Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1463



প্রিয় অভিমান পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৮|

রুহানির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। গাল দিয়ে গরম উত্তাপ বের হচ্ছে। জ্বলে যাচ্ছে। কান ঝিম ঝিম করছে। ফালাক যে ওকে কেন মারল, ঠিক কোন কারণে এত জোরে একটা থাপ্পড় মারল সেটা উদ্ধার করতে পারছে না। ফালাক আঙুল দিয়ে চোখের কোনার পানি মুছে রুহানির সামনে এসে রুহানিকে ধরে দাঁড় করাল।

রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আছে। ফালাক রুহানির বাম বাহু চেপে ধরে বলল,
“নিজের সম্পর্কে এমন বাজে কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না? নিজেকে এভাবে ছোট করছো? তুমি কি ভেবেছো এসব বললে তোমার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মাবে? আর আমি তোমাকে ভুলে যাব? না রুহানি, বরং হুট করেই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা বেড়ে গেল। শুধু ভালোবাসা না সম্মানও বেড়ে গেল। ভাঙাচোরা মানুষেরা ভালো বাসতে জানে খুব। তাই আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি বলব।”

রুহানি ফালাকের চোখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। সেই গভীর ঝিলের মতো নেশাগ্রস্ত চোখ। রুহানি ফালাকের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য শরীর ঝাকালো। রুহানি নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
“নাটক-সিনেমার ডায়লগ নাটক-সিনামাতেই ভালো মানায় বাস্তবে নয়। আমার যা বলার ছিল বলে দিয়েছি এখন তুমি যা খুশি ভাবো আই ডোন্ট কেয়ার।”

“রুহানি, নাটক-সিনেমার ডায়লগ আমি দিচ্ছি না। তুমি যে বাস্তবতার কথা বলছো আমি সেই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছি।” বলতে বলতে ফালাক রুহানির কাছে এগিয়ে আসছে।

রুহানি ফালাককে দু’হাতে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার থেকে দূরে থাকবে। আরেকবার যদি এসব আজেবাজে কথা বলেছো তাহলে তুমি আগের রুহানিকে দেখবে।”

রুহানি দৌড়ে চলে গেল। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছে।
ফালাক রুহানির পেছনে গেল না। বসে পড়ল। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিল।

.

ফালাক ঘুমাতে পারছে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। বিছানা থেকে উঠে বসল। তারপর সোজা বারান্দায় চলে গেল। হু হু করে বাতাস বইছে। ফালাকের ভেতরে যে আগুন বইছে তা শান্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
“জীবনে প্রথম কাউকে ভালোবাসলাম, মনের কথা খুলে বললাম আর সেখানে এত বাঁধা, এত সমস্যা? সবটা স্বাভাবিক হলো না কেন? কেন আমার সামনে এত বড় বাঁধা এসে দাঁড়াল?”

ফালাক রেলিঙ ধরে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর মুচকি হেসে বলল,
“বাঁধা এড়িয়ে যদি আমার মনের রাজকন্যাকে হাসিল করে রাণী করতে না পারি তাহলে কেমন আশিক হলাম? ফালাক বি কুল। ইউ কেন। আমি সব বাঁধা পেরিয়ে রুহানির মন জয় করে ওকে নিজের করব।”
তারপরই মনে হলো রুহানিকে কত জোরে মেরেছে৷ দুঃখ প্রকাশ করার আগেই ফালাক নাক ফুলিয়ে অভিমানী সুরে বলল,
“বেশ করেছি। আরো দুটো মারা দরকার ছিল। বেয়াদব মেয়ে। শুধু বেয়াদব না ফাজিল, প্রচন্ড ফাজিল। একদম ঠিক করেছি।”
ফালাক জ্বলজ্বল করা তারার দিকে চেয়ে স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“আমার #প্রিয়_অভিমান তুমি বিল্লিরাণী। আমার ছোট ছোট অভিমানগুলো তোমাকে জড়িয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে।”

রুহানি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে ফালাককে একশো গালাগাল দিল। গালাগাল করে ঘুমাতে চলে গেল। আগামীকাল ইন্সটিটিউট যেতে হবে।

.

রুহানি ফাইল দেখে দেখে কিছু লিখছে। ইমন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুহানিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে রুহানির মন খারাপ। মুখটা কেমন কালো করে রেখেছে।
রুহানির কাছে এসে বলল,
“মুড অফ নাকি?”

রুহানি মাথা তুলে বলল,”নো স্যার।”

“তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে মুড অফ। আজকে আমার মুড এত ভালো আর আমার এসিস্ট্যান্ট মুড অফ করে রেখেছে?”

রুহানি কলম রেখে ইমনকে ভালো করে দেখে বলল,
“আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি বেশ খুশি। কিন্তু এত খুশির কারণ কি স্যার?”

“আজকে আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী।”

রুহানি চমকে গিয়ে বলল,”আপনি মেরিড?”

রুহানির প্রশ্ন শুনে ইমন চমকে গেল। রুহানিকে উল্টো প্রশ্ন করল,
“আমি সারাদিন কার সাথে ফোনে ফুসুরফাসুর করি?”

“আপনার ওয়াউফ? আমি তো ভাবতাম আপনার জিএফ৷ আমি এত দিন ধরে কাজ করছি আর জানিই না আপনি মেরিড। এখানে আমার কোন দোষ নেই। কেউ বউয়ের সাথে ফোনে এত ফুসুরফাসুর করে না। ফুসুরফাসুর করে জিএফের সাথে কথা বলে। তাই আমি ভেবেছি আপনার জিএফ।”

ইমন আলতো হেসে বলল,”তাও ঠিক কিন্তু আমাদের কথা শুরু হলে শেষ হয় না। আর ও যে হারে আমার ইন্সটিটিউটকে গালাগাল করে তাতে কথা শেষ হওয়ার কথাও না।”

“গালাগাল করে কেন? উনার পছন্দ না?”

“না। ওর আমার এই প্রফেশন পছন্দ না।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,
“তাহলে এক সাথে দু’বছর কি করে আছেন?”

ইমন মুচকি হেসে বলল,”কারণ আমরা একে অপরকে ভালোবাসি আমাদের প্রফেশনকে নয়। পাঁচ বছরের সম্পর্কের পর আমাদের বিয়ে। সাত বছর আছি এক সাথে ভালোবাসার একটুও কমতি হয় নি। ভালোবাসাটাই ফ্যাক্ট বাকি সব ম্যাটার করে না। দুটো মানুষের মধ্যে ভালোবাসাটা যখন গভীর হয় তখন তাদের আশেপাশের জিনিসগুলো ম্যাটার করে না। বুঝলে?”

রুহানি কিছুই বুঝল না। ইমনও বুঝতে পারল রুহানি কিছুই বুঝে নি।
“বুঝতে হলে কাউকে ভালোবাসতে হবে।”

রুহানি ক্যান্টিনে বসে নুডলস খাচ্ছে। ওর খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু নুডলস খুব ঝাল লাগছে। খেতে পারছে না কিন্তু উপায় নেই। এটাই খেতে হবে নয়তো না খেয়ে থাকতে হবে। কারণ ওকে সব হিসেব করে খরচ করতে হয়। বাইরে নাস্তা করার জন্য যে টাকা বরাদ্দ ছিল তার বেশি খরচ করা যাবে না।

ফালাক দূরে দাঁড়িয়ে রুহানিকে দেখছে। ফালাক রুহানির সাথে কথা বলতে চায়। ওর সমস্যাগুলো, ওদের সাথে কি হয়েছে সবটা জানতে চায়। আর এটা একমাত্র রুহানিই বলতে পারে। কিন্তু রুহানি তো ওকে দেখেই রেগে যাবে। ফালাককে বলবে বলেও মনে হচ্ছে না। ফালাক চাইছে রুহানির সাথে শান্তিপূর্ণ ভাবে কথা বলতে। ফালাক রুহানির কাছে যেতে যেতে দেখল ঝালের চোটে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। রুহানি বারবার পানি খাচ্ছে। কিন্তু কমছে না। ফালাক দু’টো আইসক্রিম নিয়ে রুহানির পাশে বসল। রুহানি ফালাককে দেখেও কিছু বলল না। ফালাক ওর দিকে একটা আইসক্রিম বাড়িয়ে দিল। রুহানি মনে মনে বলছে নিবে না কিন্তু ওর যে পরিমাণ ঝাল লাগছে তাতে যদি কেউ বিষ মিশিয়েও মিষ্টি কিছু দেয় খেয়ে নিবে৷ রুহানি ফালাকের হাত থেকে আইসক্রিম নিয়ে খেতে শুরু করে দিল। ঝাল কিছুটা কমেছে।

“এসব কেন খাচ্ছো?”

রুহানি ভ্রু কুচঁকে বলল,”খাবারের অপমান করছো?”

“রুহানি তুমি ভালো করেই জানো আমি খাবারের অপমান করছি না। আমি কি বলেছি তুমি বুঝতে পেরেছো।”

“কারণ আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। আর আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না।”
রুহানির কথা শুনে ফালাকের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।

ফালাক আকুতি নিয়ে বলল,
“আমাকে একসেপ্ট করে কেন নিচ্ছো না?”
রুহানি ফালাকের দিকে অবাক চোখে তাকাল। তারপর বলল,
“মানে? মানে কি? আমি তোমার প্রপোজাল একসেপ্ট করে নিলে ভালো ভালো খেতে পারব? আমি ভালো খাওয়ার জন্য তোমার প্রেম প্রস্তাব একসেপ্ট করে নেব? সিরিয়াসলি? আমি মরে যাব তবুও নিজেকে, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেব না।”

ফালাক কি বুঝাতে চাইল আর ব্যাপারটা কোন দিকে চলে গেল।
“রুহানি আমি এটা বলতে চাই নি। তুমি ভুল বুঝছো।”

“আপনার আইসক্রিমের টাকা আমি দিয়ে দেব। এখন এখান থেকে চলে যান। আমাকে খেতে দিন।”
ফালাক রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের হাতের অর্ধ খাওয়া আইসক্রিমটা টেবিলে রেখে বলল,
“যাচ্ছি, শান্তি মতো খাও তুমি।”

ফালাক চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে রুহানির খেয়াল হলো টেবিলে ফালাক নিজের ফোন রেখে গেছে। রুহানি আশেপাশে ফালাককে খুঁজল। কিন্তু না পেয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করে ফোন হাতে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে গেল। রুহানি কি মনে করে ফোনের পাওয়ার বাটন চাপল। স্কিনে রুহানির একটা ছবি জ্বলজ্বল করছে। রুহানির বুক ধুক করে উঠল। রুহানি দ্রুত পাওয়ার বাটন চাপল।
ফালাক দু-তিন জনের সাথে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কথা বলছে একটা মেয়ের সঙ্গে।

রুহানি ভেবেছিল ফালাকের হাতে গিয়ে ফোনটা দিবে। কিন্তু এখন আর ওর যেতে ইচ্ছে করছে না। ফালাক একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে আর ওখানে ওর যাওয়াটা ওর কাছে অস্বস্তিকর লাগছে। রুহানি বিরবির করে বলছে,
“ওদিকে আমাকে ভালোবাসার কথা বলছে আর এদিকে একটা মেয়ের সঙ্গে কি সুন্দর কথা বলছে। অসভ্য, ইতর।”
শুভ রুহানিকে আড়চোখে দেখছে। রুহানি দাঁড়িয়েই আছে৷ শুভের চোখে চোখ পড়তেই ইশারা করল সামনে আসার জন্য।

শুভ রুহানির কাছে আসতেই রুহানি ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া এটা ফালাকের ফোন। ভুলে ক্যান্টিনে ফেলে এসেছে। আপনি দিয়ে দিবেন প্লিজ।”

“তুমি তো নিজেই গিয়ে দিতে পারতে।”

রুহানি আরেকবার ফালাকের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“দরকার নেই। আমি যাব না ওর সামনে। আপনি দিয়ে দিবেন।”
রুহানি যাওয়ার আগে ফালাকের দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে আরেকবার তাকাল।

শুভ দৌড়ে গিয়ে ফালাককে টেনে অন্য পাশে নিয়ে গেল। ফালাক টানাটানির কারণ বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকাল।
“ভাই, ভাবি তো জ্বলছে।”

ফালাক ভরকে গিয়ে বলল,
“ভাবি জ্বলছে মানে? কোন ভাবি?”

শুভ ফালাকের ফোন দেখিয়ে বলল,
“রুহানি। তোর ফোন দিতে এসেছিল। এলিনার সাথে তোকে কথা বলতে দেখে একা একাই রাগে ফুসফুস করছে। আমার হাতে ফোন দিয়ে বলল তোকে যেন দিয়ে দেই। তোকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসার কথা বললে সে কি রাগ।”

ফালাক শুভর কথা শুনে বলল,
“সত্যি বলছিস? ও জ্বলছে? ভুল দেখিস নি তো?”

“আমার চোখে কি সমস্যা? আমি ভুল কেন দেখব? আমি ওর চোখ মুখ দেখেছি। তুই দেখলেও বুঝতে পারতি ভাই। সে কি আগুন ওই চোখে।”

শুভর কথা শুনে ফালাকের চোখ চকচক করছে খুশিতে।

রুহানি কলিং বেল বাজাতেই ওর মা হাসি মুখে দরজা খুলে দিল। রুহানি ভেতরে গিয়ে শকড। বিস্ময় প্রকাশ করতে পারছে না। ওর বাবা মার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। আহিল বসে বসে রুহানের সাথে কথা বলছে। রুহানিকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
“হায়, রুহানি কেমন আছো?”

রুহানি মুখ গম্ভীর করে বলল,
“জি ভালো আছি।”
তারপর ওর মা’র দিকে চেয়ে বলল,
“আমি খুব টায়ার্ড ভেতরে যাচ্ছি, ফ্রেশ হবো।”
রুহানির এই মুহুর্তে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। আহিল এখানে কি করছে আর ওর বাবা-মা এলাও করল কেন?

চলবে….

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৯|

রুহানি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছছে। ওর দৃষ্টি নিচের কালো গাড়িটির দিকে। আহিল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়িটা বেরিয়ে গেল বাড়ির সীমানা থেকে। রুহানি তোয়ালে রেলিঙের উপর মেলে ঘরে এলো। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর মা ঘরে ঢুকল। রুহানি আড়চোখে মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের মুখে হাসি লেগে আছে, তৃপ্তির হাসি। অনেক দিন পরে এত খুশি দেখছে।

রুহানি মায়ের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
“মা, এই আহিল এখানে কেন এসেছিল? কি করতে এসেছে?”

রুহানির মা ওকে বিছানায় বসিয়ে পাশে বসে বলল,
“তোর বাবাকে দেখতে এসেছিল।”

রুহানি অবাক হয়ে বলল,
“বাবাকে দেখতে এসেছিল? কেন? বাবার জখম তাজা করতে এসেছে? খুব দরকার ছিল কি? তুমি এলাও কেন করেছো?”

“রুহানি, রুহানি, আমার কথা শোন৷ আগেই রিয়েক্ট করে বসিস না। আহিল এসবের কিছুই জানতো না। আমাদের সাথে, তোর সাথে কি হয়েছে, আমাদের বর্তমান অবস্থা এসব কিছুই জানতো না। না জানার কারণও তুই ভালো করে জানিস। ও আমেরিকায় সেটেল আর তুই চাস নি ও তোর সাথে যোগাযোগ করুক। তাই আমাদের কোনো খবরই ওর কাছে পৌঁছে নি। গত পরশু দেশে ফিরে তোর খোঁজ করতেই ওর বাবা-মার কাছে সব জানতে পারে। তারপর আমাদের ঠিকানা জোগাড় করে তোর বাবাকে, আমাদের দেখতে এসেছে।”

রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“দয়া দেখাতে এসেছে। বেশ করেছে। শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে আমি চুপ করে ঘরে চলে এসেছি। নয়তো…. ”

“রুহানি, আহিল প্রথমেই এসে তোর বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। ওর বাবা-মাকে বুঝিয়েছে। ওর বাবা-মা আসবে তোর আর আহিলের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে।”

রুহানি চমকে মায়ের দিকে তাকাল। ওর মা হাসছে। আহিলের সাথে আবারও সম্পর্কের জোরা লাগায় ওর মা খুব খুশি।

রুহানি ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“কি বলছো তুমি? বিয়ে, কিসের বিয়ে?”

রুহানির মা ওর কথা বুঝতে পারছে না। রুহানির এমন একটা নিউজ শুনে খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা সেখানে রাগ দেখাচ্ছে।
“আমি কোন বিয়ে করছি না এটা মাথায় ঢুকিয়ে নেও।”

রুহানির মা রুহানিকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
“তোর রাগ করাটাই স্বাভাবিক। আহিলের উপর তোর রাগ অভিমান স্বাভাবিক হলেও এখানে তো ওর কোনো দোষ নেই। ও তো তোকে এখনো বিয়ে করতে চায়।”

রুহানি চিৎকার করে বলল,
“কিন্তু আমি চাই না। আর কিসের রাগ, অভিমান? আমি উনার উপর রাগ-অভিমান কেন করব? মানুষ রাগ-অভিমান তার উপরই করে যাকে আপন ভাবে কিন্তু আহিল আমার আপনজন নয়। মোটকথা আমি বিয়ে করছি না। প্লিজ মা এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।”

রুহানির মা কটাক্ষ দেখিয়ে বলল,
“রুহানি আমি বাড়াবাড়ি করছি না তুই বাড়াবাড়িটা করছিস? বিয়ের ব্যাপারটা নতুন নয়। দু বছর আগে থেকে বিয়ের কথা হয়ে আছে। শুধু মাঝে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তাহলে এমন রিয়েক্ট কেন করছিস?”

রুহানি নিজেকে দেখিয়ে বলল,
“দেখো, আমাকে ভালো করে দেখো। আমি আর সেই রুহানি কি এক আছি? পুরনো আমিটাই যখন নেই তখন পুরনো কথা বলে কি লাভ?”

রুহানির কথা শুনে ওর মায়ের চোখে পানি চলে এলো।
“রুহানি বিয়েটা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই অনেক ভালো থাকবি। আর তোকে কষ্ট করতে হবে না।”

রুহানি শুকনো হেসে বলল,
“কষ্টকে আমি আর ভয় পাই না। আমি আমার জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছি মা। বিয়ের কথা ভুলে যাও। সে স্বপ্ন আমার আর নেই। আমি তোমাদের সাথেই সারাজীবন থাকতে চাই।”

“তুই কি ভাবছিস বল তো? তোর বাবা উপার্জনে অক্ষম, তুই সংসারের হাল ধরেছিস। তোর ইনকামে সংসার চলছে তাই তোকে আমরা বিয়ে দেব না? তোকে সারাজীবন নিজেদের কাছে রেখে দেব তোর ইনকাম খাওয়ার জন্য? তুই যদি এটা ভেবে থাকিস তবে ভুল। তোকে অবশ্যই বিয়ে দিতাম, হয়তো তোর যোগ্যতা অনুযায়ী শ্বশুর বাড়ি তোকে পাঠাতে পারতাম না কিন্তু বিয়ে তো দিতেই হতো। আজ যখন আহিল নিজে এসেছে ওকে পায়ে ঠেলে কেন দেব? এমন সুযোগ আর দু’বার আসবে না। আমাদের যা অবস্থা ভালো ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসবে না। রুহানি অবুঝ হোস না। বুঝার চেষ্টা কর। এ নিয়ে আর কথা বলবি না। আহিলের বাবা-মা আসলে যত দ্রুত সম্ভব তোর বিয়ে দিয়ে দেব।”

রুহানি বিস্ময় নিয়ে ওর মা’য়ের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“আমি চলে গেলে তোমাদের কি হবে? সংসার চলবে কি করে? আর বাবার ওষুধ? কিভাবে বলছো মা?”

রুহানির মা দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
“ওসব তোকে ভাবতে হবে না। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।”

রুহানি ওর মা’কে পর্যবেক্ষণ করে শক্ত কন্ঠে বলল,
“হয়ে যাবে না হয়ে গেছে? আহিল কোন টেনশন করতে না করেছে তাই না?”

রুহানির মা কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। রুহানি পা এলিয়ে দিয়ে বসে বলল,
“এই দিনের জন্য এত কষ্ট সহ্য করেছি? আমাকে বেঁচে দিচ্ছো?”

রুহানির মায়ের যেন রক্ত মাথায় উঠে গেল। রুহানিকে সজোরে এক থাপ্পড় মেরে বলল,
“তুই কি পণ্য যে তোকে বেঁচে দেব? না খেয়ে মরে গেলেও কোন বাবা-মা নিজের মেয়েকে বেঁচে দেয় না। যারা দেয় তারা বাবা-মা না। আহিল যথেষ্ট ভালো ছেলে। তোর জন্য একদম পারফেক্ট। খুব সুখে থাকবি। তুই না চাইলেও তোকে এই বিয়ে করতে হবে।”

রুহানির মা দরজা পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল। পেছনে ঘুরে রুহানির দিকে তাকাল। রুহানি কাঁদছে। রুহানিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আর হ্যা ভিখারি নই যে মেয়ের জামাইর টাকায় খাব। আহিল বলেছে বিজনেসটা দাঁড় করাতে সাহায্য করবে, তারপর নাহয় ওর টাকা ফেরত দিয়ে দেব। ছেলেটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। বুঝতে পেরেছে হাত পেতে টাকা নেব না। এটুকু তো মেয়ের জামাইর উপর অধিকার থাকে। সে সীমা কখনো লঙ্ঘন করব না।”
তারপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। রুহানি শব্দ করে কেঁদে দিল।
“এদের জন্য আমি এতদিন এত কষ্ট সহ্য করেছি? এদের জন্য নিজের জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ,স্বপ্ন সব বিসর্জন দিতে চেয়েছি? যাদের জন্য এতকিছু করলাম আজ তাদের কাছে আমার মতামতের কোন মূল্য নেই। আহিল এখন সব? এতদিন কোথায় ছিল? যখন প্রয়োজন ছিল তখন তো আসেনি। আমি বলেছিলাম আমার সাথে যোগাযোগ না করতে তার মানে তো এই নয় যে আমার কোন খোঁজ রাখবে না। এত কষ্টের পর আজ যখন সব গুছিয়ে নিয়েছি তখন সব তছনছ করতে চলে এসেছে।”

রুহানির শ্বাস আঁটকে আসছে। কান্নাটাও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শান্তিতেও কাঁদতে পারে না। বুকে চাপ লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে। রুহানির পিপাসা পেয়েছে খুব। পানি খাওয়া দরকার। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। রুহানি রুহানকে ডাকার চেষ্টা করছে। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই রুহানকে ড্রয়িংরুমে টিভি দেখতে দেখল। রুহান দরজা খোলার শব্দে পেছনে ঘুরে। রুহানির অবস্থা দেখে দৌড়ে আসে।
রুহান ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“আপু কি হয়েছে? এমন করছো কেন?”

রুহান রুহানিকে বসিয়ে দ্রুত পানি নিয়ে এলো। রুহানিকে পানি খাওয়াতেই রুহানি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগল।
রুহানিকে স্বাভাবিক দেখে রুহান বলল,
“আবার এই ঘটনা কেন ঘটলো আপু?”

রুহানি চোখের পানি মুছে বলল,
“কেঁদেছিলাম তাই। বাবাকে আর মা’কে কিছু বলার দরকার নেই। কেঁদেছি জানলে নানা প্রশ্ন করবে।”

“কাঁদছো কেন আপু?”

“প্রশ্ন তাহলে শুরুই করে দিলি?” রুহান ওর চোখের দিকে একবার চেয়ে চোখ নামিয়ে বলল,
“সরি আপু।”

রুহানি মন খারাপ করে নুশা আর রনকের সাথে বসে আছে। রুহানি চুপচাপ কফি খাচ্ছে। নুশা রনকের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল রুহানির মুড অফ কেন, রনক ইশারায় বলল জানে না।
নুশা তাই বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করল,
🤨”রুহানি মুড অফ কেন?”

রুহানি মন খারাপ করে বলল,
“আরেক মসিবত এসে ভীড় করেছে।”

নুশা আবারও প্রশ্ন করল,”কি?”

“কি না কে? আহিল! আহিল আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমার তো ইচ্ছে করছিল ওকে মেরে দেই।”

নুশা অস্ফুট স্বরে বলল,”আহিল! এতদিন পর?”

“আমার সুখের জীবন নষ্ট করতে এসেছে। আগামীকাল দেখা করবে দেখি কি বলে। আমি এখন উঠি রাতে ইনস্টিটিউটের ফাংশন আছে। আমাকে যেতে হবে।”

রুহানি উঠে দাঁড়াতেই দূরে ফালাককে দেখতে পেল। ফালাকের চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হাসল। রুহানি বই দিয়ে নিজেকে আড়াল করে বাইরে বের হচ্ছে। ফালাক রুহানির কাছে না এসে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

.

রাত ১১টা। প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার নামই নেই। রুহানি বারবার ঘড়ি দেখছে। ওর বাসা থেকেও ফোন আসছে। কিন্তু ওর স্যার না বলা পর্যন্ত ও যেতে পারবে না। এসিস্ট্যান্ট তাই সব জায়গায় সব কাজে এসিস্ট করতে হবে। রুহানিকে বারবার ঘড়ি দেখতে দেখে ইমন বলল,
“এনি প্রব্লেম রুহানি?”

“জি স্যার। কত রাত হয়ে গেছে। বাসা থেকে ফোন আসতেছে বারবার। মা’কে বলার পরেও বুঝতে চাইছে না। টেনশন করছে।”

“ঠিক আছে তাহলে তুমি চলে যাও। আমি ম্যানেজ করে নেব।”

রুহানি খুশি হয়ে বলল,”ধন্যবাদ স্যার।”

রুহানি আজ গাড়িও নিয়ে আসে নি। গাড়িতে তেল নেই। আর তেল কিনতে টাকা লাগবে তাই গাড়ি ছাড়াই এসেছে। একটা রিকশা পেয়ে গেলেই হলো।
কিন্তু অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে থাকার পরেও রিকশা, অটো কিছুই পাচ্ছে না। রুহানি স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। স্ট্যান্ডে এসে আরেক বিপদে পড়ল। নীরব-নিস্তব জায়গা। মানুষ জন কিছুই নেই। গা ছমছমে পরিবেশ। এই অন্ধকারে রুহানির অনেক ভয় লাগছে।
রুহানি ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সামনের দিকে। আর মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ছে। শা শা করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে লম্বা সময়ের ব্যবধানে। যা রুহানির ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।

একটা গাড়ি ধীরে ধীরে ওর পেছনে পেছনে আসছে। রুহানি অনেকক্ষণ ধরে ব্যাপারটা খেয়াল করছে। পেছনে না দেখে দ্রুত পা চালাচ্ছে। ওর গতির সাথে গাড়ির গতিও বাড়ছে। রুহানির সারা শরীরে কম্পন অনুভুত হচ্ছে। হৃদপিণ্ডটা দ্রুত বেগে চলছে। ভয়ে কুকঁড়ে যাচ্ছে।

হটাৎ করে ওর পেছনে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। একটা কন্ঠে নিজের নাম শুনে বুক ধুকপুক করে উঠলেও থেমে পেছনে ঘুরে রুহানি। পেছনের মানুষটাকে দেখে সাহস পায়। দু’পা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তুমি! এখানে কি করছো? তুমি আমাকে ইচ্ছে করে ভয় দেখাচ্ছিলে?”

ফালাক মুখ ইনোসেন্ট করে বলল,
“আমি তোমাকে কখন ভয় দেখালাম? তুমি একা একা এই রাস্তা দিয়ে হাঁটছো তাই এলাম।”

রুহানি আর কিছু বলল না।
ফালাক শক্ত কন্ঠে বলল,
“এত রাতে একা একা এই নিরিবিলি, অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটছো কেন? জানো না এই রাস্তাটা ভালো না?”

রুহানি মনে মনে বলছে, “কিছু করার নেই। রিক্স নিয়েই জীবন চালাতে হয় আমাদের। জীবন বাঁচানোর জন্য জীবনকেই বিপদে ফেলতে হয়।”

রুহানিকে চুপ দেখে ফালাক ধমকে বলল,
“এই জব ছেড়ে দেও। এত রাতে বাইরে থাকতে হয় এমন জব করার দরকার নেই।”

রুহানি ভ্রু কুঁচকে ফালাকের দিকে তাকাল। তারপর আবার সামনের দিকে হাঁটা দিল। ফালাক ওর পেছনে যেতে যেতে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো তুমি? থামো বলছি।”

“আমি বাসায় যাচ্ছি। আমার পেছনে আসবে না।”

“আমি তোমাকে দিয়ে আসব। এত রাতে একা একা তোমার যেতে হবে না। আমার গাড়িতে আসো।”

“দরকার নেই আমি যেতে পারব। কারো সাহায্য প্রয়োজন নেই।”

ফালাক রুহানিকে থামানোর জন্য মিথ্যে বলল,
“যাও, সামনে গাজাখোড়দের আড্ডা খানা। ওদের সাথে গিয়ে আড্ডা দেও। দেখবে কত সুন্দর ভাষায় তোমার সাথে কথা বলে।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়৷ তারপর পেছনে ঘুরে ফালাকের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“সত্যিই কি তাই?”

“বিশ্বাস না হলে আরো দশ মিনিট হেঁটে দেখো। আমি যাচ্ছি টাটা। আমার কাজ আছে।”

রুহানি ফালাকের কাছে এসে বলল,
“একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে চলে যাচ্ছেন? মানবতা বলে কিছু নেই,?”

“যাক বাবা, এখন আমার দোষ? আমি তো বলেছিলাম তুমিই শুনো নি… ”
রুহানি ফালাকের সাথে কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে ওঠে বসে।

.

হালকা আলোয় ফালাকের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। রুহানির ডাউট হচ্ছে। ফালাক মিটমিট করে হাসছে কেন?
“আপনি এই রাস্তায় কি করছিলেন? আপনার বাসা, অফিস কোনটাই এদিকে না। তবে কি করছিলেন?”

“তোমাকে ফলো করছিলাম।”
কি এটা বলব আশা করেছিলে? আমার কি আর কাজ নেই? আমি একজনের সাথে মিট করতে এসেছিলাম। তোমাকে দেখলাম ভয়ে ভয়ে হাঁটছো তাই লিফট দিতে চাইলাম।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল।ফালাক আড়চোখে রুহানিকে দেখছে।

চলবে……!

প্রিয় অভিমান পর্ব-১৭

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৭|

সকাল সাড়ে ন’টা। রুহানি ভার্সিটির ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটছে দ্রুত গতিতে। হাতের পাতলা বই দিয়ে সূর্যটাকে আড়াল করে নিয়েছে। সাড়ে নটায় সূর্যের প্রখরতা দেখে রুহানির মনে হচ্ছে ভর দুপুর।
আজ ও অলরেডি ক্লাসের জন্য লেট করে ফেলেছে। তাই শর্টকাট হিসেবে সরু রাস্তা ছেড়ে মাঠ দিয়ে হাঁটছে। ফালাক দুতলা থেকে রুহানিকে দেখে দৌড়ে নামছে। ওদিকে ওর ক্লাসের সময় হয়ে গেছে৷ কিন্তু ক্লাসের পরোয়া না করে রুহানির কাছে ছুটে আসছে। ফালাক নিচে নেমে রুহানিকে পেল না। এক মুহুর্তের মধ্যে রুহানি গায়েব। ফালাক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলালো। তারপর রুহানির ক্লাসের দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুহানিকে দেখা গেল। রুহানি দ্রুত পায়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। ফালাক দৌড়ানো থামিয়ে দিয়ে রুহানিকে ডাকল।

রুহানি কারো মুখে নিজের নাম শুনে থেমে গেল। কৌতূহল বশত পেছনে ঘুরে ফালাককে দেখে। ফালাক ওর দিকেই আসছে। ফালাক আসার পর পরই রুহানি স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“হায়!”

ফালাক ছোট একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
“কেমন আছো?”

“জি ভালো।”

ফালাক রুহানির দিকে তাকাল। ওর মুখে মিষ্টি হাসি।
“তুমি আজকাল কোথায় থাকো?”

রুহানির মনে কৌতূহল জাগল। নুশার বলা কথা মনে পড়ল।
“কেন বলো তো?”

ফালাক কি বলবে বুঝতে পারছে না।
“ভার্সিটি তোমাকে মিস করে। মানে তোমার আমাকে জ্বালানো সময় গুলো মিস করি।”

ফালাকের কথা শুনে রুহানি ফিক করে হেসে দিল। তারপর বলল,
“সে রুহানি আর নেই। তাই মিস করতে থাকো।”

ফালাক ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি কি জানতে পারি কি করছো আজকাল? এই পরিবর্তনের রিজন কি?”

রুহানির মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“কাজ করার চেষ্টা করছি। লাইক ইউ।”

রুহানির কথা শুনে ফালাক বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল। রুহানি কাজ করছে। ব্যাপারটা ফালাকের হজম হচ্ছে না।
“কাজ! তুমি!”

রুহানি ফালাকের কথায় আর চোখে মুখে অবিশ্বাস দেখতে পেল। হালকা হেসে বলল,
“কেন আমি কি কাজ করতে পারি না?”

ফালাক রুহানির মলিন মুখটা দেখে বলল,
“সরি, প্লিজ কিছু মনে করো না।”

রুহানি শুকনো হেসে বলল,
“না, কি মনে করব? কিছু মনে করি নি।”

“তা কি করছো আমি কি জানতে পারি?”

রুহানির ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক অতি আগ্রহের সাথে চেয়ে আছে। রুহানি আমতা আমতা করছে। ফালাক বুঝতে পারল রুহানি বলতে চাইছে না। তাই বলল,
“ইট’স ওকে বলতে হবে না।”

রুহানি হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে তাড়া দেখিয়ে বলল,
“আমার ক্লাসের দেরি হয়ে গেছে অলরেডি। আমি আসছি।”

রুহানি ফালাকের উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল। ফালাক ওকে থামাতে চেয়েও থামাল না। রুহানি এক প্রকার ফালাককে এভয়েড করে চলে গেল।
রুহানির এভাবে চলে যাওয়া ফালাকের সহ্য হলো না। ফালাক হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।

ক্লাস শেষে ফালাক রুহানির ক্লাসের সামনে এসে দাঁড়াল। রুহানির জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু রুহানির ক্লাস শেষ হওয়ার নামই নেই। ফালাকের ফোন বেজেই চলেছে। ফালাক বারবার কেটে দিচ্ছে। এক প্রকার বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে নিল।
ক্লাস রুমের দিকে চেয়ে ফোন রিসিভ করে নিল ফালাক। ওপাশের কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আসছি।”

ফোন কেটে রুহানির ক্লাসের দিকে একবার তাকাল। তারপর পকেটে ফোন রেখে চলে গেল।

.

রুহানি বাড়িতে ফিরে জানতে পারল ওর মা ওর বাবাকে নিয়ে হসপিটালে গেছে। ওর বাবা হটাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রুহানি যেভাবে ছিল সেভাবেই হসপিটালে চলে গেল। ডাক্তার ওর বাবাকে দেখছে। রুহানি ভেতরে ঢুকে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,
“বাবার কি হয়েছে? এখন কেমন আছে?”

রুহানির মা-ও ডাক্তারের বলার অপেক্ষায় আছে।
ডাক্তার চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“মনে হচ্ছে ঠিকমতো মেডিসিন নিচ্ছেন না। পাশাপাশি অনেক স্ট্রেসে আছেন। উনাকে সাবধানে থাকতে হবে আর নিয়মিত মেডিসিন নিতে হবে।”

রুহানি ওর মায়ের দিকে তাকাল। আর ওর মা ওর বাবার দিকে চেয়ে রুহানির থেকে নিজের দৃষ্টি লুকাল।

.

রুহানি ড্রয়িংরুমে গম্ভীর ভাবে বসে আছে। ওর পাশেই ওর মা আর ভাই। ওর বাবা ঘুমাচ্ছেন।
“কেন মা, কেন? বাবার মেডিসিন ঠিক মতো দিচ্ছো না কেন? আমাকে কেন বলো নি?”

রুহানির মা ভারি কন্ঠস্বরে বলল,
“আর কত, আর কত বলব রুহানি? তুই কোথায় থেকে এত টাকা এনে দিবি? তুই তো তোর সাধ্যমত চেষ্টা করছিস। বাড়ি ভাড়া আর বাজার আনার পর সামান্য কিছু টাকাই ছিল তা দিয়ে যতটা পেরেছি ওষুধ এনেছি। তোর বাবা-ই বলেছে। আমি বলেছিলাম রুহানি রাগ করবে। তার কথা পেট না বাচলে এমনিতেই মরে যাব, তখন আর ওষুধে কাজ হবে না। আগে পেট বাচুল তারপর ওষুধ।”

রুহানি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“তাই বলে আমাকে কিছু জানাবে না?”

ওর মা অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল,
“তোর বাবা নিষেধ করেছে। নিষেধ করবে না তো কি? যেখানে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠাব সেখানে মেয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি। মেয়ের উপর পুরো সংসারের দায়িত্ব দিয়ে বসে আছি।”
রুহান মাথা নিচু করে বসে আছে। ওর আর সহ্য হচ্ছে না।

বারবার মনে হচ্ছে যদি পরিবারের জন্য কিছু করতে পারতো। কিন্তু কি করবে? কি যোগ্যতা আছে ওর। কোন কিছু করার মুরদ নেই। ছোট থেকে আরাম আয়েশে বড় হয়েছে। নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। রুহান উঠে নিজের রুমে চলে গেল।

রুহানি আশ্বস্ত করে বলল,
“আগামীকালের মধ্যে টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।”

“কিন্তু তুই এত টাকা কোথায় পাবি?”

“মা নিশ্চিত থাকো চুরি-বাটপারি করব না। আমি সব ম্যানেজ করে নেব।”

সারারাত রুহানির ঘুম হলো না। কি করব টাকা জোগাড় করবে। গতকাল রাতে তো বলে দিল টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে কিন্তু কি করে ব্যবস্থা করবে?

.

রুহানি অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে গেল। আগামীকাল শহরের সনামধন্য হোটেলে নাচ করবে। এই মুহুর্তে রুহানির জন্য আর কোন রাস্তা খোলা নেই। টাকার খুব প্রয়োজন। তাই রাজি হয়েছে। বাড়িতে ওষুধ নিয়ে ফিরেছে। রুহানির মা জিজ্ঞেস করায় বলেছে ধার নিয়েছে। রুহানি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
“আজ থেকে আমার জীবন আমার নয়। আমার ব্যক্তিগত কোন স্বপ্ন নেই। আমার জীবন আর আমার স্বপ্ন আমার বাবা-মা আর ভাই। ওদের সুখের জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করলাম।”

রুহানি যদি কোন প্রোগ্রামে ড্যান্স করতো তাহলে সমাজ সেটা খারাপ চোখে দেখত না। কিন্তু যারা টাকার জন্য হোটেলে, বারে নাচ করে সমাজের চোখে তারা অসামাজিক, উশৃংখল, চরিত্রহীন। তাদের কোন সম্মান নেই। সে কাতারে আজ রুহানিও পড়ে গেল।

রুহানি পোশাকের সাথে ম্যাচ করে মুখে পাতলা জড়ির কাপড় বেঁধে নিল। যাতে কেউ ওকে চিনতে না পারে। এটাও কস্টিউমের একটা অংশ। সেদিনের মতো এক গাদা লোকের সামনে নাচ করে নিজের ভেতরটাকে মেরে ফেলে এসেছে। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে পুরো রাত কেঁদেছে। তাই ভার্সিটিতে যেতে দেরি হয়ে গেছে।

প্রায় দিনের মতো দৌড়ে দৌড়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। পেছনে থেকে আবারও ফালাকের ডাক শুনল। আজ রুহানি প্রচন্ড বিরক্ত হলো। ক্লাস লেট হওয়া সত্ত্বেও ফালাক এসে ওর আরো দেরি করিয়ে দিচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক রুহানির চোখে মুখে বিরক্তি ভাবকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
“লেট কেন?”

“তাহলে জানো আমি লেট এসেছি। জানার পরেও ডেকে কেন আরো লেট করে দিচ্ছো?”
চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল।

“কারণ আমার কিছু কথা আছে। তোমাকে তো একদম পাওয়া যায় না।”

“কথা! আমার সাথে কি এমন কথা আছে যার কারণে আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছো? বলো আমি শুনছি।”

ফালাক চারদিকে চেয়ে বলল,
“এখানে বলা যাবে না। অন্য দিকে চলো।”

রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এখন আমার তোমার কথা শোনার জন্য মঙ্গল গ্রহে যেতে হবে? তুমি কি চাইছো আমি পুরো ক্লাসটাই মিস করি?”

ফালাক শীতল কণ্ঠে বলল,
“ক্লাসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আমার কথাগুলো। প্লিজ।”

রুহানি ফালাকের চোখে মুখে আকুতি দেখতে পেল। তাই আর না করতে পারল না। রুহানির মনে হচ্ছে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে। হয়তো কোন সমস্যায় আছে।

রুহানি ফালাকের পেছনে পেছনে বারান্দার শেষ মাথায় গেল। ফালাক রুহানির দিকে দু’হাত ভাজ করে ঘুরে দাঁড়াল। রুহানি ফালাকের দিকে চেয়ে আছে কি বলবে শোনার জন্য। ফালাক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়তো তোমার কাছে আমার কথাগুলো ষ্টুপিডের মতো লাগবে বাট আমি এক বিন্দু মিথ্যা বলব না।”

রুহানি তাড়া দেখিয়ে বলল,
“আরে কথাটা তো বলো। তারপর বুঝব ষ্টুপিড কিনা।”

ফালাক রুহানির চোখে চোখ রাখল। রুহানির চোখ বলছে রুহানি কিছুই বুঝতে পারছে না।
“আমি আজ এক সুপ্ত অনুভূতির কথা বলব যা আমি কিছুদিন আগে আবিষ্কার করেছি। অসম্ভব সুন্দর একটা অনুভূতি যা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। রুহানি আমি সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করি তাই সোজাসাপটাই বলছি,আই লাভ ইউ।”

রুহানি ফালাকের প্রথম কথাগুলোর মিনিং খোজায় ব্যস্ত ছিল শেষের আই লাভ ইউ লাইনটা মাথার উপর দিয়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। একদমই ভরকে গেল।
মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই বের হলো,”অ্যায়য়!”

ফালাক র‍্যহানির কাছ থেকে এমন রিয়েকশন আশা করে নি। ভেবেছিল রাগ করবে কিংবা অন্যকিছু কিন্তু রুহানির বিভ্রান্ত চেহেরা দেখে কিছুই বুঝতে পারল না।
“রুহানি আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

রুহানি দু পা পিছিয়ে কনফিউজড ফেস নিয়ে বলল,
“ভালোবাসা! কি বলছো মাথা ঠিক আছে? কিছু খেয়েছো?”

“রুহানি আমার মাথা একদম ঠিক আছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকে চাই। অনেক দিন যাবত বলার সুযোগ খুঁজেছি কিন্তু পাই নি। এটাই সত্যি।”

রুহানি কি রিয়েক্ট করবে, কি রিয়েক্ট করা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারছে না।
“তোমার কথায় কি রিয়েক্ট করব বুঝতে পারছি না কিন্তু এসব উল্টো পাল্টা কথা আমাকে আর বলো না। বুঝলে? আমি যাচ্ছি।”

রুহানি নির্লিপ্ত ভাবে চলে যাচ্ছে।
“রুহানি আ’ম সিরিয়াস। আমি মজা করছি না কিংবা আমার মাথায় গন্ডগোল নেই। আই রিয়েলি লাভ ইউ। ট্রাস্ট মি।”

রুহানি ফালাকের দিকে ঘুরে বলল,
“ওকে আই ট্রাস্ট ইউ। বাট আই ডোন্ট লাভ ইউ। এসব ভুলে যাও। আর প্লিজ কাউকে এসব বলো না।”

রুহানি চলে যাচ্ছে ক্লাসের দিকে।

ওর মধ্যে কোন ফিলিংস হচ্ছে না। ফালাক ওকে এমন কিছু বলতে পারে কল্পনাও করতে পারে নি। ফালাক ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। রুহানির এমন হাব ভাব একদমই আশা করে নি। রুহানি ক্লাসে মন বসাতে পারল না। শুধু ভাবছে ফালাক এমন একটা কথা কি করে বলতে পারে? ক্লাস শেষ হতেই বাড়িতে চলে গেল।
চোখ বন্ধ করলে ওই ঘটনাই মনে পড়ছে।
“ভালোলাগা, ভালোবাসা শব্দগুলো আমাদের জন্য নয়৷ আমাদের জন্য শুধু একটা শব্দই বরাদ্দ বেঁচে থাকার লড়াই।”
রুহানি চাঁদর মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। কিন্তু ওদিকে ফালাকের চোখে ঘুম নেই। বারান্দায় রেলিঙের উপর বসে আছে। ভাবছে কি করে রুহানিকে হ্যা বলাবে। রুহানি রাজি হবে তো? রাজি যদি না হয় কি করবে? তবে চেষ্টা করে যাবে। আজ মনের কথাটা বলতে পেরেছে তাই অনেক।

পরের ক্লাসের দিন ভার্সিটিতে গিয়ে রুহানিকে পাওয়া যায় নি। ফালাকের আজকাল রুহানি বিহীন ক্যাম্পাস বিষের মতো লাগে। তার পরের দিন রুহানি ভার্সিটিতে এলো। ফালাকের কথা ভুলেই বসেছে আর সেটা ফালাক ওর সামনে এসে মনে করিয়ে দিল।
“পুকুরের ওই পাড়ে ক্লাস শেষে দেখা করবে।”

“কেন? আমি ওখানে যাব না।”

“তাহলে এখানেই সিন ক্রিয়েট হবে। আমাকে দায়ী করতে পারবে না।”
রুহানি ফালাকের মুখের দিকে তাকাল। হ্যা ফালাক এটা করতে পারবে ওর মুখ বলছে। তাই রুহানি বলল,
“ওকে। আসব।”

ফালাক মুচকি হেসে চলে গেল। পুরো ক্লাসে রুহানি উশখুশ করেছে। কাউকে কিছু বলে নি। ক্লাস শেষে রুহানি ফালাকের বলা জায়গায় যায়। রুহানি এই ঘটনার সমাপ্তি চায় তাই গিয়েছে। ভার্সিটি ফাকা হতে চলেছে ধীরে ধীরে।
ফালাক রুহানির পরে পৌঁছাল।

রুহানি ফালাককে দেখে কড়া গলায় বলল,
“এখানে কেন? কি চাই তোমার?”

“উত্তর চাই। আমি তোমাকে একটা প্রপোজাল দিয়েছি তার উত্তর।”

“আমি উত্তর দিয়ে দিয়েছি। আর কোন উত্তর বাকি নেই।”

ফালাক একটু দূরে সরে দুহাত প্রসারিত করে বলল,
“কিসের কমতি আমার মধ্যে? কোন দিক দিয়ে তোমার অযোগ্য?”

রুহানির এই মুহুর্তে ফালাককে অনেক সিরিয়াস লাগছে। এর আগে এই ব্যাপারটা এতটা সিরিয়াস লাগে নি।
“রুহানি এন্সার মি। ডু ইউ হেভ বয়ফ্রেন্ড?”

“নাহ!” রুহানি মাথা নিচু করে উত্তর দিল।

“তবে আমাকে তোমার পছন্দ নয়?”

রুহানি দ্রুত উত্তর দিল,”তোমাকে আমার পছন্দ নয়।”

“কেন নয়? রিজন তো একটা দেখাতে হবে।”

রুহানি যা উত্তর দেয় সেই উত্তর থেকে ফালাক আরেকটা প্রশ্ন তৈরি করে। রুহানি হাপিয়ে যাচ্ছে আর বারবার ফালাকের কথার প্যাঁচে আঁটকে যাচ্ছে।
ফালাক আবারও বলল,
“তোমার কারো সাথে রিলেশন নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে কাউকে ভালোবাসবে বিয়ে করবে। তবে সে আমি কেন নই? কোন দিক থেকে আমি তোমার অযোগ্য আমি শুধু সেটাই জানতে চাইছি রুহানি।”

রুহানি চেঁচিয়ে বলল,
“আমি কাউকে ভালোবাসব না। আমি কাউকে বিয়েও করব না। আর যোগ্যতার কথা বলছো? লুক এট মি। কতটুকু চিনো আমাকে? কতটুকুই বা জানো?”

“এটুকুই কি যথেষ্ট নয়?”

“না যথেষ্ট নয়। তোমার আমার সম্পর্কে জানা জরুরী ছিল। ঠিক আছে ভুল যখন করেছো তখন আমি নিজেই তোমাকে জানাচ্ছি। আমি রাজিব শিকদারের মেয়ে রুহানি শিকদার। রাজিব শিকদার যে কি-না এক সময় টপ বিজনেসম্যানের একজন ছিল। কিন্তু আমাদেরই আপনজন আমাদের পিঠে ছুড়ি মারায় আজ আমরা রাস্তায় এসে নেমেছি। আমার বাবা প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন৷ অভাব অনটন শব্দগুলো রোজ একটু একটু করে আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। এতদিন কেন বলিনি কাউকে জানো? কারণ এখানে কিছ মানুষ আছে যারা আমার সত্যিটা জানলে আমাকে বাচতে দেবে না। তাই এতগুলো মাস ধরে সব হাইড করে গিয়েছি।”
রুহানি কাঁদতে লাগল। ফালাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানির উপর দিয়ে এতকিছু বয়ে গেছে আর ও জানেই না।

রুহানি আবারও বলতে লাগল,
“কি ভাবে বেঁচে আছি জানো? আমি রুহানি যে টাকা পায়ের নিচে রেখে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি সেই সামান্য টাকার জন্য কাজ করছি। এগুলো তোমার জানা জরুরী ছিল। তবে আর এই কথাগুলো আমাকে বলতে পারতে না।”

ফালাক ভেজা চোখে বলল,
“রুহানি, আই ডোন্ট কেয়ার।”

রুহানি রেগে গিয়ে বলল,
“বাট আই কেয়ার। আমি কখনো বিয়ে করব না। আমার লাইফ মানে আমার ফ্যামিলি। আরেকটা কথা জানো তো টাকার জন্য আমি হোটেলে নাচ করি। যারা হোটেলে নাচ করে তারা কোন টাইপ মেয়ে হয় সেটা তোমার জানার কথা। তাই আমার পিছ ছেড়ে দেও। আমার মতো থার্ডক্লাশ হোটেলে নাচা সস্তা মেয়ের জন্য নিজেকে কষ্ট দিও না।”

ফালাক রুহানির কথা শেষ হতেই ঠাটিয়ে রুহানির গালে থাপ্পড় মারল। তাল সামলাতে না পেরে রুহানি মাটিতে পড়ে গেল।

চলবে…….!

প্রিয় অভিমান পর্ব-১৫+১৬

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৫|

ফালাক টেবিলের উপর কনুই ভর দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। রুহানি পানি খাচ্ছে। হটাৎই মনে হচ্ছিল শ্বাস আঁটকে মরে যাবে। পানি খেয়ে একটু ভালো লাগছে। রুহানি টেবিলের উপর গ্লাস রেখে ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক সোজা হয়ে বসল।

“সেদিনের পর থেকে আমার উপর ওর ভীষণ ক্ষোভ। এতদিন শুধু সুযোগ খুঁজেছে আর এই ট্যুরে এসে সে সুযোগ পেয়েও গেছে। জানি না এখন ও কি করবে। যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বুঝতে পারছি না।”
রুহানির খুব টেনশন হচ্ছে। বাবা-মার কানে যদি যায় মাতাল হয়ে সারারাত একটা ছেলের সাথে ছিল তবে কি হবে। রুহানি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। তবে তায়েফ যদি সত্যিই কিছু করে তবে ওর মার্ডার করে দিবে। তারপর যা হওয়ার হবে।

ফালাক আশ্বস্ত করে বলল,
“ডোন্ট ওরি! কিছু হবে না। আমি ওর সাথে কথা বলছি। এই বিষয়টায় আমিও জড়িয়ে আছি। যদিও ছেলে হওয়ায় সমাজ আমার উপর কোনরূপ দোষারোপ করবে না। তবুও আমি তোমার কিংবা আমার বদনাম হতে দেব না।”

রুহানি ফালাকের কথায়ও আশ্বস্ত হতে পারছে না। ওর নিজেরই কিছু করতে হবে। রুহানির ফোন বেজে উঠল। ওর মা ফোন করেছে। ফালাক ওর ফোন বাজতে দেখে বলল,
“আমি আসছি।”

রুহানি ফালাককে বিদায় দিয়ে ফোন রিসিভ করে নিল।

.

তায়েফ কানে হেডফোন গুজে ফোনে স্ক্রল করতে করতে হাঁটছে। হটাৎই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। হাতের ফোনটা ছিটকে দূরে পড়ে গেল। ফালাক ওর সামনে বসে বলল,
“আহারে! কি করে পড়লে? ফোনের ভেতর ঢুকে থাকলে এমন তো হবেই।” ( পড়ে থাকা ফোনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে)

ফালাক তায়েফকে না তুলে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
“এত দামী ফোনটা এভাবে মাটিতে পড়ে থাকা মানায়?”

তায়েফ নিজে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে রাগে গর্জে উঠে বলল,
“ল্যাং মারলেন কেন? ফেলে দিয়ে আবার নাটক করছেন?”

“আরে কুল! এগুলো তো তোমাদের কাছেই শেখা।”

তায়েফ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ফোন দিন।”

ফালাক ফোনটা পকেটে রেখে বলল,
“ওয়েট, এত পাগল হচ্ছো কেন?”

তায়েফ ফালাকের আচরনে খানিকটা অবাক হচ্ছে। কি করতে চাইছে আর কেনই বা ওর কাছে এসেছে।

ফালাক ওর আরেকটু কাছে এসে দু-হাত ভাজ করে বলল,
“রুহানির ড্রিংক চেঞ্জ করেছিস কেন?”

ফালাকের কথা শুনে তায়েফ ঘাবড়ে গেল। তারপর কনফিডেন্সের সাথে বলল,
“ফালতু কথা বলবেন না। আমি কেন ওর ড্রিংক চেঞ্জ করব?”

ফালাক মুচকি হাসল।
“আমার কাছে প্রুভ আছে। তুই যার সাহায্যে করেছিস সেই বলেছে। বারবার ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বলে দিয়েছে এলকোহল এলাও না। তবুও এনেছিস। আর তারপর একটা মেয়েকে ছলনা করে খাইয়েছিস। এই পর্যন্ত মানা যেত তারপর ওকে আমার রুমের সামনে পাঠিয়েছিস, ভিডিও করেছিস। এখন সেটা ভাইরাল করার জন্য হুমকি দিচ্ছিস। তোর কি মনে হচ্ছে ফালাক তোর হাড়-গোড় ভাঙবে না? তোকে ছেড়ে দিবে? আমি যথেষ্ট ভদ্র একটা ছেলে কিন্তু কতটা ডেঞ্জারাস তুই তো দেখিস নি। বাবা-মার একমাত্র ছেলে হওয়ায় সব সময়ই আদুরে। কেউ কখনো আমার একটা চুলও স্পর্শ করতে পারে নি। এইবারেও পারবি না। ভার্সিটিতে কমপ্লেইন তো অবশ্যই করব পাশাপাশি মানহানীর মামলা ঠুকে দেব। আমি ইয়ং বিজনেসম্যান। নিজের পরিচিতি গড়ার আগেই তোর জন্য সেটা নষ্ট হতে দেব? আমার ক্যারিয়ারের উপর কারো আঁচড় আমি সহ্য করব না। রেডি থাক তোর এই অপরাধের শাস্তি খুব দ্রুতই পাবি।”

তায়েফ ফালাকের রাগী কন্ঠের কথাগুলো শুনে ঘাবড়ে গেল। রুহানির সাথে যে ফালাকও জড়িয়ে আছে সেটা ভুলে বসেছিল। কিন্তু এতদিনে এমন একটা সুযোগ পেয়েছে রুহানিকে শায়েস্তা করার জন্য সেটা ভয় পেয়ে হাতছাড়া করে দিবে? আর কি এমন মূখ্যম সুযোগ আসবে? কিন্তু ফালাকের সাথে যদি নতুন করে কোন ঝামেলা হয়? ফালাকের হিংস্র চোখ-মুখ বলছে ফালাক ওকে ছেড়ে দিবে না। তায়েফ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
ফালাক রুহানির জন্য এটা করলেও নিজের নাম ভাঙ্গাচ্ছে যাতে তায়েফ ভয় পায়। যাতে না বুঝে রুহানিকে বাচানোর জন্য এসব করছে।
ফালাক তায়েফের দিকে চেয়ে আছে। ওর ভাব মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। বাট ফালাক এটা ভেবে নিশ্চিন্ত যে ফোনটা ওর হাতে।

তায়েফ আড়চোখে ফালাককে দেখল। তারপর বলল,
“আমার ফোনটা দিন। আমি এসব কিছু করি নি। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।”

তায়েফের কথা শুনে ফালাকের মাথায় যেন ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। ফালাক ওর দিকে চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল। হাতের মুঠে ফোনটা এমন ভাবে ধরেছে যেন ভেঙে চুরমার করে দিবে। ফালাক ফোনটা পাশের পুকুরে ছুড়ে মারল। তায়েফ চোখ বড়বড় করে তাকাল। তারপর চিৎকার করে বলল,
“আমার ফোন!”

ফালাক ওর কলার চেপে ধরে বলল,
“যা তুলে নিয়ে আন তোর ফোন। ভালো কথায় মন ভরে নি এখন শোক কর। বেশি বাড়াবাড়ি করবি মেরে পুতে দেব। রুহানির থেকে একশো হাত দূরে থাকবি। নয়তো ও একাই যথেষ্ট তোকে মেরে গেড়ে দিতে। দেখ তোর জন্য ও কি ভেবে রেখেছিল। আমি হয়তো তোর ফোন ফেলে তোকে বাঁচিয়ে দিলাম। ধন্যবাদ দে।”

তায়েফ ফালাকের দিকে আগুন চোখ নিয়ে তাকাল। যেন এই আগুনে ওকে ঝলসে দিবে।
“আর ইউ ম্যাড?”
ফালাক মুচকি হাসল। তারপর বলল,
“ইয়া আ’ম ম্যাড। তবে কিসের জন্য সেটা এখন বুঝবি না। বাচ্চা মানুষ।” (কলার ঠিক করতে করতে)
ফালাক আবারও আলতো হেসে চলে যাচ্ছে। তায়েফ ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ফালাক পেছনে ঘুরে বলল,
“নিউ ফোন পেয়ে যাবি টেনশন করিস না।”
ফালাক আবারও হাসছে। এই প্রথম কারো জন্য এমন পাগলামি করল, কাউকে হুমকি দিল। সব সময় নিজের জন্য অন্যের সাথে লড়েছে আর আজ রুহানির জন্য। যে কি-না ওর বন্ধু, আত্মীয় নয়।

রুহানি তায়েফকে খুঁজছে। ও কারো হেল্পও নিতে পারছে না। কারণ বন্ধুরা কেউ জানেই না গতকাল রাতের ঘটনা আর না জানাতে চায়। ও একাই দেখে নিবে। তায়েফকে খুঁজে পেলেই ইচ্ছে মতো মারবে তারপর ফোন কেড়ে নিবে। আগের মুডে চলে এসেছে, তায়েফ বাধ্য করল।

“বাঘিনী শিকার খুঁজতে বের হয়েছে বুঝি?”
ফালাকের কন্ঠস্বর শুনে রুহানি ডান দিকে তাকাল। ফালাক দাঁড়িয়ে আছে। ফালাক ওর কাছে এগিয়ে আসতেই রুহানি বলল,
“ওকে আমি আমার পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলতে দেব না। ওকে একবার পাই।”

“ডান!”

রুহানি চমকে ওর দিকে তাকাল। ওর ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি।
“ডান মানে?”

“বেচারা হাঁটতে হাঁটতে টাইপিং করছিল। তারপর সুযোগ বুঝে ল্যাং মারলাম যেমনটা তুমি করেছিলে। ও পড়ে গেল ওর ফোন তুলে নিলাম। ইচ্ছে মতো হুমকি দিলাম। ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এলকোহল এনেছে, তোমার ড্রিংক চেঞ্জ করেছে তার প্রমাণ আছে আমার কাছে। যদিও নেই। এছাড়া ইচ্ছে করে তোমাকে আমার রুমে পাঠিয়েছে আমার বদনাম করার জন্য। তাই আমি ওর নামে মামলা করব, ভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে জানাব ব্লা ব্লা হুমকি দিয়ে ওর ফোন…”

রুহানি চট করে বলল,”ডিলিট করে দিয়েছো?”

“আরে না, ফোন নিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছি। ঠিক পুকুর না, নর্দমা টাইপ পুকুর।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এটা ফালাক তো! ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল।
“ফেলে দিয়েছ? মাই গড! তোমাকে কিছুতে আছড় করেছে?”

“হ্যা, রুহানি!”
রুহানি ওর কথা শুনে ভরকে গেল। ফালাকও মুখ ফসকে কি বলতে কি বলে ফেলল। ফালাক কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
“না মানে, তোমার টেকনিক ব্যবহার করেছি, মানে তোমাকে অনুসরণ করে ওকে শায়েস্তা করেছি তাই বললাম রুহানি। এছাড়া আর কি করার ছিল। আমার মানসম্মানও তো জড়িত ছিল। তাই না?”
তারপর রুহানির দিকে তাকাল।
রুহানি ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
“হ্যাঁ”
ফালাকের দিকে আরেকবার আড়চোখে তাকাল। ফালাক কেমন অদ্ভুৎ আচরণ করছে।
রুহানি একটা টেনশন থেকে রক্ষা পেল। বাকি একটা দিন খুব সাবধানে কাটাল।

.

রুহানির মা ওর বাবাকে ওষুধ খেতে দিলেন। তারপর পাশে বসে রইলেন চুপ করে। রুহানির বাবা ওর মাকে উদাস দেখে বলল,
“কি হয়েছে?”

রুহানির মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বুঝতে পারছি না কি করব। বাঁচব কি করে। টাকা পয়সা সব শেষ। যা বাজার আছে তাতে ৪-৫দিন চলবে। তারপর! তারপর কি করব?”

রুহানির বাবা মাথা নিচু করে নিলেন। উনার নিজেরও জানা নেই কি করবে। ছেলে-মেয়েদের না খেয়ে মরতে দেখবেন? নিজের উপর রাগ হচ্ছে। ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু করতে পারছেন না বরং তাদের বোঝা হয়ে আছেন। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে আত্মবিসর্জন দিতে কিন্তু তারও উপায় নেই। কি করে ছেলে-মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিবে?

রুহানি গলায় হাত দিয়ে জামার ভেতর থেকে লকেটটা বের করল। তারপর হুক খুলে হাতে নিল। হীরের লকেট। গত জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন। এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে সব সময় গলায় পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবারের এমন মুহুর্তে এটাই রুহানির শেষ সম্বল। বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু বাবার দেওয়া উপহারটা বিক্রি করে দিবে? রুহানি চেয়ার টেনে বসে পড়ল। কি করবে ভাবছে। একদম সাধারণভাবে বসবাস করতে চাইলেও মাসে ওর ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে। ভাগ্যিস বাড়ি ভাড়াটা কম দিতে হয়। কেননা যারা ওদের ভাড়া দিয়েছেন তারা নিজেরা বাড়ি দেখভাল করার জন্য নিয়েছিলেন। আর এখন মালিককে না জানিয়ে ভাড়া দিয়েছে। যা পাবে তাই লাভ। বাড়ি ভাড়া, বাবার ওষুধ-পথ্য, ভাইয়ের পড়ার খরচ, সংসার খরচ সব কিছু মিলিয়ে ত্রিশ হাজারে চলা মুশকিল। আর সেখানে ওর হাতে কোন টাকা নেই বললেই চলে।

রুহান ওর পাশে এসে বসেছে। কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। রুহানি ওর চোখ মুখ দেখে বুঝে গেল।
“কিছু বলবি?”

রুহান তখনও চুপ। বলতে চেয়েও বারবার আঁটকে যাচ্ছে। কিন্তু বলতে তো হবেই।
“আপু মা’কে বলতে গিয়ে বারবার ফিরে এসেছি। আমি তো জানি সংসারের কি অবস্থা। কি করে এই মুহুর্তে এই কথা বলব? সাহস হয় নি। তোমাকেও বলতে পারছি না।”

রুহানি ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“বল, আমি সমাধান করার সর্বাত্মক চেষ্টা করব।”

“আপু মাস শেষ। স্কুলের বেতন দিতে হবে আর কোচিং-এও অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে। কিন্তু মা’কে বলতে পারছি না। আমার পড়াশোনা কি এখানেই শেষ?”
রুহানের কথা শুনে ওর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।

“না রুহান, আমি আছি তো। তুই পড়াশোনা করবি। পড়াশোনা করে অনেক বড় হবি। আমাদের দুঃখ লাঘব করবি। আমি তোর টাকার ব্যবস্থা করছি। একদম চিন্তা করিস না।”

রুহানি উঠে দাঁড়াল। ছাদে গিয়ে পাইচারি করছে। হাতের ফোনটা নিয়ে ভাবছে কাকে ফোন করা যায়। কার কাছে সাহায্য চাইবে?
তারপর হটাৎ খেয়াল হলো হাতের ফোনটাই বিক্রি করে দিবে। এত দামী ফোন দিয়ে কি করবে? যখন নিজেকেই কম দামী মনে হচ্ছে।

.

নুশা রুহানির সামনে হাসিমুখে বসে আছে। কারণ রুহানি নিজেই অনেক খুশি। রুহানির খুশি দেখে ও নিজেও খুশি।

চলবে……

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৬|

রুহানি, নুশা আর রনকের সামনে কফি রেখে বলল,
“উফফ! ফাইনালি, আমি একটা জব পেয়ে গেলাম। হ্যা এটা ঠিক যে জবটা খুবই ছোট, স্যালারি কম তবে জব পেয়েছি এতেই খুশি। চারদিন কাজ করে আঠারো হাজার পাচ্ছি তাই অনেক।”

রনক কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
“এতে করে ভার্সিটিতে দুদিন ক্লাস করতে পারবে আর বাকি দুদিন মিস যাবে। সেটা আমি কভার করে দেব। চিন্তা করো না। তবে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে হবে। এই জবে তোমাকে তেমন খাটতেও হবে না।”

রুহানি গালে হাত দিয়ে বলল,
“পড়াশোনাতে আমার আর মন নেই। ইচ্ছে করে না।”

নুশা এতক্ষণ ওদের কথা চুপ করে শুনলেও রুহানির কথা শুনে বলল,
“যে করেই হোক গ্রাজুয়েট করতে হবে। মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিবি? আজীবন কি এই জব করবি? ভালো একটা জব পেতে হলে পড়াশোনাটা শেষ করতে হবে। আপাতত এই জব কর তারপর পড়াশোনা শেষ করে নিশ্চয়ই খুব ভালো একটা জব পাবি। সারাজীবন কেউ তোকে দেখবে না, নিজের ভবিষ্যত নিজেকেই তৈরি করতে হবে।”

রনক তাল মিলিয়ে বলল,
“অবশ্যই। দেখো রুহানি এমন অনেক জবের অফার আমি পেয়েছি কিন্তু রাজি হই নি। এখানে সেখানে টিউশনি করে বেড়াচ্ছি। কারণ কি জানো? আমার মঞ্জিল অনেক বড়। স্বপ্ন যখন দেখবেই বড় স্বপ্ন দেখা উচিত। এত কষ্ট করে পড়াশোনা করছি বড় কিছু হাসিল করার জন্য। পরিবারের দুঃখ লাঘব করার জন্য। স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন পাড় করার জন্য। পার্ট টাইম জব করলে ক্লাস মিস যাবে, পড়াশোনার ক্ষতি হবে তাই করি নি। ভালো রেজাল্ট করে বের হলে ভালো একটা জব পাব সে স্বপ্নই দেখে যাচ্ছি। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা আলাদা। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি এই জব করার জন্য তোমাকে সাপোর্ট করছি। তবে পড়াশোনা ছাড়ার কথা ভেবো না।”

“এখন না হয় না ভাবলাম কিন্তু আগামী বছর? ভর্তির সময় যাবতীয় খরচ ভার্সিটি রেখে দেয় তাই এ বছর স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারছি। শুধু ফ্রম ফিলাপ বাকি। কিন্তু আগামী বছর কি করে ভর্তি হব?”

“আগামী বছরেরটা আগামী বছর দেখা যাবে। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা জ্ঞানীর কাজ তবে ভবিষ্যত ভেবে ভেবে বর্তমান নষ্ট করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।”

রুহানি রনকের দিকে হালকা হেসে চেয়ে বলল,
“বুঝেছি পন্ডিত মশাই। খুব বুঝেছি। চল ক্লাসে যাই। আগামী কাল তো আবার আসতে পারব না।”

ক্লাস শেষে রুহানি ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে নামছে। নুশা বকবক করে যাচ্ছে আর রুহানি তাল দিচ্ছে।

ফালাক নিচে দাঁড়িয়ে রুহানিকে দেখে ওর দিকে চেয়ে আছে। রুহানি সব সময় চুল খোলা রাখে। আজ উঁচু করে ঝুঁটি বেঁধেছে। গলায় একটা স্কাপ। হাতে কয়েকটা পাতলা বই। ফালাক অপলক ওকে দেখছে। রুহানির হটাৎ চোখ গেল ফালাকের দিকে। ফালাক ওর দিকে কিভাবে চেয়ে আছে। অদ্ভুত সে দৃষ্টি। রুহানিও ওর দিকে চেয়ে আছে। তবে ওর চাহুনি সাধারণ। রুহানি ওর দিকে চেয়ে ভাবছে ফালাক হটাৎ ওর দিকে এভাবে চেয়ে আছে কেন? কারণ উদঘাটন করায় ব্যস্ত। তবে আদৌও উদঘাটন করতে পারবে কি ওই গভীর চাহুনির কারণ?

ফালাকের চোখে চোখ পড়ার পরেও ফালাক চোখ সরাচ্ছে না। রুহানির কপালে ভাজ পড়ল। ফালাকের দিকে চেয়ে চেয়েই নামছে। হটাৎ হুচট খেয়ে পড়ে যেতে গেলে নুশা ধরে ফেলে বলল,
“আরে সাবধানে। কোথায় মন রেখে হাঁটছিস?”

রুহানির বুক ঢিপঢিপ করছে। এখনই পড়ে যেত। আমতা আমতা করে বলল,
“তোর কথা শুনছিলাম। আর কোথায় থাকবে মন?”
রুহানি ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক মিটমিট করে হাসছে৷ রুহানি চোখ ছোট ছোট করে নাক ফুলিয়ে ওর দিকে তাকাল। তারপর ভেংচি কেটে ওর দিকে আর না তাকিয়ে চলে গেল। ফালাক তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। ওর মনে বসন্ত না আসতেও বসন্তের ছোয়া লেগেছে।

.

রুহানি সকাল সকাল রেডি হয়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কেন জানি খুব নার্ভাস লাগছে। রুহানি শেষ বারের মতো জোরে শ্বাস নিল। তারপর শেষ বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
বাবার কাছে গিয়ে বসল।
“বাবা দোয়া করো। অনেক নার্ভাস লাগছে।”

রুহানির বাবা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“সফল হও। আর নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। মনে মনে বলো আর বিশ্বাস করো যে তুমি সব পারো। না পারা নিয়ে সংশয় তোমার মনে ভয় সৃষ্টি করছে। এই ভয়কে হারাতেই হবে। কি পারবে না?”

রুহানি মুচকি হেসে বলল,
“অবশ্যই পারব। পারতে আমাকে হবেই।”

রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে গেল। ওর মা-ও মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার দোয়া সব সময় তোর সাথে আছে। ভপ্য পাস না। সততার সঙ্গে কাজ করবি।”

রুহানি বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। রুহানি একটা ড্যান্স ইন্সটিটিউটে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে জব পেয়েছে। এই ইনস্টিটিউটের ওনার ইমন খানের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েন করেছে। ইনি একজন খ্যাতিমান ড্যান্সার। উনার আন্ডারে অগণিত স্টুডেন্ট নাচ শিখে এবং কয়েকজন খ্যাতিমান টিচারও আছেন। রুহানির কাজ ইমন খানের কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা। সবকিছুর হিসাব রাখা,কোন দিন কোথায় ফাংশন আছে, কারা কারা এডমিশন নিচ্ছে এসব তথ্য সংগ্রহ করা।

রুহানি দশ মিনিট ধরে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারছে না। জীবনে অনেক দুঃসাহসিক কাজ করেছে কখনো ভয় পায় নি। কিন্তু আজ ওর খুব ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ যদি হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেত। কিন্তু ও তো ছোট বাচ্চা নয় আর না এখানে এডমিশন নিতে এসেছে। এখানে কাজ করতে এসেছে তাই ওর নিজেকেই নিজের গার্ডিয়ান মনে করতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। রুহানি আশেপাশে তাকাল। কত বড় ইন্সটিটিউট। বিশাল বড় মাঠ। বড় বড় গাছ মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঠের চারদিকে ঘেরা বড় দালান। সামনে বিস্তৃত খোলা বারান্দা। পুরো দালান থেকে একটা একতলা দালান আলাদা করে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেটাই হচ্ছে অফিস রুম। রুহানি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

রুহানি আল্লাহর নাম নিয়ে ভেতরে পা রাখল। নিজের পরিচয় দিতেই পিয়ন রুহানিকে বসতে দিল। রুহানি একদম সোজা হয়ে বসে আছে। আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে।
চুল ঝুঁটি করা, চাপ দাঁড়ি, খাম্বার মতো লম্বা, এক হাতেই কতগুলো ব্রেসলেট পড়া মাঝারি গড়নের একজন লোক ওর দিকে আসছে। লোকটা যতই ওর দিকে এগিয়ে আসছে রুহানির বুকের ধুকধুকানি বেড়েই চলেছে। রুহানি দাঁড়িয়ে গেল।
লোকটা ওর সামনে এসে ওকে দেখে নিয়ে বলল,
“তুমিই রুহানি! প্লিজ সিট।”

রুহানি বসে পড়ল। লোকটা রুহানিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“নাচ পারো?”

রুহানি উনার প্রশ্নে চমকে গেল। নাচ জানার সাথে এই কাজের কি সম্পর্ক? রুহানি উনার দিকে আড়চোখে চেয়ে বুঝার চেষ্টা করছে উনি কি মজা করে জিজ্ঞেস করল না সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। না উনার চেহারায় হাসির চিহ্ন আছে আর না অধিক গাম্ভীর্য। রুহানি উত্তর দেয়াটাই শ্রেয় মনে করল।
“জি পারি।”

ইমন খান রুহানির উত্তর শুনে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো তোমার কাজের সাথে নাচের কি সম্পর্ক? আসলে আমি তোমাকে ইজি করার জন্য এই প্রশ্নটা করেছি। তোমাকে অনেক নার্ভাস লাগছে।”

রুহানি অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল,
“সরি স্যার। একচুয়েলি আমি লাইফে অনেক কিছু করেছি কখনো ভয় পাই নি। দু পাতা পড়ে পরীক্ষার হলে বসেও কখনো নার্ভাস হই নি। কিন্তু আজ কেন জানি নার্ভাস লাগছে।”

“মেবি আমি জানি কেন তোমার নার্ভাস লাগছে। আসলে তুমি ভয় পাচ্ছো। আর ভয়ের কারণ হচ্ছে তোমার কাছে এই জবটা অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। তোমার মনে হচ্ছে যদি না পারো, যদি কোন কারণে জবটা না থাকে। এই জন্য ভয় পাচ্ছো।”

“মেবি স্যার।”

“আচ্ছা তোমাকে কিছু কথা বলে রাখি। আমার ইনস্টিটিউট থেকে অনেকেই বিভিন্ন ওকেশনে পার্টিসিপিট করে। যদি ঢাকাতে হয় তবে আমাকে যেতে হয় না। কিন্তু ঢাকার বাইরে হলে আমাকে ওদের সাথে যেতে হয়। আমাকে যেতে হলে তোমাকেও যেতে হবে। তুমি কি পারবে?” ইমন রুহানির দিকে চেয়ে ওর ভাব বুঝার চেষ্টা করছে।

রুহানির কাছে কোন উপায় নেই। এই কাজটা দরকার তাই বলল,”হ্যাঁ পারব।”

ইমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওকে তো ডান। আমি অরুনকে বলে দিচ্ছি তোমার সব কাজ বুঝিয়ে দিবে।”

রুহানি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,”ওকে স্যার।”

.

ফালাক রুহানিকে ভার্সিটির কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। রুহানি আজ আসে নি। কিন্তু কেন? পরের ক্লাসেও রুহানিকে পায় নি। তারপর যখন আবার ভার্সিটিতে পেয়েছে তখন রুহানি ক্লাস, লাইব্রেরী আর রনকের সাথে ব্যস্ত ছিল। এক সেকেন্ডের জন্য ফ্রি ছিল না। রুহানি পড়াশোনা নিয়ে পড়ে থাকে। রুহানির বদলে যাওয়া গুলো ওর হজম হচ্ছে না। কিছু একটা ঘাপলা আছে কিন্তু কি খুঁজে পাচ্ছে না। নিয়ম করে দুদিন রুহানিকে ভার্সিটিতে দেখা যায়। বাকি দুদিন কোথায় থাকে? আর কেন এত বদলে গেল? পড়াশোনায় এত সিরিয়াস কেন? আর সেদিন নেশার ঘোরে বলা কথাগুলো। সব কেমন জানি এক জায়গায় এসে মিলে যাচ্ছে। রুহানি ওকে দেখেও দেখে না। ফালাক রুহানিকে এত গুরুত্ব দেয় কিন্তু রুহানি ফালাকের দিকে চেয়েও দেখে না। ফালাকের অস্তিত্ব ওর জন্য এক্সিটই করে না। বিষয়গুলো ফালাককে খুব পোড়াচ্ছে।

ফালাক রুহানির অনুপস্থিতিতে নুশাকে জিজ্ঞেস করল,
“রুহানির কি হয়েছে? ও ঠিক মতো ভার্সিটিতে আসে না কেন? দুদিন আসে তো বাকি দুদিন গায়েব থাকে। আর আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। কেমন শান্ত হয়ে গেছে। আগের মতো হইচই করে না। পড়াশোনা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। কিছু কি হয়েছে?”

“নাহ! কি হবে? সব ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এই প্রশ্ন কেন করছেন?”

ফালাক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ল। নুশাকে জিজ্ঞেস করে অনেক বড় বোকামি করে ফেলেছে।
“কিছু না। ওর পরিবর্তন দেখে আগ্রহ জন্মাল তাই জিজ্ঞেস করলাম। যদিও তুমি সঠিক উত্তর দেও নি। ইটস ওকে।”

ফালাক ভাবছে রুহানির সামনাসামনি হবে। ওকে জিজ্ঞেস করবে ওর কি হয়েছে। না বললে জোর করবে। তবুও জেনেই ছাড়বে। এটা ওর ভালোবাসার অধিকার। যদি জিজ্ঞেস করে কোন অধিকারে জিজ্ঞেস করছে তবে বলবে ভালোবাসার অধিকারে। আর লুকাবে না।

এদিকে নুশা রুহানিকে ফোন করে ফালাকের ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছে। রুহানি চিন্তায় পড়ে গেল। ফালাক কেন ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে? ফালাকের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল।

চলবে…….

প্রিয় অভিমান পর্ব-১৪

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৪|

রাতের পার্টির জন্য রুহানি তৈরি হচ্ছে। দুদিন যাবৎ যেন জীবনের হারানো সুখগুলোর সন্ধান মিলেছে। পেছনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকতে চাইছে। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। নুশা কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

গলা খাকাড়ি দিতেই রুহানি পেছনে ঘুরে। নুশা মিটমিট করে হাসছে। রুহানি ভ্রু প্রসারিত করে বলল,
“তোর সমস্যা কি? গলায় ব্যাঙ ঢুকেছে? অপারেশন করে বের করে দেব?”

নুশা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“তুই কি ডাক্তার?”

“গলা কাটতে ডাক্তার হওয়া লাগে না। বল কেটে দেই। আমার ব্যাগে চাকু আছে।”

নুশা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“সব সময় বাজে কথা। এখন বল এত মনোযোগ দিয়ে কার জন্য সাজগোজ করছিস?” (ভ্রু নাচিয়ে)

রুহানি আবারও নিজেকে আয়নায় দেখে বলল,
“নিজের জন্য। সবাই অন্যকে দেখানোর জন্য সাজগোজ করলেও আমি নিজের খুশির জন্য নিজেকে সাজাই। তোর ফালতু কথা শেষ হলে চল যাই।”

নুশা মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে, “এই মেয়ে মজাও বুঝে না৷ সব সময় সিরিয়াস মুড।”

ওরা ট্রুথ অর ডেয়ার গেম খেলছে। চুপিসারে বিদেশি ড্রিংকের আয়োজন করেছে। বোতল ঘুরাতেই রুহানির দিকে পড়তেই তায়েফ রুহানিকে ডেয়ার দিল ড্রিংক করার জন্য। কিন্তু রুহানি নারাজ। এসবে ওর অভ্যাস নেই। তারপর দেখা যাবে মাতাল হয়ে উল্টো পাল্টা কাজ করে ফেলবে। আর সবাই মজা নিবে। নিজের পায়ে কে কুড়াল মারতে চায়?

রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“অন্য কোন ডেয়ার দেওয়ার হলে কেউ দিতে পারো অর আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে ফাঁসানো অত সহজ না।”

কেউ আর ওকে ডেয়ারের জন্য জোরাজুরি করে নি। ফালাক দূরে দাঁড়িয়ে রুহানির দিকে নজর রাখছে আর কোল্ড ড্রিংকে চুমুক দিচ্ছে। সবার সাথে রুহানি হাসছে, গল্প করছে। ফালাক পার্টি ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য নিজের রুমে চলে গেল।

সবাই কোল্ড ড্রিংক পান করছে। রুহানিও গলা ভিজিয়ে নিল। রুহানির কাছে ড্রিংকটা কেমন অদ্ভুৎ লাগছে। সফট ড্রিংকস এমন হতে পারে না। রুহানি চুপ করে এক জায়গায় বসে আছে। নড়ছে না। নুশা বারবার ওকে ধাক্কাধাক্কি করছে কিন্তু ও থম মেরে বসে আছে।

রুহানি নুশাকে বলল,
“আমি একটু রুম থেকে আসছি।” রুহানি দ্রুত উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। নিজের ব্যালেন্স রেখে দ্রুত বাইরে চলে গেল। রুহানি বুঝতে পারছে কোনভাবে ওর ড্রিংক বদল হয়ে গেছে। না জানি এখন ও কি করবে। তাই দ্রুত নিজেদের রুমে চলে যেতে চায়। কিন্তু শরীর চলছে না। সিড়ি বেয়ে উঠছে। চোখ ছোট ছোট হয়ে আসছে। কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। রেলিঙ শক্ত করে ধরে এক পা এক পা করে আগাচ্ছে। কতটা সিড়ি পাড় করেছে সেটাও জানা নেই। কডিটোর জুড়ে হাঁটছে কিন্তু ওর রুম খুঁজে পাচ্ছে না। ফালাক ডিনার করার জন্য রুম থেকে বের হয়ে রুহানিকে দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। রুহানি চোখ ছোট ছোট করে আঙুল তুলে দুইটা রুমের দরজার দিকে রাখছে। একবার ডান পাশের রুমের দরজা আরেকবার বাম পাশের রুমের দরজা। ফালাক কিছুই বুঝতে পারছে না। রুহানি কি টস করছে, না কি করছে। ফালাক দরজা খোলা রেখেই রুহানির দিকে গেল।

রুহানি একটা ছেলেকে দেখে বলল,
“আমার ঘর কোথায় গেল? কে চুরি করে নিয়ে গেল?”

ছেলেটা কিছুই বুঝতে পারল না। রুহানির দিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলল,
“পাগল না কি?”

ছেলেটা চলে গেল। রুহানি পেছনে থেকে চেঁচামেচি করছে,
“তুই পাগল, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল।”

ফালাক ওর সামনে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে রুহানি?”

রুহানি ফালাককে দেখে বলল,
“তুমি চুরি করেছো? আমার রুম কই?” তারপর রুহানির চোখ গেল ফালাকের রুমের খোলা দরজার দিকে। তারপর বলল,
“পেয়ে গেছি। এই তো আমার রুম।”

রুহানি ফালাকের রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তাল সামলাতে না পেরে দরজা ধরে নিচে পড়ে গেল। ফালাক ওর অবস্থা দেখে বুঝতে পারল ও ড্রিংক করেছে। ফালাক ওকে ধরে দাঁড় করাল। রুহানি ফালাকের কাঁধে হেলে পড়ল। ফালাক ওকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। রুহানি ভেতরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ফালাক দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রুহানির নেশা কি করে কাটাবে? আর রুহানিকে এভাবে ওর রুমে দেখলে মানুষ উল্টো পাল্টা কথা বলবে। ফালাক দরজা ভিড়িয়ে দিল। রুহানির নাম ধরে বারবার ডাকছে। রুহানি পিটপিট করে তাকাল। ফালাক ওকে ধরে বসাল।

রুহানি ছোট ছোট চোখ করে ফালাকের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে চেনা চেনা লাগছে। কে তুমি?”

ফালাক রুহানির কথা শুনে হতবাক।
“আমি ফালাক, জুনায়েদ ফালাক।”

রুহানি কিছুক্ষণ ফালাকের দিকে চেয়ে রইল। ফালাক কনফিউজড রুহানি কি ওকে চিনতে পারছে?

রুহানি কনফিউশান নিয়ে বলল
“তুমি সেই অসভ্য, খাটাস ছেলেটা না? আমাকে অনেক জ্বালিয়েছো। এখানে কি চাও? আমার রুম থেকে চলে যাও। নয়তো….!”

রুহানি নয়তো এর পর আর কিছু বলতে পারছে না। কি বলবে মাথায় আসছে না। মাথা চুলকাচ্ছে। ফালাকের রুহানির কথা শুনে বেহুশ হবার উপক্রম। ওর রুমে ওকে হুমকি দিচ্ছে।

রুহানি হটাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর দু’হাত মেলে বলল,
“আমি পাখি হয়ে গেছি। আমি আকাশে উড়ছি। ইয়াহু! আকাশটা কত সুন্দর!” রুহানি ফালাকের দিকে ঘুরে বলল,
“তুমি গান গাও, আমি নাচব।”

ওর কথা শুনে ফালাকের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ভর করল। রুহানির মাতলামি বেশ উপভোগ করছে। ফালাক ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,
“আমি তো গান পারি না।”

রুহানি নাক মুখ কুচকে বলল,
“গতকাল গেয়েছো আমি শুনেছি। মিথ্যা বলো না।”

“কিন্তু আমি তো ভালো গাই না।”

রুহানি ফালাকের কাছে এসে ওর গাল টেনে ধরে বলল,
“কে বলেছে তুমি ভালো গাও না? তুমি যেমন কিউট তারচেয়ে বেশি কিউট তোমার কন্ঠ।”
ফালাক রুহানির আচরণে বেশ অবাক হচ্ছে।
“আমি কিউট!”

“হুমমম,অনেককককক!”
রুহানি গাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আরে গাও না, ঠিক আছে গাইতে হবে না।”

ফালাক গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি হাত পা নাড়িয়ে নাঁচতে শুরু করল। জোরে জোরে গান গাইতে শুরু করল। ফালাক ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
“আস্তে আস্তে, বাইরে কেউ শুনতে পেলে দু’জনের অবস্থাই খারাপ হবে। চুপ। একদম চুপ। গান গাইবে না। এখানে ভালো মেয়ের মতো শুয়ে থাকো।”

রুহানিকে জোর করে ফালাক শুইয়ে দিল। কি করা যায় তাই ভাবছে আর পাইচারি করছে৷ রুহানি ওর ভাবনার মাঝে উঠে গিয়ে বলল,
“আমি এখন গান গাইব।”
ফালাক আবারও গিয়ে রুহানির মুখ চেপে ধরল।
ওর মুখের কাছে গিয়ে বলল,
“হিসস, একদম না। তুমি ভালো মেয়ে না? এমন করে না। তাহলে মান-সম্মান কিছুই থাকবে না।”

রুহানি ধীরে ধীরে বলল,
“মান-সম্মান? আছে মান-সম্মান? আর আমি ভালো মেয়ে? হিহি। আমি না কি ভালো মেয়ে। হিহি।” রুহানি হাসতে শুরু করল।

ফালাক ধমক দিয়ে বলল,”চুপ! আর একটা কথা বললে বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেব। তারপর ডানা মেলে উড়তে থেকো।”

রুহানি ওর ধমক খেয়ে কেঁদে দিল। ফালাক রুহানির কান্না দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।
“রুহানি!”

রুহানি কাঁদতে কাঁদতে কাতর হয়ে বলল,
“রুহানি মরে গেছে। আমি মরে গেছি। ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। ওদের আমি কখনো ক্ষমা করব না।”(চোখের পানি মুছতে মুছতে)

ফালাক ওর কথার মাথামন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না৷ তবে কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছে। ফালাক পানি এনে রুহানিকে দিয়ে বলল,
“পানি খাও।”

রুহানি পানি খেলো না। ফালাক গ্লাস রেখে শীতল কণ্ঠে বলল,
“কে মেরে ফেলেছে তোমাকে? আমাকে বলো।”

রুহানি বলল,”জানি না।” তারপর ওর চোখ গেল বারান্দার দিকে। রুহানি সেদিকে যাচ্ছে আর ফালাকের মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে কে মেরে ফেলেছে ওকে?

রুহানি বারান্দায় গিয়ে চিৎকার করে বলছে,”আমি মরে গেছি।”
ফালাক দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরল। রুহানিকে জোর করে রুমে নিয়ে এল। রুহানির এখানে থাকা নিরাপদ নয়। কেউ জানলে বদনাম হয়ে যাবে। ফালাক সব জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিল। রুহানির হাত বাঁধল বেল্ট দিয়ে, শার্ট দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলল। রুহানি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। মুখ দিয়ে গোঙাতে শুরু করল।
ফালাক ওকে বলল,
“চুপ করে বসে থাকবে। আমি যাব আর আসব।”

ফালাক দ্রুত রুমের বাইরে চলে গেল৷ বাইরে থেকে লক করে গেল। দৌড়ে নিচে নামল। কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। রুহানি কত নাম্বার রুমে থাকে তাও জানে না আর না ওর কোন বন্ধুদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। ফালাক বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারল না। ফালাকের তখনই মনে পড়ল রুহানি কি করছে। নিশ্চয়ই হোটেলের পুরো তিনতলা মাথায় তুলে ফেলেছে। বিশাল হাঙ্গামা ক্রিয়েট করে ফেলেছে। ফালাক দৌড়ে তিনতলায় গেল। না ওর রুমের সামনে নীরবতা বিরাজমান। দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখে রুহানি ঘুমিয়ে পড়েছে। ফালাক ওর হাত, মুখের বাঁধন খুলে ওকে বারবার ডাকছে কিন্তু ও ঘুমে বিভোর। ফালাক সিদ্ধান্ত নিল রুহানি এখানেই থাকবে। রুহানির গায়ে চাঁদর দিয়ে দিল। এলোমেলো চুলগুলো এক পাশে এনে রাখল। রুহানির হাতটা শক্ত করে ধরল।

“রুহানি, আমি তোমার প্রতি একটা টান অনুভব করছি। কিন্তু এই টানের কোন নাম দিতে পারছি না। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজের মনকে মানাতে পারি না। কারণ মন আমার বশে নেই।” ফালাক রুহানির হাত ছাড়তে গিয়ে খেয়াল করল রুহানি ওর হাত শক্ত করে ধরে আছে।
ফালাক রুহানির হাতটা ছাড়িয়ে নিল।

ঘুম ভাঙতেই রুহানি পিটপিট করে চোখ মেলে। মাথাটা খুব ভারী লাগছে। হুট করে উঠে বসে। চারদিকে চেয়ে বুঝতে পারল এটা ওদের রুম নয়। তবে কার রুম? রুহানি ব্রেইনকে একটু প্রেসার দিতেই মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা। সিড়ি বেয়ে উঠছিল তারপর কি হলো মনে নেই। কার রুমে এসেছে, কিভাবে এসেছে কিছুই মনে নেই। রুহানি হটাৎ ফালাককে দেখতে পেল। ওর বুক ঢিপঢিপ করছে। ফালাক মেঝেতে বালিশে মাথা রেখে চাঁদর জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। রুহানির বুক ধুক করে উঠল। নিজের দিকে তাকিয়ে জামাকাপড় দেখে নিল। সব ঠিক আছে। এটা ফালাকের রুম। ও কি করে এলো কিছুই মনে করতে পারছে না। কোন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটিয়েছে কি-না তাও জানা নেই। রুহানি ফালাককে ফেস করতে চায় না। এখান থেকে পালাতে হবে। রুহানি বিছানা থেকে দ্রুত নামতে গিয়ে চাদরে পা লেগে ধপাস করে পড়ে যায়। রুহানির পড়ে যাওয়ার শব্দে ফালাকের ঘুম ভেঙে যায়।

রুহানিকে পড়ে থাকতে দেখে তরিঘটি করে উঠে রুহানির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“নেশা কি এখনো কাটে নি?”

রুহানি চাদর ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফালাকের কথার উত্তর দিল না।
রুহানি দৃষ্টি নত করে নিচু স্বরে বলল,
“আমি এখানে কি করে এসেছি?”

“পায়ে হেঁটে এসেছো। দুম করে আমার রুমে ঢুকে নিজের রুম বলে দাবি করেছো।”

রুহানি মনে করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। মাথা চুলকে বলল,
“তারপর?”

“তারপর আর কি পুরো রাত দৌড় করিয়েছো। কি জিনিস তুমি! হাড় জ্বালিয়ে খেয়েছো। যেসব খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারো সেগুলো কে খেতে বলেছে?” (শেষের কথাগুলো রাগী কন্ঠে বলল)

রুহানি ফালাকের দিকে তাকাল। তারপর আবার চোখ নামিয়ে বলল,
“আমি এসব কখনো খাই নি তাই অভ্যাস নেই।”

ফালাক কর্কশ গলায় বলল,
“গতকাল রাতে কেন খেয়েছো? ভদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা এসব ছুয়েও দেখে না।”

রুহানি হাত ঘষতে ঘষতে বলল,
“আমি জেনে বুঝে খাই নি। আমি তো সফট ড্রিংক মনে করে খেয়েছি।”

ফালাক সরু চোখে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“ঠিক তো?”

রুহানি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল।
“নেক্সট টাইম থেকে সাবধান। তুমি একটা মেয়ে। মেয়েদের সম্মান অনেক দামি। অনেক কষ্টে তোমাকে সামিলিয়েছি। তোমাকে আমি বাইরে মাতলামি করতে দেখি কিছু জিজ্ঞেস করতেই তুমি আমার রুমে চলে এসেছো। ভাগ্যিস আমার রুমে এসেছো। যদি অপরিচিত কারো রুমে চলে যেতে? সবাই কিন্তু আমার মতো না। তোমার অবস্থার সুযোগ নিতো। আর যা শুরু করেছিলে তুমি তাতে যার তার মাথা খারাপ হয়ে যেত।”

সব কথা রুহানি অপরাধী ভঙ্গিতে শুনলেও শেষের কথাগুলো শুনে চমকে গেল। ফালাকের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কি করেছি আমি?”

রুহানির বলার ভঙ্গি দেখে ফালাকের রাগ মাটি হয়ে গেল। ওর এই মুহুর্তে হাসি পাচ্ছে।
“বললে তুমি বিশ্বাস করবে না। আমার এই গাল দুটো টেনে রাখো নি। দেখো লাল হয়ে আছে এখনো।” (গাল দেখিয়ে)

রুহানি অসহায় ফেস করে ফালাকের দিকে তাকাল। তারপর অস্বীকার করে বলল,
“অসম্ভব! আমি এমন কিছুই করি নি। তুমি মিথ্যা বলছো। আমার কিছু মনে নেই তাই সুযোগ নিচ্ছো। আমি সব বুঝি।”

“শুধু গালই না। গান গেয়েছো, ড্যান্সও করেছো।”

রুহানি ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“অসম্ভব! এসব বলে আমাকে বোকা বানাতে পারবে না।”

“আমি জানি তুমি অস্বীকার করবে। তাই সব প্রমাণ রেখেছি। ওয়েট।”
ফালাক ফোন এনে ভিডিও অন করে রুহানির সামনে ধরল। রুহানির চোখ বড়বড় করে চেয়ে মুখে হাত দিয়ে আছে। একটু দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়ে কাদো কাদো ফেস করে বলল,
“ছিহ! আমি এমন করেছি? ছিহ!”
ফালাক হাসছে রুহানির দিকে চেয়ে।

হটাৎ রুহানি বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বলল,
“তুমি এসব ভিডিও কেন করেছ?”

“আরে ওয়েট, ওয়েট। আমার খারাপ কোন উদ্দেশ্য নেই। জাস্ট তোমাকে দেখানোর জন্য। প্রমাণ ছাড়া তো আমাকে বিশ্বাস করতে না। তাই প্রমাণ রেখেছি। দাঁড়াও তোমার সামনেই ডিলিট করে দিচ্ছি।” ফালাক রুহানিকে দেখিয়ে ডিলিট করে দিল।

রুহানি সন্দেহ নিয়ে বলল,
“আর কোন ভিডিও নেই তো?”

ফালাক নিজের ফোনটা রুহানির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি নিজেই চেক করে দেখো।”

রুহানি ইতস্তত করে বলল,
“তোমার ফোন আমি কেন চেক করব? অন্যের ফোন ঘাটাঘাটি করা ঠিক না।”

“আমি তো পারমিশন দিলাম। নেও চেক করো। তোমার মনও শান্তি আমার মনও শান্তি।”

রুহানি ফালাকের ফোন নিয়ে চেক করে কোন ভিডিও পায় নি। রুহানির হটাৎ মনে হলো কোন পিক তুলে রাখে নি তো। তাই ফালাকের দিকে একবার চেয়ে ফটো গ্যালারি চেক করে শকড। এর ঘুমন্ত একটা পিক। রুহানি আঙুল দিয়ে বাম দিকে সরাতেই ওর আরো পিক পেল। একে একে অনেকগুলো পিক পেল। তবে সবগুলো পিকই মার্জিত।
রুহানি ফালাকের দিকে ফোন ঘুরিয়ে বলল,
“এগুলো কি?”

ফালাক ছু মেরে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,”তুমি গ্যালারিতে গিয়েছো কেন?”

“ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। এখন কি বলবে? এগুলো কি? দ্রুত ডিলিট করো নয়তো ভালো হবে না।”

কিন্তু ফালাক কিছুতেই ডিলিট করবে না।
“আমি পরে ডিলিট করে দেব। আমার ফোনে কি রাখব কি ডিলিট করব সেটা একান্তই আমার মর্জি। যাইহোক যাও এখন তোমার বন্ধুরা খুঁজছে হয়তো। রাতে ওদের কাউকে খুঁজে পাই নি তাই বাধ্য হয়েই তোমাকে আমার রুমে রেখেছি এবং নিশ্চিত থাকো নিজের সীমা অতিক্রম করি নি।”

রুহানি পিকের ব্যাপারটা পরে দেখে নিবে। আপাতত ওর যাওয়া দরকার। আটটা বাজছে। রুহানি ফালাকের দিকে একবার তাকাল। ফালাক ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। রুহানি চুল বেঁধে জামাকাপড় ঠিক করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রুহানি যেতেই ফালাক হাফ ছেড়ে বাঁচল।

রুহানি রুমে গিয়ে দেখে সব এলোপাথাড়ি হয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ওদের ঘুমাতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই নুশাকে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখল।
“রুহানি কোথায় ছিলি তুই?”

রুহানি আমতা আমতা করে বলল,
“এখানেই ছিলাম। আবার কোথায় থাকব?”

নুশা ভ্রু কুচকে বলল,
“কিন্তু আমরা এসে তোকে পাই নি। তুই কি আমাদের ঘুমানোর পরে এসেছিস?”
রুহানি ওর কথার সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত বলল,
“হ্যাঁ এসে দেখি তোরা সব ঘুম।”

“কিন্তু তুই এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি? আমরা রুমে প্রায়ই আড়াইটার দিকে এসেছি।”

রুহানি কথা ঘোরানোর জন্য বলল,
“আরে ছিলাম কোথাও। এখন এসব বাদ দে। ফ্রেশ হয়ে নে। আমি এদের তুলি। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। কত বেলা হয়েছে দেখেছিস?”

নুশা আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। রুহানি হাফ ছেড়ে বাঁচল।

.

ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুহানি একা একা বাগানে হাঁটছে। তায়েফ হটাৎ ওর সামনে এসে বলল,
“রাত কেমন কাটল?”

রুহানি চমকে তায়েফের দিকে তাকাল। ও বিশ্রীভাবে হাসছে। ওর হাসির কারণ ধরতে পারছে না। আর রাতের কথা কেন বলল? রুহানি প্রশ্নবোধক চাহনি দিল।

তায়েফ আবারও হাসল তারপর বলল,
“ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করছিস? লাভ নেই। কারণ আমি সব জানি। তুই সারারাত ফালাকের সাথে ছিলি। আর এদিকে সতী সাবেত্রী সেজে ঘুরিস।”

রুহানি চোখ গরম করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তায়েফ! সবাই তোর মতো নয়। আজেবাজে কথা বলার আগে দশ বার ভাববি।”

তায়েফ ফোন বের করে বলল,
“সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। আমি তোকে যেতে দেখেছি আর আমার ফোনও। দেখ তোর কি হাল করি। কোথাও মুখ দেখাতে পারবি না।”

রুহানি ওর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। তায়েফ ওর প্রতি এতটা ক্ষিপ্ত যে যেকোনো কাজ করতে ওর বাঁধবে না। লোক জানাজানি হলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কেউ ওকে বিশ্বাস করবে না। রুহানি নিজের ভয়টা তায়েফের সামনে প্রকাশ করতে চাইছে না। ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিতে চাইলে তায়েফ ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তারপর দৌড়ে চলে যায়।

ফালাক দূর থেকে ওদের কাড়াকাড়ি দেখছিল। এগিয়ে আসতে আসতে তায়েফ রুহানিকে ফেলে চলে গেছে। ফালাক দৌড়ে গিয়ে রুহানিকে ধরে দাঁড় করালো।

“রুহানি কি হয়েছে?”

রুহানি দাঁড়িয়ে কাদো কাদো ফেস করে বলল,
“তায়েফ আমাকে রাতে তোমার রুমে যেতে দেখেছে আর সেটা ভিডিও করে প্রমাণ রেখেছে। সবাইকে গিয়ে বলবে আমি খারাপ চরিত্রের মেয়ে, সারারাত তোমার সাথে থেকেছি। সবাই এসব জানলে আমি মুখ দেখাতে পারব না। আমার মনে হচ্ছে তায়েফ ইচ্ছে করে আমার ড্রিংকস চেঞ্জ করেছে।”
রুহানির কথা শুনে ফালাকের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
রুহানি মাটিতে বসে পড়ল। ওর চোখ টলমল করছে। মনে হচ্ছে এখুনি কেঁদে দিবে। রুহানির চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না কিন্তু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফালাক রুহানিকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে দেখে ওর পাশে বসে পড়ল।

“রুহানি কিছু হবে না। আমি আছি। ডোন্ট ওরি। আমি তায়েফের সাথে ড্রিল করব।”

চলবে……

প্রিয় অভিমান পর্ব-১২+১৩

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১২|

সময় নিজ গতিতে প্রবহমান। সুখ অথবা দুঃখ, সময় নিজের মতো চলতে থাকে। কারো সুখে হিংসা করা কিংবা কারো দুঃখে ব্যথিত হওয়া সময়ের কাজ নয়। সময়ের কাজ শুধু বয়ে চলা।

রুহানির দুঃখময় জীবনও বয়ে চলছে। সময় ওর জীবনকে আরো কঠিন রুপ দিয়েছে। প্রতিনিয়ত কঠিন সংগ্রামের দিকে ধাবিত করছে।

রুহানি বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে ক্লাস শেষে বের হচ্ছে। আনমনে হাঁটছে। ওদের সংসারে টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেছে। এমন দুর্দিন যে দেখতে হবে তার সংশয় আগেই করেছিল। কিন্তু অভাব যে এত ভয়ানক তা বুঝতে পারে নি। আজ এই অভাব শব্দের অর্থ উদ্ধার করতে পারছে।

ভার্সিটি ট্যুরে যাওয়ার জন্য সবাই উচ্ছ্বাসিত। ট্যুরকে আনন্দদায়ক আর স্মৃতিবহুল করার তোড়জোড় আয়োজন চলছে।
ফালাককে লিষ্ট তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রনককে দেখে ফালাক হাতের খাতা কলম রেখে ওকে ডাকল। রনককে দেখে মনে হচ্ছে তাড়াহুড়োর মধ্যে আছে।

রনক ফালাককে দেখে এগিয়ে এল। ফালাকও নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে গেল।
“জি ভাই! কিছু বলবেন?”

“এত তাড়াহুড়োয় কোথায় যাচ্ছো? তুমি কি ট্যুরে যাবে না?”

রনক ফালাকের কথা শুনে মুচকি হাসল। তারপর বলল,
“আমার মতো নিম্মবিত্তদের জন্য ট্যুর শব্দটা বিলাসিতা ছাড়া কিছু না। আর এসবে আমার কোন আগ্রহও নেই। হাজার হাজার টাকা দিয়ে ট্যুরে যাওয়ার চেয়ে পরিবারের সাথে বসে একবেলা ভালোমন্দ খাওয়া আমার কাছে অধিক তৃপ্তিদায়ক এবং সুখকর।”

ফালাক রনককের কথা শুনে স্নিগ্ধ হেসে কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সব সময় এমন থেকো। পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করো। সুদিন আসবেই।”

“ধন্যবাদ ভাই। আমাকে এখন যেতে হবে টিউশনি আছে।”

“আচ্ছা আচ্ছা যাও৷ তোমাকে আর ধরে রাখব না।”

রনককে বিদায় দিয়ে ঘুরতেই রুহানিকে দেখল। ও কি জানি ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। ওর কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে। রুহানি কি নিয়ে এত চিন্তিত?

ফালাক এগিয়ে সামনের দিকে গেল। হটাৎ রুহানির বন্ধুরা রুহানিকে ঘিরে ধরে। ফালাক এক পাশে দাঁড়িয়ে গেল।
রুহানি আচমকা সবাইকে এক সাথে দেখে কিছুটা অবাক হলো। ওদের চোখ মুখের উচ্ছ্বাস দেখে বুঝল ওরা কোন কারণে খুব খুশি।

“কি রে তোরা এক সাথে ঘিরে ধরলি কেন? আর এত খুশি দেখাচ্ছে কেন?”

“আমরা ট্যুরে যাচ্ছি আর খুশি হব না? গতবার কত মজা করেছি। প্রতিবারের মতো এবারও খুব মজা করব।”

“ওহ আচ্ছা! ট্যুর না-কি? জানতাম না।”

রুহানির কথা শুনে সবাই অবাকের সপ্তকাশে। ট্যুরের কথা ও জানে না এটা কি করে সম্ভব?

“রুহানি তুই জানিস না? দিন দিন তুই এমন নিরামিষ হয়ে যাচ্ছিস কেন? কেমন দ্রুত বদলে যাচ্ছিস। কোন কিছুরই দেখছি খবর রাখিস না। যাই হোক ট্যুরের জন্য সব প্লানিং কিন্তু তোকেই করতে হবে।”

রুহানি শুকনো হেসে বলল,
“প্লানিং! এবার আমার যাওয়া হচ্ছে না রে। তোরা প্লানিং করে নে। আর খুব মজা করিস। আমি আসছি।”

ওর বন্ধুরা ওর কথা শুনে বাকরুদ্ধ। রুহানি ট্যুরে যাবে না। যে মেয়ে সব সময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আজ সে নির্লিপ্ত ভাবে বলছে যাবে না।
রুহানি চলে যেতে চাইলে ওর পথ আগলে জিজ্ঞেস করে,
“রুহানি কি হয়েছে তোর? কেন যাবি না? তুই ইদানীং এমন করছিস কেন? কেমন চুপসে যাচ্ছিস। যে মেয়ে ট্যুর নিয়ে সব সময় এক্সসাইটেড থাকে, এটা সেটা প্লানিং করে আর আজ ট্যুরের কথা শুনে বলছিস যাবি না? কেন?”

“আসলে আমার ইচ্ছে করছে না যেতে। সব সময় সব মানুষ কিংবা মানুষের ইচ্ছে, মানসিকতা এক থাকে না। তোরা যা প্লিজ।”

“তুই না গেলে আমরা কি করে যাই? তোকে ছাড়া আমরা ট্যুরে গিয়ে মজা করতে পারব?”

রুহানি হালকা হেসে বলল,
“কেন পারবি না? আমি যাচ্ছি না তো কি হয়েছে সবাই তো যাচ্ছে। সবার সাথে দেখবি খুব মজা করবি আমার কথা মনেও পড়বে না।”

“কিন্তু রুহানি…

রুহানি থামিয়ে দিয়ে বলল,” প্লিজ জোর করিস না। আমি যাচ্ছি না।”
রুহানি আর কিছু বলার সুযোগ দিল না। ফালাক সবটাই শুনল। ফালাক কেন জানি চাইছে রুহানি ট্যুরে যাক। কিন্তু রুহানি নিজেই চাইছে না।

.

নুশা রুহানির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রুহানি কিছুই বুঝতে পারছে না এভাবে টানাটানি করছে কেন।

রুহানিকে একটা রুমে নিয়ে কতগুলো ছেলে বসে আছে তাদের সামনে নিয়ে গেল। রুহানি ভালো করে দেখল সেখানে ফালাকও আছে। ওরা কি একটা লেখালেখি করছে।

নুশা রুহানিকে দেখিয়ে বলল,
“রুহানির নাম লিখুন। থার্ড ইয়ার। ইকোনোমিক গ্রুপ।”

রুহানি নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আমার নাম কেউ লিখবে না। আমি যাচ্ছি না। নুশা তুই কিন্তু…

” রুহানি তুই যাবি।”

“আমি বলছি আমি যাব না।” রুহানি নুশার হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
“কেউ না জানুক তুই তো জানিস আমি কেন যাব না? তবুও কেন এমন করছিস? আমি কিসের মধ্যে আছিস তুই জানিস না? এই মুহুর্তে আমার একটা জব প্রয়োজন। আর আমি ড্যাংড্যাং করতে করতে ট্যুরে যাব? ট্যুরে যাব টাকা পাব কই?”

“রুহানি টাকা নিয়ে তুই ভাবছিস কেন? আমি আছি তো। আর মানুষের জীবনে অনেক সমস্যা থাকে তার মানে এই নয় সে আনন্দ করতে পারবে না। নিজের মতো সময় কাটাতে পারবে না।”
রুহানি নুশার দিকে তাকাল। তারপর হালকা হাসল। অদ্ভুত হাসি। নুশা রুহানির হাসি দেখে অবাক চোখে চেয়ে আছে।
“এখন তোর টাকায় আমাকে ট্যুরে যেতে হবে। তাই তো? দয়া দেখাচ্ছিস?”

নুশা ওর কথা শুনে কটাক্ষ দেখিয়ে বলল,
“সব কথাকে ত্যারা ব্যাকা না করলে তোর হয় না? আচ্ছা তুই যখন রেস্টুরেন্টে খাওয়ার বিল দিতি তখন দয়া দেখাতি? আর যখন শপিং করতে যেতাম তুই বিল দিয়ে বলতি এটা আমার পক্ষ থেকে গিফট তখনও দয়া দেখিয়েছিস? এতদিন যাবত দয়া দেখিয়েছিস অথচ আমি সেটাকে বন্ধুত্ব আর বন্ধুর দেওয়া উপহার ভেবেছি? তুই আমাকে এতভাবে দয়া দেখিয়েছিস?”

রুহানি নুশার চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। নুশা আবারও বলল,
“আজ যখন আমি সামান্য একটা ট্রিপের টাকা দিতে চাইছি তখন তুই দয়া শব্দটা আনছিস?”

রুহানি ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,
“আচ্ছা আচ্ছা সরি। কিন্তু নুশা ব্যাপারটা তেমন না। তুই আসলে বুঝতে পারছিস না।”

নুশা রুহানিকে রেখে ওদের সামনে যেতে যেতে বলল,
“আমি বুঝতে চাই না। তুই যাচ্ছিস ব্যাস। ইভান ওর নামটা লিষ্টে এড কর তো।”

রুহানি এসে বাঁধা দিয়ে বলল,
“এই না৷ আমি যাচ্ছি না সো আমার নাম যেন লিষ্টে না উঠে।”

ফালাক রুহানির নাম লিখেও কেটে দিল। মনে আবারও অভিমান জড় হলো। অভিমানের প্রেক্ষিতে ওদের দুজনের কথা কাটাকাটির দিকে চেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এক্সকিউজ মি. কি তামাশা শুরু করেছো তোমরা? নাম লিখতে বলছো আবার কাটতে বলছো? একজন যাবে না তাকে শুধু শুধু জোর করার তো আর মানে হয় না। যদিও এটা তোমাদের পার্সোনাল ব্যাপার তবুও বলতে বাধ্য হলাম কারণ এছাড়াও আমাদের আরো অনেক কাজ আছে। সব দায়িত্ব আমাদের উপর পড়েছে৷ তাই প্লিজ বাইরে যাও আর ঠিক করো যাবে কি-না তারপর এসো।”

নুশা রুহানির দিকে চেয়ে বলল,
“ঠিক আছে তোকে যেতে হবে না। আমিও যাচ্ছি না।”

তারপর হনহন করে বের হয়ে গেল। রুহানি একবার ফালাকের দিকে তাকাল। তারপর নুশার পেছনে পেছনে চলে গেল। ফালাক হাতের ফোনটা উঁচু করে ওদের দেখিয়ে বলল,
“আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। হিসাবটা এগিয়ে নেও।”

ফালাক দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রুহানি নুশাকে ডাকছে কিন্তু নুশা শুনছে না। ফালাক দৌড়ে গিয়ে রুহানির হাত ধরে আঁটকে দিল। রুহানি হা করে হাতের দিকে চেয়ে আছে। ওর চোখ যেন কোঠর থেকে বেড়িয়ে আসবে।

ফালাক সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“সরি, তোমাকে থামানোর জন্যই এটা করেছি। আমি কিছু কথা বলব একটু শোন প্লিজ।”

রুহানি নুশাকে গাড়িতে ওঠে চলে যেতে দেখল। তারপর সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফালাকের দিকে চেয়ে বলল,
“কি বলবে? আমি তামাশা করি এটাই তো? যাব না বলে ঢং করছি? তাই না?”

ফালাক ভ্রু চুলকে বলল,
“ঠিক তা না। আমার মনে হচ্ছে তোমার কোন প্রব্লেম আছে। তাই যেতে পারছো না। তোমার কি প্রব্লেম জানি না তবে একটা কথা বলব যদি সম্ভব হয় তবে যাওয়ার চেষ্টা করো। এতদিনে যা বুঝেছি তোমার বন্ধুরা তোমাকে অনেক ভালোবাসে, তোমার উপর অনেক ডিপেন্ড করে। তুমি না গেলে ওদের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। ওরা গেলেও ঠিক মতো আনন্দ করতে পারবে না। আগের বারের স্মৃতি গুলো ওদের বারবার আঁটকে দেবে। তাই প্লিজ যদি পারো, একটু চেষ্টা করে দেখো…”

রুহানি জানে ফালাক যা বলছে ঠিক বলছে।
“কিন্তু আপনি এত অনুরোধ কেন করছেন?”

ফালাক রুহানির দিকে চোখ তুলে তাকাল। রুহানি খেয়াল করল কেমন অদ্ভুত সে দৃষ্টি। গভীর কিছুর নিদর্শন, মাদকতায় পূর্ণ সে চাহুনি। রুহানি চোখ নামিয়ে নিল। ফালাক স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“ঠিক জানি না।”

রুহানি আবারও ফালাকের দিকে তাকাল। তারপর চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“ভেবে দেখব। আসছি।”

রুহানি ফালাকের দিকে আরেকবার তাকাল। তারপর সামনের দিকে অগ্রসর হলো। ফালাক রুহানির এমন কুল কুল বিহেভ দেখে কিছুটা হতবাক হলেও বেশ খুশি। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে নিজের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে আবারও দৌড়ে ওই রুমে চলে গেল।

রুহানি বাড়ি ফিরে মায়ের রুমে উঁকি দিল। ওর বাবা ঘুমাচ্ছে। মা রুমে নেই। রুহানি কিচেনের দিকে গেল। ওর মা রান্না করছে। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে। রুহানি মা’কে ভালো করে দেখল। এই কয়েক মাসেই যেন অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে। কি ছিল আর কি হয়ে গেছে। চেহারায় সেই উজ্জ্বলতা নেই। কেমন নেতিয়ে গেছে।

রুহানির মা রুহানিকে দেখে বলল,
“কি রে কখন এসেছিস? দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

রুহানি ভেতরে গিয়ে বলল,”এই তো মাত্রই এসেছি।”

“এসেই রান্না ঘরে এসেছিস কেন? ক্ষিধে পেয়েছে?”

রুহানি আমতা আমতা করে বলল,
“না আসলে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”

“হ্যা বল।” রুহানির নিচু স্বর আর মাথা নিচু করে বলা কথায় ওর মার একটু ডাউট হলো।
“কি রে বল!”

“আসলে ভার্সিটিতে ট্যুর। আমি যেতে চাচ্ছিলাম।”

রুহানির মা’র বুঝতে বাকি নেই মেয়ের আপাতত এক টুকরো শান্তি প্রয়োজন। যার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। রুহানির মা-ও চায় মেয়ে কিছুদিনের জন্য একটু নিজের মতো হাসি-খুশি থাকুক। একটু শান্তিতে থাকুক। এইসবের মধ্যে তো কম কষ্ট সহ্য করছে না।

রুহানির মা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে যাবি। কত টাকা লাগবে?”

রুহানি মাথা তুলে আলতো হেসে বলল,
“টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন শুধু বাবা হ্যা বলুক।”

“তোর বাবা না করবে না। বরং খুশি হবে। কিছুদিন তো এই দুর্বিষহ জীবন থেকে দূরে থাকতে পারবি।”

রুহানির মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল। তারপর মা’কে শান্তনা দিয়ে বলল,
“ট্যুর থেকে ফিরে আমি জবের ব্যাপারে ভাবব। এভাবে আর কতদিন? আমি যা পড়াশোনা করেছি তাতে ভালো জব না হলেও ছোটখাটো একটা জব পেয়ে যাব। তুমি একদম ভেবো না।”

রুহানির মা হালকা হেসে বলল,
“না ভাবি না। তুই এসব বাদ দিয়ে ট্যুরের প্লান কর। যা আগে ফ্রেশ হয়ে নে।”

রুহানি রুমে গিয়ে নুশাকে প্রথমে টেক্সট করল,
“আমি ট্যুরে যাব। তুই ব্যবস্থা কর। বাড়িতে পারমিশন পেয়েছি।”

রুহানি বিছানার উপরে ফোনটা রেখে ফ্রেশ হতে গেল। নুশা টেক্সট পড়তেই ওর ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসি ফুটল।

চলবে…..

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১৩|

বিকেল নাগাদ সবাই হোটেলে পৌঁছে গেল। রুহানি গাড়ি থেকে নেমে আড়মোড়া ভেঙ্গে দাঁড়াল। ও একটু জার্নিতেই হাপিয়ে যায়। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। রুহানি নিজের লাগেজ হাতে নিয়ে বন্ধুদের সাথে হোটেলের গেট পাড় করে চারদিকে চোখ বুলালো। চারদিক নীরব,নিস্তব্ধ, কোলাহল মুক্ত। কোনো হোটেলের পরিবেশ যে এতটা নিরিবিলি হয় তা জানা ছিল না। বিস্তৃত লন, সুইমিং পুল সবটা জুড়ে নীরবতা।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুহানি বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রুহানির শান্তি লাগছে। কিন্তু সে শান্তিটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। নুশা এসে ওর হাত ধরে টানতে লাগল।
“শুয়ে পড়লি কেন? খেতে যাবি না?”

রুহানি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“একটু রেষ্ট করতে তো দে।”

“রেষ্ট কর‍তে গেলে আর খাবার পাবি না। চল তাড়াতাড়ি। উঠ। খেতে চাইলে এখুনি যেতে হবে।” নুশা জোর করে রুহানিকে উঠিয়ে নিয়ে গেল।

খেয়েদেয়ে একটু আড্ডা দিয়ে রুহানি রুমে ফিরতে চাইলে নুশা আবারও ওর হাত ধরে নিচে নিয়ে যাচ্ছে।
“তুই কি আমার হাত ছিড়ে ফেলার প্লান করেছিস? আমার হাত ছাড়।”

“নিচে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। গান-বাজনা করছে। আর আমরা রুমে বসে থাকব?”

“আমি একটু রেষ্ট করতে চাই। প্লিজ মাত্র কিছুক্ষণের জন্য।”

“আমরা এখানে রেষ্ট করতে আসি নি। মজা করতে এসেছি।”

নুশা রুহানিকে জোর করে নিয়ে বসিয়ে দিল। সারাটা দিন কাঠফাটা রোদ থাকলেও সন্ধ্যা থেকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। আকাশে একটা তারাও নেই। মেঘে মেঘে ঢেকে আছে পুরো আকাশ। সব মিলিয়ে যেন বৃষ্টির আয়োজন করছে প্রকৃতি।
বিভিন্ন ভাগে ভাগে ক্যাম্প ফায়ার করা হয়েছে। রুহানি ওদের ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের সাথে বসে আছে। ওরা হাসি-আনন্দে মেতে আছে।

গিটার হাতে ফালাক হোটেল থেকে বের হয়েছে। সবার দৃষ্টি ওর দিকে। হটাৎ রুহানির চোখ পড়ল সেদিকে। ফালাক গিটার হাতে হাত দিয়ে চুলগুলো ব্রাশ করতে করতে আসছে। শ্যাওলা রঙের টিশার্ট পরেছে, এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে আছে। চোখে -মুখে কিছু একটা ঝলকাচ্ছে। হয়তো কোন কিছু পাওয়ার খুশি।

ফালাককে দেখে ওদের ডিপার্টমেন্টের একজন বলল,
“ভাইয়া গিটার হাতে যে গান পারেন?”

ফালাক মুচকি হেসে বলল,
“না তেমন না, একটু একটু চেষ্টা করি আর কি।”

সবাই অনুরোধ করতে লাগল গানের জন্য। রুহানি নুশার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,”ওরা এমন শুরু করেছে কেন? গান কি কখনো শুনে নি?”

নুশা রুহানির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“ফ্রিতে যদি একটা গান শুনতে পারি খারাপ কি? তাছাড়া এই সিনিয়র তো কম জ্বালায় নি। আজ যদি গান শোনার উছিলায় কোন বিনোদন ক্রিয়েট হয় তবে জমবে বেশ।”

রুহানি আর কিছু বলল না। ফালাক ওদের অনুরোধে ওদের সাথে বসল। তারপর গিটারে সুর ধরল।
“তুমি চাইলে বৃষ্টি,
মেঘও ছিল রাজি
অপেক্ষা শুধুই বর্ষণের।
মাতাল হাওয়া বইছে
দূরে পাখি গাইছে গান
বৃষ্টি তোমার আহবান।। ”

(বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিন।)

এমন রোমান্টিক ওয়েদারে ফালাকের গাওয়া গান রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সবার মনেই এই মুহুর্তে হালকা প্রেম প্রেম অনুভূতি জাগছে। হারিয়ে যাচ্ছে দূর অজানায় কিংবা স্বপ্নের রাজ্যে। আর রুহানির এই গান শুনে ঘুম পাচ্ছে। ফালাক গান শেষ করে রুহানির দিকে তাকাল। রুহানি হাই তুলছে। রুহানিকে হাই তুলতে দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

সবাই যখন ফালাকের প্রশংসা করতে ব্যস্ত। তখন রুহানি হাই তোলায় ব্যস্ত।
রুহানি নুশাকে বলল,
“দোস্ত ঘুম পাচ্ছে।”

“এত তাড়াতাড়ি? মাত্র তো সন্ধ্যা।”

“গান শুনে। সব দোষ এই গানের। গান শোনার পর পরই ঘুম পাচ্ছে।” রুহানি ফালাকের দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলল।তারপর ফালাকের দিকে চেয়ে দেখে ফালাক ওর দিকেই চেয়ে আছে। ফালাক উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি মিন করতে চাইছো?”

রুহানিও উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“আমি কিছুই মিন করছি না।”

“তাহলে বললে কেন আমার গান শুনে ঘুম পাচ্ছে?”

রুহানি ফালাকের কথার উত্তর না দিয়ে নুশাকে বলল,
“আমি তোকে একটা কথা বলেছি। সেই কথা নিয়ে উনি কাড়াকাড়ি করছেন কেন?”

নুশা ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক বলল,
“তোমার সাথে কথা বললেও কথাটার মধ্যে আমি ছিলাম। তাই ঢুকতে বাধ্য হয়েছি। ও আমার গানের ইনসাল্ট করেছে।”

“ইশশ আসছে! যেই গান তার আবার ইনসাল্ট।”

“নুশা তোমার ফ্রেন্ডকে বলো আমার চেয়ে ভালো গান শুনাতে। যদি পারে আর কি। মনে তো হয় না সে যোগ্যতা আছে।”

“নুশা তুই বলে দে, আমি যাকে তাকে গান শুনাই না।”

“পারলে তো শোনাবে।”
নুশা পড়েছে বিপদে। দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে ফেসে গেছে।

“উনি যে কি পারেন তা বুঝাই যায়। গান শুনে মানুষের ঝিমুনি চলে আসবে।”

“আর ইনি তো লাইব্রেরীতে গিয়েও ঘুমায়। সব জায়গায় ঘুমানোর অভ্যাস হলে যা হয়। কুম্ভকর্ণ! এখন আমার গানের দোষ।”

রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“নুশা, উনাকে মুখ সামনে কথা বলতে বল।”

নুশা ওদের মাঝখানে থেকে সরে বলল,
“গাইস, ওয়েট। ঝগড়া করবে নিজেরা সরাসরি করো।
আমি বেচারিকে কেন টানছো? নে সরে গেছি। এখন মন মতো ঝগড়া কর। আমি শুনি। দাঁড়া আমি বরং ফোন বের করে রেকর্ডিং করি। যারটা ভালো হবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে এন্ড ডোন্ট ওরি শান্তনা পুরস্কারের ব্যবস্থাও আছে।”(রুহানির দিকে চেয়ে)

রুহানি নুশার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। তারপর বলল,
“আমি যার তার সাথে ঝগড়া করি না।”
তারপর ফালাকের দিকে তাকাল।

ফালাক তাচ্ছিল্য করে বলল,
“ঝগড়া করা তোমার মতো ঝগড়ুটে মেয়ের কাজ। আমার কাজ নয়।”

রুহানি নিচ থেকে ফোন তুলে হোটেলের ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। ফালাকও গিটার হাতে ভেতরে যাচ্ছে।

রুহানি পেছনে ফালাককে দেখে বলল,
“তুমি আমার পেছনে পেছনে আসছো কেন?”

ফালাক টেডি স্মাইল দিয়ে বলল,
“কারণ তুমি আমার সামনে সামনে হাঁটছো। রাস্তা ছাড়ো আগে যাই।”

রুহানি আরো জোরে জোরে হাঁটা শুরু করল। ফালাক ওর পেছনেই রয়ে গেল।

দোতলার সিড়ি পাড় করে তিনতলার সিড়িতে উঠেছে।

ফালাক পেছনে থেকে বলল,
“তোমার মতলব কি?”

রুহানি অবাক হয়ে পেছনে ঘুরে বলল,
“মানে? মতলব! কিসের মতলব?”

ফালাক উপরের দিকে ইশারা করে বলল,
“তিনতলায় তো আমার রুম। তুমি তিনতলায় কেন যাচ্ছো? আমি যতটুকু জানি ভার্সিটি থেকে সব স্টুডেন্টদের জন্য পুরো দুতলা বুক করেছে।”

রুহানির হুশ হলো। ঝগড়া করতে করতে শুধু সিড়ি পাড় করেই যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তার বোধ নেই৷ তিনতলার সিড়িতে চলে গেছে।
রুহানি ফালাকের দিকে একবার তাকাল। ফালাক মুচকি মুচকি হাসছে। এটুকুই যেন রুহানির শরীরে আগুন জ্বালাতে যথেষ্ট। তবুও ভদ্র মেয়ের মতো ফালাকের পাশ কাটিয়ে দু সিড়ি নিচে নেমে ফালাকের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,
“তুমি তিনতলায় কি করতে যাচ্ছো? তোমার রুমও তো দোতলায়।”

ফালাক দু সিড়ি নিচে নেমে বাকা হেসে বলল,
“তা দিয়ে তোমার কি? এত খবরদারি কেন করছো? তুমি কি আমার জিএফ?”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে ফালাককে ধাক্কা মারল। ফালাক তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। রুহানি সাথে সাথে দুহাত দিয়ে ফালাককে ধরে ফেলল। রুহানির বুক ঢিপঢিপ করছে। সারা শরীর কাঁপছে। ফালাক নিচে পড়ে ফেলে কি হত? ওর হাত, পা ভেঙে যেত অথবা মাথা ফেটে যেত। তুলকালাম কান্ড বেঁধে যেত। রুহানিও ফেসে যেত। লাইফে আরেকটা সমস্যা এড হত৷ ফালাকেরও ক্ষতি হত।

ফালাক অবাক হয়ে রুহানির ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে আছে। এর আগে কখনো এত ভয় পেতে দেখে নি রুহানিকে। বাদামি চোখগুলো যেন ভয়ে মাখামাখি। ফর্সা কপাল কুচকে আছে, সরু নাক
আরো সরু হয়ে গেছে। রুহানি ফালাকের হাত ছেড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিল।
রুহানি কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বলল,
“সরি, সরি। আমি ঝুকের মাথায় ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। এখানে থেকে পড়ে গেলে কি হত সেটা ভাবি নি।”

ফালাক রুহানির ফেস দেখে নিজেও কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বলল,
“ইট’স ওকে। পড়ে তো যাই নি। তুমিই হেল্প করেছো। এত সরি বলার কিছু নেই। আ’ম অলরাইট।”

রুহানি আর কিছু বলল না। নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রুহানির আচরণ ফালাককে অবাক করছে। এ যেন সেই রুহানি নয়, কোথাও একটা পরিবর্তনের ছোয়া আছে। তবে এই রুহানিকে মন্দ লাগছে না।
ফালাক রুহানির যাওয়া দেখে বলল,
“শোন।”

রুহানি পেছনে ঘুরল। ফালাক রুহানিকে এক পলক দেখে বলল,
“আমি তিনতলায় আগে থেকেই একটা রুম বুক করে রেখেছি। আসলে আমি কারো সাথে রুম শেয়ার করতে পারি না তাই। শুভ রাত্রি।”

রুহানি কিছু না বলে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে বাড়িতে ফোন করে কথা বলল কিছুক্ষণ। তারপর আবারও ধাক্কা মারার কথা মনে পড়তেই নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলল,
“রুহানি কোথাও না কোথাও তোর আগের ভয়ংকর অভ্যাসগুলো রয়ে গেছে। নয়তো ফালাককে ধাক্কা দিতে পারতি না। অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করা জরুরী, নয়তো বিপদে পড়তে এক মিনিটও লাগবে না।”

পরের দিন সকালে আর ফালাকের সাথে দেখা হয় নি। নুশা ঝগড়ার জন্য বারবার রুহানিকে ক্ষেপাচ্ছে।
“আচ্ছা তুই ফালাক ভাইকে তুমি বলিস কেন?”

“কারণ প্রথম দিন থেকেই বলি। অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“কিন্তু উনি তো সিনিয়র। আপনি বলা উচিত।” (টিপ্পনী কেটে)

“আরে রাখ তো, কে যাবে ওকে এত রেস্পেক্ট দিতে? আপনি! হুহ! আমি তুমি বলি আর তুমিই বলব আজীবন।”

নুশা বড় করে হা করে বলল,
“আজীবন! মাই গড! এত দূর!”

রুহানি চোখ ছোট ছোট করে নুশার দিকে তাকাল। নুশা এক দৌড় দিল। রুহানিও ছুটছে ওর পেছনে পেছনে।

চলবে……

প্রিয় অভিমান পর্ব-১০+১১

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১০|

রুহানি ঝড়ের বেগে ক্লাসে ঢুকল। রনকের পাশে ধপ করে বসতেই রনক রুহানির দিকে চেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। রুহানি রনকের চমকে উঠা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।

ব্যাগ রেখে বলল,
“কি রে ভূত দেখেছিস? ভয় পেয়েছিস? বুকে থু থু দে।”

রনক এর আগে যখনই ভয় পেয়ে যেত বুকে থু থু দিত। তাই রুহানি আজ ওকে বুকে থু থু দেওয়ার কথা বলল।

রনক মুচকি হেসে বলল,
“তুমি তাহলে এসেছো। যাক সুবুদ্ধি হয়েছে।”

রুহানি মুখ বাকিয়ে বলল,
“তুই তো পন্ডিত। বাকি সবাই বোকা।”

রুহানি বইপত্র বের করে বলল, “গ্যাপগুলো পূরণ করে দিস। পাশটা তো করতে হবে। তোর কাছে তো আর টিউশন পড়তে পারব না, টাকা কই।”

রনক ওর কথা শুনে বিরক্ত হলো তারপর বলল,
“বন্ধুত্বের মাঝে টাকা পয়সার কথা কেন আসছে? আমি আগের মতোই তোমাকে পড়াব।”

রুহানি বলল,”ওকে তবে সেটা ভার্সিটিতেই। আর হ্যাঁ শোন নুশাকে বলেছি তোর জন্য টিউশন দেখতে। ওর অনেক পরিচিত জন আছে, কাজিন আছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।”

রনক অবাক হয়ে রুহানির দিকে তাকাল। তারপর আলতো হাসল। রুহানি এই অবস্থায়ও ওর কথা ভাবছে। কি অদ্ভুত মেয়ে!

রুহানির বন্ধুরা ওদের কথা বলতে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কি যেন বলছে।

ব্রেকের সময় রুহানির বন্ধুরা রুহানিকে ঘিরে ধরল। রুহানি ওদের ঘিরে ধরার কারণ বুঝতে পারছে না।
“ঘটনা কি তোদের? এভাবে ঘিরে ধরলি কেন? ভীড় সরা আমার পড়াশোনা আছে।”

রুহানির এক ফ্রেন্ড বলে উঠল,
“রুহানি সত্যি কথা বলত তো ঘটনা কি? এই রনকের সাথে স্যার যেদিন থেকে বসালো তুই আর রুহানি রইলি না। সারাক্ষণ শুধু পড়াশোনা পড়াশোনা করে পাগল। রনকের সাথে চিপকে থাকিস। কি চলছে?”

রুহানি না বুঝতে পেরে কনফিউজড হয়ে বলল,
“কি চলবে?”

ওরা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। তারপর বলল,
“প্রেম করছিস না তো?”

রুহানি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। রাগে ওর গা শিরশির করছে।
“পাগল হয়েছিস না-কি? উল্টো পাল্টা কি বলছিস? ও আমার ফ্রেন্ড। এই সম্পর্কটাকেও ছাড় দিবি না? বন্ধুত্বের মতো সম্পর্কের তামাশা উড়াচ্ছিস? ছিহ! আর এছাড়া আমার বিয়ে ঠিক জানিস না তোরা?”
শেষের লাইন বলে রুহানি থমকে গেল। ওর বিয়ে ঠিক! বিয়ে! আদৌ কি বিয়ে করবে?

রুহানি ব্যাগ নিয়ে হনহন করে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। ওর বন্ধুরা চুপসে গেল। রুহানির সাথে এই মজাটা করা যে একদম ঠিক হয় নি বুঝতে পারছে আর সরি ফিল করছে।

.

রুহানি পুকুর পাড়ে সিড়িতে বই খুলে বসেছে। পাশেই রনক। রনক ওকে আগের পড়া গুলো দেখিয়ে দিচ্ছে।
“রুহানি এই বইয়ে কঠিন করে দেওয়া। আমি লাইব্রেরি থেকে অন্য বই নিয়ে পড়েছি। ওটা একদম ইজি। তুমি বসো আমি বইটা নিয়ে আসি।”

রুহানি রনককে থামিয়ে বলল,
“তুই বস আমি নিয়ে আসছি। একটু হাওয়া খেয়ে আসি।”

রুহানি বইয়ের নাম জেনে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছে। রনক পুকুরের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকাল।
ফালাক লাইব্রেরীর শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বই নেড়েচেড়ে দেখছে। রুহানি লাইব্রেরীতে গিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটছে। ও ফালাকের চোখে পড়তেই আড়চোখে তাকাল। রুহানি শেলফে কি একটা খুঁজছে। কিছু সময় পর রুহানি শেলফ থেকে বই খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে আবারো নিঃশব্দে বাইরে চলে গেল। ফালাক রুহানিকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। চুপচাপ এলো একটা বই নিল আর চলে গেল? কি করে সম্ভব?
ফালাক শেলফে বই রেখে রুহানির পেছনে পেছনে বেড়িয়ে গেল।

রুহানি বই দিয়ে সূর্যকে ঢাকার চেষ্টা করে হাঁটছে। ফালাক বেশ কিছু দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। রুহানি পুকুর পাড়ের কাছে যেতেই ফালাক রনককে বসে থাকতে দেখল। ফালাক দাঁড়িয়ে গেল। রুহানি গিয়ে রনকের পাশে বসে বই দিয়ে বলল,
“নে তোর বই।”

রনক বই সূচিপত্র দেখছে। রুহানি টিস্যু দিয়ে মুখের ঘাম মুছে টিস্যুটা ফেলে দিল।
রনক পেজ বের করে পড়াতে শুরু করল। রুহানি পূর্ণ মনোযোগ দিল।

ফালাক দূর থেকে রুহানিকে এত মনোযোগী আর স্থির দেখে অবাক হলো। রুহানি পড়াশোনার প্রতি এতটা সিনসিয়ার কবে থেকে হলো? বিষয়টা ফালাককে বেশ ভাবাচ্ছে।

ফালাকের খটকা লাগছে। রুহানি আবার রনকের সাথে প্রেম করছে না তো?
ফালাক কেমন অদৃশ্য এক জ্বলন অনুভব করছে। কেন জ্বলছে বুঝতে পারছে না।

.

রনক আর রুহানি এক সাথে ক্লাসে যাচ্ছে। ব্রেক শেষ। রনক হটাৎ ফালাককে দেখতে পেল। ফালাক তরিঘটি করে কোথাও যাচ্ছে। রনক ফালাককে ডাকল।
“ফালাক ভাই!”

রুহানি রনকের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। ফালাককে কেন ডাকছে? ফালাক পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে রনককে দেখল। সাথে রুহানিকে দেখে মুখ ভার করে নিল। তাড়াহুড়োর ভাব দেখিয়ে বলল,
“হ্যা বলো।”

“ধন্যবাদ ভাই। আজকে আপনি ইশার কাজের প্রতিবাদ করেছেন। দেখেছো রুহানি তোমাকে বলেছিলাম না ফালাক ভাই খুব ভালো মানুষ?”

রুহানি মুখ বাকাল। তারপর বলল,
“ভালোর ছিরু। প্রতিবাদ করেছে এখন এওয়ার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।”

রুহানির কথা শুনে ফালাক দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল,
“রনক, ওর জায়গায় যে কেউ থাকলেই আমি প্রতিবাদ করতাম। মানবতা বলে কিছু তো আছে। আমি আর সবার মতো অমানবিক, নিষ্ঠুর না। মানুষের প্রতি জুলুম, অবিচার করি না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। আর তোমার এই বন্ধুর মতো অকৃতজ্ঞ নই। মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শিখে নি। আমি আসছি। আমার কাজ আছে। মানুষের মতো আজাইরা থাকি না।” (রুহানির দিকে তাকিয়ে)

ফালাক রুহানির দিকে আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। তারপর আবারো ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল। রুহানি হা করে চোখ বড়বড় করে ওর যাওয়ার দিকে তাকাল। রনক বুঝতে পারল না কোন রাগ ঝেড়ে গেল রুহানির উপর।

রুহানি রনকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখেছিস কত কথা শুনিয়ে গেল? তুই আবার বলিস ভদ্র ছেলে। অসভ্য একটা।”

রনক বলল,
“মনে হয় কাজের প্রেশারে আছে। তাই….”

রুহানি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“কি এমন কাজ করে যে এত প্রেশার?”

রনক স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“আরে উনি অফিস করে রোজ। ভার্সিটির পর বাকি সময় অফিসে থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। পড়াশোনা ও কাজের প্রতি অনেক দায়িত্বশীল।”

“গরিব না-কি? দেখে তো মনে হয় না।”

রুহানির কথা শুনে রনক হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“গরিবরাই শুধু কাজ করে? উনার বাবার বিজনেস। ভাইয়ের বাবা অসুস্থ। তাই একমাত্র ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব তার উপর। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার বিজনেস সামলায়।”

রুহানির সেদিনের পার্টির কথা মনে পড়ল। ফালাককে একটা বিজনেস পার্টিতে দেখেছিল। তাহলে সেদিন সেখানে ওর নিজের কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছিল। বাহ! পড়াশোনা করে আবার বিজনেসও সামলায়? আর আমি বাপের টাকা উড়িয়েছি। বিনিময়ে এক ছিঁটা পরিশ্রম করি নি। আজ তার ফল ভোগ করছি।

রুহানি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,
“তুই এতকিছু কি করে জানলি?”

“একদিন আমার সাথে কথা হয়েছিল। সেদিন বলেছে। আসলে উনাকে লাইব্রেরীতে পড়তে দেখেছিলাম। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বাড়িতে পড়ার সময় পান না। কেন পান না সেটা জিজ্ঞেস করতে সব খুলে বলেছে। আমার খুব ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। আমি ভাবতাম আমাদের বয়সী নিন্মবিত্তরাই পরিশ্রমী। কিন্তু না। সেদিন উনার সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি। সবার জীবনেই একটা গল্প আছে।”

“হুম, চল ক্লাসে যাই।”

ফালাক গাড়িতে ওঠে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। প্রচুর রাগ লাগছে। রুহানির এমন বাঁকা বাঁকা কথা ফালাকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। রাগ লাগছে প্রচুর। সাথে অভিমানও। এক পাহাড় অভিমান যেন ওর উপর ভর করেছে। ফালাক গাড়ি স্টার্ট দিল। অফিসে কাজ আছে প্রচুর।

.

রুহানি, রুহানের স্কুল থেকে ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে৷ রুহানির মনে হচ্ছে এতক্ষণ স্বপ্নরাজ্যে ছিল। এখন এসে পড়েছে সেই করুণ বাস্তবতার মাঝে। দোতলার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুহানের হাত ধরে ভেতরে গেল।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাড়ির পেছনের ঝুপ থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। রুহানি বাবার সাথে দেখা করার জন্য রুমের কাছে গিয়ে কান্নার শব্দ পায়। দরজা ভেড়ানো ছিল তাই কান্নার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। রুহানি ভালো ভাবে শোনার চেষ্টা করছে।
রুহানির মা কাঁদছে।
“রুহানিকে কি করে এই কথাটা বলব? আমার মেয়ের কি হবে? ওর ভবিষ্যতটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? ওর জন্য আমরা কিছু করতে পারব না? আমি আর এসব দেখতে পারছি না।”

রুহানির বাবা ধরা গলায় বলল,
“সম্পর্কের কোন মূল্য নেই। সবাই টাকা চিনে। নয়তো যে আহিলের বাবা তার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল সে আজ এভাবে এই বিপদের দিনে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলতে পারে? আমি তাকে ফোন করেছিলাম যাতে আমাকে সাহায্য করে কিন্তু না সে রুহানির সাথে আহিলের বিয়ে ভেঙে দিল। আমার এতদিনের স্বপ্ন রুহানির বিয়ে দেব আজ সব শেষ করে দিল।”

“আমার মেয়েটার কি হবে? ওর কি ভালো ঘরে বিয়ে হবে না? ওকে কি সারাজীবন এই বোঝা বইতে হবে?” এই কথাগুলো বারবার বলে রুহানির মা কাঁদছে।

“আমি পারলাম না। ব্যর্থ আমি, আমি ব্যর্থ বাবা। আমি আমার মেয়েকে সুখী দেখতে পারলাম না। এর চেয়ে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল।”

রুহানির চোখেও পানি জমেছে। মেইন ডোর খুলে বাইরে চলে গেল। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়ল। অঝোরে পানি পড়ছে চোখ দিয়ে৷ কেন কাঁদছে জানা নেই।
বাবা মায়ের কান্না দেখে? তাদের কষ্ট দেখে? না নিজে রিজেক্ট হয়েছে তাই?

রুহানি সবেমাত্র অনার্সে এডমিশন নিয়েছে। বাবা একদিন ডেকে বলল,
“ওর বিয়ে ঠিক করা। তাই ও যেন খেলার বশেও কাউকে মন দিয়ে বসে না থাকে। ভার্সিটিতে হাসি-আনন্দ যা খুশী করুক কিন্তু প্রেম-ভালোবাসায় যেন না জড়ায়।”

রুহানিও কখনো প্রেম ভালোবাসায় জড়ায় নি। আহিলের ছবি দেখে অপছন্দ করার মতো কিছু পায় নি। একদিন শুধু আহিলের সাথে কথা বলেছিল। বলেছিল ওর স্বাধীনতা চাই। যখন বিয়ে হবে তখনই যেন কর্তৃত্ব দেখায় এর আগে নয়। তারপর রুহানি নিজের মতো থেকেছে। এতকিছুর মধ্যে ওর বিয়ে ঠিক এটা মাথায় কখনো আসতো না। কিন্তু ওর বাবা-মার অপেক্ষা ছিল শুধু গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা। তারপর ধুমধামে ওর বিয়ে দেবে।

চলবে……

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১১|

চারদিক নীরব নিস্তব্ধ। সুনসান নীরবতা ঘিরে ধরেছে। মাঝে মাঝে দু একটা রিকশা টিং টং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। রুহানি মাথা দু হাঁটুতে ভর করে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে আছে। হটাৎ করে শা শা করে একটা গাড়ি বাতাসের বেগে চলে গেল। রুহানির গায়ে ঝাপটা বাতাস লাগতেই মাথা তুলে বসল। ওর কেমন ভয় ভয় লাগছে। রাস্তাটা অনেক সুনসান। আশেপাশে কেউ নেই। রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে গেটের ভেতরে ঢুকে গেল। এমনিতেই অন্ধকারে ভয় লাগে। তার উপর এমন গা ছমছমে পরিবেশ।

রুহানি সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। দরজা খোলা ছিল তাই ভেতরে ঢুকতে সমস্যা হলো না। রুহানি নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। রুমের লাইট অফ। গাঢ় অন্ধকারে ওর জীবনের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভাবছে। যা এখন অতীত ছাড়া কিছুই না। দরজা খোলার শব্দে রুহানি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করল। জানে ওর মা এসেছে। রুমের লাইট অন করায় রুহানির চোখে আলো এসে বিঁধল। রুহানি চোখ কুঁচকে ভালো ভাবে বন্ধ করে নিল।

ওর মা ওর কাছে এসে বলল,
“রুহানি? ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

রুহানি কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। ওর মা ওর সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর কপালে হাত দিল।
“মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল? ডাকব?”

রুহানির মা ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। রুহানির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার রাজকন্যাটা এমন কপাল নিয়ে জন্মালো? সারাজীবন কি এভাবেই কাটবে ওর জীবন? আল্লাহ, ওর জন্য কাউকে পাঠাও যে ওর কষ্টগুলো অনুভব করতে পারবে, ওর দুঃখগুলো দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।”
রুহানির মা কিছুক্ষণ আদর করে চলে গেলেন। কিন্তু রুমের লাইট অফ করলেন না, দরজাও বন্ধ করলেন না।

মা যেতেই রুহানি চোখ মেলল। ওর চোখ থেকে গাল বেয়ে পানি পড়ার আগেই মুছে নিল। উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মাথা রেখে চোখ মেলে রাখল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জীবন যেন দীর্ঘশ্বাসময়। কিছুক্ষণ পরে পায়ের শব্দ পেল। ওর ঘরের দিকে পায়ের শব্দটা প্রখর হচ্ছে। রুহানি আবারও চোখ বন্ধ করে নিল। ওর মা খাবার নিয়ে এসেছেন। বেড সাইড টেবিলে আস্তে করে রাখলেন। পানি ঢেলে গ্লাস এনে রাখলেন। সব খাবার ডেকে রেখে রুমের লাইট অফ করে দিলেন। তারপর দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।

আজকে রুহানির ক্লাস নেই। রুহানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ওদের আগের বাড়ির দিকে ঘুরাল। রুহানি গাড়ি থামিয়ে গ্লাস খুলে দূর থেকে বাড়িটা দেখছে। ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরনো স্মৃতিরা জেগে উঠছে। ছাদে কত পার্টি করেছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে, জোৎস্না বিলাস করেছে। রুহানি নিজের অজান্তেই গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের উপর হাত রাখল। ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। রুহানি হটাৎ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।
“যে বাড়িতে ২১বছর ধরে ছিল, হাঁটি হাঁটি পায়ে যেখানে বেড়ে উঠেছে। যেখানে জীবনের সুন্দরতম অধ্যায়গুলো কাটিয়েছে, যে বাড়ির পুরোটা জুড়ে অধিকার ছিল আজ সেখানে পা রাখতে ভয় পাচ্ছে। সময় কতটা শক্তিশালী।”

রুহানি গাড়িতে গিয়ে বসল। কিছু একটা ভেবে গাড়ি স্টার্ট দিল। ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে। রুহানি একটা বিলাসবহুল বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল। তারপর কাউকে পরোয়া না করে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।

রুহানি ভেতরে গিয়েই জোরে জোরে চিৎকার শুরু করল। ওর চিৎকার শুনে ৩০-৩২ বছর বয়সী মহিলা বের হয়ে এলো। ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
“রুহানি!”

রুহানির চোখ মুখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। রুহানি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“চিনতে পারছো তাহলে?”

মহিলাটি চুপ করে গেল। রুহানি চুপ থাকতে দেখে বলল,
“মামা কই? আমি মামার সাথে কথা বলতে এসেছি। ডাকো তাকে।”

রুহানির মামী ওর মামাকে ডাকল। তিনি রুহানিকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
“রুহানি!”

রুহানি চিৎকার করে বলল,
“খবরদার ওই নামে আমাকে ডাকবে না। আমি শুধু একটা কথা বলতে এসেছি তুমি যা করেছো তার শাস্তি তুমি পাবে। ভয়ানক শাস্তি পাবে। তোমার উপর আল্লাহর গজব নাজিল হবে। প্রতারককে আল্লাহ ক্ষমা করেন না।”

“রুহানি, কি বলছিস? মাথা ঠান্ডা কর। এখানে এসে বস।”

“বসার মতো সম্পর্ক তুমি রেখেছো? কি করে পারলে নিজের আপন বোনের সাথে এমন করতে?”

“কি আশ্চর্য! আমি কি করেছি? কি করেছি বলবি তো।”

রুহানি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,”কি করেছো? তুমি কি করেছো সেটা এই মুহুর্তে তোমার ভেতরে গাইছে। তবুও জিজ্ঞেস করছো? কোন মুখে জিজ্ঞেস করছো? বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই তোমার?”

রুহানির মামা রাগ ফুটিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
“রুহানি এবার কিন্তু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু করি নি। তোদের ভুল হচ্ছে।”

রুহানি আবারও একটু হাসল। তারপর বলল,
“হাসালে মামা, তুমি কিছু করো নি। তাহলে আমাদের এই বিপদে কোন খবর নেও নি কেন? আমরা কি করছি, কোথায় আছি, কেমন আছি জানতে চাইলে না কেন?”

রুহানির মামা অন্য দিকে ঘুরে বলল,
“কারণ তোর মা সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। বলেছে ওর কোন ভাই নেই। ও মরে গেলেও যেন খোঁজ না করি।”

এমন সিরিয়াস মুহুর্তেও রুহানির মামার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে।
“আর তোমার বোনের ছেলে-মেয়ে? তারা? তাদের খোঁজ নিয়েছো?”
রুহানির মামা কথা বলছে না। ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না।
“মামা, তুমি প্রতিহিংসার বশে যা করেছো তাতে তোমার ক্ষতি অনিবার্য। তুমি আমাদের নিঃস্ব করে আমাদের অভিশাপ কুড়িয়েছো। আল্লাহ যেন তোমাকে এর শাস্তি দেয়। আমার বাবা তোমার জন্য অনেক করেছে। আজ তুমি যা সব কিছু আমার বাবার উছিলায়। আর তার সাথেই বেইমানি করেছো। তাকেই পেছনে থেকে ছুরিটা মেরেছো। তুমি একটা প্রতারক।”

রুহানির ৭বছরের মামাতো ভাই এসে রুহানিকে বলল,
“আপু, তুমি আমার বাবাকে বকছো কেন?”

রুহানি চুপ না করে ওকে বলল,
“কারণ তোর বাবা একটা বেইমান, নিমুকহারাম। তোর বাবা জালিয়াতি করে আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে৷ নিজের স্বার্থে একমাত্র বোন যে সব সময় সাপোর্ট দিয়েছে তাকে তার সন্তানসহ রাস্তায় নামিয়েছে। শুনে রাখ তোর বাবা বেইমান।”

রুহানির মামী ধমক দিয়ে বলল,
“তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। এতটুকু বাচ্চা ছেলেকে কি বলছো?”

“সত্যি বলে ভুল করে ফেলেছি? আর আমার স্পর্ধা সম্পর্কে আপনি জানেন না? আমি কিন্তু সেই রুহানিই আছি। এই আপনিও আপনার পাপের শাস্তি পাবেন। স্বামীর পাপে যেমন সঙ্গী হয়েছেন তখন শাস্তি পাওয়ার জন্য তৈরি থাকুন। অগ্রিম বরবাদি মোবারক।”
রুহানি হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রুহানির মামী ওর মামার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কিছু বললে না কেন?”

রুহানির মামা মুচকি হেসে সোফায় বসে বলল,
“ছাড়ো তো। পাগল হয়ে গেছে। তাই কামড়াতে এসেছিল? কিন্তু কামড়ানোর জন্য দাঁত প্রয়োজন সেটা ভুলে গেছে এই এক রত্তি মেয়ে।”

রুহানি ড্রাইভ করছে আর ভাবছে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন কিন্তু এত টাকা জোগাড় করবে কিভাবে? মুহুর্তেই ভাবল গাড়িটা বিক্রি করে দিবে। কিন্তু গাড়ি বিক্রি করলে রুহান স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিবে। কিছুতেই স্কুলে যাবে না। আর গাড়ি বিক্রি করার পরও যদি কিছু প্রমাণ না করতে পারে? তাহলে? শুধু শুধু টাকাগুলো নষ্ট হবে।

রুহানি দ্রুত রেডি হয়ে দৌড়ে বের হচ্ছে। আজ অনেক লেট হয়ে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের সাথে ঘরের কাজ করেছে৷ তাই ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছে আর উঠতেও। রুহানি দৌড়ে দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উঠছে। একেকজনের সাথে ধাক্কা লাগতেই সরি সরি বলে দৌড়াচ্ছে। আজ যে স্যারের ক্লাস সে খুব কড়া। এক মিনিট লেটে ক্লাসে ঢুকতে দেয় না। রুহানি দৌড়ে এসেও শেষ রক্ষে করতে পারল না। স্যার ক্লাসে ঢুকে বই হাতে নিয়ে নিয়েছেন অলরেডি৷ রুহানি দরজার সামনে থেকে সরে গেল। জানালা দিয়ে অনেকেই ওকে দেখছে। নুশা টেক্সট করে জানিয়েছে সামনে এসে স্যারের একশো কথা শোনার চেয়ে বাইরে গিয়ে হাওয়া খা। স্যারের চোখে একবার পড়লে ডেকে ভেতরে নিবেন তারপর অপমান করবেন অতঃপর বের করে দিবেন৷

রুহানি ব্যাগের বেল্ট টানতে টানতে গাল ফুলিয়ে সিড়িতে বসে রইল। একা একা বোরিং লাগছে। ফোনটা বের করে কিছুক্ষণ ফেসবুকে টু মেরে বসে রইল। ফেসবুকও ভাল্লাগছে না। আর সিড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। তাই বিরক্ত লাগছে। রুহানি হাই তুলতে তুলতে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছে। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। দু-হাত উঁচু করে আড়মোড়া ভেঙে লাইব্রেরীতে গেল। ক্লাস চলছে তাই লাইব্রেরীতে মানুষের ভীড় নেই বললেই চলে৷ প্রায় ফাঁকা। রুহানি চেয়ার টেনে একটা বই বের করে বসে পড়ল।

ফালাক ক্লাস শেষে লাইব্রেরীতে এসে টেবিলের উপর একটা মেয়েকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে। লাইব্রেরীতে কেউ ঘুমায়? স্ট্রেঞ্জ! ফালাক আরেকটু কাছে গিয়ে রুহানিকে দেখে মুখ দিয়ে বিরক্তিকর হাওয়া বের করে বলল,
“এর যে আরো কতকিছু দেখা বাকি আল্লাহ জানে।”

ফালাক একটা বই নিয়ে ইচ্ছে করে টেবিলের উপর ধপাস করে রাখল। রুহানি ঘুমের মধ্যে চমকে গিয়ে মাথা তুলল। তারপর ঘুমঘুম চোখে ফালাককে দেখে চোখ থেকে ঘুম উবে যায়। ভালো করে তাকাল। ফালাক চোখ মুখ শক্ত করে ওর দিকে চেয়ে আছে।

রুহানি কিছুটা লজ্জা পেল। তবে লজ্জাটাকে লুকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“বই রাখলে না বোম ছুড়লে?”

ফালাক চেয়ার টেনে বসে পড়ল। তারপর বলল,
“এটা ঘুমানোর জায়গা? বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও।”

“তোমার সমস্যাটা কই? আমার রাতে কম ঘুম হয়েছে তাই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। আমি তো কাউকে ডিস্টার্ব করি নি।”

ফালাক ভাবছে তাই তো। এখন কি রিজন দেখাবে? ফালাক আমতা আমতা করে বলল,
“অন্য কেউ দেখলে তোমাকে লজ্জা দিত তাই জাগিয়ে দিলাম।”

“এটা আপনার জাগানোর নমুনা? ভালো ভাবে জাগাতে পারতেন।”

“রাতভর বয়ফ্রেন্ডের সাথে গল্প না করে ঘুমালে তো আর লাইব্রেরীতে এসে ঘুমানো লাগে না।”

রুহানি ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আপনি জানেন আমি রাতভর বয়ফ্রেন্ডের সাথে গল্প করি?”

“কমনসেন্স!”

“ফালতু লোকের ফালতু কমন সেন্স।”

রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল,
“আপনার সম্পর্কে ভালো মনোভাব পোষণ করেছিলাম কিন্তু আপনি তার যোগ্য না।”

রুহানি একা একা বিড়বিড় করতে করতে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। কখন যে চোখ লেগে গেল টেরই পায় নি। আর ফালাক সেই সুযোগের উত্তম ব্যবহার করল। নিজের উপর রাগ হচ্ছে সেদিন রনকের কথা শুনে ফালাকের প্রতি পজিটিভ একটা ধারণা এসেছিল,রেস্পেক্ট করেছিল। সব ভুল মনে হচ্ছে।

চলবে…..

প্রিয় অভিমান পর্ব-০৯

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৯|

ফালাকের কন্ঠস্বর শুনে রুহানি চোখ তুলে তাকাল। ফালাক কিছুটা পিছিয়ে উপরের দিকে তাকাল। কাউকে দেখতে না পেয়ে রাগে গজগজ করতে করতে চেঁচিয়ে বলল,
“এগুলো কোন ধরনের অসভ্যতা? একটা মেয়ের গায়ে পানি ঢেলে দিল। নূন্যতম কমন সেন্স নেই? এটা ভার্সিটি বাড়ি নয়। সামনে পেলে থাপ্পড় মেরে সোজা করে দিতাম।”
ফালাক বিড়বিড় করছে।

রুহানির বন্ধুরা ততক্ষণে ছুটে উপরের দিকে চলে গেছে। ফালাক রুহানির দিকে তাকাল। রুহানি চোখ নামিয়ে নিল। নুশা ওকে ওখান থেকে নিয়ে গেল।

নুশা রুহানির চুল মুছে দিচ্ছে। সাথে সাথেই ওর জন্য ড্রেস আনিয়ে নিয়েছে পাশের শপ থেকে। রুহানি চেঞ্জ করে নিয়েছে।
রুহানি চুল থেকে নুশার হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

রুহানি উঠে দাঁড়ালে নুশা বাঁধা দিয়ে বলল,
“কেন?”

রুহানি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“তুই বুঝতে পারছিস না? এই জন্য আমি আসতে চাই নি ভার্সিটিতে।”

রুহানি আশেপাশে বন্ধুদের দিকে আড়চোখে তাকাল তারপর সাউন্ড লো করে বলল,
“তুই যেমন ভাবছিস তেমন তো নাও হতে পারে।”

রুহানি কিছু বলতে যাবে তখনই আরো কিছু বন্ধুরা ঢুকল। তারপর বলল,
“ইশার কাজ। এসব করে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। বলে কি-না ডিম ছুড়েছে তাই আমি পানি মেরেছি।”

নুশা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কিছু বলিস নি তোরা?”

ওরা রুহানির দিকে তাকাল। তারপর তুরানি বলল,
“যা শাস্তি দেওয়ার রুহানি দেবে।”

নুশা রুহানির দিকে তাকাল। রুহানি মুখ গম্ভীর করে নিল। নুশা রুহানির হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেল।
ফালাক ওর আশেপাশেই ছিল। রুহানিকে অন্য ড্রেসে ভেজা চুলে দেখল। ফালাকের মনে হচ্ছে বম ফাটবে। নিশ্চয়ই রুহানি কিছু একটা করবে।

নুশা রুহানির হাত ধরে বলল,
“রুহানি তোকে এভাবে মানায় না।”

রুহানি নুশার দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“আমার আর এসবে মন টানে না।”

“তাই বলে প্রতিবাদ করবি না?”

রুহানি শুকনো হেসে বলল,
“কি বলছিস প্রতিবাদ? এতদিন যা যা হলো, ভাগ্য আমাদের সাথে যে খেলা খেলল তার প্রতিবাদ কার কাছে করব? এ তো ছোট খাটো ব্যাপার।”

“রুহানি, বুঝার চেষ্টা কর। এভাবে হার মেনে নিস না। আজ ছোট ছোট ব্যাপারে হার মেনে নিবি কাল বড় বড় ব্যাপারে হার মানতে এক সেকেন্ড ভাববি না।”

রুহানি রেলিঙে হেলান দিয়ে বলল,
“হার মেনে তো বসেই আছি।”

নুশা রেলিঙ থেকে রুহানিকে সোজা করে দাঁড় করাল।
“যত নরম হবি ততই পায়ে পিষতে ইজি হবে। শক্ত হ যাতে কেউ পায়ে পিষা তো দূরের কথা চোখ তুলে তাকাতেও ভয় পায়।”

রুহানি বিষন্ন মুখে বলল,
“আমার সে মনোবল নেই রে। আমি ভেঙে গেছি। পুরো তরে ভেঙে গেছি।”

“রুহানি! তোর এই নির্লিপ্ততা আমার সহ্য হচ্ছে না। ইশার ব্যাপার নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি তোর ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে। তখন তুই কি করবি? এভাবে চুপচাপ সব মেনে নিবি? সবাই কি ধনী হয়ে জন্মায়? মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরে কেউ জন্ম নেয় না? তারা কি বাঁচে না? তারা কি অন্যায়কে অন্যায় বলে না? প্রতিবাদ করে না? তাহলে তুই কেন নিজেকে তুচ্ছ মনে করছিস? হীনমন্যতায় ভুগছিস? কেন হারার আগে হার মেনে নিচ্ছিস?”

রুহানি নুশার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “চল।”

ফালাক দূর থেকে ওদের কথোপকথনের এক্সপ্রেশন দেখে কনফিউজড। মনে হচ্ছে ওরা কোন গভীর আর সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। সেটা কি রুহানির সাথে?

রুহানিকে ফলো করতে লাগল ফালাক।

ইশা বারান্দার বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সাথে তায়েফও আছে। তায়েফ ইশার দলে ভিড়েছে। এক মাসে এতকিছু বদলে গেছে যা রুহানির ভাবনার বাইরে।

ইশা রুহানিকে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসছে। শব্দহীন তাচ্ছিল্যের হাসি। রুহানির শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল।
রুহানি সামনে যেতেই ইশা বেঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,
“আহারে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার।”

রুহানি ওর কথার পিষ্টে প্রশ্ন করল,
“পানি মারলি কেন?”

ইশা ভ্রু প্রসারিত করে বলল,
“তুই ডিম ছুড়েছিলি আমি পানি মেরেছি। সব শোধ।”

রুহানি তায়েফের দিকে তাকাল। তারপর ইশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখনো শোধ হয় নি।”
বলেই ইশাকে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মারল। ইশা গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে রুহানিকে দেখছে।

রুহানি ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“এখন শোধ হলো। থাপ্পড়টা কেমন লাগল সেটা তায়েফের সাথে শেয়ার করে নিস। কেননা এই থাপ্পড়ের টেস্ট ও অনেক আগেই গ্রহণ করেছে।”

তারপর পেছনে ঘুরে চলে যেতে লাগল। ইশা তেরে আসতে নিলে রুহানি পেছনে ঘুরে ওর গলা চেপে ধরে বলল,
“মেরে দেব। আরেকবার চেষ্টা করলে তোকে জাস্ট মেরে দেব।”

রুহানি তায়েফের দিকে আরেকবার তাকাল। রুহানি ওর বন্ধুদের সাথে চলে এল।

দূর থেকে ফালাক ওর কান্ড কারখানা দেখে দুহাত ভাজ করে মুচকি হাসছে। রুহানির এসব কাজ বরাবরই বিরক্ত লাগলেও আজ বিরক্ত লাগছে না। কারণ এতক্ষণ ধরে এই রুহানিকে মিস করছিল। আর মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল রুহানির কিছু হয়েছে কিন্তু এখন সব ক্লিয়ার।

রুহানির বন্ধুরা ওকে বাহবা দিচ্ছে।
রুহানি মুখ গম্ভীর করে বলল,
“ফর দ্যা লাস্ট টাইম। আমি আর এসবে নেই। আমি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। আমি আর এসব র‍্যাগিং ট্যাগিং দিয়ে আর কাউকে বিরক্ত করব না আর কারো চোখের পানির কারণ হয়ে অভিশাপ কুড়াবো না। আমি আমার মতো থাকব। পড়াশোনা করব। বাবা-মায়ের সব কথা মেনে চলব। মোট কথা ভালো মেয়ে হয়ে থাকব। আমার সাথে অন্যায় হলে প্রতিবাদ করব কিন্তু অযথা ঝামেলায় জড়াবো না।”

রুহানির কথা শুনে সবার চোখ কপালে। তুরানি এগিয়ে এসে বলল,
“তুই এসব কি বলছিস রুহানি? এসব তোর মাথায় কে ঢুকিয়েছে? ওই রনক তাই না? আমি জানতাম একদিন এমন কিছু হবে। ও তোর মাথা চিবিয়ে খাবে। তাই তো ওকে আমার পছন্দ নয়।”

“কেউ আমার মাথায় এসব ঢুকায় নি। এগুলো আমার ভাবনা, আমার সিদ্ধান্ত। তোরা আমার বন্ধু ছিলি আর থাকবি। বাট এই সব দলে আমি আর নেই। বেষ্ট অফ লাক।”
রুহানি ফালাকের কোট হাতে নিয়ে ওদের সামনে থেকে চলে গেল। নুশা ছাড়া বাকি সবাই শকডের মধ্যে আছে।

ফালাক, শুভ আর সোহানের সাথে বসে আছে। ওর হাতে একটা বই। বই হাতে কিছু একটা বলছে আর ওরা দুজন মনোযোগ দিয়ে শুনছে। শুভ আর সোহান উঠে চলে যেতেই রুহানি ফালাকের দিকে এগিয়ে গেল। ফালাক বোতল থেকে পানি খাচ্ছে। তখনই রুহানি ওর কোলে কোট ছুড়ে রাখল। হটাৎ করে কোলের উপরে কিছু রাখায় ফালাক চমকে গেল। পানি নাক মুখ দিয়ে ঢুকে গেল। ফালাক কাশতে শুরু করল। রুহানি ভ্রু কুঁচকে ওকে দেখছে। কি এমন হলো যে যক্ষা রোগীর মতো কাশছে।

ফালাক কাশি থামিয়ে বলল,
“এমন ভূতের মতো উদয় হলে কেন? দিলে তো ভয় পাইয়ে। যদি মরে টরে যেতাম?”

রুহানি চোখ উলটে মুখ বাকিয়ে বলল,
“মরে যাবে! হুহ! মরে যাওয়া কি এত সহজ?
যাই হোক ধন্যবাদ।”

ফালাক রুহানির মুখে ধন্যবাদ শব্দটা শুনে টাস্কি খেল। তারপর সেটা দমিয়ে বলল,
“এতদিন কোথায় ছিলে?”

রুহানি চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“কেন? মিস করেছো না-কি?”

ফালাক বলল,”সে তো অবশ্যই।”

রুহানি চোখ বড়বড় করে তাকাল। ফালাক নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“ওই যে আমাকে বিরক্ত করতে এসে নিজেই জব্দ হয়ে যাও। তোমাকে অনেক দিন জব্দ করি না।”
রুহানি মুখ ভেংচি কাটল। সেটা দেখে ফালাক হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“বললে না তো এতদিন কোথায় ছিলে।”

রুহানি ফালাকের দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
“হু আর ইউ? আপনি আমার কে? আপনাকে কেন বলব? সাহায্য করেছেন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? সাহায্য করেছেন ধন্যবাদ দিয়েছি ব্যাস। পার্সোনাল বিষয়ে ইন্টারেস্ট না দেখালে খুশি হব।”

রুহানির কথা শুনে ফালাকের বেশ মন খারাপ হলো। কিছুটা অপমানিত বোধ হল। মুখটা কালো করে রেখেছে। রুহানিকে একটা প্রশ্ন করেছে তাতে এত কথা শুনানোর কি খুব প্রয়োজন ছিল? ফায়াজের রুহানির প্রতি হটাৎ অনেক অভিমান হলো। কোট হাতে নিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে উঠে চলে গেল।

“রেখো আমায় খুব যতনে
কারণে-অকারণে প্রিয় অভিমানে।”

রুহানি সে সবে পাত্তা দিল না। বারবার একি প্রশ্ন কেন করছে। কি দরকার উনার জানার? অনধিকার চর্চা করতে এসেছে।

চলবে……

প্রিয় অভিমান পর্ব-০৮

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৮|

ভোরের আলো ফুটেছে। পাখিরা ডাকছে, প্রজাপতিরা ফুলে ফুলে উড়ছে। নিরশ একটা সকালের আবির্ভাব। রুহানির পরিবার নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আজ এ-ই বাড়ি, বিষয় সম্পত্তি সব নিলামে উঠবে। এত বছরের কষ্টে অর্জিত সম্পত্তি আজ অন্য কেউ মালিক হবে। কি করে ওই চোখের পাতায় ঘুম আসবে? রুহানি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজের রুমটা চোখ বুলায়। আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো গুছানো রুমটা। আজকের পর প্রতিটা দেয়াল অন্য কারোর অধীনে থাকবে। এই রুম অন্য কারো হয়ে যাবে। সে তার নিজের মতো রুম সাজাবে। ছোট থেকে যে রুমটায় বড় হয়েছে, হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে, প্রতিটি জিনিসে ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে তার সবকিছু অন্য কারো হয়ে যাবে। রুহানির কোন অধিকার থাকবে না। চাইলেও আর আসতে পারবে না। ছুতে পারবে না জানালার কাচ। রুহানির চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। মুখ চেপে ধরে কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল। দু’হাতে কার্পেট খামচে ধরে শব্দ করে কাঁদছে।

রুহানি বিষন্ন মুখে মায়ের রুমে গেল। ওর মা বিছানার উপর পাথরের মতো বসে আছে। যেন সমস্ত বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। রুহানির সাহস হলো না মায়ের কাছে যাবার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুহানের রুমের দিকে গেল। রুহানের বিছানা পরিপাটি করা। এর মানে রুহানও সারারাত বিছানায় শরীর এলায় নি। রুহানি পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও রুহানকে দেখতে পেল না। রুহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি বাগানের বড় প্যান্ডেলের দিকে। রুহানি নিঃশব্দে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

রুহান বোনের উপস্থিতি টের পেয়ে প্যান্ডেলের দিকে চোখ রেখেই বলল,
“আপু, কিছুক্ষণ পরেই ওরা চলে আসবে তাই না? তারপর আমাদের বাড়িটাও চলে যাবে।”

রুহানির বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। ভাইয়ের কথায় কি জবাব দেবে জানা নেই।

রুহান ওর দিকে ঘুরে বলল,
“আমরা কোথায় যাব আপু? আতাউর আংকেলের দেওয়া ঠিকানায়?”

রুহানি প্যান্ডেলের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“হয়তো।”

“ওখানে আমরা কি করে থাকব? আমি স্কুলে কি করে যাব? বন্ধুরা জানতে পারলে কি হবে? আমি আর স্কুলে যাব না।”

রুহানির গলা ধরে আসে। ভাইকে বুকে জড়িয়ে বলল,
“এমন কথা বলে না। দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার এই বাড়িতে ফিরে আসব।”

দু’দিন গোছগাছ করার পর ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। রনকও এসেছে। দায়িত্ব নিয়ে সকল আসবাবপত্র নিয়ে আসা থেকে শুরু করে সেট করা সব কাজ দেখছে। রুহানি, রুহান আর ওদের মা ভাড়া বাড়িতে এসেছে। আসবাবপত্র সব সেট করা হয়ে গেছে।

ওদের দেখে রনক মুচকি হেসে বলল,
“রুহানি বাড়িটা অত বড় না হলেও যথেষ্ট সুন্দর এবং পরিপাটি। আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে।”

রুহানি প্রতিউত্তরে মুচকি হাসল। ও জানে রনক কেন এ কথা বলল। এই বাড়ি দেখে যেন মন খারাপ না করে তাই। রুহানি ঘুরে ঘুরে রুম গুলো দেখে নিল। বেড রুম, ড্রয়িংরুম, কিচেন, বারান্দা সব দেখে নিল। সব জায়গায় আসবাবপত্র সেট করা হয়েছে কি-না। রুম গুলো ওদের বাড়ির তুলনায় যথেষ্ট ছোট।

রুহানি মায়ের কাছে গেল। ওর মা থম মেরে বসে আছে। লাগেজ গুলো মেঝেতে রাখা। রুহানি গিয়ে মা’য়ের পাশে বসল। তারপর হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“মা, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।”

ওর মা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু ঠিক হওয়ার নেই রে রুহানি। তোর বাবার এই অবস্থা। তোর কি হবে? রুহানের কি হবে? তোদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভেবেই আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। কি করে দুটো সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যত মেনে নেব?”

“আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে। এ নিয়ে ভেবে কি হবে? যেটা হওয়ার হবেই।”

রুহানির মা চমকে রুহানির দিকে তাকাল। রুহানি কবে থেকে ভাগ্যে বিশ্বাস শুরু করল। তার মেয়ে হটাৎ করে বড় হয়ে যাচ্ছে। বড়দের মতো কথা বলছে তাও কত ঠান্ডা স্বরে।

সেদিন রাতে রুহানি মায়ের সাথে ঘুমায়। ওর মা রুহানিকে বুকে জড়িয়ে সারারাত কেঁদেছে। একটুও ঘুমায় নি। রুহানি চুপ করে ছিল। একবারও বলে নি মা কেঁদো না।

হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়ে রুহানির বাবাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ভাড়া বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামতেই রুহানির বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“রুহানির মা আমরা কোথায় এসেছি?”

রুহানি আর ওর মা দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। রুহানি হালকা হেসে বলল,
“বাবা, আগে ভেতরে যাই তারপর সব বলছি।”

রুহানির বাবা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কোথায় এসেছে তাও বুঝতে পারছে না। অন্যের সাহায্য নিয়ে ওর বাবাকে উপর তলায় নেওয়া হলো।

ওর বাবা বাড়ির সাজসজ্জার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাচ্ছে। ওর বাবাকে রুমের ভেতরে নিতেই গম্ভীরমুখে বলল,
“এটা তাহলে আমাদের নতুন আশ্রয়স্থল। নিলামে সব কবে উঠেছে?”

রুহানি বাবার কথা শুনে চুপ করে গেল। তারপর মায়ের দিকে একবার চেয়ে বলল,
“আমি বাবার জন্য পানি নিয়ে আসছি।”
রুহানি দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

রুহানির মা বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“দুদিন আগে।”

“আমাকে বলো নি কেন?”

রুহানির মা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার শরীরের এ অবস্থা। তাছাড়া এসব তো হওয়ারই ছিল।”
রুহানির বাবা রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আমাদের ছেলেমেয়েরা এখানে থাকবে? আমি ওদের আদর-আহ্লাদে প্রাচুর্যের মাঝে বড় করেছি। সবকিছু চাওয়ার আগেই হাতের কাছে পেয়ে গেছে। ওরা এখানে কি করে থাকবে? আমি কি করে ওদের কষ্ট পেতে দেখব? আর এখন তো আমি নিজেই বোঝা। (হুইল চেয়ারে আঘাত করে) কেন আমি মরে গেলাম না। হসপিটাল থেকে কেন ফিরে এলাম? তাহলে তো নিজ চোখে আমার আদরের ছেলে-মেয়ের দুর্দশা দেখতে হতো না। এ-সব আমি দেখতে পারব না।”
(কাঁদতে কাঁদতে)

রুহানির মা নিজের কান্না আঁটকে শান্তনা দিয়ে বলল,
“তুমি এমন করছো কেন? কেন এভাবে ভেঙে পড়ছো? তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। শুধু কিছুদিন ম্যানেজ করে নিতে হবে। তোমার ছেলেমেয়ে অনেক স্ট্রং। ওরা সব সামলে নিতে পারবে। তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড় ওদের সাহস কে দিবে? সন্তানের উপর বাবার ছায়া না থাকলে সে সন্তান যে কতটা দূর্ভাগা তুমি জানো না? বাবা যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন সন্তানের মাথার উপর তার ছায়া থাকাটা জরুরী। তবেই ছেলেমেয়েরা সে ছায়ার ভরসায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। চোখের পানি মুছো। ওরা তোমাকে কাঁদতে দেখলে আতংকিত হয়ে পড়বে। আমি ওদের শক্ত, সাহসী দেখতে চাই।”

রুহানি চোখের পানি মুছে গ্লাস, জগ নিয়ে হাসিমুখে রুমে এলো। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে বাবার দিকে এগিয়ে দিল। ওর বাবা গ্লাসের দিকে অপলক চেয়ে আছে। যে মেয়ে নিজে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না সে আজ নিজের হাতে গ্লাস, জগ বয়ে এনে পানি ঢেলে খাওয়াচ্ছে।
“কি হলো বাবা? নেও।”

রুহানির কথায় চমকে গ্লাস নিয়ে পানি খেল। তারপর রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি দ্রুত সব ঠিক করে দেব। তুই চিন্তা করিস না। আগের মতোই হাসিখুশী থাকবি। আমি সব সময় তোর চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখতে চাই। তোকে খুশি দেখতে চাই।”

রুহানি বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বলল,
“আমি জানি তুমি সব ঠিক করে দেবে। আমি জানি আমার বাবা সুপারম্যান।” তারপর মিষ্টি হাসল।

এদিকে রুহানিকে দীর্ঘদিন ভার্সিটিতে না পেয়ে ফালাক অস্থির হয়ে পড়ছে। রোজ এটুকু আশা নিয়ে আসে রুহানি আজ এসেছে কিন্তু না আসে না রুহানি। অপেক্ষা শব্দটা ফালাকের কাছে অনেক ভারী মনে হচ্ছে। রুহানি না আসায় ওর সমস্যা হওয়ার কথা না। না আসলেই বরং ভালো। বিরক্ত করার কেউ নেই। কিন্তু আজকাল ফালাক রুহানির বিরক্ত করা গুলো খুব মিস করছে। রুহানিকে ছাড়া ভার্সিটির প্রতিটি স্থান নীরব, নিস্তব্ধ লাগে। রুহানি পুরো ভার্সিটি মাতিয়ে রাখত। ওর পদচারণায় সব মুখরিত থাকত। কিন্তু ও না থাকায় মনে হচ্ছে কি জানি নেই। ভার্সিটি তার প্রাণ হারিয়ে ফেলেছে। ফালাক কাকে জিজ্ঞেস করবে, কি করে খোঁজ নিবে রুহানির জানা নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করলে কি মনে করবে।

ফালাক একদিন রনককে জিজ্ঞেস করেছিল রুহানির কথা। রনককে রুহানি ওর ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করেছিল। তাই রনক বলেছে,
“ফ্যামিলির সাথে ব্যস্ত আছে। কিছুদিন পর থেকে আসবে।”

ফালাক রনকের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারে নি। অপেক্ষা করে যাচ্ছে রুহানির জন্য। এদিকে রুহানি ঠিক করেছে আর পড়াশোনা করবে না। পরিবারের একটা রোজগারের পথ খুঁজতে হবে। ও হিসাব করে দেখেছে যা ক্যাশ টাকা আছে তাতে বাড়ি ভাড়া, বাবার ওষুধ-পথ্য, ভাইয়ের পড়াশোনা আর সংসার খরচ নিয়ে তিনমাস আরামসে কেটে যাবে কিন্তু তারপর কি হবে? এছাড়া ভার্সিটিতে যাওয়া মানে নিজের হাতে নিজের বেজ্জতি করা। তাই এখন ওকে একটা কাজ খুঁজতে হবে।

.

রুহানি রান্নাঘরে মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে বাদাম খাচ্ছে। ওর মা হালুয়া বানাচ্ছে। রুহান ড্রয়িংরুম থেকে চিল্লিয়ে রুহানিকে ডাকছে।
“আপু কখন থেকে ফোন বাজছে তোমার।”

রুহানি হাতে কিছু বাদাম নিয়ে নিজের রুমে গেল। বিছানার উপর থেকে ফোন তুলে নিল। নুশা ফোন করেছে। রুহানি কেটে দিতে গিয়েও কি মনে করে রিসিভ করে নিল।

রুহানি ফোন রিসিভ করতেই নুশা বলে উঠল,
“তুই তোর ফ্যামিলির সাথে বাইরে সময় কাটাতে গিয়েছিস তাই না? তোকে যেন ডিস্টার্ব না করি আমরা।”

রুহানি চুপ করে আছে। কোন উত্তর দিচ্ছে না। নুশা উত্তর না পেয়ে খেকিয়ে বলল,
“কথা বলছিস না কেন? এমনই তো মেসেজ করে বলেছিলি।”

রুহানি আবারও চুপ করে আছে। নুশার কান্নার শব্দ পাচ্ছে।
নুশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি সব সময় তোর সব কাজে, কথায় সাপোর্ট করেছি। তুই যা বলেছিস তাই করেছি। তায়েফের সাথে পর্যন্ত সব যোগাযোগ অফ করে দিয়েছি। এতদিনের সম্পর্ক আমাদের, সবকিছু এক সাথে করি। শপিং করতে পর্যন্ত একা যাই না। অথচ তুই আমাকে কখনো আপন মনে করিস নি। বিশ্বাস আর ভরসা করিস নি। এতকিছু হয়ে গেল তুই আমাকে কিছুই বলিস নি?”

রুহানির আর বুঝতে বাকি নেই নুশা সব জেনে গেছে। রুহানি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“রনক বলেছে?”

নুশা অবাক হয়ে বলল,
“রনক! ও জানে! অথচ আমি কিছুই জানি না। আমি তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম। যে মেয়ে একদিন বন্ধুদের ছাড়া থাকতে পারে না সে ১০-১২দিন ধরে লাপাত্তা। তাই খটকা লেগেছে। তুই এখন কোথায় আছিস?”

রুহানি শুকনো মুখে বলল,
“আছি।”
“রুহানি এড্রেস চেয়েছি আমি।” রুহানি নুশার রাগ ফোনের অপর পাশ থেকেই অনুভব করতে পারছে। রুহানি এড্রেস দিয়ে দিল।

দু’ঘন্টার মধ্যে রুহানি এসে হাজির। এসেই রুহানিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল কিছুক্ষণ। রুহানি উল্টো নুশাকে শান্তনা দিচ্ছে।
হাজারো কথার মাঝে রুহানিকে ভার্সিটির কথা বললে রুহানি সরাসরি বলে দেয়, ও আর ভার্সিটিতে যাবে না। পড়াশোনা শেষ।

নুশা অনেক বুঝিয়েছে, রুহানির বাবা-মাও অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু ওর একি কথা ও আর যাবে না।
নুশা রুহানিকে এটাও বলেছে, ভার্সিটির কেউ কিছু জানে না। আর ওর বন্ধুরাও কিছু জানে না। কার এত সময় আছে অন্যের খোঁজ করার? ও আগের মতোই থাকতে পারবে কিন্তু রুহানি এক কথায় অটল।

নুশা কয়েকদিন পর পর ওদের বাড়িতে আসে। ওদের খোঁজ খবর নেয়, রুহানির সাথে সময় কাটায়, রুহানিকে বুঝায়।

রুহানির বাবা রুহানিকে অনেকবার বলার পর রুহানি ভার্সিটিতে যেতে রাজি হয়েছে। সব সময়ের মতো দামি গাড়ি চড়ে, দামী পোশাকেই ভার্সিটিতে গেল। কিন্তু কেমন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে দামি পোশাকের আড়ালে ভেতরটা লুকাতে পারছে না। গুটিগুটি পায়ে মাথা নিচু করে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। আগে যে জায়গা দিয়ে রুহানি হেঁটে যেত ওই জায়গা যেন চিৎকার করে বলতো রুহানি গিয়েছে এই জায়গা দিয়ে। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম।
রুহানি বারান্দার কাছে যেতেই ওর উপর তরল কিছু পড়ল। রুহানি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওর উপর পানি ফেলা হয়েছে। চুল, জামার কিছু অংশ ভিজে একাকার। রুহানি হাত দিয়ে মুখের উপর থেকে ভেজা চুল সরালো। তারপর উপরের দিকে তাকাতে চেয়েও পারল না। মাটির দিকে চেয়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে মানুষের ভিড় জমাতে শুরু করেছে। রুহানির চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ল। ভেজা থাকার কারণে কেউ বুঝতেও পারল না। দু’হাতে নিজের ভেজা শরীর ঢাকার চেষ্টায় রত। মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদছে।
কেউ দৌড়ে এসে ওর গায়ে কোর্ট জড়িয়ে দিল। রুহানি সামনের মানুষটাকে না দেখে মাথা নিচু করে কোর্টটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল।
নুশা খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছে। সাথে ওর বন্ধুরাও। সবাই অবাক হচ্ছে রুহানির বিহেভিয়ার দেখে। ও এতটা শান্ত কি করে। ওর যেখানে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো ভার্সিটি মাথায় তোলার কথা সেখানে নীরব পরিবেশ বিরাজমান। এটা কি করে সম্ভব?
তবে সে পরিবেশ বেশিক্ষণ নীরব থাকতে পারল না। ফালাকের হুংকারে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবেশ থমথমে রুপ নিল।

চলবে…..

প্রিয় অভিমান পর্ব-০৭

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৭|

রুহানি হসপিটালের কডিটোর জুড়ে দৌড়াচ্ছে আর চোখের পানি মুছছে। পুরো মুখ কাঁদা কাঁদা হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। দেখে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। আশেপাশে কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, কে অবাক হয়ে ওকে দেখছে তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আর না আছে খেয়াল। রুহানি নিজের মতো দৌড়াচ্ছে।

বাবা কোথায়, কিভাবে, কত নাম্বার রুমে আছে কিছুই জানা নেই। শুধু জানে তিনতলায় আছে। বাবাকে খোঁজে না পেয়ে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর ফুপিয়ে কেঁদে দিল। নিজেকে প্রচন্ড অসহায় লাগছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। আশেপাশের মানুষ ওকে এভাবে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। আর নিজেদের মতো ফিসফিস করছে।

কেউ কেউ ওর সামনে এসে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? কিন্তু রুহানি উত্তর দিচ্ছে না। চুপ করে কেঁদেই যাচ্ছে। একজন ওকে উঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ও শক্ত হয়ে বসে আছে। কান্নার মাঝে বাবা শব্দটা কয়েকবার উচ্চারণ করল। এতে করে উপস্থিত লোকজন বুঝল ওর বাবার কিছু হয়েছে।

রুহানির মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে ধরে দাঁড় করালো। রুহানির মা নিজেকে যতই শক্ত রাখার চেষ্টা করুক না কেন চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারছে না। রুহানিকে ধরে উঠাল।

রুহানি কিছু বলার আগেই ওর মা বলল,
“আমরা বাবার কাছে যাচ্ছি।”

রুহানি কাঁদতে কাঁদতে কেবিনের সামনে গেল। ১৫ বছরের রুহান পাশের বেঞ্চিতে বসে আছে। মা আর বোনকে দেখে উঠে দাঁড়াল। কাদো কাদো হয়ে বলল,
“মা, বাবার কন্ডিশন ভালো না। আমার খুব ভয় করছে।”

ওর মা বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবার কিছু হবে না। ভয় পাস না।”

রুহানি বারবার বাবার কাছে যেতে চাইলেও ডাক্তার পারমিশন দিল না। রুহানির মা ওকে আর রুহানকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল জোর করে।

রুহানি বিছানায় শুইয়ে ছটফট করছে। রাতটাকে বেশ লম্বা আর ভয়ংকর মনে হচ্ছে। রাতের এই গাঢ় অন্ধকার যেন ওকে গিলে খাচ্ছে। তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে। অস্থির অস্থির লাগছে। এই প্রথম কোন রাতকে এতটা ভয়ংকর লাগছে। এটা সেটা ভেবে পুরো নির্ঘুম একটা রাত কাটাল। মাথা ভারী হয়ে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে এর পর থেকে প্রতিটা রাতই ভয়ংকর কাটবে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের রাতগুলো হয়তো নির্ঘুমই হয়।

রুহানি দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবছে দু-তিন দিন আগের কথা। রনক হুট করে বাড়িতে চলে যায় আর বাড়িতে পৌঁছে রুহানিকে ফোন করে জানায় ওর বাবা হসপিটালে তাই ও কিছুদিন রুহানিকে পড়াতে পারবে না।
রুহানি “ওকে” বলে রেখে দেয়। এর পর আর ওর বাবার খোঁজ করে নি। একটা বারের জন্য ফোন করে নি। আসলে নিজের ব্যস্ত জীবনে ওর বাবার কথা ভাবার ফুরসতই মিলে নি। আজ রুহানির মনে পড়ছে। মনে পড়ছে হয়তো সেদিন রাতে রনকও ওর মতো ছটফট করেছে। ওর ও হয়তো ভয়ংকর রাত কেটেছে। রনকের অবস্থানটা আজ অনুভব করতে পারছে। রুহানি প্রথমে ফোন হাতে নিয়ে বাবার খোঁজ নিল তারপর রনককে ফোন করল।

একবার রিং বাজতেই রনক ফোন রিসিভ করল। ফোন রিসিভ করতেই রুহানি জিজ্ঞেস করল,
“আংকেল কেমন আছে?”

রনক মৃদু হেসে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছে। তবে অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কি যে টেনশন আর ভয়ে কাটিয়েছি পুরো পরিবার। একমাত্র আল্লাহ জানে। আমি দুয়েক দিনের মধ্যে চলে আসব।”

“কিছুদিন থেকে আয়। আংকেলের খেয়াল রাখ।” রুহানির গলা ধরে আসছে। রুহানির ধরা গলা খেয়াল করে রনক চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“রুহানি কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”

রুহানি কেঁদে দিল। এই মুহুর্তে ওর এমন একজন বন্ধু দরকার যে ওর অবস্থাটা বুঝতে পারবে। যে ওর কষ্টগুলো অনুভব করতে পারবে। আর সে হচ্ছে রনক। রুহানি কেঁদে দিল। রনক ওর কান্না শুনে বিচলিত হয়ে পড়ল। রুহানিকে যতদূর চিনে কঠিন মনের মানুষ। এত সহজে কাঁদার মেয়ে ও নয়।
রনক চুপ করে রুহানিকে কান্নার সুযোগ করে দিল। রুহানি কান্না থামিয়ে সবকিছু খুলে বলল। সব শুনে রনক স্তব্ধ হয়ে গেল।
তারপর বলল,”রুহানি, নিজেকে শক্ত করো। এটা ভেঙে পড়ার সময় না। আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আংকেল দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমি বিকেলে চলে আসছি।”
রুহানি কাঁদতে কাঁদতে ফোন কেটে দিল।

রুহানি ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলের সামনে গেল। পুরো বাড়িটা নীরব, নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। রুহানির বুকে চাপ দিচ্ছে। কেন জানি মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে পারছে না।

পানি মুখে দিয়ে ফ্রেন্ড গ্রুপে একটা ম্যাসেজ করে হসপিটালের জন্য বের হয়ে গেল।

ফালাক ভার্সিটিতে এসে রুহানিকে খুঁজছে। আজ রুহানিকে একবার পাক। কিন্তু রুহানিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো ভার্সিটি তন্নতন্ন করেও খুঁজে পেল না। তারপর বিরক্তি নিয়ে লাইব্রেরীতে পড়া শেষ করে ক্লাসে গেল। ক্লাস শেষে রুহানিকে খুঁজছে কিন্তু পায় নি। ভার্সিটি শেষ হওয়া পর্যন্ত রুহানিকে খোঁজ করল কিন্তু পেল না। অবশেষে বুঝতে পারল রুহানি আসে নি।
ফালাক মনে মনে বলল,
“ব্যাপার না। আজ আসো নি তো কি হয়েছে! আসবে তো।”

রুহানি ডাক্তারের কাছ থেকে পজিটিভ কোন উত্তর পেল না। সারাদিন হসপিটালে ছিল। রুহানি নিরাশা নিয়ে বসে আছে। কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না। দু’হাতে মাথা চেপে ধরল।

রনক দৌড়ে রুহানির সামনে এসে থামল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে। রুহানি চোখ তুলে তাকাল। রুহানির বিমর্ষ মুখ দেখে রনকের মনটা কেমন জানি করে উঠল। রুহানিকে এভাবে এর আগে দেখে নি।

কেটে গেছে দু-তিন দিন। রুহানি ড্রয়িংরুমে টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আগামী কাল সব প্রপার্টি নিলামে উঠবে। পাশেই রুহান বসে আছে। ওর পলকহীন দৃষ্টি মেঝের দিকে।

“রুহানি মা!”

রুহানি মাথা তুলে তাকাল। ওদের এই অবস্থায় ওদের কোন আত্মীয়স্বজন এগিয়ে আসে নি। সবাই জেনে গেছে ওদের সব প্রপার্টি নিলামে উঠবে। কাজের লোকেরা পর্যন্ত চলে গেছে। নতুন আশ্রয়, নতুন কাজের জন্য। কেয়ারটেকার আংকেল এসেছেন। রুহানি তাকে দেখে শুকনো হাসল।

আতাউর রহমান রুহানির কাছে এসে বলল,
“কোথায় যাবে ঠিক করেছো?”

রুহানি দৃষ্টি নামিয়ে নিল। ওর চোখের পাপড়ি ভারী হয়ে আসছে। টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
রুহানি ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কান্না আঁটকাতে পারছে না। রুহান বোনের অবস্থা দেখে উঠে চলে গেল। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে।

রুহানি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাবা এখনো হসপিটালে। আমাদের চাচা-ফুপু নেই। মামা আছে একজন। আমি জানি তার জন্যই আজ আমাদের এই অবস্থা। এটা জানার পরেও আমি তাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু রিসিভ করে নি। আমাদের একটুও খোঁজ নেয় নি। আমি কি করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কখনো এমন সিচুয়েশনে পড়ি নি। তাই কি করে কি হ্যান্ডেল করব কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজেদের বাড়ি, সব ছেড়ে কোথায় যাব? কি করব? রাস্তার ভিখারি হয়ে গেলাম আংকেল। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সব শেষ করে দেই।” রুহানি আবারও কাঁদতে লাগল।

“মা এমন কথা বলো না। তোমার মা, ভাই ওদের কি হবে? তোমার বাবার এই অবস্থা। তোমার মা সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়েছে। এখন তুমি যদি এমন করো তাহলে তাকে কে সামলাবে? তোমার ছোট ভাইটা ওকে কে দেখবে? তোমাকে হতে হবে তোমার পরিবারের বটগাছ। যার ছায়াতলে সবাইকে রাখতে হবে। তোমাকে সকল পরিস্থিতির সাথে লড়াই কর‍তে হবে। আর এ লড়াইতে তোমাকে জিততে হবে। তোমার পরিবারের জন্য জিততে হবে।”

“আংকেল আমি কি করে করব? আমি কি পারব? সে যোগ্যতা কি আমার আছে? আমি কি করে আমার পরিবারকে রক্ষা করব? কি করে পরিবারের পাশে দাঁড়াব? কি করব? কি যোগ্যতা আছে আমার?”

আতাউর রহমান আশ্বস্ত করে বলল,
“সেটা সময় বলে দেবে। সময় আর পরিস্থিতি তোমাকে যোগ্য করে তুলবে। শুধু কঠিন পরিস্থিতি থেকে পালানোর চেষ্টা না করে পরিস্থিতিকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে শিখো।”

রুহানি চোখের পানি মুছে বলল,
“আগামীকাল সব হাতছাড়া হয়ে যাবে তারপর আমরা কোথায় যাব? কোথায় থাকব? আমি, রুহান, মা আর বাবা! বাবার রিলিজ হওয়ার পর কোথায় নিয়ে যাব?”

“মা, কি বলব? এই বাড়িতে কিংবা এরকম বাড়িতে তো….
থেমে গেলে। রুহানি শুকনো হাসল। তারপর বলল,
” জানি আংকেল। আমাদের আর সে অবস্থা নেই।”

আতাউর রহমান কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
“আমার পরিচিত একজন আছে যারা বিদেশে থাকে। ওদের এক আত্মীয় নিজের মেয়েকে নিয়ে ও বাড়িতে থাকে। তোমরা চাইলে উপর তালা ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা কর‍তে পারি। কিছুদিন না-হয় থাকলে ওখানে তারপর ভালো না লাগলে অন্য কোথাও শিফট হয়ে যেও। তবে বাড়ির পরিবেশটা সুন্দর।”

রুহানি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“ঠিক আছে। মায়ের সাথে আপনার কথা বলিয়ে দেব। মা যদি বলে তাহলে আমরা ওখানে শিফট হয়ে যাব।”

.

রুহানি ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারল ওর বাবা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আর ও মা দুদিন যাবত এটা ওদের কাছ থেকে লুকিয়ে যাচ্ছে। রুহানির মনোবল যেন আবারও ভেঙে গেল। দু’ভাইবোন একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদছে। বাবার এ অবস্থা মেনে নিতে পারছে না। সব হারিয়েও এত কষ্ট পায় নি যতটা কষ্ট আজ পাচ্ছে।

ফালাক দু-তিন দিন রুহানিকে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ছে। প্রতিদিন রুহানিকে খুঁজছে কিন্তু রুহানির দেখা নেই। হটাৎ করে কোথায় উধাও হয়ে গেল? ফালাক কারো কাছ থেকে জানতেও পারছে না আর না পারছে কাউকে জিজ্ঞেস করতে।

চলবে….

প্রিয় অভিমান পর্ব-০৬

0

#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৬|

ভরদুপুর। তেজস্বী সূর্য তার সম্পূর্ণ তেজ যেন উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছে। পুকুর পাড়ে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে কিন্তু এই বাতাস সূর্যের প্রখরতা কমাতে সফল হচ্ছে না। রুহানিও সূর্যের মতো প্রখর তেজ নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে সূর্যের সাথে পাল্লা দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগেই তায়েফের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ করে এল। এতদিনের বন্ধুত্ব কিন্তু একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং নিজের উপর রাগ লাগছে। যে মেয়েদের অসম্মানের চোখে দেখে সে নিশ্চয়ই মেয়ে বন্ধুদেরও ছাড় দেয় নি। না জানি কতদিন, কতবার কুদৃষ্টি নিয়ে দেখেছে। রুহানির গা ঘিনঘিন করছে।

রুহানি পুকুর পাড়ে পা ভিজিয়ে বসে আছে। তবে এই মুহুর্তে মাথা ঠান্ডা করা দরকার। পুকুরের এই উত্তপ্ত পানি মাথায় দিলে মাথা ঠান্ডা হওয়ার বদলে গরম হয়ে ফুটবে।

“এই প্রথম মেয়ের মতো আচরণ করলে।”
ফালাক ক্যানে চুমুক দিয়ে বলল।

রুহানি পেছনে ঘুরে ফালাককে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।

ফালাক ক্যান দেখিয়ে বলল,
“এভাবে চেয়ে আছো কেন? খাবে না-কি?”

রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“হ্যাঁ খাবো তবে তোমাকে। হে আল্লাহ! আমাকে সবর দেও। একে যে কবে আমি মার্ডার করে ফেলি। বিরক্তিকর লোক।”

ফালাক বাকা হেসে বলল,
“আমি খুব টেস্টি। তোমাকে আর কি দোষ দেব সব মেয়েই আমাকে দেখলে পাগল হয়ে যায়। মেয়েদের কাছে আমি আইসক্রিম কিংবা চকলেটের মতো।”

রুহানি চোখ বড়বড় করে তাকাল। তারপর নাক ছিটকে বলল,
“হুহ! কি তার চেহারা।”

“তোমার মতো তো আর জংলী না। নিজেকে দেখো। নিজের পোশাক দেখো, চুল দেখো। চুল দেখে মনে হয় বহুকাল চিরুনি পড়ে নি। আর জামা-কাপড়েরও কোন ষ্ট্যাণ্ডার্ড নেই। পুরাই জঙ্গল।”

রুহানি ফালাকের কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“আমি জঙ্গল! এটাকে স্টাইল বলে,স্টাইল। যা তুমি বুঝবে না। কারণ তুমি নিজেই একটা জঙ্গল। জংলি লোকেরা আবার স্টাইল বুঝে না-কি!”

ফালাক রুহানির দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তোমার পোশাকে তো ছেলেদের ভাব আছে। আমার পোশাকে কি মেয়েলি ভাব আছে? আমার পোশাক সম্পূর্ণ ছেলেদের স্টাইলের এবং হাই ষ্ট্যাণ্ডার্ড।”

রুহানি চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“হ্যাঁ স্টাইল তবে ক্ষেত মার্কা স্টাইল! আসছে ষ্ট্যাণ্ডার্ড দেখাতে!”

রুহানি মুখ ভেংচি কেটে হাঁটা ধরল। কিছুদূর গিয়ে থামল। তারপর পেছনে ঘুরে বলল,
“মিস্টার ফালাক! নেক্সট টাইম আমার সাথে লাগতে আসলে খুলি উড়িয়ে দেব।”
রুহানি হাতের আঙুল দিয়ে পিস্তল সেপ করে দেখাল।

ফালাক একটু হাসল। রুহানির আচরণগুলো অদ্ভুৎ লাগে।

এভাবে কেটে গেছে দু-তিন মাস। হাসি-আনন্দ, হৈ-হুল্লোড়ে দিনগুলো সুন্দর ভাবে কেটে গেছে। রুহানি আগের চেয়ে কিঞ্চিৎ বদলেছে। দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটিতে মেতে থাকলেও আগের মতো ভার্সিটির জুনিয়রদের জ্বালাতন করে না। ওর সব জ্বালাতন আর বিরক্তি ফালাক আর ওর বিপরীত দল ইশার টিম সহ্য করছে। রুহানির দলটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। তায়েফ অনেকবার সরি বলার পরেও রুহানি মাফ করে নি। এ নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষ জমা হয়েছে। আর রুহানিও বলে দিয়েছে তোদের ইচ্ছে হলে ওর সাথে কথা বল যা খুশি কর আমি তো মানা করি নি। আমি ওর সাথে বন্ধুত্ব রাখব না ব্যস।
এ নিয়ে রুহানির আড়ালে ব্যাপক আলোচনা হয় সেটা রুহানি জানলেও পাত্তা দেয় না।
রনক রুহানিকে পড়ানোর সময় হাসি গল্পের মাধ্যমে কিছু নীতিশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে।

এই যেমন “রুহানি নিজের একটা সুন্দর ব্যক্তিত্ব গঠন করো। ব্যক্তিত্বহীন মানুষ কারো ভালোবাসা, শ্রদ্ধার যোগ্য নয়। এমন ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলো যাতে আশেপাশের মানুষ তোমার ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়, তোমাকে অনুসরণ করে। যে ব্যক্তিত্বে মিথ্যার কোনো স্থান নেই।”

“রুহানি, সব সময় নিজের আত্মসম্মানে অটল থাকবে। কোনকিছুর বিনিময়ে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিবে না। তাহলে বেঁচে থেকেও মরে যাবে।”

“নিজেকে কখনো কারো নিকট দূর্বলভাবে প্রকাশ করবে না আর না নিজের দূর্বলতা। তাহলে সে তোমার দূর্বলতায় কারণে অকারণে আঘাত করবে।”

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ায় রুহানি ওর নাম দিয়েছে পণ্ডিত। তবে এই নামে রনক যথেষ্ট সন্তুষ্ট।

ফালাক এই তিন মাসে রুহানির হাত থেকে রক্ষা পায় নি। বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করে গেছে। তবে রুহানিকেও ফেরত দিয়েছে।

ফালাক লাইব্রেরীতে পড়ায় মগ্ন। রাতে অফিসের ফাইলপত্র নিয়ে বসতে হয়, কাজ করে তাই পড়ার সুযোগ হয় না। যতটুকু সময় পায় পড়া গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
রুহানি চুইংগাম চিবাতে চিবাতে লাইব্রেরীতে ঢুকল। শেলফ থেকে একটা বই নিল। আড়চোখে ফালাককে দেখছে। ধীরে ধীরে হাঁটছে রুহানি। ফালাকের পাশ ঘেঁষে হেঁটে বাইরে চলে গেল।

ইশা তায়েফকে নিজের দলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সে খবর নুশা দিল রুহানিকে। তায়েফ জাহান্নামে যাক তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই রুহানির। তবে ইশা যে স্পর্ধা দেখাচ্ছে তাতে বেশ রেগে যায় রুহানি।

ক্যান্টিনে ইশাকে দেখে রাগে গজগজ করছে রুহানি। ইচ্ছে করছে গরম কফি ওর মুখে ঢেলে দিতে।

কিন্তু এতটাও নির্দয় হওয়া যাবে না। এতে উল্টো নিজেই কেস খেয়ে যাবে।
রুহানি ডিমের ঝুড়ি থেকে ডিম নিয়ে ইশার মাথার দিকে ছুড়ে মারে। রুহানিকে দেখে ওর বন্ধুরাও ইশাকে ডিম ছুড়ে মারে। ইশার মাথা ডিম দিয়ে ঢেকে গেছে। মুখের কাছেও গড়িয়ে পড়ছে। ডিমের গন্ধে ইশার বমি চলে আসছে। দু-হাত সরিয়ে নাক ছিটকাচ্ছে। রুহানি ওর পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,” ইউ আর লুকিং সো কিউট!”
ইশা পারলে ওকে খেয়ে ফেলে। কিন্তু এইভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নিজেই মারা পড়বে। দ্রুত ওয়াশরুমে দৌড়ে গেল।

রুহানি আর বন্ধুরা বাইরে এসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মন শান্তি হয়েছে।
রুহানি এনাউন্স করল,”গাইস! আমি আজকে সবাইকে চাইনিজ ট্রিট দেব।”

তুরানি বলল,
“আমি চাইনিজ খাব না।”

“ওকে যে যা খাবি তাই খাওয়াব। ক্যাশ, কার্ড সব আছে। আজকে আমি অনেক খুশি। যে যা চাইবি তাই দেব।”

তারপর সবাই ক্লাস মিস দিয়েই এক সাথে বেড়িয়ে গেল।

ফালাক লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে। শুভ আর সোহান ওর দিকে এগিয়ে এল কথা বলার জন্য। ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে ক্লাসের দিকে গেল। ওরা বসার পর পেছনে থেকে একজন ফালাকের কাঁধে হাত দিয়ে ডাকল। ফালাক পেছনে ঘুরে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ, তোমার চুলে চুইংগাম। বাজে ভাবে জড়িয়ে আছে।”

ফালাক চুইংগামের কথা শুনে মাথায় হাত দিতে গিয়েও দিল না। শুভকে বলল,
“দেখতো মাথায় কি?”

সোহান আর শুভ দুজনেই মাথার দিকে তাকাল। চুলে চুইংগাম আঁটকে আছে।

সোহান অসহায় ফেস করে বলল,
“ভাই, সত্যিই চুলে চুইংগাম। কি করে লাগল?”

ফালাক ভাবছে কি করে চুলে চুইংগাম লাগতে পারে কিন্তু কিছুই মাথায় এলো না।
ফালাক দ্রুত ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেল। শুভ আর সোহানও ওর পেছনে পেছনে গেল। ফালাক ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় মাথার পেছনটা দেখার চেষ্টা করছে। শুভ আর সোহানের সাহায্যে চুল থেকে চুইংগাম ছাড়াতে সক্ষম হলো।

ফালাক মুখে পানি দিচ্ছে। রাগ লাগছে প্রচুর। শুভ কি জানি ভেবে আমতা আমতা করে বলল,
“ভাই আমার মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে করেছে।”

ফালাক চমকে শুভর দিকে তাকাল। তারপর চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“রুহানি! যথেষ্ট হয়েছে আজ আর ওকে ছাড়ছি না।”

ফালাক হুড়মুড় করে বের হয়ে গেল। চোখ-মুখ লাল করে হনহন করে হাঁটছে আর রুহানিকে খুঁজছে। কিন্তু রুহানিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না।
অতঃপর জানতে পারল রুহানি অনেক আগেই চলে গেছে।
“আজ চলে গেছো তো কি হয়েছে? আসবে তো আবার। তোলা রইল তোমার জন্য।”

রুহানি রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের সাথে খাওয়া দাওয়া করছে, এক সাথে আড্ডা দিচ্ছে। সেল্ফি নিচ্ছে। কেউ কেউ ফেসবুকেও আপলোড দিয়ে দিচ্ছে। বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি, খেয়ে-দেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল।
কিন্তু বাড়িতে ফিরে ওর চোখ চড়কগাছ। বাড়িতে স্যুট-কোট পরা কয়েকজন লোক এসেছে। তারা কি যেন বলছে ওর মায়ের সাথে। ওর মায়ের বিমর্ষ ফেস দেখে ভালো ঠেকল না বিষয়টা।

রুহানি দ্রুত মায়ের কাছে গেল। ওর মা ওর দিকে তাকাল। রুহানি আতংকিত কন্ঠে বলল,
“উনারা কারা মা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”

রুহানির মা রুহানির হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
“তুই কোথায় ছিলি? তোকে কতবার ফোন করেছি হাহ?”
রুহানির মা বলতে বলতে কেঁদে দিল।

রুহানি মায়ের কান্না দেখে ভয় পেয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কি হয়েছে?”

রুহানির মা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সব শেষ হয়ে গেছে রুহানি। সব শেষ। ব্যাংকের লোকজন এসেছে।”

“বাবা কোথায়?”

রুহানির মায়ের কান্নার গতিবেগ আরো বেড়ে গেল। তিনি কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“স্ট্রোক করেছে। হসপিটালে আছে। কাছে থাকার মতো একটা মানুষ নেই। রুহানকে রেখে এসেছি। তোকে ফোন করছি তুই তো ফোন রিসিভই করছিস না। সব শেষ রুহানি। এখন আমি কি করব? কার কাছে যাব? আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না।”

রুহানি মায়ের কথা শুনে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। কিছু সময়ের ব্যবধানে কি হয়ে গেল? কিছুক্ষণ আগেও তো বন্ধুদের সাথে কত হাসি-খুশি ছিল কিন্তু বাড়িতে এত কিছু হয়ে গেছে তার কোন খবরই ওর নেই।
রুহানির মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আর পায়ের নিচেও মাটি নেই। ও অন্য কোন দুনিয়ায় আছে। কোনকিছু ভাবার ক্ষমতাও নেই। শরীরের শক্তি নিস্তেজ হয়ে আসছে। অনুভূতিরা শূন্যে ভাসমান। গভীর ভাবে ভাঙ্গনের শব্দ পাচ্ছে। তিলে তিলে গড়ে তুলা প্রাচুর্যের ভাঙ্গন।

চলবে….!