Friday, July 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1419



যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

1

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#শেষ পর্ব
জাহানারা ছেলে-মেয়েদের খেতে ডাকলেন।খাবার টেবিল পূর্ণ হলো বড় ভাইয়া, ভাবি। ছোট চাচ্চু, চাচ্চি আর তার দুই ছেলে-মেয়ে আর মহুয়া।পরিবারের সকলের সামনে মহুয়ার বাবা জানিয়ে দিলেন,,

” রওনকের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি!”

মহুয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বাবার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। কিছুটা ক্ষুদ্ধ হয়েই বললো,,

” আমি তাকে বিয়ে করতে পাড়বো না বাবা!”

বাবা মহুয়ার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। শক্ত কন্ঠে বললেন,,

” শেষ বয়সে এসে আমাদের মানুষের সামনে লাঞ্ছনা অপমানিত করতে চাইছো? এ জন্যই কি তোমাদের বড় করেছি?”

মহুয়া অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া থেকে টপটপ পানি পড়তে শুরু করেছে। মহুয়া কম্পিত কণ্ঠে বললো,

“বাবা আমার বিয়ে হয়ে গেছে যেনেও কিভাবে বিয়ে দিতে চাইছো? ”

মহুয়ার বাবা ক্ষেপে গেলেন। খাবার ভর্তি টেবিল উল্টে ফেলে দিলেন। ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো বাচ্চা দুটো। তাদের দাদাজানকে এমন রাগতে কখনো দেখেনি। কান্না কান্না চোখে মায়ের দিক তাকাতেই ছোট চাচি তাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাবা তখন দিগুণ চেঁচিয়ে বললেন,

“কিসের বিয়ে? এসব বিয়ে, ফিয়ে মানি না আমি! আমার এখানে থাকতে হলে আমার কথাই মানতে হবে!”

মহুয়া ছলছল চোখে তাকালো বাবার দিকে। কম্পিত কন্ঠে বলল,,

“বাবা তুমি মানো বা না মানো বিয়ে আমাদের হয়েছে। শরিয়ত মোতাবেক হয়েছে। কালেমা পড়ে, কবুল বলে হয়েছে। এ বিয়ে তুমি নাকচ করলেও এ বিয়ে….”

কথার মাঝেই বাবা গালে থাপার মারলেন কসে।দূরে ছিটকে সোকের কোনায় বাড়ি খায়। বাবার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি চিৎকার করে বললেন,,

“কই তোর নাগর? ডাক আজই বিদেয় করবো তোকে এই বাড়ি থেকে। তোর মতো অবাধ্য সন্তান আমার চাই না। হয়তো তোর নাগরকে ডাক বের হবি! নয় সন্ধ্যার মাঝে তৈরি হবি। আজ তোকে বিয়ে দিয়ে আপদ ঘার থেকে নামাবো!”

মহুয়া বাবার দিক অসহায় ভাবে তাকালো।আশে-পাশে সবাই দাঁড়িয়ে কেউ এগিয়ে এলোনা। মহুয়া একা, একা ছিল, আছে, থাকবে। ডুকরে উঠল
মহুয়া।

——–

দাদাজানের সামনে বসে আছে ইয়ামিন। শরীর আধো ভেজা, চুল বৃষ্টির পানিতে ভিজে লেপ্টে আছে কঁপালে। দাদাজান চুরুট খাচ্ছিলেন। নাক, মুখ দিয়ে ধোয়া ছাড়ছেন। কালো ধোঁয়া। ইয়ামিন অবাক হয়ে দাদাজানকে দেখে যাচ্ছে হাতে তার 9MM পিস্তল। মাথায় ঘুরছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। সার্ভিস সেন্টার থেকে গাড়ি আসার পর ইয়ামিন বার চারেক তল্লাশি করেছে চিঠি পায়নি। ইয়ামিন হতাশ হয়ে স্টাডি রুমে বসলো। সেখানেই ময়লার ঝুড়িতে পড়ে থাকতে দেখলো আধো পুড়ে যাওয়া চিঠি। ইয়ামিনের চোখ খুশিতে উদ্যপিত হলো৷ চিঠি বুকে জড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। বিগত কটা দিন নীজের অস্তিত্বই যেন খুঁজে পাচ্ছিলো না। ইয়ামিন হাসলো। পরমুহূর্তেই চিঠি হাতে বেড়িয়ে গেলো মায়ের রুমে। ইয়ামিনকে এভাবে দেখে চমকে উঠলেন ইয়ামিনের মা। শুকনো ঢুক গিলে চাপা হাসার চেষ্টা করে বললেন,

“কিছু বলবে বাবা?”

ইয়ামিন স্থীর দৃষ্টিকে তার মায়ের দিকে তাকালো। শীতল কন্ঠে বলল,,

“কেন মিথ্যা বললে মা? ”

ইয়ামিনের মা থম মেরে গেলেন। মাথার মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল,

“আমার ছেলের প্রাণ আমার কাছে সব থেকে দামি। তার জন্য সারাজীবন মিথ্যা বলতে হলে তাই বলবো।”

ইয়ামিন আহত দৃষ্টিতে তাকালো।দৃঢ় কন্ঠে বলল,

“কে করেছে এমন?”

মা চুপ করে রইলেন। মুখে কুলূপ এটে বসে রইলেন৷ ইয়ামিন এক পলক তাকিয়ে মায়ের দিকে। বের হয়ে সোজা দাদাজানের কাছে। ইয়ামিন এবার ঠোঁট নাড়লো,,

“কেন করলেন দাদা জান?”

দাদাজান বললেন,

“আমি কিছুই করি নি দাদু ভাই! মেয়েটি তোমার জন্য ঠিক ছিলো না!সে টাকা নিয়ে বিদায় হয়েছে। ইয়ামিন কিছুই বিশ্বাস করলো না। মহুয়া কখনোই টাকা নেয়নি তা সে জানে। ইয়ামিন তপ্ত কন্ঠে বলল,

” আমি সব জেনে গেছি দাদাজান? সেদিন মহুয়ার বাবার চাকরি আপনি খেয়ে ছিলেন। তাই না? এমন কি সেই মেয়েকেও আপনি পাঠিয়ে ছিলেন?”

দাদাজান ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,

“হে সব আমি করিয়েছি। কত সাহস এক কর্মচারী হয়ে আমার নাতির সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়ার ধান্দা করে!”

ইয়ামিন বন্দুক তাক করলো দাদাজানের দিক। চিৎকার করে বলল,

“তার মানে? জেবিন কে আপনি মারিয়ে ছিলেন?ওর এক্সিডেন্ট হয়নি!”

দাদাজানের সহজ স্বীকারোক্তি,

“হে!”

ইয়ামিন উঠে দাঁড়ালো। পুলিশের ভিতরে আসতে বলল। খবর আগেই দিয়ে এসেছিলো সে। দাদাজান সহজ ভাবেই চলে গেলেন পুলিশদের সাথে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন,

“দাদু ভাই আমার সব সম্পত্তি তোমার নামে সুখে থাকে। ”

ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দাদাজানের যাওয়ার পথে। ইয়ামিন আজ পর্যন্ত তার দাদাজানকে বুঝতে পারেনি লোকটি রহস্য ময়ে ঘেরা।

———-

মহুয়া বউ সেজে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে কাঠ হয়ে। মহুয়ার ভাবী বললো,

“জামাই চলে এসেছে। চলো!”

মহুয়া রবোর্টের মতো উঠে দাঁড়ালো। ভাবী তাকে এনে বসিয়ে দিলো একটি ছেলের পাশে। মহুয়া মাথাও তুললো না। ছেলেটির দিকে তাকালোও না। যখন কবুল বলতে বলা হলো। রোবটের মতো বলল,

“কবুল, কবুল কবুল!”

ছেলেটিও কবুল বললো। ঠিক সেই মুহুতেই মহুয়া হাতের মাঝে গুঁজে রাখা বিষের শিশি টুপ করে খেয়ে নিলো। সকলেই হতবাক। হুট করেই মহুয়ার মুখ থেকে রক্ত বের হতে আর্তনাদ করে উঠলো পরিচিত এক মুখ। ইয়ামিনকে পাশে বসে থাকতে দেখেই মহুয়া চোখ বুঝে ফেললো। ইয়ামিন বুকে চেপে কোলে তুলে দ্রুত বের হলো। পিছন থেকে কান্নার রোল পরে গেলো। মেয়ের সুখের জন্য এত কিছু করলো? মেয়েকে মৃত্যুর দাড়ে পৌছানোর জন্য নয়। মহুয়া বাবা ঠায় বসে রইলেন। ইয়ামিনের মা বোন পিছু ছুটেছে তাদের। তখনি ভাবি ঘর থেকে বের হলো। চিঠি হাতে। আঁচলে মুখ চেঁপে বলল,

“বাবা একটা বার ওর কথা শুনলে কি হতো?”

বাবা চুপ করেই রইলেন। নিথর দেহ তার। চোখের কোনে জল টলমল করছে। তিনি চিঠি মেলে ধরলেন,

“বাবা,

ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে জাহানারা মাকে মা জেনেছি তার কারণ তুমি বলেছো। আমার জীবনের প্রতিটা ডিসিশন তুমি নিয়েছো আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু মন? তা কিভাবে আমার পত্র প্রেমিকের হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। আমি পাড়তাম না তোমায় অপানিত করতে, আর না আমার পত্র প্রেমিককে ছাড়তে। ছাড়াতো তখন যেত পরিস্থিতি যদি আমাদের বিপক্ষে না হতো। ওভাবে আমাদের বিয়ে না হলেও আমি তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নিতাম। কিন্তু আমি বিবাহিত। যেভাবেই হোক বিয়ে আমার হয়েছিলো। তাহলে কেন তুমি মানতে চাইছো না? এবার হয়তো মানবে, আমার মৃত্যুতে। যতক্ষণে এ চিঠি তুমি পাবে? ততক্ষণে আমি পারি জমাবো ভিন্ন দেশে। ক্ষমা করো আমায়। ভালো থেকো।

ইতি,

তোমার ঘার থেকে নেমে যাওয়া আপদ”

মহুয়ার বাবা স্থীর হয়ে বসে রইলো। অপরাধ বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে তো ভেবে ছিলো মেয়েকে পার করে দিবেন সমাজের তুচ্ছ কথা বন্ধ করতে। একটি মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আবার ফিরে এলে কতরকম কথা শুনতে হয়? ইশশ! উনি যদি সমাজের কথা না শুনতো?? তাহলে তার মেয়ের এই অবস্থা হতো না!”

———-

মহুয়ার অবস্থা বেশি ভালো না। ডাক্তার তাদের যথাযথ চেষ্টা করছে। গলার মাঝে নল ঢুকিয়ে বিস বের করা হচ্ছে। ইয়ামিন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। মেয়েটি বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে।ইয়ামিনের বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে বার বার। এই ভয়ানক দৃশ্য সে দেখতে পারছে না। ইয়ামি দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনি কাছে এলো আয়দা। ইয়ামিনের কাছে একটি চিঠি দিয়ে বলল,

“মহুয়া আপুর ভাইয়া দিয়েছে!”

ইয়ামিন চিঠি হাতে নিলো। আয়দা চলে যেতেই চিঠি খুললো সে,

“আমার নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিক,

জানি না আমার শেষ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছাবে কিনা। তবে আমি চাই পৌঁছাক। তুমি বলেছিলে, আমি মিথ্যা বলছি। আমার কাছে কোনো প্রুভ নেই নিজেকে যাচাই করার মতো। আছে শুধু এই চিঠি। যদি কখনো পৌঁছায় হয়তো বুঝে যাবে আমি তোমার মরীচিকা। মনে আছে বলে ছিলাম? আমি মরুভূমির দেখা জল ভ্রমের ন্যায়। এবার যত ছুঁতে চাইবে? তত হারোবো দূরে।

ইতি,

মরিচীকা”

ইয়ামিন হুহু করে কেঁদে উঠলো। সেখানেই বসে হাত পা ছড়িয়ে ডাকতে লাগলো,

“মহুয়া প্লীজ কাম ব্যাক। প্লীজ, প্লীজ! ”

“ইয়ামিন?”

পিছন থেকে মহুয়ার কন্ঠে ভেসে আসতেই ইয়ামিন দৌড়ে যায় তার কাছে। ডাক্তার জানায় সে ভালো এখন। ইয়ামিন ধমকে উঠে,

“কেন করলে এমন পাগলামি! ”

মহুয়ার চোখেও পানি। ইয়ামিনের গালে স্পর্শ করে বলল,

“তোমার জন্য মরতে পারি!”

ইয়ামিন হেসে বলল,

“আমি যে তোমার সাথে বাঁচতে চাই।”

মহুয়ার ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে উঠলো। এই প্রথম দুজন যুগলবন্দীর দৃষ্টি মিলন হলো। ঠোঁটে ঠোঁটে কথা হলো। আলিঙ্গন করে নিলো একে ওপরকে।

———-

চার বছর পর,,

আজ বাবা-মায়ের হাত ধরে হেটে চলছে মেহুল। ছোট ছোট হাতে আকড়ে আছে বাবা-মায়ের আঙ্গুলের ভাজে। কবর খানার সামনে এসে থামলো তারা। ইয়ামিনের দাদাজানের কবরে। চারিদিকে ঢেকে আছে গাছপালা। ইয়ামিন শ্রদ্ধার সাথে মোনাজাত করলেন কবর খানার বাহিরে দাঁড়িয়ে দু হাত তুললো, মহুয়া আর তার মেয়ে মেহুল। ইয়ামিনের চোখে পানি। তার দাদাজানের জন্য আজ মহুয়া তার স্ত্রী। সব অবদানই তার। সেদিন মহুয়ার ঠিকানা দাদাজান দিয়েছিলেন। শুধু তাই না তাকে চমকে দিয়ে মহুয়ার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। সেদিন সময় মতো না গেরে মহুয়ার মরা মুখ তাকে দেখতে হতো। এই জন্যই বার বার দাদাজানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায় সে।কবর খানা থেকে আসার পথে তাদের ছোট মেয়ে কবুতর দেখে আবদার করে বসে। তাদের ভালবাস প্রতীক এই পায়রা যুগলদের কিনে নিলো তারা। নিজেদের ঘরের বেলকনিতে সাজিয়ে দিলো তাদের ছোট্র সংসার। তাদের কাজ গ্রিলের উপর বসে প্রেম করে তারা। ঠিক ইয়ামিন আর মহুয়ার মতো যুগলবন্দী পায়রা 🕊️ তারা।

সমাপ্ত

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-১৩+১৪

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-১৩
প্রতিবারের মতোই সেদিনও চিঠি লিখে পায়রার মাঝে বেঁধে উড়িয়ে দিয়ে ছিলো ইয়ামিন । প্রায়ই করতো৷ উত্তর মিলতো না কখন-ও। কিন্তু একদিন সব পালটে গেল। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে ফিরে এলো উড়ো চিঠির উত্তর। সেদিন ইয়ামিন কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিলো। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছিলো।গলা শুকিয়ে কাঠ। ইয়ামিন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ সিলিং এর দিক তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে। চিঠিটি কাছে টেনে বার কয়েক পড়ে ফেললো। মরীচিকা নামের চিঠি মিতা তার চিঠি সঙ্গী হয়ে যায়। ধীরে ধীরে হতে থাকে গভীর। দু ধারেই চলতে থাকে ভাসমান স্রোত। ইয়ামিনের গভীর মন দ্বিতীয় বার প্রেমে পরে গেলো। অনুভূতি দোটানা পিছনে ফেলে লিখে ফেললো একখানা রঙ্গিন চিঠি।

মরিচীকা,

আমি হয়তো কখনো কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে পারবো না তোমাকে। দামি কিছু উপহার দিতে না পাড়লেও উপহার হবে বেলিফুলের মালা, হাত ভর্তি কাঠ গোলাপ বা কখনো একটি টকটকে লাল গোলাপ। আমি নিজ হাতে গুজে দেবো তোমার খোপায়। তোমার বড় কোনো আবদার পুরন করতে হয়ত অক্ষম হবো আমি। কিন্তু কোনো এক শেষ বিকেলের, সিঁদুর রাঙ্গা মেঘের আলোয় কোনো এক পথ ধরে হাটবো আমরা। হাতে থাকবে ভাজা বাদামের ঠোঙ্গা। একটা একটা করে ছুলে আমি তোমার সামনে ধরবো বলবো,,

“আমার স্বপ্নের রানী গ্রহন করুন”

তুমি হয়তো হাসবে। ভাববে তোমার নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিক বুঝি সত্যি পাগলো। সত্যি বলি? হে পাগল আমি পাগল, সেই না দেখা, না ছোঁয়া মানুষটির জন্য পাগল।

ইতি
নিশ্চুপ পাগল প্রেমিক।

এর পরবর্তী কোনো উত্তর আসেনি। এসেছিলো একটি লকেট। মাঝে হার্ট এর ভিতরে একটি পায়রা, যার ঠোঁটে একটি চিরকুট। ইয়ামিন সেদিন খুশিতে চোখের জল ছেড়ে দিয়েছিলো। এর পর তারা ঠিক করলো তারা দেখা করবে। কিন্তু সেদিন সব পাল্টে গেলো। তার মরীচিকা এলো না। ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু যখন এলো তখন জানালো তার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে যেন আর তার জন্য অপেক্ষা না করে।

এটুকু বলেই থামলো ইয়ামিন। চোখের জল বন্যা রূপ নিলো। মহুয়াও কাদতেছে। মুখ চেপে কাঁদছে। ভাগ্য তাকে চিঠি প্রেমিকেরই দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। অথচ সে? পুরো দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরক্ষণেই মাথায় ঘন্টি বাজিয়ে যাচ্ছে, কার সাথে ইয়ামিন সেদিন কথা বলেছিলো? সেদিন মহুয়া আসতে চেয়েও পারেনি তার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেদিন। তার পরই তো তাকে খুঁজতে এত দূর আসা। মহুয়া কান্না থামাতে ঢুক গিললো। ইয়ামিনের সামনে তুলে ধরলো সেইম লকেট৷ ইয়ামিন অশ্রু বিদ্ধ চোখে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। ইয়ামিন হাটু মুড়ে ফ্লোরে বসেছিলো। মহুয়ার তার কাছে এসে বলল,

“আমি সেদিন আসতে চেয়ে ছিলাম ইয়ামিন। কিন্তু সেদিন আমার আব্বুর চাকরি চলে যায়। আব্বু টেনশনে বাসায় ফিরার সময় এক্সিডেন্ট হয়। আমাকে বাসা থেকে কল করাতে যেতে হয় সেখানে। কিন্তু আমি তো আমার এক বান্ধবীকে পাঠিয়েছিলাম আপানাকে জানাতে।”

ইয়ামিন এখনো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। মাথা ফাকা ফাকা লাগচ্ছে, তার ফিলিংসের সাথে মেয়েটি কি খেলা করছে? কে এসে বলে সে চিঠি মিত্র তার বিয়ে ঠিক, আর ফেলে চলে গেলো। আর আজ যাকে বিয়ে করেছে? সেও দাবিদার। ইয়ামিনের এবার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। পুরো পৃথিবী জালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কি পেয়েছে সবাই? তার অনুভূতি, ভালবাসা এতটাই তুচ্ছো? ইয়ামিনের মুখের রং মুহূর্তেই পাল্টে গেলো। রাগে কাপচ্ছে তার শরীর। মহুয়া এক ধাক্কা মেরে গগনবিদারী এক চিৎকার করে বলে উঠলো,,

“আমার ভালোবাসা, অনুভূতি এতো টাই ঠুনকো? যে যখন যা ইচ্ছে এসে বলে যাবে? নো! আই উইল নেভার দেট হ্যাপেন্ড। ”

মহুয়া ইয়ামিনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ফ্লোরে বসে ফুপাচ্ছে। কি ভাবে সে বিশ্বাস করাবে? সেই তার পত্র প্রেমিকা? মহুয়া কিছু একটা ভাবলো। তার পর উঠে দাঁড়িয়ে ইয়ামিনের কাছে গেলো। ইয়ামিন তখন বাহিরের পানে চেয়ে। মহুয়া দু হাত মুচরাতে মুরাতে মিনমিন করে বলল,,

“মনে পরে কি আপনার? আপনার বোনের সম্পর্কে আপনি আমাকে চিঠিতে কি লিখে পাঠিয়ে ছিলেন?”

ইয়ামিনের বুকে ধক করে উঠলো। মহুয়ার দিক ফিরে জিজ্ঞেস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মহুয়া তখনো থুতনি বুকে সাথে লাগিয়ে আছে। মহুয়া বলল কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

“আপনার বোন আপন ছিলো না আপনার। সে আপনার বাবার অবৈধ সন্তান। ”

ইয়ামিন নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। পর মুহূর্তেই তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,

“হতেই পারে তুমি আমাকে ধোকা দেয়ার চোষ্টা করছো। হতে পারে এসব তোমার সাজানো নাটক। হতে কেন আমি সিউর তুমি মিথ্যা বলছো! জীবন টা সিনেমেটিক নয়। যা বললে তাই হয়ে গেলো।আমার এসবে এখন বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সব কিছু থেকে। প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও আমি নিতে পারছি না। প্লীজ।”

শেষ কথাটি ইয়ামিন জোরেই বলল। কেঁপে উঠলো মহুয়া। ছলছল চোখে রুম থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলো।

ইয়ামিন সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। জীবন তার সাথে আর কত মজা করবে ভেবেই পাচ্ছে না। রাত থেকে ভোর হয় ইয়ামিনে ভাবনা শেষ হয় না। সে দুরের আকাশের সূর্যের হাসি উদয় হতে দেখলো। রাতে ঘন আকাশের আধার কাটিয়ে আলোকিত করে তুললো, এক মুঠো রোদ। দরজা খটখট করে শব্দ হতেই ইয়ামিন বিরক্ত হয়। মহুয়া এসেছে ভেবেই রেগে বলে,

” আমি এখন কোনো কথা বলতে চাইছি না!”

তখনি ভেসে উঠলো চিকন কন্ঠ। দরজা ঠেলে ঢুকলো আয়দা, মন খারাপ করে একটি কাগজ এগিয়ে দিলো ইয়ামিনের দিক।

“এটা কি?”

“তোমার চিঠি!”

ভ্রুকুচকায় ইয়ামিন। বলে,

“কিসের চিঠি!”

আয়দা বলল,

“ভাবি চলে গেছে!”

ইয়ামিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।

“চলে গেছে মানে? তোরা আটকাস নি!”

আয়দা সুপ্তপর্ণে শ্বাস ছাড়লো। বলল,

“আমরা কেউ ঘুম থেকে উঠে ভাবিকে পায়নি। আমার রুমেই ছিলো রাতে। সকালে এ চিঠি পাই। আর… জানতে পারি সে চলে গেছে!”

ইয়ামিনের কি করবে ভেবে পেলো না। দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বসে পড়লো। হাতের চিঠি মেলে ধরলো। থক করে উঠলো বুক, সেই লেখা, সেই ঘ্রাণ, সেই যেন পরিচিত অনুভূতি। ইয়ামিন চিঠিতে চুমু খেলো। বুকে চেপে ধরে বসে রইলো। হুট করে উঠেই বেরিয়ে গেলো মহুয়াকে খুঁজতে। কিন্তু হয়! সে আজ-ও ধরা দিলো না। গাড়ির সিটে হেলে পড়লো ইয়ামিন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো জঙ্গলে কাঁটানো মহুয়ার বাচ্চা বাচ্চা মুখ খানি। ইয়ামিন হারিয়ে গেলো। চোখের সামনে ঘোলা হয়ে গেলো। দূর থেকে ভেসে এলো চিৎকার, চেচামেচির শব্দ। ইয়ামিন জ্ঞান হারালো।

চলবে,

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#পর্ব-১৪
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি

চোখের উপর অপরিচিত কত গুলো মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকায় ইয়ামিন। পিটপিট করে তাকিয়ে আশেপাশে দেখে বুঝতে পারলো সে এখন হসপিটালের সাদা চাদরে লেপ্টে আছে। হাসপাতালের এই রুমটিতে ভিন্ন যন্ত্রপাতি। ইয়ামিনকে চোখ খুলতে দেখেই, সাদা ফিনফিনে ড্রেসের এক নারী চেঁচিয়ে উঠে, “জ্ঞান ফিরেছে উনার” বলে বেরিয়ে গেলেন। আরেকজন নার্স ইয়ামিনের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ামিন চোখ ঘুরিয়ে চাইলো। রুমের মাঝে থাকা বড় জানালা দিয়ে আসা রোদের ঝকঝকে আলো পড়ছে তার পায়ে। ইয়ামিন শুধালো,

“আমি এখানে?”

নার্সটি এগিয়ে এলো। সাদা ফিনফিনে কাপড়ে শ্যাম বর্ণের ছিপছিপে শরীরের তরুণী। স্মিত হেসে বলল,,

“আপনি হাসপাতালে!”

ইয়ামিনের মাথায় চিন্তা ভাজ পড়লো। বলল,

“আমি এখানে কি করে এলাম?”

“আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছিল স্যার!”

চমকে উঠে বলল ইয়ামিন,

“এক্সিডেন্ট? কই আমার তো মনে পরছে না কিছু?”

নার্সটি কি বলবে বুঝতে পারলো না। তার মাঝেই ঘরটিতে ঢুকলেন সাদা পোশাকে আধা-পাকা চুলের এক মাঝ বয়সি লোক। হাসি হাসি মুখে বলল,

“এখন কেমন আছেন আপনি?”

“আমার কি হয়েছে? বুঝতে পারছি না!”

লোকটির মুখে অন্ধকার নেমে এলো যেন। ঘামতে লাগলো কিছুটা। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলল,

“আপনি এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আজ দশ দিন যাবত কোমায় ছিলেন।”

ইয়ামিন অবিশ্বাসের সাথে বলল,

“অসম্ভব। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি গাড়িতে ছিলাম। চোখের সামনে আবাছা হয়েছিলো শুধু। এক্সিডেন্ট হয় নি। আপনি মিথ্যা বলছেন!”

“আমি কেনো মিথ্যা বলবো?”

“ইয়ামিন বাবা তুই উঠেছিস?”

ডাক্তারের কথার মাঝেই কালো ছাপের সাদা শাড়ি পরা এক মধ্য বয়সী নারী কেবিনে প্রবেশ করলো। মুখে মাধুর্য ভরপুর। ছেলের এমন বেহাল দেখে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো। পিছনেই ইয়ামিনের বোন আয়দা দাঁড়িয়ে ফুপাচ্ছে। জাম রঙ্গা সুতি জামায় আবরিত তরুণীর বাচ্চা সলুভ কিশোরী মুখ লাল হয়ে আছে। ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,

“তোমরা কাঁদছো কেন?”

মা ইয়ামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

” আজ কতদিন পর তোকে চোখ খুলতে দেখেছি বাবা। সেই যে গেলি রাগ করে, মেয়েদের ছবি দেখিয়ে ছিলাম বলে, আর হবে না বাবা। তুই যখন বলবি! তখনি বিয়ে করাবো!”

ইয়ামিন আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,

“কিসের বিয়ে মা? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি আবার কিসের বিয়ের কথা বলছো?”

আয়দার দিকে তাকিয়ে ইয়ামিন জিগ্যেস করলো,

“আয়দা? তুমি তোমার ভাবি খোঁজ পেয়েছো? কোথায় আছে জানো কিছু?”

আয়দা আর তার মা একে অপের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। দুজনেই কান্না ভুলে গেলো। ইয়ামিন যেন আজিব কথা বার্তা বলছে। দুজনেই হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে বলল,,

“কি যা তা বলছো ভাইয়া কিসের বিয়ে? কিসের ভাবি? বাই এনি চান্স! তুমি লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে করোনি তো? ”

ইয়ামিনের মা হতাশ হলেন। আবেগী হয়ে বললেন,,

“আমরা চাই তুমি বিয়ে করো! তাই বলে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললে? কত শখ ছিলো, এক মাত্র ছেলেকে বিয়ে করাবো ধুমধম করে! আর…”

কথার মাঝেই ইয়ামিন চিৎকার করে উঠলো। হাতের মাঝে লাগানো ক্যানুলার টেনে ছিঁড়ে ফেললো। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,

“আমার সাথে তোমরা মজা করছো মা? আমি কি মিথ্যা বলছি? এক জলজ্যান্ত মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। দাদাজান আমাদের সেই মাতাব্বরের কাছ থেকে আমাদের ছুটিয়ে আনলেন! আর তুমি বলছো কিসের বিয়ে? ”

ইয়ামিন অনেক বুঝাতে চাইলো লাভ হলো না। কেউ বিশ্বাস করতেই চাইছে না। ইয়ামিন তার মা-বোনকে সব বললো। তাতেও লাভ হলো না উল্টো তার মা কান্না জুড়ে দিলো ছেলের হলো কি? লাষ্ট না পেরে সে বলল,,

“মা দাদাজানকে ডাকো উনি সব জানেন!”

“তোর দাদাজান আউট ওফ টাউন!”

ইয়ামিনে রাগে গা রি রি করে উঠলো এবার। সবার উপর চাপা রাগ নিয়ে বের হয়ে যেতে চাইলো। ডাক্তার পথ আটকাতেই আরো ক্ষেপে গেলো ইয়ামিন। কেবিনের সব তছনছ করে বেড়িয়ে গেলো । ডাক্তার সহ নার্সরা আতঙ্ক নিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। ইয়ামিনের পিছনে ছুটলো তার বোন আয়দা। ভাইয়া, ভাইয়া বলে পিছন থেকে ডেকেও লাভ হলো না বিশেষ।

—————
আকাশে ফট ফট করছে জ্যোৎস্না। কী নিথর, সুন্দর এই রাত্রি। রাত্রির আকাশে সব তারাইএখন খুব স্পষ্ট। ইয়ামিন তাকিয়ে আছে রাতের আকাশের এই বিশাল উদারতায়।চোখ দুটি শূন্যে ফেলেই ইয়ামিন অস্ফুষ্ট ভাবে বলল,

” মহুয়া তুমি আমার কল্পনা নয়, আমার অংশ আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি খুঁজে বের করবোই তোমাকে।যে যাই বলুক আমার মন জানে আমি ভুল নই, তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো ভুল নয়। সব সত্যি, বাস্তব। ”

আজ হাসপাতাল থেকে ফিরেছে দু দিন। মহুয়া খোঁজ করেও ইয়ামিন পায়নি। মাতব্বর নিজেও অস্বীকার করে বসে আছে সব। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,,

“কি যাতা বলছেন ছোট সাহেব? আপনারা সম্মানী মানুষ আপনাদের সাথে এসন করলে আল্লাহ পাপ দিবো আমাগে তবা, তবা। এত বড় পাপিষ্ঠ আমি কল্পনায় ও হইতে পকরবো না।”

ইয়ামিনের মনে চাপা সংশয় জাগে। ডাক্তারের কাছে যেতেই তারা জানায়,

“আপনার মাথায় চাপ পড়েছে বেশি। ইউ হ্যাভ ইমাজিনড এভরিথিং। ”

ইয়ামিনের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। হাসপাতাল থেকে ফিরে সে তার ফোন চেক করেছিলো। কিছু পায়নি। কিন্তু তারিখের দিক তার চোখ আটকায়। একদিনের ব্যবধানে সব কিভাবে পাল্টে যায়? নিশ্চয়ই সবাই মিথ্যা বলছে? আচ্ছা সবাই কি তাকে পাগল ভাবচ্ছে? সে কি পাগল হয়ে গেছে??ইয়ামিন নিজের চুল টেনে ধরে। মহুয়া দেয়া শেষ চিঠিটির কথা মনে পড়তেই তার গাড়ির দিকে ছুঁটে। কিন্তু কি আশ্চর্য গাড়ি নেই! তার গাড়ি কই গেলো? ইয়ামিন তার মাকে জিজ্ঞেস করতেই জানায়,

“গাড়ি ড্যামেজ হয়েছিল। সার্ভিসিংয়ের পাঠিয়েছি কাল চলে আসবে!”

ইয়ামিন শুধু সময় গুনতে লাগলো। একমাত্র সেই চিঠিটি তার সব রহস্য খুলতে পারে। মহুয়া নামের চিঠি প্রেমিকা আছে,তার ভালবাসা, অনুভতি, অনুযোগ এত ঠুনকো না। সে তার মহুয়াকে খুঁজে বের করবেই। ইয়ামিন আকাশের দিকে তাকালো,আর্তনাদ করে বলল,,

“কোথায় লুকিয়ে আছো তুমি! আমি জানি তুমি আমার বাস্তবতা। আমার কল্পনা নয়। প্লীজ কাম ব্যাক!”

———

সন্ধ্যা হয়েছে অনেকখন। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে হুট করেই চারিদিকে স্ব স্ব বাতাস বইছে। সারা দিনের ভ্যাপসা গরম মলিন হয়ে মিষ্টি বাতাসে সতেজ করে তুলেছে চারপাশ। দূরের গাছ-পালা গুলোও বাতাসে সরলতায় মুগ্ধ হয়ে দোল খাচ্ছে যেন। কেউ কেউ মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখাতে ঘর ছেড়ে বাহিরে বের হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই যেন আকাশের বুক চিঁড়ে নেমে আসবে হিমশীতল বাড়িধারা। মহুয়া যেন তারই অপেক্ষাতে ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এলো-মেলো চুল গুলো বাতাসের তালে তাল মিলাচ্ছে। মহুয়া তাকিয়ে আছে দূরের সেই দোল খাওয়া গাছের দিকে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর আর ঘন কালো মেঘের ন্যায় জমে থাকা কষ্ট মুছে ফুরফুরে করে দিচ্ছে মুহুর্তে। মহুয়ার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। চোখের কোনের জল ছলছল করে উঠলে গড়িয়ে টুপ করে ঝড়ে যেতে পারলো না। ইচ্ছে করলেও মন খুলে হু হু কান্নার করতে পারেনা। তার বেলায় যেন নিষিদ্ধ কান্না করা। তাহলে যে বলে, ” কিছু হলেই মেয়েরা কাঁদে! কান্না নাকি মেয়েদের অস্ত্র! “কই তার বেলা এই অতি সত্যটি মিথ্যা কেন হয়ে যায়??

পুরো দুনিয়া আলোকিত করে ভয়ংকর এক বাজ পড়লো কোথাও। নিচ থেকে জাহানারার কন্ঠ ভেসে আসতেই নেমে যেতে গিয়েও থেমে গেলো মহুয়া। ততক্ষণে বৃষ্টি আকাশের বুক চিঁড়ে নিচে নেমে আসচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা। বৃষ্টির গরম ফোঁটা মাহুয়ার শরীর-ও ভিজিয়ে দিচ্ছে যেন। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই মহুয়ার। না আছে এখন নেমে যাওয়ার তারা। মহুয়া তাকিয়ে আছে ছাদের কার্নিশে উড়ে এসে মাত্রই বসা শুভ্র পলকের একটি কবুতরের দিক। মাহুয়া ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজা থেকে রক্ষা করতেই কোলে তুলে নিলো কবুতরটিকে।মনে পরে গেলো তার হাজারো স্মৃতি, ভালোবাসা, আবেগ অনুযোগ। সে কবুতরটি চিলেকোঠার ঘরে রেখে নেমে এলো। বুকে মাঝে চাপা কষ্ঠে দু ফোঁটা জল মনের অজান্তেই গড়িয়ে পরলো। ইয়ামিনের জন্য মন পুড়ে ছাই হচ্ছে। আচ্ছা? ইয়ামিন কি তাকে খুঁজবে? নাকি সে সত্যি ভুলে যাবে তার মরিচীকা কে??

চলবে,

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-১১+১২

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-১১
সন্ধ্যা থেকে আকাশ মেঘলা করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের বেগ বেশ প্রবল। এ বাতাসক মশা মারা বাতাস নামে পরিচিত। ঝড়ের সময় দরজা জানালা বন্ধ করে রাখলেও এ সময় খোলা রাখতে হয়। গ্রামের মানুষ এসময় ঘর ভর্তি করে ধোয়া দেয়। ধুপ ধোয়া। মহুয়াকে যে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, আপাতত তার দরজা-জানলা সটান করে খোলা। ঝড়ের জন্য বিদ্যুৎ চলে গেছে। মহুয়া খাটের একপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। তার পাশেই টেবিলের ওপর হারিকেন জ্বলছে। থেকে থেকে বাতাসের ঝাপটা আসতেই হারিকেনের শিখার দপ দপ করে বেড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি নিভে যাবে। ইয়ামিন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো। মহুয়া কি ঘুমিয়ে গেছে? না মেয়েটির বুক পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে, মাঠে কি কাঁদছে?

ইয়ামিন হারিকেনের আলোয় মহাকে দেখার চেষ্টা করল। হারিকেনের হলদে আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠলো মেয়েটির মুখ। মহুয়া ঘন শ্বাস ছাড়ছে। তাহলে কি মেয়েটিকে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল? ইয়ামিনের ডাকতে ইচ্ছা করলো না। কিন্তু ডাকা দরকার আজ যা হয়েছে, সে বিষয়ে কথা বলা দরকার! ইয়ামিন চুপ্টি করে বিছানার আরেক পাশে বসলো। মহুয়া ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। চাইলেও মুখখানা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে ফিরে শুলে ভালো হতো । মাঝে মাঝে মহুয়ার বাচ্চা-বাচ্চা মুখখানা দেখা যেত। জাগ্রত মহুয়ার মুখ খানা একরকম আর ঘুমন্ত মুখখানায় আরেকরকম। মহুয়া যখন ঘুমিয়ে থাকে তাকে অসহায় লাগে। খুব মায়া লাগে মহুয়ার জন্য। মহুয়া এখনো জানেনা ইয়ামিনের সাথে কাটানো রাতগুলো শুধু তাকিয়ে থেকেছে তার দিকে।বেশিরভাগ সময়ই লুকিয়ে দেখেছে। এইতো কাল নিশি রাত পর্যন্ত ড্যাবড্যাব করে দেখেছে মহুয়াকে। এক সময় ঘোর লেগে যায় ইয়ামিনের। হেঁচকা টান দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। কি স্নিগ্ধ মুখ খানা মহুয়ার। কি ভয়ঙ্কর কথা। একটি ঘুমন্ত মানুষকে এতবার দেখার কি আছে? জানা নেই তার। এই যে এখনো তার মন চাইছে মেয়েটিকে বাহু ডোরে আবদ্ধ করে পিশে ফেলতে।। ইয়ামিন গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। মহুয়ার পিঠের দিকে তাকিয়ে মনে করতে চাইল কিছু ঘন্টা আগের কথা। গ্রামের মাতব্বর ভালো লোক নয়। দাদাজানকে হেনস্ত করবেন বলেই তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিল মহুয়ার সাথে। মেটিয়া পরপর দুটি ধাক্কা খেলো কেঁদে উঠে যান শেষ তারপর বজ্জাত মাতাব্বর তাদের আটকে রেখেছে। ঘরের বাহিরে অস্ত্রধারী দুটি লোক পায়চারি করছে। দাদাজানকে খবর দেওয়া হয়েছে। কখন আসবে কে জানে, এখান থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে ইয়ামিনের। কোথায় ফেঁসে গেল সে? আচ্ছা মেয়ে টি এ সব কিভাবে নিবে সে কি বিয়েটা সিরিয়াস নিবে? নাকি সম্পর্কটা এখান থেকে বের হতেই ইতি টানবো??

ইয়ামিনের মাথায় হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেয়েটিকে এবার জাগিয়ে তোলা তুলতে ইচ্ছে করছে। ইয়ামিন এবার খুটখুট শব্দ শুরু করলো মেয়েটিকে জাগানো দরকার কী আশ্চর্য ব্যাপার আজ তাদের এতটা সিনেমাটিক ভাবে বিয়ে হল আর মেয়েটি ঘুমোচ্ছে?? যথেষ্ট ঘুম হয়েছে আট না ভেবেই পাশে থাকা স্টিলের গ্লাসটি ফ্লোরে ফেলে দিলো ইয়ামিন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মহুয়া ধড়মড় করে উঠে বসল। ফ্যালফ্যাল করে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,,

“কিসের শব্দ? ”

ইয়ামিন ভাবলেশহীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,,

“হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গেছে! ”

মহুয়া ভাঙ্গা গলায় বলল,

“বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে ”

“হুম!”

মহুয়া বিছানা থেকে নেমে একছুটে জালনা কাছে গেল। বাহিরে বৃষ্টি সাথে তাল মিলিয়ে স্ব স্ব বাতাস বইছে।মহুয়া হাত বাড়িয়ে দিলো বাহিরে।গম গম কন্ঠে বলল,

“বৃষ্টি বাতাস একসাথে হলে কি হয় জানেন?”

” না! কি হয়?”

“চখাচখির বিয়ে হয়।”

ইয়ামিন বিস্মিত হলো বিছানা থেকে নেমে মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,

“আপনাকে এসব কে বলেছে মিস মহুয়া নাকি এসব শ্লোক আপনি বানান। ”

মহুয়া জবাব দিল না। হাত বের করে বৃষ্টির পানি নিয়ে গালে স্পর্শ করল খিলখিল করে হেসে উঠলো। ইয়ামিন হাঁ করে চেয়ে রইল মেয়েটি কি পাগল হয়ে গেছে? কথায় আছে অতি শোকে মানুষ পাগল হয়ে যায়। মহুয়ার বেলায় কি তাই হল ইয়ামিন অবাকতা ধরে রাখতে না পেরে বলল,,

“আর ইউ ওকে মিস মহুয়া? ”

“হে আমি ঠিক আছি!”

“মনে হচ্ছে না!”

মহুয়া ইয়ামিনের দিক তাকালো। লোকটি তার এত কাছে? হুট করেই বুকটা ধক করে উঠলো। সে অন্য দিকে ফিরে বলল,

“কি মনে হচ্ছে?”

ইয়ামিনের সহজ স্বীকারোক্তি,

“পাগল মনে হচ্ছে!”

মহুয়ার চোখে মুখে হঠাৎ করে বিষণ্নতা ফুটে উঠল নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে চাইল। নিচের দিক তাকিয়ে মিনমিন করে বলল,

“আমি আপনাকে বড্ড বিপদে ফেলে দিয়েছি। তার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখীত।”

“দুঃখীত হওয়ার কিছু নেই মিস মহুয়া। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার।!”

মহুয়া ফুপিয়ে উঠলো। ইয়ামিন কাছে সরে এলো মহুয়ার। খুব কাছে। চোখের জল মুছে দিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

“কাঁদবেন না মিস মহুয়া। আপনার কান্না সহ্য করতে পারছি না। বুকে লাগচ্ছে! ”

মহুয়া চমকে তাকালো। ইয়ামিনের চোখে মুখে তখন কি যেন। বড্ড অদ্ভুত সেই চাহনি। মহুয়া সরে আসতে চাইলো। ইয়ামিন মহুয়ার দু বাহু চেপে ধরলো। মহুয়া ভরকে গেলো। ইয়ামিনকে ধাক্কা দিয়ার বৃথা চেষ্টা করলো।

“কি করছেন? ছাড়ুন ব্যথা পাচ্ছি!”

“আপনাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না মিস! কেন আপনাকে বড্ড আপন মনে হয়?”

মহুয়া কি বলবে বুঝতে পাড়লো না। তাকিয়ে রইলো ভীতু চোখে। ইয়ামিন আবার বলল,

“আমি এ বিয়ে টা মন থেকে মানতে চাই মহুয়া! ”

মহুয়া চোখ বড় বড় করে বলল,

” কি সব হাবিজাবি বলছেন?”

“সত্যি বলছি!”

“কিন্তু আমি চাই না!”

ইয়ামিন অধৈর্য গলায় বলল,

“কিন্তু কেন মিস মহুয়া? ”

“কারণ আমি আমার পত্র প্রেমিকে ভালোবাসি। ”

“সে মারা গেছে!”

মহুয়া তপ্ত চোখে তাকালো এবার। বলল,

“সে মরে নি। আমি জানি সে বেঁচে আছে! আমার পত্র প্রেমিক আমার কাছে একদিন ঠিক ফিরে আসবে!”

ইয়ামিন অসহায় চোখে তাকালো।চাপা গলায় বলল,

“এসবের কোনো ভিত্তি নেই! আপনি এখন আমার অর্ধাঙ্গিনী। ”

মহুয়া মুহূর্তেই চর বসিয়ে দিলো ইয়ামিনের গালে। ইয়ামিন স্তম্ভিত হলো। পর পর তার সাথেই এমন কেনো হয়? সে ও তো ভালোবাসা চায়। সেতো ভালোবেসে ছিলো। তারোও তো একটি পত্র প্রেমিকা হয়েছিলো। কিন্তু সে ধোকা পেলো। শুধুই ধোকা।

————-

পরেরদিন ঠিক ভোর বেলাই দাদাজান তাদের নিয়ে যান। গম্ভীর ফ্যাকাসে মুখ আর ঢোলা চামড়ার সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকচি ফ্যাস ফ্যাস করে বলল,,

“ইয়ামিন কাজটি তুমি ভালো করো নি। এ বিয়ে আমি মানি না!”

ইয়ামিন মহুয়ার দিক এক পলক তাকিয়ে দাদাজানকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“আপনি মানেন আর না মানেন। এ বিয়ে হয়েছে দাদাজান!”

দাদাজান নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,,

“মেয়েটির পরিচয় কি? নিচু জাতের মনে হচ্ছে? এমন মেয়ে আমার ঘরের বউ হতে পারবে না!”

ইয়ামিন চেঁচিয়ে উঠলো,

” মেয়েটি যেমন হোক আমার বউ। ওর সম্পর্কে আর একটি কথাও শুনবো না!”

ইয়াসিন সাহেব আবাক দৃষ্টিতে নাতিকে দেখছেন। ইয়ামিন তার সাথে এত উঁচু কথা কিভাবে বলতে পারলো?উনি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন এর একটি ব্যবস্থা তিনি নিবেন। জ্বর উঠলে যেমন মাথা ঠান্ডা করতে পানি দিতে হয়? শরীর পঁচন ধরলে পঁচা অংশ কেঁটে ফেলতে হয়।ঠিক তেমনি,শরীরকে নীরোগ রাখতে নানান চিকিৎসা করতে হয়। তিনিও করবেন। রোগ বারার আগেই উপরে ফেলবেন।

————

চলবে,

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-১২
বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়চ্ছে। ঘর শীতল। মৃদু টিমটিম লাল-নীল আলো।বিছানার পাশে ছোট ছোট মোম জ্বলজ্বল করছে। বাসর রাতের মতো সাজানো ঘরটি আজ ইয়ামিনের। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশকুসুম ভাবচ্ছে। মহুয়া তার অংশ হয়ে গেছে। অথচ তার যে একটি অতীত আছে! তাতো বলার সুযোগ পায়নি। তো কি হয়েছে তখন পায়নি? আজ রাতটুকু তো পেয়েছে? নতুন সম্পর্কে গড়ে উঠার আগে অবশ্যই পুরাতন সম্পর্কে জানানো দরকার? ইয়ামিন মনে মনে স্থীর করে ফেললো আজ সব বলবে সে মহুয়াকে সব শোনার পর যদি সে চায়! নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে? তাহলে তাই হবে। ইয়ামিন গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। সেই মুহূর্তে দরজা বাহিরে শোনা গেলো একদল কিশোরী, তরুণীর খিলখিল শব্দ।তারা দরজা ঠেলে মহুয়াকে ভিতরে নিয়ে এলো।সুন্দর মুখশ্রীর আর পিটানো শরীরের চকচকে ঝকঝকে লাল লেহেঙ্গা। খিলখিল করে হেসে এগিয়ে এসে বলল,

“ভাইয়া টাকা দাও। নয়তো বউ কিন্তু নিয়ে পালিয়ে যাবো!”

তারপর খানিক ফিসফিস করে বলল,

“সারা রাত পরে কিন্তু কাছে পাবে না!”

মেয়েটির কথায় হাসির রোল পড়লো। ইয়ামিন কাছে এসে মেয়েটির কান চেঁপে ধরে বলল,

“আয়দা খুব পেকে গেছিস তুই!”

কানে ধরতেই “ব্যাধা পাচ্ছি” বলে ন্যাকামো কান্নার ভঙ্গি করে বলে,,

“এই ভাইয়া ছাড়ো ব্যাথা পাচ্ছি কিন্তু। আমি কিন্তু সত্যি বলছি, টাকা নাই বউ, ফউ নাই। ভাবিকে নিয়ে চলে যাবো হুম!”

ইয়ামিন হেসে দিলো। আয়দার চুলে জোরে টান দিয়ে বলল,

“ড্রামা কুইন। নাটক, ফাটকে নাম লিখিয়ে ফেল। ভালো ইনকাম হবে তোর। আমার টাকা গুলো বাঁচবে!”

ইয়ামিন ১০ হাজার টাকা একটি বান্ডিল বের করতেই ছু মেরে নিয়ে গেল আয়দা।বান্ধবীদের সাথে দৌড়ে পালাতে পালাতে বলল,

“আমি যত টাকাই ইনকাম করি না কেন! ভাইয়ের টাকাতো নিবোই, ইহাতে আলদা মজা আছে যে!”

ইয়ামিন হাসলো। মহুয়ার দিক একপলক তাকিয়ে বসতে বলল।গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো মহুয়া। ইয়ামিন কাঁধ বাকিয়ে এক বার তাকিয়ে আবার বাহিরে তাকালো। মহুয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“আমার পাশে এসে দাঁড়া-ও। ”

মহুয়া কাচুমাচু হয়ে ইয়ামিনের পাশে দাঁড়ালো। অনেকটা জড়তা কাজ করছে। ইয়ামিন কোনো ভণিতা ছাড়াই বলতে শুরু করলো,

” অনার্সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। টগবগ জোয়ান, ভার্সিটির সেরার খাতায় আমার নাম। সব স্টুডেন্ট, শিক্ষকের আকর্ষণ। আমার ধারণা ছিলো পড়াশোনার বাহিরে কোনো দুনিয়ায় নেই। কিন্তু সব পাল্টে এক তরুনী আগমন ঘটলো আমার জীবনে।ধাপিয়ে প্রেম শুরু হলো আমাদের। বেপরোয়া ভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো যেন ছিলো আমাদের কাজ।”

এ পর্যায় একটু হাসলো ইয়ামিন। পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠতেই চোখের কোনে টলমল করে উঠলো বিষাদ। ইয়ামিন বিছানায় হেলে বসলো। মহুয়া তাকিয়ে রইলো যন্ত্রণায় নিঃশেষ হওয়া মানবটির দিকে।ইয়ামিন আবার বলতে শুরু করলো,

“আমার তানিশার ধারণাও ছিলো তোমার মতো। খুব চাইতো পায়রা প্রেম করবে। তার প্রেমের সাক্ষী হবে আকাশ, চাঁদ, তারা, বৃষ্টি, গাছ-পালা। কিন্তু হলো না। তাই মনে দুঃখ পুষিয়ে রাখতো সব সময়। তাই আমি বার্থডেতে পায়রা গিফট করি। কিন্তু সে হোস্টেলে থাকতো বলে পায়রা আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি। আমার বাসায় তানিশা প্রায় আসতো। পায়রাদের সাথে খেলতো। আমি সব ক্যামেরাবন্দি করে রাখতাম।”

আবার হাসলো ইয়ামিন। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো কয়েক ফোঁটা। মহুয়া ইয়ামিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ইয়ামিন এবার বাচ্চাদের মতো কাঁদে দিলো। মহুয়া ইয়ামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ইয়ামিন মহুয়াকে ঝাঁপটে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিলো। মহুয়ার চোখেও বৃষ্টি নামলো। আকড়ে রাখলো ইয়ামিকে। ইয়ামিন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

“সব ঠিক ছিলো। তাহলে কেনো এমন হলো? সে কেনো চলে গেলো? কেন চলে গেলো? আমরা তো এক সাথে বাঁচবো, মরবো বলেছিলাম। সে কেন তার ওয়াদা ভাঙ্গলো!জানো সাদা কাপড়ে মোড়ানো ওর রক্তে লাল হওয়া মুখখানি ভুলতে পারি না। এই দুই হাতে ওর মুখ স্পর্শ করেছি। তানিশার রক্তে লাল হয়েছিল আমার হাত। আমি ভুলতে পারি না। পারি না ভুলতে।”

কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। ইয়ামিন এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মহুয়ার কষ্ট হচ্ছে। কি বলবে এখন ইয়ামিনকে? কি বলা উচিত এ মুহূর্তে? ইয়ামিনের আম্মু অবশ্য সব বলেছেন। তানিশা মেয়েটি রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। কোনো এক ট্রাক চাপা দিয়েছিলো তানিশার সি এন জিকে আর সেখানেই তানিশা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। মহুয়ার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বান বের হয়। ইয়ামিনের দিকে পানি এগিয়ে দিলো। এক ঢুক পানি খেয়ে ইয়ামিন আবার জানালার ধারে এসে ঠাই নেয়। রাতের নিকেশ কালো অন্ধকারে ঢাকা চারিপাশ।ইয়ামি আবার বলতে শুরু করলো,

“তানিশা চলে যাওয়ার পর আমি নিজেকে বন্ধ করে ফেলি ঘরের চার দেয়ালের মাঝেই। আমার সঙ্গী হয়ে উঠে পায়রা। ”

“পায়রা?”

“হে পায়রা! সাদা পালকে ঘেরা নির্জীব প্রাণী! ”

মহুয়া অবাক হয়ে চাইলো ইয়ামিনের দিক। মনে মাঝে কেমন ভয় ভয় করছে। সারা শরীর হালকা কাঁপুন দিচ্ছে। মহুয়া শুকনো ঢুক গিললো। ইয়ামিন হেসে বলল,

“৯০ দশকের পাগলো প্রেম আমিও করেছি মহুয়া!”

মহুয়া হা হয়ে গেলো। পরের কথা টুকু শুনে শরীর শিরশির করে উঠলো।

চলবে,

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-১০

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-১০
মল্লিক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ামিন আর মহুয়া। দোতলা পাকা দালানটি পুরে কালো ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে। দূর থেকে দেখে ভুতুড়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। এই গ্রামের লোকেরা নাকি বাড়িটিকে ভুতের বাড়ি হিসেবে চিনে। মজা কথা হচ্ছে এখানে এসে বাড়িটির কথা এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মুখ আতঙ্কে এতটুকু হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে বুকে থুতু দিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন,

“বাবা ওখানে কেন যাইবা? ওটাতো ভুতের বাড়ি। গাছের পাতায় পাতায় ভুত। বাড়ি আনাচে কানাচে ভুত। ”

ইয়ামিন কঁপাল কুঁচকে ফেললো। ডিজিটাল যুগে এসেও এরা ভুত বিশ্বাস করে? ব্যপারটা খুবই অদ্ভুত। ইয়ামিন বলল,,

“আপনি ভুত দেখেছেন?”

লোকটি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন,

“আমি দেখি নাই। আমার ভাই দেখেছেন। বাড়ির ভিতর মেয়ে ছেলে হেসে, খেলে বেড়ায়, গান করে। মাঝে চোখ ও মারে।!”

“ভুত চোখ মারে?”

“হে মারে!”

“আপনাকে মেরেছে?”

লোকটি খুশি খুশি কন্ঠে বললেন,

“নাহ্ আমার ভাইকে মেরেছে!”

ইয়ামিন বিরক্তবোধ করলো। শক্ত গলায় বলল,,

“আপনি অতিরিক্ত কথা বলেন! যার কোনো ভিত্তি নেই। এ যুগে ভুত টুত নেই। আর থাকলেও আমরা তার সাথে কথা বলে আসবো। পারলে দাওয়াত করবো। এবার রাস্তা দেখান!”

বৃদ্ধার মুখ চুপসে গেলো, বড্ড আফসোসের সাথে বলল,

“জোয়ান ছাওয়ালপাওয়াল টগবগ শরীর। ডরভয় নাই। আমরাও ছিলাম এখন নাই। বয়সের সাথে সব ফুস। ”

ইয়ামিন এবার রাঙ্গানিত দৃষ্টিতে তাকাতেই লোক পথ দেখিয়ে উল্টো পথে হাটা ধরলো। ইয়ামিন সেদিকে তাকিয়ে ছোট শ্বাস ফেললো। গ্রামের মানুষ গুলো একটু বেশিই কথা বলে। এদের ক জিগ্যেস করলে ঁ বিন্দু পর্যন্ত বলে দেয়। মহুয়া ততক্ষণে ঘাট থেকে উপরে এসে সাথে দাঁড়ালো। ইয়ামিন এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মেয়েটি কেঁদে কুটে কি হাল করেছে মুখের। তাতেও যেন সুন্দর লাগচ্ছে তাকে। খুব সুন্দর, ভয়ঙ্কর সুন্দর। মহুয়া ভাঙা গলায় বলল,,

“ঠিকনা পেয়েছেন?”

“হে!কিছুটা হাটতে হবে!”

ইয়ামিনের পিছু পিছু এলো মহুয়া। মল্লিক বাড়ি চৌকাঠ পরোতেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। বুকের ভেতর যেন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে।বাড়ির প্রতিটি ইট যেন চিৎকার করে মহুয়াকে বলছে, “ওহে পত্র প্রেমিকা তুমি এসেছো? এসেছো আমার বুকে?”

ইয়ামিন সুক্ষ্ম ভাবে তা লক্ষ করছে। মেয়েটি কাঁদছে। কান্নার শব্দেই। শরীর কাঁপাচ্ছে শুধু। ইয়ামিনের আজ বড্ড মনে পড়চ্ছে তার প্রাক্তনের কথা। ইয়ামিন প্রথম প্রেমে পড়েছিলো জেবিন নামের একটি মেয়ের সাথে। চুটিয়ে প্রেম চলেছিলো তাদের। ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াতো তারা। জেবিন ছিলো ময়মনসিংহের। তাদের সম্পর্কে যখন ৩ বছর পূর্ণ হবে তার আগেই ঘটলো দুর্ঘটনা। বাড়ি থেকে ফিরার সময় বাস এক্সিডেন্টে হারিয়ে গেলো জেবিন। সেদিন ঠিক এভাবেই কেঁদেছিলো ইয়ামিন। পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠতেই চোখ দুটি ভিজে উঠলো ইয়ামিনের। কষ্ট গুলো গোপন করে এগিয়ে এলো মহুয়া কাছে, মহুয়ার মাথায় আলতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,,

“মিস মহুয়া দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামচ্ছে। দিনের অবস্থাও ভালো না। এবার আমাদের যেতে হবে। ”

মহুয়া মাথা নাড়লো। মেয়েটির মুখে আজ রা নেই। তারা কিছুক্ষন হেটে ঘাটে এসে দাঁড়ালো।ঘাটে মাঝি নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ইয়ামিন ফোনের ফ্লাশ লাইট ওন করলো। দূর দূর পর্যন্ত মানুষ নেই। এর মাঝেই বিপদ বাড়াতেই হুড়মুড় করে নামলো বৃষ্টি। এবার যেন ইয়ামিন পড়লো গভীর অথৈ জলে। একলা একটা মেয়েকে নিয়ে এত রাতে কই ঠায় নিবে? ভাবতেই মহুয়ার কন্ঠ ভেসে এলো। মহুয়া ছাউনি ওয়ালা এক নৌকা থেকে ডাকচ্ছে। ইয়ামিন দৌঁড়ে গেলো। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। তাদের মাঝে কোনো কথা নেই। পিনপতন নিরবতা। শুধু শোনা যাচ্ছে বৃষ্টি শব্দ৷ মেঘের গুরগুর শব্দ। নিরবতা ভেঙ্গে এবার মহুয়াই কথা বলল,

“আপনাকে ধন্যবাদ। আমার জন্য এত কষ্ট করলেন।”

ইয়ামিন কিছু বলল না। ঠোঁটে হাসি নিয়ে ভেজা চুল টানতে লাগলো। মহুয়া আবার বলল,

“আচ্ছা আপনার সম্পর্কে আমিতো কিছুই জানি না? কিছু বলুন?”

ইয়ামিনের দাম্ভিক মুখখানায় আবারো হাসি ফুঁটে উঠলো।বলল,

“আমি একজন মানুষ। এটি আমার প্রথম পরিচয়।”

মহুয়া হেসে দিলো। বিষন্ন মুখটি এবার যেন একটু আলোকিত হলো। ইয়ামিন বলল,,

“এবার কি করবেন?”

মহুয়া মুখে আবারো বিষন্নতা ছেয়ে গেলো। দূরের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে বলল,

“যার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে এসেছি! সে তো নেই। আর কি করবো। ফিরে যাবো!”

“আপনার বাসায় সবাই মেনে নিবে?”

“নিবে না টিক। কিন্তু ফেলবেও না। আমার বাবা বাহিরে শক্ত কিন্তু ভিতরটা নরম।”

ইয়ামিন হাসলো। বলল,

“বাবারা হয়ই এমন!”

দুজনের মাঝে কিছু কথা চললো মাঝ রাত পর্যন্ত। বৃষ্টির বেগ তখন কমে নি। যাওয়ার মতো জায়গাও তার পাচ্ছি লো না। আজো একটি বর্ষণের রাত কাঁটাতে হলো খোলা আকাশের নিচে।নদীর বুকে এক ডিঙ্গি নৌকার মাঝে। সময় যেন সেখাই থেমে গেছে তাদের। সামনের আসা বড় ঝড়ের কেউ অবগত নয়। ভাবতে ও পারবে না। সময় তাদের কত দূর নিয়ে ফেলবে। রাতটি কোনো মতে কেঁটে গেলো। ভোড়ে আলো ফুঁটে উঠলো চারিদিক। কাক ডাকা ভোরে শুধু পাখি না শোনা গেলো মানুষে গুঞ্জন। তাদের কিছু তিক্ত কথা কানের পর্দায় পৌঁছাতেই ঘুম ছুটে মহুয়ার। নিজেকে ইয়ামিনের বুকে আবিস্কার করে ভরকে গেলো। চটজলদি উঠতে গিয়ে ভেসে উঠলো কৌতূহল পূর্ণ কয়েকটি মুখ। ভেসে আসলো কিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য বাক্য। ইয়ামিনকে ঝাকিয়ে তুললো এবার মহুয়া। ইয়ামিন যখন উঠলো তখনি একজন বলে উঠলো,

“ফষ্টিনষ্টি করার জন্য আমার নৌকাই পাইছিলা? এসব এই গ্রামে চলবো না। মাতবর ডাকো তোমরা!”

মুহূর্তেই অজানা, অচেনা ভয় ঝেঁকে বসলো মহুয়াকে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসচ্ছে তার। ইয়ামিন নিজেো হতবিহবল। কিছু বলবে তার আগেই কিছু লোক নৌকা থেকে টেনে নামালো ইয়ামিন কে। আর দুজন ধরলো মহুয়াকে। নিয়ে গেলো তাদের এলাকার মাতবরের কাছে। মাতবর গ্রামবাসিকে বুঝিয়ে বিদায় করলেন। মহুয়া একটি ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সে ফুপিয়ে কাঁদচ্ছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে ।ইয়ামিনকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মুখ খোলা। সে বার বার বলছে,

“আপনাদের ভুল হচ্ছে? আমাকে কিছু বলতে দিন?”

মাতবর ধমকে উঠে বললেন,,

“নষ্ট ছেলে মেয়েদের আবার কি কথা? বাহির থেকে আইসা আমার এলাকা নষ্ট করবা? আমি ছাইড়া দিবো?”

ইয়ামিন চেতে গেলো। গলা ছেড়ে বলল,,

” আপনি আমাকে চিনেন না? চিনলে এসব বলার সাহস পেতেন না! ”

মাতবর বললেন,

“পোলার দেমাক দেখছো? দোষ করছে আবার বক বক করে? সাহস কত??”

ইয়ামিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” আমরা এখানে আজে বাজে কাজ করতে আসিনি। মল্লিক বাড়ি এসেছিলাম। ফিরার সময় ঘাটে মাঝি ছিলো না। বৃষ্টি পড়ছিলো নৌকায় অপেক্ষা করছিলাম আমরা!”

মাতবর হু হা করে হেসে উঠলেন। যেন কৌতুক বলছেন। বললেন,

“চোরের মার বড় গলা!”

ইয়ামিন ক্ষেপে গেলো। গলা উঁচিয়ে বলল,

” আপনার মতো ফালতু লোক আর একটাও দেখিনি। আপনি জানেন না? আমার একটা পোনে আপনার মাতবর গিরি ছুটে যাবে?”

মাতবর রেগে এক থাপার মারলো ইয়ামিনকে। ইয়ামিন থেমে নেই হিংস্র বাগের ন্যায় তাকিয়ে বলল,,

“একটা ফোন করতে দে। দেখ তোর কি হাল করি?”

মাতবর তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নবজের জায়গায় বসে তার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস বললেন,

“এ পোলার ডিটেইলস বের কর!”

কর্মী তাই করলো। আদ ঘন্টার মাঝে জানালো। বান্দরবানের এমপির নাতি হচ্ছে ইয়ামিন। মাতবরের ঠোঁটে শয়তানী হাসি ফুঁটে উঠলো। কর্মীকে ফিসফিস করে বলল,

“কাজী ডাক। প্রতিশোধ নিয়ার সঠিক সময় এখন!”

লোকটি তাই করলো। মিনিট দশকের মাঝে ফিরে এলো কাজি নিয়ে। মাতবর হাঁক ছেড়ে বললেন,

“এক শর্তে তোমারে ছাড়তে পারি বাবা! হয় নষ্ট মাইয়ারে বিয়া করো? ”

ইয়ামিন সাথে সাথে নাকচ করলো,

“এই বিয়ে আমি করতে পারবো না? আর ও নষ্ট মেয়ে নয়। মুখ সামলে কথা বলুন!”

মাতবর হাসলেন। একজন মহিলাকে ইশরা করলেন মেয়েটিকে আনতে। মহিলাটি আসতেই মাতবর মহুয়ার শরীরে দিকে বিশ্রী ভাবে চাইলো। বলল,

“বিয়া করো নইলে, আমার দাসী বানায় রাখবো। আর তোমাকে আমার লোকজন ওই পারে দিয়া আসবে!”

ইয়ামিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে কি বলবে? কি করবে ভেবে পাচ্ছে না! মহুয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। মাতবরের পায়ের কাছে বসে বলল,

“উনাকে ছেড়ে দেন! উনার কোনো দোষ নেই। উনি আমাকে সাহায্য করতেই এত দূর এসেছেন। প্লীজ এত বড় শাস্তি দিবেন না!”

মাতবরের দয়া হলো না। উল্টো তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

“নষ্টামি করার পর ধরা পড়লে এমন ন্যাকামি সবাই করে! কি গো বাবাজী? চুপ কেন? বিয়ে করবা? নাকি তারে আমি আমার কাছে রাইখা দিমু? আমার অবশ্যি ছোট মাইয়াগো উপর টান বহুত।”

ইয়ামিনের গা জ্বলে উঠলো। মাতবরে মুখে থুতু মেরে বলল,

“তোর মতো জানোয়ার এই গ্রামের মাতবর কিভাবে হতে পারে? আমি তোকে জেলের ভাত না খাইয়া ছাড়ছি না!”

মাতবর ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। বললেন,,

” নিজে নষ্টামি করলে দোষ নাই আমি করলেই যত দোষ? এটা তো ঠিক না? আমারো তো কচি মাল ভালো লাগে!”

মাতবরের কথা গা গুলিয়ে এলো মহুয়ার। চোখ বন্ধ করে বসে রইলো সে। ইয়ামিন মহুয়ার দিক এক পলক তাকিয়ে বলল,

“আমি বিয়েতে রাজি!”

চলবে

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-০৯

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-৯

“ছেলে গুলো কে মিস মহুয়া? ”

“আমি কিভাবে বলব!”

ইয়ামিন বিরক্তি নিয়ে বলল,

“তারা আপনাকেই মারতে এসেছিলো? আর আপনি চিনেন না?”

মহুয়া আকাশ ছুঁয়া অবাক হয়ে বলল,

“এটা অসম্ভব। আমাকে কেন মারতে চাইবে?”

” সেটা তো আপনি ভালো জানেন?”

“বিশ্বাস করুন আমার তেমন এনিমি নেই৷ বরং আমি নিজেই মধ্যে বিত্ত ঘর থেকে বিলং করি। শত্রু তত্রু আমার কেন হবে বলুন?”

“সেটা আপনার ভালো জানা কথা মিস? আমি তাই বলছি যা ওই ছেলে গুলো বলেছে!”

মহুয়া গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! তখন সময় মতো আপনি পুলিশে হুইসেল না বাজালে এতক্ষণে পটল তুলতাম!”

বলেই হাসলো মহুয়া। কিন্তু ইয়ামিনের দিক চোখ যেতেই ইয়ামিনের দাম্ভীক গম্ভীর মুখখানী দেখে চুপসে গেলো মুখ। আসহায় চাহনি নিয়ে বাচ্চাদের মতো ফেস করে বলল,

“আমি সত্যি জানি না। বিশ্বাস করুন!”

ইয়ামিন অন্যদিকে তাকালো। মহুয়া কৌতূহল নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” তা মিস্টার ইয়ামিন? আপনি সব সময় এমন সিরিয়াস মুডে কেন থাকেন? হাসতেও তো পারেন? হাসলে কিন্তু সুন্দর লাগে বড্ড আপনাকে!”

মহুয়ার কথায় কোনো ভাবান্তর হলো না ইয়ামিনের। মহুয়া ইয়ামিন মুখ পানে চেয়ে বাহিরে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,

“বেটা অল্প বয়সেই বয়সী বয়সী ভাব করে কেন। উফ? মিঃ ইয়াং বুড়ো!”

মহুয়াকে বিড়বিড় করতে দেখে ইয়ামিন বলল,

“এটা কি আপনার রোগ মিস মহুয়া? নিজের সাথে বিড়বিড় করা?”

মহুয়া কিছু বুঝতে না পেরে হা করে চেয়ে রইলো কতক্ষণ। পরক্ষনেই বোকা বোকো হেসে বলল,

” আমি একটু এমনি!”

ইয়ামিন মনে মনে হাসলো। মেয়েটিকে বিড়বিড় করার সময় ঠোঁট দুটি নন স্টোপ নড়াতেই থাকে। ভালোই লাগে তার কাছে। ইয়ামিন হুট করেই বলল,

” চলুন তবে এবার আপনার পত্র প্রেমিক খোঁজা যাক?”

মহুয়া বিস্ময় নিয়ে তাকালো বলল,

“সত্যি আপনি আমার হেল্প করবেন?”

ইয়ামিন বাঁকা হাসলো। মুগ্ধ নয়নে দেখলো মহুয়া। ছেলেটি কি সুন্দর হাসে। আনমনে বলেই ফেললো সে,

” আপনার হাসি খুব সুন্দর। চান্দের মতো ঝকঝকে, চকচকে।”

ইয়ামিন থতমত খেয়ে গেলো। গলা পরিস্কার করে বলল,

” যাওয়া যাক? তার আগে বরং পেট পূজ হোক?”

মহুয়া সায় দিলো। ইয়ামিন গাড়ি স্টার্ট করে স্বাই করে চলে গেলো অচেনা -অজানা গন্তব্য!

——-

বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। এদিক ওদিক ছাতা নিয়ে ছুটছে ব্যস্ত মানুষ। দূর কোথাও টং দোকানের ধোয়ায় চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাঁপে কেউ কেউ পড়ছে খবরের কাগজ তো করছে রাজনৈতিক, সমাজিক বা ধার্মিক কথা বার্তা। মেঘলা ঘোলাটে দিন মৃদু ঠান্ডা আবেশে ছুটে ঢুকলো সেখানে মহুয়া আর ইয়ামিন। ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। গায়ের শার্ট লেপ্টে প্রশস্ত বুক ভাস্যমান। মহুয়া উচ্ছলতা মুখ, ঠোঁটের কোনে প্রাপ্তির হাসি। ভেজা কাপড়ে লেপ্টে থাকা কোমড় সমান চুল টেনে ডান পাশে আনলো।খোলা বাম পাশের হলদাটে কাঁধের উপর গোল কালো কুচকুচে বড় তীলটিতে চোখ আটকালো ইয়ামিনে। পরমুহূর্তে চোখ ফিরিয়ে নিলো।মহুয়া ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করলো। মৃদু এসে লোকটি জিজ্ঞেস করলো, ঠিকানার কথা। কথা বলার সময় মহুয়া ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে ঝাড়তে লাগলো। বড় বড় চোখের ভাড়ী পল্লব ফেলছে মেয়েটি। হুট করেই ইয়ামিনের বুকে ধুরু ধুরু ব্যথা অনুভব করলো। মিষ্টি ব্যথা।মুগ্ধতার ব্যথা। চিন চিন ব্যথা। ইয়ামি হঠাৎ অবাক হলো, কোনো প্রেমিক কি তৃতীয় বারের মতোও প্রেমে পড়ে? আচ্ছা তার অনুভতি গুলো কি অযুক্তিক নয়?তার মনে এখনো একজন বসত করছে! তারপরও এ কেমন অনুভূতি কাজ করছে? তার প্রেম, ভালোবাসা কি এতই ঠুনকো?? ইয়ামিন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার চাইলো মেয়েটির দিক। মহুয়ার কিছুক্ষন আগের উচ্ছলতার বদলে নেমে এসেছে ঘনকালো মেঘ। ইয়ামিন থমকালো, মেয়েটির মলিন মুখে। মেয়েটি কি কাঁদচ্ছে? আগাগোড়া নিরক্ষন করে বলে উঠলো ইয়ামিন,,

“কি হয়েছে মিস মহুয়া!”

মহুয়া আহত চোখে তাকালো। ভেঁজা কন্ঠে বলল,,

“আমি কি তাকে সত্যি হারিয়ে ফেলেছি? কেউ এই ঠিকানা চিনছেই না!”

ইয়ামিন মহুয়ার কাছে এলো৷ ভিজে চুল গুলো আবারো ঠেলে দিয়ে মহুয়ার হাত থেকে কাগজের টুকরোটি নিয়ে বলল,

“ভেঙে পরবেন না মিস মহুয়া। উনি না জানুক, কেউ তো জানবেই? আসুন আমরা ওই দিকটাই দেখি!”

মহুয়া মাথা হেলালো। ইয়ামিনের পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে এলো একটি দোকানে। হাতে কাগজটি এগিয়ে, গম্ভীর কিন্তু বিনয়ী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“মামা এই ঠিকানাটা বলতে পারবেন? ”

লোকটি পান চিবাচ্ছিলো। চোখের সামনে শহরে দুই নর-নারীরকে দেখে চোখ কুচকালো। কাগজটি হাত বাড়িয়ে নিয়ে, এক পলক তাকালো তাদের দিক। আবারও কাগজে নজর বুলিয়ে পিক করে পানের রস ছিটালো বাহিরে। বাম হাতে মুখের পানে রস টুকু মুছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

” মল্লিক বাড়ি যাইতে চান? কি জন্নি? ”

“আপনি চিনেন?”

“হয় চিনি। কিন্তু কেন যাবেন?”

” আমাদের একটু কাজ আছে। আপনি একটু ঠিকানা বলে দিন!”

লোকটি কিছু বলল না। এদিকে মহুয়ার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! প্রিয় মানুষটির এত কাছে এসে গেছে ভেবেই ভয়ে আত্মা কাঁপচ্ছে। কিন্তু লোকটি কিছুই বলছে না কেন?মহুয়া শুকনো ঢুক গিললো। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, অধৈর্যর মতো বলল,

“মামা চুপ করে আছেন কেন কিছু বলেন প্লীজ?কোথায় এই ঠিকানা? ”

লোকটি এবার মাথা তুলে তাকালো। মহুয়া ছলছল চেখে তাকিয়ে বলল,

“আম্মাজান ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। দুই বছর আগে ওই বাড়িতে আগুন লাইগা সব মানুষ মইরা গেছে। একটাও বাইচা নাই!”

মহুয়ার বুক ধক করে উঠলো। মুহূর্তে মনে হলো শরীর হালকা লাগচ্ছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসচ্ছে। চোখের জল গড়িয়ে পড়তেই তোতলানো কন্ঠে বলল,

“আ-প-নি মিথ্যা বলছেন? এমন হতে পারে না!”

ঢুকরে উঠলো মহুয়া। ইয়ামিন মহুয়াকে তার বুকে সাথে চেপে ধরলো। লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার কোথাও ভুল গচ্ছে না তো? এ গ্রামে কি আর কেনো মল্লিক বাড়ি নেই!”

লোকটি মাথা দুলালো এদিক অদিক। বলল,

“না মামা। আর নাই!”

ইয়ামিন এক পলক তাকালো মহুয়ার দিক। মেয়েটি শরীরের ভর ছেড়ে নেতিয়ে পড়ছে।হু হু করে কাঁদচ্ছে। আজ বড্ড অভিমান হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার উপর ইয়ামিনের। ভালোবাসার মানুষ গুলোকে উনি এভাবে কেড়ে নিয়ে কেন যায়? এত কষ্ট, বুক চিঁড়া দুঃখ, উল্টো-পাল্টে করে দিয়ে যায় সব। কেন? মহুয়া এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আশেপাশে চোখ জোড়া তাকিয়ে রইলো তাদের দিক। ইয়ামিনের বুকেও পুরোনো জখম তাজা হয়ে উঠলো। মহুয়ার মাথা হাত বুলিয়ে আকাশের দিক তাকালো। অভিমানী চোখ দুটি দিয়ে প্রশ্ন বিদ্ধ করতে বৃথা চেষ্টা করলো উপর ওয়ালাকে। মৃদু কন্ঠে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,,

“কেন এমন হয় আল্লাহ? ”

চলবে,

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-০৮

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#পর্ব-৮
বাহিরে এখন ফুটফুটে ভোর। পাখির কিচিরমিচিরে জেগে উঠছে পৃথিবী। চারিদিকে ঘেরা জঙ্গল আর বিশাল বট গাছের উপরের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের সোনালী আলো। সারা রাতের বৃষ্টির পর মিষ্টি এক ফালি রোদ চোখে, মুখে পড়তেই বিরক্ত লাগলো মহুয়ার। ভ্রু কুচকে আরো আকড়ে ধরলো ইয়ামিনের উষ্ণ শরীর। কারো নড়চড় অনুভব করতেই ঘুম ছুটে গেলো ইয়ামিনের। পিটপিট করে চোখ খুলে আবিস্কার করলো তার বুকে সাথে কেউ লেপ্টে আছে। এক প্রকার চমকে উঠে বসে ইয়ামিন।মহুয়া তখনও ঘুমে। ড্যাব ড্যাব করে বাচ্চা মুখখানী দেখে ইয়ামিন ফোস করে শ্বাস ছাড়লো। হঠাৎ করে মেয়েটিকে সুন্দর লাগছে কেন? মেয়েটির চেহারার বুঝি রং বদলায়?হলদে আলোয় কান্না জড়িত চোখ মুখ টমেটোর মতো টকটকে লাল তো কখন-ও জ্যোৎস্না আলোয় স্বচ্ছ মুখখানা কখন-ও বা ঘুমন্ত মুখ খানির উপর রোদের সোনালী আলো স্নিগ্ধ মুখখানি । প্রতিটি রূপেই অপরূপা। এনসেল আড়ামের ফটোগ্রাফির বইয়ে পড়েছিলো ইয়ামিন,” তিনটি স্পট লাইটে যে কোনো মানুষের চেহারার রং নিয়ে খেলা করা যায়!” তাহলে কি প্রকৃতি তার চোখ ধাঁধানো আলোও তার চোখের সাথে খেলা করছে?আচ্ছা সে কি মেয়েটির মায়ায় পড়ে যাচ্ছে? কিন্তু তা কি আদো সম্ভব? ইয়ামিন চোখ বুঁজে নিজের ভাবনা কিক মেরে দূরে ঠেলে দিলো, মহুয়াকে আলতো হাতে ডেকে বলল,,

“শুনচ্ছেন মিস মহুয়া? সকাল হয়ে গেছে? এবার আমাদের যেতে হবে? মহুয়া? প্লিজ উঠুন? ”

মহুয়া উঠলো না উলটো পাশে ফিরে শুয়ে পড়লো। ঘুম জোড়ানো কন্ঠে বলল,

“পত্র প্রেমিক তুমি বড্ড পঁচা। সব সময় ঘুম ভাঙ্গতেই পায়রার মতো উড়ে যাও।”

ইয়ামিন চোখ কঁপালো উঠে গেলো। মেয়ে বলে কি? ঘুমের মাঝেও পত্র প্রেমিক পত্র প্রেমিক করে মারা যাচ্ছে এই মেয়ে কি সাংঘাতিক?? কঁপাল কুঁচকে ফেললো ইয়ামিন। দূর কোথা থেকে ভেসে এলো কোকিলের মধুর স্বর। ইয়ামিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশে পাশে তাকালে বর্ষাকালে কোকিলের ডাক বড্ড বেমানান মনে হলো ইয়ামিনের কাছে। বিপদের সংকেত নয় তো? মহুয়া বার কয়েক ডেকেও উঠানো গেলো না। মেয়েটি এতই ঘুম কাতুরী? তার উপর তার সিক্স সেন্স জানান দিচ্ছে আগাম বিপদ সংকেত। পাহাড়ি অঞ্চল গুলোয় ডাকাত, সন্ত্রাসীদের ঘর বলেও বলা হয়। সময় অপচয় না করে কোলে নিয়ে হাটা ধরলো ইয়ামিন। শুকনো পাতার মর্মর শব্দ করে পা এগিয়ে যেতে লাগলো। মহুয়াকে পরম যত্নে বাচ্চাদের মতো আগলে নিয়েছে। বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি করে বুকে মাঝে লেপ্টে আছে মেয়েটি। ইয়ামিন মুগ্ধ নয়নে দেখছে। তার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। ইয়ামিনের মুগ্ধতায় বেঘাত ঘটলো কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ। মুখে গামছা বেঁধে হাত ধারোলো অস্ত্র। ইয়ামিন কঁপাল জোড়া সূক্ষ্ম ভাগ পড়লো।ইয়ামিন গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“কি চাই?”

“মাইয়্যা ডারে চাই!”

ইয়ামি লোক গুলোর আগাগোড়া দেখে নিয়ে বলল,

“মেয়েটি কে কেন চাই?”

লোক গুলোর মাঝে এক জন বলে উঠলো,

“আপনার জাইনা কাজ নাই। মাইয়া দিয়া দেন!”

ইয়ামিন মহুয়ার দিক এক পলক তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বলল,,

“যদি না দেই?”

“কল্লা ফালায় দিবো!”

বলেই একজন এগিয়ে এলো। তখনি পিছন থেকে একটি লোক ফিসফিস করে বলল,

“হুদাই ঝামেলা কইরিস না। আমাগো কাম মাইয়ারে দিয়া। মাইয়া পাইয়াই আমরা চম্পট! ”

ইয়ামিন লিপ রিডিং জানে। তার বুঝতে অসুবিধে হয় না তাদের কথোপকথন। লোক গুলো আবার এক কথা বলতেই ইয়ামিন উঁচু গলায় বলল,,

“সাহস থাকলে নিয়ে যা আমার কাছ থেকে!”

ইয়ামিনের কথায় তেড়ে এলো একজন তার বুক বরাবর লাথি বসাতেই ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো। ইয়ামিন এবার হাসলো রহস্যময় হাসি,

“আমার এলাকায় এসে আমাকেই মেও মেও করছিস? ”

তখনি বেটে একটি লোক বলল,,

“দেহেন হুদাই আমাগো সাথে পাঙ্গা নিতাছেন?মেয়েটিরে ধইরা নিয়া যাওয়ার অর্ডার আইছে উপর থাইকা। আপনার গায়ে টোকা দিবার চাইনা। মাইয়া ডা দিয়া দেন!”

” কার অর্ডার আছে?”

” বলা নিষেধ! ”

“মেয়েটিকে আমি দিচ্ছি না।!”

হাঁটা ধরলো ইয়ামিন আবার। পিছন থেকে তখন একজন লাঠি ছুঁড়ে দিলো তার গায়ে। ইয়ামিন ধপ করে পড়ে গেলো। ছিটকে গিয়ে মাথায় চোট পেলো মহুয়াও। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে আশপাশ চোখ বুলালো। সামনেই তামিল মুভির ভিলেনদের মতো দেখতে লোকদের দেখে চোখ চড়কগাছ। ডান পাশেই ইয়ামিনকে দেখে দৌঁড়ে গেলো তার কাছে। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,

” একি আপনি এভাবে পড়ে আছেন কেন? আর আমরা কই? আমরা না কুড়ে ঘরে ছিলাম? এখানে কি করে এলাম!”

ইয়ামিন হাতে ব্যথা পেয়েছে ভালোই। মহুয়ার কথা বড্ড বিরক্ত এই মুহূর্তে। চাপা রাগ নিয়েই দাঁত খিচিয়ে বলল,,

” এত ঘুম কাতুরী মেয়ে আজ পর্যন্ত দেখিনি আমি। মানে দুনিয়ে এদিকে ভেস্তে যাচ্ছে আর আপনি ঘুম।”

মহুয়া লজ্জা পেলো খুব। মাথা নুয়ে অপরাধীর মতো বলল,

“সরি!”

বিরক্তিতে মুখ কুচকালো ইয়ামিন। মহুয়া প্রসঙ্গ টেনে বলল,

“ইনারা করা? এমন ডাকাত ডাকাত লাগচ্ছে কেন?”

“আপনার আত্মীয়া! আপনাকে নিতে এসেছে। চলে যান এদের সাথে। রক্ষে হবে আমার!”

মহুয়া কিছুই বুঝলো না ড্যাবড্যাব এক বার ইয়ামিন আরেকবার তামিল মুভি ভিলেনদের মতো লোক গুলোর দিক তাকিয়ে ঠোঁট উল্টালো,

” এদের আমি চিনি না!”

ইয়ামিন এবার রাগে গা রি রি করছে। কি বেকুব মেয়ের পাল্লায় পড়েছে সে? তাদের কথার মাঝে এক লোক চেচিয়ে বলল,

“অনেক রং তামাশা হইছে। ওই লালু মাইয়ারে ধর!”

মহুয়া ভয় ভয়ে বলল,,

” আমাকে ধরবে মানে? আমি কি করেছি?”

আরেক লোক হেসে বলল,,

“তোমারে যত্ন-আত্তি করবো!”

মহুয়া ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। ধরধর করে কেঁপে উঠে ইয়ামিনের দিক তাকালো। লোকটি ভাবলেশহীন ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তখনি লালু না নামের লোকটি মহুয়ার হাত টেনে ধরে উঠালো। ইয়ামিন তখন নিশ্চুপ। মহুয়া চেচামেচি করলো। ইয়ামিকে ডাকলো। লাভ হলো না। এক পর্যায় লোক গুলো টেন হিঁচড়ে নিয়ে ধুপ করে ফালিয়ে দিলো নদীর পাড়ে। এবং উঁচু করলো রাম দা। মহুয়া খিঁচিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। মুহূর্তেই মনে পড়লো তার পত্র প্রেমিকের কথা। এই বুঝি তাদের পথ চলা শেষ? এখানেই সব স্বপ্ন শেষ, কেও জানবেও না আর মহুয়া কোথায়? বেঁচে আছে না মোরে গেছে? আচ্ছা তার নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিক সইতে পারবে তো? দ্বিতীয় বারের মতো তার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলতে? নাকি সে কখনও জানতেই পারবেনা, তার প্রিয়তমা তার শহরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে। মহুয়া চোখ বুঁজে নিলো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। দোয়া করতে লাগলো তার পাগলাটে প্রেমিক যেন ভালো থাকে।
আচ্ছা তার পাগলাটে প্রেমিক কি তার মরার খবর জানতে পারবে?

চলবে,

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-০৭

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#পর্ব-৭

ইয়ামিন দাঁড়ালো না দৌঁড়ে গেলো সেদিকে আর তখনি দেখলো মহুয়া একটি পাথরের উপর উঠে বসে আছে আর”সু সু” করে কিছু একটা তাড়াচ্ছে। ইয়ামিনের কুঞ্চিত ভ্রু আরো কুচকে এলো কাছে যেয়ে প্রশ্ন করলো,

“আপনি ঠিক আছেন? কি হয়েছে?”

মহুয়া ভয়ে চোখ গোল গোল করে ফিসফিস করলো,

” ওখানে সসসাপ!”

ইয়ামিনের চমকে গেলো। বিস্মিত গলায় বলল,

“কোথায়?”

মহুয়া ভয়ে ভয়ে হাত উঁচা করলো। ইয়ামিন তাকাতেই সাপটি তাদের দিক ফোঁস করে উঠলো। ইয়ামিন নিজেও লাফ দিয়ে আরেকটি পাথরে উঠে বসে পড়লো! বিড়বিড় করে বলে,

“সাপে আমার বড্ড ভয় মিস মহুয়া। ফোবিয়া আছে খু্ব! প্লিজ হেল্প মহুয়া!”

মহুয়া অবাক হয়ে তাকালো। এই ছেলে বলে কি?

” আপনি সাপ দেখে ভয় পান?”

ইয়ামিন বিরক্তি নিয়ে বলল,

“আমি কি ইংরেজি বলেছি মিস?”

মহুয়া অবাক চোখে হাসলো। বলল,

“আপনিও তাহলে কিছু দেখে ভয় পান!হে হে। ”

ইয়ামিন রাগান্বিত দৃষ্টি ছুড়লো মহুয়ার দিকে।কিন্তু কিছু বলল না। মহুয়াই বলল,

এখন কি করবো? বৃষ্টিতে তো আবার ভিজে যাচ্ছি? এখানেই কি বসে থাকতে হবে?”

ইয়ামিন এবার-ও কিছু বলল না। মহুয়া ছোট শ্বাস ছেড়ে পাশে থাকা পাথড় ছুড়ে মারলো। ইয়ামিন চেচিয়ে উঠলো,

“এই কি করছেন? পাথর ছুড়ছেন কেন?”

মহুয়া অকপটে বলল,

“তাড়াবার চেষ্ট করছি!”

“আপনি মোটেও তাড়াচ্ছেন না। উল্টো দাওয়াত করছেন আসুন সাপ মশাই আমাদের খান!”

মহুয়া হো হো করে হেসে দিলো। বলল,

” এতো ডেঞ্জার মুডে এত ফানি কথা কেউ বলতে পারে জানা ছিলো না।”

ইয়ামিন রেগে গিয়ে বলল,,

“আমি সিরিয়াস মিস মহুয়া! ”

মহুয়া আর কিছু বলল না। সে আগের মতোই পাথর টুকরো ছুঁড়তেই। সাপটি চলে গেলো। দুজনেই স্থীর শ্বাস ছাড়লো।দুজনেই ফিরে এলো সেই ঘরটিতে। মহুয়া আগের মতোই আগুনের পাশে বসে পড়লো। ইয়ামিন লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো মাচার উপর। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগলো। ঠান্ডা বাড়তে লাগলো। দূর কোথা থেকে ভেসে আসতে লাগলো শেয়ালের হাক। মহুয়ার বুক কেঁপে উঠছে। ইয়ামিন ঘুমিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। মহুয়া বাহিরে তাকালো বৃষ্টির বেগ বাড়াচ্ছে। মহুয়া আগুনের বেগুনি রশ্মির মাঝে বাহিরে বৃষ্টি দেখছে।মনের মাঝে বিষন্নতা ঝেঁকে বসেছে। মনে পড়চ্ছে সূবর্ণ অতীতের কথা। সেদিন-ও বৃষ্টি ছিলো। ঘরের কোনে থাকা ছোট্ট মিউজিক প্লেয়ারে বাজছিল হেমন্ত কুমারের গাওয়া বিখ্যাত গান,

এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?
এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?

আনমোনা হয়ে মহুয়া জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে বৃষ্টি স্পর্শ করলো। ঠোঁটে বাঁজলো মিউজিক প্লেয়ারের গানটি। মুচকে হেসে চোখ বুঝে উপভোগ করলো আবেশে। এমন সময় পালক ঝাপটে উপস্থিত হলো পায়রা। বৃষ্টি ভিজে জুবুথুবু। পায়রাটিকে দেখেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফোঁটে মহুয়ার।কাছে এসে কোলে তুলে নিলো। পায়ে বেঁধে দেয়া চিঠি পেয়ে লাজুক হাসলো। প্রথম প্রেমে পড়লে যেমন অনুভূতি হতো ঠিক তেমন অনুভূতি হচ্ছে। প্রেমের শুরুটাই হচ্ছে তাদের কদিন যাবত। অথচ চিঠি পড়লে মনে হয় কত বছরের চেনা এই মানুষটি। মহুয়া চিঠির ঘ্রাণ নিলো। আজ কাঠগোলাপ ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে চিঠি থেকে। প্রতিবারই এমনটি হয়। চিঠি পাবার পর ভিন্ন৷ ভিন্ন ফুলের সু ঘ্রাণ নাকের মাঝে খেলা করে। মহুয়া এবার চিঠি মেলে ধরলো। সেই চেনা পরিচিত গোটা গোটা অক্ষরে সাজানো মনের অনুভূতি কি সুন্দর লিখে ফেলেছে ছেলেটি। মহুয়া হাসলো। সামন পড়ে থাকা ভেঁজা চুল গুলো গুঁজে নিলো কানের পিছনে। হুহু বাতাসে তাও যেন এলো মেলো করে দিচ্ছে চুল। এবার আর সরাতে ইচ্ছে করলো না। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পড়তে লাগলো,

মরিচীকা,

আমার বড্ড ভয় কি জানো? বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ আমার কানে বাজে। বৃষ্টিতে ভিজলে গায়ের কাপড় ভিজে শরীর ঘিন ঘিন করে। কাঁদা-মাটি পায়ে লাগবে বলে আমি রাস্তা বদলে ফেলি। অথচ এ বৃষ্টি আজ ভালো লাগচ্ছে। ছুঁতে মন চাইছে। গা ভিজিয়ে ছাদে বসে উপভোগ করছি। বিশ্বাস কর এমন শান্তি কখনো হয়নি! বলতে পারবে? কেন হচ্ছে এমন? কেন মনের মাঝে এই বৃষ্টি স্বচ্ছ রং রাঙিয়ে তুলেছে? সকল কষ্ট, দুঃখ মিটে গেছে? কেনো? বলতে পারবে কি? আচ্ছা? এমনটি এ জন্য তো নয়? তুমি আমার জীবনে উড়ে চিঠি হিসেবে এসেছো বলে? আচ্ছা তুমি এই বৃষ্টি স্পর্শ করেছিলে? তাই কি শান্তি লাগচ্ছে আমার বৃষ্ট বিলাস করতে?

ইতি,

তোমার নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিক।

মহুয়া সেদিন বুকের মাঝে চেপে ধরে কেঁধে ছিলো। চটপট কাগজে কলম তুলে লিখে ফেলেছিল,

আমার নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিক,

আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি। এই বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা তার সাক্ষী। সাক্ষী এই মেঘলা আকাশের মেঘ। সাক্ষী তোমার শুভ্র পায়রা! সাক্ষী এই বন্ধ রুম। সাক্ষী দক্ষিণের খোলা জানালা। সাক্ষী আমার মন। বড্ড ভালোবাসে ফেলেছি তোমাকে। আমার শহরের প্রতিটি কোনা কোনা আজ সাক্ষী হবে তোমার আমার অদৃশ্য ভালোবাসার। আমার ভালোবাসার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ।

ইতি,

মরিচীকা

হঠাৎ হেঁচকা টান মেরে গায়ের ওরনা দূরে ফেলে দিতেই মহুয়ার ভাবনায় ভাঙ্গন ধরে। আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই ভেসে উঠে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা আগুন। মহুয়া হতভম্ব হয়ে মুখ হাত চেপে ধরে। এতটাই ভাবনায় হারিয়ে ছিলো যে ওড়না ছিটকে আসা আগুন লেগে যায় তা বুঝতেই পারেনি মহুয়া। ইয়ামিনের পোড়া গন্ধ নাকে লাগতেই তন্দ্রা ছুটে যায়। মহুয়ার দিক তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠে। মেয়েটির ওড়নায় আগুন লেগেছে। তথচ মেয়েটি মুচকি হাসচ্ছে। সে কি পাগল!ইয়ামিন তপ্ত কন্ঠে বলল,

” আপনার কি সমস্যা মিস? আগুন লেগে গেছে কতখানি খবরই নেই আপনরা? আর ইউ মেন্টালি সিক? ”

মহুয়া কথা বলতে ভুলে গেছে যেন। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে ওড়নার দিক। ইয়ামিন মহুয়াকে ঝাঁকি দিলো। মহুয়া হু হু করে কেঁদে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরলো। ইয়ামিন কিছুই বুঝলো না। মহুয়া এভাবে জড়িয়ে ধরাতে অস্থিরতা লাগচ্ছে তার কাছে। ইয়ামিন পড়লো বিপাকে।এবার কন্ঠে খাদে নামিয়ে বলল,

“মিস কি হয়েছে? কাঁদচ্ছেন কেনো?”

মহুয়া বিড়বিড় করছে এবার। বলল,

“আমার মা পুড়ে যাচ্ছে বাঁচান তাকে! আমার মা!”

বারবার আওড়ানো কথা গুলো কিছুটা ধরতে পাড়লো ইয়ামিন। হয়তো এভাবে আগুন লাগেয় তার কোনো অতীত মনে পড়ে গেছে? ইয়ামিন আবার বুঝাতে চাইলো। তার আগেই শরীরের ভর ছেড়ে দিলো মহুয়া। ইয়ামিন হতবিহ্বল হয়ে ধরে আছে। কি করবে সে? মেয়েটি যে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। এবার?? এই গহীন জঙ্গলে এই মেয়েকে নিয়ে যেন গভীর জলে পড়লো। রাগে বিরক্তিতে কঁপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে নিজেকেই গালি দিলো! কি দরকার ছিলো এখানে আসার?

চলবে,

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-৫+৬

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#পর্ব-৫

মেয়েটিকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার পর ইয়ামিন লক্ষ করলো তার মন খারাপ লাগচ্ছে।ভিষন রকম খারাপ। অথচ মন খারাপ লাগার মতো কোনো কারণ ছিলো না। বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইয়ামিন তার হল রুমের বড় কাঁচের জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। নিকোটিনের কালো ধোয়া টান দিয়ে নাক, মুখ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে ইয়ামিন। মেয়েটিকে সে এক রাতের জন্যই আশ্রয় দিয়ে ছিলো। সকাল হয়েছে সে চলে যাবে এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু মেয়েটির সাথে সেই রূঢ় ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাই কি খারাপ লাগচ্ছে? ইয়ামিন সিগারেটের আরেক টান দিলো। বৃষ্টির ঝাপটা আসচ্ছে আধো খাওয়া সিগারেট ভিজে যাচ্ছে। তাতেও তারা নেই ইয়ামিনের। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাহিরে। অথচ তার দৃষ্টি কোথাও স্থীর নেই। চোখে ভাসচ্ছে সকালে টেবিলে বসে খাবার খেতে থাকা মেয়েটি।গোল-গাল একটি পরিচিত মুখ। যেন মনে হচ্ছে কত চেনা? অথচ ইয়ামিন জানে? তা সম্ভব নয়। তবুও মনের মাঝে প্রশ্ন উদ্বেগ হয়, কেন-ও নয়?মনের এই অসংখ্য প্রশ্ন এক পর্যায় জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে জানালা বন্ধ করে দেয়। হয়তো তার ধারণা মনের দুঃখ, কষ্ট সে এই মুহূর্তে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে বাহিরে। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো ইয়ামিন। সোফায় বসে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে টিভি ওন করলো। সাথে সাথে ভেসে উঠলো চট্টগ্রামের সাথে বিছিন্নর খবর। ইয়ামিন কি ভেবে উঠে দাঁড়ালো। সিগারেট এস্টে মারিয়ে অস্থির হয়ে বেড়িয়ে গেলো। এত ব্যাকুলতা কেন হচ্ছে ইয়ামিনের?

কার্যকরণ ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই হয় না!সে কি কার্যকারণ ছাড়াই মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে?নিশ্চয়ই না?আবার হয়তো আছে? যা ইয়ামিন স্বীকার করতে চাইছে না? মেয়েটি দু হাত মুখ চেপে কাঁদচ্ছে বসে। যতবার মেয়েটিকে দেখে তার বুক ধকধক করে। মনে হয় তার মেহুলের কথা! কি অসম্ভব মিল তাদের! এলো মেলো কেশ বাতাসের সাথে উড়চ্ছে। ইয়ামি তার কাছে গেলো।

“এক্সকিউজ মি মিস?”

পরিচিত এক কন্ঠে চট করে তাকালো মহুয়া মনের ভয় ভীতি ঠেলে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরলো। হাউমাউ করে কেঁদে দিল বুকে মুখ গুঁজে। বেচারা ইয়ামিন হতবিহ্বল ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। কি আশ্চর্য? মেয়েটি কাঁদলেও মেহুলের মতো মনে হয়। শরীর কাঁপতে লাগে ইয়ামিনের! একরকম চেহারার মানুষ অনেকেই আছে এ পৃথিবীতে। মিল থাকা কি অস্বাভাবিক কিছু?

“আপনি ঠিক আছেন? কাঁদচ্ছেন কেনো মিস?”

মহুয়া নাক টানলো। ইয়ামিনের বুক থেকে মাথা তুলে কোঁদন রত কন্ঠে বলল,,

” আমি বাসায় যেতে পারবো না! এখানেও কাউকে চিনি না! কোথায় যাবো ভেবে পাচ্ছি না। যার জন্য এত দূর এসেছি তার ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি। কি করবো বুঝতে পাড়ছি না। আপনাকে দেখে আর কান্না আটকাতে পারিনি৷ মনে হচ্ছিলো আপনি আমার শেষ ভরসা!”

আবার কেঁদে উঠলো মহুয়া। ইয়ামিন বলল,,

“কাঁদবেন না মিস! আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন!”

মহুয়া কিছু বলল না তাকিয়ে রইলো ইয়ামিনের গম্ভীর দাম্ভিকতাপূর্ন মুখ পানে।

————–

সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে। মহুয়াকে নিয়ে বের হয়েছে ইয়ামিন। না চাইতেও সে চাইছে মহুয়ার সাহায্য করতে। কিন্তু মেয়েটিকি পাগল? এত দূর এক ধোঁয়াশার পিছনে ছুটে আসচ্ছে মহুয়া?

“তো আপনি আপনার চিঠি প্রেমিক খুজতেই এত দূর চলে এলেন?আদো তার অস্তিত্ব আছে কি না? ভেবেছেন কখনো?এটা পাগলামি ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না মিস মহুয়া!”

মহুয়া গাড়ির জানালা ভেদ করে বাহিরে তাকিয়ে আছে। পড়নে তার কলাপাতা রঙ্গের সুতি জামা। বড় চুল গুলো আজ খোঁপা করা৷ সামনের ছোট চুল গুলো বাতাসের তালে তালে নড়ছে।মহুয়া ডান হাতে চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। ঠোঁটে দেখা গেল চকচক হাসি। বৃষ্টি নেই অন্ধকার স্থীর চারিদিক। মহুয়া বলল,,

“ভালোবাসা মানেই তো পাগলামি! আজ যদি তার সাথে শুধু প্রেমের সম্পর্ক থাকতো? তাহলে হয়তো ভুলে যেতাম৷ কিন্তু তার সাথে আমার অন্তরের সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক।”

ইয়ামিন হাসলো, কিশোরী তরুণী মেয়েদের এসব বিষয়ে বুঝি ঝোঁক বেশি থাকে? এরা দুনিয়ার কালো কুৎসিত অন্ধকার ভয় পায় না? ভালোবাসায় এত শক্তি? তাহলে ইয়ামিনের সাথে এমন কেন হলো? মুহুর্তে ইয়ামিন বুঝতে পারলো তার বিরক্তি লাগচ্ছে। এই ভালোবাসা নামক বস্তু তার বিরক্তি বাড়চ্ছে। ইয়ামিন অকপটে বলল,,

“এসব গল্প, কথা, কাল্পনিক। বাস্তবতায় ভিত্তিহীন!”

মহুয়া কঁপাল কুচকে ইয়ামিনের দিক তাকালো। বিজ্ঞ মানুষদের মতো বলল,,

“মোটেও নয়। ভালবাসা পবিত্র। ভালোবাসা আছে বলেই এ পৃথিবী টিকে আছে!”

“তা আছে। কিন্তু চিঠি, ফিঠির প্রেম এসব বাচ্চামো!”

“নব্বই দশকের মানুষ গুলো কিন্তু এমন বাচ্চামো করতো সাহেব! ”

“তখনের বিষয় বস্তু আলাদা ছিলো মিস মহুয়া। আর এখন ছেলে, মেয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় প্রেম করে। আর সেখানে আপনার পায়রা প্রেমিক খুঁজে পাওয়া কি ধোয়াশা নয়?”

মহুয়ার কান্না পেলো। চোখ দুটি বাহিরে নিবদ্ধ করলো। মিনমিন করে বলল,

” সে আছে। আমি জানি আছে। আমি যেমন তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি? সেও খুঁজে বেড়াচ্ছ। আমার মন বলছে সে আছে!”

মহুয়ার ভাবনা তড়াক করে বেঘাত ঘটলা মহুয়ার ফোনের রিং টোন। কিছুক্ষণ আগেই ফোন ওন করেছিলো সে। বাসায় বার কয়েক কল দিয়েও কোনো লাভ হয়নি মহুয়ার কেউ ফোন তুলে নি। কিন্তু মহুয়া অবাক। বাসা থেকে কল এসেছে দেখে। চোখ দেখে জলের ফোয়ারা। ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে উঠলো খড়খড়ে কন্ঠ,

” আমাকে অযথা ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে না তুমি। আমি ভেবে নিয়েছি আমার এক মেয়ে মরে গেছে। এর পর ফোন দিলে আমার আর তোমার মায়ে মরা মুখ দিখবে!”

মহুয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ওপাশ থেকে ফোন কেঁটে যেতেই হু হু করে কেঁদে উঠলো মহুয়া। বাবার বলা প্রতিটি কথা বুকে সুইয়ের মতো বিদ্ধ করতে লাগলো।ইয়ামিন মহুয়ার দিক তাকিয়ে রইলো। তার বুকে কেমন জানি লাগচ্ছে মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে। মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব বাঁধা পেরিয়ে খুশি গুলো মহুয়ার পায়ের নিচে রাখতে। কিন্তু এমন কেন লাগচ্ছে ইয়ামিনে? কেন মন চাইছে? মেয়েটিকে বুকের সাথে শক্ত করে ঝাপটে ধরতে?”

মহুয়ার সাথে ইয়ামিনের দৃষ্টি মিলন হলো। কিছুক্ষন আগের সেই হাসতে থাকা মেয়েটি এখন কতটা না মলিন? ইয়ামিনের সইতে ইচ্ছে করলো না। মহুয়ার হাতে ইয়ামিন আড়ষ্টতার সাথে ধরলো। মহুয়া তাকাতেই ইয়ামিন বলল,,

“মিস মহুয়া এক জায়গায় যাবেন?দেখবেন আপনার মন বালো লাগবে!”

মহুয়া মাথা নাড়লো। সে যাবে। মনের কষ্ট থেকে কিছুটা হলেও দূরে থাকা যাবে!

চলবে,

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#পর্ব-৬
সাঝের আধার সেই কখন পেড়িয়ে নেমেছে ঘুটঘুটে অান্ধার। ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসচ্ছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। মাঝে মাঝে পালক ঝাপটে জানান দিচ্ছে নিশাচরদের উপস্থিত । মহুয়া এই ছমছম পরিবেশে ভয়ে ভয়ে তাকালো আশে পাশে। মেয়েটির মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়েগেছে। ইয়ামিন তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটিকে দেখে ভয় ভয় করছে মহুয়ার। বার কয়েক জিগ্যেস করেও জানতে পাড়েনি তারা কই যাচ্ছে? এই গহিন জঙ্গল, পাহাড় ঠেলে। চারিদিকে নিস্তব্ধতায় ছায়া। মাথা ভনভন করছে কিছু অযুক্তিকর প্রশ্ন। লোকটি এই ঘন জঙ্গলে কেনো আনলো? মহুয়ার কি ঠিক হয়েছে এখানে আসা? কোনো কু মতলব আটেনিতো?যদি মেরে টেড়ে ফেলে তখন? শহরের লোকালয় ছেড়ে খানিকটা দূরেই চলে এসেছে তারা। মৌয়ালরা তখন মধু সংগ্রহ করে ঘরে ফিরছিলেন। মহুয়া শুঁকনো ঢুক গিললো। আশে পাশে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে আবার প্রশ্ন ছুড়লো,

” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

ইয়ামিন মহুয়ার দিক তাকালো ফোনের ফ্লাস লাইটে মৃদুমন্দ দেখাচ্ছে ইয়ামিনের গৌরবর্ণ দাম্ভিকময় মায়াবী মুখ খানা। ইয়ামিন মহুয়ার কথার পৃষ্ঠে কোনো উত্তর করলো না। শুধ হাসলো রহস্যময় হাসি। মহুয়ার বুক ধক করে উঠলো খুব জোড়ে। ছেলেটিকে এ প্রথম হাসতে দেখলো সে। হাসিটা একদম বুকে গিয়ে বিঁধল যেন। মহুয়া চোখ সরিয়ে নিলো। বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম করে আওয়াজ হচ্ছে। বাম হাতে বুক চেপে আবার হাঁটা ধরলো। কিন্তু চারিদিকে নিস্তব্ধতা মহুয়ার মন ঘায়েল করে যাচ্ছে। কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে খুব। সে আবার একই প্রশ্ন করলে এবার উত্তর দে ইয়ামিন,

“আপনি এত ডেস্পারেট কেন মিস মহুয়া? একটু শান্ত থাকুন? যেভাবে জোরে জোরে কথা বলছেন! জঙ্গলের হিংস্র জীব জন্তুর খাবার হয়ে না যেতে হয়?”

ইয়ামিনের কথায় আশেপাশে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো মহুয়া।ভয়ে মেয়েটি মুখ সাদা হয়ে গেছে।মহুয়া ফিসফিস করে বলল,,

” এই জঙ্গলে হিংস্র জীবজন্তু-ও আছে? ”

ইয়ামিন দাঁড়িয়ে গেলো। মেয়েটি ভয়ে সিটিয়ে গেছে। মুখ টিপে হেসে মহুয়ার দিক ঝুকে পড়লো।ঠিক সেই মুহূর্তে নাকে বাড়ি খেলে মিষ্টিগন্ধ। মহুয়া শ্বাসরুদ্ধ করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে মহুয়ার মতোই ফিসফিস করে বলল,,

“শুধু হিংস্র জীব জন্তু নয় ভূত-ও আছে, গলা কাঁটা ভুত ”

মহুয়া দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইয়ামিন ভুতের কথা বলতেই দূর কোথা থেকে ভেসে এলো কিছু শব্দ। মহুয়া সাথে সাথেই ঝাপটে ধরলো ইয়ামিনের হাত। আর বলতে লাগলো,,

” প্লিজ জলদি চলুন ভুত এসে গেছে!”

ইয়ামিন মহুয়া মুখের ভঙ্গিমা দেখে হু হা করে হেসে দিলো। বলল,

“মিস মহুয়া! এতটুকু কলিজা নিয়ে বেড়িয়েছেন বাসা থেকে পত্র প্রেমিক খুঁজতে? ”

মহুয়া রেগে গেলো। বলল,,

” সকল মানুষেরই কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকে। আপনারও আছে তাই বলে মজা করতে হয় না? ”

ইয়ামিন মুখ টিপে হাসলো। বলল,,

“বাচ্চা মেয়েরা এসব দেখেই ভয় পায়! ”

মহুয়া কোমরে হাত দিয়ে আঙুল তুলে গর্ব করে বলল,

“দেখুন মিঃ আমি মোটেও বাচ্চা না। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি!”

ইয়ামিন আকাশ থেকে পড়লো যেন। বলল,,

“মিস মহুয়া আমিতো নিতান্তই আপনাকে ইন্টারে পড়া বাচ্চা মেয়ে ভেবে ছিলাম!”

মহুয়া হেসে ফেললো। বলল,,

“সবাই এমন ভুল করে ফেলে!”

“এটাই স্বাভাবিক! ”

দুজনের মাঝে শুরু হলো আবারো পিনপতন নিরবতা। তারা আরো কিছু দূর হেঁটে যেতেই মহুয়া বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেলো। রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে মাত্রই। পাহারে চুড়ায় দাঁড়িয়ে চাঁদটি ছুঁই ছুঁই । পাহাড়ে নিচ দিয়ে ভেসে গেছে কোনো নদীর শাখা। নদীর পানিতে ফুঁটে উঠছে সেই দৃশ্য। মহুয়া মুখে হাত দিয়ে বলল,

“আল্লাহ কি সুন্দর দৃশ্য। ”

ইয়ামিন পাশে দাঁড়িয়ে মহুয়ার মুখে রিয়াকশন দেখে মজা পাচ্ছে চাদেঁর আলো মেয়েটিকে যে কত স্নিগ্ধ লাগছে! মেয়েটি কি তা জানে?ইয়ামিন নিজের অকপটেই সেই দৃশ্য ক্যাপচার করলো নিজের ফোনে। কেন করলো? কি ভেবে করলো? জানা নেই তার! তবুও মন বলে যাচ্ছে প্রকৃতির পূজারী আমরা সবাই ।

ইয়ামিন পাশেই বসে পড়লো একটি পাথরের উপর। তার থেকে কিছুটা দূরে বসেছে মহুয়া। ইয়ামিন মহুয়ার হাস্যজ্জল মুখ পানে তাকিয়ে রইল। ঘন ঘন চোখের পল্লব ফেলে মহুয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় এলো মেলো করে দেয়া চুল গুলো গুঁজে নিচ্ছে কানের পিছনে। ঠোঁটজোড়া মৃদু হাসির খেলা। ইয়ামিন বলল,

“মিস মহুয়া? হাউ ইট ফিলস নাও? ”

মহুয়া খুশিতে আপ্লূত। বলল,

“মনস্পর্শকর অনুভূতি। চারিদিকের হিম শীতল বাতাস। চাঁদের আলো সব মিলিয়ে যেমনটি কখনো ভেবেছিলাম ঠিক তেমন?”

ইয়ামিন ভ্রুকুচকালো। বলল,

“পত্র প্রেমিকের সাথে এমন কিছু কল্পনা করেছিলেন?”

মহুয়া হাসলো।বলল,

“আমার পত্র প্রেমিক খুব রোমান্টিক ছিলো! আপনার বুঝি এমন স্বপ্ন নেই?”

ইয়ামিন জোরালো শ্বাস ছাড়লো। বলল,,

“এবার আমাদের উঠা দরকার। এটা পাহাড়ি অঞ্চল। এই যে দেখন কত সুন্দর চন্দ্রিমা। খনিকারে মাঝেই দেখা দিবে প্রকৃতির তান্ডব লীলা।”

স্পষ্ট বুঝা গেলো ইয়ামিন কথা এড়িয়ে গেছে। মহুয়া বুঝতে পেরেও কিছু বলল না। সবারই তো থাকে মনের মাঝে গোপন কথা৷সে বলল,

“হে শুনেছি পাহাড়ি অঞ্চলের মায়াবী মায়াজালের কথা গুলো।”

তারা চলতে শুরু করলো আবার। তাদের ভাবনা চিন্তা সঠিক করেই শুরু হয়ে গেলো তান্ডব। গাছপালার ডালপালা নাড়িয়ে ঝুমঝুমিয়ে নামলো মুষলধারে বৃষ্টি। বাধ্য হয়ে ছুটতে হয় তাদের।দুজনেই হাঁপাচ্ছে। দুজনেই কাকভেজা। তার উপর ঠান্ডার তোর। সব মিলিয়ে বেহাল অবস্থা তাদের। আরো কিছুটা যেতেই একটি টিলার উপর একটি ছনের ঘর দেখতে পেলো তারা। ঘরটির দুদিক বন্ধ দুদিক খোলা। ঘরের এক সাইডে একটি মাচা বাঁধা। তার উল্টো পাশে একটি হারিকেন ঝুলছে। আর ঠিক নিচেই পড়ে আছে কিছু ছন আর কাঠের স্তূপ। মহুয় অবাক হয়ে বলল,,

“এই গহীন জঙ্গলে এত সুন্দর ঘর। কিভাবে?”

ইয়ামিন এদিক-ওদিক কিছু খুঁজ ছিলো। মহুয়া কথা সে বলল,,

“এমন ঘর মৌয়াল বা কাঠুরেরাই করে সাধারণত আমাদের মতো বিপদে পরে রাত কাঁটানোর জন্য”

ইয়ামিন লাইটার দিয়ে হারিকেন জ্বালালো। হলদে আলোও আলোকিত হলো ঘরটি। ইয়ামিন মহুয়ার দিকে তাকালো। ভিজে যাওয়া কাপড়ে লেপ্টে থাকা মহুয়ার শরীরে কার্ভ গুলো স্পষ্ট। মেয়েটি কাপচ্ছে। তার উপর হু হু করে শীত বাড়চ্ছে। ইয়ামিন চোখ ফিরিয়ে নিলো। আবারো কিছু খুঁজতে লাগলো। মহুয়া জিজ্ঞেস করলো,

” কি খুঁজচ্ছেন?”

মহুয়া কথা গুলো ভাড়ি ভাড়ি শোনাচ্ছে। কন্ঠ মৃদুমন্দ কাঁপছে। ইয়ামি মাটির একটি ভাঙ্গা পাতিল দেখতে পেয়ে তাতে খর আর কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে পাশে বসলো। পড়নের কালো জেকেটি বাশের তারকাটায় লাগিয়ে রাখলো। মহুয়া তার ওড়না পেঁচিয়ে নিয়েছে ততখনে। মাথার চুল চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে। ইয়ামিন বলল,,

” মিস মহুয়া এখানে এসে বসুন আরাম পাবেন।”

মহুয়া যেন সেই কথারই অপেক্ষা করছিলো।চটপট এসে৷ বসে পড়লো ইয়ামিনের সাথে। দাঁতে দাঁত লাগানো হাড়কাঁপানো শীতে মরেই যাচ্ছিলো মহুয়া। আগুনের উপর বার বার দু হাত মেলে দিয়ে গালে ধরেছিল সে। ইয়ামিন কাঠ, খর ঠিক করছিলো আর আড় চোখে মহুয়াকে দেখছিলো। মেয়েটির ঠোঁট শুকিয়ে আছে। মুখটা মলিন। তবুও কতই মায়া যেন। ইয়ামিন বুঝতে পাড়লো তার মনের পরিবর্তন। কিন্তু তা কিসের? বিপরীত লিঙ্গের মানুষের শরীরের টান না মোহো? ইয়ামিন বার কয়েক শ্বাস ছাড়লো। ঝিম ধরা একটা ভাব আসচ্ছে গায়ে। তা দূর করা দরকার! সে উঠে মাচার উপর শুয়ে পড়লো কঁপালে হাত ঠেকিয়ে। তার ভয় হচ্ছে এমন নয় যে এভাবে আর সে রাত কাঁটায়নি কখনো তবে এবার ভিন্ন। সাথে একটি মেয়ে আছে। যার ভেজা শরীর তাকে বড্ড আবেদনময়ী করে তুলছে। সে কখন-ও ভাবে নি এভাবে কোনো মেয়ের সাথে রাত কাঁটাতে হবে।ইয়ামিনকে শুয়ে পড়তে দেখে মন খারাপ হলো মহুয়ার সেদিকে এক পলক তাকিয়ে বাহিরে তাকালো আবার। কি ভেবে এবার অস্ফুট স্বরে বললো মহুয়া,

“এই যে শুনচ্ছে?ঘুমিয়ে গেছেন কি?”

ইয়ামিন চোখের উপর থেকে হাত সরালো। ভ্রু কুচকে চাইলো মহুয়ার দিক। মহুয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে লোকটির ভ্রুজোরা কুচকে আছে। মহুয়া কাচুমাচু করতে লাগলো। ইয়ামিন এবার ঠোঁট নাড়লো,

“কি হয়েছে মিস মহুয়া? ”

মহুয়া একটুখানি ঠোঁট কামড়ালো, বলল,,

“আমার বাহিরে যেতে হবে!”

“এই বৃষ্টি বাহিরে গিয়ে কি করবেন মিস?যেভাবে মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে! ”

মহুয়া মাথা নত করলো। ওড়নার আঁচলের কোনাটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,,

“ইয়ে মানে! আমার ওয়াশরুম যাওয়া প্রয়োজন!”

ইয়ামিন কেশে উঠলো। এই জঙ্গলে ওয়াশরুম কোথায় পাবে বেচারা? মেয়ে মানুষ কিছু বলতেও পাড়চ্ছে না। ইয়ামিন যেন পড়লো মাইনকার চিপায়! খানিকটা চুপ থেকে বলল,,

“মিস এখানে ওয়াশরুম পাওয়া যাবে না বরং ঝোঁপের আড়ালেই কাজ সারতে হবে আপনি চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি!”

মহুয়ার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু সে কি করবে? প্রকৃতির নিয়মের সাথে সে কি লড়াই করার ক্ষমতা রাখে? মহুয়া চাইলেও চেপে রাখতেই পাড়ছে না। মহুয়া লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে বলল,,

“প্লীজ!”

ইয়ামিন নেমে এলো মাচা থেকে। ঘরটি কিছু দূরেই ছিলো কচু পাতার বড় বড় গাছ। ইয়ামি তা নিয়ে একটি নিজের ও অপরটি মহুয়াকে দিয়ে এগিয়ে গেলো ঝোপের কাছে। মহুয়া ঝোপে ঢুকবার আগেই ইয়ামি একটি মাটির কলসি এগিয়ে দিলো মহুয়ার হাতে।কলটি সে ছনের ঘরের বাহিরে পেয়েছিলো, বৃষ্টি পানিতে টাইট টুম্বুর ভরা ছিলো। মহুয়া ছু মেরে নিয়ে প্রায় দৌড়ে চলে গেলো ঝোঁপের ভিতর ইয়ামি বাহিরে রইলো দাঁড়িয়ে। মনে মনে হাসলো। মেয়েটির লজ্জা মাখা লাল রঙ্গা মুখটি মনের ধক করে উঠছে বারবার। মিনিট পাঁচেক পর মহুয়াকে আসতে না দেখে ইয়ামিন এগিয়ে যেতেই ভেসে আসলো কারো চিৎকার । ইয়ামিন দাঁড়ালো না দৌঁড়ে গেলো সেদিকে আর তখনি দেখলো…..

চলবে,

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-০৪

0

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
#পর্ব-৪

সোনালী এক মুঠো রোধ চোখে মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে যায় মহুয়ার। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানায় বসে থাকে থম মরে কিছুক্ষণ। খুদায় তার পেট চু চু করছে। কাল সকাল থেকে পেটে কিচ্ছুটি পড়েনি মহুয়ার। মহুয়া উঠে দাঁড়ালো। বিছানার এক কোনো তার পড়নের কাপড় সুন্দর করে ভাজ করে রাখা। সেগুলো নিয়ে এগিয়ে গেলো সে ওয়াশরুমের দিক।কিছু সময় নিয়ে ফ্রেস হয়ে ভিজে লম্বা চুল ছেড়ে বের হয়। কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করে পা বাড়ায় বাহিরে। পেট এবার কথাই শুনচ্ছে না। মহুয়া সব সইতে পারে। কিন্তু খুদা তার সহ্য ক্ষমতা চুরমার করে দেয়। পা টিপে টিপে রুমের বাহির এসে থ মহুয়া। এত বড় বাড়ি আর সাজসজ্জা দেখে হা হয়ে গেছে সে। মধ্য বিত্ত ঘরের মেয়ে সে। এসব কিছু শুধু টিভিতেই দেখছে। মহুয়া ছোট শ্বাস ছাড়লো৷ এদিক ওদিক খুঁজে কাউকে না পেয়ে রান্না ঘর খুঁজে বের করলো।

সকলের প্রর্থনা শেষে ইয়ামিন জগিং করতে বের হয়েছে। সারা রাত ঝুম বৃষ্টির পর সকালের মিষ্টি রোদের ঝলমলে আলো প্রকৃতির রূপ আরো বৃদ্ধি করছে। পাহাড়ি এলকা আর জঙ্গলে ঘেরা শহরের এই এলাকাটিতে বড়বড় জামরুল গাছের ডাল পালা থেকে ঝিলিক দিচ্ছে। ইয়ামিনের এমন পরিবেশ খুব ভালো লাগে। শহর থেকে কোলাহল মুক্ত এলাকাই সে বেছে নিয়েছে নির্জনে থাকার জন্য। জগিং শেষে ঘামে চিটচিটে অবস্থা বাসার সদর দরজায় প্রবেশ করতেই ভ্রুকুচকে যায় ইয়ামিনের। রান্না ঘরে থেকে টুংটাং শব্দ আসচ্ছে। এদিকে চোর ডাকাতে উপদ্রব আছে ভেবেই পাশে থাকা হকি স্টিক নিয়ে নরম পায়ে এগিয়ে যায়। সামনে এগিয়ে যেতেই ভ্রু জোরার মাঝ বরাবর সুক্ষ ভাজ পরে। রাতের মেয়েটি টেবিলের উপর বসে হাপুসহুপুস খাবার খাচ্ছে। ইয়ামিন বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই মহুয়া থতমত খেয়ে যায়। গলায় খাবার আটকে আসে তার। খুক খুক করে কাশতে থাকে সে। হুট করে ইয়ামিনকে দেখে হেচকি উঠে গেছে। ইয়ামিন গাল ফুলে শ্বাস ছেড়ে পানি এগিয়ে দিল। মহুয়া এক ডুকে পানি খেয়ে শেষ করে বলল,,

“খুব খিদে পেয়েছিলো। সরি না বলে খাবার খেয়ে ফেলেছি আপনার! আমি না হয় আবার রেধে দিবো!”

ইয়ামিন আড় চোখে তাকালো। মেয়েটির মুখ কাচুমাচু করে থুতনি ঠেকিয়ে ফেলেছে গলার নিচে।ভেজে চুল থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ে ফ্লোর মাখামাখি। ইয়ামিনের হাসি পেলো। মেয়েটির বয়স ১৮/১৯ এর ঘরেই হবে ভাবলো। ইয়ামিন গম্ভীর কন্ঠে বলল,,

“আপনি খেয়ে নিন। তারপর কথা হবে!”

মহুয়া প্লেটের খাবার দ্রুত গতিতে শেষ করে ফেললো। ইয়ামিন মুগ্ধ নয়নে দেখলো। এর আগে এমন কখনো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না তার। কিন্তু এতো রাতে ওই রাস্তায় কি করছিলো এই মেয়ে?

“আপনি এত রাতে বড় রাস্তায় কি করছিলেন?”

মহুয়ার খাবার বন্ধ হয়ে গেলো। রাতের সেই ভয়ংকর রকমের খারাপ অনুভূতির কথা মনে আসতেই চুপ করে রইলো।

ইয়ামিন আবার জিগ্যেস করলো,

“কি হলো মিস?”

মহুয়া ইয়ামিনের কথাটা এড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,

“আমি এখন কোথায় আছি?”

“বান্দরবান।”

বিস্ময়ে চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেলো মহুয়ার। মহুয়া খানিক চেঁচিয়ে বলল,

” আমি কিভাবে এলাম এখানে!”

ইয়ামিন আবার দেখে নিলো মহুয়াকে।মেয়েটি কিভাবে এখানে এসেছে তা ইয়ামিন কিভাবে জানবে? সে তো আর ধরে বেঁধে এ শহরে আনেনি! হঠাৎ করে বুঝতে পারলো তার বিরক্ত লাগচ্ছে। বিরক্তিতে গা শিরশির করছে। কঁপাল কুচকে বিরক্ত মাখা কন্ঠেই বলল,,

“সেটা কি আমার জানার কথা?”

মহুয়া চুপ করে থেকে মিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,,

” আসলে আমি বাসে ছিলাম। বাস নষ্ট হয়ে যাওয়াতে রাস্তায় নামতে হয়। কখন কোন পথে চলে গেলাম বুঝি নি। তার উপর কিছু খারাপ লোক পিছু নিলো। আর আপনি ফেরেস্তার মতো এসে সাহায্য করলেন!”

ইয়ামিন আর কিছু জিগ্যেস করলো না। মেয়ে মানুষ মানেই আজাইরা ঝামেলা। ইয়ামিন কে চুপ থাকতে দেখে মহুয়া বলল,,

” আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।”

ইয়ামিন তার ফিডব্যাক দিলো না উল্টো উঠে যেতে যেতে আবার ঘাড় বাকিয়ে মহুয়ার দিক কাত করে বলে উঠলো,,

” আপনি এখন সুস্থ আছেন। আপনার গন্তব্য চলে যাওয়া উচিত মিস, আপনার পরিবার হয়তো চিন্তা করছে!”

মহুয়া অপমানিত বোধ করলো। গলা উচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,,

” আমি আপনার বাসায় থাকতও চাই না। আপনি আমার জন্য রাতে যা করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ টুকু জানানোর জন্যই ছিলাম। ”

ইয়ামিন সহজ স্বীকারোক্তি,

” আপনার ধন্যবাদ লাগবেনা আমার মিস..।”

মহুয়া আর দাঁড়ালো না অপমানে তার গা রি রি করছে। লোকটিকে ভালো ভেবে ছিলো মহুয়া। এতটা কেয়ার করেছিলো তাকে। কিন্তু এখন তো উল্টো। বদমেজাজি লোক একটা।মহুয়ার বুক ফেঁটে কান্না পেলো।সব দোষ গিয়ে ঘুরে ফিরে পড়লো পত্র প্রেমিকের ঘারেই। আজ এসব দেখতে হচ্ছে সেই পত্র প্রেমিকের জন্য অথচ সে নিজেই লাপাতা হয়ে গেছে হুট করেই। মহুয়া তার ব্যাগ নিয়ে গটগট করে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। নিজের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চায়ের ধোয়া উঠা কফি তে চুমুক দিচ্ছে ইয়ামিন। মহুয়া বাসার গেট ক্রশ করতেই শান্তির শ্বাস ছাড়লো ইয়ামিন। আজ কাল মেয়েরা তার কাছে এলার্জীর মতো। যতক্ষণ আশেপাশে থাকে রিয়াকশন ছাড়ায়!

———-

বর্ষার মাঝামাঝি সময় চলছে । কিছুক্ষণ পর পরই ঝুমঝুমিয়ে পুরো দুনিয়া আধার করে নামচ্ছে বৃষ্টি তো পরক্ষণেই দেখা দিচ্ছে সূর্যী মামার খিলখিল করা হাসি। রাস্তা ঘাটে কাঁদা মাখা আর ভাঙ্গা অংশে জমে থাকা পানি দেখে নাক ছিটকায় মহুয়া।খুব কষ্টে বাসস্টেন্ড খুঁজে বৃষ্টি মাথায় খুঁজে বের করতে নাজেহাল অবস্থা। বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে মহুয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বাস চলছে না রাস্তা বন্ধ রাতের ঝড়ে বড় বড় গাছ ভেঙ্গে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও ঢল নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কি করবে মহুয়া এখন? অপরিচিত এক শহরেই বা কি করবে সে? মাথায় হাত দিয়ে পাশের বেঞ্চে বসে পড়লো মহুয়া। একা একা নিজ বাসা থেকে বের হওয়া ভাড়ি পড়লো তার উপর। সে কি করবে এখন? কোথায় যাবে?যেদিকে তাকাছে, যত দূর চোখ যাচ্ছে সব অপরিচত লাগচ্ছে তার কাছে। কিছু কিছু মানুষকে মহুয়ার দিক তাকিয়ে থাকতে দেখে ভীতি তৈরি হচ্ছে।গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির আবার শুরু হচ্ছে। ধীরে ধীরে বাস স্ট্যান্ড খালিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শুধু মহুয়া পড়েছে অতুল সাগরে। হু হু করে কেঁদে উঠলো দু হাতে মুখ গুঁজে মহুয়া।

“এক্সকিউজ মি মিস?”

পরিচিত এক কন্ঠে চট করে তাকালো মহুয়া মনের ভয় ভীতি ঠেলে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরলো। হাউমাউ করে কেঁদে দিল বুকে মুখ গুঁজে। বেচারা ইয়ামিন হতবিহ্বল ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।

চলবে,❤️

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-০৩

0

#যুগলবন্দী_পায়রা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-৩

চোখ পিটপিট করে তাকালো মহুয়া। মাথার উপর ভনভন করে পাখা ঘুরছে। ঘরটিতে মৃদুমন্দ আলো। দূর কোথা থেকে ভেসে আসচ্ছে কাঠগোলাপের তীব্র গন্ধ। মহুয়া আশে পাশে চোখ বুলালো। কটা বাজে?জানা দরকার? খোলা জানালা দিয়ে রাতের মেঘলা আকাশ ভাসচ্ছে আর ফরফর করে আসা বাতাসে উড়ে চলছে শুভ্র আর লাল পর্দা। ঘরটিতে সব রুচিশীল আসবাপত্র-ও শুভ্র আর লাল। মাথায় অসহনীয় ব্যথা নিয়ে উঠে বসতে চাইলো মহুয়া।কিন্তু উঠতে ব্যর্থ সারা শরীরে ব্যথায় জর্জরিত। মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলো বেন্ডেজ করা। মনে পড়ে গেলো এক্সিডেন্টের কথা। মহুয়া ধরফড় করে উঠে বসলো। কোথায় সে? গায়ের কাথা সরিয়ে উঠতেই আরেক ধাক্কা খেলো। তার শরীরে কোনো পুরুষের শার্ট ছাড়া কিচ্ছুটি নেই?গলা শুকিয়ে এলো মহুয়ার। অচেনা, অজানা ভয় ঝেঁকে বসলো তাকে। বার বার পেটে মোচড় দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে কোনো বাজে ঘটনা ঘটে গেছে কি এই এক পশলা বৃষ্টির রাতে? ধীরে ধীরে সব কথা মনে হতে লাগলো। পা জোরার মালিককে দেখেই জ্ঞান হারিয়েছে মহুয়া! লোকটি তার সাথে বাজে কিছু করে নি তো? কিন্তু মহুয়ার মন সায় দিলো না। লোকটির গভীর কালো কুচকুচে চোখে শুধু শুদ্ধতাই দেখতে পেয়েছিলো মহুয়া। তবে মস্তিষ্ক এর আগের লোক গুলোর কথা ভেবে চাপা ভয়ে জানান দিচ্ছে, ” পুরুষ মানুষ সব এক রকম। একা মেয়ে পেলে ছেড়ে দিবে না কখনোই” কিন্তু মন বলছে মিথ্যা, অহেতুক ভাবনা।

মন আর মস্তিষ্কের সাথে মহুয়া লড়াইয়ের মাঝেই দরজা ঠেলে কেউ ভিতরে পা বাড়ালো। মহুয়া চোখ মেলে তাকাতেই ভেসে উঠলো লোমহীন উদাম বুকের অত্যন্ত সুপুরুষ। মহুয়ার চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠলো। মস্তিষ্কে খেলে গেলো নানান প্রশ্ন। মুহূর্তই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ফোঁটা ফোঁটা জল। মহুয়ার ফ্যাকাসে মুখ দেখে ভ্রু কুচকে গেলো ইয়ামিনের। মহুয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অাতঙ্কিত কন্ঠে বলল,,

“আপনি ঠিক আছেন কাঁদচ্ছেন কেনো? ব্যথা বেশি করছে কি? ডাক্তার ডাকবো?”

মহুয়া হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইয়ামিনের দিকে। গৌরবর্ণের দীর্ঘ দেহী পুরুষ। শক্তপোক্ত ব্যয়ামপুষ্ঠ শরীর। ভ্রু জোড়ার নিচে কালো কুচকুচে মনির গভীর চোখ জোড়া। উদম লোমহীন বুক। শুধু পরনে আছে একটি কালো টাউজার। যা নাভির নিচে নেমে আছে। মহুয়া মনে আতঙ্ক আরো ভর করলো। ইয়ামিন আরো কাছে আসতেই ঝাপিয়ে পড়ে কন্ঠ নালি চেপে ধরলো।মহুয়ার বড় বড় নখ দেবে রক্ত বেড়িয়ে আসে ইয়ামিনের গলা থেকে।ইয়ামিন বিস্ময়ে হতভম্ব। মহুয়ার চিৎকারে তার সম্বিৎ ফিরে পেলো।

” কেন করলের এমন বলুন? কেন করলেন?”

ইয়ামিন মহুয়ার হাতটি তার কন্ঠনালি থেকে শরীয়ে মহুয়ার পিঠের দিক নিয়ে ঠেসে ধরল। মহুয়া ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো। ইয়ামিন মহুয়ার মুখের তাকিয়ে বুঝতে চাইলো। হচ্ছেটা কি? মেয়েটা বলছেটা কি? খানিকটা বাদে ধাতস্থ হয়ে ভয়ানক গমগম কন্ঠে বলল,,

“কি যাতা বলছেন? কি করেছি আপনার সাথে?আমি আপনাকে হেল্প করেছি কই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন? না করে আমার গায়ে দাগ বসাচ্ছেন? ”

মহুয়া ছাড়া পাবার চেষ্টা করছে লোকটি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। মহুয়া নিজেকে ছাড়াবার জন্য ইয়ামিনের বুকে হাত রাখতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি শিরশির করে উঠলো দেহে।কিন্তু কেন? ভয় লাগলো এবার মহুয়ার তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে এক হাতে ধাক্কা দিতে লাগলো। শক্তপোক্ত বিশাল দেহী লোকের সাথে কখনোই পারবে না তার জানা।রাগে কাঁপতে কাঁপতে মহুয়া ত্রুদ্ধ স্বরে বলল,,

“আপনার শরীরে হালকা দাগ পড়েছে। আর আপনি আমার সারাজীবনে দাগ বসিয়ে দিয়েছেন। ছাড়বো না আমি আপনাকে। কেস ঠুকবো আপনার নামে!ছাড়ুন!”

বলেই মহুয়া কামুড় বসালো ইয়ামিনের বুকে। ইয়ামিন স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাগে গজগজ করতে করতে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো মহুয়াকে। মহুয়া উঠতে নিবে তার আগেই তার উপর ঝুঁকে পড়ে ইয়ামিন। গাল চেপে মহুয়াকে ধরে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে বলল,

“ইয়ামিনের এক ইশারায় হাজার টা মেয়ে বেড পাটনার হতে রাজি। তোমার মতো বেহেঞ্জি সেখানেই নিতান্তই তুচ্ছ। আমার এতও রুচি খারাপনা যে তোমার সাথে শুতে হবে!”

কঁপালে উঠে গেলো চোখ মহুয়ার। অকপটে বলা ভয়ংকর কথা গুলো কানে বাজতে লাগলো তার। মনের মাঝে এক রাশ বেদনার ছাপ উঠে উঠলো। মনে মনে বলল তার পত্রপ্রেমিকের সে যোগ্য তো? যদি ফিরিয়ে দেয়।বিষন্ন হয়ে গেলো তার মন। চোখের জল টপ টপ করতে লাগলো ।তবুও নিজেকে সামলে বলে উঠলো,,

“এতোই যখন অপছন্দ তাহলে আমার গায়ে হাত কেন দিয়েছেন?”

ইয়ামিন স্বভাবসুলভ ভ্রু কুচকায়। গম্ভীর থমথমে কন্ঠে বলে উঠে,,

” আমি আপনাকে টাচ করিনি!”

“তাহলে আমার কাপড়!”

“মিস নিরু পালটে দিয়েছেন আপনার কাপড়। ”

সরে এলো ইয়ামিন। মহুয়া পড়েই রইলো বিছানা। ইয়ামিনের চোখের সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেয়ে গেলো সে। এক গাদা আড়ষ্টতা ভর করলো।নিজের কাজে নিজেই লজ্জা পেয়েছে সে। লোকটি তাকে সহায়তা না করলে সত্যি সত্যি কোনো পশুর শিকার হতো সে। মুহূর্তে কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আসতে চাওয়ার আগেই টুপ করে গিলে নিলো মহুয়া। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,,

” আমি দুঃখীত। আপনাকে আমি ভুল বুঝেছি! ”

ইয়ামিন আবার তাকালো। মেয়েটি উঠে বসে আছে।তখন রাগের মাথায় বেহেঞ্জি বললেও মেয়েটি সুন্দর। ছোট একটি পুতুলের মতো। চুল গুলো এলো মেলো হয়ে আছে। মুখটা দেখতে নিতান্তই বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। গায়ের রঙ হলদে ফর্সা। ইয়ামিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো মহুয়াকে।তার চোখ মাথার চুল থেকে মুখ, গলায় আসতেই নজর সরিয়ে নেয়। ধস্তাধস্তির সময় মহুয়া শার্টের বোতাম ছিড়ে গেছে দুটি। ইয়ামিনের নজর এভাবে ফিরিয়ে নিতেই ভ্রু কুচকে যায় মহুয়ার। নিজের দিক তাকিয়ে দেখতেই আত্মকে উঠলো মহুয়া। বিছানার চাদর টেনে গায়ে জড়িয়ে বসে পড়লো। ইয়ামিন গলা পরিস্কার করে বলল,,

“রেস্ট করুন। সকালে কথা হবে!”

ইয়ামিনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো মহুয়া। প্রশস্ত পিঠে ছোট ছোট লাল তিল। আর ঠিক মাঝামাঝিতে রক্ত জমাটবাধার মতো জম্মদাগ ভাস্যমান।মহুয়া চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিজেকে লুচু লুচু মনে হলো। লোকটিই বা কেমন? একটি মেয়ে মানুষের সামনে উদোম বদোম ঘুরছে?মহুয়া বিছানা গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিকে কাজ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে পাওয়া চিঠির কথা গুলো মনে করতে করতে ঘুম জগতে পাড়ি জমালো মহুয়া।

——
তিন দিনের মাথায় চিঠি নিয়ে হাজির হয়েছিলো পায়রাটি। মহুয়া সেদিন ভিষণ অবাক।বুকের ধড়ফড়ানী বৃদ্ধি পেয়েছিলো কয়েকশ গুন।মনে হচ্ছিল সিনেমার মতো তার চারপাশে গান বাজতেছে, স্ব স্ব শব্দে হাওয়া বইছে। নিজেকে নব্বই দশকের প্রেমিকা প্রেমিকা লাগচ্ছে। যদিও সে মনে মনে চাইতো লোকটির কাছ থেকে আসুক, ফিরে আসুক তার উত্তর। কিন্তু এত জলদি ভেবেই পেলো না সে! চটপট চিঠি খুলতেই ভেসে উঠলো চেনা পরিচিত গোটা গোটা অক্ষরের গুটি কয়েক লিখা। এতেই যেন মহুয়া সন্তুষ্ট। বার কয়েক বার পড়ে নিলো সে। যতবার পরে বুকে ভিতর ডিপ ডিপ করে ওয়াজ শোনা বেড়ে যায়! এমন কেন হচ্ছে?মহুয়া আবার পড়লো,,

” আমার চিঠি কখনোই সঠিক ঠিকানায় যাবে না মিস মরিচীকা। আমার প্রিয়তমা তার শহর আমার জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। চাইলে-ও সে আমাকে ধরা দিবে না। কখনোই আমার কাছে ধরা দিবেনা। তবুও অবাক হয়েছি। ১৬ কোটি মানুষের ভীরে এত বছরে কেউ চিঠির উত্তর তো দিলো! কিন্তু সেই অপরিচিত চিঠি মিতার নামটি বেমান হয়ে গেলো না? সত্যি বলতে এই রহস্য জানতেই আমার এ পত্র লিখা।

ইতি,
আপনার নাম দিয়া পাগলাটে নিশ্চুপ প্রেমিক।

এক নিমিষেই আরেকবার পরে উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠেছিলো সে। ইশ কি অনুভূতি, কত আবেগে সেদিন চোখের জল টুপ করে পড়ে গেছিলো। সেদিনের অনুভূতি যেন আজও পুরোনো নয়। দিন, গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর তার পরেও অনুভূতি বাড়চ্ছে। বাড়চ্ছে অপেক্ষা করা মিষ্টি অনুভূতি। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো মহুয়া। সত্যি কি এই অনুভূতিতে জর্জরিত হয়ে থাকা এক বুক ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে?

চলবে,