Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1093



তনয়া পর্ব-০৫

0

#তনয়া
#পর্ব-৫
সিফাতী সাদিকা সিতু

হলুদ অনুষ্ঠানের আনন্দ তিনগুন বেড়ে গিয়েছে রাফাতের আগমনে।অথচ এখানে আসার পর থেকে রাফাত লজ্জায় কাবু হয়ে আছে।আয়রার অবস্থাও একি।কিছুক্ষণ আগেই তো মানুষটা ভিডিও কলে কথা বলল।অথচ হুট করে চলে আসলো কাউকে কিছু না জানিয়ে।আরাফ সবাইকে বলছে,তাকেই নাকি সারপ্রাইজ দেবার জন্য এসেছে ওরা।আয়রার খুশি হলেও লজ্জায় রাঙা হয়ে বসে আছে।বড়রা সবাই নিচে নেমে গেছে।অনেকে তো মুখ টিপে হাসছিল।
তার এক কাজিন ফিসফিসিয়ে কানের কাছে এসে বলে গেছে,

“কিরে,তোর হবু বর তো দেখছি বউপাগল হবে।একরাতও ধৈর্য্য ধরতে পারলো না।তোর কপাল খুব ভালো রে, জামাই তোর আঁচলের তলায় থাকবে। ”

আয়রার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। কেন যে এমন কান্ড করে বসলো মানুষটা? ভেবে পেল না সে। দরকার ছিল এসবের?সেই তো কাল বিয়ে হয়ে সারাজীবনের জন্য রাফাতের হয়ে যাবে সে!
তবে বুকের ভেতরটা অনাবিল সুখের ফোয়ারায় ভেসে যাচ্ছে।

তনু চোখমুখ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে সবটা।রাফাত যদি সারপ্রাইজ দিতে এসেই থাকে তাহলে এত লজ্জা পাচ্ছে কেন?আপার সাথে নাচ করতে কিছুতেই রাজি হলো না।আপাকেও তো নড়ানো গেল না।দুজনেই একি ধরনের।কিন্তু রাফাতের যদি এতই তো এখানে আসতে লজ্জা করেনি?ঠিক মেলাতে পারছে না কিছু!এদিকে আরাফ আসছে থেকে তার আশেপাশেই ঘুরছে। বলছে,

“সে তনু আর আয়রাকে ছাড়া কাউকে না চেনায় অসস্তি হচ্ছে। রাফাত তাকে জোর করে এনেছে।আয়রার কাছে তো আর থাকতে পারে না তাই তনুর কাছেই আসছে।”

এমন অকাট্য যুক্তির বিপরীতে কিছু বলার মতো খুঁজে পায় নি।বাধ্য হয়ে তনুকে কথা বলতে হচ্ছে। তনুই জোর করে আরাফকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে শুধু, মিশকাত ছাড়া।মিশকাতকে তো চেনার কথা!সেদিন কফি শপে দুজনের পরিচয় হয়েছিল।কিন্ত আপাতত ছাদের কোথাও মিশকাতকে দেখতে পেল না তনু।এ দিকে আরাফকে কেমন বিরক্ত লাগছে।একটু পরেই ওরা আড্ডা বসাবে।নাচ গানে মেতে উঠবে সবাই।তনু তন্ময়কে ডাকলো,

“শোন, মিশকাত ভাই কোথায় রে?”

“জানি না। ছাঁদে তো দেখতে পাচ্ছি না।নিচে আছে হয়তো।”

“ডেকে আন একটু।বলবি, আমি ডাকছি।”

তন্ময় ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে নিচে নেমে গেল।

মিশকাত রাগ করে বসে আছে ঘরে।তার দেয়া ফুল তনু চুলে গুঁজে দেয় নি।ইচ্ছে হচ্ছে তনুর দুগালে দুটো থাপ্পড় দিতে।এত ভাব কেন মেয়েটার?মিশকাতকে কষ্ট না দিলে কি পেটের ভাত হজম হয় না?কি এমন হতো ফুল দুটো চুলে গুঁজলে।এমন নয় যে মিশকাতের ফুল চুলে দিলে সব চুল খসে পরবে! যেই না চুলের শ্রী তার আবার কত বাহার।সারাক্ষণ তো একটা গরুর লেজের মতো বেনুনি করে ঝুলিয়ে বেড়ায়।মিশকাত রাগে গজগজ করছে।

তন্ময় এ ঘর ঐ ঘর খুঁজেতে খুঁজতে পেয়ে গেল মিশকাতকে।দৌড়ে এসে বলল,

“ভাইয়া তোমায় তনুপি ডাকছে!”

“কে ডাকছে?”

“তনুপি!”

মিশকাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো।মহারানী আবার তাকে ডাকছে কেন?সে কোনো উজির নাজির নয় যে পেয়াদা পাঠিয়ে ডাকা হচ্ছে। নিজে আসতে পারতো না!সবকিছুতেই এই মেয়েটার নকড়া!ভাব খানা এমন সে।তার নাম শুনলেই আমি ছুটে গিয়ে পায়ে পরে বলল,মহারানী আদেশ করুন!
যত্তসব,চড়িয়ে সোজা করতে পারলে মনটা শান্ত হতো।

“কেন ডাকছে?”

“জানি না।আমায় শুধু বলল তোমায় ডেকে আনতে।”

“তুই গিয়ে বলে দে,আমি এখন আসতে পারব না।”

তন্ময় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।বলল,

“সেকি! আমরা তো একটু পর ফানুস ওড়াব।তুমি আসবে না বলছ কেন?”

মিশকাত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,

” আচ্ছা, চল।”

মিশকাতের ছাঁদে উঠেই মেজাজ প্রচন্ড খিঁচে গেল।সেদিনের কফি শপের ওই ছেলেটার সাথে দাঁড়িয়ে তনু হেসে হেসে গল্প করছে।সে গটগট করে হেঁটে তনুর সামনে দাঁড়াল।

“ডেকেছিস কেন?”গলার ঝাঁঝটুকু লুকোতে পারলো না।

তনু ভেবে পায় না মিশকাত ভাই এর রাগ সবসময় কি নাকের ডগায় থাকে?নাকি তনুর বেলাতেই এত রাগের বাহার!

“হ্যাঁ।”

আরাফকে দেখিয়ে বলল,” উনাকে চিনতে পেরেছ তো?সেদিন কফিশপে পরিচয় হয়েছিল।রাফাত ভাইয়ার কাজিন উনি।”

আরাফ একবার তীক্ষ্ণ চোখে তনুকে পরখ করলো।এরপর আরাফের সাথে হ্যান্ডশেক করলো।

তনু বলল,” উনি একটু আনকমফোর্ট ফিল করছেন।তুমি একটু ওনার সাথে গল্প করো তো।

তনু আর কিছু না বলেই দ্রুত কেঁটে পরলো।

আরাফ তনুর যাওয়ার পানে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো।

মিশকাতের খটকা লাগলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকালো।ভেবে আশ্চর্য হলো যে, শিক্ষিত একটা ছেলে কিনা এরকম একটা পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না!

এছাড়া রাফাতেরও ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় না সে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে আয়রাকে।ঠিক বাচ্চাকে জোর করে তেতো ঔষুধ খাওয়ালে বাচ্চা যেমন করে! মনে হচ্ছে তাকে জোর করে আয়রার পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছে।তবে ধীরে ধীরে মিশকাতের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল।সেই সাথে রাগ উথলে উঠলো যেন।আরাফের কোনো কথার জবাব না দিয়ে সরে গেল।

আরাফ কিছুই বুঝলো মা।তনুর হঠাৎ চলে যাচ্ছে, মিশকাতও এভাবে ফট করে উঠে চলে গেল।এদের কর্মকান্ড কেমন অদ্ভুত!

মিশকাত তনুর কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,তোর নাগরের সাথে তুই রসিয়ে গল্প কর,আমাকে কেন পাঠিয়েছিস?খবরদার যদি এমন আলতু ফালতু বিষয়ে আমায় ডেকেছিস তো তোর হাত পা ভেঙে ফেলবো একদম।

মিশকাতের যাওয়ার পানে হতভম্ব তাকিয়ে থাকলো তনু।কি বলে গেল এসব?”নাগর” কথাটার মানে কি?ছি!মিশকাত ভাই আসলেই বেশি বাড়াবাড়ি করছে।কে নাগর আর কেনই বা এমন আচরণ করলো কিছুই বোধগম্য হলো না।মনটা শুধু বিক্ষুব্ধ হয়ে রইলো।

সারারাতের হইচই শেষে ভোরের দিকে সকলে গাদাগাদি করে শুয়ে ঘুমে কাত হয়ে পরে রইলো।তনু ওদের সাথে থাকলো সারাটা সময় মনমরা হয়েই ছিল।মিশকাত মাথা ব্যাথার অযুহাত ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।অনেকে ডাকাডাকি করেও বের করতে পারেনি ঘর থেকে।বাধ্য হয়ে মিশকাতকে ছাড়াই আনন্দে মেতে উঠেছিল সবাই।

তনুর ঘুম হয়নি।সে সবার আগে উঠে পরেছে।বাড়ির সামনে ক্যাটারিং এর লোকজন কাজে ব্যস্ত।তনু রান্নাঘরে ঢুকে মা কে দেখতে পেল।আরও কয়েকজন মহিলাও আছে।সবাই তনুর দাদুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন।তনু চা বানিয়ে নিয়ে ছাঁদে দিকে পা বাড়ালো।শায়লা বেগম বলে দিয়েছেন,একটু পর আয়রাকে ডেকে তুলে গোসলে পাঠাতে।এগারোটার মধ্যে পার্লারের মেয়ে গুলো চলে আসবে।

তনুর হাসি পায় মায়ের কথায়।আপার আজ বিয়ে তবুও আপাকে ছোট বাচ্চার মতো ঘুম থেকে ডেকে তুলে গোসল করার তাড়া দিতে হবে?
মা তার পুরোনো অভ্যাস এত সহজে ভুলতে পারবে না।হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল।আজ আপা চলে যাবে।মা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবে।আপাকে ছাড়া মা কখনো থাকে নি।কোথাও বেড়াতে গেলে আয়রা আপাকে একা ছাড়তেন না।মামা খালাদের বাসায় সে তন্ময় একা গিয়ে কিছু থেকে আসলেও আয়রা আপা তা কখনো করেনি?আচ্ছা, তার এত ভালো আপাটা কি এসব বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে?

তনু ছাঁদে উঠে থেমে গেল। মিশকাত এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা কি ঘুমোয় নি নাকি?এত সকালে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?তনু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এভাবে মিশকাতকে দেখতে ভালো লাগে না, কষ্ট হয়।এসবের শেষ কোথায় সে জানে না তবে এবার সে মিশকাত ভাইকে সবটা জানাবে।মিশকাত ভাই জলন্ত আগুন নিয়ে খেলা শুরু করার আগেই থামানো উচিত।এভাবে আর চলতে পারে না।তনু ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল।আয়রা আপাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো আয়রা ঘুম থেকে উঠে গেছে।কি মিষ্টি লাগছে দেখতে আপাকে!বিয়ের দিন সব মেয়েকেই বুঝি এত ভালো লাগে?

“আপা তুমি গোসলটা সেড়ে নাও।একটু পরেই হইচই পরে যাবে।”

“আচ্ছা।আমার না অনেক খিদে পেয়েছে তনু,আমি কিন্তু গোসল শেষ করেই খাবো?”
তুই মাকে বলিস।

তনু হেসে ফেললো এমন বাচ্চামো কথায়।বলল,

“তুমি বোধহয় একমাত্র বিয়ের কনে, যে ঘুম থেকে উঠেই খাবার চাইছে।আচ্ছা তুমি গোসল করে নেও আমি মাকে বলছি।দেখে যাবে তোমার গোসল শেষ হওয়ার আগেই মা খাবার নিয়ে হাজির হয়ে যাবে।”

তনু মাকে বলে নিজের ঘরে এলো।তার বিছানায় সব বোন গুলো এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। তনু খাতা কলম নিয়ে জানালার কাছটায় বসলো।কলমের খোঁচায় নিজের এতদিনের জমে থাকা কথা গুলো অনুভূতি, কষ্ট গুলো উগরে দিচ্ছে।

চলবে..

তনয়া পর্ব-০৪

0

#তনয়া
#পর্ব-৪
সিফাতী সাদিকা সিতু

তনুর সব থেকে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে,সাজগোজ করলে তাকে বেশি খারাপ দেখায়।সাদামাটা থেকে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে হুটহাট একদিন সাজলে কেমন অসস্তি হয়।লজ্জায় ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না।সবাই যদিও বলছে খুব ভালো লাগছে দেখতে!

তনু লাল সবুজ মিশেলের একটা শাড়ি পরেছে।টান টান করে বেনুনি করেছে। দুহাতে গোলাপ ফুল দিয়ে বানানো মালা জড়ানো। মুখে মেকআপ। সব মেয়েরা একি ধরনের শাড়ি পড়েছে আজ।লাল সবুজ মিশেলের শাড়ি গুলো অর্ডার দিয়ে তৈরী করা হয়েছে।ছেলেদের জন্য সবুজ পাঞ্জাবি।আয়রার জন্য অবশ্য বাসন্তী রংয়ের শাড়ি,কাঠগোলাপের গয়না।

সবাই মিলে গায়ে হলুদের থিমটা এভাবেই ভেবেছে।ছাঁদেও টাটকা গোলাপ ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে।চারপাশে রঙিন পর্দার আবরণ। সবাই তাড়া দিচ্ছে বের হবার জন্য। অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে।ফটোগ্রাফার তৈরী আছে।আয়রাকে নিয়ে ছাঁদে যেতে হবে।

তনু আয়নায় নিজেকে আর একবার পরখ করে নিলো।লজ্জাটা কমাতে পারছে না সে।আপাও তো এভাবে লজ্জা পাচ্ছে না!তাহলে তার হলো টা কি আজ?শাড়ি তো এর আগেও পরেছে সে অনেকবার।বিয়ে বাড়িতেই পরতে হতো বেশি তবু আজ লজ্জা গুলো তাকে কেমন কাবু করে ফেলছে!

এত লজ্জার কারণ কি,মিশকাত ভাই?

সবাই হলুদের ডালা হাতে দাঁড়িয়ে গেল ছবি তুলতে।তনু সামনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। মিশকাত ভাই ফটোগ্রাফারের পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।সবুজ পান্জাবিটা খুব মানিয়েছে মিশকাতকে।তনুর অসস্তি হতে লাগলো।ছবি তোলা শেষ হতেই ছাঁদে উঠে গেল দ্রুত। সবকিছু ঠিকঠাক করে আয়রাকে বসিয়ে দিলো যথাস্থানে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মিশকাতের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। তনু সরে যেতে চাইলো মিশকাতের রহস্যময় দৃষ্টির আচঁ থেকে।কিন্তু যেতে পারলো না।আয়রা টেনে পাশে বসালো তাকে।

আয়রার খুব নার্ভাস লাগছে।তনু বলল,

“পানি খাবে, আপা?”

“নাহ,তুই আমার পাশে বসে থাক শুধু। আমার কেমন যেন লাগছে। বুকের ভেতরটা কেমন উচাটন করছে।”

“মাকে ডাকবো,তোমার পাশে এসে বসবে?”

“না থাক।মা আমার থেকেও বেশি নার্ভাস।তুই আমার সাথে থাক তাহলেই হবে।”

তনুর চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। আপাকে প্রবল স্নেহের চাদরে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করলো তার।আপা চলে যাবে ভাবতেই কেমন বিবশ হয়ে আসছে মনটা।তবু নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

“এখানে সবাই তোমার আপনজন।নার্ভাস হচ্ছো কেন আপা?যেখানে যাচ্ছ তারাও তোমার আপনজন হয়ে যাবে।নিজের এই শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত গুলো মনের মতো করে উপভোগ করো।দেখবে খুব ভালো লাগবে।”

“আমি তো সেটাই পাচ্ছি না রে।কেমন যেন ভয় করছে।যদি খারাপ কিছু হয়?”

” আপা তুমি কি জানো,তুমি যখন স্কুল থেকে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে তখন আমার তখন মনে হতো, কে আমার এত ভালো আপাকে কষ্ট দেয়? আমার অবুঝ মন তখন তোমার কান্নার পেছনে যে দায়ী তাকে খুঁজতে চাইতো।খুব কঠিন শাস্তি দিতে চাইতো।আমি তখন শুধু বুঝতাম আমার আপার সুন্দর কোমল গাল গুলো দিয়ে কেন কষ্ট ঝরবে?আমার আপাকে সবাইকে ভালোবাসবে।আমার আপা তো খুব করে ভালোবাসার মতো একজন।তাকে কষ্ট দেয়ার অধিকার কারো থাকতেই নেই।”

আয়রা ছলছল চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে।

তনু বলে চলল,

“পৃথিবীতে যতই নোংরা থাকুক না কেন তোমার মতো শুভ্র কোমল নারীকে সেই ময়লা কখনোই ছুঁতে পারবে না আপা।আমার আপা শুধু ভালোবাসা পেতেই এই পৃথিবীতে এসেছে।কোনো কষ্ট তোমার ধারে কাছেও আসবে না।তুমি দেখে নিও সৃষ্টিকর্তা তোমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে।এত ভালোবাসা পাবে যে তুমি মুঠো ভরে নিলেও হাতের পাশ বেয়ে চুঁয়ে চুঁয়ে পরবে।আমার যখন ভালোবাসার দরকার হবে আমি তোমার কাছ থেকে চেয়ে নেব,দেবে তো আমায়, আপা?”

আয়রা শব্দ করে কেঁদে উঠে তনুকে জড়িয়ে ধরলো।

সবাই এদের দুবোনকে দেখে অবাক।এত সেজেগুজে এসে কিনা এমন জড়াজড়ি করে কাঁদছে।

বড় মামা এসে ধমক দিলো।তনুকে বলল,

“তোরা এমন শুরু করলি কেন?তোর মা এসে দেখলে সেও তো শুরু করে দেবে।এতসব আয়োজন করে কি লাভ হলো? ”

তনু চোখ মুছে বলল,

“তুমি যাও মাকে ডেকে এনো।আমরা একদম ঠিক আছি।মা, প্রথম হলুদ লাগাবে আপাকে।”

তনু টিস্যু চেপে চেপে আয়রার চোখের কোণের পানিটুকু মুছে দিলো।

মিশকাত একট দূর থেকে সবটা দেখছে। তার তনুর ছলছলে চোখ দুটো মোটেও ভালো লাগছে না দেখতে।চোখের পাতা গুলো কেমন ভিজে লেপ্টে গেছে।শাড়িতে সারা অঙ্গ জড়িয়ে একটা মেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে,থেমে থেমে চোখের কোণটুকু আস্তে মুছে নিচ্ছে।আহা কি সুন্দর দৃশ্য! মিশকাতের মনে হলো সে যদি এই কান্নারত রমনীর মুখটা একটু আলতোভাবে ছুঁয়ে দিতে পারতো তাহলে বেশ হতো।মসৃণ ত্বকের ফুলে ওঠা গাল দুটো টিপে দিয়ে বলত,

“এমন বোকার মতো কাঁদছিস কেন পাগলি?জানিস না তোর কষ্ট গুলো অন্য কারো রক্তক্ষরণের কারণ হয়!”

একে একে সবাই হলুদ লাগানো শুরু করলো। গান বাজছে,বড়দের হৈহুল্লোড়, বাচ্চাদের চেঁচামেচি, আনন্দ, দুঃখ সব মিলে মিশে অদ্ভুত মুগ্ধতা বিরাজ করছে পুরোটা সময় জুড়ে।

তনু আপাকে বলে একটু উঠে আসলো।সে একটু নিচে যাবে প্রয়োজনীয় কাজে।সিঁড়ির কাছে আসতেই মিশকাত তাকে তাড়াতাড়ি টেনে নামালো নিচে।আঁতকে উঠেছে তনু এমন কান্ডে।ভয়ে একটু চেঁচিয়েও উঠেছিল কিন্তু এত কোলাহলে সবটা চাপা পরে গেছে।

“আমার হাত ছাড়, মিশকাত ভাই।”

“অনন্তকাল তোর হাত ধরে বসে থাকার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।নিজেকে ক্যাটরিনা কাইফ ভেবে বসে থাকিস না।”

তনু ঝটকা মেরে মিশকাতের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।বলল,

“তুমি আমায় এভাবে টানলে কেন?কেউ দেখে ফেললে কি হতো?”

“কি হতো?”মিশকাত দু পকেটে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল।

তনু কিছু বলল না।রাগ লাগছে তার।হঠাৎ করে এই যন্ত্রণা কেন যে উদয় হলো?

“তোকে কেমন খ্যাত লাগছে জানিস?এভাবে খিঁচে গরুর লেজের মতো চুল গুলো বেঁধে রেখেছিস কেন?দেখতে খুব বাজে লাগছে। তার ওপর আবার ঠোঁট উল্টে ভ্যাঁভ্যাঁ করে কাঁদছিলি।তোর কোনো হুশ জ্ঞান নেই?ফটোগ্রাফার তো ছবি তুলেই যাচ্ছে।যখন ছবি গুলো দেখতি তখন হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে বসতি নিজেকে এই রূপে দেখে।”

তনু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত গুলো কথায় তার মাথায় ভনভন করছে। মিশকাত তাকে এভাবে অপমান করছে কেন?

“যাইহোক,চুল যখন বেঁধেই নিয়েছিস তখন তো আর করার কিছু নেই।”পকেট থেকে দুটো গোলাপ বের করে তনুর দিকে বাড়িয়ে ধরে আবার বলল,

“এদুটো ফুল চুলে গেঁথে নে।তাহলে ভালো লাগবে।তোর তো কমনসেন্স বলতে কিছুই নেই।এত ফুল হাতে পরে আছিস অথচ চুলে একটা ফুল গুঁজে দিতে পারিস নি!এই হলো তোর রুচি!ভালো জিনিস চিনতে পারিস না।”

ফুল দুটো তনুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মিশকাত আর দাঁড়ালো না।গটগট করে হেঁটে চলে গেল ছাঁদের দিকে।

তনু তার জায়গা থেকে নড়লো না।সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে।মিশকাত আসলে কি বোঝাতে চাইলো?তাকে অপমান করলো নাকি অন্যকিছু?তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুল দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলো।

“এইটুকুর জন্য এত ঘুরিয়ে, এত পেঁচিয়ে, এত কথা! ”

তনু ঠোঁট কামড়ে হাসলো।সরাসরি তাকে বলতে না পেরে কতগুলো কথা বলতে হলো বেচারাকে।তনুর মনটা খারাপ হয়ে গেল।মানুষটা যে অসম ভালোবাসা বুকে চেঁপে আছে তার কোনো ভবিষ্যত নেই।তনু তো প্রতিনিয়ত পুড়ে মরেছে এটা ভেবে যে মিশকাত ভাই অন্তত ভালো থাকুক!এখন দেখছে তার পথেই পা বাড়িয়ে আছে মিশকাত!

তনু যখন ছাঁদে উঠলো তখন রাফাত ভিডিও কলে আয়রার সাথে কথা বলছে। ফোনটা হাতে নিয়ে আছে মিশকাত।তনু আর সেদিকে গেল না।বড় মামার কাছে দাঁড়াতেই বড় মামি কেমন সরু চোখে তাকালো।তনু সেখানেও বেশিক্ষণ দাঁড়ালো না।সে সোজা বাবার কাছে চলে এলো।ছোট চাচার সাথে বাবা বসে আছে।চোখ মুখ গুলো কেমন শুকিয়ে গেছে।তনু বাবার পাশ ঘেষে বসলো।

“কিরে, খুব মন খারাপ হচ্ছে আপার জন্য?”

“তোমারও তো হচ্ছে! ”

“তানভীর সাহেব হাসলেন।তনুর যে কষ্ট হচ্ছে তা বেশ বুঝলেন।তার নিজেরও তো থেকে থেকে বুকটা ভারী হয়ে আসছে।শায়লা তো হলুদ ছুঁয়েই চলে গেছে।এখানে থাকলে নাকি কান্না আটকাতে পারবে না। এই সুন্দর পরিবারের একটা সুন্দর গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আয়রার জন্মের পর সবথেকে খুশি হয়েছিলেন তিনি।ছোট শরীরটাকে কোলে নিতে পারতেন না ঠিকঠাক তবুও সারাক্ষণ লেগে থাকতেন মেয়ের কাছে।তিনি শখ করে” আয়রা” নাম রেখেছিলেন।।এরপর তনুর জন্মের পর সে খুশি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।”তনয়া” নামের ছোট মেয়েটার আধো বুলিতে প্রথম কথা “বাবা ” বলতে শিখেছিল। সবাই তনু নামে ডাকলেও তিনি সবসময় পুরো নাম ধরেই ডাকেন।এরপর ছোট ছেলে তন্ময়।পরিবার ভরে উঠেছে তখন থেকেই।হাসি আনন্দে কেটে গেল কতগুলো বছর!আজ সেই বড় রত্নটাকে পরের ঘরে পাঠানোর সময় এসে গেছে!তানভীর সাহেবের বুকটা ভার হয়ে এলো।

তনু বাবাকে দেখেই বুঝে গেল।সে বাবার বুকে মাথা রাখলো।বিড়বিড়িয়ে বলল,

“তুমি কষ্ট পেয় না বাবা।তোমার আয়রা না থাকলেও তোমার তনয়া কখনো তোমায় ছেড়ে যাবে না।তোমার বুকটা ছাড়া যে কোথাও কোনো জায়গাও হবে না তোমার আয়রার।”

…………….

আরাফ বিকেল থেকে অনেক চেষ্টা চালিয়ে রাফাতকে রাজি করাতে পারলো অবশেষে। বিয়ের আগে হবু শ্বশুর বাড়িতে যেতে প্রচন্ড আপত্তি রাফাতের।অনেক বোঝাতে হয়েছে এজন্য।

এখন সবাই বর কনের হলুদ একসঙ্গে আয়োজন করে।তাড়াছা হলুদ অনুষ্ঠানের মাঝে বর হুট করে এসে সারপ্রাইজ দেয় এমন রীতি চলছে আজকাল।এজন্য ভিডিও ফোনে আয়রাকে দেখিয়েছে।বলেছে,দ্যাখ তোর বউকে কত সুন্দর লাগছে?সামনাসামনি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না তোর?।তাড়াছা খেয়াল করেছিস ভাবীর মুখটা কেমন শুকনো লাগছে!বেচারা সবাইকে ছেড়ে তোর কাছে আসবে আর তুই তাকে একটু সারপ্রাইজ দিয়ে খুশি করতে পারবি না?এমন অনেক ধরনের কথা বলে অবশেষে রাজি করিয়েছে।

রাফাতকে তো আর বলা যায় না যে, তার মন ছটফট করছে তনয়াকে এক নজর দেখার জন্য।ঘন পাপড়িতে ঘেরা কাজল কালো চোখ জোড়া যে তার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে!

“আরাফ মা যদি জানতে পারে খুব বকবে, দেখিস?”

“বকা খাবি না হয়।বউয়ের জন্য সামান্য বকা খেতেও তোর এত ভয়!তুই শালা বিয়ে করবি কিভাবে?শোন, “পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া”।

“উফ,আজ যে কপালে কি আছে কে জানে?”রাফাত আরাফের সাথে পেরে না উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

চলবে…

তনয়া পর্ব-০৩

0

#তনয়া
#পর্ব-৩
সিফাতী সাদিকা সিতু

অনেক ধরনের আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে।দুদিন পরেই হলুদ। কাজিনরা সবাই বায়না করছে এবার মেহেদী অনুষ্ঠান আলাদা ভাবে করবে।হলুদের আগের রাতে মেহেদীর আয়োজন হবে ঘটা করে।সেখানে নাচ গান হৈ-হুল্লোড় সবকিছু হবে।সকাল থেকেই সব ভাই বোনরা এ নিয়ে কুটকুট করছে।তনু অবশ্য এসবের মাঝে থাকলেও নিজে থেকে কিছু বলছে না।কারণ তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। মিশকাত ভাই তাকে উঠতে বসতে অপমান করছে।তনুর এখন হাসি পায় মাঝে মাঝে।মিশকাত দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে চাইছে।না ঘৃণা করতে পারছে না ভালোবাসা ভুলতে পারছে।দুটোর মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলেছে।তাই তনুর সাথে ঠিক কি করা উচিত মিশকাত সেটাই বুঝে উঠতে পারে না।

তনু সিঁড়ির দিকে আনমনা হয়ে তাকাতেই
দেখতে পেল মিশকাত ভাই নামছে।কালো টিশার্টে মিশকাতকে দারুণ লাগছে। মিশকাতের গায়ে রং ফর্সা হওয়ায় কালো রং খুব ভালো মানায়।তনু চোখ সরিয়ে নিলো।বুকের ভেতর কোথাও খুব জ্বলছে। সে নিজের দিকে তাকালো। তার পরনে বটল গ্রিন কালারের সালোয়ার কামিজ।রাতের করা বিনুনিটাও খোলা হয়নি।মাথার ওপরটায় একটু চিরুনি চালিয়ে বের হয়েছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা।তনু নিজের ঠোঁট কামড়ে নিরবে হাসলো।সে কোনো দিক থেকেই মিশকাত ভাইয়ের জন্য নয়!শুধু মিশকাত কেন সে কি কখনো কারও যোগ্য হতে পারবে?

মিশকাত এসে তনুর থেকে একটু দূরত্ব রেখে পাশে বসলো।তনু আরও গুটিয়ে গেল।তা খেয়াল করে মিশকাতের রাগ উঠে গেল।কি ভাবে নিজেকে তনু? কোন রাজ্যের পাটরানী সে?মিশকাতের জেদ চেপে গেল।সে তনুর আরও কাছ ঘেঁষে বসলো।তনু চমকে উঠলো মিশকাতের এমন আচরণে।

“তুমি সরে বসো মিশকাত ভাই।”

“তুই সরে বস।” মিশকাত দাঁতে দাঁত চেপে উওর দিলো।

“আর তো জায়গা নেই।পরে যাব তো আমি!”

“যা পরে,পরে মরে যা তুই।”

তনু ফাঁকা ঢোক গিললো। মিশকাত এই কয়দিনেই অন্য রকম হয়ে গেছে।ভালোই তো ছিল এতদিন ধরে। কেন যে বড় আপার বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল আর কেনই বা আবার মিশকাতের সাথে দেখা হলো তার?নিজেকে সে আর কত নিয়ন্ত্রণে রাখবে?মাঝে মাঝে মন ও মস্তিষ্কের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।মনটা জিততে খুব চেষ্টা করে।তনুর মনে হয় সে হাঁপিয়ে উঠেছে।এভাবে নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা যায় না।

তনু উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না।তার ওরনার ওপর বসে আছে মিশকাত।তনু মহা ফ্যাসাদে পরলো।কি চাইছে মিশকাত ভাই?মানুষটা এখনো কি সেই সময় গুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।

তনু জোরে একটা শ্বাস নিলো।ধীর স্বরে বলল,

“আমার ওরনার ওপর বসেছ কেন?”

মিশকাতের কোনো ভাবান্তর হলো না।সে অন্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।

তনু বাধ্য হয়ে সবাইকে বলল,

“গোল টেবিল বৈঠক শেষ করো তাড়াতাড়ি সবাই।বসে বসে কথা বললে তো হবে না সব আয়োজনও তো করতে হবে।”

“শান্তা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তনুর দিকে।বলল,
সেটা নিয়েই তো আলোচনা হচ্ছে।তুই কি কানে শুনতে পাস না?”

আরেক কাজিন মারুফ বলল,
“তোর মন কোথায় রে?এত উসখুস কেন করছিস?”

তনু পরলো মহা বিপাকে।তার ভাই বোন গুলো সব বিচ্চুরদল।

মিশকাত শুধু ভাবছে তার পাশে বসতেও তনুর এত অসুবিধা হয় তাহলে বোঝাই যায় সে শুধু শুধু নিজের সম্মান নিচে নামিয়ে ফেলে।কিন্তু সে যে তনুর চোখের ভাষা পড়তে পারে।কখনো ভুল হয়নি সে ভাষা বুঝতে।একমাত্র সেটাকেই অবলম্বন করে সে এক বুক আশা নিয়ে দিন গুনতে থাকে।

মিশকাত তার মুখটা একটু এগিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

তোর এতো অহংকার কেন?নিজেকে মিস ইউনিভার্স মনে করিস?

তনু অসহায় চোখে তাকালো মিশকাতের পানে।বলল,

“নিজেকে আমি কিছুই মনে করিনা। তোমার অনেক কিছুই মনে হতেই পারে সেজন্য আমার করার কিছু নেই।তুমি তোমার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না সেটা তোমার সমস্যা।আমি আমার মতোই আছি।”

মিশকাত চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“কেন তুই এতো আঘাত করতে জানিস তনু।যেদিন তোর আঘাতে আমি শেষ হয়ে যাব সেদিন ঠিক বুঝবি!”

তনুর কানে এসে লাগে কথা গুলো।বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।কান্না গুলো গলার কাছে এসে দলা পাকিয়েছে।

***

“শায়লা গহনা গুলো ব্যাংক থেকে নিয়ে এসেছ?”

“নাহ্,তুমি আনবে তো সেগুলো?”

“সেটা আগে বলবে তো?আমি কতবার বাইরে যাচ্ছি এক ফাঁকে নিয়ে আসতে পারতাম।”

“কাল যেও বড় ভাইজানকেও নিয়ে।তোমার একা যাওয়া তো ঠিক হবে না।”

“তা না হয় যাওয়া যাবে।” তা শুনলাম ছেলে মেয়ে গুলো নাকি ছাঁদে হলুদের আয়োজন করতে চাচ্ছে? ”

“হ্যাঁ, ওরা তো তাই বলল।অনেক ফুল লাগবে।লিষ্টটা আমার হাতে দিয়েছে।”

“ঠিক আছে আমায় দিও অর্ডার দিয়ে আসবো।” আমার আয়রার মায়ের জন্য কোনো কিছুর কমতি আমি রাখবো না।”

শায়লা বেগমের চোখ জোড়া ভিজে এলো।তার আদরের মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে মন সায় দেয়া না।তবুও সমাজের,ধর্মের নিয়ম মানতে হবে।যখন তখন মেয়েটার মুখটা দেখতে পারবেন আর এটা ভাবলেই বুকটা ফেটে যায়।আয়রার তার প্রথম সন্তান। মাতৃত্বের অনুভূতি আয়রাকে দিয়েই পেয়েছেন।খুব যত্নে,স্নেহে বড় করেছেন।এখন বিয়ে দিচ্ছেন। এর মাঝে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে! অথচ মনে হয় এই তো সেদিন কোল আলো করে এসেছে মেয়েটা।

“আরে কাঁদছ কেন আবার?আয়রা এসে দেখুক শুধু। মেয়ের জন্য তুমি তো নিজেই দেখে শুনে পাত্র ঠিক করলে তাহলে এত চিন্তা কেন করছো?”

“মানুষের ভেরতটা তো পড়তে পারা যায় না।কার মনে কি থাকে বোঝা যায় কখনো!”

“তবুও ছেলে খুব ভালো।একদম আমাদের আয়রার মতই।”

“সে জন্যই তো আমি ছেলেটাকে এত পছন্দ করেছি।মেয়েটা আমার দুনিয়ার প্যাচগোজ কিছু বোঝে না।ওর জন্য রাফাত ঠিক আছে।”

“এখন চোখ মুছে ফেলো দেখি,তোমার তো এখন সুখের সময়।বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। দুদিন পর আমার তনয়ার বিয়েও হয়ে যাবে।তনয়ার জন্যও আমি ঠিক ভালো ছেলে খুঁজে পাব।”

শায়লা বেগমের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। তনুর কথা ভাবতেই কষ্টটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

মিশকাত যে ঘরেই যাচ্ছে সে ঘরেই কেউ না কেউ আছেই।কোনো ওয়াশরুম ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না।বিরক্ত লাগছে তার।সারা শরীর ঘেমে গেছে।এখন গোসল করতে না পারলে শান্তি পাবে না।আজ সন্ধ্যার পর মেহেন্দি অনুষ্ঠান।সকাল থেকে তাই নিয়ে ব্যস্ত।ছাঁদটাকে ওরা সবাই মিলে খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়েছে। এত কাজ করে সকলে হাপিয়ে উঠেছে। এখন গোসল সেড়ে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে একটু বিশ্রাম করবে সবাই।এরপর বিকেলে রেডি হতে হবে।আজ সারারাত মজা করবে ওরা। নাচ গান আড্ডায় মেতে থাকবে।

তনু সদ্য গোসল সেড়ে বেরিয়েছে।মাথায় এখনো তোয়ালে পেঁচানো।তার খুব খিদে পেয়েছে তাই আগে খেতে যাবে। খেয়ে একটা ঘুম দেবে।কারন আজ রাতে যে ঘুমোনোর উপায় নেই তা বুঝে গেছে।হলুদের দিন সারারাত জাগলে বিয়ের দিন অনেকের সমস্যা হতে পারে ভেবেই আজকে এই ব্যবস্থা করা হলো।এতে মজা করাও হলো সবকিছু ঠিকঠাক থাকলো।তনু মিশকাত কে খেয়াল করে নি।সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে মিশকাতের সাথে মুখোমুখি হয়ে গেল।তনু একটু হকচকিয়ে গেল। মিশকাত সারা মুখ ঘামে চিকচিক করছে। টিশার্টের বুকের কাছের বোতাম গুলো খোলা।লোমশ বুকেও ঘামের ফোঁটার অস্তিত্ব। মিশকাত স্থির চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে জন্য সে তাড়াতাড়ি নেমে গেল।

“তনু!”

মিশকাতের আচমকা এই ডাকে থেমে যেতে হলো।নিচ থেকে ওপরে তাকিয়ে দেখলো সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে মিশকাত একি ভাবে তার দিকে আছে।

“কিছু বলবে?”

“আমায় একটু গোসল করার ব্যবস্থা করে দিবি?কোনো ওয়াশরুমে ফাঁকা পাচ্ছি না।”

তনু একটু থমকালো।এই জন্যই কি তাকে থামালো মিশকাত ভাই।সে তো অন্য কিছু ভেবেছে।একটু আগে মিশকাত ভাইয়ের চোখে সে তার প্রতি মুগ্ধতা দেখেছে।ভেবেছে কিছু হয়ত বলবে।তনু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবার ওপরে উঠে আসলো।মিশকাত বলল,

“আমার সাথে এসো।আমার ঘরের ওয়াশরুম ফাঁকা আছে।”

মিশকাত মুচকি হেসে তনুর সাথে পা বাড়ালো। তনুকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে।মিশকাতের ইচ্ছে করছে শুধু তাকিয়ে থাকতে।বলতে ইচ্ছে করছে,তোর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকার অনুমতি দিবি? কিন্তু পারলো না বলতে।

চলবে..

তনয়া পর্ব-০২

0

#তনয়া
#পর্ব- ২
সিফাতী সাদিকা সিতু

দরজার অনবরত কড়াঘাতে পাশে থাকা বোনটা দৌড়ে দরজা খুলে দিলে সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে আমার পাশে এলো।আমি তখনো ভয়েই আছি।সত্যি বলতে আমি প্রচন্ড ভীতু একটা মেয়ে।রাতে ইলেক্ট্রনিক লাইটে চারপাশ আলোকিত হয়ে থাকলেও আমি বারান্দায় কারও ছায়া দেখলেও চিৎকার করে উঠি।কিন্তু আজ অন্যরকম হয়ে গেছে সব।লাইট জ্বালানোর পর সবাই আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,

মা এসে বলল,ভয় পেয়েছিস তনু?তোর জামা ভেজা কেন? সারা মুখে তো পানি লেগে আছে।রাতে মুখ ধুতে গেলি কেন?মা নিজেই দিশেহারা হয়ে গেল প্রশ্ন করে।

মায়ের কথায় চমকে উঠলাম।পরখ করে দেখলাম সত্যি জামার গলার কাছটা ভেজা।
এর মানে ঠান্ডা শীতল স্পর্শটা পানি ছিলো!
কিন্তু আমি তো পানি খেতে উঠিনি বা ওয়াশরুমেও যাইনি?তাহলে এতসব হলো কখন?
আমি এভাবে ভিজলাম কেন?প্রশ্নগুলো মনে জাগছে আর শিউরে শিউরে উঠছি।ভুতের ভয় জেঁকে বসলো মনে।মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরলাম।

বাবা বলল,ও হয়ত পানি খেতে গিয়ে অন্ধকারে সব ভিজে ফেলেছে।

আমি কোনোমতে মাথা নাড়লাম।কারণ সবার সামনে যদি বলি আমি কিছু করিনি,ভুতে সব করেছে তাহলে সবার কাছে এই মাঝরাতে হাসির খোরাক হতে হবে।বড় মামা এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,তুই তো বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি আমাদের!

বড়মামাকে দেখে আমার মনে পরলো মিশকাত ভাইয়ের কথা।চট করে সোজা হয়ে বসলাম।ভালো ভাবে তাকিয়ে কোথাও দেখতে পেলাম না সেই, ‘কুপুরুষ’ কে!

মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।একটু পর সবাই চলে গেল।মাকে ফিসফিসিয়ে বললাম, আমার সাথে ঘুমোনোর জন্য।

এই নিয়ে মায়ের কাছে অনেক বকা খেতে হয় আমায়।মা নাকি চিন্তা করেন এতসব মেয়ে এখনো ভুতের ভয় পায়,সে শ্বশুর বাড়ি গেলে কি করবে?সব মায়েরই একি চিন্তা, মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গেলে কি করবে?শ্বশুরবাড়িটাই মনে হয় মেয়েদের একমাত্র পরিক্ষা ক্ষেত্র।

আচ্ছা, “মায়ের কি মনে হয় তার তনয়া কখনো শ্বশুর বাড়ি যেতে পারবে?”

মা যখন আলো নিভিয়ে আমার সাথে শুয়ে পরলো তখন আমি ভাবতে লাগলাম,আমার মুখে পানি আসলো কিভাবে?কিন্তু ভেবে কোনো সঠিক কারণ বের করতে পারলাম না।একবার মনে হলো বাবা ঠিক বলেছে,আমি হয়ত ঘুমের ঘোরে পানি খেতে গিয়ে এই অবস্থা করেছি।কিন্তু মন সায় দিলো না।হঠাৎ আমার মিশকাত ভাইয়ের কথা মনে পরে গেল।আমি একটু কেঁপে উঠলাম এবং সেই সাথে মনে পরে গেল তিনবছর আগে ঠিক এমনই একটা ঘটনা ঘটে ছিল।মিশকাত ভাইকে এড়িয়ে চলার কারণে আমার মুখে ঠান্ডা পানি ছুঁড়ে বলেছিল,”নিজেকে এত রূপবতী মনে করিস না,তোর ওই বান্দর মার্কা মুখটা না দেখলে কেউ মরে যাবে না।আমার সাথে ভাব নিয়েছিস তার একটু ছোট শাস্তির নমুনা দিলাম।এরপর থেকে তোর ভাব গুলোকে বস্তা বন্দী করে পঁচা ডোবায় ফেলে দিয়ে আসবি!”

আমার কেন জানি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ব্যাপারটার সাথে সেদিনের মিশকাত ভাইয়ের করা আচরনের মিল খুঁজে পাচ্ছি। আমি যে সুকৌশলে মিশকাত ভাইকে এড়িয়ে চলছি সেটা কি মিশকাত ভাই বুঝে গেল?আমার সারা গায়ে কাঁটা দিলো।চোখ বন্ধ করে মায়ের আরও কাছে ঘেষে শুয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম।

বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো, মিশকাত।রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনি।সকাল বেলা সেই ঘুম একটু পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে।নিচে আসতেই ফুপি তাকে ঠেলে বসিয়ে দিলো নাস্তার টেবিলে।বেলা এগারোটায় সে নাস্তা করছে একা একা।স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নিলো।বেশ শান্ত লাগছে বাড়িটাকে!রান্নাঘরের টুকটাক শব্দ ছাড়া তেমন কোনো আওয়াজ আসছে না।মিশকাত হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে দিলো।এই স্যান্ডউইচটার স্বাদ এতো চেনা লাগছে কেন?

মিশকাত বসা থেকে উঠে এসে সোজা রান্না ঘরে ঢুকলো।

“ফুপি তুমি বানিয়েছ স্যান্ডউইচ? ”

“কেন রে খেতে মজা হয়নি বুঝি,কিন্তু তনু তো খুব ভালো স্যান্ডউইচ বানায়!”

মিশকাত শুধু নিরবে হাসলো।বলল,

“নাহ্ তেমন কিছু নয়,অন্য কিছু থাকলে দাও আমি স্যান্ডউইচ খাব না।”

“সবাই তো সকালে খিচুড়ি খেয়েছে।তোকেও দেব?”

“দাও।”

“তুই গিয়ে বস আমি নিয়ে আসছি?”

মিশকাত গেল না।সে আবার বলল,

“আয়রা আপারা কি বাড়িতে নেই?মাকেও দেখছি না?”

“সবাই তো বাইরে গেছে।অল্পকিছু কেনাকাটা বাকি আছে। তাই আমি বড় ভাবীকে পাঠালাম।”

শায়লা বেগম একটু থেমে বলল,”তুইও যাবি নাকি একটু?”আজ রাফাত আসবে! ”

মিশকাত সানন্দে রাজি হয়ে গেল।ঠিকানাটা জেনে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরিয়ে পরলো।

শপিংমলের পাশের ক্যাফেতে রাফাত আয়রা বসে আছে।আয়রা লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে।রাফাতের অবস্থাও একি।সে বোধহয় আয়রার থেকেও লজ্জা বেশি পাচ্ছে। আয়রার সাথে কথা বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছে,চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না।বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।ফোনে কথা বলতে এত লজ্জা লাগে নি কখনো।অথচ আজ যেন পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা গুলো এসে ভীড় করেছে দুজনের মাঝে।

“তুমি কফি নেবে আরও?”

আয়রা মৃদুস্বরে বলল,”নাহ।”

রাফাত কি বলবে কথা খুঁজে পেয়ে বলল,

“বিয়ের শাড়ি পছন্দ হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার কি ভালো লাগছে না?”

আয়রা মাথা তুলে তাকালো।

না মানে,তুমি কথা বলছো না,যা জিজ্ঞেস করছি সব হ্যাঁ না তে উত্তর দিচ্ছো তাই। তোমার ভালো না লাগলে উঠি চলো।”

আয়রার মনটা খারাপ হয়ে গেল।সে লজ্জায় ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না।রাফাতের শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে।অন্যদিকে উঠতেও ইচ্ছে করছে না।মনে হচ্ছে সারাজীবন এভাবেই বসে পার করে দিতে।

“না তেমন কিছু নয়।আমার খারাপ লাগছে না।”

রাফাত মুচকি হাসলো।মেয়েটা তারই মতো নার্ভাস।

তনু ওদের থেকে একটু দূরে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে।বিরক্তির কারণ,”সামনে বসা রাফাতের কাজিন আরাফ।”ছেলেটা আঁড়চোখে বারবার তার দিকেই তাকাচ্ছে।তনুর অসস্তি হচ্ছে। কিছু বলতেও পারছে না। কয়েকদিন পরেই আত্মীয় হতে চলেছে।

“আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? ”

“না।শুধু বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”

“তাহলে চলুন আশেপাশে কোথাও হেঁটে আসি।”

“ইচ্ছে তো করছে কিন্তু উপায় নেই।আপা আমায় কোথাও যেতে বারন করেছে।দেখছেন না দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে দুজনেই লজ্জায় কাত হয়ে আছে।”

আরাফ জোরে হেসে উঠলো। বলল,
“আপনিও কি লজ্জা পাচ্ছেন?”

“আমি লজ্জা পাবো কোন?”

“নাহ, এমনি জানতে চাইলাম।” আপনি আমার অনেক ছোট হবেন।আমি কি তুমি বলতে পারি?”

“অবশ্যই। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা বেশ,তুমি তাহলে কবে বিয়ে করছো?তোমার আপার পরেই তো তোমার সিরিয়াল।”

তনু কেঁপে উঠলো আরাফের কথায়।কি বলবে ভেবে পেল না।মানসপটে শুধু মিশকাতের মুখটা ভেসে উঠলো হঠাৎ। তনু সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

“কিরে বসে বসে ঘুমাইতেছিস ক্যান?ভদ্রতা এখনো শিখলি না!”

তনু চট করে চোখ জোড়া খুলে আবার বন্ধ করে নিলো।কি দেখলো সে।তার সামনে মিশকাত ভাই বসে আছে!

মিশকাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তনুর দিকে।তার পাশে থাকা আরাফ অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।আসলে সে কিছু বুঝতে পারছে না।কোথা থেকে যেন এই ছেলেটা এসে বসে পরলো!

কিরে তোর কি ব্যারাম ট্যারাম ধরলো নাকি।ব্যারামী মুরগীর মতো টুপতেছিস কেন?

তনু এবার চোখ খুললো।সোজা হয়ে বসে সোজা মিশকাতে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি এখানে কেন?”

তনুর কথায় মিশকাত অপমান বোধ করলো।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।বলল,

“কেন তুই কি এই ক্যাফের মালিক।তুই শুধু একা আসতে পারিস আমি পারি না।তাছাড়া ফুপি আমাকে পাঠিয়েছে আয়রার আপার হবু বর দেখার জন্য। তোর মতো অসভ্য বেয়াদবের কাছে আসিনি।আর কে জানতো আয়রা আপার সাথে তোর টাও দেখে ফেলব!”মিশকাতের চোখ জোড়া লাল হয়ে গেছে রাগে।

তনু মনে মনে হাসলো।সে ঠিক জানতো মিশকাত তাকে দেখতে না পেয়ে এখানে এসেছে।তবে একটু চমকালো সে।আরাফকে মিশকাত অন্য ভাবে ভেবে নিয়েছে।যা ভাবার ভাবুক সে কিছু বলবে না।

আরাফ এবার বলল,

তনয়া,আমি কিছু বুঝতে পারছি না।কে এনি?

আমার বড় মামার ছেলে।বড় আপার বিয়ের জন্য এসেছে।

ওহ,তোমার মামাতো ভাই হন!

নাহ,আমি ওর মামাতো ভাই নই।মিশকাত প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো।

তনু আরাফ হতভম্ব হয়ে গেছে হঠাৎ মিশকাতের এমন চেঁচানোয়।

তনু চোখ মুখ খিঁচে বসে আছে।সে শুধু ভাবছে রাফাতের সামনে যেন মিশকাত ভাই কোনো সিনক্রিয়েট না করে।

তনু যে বলল আপনি ওর বড় মামার ছেলে।তাহলে তো মামাতো ভাই হলেন।

হ্যাঁ আমি ওর বড় মামার ছেলে হতে পারি কিন্তু ওর মামাতো ভাই নই।

তনু চট করে তাকালো মিশকাতের দিকে।খুব করে বুঝতে চাইলো মিশকাতের কথার অর্থ।

তনুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিশকাত বলল,আসলে ওর মতো অসভ্য মেয়ের মামাতো ভাই হিসেবে আমি নিজেকে পরিচয় দিতে চাই না।বাই দ্যা ওয়ে, আমি মিশকাত। আপনি?

আমি আরাফ।রাফাতের কাজিন।

তনু বিড়বিড়িয়ে বলল,”মিশকাত নাম না হয়ে তেমার নাম হওয়া উচিত মিচকা শয়তান! ”

বড় মামকে চা দিতে এসে মামির মুখোমুখি হয়ে গেল তনু।মামা ঘরে নেই।মামি বসে আছে জামাকাপড় গোছাচ্ছে। তনু কি বলবে ভেবে পেল না?

তনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মামি বললো,

বোনের বিয়েতে তো তুই বেশি কাজ করছিস রে তনু?

তা বলতে পারো।কাজ করতে ভালো লাগে মামি।আর বড় আপার বিয়েতে নিজের হাতে কাজ করতে পারাটা আমার জন্য অনেক আনন্দের।

তা ঠিক।তোর অনেক গুন বলতে হবে।

তনু দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রইলো।মামি তাকে ঠিক জায়গায় খোঁচাটা মেরে বুঝিয়ে দিলো তনুকে সীমা অতিক্রম না করতে।নতুন করে বুঝিয়ে দেয়ার কোনো দরকার ছিল না।তনু নিজেকে চেনে।সে কখনো সীমা অতিক্রম করবেও না।

চলবে..

তনয়া পর্ব-০১

0

#তনয়া
#পর্ব-১
সিফাতী সাদিকা সিতু

বড় আপার বিয়ে ঠিক হতেই আনন্দের ধুম পরে গেল। ইন্জিনিয়ার পাত্র পেয়ে মা বাবা দুজনেই খুশিতে বাঁধনহারা। সব আত্মীয় স্বজনদের বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকে আসতে হবে, এই বলে দাওয়াত করতে শুরু করে দিয়েছে।বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা!এমনিতেই নানার বাড়ি এবং দাদার বাড়ির সবাই বিয়ের সাত আট দিন আগেই এসে হাজির হবে।বাবা পরিবারের বড় ছেলে এবং শ্বশুর বাড়ির ছোট জামাই হওয়ায় পারিবারিক অনুষ্ঠান গুলোতে বেশ চাপে পরতে হয় আমাদের।আমার মামা খালা এবং চাচা ফুফুদের মাঝে একধরনের নিরব যুদ্ধ শুরু হয় যে কোনো অনুষ্ঠানেই।এক পক্ষের দাবী আমরা ওদের থেকে ওপর পক্ষকে বেশি মূল্যায়ন করি।ওপর পক্ষেরও একি কথা।এই নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় আমাদের।শুধু আমরা নই যেকোনো অনুষ্ঠানেই দুই পরিবারের গ্যাদারিং হবেই।তার একটা বড় কারণ, আমরা সব কাজিনরা। কাজিনদের সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়। হিসেব করলে বিশের কোটা পার হয়ে যাবে।তবে অনেকে পড়াশোনার কারণে দেশের বাইরে থাকে।কয়েকজনের বিয়ে শাদী হওয়ায় আগে থেকে এসে গ্যাদারিং করতে পারে না।তবুও দেখা যাবে বারো থেকে চৌদ্দজন বিয়ের আগেই এসে উপস্থিত হবে।

বিয়ের শপিং করার আনন্দ, গায়ে হলুদের থিম নিয়ে প্ল্যান করা এসব কিছুর আগেই আমার মন থেকে বিয়ের আনন্দ কর্পূরের মতো উড়ে গেল,

‘মিশকাত ভাই আসবে শুনে।’

পুরোনো ক্ষত দগদগে হয়ে উঠলো।হয়ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে।তিনবছর আগের সেই বিষাক্ত দিনটা মানসপটে উঁকি দিচ্ছে।আমার মনে হলো এবার বড় আপার বিয়েটা আমার জীবনে আনন্দ নয় শাস্তি রূপে এসেছে।তা না হলে মিশকাত ভাইয়ের সাথে আমার আবার দেখা হবেই বা কেন?হওয়ার তো কথা নয়?

নিজের বোনের বিয়েতে মিশকাত ভাইয়ের কাছে অপমানিত হয়ে বিয়ের সবটুকু আনন্দ মাটি হয়ে যাবে আমার।পারিবারিক প্রতিটি অনুষ্ঠানে যতটা সম্ভব আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি ওই মানুষটার কাছ থেকে।মিশকাত ভাই যে আমায় অপমান করে তার বড় একটা কারণও আছে।পুরোনো কাসুন্দি ঘাটতে ইচ্ছে হয় না।কিন্তু মিশকাত ভাইয়াকে কে মোটেও সহ্য হয়না আমার।চরম লেভেলের অসভ্য একটা ছেলে। ভদ্র, সভ্য, মেধাবী ছাত্র, সুদর্শন, সুপুরুষ হিসেবে গোটা আত্মীয় মহলের কাছে পরিচিত।অথচ কেউ জানেই না ছেলেটা সুপুরুষ নয় ,কুপুরুষ! আর এই বিষয়ে একমাত্র অবগত আমি নিজেই।আমার মতো অসুন্দরী,লেখাপড়ায় ডাব্বা মারা, ঘরকুনো একটা মেয়ের কথা কেউ কখনো বিশ্বাস করবে না।এসব ভাবতে গিয়ে মাথা ধরে গেল।কষ্ট গুলো মাথাচাড়া দিচ্ছে।হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। রান্নাঘরে গিয়ে এককাপ চা বানাতে এলাম।চা বানাতে গিয়ে মনে পরলো,এই যে আমি কফি খেতে পারি না, এটা নিয়েও মিশকাত ভাই আমায় অপমান করেছিলো।মোর্শেদা আপার বিয়ের সময় চোখ মুখ কুঁচকে বলেছিলো,

তুই কফিও খেতে পারিস না, তনু?পারিস টা কি তাহলে?আজকালকার মেয়েছেলে হয়ে কাপে চা নিয়ে ছফছফ শব্দ তুলে খাস?ছি ছি,ম্যানার্স শেখ তনু। তা না হলে তোকে নিয়ে ফুপি কোথাও বের হতে পারবে না।

আমি সেদিন ওয়াশরুমে ঢুকে কেঁদেছি ঘন্টাখানেক।পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি ওই মানুষটা জন্মেছেই আমায় অপমান করতে।তাই নিজে এতো কষ্ট না পেয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।আমি তো জানি মিশকাত ভাই কেন আমার সাথে এমন আচরণ করে!তাই সবটা সহ্য করা শিখতে হয়েছে।এই কষ্ট গুলোর পথ তো আমি নিজ হাতে তৈরী করেছি।তবুও খারাপ লাগে আমার।মন বলে তো আমারও কিছু আছে?

কিরে তনু চায়ের পানি তো কমে যাচ্ছে,চা পাতা দিস না কেন?

মায়ের কথায় ভাবনা থেকে বের হতে হলো।দ্রুত হাতে চা পাতার কৌটো টা হাতে নিলাম।একটু পর চায়ের কাপ হাতে ঘরে এসে দেখলাম, বড় আপা ফোনে কথা বলছে।

বিয়ের ডেট ফাইনাল হবার পর থেকেই হবু জামাইর সাথে কথা বলছে।বড় আপার চোখে মুখে খুশির ঝলক।যা দূর থেকেও দৃষ্টিগোচর হয়।আপা জীবনের শ্রেষ্ট সময় মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি আর ঘরের ভেতর ঢুকলাম না।চা নিয়ে ছাদে উঠে গেলাম।

আমাদের বাড়িটা ডুপ্লেক্স। ব্যবসার শুরুতে ইস্কাটনে চারকাঠা জায়গা কিনে রেখেছিল বাবা। বছরতিনেক আগে বাড়ি করেছেন।আমার সবথেকে পছন্দের জায়গা হলো ছাঁদ। ছাঁদে সআমি দোলনা রেখেছি।বিভিন্ন ফুলের গাছও আছে।আমার মতো ঘরোয়া টাইপ মেয়ের অবসর সময় কেটে যায় এই ছাঁদেই।

ছাঁদে ওঠার পর মনো হলো,মিশকাত ভাই এই প্রথম বোধহয় আমাদের এই নতুন বাড়িতে আসবেন।মোহাম্মদপুরের পুরোনো ফ্লাটে অনেকবার আসলেও এই নতুন বাড়িতে আসে নি একবারও।বড় মামা আসলেও মামি বা মিশকাত ভাই কখনো আসে নি।বড়মামির না আসার বড় একটা কারণ, মা!
মায়ের সাথে কিছু একটা বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে কয়েকবছর আগে।তবে এবার বড় আপার বিয়ে উপলক্ষে বড়মামি আসবেন। খুব বেশি সময় ছাঁদে থাকতে পারলাম না।ছোট ভাই তন্ময় এসে ডেকে নিয়ে গেল।

মায়ের ঘরে ঢুকতেই মা তা একগাদা কাজের হুকুমজারি করলো।তনুর অবশ্য ঘরোয়া কাজকর্মের প্রতি একটু আগ্রহ বেশি।বড় আপা সেদিক থেকে পিছিয়ে আছে।বড় আপা তো ডিম ভাজি ছাড়া কোনো রান্নাই জানে না।মায়ের প্রথম সন্তান হওয়ার দরুন সবসময় একটু বেশি আদর পেয়েছে বড় আপা।বড় আপার জন্মের চার বছর পর তনুর জন্ম।তন্ময়ের জন্ম তার আরও তিন বছর পর।ঠিক করা হলো সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের জন্য উপরের সবকয়টা ঘর ঠিকঠাক করে রাখা হবে।নিচের তলায় যত কাজকর্ম সব হবে।সে অনুযায়ী বিছানার চাদর পর্দা সবকিছু নিয়ে তনু উপরে উঠে গেল।একমাত্র কাজের মধ্যে থাকলেই সে’ মিশকাত ভাই ‘নামক চিন্তা থেকে দূরে থাকবে।

দেখতে দেখতে বিয়ের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেল।তনু একরাশ মন খারাপ নিয়ে সবটা করলান।একসময় তার মনে হলো আমি কেন এত বিচলিত হচ্ছি?এবার তো নিজের বাড়িতেই থাকবো, সবকিছু নিজের মতো হবে,তাহলে এত মন ছোট করার কি আছে?তিন বছরে অনেক কিছুই অন্যরকম হয়ে গেছে।মিশকাত ভাইকে আগে যেভাবে এড়িয়ে চলেছি তার থেকে দ্বিগুণ এড়িয়ে চলবো।অপমানিত হওয়ার কোনো জায়গা রাখবো না।সব থেকে বড় কথা হলো শুধু শুধু অপমান নেবোই বা কেন?প্রতিবাদ করবো না কেন? এখন অনেকটা বড় হয়েছি,অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছি।এই তো গেল এপ্রিলে একুশে পা দিলাম।এসব ভবনা ছেড়ে বিয়েতে মন দিয়ে ভালো হবে।মিশকাত নামের অধ্যায় টা খুলতে চাইলাম না নতুন করে।

পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা রক্তিম আভা ছড়িয়েছে,যেন সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে নীড়ে ফেরার সময় হয়েছে।ঠিক সে সময়ে ছাঁদে উঠেছিলাম ফুল গাছ গুলোতে পানি দিতে। বড় আপার বিয়ের জন্য ব্যস্ত সময় কাটছে।ঠিকমতো যত্ন নিতে পারছি না গাছ গুলোর।ছোট বালতি থেকে পানি তুলে গাছগুলোতে ঢালছি।কোনো কোনো গাছে একটু হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।ফুল আমার খুব পছন্দের একটা জিনিস,অবশ্য শুধু আমার নয়, প্রায় অনেকেরই প্রিয় জিনিস। ঠিক সে সময় গাড়ির শব্দে নিচে ঝুঁকলাম কৌতুহলী হয়ে।

এমন সময় আবার কোন আত্মীয় এলো?

আমাকে একসাথে অবাক এবং অসহায় করে দিয়ে বড় মামা,মামির সাথের মিশকাত ভাই সিএনজি থেকে নামলো।এক ঝলকে চিনে ফেললাম সেই মানুষটাকে।চেনা নিশ্বাস কি কখনো অচেনা হয়!আমার হাসফাস লাগতে শুরু করলো।দৌড়ে নেমে এলাম ছাঁদ থেকে।ওই মানুষটার মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার।মা ডাকলেও যাবো না।পরে মামার সাথে ঠিক দেখা করে নিবো।বসার ঘরের অনেক কিছুই কানে আসছে।যখন শুনতে পেলাম মা তন্ময়কে বলছে আমায় ডাকতে তখন ঝটপট বিছানায় উঠে পরলাম।ঘুমের ভান করে কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকলাম।

তন্ময় ‘তনুপি’ বলে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো।তনুকে শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো।তনুকে ভালো ভাবে পরখ করে বুঝলো, তনুপি ঘুমোচ্ছে।তন্ময় ফিরে যেতে যেতে ভাবলো সে তো একটু আগেই তনুপিকে ছাঁদে যেতে দেখলো,এর মধ্যেই তনুপি ঘরে এসে ঘুমিয়ে পরলো কখন?তন্ময় সুবোধ বালকের ন্যায় ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

তন্ময় বসার ঘরে গিয়ে তনুর ঘুমিয়ে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট করলো সবার কাছে।আমি বিছানায় বসে সবটা শুনলাম।

মিশকাত ঝুঁকে আছে নাস্তার প্লেটের ওপর।তার অতি প্রিয় ফুপির হাতের বানানো জর্দা সেমাই খুব যত্ন করে আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে।যেন জাগতিক সবকিছু বাইরে অবস্থান করছে সে।উপস্থিত কারো কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না।মিশকাত হাত থাকা দামী ব্র্যান্ডের ঘড়িটার দিকে তাকালো।প্রায় ছয়টা বাজতে চলেছে।এতদামী ঘড়ি সে কখনোই পরে না আজ পরেছে বিশেষ কারণে। ঘড়িটা তাকে তার খুব কাছের এক বন্ধু জন্মদিনে গিফট করেছে।এখন মনে হচ্ছে ঘড়িটা পরার প্রয়োজন ছিলো না,এমনকি আয়রা আপার বিয়েতে আসারও।

ব্লু জিন্স, টিশার্ট আর ডেনিম জ্যাকেট পরা মিশকাত বেশ সুদর্শন দেখাচ্ছে।

তন্ময় তো বলেই ফেলেছিল, ভাইয়া তুমি তো অনেক পাল্টে গেছ!

মিশকাত মুচকি হেসেছে শুধু।এই পরিবর্তন গুলো তো সে নিজেই চেয়েছে।মিশকাতের বাবা সরকারি চাকুরীজীবি। খুব বেশি বিলাসবহুল জীবন ধারণ না করতে পারলেও খুব একটা খারাপ অবস্থা কখনো হয়নি।সমাজে সবসময় চলনসই একটা অবস্থানে থাকতে পারে।সে তুলনায় তনুদের অবস্থা ওদের থেকে ভালো।শুধু ভালো বললে বিশেষনটা ঠিক মতো হবে না।একটু বেশিই ভালো।তনুদের বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই মিশকাতের মাথায় কয়েকধরনের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।বসার ঘরে দামী সোফা,ঝাড়বাতি, শোপিচের চাকচিক্য দেখেই মিশকাত হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। এর আগে হিসেব নিকেষ গুলো অন্যরকম হয়নি তার।তিনবছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে তাহলে!তবে হিসেব টা কি তা বোধহয় জানার উপায় নেই।

আয়রা মিশকাতকে উপরে নিয়ে গেল ঘর দেখিয়ে দেয়ার জন্য।মিশকাত যেতে যেতে বললো,

বিয়ের কনে জন্যই কি তোমার গ্লামার বেড়ে গেছে, আপা?

আয়রা মিশকাতের থেকে একবছরের বড়।মিশকাত তাকে এত সম্মান দিয়ে আপা ডাকে কেন কে জানে?

আয়রা লজ্জায় টুকটুকে হয়ে গেল।ইদানীং সে কারণে অকারণে লজ্জা পাচ্ছে।এই লজ্জাটুকুর কারণ, রাফাত সাহেব।

আয়রার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখে মিশকাতের খুব ভালো লাগলো।সে আবার বললো,

তোমার হবু বর সাহেব শুনলাম ইন্জিনিয়ার, তা নাম কি সেই ভাগ্যবান পুরুষের?

আয়রা দ্বিগুণ লজ্জা নিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,

“রাফাত ইসলাম।”

আশ্চর্য! , আয়রার নামটা বলতেও অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করলো।রাফাতে সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পৃথিবীর সবকিছুই তার বড্ড বেশি ভালো লাগছে।নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে।আয়রা খুব নরম,সহজ সরল টাইপের মেয়ে।দুনিয়ায় এত প্যাচগোজ,বাস্তবতার নির্মম জটিলতার কোনোটা সম্পর্কেই বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই।শায়লা বেগম বড় মেয়েকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখে খুব যত্নে, আহ্লাদে বড় করেছেন।

রাতে আরও বেশকিছু মেহমান আসলো।তনু সন্ধ্যার পর ফাঁক বুঝে মামা, মামির সাথে দেখা করে নিয়েছে।গ্রাম থেকে তারই সমবয়সী ফুফাতো বোন এসেছে।তনু রাতে খেয়ে নিয়েছে ওদের সাথেই।সে সবরকম চেষ্টা করছে মিশকাতের নজরে না পরার।

আজ তনু বড় আপার সাথে ঘুমোয়নি।আপা তার অর্ধেক রাত হবু জামাইর সাথেই কাটিয়ে দেয়।কুটকুট করে কথা বলে যা সে পাশে শুয়েও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারেনা। তাই সে আজ বড় আপাকে মন খুলে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য গ্রাম থেকে আসা ফুপাতো বোনের সাথে ঘুমিয়েছে।তবে কোনো কারণে ঘুমটা ভেঙে গেছে তার।ঘরের মধ্যে ভারী নিশ্বাসের অনুভূতি হচ্ছে। যা খুব একটা অচেনা লাগছে না ।ঘুমের ঘোর থেকে বের না হতেই মুখে খুব শীতল কিছুর স্পর্শে ভয়ে বিরাট চিৎকার করে উঠে বসলো।তনুর চিৎকারে বোধহয় গোটা বাড়িটাই কেঁপে উঠেছে,তা না হলে একে একে সবাই এসে দরজার বাইরে জমা হতে সময় নিলো না, কেন?

চলবে..

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-২০(শেষ পর্ব)

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ২০

নাগরদোলা থেকে নামা মাত্রই সাদের মাথা চরকার মতো ঘুরতে শুরু করলো। বহুকষ্টে দুলতে দুলতে বাড়ি এলো। ঘরে ঢুকেই ধপাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো। তমাকে যদি একটা শিক্ষা না দিয়েছে তবে তাঁর নামও ইরফান রশিদ সাদ না!

তমা আর আঙুর বালা রাতে একসঙ্গে ঘুমোচ্ছে। তমার তখন সবেমাত্র চোখ লেগে এসেছে। কারো ফুঁপানোর শব্দ শুনে উঠে বসলো তমা। আঙুর বালা বালিশে হেলান দিয়ে চোখের পানি মুছছে। তমা মায়াভরা কন্ঠে আঙুর বালাকে বললো,” কী হয়েছে দাদু? তুমি কাঁদছো কেন?”

আঙুর বালা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,”আর কী হইবো? কিছু হয় নাই।”

তমা আঙুর বালার আঁচল ধরে বললো,”তাহলে শুধু শুধু কান্না করছো কেন?”

আঙুর বালা তমাকে ঝারি মেরে বললো,” আমার কান্দন আমি কান্দি। তোর কী?”

তমা এবার চুপ হয়ে গেল৷ আর কোনো কথা না বলে, আঙুর বালার পাশে বসে রইলো। আঙুর বালা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, ” আজকা তোর দাদার কথা বার বার মনে পরতাসে। তুই আর ওয় যহন মেলায় গেলি আমার বুকটা খাঁ খাঁ কইরা উঠসে। আমি যহন বিয়া কইরা এই বাড়িতে আইলাম। তহন আমি তোর মতো। হ্যাং/লা, জুংলা একটা চিকনা পাতলা শরীর লইয়া হারাদিন টইটই করতাম। আমার শাশুড়ী আবার এডি পছন্দ করতো না। বাইরে গেলে কী গাইল(গাল) যে পারতো! একবার হুনলাম মাঠের ওইদিকে মেলা হইবো। তোর দাদারে কইলাম। হ্যায় আমারে বিকালে লইয়া গেল। কতকিছু কিনা দিলো। ঝালমুড়ি, বাদামবুট খাওয়াইলো। আহারো! মানুষটা নাই। হারাদিন খালি হ্যার কথা মনে পরে।আমারে কত ভালোবাসতো। চল হ্যানে ঘুরতে যাই। এইডা খাই ওইডা খাই। আমার আর ভাল্লাগে না রে! আল্লাহ এত মানুষের মর/ন দেয়। আমি মরি না ক্যা? আমার আর একলা একলা ভালা লাগে না। কারে লইয়া থাকুম আমি?”

আঙুর বালা চোখের জল ফেলতে ফেলতে কথাগুলো বললেন। তমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। চুপটি করে আঙুর বালাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো তমা।

সকালে তমা পুকুর পাড়ে বসে বসে পা দোলাচ্ছে। এমন সময় সাদ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। তমা সাদকে দেখে গান ধরলো,” ১৫ আর ১৬ নাগরদোলায় দোলো।”
সাদের মাথায় যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এই মেয়েটা ভারী বেয়া/দব তো! সাদ তমার দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,”তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো তমা! তোমাকে আমি দেখে নেবো।”

তমা ফিক করে হেসে বললো,” কাল নাগর দোলার ঘুরনি খেয়ে মাথা আছে না গেছে? সাত-সকালে এত মাতলামি না করে ঘরে গিয়ে ঘুম দিন। যান!”

সাদ এবার রেগেমেগে আগুনের জমাট বাঁধা কুন্ডলীর ন্যায় তমাকে বললো, “তোমার হাল যদি বেহাল না করেছি তবে আমার নাম সাদ না।”

তমা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো,” আপনার নাম সাদ না পাদ! হাহা!”

সাদ এবার রেগে গিয়ে তমাকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিলো। তমা পুকুরে পরে গিয়ে টুপ করে ডুবে গেল। পানির নিচে শ্বাস বন্ধ করে বসে করে নিচে বসে থাকলো। সাদ পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। তমা গেল কোথায়?পাঁচ মিনিট আগে তমাকে পুকুরে ফেলে দিয়েছে। এখনও উঠলো না যে? তমা আবার মরে-টরে গেল না তো? সাদ ভয়ে ভয়ে এক পা এক পা করে পানিতে নামল। কিন্তু কীসের তমা কীসের কী!

পেছন থেকে শিস বাজানোর শব্দ শুনে সাদ পেছনে ফিরে তাকালো। ওমা সেকি! তমা তো পানির নিচে ছিল। তবে ওপরে উঠলো কী করে? তমা সাদকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো,” ছোটবেলা থেকে গ্রামে বড় হয়েছি।সাঁতার জানি!”

এটুকু বলেই তমা পুকুর পাড় থেকে লাফাতে লাফাতে চলে এলো। সাদ মদন হয়ে পুকুরে বসে থাকলো। অন্যকে পানিতে ফেলতে গিয়ে নিজেই কিনা শেষমেশ পানিতে পরে গেল!

সাদ ঘরে ঢোকার সময় শুনতে পেল আঙুর বালা আর অনিতা গল্প করছে। অনিতা কথা প্রসঙ্গে আঙুর বালাকে বলতে লাগলো,” সাদ যখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরি করবে। তখন, সাদ আর তমার বড় করে বৌভাতের অনুষ্ঠান করবো। তমার জন্য কত গহনা তুলে রেখেছি আমি। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরিয়ে তমাকে ঘরে তুলবো আমরা। আমার ছেলের একটা মাত্র বউ।”
সাদ এটুকু শুনে মুচকি হাসলো। তাঁর মায়ের এত স্বপ্ন তমাকে নিয়ে। একবার যদি টের পেতো তমার পেটে পেটে এত শয়তা/নি আর কু/বুদ্ধি তাহলে আর ভুলেও তমার দিকে ফিরে তাকাতো না।

ইদের ছুটি শেষ, কাল থেকে স্কুল কলেজ সব শুরু। তমারও কাল থেকে স্কুল শুরু। সাদের ও কলেজ শুধু কাল থেকে। তাই আজ দুপুরে খাবার খেয়েই সবাই রওনা দেবে।

তমার আজ মন ভীষণ খারাপ। সাদ চলে গেলে কার সঙ্গে ঝগড়া করবে তমা? কেন সাদ এত অল্প সময়ের জন্য আসে? আর কতগুলো থেকে গেলে কী হতো? কলেজে কয়দিন না গেলে কী এমন ক্ষতি হতো? তমা দুপুরে রাগ করে কিছুই খেলো না। সাদ চলে যাওয়ার আগে একবার সাদের সঙ্গে দেখাও করলো না।রাগে দুঃখে গাছতলায় মাথা নিচু করে বসে রইলো।

সাদকে অনিতা তাড়া দিতে শুরু করলেন। এখন না বের হলে দেরি হয়ে যাবে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। সাদ ঘুরে ফিরে শুধু তমাকে খুঁজছিল। তমাকে খুঁজে না পেয়ে পুকুর পাড়ে দৌড়ে গেল। তমা যে সেখানেও নেই। তবে গেল কোথায় তমা? তমাকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পেছনের গাছ তলায় এলো সাদ। তমা মাথা নিচু করে বসে আছে। সাদ তমার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে তমাকে ডাক দিলো,”তমা!”

তমা প্রত্ত্যুতরে কোনো জবাব দিলো না। এই মানুষটার সঙ্গে কোনো কথা নেই তমার। সাদ তমার মাথাটা উঁচু করে ধরলো। কেঁদে কেটে মুখ লাল টকটকে বানিয়ে ফেলেছে। সাদ বিনয়ের স্বরে বললো,” আমি কী একেবারে চলে যাচ্ছি? আবার আসবো তো!”

তমা তবুও নিরুত্তর। সাদ তমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে গভীর মমতায় বললো,”এই কিছুদিন পরপরই তো দেখা হয়। তবুও তুমি এমন কেন করো? ফোন ও তো আছে? ভিডিও কল দেবে আমাকে দেখতে পাবে।”

তমা সাদের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,” ওখানে শুধু দেখা যায়। ছোঁয়া তো যায় না!”

সাদ এবার কিছুটা চুপ হয়ে গেল। তমার কথার কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। নিবিড় কন্ঠে তমাকে বললো,” এখন তো অল্প অল্প দেখা হচ্ছে। আমার যখন পড়াশোনা শেষ হবে তখন অনেক অনেক দিন একসাথে থাকতে পারবো আমরা। এখন যদি পড়াশোনা ঠিকমত না করি। ফাঁকি দেই তাহলে তো আম্মু তোমার সঙ্গে দেখাই করতে দেবে না।”

তমা চুপ করে বসে রইলো। সাদ স্নেহ মাখা কন্ঠে তমাকে বললো,” আমি যাই এবার? ”

তমা মাথা নাড়িয়ে বললো,” আবার আসবেন তো?”

সাদ হেসে বললো,” আবার যখন আসবো অনেক অনেক দিন থাকবো। খুব মজা করবো তখন।”

তমা হঠাৎ দৌড়ে এসে সাদকে জাপটে ধরলো। সাদ নিবিড় বন্ধনে আঁকড়ে ধরলো তমাকে। তবে, দূর থেকে অনিতার গলার স্বর শুনে আস্তে আস্তে বাঁধন হালকা করে সাদকে মুক্ত করে দিলো তমা।

“আসি তবে” সাদ এটুকু বলেই পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। তমা পেছন থেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সাদ কিছু দূর গিয়েই আবার পেছন ফিরে তাকালো। অবাক করা বিষয় সে আর ক্রদনরত তমাকে দেখতে পাচ্ছে না! দেখতে পাচ্ছে লাল শাড়ি ও অলংকার পরিহিত বিয়ের সাজে দাঁড়িয়ে থাকা তমাকে।
আচ্ছা! মা যে বলেছিল তমাকে লাল শাড়ি পরিয়ে বৌভাতের অনুষ্ঠান পালন করবে। তখন কী তমাকে দেখতে এরকমই লাগবে?
সমাপ্ত,,

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-১৯

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ১৯

“আপনি এত কি/প্টা কেন?” তমা একথাটা বলেই সাদের দিকে তাকালো।

সাদ সোফায় বসে ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তমা সাদের সামনাসামনি বসেই সাদকে হঠাৎ কি/প্টা বলে সম্মোধন করলো। সাদ হাত থেকে ফোনটা সরিয়ে একবার তমার দিকে তাকালো। সোফা হতে উঠে বসে বললো,” আমাকে কোন দিক দিয়ে কি/প্টা মনে হয় তোমার? তুমি কি/প্টা তাই সবাইকেই নিজের মতো মনে হয় তোমার।”

তমা সোফায় পা উঠিয়ে বসতে বসতে বললো,” আজকে একটা ইদের দিন। ভেবেছিলাম আজ আপনার পিছু লাগবো না। কিন্তু, শেষ অবধি আর পারলাম না। আপনি না বলেন আপনি আমার বড়? তো বড় হয়ে আমাকে এখনও সালামী দিলেন না কেন এখনও?”

সাদ তমার কথা শুমে এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। আজ সাদের পকেট ফাঁকা হবে এটা তো নিশ্চিত! পেছন থেকে অনিতা হঠাৎ বললো,” আসলেই তো সাদ! তুই না কি ওর বড়। তো বড় হলে যে ইদের সালামী দিতে হয় তুই জানিস না?”

সাদ বেচারা মহা বিপদে পরলো। বুদ্ধি করে তমাকে বললো,” সালামী যেহেতু চেয়েছো৷ পাবে কিন্তু সালাম তো করলে না। পা ধরে সালাম করো তারপরই সালামী দেবো।”

তমা তৎক্ষনাৎ সাদের দু”পা ধরে সালাম করলো। সাদ ভ্রু উঁচু করে বললো,” হয়নি হয়নি! এটাকে সালাম বলে না কি? তোমার সালামী বাদ! সালাম-ই করতে পারো না ঠিকঠাক ভাবে। আবার আমি সালামী কী দেবো?”

তমা অগ্নিদৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকালো। কিন্তু সাদ নিজের মতো বসেই আছে। তমার দিকে কোনো পাত্তা নেই। তমা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের কাজে চলে গেল। সাদকে এর শাস্তি যদি সে না দিয়েছে তাহলে তাঁর নাম তাবাসসুম তমা না! তমা তো তমা-ই! সে এর প্রতিশোধ নেবেই নেবে!

দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তমা অনিতার সামনে গিয়ে অনেকটা সময় ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করলো। ইদের মতো একটা এত ভালো দিনে মা আর ভাইকে না দেখলে তমার ভালো লাগবে না মোটেও। অনিতা শেষমেশ অনুমতি দিয়ে দিলো। তবে, সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকা চলবে না। তমা নতুন জুতো পায়ে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেল। সাদ অবশ্য নিজের বাড়িতেই আছে। নিজের মতো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছানায় পরে আছে।

ইদের পরদিনও গ্রামে বেশ উৎসব উৎসব ভাব রয়েছে। তমা অনিতার কাছে গিয়ে বায়না করে বললো,” আজকে বড় মাঠে মেলা হবে। আমাকে যেতে দাও না আম্মু।”

অনিতা তমার কথা শুনেই শুরুতেই না করে দিলো। এত বড় মেয়েকে একা একা বাইরে যেতে দেবেন না উনি। তমা মুখ ভার করে বসে রইলো। ভালো লাগে না আর! একটু যেতে দিলে কী হতো?

আঙুর বালা তমার মন খারাপ দেখে অনিতাকে বললেন,” ওয় একলা যাইবো ক্যা? তোমার পোলা সাদরে দিয়া পাঠায়া দাও। ছে/ড়িডা যখন এত শখ করতাসে। যাক একটু! ঘুইরা বেড়ানোর সময় তো এহনই। এহন না ঘুরলে আর কহন ঘুরবো? আমগো মতো বুইড়া হইয়া দাঁত ভাঙলে?”

অনিতা শাশুড়ির কথা শুনে আর কোনো যুক্তি খুঁজে পেলেন না। অগত্যা সাদকে বললেন তমাকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে যেতে।

সাদ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে ছিল। অনিতা গিয়ে সেই মুহূর্তে সাদকে বললো,” বাবা, কোথায় না কি মেলা হচ্ছে? তমা যেতে চাচ্ছে। এত বড় মেয়েকে আমি একা একা ছাড়তে পারবো না। তুমি একটু নিয়ে যাও তো তমাকে।”

সাদ তমার কথা শুনে ঢোক গিললো। এই মেয়ে অনেক ভয়ংকর! কখন কী ঘটিয়ে ফেলে কে জানে!যতবার তমার সাথে বাইরে গিয়েছে তমা একটা না একটা বিপদে সাদকে ফেলেছেই! সাদ তমার সাথে কোথাও যেতে মোটেও ইচ্ছুক না। তাই নিজের মাকে বললো,” আম্মু, আমি আন্দাজে ওকে কোথায় নিয়ে যাবো? আমি তো এখানকার পথ-ঘাট চিনি না কিছু।”

অনিতাকে বিনয়ের স্বরে সাদকে বললো,”এতে কোনো সমস্যা হবে না বাবা। তমা তো এখানেই থাকে। ও তোমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। এটা নিয়ে ভেবো না তুমি।এখন তাড়াতাড়ি তমাকে নিয়ে যাও। একটু পরে আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। এটা তো শহর না যে সন্ধ্যা হলেও সমস্যা নেই। এটা গ্রাম, তাই তুমি বের হয়ে যাও। সাবধানে যেও, নাদিয়াও ছোট মানুষ। ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেও।”

সাদ বিরক্তি মাখা মুখ করে তমাকে নিয়ে বের হলো। একটু সাবধানে সাবধানে থাকতে হবে আজ। এই মেয়ে অনেক চালাক। কখন কোন কথা বলে বিপদে ফেলে কে জানে!

তমা সাদকে পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল। সাথে রয়েছে ছোট্ট নাদিয়া। তমা নাদিয়ার হাত ধরে তাঁকে সামলে রেখেছে। ছোট মানুষ পরে-টরে আঘাত পেলে?

গ্রামের মেলা বেশ বড়সড় ভাবেই হচ্ছে। পাশের গ্রাম থেকেও লোকজন মেলায় ঘুরতে এসেছে। তমা সাদের কাছে বায়না ধরলো তাঁকে ঝালমুড়ি কিনে দিতে। গোল গোল আলু দেওয়া ঝালমুড়ি। অনেক মজার! সাদ তিনটা ঝালমুড়ি নিলো ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছ থেকে।

ছোট ছোট ঠোঙ্গায় রাখা ঝালমুড়ি খেতে খেতে সাদ এদিক ওদিক ঘুরে সবাইকে দেখছে। নাদিয়া ইতিমধ্যে একবার বায়না ধরেছে তাকে গোলাপি গোলাপি হাওয়াই মিঠাই কিনে দিতে হবে। সাদ অবশ্য দু’টো হাওয়াই মিঠাই কিনে দিয়েছে। একটা নাদিয়ার;আরেকটা তমার।

মেলায় এত জনসমাগমে বেশ হইচইপূর্ণ পরিবেশ। সাদের অবশ্য ভালোই লাগছে। শহরে এসব কখনো দেখেনি সাদ। প্রতিবছর ১-২ বার গ্রামে আসলেও সেটুকু সময় ঘরে বসেই কাটানো হয় সাদের। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে খুব একটা বের হয় না সে। ভালোই হয়েছে তমার জন্য অন্তত নতুন একটা জিনিসের সাথে পরিচিত হতে পারলো সাদ।

তমার হাতে মালাই কুলফি। বাদাম আর দুধের সর দিয়ে বানানো। সাদ কিনে দিয়েছে একটু আগে। তমা দূর থেকে ছেলে-মেয়েদের চিৎকার শুনে দৌড়ে গেল। সবাই নাগর দোলায় উঠে আনন্দে চিৎকার করছে। তমা এবার সাদের কাছে নাগর দোলায় চড়ার জন্য বায়না করলো। সাদ দাম জিজ্ঞেস করতেই জানতে পেল জনপ্রতি পাঁচ টাকা দাম।

তমা আর নাদিয়া কুলফি হাতে নাগর দোলায় চড়েছে। নাদিয়া হঠাৎ সাদকে বলে উঠলো,” ভাইয়া তুমি উঠবে না?” সাদ কিছু বলার আগেই তমা বলে উঠলো,” তোমার ভাইয়া ভীতুর ডিম। এসব নাগর দোলা-টোলাকে ভয় পায়।”

সাদ তমার সঙ্গে জেদ দেখিয়ে নিজেও নাগর দোলায় চড়ে বসলো। প্রথমবার যখন নাগর দোলায় একটা হালকা ঘুরানি দিলো তখন সাদের ভালোই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করে জোরে জোরে নাগর দোলা ঘুরতে শুরু করলো। সাদ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। সাদ হঠাৎ নিচের দিকে তাকালো ভয়ে ভয়ে। এত জোরে নাগর দোলা দুলছে দেখে সাদ জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো,” থামান! থামান! আমি নামবো! আমি নামবো! আল্লাহ বাঁচাও! আল্লাহ আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে! আম্মু! আমি নামবো! আমি নামবো!”

কিন্তু ছেলে-মেয়েদের চিৎকারে কেউই সাদের কথা কিছুই শুনতে পেল না। সাদ শেষে তমাকে বললো,” তমা এটাকে থামতে বলো! অনেক ঝাকি লাগছে! আমি নামবো!”

তমা তো সাদের অবস্থা দেখে হেসেই চলেছে! বিরবির করে সাদকে বললো,” কালকে পায়ে সালাম করা সত্ত্বেও কোনো সালামী পাইনি। এটার শোধ কী আমি তুলবো না ভেবেছেন?”

তমা সাদের বুক পকেট থেকে পনেরো টাজা নিচে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,” এই যে মামা! আমরা আরো একবার চড়বো। তিনজন, টাকা রাখেন।”

এবার নাগর-দোলা আবারও জোরে জোরে ঘুরতে শুরু করলো। সাদ নাগরদোলা ঘুরতে দেখে বললো,” আল্লাহ গো! আমাকে বাঁচাও! আমি শেষ! আমাকে নামাও কেউ! আমাকে দয়া করে নামিয়ে দাও! আমি নামবো!”

কিন্তু সবাই তো নিজের মতো চিৎকার করতেই ব্যস্ত। সাদের কথা শোনার সময় কারো আছে? সাদ আরো জোরে জোরে আল্লাহ গো! আল্লাহ গো!বলে চিৎকার করতে শুরু করলো। তমা পাশ থেকে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। বাছাধন! তুমি ঘুঘু দেখেছো কিন্তু ফাঁদ দেখোনি! কত ধানে কত চাল বোঝো এবার।

চলবে…

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-১৮

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ১৮

ইফতারের পর অন্যান্য দিনের তুলনায় সবাই আজ বেশ উত্তেজিত। আজ চাঁদ উঠলে ইদ কাল ইদ। গ্রামের ছোট বড় সবাই উঠোনে চেয়ার পেতে বসে খালি আকাশে চাঁদ খুঁজছে।

” আকাশে চাঁদ দেখা গিয়েছে! কাল উৎযাপিত হচ্ছে পবিত্র ইদ-উল-ফিতর।” টিভিতে এই নিউজ দেখা মাত্রই সবাই একত্রে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। কাল তাহলে আসলেই ইদ! হুররে!

রান্নাঘরে সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আঙুর বালার জামাও দর্জি কিছুক্ষন আগে বাড়ি এসে দিয়ে গেছে। আঙুর বালা এখন বেজায় খুশি।
কাল ইদ, সকালে ঘুম থেকে উঠে এত রান্না করা বেশ ঝামেলার। তাই সকালের জন্য সেমাই, পায়েস, পিঠা এসব বানিয়ে রাখতে হবে। সেমাইয়ে নারকেল কোড়ানো দিতে হবে। হেরা তমাকে ডেকে পাঠালো। সবাই একসঙ্গে হাতে হাতে কাজ করলে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়। তমা বেশ দক্ষতার সাথে নারকেল ভাঙলো। তারপর নারকেল কোড়ানো শেষে টেবিলের ওপরে রাখলো।

সাদ টেবিলের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছিল। খুব খুদা পেয়েছে যে! টেবিলের ওপরে নারকেল কোড়ানো দেখতে পেয়ে সাদের চোখ ঝলমল করে উঠলো। দ্রুত মুড়ির টিন আর চিনির কৌটা বের করলো সাদ। বড় একটা বোলে নারকোল কোড়া দিয়ে চিনি দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে বসে পরলো। টিভির রিমোট হাতে নিয়ে মুড়ি খেতে খেতে টিভির দিকে তাকালো।

তমা পরে রান্নাঘর থেকে নারকেল কোড়ানো নিতে আসলে, টেবিল পুরো শুন্য দেখতে পেল। হেরাকে বললো,” চাচী আমি না নারকেল রেখেছিলাম ওখানে? কোথায় গেল?” হেরা পায়েস রান্না করছিল। চুলার আঁচ কমাতে কমাতে বললো,” কী জানি! দেখো তুমি কোথায় রেখেছো।”

তমা পেছনের ঘরে গিয়ে দেখলো সাদের হাতে মুড়ির বোল। তমা যা বোঝার বুঝে ফেললো। অনিতার কাছে গিয়ে বললো,” আম্মু, আমি টেবিলের ওপরে নারকেল কোড়ানো রেখেছিলাম। কত কষ্ট করে কুড়িয়ে রেখেছি নারকেলগুলো! সব খেয়ে ফেলেছে! এখন নারকেলও নেই বাসায়। কী হবে এখন?”

অনিতা সাদকে গিয়ে হালকা বকাঝকা করলো। না বলে কয়ে কোনো জিনিস নেওয়া ঠিক নয়। তমা দূরে থেকে হালকা হাসলো। ভালোই হয়েছে বকেছে সাদকে। সবকিছুতে বেশি বেশি বোঝে!

গ্রামে থাকলে সাদ সবসময় পুকুরেই গোসল করে। সকালে ঘুম থেকে সাদ আজ সবার আগে উঠেছে। ইদের দিন কেন যেন সকাল সকালই ঘুমটা ভেঙে যায়। সাদ জামাকাপড় এবং গামছা নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। আঙুর বালা ছাড়া এত সকালে ঘুম থেকে কেউ ওঠে না। আঙুর বালার ঘরের সামনে দিয়ে আসার সময় সাদ তমার গলা শুনতে পেল। তমা জেগে আছে ভেবে সাদ দ্রুত পা চালালো। এই মেয়ের সামনে পুকুরে নামলে সে আবার সেদিনের মতো পা টেনে ধরবে পুকুরের নিচ থেকে।

পুরো বাড়ি খুব নিরব, নিস্তব্ধ। সাদ উঠোন মাড়িয়ে পুকুর পাড়ের দিকে এগোলো। পুকুরে সিঁড়িতে জামাকাপড় রেখে পুকুরে গিয়ে একটা ডুব দিলো। সাদ সাঁতার জানে না। কাউকে না জানিয়ে পানিতে নামাটা যে ঠিক হয়নি তা সাদ ভয়াবহ ভাবে উপলব্ধি করতে পারলো। পুকুরের সবচেয়ে বেশ গভীরের সিঁড়িটাতে অবস্থান করছে সাদ। গোসল গা ধুয়ে পুকুর পাড় উঠে আসার পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা পিছলে পরলো সাদ। পা ভীষণ ভাবে মচকে গেছে। সাদের শরীর পানিতে ডুবে গেছে বেশ খানিকটা। সাদ হাত পা নাড়িয়ে ওপরে উঠে আসতে চাইলো। কিন্ত পুকুরের পানি প্রচুর ভারী আর ঘোলাটে প্রকৃতির। সাদ যত ওপরে আসতে চাচ্ছিল ভেতরে তত পানির অঁতলে ডুবে যাচ্ছিল। বাড়ির সবাই ঘুম। তাই চিৎকারেও কোনো কাজ হবে না।

তমা সবে ঘুম থেকে উঠেছে। বাড়ির পেছনের পুকুরের সামনে দাঁত মাজতে মাজতে এসে দাঁড়ালো। পুকুরের সামনে সাদের জামাকাপড় দেখে বিস্মিত হলো তমা। সাদের জামাকাপড় এখানে কিন্তু সাদ নেই। ব্যাপারটায় তমা বেশ অবাক হলো। পানির ভেতর থেকে কারো হাত পা নাড়ানোর মতো শব্দ পেল তমা। কিছু বুঝতে আর বাকি রইলো না। তমা দৌড়ে পুকুরে নামলো। দ্রুত পায়ে পুকুরে একেবারে শেষ সিঁড়িতে এসে পৌঁছালো। শেষ সিঁড়িতে খুব একটা কেউ বসে না বিধায় শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। তমা সাদের হাত ধরে ওপরে ওঠালো। সাদের নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। পা মচকে গেছে বিধায় হাঁটতেও পারছে না। তমা আস্তে আস্তে সাদকে নিয়ে ওপরে উঠে এলো।

অনেকটা সময় পানিতে থাকার কারণে সাদের পায়ের বুড়ো আঙুল দু’টো পুরো ভাঁজ হয়ে গেছে। সাদ অনেক চেষ্টা করছে পায়ের আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করার জন্য কিন্তু হচ্ছে না। পা আরো অবশ হয়ে আসছে। তমা সাদের পাশেই বসে আছে। তমা সাদের কান্ড দেখে সাদের পায়ের বুড়ো আঙুল দু’টো ভরে জোরে টান দিলো। সাদ আর্তনাদের স্বরে তমাকে বললো,” পাগ/ল হয়ে গেছো তমা? আমার পায়ের আঙুরগুলো ভেঙে যাবে। ছাড়ো তমা ছাড়ো! আহ!”

তমা সাদের পায়ের আঙুল দুটো জোরে মচকে দিয়ে বললো,” পাগ/ল আমি না আপনি হয়েছেন। সাঁতার জানেন না তো এই সাত-সকালে পুকুরে একা একা নেমেছিলেন কেন?”

সাদ পায়ের আঙুল চেপে ধরে বললো,” হুম, একা একা না নেমে তোমার আশায় অপেক্ষা করি আর তুমি পানির নিচ থেকে আমার পা চেপে ধরো!”

তমা জোরে জোরে হেসে বললো,” আমার ভয়ে একা একা পানিতে নামতে গিয়ে আজ মর/তে বসেছিলেন! হাহা! আপনি আসলেই বল/দ বাবাজী! একটা মেয়ের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান! হাহা!”

সাদ নাক মুছতে মুছতে তমাকে বললো,” আমার পায়ের আঙুলগুলো এভাবে মচকে ধরলে কেন? ”

তমা স্থির চিত্তে বললো,” পানিতে বেশিক্ষন সময় হাত পা ডুবিয়ে রাখলে এরকম হয়। জোরে জোরে টান দিলে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। আপনার তো মাথায় বুদ্ধির অভা/ব তাই এসব জানেন না।”

তমা এবার পুকুর পাড় থেকে উঠে দাঁড়ালো। উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো। সাদ পেছন থেকে তমাকে বললো,” বাড়ির কাউকে বলো না এসব। আমাকে গ্রামে নিয়ে আসবে না তাহলে।”

তমা সাদের বলা কথা শুনতে পেল। তবে পেছন ফিরে আর তাকালো না। তমা চলে যেতেই সাদ নাম মুছলো। পানি ঢুকে নাক পুরো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শ্বাস নিতেই পারছিল না। জীবনে শিক্ষা হয়ে থাকলে সাদ আর জীবনে একা একা পুকুরে নামবে না এটা তো শিওর!

বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠে পরেছে ইতিমধ্যে। হেরা, অনিতা টেবিলে বানান পদের নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে। মহসীন, সাদের ছোট চাচা রাফসীন টেবিলে বসে আছে। সাদ নতুন পাঞ্জাবী পরে সোফায় হাত পা মেলে বসে আছে। তমা নতুন জামা পরে ঘর থেকে বের হলো। একসঙ্গে সবাই এবার টেবিলে নাস্তা করতে বসলো। মহসীন, রাফসীন দুজনেই তমাকে ইদের সালামী দিলো। সাদকেও দিলো তবে তমার সাদের থেকে একটু বেশি। সাদ তমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সবকিছুতে তমার ঢং বেশি বেশি হুহ!

আঙুর বালা নতুন জামা গায়ে দিয়ে টেবিলে এসে বসলো। সবার সামনে তমার দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি এখনও কত জোয়ান। আমি বলে ঢিলাঢোলা জামা পিন্দা ঘুরুম! আইসেরে!আমি বুঝি ফেশান (ফ্যাশন) চিনি না। দেখ ছে/ড়ি তোর চাইতেও আমারে কত সুন্দর লাগে। আয়নায় তোর চেহারাডা দেহিস আর আমারটা দেহিস। এহনও রাস্তা দিয়া গেলে মাইনষে আমার দিকে তাকায়া থাকে!”

মহসীন নিজের মায়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন। বয়সের সাথে সাথে মায়ের মাথাটা যাচ্ছে একেবারে! অনিতা আঙুর বালা আর তমাকে নাস্তা বেড়ে দিলো। নিজেও খেতে আসলো। তমা স্বাভাবিক ভাবেই নিজের হাত দিয়ে খেলো। আঙুর বালা নাস্তার প্লেটে হাত দিতেই আওয়াজ করে উঠলেন। তমা চমকে উঠে আঙুর বালার দিকে তাকালো। আঙুর বালা নিজের হাত টানটান করতে করতে তমার দিকে আঙুর দিয়ে জোরে জোরে বললেন,” তোর দেহাদেহি আমি জামার হাতা চিপা দিসি। বেদ্দ/প ছে/ড়ি! আমি এহন হাত লরাইতে পারি না। জামার হাতা খালি টান খায়। তুই আমারে হিংসা করোস। এর লাইগা আমার এত সুন্দর জামাডা নষ্ট করলি। কুট/নি ছে/ড়ি! আমি এহন হাতই লরাইতে পারতাসি না! আমার এত সুন্দর ইদের নতুন জামাডা গেল রে গেল!”

আঙুর বালার কান্ড দেখে সবাই একত্রে হেসে ফেললেন। অনিতা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে শাশুড়ির দিকে তাকালো। নিজেকে জোয়ান প্রমান করতে গিয়ে কী এক অবস্থায় পরেছেন বেচারা! ইদের নতুন জামাটা পুরো গেল। জামার হাতা এতই টাইট হয়েছে যে হাত নাড়ানোটা পুরো অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। তমাও বেশ কিছুক্ষন আঙুর বালার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর হেসে ফেললো! আহারে বেচারী! বেশি ফ্যাশন করতে গিয়ে ইদের জামাই বরবাদ করে ফেলেছেন!

চলবে….

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-১৭

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ১৭

তমার এখন স্কুলে ক্লাস নেই। রমজানের ছুটি দিয়ে চলছে।ইদের পর আবার যথারীতি ক্লাস শুরু হবে।

আঙুর বালা তমাকে বলেছেন ২০ রোজার পরে আবার সাদ আসবে। কিছুদিন থাকবে এখানে। তমা অতি আগ্রহে দিন গুনছে। ইশ! কেন যে সাদ এখনও আসছে না।

তমা দুপুরে গোসল করে শাড়ি পরে বের হলো। সাধারণত বাড়িতে সেলোয়ার-কামিজ পরে তমা। কিন্তু, আজকের দিনটা একটু বেশিই স্পেশাল! সাদ আসবে!

তমা উঠোনে বসে বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করলো। সাদ এখনও আসছে না কেন? একটু পরে তো আজান দিয়ে দেবে। সবাই ইফতারি করতে বসে পরবে। সাদ কখন আসবে তাহলে?

আঙুর বালা অনেকক্ষন ধরে তমাকে ডাকাডাকি করছে। তমা বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো। এখন তাঁকে আবার কাজে হাত লাগাতে হবে। তমা লেবুর সরবত বানিয়ে টেবিলে রাখলো। তমা নিজেও রোজা রেখেছে। এখন সরবতের চিনি টেস্ট করবে কে? তমা উঁচু স্বরে রান্নদঘর থেকে নাদিয়াকে ডাক দিলো। নাদিয়া ছোট্ট একটা হিজাব পরে দৌড়ে এলো। সামনের বছর থেকে নাদিয়াও রোজা রাখবে। এখন তো নাদিয়া রোজ তিনটা রোজা রাখে। তিনবেলা খেয়ে তিনটা রোজা। হিহি! তমা একটা গ্লাসে নাদিয়াকে একটু সরবত ঢেলে দিয়ে বললো,” একটু খেয়ে দেখো তো। চিনি হয়েছে কি না।”

নাদিয়া পা উঁচু করে টেবিল থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছোট্ট চুমুক দিলো। ঢোক গিলে বললো,” মজা!” তমা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,” মিষ্টি হয়েছে? ” নাদিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

তমা টেবিলে ইফতার রাখতে রাখতে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। সাদ যে কখন আসবে! কতদিন দেখেনি সাদকে!

আজান দিলে সবাই বিসমিল্লাহ পরে সরবত মুখে দিলো। বাইরে থেকে কারো আওয়াজ পাওয়া গেল। আঙুর বালা মেইন গেট খুলে বাপজান বাপজান বলে ছুটে গেলেন। তমা প্রথমে কিছুটা ভরকে গেলেও। পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটে গেল। নিশ্চয়ই সাদ এসেছে।

তমা এদিক ওদিক তাকিয়ে সাদকে খুঁজলো। মহসীন খান একাই এসেছে আর কেউ আসেনি। মহসীন খান ঘরে এসে বসতেই, তমা তাঁকে ইফতারি দিয়ে বললো,” বাকিরা আসেনি? ওনারা কোথায়?”
মহসীন খান কিছু বলার আগেই আঙুর বালা পাশ থেকে বললেন,” বউ তোর শাশুড়ী আর জামাই আরো পরে আইবো। ওর জামাইয়ের পড়ালেখা আছে না? ওয় এত তাড়াতাড়ি আইবো কেমনে? ওরা আইবো সাতাইশ আটাইশ রোজায়।”

তমা অশ্রুসিক্ত নয়নে উঠোনের দিকে তাকালো। এরপর এক ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। বিছানায় চুপটি করে শুয়ে নিরবে নিভৃতে অশ্রু বির্সজন দিলো। আর কথা নেই সাদের সঙ্গে। আসুক যেদিন ইচ্ছে সেদিন। তমা আর কথা বলবে না সাদের সঙ্গে!

সাতাশ রোজা খুব ভালো মতোই কেটে গেল। সাদের তবুও কোনো ইয়াত্তা নেই। তমার ছোট্ট হৃদয় ভেবে নিলো। সাদ এবার আর আসবে না।

একদিন কী দুদিন পরে ইদ। আটাইশ রোজা চলছে আজ। সবার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। কবে যে ইদ আসবে। সকালে উঠে তমা কোরআন শরিফ পাঠ করেছে। রোজার মাস সুতরাং নাস্তা করার ঝামেলা নেই।

তমা শুকনো মুখে বাড়ির পেছনের পুকুর ধারে বসে আছে। সাদ আর আসবেই না এবার। আসলে আগেই আসতো৷ তমা পানিতে দু’পা ভেঙ্গে বসলো। ভালো লাগছে না কিছু।

উঠোন থেকে মানুষের আনাগোনা চিৎকার শুনলো তমা। তমা তবুও বসে রইলো। এই দুপুর বেলা অনেকেই আসেন। কেউ খয়রাত নিতে আসে। কেউ ইফতারে খাবার জন্য খাবার চাইতে আসে। এটা রোজকার ব্যাপার। তমা সেখানেই মূর্তির ন্যায় স্থির ভাবে বসে রইলো। বেশ রোদ পরেছে আজ। তমা ঘেমে একাকার। তমা এবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। ঘরে গিয়ে এখন একটু বিশ্রাম নেবে।

তমা উঠে দাঁড়াতেই অনিতার গলার স্বর শুনতে পেল। বাড়ির ভেতর থেকে অনিতার গলা আওয়াজ আসছে। তমা হেসে ছুটে গেল। বেশ জোরে কারো শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে আঘাত পেল তমা। কাঁধে ব্যাথা পেয়ে তমা ফিরে তাকালো। তমার চক্ষুযুগল বের হয়ে আসার উপক্রম। এটা তো সাদ! তমা মুখ গোমড়া করে ফিরিয়ে নিলো। এত দেরি করে আসলো কেন সাদ? আরেকটু আগে এলে কী হতো?

সাদ এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। তমা স্থির হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো। সাদ হঠাৎ সামনে এসে পরায় চমকে গিয়ে সাদের দিকে তাকালো। সাদ তমাকে আকূল হৃদয়ে জড়িয়ে নিলো বাহুডোরে। তমা কিছু বললো না। চুপটি করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

তমা অনিতার সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করলো। আঙুর বালা তমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন,” তোর জামাই আইসে। ওরে দেখসিলি? কথাবার্তা কিছু কইসোস?”

তমা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। আঙুর বালা তমা আরেকটু কাছে গিয়ে বললো,” ওরে দেইখা চুম্মা/চাটি করোস নাই তো আবার? তোর রোজা কিন্তু হালকা হইয়া যাইবো ”

তমা বিরক্তিমাখা মুখ করে আঙুর বালার দিকে তাকালো। ছি ছি! বেহা/য়া বুড়ির লাজলজ্জা কিচ্ছু নেই!

অনিতা সবার জন্য কেনাকাটা করে এনেছেন। সব রেডিমেড, বানানোর কোনো ঝামেলা নেই। আঙুর বালা আগে থেকেই জামাকাপড় কিনে বানাতে দিয়ে এসেছেন। দর্জি একটু আগে সেগুলো দিয়ে গেছে। তমার জামা নরমাল থাকলেও তমার জামার হাতা একটু টাইট। তাই তমা জামাকাপড় সব এভাবেই বানানো। তমা জামাকাপড়ের হাতা সবসময় একটু টাইটই পরে বলা চলে। আঙুর বালা তমার জামাটা একটু খুঁটিয়ে দেখলেন। নিজেই কিনে দিয়েছেন। তবুও তমার জামার হাতাটা দেখে মুগ্ধ হলেন। একেবারে হাতের সঙ্গে লেগে থাকবে কাপড়। আর জামাটা একটু ঢোলা।

আঙুর বালা দর্জিকে বাসায় ডেকে পাঠালেন। নিজের জামাটা ফেরত দিয়ে বললেন,” ওই, আমারেও এমন চিপা হাতার জামা বানাইয়া দে। হাতাডারে কাই/টা চিপা বানা। আমি এহনও জোয়ানী। আমি এমন ঢিলাঢালা হাতা দিয়া জামা পরুম না। আমারেও ওর মতো চিপা হাতার জামা কইরা দে।”

দর্জি জামা ফেরত নিয়ে গেলেন। বললেন ইদের আগের দিন দিয়ে যাবেন। বাড়িতে ইতিমধ্যে হাসাহাসি পরে গেছে আঙুর বালার করা কাজ নিয়ে। তমার দেখাদেখি এখন তিনিও চিপা হাতার জামা পরবেন। কী একটা অবস্থা!

পুতুল ঘরময় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। নাদিয়া মেঝেতে বসে বসে খেলনাপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলছে।

তমা বেশ কিছুক্ষন যাবত নিজের ফোনটা খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে খাটের তলায় ফোনটা খুঁজে পেল। কিন্তু, খাটের তলায় ফোনটা ফেলেছে কে?

তমা নাদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো। নাদিয়া মাথা নাড়িয়ে না বললো। যাঁর অর্থ সে জানে না কে ফেলেছে। তমা সকালে পুতুলকে খাটের ওপরে রেখে কাজ করছিল। তাই পুতুল ছাড়া এই কাজ আর
কেউ করেনি। তমা ঠোঁট টিপে হেসে পুতুলের দিকে এগিয়ে গেল। আদর করে কোলে তুলে নিলো। গাল টিপে দিয়ে বললো,” আমার ময়না পাখি কে?”

পুতুল গাল ফুলিয়ে বললো,” আমি!” তমা আবার বললো,” আমার টিয়াপাখি কে?” পুতুল হাত পা নাড়াতে নাড়াতে অস্পষ্ট গলায় বললো,” আমি!” তমা পুতুলের গালে চুমু খেয়ে বললো,” আমার হীরামন পাখি কে?” পুতুল হাত নাড়াতে নাড়াতে বললো,” আমি!”

তমা দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো,” আমার মোবাইল খাটের নিচে ফেলেছে কে?” পুতুল স্বাভাবিক ভাবে বললো,” আমি!”

তমা এবার গাল ফুলিয়ে বললো, ” তুমি ভাবীর ফোন ফেলে দিয়েছো?” পুতুল এবার ঠোঁট ফোলালো। সে তো ইচ্ছে করে ভাবীমনির ফোন খাটের নিচে ফেলেনি। ওটা নিয়ে খেলতে খেলতে পরে গেছে।

চলবে…

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-১৬

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ১৬

আঙুর বালা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নাক কুঁচকে তমাকে বললেন,” ঘরে এমন সিগা/রেটের গন্ধ আহে ক্যা?”

তমা কাচুমাচু হয়ে বললো,” ছোট চাচ্চু জানালার কাছে সিগা/রেট খেয়েছে হয়তো। তাই ঘরে গন্ধ চলে এসেছে। ”

আঙুর বালা টেবিলে পানের কৌটোটা রেখে বললেন,” হুম, এই পোলাডারে এত নিষেধ করি। এডি খাওয়া ভালো না।তাও হারাদিন এই ছাইছুই লইয়া পইরা থাকে। আমি মর/লে যদি আল্লাহ ওগোরে একটু সুবুদ্ধি দেয়!”

তমা বড় একটা নিঃশ্বাস ফেললো। যাক এই যাত্রায় বাঁচা গেছে। আঙুর বালা কিছু টের পেলে আর রক্ষে থাকতো না।

সন্ধ্যা গড়িয়ে আসতেই তমা বই নিয়ে বসলো। নাদিয়াও তমার পাশে নিজের বই নিয়ে পড়তে বসেছে। আঙুর বালা নিজের বাটন ফোনটা নিয়ে তমার দিকে ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,”ওই ছে/ড়ি! কানে কী তুলা গুইজ্জা থুইথোস? তোরে কতক্ষন ধইরা ফুন দিতাসে। তুই হুনোস না?”

তমা বই বন্ধ করে আঙুর বালাকে বললো,” কে ফোন দিয়েছে?”

আঙুর বালা তমার সামনে বাটন ফোনটা রেখে বললো,” ধইরা দেখ তুই!”

তমা ফোনটা নিজের হাতে নিতেই আঙুর বালা সেখান থেকে চলে গেল। তমা ফোনটা কানে নিয়ে বললো,” হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে জবাব এলো,” আমি ছাড়া আর কে? ফোন দিচ্ছি কত সময় ধরে। তুমি কোথায় থাকো আর তোমার ফোন কোথায় থাকে?”

তমা কানের পাশ থেকে ফোনটা সরিয়ে নাম্বারটার দিকে চোখ বুলালো। নাম্বারটা সাদের! কন্ঠস্বরটাও সাদেরই!

তমা অভিমানসিক্ত গলায় বললো,” আপনি তো ব্যস্ত মানুষ। ফোন দিলেন কেন? আপনার তো কত কাজ পডে আছে। আমার খোঁজ খবর নেওয়ার মতো সময় কী আপনার আছে বা ছিল? রাখছি আমি। আপনার বিরক্তির কারণ হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।”

তমা কল কেটে দেওয়ার আগ মুহূর্তেই সাদ বললো,” তোমার মতো আমাকে ভালো লাগে না। যখন গ্রামে ছিলাম;তখন কত অত্যাচার করতে। কিছুতে কিছু হলেই আমার ওপরে চড়াও হতে। এখন এত মায়াদয়ার উদয় হলো কেন? রাগে জলজ্যান্ত চন্ডী হয়ে যাওয়া মেয়েটা আজ এত শান্ত হয়ে গেল কেন?”

সাদের আদুরে ভঙ্গিতে বলা কথাগুলোই তমা প্রায় কেঁদেই ফেললো। সাদকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললো,” দুষ্টমি করেছেন শাস্তি পেয়েছেন। আরো দুষ্টুমি করলে আরো শাস্তি পাবেন।”

সাদ হেসে বললো,” হাহা! লবঙ্গ লতিকা! ”

তমা জোরে চিৎকার করে বললো,” কী?”

সাদ হাসিসিক্ত মুখে বললো,” তোমাকে দেখলেই আমার একটা কথা মাথায় আসে। লবঙ্গ লতিকা! জানো, লবঙ্গ লতিকা হচ্ছে একটা পিঠার নাম। আমার সবচেয়ে পছন্দের পিঠা হচ্ছে লবঙ্গ লতিকা। তবে, এই পিঠার সবচেয়ে বিরক্তিকর দিক হচ্ছে পিঠার মাঝখানে গুঁজে থাকা লবঙ্গটা। কিন্তু, লবঙ্গের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই পিঠার নাম লবঙ্গ লতিকা। পিঠার মধ্যিখানের লবঙ্গটা হচ্ছে তোমার রাগ। আর লতিকা হচ্ছো তুমি। তুমি আর তোমার রাগ এই দুটো জিনিস একত্রে মিশ্রিত হয়েছে বলেই হয়তো তুমি লবঙ্গ লতিকা!”

তমা আর কিছু শুনতে পেল না। তাঁর আগেই কলটা কেটে দিয়েছে সে। আর কিছু শোনার ইচ্ছেও নেই তাঁর। খুব লজ্জা লাগছে তমার। লবঙ্গ লতিকা! সত্যি কী তমা লবঙ্গ লতিকা?

রাতে আঙুর বালাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমলো তমা। নারিকেল তেল আর পান সুপারীর কী সুন্দর একটা ঘ্রান বের হচ্ছে দাদুর গা থেকে! তমা বারবার বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিলো। কী অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রানটা!

তমা ক্লাসে গিয়ে সামনের বেঞ্চ বরাবর বসেছে। হাসান স্যারের ইংরেজি ক্লাস আছে আজকে।

হাসান স্যার ক্লাসে ঢুকেই তমাকে দেখে অবাক হলেন। কী ব্যাপার! তমার মতো ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট আজকে ক্লাসে এসেছে! তাও আবার বসেছে সামনের বেঞ্চে! হাসান স্যার ক্লাসে ঢুকেই তমাকে সবার আগে পড়া ধরলেন। তমা পড়া না পেরে কাচুমাচু হয়ে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হাসান স্যার তমার হাতে তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত শগন্তি বেত দিয়ে দুটো বারি দিলেন। তারপর তমাকে বেঞ্চের ওপরে দাঁড়া করিয়ে রাখলেন।

তমা ভেতরে ভেতরে হাসান স্যারের ওপর আজ ভীষণ চড়ে আছে! আজ হাসান স্যারে র একটা হেস্তনেস্ত করবেই! স্যারের আগের ক্লাস হয়েছে আগের সপ্তাহে। তখন তো তমা স্কুলে আসেনি। তাহলে আজকের দিনটা তাঁকে একটু ছাড় দিকে কী হতো হাসান স্যারের? তমা কান ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফন্দি আঁটলো।

ছুটি হওয়ার দশমিনিট আগে ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে ক্লাস থেকে বের হলো তমা। হাসান স্যার রোজ সাইকেলে করে স্কুলে আসেন। তমা স্কুলের পেছনের মাঠের দিকে অগ্রোসর হলো। সাইকেলটা নিয়ে আস্তে আস্তে ঠেলতে ঠেলতে নতুন বিল্ডিংয়ের বালুর স্তুপের মধ্যে ফেলে দিলো। ভেজা বালু দিয়ে হাসান স্যারের সাইকেল একাকার অবস্থা! বাসায় দিয়ে সাবান জল দিয়ে না ধোয়া অবধি এত বালু সহজে উঠবে না।

ছুটির ঘন্টা বাজতেই তমা সবার সাথে একত্রে ক্লাস থেকে বের হলো। বড় মাঠের সামনে হাসান স্যার বেশ চিৎকার চেচামেচি করছে। তমা ঠোঁট টিপে হাসলো। স্যারের চিৎকার,রাগারাগির শব্দে সবাই সেখানে গিয়ে গোল করে জটলা বাঁধিয়েছে। তমা কিছু না বোঝার ভান ধরে সেখানে গেল। গিয়ে তমার পেট ফেটে হাসি বের হওয়ার মতো অবস্থা। ভেজা বালুর স্তুপ থেকে সাইকেল ওঠাতে গিয়ে স্যারের পুরো শরীর বালু দিয়ে একাকার অবস্থা! এতদিন তমা শুনে এসেছে তুষারমানব। আজ তমা স্বচোখে দেখলো বালু মানব! বেশ হয়েছে! আরো তমার সাথে লাগতে আসো!

তমা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিজের মতো হাঁটতে শুরু করলো। পেছন থেকে হাসান স্যার চিৎকার করে বলছে,” আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো রেসপেক্ট নেই! কী অস/ভ্য! আমার এত সুন্দর নতুন সাইকেলটার কী অবস্থা করলো! কালকে ক্লাসে এসে সবগুলোকে চালতা পোড়া খাওয়াবো! তারপরই বের হবে আসল কাহিনি! ”

তমা ফিক করে হেসে ফেললো। যতই চাল পোড়া খাওয়াও আর ময়দা পোড়া খাওয়াও না কেন। তমার পেট থেকে কথা বার করা এত সহজ না হুহ!

চলবে…