Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1462



আঁধারের আলো পর্ব-০৪

0

#আঁধারের_আলো
#পর্ব_৪
#লেখাঃInsia_Ahmed_Hayat

বাবার বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আলো। নিজের সাথে করে আনা ট্রলি ব্যাগ টা বাহিরে রেখে হাতে খবরের কাগজে মোড়ানো একটা বক্স নিয়ে প্রবেশ করলো। আলোকে এখানে দেখে ওর মা ও ভাইয়ের বউ এগিয়ে এলো।
এই সেই আলো যার চোখের নিচে কালি।অনেকটা ফুলে গেছে অনেক।এই ফুলা মোটা নয়।অতিরিক্ত পরিশ্রম এ ফলে এমন অবস্থা হয়ে গেছে। কেমন ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে। নিজের মলিন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আলোকে দেখে ওর মা জিজ্ঞেস করলো,

মাঃআলো তুই এই সময় এখানে।আর এতো বড় ব্যাগ নিয়ে এসেছিস কেন?

দাদীঃ কেন আবার আমার নাতীর থিকা টাকা নিয়া পেট ভরে নাই তাই আবার আইসে টাকা নিতো।

আলো দাদীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। সাথে তার ভাইয়ে শাশুড়ী কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলো তার কাছে গেলো।

আলোঃ চাচী টাকাটা দিন।

ভাইয়ের বউঃ কিসের টাকা আপু(অবাক হয়ে)
সবাই অবাক বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে

আলো সেদিকে কান না দিয়ে এবার একটু জোরে বলল
আলোঃটাকা গুলো দিন।

আলোর ভাই এর শাশুড়ী রুমে গিয়ে টাকা এনে আলোর হাতে দিলো।

আলোঃ আমি এখানে টাকা নিতে আসিনি। ওইদিন আমি টাকার জন্য পাঠায়নি যার কাছে বিয়ে দিয়েছেন সে আমায় না বলে টাকা নিতে চলে আসে। যাইহোক টাকা আমি ওইদিনের পরের দিনই ফেরত দিয়ে গিয়েছি। আকরামের(আলোর ভাই) শাশুড়ী আমায় বাসায় যেতে মানা করায় তার কাছেই বাহিরে থেকে টাকা দিয়ে চলে গিয়েছি। ফাতেমা(আকরামের বউ) এই নেও টাকা আকরাম আসলে ওকে দিয়ে দিবা। আর বলবা আমি টাকা চাইনি। আমার টাকার প্রয়োজন নেই।

ফাতেমাঃ মা আপু টাকা দিয়েছে বলেননি কেনো। আর আপুকে বাসায় আনেননি কেনো।

ফাতেমার মা আমতা আমতা করে বলল
ফাতেমার মাঃআসলে আমার মনে ছিলো না। আর

আর কিছু বলার আগেই আলো তাকে থামিয়ে বলা শুরু করলো।
আলোঃ আমি আজকে এখানে কিছু কথা বলার জন্য এসেছি যা গত ১২ বছরে বাবা মারা যাওয়ার পর বলা হয়নি।

দাদীঃ কি বলতে আইসো তুমি। কয়দিন পর পর দৌড় দিয়া আইসা তামাশা করো।

আলোঃ দাদীমা আমার বিয়ে ২ বছর হয়েছে এই দুই বছরে ৫ বারও আমি এই বাড়িতে আসিনি। তাহলে কিভাবে বলেন যে দুইদিন পর পর এসেছি। আচ্ছা আমায় আপনি দেখতে পারেননা কেন। আমি মেয়ে বলে৷ আপনাকে একটা প্রশ্ন করি।আপনি যখন জন্ম নিয়েছেন তখন কি ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছেন নাকি মেয়ে হয়ে?
বলেই একটু দম নিলো। কান্না পাচ্ছে খুব। এই প্রথম আলো মনে চাপা কথা গুলো বলছে। আর বলতেই হবে। আজ না বললে কখনোই বলা হবে না।

আলোর দাদী চুপ হয়ে আছে। তার চুপ থাকায় আলো আবার বলা শুরু করলো।

আলোঃ আপনি আগের যুগে মেয়ে হয়ে ভালো ভাবে থেকেছেন খেয়েছেন ভালো জায়গায় বিয়ে করে বাচ্চা জন্ম দিয়ে নাতী নাতনি দেখে। নাতীর ঘরে পতি দেখতে যাচ্ছেন। কই আপনার মা দাদীরা তোহ আপনাকে ঠিকই ভালো লালন পালন করেছে। তাহলে আমি এই যুগে হয়ে শিক্ষিত সমাজে থেকে আমার প্রাপ্য অধিকার ভালোবাসা থেকে কেন বঞ্চিত হবো। কেন ছেলে মেয়েকে আলাদা চোখে দেখতে হবে। আশেপাশে কতো মানুষ দেখলাম কই তারাও তোহ কন্যা সন্তানকে ঠিকউ লালন পালন করছে। তারা পার্থক্য করছে না কেন। আছে কি উত্তর কারো কাছে। দাদী আপনিই বলেন আপনি মেয়ে হয়ে সসম্মানে বাচতে পারলে আমি মেয়ে হয়ে পারবো না কেন। নাকি আপনি মেয়ে হওয়া আর আমি মেয়ে হওয়ার মাঝেও তফাৎ আছে।

আলোর গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে বার বার মুছে ফেলছে। কথা গুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। কিন্তু আজ থামবে না।আজ যে বলতেই হবে।সবাই চুপ হয়ে আছে। আলোর মা ও ভাইয়ের বউ কাদছে।

আলোঃ আমাকে আপনারা সব সময় টিস্যুর মতো ব্যবহার করেছেন। বাবার এক্সিডেন্টে মারা গেছে তা কি আমার দোষ। সব সময় সব কিছুর জন্য আমাকে দোষ দেওয়া হয়েছে । আমাকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজের লোকের মতো কাটানো হয়েছে কারন বংশের ছেলেকে লালন পালন করতে হবে তাই। থাকা খাওয়া পোশাক সব দিক দিয়ে আমি বঞ্চিত ছিলাম। আমার কষ্টে টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে আমাকেই কথা শোনানো হতো। আর একবারও কি আমায় দেখতে চেয়েছেন আমি ওইবাড়িতে বেচে আছি নাকি মরে গিয়েছি।ওই বাড়িতে কেমন আছি একবারও খোজ নেননি। আরে একবারো দেখতেও জাননি আর না আমায় কখনো বলেছে এইবাড়িতে আসতে। কখনো ফোন দিয়ে দুইমিনিট কথা বলে জিজ্ঞেসও করেননি যে আলো কেমন আছো। আমি নিজে থেকে বেহায়ার মতো ফোন দিতাম আর আপনাদের কথা শুনতাম।আচ্ছা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ব্যস দায়িত্ব শেষ। আপনাদের মাঝে দায়িত্ববোধ নামক জিনিসটা মরে গিয়েছে। আর সব চেয়ে বড় কথা জীবনে একটা জিনিস চেয়েছিলাম। আঁধারকে বিয়ে করার কথা সেখানেও আমাকে শাস্তি হিসেবে একজন অমানবিক পুরুষ এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কেন এইবাড়ির ছেলে যদি তার পছন্দের মানুষকে জীবন সঙ্গী বানাতে পারে তাহলে মেয়েটি কেন পারবে না।কেন?

আলো কান্নার ভেঙে পড়লো কতো বছর পর কাদছে জানা নেই তার। বিয়ের সময় বিদায়েও কাদেনি সে। ফাতেমা আলোর পাশে এসে দাড়ালো কি বলে শান্তনা দিবে বুঝতে পারছে না। আলো মাও কাদছে।

হুট করে আলোর দাদী এমন কিছু বলল যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না।

দাদীঃও এই কথা এবার বুঝছি তোমার নাগর বুঝি আইসা পড়ছে তাই না।তার সাথে যাওয়ার জন্য এত কথা। আমাগো মান সম্মান ডুবানোর জন্য এই রাস্তা। তোরে তোহ জন্মের সময়ই মাইরা ফালানো উচিত ছিলো।

আলোর মা ঃমা আপনি এইগুলো কি বলছেন। চুপ করুন দয়া করে। আজ কিছু বলবেন না।
আলো কান্নার মাঝেই হেসে দিলো সবাই অবাক হলো

আলোঃসত্যি দাদী আপনি আর আপনার মানসিকতা কখনোই বদলাবে না। যাক আমি কাউকে কোনো কৈফত দিতে আসিনি। যেই কাজে এসেছি তাই করি।

চোখের জল মুছে ফাতেমার হাতে খবরের কাগজে মুড়ানো বক্সটা দিলো।

আলোঃ তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে ফাতেমা। আমার ভাইয়ে খেয়েল রেখো।আর হ্যা তোমার যদি মেয়ে হয় তাহলে দয়া করে এইবাড়িতে এদের কারো ছায়া তোমার মেয়ের উপর পড়তে দিও না। জীবনটা অভিশপ্ত হয়ে যাবে। আল্লাহ যেনো তোমায় কন্যা সন্তান না দেয়। আর এই বক্সটা আকরামকে দিয়ে দিও। তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে তুমি এই বক্সটা খুলবে না। কারো কথায়ও খোলবে না প্লিজ(ফাতেমার মায়ের দিকে তাকিয়ে) আমি চাই বক্স আকরাম খুলুক। নিজের খেয়াল রেখো ভালো থেকো।

আলো কথা শেষ করে বাহিরের দিকে পা বাড়ালো।
ফাতেমাঃআপু আপনার ভাই আসার পরই যেতেন। নিজ হাতে দিতেন বক্সটা।

আলো মুচকি হাসলো
আলোঃআমার যে সময় নেই ফাতেমা। তুমিই দিয়ে দিও এটার জন্যই এসেছিলাম।

আলোর মা আলো হাত ধরে ওকে জড়িয়ে ধরে কাদছ। আলো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
আলোঃআমায় ছাড়ুন।যেতে দিন যেতে হবে।

আলোর মাঃ মা গো আমারে মাফ করে দেও। আমি কোনো দিন তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করি নাই। মায়ের (শাশুড়ীর) সাথে থাকতে থাকতে তার মতোই হয়ে গিয়েছি। তুমি আমার মাফ করে দেও।

আলোঃ মাফ করার কিছুই নেই। আর জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায় নাকি। আপনাকে আমি তুমি থেকে আপনি কেন ডাকি জানেন। কারন আমার কাছে আপনজন যখন পর হয়ে যায় তখন তাকে আপনি বলে ডেকে থাকি। আপনাকে ঠিক মা বলে কবে ডেকেছি বলতে পারবেন। পারবেন না।

আলোর মা চুপ হয়ে কথা গুলো শুনে ভাবতে লাগলো।

আলো সবার দিকে চেয়ে বলল
আলোঃআশা করি আমার চেহারা যেনো আপনাদের না দেখা লাগে।

এর মাঝে ফাতেমা আকরামকে মেসেজ করে আসতে বলে। কেন যেনো আজ তার ভয় করছে।

আলো কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাহিরে চলে এলো। দ্রুত পায়ে একটা অটোতে উঠে বাস স্টান্ডের দিকে যাচ্ছে।

চলে যাচ্ছে দুই পরিবার থেকে বহু দূর। গার্লস গ্রুপ থেকে এক আপুর সাথে তার পরিচয় হয়৷ তার কষ্টের কাহিনি শুনে আপু তার কাছে চলে আসতে বলে। ওই আপু একা থাকে। আলো তার ফোন নাম্বার নিয়ে রাখে সময়ে কাজে লাগবে তাই। আজ সকালে শাওনের বলা কথা গুলোর পর সিদ্ধান্ত নেই চলে যাবে বহু দুর। অনেক আপু তাকে সাহস দেয়। নিজের জন্য লড়াই করার শক্তি দেয় যার ফল আজ। সেই আপু ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে।আলো সেই ঠিকানায় রওনা হয়েছে।

শাওনদের বাড়িতে শাওনের মা শাওনকে বকছে।

শাওনের মাঃ তোর বউ স্বর্নের চেইন লইয়া গেছে গা।আমারে জিগায়ও নাই। তুই কিছু কস না তাই মাথায় উঠছে। এমনে এতো কাম ফালাইয়া বাপের বাড়ি গিয়া মরছে। চেইন আমার কাছে রাখছি হারায় যাইবো গা তাই। বিয়ে মধ্যে বাপের বাড়ি থিক্কা সুতার সমান চিকুন চেইন আনছিলো সেইটাও লইয়া গেলো। পোড়া কপাল আমার।

রুপাঃ থাক খালা শাওন ভাই আপনেরে নতুন দেইখা চেইন আইনা দিবোনে।

শাওন কিছু না বলে রুমে চলে গেল।
আলমারি খুলে দেখলো পুরনো কাপর চোপড় পড়ে আছে। আর শাড়ি( বিয়ে মধ্যে উপহার পেয়েছিলো সেইসব শাড়ি) কিছু নতুন থ্রিপিস যেগুলো কোনো ভালো দিনে পড়তো ওইগুলো নিয়ে বাকি সব রাখা। খালি বিয়ের শাড়ি পড়ে আছে।

শাওন ভাবছে চেইন নিয়ে গেল। বিয়ে দুই বছরে মা সেই যে চেইন নিয়েছে কত চাওয়ার পরও দেয় নাই। আর আজ নিজে থেকে নিয়ে গেছে।ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে। শাওন তারতারি তার ড্রয়ার দেখলো যেখানে টাকা রাখে। সেটা খুলে দেখলো না টাকা যেখানে ছিলো সেখানেই আছে। কিছুক্ষন গুনে নিলো সব ঠিক। বিয়ের সময় একটা ট্রলি কিনেছিলো ওটা নেই। শাওন এইসব ভেবে কুল পাচ্ছেনা। ভাবলো অনেকদিন পর বাবার বাড়ি থাকতে গিয়েছে তাই এইভাবে গেলো।কখনো তোহ কিছু কিনে দেয় নাই তাই সব নিয়ে গেছে যাতে কেউ বলতে না পারে সে কিছু দেয় না বউকে। যাক বুদ্ধিমতি আছে।
শাওন গান গাইতে গাইতে চলে গেলো।

ওইদিকে
আধার নিজের দোকান চালু করে দিয়েছে। একজন কর্মচারীও রেখেছে। আঁধার দোকানে বসে নিজের মানি ব্যাগে রাখা সাদাকালো ছবির উপরে হাত ভুলাচ্ছে। ছবিতে একটি বাচ্চা মেয়ে গোমড়া মুখ করা ছবি। এই ছবিটি আর কারো নয় আলোর। তখন তারা 4 এ পরতো কোনো কারনে ছবি তুলতে হবে। ছবি তুলে আলো দেখলো তার ছবি সুন্দর হয়নি। মাথায় তেল চুবচুব করছে। ছবিটা বাকা উঠেছে তাই রাগ করে ফেলে দিয়েছিলো। আঁধার সেটা কুড়িয়ে নিজের কাছে সযত্নে রেখে দেয়। এতো বছর ধরে নিজের কাছেই আছে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। রাতে ছবির সাথে কথা বলে। আরো কতো কি।

আঁধার হাসছে আর মনে মনে বলছে।
আঁধারঃ আমার দুই মাসের বড় আলো। খুব তোহ জোড় গলায় বলেছিলো তুমি শুধু আঁধারের আলো। কিন্ত আজ কি হলো আঁধারের আলো যে অন্য কারো হয়ে গেলো। তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। শুধু শেষ একটাই ইচ্ছা এই ২৬ বছরের নারী আলো কেমন দেখতে তাই দেখতে চাই।

আলো বাস থেকে নেমে একজনকে খুজছে। কিছুক্ষনপর একজন মেয়ে আসলো আলো তার সাথে কথা বলল
এরপর দুজন চলে গেলো। মানুষ বড়ই অদ্ভুত তাই না সামান্য কষ্টের কথা শুনে সাহায্য করার জন্য চলে এলো আপু। আর কাছের মানুষের কাছ থেকে শত কষ্ট পেয়েও একটুখানি সুখের আশায় ছিলাম। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে আপনের চেয়ে পর ভালো। সামনের দিন গুলো কিভাবে কাটবে জানি না।
লেখনীতেঃInsia Ahmed Hayat
আলো আর মেয়েটি একটি ফ্লাটে আসলো।

মেয়েটিঃ আলো তুমি বসো আমি তোমার জন্য শরবত নিয়ে আসি।

আলো চারদিক দেখছে অনেকটা গুছানো ঘর। এতো বড় ফ্ল্যাট এ উনি একা থাকে
মেয়েটিঃ কি দেখছো।(শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল)

আলোঃ মনিরা আপু এতো বড় বাড়িতে তুমি একা থাকো।

মনিরাঃ একসময় বর আর আমি থাকতাম এখন শুধু আমি।

আলোঃ আপু কিছু মনে না করলে একটা কথা।

মনিরাঃ একটা নয় ১০০ টা বলো। আগে ফ্রেশ হয়ে নেও কিছু তোহ খাওনি সকাল থেকে চলো আমরা খেয়ে সারাদিন গল্প করবো।

আলোর চোখ ছলছল করছে। চিনা নাই জানা নাই একটা মেয়েকে থাকতে দিচ্ছে খেতে দিচ্ছে।

মনিরাঃ অফফো চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে ফেলো। এই জল যেনো গড়িয়ে না পড়ে ঠিক আছে। আর চিন্তা করার কোনো কারন নেই আমি তোমার পাশে আছি। আমাকে বড় বোন ভাবতে পারো

★★
আলো ও মনিরা বসে বসে কথা বলছে।

মনিরাঃ ছোট বেলায় আমার বাবা মারা যায় মা কষ্ট করে বড় করে আর লালন পালন করতে থাকেকিন্তু হঠাৎ মাও মারা যায়। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না এরপর আমার একজনের সাথে পরিচয় বয়সে আমার অনেক বড়। একদিন সে আমায় বিয়ের প্রস্তাব দেয় উপায় না পেয়ে রাজি হয়ে যাই। লোকটা আমায় বড্ড ভালোবাসতো। আমাকে পড়াশোনা করিয়ে এখানে আনার পেছনে তারই অবদান। আজ আমি ভালো জব করি এই ফ্লাটের মালিক আমি ভালোই চলছে দিনকাল।

আলোঃ উনি কোথায় এখন।

মনিরাঃ উনিও আমায় ছেড়ে একা করে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে। যাক তুমি চিন্তা করো না তোমার জন্যও আমি কিছু না কিছু করবো।নিজের পায়ে দাড়াতে হবে। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি তোমার সঙ্গ দিবো। তোহ এখন তুমি কি চাও।

আলো হালকা ভেবে বলল
আলোঃ ডিভোর্স

অন্যদিকে আকরাম বাসায় এসে সব কিছু শুনে চুপ হয়ে আছ। ওর আসতে দেরি হয়েছে না হয় আজ ওর বোন ওর সাথে থাকতো।
বোনের দেওয়া বক্সটা খুলতে বড্ড ভয় করছে। কয়েকবার কল করেছে কিন্ত ফোন বন্ধ। শাওনকেও কল দিয়েছে সেখানেও নেই। তার বোনের কিছু হলো না। সাত পাচ না ভেবে বক্সটা খুললো।

বক্সের ভেতরে ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ের দুইটা জামা। যা দেখে আকরাম অবাক এটা তোহ তার বোনের ছোট বেলার জামা যেটা। যখন আকরাম ছোট ছিলো হুটহাট করেই আলোর জামা পড়ে ফেলতো। আকরামের এই জামা নাকি খুব পছন্দের অনেক ঝগড়া হতো এরপর আকরামের মা জামাটা আলমারিতে রেখে দেয় বের করেনি আর। আকরাম ভেবেছিলো ফেলে দিয়েছে এটা কিভাবে আলোর কাছে ছিলো। জামা গুলো বড় ছিলো এখন দেখে মনে হচ্ছে আলো কেটে হালকা ছোট করে ১ বছরের বাচ্চার সাইজ বানিয়ে একটু ডিজাইন করে দিয়েছে। এরপরও আকরামে চিনতে ভুল হয়নি যে এটা আলোর জামা।

বক্সে জামার সাথে একটা ছোট বক্স আর তার পাশেই সাদা কাগজ হয়তো চিঠি।

ছোট বক্সটা খুলে দেখলো বক্সে ছোট ছোট রিং কানের দুল।

আকরাম চিঠিটা হাতে নিলো পড়তে বেশ ভয় করছে। চিঠিটা সাহস করে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সবাইকে চিৎকার করে বলছে।

আমার বোন চলে গিয়েছে।কোথায় খুজবো তাকে।আমার বোনের সাথেই এমন কেনো হলো।

চিঠিতে কি লেখা কেউ জানে না। ফাতেমাকেও ধরতে দিচ্ছে না চিঠি।

আলো চলে যাওয়ার ৭ দিন হয়ে গেলো। আকরাম রোজ চিঠিটা পরে আর কাদে। অনেক জায়গায় খুজেছে নিজের বোনকে। আকরাম তার মা, শাশুড়ী আর দাদীর সাথে একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ফাতেমার সাথে কথা বলে আর সে চায় তার যেনো মেয়েই হয় এই অবস্থায় ফাতেমার অনেক খেয়াল রাখছে আকরাম। শাওনের বাসায় গিয়েও শাসিয়ে এসেছে সবাইকেল।

শাওন চিন্তায় পড়ে গেলো আলো হঠাৎ কোথায় চলে গেলো।

দুইদিন পর শাওনের দুই বোন এসেছে। শাওনদের বাসায় এসেই রুপাকে রুম থেকে বের করে ৪,৫ টা চড় বসিয়ে দিয়েছে দুই বোন মিলে। ওদের এমন কাজে সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। দুই বোন প্রচুর রেগে আছে।

চলবে

আঁধারের আলো পর্ব-২+৩

0

#আঁধারের_আলো
#পর্ব_২_3
#লেখাঃInsia_Ahmed_Hayat

শাওনদের বাড়ির পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সবাই। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আলোও করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আলোর শাশুড়ী সবাইকে বলছে

শাশুড়ী ঃ দেখছো শাওনের বাপ আমার পোলার কষ্টের টাকা কেমনে নষ্ট করে। আলো এতো গুলো ভাত বাড়ির পিছে কেন ফালাইলা।(চিল্লিয়ে)

আশেপাশের মানুষ এসে তামাশা দেখছে।
আলোঃআমি ফালাইনি মা।

রুপাঃতুমি ফালাওনি তোহ কি উড়ে এসেছে ভাত গুলো।

আলোঃ মা সত্যি আমি ফালাইনি। আমি কেনো ফালাবো।

শাওনের বাবাঃ আচ্ছা এতো গুলো ভাত এখানে। অন্য কারোরও তোহ হতে পারে।

শাওনের মাঃ অন্য কারো হইবো না। পাতিলে গিয়ে দেখেন। পুরো পাতিল খালি। তুই এতো গুলো ভাত এনে ফালাইলি কেন। প্রতিদিন বেশি বেশি করে ভাত রান্না করস তারপরও ভাত পাই না।

আলোঃ হ্যা মা আমিও বুঝতে পারছি না। প্রতিদিন ভাত সর্ট পড়ে। রাতে ওনি(শাওন) খাওয়ার পর আর ভাত থাকে না।হয়তো অল্প করে খেয়ে নেই নয়তো না খেয়ে থাকি। তাই তোহ প্রতিদিন একটু বেশি করে রান্না করি তারপরও কম পড়ে আজ বুঝলাম কেনো কম পড়ে। কিন্ত সত্যি আমি ফেলে দেইনি বিশ্বাস করেন আমি ফেলে দেইনি। কেন আমি ফেলে দিবো। ( মনে মনে বলছে। কারন তার কথা শোনার যে কেউ নেই। নিজের দুঃক্ষ গুলো মা, ভাই এর কাছে বলার স্বাধীনতা নেই)

শাওন এতোক্ষন চুপ করে ছিলো। কিছু না বলে চলে যায়। শাশুড়ী আর রুপা মিলে আলোকে আরো অনেক কথা শুনিয়ে এক সময় তারাও চলে যায়। শ্বশুর আলোর দিকে চেয়ে চলে গেলো।

আলো সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাশের বাসার চাচাতো ভাবি আলো কাছে এলো।

ভাবিঃ আলো আর কতো অপমান সহ্য করবা। তুমি কিছু বলোনা কেনো।

আলো মুচকি হেসে বলল
আলোঃ প্রতিবাদ করা যে কেউ শিখায়নি। মানুষের কথা হজম করাটা ঠিকই শিখিয়েছে।

বলেই চলে গেলো। এভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। একদিন আলো সকালে রান্না করছে উঠানে বসে আছে শাশুড়ী। হঠাৎ পাশের বাসার চাচী এসে বসলো। দুজনে মিলে গল্প করছে। আলো রান্না ঘর থেকে স্পষ্ট সব শুনতে পাচ্ছে। কথার মাঝে চাচী তার পুত্র বধুর কথা বলল, আসলে ইনিয়ে বিনিয়ে শাশুড়ীকে খোচা দিচ্ছে,
চাচীঃ ভাবি জানেনি ৮০ হাজার টাকা দিয়া বউ এর বাপে খাট বানায় পাঠায়ছে যাতে তাগো মাইয়া ভালো ভাবে থাকতে পারে।

শাশুড়ীঃকউ কি এতো দাম দিয়া।

চাচীঃ হও বুঝেন না এইগুলো হলো সামাজিকতা। সাথে ফ্রিজও দিছে। আপনে কই পোলাডারে বিয়া করাইলেন। ভালো জাগায় করাইতে পারলেন না। আমগো বউ এর কিন্তু বাচ্চা হইবো।

শাশুড়ীঃভালা তোহ

চাচীঃ হো আর আপনে না কি বিয়া করাইলেন।এতদিনে নাতীর মুখও দেখতে পারলেন না। কবিরাজ দেখান ভালা দেইখা।

শাশুড়ীঃ অনেক দেখাইছি কোনো কাম হয় না

চাচীঃ আইচ্ছা বাদ দে মাইয়ারই কোনো দোষ আছে। আইচ্ছা এইবার ঈদে আমগো বউ এর বাড়ি
থেকে বাজার পাঠাইছে। আপনের বউ এর বাড়ি থেকে কি কি পাঠাইছে।

শাশুড়ী চুপচাপ কথা গুলো শুনছিলো। কোনো মতে কথা কাটিয়ে ঘরে চলে গেলো। এইদিকে আলো হালকা হাসলো। একটা মেয়েকে তার শশুরবাড়িতে নিচু করার জন্য পাশের বাড়ি চাচী আর সমাজই দায়ি। আমার শাশুড়ীর এইসবে লোভ নেই কিন্তু যখন শুনে ওমুকের বউয়ের বাড়ি থেকে এটা দিছে সেটা দিছে। সেখানে যে কেউর মাথা নষ্ট হবে। রাগ উঠবে লোভ জাগবে। তারা যৌতুক নিবেও ঢোল পিটিয়ে মানুষকে জানাবে আবার যারা নিবে না তাদের কানে বিষও ঢেলে দিবে। জানি না চাচীর এইসবের কথার ফল কি হবে। কি আর হবে আস্তে আস্তে এইসবের প্রভাব আমার উপর পড়ছে। আমার ভাই এতো দামের খাট দেওয়ার সামর্থ্য নেই। ছোট মানুষ পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করছে সাথে সংসারের হাল ধরেছে। আমি কিভাবে স্বার্থপরের মতো বাবার বাড়ি থেকে কিছু চাইবো। তার উপর আমি যে বেচে আছি নাকি মরে গেছি সেই খোজই তোহ কেউ নেয় না। আবার তাদের কাছ থেকে কি আশা করবো। আমার ভাই এর সাথে আমার কখনো মিল ছিলো না। ও আমার সাথে কথা কম বলতো এখনো বলে না।আমি নিজে থেকেই ওকে কল দিয়ে থাকি। শুনলাম ওর বউ এর নাকি বাচ্চা হবে। শুনে খুবই খুশি হলাম আবার দুঃক্ষ লাগছে যদি মেয়ে হয় তাহলে কি সেই মেয়ের সাথেও আমার মতো আচরণ করবে। ভয় হয় খুবই ভয় হয়।আল্লাহ যেনো তাকে পুত্র সন্তানই দান করে।

যাইহোক আমার শাশুড়ী পরিবর্তন এর জন্য এইসব চাচীরাই দায়ি। শুরুতে কিছুই বলতো শাশুড়ী কিন্তু এইসব শুনতে শুনতে উনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করে।

—————————————-
একদিন বিকালে শাওন বাসায় এসে আলো তখন কাজ করছিলো।
শাওনঃ আলো আলো

আলোঃ জিই আসছি।

আলো রুমে আসার পর আলোর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে
“তোমার জন্য উপহার”

আলো খুশি হলো। এই দেড় বছরে প্রথম শাওন তাকে কিছু কিনে দিলো। প্যাকেট খুলে দেখলো একটা ছোট ডায়মন্ড এর নাক ফুল। আলো এতোদিন পাথরের নাক ফুল পড়তো। শাওন বলল পড়তে আলো বলল পড়ে পড়বে। এরপর শাওন দোকানে চলে গেলো। আলোর অনেক খুশি লাগছে। প্রায় ৫ মিনিট ধরে নাক ফুলের দিকে চেয়ে আছে।

অন্যদিকে

আঁধার এলাকায় একটা দোকান দিলো ঔষধ এর দোকান। সে খেয়াল করলো সব আছে কিন্তু ঔষধ এর জন্য অনেক দূরে যেতে হয় তাই সে এই দোকান দিলো। আজ থেকে দোকানে মালামাল এনে সব ঠিক ঠাক করবে।

আঁধার নিজের রুমে বসে হিসাব করছে। এমন সময় তার দরজায় কড়া পড়লো।

আঁধার দরজায় তাকিয়ে দেখলো তার বউ ভাবি দাঁড়িয়ে আছে।
আঁধারঃ ভাবি আপনি?

ভাবিঃআসতে পাড়ি।

আঁধারঃ হ্যা হ্যা আসুন। কোনো দরকার।

ভাবি এসে বসল।
ভাবিঃ আঁধার ভাইয়া আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।

আঁধারঃ হ্যা বলুন কি হয়েছে। ভাইয়ার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে নাকি?

ভাবিঃ না তেমন কিছুই না। আসলে আমার বিয়ের ৫ বছর হলো। আপনাকে দেখছি আপনি খুব চুপচাপ থাকেন। হঠাৎ করে একদিন বললেন বিদেশ যাবেন।পড়াশোনা করবেন না। তোহ আপনার ভাই আপনাকে তার কাছে নিয়ে গেল। সেখানে ৪ বছর থাকলেন। অনেক ছুটি থাকার পর দেশে আসেননি। একটাই কথা টাকা কামাতে হবে। এরপর ১ বছর আগে আসলেন। আর হুট করে সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করবেন না। ঠিক বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে খুলে বলুন। আমাকে ভাবি নয়। বড় বোন বা বন্ধু মনে করুন।

আঁধার চুপচাপ তার ভাবির কথা শুনছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলো। এতোদিনের মনের চাপা কষ্ট গুলো আজ বলতে যাচ্ছে কাউকে।

আঁধারঃ আমি একজনকে ভালোবাসি। এখন থেকে নয়। যখন আমার বয়স ৭ বছর তখন থেকে। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। সমবয়সী আমরা সে আমার ২ মাসের বড় হাহাহা। ছোট বেলায় এই কথা বার বার মনে করিয়ে দিতো।হালকা চাপা স্বভাবের ছিলো কিন্তু আমার সাথে কথা ঝুড়ি ফুটতো। আমাকে সব সময় বকা দিতো কারন সে আমার বড় ছিলো তাও দুই মাসে এই কথা দিনে ১৫ বার আমাকে শোনাতো। হাহাহা

বলেই আঁধার হাসছে। ভাবি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম আঁধারকে হাসতে দেখলো। শাশুড়ীর কথায় আজ দেবরের সাথে খোলাখুলি কথা বলতে এসে অবাক হচ্ছে।

ভাবিঃ ওম বেশ তোহ সে কোথায়, নাম কি, কোথায় থাকে?

ভাবির এমন প্রশ্ন আঁধারের চেহারায় হতাশ ছেয়ে গেলো।নিজের মনের চাপা কষ্ট গুলো বের হয়ে চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠছে।

আঁধারঃ আলো তার নাম আলো। বর্তমানে সে শ্বশুরবাড়িতে। ১৪ বছর হয়ে গেছে তার সাথে দেখা হয় না কথা হয় না।
আচ্ছা ভাবি আমি আসি আমার কাজ আছে।

কোনো মতে কথা কাটিয়ে চলে গেলো আঁধার। ভাবি যাওয়ার পথে চেয়ে আছে। আঁধারের মা এসে বসল।

আঁধারের মাঃ বউমা কি বলেছে আঁধার আর এইভবে তারাহুরো করে যে চলে গেলো।

আঁধারের ভাবিঃ আলো নামের এক মেয়েকে ভালোবাসে। আলো নামে কাউকে চিনেন কি মা?

আঁধারের মা চিন্তায় পড়ে গেলো। নামটা বেশ শোনা শোনা লাগছে।

আঁধারের মাঃ নাম শুনেছি কিন্তু মনে পড়ছে না।

আঁধারের ভাবিঃ ওরা একই ক্লাসে একই স্কুলে পড়তো। একটু মনে করার চেষ্টা করুন।

আঁধারের মা ঃআচ্ছা আমি ভেবে দেখছি

★★
পরেরদিন বিকালে সব কাজ শেষ করে। নিজের ভাই এর ফোনে কল দিলো।
অনেক কষ্টে করে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কিনেছি এটাই ব্যবহার করি। তাও বাবার বাড়ি থাকতে স্টুডেন্ট এর বেতনের টাকা জমিয়ে কেনা ফোন। খুব যত্ন করেই রাখছি। আমি সব কিছুই যত্ন করে রাখার চেষ্টা করি তারপরও আমার যত্নে গড়া জিনিস হারিয়ে যায়।

পরপর ২ বার কল দিলাম ব্যস্ত বলছে।জানিনা যতবার কল দেই ততবারই ব্যস্ত বলে থাকে। তাই ভাই এর বউ ফাতেমাকে কল দিলাম। মেয়েটা গর্ভবতী কেমন আছে খোজ খবর নেই।

২ বার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো।

আলোঃ আসসালামু আলাইকুম ফাতেমা।

ওইপাশেঃ আমি ফাতেমার মা বলছি। কেন কল দিয়েছো আর কি চাই। ভাই এর কাছ থেকে খালি নেওয়ার মধ্যে আছো দেওয়ার মধ্যে নাই। জামাই কতো কষ্ট করে কাজ করে। টাকা জমাচ্ছে ফাতেমার ডেলিভারির জন্য আর তুমি লোভী মেয়ে আমার মেয়ের সুখ দেখতে পারোনি তাই না।

আন্টির কথার আগামাথা বুঝতে না পেড়ে ওনাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
আলোঃআন্টি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝিয়ে বলুন।

ফাতেমার মাঃ কি বলবো। তোমার জামাইক্র যে পাঠিয়েছো টাকার জন্য। তোমার জামাই এসে বলেছে তোমার নাকি কিছু টাকা লাগবে চিকিৎসার জন্য। নিজে তোহ বাচ্চা জন্ম দিতে পারোনি আবার আমার মেয়ের বাচ্চা হবে তাই হিংসা হচ্ছে তাই না। লোভী মেয়ে হিংসুটে,অলক্ষি কোথাকার।

আরো অনেক কথা শুনিয়ে ফোন কেটে দিলো।আলোর চোখের কোনে নোনা জল জমে গেলো। তা গড়িয়ে পড়ার আগে মুছে ফেললো। বাবার মৃত্যুর জন্য আমাকে যখন দায়ি করেছিলো প্রচুর কেদেছিলাম। এরপর যখন স্কুলের যেতে পারবো না তখনও কেদেও কারো মন গলাতে পারিনি। মানুষ আমাকে সব অলক্ষি বলতো। এইসব আস্তে আস্তে সহে গিয়েছিলো। পৃথিবীতে দুইজন আমায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে এক আমার বাবা আরেকজন সে। যে আমার থেকে ১৪ বছর আগেই অনেক দূরে চলে গেছে। তার দেখা আর মেলেনি। বাবার মারা যাওয়ার পর নিজেকে এতোটাই গুটিয়ে নিয়েছিলাম যে প্রয়োজন ছাড়া কোথাও যেতাম না। মানুষ তোহ বাদই দিলাম আমার মা ও দাদী কথা শুনতে শুনতে তিক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে বাবা থাকলে হয়তো আজ আমি অনেক সুখি থাকতাম। বাবাকে আমার অবস্থার কথা বললে দৌড়ে আমায় নিতে চলে আসতো। কিন্তু নেই কেও নেই আমার। একটা ভাই যার সাথে আমার কথাই হয়না। মানুষ ঈদে বাবার বাড়ি যায়। বিয়ে হওয়ার ২ বছর হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ৫ বারও বাবার বাড়ি যেতে পারিনি। এক তোহ শশুরবাড়ি থেকে আমি চলে গেলে কাজ করবে কে আরেক হলো বাবার বাড়িতে আমি গেলে আমাকে খাওয়াতে তাদের খরচ হবে। মা আমায় কিছু বলতো না কিন্তু দাদী আর তার সাথে যোগ দেওয়া নতুন মানুষ আমার ভাই এর শাশুড়ী। আমি জানি আমার মা কখনোই সুখ পায়নি। পাবে কিভাবে প্রথমেই যে আমার জন্ম হলো কন্যা সন্তানের। সুখের আবেশ পেয়েছে আমার ভাই হওয়ার পর আমার মাকে মাথায় তুলে দিলো। এখনো হয়তো আমার জন্য মা কষ্ট পায়।

রুপা আপু আমার বরকে পছন্দ করতো তা আমি আগেই বুঝে গিয়েছি তারপরও কিছু বলিনি কারন আমার বরের মেয়ের নেশার চেয়ে টাকা ও জুয়ার নেশা আছে। জুয়া খুবই ভয়ংকর নেশা মানুষকে তচনচ করে দেয়। রুপাকে আমার বর পছন্দ করে না কারন তার বোনেদের সাথে কখনোই ভালো ব্যবহার করেনি।তাই উনি আমায় বিয়ে করে যাতে তার বোনেরা ভালোভাবে থাকতে পারে বাবার বাড়ি আসার পর। উনি নিজের বোনদের অনেক ভালোবাসে। আমায় কখনো অসম্মান করেনি কিন্তু ওইযে জুয়ার নেশা যার ফলে আজ উনি আমায় না বলে ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই জুয়ায় হেড়েছে।

রাতে
শাওন বাসায় আসে। তাকে পানি দিয়ে তার কাছে বসেছি।
আলোঃ আমার ভাই এর কাছ থেকে কত টাকা নিয়ে এসেছেন আপনি?(শান্ত গলায়)

শাওনঃ ওহ তাহলে তোমার ভাই বলেই দিয়েছে। হ্যা নিয়েছি টাকা আর তোমার জন্যই তোহ নিয়েছি। ওইযে তোমাকে উপহার দিলাম নাক ফুলটা। মনে করো তোমার ভাই এর দেওয়া উপহার। যাও গিয়ে খাবার নিয়ে আসো প্রচুর ক্ষিদে পেয়েছে।

বলেই বাথরুমে চলে গেলো শাওন। আলো চুপ হয়ে আছে। কেমন মানুষ ইনি ছি।

পরেরদিন
শাওনের মাঃ বউ আমার ব্লাউজটা সেলায় হয়েছে।

আলো কিছু না বলে ব্লাউজ তার হাতে দিয়ে দিলো। বাবার বাড়ি থেকে নিজের সেলাই মেশিনটা নিয়ে এসেছিলো। কারন ওখানে দুটো সেলাই মেশিন একটা মায়ের জন্য আরেকটা নিজের জন্য।

কয়েকঘন্টা পর
শাওন বাসায় এসে তার মায়ের রুমে গেলো।

শাওনঃ মা কি হয়েছে। ফোন করে আসতে বললা কেনো?

শাওনের মাঃ তোর বউ কি করছে জানোস।

শাওনঃ আবার কি করেছে

রুপাঃ রহমান চাচার বউ এর কাছে তোমার বউ তার সেলাই মেশিন বিক্রি করে। বাবার বাড়ি গেছে।

শাওনঃ মানে কি কেনো। আর বিক্রি করার সময় তোরা কোথায় ছিলি।

শাওনের মাঃ আমার ব্লাউজটা দিয়াই নিজেই বেচে গেছে গা একবারও বলে যায় নাই। এখন তোর বউওরে তুই কিছু বলবে।আমার তোহ দাম নাই।

রুপাঃ হ্যা অনেক হয়েছে শাওন ভাই এবার কিছু করো। বিক্রি করছে যাতে আমাদের জামা কাপর বানায় দেওয়া না লাগে।

শাওন প্রচুর রেগে আলোকে কল দিচ্ছে। কিন্ত ফোন বন্ধ।

১ ঘন্টা পর আলো এসে হাজির। এখান থেকে বাবার বাড়ি যেতে ৪০ মিনিট লাগে।
আলো কিছু না বলে নিজের রূমে পা বাড়ায়।

চলবে

( গল্পটা বাস্তব থেকে কিছুটা নেওয়া হয়েছে। আর অনেকে বলছে মেয়েরা এইসব সহ্য করে। হ্যাগো আমি নিজের চোখে দেখেছি কতো কতো মেয়ে মুখ বুঝে সহ্য করে। কারো বাবা নেই আবার কারো বাবা থেকেও মুখ বুঝে সহ্য করছে। আর আমার লেখায় কোনো ভুল হলে আমার ভুল ধরিয়ে দিবেন ধন্যবাদ)

#আঁধারের_আলো
#পর্ব_৩
#লেখাঃInsia_Ahmed_Hayat

আলো বাসা এসে নিজের রুমে চলে গেলো। গিয়ে সে অবাক রুমে শাওন বসে আছে। হয়তো তার অপেক্ষা করছে। আলো রুমের দিকে খেয়াল করে দেখলো মেঝেতে পড়ে আছে তার সব জামা কাপর।সব এলোমেলো হয়ে আছে। শাওনের দিকে একবার চেয়ে দেখলাম সে তার দিকেই চেয়ে আছে। আলো সেদিকে না তাকিয়ে জামা গুলো উঠও। জামার দিকে নজর গেলো। একি সব গুলো জামা দেখলাম। শাওনের দিকে তাকালাম। সে একটা হাসি দিয়ে বলল

শাওনঃ তুমি তোহ সেলাই ভালো পারো তাই ভাবলাম। জামা গুলো কেটে দেই তুমি না হয় সেলায় করে নতুন ডিজাইন করে নিবা। ওম তোমার সেলায় মেশিন টা যে দেখছি না।

মানুষ কতোটা খারাপ হলে এমন করতে পারে। আলোর সব জামা বের করে মাঝ দিয়ে এলোমেলো ভাবে কেটে দিয়েছে। এমনভাবেই কেটেছে যে কিভাবে জোড়া লাগাবে তাই ভাবছে।

আলোঃ আমার ভাই কাছ থেকে কতো টাকা নিয়ে এসেছেন।

শাওনঃ কেন টাকা তো দিয়েই আসলা। আর কি দরকার। কেমন ভাই তোমার বোনকে সামান্য টাকা দিতে পারে না। যাইহোক আমার কাজ আছে আমি দোকানে গেলাম।

বলে শাওন চলে গেলো। আলো জামা গুলোর দিকে চেয়ে আছে।এই জামাগুলো তার নিজের বানানো। নিজের টাকা দিয়ে বানিয়েছে৷ আর সাথে ননদ ও ননাসের দেওয়া উপহার ছিলো। বিয়ে পর এক সুতাও কিনে দেয়নি অথচ আমার সব গুলো জামা এইভাবে নষ্ট করে দিলো। আসলে জুয়াখোরদের কাছে কিছু আশা করাই বোকামি।
★★
সুই সুতা নিয়ে কাচি দিয়ে হালকা ঠিক করার চেষ্টা করছি।
★★

রাতে শাওন বাসায় আসলো। শীতের সময় বছরের শেষ। এই শীতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় ১,২ টা পর্যন্ত। সারারাত জুয়া খেলে এরপর দোকান বন্ধ করে বাসায় আসে। কেউ কিছু বলেও না।
শাওনের হাতে বাজারের ব্যাগ দেখে মনে মনে বলল
“আজও নতুন শাস্তির ব্যবস্থা করেছে হয়তো”

শাওনঃ শোনো চালে গুড়া গুলো দিয়ে পিঠা বানাতে বসো কালকে আমার বোন আর ভাগিনাদের জন্য পিঠা নিয়ে যাবো।

আলো চুপচাপ শাওনের দিকে চেয়ে আছে। এরপর খাবার দিলো। খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। আজকে ভাত নেই। রোজ রোজ ভাতের ঝামেলা ভালো লাগে না। দেখে গিয়েছিলাম ভাত আছে কিছুক্ষন আগেই রুপা এক প্লেট ভাত নিজের জন্য নিয়ে গেলো। এই মেয়ে রাত ৮ টায় একবার খেয়েছে আর ১২ টায় একবার খেয়েছে জানি না কেন এমন করলো। অন্য কেউ খাবে কি না সেদিকে খেয়াল নেই।এরপর চালে গুড়ো দিয়ে দুটি রুটি বানিয়ে খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমিও মানুষ কাজের লোকের মতো এতো কাজ করতে পারবো না। রাতে মাছ নিয়ে আসবে, চালে গুড়ো নিয়ে আসবে। আমার দিকে কোনো খেয়াল নেই কারো শুধু হুকুমের উপর চলে।

কালকে রাতে একটা গার্লস গ্রুপে নিজের মনের না বলা দুঃক্ষের কথা গুলো শেয়ার করেছিলাম ফেক আইডি দিয়ে সেখানে দেখলাম আমার মতো অনেক বোন এমন অবস্থায় মুখ বুঝে সহ্য করছে। অনেকে আমায় অনেক সাহস দিয়েছে যা বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ দেয়নি। এইভাবে এতো কাজ করতে করতে একদিন মরেই যাবো। তাই আজ সাহস করে নিজের জন্য কিছু করতে হবে। বাচ্চা হচ্ছে না এতে আমার কেন দোষ হবে কতো মানুষের দশ, বারো বছর ধরে বাচ্চা হয় না কই তারাও তোহ সংসার করছে। অনেকে বলল তাদের কারো ৬ বছর, ৮ বছর ধরে বাচ্চা হচ্ছে না কিন্তু বর সাপোর্ট দিচ্ছে। আল্লাহ না দিলে কি করার। দোয়া ছাড়া তোহ আর কোনো পথ নেই।

এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। আজ মেঝেতে ঘুমাচ্ছি।শাওনের পাশে ঘুমাতেও কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করছে।

সকালে শাওনের আগেই ঘুম থেকে উঠে কাজে লেগে গেলাম।

ঘুম থেকে উঠে শাওন চিল্লাচিল্লি করছে। আলো সেইদিকে কান না দিয়ে তার নিজের কাজ করছে। কাজ শেষ করে পিঠা বানাবে।

শাওনঃ তোমাকে না বলেছি রাতে পিঠা বানাতে। বানাওনি কেন।

আলোঃ কাজ সেরে বানাতো বসবো।( আর আমি মানুষ রোবট নই।আমারও ঘুমের প্রয়োজন আছে। নির্ঘুমে থেকে থেকে আমি এতো কাজ কেন করবো){ মনে মনে বলল}

শাওন আর কিছু বলল না চলে গেলো। এই সময় সে মুখ খারাপ করতে চাচ্ছে না। আর আজ আলোকে কেমন যে অন্যরকম লাগছে।

কাজ শেষ করে আলো রুপাকে ডাকছে।

আলোঃ রুপা ও রুপা এদিকে আসো।

রুপাঃ কি হয়েছে এতো ডাকাডাকি করছেন কেন?

আলোঃ বড় আপু আর ছোট আপুর বাড়িতে পিঠা পাঠাবো তাই আমার সাথে পিঠা বানাতে বসো।

রুপাঃ আমি পিঠা বানাবো কেন। আপনার ননাস, ননদ আপনি বানান। আমি পিঠা বানাতে পারিনা।

” তোহ কি পারেন বসে বসে অন্যের ঘরে খেতে পারেন। আর মানুষকে অর্ডার দিতে পারেন আর কূটনামি করতে পারেন তাই না।” (কেউ একজন বলল।)

আলোঃ সূচি আপু আপনি। এমা বললেন না যে আসবেন। ওনি(শাওন) গিয়ে নিয়ে আসতো। আসতে কি কোনো অসুবিধা হয়নি তো।

সূচিঃ না ভাবি। বড় আপাও আসছে ভাবি। ওইদিন তোহ চলে গিয়েছিলাম তাই আজ আসলাম শীতে বাচ্চারা নানীবাড়িতে আসবে বায়না ধরলো।

আলোঃ মা দেখে যান ছোট আপু এসেছে।(জোড়ে)
আলো খুশি হয়ে সূচির মালামাল ঘরে নিয়ে গেলো। রুপে মুখ বাকা করে ঘরে চলে গেল। এই সূচি আর সাথীর সাথে সে কথায় পারবে না তাই কথা বাড়ায় না।

শাওনের মাঃ কিগো মা আইসো তুমি। আসো। দেও আমার নাতীটারে দেও।

সূচি আপুর ১ বছরের ছেলেকে কোলে নিলো আর ৫ বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে ভেতরে গেলো।

শাওনের মাঃ আলো সূচিরে সরবত দেও। কতো দূর থেকে আইসে।
কিরে মা জামাই বাবু আসলো না। আর না কইয়া যে আইসো। আমারে ফোন দিলা না। কত কষ্ট কইরা আইসো শাওনের বাপেরে পাঠাইতাম হেয় নিয়া আইতো। তো বিয়ান সাব আর বিহাই সাব ভালো আছেনি।

সূচিঃ উনি(বর) ব্যস্ত মা তাই আসে নাই। আর সবাই ভালো। আচ্ছা বড় ভাই কোথায়।

আলো সরবত দিতে দিতে বলল
আলোঃ উনি আসতেছে দোকান বন্ধ করে। আর আপনি একা আসছে কিভাবে। কখন রওনা দিয়েছেন।

সূচিঃ আমার ভাসুর আর শ্বশুর মিলে আমাকে আর ভাবিকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছে। আমার জাও তার বাবার বাড়ি গিয়েছে আমিও আসলাম। যাক আমার বড় ব্যাগ টা দেও তোহ ভাবি।

সূচি তার ব্যাগ থেকে অনেক কিছু বের করলো। এরমাঝে শাওন এসে হাজির।
রুপাও কান পেতে ওদের সবার কথা শুনছে।

শাওনঃ তুই আসবি বললি না কেন। আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম হলে।

সূচিঃ তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে চলে আসছি।আচ্ছা সবার জন্য শীতে পিঠা নিয়ে এসেছি। সব ধরনের পিঠা বানিয়েছি কালকে।

শাওনের মাঃ সব গুলা তুই একলা বানাইছোত। এতো কষ্ট করলি কেন। তোর ভাই কালকে চালের গুড়া নিয়ে আসছে। বউরে কইছে রাতে বানাইতে বানায় নাই।(চোখ রাঙিয়ে আলোর দিকে তাকাল)
আলো চুপ করে আছে। সুচি সেই দিকে কান না দিয়ে। আলোকে বলল
লেখনিতেঃInsia Ahmed Hayat

সূচিঃ আলো ভাবি আমার জা আপনার জন্য পাটিসাপটা পিঠা বানিয়েছে।আপনার খুব পছন্দ তাই। গতবার আপনি তার পছন্দের আর আমার ননদের পছন্দের চিতই পিঠা ও দুধ চিতই পিঠা বানিয়ে পাঠিয়েছেন না৷ তারা যে কি খুশি তাই এইবার ননদ আর আমরা দুই জা মিলে পিঠা বানালাম। শাশুড়ী তোহ আমাদের জোড় দিয়ে বলল আপনার জন্য এইবার নিয়ে যেতেই হবে। খেয়ে দেখুন তোহ। এই সব পাটিসাপটা পিঠা আপনার।

বলেই হাতে পিঠা বক্সটা এগিয়ে দিলো। সবাই যেনো হালকা রাগী ভাব নিয়েই আছে। আলো হাসি মুখে বক্স নিয়ে নিলো। খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সবাই চেহারা দেখে খেলো না।

আলোঃ পরে খাবো আপু। আপনি এখন রেস্ট নিন।

আলো সব কিছু গুছিয়ে রান্না ঘরে গেলো কিছুক্ষন পর বড় আপু চলে আসবে। আজ তাদের জন্য গরুর মাংস রান্না করবে আলো। গতবার তোহ খেতে পারলো না এভার ভালো করে রান্না করবে।

রান্না বান্না শেষ করলো। বড় আপাও চলে আসছে। গরুর মাংস রান্না করে শাশুড়ী আর শাওনকে হালকা টেস্ট করে লবন চেক করালো। সে এবার বলল যদি লবন / মরিচ বেশি হয়ে যায় তাহলে বুঝে নিতে যে অন্য কেউ করেছে।

সাথী আপু ও তার দুই মেয়েও চলে এসেছে।
সবাই খাবার টেবিলে বসেছে। সাথী আপু রান্না করে নিয়ে এসেছে। উনি কাবাব আর পায়েশ বানিয়ে বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। সবাই খাবার খাবে আলোকে তার শ্বশুর আর ননাস আর ননদ জোর করে বসিয়েছে। এতোদিন সবার শেষ এ খেতো কিন্তু আপুরা আসলে এক সাথে খায়। আলোকে নিজের বোনের মতো মনে করেন। ভাগ্য একটু হলেও ভালো তাই এমন বোনের মতো ননদ ননাস পেয়েছে। তারা সব সময় আলোর সাথে ভালো ব্যবহার করে। শুরুতে শাশুড়ীও ভালো ব্যবহার করতো কিন্তু বাচ্চা না হওয়ায় আর পাশের বাড়ির চাচীরা তাদের বউদের কথা বলে বলে এক সময় আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের পাত্রী বানিয়ে দিলো।সাথে রুপা তোহ আছে। বিয়ে পর থেকে এখানেই পড়ে আছে। ঈদের সময় ২ দিন নিজের বাড়ি থেকে দৌড়ে চলে আসে। আমার বর তাকে পাত্তা দেয় না তারপরও আমাদের পেছনে পড়ে আছে।

আপুরা ১০ দিন থেকে চলে গেলো।

অন্যদিকে

আঁধার এর রুমে ওর বড় বোন, মা,ভাবি বসে আছে। আঁধার চুপ করে আছে।

আঁধারের বোনঃ আমি সবাইকে সবটা বলে দিয়েছি আঁধার। আমি তোমকে আর এভাবে দেখতে পারছি না। ওই মেয়ে তোমাকে ছেড়ে অন্য কারো হয়ে গিয়েছে তুমি কেনো তার জন্য অপেক্ষা করছো।
সে তোহ ফিরবে না। সে তার স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

আঁধারঃ আপু ভালোবাসলে যে মিল হবে এমন তো নয়। আমাদের না হয় অমিলই থাক। আমরা ওর সাথে আমার শেষ দেখে ১৪ বছর আগে। যেদিন আমরা ওই এলাকা ছেড়ে এইখানে এসেছিলাম। এই ১৪ বছরে তার কথা আমি মূহুর্তে মূহুর্তে মনে করি তার হাসি৷ তার কথা সব। সে আমায় বদলে দিয়েছিলো আমার পাশে ছিলো। কিভাবে আমি তাকে ভুলতে পারি। আমাকে ভুলে যাওয়ার কথা বলো না প্লিজ। ১৪ বছরে অনেক চেষ্টা করেও তার দেখা পাইনি। তারপরও আমি তার জন্য অপেক্ষা করবো। কারন সে বলেছিলো। সে শুধু আঁধারের_আলো।

বলে ছাদে চলে গেলো।

★★
আঁধারের মাঃ আয়েশা(আধারের বোন) একবার আমাকে সব বলতা।

আয়েশাঃ কি বলতাম। আমি নিজেও জানতাম না তোমরা তো জানো আঁধার সহজে কাউকে কিছু বলতে চায় না। আর আমি আলোকে চিনি তাই আমাকে নিয়ে ওদের বাসায় গিয়েছিলো ৭ বছর আগে। অনেক চেষ্টা করেছে আলোর সাথে দেখা করার কথা বলার।কিন্তু আলো প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতো না। তার উপর ওর দাদী দেখা করতে দিতো না। আমি আর আধার বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ায় বলেছে আঁধারের চাকরি নাই বয়স কম। দিবে না বিয়ে। আঁধার ৩,৪ বছরের সময় চেয়েছিলো সে কিছু না কিছু করবে কিন্ত কে জানতো ওর বিয়ে হয়ে যাবে। আমি অনেক খোজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। এখান থেকে অনেক দূরে হওয়ায় যেতেও সময় লাগে মা।আর আঁধার বলেছে ও তোমাদেরকে বলবে তাই আমি এতো বছর চুপ ছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম সেদিন আলোর কথা জিজ্ঞেস করায় বুঝতে পারলাম।

আঁধারের ভাবিঃ মা আপনারা কি আলো কে চেনেন কেমন দেখতে।

আঁধারের মাঃ হ্যা বউ মা চিনি ২০ বছর আগে আমি আর তোমার বাবা আমার তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে ওখানে আলোদের বাড়ি পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। তোমার বাবা কাজ করতো সেখানে। আর সেখানে আধারের সাথে পড় এক মেয়ে নাম তার আলো। একই স্কুলে একই ক্লাসে। আলোর সাথে দেখা হওয়ার পর আঁধার সারাদিন আমার সাথে আলোর কথাই বলতো।একটা কাহিনি এখনো আমার মনে আছে আলো ওকে বাচিয়েছে। ও নাকি রাস্তায় সবার সামনে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলো আশেপাশের বাচ্চারা হাসাহাসিতে আঁধার এর সেকি কান্না পাচ্ছিলো হঠাৎ নাকি একটা মেয়ে তার পাশে মাটিতে বসে পড়ে নিজের ড্রেসে হালকা কাদা মেখে তার দেখে আশেপাশের বাচ্চারা হাসি বন্ধ করে চলে যায়। এরপর আঁধারকে বাসায় দিয়ে নিজের বাসায় চলে যায়। আঁধার তখন থেকেই যখনই আলোকে দেখতো দৌড়ে ওর কাছে চলে যেতো। এই কাহিনি আধার আমাকে অনেক বার বলতো।

এইসব বলছে আর আধারের মায়ের চোখ ছলছল করছে। নিজের ছেলের মনের কথা বুঝতে পারেনি। ৫ বছর ওখানে থেকে এরপর ওর বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে এখানে আসে ১৪ বছর হয়ে গেলো। আর এই ১৪ বছর আঁধার কতো শত বাহানা করে ওই এলাকায় গিয়েছে। আজ বুঝতে পারলো কেন গিয়েছে।

এভাবে অনেকদিন কেটে যায়। আলোর ভাই এর বউরে বাচ্চা হওয়ার সময় চলে এলো।

একদিন সকালে শাওন আলোকে বলছে

শাওনঃ আলো দোকানের মাল উঠাবো তোমার ভাই এর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা চাও তোহ।

আলোঃ কি বলেন আমার ভাই কোথা থেকে টাকা দিবে। আর কয়দিন পর ওর বউ এর ডেলিভারি আপনি জানেন না।

শাওনঃ হ্যা আমি কিছু চাইলেই এই সমস্যা সেই সমস্যা। আর বিয়ের সময়ও তোহ কিছু দেয় নাই। আমি আহামরি কি চেয়েছি যে দিতে পারবে না। আমাকে ধার দিতে বলো আমি ফেরত দিয়ে দিবো।

আলোঃ দেখুন এটা সম্ভব না এর আগেও আপনি আমায় না বলে ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসেছেন। আমি পারবো না।

শাওন হালকা রেগে গেলো।
শাওনঃ শোনো নিজের কাপর চোপড় রেডি করো আমি তোমায় গাড়িতে উঠিয়ে দিবো। টাকা নিয়ে আসতে পারলে আসবা না পারলে আসার দরকার নেই। এমনিতেও তুমি কোনো কাজেরই না আমি আমাদের বিয়ের এতো দিন হয়ে গেছে বাবা হতে পারলাম না। আমি দোকানে যাচ্ছি এসে যেনো তোমার মুখ না দেখা লাগে। বলেই চলে গেলো।

আলো সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

দুপুরে শাওন খাবার খেতে এসে দেখে আলো নেই। সারাবাড়ি খুজেও আলোকে পেলো না। ওর মাও বলল আলো নাকি চলে গেছে। এর মানে সত্যি চলে গেছে। যখন গিয়েছে টাকা নিয়েই আসবে। তাই সে মাথা ঘামালোনা।

বাবার বাড়ির দরজার দাড়িয়ে আছে আলো। আলোকে এভাবে এতো বড় ব্যাগের সাথে দেখে সবাই অবাক হয়ে চেয়ে আছে। আলোর দাদী বিরক্ত নিয়ে বসে আছে। হুট করে আলোর আসায় সবাই অবাক।

চলবে

আঁধারের আলো পর্ব-০১

0

#আঁধারের_আলো
#পর্ব_১
#লেখাঃInsia_Ahmed_Hayat

রাত ১ টা বাজে বর আট কেজি মাছের ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাটতে বলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলে। আমি তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছি। একটা মানুষ এতোটা নির্দয় কিভাবে হতে পারে । মাছ গুলো নিয়ে রান্না ঘরে রেখে তার জন্য খাবার বেড়ে রুমে নিয়ে গেলাম। খাবার তার সামনে রেখে চলে আসছিলাম পেছন থেকেই তার ডাক।

“আলো কালকে সকালে আমি মাছ ভাজা খাবো তাই মাছ গুলো যেনো এখনই কেটে রাখো। আর হ্যা কালকে সকালেই যেনো আমি মাছ পাই”

“জিই” বলে বের হয়ে গেলাম। বাবা মা সখ করে নাম রেখেছিলো আলো।কিন্তু জীবনে আলোই আসলো না। অন্ধকার আর অন্ধকার দেখতে পাই।

পানির গ্লাস নিয়ে আমার বর শাওনের সামনে দাড়িয়ে আছি উনি ওনার মতোই খেয়ে যাচ্ছে। একটা বার জিজ্ঞেস করলো না যে আলো তুমি কি খেয়েছো। আমিও না কার কাছ থেকেই বা কি আশা করে। বিয়ে দেড় বছর হয়ে গিয়েছে আর আমি মা হতে পারিনি এরচেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে। তাকে একটা বাচ্চা দিতে পারিনি তাই আজ আমার এই দশা।

শাওন খাবার শেষ করে শুয়ে পড়লো আমি সব গুছিয়ে লাইট অফ করে রান্না ঘরের দিকে গেলাম। এই বাড়ির নিয়ম বরের আগে স্ত্রী খাবার খেতে পারবে না তাই রোজ শাওনের জন্য রাত ১,২ পর্যন্ত অপেক্ষা করি। বাবা নামক ছায়াটা নেই তাই আমার এই অবস্থা।

পাতিলে অল্প ভাত ছিল তাই খেয়ে মাছ কাটতে বসলাম। মাছের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে মাছকে বললাম

আলোঃ মাছ আজ না আসলেও পারতি আজও আমায় ঘুমানো যাবে না। জানিস তোহ আমি মাছ কাটতে পারিনা তারপরও অল্প শিখেছি আর কাটতে দেড়ি হয়। এই জিনিসটা শাওন জেনেও নিয়ে এসেছে। কি আর করার তোকে এখন আমার কাটতে হবে।

মাছ কাটতে কাটতে নিজের কথাগুলো বলে ফেলি। আমি আলো ইসলাম। আমাদের পরিবারে আমরা ৫ জন সদস্যই ছিলাম আমি আম্মু আব্বু আর ছোট ভাই আর আমার দাদী। আমার ভাই আমার থেকে দুই বছরের ছোট ছিলো। আমার আব্বু প্রবাসী ছিলো।
তখন আমি ক্লাস 6 এ পড়ি আব্বু একেবারের জন্য এসে পড়ে। দিনকাল ভালো যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ কি যে হলো আমাদের জীবন একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল আব্বু রোড এক্সিডেন্ট এ মারা গেলো।আর আমরা এতিম হয়ে গেলাম কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। আত্নীয় স্বজনও আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো শেষ ফলে আমার মা ও দাদী মিলে সিদ্ধান্ত নিলো আমাকে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে লাগতে হবে। কি আর করার ক্লাস 8 এ আমার পড়াশোনার অবসান ঘটে কিন্তু আমার ভাই পড়াশোনা করছে। করবেই না কেনো বংশের একমাত্র ছেলে লেখাপড়া না করলে কি হয়। মায়ের কাছ থেকে সেলাই কাজ শিখে তা দিয়ে শুরু করলাম আর আশেপাশের বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়িয়েই চলতো আমাদের জীবন। (আমার মায়ের কোমরে ব্যথা থাকতো তাই উনি সেলাই করতো না)। আমার মা মাঝে মাঝে বাবার বাড়ি থেকে কিছু সাহায্য পেতো হঠাৎ তাও বন্ধ হয়ে গেলো। মামা আর সাহায্য করতে পারবে না সাফ সাফ জানিয়ে দিলো।

ছোট থেকেই আমার দাদী আমায় দেখতে পারতো না কারন মেয়ে হয়ে জন্মেছি তাই। আমার দাদীর সাথে মাও তেমন হয়ে গিয়েছে। সারাদিন সেলাই, আর টিউশনি করে,সাথে বাসায় সব কাজ আর রান্নাবান্না আমায়ই করতে হতো।

হয়তো এইসবের কারনেই সংসার জীবনে কাজের জন্য কথা কম শুনতে হয়েছে।আমার জীবনের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নিয়েছে।আর সিদ্ধান্ত সব সময়ের মতো ভুল ছিলো। আমি কি চাই তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। হয়তো সবাই আমাকে মানুষ কম রোবট বেশি ভাবতো।

আমার বয়স যখন ২৪ তখন আমার বিয়ে হয় শাওনের সাথে। বিয়ে নিয়েও কতোশত কথা। কেউ আমায় বিয়ে করতে চাইনি।আমার নাকি দোষ আছে আমি নাকি ভালো না তাই তোহ বড় বোন রেখে ছোট ভাই বিয়ে করে ফেলেছে।

এমন অনেক কথা শুনেই যাচ্ছিলাম। আমার পরিবার আমায় বিয়ে দেয়নি কারন আমি তাদের প্রয়োজন ছিলাম।যখনই দেখলো তাদের ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে পড়াশোনার পাশাপাশি একটা কাজ করছে। তখন আমায় ব্যবহার করা টিস্যুর ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।

———————————————————-
আমার ছোট ভাই আকরামের যখন ২১ বছর বয়স হঠাৎ করেই সে এক মেয়েকে নিয়ে হাজির। বাসায় এসে বলল সে বিয়ে করেছে। তখন আমি ২৩ বছরে পা দিয়েছি। আমি হাসি মুখে ছোট ভাইয়ের বউকে বরন করে নিয়েছিলাম। তারজন্যও আমায় কথা শুনতে হয়েছিলো। আমি কখনো কোনো কিছুর প্রতিবাদ করিনি। আর করার প্রয়োজনও পরেনি কারন এইসব আস্তে আস্তে সয়ে গিয়েছিলো।

এভাবে হুট করে আকরামের বিয়ের কারনে সমাজ ও পরিবারের কাছে আমি হাসিত পাত্র আর বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম। যে যেভাবে পেড়েছে আমায় মেশিনের মতো ব্যবহার করেছে।

ঠিক এক বছর পর আকরামের শাশুড়ী আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আনে।মা আর দাদী না দেখেই রাজি হয়ে যায়। হবেই না কেন বাড়ি থেকে যত তারাতারি সম্ভব বিদায় করতে পারলেই হলো। আমি তখনো চুপ ছিলাম। অত:পর শাওনের সাথে আমার বিয়েটা হয়েই গেলো। বিয়ের পর জানলাম শাওন মুদির দোকানদার। ইনকাম ভালোই কিন্তু তার জুয়ার নেশা আছে। তার জন্য সে রোজ রাতে দেরি করে বাসায় ফিরতো।

———————————————————-
মাছ কাটতে কাটতে ভোর হয়ে গেলো।আজান দিচ্ছে আজও ঘুমাতে পারলাম না। মাছ গুলো নিয়ে ধুয়ে রেখে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
নিজের রুমের কাছে এসে চুপ করে তাকিয়ে রইলাম।
আমার রুম থেকে আমার বরের খালাতো বোন রুপা বের হয়ে আমাকে দেখে অবাক।

রুপাঃ আব ভাবি আমি আসলে আপনাকে খুজছিলাম। আপনি কোথায় ছিলেন।

আলোঃ রান্না ঘরে ছিলাম(শান্ত ভাবে) তোহ আজ কি নিতে এসেছেন।ফোনের চার্জার নাকি চিরুনি নাকি টর্চ লাইট।

রুপাঃ আসলে আমার না চা খেতে ইচ্ছে করছিলো তাই আপনার কাছে আসলাম এক কাপ চা বানিয়ে দিতেন তাই।

আলোঃ আচ্ছা ঠিক আছে আপনি জান আমি আসছি।

রুপাঃ না ভাবি থাক আমার লাগবে না। এখন আর ইচ্ছে নেই।

বলে দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আমি তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছি। এটা নতুন কিছু নয়। পড়াশোনার জন্য শাওনের খালাতো বোন ওদের সাথেই থেকে ভার্সিটিতে পড়ছে। রোজ রোজ রাত বিরাতে আমাদের রুমে এসে পড়া তার রুটিন্ হয়ে গেছে। এই বিষয় এ আমার বর ও শ্বশুরশাশুড়ীকে বলায় অনেক কথা শুনতে হয়েছিলো। এরপর থেকে কিছু বলিনা কাউকে। রাত বিরাতে রুপাকে চা, নুডলস বানিয়ে দিতে হবেই। কারন সে বাড়ির অতিথি আর অতিথিকে আপ্যায়ন করতে হয়।কথাটা অবশ্য আমার বর বলেছে।

———————————————————-
রুমে এসে বসেছি ৫ মিনিট হলো প্রচুর ঘুম পাচ্ছে কিন্তু ঘুমানো যাবে না। এই বাড়ির নিয়ম হলো বউ মানুষেরা বেশি ঘুমান না। অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়ে। তাই নামাজ পড়ে। ঘর হালকা ঘুছিয়ে উঠান ঝারু দিয়ে রান্না ঘরে আসলাম।

ফ্রিজে এখনো গরুর মাংসের পাতিলটা পড়ে আছে। আমি খুব ভালোই রান্না করি আমার রান্নার অনেক প্রশংসাও পেয়েছি। অবশ্য আমার বড় ননাস সাথী আর ছোট ননদ সূচি আমার হাতের গরুর মাংস অনেক পছন্দ করে। আমার বর তার বোনদের অনেক ভালোবাসে। গতকাল তারা বেরাতে এসে বাসায় রাগারাগি আর কথা কাটাকাটি করে চলে যায়। এর জন্য আমিই দায়ি।কারন সব সময়ের মতো এবারও তাদের জন্য আমার বর বাজার থেকে মাংস কিনে নিয়ে এসেছে আর আমি তা রান্না করেছিলাম।কিন্তু খাবার টেবিলে বসে সবাই খাবার মুখে নিয়ে থু থু করছিলো।
কিন্তু আপুরা একটা টু শব্দও করেনি। তারা আমার দিকে শুধু চেয়েছিলো।

তখন শাশুড়ী বলেছিলো।
” এইগুলো তুমি ইচ্ছা কইরা করছো না।যাতে আমার মাইয়ারা খাইতে না পারে। এতো হিংসা পেটে নিয়া থাকো কেমনে”

সাথিঃআহা মা ছাড়ো না। এতোদিন ধরে খাচ্ছি কই কখনো তোহ এমন হয়নি আজ প্রথম হয়েছে তাতে কি।

সূচিঃ হ্যা মা বাদ দেও।ভাবির হাতের রান্না কতোবার খেলাম কখনো তোহ লবন,মরিচের কম বেশি হয়নি। আজ হয়তো ভুল করে হয়েছে। নয়তো কেউ করেছে(রুপার দিকে চেয়ে কথাটা বলল)

শাশুড়ীঃনে এইবার তোহ খুশি আমার মাইয়া গুলোরে দেখতে পারোস না তাই মাংসে লবন বেশি দিছস তাই না।

আলোঃনা মা আমি সব ঠিকঠাকই দেখেছিলাম। তারপরও কিভাবে যে লবন বেশি হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না।

শাশুড়ীঃহ্যা তা বুঝবা কেমনে লব্ধি ন তোহ অন্য কেউ মিশায় দিছে তাই না। কতোবার কইছিলাম শাওনরে এমন ফকিন্নি বাড়িতে বিয়ে করিছননা। কিন্ত আমার কথা শুনোস নাই বাপ পোলা মিল্লা বলস মাইয়া ভালো।

সাথিঃআহা মা বাদ দেও না। আলো মাংসে আলু আর টমেটো দিয়ে জ্বাল করো দেখবা লবন কমে যাবে।

আলোঃঠিক আছে আপু।

শাশুড়ী আমার রাগে ফুসতে ফুসতে চলে গেলো।সাথে শ্বশুরও।শাওন চুপচাপ আমার দিকে চেয়ে আছে।

রুপাঃএইবার তোহ খুশি হয়েছেন ভাবি। শাওন কি বিয়ে করছো ঘরে অশান্তি ছাড়া কিছুই পারে না। বাপের বাড়ি থেকে কি কিছু শিখে আসেন নাই।

সুচিঃরুপা তুই এইসব কথা কেনো বলছিস। তুই কি পারিস।অন্যের সংসারে দখল দিতে আসবি না।(রেগে)

এইনার দুইবোন আর রুপার মাঝে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আপুরা চলে যায়। আর আমি সেখানেই নির্বাক হিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শাওন চুপচাপ উঠে চলে গেলো আর ফিরলো রাতে। আমি জানতাম আজকে কাহিনির জন্য শাস্তি হিসেবে আমায় নির্ঘুম থাকতে হবে। শাওন কখনো আমার গায়ে হাত তোলেনি কিন্তু মানসিক ভাবে অত্যাচার করতে ভালোই জানে। জানিনা কিভাবে এবার লবন বেশি হয়েছিলো।

চুলায় ভাত বসিয়ে আরেক চুলায় মাছ ভাজতেছি। কিছুক্ষন পর আমার শাশুড়ী এসে হাজির।

শাশুড়ীঃতুমি গোসল না করে আমার রান্ধন ঘরে আসছো কেন। দ
এই খাওন আমরা খামু না।

আলোঃচিন্তা করার কিছু নেই মা৷ সারারাত মাছ কেটে আজানের সময় রুমে গিয়েছি।ঘুমাইনি তাই গোছল করার প্রয়োজন নেই।(বলেই নিজের কাজে মন দিলাম)

শাশুড়ী কিছু না বলে চলে গেলো। সারাদিন কাজ করে যখন দুপুরে নিজের রুমে একটু শুয়েছি। ওমনি রুপা এসে হাজির।

রুপাঃ ভাবি আমার মোগলাই পরটা খেতে ইচ্ছে করছে উঠে বানায় দেও।
আমি একবার রুপার দিকে তাকালাম।এই মেয়েটা জানে আমি সারারাত ঘুমাইনি।তারপরও আমায় কাজের হুকুম দিতে দৌড়ে চলে আসলো। এরপর উঠে গিয়ে মোগলাই বানাতে গেলাম। এইসব বলার মতো কেউ নেই। সাথি আর সুচি আপু বাসায় আসলে আরাম পাই। তারা খুবই ভালো।

এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো।

একদিন রাতে শাওনকে বলল

আলোঃশুনুন আমাদের বাচ্চা হচ্ছে না একবার ডাক্তার দেখালে ভালো হয়। অনেক তোহ কবিরাজের কাছে দৌড়ালাম।

শাওনঃ শোনো ডাক্তার এর কাছে তুমি যাও। কারন সমস্যা তোমার আমার না। এক মাস সময় দিচ্ছে আমায় বাচ্চা দিতে না পারলে তোমায় আমি ডিভোর্স দিবো।

বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। বাচ্চা না হওয়ার জন্য কতো কথা শুনতে যে হলো। আচ্ছা বাচ্চা না হওয়া কি শুধু মেয়েদেরই দোষ ছেলেদের কি কোনো দোষ নেই।

অন্যদিকে
১ বছর হয়ে গেলো আধার দেশে এসেছে।
সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করবে না। আঁধারের মা অনেক চেষ্টা করে ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারেনি। ছেলে বিয়ে না করার কারন মা হয়েও বুঝতে পারছে না।

আঁধারের মাঃ আঁধার বাবা আমি তোমার মা হয়েও বুঝতে পারছি না। তুমি কেন বিয়ে করবা না।

আঁধার তার মায়ের দিকে চেয়ে আছে।
আঁধারঃমা আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি না। আর আমি আর বিদেশ যাবো না। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত আমি যা করার দেশে থেকেই করবো। আর বার বার আমায় এক প্রশ্ন করবা না।

আঁধার চলে গেলো।
” আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম আলো। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। তুমি যে এই আঁধারের_আলো। তোমায় ছাড়া আমার জীবন আঁধার রয়ে গেছে। তুমি এসেই আলোকিত করে দিবে সেই অপেক্ষা আছি।”

৪ বছর বিদেশে থেকে টাকা কামিয়ে দেশে যখন শুনলো আলোর বিয়ে হয়েগিয়েছে। তখন অনেক ভেঙে পড়েছিলো আঁধার।

ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলো। হয়তো তাদের আলাদা হওয়ারই ছিলো।

______________________________
আলোর শাশুড়ীঃ শাওন ও শাওন এদিকে আয় দেখে যা তোর বউ কি করছে। ওই রুপা, শাওনের বাপ কই তুমি দেইখা যাও কি করছে গো।(চিল্লাচিল্লি করে)

সবাই চিল্লাচিল্লি আওয়াজে দৌড়ে এসে অভাক হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে।

প্রিয় অভিমান পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

1

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|অন্তিম পর্ব|
|প্রথম অংশ|

ফালাক ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে। লাস্ট কয়েক মাস যাবৎ সাইকিয়াট্রিস্টের আন্ডারে আছে। কিছু মানসিক সমস্যায় ভুগছে। ও দৃষ্টি নত করে শান্ত ভঙ্গিতে ডাক্তারের বিপরীত চেয়ারে বসে আছে। ডাক্তার নাকের ডগায় চশমা রেখে রিপোর্ট দেখছে। ওর পাশে সোহান চিন্তিত ভঙ্গিতে ডাক্তারের দিকে চেয়ে আছে। অপর দিকে ফালাক ভাবলেশহীন। ডাক্তার চশমা খুলে রিপোর্ট থেকে চোখ সরিয়ে ওদের দিকে তাকাল। সোহান নড়েচড়ে বসল। অতি আগ্রহের সহিত অপেক্ষা করছে ডাক্তার কি বলে শোনার জন্য।

ডাক্তার হাসিমুখে বলল,
“মাশাল্লাহ। অনেক ইম্প্রুভ করেছো ফালাক। একদম সুস্থ হয়ে গেছো। আর কিছু মেডিসিন নিবে পাশাপাশি ইন্সট্রাকশনগুলো মেনে চলবে একদম ফিট হয়ে যাবে। আমি নতুন মেডিসিন লিখে দিচ্ছি।”
ডাক্তার মেডিসিন লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সোহান ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক একি রকম আছে।

ফালাক হেঁটে চলেছে সোহান ওর পেছনে পেছনে হাঁটছে। হাতের প্রেসক্রিপশন দেখছে।
“আরে ভাই আমার সুস্থ হয়ে গেছিস তুই।”

ফালাক গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তাতে কি? আবার অসুস্থ হয়ে পড়ব। যতদিন রুহানিকে খুঁজে না পাচ্ছি সুস্থ আমি হবো না।”

ফালাকের কথা শুনে সোহানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। হটাৎ করেই বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল।

.

রুহানি হসপিটালের বেডে নিস্তেজ দেহে লেপ্টে আছে। চোখের নিচে মোটা করে কালি পড়েছে। সামনে কিছু চুল এঁকেবেঁকে পড়ে আছে। চোখ জোড়া বন্ধ। মুখ জুড়ে বিষন্নতা ঘিরে আছে। অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। ভেজা পাপড়িগুলো শুকিয়ে এসেছে। রুহানি ধীরে ধীরে চোখ মেলল। জানালার সাদা পর্দা গুলো উড়ছে। ওর চোখজোড়া কাউকে খুঁজছে।

শুকনো কন্ঠে ডাকল,
“আন্টি! আন্টি!”

মাঝ বয়সী এক ভদ্রমহিলা দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। তারপর রুহানির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কি মা? কিছু লাগবে তোমার?”

রুহানি আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ। অনেক তো করলে আমার জন্য। আরেকটু করবে?”

“হ্যাঁ বলো মা কি করতে হবে?”

“সেটা পরে বলছি। আগে আমার মোবাইলটা দেও। একটা কল করতে হবে।”

মধ্যবয়সী মহিলা ব্যাগ থেকে ওর ফোন বের করে দিল। রুহানি ডান হাত ধীরে ধীরে তুলে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল। তারপর অনেকটা সময় লাগিয়ে একটা নাম্বার তুলল।

নুশার সামনে এনগেজমেন্ট। কাজিনের সাথে শপিংয়ে ব্যস্ত। এরি মাঝে ফোন বেজে উঠল। হাতের ব্যাগগুলো কাজিনের হাতে দিয়ে ফোন রিসিভ করল। ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার পরেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। নুশা আবারো হ্যালো বলল। কিন্তু কেউ জবাব দিচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে নাম্বারের দিকে তাকাল। কানে নিয়ে স্পষ্ট কারো নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই শীতল একটা কন্ঠস্বর বলল,
“নুশা,আমি রুহানি।”

নুশা যেন হটাৎ করেই সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলল। কথা বলতে পারছে না। এই একটা কন্ঠস্বর শোনার জন্য কতগুলো মাস অপেক্ষা করেছে। আজ সেই কাঙ্খিত ফোনকল এসেছে। ওর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। নুশা মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ওর কাজিন ওকে এভাবে বসে পড়তে আর কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গেল।
“রুহানি তুই কোথায় আছিস? কেমন আছিস? কোথায় ছিলি এতদিন?”

“সব বলছি। আগে কান্না থামা। সবার কি খবর?”

নুশা অভিমান নিয়ে বলল,
“যেমন রেখে গিয়েছিস। তুই এমন একটা কাজ কি করে করলি রুহানি? আমি তোর বন্ধু আমাকেও তুই তোর সমস্যাগুলো শেয়ার করিস নি। কেন বলিস নি? আংকেল আন্টি আমাকে দেখলেই কাঁদে তাই এখন আর যাইনা তাদের খোঁজ নিতে। যেমনই হোক,যাই হোক বাবা-মা তো। তাদের তো জ্বলবেই। তুই চলে যাওয়ার পর ফালাক ভাই একাই কেসটা লড়েছে। তদন্তে অনেক কিছু বেড়িয়ে এসেছে। তোর মামা যে মেইন কালপিট সেটা প্রমাণ হয়েছে। তার জেল জরিমানা হয়। আর এতে করে তোদের কোম্পানি মানে আংকেল বড় এমাউন্টের ক্ষতিপূরণ পায় তোর মামার কাছ থেকে। সে টাকা দিয়ে ব্যবসাটা নতুন করে দাঁড় করিয়েছে। বাড়ি কিনেছে। উনারা ফালাক ভাইয়ার কাছে মাফও চেয়েছে। ভাইয়া কি করবে বড়রা মাফ চাইলে তো ফিরিয়ে দিতে পারেন না তাই মাফ করে দিয়েছে। জানিনা মন থেকে করেছে কি-না তবে সব কিছুই আগের মতো হয়ে গেছে শুধু তুই নেই।”

রুহানি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“ফালাক কেমন আছে?”

ফালাকের কথা শুনে নুশা চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“দুদিন আগে ফোন করেছিলাম শুনলাম এখন ভালো আছেন। কিন্তু মাঝখানে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। খুব পাগলামি করতো। অনেক ট্রিটমেন্ট করেছেন। লাস্ট কয়েক মাস যাবৎ সাইকিয়াট্রিস্টের অধীনে আছেন। শুনলাম আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ।”

রুহানি চোখের পানি মুছে নিল। তারপর নিজেকে শক্ত করার জন্য, মনটা অন্য দিকে ঘোরানোর জন্য বলল,
“রুহান কি করছে আজকাল?”

“ও পড়াশোনা করছে। আন্টি বিজনেস দেখছেন আর আংকেলের অবস্থা তো জানিসই। তবে তারও উন্নত চিকিৎসা চলছে।”

রুহানির সব শুনে ভালো লাগল। ওর মামার উচিত বিচার হয়েছে। শুধু মাঝখান থেকে ওদের এতকিছু সহ্য করতে হলো। আজ এই দিন দেখতে হলো।

রুহানির রনকের কথা মনে পড়ল।
“এই শোন রনকের কি খবর? কি করছে?”

রুহানি যেন হটাৎ করেই অসুস্থ শরীরে হারানো শক্তি ফিরে পেল। এটা আসলে শরীরের নয়, মনের শক্তি।
নুশা উত্তর দিল,
“আছে ওই আগের মতোই। পড়াশোনা, টিউশনি এই করে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের পথে। মাঝেমধ্যে এক সাথে বসে কথা বলি। তোর কথা বলে, মন খারাপ করে, আপসোস করে।”

“আচ্ছা ওকেও সাথে নিয়ে আসিস। আমাকে দেখতে আসবি তো তোরা?”

নুশা অবাক হয়ে বলল,
“দেখতে আসব মানে? তুই কোথায় আছিস বল আমরা নিয়ে আসব। তোকে আনতে যাব, দেখতে কেন?”

“ওই একি কথা। রনককে নিয়ে আসিস। আমি চট্রগ্রাম আছি। একটা হসপিটালে।”
হসপিটালের কথা শুনে নুশা চমকে উঠল। রুহানি হসপিটালে কি করছে,অসুস্থ নয়তো নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

নুশা বিচলিত হয়ে বলল,
“হসপিটাল? হসপিটাল কেন? তোর কি হয়েছে? অসুস্থ?”

“এত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই৷ একটু অসুস্থ। দোয়া করিস। আর তাড়াতাড়ি চলে আয়। সবাইকে খুব মনে পড়ছে।”

“আসব। আমি এখন আংকেল আন্টিকে জানাই। উনারা খুব খুশি হবেন। আমার যে কি খুশি লাগছে রুহানি তোকে বলে বুঝাতে পারব না।”

রুহানি আলতো হাসল। নুশা ওর হাসির শব্দ পেল।
রুহানি অনুরোধের সুরে বলল,
“ফালাককে সবার আগে জানাবি। এখুনি জানা আর যত দ্রুত সম্ভব আমার কাছে আসতে বল। ওকে আমার খুব দরকার।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। ফালাক ভাইয়া অনেক কষ্টে ছিল৷ উনি নিজেকেই এর জন্য দায়ী ভাবতো। উনার মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। তোকে পাওয়া গেছে জানলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়বেন।”

“আচ্ছা, ওকে এখুনি ফোন কর। আমি রাখছি।”

রুহানি ফোন রেখে দিল। গলা শুকিয়ে এসেছে।
“আন্টি একটু পানি দেও।”

মাঝবয়েসী মহিলাটি এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছিল। চোখের পানি মুছে উঠে গিয়ে পানি এনে দিল রুহানিকে। রুহানি পানি খেয়ে বলল,
“আন্টি ফালাক আসবে। ফালাক আমার হাসব্যান্ড। যদি আমার কিছু হয়ে যায়,ওর সাথে দেখা না কর‍তে পারি তাহলে ওর আমানত ওর হাতে তুলে দিও।”
রুহানি ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। আর প্রার্থনা করছে,
“আল্লাহ আমাকে শক্তি দেও। তুমি সব সময় আমার পাশে থেকেছো, শক্তি দিয়েছো। আমাকে শক্তি দেও হারিয়ে দিও না।”

ওর তথাকথিত আন্টি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার কিছু হবে না মা। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। তোমার স্বামীর সাথে তোমার দেখা হবে, কথা হবে, মান-অভিমান ভুলে আবারও সংসার করবে। তোমার বাবা-মাও আসবে। সবাই আসবে।”

“আবারও দেখা হবে আমাদের
অচেনা নতুন এক শহরে
কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে।”

চলবে…..

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা‌_নওশীন

|অন্তিম পর্ব|
|শেষ অংশ|

রুহানির অস্থির চোখগুলো বারবার দরজার দিকে ফালাককে খুঁজছে। রুহানি জানে ঢাকা থেকে আসতে অনেক সময় লাগবে কিন্তু ওর অবাধ্য মনটা মানতে চাইছে না। না চাইতেও বারবার চোখজোড়া দরজার দিকে যাচ্ছে। আজ হটাৎ করেই ফালাককে দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছে। এতগুলো মাসেও এতটা অস্থির হয়নি। আজ যেন মনের তৃষ্ণা তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। সে মনের তৃষ্ণা একমাত্র ফালাকই মেটাতে পারে।
এরি মধ্যে ডাক্তার দুবার এসে গেছে। রুহানি কয়েকবার ঘুমিয়েও পড়েছে। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। রুহানি ডাক্তারের কথা কানেই নিচ্ছে না। জেদ ধরে আছে। শরীরের ব্যথাটাও জানান দিচ্ছে সময় হয়তো ঘনিয়ে আসছে। রুহানির ক্লান্ত চোখগুলো বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের উচ্ছ্বাসময় শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সময়গুলো ভেসে আসছে। কি না করেছে এ জীবনে। হাসি-আনন্দে কেটেছে ছেলেবেলা। ভার্সিটিতে সবার মাথা চিবিয়ে খেয়েছে। কিভাবে সবাইকে র‍্যাগিং করতো। ফালাকের সাথে প্রথম দিন কি করেছিল সে-সব ভাবতেই মনের অজান্তেই বন্ধ চোখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।

.

ফালাক ঘর্মাক্ত মুখ মুছতে মুছতে দৌড়াচ্ছে। ওর পথ যেন ফুরোচ্ছে না। এত দীর্ঘ পথ এর আগে পেরোয়নি। ওর এলোমেলো চুলগুলো কপালে আছড়ে পড়ছে। চোখ খুঁজছে তার প্রিয়তমাকে। রিসিপশনে রুহানির খোঁজ নিয়ে কেবিন নং জেনেছে। ফালাক ঝড়ের বেগে পৌঁছে গেছে ওর গন্তব্যে।
রুহানির কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পা কাঁপছে, বুক ধুকধুক করছে। অজানা অনুভূতি হচ্ছে। আর কয়েক পা এগুলেই রুহানিকে দেখতে পাবে, ছুতে পারবে। অন্য রকক ভালো লাগা কাজ করছে। ফালাক ধীরে ধীরে ভেতরে পা দিলো। ওর চোখ পড়ল বেডে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। লেপ্টে বাচ্চাদের মতো শুয়ে আছে। এই কয়েক মাসে অনেকটা বদলে গেছে রুহানি। মুখটা শুকিয়ে গেছে। ফালাক এক দৃষ্টিতে রুহানিকে দেখছে। মাঝবয়েসী মহিলাটি ফালাককে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।

ফালাকের দিকে দু’পা এগিয়ে বলল,
“কে তুমি বাবা?”

ফালাক রুহানিকে দেখায় এতটা মত্ত ছিল যে রুমের ভেতরে আর কেউ আছে সেটা চোখেই পড়েনি।
“জি আমি ফালাক। রুহানির হাসব্যান্ড।”

ফালাকের কথা শুনে উনার মুখে হাসি ফুটল। তারপর কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলল,
“তোমার জন্যই মেয়েটা এতক্ষণ অপেক্ষা করছে। যাও বাবা। ওর কাছে যাও।”

উনি চোখ মুছতে মুছতে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
ফালাক রুহানির কাছে গিয়ে ওর পাশে বসে ওর কপালে, গালে, নাকে,চোখে, মুখে অনবরত চুমু খেল। গাল বেয়ে পানি রুহানির গালের উপর পড়ল। রুহানি নড়েচড়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
“ফালাক!”

ফালাক রুহানিকে সাড়া দিতে দেখে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“রুহানি আমি এসেছি।”

রুহানি ধীরে ধীরে চোখ খুলে ফালাককে দেখে আলতো হাসল। ওর হাসি দেখে ফালাকের বুকে শীতল প্রবাহ বয়ে গেল।
রুহানি হাত বাড়িয়ে ফালাকের হাতটা ধরল। তারপর কেঁদে দিল।
“তুমি এসেছো? আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে আর দেখতে পাব না এ জীবনে। তোমাকে দেখার ইচ্ছে আমার অপূর্ণই থেকে যাবে।”

“এভাবে কেন বলছো রুহানি? কেন চলে এলে আমাকে ছেড়ে? অন্যায় করেছিলাম তোমার সাথে কিন্তু বিশ্বাস করো আমার উদ্দেশ্য সৎ ছিল। তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো।”

রুহানি হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমাকে একটু উঠিয়ে বসাও।”

ফালাক রুহানির হাত ধরে উঠিয়ে বসাল। রুহানি ওর হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসে। ফালাক ওর কপালের উপর থেকে বেবি হেয়ারগুলো দু’হাতে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“রুহানি কি হয়েছে তোমার? তুমি হসপিটালে কেন? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

রুহানি কোন উত্তর না দিয়ে ফালাককে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে বলল,
“কিছু হয়নি আমার।”

ফালাক রুহানির কথায় আশ্বস্ত হতে পারছে না। কিন্তু রুহানি কান্না করায় ফালাক পালটা প্রশ্ন করছে না। ফালাক রুহানিযে আরো জোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে রুহানি মৃদু চিৎকার করে বলল,
“আহ! আমার পেট। ব্যথা পাচ্ছি।”

ফালাক দ্রুত ছেড়ে দিয়ে এক প্রকার ছিটকে সরে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোমার পেটে?”
ফালাকের চোখ গেল ওর পেটের দিকে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। রুহানির দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
রুহানি মৃদু হেসে বলল,
“একটা কিউট বেবি আছে আমার পেটে। আমাদের বেবি। ডাক্তার বলেছে আমাদের একটা পুতুলের মতো মেয়ে হবে।”

ফালাক রুহানির কথা শুনে রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে। একবার রুহানির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার পেটের দিকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ওর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এতদিনের সমস্ত কষ্ট যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। রুহানির উপর রাগ করা উচিত কিন্তু তাও করতে পারছে না। রুহানিকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। রুহানিও কাঁদছে।

.

যেদিন রাতে চলে এলাম সেদিন সকালে প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট এলো। আমি খুশি হবো না ভয় পাবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে এতকিছুর মধ্যে শান্তির একটা উৎস খুঁজে পেয়েছিলাম। খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু সবাই জানাজানির পর কি হবে সেটা ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেল।

আমার বেবিকে খুশি মনে একসেপ্ট না করে সেটাকে ইস্যু করে নতুন ঝামেলা তৈরি করবে সেটা আমি মানতে পারছিলাম না। এছাড়া আমি সবার প্রতি বিরক্ত ছিলাম। এক রাশ অভিমান ছিল সবার উপর। বিশেষ করে তোমার উপর। তোমার কথাগুলো আমাকে ভীষণ হার্ট করে তাই সিদ্ধান্ত নেই আমার জীবনে যে শান্তি বয়ে এনেছে তাকে আমি সবার ধরা ছোয়ার বাইরে রাখবো। ওকে কোনো দুঃখ কষ্ট যেন ছুতে না পারে। তাই ভেবেছিলাম আমি আবার নতুন করে বাঁচব। কারো জন্য ভাবব না। কেউ আমার মূল্য দেয়নি। নিজের কথা আর নিজের সন্তানের কথা ভাবব। কোনো আপনজনের কাছে থাকব না। আর না তাদের কাছ থেকে কোনো আঘাত পাবো। তারপর আমার স্কুল লাইফের এক ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করলাম৷ ওর নাম অনিতা। ওর সাথে আমার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ ছিল। চট্রগ্রাম ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। ও একটা ফ্ল্যাট নিয়ে এক ফ্রেন্ডের সাথে থাকে। আমি সেখানে নির্দ্বিধায় থাকতে পারি। তারপর চলে গেলাম ওর কাছে। ওখানে থেকেই জব খুঁজতে থাকলাম। অনিতা আমাকে কিছু টিউশনি খুঁজে দিল। ছোটখাটো একটা জবও পেয়ে গেলাম। এক রুমের একটা বাসা নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করলাম। আমার এখানে যে আন্টিকে দেখেছো উনি আমার বাসায় কাজ করতো। উনিই এই কয়েক মাস আমার দেখাশোনা করেছেন৷ যখন চার মাস তখন ডাক্তার ব্যাড নিউজ দিল। আমার শরীরের কন্ডিশন ঠিক নেই। বাচ্চা থাকাটা আমার লাইফের জন্য রিক্স। তাছাড়া হার্টের সমস্যা ধরা পড়ল। শ্বাসের সমস্যাও বেড়ে যাচ্ছিল। তাই এবোরশন করাটা জরুরী। হার্টের অপারেশন করার এডভাইস দিলেন। কিন্তু আমি কিছুই করিনি। যে বাচ্চাটা আমার জীবনে শান্তি বয়ে এনেছে। আমার মানসিক শক্তি জুগিয়েছে তাকে আমি মেরে ফেলব? তাকে ছাড়া আমি এই মৃত শরীর দিয়ে কি করব? কি করব আমার শারিরীক সুস্থতা দিয়ে? ওর জন্য সব ছেড়ে চলে এলাম। ওকে সকল পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে চলে এলাম। আর ওকেই মেরে ফেলব? বাঁচতে পারব আমি? তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যদি মরে যাই দুজন এক সাথেই মরে যাব। নিজেকে নয় ওকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করব। এতগুলো মাস লড়াই করে এসেছি সকল অসুস্থতার সাথে। কিন্তু নয় মাসে এসেই হেরে গেলাম। হটাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। সেন্স হারাই তারপর নিজেকে আবিষ্কার করি হসপিটালে। ডাক্তার বললেন আমার কন্ডিশন ভালো না। আমার জন্য বাচ্চাও রিক্সে আছে। তাই সিজার করা জরুরী। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করলে আমার সাথে সাথে ওরও ক্ষতি হতে পারে।”

রুহানি থেমে ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক ওর কথা শুনে শকডে আছে। রুহানি অনুনয়ের সুরে বলল,
“ফালাক আমি মরে গেলেও আপসোস নেই। আমি আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে চাই। আমি চাই ও পৃথিবীর আলো দেখুক। হেসে খেলে বড় হোক।”

ফালাক রুহানির হাত ধরে বলল,
“ওর কিছু হবে না। ওর বাবা এসে পড়েছে। তোমার এত সেক্রিফাইজ হেলায় যেতে পারে না। সাহস রাখো।”

রুহানি হালকা হেসে বলল,
“আমি এখন ওটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমার বাচ্চা আর এখন একা নয়। চলে এসেছে ওর বাবা।”

ফালাক ওর হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি।”

রুহানি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিল। ফালাক ডাক্তারের সাথে কথা বলতেই ডাক্তার বললেন,
“পেসেন্টের অবস্থা ভালো না। উনার আশা ছেড়ে দিন। উনি নিজেও জানে উনার জীবনের কোনো আশা নেই। তবুও আমরা আমাদের চেষ্টা করব। তবে আপনাদের সব ধরনের খবরের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। উনার বাচার আশা ১% ও নেই। আপনি আগের রিপোর্টগুলো দেখলে বুঝতে পারতেন। উনি নিজেই নিজের জীবন রিক্সে ফেলেছেন।”

ফালাক ডাক্তারের কথা শুনে একদম ভেঙে পড়ল। মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এতদিন রুহানিকে না পেয়েই ভালো ছিল। আজ পেয়ে কি করে হারাবে? কি করে সেই ব্যথা সহ্য করবে?

“আপনি ওর জন্য হসপিটালের সবচেয়ে ভালো ডাক্তার আর ওটির ব্যবস্থা করুন। আর প্লিজ ওকে বাঁচিয়ে দিন। ওকে অনেক দিন পর পেয়েছি। এতদিন অভিমান করে আমাদের থেকে দূরে ছিল। একা একাই অসুস্থতার সাথে লড়াই করেছে। এতদিন পর পেয়ে ওকে হারাতে পারব না। সে শক্তি আমাদের নেই। প্লিজ ডক্টর।” (হাত জোড় করে)

ডাক্তার ফালাকের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমরা চেষ্টা করছি।”

ডাক্তার ওটির ব্যবস্থা করতে যেতেই ফালাক কান্নায় ভেঙে পড়ল। মেঝেতে বসে হাওমাও করে কাঁদছে। রুহানির মা, ভাই রুহান, নুশা, রনক সবাই দৌড়ে আসছে। ফালাককে এভাবে মেঝেতে বসে কাঁদতে দেখে ওরা ঘাবড়ে গেল। রনক ওর পাশে বসে বলল,
“ভাই কাঁদছেন কেন? রুহানি কোথায়?”

ফালাক কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ওটিতে নিয়ে গেছে।”

“আপনি কাঁদছেন কেন?”
সবার দৃষ্টি ওর দিকে। ফালাক কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ওর অবস্থা ভালো না। ডাক্তার বলছে রুহানির বাঁচার সম্ভবনা নেই।” ফালাক আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফালাকের কথা শুনে সবাই হতবাক। রুহানির মা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।
নুশা উনাকে সামলাচ্ছে।
“নুশা ও কি বলছে? আমার মেয়েটার কি হয়েছে? কি বলছে ওরা?”

“আন্টি কিছু হবে না। রুহানি ঠিক হয়ে যাবে।” নুশা কাঁদতে কাঁদতে বলল।

ফালাক একটা বেঞ্চিতে বসে কেঁদেই যাচ্ছে আর দোয়া করছে ও যেন সুস্থ হয়ে যায়।

ডাক্তার বেরুতেই সবাই দৌড়ে গেল। নার্স সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এলেন। রুহানির মা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন। ফুটফুটে মেয়ে শিশুকে কোলে নিয়ে চুমু খেল। ফালাক শুকনো মুখে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,
“রুহানি…. আমার স্ত্রী?”

ডাক্তার মুখ ভার করে বলল,
“উনার হাতে বেশি সময় নেই। আপনারা দেখা করে নিন। কিছু বলার থাকলে বলে নিন।”
(চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। তাই ভুল ক্ষমা করবেন)

ডাক্তারের কথা শুনে ফালাক অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও যেন হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। রুহানির মা পড়ে যেতে নিলে নুশা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে রনকের কোলে দিয়ে উনাকে সামলাচ্ছে। সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ল।

ডাক্তার ওদের অবস্থা দেখে বলল,
“আপনারা কান্নাকাটি থামান। পেসেন্টের সাথে দেখা করুন। উনি আপনাদের অপেক্ষায় আছেন। উনার সামনে কান্নাকাটি করবেন না। সময় কম।”

ফালাক নিজেকে সামলাতে পারছে না। কি করে সামলাবে? এতদিন যাকে খুঁজেছে তাকে মৃত্যু শয্যায় দেখছে। যে কিছুক্ষণ পরে মারা যাবে। যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে,যার পাগলামিগুলো ভালোবেসেছে। তাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে? বাঁচবে কি করে? ওর বুকের ভেতর তুলুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিজেকেই মুমূর্ষু রোগী মনে হচ্ছে। ফালাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রনক ছলছল চোখে রুহানির বাচ্চার দিকে তাকাল। তারপর ফালাককে বলল,
“ভাই, নিজেকে সামলান। আপনি এমন করলে এই ফুটফুটে বাচ্চাটার ভবিষ্যত কি হবে? নিজেকে সামলে রুহানির সাথে দেখা করুন। পরে নাহলে পস্তাতে হতে পারে। প্লিজ ভাই যান।”
ফালাক কোন কথা না বলে পাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়ল। যে আশা টুকু ছিল তাও নিভে গেল। এমন কিছু কখনো ওর কান শুনবে ভাবতেও পারেনি।

কেউ ভেতরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত না তাই রনক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রনক রুহানির মেয়েকে রুহানের কোলে দিয়ে ভেতরে গেল।
রনক ভেতরে গিয়ে থমকে গেল। বেডে যে মেয়েটা শুয়ে আছে তাকে রুহানি মনেই হচ্ছে না। রুহানি একটা ঝড়ের নাম৷ সে এত শান্ত কি করে হতে পারে? রুহানি চোখ বন্ধ করে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। রনকের বুকটা হু হু করে উঠল। যে মেয়েটা পুরো ভার্সিটি জুড়ে রাজ করে বেড়াতো। যার চঞ্চলতায় মুখরিত থাকত আশেপাশ সে এত স্থির হয়ে শুয়ে আছে। কি অদ্ভুত!
রুহানি কারো আসার শব্দে পিটপিট করে চোখ মেলল। রনককে দেখে আলতো করে হাসল। রনক জোর করে একটু হাসল। রুহানি কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।

রনক ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“আমি একা আসিনি। আন্টি, রুহান, নুশাও এসেছে। ওরা বাবুকে দেখছে। এখুনি চলে আসবে। তোমার মেয়ে মাশাল্লাহ তোমার চেয়েও সুন্দর হয়েছে। আস্ত একটা পরী।”

রুহানি আবারও আলতো হাসল। তারপর জড়ানো গলায় বলল,
“ফা…লা..ক।”

রুহানি যেন কষ্ট করে আর কিছু বলার চেষ্টা না করে তাই দ্রুত বলল,
“ভাইয়াও বাইরে। এখুনি চলে আসবে। তুমি একটু রেস্ট করো। নতুন অতিথিকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত।”

রুহানি মনে মনে বলছে,
“রেস্ট তো করব। সারাজীবনের জন্য দুনিয়ার সব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছি।”

এরি মাঝে রুহানির মা কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে ঢুকল। রুহানির কাছে এসে রুহানির হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দে মা। ক্ষমা করে দে। আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। আমার জন্য এত কষ্ট সহ্য করেছিস। ক্ষমা করে দে। আমি নিজেকে মাফ করতে পারছি না।”

রুহানি কথা বলছে পারছে না। তবুও বলার চেষ্টা করছে,
“এ-সব আমি ভুলে গেছি মা।”

নুশা আর রুহান ভেতরে ঢুকল। আর পেছনে পেছনে ফালাক আসছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব কেঁদেছে। রুহানি, রুহান আর নুশার দিকে চেয়ে আলতো হাসল। রুহানির মা নাতনিকে কোলে নিয়ে রুহানির কাছে দিল। রুহানি নিতে পারছে না। কাত হয়ে দু’হাতে কোনোরকমে নিয়ে চোখের পানি ফেলে ওর কপালে গালে চুমু খেল।
“আমার কলিজাটা। আর কি চাই আমার?”

রুহানি পারছে না তাই ফালাক ওর পাশে গিয়ে বসে এক হাতে বাবুকে ধরল। রুহানি রুহানের দিকে চেয়ে বলল,
“ছবি তোল একটা।”

সবাই ওর কথা শুনে অবাক। রুহানি চায় ওর মেয়ের জন্য একটা স্মৃতি চিহ্ন রেখে যেতে। রুহান সবার দিকে একবার চেয়ে ক্যাপচার করে নিল ওদের সুন্দর মুহুর্তগুলো।
রুহানি ধরে রাখতে পারছে না তাই ফালাক বাবুকে কোলে তুলে নিল। কোলে নিতেই অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় ওর মনে। কেমন একটা ভালোলাগা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখছে ওকে। ফালাক ওর মুখের দিকে তাকাল। ওর মুখের দিকে চেয়ে যেন ওর সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর সুখ ওর কাছে ধরা দিয়েছে। ফালাক আলতো হেসে চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে আজান দিয়ে বলল,
“তোমার নাম রুহা। তুমি তোমার মায়ের অংশ তাই তোমার নামটাও তোমার মায়ের নামের অংশেই থাক।”

নাম শুনে রুহানির চোখে খুশিতে পানি চলে এল। ফালাক বুকের কাছে নিয়ে আলতো করে জড়িয়ে রুহানির দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“সুন্দর একটা অনুভূতি হচ্ছে।”

রুহানি ফালাকের হাত ধরে বলল,
“ও এখন থেকে তোমার সবকিছু। ওকে কখনো কষ্ট দেবে না। ওকে তোমার মতো ভদ্র, শান্ত স্বভাবের বানাবে। সুশিক্ষায় মানুষের মতো মানুষ বানাবে। কখনো কোনো সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিবে না। ওকে কখনো একা ছেড়ে দিবে না। সব সময় পাশে থাকবে।”
রুহানি কথাগুলো বলে কেঁদে দিল। রুহানির মা-ও কাঁদছে।
রুহানির মা বেশ বুঝতে পারছে ও কি মিন করছে।
রুহানি কান্না থামিয়ে বাবুর গালে হাত ছুইয়ে দিল। বাবু পিটপিট করে তাকাল রুহানির দিকে। রুহানি আলতো হাসল। তারপর ঢোক গিলে ফালাককে বলল,
“আমাকে জড়িয়ে আমার পাশে একটু শুবে?”

রুহানির আকুতিভরা কথাগুলো ফালাকের সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। ফালাক নুশার দিকে ইশারা করল। নুশা বাবুকে কোলে নিয়ে সবাইকে ইশারা করে বাইরে চলে গেল। নুশার পেছনে পেছনে সবাই বাইরে চলে গেল।
ফালাক রুহানির পাশে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুহানি ফালাকের মুখের দিকে চেয়ে আছে। ফালাককে যেন আজন্মের দেখা দেখছে।
রুহানি হাত বাড়িয়ে ফালাকের সমস্ত মুখে হাত বুলাচ্ছে। ফালাক চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে। ফালাক রুহানিকে হালকা করে তুলে বুকে নিল। রুহানি ফালাকের বুকে নিশ্চুপ হয়ে মাথা দিয়ে রাখল।
“আমি তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি না। রুহাকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। তাই আমাকে স্বার্থপর বলো না। ও এতদিন আমার কাছে তোমার আমানত ছিল আজ থেকে ও তোমার কাছে আমার আমানত। ঠিকমত দায়িত্ব পালন করো।”
ফালাক আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। সব বাঁধ ভেঙে গেল। শব্দ করে কেঁদে দিল।
“রুহানি আমি রুহাকে কখনো কষ্ট দেব না। কিন্তু তোমাকে আমাদের সাথে থাকতে হবে। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। মরে যাব। বলো তুমি থাকবে আমাদের সাথে। রুহাকে আমি কি জবাব দেব? তোমাকে ওর প্রয়োজন রুহানি। আমাদের ছেড়ে যেও না।”

রুহানি টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। ওর কাঁদতে কাঁদতে হেচঁকি উঠে যাচ্ছে।
“ফালাক আমি বাঁচতে চাই। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। রুহাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে। কোলে নিতে ইচ্ছে করছে। ওর বড় হওয়া দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার বুকে মাথা দিয়ে রোজ ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। আমার বাঁচতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি বাঁচতে চাই। তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই।”

রুহানি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। ফালাক ওর অবস্থা দেখে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“রুহানি শান্ত হও। কিছু হবে না তোমার। তোমার কিছু হবে না। চুপ করে থাকো।”
রুহানি চুপ করে গেল। চুপ করে ওর বুকে মাথা দিয়ে রাখল। ফালাক নিঃশব্দে কাঁদছে আর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ এভাবে বয়ে গেল। রুহানি আর সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। ফালাক ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাকল কিন্তু ও সাড়াশব্দ দিচ্ছে না।
ফালাক রুহানির সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। ওর বুক কেঁপে উঠল। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ফালাক রুহানিকে ওর বুক থেকে তুলে ওর গালে হাত দিয়ে বারবার ডাকছে। কিন্তু রুহানি নড়ছে না। ফালাক উঠে ওর নার্ভ চেক করল। কোনো রেসপন্স নেই৷ চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকল। ডাক্তারের সাথে সবাই ভেতরে এলো। ডাক্তার চেক করছে রুহানিকে। সবার বুক ঢিপঢিপ করছে।
ডাক্তার ওকে চেক করে বিমর্ষ মুখে ওদের দিকে নিচুস্বরে বলল,
“সি ইজ নো মোর।”

সবাই ডাক্তারের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কাঁদতেও পারছে না। ফালাকের পুরো দুনিয়া যেন দুলছে। ও স্থির থাকতে পারছে না। ব্যালেন্স হারিয়ে বসে পড়ে বলল,
“নাহ এ হতে পারে না। রুহানি আমাকে আর রুহাকে একা ছেড়ে কিছুতেই চলে যেতে পারে না। ও আমাকে বলেছে ও থাকতে চায় আমাদের সাথে। তাহলে কি করে?”

সবার আহাজারিতে পুরো রুম ভারী হয়ে গেল। রুহানির মা বুক চাপড়ে কাঁদছে। নুশা রুহাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। ফালাক রুহানির কাছে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। রুহানিকের হাত ধরে বলছে,
“তুমি থাকতে চাও বলে চলে গেলে কেন? আমি কি করে বাঁচব? রুহার কথা ভাবলে না? রুহানি!”
ফালাক রুহানির নাম ধরে চিৎকার করছে। রুহাও কেঁদে উঠল। বাচ্চা মেয়েটাও হয়তো বুঝেছে জন্ম নিতেই মা হারা হয়ে গেল এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে। রুহার কান্না দেখে সবার কান্নার গতি বেড়ে গেল। নার্সরা দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছে। এ এক ভয়ানক দৃশ্য। হৃদয়বিদারক দৃশ্য। কোনো মানব হৃদয় এ দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না।

.

ফালাক বেলি ফুলের গাছের কাছে বসে আছে। সামনেই কবর। রুহানির কবর। ফালাক দু’হাত তুলে ফাতিহা পড়ে দোয়া করে চোখের পানি মুছে বলল,
“আচ্ছা রুহানি তুমি কি আমাদের দেখো? আমাদের যদি দেখে থাকো তবে কি তোমার হিংসা হয় না? রুহা আমাকে এত ভালোবাসে তোমার তো হিংসা হওয়ার কথা। কারণ তুমি ওর কেয়ারগুলো পাচ্ছো না। জানো তো মাঝে মাঝে তোমার প্রতি বড্ড অভিমান হয়। ভাবি আর আসব না। কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে তোমার কাছে না এসে আমি থাকতে পারি না। তোমার সাথে কথা না বললে মনে শান্তি পাইনা। রাগ করছো? তোমার এত অভিমান,তবে আমি কেন অভিমান করতে পারব না? আমার কি অধিকার নেই? উফফ, তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই গাল ফুলিয়ে বসে আছে। আমাকে যেতে হবে। আবার আসব।”

.

রুহা চাঁদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ফালাক ঘড়ির দিকে তাকাল। মাত্র ৯টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি কি করে ঘুমালো?
ফালাক রুহার পাশে শুয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুহা অন্যদিকে ঘুরে গিয়ে বলল,
“আজও মাম্মার সাথে একা দেখা করতে গিয়েছো? আড়ি তোমার সাথে।”

ফালাক বুঝল মেয়ের বড্ড রাগ না ঠিক রাগ না অভিমান হয়েছে। ফালাক ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়ের অভিমান ভাঙাতে।

.

রুহা ফালাকের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। ও রুহানির ডুব্লিকেট হয়েছে। রুহানির চেহারা পেয়েছে। চোখগুলো ফালাকের তথাকথিত বিড়ালের মতো চোখ। সেই সরু নাক। ফালাকের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ফালাক চোখ মুছে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করল।

“যদি মনে পড়ে আমায় ভীষণ ভাবে
আগলে রেখো প্রিয় অভিমানে….
অনুরাগে সিক্ত তোমার নাম
প্রিয় অভিমান……।”

সমাপ্ত!

প্রিয় অভিমান পর্ব-২৯

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৯|

রুহানি পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। চারদিকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে। রুহানি আকাশের দিকে তাকাল। তারপর তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“মানুষের সাথে লড়াই করা যায় কিন্তু তোমার সাথে লড়াই কি করে করব? সৃষ্টি কি কখনো স্রষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে? পারে না। আমিও পারব না।”

রুহানি হাতে রাখা পেপারটা ব্যাগে রেখে কলম বের করে ডাইরিতে লিখতে শুরু করল। লিখা শেষে চারটা পাতা আলাদা আলাদা করে ভাজ করে ব্যাগে রাখল।

“মেয়েরা জন্ম থেকেই সেক্রিফাইজ করে যায়। নিজের জন্য কখনো কিছু করার সুযোগ পায় না। বাবার ঘরে থাকাকালীন পরিবারের জন্য ভেবে যায়, বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির জন্য। এভাবে অন্যের জন্য ভাবতে ভাবতেই জীবন চলে যায়৷ নিজের জন্য আর ভাবা হয় না। তবে আমি আজ থেকে আমার কথা ভাবব। সবাই আমার সামনে অপশন রেখে যাচ্ছে কিংবা নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছে। আমার বাবা-মা তাদের সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আহিল আমাকে বিয়ে করবে বলে জেদ চেপে আছে। আর ফালাক সে তো চাইছে আমি সব ছেড়ে ছুড়ে তার কাছে চলে যাই। কেউ জানতে চাইছে না আমি কি চাইছি। আমি হাপিয়ে গেছি। সবার চাওয়া পূরণ করা একটা মানুষের পক্ষে কি আদৌও সম্ভব? আমি একা মানুষ এত মানুষের চাওয়া পূরণ করব কিভাবে? পারব না আমি কারো চাওয়া পূরণ করতে। আমি না এখন আমার পরিবারকে চাই আর না ফালাককে চাই। আমি এখন শুধু শান্তি চাই। আমার বাঁচার জন্য একটু শান্তি প্রয়োজন। আমি প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে চাই৷ কাউকে আমার প্রয়োজন নেই। সবাই স্বার্থপর। সবাই নিজের স্বার্থ দেখছে। আমিও আজ শুধু আমার স্বার্থ দেখব৷ আর কাউকে খুশি করতে চাই না। কাউকে না।”

রুহানি একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখল। মায়ের সাথে পার্কে আসছে। মা তার হাত ধরে রেখেছে। রুহানি হালকা হাসল। ওর ফোনটা বেজে উঠল। ফালাক ফোন করেছে। সেদিনের পর থেকে রোজ একবার করে ফোন করে কিন্তু কথা বলে না৷ রুহানি হ্যালো হ্যালো এটা সেটা বলে কিন্তু ফালাকের সাড়া পায় না। আজও ফোন করেছে। রুহানি ফোন রিসিভ করল। কিন্তু আজ আর ও হ্যালো বলল না। ফালাক যেমন অপর পাশ থেকে চুপ করে থাকে আজ রুহানিও তাই করছে। ফালাকের আজ অস্থির লাগছে। ছটফট করছে। প্র‍তিদিন রুহানির কন্ঠস্বর শুনতে পেত কিন্তু আজ তাও পাচ্ছে না। ফালাকের ইচ্ছে করছে বলতে রুহানি একটু কথা বলো। কিন্তু কোথাও আঁটকে গেল। এই আঁটকে যাওয়ার নাম অভিমান। কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও রুহানি কোন কথা বলল না। ফালাক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন কেটে দিল। রুহানির বুকটা হু হু করে উঠল ফালাকের দীর্ঘশ্বাসে।

ব্যাগে ফোনটা রেখে চোখের কোন থেকে পানি মুছে নিজেকে বলল,
“আমি আর কাঁদব না। কাঁদবে তো তারা যারা আমাকে রোজ কাঁদিয়েছে। নিজেদের স্বার্থে রোজ ব্যবহার করেছে। যারা আমার চাওয়াকে মূল্য দেয়নি। যারা আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেনি আমি কি চাই।”

.

রুহানি আজ আর ইন্সটিটিউট যায়নি। প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সেরে সোজা বাড়িতে চলে গেল। বাড়িতে তোরজোর চলছে। লাগেজ,জিনিসপত্র গুছানো শুরু করে দিয়েছে ওর মা। আগামীকালই ওরা ও বাড়িতে উঠবে। রুহানি নিজের রুমে গিয়ে নিজের লাগেজও গুছিয়ে নিল৷ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শুধু লাগেজে নিল বাকি সব যেখানে যা ছিল সেখানেই আছে৷ তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিল। শরীরটা দূর্বল লাগছে। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। ঘুম ভাঙতেই রুহানি ওর মা’কে মাথার পাশে বসে থাকতে দেখল। ওর মা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“অবেলায় শুয়ে আছিস কেন? ক’দিন ধরে দেখছি ঠিকমতো খাচ্ছিস না। সারাক্ষণ শুয়ে শুয়ে কাটাচ্ছিস। শরীর খারাপ নয়তো?”

রুহানি মা’য়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“শরীর ঠিক আছে। আমাকে খেতে দেও। ক্ষুধা পেয়েছে খুব।”

রুহানি খেয়েদেয়ে আবারও শুয়ে রইল। কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কারণে ওর ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
রুহানি রুহানের ঘরে গেল। নিজেদের বাড়িতে যাওয়া নিয়ে ও খুব এক্সসাইটেড। ছোট মানুষ এতেই খুশি।

রুহানি ওর পাশে গিয়ে বসে বলল,
“তোর খোঁজ ঠিক করে নিতে পারিনি। পরীক্ষা দিলি এতদিন। কেমন ছিল সব?”

“সবগুলো পরীক্ষাই খুব ভালো হয়েছে। সবটাই সহজ ছিল।”

রুহানি আস্তে আস্তে বলল,
“জীবনটাও যদি এমন সহজ হতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। রুহান এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিস। অনেক বড় হয়ে গেছিস৷ সামনে অনেক কঠিন সময় আসবে। আমার মতো হার মেনে নিস না। জীবনে যা করতে ইচ্ছে করে করবি। বুজলি?”

“হুম বুঝেছি আপু। মধ্যবিত্তরা একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়৷ আমিও তাই হয়েছি। চিন্তা করো না আমাকে নিয়ে।”
রুহানি রুহানের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল।

.

গভীর রাত সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ সবাই একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ সারাদিন প্রচন্ড খাটাখাটুনি গেছে কি-না। রুহানির চোখে ঘুম নেই। শেষ বারের মতো বাবা-মায়ের মুখটা হালকা আলোয় দেখে নিয়ে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেল ওর গন্তব্যে।
সকাল থেকে রুহানির দেখা নেই। ওর ঘর, বাড়ির আশেপাশে সব জায়গায় দেখে নিয়েছে। রুহানি কোথাও নেই। ওর বাবা-মা চিন্তিত হয়ে পড়ল।

রুহান বাইরে রুহানিকে খুঁজতে বের হয়েছে। ওর মা ওর রুমে লাগেজ দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে আহিলকে ফোন করল।

.

সবাই ড্রয়িংরুমে জড়ো হয়ে বসে আছে। উনাদের ধারণা রুহানি ফালাকের কাছে চলে গেছে। রুহানির বাবা ফালাকের মা’য়ের নাম্বার খুঁজছে। কিছুদিন আগে ফোন করেছিলেন। নুশা হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকল।
রুহানির মা’য়ের কাছে গিয়ে বলল,
“কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?”

“না মা, ও কি ফালাকের কাছে গেলো? ফালাকের নাম্বার আছে তোমার কাছে? একটু খোঁজ নিতে পারবে?”

নুশার মনে হচ্ছে না ফালাকের কাছে গেছে। কারণ গতকালই রুহানি ওর কাছে এসেছিল।
“আন্টি আমার মনে হয় না রুহানি ফালাকের কাছে গিয়েছে। গতকাল ও এসেছিল আমার কাছে৷ ওর লকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল আমার কিছু টাকা লাগবে। আমি… ”

নুশা কথা শেষ করার আগেই রুহান রুম থেকে চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে। সবাই এক প্রকার দৌড়ে ওর রুমে গেল।
রুহানের হাতে কয়েকটা ভাজ করা কাগজ। রুহান সেগুলো দেখিয়ে বলল,
“টেবিলের উপর ছিল। চিরকুটগুলো আপু লিখেছে। চারটা চিরকুটের উপর নাম লেখা। রুহান, ফালাক, আহিল এবং মা-বাবা।”
রুহানের বাবা হুইলচেয়ারে ঘরে ঢুকল।

সবাই বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে। রুহান নিজের চিরকুটটা খুলে পড়তে শুরু করল,
“আমার আদরের ছোট্ট ভাইটার উপর অনেক বুঝা চাপিয়ে দিয়ে গেলাম। আমাকে মাফ করিস। এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। বাবা-মাকে দেখিস আর ঠিক করে পড়াশোনা করিস। আমার আলমারিতে লাল ব্যাগে আট লক্ষ টাকা আছে। ওগুলো তোর জন্য। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে নিজের জীবন গড়ার লড়াইটা তোকেই করতে হবে। সে পর্যন্ত এ টাকাগুলো খরচ করিস। আর চিরকুট গুলো নাম লেখা ব্যক্তিদের হাতে পৌঁছে দিস। ভালো থাকিস। আমার দোয়া সব সময় তোর সাথে থাকবে।”
রুহানের পড়া শেষ হতেই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। পুরো ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা।

নুশা বলতে শুরু করল,
“এজন্যই গতকাল আমার কাছ থেকে টাকা এনেছিল।”
সবাই ওর দিকে তাকাল। নুশা আবারও বলতে শুরু করল,
“আমাকে ওর লকেট দিয়ে বলল এটা রাখ। আমার কিছু টাকা লাগবে। আমি ওটা না নিয়েই বললাম লাগবে নিবি কিন্তু এটা কেন দিচ্ছিস? বলল বেশি টাকা লাগবে। তাই এটা তোর কাছে বিক্রি করতে চাই। তুই জানিস এর ভ্যালু কতটা আমার কাছে। তাই চাই না অন্য কারো হাতে যাক। তুই এটা কিনে রাখ। আমার চেয়ে তোর কাছে এটা নিরাপদ থাকবে প্লিজ রাখ। এখন বুঝতে পেরেছি ওই টাকা রুহানকে দিয়েছে।”

রুহান একটা চিরকুট আহিলের দিকে এগিয়ে দিল। আহিল দ্রুত সেটা খুলল। দু লাইন লেখা।
“কাউকে শুদ্ধভাবে ভালোবেসে যদি মন থেকে চান তবেই তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমি তো আপনার জেদ ছিলাম।”

আহিল চোখ বন্ধ করে ফেলল। সবাই কৌতূহল নিয়ে চেয়ে আছে। আহিল রুম থেকে বের হয়ে গেল।

রুহান বাবার হাতে একটা চিরকুট এগিয়ে দিল।
ওর বাবা চিরকুটটা পড়তে শুরু করল,
“বাবা তুমি ছোট থেকে আমার সব শখ,আহ্লাদ পূরন করেছো কারণ সেগুলো তোমার ক্ষমতায় ছিল। আমি তোমার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারলাম না কারণ এটা আমার আয়ত্তে নেই। একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করা আমার জন্য জুলুম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তুমিও দেখোনি অথচ আমি তোমার সামনেই রোজ শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই চলে গেলাম। একটা কথা জেনে রেখো এই জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি তোমাকেই ভালোবেসেছি বাবা।”
পড়া শেষে অস্ফুট কাঁপা কন্ঠে উচ্চারিত করল,
“রুহানি!”

পরের অংশটুকু ওর মায়ের জন্য লেখা হয়েছে।
“মা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দ। মা এমন একজন যে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে মনের ব্যথা বুঝতে পারে। তুমি পরিস্থিতি দেখেছো কিন্তু আমার মনের ব্যথা দেখোনি। বুঝেও বুঝতে চাওনি আমায়। এই শাস্তি কি তোমার প্রাপ্য নয়?”

ওর মা বসে পড়ল। কান্নায় ভেঙে পড়ল। ততক্ষণে নুশা ফালাককে ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছে।
কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“রুহানির বাবা আমাদের মেয়েটা কোথায় গেল? ওকে খুঁজে এনে দেও। আমি থাকতে পারছি না। ও কোথায় গেল? আমাদের উপর ওর এত অভিমান জমেছে? আমাদের ছেড়ে চলে গেল? একা একা কোথায় গেল? কেমন আছে?”
বলেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল।

রুহান চোখের পানি মুছছে। হাতে ফালাকের জন্য লেখা রুহানির চিঠি।

.

ফালাক কাঁপা কাঁপা হাতে ভাজ খুলল। ওর চোখগুলো ভীত আর ঠোঁট কম্পিত হচ্ছে।
“আমি জানি তুমি সেদিনও আমাকে ভালোবাসতে, আজো বাসো হয়তো ভবিষ্যতেও বাসবে। কিন্তু এটুকুই কি আমার জন্য যথেষ্ট ছিল? তুমি তো সব জানতে। জেনে-বুঝে কেন আমার সাথে এমন করলে? আমি তো তোমাকে শুধু আমার প্রেমিক ভাবিনি বন্ধুও ভেবেছি। কিন্তু তুমি আমার সেই ভাবনার মর্যাদা রাখোনি। রুহানি কাউকে ছাড় দিবে না। তোমার যা ছিল তা আমি কেড়ে নিয়ে গেলাম। তুমি আমাকে যা যা দিয়েছো সব কিছু নিয়ে গেলাম কোনো স্মৃতিচিহ্ন রাখিনি তোমার জন্য।”

পড়া শেষে ফালাক চিৎকার করে বলল,
“মিথ্যা সব মিথ্যা। এসব মিথ্যা। রুহানি আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। এসব আপনাদের ষড়যন্ত্র। আমার কাছ থেকে ওকে দূরে রাখার জন্য এসব নাটক করছেন তাই না? ও আমার স্ত্রী, আমাকে ছেড়ে ও কোথাও যেতে পারে না আর না কেউ ওকে কেড়ে নিতে পারবে।”

ফালাকের কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। সবার চোখে মুখে বিস্ময়। রুহানির মা চোখের পানি মুছে বলল,
“স্ত্রী! কি আবল তাবল বলছো?”

ফালাক কটাক্ষ করে বলল,
“আবল তাবল নয়। সত্যি একদম সত্যি। ও আমার স্ত্রী। ও কোথায়? ওর কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না। ওকে কোথায় রেখেছেন? আপনাদের জন্য অনেক সহ্য করেছি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি রুহানিকে চাই। ও কোথায়?”

নুশা এগিয়ে এসে ওকে থামানোর চেষ্টা করে বলল,
“ভাইয়া সত্যিই ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সময় নষ্ট না করে ওকে খোঁজতে হবে।”

আহিল স্তব্দ হয়ে বসে আছে। ওর মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। রুহানি যদি সত্যিই ফালাককে বিয়ে করে তবে চলে যাবে কেন? ফালাক মিথ্যে বলছে না তো? আহিলের কাছে ফালাকের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
আহিল উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“অনেক হয়েছে। এখন ওকে খোঁজা দরকার।”

ফালাক ওর কথা শুনে চেঁচিয়ে বলল,
“ওর জীবনটা ধ্বংস করে দিয়ে শান্তি হয়নি? ও আমার স্ত্রী, আমি ওকে খুঁজে বের করব।”

ফালাক বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে আহিল রুহানির বাবা-মা’কে আস্বস্ত করে চলে গেল।

.

১০-১২দিন কেটে গেছে রুহানিকে পাওয়া যায়নি। সব রকমের চেষ্টা এই কয়দিনে করা হয়েছে৷ ফালাক বিমর্ষচিত্তে বসে আছে। ওর চোখের নিচে কালি পড়েছে৷ কয়েক দিনেই রোগা পাতলা হয়ে গেছে।
“রুহানি এভাবে শাস্তি দিও না। যত রাগ, অভিমান সামনে এসে উশুল করো দূরে থেকে নয়। আমি আর সইতে পারছি না। শক্তি নেই আমার। প্লিজ কাম ব্যাক। আমি আর তোমাকে কষ্ট দেব না। তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব।”
ফালাক চোখের পানি মুছছে।

ফালাকের মা এসে৷ ওর কাঁধে হাত রাখল। ফালাক রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়াল।
“কি চাও তুমি? রুহানি চলে গেছে আমার জীবন থেকে হ্যাপি নাও? ও কোথায়, কিভাবে আছে কিছুই জানি না। সব তোমার জন্য। তুমি আমাকে এই আগুনে ফেলেছো মা যেখানে প্রতিনিয়ত আমি জ্বলে যাচ্ছি।”

“ফালাক, আমার কথা শোন। শান্ত হ।”

ফালাক রাগের বশে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গেলেছে৷ ওয়ারড্রবের উপর থেকে সব টানে ফেলে দিল। এটা সেটা ছুড়ে মারছে। পুরো ঘর মুহুর্তেই ধ্বংসাত্মক রুপ নিল। ওর হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অসার শরীর ঢলে পড়ল।

.

রুহানির মা দিনরাত কেঁদে যাচ্ছে আর ওর বাবা আজকাল কথা বলতে যেন ভুলেই গেছে। সব সময় মুখে কাঠিন্যতা টেনে বসে থাকেন।
আহিলের আপসোস করা ছাড়া আর কিছুই নেই। ও নিজের কাজের জন্য আপসোস করছে। চোখের সামনে একটা পরিবারকে কষ্ট পেতে দেখে নিজের পাপগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
“সরি রুহানি। ফিরে এসো। আমি আর তোমার সুখের পথে বাঁধা হবো না। তোমার খুশিতে নিজেকে খুশি করার চেষ্টা করব।”

চলবে….!

প্রিয় অভিমান পর্ব-২৭+২৮

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৭|

“রুহানি,চলো বিয়ে করে ফেলি। বিয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান।”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে চমকে উঠল। ধীরে ধীরে ফালাকের মুখের দিকে তাকাল। ফালাককে দেখে মনে হচ্ছে না মজা করছে। ওর মুখ দেখেই মনে হচ্ছে সিরিয়াস মুডে আছে।

রুহানি আমতা আমতা করে বলল,
“কি বলছো?”

রুহানি সরে যেতে চাইলে ফালাক ওর দুবাহু চেপে ধরে বলল,
“বিয়ের কথা শুনে ভয় পাচ্ছো কেন? বিয়ে করতে চাও না আমাকে হাহ?”

রুহানি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। তারপর নিচু সুরে বলল,
“অবশ্যই চাই, কিন্তু সিচুয়েশন তো দেখছো। হুট করে বিয়ে করা যায় না-কি?”

ফালাক হালকা হাসল। হেসে বলল,
“সিচুয়েশনের দিকে চেয়ে থাকলে এ জীবনে আর বিয়ে করা হবে না। তোমার ফ্যামিলি আমাকে যে ট্রাপে ফাসিয়েছে তাতে তো নয়ই।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আমার ফ্যামিলি ট্রাপ কষেছে? কি করেছে আমার ফ্যামিলি?”

“তোমার মা আমাকে সাতদিনের সময় দেয়নি? সাত দিন! সিরিয়াসলি? সাত দিন কি যথেষ্ট ছিল? উনারা জানেন না আমার বাড়ির আবহাওয়া কেমন? জাস্ট দেখানোর জন্য আমাকে সাতদিনের সময় দিয়েছে। মন থেকে চাইছেন আহিলের সাথে বিয়ে দিতে।”

রুহানি রেগেমেগে বলল,
“তোমার মা-ও তো রাজি হচ্ছে না। সেটা তোমার চোখে পড়ছে না? ”

ফালাক শক্ত কন্ঠে বলল,
“তোমার ফ্যামিলি আমার ফ্যামিলি কেউ চাইছে না আমাদের সম্পর্কটা থাকুক। আর আমি এই সম্পর্ক রাখার জন্য, একটা নাম দেওয়ার জন্য সব করতে পারি।”

রুহানি ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কি করতে চাইছো তুমি?”

ফালাক রুহানির চোখে চোখ রেখে বলল,
“যদি বলি অলরেডি চাওয়া পূরণ করে ফেলেছি।”

রুহানি বুঝতে পারছে না কোন চাওয়া, কখন, কিভাবে পূরণ করেছে। কিছুই না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,
“কিসের চাওয়া? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

ফালাক রুহানিকে ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেল। নিজের চুলে হাত বুলিয়ে রুহানির দিকে ঘুরে বলল,
“তোমাকে আজ বউ সাজালাম কেন? কেন বউ সাজে দেখতে চাইলাম? নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।”

রুহানি সেটাও জানে না কেন? তাই প্রশ্ন করল,
“কেন?”

ফালাক রুহানির একদম কাছে এসে দাঁড়াল।
তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছি। তুমি আইননুসারে আমার স্ত্রী।”

রুহানি কপাল কুঁচকে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কিহ!”

ফালাক উচ্চস্বরে বলল,
“হ্যাঁ। বিয়ে করেছি আমি তোমাকে।”

রুহানি দু’পা পিছিয়ে বলল,
“মজা করছো তাই না?”

“তোমার কি মনে হচ্ছে আমি মজা করার মুডে আছি? আমি সিরিয়াস, আমি তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছি। তুমি চাইলে প্রুভও দেখাতে পারি।”

রুহানি অবাকের উপর অবাক হয়ে যাচ্ছে। ফালাক কি বলছে আদৌও ওর মাথায় ঢুকছে না।
“কিসের প্রুভ? আর আমি বিয়ে করেছি আমিই জানি না? ফাজলামো করছো আমার সাথে?”

ফালাক সোজাসাপটা বলতে পারছে না। থেমে থেমে বলল,
“বিয়েটা তোমার অজান্তেই হয়েছে। আমি সেদিন কিছু পেপারে তোমার সাইন লাগবে বলে কাবিননামায় তোমার সাইন করিয়ে নিয়েছি।”

রুহানির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখে পানি এসে পড়েছে। ফালাকের কলার চেপে ধরে বলল,
“বুঝতে পারছো কি বলছো তুমি? তুমি মিথ্যা বলছো তাই না? আমার সাথে তুমি কখনো এমন করতে পারো না। কিছুতেই আমাকে ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করতে পারো না। আমি বিশ্বাস করি না।”

ফালাক নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমি এটাই করেছি। আর আমি ভুল কিছু করিনি। তোমাকে বলেছি না তোমার এতটা কাছে আমি কাউকে সহ্য করব না? তাই তোমাকে নিজের করে নিয়েছি। আমি কিচ্ছু ভুল করিনি। যা আমার আমি তাই অধিকার করে নিয়েছি। তোমার যদি মনে হয় আমি অন্যায় করেছি তাহলে করেছি। এর জন্য তুমি আমাকে ফাঁসি দিয়ে দেও আমার আপত্তি নেই।”

রুহানি মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না ফালাক ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করেছে। এই বিয়ের কথা জানাজানি হলে তুফান শুরু হয়ে যাবে। ওর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
ফালাক আলমারি থেকে একটা পেপার এনে রুহানির সামনে ধরল। রুহানি দ্রুত পেপারটা দেখল। ওর নাম স্বাক্ষরের জায়গায় জ্বলজ্বল করছে।
“তোমার একাউন্ট চেক করোনি। দেনমোহরের টাকা সেদিনই শোধ করে দিয়েছি।”

রুহানি রাগে,ক্ষোভে পেপার ছিড়ে ফেলে বলল,
“এটা কোন বিয়ে না। এভাবে কখনো বিয়ে হয় না। আমি এই বিয়ে মানি না।”

রুহানি চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল। ফালাকের দিকে তাকাল।
“পেপার ছিড়ে ফেললেই একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না, তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। মেনে নেও তুমি বিবাহিত। ফালাকের স্ত্রী।”

“অন্যভাবে হলে খুশি খুশি মেনে নিতাম কিন্তু তুমি যে ওয়ে ব্যবহার করেছো তাতে আমি কিছুতেই মানব না।”

রুহানি চোখের পানি মুছতে মুছতে চোখ শক্ত করে ফালাকের দিকে চেয়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। ফালাক ওকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে রুহানি আরও রেগে যায়।
“খবরদার, আমাকে ছুবে না। একদম ছুবে না।”

ফালাক জোর করে রুহানিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“একশোবার ছুতে পারি। তুমি আমার বিয়ে করা বউ। অধিকার আছে।”

রুহানি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। ফালাক পেছনে থেকে রুহানিকে জড়িয়ে ধরে ওর চুলে নাক ডুবিয়ে বলল,
“রুহানি মাফ করে দেও। এছাড়া আমার উপায় ছিল না।”

রুহানি ফালাককে ধাক্কা মারল। কিন্তু ফালাক ওকে ছাড়ল না। জোর করেই শক্ত করে ধরে রাখল। ঘাড়ে, গলায় উষ্ণ ছোঁয়া দিচ্ছে। রুহানি ছোটার জন্য ছটফট করছে। ফালাক রুহানিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। রুহানি ভয়ানক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। রাগে ফুসফুস করছে। কিন্তু ফালাক পাত্তা না দিয়ে মুচকি হাসল। এক হাতে ওর দু’হাত চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলাল। রুহানি প্রথমে বাঁধা দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও পরে শান্ত হয়ে গেল। ফালাকের আহবানে সাড়া দিল। ফালাক ওর হাত ছেড়ে দিল। রুহানি দু’হাতে ফালাককে নিজের সাথে আলিঙ্গন করে নিল গভীর থেকে গভীর ভাবে। ফালাক রুহানির সম্মতিতেই নিজের অধিকার আদায় করে নিল।

চলবে…..

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৮|

আলোয় ঝলমলে রুমটায় বর্তমানে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাজত্ব করছে। ফালাকের ঘুম ভাঙতেই নিজেকে হালকা অনুভব হচ্ছে। ফালাক দ্রুত চোখ মেলল। ডানপাশে বামপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না পেয়ে বেড সাইড টেবিল ল্যাম্প অন করল। রুহানি বিছানায় নেই। আর ঘরটায় এত অন্ধকার যে মৃদু আলোতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফালাক রুহানিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন রুহানিকে না পেয়ে বুকটা শূন্য শূন্য লাগছে। ফালাক দ্রুত বিছানা থেকে নামতে নামতে রুহানির নাম ধরে ডাকছে। রুমের লাইট অন করল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। ফালাক ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যা ৭টা ১৩ বাজে। ওর বুকটা ধুক করে উঠল। রুহানি চলে যায়নি তো? ফালাক ওয়াশরুমে নক করল। দরজা খোলা। ওয়াশরুমে শাড়িটা অর্ধ ভেজা হয়ে অবহেলায় পড়ে আছে। ফালাক শাড়িটা ছুয়ে মেঝেতেই রেখে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে গেল। ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন সব জায়গায় খুঁজল কিন্তু রুহানি নেই। ফালাক রুহানির নাম্বারে ডায়েল করল। কল হয়ে কেটে গেল। কয়েকবার ট্রাই করার পরেও রিসিভ হলো না। ফালাক ফোন টেবিলের উপর রেগে রাগে গজগজ করছে।
“রুহানি কিছু না বলেই চলে গেলে? কিছু তো বলে যাবে? একটা মেসেজ করতে পারতে। কলও রিসিভ করছো না।”

.

রুহানি ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে বসে আছে। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দু’হাতে মুখ চেপে বসে আছে।
“কি করলি এটা তুই রুহানি? আবেগের বশে কি করে বসলাম? যেখানে কেউ আমাদের সম্পর্কটাই মেনে নিতে প্রস্তুত নয় সেখানে আমি… ” রুহানি নিজের চুল ধরে নিজেই টানছে।

.

ফালাক বারবার ফোন করেও রুহানিকে না পেয়ে এক প্রকার বিরক্ত। রুহানি ছোট্ট একটা মেসেজ করে দিল ফালাককে।
“আমার শরীর খারাপ লাগছে। ঘুমাবো এখন প্লিজ ফোন করো না।”
রুহানি তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফালাকের সাথে এখন কথা বলতেও অস্বস্তি লাগছে। আর কি বলবে, কি বলার আছে।

.

ফালাক আর চেষ্টা করেও রুহানির সাথে তেমন কথা বলতে পারেনি। রুহানি ফালাককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল,
“পরশু থেকে আমার পরীক্ষা। আমি এখন শুধু পড়াশোনায় মন দিতে চাই। অন্য কোন প্যারা নিতে চাই না। প্লিজ আমাকে কিছুদিনের জন্য এসব থেকে দূরে রাখো।”

রুহানি ফালাকের নিশ্বাসের শব্দ পেল। ফালাক বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু নিজের থেকে দূরে রাখছি না।”
ফালাক সাথে সাথে ফোন কেটে দিল।

রুহানির পরীক্ষার সময় খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ফালাক অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু রুহানি একবারো রিসিভ করেনি। রুহানি মূলত সেদিনের ঘটনার জন্য ভয় পেয়ে আছে। এখন ফালাককেও ওর ভয় লাগছে। ফালাক ফোন করে ওকে পায় না কিন্তু রুহানি কিছুক্ষণ পরে ঠিকি মেসেজ করে। ঘুমাচ্ছিলাম, খাচ্ছিলাম, কাজ করছিলাম, পড়ছিলাম, ওয়াশরুমে ছিলাম এই ধরনের বাহানামূলক মেসেজ পায়। ফালাক এগুলো দেখে মুচকি হাসে। তারপর থেকে ফালাক টুকটাক মেসেজ করে রুহানিকে। রুহানি মেসেজের উত্তর দেয়, ফালাকের খোঁজ খবর নেয়, পরীক্ষা পড়াশোনার খবরাখবর দেয়। এভাবেই চলছে৷ ফালাক রুহানির পরীক্ষা শেষ হওয়ার আশায় আছে।

দেখতে দেখতে পরীক্ষার বাইশ দিন কেটে গেল। এই ক’টা দিন ফালাক দূর থেকে রুহানিকে দেখতো। সামনে যেত না ইচ্ছে করে। রুহানিকে নিজের মতো থাকতে দিয়েছে। চায়নি কোনো কিছুর প্রভাব ওর পড়াশোনার ক্ষতির কারণ হোক। পরীক্ষা শেষ হতেই ফালাক ওকে ফোনের উপর ফোন করেই যাচ্ছে। কিন্তু রুহানি রিসিভ করছে না। ফালাকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে৷
ফালাক রাতের বেলায়ই রুহানির বাসার নিচে চলে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে চোখ রেখে ফোন দিয়েই যাচ্ছে অনবরত। ফালাক রাগে ফুসফুস করছে আর পাইচারি করছে। চেহারায় রাগ স্পষ্ট। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পায়ের আঘাতে মাটি ভেদ করে ফেলবে।
বারবার ফোন বাজায় রুহানি সাইলেন্ট মুডে রেখে দিয়েছে। মেসেজও আসছে। রুহানির মন উশখুশ করছে মেসেজ দেখার জন্য। আঙুলটাও ইসপিস করছে। রুহানি ওর মেসেজ দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। লাফ দিয়ে উঠে চুপিচুপি বারান্দায় গেল। ফালাক সত্যিই রাস্তার ওপাড়ে পাইচারি করছে। চেহারা অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝা না গেলেও অববয় বলছে এটা ফালাক।

রুহানি ঘামছে৷ কি করবে বুঝতে পারছে না। ঘরের ফোনটা আবারও বেজে উঠল। রুহানি টোনের শব্দে চমকে উঠল। কল রিসিভ করতে বাধ্য হলো।
কল রিসিভ করতেই ফালাক যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল। মুচকি হেসে বিরবির করে বলল যাক কাজ হয়েছে৷
কল রিসিভ করে বাজখাঁই গলায় বলল,
“আমি তোমার সাথে মিট করতে চাই রাইট নাও।”

রুহানি না যাওয়ার জন্য বাহানা খুঁজছে।
“এত রাতে আমি…

” ডোন্ট টেল মি এত রাতে বের হতে পারবে না। এত রাত নয় মাত্র ন’টা বাজে৷ আর এর চেয়ে বেশি রাতেও তুমি অনিরাপদ জায়গায় হেঁটেছো। আর আমি তোমার জন্য নিরাপদ। তাড়াতাড়ি এসো। আমাকে অপেক্ষা করিও না।”

ফালাক ফোন কেটে দিলে রুহানি ফোনের দিকে অসহায় ফেস করে তাকাল।

.

রুহানি গেট দিয়ে বের হতেই ফালাক ওর হাত ধরে নিজের গাড়িতে ওঠায়। রুহানিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুদূর গিয়ে ফাঁকা রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের কাছে গাড়ি থামাল। তারপর নিজে নেমে রুহানিকেও নামাল। রুহানি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফালাক ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। রুহানি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তাই ফালাক বলল,
“হুয়াট্স রং উইথ ইউ?”

রুহানি একবার চোখ তুলে ফালাকের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। ফালাকের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রুহানির দুবাহু চেপে ধরে বলল,
“কি সমস্যা আমার সাথে?”

রুহানি নিচুস্বরে বলল,
“কিছু না।”

ফালাক রুহানির হাত ছেড়ে দিল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রাগটা কন্ট্রোল করে বলল,
“আমি সেদিন তোমাকে জোর করেছি? করিনি তো। তোমার সায় ছিল। তবে কিসের শাস্তি পাচ্ছি আমি? কেন সেদিনের পর থেকে এমন করছো আমার সাথে?”

রুহানি এইবার মুখ খুলল।
“তোমাকে কিসের শাস্তি দেব? শাস্তি তো দিচ্ছি নিজেকে। সেদিন থেকেই শাস্তি পাচ্ছি। আবেগপ্রবণ হয়ে আমি একটা অন্যায়….”

রুহানির কথা শেষ হবার আগেই ফালাক চিৎকার করে বলল,
“অন্যায়? কোনো অন্যায় করোনি। না তুমি করেছো আর না আমি। সেদিন যা ছিল তার নাম ভালোবাসা, পূর্ণ ইচ্ছে, অধিকার। আবেগ বলে অপমান করবে না। টেক ইট ইজি।”

ফালাকের জন্য ইজি হলেও রুহানির জন্য ইজি লাগছে না। যেখানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে। রুহানির ভাবনার মাঝেই ফালাক ওকে জড়িয়ে ধরল।
রুহানি ইতস্তত করে বলল,
“ফালাক রাস্তা এটা। কেউ দেখলে কি ভাববে?”

“ভাবুক। কতদিন পর তোমাকে এত কাছ থেকে দেখছি, ছুতে পারছি। এই দূরত্ব সহ্য করতে পারছি না।”

রুহানি আর কিছু বলল না। যা হবার হোক। মুহুর্তটা নষ্ট হতে দেবে না। ফালাকের সাথে লেপ্টে রইলো কিছুক্ষণ।

.

রুহানি বাসায় ঢুকতেই ওর মা কিচেন থেকে বের হতে হতে রুহানিকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“এত রাতে কোথায় গিয়েছিলি?”

রুহানি চট করে বলল,
“ছাদে গিয়েছিলাম।”

হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে রুহানের রুমে যেতে যেতে বলল,
“রাতের বেলায় ছাদে আর যাস না।”

রুহানি মাথা নাড়িয়ে কোনো ভাবে রুমে চলে এলো। রুহানের দুদিন পর থেকে এসএসসি পরীক্ষা। পড়াশোনা করছে খুব৷
রুহানি গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রুহানের পরীক্ষা শেষ হবার পর এই বাড়িতে একটা বড়সড় ঝড় হবে যার পূর্বাভাস রুহানি আগে থেকেই পেয়ে গেছে। তবে আর ভয় পাচ্ছে না অপেক্ষা শুধু সেই সময়ের।

.
.

রুহানির জব, মাঝেমধ্যে ফালাকের সাথে সবার অজান্তে মিট করা, আহিলের সাথে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা করা, কড়া জবাব দেওয়ার মধ্যে দিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে। রুহানের পরীক্ষাও ভালো কতো চলছে।
ফালাকের মা ছেলের ডেস্পারেট অবস্থার জন্য বিরক্ত। কিছুতেই ছেলেকে ফেরাতে পারছেন না আর না ফালাক বাড়িতে ফিরছে। ফোন করলেই তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়। এখন তো ফালাক বলছে রুহানিকে কাগজে কলমে বিয়ে করে নিয়েছে। যদিও ছেলের কথা তিনি বিশ্বাস করেনি কিন্তু মাথা গরম হয়ে গেছে ওর কথার ধরণ দেখে। রাগের মাথায় রুহানির বাবাকে ফোন করলেন। রুহানির মা ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকার দিয়ে ওর বাবাকে দিলেন।

সালাম, কোন প্রকার সম্ভাষণ ছাড়াই বলতে শুরু করলেন,
“আপনারা কি পেয়েছেন বলুন তো? কি চান আমার ছেলের কাছে? শুনলাম আপনার মেয়েকে একটা ছেলে বিয়ে করতে চায়। তার সাথে বিয়ে দিয়ে শান্তি থাকুন না। না আপনাদের একজন বিলিয়নধারী জামাইয়ে পোষাবে না? আল্লাহর ওয়াস্তে আমার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে ওই ছেলের সাথে দ্রুত বিয়ে দিয়ে আমাদের উদ্ধার করে দিন। আপনার কাছে এটা আমার অনুরোধ।”
তারপর খট করে ফোন কেটে দিল। রুহানির মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
“রুহানিকে ডেকে দেও।”

.

রুহানি ওর বাবার পাশে বসে আছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে বুঝতে পারছে। তিনি বলতে শুরু করলেন,
“আমরা কোটিপতি জামাই নয় তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যত চেয়েছি। সব বাবা-মাই ছেলেমেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত চায়। এতে দোষের কিছু নেই। তুই আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছিস। তবে আমিও কিন্তু তোকে কষ্ট করেই বড় করেছি। বিনা পরিশ্রমে আমার ব্যাংকে টাকা জমা হয়নি। এত দামী জামাকাপড়, বিলাসবহুল গাড়ি, বন্ধুদের সাথে টাকা উড়ানো এমনে এমনেই আসেনি। সব আমার পরিশ্রম থেকে এসেছে। আমি বাবা হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি আর তুই মেয়ে হিসেবে বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছিস। আমরা তোর ভালো চাই। আমরা ভেবেচিন্তে ডিসিশন নেই তোর মতো আবেগপ্রবণ হয়ে নয়। আমি হাতজোড় করছি তুই ফালাককে ভুলে যা আর আহিলকে বিয়ে করে নে।”

রুহানির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বাবার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। ওর মুখে কথা সরছে না। বাকরুদ্ধ হয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে।

পরের দিন আহিল চলে এসেছে। সাথে কিছু পেপার। রুহানি নাস্তা করছিল। আহিলকে সকাল সকাল দেখেই মেজাজ চটে গেল। আহিল রুহানির দিকে একবার তাকাল তারপর হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
“আপনাদের বাড়ির পেপার।”

রুহানির মা অবাক হয়ে হাতে নিয়ে পেপার ঘেটে দেখছে। উনাদের সেই বাড়ির পেপার। রুহানি বাড়ির পেপারের কথা শুনে নাস্তা করা রেখে উঠে এসে বলল,
“বাড়ির পেপার মানে?”

“ক’দিন পরে আমাদের বিয়ে। রুহানের পরীক্ষা শেষ হলেই তো। আর বিয়ে উপলক্ষে আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার এই বাড়িটা। দেনমোহর দেয় না তেমন আর কি।”

আহিলের কথা শুনে রুহানি স্তব্ধ হয়ে রইল।
তারপর বলল,
“আমি আপনার কাছে চেয়েছি? আমি বলেছি দেনমোহর হিসেবে আমাকে বাড়ি গিফট করুন?”

“তাহলে এটা গিফট হিসেবেই রাখো। আর বলো তুমি কি চাও?”

“আমি যা চাই তা আপনি কিছুতেই দিতে পারবেন না। তাই দূরেই থাকুন। আর আমি কোনো পণ্য নই যা একটা বাড়ি দ্বারা বিনিময় করা যাবে।” (মায়ের দিকে চেয়ে)

ওর মা ধমকে উঠল,”রুহানিইই। তোর বাবা গতকাল কি বলল? ভুলে গেছিস?”

“তাই বলে বিক্রি করে দিবে?”

রুহানির এই কথা শুনে ওর মায়ের মাথায় যেন আগুন জ্বলে গেল। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে রুহানিকে থাপ্পড় মারল। রুহানি গালে হাত দিয়ে চোখে আগুন জ্বালিয়ে আহিলকে বলল,
“জীবন থাকতে আমি আপনাকে বিয়ে করছি না। রুহানি ফালাকের আছে, থাকবে আর আছে। মিলিয়ে নিবেন। আর হ্যা একদিন ঠিকই বুঝতে পারবেন তবে সেদিন আপসোস ছাড়া কিছু করার থাকবে না।”

রুহানির লাল টকটকে চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আহিল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। রুহানি মা’য়ের দিকে একবার তাকাল তারপর ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

রুহানি সোজা ফালাকের ফ্ল্যাটে গেল। ইন্সটিটিউটে পরে যাবে। ফালাক অফিসের জন্য তৈরি হয়েছে৷ রুহানিকে এই সময় দেখে কিছুটা অবাক হলো আর ওর বিধ্বস্ত মুখটা দেখে চিন্তিত।

ফালাক কিছুটা অনুমানও করতে পারছে। ব্যস্ততার সুরে বলল,
“জরুরী কিছু বলতে এসেছো? বিয়ের দাওয়াত দিতে নয়তো?”

রুহানির ফালাকের কথা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
রুহানি রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“কি করে বলছো তুমি এই কথা? মজা লাগছে তোমার?”

ফালাক রুহানির এক হাত চেপে ধরে বলল,
“তাহলে কি লাগবে? আমার বিয়ে করা বউয়ের আরেকজনের সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে।”

“ওটা কোনো বিয়ে? কাউকে না জানিয়ে ইনফ্যাক্ট আমার অজান্তে তুমি কি করে বিয়ে করতে পারলে? কেউ মানবে?”

“তাহলে আর কি এক কাজ করো আহিলকে বিয়ে করে নেও।”(নির্লিপ্ত ভাবে)

রুহানি অসহায় ফেস করে বলল,
” ফালাক প্লিজ। তোমার মা গতকাল রাতে ফোন করে উল্টো পাল্টা বলেছে৷ বাবা জেদ ধরে বসে আছে আহিলের সাথেই বিয়ে দিবে। এখন আমি কি করব?”

“কি করবে? বিয়ে করবে৷ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে তো বলতে পারবে না, স্বীকার করবে না বিয়েটাকে সো একজনের স্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্য একজনকে বিয়ে করে নিবে, একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করে নিবে, একজনের সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ হওয়ার পরেও অন্যজনের ছোয়া মেনে নিবে। ব্যাস আর কিছু না।”

রুহানির চোখ ছলছল করছে। ফালাকের দিকে চেয়ে আছে। ফালাকের কথাগুলো বেশ আঘাত করছে ওকে। কেমন সহজেই বলে দিচ্ছে কথাগুলো।
ফালাক ডাইরেক্ট বলল,
“তোমার কাছে দুটো অপশন খোলা আছে। তোমার আমার পরিবার কেউ আমাদের মানবে না তাদের আশা ছেড়ে দেও৷ চলে এসো আমার কাছে। পরিবার, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব সব ভুলে যাও। আর নয়তো ফ্যামিলির খুশির জন্য নিজের খুশি বিসর্জন দিয়ে আহিলকে বিয়ে করে নেও। আমার আর কিছু বলার নেই।”

“ফালাক তুমি দায়সারা কথা কি করে বলছো? আমার অবস্থা, আমার মানসিক অবস্থা তোমার চোখে পড়ছে না? তুমি তোমার ডিসিশন আমার উপর চাপিতে দিচ্ছো কি করে? আমি এসেছিলাম তোমার সাহায্য, সাপোর্ট চাইতে আর তুমি?”

ফালাক রুহানির হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আ’ম ফিড আপ৷ আর না। তুমি এখানে এসেছো ড্রামা করতে৷ বিয়ে তুমি আহিলকেই করতে চাও। আহিল তো তোমাদের বাড়িও কিনে নিয়েছে তোমার নামে। তোমাকে গিফট করার জন্য। এমন হাসব্যান্ড ক’জন পায়। তোমাকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আহিলের সাথে সুখে থাকো। নাও গেট আউট।”
ফালাক ঠাস করে রুহানির মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিল।

রুহানি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ফালাককে চিনতেই পারছে না। এত রাতারাতি একটা মানুষ বদলে যায় কি করে। রুহানি কাঁদতে কাঁদতে দরজা ধাক্কাচ্ছে।
“ফালাক দরজা খোল। এভাবে আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারো না। কথা বলো আমার সাথে। তুমি আমাকে ভালোবাসো। এভাবে দায়সারা কথা বলতে পারো না। আমি আহিলকে বিয়ে করতে পারব না। দরজা খোল।”

ফালাক দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছে করেই কথা বলছে না। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পরেও দরজা না খোলায় রুহানি বাধ্য হয়ে চলে যায়।

রুহানির সাড়াশব্দ না পেয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। লাল ড্রেস পরা একটা মেয়ে রিকশায় উঠে যাচ্ছে।
“রুহানি সরি তোমাকে হার্ট করার জন্য। তোমাকে যদি হার্ট না করি তাহলে তুমি কঠোর হতে পারবে না। ডিসিশন নিতে পারবে না। তাই তোমার প্রতি কঠোর হয়েছি। আমাকে হারানোর ভয় তোমার মধ্যে ঢুকলে তবেই তুমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি তোমার হাসব্যান্ড। পারিবারিক দায়বদ্ধতা এড়াতে পারবে, মানসিক মুক্তি পাবে।”

চলবে…..!

প্রিয় অভিমান পর্ব-২৫+২৬

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৫|

রুহানি শুকনো পাতাগুলো পদতলে পিষে আনমনে হাঁটছে। হটাৎ করে ওর কানে মরমর শব্দ ঝড় তুলছে। রুহানি ঝরে পড়া শুকনো পাতার দিকে তাকাল। নিজেকেও ওর আজকাল তাই মনে হয়। স্বচ্ছ পানির দিকে চেয়ে সিড়িতে বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ পর ফালাক হন্তদন্ত হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। ফালাককে দেখে ওর ধ্যান ভাঙলো।
“তুমি এখানে বসে আছো আর আমি তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি। ফোন করছি রিসিভও করছো না।”

রুহানি তখনও কিছুটা আনমনে কিছু ভাবছে।
“ওহ, আসলে খেয়াল করি নি।”

ফালাক রুহানিকে ভালো করে দেখল। মুখটা শুষ্ক, চুলগুলো এলোমেলো, চোখগুলো কেমন ভাবনায় ডুবে আছে, কথাও বলছে কেমন করে। মনে হচ্ছে নিজের মধ্যে নেই।

ফালাক রুহানির পাশে বসে ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
“এমন এলোমেলো বেখেয়ালি লাগছে কেন? তোমাকে এমন চুপচাপ, মনমরা ভালো লাগে না। তুমি হাসবে, তোমার চোখ হাসবে, চারপাশ প্রাণবন্ত উৎসবমুখর মনে হবে। কিন্তু তা নয় তুমি সব টেনশন নিজের মধ্যে নিয়ে রেখেছো। আমি আছি তো।”

রুহানি অসহায় ফেস করে বলল,
“তুমি আছো জানি কিন্তু ব্যাপারটা এখন তোমার, আমার, আহিল তিনটা পরিবারের সাথে জড়িয়ে গেছে। তোমার বাবা-মা কিছুতেই আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না। আর এদিকে আহিলও আমার পেছন ছাড়বে না। মহা ঝামেলায় পড়ে গেছি।”

ফালাক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“রুহানি দেখো আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাকে নিয়েই তাদের যত স্বপ্ন। মা তোমাকে চেনে না, জানে না তাই তোমার সম্পর্কে অন্য রকম ধারণা পোষণ করেছে।”

“আমি তোমার মা’কে দোষ দিচ্ছি না। তার এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক। আমাকে যদি কেউ এসে কারো সম্পর্কে এমন কিছু বলে আমি তোমার মা’য়ের মতো সেম মনোভাব পোষণ করতাম।”

ফালাক স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে রুহানির দিকে চেয়ে বলল,
“আমি মায়ের সাথে কথা বলব। মা’কে বুঝাবো। তিনি যদি বুঝে যান তবে ঠিক আছে আর যদি না বুঝে তাহলে….!”

রুহানি ফালাকের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাল। ফালাকের ‘তাহলে’ শব্দটা শুনে ওর বুকটা ধুক করে উঠল। ফালাক কি ওর মা’য়ের জন্য ওকে ছেড়ে দিবে?
রুহানি ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“তাহলে কি ফালাক?”

ফালাক বলল,
“তাহলে আমরা বিয়ে করে ফেলব। একবার বিয়ে করে ফেললে বাবা-মা মেনে নিতে বাধ্য। কিছুদিন হয়তো রাগ করে থাকবে তারপর মেনে নিবে। একমাত্র ছেলেকে কতদিন দূরে সরিয়ে রাখবে? দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“ফালাক পাগল হয়ে গেছো? ইউ মিন আমরা নিজেরা একা বিয়ে করব? মানে যাকে বলে পালিয়ে?”

“এমন কি হয় না? অহরহ হচ্ছে। ফ্যামিলি রাজি না থাকলে নিজেরা বিয়ে করে নেয় তারপর ফ্যামিলি মেনে নেয়। ”

“কিন্তু ফালাক…..

ফালাক রুহানিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” পরেরটা পরে ভাবা যাবে। তুমি সকালে কিছু খাওনি তাই না? চলো ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেয়ে নেই।”

রুহানি ফালাকের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আমার ক্ষিধে নেই।”

“আমি জানি তোমার ক্ষিধে পেয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আর তোমার মাথা কাজ করবে না। আমার হাত কামড়াতে শুরু করবে।” (মজা করে)

রুহানি ফালাকের কথা শুনে ফালাককে মারতে শুরু করল। সেটা দেখে ফালাক বলল,
“দেখেছো তোমার মাথা কাজ করছে না।”

রুহানি নাক ফুলিয়ে বলল,”ফালাক, ভালো হচ্ছে না।”

ফালাক আলতো হেসে বলল,
“তাহলে চলো, আমারও ক্ষুধা পেয়েছে। নাস্তা না করেই কারো সাথে দেখা না করেই চলে এসেছি।”

রুহানি ফালাকের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল।

.

ফালাক খাবার অর্ডার করে রুহানির দিকে আড়চোখে তাকাল। তারপর নিজের ফোন বের করতে করতে বলল,
“আহিলকে কোথায় পাওয়া যাবে?”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে চমকে গেল। তারপর ফালাকের দিকে চেয়ে ওর মনোভাব বুঝার চেষ্টা করে বলল,
“কেন?”

ফালাক আলতো হেসে বলল,
“ওর সাথে হিসেব মিটাতে হবে না?”

রুহানির আহিলের নাম শুনেই সবকিছু আবার নতুন করে মাথায় ঘুরছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ওর জন্য আমিও যথেষ্ট। ও যে বহুরূপী গিরগিটি জানাই ছিল না। আমারই ভুল। ওকে আমার এতকিছু বলাই উচিত হয়নি। ওকে তো এর জবাব দিতেই হবে। আই হোপ বাবা আর মাও ওর বিপক্ষে কথা বলবে।”

“ওকে, তুমি তোমার কায়দায় জবাব নিও। তবে আমি ওকে ছাড়ছি না। আর হ্যাঁ তোমার কাছে ওর কোনো পিকচার আছে? আমি তো ওকে আজ পর্যন্ত দেখিনি। সামনে এলেও চিনবো না।”

রুহানি ফোন ঘেটে আহিলের একটা পিকচার খুঁজে পেতে সক্ষম হলো। ফোনটা ফালাকের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“এই যে আহিল।”

ফালাক ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে ভালো করে দেখছে। আহিল সব দিক দিয়ে ওর চেয়ে সুন্দর। দেখেই মনে হচ্ছে ড্যাশিং আর স্ট্রং পার্সোনালিটির মানুষ। যেকোনো মেয়েই প্রেমে পড়ে যাবে।
ফালাক রুহানির দিকে চেয়ে বলল,
“তোমার ফোনে ওর পিক কি করছে?”

রুহানি ওর প্রশ্নে যেন ভরকে গেল। নিজেই দেখতে চাইলো আর এখন বলছে ওর পিকচার কি করছে।
রুহানি কি উত্তর দিবে ফালাকের প্রশ্নে। ফালাক বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

“অনেক আগের। এই একটা পিকচারই আছে। অনেক সময় লাগে না, তাই আর কি। এখন যেমন তোমাকে দেখাতে পারলাম।
না থাকলে কি করে দেখাতাম?”

ফালাক পালটা প্রশ্ন করল,
“আমার কয়টা পিকচার আছে তোমার ফোনে?”

রুহানি চুপ করে গেল। কারণ ফালাকের কোন পিকচারই ওর ফোনে নেই। প্রায় রোজই দেখা হয়, সোসাইল সাইটে ওর পিকচার দেখে কিন্তু কখনো সেভ করে রাখেনি।
ফালাক রুহানির চুপ করে থাকায় উত্তর পেয়ে গেছে। আহিলের পিকচার ডিলিট করে রাগে ফুসফুস করতে করতে বিড়বিড় করে বলল,
“বয়ফ্রেন্ডের পিকচার নেই, অন্য ছেলের পিকচার ফোনে রেখে দিয়েছে।”

“আরে তুমি এত রিয়েক্ট করছো কেন? এখন থেকে গ্যালারি ভর্তি তোমার পিকচার রেখে দেব। ভাল্লাগে না। হুদাই রাগ দেখাচ্ছে। আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খাবার দেও।”

রুহানি এখন নিজেই রেগে গেছে। ফালাক তাই নিজেকে সংযত করে নিল।

.

রুহানি ক্লাস শেষে আহিলের অফিসে যাচ্ছে। অফিসে গিয়ে আহিলকে পায়নি। তাই আহিলকে ফোন করল। ফোন করে জানতে পারল ও ওদের বাড়িতে যাচ্ছে। রুহানির প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে যদি উড়ে চলে যেতে পারত। আহিল বাড়িতে গিয়ে ওর অনুপস্থিতিতে কি বুঝাবে ওর বাবা আর মা’কে।

আহিল ওদের বাড়িতে ঢুকলে রুহানির মা ভালো ভাবে ওকে গ্রহণ করেনি। প্রতিবার ওকে দরজার বাইরে দেখলে হাসিমুখে ভেতরে আসতে বলে কিন্তু আজ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আহিল কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
“কিছু হয়েছে আন্টি?”

রুহানির মা উত্তরে বলল,
“ভেতরে এসো।”

আহিল ভেতরে যাওয়ার পর রুহানির মা সবকিছু বলার পর প্রশ্ন করল,
“আহিল কেন করেছো এমন? তোমার কাছে এমন কিছু সত্যিই আশা করিনি। আমাদের সম্মান তোমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছি আর তুমি তার সম্মানটা কোথায় রাখলে?”

“আন্টি সবকিছুর পেছনে একটা কারণ থাকে। আমাকে এক্সপ্লেইন করতে দিন।”

পেছনে থেকে রুহানি বলল,
“এক্সপ্লেইন তো আপনাকে করতেই হবে। তো করুন আমিও শুনছি।”

সবার দৃষ্টি রুহানির দিকে। মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছে৷ কেমন হাপাচ্ছে, কপাল আর নাক ঘর্মাক্ত।

আহিল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“রুহানি, ফালাক আর ফালাকের ফ্যামিলি তোমার জন্য পারফেক্ট না। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম আর সে অনুযায়ী আমি ওর ফ্যামিলির সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।”

“কথা বলতে গিয়েছিলেন না আমার বদনাম করতে গিয়েছিলেন? যাতে ফালাকের সাথে আমার সম্পর্ক না থাকে তার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন?”

আহিল ধমকে বলল,
“শাট আপ! যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলো না। আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছো তুমি তাই বাস্তবতা সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই তোমার। তুমি নিজের হাতে দুর্ভোগ টেনে আনতে চলেছো।”

রুহান ওর বাবাকে নিয়ে এসেছে। ওর বাবাও পুরো ব্যাপারটা শুনছে। আহিল রুহানির বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আংকেল, রুহানির এই সত্যটা প্রকাশ করার জন্য আমি দুঃখিত। আমি ফালাকের ব্যাপারটা জানার পরে ওর সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম কথা বলে ওদের মনোভাব বুঝার জন্য। আমি কিছুই গোপন করিনি। গোপন না করার একটাই কারণ একদিন সবার সামনে সত্যিটা আসবে৷ সেদিন তাদের কি মনোভাব হবে? ওর মায়ের অনেক দেমাক। ফালাক তার একমাত্র ছেলে। তার ছেলের জন্য তিনি নিজেদের স্ট্যাটাস অনুযায়ী বউ আনবে। তিনি বলেছেন তার কিসের অভাব? ধন-সম্পদ, নাম,খ্যাতি,যশ,প্রভাব-প্রতিপত্তি, সামাজিক মর্যাদা কোন কিছুর অভাব নেই। তার কথাও ঠিক আছে। তিনি তার স্ট্যাটাস অনুযায়ী আত্মীয়তা করতে চাইবেন। ফালাক একমাত্র ছেলে তার, আমার মতো আরো একজন ভাই নেই। আমার বাবা-মায়ের সব আশা আমাকে ঘিরে নয় বরং আমাদের দুই ভাইকে ঘিরে। আর আমরা দুই পরিবার একে অপরের পরিচিত তাই সবাই সবাইকে খুব কাছ থেকে চিনি, জানি। যেটা ফালাকের পরিবার জানে না। ফালাকের পরিবার যেখানে তোমাকে মেনে নিবে না সেখানে তুমি কি করে সুখী হবে? রোজ লড়াই করবে রুহানি?”

“ফালাক আমার সাথে থাকলে আমি সব করতে পারব।”

আহিল তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ফালাক কতদিন থাকবে তোমার সাথে? প্রথম দু’চার দিন। তারপর ও নিজেই বিরক্ত হয়ে যাবে। তুমি দুদিনের জন্য বিয়ে করছো না, সারাজীবন তোমাকে থাকতে হবে এটা মাথায় রেখো। ফালাক তোমাকে ভালোবাসে? না,এটা ওর মোহ। বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র ছেলে, ওর অল্প বয়স, তোমাকে ভার্সিটিতে কাছে থেকে দেখেছে, তোমার এটিটিউট, রুপ দেখে মুগ্ধ হয়েছে তাই সব কিছু মেনে নিয়েই তোমাকে চাইছে। কিন্তু যখন ওর মোহ কেটে যাবে তখন? তখন তোমার কি হবে রুহানি? তোমার নাচ করার কথা শুনে ওর মা তোমার সম্পর্কে বাজে একটা ধারণা পোষণ করে নিল। আর আমার পরিবারকে যখন এই ব্যাপারে বলেছি তারা হতাশ হয়েছে কিন্তু তোমার চরিত্র নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করে নি। তোমাদের আর্থিক অবস্থার জন্য প্রথমে অমত করলেও এখন তারা মেনে নিয়েছে। ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ আমি নিজে এসেছি তোমার কাছে, তোমাদের কাছে। তফাত দেখো আর কোনটা ভালোবাসা সেটা বুঝার চেষ্টা করো। আবেগে ভেসে গিয়ে জীবনটা ভাসিয়ে দিও না। মাথাটা কাজে লাগাও, একটু ভাবো উত্তর পেয়ে যাবে।”

রুহানির বাবা আর মায়ের দিকে তাকাল। তারা আহিলের কথায় গলে যাচ্ছে।
“বাবা, ফালাক খুব ভালো ছেলে। ও বলেছে ওর মায়ের সাথে কথা বলবে। পরিবারকে রাজি করাবে। ফালাক আমাকে ভালোবাসে।”

আহিল রুহানির কথা শেষ হতেই বলল,
“আসলে কি জানো রুহানি, তোমার খারাপ সময়ে আমি তোমার পাশে ছিলাম না তাই আমার প্রতি তোমার একটা ক্ষোভ কাজ করে। নয়তো বরাবরই আমাকে বিয়ে করার জন্য তুমি রাজি ছিলে। তুমি কষ্ট পেয়েছো আর ওই সময় ফালাক হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সাপোর্ট দিয়েছে তাই ওকে তোমার আপন মনে হচ্ছে। কিন্তু এই মনোভাব সব সময় থাকবে না। আমি তোমার বাগদত্তা। আমি তোমাকে এমন সিচুয়েশনে পড়তে দিতে পারি না। ওদের সাথে জড়ালে তোমাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে। ফালাকের ফ্যামিলি রাজি থাকলে আমি আপত্তি করতাম না। ইনফ্যাক্ট এখনো করব না। তুমি বলো ওর বাবাকে এসে তোমাদের ব্যাপারে কথা বলতে। যদি তারা আসে, তোমাকে মেনে নেয় তবে আমি কথা দিচ্ছি সরে যাব তোমার জীবন থেকে।”

আহিল দাঁড়িয়ে গেল। তারপর রুহানির বাবা-মার উদ্দেশ্যে বলল,
“আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে ও। আমি শুধু এটুকুই বুঝতে পারছি কিন্তু কিছু করতে পারছি না বুঝানো ছাড়া,ওয়ার্ন করা ছাড়া। আর যখন ও এসব দুর্ভোগের সাথে জড়িয়ে যাবে তখন আমার এটুকু করারও থাকবে না। কারণ সেটা হবে অনধিকার চর্চা। মূল্যহীন। তখন আহিলকে ওর আশেপাশেও পাবে না। সিদ্ধান্ত আপনাদের। আমি আসছি।”

রুহানির আর কিছুই করার থাকল না। আহিল যে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে বুঝে গেছে। আর এও বুঝে গেছে ওর বাবা-মার ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলেছে। রুহানি দাঁড়িয়ে রাগে গজগজ করছে।

.

রুহানির বাবা আর মা ওকে আর কিছুই বলল না। সারারাত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে রুহানিকে একটা সুযোগ দিবে। তবে শুধু একটা সুযোগ। যদি ফেল হয় তবে ওকে আর ওর জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিবে না। আহিল আর আহিলের পরিবার ওদের পূর্বপরিচিত। একে অপরকে খুব ভালো করে চিনে। কিন্তু ফালাকের পরিবার ওদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। ওদের চাল-চলন, আচার-আচরণ,পছন্দ-অপছন্দ কিছুই জানে না। আহিলের সাথে বিয়ে হলে রুহানি ভালো থাকবে, আহিল সব জেনেও রুহানিকে বিয়ে করতে চাইছে। এতে প্রমাণ হয় আহিল রুহানিকে কতটা ভালোবাসে আর রুহানির জন্য ভবিষ্যতে কি কি করতে পারবে। আহিল ম্যাচিউর ছেলে।
বিয়ের পর রুহানি নিজের মতো আহিলের সাথে আমেরিকা থাকবে। কোনো ঝামেলা নেই। তবে তারা রুহানিকে একটা সুযোগ দিতে চায়। ফালাকের সাথে কথা বলবে।

চলবে……!

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৬|

রুহানি বসে বসে নখ কামড়াচ্ছে। কপালে চিন্তার রেখা পড়েছে। মনে হচ্ছে মাথাটাও ধরেছে। রুহানি দু’হাতে চুল গুলো হালকা টেনে টেনে মাথাকে আরাম দিচ্ছে। সামনেই চায়ের কাপ। কাপ ভর্তি দুধ চা অনাদরে পড়ে আছে। রুহানির নজর গেল কাপের দিকে। চুল থেকে হাত সরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অতি আগ্রহের সহিত চুমুক দিল। মুহুর্তেই ওর চেহারার রং পালটে গেল। ঠান্ডা চা বিদঘুটে লাগছে। রুহানি না গিলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফেলে দিল।
বারান্দায় এসে দাঁড়াল। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। ওর মা ফালাকের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। রুহানি যেতে চাইলে নেয়নি। এখন বসে বসে টেনশন করা ছাড়া উপায় নেই।

.

ফালাক রুহানির মা’য়ের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রুহানির মা ওকে থামিয়ে বলল,
“ব্যস্ত হয়ো না। আমি তোমার সাথে দুটো কথা বলতে চাই।”

ফালাক চেয়ার টেনে বসে বলল,
“জি বলুন।”
ফালাক ভেতরে ভেতরে নার্ভাস ফিল করছে। তবুও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।

রুহানির মা ভনিতা না করেই বলল,
“রুহানিকে তুমি ভালোবাসো?”

ফালাক থমকে গেল। এই প্রশ্ন করতে এসেছে এখানে। ফালাক উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁট ফাক করতেই উনি বললেন,
“রুহানি বলেছে তুমি ওকে ভালোবাসো। ও যেহেতু বলেছে ধরেই নিলাম ভালোবাসো। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিও তুমি জানো। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কোন বিপদ কিংবা সন্তানের ক্ষতি মেনে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি আমাদের নেই। সব হারিয়ে রুহানি আর রুহানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছি। তাই ওদের কোনরূপ ক্ষতি মেনে নিতে পারব না। রুহানি আর রুহানই এখন আমাদের সব। রুহানি ছোট থেকেই একটু রাগি,জেদি টাইপ মেয়ে। যা বলে তাই করে, যেটা চায় সেটা পেয়েই ছাড়ে। বাবার আদর-আহ্লাদে বড় হয়েছে তো তাই। এখন পরিস্থিতির কারণে নরম হলেও অনেক কিছুই আগের মতো আছে। ওর কথা ভেবেই এখানে আসা। তুমি এটাও জানো যে দু’বছর আগে রুহানির সম্মতিতেই আহিলের সাথে পারিবারিক ভাবেই বিয়ে ঠিক করেছি। আহিল তখন আমেরিকা থাকতো। দুই পরিবারের মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু হটাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে পড়ল। আমাদের এই অবস্থা পাশাপাশি ওর বিয়ে ভেঙে যাওয়া। মেয়েটা একদম ভেঙে পড়ে। আমাদের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত রেখে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর তুমি এলে ওর জীবনে। তোমার প্রতি দুর্বল হতে হতেই আহিল চলে এলো। কিন্তু রুহানি আহিলের ফিরে আসা ভালোভাবে নিতে পারেনি। আহিলের প্রতি ওর একটা রাগ,ক্ষোভ কাজ করত। প্রথমে আমাদেরও করেছিল যাইহোক বাদ দেই সে-সব কথা৷ আমরা আহিলের সাথেই বিয়ের কথা আগাচ্ছিলাম মাঝখানে রুহানি বাঁধ দিল। তোমার কথা বলল। রুহানির কথা ভেবে সেটাও মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ফ্যামিলি, তারা তো মানবে না। যে ফ্যামিলি আমার মেয়েকে চায় না সেখানে জোর করার উপায় নেই।”

ফালাক মাথা নিচু করে চুপচাপ কথাগুলো শুনছে। উনার কথার মাঝে কোন বাঁধা সৃষ্টি করেনি।
“এখন মেইন কথায় আসি। তুমি কি রুহানিকে বিয়ে করতে চাও?”

ফালাক নম্রস্বরে বলল,
“জি আন্টি অবশ্যই চাই। আমি সত্যিই রুহানির সাথে, রুহানির পাশে থাকতে চাইছি। আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলব। আমার বিশ্বাস তারা আপত্তি করতো না যদি না আহিল রুহানির কিছু সিক্রেট ওপেন না করত। কিন্তু এখন ব্যাপারটাই জটিল হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ হয়তো জটিল হয়েছে। কিন্তু রুহানি তোমার প্রতি দিন দিন আরো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। পরে দেখা গেল পরিস্থিতি, পরিবারের চাপে তুমিও ওকে ছেড়ে চলে গেলে এটা কিন্তু ও মেনে নিতে পারবে না। আমার মেয়েটা মরে যাবে। তাই বলছি যদি ওকে বিয়ে করা সম্ভব না হয় তবে সম্পর্ক আর এগিও না। আর যদি বিয়ে করার হয় তবে তোমার বাবা-মাকে বিয়ের কথা বলতে আমাদের বাড়িতে পাঠাও। তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি। এর বেশি সময় আমি নিতে পারব না। কারণ আমি কিছুতেই রুহানির জীবনটা ধ্বংস হতে দেখতে পারব না। এমনিতেই আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।”

ফালাক থ হয়ে আছে। এক সপ্তাহে পারবে তো বাবা-মাকে মানাতে। যদি না পারে তাহলে? ফালাকের মুখ শুকিয়ে গেল।

ফালাক শুকনো মুখে বলল,
“আমি চেষ্টা করব। কিন্তু আন্টি একটা কথা আমি সত্যিই রুহানিকে ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করতে চাই। সত্যিই চাই।”

রুহানির মা কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু বলল,”হয়তো চাও। কিন্তু তোমার বাবা-মায়েরও একটা চাওয়ার ব্যাপার আছে। সেটাও তোমাকে দেখতে হবে। আমারও আমার মেয়ের কাছে কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে।”

ফালাক খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

.

ফালাক অনবরত চেষ্টা করছে ওর মা’কে বুঝানোর। ওর বিশ্বাস মা মেনে নিলেই বাবা মেনে নিবে। কিন্তু এখন ওর সাথে মায়েরই মনোমালিন্য শুরু হয়ে গেছে। তাই ফালাক রাগ করে কয়েক দিন যাবত বাড়িতে যাচ্ছে না। ওর বাবা এসে জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেছে। সেখানে ওর মায়ের সাথে আবারও নতুন করে তর্কাতর্কি চলতে থাকে।

রাতের বেলা ওর বাবা ওকে ডেকে নিয়ে বলল,
“কেন এমন করছিস? কেন পরিবারের সাথে সম্পর্কগুলো উদ্ভট করছিস? কিছুদিন যাবত কি অশান্তি চলছে এই বাড়িতে। এভাবে চলতে পারে না। কি দরকার এমন একটা সিচুয়েশনে নিজেকে ফেলার? ফালাক সব ভুলে যা। মেয়েটাকে ভুলে যা। আমরা তোর জন্য অন্য একটা মেয়ে দেখছি। তাকে বিয়ে করে সুখে থাক। দয়া করে আর কথা বাড়াস না। বাড়িতে অশান্তি করিস না। আর ভালো লাগছে না।”

ফালাক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলতো হেসে বলল,
“অন্য মেয়েকে বিয়ে করলে আমি যদি ভালো থাকতাম তাহলে কেন এতদিন ধরে তোমাদের সাথে লড়াই করে যাচ্ছি? আমার ভালো থাকাটা রুহানির উপর নির্ভরশীল।”

ফালাকের বাবা দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বাজখাঁই গলায় বলল,
“তুই থাক তোর জেদ নিয়ে। দুনিয়াতে আর মেয়ে নেই? তোকে ওই মেয়ের পেছনেই পড়তে হলো?”
একা একা বিরবির করে রুহানির সমন্ধে দু’চারটে মন্দ কথা বলতে বলতে চলে গেলেন।

রুহানি মুখ গোমড়া করে বসে আছে। ফালাক শুকনো মুখে ওর পাশে এসে বসল। ফালাকের শুকনো মুখ দেখে রুহানি উদ্বেগ- উৎকন্ঠা নিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? খারাপ কিছু হয়েছে?”

“তুমি ওসব বাদ দেও। সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা না তোমার। পড়াশোনায় মন দেও।”

রুহানি ভারি কন্ঠস্বরে বলল,
“আংকেল, আন্টি কি বলেছেন? রাজি হয়নি তাই না?” রুহানির গলা ধরে এলো।

ফালাক ওর দিকে চেয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

রুহানি শুকনো হেসে বলল,
“আর চেষ্টা! এক সপ্তাহ হয়ে গেছে ফালাক।”

“এতদিন বাড়িতে যাইনি। মায়ের সাথে ঝামেলা হয়েছে খুব। গতকাল বাবা জোর করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। তারপর আবার নতুন সমস্যা শুরু হয়। আমি বুঝতে পারছি না কবে পর্যন্ত সব ঠিক হবে। মায়ের এক কথা আমি সব মেনে নিতাম, আমার কোনকিছুতে সমস্যা ছিল না কিন্তু হোটেলে নাচ? সমাজে দাঁড়াব কোন মুখে? মানুষ তো থুথু ছিটাবে।”

রুহানির চোখ জোড়া জলে ভরে উঠছে। গলা ধরে আসছে। মনে হচ্ছে খুব বড় পাপ করে ফেলেছে। যে কারণে সেই পাপ স্বরুপ এত কথা শুনতে হচ্ছে।

রুহানি উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“সব শেষ।”

ফালাক ওর কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কিছু শেষ হয়নি। আমি শেষ হতে দেব না।”

রুহানি ফালাকের দিকে ছলছলে চোখে বলল,
“এর পরেও কি করে বলছো? তুমি দেখতে পাচ্ছো না সব শেষ হয়ে যাচ্ছে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি।”

রুহানি ফালাককে রেখেই চলে যাচ্ছে। ফালাক ওর পেছনে পেছনে গিয়ে ওকে বাঁধা দিল। ফালাক বাঁধা দেওয়ায় রুহানি প্রচন্ড রেগে গেল। রেগে গিয়ে বলল,
“প্লিজ আমাকে একটু একা ছেড়ে দেও। প্লিজ।”

“কিন্তু রুহানি তুমি ওভার রিয়েক্ট করছো। রাগ কেন দেখাচ্ছো আমাকে?”

রুহানির আসলেই খুব রাগ হচ্ছে। রাগটা ঠিক কার উপর বুজতে পারছে না। তবে রাগ হচ্ছে। মাথায় আগুন জ্বলছে।
রুহানি চিৎকার করে বলল,
“আমি রাগ দেখাচ্ছি কারণ আমি খারাপ মেয়ে। আমার থেকে দূরে থাকো।”

রুহানি একটা রিকশা নিয়ে উঠে গেল। ফালাক শেষ বারের মতো ওকে ডেকে চুপ হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না।

.

ফালাক তিন দিন রুহানির সাথে যোগাযোগ করেনি। প্রথম দুদিন ফোন করে, হাজার চেষ্টা করেও ওর দেখা পায়নি। তাই আর ওকে ফোন করেনি রাগ করে। তারপর ফোন করল। ফোন করতেই রুহানি রিসিভ করল।

দু’পাশেই পিনপতন নীরবতা। ফালাক নীরবতা ভেঙে বলল,
“একটু দেখা করবে আমার সাথে?”
ফালাকের কন্ঠে আকুলতা স্পষ্ট। রুহানি সে আকুলতা উপেক্ষা করতে পারল না। তাই বলল,
“আসছি।”

রুহানির এই ছোট্ট আসছি কথায় যেন ফালাক পুরো পৃথিবী পেয়ে গেল। মুখে হাসি ফুটল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুহানির আগমনের আয়োজনে।
রুহানি ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে কারো কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। কয়েকবার ফালাকের নাম ধরে ডাকতেই দুজন মেয়ে একটা রুম থেকে হাসি মুখে বেড়িয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার নাম কি রুহানি?”

রুহানি কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। তারপর ওরা ওর হাত ধরে রুমের ভেতরে নিয়ে গেল। রুহানিও রোবটের মতো ওদের সাথে চলে গেল। মেকাপ, শাড়ি-গয়না পড়ে আছে খাটের উপর। একটা লাল শাড়ি রুহানির সামনে এনে বলল,
“শাড়িটাাতে আপনাকে বেশ মানাবে। স্যারের পছন্দ আছে।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,
“কিসের শাড়ি? শাড়ি দিয়ে কি হবে?”

“স্যার বলেছে আপনাকে পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে।”

“কিন্তু কেন?”

“তা তো জানি না৷ আমাদের যেটুকু বলা হয়েছে ততটুকুই করব।”
ওদের জোড়াজুড়িতে রুহানি শাড়ি পরে নিল। কিন্তু কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ওরা সাজিয়ে দিচ্ছে কিন্তু রুহানির সেদিকে খেয়াল নেই। ও ভাবনায় বিভোর। ফালাককেও কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।

সাজানো শেষে রুহানির নিজের দিকে খেয়াল হলো। একদম বউ মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ নিজেকেই মুগ্ধ হয়ে দেখল। ওরা সাজানো শেষে চলে গেল। রুহানি আর না পেরে ফালাককে ফোন করল। ফোনের টোন কাছেই বাজছে৷ পেছনে ঘুরতেই ফালাককে দেখতে পেল। ফালাক স্যুট কোর্ট পরা। ঘোরলাগা চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে। রুহানির একটু একটু ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ফালাক রুহানির দিকে এগিয়ে এল। ফালাক যতই এগিয়ে আসছে ওর হৃদপিণ্ডের গতি বাড়তে থাকল। ফালাক ওর কাছে এসে কানের ঝুমকায় টুকা মারল। রুহানি সাথে সাথে কেঁপে উঠল। ফালাক রুহানির চুলের বাঁধন এক টানে খুলে ফেলল। তারপর দূরে গিয়ে দাঁড়াল। রুহানিকে দু-চোখ ভরে দেখে বলল,
“পারফেক্ট। আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখতে। তাই আজ সে ইচ্ছে পূরণ করে ফেললাম।”

রুহানি স্বস্থির নিশ্বাস নিল। ও ভেবেছিল ফালাক না ওকে আজ জোর জবরদস্তি করে বিয়েই করে নেয়। কিন্তু ওর ভাবনায় পানি ঢেলে রুহানিকে শান্তি করে দিল।

ফালাক আবার রুহানির কাছে গেল। চুলে হাত ডুবিয়ে বলল,” তোমার জন্য সুখবর আছে। তোমার কেসটা অনেকটা এগিয়েছে। ইনভেস্টিগেশনে অনেক নতুন তথ্য উঠে এসেছে যা সবটাই তোমাদের পক্ষে।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে মুচকি হাসল। ওর চোখে প্রাপ্তির খুশি।

ফালাক হটাৎ জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো?”

রুহানির হাসি মিলিয়ে গেল। মলিন মুখে ওর দিকে তাকাল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। ওর চোখ ছলছল করছে।
ফালাক রুহানিকে নিজের সাথে আলতো করে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“রুহানি আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। এতটাই ভালোবাসি যে কারো এতটা কাছে তোমাকে যেতে দিতে পারব না।”

রুহানি ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমিও কারো এতটা কাছে যেতে পারব না। প্লিজ কিছু করো ফালাক। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। দেখবে একদিন মরে গেছি।”

ফালাক ওর ঠোঁটে আঙুল ছুইয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“হিশশ! এ কথা বলো না। মরে গেলে একা কেন মরবে? আমাকে নিয়েই মরবে। আমিও আর নিতে পারছি না।”

রুহানি ফালাককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল। ফালাক রুহানিকে ছাড়িয়ে ওর চোখের পানি মোছানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রুহানি কেঁদেই চলেছে। ফালাক দু’হাতে রুহানির মাথা চেপে ধরে। কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
“চুপ! একদম চুপ! সব ঠিক হয়ে যাবে।” আচমকা রুহানির ঠোঁটের কোনে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে বুকে চেপে ধরল। যেন হারিয়ে না যায়।

চলবে….

প্রিয় অভিমান পর্ব-২৪

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৪|

সকালের আলো ফুটেছে। স্নিগ্ধ মিষ্টি রোদ জানালা ভেদ করে রুহানির বিছানায় পড়েছে। পুরো ঘরে আলোর আভা জানান দিচ্ছে সকাল হয়েছে। কিন্তু রুহানির বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে। অনেক রাত পর্যন্ত ফালাকের সাথে কথা বলেছে। রুহানি গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় দুম দুম শব্দ। মনে হচ্ছে বাইরে যুদ্ধ লেগে গেছে। আর যুদ্ধের সেই বোমা বারুদ ওর দরজায় পড়ছে।

রুহানির মা বারবার রুহানিকে ডেকে যাচ্ছে। রুহানি আর না পেরে উঠে বসে পড়ল।
“ওহ, মা থামো এবার। উঠে পড়েছি।”

দরজায় আর কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রুহানি হাই তুলে চোখ বন্ধ করে বিছানায় চুপটি করে বসে আছে। ইচ্ছে করছে বিছানায় শুইয়ে পড়তে। রুহানি চোখ খুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে আটটা বাজছে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে গেল।

ইন্সটিটিউটে পা রাখতেই ওর ফোন বেজে উঠল। রুহানি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে স্কিনে তাকাল। ফোনের স্কিনে আহিলের নামটা জ্বলজ্বল করছে। আহিল কি বলতে ফোন করেছে সেটা ভাবতে ভাবতে কেটে গেল। রুহানি নিজেই কল করে নিল।

আহিল অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভেবেছিলাম ইচ্ছে করেই ধরছো না। রাতে অনেক বার ফোন করেছি ব্যস্ত পেয়েছি। নিশ্চয়ই ফালাকের সাথে ব্যস্ত ছিলে।”

রুহানি ছোট্ট করে বলল, “হুম।”

আহিল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রুহানি কানে ফোন নিয়ে অফিস রুমের দিকে যাচ্ছে।
“রুহানি আমি ফালাকের সম্পর্কে জানতে চাই। যদি ফালাক সব দিক দিয়ে তোমার জন্য পারফেক্ট হয় তবে আমি তোমার বাবা-মার সাথে কথা বলব। ফালাকের ফ্যামিলির সাথেও কথা বলব। আমার কোন আপত্তি থাকবে না। যতই হোক আমার একটা দায়িত্ব আছে তোমার প্রতি সেটা এড়িয়ে যেতে চাই না।”

রুহানি ফালাকের পরিচয় দিল, ওর সম্পর্কে সব কিছু বলার পর বলল,
“আমি আপনাকে ফালাকের পরিচয় দিলাম অন্য কারণে। ভালোবেসেছি কোন ক্রাইম করি নি। লুকানোর কিছু নেই তাই। আমি জানি ফালাক আমার জন্য পারফেক্ট আর হোপফুলি আপনারও সেটাই মনে হবে।”

আহিল মৃদু হাসল। মৃদু হেসে বলল,
“ফালাকের কাছেও নিশ্চয়ই কিছু লুকাও নি।”

“না, ওর কাছে আমার লুকানোর মতো কিছু নেই। আপনার ব্যাপারেও ও সব জানে। আমার পরিবার, আমার জব, আমি কি করি সব জানে। সব জেনেই আমাকে ভলোবেসে আমার পাশে আছে। এমনকি এটাও জানে আমি দু’বার টাকার জন্য হোটেলে নাচ করেছি যেটা আমার পরিবারও জানে না।”

আহিল রুহানির কথা শুনে চমকে গেল। রুহানির ব্যাপারে সব জানলেও এটা জানে না যে রুহানি হোটেলে নাচ করেছে টাকার জন্য। আহিল তখনকার মতো কথা শেষ করল।

.

রুহানি ব্রেক টাইমে ফালাককে ফোন করল। ফালাক অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং এটেন্ড করায় রুহানির সাথে কথা বলতে পারে নি। ফালাক মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে রিলেক্স মুডে বসল। ডেক্সের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে লক খুলে দেখতে পেল রুহানি অনেকবার ফোন করেছে। ফালাক দ্রুত রুহানিকে কল করল।

রুহানি তখন কাজ করছিল। টেবিলের উপরে ফোনটা বেজে চলেছে। রুহানি রিসিভ করে ফিসফিস করে বলল,
“কাজ করছি। তুমি কি আজ ফ্ল্যাটে থাকবে? কথা ছিল।”

“আজকে তো আমাকে বাসায় যেতে হবে। তবে কিছু সময়ের জন্য থাকতে পারি। পাঁচটা নাগাদ আমি ফ্ল্যাটে থাকব। তুমি এসো।”

“আচ্ছা, আমি পাঁচটার পর তোমার ফ্ল্যাটে যাব। এখন রাখছি।”
রুহানি ফোন কেটে দিয়ে নিজের কাজে মন দিল। ফালাকও ল্যাপটপ খুলে বসল। রুহানির সাথে আবার কি হলো সেটা মাথায় ঘুরছে।

.

ফালাক ফ্রেশ হয়ে কিচেনে কফি বানাতে গেল আর তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। রুহানি ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যে গরম পড়েছে। এটুকু রাস্তা আসতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল। দরজা খুলে গেল। ফালাক সাদা টিশার্ট আর টাওজার পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি কোন কথা না বলে সরাসরি ভেতরে ঢুকে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেল। ফালাকও ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছে। রুহানি জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে পিপাসা মিটিয়ে নিল।

তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ফালাককে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পিপাসা পেয়েছিল খুব। বাইরে কি যে গরম।”

ফালাক টেবিলের উপর থেকে টিস্যু নিয়ে রুহানির কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলল,
“হাত মুখ ধুয়ে নেও ভালো লাগবে।”

রুহানি ব্যাগ রেখে ডাইনিং স্পেসের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুমে হাত মুখ ধুতে চলে গেল।
রুহানির এখন একটু রিলেক্স লাগছে। ফালাক বরফের টুকরো গ্লাসে দিচ্ছে। লেবু চিপকে রস পানিতে দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া দিচ্ছে। রুহানির ধীরে ধীরে ফালাকের দিকে এগিয়ে গেল।

ফালাক রুহানিকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“শরবতটা খাও ভালো লাগবে।”
তারপর গ্লাস এগিয়ে দিল।

রুহানির পিপাসা তখনও মিটে নি। তাই গ্লাস নিয়ে এক ঢুক খেয়ে ফালাকের দিকে চেয়ে বলল,
“বাহ! তুমি দেখছি খুব কাজের। ভালো বানিয়েছো।”

ফালাক ভাব দেখিয়ে বলল,
“অবশ্যই। সবাইকে কি তোমার মতো অকাজের মনে করো?”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি বললে তুমি? পাঞ্চ খেয়ে নাক ফাটাতে চাও?”

ফালাক ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“একদম না। তারপর দেখা যাবে ভাঙা নাকের জন্য বউ পাব না।”
তখনই ফালাকের নাকে পোড়া পোড়া গন্ধ এলো। ফালাক নাক দিয়ে বারবার শুকে রুহানির দিকে চেয়ে বলল,
“গন্ধ পাচ্ছো কোনো?”

রুহানি নিশ্বাস টেনে বলল,
“হ্যাঁ কিচেন থেকে আসছে। কিছু কি পুড়ছে?”

ফালাক ওহ মাই আল্লাহ বলে কিচেনে দৌড়ে গেল। রুহানিও গেল। ফালাক কফির জন্য পানি বসিয়েছিল পানি শুকিয়ে পাত্র পুড়ে গেছে। ফালাক তাড়াতাড়ি চুলা বন্ধ করে দিল। রুহানি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

“এই তোমার ফার্স্ট ক্লাস কাজের নমুনা? কি মশাই এতক্ষণ তো বেশ বড়াই করছিলেন।”

“এসব তোমার জন্য হয়েছে। দরদ দেখিয়ে শরবত খাওয়াতে গিয়ে এই অবস্থা।”

রুহানি ফালাকের কলার চেপে ধরে বলল,
“আমার জন্য দরদ দেখাবে না তো কার জন্য দেখাবে?”

ফালাক রুহানির নাকের ডগা চেপে ধরে বলল,
“বেডরুমে যে আছে তার জন্য।”

রুহানি ফালাকের কলার ছেড়ে বেডরুমের দিকে গেল। রুহানির মনে হচ্ছে বেডরুমে সিক্রেট কিছু আছে। নয়তো সেদিন যেতে দিল না কেন।
ফালাক মিটমিট করে হাসতে হাসতে রুহানির পেছনে পেছনে গেল।

ফালাকের রুমে গিয়ে রুহানির চোখ ছানাবড়া। চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। কথা বলতে ভুলে গেছে। পুরো রুম জুড়ে যেন রুহানির বসবাস। প্রতিটি দেয়ালে ওর ছবি দিয়ে ভর্তি। বিছানার মাথার কাছের দেয়ালে রুহানির বাঁধানো একটা বড় পেইন্ট। রুহানির বিস্ময় যেন কাটছে না। রুহানি ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক রুহানির বিস্মিত চোখ স্পষ্ট দেখতে পেল। সে চোখে পানি টলমল করছে।

“এসব তুমি কবে করলে?”

ফালাক মাথা চুলকে বলল,
“বহুকাল আগে।”

রুহানি কথা বলছে না। আবারো বড় পেইন্টের দিকে তাকাল। নিজেকে অপ্সরী কিংবা কোনো রাজ্যের রাণী লাগছে। একদম ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। ফালাক রুহানির কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বলল,
“তুমি দেখছি ইমোশনাল হয়ে পড়ছো? সামান্য পিকচারই তো।”

রুহানি কোন কথা বলছে না। ফালাক পরিস্থিতি অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বলল,
“তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু।”

রুহানি ফালাকের বিছানায় বসল। ফালাক ওর পাশে বসল। পূর্ণ দৃষ্টি রুহানির দিকে। রুহানি ফালাককে সব খুলে বলল।
“আহিল আমাকে হয়তো ফলো করত। ও নিজেই সব জেনেছে। রাতের বেলা হুট করে বাসায় চলে আসে। তারপর আমি সব স্বীকার করে নেই। আর সব কিছু ক্লিয়ার করে দিয়েছি। তারপর আজকে সকালে ফোন করে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। আমি সব বলে দিয়েছি। কিন্তু ও হুট করে তোমার পরিচয়, ঠিকানা কেন চাইল বুঝতে পারছি না। আর ওর বিহেভিয়ারও অদ্ভুত লাগছে আমার।”

ফালাকও ওর কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারপর রুহানিকে শান্ত করার জন্য বলল,
“সেসব দেখা যাবে। তোমাকে আগামীকাল আমার সাথে যেতে হবে। কেইস ফাইল হবে।”

“আচ্ছা, এখন আমাকে বাসায় যেতে হবে। আগামীকাল ভার্সিটিতে দেখা হবে।”

“আমি যাওয়ার সময় তোমাকে পৌঁছে দেব। আমি রেডি হয়ে নেই।”

.

ফালাক রুহানিকে ওর বাড়ি থেকে একটু দূরে নামিয়ে দিল। ফালাক রুহানির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে পেছনে পেছনে হাঁটছে। রুহানির কেন জানি অনেক ভালো লাগছে। কেউ ওর কেয়ার করছে। রুহানি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকার পর ফালাক দাঁড়িয়ে গেল। রুহানি বাড়িতে ঢুকে ফালাককে মেসেজ করে জানিয়ে দিল চলে এসেছে। ফোন থেকে চোখ সরাতেই মায়ের মুখোমুখি পড়ল। ওর মা ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রুহানি দাঁড়িয়ে গেল।

রুহানির মা শক্ত কন্ঠে বলল,
“রাত ৮টা বাজে। এত দেরি হলো কেন? কোথায় গিয়েছিলি?”

রুহানি আমতা আমতা করে বলল,
“একটু কাজ ছিল।”

“কি কাজ শুনি? ওই ছেলেটার সাথে ঘুরে বেড়ানো?”
রুহানি মায়ের কথা শুনে চমকে গেল। ওর মা কি করে জানল। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় বিড়বিড় করে বলল, “আহিল।”

রুহানির মা ওর জবাব না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,
“যা শুনছি তা কি সঠিক? তোর অন্য জায়গায় পছন্দ আছে?”

রুহানি আর না ভয় পেয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
“কেন থাকতে পারে না? থাকাটা কি অন্যায়?”

রুহানির মা চেঁচিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, অন্যায়৷ অবশ্যই অন্যায়। আহিলের সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিছুদিন পরে ওর বাবা-মা আসবে। আর এখন মেয়ে বলছে তার অন্য জায়গায় পছন্দ আছে। কি করে তুই এমন একটা কাজ করলি? আহিলের বাবা-মার সামনে কোন মুখে দাঁড়াব? আর আহিল? ওর কি দোষ? ওর কাছে আমাদের এভাবে ছোট করলি? আমাদের দুর্দিনে এগিয়ে এসেছে তার প্রতিদান এভাবে দিবি?”

রুহানির মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ওর বাবা হুইলচেয়ারে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রুহানও পড়া ছেড়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
রুহানিও ভীষণ রেগে গেছে।
“আহিল! আহিল! তোমাদের মেইন প্রায়োরিটি এখন আহিল। আমার কোন দাম নেই? আমি কি তোমার পেটের মেয়ে নই? আর দুর্দিন, কোন দুর্দিনের কথা বলছো মা? আহিল দুর্দিনে নয় সুদিনে এসে আমার সুখ-শান্তি নষ্ট করতে এসেছে। কোথায় ছিলে সেদিন তোমার আর বাবার প্রিয় আহিল, যেদিন আমি কাঠ ফাটা রোদে, ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি কিছু টাকার জন্য?

কোথায় ছিল সেদিন যেদিন আমি নিজের সম্মান বাজারে তুলেছি? বাবার অসুস্থতার জন্য,ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য হোটেলে গিয়ে নাচ করেছি। আমি রুহানি পাঁচ হাজার টাকার জন্য ভরা মজলিসে নাচ করেছি। সে খবর তোমাদের আছে? কাদের জন্য আমি এতকিছু করেছি বলতে পারো মা? “(রুহানি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল)

কান্না থামিয়ে বলল,
” আজ আমার সেই বাবা-মা আমাকে ভুলে গেছে। আমি ছোট থেকে আরাম-আয়েশে বড় হয়েছি। কষ্ট, অভাব কখনো আমাকে ছুয়ে দেখে নি। কিছু চাওয়ার আগেই পেয়েছি। সেই আমি কিছু টাকার জন্য কি না করছি, নিজের পরিবারের খুশির জন্য নিজের খুশি বিসর্জন দিয়েছি। কাজ করেছি। হ্যা তোমাদেরও এ নিয়ে দুঃখ আছে, আপসোস করেছো কিন্তু মানসিক আর শারিরীক যন্ত্রণা দুটোই আমাকে ভুগতে হয়েছে। কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। মরে গিয়ে মুক্তি পেতে চেয়েছি কতবার কিন্তু তোমাদের কথা ভেবেছি। সব সময় তোমাদের কথা ভেবেছি। তোমরা সেসব দিনের কথা ভুলে গেলেও আমি ভুলতে পারব না। আমার মন-মস্তিস্ক সেটা হতে দেবে না। আমি চাইলেই সে-সব দুর্বিষহ দিনের কথা ভুলতে পারব না। যখন আমার মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন ছিল, সবচেয়ে বেশি আহিলকে প্রয়োজন ছিল তখন আহিল কোথায় ছিল? ভুলে গেলে সেদিনের কথা যেদিন বাবা আহিলের বাবাকে ফোন করেছিল সাহায্যের জন্য আর উনি বিয়ে ভেঙে দিল? তোমরা ভুলে যেতে পারো আমি পারি নি। আর না কখনো ভুলতে পারব। যাইহোক এ-সব বলে লাভ নেই। আমার কষ্টের কথা কেউ বুঝবে না। আমার খুশির কথা আমার বাবা-মার ভাবার সময় নেই। আমি তোমাদের জন্য অনেক কিছু করেছি কিন্তু তোমাদের খুশির জন্য আমি আহিলকে বিয়ে করতে পারব না। আর হ্যাঁ আমি আহিলকে ধোঁকা দেই নি। হয়তো এটা আহিল তোমাদের বলে নি। আহিলের বাবা বিয়ে ভাঙার পরেই আমি ফালাককে ভালোবেসেছি। তাই ধোঁকা দেওয়া কিংবা তোমাদের ছোট হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু তোমরা যদি তাই মনে করো আমার কিছু করার নেই।”

রুহানি সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। ওর বাবা-মা দুজনেই নির্বাক। একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। রুহান তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে। নীরবতা ভেঙে রুহান বাবা-মার কাছে এসে বলল,
“নিজেদের সুবিধার জন্য আপুকে বিয়ে করার জন্য জোর করা হলে সেটা অন্যায় হবে।”
রুহান আবার নিজের রুমে চলে গেল।

.

ফালাক বাড়িতে ঢুকতেই ওর মা গম্ভীরমুখে এগিয়ে এসে বলল,
“এত দেরি হলো কেন? তুমি অফিস থেকে সাড়ে চারটায় বেড়িয়েছো আর বাড়িতে এসেছো ন’টায়?”

ফালাক বাহানা খুঁজছে। তখনই ওর মা বলল,
“আমি কি তোমার কোনো খবর রাখি না? তুমি আমার একমাত্র ছেলে ফালাক। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন, আশা। তোমাকে সেভাবেই বড় করেছি আর তুমি হোটেল নাচনেয়ালি একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করছো? এই তোমার চয়েস? ছিহ!”

ফালাক মায়ের কথা শুনে হতবাক। ওর মা রুহানির কথা বলছে কিন্তু এসব তিনি কি করে জানলেন? কে বলেছে?
“মা তোমাকে এসব কে বলেছে?”

“কে বলেছে সেটা ফ্যাক্ট না। চোখ কান খোলা রাখলে সব জানা যায়, দেখা যায়। আমি সব মেনে নেব কিন্তু হোটেলে নাচ করা মেয়ে আমার বাড়ির বউ হবে না।”

“মা, রুহানি খুব ভালো মেয়ে। ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। ওদের পরিবারের সাথে একটা দুর্ঘটনা…..
ফালাকের মা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” আমি সব জানি। সব খোঁজ আমি করেছি কিন্তু আমার শেষ কথা হোটেলে নাচা মেয়ে আমার বাড়ির বউ হবে না। তুমি ওকে ভুলে যাও। আমি তোমার জন্য মেয়ে দেখছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেব।”

ফালাক এতক্ষণ ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও শক্ত কন্ঠে বলল,
“কারো চরিত্র একটা ঘটনা দ্বারা বিচার করা যায় না। কেউ শখ করে হোটেলে নাচতে যায় না। আমি রুহানিকে ভালোবাসি। নিজেকে ভুলে যাব কিন্তু ওকে ভুলতে পারব না। বিয়ে করলে ওকেই করব। তোমার কথা রাখতে পারছি না। সরি মা।”

রুহানি বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে। আজ অনেক কিছু বলে ফেলেছে। আর সহ্য করতে পারছে না।
ফালাক ফোন করেই যাচ্ছে রুহানি চোখের পানি মুছে কল রিসিভ করল।
কল রিসিভ করতেই ফালাক হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“আহিল কি করেছে জানো? তোমার সন্দেহই ঠিক ছিল। ও আমার বাড়ির ঠিকানা এইজন্যই নিয়েছিল। ও আমার বাড়িতে বলেছে হোটেলে নাচনেয়ালির সাথে আমি প্রেম করি। আমার বাড়িতে ভয়ানক অবস্থা। মা তো আমার উপর রেগে আছে।”

রুহানি ওর থামানো কান্না যেন আর থামিয়ে রাখতে পারল না। রাগে ফেটে যাচ্ছে। রাগ-কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“ও আমার বাড়িতেও ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে। মা আমাকে অনেক বকাবকি করেছে।”

ফালাকের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। আহিলকে হাতের কাছে পেলে কি করত জানা নেই। রাগে গজগজ করছে। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে।
“ওকে পেলে আমি মার্ডার করে দেব।”
তারপর ফোন কেটে দিল। রুহানি বিছানায় ফোন রেখে মায়ের ঘরে গেল। ওর বাবা আর মা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। রুহানিকে দেখে থমকে গেল। রুহানির চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ফুসফুস করছে।

রুহানির মা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে রুহানি, এমন করছিস কেন?”
রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আহিল কি চাইছে? আমি যেন সভ্য সমাজে না বাস করতে পারি? সবাই যেন আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়?”

“কি করেছে ও?”

“তোমাদের অতি প্রিয় আহিল মানুষের কাছে বলে বেড়াচ্ছে আমি হোটেলে নাচ করা মেয়ে। ফালাকের মায়ের কাছে আমার নামে খারাপ কথা বলেছে। এরপরও আহিল তোমাদের কাছে সেরা? ওকে আমি….”

রুহানির শ্বাস উঠে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। ওর মা দ্রুত ওকে ধরে বসিয়ে পানি দিল। ওর মাথায় পিঠে হাত বুলাচ্ছে। যাতে ও শান্ত হয়ে যায়। রুহানি পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে কেঁদে দিল।

চলবে…….

প্রিয় অভিমান পর্ব-২২+২৩

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২২|

রুহানি টেবিলের উপর মাথা রেখে বসে আছে আর ওর বন্ধুদের বকবক শুনছে। ওর মাথায় একটা কথাই ঘুরছে ফালাক ওকে এড়িয়ে চলে গেল। বুঝতে পারছে না এতকিছুর পর ফালাকের না ওর রাগ করার কথা।

রুহানি মাথা তুলে উঠে বসে। ওর ভালো লাগছে না। মন খারাপ আর তার উপর বন্ধুদের এই বকবকানি বিরক্ত লাগছে।

রুহানি উঠে দাঁড়াল। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে নুশা বলল,
“কই যাস এত জবরদস্ত আড্ডা ছেড়ে?”

“তোদের এই জবরদস্ত আড্ডায় বিরক্ত লাগছে। হাওয়া খেয়ে আসি।”

নুশা মিনমিন করে বলল,”প্রেমে পড়লে প্রেমিক ছাড়া সব পানসে লাগে।”

রুহানি ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। নুশা মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে বলল,”আমি কিছু বলি নি।”

রুহানি ব্যাগ নিয়ে দুম করে বেরিয়ে গেল। রুহানির রাগ লাগছে ফালাক ওকে এড়িয়ে কেন গেল? সেদিন তো ওই ওকে অপমান করেছিল। রুহানি তো একটা প্রতিউত্তর করে নি। এর জবাব ওর চাই।

ফালাক যেখানে যেখানে থাকতে পারে তার সব জায়গায় খোঁজা শেষ। অবশেষে ফালাককে লাইব্রেরীতে পাওয়া গেল।

ফালাক বই খুলে বসে আছে। শুধুমাত্র পড়ার ভান করে যাচ্ছে। মাথায় ঘুরছে অন্য কিছু। নুশা কেন ডেকেছিল? আর সাথে রুহানিও ছিল। ফালাক এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জোর করে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া ব্যস্ত। ফালাক পাতা উল্টাতেই রুহানি নিঃশব্দে ওর পাশের চেয়ারে বসল।

রুহানি নিচু গলায় ফালাকের দিকে হেলে বলল,
“ফালাক!”

ফালাক রুহানির দিকে চেয়ে চমকে গেল। ও কখন এসে বসেছে খেয়ালই করে নি।
ফালাককে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
“দু-মিনিট কথা বলতে চাই।”

ফালাক ফিসফিস করে বলল,
“এটা লাইব্রেরী, গল্প করার জায়গা না। তাই প্লিজ কথা বলো না।”

“আমি তো চেঁচিয়ে কথা বলব না।”

ফালাক ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“রুহানি বিরক্ত করো না প্লিজ। আমি গুরুত্বপূর্ণ একটা কলাম পড়ছি।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে চুপ করে গেল। তারপর সোজা হয়ে বসে রইল। ফালাক আড়চোখে রুহানির দিকে তাকাল। ও গাল ফুলিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছে। ফালাক পাত্তা না দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিল। দুই লাইন পড়ার পর বুঝতে পারল ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কি করে ঢুকবে রুহানি ওর পাশে বসে ওর মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। ফালাক বই রেখে উঠে গেল। রুহানি ফালাককে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে কনফিউশনে পড়ে গেল ও বসে থাকবে না উঠবে।
ফালাক ওকে বুঝার সময় না দিয়ে হনহন করে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে গেল। রুহানিও দ্রুত লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ফালাকের পেছনে পেছনে গেল।

রুহানিকে পেছনে আসতে দেখে ফালাক বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কি চাই তোমার পেছনে পেছনে আসছো কেন?”

রুহানি দাঁড়িয়ে গেল। তারপর শুকনো হেসে বলল,
“আমি পেছনে পেছনে আসছি না তুমি আমাকে পেছনে পেছনে ঘোরাচ্ছো?”

ফালাক ওর কথা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, এটা তোমাকে বলার পর, তুমি জানার পরেও আমাকে কেন ঘোরাচ্ছো? শুনলেই তো হয়।”

ফালাক নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না? একজন মানুষ যখন বারবার কাউকে এড়িয়ে যায় তার মানে এটাই যে সে মানুষটা তার জন্য বিরক্তিকর। তুমি কি বুঝতে পারছো না তুমি আমার জন্য কতটা বিরক্তিকর?”

রুহানি মাথা নিচু করে নিল। তারপর মাথা উঁচু নিচু করে বুঝাল তার অবস্থান। চোখে পানি চলে এসেছে ওর। এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না। ফালাকের তিক্ত কথাগুলো ওকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। ফালাক তখনও দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল।

রুহানি বুঝতে পারছে না ওর দোষটা কোথায়। কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে৷ ফোনের অপর পাশ থেকে নুশা ওকে বিভিন্নভাবে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুহানির একই কথা,
“সেদিন ফালাক আমাকে কত আজেবাজে কথা বলেছে। আমার হোটেলে নাচ করা নিয়ে কটু কথা বলেছে। আমাকে লোভী বলেছে। আমি নাকি টাকার জন্য সব করতে পারি। বাজে ইংগিতও করেছে। এতকিছুর পরেও আমি গিয়েছি ওর কাছে আর ও আমার সাথে কি করলো? নুশা আমি কি এই ব্যবহার ডিজার্ভ করি?”

“একদম না৷ তুই কাঁদছিস কেন? ও তোকে পায়ে ঠেলেছে, ও পস্তাবে। কিন্তু তোকে এর জবাব নিতেই হবে।”

“জবাব নেব কি করে? ও তো আমাকে কিছু বলার সুযোগই দেয় না। এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। আমি সুযোগ পেলে তো কিছু বলব? কিন্তু সে সুযোগই পাই না।”

“হামলা কর ওকে। ওর বাড়িতে চলে যা। শুনেছি ভার্সিটির এইদিকে কোন এক ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানে গিয়ে ধরবি।”

“কিন্তু নুশা…”

“ডোন্ট ওরি, আমি যাব তোর সাথে। বাইরে অপেক্ষা করব৷ আর তুই কবে থেকে কাউকে ভয় পেতে শুরু করলি?”

“এড্রেস?”

“ম্যানেজ করে নেব। এখন তুই কান্নাকাটি বন্ধ কর।”

রুহানি কান্নাকাটি বন্ধ করলেও ফালাকের ফ্ল্যাটে যাবে এটা ভেবে নার্ভাস লাগছে।

.

মাঝে কেটে গেছে আরো দুটো দিন। রুহানি ফালাকের সাথে দেখা করে অপমান আর ইগ্নোর করার জবাব নেবে। সন্ধ্যা বেলায় রুহানি আর নুশা ফালাকের বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে হাজির। দশ তলা বিল্ডিংয়ের আটতলায় একটা ফ্ল্যাটে ফালাক থাকে।
রুহানি ফালাকের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জোরে একটা শ্বাস নিল। নিজেকে শক্ত করে কলিং বেল চাপল। দু’বার বেল বাজাতেই ফালাক দরজা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে গেল। রুহানি ফালাকের চাহুনিকে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ফালাক তখনও দরজার সামনে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি হুট করে ওর ফ্ল্যাটে কি করছে?

রুহানি ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক দেখছে। আর উঁকিঝুঁকি মারছে। ফালাক ওর বিহেভিয়ার দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারছে না।
ফালাক দরজা বন্ধ করে রুহানির সামনে গিয়ে বলল,”হুয়াট?”

রুহানি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আর কে থাকে এখানে?”

ফালাক চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“মানে? কে থাকবে? কেউ থাকে না, আমি একাই থাকি। তুমি এই সময় এখানে কি চাও সেটা বলো। পারমিশন ছাড়া হুট করে কারো ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওয়া কোন ধরনের অসভ্যতা?”

রুহানি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আমার মতো মেয়েদের আচরণ তো এমনই। সময়, স্থান কিছুই মানে না৷ প্রয়োজনে যেখানে সেখানে চলে যায়। অবাক হওয়ার কি আছে?”

ফালাক রুহানির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। তারপর বলল,
“এখান থেকে যাও।”

রুহানি সন্দেহ নিয়ে বলল,”দূর দূর করছো কেন? কে আছে এখানে? কাকে ভয় পাচ্ছো?”

তারপর রুহানি ফালাকের রুমের দিকে যাচ্ছিল। ফালাক ওর হাত চেপে ধরে ফ্লাটের বাইরে বেরিয়ে এলো। রুহানি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, ছটফট করছে। ফালাক রুহানিকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল। ছাদে নিয়ে রুহানির হাত ছেড়ে দিল।

রুহানি চারদিকে চেয়ে বলল,
“আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন?”

ফালাক শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি বুঝেছি তুমি তোমার কথা না বলে আমার পিছ ছাড়বে না। নেও বলো কি বলবে। আমি শুনছি।”

“হ্যাঁ, শুনতে হবে। জবাব চাই আমি। আমার প্রতি তোমার এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি? তুমি আমাকে সেদিন এত এত কথা শুনালে, এত আজেবাজে কথা বললে, আমি অসুস্থ পর্যন্ত হয়ে গেলাম। সেসব নাহয় বাদই দিলাম। তারপর থেকে তুমি আমার সাথে কি আচরণটা করছো? কেন করছো?”

ফালাক রুহানির দিকে আগাতে আগাতে বলল,
“কি করেছি আমি? তোমার থেকে দূরে থাকছি এর বেশি তো কিছু করি নি। না-কি তুমি এটা চাও আমি আগের মতো তোমার পেছনে ঘুরঘুর করি? হাহ! এটাই চাচ্ছো?”

রুহানি পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আমি এর কথা বলছি না। তুমি ভালো করেই জানো তুমি কি করছো।”

ফালাক হোহো করে উচ্চস্বরে হেসে বলল,
“আমি একটা মেয়েকে ভালোবেসে ছিলাম কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে নি, অন্য একজনকে ভালোবেসেছে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে তাই আমি তার থেকে সরে এসেছি, তাকে এড়িয়ে চলছি, ভালোবাসার আগুন চোখের পানিতে নিভানোর চেষ্টা করছি। ব্যাস!”

রুহানি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু এখন আর বলতে পারছে না।
ফালাকের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
রুহানি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
“তোমার আমার কথা শোনা উচিত ছিল। সবটা জানা উচিত ছিল। কিছু না জেনে না শুনে কারো সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা কি ঠিক? আহিলের সাথে দু’বছর আগে থেকেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”

রুহানির কথা শুনে ফালাক রিয়েক্ট করতে ভুলে গেল। তার মানে রুহানি অনেক আগে থেকেই অন্য কারো। রুহানির প্রতি অন্য কারো অধিকার। ফালাক শুধুমাত্র তৃতীয় পার্সন হয়ে ওদের মাঝে ঢুকেছিল। ফালাক ছলছলে চোখে বলল,
“বেশ, তাহলে আমিই মাঝে ঢুকে পড়েছিলাম। তোমার এটা আগে বলা উচিত ছিল। রুহানি চলে যাও। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার যন্ত্রণা বাড়িও না। প্লিজ চলে যাও।”

ফালাক চোখের কোনা থেকে পানি মুছে ছাদ থেকে চলে যাচ্ছে। রুহানি ফালাককে ডাকছে কিন্তু ফালাক দাঁড়াচ্ছে না। ফালাকের বুকের ভেতরটা হুহু করছে। উত্তাল পাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷ একটা চাপা আর্তনাদ যন্ত্রণা দিচ্ছে। রুহানির ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে করছে না।

রুহানি চিৎকার করে বলল,
“ফালাক আই লাভ ইউ।”

ফালাক থমকে দাঁড়িয়ে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে দুঃখে কষ্টে ওর কান গেছে। রুহানি ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ফালাক আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।”

ফালাক ঘুরে দাঁড়াল। রুহানি বসে বসে কাঁদছে। ফালাক ওর দিকে এগিয়ে গেল। রুহানির পাশে বসে কাঁপা গলায় বলল,
“কি বললে তুমি?”

রুহানি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। যখনই আহিলের সাথে বিয়ের কথা ভাবি দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রথমে বুঝতে পারি নি, পরবর্তীতে তোমার মুখটা বারবার ভেসে উঠতো। যখন বুঝতে পেরেছি তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি শুনতে চাও নি।”

ফালাকের হৃদয় জুড়ে আলোড়ন শুরু হয়েছে। প্রাপ্তির অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীর সুখ ওর কাছে এসে ধরা দিয়েছে।
ফালাক রুহানির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“আমি যা শুনতে চেয়েছি তোমার কাছে তুমি বলতে এসেছো অথচ আমি ফিরিয়ে দিয়েছি? কত বড় অপদার্থ আমি।”

“তা তো অবশ্যই। কতবার বলতে চেয়েছি কিন্তু তুমি শুনতে চাও নি। আমি এতটা টানাপোড়েনের মাঝেও তোমাকে বেছে নিয়েছি কিন্তু তোমার সাপোর্ট পাই নি।

ফালাক অসহায় ফেস করে বলল,
“সরি রুহানি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর হবে না।”

রুহানি চুপ করে আছে৷ ফালাক দাঁড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে দুহাত প্রসারিত করে বলল,
“বাদামি চোখের কণ্যা মনের লেনদেনটা অফিসিয়ালি হয়ে যাবে কি? গ্রহণ করবে কি আমায় বিল্লিরাণী? ”

রুহানি দু’হাতে চোখের পানি মুছে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে ফালাককে জড়িয়ে ধরল। শুভ পরিণয়ে একে অপরকে বেঁধে নিল।

চলবে…..

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২৩|

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পুরো কলোনিতে বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকার কলোনির কর্দমাক্ত রাস্তা বাজ পড়ার কারণে দিনের আলোর মতো ঝলমলিয়ে উঠছে আবার মুহুর্তেই মিলিয়ে যাচ্ছে। এমনই বর্ষণরত রাতে হাজারো যুবক-যুবতী প্রেম গাথা তৈরি করছে। ছন্দে, উপমায় নিজেদের সুপ্ত অনুভূতি প্রকাশ করছে। ফালাক আর রুহানি ফোনালাপে প্রেম-কাব্য রচনা করছে। রুহানি চাঁদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিল। শীত শীত লাগছে।

ফালাক বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছুয়ে বলল,
“রুহানি বারান্দায় এসে দেখো কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে।”

“হু, সাথে বাজ পড়ছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমি বারান্দায় যাব না। দরজা বন্ধ করে দিয়েছি অনেক আগে।”

“রুহানি যে এত ভীতু জানতাম না তো। বাজ পড়ার শব্দে ভয় পায়? হাও সুইট!”

“মজা করছো না? আমার সত্যিই ভয় লাগে। হার্ট দুর্বল কি-না তারপর দেখা গেল হার্ট এটাক করে মরে টরে গেলাম।”

ফালাক রাগ দেখিয়ে বলল,
“এসব কি বলো? মরে-টরে যাবে মানে কি? যদি আরেকবার মরে যাওয়ার কথা বলো তবে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা ভাই, বলব না।”

ফালাক নাক ছিটকে বলল,
“ভাই? সিরিয়াসলি?”

“উমম, তাহলে কি আংকেল লাগো তুমি? আংকেল বলব?”

“কি বলবে সেটা আগামীকাল ভার্সিটিতে আসো তারপর বুঝাচ্ছি। আর শুনো তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

রুহানি উঠে বসে বলল, “কি কথা?”

“সেটা আগামীকাল সামনাসামনি বলব। এখন ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে। আর হ্যাঁ আমাকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ভুলো না।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “আচ্ছা। গুড নাইট।”
ফালাক কিছু না বলে কান পেতে রইল। ফালাকের উত্তর না পেয়ে রুহানিও চুপ করে রইল। তারপর মুচকি হেসে ফোন কেটে দিল।

.

রুহানি আজ পরিপাটি হয়ে ভার্সিটিতে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছে। কোনো কমতি চোখে পড়ছে না। আজ রিলেশনের প্রথম দিন ফালাকের সাথে দেখা হবে। তাই কোনো কমতি থাকা যাবে না। রুহানি শেষ বার নিজেকে দেখে পূর্নতার হাসি হাসল।

.

ভার্সিটিতে ঢুকতেই রুহানির ফোনে টুং শব্দ করে মেসেজ এলো। রুহানি দ্রুত মেসেজ ওপেন করল। ফালাক মেসেজ করেছে। ওকে পুকুর পাড়ে যেতে বলেছে।
রুহানি পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখে ফালাক পা ভিজিয়ে বসে আছে। রুহানি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ফালাক ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। রুহানি চুপচাপ ওর পাশে বসে আছে।
ফালাকও কিছু বলছে না।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ফালাক বলল,
“তুমি এত ঠান্ডা কবে হলে? এমন চুপ করে বসে আছো কেন?”

“আচ্ছা, কিছু বলার কথা কার? তোমার না আমার? তুমিই তো কিছু বলার জন্য ডেকেছো। এখন চুপ করে আছো।”

ফালাক পা উঠিয়ে বলল,
“ভালো কথা মনে করেছো।”

ফালাককে খুবই সিরিয়াস মুডে লাগছে। রুহানিও সিরিয়াস হয়ে ওর কথা শোনার প্রস্তুতি নিল।

“আচ্ছা, আহিলের সাথে কথা বলবে কবে? ওর সাথে কথা বলে সব ক্লিয়ার করা জরুরী। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নয়তো পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে। তুমি আজই ওর সাথে কথা বলবে। এই টেনশন আর নিতে পারছি না। একদিনেই হাপিয়ে গেছি। সারারাত ঘুমাতে পারি নি।”

রুহানি আমতা আমতা করছে। রুহানির এমন ফেস দেখে ফালাক কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল।
“হোয়াট রুহানি? কিছু বলছো না কেন?”

রুহানি ফালাকের দিকে অসহায় ফেস করে তাকাল। তারপর বলল,
“বুঝতে পারছি না কি করে সবকিছু ফেস করব।”

ফালাক সংকোচিত করে বলল,
“কি করে ফেস করবে মানে? তুমি কি আহিলকে সব ক্লিয়ার করতে চাও না? ওর লাইফ থেকে বেরিয়ে আসতে চাও না?”

রুহানি ফালাকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রতিউত্তরে বলল,
“রাগ করছো কেন? আমি অবশ্যই চাই এসব থেকে বেরিয়ে আসতে। আমার কি ভালো লাগছে? আমি ভাবছি বাবা আর মা’য়ের কথা। বিশেষ করে বাবার কথা। জানি না তাদের কি রিয়েকশন হবে। বাবা এমনিতেই অসুস্থ।”

ফালাক রুহানির বাবার অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে বলল,
“সবাইকেই সত্যিটা ফেস করতে হবে। কিন্তু প্রথমে তুমি আহিলের সাথে কথা বলো। ওকে তোমার আর আমার সব কথা বুঝিয়ে বলো। ও যদি বুঝে যায় আর নিজে থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এখুনি আংকেল আন্টিকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।”

রুহানি ফালাকের কথার সাথে একমত হয়ে বলল,
“ঠিক বলেছো। আমি আগামীকালই আহিলের সাথে দেখা করে সব কিছু জানাব। দেখা যাক কি হয়।”

“তুমি চাইলে আমি উনার সাথে কথা বলতে পারি। যদি তুমি বলতে না পারো। আর বলার পর না জানি উনার কি রিয়েকশন হবে। তাই আমি তোমার সাথে যেতে চাইছি।”

রুহানি বাঁধা দিয়ে বলল,
“প্রয়োজন নেই ফালাক। আমি একাই সব ম্যানেজ করে নেব। তোমার যাওয়াটা উচিত হবে না। আমাদের একা কথা বলা উচিত।”

ফালাক কিছুক্ষণ উশখুশ করে বলল,
“তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।”

রুহানি বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,
“আহিল আমাকে খেয়ে ফেলবে না। উনি বাঘ-ভাল্লুক না। আর আমি উনাকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা রাখি।”

ফালাক রুহানিকে রেগে যেতে দেখে বলল,
“ওকে ওকে তুমি একাই যেও।”

ফালাক মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
“দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনো।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,”আরও?”

ফালাক রুহানির হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“রুহানি প্লিজ কিছু লুকাবে না। ইতস্ততও করবে না। আমি তোমার পর নই। ইন ফিউচার আমাদের বিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। তাই আমি যা জিজ্ঞেস করি বলবে প্লিজ।”

রুহানি ফালাকের মুখের দিকে চেয়ে আছে। ফালাক ওকে কি জিজ্ঞেস করবে। এত ফর্মালিটি কিসের জন্য।
ফালাক আবারও বলতে শুরু করল,
“কি হয়েছিল তোমাদের সাথে? তুমি বলেছিলে আপনজন তোমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি তোমাদের কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরের খবর তো তোমরা আর তোমাদের আপনজনরা জানে। তাই আমাকে সবটা বলো।”

রুহানি ইতস্তত করে বলল,”বাদ দেও পুরনো কথা।”

“তুমি কি এখনো আপন ভাবতে পারো নি? আমি কি তোমার পর?”

ফালাকের ইমোশনাল কথায় রুহানি বলতে শুরু করল,
“আমার মামা লোভী প্রকৃতির মানুষ। অনেক বার উনার জন্য আমাদের কোম্পানি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে আর বাবা বারবারই মাফ করে দিয়েছেন। কিন্তু লাস্ট টাইম একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। আমরা যে ডিলটা পেতে যাচ্ছিলাম তাতে মামা বাগড়া দেয়। আর বাবা রেগে যায় খুব। অনেক ততর্কবিতর্ক হয়। মামা বাবাকে হুমকি দিয়ে যায় এক প্রকার। ডিল সাইন হয়। ব্যাংক লোন পাশ হয়, লোন পাই, কাজও শুরু হয়। মামা সহ্য করতে পারে নি। কেননা ডিলটা তার চাই। সে আমাদের কোম্পানির কাউকে হাত করে সব ইনফরমেশন লিক করে দেয়। এতে ডিলের কিছু শর্ত লঙ্ঘন হয়। অনেক ঝামেলা হয় এক পর্যায়ে ডিল ক্যান্সেল হয়ে যায়। তারপর মামলা, উকিল, কোর্ট এসব করে অনেক দিন যায়। আমাদের কোম্পানির অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে শুরু করে। পরবর্তীতে নানান সমস্যা এটা সেটা সব শেষ।”
রুহানি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর চোখ ছলছল করছে।

ফালাক রুহানির হাত চেপে ধরে বলল,
“শক্ত হও রুহানি। উনাকে উনার পাপের শাস্তি পেতে হবে। আমি সব তদন্ত করার জন্য মামলা করব, আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যদি তুমি অনুমতি দেও।”

রুহানি মুখ তুলে ফালাকের দিকে চেয়ে বলল,
“যদি ভালো রেজাল্ট না আসে। তাহলে শুধু শুধু এসব ঝামেলায় জড়ানোর কি প্রয়োজন?”

ফালাক রুহানিকে আশ্বস্ত করে বলল,
“চেষ্টা তো করে দেখতে পারি। আমার উপর ভরসা রাখো। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব। আমি জানি তোমার আত্মসম্মান অনেক বেশি। তাই যত টাকা খরচ হবে আমি সব টুকে রাখব। তুমি পরে আমাকে ফেরত দিয়ে দিও।”

রুহানি কেন জানি আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। ওর মামাকে শাস্তি দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছে৷
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে কি করতে হবে?”

“সে-সব সময় হলেই জানাব৷ এখন তুমি আহিলের ব্যাপারটা দেখো।”

.

রুহানি ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আহিলকে ফোন করে দেখা করার কথা বলতে হবে। কিন্তু ফোন করতে পারছে না। কেন যেন উশখুশ করছে। তখনই রুহান ওকে ডাকতে এল।
“আপু আহিল ভাই এসেছে। তোর সাথে না-কি কি দরকার।”

আহিলের কথা শুনে রুহানি লাফিয়ে উঠে বসে। তারপর এক প্রকার দৌড়ে রুম থেকে বের হয়। আহিল ড্রয়িংরুমে বসে আছে। ওকে বিষন্ন লাগছে খুব। রুহানিকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার সাথে একটু জরুরী কথা ছিল। আমার সাথে একটু ছাদে যাবে প্লিজ।”

এত রাতে ছাদে কি কাজ এসব প্রশ্ন মনে এলেও রুহানি যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল।

রুহানি ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতেই আহিল ওর বরাবর দাঁড়াল। তারপর বলল,
“আমি যে এত বছর তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, কাউকে আমার জীবনে আসতে দেই নি তার প্রতিদান কে দিবে?”

রুহানি বিস্ময় নিয়ে বলল,
“প্রতিদান! কিসের প্রতিদান? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“আমি তোমার আর তোমার প্রেমিকের কথা বলছি। এইজন্যই তুমি বারবার আমাকে বিয়ে করবে না বলেছো। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি। তোমার প্রেমিক আছে বলেই যখন বাবা বিয়ে ভেঙে দেয় তুমি প্রতিক্রিয়া দেখাও নি। এইজন্য তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইতে না। এখন আমার কাছে সব ক্লিয়ার। তুমি আমাকে এতবছর ধোঁকার মধ্যে রেখেছো। কিন্তু কেন?”

রুহানির মাথা ভনভন করছে। ফালাকের ব্যাপারটা যে জেনেছে সেটা বুঝতে পারছে। এতে সুবিধাই হলো কিন্তু ওর নামে যে অভিযোগ এনেছে তা তো ভুল।
“আপনার মাথা ঠিক আছে? আপনি কি বলতে চাইছেন আমি আপনার সাথে কমিটমেন্টে থাকার পরেও অন্য জনের সাথে রিলেশনে গিয়েছি? যদি আপনি এটাই মিন করে থাকেন তবে আপনি আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন। আপনার বাবা বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সাথে সাথে আমার আর আমার পরিবারের জন্য সব সেদিনই শেষ হয়ে গেছে। তারপর ফালাক আসে আমার জীবনে। কিন্তু আমার জীবনে এতটাই ঝড় বয়ে গেছে সে সাহস করতে পারি নি, বুঝেও বুঝতে চাই নি। নিজের অনুভূতিকে এড়িয়ে গিয়েছি। কিন্তু একটা সময় আর পারি নি। তাই আপনাকে বলেছি আমি বিয়ে করব না। ফালাকের কথা না বলার কারণ হচ্ছে তখন ফালাক আর আমার সম্পর্ক ছন্নছাড়া ছিল। রাগ-অভিমান চলছিল। আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে দুজনেই অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। তাই সময় চেয়েছি। গতকাল সব ঠিক হওয়ার পরে আপনাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। এই যে দেখুন ফোনটা আমার হাতে। আমি আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আপনার সাথে যখন দেখা হয়েই গেল তখন বলছি আমি আর ফালাক একে অপরকে ভালোবাসি। আপনার জানার অধিকার আছে তাই জানালাম। আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলেও সেই অনুভূতি আপনার প্রতি আমার তৈরি হয় নি যা ফালাকের জন্য হয়েছে।”

রুহানি এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে জোরে শ্বাস নিল।
আহিল স্তব্ধ হয়ে আছে। ওর দৃষ্টি মেঝের দিকে।
আহিলের ভেতরে ঝড় বইছে। কি করবে বুঝতে পারছে না।
রুহানিকে ছোট্ট করে বলল,
“জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি আজ আসছি।”
আহিল এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল।

.

রুহানি বাড়ির ভেতরে যাওয়ার পর ওর মা বারবার জিজ্ঞেস করছে,
“আহিল কি বলল? কোন সমস্যা?”

“মা কিছু হয় নি। এমনি এসেছিল কথা বলতে।”

“কিন্তু ওকে দেখে তো তা মনে হচ্ছিল না। কিছু হয়েছে? বল না?”

“মা, আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করো।”
রুহানি বিরক্তি নিয়ে ফোন ঘাটতে ঘাটতে ঘাটতে রুমে যাচ্ছে।
রুহানির মা একা একা বলছে,
“যাক কিছু না হলেই ভালো। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কি না কি হয়েছে। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।”

রুহানি মায়ের বিড়বিড় কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর মায়ের দিকে ঘুরে মায়ের আস্বস্ত মুখটা দেখে বলল,
“কেন মা ভয় কেন পেয়েছিলে? আহিল হাতছাড়া হয়ে গেল কি-না, তোমার মেয়ের কপাল পুড়লো কি-না এসব ভাবছিলে? মেয়ের কথা ভাবার সময় আছে তোমাদের?”

রুহানির মা ওর কথা শুনে হতবাক।

চলবে…

প্রিয় অভিমান পর্ব-২০+২১

0

#প্রিয়_অভিমান 🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২০|

আহিল রেস্টুরেন্টে বসে দু কাপ কফি শেষ করে তৃতীয় বারের মতো কফিতে চামচ নাড়ছে। আর বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। অধীর আগ্রহে রুহানির জন্য অপেক্ষা করছে। আহিল চামচ রেখে হাত ঘড়িতে সময় দেখল অলরেডি ৩৫ মিনিট চলে গেছে কিন্তু রুহানির আসার নাম নেই। কল করেও পাচ্ছে না। ফোন সুইচড অফ বলছে।

আহিল আবারও রুহানির নাম্বারে ডায়েল করল। কিন্তু কর্কশ কন্ঠে একজন মহিলা বারবার একি কথা বলায় আহিল বেশ বিরক্ত হলো।
রুহানি দরজার সামনে এসেই বরাবর টেবিলে আহিলকে দেখতে পেল। দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে ভেতরে গেল৷ রুহানি হন্তদন্ত হয়ে এমন ভাবে ভেতরে ঢুকল যেন এক প্রকার দৌড়ে এসেছে। আহিল রুহানিকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।

রুহানি চেয়ার টেনে বসে নেকামো করে বলল,
“সরি সরি একটু লেট হয়ে গেল। আসলে এত জ্যাম ছিল।”

আহিল মুচকি হেসে বলল,
“ইট’স ওকে। তেমন লেট হয় নি।”

রুহানি মনে মনে বলছে,”প্রায় চল্লিশ মিনিট লেট করেছি তবুও বলছে তেমন লেট হয় নি। ন্যাকা।”

“কি খাবে বলো?”

“আমার কিছু খাওয়ার ইচ্ছে নেই। তবে কফি খেতে পারি।”

“আচ্ছা, অর্ডার করছি।”
আহিল কফির অর্ডার করে দিল। রুহানি চুপ করে বসে আছে। আহিল ওর দিকে চেয়ে আছে। রুহানির কেমন অস্বস্তি লাগছে তাই মাথা নিচু করে বসে আছে। নখ দিয়ে নখ খুটছে। দুজনেই চুপ।

আহিল নীরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?”

রুহানি চোখ তুলে বলল,
“কেন বলুন তো?”

আহিল ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি জানি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট। এই যে আমার সাথে ঠিক মতো কথা বলছো না। ওইদিন তোমাদের বাড়িতে গেলাম সেদিনও কথা বললে না। আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছি কিন্তু তোমার মধ্যে কোন উচ্ছলতা নেই, চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলে তারপর আর বের হলে না?”

রুহানি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“উচ্ছলতা প্রকাশ করার কি কথা ছিল? উচ্ছলতা প্রকাশ করার মতো কি করেছেন?”

আহিল থমকে গেল। তারপর নিজেকে সামলে বলল,
“তুমি, তোমার পরিবার অনেক খারাপ সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছো। সে সময় আমার তোমার পাশে থাকা উচিত ছিল কিন্তু আমি থাকতে পারি নি। রুহানি আমি এসবের কিছুই জানতে পারি নি। আমি যখন জানতে পেরেছি তখন জাস্ট স্তব্ধ হয়ে গেছি। কিছু ভাবতে পারছিলাম না। অনেক কষ্ট হচ্ছিল, আপসোস হচ্ছিল। তবুও তোমার আমার উপর রাগ-অভিমান করা স্বাভাবিক।”

“আমি আপনার উপর রাগ-অভিমান কিছুই করি নি। যখন আমাদের নিজের লোক পেছনে থেকে ছুরি মেরেছে সেখানে তো আপনার কিংবা আপনার পরিবারের সাথে আমাদের তেমন সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। হ্যা একটা সম্পর্ক গড়ার কথা ছিল কিন্তু হয় নি।”

“হয়নি হবে। রুহানি, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব সব ঠিক করার। আমার উপর ভরসা রাখো।”
আহিলের কথা শেষ হতেই কফি চলে এলো। রুহানি কোন উত্তর দিতে পারল না।

রুহানি কফিটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিল। অপেক্ষা করছে সঠিক সময়ের।
রুহানি কিছু বলতে চাইছে সেটা আহিল খেয়াল করছে।
“রুহানি যা বলতে চাও নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”

রুহানি আহিলের চোখের দিকে তাকাল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি এই কয়েক মাসে জীবনের অনেক কঠিন সময় দেখেছি। জীবন কি বুঝতে পেরেছি। যা কখনো করি নি তাই করেছি। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছি। এতটা খন্ড তৈরি হয়েছে নিজেকে খুঁজে পাই নি। পুরনো রুহানি কোথাও হারিয়ে গেছে। সেই আমি আর নেই। তাই আমার স্বপ্নগুলোও আগের মতো নেই। আমার সবটা জুড়ে এখন আমার পরিবার। তাই আমি বিয়ে করতে চাই না।”

রুহানির শেষ লাইন শুনে আহিল স্তব্ধ হয়ে রইল। রুহানি চোখ তুলে আহিলের দিকে তাকাল। আহিলের চোখগুলোও যেন থমকে গেছে।

আহিল নিজেকে স্বাভাবিক করে ঢোক গিলে বলল,
“তুমি যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছো আর এখন যে পরিস্থিতিতে আছো তাতে তোমার এমন ভাবনা স্বাভাবিক কিন্তু এখানে আমার দোষটা কোথায়? রুহানি তুমি বর্তমান অবস্থা ভাবছো, ভবিষ্যত ভাবছো না। সব সময় পরিস্থিতি এক থাকবে না। তাই প্লিজ এসব বলো না। আমার বাবা-মা খুব শীঘ্রই তোমাদের বাসায় যাবে বিয়ের তারিখ দিতে।”

.

আহিল রুহানিকে গেটের সামনে নামিয়ে দিতেই রুহানি ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। আহিল যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে রুহানি বাইরে বের হলো। রুহানির বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে গেলেই হাজারো প্রশ্ন করবে যে কারণে রুহানির বিরক্ত লাগছে। এতশত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না।
রুহানি রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে তাই রাস্তা অন্য সময়ের চেয়ে যথেষ্ট নীরব। হালকা বাতাস বইছে। রুহানির জামার সাথে খোলা চুলগুলো উড়ছে। রুহানি চুল বেঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে।
মানুষের কিছু কষ্ট থাকে, যা কাউকে বলা যায় না, বললেও বুঝে না। সে কষ্টগুলো বুকের ভেতর চেপে রাখতে হয়। তা একান্তই ব্যক্তিগত কষ্ট। রুহানি যেন সে কষ্টগুলোই স্নিগ্ধ বাতাসের সাথে উড়িয়ে দিচ্ছে।
রুহানি ফুটপাতের ওপর গিয়ে বসল। আনমনে কিছু ভাবছে। আহিলকে বিয়ে করার ব্যাপারটা ওর মন মানছে না। রুহানি একা একা বসে আছে। সময় সময়ের মতো বয়ে চলেছে। হটাৎ পায়ের শব্দ পেয়ে হুড়মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল ও।

ফালাক চোখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখগুলো যেন জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা। চুলগুলো এলোমেলো। কেমন বিধ্বস্ত লাগছে৷ ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর সামনে ওর চিরশত্রু দাঁড়িয়ে আছে। যাকে খুন করতে এসেছে।

রুহানি ফালাকের অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও দু পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলে কি হয়েছে কিন্তু তার আগেই ফালাক রুহানির কপালে পিস্তল ঠেকাল। রুহানি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নড়তে পারছে না। কিছু বলতেও পারছে না। কথাগুলো গলায় এসে আঁটকে আছে। বের হচ্ছে না। শুধু ঢোক গিলছে। কপালে চিকন ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে। চোখ বন্ধ করে নিল।

ফালাক রুহানির কপালে আরেকটু শক্ত করে ধরে ভাঙা গলায় বলল,
“কেন রুহানি, কেন? এত বড় ধোঁকা কেন দিলে? আমার অপরাধটা কোথায় ছিল?”

রুহানি স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল,
“কি করেছি আমি?”

ফালাক রুহানির কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে ওকে রাস্তার ধারের দেয়ালে চেপে ধরে বলল,
“আবার বলছো কি করেছো? তুমি জানো না কি করেছো? তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার কোনো খোঁজ রাখি না?”

রুহানির তখন মাথায় একটা কথায় এলো ফালাক হয়তো আহিলের কথা জেনে গেছে।

“আমাকে কুকুরের মতো তোমার পেছনে ঘুরিয়েছো। কাউকে কখনও ভালোবাসবে না, বিয়ে করবে না এসব বলে এভয়েড করেছো। আমি সারাক্ষণ চেষ্টা করে গেছি তোমার মনে আমার জন্য অনুভূতি তৈরি করার জন্য। আর তুমি তলে তলে অন্য একজনকে নিয়ে সংসার গড়ার স্বপ্ন বুনে যাচ্ছো? কেন করলে এটা তুমি? তুমি যদি বলতে ফালাক আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি, বিয়ে করব তাহলে কষ্ট হলেও মেনে নিতাম কিন্তু তুমি এতদিন আমার সাথে যা করলে তা আমি কি করে ভুলব? তোমার প্রতি রোজ একটু একটু যে ভালোবাসা বেড়েছে তার কি করব?”

ফালাক কাঁদতে কাঁদতে রুহানির কপাল থেকে পিস্তল সরিয়ে নিল। রুহানি চোখ খুলে ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক চোখের পানি মুছছে।
“ফালাক আমি মিথ্যা কিছু বলি নি। তখন ওর সাথে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। আর এখনো নেই। আহিলের সাথে ফ্যামিলি থেকে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে।”

ফালাক রুহানির দিকে চেয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
“মানলাম তখন কিছু ছিল না। কিন্তু বলেছিলে তো বিয়ে করবে না কোনদিন। তাহলে এখন? এখন কেন ফ্যামিলির কথায় বিয়ে করতে রাজি হলে? আমি তো তোমাকে বিয়ের কথাই বলেছিলাম তখন আমাকে কেন রিজেক্ট করলে? উত্তর দেও রুহানি।”

রুহানি মাথা নিচু করে বলল,
“বিয়ে তো আমি এখনো করতে চাই না কিন্তু ফ্যামিলির কথা ভেবে হয়তো বিয়েটা আমাকে করতে হবে।”

ফালাক রুহানির কথা শুনে হেসে ফেলল। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসছে। রুহানি বিস্ময় নিয়ে ফালাকের দিকে চেয়ে আছে।
ফালাক হাসি থামিয়ে বলল,
“আহিল! নামকরা ব্যবসায়ী। একবার বিয়ে করে নিলে তোমার পাশাপাশি তোমার ফ্যামিলির লাইফ সেট। তাই তো তোমার আর তোমার ফ্যামিলির বিয়ের জন্য এত তোরজোর। টাকার জন্য? সুখ-শান্তির জন্য? আত্মসম্মান নিয়ে না বড্ড বড়াই করতে? আজ কি হলো রুহানি? টাকার কাছে হেরে গেল তোমার আত্মসম্মান? যদি টাকাই মেইন ইস্যু হয় তবে আমাকে বলতে রুহানি। তোমার জন্য সব ছেড়ে দিতাম।”

“ফালাক, তুমি এসব কথা কি করে বলছো? টাকার কাছে আমি নিজেকে বিক্রি করে দিচ্ছি?”

ফালাক চেঁচিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, টাকার কাছে তুমি নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছো। টাকার জন্য তুমি হুট করে বিয়ের প্রতি পজেটিভ ধারণা এনে ফেলেছো ভাবা যায়? তোমাকে আমি সবার চেয়ে আলাদা ভেবেছিলাম বাট তুমি টাকার জন্য যেকোনো কাজ করতে পারো। হোটেলে গিয়ে নাচতে পারো, কারো সাথে থাকতেও পারো।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে নিল। ওর কান ঝিম ধরে যাচ্ছে। ফালাক ওর সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারল? ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

ফালাক রুহানির দুবাহু চেপে ধরে বলল,
“কত টাকা চাই তোমার? আমাকে বলো আমি সব দেব। তবুও আমার তোমাকে চাই। টাকার জন্য যেখানে আহিলের সাথে থাকবে সেখানে না হয় আমার কাছে থাকবে। ভালো নাহয় নাই বাসলে। আমার টাকাকেই ভালোবাসলে। বলো কত টাকা চাই?”

রুহানি ঝারা দিয়ে ফালাককে সরিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমাকে তোমার নষ্ট গলির মেয়ে মনে হচ্ছে? টাকা দিয়ে আমার দর দাম করছো? তুমি আমাকে এই ভালোবেসেছিলে?”
রুহানির কান্নার কারণে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে।

“ভালোবাসার কথা তোমার মুখে মানায় না। তুমি শুধু টাকার ভাষা বুঝো, তাই টাকার ভাষায় তোমাকে চাইছি। কি করব ভালোবেসে ফেলেছি খুব। তাই তুমি যে ভাষা বুঝো সে ভাষায় তোমাকে নিজের করতে চাইছি।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে বসে পড়ল।
“আমি এই কয়েক মাস অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু কখনো কারো কাছে মাথা নত করি নি। নিজের সম্মান বিসর্জন দেই নি। আর তুমি বলছো আমি টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিচ্ছি?”

“তো কি করেছো বলো? তোমার বাবা-মা আহিলের টাকার জন্য তোমার বিয়ের জন্য অস্থির হয় নি? তুমি ডেটে যাও নি আহিলের সাথে? আমাকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলে? কারণ আমি ভালোবাসার কথা বলেছিলাম তোমার ফ্যামিলির সব সমস্যা, দুঃখ লাঘব করব বলি নি। টাকার কথা বলি নি। তাই তোমার আমার চেয়ে আহিলকেই ব্যাটার মনে হয়েছে।”

রুহানির দম বন্ধ হয়ে আসছে।

অতিরিক্ত কান্নার জন্য হিঁচকি এখন খিঁচুনিতে রুপ নিচ্ছে৷ শ্বাস নিতে পারছে না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে খুব। রুহানি টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। ফালাক রুহানির এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল। রুহানি ব্যাগ থেকে পানি বের করার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত কাঁপছে।

ফালাক বিচলিত কন্ঠে বলল,
“রুহানি কি হলো তোমার? এমন করছো কেন?”

রুহানি অস্ফুট স্বরে বলল,
“পানি!”

ফালাক রুহানির খোলা ব্যাগে পানির বোতল দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি রুহানিকে খাইয়ে দিল। অন্য সময় পানি খাওয়ার পর আস্তে আস্তে ঠিক হলেও এখন হচ্ছে না। ফালাক রুহানির অবস্থা দেখে দ্রুত উঠে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলল। রুহানির কাছে এসে রুহানিকে কোলে তুলে গাড়ির দিকে দ্রুত গতিতে যাচ্ছে। রুহানি ওর কোলে জ্ঞান হারাল।

.

ফালাক চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর প্রাণ যেন বেরিয়ে আসছে। রুহানির মা আর ভাইও চলে এসেছে। রুহানির ফোনে কল করায় ফালাক রিসিভ করে সব জানিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আহিলও চলে এলো। আহিলকে দেখে ফালাক কেমন করে তাকাচ্ছে।
আহিল চিন্তিত ভঙ্গিতে রুহানির মা’কে বলল,
“কি হয়েছে আন্টি? রুহানির হুট করে কি হলো?”

” আসলে বাবা ও অতিরিক্ত কান্নাকাটি করলে কিংবা স্ট্রেসে থাকলে এমন হয় কিন্তু আজ কি হয়েছে জানি না।”

ফালাক সবটা বলে নি শুধু বলেছে ওর এমন অবস্থা দেখে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।

কিছুক্ষণ পরে রুহানির জ্ঞান ফিরলে আহিল ওর পাশে বসে বলল,
“সব ঠিক হয়ে যাবে রুহানি। আমি তোমাকে ভালো ডক্তর দেখাব।”

“আমি বাসায় যাব আহিল।”

“আচ্ছা, এখুনি আমরা তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব।”

ফালাক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুহানির দিকে চেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে ঘুরে বের হয়ে গেল রুম থেকে। রুহানি ফালাকের যাওয়ার সময় পেছনের অংশ দেখল।

.

রুহানি দুদিন পর ভার্সিটিতে গেল। দূর থেকে ফালাককে দেখতে পেল। ফালাকের বলা কথাগুলো মনে পড়ল। ফালাক তখনও ওকে দেখে নি। রুহানি দাঁড়িয়ে আছে। ফালাকের চেহারা যেন দুদিনেই বদলে গেছে। কেমন হিংস্র হিংস্র ভাব। শুভ রুহানিকে দেখে ফালাককে বলল,
“রুহানি আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকেই দেখছে।”

ফালাক চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“আজকের পর থেকে ওর নাম আর আমার সামনে নিবি না।”

সোহান হালকা হেসে বলল,
“রাগ করছিস কেন? ভালো বাসিস তো।”

“কিসের ভালোবাসা? আমি ওকে ভালোবাসি না। এতদিনের ভুল শোধরে নিয়েছি।” সোহানকে ধাক্কা মেরে বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। রুহানি সবটাই দূর থেকে দেখল।

ফালাক রুহানির দিকে না চেয়েই ওকে পাশ কাটিয়ে গাড়ির দিকে গেল। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গাড়ি স্টার্ট দিল।

চলবে…….

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-২১|

মুখে ভুলে যাওয়ার কথা বললেই কি ভুলে যাওয়া এত সহজ? যাকে মনের গভীরে জায়গা দিয়েছে, তিল তিল করে তার অবস্থান পোক্ত হয়েছে তাকে কি এত সহজেই মনের গভীরে থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়? যায় না। ফালাকের ক্ষেত্রেই সেটাই ঘটেছে।
ফালাক আটতলা বিল্ডিংয়ের নিজের ফ্লাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার আশেপাশের বিল্ডিংয়ের আলোয় পরাজিত। প্রতিটি বাড়িতে আলো জ্বলছে। আকাশেও এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ফালাক হাজার চেষ্টা করেও রুহানিকে ভুলতে পারছে না। ফ্লাটে এসেছে দুঃখ বিলাস করতে। এই দুঃখী চেহারা নিয়ে বাড়িতে যায় নি। তাহলে বাবা-মায়ের হাজারো প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। শুধু জবাবই না তাদের টেনশন আর রাতের ঘুম কাড়ার কারণও হবে। অফিসের পাশের এই ফ্লাটে ফালাক প্রায়শই আসে সময় কাটাতে। অফিসে প্রচুর কাজ ফিরতে গেলে অনেক রাত হবে তাই বাড়িতে ফিরতে পারবে না বলে জানিয়েছে মা’কে।

ফালাক নিজের কষ্ট উড়াবে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। শুনেছে সিগারেট খেলে নাকি কষ্ট ভুলে থাকা যায়। সিগারেটের ধোঁয়ায় কষ্ট উড়ায়। তাই আজ সিগারেট কিনে এনেছে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। এই প্রথম সিগারেট খাবে। খাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে ওর। অভ্যাস নেই, এছাড়া কখনো কাউকে কাছ থেকে খেতে পর্যন্ত দেখে নি। তাতে কি ফালাক তো আজ খাবেই।
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দিল। আগুন জ্বালানোর পর কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু ফালাক পরল বিপদে। ধোঁয়া বের করতে পারছে না। মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হবার বদলে ভেতরে ঢুকে গেছে। ফালাক সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাশতে শুরু করল। বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে। একন জঘন্য জিনিস এর আগে দেখে নি। ফালাক দ্রুত রুমের ভেতরে গিয়ে জগ থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিল।

তারপর বুকে হাত দিয়ে বিরবির করে বলল,
“এগুলো মানুষ খায় কিভাবে? ওয়াক! ছিহ! এত বাজে জিনিস। এটা তো আমার কষ্ট কমানোর বদলে বাড়িয়ে দিল। না জানি কতগুলো ধোঁয়া পেটের ভেতর গিয়ে বসবাস করছে। শান্তিতে বসবাস করছে না হাঙ্গামা করছে কে জানে?”

ফালাক আরেক গ্লাস পানি খেয়ে সিগারেটের প্যাকেট ঝুড়িতে ফেলে দিল। বিরক্ত আর রাগ দুটোই লাগছে। আগে জানলে সিগারেট ছুয়েও দেখত না।
ফালাক শুভ্র সাদা দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পুরো দেয়াল জুড়ে রুহানির ছবি। ফালাক যত ছবি পেয়েছে ওর সব দেয়ালে এক সাথে পাশাপাশি বাঁধিয়ে রেখেছে। রুহানিকে দেখে হটাৎ করেই বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। স্বপ্ন ভাঙার ব্যথা।

.

রুহানি নিজের রুম জুড়ে পাইচারি করছে। অস্থির অস্থির করছে। এদিক থেকে সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে আর চুলে হাত বুলাচ্ছে। রুহানির মা দরজায় নক করল। রুহানি জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“হ্যা মা এসো।”

রুহানির মাকে দেখে খুব খুশি মনে হচ্ছে। খুশি যেন তার চোখ মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে।
রুহানি জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাল।
রুহানির মা রুহানির দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বলল,
“এখনো জেগে আছিস কেন? ঘুমিয়ে পড়। আর হ্যা শোন আগামীকাল ইন্সটিটিউট থেকে তাড়াতাড়ি আসিস। আহিলের বাবা-মা আসবে।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,
“ওরা কেন আসবে?”

রুহানির মা আলতো হেসে বলল,
“কেন আবার? হয়তো বিয়ের কথা বলতে আসবে। আমি আর তোর বাবা ভেবেছিলাম আমাদের সাথে সাথে তোর কপালও পুড়েছে। এগুলো ভেবে তোর বাবা কত কেঁদেছে। কিন্তু দেখ সব ঠিক হয়ে গেছে। তোর বাবা তো ভীষণ খুশি। বলছে এখন মরে গেলেও দুঃখ নেই। আমরা আর ক’দিন তুই আর রুহান ভালো থাকলেই মরেও শান্তি পাব।”
রুহানির মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”শুয়ে পড়।”

রুহানি মাথা নাড়িয়ে ছলছল চোখে বলল,”হুম।”

.

রুহানির ঘুম আসছে না৷ কি হতে কি হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু এত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যে কিছুই করতে পারছে না। রুহানি বিছানায় উঠে বসে।
“হে আল্লাহ, কোন গোলকধাঁধায় ফেসে গেলাম? কি হচ্ছে এ-সব? কি করব আমি? জীবনের কঠিন সময়েও এতটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি নি, তাহলে এখন এমন কেন হচ্ছে? আমার আহিলের সাথে কথা বলতে হবে। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তাহলে মানসিক যন্ত্রণায় মরে যাব।”
রুহানি বেড সাইড টেবিল থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিল আহিলকে ফোন করার জন্য।

.

রুহানি ইনস্টিটিউট যাওয়ার আগে আহিলের সাথে দেখা করে কথা বলবে। তাই সেদিনের সেই রেস্টুরেন্টে বসে আছে। আজ রুহানি আহিলের আগে এসে বসে আছে। কিন্তু আহিলের খবর নেই। খবর থাকার কথাও না। আজ ও সময়ের আগেই চলে এসেছে।

কিছুক্ষণ পরে আহিল ভেতরে এসে রুহানিকে দেখে বসতে বসতে বলল,
“সরি, সরি, আমি হয়তো লেট করে ফেলেছি।”

“না ঠিক আছে আপনি সময় মতোই এসেছেন। আমিই একটু তাড়াতাড়ি এসেছি।”

আহিল রুহানির কথা শুনে বলল,
“আগে আগেই চলে এসেছো। গুরুত্বপূর্ণ কিছু?”

রুহানি আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে তা নয়, আমাকে ইন্সটিটিউট যেতে হবে তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি৷ কথা শেষ করে সময় মতো যেতে হবে তাই।”

“হ্যাঁ তাহলে বলো কি বলতে চাও? কোন সমস্যা?”

রুহানি ইতস্তত করছে। কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। কোথায় থেকে শুরু করবে।

রুহানি নিজের জড়তা কাটিয়ে বলল,
“দেখুন বিয়ে কোন ছেলেখেলা নয়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে হুট করে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। আমার পরিবার আমাকে জোর করছে, আমার কথা শুনতেই চাইছে না। কারণটা আপনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু আমি এভাবে বিয়ে করতে পারব না। আমার সময় প্রয়োজন। আপনি হয়তো পুরনো কথা টানতে পারেন কিন্তু যেখানে পুরনো আমিটাই নেই সেখানে পুরনো কথা টানা বোকামি। পরিস্থিতি, আমার চিন্তাভাবনা সব কিছু এখন আলাদা তাই আমি নতুন করে ভাবতে চাই বিয়েটা নিয়ে। আমার রিকুয়েষ্ট আপনি আমার কথাগুলো বুঝবেন। এসব আমার জন্য মোটেও সহজ নয়। প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছি। আর পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে বললাম। এখন আপনিও যদি আমার পরিবারের মতো না বুঝেন হয়তো বিয়েটা আমি করে নেব কিন্তু আমি আর আমি থাকব না।”

আহিল রুহানির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুঝেছি আমি রুহানি। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বিষয়টা আমি যেমন ভাবছি তেমন নয়। বেশ ঘোলাটে।”

রুহানি আমতা আমতা করে বলল, “তেমন কোন ব্যাপার নয়। আসলে আমার জীবনে ঝড় না এলে আমি জীবনের আসল মানে বুঝতাম না। বুঝতে পারতাম না জীবন কতটা মিনিংফুল। হয়তো অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু মানুষ হতে পেরেছি। এটা আমি অনুভব করতে পেরেছি। এই বদলে যাওয়া নতুন আমি সব কিছুর মাঝেই মানে খুঁজি। নিজের ভালোমন্দ খুঁজি। নিজের পছন্দ অপছন্দ প্রায়োরিটি দেই। তাই আমার সময় প্রয়োজন। হুট করে আমি বিয়ে করতে পারব না।”

আহিল এই রুহানিকে দেখে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। কেমন অবলীলায় নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা বলে যাচ্ছে।

“ঠিক আছে। তুমি সময় নেও। আমি বাড়িতে বুঝিয়ে বলল। তবে আমার মনে হচ্ছে তোমার উত্তর হ্যাঁ হবে না।”

রুহানি চোখ তুলে আহিলের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“কথা দিতে পারছি না। আমার উত্তর হ্যাঁ না দুটোই হতে পারে। আপনি চাইলে ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিতে পারেন।”

“অপেক্ষা করব। আমি এত দ্রুত ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি না।”

রুহানি আশ্বস্ত হলো। আহিল ব্যাপারটা বুঝেছে। রুহানি নিজেকে বুঝার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে।

.

রুহানি সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরেই রুহানের ঘরে গেল। রুহান পড়তে বসেছে। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। রুহানির উপস্থিতি টের পেয়ে রুহান বই রেখে ঘুরে তাকাল।
“আপু, কিছু বলবে?”

রুহানি ঠোঁট কামড়ে সময় নিয়ে বলল,
“ওরা এসেছিল?”

“না আপু। আহিল ভাইয়া কোন এক কাজে আঁটকে গেছে। বলেছে অন্য সময় আসবে।”

রুহানি স্বস্থির নিশ্বাস নিল। এর চেয়ে ভালো খবর যেন আর হয় না। রুহানি চেয়ার টেনে রুহানের পাশে বসে বলল,
“পড়াশোনা ঠিক মতো করছিস তো? মাঝে একটা মাস তারপর পরীক্ষা। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। আমি রনকের সাথে কথা বলেছি পরীক্ষা পর্যন্ত ও তোকে পড়াতে আসবে।”

রুহানি স্মিত হেসে রুহানির হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“আপু একদম চিন্তা করো না। আমার প্রিপারেশন খুব ভালো। দিনরাত পড়াশোনা করছি। ইনশাআল্লাহ খুব ভালো রেজাল্ট হবে। দেখে নিও আমি তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করব।”

রুহানি রুহানের হাতের উপর আরেক হাত রেখে বলল,
“অবশ্যই। আমার ভাই টপ করবে।”

“আপু আমার কথা বাদ দেও। আগামী মাসে তোমার থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। তুমি তো পড়াশোনা ঠিক করে করছোই না।”

“করছি, তুই দেখিস না। আর আমি টেনেটুনে পাশ করে গেলেই হলো কিন্তু তোকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।”

“আপু, আমি একটা কথা বলতে চাই। আমি উচ্চ মাধ্যমিকে অন্যত্র ভর্তি হতে চাই।”

“কেন? তোর স্কুলেই তো উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আছে। তাহলে অন্য জায়গায় কেন ভর্তি হবি?”

“আপু আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই। যেমন আমি তেমন করে থাকতে চাই। আমি এমন এক জায়গায় এডমিশন নিতে চাই যেখানে আমাকে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। যেখানে কারো কটু কথা শুনতে হবে না৷ যেখানে আমি মাথা উঁচু করে যেতে পারব, সবার সাথে নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারব। কোন ভয় থাকবে না। নতুন করে বাঁচতে পারব। রিকশায় চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে গেলেও কারো হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। প্লিজ আপু। আমার স্কুল ছাড়াও অনেক ভালো ভালো স্কুল-কলেজ আছে। যেখানে কম টাকা খরচ করেও ভালো রেজাল্ট করা যায়। শিক্ষার মান ভালো। আমি অবশ্যই ভালো একটা কলেজে চান্স পেয়ে যাব আর সেখান থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়ে ভালো ভার্সিটিতে এডমিশন নিতে পারব।”

রুহানি ওর কথাগুলো ভালো করে ভেবে দেখে বলল,
“আচ্ছা, আমার ভাই যা বলবে তাই হবে। এখন পড়তে বস।”

রুহান হালকা হেসে আবারও বইয়ে মনোযোগ দিল।

রুহানি নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। কেমন হালকা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে ভারী কিছু মাথার উপর থেকে নেমে গেছে। রুহানি চোখ বন্ধ করে নিজেকে কল্পনা করছে বউ সাজে। কিন্তু কিছুতেই বর হিসেবে আহিলকে সহ্য করতে পারছে না। রুহানি চোখ খুলল। সিলিংয়ের দিকে চেয়ে আছে। ফালাকের মুখটা ভেসে উঠছে। রুহানির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। বুঝতে পারছে না ওর সাথে কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে।

রুহানি রেডি হয়ে সকাল সকাল নুশার বাড়িতে হাজির।

নুশা ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল আর তখনই রুহানিকে রুমে ঢুকতে দেখে বেশ অবাক হলো। রুহানি ওর বিছানার উপরে গিয়ে বসে পড়ল। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঘুম হয় নি। মুখটা কেমন ফ্যাকাসে। লাল চোখগুলো ছলছল করছে। নুশা দ্রুত ওর পাশে বসে ওর হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে রুহানি? তোকে এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেন?”

রুহানি নুশার দিকে চেয়ে কেঁদে ফেলল। নুশা হুট করে ওর কান্না দেখে ঘাবড়ে গেল। কি বলে শান্তনা দেবে, কি করে কান্না থামাবে তার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

নুশা অনেক চেষ্টা করে ওর কান্না থামাতে সক্ষম হলো। রুহানি কান্না থামাতেই নুশা জিজ্ঞেস করল,
“এখন বল কি হয়েছে?”

রুহানি চোখের পানি মুছে বলল,
“আ’ম ইন লাভ!”

রুহানির কথা শুনে নুশা এতটা অবাক হলো যে হতবাক হয়ে আছে।
বিস্ময় কাটিয়ে বলল,”আহিল!”

রুহানি মাথা নাড়িয়ে না করল।

নুশা ভেবেছিল আহিল। কিন্তু রুহানি না করল।
“তাহলে কে সেই ভাগ্যবান?”

রুহানি ইতস্তত করে বলল,”ফালাক!”

নুশা ওর কথা শুনে কয়েক হাজার বোল্টের শকড খেল। রুহানি নুশাকে সব খুলে বলল। নুশা সব শুনে রিয়েক্ট করতে ভুলে গেল।
“বাহ! ডুবে ডুবে আমার বান্ধবী পানি খাচ্ছে আর আমি জানিই না।”

“মজা করিস না। এখন বল কি করব? ফালাক আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছে। কি করে ওর সাথে কথা বলব? ও আমার সাথে কথাই বলবে না আমি শিউর।”

“আগে ভার্সিটিতে চল। চেষ্টা তো করতে হবে। আগেই হাল ছেড়ে দিস না।”

.

নুশা রুহানিকে নিয়ে ভার্সিটিতে গেল। ওরা দুজন ফালাককে খুঁজছে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর পেয়েও গেল। নুশা ফালাককে ডাকল।
ফালাক নুশার ডাক শুনে ওর দিকে তাকাতেই সাথে রুহানিকে দেখতে পেল। রুহানিকে দেখে ওর চেহারার রং পালটে গেল। নুশার ডাকে সাড়া না দিয়ে চলে গেল। রুহানি নুশার দিকে কাঁদো কাঁদো ফেস করে তাকাল।

চলবে…….!