Friday, July 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1421



সাঝের বাতি পর্ব-০২

0

#সাঝের_বাতি
#Sajid_Hasan
#পর্ব_২

ঘন শ্বাস নিচ্ছে সিয়াম ভাইয়া।তার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট ।চাঁদের আলোয় পুরো মুখটাই জ্বলজ্বল করছে।চেয়াল খিচে রয়েছেন উনি।কপালের রগগুলো ভেসে উঠেছে।ঠোঁটগুলো হালকা খিচে রয়েছেন।চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পরেছে চারিদিকে।সাদা কালারের শার্টটা ভিজে গেছে ঘামে।শার্টের সামনের দুটো বোতামই খোলা।তার চোখমুখ দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।অদ্ভুত লাগছে আজ।এরকম গোমরাটে রাগ তার কখনোই দেখিনি।বারবার মনে হচ্ছে,এই বুঝি কিছু বলবেন,হয়তোবা আবার অপমান করবে,নয়তো মারবেন!
.. ভাবনার বাধ ভেঙে উঠে দাড়ালেন সিয়াম ভাইয়া।কি যেনো ভেবে অবার ঝুকে পরলেন আমার দিকে।তার অচরনে রিতিমত ভয়ে সকড্ হয়ে আছি।কিছু না ভেবেই চোখমুখ বন্ধ করে নিলাম।

-ভয় পাচ্ছিস?

ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে চোখ খুললাম।কিছু বলার সাহস নেই তাই চুপ করে রইলাম।আমার কোনো উওর না পেয়ে চেঁচিয়ে বললেন উনি,

-কি রে কোনো কথা বলছিস না!ভয় পেয়েছিস খুব। তা আগে মনে ছিলো না এরকম করার আগে।প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলি না তুই।তাহলে ভয় কেনো পাচ্ছিস।

কিছুই বললাম না।কারন,আমাকে যে উনি কখনোই বোঝেনি আর আজও বুঝবেনা এটাই স্বাভাবিক।উনি মনে করছেন এগুলো আমি ইচ্ছে করে করেছি কিন্তু আমি ওই কফিটা ইচ্ছে করে ফেলিনি।
যাইহোক যেভাবেই হোক বুকে সাহস নিয়ে বলতে চাচ্ছিলাম এগুলো আমি করিনি। বলতে গিয়েও কথাগুলো বলতে পরিনি।

-তোদের মতো মিডিলক্লাস ফ্যামিলির চুপ থাকা ছারা কিছুই আশা করা যায় না।দোষ করবি, আবার চুপও থাকবি।চুপ থকে অন্য কোথাও বেচে যেতে পারিস কিন্তু এই সিয়াম এর কাছ থেকে ওত সহজে বাচাঁ যাবে না।আরে তোদের মতো মেয়েদের আমার ভালো করেই জানা আছে!আর তুই আব্বুকে আমার বিরুদ্ধে বিষিয়ে দিয়েছিস তাইনা?

-আপনি আমায় যা বলবেন বলুন কিন্তু আমার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না আপনি।দোষ তো আমি করেছি তাহলে আমার পরিবারকে কেনো টানছেন এখানে?আর মিডিলক্লাস,হ্যা আমরা মিডিলক্লাস! আমাদের আপনাদের মতো গাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা কিছুই নেই কিন্ত আমরা আপনার মতো অমানুষ নই।আপনি একবারও বোঝার চেষ্টা করেছেন আমি ইচ্ছে করে করেছি নাকি অনিচ্ছাকৃত করেছি।একবারও বোঝার চেষ্টাটাও করেন নি আপনি।আর আমি চাচ্চুকে কিছুই বলিনি।আপনি কেনো আমায় এতো ভুল বোঝেন? ”

ব্যাস!এতটুকু কথাই তার রাগার জন্য যথেষ্ট। একহাত দিয়ে গাল দুটো টিপে ধরলেন আমার।ঠোঁটের কোনে আঘাত লাগায় ব্যাথাটা দ্বিগুন বেড়ে গেলো।তাই বাধ্যহয়ে আমতাআমতা করে বললাম,

“আহ্ লাগছে!ছাড়ুন সিয়াম ভাইয়া।”

আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন উনি।কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।উঠে গিয়ে সজরে পাশে থাকা টেবিল লাত্থি দিলেন তারপর ধির পায়ে বেড়িয়ে গেলেন।আমি তো অবাক, কিছুই বললোনা।কিভাবে সম্ভব? যাই হোক!চোখে আর ঘুম এলো না। নিজেকে সমানে গালি দিয়ে যাচ্ছি,কেনো আমি একটু দেখে চললাম না।উনিতো এতটা রাগ কখনোই করেনি আমার উপর।আর আমিও তো ইচ্ছে করে করিনি।যদি ওখানে ফুলের টপটা একবার দেখতাম।তাহলে হোঁচট ও খেতে হতো না আর সিয়াম ভাইয়ার শরীরে ওই কোল্ড কফিটাও পরতো না।যদি ছোটবেলার মতো আমাদের সম্পর্কটা হয়ে যেতো….
____________________________________

আমার আর সিয়াম ভাইয়ার সম্পর্কটা মটু-পাটলুর থেকেও গভীর ছিলো।এই গভীর সম্পর্কে যে এতটা খাত ধরবে তা আমি কল্পনাতেও ভাবীনি।ছোটবেলা থেকেই যে মানুষটি সিয়া নামে পাগল ছিলো সে আজ আমায়…
.
আমার যখন নয় বছর বয়স ঠিক তখন বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য চলে যায় সিয়াম ভাইয়া। আর তারপর আমাদের আর চাচ্চুর মাঝে সম্পর্ক বিভ্রাট।মূলত দাদুর কিছু ভুলের কারনেই এমনটা হয়েছিলো।অবশ্য এখন সবটা মিটমাট হয়ে গেছে।কিন্তু দূরত্ব বেড়ে গেছে হাজারো মাইল।আগের মতো এখন আমরা একসাথে আর থাকি না।উপরোক্ত ঘটনার পর বাবাকে কখনো দেখিনি একরাত এ বাড়িতে থাকতে। আসে,কিছুক্ষণ বসে,একটু গল্প করে তারপর চলে যায়।কখনো চাচ্চু কিংবা চাচি তাকে আটকাতে পারেনি।বিদেশে থাকা অবস্থায় সিয়াম ভাইয়াকে এসবের কিছুই জানানো হয়নি।সূদীর্ঘ বারো বছর পর যখন ফিরেছিলেন আমাদের বিচ্ছিন্নতার ঘটনা শুনে সিয়াম ভাইয়া সামান্য ভ্রু টাও কোঁচকায়নি।আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিলো তার গায়ে।আমাদের সাথে ঠিকমতো কথাও বলেননি তিনি।যে সিয়ার নামকরণ পর্যন্ত করেছিলো সে মানুষটি একবাও কথা বলারও চেষ্টা করেনি তার সিয়ার সাথে।ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি,

তখন সিয়াম ভাইয়ার বয়স সারে সাত বছর।আমার জন্মের কিছুদিন পর যখন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে নিয়ে এসেছিলো আমাদের আমাকে দেখেই সিয়াম ভাইয়া কোলে তুলে নিয়েছিলো।ফটাফট দু চারটে চুমু একে দিয়েছিলো মুখ ভরে।তখন থেকেই একসাথে বড় হওয়া আমাদের।সবসময় একসাথে থাকতাম দুজনে।উনি আমার নামটা তার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলেন সিয়া!অনেক ঝামেলা করছে কিন্তু নামের একটি শব্দ ও পাল্টতে দেয়নি।আমায় নাকি চোখের আড়াল হতে দিতেন না উনি।বিদেশ যাওয়ার আগে আমার হাতে একটি সাদা ধবধবে কাচের পাথর দিয়েছিলেন সিয়াম ভাইয়া।আর কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছিলেন,

-এই পাথরটা তোকে এর সূন্দর্যতা দেখে দিচ্ছি না,এটা আমাদের সৃতি হিসেবে দিচ্ছি!ওখান থেকে এসে আমি এটা তোর কাছ থেকে নেবো।যত্ন করে রাখিস।আর নিজের খেয়াল রাখিস!

তার কথায় বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিলো। নিজেকে যথাসম্ভব আটকাতে চেয়েও পারিনি।চিৎকার করে কেদেঁ উঠি আমি।আমাকে সামাল না দিয়েই পেছন ঘুরে অতিদ্রুত চলে যান উনি।সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম চাচি বাবা কেউই সামলাতে পারেনি আমায়।

পুরো বারোটা বছর নিজের কাছে আগলে রেখেছি সেই পাথরটি।এখনো আছে! তেবে দেখানোর মতো সেই সিয়াম আর সিয়াম নেই।সিয়ার নামে পাগল নন আজ তিনি।বারোটা বছরে যার জন্য অপেক্ষা করলাম সেই আমায় উপেক্ষা করলো!
একদম সুদর্ষন একটি যুবক হয়ে ফিরেছিলেন তিনি।প্রথম দেখাতেই আমার সম্পূর্ণ একটি অচেনা মানুষ মনে হয়েছিলো তাকে।একদম বিদেশি একটি ছেলে।তখনো অবাক হইনি অমি, অবাক তো হয়েছিলাম যখন তিনি আমায় না চেনার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন। আর সেদিন থেকেই আমার এই প্রচেষ্টা! তবে পরিনি!
:
:
সকালে কারো হাতের ছোঁয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেলো।চোখ মেলে তাকাতেই মাকে দেখলাম।মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।আমার কিছু বলার আগেই মা বললো,

-আমি সবটা শুনেছি!এ নিয়ে মন খারাপ করিস না।আর এতে তোরো তো দোষ আছে।এতো অপমান করার পরও তুই ওর পিছন ছারিস নি।

-সিয়া!

কারো ডাকার আওয়াজে দরজার দিকে তাকালাম।বিষন্ন মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন চাচি।কোনো রকম রিয়েক্ট করলাম না।চাচির হাতে খাবারের প্লেট।এগিয়ে এসে বললেন,

-আমার কল্পনার ও বাইরে ছিলো যে সিয়াম এরকম করবে।ও যে….

-থাক না চাচি! এতে সিয়াম ভাইয়ার কোনো দোষ নেই। আমারই দেখে চলা উচিত ছিলো।আচ্ছা এসব বাদ দাও কখন এলে তোমরা?

চাচী উত্তর দিলো,

-ভোরে এসেছি! তুই ফ্রেশ হয়ে তারাতাড়ি খেয়ে নে।উঠতে পারবি তো?

চাচির কথায় একটু উঠার চেষ্টা করলাম।একটু পর সার্থক ও হলাম। রাতে ঔষধ খেয়ে এখন একটু বেটার ফিল করছি।ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখি চাচ্চুও হাজির।সবাই গল্প করছে।ধির পায়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে বেডে গিয়ে বসতেই চাচ্চু বললেন,

-এখন কেমন আছিস সিয়া?

-হুম…অনেকটা ভালো চাচ্চু!

-নে এবার তারাতাড়ি খাবারটা শেষ কর তারপর তোর ঔষধ আছে।

চাচি কথাটা বললেন।আমি মার দিকে করুন কন্ঠে বললাম,

-মা আমরা কখন বাড়ি যাবো?

কথাটা শুনেই চাচি ও চাচ্চু আমার দিকে তাকালো।তাদের চোখের কোনো ভাষাই আমি পড়তে পারলাম না।কোনো রিয়েক্ট ও করলেন না তারা।

-যাবো তুই একটু সুস্থ হ তারপড় না হয়…

-না মা আর নয়! তোমরা কিছু মনে করো না গো চাচ্চু।আমি এখানে থাকতে চাইছি না। কেমন দমবন্ধ লাগছে আমার।আমি বাড়ি যেতে চাই।

-হুম.যাবি তো নিষ্চয়ই যাবি।কিন্তু তোকে তো আগে সুস্থ হতে হবে।একটু সুস্থ হলেই না হয় তুই চলে যাস।
:
:
:
পরপর দুদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে এ বাড়িতে থাকলাম।এখন অনেকটাই সুস্থ আমি।এ দুদিনে একবারও দেখা হয়নি সিয়াম ভাইয়ার সাথে।চলে যাওয়ার আগে চাচ্চু আমায় মাঝেমাঝে এখানে আসতে বলেছে।কিন্তু আমি আর কিসের জন্য আসবো?কি লক্ষ্যে আসবো?সব শেষ!যানিনা এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো!

#চলবে…

সাঝের বাতি পর্ব-০১

0

সাঝের_বাতি
#Sajid_Hasan
#পর্ব_১

একের পর এক লাঠির আঘাতে রক্তিম লাল দাগ ফুটে উঠছে শরীরে।ব্যাথায় চিৎকার করছি আমি।ক্রমশ বেড়েই চলেছে সেই দাগ।দুচোখ দিয়ে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে।এ এমন বৃষ্টি থামার নাম নেই। আমার আর্তনাদে দোতলা বাড়ীটি দ্বিতীয়বার প্রতিশব্দ করে জানিয়ে সাক্ষী হয়ে থাকতে চাইছে।ব্যাথা!ব্যাথা তো আমার বুকে হচ্ছে,রক্তক্ষরন হচ্ছে সেথায়।সে ব্যাথার কাছে শরীরের ব্যাথা তুচ্ছ।কখনই আশা করিনি নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার! তার জ্বলন্ত রাগ আমায় ভস্ম করে দিচ্ছে।ক্রমশ অবস হয়ে আসছে হাত পা।নড়ানোর শক্তিটুকুও হাড়িয়ে ফেলেছি।অনেক আকুতি মিনুতি করেও কোনো লাভ হয়নি।এত দিনের সমস্ত রাগ আজ মেটাবে সে।আমার ভালোবাসা তার কছে যে কোনো দাম নেই তা সে আজ হারে হারে টের পাইয়ে দিচ্ছে।এত ব্যাথার মাঝেও তার বিরবির করে বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম ,

-আরও করবি!খুব সখ না তোর ভালোবাসার।নে প্রান ভরে ভালোবাসা নে।

তার এসব কথায় বুকটা ছিরে যাচ্ছে।আর তার এই কথাগুলো আরও কয়েকগুণ ব্যাথাকে বাড়িয়ে তুলছে।এত আর্তনাত, এত চিৎকার কোনো কিছুই গলাতে পারছে না তার মন, থামছে না সে,ক্রমশ মোটা বেতের লাঠির আঘাত বেড়েই চলেছে।বন্ধ ঘরটায় আজই বোধহয় শেষ দিন আমার।এতটুকুও আলোর ছোয়া নেই দোতলার পশ্চিমের ঘরটায়।
মনে মনে এসব ভাবছি আর ব্যাথায় কোকাচ্ছি। আমার ভাবনায় বাধ ভেঙে দরজাটা বারবার কেউ সজরে ঠেলছে।দরজার ওপার থেকে একজন মধ্যবয়ষ্ক লোকের আওয়াজ ভেসে আসছে।তার আওয়াজে একটু স্তব্ধ হয় সিয়াম ভাইয়া।ঘেমে নেয়ে গেছে,সিলকি চুলগলো অগছালো হয়ে চারিদিকে ছরিয়ে পড়েছে।জোরা কান দুটো খারা করে শোনার চেষ্টা করে ভেসে আসা কথা গুলো।

-সিয়াম শুনতে পাচ্ছিস!দরজা খোল,কিরে?সিয়াম!

কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই আমার দিকে একপা এগিয়ে আসেন সিয়াম ভাইয়া। মোটা বেতের ডগা থুতনিতে লাগিয়ে আলতো উচুঁ করে মাথাটি।একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে ওঠে,

-আজকের পর আমার ধারের কাছেও আসার চেষ্টা করবি না।আর যদি আসিস এর থেকেও কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে তোর জন্য।তোকে হাজার বার বলেছি তোকে ভালোবাসি না আমি!আমারি ভুল! তোকে আগেই শাস্তি দেয়া উচিৎ ছিলো।যাই হোক..মাইন্ড ইট!

কথাটা বলেই মেঝেতে ছুরে মারে লাঠিটা। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছি আমি।একটু পর হালকা আলোর রশ্মি মুখে এসে পরতেই চোখ খুলি,সিয়াম ভাইয়া দরজা খুলেছে!দরজায় এতক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করা লোকটা আর কেউ নয় চাচ্চু অর্থাৎ সিয়াম ভাইয়ার বাবা।চাচ্চুর মখটা বিষন্ন। একপলক সিয়ামের দিকে তাকিয়ে একদৌরে দৌড়ে ঘরে ডোকে চাচ্চু।আমায় অবস্থা দেখে একপ্রকার অবাকের শীর্ষে পৌঁছে যান উনি।পুরো গায়ে রক্তিম লাল দাগ,ফুলে উঠেছে পুরো শরীর, কপালের কোনে রক্ত জমাট বেধে আছে,ঠোঁটের কোনে দিয়ে অঝোরে রক্ত পড়ছে।ঝাপসা আলোয় পুরো স্পষ্ট। আমার এমন অবস্থা দেখে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দেয় চাচ্চু।তরিঘিরি ফোন দেয় ডাক্তারকে।খুব এমারজেন্সি বলে তারাতাড়ি আসতে বলে ফোন কেটে দেয়।
.
ঝড়ের গতিতে হেঁটে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দেয় সিয়াম।রাগে চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে রয়েছে।বেলকনির রেলিং শক্ত হাতে খিচে ধরে সিয়াম।চুল বেঁয়ে নেমে আসছে বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা।রেলিংটাকে আরও খিচে ধরলো সিয়াম।যেনো রেলিং এর উপরই রাগ তার।এবার বেলকনিতে থাকা ছোট্ট টি টেবিলের চেয়ারে বসে পরে সিয়াম।

-কত সাহস!ওর সাহস কি করে হয় আমাকে ধাক্কা দেয়ার আর ওই কোল্ড কফি…ওহ্! ও কি জানে না আমার ঠান্ডায় ফোবিয়া আছে?জানে!..কিন্তু ইচ্ছে করেই আজ এটা করলো আমার সাথে।দুটো বছর ধরে সিয়ার ওই এক ঘ্যানঘ্যানানি,আমি আপনাকে ভালোবাসি সিয়াম ভাইয়া ‘ ভালোবাসি আপনাকে ‘ একটু বুঝুন,হাপিয়ে উঠেছি আমি!এত অপমান,কতোকগুলো থাপ্পড়! কোনো কিছুই কাজে লাগেনি।বেহায়া মেয়ে একটা।

রাগী কন্ঠে একপ্রকার চিৎকার করেই কথাটা বললো সিয়াম।হেলিয়ে দিলো নিজের পীট চেয়ারে।চোখ বুজতেই ঘুমে চোখ লেগে এলো তার।অতিদ্রুত গভীর ঘুমে অচ্ছন্ন হয়ে যায় সিয়াম।
.
-তোর খুব ব্যাথা করছে না সিয়া।আমি জানি রে মা,তুই অনেক ভালোবাসিস সিয়ামকে।কিন্তু কষ্ট একটাই তোর ভালোবাসার মর্যাদা সে কখনোই দিতে পারবেনা।সে হয়তো কখনোই তোর ভালোবাসার যোগ্য মানুষই নয়।দেখিস তোর জন্য এক রাজপুত্র আসবে।অনেক ভালোবাসবে তোকে।তুই চিন্তা করিস না,শাস্তি ও পাবে,সিয়ামকে তার যোগ্য শাস্তি আমি দিবো।নিজের সন্তান বলতেও লজ্জা করছে আমার।কতটা নিষ্টুর মনের মানুষ হলে এরকম টা করতে পারে।কুলাঙ্গার ছেলে একটা..ছি..!

– ন..না চাচ্চু,তুমি ভুল বুঝ..ছো সিয়াম ভাইয়াকে।আমারি তো ভু.ভুল….

-থাক! তোকে আর ওর হয়ে সাফাই গাইতে হবে না।কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার এসে যাবে।এরকম শরীর নিয়ে তোকে আর কথা বলতে হবে না

-সা.সাফাই নয় গো চা..চাচ্চু! এতে ভাইয়ার কোনো দোষ নেই।তুমি গিয়ে একবা..র তাকে দেখে এসো ওনার ওই ঠান্ডা..

-চুপ কর! তুই এখনো ওকে নিয়ে ভাবছিস?ও তোকে এতটা কষ্ট দিলো আর তুই?

আর কথা এগোলো না কিছুক্ষণ নিরবতা কটার পর দরজায় কেউ নক্ করলো। আলতো ঘার ঘুরে তাকাতেই একজন সুর্দশন যুবক চোখে পরলো।ব্লাক কালারের প্যান্ট,সাদা টি-শার্ট, ফুল সেভ করা সুর্দশন লোকটা কিছু বলার আগেই চাচ্চু তার দিকে এগিয়ে গেলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করেই বলে উঠলো-

-এসো আকাশ! আসলে অসময়ে ডাকার জন্য দুঃখিত।

এরপর চাচ্চু তাকে আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটানা বিস্তারিত বললো।তিনি আমায় অনেকক্ষন যাবত পরীক্ষা – নিকিক্ষা করে বললেন-

-আঙ্কেল সিয়াম কি পাগল হয়ে গিয়েছে?কি করে পারলো এরকম নিকৃষ্ট হতে?কিভাবে মেরেছে মেয়েটাকে।আমি কিছু ওষুধ ও কিছু জেল লিখে দিচ্ছি,ইমিডিয়েট সেগুলো আনিয়ে নেবেন।আর ওর দু তিন দিন টোটালি রেস্ট প্রয়োজন। একদম বিছানা থেকে ওঠা যাবে না।

কিহ্!দু..তিন দিন আমি তো এখানে এক মূহুর্ত থাকতে চাই না।আর সেখানে দু তিন দিন বিছানা থেকেই ওঠা যাবে না।আজ আমার কাছে তো সবটাই স্পষ্ট। এতদিন ভেবেছিলাম উনি হয়তো কোনো একদিন আমাকে বুঝবে। আমায় ভালোবেসে কাছে টেনে নেবে।কিন্তু আজ সে আমার সমস্ত সপ্ন ভেঙে বুঝিয়ে দিয়েছে কতটা ঘৃণা আমার জন্য পুশে রেখেছেন তিনি,সামন্য ভালোবাসা জন্ম নেয়নি এতোদিনে।বৃথা চেষ্টা করে গেছি এতদিন।কিন্তু আর না,আর নয় বৃথা চেষ্টা।আমি আর এক মূহুর্ত আপনার জিবনে থাকতে চাই না।অনেক দুরে যেতে চাই আমি,যেখানে আর কোনোদিন আপনার সাথে দেখা হবে না।আপনি তো আমার জন্য অতিষ্ট! তবে আজ থেকে আর আপনাকে এই সিয়া অতিষ্ঠ করবে না। আপনার পেছন পেছন ঘুরবে না,বারবার বলবো না আপনাকে ভালোবাসি।যথাসম্ভব চেষ্টা করব এ বাড়িতে না আসার।
ভাবনার মাঝেই বুকের ভেতরে কেউ করাঘাত করছিলো।বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস।চারিদিকে একবার তাকালাম কেউ নেই।চাচ্চু আর ডাক্তারবাবুর বাইরে থেকে কথা বলার আওয়াজ আসছে।বুঝলাম তারা কি ব্যাপারে কথা বলছে।একটু পর চাচ্চু খাবার ও ঔষধ নিয়ে এলো।না চাইতেও খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিলাম কারন যত তারাতাড়ি সুস্থ হবো তত তারাতাড়ি চলে যেতে পারবো এখান থেকে।
.
ঘুমের ঘোরে কারো সজরে থাপ্পরে হকচকিয়ে উটলো সিয়াম।গালে হাত দিয়ে মাথা বেকিয়ে নিচু করে আছে সে।সামনে তাকানো আগেই আরো একটা থাপ্পড় দিলো ইবনান শেখ।

-আব্বু!আব্বু তুমি?..

-চুপ একদম চুপ!তুই আমায় একদম আব্বু বলবি না।যে ছেলের মধ্যে সামান্ন মনুষ্যত্ব নেই তাকে আমি আমার ছেলে বলেই মানি না।

-…………………. ”

-তোর লজ্জা করছে না ওইটুকু মেয়ের সাথে এতটা খারাপ আচরন করতে।কি দোষ করেছিলো ও?সামান্য কারনে মেয়েটাকে এভাবে মারলি?এতদিনে তো কম কষ্ট দিসনি মেয়েটাকে।কাউকে ভালোবাসা তো অন্যায় কিছু নয়।অথচ প্রতিবারই যখন মেয়েটা তোর কাছে ভালোবাসার প্রস্তাব নিয়ে গেছে তুই তাকে তার বদৌলতে বুকভরা কষ্ট আর বেদনা দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিস।এমন একটাও তুই উদাহারন দিতে পারবি না যে তাকে কতকগুলো থাপ্পড় আর অপমান ছারা কিছু দিয়ে ফেরাসনি।তবুও মেয়েটা এক সপ্তাহ তোকে না দেখে থাকতে পারতো না,এত অপমান এত কষ্ট তার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ।…

-তুমি এতে আমার দোষ দেখছো?ও অপরাধ করেছে তাই আমি ওকে শাস্তি দিয়েছি।আচ্ছা ও কি জানতো না যে ঠান্ডায় আমার ফোবিয়া হয় আর আমায় ও ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিয়েছে।সব ও আমার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। সবটা ইচ্ছাকৃত করা ওর।এখানে আমার দোষ কোথায়?”

-ও কিছুই ইচ্ছে করে করেনি। আর তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস ঘটনাস্থলে আমিও ছিলাম।সবটা আমি নিজে দেখেছি।তুই ওকে মারার আগে একবার আমাদের মানসম্মান এর কথা ভেবে দেখলি না।কাল যখন সিয়ার মা আসবে তখন কি করে মুখ দেখাবো আমি?সিয়ার কষ্ট,সিয়ার ভালোবাসা তো তুই কোনোদিনই দেখিসনি আর আজও দেখবি না সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু তুই আজ তোর পরিবারের কথাও ভাবিসনি।আমাদের মাথা হেট করে দিয়েছিস।ছিহ্!তোকে আমার ছেলে বলতে লজ্জা হচ্ছে।

কথাটা বলে হনহনিয়ে রুম ত্যাগ করলেন ইবনান শেখ।রাগ ও কষ্ট ঘিরে ধরলো সিয়ামকে।যে বাবা তার সাথে কোনোদিন রাগী কন্ঠে কথা বলেনি আজ সে বাবা তাকে মারলো এমনকি ছেলে বলতে লজ্জা করছে তার।সব দোষ ওই সিয়ার! আজ ওর জন্যই আব্বু আমার সাথে এরকম আচরন করলো। সিয়াকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে,আমার আব্বুকে ক্ষেপিয়ে ওই নিষ্চই তুলেছে।খুব,খুব শিগ্রয়ই শাস্তি পাবি তুই সিয়া!খুব শিগ্রয়ই।
.
রাত এগারোটা ছুই ছুই। ঘুম নেই চোখে একধ্যানে ভেবে চলেছি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো।মন ভেঙে গেছে আজ তবে আর আশা নেই সিয়াম ভাইয়ার প্রতি। জানি অনেক কষ্ট হবে আপনাকে ভুলতে হয়তো ভুলতেই পারবো না কোনোদিন তবে আর আপনার মুখোমুখি কোনো দিন হবো না।আমি যে এখনো ছোট সেটা আমিও জানি তবে ওতটাও তো ছোট নই সিয়াম ভাইয়া।আবারো এক দীর্ঘ নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। অনেক চেষ্টায় রাত দুটোর পর ঘুম এলো।জেগে থাকার ইচ্ছে নেই তাই স্বোদরে গ্রহন করে নিলাম ঘুমকে।বুজিয়ে দিলাম চোখদুটো। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই গভীর ঘুমে অচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।

_________________________________

গভীর ঘুমেই কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছি রুমে।অনেক কাছ থেকে কেউ দেখছে আমায়। তার শিতল শ্বাস আছরে পরছে মুখে।ঘনঘন শ্বাস নিয়ে কেউ এক ধ্যানে দেখছে আমায়।গভীর ঘুমে আচ্ছান্ন হওয়া চোখ খুলতে পাচ্ছি না।ধিরে ধিরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে লোকটি।তার শ্বাস আরও ঘন হচ্ছে।তার নাক আমার নাকের সাথে স্পর্শ করার সাথেসাথে ঘুম ভেঙে যায় আমার।পিটপিট চোখে তাকাতেই অবাকের শীর্ষে পৌছে যাই।চিৎকার করার আগেই মুখ চেপে ধরে লোকটা। তার শিতল শ্বাস বুকের ভিতরে গিয়ে হৃদয়ে হানা দিচ্চে।তার চোখ দুটো লাল টকটকে।চেয়াল খিচে আছে তিনি।আমি কিছু বলার আগেই আস্তে আস্তে বললেন তিনি……….

#চলবে_??

শুক্লাদ্বাদশী পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#শুক্লাদ্বাদশী
অন্তিম পর্ব
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আরোশ স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গা কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। নিশ্বাস ফেলতেও ভারী কষ্ট লাগছে। ভয়ে পেটের ভেতরটা পাক দিচ্ছে৷ কাওছার ভাই কুদ্দুসের পেটে একটা লাথি মারলো। কুদ্দুস কুকিয়ে উঠে।

কাওছার এক গাদা থুথু ফেলে বলে, আরোশ দেরি করা যাবে না! আজকে শালার ব্যাটা গুলাকে জব্দ করতে হবে। এই গ্রাম থেকে জিন্দা ফেরত যেতে দিব না।

— মোট আটজন ওরা!সাথে রাইফেল,অস্ত্র সবই আছে। কিভাবে লড়াই করব আমরা?

কাওছার ভাই গম্ভীর গলায় বলে, ভুলে যাস কেন বারবার ? আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অস্ত্র না থাকলেও যুদ্ধে লড়াই করতে হবে৷

আরোশের চোখে মুখে বিষন্নতা গ্রাস করে ফেলেছে৷

কাওছার ভাই বলল, তুই যদি ভয় পাস তাইলে থাক! আমি একাই যাব৷

— ভয় পাচ্ছি একথা কে বলল? বাংলার ছেলে আমি! সহজে ভয় পাওয়া আমার স্বভাব না৷

কাওছার ভাই বলল, চল আগে দুর্গাদের বাসায় যাই। তুই পেছন দিক দিয়ে যা। আমি সামন দিয়ে যাচ্ছি।

— আচ্ছা।

— আমার কাছে রাইফেল নেই। একটা ডাব কাটা দা আছে। তোকে দিচ্ছে সঙ্গে রাখ৷

— আচ্ছা।

কাওছার ভাই ঘর থেকে দা বের করে দিলে আরোশ আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না।দৌড় লাগালো। হাত-পা ভীষণ রকমের কাঁপছে তার! দুর্গা ঠিক আছে তো! দুর্গা আর সুদীপ মল্লিকের কিছু হলে সে কিভাবে সহ্য করবে? এ’কটা দিনে তাদের প্রতি যে আরোশের মায়া জন্মে গেছে তা খুব করে টের পাচ্ছে সে। চোখের কার্ণিশে যে জল এসে চিকচিক করছে তা অনুভব করছে সে। দু সপ্তাহের কম তাদের সঙ্গে ছিল এতেই এতো মায়া জন্মে গেল?

আচ্ছা! মায়া জন্মানো সহজ নাকি মায়া কাটানো সহজ?

আরোশ এক নিশ্বাসে দৌড়ে দুর্গাদের বাসার পেছন দিকে এসে থামলো। হাঁপাচ্ছে সে।কলপাড়ের দিকটাই পেছনের দিক। এইদিকটায় কেবল আরোশের কোমড় সমান একটা দেয়াল দিয়ে বাঁধাই করা। যা সহজেই টপকে ওই পাড়ে নামা যায়। আরোশ বিড়ালের মতো পা ফেলে দেয়াল টপকালো।দেয়াল টপকে নিচে নেমেই কলপাড়ের এক ভাগের তিন অংশ তার নজরে এলো। সে ধীর পায়ে কলপাড়ে এগুতে লাগে। আশেপাশে অতিরিক্ত নিরবতা যে-টা কিনা আরোশের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। দোয়া শুধু একটাই দুর্গা আর সুদীপ মল্লিক যেন সুরক্ষিত থাকে। দরকার হলে নিজের জান বাঁজি রেখে তাদের রক্ষা করবে আরোশ।

সুদীপ মল্লিকের মধ্যে নিজের বাবার ছায়া খুঁজে পেয়েছিল আরোশ। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, আরোশের বাবা সুশিক্ষিত একজন লোক ছিলো এদিকে সুদীপ মল্লিক অশিক্ষিত গ্রামের এক লোক। তাদের ধর্ম আলাদা।,বর্ণ আলাদা, পরিবেশ ভিন্ন, সবকিছুতেই অমিল তারপর ও আরোশ সুদীপের সঙ্গে বাবার মিল পেত?

আচ্ছা! ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের ঊর্ধ্বে কি পিতা? অবশ্যই! পৃথিবীর সব বাবাই কি এক? তাদের ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিও কি একই রকম?

কলপাড়ে যেতেই আরোশের চক্ষু কপালে উঠে আসলো। দুর্গা গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আরোশ আস্তে করে ডাক দেয়, দুর্গা!

দুর্গা ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে তাকিয়ে নিয়ে জোড়ে বলে উঠে, কে?

আরোশ তার সামনে এসে দাড়ালো এবং ফিসফিস করে বলে, আস্তে কথা বলো।

দুর্গা মাস্টারমশাইকে যেন জানে প্রাণ ফিরে পেল। সে।হড়বড় করে বলে উঠে, বাসায় মিলিটারি বাহিনী এসেছে। বাবা আমাকে এদিকে লুকিয়ে রেখে দরজা আটকে দিয়েছে৷ আপনি আমার বাবাকে বাঁচান মাস্টারমশাই!

বলে আহাজারি করে কান্না ধরলো এবং তাকে জড়িয়ে ধরে। আরোশ আশেপাশে তাকিয়ে আস্তে করে বলে, ওরা কতজন?

দুর্গা বলল,অনেকজন। মাস্টারমশাই দোহাই লাগে আমার বাবাকে বাঁচান।

তখনি বাসার ভেতর থেকে দুইবার গুলির শব্দ হলো। গুলির শব্দে কাকেরাও কাকা করে উঠে। গাছে বসে থাকা পাখিগুলোও কিচিরমিচির করে ডানা ঝাপ্টাতে লাগে৷

দুর্গার শরীর অবস হয়ে আসলো। সে বাবা বলে চিৎকার করতে গেলে আরোশ তার মুখ চেপে ধরে।

দুর্গার চোখ ভিজে উঠে। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো আরোশের কাছ থেকে। আরোশ তাকে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে। সে জানে, ছেড়ে দিলেই দুর্গা নিজের বাবার কাছে ছুটে যাবে আর তখনি পাক বাহিনী তাকে ধরে ফেলে হয় মেরে ফেলবে কিংবা ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করবে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার।
ভেতর থেকে পরিচিত কন্ঠস্বরে গোঙ্গানীর শব্দ ভেসে আসে। আরোশের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আরেকজন বাবা মারা গেল! কিন্তু সে অসহায়। কেন এতো অসহায় বাঙালী?কেন নিজের সঙ্গে অবিচার হওয়া সত্ত্বেও পালিয়ে যায়? কেন কিছু সংখ্যক মানুষ নিজের গাঁওয়ের মানুষকে হত্যা করার জন্য পাকদের রাস্তা চিনিয়ে আনছে? কিছু পরিমাণ টাকার জন্য? ছিঃ!

দুর্গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কানে বাবার গোঙ্গানী শোনা মাত্র তার সমস্ত ইন্দ্রীয় অচল হয়ে গেছে। কান্নারা দলা পাকিয়ে এসে থেমে যাচ্ছে। অশ্রুরা বর্ষণের ন্যায় ঝড়তে পারছে না! চোখেই আটকা পড়ছে।

আরোশ তাকে এক ঝটকায় টেনে বাইরে নিয়ে এলো। দুর্গাকে নিয়ে দেয়াল টপকাতে তার বেগ পেতে হয়েছে তবুও অবশেষে ঝোড়-ঝাড়ে এসে থামলো সে।

দুর্গাকে ছাড়া মাত্র সে পাগলের ন্যায় কান্না জুড়ে দিলো। বাবা বলে দু’বার হাক ছেড়ে ডাকলো প্রতিউত্তরে কেউ ” কি রে মা” বলে আওয়াজ দিলো না।

দুর্গা হাটু গেড়ে বসে কান্না করতে লাগলো। সে মাটির ঘাস টেনে টেনে উপচে ফেলছে। প্রচন্ড কাঁপছে সে।

আচমকা আরোশ ডাব কাটা দা বের করলো। দুর্গা চমকে উঠে দূরে সরে যায়।

সে বলে উঠে, এখান থেকে কোথায় যাবে না। আমি আসছি দূর্গা। তোমার বাবা, আমার বাবার উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েই আমি ফিরব।

দুর্গা অবিশ্বাস্য চাউনীতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে, আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? আপনার হাতে দা কেন? আপনি কুদ্দুস ভাইয়ের বাসার সামনে কি করছিলেন? আপনি কি রাজাকার?

আরোশ পিলে চমকে উঠে বলে, মায়ের সঙ্গে বেঈমানী করার মতো রুচিহীন না আমি৷

— তাহলে কে আপনি? আপনার পরিচয় কি?

আরোশ কম্পন ধরানো স্বরে বলে উঠে,
আমার প্রথম পরিচয় আমি মানুষ।
আমার দ্বিতীয় পরিচয় আমি মুসলিম।
এবং আমার তৃতীয় পরিচয় আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

দুর্গার গা বেয়ে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। সে এতোই অবাক যে মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারলো না৷

আরোশ দৌঁড়াতে লাগলো এতোগুলো সেনার সঙ্গে তারা দুইজন সরাসরি পারবে না। কাওছার ভাইকে থামাতে হবে। নাহলে সর্বনাশ অপেক্ষা করছে তার জন্য।

___________________

— আসসালামু আলাইকুম জনাব৷

পাকিস্তানি আর্মির আটজন যখন সুদীপ মল্লিকের বাসায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে বের হলো তখনি কেউ তাদের সালাম দিয়ে উঠলো। তারা বেশ বিরক্ত। কথা ছিল কুদ্দুস সঙ্গে সঙ্গে থাকবে কিন্তু ব্যাটা লাপাত্তা।

তাদের মধ্যে কেউ একজন সালামের উত্তর দিয়ে বলে, তোম কওন হো ছোকড়া?

যুবকটা বলে উঠে, স্যার, আমি কুদ্দুসের ভাই। হুট করে ওর জ্বর এসেছে তাই আসতে পারেনি জন্য আমাকে পাঠিয়েছে৷

পাকিস্তানি আর্মির একজন বলে, তোম কুদ্দুসকে কে ভাই হো?

— জি জনাব।

পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকজন সামনে এলো। বেশ লম্বা সে। গটগট করে বাংলায় বলে।,কুদ্দুস ব্যাটা আসে নাই কেন?

— ও অসুস্থ। আমাকে পাঠিয়েছে৷

উনি সরু চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি কে? নাম কি তোমার?

— জি স্যার আমার নাম আরোশ।

— আরোশ?

— জি।

— আরোশ মানে কি?

— আল্লাহর সিংহাসন।

— মুসলিম?

আরোশ হেসে জবাব দিয়ে বলে, মুসলিম জন্য ই তো চাই পাকিস্তান যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ হোক।

পাকসেনার মুখে হাসি ফুটে উঠে। আরোশ জানত তারা এই জবাবে সন্তষ্ট হবে।

একজন বলে উঠে, চল,গ্রামের অন্যন্যা হিন্দুদের বাসায় নিয়ে চলো।

আরোশ বলে উঠে, জনাব একটা সমস্যা আছে৷

কি সমস্যা?

— আসলে আমাদের গ্রামের পুকুর ঘাটের দিকের আইলটা খুব সরু। দুইজন তিনজন ছাড়া যাওয়া যায় না। তার উপর আজকে কাদা কাদা।

— সমস্যা নাই চলো।

আরোশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল এবং বলল, একবারে এতো জন একসাথে গেলে গ্রামবাসী বুঝে গেলে আপনাদের জন্য বিপদ হবে। এরচেয়ে দুইজন করে আইল পার হোন।

— আচ্ছা যেমনটা তোমার ঠিক লাগে।

— আপনারা ছয়জন এখানে অপেক্ষা করুন। আমি প্রথমে দুইজনকে নিয়ে আইল পার করাচ্ছি।

আরোশ দুইজন পাকসেনা নিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো।

বেশ কিছুক্ষন হেঁটে হেঁটে সে পুকুরের সামনে এসে দাড়ালো। পুকুরের পাশেই ধান ক্ষেত এবং ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে চিকন সরু পথ যাকে আইল বলে। ধান ক্ষেত পাড় হলেই ওদিকে চারটা হিন্দু বাড়ি আছে এই বলে পাকসেনা দুটোকে আগে আগে যেতে দিয়ে নিজে পেছনে থাকলো আরোশ।

পরিকল্পনা অনুয়ায়ী ঠিক মাঝে গিয়ে কাওছার হামলা করবে সঙ্গে গ্রামের তিনজন ছেলেও আছে। আর পেছনে তো আরোশ দা হাতে দাঁড়িয়ে আছেই।

পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মাঝ বরাবর আসতেই কাওছার ভাই পাক বাহিনীর মাথায় আঘাত করে এবং দ্বিতীয় জন কিছু বোঝার আগেই আরোশ দা দিয়ে তার কাধে আঘাত করলো। দুইজনই রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে৷

আরোশ সময় নষ্ট না করে নিজের শরীর থেকে রক্ত মুছে আবারো উলটো পথে রওনা হলো। প্রচন্ড উত্তেজিত সে। প্রতিটা নার্ভেই শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার৷ তরতর করে।ঘামছে সে।

দুর্গার বাসার সামনে পৌঁছে আবারো দুইজন পাকসেনা নিয়ে বের হয়ে আইলের মাঝে আসলে ঠিক আগের মতোন হামলা করা হয় তাদের উপর। পরিকল্পনা অনুয়ায়ী সবকিছু হচ্ছে জন্য সবাই স্বস্তি পাচ্ছে।

কাওছার ভাইকে একদম ঠিক সময়ে গিয়ে থামিয়েছিল আরোশ। কাওছার দুর্গার বাসায় ঢুকতে যাবে তার আগেই আরোশ তাকে বাঁধা দিয়ে সরিয়ে এনে এই পরিকল্পনা তৈরি করে।

তৃতীয়বার আর পরিকল্পনা মাফিক কিছু ই হলোনা। পাকিস্তানি বাহিনীর চারজনই একসাথে যাবে। তাদের নাকি অপেক্ষা করে সময় বরবাদ করার ইচ্ছা নেই আর।

আরোশ মহাবিপদে পড়ে গেল। দুরুদুরু বুকে হাঁটা ধরলো সে।

আইলের সামনে এসে এদিক-ওদিক তাকালো। কিভাবে বার্তা পাঠাবে কাওছার ভাইকে? সামনে ঘোর বিপদ! অন্য কোথায় নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এরচেয়ে আইলের মাঝে গিয়ে হামলা চালানোই শ্রেয়।

আইলের মাঝে আসতেই কাওছার ভাই জয় বাংলা বলে প্রথম জনকে আঘাত করে। আরোশ চতুর্থ জনকে পেছন দিয়ে আঘাত করে।

চারজন পাকসেনাকে দেখে কাওছার ঘাবড়ে গিয়ে মহা মূল্যবান সাত সেকেন্ড অপচয় করে যার জন্য তাকে ভর্তুকি পোহাতে হয়। দ্বিতীয়জন তাদের কিছু করতে না পারলেও তৃতীয় পাক সেনা বন্দুক বের করে আরোশের কাধে গুলি করে।

আরোশ সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বাকি তিনজন গ্রামের ছেলের মধ্যে একজন শফিক ছিল। সে সুযোগ বুঝে পেছন থেকে তৃতীয় সেনা ও দ্বিতীয় সেনার মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত করে।

এভাবেই বাংলার ছেলেরা নিজেদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে নিজের গ্রামের সরল মানুয়গুলোকে দানবদের হাত থেকে রক্ষা করে।

________________

গুলির আঘাতে প্রচন্ড জ্বর আসে আরোশের। তিন দিন সে প্রায় অজ্ঞান থাকে। যখন জ্ঞান ফিরলো তার, সে কাওছার ভাইয়ের বাসায় ছিলো।

আরোশ উঠে দাঁড়ায়। গুলি আঘাতের ক্ষত স্থান ব্যথায় টনটন করে উঠে৷ সে সমস্ত ব্যথা উপেক্ষা করে ছুটে যায় দুর্গার বাসায়৷

সুদীপ মল্লিকের বাড়ি শূন্যতায় খাঁখাঁ করছে। বুক শুকিয়ে যায় আরোশের। দুর্গা কোথায়?

আশেপাশে চোখ বুলাতেই দেখলো উঠানে পা ছড়িয়ে বসে আছে দুর্গা।

আরোশ সামনে গিয়ে ডাক দেয়, দুর্গা?

দুর্গার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। সে যেমন ভাবে চুপ ছিল সেভাবেই চুপ আছে৷

আরোশ জানে সুদীপ মল্লিক আর নেই কিন্তু বিশ্বাস হয় না তার। মৃত্যু কি আসলেই এতো সহজ?

সে পুনরায় ডাকে, দুর্গা।

দুর্গা ভরাট কন্ঠে বলে, আপনি সুস্থ হয়েছেন?

— হ্যাঁ। তুমি কেমন আছো দুর্গা?

দুর্গা সে জবাব না দিয়ে বলে উঠে, আমাকে বিয়ে করবেন মাস্টারমশাই?

আরোশ আতকে উঠে বলে, এইসব কি বলছো তুমি? তুমি জানো না আমি মুসলিম?

দুর্গা তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠে, আমরা সবসময় ভুল মানুষটাকেই কেন ভালোবাসি মাস্টারমশাই?

— দুর্গা ঠিক আছো তুমি?

দুর্গা উত্তর না দিয়ে এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তার পরনে কালো শাড়ি। চুল এলেমেলো হয়ে মুখের চারিপাশে ছড়িয়ে আছে৷ দুর্গাকে ঠিক যেন কালিমার মতো লাগছে। শুধু কপালে লাল টিপটার অভাব বুঝি!

আরোশ চমকে উঠে। তিনদিনেই মেয়েটা এমন বদলে কেন গেল? এ কোন দুর্গা? কোথায় হারিয়ে গেল দুষ্টু চঞ্চল দুর্গা? এই দুর্গা এমন লোহার মতো শক্ত কেন?

এরপর! এরপর আরো একমাস কেটে যায়। গ্রামের সবাই জেনে যায়, আরোশ আর কাওছার মুক্তিযোদ্ধা। আবার অনেকে গ্রামে ছেড়ে আরো গহীন গ্রামে পালিয়ে যায়। রোজিনার পরিবার ও গ্রাম ছাড়লো। তাদের ইচ্ছা আছে বর্ডার অতিক্রম করে ভারত চলে যাওয়ার।

রোজিনা চলে যাওয়ার আগে দুর্গার হাত ধরে বলে, তুইও চল দুর্গা আমাদের সঙ্গে ।

দুর্গা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলে, বাবার শেষ স্মৃতি ছেড়ে কোথাও যাব না আমি৷

— এ বাসায় থেকে কি করবি একলা?

— জানি না। তুমি আমার চিন্তা করো না৷আমি ভালই থাকব।

রোজিনা দুর্গার কপালে চুমু খেল। সে জানে না এরপর আর কোন দিন দুগ্গার সঙ্গে দেখা হবে কিনা? আদৌ তারা বেঁচে থাকবে কিনা? আবারো নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে আসতে পারবে কিনা? সবকিছুতেই কেমন অনিশ্চয়তা!

এক মাসে গ্রামের কয়েকটা ছেলে মোটামুটি ট্রেনিং রপ্ত করে নেয়। আরোশকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। আপাতত চন্দনপুরে আর ভয় নেই। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী অন্যান্য বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাচ্ছে। ক্যাম্প তৈরি করছে।

চলে যাওয়ার আগের দিন দুপুরে সে দুর্গার বাসায় এসে দেখে দুর্গা ঘরে নেই। খবর পাওয়া গেল দুর্গা নাকি পুকুর ঘাটে বসে আছে৷

আরোশ পুকুর ঘাটে গিয়ে দুর্গার পাশে বসে বলে, দুর্গা আমাকে যেতে হবে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো৷

দুর্গা তার চোখে চোখ রাখলো। সে দিব্যি টের পাচ্ছে মাস্টারমশাইয়ের চোখে বিচ্ছেদের বেদনা। দুর্গা আস্তে করে বলে, আমরা কবে স্বাধীনতা জয় লাভ করব?

— খুব শীঘ্রই।

— দেশ স্বাধীন হলে আপনি ফিরবেন আমার কাছে?

আরোশ নিষ্পলকভাবে তার দিকে চেয়ে থেকে হাতে হাত রেখে বলে, কেন এমন অন্যায় আবদার করছো?

— ঈশ্বরের কাছে প্রাথনা রইল, পরের জন্মে
যেন এক তরফা ভালোবাসার মানুষটিকে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা নিয়ে পাঠায় ।

মৃদ্যু হেসে বলল কথাটা দুর্গা।

আরোশ উঠে দাঁড়ায়। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে সে কেঁদে দিবে।

যাওয়ার আগে কাঁপা গলায় আরোশ বলে উঠে, ইনশাআল্লাহ আমরা বিজয়ী হবো। তুমি নিজের খেয়াল রাখবে। মিলিয়ে নিও! আগামী পূজায় আবারো মেলা হবে। তুমি আলতা কিনতে যাবে। দেখিও সব ঠিক হয়ে যাবে। কারো ভয়ে রাত জাগতে হবে না তোমাকে।

দুর্গা স্বচ্ছ পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, প্রতি রাতে আমাদের আলিঙ্গায় এসে কেন দাঁড়িয়ে থাকেন?

দুর্গার কথায় ভড়কে যায় আরোশ। সে মিনমিন সুরে বলে, জানি না।

এরপর? এরপর আর কথা হয়নি তাদের। আরোশ সত্যি সত্যি পরদিন দুপুরে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে দুর্গার বাসার সামনে গিয়ে দাড়ায়। বুকটা তার হুহু করে উঠে। কাকতালীয় ভাবে আজো দুর্গা ভিজা কাপড়ে তার সামনে তথা উঠানে এসে দাঁড়ায়। অনুভূতিহীন শূন্য চোখে দুর্গা তার দিকে তাকালো এবং স্মিত হাসলো। সেই হাসিটা যেন আরোশের বুকে শূলের ন্যায় বিধলো।

আরোশ বলে উঠে, যাচ্ছি দুর্গা।

— যান। বিজয়ী বীর হয়ে ফিরে আসুন এই প্রার্থনা রইল।

— নিজের যত্ন নিবে।

দুর্গা চোখ মুছে বলে উঠে, পরের জন্ম সত্য হলে, আমি আপনাকে অভিশাপ দিব আপনি যেন আমার হোন ।

আরোশ কিছু বললো না। দুর্গাকে দেখে নিয়ে বের হলো। হাঁটা ধরলো সে। হেঁটে হেঁটে দুর্গার বাসার সামনে গিয়ে গরুর গাড়িতে উঠে পড়ে।

গরুর গাড়ি চলা শুরু করে দিলো। আরোশ পকেট থেকে দুর্গার কাঁচা হাতের চিঠিটা বের করে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

আমি জীবনে তিনজনকে সবচেয়ে ভালোবাসি। প্রথম জন হলো আমার রব। দ্বিতীয়জন হলো আমার দুই মা। একজন যে আমাকে গর্ভে রেখেছে আর দ্বিতীয় মা হলো আমার বাংলা মা — যার বুকে আমি শ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি। এবং আমার তৃতীয় ও সবচেয়ে মহামূল্যবান ভালোবাসা হলে তুমি দুর্গা।

আরোশের পেছনে দুটো চোখ থাকলে সে দেখতে পেত, আঠারোতে পা দেওয়া এক তরুণী তার জন্য ইতিমধ্যে অপেক্ষা করা শুরু করে দিয়েছে । তার ফেরার প্রহর গুনছে! অথচ যার জন্য অপেক্ষারত সে, তার ফেরবার কোন প্রতিশ্রুতি নেই।

দুর্গা উঠান পেরিয়ে বাসার সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দু নয়ন দিয়ে টলমল চোখে আরোশের প্রস্তান দেখছে।

তার চিৎকার করে বলতে মন চাচ্ছে,

“তোমাকে অন্য কেউ আলিঙ্গন করার আগে যেন ঈশ্বর আমার আয়ুরেখার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।”

আচমকা লেলুয়া হাওয়া বয়ে গেল। দুদিন ধরে প্রচন্ড গরম। আরোশ দুর্গার চোখের সীমানার বাইরে চলে গেলে সে ঘরে ফিরে আসে এবং চমকে যায়, কি আশ্চর্য! মাস্টারমশাইয়ের নাম জানা হলো না তো!
পরক্ষনে সে মনে মনে বলে উঠে, থাক না একটা নামহীন সম্পর্ক!

আজকে দুর্গার মাথার উপর দুটো শালিক পাখি কিচিরমিচির করে গান গেয়ে উড়াউড়ি করছে।

আচ্ছা, আদৌ কোন একদিন এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নটি শেষ হবে? দুর্গা কি আবারো সাদা ও লাল পাড়ের শাড়ি পড়ে আরতি হাতে পূজায় যেতে পারবে কোন দিন? রোজিনা আপা কি আবারো ফিরে আসবেন? আবার আগের মতোন তাকে গ্রামের খবর দিতে দৌঁড়ে আসবেন আপা কোন একদিন? আচ্ছা! কোন একদিন কি মাস্টারমশাই এসে তার সিঁথীতে সিদুর দিবে? আদৌ কি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কোন একদিন? আবারো কি বৃষ্টি নামলে গ্রামের মেয়েরা ভিজতে বের হবে কোন একদিন ?

আদৌ কি বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে জয় বাংলা ধ্বনি উউচ্চারিত হবে? কবে শেষ হবে এই ” কোন একদিনের” অপেক্ষা? কবে অবসান ঘটবে দুর্গার এই মনণ যন্ত্রণার ন্যায় অপেক্ষার?

দুর্গা দু কদম এগিয়ে এসে গম্ভীর দৃষ্টিতে মাথা উচিয়ে শালিকজোড়াকে দেখতে লাগে। সূর্যের তাপে তার মুখ লাল হয়ে এলো।

দুর্গার চোখ বেয়ে প্রায় একমাস পর দু’ফুটো অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

সমাপ্ত।

[ আসসালামু আলাইকুম। অপ্রত্যাশিত সমাপ্তির জন্য দুঃখিত পরিশেষে সকলকে ভালোবাসা অবিরাম। নিশ্চয়ই আপনাদের জন্য আগামীতে আমার তরফ থেকে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। আল্লাহ হাফেজ। ]

_______________________________

শুক্লাদ্বাদশী পর্ব-০৬

0

#শুক্লাদ্বাদশী
Part–6
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সুদীপ মল্লিক চিন্তিত হয়ে দুর্গার মাথার কাছে একটা মোড়ায় বসে আছেন। মেয়েটা জ্বরে কাঁপছে।ঠোঁট দুটোও থেকে থেকে একটু করে কাঁপছে।মুখটা মলিন হয়ে আছে।

বড়ই আহ্লাদী মেয়ে তার। মা-মরা মেয়েকে সুদীপ মল্লিক কোন দিন বকেনি। হাজারো দুষ্টমি করেও বাবার কাছে একবিন্দু বকা খায় নি দুর্গা। মেয়ে অবশ্য পড়ালেখায় ভালো কাজেই স্কুলের শিক্ষকও দুর্গাকে স্নেহ করে। জন্ম থেকে দুর্গা এই গ্রামেই বেড়ে উঠেছে। গ্রামের প্রতিটা মানুষ দুর্গার আপনজন।সবার সঙ্গে দুর্গার খাতির। জেলের বৌ থেকে শুরু করে ল্যাংরা মামা, লেজ-ফিতা বিক্রি করা লোকটাও দুর্গাকে চেনে।

আঠারো বছর বয়সী মেয়েটাকে এর আগে কোনদিন কাঁদতে দেখে নি সুদীপ মল্লিক।সবসময় হাসি-খুশি থাকে তার মা টা। জন্মদিনের দিন যে দুর্গা কেঁদেছে এটা ভাবতেই তার বাবার বুকটা হুহু করে উঠে৷ তিনি দুর্গার কপালে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। লজেন্স গুলো বিছানায় পড়ে আছে। অন্য সময় হলে দুর্গা লজেন্স খেয়ে ঠোঁট লাল করে খিলখিল করে হেসে রোজিনার বাসায় চলে যেত৷ মেয়ে অসুস্থ হলে সুদীপ মল্লিকের ভালো লাগে না। দুর্গা ঘুমাচ্ছে। রাত হয়ে আসছে। আরোশের কোন সাড়াশব্দ ও নেই। ছেলেটা যে ঘরে নেই তা ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন সুদীপ মল্লিক। কোথায় গেল ছেলেটা? আরোশের দায়িত্ব সুদীপ মল্লিককে কাওছার দিয়েছে। আরোশ তার বাসায় থাকতে আসার আগে কাওছার বারবার করে বলেছে, নিজের ছেলের মত যত্নে রাখবেন। দেশের জন্য লড়াই করছে ছেলেটা।

সেই ছেলে এখনো বাড়ি ফেরেনি। কোথায় আছে সে জানে না। রাতে খেল কিনা কে জানে?

তার কপালে চিন্তার ভাজ গাঢ় হলো।

তখনি দুর্গা উঠে বসে মৃদ্যু গলায় ডাকে, বাবা?
সুদীপ মল্লিক মেয়ের কন্ঠ শুনে নড়েচড়ে উঠে৷

দুর্গা উঠে বসেছে। চোখ গুলো লাল হলেও তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে সে দুঃখী। অনুভূতি গোপন করে রেখেছে বাবার কাছ থেকে।

সুদীপ মল্লিক বলল, এখন কেমন লাগছে তোর মা?

— ভালো।

–ভাত খাবি?

— হ্যাঁ। ক্ষুধা পেয়েছে। চল খেয়ে নিই।

— চল।

বাবা-মেয়ে উঠানে এসে বসলো। মন ভোলানো মাতাল হাওয়া বইছে। গা জুড়িয়ে গেল দুর্গার৷ ক্লান্তি ভাব ঘুঁচে গেল তার।

সুদীপ মল্লিক একটা থালায় ভাত আর আলু ভর্তা নিয়ে বলে উঠে, কই ভাবলাম তোর জন্মদিনে পোড়া হাঁস ভুনা আর গরম গরম ভাত খাব৷

— থাক বাবা। আজকে না। খাওয়ার রুচি নেই৷

— জ্বর এলে রুচি থাকে না। দেখি কালকে তোর জন্য সদর থেকে ঔষধ কিনে আনব৷

দুর্গা আতকে উঠে বলে, না বাবা। তুমি সদরে যাবে না ভুলেও। ওদিকে পাকসেনা টহল দেয়। আমার জ্বর সেড়ে গেছে৷

সুদীপ মল্লিক স্মিত হাসলেন। মেয়ে মিথ্যা বলে বাবাকে ভোলাচ্ছে যেন সদরে না যায়।

সে দুর্গার পাশে বসলেন এবং ভাত মাখাতে মাখাতে বলল, আচ্ছা যাব না।

এরপর দুর্গাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন। দুর্গাও সাবলীলভাবে খাচ্ছে।

সাধারণত দুর্গার বয়সী মেয়েদের সঙ্গে বাবাদের একটা অদৃশ্য দূরত্ব এসে যায়৷ কিন্তু দুর্গার বেলায় তা ব্যতিক্রম। সে বাবা ভক্ত মেয়ে।

সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে প্রশ্ন করেন, তোর মাস্টারমশাই কই রে?

দুর্গা থমকে গেল। চোখ গুলো এলোমেলো হয়ে খুঁজতে লাগলো লম্বা যুবকটাকে। কিন্তু তার জায়গাটা ফাঁকা। দুর্গা জানে না মাস্টারমশাই কোথায়। কিন্তু কলপাড় থেকে সে সোজা বাসার বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে তাদের দুজনের মধ্যে একবার চোখাচোখি হয়েছিলো। দুর্গার চোখে ছিল আকুলতা আর উনার চোখে ছিলো আগুন ঝলসানো রাগ!

সে ফোঁস করে দম ছেড়ে বলে, জানি না বাবা।

— তুই খেয়ে শুয়ে পড়। আমি ছেলেটার খোঁজে যাচ্ছি।

দুর্গা ডাগর চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, লজেন্স কই আমার?

এতোক্ষণে সুদীপ মল্লিকের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে।

সে আনন্দিত হয়ে বলে।,তোর ঘরে আছে।

দুর্গা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। বাবার গোমড়া মুখ তার একদমই পছন্দ না। সে নিজের ঘরে এসে বসলো।

বাবা চাঁদর গায়ে বাইরে বের হলেন। দুর্গা লজেন্স গুলো নেড়েচেড়ে রেখে দিলো। খাওয়ার ইচ্ছা নেই তার। লজেন্স পাশে রেখেও সে তা না খেয়ে কিভাবে বসে আছে? অন্য দিন হলে একটার পর একটা লজেন্সের প্যাকেট খুলে খেয়ে ফেলত!

★★★

আরোশ কাওছার ভাইয়ের সঙ্গে রাতের ভাত খেয়ে বাইরে বের হয়েছে। হাতে সিগারেট। দুজনের মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে। গ্রামের ছেলেদের কিভাবে ট্রেনিং দেয়া যায় সেটা নিয়ে কাওছার ভাই বেশ বিচলিত। আরোশ বলে উঠে, আপনাদের চন্দনপুর গ্রামে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে থাকেন?

— হ্যাঁ। সবাই মিলেমিশে থাকি আমরা।
বুঝলি এই গ্রাম হলো আমার দ্বিতীয় মা।

আরোশ হেসে বলে, আপনাদের সবার মাঝে অনেক মিল তাই না?

— হ্যাঁ। গ্রামের সবাই নিজের আত্মীয়ের মতো। মনেই হয় তারা পর! সবাই আপন, সবাই আমার ভাই-বোন।

— দুর্গাকেও নিজের বোন ভাবেন?

— অবশ্যই। দুগ্গা আমার সবচেয়ে আদরের ছোট্ট বোন। একটু দুষ্টু এইজন্যই বেশি স্নেহ করি।

আরোশ অদ্ভুত চোখে তাকালো তার দিকে। তখনি তাদের সামনে এসে দাড়ালো সুদীপ মল্লিক।

আরোশ বেশ বিষ্মিত হলো সুদীপ মল্লিক কে দেখে। উনি কিভাবে যেন তার হাতে থাকা সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে আছেন যার জন্য আরোশ বিব্রত হয়ে মাটিতে ফেলে দিলো সিগারেট টা।

সুদীপ মল্লিক বলে, বাবা তুমি এখনো বাসায় ফিরছো না কেন?

কাওছার ভাই বলল, আরোশ আজকে থেকে আমার সঙ্গে থাকবে কাকা৷

— সেকি কেন?

— আসলে ট্রেনিং শুরু করব আমরা। সেইজন্য কাজ করতে হবে সবাইকে। আরোশের উপর দায়িত্ব বেশি।

— ওহ।

কাওছার ভাই নিজ থেকে বলে উঠে, দুগ্গা কেমন আছে?

— আজকে মেয়েটার জন্মদিন কিন্তু দেখো কি কান্ড! মেয়েটা জ্বরে কাতরাচ্ছে।

আরোশ দুর্গার অসুস্থতার খবর শুনে পিলে চমকে উঠে। কেমন খারাপ লাগা তাকে গ্রাস করে ফেলে মূহুর্তের মধ্যে। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

কাওছার ভাই বিভিন্ন আলাপ জুড়ে দিলো সুদীপ মল্লিকের সঙ্গে। এরপর কিছুক্ষন পর উনি চলে গেলে কাওছার ভাই আরোশকে উদ্দেশ্য করে বলে, বেচারা দুগ্গা আজ অসুস্থ। তুই তো জানিস না! দুগ্গা নিজের প্রতি জন্মদিনে মায়ের শাড়ি পড়ে সেজেগুজে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দোয়া নেয়। এইবার আর তা করা হলো না মেয়েটার৷

আরোশের নিজেকে অপরাধী লাগতে লাগলো
কম বয়সী মেয়ে দুর্গা। এই বয়সে এমন আবেগ আসেই।আরোশের উচিত ছিল দুর্গাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা। তাছাড়া মেয়েটা তো তার আসল পরিচয় জানেও না। সে জানেও না আরোশ মুসলিম। বাচ্চা মেয়ে একটা ভুল করে বসেছে। কোথায় আরোশ তার ভুল শুধরে দিবে তা না করে সে কিনা দুর্গাকে শাস্তি দিল।নিজের প্রতিই রাগ লাগছে তার।

কাওছার ভাই বলে উঠে, কিছু হয়েছে?তোকে উদাসিন দেখাচ্ছে?

আরোশ জোড়পূর্বক হেসে বলে, না ভাই। সব ঠিক আছে। ঘুম পাচ্ছে খুব।

— ঘরে যাবি?

— হু।

— আয়। আমার সাথে — বলে কাওছার ভাই তাকে ঘরে নিয়ে এলো। কাওছার ভাইয়ের রুমেই আরেকটা চৌকি আছে। সেখানেই আরোশের শোয়ার ব্যবস্থা হলো।

আরোশ নিজের সমস্ত ভার বিছানায় বিলিয়ে দিলো।চোখে রাজ্যের ঘুম। কিন্তু আফসোস চোখে ঘুম থাকা সত্তেও সে ঘুমুতে পারছে না।চোখ বুজলেই দুর্গার আঁকাবাঁকা দাঁতের হাসি মাথায় কিলবিল করছে। কালকে থেকে কি সে আর দুর্গাকে পড়াবে না?

আচমকা তার মন অতিরিক্ত পরিমানে খারাপ হয়ে গেল৷ কিন্তু কেন? মন খারাপ ভাবটা কার জন্য হচ্ছে? উত্তর কি জানে আরোশ?

চলবে৷

#শুক্লাদ্বাদশী
বোনাস পার্ট
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আজকে সম্ভবত পূর্ণিমা। আকাশে বিশাল এক ফালি চাঁদ উঠেছে থালার মতো। মধ্য রাতে জেগে জেগে আকাশের ওই চাঁদটা দেখায় ব্যস্ত আরোশ। কি করবে সে?ঘুম আসছে না তাফ। চাঁদ দেখতে ভালোই লাগছে । চাঁদের আলোয় ক্লান্তি ভাব না কমলেও স্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। চোখে রাজ্যের এক গাদা ঘুম থাকলে সে টানা চার ঘন্টা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমাতে পারেনি কাজেই জানালা দিয়ে আকাশ, আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘ আর চাঁদটা দেখছে সে।

আরোশ স্মৃতিচরণ করতে লাগলো। কি সুন্দর পুতুল খেলার মতো দিন ছিলো তার। বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র ছেলে সে।ঢাকায় নিজের বাড়ি। বাবা ঢাকা ভার্সিটির প্রফেসর । সম্মান, টাকা কিছুরই অভাব ছিলো না তার জীবনে। সে নিজেও ছোট বেলা থেকে দারুণ ব্রিলিয়ান্ট তাই তো নিজের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়াও পূরিপূর্ণ হলো। যেদিন সে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তথা বুয়েটে ভর্তি হলো, বাবা কত খুশি হয়েছিলেন। খুশি হয়ে নিজের ব্যবহৃত কলমটা আরোশকে উপহার দিয়ে বলল, মে আল্লাহ ব্লেস ইউ মাই সান!

আরোশের অজান্তেই চোখ চিকচিক করে উঠলো। আরোশের মাঝে মাঝে মনেই থাকে না বাবা তার নেই!

২৫ শে মার্চ রাতের “অপারেশন সার্চ লাইট” এ দাউদাউ করে জ্বলেছিল পলাশীর বস্তি, বিদ্রোহ ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইসেন্স সঙ্গে বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। রাতের শেষ প্রহরে নিরপরাধ বাঙালীদের উপর যে অবিচারে।মৃত্যু মিছিল ঘটেছিল যার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চকে কালরাত বলা হয়, সেই রাতে আরোশের পিতাও হত্যা হন। আরোশরা তার বাবার লাশটাও পায়নি৷ কোথায় যে মাটি চাপা দিয়ে গুম করে দিলো হানাদার বাহিনীরা তা অজানাই রয়ে গেল। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায় তার বাবা ঢাকা ভার্সিটির ক্যাম্পাসে কাজে গিয়েছিলো আর ফেরেনি। আরোশ আর তার মা অপেক্ষায় ছিল তিনি আসবেন। একদিন, দুইদিন, তিনদিন গড়িয়ে আজকে কাটায় কাটায় দুই মাস হয়ে গেল, বাবা আর ফিরে এলো না। আরোশের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে।

মায়ের অবাধ্যতা করে সে যুদ্ধে নাম লেখালো। ট্রেনিং নিল। মাকে তার নানুবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সে ট্রেনিংয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। অবশেষে দুই মাস ব্যাপি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর সে গ্রেনেড হামলা করায় বেশ পটু হয়ে যায়। কিন্তু রাইফেল তেমন একটা ভালো চালাতে পারেনা।

আরোশ চোখ মুছলো। ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে এই মে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত না জানি কত মায়ের কোল খালি হলো, কত সন্তান এতিম হলো, কত নারীকে সিঁদূর বির্সজন দিতে হলো! হিসেব নেই। কেউ কি এই অত্যাচারের হিসাব রাখছে?

আরোশ ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে রজনী গুলো এতো কেন দীর্ঘময় হচ্ছে? আচ্ছা এমন কি হতে পারে না? বাবা মারা যান নি। বেঁচে পালিয়েছেন কোথায়? এমন হওয়া কি খুব অসম্ভব? জানা নেই তার৷ মাকে খুব মনে পড়ে। বারবার আকুতি করব বলছিল, যেন যুদ্ধে না যায়। আরোশ তখন নিজের মধ্যে ছিল না। এক মায়ের কথা মেনে নিয়ে তার দ্বিতীয় মায়ের অস্তিত্ব তো বিলীন হতে দেওয়া যাবে না! তাকে তো লড়তেই হবে। নিজের জন্য, তার বাবার হত্যার প্রতিশোধের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য তাকে যেতে হবে।

সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য নাকি থামে না কিন্তু আরোশের কাছে জীবন থেমে গেছে। দিন কখন হচ্ছে, কখন রাত হচ্ছে তার হিসেব রাখে না সে।আরেকটা দীর্ঘ রাত পাড় করে দিলো সে।

সকালে সে আর কাওছার ভাই গ্রামের দোকানে গেলেন। আজকে অনেকেই বের হয়েছে। অনেলে সদরে যাচ্ছে৷ কারণ দূর-দূরান্তে পাক বাহিনী নেই। সদর আর রাখাল পাড়ার পাক সেনার ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছে। এখন আর ভয় কিসের?

গ্রামের ছোট্ট চায়ের দোকানে অনেকে গল্প করছে। সব গল্প-জল্পনার মূলে হলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। তারা কোথায় লুকিয়ে আছে? সামনে আসছে না কেন? কে তারা? এইসব নানা কথা।

আরোশ চা খেতে খেতে গ্রামের মানুষের কথা শুনছে। আজকে নাকি অনেকে হাঁট বসাবে।
কাওছার উল্লাসের সঙ্গে আরোশের কানে ফিসফিস করে বলে, এরা কিন্তু তোকে নিয়েই কথা বলছে।

আরোশ কিছু বললো না। তার দৃষ্টি আটকে গেল হেলেদুলে হাঁটতে থাকা কমলা শাড়ি পড়া দুর্গার দিকে। দুর্গা এইদিকে কি করছে?

দুর্গা দোকানের সামনে এসে বলে, চাচা চিনি দাও তো এক কেজি।

দুর্গা আরোশকে দেখেও না দেখার ভান ধরলো। আরোশ যে তার পাশে দাঁড়ানো সে যেন তা দেখতেই পেল না। দুর্গার এহেন কান্ডে আরোশ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।

চিনির ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে ঘুরে দাড়াতেই আরোশ তার সামনে এসে দাড়ালো। দুর্গা ভ্রু কুচকে তাকালো।

আরোশের নিজের উপর রাগ হতে লাগে। কি দরকার ছিল দুর্গার সামনে এসে দাঁড়ানোর?

— কেমন আছো দুর্গা?

দুর্গা কিছু না বলে অন্যদিকে ফিরে তাকালো।আরোশ উত্তরের আশায় রইলো। কিন্তু দুর্গা কিছু বলল না। সে হতাশ না হলে ও কিছুটা বিব্রতবোধ করে।

দুর্গা তাকে উপেক্ষা করে বড় বড় পায়ে বাড়ি ফিরে যেতে লাগলো।

কাওছার ভাই সবটা দেখে প্রশ্ন করে, তোমার দুর্গার সাথে লেগেছে নাকি?

— না তো।

— মনে হলো দুর্গা তোমার উপর অভিমান করেছে৷

আরোশ আতকে উঠে। সেকি! দুর্গা তার উপর অভিমান কেন করবে? অভিমান করার জন্য একটা অধিকার লাগে। আরোশ সেই অধিকার দুর্গাকে দেয়নি আর কখনো দিবেও না!

সে চায়ের কাপ রেখে হাঁটা ধরলো। আজকে গ্রাম ঘুরবে সে।দুর্গার গ্রাম ঘুরে দেখবে।

চন্দনপুর আকারে খুব ছোট্ট এক গ্রাম। বিশটা বাড়ি মিলে এই গ্রাম। গ্রামের পাশ ঘেঁষে নদী চলে গেছে। সদরে যাওয়ার রাস্তা হলো এই নদী পথে নৌকা করে যাওয়া। নদীর ঘাট সোজা সদরের চৌরাস্তায় মিলেছে। এছাড়াও একটা পুকুর আছে। স্বচ্ছ সেই পুকুরের পানি।

ছোট ছোট মাটির ঘর,ঘরের উপরটা টিনের চালা দেয়া প্রায় প্রতিটা বাড়িতে।

গাছ-গাছালিতে ভরপুর গ্রামটা। চারিদিক সবুজ আর সবুজের সমাহার। গ্রামের শুরুতেই বিশাল এক বট গাছ।এই বট গাছে নাকি পেত্নি আছে। এইসব আজগুবি কথা তাকে দুর্গা শুনিয়েছে ।

আরোশ দুর্গাকে রিলেটিভিটির সুত্র বোঝাচ্ছিল, ওমনি দুর্গা বলে উঠে, জানেন মাস্টারমশাই! আমাদের গ্রামের বটতলায় পেত্নি থাকে। রোজিনা আপা দেখেছে। রাত করে পেত্নিটা সুন্দরী মেয়েদের ধরে,,,,,,

আরোশ বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বলেছিল, তুমি তো সুন্দর না কাজেই তুমি গেলে কিছু হবে না। এবার বলো– ই ইকুয়াল টু কি? দুর্গা উত্তর দিতে পারছিলো না।

আরোশ চমকে উঠে। আঁকাবাঁকা দাঁতের মেয়েটার কথা তার ক্ষণে ক্ষণে কেন মনে পড়ছে?

★★★

চারদিন কেটে গেছে। গ্রামের পরিবেশ স্বাভাবিক। সবাই আগের মতো বের হচ্ছে। দোকানে আসর পেতে আড্ডা দেয়। আরোশ ও সেই আসরে উপস্থিত থাকে। বিভিন্ন জ্ঞানী কথা বলে নিজের একটা ব্যক্তিত্ব এই চার দিনে সে তৈরি করে ফেলেছে৷

আজকে সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে জন্য বাইরে বের হয় নি। কাওছার ভাই ঘরে নেই। আরোশ একা আছে। উনি ট্রেনিং করানোর জন্য জায়গা খুঁজতে বের হয়েছে শফিককে নিয়ে। সাব্বির আর এরিক এই গ্রামে থাকছে না কাজেই তাদের সঙ্গে তেমন দেখা হয় না।

আরোশের প্রচন্ড চায়ের পিপাসা পেয়েছে৷ এমন বৃষ্টি মুখর দিনে চা ছাড়া চলে? কিন্তু বানিয়ে দিবে কে? খড়ির চুলায় চা বানানো সম্ভব না তার জন্য। দুর্গা থাকলে একটা কথা ছিল। চায়ের সঙ্গে পিঁয়াজু বানিয়ে আনত নিশ্চয়ই। আজকে সকাল থেকে দুর্গার।কথা মনে পড়ছে। বৃষ্টি হলে বুঝি দুর্গাও ময়ুরের মতো পেখম তুলে নাচে! সেদিনের দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যপট তার চোখে ভাসছে। চারদিন ধরে আরোশ কেবল দুর্গাকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছে। দুর্গার লেখা এলোমেলো অগোছনো চিঠিটাও যত্নে তুলে রেখেছে সে!

তখনিই কাওছার ভাই ফিরে এলেন। মুখটা তার মেঘের মতো কালো।

আরোশ জিজ্ঞেসে করে, ভাই কিছু হয়েছে?

কাওছার ভাই অন্যমনস্ক হয়ে বলে।,সর্বনাশ হয়েছে রে আরোশ৷

— কি হয়েছে

— সদর থেকে চারটা মেয়েকে পাক বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে।

— সেকি!

— হ্যাঁ রে।খুব চিন্তায় আছি। সদর থেকে আমদের গ্রামে আসা খুব সহজ।

— কিন্তু রাস্তা বোধহয় ওরা চেনে না।

— চেনে না কিন্তু চিনিয়ে দেয়ার লোক আছে।

— মানে?

— মানে হলো এই গ্রামে এক-দুইটা বেঈমান ও আছে। কুদ্দুস কে চিনিস? শান্তি কমিটিতে নিজের নাম লিখিয়েছে। শালার জবান ছিঁড়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কেমন হারামখোর ব্যাটা। নিজের মায়ের সঙ্গে বেঈমানী। এরা হচ্ছে জারজ।

— ভাই আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। এক কাজ করি, কুদ্দুসকে ধরে আনি৷

— ও বাসায় নাই। আরোশ তুই এক কাজ কর, ওর বাসার সামনে গিয়ে পাহাড়া দে। যেই না আসবে ব্যাটার টুটি চেপে ধরে আমার কাছে আনবি৷

— আচ্ছা।

অগত্যা আরোশ বের হয়ে কুদ্দুসের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এদিকে কেউ নেই। নিশ্চুপ চারিদিক। আরোশ দাঁড়িয়ে থেকে কুদ্দুসের অপেক্ষায় রইল। সিগারেট ধরালো সে।কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে? সূর্য তখন মাথার উপরে। দু-একটা হাঁসের প্যাক প্যাক ডাক কানে এসে বাঁধছে।

আচমকা এদিকে দুর্গা আর রোজিনা এলো। তখন দুপুর প্রায়। আজকেও দুর্গা শুধু শাড়ি পড়ে আছে। ব্লাউজ নেই পরনে। তারা কি এই পথ ধরে পুকুরে স্নান করতে যায়? রোজিনা তার দিকে সরু চোখে তাকালো এরপর দুর্গা কে নিয়ে যেই গতিতে হাঁটছিল তার চেয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো।দুর্গা একবার ও তার দিকে তাকালো না। কিন্তু আরোশের চোখ দুর্গার খোলা চুলের দিকে আটকা পড়লো! এইজন্যই হয়তোবা বলে, নিষিদ্ধ কোন কিছুর উপর আমাদের মন ও মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

দুর্গারা যখন ফিরে গেলে তখনো আরেকবার তাদের সাক্ষাৎ হলো। আরোশ এবারে হাসার চেষ্টা করলো। দুর্গার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখলো না সে।

সন্ধ্যা মেলাবার আগে কুদ্দুর মাথায় টুপি পড়ে বাড়ি ফিরতেই আরোশ তাকে ধরে ফেলে। কুদ্দুস একা এবং আক্রমনের জন্য অপ্রস্তুত ছিল কাজেই তাকে হাত করতে আরোশের সময় লাগে নি। তার মুখ বেঁধে, সন্ধ্যার নিলাভ আকাশের নিচে হেঁটে হেঁটে, কুদ্দুসকে জোড় করে কাওছার ভাইয়ের বাড়ি নিয়ে এলো। মাগরিবের আযান পড়ে গিয়েছিলো তখন৷ ঝোপঝাড় থেকে এক প্রকার লুকিয়ে আরোশ তাকে ধরে-বেঁধে এনেছে সবার চক্ষু আড়ালে।

কাওছার ভাই কুদ্দুসকে হাতের নাগালে পাওয়া মাত্র কিল-ঘুষি মারতে লাগলো।কুদ্দুস মার খেতে খেতে বার বার মাফ চাচ্ছিল। কিন্তু ভাই দমার পাত্র না। সে কুদ্দুসলে সমান তালে মারতে লাগে এবং সব কিছু প্রকাশ করার জন্য বাধ্য করে।

এরপর তারা যা শুনলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মিলিটারি বাহিনী নাকি এই গ্রামে এসেছে। বটতলায় আছে এখন। জিপ নিয়ে এসেছে। মোট পাঁচ জন এসেছে রাইফেলসহ। হিন্দুদের একটা তালিকা করিয়েছে কুদ্দুসকে দিয়ে তারা। আজকে নাকি কেবল হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালাবে৷

আরোশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কুদ্দুসের মতে, সেই তালিকায় সবার আগে সুদীপ মল্লিকের নাম!

আরোশ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে, আল্লাহ রক্ষা কর।

তার গায়ের প্রতিটা লোমকূপ খাঁড়া হয়ে গেল।

চলবে।

শুক্লাদ্বাদশী পর্ব-০৫

0

#শুক্লাদ্বাদশী
Part–5
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সকাল দশটা বাজে। সুর্যের তেজ এখনো প্রখর হয়নি। সুমিস্টি তাপ বিকিরণ করছে সূয্যিমামা। আরোশ উঠানে বসে বসে গায়ে তাপ মাখাচ্ছে। সূর্যের আলোর ভিটামিন ডি নিজের গায়ে বিনামূল্যে নিচ্ছে সে।আরোশ শহরের ছেলে। জন্ম থেকেই ঢাকায় থাকে। গ্রামে সচারাচর আসা হয়নি৷ আসলেও তিন-চার দিন থেকে বাড়ি ফিরে গেছে। এবারই প্রথম গ্রামের পরিবেশ উপভোগ করছে সে।আরোশের কাছে প্রথম প্রথম গ্রামটাকে একদমই ভালো লাগত না। কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আগে কলপাড়ে গোসল করতে বেশ বিব্রতবোধ করত৷ আজ-কাল আর করে না। অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে তৈরি করা ভর্তা খেতে কষ্ট হত। আজ-কাল সেই ঝালযুক্ত ভর্তা সুস্বাদু লাগছে৷

আরোশ উঠানে বসতেই দুর্গা হাজির হলো। আজকে দুর্গার ছুটি। সে আজকে কিছুতেই পড়বে না। আরোশ জোড়াজুড়ি করছিল পড়ানোর জন্য কিন্তু জোড় করে বিয়ে করানো লেগেও পদার্থ বিজ্ঞান পড়ানো যায়না। কাজেই না চাইতেও দুর্গাকে ছূটি দিয়েছে সে।তবে কালকের হোমওয়ার্ক চেক করবে সে।এই ব্যাপার মাফ পায়নি দুর্গা।

দুর্গা আজকে কালো রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। মেয়েটা সবসময়ই শাড়ি পড়ে থাকে।শাড়ি পড়ার জন্য মেয়েটার বয়স ছয়-সাত বছর বেশি লাগে। আজকে আবার মোটা করে কাজল দিয়েছে চোখে। চুল গুলো পরিপাটি করে বেনুনি করা। অমায়িক সৌন্দর্য তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া দায়। কিন্তু মাঝে মাঝে দায়বদ্ধতা নিয়ে কিছু কাজ করতে হয়৷ কাজেই আরোশ চোখ ফিরিয়ে নিল।

দুর্গা খাতা বের করে দিলো। তিন সাবজেক্টের হোমওয়ার্ক চেক করবে আরোশ৷

চঞ্চল দুর্গা বলে উঠে, আমি আপার বাসায় যাই তাহলে?

আরোশ সাবলীল ভাবে বলে, না থাকো। কোন ভুল করলে সেগুলো ধরিয়ে দিচ্ছি।

দুর্গা ক্যাংগারুর মতো লাফ মেরে উঠানের নিচে নেমে গেল এবং বেশ সহজ গলায় বলে, উহু। আজকে আমার ছুটি। আজকে আমি পড়াশোনা থেকে দুই মাঈল দূরে থাকব৷ আমি চললাম। আপনি আমার খাতাগুলো মোড়ায় রেখে দিয়েন।

আরোশকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দুর্গা সদর দরজা অতিক্রম করলো।আরোশ জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলো আজকে কোন বিশেষ দিন কিনা — তা আর হলো না।

সে মনোযোগ দিয়ে খাতা কাটা শুরু করলো।গতকালকে সে দুর্গাকে বাংলা, ইংরেজি আর অংক করতে দিয়েছিল৷ প্রথমে বাংলা হোমওয়ার্ক চেক করে যেই না অংক খাতা বের করলো। সে পিলে চমকে উঠে। হোমওয়ার্কের খাতা সম্পূর্ণ সাদা ও ফাঁকা কিন্তু শুণ্য খাতায় একটা খামসহ চিঠি দেখলো সে।খামটা হাতে বানানো। খামের ভাঁজে ভাঁজে ভাত লেপ্টে আছে। আঠা হিসেবে ভাত গেলে দেয়া হয়েছে৷ আরোশ খুবই যত্ন সহকারে খামের ভাজ খুলতেই বেরিয়ে এলো চিঠিটা।

সে বড্ড আগ্রহ নিয়ে চিঠি খুললো। গুটিগুটি লেখা গুলো চোখে পড়তেই আরোশ চিনে ফেললো, চিঠির লেখিকাকে। তার অনুগত ছাত্রী দুর্গার হাতের লেখা এটা। সে ভ্রু কুচকে চিঠি পড়া শুরু করে৷ চিঠির প্রথমেই লেখা,

প্রিয় মাস্টারমহাশয়।

আমার অংক খাতা শুন্য দেখে নিশ্চয়ই রেগে গেছেন। রাগবেন না কেমন? এই নিয়ে দশবার আপনাকে চিঠি লেখার প্র‍য়াস করে ব্যর্থ হয়েছি।কালকে বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হয়ে আপনার জন্য চিঠি লিখলাম কিন্তু মন মতো না হওয়ায় ছিঁড়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলে দিয়েছি। এই চিঠিটা ভোরবেলায় লিখেছি।আপনি কি জানেন, আমার অংক খাতাটাই কেবল শূন্য কিন্তু আমার মনে ভালো লাগার আবেশে কানায় কানায় ভরপুর৷ আমার মনের প্রতিটা ভালো লাগার অনু, পরমাণু তে কেবল আপনার নাম লেখা যদিও বা আপনার নাম আমি জানি না।

আপনি কি জানেন? সম্বোধন হীন সম্পর্ক গুলো বেশি মজবুত হয়। মনের অজান্তে একটা বড়সড় ঘটনা ঘটে গেছে তাহলো আমি আপনাকে আমার মন দিয়ে ফেলেছি। প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে আমার ধারণা ও ছিলো না৷ আমি হচ্ছি সেই মেয়ে যে এখনো কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা খেলি। সে কিভাবে আপনার মতো জ্ঞানী মানুষ কে ভালোবেসে ফেললো তাও আমার অজানা। আপনি কি জানেন, আপনি কেবল আমায় রয়াসনের বিক্রিয়া শেখান নি বরংচ ভালোবাসতে শিখেয়েছেন।আপনি যখন মাথা নিচু করে পড়ান, আমি বেহায়ার মতো আপনাকে দেখি। আপনি কি জানেন, আপনি আর আমি মিলে ওই সংযোজন বিক্রিয়ার মতোন! দুই মন মিলে এক হবো আমরা!

ইতি
মাস্টারমশাইয়ের দুর্গা মল্লিক৷

আরোশ চিঠিটা পড়ে থ মেরে যায়। নিস্তব্ধ সে।বুঝতে পারে নি দুর্গার মনে এমন কিছু চলছে। নিজের প্রতি ধিক্কার বোধ হচ্ছে তার কেন সে আগে এই মেয়েটার মনের কথা বুঝলো না? কবে থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছে দুর্গা তাকে? আচ্ছা! ভালোবাসার ও কি উপযুক্ত সময় স্থান কাল প্রয়োজন? নাকি এমনি এমনি প্রাকৃতিক ভাবে ঘটে যায়৷ আরোশের পিপাসা লাগতে শুরু করে।সে উঠানে বসেই আছে। হাত-পা ভীষণ রকমের ব্যথা করছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। দুর্গা কেন তাকে চিঠি লিখলো? দুর্গা কি জানে না সে মুসলিম! কেন এমন নিষিদ্ধ আবদার করে বসলো সে?

আরোশ প্রায় অনেকক্ষণ ঝিম করে বসে রইল। বেলা বাড়লে দুর্গা ফিরে এসেই চমক খায়। মাস্টারমশাই এখনো উঠানেই বসে আছে। এই প্রথম দস্যি, চঞ্চল দুর্গা লজ্জা, সংকোচ, ভয়ে মিইয়ে গেল। মাস্টার কি তার লেখা চিঠি পড়েছে?

সে আগানোর সাহস পাচ্ছে না৷ একবার ভাবলো, বাসার সদর দরজা থেকে আবারো রোজিনা আপার বাসায় ফিরে যাবে। কিন্তু তার আগেই মাস্টারের সঙ্গে তার চোখাচোখি হলো। সে হাসার চেষ্টা করলো। এবার তো পালানোর উপায় নেই।

দুর্গা বাসার ভেতরে ঢুকল। আজকে বাবা ঘরে নেই। সে একা বাসায়।

উঠানের সামন থেকে নিজের ঘরে ঢুকে যেতেই আরোশ থমথমে গলায় বলে, দুর্গা এদিকে আসো!

দুর্গা কেঁপে উঠে। সে শুকনো ঢোক গিলে।
আরোশ তার সামনে সে বলে, কানে ধরো।

দুর্গার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে কেন কানে ধরবে?

— কি হলো? কথা কানে যায় না? কানে ধরে নিল ডাউন দাও বলছি।

দুর্গা কাদো কাদো হয়ে বলে, কেন?

— কেন এর উত্তর তুমি জানো। সাহস কিভাবে হয় আমাকে প্রেম পত্র দেয়ার? আমি এখানে প্রেম করতে এসেছি?

দুর্গা উত্তর দিলো না৷

— কি হলো জবাব দাও! (ভীষণ রাগী গলায়)

আরোশের ধমক খেয়ে দুর্গার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

দুর্গা আহত গলায় বলে, আপনি এমন কেন? সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারেন না?

— না। পারিনা। তোমার মতো মেয়ের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলিও না৷

— আমার মতো মেয়ে মানে?

— বেহায়া মেয়ে কোথাকার।

দুর্গা পুনরায় আহত হলো। তার গাল বেয়ে টসটসে তাজা দুটো ফোটা অশ্রু বিসর্জন হলো। এরপর মাথা নিচু করে বলে, ভালোবাসায় এক-আধটু বেহায়া হতে হয়৷

আরোশ তা শুনতে পায়নি। সে গর্জে উঠে বলে, কানে ধরো।

দুর্গা ভয়ে ভয়ে তার দু’হাত দিয়ে দু’কান চেপে ধরে। লজ্জা, অপমানে তার নাক, কান দিয়ে ধোয়া বের হতে লাগে৷

আরোশ এতেও শান্ত হলো না। সে ধমকে উঠে বলে, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকো৷

দুর্গা অতিমাত্রায় বিষ্মিত হলো। সে এক পায়ের হাটু ভাজ করে গুটিয়ে নিয়ে, এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সামনে থাকা সুদর্শন পুরুষ টাকে তার পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর যুবক বলে মনে হলো।হিটলার ও এরচেয়ে মায়াবান ছিলো বোধহয়। হুহ।

আরোশ মিনিট ছয় চুপ থেকে বলে, ঠিক আছে। যাও।

দুর্গা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সে পা জমিনে ফেলে দুই পায়ে ভর দিয়ে আচমকা কেঁদে দেয়৷

আরোশ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। দুর্গা কান্না করতে করতে বলে, আজকে আমার জন্মদিন। আর আপনি এভাবে আমাকে অপদস্ত করলেন।

দুর্গা কান্না মাখা চেহারা দেখে আরোশ ঘাবড়ে যায়। সে কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। নিশ্চুপ রইল।

দুর্গা এবারে শব্দ করে কান্না করে বলে, ভালোবাসি বলে সাজা দিলেন মাস্টারমশাই?

দুর্গার প্রশ্নে অন্তর কেপে উঠে আরোশের। সে দুর্গাকে উপেক্ষা করে কলপাড়ে চলে গেল। দুর্গাদের বাসায় বিশাল কুয়া আছে। কুয়ার সঙ্গে লাগানো বাঁশে দড়ি বাঁধানো আছে। দড়ির মুখে বালতি বেঁধে কুয়া থেকে পানি তুলতে হয়৷ আজকে সৌভাগ্যক্রমে বালতিতে পানি ছিলো৷ আরোশ বালতি থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে ঝাপ্টা মারলো। চোখ জ্বালা করছে। মন জ্বালা করছে। চোখের জ্বালা তো পানি দিয়ে মিটালো কিন্তু মনের জ্বালা কিভাবে মেটাবে সে?

সেদিন বিকেলে, সুদীপ মল্লিক দুটো হাঁস নিয়ে বাড়ি ফিরলো। দুর্গার জন্মদিন উপলক্ষে দুর্গার প্রিয় লজেন্স ও এক প্যাকেট এনেছেন।দুর্গা পোড়া হাস ভুনা খেতে পছন্দ করে। বাড়ি ফিরতেই তার মন খারাপ হয়ে গেল।কারন দুর্গার চোখ মুখ ফুলে একাকার। চোখ মুখ লাল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এতোক্ষন যাবত কাদছিলো।

তিনি দৌড়ে দুর্গার কাছে গিয়ে বুঝলো, তার আদরের মেয়ের ভীষণ জ্বর এসেছে। তাও উঠানে চুপচাপ বসে আছে। আরোশ কোথায়?

সুদীপ মল্লিক দুর্গার দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল।মেয়েটা কি কষ্ট পাচ্ছে কোন কারণে?

★★★

আরোশ কলপাড় থেকে সোজা বাসার বাইরে চলে এসেছে। কাওছার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে নিজের থাকার জায়গা বদলে নিবে সে।দুর্গার চেহারা আর সে দেখতে চায় না।

কাওছার ভাই নিজের ঘরেই ছিলো। আরোশকে তার বাসায় আসতে দেখে তিনি হেসে বললো, এতোদিনে আমার বাসায় ঘুরতে আসার সময় হলো তোমার?

আরোশ ভদ্রতাসূচক হাসি হেসে বলে, ভাই একটা হেল্প লাগবে৷

— বলো।

— আমি সুদীপ মল্লিকের বাসায় থাকব না।

কাওছার ভাই বলে, কিছু হয়েছে?

আরোশ আকাশের দিকে উদাসিন হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে, আগুন আর কেরোসিন একসঙ্গে রাখতে নেই।দুর্গার বয়স কম। অবিবাহিত। আমিও যুবক।গ্রামের লোকে বাজে কথা রটাবে। আমি তা চাই না।

কাওছার ভাই কিছু একটা ভেবে বলে।,তো বেশ। আমার সঙ্গে থাকো। সমস্যা কোথায়? ইয়ং ম্যান। নাও একটা সিগারেট খাও৷ টেনশন নেয়া বন্ধ করো। টেনশন এখন পাকিস্তানিরা করবে।

কাওছার ভাই সবাইকেই একটা করে সিগারেট খেতে দেয়। আরোশ নিজে থেকে কোন দিন সিগারেট কিনে খায় না। কেউ দিলে সেটা আলাদা ব্যাপার। আব্বা রাগ করত সিগারেট খেতে দেখলে।আব্বার কথা ভাবতেই তার মন হুহু করে কেঁদে উঠে। সে তৎক্ষানিক নিজেকে সামলে নেয়। কাঁদবে না সে।বরং শক্ত হয়ে প্রতিশোধ নিবে। নিজের দেশের সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে হওয়া অবিচারের প্রতিশোধ তো তাকেই নিতে হবে। কাঁদলে চলবে কি?

কান্না তো দুর্বলতার অলংকার। বাঙালী দুর্বল নয় বরং সাহসী জাতী। লড়াকু সৈনিক তারা।

কাওছার ভাই বলে উঠে, একটা জরুরি কথা আছে।

— কি?

— এই গ্রামের কয়েকটা ছেলে যুদ্ধ করতে চায়। ওদের ট্রেনিং দিতে হবে৷

— দিবেন।

— দিব বলা কি এতোই সহজ? অনেক কিছু
লাগবে। একটা নিরিবিলি জায়গা ও দরকার।

চলবে।

শুক্লাদ্বাদশী পর্ব-০৪

0

#শুক্লাদ্বাদশী
Part–4
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

–মাস্টারমশাই জানেন! রাখাল পাড়ায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে।

আরোশ সকালে যখন দুর্গাকে পড়াতে এলো তখন দুর্গা তাকে এই তথ্য দিলো। আরোশ অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে, তাই নাকি!

— জি! তাই। আমাদের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা এসে গেছে বলে এক গাল হাসল সে।

আরোশ সেই হাসির দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।
দুর্গা বলে উঠে, রোজিনা আপা জানালো, মধ্য রাতে নাকি গ্রেনেড হামলা হয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। ওদের ক্যাম্প জ্বলে ছারখার। আজকে সকালেই ঘাটি ছেড়ে পাকসেনা গ্রাম ত্যাগ করেছে।

দুর্গার চোখ-মুখে আনন্দের ছাপ। আরোশ তা দেখে মুচকি হেসে বলে, তাহলে তো খুবই ভালো। আমরা এখনো নিরাপদ।

— জানেন পাঁচ মিনিট পর পর টানা পাঁচবার বিকট শব্দ হয়েছিল। কিন্তু আমি আওয়াজ পাই নি। আমার ঘুম খুব ঘণ। বাজ পড়লেও ঘুম ভাঙ্গে না

আরোশ ভ্রু কুচকে তাকাল।তার স্পষ্ট মনে আছে , গ্রেনেড হামলা একটাই করা হয়েছিল। সে নিজেই পাকসেনার ক্যাম্প গ্রেনেড দিয়ে উড়ালো। একবার ই বিকট শব্দ হলো। অথচ দুর্গা বলে কিনা পাঁচ মিনিট পর পর পাঁচবার শব্দ হয়েছিল। কি আজব কারবার!

দুর্গা প্রফুল্ল মনে বলে, ইশ! মুক্তিযোদ্ধাদের যদি একবার দেখতে পেতাম। পা ছুঁয়ে সালাম করতাম।

তোমার সামনেই বসে আছে বলতে গিয়েও থেমে যায় আরোশ। প্রসঙ্গ পালটে বলে, পড়তে বসো। আজকে ক্যালকুলাস পড়াব। খাতা বের কর।

দুর্গা মাথা চুলকায়৷ সে অংকে বড্ড কাঁচা। মাস্টারমশাইয়ের কাছে লজ্জা পেতে চায় না সে। সে তড়িঘড়ি করে বলে, আচ্ছা মাস্টার, আপনার নাম কি?

— আমার কোন নাম নেই।

মাস্টারমশাই তার নিজের নাম দুর্গাকে বলছে জন্য সে কিছুটা কষ্ট পেল। কেন যে উনি নিজের নাম বলে না কেন জানে?

পড়াতে গিয়ে আচমকা দুর্গার নরম হাতের সঙ্গে আরোশের হাত লেগে যায়। আরোশ কেপে উঠে নিজের অজান্তেই৷ দুর্গার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সে। মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে আছে৷

সে বলে উঠে, কি ভাবছো এতো?

দুর্গা আনমনে বলে উঠে, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভাবছি। আচ্ছা মাস্টারমশাই মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কেমন?

— জানি না৷

— যুদ্ধ কিভাবে করে?

আরোশ বলে উঠে, জানি না। একটু পড়ায় মন দাও।

দুর্গা বিড়বিড়িয়ে বলে, আমি তো আমার মন আপনাকে দিয়েছি এখন পড়ায় কিভাবে দিব? আমার কি দুটো মন কিনা!

আরোশ উঠানে বসেই আকাশের দিকে তাকালো। ঝড়ো হাওয়া বইছে। দুর্গার হাতের স্পর্শ পাওয়ার পর থেকে মনটা কেমন বিষিয়ে গেছে। পঁচিশ বছর বয়সে এই প্রথম কোন মেয়েকে দেখে তার অন্তর কেঁপে উঠেছে। কোষের প্রতিটা নিউক্লিয়াসে ভালো লাগার আবেশ পৌঁছে গেছে কিন্তু হায় আফসোস সে- নারী তার জন্য নিষিদ্ধ।

আরোশ মাথা নিচু করে দুর্গাকে এক মনে পড়াতে লাগে। তখনি বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ কানে আসে। মূহুর্তেই উঠানেও বৃষ্টির ঝাপ্টা গায়ে এসে লাগতে লাগলো।

আরোশ বলল, আজকে এইটুকুই। কালকে আবারো পড়াব।

দুর্গা বই খাতা গুছাতে লাগে। আরোশ তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে এসে বসে৷

দুর্গা বই-পুস্তক ঘরে রেখে এসে উঠান পেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় এসে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগে। ইশ! বছরের দ্বিতীয় বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোটা গায়ে লাগতেই দুর্গা মন ভালো হয়ে গেল। হাত দুটো সামনে এগিয়ে এনে একসাথে করে হাতের তালুতে পানির ফোটা জমাতে লাগলো।

ক্ষনেই সে ভিজে জুবুথুবু হয়ে যায়। মাস্টারমশাই যেদিন বাড়ি এল সেদিন ও বৃষ্টি হয়েছিল।

দুর্গা গুনগুনিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাচ্ছে আর বৃষ্টিবিলাস করছে৷

আরোশ পেছনে থেকে তার দিকে অপলক নয়নে চেয়ে থাকে৷

আচমকা দুর্গার শাড়ি যথাযথ স্থান থেকে সরে গিয়ে ফর্সা পেট আরোশের নজরে এলো। সে চোখ সরিয়ে নেয়। এই মেয়েটাও না! শুধু হাতে-পায়ে বড় হয়েছে। বুদ্ধি হাঁটুতেই পড়ে আছে৷

আরোশ ঘরে ঢুকে পড়ে। আজকে রাতে আবারো বেরুতে হবে। কালকে দুর্গা ঘুমিয়ে পড়ার পর গিয়েছিল। কিন্তু আজকে আরো আগেই যেতে হবে। রাখাল পাড়া কাছে হওয়ায় দেরিতে রওনা দিয়েছিল কিন্তু আজকে সদরে যাবে। সময়ের ব্যাপার আছে। দেরি করা যাবে না। সদরের ক্যাম্পে যেকরেই হোক হামলা চালাতে হবে৷

বৃষ্টি থেমে যেতেই ভেজা কাপড়ে উঠানে এলো দুর্গা উঠান থেকে মাস্টারমশাই কে দেখতেই তার গায়ে হীম শিহরণ বয়ে গেল। সে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ মাস্টারমশাই কে প্রেমপত্র লিখবে।

দুর্গা চটজলদি নিজের ঘরে গিয়ে খাতা বের করলো। এই ভেজা কাপড়েই নিজের মনের অবক্ত্য কথা গুলো লেখায় প্রকাশ করবে৷ দুর্গা অনেকটা সময় নিয়ে খাতায় লেখালেখি করলো। কিন্তু এই চিঠি দিবে কিভাবে??

★★★

সুদীপ মল্লিক খালি গায়ে বসে আছেন। সকালের দিকে বৃষ্টি হলেও সন্ধ্যার পরপর থেকে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ভ্যাপসা গরম যাকে বলে৷ খালি গায়ে উঠানে বসে আছেন তিনি। দুর্গা ভাত রান্না করছে।

আরোশ নিজের ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে গেল। তাকে দেখে সুদীপ মল্লিক এক গাল হেসে বলে, কেমন আছো বাবা?

আরোশ এক কথায় উত্তর দেয়, ভালো৷ আপনি?

— আমিও ভালো। কিন্তু এইবার যা গরম পড়েছে। সহ্যের বাইরে। আমার মনে হয় এইবার সবচেয়ে বেশি গরম পড়লো।

আরোশ কিছু বললো না। উনি বলতে লাগলেন, তোমার কথামতে দুর্গাকে তোমার সত্য পরিচয় বলি নি। ও জানে তুমি আমার দূর সম্পর্কের ভাগ্না৷

— ও। ভালো করেছেন৷

— মেয়েটা আমার সহজ-সরল। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে কখনোই মিথ্যা বলে না।

— ওহ।

আরোশ এতোক্ষন চুপচাপ বসে থাকলেও, এবারে মুখ খুললো। সে বলে উঠে, আজকে আমাকে রাতে বাইরে যেতে হবে। কাজ আছে।

সুদীপ মল্লিকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে৷ তিনি বলে, কালকে তোমরাই গ্রেনেড হামলা করেছিলে তাই না?

— জি।

— সাবাশ! বাঘের বাচ্চা তোমরা।

আরোশ স্মিত হাসলো। উত্তরে নিরব রইল।

দুর্গা গরম গরম ভাত আর কাঁঠালের বিচি ভর্তা উঠানে পরিবেশন করলো।

আরোশ হাত ধুয়ে খেতে বসলো। সে এর আগে বহুবার কাঁঠালের বিচির ভর্তা খেয়েছে কিন্তু দুর্গার হাতের ভর্তাটা অসাধারণ।

খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ঘরে ফিরলো আরোশ
ঝিঁঝিঁ পোকা এখনো ডাকা শুরু করে নি আজকে।

রাত আরেকটু বাড়তেই চাদর গায়ে বেরিয়ে যায় সে।

সোজা হাটা ধরলো মেঠোপথ বেয়ে লাল মসজিদের দিকে। এইখানেই সবাই একত্র হবে৷ সে পৌঁছে দেখে কাওছার ভাই ইতিমধ্যে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।

তাকে দেখে সালাম দিলো আরোশ। তিনি বলে উঠে, সারা গ্রামে হৈচৈ উঠে গেছে৷

— জানি৷

— শালা পাকিস্তানি গুলো ভয়ে পালাইছে একটা
গ্রেনেড এর ধোয়া সহ্য করতে পারে না আবার বাঙালীদের সঙ্গে লড়তে আসছে!

আরোশ কিছু বলল না। বরাবরের মতো চুপ থাকে। আজকে সদরে যাবে। সেখানে বিশাল ক্যাম্প বানানো হয়েছে। পুরা ক্যাম্প শেষ করতে তিনটার মতো গ্রেনেড লাগবে। আরোশ ছাড়া কেউ গ্রেনেড হামলা করতে পারে না। সাব্বির রাইফেল চালাতে পারে ভালো। কিন্তু গ্রেনেড ছুড়ে মারতে পারে না৷ তার নাকি ভয় লাগে। যা করার আরোশকেই করতে হবে। পরপর তিনটা গ্রেনেড মারা খুবই দুষ্কর কাজ। ধরা পড়লেই শেষ। মনোবল শক্ত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কাওছার ভাই একটা সিগারেট খেতে দিলো তাকে।

সিগারেট ফুকতে থাকে সে।অস্থিরতায় হাত কাপছে তার৷ ভয়, আনন্দ, টেনশন সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি।

একে একে সাব্বির, বল্টু আর এরেক চলে আসলে তারা গন্তব্য রওনা হয়।

চৌরাস্তার মোড়েও ক্যাম্প। বাইরে দিয়ে চারজন পাক সেনা গুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

কাওছার ভাইয়ের পরিকল্পনা মতে, সাব্বির এগিয়ে গিয়ে একজন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিলো।

আরোশ সুযোগ মতে পেছনের দিকে চলে যায়। এখন কেবল অপেক্ষার পালা। উত্তেজনায় হাত-পা কাপছে। বুকের হৃদপিন্ড কাপছে৷

মিনিট বিশ পর রেডিও থেকে ভেসে আসলো, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম৷

সকল অস্থিরতা কে দূরে পিষে ফেলে আরোশ হেসে দিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে সে গ্রেনেড ছুড়ে মারে ক্যাম্পের দিকে। গতকালকের মতো আজও বিকট শব্দ হলো। চোখের সামনে পাকদের পরাজয় দেখে উল্লাস প্রকাশ করে সে।

চলবে।
[ সম্পূর্ণ লেখা শেষ করে যেই না দুপুরে গল্প পোস্ট দিব, সেই সময় ভুলে লেখাটা ডিলিট করে দিয়েছি জন্য লেইট হলো। লেখার মান আজকে ভালো হয়নি। দুঃখিত সেজন্য ]

শুক্লাদ্বাদশী পর্ব-০৩

0

#শুক্লাদ্বাদশী
Part–3
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

জৈষ্ঠ্যমাসের শুরু। ঠাঠা রোদ। মাথার উপর সূর্য লম্বাভাবে কিরণ দিচ্ছে। গরমে অস্থির মানুষ-জন। কিন্তু দুর্গার মধ্যে অন্য এক অস্থিরতা। গ্রীষ্মের প্রখরতা তাকে গ্রাস করতে পারছে না। তার মন অন্যদিকে, অন্যজনের কাছে পড়ে আছে। সে অনেকক্ষণ ধরে উঠানের সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে পায়চারি করছে। উশখুশ করছে সে। মনটা পড়ে আছে একেবারে ধানের গোলার পাশের মুরগির খামারের মতো ছোট্ট ঘরটায়। ওই ওত টুকুন ছোট্ট ঘরটাতেই তো মাস্টার মশাই থাকছে৷ হু! মাস্টার মশাই-ই তো সাতদিন আগে আসা সেই বানরের মতো দেখতে ছেলেটার পরিচয় এখন!

বাবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে হয়। ঢাকায় থাকে। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে৷ যখনই দুর্গার কান শ্রবণ করলো, ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার –তার বুকের মধ্যে কারা যেন হাতুড়ি পেটাতে লাগলো। দুর্গা এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতেই লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে গেল। আচ্ছা সে কি লোভী কোন মেয়ে? ইঞ্জিনিয়ার জন্য দুর্গার মনে তার জন্য বিশেষ কিছু একটা অনুভূতি কাজ করছে। কি সেই অনুভূতি নাম জানা নেই তার!

এমনই সময় বড় বড় পা ফেলে মাস্টার মশাই ঘর থেকে বেরুলো। দুর্গার হাত-পা ইতিমধ্যে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

আরোশ দুর্গার সামনে এসে দাঁড়ালো। এই।চঞ্চল চটপটে মেয়েটার সঙ্গে আজকে পাক্কা সাত দিন পর আরোশের সাক্ষাৎকার। তাও শিক্ষক বেশে! মেয়েটার পড়ানোর দায়িত্বের বোঝা তার ঘাড়ে এসে চেপেছে।

দুর্গা তাকে দেখে বলে উঠে, আপনি কি আমাকে সত্যি সত্যি পড়াবেন নাকি?

আরোশ বিরক্তি ভাব আড়াল করে বলে, মিথ্যা মিথ্যা পড়ানো গেলে মিথ্যা ভাবেই পড়াতাম।

দুর্গার কান লাল হয়ে আসলো। সে জড়তায় কুচকে গেল।

— পড়ার টেবিলে গিয়ে বসো। আমি আসছি৷

দুর্গা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আরোশ তা দেখে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে, পড়ালেখার ব্যাপারে হেলাফেলা আমার পছন্দ না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নিও।

দুর্গা একবার চোখ তুলে তাকালো। এরপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলে। ইশ! সামান্য জ্বরেই বেচারা শুকিয়ে গেছে৷ এ কয়েকটা দিন বেচারা জ্বরে ভুগেছে। এতেই যেন তার ওজন দুর্গার চোখে দুই কেজি কমে গেছে। ঠোঁটে জ্বর ফোড়া উঠে লাল হয়ে আছে ঠোঁটের নিচের দিকটা।

আরোশ বলে উঠে, শোন দুর্গা তুমি কোন চ্যাপ্টার পারো বা পারো না সেই সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কিন্তু তুমি নিজে তো জানো, কিসে তুমি দুর্বল। আমাকে জানিয়ে দিবে সেইসব চ্যাপ্টার বেশি সময় নিয়ে পড়াবা।

তার মুখে দুর্গা নিজের নাম শুনে মনে মনে খুব খুশি হলো। যাক মাস্টার মশাই অন্তত তার নাম তো জানেন!

আরোশ নরম সুর তুলে বলে, উঠানেই বসি কি বলো?

— আচ্ছা৷

— বই আনো। রসায়ন আর ইংরেজি বই আনো।

দুর্গা বিনাবাক্য ব্যয় করে ছুট লাগালো নিজের বই-খাতা আনার জন্য। তা দেখে মৃদ্যু হাসে আরোশ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্গা দুই হাত ভর্তি বই নিয়ে ফিরলো৷ আরোশ তাকে উঠানে বসতে বলে। উঠানের মাঝে দুইটা বেতের মোড়া পাতা আছে সেখানেই মুখোমুখি বসলো দুইজনে। আরোশ দুর্গার হাত থেকে বইগুলো নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগে৷

আর এইদিকে দুর্গা ফাঁক-ফোকড় দিয়ে আরোশকে এক প্রকার লুকিয়ে দেখতে লাগলো। যতোবার আরোশের মুখমন্ডল দেখছে সে, ততোবারই চোখের মণি জ্বলজ্বল করে উঠছে। লুকিয়ে দেখতে গিয়েও ধরাও খেল দুর্গা। মাস্টার মশাই তার দিকে তাকালেন এবং দুর্গাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলে, কিছু বলবে?

দুর্গা যেন এই প্রশ্ন পিলে চমকে উঠে। সে আমতাআমতা করে বলে, আ,,,আমি অংক বড্ড কাঁচা।

আরোশ স্মিত হেসে বলে, আচ্ছা বুঝলাম। কালকে থেকে অংক রোজ এক ঘন্টা করে পড়াব। গনিত হলো বিজ্ঞানের রাণী। বিজ্ঞান গনিত ছাড়া অচল।

দুর্গা মনে মনে বলে, আমার মনও আপনাকে রাজা বানিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। আমিও আপনাকে ছাড়া অচল — শেষ কথা বলতেই দুর্গা আবারো চমকে উঠে। ছিঃ ছিঃ কিসব ভাবছে সে। ভাগ্যিস মাস্টার মশাই তার মনের কথাগুলো শুনে নি। শুনলে নিশ্চয়ই তাকে বেহায়া উপাধি দিয়ে দিত।

মানুষকে যদি মনের কথা শোনার ক্ষমতা দেওয়া হতো, তবে দু’দন্ডের মধ্যে বিশ্ব তচনচ হয়ে যেত।

রসায়ন বই হাতে নিয়েই আরোশ প্রশ্ন করে, বলো তো বাফার দ্রবণ কাকে বলে?

দুর্গা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর মনে করার চেষ্টা করলো। কিন্তু পাজি, দুষ্টু মন সে তো আর পড়ার মধ্যে নেই। দুর্গা বিগত দিনে পড়া সবকিছুই ভুলে গেছে। বাফার-ডাফার দ্রবণ-ফ্রবণ কি তাও আর মনে নেই তার।

আরোশ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়। দুর্গার মুখে যেন কেউ আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ ও বের হচ্ছে না।

আরোশ কিছুটা রাগী গলায় বলে, পারো না?

দুর্গা এবারে সরাসরি তার দিকে তাকালো। এতে কিছুটা ঘাবড়ালো আরোশ। মেয়েটা এভাবে চোখে চোখ রাখে কেন? প্রায়ই এমন করে! যখনই এই মেয়েটা তার চোখে চোখ রাখে তখনিই আরোশের কেমন যেন অস্থির লাগে।

দুর্গা মাথা নেড়ে বলে, উহু।

— পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না?

— লাগে।

— তাহলে পড়ো না কেন?

দুর্গা এর উত্তর না দিয়ে ফটাফট বলে উঠে, জানেন আমি ডাক্তার হতে চাই।

— গুড।

— আমাদের গ্রামে আমি আর বিল্লাল কেবল সাইন্স নিয়েছি। আর টুম্পা, জবা, পারুল ওরা আর্টস নিয়েছে। জয়নবের তো বিয়ে হয়ে গেছে তাই কলেজ আসা বাদ দিয়েছে। রঞ্জু ম্যাট্রিক পাশ করতে পারে নি,,,,,,

— হয়েছে থামো এবার।তোমার কাছে হিস্ট্রি জানতে চাই নি।

দুর্গা ফিক করে হেসে ফেলে। আরোশ মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। আঁকাবাঁকা হাসিটার মধ্যে একটা যাদু আছে সম্ভবত। কেবল ঘোর লেগে যায়। সে নিজেকে সংযত করে বলে, বাফার দ্রবণ মানে হলো, যে দ্রবণে সামান্য দুর্বল অম্ল বা ক্ষার যোগ করার পরও দ্রবণের pH- মান
অপরিবর্তিত থাকে তাকে বাফার
দ্রবণ বলে! বুঝলে?

দুর্গা মাথা ঝাকালো যার অর্থ সে বুঝেছে।

আরোশ সামনের পৃষ্ঠার পড়া গুলো বুঝাতে লাগে । একবারও মনের ভুলেও দুর্গার দিকে তাকালো। সে বুঝে গেছে এই মেয়েটা সর্বনাশা তার জন্য।

‘জীবন থেকে সর্বানাশীকে দূরে রাখতে হয়।’

দুর্গা হুট করে প্রশ্ন করে বসে, pH মানে কি?

আরোশ হতাশ না হয়ে পারলো না। আরে যে pH মানেই জানে না, তাকে বাফার দ্রবণ বুঝিয়ে লাভ কি? সে কটমট করে দুর্গার দিকে তাকিয়ে বলে, pH কি তা জানো না?

দুর্গা ঢোক গিলে বলে, ভুলে গেছি।

— নিজের নাম মনে আছে?

— হ্যাঁ।

— বাবার নাম আছে মনে থাকে?

দুর্গা অবাক হয়ে বলে।,থাকবে না কেন?

— ভাত খাওয়ার কথা ভুলে যাও?

— ভাত খাওয়ার কথা কেউ ভুলে নাকি?

আরোশ বই টা নিচে ধাম করে ফেল বলে।,তাহলে pH কাকে বলে সেটা কেন ভুলে গেলে?

দুর্গা অসহায় চোখে বলে, কি জানি? কিন্তু রেডিওতে বলা প্রতিটা কথা আমার মনে থাকে!বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটা লাইন মুখস্ত। শুনবেন?

— না।

— আচ্ছা আপনাকে কি বলে ডাকবো?

আরোশ হচকচিয়ে গেল। এই মেয়েটা এমন উদ্ভট কেন? পড়তে এসেছো পড়ো তা না দুনিয়ার কথার ঝুলি নিয়ে বসবে।

সে অল্প কথায় বলে, ভাই বলে ডাকবে।

দুর্গা মুখ ফসকে বলে দেয়, অসম্ভব ।

আরোশ ভারী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, অসম্ভব কেন?

দুর্গা নিজেও পুনরায় পিলে চমকে উঠে। নিশ্বাস ভারী হতে লাগে। কি বলবে উত্তরে? সে নিজেই তো উত্তর জানে না। কেবল এতোটুকুই বুঝে, লম্বা করে এই রোগা পাতলা ছেলেটা আর যাই হোক ভাই ডাকা যাবে না। ভাইয়া হলেও কথা ছিল।

ভাই আর ভাইয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। ভাই বলে যাকে ডাকা হয় তার সঙ্গে ভাই-বোনের এক পবিত্র সম্পর্ক থাকে। সবাইকে ভাই বলে ডাকা যায় না! ভাই একটা আপন শব্দ। আচ্ছা শব্দও আবার আপন হয়?

তখনি মেইন গেটের বাহির থেকে দুর্গা শুনতে পেল রোজিনা আপা তার নাম ধরে ডাকছে। সে এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে আপার কাছে দৌড়ে গেল।

আরোশ এই কয়েকদিনে রোজিনাকে ভালো মতোন চিনে গেছে। রোজিনা মেয়েটা যে বাঁচাল প্রকৃতির তাও বুঝে গেছে। এটাও বুঝে গেছে এই রোজিনা নামক মেয়েটা দুর্গাকে কোন কারণে খুব স্নেহ করে। দুই বাড়ি পরেই এই মেয়ের বাড়ি। আরোশ উঠে দাঁড়ালো। আজকে আর দুর্গাকে পড়াবে না।মেয়েটা অভদ্রতা করেছে। কিভাবে তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পড়া রেখে উঠে গেল? গল্প করতে দৌড়ে গেল। আরোশ তার শিক্ষক হয়। কিন্তু সম্মান দেখালো না।

সে ফোস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের ঘরে ফিরে আসে। আকারে খুবই ছোট ঘরটা। তবুও একাকিত্ব আছে এই ঘরে। এই ঘর থেকে সহজে দুর্গার রুম দেখা যায় না। একটা চৌকি ছাড়া আসবাবপত্র বলতে আর কিছু-ই নেই। তবে বিশাল বড় একটা জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে সুবিশাল আকাশ দেখা যায়। আরোশের জন্য এ-ই যথেষ্ট। সে চৌকিতে আয়েশ করে বসে। এই বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বরে আক্রান্ত হলো সে।টানা পাঁচ দিন
জ্বর-সর্দি- টনসিলে ভুগে একাকার অবস্থা। অবশ্য কালকেই সে সুস্থ হয়েছে। তবু্ও আজ আর গতকাল মিলিয়ে পাক্কা দুই দিন খুব করে বিশ্রাম নিয়েছে সে।নিজের সুটকেস থেকে একটা বই বের করলো। ইংরেজি সাহিত্যের বই। এমনি হাতে ধরে বসে রইল সে।পড়ছে না। দুর্গা মেয়েটা এখনো তার আসল পরিচয় জানে না। সে নিজেই সুদীপ মল্লিক কে মানা করে দিয়েছে জানাতে। এইজন্য মেয়েটা তার নামটাও জানে না। দুর্গাকে সত্যি সত্যি কিছু না জানানোর জন্য সুদীপ মল্লিকের জন্য তার সম্মানটা বেড়ে গেল। লোকটা খুব সাদা-সিধে। গ্রামের সহজ-সরল গৃহস্থ পরিবারের কর্তা সে।এই বাড়ির কর্তাগিন্নি নাকি দুর্গার দুই বছর বয়সেই টাইফয়েডে মারা গেছে।

তখনি মাগরিবের আযান পড়লো আরোশ নামাজ পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। ওযু করতে কলপাড়ে যেতে হবে তাকে। সাবধানে ওযু করতে হবে তাকে। দুর্গার চোখে না পড়লেই হলো। মেয়েটা বড্ড দুষ্টু চটপটে স্বভাবের। কাকে কি বলে দিবে কে জানে? তার চেয়ে দুর্গার থেকে সত্য আড়াল করে রাখাই ভালো।

_________________

রোজিনা আর দুর্গা এখনো গল্প করছে।
রোজিনা ভাষণ দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলে, জানিস শফিক পাগলটা কি করেছে?

দুর্গা উৎসাহ দেখিয়ে বলে, কি করেছে শফিক ভাই?

— পাগলটা মাটি খুঁড়ছে।

— সেকি কেন?

— পাক বাহিনীদের ওই গর্তে ফেলে নাকি পিটাবে। দেখ কান্ড!

দুর্গা কি যেন একটা ভেবে বলে, আপা তুমি শফিক ভাইকে খুব ভালোবাসো তাই না?

রোজিনা লজ্জায় নতজানু হয়ে গেল এবং বলে।,যাহ! ওই পাগলকে ভালোবাসব কোন দুঃখে!

দুর্গা মিস্টি হেসে বলে, আপা ভালোবাসা কাকে বলে?

রোজিনা চোখ বড় বড় করে বলে, তোর ভালোবাসা কাকে বলে তা জেনে লাভ কি?

— সেদিন যুদ্ধ সম্পর্কে ও কিছু বললে না আজকে ভালোবাসা সম্পর্কে ও কিছু বলছো না!

— তোর এসবে কাজ নেই।

— তাহলে আমার কাজটা কোথায়?

— দেখ, ভালোবাসা, যুদ্ধ দুটোই একই জিনিস। এইসব নিয়ে ভাববি না। ভালো কথা ওই ছেলেটা তোদের বাড়িতেই থাকবে এখন থেকে?

— হ্যাঁ।

— সে কি বোবা? কথা।বলতে দেখলাম না একদিন ও!

দুর্গা ফিক করে হেসে ফেলে এবং বলে।,বোবা না গো। বিজ্ঞানের মানুষ। জ্ঞানী কথা বলে সবসময়। জানো উনি ইঞ্জিনিয়ার। তাও আবার ঢাকা থাকে।

— বাপ রে! আচ্ছা যাই রে তুই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যাস।

দুর্গা মাথা নাড়লো। আপা যেতেই সে উঠানে এলো। মাস্টার মশাই নেই। নিজের ঘরে চলে গেছে। সে বই-খাতা নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

রাতে খাওয়ার সময় আর মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। দুর্গা রাতে খেয়ে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

★★★

নিশুতি রাত। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ।সারা গ্রাম ঘুমিয়ে আছে। ঘুম নেই কেবল চারজন যুবকের। চারজনের পরনেই প্যান্ট-শার্ট। তারা বিড়ালের মতো বিনা শব্দ করে এগুচ্ছে। তাদের নিশ্বাসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। খানিক সময়ের ব্যবধানে রাখাল পাড়ার আকাশ-পাতাল, জমিন বিকট শব্দে কেঁপে উঠে। নিশাচর পাখি গুলো কলরব শুরু করে। বিকট শব্দে জেগে যায়, ঘুমন্ত পাখি, দুটো কাক আকাশে উড়াউড়ি করে কাকা ধ্বনি তুলছে। রাখাল পাড়ার আকাশে ধোয়া উড়ছে। গ্রামবাসী এখনো ঠাওর করতে পারি নি কি ঘটে গেল৷ কেউ টের পাওয়ার আগেই সেই চার জোড়া পা প্রস্থান করে।

তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে, জয় বাংলা। তাকে অনুকরণ করে বাকিরাও বলে, “জয় বাংলা”

চলবে।

শুক্লাদ্বাদশী পর্ব-০২

0

#শুক্লাদ্বাদশী
Part–2
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

— তোদের বাসায় এই অপরিচিত যুবকটা কে রে? তোর প্রেমিক?

অচেনা এক কন্ঠস্বরে যখনি একজন নারী এই কথাগুলো বললো, আরোশ তড়িৎ গতিতে মেয়েটার কাছ থেকে নিজের বাঁধন ছিন্ন করে দূরে সরে এসে দাঁড়ায়।

সে অপরিচিত মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। তারই বয়সী বোধহয় মেয়েটা!
লম্বা শ্যামলা পরনে কমলা শাড়ি, চুল খোপা করা।

মেয়েটা আবারো বলে উঠে, কি রে দুর্গা কথা বলছিস না কেন? কে হয় এই ছেলে তোর? কাকা কোথায়?

আরোশের বুকে কম্পন বয়ে গেল। মেয়েটার নাম কি দুর্গা?

আরোশ খেয়াল করলো, কমবয়সী মেয়েটা বলে উঠে, বাবা বাসায় নেই।

মধ্যবয়সী মেয়ে চটজলদি বলল, সর্বনাশ! ফাঁকা বাসায় একটা ছেলেকে ঢুকতে দিয়েছিস কেন? আমি না এসে অন্য কেউ চলে এসে এই দৃশ্য দেখলে কি হত ভাবতে পারছিস তুই? যা নিজের ঘরে যা! আর এই ছেলেকে বিদাই কর৷

আরোশ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। এ তো দেখি বিরাট মসিবত! তাকে নাকি বের করে দিবে? বের করে দিলে সে যাবে কোথায়? এই দুটো মেয়ের কথোপকথন শুনে মনে হচ্ছে, সুদীপ সাহেব বাড়ি নেই। আরোশ আসবে এই খবর কেবল তিনি জানেন। আর এখন উনার অনুপস্থিতিতে সে কি করবে? সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো।

কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলো। ঠিক সেই সময় বাড়ির কর্তা সুদীপ মল্লিক এক ডজন সাগর কলা হাতে বাড়ি ফিরে এলেন। মুখটা তার কালো হয়ে আছে।

বাবার কালো মুখ দেখে দুর্গা চমকে উঠে। বাবার কি কিছু হয়েছে?

সে এগিয়ে যায় বাবার দিকে। সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে দেখে মেকি হেসে বলে, মা! কলপাড় থেকে পানি এনে দে তো। পায়ে কাদা লেগেছে। পরিষ্কার করব৷

দুর্গা ছুট লাগায় কলপাড়ের দিকে।

আরোশ বড় বড় পা ফেলে সুদীপ মল্লিকের কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগে। সে পেছনে না তাকিয়েই বুঝে ফেললো, মধ্যবয়সী মেয়েটা আড়ি পেতে তার কথা শোনার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এজন্য সে আওয়াজ নিচু করে বলে, সুদীপ সাহেব! কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন?

সুদীপ মল্লিক চশমার ফাঁক দিয়ে লম্বা ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। গায়ের রং ময়লাটে ধরনের। চেহারা রোদে জ্বলে গেছে।
ছেলেটা যে একসময় ফর্সা ছিলো তা সে দিব্যি টের পেয়ে গেল। কেমন শীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুক্ষ্ম ত্বকের অধিকারী ছেলেটাকে সে চিনলো না। তাই বলে উঠে, তুমি কি মোড়ল বাড়ির ছেলে?

— না।

ছেলেটার জবাব এতোটাই শক্ত ছিল যে সে পুনরায় ছেলেটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো যেন সে ভুল বলায় ঘোর অপরাধ হয়েছে। সে মস্তিষ্কে জোর দিচ্ছে কিন্তু নাহ কিছুতেই মনে করতে পারছে না যে ছেলেটা কে? তিনি কৌশলে বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই রায় বাড়ির ছেলে?

আরোশ মুখ শক্ত রেখে বলে উঠে, কাওছার ভাইয়ের সঙ্গে আপনার কথা হয়নি?

সুদীপ মল্লিক কাওছারের কথা শুনে চমকে উঠে। চোখে মুখে একধরনের প্রফুল্লতা গ্রাস করে ফেলে।

সে তাড়াহুড়ো করে বলে, তুমি আরোশ?

— জি।

— আমার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না তুমি আমার বাড়িতে এসেছো বাবাজান।

— আসার তো কথা ছিল।

— তবুও। আসো ভেতরে আসো।

আরোশ লক্ষ্য করলো, বয়স্ক এই লোকটার চেহারায় আনন্দ ভাব ফুটে উঠেছে। কাউকে আনন্দিত হতে দেখলে আরোশের ও আনন্দ লাগে৷

তখনি দুর্গা একটা কলসিতে করে পানি এনে ধাম করে মাটিতে ফেলে বলে, বাবা, এই যে পানি। পা ধুয়ে ঘরে আসো। বাইরে প্রচন্ড গরম৷

সুদীপ মল্লিক কলসি থেকে পানি ঢেলে পায়ে লেগে থাকা কাদা ধুয়ে ফেলে দুর্গার উদ্দেশ্য বলে উঠে, ভাত বেড়ে ফেল।

— এখন?

— হ্যা।

দুর্গা অবাক না হয়ে পারলো না। পাত্রপক্ষের বাসা থেকে বাবা না খেয়ে ফিরেছে? বিকেল পাচটা তো বাজেই। এক বেলায় বাবা ভাত খেতে চাচ্ছেন কি জন্য?

তিনি আবারো বলে উঠে, দুইজনের জন্য খাবার বেড়ে দে।

— আচ্ছা।– কথা শেষ করে দুর্গা বাসার ভেতরে ঢুকতে গেলেই রোজিনা আপার তীক্ষ্ম নজরের ভাগীদার হলো।

দুর্গা মৃদ্যু হেসে বলে, আপা ভাত খাবি?

রোজিনা মুখ বাকিয়ে বলে উঠে, রাখ তোর ভাতের কথা। এই ছেলেটা কে রে? আমার একে কেমন যেন উদ্ভট লাগছে?

দুর্গা বলে উঠে, তোমার উদ্ভট লাগছে? আমার তো বানরের মতো লেগেছে।

রোজিনা আপা মুখ বাকিয়েই বলতে লাগে, গ্রামের কোন খরব রাখিস তুই?

দুর্গা বলে উঠে, কেন কি হলো আবার?

— দুই গ্রাম পর রাখাল পাড়ায় পাকিস্তানী বাহিনী ক্যাম্প বানাচ্ছে। সাত দিন পর নাকি চৌদ্দ জন পাক সেনা টহলে আসবে।

দুর্গা আতকে উঠে বলে, বলো কি আপা! দুই গ্রাম মানে আমাদের খুব কাছাকাছি তো।

— হ্যা রে।

— এখন কি হবে আপা আমাদের?

— জানি না রে। শুনলাম আমাদের গ্রাম থেকে নাকি পাকিস্তানি বাহিনীদের সাহায্য করছে৷

— কে?

— জানি না। শোন তুই সাবধানে থাকবি৷ ঘর থেকে বেরুবি না এক্কেবারে। বুঝেছিস?

— তুমিও বের হবে না আপা।

রোজিনা স্মিত হেসে বলে, আমার চিন্তা করতে হবে না। জানিস?

— কি?

— শফিক নাকি যুদ্ধে যাবে৷

কথাটা খুব ধীর গলায় বলে রোজিনা আপা।
দুর্গা চোখ গোল গোল করে অবিশ্বাসের সুরে বলে, আমাদের শফিক ভাই?

— তো আর কে? এই গ্রামে ওর মতো পাগলাটে আর কেউ আছে?

দুর্গা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো রোজিনার কথায়৷
রোজিনাকে দেখে মনে হচ্ছে, শফিক যুদ্ধে নাম দিবে শুনে সে খুব খুশি।

দুর্গা বলে উঠে, আপা যুদ্ধ কিভাবে করে?

রোজিনা ভ্রু কুচকে বলে, তোর এসব জেনে কি লাভ? শোন! ভুলেও বাসার বাইরে যাবি না। ঘরে থাকবি। অপরিচিত কারো ডাকে সাড়া দিবি না।

— আচ্ছা।

রোজিনা আবারো কি যেন ভাবলো, তারপর বলে উঠে, জানিস! শফিক বললো, মুক্তিযোদ্ধারাও নাকি আসবে আমাদের গ্রামে।

দুর্গার চোখ মুখ ঝিলিক মেরে উঠলো। মূহুর্তে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। সে কম্পিত গলায় বলে, মুক্তিযোদ্ধারা আসবে?

— শুধু কি আসবে নাকি! পাকিস্তানি দের নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে দেখে নিস! খেলা তো মাত্র শুরু রে!

দুর্গার ছোট্ট সহজ-সরল মনে গেঁথে গেল “মুক্তিযোদ্ধা” শব্দটা। আচ্ছা এই শব্দটা এতোটা পবিত্র কেন? কেন মুক্তিযোদ্ধা দের কথা ভাবলে তার চোখে পানি চলে আসে। দুর্গা মনের ক্যানভাসে মুক্তিযোদ্ধার ছবি আঁকার চেষ্টা চালানো। তার মনের মুক্তিযোদ্ধাটার পরনে প্যান্ট-শার্ট। মাথায় গামছা বাধা। রোদে মুখ, হাত পুড়ে গেছে। বেশ লম্বা। রাইফেল হাতে তাড়া করছে দুষ্টু পাকিস্তানি দেরকে।

তার ভাবনার সুতো ছিন্ন হলো বাবার ডাকে। বাবা বলে উঠে, দুর্গা মা! কই হাওয়া হলি! ছেলেটা অপেক্ষা করছে। ভাত নিয়ে আয়।

দুর্গা সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে দুপুরের ভাত আর কাঁচা কাঠালের তরকারি নিয়ে উঠানের দিকে হাঁটা দিলো৷

সুদীপ মল্লিক অতিরিক্ত উত্তেজনা নিয়ে আরোশকে বলে উঠে, বাবাজি, নাও চারটে ভাত খাও।

আরোশের প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। সকালে একটা কলা খেয়েছে। এরপর এখন বেলা ডুবলো বললেই চলে কিন্তু পেটে একটা দানা ও জোটেনি। খাবারের ঘ্রাণ নাকে আসতেই ক্ষুধা মশাই যেন পেটের ভেতর হরতাল শুরু করে দিলো।

দুর্গা প্লেট এগিয়ে দিতেই সে কোন দিকে না তাকিয়ে গোগ্রাসে ভাত গিলতে লাগলো। কাঠালের তরকারি ও যে এতো অমৃত হয় তা জানা ছিল না আরোশের।

দুর্গা ছেলেটাকে এভাবে খেতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো। সে বলল, আস্তে ধীরে খান। আপনার ভাত কেউ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে না।

বাচ্চা মেয়েটার মুখে এমন কথা শুনে আরোশ বেশ লজ্জা পেল৷ অপমানিত বোধ করল। এই জন্য খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে ধমক দিয়ে বলে, বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই৷ সম্মান দিয়ে কথা বলবে।

দুর্গা বিড়বিড়িয়ে বলে।,সম্মান না ছাই! হুহ, উনি হলো গিয়ে একটা লম্পট ধরনের দুষ্টু লোক। ওনার তো মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না।

সুদীপ মল্লিক বলে উঠে, কিছু বললে নাকি?

দুর্গা মেকি হেসে বলে, বাবা পাত্রপক্ষরা ক বললো?

সুদীপ মল্লিক উদাসিতা ভরা কন্ঠে বলে, নাকজ করে দিয়েছি এই প্রস্তাব।

দুর্গা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। স্বপ্ন লাগছে সবকিছু। মূহুর্তের মধ্যে সকল দুঃখ, কষ্ট কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। ভগবান নিশ্চয়ই তার প্রার্থনা শুনেছে৷

চলবে।

শুক্লাদ্বাদশী পর্ব-০১

0

#শুক্লাদ্বাদশী
পর্ব–১
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

— আপনি ভারী অসভ্য তো! এভাবে কোন মেয়ের ঘরে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া কেমন ধরনের ভদ্রতা শুনি?

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কম বয়সী একটা মেয়ের মুখে এমন নেতিবাচক কথা শুনে আরোশের গা রিরি করতে লাগে। প্রচুন্ড রাগ হলো তার। এক প্রকার মানুষ আছে,যারা কোন কিছু যাচাই-বাছাই না করেই মন্তব্য পোষণ করে।এদেরকে আরোশের একদম পছন্দ না। মানুষ মাত্র চিন্তাশীল৷ অথচ এই শ্রেণির লোকেরা চিন্তা করতে নারাজ।

মেয়েটা পুনরায় ঝাঁঝ গলায় বলে উঠে, একটা মেয়েকে এভাবে আপত্তিকর অবস্থাতে দেখেও আপনি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। এতো বিবেকহীন কেন আপনি বলুন তো? আপনার কি কোন লাজ-লজ্জা নাই? ঘরে মা-বোন নেই?

মেয়েটার কন্ঠ অতিরিক্ত ঝাঁঝালো। নিশ্চয়ই অন্য কারো রাগ তার উপর ঝাড়ছে।

আরোশ এবারে মেয়েটার দিকে তাকালো। সাধারণ বাঙালী চেহারা। নাকটা একটু বোঁচা। চোখের নিচটায় হালকা কালি জমা। ঠোঁটের হাফ ইঞ্জি নিচে বড় কুচকুচে একটা তিল। এবারে, গায়ের রং লক্ষ্য করলো সে। ধবধবে ফর্সা বা দুধে আলতা গায়ের রঙ নয় মেয়েটির, আবার শ্যামলাও না। এমন চামড়ার মেয়েদেরকে সম্ভবত বলা হয়, হলুদ ফর্সা। মেয়েটা হলুদ ফর্সার অধিকারী।

আপত্তিকর অবস্থা বলতে মেয়েটা কি বোঝাচ্ছে সেটা বোঝার জন্য আরোশ মেয়েটার দিকে আরো তীক্ষ্ম নজর দেয়।

মেয়েটা তা বুঝে ফেলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বাজখাঁই গলায় বলে, বেয়াদব ছেলে কোথাকার! বের হন বলছি আমার ঘর থেকে।মেয়ে মানুষ দেখলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তাই না? গিলে খেতে মন চায়! লম্পট কোথাকার! এমনি এমনি তো আর অসভ্য বলিনি।

আরোশ এবারে বুঝলো মেয়েটা আসলে ভেজা কাপড়ে আছে। শরীরে লেপ্টে আছে পরনের শাড়িটা। ভিজে জুবুথুবু অবস্থা যাকে বলে। চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। চুলের পানি মেঝেতে পড়ছে। আরোশ বুঝে পাচ্ছে না ভেজা অবস্থায় থাকা কিভাবে আপত্তিকর অবস্থা হয়?মেয়েটার কি মাথা ঠিক আছে? তাছাড়া এতো কম বয়সী মেয়ে তার উপর রাগ ঝাড়ছে এটাও আরোশের আত্নসম্মানে লাগছে খুব। কথায় কথায় মেয়েটা কোন কিছু বিবেচনা না করেই তাকে গালি-গালাজ করছে।

আচমকা আরোশের খেয়াল হলো মেয়েটার পরনে ব্লাউজ নেই। কিন্তু সুন্দর-পরিপাটি করে আটপৌরে শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক প্যাচে গ্রাম্য ধাঁচে পেছন দিয়ে আঁচল গুজে শাড়ি পরিধান করা যাকে বলে। এমনকি কোমড়ের সঙ্গে শাড়ির আঁচল গুজে দেয়া। গ্রাম বাংলার আর দশটে মেয়েও ঠিক এভাবেই শাড়ি পড়ে স্নান করতে যায়৷ খুবই সাধারণ দৃশ্যপট তবুও আরোশ এই সাধারণ বিষয়টি কে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলোনা।কি যেন হয়ে গেল তার ভেতর-ভেতর!

তার চোখ অস্বাভাবিকভাবে, মার্বেলের মতো বড় হয়ে যায়। বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ বাড়তে লাগে। এম্নিতেই সে হাপাচ্ছিলো। প্রচুন্ড বেগে দৌড়ে আসার ফলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছিল। অতঃপর এমন বিষ্ময়কর কিছু দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্বাস আটকে আসতে লাগে তার। সে খুকখুক করে কাশতে লাগলো। হুট করে মূহুর্তের মধ্যে গলা কাঠে পরিনত হয়ে গেল। ঢোক গিলতেও সে ভুলে গেল। গা বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কেমন অস্থির লাগা শুরু করলো। সে এখনো বেহায়ার মতো মেয়েটার মুখমণ্ডলের পানে চেয়ে আছে। সাধারণ চেহারা হলেও মেয়েটার মুখে কিছু একটা আছে যা তার চোখে ধরা পড়ছে কিন্তু ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে না! সে আবারো খুকখুক করে কাশলো৷

মেয়েটা বিরক্ত হয়ে গেল এবং ফটাফট বলে উঠে, যক্ষ্মা রোগী নাকি?

আরোশ জবাব দিলোনা। মেয়েটার আঁকাবাঁকা দাঁত তাকে আর্কষিত করলো। আঁকাবাঁকা দাঁত ও এতো চমৎকার হয়! আরোশের মনে হচ্ছে এই মেয়ের দাঁতগুলো আঁকাবাঁকা নাহলে দুনিয়া উলটে যেত! সে বহু কষ্টে ঢোক গিলল। অস্বস্তি বোধ দূর করার জন্য কি করবে তা বুঝে কুল পাচ্ছেনা। বেরিয়ে যাবে ঘর থেকে? যাওয়া তো উচিত!

মেয়েটা আবারো বলে উঠে, ভারী ইতর স্বভাবের তো আপনি! এতো অপমান করছি তাও আমার দিক থেকে চোখ সরান! দেখুন আমি বিবাহিত। খবরদার বাজে কিছু করার চিন্তা মাথায় আনবেন না,,,,,,,,,

আরোশের বুকে যেন আকাশের সমান ভারী কিছু আছড়ে পড়লো। হুট করে বুকে মৌমাছির হূল ফোড়ার মতো ব্যথা অনুভব হলো কেন?

সে এক পা দু পা পিছাতে পিছাতে বলে, দুঃখিত। আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন৷

— থাক! এখন আর এতো সাধুবাবা সাজতে হবেনা। কৃপা করে আমার সামনে থেকে চলে যান৷

— আপনি ভুল ভাবছেন আমাকে। আমি মোটেও এমন ছেলে না।

— তাহলে কেমন ছেলে আপনি? ( কটাক্ষের সুরে বললো মেয়েটা)

— জানি না।

— জানবেন কিভাবে? নিজেকে আয়নায় দেখেছেন কখনো? এই মূহুর্তে আপনাকে দেখতে বানরের মতো লাগছে! বনে বসবাস করা বানর! বুঝেছেন কি বলছি?

— না৷

— মানকি মতো লাগছে আপনাকে!

বলেই মেয়েটা আঁকাবাকা দাতে হালকা হাসতেই থেমে যায় যেন তার হাসা বারং!

হাসির আওয়াজে চকিত দৃষ্টিতে আরোশ সব লজ্জার মাথা খেয়ে মেয়েটার পানে তাকিয়ে থাকে। কেমন হাসফাস লাগা শুরু হলো তার। সে আর এক দন্ড অপেক্ষা না করে ঘর ছেড়ে, উঠান পেড়িয়ে মেয়েটার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল।

★★★
অপরিচিত লম্পট ধরনের ছেলেটা দৌড়ে পালাতেই আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর বেশ শব্দ করে ঘরের দরজা ভিজিয়ে দিলাম। নিষ্পলক চোখে কিছুটা সময় ওই জং ধরা দরজার পানে চেয়ে রয়ে থেকে, কিছু সময় পর, ঘরের মাঝ বরাবর এসে হাটু গেড়ে বসে কেঁদে ফেললাম। এতোক্ষন যাবত কান্না আটকানোর বহু চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চেষ্টা সফল হলোনা। শেষমেস কান্নারা দলা পাকিয়ে চোখ বেয়ে বেয়ে বর্ষন হতে লাগলো।গাল ভিজে যাচ্ছে চোখের অশ্রুতে আর মন পুড়ে যাচ্ছে হাহাকারে৷

ডুকরে ডুকরে কাদতে লাগলাম। আজকে আমার জন্য কাল-রাত। আজকের রাতের উপর আমার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ স্বপ্ন পূরণ কিংবা স্বপ্ন ভঙ্গন নির্ভর করছে। বাবার সিদ্ধান্ত জানার জন্য আমি চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছি।

সাত দিন আগেই আমার বয়স আঠারো হলো। হাজারো স্বপ্ন দেখা ও রঙের বয়স আমার। মাত্র আঠারোতে পা দিতেই যেন চারপাশের মানুষ-জনের কাছে আমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি। বিয়ে দেয়ার বয়স নাকি হয়ে গেছে? কে জানে? আঠারো বছর বয়সই বোধহয় বিবাহের জন্য উত্তম সময়? ছেলেটাকে মিথ্যা বলেছি আমি বিবাহিত নই কিন্তু বাবা আমার নামের আগে বিবাহিতা তকমা লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আচ্ছা আমি যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতাম, তবুও কি আঠারোতে পা দিলে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগত সবাই? কে জানে? আমার মনে হচ্ছে, ইশ যদি ছেলে হয়ে জন্ম নিতাম! তাহলে আমিও মুক্ত স্বাধীনভাবে স্বপ্ন দেখতে পারতাম। ইচ্ছা হলেই ছুট লাগাতাম সদরে! কেউ বাঁধা দিয়ে বলত না, মেয়ে মানুষ কেন একলা ওতো দূর যাবে?

আশেপাশের অবস্থা ভালো না জন্য পাশের বাসার চাচি সহ আব্বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেছে আমাকে শ্বশুড়বাড়ি পাঠানোর জন্য। বিয়ে দেয়ার পেছনে আরো একটা কারণ হলো রুপ। বাবা আর চাচি ভাবেন আমি বুঝি খুব রূপবতী। এটা যে তাদের ভুল ধারণা সে সম্পর্কে তারা বিন্দুমাত্র অবগত না। আমি মোটেও সুন্দরী না। খুব সাধারণ একজন মেয়ে। তারপর ও তারা যত দ্রুত সম্ভব আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি! আমি খুব করে চাই বিয়ে যেন নাহয়। আমার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার। বড় একজন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ। কিন্তু বাবা আমাকে একদম বুঝে না। তার মতে, আমার নিরাপত্তাই সবকিছু। বাবাকেও দোষ দেওয়া যায় না। আসলেই তো কম বয়সী মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় আছে। কখন কি ঘটে যায় কে জানে? প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘন্টা, প্রতিটি মিনিট আতংকে কাটছে! ভয়ে।ভয়ে যাচ্ছে দিন গুলো।

হুট করে আমার মাথায় একটা ভয়ংকর চিন্তা খেলে গেল। ছেলেটা কে? আগে তো কোনদিন দেখিনি তাকে! এই ভর দুপুরে কি চাই? বাবা তো বাসায় নেই! আমি একা বাসায়। ভয়ে ঢোক গিললাম।খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে না তো আর জন্য! কোন কিছু না ভেবেই দ্রুত শাড়ি বদলিয়ে ঘরের বাইরে বের হলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাসার সামনের খালি জায়গায় ওই লম্বা বাঁশের মতো রোগা মেরুন শার্ট পড়া ছেলেটাকে আবারো দেখতে পেলাম।

এক পা এগিয়ে আসতেই সে বলে উঠে,এইদিকে আসবেন না। পানি পড়েছে। জায়গাটা পিছলা হয়ে আছে৷

আমি অতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে বলে উঠি, জন্ম থেকে এই বাসায় বেড়ে উঠেছি। চোখ বন্ধ করেও হাটতে পারব।

কথাটা শেষ করে যেই না উঠানের সিঁড়ি হতে নিচে পা ফেলব, ওমনি পিচ্ছিল কাদায় পা লেগে চিটপাটাং হয়ে পড়তে ধরলে, খুব গরম দুটো হাত আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে।

আমি চমকে উঠি তার উষ্ণ স্পর্শ তে। তিরতির করে কাপতে লাগলো আমার চোখের পাপড়ি। কেমন যেন চাপা বেদনা তৈরি হলো আমার মনের কোণে। চোখে পানি চলে আসলো।

সে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে, বিনীত গলায় বলে, এখুনি তো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত!

অতি নিকটে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন।আমাদের মাঝে দূরত্ব কেবল চার ইঞ্জি।
তার গায়ের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছে।
আমি বিষ্ময় ভরা চোখে তার দিকে চেয়ে আছি। নাকের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো ফোটা ফোটা ঘাম জমে গেল।

আচমকা কার যেন কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে। কানে ধ্বনি এলো, ছিঃ! ছিঃ! এইসব কি নষ্টামি চলছে? তোদের উপর গজব পড়বে৷

চলবে।

প্রেমের আটফোড়ন পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেমের আটফোড়ন
#writer :Arshiya shidratul falak
#পর্ব :৮(শেষ)
অধরা কোনো উপায় না পেয়েই রিহানকে সাথে করে নিয়ে গেল,,,

অধরা আব্রাহামের বাসার সামনে কলিং বেল চাপ দিতেই ভাবি এসে দরজা খুলে দিলেন। আব্রাহামের বাবা বিদেশ থাকেন। তাই ভাবি আর আব্রাহাম ওদের পরিবারে,

হাই ভাবি কেমন আছেন,,?

আরে অধরা যে আসো ভেতরে আসো,,

অধরার পাশে রিহানকে দেখে ভাবি মাথা নেরে অধরাকে ইশারা করলেন যে কে ইনি,,

অধরা বলল আমার ভার্সিটির ফেন্ড,,

রিহানের এবার রাগ হলো তাও নিজের রাগকে সংযুত রেখে বল্লেন

ভাবি আমরা কি ভেতরে আসবো??

আরে হে আসো তোমরা, আমিও পাগলের মত তোমাদের বাহিরে দাড় করিয়ে রাখছি। আসো ভেতে আসো,,

অধরা আর রিহান বাসার ভেতরে ডুকতেই আব্রাহাম ছুটে আসলো , এসেই অধরাকে জরিয়ে ধরলো,,
তারপর রিহানকে দেখে অধরার কানে কানে বলতে লাগলো ….

পুফি পুফি এতা কে হয় তোমার??

অধরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিহান বলে উঠলো,,
আমাকে চিনতে পারছোনা বাবু। আমি তোমার তোমার আংকেল। তোমার ফুপির স্বা……
বলতে পারলো না অধরা রিহানের কথার মাঝে টান দিল,,
আব্রাহাম সোনা ওনি আমার বন্ধু নতুন বন্ধু বুঝলে,,

ও আত্তা।
রিহান এবার অধরার মুখের দিকে রাগি লুক নিয়ে তাকিয়ে রইলেন,,
অধরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা এই রিহানটা চায় আসলে কি???
নিজেই বলল কারো কাছে বৌ হিসাবে পরিচয় না দিতে আবার এখন নিজে এসেই বলে পরিচয় দিতে চাচ্ছে স্ত্রী হিসাবে,,
অধরা পড়েছে মহা ঝামেলায়,, আব্রাহামের বাসায় কিছুক্ষন গল্প করে বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য বের হয়,তখন সামনে এসে রিহান আবার পথ আটকায়,,

এই মেয়ে আপনাকে না বল্লাম আমার সাথে আমার বাসায় যেতে । বাবা বলছে আপনাকে নিয়ে যেন বাসায় যাই,

আমি যাবো না যাবোনা যাবোনা ব্যাস হয়েছে,, যান এবার আপনার পথ আপনি ধরেন।

রিহান এবার রেগে গেল, তাই অধরাকে কোলে করে বাইকের সামনে বসিয়ে রাখল এবং পেছনে সে বসে পড়লো, অধরা বেচারি তো পুরা শক খাচ্ছে,, এ ছেলে চাইছেটা কি সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না,,,

অধরাকে নিয়ে রিহান বাসার আসলেন,, বাসার ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলেন তার গুনধর বন্ধুরা সব ছাদ থেকে তাদের কাহিনী দেখছে আর হাসছে মুখ টিপে।

অধরা ঘরে প্রবেশ করতেই রেহানা ছুটে এসে অধরাকে জরিয়ে ধরলেন , আরিফ চৌধুরি সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন অধরাকে দেখে তাড়াতাড়ি সামনে আসে, এসেই অধরাকে আর রেহানাকে জরিয়ে ধরে দুই মেয়ের কপালে চুমু একে দেয়,,
ওনার এমন পরম ভালোবাসার আবেশে অধরার চোখ থেকে অঝরে পানি পড়ছে ,,,

অধরা মনে মনে বলছে শুনেছি বড়লোকরা নাকি গরিবদের সহ্য করতে পারেন না। আর ওনারা কত বড় মনের মকনুষ আমার মত একটা এতিম গরিব মেয়েকে কতটা ভলোবাসা দিয়েছেন। আজ যদি আমার বাবা বেচে থাকতেন তাহলে আমাকে হয়তো এভাবে আদর করতেন, তখন আরিফ চৌধুরি অধরাকে বলতে লাগলেন,,,

কি হলো মা তুই এভাবে বার বার কাদিস কেন??
না বাবা এমনেই,,
না আমাকে বলতে হবে তোর এত কষ্ট কেন??
তখনই রোদ্দুর এসে বলল,,
আসলে আমার বোনটা ছোট থেকে বাবার আদর স্নেহ, ভালোবসা কিছুই পাইনি তো তাই,,,
আরিফ চৌধুরি এবার মুখটাকে মলিন করে নরম কন্ঠে বল্লেন,,

কে বলল সে বাবার ভালোবাসা পায় নি আমি দেব, আজ থেকে আমার দুই মেয়ে এক ছেলে,,

অধরা বেশ খুশি মনে বাবাকে জরিয়ে ধরলেন,
————————-

রৌদ্দুর ভাইয়া দারান???

হঠাৎ মেয়ালি কন্ঠ ভেসে আসতেই রৌদ্দুর পেছন ফিরে তাকালো তাকিয়ে রেহানাকে দেখতে পেল,,,, রৌদ্দুরের সাথে তুর্য দাড়িয়ে ছিল,, রেহানা ইশারা করায় সে চলে যায়,
রেহানা বসে আছে একটা টুল এর উপর রেহানা থেকে রৌদ্দুর কিছুটা দূরত্ব রেখে দাড়িয়ে আছে,,

কি জন্য ডাকলে (রৌদ্দুর)
একটা কথা ছিল( রেহানা()
কি কথা,,,,
রেহানা আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,,

আ আ আসলে আপনি বিয়ে করবেন কবে,,,???

রেহানার এমন প্রশ্নে রৌদ্দুর ভ্যাবাচ্যাকা ধেয়ে যায়। কি বলবে বুঝে ওঠতে পারছেনা।

তাও নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,,

হুম বিয়ে তো করবোই,,
কথাটা বলার সাথে সাথেই রেহানা রৌদ্দুরকে প্রশ্ন করে ফেলেল,,, কোনো মেয়েকে পছন্দ করে কিনা,, রৌদ্দুর বিষ্মিতমুখ নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল তারপর কোমল কন্ঠে বলল,,

হুম মেয়েটাকে আমি খুব লাভ করি। বাট সে করে কিনা তা আদোও জানা হয়ে ওঠে নি,,

কে সে,,??

আছে একজন আমার মনের রানী,,,


রেহানা রৌদ্দুর মুখপানে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো গভীর চাহনীতে,, তারপর চোখের কোনে একরাশ জল নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে,,
নিরর্জন রাস্তার কিনারে মাঝপথে হেটে চলেছে রেহানা,,চোখ থেকে বিষাদময় আশ্রু গরিয়ে পরছে গাল বেয়ে বেয়ে, একতরফা ভালোবাসাটা আসলেই কঠিনজনক।দুই বছর ধরে রৌদ্দুকে ভালোবেসে এসেছে,, কিন্তু মুখফুটে কখনোই বলে উঠতে পারে নি যে,, রৌদ্দুর আমি তোমাকে ভীষন রকম ভালোবাসি,,

এতদিন রেহানা মনে করে ছিলের হয়তো রৌদ্দুর তাকে পছন্দ করে। কিন্তু আজ সব মিথ্যা করে দিল।।

______________

রাতে সবাই একসাথে ডিনারে বসেছে অধরাও আছে সাথে। বাবার জোরাজুরিতে রিহানের বাসায়ই রয়ে গেল,,, সবাই খাবার খাচ্ছে কিন্তু অধরা খাচ্ছেনা, সকাল থেকে কিছু না খাওয়ায় তার শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে,, আর এখন টেবিলে রাখা খাবারের গন্ধে কেমন যেন বমি বমি পাচ্ছে,,,

অধরা চিকেন থেকে একটা চিকেনের লেগ পিছ নিল। সেটা মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই দৌড়ে ওয়াস রুমে গেল,, রিহানও খাবার ছেড়ে অধরার পেছন দৌড় দিল এসে দেখে অধরা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে,, তাই রিহান আর জ্বালালো না,,

সে শুয়ে পরে মাঝে কোলবালিশ রেখে। মধ্যে রাতে কারো গরম নিঃস্বাশে ঘুম ভেঙ্গে যায় রিহানের, তাকিয়ে দেখে অধরা তাকে জরিয়ে শুয়ে আছে কোলবালিশ নিচে ফেলে, এমনভাবে জরিয়ে আছে যেন ছুটলেই পালিয়ে যাবে,, রিহান একটা মুচকি হাসি দিল,,

চলে গেল অতীতে,,,,, আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে অধরাকে দেখেছিলো রাস্তার একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে হেটে হেটে কোথায় যাচ্ছে,, রিহান প্রথম দেখায় অধরাকে ভালো লেগে যায়। তারপর আস্তে আস্তে খোজ নিয়ে দেখে অধরার এতিম এব্ং অসহায়।

সেদিনের পর থেকে রিহান অধরাকে ফলো করতে থাকে,,

অধরা পাশের বাসার ভাবিটা ছিল রিহানের বন্ধু অতসী,, রিহান তাকে সব কিছু খুলে বলায় অতসী তাকে সাহায্য করে,,,,

____

ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে অধরার ডাকে,,

এই যে মিস্টার আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরুন খুব ঠান্ডা লাগছে,,,

ঘুম ঘুম চোখেই অধরা কথাগুলো বলল,, রিহান অধরাকে জরিয়ে ধরতে যাওয়ায় থেমে গেল, কারন অধরার গায়ে জ্বর এ পুরে যাচ্ছে, রিহান তাড়াতাড়ি ওঠে একটা বাটিতে করে পানি এনে জল পট্টি দিতে থাকে, এভাবে সকাল হয়,,
অধরা সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখে রিহান তার পাশে বসে বসে ঘুমাচ্ছে,, তার সামনে একটা পাত্রে জল তার ভেতর আবার একটা কাপড় অধরার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে কাল সারা রাত রিহান অধরার সেবায় মগ্ন ছিলেন৷,, তারপর অধরা লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে ওঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে যায়,,, গিয়ে দেখে রেহানা মন মরা করে বসে আছে,, তাকে জিজ্ঞেস করায় সে সব কিছু বলে,, প্রথমে বলতে চাইছিলো না কিন্তু অধরার জোরাজুরিতে বলতে বাধ্য হইছে, ,
অধরা সব শুনে তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না,,
,,,এভাবে কেটে গেলো তাদের একটি বছর,,

একটি বছরে অনেক কিছুই পরীবর্তন হয়েছে,,,
রিহান অধরাকে নিজের করে পেয়ছে,,
রৌদ্দুও রেহানাকে আপন করতে পেরেছে,, সেদিন রৌদ্দুর যখন রেহানে বলেছিল সে একটি মেয়েকে ভালোবাসে সেটা আর কেউ নয় রেহানাই ছিল,,,,

____________

রাস্তার পাশে হাটছে রিহান অধরার হাত ধরে তখন অধরা বলল,,

আচ্ছা রিহান আমাদের সম্পর্কটাকে কি নাম দেওয়া যায় বলো তো,, যেখানে আমরা সারাদিন ঝগড়া করি পরে আবার এক হয়ে যাই,,

রিহান বলল টম এন্ড জেরি,,

অধরা হোহো করে হেসে ওঠলো

সমাপ্ত