। প্লিজ। ”
– ” আমার লাল রংয়ের জামা নেই। এবার ফোন রাখ।”

– ” তো আমি এসে একটা দিয়ে যাই? ”

আমি হামযার কন্ঠস্বর শুনে অবাক হই। মাথায় ঘুরপাক খায় হামযাঘটিত ঘটনাগুলো। আমার প্রতি ওর যত্ন নেওয়া, আমার খেয়াল রাখা, সবমুহূর্তে আমায় চোখেচোখে রাখা। আমাকে নিয়ে ওর অধিকারসূচক কথাবার্তা। আমি দৃঢ় গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

– ” তুই কি আমাকে পছন্দ করিস হামযা? ”

হামযা উৎফুল্ল কন্ঠে উত্তর দিলো।
– ” শুধু পছন্দ নয় ভালোবাসি তোকে। সেই প্রথমদিনের প্রথম দেখা থেকে। আমি জানি তুই আমাকে না বলতে পারবি না। কারন আমি দেখতে শুনতে ভালো, পড়াশোনায় ভালো, আমার আব্বুর টাকাপয়সা আছে। বাড়ির একমাত্র ছেলে আমি, আর আমার ভবিষ্যৎ রোদের মতো উজ্জ্বল। একেবারে চকচক করছে। ”

আমি এবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।কি উত্তর দিবো ওকে? আমি যে বিবাহিত এটা কাউকে বলতে মানা করেছে আব্বু, আবার হামযা এমন ঘাড়ত্যাড়া ছেলে যে যথোপযুক্ত যুক্তি এবং প্রমাণ না পেলে আমার পিছু ছাড়বে না। আমি ফোন কেটে, ফোন বন্ধ করে রাখলাম। সকালে আম্মুকে বলবো হামযার কথা, তারপর তারা যা বলবে সেটাই করা হবে।

চলবে?

একটা পরীর গল্প পর্ব-০৫

0

#একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#পর্ব_০৫

অভীক কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে কথা বলতে যাবেন, ঠিক সে মুহূর্তে আমি ছাদে পা রাখি। গল্প শোনার তীব্র আগ্রহ দমাতে পারলাম না কিছুতেই। কিন্তু খাঁটাশ ব্যাটা কি করলো? আমি যাওয়া মাত্র উনি ক্ষিপ্তস্বরে বললেন।

– ” শুভ্র পরিবেশে তমসার প্রবেশ ঘটলে কোনো ভালো ঘটনাই বর্ণনা করা অসম্ভব। আজ নয় #একটা_পরীর_গল্প অন্য কোনো দিন শোনাবো তোদের। ”

আমার এবার ভীষন রাগ হলো। এতোদিন সহ্য করতে পারলেও এখন আর পারছি না। ওনাকে কিছু না বলে বলে এই হাল। আমি ঠোট উল্টিয়ে বলি।

– ” ভালো ঘটনার বর্ণনা যেকোনো সময়ই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাতে আলো কিংবা অন্ধকার কোনো প্রভাব ফেলে না। তবে যে ব্যাখ্যা করবে তার মনের ভেতর তিমির ঝেকে বসলে সে তো বেঁকে বসবেই। ”

আমার কথার অর্থ আর কেউ না বুঝলেও অভীক যে বুঝেছে তা ওনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমার দিকে চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি ওনার চাহুনি উপেক্ষা করে বসার সাথে আসরে যোগ দিলাম। আমার দেবররা আমাকে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল। তারা তাদের প্রশ্নের ঝুড়ি মেলে বসেছে। তাদের একেক জনের একেক রকম প্রশ্ন। পরিশেষে যেটা অনুধাবন করতে পারলাম সেটা হলো অভীক এবাড়ির ছেলেদের লিস্টের দ্বিতীয় সন্তান। ওর একজন বড় ভাই’ও আছেন। মেহবুব ভাই, বিবাহিত। একটা মেয়েও আছে তার।

রাতে সবার সঙ্গে একসাথে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরে আসি আমি। ভেবে নিয়েছি এই ব্যাটা যেভাবে আমায় অপমান করে আমিও তাকে তার উত্তর সেভাবেই দিবো। আমি খাটের ওপর বসে নিজের হাতের চুড়িগুলো খুলতে লাগলাম। ডজন ডজন চুড়ি পড়ে ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে। একে তো শব্দ হবে তারওপর গুঁতো খেলে তো ব্যাথা ফ্রি। অভীক ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমার পাশে এসে বসে নিজের ফোনে মনোযোগী হলেন। আজ নিজের ফোন নেই বলে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে। আমি উঠে জানালার পাল্লা খুলে বাইরের দিকে চেয়ে রইলাম। চাঁদের শুভ্র, স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ছে উঁচু সারির গাছগুলোতে। নিচে সেই আলোর আবছা ছাঁয়া। চাঁদের পাশে কয়েকটা তারা মিটিমিটি জ্বলছে। দূর থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। হুক্কাহুয়া, হুক্কাহুয়া। কয়েকটা কুকুরও ঘেউঘেউ করে চুপ হয়ে গেলো। কানে এই নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ ভেসে আসছে। জানালার লোহার সিকটা একহাতে ধরে দাড়ালাম। কয়েকটা জোনাকি উড়ছে সামনে। টিমটিম করে জ্বলছে তাদের রশ্মি।অভীক ঝাঁঝালো কন্ঠে ডাকলেন আমাকে।

– ” ওখানে কি করছিস? মানছি তুই কালা ভুত, বাঁশঝাড়ে গিয়ে নিজের সইদের সাথে খেলতে চাস। কিন্তু ওসব তোর বাপেরবাড়ি গিয়ে করবি। এখানে নয়। ”

আমি ফুসে উঠে বললাম।
– ” আমি না হয় কালা ভুত, দেখতে কালো, কিছু পারি না। কিন্তু আপনি কি? বাইরে টাই শুধু সাদা। ভেতরে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবসময় শুধু খোঁটা দেন। আপনার মতো গান গাইতে আমার দু সেকেন্ডও সময় লাগে না। শহরে থাকেন বলে গ্রামের মানুষকে মানুষ বলে ভাবেন না। তাইনা? ”

উনি বিরক্তির সুরে বললেন।
– ” এই গ্রামে তুই বাদে সবাইকেই মানুষ ভাবি। আর আমার ভেতরটা কেমন সেটা তুই বুঝলি কি করে? এই তুই লুকিয়ে চুরিয়ে আমার ইজ্জত দেখে ফেলিস নি তো? তাই তো বলি বিয়ের জন্য “না” করে না কেন? আমার মতো সুঠামদেহি পুরুষ দেখে মন, মাথা, চোখ সামলে রাখতে পারিস নি তাইনা? ”

ওনার কথা শুনে আমি পুরো থ। এই লোকটার সামনে চুপ করে থাকলে উনি আমাকে অপমান করেন, আর কিছু বললে সেই কথার মোড় পাল্টে এমন বেহায়া জাতিয় কথা বলে যেটা শোনার পর আমি আর ঝগড়া করার পর্যায়ে থাকি না। লজ্জায়, অপ্রস্তুত হয়ে নিজের আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভা নিজের ভেতরেই দমিয়ে রাখতে হয় যেন তারা বাইরে বেড়িয়ে এসে আমাকে আর বিস্ফোরণের সম্মুখিনে না ফেলায়। একেবারে নির্লজ্জ খাঁটাশ খচ্চর ছেলে এই ব্যক্তি। আমি দরজা খুলে বাইরে বের হতেই দেখি অভীকের ভাই-বোনেরা করিডোরেই ঘুরঘুর করছে। যার অর্থ ওরা আমাদের ভেতরের খবর জানার জন্য প্রবল উৎসুক। আমি নিরুপায় হয়ে আবার ঘরের ভেতরে চলে আসি। অভীকের চোখ তখনও ফোনে নিবদ্ধ। আমি গিয়েই ওনার পাশে দূরত্বে রেখে শুয়ে পড়ি। উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন।

– ” তোর বাপটা আমাকে একেবারে ফাঁসিয়ে দিলো রে পরী। শেষে কিনা ধরে বেঁধে পঁনের বছর বয়সী এক কালো ভুতের সাথে বিয়ে দিলো। বাল্যবিবাহ’র কেসে যদি আমি জেলে যাই? তোর চৌদ্দগুষ্টিকে ফাঁসিয়ে তবেই যাবো। মনে রাখিস অভীকের এই কথাটা। ”

আমি হাই তুললাম ওনার কথার প্রতিক্রিয়ায়। উনি সেটা দেখে রেগে বিপরীত পাশে শুয়ে পড়লেন। আমি শুধু ভাবছি বিয়ের পরও বউএর কাছে আসে না কেন এই ছেলে। এর কোনো সমস্যা নেই তো? ভাবিরা যে বিয়ের দিন সকালে এতোকিছু শেখালো, বোঝালো আমাকে। কিন্তু সেসব কোন কাজে আসবে? যাক আমার কি? আমার জন্য তো ভালোই হলো। কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে পড়তে হলো না। উনি এবার আমার দিকে ফিরলেন।

– ” এই পরী তোর কাছে চকলেট আছে? ”

ওনার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যাই আমি। মাথা নেড়ে “হ্যাঁ ” বলতেই উনি উঠে গিয়ে আমার ব্যাগ হাতড়াতে শুরু করলেন। আমি লজ্জায় পড়ে যাই এবার। আমার ব্যক্তিগত অনেক কিছুই আছে ব্যাগে, লোকটা তো আমার কাছ থেকে একবার অনুমতি নিয়ে তারপর ব্যাগ ধরতে পারে ।তা না, অসভ্যলোক কোথাকার। আমি উঠে, ছুটে গিয়ে ওনার হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিলাম। মুখে বললাম।

– ” আমি দিচ্ছি। ”

চকলেট হাতে নিয়ে উনি বাইরে চলে গেলেন।আমি নিজের ব্যাগটা লুকিয়ে রাখলাম। না জানি আবার কখন এসে টানাটানি করে। উনি মুহূর্তেই ফিরে আসলেন ঘরে। আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি ক্লান্ত সুরে বললেন।

– ” লাইট টা বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রাখ। নাহলে তোর আঁধারে ঘুমাইলে চোখে কিছুই দেখবো না। ”

– ” মানুষ ঘুমালে এমনিতেই চোখে কিছু দেখে না। তাই আমার আঁধার নিয়ে এতো ভাবতে হবে না আপনার।”

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দম নিয়ে বললেন।
– ” সাধে কি আর বলি তোর ঘটে গ ব র ছাড়া কিছু নেই। মানুষ ঘুমালেও ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে সে। কিন্তু তোর ঘুটঘুটে কালোয় আমার স্বপ্নের ভেতরেও আলোর অভাব দেখা দেবে। তাই ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দে। বেশি বকবক করিস না তো। তোর ফাঁটা বাঁশের গলা শুনলেই কানে পো পো শব্দ হয়।”

আমি স্তব্ধ ওনার কথায়। মানে প্রতিটা কথার একটা ত্যাড়া উত্তর উনি তৈরি রাখেনই। কিছু বললেই তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে অপমান করার হেতুতে কিছু না কিছু বলবেনই। এই লোকটাকে নিয়ে কি সত্যিই আমায় সারাজীবন কাটাতে হবে? আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি আবার বললেন।

-” কি রে খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস কেন হাম্বা? হাম্বা মানে বুঝিস তো? গরু। হাম্বা হাম্বা করার ইচ্ছে থাকলে বাইরে গিয়ে কর। আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দে। এমনিতেও তো আমার ঘুম হারাম করার জন্য তোর মতো একটাকে ঝোলানো হয়েছে আমার ঘাড়ে তাই আকুতি মিনতি করে ঘুমাতে হচ্ছে। একটু কৃপা কর ডাইনি। ”

– ” আপনার মুখ কি একটু চুপ থাকতে জানে না? সারাটাদিন আমার পেছনে অযথা বাক্য অপচয় করে চলেছে। ”

– ” আল্লাহ মুখ কিসের জন্য দিয়েছেন? কথা বলার জন্যই তো। তাহলে চুপ থাকবো কেন? আর তোর ফালতু কথা আমি শুনছিই বা কেন? দেখি সড় তো আমিই লাইট অফ করে দিচ্ছি। ”

আমি ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। উনি গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। অগত্যা আমিও গিয়ে ওনার পাশে শুয়ে পড়ি। মাঝরাতে টের পেলাম ওনার এক পা আমার পেটের ওপর তুলে দিয়েছেন। পাশে তাকাতেই দেখি উনি ঘুমের ঘোরে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। নে পরী আজকের রাতটাও তোকে চ্যাপ্টা হয়েই শুয়ে থাকতে হবে। এতো বচন ছাড়েন ইনি, এতো কিছু জানেন, শিখেছেন, অথচ নিজের হাত-পা’ই সংযত করতে শেখেননি। আমি ওনার পা’য়ে জোরে চিমটি দিলাম। উনি মশা ভেবে জোরে চর দিলেন পায়ে। আমি ততক্ষনে ওনার থেকে কিছুটা সড়ে এসেছি। দানবের মতো হাত-পা, শরীরে পড়ে পুরো ব্যাথা হয়ে গিয়েছে আমার হাত- পা, পেট। ভোরে ঘুম ভাঙে আমার। উনি তখন নামাযে দাড়িয়েছেন। আমি ওযু করে এসে নামায পড়ে নিলাম।

– ” পরী। ”

আমি জায়নামায গোছাতে গোছাতে উত্তর দিলাম।
– ” হ্যাঁ বলুন। ”

– ” তোকে আজ সুন্দর লাগছে। ”

এইটুকু বলেই থেমে গেলেন উনি। আমিও থমকে দাড়ালাম।কিন্তু পরক্ষনেই উনি বলে উঠলেন।

– “একদম তোদের বাড়ির গাছের ডালে যে বাঁদরটা আসে তার মতো লাগছে, লাল টকটকে ঠোট, ফর্সা চেহারা, চোখের লেপ্টে যাওয়া কাজল, এলোমেলো চুল। ”

আমি উদাসিন চোখে তার দিকে চেয়ে উত্তর দিলাম।
– ” তবুও ভালো। অন্ততো ফর্সা চেহারা তো বললেন।”

অভীক উচ্চস্বরে হাসলেন।আমি আর তর্কে জগালাম না। ওনার সাথে তর্কের যুদ্ধে কখনই জিততে পারবো না আমি। শুধু শুধু কষ্ট করে যুক্তি সাজিয়ে লাভ নেই। তবে লোকটার এই স্বভাবের জন্যই হয়তো ওনাকে এতোটা ভালো লাগে। লজ্জায় আমার চোখেমুখে ফুটে ওঠে এক রক্তিম আভা। ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি। আমার হাসি দেখে অভীক ভ্রু কুচকে তাকায়।

– ” কি রে ভুতেরা কি দল বেঁধে এসে তোকে ফানি জোক্স শোনাচ্ছে? এভাবে হাসছিস কেন? নাকি পাগল-টাগল হয়ে গেলি? শেষে কিনা আব্বু, পাগল ঝুলিয়ে দিলো আমার ঘাড়ে? ”

আমি কিছু না বলে বাইরে চলে আসি। সবার জন্য নাস্তা বানাবো বলে, মনস্থির করলাম। দীপ্তি মিষ্টিও ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে চলে আসলো। দীপ্তি আর আমি সবার জন্য পরটা, গরুর মাংসের ঝাল বানিয়ে ফেলেছি। আম্মু এসে মাঝে একবার দেখে যান আমাদের। দীপ্তি চায়ের পানি বসিয়েছে।

– ” দীপ্তি চা’য়ের কাপগুলো নিয়ে যা। আমি তোর ভাইয়ার জন্য কফি নিয়ে আসছি। ”

পরক্ষনেই ভাবলাম আমি কফি দিলে হয়তো উনি খাবেন না। তাই দীপ্তিকে আবার ডেকে কফির মগটাও ওর হাতেই দিলাম।

– ” বলবি না যে আমি বানিয়েছি। বলবি তুই বানিয়েছিস। ”

দীপ্তি সন্দিহান চোখে আমার দিকে তাকালো। এরপরই শব্দ করে হেসে উঠলো। ওর হাসির তালের সঙ্গে আমার হাসিও যোগ দিলো। ছোট্ট মিষ্টি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আমাদের হাসির কারন খোজার চেষ্টা করছে। দীপ্তি কফি দিয়ে, আমার পাশে এসে দাড়ায়। সবাই খাচ্ছে। আর অভীক পরটা ছিড়ে ছিড়ে প্লেটের পাশে রাখছে। সবাই খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওনার দিকে তাকায়। মেহবুব ভাই সন্দিহান চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

– ” কি করছিস অভীক?পরটা না খেয়ে ছিড়ে ছিড়ে প্লেটের পাশে রাখছিস কেন? ”

অভীক উত্তর দিলেন না। দীপ্তি কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

– ” আপু ভাইয়ার কি করছে বল তো? ”

– ” আমি কি করে জানবো?

– ” তুই জানবি না তো কে জানবে? বল এমন করছে কেন ভাইয়া? ”

– ” আমি কোনো গণক না যে গণনা করে বলবো। সড় তো তোর কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ”

দীপ্তি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে।
– ” এখন তো মেজাজ খারাপ লাগবেই। বর পেয়ে বোনকে ভুলে গিয়েছিস। ভালো, ভালো। আমি কে? কে হই তোর? ”

আমি চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে তাকালাম। ও ফিক করে হেসে দিয়ে আমার ওরনা ধরে রাখলো। অভীক মিষ্টিকে ডেকে নিজের প্লেটটা মিষ্টির হাতে দিয়ে দিলো। একটা বাটিতে মাংসের টুকরো গুলোও ছিড়লো, এরপর তাতে ঝোল দিয়ে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো।

– ” এবার খেয়ে নে। পেঁচার মতো মুখ করে থাকিস না। ”

এতক্ষণে আমরা সবাই আসল ঘটনা বুঝতে পারলাম। মিষ্টির জন্য উনি এতক্ষণ এসব করলেন। মিষ্টি লাজুক হেসে আমার দিকে এগিয়ে আসলো। মধুরস্বরে বললো।

– ” চলো আমরা একসাথে খাই। পেঁচার মতো মুখ করে থেকো না ভাবি। দেখো ভাইয়া আমাদের সবার জন্য ছিড়ে দিয়েছে। ”

মিষ্টির কথা শুনে প্রথমবার প্লেটের দিকে তাকালাম। অন্ততো ১০-১২ টা পরটা ছিড়ে রাখা। ১০বছরের বছরের বাচ্চার জন্য এতো পরটা ছিড়েছেন উনি? দীপ্তি আমাকে খোঁচা মারলো। এই মেয়েটাও বয়সের আগে পেঁকে গিয়েছে। মিষ্টির দিক থেকে চোখ সড়িয়ে খাবার টেবিলের দিকে তাকালাম আমি। একি ১২-১৩জোড়া আমার দিকে তাক করা। আমার কানে ভেসে আসলো মিষ্টির বলা সেই কথাটি ‘ পেঁচার মতো মুখ করে থেকো না ভাবি।’ তার মানে উনি মিষ্টিকে নয় আমাকে পেঁচা বলেছেন। মেহবুব ভাই গলা উঁচু করে বললেন।

– ” ওহ আচ্ছা। এই ব্যাপার। তাহলে ইদানিং মিষ্টিকেও অযুহাত বানানো হচ্ছে। ”

অভীক খানিকটা ভড়কে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। শক্তগলায় বললেন।

– ” ভুলবশত ভাবে ছিড়ে ফেলেছি। খেয়াল ছিলো না। এতে ‘ওহ আচ্ছা, এই ব্যাপার, সেই ব্যাপার ‘কোথা থেকে আসলো? আম্মু আমাকে খেতে দাও। বাইরে যাবো একটু। কাজ আছে।”

আমি সরাসরি মুখ ভেঙচি দিলাম ওনাকে। সবাই সেটা দেখে মুখ টিপে হাসলো। আর উনি তো রেগে পুরো আগুন। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে করতে। ব্যাপারটা খানিকটা আগুনে ঘি ঢালার মতো। ঘরে এসে আমরা তিনজন টিভি দেখতে দেখতে খাচ্ছি এমন সময় অভীক ঘরে আসলেন।

– ” মুখ ভেঙচি দিলি ক্যান? ”

– ” আমার মুখ। আমি দিয়েছি, তাতে আপনার এতো জ্বলে ক্যান? ”

উনি আর কথা বাড়ালেন না। শার্ট বদলে বাইরে চলে গেলেন। মিষ্টি টিভি দেখতে দেখতে বললো।

– ” জানো ভাবি, আমরা যেদিন তোমার বিয়েতে এসেছিলাম তার আগের দিন ভাইয়া অনেক কেঁদেছিলো। আমাকে বলতে মানা করেছিলো যেন এসব আমি তোমাকে না বলি। কেন বলোতো? তোমার সাথে কি ভাইয়ার ঝগড়া হয় অনেক? তোমরা কি আমাদের মতো মারামারি করো? ”

আমি মিষ্টির কথা শুনে অবাক হই। মিষ্টির কথার ধরন পাঁচবছরের বাচ্চাদের মতো এটা আজ খেয়াল করলাম। আর দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক নয় ও। অভীকের কান্নার কথা তখন মগজে জায়গা পেলো না। আমি ব্যস্ত মিষ্টিকে নিয়ে।

চলবে?

একটা পরীর গল্প পর্ব-০৪

0

#একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#পর্ব_০৪

আযানের শব্দ কানে যেতেই আবদ্ধ নয়নযুগল মেলতে শুরু করলাম। পাশে অভীক ভাইয়া ঘুমে বিভোর। আমি উঠে ওযু করে ঘরে আসতেই দেখলাম উনি বিছানায় উঠে বসে আছেন। আমাকে দেখে উনি কপাল ঘুচালেন। ওনার এমন কাজে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন।

– ” নামায কি তুই একাই পড়িস? আমরা পড়ি না? আমাদের ডাকার প্রয়োজন বোধ হয় না তোর? ”

আমি সামান্য এগিয়ে গিয়ে ওনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। ওনার মাঝেও হুট করে এক শীতল হাওয়া বয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। খোঁচা মেরে কথা বললেও ওনার বলা কথার মাঝে একটা শীতল প্রণয় বিরাজ করছে। উনি একেবারে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে উনি নিজেও আমার দৃষ্টি অনুকরণ করে তাকালেন। আমি চোখ সড়িয়ে নেই। উনি উঠে চলে যান। আমি জায়নামায বিছিয়ে নামাযের জন্য দাড়াই। নামায শেষে পাশে তাকাতেই দেখি উনি সিজদা দিচ্ছেন। আমি যথাস্থানে জায়নামায গুছিয়ে রেখে খাটে এসে বসলাম। দীপ্তি এসেছে ঘরে, সাথে অনা।

– ” এই আপু চল ঘুরতে যাবি না? ”

আমি অবাক হয়ে দীপ্তির দিকে তাকালাম। সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে কোথায় ঘুরতে যাবো? অনা আবার বলে ওঠে।

– ” ভাইয়া তো বললো গ্রামের সূর্যোদয় দেখবে। তাই আমরাও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলাম। তোরা কি যাবি না? ”

আমি কিছু বলার আগেই উনি বলে উঠলেন।
– ” তোমরা তৈরি হয়ে, বের হও। আমরা আসছি। ”

ওরা, তার কথা শুনেই বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। আমি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি। সবার সাথে কি সুন্দর ব্যবহার করেন আর আমার সাথে? উনি ওনার ব্যাগ থেকে একটা টিশার্ট আর জিন্স বের করলেন। আমি বাইরে চলে আসলাম।। যদিও উনি আমাকে বাইরে যেতে বলেন নি তবুও, ঘরে থেকে গেলে হাজারটা কথা শোনাতেন।কি দরকার সকাল সকাল কটুকথা শোনার। উঠানটা শুষ্ক হয়ে আছে। আমাদের উঠানে মাটির থেকে বালির অংশই বেশি যার কারনে এই হাল। সবাই জড়ো হয়ে দাড়ালো। আমি চৌকিতে বসে বসে গণনা করছি ঠিক কতজন ঘুরতে যাবো। ইতোমধ্যে ১৩জন এসে দাড়িয়েছে, আমরা সহ ১৫জন। অভীক ভাইয়া ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা ওদের কাছে চলে গেলেন। কাধে ওনার গিটারটা ঝুলছে। আমি বেকুবের মতো বসে রইলাম। সবাই বেড়িয়ে পড়লো ধানক্ষেত দেখার উদ্দেশ্যে। কারোর খেয়ালই নেই যে আমি এখনও আসিনি ওদের মাঝে। রাগের চোটে আমি ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এতক্ষন ওনার জন্য বসে রইলাম আর উনি কিনা আমাকে রেখেই চলে গেলেন। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি মাত্র। এরমধ্যেই দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলতেই দেখি ভাইয়া অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

– ” ঘরে কি করছিস? তোকে কি রোম কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ করতে হবে? আর চুলের এ হাল কেন? বস্তিদের মতো ঘুরছিস। যা চুল বেধে আয় ”

আমি মৃদুস্বরে জবাব দিলাম।
– ” আমি যাবো না ভাইয়া। আপনারা যান। ”

– ” ঠাটিয়ে দেবো এক চড়। তোর কোন আমলের ভাইয়া আমি? তোর গুষ্টির কেউ? দিনে চৌদ্দবার ভাইয়া ডাকিস। তোর মতো বস্তিটাইপের বোনের দরকার নেই আমার। তাছাড়া তোর আব্বু আর আমার আব্বু খুব ভালো বন্ধু সে’খাতিরে তোকে সহ্য করছি নাহলে তোর মতো মেয়ে আমার বাড়ির চারপাশেও ঘুরঘুর করার সাহস পায় না। বুঝেছিস? ”

আমি কিঞ্চিত বিরক্ত হলাম ওনার কথা শুনে। এই এক কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। এই লোকটাও একটু ক্লান্ত হয়না। আমি চুলের খোপা খুলে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলাম। কোমর ছাপিয়ে চুল হওয়ায় ঠিকভাবে আচড়াতেও পারছি না। হাত পৌছাচ্ছে না। অভীক দ্রুত এসে আমার হাত থেকে চিরুনি ছিনিয়ে নিলো। নিজেই আমার চুল আচড়ে দিয়ে বললো।

– ” কচ্ছপের গতিতে চললে একেবারে দুপুরে গিয়ে পৌছাতে হবে ওদের মিছিলে। তাড়াতাড়ি কর। ”

আমি আয়নার ওনার মুখমন্ডল দেখতে ব্যস্ত। ওনার রেশম-কোমল চুলগুলো মাথার তালে দুলছে। কয়েকটা চুল চোখের ওপর এসে পড়ছে। উনি ঠোটের ভাজে চিরুনি চেপে ধরে আমার চুলে বিনুনি গাঁথতে শুরু করেন।

– ” নে এবার চল। ”

উনি আগে আগে হাটছেন আর আমি ওনাকে অনুসরণ করছি। একটা কথা আজ অবধি কাউকে বলা হয়নি যে আমি ওনাকে পছন্দ করি, পছন্দ ঠিক নয়। ভালোবাসি ওনাকে। আগে নিজেও বুঝতাম না ভাবতাম তার চেহারা সুন্দর বলে পছন্দ করি কিন্তু দুবছর আগে বুঝতে পারি এটা আবেগ, আর এখন বুঝি ভালোবাসা। কিছু করার নেই আমার কিশরীমন এখন পুরোটাই অভীকে আবদ্ধ। চোখ দুটো তার চোখে নিবদ্ধ। ভেবে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি। উনি দিব্বি সবার সাথে খোশগল্প করতে করতে হেটে যাচ্ছেন। ওনাকে পেয়ে সবাই বেমালুম আমার কথা ভুলে গিয়েছে। আমিও যে ওদের সাথে আছি সেটা কারোর নজরেই নেই। সবাই মিলে স্কুলের সিড়ির কাছে এসে দাড়ালো। আমিও পিছু পিছু যাই। সবাই ওনাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে, যেমন কোন কলেজে পড়েন, কিভাবে গানের রেকর্ডিং হয়, ওনাদের বাড়ি কেমন, ওনার কেমন মেয়ে পছন্দ। এই প্রশ্নটা করা মাত্র উনি রুক্ষ কন্ঠে বলেন।

– ” তোমাদের বোনের মতো যারা আছে তারা বাদে যে কোনো মেয়েই আমার পছন্দের তালিকায় জায়গা পাবে। ”

আমি ফোস করে উঠি ওনার কথায়। আগে শুধু ঘরে বদনাম করতো, অপমান করতো, এখন বাইরেও শুরু করেছেন। খচ্চর ব্যাটা। আমি সিড়ি বেয়ে কিছুটা উপরে উঠে দাড়াই। সূর্য দিগন্তে তার শুভ্র কোমল কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। অভীকের মুখের একপাশে শুভ্র কিরণ পড়তেই উনি চট করে চোখ বুজে নিলেন। মুহূর্তেই আমার ঠোটে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। উনি চোখ পিটপিট করে তাকালেন। সামনের রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়িতে করে কাটা ধানের আঁটি নিয়ে যাচ্ছে কৃষক। রোদের কোমল কিরণে চিকচিক করছে ধানের প্রতিটা শস্য। দূরে খালের পানিতে ঝাঁক ঝাঁক হাসের দল ভেসে বেড়াচ্ছে। বাচ্চারা সিপারাহাতে মসজিদের উদ্দেশ্যে হেটে যাচ্ছে। রোদের আলো পানিতে ঝলমল করছে। উনি গিটারের সুর তুললেন। দীপ্তি গলা ছেড়ে গাইতে আরম্ভ করলো

– ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে…..

গান শেষে উনি দীপ্তির প্রশংসা করে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন।

– ” তাও তো ভালো দীপ্তি, তুমি গান পারো। আর তোমার যে বোন আছে না? দুনিয়ার কোনো কাজই পারে না। পারে শুধু গিলতে, ঘুমাতে আর ড্যাংড্যাং করে ঘুরতে। ”

দীপ্তি হেসে বলে।
– ” আরে না ভাইয়া। আপু আগে অনেক সুন্দর গান গাইতো। স্কুলে তো প্রতিবার গানের প্রতিযোগিতায় আপুই প্রথম হতো। ”

অভীক বিদ্রুপ করে বললো।
– ” আচ্ছা তাই নাকি? তো বলো তোমার আপুকে তার কাকের গলা থেকে একটু ফাটা বাঁশের আওয়াজ বের করতে। আমরাও দেখি সে কেমন গায়িকা। ”

আমি সজোরে ‘না’ বলে উঠলাম। সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার কপাল বেয়ে ঘামের বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে সন্তর্পণে। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। বুঝতে পারলাম শুধু পা নয় আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। আমি দ্রুততার সাথে সিড়ি বেয়ে নেমে যেতে লাগলাম। হঠাৎ আমার ওরনার এক কোনা সিড়ির পাশের ইটের টুকরোয় লেগে আটকে যায়। পেছনে টান অনুভব করে আমিও পেছনে তাকাই আর ভুলবশত সিড়ির ওপর পা না পড়ে পিছলে পড়ে যেতে থাকি নিচের দিকে। অভীক আমাকে পড়ে যেতে দেখে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এগিয়ে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে। তবুও আমার মাথা রেলিং এর ওপর গিয়ে গড়ে। ব্যাথার চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসে। অভীকের অস্ফুট কাতর কন্ঠ ভেসে আসে আমার কানে।

– ” পরী! এই পরী কি হলো তোর? পরী। ”

ঘুম ভাঙতেই দেখলাম অভীক আমার পাশে উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে বসে আছে। ঘরে আর কেউ নেই। আমি অসুস্থ অথচ কেউ আসলো না? আর ইনি বসে আসেন। ব্যাপারটা দেখে একটা লোককথা মনে পড়ে গেলো, ‘মা’য়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ‘। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি ধমকের সুরে বললেন।

– ” তোকে নিয়ে দেখছি কোথাও যাওয়াও মুশকিল। যেখানে সেখানে মুখ থুবড়ে পড়িস। এতো যে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে গিলিস সব যায় কোথায়? তোর পেছনে তো আংকেলদের সব খাবারও ওয়েস্ট হচ্ছে। ”

ওনার এমন কথা শুনে আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একজন অসুস্থ মানুষকেও যে এভাবে খোঁটা দিতে পারে কেউ, সেটা এই ব্যক্তিকে না দেখলে হয়তো জানতেই পারতাম না। না যথেষ্ট হয়েছে। আর সহ্য করবো না খাঁটাশ ব্যাটার এমন অত্যাচার। কিন্তু আমার অতীত? সেটা কিভাবে জানাবো ওনাকে? আমাকে অন্যমনস্ক দেখে উনি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন।

– ” আজ বিকালে আমরা দাদুবাড়ি যাবো। খেয়ে এখন থেকেই রেডি হতে শুরু কর। তোর তো আবার সাজতে গুজতে তিনদিন লেগে যায়। আমাদের হাতে ওতো সময় নেই। আর হ্যা এই যে ঔষধ এটা খেয়ে নে মাথাব্যথা কমে যাবে। ”

আমি আশ্চর্য হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনি ভ্রু কুচকে তাকান আমার চাহুনিতে।

– ” দয়া করে দাদুবাড়ি গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়িস না। আমার মান সম্মান আর ডুবাস না। এটা জলদি খা, আর রেডি হয়ে নে। তোর জন্য আর ঝামেলায় পড়তে রাজি নই আমি। ”

আমি উদাসিন কন্ঠে বললাম।
– ” আমি যাবো না। আপনারা যান। ”

উনি চোয়াল শক্ত করে বললেন।
– ” তোর কাছে কি আমি কোনো মতামত জানতে চেয়েছি ? আমি শুধু জানিয়ে গেলাম বিকেলের মধ্যে রেডি থাকবি। নাহলে এমন মার মারবো না, মেরে চেহারার ম্যাপ বদলে দিবো। ”

আমি সটান দাড়িয়ে গেলাম।এই লোকটাকে বিশ্বাস নেই। সত্যি সত্যি মেরে বসতে পারে। আগে তো কম মারেনি। দজ্জাল কোথাকার। উনি বাইরে গিয়ে আবার ফেরত আসলেন। হাতে একটা প্যাকেট। আমি সন্তর্পণে প্যাকেটটা দেখার চেষ্টা করতে থাকলাম। উনি ফট করে বলে উঠলেন।

– ” এই শাড়িটা তোর জন্য। এটা পড়ে যাবি আমার সাথে। বস্তিদের মতো আসলে বড় রাস্তার পাশে যে কুয়ো আছে সেখানে ফেলে দিয়ে আসবো তোকে। জলদি তৈরি হ। ”

কথাটা বলেই চলে গেলেন উনি। আমি ঠায় দাড়িয়ে রইলাম। আমি কি এতোটাই খারাপ? এতোটা অপমানের, অসম্মানের যোগ্য? আমাকে কি সত্যিই ভালোবাসা যায় না? মাঝে মাঝে মনের ভেতর যে ভালোবাসা টোকা দেয় তাকে কেন সাদরে গ্রহণ করতে পারছি না? কেন বারবার তাকে দূরে ঠেলে দিতে হচ্ছে?

বিকালে ওনাদের সাথে আমি দাদুবাড়ি আসি। দীপ্তিও আমার সাথে এসেছে। মিষ্টি আমার ননদ। সে আমাকে আমার ঘর দেখিয়ে দিয়ে ছুটে চলে গেলো ছাদে। বাড়ির সবাই এসে আমাকে দেখছেন আর উপহার দিচ্ছেন। অভীক তার ভাইবোনদের সঙ্গে দাড়িয়ে আছে দূরে। আমি ঘরে এসে উপহারগুলো খাটের ওপর রাখি। মাথা থেকে ঘোমটা খুলে ফেলি। আমার শাশুড়ি আম্মু এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হাতে একজোড়া রুলি পড়িয়ে দিলেন।

– ” অভীক তোমাকে খুব বিরক্ত করছে নাকি? ওর কথায় কষ্ট পেও না। জানো তো ও কেমন। একটু সময় যেতে দাও। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

আমি মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বললাম। উনি আমার মুখশ্রী দুহাতে ধরে কপালে চুঁমু খেলেন। মৃদুস্বরে বললেন।

– ” খুব মিষ্টি মেয়ে তুমি। একদম মন খারাপ করবে না। কিছু লাগলে আমাকে কিংবা অভীকের বাবাকে বলবে। অভীক তো বরাবরই ছন্নছাড়া। ও কখন কি করে নিজেও বোঝে না। ”

– ” আপনি চিন্তা করবেন না। আমার কিছু প্রয়োজন হলে আমি আপনাকেই বলবো। ”

– ” এ্যাই মেয়ে আপনি কি হ্যা? অভীক মিষ্টির মতো তুমি করে ডাকবে। ”

– ” তাহলে ওনাদের মতো আমাকে তুই করে ডাকুন। আমাকে কেন তুমি বলছেন? ”

আমার কথায় তিনি মৃদু হাসলেন।
– ” পাগলি মেয়ে। ছাদে যা। অভীকসহ সবাই আছে ওখানে। ”

– ” আচ্ছা। ”

ছাদে গিয়ে দেখি সবাই খেজুরপাতার মাদুর বিছিয়ে গল্পে মজে আছে। সবার মাঝে বসে আছে অভীক। মিষ্টি উত্তেজিত হয়ে অভীকের হাত ধরে লাফাচ্ছে আর বলছে।

– ” ভাইয়া ওই গল্পটা বলো। ওটা তো বলছোই না। শুধু নাম জানিয়ে রেখেছো। তুমি বলেছিলে এরপর যেদিন গ্রামে আসবো সেদিন ভরা আসরে গল্পটা বলবে। আজ তো এসেছি। এখন বলো না গল্পটা। আমরা সবাই শুনতে চাই সেই #একটা_পরীর_গল্প ”

চলবে?